You dont have javascript enabled! Please enable it!
শিরোনাম সূত্র সময়কাল
১৬। বাংলাদেশের সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামে গেরিলা বাহিনীর গঠন ও যুদ্ধ তৎপরতার বিবরণ ‘দৈনিক পূর্বদেশ’
৮ ই জানুয়ারী, ১৯৭২
এপ্রিল-ডিসেম্বর
১৯৭১

<৯, ১৬.১, ৪৫০-৪৫১>

কাদের বাহিনীর গঠন ও যুদ্ধ তৎপরতা-১
সাক্ষাৎকারঃ কাদের সিদ্দিকী
১৯৭২

(দৈনিক পূর্বদেশ (৮ই জানুয়ারি ১৯৭২)-এ প্রকাশিত “বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে সাক্ষাৎকার” থেকে সংকলিত। সাক্ষাৎকারটি যৌথভাবে গ্রহণ করেছিলেন কাদের বাহিনীর সদস্য রফিক আজাদ ও মাহবুব সাদিক)

প্রশ্নঃ স্যার, কি করে আপনি এই বিরাট সংগঠন গড়ে তুললেন, একটু বলবেন কি?

উত্তরঃ ৩রা এপ্রিল নটিয়াপাড়া যুদ্ধের পর আমরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যাই। পাক বাহিনী টাঙ্গাইলে আসে। ১৯শে এপ্রিল ময়মনসিংহের দিকে অগ্রসরমান পাক বাহিনীকে কালিহাতীতে বাঁধা দেই। নেতৃত্বে ছিলো ইপিআর। এখানেই আমি প্রথম গুলি ছুড়ি। পাক বাহিনীর একজন মেজর সহ অসংখ্য লোক মারা যায়। আমরা ডিফেন্স উঠিয়ে ছত্রভঙ্গ হই। গ্রাম গ্রামান্তরে ঘোরাঘুরির পর সংবাদ পাই পাহাড়ে একটি ইপিআর-এর প্লাটুন আছে। এই প্লাটুনকে খুজতে থাকি। আমার সঙ্গে এগারো জন ছিলো। ছিলো মনি, খোরশেদ আলম ও শাহজাহান। এক রাতে ৪১ মাইল পথ হেটে আড়াইপাড়া মাদ্রাসায় আস্তানা গড়ি। এই সময় পাহাড়ের হামিদুল হকের সঙ্গে দেখা পাই। ইপিআর্ִদের রেখে যাওয়া কিছু অস্ত্রশস্ত্র হস্তগত হয়। এই পর্যায়ে আমার সংগঠনের সদস্যসংখ্যা একশতে দাড়ায়। এখান থেকেই সত্যিকারের সূত্রপাত।

প্রশ্নঃ স্যার, আপনার নেতৃত্বে কখন কোথায় প্রথম যুদ্ধ হয়?

উত্তরঃ কালিহাতী থেকে তিন মাইল দূরে চারান নামক গ্রামে। তারিখটা ২২শে মে। এখানে আমি এলএমজি ব্যবহার করি।

প্রশ্নঃ জনসাধারণ মুক্তিযুদ্ধে আপনার সঙ্গে কি ধরনের সহযোগিতা করতো?

উত্তরঃ প্রথম দিকে তারা পাক বাহিনীর ভয়ে ছিলো। অচিরেই এই ভয় কেটে যায় এবং তারা সর্বাত্মক সহযোগিতা শুরু করে।

প্রশ্নঃ আপনি কোথা থেকে হাতিয়ার পেতেন? আপনাকে কারা হাতিয়ার সরবরাহ করতো?

উত্তরঃ কেন, চীন ও আমেরিকা। অবাক হচ্ছেন বুঝি? অবাক হওয়ার কিছু নেই। কেননা তারা পাক বাহিনীকে হাতিয়ার দিতো, আমরা পাক বাহিনীর কাছ থেকে কেড়ে নিতাম।

প্রশ্নঃ স্যার, আপনার জওয়ানদের কতটুকু প্রশিক্ষণ দিয়ে যুদ্ধে পাঠাতেন?

উত্তরঃ যারা দেশমাতৃকার যোগ্য সন্তান তারা নিজের মাকে রক্ষা করার জন্য খালি হাতেও লড়তে পারে। ট্রেনিং-এর চেয়ে আদর্শ চেতনাই বড়। ট্রেনিং দিয়ে তাদের যুদ্ধ শিখাতে হয়নি, শত্রুর মোকাবেলা করেই তারা যুদ্ধ করতে শিখেছে।

প্রশ্নঃ আপনার পরিচালিত অধিকাংশ যুদ্ধগুলো চোরাগোপ্তা না সম্মুখসমর?

উত্তরঃ অধিকাংশ সম্মুখসমর। ব্যতিক্রম কেবল মাকড়াই’র যুদ্ধ।

প্রশ্নঃ যুদ্ধক্ষেত্রে ধৃত শত্রুদের ব্যাপারে আপনি সাধারণতঃ কি ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন?

উত্তরঃ যতক্ষণ শত্রুর হাতে হাতিয়ার থাকতো ততক্ষণই সে আমার বাধ্য। কিন্তু বন্দী ও আত্মসমর্পিত শত্রুর প্রতি আমার কোনো দ্বেষ ছিলো না। তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা হতো।

প্রশ্নঃ স্যার আপনি নিজে যে সমস্ত যুদ্ধ করেছেন তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোনটি এবং কেনো?

উত্তরঃ ধলাপাড়ার কাছে মাকড়াই-এর যুদ্ধ, ২১শে নভেম্বর বাঁশাইলের কামুটিয়ার নদীর ধারে সংঘটিত যুদ্ধ। মাকড়াইতে দশ মিনিটের যুদ্ধে ৩৮ জন খান সেনাকে হত্যা করি। কামুটিয়ার খান সেনাদেরও পাকা বাংকার ধূলিস্যাৎ করে তাদের তিন মাইল দূরে তাড়িয়ে দেই।

প্রশ্নঃ স্যার যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুর প্রতি আপনার কখনো অনুকম্পা হতো?

উত্তরঃ হ্যা, মাঝে-মধ্যে কখনো হতো বৈকি।

প্রশ্নঃ নয়মাসে আপনার জীবনের প্রতি কোনো যুদ্ধে সবচেয়ে বড় ঝুঁকি এসেছিলো, কেমনভাবে এবং কেনো?

উত্তরঃ নাগরপুরের। আকস্মিকভাবে একটি চরম অসুবিধাজনক অবস্থান থেকে শত্রুর উপর গুলি চালাচ্ছিলাম। তিন দিকেই আমাদের সবার রাস্তা বন্ধ ছিলো। চতুর্থ দিকে কেবল পানি আর পানি। ইতিমধ্যে আমার দিকে অগ্রসরমান শত্রুর কমান্ডারকে নিজের দলের ছেলে মনে করে তাকে অনেক কাছে এগুতে দেই। ৪০ গজ দূরে থাকতে তাকে শত্রু বলে চিনতে পেরে গুলি ছুড়তে থাকি। পরে তিন দিকের শত্রু বেষ্টনী ভেদ করে নিরাপদ আশ্রয়ে যাই।

প্রশ্নঃ স্যার, মুজিবনগর থেকে আপনি কখনো সক্রিয় সাহায্য পেয়েছেন?

উত্তরঃ আগষ্ট মাসের পূর্ব পর্যন্ত মুজিবনগর থেকে কোনো সাহায্য পাইনি। পরে অবশ্য পেয়েছি।

প্রশ্নঃ আপনার অধিনে যে সব জওয়ান আছে তাদের মধ্যে কে কে আপনাকে প্রায় অধিকাংশ যুদ্ধে ছায়ার মতো অনুসরণ করতো?

উত্তরঃ সবু, খোকা, হালিম, ফজলুল হক, আবদুল্লা, ফজলু, আজাহার, লতিফ, দুলাল, মাসুদ, বেনু, শামসু, সাখাওয়াত এবং আরো কয়েকজন।

প্রশ্নঃ মুক্তিযুদ্ধে আপনাকে কে প্রেরণা জোগাতেন?

উত্তরঃ বাঙালি জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান।

——————————————

<৯, ১৬.২, ৪৫১-৪৫৯>

 

কাদের বাহিনীর গঠন ও যুদ্ধ তৎপরতা-২

কাদের বাহিনী সাড়ে তিনশো লড়াই-এ অংশ নিয়েছে

 

(কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে বিশেষ সাক্ষাৎকারের উপর ভিত্তি করে রচিত প্রতিবেদন থেকে সংকলিত। প্রতিবেদনটি দৈনিক বাংলা ৮-১৩ ই ডিসেম্বর ১৯৭২ সালে বিভিন্ন শিরোনামে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিলো। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছিলেন হেদায়েত হোসাইন মোরশেদ)

       কাদের বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা সংখ্যা ছিল ১৭ হাজার। এদের সহায়ক স্বেচ্ছাসেবকদের সংখ্যা ছিল ৭২ হাজারেরও বেশী। একটি সেনাবাহিনীরমতো সুশৃঙ্খল প্রশাসন ব্যবস্থা। সমগ্র টাঙ্গাইল জেলা এবং ঢাকা, ময়মনসিংহ ও পাবনার কিছু অংশ ছিল কর্মক্ষেত্র, ৫টি সেক্টরে বিভক্ত ছিল সমগ্র এলাকা। মুক্তিযোদ্ধারা বিভক্ত ছিল ৯৭ কোম্পানীতে। ৫টি সেক্টরে ছিল পাঁচটি সদর দফতর। কোম্পানীগুলোরও ছিল পৃথক সদর দফতর। এসব সদর দফতর ছিল ভ্রাম্যমাণ। এছাড়া সবার ছিল একটি উর্ধ্বতন স্থায়ী সদর দফতর যেখানে হানাদার পাকিস্তানীরা কোনদিনই পা ফেলতে পারেনি। মুক্তিযোদ্ধাদের বাহিনীতে ছিল সিগন্যালার- হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসের পাতায় যুদ্ধ বর্ণনায় যে ধরনের সিগন্যালার বা খবর সরবরাহকারীর সন্ধান মেলে তেমনি। আবার এর সাথে সাথে ছিল বেতার যোগাযোগ ব্যবস্থা।

এই বাহিনীর কোন যোদ্ধা অধিকৃত বাংলাদেশের বাইরের কোন জায়গা থেকে ট্রেনিং নিয়ে আসেনি। অধিকৃত এলাকাতেই তারা পেয়েছেন প্রশিক্ষণ, আঘাত হেনেছেন শত্রুর উপরে, ধ্বংস করেছেন শত্রুর হানাদারদের আর একের পর এক মুক্ত করেছেন অধিকৃত অঞ্চল। মুক্ত এলাকায় চালু করেছেন বেসামরিক শাসন ব্যবস্থা ১৬ই ডিসেম্বরের অনেক আগেই। একটি সেনাবাহিনীতে যে সব উপকরণ থাকা প্রয়োজন তার প্রায় সব কিছুই এদের ছিল। হাসপাতাল ছিল, যোদ্ধাদের উদ্দীপনা জাগানোর জন্য ছিল সাংস্কৃতিক দল। রণাঙ্গন নামে একটি সাপ্তাহিক মুখপত্র তারা প্রকাশ করতেন। ছিল সুষ্ঠ গণসংযোগ ব্যবস্থা। আরেকটি কথা- শুধু বিমান ছাড়া একটি সশস্ত্র বাহিনীর যে সব অস্ত্র ও গোলাবারুদ থাকা প্রয়োজন পরিমাণে সামান্য হলেও তার অনেকগুলোই তাদের কাছে ছিল। শত্রুর কাছ থেকে ছিনিয়ে তারা এসব অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহ করেছিলেন। ব্যাপক সম্মুখসমর, খণ্ড যুদ্ধ ও ছোটখাটো সংঘর্ষ সহ বাহিনীর মোট লড়াইয়ের সংখ্যা সাড়ে তিনশোরও বেশী। তাদের হাতে নিহত হয়েছে সহস্রাধিক খানসেনা ও রাজাকার। আর এই বাহিনীর শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা হলো একত্রিশ জন।

তাদের নিজস্ব যুদ্ধপদ্ধতি ও কৌশল ছিল, গেরিলা যুদ্ধ তারা করেছেন। ঝাঁপিয়ে পড়েছেন অনেক সম্মুখ সমরে। গেরিলা পদ্ধতির যুদ্ধের একটি রীতি হলো ‘হিট অ্যাণ্ড রান’ অর্থাৎ আঘাত হেনে পালিয়ে যাও। কিন্তু এই বাহিনী গেরিলা যুদ্ধে একটি নবতর রীতি সংযোজন করেছিল। তা হলো ‘সাডেন হিট, ষ্টে অ্যাণ্ড অ্যাডভান্স’ অতর্কিতে এসে আঘাত হানো, অবস্থান করো ও এগিয়ে যাও।

বাহিনীর নাম কাদের বাহিনী আর অধীনায়কের নাম কাদের সিদ্দিকী। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে এই বাহিনী আর অধিনায়কের নাম চিরদিন ভাস্বর হয়ে থাকবে। কাদের বাহিনীর নাম শুনলে হানাদার পাকিস্তানী ও তাদের সহযোগীদের বুকের পাঁজরে ত্রাসের কাঁপন জাগতো। আর কাদের সিদ্দিকী রূপকথার নায়কের মত একটি নাম, অধিকৃত বাংলাদেশ একটি অঞ্চলের মুক্তিপাগল বাঙালির কাছে যে নাম ছিল আস্থা, প্রত্যয়, সাহস, সংগ্রাম ও বিজয়ের বরাভয় আর হানাদারদের কাছে ছিল ভীতি আর বিলুপ্তির পরোয়ানা।

…… দলগত বা বাহিনীগতভাবে ‘কাদের বাহিনী’ প্রথম যুদ্ধ সংগটিত হয় একাত্তর সালের ২২ শে মে চারানে। এই সংঘর্ষ চল্লিশ মিনিট স্থায়ী হয়েছিল। যুদ্ধে ১৫ জন খান সেনা নিহত হয়। আহত হয় আরো বেশী। মুক্তিযোদ্ধারা কেউ হতাহত হয়নি। দুজন গ্রামবাসী শহীদ হন। এরপর থেকে চলেছে খান সেনাদের উপরে অব্যাহত আক্রমণ। খান সেনাদের অস্ত্রবাহী জাহাজের উপর হামলা চালিয়ে এক কিস্তিতেই দখল করেছে একুশ কোটি টাকার গোলাবারুদ। ২৩ ঘণ্টা সময়ের মধ্যে টাঙ্গাইল থেকে কড্ডা পর্যন্ত রাস্তায় ১৭টি গুরুতবপূর্ণ সেতু ধ্বংস করেছে তারা। একাত্তরের নভেম্বর নাগাদ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ থানা মুক্ত করেন তারা এবং অমনি কয়েকশ অপারেশন। ১২ই ডিসেম্বর মুক্ত হয় টাঙ্গাইল। মেজর জেনারেল নাগরা, ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার ও ব্রিগেডিয়ার সানত সিং- এর ভারতীয় বাহিনীর সাথে সম্মিলিতভাবে কাদের বাহিনী অগ্রাভিযান করে ১২ই ডিসেম্বর পরবর্তী কয়েকটি দিন। ১৬ ডিসেম্বর মেজর জেনারেল নাগরার বাহিনী যখন সবার আগে ঢাকা প্রবেশ করে তখন তাঁর সাথে ছিল কাদের বাহিনী ও কাদের সিদ্দিকী।

বাঘা সিদ্দিকীর সাথে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে আমি মিলিত হয়েছিলাম। আমার টেপ রেকর্ডারে তিনি একনাগাড়ে প্রায় আড়াই ঘণ্টা তাঁর বক্তব্য রাখেন। ২৫শে মার্চের পরবর্তী পর্যায়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ ও বাহিনী সংগঠন থেকে শুরু করে ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন ঘটনা ও বিষয়ের কথা বলেন।

কাদের সিদ্দিকী বলেন যে, কোন বাহিনী গঠনের মানসিকতা নিয়ে অন্তত প্রথম অবস্থায় তিনি যুদ্ধে নামেননি। তিনি বললেন, যখন ২৫শে মার্চ ইয়াহিয়া আমাদের উপর তার বাহিনী নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে তখন আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। আমি আগে ভাবতাম কোন কিছুর সমাধান হিংসাত্মক উপায়ে হয় না। ২৩শে মার্চ আমরা অধিকার আদায়ের শপথ নিলাম। এবং সেদিন প্রথম সবক নিলাম প্রয়োজন হলে অস্ত্রের মাধ্যমেও রাজনীতি করতে হতে পারে। ২৫শে মার্চের পর টাঙ্গাইলে সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। সেখানে আমার কোন যোগ্যতা নেই। তার জন্য কোন দায়িত্ব না পেলেও নিজে একজন কর্মী হিসাবে থাকার চেষ্টা করলাম। আমি আগে থেকেই জানতাম রাজনীতির মঞ্চের নেতৃত্ব আর যুদ্ধের নেতৃত্ব এক জিনিস নয়।

৩রা এপ্রিল, ১৯৭১ সাল। হানাদার পাক বাহিনী এগিয়ে এলো টাঙ্গাইলের পথে। তাদেরকে সাটিয়াচড়ায় বাধা দেয়া হয়, বললেন কাদের সিদ্দিকী। সেই যুদ্ধ প্রাক্তন ইপিআর’রাই করেছিল। মাত্র ২ প্লাটুন ইপিআর সেদিন বাধা দেয় হানাদার খান সেনাদের একটি ব্যাটালিয়নকে। যুদ্ধে আমাদের হার হয়। ভাবলাম পাহাড়ে পালিয়ে চলে যাবো। কিন্তু দেশ ছেড়ে যাবো না। যা হয় দেশেই হবে।

\ শত্রুর মোকাবিলা করেই কাদের বাহিনী যুদ্ধ শিখছে \

       ১৯শে এপ্রিল। ময়মনসিংহের পথে রওনা হয় পাকবাহিনী। পথে কালিহাতিতে তাদের বাধা দেয়া হয়। নেতৃত্ব ছিল ইপিআর-এর। কাদের সিদ্দিকীও এদের সঙ্গে অংশগ্রহণ করেন। শত্রুপক্ষের মেজর কামাল সহ বহু খান সেনা এই যুদ্ধে হতাহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা ডিফেন্স উঠিয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এদিকে গ্রাম-গ্রামান্তরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন কাদের সিদ্দিকী। সঙ্গে রয়েছেন কয়েকজন মুক্তিপাগল যুবক। কাদের সিদ্দিকী বলছিলেন, আমার আয়ত্তে কুড়ি পচিঁশটি বন্দুক ছিল। এগুলো নিয়ে পাহাড়ে চলে গেলাম। লুকিয়ে রাখলাম। কয়েকদিন পর শুনতে পেলাম কাদের সিদ্দিকীর মাথা কেউ এনে দিতে পারে তাকে লাখ টাকা পুরুস্কার দেয়া হবে। ভয় পেলাম প্রথমে। আমাদের দেশে হাজার টাকার জন্য মানুষ মানুষকে খুন করে। আমাকে তো ধরিয়েও দিতে পারে। অনেকগুলো যুবক ও তরুণ আমার সাথে গিয়েছিল। তাদের কয়েকজনকে ফিরিয়ে দিলাম। আমি তখন কিছুটা ফ্রাস্ট্রেটেড। আমি পারবো কিনা সন্দেহ ঢুকছে মনে। আমি যে যুদ্ধের নেতৃত্ব দিতে পারবো তা তখন আমার জানা নেই। সহগামী বন্ধুদের বললাম, তোমরা চলে যাও। তোমরা এখনো দোষী সাব্যস্ত হয়নি। আমি মনস্থির করলাম এমনিভাবে পালিয়ে থাকবো। যদি কোনদিন সুযোগ পাই এবং একজন পাকসেনাকেও হত্যা করতে পারি তাহলে মনে সান্ত্বনা পাবো তবু তো একটাকে মারলাম।

কাদের সিদ্দিকী বললেন, কিন্তু পরে দেখলাম আমাকে জঙ্গলে কাটাতে হলো না। মুক্তি পাওয়ার জন্য মানুষ পাগল। সংগ্রামের জন্য তাদের দারুণ আগ্রহ। লাখ টাকার বিনিময়েও তারা ধরিয়ে দিতে রাজী নয়। এভাবে কয়েকদিন কেটে গেলো। বিভিন্ন জায়গা থেকে ছেলেরা এসে আমাকে জিজ্ঞাসা করে, কাদের ভাই, কোথায় ট্রেনিং হচ্ছে? আপনি কোথায় ট্রেনিং দিচ্ছেন, বলুন। বুকে অনেক ভরসা পেলাম। রিক্রুট শুরু করলাম। ৬ই মে নাগাদ আমার দলের লোকসংখ্যা দাঁড়ালো ৪০০ জন। ১৪ই মে বাহেরাতৈলে পবিত্র কোরআন হাতে নিয়ে আমার জোয়ানদের শপথ করালাম যতদিন বাংলাদেশ স্বাধীন না হবে, বঙ্গবন্ধু ফেরত না আসবেন, ততদিন আমাদের যেই জীবিত থাকি যুদ্ধ করবো। সেই থেকে আমাদের সুপরিকল্পিত যুদ্ধ শুরু হলো।

কাদের সিদ্দিকী বললেন, অক্টোবর মাস পর্যন্ত আমি চেষ্টা করেছি আমাকে ছায়া দেয়ার মতো এবং নেতৃত্ব দেয়ার মতো কাউকে যদি পেতাম। আমরা তার হুকুম মেনে কাজ করতাম। অনেকে এসেই আমার সাথে যোগদান করেছে। প্রথমে ভেবেছি এই বোধ হয় কোন নেতা পাবো। কিন্তু পরে দেখেছি তারা আমাকে নেতৃত্ব দেয়ার চেষ্টা করেননি বরং আমার কাছ থেকে নেতৃত্ব আদায়ের চেষ্টা করেছে। তাদের জোরেই আমি নেতা হয়েছিলাম।

কাদের সিদ্দিকী বলেন, কাদের বাহিনী নাম আমি দিইনি। স্বাধীন বাংলা বেতার থেকেই প্রথম আমাদের যুদ্ধকে কাদেরিয়া মার বলে বর্ণনা করে। আমার বাহিনীর নাম দেয় কাদের বাহিনী। পরে আমার ছেলেরাও এই নাম গ্রহণ করে। বঙ্গবন্ধুও পাকিস্তানি কারাগার থেকে বেরিয়ে এসে আমাদেরকে কাদের বাহিনী নামে অভিহিত করেন। কিন্তু আমি আগেও ভাবতাম এবং আজো ভাবি স্বাধীনতার জন্যে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। আমরা মুক্তিবাহিনী। মুক্তিযোদ্ধা।

৩রা জুন কাদের বাহিনীর সাথে সংঘর্ষ হয় গোপালপুর, মধুপুর ও টাঙ্গাইল থানার সম্মিলিত পুলিশ বাহিনীর সাথে। খণ্ডযুদ্ধ হয় বইলামপুরে। হেরে পুলিশ বাহিনী পালিয়ে যায়। সাতজন পুলিশ কাদের বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়। ১২ই জুন হলো বল্লার যুদ্ধ। পাঁচ ঘণ্টা চলে এই যুদ্ধ। কাদের সিদ্দিকীর ভাষায় জনগণের মনোবল বৃদ্ধির জন্য প্রথম পর্যায়ের এই যুদ্ধ অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে আমাদের কাছে আবির্ভূত হয়েছিল। দল সংগঠনের পর খানসেনাদের সাথে এটা ছিল আমাদের প্রথম সম্মুখযুদ্ধ। আমরা ছিলাম প্রায় ১৫০জন। কিন্তু পজিশন নিয়েছিলাম কৌশলগত কারণে মাত্র ১৩ জন। সেই যুদ্ধে ১৬ জন পাকসেনা নিহত হয়। আহত কত হয়েছিল বলতে পারবো না। যুদ্ধে ওরা হেরে গিয়ে পিছিয়ে গেলো। কিন্তু লাশগুলো নিয়ে যাওয়ার জন্য তারা তখনো গুলি চালিয়ে একটি কভার সৃষ্টির চেষ্টা করেছিল। আমি তখন ভাবছি, খান সেনাদের অন্তত কয়েকটি লাশ আমাদের নিয়ে যেতেই হবে। তাহলে মানুষ বিশ্বাস করবে যে আমরাও লড়তে পারবো। আপ্রাণ চেষ্টা করে পাঁচটি লাশ নিয়ে এলাম। একটি লাইট মেশিন গানসহ ৯টি রাইফেলও হস্তগত করলাম। কিন্তু সেদিন মেশিনগান রাইফেলের চেয়েও বড় কাজে এসেছিল ওই লাশগুলো। পাঁচটি লাশ দেখার জন্য কুড়ি হাজারের মতো লোক জমায়েত হয়েছিল। এমন কোন লোক ছিল না যে লাশগুলোকে সেদিন ঘৃণাভরে লাত্থি মারেনি। পরে লাশগুলোকে আমরা নদীতে ভাসিয়ে দিই। এরপর জনগণের মনে এক অদ্ভুত উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়েছিল।

আগষ্ট মাসে কাদের সিদ্দিকীর হাতে গুলি লাগে। টাঙ্গাইল থেকে ১২৮ মাইল পথ পাড়ি দিয়ে তিন দিনে তিনি সীমান্তের ওপারে গিয়ে পৌঁছেন। ২৩শে আগষ্ট তিনি চলে যান। বাংলাদেশে আবার ফিরে আসেন ১৩ই সেপ্টেম্বর। ভারত অবস্থানকালীন অভিজ্ঞতা সম্পর্কে কাদের সিদ্দিকী বলেন যে, ‘ভারতীয় বাহিনী আমার সাথে খুব ভাল ব্যবহার করেছে। আমার যদ্দুর জ্ঞানবুদ্ধি আছে তাতে মনে করি ভারতীয় বাহিনীর লোকেরা খুব ভালো করেই  অনুভব করেছে যে আমাদের স্বাধীন করা উচিত’।

কাদের বাহিনীর সংগঠন গত ব্যাপারে কয়েকটি প্রশ্নও আমি কাদের সিদ্দিকীর কাছে রেখেছিলাম। তিনি জানান, মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়ক হিসাবে ছিল স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। প্রত্যেক ইউনিয়ন, গ্রাম এবং ওয়ার্ডে এই বাহিনী ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা জনগণের সাথে সরাসরি যোগাযোগ রাখতো না। মুক্তিফৌজ কোথাও অপারেশনে গেলে বা ঘাঁটি গেড়ে অবস্থান করলে তাদের খবরদারির ভার থাকতো স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর হাতে। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যেও কয়েকটি দল ছিল। এগুলো হলো হেলথ কোর, যোগাযোগ দল ও যুদ্ধের দায়িত্ব প্রাপ্ত যোদ্ধাদল। এই শেষোক্ত শ্রেণীই ছিল সর্বাধিক সম্মানের অধিকারী। যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের জন্য কোন ক্ষেত্রের অভাব ছিল না। যুদ্ধক্ষেত্রেই তারা প্রশিক্ষন পেয়েছে। বিশেষ কোন ট্রেনিং দিয়ে তাদের যুদ্ধ শেখাতে হয়নি। শত্রুর মোকাবেলা করেই তারা যুদ্ধ শিখেছে। টাঙ্গাইল জেলায় কাদের বাহিনী তাদের তৎপরতা সর্বাধিক কেন্দ্রিভূত করেছিল। পাঁচটি সেক্টরে জেলাটি বিভক্ত ছিল। কোম্পানী ছিল ৯৭ টি। সেক্টরের অধিনায়ক হিসাবে কাউকে কখনো বিশেষ দায়িত্ব দেয়া হয়নি। একজন সিনিয়র কোম্পানী কমান্ডারের উপর তার নিজস্ব কোম্পানী ছাড়াও সেক্টরের দায়িত্ব দেয়া হতো।

বাহিনীর ঊর্ধ্বতন সদর দফতর ‘মহানন্দপুরে’ অবস্থিত ছিল। বাহিনীর একজন প্রশাসনিক প্রধান ছিলেন। একাত্তর সালের জুলাই মাস থেকে বাংলাদেশে সরকারের অনুমতিক্রমে কাদের বাহিনী জনগণের দৈনন্দিন জীবনের সকল দুঃখ-দুর্দশা মোচনের জন্য সামগ্রিক ব্যবস্থা গ্রহণ শুরু করেন।

কাদের বাহিনীর একটি সিকিউরিটি বা ইনটেলিজেন্স বিভাগ এবং সাথে সাথে কাউন্টার ইনটেলিজেন্স ব্যবস্থা চালু ছিল। বাহিনীর লোকজন সম্পর্কে খবরাখবর সংগ্রহ করে রিপোর্ট করা ছিল এদের কাজ। মুক্তিযোদ্ধাদের গতিবিধি ছিল কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত। কাদের বাহিনীর সিগন্যাল বা কুরিয়ার সার্ভিসের ব্যবস্থা ছিল অদ্ভুত। সর্বক্ষন বিভিন্ন এলাকায় রুটিনমাফিক সিগন্যালম্যানের কাছে দ্রুত দৌড়ে দিয়ে খবর পৌঁছে দিতো। সে পৌঁছে দিতো পরের পয়েন্টে। এমনি করে করা হতো খবর এবং তা সব সময়ই (বিশেষ করে যা জরুরী গোপন আশু নির্দেশ) থাকতো লিখিত। বিভিন্ন পয়েন্টের সিগন্যালম্যানের নাম তাতে স্বাক্ষরিত থাকতো। কাদের সিদ্দিকী জানান যে, এভাবে ১০ মাইল দুরবর্তী কোন স্থানে খবর পাঠাতে তাদের সময় লাগতো বড়জোর ২৫ মিনিট। নভেম্বর মাস থেকে কাদের বাহিনীর শক্তিসম্পন্ন বেতার ব্যবস্থা চালু করে।

\ যুদ্ধে কখনো হারি নি-কিন্তু নাগপুরের কোন যুদ্ধে আমি জিতিনিঃ

কাদের সিদ্দিকী \

কাদের বাহিনীর মোট লড়াইয়ের সংখ্যা তিনশরও বেশী। প্রত্যেকটি যুদ্ধ হামলা কিংবা স্যাবোটাজ অপারেশনই ছিল কোন না কোন দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। তবুও এর মধ্যে কয়েকটি লড়াই-এর স্মৃতি মনে দাগ কেটে রয়েছে। সে কথাই বলছিলেন কাদের সিদ্দিকী। ১১ই আগষ্ট কমান্ডার হাবিবের নেতৃত্বে কাদের বাহিনী একটি দল ভূয়াপুরের কাছে মাটিকাটায় ধলেশ্বরীতে পাকবাহিনীর অস্ত্রবাহী জাহাজের ওপর হামলা চালাল। জাহাজটির নাম আর এস ইউ ইঞ্জিনিয়ার্স, এলসি-৩। ঢাকা থেকে রংপুরের সেনানিবাসে যাচ্ছিল ২১ কোটি টাকার অস্ত্র নিয়ে। সঙ্গে আরও কয়েকটি জাহাজ ছিল। কিন্তু কাদের বাহিনীর যোদ্ধারা সিরাজকান্দির উত্তরে মাটিকাটা চরে নদী তীরবর্তী দুটি বাড়ি থেকে ষ্টেনগান, এলএমজি আর মর্টার দিয়ে হামলা চালিয়েছিল সঠিক লক্ষ্যবস্তুর উপর। ঘায়েল হলো জাহাজ, কুপোকাত হলো জাহাজের অধিনায়ক আমানুল্লাহ খান, খতম হলো শতাধিক খান সেনা। কাদের বাহিনী ছিনিয়ে নিল ২১ কোটির অস্ত্র ও গোলাবারুদ যার মধ্যে ছিল ১২০ এম এম ২ ইঞ্চি ও ৩ ইঞ্চি মর্টার, ৮৩ এম এম ক্যালেন্ডার সাইজ ভারী কামান ও প্রচুর রাইফেল। এরপর পাক বাহিনী প্রচণ্ড আক্রোশে পাল্টা হামলা চালিয়েছিল। দুটো এফ-৮৬ স্যাবর জেট তাদেরকে কভার দিতে এগিয়ে এসেছে। কিন্তু কিছুই হয়নি। ২১ কোটি টাকার অস্ত্র কাদের বাহিনী তাদের সদর নিয়ে চলে গেল। এই যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে কাদের সিদ্দিকীও মাটিকাটায় ছিলেন।

ব্যাক্তিগতভাবে যে সব যুদ্ধ করেছেন তার মধ্যে মনে দাগ কাটার মতো কয়েকটি যুদ্ধের কথা কাদের সিদ্দিকী বললেন। একটি যুদ্ধ হল আগষ্টে ধলাপাড়ার যুদ্ধ। এই যুদ্ধে কাদের সিদ্দিকী আহত হন।  ২০শে নভেম্বর আড়াই হাজার পাকসেনা অর্থ্যাৎ পুরো একটি বিগ্রেডকে ঢাকা-টাঙ্গাইল রোড থেকে হটিয়ে দিয়ে করটিয়া পর্যন্ত এলাকা কব্জায় রেখে ২৩ ঘণ্টায় ১৭টি সেতু ধ্বংস করে দেয় কাদের বাহিনী। পাক বাহিনী পাল্টা বিমান আক্রমণ চালায় কাদের সিদ্দিকী জানান, এত সামনাসামনি যুদ্ধ এর আগে আমি কোন দিন করিনি। ওরা একবার এগিয়ে আসছে, আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি। আবার আমরা এগিয়ে যাচ্ছি ওরা পিছু হটছে। এভাবে পাঁচ ঘণ্টা যুদ্ধ চলার পর পাক সেনারা হেরে যায়। কাদের বাহিনী পাকসেনাদের কয়েক মাইল পিছু হটিয়ে দিয়ে আসে।

কাদের সিদ্দিকীর ব্যাক্তিগত অংশগ্রহ্ন-সমৃদ্ধ যুদ্ধের মধ্যে সবচেয়ে ধকল গেছে নাগপুরের যুদ্ধে। কাদের সিদ্দিকী আমাকে বললেন, আমার জন্য টাঙ্গাইল জেলায় একটি দুর্ভাগ্যজনক থানা ছিল নাগরপুর। আমি জীবনে কোন যুদ্ধেই হারিনি। কিন্তু নাগরপুর থানার কোন যুদ্ধেই জিতিনি। ১৭ই অক্টোবর আমি নাগরপুর অভিযান করেছিলাম। সেদিন আমার মারা যাওয়ার মত অবস্থা। কোন রকমে বেঁচে যাই। তারপরও আমি অভিযান চালাই। সেখানেও আমি হেরে যাই। ৩০শে নভেম্বর বেলা প্রায় সাড়ে ১২টায় নাগরপুর থানা দফতরের উপর হামলা করি। আমাদের মনে ছিল প্রচণ্ড উৎসাহ। নাগরপুর থানায় ৬৫ জন সৈন্য রয়েছে-তাও মিলিশিয়া। আর আমাদের হল ২৫০ জন যোদ্ধা। ভাবলাম, আজ হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে থানায় উঠবো। কিন্তু পারলাম না। ২টা তিন ইঞ্চি মর্টার, ২টা আড়াই ইঞ্চি মর্টার, ৭/৮টি ২ ইঞ্চি মর্টার, ৪টা গ্রেনেড নিক্ষেপকারী রাইফেল আমাদের সাথে। এ ছাড়া রয়েছে ১৯টি লাইট মেশিনগান। জীবনে এত এলএমজি আর কোথাও ব্যবহার করিনি। এছাড়া স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ছাড়া কোন সিংগলশট অস্ত্রও আমরা ব্যবহার করিনি। কিন্তু থানাটির অবস্থান ছিল ভারী বিদঘুটে। সম্মুখে ফাঁকা জায়গা। কভার নেয়ার মতো কোন স্থান নেই। ফলে এগোনো যায় না। আর শত্রুরা মরিচা থেকে ফায়ার করছে। আমি ১৫৮ রাউণ্ড ৩ ইঞ্চি মর্টারের গোলাবর্ষন করি। কিন্তু একটি গোলাও থানার ওপরে ফেলতে পারলাম না। আমি এমন ব্যর্থ আর কোথাও হয়নি। একশ গজ দূর থেকে ৫৪ রাউণ্ড দুই ইঞ্চি মর্টারের ফায়ারও করেছি। কিন্তু একটাও লক্ষ্যস্থলে পড়েনি। ২রা ডিসেম্বর পর্যন্ত হামলা চালালাম। কিন্তু পাক সেনাদের মরিচা থেকে ডিবপার্জ করতে পারলাম না। এত প্রস্তুতির পরও সবচেয়ে বেশী ধকল আমার এখানে গেছে। আসল চাইনিজ ৮৩ ব্লেণ্ড সাউণ্ড কিন্তু তার ফ্লাশ প্রোটেক্ট করার জন্য যে কভার থাকে তা নেই। রাউণ্ড ভরলাম ফায়ার করলাম। থানায় শত্রুদের একটা মরিচা উড়ে গেল। কিন্তু আমাকেও ধাক্কা মেরে হাত তিনেক পেছনে ফেলে দিল। আমার মাথার টুপি উড়িয়ে নিয়ে ফেলল প্রায় পনের হাত পিছনে।

৩রা ডিসেম্বর পাক বাহিনীর রিইনফোর্সমেন্ট কন্টিনজেন্ট এগিয়ে এলো ময়মনসিংহ থেকে টাঙ্গাইল। কাদের সিদ্দিকী এগিয়ে গেলেন এলাসিন গুদারা ঘাটে পাক বাহিনীকে বাধা দিতে। কিন্তু সময়ের সামান্য হেরফের তিনি গুদারা ঘাটের ওপারে পাক বাহিনীকে বাধা দিতে পারলেন না। পাক বাহিনী এপারে চলে এলো। কাদের বাহিনী সুবিধামত পজিশন নিতে পারলেন না। কাদের সিদ্দিকী বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লেন। কিন্তু মাত্র কয়েক ঘন্টার জন্য। আবার সবকিছু ঐ এলাকায় সুসংগঠিত হয়ে গেল। ৩রা ডিসেম্বর মধ্য রাতে কাদের সিদ্দিকী ছিলেন কেদারপুরে। শেষ রাতে গোলা আর বোমাবর্ষনের শব্দ শুনতে পেলেন। খনিক পরই মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেল বিমান। সঙ্গীদের বললেন কাদের সিদ্দিকী, কাল থেকে নতুন সুখবর হবে। সঙ্গীরা এ কথার অর্থ জানতে চাইলেন। কাদের সিদ্দিকী বললেন। এই যে দেখলে না আমাদের বিমান শত্রুদের উপর আক্রমণ হেনে চলে গেলো। এরকম আঘাত হানলেই কাজ হবে। বাদবাকি আমরা পারব। পরের দিন কাদের সিদ্দিকী নবতর পরিস্থিতিতে সবাইকে সংগঠিত করলেন।

কাদের সিদ্দিকী নতুন পরিকল্পনা নিলেন ঢাকা-টাঙ্গাইল সড়কে যে সেতুগুলো বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে তার নিচু দিয়ে যে রাস্তা হয়েছে তাতেও প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করা হবে। সেখানে এন্টি ট্যাংক মাইন বসানো হবে এবং এই মাইন প্রতিরক্ষার জন্য এর চারপাশে বসানো হবে একাধিক এন্টি পারসোনেল মাইন। প্রতি রাতে এই মাইন বসানোর নির্দেশ দেয়া হল। কাদের বাহিনীর যোদ্ধারা জালের মতো মাইন বিছিয়ে ফেললো। সঙ্গে সঙ্গে কাদের সিদ্দিকী আরেকটি পরিকল্পনা নিলেন, আগামী দুই দিনের মধ্যে টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ সড়কের সেতুগুলো ভেঙ্গে ফেলতে হবে। তারপর টাঙ্গাইল দখল করতে হবে। উল্লেখ্য, ২০শে নভেম্বর টাঙ্গাইল দখলের পরিকল্পনা কাদের সিদ্দিকীর ছিল। ঢাকা-টাঙ্গাইল এবং টাঙ্গাইল- ময়মনসিংহের সড়কের সেতুগুলো একযোগে ভেঙ্গে ফেলা হবে- মধুপুর থেকে শুরু করে ৯টা সেতু ধ্বংস করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল। কিন্তু অপাশের দায়িত্বে যারা ছিলেন তারা আর পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজে হাত দিতে পারেনি।

যাহোক, এবার কাদের সিদ্দিকী সেতু ভাঙ্গার জন্য নতুন করে পরিকল্পনা নিলেন। তিনি ভাবলেন, ঢাকায় এখন শত্রুদের ওপর বিমান আঘাত হানা হবে; সীমান্ত ছেড়ে পাকবাহিনী আসবে না এবং এই সড়কটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই সেতু ভেঙ্গে পাকবাহিনী যোগাযোগের পথ বিচ্ছিন্ন করে টাঙ্গাইল তিনি দখল করবেন। ৪ঠা ডিসেম্বর কাদের সিদ্দিকী মার্চ শুরু করলেন। তখন কামালপুরে সম্মিলিত বাহিনীর সাথে পাকবাহিনীর যুদ্ধ চলছে। কাদের সিদ্দিকী স্থির করলেন তিনি মধুপুর দখল করে পুংলী সেতু পর্যন্ত আসবেন।

কাদের সিদ্দিকী বললেন, ৭ই ডিসেম্বর আমি নিকরাইল থেকে কোথায় কি করা হবে তার পরিকল্পনা করলাম। স্থির করলাম আমার ৫ হাজার যোদ্ধাকে নিয়ে এবারকার পরবর্তী পর্যায়ের অপারেশন চালাবো। আর সব যোদ্ধা থাকবে ডিফেন্সে এবং এই ৫ হাজার করবে এ্যাকশন। এর আগে ৬ই ডিসেম্বর ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। ৭ই ডিসেম্বর আমি নিকরাইলে জনসভা করলাম। কুড়ি থেকে ত্রিশ হাজার লোক হল। সভায় জনগণকে বললাম, আপনাদের সাথে আর দেখা হবে কিনা জানি না। বাংলাদেশ আজ স্বীকৃতি পেয়েছে। কাদের সিদ্দিকী বললেন, ৭ই ডিসেম্বর রাতে সম্মিলিত বাহিনীতে ভারতীয় বাহিনীর ব্রিগেডিয়ার সানত সিং আমাকে অয়ারলেসে যোগাযোগ করে জানালেন, আমরা জামালপুর পর্যন্ত এসে গেছি, ব্রহ্মপুত্র নদী আমরা পার হতে পারছি না। আপনি জামালপুরের দক্ষিন দিক থেকে পাকবাহিনীর উপর হামলা করুন আর আমরা উত্তর দিক থেকে হামলা করছি। আমি তাই জামালপুর রওয়ানা হলাম। কিন্তু  ধনবাড়ী পর্যন্ত গিয়ে মত পরিবর্তন করলাম। আমি ঘুরে পথ পরিবর্তন করলাম। ৯ই ডিসেম্বর ব্রিগেডিয়ার সানত সিংকে অয়ারলেসে জানালামঃ আমি আপনার প্রস্তাব মানতে পারলাম না। কিন্তু ঢাকা থেকে পাকবাহিনী যেন ফোর্স পাঠাতে না পারে আমি সেই চেষ্টা করছি। আমি কথা দিলাম, পাক বাহিনীর একটিও সৈন্য যদি এই পথে এইদিকে আসতে পারে তবে আমি আইনত দণ্ড নেবো। আপনি আমাদের একটু উপকার করুন- গোপালপুরে আমাদের একটু এয়ার কভার দিন।

কাদের সিদ্দিকী বললেন, তাঁরা আমাদের কথায় রাজী হলেন। ১০ই ডিসেম্বর সকাল বেলা আমরা ঘাটাইল থানায় হামলা করলাম। বিকেল সাড়ে চারটায় থানা ঘাঁটির উপর হামলা করলাম। সেদিনই ঘাটাইলের পতন হলো। এদিকে সকাল ১০টা-১১টায় গোপালপুরে এয়ার কভার দেওয়ার কথা, আমার বাহিনীর যোদ্ধারা সেখানে অপেক্ষা করছে। কিন্তু বিমানের দেখা নেই। আমাদের কোন কনফার্মও করেনি। আমার ছেলেরা গোপালপুর ঘাঁটিতে আক্রমণ চালিয়ে কব্জা করে নিতে পারে। কিন্তু তারা বিমান হামলার জন্য অপেক্ষা করছে। পরে ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেল। বলা সাড়ে তিনটার দিকে আমার ছেলেরা শত্রুর ঘাঁটির উপর আক্রমণ করলো। পতন হলো গোপালপুরের।

বলছিলেন কাদের সিদ্দিকীঃ এদিকে জামালপুর আর আমাদের সাহায্যের দরকার হয়নি সম্মিলিত বাহিনীর। জামালপুর শত্রুর অবস্থানের উপর সম্মিলিত বাহিনীর বিমান এক হাজার পাউন্ডের দুটি বোমাবর্ষন করে। এতে ব্রক্ষপুত্র নদীর তীরে শত্রুদের প্রায় ৩৮টি মরিচা ধসে একেবারে পুকুরের মতো হয়ে যায়। এরপর পাকবাহিনী পালাতে শুরু করে। এদিকে রাস্তাটি এলেঙ্গা পর্যন্ত আমাদের দখলে এসেছে। টাঙ্গাইলে পাকবাহিনী র‍যেছে। পলাতক পাকবাহিনীর কনভয়ের উপর সম্মিলিত বাহিনীর বিমান স্ট্রাফিং করে গেল। ১১ ডিসেম্বর ভোর বেলায় আমরা পরিকল্পনা নিলাম আজ টাঙ্গাইল দখল করতেই হবে। কমান্ডার হাবিবের নেতৃত্বে একটি বাহিনীকে পাঠানো হলো ময়মনসিংহ থেকে পাকবাহিনীর আগমনকে ঠেকিয়ে রাখার জন্য। আগের রাতেই খবর পেয়েছি পাকবাহিনীর কনভয় যেতে পারছেনা। টাঙ্গাইল-ঢাকা রোডে পাতা আমাদের মাইনের জালের ফাঁদে তারা আটকা পড়েছে। প্রত্যেকটি সেতুর নিচের ডাইভারসন রোডে রয়েছে মাইন। ভাতকুড়া ব্রীজের নীচে একটি মাইনের ঘায়েই পড়ে গেল এগারটি গাড়ি। রোড ক্লিয়ার নেই। টাঙ্গাইল থেকে ভাতকুড়া হয়ে কালিহাতি পর্যন্ত লাইনআপ হয়ে রয়েছে শত্রুদের কনভয়ের গাড়ী। কালিহাতী থানা আমাদের ছেলেদের দখলে। আমরা এগিয়ে এলাম। আমি ১১ই ডিসেম্বর আবার স্মমিলিত বাহিনীর বিমানকে টাঙ্গাইল থেকে এলাঙ্গা পর্যন্ত বিমান হামলা ও এয়ার কভারের কথা বলেছি। তারা জানিয়েছেন, দিচ্ছেন, এদিকে কমান্ডার সবুরকে রেকি পার্টি নিয়ে পাঠিয়েছি। কিন্তু তারা এগিয়ে গেছে। ভয় হলো বিমান হামলা না আবার ভূলে তার উপর হয়। আল্লাহর রহমত, এলাঙ্গা থেকে অল্প একটু এ পাশে সবুর হল্ট হয়েছে। হল্ট এ জন্য করেছে যে ওপাশে পাকবাহিনী রয়েছে এক ব্যাটালিয়ন। আটকা পড়েছে। সবুরকে নির্দেশ দিলাম একটু পিছিয়ে আসার জন্য। এর পাঁচ মিনিটের মধ্যেই বিমান হামলা হলো। সে কি মার! পাকবাহিনী যেখানে পালিয়েছে সেখানেই তার উপর হামলা। শত্রুরা দিশেহারা হয়ে পড়লো। আমরা ডবল মার্চ করে এগিয়ে গেলাম। আমাদের দেখে পাকবাহিনীর সেকি দৌড়। পাকবাহিনী যে এমন দৌড়াতে পারে তা না দেখলে বোঝা সম্ভব নয়। আমরা তাদের দিকে ভ্রুক্ষেপই করলাম না। ধরাতো ওরা পড়বেই। আমাদের বাহিনী সড়ক ধরে এগিয়ে চললো। আমাদের বাহিনী তারপর পুংলী ব্রীজে পৌঁছলো। সে সময় ওখানে ভারতীয় বাহিনীর ছত্রীসেনা নামলো। অনেক এলাকা জুড়ে তারা নামলো। একটু পরে খবর আসলো ভারতীয় বাহিনী এসে পড়েছে। আমি ভাবতে পারিনি এত তাড়াতাড়ি তারা আসতে পারবে। আমাকে তারা জিজ্ঞাসা করলেন টাঙ্গাইলের খবর কি? টাঙ্গাইলের দায়িত্ব তো আমার। একটু সবুর করুন। খানিক পর খবর দিচ্ছি। পাকবাহিনীর ফেলে আসা বাসে উঠলাম। এসে দেখি গোলাগুলি চলছে শহরে। পাকবাহিনীর তিনশ সৈন্য রয়েছে শহরে। আমার বাহিনীর যোদ্ধাদের সঙ্গে পাল্টা গুলি বিনিময় হচ্ছে। কিন্তু আত্মসমর্পন করছে না। বলছে যে, হয় ভারতীয় বাহিনী, নয়তো কাদের বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পন করবে। আমি গিয়ে আহবান জানালাম আত্মসমর্পনের জন্যে। পাকবাহিনীর কমান্ডার এসে আত্মসমর্পন করে বললেন ‘যো আপ করে’ ভারতীয় বাহিনীর কাছে খবর গেল, এবার আসতে পারেন। টাঙ্গাইল ক্লিয়ার। অবশ্য টাঙ্গাইল সকালেই ক্লিয়ার হয়েছিল। আমার শুধু অন্য সব দায়িত্বে আটকে থাকায় আসতে দেরি হয়েছিল। ভারতীয় বাহিনী টাঙ্গাইল এলো। গোড়াই পর্যন্ত আমি অপারেশন প্লান করে দিয়েছিলাম। খবর পেলাম গোড়াই পর্যন্ত সব ক্লিয়ার।

\ আমার পরিচয় পেয়ে নিয়াজী তড়াক করে দাঁড়িয়ে আমাকে স্যালুট করলো \

       ১২ই ডিসেম্বর। গোরাই গিয়ে অবস্থান নিল ভারতীয় বাহিনী। কাদের সিদ্দিকী তার বাহিনীকে ১২ ও ১৩ই ডিসেম্বর বিশ্রামের নির্দেশ দিলেন। ১৪ ডিসেম্বর তিনি টাঙ্গাইলে জনসভা করলেন। সেই জনসভায় বললেন, এই বোধ হয় শেষ দেখা। আর দেখা নাও হতে পারে। এই যে আপনাদের সাথে মিলিত হতে পারলাম এটাই আমার শান্তি। কাদের সিদ্দিকী আমাকে এ প্রসঙ্গে বললেন, ঢাকা যে এত সকালে মুক্ত হবে তখনো তা ভাবিনি। আমি মনে করেছিলাম অন্তত আরো একমাস যুদ্ধ হবে। কাদের সিদ্দিকী ঢাকা অভিযানের জন্য নিজের বাহিনী থেকে আড়াই হাজার যোদ্ধা বাছাই করলেন। শুরু হলো ঢাকা অভিমুখে অভিযান। স্থির হপ্লো দুটি পথে সম্মিলিত বাহিনী ঢাকার দিকে এগিয়ে যাবে-

১। সাভার হয়ে এবং

২। টঙ্গী হয়ে।

১৫ই ডিসেম্বর সকালে পাক বাহিনী সম্মিলিত বাহিনীর অগ্রাভিযান রোধ করার জন্য কড্ডার সেতু ভেঙ্গে দেয়। এসব ঘটনার কথা বলছিলেন কাদের সিদ্দিকী, “সকালে ওরা ব্রিজ উড়িয়ে দিল। সম্মিলিত বাহিনীতে ভারতীয় বাহিনীর মেজর জেনারেল নাগরা আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কেয়া সিদ্দিকী! কেয়া হো গেয়া! আমি বললাম, কি আর হবে। পাক বাহিনী ব্রিজ ভেঙ্গে দিল। পাকবাহিনীর কাণ্ড দেখে আমার তখন খুব হাসি পাচ্ছিল। ভাবছিলাম, পাক মিলিটারি তোদের রোধ করার জন্য ব্রিজ ভেঙ্গে ফেলি। মেজর জেনারেল নাগরাকে বললাম, আজ আভি অর নেহী যায়েগা। জেনারেল নাগরা বললেন, কিউ সিদ্দিকী কিউ? আমি বললাম, হাম প্লান বানায়েঙ্গে। রাতের বেলা পরিকল্পনা তৈরি করলাম। একদল ডানদিকে আর একদল বাম দিকে রাতের আবছায়ায় নদী পার হলো স্থানীয় লোকজনদের সহায়তায়। আমাদের ১০০ জন করে মুক্তিযোদ্ধা এবং ভারতীয় বাহিনীর একটি করে ব্যাটালিয়ান। পাক বাহিনী তখনো নিশ্চিন্তে রয়েছে। ভেবেছে, আমরা তো নদী পার হতে পারবোই না। আল্লাহর কি রহমত, সম্মিলিত বাহিনী নদী পার হয়েই শত্রুদের দুজনকে মেরে ফেলল। ব্রিজ ভেঙ্গে যারা খেতে বসেছিল তাদের পাকড়াও করলো।”

১৫ই ডিসেম্বর সকালে সম্মিলিত বাহিনীর আরেকটি দল এগিয়ে গিয়েছিল সভারের পথে। এখন যেখানে রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্প সেখানে যুদ্ধ হয়। তারপর আর কোন যুদ্ধ হয়নি। এই বাহিনী ১৬ই ডিসেম্বর সকালে মিরপুর থেকে সাভার অভিমুখী সড়ক সেখানে প্রস্থে দ্বিগুণ হয়ে অর্থাৎ ডবল রোড হিসেবে শুরু হয়েছে সেখানে এসে অবস্থান নিল। আর এদিকে টঙ্গী অভিমূখী বাহিনী ১৬ই ডিসেম্বর বোর্ড বাজারে এসে পৌঁছালো।

১৬ই ডিসেম্বর সকালে মেজর জেনারেল নাগরা ও কাদের সিদ্দিকী একটি হেলিকপ্টারে এসে সাভারগামী সড়কে মিরপুর ব্রিজের পরবর্তী ব্রিজের কাছে নামলেন। সঙ্গে রয়েছেন ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার। বলছিলেন কাদের সিদ্দিকীঃ ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার টঙ্গী অভিমুখে এগিয়ে যাওয়া বাহিনীর অধিনায়কত্ব করছিলেন। সাভারগামী বাহিনীর অধিনায়কত্ব করছিলেন ব্রিগেডিয়ার সানত সিং। হেলিকপ্টার থেকে নেমে মেজর জেনারেল নাগরা জেনারেল নিয়াজীর কাছে একটি চিঠি লিখলেন। তাতে তিনি নিয়াজীকে লিখলেন, আমি অমুক জায়গায় রয়েছি। তুমি আত্মসমর্পন করবে কিনা জানাও এবং উত্তর দাও। ভারতীয় বাহিনীর একজন মেজরকে বাহক করে চিঠি পাঠানো হলো। তার সাথে রয়েছে ভারতীয় বাহিনীর তিনজন জওয়ান ও পথ চেনাবার জন্য একজন মুক্তিযোদ্ধা। দু’টি জীপ তাদের নিয়ে চলে গেলো। জীপের সম্মুখে সাদা পতাকা। সঙ্গে কোন অস্ত্র নেই। নিয়াজী চিঠি পেয়ে জানাল যে, সে আত্মসমর্পন করতে প্রস্তুত। কিন্তু কোন লিখিত ভাষ্য সে দিল না। পাকবাহিনীর মেজর জেনারেল জামশেদকে পাঠিয়ে দিল। জামশেদ এসে মেজর জেনারেল নাগারাকে স্যালুট করলো। তখন নাগারা বললেন, ‘শুনো সিদ্দিকী, হামকো স্যালুট করেগা তো হাম লেগা আউর তুম লেগা। হামলোগ দো এক সাথ আয়া হ্যায়।’ জামশেদ এসে তার নিজের রিভলভার ও মাথার ফৌজি টুপি তুলে দিল সম্মিলিত বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পনের প্রতিক হিসাবে। রিভলভারটি গ্রহণ করলেন মেজর জেনারেল নাগরা এবং টুপি তুলে দিল আমার হাতে। জেনারেল নাগরা তখন আমাকে বললেন, আরে সিদ্দিকী, ক্যামেরাম্যান হ্যায়? ইয়েতো হিষ্ট্রি বন যায়েগা। কিন্তু দুর্ভাগ্য, সে সময়ে কোন ক্যামেরা ম্যান সেখানে ছিল না। মেজর জেনারেল জামশেদ যখন আত্মসমর্পন করলো, তখন সকাল দশটা।

কাদের সিদ্দিকী বললেন, ‘আমরা ঠিক করলাম যে, জেনারেল নিয়াজীর সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে হবে। মিরপুর ব্রিজের এপারে এলাম জেনারেল নাগরা, ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার, ব্রিগেডিয়ার সানত সিং ও আমি এলাম পাক বাহিনীর গাড়ীতে চেপে। রাস্তায় প্রহরারত পাক বাহিনী আমাদের স্যালুট ঠুকছে। আমাদের বাহিনী পড়ে রইলো পেছনে। এপারে এসে এক জায়গায় টেলিফোন করতে গিয়ে দেখি কোন শব্দ নেই। টেলিফোন ডেড। লাইন কাট আপ। এলাম মোহাম্মদপুর। নিয়াজীকে টেলিফোন করা হলো কিন্তু সাড়া নেই রিং হচ্ছে না। তখন জেনারেল নাগরা বললেন, উন লোক চালাকি কিয়া। যেধার যাতাহু ওধারই লাইন নেহী হ্যায়। তখন সকাল প্রায় সোয়া দশটা পেরিয়েছে। জেনারেল নাগরা তখন ভাবছেন যে আমরা ক্যান্টনমেন্টে যাবো কি যাবো না। যাওয়াটা কি ঠিক হবে। আমি বললাম, যখন এসেই পরেছি তখন যাবোই। তারপর দশটা চল্লিশ মিনিটে আমরা ক্যান্টনমেন্টে নিয়াজীর দফতরে পৌঁছলাম। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘর। নিয়াজী এসে স্যালুট করলো। নাগরা স্যালুটের জবাব দিলেন। নাগরা বসলেন। নিয়াজী বসলো। নাগরা তখন পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন, ইয়ে হ্যা ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার, ইয়ে হ্যায় ব্রিগেডিয়ার সানত সিং, আউর ইয়ে হ্যায় বাংলাদেশ বাহিনীর কাদের সিদ্দিকী। নিয়াজী তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে স্যালুট করলো এবং করমর্দনের জন্যে হাত বাড়িয়ে দিল। আমি তখনো বসে রয়েছি। ইতস্তত করছি, আর ভাবছি নিয়াজীর সাথে হ্যাণ্ডসেক করবো কিনা। নিয়াজী তখনো হাত বাড়িয়ে রয়েছে। জেনারেল নাগরা বললেন, কেয়া হুয়া সিদ্দিকী, হাত মিলাও। তুমকো নিয়াজীকে সাথে নেহী-এক ইনসানকে সাথ হাত মিলাতা হ্যায়। মিলাও।

—————————————————

 

<৯, ১৬, ৪৫৯-৪৬৪>

কাদের বাহিনী সম্পর্কিত আরো বিবরণ-৩

(কাদেরিয়া বাহিনীর বিভিন্ন দিক সম্পর্কে এই বিবরণ গৃহীত হয়েছে মোহাম্মদ মোদাব্বের রচিত ও শিরিন প্রেস, ঢাকা থেকে প্রকাশিত “মুক্তি সংগ্রামে বাঘা সিদ্দিকী” (১৬ ডিসেম্বর ১৯৭৩) গ্রন্থ থেকে। কাদের বাহিনী সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্যের জন্য গ্রন্থটি দ্রষ্টব্য)

১৪ ই মে বহেরাতৈল গ্রামে মুক্তিবাহিনীর শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের পর কয়েকজন প্রতিভাবান দেশভক্ত ছাত্র কাদের সিদ্দিকীর সাথে এসে যোগ দিলেন এবং দেশমাতৃকার মুক্তি সাধনে জীবন গঠন করার শপথ নিলেন। এদের মধ্যে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ হলের ছাত্রসংসদের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুল আলম শহীদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন বিভাগের শেষ পর্বের ছাত্র নূরুন্নবী, টাঙ্গাইল জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি এনায়েত করিম, সৈয়দ নজরুল ইসলাম। রঞ্জু, মুসা ও ফজলু নামক তিনজন ছাত্রও এই সময়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন। অছাত্রদের মধ্যে সামরিক বাহিনী থেকে দলত্যাগী ক্যাপ্টেন ফজলুর রহমান এবং লোকমান, গফুর, লাবিবুর রহমান, লাল্টু ও সরওয়ার মুক্তি সংগ্রামে যোগদান করে। লাবিবুর রহমান পরে এক সম্মুখ সংঘর্ষে শাহাদাৎ বরণ করেন।

প্রকৃতপক্ষে চারান সংঘর্ষ সাফল্যের পর দেশবাসির মনে নতুন উদ্দীপনার সৃষ্টি হল। ব্যাপকভাবে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামে আমাদের জয় যে সুনিশ্চিত, এ কথা দেশের তরুণদের মধ্যে প্রত্যয় সৃষ্টি করলো। তাই দলে দলে তরুণ, যুবক ও ছাত্ররা কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়ার জন্য পাহাড় এলাকায় মুক্তিবাহিনী ঘাঁটির তল্লাসে বেড়িয়ে পড়লো। যথারীতি পরীক্ষার পর তাদের মুক্তি বাহিনীতে ভর্তি করা হলো। ..

মুক্তিবাহিনীর সদর দফতরসহ মুক্ত এলাকা ছিল উত্তরে মধুপুর ময়মনসিংহ সড়কের দক্ষিন থেকে কালিয়াকৈর-এর উত্তর পর্যন্ত ৫০ মাইল জঙ্গল এলাকা, পূর্বে ভালুকা, গফরগাঁও ও শ্রীপুর। পশ্চিমে টাঙ্গাইল মধুপুর সড়ক ৩০ মাইল। অর্থাৎ এই ১৫০০ বর্গমাইল এলাকা কাদেরিয়া বাহিনীর করায়ত্ত নিরাপদ ছিল। এই অঞ্চল রক্ষার জন্য প্রাণপণ সংগ্রাম করতে হবে, সে জন্য এই এলাকাকে এক শক্তিশালী বৃত্তাকারে প্রতিষ্ঠিত রক্ষাব্যূহ দ্বারা পরিবেষ্টিত করা প্রয়োজন। এই উদ্দেশ্যে অধিনায়ক সিদ্দিকী বিচক্ষন সেনানয়কের ন্যায় নিন্মলিখিতভাবে ঘাঁটি পত্তন করলেন এক একজন দক্ষ নায়কের অধীনেঃ-

১। বহেরা ৪ নং কোম্পানী। অধিনায়ক ক্যাপ্টেন ফজলুর রহমান, সহকারী গোলাম মোস্তফা।

২। মরিচা – নং কোম্পানী। কমান্ডার নবী নেওয়াজ খান।

৩। দেওয়াপাড়া ১ নং কোম্পানী। কমান্ডার লোকমান হোসেন।

৪। রাঙ্গামাটি ১ নং (কো) কোম্পানী। কমান্ডার আবদুল হাকিম।

৫। আসিম ১১ নং কোম্পানী। কমান্ডার লালু, সহকারী সারোয়ার হোসেন।

৬। রাঙ্গামাটি ১২ নং কোম্পানী। কমান্ডার মুনির হোসেন।

৭। ভালুকা- শ্রীপুর ৬ নং কোম্পানী। কমান্ডার আফসারুদ্দিন আহম্মদ।

৮। হতেয়া ১২ নং কোম্পানী। কমান্ডার হাবিবুর রহমান, সহকারী ইউনুস আলী।

৯। পাথারঘাটা ৩ নং কোম্পানী। কমান্ডার মোকাদ্দেস আলী খান। সহকারী মতিউর রহমান।

সঙ্গে সঙ্গে আরেকটি মুক্তাঞ্চল গড়ে ওঠে টাঙ্গাইল ময়মনসিংহ সড়কের পশ্চিম দিক থেকে যমুনার পার পর্যন্ত বিরাট চরভর এলাকা, উত্তরে জগন্নাথগঞ্জ ঘাট থেকে দক্ষিণে নাগরপুর পর্যন্ত ধলেশ্বরী যমুনার চরঅঞ্চল মিলে গড়ে ওঠে এই মুক্ত এলাকা। এই অঞ্চলের আঞ্চলিক সদর হল ভূয়াপুর থানায়।

এই নতুন মুক্তাঞ্চলের জন্য নিন্মরূপে তিন কোম্পানী মুক্তিযোদ্ধা স্থায়ীভাবে মোতায়েন করা হয়।

১ নং (খ) কোম্পানী-নায়ক- আবদুল গফুর।

১ নং (গ) কোম্পানী- নায়ক- খুরশিদ আলম।

বাঘা কোম্পানী    নায়ক হাবিবুর রহমান। এই বাঘা কোম্পানীর উপর বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হয় নদী পথ পাহারা দেওয়ার। ছোট ছোট টাপুরে নৌকা সব সময়ে প্রস্তুত রাখা হত নদীতে টহল দেওয়া ও দুশমনের লঞ্চ ও গানবোট এ্যামবুশ করার জন্য।

এ সব কোম্পানী ছাড়া রেজাউল কোম্পানী, হুমায়ন কোম্পানী, বেনু কোম্পানী, আমানুল্লাহ কোম্পানী প্রভৃতি ছোট ছোট মুক্তিসেনা দল এই অঞ্চলে অভিযান চালাতো।

’৭১ সালের ৭ই জুলাইয়ের মধ্যে মুক্তাঞ্চলের চারিদিকে এই দুর্ভেদ্য ঘাঁটি স্থাপন শেষ হলো। বাঘা সিদ্দিকী প্রতিদিন এক ঘাঁটি থেকে অন্য ঘাঁটিতে ঘুরে ঘুরে বীর সৈনিকদের নিয়ম শৃঙ্খলা ও কর্তব্য নিষ্ঠা পরীক্ষা করে ফিরতে লাগলেন। তার সঙ্গে রাখলেন ৩০/৩৫ জন তরুণ মুক্তিযোদ্ধা। এঁরা রণকৌশল অতি নিপুণভাবে আয়ত্ত করে নিয়েছিলেন। যখনই কোন অঞ্চলে যুদ্ধ লেগেছে, এই দল উল্কার মতো ছুটে গিয়েছে এবং যুদ্ধরত স্থানীয় সেনাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছে। সেজন্য বাঘা সিদ্দিকী এই দলটিকে বলা হতো ফাইটিং প্লাটুন বা লড়ুয়ে দল।

গ্রেনেড পার্টি বা সুসাইড স্কোয়াডঃ মুক্তিযুদ্ধে একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করে গ্রেনেড বা হাতবোমা নিক্ষেপকারী দল। এরা হানাদার সেনাদের আতংকের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কাদেরিয়া বাহিনীতে এই রকম গ্রেনেড নিক্ষেপকারীদের শক্তিশালী দল গড়ে তোলা হয়। এদের বলা হত সুসাইড স্কোয়াড যাকে যুদ্ধের পরিভাষায় বলা হয় জানবাজ। জীবনকে বাজি রেখে এরা জীবনের সন্ধান দেয়। এই শাখায় যারা বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় রেখেছেন তাঁদের মধ্যে বাকু সালাহউদ্দিন (শহীদ), আবুল কালাম ও মিনুর নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

সদর দফতরঃ মুক্তিবাহিনীর হেড কোয়ার্টার বা সদর দফতরের অবস্থান ও কার্যপ্রণালী বিবৃত করা প্রয়োজন। শালগজারী আবৃত গভীর জঙ্গলের মধ্যে এই সদর দফতর স্থাপন করা হয়। এই দফতরটির পাঁচটি বিভাগ, যথা-

(১) অস্ত্রাগার

(২) বেসামরিক দফতর

(৩) বেতার যোগাযোগ ও টেলিফোন

(৪) হাসপাতাল ও

(৫) জেলখানা।

সদর দফতরের আবাসিক অধিনায়ক হলেন আনোয়ারুল আলম শহীদ। অস্ত্রাগার বেতার যোগাযোগ ও টেলিফোন দফতরটি কড়া প্রহরাধীনে রাখা হয়। এগুলির নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত কঠোর। স্বয়ং অধিনায়ক সিদ্দিকীর অনুমোদন ব্যতীত অন্য কারো এই দফতরে প্রবেশের অধিকার ছিল না। গভীর জঙ্গলের মধ্যে এক মাইল এলাকা জুড়ে এই সব দফতর স্থাপন করা হয়। প্রত্যেকটি বিভাগই টেলিফোন দ্বারা পরস্পর সংযুক্ত করা হয়।

সদর দফতরের অন্তর্ভুক্ত করা হয় ট্রেনিং ক্যাম্প বা শিক্ষা শিবির ও ট্রানজিট ক্যাম্প। ট্রেনিং ক্যাম্পটি খোলা হয় সখীপুর থেকে দুই মাইল উত্তরে আন্দি নামক স্থানে। এই স্থানটিও ছিল গভীর জঙ্গলের মধ্যে। তিন একর পরিমাণ জমির উপর টিনের ছাপড়া ঘর তুলে মুক্তিবাহিনীর ছেলেদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়। জঙ্গল গাছপালার ডালপাতা টিনের ছাদের উপর স্বাভাবিক আচ্ছাদন সৃষ্টি করেছিল। ফলে পৃথক ছদ্মাবরণের প্রয়োজন হয়নি। দুশমনের বিমান কখনো এই অঞ্চলের সন্ধান পায়নি। শিবির এলাকায় কুপ খনন করে পানীয় জলের ব্যবস্থা করা হয়। সর্বাধিক সিদ্দিকীর অনুপস্থিতিতে রিক্রুটিং অফিসার খোরশেদ আলম নতুন লোক ভর্তি করতেন। রেশন সরবরাহের দায়িত্ব তাঁর উপর দেওয়া হয়। সদর দফতরের পাঁচ বর্গমাইল এলাকা বাঘা সিদ্দিকীর নির্দেশে সংরক্ষিত এলাকা বলে গণ্য হতো।

বেসামরিক দফতরঃ এই দফতরের অধিনায়ক আনোয়ারুল আলম শহীদ তাঁর দফতর স্থাপন করেন মহানন্দপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবন। সংরক্ষিত এলাকার বাইরে এই দফতর স্থাপন করার কারণ হলো, জনসাধারণের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা। এটাই এদের অন্যতম কর্তব্য। সংরক্ষিত এলাকায় থেকে এটা সম্ভব নয়। শহীদ সাহেব তার দফতরের কাজ ভাগ করে কয়েকজনের উপর ন্যস্ত করেন। অর্থ ও হিসাব বিভাগের ভার পেলেন আনোয়ার হোসেন। ইনি বেঙ্গল রেজিমেন্টের নন কমিশনড অফিসার ছিলেন। হিসাব সংরক্ষণের ব্যাপারে প্রচুর অভিজ্ঞতার অধিকারী এই হোসেন সাহেব অতি দক্ষতার সঙ্গে অর্থ সংরক্ষণ ও ব্যয়ের পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসেব রক্ষার দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের জন্য সাহায্য ও দালালদের জরিমানার মাধ্যমে যে অর্থ পাওয়া যেত তার সবটাই প্রথমে সদর দফতরে পাঠানো হতো। বাঘা সিদ্দিকীর অনুমোদনক্রমে এই অর্থই পরে বিভিন্ন কোম্পানীর জন্য বরাদ্দ করা হতো। শাসন বিভাগের অন্যান্য কাজের জন্যও এই অর্থ বরাদ্দ দেয়া হতো। দখল আমলের নয় মাসে যে অর্থ আয় হয়েছে এবং বিভিন্ন কাজে ব্যয় হয়েছে তার প্রতিটি কপর্দকের হিসেব নিখুঁতভাবে রক্ষা করায় মুজিবনগরে তাঁর কাজ প্রশংসিত হয়েছে। আনোয়ারুল আলম শহীদ মুজিবনগরের বাংলাদেশ সরকারের নিকট যখন আয়-ব্যয়ের বিস্তারিত হিসাব দাখিল করেন তখন তদানীন্তন অর্থমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলী বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে বলেছিলেন, তোমাদের এই কাজে আমি মুগ্ধ হয়েছি। একদিকে রক্তক্ষয়ী যদ্ধ চালিয়ে যাওয়া, অপরদিকে পাই পয়সার হিসেব রাখা অসম্ভব ব্যাপার। তোমরা এই অসম্ভবকে সম্ভব করেছো।

স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীঃ সদর দফতরে এই বাহিনীর বিভাগীয় অধিকর্তা নিযুক্ত হন। প্রাক্তন ছাত্রনেতা সোহরাব আলী খান আরজু। একে সহায়তা করেন দাউদ খান, আলী হোসেন, আবদুল লতিফ ও অধ্যাপক আতোয়ার কাজী।

খাদ্য দফতরঃ খাদ্য দফতরের দায়িত্ব দেওয়া হয় পাহাড়িয়া অঞ্চলের ছেলে করটিয়া সাদত কলেজের ছাত্র ওসমান গনির উপর। সদর দফতরের সকলের খাদ্য সরবরাহ করতেন ইনি। মুক্তিবাহিনীর খাদ্যসামগ্রী পূর্বাঞ্চলীয় মুক্ত এলাকা থেকে সংগ্রহ করা হতো এবং তা গনির ভান্ডারে জমা থাকত। গনির বড় ভাই আলী এই খাদ্য সংগ্রহের ব্যাপারে খুবই সাহায্য করেছেন।

ইনটেলিজেন্স বিভাগঃ এই বিভাগ এক কথায় গোয়েন্দা বিভাগ বলা যায়। নুরুন্নবী ও হামিদুল হকের উপর এই অতি প্রয়োজনীয় ও গুরুতবপূর্ণ বিভাগের কাজ দেওয়া হয়। এই বিভাগের কাজ দুই ভাগে ভাগ করা হয়। যথা-

(১) দুশমনের সম্পর্কে তথ্য, পাকবাহিনীর গতিবিধি ও তাদের শক্তি, অবস্থান এবং বাঙালি রাজাকার প্রভৃতি স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির সংবাদ সংগ্রহ।

(২) মুক্তিবাহিনীর কেউ কোন অন্যায় কাজ করে কিনা। দলীয় ঐক্য ও শৃঙ্খলা নষ্ট হয় এমন কোন কাজ করে কিনা, অধিনায়কের নির্দেশ অমান্য ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে কিনা, সে সবের বিস্তারিত ও নির্ভরযোগ্য সংবাদ সংগ্রহ করা।

নুরুন্নবী ও হামিদুল হক কর্তৃপক্ষের অনুমোদনক্রমে এই বিভাগে বাছাই করে লোক ভর্তি করেন। অচিরে এটি একটি শক্তিশালী বিভাগরুপে গড়ে ওঠে। অত্যন্ত গোপনীয়তা রক্ষা করে প্রত্যেক কোম্পানীতে একজন করে গোয়েন্দা নিয়োগ করা হয়। যেমন ৪ নং কোম্পানীতে গোয়েন্দা অফিসার হিসাবে ঢুকে পড়লেন জনাব নজরুল ইসলাম। তিনি পূর্বে একজন ব্যবসায়ী ছিলেন।

শত্রু কবলিত এলাকায় একটু বেশী বয়সের লোকদের গোয়েন্দা হিসেবে নিয়োগ করা হয়। কারণ বেশী বয়সের লোকদের হানাদার বাহিনী একটু কম সন্দেহ করতো। প্রায় তিন গ্রামে একজন করে গোয়েন্দা মোতায়েন করা হয় এবং তারা নিয়মিতভাবে দুশমনের সব সংবাদ যথাস্থানে পৌঁছে দিতো। শুনলে অনেকে আশ্চর্য হবেন যে, শান্তি কমিটির কয়েকজন সদস্য মুক্তিবাহিনীর গোয়েন্দার কর্তব্য সম্পাদন করেছেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায় যে, ভূয়াপুর শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান আবদুল বারী তালুকদার মুক্তিবাহিনীর গোয়েন্দার কাজ করেছেন। গোয়েন্দা বিভাগের আর একজন নামকরা অফিসার ছিলেন ছাত্রনেতা সোহরাওয়ার্দী। তিনি পাকবাহিনীর হাতে বন্দী হন। মুক্তিবাহিনী থেকে তার উপর আত্মসমর্পনের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু পরে শান্তি কমিটি ও রাজাকারদের সঙ্গে মিশে গিয়ে তাদের সব সংবাদ মুক্তিবাহিনীর কাছে পাচার করতে থাকেন।

বেতার ও টেলিফোন বিভাগঃ এই বিভাগের দায়িত্বে নিযুক্ত হন আবদুল আজিজ বাঙ্গাল। ভূয়াপুর কলেজের ছাত্র ও একজন ছাত্রনেতা হিসেবে তিনি সুপরিচিত। বেসামরিক দফতর থেকে এক মাইল দূরে গভীর জঙ্গলের মধ্যে ইংরেজ নামক এক কাঠুরিয়ার বাড়ীতে আজিজের টেলিফোন ও বেতার দফতর খোলা হয়। এখান থেকেই সদর দফতরের সকল বিভাগে টেলিফোন যোগাযোগ সাধিত হয়। ফোনের রিসিভার, তার, বেতার ট্রান্সমিটার ও রিসিভার সেটগুলো বিভিন্ন থানা লুট করে সংগ্রহ করা হয়। এই দফতরের সঙ্গে আরো দুটি অঞ্চলের বেতার যোগাযোগ স্থাপিত হয়- একটি পশ্চিমাঞ্চলে ভূয়াপুরের গ্রাম এলাকায় এবং অপরটি ধলাপাড়ায়। এই দফতরে আজিজের সহকারী হিসাবে কাজ করেন আব্দুল্লাহ, শামসু রশীদ, ইমাম, আবদুল ও হাকিম। কাঠুরিয়া ইংরেজ এই দফতরের বাবুর্চির দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

অনেক দুঃসাহসিক কাণ্ডকারখানার নায়ক ছিলেন এই দফতরের কর্মীরা। তারা পাক হানাদারদের বেতার যোগাযোগ কেন্দ্রের সঙ্গে অদ্ভূত রকমে যোগাযোগ স্থাপন করে। টাঙ্গাইল অয়ারলেস কেন্দ্রের কয়েকজন অপারেটরকে এরা দলে ভিড়িয়ে ফেলে। এই অপারেটররা সুযোগ পেলেই দুশমনদের সব গোপন খবর মুক্তিবাহিনীর বেতার কেন্দ্রে জানিয়ে দিতো নিজেদের ট্রান্সমিটারের সাহায্যে। বলাবহুল্য, এই সময় খান সেনাদের বেতার যোগাযোগ কেন্দ্রে সর্বদা কড়া প্রহরাধীনে থাকতো। তার মধ্যেই কয়েকজন দেশপ্রেমিক অফিসার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সংবাদ জানিয়ে দিতেন। এ ব্যাপারে টাঙ্গাইল বেতার কেন্দ্রের আবদুর রাজ্জাক অভূতপূর্ব দেশপ্রেমের পরিচয় দিয়েছেন। তিনি প্রায়ই গভীর রাত্রে মুক্তিবাহিনীর বেতার কেন্দ্রের আজিজ বাঙ্গালের সঙ্গে কথা বলতেন। এমনিভাবে মানিকগঞ্জের অপারেটর জিল্লুর রহমান, জামালপুরের মুজিবর রহমান, গোড়াই ক্যাডেট আবু বকর সিদ্দিক এবং সিরাজগঞ্জের একজন অপারেটর নিয়মিতভাবে তাদের ট্রান্সমিটার যন্ত্রের সাহায্যে মুক্তিবাহিনীকে সকল সংবাদ পাচার করতেন।

সিগন্যাল বিভাগঃ বেতার যোগাযোগ ও টেলিফোন ছাড়াও বার্তা বিনিময়ের জন্য সদর দফতরে সিগন্যাল বিভাগ খোলা হয়। প্রথমদিকে মুসা ও খালেকের উপর এই বিভাগের ভার দেওয়া হয়। কিছুদিন পরে সদর দফতরে শহীদ সাহেব স্বয়ং এই বিভাগের ভার গ্রহণ করেন। মুসা ও খালেককে অন্য বিভাগে বদলি করা হয়। মুক্তিবাহিনীর মধ্যে থেকে বাছাই করা লোক নিয়ে এই বিভাগে কর্মঠ লোক নিয়োগ করা হয়। এদের কাজ ছিল যে কোন উপায়ে হোক সংবাদ যথাস্থানে পৌঁছে দেয়া এবং সংগ্রহ করা। এ জন্য এরা পায়ে হেঁটে, সাইকেলে, ঘোড়ায় চড়ে, স্পিডবোটে বা নৌকায় এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াত করতো। শত্রু কবলিত এলাকার মধ্য দিয়ে চলাফেরা করতে হলে এরা সাধারণ পায়ে হেঁটে, সাইকেল অথবা নৌকার সাহায্য নিত।

সদর দফতর ছাড়াও প্রতি কোম্পানীতে দুইজন করে সংকেতদানকারী বা সিগন্যালম্যান থাকতো। সদর দফতরের সিগন্যালম্যান আবু হেনা মোস্তফা কামাল (করটিয়া কলেজের ছাত্র) ও আবদুল গণি (কচুয়া হাই স্কুলের ছাত্র) ছিল দক্ষ ঘোড়সওয়ার। ঘোড়ায় চড়ে এরা সংবাদ আদান-প্রদান করতো। এদের কাজ ছিল পূর্বাঞ্চলীয় মুক্ত এলাকার চারিদিকে রক্ষা ঘাঁটির সাথে প্রাত্যহিক যোগাযোগ রক্ষা করা। অপর সিগন্যালম্যান কাসেম সপ্তাহে দুইবার ভূয়াপুর ও সদর দফতরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতো।

জেলখানাঃ মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধ সংগ্রাম তীব্রতর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বাসঘাতক রাজাকার, দালাল ও ধৃত খানসেনাদের রাখার জন্য জেলখানায় প্রয়োজন হয়। এ জন্য বেসামরিক সদর দফতর থেকে এক মাইল দূরে একটি জেলখানা খোলা হয়। এ জন্য একটি বেশ বড় ধরনের বাড়ি নেওয়া হয়। এক প্লাটুন মুক্তিসেনা নিয়োগ করা হল এই জেলখানা পাহারা দেওয়ার জন্য। এই প্লাটুনের কমান্ডার ছিল আনসার। আর জেলার দায়িত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ করা হয় মহু নামক এক দুর্ধর্ষ লোককে।

হাসপাতালঃ সামরিক প্রয়োজনে ফিল্ড হাসপাতাল প্রতিষ্টা অপরিহার্য কর্তব্য। অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ প্রভৃতি সংগ্রহের প্রয়োজনীয়তাকে যেমন অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে, হাসপাতাল প্রতিষ্ঠাকেও তেমনি অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। কাজের পরিকল্পনা দিলে তা কার্যকরী করতে মানুষের অভাব হয় না। মুক্তিযুদ্ধে এটা প্রমানিত হয়েছে। বাঘা সিদ্দিকী হাসপাতাল খোলার নির্দেশ দিলেন আর তা কার্যকরী করতে এগিয়ে এলেন কাউলজানির একজন মেডিক্যাল ছাত্র শাহাজাদা চৌধুরী। ইনি ময়মনসিংহ চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ের শেষ বর্ষ এমবিবিএস-এর ছাত্র। সিদ্দিকী এই তরুণের উপর হাসপাতাল খোলার গুরুদায়িত্ব দিলেন। সদর দফতরের শিক্ষা শিবিরের কাছে আন্দি নামক স্থানে বড় বড় তিনটি টিনের ছাপড়া ঘর তৈরী হল। রোগীদের জন্য বিছানাপত্র ও খাটিয়া এলো। ডাঃ শাহাজাদার সঙ্গে যোগ দিলেন সখিপুর সরকারী হাসপাতালের ডাক্তার এবং কম্পাউন্ডার রতন। সব রকমের সক্রিয় সাহায্য দিলেন স্কুল শিক্ষক আমজাদ হোসেন। গোয়েন্দা বিভাগের সহায়তায় ঢাকা থেকে হাসপাতালের জন্য ওষুধ ও অস্ত্রোপাচারের যন্ত্রপাতি আমদানি করা হলো। রোগীদের আরামের জন্য হাসপাতাল বেডের উপর কেরোসিনচালিত দুইটি পাখা টাঙ্গিয়ে দেওয়া হলো। এমনি করে ২০ বিছানার একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ হাসপাতাল গড়ে উঠলো। আর রোগীদের সেবার সার্বিক দায়িত্ব নিলেন হামিদ সাহেব। হাসপাতাল ছাড়াও প্রত্যেকটি কোম্পানীতে একজন করে ডাক্তার রাখার ব্যবস্থা করা হয়।

সদর দফতরের নিরাপত্তা রক্ষাঃ সদর দফতরের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হলো। নৌবাহিনীর প্রাক্তন সৈনিক খলিলুর রহমানের অধিনায়কত্বে ১৩ নং কোম্পানী ক শাখাকে এই দফতরের তদারকির ভার দেওয়া হয়। সদর দফতরের কাছেই ছিল অধিনায়ক খলিলের বাড়ী। সর্বাধিনায়ক সিদ্দিকীর বিশ্বস্ত সঙ্গী হিসেবে তার কর্তব্যপরায়নতা ছিল পরীক্ষিত। তার কোম্পানীর একটি প্লাটুনকে সদর দফতরের বেসামরিক বিভাগের রক্ষনায় নিয়োগ করা হয়। এই প্লাটুনের কমান্ডে দেওয়া হয় কালিহাতী ছাত্রলীগের  সভাপতি আবদুর রাজ্জাককে। গভীর জঙ্গলের মধ্যে যে সব বেপরোয়া তরুণ মুক্তিযোদ্ধা আরামকে হারাম করে ও রাতের ঘুম ত্যাগ করে অতন্দ্র প্রহরীর মতো সদর দফতরের নিরাপত্তা রক্ষা করেছিল তাদের মধ্যে ঢাকা কলেজের সানু, কালিহাতির মান্নান, শহীদ সালু, পাহাড়িয়া উপজাতীয় ছেলে লক্ষন চন্দ্র বর্মণ ও কচুয়ার আবদুল্লাহর নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

———————————————–

<৯, ১৬.৪, ৪৬৪-৪৭৪>

আফসার ব্যাটালিয়ন

ময়মনসিংহ জেলার ভালুকা থানার নিভৃত পল্লী মল্লিকবাড়ী গ্রামে একটি মাত্র রাইফেল নিয়ে মেজর আফসার উদ্দিন আহমেদ সাহেব পার্টি গঠন করেন। পাকবাহিনী ও দুষ্কৃতিকারীগণের সাথে লড়াই করে মেজর আফছার সাহেব শত্রুদেরকে সমুচিত শিক্ষা দিয়েছেন এবং তিনি তার পার্টি নিয়ে শত্রুপক্ষের নিকট থেকে আড়াই হাজারেরও অধিক রাইফেল, ব্রেটাগান, রকেট লান্সার, স্টেনগান, এমএমজি ইত্যাদি উদ্ধার করেন। তার দ্বারা পরিচালিত বাহিনীতে সর্বমোট প্রায় সাড়ে চার হাজার মুক্তিযোদ্ধা ছিল।

মেজর আফছার সাহেবের পৃষ্ঠপোষকতায় আফছার ব্যাটালিয়নের তরফ থেকে সাপ্তাহিক জাগ্রত বাংলা পত্রিকা যাবতীয় সংবাদ পরিবেশন করে মুক্তিকামী মানব মনে প্রেরণা জুগিয়েছে।

আফছার ব্যাটালিয়নের তরফ থেকে রোগাক্রান্ত মুক্তিযোদ্ধা এবং বিপর্যস্ত মানুষের চিকিৎসার জন্য ১৩ জন ডাক্তার ও ৩ জন নার্স সমন্বয়ে একটি ভ্রাম্যমাণ হাসপাতাল স্থাপিত হয়েছিল মেজর আফছার সাহেবের প্রচেষ্টায়। আফছার ব্যাটালিয়ন কর্তৃক মুক্ত এলাকার সুষ্ঠু শাসন ব্যবস্থা কায়েম করা হয়েছিল। এই শাসন ব্যবস্থার মাধ্যমে আফছার ব্যাটালিয়ন তাদের দ্বারা মুক্ত এলাকায় শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রেখেছে।

মেজর আফছার সাহেব কর্তৃক পরিচালিত মুক্তিবাহিনীকে সেনাবাহিনীর নিয়মানুযায়ী মোট ২৫টি কোম্পানী অর্থাৎ ৫টি ব্যাটালিয়নে ভাগ করা হয়। প্রত্যেক কোম্পানীতে ৩টি প্লাটুন, প্রত্যেক প্লাটুনে ৩টি সেকশন এবং প্রত্যেক সেকশনে ১৫ জন করে মুক্তিসেনা ছিল। প্রকাশ থাকে যে হাসপাতাল, পত্রিকা অফিস এবং বার্তা বিভাগের মুক্তিযোদ্ধারা কোম্পানীর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না।

ময়মনসিংহ সদর (দক্ষিণ) ও ঢাকা সদর (উত্তর) সেক্টরের সমস্ত মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে আফছার ব্যাটালিয়ন গঠিত হয়েছিল। আফছার ব্যাটালিয়নের কৃতিত্বের কথা এ পুস্তকে তুলে ধরা হয়েছে। আফছার ব্যাটালিয়নের প্রত্যেক মুক্তিযোদ্ধাই এই কৃতিত্বের অংশীদার।

স্বাধীনতা সংগ্রামের রক্ষীবাহিনী এক বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। রক্ষীবাহিনীর অক্লান্ত পরিশ্রম, অকৃত্রিম সেবাযত্ন এবং অসীম ভালোবাসার উপর ভিত্তি করেই আফছার ব্যাটালিয়ন সফলতার চরম শিখরে আরোহণ করতে সক্ষম হয়েছে। বিশেষ করে বাটাজুর, কচিন, ডাকাতিয়া, পাঁচগাঁও, কাওলামারী, রাজৈ, ফুলবাড়িয়া, আমিরাবাড়ী, নারাঙ্গী, বড়ইদ, দক্ষিণ ফুলবাড়িয়া ও কালিয়াকৈর এলাকার রক্ষীবাহিনী স্বাধীনতা সংগ্রামে যে ভূমিকা পালন করেছে তা মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

…পাকবাহিনী কর্তৃক হামলার প্রথমাবস্থায় মুক্তিকামী বাঙালি নওজোয়ানগণ (প্রাক্তন ই পি আর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট, পুলিশ বাহিনী, আনসার, মুজাহিদ, ও অন্যান্যরা)। বীরবিক্রমে পাল্টা আক্রমণ চালান, কিন্তু পাকবাহিনীর মত সুসংগঠিত বর্বর বাহিনীর সাথে টিকে ওঠা সম্ভব না হওয়ার পূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহনের জন্য বন্ধু রাষ্ট্রে আশ্রয় নেন।

মাতৃভূমিকে মুক্ত করার জন্য জীবন-মরণ পণ করে অগণিত বাঙালি নওজোয়ান ওপার বাংলার সামরিক শিক্ষা গ্রহণ শুরু করে। মেজর আফছারউদ্দিন আহমেদ সাহেব ওপার বাংলায় পাড়ি না জমিয়ে দেশের অভ্যন্তরে মুক্তিবাহিনী গঠন করেন, বর্বর বাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করে এক বিরাট এলাকা মুক্ত করেন। একই সময়ে টাঙ্গাইল জেলার কাদের সিদ্দিকী সাহেবও দেশের অভ্যন্তরে পার্টি গঠন করেন এবং এক বিরাট এলাকা মুক্ত করার প্রয়াস পান।

…ওপার বাংলা থেকে মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে আসার বেশ কিছুদিন আগেই পাকবাহিনীর নিকট থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ ছিনিয়ে এনে মেজর আফছার উদ্দিন তাঁর পরিচালিত মুক্তিদলকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তোলেন। তিনি ১৯৭১ সনের জুন মাসে ভালুকা থানার ভাওয়ালিয়া বাজু এলাকায় পাকবাহিনীর সাথে একটানা ৪৮ ঘণ্টা সম্মুখযুদ্ধ করে এক রেকর্ড সৃষ্টি করেন। স্বাধীনতা সংগ্রামে তিনি অগণিত সম্মুখ ও গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন। তাঁর অসীম কর্মদক্ষতার গুণে তিনি একটি রাইফেল থেকে শুরু করে প্রায় সাড়ে চার হাজারেরও অধিক মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে মুক্তিবাহিনী গঠন করেন এবং দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিবাহিনী ভেঙ্গে দেওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করেন।

তিনি শপথ করেছিলেন- ‘দেশকে শত্রুমুক্ত না করা পর্যন্ত অস্ত্র ত্যাগ করবো না আমার যদি মৃত্যু হয় তাহলে যেন মুক্ত এলাকাতেই হয়।’ বর্বর বাহিনী শত চেষ্টা করেও আফছার ব্যাটালিয়ন কর্তৃক মুক্ত এলাকায় প্রবেশ করতে পারে নি। আফছার সাহেব শপথ করেছিলেন- ‘জীবিত থাকতে মুক্ত এলাকায় শত্রুদেরকে প্রবেশ করতে দেব না।’ তাঁর শপথ অক্ষরে অক্ষরে রক্ষা করেছেন। তিনি তাঁর নিজের প্রতিষ্ঠিত পত্রিকা সাপ্তাহিক ‘জাগ্রত বাংলা’য় তাঁর বাহিনী কর্তৃক মুক্ত এলাকার মানচিত্র অংকন করে সমস্ত বাংলাদেশ, ওপার বাংলা ও পাক বাহিনীর অনেক ঘাঁটিতেও বিতরণ করেছেন। তিনি ১৯৭১ সনের আগস্ট মাসের মাঝামাঝিতে আগরতলা যেয়ে লেঃ কর্নেল নুরুজ্জামান সাহেবের সাথে সাক্ষাৎ করেন। লেঃ কর্নেল নুরুজ্জামান সাহেব বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে কিছু অস্ত্র ও অসীম উৎসাহ উদ্দিপনা দিয়ে বিশেষভাবে উপকৃত করেন।

ময়মনসিংহ সদর (দক্ষিণ) সেক্টরের মুক্তিবাহিনী অধিনায়ক মেজর আফছার উদ্দিন আহমেদের গঠিত ব্যাটালিয়নের স্বাধীনতা সংগ্রামের কার্যাবলীঃ-

২৩-৪-১৯৭১> ময়মনসিংহ জিলার ভালুকা থানা আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি মল্লিকবাড়ী ইউনিয়ন কাউন্সিল সদস্য জনাব আফছার আহমেদ মাতৃভূমিকে পশ্চিমাদের কবল হতে শোষণমুক্ত করার উদ্দেশ্যে ভালুকা থানার রাজৈর গ্রামের বিশিষ্ট আওয়ামীলীগ কর্মী মোঃ আব্দুল হামিদ সাহেবের নিকট থেকে একটি রাইফেল ও ৩০ রাউণ্ড গুলি নিয়ে মুক্তিবাহিনী গঠন করার সিদ্ধান্ত করেন।

২৪-৪-১৯৭১> প্রাক্তন ই পি আর বাহিনীর ফেলে যাওয়া ৭টি রাইফেল এবং উপরোক্ত আব্দুল হামিদ সাহেবের নিকট থেকে সংগ্রহ করা ১টি রাইফেল মোট ৮টি রাইফেল নিয়ে জনাব আফছারউদ্দিন আহমেদ সাহেবের নেতৃত্বে মল্লিকবাড়ী এলাকায়

১। মোঃ আমজাদ হোসেন

২। মোঃ আবদুল খালেক

৩। শ্রীনারায়ণ চন্দ্র পাল

৪। মোঃ আবদুল বারেক মিয়া

৫। মোঃ আবদুল মান্নান

৬। শ্রী-অনীলচন্দ্র সাংমা ও

৭। ছমির উদ্দিন মিয়ার সহযোগিতায় সর্বপ্রথম মুক্তিবাহিনী গঠন করা হয়। মোঃ আবদুল মান্নান ভাওয়ালিয়া বাজু যুদ্ধে এবং শ্রী অনীলচন্দ্র সাংমা ডুমনিঘাট যুদ্ধে নিহত হন।

মুক্তিবাহিনী গঠনে সক্রিয়ভাবে যারা সাহায্য করেছেন তাঁরা হলেন মোঃ জবান আলী ফকির, ডাঃ হাফিজউদ্দিন আহমেদ, মোঃ আবদুল রাজ্জাক, মোঃ আবদুল হামিদ, মোঃ মোসলেম মিয়া, বাবু প্রেম অধিকারী এবং মোঃ হাফিজুর রহমান। উক্ত পার্টি ভালুকা, গফরগাঁও, ফুলবাড়ীয়া, ত্রিশাল, কোতোয়ালী, শ্রীপুর, কালিয়াকৈর বাশাইল, কালিহাতি, মির্জাপুর এবং মুক্তাগাছা ইত্যাদি এলাকায় কাজ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। পরিচালিত জনাব আফছারউদ্দিন আহমেদ নির্দেশ মোতাবেক কাজ করবার জন্য শপথগ্রহণ করেন।

২৬-৪-১৯৭১> বিভিন্ন স্থানে হানা দিয়ে ঢাকাতে ও দুষ্কৃতিকারীদের নিকট থেকে অস্ত্র উদ্ধার কার্য শুরু করা হয়। অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই মোট ২৫টি রাইফেল বিভিন্ন উপায়ে সংগ্রহ করা হয়।

২-৫-১৯৭১> অধিনায়ক আফছারউদ্দিন আহমেদ সাহেবের নেতৃত্বে ভালুকা থানা হেডকোয়ার্টার আক্রমণ করা হয় এবং সেখান থেকে ১০টি রাইফেল এবং ১৫৫০ রাউণ্ড গুলি ও ৩০টি বেয়নেট উদ্ধার করা হয়।

১২-৫-১৯৭১> টাঙ্গাইল জেলার বল্লা এলাকায় পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে কাদের সিদ্দিকী সাহেবের সঙ্গে অধিনায়ক আফছার সাহেব একটি কোম্পানী নিয়ে বল্লা আক্রমণ করেন। উক্ত যুদ্ধে ৫১ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং বহুসংখ্যক আহত হয়।

২০-৫-১৯৭১> ভালুকা থানার বাইন্দা গ্রামের কুখ্যাত ডাকাত, লুণ্ঠনকারী ও পাক বাহিনীর দালাল ইছহাক খানের হত্যা করা হয়।

২১-৫-১৯৭১> এই দিনে ভালুকা থানা আক্রমণ করে ২টি ব্রেটাগান, ১০টি রাইফেল এবং এক বাক্সগুলি উদ্ধার করা হয়।

২২-৫-১৯৭১> অধিনায়ক আফছার সাহেবের নেতৃত্বে গফরগাঁও থানার কাওরাইদ রেল স্টেশনের উত্তর পার্শ্বস্থিত গ্রাম গয়েশপুর থেকে মুক্তিসেনা নুরুল ইসলামের সহায়তায় ২টি চাইনীজ রাইফেল এবং ৬ বাক্স গুলি উদ্ধার করা হয়।

০২-০৬-১৯৭১> বিভিন্ন স্থানে হানা দিয়ে ডাকাত ও দুষ্কৃতিকারীদের নিকট থেকে মোট ১১টি রাইফেল উদ্ধার করা হয়।

২৩-৬-১৯৭১> ভালুকা থানার পোনাশাইল এলাকার একদল মুক্তিসেনা টহল দেওয়াকালীন সময়ে একখানা সন্দেহজনক নৌকা আটক করা হয়। উক্ত নৌকা তল্লাশী করে ৫টি রাইফেল ও ৪ বাক্স গুলিসহ ৫ জন পুলিশ ধরা হয়। উক্ত পুলিশের নিকট থেকে অনেক গোপন তথ্য জানা সম্ভব হয়। তারা মুক্তিবাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করে।

২৫-০৬-১৯৭১> পনের শতাধিক পাক সেনার একটি দল তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে ভালুকা ঘাঁটি করার উদ্দেশ্যে গফরগাঁও থেকে ভালুকা রওয়ানা হয়। পাক সেনাদের এই সুসজ্জিত বাহিনী ভালুকা যাওয়ার সময় অধিনায়ক আফছার সাহেব ৪২ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে সকাল ৮ ঘটিকায় ভাওয়ালিয়া বাজু বাজারের ঘাটে তাদের রাস্তা রোধ করেন এবং যুদ্ধ শুরু হয়। পাকসেনারা অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। মুক্তিসেনারা মাত্র ২ টি এল এম জি (হালকা মেশিনগান) ও ৩৭ টি রাইফেল নিয়ে যুদ্ধ শুরু করেন। অবিরাম ৩৫ ঘণ্টা যুদ্ধ চলার পর পাকবাহিনী অগ্রসর হতে না পারায় মুক্তিসেনাদের পিছন দিকে পাক সেনাদের সাহায্যের জন্য হেলিকপ্টার দ্বারা কয়েকবারে ৩ শতাধিক পাকসেনা অবতরণ করানো হয়। এই যুদ্ধ মোট ৪৮ ঘণ্টা স্থায়ী হয়। এতে ১৯৫ জন পাকসেনা নিহত ও বহুসংখ্যক আহত হয়। এই যুদ্ধে মুক্তিসেনা আঃ মান্নান শহীদ হন এবং ৩জন মুক্তিসেনা আহত হন।

২৮-৬-১৯৭১> অধিনায়ক আফছারউদ্দিন সাহেব নিজেই রাত্রি ৩ ঘটিকায় ভালুকা থানায় গ্রেনেড আক্রমণ চালিয়ে ১৭ জন পাকসেনাকে নিহত ও কয়েকজনকে আহত করেন।

১৭-৭-১৯৭১> মেজর আফছারউদ্দিন আহমেদ সাহেবের নেতৃত্বে গফরগাঁও থানার দেউলপাড়া এলাকায় পাক সেনাদের একটি টহলদারী ট্রেনের উপর মুক্তিসেনারা আক্রমণ চালায়। ফলে ৭ জন পাক সেনা নিহত ও কয়েকজন আহত হয়।

১৯-৭-১৯৭১ ভালুকা থানার হরিরবাড়ী এলাকায় সিস্টোর বাজারে আফছার সাহেবের নেতৃত্বে রাত্রি ৩ টা ২০ মিনিটে পাকসেনাদের ঘাঁটি আক্রমণ করা হয়। ফলে ২৩ জন পাকসেনা নিহত ও ৯ জন আহত হয়। রাত্রের আক্রমনে তারা ভীত হয়ে পরের দিন ত্যাগ করে পলায়ন করে।

২৫-৭-৭১> অধিনায়ক আফছার সাহেব নিজে একদল মুক্তিসেনা নিয়ে অতর্কিত মল্লিকবাড়ী ঘাঁটিতে আক্রমণ চালিয়ে রাত্রি ৪ টা ২০ মিনিটে পাকসেনাদের ১৬ জনকে নিহত ও কয়েকজনকে আহত করেন।

২৬-৭-১৯৭১> মল্লিকবাড়ী পাকবাহিনীর ঘাঁটিতে মুক্তিযোদ্ধারা রাত্রি ২ ঘটিকায় গেরিলা পদ্ধতিতে গ্রেনেড চার্জ করে পাকসেনাদের ৪ জনকে নিহত ও ৩ জনকে গুরুতরভাবে আহত করেন। একই দিন অন্য একদল মুক্তিযোদ্ধা ঢাকা জেলার শ্রীপুর থানার মাওয়া গ্রামের কুখ্যাত ডাকাত ও দালাল হাবিবুর রহমান (এম ইউ সি) এবং হামিদ ফকিরকে হত্যা করেন।

২৯-৭-১৯৭১> আফছার ব্যাটালিয়নের কোম্পানী কমান্ডার চাঁন মিয়ার দলের হাতে পাকবাহিনীর ৩ জন গুপ্তচর পারুলদীয়া বাজারে ধরা পড়ে ও তাদেরকে হত্যা করা হয়। অধিনায়ক আফছার সাহেব ১লা আগস্ট তারিখে অন্য একদল মুক্তিসেনা নিয়ে ভালুকা থানার ভয়াবহ খেয়াঘাটে পাকবাহিনীর উপর আক্রমণ চালিয়ে ৯ জন পাকসেনাকে হত্যা করেন।

০৩-৮-১৯৭১> প্লাটুন কমান্ডার হাফিজুর রহমান, মোঃ আইয়ুব আলী এবং সেকশন কমান্ডার আবদুল করিমের নেতৃত্বে একদল মুক্তিসেনা ত্রিশাল থানার কানিহারী গ্রামে একদল রাজাকারের উপর আক্রমণ চালিয়ে একটি রিভলবার ও কয়েক রাউণ্ড গুলি উদ্ধার করেন। ঐদিন রাত্রে প্লাটুন কমান্ডার হাফিজুর রহমান একজন মুক্তিসেনা সাথে নিয়ে গেরিলা পদ্ধতিতে কালীরবাজার স্কুলের ছাত্র ফোরকানউদ্দিন আহমেদ, কাঁঠাল গ্রামের মোঃ আবু তাহের, মহসীন, শামছুল হক, জালাল, টুকু ও সুন্দর আলীর সহায়তায় কালীরবাজার হাই স্কুল ল্যাবরেটরী থেকে কিছু হাত বোমা, এসিড, বারুদ ইত্যাদি উদ্ধার করেন। একই দিন প্লাটুন কমান্ডার আইয়ুব আলী সাহেব অন্য কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা সাথে নিয়ে কাঁঠাল গ্রামে হানা দিয়ে ২ জন দুষ্কৃতিকারীকে গ্রেফতার করেন।

০৪-৮-১৯৭১> পাকবাহিনী ভালুকা থানার ডাকাতিয়া বাজার এবং গ্রামের বাড়িঘর লুটপাট করে ফিরবার পথে অধিনায়ক আফছার সাহেবের নেতৃত্বে ২ দল মুক্তিসেনা পাকসেনাদের পিছন ও বাম দিক থেকে আক্রমণ চালায়। ফলে পাকবাহিনী ৩০ জন সেনা নিহত ও আহত হয়। লুট করা সমস্ত মালপত্র মুক্তিসেনাদের হস্তগত হয়। একটি ব্যারোমিটারও পাওয়া যায়। মেজর আফছার সাহেবের নির্দেশে গফরগাঁও থানার কুখ্যাত ডাকাত ও রাজাকার কমান্ডার গাওয়াকে মুক্তিবাহিনীর কোম্পানী কমান্ডার চাঁন মিয়ার নেতৃত্বে তার নিজ বাড়ির গ্রেফতার ও পরে হত্যা করা হয়।

০৯-৮-১৯৭১> অধিনায়ক আফছার সাহেব নিজেই কোম্পানী কমান্ডার মোমতাজউদ্দিন ও অল্প কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে বিকাল ৫ ঘটিকায় মল্লিকবাড়ী ঘাঁটি আক্রমণ করেন এবং ১৪ জন পাকসেনা, ৪ জন রাজাকারকে নিহত ও কয়েকজনকে আহত করেন।

১০-৮-১৯৭১> সকালে পাকবাহিনীর একটি দল মল্লিকবাড়ী বাজার থেকে ভালুকা যাওয়ার জন্যে খেয়াঘাটে এসে নৌকায় চড়লে অধিনায়ক আফছার সাহেবের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা পাকসেনাদলকে আক্রমণ করেন। ফলে ১৪ জন পাকসেনা এবং ২ জন নৌকার মাঝি নিহত হয়। মল্লিকবাড়ী বাজারে ২৪ জন খানসেনা নিহত ও কয়েকজন আহত হয়।

১২-৮-১৯৭১> মল্লিকবাড়ী বাজারের ঘাট আক্রমণ চালিয়ে ১১ জন পাকসেনা ও ২ জন রাজাকার হত্যা করা হয়।

১৩-৮-১৯৭১> অধিনায়ক আফছার সাহেবের নেতৃত্বে মল্লিকবাড়ী বাজারে অতর্কিত হামলা চালিয়ে ২৬ জন রাজাকার ও ২ জন পাক সেনাকে হত্যা করা হয়।

১৪-৮-১৯৭১> মেজর আফছার সাহেবের নির্দেশে প্লাটুন কমান্ডার আইয়ুব আলী ও সেকশন কমান্ডার আমজাত হোসেনের দল কর্তৃক ভরাডুবা গ্রামের হজরত আলী নামে একজন রাজাকার ধৃত ও নিহত হয়। অধিনায়ক আফছার সাহেবের নেতৃত্বে মল্লিকবাড়ী ঘাঁটি আক্রমণ করা হয়। ফলে ৭ জন রাজাকার নিহত ও কয়েকজন আহত হয় এবং ৩ টি রাইফেল উদ্ধার করা হয়। এই দিন সন্ধ্যায় অধিনায়ক আফছার সাহেব হাকিম সাহেবকে ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক হিসেবে নিযুক্ত করে ওপার বাংলায় রওয়ানা হন।

১৫-৮-১৯৭১> একদল মুক্তিযোদ্ধা কর্তৃক ভায়াবহ ঘাটে পাকবাহিনী একটি দলের সাথে অবিরাম ৪ ঘণ্টা গুলি বিনিময়ের ফলে ১৯ জন রাজাকার নিহত এবং কয়েকজন আহত হয়। উক্ত রাজাকারদের নিকট থেকে ৪ টি রাইফেল উদ্ধার করা হয়।

২৬-০৮-১৯৭১> মেজর আফছার সাহেবের নির্দেশে প্লাটুন কমান্ডার আইয়ুব আলীর নেতৃত্বে একদল মুকিসেনা ভালুকা থানার ভায়াবহ এলাকা দিয়ে অগ্রসর হয়ে মল্লিকবাড়ী ঘাঁটি আক্রমণ করেন। ফলে পাকসেনাদের ৮ জন নিহত ও কয়েকজন আহত হয়।

২৭-৮-১৯৭১> ভালুকা থানার বাটাজুর এলাকায় পাকসেনাদের একজন গুপ্তচর ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক হাকিম সাহেবের দলভুক্ত প্লাটুন কমান্ডার নারায়ণচন্দ্র পালের হাতে ধরা পড়ে, তাঁকে পরে হত্যা করা হয়।

২৮-৮-১৯৭১> ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক হাকিম সাহেবের নেতৃত্বে প্লাটুন কমান্ডার ফজলুল হক বেগ, নুরুল ইসলাম ও হাফিজুর রহমান তাদের দলের মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে ঢাকা জেলার কালিয়াকৈর থানার শালদাহপাড়া এলাকায় হানা দেন। এই হামলায় পাকবাহিনীর কুখ্যাত দালাল ও রাজাকার সাহেব গ্রেফতার হয় ও তাকে হত্যা করা হয়। অনেক লুটের মাল উদ্ধার করা হয় এবং এই সমস্ত মালামাল তাদের প্রকৃত মালিক ও গরিবদের মধ্যে বিতরণ করা হয়।

২৯-৮-১৯৭১> প্লাটুন কমান্ডার কাছিমউদ্দিন তার দল নিয়ে মল্লিকবাড়ী ঘাঁটিতে গেরিলা আক্রমণ চালান, ফলে পাকসেনাদের ৪ জন নিহত ও ৩ জন আহত হয়।

০১-৯-১৯৭১> প্লাটুন আইয়ুব আলী ও সেকশন কমান্ডার আমজাদ হোসেন মিলিতভাবে মল্লিকবাড়ী ঘাঁটি আক্রমণ করেন, ফলে ১২ জন রাজাকার নিহত ও কয়েকজন আহত হয়।

০২-৯-১৯৭১> প্লাটুন কমান্ডার কাছিমউদ্দিন তার দল নিয়ে ভালুকা পাকসেনাদের ঘাঁটিতে গেরিলা আক্রমণ চালান। ফলে ২ জন নিহত ও ৩ জন আহত হয়।

০৩-৯-১৯৭১> সেকশন কমান্ডার আমজাদ হোসেন ১৬ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে ভালুকা থানার ভরাডুবা গ্রামে একদল রাজাকারের উপর আক্রমণ করেন। ফলে ৫ জন রাজাকার নিহত হয়।

০৪-৯-১৯৭১> এই তারিখে বিকাল ৩ ঘটিকায় ভালুকা থেকে ভরাডুবা ও মেদুয়ালী এলাকায় ২ শতাধিক রাজাকার ও পাকবাহিনীর একটি দল বাজার ও বাড়ি ঘর লুট করে এবং বাংলাদেশ সরকারের সমর্থক ৭৬ জন লোককে গ্রেফতার করে তাদের মাথায় লুট করা মালের বোঝা চাপিয়ে ভালুকায় ফিরতে থাকে। এক খবর পেয়ে প্লাটুন কমান্ডার মোঃ হাফিজুর রহমান, মোহাম্মদ আমজাদ হোসেন, দিলদার আহমেদ, মোঃ আবদুল মোতালেব, মনিরউদ্দিন ও আবদুল মান্নানসহ মোট ১৪ জন মুক্তিসেনা নিয়ে ৪ মাইল রাস্তা দৌড়ে যেয়ে ভাণ্ডার গ্রামের সীমান্তে পাকবাহিনীর উপর আক্রমণ চালায়। আক্রমণের ফলে ১২ জন রাজাকার নিহত ও কয়েকজন আহত হয়। গ্রেফতারকৃত সমস্ত লোক ও লুট করা জিনিসপত্র ফেলে পাকসেনারা ভালুকা ফিরে যেতে বাধ্য হয়। পাকসেনাদের নিকট থেকে ১০ টি রাইফেল উদ্ধার করা হয়।

১০-৯-১৯৭১> পাকবাহিনীর একটি দল ভালুকা ঘাঁটির পাকসেনাদের খাদ্য সম্ভার বড় বড় ৫টি নৌকা বোঝাই করে ভালুকা আসার পথে কোম্পানী কমান্ডার চাঁন মিয়া তার দল নিয়ে ঝালপাজা গ্রামে আক্রমণ করেন। যুদ্ধে ৪ জন পাকসেনা নিহত ও কয়েকজন আহত হয়। নৌকাসহ ৫৭০ মণ আটা ও ২০ মণ চিনি মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়। উক্ত আটা ও চিনি রাজৈ ইউনিয়নের গরীব দুঃখীদের মধ্যে বিতরণ করা হয়।

১৩-৯-১৯৭১> অধিনায়ক মেজর আফছার সাহেবের ব্যাটালিয়নের কোম্পানী কমান্ডার আবুল কাশেম একটি কোম্পানী ও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আসার পথে রায়ের গ্রামে এলাকায় এক স্কুলে রাত্রি যাপন করেন। গ্রাম্য রাজাকার ও দালালরা খবর দেওয়ার ফলে ত্রিশাল ও গফরগাঁও ঘাঁটি থেকে পাকবাহিনী ভোর রাত্রে তিন দিক থেকে অতর্কিত আক্রমণ চালায়। দীর্ঘ ৭ ঘণ্টা যুদ্ধের পর কাশেম সাহেবের দল কর্তৃক ১৬ জন পাকসেনা ও ৫ জন রাজাকার নিহত হয়। এই যুদ্ধে ১০ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।

১৫-৯-৭১> প্লাটুন কমান্ডার আইয়ুব আলী, দিলদার আহমেদ, হাফিজুর রহমান, মোঃ আবুল কাশেম যথাক্রমে কুমারঘাট, মুচারঘাট, বান্দিয়া ও নিমুরী এলাকায় দীর্ঘ ৪ ঘণ্টা যাবৎ পাকসেনাদের সাথে যুদ্ধ করেন। ফলে ৫ জন রাজাকার নিহত ও কয়েকজন আহত হয়।

১৮-৯-১৯৭১> কোম্পানী কমান্ডার মোমতাজউদ্দিন খানের নেতৃত্বে বান্দিয়া এলাকায় চার ঘন্টা যাবৎ পাকবাহিনীর সাথে গুলি বিনিময় হয়। ফলে ১২ জন রাজাকার নিহত হয়।

১৯-৯-১৯৭১> ভালুকা থানার রাজৈ গ্রাম এলাকায় পাক বাহিনী লুট করতে আসলে কোম্পানী কমান্ডার চাঁন মিয়া তারাদল নিয়ে আক্রমণ করেন। ফলে ৭ জন পাকসেনা নিহত হয় ও কয়েকজন আহত হয়। ২ ঘন্টা গুলি বিনিময়ের পর পাকসেনারা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। একই দিন ভালুকা থানার পোনাশাইল এলাকায় কোম্পানী কমান্ডার চাঁন মিয়ার একটি প্লাটুনের সহিত একদল রাজাকার ও পাকসেনাদের এক ঘন্টাকাল গুলি বিনিময় হয়। এই যুদ্ধে দুই জন পাক সেনা নিহত হয়।

২১-৯-১৯৭১> সকাল ৯ ঘটিকায় ভালুকা ঘাঁটি থেকে প্রায় চার শতাধিক রাজাকার পাক বাহিনীর একটি দল ৪ ভাগ হয়ে বড়াইদ এলাকার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। বড়াইদ গ্রামে আফছার ব্যাটালিয়নের কোম্পানী হেডকোয়ার্টার ছিলো। পাক বাহিনীর আসার খবর পেয়ে কোম্পানী কমান্ডার মোমতাজউদ্দিন খান, প্লাটুন কমান্ডার সামছুদ্দিন, মনির উদ্দিন, মোঃ মোতালিব মাস্টার ও হাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে পাক বাহিনীর ৪টি রাস্তা প্রতিরোধ করে। দীর্ঘ ৪ ঘন্টা গুলি বিনিময়ের পর পাকবাহিনী ফিরে যেতে বাধ্য হয়। এই যুদ্ধে ১৪ জন পাক সেনা নিহত হয় ও কয়েকজন আহত হয়। তারা অনেক লুটের মাল ফেলে যায়। উক্ত মাল প্রকৃত মালিকদের ফেরত দেওয়া হয়।

২৪-৯-১৯৭১> পাকসেনাদের একটি দল মল্লিকবাড়ী এলাকায় লুট করতে আসলে অধিনায়ক সাহেবের দলের প্লাটুন কমান্ডার নাজিমউদ্দিন ও হাবিলদার আবদুল মোতালেব পাক বাহিনীর উপর অতর্কিত আক্রমণ করেন। এতে ২ জন পাকসেনা ও ৩ জন রাজাকার নিহত হয়। ২৬শে সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় অধিনায়ক আফছার উদ্দিন আহমেদ ওপার বাংলা থেকে মেজর পদে উন্নিত হয়ে দেশে ফিরে আসেন। ২৭ তারিখ সকাল ৮ ঘটিকায় তিনি নিজে কোম্পানীর কমান্ডার নাজিমউদ্দিন ও তার দলসহ মল্লিকবাড়ী পাক ঘাঁটি আক্রমণ করেন। এতে ৫ জন পাকসেনা ও ৪ জন রাজাকার নিহত হয়।

২৯-৯-১৯৭১> রাত্রি ২ ঘটিকায় কোম্পানী কমান্ডার আবুল কাসেম এবং প্লাটুন মনিরউদ্দিন কয়েকজন মুক্তিসেনা নিয়ে ভালুকা ঘাঁটিতে গেরিলা আক্রমণ চালান। ফলে ৪ জন পাকসেনা ৩ জন রাজাকার নিহত হয় এবং কয়েকজন আহত হয়।

১লা অক্টোবর ভোর ৪ ঘটিকায় ভালুকা, কাশীগঞ্জ ও ত্রিশাল থেকে পাক বাহিনীর তিনটি দল একযোগে বাইন্দা ও বড়াইদা এলাকার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। কোম্পানী কমান্ডার কাশেম সাহেবের নেতৃত্বে কমান্ডার কছিম উদ্দিন, মনির উদ্দিন ও হাফিজুর রহমান তাদের পথরোধ করেন। ১৭ ঘন্টাকাল স্থায়ী এই যুদ্ধে মোট ৭১ জন পাকসেনা ও রাজাকার নিহত হয় এবং বহুসংখ্যক আহত হয়। ৩ অক্টোবর মল্লিকবাড়ী ঘাঁটি থেকে পাক বাহিনীর একটি দল ভালুকা থানার তালাব এলাকায় লুট করার সময় অধিনায়ক আফছার সাহেব ও কোম্পানী কমান্ডার মোমতাজ উদ্দিন খান একদল মুক্তিসেনাসহ ঝাঁপিয়ে পড়েন। ফলে ৪ জন পাকসেনা ও ২২ জন রাজাকার নিহত ও ৩ জন আহত হয়।

৫-১০-১৯৭১> ভালুকা ঘাঁটি হতে পাকবাহিনীর একটি দল বিরুনিয়া ও মেদিলা গ্রাম লুট করতে আসলে কোম্পানী কমান্ডার মোমতাজ উদ্দিন, প্লাটুন কমান্ডার মজিবুর রহমান ও মোঃ নুরুল ইসলাম পাক বাহিনীর উপর আক্রমণ চালায়। ২ ঘন্টা গুলি বিনিময়ের পর ৯ জন রাজাকার নিহত ও ৫ জন আহত হয়।

৭ অক্টোবর মেজর আফছার সাহেব স্বয়ং একদল মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে রাত্রি ৮-৪৫ মিনিটে মল্লিকবাড়ী ঘাঁটি আক্রমণ করেন। ২ ঘন্টাকাল গুলি বিনিময়ের পর ১৯ জন পাকসেনা ও ১৪ জন রাজাকার নিহত ও কয়েকজন আহত হয়। পরদিন পাকবাহিনীর একটি দল পোনাশাইল এলাকার বাগেরপাড়ার দিকে অগ্রসর হতে থাকলে মুক্তিসেনারা অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এতে ৮ জন রাজাকার নিহত ৩ জন রাজাকার আহত হয়। একই দিন কোম্পানী কমান্ডার চাঁন মিয়া তার দল নিয়ে গফরগাঁও থানার এক রাজাকার ক্যাম্পে অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে ৪টি রাইফেল এবং ১২ শত রাউণ্ড গুলি উদ্ধার করে। এছাড়া ৯ জন রাজাকার নিহত হয়।

৯-১০-১৯৭১> কোম্পানী কমান্ডার হাকিম সাহেব তার কোম্পানীর প্লাটুন কমান্ডার দিলদার আহমেদ, শ্রী নারায়ণচন্দ্র পাল ও তমিজউদ্দিন আহমেদ এবং ৯০ জন মুক্তিযোদ্ধাসহ ঢাকা জেলার কালিয়াকৈর ঘাঁটি আক্রমণ করেন। পাকসেনারা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। রাজাকারগণ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং সেখানেই মারা যায়। মোট ৩৪ জন রাজাকার ও ১২ জন পাকসেনা খতম হয়।

১০ অক্টোবর মল্লিকবাড়ী ঘাঁটি থেকে ৫০ জন পাকসেনা ও ৩৫০ জনের একটি রাজাকার দল চানপুর গ্রামে লুটতরাজ আরম্ভ করে। এই খবর পেয়ে মেজর আফছার মাত্র ১৫ মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। দীর্ঘ ১০ ঘন্টা স্থায়ী এই যুদ্ধে ৫ জন পাকসেনা ও ৭ জন রাজাকার নিহত হয়। পাকবাহিনীর গুলিতে মুক্তিসেনা অনিলচন্দ্র সাংমা মৃত্যুবরণ করেন। এছাড়া একজন পুরুষ, একজন নারী এবং একটি ছেলেকে পাকবাহিনী পলায়নের সময় গুলি করে হত্যা করে। ঐ দিন দিবাগত রাত্রে সেকশন কমান্ডার আবদুল হালিম তার দল নিয়ে ধলা-গফরগাঁও রেল লাইনের চারিপাড়া পুলে পাহারারত রাজাকারদের উপর আক্রমণ চালান। এতে ১৪ জন রাজাকার আহত ও ৪ জন নিহত হয়। রাজাকারগণ ৫ শত রাউণ্ড গুলি ফেলে পালিয়ে গেলে তা মুক্তি সেনাদের হস্তগত হয়।

১৩-১০-১৯৭১> ভালুকা থেকে পাকবাহিনী ও রাজাকারদের একটি দল মেদুয়ারী গ্রামের সরকার বাড়িতে ক্যাম্প করে। একদল মুক্তিসেনা তাদের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। প্রায় আড়াই ঘন্টা গুলি বিনিময়ের পর পাক বাহিনীর ৮ জন নিহত হয় এবং অন্যরা পালিয়ে যায়।

১৫-১০-১৯৭১> আফছার ব্যাটালিয়নের কোম্পানী কমান্ডার মোঃ চাঁন মিয়া তার দলসহ মশাখালী রেল স্টেশনের দক্ষিনে করচঙ্গীর পুলের ধারে পাকবাহিনীর সাথে দীর্ঘ ৫ ঘন্টা গুলি বিনিময়ের পর পুলের বাঙ্কারে পৌঁছতে সক্ষম হন। পর পর নয়টি গ্রেনেড চার্জ করে বাঙ্কারগুলি দখল করা হয়। উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিস্ফোরক দ্বারা পুলটি ধ্বংস করে দেওয়া হয়। পুল ধ্বংস করার পর মশাখালি স্টেশনে আক্রমণ চালানো হয়। এতে একজন দারোগাসহ ১৫ জন রাজাকার ও পাকসেনা নিহত হয়। ১৩টি রাইফেল সহ ১২ জন রাজাকার চাঁন মিয়ার নিকট আত্মসমর্পণ করে। একই দিন দিবাগত রাত্রে উক্ত কোম্পানী কমান্ডার তার দলসহ অন্য একটি অভিযান চালিয়ে প্রায় ২০০ গজ রেলপথ নষ্ট করে দেন। মাইন বিস্ফোরণে মুক্তিসেনা আঃ মান্নান শহীদ হন।

১৬-১০-১৯৭১> বিকাল ৪-৩০ মিনিটে কোম্পানী কমান্ডার মোঃ চাঁন মিয়া তার দলসহ গফরগাঁও থানার শীলা নদীর পুলে পাকসেনাদের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালান। এতে পাকসেনাদের ৪ জন নিহত ও ৬ জন আহত হয়। একই দিন দিবাগত রাত্রে করচঙ্গী পুলের দক্ষিণে পাচগড়িয়া পুলে পাহারারত রাজাকারদের উপর আক্রমণ করেন। রাজাকার দল পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। পুলটি ধ্বংস করে দেওয়া হয়। ৭ জন রাজাকার অস্ত্রশস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করে।

২২-১০-১৯৭১> মশাখালি রেল স্টেশনের পশ্চিমে শীলা নদীর পাড়ে পাকসেনাদের উপর মুক্তিসেনারা অতর্কিত আক্রমণ করেন। ৫ জন রাজাকার ও একজন পাকসেনা নিহত হয়। আত্মসমর্পণকারী ৪ জন রাজাকার মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে মিলিত হয়ে যুদ্ধ করতে গিয়ে এই যুদ্ধে শাহাদাৎ বরণ করেন। দীর্ঘ তিন ঘন্টা যুদ্ধ করার পর পাক বাহিনী ফিরে যেতে বাধ্য হয়।

২৪-১০-১৯৭১> ভালুকা থানার বিরুনিয়া গ্রামে পাকসেনারা লুটতরাজ ও অগ্নিসংযোগ আরম্ভ করলে অধিনায়ক আফছার সাহেব চাঁন মিয়া কোম্পানীর মুক্তিসেনাদের নিয়ে পাকবাহিনীকে আক্রমণ করেন। ২ ঘন্টা গুলি বিনিময়ের পর ৫ জন পাকসেনা আহত হয়। ২৬ অক্টোবর- প্লাটুন কমান্ডার আবদুল হালিম কাশীগঞ্জে পাকসেনাদের ঘাঁটি আক্রমণ করেন। পাকসেনারা উপায় না দেখে অয়ারলেস মারফত তাদের অন্যান্য ঘাঁটিতে সাহায্য চায়। ভালুকা, আছিম, ত্রিশাল এবং গফরগাঁও থেকে পাকসেনারা কাশীগঞ্জে আসতে থাকে। কোম্পানী কমান্ডার মনিরউদ্দিন মিলিতভাবে তাদের দলের জোয়ানদের নিয়ে এ স্থানে যুদ্ধ আরম্ভ করে। কাশীগঞ্জের মাহু ভূঞাসহ মোট ৬৫ জন রাজাকার নিহত এবং অস্ত্রশস্ত্র সহ ১৭ গ্রেপ্তার করা হয়। ঘাঁটি সম্পূর্ণরূপে মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে এবং মোট ৫২টি রাইফেল উদ্ধার করা হয়।

২৮-১০-১৯৭১> মেজর আফছার সাহেবের নির্দেশে কোম্পানী হাকিম ঢাকা জেলার কালিয়াকৈর থানার কচিঘাটা এলাকায় পাক বাহিনীর উপর আক্রমণ করে। দীর্ঘ ১৫ ঘন্টার যুদ্ধে ৫২ জন পাকসেনা নিহত হয়।

৩০-১০-১৯৭১> অধিনায়ক আফছার সাহেব নিজেই একদল মুক্তিসেনাসহ ঢাকা জেলার কালিয়াকৈর থানার ফুলবাড়িয়া এলাকায় পাকসেনাদের উপর হামলা করেন। এতে ৭ জন পাকসেনা নিহত ও কয়েকজন আহত হয়। মুক্তিসেনারা মাইন বিস্ফোরণ ঘটিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ পুল সম্পূর্ণ দখল করে দেয়।

৩১-১০-১৯৭১> অধিনায়ক আফছার সাহেব কোম্পানী কমান্ডার মোমতাজউদ্দিন খান, সিরাজুল হক, হালিমউদ্দিন এবং তাদের জোয়ানদের নিয়ে গফরগাঁও থানার রসুলপুরে (আমলীতলা) রাজাকারঘাঁটি আক্রমণ করেন। এই যুদ্ধে মোট ৬৮ জন রাজাকার নিহত হয়। ৬৫টি রাইফেল, একটি স্টেনগান ও ৩ বাক্স গুলি উদ্ধার করা হয়। ঘাঁটিখানা মুক্তিসেনাদের দখলে আসে। এই যুদ্ধে অসীম সাহসী যোদ্ধা মোমতাজউদ্দিন খান শহীদ হন।

৯-১১-১৯৭১> মেজর আফছার সাহেব নিজে কোম্পানী কমান্ডার সামছউদ্দিন আহমেদ, ফয়েজউদ্দিন ও মোতালেব হাবিলদার এবং মুক্তিসেনাদের নিয়ে মল্লিকবাড়ি ঘাঁটি আক্রমণ করেন। এই যুদ্ধে ৩৩ জন পাকসেনা ও ৬ জন রাজাকার নিহত হয়। পাকবাহিনী ঘাঁটি ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় এবং ঘাঁটিটি মুক্তিসেনাদের আয়ত্তে আসে।

১০-১১-১৯৭১> কোম্পানী কমান্ডার চাঁন মিয়া রাজৈ এলাকায় পাকবাহিনীর উপর আক্রমণ চালিয়ে পাকসেনাদেরকে পালিয়ে যেতে বাধ্য করেন এবং একটি রাইফেল ও ৪৪ রাউণ্ড গুলিসহ একজন রাজাকারকে গ্রেপ্তার করেন। ১১ নভেম্বরে অধিনায়ক আফছার সাহেব কমান্ডার চাঁন মিয়া, সিরাজুল হক ও দুলু একত্রিত হয়ে ভালুকায় পাকঘাঁটি আক্রমণ করেন। দীর্ঘ ৮ ঘন্টার যুদ্ধে ৯ জন পাকসেনা ও ৭ জন রাজাকার নিহত এবং কয়েকজন আহত হয়। পরদিন ভালুকা থানার চান্দের আটি গ্রামে একদল পাকসেনা লুট করতে গেলে কোম্পানী কমান্ডার চাঁন মিয়া তার দল নিয়ে পাকসেনাদের উপর আক্রমণ করেন। ১১ ঘন্টার এই যুদ্ধে ১১ জন পাকসেনা ও ৯ জন রাজাকার নিহত হয় ও কয়েকজন আহত হয়। মুক্তিবাহিনীর প্লাটুন কমান্ডার সমশের আলীসহ ৫ জন মুক্তিসেনা শহীদ হন।

১৩-১১-১৯৭১> কোম্পানী কমান্ডার ফজলুল ওয়াহাব ও চাঁন মিয়ার পরিচালনায় ভালুকা থানা ও ভাওয়ালিয়া বাজু এলাকায় পাকসেনাদের উপর আক্রমণ চালানো হয়। ৩ জন পাকসেনা ও কয়েকজন রাজাকার আহত হয়।

১৫ নভেম্বর পাকবাহিনী ও রাজাকার বাহিনী প্রায় ৪ শতাধিক সৈন্য ধানশুর গ্রামে ঢুকে অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজ করতে থাকে। মেজর আফছার সাহেবের পরিচালনায় তিনদিক থেকে পাকবাহিনীর উপর আক্রমণ করা হয়। এই যুদ্ধে পাকবাহিনী ও রাজাকার সমন্বয়ে ৩৪ জন নিহত হয়। মুক্তিসেনা জহির উদ্দিন শহীদ হন।

০২-১২-১৯৭১> কোম্পানী কমান্ডার মোছলেহ উদ্দিন আহমেদ, প্লাটুন কমান্ডার এমদাদুল হক ও নাজিম উদ্দিন খানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা ধানশুর ও কাটালী গ্রামের বড় রাস্তায় পাক বাহিনীর উপর আক্রমণ করেন। এই যুদ্ধে ১৪ জন পাকসেনা ও ১৩ জন রাজাকার নিহত হয়। একই দিন মশাখালি ও কাওরাইদ থেকে পাকবাহিনী রাজৈ গ্রামে লুট করতে আসলে কোম্পানী কমান্ডার চাঁন মিয়া প্লাটুন কমান্ডার মজিবর রহমান ও নজরুল ইসলাম মুক্তিবাহিনীর দল নিয়ে পাকসেনাদের উপর গুলি চালান। এই যুদ্ধে একজন পাকসেনা নিহত হয়। ৩ ডিসেম্বর প্লাটুন কমান্ডার আবুল হাশিম ও কোম্পানী কমান্ডার ফজলুল ওয়াহাবের নেতৃত্বে ভালুকা থানার ভাওয়ালিয়া বাজু এলাকায় পাকবাহিনীর উপর আক্রমণ করা হয়। এতে ৩ জন পাকসেনা ও ২৭ জন রাজাকার নিহত হয়। একজন রাজাকার তার নিজ দলের কমান্ডার ও আরো একজন রাজাকারকে হত্যা করে ৩টি রাইফেলসহ মুক্তিবাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করে।

০৪-১২-১৯৭১> ভালুকা থানার চাপড়াবাড়ী এলাকায় রাজাকারদের উপর আক্রমণ চালিয়ে ৩ জন রাজাকার হত্যা করা হয়। একই দিন কোম্পানী কমান্ডার মোছলেহ উদ্দিন আহমেদ ও প্লাটুন কমান্ডার গিয়াসউদ্দিন আহমেদ একদল মুক্তিসেনা নিয়ে কাঠালী ও বাশিল এলাকায় পাক বাহিনীর উপর আক্রমণ করেন। ৭ জন পাকসেনা ও ১০ জন রাজাকার নিহত ও কয়েকজন আহত হয় সেদিনের যুদ্ধে।

০৬-১২-১৯৭১> বিকাল ৪ ঘটিকায় ঢাকা জেলার কালিয়াকৈর হতে ৪টি ট্রাক ভর্তি হয়ে পাকসেনারা যাওয়ার সময় কোম্পানী কমান্ডার হাকিম সাহেব, প্লাটুন কমান্ডার দিলদার আহমেদ ও নারায়ণচন্দ্র পালের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা অতর্কিত আক্রমণ করেন। এই হামলায় ২৭ জন পাকসেনা নিহত ও ৪ জন গুরুতররূপে আহত হয়। তিনটি ট্রাক সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেওয়া হয়।

০৭-১২-১৯৭১> মেজর আফছার সাহেব ও কোম্পানী কমান্ডার ফজলুল ওয়াহাব তিনটি কোম্পানীসহ পাকসৈন্যদের ভালুকা ঘাঁটি আক্রমণ করেন। ২ জন পাকসেনা ও ৩০ জন রাজাকার নিহত হয় এই যুদ্ধে। ৩০ ঘন্টাকাল ধরে যুদ্ধ চলার পর পাকবাহিনী পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। ফলে ভালুকা ঘাঁটি সম্পূর্ণরূপে মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে। ৮ ডিসেম্বর পলায়নরত পাকফৌজের পিছু ধাওয়া করে মেজর আফছার ও কোম্পানী কমান্ডার ফজলুল ওয়াহাব গফরগাঁও থানার ভারইল গ্রামের নিকটবর্তী স্থানে পাক সেনাদের ঘেরাও এবং আক্রমন করেন। এখানে তিনজন পাকসেনা ও পাঁচ জন রাজাকার নিহত হয়। পরের দিন মেজর আফছার মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে গফরগাঁও থানা হেডকোয়ার্টার দখল করেন এবং অনেক অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করেন।

১০-১২-১৯৭১> গফরগাঁও থানার নতুন অফিস ইনচার্জ হাফিজুর রহমান, কোম্পানী কমান্ডার ফজলুল ওয়াহাব, কোম্পানী কমান্ডার নাজিমউদ্দিন খান ও প্লাটুন কমান্ডার আবদুল বারী মাষ্টার সাহেবের নেতৃত্বে ত্রিশালে পাকবাহিনীর ঘাঁটি আক্রমণ করা হয়। পাকসেনারা রাজাকারদের সাথে ছলনা করে পালিয়ে যায়। রাজাকাররা অন্য উপায় না দেখে বাধ্য হয়ে ১০৬টি রাইফেলসহ আত্মসমর্পণ করে। ত্রিশাল ঘাঁটি মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়।

১৪-১২-১৯৭১> ময়মনসিংহ শহর থেকে পলায়নরত প্রায় ১০০ জন পাকসেনার একটি দল ভালুকা থানার পাড়াগাঁও এলাকার এক গভীর জঙ্গলে আশ্রয় নেয়। মেজর আফছার সাহেবের তৃতীয় ছেলে সেকশন কমান্ডার নাজিমউদ্দিন কিছুসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা মিলে উক্ত পাক সেনাদেরকে আক্রমণ করে। দুই ঘন্টা তুমুল যুদ্ধের পর নাজিমউদ্দিন আহত হয়।

১৫ ডিসেম্বর মেজর আফছার উদ্দিন তার দলের কোম্পানী কমান্ডার কুদ্দুছ খান, গিয়াসউদ্দিন ও কোম্পানী কমান্ডার নাজিমউদ্দিনের সঙ্গে মিলিত হয়ে আক্রমণ করে উক্ত পলায়নরত পাকবাহিনীকে। মেজর সাহেব পাকবাহিনীর উপর তুমুল আক্রমণ চালিয়ে ৪০ জনকে হত্যা করেন এবং ১৮ জনকে অস্ত্রসহ জীবন্ত ধরে ফেলেন। তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে ১৭ ডিসেম্বর তিনি ঢাকা পৌঁছেন। কুর্মিটোলা ঘাঁটির নিকট পাকবাহিনীর ২ জন সৈন্য মারা যায়। বাকী মৃত সৈন্যদের নিয়ে মেজর আফছার ক্যান্টমেন্টে পৌঁছতে সক্ষম হন।

আফছার ব্যাটালিয়নের মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকাঃ

অধিনায়ক- মেজর আফছারউদ্দিন আহমেদ

সহকারী অধিনায়ক- মোমতাজউদ্দিন খান (শহীদ), নাজিমউদ্দিন (শহীদ), আবদুল হাকিম, আবুল কাশেম এবং হাফিজুর রহমান।

এ্যাডজুট্যান্ট- এএমএম মোছলেহ উদ্দিন আহমেদ বিএ

সিকিউরিটি অফিসার- মোঃ আখতার হোসাইন মণ্ডল

সহ-সিকিউরিটি অফিসার- মোঃ আঃ হামিদ (গফরগাঁও)

কোয়াটার মাস্টার- ডাঃ হাফিজউদ্দিন আহমেদ, একেএম আছাদুজ্জামান, মোঃ মোছলেহ উদ্দিন (ডাকাতিয়া), নুরুল আমিন, মোঃ ফজলুল হক বেগ, এসএস ওমর আলী, মোঃ আবদুল গফুর মাস্টার, মোছলেহ উদ্দিন (রসুলপুর), মোঃ আবদুল মোতালিব এবং সুবেদার মেজর সুলতান আহমেদ।

অফিস ইনচার্জ- মোঃ হাফিজুর রহমান জেসিও

এ্যাডজুট্যান্ট- মোঃ আঃ মোতালেব হাবিলদার

একাউন্ট ক্লার্ক- মোঃ আবুল কাশেম

সহকারী ক্লার্ক- মোঃ নরুল আমিন

ডিসপাচ ক্লার্ক- মোঃ আব্দুল খালেক

সহকারী ক্লার্ক- মোঃ শাহজাহান চৌধুরী

ষ্টেট ক্লার্ক- মোঃ জামালউদ্দিন

সহকারী ক্লার্ক- মোঃ আলী আকবর

রেকর্ড ক্লার্ক- এফএম আবুল কাশেম

সহকারী ক্লার্ক- নুরুল হুদা চৌধুরী (দুলু)

বিএইচএম- মোঃ আবুল কাশেম (বখুরা), গফরগাঁও

অডিটর- মোঃ আঃ সবুর, বি, কম

উপদেষ্টা পরিষদঃ

১। মেজর আফছার উদ্দিন- অধিনায়ক

২। ডাঃ ওয়াইজউদ্দিন আহমেদ- মেডিক্যাল অফিসার

৩। মোঃ হাফিজুর রহমান- অফিস ইনচার্জ

৪। মোঃ আবদুল হাকিম- কোম্পানী কমান্ডার

৫। হাফিজউদ্দিন আহমেদ- সম্পাদক, জাগ্রত বাংলা

৬। আক্তার হোসাইন মণ্ডল- সিকিউরিটি অফিসার

৭। মোঃ ফজলুল হক বেগ- কোম্পানী কমান্ডার

৮। মোঃ আবদুল জলিল- কোয়াটার মাস্টার

৯। মোঃ আনছারউদ্দিন মাস্টার- কোম্পানী কমান্ডার এবং

১০। মোঃ ফজলুল ওয়াহাব

বিচার বিভাগঃ

১। মেজর আফছারউদ্দিন- অধিনায়ক

২। মোঃ সিরাজুল হক- কোম্পানী কমান্ডার

৩। আইয়ুব আলী- কোম্পানী কমান্ডার

৪। আখতার হোসাইন মণ্ডল- সিকিউরিটি অফিসার

৫। মোঃ হাফিজুর রহমান- অফিস ইনচার্জ

৬। মোঃ চাঁন মিয়া- কোম্পানী কমান্ডার

৭। আঃ হাকিম- কোম্পানী কমান্ডার

৮। আবুল কাশেম- সহকারী অধিনায়ক

৯। সামছউদ্দিন- কোম্পানী কমান্ডার

১০। এ, এন, এম মোছলেহউদ্দিন আহমেদ- এডজুট্যান্ট

শাসন বিভাগঃ

১। মেজর আফছার উদ্দিন আহমেদ

২। মোঃ আবদুল হাকিম

৩। আনছারউদ্দিন মাস্টার

৪। হাফিজুর রহমান

৫। আবুল কাশেম

৬। আব্দুল জলিল

৭। ফজলুল হক বেগ

৮। আখতার হোসাইন মণ্ডল

৯। চাঁন মিয়া

১০। ফজলুল ওয়াহাব

কোম্পানী কমান্ডার ও সহকারী কমান্ডারবৃন্দ

১ম ব্যাটালিয়ন

কোম্পানী কমান্ডার                                    সহকারী কমান্ডার

‘এ’> মোঃ চাঁন মিয়া                                          মোঃ কাজিমউদ্দিন

‘বি’> মোঃ আবদুল কুদ্দুছ খান                            মোঃ মজিবুর রহমান

‘সি’> মোঃ আইয়ুব আলী                                মোঃ আঃ বারী মাস্টার

‘ডি’> মোঃ আঃ হাকিম                                 মোঃ ছিদ্দিক হোসাইন

‘ই’> মোঃ আনছারউদ্দিন মাস্টার                           মোঃ সিরাজুল হক

২য় ব্যাটালিয়ন

‘এ’> শামছউদ্দিন আহমেদ                                মোঃ মুজিবর রহমান

‘বি’> মোঃ কাছিমউদ্দিন                                 মোঃ আঃ হালিম

‘সি’> মোঃ নাজিমউদ্দিন                                 মোঃ হাসমত আলী

‘ডি’> মোঃ ফয়েজউদ্দিন                                 মোঃ জবান আলী

‘ই’> মোঃ আঃ মজিদ                                  মোঃ আবুল কাশেম (ফুলপুর)

৩য় ব্যাটালিয়ন

‘এ’> বশিরউদ্দিন আহমেদ                                তমিজউদ্দিন আহমেদ

‘বি’> মোঃ ফজলুল ওয়াহাব                              মোঃ আইয়ুব আলী

‘সি’> মোঃ ওয়াহেদ আলী                                মোঃ হাতেম আলী খান

‘ডি’> মোঃ নুরুল ইসলাম                                মোঃ আঃ ছাত্তার

‘ই’> মোঃ ফজলুল হক বেগ                       মোঃ সিরাজুল হক (কাঠালী)

৪র্থ ব্যাটালিয়ন

‘এ’> মোঃ শামসুর রহমাম                               মোঃ আঃ রশিদ

‘বি’> মোঃ সিরাজুল হক (গফরগাঁও)                        মোঃ খোরশেদ আলম

‘সি’> এমদাদুল হক (দুলু)                        মোঃ সিরাজুল হক (কাচিনা)

‘ডি’> মোঃ আঃ রাজ্জাক                   মোঃ আনছারউদ্দিন মুন্সী (গফরগাঁও)

‘ই’> মোঃ খলিরুর রহমান                               মোঃ নজরুল ইসলাম

৫ম ব্যাটালিয়ন

‘এ’> মোঃ আলাউদ্দিন আহমেদ               মোঃ আঃ কাশেম (বোকাইনগর)

‘বি’> গিয়াসউদ্দিন আহমদ                        মোঃ সিরাজুল হক (রায়মনি)

‘সি’> মোঃ আঃ করিম পাঠান                      আঃ মান্নান (আমিরাবাড়ী)

‘ডি’> মোঃ এসএম শামসুল হক (খোকন)              মোঃ নুরুল আমীন খান

‘ই’> মোঃ আঃ ছামাদ                                  মোঃ আঃ মোতালেব খান

———————————————–

<৯, ১৬.৫, ৪৭৪-৪৭৮>

হেমায়েত বাহিনী

(ফরিদপুর থেকে প্রকাশিত মাসিক ‘গণমন’ (ডিসেম্বর, ১৯৭৭)- প্রকাশিত ‘হেমায়েতউদ্দিন বীর বিক্রম’ শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে সংকলিত। হেমায়েতউদ্দিন লিখিত যুদ্ধকালীন ডায়রী এবং সাক্ষাৎকারের উপর ভিত্তি করে প্রতিবেদনটি লিখেছিলেন এমএ সামাদ)

যে গোপালগঞ্জের এক মহান সন্তানের ভাবমূর্তী আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে বলিষ্ঠভাবে নেতৃত্ব দান করেছে তারই আরেক সন্তান হেমায়েতউদ্দিন গোপালগঞ্জ এলাকায় স্বাধীনতা যুদ্ধে বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। বক্ষ্যমাণ নিবন্ধে এ সম্পর্কেই আলোচনার প্রয়াস পাবো।

হেমায়েতউদ্দিন ছিলেন দ্বিতীয় ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টর একজন হাবিলদার। ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চের কালো রাত্রে হানাদার বাহিনী যখন ঢাকায় আক্রমণকারীর ভূমিকা গ্রহণ করে তখন তিনি জয়দেবপুর ছাউনিতে ছিলেন। এখানে অবস্থানরত ২য় ইষ্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট তখনো সরকারী নিয়ন্ত্রণে ছিলো। ২৭ মার্চ সর্বপ্রথম কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমানের (বর্তমানে মহামান্য রাষ্ট্রপতি) কণ্ঠস্বর ঘোষিত হলো, “আমরা স্বাধীনতা ঘোষণা করছি।” এই ঘোষণা শ্রুত হবার কিছুক্ষণ আগে বা পরে মেজর কে এম শফিউল্লাহ মর্টার প্লাটুন ও একটি কোম্পানী নিয়ে ব্যারাক থেকে বেরিয়ে পড়লেল। তিনি মেজর মইনুল হোসেনকে একটি গোপন নির্দেশ দিয়ে গেলেন। যার ফলে অল্পক্ষণের মধ্যেই ছাউনির মধ্যস্থ সমস্ত বাঙালি পরিবারকে গ্রামের দিকে পাঠিয়ে দেয়া শুরু হলো। হাবিলদার হেমায়েতউদ্দিন ও আব্দুল আজিজকে ৩৮ জন জোয়ান দিয়ে দক্ষিণের রথখোলার পেট্রোল ডিউটিতে পাঠানো হলো। তারা ডিউটিতে যাবার সময় অন্য কোনো নির্দেশ পাননি। শুধু পরস্পর জানতে পেরেছিলেন যে, গভীর রাতে কয়েকটি গুলির আওয়াজ হলে সবাইকে রানীর ঘাটে একত্র হতে হবে।

হঠাৎ রাত এগারোটায় গোলাগুলি শুরু হলো। অনর্গল গুলি হওয়ার ফলে এটাকে বাইরের আক্রমণ বলে সন্দেহ করলো। হেমায়েত এবং আবদুল আজিজের মধ্যেও মতভেদ দেখা দিলো। ফলে এই দলও ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়লো। হেমায়েতউদ্দিন জোয়ান আইয়ুব ও আলমকে নিয়ে পার্শ্ববর্তী গ্রামে ঢুকে পড়লেন। তারা ভোর পাঁচটার দিকে বুকে হেটে (ক্রলিং করে) শিবিরের দিকে অগ্রসর হন। তারা লক্ষ্য করলেন যে, অভ্যন্তরে বাঙালি কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। বরং কয়েকজন পাঞ্জাবী জোয়ান বাইরের সাহায্যের প্রতিক্ষায় তখনও পূর্বদিকের গেট পাহারা দিচ্ছে। সুযোগ বুঝে এরা তিনজন বালিকা বিদ্যালয়ের গা ঘেষে অগ্রসর হন এবং পাহারারত এই পাঁচজন পাঞ্জাবী সৈনিকের ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের খতম করে দেন। অতঃপর ভিতরে প্রবেশ করে তারা আরো আট জন সৈন্যকে হত্যা করেন এবং আহতদের বেয়নেট দিয়ে শেষ করেন। দক্ষিণ পাশে অফিস সংলগ্ন অয়ারলেস সেন্টারের অপারেটরদের মধ্যে জীবিত দুইজনকে তারা এসএমজির ব্রাশফায়ারে খতম করে ফেলেন। এই নিধনযজ্ঞ সমাপ্ত করে তারা আবার ছাউনিতে ফিরে এসে চতুর্দিক থেকে বাইরের লোক আহবান করেন। বাঙালি কন্ঠের আওয়াজ পেয়ে চারদিক থেকে লোকজন এসে পড়লো। এদের মধ্যে ইপিআই, ডিসির শ্রমিক নেতা আবদুল মোতালেব ও প্রচুর ছাত্র ও শ্রমিক ছিলো। অল্পক্ষণের মধ্যই শুরু হলো হেমায়েতের নেতৃত্বর অস্ত্র অপসারণ।

এখান থেকে হেমায়েতউদ্দিন শতাধিক অস্ত্র, প্রচুর গোলাবারুদ, ৩টি গাড়ী এবং কয়েকজন জোয়ান নিয়ে পূর্বদিকে মাত্র হাইস্কুলে চলে যান। অবশ্য দুদিনের মধ্যেই ২০ জন ছাড়া বাকী সকলেই অস্ত্র নিয়ে পালিয়ে যায়। অবস্থা দেখে ৩০শে মার্চ তিনি ২০ জন জোয়ানসহ কাপাসিয়া থানার দিকে অগ্রসর হন। সেখানে পৌঁছে তিনি জানতে পারলেন ২৭শে মার্চ রাত্রে জয়দেবপুর থেকে মেজর কেএম শফিউল্লাহর নেতৃত্বে বেরিয়ে আসা বাহিনী এখান দিয়ে চলে গেছে। ইতিমধ্যেই পাকবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ জোরদার হবার ফলে কাপাসিয়া অবস্থান নিরাপদ নয় দেখে হেমায়েতউদ্দিন তার লোকজন নিয়ে একটা বিশেষ লঞ্চে বর্মী গমন করেন। যেখান থেকে পায়ে হেটে ঢাকা-ময়মনসিংহ সীমান্ত বরাবর ‘কাওরাইদ’ নামক স্থানে পৌঁছেন। ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সুবেদার আবুল বাশার ও নায়েব সুবেদার মীর মোশারফ হোসেনর নেতৃত্বে এখানে একটি প্রতিরোধ বাহিনী গড়ে উঠেছিলো। হেমায়েত তার ২০ জন সঙ্গীসহ এখানে তাদের সাথে যোগদান করেন। এই ক্যাম্পে সেনাবাহিনীর লোকের চেয়ে আনসার ও মুজাহিদ বাহিনীর লোক বেশী থাকার ফলে তাদের কার্যকলাপে ‘কাওরাইদ’ ক্যাম্পে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় এবং নিয়মিত বাহিনীর জোয়ানদের মন বিগড়ে যায়।

ফলে ৯ এপ্রিল ফরিদপুর ও বরিশালের মাত্র ১১ জন সঙ্গী নিয়ে হেমায়েত ফরিদপুর রওয়ানা হন। তার সাথে কাপাসিয়ার ইব্রাহিম নামক একটি যুবকও ছিলো। এদের প্রত্যেকের সাথে ছিলো ১টি করে চাইনিজ রাইফেল ও ৮০০ রাউণ্ড গুলি। এছাড়া ২টি হালকা মেশিনগান, ৪টি চাইনিজ এসএমজি ও ৪০০০ গোলা বারুদও তাদের সাথে ছিলো। গ্রাম থেকে লোক ধরে এনে তাদের দিয়ে বোঝা টানিয়ে এবং পথ দেখিয়ে তারা অগ্রসর হচ্ছিলেন। গজারী বন পার হয়ে ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কে পাকবাহিনীর একটি ইউনিটকে তারা আক্রমণ করেন। এই সংঘর্ষে হেমায়েত বাহিনীর ৪ জন শহীদ হয়ে যান। কিন্তু তারা পাক বাহিনীর ৫ খানা জীপসহ বিপুল ক্ষয়ক্ষতি সাধন করেন।

এভাবে কয়েকটি অপারেশন চালিয়ে অবশেষে ১৭ এপ্রিল অপরাহ্ন ২টায় এক জেলে নৌকায় পদ্মা পাড়ি দিয়ে হেমায়েত ও তার সঙ্গীরা নারারটেক চরে অবতরণ করেন। তারা ফরিদপুরে পৌঁছে খন্দকার ওবায়দুর রহমান ও অন্যান্য আওয়ামী লীগ নেতার সাথে জেলা বোর্ডের কমলাপুরস্থ ডাকবাংলায় দেখা করেন এবং জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের সাথে দেখা করে পুলিশ বাহিনী ও অস্ত্রশস্ত্রের নিয়ন্ত্রণ হাতে পাবার দাবী করতে থাকেন।

ইতিমধ্যে ২১ এপ্রিল প্রত্যুষে পাকবাহিনী গোয়ালন্দে পৌঁছে যায় এবং ফরিদপুর শহরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। তাদের প্রতিহত করার কাজে সংশ্লিষ্ট কারো সহযোগীতা না পাওয়ায় সঙ্গীদের নিয়ে তিনি ভাঙ্গা উপস্থিত হন। সেখানে কিছু প্রশিক্ষণহীন যুবক প্রতিরোধ করার চেষ্টা করছিলো। কিন্তু তাদের মধ্যে দলাদলি দেখে হেমায়েতউদ্দিন নৌকাযোগে টেকেরহাট হয়ে ‘বাঘিয়ার বিল’ অতিক্রম করে ২৬ এপ্রিল ‘ফান্দি’ নিজ গ্রামে উপস্থিত হন। তার গ্রামের নিরীহ জনসাধারণ ও আত্মীয়স্বজন ইতিমধ্যেই পাক বাহিনীর অত্যাচারের কথা শুনে এবং দুর্বৃত্তদের দৌরাত্ম দেখে সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিলো। হেমায়েত বাড়িতে যেতেই নিরীহ গ্রমাবাসী তাকে এ বিদ্রোহের পথ পরিত্যাগ করতে অনুরোধ করে, আর দালাল দুর্বৃত্তরা ভয় দেখাতে থাকে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে হেমায়েতের স্ত্রী হাজেরা ৭ মে এক দুর্ঘটনায় মারা যায়। চান মিয়া নামক একজন মাতবর শ্রেণীর লোক এই দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে দল পাকাতে শুরু করলে ৯ মে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। অতঃপর হেমায়েত বাড়ি থেকে লোকজনসহ পার্শ্ববর্তী ‘পিঠা বাড়ী’ গ্রামে চলে যান। অবশ্য তিনি তার সাথীদের আগেই বিদায় করে দিয়েছিলেন। ইব্রাহীম এবং সোলায়মান ছাড়া আর কেউ তার সাথে ছিলো না।

৯ই মে চাঁন মিয়ার হত্যার দিনই কোটালীপাড়া ও গোপালগঞ্জ থানা থেকে পুলিশ ও পাকবাহিনী এসে হেমায়েতের বাড়ি পুড়িয়ে তার শেষ আকর্ষণ নিশ্চিন্ন করে দেয়। এরপর হেমায়েত বেপরোয়া হয়ে উঠেন এবং সত্যিকারভাবে নতুন করে সংগ্রামের জন্য মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকেন।

কয়েকদিন পর ১৪ই মে ভোরবেলা হেমায়েত তার সঙ্গী ইব্রাহীম ও সোলায়মানকে নিয়ে কোটালীপাড়া থানা আক্রমণ করে বসেন। তাদের আধুনিক অস্ত্রের মার এবং বেপরোয়া বীরত্বের কাছে মুহুর্তেই ৫৪ জন পুলিশ আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। অভ্যন্তরীণভাবে শক্তি সঞ্চয় করে এ ধরনের সাফল্য গ্রাম বাংলায় এটাই প্রথম! এতে স্থানীয় জনসাধারণ বিপুলভাবে উৎসাহিত হলো। হেমায়েত থানা থেকে পাঁচ মণ চাউল ও অন্যান্য রসদ নিয়ে বাঘিয়ার বিলের কলাবাড়ী গ্রামের চিত্ত গয়ানের বাড়ীতে চলে যান। পরে পীরের বাড়ীর আওয়ামী লীগ কর্মী লক্ষীকান্ত বলের অনুরোধে হেমায়েত তার গ্রামে ঘাঁটি স্থাপন করেন। এ সময় গৌরণদী অঞ্চলের ১২ জন জোয়ান ও কিছু ছাত্র হেমায়েতের সাথে যোগ দেয়।

পাকবাহিনীর লোকেরা নদীপথে খোঁজাখুঁজি করলেও বিলের অভ্যন্তরে মোটেও প্রবেশ করতো না। তবে এখানে দল সংগঠিত করতে তেমন সুবিধা না হওয়ায় হেমায়েত গৌরণদী চলে যান এবং ২৯ মে বরিশাল গৌরনদী থানার ‘বাটরা বাজারে’ আনুষ্ঠানিকভাবে হেমায়েত বাহিনী উদ্বোধন করেন। এর আগে ২৬ মে এক সফল আক্রমণে এই বাটরা বাজার তাদের নিয়ন্ত্রণে আসে।

শীঘ্রই বিভিন্ন এলাকা থেকে বিপুল সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা এই বাহিনীতে যোগ দিতে আরম্ভ করে। স্থান সংকুলানে অসুবিধা হওয়ায় পশ্চিম দিকে পয়সার হাটের উত্তরে রাজাপুর নামক গ্রামে তিনি সদর দফতর স্থাপন করেন।

১লা জুন বরিশাল ও ফরিদপুরের এই অঞ্চলে স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করা হয়। দেশের এই এই অঞ্চলই সর্বপ্রথম মুক্ত অঞ্চল হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। মুজিবনগর বেতার কেন্দ্র থেকেও এ কথা প্রচার করা হয়।

৩রা জুন পাকবাহিনীর এক বিরাট দল কোটালীপাড়া থানায় উপস্থিত হয় এবং রাত্রে নৌকাযোগে কোটালীপাড়া ও পয়সার হাটের খাল বেয়ে মুক্তিবাহিনীর ঘাঁটি আক্রমণ করতে এগিয়ে যায়। এই দলে ১২ খানা নৌকায় পুলিশ, লাঠিয়াল ও পাকবাহিনীর প্রায় ৩০০ লোক ছিলো। রাত দুটায় হেমায়েত তার বাহিনী নিয়ে অগ্রবর্তী ‘হন্যহাটি’ নামক স্থানে উপস্থিত হয়ে খালের দুপাড় থেকে এদের উপর আক্রমণ পরিচালনা করেন। পথে এই আক্রমণের জন্য পাকবাহিনী প্রস্তুত ছিলো না। তাই এই অতর্কিত আক্রমণে দিশেহারা হয়ে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। তবে হেমায়েত বাহিনীর ইব্রাহীম শাহাদাৎ বরণ করেন। এই আক্রমণের ফলে ২৪ জন পুলিশ ও লাঠিয়াল ধরা পড়ে।

এই নাজেহাল অবস্থায় প্রতিশোধ নেবার জন্য ৭ জুন পুনরায় ৩ খানা ‘স্টীল বডি’ লঞ্চ নিয়ে দক্ষিণ দিক দিয়ে পাকবাহিনী রাজাপুর ঘাঁটি আক্রমণ করে। হেমায়েত কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে লঞ্চগুলোকে পিছন দিক দিয়ে আক্রমণ করেন। অপর দিকে ঘাঁটির বাঙ্কার থেকে সামনের দিক দিয়ে গোলাবর্ষণ শুরু হয়। উপায়ন্তর না দেখে লঞ্চগুলো পালাতে শুরু করে এবং শাতলা গ্রামের বাঁক ঘুরে কোন রকমে পালিয়ে রক্ষা পায়। এই দৃশ্যে জনসাধারণ বিপুলভাবে আনন্দিত হয়। তারা হেমায়েত বাহিনীর এই দলটিকে কাঁধে তুলে পয়সার হাটে নিয়ে আসে। সেখানে তড়িঘড়ি করে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়ে যায় এবং হেমায়েতকে জনসাধারণ ‘মেজর’ খেতাবে ভূষিত করে। এই যুদ্ধের ফলে প্রায় ২০ মাইল এলাকা মুক্ত অঞ্চলে পরিণত হয়। এই সময় শাতলা গ্রামের নদীর বাঁকে একটি অগ্রবর্তী ঘাঁটিও স্থাপন করা হয়।

এরপর রাজাপুর থেকে সরে গিয়ে জহরের কান্দি হাইস্কুলে ঘাঁটি স্থাপন করে সামরিক প্রশিক্ষণ ক্যাম্প খোলা হয়। দলে দলে যুবক ছাত্র জনতা এসে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে লাগলো। পক্ষান্তরে এ সময় ভারত থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গেরিলারাও কিছু কিছু অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এসে দলে ভিড়তে লাগলো। অতঃপর কালকিনি থানার চলবল গ্রামে অপারেশন ঘাঁটি সরিয়ে নেওয়া হয়। ১১ জুলাই টুঙ্গীপাড়া শেখ বাড়িতে দেড়শ পাঞ্জাবী সৈন্যের বিরুদ্ধে এক সফল আক্রমণ পরিচালনা করা হয়।

১৪ই জুলাই পাকবাহিনী মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ ও টেকেরহাট, এই তিন দিক থেকে আবার চলবলের ঘাঁটির উপর হামলা চালায় এবং ক্যাম্পের কাছে রামশীল নামক গ্রামে ঢুকে পড়ে। হেমায়েতের সাথে তখন মাত্র ১৩ জন সঙ্গী ছিলো। এদের নিয়েই তিনি অগ্রসর হন এবং এই হামলা প্রতিহত করার প্রয়াস পান।

রামশীল গ্রামের মধ্য দিয়ে একটি খাল গৌরণদী থানার বাসাইল গ্রামের দিকে চলে গেছে। গৌরণদী থেকে ঐ খাল বেঁয়ে হানাদার বাহিনী আসতে পারে ভেবে পূর্ব দিকে মুখ করে ৩ জন, দক্ষিণ দিকে মুখ দিয়ে ৩ জন এবং সংকেত দেবার জন্য বাইরে একজন বসানো হলো। অতঃপর হেমায়েত বাকী ৬ জনকে পশ্চিমমুখী হয়ে বসালেন। কোটালীপাড়া বান্দাবাড়ী খালের মধ্য দিয়ে হানাদার বাহিনী অগ্রসর হতে পারে মনে করেই তিনি এ জায়গায় অবস্থান নিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে এদিক থেকেই হানাদারদের অগ্রগামী বাহিনী দেখা গেলো। তারা কাছাকাছি আসতেই হেমায়েত মেশিনগানের গুলি চালালেন। তুমুল গোলাগুলি শুরু হয়ে গেলো। হঠাৎ শত্রুপক্ষের একটা বুলেট তার সহকর্মী মকবুলের মাথার খুলি ভেদ করে চলে গেলে সে তৎক্ষণাৎ মারা যায়। মকবুলের লাশ টানতে যেতেই একটা শেলের টুকরা হেমায়েতের গালের বাঁ পাশ দিয়ে ঢুকে ডান পাশ দিয়ে বের হয়ে গেলো। এতে জিহ্বার খানিকটা কেটে গেলো এবং কয়েকটা দাতও পড়ে গেলো। তবুও তিনি কর্তব্যচ্যুত হলেন না। বরং অসীম সাহস আর প্রবল প্রতাপের সাথে পাল্টা আক্রমণ রচনা করে চললেন। এভাবে দীর্ঘ সময় তুমুল সংঘর্ষের পর হানাদার বাহিনী পিছু হটতে শুরু করলো। এই যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর প্রচুর হতাহত হয়। যুদ্ধের পর হেমায়েত বুঝতে পারলেন যে আঘাত খুবই সাংঘাতিক, ফলে তাকে দীর্ঘদিন রাজ্যেশ্ব ডাক্তারের চিকিৎসায় থাকতে হয়।

একস্থানে বেশীদিন ঘাঁটি রাখা ঠিক হবে না কারণ পাকবাহিনী খোঁজ পেলেই সেখানে আক্রমণের আশংকা দেখা দেয়। তাই রামশীলের যুদ্ধের পর আর চলবল ঘাঁটি রাখা মোটেই নিরাপদ নয়। তাছাড়া যে কোনো সময় বিমান আক্রমণও অসম্ভব কিছু না। তাই ঘাঁটি সরিয়ে গোপালগঞ্জের পূর্ব সীমান্তে বিলের উত্তর প্রান্তে ‘রুথিয়ার পাড়ে’ একটি পরিত্যক্ত বাড়ীতে ছাউনি ফেলা হলো। এ বাড়ীর প্রায় সকলেই ভারত চলে গিয়েছিলো। পাঁচখানা দোতলা ঘর নিয়ে বেশ বড় বাড়ী। এখানেই জুলাই মাসের শেষ দিকে ‘এসোসিয়েটেড প্রেস’র একজন সাংবাদিক হেমায়েতের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। ৪ঠা আগষ্ট সংখ্যায় হেমায়েতের ছবিসহ প্রকাশিত হয়।

ওদিকে কোটালীপাড়া থানায় পুনরায় অস্ত্র, গোলাবারুদ ও খাদ্যশস্য মজুদ করার খবর পাবার পর ১৫ সেপ্টেম্বর তারা আবার কোটালীপাড়া থানা আক্রমণ করেন। ১৪ ঘন্টা যুদ্ধ চলার পর থানা দখলে আসে। প্রচুর খাদ্যশস্য ও গোলাবারুদ হস্তগত হলো। অতঃপর হেমায়েত বাহিনী ৩ ডিসেম্বর শেষবারের মতো কোটালীপাড়া থানা দখল করেন।

কোটালীপাড়ায় আরো তিন জায়গায় পাকবাহিনীর ঘাঁটি ছিলো। ঘাগোর গুদাম ঘর, কুরপালামূ কম্যূনিটি সেন্টার এবং গোপালগঞ্জ মাদ্রাসায়। ডিসেম্বর মাসের শুরুতেই চতুর্দিক থেকে আক্রমণ করে এইসব ঘাঁটি নাস্তানাবুদ করে দেয়া হয়। ৩ ডিসেম্বর যুদ্ধের ফলে চুড়ান্তভাবে এই থানা মুক্ত হয়ে গেলো। এই যুদ্ধে জেলা অধিনায়ক ক্যাপ্টেন নুর মোহাম্মদ বাবুলও তার সাথে ছিলেন।

হেমায়েত বাহিনীর কর্মক্ষেত্র ছিলো বরিশালের উজিরপুর গৌরণদী থানা, ফরিদপুরের কালকিনি, মাদারীপুর, রাজৈর, গোপালগঞ্জ ও কোটালীপাড়া। মকসুদপুর, কাশিয়ানী এবং খুলনার মোল্লারহাট থানার অংশবিশেষও তার কর্মক্ষেত্রের অন্তর্ভুক্ত ছিলো।

সম্পূর্ণ অভ্যন্তরীনভাবে গড়ে উঠেছিলো এই হেমায়েত বাহিনী। তার দলে মুক্তিযোদ্ধা ছিলো ৫০৫৪ জন। তাদের মধ্যে নিয়মিত সশস্ত্র বাহিনীর লোক ছিলো ৩৪০ জন। এদের সাহায্যে তিন কোটালীপাড়া থানার জহরের কান্দি হাইস্কুলে সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খোলেন এবং তিন মাসে প্রায় চার হাজার যুবককে প্রশিক্ষণ দান করা হয়। এদের মধ্যে দেড় হাজার গরীব শ্রেণীর মুক্তিযোদ্ধাকে মাসিক ৯৫.০০ টাকা হিসাবে বেতনও দেয়া হতো। কোটালীপাড়া, নারকেলবাড়ীর চার্চমিশনে একটি সংক্ষিপ্ত নার্সিং প্রশিক্ষণ কেন্দ্রও খোলা হয়েছিলো। সেখানে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য একটি হাসপাতালও পরিচালনা করা হতো।

আগেই বলা হয়েছে হেমায়েত বাহিনী ছিলো সম্পূর্ণরূপে অভ্যন্তরীনভাবে গড়ে ওঠা একটি সংগঠন। এদের অস্ত্রশস্ত্রের বেশীরভাগই ছিলো পাকবাহিনীর কাছ থেকে কেঁড়ে নেওয়া। তারা পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে আঠারটি সফল আক্রমণ পরিচালনা করেন। এই বিরাট সাফল্য মূলতঃ হেমায়েতউদ্দিনের নিষ্ঠা এবং তার সঙ্গীদের দায়িত্ববোধ, আন্তরিকতা ও আনুগত্যের ফলেই সম্ভব হয়েছে। দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে এমন একক প্রচেষ্টায় অভ্যন্তরীনভাবে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানের নজীর বিরল। বাংলাদেশের সরকার এই বীর যোদ্ধার কৃতিত্বপূর্ণ কাজের স্বীকৃতি সরূপ তাকে ‘বীর বিক্রম’ খেতাবে ভূষিত করেন।

——————————————

<৯, ১৬.৬, ৪৭৮-৪৭৯>

ঢাকায় গেরিলা অপারেশন-১
সাক্ষাতকারঃ মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী (মায়া) বীর বিক্রম
(‘রোববার’ বিজয় দিবস সংখ্যা, ১৯৮১-সালে,প্রকাশিত জিল্লুর রহিম রচিত ‘ঢাকা শহরে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম সকল অভিযান শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে সংকলিত)

মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে অর্থাৎ মে মাসের শেষের দিকে আগরতলার এক ক্যাম্পে আমাদের ‘কমান্ডো’ আক্রমণের কলাকৌশল সম্পর্কে ক্লাশ নিচ্ছিলেন ক্যাপ্টেন হায়দার (পরবর্তকালে কর্নেল) ক্লাশ চলাকালে ক্যাম্প পরিদর্শনে এলেন ২নং সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ (পরবর্তীকালে ব্রিগেডিয়ার)। সেখানে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবলকে দৃঢ় করার জন্য সংক্ষিপ্ত এক জ্বালাময়ী ভাষণ দেন। এরপর তিনি একটি “সুইসাইড স্কোয়াড” গঠন করেন। সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন। এই স্কোয়াড পাঠানোর মূল উদ্দেশ্য ছিলো ঢাকা শহরে দখলদার সামরিক বাহিনীর আতঙ্ক সৃষ্টি করা, সেই সঙ্গে বিদেশী সাংবাদিক এবং বিদেশী অর্থনীতিক সাহায্যদাতা সংস্থার লোকজনের মধ্যে এই ধারনা দেয় যে, ঢাকা শহরের কেন্দ্রবিন্দুতেও মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতা ও আক্রমণ অব্যাহত রয়েছে।

জুনের প্রথমে আমাদের ১৬ জনের দলটি ঢাকার দিকে রওনা দেয়। আমাদের এই ১৬ জনের কাছে জনপ্রতি ৪টি করে গ্রেনেড এবং ২০ পাউণ্ড করে বিস্ফোরক ছাড়া অন্য কোন অস্ত্র ছিল না। ঢাকা আসার পথে দলের ৪ জন স্বেচ্ছায় বিচ্ছিন্ন হয়ে ফিরে যান। ৬ই জুন আমরা ঢাকা শহরে প্রবেশ করি। ঢাকায় এসে আমরা জানতে পারলাম যে ৯ই জুন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে সামরিক জান্তা এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। প্রিন্স সদরুদ্দিনসহ অর্থনৈতিক সাহায্যদাতা সংস্থার বেশকিছু প্রতিনিধি এবং বিদেশী সাংবাদিক এসেছিলেন। তারা হোটেল ইন্টারকনে ছিলেন। সামরিক জান্তা তাদের ভেতর প্রচার করেছিল যে ঢাকা শহর সম্পূর্ণ শান্ত। দেশের কোথাও মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে না, শুধু সীমান্ত এলাকায় সামান্য গোলমাল ছাড়া। আমরা সেই ধারনা পাল্টানোর জন্য প্রথমে ইন্টারকনে অপারেশন করার সিদ্ধান্ত গ্রহন করি। অপারেশনের দিন ঠিক করা হয় ৯জুন। কারণ, ঐদিন রাত ৭-৩০ মিনিটে বিদেশী সাংবাদিক ও সাহায্যদাতা সংস্থার প্রতিনিধিদের সন্মানে সামরিক জান্তা নৈশভোজের আয়োজন করে।

অনুষ্ঠান চলাকালীন সময়ে অপারেশন করার সিদ্ধান্ত গ্রহন করে প্রথমে আমরা ইন্টারক্নে ‘রেকি’ করি। আমরা সব সময় ‘রেকির’ উপর বিশেষ গুরুত্ব দিতাম। কারণ, অভিযানের সাফল্য শতকরা ৯০ ভাগ নির্ভর করে সঠিক ‘রেকি’র উপর। রেকিতে আমার সঙ্গে ছিলো আলম ও জিয়া। রেকি করার দিন বিকেলবেলা একটি গাড়িতে করে স্বাভাবিক ভাঙ্গিতেই আমরা হোটেলের সামনে নেমে ভিতরে যাই। প্রথমে আমাদের কাজ ছিল অপারেশনটা কিভাবে পরিচালনা করা যায় সে সম্পর্কে হোটেলের ভেতরে অবস্থান সম্পর্কে সঠিক ধারনা নেয়া। সিদ্ধান্ত মোতাবেক রেষ্টুরেন্টে যাই এবং কিছু খাওয়া-দাওয়ার ছলে আমাদের প্রয়োজনীয় সময় ব্যায় করে ভেতরের সকল অবস্থান সম্পর্কে ওয়াকেবহাল হয়ে ফিরে আসি। শেল্টারব ফিরে আমরা দলগতভাবে পুরো ব্যাপারটা নিয়ে পর্যালোচনা করার পর আক্রমনের কৌশল নির্ধারণ করি। আমরা শুধুমাত্র গ্রেনেড ছুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করার জন্য ৬ জনের একটি দল যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। অপারেশনের জন্য একান্তভাবে গাড়ির প্রয়োজন, কিন্তু আমাদের কোন গাড়ির ব্যবস্থা ছিল না।

ইন্টারকনে যেদিন অপারেশন করেছিলাম সেইদিন সন্ধ্যা আনুমানিক ৬-৩০ মিনিটের পর গুলশান থেকে একজন আবাঙালির একটি গাড়ি জোড়পূর্বক সংগ্রহ করা হয়। ঐ গাড়িতেই ৬ জনের ‘অপারেশন গ্রুপ’ নিয়ে আমরা রওনা হই। বাদল মামা গাড়ি চালাচ্ছিলেন। গাড়ির সামনের সিটে ছিলেন চুলু ভাই ও স্বপন। পেছনে আমি জিয়া ও আলম। হোটেলের সামনের দিকে গাড়ি থামিয়ে আমরা তিনজন নেমে পড়লাম। তখন ইন্টারকনে সামনের দিকটায় উঁচু কয়েকটি গাছ ছিল। গাড়ি থেকে নেমে সামনের দেয়াল টপকে আমরা ভিতরে প্রবেশ করে আবছা অন্ধকারে গাছের আড়ালে চলে যাই। ঘড়ির কাঁটার সাথে পাল্লা দিয়ে আমাদের সময় অতিবাহিত হচ্ছে। প্রতিটি মুহূর্তে আমরা তীক্ষ্ণতার সঙ্গে লক্ষ্য করে হোটেলের মূল প্রবেশ পথে পরপর তিনটি গ্রেনেড ছুড়ে ফেলি। গ্রেনেড গুলো বিস্ফোরিত না হওয়া পর্যন্ত আমরা গাছের আড়ালেই দাঁড়িয়ে থাকি। ইতিমধ্যে বিস্ফোরণের শব্দে লোকজন ছুটোছুটি, চিৎকার শুরু হয়েছে। আমরা দেয়াল টপকিয়ে তড়িৎ গতিতে গাড়িতে উঠে পড়ি।

আগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গাড়ি ঘুরিয়ে আমরা চলে যাই রমনা থানার কাছে জনৈক জামাত নেতার বাড়িতে। সেখানে তখন হানাদার বাহিনীর তাবেদার শান্তি কমিটির লোকজনের এক সম্মেলন চলছিলো। আকস্মিকভাবে আমরা গাড়ি নিয়েই ভেতরে ঢুকে পড়ে পরপর তিনটি গ্রেনেড নিক্ষেপ করে চোখের নিমিষে গাড়ি ঘুরিয়ে অদৃশ্য হয়ে যাই। সেদিন আমাদের সিদ্ধান্ত ছিলো ইন্টারকনে অপারেশন সফল হলে ঢাকার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় আক্রমন করা। তাই রমনা থেকে সোজা চলে যাই ‘দৈনিক পাকিস্তান’ (দৈনিক বাংলা) ও ‘মর্নিং নিউজ’ সংবাদ-পত্র অফিসের সামনে। চলন্ত অবস্থায় সেখানে ২ টি গ্রেনেড নিক্ষেপ করে আমরা পুরানা পল্টনের গলিতে ঢুকে পড়ে সেখানে গাড়ি ফেলে নিরাপদে ফিরে যাই।

ঢাকা শহরে একই দিনে আমরা এই তিনটি সফল আক্রমন পরিচালনা করেছিলাম। সেদিনের ঘটনা আজো আমার স্মৃতিতে ভাসে, কারণ, এই আক্রমণ ছিলো ঢাকা শহরের প্রথম সফল গেরিলা অভিযান।

—————————————————

<৯, ১৬.৭, ৪৮০>

ঢাকায় গেরিলা অপারেশন-২
সাক্ষাৎকারঃ এ মাসুদ (চুলু)

(‘রোববার’ বিজয় দিবস সংখ্যা, ১৯৮১-সালে,প্রকাশিত জিল্লুর রহিম রচিত ‘ঢাকা শহরে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম সকল অভিযান শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে সংকলিত)

আগষ্টের প্রথম সপ্তাহে ফার্মগেটে আমরা সামরিক বাহিনীর ক্যাম্পে এক সফল গেরিলা আক্রমণ পরিচালনা করেছিলাম। এই অপারেশনের দিনটি আমার কাছে এই জন্য স্মরণীয় যে সেদিনের ঘটনার সবকিছু আজো চোখের সামনে ভাসে। তখন গুলশানে আমাদের শেলটার ছিলো। ফার্মগেটে সামরিক বাহিনীর ক্যাম্প কিছু সিপাইসহ একজন ক্যাম্পেট র্যাংকের অফিসার থাকতো। ফার্মগেট দিয়ে চলাচলকারী সকল গাড়ি ও লোকজনকে তারা তল্লাশী করায় আমরা চলাচলে প্রতিবন্ধকতার সম্মুখিন হচ্ছিলাম। তাই এই ক্যাম্প আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। প্রথমে রেকি করলাম আমি, মায়া, বদি ও কাজী। রেকির পর সিদ্ধান্ত হলো যে, ক্যাম্প আক্রমণ করতে আমরা সক্ষম হবো। ফার্মগেট আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেবার পর দ্বিতীয় দফা রেকির জন্য পাঠানো হলো উলফত ও দুলালকে। প্রথম ও দ্বিতীয় রেকি থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে আমরা আক্রমণের কৌশল নির্ধারণ করি।

সামাদ ভাইয়ের তৎকালীন মগবাজারের বাড়িতে আমাদের অপারেশন গ্রুপের অবস্থান ছিলো। অপারেশনের আগে ফার্মগেট সামরিক ক্যাম্পের খুব কাছে একটি বাড়ি থেকে দুলাল টেলিফোনে সামরিক ক্যাম্পের সর্বশেষ তৎপরতা এবং অবস্থান সম্পর্কে আমাদের অবহিত করছিলো। অপারেশনে আমরা দুটি গাড়ি ব্যবহার করেছিলাম। অপারেশনের গাড়িটি ছিলো সামাদ ভাইয়ের। চালাচ্ছিলেন সামাদ ভাই নিজেই। তার সঙ্গে ছিলো আলম, কাজী, পুলু, উলফত ও বদি। সামাদ ভাইয়ের গাড়ি চালনার ভেতর সেদিন যেনো যাদুর স্পর্শ ছিলো। সে এক অকল্পনীয় কৌশল। আমি পিছনে কভার গাড়িতে ছিলাম। আমার সঙ্গে ছিলো গাজী দস্তগীর, জিয়া ও আনু। এখন যেখানে ফার্মগেট ওভারব্রীজ সেখানে রাস্তার দু’পাশে সামরিক বাহিনীর কড়া পাহারা ছিলো। অপারেশনের জন্য আমরা ত্বরিত কৌশল গ্রহণ করেছিলাম।

সন্ধ্যা হয়ে আসছে। এমন সময় অপারেশন স্থলে পৌঁছে লক্ষ্য করলাম সেনাবাহিনীর কয়েকজন লোক টুলের উপর বসে গল্প করছে ও কয়েকজন দাড়িয়ে রয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য ছিলো আকস্মিক আক্রমণ পরিচালনা করা যাতে হানাদার বাহিনীর মনোবল ভেঙ্গে পড়ে। প্রথমেই ২টি এসএমজি দিয়ে আলম ও পুলু দুদিকে গার্ড দুজনকে বুলেটবিদ্ধ করে গাড়ি থেকে ক্যাম্পের ভিতর ব্রাশফায়ার শুরু করে। এই ত্বরিত আক্রমণে পাকসেনারা হতভম্ব হয়ে যায়। আতংকে তাদের ছোটাছুটিতে এক বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হওয়ায় পাল্টা আক্রমণের সুযোগ নিতে তারা সক্ষম হয়নি। এরই ভিতর সামাদ ভাই গাড়িটাকে দাড়ানো অবস্থায় রাস্তার সেই স্বল্প পরিসর জায়গায় মুহুর্তের ভেতর এমনভাবে ঘুরিয়ে নিলেন যা আমার কাছে আজো বিস্ময়কর, অলৌকিক মনে হয়। গাড়িটাকে তিনি এমনভাবে ঘুরিয়েছিলেন, ঠিক যেনো ডিগবাজির মতো। এই অস্বাভাবিক গাড়ি ঘুরানোর সাথে সাথেই আলম ও পুলু গাড়িতে উঠে পড়ে এবং গাড়ি থেকে পাক বাহিনীর প্রধান ক্যাম্প লক্ষ্য করে গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়। সফল আক্রমণ পরিচালনা করে চোখের পলকে সামাদ ভাইয়ের গাড়ি অদৃশ্য হয়ে যায়। সামাদ ভাই নিরাপদে আগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মতিঝিলের নাভানা ওয়ার্কশপে পৌঁছে জামান ভাই ও আনোয়ার ভাইয়ের হেফাজতে আর্মস সহ গাড়ি রেখে ফিরে যান বাড়িতে। কভার গাড়ি নিয়ে আমরা গুলশানের শেলটারে পৌঁছাই। পরে জানতে পেরেছিলাম এই অপারেশনে ১জন অফিসারসহ ১৭ জন পাকসেনা নিহত হয়েছিলো।

————————————————-

<৯, ১৬, ৪৮০-৪৮৬>

ঢাকায় গেরিলা অপারেশন-৩
সাক্ষাৎকারঃ আবদুস সামাদ,বিপি

(স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস প্রকল্প ৫-৬-৮৩ তারিখে গৃহীত)

একাত্তরের মার্চে আমার বাসা ছিল ৪১৫ নিউ ইস্কাটন রোডে, এখন চীনা দূতাবাস অবস্থিত ঠিক তার পাশে। ঢাকা নিওন সাইন নামে আমার একটি ছোট লাইটিং কারখানা ছিল আমার। ঢাকার বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক ইত্যাদিতে প্লাস্টিক সাইন সরবরাহ হতো আমার কারখানা থেকে। সে সময় যেহেতু ঢাকায় বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক প্রভৃতির কর্মকর্তাদের অধিকাংশই ছিল অবাঙালি, সেহেতু তাদের সাথে আমার ব্যবসায়িক যোগাযোগের সুবাদে আমি পাঞ্জাব ও উর্দু ভাষাটা ভালোই শিখেছিলাম। এটা ঢাকার গেরিলাযুদ্ধ পরিচালনা কালে আমার পক্ষে অনুকূল হয়েছিল। অনর্গল উর্দু ও পাঞ্জাবী ভাষা বলতে পারার কারণে উর্ধ্বতন কর্মকর্তাস্থানীয় কোনও অবাঙালি আমাকে ঢাকায় গেরিলাযুদ্ধের একজন সংগঠক বা সহায়তাকারীরূপে সন্দেহ করতে পারেনি।

যা হোক, ২৫ মার্চ সন্ধ্যে থেকে যখন সমস্ত শহরের পরিস্থিতি ক্রমেই থমথমে হয়ে উঠেছিল এবং পাকিস্তানী সামরিক কার্যক্রমের আসন্নতা যখন ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছিল তখন আমার কারখানার কিছুসংখ্যক কর্মী এবং আমার বাড়ির পার্শ্ববর্তী আলো ডেকোরেটরের আরও কিছু লোকজন মিলে নিউ ইস্কাটন রোডের কিছু জায়গায় গর্ত করা শুরু করে এবং দিলুরোডসহ আশেপাশের এলাকায় বহু ঠেলেগাড়ি জমা করে ব্যারিকেড সৃষ্টি করে যেন পাকবাহিনী এই পথ দিয়ে অগ্রসর হতে না পারে। আমাদের আশংকা বাস্তবে রূপ নিতে বেশী দেরি হল না। রাতের মধ্যেই বাংলা মোটর (তৎকালীন পাকমোটর) হয়ে নিউ ইস্কাটন রোড ধরে পাকবাহিনীর সামরিক যানগুলি এগিয়ে এলো। মনে আছে, সামনের যে জীপগুলি ছিল, সেগুলির বাতি ছিল হলুদ রঙের। গাড়িগুলি আমাদের তোইরি ব্যারিকেডের সম্মুখীন হতেই প্রচণ্ড ফায়ারিং শুরু হয়ে গেল। ফায়ারিংযের মুখে রাস্তাঘাট মুহুর্তেই ফাঁকা হয়ে গেল। আমরাও আত্মরক্ষার্থে বাসার ভেতর আশ্রয় নিলাম। উন্মত্ত গাড়িগুলি ব্যারিকেড চুরমার করে মৌচাক হয়ে রাজারবাগের দিকে ছুটে যায়। রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রমণ করতে পাকিস্তানী সামরিক যান এই নিউ ইস্কাটন রোড ব্যবহার করেছিল।

ঢাকা শহর পাক কবলিত হওয়ার পর এপ্রিলের শেষের দিকে আমার বিশিষ্ট বন্ধু তৎকালীন পাকিস্তান বিমান বাহিনীর ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট হামিদুল্লাহ খানের-যিনি পরে ১১নং সেক্টর অধিনায়ক কর্নেল তাহের আহত হওয়ার পর ঐ সেক্টরের দায়িত্ব নিয়েছিলেন, সাথে তাঁর ধানমন্ডির বাড়িতে একদিন দেখা হয়। তিনি তখন পাক বিমানবাহিনী থেকে ডিফেক্ট করার কথা ভাবছিলেন, কিন্তু ঠিক উপায় খুঁজে পাচ্ছিলেন না। আমি তাঁর পরিবারের নিরাপত্তার দায়িত্ব গ্রহণে সম্মত হলে তিনি আগরতলা চলে গিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগ দেন। এ ব্যাপারে আমি যোগাযোগে সাহায্য করি।

এ সময় আমি বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে গেরিলা ট্রেনিং চলার কথা শুনতে পাই, এবং কোনও গেরিলা দলের খোঁজ পাই কিনা তাঁর জন্য অনুসন্ধান চালাতে থাকি। এই অবস্থার মধ্যে আমার বাড়ির নিকটের প্রতিবেশী পাকিস্তান রেডিও-এর একজন কর্মচারী হাফিজ ভাইয়ের বাসায় একটি ছেলের মুখে মুজিবনগর এলাকায় জোর গেরিলা ট্রেনিং চলার কথা শুনতে পাই। আরও শুনতে পাই যে, অতি শীঘ্রই ভারত থেকে ঢাকা শহরের অভ্যন্তরে গেরিলা তৎপরতা চালানোর জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গেরিলা দল পাঠানো হবে। খবর শুনে আমি উৎফুল্ল হয়ে উঠি এবং এরূপ গেরিলা দল এলে আমি তাদের সর্মতোভাবে সাহায্য করার আগ্রহ প্রকাশ করি। ছেলেটি তাঁর নিজের আইডেন্টিটি গোপন রেখে শীঘ্রই একজন গেরিলা যোদ্ধাকে আমার কাছে পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দেয়। এর সপ্তাহ দু’য়েক পরেই হঠাৎ এক সকালে আমার বাড়ির পেছনের গেট দিয়ে একটি ছেলে এসে হাজির। সে এসে দ্বিধাজড়িত কন্ঠে আমার খোঁজ করতেই আমি তাঁর কাছে আমার পরিচয় দিলাম এবং তাকে নিয়ে এসে আমার ড্রয়িংরুমে বসালাম। আমি গেরিলাদের যুদ্ধে সাহায্যদানে ইচ্ছুক কিনা সরাসরি জানতে চাইলে আমি আমার পূর্ণ সম্মতি জ্ঞাপন করি। নিশ্চিত হয়ে সে তখন গাজী দস্তগীর বলে নিজের পরিচয় দেয় এবং খুব শীঘ্রই এই ব্যাপারে যোগাযোগ করবে বলে আমাকে জানায়। ঢাকায় গেরিলাদের সাথে এ ভাবেই আমার প্রথমিক যোগাযোগ গড়ে ওঠে, এবং আমি তাদের কিভাবে সাহায্য-সহায়তা করতে পারি সেসম্পর্কে চিন্তা করতে শুরু করি। আমার কিছু পূর্ব সামরিক জ্ঞান ছিল এবং বেশকিছু সামরিক অফিসারের সাথে আমার বন্ধুত্ব ছিল। ভেতরে দেশপ্রেম কাজ করছিল, তারই প্রেরণায় আধুনিক সমরাস্ত্র সজ্জিত একটি হৃদয়হীন শক্তির মুখে সামরিক ছাউনি পরিবেষ্টিত ঢাকা শহরের জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রতিরোধের শিখা জ্বালাতে আমি আমার সামান্য সীমিত শক্তি নিয়োগ সংকল্পবদ্ধ হই। এটা সুবিদিত যে, গেরিলারা জনবিচ্ছিন্নভাবে কোনো কাজ করতে পারে না। গণসমর্থন তাদের কাজের অপরিহার্য প্রাথমিক শর্ত। সে জন্য আমি প্রথম যে কাজটি করেছিলাম সেটা ছিল ঢাকায় আগত প্রথম গেরিলাদের জন্য শেলটারের ব্যবস্থা করা।

গাজী দস্তগীরের সাথে আলাপের কয়েকদিন পরই সে কয়েকজন ছেলেকে নিয়ে আমার বাসায় চলে আসে। এরা ছিল ২ নং সেক্টরের মেলাঘর,নির্ভয়পুর প্রভৃতি স্থানে আধুনিক গেরিলা যুদ্ধের ট্রেনিংপ্রাপ্ত। এদের মধ্যে যাদের নাম এখনো আমার স্মৃতিপটে উজ্জ্বল তারা হচ্ছেন মোফাজ্জল হসেন চৌধুরী মায়া (মায়া ক্র্যাক প্লাটুনের দায়িত্বপ্রাপ্ত), উলফত, জুয়েল, এবং যাদের নাম আমার স্মরণে নেই। গাজী দস্তগীর এদের সবাইকে একে একে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে জানায় যে, তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গেরিলা যুদ্ধের উপযোগী অস্ত্রশস্ত্র সঙ্গে করে এনেছে। তখন গেরিলাদের ঢাকা প্রবেশের রাস্তা দু’টি- একটি বিবিরবাজার-কুমিল্লা হয়ে, অপরটি মীরপুরের নদীপথে মালিবাগ পর্যন্ত। গেরিলারা আমাকে জানালো, যে অস্ত্রশস্ত্র আনা হয়েছে সেগুলি তারা মালিবাগের একটি বাসায় রেখে এসেছে, রাস্তায় রাস্তায় পাকবাহিনীর জোর তল্লাশী চলায় সেগুলো তারা আমার বাসা পর্যন্ত আনতে সাহস পায়নি। অস্ত্রগুলি দু’টি বস্তায় ভর্তি। একটিতে ছিল কয়েকটি স্টেনগান, চাইনিজ রাইফেল, বুলেট ইত্যাদি। অপরটিতে ছিল, যাকে বলা হয় প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ, অনেকটা গোলানো ময়দার মতো দেখতে, প্লাস্টিকের থলিতে ভর্তি। এ ছাড়া ছিল বিস্ফোরণ ঘটানোর অন্যান্য যাবতীয় প্রয়োজনীয় সামগ্রী।

গেরিলারা অস্ত্রগুলি নিরাপদে রাখার ব্যাপারে স্বতঃই চিন্তিত হয়ে পড়েছিল। আমি তাদের এ ব্যাপারে আশ্বাস দিই, গাজী দস্তগীরের দু’টি ছেলেসহ আমার নিজের টয়োটা করওলা গাড়ি নিয়ে মালিবাগের সে বাসায় চলে যাই এবং বস্তাভর্তি অস্ত্রগুলি নিয়ে আসি এবং আমার অফিসের স্টিলের আলমারি খালি করে তাতে সেগুলি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করি। দলে তখন আমরা ছিলাম মোট ৭ জন। আমাদের স্বাধীনতাকে ছিনিয়ে আনতেই হবে, এই ছিল প্রতিজ্ঞা।

এভাবেই প্রথমে প্রশিক্ষিত জনে ও অস্ত্রে গেরিলা অপারেশনোপযোগী তৎপরতার প্রাথমিক ভিত্তি রচিত হবার পরই ঢাকায় আলোড়ন সৃষ্টিকারী গেরিলা যুদ্ধের সূচনা ঘটে। গেরিলাদের আনা অস্ত্রগুলি সম্বন্ধে আমার পূর্ব ধারণা বিশেষ কিছু ছিল না। তাই আমার বাসায় নিয়ে আসার পর সেগুলির ব্যবহার সম্পর্কে প্রাথমিকভাবে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। আমার কাছে সবচেয়ে মারাত্মক ঠেকেছিল এক্সপ্লোসিভগুলি, সেগুলি ছুঁয়ে দেখতে সাহসে কুলোচ্ছিল না, ছিল টাইম পেন্সিল বোম, ইগনেটিং অয়ার, ডেটোনেটর ইত্যাদি বিধ্বংসী ধরনের নানা ডিভাইস।

অস্ত্রগুলি আনার পরদিনও আমরা সেগুলি নানাভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখি। তারপর উলফত, মায়া, জিয়েল আমরা সবাই মিলে কিভাবে কোথায় অপারেশন চালানো যাবে এ নিয়ে পরিকল্পনা করি। মায়াকে ২ নং সেক্টর থেকে এই দলের দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয়েছিল, এবং এই জন্য তার দল পরিচিত ছিল মায়া ক্র্যাক প্লাটুন বলে। ঢাকা শহরে আমার বিশেষ অবস্থাবগত কারণে- যা আমি পূর্বেই উল্লেখ করেছি, মায়া পরিকল্পিত অপারেশনগুলিতে স্থানীয়ভাবে আমার নেতৃত্ব কামনা করে এবং আমি তার আগস্ট মাসে পাক সামরিক জান্তার হাতে ধরা পড়ার পূর্বমুহূর্তে পর্যন্ত সানন্দে পালন করেছিলাম। গেরিলাদের ঢাকায় নিজ বাসগৃহে থাকার সমূহ আসুবিধা ছিল। গেরিলা যুদ্ধের জন্য অত্যাবশ্যক গণভিত্তি হিসাবে আমি তাদের নিরাপদ শেলটারের ব্যবস্থা করেছিলাম, তাদের খাদ্য ও প্রয়োজনীয় পোশাক পরিচ্ছদ সরবরাহ করেছিলাম- সমস্তই এককভাবে এবং তাদের অপারেশন সংগঠন ও পরিচালনায় সাহায্য করেছিলাম প্রত্যক্ষভাবে।

২নং সেক্টরের অধিনায়ক তৎকালীন মেজর খালেদ মোশাররফ এবং গেরিলা প্রশিক্ষক মেজর, এ ,টি এম হায়দার প্রায়ঃশই গোপনে কুরিয়ার মারফৎ আমাকে চিঠিপত্র পাঠাতেন ঢাকায় গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা এবং গেরিলাদের নিরাপত্তা বিধানের জন্য। এক পর্যায়ে মুজিবনগর থেকে জেনারেল এম, এ, জি ওসমানীরও নির্দেশ সম্বলিত চিঠি পেয়েছিলাম।

ঢাকায় পরিকল্পিত গেরিলা অপারেশন চলাকালীন সময়ে আমরা দ্বিতীয় দফা আরও কিছু অস্ত্রশস্ত্র পাই। এগুলো ছিল বিশেষ ধরণের এবং  গেরিলাদের ভাষায় ছিল ঢাকা শহরকে কাঁপিয়ে তোলার মতো। অস্ত্রগুলি এসে পৌঁছেছিল স্বামীবাগের পুরনো একতলা একটি বাসায়, সেগুলি ছিল বয়স্কা এক মহিলার হেফাজতে। আমি দু’জন গেরিলা যোদ্ধাকে সঙ্গে নিয়ে অস্ত্রগুলি আনতে যাই। গেরিলা দু’জন উক্ত মহিলার পরিচিত থাকায় তিনি সন্দেহমুক্ত হয়ে দ্রুত অস্ত্রগুলো আমার হাতে তুলে দেন। একটি সুটকেসে ও একটি বস্তায় সেগুলি ভর্তি ছিল। অস্ত্রগুলো বেশ ভারী থাকায় সুটকেসের তলা ফেটে গিয়েছিল, এ নিয়ে মহিলা বেশ দুশ্চিন্তায় ছিলেন। অস্ত্রগুলি নিয়ে আমরা দ্বিতীয় দফা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাই, এবং সেটি আমার অফিসেই। খোদ ঢাকা শহরই ছিল আমাদের এরিয়া অব গেরিলা অপারেশন, অস্ত্র প্রয়োগের কলাকৌশল রপ্ত করারও গোপন কেন্দ্র ছিল আমার প্লাস্টিক নিওন সাইন কারখানা ছোট্ট অফিসগৃহে- কারখানার ভারী ভারী হাতুড়ি, শাবল, কোদাল সহকারে লোহার কাজকর্মের দৈনন্দিন ধাতব শব্দরাজির আড়ালে। এসব নতুন পরীক্ষিত অস্ত্রগুলির মধ্যে ছিল বেশকিছু হ্যাণ্ড গ্রেনেড, এম-কে ১৪ মাইন, এম-কে ১৬ মাইন এবং ১৬ মাইনের ক্যাবলসহ একখানা রীল।

উল্লেখ্য, আমাদের গেরিলা তৎপরতার মান ক্রমশঃ যতই উন্নত হয়ে উঠছিল ততই আমরা সেক্টর কমান্ডারদের নির্দেশ সমেত অনেক নতুন নতুন অস্ত্রও পাচ্ছিলাম। এ প্রসঙ্গে একজন অত্যন্ত সাহসী গেরিলা আবু- বকরের নাম মনে পড়ছে, গুলশান ২য় মার্কেটের পেছনে তার বাসা ছিল। সে মাঝে মাঝেই প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আসতো এবং তার মারফত আরও কয়েকজন তরুণ গেরিলার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল, যাদের মধ্যে দু’জন স্বৈরাচারী আইয়ুব আমলের পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর আব্দুল মোনেম খানের সাড়াজাগানো হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন করেছিল। এরা ছিল খুব স্মার্ট এবং সুপ্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। বিশেষ করে আবু বকরের পায়ের আড়ালে প্লাস্টিক মোড়ানো ভাঁজ করা স্টেন বহনের কৌশল ছিল খুব চমকপ্রদ। চেকিংয়ে দেহতল্লাশীর সময় তার হদিসই মিলত না। মাহবুব সালাম ও নীলুর গুলশানের বাসায়ও এক্সপ্লোসিভ রাখা হতো। নীলু ও শাহজাহান নামের একটি ছেলে দু’টো অপারেশন করেছিল, যদিও তা সফল হয়নি। এরা ছিল আমার রিক্রুট। এদের অপারেশনে আমি নিজেও জড়িত ছিলাম।

অপারেশনকালে আমাদের সাথে আরও কিছু ছেলে যোগ দেয়। তাদের মাঝে মেজর জেনারেল(অবসরপ্রাপ্ত) আমজাদ চৌধুরীর ছোট ভাই আনোয়ার চৌধুরী ছিল অন্যতম। মিঃ জামানের নাভানা ওয়ার্কশপে গোপনে তাদের সাথে আমার যোগাযোগ ঘটে। আনোয়ার চৌধুরীর অপারেশনে বিশেষ করে গাড়ির ব্যবস্থা করার ব্যাপারে বিশেষভাবে সহায়তা করেছিল।

দেশে স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে, বিশ্ববাসীর কাছে দখলদার বাহিনীর এই দাবী চূর্ণ করার উদ্দেশ্যে আমরা প্রথম প্রচেষ্টা নিই ঢাকা শহরে সন্ত্রাস সৃষ্টির। সংশ্লিষ্ট সেক্টর কমান্ডারদেরও নির্দেশ ছিল এটা। এ ব্যাপারে যা কিছু প্লান প্রোগ্রাম তার সবই হত আমার বাসার ড্রয়িং রুমে। সন্ধ্যার অন্ধকার ছিল আমাদের অপারেশনগুলি উপযুক্ত সময়। অপেরেশনগুলি ছিল কমান্ডার খালেদ মোশাররফের ভাশায়ঃ ‘সিটি টেররাইজিং অপারেশনস’।

মুক্তিবাহিনীর সুদৃপ্ত অস্তিত্ব ঘোষাণার জন্য আমরা মোহাম্মদপুরের অবাঙ্গালি অধ্যুষিত এলাকা থেকেই প্রথম যাত্রা শুরু করি। বিশ্বস্ত বাহন আমার টয়োটা করোলা, দলে হাফিজ ভাই, উলফত, গাজী বাপী এবং আমি। আগস্টের দিকে ঘটনা। আমরা যখন আইয়ুব (বর্তমানে আসাদ) গেটের কাছাকাছি, তখন মীরপুরের দিক থকে একটি আর্মি কনভয় আসছিল। আমরা সেটা লক্ষ্য করি। আমদের সাথে কিছু এম-কে মাইন-১৪ ছিল। পেট্রোল নেবার ছল করে কাছে পেট্রোল পাম্পে গাড়ি থামাই, এরই মধ্যে উলফত রাস্তায় খুব দ্রুত ক’টি মাইন পেতে দিল, কনভয় এগিয়ে আসার আগেই। কনভয়ের প্রথম দুটো গাড়ি নির্বিবাদেই পার হয়ে গেল, পরের গাড়ির বেলায় ঘটল পরম আকাঙ্ক্ষিত বিস্ফোরণটি। মাইনের আঘাতে গাড়ির চাকা প্রচণ্ড শব্দে বার্স্ট হয়ে গেল, চারদিক নড়ে উঠল। আমরা ততক্ষণে হাওয়া।

আসাদ গেটে সন্ত্রাসের কাণ্ডটি ঘটিয়ে ঐদিনই শিকার খুঁজতে টোয়োটা করোলা চলে আসে হাইকোর্ট-ময়মনসিংহ রোড ক্রসিং-এর ট্রাফিক রাউন্ডে- এখন যেখানে স্বাধীনতা উত্তর শিল্পর্কীতি জোড়া দোয়েল ডানা বিস্তার করে আছে। সেখানে বাপী আর উলফতের পাতা মাইনের শিকার হয় অবাঙালি যাত্রীবাহী এক ডবল ডেকার বাস। এর পরদিন নর্থ-সাউথ রোডের উপর চাংওয়াতে অপারেশনের প্ল্যান নেওয়া হয়। কিন্তু হঠাৎ এক আর্মি চলে আসাতে অপারেশন হলো না। তবে রাস্তার উল্টো পাশে রাখা আর্মি অফিসারের জীপের চাকার নিচে এম-কে ১৪ রেখে আমরা দ্রুত সরে পড়ি। গাড়িতে ছিলাম আমরা মোট ৪ জন। স্টিয়ারিংয়ে আমি, বাকী ৩ জন ছিল উলফত, হাফিজ ও বাপী। আমরা সরে পড়ার আধ ঘন্টার মধ্যে প্লাস্টিক মাইন দারুণ আওয়াজে ফেটে গিয়ে জীপ দু’টির চাকা বিধ্বস্ত হয়।

এভাবে আরো বেশ কিছু গেরিলা অপারেশন আমরা করি। এগুলি ছিল গ্যানিজ ও ভোগ ফ্যাশন বিপনিকেদ্রিক অপারেশন, গ্রীন রোডের মোড়ে পেট্রোল পাম্প অপারেশন- যাতে সায়েন্স ল্যাবরেটরীর রাস্তায় হাফিজের(পরবর্তী কালে শহীদ) বসানো এম-কে ১৬ মাইনের তোড়ে খানসেনাসহ একটি মিলিটারী জীপ উড়ে গিয়েছিল, কমলাপুর স্টেশন অপারেশন, টয়েনবি সার্কুলার রোডস্থ গভর্ণর হাউসের পাশ্ববর্তী পি-এন-ও(পাকিস্তান ন্যাশনাল ওয়েল বা দাউদ পেট্রোলিয়াম লিঃ) পেট্রোল পাম্প অপারেশন ইত্যাদি। মায়া ক্র্যাক প্লাটুনের এসব অভিযানে অংশ নিয়েছিল(গ্যানিজ ও ভোগ-এর অপারেশন) মায়া, মানু এবং গাজী দস্তগীর। এরা একটি ৯০ সিসি হোন্ডায় চেপে অপারেশনে যায়। সাথে ছিল একটি স্টেন, গোটা কয়েক গ্রেনেড-৩৬ ও ফসফরাস বোমা। কভারে ছিলাম টয়োটাতে চেপে আমি (সামাদ) উলতফ ও জুয়েল (পরবর্তীকালে শহীদ)। পি-এনও পেট্রোল পাম্প অভিযানটি হয়েছিল একটু ভিন্ন কায়দায়। মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা এখানে হানা দিয়েছিল কালো মুখোশ পরে, শুধু চোখ দুটো বের করে রেখে। মুখোশগুলো সেলাই করে দিয়েছিলেন আমার স্ত্রী শাহীন বানু। পাম্পের অবাঙালি কর্মচারীর ‘ফ্যান্টোমাস আগেয়া’ বলে আর্ত চিৎকার করে পালিয়ে যায়। গেরিলা দল ১০ পাউণ্ড পিকে চার্জ লাগিয়ে প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটায় অপারেশনের স্টেন হাতে ছিল গাজী দস্তগীর ও টুলু। পাম্প অফিসের ঘরের পাহারায় ছিল নীলু। বিস্ফোরক চার্জ বসিয়েছিল মায়া। গাড়ির ড্রাইভিংয়ে ছিলাম আমি। এই ভক্স ও্যাগন গাড়িটি ছিল এয়ার ভাইস মার্শাল (তৎকালীন উইং কমান্ডাএ), কে,এম, আমিনুল ইসলামের। তিনি মুক্তিযুদ্ধে সীমান্ত অতিক্রমের পূর্বে এই গাড়ি ও তার নিজের পিস্তলটি আমাকে দিয়ে গিয়েছিলেন। এই গাড়িটি পাওয়ার স্টেশনশহ ঢাকার বিভিন্ন অপারেশনে আমাদের প্রভূত  কাজে এসেছিল।

কমলাপুর রেল স্টেশনের অপারেশনটি ছিল আমার, মায়া, দস্তগীর- সম্মিলিতভাবে এই তিনজনের একটি গ্রেনেড থ্রো-এর অপারেশন। গ্রেনেড দুটি ছিল আমার গাড়ির ডেস্ক বোর্ডে দুটি বৈদ্যুতিক তারের বাল্বের মোড়কে ঢাকা, যাতে চেকিংয়ে পড়লে খানসেনাদের দৃষ্টিকে তা সহজেই প্রতারিত করতে পারে। প্রয়োজনীয় কভার দেওয়ার জন্য আমার গাড়ির পেছনের বনেটে বানানো, ঠিক সীটের মতো দেখতে, একটি চোরা পকেটে রাখতাম সব সময় দুটো স্টেনগান।

আমদের এই অপারেশনগুলির উদ্দেশ্য ছিল হানাদার বাহিনী অধিকৃত খোদ ঢাকা নগরীতেই যে স্বাভাবিক অবস্থা আদৌ বিরাজ করছে না তা বিশ্বকে জানিয়ে দেয়া। আমার এই প্রাথমিক উদ্দেশ্যে সফল হয়েছিলাম এবং আমাদের এই দুর্ধর্ষ অভিযানসমূহের প্রত্যক্ষ ফলশ্রুতিতে অপরাহ্নকাল অতিক্রান্ত হতে না হতেই ঢাকা শহর জনশূন্য হয়ে পড়া ছিল তখনকার দিনে প্রায় রোজকার অবস্থা। তবে আমাদের যা কিছু অপারেশন হয়েছিল, তা হয়েছিল নতুন ঢাকা এলাকাতেই। পুরনো ঢাকায় আমাদের কার্যক্রমকে সম্প্রসারিত করতে পারিনি।

অপারেশনের সমস্ত খবর আমি স্বহস্তে লিপিবদ্ধ করে সেক্টরে পাঠিয়ে দিতাম। আমাদের এই প্রাথমিক গেরিলা মিশনগুলির সাফল্যের পরবর্তী পর্যায়ে মেজর অপারেশন চালানোর নির্দেশ পেতে থাকি। এই সময় আমরা জেনারেল ওসমানীর একখানি চিঠি পাই। তাঁর চিঠিতে ছিল অপারেশনের জন্য রেকি করা, অবজেকটিভ বা টার্গেট স্থির করা, এসকেপ রুট ঠিক রাখা এবং বিভিন্ন স্থানে নিরাপদ আশ্রয়স্থল খুঁজে বের করা সংক্রান্ত মূল্যবান পরামর্শ।

প্রাথমিক অভিযানগুলির সাফল্য আমাদের আরবান গেরিলা কার্যক্রমকে আরও বিকশিত করে তুলতে থাকে এবং উন্নত ফায়ার পাওয়ারসজ্জিত একটি আধুনিক সেনাবাহিনীকে চ্যালেঞ্জ করার মতো অবস্থায় এনে দাঁড় করায়। আমাদের গেরিলা দলে ক্রমেই আরো নতুন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছেলেরা আসতে শুরু করে। এদের মধ্যে বদি(বদিউল আলম), আলম, স্বপনের কথা মনে পড়ছে। জন সমর্থনের ক্ষেত্রেও ক্রমশঃ প্রসারিত হতে শুরু করে। উলতফের চাচা সাংবাদিক আতাউস সামাদ ফ্লাইট লেঃ হামিদুল্লাহকে সীমান্ত অতিক্রমে সাহায্যকারী পরিবারের টিকাটুলী হাটখোলার শাহাদাত চৌধুরী (বর্তমানে সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রার’ ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক) তাঁর ছোট ভাই ফতে আলী, এবং তাদের কনিষ্ঠ আরেক ডাক্তার ভ্রাতা আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসেন। হাফিজ ভাইয়ের বাসায় আলতাফ মাহমুদের যাতায়াত ছিল, গেরিলা তৎপরতায় তাঁর সমর্থন ছিল। সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র এক জায়গায় থাকলে তা জানাজানির পর যদি পুরো সম্ভারই শত্রুদের হাতে ধরা পড়ে যায় এই আশংকায় আলতাফ মাহমুদ সেগুলি বিভিন্ন স্থানে রাখার পরামর্শ দেন এবং তাঁর নিজের বাসায়ও তার কিছু নিয়ে রাখেন। গেরিলাদের সাথে তাঁর এই সংযোগ ও তাঁর বাসায় এই অস্ত্র পাওয়ার জন্য পাকবাহিনী তাকে ক্যান্টনমেন্টে ধরে নিয়ে যায় এবং অকথ্য নির্যাতন করে বাংলাদেশের এই প্রখ্যাত সুরকারকে হত্যা করে।

গেরিলা কর্মকান্ডের ক্রম বিস্তৃতিতের পরবর্তী ধাপে মায়া ক্র্যাক প্লাটুন যে অপারেশনগুলি পরিকল্পনা গ্রহণ করে বিশেষভাবে সেগুলি ছিল

(১) ফার্মগেট অপারেশন

(২) দুঃসাহসিক উলান পাওয়ার স্টেশন অপারেশন

(৩) গুলবাগ পাওয়ার স্টেশন অপারেশন

(৪) ওয়াপদা পাওয়ার হাউস রেইড

(৫) কাটাবন মসজিদের উত্তর পার্শ্বস্থ বৈদ্যুতিক স্টেশনে হামলা

(৬) হোটেল ইন্টারকনের বিস্ফোরণ ইত্যাদি।

এ ছাড়া, এগারনা রকটে যোগে এমপি হোস্টেল আক্রমণও ছিল এই পর্যায়ের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা যাতে ব্রিগেডিয়ার বশরি, লেঃ জেনারেল কর্নেল হেফাজীর মতো পাকিস্তানী সামরিক অফিসাররাও ভয়ে আধমরা হয়ে গিয়েছিল। এম-কে ১৬ মাইন সংস্থাপন করে রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির প্রয়াসও এই সময়ের ব্যাপার। এগুলি সবই ছিল জুলাই-আগস্ট মাসের ঘটনা।

ফার্মগেট অপারেশন চালিয়েছিল মোট ৬ জন গেরিলা- আমি (ড্রাইভিংয়ে) জুয়েল, বদিউজ্জামান আলম, পুলু ও স্বপন। অস্ত্রশস্ত্রের মধ্যে ছিল আলমের হাতে একটি চাইনীজ এস, এম জি, বাকী সবাইয়ের হাতে স্টেনগান। একটি ফসফরাস গ্রেনেড ও একটি গ্রেনেড-৩৬ জুয়েল ও পুলুর হাতে। অপারেশনটি মাত্র তিন মিনিটেরও কম সময়ের মধ্যে সম্পন্ন হয়। অবশ্য তাঁর পূর্বে কয়েক দফা রেকি করে অভিযানের পরিকল্পনা স্থির করা হয়। এ অপারেশনে মারা গিয়েছিল হানাদার বাহিনীর ৫ জন মিলিটারী পুলিশ ও তাদের সহযোগী ৬ জন রাজাকার। ঢাক সেনানিবাস, অপারশন হেড কোয়ার্টার, এম পি এ হোস্টেল এবং তৎকালীন দ্বিতীয় রাজধানী (বর্তমানে শেরে-বাংলা নগর) এলাকার কাছাকাছি ফার্মগেটে খান সেনাদের একটি বড় ধরনের কড়া চেকপোস্টের উপর গেরিলাদের এই দুঃসাহসিক হামলা বিশেষ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিল। উলান অপারেশনেও এমনি ইমপ্যাক্ট সৃষ্টি হয়েছিল। এটি ছিল জুলাইয়ের শেষ পক্ষের ঘটনা। অপারেশনটি সংঘটিত হয় গাজী দস্তগীরের নেতৃত্বে। দলে ছিল জিয়া, নীলু, হাফিজ এবং অন্যান্য আরো কয়েকজন। এরা ক্ষিপ্রতার সাথে পাওয়ার স্টেশনে পাহারারত পুলিশদের অতি সহজেই পরাভূত করে ট্রান্সফর্মারটিকে মারাত্মক ক্ষতি সাধনে সমর্থ হয়েছিল। একই সময় রাত্রি নয়টার দিকে গুলবাগ পাওয়ার স্টেশনটিও উড়িয়ে দেওয়া হয়। ক্র্যাক প্লাটুনের পুলু, সাইদ, জুয়েল হানিফ ও বাশার আরেকটি দলে বিভক্ত হয়ে এই অপারেশন চালায়, নেতৃত্বে ছিল জুয়েল। গাড়ির ড্রাইভিংয়ে ছিলাম আমি। ওয়াপদা পাওয়ার হাউজ অপারেশন করি মায়া, আমি,উলফত এই কয়জনে মিলে। কাঁটাবনের উত্তর পার্শ্বস্থ কেন্দ্রের উপর হামলাটি চাইয়েছিল আলম, জিয়া, বদি চুল্লুর গাড়িতে করে।

বিশেষভাবে ঢাকার পাওয়ার স্টেশনগুলি মায়া ক্র্যাক প্লাটুনের আক্রমণের লক্ষ্য ছিল এই উদ্দেশ্যে যে, এগুলিকে অকেজো করে দিতে পারলে শুধু ঢাকা নগরীই অন্ধকারে নিমজ্জিত থাকবে না, বন্ধ হয়ে যাবে দখলদার বাহিনীর রেডিও, টিভির সমস্ত প্রচার ও তাদের কর্মপ্রবাহ। এসব বৈদ্যুতিক ট্রান্সফর্মার সম্পর্কিত খুঁটিনাটি তথ্য জুগিয়েছিলেন দু’জন প্রকৌশলী। এদের একজন ছিলেন ওয়াপদার বিদ্যুৎ সরবরাহ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী।

জনাব নজরুল ইসলাম (পরবর্তীতে শহীদ)। তারা ট্রান্সফর্মারগুলি কিভাবে ধ্বংস করতে হবে তার জন্য প্রয়োজনীয় ডায়াগ্রাম ইত্যাদি সরবরাহ করেছিলেন। একই সঙ্গে স্মরণ করতে হয় তৎকালীন যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সেকশন অফিসার জনাব ডাবলু আহমদের কথা। তিনি বাংলাদেশের সকল ব্রিজে আর কালভার্ট এর ব্লুপ্রিন্ট তাঁর অফিস থেকে গোপনে মুজিবনগর সরকারের কাছে আমার মাধ্যমে সরবরাহ করেছিলেন, পরে তিনি পাকবাহিনী কর্তৃক ধৃত হয়ে ক্যান্টনমেন্টে অকথ্য নির্যাতনের শিকার হন। সেলিম নামের এক বোম্বাইয়া যুবকের কথাও প্রসঙ্গগতঃ উল্লেখের দাবী রাখে। সে বার্মা থেকে এসে ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করছিল এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন ছিল। পাঞ্জাবীদের সাথে তার যোগাযোগ থাকায় তার মারফত অনেক গুরুত্বপুর্ণ তথ্য পেতাম। সেগুলি আমাদের অপারেশনের পক্ষে সহায়ক হয়েছিল।

হোটেল ইন্টারকনের ওপর ১১ ই আগস্টের ২য় দফায় হামলা ছিল ক্র্যাক প্লাটুনের একটি মাষ্টার পিস বিশেষ। এ অপারেশনের মূল নায়ক ছিলাম আমি এবং বাকের (পরে শহীদ)। উলফত, মায়া ও গাজী ছিল সাথে। হোটেল ইন্টারকনের ওপর জুন মাসের হামলার পর খানসেনারা কড়া পাহারা বসিয়েছিল। সেখানে প্রবেশ করা দুঃসাধ্য ব্যাপার। মিঃ জামান ও ওয়ারিস নামে জৈনিক বিহারীর বদৌলতে হোটেলের প্রেমিসে অবস্থিত থাই ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের নতুন অফিস কক্ষের জন্য গ্লো-সাইন তৈরির অর্ডার সংগ্রহ করে সেই সুবাদে হোটেলে প্রবেশের সুযোগ করে নিই এবং কিভাবে অপারেশন করা যায় সে সম্বন্ধে রেকি করি। ব্যবসার নাম করে আমি সব সময় একটি ব্রীফকেস বহন করে নিয়ে যেতাম। গ্লো-সাইন তৈরীর কাজ শেষ হওয়ার পর দিনই ব্রীফকেসে ২৮ পাউণ্ড পি-কে এবং ৫৫ মিনিট মেয়াদী ‘টাইম পেন্সিল’ ভরে বিকেলে গাড়িতে চেপে রওয়ানা হলাম আমি, বাকের, মায়া ও গাজী। এদের মধ্যে শেষের দু’জন গাড়ীতে স্টেনগান নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো। এরপর হেদায়েত হোসাইন মোরশেদ রচিত ‘বিচ্ছুদের নেপথ্য কাহিনী’ শিরোনামে দৈনিক বাংলা, ১০ জানুয়ারী, ১৯৭২-এ প্রকাশিত সিরিজে* অপারেশনের অবশিষ্ট বর্ণনা হচ্ছেঃ হোটেলের লাউঞ্জে প্রবেশের জন্যে মূল দরজা দিয়ে না ঢুকে ‘সুইস এয়ার’-এর অফিসকক্ষের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকলো সামাদ ও বাকের। এ ব্যাপারে সহায়তা করলো ঐ অফিসেরই এক বন্ধু মোঃ শফি। প্রথমে সামাদ টয়লেট রুমে ঢুকলেন। খানিক পরে বাকের। ব্রীফকেস নিয়ে একেবারে কোনার ল্যাট্রিনে ঢুকলো বাকের। বাক্স খুলে ‘টাইম পেন্সিল’ প্রেস করলো। এর আগেই ল্যাট্রিনের দরজার ‘লক’ করা হয়েছে, সামাদ সাহেব রয়েছেন টয়লেটের মূল দরজার দাঁড়িয়ে ‘কভার’ হিসেবে। বাকের ব্রীফকেসটি রাখলো কমোডের পেছনে। তারপর দরজা তেমনি বন্ধ রেখে ল্যাট্রিনের উপর দিক দিয়ে দেয়াল টপকে বেরিয়ে এলো বাকের। তারপর প্রথমে সামাদ ও পরে বাকের হোটেল ছেড়ে বেরিয়ে গেল। ৫-৫৬ মিনিটে ঘটলো প্রচণ্ড বিস্ফোরণ। হোটেল লাউঞ্জ শপিং আর্কেড এবং আশেপাশের কক্ষের কাঁচ টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙ্গে গেল, ছিটকে গেল কক্ষের দরজা, ভেঙ্গে পড়লো কক্ষের ভেতরকার এবং লাউঞ্জের লাগোয়া দেয়াল। আহত হলো বেশ কয়েকজন। বিশ্ব সংবাদপত্রসমূহে বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর তৎপরতার রোমাঞ্চকর সচিত্র সংবাদ গুরুত্বের সাথে প্রকাশিত হলো। প্রকাশিত এরূপ একটি সংবাদের অংশবিশেষ এখনো আমার মনে আছে। এটা ছিল, “It shows that the guerillas can move at Dacca city at their will.” (অনুবাদঃ এটা নিঈদেশ করে যে গেরিলারা ঢাকায় মন মতো চলাফেরা করতে পারছে)

———————————————–

<৯, ১৬.৭, ৪৮৬-৪৯০>

ঢাকায় গেরিলা অপারেশন-৪

সাক্ষাৎকারঃ নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু

(পরবর্তীতে ‘ঢাকায় গেরিলা অপারেশন’ নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত। ঢাকার গেরিলা অপারেশন সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্যাদির জন্য বইটি দ্রষ্টব্য।

মানিক বাহিনী গেরিলা ইউনিট প্রধান রেজাউল করিম মানিক হানাদার বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে শাহাদাৎ বরণের পর তিনি উক্ত ইউনিটের অধিনায়কত্ব করেন। সাক্ষাৎকারটি প্রকল্প কর্তৃক ১২-৭-৮৩ তারিখে গৃহীত)

২৫শে এপ্রিল আমি সীমান্ত অতিক্রম করি। কাঠালিয়া হয়ে আগরতলা এসে পৌঁছি। সেখানে মেজর হায়দারের সাথে আমার দেখা হয়। মেজর হায়দারের সাথে আলাপ হলো। মেজর হায়দার আমাকে ঢাকা থেকে ছেলে সংগ্রহ করে নিয়ে আসতে বললেন। এরপর আমি ঢাকায় আসি । ঢাকায় এসে আমি কিছু ছেলে জোগাড় করি এবং পুনরায় ২২শে মে ঢাকা ত্যাগ করি এবং মতিনগরে উপস্থিত হই। আমাদের সেখানে ট্রেনিং নিতে দেয়া হয়নি। এই সময় কামাল লোহানীর সাথে আমার দেখা হয়। তিনি আমাকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে নিয়ে যান। সেখানে আমি দুই সপ্তাহকাল অবস্থান করি। স্বাধীন বাংলা বেতারে আমি কিছু কবিতাও পাঠ করি। সেখানে নওগাঁর জলিল সাহেবের (এম-পি) সাথে আমার দেখা হয়। আমি সরাসরি যুদ্ধ করতে চাই এই ইচ্ছা প্রকাশ করলে আমাকে তিনি তাঁর দিনাজপুর ক্যাম্পে ট্রেনিং নিতে বলেন। আমি সাথে সাথে রাজি হয়ে যাই এবং ২৭ জন ছেলে সহ পশ্চিম দিনাজপুরের বালুরঘাট ট্রেনিং নিতে শুরু করি। আমার ছেলেদের মধ্যে ছিল আসাদ, ওমর, পনির, মঞ্জু, ইফতেখার, তৌফিক প্রমুখ ছাত্র। সেখানে ৪৫ দিনে আমাদের ট্রেনিং সমাপ্ত হয়।

এর মধ্যে ট্রেনিং চলাকালে আমি কলকাতায় আসি। কলকাতায় মেজর খালেদ মোশাররফের সাথে আমার দেখা হয়। তিনি তখন ২ নং সেক্টরের অধিনায়ক। ঢাকা যেহেতু ২ নং সেক্টরের অধীনে ছিল, সেহেতু তিনি আমাদের ২৭ জনকেই দিনাজপুর থেকে আগরতলায় তাঁর অধীনে নিয়ে আসেন। এর প্রধান কারণ ছিল আমরা ছিলাম ঢাকার বাসিন্দা।

মেজর খালেদ মোশাররফের অধীনে পুনরায় আমাদের ১৫ দিনের একটি ব্রাশ-আপ ক্লাশ হয়। সেখানে তিনি আরো ২৫ জন ছেলে কে নিয়ে মোট ৫২ জনের একটি টিম তৈরী করেন এবং সবাইকে ঢাকা উত্তরের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেন। আমরা প্রথমে তিতাসের ভেতর দিয়ে ঢুকতে শুরু করি। আখাউড়া-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়কের একটি ব্রীজের নিচ দিয়ে আমরা গভীর রাত্রিতে ঢুকতাম। এর পাশের গ্রামটি ছিল মনিহন। সেই সাথে আমরা প্রথম ঢুকি সেপ্টেম্বর মাসে।

পাকবাহিনী অই ব্রীজের ওপর মোতায়েন ছিল। একদিন পাকসেনারা ব্রীজের উপর থেকে আমাদের উপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। আমাদের সাথে ফরিদপুরের একটা দল সেই পথে অগ্রসর হচ্ছিল। এ আক্রমনে অগ্রগামী দলটির ১৪ জন ঘটনাস্থলে মারা যায়। অই ঘটনার দুইদিন পর আমরা পেনিট্রেট করি এবং তিতাসে এসে পৌঁছি। সেখান থেকে আমরা ধামরাই থানার এক গ্রামে এসে উপস্থিত হই।

এই গ্রামে আসতে আমাদের সাত দিন সাত রাত লেগেছিল। সেই রাতগুলো ছিল ভীষন ভয়াবহ। দু’দিন দু’রাত আমরা স্রেফ নদীর পানি খেয়ে কাটাই। কারণ, আমাদের রেশন ফুরিয়ে গিয়েছিল। নদীতে যে সমস্ত গয়নার নৌকা যাতায়াত করতো সে সমস্ত নৌকার মাঝিদের সহায়তায় পাটাতনে লুকিয়ে থেকে আমরা আমাদের গন্তব্যে পৌঁছতাম। এ ব্যাপারে মাঝিদের ভূমিকা ছিল খুবই নির্ভীক। বলতে গেলে  এঁরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সাথে সরাসরি জড়িত ছিল।

এবার আমরা রোহার একটি ছোট্ট বাজারে উঠি এবং সেখানে যখন আমরা রাত্রিযাপন করছিলাম, তখনই হঠাৎ পাকবাহিনীর আক্রমণ শুরু হয়। আমরা যে সেখানে এসেছি এই কথা ইতোমধ্যেই দালালেরা পৌঁছিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু সেই আক্রমণ আমরা প্রতিহত করি। সেদিনের ঐ পাল্টা আক্রমণে আমাদের দলের আশরাফ নামে এক ছেলে (বি,ডি,আর সুবেদার) অত্যন্ত সাহসের সাথে যুদ্ধ করে। সেই যুদ্ধে আমরা ১৯ জন পাকসেনার প্রাণনাশ করি। পাকবাহিনী নিরুপায় হয়ে সেই স্থান ত্যাগ করে এবং ফিরে যাওয়ার পথে গ্রামের নিরীহ জনগণের উপরে অত্যাচার চালায়, তাদের ঘরবাড়ী লুট ও অগ্নিসংযোগ করে।

এরপরে রোহা ছেড়ে আমরা সিঙ্গাইর থানা এলাকার কাছাকাছি একটা গ্রামে ক্যাম্প করি। এখানে আমরা একটি অপারেশন করি। এই অপারেশনে ১৪ জন পাকসেনার একটি রেশনিং কোরকে আক্রমণ করি এবং সবকটা পাকসেনা কে খতম করি। এরপরে আমরা সেই স্থান থেকে আমাদের ক্যাম্পকে নিরাপদ এলাকায় নিয়ে আসি । এই নতুন স্থানটির নাম ছিল শিমুলিয়া। এখানে এসে আমরা ট্রেনিং ক্যাম্প স্থাপন করি। এভাবে আমাদের আক্রমনের পরিধদি ক্রমশঃ বিস্তার লাভ করতে থাকে এবং এক পর্যায়ে ২৩ জনের একটি সংঘবদ্ধ দল নিয়ে মূল ঢাকা নগরীতে প্রবেশ করি। দলটি ঢাকা শহর এলাকায় বেশ কয়েকটি অপারেশন করে। এই দলটির মধ্যে ছিল রইসুল ইসলাম আসাদ, মুনীরউদ্দিন, ফেরদৌস, মাহাবুব আলী, জাহেদ, শফিকুল ইসলাম স্বপন, জন, ফিরোজ, মোহাম্মদ আলী, ওমর, আরিফ, রমজান এবং আরো বেশ কয়েকজন নির্ভীক যোদ্ধা।

আমাদের দল ছাড়াও আরো একটি দলকে শাহাবুদ্দীনের (চিত্রশিল্পী) নেতৃত্বে ঢাকা দক্ষিনের কিছু এলাকায় গেরিলা তৎপরতা চালানোর জন্য পাঠানো হয়। এরা বুড়িগঙ্গা ও তার আশেপাশের এলাকা জুড়ে বিভিন্ন সময়ে শত্রুদের নাজেহাল করে। এই দলে ছিল কুতুব, ইমাম হোসেন, বজলু এবং আরো অনেকে।

গেরিলা কার্যক্রমের পাশাপাশি আমাদের দলকে আরো একটি দায়িত্ব দেয়া হয়। এটা ছিল ঢাকা শহরে গেরিলা তৎপরতার কথা প্রচার করা। এর উদ্দেশ্য ছিল ঢাকায় অবস্থানরত বিদেশীদের কে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ব্যাপারে অবহিত করা। এজন্য আমরা প্রথমে ঢাকার সেগুনবাগিচা হাই স্কুল থেকে একটি সাইক্লোস্টাইল মেশিন ছিনিয়ে এনে “গেরিলা” নামে একটি পত্রিকা প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিই। পত্রিকাটির ভাষা ছিল ইংরেজী। পত্রিকার মূল দায়িত্বে ছিল ফেরদৌস, ফিরোজ, জন, মোহাম্মদ আলী, জাহেদ, আরিফ এবং আরো কিছু মুক্তিকামী কর্মী। প্রতিমাসে পত্রিকাটির দু’টি করে পরপর সাতটি সংখ্যা বের হয়। এতে মুলতঃ যুদ্ধের খবরাখবর থাকত। পত্রিকাগুলো আমরা ঢাকায় অবস্থানরত বিভিন্ন বিদেশী সংস্থায় পাঠিয়ে দিতাম।

ঢাকায় আমাদের মূল দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল ঢাকার সাথে অন্যান্য অঞ্চলের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা। পাকসেনারা যাতে রসদ সরবরাহ করতে না পারে তার ব্যাবস্থা করা এবং হত্যাযজ্ঞ চালানোর জন্য ঢাকা শহরে পাকসেনাদের যে সমস্ত ঘাঁটি ছিল সেগুলো ধ্বংস করা।

ঢাকায় আমাদের প্রথম অপারেশন হয় কাকরাইলের মোড়ে। কাকরাইলের মোড়ে যে পেট্রোল পাম্পটি ছিল, আমরা প্রথমেই সেটিকে ধ্বংস করি। তারপরর মাহবুব আলী এবং ফেরদৌসের নেতৃত্বে ঢাকা ডি,আই,টি ভবনে অবস্থিত টেলিভিশন কেন্দ্রটি নষ্ট করে দেয়ার পরিকল্পনা করি। তখন মাহবুব আলী ডি,আই,টি ভবনেই চাকুরি করতেন। সে অফিসে আসার সময় প্রতিদিন কিছু কিছু বিস্ফোরক শরীরের বিভিন্ন জায়গায় লুকিয়ে শত্রুর চোখ ফাকি দিয়ে ডি,আই, টি ভবনেই জমাতে শুরু করল। প্রথমে আমাদের পরিকল্পনা ছিল ৮ পাউণ্ড দিয়ে ডি,আই,টির চূড়া উড়িয়ে দেয়া। কিন্তু পাঁচ পাউণ্ড সরানর পরে শত্রুবাহিনী সন্দেহ করতে শুরু করল। তখন মাহবুব আলী তাড়াতাড়ি আমার কাছে ছুটে আসে। আমি তাকে ধরা পড়ার আগেই ওটা ফাটিয়ে দিতে বলি। মাহবুব আলী তার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ডি,আই,টি চূড়ার নিচে ওটা ফাটিয়ে দেয়। তবে বিস্ফোরকের পরিমাণ কম হওয়াতে চুড়াটি সম্পুর্ন্রূপে ধ্বংস করা যায় নি। তবুও চূড়া টিতে চিড় ধরে যায়। ঢাকা শহরে আমাদের এই অপারেশনের উপরে বিদেশি পত্রিকাতেও রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল।

নভেম্বরের দিকে ঢাকা শহরে পাকবাহিনীর নির্যাতন আরো বেড়ে যায়। তাই আমরা ঢাকা শহরে পাকবাহিনীর উপরে সরাসরি আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেই। এ ব্যাপারে আসাদকে দায়িত্ব দেয়া হয়। এর দু’একদিন পরেই আরিফ, ফেরদৌস ও জন একটি গাড়ী হাইজ্যাক করে বায়তুল মোকাররমে নিয়ে আসে। সেখানে পাকবাহিনীর দু’টি লরির মাঝখানে আমাদের গাড়িটী রেখে বিস্ফোরকে অগ্নিসংযোগ করা হয়। কিন্তু প্রায় ১০ মিনিট চলে যাওয়ার পরেও বিস্ফোরণ হচ্ছে না দেখে আসাদ পুনরায় গাড়িটির ভিতর ঢুকে অগ্নিসংযোগ করে আসে। এই যাত্রায় আমরা সাফল্য লাভ করি। সেখানে ১৬ জন পাকসৈন্য মারা যায়। আমরা এই অপারেশন করি সাড়ে ১২টার দিকে এবং বিবিসির ৩টার সংবাদে এই ঘটনাটি প্রচার করা হয়।

অক্টোবরের দিকে আমরা মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাঙ্ক অপারেশন করি। এই অপারেশনে নেতৃত্ব দিয়েছিল মুনির। ফ্রোজ, আসিফ এবং আসাদও এর যুক্ত ছিল। মুনির অত্যন্ত সাহসের সাথে একটি মাত্র খেলনা পিস্তল দিয়ে এই ব্যাঙ্ক অপারেশন করেছিল। সেখান থেকে আমরা কিছু টাকা সংগ্রহ করি। এই অর্থ সংগ্রহ করা হয়েছিল শিমুলিয়া ট্রেনিং ক্যাম্পের জন্য।

এছাড়া নভেম্বরের দিকে ঢাকা শহরে আমরা আরো কয়েকটি অপারেশন করি। সেগুলি ছিল রেডিও বাংলাদেশ (শাহবাগ), মালিবাগ রেলক্রসিং, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রভৃতি এলাকায় অপারেশন। মালিবাগ রেলক্রসিং- এর কাছে রেললাইন উড়িয়ে দিতে গিয়ে ভোর চারটা থেকে পাকবাহিনীর সাথে আমাদের প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয়। এতে তাদের একটি সেকশন পুরোপুরিভাবে বিনষ্ট হয়। একই মাসে আমরা বাংলাদেশ রেডিও (শাহবাগ) আক্রমণ করি এবং পাহারারত বহু পাকসেনাকে আঘাত হানি। এই অপারেশনে আমরা কিছু পাকসৈন্যকে খতম করে অন্যত্র সরে যাই।

আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আক্রমণের পরিকল্পনা করি অক্টোবরের দিকে। তখন দখলদার পাক সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাশ চালু করার চেষ্টা করছিল। আমরা এই সংবাদ পেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু এক্সপ্লোসিভ বসাই। প্রথমে সাইকোলজি বিভাগে একটি এবং তিনতলা, চারতলাতেও কিছু এক্সপ্লোসিভ বসাই। এই অপারেশনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাশ চলা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর আমাকে খোজাখুঁজি শুরু হয় এবং আমার বাড়ি তল্লাশী করে আমার পাঁচ ভাইকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়।

আমরা আরো একটি অপারেশন করি অক্টোবরের প্রথম দিকে, সাভারের রেডিও স্টেশনের সামনে। এই পথে আমরা তিনটি পাকিস্তানী লরি আক্রমণ করি এবং প্রায় ৩৭ জন পাকসৈন্য হত্যা করি। এরও আগে স্পেটেম্বরের শেষের দিকে সাভারে আমরা একটা অপারেশন করেছিলাম। এটি হয়েছিল সাভার রেডিও স্টেশন থেকে মানিকগঞ্জের বড়াল ব্রিজ পর্যন্ত প্রায় ৩০ মেইল এলাকা জুড়ে। এই হাইওয়ে অপারেশনে আমরা একদিনে প্রায় চার’শ ছেলে কে কাজে লাগাই এবং ৩০ মাইলের মধ্যে ৩১৯ জন রাজাকারকে আত্মসমর্পনে বাধ্য করি এবং তাদের কাছ থেকে অনেক অস্ত্রশস্ত্র কেড়ে নেই।

১৪ই নভেম্বরের ভায়াডুবি ব্রিজ অপারেশন ছিল আমাদের আরেকটি উল্লেখযোগ্য গেরিলা অভিযান। এখানে আমরা প্রচণ্ড সংঘর্ষে লিপ্ত হই। শত্রুসেনারা সংখ্যায় ছিল ২০ জন। আমাদের আক্রমণ ভাগে ছিল ৪৪ জন। পাঁচ জনের উপরে দায়িত্ব ছিল ব্রিজ দখলের সে ৫ জন ছিল মেজবাহউদ্দিন সাবু, সুবেদার আশরাফ, সুবেদার ওয়াজেদ, হাকিম আর আমি। আমরা সব শত্রুসেনাকে খতম করে অবশেষে ব্রীজটা দখল করতে সমর্থ হই। আমাদের অস্ত্রশস্ত্রের মধ্যে ছিল একটি এলএমজি, একটি ২” মর্টার এবং একটি স্টেনগান। এ দিয়ে আমরা ব্রীজটি দখল করি। তবে আমরা বেশী সময় ব্রীজটি দখলে রাখতে পারি নি। কিছুক্ষনের মধ্যেই তা পুনরায় শত্রুর দখলে চলে যায়। তারা মানিকগঞ্জ থেকে তিনগাড়ি সৈন্যসহ (প্রায় ৭০০ জন) ব্রীজ অভিমুখে রওয়ানা হয়। রাত্রি তখন গভীর। তারা মানিকগঞ্জের দিক থেকে আমাদের উপরে প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। আমরা এক ভীষণ সংঘর্ষে লিপ্ত হই। এই যুদ্ধে আমাদের প্লাটুনের অধিনায়ক মানিক শহীদ হয় এবং বেশ কয়েকজন যোদ্ধা আহত হয়। আমরা সেখান থেকে পিছু হটে যাই। এর চারদিন পরে ১৮ই নভেম্বর আমরা পুনরায় ব্রীজটা দখল করি এবং পরবর্তী তে উড়িয়ে দেই। এরই মধ্যে ধামরাই এলাকাও আমরা পুরোপুরি মুক্ত করে ফেলি। ধামরাইতে ১৫০ জনের একটি কোম্পানী মোতায়েন রেখে মূল ক্যাম্প সাভারের জিরাবো তে স্থানান্তর করি। এখান থেকেই আমরা সাভারের মহাসড়ক নিয়ন্ত্রনে নিয়ে নেই এবং উত্তরবঙ্গ থেকে ঢাকাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলি। সাভারে তখন পাকিস্তানীদের বড় ধরনের ক্যাম্প ছিল। এই ক্যাম্পটি আমরা ঝটিকা আক্রমণের মাধ্যমে দখল করে ফেলি। আক্রমন টি চালানো হয় নভেম্বরের শেষ দিকে। এর পরপরই আমরা সাভার থানা দখল করি, ফলে পুরো সাভার এলাকাই আমাদের নিয়ন্ত্রনে চলে আসে।

১৩ই ডিসেম্বর টাঙ্গাইল থেকে ৩৩ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট মিত্র বাহিনীর চাপে পিছু হটে ঢাকার দিকে আসছিল। আমরা এই রেজিমেন্টকে সাভারের কাছে বাধা দিই এবং ফলে সেখানে একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে আমরা পুরো শক্তি কাজে লাগাই এবং ৩৩ পাঞ্জাব রেজিমেন্টকে আত্মসমর্পণ করাই। এখানে শত্রুপক্ষের প্রায় শতাধিক সৈন্য নিহত হয় এবং একজন পাকিস্তানী সুবেদার মেজর আত্মসমর্পণ না করে আত্মহত্যা করে। আমাদের মুক্তির পুর্ব মুহূর্তের এ যুদ্ধই ছিল এ এলাকার সবচেয়ে বড় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। এই যুদ্ধে আমরা টিটোকে হারাই। এরপর আমরা ১৬ই ডিসেম্বর মিত্র বাহিনীর সাথে প্রথম ঢাকায় প্রবেশ করি। আমাদের ছেলেদের মধ্যে মানিক, আফতাব, আমজাদ, নেহাল, টিটো এবং মানিক সহ মোট ছয়জন বিভিন্ন সংঘর্ষে শহীদ হয়।

—————————————————

<৯, ১৬.১০, ৪৯০-৪৯২>

ঢাকায় গেরিলা অপারেশন-৫

প্রতিবেদন: শাহাদাত চৌধুরী

(‘দৈনিক বাংলা’ ১ ডিসেম্বর ১৯৭২-এ প্রকাশিত ‘মানুষের সঙ্গে মিশে যুদ্ধ করেছে গেরিলারা’ শীর্ষক প্রতিবেদনের অংশ)

       নভেম্বরের প্রথম দিকে বিবিসির খবরে বলা হয়েছিল ঢাকা শহর ঘিরে রেখেছে ৮ হাজার মুক্তিবাহিনী। তাঁরা বিচ্ছিন্নভাবে গেরিলা তৎপরতা চালাচ্ছে, কিন্তু যে কোন সময় একসঙ্গে শহরে প্রবেশ করবে।

গেরিলা রণনীতিতে বেছে নিতে হয় শত্রুর দুর্বলতম অংশ। সেক্ষেত্রে শত্রুর সবচেয়ে বড় ঘাঁটি রাজধানী শেষ লক্ষ্যস্থল হওয়ার কথা। কিন্তু ঢাকা শহরে যেসব আক্রমণ চালানো হয় তার রুদ্দেশ্য সামরিক কৌশলগত আধিপত্য অর্জন ছিল না। উদ্দেশ্যটা মূলতঃ ছিল পৃথিবীকে জানিয়ে দেয়া যে মুক্তিবাহিনী যুদ্ধ করছে, এবং সহজেই আঘাত হানছে শত্রুর সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যূহে।

এ সম্পর্কে খুব স্পষ্ট করে বলেছিলেন অধিনায়ক। “শহরে যুদ্ধের প্রয়োজন নেই। শত্রুকে শুধু জানিয়ে দাও যে তোমরা আছো”, দুই নম্বর সেক্টর এবং “কে” ফোর্সের অধিনায়ক কর্নেল খালেদ মোশাররফ সবসময় বলতেন গেরিলাদের উদ্দেশ্যসম্বন্ধে। একাত্তরের সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে ঢাকার কয়েকটি দুঃসাহসিক গেরিলা প্লাটুন কে প্রত্যাহার করা হয়। কারণ, এদের কিছু যোদ্ধা ধরা পড়েন শত্রুর হাতে। তখন কর্নেল খালেদ বলেছিলেন, “কাউবয় এডভেঞ্চার গেরিলা যুদ্ধ নয়। গেরিলা যুদ্ধ বীরত্ব দেখাবার জন্য নয়।”

বিবিসির ভাষ্যকারের তথ্য নির্ভুল বলা যেত যদি তিনি গেরিলার সংখ্যাকে দ্বিগুণ বলতেন। শহরকে ঘিরে থাকা গেরিলাদের প্রতি নির্দেশ ছিল, যা-ই হোক, মাথা তুলবে না প্রয়োজন ছাড়া। ঢাকার পুরোনো যে দলটা কে প্রত্যাহার করা হয়েছিল তারাও নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ‘ক্র্যাক’ নাম নিয়ে ঢাকার পাশের ত্রিমোহনী, গোরানবাহিরদা অঞ্চলে ঘাঁটি করে। কর্নেল খালেদ আশা করতেন নভেম্বর মাসে মেজর হায়দার কে দিয়ে ঢাকা শহরে মিরাকল দেখাবেন। সে জন্যই মেজর হায়দার তাঁর প্রিয় দলটাকে অনেকদিন ক্যাম্পে আটকে রেখেছিলেন। অক্টোবরে কর্নেলঅখালেদ আহত হলে পুরো দায়িত্ব মেজর হায়দারের উপরে এসে যায়। তাই মেজর হায়দার নভেম্বরে ঢাকায় আসতে পারেননি।

মে মাসে ঢাকা শহরে একটা গোপন কথা প্রবাদের মত লোকের মুখে মুখে ফিরত, “ক্যাপ্টেন হায়দার আসছেন।” কথা টা মেজর হায়দার কে জানানো হলে তাঁর চোখে মুখে অদ্ভুত আনন্দ, প্রত্যয় দেখা যেত। বলতেন, “আমি যাব।” কিন্তু তাঁর পক্ষে আসা সম্ভব ছিল না। কারণ গেরিলা অ্যাকশনের অধিনায়ক ছিলেন তিনি। সকাল ৬ টায় ঘুম থেকে উঠে ছেলেদের শিক্ষা দেয়া, ব্রিফ করা, গাড়ি করে বাংলাদেশের ভেতরে তাদের নামিয়ে দেয়া তাঁর দৈনন্দিন কর্মসুচী ছিল। তিনটার আগে ঘুমাতে পারতেন না।

২নং সেক্টরের বৈশিষ্ট্য ছিল তাঁর নিজস্ব ট্রেনিং ক্যাম্প। ভারতের সাথে চুক্তি হবার আগেই মেজর হায়দার কাঠালিয়া তে কুমিল্লার কিছু ছেলেকে ট্রেনিং দিয়ে ঢুকিয়ে দেন দালাল হত্যার জন্য। ঘরের বিভীষণকে আগে শেষ করা প্রয়োজন। তারপর প্রথম ব্যাচের শিক্ষা দেয়া হয় নবীনগরে, পরে মেলাঘরে। এদেরকে নিখুঁত গেরিলা হিসাবে তৈরী করার জন্য নানাভাবে ট্রেনিং দেয়া হত। সুবিধে ছিল এই যে, মেজর ছিলেন কমান্ডো বাহিনীর লোক।

নভেম্বর মাস থেকেই ঢাকায় গেরিলারা তৎপরতা বৃদ্ধি করে। ‘মানিক গ্রুপ’ সাভার অঞ্চলে আর এদিকে ‘ক্র্যাক’। ‘ক্র্যাক’রা এসেই বাংলাদেশের পতাকা তুলে দিয়েছিল স্থানীয় পাঠশালায়, যেখানে তাঁরা থাকত। এই পতাকাকে কেন্দ্র করে পাক হানাদারেরা আক্রমণের চেষ্টা করে ব্যার্থ হয়। হেলিকপ্টারে করে কমান্ডো নামানোর চেষ্টা করেও পারেনি। পুরো রূপগঞ্জ থানা তখন গেরিলা ক্যাম্পে পরিণত হয়েছে। শীতলক্ষ্যা পাড় ধরে মিল্গুলোতে ছিল আর্মি বাংকার। তারা গেরিলা আক্রমণে আস্তে আস্তে কেটে পড়তে আরম্ভ করে। ঢাকায় যখন ৩রা ডিসেম্বরে ভারতীয় বিমান এয়ারপোর্টে বোম্বিং করে তখন ঢাকার লোক শহর ত্যাগ করে। এই শহরত্যাগীরা বাসাবো এবং পরে ভাঙ্গা ব্রীজটা পার হয়েই বাংলাদেশের পতাকা আর অস্ত্র নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের দেখে অবাক হয়ে যায়।

বিমান আক্রমনের রাতে গেরিলারা সব পজিশন নিয়ে ছিল। কারণ, রাতে বিমান আক্রমণে বিভিন্ন অংশ থেকে পাক আর্মি এবং রাজাকারেরা প্লেনের উদ্দেশ্যে রাইফেল ফায়ার শুরু করে। গেরিলারা প্রথমে ভাবে, চারিদিক থেকে পুরো অঞ্চলটা ঘেরাও করা হচ্ছে। কিন্তু পরমুহূর্তে আকাশে প্লেন দেখে বুঝে নেয় ব্যাপারটা কি।

এর ভেতর ঢাকা শহরের উপর ‘ক্র্যাক’ প্লাটুন বড় কিছু করেনি। কিন্তু যেদিন বেতারে সপ্তম নৌ-বহরের কথা বলা হলো তার পরদিন দু’জন গেরিলাকে পাঠিয়ে দেয়া হলো আমেরিকান সেন্টার উড়িয়ে দিতে। ঢাকা শহরে হানাদারদের নাকের ডগায় আমেরিকান সেন্টার উড়িয়ে দেয়া হয়।

এদিকে গুল টেক্সটাইল মিলের শত্রুবাংকার আক্রমণ করা হয়। বাইরে থেকে শত্রুর রি-ইনফোর্সমেন্ট ঘটে। পুরো এলাকা নিয়ে যুদ্ধ হয়। শত্রুরা ২৭ টি লাশ রেখে পালিয়ে যায়। গেরিলারা বৃহত্তর আক্রমণ প্রতিরোধের বূহ্য রচনা করে। এ সময় ঢাকা থেকে দাঙ্গার সম্ভাবনার কথা আসে। কিছু গেরিলা শহরে চলে স্টেনগান নিয়ে দাঙ্গা প্রতিরোধ করার জন্য। এদিকে শহর থেকে বেরোবার প্রত্যেকটি পথে অ্যামবুশ পেতে রাখা হয়। প্রত্যেকটা মুক্তিবাহিনীর গ্রুপই এসব অ্যাম্বুশে অংশ নেয়। দু’একটা সিভিলিয়ান গাড়ি করে বিচ্ছিন্নভাবে প্রত্যাবর্তন করতে দেখা যায় শত্রু অফিসারদের। শহ্রে পালিয়ে আসছিল তারা। তারাই ফাঁদে পড়ে। পাক হানাদারদের নিশ্চল হয়ে যেতে দেখেই গেরিলা রা বুঝেছিল যুদ্ধ করার ক্ষমতা আর তাদের নেই। যুদ্ধ শেষ হলো বলে।

এগারই ডিসেম্বর খবর আসে ভারতীয় বাহিনী তারাবোর কাছাকাছি এসে গেছে। এর পরই এসে পড়েন ক্যাপ্টেন মালেক ২ নং সেক্টরের ট্রূপ নিয়ে। তিনি সিদ্ধান্ত নেন নারায়ঙ্গঞ্জ রোডের পাশে স্লটার হাউজের শত্রুবুহ্য তিনি আক্রমণ করবেন। কিন্তু সকালে খবর এলো শীতলক্ষ্যার উপর সেকেণ্ড বেঙ্গল রেজিমেন্ট প্রতিরক্ষা বুহ্য রচনা করেছে। সমস্ত মর্টারের মুখ এদিকে, গেরিলারা মনে করে বোধহয় শত্রুর আক্রমন এদিক থেকেই ঘটবে। শহর আর শীতলক্ষ্যার মধ্যবর্তী অঞ্চলের সব গেরিলা হয় আরো সামনে আসে অথবা লক্ষ্যার ওপারেই চলে যায়। অবস্থা  বুঝে সেকেণ্ড বেঙ্গল রেজিমেন্ট বালু নদী পর্যন্ত অগ্রসর হয়।

১৩ ডিসেম্বর তারিখে মেজর হায়দার একা একা পৌঁছান, রূপগঞ্জ এলাকায় ‘এস’ ফোর্সের অধিনায়ক কর্নেল শফিউল্লাহর সাথে তার দেখা হয় লক্ষ্যার তীরে।

কর্নেল শফিউল্লাহ মেজর হায়দার কে জিজ্ঞেস করেন, “হায়দার, তোমার ছেলেরা এখানে এভাবে ঘোরাফেরা করছে কেন?”

মেজর হায়দার বলেন, “স্যার, এরা ন’মাস ধরে এখানেই আছে, এদের সব চেনা।”

মানুষের সাথে মিশে যুদ্ধ করেছে গেরিলারা। প্রত্যেকটা ঘরে ছিল তাঁদের ঠাঁই। লোকের বিশ্বাস তাদের আত্মবিশ্বাস দিয়েছে শত্রুকে প্রতিহত করার। গ্রামবাসিরা তাদের ভেতর জাগিয়ে  দিয়েছে দায়িত্ববোধ।

এক সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ আক্রমণ গেরিলারা করতে পারেনি। মেজর হায়দার কে সঙ্গে পেয়েও নতুন আক্রমণে পরিকল্পনা রচনার সময় পায়নি, দরকার হয়নি বলে।

১৬ই ডিসেম্বর দুপুরে দশটা হেলিকপ্টার উড়ে যাচ্ছিল একসঙ্গে। নিয়মতান্ত্রিক জৌলুসে, অহংকারে। গেরিলারা হঠাৎ বিহবল হয়ে পড়ল। তারপরই ফেটে পড়ল উল্লাসে। চারিদিক থেকে সবাই ঢুকে পড়ল শহরে, নিজের ইচ্ছায়, স্বাধীনতায়।

———————————————————-

<, ১৬.১১, ৪৯২-৪৯৪>

ঢাকায় গেরিলা অপারেশন

প্রতিবেদন- মোঃ জহিরুল হক

(১৬ ডিসেম্বর ১৯৭৩ সালে ‘দৈনিক মর্নিং নিউজ’-এ প্রকাশিত ‘Guerilla operation in Dhaka’ শীর্ষক প্রতিবেদনের অংশ)

(অনুবাদ)

১৯৭১ জুলাইয়ে প্রথম সপ্তাহে আমাদের বীর মুক্তিবাহিনী দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান শুরু করে।এমন কি গেরিলারা (মুক্তিবাহিনী নামে ভালো পরিচিত) ঢাকা শহরেও অভিযান শুরু করে, যা পাকিস্তানিদের শক্তিশালী অভেদ্য দূর্গ ছিলো।

কিন্তু শহরে অপারেশন এর মাধ্যমে তারা আধিপত্য অর্জন করতে পারেনি। বরং বিশ্ব বাসীর কাছে এটা উপস্থাপন করা গেছে যে গেরিলারা প্রাণপনে পৃথিবীর একটি প্রশিক্ষিত ও শক্তিশালী বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছিল। গেরিলারা ২ ভাগে ভাগ হয়ে গেলো।

১৯৭১ এর সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে কিছু গেরিলা প্লাটুন বিভিন্ন অপারেশনের সময়ে আটক বেশ কিছু গেরিলা কমান্ডো কে মুক্ত করে নিয়ে আসে। গেরিলা কমান্ডারের আদেশ ছিলো যে গেরিলাদের কোন হদিস এবং পরিকল্পনা ও কর্মসূচি সংক্রান্ত কোন তথ্য যাতে কেউ জানতে না পারে। অপারেশনের সময় শত্রু বাহিনীর হতে ধরা পড়া কিছু অকুতোভয় গেরিলা হাসিমুখে মৃত্যু কে মেনে নিয়েছিলো কিন্তু কোন তথ্য প্রকাশ করেনি।

মেজর খালেদ মোশারফ কে ট্রান্সফার করা হয় গোরান-বাহিরদা থেকে নিয়ে আসা গেরিলা প্লাটুনে, যারা ঢাকার আশে পাশে রাজাকারদের উপর বেশ কয়েকটি অপারেশন চালায়। আগস্ট 1971 থেকে গেরিলারা শহরের মধ্যে তাদের আক্রমণ শানিত করে, যার ফলে পাকিস্তানিরা কি করতে হবে ভেবে না পেয়ে হতবিহব্বল হয়ে পড়ে। তারা বুঝতে পারেনা গেরিলারা কিভাবে এসে আক্রমণ করে আবার পালিয়ে যায়। ক্র্যাক প্লাটুন শহরে কিছু সফল অপারেশন সম্পন করে। তাদের মূল কাজ ছিলো পুলিশের চেকপয়েন্টে  হামলা, পাওয়ার স্টেশন ও পেট্রোল পাম্প উড়িয়ে দেওয়া সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বিস্ফোরণ ঘটানো। ক্রাকপ্লাটুনের অন্যতম প্রধান একটি কাজ ছিল  শহরের মানুষের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করা যাবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হয়। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনী  দেশের বাইরে প্রচার করতে থাকে যে পূর্ব পাকিস্তানে সব কিছু স্বাভাবিক রয়েছে।

ক্রাকপ্লাটুনের আদেশককৃত অপারেশন এর মধ্যে রামপুর পাওয়ার স্টেশন উড়িয়ে দেয়া, হোটেল পূর্বানি ও ইউএসআইএস লাইব্রেরিতে বিস্ফোরণ, তাঁতারী বাজার এলাকায় রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ ও যাত্রাবাড়ীতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষ অন্যতম। শুরুদিকে ক্রাকপ্লাটুন যখন ঢাকায় আসে তখন তাদের সদস্য সংখ্যা ছিলো মাত্র ১৭ জন। কিন্তু পর্যায় ক্রমে সেই সংখ্যা ১৪০ গিয়ে পৌঁছায়। ৩০ জন ক্রাকপ্লাটুনের ৯ জন গেরিলা পাকিস্তানিদের হাতে ধরা পড়ে। এদের মধ্যে ৭ জন নিহত হয়। নিহতরা হলেন হাফিজ, জুয়েল, বদি, আজাদ, বাকি, রুমী ও আলতাফ।

ক্রাকপ্লাটুন সারা শহর কে অন্ধকারে নিমজ্জিত করে ফেলার জন্য রামপুরা পাওয়ার স্টেশন উড়িয়ে দেয়। কিন্তু তার ফলে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয় যা অর্থনীতির উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলে।

১৬ জুলাই ১৯৭১ রাত ৯ টার সময় ক্রাকপ্লাটুনের ৬ জন গেরিলা রামপুরায় অবস্থিত শহরের সবচেয়ে বড় পাওয়ার স্টেশন উড়িয়ে দেয়ার কাজ শুরু করে। তারা সাথে করে ২০ পাউণ্ড প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ, ডেটোনেটর এবং ফিউজ নিয়েছিলো। এই অল্প কয়েকজন গেরিলা খুব ভালো ভাবে অপারেশনটি সম্পন্ন করলো। পাওয়ার স্টেশনের গেটে পৌঁছে তারা বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে পুলিশ এবং গার্ডদের রাইফেল কে ফাঁকি দেয়। একই সময় একজন কমান্ডো টেলিফোন লাইন বিচ্ছিন্ন করে দেয়। তারা গার্ডের থেকে চাবি ছিনিয়ে নেয় এবং অস্ত্রের মুখে অন্য গার্ড এবং পুলিশদের রুম দেখিয়ে দিতে বাধ্য করে। তারা ১৭ জন পুলিশকে বন্দি করে এবং অপারেটরকে বাধ্য করে তাদের কে ট্রান্সফর্মার রুমে নিয়ে যেতে। ট্রান্সফরমার রুমে গেরিলারা এক্সপ্লোসিভ বসিয়ে ট্রান্সফরমার উড়িয়ে দেয়।

১৯৭১ এ নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ২ জন গেরিলা কলাবাগানে আর্মি ভ্যানের উপর এক দুঃসাহসিক অপারেশন চালায়। গেরিলা ২ জন যখন রিক্সাওয়ালার ছদ্মবেশ ধারণ করে রিক্সা নিয়ে কলাবাগান থেকে আসছিলো, তখন তারা দেখতে পেলো একটা পাকিস্তানি মিলিটারি ভ্যান তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। তারা তাড়াতাড়ি রিক্সা থেকে নেমে রিক্সায় লুকানো অস্ত্র বের করে নেয়। মিলিটারি ভ্যান তাদের কাছাকাছি আসলে গেরিলারা গুলি শুরু করে, এতে ভ্যানের ড্রাইভার বাদে সবাই মারা পড়ে।

ঢাকায় গেরিলা অপারেশন যখন তীব্র রূপ নিয়েছিল তখন সেনাবাহিনীর কার্যত রাতের বেলায় ব্যারাকের বাইরে আসতো না। গেরিলারা দিনে দুপুরে বক্সীবাজার মেডিকেল কলেজ হোস্টেল গেটে হামলা চালায় এবং ২ জন রাজাকারকে হত্যা করে।এছাড়াও নারায়ণগঞ্জ ভিক্টোরিয়া হাসপাতালের দায়িত্বে থাকা ৫ জন রাজাকারকেও গেরিলারা হত্যা করে।

হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে কর্তৃপক্ষ কঠোর নিরাপত্তা বিধান করলেও গেরিলারা সেখানে বিস্ফোরণ ঘটায়। হোটেলের হামলা করার কারণ হলো, হোটেলে অবস্থান করা বিদেশীরা যাতে বুঝতে পারে পাকিস্তানিরা দেশের অবস্থা সম্পর্কে যা বলেছে তা মিথ্যা প্রোপাগান্ডা ছাড়া আর কিছুই নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবন, এসএসসি পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে সিদ্ধেশ্বরী হাইস্কুল সহ বায়তুল মোকাররম এবং বাণিজ্যিক এলাকা মতিঝিলের বেশ কিছু স্থানেও বোমা হামলা করা হয়। বাইতুল মোকাররম এবং মতিঝিল এলাকায় করা বোমা হামলা বেশ কার্যকর হয়েছিলো। এতে সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে এবং শহর ছাড়তে শুরু করে। বিশ্ববিদ্যালয় এবং স্কুলে বোমা বিস্ফোরণের পর থেকে ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষালয়ে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। ক্রাকপ্লাটুনের গেরিলারা যাত্রাবাড়ীতে সম্মুখযুদ্ধে পাকবাহিনীর বহু সৈনিক খতম করে এবং যাত্রাবাড়ীর ব্রিজ উড়িয়ে দিয়ে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের যোগাযোগ ব্যবস্থা অচল করে দেয়।

বিজয় যত ঘনিয়ে আসে ততই গেরিলাদের অপারেশন তীব্রতর হতে শুরু করে।অক্টোবর থেকেই তারা তাদের অপারেশন বৃদ্ধি করে। একই সময়ে মানিক প্লাটুন সাভারে সক্রিয় ছিলো এবং সেখানে তারা কয়েকটা অপারেশন সম্পন্ন করে। এই প্লাটুন ওই এলাকায় নভেম্বর মাসে একটা স্কুলের বিল্ডিং এর প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে। নভেম্বর মাসে গেরিলারা রূপগঞ্জ থানা নিজেদের দখলে নেয় এবং সেখানে নিজেরদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে।

৪ ডিসেম্বর পাকিস্তান  ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে, ভারত গেরিলা বেষ্টিত ঢাকায় ঢাকায় ভারতীয় ফাইটার দিয়ে সব দিক থেকে আক্রমণ শুরু করে। প্রায় ৮০০০ গেরিলা সারা শহর সক্রিয় ছিল। গুল টেক্সটাইল মিলসে গেরিলারা শত্রুদের বাংকারে হামলা চালিয়ে ২৭ সৈন্যকে হত্যা করলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সেই এলাকা থেকে পিছু হটে। ১১ ডিসেম্বর ক্যাপ্টেন মালেক তার বাহিনীসহ তারাবোতে পৌঁছেন, ১৩ ডিসেম্বর মেজর হায়দার রূপগঞ্জ আসেন এবং শীতলক্ষ্যার তীরে মেজর শফিউল্ল্যাহর সাথে দেখা করেন। মেজর শফিউল্ল্যাহ “এস” ফোর্সের কমান্ডার ছিলেন। এদিকে কাদের সিদ্দীকির গেরিলা বাহিনী টাঙ্গাইল শত্রুমুক্ত করার পর ঢাকার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। কারণ ঢাকা গেরিলাদের সহায়তা ছাড়া মুক্ত হতে পারতো না। গেরিলারা পাকিস্তানিদের মনোবল ভেঙ্গে দিয়েছিলো এবং বুঝিয়ে দিয়েছিল যে তাদের পতন আসন্ন।

———————————————

(৯, ১৫.১১, ৪৯৪)

স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে রংপুরের স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহৃত কোডসমূহঃ

(রংপুর জেলার পলাশবাড়ী হতে সংগৃহীত)

পাকবাহিনী              -R.F

পাঞ্জাব রেজিমেন্টে          -P.R

বেলুচ রেজিমেন্ট           -B.R

রাজাকার বাহিনী          -R.F

লাইট মেশিনগান          -LMG

ভারী মেশিনগান          -HMG

মর্টার                        -MG

জয়পুরহাট               -৩য় বাড়ী

পাঁচবিবি                -২য় বাড়ী

হিলি                         -১ম বাড়ী

ক্যাম্প                        -বাড়ী

ট্রেঞ্চ                         -কুঠুরী

কর্নেল                        -বড়কর্তা

ব্রিগেডিয়ার                     -বড় ভাই

মেজর                        -মেজ ভাই

ক্যাপ্টেন                -ছোট ভাই

বিহারী                        -NB

গোলাগুলি               -রাগারাগী

DIB                         -টিকটিকি

পশ্চিম   পাকিস্তানী               -লাল ককুর

India-pak Border         -বেড়া

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!