You dont have javascript enabled! Please enable it!
শিরোনাম সূত্র তারিখ
১। ঢাকার সশস্ত্র প্রতিরোধের বিবরণ বাংলা একাডেমীর দলিলপত্র ১৯৭১

<৯, ১.১, ১-৯>

ঢাকা সেনানিবাস ও শহরে যা ঘটেছিল

সাক্ষাৎকারঃ লেঃ কর্নেল আবু তাহের সালাউদ্দিন

(১৯৭১ সালে পালিস্তান সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগে ক্যাপ্টেন পদে ঢাকা সেনানিবাসে কর্মরত ছিলেন)

অসহযোগ আন্দোলনের সময় যেসকল ছোটখাটো গণ্ডগোল আরম্ভ হয় তাতে পাকিস্তান সরকার সম্পূর্ণরূপ আওয়ামী লীগের উপর দোষারোপ করে এবং এই দোষ দিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী সরকারের সহযোগিতায় ২৫ শে মার্চ বাংলাদেশে সীমাহীন গনহত্যা চালায়। কিন্তু এই হত্যার পরিকল্পনা অসহযোগ আন্দোলনের পূর্ব থেকে পাকিস্তান সরকার ও সেনাবাহিনী ছিল। তার কারণস্বরূপ-

যে কোন দেশে সেনাবাহিনীর সৈন্য এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় মোতায়েন করতে হলে তার মূল  জায়গা অর্থাৎ যেখানে থেকে সৈন্য পাঠান হয় সেই জায়গায় প্রতিরিক্ষার উপর প্রথম গুরুত্ব দিতে হয় এবং সেটা করতে পারলেই সেই জায়গা থেকে সরানোর আদেশ হয়। (এখানে উল্লেখ করা যায় যে, পাকিস্তান সামরিক সরকার ফেব্রুয়ারি, ১৯৭১ থেকেই এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে থাকে। তাতেই প্রমান হয় যে পাকিস্তান সামরিক সরকারের সুপরিকল্পনা ছিল)।

যেহেতু সীমান্ত এলাকায় শত্রুদেশের সৈন্যের সঙ্গে কোন ছোটখাটো গোলাগুলি বিনিময় হয়নি বা দেশের জনসাধারণ ও খবরের কাগজে যুদ্ধের কোন হুমকির আভাসও পাওয়া যায়নি তথাপি পাকিস্তান সরকারের এরূপ সৈন্য মোতায়েন (বিভিন্ন থানা পর্যায়ে) প্রমান হয় যে পাকিস্তানী সামরিক সরকার বাংলাদেশের জনসাধারনের উপর গনহত্যার পরিকল্পনা পূর্ব থেকেই করেছিল।

১লা মার্চ, ৭১ থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ জেনারেলগন বিভিন্ন সময় ঢাকাসহ বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে সম্মেলন করেন। তাদের মধ্যে কয়েকজন হলেনঃ

(১) লেঃ জেঃ টিক্কা খান, কমান্ডার ইস্টার্ণ কমাণ্ড।

(২) মোঃ জেঃ খাদেম হোসেন রাজা, জি-ও-সি, ১৪ ডিভিশন।

(৩) জেনারেল আব্দুল হামিদ খান, চীফ অব আর্মি স্টাফ।

(৪) লেঃ জেঃ এ,এ,কে নিয়াজী, কোর কমান্ডার।

(৫) মেঃ জেঃ আকবর হোসেন, ডাইরেক্ট জেনারেল, ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স।

(৬) মোঃ জেঃ ওমর,চেয়ারম্যান, ন্যাশনাল সিকিউরিটি কমিশন।

(৭) মেঃ জেঃ কমর আলী মীর্জা,প্রাক্তন ডাইরেক্টর, মিলিটারী ইন্টেলিজেন্স (তখন-ডাইরেক্টর সাপ্লাই এণ্ড ট্রান্সপোর্ট।

(৮) মেঃ জেঃ মিঠঠা খান, স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপ কমান্ডার এণ্ড কোয়ার্টার মাস্টার জেনারেল।

(৯) মেঃ জেঃ খোদা দাদ, এডজুট্যান্ট জেনারেল।

(১০) মেঃ জেঃ গুল হাসান, চীফ অব দি জেনারেল স্টাফ।

(১১) মেঃ জেঃ রাও ফরমান আলী খান, সিভিল এফেয়ার্স এডভাইজার, গভর্ণমেন্ট অব আনসারী পাকিস্তান।

(১২) ব্রিগেডিয়ার আনসারী (মেঃ জেঃ আনসারী) (স্টেশন ,ঢাকা), (পরে জি-ও-সি, ৯-ডিভিশন)।

(১৩) মেঃ জেঃ নজর হুসেন শাহ।

(১৪) মেঃ জেঃ কাজী আবদুল মজিদ।

(১৫) লেঃ  জেঃ পীরজাদা, (পি-এস-ও-টু জেঃ ইয়াহিয়া খান)।

(১৬) মেজর জেনারেল জামশেদ।

(১৭)মেঃ জেঃ বাহাদুর শের।

সৈন্য বিভিন্ন এলাকায় মোতায়েন করার পূর্বে কতকগুলো দিক চিন্তা করতে হয়, যেমন সৈন্যদের থাকা, খাওয়া, বেতন, যানবাহন,  যোগাযোগ ইত্যাদি। তাছাড়া  ডাটা, ম্যাপ ইত্যাদি করতে হয়। পঁচিশে মার্চের গনহত্যা যদি হঠাৎই হতো তাহলে পাকিস্তানি সৈন্যগন ২৫ শে মার্চে বাংলাদেশের প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় একই সাথে একই সময়ে  বাঙালি সৈন্য, ই-পি-আর, পুলিশ, আনসার, তথা জনসাধারনের উপর উপর আক্রমন ও গনহত্যা চালায় কিভাবে! এতেই প্রমান হয় যে পাকিস্তান সামরিক সরকারের পূর্ব পরিকল্পনা নিশ্চয়ই ছিল।

১৫ই মার্চ, ৭১ এ প্রেসিডেন্ট জেঃ ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ও  আওয়ামী লীগ নের্তৃবর্গের সঙ্গে রাজনৈতিক সমস্যা, ক্ষমতা হস্তান্তর, অসহযোগ আন্দোলন  প্রভৃতি সম্পর্কে প্রেসিডেন্ট হাউসে (বর্তমান গনভবন) এবং বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সভায় আলোচনা করেন। অপরদিকে রাতের অন্ধকারে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে উপোরোল্লিখিত জেনারেলদের সঙ্গে গোপন বৈঠক চলত।

যেহেতু আর্মি  ইন্টেলিজেন্স এ ছিলাম ও সাধারণ পোশাকে কর্তব্য পালন ও চলাফেরা করতাম, সেজন্যই আমি পাকিস্তান সামরিক সরকারের কার্যকলাপ অনুসরণ করতে পারি।

২৫শে মার্চের পূর্বেই তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান সেনাবাহিনী তে যে সমস্ত উচ্চপদস্থ বাঙালি অফিসার ছিলেন, তাঁদেরকে বিভিন্ন অজুহাতে তাঁদের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। কয়েকজন বাঙালি অফিসারসহ কিছু বাঙালি সৈন্য পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠায়। পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত পাঞ্জাবী সৈন্যদের সঙ্গে যে সমস্ত বাঙালি সৈন্য ছিলেন তাঁদেরকে নিরস্ত্র করা হয়। বেঙ্গল রেজিমেন্টের সকল সৈন্যকে সীমান্ত এলাকায় প্রেরণ করে ভারতের হুমকির অজুহাতে।

যেসকল বাঙালি অফিসারকে স্ব স্ব পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় ও কয়েকজনকে অন্য পদে দেওয়া হয়, তাদের পরিচয় যথাক্রমেঃ

(১) মেজর (বর্তমানে কর্নেল) খালেদ মোশাররফ, চীফ অব জেনারেল স্টাফ, বাংলাদেশ আর্মি। তিনি ছিলেন ৫৭-ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারের (ঢাকা) ব্রিগেড মেজর (ব্রিগেড মেজরের কাজ হচ্ছে ব্রিগেডের অপারেশন প্লান করা এবং পরিচালনা করা)। মেজর খালেদ মোশাররফকে পাঠায় কুমিল্লা ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টে এবং তদস্থলে একজন পাঞ্জাবী অফিসারকে নিয়োগ করে।

(২) ব্রিগেডিয়ার মজুমদার।  তিনি চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের কমান্ডান্ট ছিলেন।তাঁকে ২২শে মার্চ ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে আসা হয় এবং গৃহবন্দী অবস্থায় রাখা হয়।তার সঙ্গে ছিলেন ক্যাপ্টেন আমিন আহমেদ চৌধুরী। ক্যাপ্টেন চৌধুরী (বর্তমানে মেজর)  বর্তমানে বাংলাদেশ ১৬-বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমাণ্ড’র।

(৩) লেঃ কঃ মাসুদুল হাসান খান। তিনি ২য় বেঙ্গল রেজিমেন্টে জয়দেবপুরে ছিলেন। তাঁকে ২২শে অথবা ২৩শে মার্চ ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে আসে এবং তাকেও গৃহবন্দী করে এবং তার স্থলে লেঃ কঃ রকিবকে জয়দেবপুর ২য় বেঙ্গল রেজিমেন্টে পাঠায়। কারণ লেঃ কঃ রকিব ৩২-পাঞ্জাব রেজিমেন্টেই ঢাকায় ২৫শে মার্চের রাতে গনহত্যা চালায়। এছাড়াও কয়েকজন বাঙালি অফিসারকে ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় রাখা হয়। তাদেরকে বাইরের যোগাযোগ থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত করা হয়।

বেঙ্গল রেজিমেন্টকে কয়েকটি ক্যান্টনমেন্ট থেকে সীমান্ত এলাকায় মোতায়েন করা হয়। যেমন,  প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টকে যশোর ক্যাণ্টনমেন্ট থেকে চৌগাছা (সীমান্ত এলাকা) পাঠায়। ২য় বেঙ্গল রেজিমেন্টকে জয়দেবপুর থেকে তাদেরকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য একব কোম্পানী পাঠায় টাঙ্গাইল। উক্ত কোম্পানীর কমান্ডার ছিলেন মেজর শফিউল্লাহ (বর্তমানে ব্রিগেডিয়ার-চীফ অব বাংলাদেশ আর্মি)। অন্য একটি পাঠায় ময়মনসিংহে। উক্ত কোম্পানীর কমান্ডার ছিলেন মেজর নূরুল ইসলাম (বর্তমান লেঃ কর্নেল)।

সৈয়দপুরে অবস্থিত ৩য় বেঙ্গল রেজিমেন্টকে কয়েক ভাগে বিভক্ত করে সীমান্ত এলাকায় পাঠায়। কুমিল্লায় অবস্থিত ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্ট কে পাঠায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। উক্ত রেজিমেন্টের কমান্ডার ছিলেন মেজর (বর্তমান কর্নেল) খালেদ মোশাররফ। ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট ছিল চট্টগ্রামে। তাদেরকে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠানোর আপ্রান চেষ্টা করে ব্যার্থ হয়ে চট্টগ্রাম শহর ও বন্দর এলাকায় মোতায়েন করে। ১০ম বেঙ্গল রেজিমেন্টকে (ন্যাশনাল সার্ভিস ব্যাটেলিয়ন, যার অধিকাংশই ছাত্রদের নিয়ে গঠিত হয়েছিল) ২৫শে মার্চের পূর্বেই ঢাকায় নিরস্ত্র করে। এছাড়াও ৬০৪ ফিল্ড ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের প্রায় ২৫ জন বাঙালিকে (যার সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ড ছিলাম আমি নিজেই) নিরস্ত্র করা হয়। শুধুমাত্র আমার অস্ত্রটা নিতে তারা সাহস করে নাই। তাছাড়া ঢাকায় অবস্থানরত নিম্নপদের সৈন্যগন যেমন সিগনাল রেজিমেন্ট, ইঞ্জিনিয়ার ব্যাটালিয়ন, ৬০৪ কম্বাইণ্ড ওয়ার্কশপ, ১৪৭ ইনফ্যানট্রি ওয়ার্কশপ, সাপ্লাই এণ্ড ট্রান্সপোর্ট ব্যাটালিয়ন, স্টেশন সাপ্লাই ডিপো, গাজীপুর অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরী,  কম্বাইণ্ড অর্ডন্যান্স ডিপো, স্টেশন সাপ্লাই ডিপো, ট্রানজিট ক্যাম্প,ফিল্ড এম্বুলেন্স ও পাকিস্তান বিমান বাহিনীর সমস্ত সৈন্যদেরকে অতি কায়দায় ও চালাকি করে নিরস্ত্র করে। বাঙালিকে কেন নিরস্ত্র করা হচ্ছে পাঞ্জাবীরা তার কারণস্বরূপ  দেখায় যে, যারা বাঙালি তারা বাঙালি আইন-শৃংখলা ভঙ্গকারী জনগনের উপর গুলি চালাতে সক্ষম হবে না। জনগনের উপর গুলি চালাতে আমাদের মায়া-মমতা লাগা স্বাভাবিক।  কাজেই পাঞ্জাবীদের হাতে অস্ত্র কম থাকায় আমাদের অস্ত্র নিয়ে আইন শৃংখলা স্বাভাবিক ও আয়ত্তে আনার চেষ্টা করবে- এই কারনে আমাদের কাছ থেকে অস্ত্র নিচ্ছে।

অসহযোগ আন্দোলন চলাকালীন শাহেদ নসরুল্লাহ (ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র)  আমার অফিসে প্রায়ই দেখা করত ও আমার নিকট থেকে খবরাখবর নিত। শাহেদ নসরুল্লাহ এভাবে আসা যাওয়া করাতে আমাকে আমার অফিসার কমান্ডিং মেজর মনোয়ার হোসেন জিজ্ঞাসা করেন যে ছেলেটি কে এবং কেন আসে। আমি আমার আত্মীয় বলে পরিচয় দেই এবং জানাই যে,  যেহেতু আমাকে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হতে দেয়া হয় না সেজন্য আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে। পরে একদিন  শাহেদ নসরুল্লাহ  যখন আমার অফিস থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল তখন রাস্তায় মেজর মনোয়ার হোসেনের হাওলাদার মোঃ আশরাফ তার ফটো তুলে নেয়।

পরদিন নসরুল্লাহ আমার নিকট এসে হাওলাদার কর্তৃক তার ফটো তোলার কথা জানায়। আমি নসরুল্লাহকে সাহস দিয়ে বলি ওতে কিছু হবে না। এরপর পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভূট্টো যখন ঢাকায় আসে তখন শাহেদ ছাত্রনেতাদের নের্তৃত্বে একটি ছাত্র ও গনবিক্ষোভ মিছিল হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে পৌঁছে এবং ভূট্টো কে নিন্দা করে বিভিন্ন শ্লোগান দেয়। ঐ মিছিলে শাহেদ নসরুল্লাহর শ্লোগান দেওয়া ফটোটি  ‘দি পিপল’ পত্রিকায় দেখা যায়। পিপল পত্রিকায় নসরুল্লাহর ফটো দেখা মাত্র মেজর মনোয়ার হোসেন আমাকে ডেকে বলেন, যে ছেলেটি তোমার নিকট আসে ও তোমার আত্মীয়, সে তো একজন ছাত্রনেতা সে ছেলেটি মিছিলে নের্তৃত্ব দিয়েছিল। তিনি পিপল পত্রিকাটির কপি এনে আমাকে দেখান। তখন আমি মেজর মনোয়ার হোসেন কে জানাই যে আমি সঠিক কিছু বুঝতে পারছি না, সে তো কোনদিন ছাত্ররাজনীতি করতো না। এর থেকে মেজর মনোয়ার হোসেন আমাকে আরও বেশী সন্দেহের চোখে দেখেন।

এরপর ১৫ই মার্চ থেকে ২৩শে মার্চ পর্যন্ত ইয়াহিয়া খানের ঢাকা আগমন ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানসহ আওয়ামী লীগ ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার অগ্রগতির কথা শুনে আমরা কিছুটা আশাবাদী ছিলাম যে তারা সম্ভবত আওয়ামী লীগকে শান্তিপূর্ণ ভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে। আমরা বাঙালি অফিসাররাও পাঞ্জাবীদের মতিগতিকে তেমনভাবে লক্ষ্য করতাম না আওয়ামী লীগ ক্ষমতা পাবে মনে করে (আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক জনাব তাজউদ্দীনের প্রেসনোটের উপর ভিত্তি করে)।

২৩শে মার্চ প্রদেশব্যাপী ছাত্র ও গণহত্যার প্রতিবাদে ঢাকায় প্রত্যেক বাঙালির ঘরে ঘরে বাংলাদেশের পতাকা ও কালো পতাকা উত্তোলিত হয় এবং ২৪শে মার্চ সকালে পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির প্রেসিডেন্ট ওয়ালী খানসহ আরও কয়েকজন পশ্চিম পাকিস্তানী রাজনৈতিক নেতার ঢাকা ত্যাগ করে যাওয়ায় আমাদের মনে সন্দেহ হয় এজন্য যে, হয়তবা আলোচনা মোটেই ফলপ্রসূ হয় নাই।

২৫শে মার্চ আমি আকস্মিকভাবে বিকেল চারটায় ক্যান্টনমেন্ট থেকে বাইরে চলে যাই আত্মীয়স্বজনের সাথে দেখা করতে। দুর্ভাগ্যবশত শহর থেকে আমার মেসে ফিরতে রাত প্রায় ৯টা বেজে যায়। আমি ক্যান্টমেন্টে এসে সোজা আমার কক্ষে না গিয়ে ডাইনিং হলে যাই। খাওয়ার টেবিলে পাঞ্জাবী অফিসাররা  উপস্থিত ছিল। খাবার পরে সাড়ে ন’টায় আমার কক্ষে যাই। সেখানে সিপাই মোশাররফ হোসেন (বাঙালি)  আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। আমাকে দেখেই সে আমার নিকট ছুটে আসে এবং জানায় যে, সে আমার জন্য বিকেল ৪টা থেকে অপেক্ষা করছে। একথা বলেই সে সঙ্গে সঙ্গে তার পকেট থেকে ছোট এক টুকরো কাগজ বের করে আমার হাতে দেয়।

উক্ত চিঠিখানা লিখেছিলেন ৩১-ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারীর ক্যাপ্টেন (বর্তমান মেজর) খুরশীদ আলম চৌধুরী।  তিনি লিখেছিলেন, ৩১-ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারীর কমান্ডিং অফিসার কর্নেল জাহেদ হাসান ঐদিন (২৫ শে মার্চ) বেলা আড়াইটায় নির্দেশ দিয়েছেন অদ্য রাতে (২৫ শে মার্চ) তার রেজিমেন্ট কে শহরে যাবার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। শহরে আইন-শৃংখলা রক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে বলে জানান এবং আরও বলেন যে যদিও শান্তি-শৃংখলা রক্ষা করার শহরে যাওয়া হবে তবু একটা যুদ্ধের প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ সঙ্গে নিতে হবে। আরও বলেছিলেন যে, তার নির্দেশের পর কোন বাঙালি অফিসার বা জোয়ানরা রেজিমেন্ট এলাকা থেকে কোনক্রমেই বাইরে যেতে পারবে না (তখন থেকে যতক্ষন পর্যন্ত রেজিমেন্ট শহরের উদ্দেশ্যে বের না হয়)। উক্ত ক্যাপ্টেন  খুরশীদ আলম চৌধুরীর পক্ষে আমার নিকট চিঠিখানা এজন্যই পাঠানো সম্ভব হয়েছিল যে, তার রেজিমেন্ট এলাকা ও আমার মেস পাশাপাশি জায়গায় ছিল,মাঝখানে শুধু কাঁটাতারের বেড়া।

চিঠিখানা আমার হস্তগত হওয়ার পর আমি কিছুক্ষন অস্বস্তি বোধ করি। এমতবস্থায় কি করা কর্তব্য সে চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়ি এবং আমার সমস্ত শরীর ঘামতে থাকে। গভীর চিন্তার পর আমার পাশের কক্ষের বন্ধু ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট  মুস্তাফিজুর রহমান (তিনি আর্মি ইঞ্জিনিয়ার্সের ক্যাপ্টেন এবং বিমান বাহিনীর সঙ্গে ডেপুটেশনে ছিলেন এবং সেখানে সহকারী গ্যারিসন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করতেন)  এর নিকট যাই। মুস্তাফিজুর রহমান আমার একান্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন এবং আমরা দু’জনে মাঝে মাঝে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির উপর আলোচনা করতাম। তাঁকে ক্যাপ্টেন খুরশীদ আলম চৌধুরীর চিঠিখানা সম্বন্ধে জানাই। দু’জনে কিছুক্ষণ চিন্তা করে শহরে গিয়ে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নের্তৃবর্গকে এ খবর পৌঁছানোর সিদ্ধান্ত নেই। শেখ কামালের বিশিষ্ট বন্ধু শাহেদ নসরুল্লাহকে (ধানমন্ডীর বাসায়) প্রথমে খবর দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। কেননা শাহেদ নসরুল্লাহকে খবর দিলে সঙ্গে সঙ্গে শেখ  কামালের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিকট এ খবর অতিশীঘ্র পৌঁছাবে। মুস্তাফিজুর রহমান বললেন, তার কয়েকজন ভাই, যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল (বর্তমান সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ও বিভিন্ন হলে রয়েছে, তাদেরকেও এ খবর জানালে ছাত্ররাও প্রস্তুতি নিতে পারবে। এই সিদ্ধান্ত  নিয়েই আমরা দু’জন তার নিজস্ব টয়োটা গাড়িতে শহরে রওনা হই (রাত প্রায় দশটা)। যখন আমাদের টয়োটা গাড়ী ৩১-ফিল্ড রেজিমেন্টের গেটে পৌঁছে তখন আমরা দেখতে পাই যে,  ৩১-ফিল্ড রেজিমেন্টের গেট দিয়ে চীফ অব আর্মি স্টাফের পতাকাসহ ৪ তারকাবিশিষ্ট একখানা স্টাফ কার বের হচ্ছে। উক্ত গাড়ীতে জেঃ আব্দুল হামিদ খান, চীফ অব আর্মি স্টাফ, পাকিস্তান আর্মি এবং জেনারেল টিক্কা খান, কমান্ডার ইস্টার্ণ কমাণ্ড ছিলেন। উক্ত গাড়ীর পিছনে প্রায় ৫০/৬০ খানা খোলাগাড়ী ছিল। কয়েকটি গাড়ীতে ভারী মেশীনগান লাগানো, কয়েকটি গাড়ীতে রিকয়েললেস রাইফেল লাগানো, কয়েকটি বড় বড় ট্রাকে পুরো যুদ্ধের পোষাক ও অস্ত্রসহ সৈন্য ছিল। আমরা রাস্তা নির্দেশের উলটোপথ দিয়ে তাদেরকে পিছনে ফেলে আগে চলে যাই। তখন শহরে লোকজন স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করছিল। প্রথমে আমরা ধানমন্ডি ২৬ নং সড়কে শাহেদ নসরুল্লাহর বাসভবনে গিয়ে বিস্তারিত জানাই এবং শেখ কামালের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর নিকট আমাদের খবর  পৌঁছানোর কথা বলি। এছাড়া তাকে (নসরুল্লাহ)  তার বাসা থেকে অন্যত্র চলে যাবার পরামর্শ দেই। কেননা মেজর মনোয়ার হোসেনের নিকট তার তুলে দেওয়া ফটো ও দি পিপল পত্রিকায় প্রকাশিত ফটো ছিল। আমাদের কথা শুনে শাহেদ নসরুল্লাহর পিতা খুবই চিন্তায় পড়েন। কিছুক্ষন পর আমরা মুস্তাফিজুর রহমানের ভাই ও আত্মীয়স্বজনকে খবর দেয়ার জন্য মোহাম্মদপুরে যাই। তাদেরকেও আমরা বিস্তারিত খবর জানাই এবং সতর্ক হওয়ার জন্য অন্যান্য বন্ধুবান্ধব এবং আত্মীয়স্বজনকে খবর পৌঁছাতে বলি। সেখান থেকে আমরা ক্যান্টনমেন্ট ফিরে আসার পথে ফার্মগেট ছাত্রদের একটা বিরাট মিছিলের মাঝে পড়ি। ছাত্ররা ফার্মগেটে প্রতিবন্ধকতা (ব্যারিকেড)  সৃষ্টি করেছিল যেন শহরে সৈন্যবাহিনীর যে সমস্ত গাড়ী গিয়েছে তারা ক্যান্টনমেন্টে ফিরে আসতে না পারে। আমরা যখন মিছিলের মাঝে পড়ি তখন কয়েকজন  ছাত্র আমাদের পরিচয় জানতে চায়। আমি সেনাবাহিনীর পরিচয় না দিয়ে বাঙালি ও সাধারণ মানুষ,  গুলশানে বাসা আছে বলে জানাই। তখন তারা আমাদের গাড়ী চলার জন্য একটু জায়গা পরিস্কার করে দেয় (তখন রাত প্রায় এগারটা)। ব্যারিকেড অতিক্রম করার পরই আমরা দেখলাম সেনাবাহিনীর ৪ খানা মেশিনগান লাগানো গাড়ী (বাতি নিভানো) কয়েকজন সৈন্য ফার্মগেটের দিকে ঠেলে নিচ্ছে। আমাদের গাড়ী একটু থামালাম। গাড়ী কয়েকখানা ফার্মগেটের কাছাকাছি গিয়েই ছাত্রদের উপর গুলি চালাতে শুরু করে। ফলে সঙ্গে সঙ্গে বেশকিছু ছাত্র ও সাধারণ মানুষ সেখানেই মারা যায়। তারপর আমরা ক্যান্টনমেন্টে আমাদের মেসে ফিরে আসি। কিছুক্ষন পর আমি আমাদের চট্টগ্রামের বাসায় আমার পিতার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলি এবং জানতে পারি যে চট্টগ্রামেও পশ্চিমা সৈন্যরা শহরে নিরীহ জনসাধারণের উপর নির্মমভাবে গুলি করছে এবং হত্যাকাণ্ড শুরু করেছে। আমার পিতার সঙ্গে কথা শেষ করেই আমি ঢাকায় ধানমন্ডিতে আমার মামা এডভোকেট জনাব আবু তাহের চৌধুরীকে টেলিফোন করি ও তাকে ঢাকা ও চট্টগ্রামে পাঞ্জাবী সেনাবাহিনী কর্তৃক গনহত্যার খবর জানাই। রাত বারটা পর্যন্ত টেলিফোন যোগাযোগ ছিল, তার পরই আমাদের কানে অসংখ্য গুলির আওয়াজ আসে। মীরপুর,  গুলশান ও এয়ারপোর্ট এলাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় গোলাগুলির আওয়াজ ও দাউ দাউ করে আগুন জ্বলতে দেখি। এসময় পুরোদমে পাঞ্জাবীরা নিরীহ ঘুমন্ত জনসাধারণের উপর আক্রমণ করে মেশিনগান দিয়ে নির্মমভাবে গনহত্যা শুরু করেছে। এভাবে সারারাত গনহত্যা চালায়। শেষরাতে সেনাবাহিনী ক্যান্টনমেন্ট থেকে ট্যাঙ্ক  নিয়ে শহরে আক্রমন চালায় এবং অসংখ্য বোমা বিস্ফোরণের আওয়াজ পাই। এভাবে আমি, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মুস্তাফিজ, ক্যাপ্টেন এনামসহ আরো কয়েকজন চিন্তায় থাকি ও অনিদ্রায় রাত কাটাই।

আমাদের বিল্ডিং-এ পাঞ্জাবী মেজর পীর কমরউদ্দিন (জি-এইচ-কিউ ফিল্ড ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের অফিসার কমান্ডিং ছিলেন) সকালে ঘুম থেকে উঠেই তার বিছানাপত্রসহ সমস্ত কিছু গুছিয়ে নিয়ে যখন চলে যাচ্ছিলেন তখন আমরা তাকে জিজ্ঞেস করি, কোথায় যাচ্ছেন? তিনি বলেন, তিনি অফিসে যাচ্ছেন এবং অফিসেই থাকবেন। মেজর কমর পাঞ্জাবী হলেও আমার একজন বিশিষ্ট বন্ধু এবং একই সাথে ইনটেলিজেন্স কোর্স করি। আমার আত্মীয়স্বজনের অনেকেই তাকে চিনতেন। তিনি চলে যাবার সময় অকথ্য ভাষায় আমাদেরকে কতগুলি কটুক্তি করেন ও আওয়ামী লীগকে গালিগালাজ করেন। আমাদেরকে সন্দেহ করে কিংবা ভয় করেই হয়তবা তিনি চলে যান। তার এরুপ কটুক্তি ও গালাগালিতে আমরা সবাই ধারনা করি যে অন্যান্য পাঞ্জাবী অফিসারও বোধ হয় বাঙালি অফিসার ও সৈন্যদের সঙ্গে অনুরূপ দুর্ব্যাবহার করেছে।

২৬শে মার্চ সকাল সাতটায় আমি আমার অফিসে যাই। মেজর মনোয়ার হোসেনসহ মেজর ফারুকী ও মেজর মীর্জা উপস্থিত ছিলেন। তারা খুব আনন্দ ও হাসাহাসি করছিলেন এবং অতি খুশীতে মিষ্টি খাচ্ছিলেন। মেজর মনোয়ার হোসেন আওয়ামী লীগের পতন ও  বাঙালিদের দমন করার কথায় মেতে ছিলেন।তারা আমাকেও মিষ্টি  খেতে বলেন। তখন আমি অত্যন্ত অস্বস্তি বোধ করছিলাম। আমার মিষ্টি খাওয়ার ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও একটা মিষ্টি খেলাম, তারপরই আমি শহরে আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করার জন্য মেজর মনোয়ার হোসেনের নিকট কয়েক ঘন্টার জন্য বাইরে যাবার অনুমতি চাই। কিন্তু তিনি আমাকে বাইরে যাওয়া থেকে বঞ্চিত করেন এবং বলেন,  শহরে অনেক বাঙালি দুস্কৃতিকারী মারা গেছে। যেহেতু তুমি বাঙালি,  কাজেই তাদের মৃতদেহ দেখে তুমি স্বাভাবিকভাবেই সহ্য করতে পারবে না, কাজেই তোমাকে এখন বাইরে বা শহরে যাবার অনুমতি দিতে পারি না। আমি অফিসে প্রায় দু’টা পর্যন্ত বসে রইলাম। এসময় ইউনিটের বেশ কয়েকজন বাঙালি সৈন্য আমার নিকট এসে শহরে ভয়াবহ পরিস্থিতির খবর জানায় এবং এমতাবস্থায় তাদের কি কর্তব্য তা আমার নিকট হতে জানার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে। আমি তাদেরকে কিছুটা সান্ত্বনা দেই ও আরও কিছু সময়ের জন্য ধৈর্য সহকারে অপেক্ষা করতে বলি। তারপর আড়াইটার সময় আমি আমার মেসে খেতে যাই এবং খাবার পরে কক্ষে প্রবেশ করলে আমার সিপাই মোশাররফ (যার নিকট একটা স্টেনগান থাকত) আমাকে জানায় যে তার নিকট থেকে পাঞ্জাবীরা স্টেনগানটি নিয়ে  নিয়েছে। সিপাই মোশাররফের কাছ থেকে স্টেনগান কেড়ে নেয়ায় আমার একটু ভয় হয় এবং অত্যন্ত চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়ি। তার পরই আমাদের পাশের বাড়িতে মেজর মওলার (বাংগালী-১৪৯ ইনফ্যানট্রি ওয়ার্কশপের কমান্ডিং অফিসার) নিকট গিয়ে স্টেনগান কেড়ে নেয়ার কথা জানাই এবং আমরা যারা বাঙালি ছিলাম সবাই নিরাপত্তার কথাও বলি। আমার কথা শুনে মেজর মওলা বলেন,  বাঙালিদেরকে পাঞ্জাবীরা মারবে না – মারতে পারে না। কিন্তু তবু আমরা তিন – চারজন অফিসার রাতে তার বাসায় থাকা ও ঘুমানোর কথা বলি এবং আরও জানাই যে আমাদের ঘুমের সময় একজন অফিসার রাতে সবসময় পাহারা থাকবে। তিনি রাজি হলেন। আমি, ক্যাপ্টেন এনাম এবং মুস্তাফিজ ও মেজর ইকবাল তার বাসায়ই থাকি। কিন্তু সারারাত গুলির আওয়াজ এবং মীরপুর, গুলশান এলাকায় আগুন লাগানো দেখে আমাদের মোটেই ঘুম হয় নি।

২৭শে মার্চ, সকাল সাড়ে সাতটায় আমি অফিসে গেলে দেখতে পাই যে, তিনটা ই-পি-আর ট্রাক অসংখ্য রাইফেল ও অস্ত্রশস্ত্র (অস্ত্রগুলোতে অনেক লাল রক্ত লাগানো দেখতে পাই) নিয়ে ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় ঢুকছে। আমার অফিসের অফিসের অনেক বাঙালি সিপাই আমাকে জানায় যে, ই-পি-আর ক্যাম্প এবং রাজারবাগ পুলিশ ক্যাম্পে পাঞ্জাবীরা নিষ্ঠুরভাবে আক্রমন করে এবং বহু ই-পি-আর ও পুলিশকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। এসময় আমি আমার শহরের আত্মীয়স্বজনের কোন খবরাখবর না পেয়ে খুবই চিন্তায় পড়ি এবং আমি মেজর মনোয়ার হোসেনকে কঠোরভাবে জানাই যে,  যে কোন প্রকারে  হোক আমাকে অন্তত আধ ঘন্টার জন্য শহরে যেতে হবে। পরে মেজর মনোয়ার হোসেন আমাকে শহরে যাবার অনুমতি দেন।  অনুমতি পাওয়ার পর আমি সকাল দশটার সময় এম, এম দৌল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারকে (জি-২ ইন্টেলিজেন্স হেড কোয়ার্টার,  ইস্টার্ণ কমাণ্ড) সঙ্গে নিয়ে জীপে শহরে চলে যাই।

সেদিন সকাল দশটা বিকাল ৬ টা পর্যন্ত কোন কারফিউ ছিল না। আমরা যাবার পথেই দেখলাম অসংখ্য নরনারী শহর ছেড়ে বাইরে চলে যাচ্ছে। এয়ারপোর্ট এলাকা পার হবার পর আমরা স্বচক্ষে যা দেখলাম তা হলোঃ

ফার্মগেটের পরে আওলাদ হোসেন মার্কেটের সমস্ত কাঁচা ঘরবাড়ি এবং দোকানপাট (কমপক্ষে ৬০/৭০ টি) জ্বালিয়ে দিয়েছে।

ইস্কাটন রোডে আমার ভগ্নিপতি জনাব এস, আর, খান (সেকশন অফিসার, মিনিস্ট্রি অব ইনফরমেশন) এর বাসায় যাই। সেখানে তাদের মুখে শুনতে পাই যে ঐ এলাকায় পাঞ্জাবীরা ২৫শে ও ২৬শে মার্চ রাস্তায় বাঙালি যাদেরকেই পেয়েছে তাদের সবাইকে জঘন্যভাবে হত্যা করে রাস্তার আশেপাশে মাটিতে চাপা দিয়েছে। ইস্কাটন রোড থেকে বের হয়ে যখন আমরা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের কাছে পৌঁছালাম তখন ডানদিকে দি পিপল পত্রিকার অফিস দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে এবং অসংখ্য মৃত লাশ পড়ে রয়েছে এবং  অনেক লাশ আগুনে জ্বলছে।  ঐ রাস্তা দিয়ে রাতে ট্যাংক চালানো হয়েছে। ট্যাংকের চেইন এর ছক তখনো রাস্তায় ছিল।

সেখান থেকে আমরা হাতিরপুলে মেজর দৌল্লাহ সাহেবের বাসায় যাই। সেখানে মেজর দৌল্লাহ সাহেবের ছোট ভাই জনাব জনাব আসফউদ্দৌল্লাহ (বর্তমান জয়েন্ট সেক্রেটারী, ওয়ার্কস) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইকবাল হল,  জগন্নাথ হল ও স্টাফ কোয়ার্টারে ঢুকে পাঞ্জাবীরা কিভাবে জঘন্যভাবে ছাত্র ও শিক্ষকদের হত্যা করেছে তার বিবরণ দেন (২৫শে ও ২৬শে মার্চ জনাব আসফউদ্দৌলাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্টাফ কোয়ার্টারে তার শ্বশুর ভূগোল বিভাগের অধ্যক্ষ ডঃ নফিজ আহমেদের বাসায় ছিলেন)। জনাব আসফউদ্দৌলাকেও পাঞ্জাবীরা হত্যা করার চেষ্টা করে কিন্তু ডঃ নফিস তাঁকে রক্ষা করেন। হাতিরপুল এলাকায়ও আমরা কিছুকিছু বাড়িঘর ভস্মীভূত দেখি এবং কয়েকটি লাশ রাস্তায় দেখতে পাই।

হাতিরপুল থেকে আমরা ধানমন্ডি ১৪ নং সড়কে আমার মামা এডভোকেট আবু তাহের চৌধুরীর বাসায় যাই। মামার মুখে শুনতে পাই যে সেখানেও পাকিস্তানী বর্বর সেনাবাহিনীর সৈন্যরা বহু লোককে গুলি করে হত্যা করেছে এবং নারী ধর্ষন করে, কতিপয় মেয়েকে গাড়ীতে তুলে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে গেছে।

মামার কাছে থেকে বিদায় নিয়ে আমরা নিউ মার্কেট হয়ে ইকবাল হলে রওনা হই। নিউ মার্কেটে বাজার সম্পূর্ণ ভস্মীভূত অবস্থায় দেখি। আজিমপুর হয়ে যখন আমরা রেল ক্রসিং এ পৌঁছি তখন সেখানে বেশ কিছু সংখ্যক লাশ দেখতে পাই। ইকবাল হলের গেটে ঢোকার পর মাঠের মধ্যে আমরা ১১ জনের মৃতদেহ একই লাইনে পড়ে রয়েছে দেখতে পাই। প্রত্যেকের চেহারাই ছাত্র বলে ধারনা হলো। হলের সমস্ত দরজা জানালার কাঁচ ভাঙ্গা অবস্থায় দেখি এবং দেয়ালে ট্যাংকের গোলা দাগ ও গর্ত দেখা যাচ্ছিল। হলের মধ্যে ঢুকে কয়েকটি কক্ষে তাজা লাশ পড়ে থাকতে দেখি।

এ সময় বহু লোক হলের ভেতরে ঢুকে মৃত লাশগুলি দেখছিল। হল থেকে বের হবার সময় মাঠের মধ্যে কয়েকটি বিরাট গর্ত দেখতে পাই। জনসাধারণের মুখে শুনতে পাই যে, বহু ছাত্রকে হত্যা করে ঐ সমস্ত গর্তে কবর দেয়া হয়েছে। ইকবাল হল থেকে বের হয়ে রাস্তা দিয়ে যাবার সময় এস এম হলের দেয়ালেও ট্যাংকের অনেক গোলার দাগ দেখতে পাই। এরপর আমরা জগন্নাথ হলের ভিতরে প্রবেশ করি। সেখানেও  ইকবাল হলের মত একইভাবে মৃত লাশ ও গর্ত করা কবর দেখতে পাই। সেখানে কয়েকজন ছাত্র ও লোকের মুখে ডাঃ জি সি দেবসহ শিক্ষক, ছাত্র ও রোকেয়া হলে নারী ধর্ষণের করুণ কাহিনী শুনতে পাই।

জগন্নাথ হল থেকে বের হয়ে রোকেয়া হলের পাশ দিয়ে রেসকোর্স অতিক্রম করার সময় রেসকোর্সের মাঝখানে অবস্থিত হিন্দু মন্দিরটি সম্পূর্ণ ধ্বংস অবস্থায় দেখি। হিন্দু মন্দিরে যে সমস্ত  হিন্দু নরনারী  ছিল তাদেরকে হত্যা করা হয় এবং তাদের কয়েকটি মৃতদেহ আমরা রাস্তা থেকেই দেখতে পাই।

রেসকোর্স থেকে হাইকোর্ট হয়ে গুলিস্তান এলাকায় যাই। গুলিস্তান থেকে নওয়াবপুর রোডে অনেক বাড়িঘরে আগুন জ্বলতে দেখি। আমরা গভর্ণর হাউস (বর্তমান বঙ্গভবন) দিয়ে দৌল্লাহ সাহেবের এক ভাইয়ের বাসায় (উয়ারী) যাই। সেখানেও তার নিকট পাক হানাদার বাহিনী কর্তৃক নিরীহ জনসাধারণের উপর অত্যাচার ও গনহত্যার কাহিনী শুনি। সেখান থেকে ইত্তেফাক অফিসে আগুন জ্বলতে দেখি। তারপর আমরা পুরানা পল্টনে আওয়ামী লীগ অফিসের সম্মুখে অফিসের সমস্ত কাগজপত্র রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখি এবং কিছু কিছু কাগজ বা অন্য কিছু পোড়া দেখতে পাই। আওয়ামী লীগ অফিস থেকে মতিঝিল হয়ে আমরা রাজারবাগ পুলিশ ক্যাম্পের সম্মুখে যাই। তখন প্রায় বিকেল তিনটা বাজে। সেখানে ইঞ্জিনিয়ার্স এর মেজর এনামের মুখে আমরা রাজারবাগ পুলিশ ক্যাম্পের যে বিস্তারিত ঘটনা জানতে পারি তা হলোঃ

২৫শে মার্চ রাত বারোটার সময় বর্বর পাক হানাদার বাহিনীর সৈন্যরা পুরা যুদ্ধের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে রাজারবাগ পুলিশ ক্যাম্পের চতুর্দিক থেকে অতর্কিত হামলা করে গুলি চালায়। পুলিশরাও বীরত্বের সাথে নিজেদের আত্মরক্ষার্থে পাল্টা গুলি চালায়। এভাবে সারারাত উভয় পক্ষ যুদ্ধ চালায়। এবং যুদ্ধে যখন পাক বাহিনী কোনক্রমেই পুলিশ দলের সঙ্গে জয়লাভ করতে পারছিল না তখন ভোর চারটার সময় পাক হানাদার বাহিনী ট্যাংক নিয়ে আক্রমন চালায়। ট্যাংকের আক্রমনও বীর পুলিশ ভাইয়েরা প্রতিহত করে। ২৫শে মার্চ সারারাত ২৬শে মার্চ বিকাল ৪টা পর্যন্ত এক নাগাড়ে পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে পুলিশ ভাইয়েরা প্রচণ্ড যুদ্ধ করে।

বিকাল চারটার পর পুলিশ বাহিনীর গোলাবারুদ প্রায় শেষ হয়ে যায় এবং প্রায় সাতশ পুলিশ ভাই শহীদ হন। প্রায় সাড়ে তিনশ আত্মসমর্পন করেন। বাকি সবাই পালিয়ে যেতে সক্ষম হন।যে সমস্ত পুলিশ ভাই শহীদ হন তাদের লাশ পাঞ্জাবীরা পুলিশ ক্যাম্পের মাঠে বিরাট গর্ত করে কবর দেয়। মেজর এনামের মুখে বিস্তারিত খবর নিয়ে আমরা পিলখানা ইপিআর ক্যাম্পে যাই। সেখানে পাক হানাদার বাহিনী পিলখানার চতুর্দিকে ব্যারিকেড সৃষ্টি করে রাখায় আমরা কিছুই দেখতে পারিনি। সেখান থেকে আমরা বিকাল চারটার সময় ক্যান্টনমেন্টে ফিরে আসি।

ক্যান্টনমেন্ট পৌঁছে আমি গোছল করি। বিকাল ৫ টার সময় আমার নায়েক সুবেদার ফজলুল করিম আমাকে জানায় যে, সেক্রেটারিয়েট অফিসের কয়েকজন পদস্থ কর্মচারী ৩ টা বাসে পরিবারসহ ময়মনসিংহ সড়ক দিয়ে ময়মনসিংহ যাবার সময় (তাদের অধিকাংশই ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইলের অধিবাসী) পাঞ্জাবী ১৩-এফ-এ রেজিমেন্টে সৈন্যরা কুর্মিটোলা রেল স্টেশনের সম্মুখে যেখানে আর্মি ব্যারিকেড সৃষ্টি করেছিল সেখানে উক্ত বাস ৩ টা বাস থামিয়ে বিবাহিত ও অবিবাহিত যুবতী মেয়েদেরকে এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে রাখে এবং  যুবক ও বয়স্ক স্ত্রী পুরুষদের মারধর করে তাদের বাস ছেড়ে দেয়। পরে মেয়েদেরকে ক্যান্টনমেন্টে ১৯-সিগনাল ব্যাটালিয়নে নিয়ে যায়। এবং পরস্পর শোনা যায় যে সেখানে মেয়েদেরকে ধর্ষন ও অত্যাচার করছিল। এ খবর পাবার পর আমি লেঃ কর্নেল তাজ মোহাম্মদকে জানাতে যাই। লেঃ কর্নেল তাজকে না পেয়ে লেঃ কর্নেল সিনওয়ারীর (জিএসও-১ ইনটেলিজেন্স, জেড কোয়ার্টার, ইস্টার্ণ কমাণ্ড) নিকট যাই। তাকে না পেয়ে ১৪ ডিভিশন হেড কোয়ার্টার অফিসার মেসে  যাই। সেখান থেকে টেলিফোনে মেজর হাজী মোঃ কেয়ানীকে (জি-২ ইনটেলিজেন্স ১৪ ডিভিশন) নারী ধর্ষন ও অত্যাচারের কথা জানাই। আমার কথা শুনে মেজর হাজী কেয়ানী সাহেব অত্যন্ত দুঃখ প্রকাশ করে বলেন যে তার করার কিছু নেই। কেননা ইতিপূর্বেও তিনি অনুরূপ কয়েকটি ঘটনার কথা শুনেছেন। তিনি বলেন, এ সমস্ত জঘন্য কার্যকলাপের জন্য কয়েকজন অফিসারই দায়ী। এবং বর্তমানে পরিস্থিতি এমন এক পর্যায়ে গিয়েছে যা তার পক্ষে বা অন্য কোন অফিসারের পক্ষেও আয়ত্ত্বে নেওয়া সম্ভব নয়। কেননা কতিপয় অফিসারের দোষেই সৈন্যরা বেশী প্রশ্রয় পেয়েছে। তিনি আমার কঠোর মনোভাব বুঝতে পেরে আমার নিকট তার অক্ষমতা প্রকাশ করে ক্ষমা চান এবং আরও বলেন যে, আমি যেন লজ্জাজনক কথা বলে তাঁকে গুনাহগার না করি। মেজর হাজী মোঃ কেয়ানী সাহেবের সঙ্গে টেলিফোনে কথা শেষ করে আমার মেসে ফেরার পথে শহীদ আনোয়ার বালিকা বিদ্যালয় প্রাঙ্গনের এক ব্যাটালিয়ন কমান্ডোর উপস্থিতিতে লেঃ জেঃ টিক্কা খানের ভাষন শুনতে পাই। তখন বিকাল সাড়ে ছটা। সন্ধ্যা সাতটার সময় আমার নায়েক সুবেদার ফজলুল করিম দুজন পাঞ্জাবীসহ জীপে আমার মেসে আসে। ফজলুল করিম আমাকে জানায় যে পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ।তাকে নির্দেশ দিয়েছে সার্ভে অব পাকিস্তান-এ (বর্তমান সার্ভে অব বাংলাদেশ) গিয়ে চট্টগ্রামের মানচিত্র আনতে। আমি তাকে চুপে চুপে বললাম আমার ইউনিটে যে সমস্ত বাঙালি রয়েছে তাদের সবাইকে পালিয়ে যেতে। এবং ফজলুল করিম আমাকে জানাল যে তার সাথে দুইজন পাঞ্জাবী রয়েছে কাজেই সে কি করে পালাবে। আমি তাকে মানচিত্র নিয়ে আসার পর সুযোগ মত দেখা করতে বললাম। ফজলুল করিম চলে যাবার পর আমি চিন্তা করতে লাগলাম যে হঠাৎ এক ব্যাটালিয়ন কমান্ডোর একত্রে উপস্থিত হওয়ার কারণ কি থাকতে পারে এবং শেষ পর্যন্ত এই ধারনা হলো যে, তাদেরকে হয়তো বা কোথাও পাঠানো হচ্ছে এবং সেভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছে। তারপর চট্টগ্রামের মানচিত্র সংগ্রহের কথা শুনে পুরোপুরি বিশ্বাস হলো যে,  চট্টগ্রামের যুদ্ধে পাকিস্তানী সৈন্যরা বোধ হয় আমাদের বাঙালিদের নিকট পরাজিত হয়েছে এবং সে জন্যই মানচিত্রের সাহায্যে রাতে প্যারাসুটে তাদেরকে চট্টগ্রামে পৌঁছাবে। ইতিপূর্বে সন্ধ্যা সাতটার সময় ক্যাপ্টেন এনামের কক্ষে রেডিওতে আমরা চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রে মেজর জিয়াউর রহমান (বর্তমান ব্রিগেডিয়ার) এর ভাষন শুনতে পাই। বেতারে মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর পক্ষ থেকে বাংলার স্বাধীনতা ঘোষনা করেন এবং সমস্ত বাঙালি সেনাবাহিনীর সদস্য, ইপিআর, বিমান বাহিনী, পুলিশ বাহিনী ও জনসাধারণকে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাদেরকে চিরতরে এদেশ থেকে নির্মূল ও খতম করার আহবান জানান। এবং তিনি নিজেকে মুক্তিযুদ্ধের সিইনসি ঘোষনা করেন।  এ খবর শোনার পর আমরা কয়েকজন অত্যন্ত আনন্দিত হই এবং অনেক মনোবল ফিরে পাই। আমরা বুঝতে পারলাম যে চট্টগ্রামে পাক বাহিনী পরাজিত হয়েছে এবং আমাদের পুরোপুরি দখল রয়েছে। এর পর থেকে আমি কিভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করব এবং কিভাবে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হয়ে গিয়ে যুদ্ধ করব সে চিন্তাই করতে লাগলাম। রাত ৯টার সময় ক্যাপ্টেন এনামের মারফত একটি ভীতিজনক খবর শুনতে পাই। সেটা হচ্ছে ৭ই ডিসেম্বর ’৭০ আমি এবং ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মুস্তাফিজ আমাদের মেসে পাঞ্জাবী অফিসারদের উপস্থিতিতে টেলিভিশনে দেশের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল দেখছিলাম। আওয়ামী লীগের পক্ষে সন্তোষজনক ফলাফলে পাঞ্জাবী অফিসাররা সকলেই কক্ষ থেকে কেটে পড়তে থাকে। ক্রমে ক্রমে সবাই কক্ষ ত্যাগ করলেও আমি এবং মুস্তাফিজ শুধু কক্ষে থাকি। রাত বারোটার সময় নায়েক পয়া খান (পাঠান) আমাদেরকে জানায় যে, মেস কমিটির সভাপতি মেজর রানার (পাঞ্জাবী)  নির্দেশমত রাত বারোটার পর টেলিভিশন অনুষ্ঠান দেখা বন্ধ করতে হবে। আমরা তাকে বুঝিয়ে বললাম যে,  সারা দেশের লোক টেলিভিশন দেখছে এমন কি প্রেসিডেন্ট স্বয়ং টেলিভিশনে নির্বাচনের খবরা খবর নিচ্ছেন সেখানে আমরা রাত বারোটার পর খবর শুনলে তেমন অসুবিধা হবে না। তাকে আরও বললাম যে, তার যদি কোন অসুবিধা হয় তবে আমরা অন্য বেয়ারা রেখে তাকে তার কর্তব্যের অতিরিক্ত পয়সা দিয়ে দেব। আমাদের কথায় কর্ণপাত না করে উক্ত নায়েক পয়া খান নিজেই টেলিভিশন বন্ধ করে দেয়। কিন্তু পরক্ষণই লেফটেন্যান্ট মুস্তাফিজ টেলিভিশন অন করে। নায়েক পয়া খান দ্বিতীয়বার টেলিভিশন বন্ধ করলে লেফটেন্যান্ট মুস্তাফিজ পুনরায় অন করে। কিন্তু পয়া খান আমাদের তোয়াক্কা না করে তৃতীয়বারও টেলিভিশন বন্ধ করে। এবারেও মুস্তাফিজ টেলিভিশন অন করতে উদ্যত হলে পয়া খান মুস্তাফিজের হাত ধরে ফেলে। তখন আমি রাগান্বিত হয়ে পয়া খানের জামার কলার চেপে ধরে উত্তম-মাধ্যম দিয়ে কক্ষ থেকে বের করে দিলে সে দৌড়ে গিয়ে একটা ছোড়া নিয়ে এসে আমাদের গালাগালি করতে থাকে যে, ‘শালা বাঙ্গাল লোককো খতম করেঙ্গে।’ এ সময় সেন্ট্রি দৌড়ে এসে তাকে ধরে সরিয়ে নিয়ে যায়। পরদিন আমি আমার অফিসার কমান্ডিং মেজর মনোয়ার হোসেনকে লিখিতভাবে এবং মেজর রানাকে মৌখিকভাবে জানাই।পরে ঘটনার তদন্ত চলে। লেঃ কঃ শরিফের সভাপতিত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির বিস্তারিত বিবৃতিতে আমাকে এবং মুস্তাফিজকেই দোষী করা হয় এবং আমাদের বিরুদ্ধে কোর্ট মার্শাল হওয়ার কথা প্রকাশ করে।

দ্বিতীয়ত, দেশের পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে আমাদেরকে হত্যা করার হুমকি দেখায়। মেজর রানা ক্যাপ্টেন এনামকে আরও বলেছিলেন যে, যেহেতু আমার আত্মীয়স্বজনের অনেকে এমএনএ ও এমপিএ এবং অনেকেই আওয়ামী লীগ সমর্থক সেহেতু আমি এবং মুস্তাফিজ দুজনই আওয়ামী লীগের সমর্থক সুতরাং আমাদের দুজনকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ভোগ করতে হবে। রাত ৯টার সময় (২৭ শে মার্চ ১৯৭১) ক্যাপ্টেন এনামের মুখে উপরোক্ত কথা শুনে আমি খুবই ঘাবড়ে যাই। কিছুক্ষন পর আমি ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালানোর সিদ্ধান্ত নেই এবং ক্যাপ্টেন এনামকেও  আমার সঙ্গে পালানোর ইঙ্গিত দেই। কিন্তু সে নেতিবাচক জবাব দেয় এবং আমার কক্ষ থেকে তার নিজ কক্ষে চলে যায়। আমি চুপ করে মুস্তাফিজের কক্ষে গিয়ে তাকে আমার সঙ্গে পালানোর কথা বলি। সে পালানোর কোনো সিদ্ধান্ত রাতে নিতে পারলো না।

———————————————-

<৯, ১.২, ৯-১০>

ঢাকা সেনানিবাসের অভ্যন্তরের কিছু কথা

সাক্ষাৎকারঃ এয়ার কমোডোর এম, কে, বাশার

২৫শে মার্চ বিকাল চারটার সময় বিশেষ বোয়িং তার নিরাপত্তা প্রহরী নিয়ে বিমান বন্দরে অবতরণ করে। বিমান বাহিনীর দুজন অফিসার (তন্মধ্যে একজন আমি ও ছিলাম) এবং একজন টেকনিশিয়ানকে বোয়েংটির কাছে যেতে দেওয়া হয়। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় সেনানিবাস থেকে টেলিফোনে নির্দেশ দেওয়া হয় বোয়িং ষ্টার্ট করার জন্য। রাত আটটায় একটা প্রাইভেট গাড়ীতে করে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান(এর গাড়ীর ড্রাইভার ছিলো একজন কর্ণেল) ঢাকা সেনানিবাস থেকে সোজা একটা বোয়িং- এ উঠে যান এবং সঙ্গে সঙ্গে বিমান চলে যায়। ঐ বিমানে প্রেসিডেন্ট একা ছিলেন। প্রেসিডেন্টের এভাবে চলে যাওয়াতে আমার ধারণা হলো যে, হয়তো জেনারেল হামিদ খান ক্ষমতা দখল করেছেন এবং ইয়াহিয়া খানকে বোয়িং-এ করে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এখানে উল্লেখ্য যে, জেনারেল হামিদ তখন ঢাকায় ছিলেন।

২৫ শে মার্চ রাতে আমি বনানীতে আমার বাসায় ছিলাম। রাত বারোটার পর ভীষণ গোলাগুলির আওয়াজ শুনতে পেলাম। ভোর রাত থেকে জনগণ বনানীর ওই পথ দিয়ে গ্রামের দিকে পালাচ্ছে।

২৭ শে মার্চ আমি অফিসে আসি। সেই সময়কার বেস কমান্ডার ছিলেন এয়ার কমোডোর জাফর মাসুদ, যিনি মিঠঠি মাসুদ হিসাবে বিমান বাহিনীতে পরিচিত ছিলেন। আমরা বাঙালি অফিসাররা তাঁর সাথে দেখা করলাম এবংদেশের এই পরিস্থিতিতে আমাদের নিরাপত্তার ব্যাপারে তার সাথে আলাপ করলাম। তিনি বললেন, নো ওয়ান উইল টাচ মাই মেন অর অফিসার বিফোর দে কিল মি’। আমরা তাকে অনুরোধ করলাম তিনি যেন সবাইকে ডেকে সান্তনা দেন। এর মধ্য ২৯ শে মার্চ সেনাবাহিনী বিমান বাহিনীর কাছে বিমান সাহায্য চেয়ে পাঠায়। তিনি সে সাহায্য দিতে অস্বীকার করেন।

৩০ শে মার্চ তিনি বেসের সবাইকে ডেকে ভাষণ দেন। তিনি বলেন, “তোমরা সবাই জান যে, সেনাবাহিনী তৎপরতা চালাচ্ছে। আমি বিমান সাহায্য দিতে অস্বীকার করেছি। কিন্তু আমি কতদিন এটা ঠেকিয়ে রাখতে পারব বলতে পারছি না। সমস্ত বাঙালি পাইলট দেরকে এই সব মিশনে যাওয়া থেকে অব্যাহতি দিচ্ছি এবং যে সমস্ত বাঙালি টেকনিশিয়ানরা এই সমস্ত বিমানে কাজ করতে চায়না তারা অনির্দিষ্ট কালের জন্য ছুটিতে যেতে পারে।”

এপ্রিল মাসের ৩/৪ তারিখে প্রথম বিমান হামলা চালানো হয় পাবনার আশেপাশে। এয়ার কমোডোরের নির্দেশ ছিলো যদি কোথাও লোক জমায়েত দেখা যায় প্রথমে যেন ওয়ার্নিং শর্ট করা হয় যাতে করে জনতা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। অপরদিকে সেনাবাহিনীর নির্দেশ ছিলো ম্যাসাকার করার জন্য। এই জন্য এয়ার কমোডোর জাফর মাসুদকে বদলি করে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়া হয় এবং চাকরী থেকে বরখাস্ত করা হয়।

এর মধ্য সমস্ত বাঙালি অফিসারকে পশ্চিম পাকিস্তানে বদলি করা হয়। আমরা ছুটি নিলাম। আমরা কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। জিয়াউর রহমানের ভাষণ আমরা শুনেছিলাম। লোকমুখে শুনলাম যে, ময়মনসিংহ এলাকায় প্রতিরোধ চলছে। তখন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মীর্জাকে খবর আনার জন্য পাঠানো হয়। সেও ঠিকমতো কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারেনি-তবে একটা থমথমে পরিবেশ সে লক্ষ্য করেছিল। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট কাদেরকে আগরতলাতে পাঠানো হয়। সে ভারতে গিয়েছিলো এবং খালেদ মোশাররফের বাহিনীর সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম হযেছিল।যখন সে ফিরে কুমিল্লা আসে তখন পাক বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। পরে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

১২ ই মে আমরা ঢাকা ত্যাগ করলাম।নরসিংদী হয়ে লঞ্চে রওনা হলাম। লঞ্চ থেকে আমরা দেখলাম যে, পাক বাহিনী একটা গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে। পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রের সাথে আমাদের দেখা হয়। সে তার বাড়ীতে আমাদের আশ্রয় দিয়েছিল।

—————————————————-

<৯, ১.৩, ১০-১১>

ঢাকা সেনানিবাসের অভ্যন্তরের আরও কিছু কথা

সাক্ষাৎকারঃ আব্দুল করিম খন্দকার
ডেপুটি চীফ অফ ষ্টাফ বাংলাদেশ ফোর্সেস

(জুন ৭১- ডিসেম্বর ৭১)

২৩ মার্চ ১৯৭১- এ পাকিস্তান দিবস উপলক্ষে ঢাকাতে এক আন্তঃসার্ভিসেস কুচকাওয়াজের আয়োজন করার কথা হয়েছিল। আমাকে সেনাবাহিনী, বিমান বাহিনী ও নৌ বাহিনীর ঐ প্যারেডের প্যারেড কমান্ডার এর দায়ীত্ব দেওয়া হয়। জাকজমকের সাথে এই অনুষ্ঠান আয়োজনের কথা ছিল।ফেব্রুয়ারী মাসের ২৬ তারিখ হঠাৎ খবর পেলাম যে প্যারেড বাতিল করা হয়েছে। আমি একটু আশ্চর্য্য হলাম। আমি আর্মি ডিভ হেডকোয়াটারে এসে কর্ণেল গীলের সাথে দেখা করলাম। সেখানে আরও কয়েকজন উচ্চ পদস্থ অফিসার ছিলেন, সবাইকে কেমন যেন এক অস্বস্তিকর অবস্থায় দেখলাম।

২৮ ফেব্রুয়ারী পশ্চিম পাকিস্তান থেকে একটা বোয়িং ঢাকা বিমান বন্দরে অবতরণ করে। সেটাতে বেসামরিক পোষাকে সেনাবাহিনীর লোকজন ছিল।

১লা মার্চ জাতীয় পরিষদের বৈঠক স্থগিত ঘোষণা করা হয়। তখন থেকে প্রত্যেক দিন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সেনাবাহিনীর লোকজন আসতে থাকে এবং প্রত্যহ এর সংখ্যা বাড়তে থাকে।

ঢাকা বিমান বন্দরে যেদিন থেকে বাঙালি কর্মচারীরা কাজে যোগ দিতে বিরত থাকে সেদিন থেকে পাক সেনাবাহিনী বিমান বন্দরের নিয়ন্ত্রন নিজেদের কাছে রাখে এবং বিমান বন্দরে পজিশন নিয়ে থাকে।

৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ দেওয়ার কথা শুনে পাকিস্তানী সৈন্যরা এক উদ্বেগজনক অবস্থায় ছিল- তিনি কি বলবেন, কি করবেন। মিটিংয়ের পরে কোন গণ্ডগোল সৃষ্টি না হওয়ায় তারা সবাই একটু আশ্বস্ত হয়। সেদিন সমস্ত সেনাবাহিনীর লোকজনকে জরুরী অবস্থা মোকাবেলার জন্য সজাগ বা সতর্ক রাখা হয়েছিল। অসহযোগ আন্দোলন শুরু হওয়ার পর তাঁরা তাঁদের সৈন্য সংখ্যা বৃদ্ধি করতে লাগলো এবং বিমান বন্দর ও সেনানিবাসের চারদিকে এনট্রেন্সড পজিশন নিতে শুরু করে। এবং বাঙালি ও পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের মধ্য সন্দেহ, অবিশ্বাস সৃষ্টি হতে শুরু হল।

বিমান বাহিনীতেও শেষের দিকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে কমান্ডোদের আনা হচ্ছিলো। এয়ারফিল্ডের বিভিন্ন জায়গায় বাঙালিদের সরিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানীদের নিয়োগ করা হয়।

২৮ মার্চ আমি এমওডিসি কমান্ডারকে ডেকে যদি পারে ছুটি নিয়ে ও অস্ত্র নিয়ে পালিয়ে যেতে বললাম। বেশ কয়েকজন এমওডিসি কমান্ডার অস্ত্র নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল।

২৮/২৯ শে মার্চ বিমান বাহিনীর স্যাবর জেটগুলোতে রকেট লাগানো শুরু হয়- কুমিল্লা, চট্রগ্রাম ও যেই সমস্ত জায়গায় প্রতিরোধ চলছে ঐ সমস্ত এলাকায় বোমা বর্ষণের জন্য। রকেট গান ফিট করার কাজে সে সময় বাঙালিরা ছিল। কিন্তু ওইদিন ওই কাজে পশ্চিম পাকিস্তানীদের নিয়োগ করা হয়। ২৯/৩০ শে মার্চ বিমান বাহিনী চট্রগ্রাম বেতার কেন্দ্রে বোমা বর্ষণের জন্য যায়। সেখান থেকে মেজর জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষনা করেছিলেন।

২৫ শে মার্চের ক্রাক ডাউন – এরপর আমি নিজেকে পাকিস্তান বিমান বাহিনীর সদস্য বলে মেনে নিতে পারছিলাম না।

আমি ২৯ শে মার্চ ছুটির জন্য দরখাস্ত করেছিলাম। দুই সপ্তাহের ছুটি দেওয়া হয়েছিল। আমি ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মারগুবের সাথে যোগাযোগ করলাম এবং ৩ রা এপ্রিল স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ভারত যাওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থার দরুণ যেতে পারিনি।

১২ ই মে তারিখে আমি, উইং কমান্ডার বাশার, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট রেজা(অবসরপ্রাপ্ত ফ্লাইং অফিসার- বদরুল আলম আগরতলাতে পৌঁছি)

—————————————————-

<৯, ১.৪, ১২>

ঢাকার পিলখানার কথা
সাক্ষাৎকারঃ মেজর দেলোয়ার হোসেন
১৯ নভেম্বর ১৯৭৩

মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহের দিকে ২২ জন বেলুচকে পিলখানাতে আনা হয়েছিলো। তাদেরকে এখানে থাকার জায়গা দেয়া হয়েছিলো। এবং পিলখানার ইপিআর’এর সাথে ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় ইন্টারনাল সিকিউরিটি ডিউটি করার জন্য ভার দেয়া হয়েছিলো। ওরা এখানে আসাতে ইপিআরদের মাঝে সন্দেহ অবিশ্বাস আরো ঘনীভূত হয়। ওরা এখানে আসাতে আমরা বুঝতে পারলাম যে হয়তো কিছু একটা ঘটতে পারে। ক্যাপ্টেন গিয়াসের সাথেও আমার এ ব্যাপারে কথাবার্তা হয়েছিলো।

২৫ মার্চ বেলা একটার সময় মেজর জামিল (পশ্চিম পাকিস্তানী, জেনারেল স্টাফ অফিসার- ইপিআর হেড কোয়ার্টার) আমাকে তার অফিসে ডেকে পাঠান। তিন ঘন্টা পর্যন্ত আমি তার অফিসে বসে অফিশিয়াল কথাবার্তা বলেছি। তারপর তিনি আমাকে বলেন যে, তোমাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। প্রহরী এসে আমাকে নিয়ে যায়।

রাত আনুমানিক ১২টার দিকে চারিদিকে গোলাগুলি শুরু হয়ে যায়। আমি অনুমান করেছি যে, ২২ বেলুচ বাঙালি ইপিআরদের উপর আক্রমণ করেছে। আমাকে যে ঘরে বন্দী করে রাখা হয়েছিলো সেদিকেও গুলি এসে পড়ছিলো। রাত তিন চারটার দিকে গোলাগুলি একটু কমে যায়। আমাদের যে সমস্ত বাঙালি ইপিআর পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলো তারা নিরাপদ জায়গায় গিয়ে গুলি ছুঁড়ছিলো। জানালা দিয়ে দেখতে পেলাম তারা অনেককে বন্দী করে নিয়ে যাচ্ছে। ২৬ মার্চেও ঠুসঠাস গুলির শব্দ শুনতে পেলাম।

২৭ মার্চ সকালে ক্যাপ্টেন আরেফ (পাঞ্জাবী) যে এই হেড কোয়ার্টারে কাজ করতো সে আমাকে এসে বললো, “ইউ আর এ গাদ্দার, ইউর আংকেল ক্যাপ্টেন রফিক ইজ অলসো এ গাদ্দার। উই আর গোইং শুট ইউ আউট বোথ।”

১৭ এপ্রিল পর্যন্ত আমাকে এখানে বন্দী অবস্থায় রাখা হয়। বন্দী অবস্থায় আমাকে অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিলো। কিন্তু কোনো নির্যাতন চালানো হয় নি। পরে আমাকে পাকিস্তান পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ঐ রাতে বহু বাঙালি ইপিআরকে হত্যা করা হয়। বন্দী অবস্থায়ও অনেককে হত্যা করা হয়।

মার্চ মাসের তৃতীয় সপ্তাহে পিলখানার বাঙালি ইপিআর’রা বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেছিলো প্যারেড গ্রাউন্ডের মাঝখানে দণ্ডায়মান বটবৃক্ষের শীর্ষে। বাংলাদেশ সেনানিবাস সমূহের মধ্যে প্রথম জাতীয় পতাকা পিলখানাতেই উত্তোলিত হয়েছিলো। ল্যান্স নায়েক বাশার এ পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। পরে তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। পিলখানায় অবস্থিত প্রায় ২৫০০ বাঙালি সৈন্যের মধ্যে মাত্র ৬ শতাধিক সৈন্য রাতের অন্ধকারে পালাতে সক্ষম হয়েছিলো। বাকি সবাই বন্দী হয় আর তাদের পাঠানো হয় নৃশংস অত্যাচার ও হত্যার বধ্যভুমি মোহাম্মদপুর বন্দী শিবিরে। পরবর্তীকালে জিসিও/এসসিও এবং সুশিক্ষিত প্রায় ৭ শতাধিক বাঙালি সৈনিককে হত্যা করা হয়েছিলো বুলেট ও বেয়নটের নির্মম আঘাতে। ঐ রাতে যারা পালাতে পেরেছিলো তাদের অনেকে স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দিয়েছিলো। তারা প্রতি এলাকায় অমিতবিক্রমে সম্মুখযুদ্ধে পর্যুদস্ত করেছিলো পাকিস্তানীদের।

বাংলাদেশের দীর্ঘ নয় মাসে এই বাহিনীর ১ হাজারের মতো সদস্য স্বাধীনতার জন্য নিজেদের মূল্যবান জীবন উৎসর্গ করেছিলো। অনেকে পঙ্গু অবস্থায় দিন যাপন করছে।

স্বাক্ষরঃ দেলোয়ার হোসেন
১৯-১১-৭৩

——————————————-

<৯, ১.৫, ১৩-১৪>

পিলখানার আরও কথা
সাক্ষাৎকারঃ মোঃ আশরাফ আলী সরদার
১২১৯৭৪

২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবস ছিল। ঐ দিন আমরা প্রস্তুত ছিলাম কোন একটা নির্দেশ পাবার অপেক্ষায়। কিন্তু দুভার্গ্যবশত কোন নির্দেশ পাই নি। তারপর ২৪শে মার্চ আমাদের নিজস্ব সিদ্ধান্তে পিলখানার প্যারেড গ্রাউন্ডের বটবৃক্ষের শীর্ষে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। এবং সে পতাকার উর্দুতে লেখা ছিল, “ পশ্চিমারা আবি বাংলা ছোড়কে ভাগ যাও, নেহি ত এধারই তোম লোগ ভাগ যাও, নেহি ত এ ধারই তোম লোগ কা কবর বানায়েগা।”

পশ্চিম পাকিস্তানীরা এ পতাকা দেখে উত্তেজিত হয়ে ওঠে এবং ঐ পতাকা নামিয়ে ঢাকা সেনানিবাসে পাঠিয়ে দেয়। এই পতাকা উত্তোলন সংবাদ সিগনালের বেতার মারফত সমস্ত সেক্টর, উইং এবং চৌকিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এবং তারাও বিকেলে খবর দিল যে তারাও পতাকা উত্তোলন করেছে। যশোর থেকে বেতারে খবর আসলো যে, সেখানকার বাঙালি ইপিআররা যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে সাময়িক সালাম (গার্ড অব অনার) দিয়ে পতাকা উত্তোলন করেছে।

২৪শে মার্চ রাতে পিলখানায় অবস্থিত সমস্ত বাঙালি ইপিআরকে নিরস্ত্র করা হয়। পশ্চিম পাকিস্তানীরা আমাদের বলে যে, শেখ সাহেবের ৭ই মার্চের ঘোষিত চার দফা ইয়াহিয়া খান মেনেছে এবং শিগগিরিই ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে। দেশে এখন শান্তি বিরাজ করছে। সুতরাং সবাই অস্ত্র জমা দিয়ে বিশ্রাম করুন।

২৫শে মার্চ বৃহস্পতিবার বিকেল পর্যন্ত আমরা পশ্চিম পাকিস্তানীদের উপোরোক্ত ভূয়া আশ্বাসে বিশ্বাস করেছিলাম। কিন্তু যখন শুনতে পারলাম যে, নরখাদক ইয়াহিয়া তার দলবল নিয়ে কোন সিদ্ধান্ত ছাড়াই ঢাকা ত্যাগ করেছে তখন আমি নায়েক সুবেদার শহীদ শামসুল হক সাহেবের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি সেদিন কোয়াটার গার্ড ডিউটি অফিসার ছিলেন। তিনি আমাকে বাইরে গিয়ে সংবাদ নিতে নির্দেশ দিলেন। তখন রাত প্রায় আটটা। আমি সরাসরি ইকবাল হলে যাই। কিন্ত সেখানে কোন ছাত্রনেতাকে পেলাম না। আমি সেখান থেকে সুবেদার শহীদ জহীরউদ্দিন মুন্সির বাড়ীতে যাই। তাকে সমস্ত বিষয় অবগত করি। তিনি আমার কথা পুরোপুরি বিশ্বাস না করে নায়েক নূর হোসেনের সঙ্গে শেখ সাহেবের বাড়ির দিকে রওনা হন। তিনি আমাকে কি করতে হবে না হবে পরে জানাবেন বলে বললেন। আমি এবং হাবিলদার শহীদ বেলায়েত হোসেন রাত এগারোটা পর্যন্ত তাদের অপেক্ষায় সিগনাল ওয়ার্কশপে বসে থাকি। আমরা দুজন আমাদের সিগনালের লোকজনকে কিছু একটা খবর আসবে বলে সর্তক করে দিয়েছিলাম। এবং ১৫ শাখার জনৈক সিপাহীকে এ সংবাদ পৌছে দেই। এছাড়া আমরা উভয়ে আমাদের অস্ত্রাগারের ভারপ্রাপ্ত এনসিও শহীদ নায়েক হাসেমকে জিজ্ঞাসা করি যে, অস্ত্রাগারের কোন ডুপ্লিকেট চাবি তৈরী হয়েছে কি না যা আগে আপনাকে বলা হয়েছিল। তিনি বললেন যে, তার কাছে ডুপ্লিকেট চাবি আছে। এই সংবাদ আমরা শহীদ নায়েক সুবেদার শামসুল হক সাহেবকে কোয়াটার গার্ডে গিয়ে জানাই। তিনি আমাদেরকে নির্দেশ দিলেন যে, কোন রকম হামলা হলে প্রত্যোকে অনতিবিলম্বে অস্ত্রাগারে চলে আসবে। এখানে আমি উপস্থিত থাকবো তোমরা লাইনে গিয়ে বিশ্রাম নাও এবং দুজন প্রহরী নিয়োগ কর। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমাদের সে সুযোগ আসে নি।

২৫শে মার্চ দিবাগত রাত ১টা পাঁচ মিনিটে প্রথম গুলির আওয়াজ হয়। আমরা প্রত্যেকেই সামরিক পোশাকে ব্যারাকে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। আমাদের প্রহরী আমাদেরকে সর্তক করে দিয়ে বলে যে, পশ্চিমারা আমাদেরকে আমক্রম করেছে। তখন আমরা সবাই পূর্ব নির্দেশ মতো অস্ত্রাগারে যাবার জন্য বের হয়ে পড়ি। কিন্ত দেখতে পেলাম গুলির আগেই তারা সমস্ত পিলখানাকে অস্ত্রাগারে যাবার জন্য বের হয়ে পড়ি। কিন্তু দেখতে পেলাম গুলির আগেই তারা সমস্ত পিলখানাকে অস্ত্রাগারসহ দখলে নিয়ে নিয়েছে। আমরা যখন বাইরে আসলাম তখন চারিদিক থেকে এলএমজি/এসএমজি ব্রাশ ফায়ার আমাদের উপর আসতে থাকে। তখন আমরা অনন্যপায় হয়ে এদিক-সেদিক দৌড়াদৌড়ি করতে থাকি। অল্প সংখ্যক পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। বাকি সবাই বন্দী হয়ে যায়। রাত ৪টার সময় আত্মসর্মপণ করায়।

৩নং গেটে কর্তব্যরত কয়েকজন বাঙালি ইপিআর পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। একজন লেফটেন্যান্টসহ ৬ জন পশ্চিম পাকিস্তানী বেলুচ রেজিমেন্টের লোক নিহত হয়। এই খণ্ড যুদ্ধে বাঙালিদের সঙ্গে কর্তব্যরত একজন পাঞ্জাবী ইপিআর মোহাম্মদ খানকেও হত্যা করা হয়। এই খণ্ড যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিল গার্ড কমান্ডার নায়েক জহিরুল হক। সে তার সহকর্মীদের নিয়ে বেড়িয়ে যেতে সক্ষম হয়। ঢাকায় অবস্থিত সিগনালের প্রধান বেতার কেন্দ্রে খবর পৌঁছে দেয়া হয় যে, উইং কমান্ডের লেফটেন্যান্ট কর্ণেল আব্দুর রহমান আওয়ান আমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছে সমস্ত বেতার যোগাযোগ বন্ধ রাখার জন্য। আমাদের কর্তব্যরত অপারেটররা সংকেতের সাহায্যে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির কথা বাইরে কর্তব্যরত সেক্টর/উইং/বিওপি পযর্ন্ত সমস্ত ইপিআরকে জানিয়ে দেন। ২৬ শে মার্চ সকাল দশটা পর্যন্ত আমাদের এইচ-এফ (হাই ফ্রিকোয়েন্সি সেট) চালু থাকে যার মাধ্যমে ২৬শে মার্চের ঘটনা নায়েক শহীদ বাশার বাইরের সবাইকে জানিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি তার শেষ সংবাদে চট্টগ্রামকে বলেছিলেন যে, আমাদের সবাই বন্দী হয়ে গেছে। হয়তো কিছুক্ষণ পর আমিও বন্দী হয়ে যাব আর নির্দেশ দেবার সময় পাবনা। তোমরা সমস্ত পশ্চিমাদের খতম কর। চট্টগ্রাম থেকে হাবিলদার বাহার উক্ত সংবাদ সীমান্তের চৌকি পযর্ন্ত পৌঁছে দেয় এবং আমাদের লোকজনকে অনুপ্রাণিত করার জন্য সে বলেছে যে, আমি ঢাকা থেকে বলছি। সম্পূর্ণ ঢাকা আমাদের নিয়ন্ত্রাণাধীন চলে এসেছে এবং ইপিআর- এর ডাইরেক্টর জেনারেল বিগ্রেডিয়ার নেসার আহমদ বন্দী হয়েছেন। তোমরা স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড় এবং সমস্ত পশ্চিম পাকিস্তানীদের বন্দী করে রির্পোট দাও।

———————————————

<৯, ১.৬, ১৪-১৫>

প্রতিরোধ যুদ্ধে রাজারবাগ পুলিশ বাহিনী

সাক্ষাৎকারঃ মোঃ আসমত আলী আকন্দ
(১৯৭১ সালের পূর্বে রাজারবাগ পুলিস রিজার্ভ অফিসের প্রোসিডিং সেকশনে এ-এস-আই হিসেবে কর্মরত ছিলেন)

এস, আই অব পুলিশ, রমনা থানা, ঢাকা
১০-১-৭৪

১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ সন্ধ্যায় আমি রাজারবাগ রিজার্ভ অফিসে কাজ করছিলাম। আমাদের রিজার্ভ অফিসের বাইরে সহস্র বিক্ষুদ্ধ জনতা বড় বড় গাছ ও ইট পাটকেল দিয়ে ব্যারিকেড তৈরী করেছিলো। সন্ধ্যার সময় এ সংবাদ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিলো যে, পাক হানাদার বাহিনী রাজারবাগ পুলিশের রিজার্ভ অফিস আক্রমণ করবে। এ সংবাদ শোনার পরে আমি রাত সাড়ে ন’টার সময় তেজগাঁও থানার কর্তব্যরত পুলিশ কর্মকর্তাকে ঢাকা সেনানিবাসে পাক হানাদারদের মনোভাব কি তা জানবার জন্য টেলিফোনে অনুরোধ করি। তিনিও পাক হানাদার কর্তৃক রাজারবাগ রিজার্ভ অফিস আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনার কথা শুনেছেন বলে জানান। এরপর আমি তেজগাঁও’এ আবার ফোন করে জানতে পারি যে, তখন পাক হানাদারদের প্রায় ৮০/৯০টি সশস্ত্র ট্রাক ও জীপ তাদের থানার রাস্তা ধরে রাজধানীতে প্রবেশ করতে তারা দেখেছেন। রাজারবাগ রিজার্ভ পুলিশের উপর পাক হানাদারদের এমন উলঙ্গ হামলার সংবাদ শুনে আমাদের আরআই একেবারে হতবাক হয়ে যান। এরপর আমরা পুলিশের রিজার্ভ অস্ত্রাগার থেকে প্রয়োজন মত অস্ত্র নিয়ে হানাদারদের শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত প্রতিরোধ এবং প্রতিহত করার জন্য রাজারবাগ পুলিশ রিজার্ভ অফিসের চারিদিকে পজিশন নিয়ে শত্রুর অপেক্ষা করতে থাকি। আমরা পুলিশ লাইনের সমস্ত বাতি নিভিয়ে চারিদিকের পরিবেশ একেবারে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে ফেলি। আমরা বাইরে অনেক দূর থেকে পাক হানাদারদের বিক্ষিপ্ত গুলিবর্ষণের শব্দ শুনছিলাম। আমরা শুধু পজিশন নিয়ে শত্রুর অপেক্ষা করছিলাম। অয়ারলেস ও টেলিফোনের সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো।

সারা শহর অন্ধকার, নীরব, নিথর ও নিস্তব্ধ। আনুমানিক মধ্যরাতে পাক হানাদারেরা প্রথম রাজারবাগ পুলিশ লাইনের হাসপাতাল গেট (দক্ষিন দিক) থেকে গোলাবর্ষণ শুরু করে। আমরা তার পাল্টা জবাব দেই। এবং পাক পশুদের প্রাণপণ প্রতিহত করার চেষ্টা করি। ওরা আমাদের লৌহকঠিন মনোবল ভেঙ্গে দেওয়ার জন্য ভারী অস্ত্র, শেল, কামান ও ট্যাংক ব্যবহার করে। আমাদের উপর সাংঘাতিকভাবে বৃষ্টির মতো গোলাবর্ষণ করতে থাকে। আমরা প্রথমে আত্মসমর্পণ করিনি এবং আত্মসমর্পণের মতো কোনো দুর্বলতাও দেখাই নি। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের উদাত্ত আহবান অনুযায়ী আমরা আমাদের যার হাতে যে অস্ত্র ছিলো তা দিয়ে সমস্ত পাক হানাদারদের প্রাণপণে প্রতিহত করার চেষ্টা করি। এবং এভাবে আমাদের সামান্য অস্ত্র নিয়ে পাক হানাদেরদের প্রাণপণ প্রতিরোধ ও প্রতিহত করে জীবনদান করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে যুদ্ধ করছিলাম। আমাদের মনোবল ভেঙ্গে দেওয়ার জন্য ওরা গভীর রাতে রিজার্ভ অফিসের উত্তর দিকে টিনশেড ব্যারাকে লাইট বোম ও পেট্রোল দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। সেখানে পাক সেনাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সৃষ্টি করেছিলো আমাদের এমন কতিপয় বীর সিপাহী নিদারুন ভাবে দগ্ধীভূত হয়ে শহীদ হন। অনেকে সাংঘাতিকভাবে আহত হয়ে সেখানেই মৃতবৎ পড়ে থাকেন। আগুনের লেলিহান শিখা ক্রমেই প্রসারিত হতে থাকে এবং সমস্ত ব্যারাক পুড়ে ভস্ম হয়ে যায়। আমরা উপায়ন্তর না দেখে ছাদের উপর গিয়ে আত্মরক্ষা করতে থাকি। সেই সাথে পাক হানাদারদের প্রাণপণ প্রতিহত করা অব্যাহত রাখি। ব্যারাকের চারিদিকে আগুনের লেলিহান শিখায় আমরা বিন্দুমাত্র দমে যাইনি। আর আমাদের মনোবল কোনো সময়ই দুর্বল হয়ে পড়েনি। ওদিকে কামান, শেল আর ট্যাংকের গর্জন ও বৃষ্টির মতো গোলাবর্ষণ চলছিলো। কামান ও শেলের প্রচণ্ড আঘাতে আমাদের কয়েকটি পাকা ব্যারাকের প্রাচীরঘেরা মটর ওয়ার্কশপ মাটিতে ধসে পড়ে। ফলে আমাদের সিপাহীরা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে নিজ নিজ সুবিধামতো স্থান গ্রহণ করে। চারিদিকে জ্বলন্ত আগুন, অবিরাম শেলিং ও কামানের গর্জনের মধ্যেও প্রাণপণে প্রতিরোধ করছিলো পাক পশুদের। আমাদের অনেক বীর সিপাহীকে প্রতিরোধ করতে করতে শহীদ হতে দেখেছি আমি স্বচক্ষে। এমনিভাবে পাক হানাদারদের প্রতিহত করতে করতে রাতের অন্ধকার কেটে যায়। ভোর হয়ে যায় এবং বেলা উঠে যায়। আমাদের গুলি প্রায় নিঃশেষ হয়ে যায় দেখে আমরা আর কোনো উপায়ন্তর পাই না। ইতিমধ্যে পাক হানাদারদের হাজারো হুমকির মুখেও আমাদের মনোবল এতটুকু দুর্বল হয়ে পড়েনি। তারা ব্যারাকে ঢুকে আমাদের বন্দী করে এবং ছাদের উপর থেকে আমাদেরকে নিচে নামিয়ে এনে বুটের লাথি ও বন্দুকের বাট দিয়ে সজোরে এলোপাতারি আঘাত করতে শুরু করে। আকস্মাৎ এক হানাদার পাক পশু হাতের বন্দুক দ্বারা আমার মাথায় সজোরে আঘাত করলে আমার মাথা ফেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত পড়তে থাকে। তৎক্ষণাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাই। তিন ঘন্টা পড়ে আমি জ্ঞান ফিরে পাই। উর্ধ্বতন কর্মকর্তা, এমআই, এএসআই, হাবিলদার, সুবেদার, নায়েক, সিপাহীসহ আমরা প্রায় দেড়শত বীর যোদ্ধাকে পাক হানাদারদের হাতে বন্দী অবস্থায় কাটাতে হয়। ১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চ থেকে ২৯ শে মার্চ পর্যন্ত সম্পূর্ণ বন্দী অবস্থায় কাটাতে হয়।

২৯শে মার্চ বিকাল সাড়ে চারটায় ঢাকার তৎকালীন পুলিশ সুপার জনাব ই.এ. চৌধুরী রাজারবাগে আমাদের পুলিশ লাইনে আসেন এবং পাক হানাদারদের মেজরের সাথে কথোপকথনের পর আমাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয় “আব তুমলোগ চালা যাও, আয়েন্দা কাল ভোর ছ বাজে মিল ব্যারাকমে তোমলোগ রিপোর্ট করেগা, আওর উহাই তোমলোগ রাহেগা- ইদার হামলোগকা জোয়ান রাহেগা।”

  • ৯ম খণ্ডের ১৫ নং পৃষ্ঠার শেষাংশে মুদ্রিত অর্থাৎ উপরের হলুদ চিহ্নিত অংশটুকু দলিলপত্রের ৮ম খণ্ডের ২২ নং পৃষ্ঠার সাথে কনফ্লিক্ট করে। আপনারা ক্রসচেক করে দেখতে পারেন।

————————————————————-

 

<৯, ১.৭, ১৫-১৬>

সাক্ষাৎকারঃ আঃ গনি তালুকদার

(১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চের স্বাধীনতা সময় রাজারবাগ (রিজার্ভ) পুলিস লাইনে ওয়ারলেস অপারেটর ছিলেন)
অফিস সহকারী (পুলিশ), রমনা থানা, ঢাকা (সদর)
৯-১-৭৪

 

সিপাহী আব্দুল খালেক খালেক, মোজাম্মেল হক, মুখলেসুর রহমান, মির্জা মহিউদ্দিন এবং আরো অন্যান্য বন্ধু ও সহকর্মীসহ আমরা ২৫ শে মার্চ রাত দশটার সময় খাওয়া-দাওয়া করে ১৪ নং ব্যারাকে বসে ছিলাম। রাত পৌনে এগারোটার সময় ঢাকা পিলখানা ইপিআর হেড কোয়াটার থেকে টেলিফোনে পাক হানাদার কর্তৃক রাজারবাগ পুলিশ রিজার্ভ ও ইপিআর হেডকোয়াটার আক্রমনের সংবাদ পাই। টেলিফোনে ইপিআর হেডকোয়াটার থেকে আমাদের সশস্ত্রভাবে পাক হানাদারদের মোকাবেলা করার জন্য থাকতে বলা হয়। আমরা আমাদের ১৪ ব্যারাকে মোট পঞ্চাশজন সিপাহী এএসআই, হাবিলদার ও সাধারণ সিপাহী উপস্থিত ছিলাম। এসংবাদ দ্রুত রাজারবাগ রিজার্ভ পুলিশের আরআই ও এসপি হেডকোয়াটারকে জানানো হয়। এ সংবাদ পেয়ে রিজার্ভ পুলিশের সকল অফিসার ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা সবাই ডিউটিতে এসে সকল সিপাহী, সুবেদার, এএসআই, এসআই, হাবিলদার সবাইকে অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিতকরে পাক হানাদারদের মোকাবেলা করার জন্য তৈরী করেন এবং প্রত্যেক ডিউটিতে মোতায়েন করেন। তৎকালীন রাজারবাগ পুলিশ লাইনের পুলিশ সুপার মিঃ শাহজাহান ও আরআই মিঃ মফিজউদ্দিন আমাদের এই সশস্ত্র প্রস্তুতিতে নেতৃত্ব দান করেন।

পুলিশ সুপার ও আরআই উভয়েই শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়ে যাবার জন্য জ্বালাময়ী ভাষায় সংক্ষিপ্ত নির্দেশ দান করে নিজ নিজ দায়িত্বে চলে যান। এরপর রাজারবাগ পুলিশ লাইনের সমস্ত বাতি নিভিয়ে দেওয়া হয়। আমরা সবাই সিপাহী, হাবিলদার, সুবেদার, এএসআই, এসআই, সবাই সশস্ত্রভাবে পজিশন নিয়ে পাক হানাদার বাহিনীর অপেক্ষা করতে থাকি। এসময় অয়ারলেস এবং টেলিফোন সবকিছু অচল করে দেওয়া হয়েছিল। রাজারবাগ পুলিশ লাইনের বাইরে সহ ছাত্র-জনতা বড় বড় গাছ লাইটপোষ্ট, ইট-পাটকেল ফেলে ব্যারিকেট তৈরী করে। রাজারবাগে প্রবেশ করার পথে পথে বহু প্রশস্ত ড্রেন কাটা হয় হানাদার বাহিনীর অগ্রগতি প্রতিরোধ করার জন্য। এভাবে প্রস্তুতি ও প্রতিরোধ তৈরী করার মধ্য দিয়ে সাড়ে এগারোটা বেজে যায়। পাক হানাদাররা রাত সাড়ে এগারোটার সময় রাজারবাগ পুলিশ লাইনে চারিদিক থেকে লাইট বোম মারতে মারতে অগ্রসর হয়। এরমধ্যে চলছিল বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ, কামান ও ট্যাংকের গর্জন। পাক হানাদার হামলার সাথে সাথে আমরা সবাই আমাদের সামান্য রাইফেল বন্দুক নিয়ে ওদের হামলার প্রাণপণ জবাব দিতে থাকি। ওরা আমাদের দৃঢ় মনোবল দেখে এরপর যুগপৎ কামান ও ট্যাংক ব্যবহার করে। আমরা টিকতে না পেরে ক্রমে পিছু হটতে থাকি। আমাদের অধিকাংশ বীর যোদ্ধা লড়তে লড়তে শহীদ হন। অনেকে দারুণভাবে আহত হয়ে মৃতবৎ সেখানেই পড়ে থাকেন। আর অনেকে আহত দেহ নিয়ে প্রাণ রক্ষা করতে সমর্থ হন। পাক হানাদার পশুরা আমাদের লৌহকঠিন মনোবল ভেঙ্গে দেয়ার জন্য এরপর রাজারবাগ পুলিশ লাইনের সকল ব্যারাকে লাইট বোমা ও প্রেট্রোল দ্বারা আগুন লাগিয়ে দেয়। আমাদের বহু আহত যোদ্ধা ঐ সকল ব্যারাকে আটকা পড়ে জলন্ত আগুনে দগ্ধীভূত হয়ে শাহাদাৎ বরণ করেন। আনুমানিক রাত তিনটার সময় অবিরাম গোলাবর্ষনের মধ্য দিয়ে আমি আমার অস্ত্র ফেলে দিয়ে আত্মরক্ষা করার জন্য ঢাকা শহরের বাইরে চলে যাই।

————————————————

<৯, ১.৮, ১৬-১৯>

সাক্ষাৎকারঃ শরীফ খান মোহাম্মদ আলী

(১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাজারবাগ পুলিশ লাইনে হাবিলদার মেজর হিসেবে কর্মরত ছিলেন)


আর্মড সাব-ইন্সপেক্টর অব  পুলিশ
বিআরপি, রাজশাহী
৩-২
৭৪

 

১৯৭১ সালের  ২৫শে মার্চ  সকাল থেকে আমাদের পুলিশ লাইনে নীরব, নিস্তব্ধ ও থমথমে ভাব বিরাজ করছিলো। স্পেশাল  আর্ম  ফোর্স-এ আমার লাইনে রাত আটটায় বাইরের কর্তব্যরত সিপাহী বাদে আমি নাম ডাকার সময় মাত্র ত্রিশজন বাঙালি সিপাহীকে উপস্থিত পেয়েছি। আমি কোন অবাঙালি সিপাহীকেই  লাইনে উপস্থিত পাইনি। ওরা সন্ধ্যার পরপরই আমার লাইন থেকে ডিউটি ত্যাগ করে কোথায় উধাও হয়ে গিয়েছিল তার কোনো হদিস পাইনি। নাম ডাকার সময় বিপুলসংখ্যক সিপাহীর এভাবে উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনা রাজারবাগ পুলিশ লাইনের ইতিহাসে আর ঘটে নি। ঢাকা জেলা রিজার্ভ লাইনের এ অবস্থা ছাড়া কেন্দ্রীয় লাইন থেকেও সেদিন সকল অবাঙালি সিপাহী তাদের পদস্থ অফিসারদের নির্দেশ ও মর্যাদা  একেবারে উলঙ্গভাবে, পুলিশের ইতিহাসে এই প্রথম , অবজ্ঞা ও উপেক্ষা করে সম্মিলিতভাবে একযোগে উধাও হয়ে গিয়েছিলো। অবাঙালি সিপাহীদের রাজারবাগ পুলিশ লাইন থেকে এভাবে উধাও হয়ে যাওয়ার পর আমরা আসন্ন বিপদের কথা বুঝতে পারি এবং আমার অধীন বাঙালি সিপাহীদের হাতে অস্ত্র দিয়ে পুলিশ লাইনের সকল প্রবেশপথে তাদেরকে কড়া প্রহরায় নিযুক্ত করি। পুলিশ লাইনের চারটি প্রবেশপথে চারজন হাবিলদারের সাথে ছয়জন করে সশস্ত্র সিপাহী মোতায়েন রাখি। আমি খুব চিন্তাযুক্তভাবে পুলিশ লাইনে টহলরত ছিলাম। আমি এক সময় দোতলা থেকে অস্ত্রাগারের সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামছিলাম। এমন সময় অস্ত্রাগারের ভিতরের টেলিফোনটি বেজে উঠলে আমার কর্তব্যরত নায়েক চিৎকার করে আমাকে টেলিফোন ধরতে বলে। আমি দৌড়ে গিয়ে টেলিফোন ধরলাম। অস্ত্রাগারের সেই টেলিফোনে এক ভীতসন্ত্রস্ত কাঁদো কাঁদো কম্পিত কণ্ঠ চাপাচাপা অস্ফুট কণ্ঠে বলছিল “মিলিটারী হেডকোয়ার্টারে বহু সশস্ত্র আর্মি ট্রাক লাইন হয়ে দাড়িয়ে আছে। ওরা এখুনি রাজধানী আক্রমণ করতে যাচ্ছে।” সেই ভীত কণ্ঠ আরো বলেছিলো- “ওদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু রাজারবাগ পুলিশ লাইন, ই-পি-আর হেড কোয়ার্টার ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইকবাল হল।“ এ কথা বলেই সেই কণ্ঠ স্তব্ধ হয়ে গেলো। “কে বলছেন? কোথা থেকে বলছেন ?“ আমি চিৎকার করে এসব প্রশ্ন করার সাথে সাথে টেলিফোনের লাইন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো। সিপাহীরা টেলিফোনের এ মারাত্মক সংবাদ লাইনের সর্বত্র চীৎকার করে ছড়িয়ে দিচ্ছিলো। এ সংবাদে সকল সিপাহী অস্ত্রাগারের দিকে ছুটে এসে টেলিফোনের সংবাদ সম্পর্কে নানা প্রশ্ন করতে থাকে। এ সময় আমি লাইনে বসে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের তৎকালীন আর-আই মিঃ মফিজউদ্দীনের সাথে তার বাসায় টেলিফোনে যোগাযোগ করে ঢাকা সেনানিবাস থেকে ভেসে আসা পাক সেনাদের রাজারবাগ পুলিশ লাইনের দিকে ধেয়ে আসার সংবাদ বিস্তারিত জানালে তিনি তৎকালীন পুলিশ সুপার ই,এ, চৌধুরী সাহেবকে সব কিছু জানাচ্ছেন বলে টেলিফোন ছেড়ে দেন। এদিকে আমার সিপাহীরা এবং রাজারবাগ পুলিশ লাইনের চারশত বাঙালি বলছিলো “অস্ত্র দাও, অস্ত্র দাও। আমাদের হাতে অস্ত্র তুলে দাও, আমরা ওদের প্রতিরোধ করব, প্রতিহত করবো।“ শেষ পর্যন্ত অস্ত্রাগারের সামনে দাঁড়িয়ে আমার হাবিলদার সহকর্মীরা বুকফাটা চীৎকারে রাজারবাগ কাঁপিয়ে তুলে বলছিলো “আমাদের হাতে অস্ত্র দাও, আমরা লড়বো, লড়তে লড়তে মরবো, শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত লড়াই করবো ঐ বেঈমানদের বিরুদ্ধে কিন্তু পিছু হটবো না, হটবো না।“ এরপর আমি রিজার্ভ ইন্সপেক্টর সাহেবের বাসায় গিয়ে তাকে না পেয়ে আমাদের ফোর্সের সুবেদার আবুল কাসেমকে এ সংবাদ জানালে তিনি লাইনে ছুটে আসেন। এর পরপরই আমাদের আরআই সাহেব পুলিশ সুপার ই,এ চৌধুরীর সাথে আলাপ –আলোচনা করে লাইনে এসে বলেন, “তোমরা ওদের রুখতে পারবে না কোনো প্রকারেই, দেখো আমাদের নীরব থাকাই ভালো।“

 কিন্তু তখন নীরব থেকে প্রাণ বাঁচাবার কোনো উপায় ছিলো না। পুলিশ লাইনের সকল বাঙালি সিপাহীই তখন অস্ত্র নিয়ে ওদেরকে প্রাণপণ প্রতিরোধ করার জন্য ব্যাকুল ও ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলো। সিপাহীরা বলছিলো, “আর-আই সাহেব আপনি অস্ত্রাগার খুলে দিন, আমাদের হাতে অস্ত্র তুলে দিন, আমরা ওদের প্রতিরোধ করবো।“ এরপর আর-আই সাহেব অস্ত্রাগারের চাবি দিয়ে দিলে বাঙালি সিপাহীরা সবাই পাগলের মতো অস্ত্রাগারে প্রবেশ করে যার যার প্রয়োজন মতো রাইফেল ও গুলি হাতে তুলে নেয়। এ সময় চারিদিক থেকে হাজারো জনতা রাজারবাগ পুলিশ লাইনে প্রবেশ করে আমাদের অস্ত্রাগার থেকে বিনা বাধায় অস্ত্র নিয়ে যায়। এসময় আমাদের অফিসাররা বাইরে কর্তব্যরত ছিলেন। এ সময় সুবেদার ফোর্স আবুল কাসেম, আর-ও হাফিজুর রহমান, সার্জেন্ট মূর্তজা হোসেন, সুবেদার আবুল হাশেম, নায়েক মোহাম্মদ আলী  (ফুটবল খেলোয়াড়) সবাই সশস্ত্রভাবে আমাদের সিপাহীদের সাথে মরণের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য তৈরী ছিলেন। রাজারবাগ পুলিশ লাইনের সমস্ত বাতি নিভিয়ে দিয়ে সমস্ত সিপাহী লাইনের চারিদিকে মাটিতে শুয়ে, ছাদের উপর বসে থেকে, দাঁড়িয়ে থেকে, গাছের আড়ালে থেকে পজিশন নিয়ে পাক পশুদের অপেক্ষায় ছিলো। সেদিন হাবিলদার তাজু আহমেদ, হাবিলদার আবুল হোসেন, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ফুটবল খেলোয়াড় নায়েক মোহাম্মদ আলী, হাবিলদার আতাউর রহমান, সিপাহী মোহাম্মদ আলী, আরও কতিপয় হাবিলদার, নায়েক ও সিপাহী এবং কেন্দ্রীয় পুলিশ ফোর্সের সুবেদার খলিলুর রহমান মৃত্যুকে তোয়াক্কা না করে সবার সামনে দাঁড়িয়ে পুলিশ লাইনের সবাইকে এ প্রতিরোধে বীরের মতো নেতৃত্ব দিয়েছেন। ওদের সকলকে সালাম।

আমরা চারিদিকে ছড়িয়ে পজিশন নিচ্ছিলাম ওদের প্রতিরোধ করার জন্য। হঠাৎ টেলিফোন বেজে উঠল। টেলিফোনে এক ভীতসন্ত্রস্ত কম্পিত বাঙালি সিপাহী কণ্ঠ বলছিলো, “ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট ফাঁড়ি থেকে বলছি। একশত সশস্ত্র আর্মি ট্রাক রাজধানীর দিকে এগোচ্ছে।“ এরপরই আরেক বাঙালি পুলিশের কণ্ঠ টেলিফোনে ভেসে আসলো, সেই মার্জিত কণ্ঠ বলছিলো, ”তেজগাঁ থানার সামনে দিয়ে সশস্ত্র আর্মি ট্রাক রাজধানীর দিকে এগোচ্ছে।“ এরপর আমাদের ওয়ারলেসে এক পুলিশ কণ্ঠ বলে উঠল, “ময়মসিংহ রোড থেকে টহলরত অফিসার বলছি, পাক আর্মির বহু ট্রাক রমনা রেসকোর্স মাঠে জড়ো হয়েছে।“ কিছুক্ষণ পরই দেখলাম পাক পশুর একটি দল হাতে স্বয়ংক্রিয় মেশিনগান নিয়ে সশস্ত্রভাবে চোরের মতো টিপে টিপে পা ফেলে আমাদের ব্যারাকের দিকে গুলি বর্ষণ করে। সাথে সাথে আমাদের রাইফেল গর্জে ওঠে। ওদের গুলিবর্ষণের জবাব দেই আমরা সম্মিলিতভাবে। পাক পশুদের প্রথম অগ্রগামী দলের কিছু সেনা মারা যায়। রাস্তায় ওদের লাশ পড়ে থাকে। অবশিষ্ট পাক পশু বিপদ বুঝতে পেরে সেই অন্ধকারে আবার চোরের মতো পিছু হটে যায়। এ ঘটনা ঘটে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই রাজারবাগ পুলিশ লাইনের দক্ষিণ- পূর্ব কোনে হাসপাতালের দিক থেকে অবিরাম শেলিং করতে থাকে পাক পশুরা। এরপর তারা উম্মত্তের মতো শেলিং করতে থাকে আমাদের পুলিশ লাইনের বিল্ডিং- এর উপর, উত্তর – পূর্ব কোণ থেকে। এভাবে তারা অবিরাম শেলিং করতে করতে পুলিশ লাইনের পূর্ব দিক থেকে ঢুকে পড়ে আমাদের এলাকার অভ্যন্তরে। আমাদের রাইফেলধারী বাঙালি পুলিশ প্রহরী তখন প্রাণপণ প্রতিরোধ করে যাচ্ছিল পাক পশুদের অবিরাম শেলিং- এর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। আমাদের বহু সিপাহী পুলিশ লাইনের পূর্ব দিকে ওদের প্রাণপণ প্রতিরোধ করতে করতে শহীদ হন। অবশিষ্ট সিপাহীরা রাইফেল নিয়ে পিছু হটে আমাদের ব্যারাকের বিভিন্ন নিরাপদ জায়গায় পজিশন নিয়ে ওদের প্রতিরোধ করতে থাকে। আমাদের সিপাহীদের প্রতিরোধ ও দৃঢ় মনোবলের সম্মুখে ওরা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে আমাদের পুলিশ লাইনের পূর্ব দিকের ব্যারাকে লাইট-বোম বৃষ্টির মত বর্ষণ করতে করতে ভিতরে প্রবেশ করছিল। ওদের অবিরাম গোলাবর্ষণে আমাদের ব্যারাকের চারদিকে আগুন ধরে যায়, অস্ত্রাগারের দেয়াল ভেঙ্গে পড়ে যায়। দোতলার দেওয়ালগুলো ভেঙ্গে পড়তে থাকে আস্তে আস্তে। ওরা আমাদের আওতার বাইরে থেকে শেলিং করছিল, আর লাইট বোম মারছিল। আমাদের পুলিশ লাইনের একেবারে অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে তখনও সাহস পায়নি। রাত আনুমানিক আড়াইটার সময় ওরা মরিয়া হয়ে আমাদের ব্যারাকের অভ্যন্তরে প্রবেশ করার চেষ্টা করেছিল। অবিরাম শেলিং হচ্ছিল, আগুনের ভয়ংকর ফুলকি নিয়ে লাইট- বোমগুলি একের পর এক পড়ছিল আমাদের দিকে। চারিদিকে আমরা ট্যাংক ও কামানের কান ফাটা ভীষণ গর্জন শুনছিলাম। পাক পশুরা এভাবে অজস্র শেলিং ও কামানের গোলাবর্ষণ করতে করতে আমাদের আওতার ভিতরে এসে গেলে আমাদের সিপাহীদের রাইফেলগুলো আবার গর্জে ওঠে। পশুদের কতিপয় আমাদের বীর নায়েক বিখ্যাত ফুটবলার খেলোয়াড়ের নেতৃত্বে, আমাদের সিপাহী কায়েস, সাত্তার, হাফিজ, নায়েক আঃ সুবহানের রাইফেলের গুলিতে মাটিতে পড়ে যায়। আর অবশিষ্ট পশুর দল পিছু হটে যায়। আমাদের বীর সিপাহীরা অবিরাম প্রতিরোধ করে যচ্ছিল, প্রাণপণে ব্যারাকের সেই জ্বলন্ত আগুনের পাশে দাঁড়িয়ে আমাদের বীর সিপাহীরা বীরবিক্রমে প্রতিহত করছিল। উম্মত্ত সেনাদের অগ্রগতিকে রুখে দিচ্ছিল নির্ভিকভাবে। আগুন ক্রমে ক্রমে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের উত্তর দিকের ব্যারাকে ছড়িয়ে পড়ছিল। আগুনের লেলিহান শিখায় সেই ধেয়ে আসা ভস্মের মধ্যে আমাদের কতিপয় বীর সিপাহী প্রতিরোধ সৃষ্টি করার সময় অকস্মাৎ আটকা পড়ে নিদারুন ভাবে শহীদ হন। আর অবশিষ্ট সিপাহী আগুন ও শেলিং –এর মুখে আস্তে আস্তে পিছু হটতে হটতে আমাদের প্রধান বিল্ডিং- এর দিকে আসতে থাকে- আমাদের বীর সিপাহীরা তখনও প্রতিরোধ করে যাচ্ছিল বীর বিক্রমে। মাইক্রোফোনে ওদের উম্মত্ত গর্জন শুনছিলাম, “তোমলোগ সারেন্ডার করো, হাতিয়ার দে দাও, নাই তো খাতাম কার দিওঙ্গা, তামা হও যায়েগা।“

আমাদের বীর সিপাহীরা ওদের মিথ্যা ভাঁওতায় কান না দিয়ে প্রাণপণ প্রতিরোধ করছিলো ওদের। কিন্তু আমাদের বীর সিপাহীরা ও আমাদের সকলের গুলি শেষ হয়ে গিয়েছিলো। আমাদের অস্ত্রাগারেও তখন প্রবেশ করার উপায় ছিলো না। সেখানে ওরা গোলাবর্ষণ করছিলো উম্মত্তভাবে। আমি উপায়ন্তর না দেখে পিছু হটতে হটতে পুলিশ লাইনের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত ঘোড়ার আস্তাবলের পিছনের রাস্তা দিয়ে আমিনবাগের মধ্যে দিয়ে চলে এসে প্রাণ বাঁচাই। এরপর আমি গ্রামের দিকে গিয়ে বাংলার মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ি।

————————————————-

<৯, ১.৯, ১৯-২১>

ঢাকার মিরপুরে প্রতিরোধ

সাক্ষাৎকার : মোহাম্মদ আ: সোবহান

(মোহাম্মদ আব্দুস সোবহান ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাজারবাগ পুলিশ লাইনে আর্মড সাব ইন্সপেক্টর অব পুলিশ হিসেবে কর্মরত থাকাকালে মিরপুর দশ নম্বর সেকশনে জরুরী টহলে গিয়েছিলেন)

 

ইন্সপেক্টর অফ রিজার্ভ পুলিশ

বি-আর-পি, রাজশাহী

২৯-১-১৯৭৪

আমার ওয়ারলেস সেটটি কিছুক্ষন নীরব থাকার পর রাজারবাগ ওয়ারলেস কন্ট্রোল রুম থেকে আর এক বাঙালি পুলিশের কণ্ঠ ঘোষণা করলো, “অল অফিসার্স অফ এণ্ড অ্যাভব র‍্যাঙ্ক অফ ইন্সপেক্টরস উইল প্রোসিড টু দেয়ার কোয়ার্টার্স।” হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালের পশ্চিমের গেটে প্রহরারত বাঙালি পুলিশের ভীতসন্ত্রস্ত কণ্ঠ আমার ওয়ারলেস সেটে বেজে ওঠার পর এবং রাজারবাগ পুলিশ লাইনের কন্ট্রোল রুমের ওয়ারলেস থেকে সতর্কবাণী পাওয়ার পর আমারা সন্ত্রস্ত হয়ে পরেছিলাম। এরপর বিএসপি, ইন্সপেক্টর সহ সকল পদস্থ বাঙালি পুলিশ অফিসার যারা মিরপুর ও অন্যান্য স্থানে বিভিন্ন সেকশন ও সেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন, ওয়ারলেস মারফৎ রাজারবাগ কন্ট্রোল রুম থেকে উপরোক্ত নির্দেশ পাওয়ার পর সবাই হেড কোয়ার্টারে চলে গেলে আমি আমার এক প্লাটুন (৩৭ জন পুলিশ) নিয়ে মিরপুর থানায় উঠি। সেখানে আমি মিরপুরের বিভিন্ন সেকশনে কর্তব্যরত সকল ফোর্সকেই জমায়েত দেখতে পাই। সারা মিরপুরে এ সময় থমথমে ভাব বিরাজ করছিলো। হঠাৎ পুলিশ (কমিশনার বিল্ডিং) কন্ট্রোল রুম থেকে আবার ওয়্যারলেস সেটে বাঙালি পুলিশের কম্পিত কণ্ঠ বেজে উঠলো। সেই কণ্ঠ বলছিলো- “পাক আর্মি ভারী কামান, ট্যাংক ও মেশিনগান নিয়ে আমাদের কন্ট্রোনল রুম ঘেরাও করে ফেলেছে। ওরা গোলাবর্ষণ করতে করতে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে আসছে আমাদিগকে নিশ্চিহ্ণ করে দেবার জন্য- ওরা ভীষণভাবে ধেয়ে আসছে – তোমরা যে যেখানে থাকো এগিয়ে আসো, আমাদের রক্ষা করো, বাঁচাও, আমাদের বাঁচাও।” সেই কণ্ঠ বলে যাচ্ছিলো– “রাজারবাগ পুলিশ লাইনে পাকপশুদের হামলা হয়েছে, সেখানেই গোলাগুলি চলছে, আমাদের বীর পুলিশরা লড়ছে, সেখানকার ওয়্যারলেস বেইস থেকে আমরা কোন শব্দ পাচ্ছি না, সব নীরব নিস্তব্ধ হয়ে গেছে।” পরক্ষনেই আমারা ঢাকার আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলাম আকাশে বৃষ্টির মতো লাইট বোম উড়ছে। কামান, ট্যাঙ্ক আর গোলাবর্ষণের ভীষণ গর্জন শুনছিলাম, অসংখ্য মানুষের বুকফাটা অসহায় কান্নার রোল ভেসে আসছিলো। অস্থির অধীর ছাত্র জনতা যেন ঝাপিয়ে পড়ছে সেই অসংখ্য কামান, ট্যাঙ্ক ও গোলাবর্ষণের  আগুনের মধ্যে। চোখের সামনে দেখলাম আগুন আর আগুন, জ্বলন্ত আগুনের লেলিহান শিখা জ্বলছে, রাজধানী ঢাকা জ্বলছে। চোখ ফিরিয়ে মোহাম্মদপুরের আসাদ গেটের দিকে তাকিয়ে দেখলাম সেখানেও ভীষণ গুলি আরম্ভ হয়ে গেছে, বাড়ি ঘর জ্বলছে । সেই ভয়াল ও ভয়ংকর গোলাবর্ষন ও আগুনের লেলিহান শিখা আস্তে আস্তে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছিলো, আমাদের ফোর্স সবই মিরপুর থানায় জামায়েত হয়েছিল। অর্ধেকের হাতে ছিলো লাঠি আর অর্ধেকের হাতে ছিলো সাধারণ রাইফেল আর বিশ রাউণ্ড গুলি। মিরপুর থানায় এভাবে বসে থাকলে সব এক সাথে ওদের ঘেরাও এর মধ্যে পড়ে কুকুর-বিড়ালের মতো মরতে হবে ভেবে আমরা আমাদের ফোর্সকে বিভিন্ন জায়াগায় ছড়িয়ে পজিশন নিতে বলি  আর আমার সিপাহীদের যাদের হাতে শুধু লাঠি ছিল তাদের চলে যেতে বলি আত্মরক্ষার জন্য। আমি আমার ফোর্স নিয়ে মিরপুর ইটখোলার ভিতরে পজিশন নিয়ে পাক পশুদের অপেক্ষা করতে থাকি। আমারা পালাই নাই। কারণ পালাবার ইচ্ছা আমাদের ছিলো না। আমারা মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দৃঢ় শপথ নিয়েছিলাম। সামান্য রাইফেল নিয়েই আমারা পশুদের প্রতিরোধ করবো। প্রতিহত করবো, লড়বো তবু পিছু হটবো না। সারারাত আমি আমার সশস্ত্র ফোর্স নিয়ে সেই ইটখোলার বিভিন্ন জায়াগায় ছড়িয়ে পড়ে পজিশন নিয়ে বসেছিলাম। আর ঢাকার আকাশে দেখেছিলাম আগুনের লেলিহান শিখা, সকল নিরীহ নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার সহিত পাক পশুদের কামান ও ট্যাঙ্ক যুদ্ধের তাণ্ডবলীলা। রাত তিনটার সময় আমরা দেখছিলাম আমাদের চোখের সম্মুখে চারটি সশস্ত্র পাকসেনাদের ট্রাক চলে গেলো। ট্রাকের পিছনে পিছনে যাচ্ছিলো কামান বসানো ‘ডজ’। মিরপুরের ইপিআর বাহিনীর সাথে আমারা পাক আর্মিদের এক ঘন্টা তুমুল সংঘর্ষ দেখলাম। কামান ও ট্যাঙ্কের কানফাটা গর্জনে আমারা সবাই বিমূঢ় হয়ে পড়ছিলাম। কিছুক্ষন পর দেখলাম পাক আর্মি সেই সশস্ত্র ট্রাকগুলো নিয়ে ফিরছে আর তার পিছনে আরও তিনটি ট্রাক আসছিল। ঐ অতিরিক্ত ট্রাকে ছিলো পর্যুদস্ত বাঙালি ইপিআর বন্দীরা। আমাদের সম্মুখ দিয়েই পাক পশুদের সশস্ত্র ট্রাকগুলো ইপিআর বন্দীদের নিয়ে সদর্পে এগোচ্ছিলো। আমি আমার সিপাহীদের ওদের উপর গুলিবর্ষণ করতে নিষেধ করছিলাম। ওদের গাড়িগুলো এগোচ্ছিলো– সবই চলে গেলো । পিছনে দুটি গাড়ি থাকতেই আমার এক সিপাহী হঠাৎ ওদের প্রতি গুলিবর্ষণ করতেই ওরা ট্রাক থামিয়ে নেমে পড়ে কুকুরের মতো। ভীষণ ব্রাশ ফায়ার শুরু হয় আমার সিপাহীদের উপর। আমাদের উপর পড়ছিলো অসংখ্য গ্রেনেড, আরোও পড়েছে স্বয়ংক্রিয় মেশিনগান থেকে বৃষ্টির মত অসংখ্য গুলি। আমরা আমাদের সামান্য রাইফেল নিয়েই পশুদের প্রাণপণ প্রতিরোধ করতে থাকি । কিছুক্ষণ পর আমাদের গুলি শেষ হয়ে গেলে আমরা গুলিবর্ষণ করতে করতে আস্তে আস্তে পিছু হটতে থাকি– আমাদের হাতে সামান্য রাইফেল থাকলেও ওরা রাতের কালো অন্ধকারে সেই ভারী কামান, ট্যাঙ্ক বহর ও অসংখ্য মেশিনগান, গ্রেনেড ও সশস্ত্র সৈন্য নিয়েও আমাদের সামনে সদম্ভে এগিয়ে আসতে সাহস পায় নাই। আমাদের দূর্জয় মানসিক শক্তির সামনে ওরা প্রথমত আসতে সাহস পায় নাই। সামান্য রাইফেল দিয়েই ওদেরকে প্রায় এক ঘন্টা প্রতিরোধের পর আমি আমার ফোর্স নিয়ে পিছু হটছিলাম। আমার ফোর্স সব পিছনে চলে গিয়েছিলো। আমি আমার দূর্জয় সিপাহী নিয়ে একাই ওদের বিরুদ্ধে ফাইট দিচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখলাম ওরা নীরব- ওদের নীরবতা দেখে আমি  ওদের ঘেরাওয়ের মাঝে পড়ে যাওয়ার ভয়ে পিছু হটে চলে আসি। পিছনে এসে দেখমাল এক প্রাসাদের ছাদের উপর এক বিদেশী দাঁড়িয়ে আছেন। আমি তার গেটের সামনে যাওয়ার সাথে সাথে সেই বিদেশী ভদ্রলোক এসে আমাকে ভিতরে নিয়ে গিয়ে বিল্ডিংয়ের পিছনে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় দিলেন। কিন্তু সে জায়গা নিরাপদ মনে না করায় আমরা সেই ভদ্রলোকের পরামর্শ অনুযায়ী তার বিল্ডিংয়ের পিছনের রাস্তা দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। আমার এক সিপাহীর কথামত আমরা সবাই নিকটবর্তী অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার মান্নান সাহেবের বাসায় গিয়ে আশ্রয় নেই। তিনি আমাদিগকে যথেষ্ট যত্ন করেন। আমারা তার বাড়িতে চা নাস্তা খেয়ে ছাদের উপরে গিয়ে দেখলাম পাক আর্মিরা ইটখোলার ভিতরে ঢুকে আমাদিগকে সার্চ করছে, তখন ভোর হয়ে গিয়েছিলো। অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার তার বাসা থেকেই ধেয়ে আসতে থাকা পাক আর্মিদের বিরুদ্ধে ফাইট দিতে বললেন কিন্তু আমার সিপাহীদের গুলি শেষ হয়ে যাওয়ায় এবং রাতের ফাইটে আমরা সাঙ্ঘাতিক ভাবে ক্লান্ত হয়ে যাওয়ায় কল্যানপুরের বাঙালি এলাকায় চলে গিয়ে পুলিশের পোশাক ফেলে দিয়ে কলোনীর বাঙালি ভাইদের দেয়া ছেঁড়া লুঙ্গী গেঞ্জী পরে কল্যানপুর কলোনীর ছাত্র-জনতার সাথে মিশে গিয়ে সেখাঙ্কার বাঙালি জনতাকে সর্বতোভাবে সাহস দিতে থাকি। সকাল তখন দশটা বেজে গিয়েছিলো। আমি আমার হাতে রাখা অচল ওয়্যারলেস সেটটা মেরামত করে সচল করে দিয়ে ঢাকার সব পুলিশ সেক্টর ডেড দেখলাম। মিরপুর থানার সহিত লাইন দিলাম, সেখান থেকে এক বাঙালি কণ্ঠ ভেসে আসছিল– জোর করে স্বাভাবিক করা সেই কণ্ঠ বলছিলো, “মিরপুর থানা,” পরক্ষনেই এক অবাঙালি পাকসেনা ওয়্যারলেস সেটে বলে ওঠে– “কোন শালা কাহা তোম বোলতা হায়।” আমি বেশ বুঝতে পারি ওয়্যারলেসে বাঙালি কণ্ঠ সোনা গেলেও সেখানে পাকসেনাদের প্রভুত্ব বহাল রয়েছে। এরপর আমি আমার ওয়্যারলেস সেটটি অচল করে কল্যানপুর কলোনীর এক বাঙালির বাসায় রেখে পার্শ্ববর্তী মসজিদে জুম্মার নামাজ পড়তে গিয়েছিলাম। মসজিদে জনতার ব্যাকুল চাহনী কিছুতেই এড়াতে পারলাম না। নামাজ শেষে বের হয়ে এসে পাশের এক ছোট ঘরে বসে আছি এমন সময় দেখলাম অসংখ্য দাঙ্গাবাজ বিহারী লাফিয়ে লাফিয়ে আসছে, পিছনে পাকসেনাদের গাড়ী। বিহারীরা সেখানে এসেই বাঙালি কনোনীতে আগুন লাগিয়ে দিয়ে লুটপাট শুরু করে দিলো। ইতিমধ্যে পাকসেনাদের গাড়ী দুটো বিহারীদের বাঙালি কলোনীতে লুণ্ঠনে লাগিয়ে দিতে চলে গেলো। আমরা বিহারীদের তাণ্ডবলীলা আর সইতে পারলাম না– আমি আমার সিপাহীদের পজিশন নিয়ে বিহারীদের উপর ফায়ার করার নির্দেশ দিলে দুজন বিহারী গুলি খেয়ে পড়ে যায়– আর বাকীসব বিহারী দৌড়ে পালিয়ে যায়। তখনকার মত কল্যানপুর বাঙালি কলোনী বেঁচে যায় বিহারী লুণ্ঠন থেকে। আমাদের গুলিবর্ষনে বাঙালি কলোনীতে আসন্ন পাক ও বিহারীদের হামলা ও লুণ্ঠনের আশংকায় সবাই ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পাগলের মতো পালাতে থেকে চারদিকে। এরপর আমি মিরপুরের রাস্তার সামনে নদী পার হয়ে গ্রামের দীর্ঘ রাস্তা ধরে আমাদের সিপাহীদের নিয়ে অজানার পথে অদৃশ্য হয়ে যাই।

——————————————————

 

<৯, ১.১০, ২১-২৭>

ঢাকা শহরে সশস্ত্র প্রতিরোধ
সাক্ষাৎকারঃ লেঃ (অবঃ) আনোয়ার হোসেন

অসহযোগ আন্দোলনের পূর্ণ সমর্থন ছিল। আমি ঢাকা সেনানিবাসে দ্বিতীয় বেঙ্গলে ছিলাম।

২৫ শে মার্চের ঘটনায় বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠি। আমার বাঙ্গালি অফিসারদের সাথে কথা বললে তারা আমাকে নিরুৎসাহিত করেন। তারপর আমরা ১৬জন যুবক আলাপ- আলোচনা করে ২৭শে মার্চ সেনানিবাস থেকে পালিয়ে যাই। তেজগাঁ ড্রাম ফ্যাক্টরীর কাছে এসে দেখি মুক্তিবাহিনী গঠন হয়েছে। সেখানে ইপিআর, আনসার, মুজাহিদ, ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক সবাই ছিল। আমি দলের নেতৃত্ব হাতে নেই। আমরা ৩৫০ জনের উপরে ছিলাম। তেজগাঁ রেল লাইনের অপরদিকে ডিফেন্স নিয়ে ২ শে মার্চ পাকসেনাদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হই। ১২৬ জন পাক সেনা হতাহত, ৩টি গাড়ী ধ্বংস এবং অনেক আহত হয়। বহু অস্ত্রও আমরা উদ্ধার করি। অস্ত্র দ্বারা আমরা পুনর্গঠিত ও নববলে বলীয়ান হই। ৩০শে মার্চ ঢাকার মহাখালীতে আমরা ১০জন রেকি করতে বের হই। আগে থেকে আমরা বুঝতে পারিনি যে পাকসেনারা এ্যামবুশে পরে যাই। শামসুল আলম নামক একজন ইপিআর ওখানে শহীদ হন। বাকী নয়জন কোন রকমে বেঁচে আসি। সময় ছিল রাত সাড়ে দশটা। ৩১ শে মার্চ সেকেণ্ড ক্যাপিটালে আসাদ গেটের নিকটে হাসপাতালের কাছে পাক সেনাদের অবস্থান ছিল। আমরা রাত ৩টায় আক্রমন চালাই। এতে ৫ জন পাক সেনা খতম হয়। আমাদের কোন ক্ষতি হয় নি।

ভোর পাঁচটায় পাকসেনারা ব্যাপক সেনা ও অস্ত্র নিয়ে আমাদের উপর আক্রমন চালায়। ওদের সামনে টিকতে না পেরে পালাবার চেষ্টা করি। সবাই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, বেশ কিছু শহীদ হন। আমিসহ সাতজন পাক সেনাদের হাতে ধরা পড়ি। তারিখ ১লা এপ্রিল।

বংশাল ফাঁড়ির প্রতিরোধ

(শারদীয় কালান্তর, সেপ্টেম্বর ১৯৭১ সংখ্যায় প্রকাশিত সত্যেন সেন রচিত “নাদির গুন্ডা” শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে সংকলিত)

১৯৭১ সালের পঁচিশে মার্চের সেই ভয়ংকরী রাত্রি, যার কথা বাংলাদেশের মানুষেরা কোনো দিনই ভুলতে পারবে না। ওরা ঢাকা শহরকে রক্তবন্যায় ভাসিয়ে দেবার জন্য অতর্কিতে নেমে এলো। ওরা জানতো, এদেশে ওদের পক্ষে কেউ নেই। সরকারী কর্মচারী থেকে রাস্তার পুলিশ পর্যন্ত, শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী থেকে শহরের মেহনতী মানুষ আর গ্রামের কৃষক পর্যন্ত জনসাধারণের সমস্ত স্তর থেকে ওরা সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন। তাই পশ্চিমী শাসক চক্রের জঙ্গী বাহিনী কোন রকম বাছ-বিচার না করে সর্বগ্রাসী আক্রমণ নিয়ে নেমে এসেছিল।

রাত বারোটার পর ঘড়ি দেখে কাঁটায় কাঁটায় একই সঙ্গে ওরা বিশ্ববিদ্যালয় অঞ্চল, লালবাগ, পিলখানায় ইপিআর ব্যারাকে, পুলিশ ব্যারাকে এমনকি থানায় থানায় ফাঁড়িতে ফাঁড়িতে আক্রমণ করে বসলো। সবাই জানে, একমাত্র রাজারবাগ পুলিশ লাইন ছাড়া আর কোন জায়গা থেকে তারা কোনো প্রতিরোধ পায়নি, যেখানে গেছে সেখানেই অবাধে ধ্বংসলীলা চালিয়ে গেছে। কিন্তু এর ছোট্ট একটা ব্যতিক্রমও আছে। এই খবরটা কিন্তু খুব কম লোকই জানে।

নবাবপুর থেকে বংশালের রাস্তায় ঢুকলে বাঁয়ে নিশাত সিনেমা হল, ডাইনে দৈনিক সংবাদ অফিস, সেখান থেকে একটুখানি এগিয়ে গেলে বংশাল ফাঁড়ি। কিছুসংখ্যক সৈন্য মেশিনগান-রাইফেল নিয়ে এই ফাঁড়ি আক্রমণ করতে গিয়েছিল। তারা নিশ্চিন্ত মনে রাত্রির নিঃশব্দতার বুকে আর্মি বুটের খট খট শব্দ হেনে ফাঁড়িটার দিকে এগিয়ে চলেছিল। এখানে কারো কাছ থেকে যে প্রতিরোধ আসতে পারে এমন কথা তারা কল্পনাও করতে পারেনি। ভেবেছিল, অবাধে ও স্বচ্ছন্দে তাদের হত্যালীলা চালিয়ে যাবে, একটা প্রাণীকেও রেহাই দেবে না। কিন্তু ফাঁড়িটার কাছে যেতেই এক পশলা বৃষ্টিধারার মতো মেশিনগানের গুলি তাদের অভ্যর্থনা জানাল। ওরা ভীষণ চমকে উঠে পিছিয়ে গেল। এটা কি বিশ্বাস করবার মতো কথা। এক সামান্য ফাঁড়ির জনকয়েক পুলিশ, তাদের এত বড় সাহস হবে! কিন্তু বিশ্বাস না করে উপায় ছিল না, ওদের মধ্যে কয়েকজন সেই গুলিতে আহত হয়েছে। এরপর ফাঁড়ির ভেতর থেকে পরপর কয়েকবার রাইফেলের শব্দ শোনা গেল।

এবার দু’পক্ষে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। বংশালের পথে একটিও জনপ্রাণী নেই। ঘরে ঘরে দরজা-জানালা বন্ধ। কারো কোন সাড়া-শব্দ নেই, শুধু ঘন ঘন মেশিনগান আর রাইফেলের শব্দে বংশালের পথ আর দুই ধারের বাড়িগুলি থেকে থেকে কেঁপে উঠছিল। সৈন্যরা বেশ একটু বেকায়দায় পড়ে গিয়েছিলো।

ফাঁড়ির ভেতরে কে কোথায় আছে, কারা কি করছে- কিছুই তারা দেখতে পাচ্ছিল না। অপর পক্ষে অন্ধকার ফাঁড়িটার মধ্যে উপযুক্ত জায়গায় পজিশন নিয়ে প্রতিরোধকারীরা তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ছিল। রাস্তার আলোয় সৈন্যদের তারা ভালো করেই দেখতে পাচ্ছিল। ফলে এইবার ওরা বেশিক্ষন লড়াই চালিয়ে যেতে পারলো না, তখনকার মতো সেখান থেকে পৃষ্ঠভঙ্গ দিল।

ফাঁড়ির মধ্যে প্রতিরোধকারীরা উল্লাসে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি তুলল। আক্রমণকারীদের মধ্যে জনকয়েক সম্ভবত হতাহত হয়েছিল। কিন্তু পশ্চাদপসরণকারী সৈন্যরা তাদের কোনো চিহ্ন রেখে যায় নি।

ফাঁড়ির পুলিশেরা এভাবে একদল সশস্ত্র সৈন্যকে হটিয়ে দেবে, এটা সত্য সত্যই অভাবনীয়। আরও আশ্চর্যের কথা, তারা ফাঁড়ির মধ্যে থেকে মেশিনগান চালিয়েছিল। থানা বা ফাঁড়ির পুলিশদের হাতে কখনো মেশিনগান দেওয়া হয় না। একমাত্র বন্দুক ও রাইফেল তাদের সম্বল। এই সংকট মুহূর্তে এই মেশিনগান কেমন করে তাদের হাতে এলো?

বংশাল মহল্লার লোকের মুখে এর উত্তরটা আমি পেয়েছি। এটা শুধু ফাঁড়ির পুলিশের কাজ নয়। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল এই মহল্লারই সুপরিচিত নাদির গুন্ডা ও তার কয়েকজন সাগরেদ। যোগ দিয়েছিল বললে কথাটা সঠিকভাবে বলা হবে না। কার্যত এই নাদিরের নেতৃত্বেই নাকি এই প্রতিরোধকে সংঘটিত করে সৈন্যদের হটিয়ে দেয়ার সম্ভব হয়েছিল।

নাদিরের সঙ্গে যোগাযোগ না থাকলে ফাঁড়ির পুলিশেরা এ কাজে হাত দিতে সাহস করত না। আর মেশিনগান? শুধু বংশাল মহল্লা নয়, পাশাপাশি মহল্লার অনেকেই এ কথা শুনেছিল যে সারা শহরের মধ্যে এক্তিমাত্র লোক আছে যার হাতে একটি মেশিনগান আছে। সেই লোকটি হচ্ছে নাদির গুন্ডা নামে পরিচিত নাদির মিয়া। কি করে সে এই মেশিনগান সংগ্রহ করেছিল, একমাত্র সে-ই জানে।

প্রাক-স্বাধীনতার যুগে বিখ্যাত উর্দু লেখক কিষণচন্দর ‘তিন গুন্ডা’ নামে এক অপূর্ব কাহিনী লিখেছিলেন। কাহিনীর সেই তথাকথিত গুন্ডারা স্বাধীনতা আন্দোলন উপলক্ষে গুলিতে প্রাণ দিয়েছিল। কিন্তু সত্য সত্যই এরা কেউ গুন্ডা ছিল না। সরকারী প্রচারণায় স্বাধীনতা আন্দোলনের এই শহীদদের গুন্ডা বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছিল।

নাদির গুন্ডার ব্যাপারটা কিন্তু সে রকম নয়। সত্য সত্যই সে গুন্ডামি করত। যেই পরিবেশে জন্মেছিল, বড় হয়েছিল, সেই পরিবেশই তাকে এই পথে টেনে আনে। বয়স আর কত? ত্রিশের কোঠার নিচেই ছিল। এই বয়সেই সে গুন্ডা নামে কুখ্যাত হয়ে উঠেছিল। তবু সাধারণ গুন্ডাদের চেয়ে সে স্বতন্ত্র ছিল। তার পরিচিত যারা, এর কথাটা তাদের জানা ছিল যে, অনেকে বিপদে-আপদে নাদির গুন্ডার কাছ থেকে নানাভাবে সাহায্য পেয়েছে, ভালোবাসাও পেয়েছে।

এই সংসারে এমন অনেক ঘটনা ঘটে যা বিশ্বাস করা কঠিন অথচ সত্য। নাদির গুন্ডার জীবনে এমনি এক ঘটনা ঘটল। স্বাধীন বাংলা আন্দোলনের সংস্পর্শে এসে লোকটা কেমন করে যেন সম্পূর্ণ বদলে গেল। আর সব কথা যেন ভুলে গেল সে। কেমন করে বাংলাদেশকে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকচক্রের হাত থেকে মুক্ত করা যাবে- এটাই তার ধ্যান, জ্ঞান, জপমন্ত্র হয়ে দাঁড়াল। কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত না হলেও সে বিভিন্ন মহল্লায় রাজনৈতিক কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলত।

একটা বিষয়ে সে নিঃসন্দেহে ছিল যে, সত্য সত্যই ওদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করতে হলে সশস্ত্র সংগ্রামে নামতে হবে। সেই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে সে এই মেশিনগান আর অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করে নিয়েছিল। আর এই নাদির গুন্ডার প্রভাবে একই পথের পথিক আরও কয়েকটি ছেলে তাকে ঘিরে দাঁড়িয়েছিল।

পঁচিশে মার্চের সেই বিভীষিকা নাদিরের মনকে বিন্দুমাত্র দমিয়ে দিতে পারেনি। ওদের সেই পৈশাচিক হত্যা আর ধ্বংসলীলা তাকে প্রতিহিংসায় উম্মত্ত করে তুলেছিল। সারা শহরে হতাশা আর আতঙ্কের আবহাওয়া। তার মধ্যে দুর্জয় সাহস বুকে নিয়ে মহল্লায় মহল্লায় ঘুরে সে প্রতিরোধের কৌশল ও সংগঠন গড়ে তুলেছিল। তার এই সাহস আর নিষ্ঠার পরিচয় পেয়ে মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে মহল্লার লোকেরা তাকে আপন মানুষ বলে চিনে নিল।

তারা বলাবলি করত, এই শহরে নাদিরের মতো আরও গোটা কয়েক মানুষ যদি থাকত, তবে আমরা ওদের নাভিশ্বাস তুলে দিতে পারতাম। নাদিরের নামটা মিলিটারি গোয়েন্দাদের কাছে পৌঁছাতে দেরি হয়নি। তারা তন্নতন্ন করে তার সন্ধান করে ফিরেছিল।

পঁচিশে মার্চের পর থেকেই লুণ্ঠনরত সৈন্যের দল ঘরবাড়ি-দোকানপাট ভেঙ্গেচুরে ইচ্ছামতো লুঠপাট করে চলেছে। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে শহরের গোটা কয়েক রেশনের দোকান লুট হয়ে গেল। শহরের মানুষ ভয়ে আঁতকে উঠল। এভাবে রেশনের দোকান যদি লুট হয়ে যায়, তবে খাবে কি তারা? শেষকালে কি না খেয়েই মরতে হবে? ভয়ে দিশেহারা মানুষ কি করবে পথ খুঁজে পায় না।

রেশনের দোকানের মালিকেরা ভয়ে দোকান খুলতে চায় না। এই দুর্দিনে সর্বসাধারনের অবস্থা চিন্তা করে অস্থির হয়ে উঠল নাদির। কিছু একটা করতেই হয়। ঐ শয়তানেরা এসে রেশনের চাল লুট করে নিয়ে যাবে আর তারা অসহায়ের মতো হাত গুটিয়ে বসে বসে দেখবে, এ কিছুতেই চলবে না। কিন্তু কি করতে পারে সে?

একদিন মহল্লার লোকেরা অবাক হয়ে দেখল নাদির আর তার দলবল তাদের রেশনের দোকান ভেঙ্গে বস্তা বস্তা চাল বের করে নিয়ে যাচ্ছে। শেষকালে নাদিরের এই কাজ! তারা হতবুদ্ধি হয়ে গেল। কিন্তু একটু পরেই তাদের আসল ব্যাপারটা বুঝতে বাকি রইল না। নাদির তাদের মুখের দিকে চেয়েই এই দুঃসাহসের কাজে হাত দিয়েছে। নাদির আর তার সঙ্গীরা অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে সেই চাল মহল্লার ঘরে ঘরে ভাগ করে দিল। পাড়ার লোকে তখনকার মত কিছুটা চাল পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। হাতের কাজটা সেরে ফেলে অদৃশ্য হয়ে গেল নাদির। তার মাথার উপর মৃত্যুর পরোয়ানা ঝুলছে। খবরটা ইতিমধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। মিলিটারির জীপ তার সন্ধান নিয়ে ফিরছে।

এরপর দুঃসাহসী নাদির আর বেশীদিন কাজ করার সুযোগ পায়নি। এপ্রিলের মধ্যভাগে গ্যাদা নামে এক কুখ্যাত গুন্ডা তাকে মিলিটারির হাতে ধরিয়ে দিল। গ্যাদা ইতিমধ্যেই মিলিটারির দালালি করে আরো কয়েকজনকে ধরিয়ে দিয়েছে। তাছাড়া নাদিরের বিরুদ্ধে তার ব্যক্তিগত আক্রোশ ছিল। একবার নাদিরের গুলিতে জখম হয়ে তাকে বেশ কিছুদিন শয্যাশায়ী থাকতে হয়েছিল। তখন রাত অনেক হয়েছে। নাদির একটি জীপে করে আসছিল। আর্মানিটোলা ময়দানের কাছে এসে তার জীপটা একটা বাড়ির পাশে দাঁড়াল। ওরা আগে থেকেই তৈরি হয়ে ছিল। একটা সঙ্কেত পেয়ে মিলিটারির লোকেরা বিদ্যুৎগতিতে এসে তার জীপটাকে ঘিরে ফেলল। তারপর তারা তাকে ধরে নিয়ে তাদের আস্তানায় চলে গেল। নাদির সেই যে গেল, তারপর আর ফিরে আসেনি। ফিরে আসবে না কোনদিন।

 

নরসিংদীতে সশস্ত্র প্রতিরোধ

(সত্যেন সেন রচিত “প্রতিরোধ সংগ্রামে বাংলাদেশ” (আগষ্ট ১৯৭১) নামক গ্রন্থের “ওরা বারো জন” শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে সংকলিত)

এপ্রিল মাসের তৃতীয় সপ্তাহ।

ভারতীয় বেতার মারফৎ একটি সংবাদ প্রচারিত হলো- ঢাকা শহর থেকে কুড়ি কিলোমিটার দূরে কোন এক জায়গায় পাকিস্তানী সৈন্যদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ চলছে। খবরটা চাঞ্চল্যকর, বিশেষ করে ঢাকা জেলার লোকদের কাছে। দিনের পর দিন বাংলাদেশের নানা জায়গা থেকে মুক্তিবাহিনীর সক্রিয়তার সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু ঢাকা জেলায় তাদের প্রতিরোধের চিহ্নমাত্র নেই। অবশ্য ২৫শে মার্চ তারিখে সামরিক হামলার প্রথম রাত্রিতে রাজারবাগের পুলিশ ভাইয়েরা বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধ দিয়েছিল। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে এই কাহিনী অবিস্মরণীয়। তার দুই দিন বাদে নারায়ণগঞ্জ শহরের সংগ্রামী ভাইয়েরা শুধুমাত্র গোটা কয়েক রাইফেলের উপর নির্ভর করে আধুনিক যুদ্ধবিদ্যায় সুশিক্ষিত সৈন্যদলকে দুই দিন পর্যন্ত আটকে রেখেছিল শহরে ঢুকতে দেয়নি। তাদের মধ্যে যারা সবচেয়ে উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণ করেছিল তারা সবাই তরুণ ও কিশোর; অভিজ্ঞতার দিক দিয়ে একেবারেই কাঁচা। আমাদের এই সংগ্রামী ভাইদের জন্য ঢাকা জেলার মানুষ সঙ্গতভাবে গর্ববোধ করতে পারে। কিন্তু তারপর?

তারপর থেকে সারা ঢাকা জেলায় মুক্তিসংগ্রামীদের কোন সাড়া শব্দ নেই। ঢাকা জেলার মানুষ দুঃখ করে বলে, সবাই এগিয়ে যাচ্ছে, আমরাই শুধু পেছনে পড়ে আছি।

কুড়ি কিলোমিটার দূরের সেই জায়গাটা কোথায় তাই নিয়ে বিতর্ক ও বাদানুবাদ চলে। দূরত্ব সম্পর্কে অনেকের সঠিক ধারণা নেই। কেউ বলে সাভার, কেউ বলে নরসিংদী, আমার কেউ বলে জয়দেবপুর। এবার এমন লোকও আছে যারা এই ভারতীয় প্রচারণাকে একদম গাঁজাখোরি বলে উড়িয়ে দেয়, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ একে সত্যি বলে বিশ্বাস করে। শুধু যে বিশ্বাস করে তাই নয়, নিজেদের কল্পনার সাহায্যে তাদের আরো দ্বিগুণ করে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তোলে। ইতিপূর্বে নরসিংদীর উপর পাকিস্তানী বোমারু বিমান বোমা ফেলেছে। এটা ভারতীয় বেতারের প্রচার নয়, প্রত্যক্ষদর্শীরা বোমাবিধ্বস্ত নরসিংদীর সেই ভয়াবহ দৃশ্য দেখে এসেছে।

বাইরের লোকে এটুকুই শুধু জানল, কিন্তু ঠিক কোন জায়গায় যুদ্ধ বেধেছিল এবং যুদ্ধের ফলাফল কি সেই সম্পর্কে কারো মনে কোন স্পষ্ট ধারণা ছিল না। তাছাড়া নিত্যনতুন এমন সব চমকপ্রদ ঘটনা ঘটছে যে শহর থেকে কুড়ি কিলোমিটার দূরের সেই সংঘর্ষ সম্পর্কে কে আর মাথা ঘামায়।

যারা বাইরের লোক তাদের কাছে ঘটনাটা ছোট হতে পারে। কিন্তু স্থানীয়ভাবে ঘটনাটা দারুন উত্তেজনা ও উৎসাহের সৃষ্টি করেছে। আমার এক বন্ধু তার নিজস্ব কাজে ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন। ভাগ্যক্রমে তার সঙ্গে আমার দেখা হয়ে গিয়েছিল, সেইজন্যই এই উল্লেখযোগ্য ঘটনাটা সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করতে পারছি। আজ সারা বাংলাদেশ জুড়ে এই ধরনের যে সমস্ত ঘটে চলেছে, তার কতটুকু খবরই বা আমরা রাখি।

পাকিস্তানের বোমারু বিমানে ৪ঠা এপ্রিল ও ৫ই এপ্রিল পরপর দুই দিন নরসিংদীর উপর বোমা ফেলেছিল। তারপর দিন সাতেক কেটে গেল, ইতিমধ্যে পাকিস্তানী সৈন্য বা মুক্তিবাহিনী কেউ নরসিংদীতে প্রবেশ করেনি। তারপর হঠাৎ একদিন শোনা গেল পাকিস্তানী সৈন্যরা নরসিংদী দখল করবার জন্য ছুটে আসছে। গুজব নয়, প্রত্যক্ষদর্শীরা তাদের দেখে এসেছে।

তাঁতের কাপড়ের হাট হিসেবে বিখ্যাত বাবুরহাট থেকে জিনারদী পর্যন্ত একটি রাস্তা চলে এসেছে। মাইল সাতেকের পথ, জিনারদী থেকে নরসিংদী তিন মাইল। সৈন্যরা এই পথ ধরে এগিয়ে আসছিল। তাদের দলে কয়েকশ’ সৈন্য। সৈন্যবাহিনীর ট্রাকগুলি একের পর এক মিছিল করে আসছিল। তাদের সঙ্গে মর্টার, রকেট, মেশিনগান- কোন কিছুরই অভাব নেই। মুক্তিবাহিনীর ‘দুষ্কৃতকারী’ লোকগুলিকে তারা নিঃশেষে খতম করবে, চূর্ণ করে ধুলোয় মিশিয়ে দেবে।

বাবুরহাট থেকে জিনারদী, মাঝখানে পাঁচদোনা গ্রাম। এই পাঁচদোনা গ্রামের কাছে সংঘর্ষটা ঘটেছিল, সেইদিন ১৩ই এপ্রিল। প্রথমে গোটা পাঁচেক সৈন্যবাহিনীর ট্রাক। এই ট্রাকের কনভয় থেকে সৈন্যরা কিছুটা সামনে এগিয়ে এসেছে। পথ জনশূন্য। তবে মাঝে মাঝে দুই-একটা অতি সাহসী কৌতূহলী লোক ঝোপ-ঝাড়ের আড়াল থেকে উঁকিঝুঁকি মারছে। সৈন্যরা নিশ্চিন্ত মনে এগিয়ে চলেছিল। হঠাৎ এক সময় শান্ত পল্লী-প্রকৃতিকে চমকে দিয়ে গুড়ুম গুড়ুম-পরপর তিনবার কামানের গর্জন শোনা গেল। অতি পরিচিত মর্টারের আওয়াজ। শুধু আওয়াজই নয়, একটা গোলার টুকরো ছিটকে এসে একটা ট্রাকের উপর পড়ল। ট্রাকের উপর সৈন্যদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। এমন অপ্রত্যাশিতভাবে আক্রান্ত হতে হবে ওরা ভাবতে পারেনি। ওরা কি তবে শত্রুপক্ষের কব্জির মধ্যে এসে পড়েছে? এই অচেনা-অজানা নির্বান্ধব দেশে তারা কি করে আত্মরক্ষা করবে? প্রতিপক্ষ সহজ নয়, ওরা মর্টার নিয়ে আক্রমণ করতে এসেছে। ওদের সঙ্গে কত লোক আছে কে বলবে? এরা সংখ্যায় বড় কম হবে না। তা না হলে এরা এভাবে আক্রমণ করতে সাহস করত না। যারা আক্রমণ করছে, তারা ঝোপঝাড়ের আড়ালে এমন সুকৌশলে আত্মগোপন করে আছে যে, রাস্তা থেকে তাদের কোন মতেই দেখা যায় না। ট্রাক নিয়ে সেই দিকে এগোবার উপায় নেই, যেতে হলে পায়ে হেঁটে যেতে হয়। কিন্তু সেটা কোনমতেই নিরাপদ নয়। ওদের সঙ্গে শুধু মর্টার নয় মেশিনগানও আছে। একপশলা বৃষ্টির মত কয়েক ঝাঁক মেশিনগানের গুলি ট্রাকের উপর এসে পড়েছে। প্রথম পর্যায়েই সৈন্যদের কয়েকজন মারাত্মকভাবে জখম হয়ে পড়েছে। সৈন্যরা আর দেরী না করে অনুমানের উপর নির্ভর করে মর্টারের গোলাবর্ষণ করতে লাগল। তাদের মেশিনগানও অবিরাম কাজ করে চলেছে।

এইভাবে কয়েক ঘণ্টা ধরে দুই পক্ষের গোলাগুলির বর্ষণ চলল, একে রীতিমতো যুদ্ধ ছাড়া আর কি বলা যেতে পারে। এই কয়েক ঘণ্টার যুদ্ধে পাক সৈন্যদের নিদারুণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। মর্টার আর মেশিনগানের গোলাগুলিতে তাদের তিন ট্রাক সৈন্য হতাহত হয়েছে। এদের সংখ্যা প্রায় একশো, অপরপক্ষে অদৃশ্য গেরিলা বাহিনীর কি পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা বুঝে উঠা সম্ভব ছিল না। তবে এই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে, গেরিলা বাহিনীর লোকেরা বড় কম নয়। অস্ত্রসস্ত্রের দিক দিয়ে ওরা যথেষ্ট শক্তিশালী। এরপর আরও কিছুদূর এগোতে গেলে ওদের ফাঁদের মধ্যে সবশুদ্ধু আটকে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এই অবস্থায় বাবুরহাটের দিকে ফিরে যাওয়াটাই ওরা সঙ্গত বলে মনে করল।

অদৃশ্য মুক্তিবাহিনী গোলাগুলি বর্ষণ করে নিঃশব্দ হয়ে গেছে। খুব সম্ভবত এটা ওদের চাল। ওরা প্রলোভন দেখিয়ে আরও দূরে সম্পূর্ণ ওদের আয়ত্তের মধ্যে টেনে নিতে চাইছে। পাক-সৈন্যরা আপাদত বাবুরহাটে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল। প্রথম তিনটা ট্রাক একেবারে অচল হয়ে গেছে। নিহত ও জখমী সৈন্যদের দেহ অন্যান্য ট্রাকে বোঝাই করা হলো। এবার ওদের এই শোকের মিছিল ফিরে চলল বাবুরহাটের দিকে। অচল ট্রাক তিনটি এই যুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন হিসাবে রাস্তার উপর পড়ে রইল। বেশ কিছুদিন সেগুলি ঐভাবে পড়ে ছিল।

বেলা বেশী নেই, এই অবস্থায় আর বেশী দূর এগোনো বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। ওরা স্থির করল কাল বাবুরহাট থেকে এবার নতুন করে অভিযান শুরু করতে হবে। প্রতিপক্ষ যথেষ্ট শক্তিশালী সেই বিষয়ে সন্দেহ নেই। অবস্থা সুবিধাজনক বলে মনে হলে ঢাকা থেকে আরও বেশী সৈন্য আনাবার প্রয়োজন হতে পারে।

এবার মুক্তিবাহিনীর কথায় আসা যাক। যাদের তীব্র আক্রমনে আধুনিক যুদ্ধবিদ্যায় সুশিক্ষিত পাক-সৈন্যদল নিদারুণ ক্ষয়ক্ষতি বরণ করে পিছিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল, বিশ্বাস করুন আর নাই করুন তারা সংখ্যায় ছিল মাত্র বারো জন। তাদের অস্ত্রের মধ্যে ছিল শুধুমাত্র একটি মর্টার আর একটি মেশিনগান। এদের মধ্যে কেউ মারা যায়নি, শুধু দু’জন জখম হয়েছিল।

ওদের ঘাঁটি থেকে কয়েক মাইল দূরে। কোথায় সেই ঘাঁটি এই কথাটা একমাত্র তারাই জানে। ওরা সেই ঘাঁটি থেকে জোয়ান ছেলেদের নিয়ে বসল। আর তাদের পরিকল্পনাটা ওদের কাছে খুলে বলল। ছেলেরা শুনে উল্লাসে আত্মহারা হয়ে বলল- আমরাও থাকব আপনাদের সঙ্গে। আমরাও এখানে মুক্তিবাহিনী গড়ে তোলার কথা ভাবছিলাম। আপনাদের কয়জন লোক চাই বলুন।

না, না আমাদের যা প্ল্যান তাতে এই বারোজনই যথেষ্ট। তার বেশী লোক নিতে গেলে সবকিছু ভন্ডুল হয়ে যাবে। আপনারা শুধু চারদিকে লক্ষ্য রাখবেন। দেখবেন ওরা যেন হঠাৎ আমাদের চমকে দিতে না পারে। এমন আরও অনেক কাজ আছে, যা আপনারা করতে পারেন। করতে পারেন নয়, করতেই হবে আপনাদের। আপনারা না করলে কে করবে!

ওরা বলল, আপনারা যা বলবেন আমরা তাই করতে রাজী আছি।

কিন্তু বুড়োদের মনে একটা খটকা লেগেছে। একজন প্রশ্ন তুলল, এরা যদি আপনাদের এখানে এসে এই সমস্ত গোলমাল বাধিয়ে বসে, তাহলে ওরা আমাদের উপর বদলা নেবে। আমাদের ঝাড়ে-গুষ্টিতে শেষ করবে।

“এই অবস্থায় কি করতে বলেন আপনি” একজন প্রশ্ন করল।

বুড়ো আসল শয়তান! প্রথমেই মুখ খুলতে চায় না, পরে সবার চাপাচাপিতে বলে ফেলল। কথাটা ভাল শোনায় না। তারপরও অনুপায় হয়ে বলতে হচ্ছে।

আমরা বাধা দিলে ওরা তা মানবে না, ওদের যা করবার তা করবেই। এই অবস্থায় এদের ধরিয়ে দেওয়া ছাড়া নিজেদের বাঁচাবার আর কোন পথ দেখছি না। শুধু আমার জন্য বলছি না। আমি এই অঞ্চলের সবার কথা ভেবেই বলছি। এমন একটা কথা কেউ মেনে নিতে পারে না। হাজার হোক, এরা তাদেরই দেশের ছেলে, তাদের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করে চলেছে। এদের কি ধরিয়ে দেওয়া যায়! এদের কি শত্রুর হাতে তুলে দেওয়া যায়!

ইতিমধ্যে খবরটা ছেলেদের কাছে পৌঁছে গেছে। ওরা দল বেঁধে বুড়োদের সামনে এসে চড়াও করল, কোনরকম ভূমিকা না করে উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠল, যদি কোন বেইমান ধরিয়ে দিতে চেষ্টা করে, তাহলে আমরা তাকে কেটে কুচোকুচো করে ফেলব। বুড়োরা সবাই চুপ। এবার আর কারো মুখে কোন কথা শোনা গেল না। মুক্তিবাহিনীর লোকেরা ছেলেদের সাহায্য নিয়ে সমস্ত অঞ্চলটা ঘুরে ঘুরে পরীক্ষা করে দেখল। তার পরের দিন তাদের পরিকল্পনানুযায়ী তারা সেই দুঃসাহসিক কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ল।

এই বারোজন বীর দেশপ্রেমিকেরা নাম আমরা জানি না। কিন্তু এই বারোজনের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের কাহিনী মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে। সেখানকার মানুষ এদের কথা ভুলতে পারবে না।

পরদিন পাক-সৈন্যদল তাদের পথের বাধা দূর করার জন্য বাবুরহাট থেকে দূরপাল্লার কামান দেগে গ্রামের পর গ্রাম অগ্নিবর্ষণ করে চলল, কয়েক ঘণ্টা ধরে এই গোলা বর্ষণ চলল। কিন্তু যাদের লক্ষ্য করে তারা গোলা ছুঁড়েছিল, তারা সেখান থেকে বহু দূরে, তাদের ধরাছোঁয়ার নাগালের বাইরে নতুন অঞ্চলে নতুন খেলায় মেতে উঠেছে।

——————————————-

২) সশস্ত্র প্রতিরোধ- চট্টগ্রাম

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২। চট্টগ্রামের সশস্ত্র প্রতিরোধের বিবরণ ১৯৭১

<৯, ২.১, ২৮-৩২>

 

সেদিন চট্টগ্রামে যেমন করে
স্বাধীনতা লড়াই শুরু হয়েছিল

সাক্ষাৎকারঃ লেঃ কর্নেল জিয়াউর রহমান

(উনি ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ড হিসেবে মেজর পদে কর্মরত ছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি লেঃ জেনারেল এবং রাষ্ট্রপতি পদে আসীন হন। লেখাটি ২৬ শে মার্চ, ১৯৭২ সংখ্যার ‘দৈনিক বাংলা’ থেকে সংকলিত)

৩রা মার্চ, ১৯৭১ সাল। সময় সকাল সাড়ে নয় টা। এই প্রথম পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার তথা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সশস্ত্রভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ার ব্যাপারে প্রথম প্রকাশ্য আলোচনা। এদিকে ঢাকা ও চট্টগ্রামের পরিস্থিতি দ্রুত অবনতি ঘটছিল। সামরিক বাহিনীর অন্যান্য বাঙালি অফিসাররা অস্থির হয়ে উঠেছিলেন। তাঁদের সবার মনেই একটি চিন্তাই পাক খেয়ে ফিরছিল- কি করা যায়? কি করব?

বিভিন্ন খবরাখবর নিয়ে তাঁরা বার-বার ছুটে আসছিলেন মেজর জিয়ার কাছে। মেজর জিয়া তখন ছিলেন ৮ম ইস্ট বেঙ্গল ব্যাটালিয়নের বাঙালি অফিসারদের মধ্যে সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত।

এর পর এলো ৭ই মার্চ। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দিলেন। বললেন, যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত হও। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল।

৮ম ইস্ট বেঙ্গল ব্যাটালিয়নের অফিসাররা একে অস্ত্র তুলে নেবার আহবান বলেই মনে করলেন।

পরদিন ৮ই মার্চ। আবার সেই সকাল। ওরা দু’জন সবার অলক্ষ্যে আবার উঠে এলেন ছাদে। মেজর জিয়াউর রহমান আর ক্যাপ্টেন অলি আহমদ। বিদ্রোহ ঘোষনা সম্পর্কে একটি সুস্পষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে দু”জনে আলোচনা করলেন। ঠিক হলো বিদ্রোহ ঘোষনার জন্য উপযুক্ত মুহূর্তটির জন্য অপেক্ষা করতে হবে।

কিন্তু কখন আসবে সেই উপযুক্ত মুহূর্ত? কখন? কবে?
ওঁরা জানতেন এই বিশেষ মুহুর্ত টি আসবে তখনই যখন তাদের বিদ্রোহের সমর্থনে পূর্ণ আন্তরিকতা নিয়ে এগিয়ে আসবে জনসাধারণ। এই মুহুর্ত টি আসনে তখনই যখন শত্রুর বর্বরতা সম্পর্কে সুস্পষ্ট প্রমাণ সবার সামনে তুলে ধরা যাবে। এদিকে ইয়াহিয়া বসলো মুজিবের সঙ্গে আলোচনায়। ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি অফিসাররা রূদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করতে লাগলেন আলোচনার ফল কি হয়?…আলোচনার অন্তরালে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের এক জঘন্যতম চক্রান্ত। সে চক্রান্ত বাঙালিদের উপর হামলার। সে চক্রান্ত বাংলাদেশের উপর বর্বর অভিযানের।

আলোচনা চলছিল। আর এদিকে আসছিল জাহাজ বোঝাই সৈন্য। বিপুল পরিমান অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ। জাহাজ বোঝাই করে যে সব সৈন্য আসছিলো, তাদেরকে দ্রুত বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হচ্ছিল।

এমন সময় ডাক এলো লেঃ কর্নেল এম, আর, চৌধুরীর কাছ থেকে। ১৭ইমার্চ রাত সাড়ে নয়টায় চট্টগ্রামে স্টেডিয়ামে সামরিক আইন সদর দপ্তরে তার ডাকে প্রথম গুপ্ত বৈঠক অনুষ্ঠিত হল- চারজন সামরিক বাহিনীর বাঙালি অফিসারের মধ্যে। এরা চারজন হচ্ছেন লেঃ কর্নেল এম, আর, চৌধুরী, মেজর জিয়াউর রহমান, নোয়াখালীর মেজর আমীন আহমদ চৌধুরী ও ক্যাপ্টেন অলি আহমদ।

-কি মনে করছ? বৈঠকের শুরুতেই কর্নেল চৌধুরী পরিস্থিত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন মেজর জিয়াকে।

-ওদের ভাবগতি দেখে পরিস্কার মনে হচ্ছে ওরা হামলা চালাবে।

কর্নেল বললেন তাঁরও তাই ধারনা। কিন্তু কি করা যায়? সবারই মনে এই প্রশ্ন। এক- বিদ্রোহ। কর্নেল চৌধুরী সুস্পষ্ট ভাবে বললেন, সশস্ত্র অভ্যুত্থানই একমাত্র পথ। তিনি প্রথম বাঙালি সামরিক অফিসার যিনি সশস্ত্র অভ্যূত্থানের আহবান জানালেন।

সশস্ত্র অভ্যুত্থান। পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ। ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম ‘সিপাহী বিদ্রোহের’ পর আর এক নতুনতর সিপাহী বিদ্রোহ। এ বিদ্রোহ অবিশ্যম্ভাবী। সশস্ত্র অভ্যুত্থান ছাড়া বিকল্প আর কিছু নেই।

ওরা চারজন বাঙালি অফিসার বসলেন বিদ্রোহের পরিকল্পনা প্রণয়নে। ঠিক হলো ক্যান্টনমেন্টের স্টেশন কমান্ডার একমাত্র বাঙালি ব্রিগেডিয়ার এম, আর মজুমদারকে এ পরিকল্পনা থেকে বাইরে রাখতে হবে। ঠিক হলো লেঃ কর্নেল এম, আর, চৌধুরীর নেতৃত্বেই তারা বিদ্রোহের প্রস্তুতি চালিয়ে যাবেন।

এদিকে পাকিস্তানী হামলার প্রস্তুতি চলছিল পুরোদমে। বাঙালি অফিসারদের উপরে তাদের সজাগ দৃষ্টি হয়ে উঠেছিল আরো প্রখর। আর এরাও পাল্টা গোয়েন্দা বৃত্তি চালিয়ে সংগ্রহ করছিলেন পাক সেনাদের তৎপরতা। এরই মধ্যে কুমিল্লা থেকে বিস্তারিত খবর আসতে থাকল।

কমাণ্ড ব্যাটেলিয়নকে আনা হল চট্টগ্রামে। তাদেরকে রাখা হতে লাগল শহরের অবাঙালিদের বাড়ি বাড়ি। চট্টগ্রামের ২০ তম বালুচ রেজিমেন্টের সৈন্যরাও প্রতি রাতে সাদা পোশাকে অসামরিক ট্রাকে করে বেরিয়ে যেত শহরে। তাদের কাজ ছিল অবাঙালিদের সাথে মিলে লুটপাট করা।

বাংলাদেশের উপর বর্বর হামলার প্রস্তুতি দেখতে এলেন পাক সেনাবাহিনীর জেনারেল হামিদ খান। ২১ শে মার্চ চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে তাকে আপ্যায়িত করা হল মধ্যাহ্ন ভোজে। এই মধ্যাহ্ন ভোজেই পশ্চিমা সামরিক অফিসারদের কানাঘুষা আর জেনারেল হামিদের একটু ছোট্ট উক্তিতে বাঙালি অফিসাররা স্পষ্ট বুঝতে পারলেন দিন ঘনিয়ে এসেছে। হামলা অত্যাসন্ন।

মধ্যাহ্ন ভোজে জেনারেল হামিদ বীর বাঙালি অফিসারদের যেন চিনতেই পারেন নি। তার যত কানাঘুষা আর কথাবার্তা চলছিল পশ্চিমা অফিসারদের সাথে।

কি এত কানাঘুষা? কিসের এত ফিসফাস? সন্দিগ্ধ হয়ে উঠেছিল্ল মেজর জিয়ার মন। কৌশলে একজনের সাথে কথা বলতে বলতে গিয়ে দাঁড়ালেন জেনারেল হামিদের ঠিক পেছনে। দাঁড়ালেন পেছন ফিরে। কথা বলতে লাগলেন সঙ্গীটির সাথে আর দু’কান সজাগ রাখলেন জেনারেল হামিদের কথার দিকে।

জেনারেল হামিদ তখন বলছিলেন ২০ তম বালুচ রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার লেঃ কর্নেল ফাতমীর সাথে। অনেক কথার মধ্যে অনেকটা যেন সামরিক নির্দেশের মতই কর্নেল ফাতমীকে বলে উঠলেন জেনারেল হামিদ- “দেখ ফাতমী, অভিযান (একশন) খুব দ্রুত ও কম সময়ের মধ্যে হতে হবে। আমাদের পক্ষের কেউ যেন হতাহত না হয়।”

আঁতকে উঠলেন মেজর জিয়া। একি? কি হতে যাচ্ছে? ঐ দিনই বিকেলে তিনি সস্ত্রীক এক সৌজন্য সাক্ষাতে গেলেন ব্রিগেডিয়ার মজুমদারের বাসায়। কথায় কথায় তিনি জানতে চাইলেন জেনারেল হামিদের সফরের উদ্দেশ্য। কিন্তু ব্রিগেডিয়াম মজুমদারের সে তথ্য ছিল অজানা। তিনি শুধু বললেন, ওরা আমাকে বিশ্বাস করে না। তিনি জানালেন, জেনারেল হামিদ যখন অপারেশন রুমে ছিলেন তাঁকে সে ঘরে ঢুকতেই দেয়া হয় নি।

– কি বুঝলেন? জানতে চাইলেন মেজর জিয়া।

– মনে হচ্ছে সামথিং ফিশি।

জিয়া বললেন, ফিশি নয়- বিরাট কিছু। বিরাট এক চক্রান্তে মেতেছে ওরা। ব্রিগেডিয়ার মজুমদার মেনে নিলেন সে কথা। পরদিন ২২শে মার্চ। রাত ১১ টায় চট্টগ্রাম ই-পি-আর সেক্টর দফতরের এডজুট্যান্ট ক্যাপ্টেন রফিক এসে দেখা করলেন মেজর জিয়ার সাথে। তিনি সরাসরি বললেন, সময় খুব দ্রুত এগিয়ে আসছে। আমাদের বিদ্রোহ ঘোষনা করতেই হবে। আপনার প্রতি আমাদের আস্থা আছে। আপনি বিদ্রোহ ঘোষনা করুন। ই-পি-আর দের সাহায্য পাবেন। মেজর জিয়া তাঁকে তাঁদের পরিকল্পনার কথা জানান। ই-পি-আর এর সাহায্য সম্পর্কে আলোচনা করেন। ২৫শে মার্চে ব্যাপক রদবদল ঘটে গেল ক্যান্টনমেন্টের প্রশাসন ব্যবস্থায়।

ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারে করে উড়ে এলেন জেনারেল খাদেম হোসেন রাজা, জেনারেল আনসারি, মেজর জেনারেল মিঠা খান, লেঃ জেনারেল খোদাদাদ খান প্রমুখ। ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে তারা জোর করে ধরে নিয়ে গেলেন ঢাকায়। সেই সাথে নিয়ে গেলেন মেজর আমিন আহমদ চৌধুরীকেও। ব্রিগেডিয়ার মজুমদারের স্থানে আনসারী নিযুক্ত হলেন স্টেশন কমান্ডার। কর্নেল শিগারী দায়িত্ব নেন ই-পি-আর এর সেক্টর কমান্ডার হিসাবে।

এই রদবদলে আশংকিত হয়ে উঠেন বাঙালি সৈনিক ও অফিসারেরা। এই দিনই গুরুতর অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন লেঃ কর্নেল চৌধুরী।

এদিকে চট্টগ্রাম শহরের উত্তেজনা ক্রমেই বেড়ে চলছিল। অস্ত্র বোঝাই জাহাজ সোয়াতের বিরুদ্ধে গড়ে তোলা হচ্ছিল প্রবল প্রতিরোধ। অস্ত্র খালাস করে যাতে পশ্চিমা সৈন্যদের হাতে পৌছাতে না পারে তার জন্য রাস্তায় রাস্তায় তৈরী করা হলো ব্যারিকেড। এই ব্যারিকেড সরিয়ে রাস্তা পরিস্কারের কাজে লাগানো হল বাঙালি সৈন্যদের। রাত ১০ টা পর্যন্ত চলল এই ব্যারিকেড সরানোর কাজ। রাত ১১ টার অফিসার কমান্ডিং জানজুয়া আকস্মিকভাবে মেজর জিয়ার কাছে নির্দেশ পাঠালেন এক কোম্পানী সৈন্য নিয়ে বন্দরে যাওয়ার জন্য। এই আকস্মিক ও রহস্যজনক নির্দেশের অর্থ তাঁর কাছে বোধগম্য হল না। রাত প্রায় সাড়ে এগারোটায় জানজুয়া নিজে এসে তাকে নৌবাহিনীর একটা ট্রাকে তুলে ষোল শহর ক্যান্টনমেন্ট থেকে বন্দরের দিকে রওনা করিয়ে দেন কিন্তু রাস্তায় ব্যারিকেড সরিয়ে সরিয়ে যেতে তার দেরী হচ্ছিল। আগ্রাবাদে যখন একটা বড় ব্যারিকেডের সামনে বাধা পেয়ে তার ট্রাক দাঁড়িয়ে পড়ে তখনই পিছন থেকে ছুটে আসে একটি ডজ গাড়ি। ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান গাড়ী থেকে নেমেই আসেন মেজর জিয়ার কাছে। তাঁকে হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে যান রাস্তার ধারে।

-পশ্চিমারা গোলাগুলি শুরু করেছে। শহরের বহু লোক হতাহত হয়েছে। খালেকুজ্জামানের উত্তেজিত কণ্ঠস্বর থেকে কথা কয়টি ঝরে পরে। কি করবেন জিয়া ভাই এখন?

মাত্র আধ মিনিট। গভীর চিন্তায় তলিয়ে যান মেজর জিয়া। তারপর বজ্রনির্ঘোষে বলে উঠেন- উই রিভোল্ট!

সাথে সাথে তিনি খালেকুজ্জামান কে ফিরে যেতে বলেন। বললেন, ব্যাটালিয়নকে তৈরি করার জন্য অলি আহমেদকে নির্দেশ দিতে। আর সেই সাথে নির্দেশ পাঠান ব্যাটালিয়নের সমস্ত পশ্চিমা অফিসারকে গ্রেপ্তারের।

খালেকুজ্জামান দ্রুত ফিরে গেলেন ষোল শহরের দিকে। আর মেজর জিয়া ফিরে এলেন ট্রাকে। যে পশ্চিমা অফিসারকে তার সাথে দেয়া হয়েছিল, তাকে বললেন, হুকুম বদলে গেছে। বন্দরে যেতে হবে না। আমাদের এখন ফিরে যেতে হবে ক্যান্টনমেন্টে। বাঙালি সৈন্য যারা তার সাথে ছিলেন তাঁদেরকে ইশারায় বললেন রাইফেল লোড করে রাখতে, প্রয়োজন হতে পারে।

তাঁরা ফিরে আসেন ব্যাটালিয়নে। এসেই তিনি সাথের পশ্চিমা অফিসারকে অস্ত্র সমর্পণের নির্দেশ দিয়ে বলেন, তুমি এখন আমাদের হাতে বন্দী। অফিসারটি আত্মসমর্পন করলে তিনি ট্রাক থেকে নেমে ট্রাকের পশ্চিমা নৌ-সেনাদের দিকে রাইফেল তাক করে তাদেরকেও অস্ত্র ছেড়ে আত্মমসমর্পন করতে বলেন। হতচকিত পশ্চিমা সেনারা সবাই আত্মসমর্পণ করে।

এরপর তিনি একাই গাড়ি নিয়ে ছুটে যান অফিসার কমান্ডিং জানজুয়ার বাড়ি। কলিং বেল টিপতেই ঘুম থেকে উঠে আসেন জানজুযা। আর সামনেই মেজর জিয়াকে দেখে ভূত দেখার মত করে চমকে উঠেন। তার ধারনা ছিল পরিকল্পনা অনুযায়ী মেজর জিয়া বন্দরে বন্দী রয়েছে। জানজুয়া কে গ্রেফতার করে নিয়ে ষোলশহরে ফিরে আসেন মেজর জিয়া। পথে অফিসার্স মেসে মেজর শওকত কে তিনি সব কথা বলতেই মেজর শওকত উৎফুল্ল হয়ে উঠেন এবং বিদ্রোহে তাঁর সাথে যোগ দেয়ার কথা ঘোষনা করে দ্রুত ব্যাটালিয়নে চলে আসেন।

এরপরই মেজর জিয়া স্থানীয় জননেতা ও বেসামরিক অফিসারদের সাথে যোগাযোগ চেষ্টা করেন, কিন্তু কাউকেই পান না। তখন টেলিফোন এক্সচেঞ্জের অপারেটর কে জানালেন সবাইকে টেলিফোন করে ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিদ্রোহের ঘোষনার কথা জানাতে। অপারেটর সানন্দে তাঁর এই নির্দেশ জানাতে রাজি হন।

তিনি লেঃ কর্নেল এম, আর , চৌধুরীকেও টেলিফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। কিন্তু তাঁকেও পাননি। পরে শুনেছিলেন পকিস্তানী সৈন্যরা এই রাতেই গুরুতর অসুস্থ এম, আর , চৌধুরীকে হত্যা করেছিল।

শুরু হয়ে গেল বিদ্রোহ। রাত তখন দুটো। ব্যাটালিয়নের আড়াইশোর মত সৈনিককে একত্রিত করে তাঁদেরকে সব কথা বলেন মেজর জিয়া। সবাই একবাক্যে এই বিদ্রোহের প্রতি তাঁদের পূর্ণ সমর্থনের কথা ঘোষনা করেন। তাঁরা জানান, দেশের স্বাধীনতার জন্য তাঁরা জান দিতেও প্রস্তুত। কিছু সৈন্য ষোলশহরে রেখে বাকিদের নিয়ে মেজর জিয়া বেরিয়ে পরেন কালুরঘাটের পথে। এদিকে ই-পি-আর এর জোয়ানেরাও লড়াই শুরু করেছিল। কালুরঘাটে পরেরদিন তাঁদের সাথে বেশ কিছু পুলিশ ও যোগ দেন।

২৬শে মার্চ সকাল। আগের রাতে ঢাকা শহরে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে রাজধানীর উপরে পূর্ণ কর্তৃত্ব স্থাপন করেছিল পাকিস্তানী বাহিনী। আর আনন্দে সকাল হতেই পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের সদর দফতরে চলছিল মিষ্টি বিতরণ আর অভিনন্দন বিনিময়ের পালা। কিন্তু কয়েক মূহুর্ত পরেই তাদের হাসি ম্লান হয়ে যায়। মিষ্টি হয়ে যায় বিস্বাদ। চট্টগ্রামের যুদ্ধের খবর যখন তাদের কাছে পৌছাল, তখন এক নিদারুন সন্ত্রস্তে আঁতকে উঠলেন তারা।

চট্টগ্রাম। পাকিস্তানীদের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ালো চট্টগ্রাম। ২৭শে মার্চ সকালেই বিমান বোঝাই হয়ে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এসে গেল পুরো দ্বিতীয় কমাণ্ডো ব্যাটালিয়ন। চট্টগ্রাম যুদ্ধের পরিকল্পনা তৈরীর জন্য মিঠা খান কে হেলিকপ্টারে পাঠানো হয় চট্টগ্রামে। বাঙালি সৈন্যরা গুলি করে সে হেলিকপ্টারটি ফুটো করে দেয়। একই সাথে বিমানে করে নামানো হতে লাগল দ্বিতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়ন কে। নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ বাবর কে নিয়ে আসা হয় বন্দরে। এতে ছিল দুই ব্যাটালিয়ন সৈন্য। ডেস্ট্রয়ার, এক স্কোয়াড্রন ট্যাঙ্ক ও লাগানো হয় এই যুদ্ধে। জাহাজের গান থেকেও গোলা নিক্ষেপ হতে থাকে শহরের দিকে।

এই বিরাট শক্তির মোকাবিলায় বেশিক্ষন টিকে থাকা সম্ভব হবে না এ কথা বাঙালি সৈন্যরা বুঝেছিলেন। তাই শহর ছেড়ে যাবার আগেই বিশ্ববাসীকে কথা জানিয়ে যাবার জন্য মেজর জিয়া ২৭শে মার্চ সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রে যান। বেতার কেন্দ্রের কর্মীরা মেজর জিয়া কে পেয়ে উৎফুল্ল হয়ে উঠেন। কিন্তু কি বলবেন তিনি? একটি করে বিবৃতি লিখেন আবার ছিড়ে ফেলেন। কি জানাবেন তিনি বিশ্ববাসী এবং দেশবাসী কে বেতার মারফৎ? এদিকে বেতার কর্মীরা বারবার ঘোষণা করছিলেন- আর পনের মিনিটের মধ্যে মেজর জিয়া ভাষণ দেবেন। কিন্তু পনের মিনিট পার হয়ে গেল। মেজর জিয়া মাত্র তিনলাইন লিখতে পেরেছেন। তখন তাঁর মানসিক অবস্থা বুঝাবার নয়। বিবৃতি লেখার ঝুঁকিও ছিল অনেক। ভাবতে হচ্ছিলো শব্দ চয়ন, বক্তব্য পেশ প্রভৃতি নিয়ে।

প্রায় দেড় ঘন্টা মোসাবিদার পরে তিনি তৈরী করেন তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণটি। নিজেই সেটা বাংলা ও ইংরেজীতে পাঠ করেন।

১১ই এপ্রিল পর্যন্ত কালুরঘাটে থেকে তাঁরা চট্টগ্রামের যুদ্ধ চালিয়ে যান। তাঁদের যুদ্ধের সাথে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল ২০ তম বালুচ রেজিমেন্ট, কুমিল্লা থেকে নিয়ে যাওয়া ৫৩-ব্রিগেড। আর নিশ্চিহ্ন হয়েছিল কমান্ডো, যারা অবাঙালিদের ঘরে ঘরে ঘাঁটি গেড়েছিল।

এদেরকে ছাড়াও চট্টগ্রামের এই যুদ্ধে বাঙালিদের বিরুদ্ধে লাগানো হয়েছিল কোয়েটা থেকে নিয়ে আসা ১৬শ ডিভিশন ও প্রথম কমান্ডো ব্যাটালিয়নকে।

৩০শে মার্চ সকালে মেজর জিয়া স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র (চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র) থেকে আর এক ঐতিহাসিক ভাষণে শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ কমান্ডার ঘোষণা করেন।

এই দিনই দুটি পাকিস্তানী বিমান থেকে গোলাবর্ষন করে বেতার কেন্দ্রটি ধ্বংস করে দেওয়া হয়।

১১ই এপ্রিল কালুরঘাট এলাকা থেকে অবস্থান সরিয়ে নেয়ার পর যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে আশেপাশের বিস্তীর্ণ এলাকায়। এ যুদ্ধ চলে রামগড়, রাঙ্গামাটি এলাকায়। যুদ্ধ চলে কক্সবাজারের পথে, শুভপুরে। যুদ্ধ শুরু হবার পর থেকেই দলে দলে জনসাধারণ বিশেষ করে ছাত্ররা এসে যোগ দিয়েছে বাহিনীতে। অস্ত্র ধরেছে, ট্রেনিং নিয়েছে, বীরত্বের সাথে লড়াই করেছে।

৩০শে মার্চ চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র ধ্বংস হয়ে যাবার পর ৩রা এপ্রিল রাত সাড়ে নয়টায় পার্বত্য চট্টগ্রামের কোন এক গোপন এলাকা থেকে চালু করা হয় আরেকটি বেতার কেন্দ্র। “আমার সোনার বাংলা” দিয়ে করা হয় এই কেন্দ্রের উদ্বোধন। এই গানটি গাইবার জন্য সেই রাতে সেখানে এসেছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রামের তদানীন্তন পুলিশ সুপার জনাব রহমানের তিন মেয়ে।

—————————————————————-

<৯, ২.২, ৩২-৪০>

ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের ঘটনা ও প্রতিরোধ
সাক্ষাৎকার : মেজর এনামুল হক চৌধুরী
(১৯৭১ সালের মার্চে ক্যাপ্টেন পদে কর্মরত ছিলেন। সাক্ষাৎকারটি বাংলা একাডেমীর দলিলপত্র থেকে সংকলিত)

৭ -১১ -১৯৭৩

২৪শে মার্চ ব্রিগেডিয়ার মজুমদার,  কর্নেল হামিদ হোসেন শিগরী, ক্যাপ্টেন মোহসিন (এডজুট্যান্ট) চট্টগ্রাম বন্দরে  ‘এম, ভি, সোয়াত’ জাহাজের অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ খালাসের ব্যাপারে আলোচনা করার জন্য এক উচ্চ পর্যায়ের সম্মেলনে যোগ দিতে চলে যান। আমাকে নির্দেশ দিয়ে যান ব্রিগেডিয়ার আনসারী,  হেলিকপ্টার যোগে ঢাকা থেকে আসার পর তাকে জীপ যোগে চট্টগ্রাম বন্দরে পাঠিয়ে দিতে।

হেলিকপ্টার যখন চট্টগ্রাম সেনানিবাস অবতরণ করে তখন আশ্চর্যের সাথে দেখতে পাই লেফটেন্যান্ট জেনারেল আব্দুল হামিদ খান (সি-ও-এস,  পাকিস্তান আর্মি),  জেনারেল নওয়াজেশ,  জেনারেল  খাদিম হোসেন রাজা (জি-ও-সি,  ১৪ ডিভিশন,  ঢাকা)  এবং ব্রিগেডিয়ার  আনসারী এরা সবাই হেলিকপ্টারে ঢাকা থেকে এসেছেন। কিন্তু ব্রিগেডিয়ার আনসারী সেই হেলিকপ্টারে চট্টগ্রাম বন্দরে চলে যান। তাদেরকে দেখার সাথে সাথে আমরা সবাই আশ্চর্যান্বিত হয়ে গেলাম কারণ তাদের আগমন অপ্রত্যাশিত ছিল।

জেনারেল দের আগমনের সাথে ২০-বালুচের সি-ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফাতমী ই-বি-আর-সি তে আসেন। চা পানের পর জেনারেল খাদেম হোসেন রাজা ২০-বালুচের সি-ওর সাথে ২০-বালুচ অফিসে যান। কিন্তু আমরা আশ্চর্য হয়ে যাই যে, স্টার প্লেট ছাড়াই তিনি গাড়িতে করে ছদ্মবেশে ২০-বালুচের অফিসে চলে যান। ই-বি-আর-সি অফিসার মেস এ আমরা লাঞ্চ পার্টির ব্যাবস্থা করি। সেখানে প্রায় ৩০/৪০ জন অফিসার উপস্থিত ছিলেন।  ব্রিগেডিয়ার মজুমদার ও ব্রিগেডিয়ার আনসারির জন্য আমরা প্রায় ১ ঘন্টা পর্যন্ত অপেক্ষা করছিলাম। ব্রিগেডিয়ার মজুমদার তিনটার সময় পোর্ট থেকে আমাকে টেলিফোনে পার্টি শুরু করার নির্দেশ দিলেন।

পার্টি হৈ হুল্লোড় এবং আনন্দের সাথে শুরু হয়ে যায়। কথা প্রসংগে জেনারেল খাদেম হোসেন রাজা মেজর মং কেও (এস-এস-ও) কে জিজ্ঞেস করেন যে অবসর জীবনে তিনি কি করবেন।  তিনি বললেন,  দেশের এই অনিশ্চিত  পরিস্থিতিতে  বাইরের কিছু চিন্তা করা সম্ভব নয়। খাদেম হোসেন রাজা বললেন, “থিংস আর গোয়িং টু বি নরমালাইজড ভেরী সুন। ডু নট ওরি। প্ল্যান ফর ইওর ফিউচার।“

খাদেম হোসেন রাজা আমাদেরকেও বললেন। “দিস আনসারটেইনিটি ইজ গোয়িং টু বি ওভার ভেরী সুন। ওয়ার্ক হার্ড। ডিভোট ইওর টাইম ফর ট্রেনিং।

ব্রিগেডিয়ার মজুমদারও বেলা পৌনে চারটার দিকে হেলিকপ্টার যোগে ব্রিগেডিয়ার আনসারী,  ক্যাপ্টেন মোহসিনসহ ই-বি-আর-সি তে আসেন। খাওয়া শেষ করার পর ব্রিগেডিয়ার মজুমদার আমাকে বলেন যে বিশেষ কারনে তিনি ঢাকা চলে যাচ্ছেন। তিনি আরো বলেন, “লুক আফটার ইওরসেল্ফ।”

তার সাথে ক্যাপ্টেন আমিন আহমদ চৌধুরী (এ-আর-ও-পি) মেডিকেল চেক আপ এর জন্য ঢাকা আসেন। সব জেনারেল একই হেলিকপ্টারে ঢাকা রওনা হয়ে যান।

২৪শে  মার্চ বিকালে ই-বি-আর-সিতে থমথমে ভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। আমাদের পেরিমিটার গার্ড এর সংখ্যা বাড়িয়ে দেয়া হয়।

২৫শে মার্চ বিকেলে কর্নেল এম, আর, চৌধুরী (চীফ ইন্সট্রাক্টর, ই-বি-আর-সি) আমাকে  সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র জোয়ানদের দিয়ে দিতে বললেন। সমস্ত জোয়ানদের বিভিন্নভাবে অরগানাইজ করা হয়।

এখানে উল্লেখ করা দরকার যে,  ষোলশহরে অবস্থিত অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিশেষ কোন অস্ত্রশস্ত্র ছিল না। ই-বি-আর-সি থেকে দেড়শত রাইফেল তারা ধার চেয়েছিল।  আমরা ঢাকা থেকে স্যাংশন পেয়ে তাদেরকে নিয়ে যেতে নির্দেশ দেই। অষ্টম বেঙ্গলের কোয়ার্টার মাষ্টার ক্যাপ্টেন অলি আহমদ আজ নেবেন কাল নেবেন বলে আর নেন নাই।  অষ্টম বেঙ্গলের কিছু সৈন্য এডভান্স পার্টি  হিসেবে পাকিস্তান চলে যায়। যাবার প্রস্তুতি হিসেবে সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র, গাড়ী জমা দিতে হয়েছিল। খুব কম অস্ত্রশস্ত্র, গাড়ী বাকি সৈন্যদের কাছে ছিল।

২৫শে মার্চ সকাল থেকেই চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন জায়গায় জনসাধারণ ব্যারিকেড সৃষ্টি করতে শুরু করে। বায়েজীদ বোস্তাম  থেকে ব্যারিকেড পরিস্কার করার জন্য ই-বি-আর-সি কে নির্দেশ দেয়া হয়। সাথে বেলুচ রেজিমেন্টের একটি কোম্পানীও ছিল।

লেফটেন্যান্ট  কর্নেল এম, আর চৌধুরীকে ব্যারিকেড পরিস্কার করার দায়িত্ব দেয়া হয়।  তার সাথে ক্যাপ্টেন আজিজ ব্যারিকেড পরিস্কারের কাজ তদারকি করছিলো।

সকাল ১১টা থেকে চারটে পর্যন্ত সকল সৈন্যসামন্ত নিয়ে মাত্র ২০০ গজ রাস্তা পরিস্কার করা হয়। বহু কষ্টে বায়েজীদ বোস্তামীর রাস্তার মোড় পর্যন্ত যান। সৈন্যদেরকে সেখানেই দুপুরের খাবার দেয়া হয়।

বেলা সাড়ে তিনটার দিকে বেসামরিক ট্রাক যেগুলো আমাদের সৈন্য নিয়ে ব্যারিকেড পরিস্কারের কাজে যাচ্ছিল সমস্ত ড্রাইভার ট্রাক ফেলে পলায়ন করেন।

বায়েজীদ বোস্তামের মোড়ে বিপুল জনসমাবেশ হয়েছিলো। তারা ড্রাম দিয়ে ব্যারিকেড তৈরী করছিল। এবং যেখানে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করছিল শ্লোগানে শ্লোগানে সে এলাকাকে তারা মুখরিত করে তুলেছিল।

জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য বাধ্য হয়ে কর্নেল এম, আর চৌধুরী নির্দেশে এক রাউণ্ড গুলি ছোড়া হয়। এতে তিনজন লোক আহত হয়।  একজনের অবস্থা খুব শোচনীয় ছিল।  পরে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আর সামনের দিকে অগ্রসর না হয়ে এম,  আর  চৌধুরী সৈন্য সামন্ত নিয়ে সেনানিবাসে ফিরে আসেন।

এরপর কর্নেল এম, আর চৌধুরীর সাথে আমার দেখা হয়। তিনি অত্যান্ত দুঃখের সাথে বলেন যে, এই গুলিটি শুধু পাকিস্তানীদের দেখাবার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলাম।

সন্ধ্যা ৭টার দিকে আমাদের এক কোম্পানীকে জেটি এলাকায় যেতে নির্দেশ দেয়া হয়। মেজর কামাল মেহের (পাঞ্জাবী) ক্যাপ্টেন আজিজ কোম্পানীকে নিয়ে জেটিতে রওনা হয়ে যান।

২১শে মার্চ ব্রিগেডিয়ার মজুমদার ই-বি-আর-সি’র বাঙালি অফিসারদেরকে ডেকে চট্টগ্রাম শহরকে পুরো নিয়ন্ত্রনে আনা এবং বাঙালিদের যেন অযথা হয়রানি, দুঃখ দুর্দশার সম্মুখীন হতে না হয়। সেদিকে লক্ষ্য  রাখার নির্দেশ দিলেন। তদানুসারে আমরা সমস্ত অফিসার সৈন্যদের নিয়ে শহরে যাই। আমি নিজে অয়ারলেস কলোনীতে যাই। সেখানে ক্যাপ্টেন রফিকের (এডজুট্যান্ট, ই-পি-আর) সাথে দেখা হয়। তার সাথে চট্টগ্রামের ডি-সি এবং এস-পিও ছিলেন। রাত আটটার দিকে অয়ারলেস কলোনীতে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। বহু কষ্টে ই-পি-আর ও বেঙ্গল রেজিমেন্ট পরিস্থিতি  নিয়ন্ত্রনে আনে।  তার জন্য ডি-সি,  এস পি খুব আনন্দিত হন এবং বলেন যে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা থাকলে পরিস্থিতি আরো মারাত্মক আকার ধারণ করত।

পরে আমি নৌবাহিনীর পশ্চিম পাকিস্তানী জোয়ানদেরকে হাতে অস্ত্রশস্ত্র সহ দেখতে পাই। অয়ারলেস কলোনীতেও তাদেরকে দেখা গিয়েছিল। তা আমি ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে বলি। তিনি বললেন যে এরপর নৌবাহিনীর কোন লোককে শহরে দেখা যাবে না।

কর্নেল এম, আর, চৌধুরী সেদিন খুব অসুস্থ ছিলেন। তার দুদিন আগে হাতে ব্যাথা পেয়েছিলেন। তিনি বলেন, “পরিস্থিতি খুব খারাপ। আমাদেরকে সাবধানে থাকতে হবে।“ এই সময় ঢাকা থেকে ক্যাপ্টেন আমিন আহমদ চৌধুরী টেলিফোনে চারদিকে খেয়াল রাখতে  বলেন। টেলিফোনটি এম, আর, চৌধুরী কে দিতে বলেন। এম, আর, চৌধুরী টেলিফোনে কথোপকথনের পর আমাকে বলেন, “পরিস্থিতি বড় খারাপ,  আমাদেরকে অত্যন্ত সতর্কের সাথে থাকতে হবে।“

২৫ শে মার্চ রাতে মেসে যাবার পর কর্তব্যরত অবস্থায় ক্যাপ্টেন মোহসিন আমাকে বললেন,  তার মেয়ে বড় অসুস্থ। আমি যদি তার জায়গায় ডিউটি করি তাহলে রাতে তিনি বাসায় থাকতে পারেন। আমি তাতে সম্মত হলাম।

অফিসে আসার পর ক্যাপ্টেন মোহসীন সব বুঝিয়ে দেন। এই সময়  মেজর বেগ  আসেন,  তিনি কড়া নির্দেশ দিয়ে যান যে আজকের পরিস্থিতি খুব খারাপ। যদি প্রয়োজন হয়  তাহলে সারারাত ডিউটি করতে হবে।

কর্নেল এম, আর চৌধুরীর সাথেও আমার দেখা হয়। তিনি বললেন আমি খাবার জন্য মেসে যাচ্ছি, এবং আমার কক্ষে থাকব। প্রয়োজন হলে আমার সাথে টেলিফোনে যোগাযোগ করবে। তবে পরিস্থিতি খারাপ।

রাতে শহর থেকে অনেক টেলিফোন পাই। বন্ধুবান্ধবরা পরিস্থিতি কেমন জিজ্ঞেস করছিলো। তাদেরকে বললাম যে, তারা যদি কিছু জানে তাহলে আমাকে যেন জানায়।

রাত সাড়ে এগারটার দিকে অষ্টম বেঙ্গল থেকে মেজর মীর শওকত আলী টেলিফোনে বললেন, ই-বি-আর-সি ও যত গাড়ী আছে সবগুলোই যেন তাদের জন্য সত্বর পাঠিয়ে দেয়া হয়। কারণ তাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে এমভি-সোয়াত থেকে সত্বর অস্ত্রশস্ত্র আনলোড করতে। কিছুক্ষন পর তিনি টেলিফোনে বললেন।  তার অধিনস্থ সকলে গাড়ির জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে।

আমি বললাম, গাড়ির জন্য খবর দেয়া হয়েছে। দু’তিন মিনিট তিনি আবার টেলিফোনে বললেন, ব্রিগেডিয়ার আনসারী তার সৈন্যসামন্ত নিয়ে যেতে নির্দেশ দিয়েছেন। যদি পাঠাতে আমি দেরি করি তাহলে আমার অসুবিধা হবে।

আমি জবাব দিলাম, “গাড়ি যাচ্ছে।“ এই সময় চট্টগ্রাম শহর থেকে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক এর ভাইস চেয়ারম্যান এম, এ কাদের আমাকে টেলিফোনে বললেন, ঢাকার কোন খবর পেয়েছেন। আমি বললাম না।  তিনি বললেন ঢাকায় পুলিশ, ই-পি-আর’ এর উপর পশ্চিম পাকিস্তানীরা হামলা চালিয়েছে। তারা বিদ্রোহ ঘোষনা করেছে। ঢাকার বাঙালি সামরিক বাহিনীর লোকেরাও বিদ্রোহ ঘোষনা করেছে।

টেলিফোন এক্সচেঞ্জ অপারেটর সে সময়ে বাঙালি ছিল,  তাই কোন অসুবিধা হয়নি।  আমি তাদের সবাইকে বললাম। আপনি কর্নেল এম, আর চৌধুরীর সাথে কথা বলুন। কাদের সাহেব ও এম,  আর চৌধুরী যখন কথা বলছিলেন তখন অপারেটর কে বলি তাদের কথোপকথন আমাকে মনিটর করতে।

কথা শেষ করে আমি বললাম, স্যার আমি সব শুনছি।  তিনি বললেন,  বাকি যতসব অস্ত্রশস্ত্র আছে সমস্ত জোয়ানদেরকে দিয়ে দিতে। তিনি সত্বর অফিসে আসছেন বলে জানালেন।  আমি সুবেদার মেজর,  নায়েক সুবেদার,  কোয়ার্টার মাস্টার ও অন্যদেরকেও ডেকে অস্ত্রশস্ত্র কোটে থেকে নিয়ে নিতে নির্দেশ দেই। তারা নির্দেশ নিয়ে বাইরে যাবার সাথে সাথে দেখতে পাই ২০-বালুচ থেকে অনেকগুলো গাড়ি আসছে।  গাড়িগুলো আমাদের সামনের রাস্তা দিয়ে শহরের দিকে যেতে দেখতে পাই। কিন্তু কিছুক্ষনের মধ্যে সব গাড়ি থেমে যায়। আমি বাইরে এসে দেখতে পাই গাড়ি থেকে সেনাবাহিনীর লোকজন নিচে নামছে। কোয়ার্টার গার্ড থেকে গার্ড কমান্ডার দৌড়ে এসে আমাকে বলে যে, ২০ বেলুচের সমস্ত লোক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে গাড়ি থেকে নামছে। আমি তাকে বললাম তুমি চলে যাও। সে যাওয়ার সাথে সাথে কোয়ার্টার গার্ডের লোকজনকে স্ট্যাণ্ড টু (সতর্ক) করা হয়।

অল্পক্ষনের মধ্যে ২০-বালুচের লোকেরা কোয়ার্টার গার্ডের রক্ষীদের উপর হামলা চালায়। মূহুর্তের মধ্যে চারদিক থেকে গোলাগুলি শুরু হয়ে যায়।

তখন হামিদ হোসেন শিগরী আমাকে টেলিফোন করে জানতে চান কোথা থেকে এ গোলাগুলি হচ্ছে বা কেন হচ্ছে। আমি বললাম, আমি কিছু জানি না। তবে বেলুচ রেজিমেন্টের লোকেরা আমাদের লোকদের উপর গোলাগুলি ছুড়ছে। তিনি বললেন, “ডু নট ওরি। আই উইল ট্রাই টু কন্ট্রোল দি সিচুয়েশন ইফ নিডেড। আই উইল শেড মাই ফর বেঙ্গল রেজিমেন্ট। দেয়ার ইজ নো ডিফারেন্স বিটুইন মাই সন এণ্ড ইউ ক্যাপ্টেন এনাম। আই উইল বি দি ফার্স্ট ম্যান টু টেক ইউ আউট ফ্রম দি ডিউটি রুম।“

চারদিক থেকে রাইফেল, এল-এম-জি, ২” মর্টারের আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছিল না। এ পরিস্থিতি চলতে থাকে দু’ঘন্টার মত। তারপর গর্জে ওঠে ৩” মর্টারের আওয়াজ।

কর্নেল শিগরীর আবার টেলিফোন পাই। তিনি বললেন, কে যে  আমার বাসার চতুর্দিকে গুলি ছুঁড়ছে। কিছুক্ষণ পর দু-তিন মিনিটের বিরতি হয়।

তিনি পুনরায় টেলিফোনে বললেন, “ইজ ইট এডভাইজ্যাবল ফর মি টু কাম টু অফিস এণ্ড টেক ইউ আউট?” আমি জবাব দিলাম গোলাগুলি বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত আসা উচিৎ নয়। তার সাথে সাথে পুনরায় সবরকমের গোলাগুলির আওয়াজ শোনা গেল। সাথে সাথে ট্যাংকের গর্জনও শোনা গেল। আমি যে ডিউটি রুমে ছিলাম, পাশে ৩” মর্টারের গোলা পড়ে। দরজা জানালার চতুর্দিক দিয়ে অনবরত গোলাবর্ষণ হচ্ছিল। আমি বাধ্য হয়ে টেলিফোনটি নিয়ে জমিনের উপর অবস্থান নিয়ে শুয়ে থাকি।  কর্নেল শিগরী আবার টেলিফোনে বললেন যদি কোন অফিসার আসে তাহলে তাকে কর্নেল শিগরীর সাথে কথা বলতে দেয়ার জন্য। আমাকে বললেন, তোমার কোন অসুবিধা হবে না। আমি সত্বর আসব। কিন্তু তারপর তার নিকট থেকে কোন সাড়া পাওয়া গেল না।

কিছুক্ষন পর গোলাগুলি কিছুটা কমে যায়।  বাহির থেকে কে যেন বলছিল আমার রুমে বহু লোক আছে।  সাথে সাথে আমি পাঞ্জাবী ক্যাপ্টেন আনোয়ারের কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে উচ্চকন্ঠে বললাম আমার কাছে আসতে।  আমাকে বলা হল বাইরে আসার সাথে সাথে হ্যাণ্ডস আপ করিয়ে তার বিকট স্বরে যেতে বলা হয়। দেখা হওয়ার সাথে সাথে ক্যাপ্টেন আনোয়ার বলে “ডু – নট ওরি।  ইউ আর নট এ প্রিজনার অব ওয়ার।  ফ্যাক্ট ইজ দ্যাট ইউ আনডার মাই কমাণ্ড।“

আমি তাকে কর্নেল শিগরীর সাথে কথা বলতে বলি। সে আমার কথামত কর্নেল শিগরীর সাথে আমার ডিউটি রুম থেকে কথা বলে। সে আমাকে সাথে করে ডিউটি রুম থেকে কোট এ নিয়ে যায় আর বলে, ভাগতে চেষ্টা করলে বিপদ হবে সাথে সাথে তিনজন প্রহরী আমার জন্য মোতায়েন করা হয়।

সেখানে দেখতে পাই বাঙালি সৈনিকদের মৃত্যুর আর্তনাদ। কেউ বাবারে মারে বলে চিৎকার করছে। কেউ পানির জন্য কাতরাচ্ছে।  আর সাথে সাথে দেখতে পাই পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা ঐ সমস্ত লোকদেরও  বেয়নেটের গুতো দিচ্ছে আর বলছে। বাংগালীকা জান বহুত ছখত হায়। আর ইয়ে শালা মারতা ভি নেহি হায়। মূমুর্ষ বাঙালি সৈন্যদের উপর পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের নির্যাতন যথেচ্ছ চলছিল।  যারা মূমুর্ষু অবস্থায় ছটফট করছিল পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা তাদের গলার উপর বুট দিয়ে চেপে ধরেছে, যাতে তাড়াতাড়ি তারা মারা যায়।

আমাকে প্রহরারত এক প্রহরী বলে, আপ আগার অর্ডার দেতে হাম ভি ইয়ে করনে ছাকতা। লেকিন ইয়ে আচ্ছা নেহী হায়। এক মুসলমান দুসরা মুসলমানকো খামাখা মার রাহা হায়। খোদা কি কসম হাম অভিতক এক গুলি ভী নেহী মারা। “সাথে সাথে আমাকে বলে “লেফটেন্যান্ট আবু তালেব (বাঙালি – আর্মি এডুকেশন কোর) সাব জিন্দা হায়।  উসকো সব বেয়নেট কররা থা উস টাইম পর হাম উনকা বাচা দিয়া।  উস দিন এমতেহানমে  সাব নে হামে পাশ করায়া। ইস লিয়ে হামনে ইস ইয়ে কিয়া। “এই সৈন্যটি আমার সাথে খুব ভাল ব্যাবহার করেছিল। আমিও তাকে অনুরোধ করেছি আমার কাছে থাকতে।  সে বলে ” ছোবাহ তাক হাম জিন্দা রাহেগা তো আপ ভী জিন্দা রাহেগা।”

ভোর হওয়ার সাথে সাথে ট্যাঙ্কের গর্জন বেশী বাড়তে থাকে। ব্যারাকের উপর ট্যাঙ্কের গোলাবর্ষন চলতে থাকে।  চারদিকে পাহাড়ের উপর তিন ইঞ্চি মর্টারের গোলা পড়তে থাকে আর চতুর্দিকে বাঙালি আহত সৈন্যদের গোঙানী ও আর্তনাদ পুরো এলাকায় এক বিভীষিকা এবং বীভৎসতা সৃষ্টি করেছিল।  তারপর দেখা গেল বহু বাঙালি সৈন্যকে চতুর্দিক থেকে বেয়নেটের মুখে ধরে আনা হচ্ছে আর তাদেরকে ই-বি-আর-সি স্কুল কক্ষে ঢুকানো হচ্ছে। একদল ভেতরে ঢোকার সাথে সাথে আর কয়েকজন পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যকে বড় লাঠি নিয়ে ঢুকতে দেখি। আর সাথে সাথে তাদের বেদম মারপিট শুরু হয়ে যায়।  তারা যখন ভীষন আর্তনাদ শুরু করে তখন পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা বাইরে আসে। বাহির থেকে ভেতরে দু-তিন রাউণ্ড গুলি ছোড়ার সাথে সাথে আর্তনাদ বন্ধ হয়ে যায়।

আমার সামনে যে সব সিপাহীকে গ্রেফতার করে আনা হয়েছিল। তাদেরকে বাঁধা হয়। ভোর সাতটার দিকে একজন সুবেদার এসে আমাকে জিজ্ঞেস করে  “খাজনা (ট্রেজারী) কিধার হায়। আমি আঙ্গুল দিয়ে দেখবার সাথে সাথে সুবেদার আমার উপর স্টেনগান উঠিয়ে বলে, ছহি ছহি বাতাও কিধার হায়। কারণ দুদিন আগে দেড় লাখ টাকা সিপাহীদের বেতন বাবদ ঢাকা থেকে ই-বি-আর-সি তে পাঠানো হয়েছিল।

কিছুক্ষনের মধ্যে সুবেদার একটি হাবিলদার কে নির্দেশ করে বলে,  সাব কো ভী বাঁধো।  হাবিলদার একটা রশি নিয়ে আসে।  আমি দুই হাত পিছু করার সাথে সাথে সে আমাকে বেশ শক্তভাবে বেঁধে ফেলে।  আমি বলি , ওস্তাদ বহুত জোয়াদা টাইট হায়,  সে বলে সাব আপকা বাজু বহুত মোটা হায়।  আমি হাসতে হাসতে বলি,  হামতো গামা নেহী হায়।  যাক সে আমার বাঁধন একটু শিথিল করে,  কিছুক্ষন পর আমার কমান্ডো  প্রহরীটি বাঁধন খুলে নামেমাত্র বেঁধে দেয়।

এই সময় আমাদের সুবেদার মেজর রুহুল আমিন, নায়েক সুবেদার কোয়ার্টার মাস্টার লুৎফুলকেও বেঁধে আনা হয়।

কিছুক্ষন পরে সুবেদার রহমান কে বেঁধে আনা হয়। তাকে আমি গুলিবিদ্ধ অবস্থায় দেখলাম।  একটা গুলি তার পেটে ঢুকে অপর দিকে বের হয়ে যায়। রক্ত পড়ছিল। তাকেও বেঁধে রাখা হয়।  পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা আমাদেরকে দেখিয়ে দেখিয়ে চা, পরাটা, হালুয়া, খাচ্ছিল। কমান্ডো প্রহরীটি আমার জন্য চা আনতে যাওয়াতে তাকে অপমান করা হয়। সে এসে বলে, “সময় সবকিছু করে।“

আমার সামনের লোকদেরকে খালি চা দেওয়া হয়।  তারা বিষ মনে করে খেতে ইতস্তত করে।  আমি একটু মুখে নিয়ে বলি, খেয়ে ফেল, কোন অসুবিধা হবে না। কিন্তু সুবেদার মেজর ও নায়েক সুবেদার লুৎফর রহমান তাতেও চা স্পর্শ করলেন না।

পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা ই-বি-আর-সি পাহাড়ের নিচে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় আর পাহাড়ের উপর ৩” মর্টার আর ট্যাংক দিয়ে অনবরত গোলাবর্ষন করতে থাকে। উপর থেকে প্রত্যুত্তরে দু-চারটি গুলিও আসতে থাকে।

২৬শে মার্চ বেলা এগারটার দিকে আমাদের কোয়ার্টার গার্ড থেকে পলাতক একটি বাঙালি সৈন্য ই-বি-আর-সি ফুটবল মাঠের ড্রেন থেকে অকস্মাৎ তিনটি গুলি ছুড়লে প্রায় ৬ জন পাকিস্তানী সৈন্য মৃত্যুবরণ করে। প্রায় ১২/১৩ জন মারাত্মকভাবে আহত হয়। তারপর সে পালাতে শুরু করে। পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে থাকে। শেষ পর্যন্ত সৈন্যটি তাদের গুলিতে মৃত্যুবরণ করে।

২৬শে মার্চ ভোর ৭টার দিকে পাক সৈন্যরা যেসব লোকদেরকে রাত্রে নির্দয়ভাবে হত্যা করেছিলো তাদেরকে একটি ট্রাকে ভর্তি করতে দেখতে পাই। আমার সামনে দিয়েও শ’খানেকেরও উপর লাশ নিয়ে যেতে  দেখতে পাই। প্রত্যেক লাশকে চারজন সৈন্য হাত পা ধরে মরা কুকুরের মতো নিয়ে যাচ্ছিলো। মাঝে মাঝে সৈন্যদেরকে কিছু লাশ মাটিতে ছেঁচড়িয়ে নিয়ে যেতে দেখতে পাই।

এই সময় কয়েকজন পশ্চিম পাকিস্তানী জুনিয়র অফিসারকে দেখতে পাই। তারা আমাকে বাঁধা অবস্থায় দেখে দুঃখ প্রকাশ করে। একজন ২০-বেলুচের লেফটেন্যান্ট কোয়ার্টার মাস্টার কেঁদে ফেলেছিলো।

বেলা তিনটার দিকে কর্নেল ফাতমী (২০ বেলুচের কমান্ডিং অফিসার) ইবিআরসি এলাকাতে আসেন এবং আমাকে বাঁধা অবস্থায় দেখে মনোক্ষুন্ন হন। তিনি এক হাবিলদারকে আমার বাঁধন খুলে দিতে নির্দেশ দেন। আমি লেফটেন্যান্ট আবু তালেবের কথা বলাতেও তার বাঁধন খুলে দেয়। অনুরোধ করাতে সুবেদার মেজর রুহুল আমীন ও নায়েক সুবেদার কোয়ার্টার মাস্টার লুৎফর রহমানের বাঁধনও খুলে দেওয়া হয়। আর লুৎফর রহমানকে বলেন, ‘তুমি একটা মেগাফোন নিয়ে যে সমস্ত লোক পাহাড়ের উপর বা অন্যান্য জায়গায় আছে তাদেরকে আত্মসমর্পণ করতে আহবান জানাও।’ তারা যদি খালি হাতে হাত উঁচু করে আসে তাহলে তাদেরকে কেউ মারবে না। পরক্ষণে তিনি সমস্ত বাঙালি সৈন্যর হাতের বাঁধন খুলে এক জায়গায় একত্রিত করতে নির্দেশ দেন। তাই করা হলো। আমাকে বলেন যে তুমি গিয়ে তাদের সাথে কথা বলতে পারো। তাদের উপর আর কোনো অত্যাচার করা হবে না।“

আমি গিয়ে সকলকে একত্র করে তাই বললাম। ৫০০/৬০০ জন বাঁধা অবস্থায় ছিলো। পুনরায় কর্নেল ফাতমীর সাথে দেখা করলে তিনি আমাকে বলেন, “এ্যানি হয়ার ইউ ওয়ান্ট টু গো ইউ ক্যান গো। ইফ ইউ ওয়ান্ট টু স্টে ইন অফিসার মেস, গো এহেড। বেটার গো হোম।”

আমি অন্যদের কথা জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ঢাকা থেকে নির্দেশ পেলে তাদেরকেও ছেড়ে দেওয়া হবে।

আমি দুজন সিপাহী নিয়ে মেসে টাকা আনতে যাই। ওখানে প্রহরারত হাবিলদার পাঞ্জাবী ভাষায় আমার প্রহরারত সিপাহীদের বলল, সাহেব যখন ভিতরে যাবে তখন তাকে হত্যা করো। আমি শুনতে পেয়ে একটু সামনে যেয়ে আবার ফিরে এসে বললাম, ওস্তাদ আব লোগ কোকাকোলা ফান্টা পিয়া, হামারা নাম পর পিলে। হামে এক বাদ ইয়াদ আয়া, কর্নেল সাব নে বাতায়া সিএমএইচ ছে ডাক্তার লে কর জখমী কো পহেলা দেখন কি লিয়ে। হাম ফের থোর বাদমে আয়েঙ্গা। এ যাত্রা মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যাই।

তারপর আবার কর্নেল ফাতমীর সাথে দেখা হয়। আমি বলি, আমার লোকজনের খাবারের কোনো ব্যবস্থা আছে? তিনি বলেন, আমাদের লোক নিয়ে তাদের খাবারের ব্যবস্থা করুন। না হয় তারা কষ্ট পাবে।

তিনি আরো বলেন, ইবিআরসি’র সামনে কোনো পশ্চিম পাকিস্তানী থাকবে না। রাত্রে তাদের কোনো অসুবিধা হবে না। এখানে বলা যেতে পারে ইবিআরসি’র সামনের জায়গাটা হলো বায়েজিদ বোস্তাম ও বেসমরিক লোকদের বাড়িঘর। লোকজনকে একত্রিত করে পুনরায় আমি তাদের খাবারের ব্যবস্থা করার জন্য বলি। আর বলি আমাকে লেফটেন্যান্ট তালেব, সুবেদার মেজর রুহুল আমীন ও নায়েব সুবেদার কোয়ার্টার মাস্টার লুৎফর রহনানকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা বাইরে যাচ্ছি। বাকিদের ঢাকা থেকে ক্লিয়ারেন্স পেলে ছেড়ে দেওয়া হবে। তবে ইবিআরসি’র সামনে রাত্রে কোনো পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য থাকবে না।

ই-বি-আর-সি থেকে বের হওয়া কষ্টকর ছিলো। চারিদিক থেকে এখনো এলোপাতাড়ি গোলাগুলি চলছিলো। মৃত্যুকে হাতে নিয়ে বহু কষ্টে ইবিআরসি এলাকা থেকে বের হতে সক্ষম হই।

ই-বি-আর-সি’র বাইরে একটি ফ্লাটে আমাদের চারজন অফিসার ছিলেন। আসার পথে তাদেরকে বাইরে নিয়ে আসতে যাই। আমাকে দেখে তারা যেনো আকাশ থেকে পড়ছেন বলে মনে হলো। আমাকে দেখার সাথে সাথে তারা ইবিআরসি’র ভিতরের অবস্থা জানতে চান। আমি উপরে বর্ণিত দু-একটি কথা বলার সাথে সাথে তাদেরকে আমার সাথে আসতে বলি। সেখানে ছিলেন মেজর রেজাউল রহমান (মেডিক্যাল স্পেশালিষ্ট), মেজর আশরাফ (রেডিওলজিষ্ট), ক্যাপ্টেন বাশার (আর্মি সাপ্লাই কোর) ও ক্যাপ্টেন মোহসীন (এডজুট্যান্ট, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট)।

তাদের মধ্যে একজন বলেন, আমরা তো মনে করেছিলাম ইবিআরসি’তে পশ্চিম পাকিস্তানীরা ফাঁকা আওয়াজ করেছে। জবাবে আমি বলি, “এক হাজারেরও অধিক লোককে তারা বেয়নেট বুলেট ও অন্যান্য মরণাস্ত্র দিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে।“

এ কথা শোনা মাত্রই মেজর রেজাউল রহমান সকলকে তৎক্ষণাৎ আমার সাথে শহরের দিকে চলে যেতে বলেন। পরিবারের সকলকে নিয়ে আমরা যাযাবরের মতো শহরের দিকে রওয়ানা হই।

চট্রগ্রাম শহরে আসার পর দেখি শহরবাসীরা ছোট ছোট অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মারমুখী হয়ে এদিক ওদিক ছোটাছোটি করছে। আমি আমার এক আত্মীয়ের বাড়িতে রাত দশটায় যাই এবং সেখানে রাতযাপন করি।

সকালে আওয়ামী লীগ অফিসে জনাব এম আর সিদ্দিকীর সাথে কথা হয়। তিনি আমাকে চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত ইপিআরের কমাণ্ড নিতে বলেন।

আমি কয়েকজন ছাত্রের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে রওয়ানা হই এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে (চট্রগ্রাম বেতার কেন্দ্র) যাই। সেখানে ক্যাপ্টেন সুবেদ আলী ভূঁইয়া ও লেফটেন্যান্ট শমসের মুবিনকে দেখতে পাই। সুবিদ আলী ভুঁইয়াকে দেখামাত্র বলি, “কেন বিনা যুদ্ধে ই-বি-আর-সি ছেড়ে চলে আসলে?”

 সে জবাবে বলে, কোনো উপায় না দেখে আত্মগোপন করছি। বেশী কিছু না বলে তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবার কথা বললাম। সে আমাকে যাওয়ার জন্য বললো। আমি বললাম, “আমি কোরবানীর বকরা, তাই যাচ্ছি।“ তারপর ছাত্রদের সাথে গাড়িতে করে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই। সেখানে ইপিআর’দের সংগঠিত করি।

আমি ইপিআর’এর লোকদেরকে যুদ্ধ করার জন্য এক জ্বালাময়ী বক্তৃতায় ইবিআরসি’র ঘটনাবলীর কথা বলাতে তারা একযোগে পশ্চিম পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে তাদের দৃঢ় শপথ ঘোষণা করলো।

ই-পি-আর’দের নিয়ে কোথায় কি করতে হবে তার পরিকল্পনা করার পর আমি পুনরায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে মেজর জিয়াউর রহমানের সাথে যোগাযোগ করতে চেষ্টা করি। দেখা না পেয়ে বেতার কেন্দ্রে একদিনের মতো কাজ করি। বাইরে যাবার পর দেখি চারিদিকে লুটপাট, মারামারি চলছে। একজন ছদ্মবেশী ক্যাপ্টেন, নাম নাসির। তার সাথে কতোয়ালী থানা থেকে অস্ত্রশস্ত্র বাহির করতে যাই। সেখানে প্রহরারত প্রহরীদের দেখি। নাসিরের হাবভাবে মনে হলো যে, সে সেনাবাহিনীর লোক নয়। তদুপরি থানা থেকে ১০/১৫ হাজার টাকা চাওয়াতে মনে আরো সন্দেহ হয়। চট্রগ্রামে আরো দুদিন ছোটখাটো অপারেশন করার পর আমি ফেনীর পথে রওয়ানা হই এবং ফেনী, নোয়াখালী, মাইজদী, লাকসাম, কুমিল্লার মিয়ার বাজার, চৌদ্দগ্রাম এলাকার সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব নেই। ফেনীতে হেডকোয়ার্টার ছিলো। পুলিশ, ইপিআর, আর্মি, মুজাহিদ, ইউওটিসি ও ছাত্রদের নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী মুক্তিবাহিনী গঠন করতে সক্ষম হই। সেখানে জনাব খাজা আহমেদ, জনাব জহরুল কাইয়ূম- এম-সি-এ’কে ভারত থেকে আমাদের জন্য অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করতে অনুরোধ করি। তারা তাদের চেষ্টা চালান। দুদিন পর বেলুনিয়ার এসডিও ও বিএসএফ কমান্ডারের সাথে আমাদের এক উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক হয়। সেখানে জনাব খাজা আহমদ, জনাব জহুরুল কাইয়ূম, জনাব আবদুর রশিদ এমসিএ উপস্থিত ছিলেন। আমাদের অস্ত্রশস্ত্রের প্রয়োজন তাদেরকে জানাই। বিএসএফ কমান্ডার সবকিছু দিতে স্বীকার করেন।

আমরা বাংলাদেশ থেকে ভারত সীমান্তে রসদপত্র রাখার ব্যবস্থা করাই। সেদিনই সব ব্যবস্থা করা হয়। তার সাথে সাথে বার্টার সিস্টেম আমাদের প্রয়োজনীয় জিনিস তারা দিবেন বলেও স্বীকার করেন।

আমরা আমাদের এলাকাটাকে পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী থেকে মুক্ত রাখার জন্য চতুর্দিকে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ঘাঁটি তৈরী করি। যে সব রাস্তা দিয়ে হানাদার বাহিনী চলাচল করার সম্ভবনা ছিলো সেসব রাস্তার গুরুত্বপূর্ণ সেতুগুলো ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া হয়। যেমনঃ চৌদ্দগ্রাম-লাকসাম রাস্তার ডাকাতিয়া নদীর উপর বড় সেতু হরিকোট পুল, ফেনী-লাকসাম রেলওয়ে রাস্তার বড় সেতু পরিকোট ব্রীজ। এছাড়া নোয়াখালীর অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্রীজও উড়িয়ে দেওয়া হয়েছিলো। পরিকোট ব্রীজের সত্বর মেরামতের কাজ পরিদর্শনের জন্য কুখ্যাত টিক্কা খান এসেছিলো এখানে।

লাকসামে আমাদের অবরোধ প্রতিহত করতে পশ্চিম পাকিস্তানীরা মারমুখী হয়ে পড়ে। বিভিন্ন জায়গায় চারদিন অনবরত যুদ্ধের পর আমাদেরকে লাকসাম ছাড়তে হয়।

লাকসাম-নোয়াখালী প্রবেশপথে খণ্ড খণ্ড বহু যুদ্ধ হয়। যার নেতৃত্বের ভার সুবেদার লুৎফরকে দেয়া হয়েছিলো। বহুদিন খণ্ডযুদ্ধ চলার পর ভারী আধুনিক অস্ত্রের অভাবে পিছু হটতে বাধ্য হই।

সামান্য কিছু অস্ত্র নিয়ে ভারত থেকে মাঝে মাঝে এমসিএ নুরুল হক যুদ্ধক্ষেত্রে আসতেন। তাকে দেখে আমাদের লোকজন দ্বিগুন উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে যুদ্ধ করার মনোবল পেত।

সমুদ্রপথে পশ্চিম পাকিস্তানীদের আক্রমণ প্রতিহত করতে চারদিক দিয়ে বহু বাঙ্কার তৈরী করা হয়। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানীরা আমাদের শক্তিশালী অবরোধ দেখে নোয়াখালী থেকে ফেনী না এসে লাকসাম থেকে ফেনীর দিয়ে রেলপথে ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে অগ্রসর হয়। পরিকোট পুলের নিকটে প্রায় একদিন যুদ্ধ চলে। তাদের ত্রিমুখী আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে আমাদের লোকজন পিছু হটে আসে। আমাদের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিলো। ঐ দিনই পাকিস্তানী সেনাদেরকে তিনদিকে আটক করে রাখি। নোয়াখালীর পশ্চিম দিকে, ফেনীর উত্তর দিকে ও বুরবুরিয়া ঘাট এলাকায়।

পশ্চিম পাকিস্তানীরা একদিন গুণবতীতে অপেক্ষা করার পর অতর্কিতে ফেনীর তিন দিক ঘিরে ফেলে। আমাদের লোক মারমুখী হয়ে বারো ঘন্টার মতো তাদেরকে বহু কষ্টে ঠেকিয়ে রাখে। কিন্তু তাদের ভারী আধুনিক অস্ত্রের মুখে টিকতে না পেরে ফেনী ছাড়তে বাধ্য হয় এবং ভারতের সীমান্তে গিয়ে একত্রিত হয়। তখন ছিলো মে মাস।

একিনপুরে আমরা সবাই একত্রিত হই। একিনপুর থেকে চার কোম্পানী সৈন্য নিয়ে শুভপুর বুরবুরিয়া ঘাট, মুহুরী নদী ও ছাগলনাইয়া ফ্রন্টে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে যাই। ছাগলনাইয়ায় বাঙ্কার তৈরী করে অপেক্ষা করছিলাম। পাক সেনাবাহিনী একদিন অতর্কিতে হামলা করে। তাদের কিছু সংখ্যক মুহুরী নদী পাড় হতে দেই এবং এবং তাদের উপর অতর্কিতে হামলা চালানো হয়। অনেক পাক সৈন্য নিহত হয়। এমনকি তাদের লাশ নিতেও দেড় দিন পর্যন্ত কোনো আসে নাই। বাধ্য হয়ে সকল সৈন্য সামন্ত নিয়ে ভারতে আসতে হয়। আমরা ১নং সেক্টরে প্রথম পর্যায়ে মেজর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে সংগঠিত হই। আমার কিছুসংখ্যক লোক খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে ২নং সেক্টরে যুদ্ধ করে।

স্বাক্ষরঃ এনামুল হক চৌধুরী

০৭-১১-১৯৭৩

———————————————–

<৯, ২.৩, ৪১-৪৪>

ক্যাপ্টেন শমসের মুবিনের

দৃষ্টিতে চট্টগ্রামের প্রতিরোধ

সাক্ষাৎকারঃ ক্যাপ্টেন শমসের মুবিন চৌধুরী

২০-১০-১৯৭৩

(বাংলা একাডেমির দলিলপত্র থেকে সংকলিত)

মার্চের ২২ তারিখে ক্যাপ্টেন হারুন (এসিস্ট্যান্ট উইং কমান্ডার, ইপিআর) কাপ্তাই এসে আমাকে বললো যে আমাকে মেজর রফিকের (এডজুট্যান্ট, ইপিআর) বাসায় যেতে হবে। ২২শে মার্চ রাতে আমি, ক্যাপ্টেন হারুন, মেজর খালেকুজ্জামান, ক্যাপ্টেন অলি মিলে মেজর রফিকের বাসায় গেলাম।

জনাব কায়সার এমপিএ এবং ডাক্তার মান্নান, এই দুজন আওয়ামী লীগ কর্মীও সেখানে ছিলেন। আমরা স্থির করলাম যে, এখানে আলাপ-আলোচনা করা নিরাপদ নয়, তাই আমরা চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে গেলাম। যাবার সময় আমরা খুব সতর্ক ছিলাম যে, কেউ আমাদের অনুসরণ করছে কিনা।

আমরা আওয়ামী লীগ কর্মীদের তাদের পরিকল্পনা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। তারা বললেন যে, শেখ সাহেব রাজনৈতিক সমাধানের আশা করছেন। আমরা বললাম যে, আমরা আপনাদের সাথে আছি। আপনাদের পক্ষ থেকে যদি ঠিক সময়ে কোনো সাড়া বা আভাস পাই তাহলে আমরা কিছু একটা করতে পারি।

আমরা বুঝতে পারলাম যে তাদের কোনো প্রস্তুতি নেই। আমরা বললাম যে আমরা মানসিক দিক থেকে প্রস্তুত আছি। আপনারা ঢাকা থেকে খবরাখবর নিয়ে অমাদের জানাবেন।

২৩শে মার্চ মেজর রফিক আমাদের প্রস্তুত থাকতে বললেন। কিন্তু কিছু একটা হবে কিনা তিনি তখনো জানেন না। আমাদের আলাপ-আলোচনার কথা মেজর জিয়াউর রহমানকে জানালাম। তাকে আমরা আবার আশ্বাস দিলাম যে আমরা সবসময় তার সাথে থাকবো। এর আগে লেঃ মাহফুজকে পরিস্থিতি অবগত করানোর জন্য মেজর জিয়াউর রহমান আমাকে বলেছিলেন। আমি তাকে পরিস্থিতি বুঝিয়ে বললাম যে আমাদেরকে পাকিস্তানীরা সন্দেহ ও অবিশ্বাসের চোখে দেখছে। আমরাও তাদেরকে বিশ্বাস করতে পারছি না। মেজর জিয়াউর রহমান বলেছেন যে ‘সিটিং ডাক’-এর মতো না থেকে নিরস্ত্র করতে আসলে তা প্রতিহত করবেন। মাহফুজ বললো যে পরিস্থিতি এতো মারাত্মক আকার ধারণ করেছে কিনা? তারপর সে বললো যে আচ্ছা ঠিক আছে।

২৪শে মার্চ মেজর রফিক আমাকে বললো যে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ তাদের কোনো সিদ্ধান্ত এখনো আমাদেরকে জানান নি। ২৪শে রাতে খবর পেলাম যে জনগণ রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড তৈরী করছে। ‘এমভি সোয়াত’ থেকে অস্ত্রশস্ত্র খালাস করতে জনগণ বাধা দিচ্ছে। জেটি থেকে সেনানিবাস পর্যন্ত রাস্তায় ব্যারিকেড সৃষ্টি করা হয়েছ যাতে সেনাবাহিনীর লোকজন চলাফেরা করতে না পারে। এ খবরটা আমি জিয়াউর রহমান সাহেবকে পাঠালাম।

আমাদের সৈনিকদের মাঝে একটা আতংক দেখতে পেলাম। কি হবে? কি করতে হবে না হবে? বাইরের ঘটনাবলীতে সৈনিকরাও যথেষ্ট উদ্বগ্ন ছিলো। আমি সারারাত সজাগ ছিলাম। ২৪শে মার্চ পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর দুইজন মেজর জেনারেল চট্রগ্রামে ইবিআরসি-তে এসেছিলেন। ঐদিন জানতে পারলাম দু’জনের সাথে করে ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে (ইবিআরসি-কমান্ডার মার্শাল ল এডমিনিসট্রেটর) ঢাকা নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এ খবরটা জিয়াউর রহমানকে জানাই। আমাদের সি,ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল জানজুয়া বললেন যে ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে ঢাকা নিয়ে যাওয়া হয় নি। তিনি বার বার বলেছিলেন যে ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে ঢাকা নিয়ে যাওয়া হয় নি। ব্রিগেডিয়ার মজুমদারের জায়গায় ব্রিগেডিয়ার আনসারীকে সামরিক প্রশাসক নিযুক্ত করা হয়।

২৫শে মার্চ ব্রিগেডিয়ার আনসারী আমাদের সিও’কে নির্দেশ দিলেন যে আমরা যেনো ব্যারিকেড পরিস্কার করি। “অল ব্যারিকেড মাস্ট বি ক্লিয়ার এ্যাট এনি কস্ট”-এটা ব্রিগেডিয়ার আনসারীর মেসেজ ছিলো। ‘এ্যাট এনি কস্ট’ শব্দটার উপর আমাদের সিও খুব এ্যামফ্যাসিস করছিলেন। ষোলশহর রেলক্রসিং এর উপর ওয়াগন দিয়ে ব্যারিকেড সৃষ্টি করা হয়েছিলো। ঐ ব্যারিকেড সরাতে পুরো একটা কোম্পানী ডিটেইল করা হলো। সুবেদার খালেককে বললাম যে, এই ট্রেনের ওয়াগন যেনো বিকেল চারটার আগে সরানো না হয়। কমান্ডিং অফিসার আমাদের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারদেরকে ডেকে ঐ ওয়াগনগুলোর চাকা ব্রেক করতে শুরু করলেন। জনসাধারণ খুব হৈ হুল্লোড় করছিলো। বিকেল পর্যন্ত ঐ ব্যারিকেড সরানো হলো। বায়েজীদ বোস্তামি পর্যন্ত সমস্ত ব্যারিকেড পরিস্কার করতে নির্দেশ দেয়া হলো। আমরা আশা করেছিলাম যে আওয়ামী লীগ হাই কমাণ্ড থেকে কোনো নির্দেশ পাবো। আমি মেজর রফিকের সাথে টেলিফোনে যোগাযোগ করি। তিনিও বললেন যে কোনোনির্দেশ তিনিও পাননি। তিনিও প্রস্তুত আছেন।

আমরা ব্যারিকেড পরিস্কার করতে গেলাম। ২৫শে মার্চ রাত ৯টা নাগাদ সমস্ত ব্যারিকেড পরিস্কার করা হলো। জনসাধারণ আমাদেরকে খুব বাধা দিচ্ছিল। ” আপনারা এসব করবেন না। আপনাদেরই ক্ষতি হবে।” জনসাধারণ এসব বলছিলো। আমরা বললাম যে আমাদের নিজেদের ইচ্ছায় কিছু করছি না। আমরা শুধু নির্দেশ পালন করছি। তদুপরি আমরা অন্য কোনো নির্দেশও পাচ্ছি না। কমান্ডিং যে কোনো উপায়ে হোক ব্যারিকেড ক্লিয়ার করার নির্দেশ দিচ্ছিলেন।

ষোলশহর থেকে বায়েজীদ বোস্তামী পর্যন্ত ডিউটি দেবার জন্য আমাদের উপর নির্দেশ দেয়া হলো। আমরা যখন ডিউটি করছিলাম তখন বেলুচ রেজিমেন্টের ৫টা গাড়ি আমাদের সামনে দিয়ে ক্যান্টনমেন্টের দিকে চলে গেলো। ঐসব গাড়িতে গোলাবারুদ ও এমুনিশেনও ছিলো।

রাত সাড়ে এগারোটায় লেফটেন্যান্ট কর্নেল জানজুয়ার সাথে দেখা হয়। তিনি আমাকে মেজর জিয়াউর রহমানকে চট্টগ্রাম পোর্টে ডিউটি করার জন্য খবর দিতে বললেন। তিনি জিয়াউর রহমানের স্ত্রীকে বলতে বললেন যে ভয়ের কোনো কারণ নেই। জিয়াউর রহমান ২৬শে মার্চ সকালে চলে আসবে।

রাস্তায় ছেলেরা একটা গর্ত করেছিলো। আমাকে সেই গর্তটা ভরাট করতে বলা হলো। আমি জিয়াউর রহমানের স্ত্রীকে এ খবর দিলাম। জিয়াউর রহমানকেও এ খবর জানালাম।

রাত বারোটায় আমি ষোলশহর ক্যান্টনমেন্টের গেটে গেলাম। সেখানে গিয়ে গুলির আওয়াজ শুনতে পেলাম। বৃষ্টির মতো গুলি হচ্ছিলো। ক্যাপ্টেন অলিকে টেলিফোনে জানালাম যে ক্যান্টনমেন্টের ভিতরে ভীষণ গোলাগুলি হচ্ছে। আমি বুঝতে পারছি না সেখানে ঠিক কি হচ্ছে। ক্যাপ্টেন অলি আমাকে সঠিক খবর নেবার চেষ্টা করতে বললেন এবং তাকে জানাতে বললেন। এমন সময় কিছু বাঙালি সৈন্যকে গেটের দিকে আসতে দেখলাম। তারা আমাকে বললেন যে, স্যার বেলুচ রেজিমেন্ট আমাদের উপর হামলা চালিয়েছে এবং আমাদের অনেককে মেরে ফেলেছে। কর্নেল এমআর চৌধুরীকেও (ইবিআরসি চীফ ইন্সট্রাক্টর) মেরে ফেলেছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে তাদেরকে গাড়িতে উঠালাম এবং আমার সাথে ষোলশহরে এইটথ বেঙ্গলে নিয়ে আসলাম।

এইটথ বেঙ্গলে এসে শুনলাম যে, সমস্ত পশ্চিম পাকিস্তানী অফিসারদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মেজর জিয়াউর রহমানের নির্দেশে এটা করা হয়েছে। মেজর জিয়াউর রহমানের সাথে আমার দেখা হয়। তিনি বললেন যে, এখন থেকে তিনিই হচ্ছেন ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসার। তিনি আরো বললেন যে, গোলাগুলির খবর তিনি শুনেছেন। এখবর শোনার পর তিনি ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসার লেঃ কর্নেল জানজুয়াসহ অন্যান্য পশ্চিম পাকিস্তানী অফিসারদের গ্রেফতার করেছেন। পরে ওদের সবাইকে মেরে ফেলা হয়েছিলো। তারপর মেজর জিয়াউর রহমান আমাকে ব্যাটালিয়নের সবাইকে এক জায়গায় একত্রিত করতে বললেন। সবাইকে এক জায়গায় একত্রিত করা হলো। তারপর মেজর জিয়াউর রহমান টেবিলের উপরে উঠে বক্তৃতা দিলেন। তিনি বললেন, “আজ থেকে আমি অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসার হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার সংকল্প ঘোষণা করলাম। এবং আমার নির্দেশেই সবকিছু চলবে। আপনারা সবাই আমার সাথে থাকবেন। এখন এখানে থাকা আমাদের জন্য নিরাপদ নয়। আমরা সবাই কালুরঘাটের দিকে যাবো, সেখানে গিয়ে আমরা সবকিছু রিঅর্গানাইজ করবো এবং আমাদের পরবর্তী কর্মস্থল নির্ধারণ করবো।”

২৬শে মার্চ ভোরে আমরা কালুরঘাটের আরেকটু দুরে গিয়ে পৌঁছালাম। সেখানে আমরা বিশ্রাম নিলাম এবং রিঅর্গানাইজেশন করলাম। ২৬শে মার্চ এভাবে কেটে গেলো।

২৭শে মার্চ সন্ধ্যার সময় মেজর জিয়াউর রহমান চট্রগ্রাম বেতার কেন্দ্রে গেলেন এবং ভাষণ দিলেন। ভাষণে তিনি বললেন যে, আমরা স্বাধীনতা যুদ্ধে লিপ্ত আছি। আপনারা যে যেখানে আছেন, সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেন। তিনি বিশ্বের শান্তিকামী দেশগুলোর সাহায্য এবং সহযোগীতা কামনা করলেন। দেশবাসীকে যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে বললেন।

২৮শে মার্চ সারাদিন আমি ঐ ভাষণ বেতার কেন্দ্র থেকে পড়ি।

চট্টেশ্বরী রোডে অপারেশনঃ

পাকিস্তানী সেনাবাহিনী আমাদের এ্যামবুশ করেছিলো। আমরা দশ জন ছিলাম। আমরা ওদের কাউন্টার এ্যামবুশ করেছিলাম।

২৯শে মার্চ আসকের দীঘি অপারেশনঃ

প্রায় ১২ ঘন্টা এখানে পাকিস্তানী বাহিনীর সাথে আমাদের গোলাগুলি বিনিময় হয়।

৩০শে মার্চ বাকুলিয়া গ্রাম অপারেশনঃ

এখানে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর দুটো গেরিলা কমান্ডোকে হত্যা করা হয়।

এপ্রিল মাসের এগারো তারিখে কালুরঘাট ব্রীজে অপারেশন চালানো হয়। এখানে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী আমাদের আক্রমণ করে। এই যুদ্ধে আমি গুরতররুপে আহত হই। আমি পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়ি। তারপর আমাকে ঢাকা নিয়ে আসা হয়। বন্দী শিবিরে রাখা হয়এবং অশেষ নির্যাতন করা হয়। প্রত্যহ আমাকে মারধোর করা হতো। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে আমাকে রাখা হয়।আমার সাথে আরো অনেক বন্দী ছিলো। এদের বাসা থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। জুন মাস পর্যন্ত আমার উপর অত্যাচার চলে। নভেম্বর মাসে আমার বিরুদ্ধে চার্জশীট আনা হয়। বলা হয়েছিলো আমাকে কোর্ট মার্শাল করা হবে। কিন্তু ডিসেম্বরের ১৬ তারিখে পাক বাহিনী আত্মসমর্পন করে। আমি মুক্ত হয়ে যাই।

এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, কালুরঘাটে এসে গ্রামে আমরা শপথগ্রহণ করলাম। শপথবাক্য পাঠ করেছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান- বাংলাদেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত আমরা লড়াই চালিয়ে যাবো। এমনকি যদি প্রয়োজন হয় দেশের জন্য আমরা প্রাণ দেবো।

আমাদের ব্যাটালিয়নের হেডকোয়ার্টার ছিলো গ্রামে। ৩০শে মার্চ বাকুলিয়া গ্রামে অপারেশন চালিয়ে আমরা দুজন কমান্ডোকে হত্যা করি।

চকবাজারে আমরা প্রতিরক্ষা ব্যুহ তৈরী করি। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ট্যাংক আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে আমরা পিছু হটে যাই।

চট্রগ্রাম কালুরঘাটের যুদ্ধঃ

১১ই এপ্রিল সকাল আটটার সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনী ভীষণ আর্টিলারি ফায়ার শুরু করে। আমি এবং মেজর হারুন আমাদের অবস্থান পর্যবেক্ষণ করছিলাম। আমাদের সৈন্য সংখ্যা ছিলো প্রায় ৩৫ জন। ওদের সংখ্যা ছিলো ১০০-এর উপরে। আমাদের একজন সিপাহী এই যুদ্ধে মারা যায়। মেজর হারুন ব্রীজের উপর আহত হন। আহত হবার পর অতিকষ্টে তাকে পুলের অপর দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। পাকিস্তান বাহিনীর তীব্র আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে পিছু হটতে নির্দেশ দিলাম। আমাকে একজন সৈন্য বললো চলে যেতে। আমি বললাম যে, আমি আসছি। আমি রয়ে গেলাম। হঠাৎ আমি নিজেকে পাকিস্তান বাহিনী কর্তৃক ঘেরাও অবস্থায় দেখলাম। অন্য সবাই পুলের অপর পারে চলে যেতে সক্ষম হয়। আমি ট্রেঞ্চ থেকে বের হয়ে চারিদিকে চাইনিজ স্টেনগান দিয়ে গুলি ছুড়তে থাকলাম। তারপর একটা গুলি এসে আমার কোমরে লাগে এবং আমি গুরুতর আহত হয়ে পুলের উপর পড়ে গেলাম। আমি ভাবতে লাগলাম যে, শত্রুরা আমাকে ধরে ফেলবে। আমি ওদের হাতে ধরা পড়ার চেয়ে আত্মহত্যা করে মৃত্যুবরণ করাকে শ্রেয় বলে স্থির করলাম। কিন্তু স্টেনগানটা দুরে ছিলো। তাই এটা সম্ভব হলো না। আমি ভাবছিলাম ওরা আমাকে ধরে মেরে ফেলবে কিন্তু শত্রুরা আমাকে ধরে নিয়ে যায় এবং বন্দী করে রাখে। তারপর আমাকে ঢাকা পাঠিয়ে দেয়।

স্বাক্ষরঃ

শমসের

বাংলাদেশ আর্মি

——————————————————–

<৯, ২.৪, ৪৪-৪৬>

চট্টগ্রামে সশস্ত্র প্রতিরোধ

সাক্ষাৎকারঃ বিগ্রেডিয়ার হারুন আহমেদ চৌধুরী

(১৯৭১ সালে ক্যাপ্টেন পদে কর্মরত ছিলেন)

১৭১৯৭৫

২২শে মার্চ আমি চট্টগ্রামে আসলে ক্যাপ্টেন রফিক আমাকে বললেন,৮ম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট অনেক বাঙালী অফিসার আছেন,তাদের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে দেশের অবস্থা সম্পর্কে আলোচনা কর এবং বিদ্রোহ সম্পর্কে কথাবার্তা চালাও।আমি ক্যাপ্টেন রফিকের কথামত ২৩শে মার্চ ৮ম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেসে যাই এবং আমার কোর্স মেট ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান চৌধুরী(বর্তমানে লেঃকঃ) ক্যাপ্টেন অলি আহমেদ(বর্তমানে মেজর) লেঃমাহফুজুর রহমান(বর্তমানে মেজর),লেঃশমসের মুবিন চৌধুরী (বর্তমানে মেজর) এর সঙ্গে দেখা করে কথাবার্তা বলি।মেজর শওকত তখন মেসে ছিলেন।কিন্তু যেহেতু তিনি সিনিয়র,সেহেতু তার সঙ্গে কথা বলতে সাহস পাই নি।

উপরের বর্নিত অফিসার বৃন্দকে নিয়ে আমি ক্যাপ্টেন রফিকের বাসায় সন্ধ্যায় আসি,এবং সেখানে থেকে ক্যাপ্টেন রফিক সহ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এর অধ্যাপকের বাসায় পৌছাই-তখন রাত আনুমানিক সাড়ে ৯’টা।আমার নিজের একটি ভক্সওয়াগন গাড়ি ছিল।ঐ গাড়িতে করে আমরা গিয়েছিলাম।ঐ সভাতে এমপিএ আতাউর রহমান কায়সার ছিলেন,ডঃ মান্নান সহ আরও কয়েকজন উপস্থিত ছিলেন।সভায় দেশের সর্বশেষ অবস্থা,আমাদের ক্ষমতা,পাকিস্তান থেকে সৈন্য নিয়ে আসা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা হয়।সামরিক বাহিনী গতিবিধি দেখে আমরা নিশ্চিত হলাম যে,পাকিস্তানি সেনারা সত্বর বাঙালীদের বিরুদ্ধে একটা কিছু করতে যাচ্ছে।সভায় ৮ম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের তরুন অফিসার বৃন্দের(২ জন) মাঝে সমঝোতা হয় এবং সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে,যদি পাক বাহিনী আক্রমন করে আমরা বাঙালীরা একসঙ্গে প্রতিরোধ গড়বো এবং সমুচিত জবাব দেব।

২৪শে মার্চ সকালে আমি কাপ্তাই চলে যাই।কথা হয় যে,পাকিস্তানীরা যদি আক্রমন করে অথবা ইঙ্গিত দেয় তাহলে আমরা বিদ্রোহ করবো এবং ক্যাপ্টেন রফিক আগে বিদ্রোহ করলে সে আমাকে খবর দেবে।রফিক আরোও বললো যে,ইন্সপেকশনের নামে পান্জাবীদের অস্ত্রের ফায়ারিং পিন অকেজো করে দিয়েছে এবং তুমিও তোমার উইং-এ তাই করো।আমি রাজী হলাম।আমাকে কোর্ড ওয়ার্ড দিলেন,”ব্রিং সাম উড ফর মি”-অর্থ হলো চট্টগ্রামে যুদ্ধ শুরু হয়েছে।আমাকেও বিদ্রোহ শুরু করতে হবে।এবং সমস্ত অবাঙালীদের বন্দী করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ক্যাপ্টেন রফিকের সঙ্গে মিলতে হবে।

২৪শে মার্চ খুব ভোরে আমি কাপ্তাই চলে গেলাম।আমার উইং-এ সুবেদার মেজর ছিল (বাঙালী) নাজমুল হক।সুবেদার মেজর আমাকে সব খবরাখবর এনে দিত।অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে অবাঙালী এন-সিও এবং জে-সি ওরা রাতে গোপনে মেজর পীর মোহাম্মদের(উইং কমান্ডার) বাসাতে সলাপরামর্শ করতো।আমি সবসময় সতর্ক থাকতাম এবং বুঝতে পারতাম উইং কমান্ডার এবং অবাঙালীদের মনে আক্রমনাত্বক প্রস্তুতি চলছে।আমি ভিআইপি রেস্ট হাউসে থাকতাম।

২৪শে মার্চ সন্ধ্যায় ক্যাপ্টেন ফারুক বান্দরবন থেকে উইং হেড কোয়াটারে আসে।ক্যাপ্টেন জায়দী আমার অনুমতি নিয়ে ২৫শে মার্চ সন্ধ্যায় কাপ্তাইতে আসেন।ক্যাপ্টেন ফারুক এবং ক্যাপ্টেন জায়দী আমার রুমে জায়গা নিলেন।আমরা তিনজন কথাবর্তা বলে রাত ৯-৩০ থেকে ১০ টার দিকে ঘুমাতে যাই।এমন সময় আমার ওডার্রলি দরজা ধাক্কা দেয় এবং আমার টেলিফোনের কথা বলে।আমি টেলিফোন যেয়ে শুনলাম লাইন কেটে গেছে।তবে অপারেটর বলল,ক্যাপ্টেন রফিক কথা বলতে চেয়েছিলেন।আমি রুমে ফিরে যাই।এবং মিনিট দশেক পর আবার টেলিফোন আসে।টেলিফোন ধরে জানলাম এস,আর, সিদ্দিকী।জনাব সিদ্দিকী বলেন,২০-বালুচ বেঙ্গল রেজিমেন্ট আক্রমন করেছে।শহরে খুব গোলমাল,আপনি বিদ্রোহ করেন এবং চট্টগ্রাম শহরে চলে আসেন।আমি রফিকের সাথে কথা বলতে চাইছিলাম।তিনি বললেন,”রফিক যুদ্ধ করছে,সে এখানে নাই।এরপর আবার টেলিফোন পেলাম,করেছেন জনাব এম, আর, সিদ্দিকী।জনাব সিদ্দিকী বললেন বলেন,”রফিক যুদ্ধ ময়দানে তবে একটি কোর্ড ওয়ার্ড পাঠাতে বলেছেন,সেটি হলো, “ব্রিং সাম উড ফর মি।” তখন আমি অবস্থাটা বুঝলাম।তখনই আমার রুমে এসে পোশাক পরি এবং সিদ্ধান্ত নিই অবাঙালীদের নিরস্ত্র করবো এবং চট্টগ্রামে রওনা হব।পোষাক পড়ার সময় অবাঙালী অফিসার জেগে যায় এবং তিনি জিজ্ঞাসা করেন যে আমি পোশাক ক্যান পরছি।”লাইনে কিছু গোলমাল,এখনই ফিরে আসবো,তোমরা ঘুমাও”।এই কথা বলেই আমি চলে যাই।গাড়িতে উঠতে যাচ্ছি এমন সময় এক অবাঙালী এনসিও আমার দিকে আসে,এবং বলে স্যার,লাইনে গোলমাল।তখন এনসিওকে তুলে নিয়ে আমি লাইনে যাই।লাইনে পৌঁছে আমি সুবেদার মেজরকে ডাকি এবং সমস্ত কথা বলি।তাকে বলি,”কোতে চাবি নিয়ে প্রস্তুত থাকুন।বাঁশী বাজালে কোত খুলে দেবেন।”ঐ রাতে গার্ড কমান্ডার ছিল একজন পান্জাবী।তাকে ডেকে আমাদের দোতলায় সমস্ত এনসিওকে ডাকতে বললাম।আমার সাথের এনসিওকে তার আগেই উপরে পাঠিয়েছিলাম।গার্ড কমান্ডার উপর তলা থেকে নিচের তলায় নামার সঙ্গে সঙ্গে তাকে বন্দী করি।এবং অস্ত্র কেড়ে নেই।আমার কথামত কোয়ার্টার গার্ডের বাঙালী সৈনিকরা সঙ্গে সঙ্গে দোতলার সিঁড়ির মুখে পজিশন নিতে থাকে।হুইসেল দেই,সমস্ত বাঙালী সৈনিকদের উপর হতে নিচে নেমে আসতে বলি এবং অবাঙালীদের উপরে থাকতে বলি।কোন অবাঙালী নামার চেষ্টা করলে গুলি করার হুকুম দেই।বাঙালীরা প্রস্তুত ছিল,তাই হুইসেলের সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত বাঙালীরা নিচে নেমে আসে।কোত খুলে দেওয়া হয় এবং সকলের হাতে অস্ত্র-গোলাবারুদ তুলে দেওয়া হয়।আমি তখন উইং কমান্ডার মেজর পীর মহাম্মদকে নিরস্ত্র করতে গেলাম।কাপ্তাইতে তখন কতগুলো পয়েন্ট ছিল সে পয়েন্টে গার্ড ছিল অবাঙালী।আমি তখন পয়েন্টের গার্ডটিকে নিরস্ত্র করি এবং তারপর মেজর পীর মহাম্মদের বাসাই যাই।মেজর পীর মহাম্মদ তখন ঘুমাচ্ছিলেন।ডাকাডাকিতে উঠলেন এবং তিনি আমাকে পোষাক পড়া দেখে ঘাবড়ে গেলেন।তিনি আসলে বললাম,”আপনি বন্দী।বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে,আমি উইং এর দায়িত্ব নিয়েছি।”মেজর পীর মহাম্মদ অস্ত্র ধরার চেষ্টা করলেন।আমি হুশিয়ার করে দেই,”অগ্রসর হলে মৃত্যু।””ঘরে থাকেন,কোন অসুবিধা হবে না আপনার।”এই বলে বাইরে গার্ড রেখে আবার রুমের দিকে যাই।রুমে পৌঁছে দেখলাম ক্যাপ্টেনদ্বয় উঠে বসেছে। তাদেরকে বললাম, ‘”তোমরা বন্দী এদেশ স্বাধীন।”পান্জাবী ক্যাপ্টেন জায়দী উঠবার চেষ্টা করে,তার আগেই তাকে বন্দী করে ফেলি।ক্যাপ্টেন ফারুক পাঠান ছিল।সে খুশী হয়ে বললো।”আমি ভালোই হলো আমি তোমার অনুগত হয়ে বাংলাদেশের সেবা করবো।”রাত তখন সাড়ে এগারোটা হবে।হাজার হাজার জনতা পথে নেমেছে।আমি ই-পি আর কোম্পানীর ৪/৫ জনকে উইং হেডকোয়ার্টারে রেখে বাকী সবাইকে নিয়ে রাত সাড়ে তিনটার দিকে চট্টগ্রামের পথে রওনা হই।যাবার পূর্বে অয়ারলেস মারফত আমার অবশিষ্ট কোম্পানী গুলোতে মেসেজ পাঠাই যে,সমস্ত অবাঙালীদের বন্দী করে কাপ্তাইতে একত্রিত হয়ে চট্টগ্রামের দিকে রওনা হও।“

২৬শে মার্চ আমি যখন চট্টগ্রাম শহর থেকে ৭/৮ মাইল দূরে ছিলাম দেখলাম বেঙ্গল রেজিমেন্টের কয়েকজন সৈন্য পটিয়ার দিকে দৌড়াচ্ছে।তাদের জিজ্ঞাসা করে জানলাম পাক বাহিনী আক্রমন করেছে।আমি অগ্রসর হলে মেজর জিয়ার সাক্ষাৎ পাই।তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে বললেন”ক্যাপ্টেন রফিক শহরে যুদ্ধ করছে আমরা ৮ম ইষ্ট বেঙ্গল পটিয়াতে একত্রিত হবো তারপর আবার শহরে এসে পাল্টা আক্রমন চালাবো।”আমাকে তার সঙ্গে থাকতে বললেন।আমি মেজর জিয়ার সঙ্গে থেকে গেলাম।এরপর মেজর জিয়ার কমান্ডে কাজ করতে থাকি।পটিয়াতে আমরা সবাই মেজর জিয়ার নেতৃত্বে শপথ নেই।কালুরঘাটে পাক-বাহিনী ব্যাপকভাবে চাপ দিয়ে যাচ্ছিল। ১১ই এপ্রিল পাকসেনারা চারদিক থেকে বৃষ্টির মতো গোলা ফেলতে থাকে।

ঐ তারিখে আমি এবং শমসের মুবিন চৌধুরী গুরুতর রুপে আহত হই।আমাকে পটিয়ায় নিয়ে যাওয়া হয়।ডঃ নূর হোসেন(অস্ত্র বিশেষজ্ঞ) পটিয়াতে আমার অস্ত্রপাচার করেন।তারপর আওয়ামিলীগের লোকজন গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে নিয়ে ফিরতে থাকে।ইতিমধ্যে কালুরঘাটের পতন ঘটে।মালুরঘাট নামক স্থানে খৃষ্টান মিশনারী হাসপাতালে পুনরায় আমার অস্ত্রপাচার করে সেখান থেকে কক্সবাজারের উখিয়া নামক স্থানে সমসের আলম চৌধুরীর বাড়িতে রাখেন।সমসের আলম চৌধুরী আমাকে ঔষধ পত্র দিয়ে এবং সেবা-যত্ম করে সুস্থ করে তোলেন। ফকরুদ্দিন (আমার ব্যাটসম্যান) সব সময় সঙ্গে ছিল।খামারবাড়ি নামক স্থানে থাকা অবস্থায় পান্জাবীরা আমাদের খোঁজে আসে।তখন আমাকে স্ট্রেচারে করে সবাই বার্মা চলে যায়।বার্মা রিফুইজি ক্যাম্পে সবাই আশ্রয় নিই।সেখানে চিকিৎসার পর আমি সুস্থ হয়ে উঠি।বার্মা থেকে পালিয়ে ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে টেকনাফে আসি।টেকনাফে এসে বেশ কিছু ই.পি.আর ছেলে পেলাম এবং তাদের সঙ্গে অন্যান্যরাও ছিল।আমি ওখানে থেকে যাই এবং আবার যুদ্ধে নেমে পড়ি।

১১/১২ই ডিসেম্বরে কক্সবাজারে ভারতীয় সেনাবাহিনী নামলে আমি তাদের সঙ্গে যোগ দিই এবং দেশ মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাই।

স্বাক্ষরঃ

হারুন আহমেদ

১৭-১-৭৫

——————————————–

<৯, ২.৫, ৪৬-৫১>

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে ক্যাপ্টেন ভূইয়া
মেজর এম,এস,এ,ভূঁইয়া

(১৯৭১ সালে ক্যাপ্টেন পদে কর্মরত ছিলেন। বিবরণটি তাঁর রচিত ‘মুক্তিযুদ্ধে নয়মাস’ গ্রন্থ, ঢাকা, ১৯৭৪ থেকে সংকলিত)

২৬শে মার্চ দুপুরে ক্যাপ্টেন রফিকের সাথে আলাপের সময় আমি জানতে পারি যে, একটি বেতার কেন্দ্র আমাদের দখলে রয়েছে। ২৮শে মার্চের সন্ধ্যা থেকে ২৯শে মার্চের রাত পর্যন্ত আমি এই বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রে ছিলাম। আমার সে সময়কার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার রূপায়নই এই আলেখ্য।

বলা বাহুল্য বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র এবং পরে মুজিবনগর থেকে প্রচারিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র নামে পরিচিত এই ঐতিহাসিক বেতার কেন্দ্র গোড়াতে খোলা হয়েছিল চট্টগ্রামে।

বেতার কেন্দ্রটি খোলা হয়েছিল চট্টগ্রামের কালুরঘাটে। ২৮শে মার্চ সকালে কালুরঘাটে মেজর জিয়ার সাথে সাক্ষাৎ করে চট্টগ্রাম শহরে ফেরার পথে আমি প্রথমবারের মতো বেতার কেন্দ্রটিতে প্রবেশ করি। কিছুক্ষনের মধ্যেই ঐ বেতার কেন্দ্রে কর্মরত স্টাফের সাথে আমার পরিচয় হয়। সেখানে ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্টের লেফটেন্যান্ট শমশের-এর সাথেও আমার দেখা হলো লেফটেন্যান্ট শমশের সে সময়ে মেজর জিয়াউর রহমানের লিখিত ভাষন বারবার প্রচার করছিলেন।

সেদিন পশ্চিম কমোডোর মমতাজের বাসা আক্রমণের পর আমি বেতার কেন্দ্রে ফিরে আসি এবং লেফটেন্যান্ট শমসেরের স্থলাভিষিক্ত হই। মেজর জিয়ার নির্দেশ অনুযায়ী লেফটেন্যান্ট শমশের সে সময়ে কালুরঘাটে ফিরে যান।

বেতার কেন্দ্রে অবস্থানকালে সেখানে আমার কাজ ছিল ঐ ‘বিপ্লবী বেতার-কেন্দ্রের’ চারদিকে মোতায়েন প্রতিরক্ষা বাহিনীকে কমাণ্ড করা ঐ কেন্দ্রের গোপনীয়তা রক্ষা করা এবং বেতার কেন্দ্রে প্রচারিতব্য সংবাদ, বুলেটিন ও নানা কথিকা পড়ে সেসব এ্যাপ্রুভ করে দেওয়া। আমার স্পষ্ট মনে আছে,বেতার-কেন্দ্রে থাকাকালীন আমাদের সাথে যারা কাজ করতেন তাদের বেতার কেন্দ্রের অভ্যন্তরে আসা যাওয়ার অনুমতি দিয়ে আমি ৭টি ‘পাস’ ইস্যু করেছিলাম। প্রথমে ৬টি পরে ১টি পাস ইস্যু করা হয়েছিল। মেজর জিয়ার নির্দেশ ছিল কোন সংবাদ বা কথিকা বেতার কেন্দ্রে প্রচার করার আগে অবশ্যই তা কোন অফিসারকে পড়ে চেক করে দিতে হবে। লেফটেন্যান্ট শমশের বেতার কেন্দ্র থেকে কালুরঘাট চলে যাবার সময় মেজর জিয়ার এই নির্দেশের কথা আমাকে বলে গিয়েছিলেন। সে সময় বেতার-কেন্দ্র থেকে আমি সেসব সংবাদ এবং কথিকা পাঠ করেছি তার সবগুলোতেই আমি আমার ইনিশিয়াল দিয়েছি। বলা বাহুল্য এসব কাজ করার সময় আমার এক অসাধারণ বিপ্লবী চেতনার জন্ম হয়েছিল। বলতে দ্বিধা নেই, সে সময় আরব জাহানের প্রখ্যাত গেরিলা নেতা ইয়াসের আরাফাতের কর্মধারা ও জীবন-চেতনা আমাকে অনুপ্রাণিত করে তুলেছিল। তার কথা তখন আমার বারবারই মনে পড়তো, মনে পড়তো তার বিপ্লবী সংস্থা ‘প্যালেস্টাইন লিবারেল ফ্রন্ট’-এর কথাও। মনে আছে একটি কথিকায় লেখক প্রদত্ত নামটি কেটে দিয়ে তার ওপর আমি লাল কালিতে আমাদের সংগ্রামী-সংস্থার নাম দিয়েছিলাম ‘বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্ট’। পরবর্তীকালে সাংবাদিকরা এর বাংলা অনুবাদ করেছিলেন ‘মুক্তিফৌজ।”

২৮শে মার্চ সন্ধ্যায় লেফটেন্যান্ট শমসের ও আমি অনেকক্ষন আলাপ আলোচনার পর ব্লাক আউট ঘোষনার সিদ্ধান্ত নিই। সে অনুসারে বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে ব্লাক আউট পালনের ঘোষণাও প্রচারিত হয়। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশে সবাইকে নিজ নিজ হাতিয়ার নিয়ে ক্যাপ্টেন মুহাসিন, ক্যাপ্টেন মুখলেস, ক্যাপ্টেন ইনাম, ক্যাপ্টেন ওয়ালী, ক্যাপ্টেন ভূঁইয়া ও অন্যান্যের কাছে রিপোর্ট করার আহবান জানানো হয়েছিল। অবশ্য এই ঘোষণায় কোন জায়গার নাম উল্লেখিত হয় নি।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণায় বলা হয়েছিলোঃ ‘নিজ নিজ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে লালদীঘির ময়দানে ক্যাপ্টেন ভূঁইয়ার কাছে রিপোর্ট করুন। এই ঘোষণা রিপোর্ট করার স্থান হিসেবে লালদীঘির ময়দানের উল্লেখ ছিল কারণ ২৯শে মার্চ সকালে দেখা গেল যে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম-কাপ্তাই রোড ধরে হাজার হাজার লোক নিজ নিজ বাড়ির দিকে ছুটে যাচ্ছে। উল্লেখ করা আবশ্যক যে, ২৮-২৯ শে মার্চ রাতে পি,এন,এস জাহাঙ্গীর যুদ্ধজাহাজ থেকে পাঞ্জাবীরা চট্টগ্রাম শহরে অত্যাধিক শোলিং করেছিল। শেলিং এর দরুন কয়েক জায়গায় আগুন ধরে যায়। আগুনের ফুলকিতে মনে হয়েছিল চট্টগ্রাম শহরে বুঝি পাইকারী ধ্বংসলীলা চলছে। এ অবস্থা দেখে বেসামরিক লোকেরা যার হাতে বন্দুক বা অন্য অস্ত্র ছিল তাই নিয়ে প্রাণভয়ে গ্রামের দিকে ছুটে যাচ্ছিল। তাদের মধ্যে তখন নেতৃত্ব দেওয়ার মতো কেউই ছিলনা, তাই তারা অসংঘবদ্ধভাবে গ্রামের দিকে চলে যাচ্ছিল। ঐসব লোকদের আবার একত্রিত করে পুনর্গঠিত করার উদ্দেশ্যই বিপ্লবী বেতার থেকে অস্ত্র নিয়ে লোকদের আবার একত্রিত করে। পূনর্গঠিত করার উদ্দেশ্যেই বিপ্লবী বেতার থেকে অস্ত্র নিয়ে লালদীঘির ময়দানে ক্যাপ্টেন ভূঁইয়ার কাছে রিপোর্ট করার নির্দেশ প্রচারিত হয়েছিল। সত্বর তাদের এক জায়গায় জমায়েত করতে হলে এ-ধরনের ঘোষনা প্রচার ছাড়া গত্যন্তর ছিলনা। বলা বাহুল্য, এই ঘোষনা এ-সময়ে বেতার-কেন্দ্রে উপস্থিত কয়েকজনের সাথে আলোচনা করেই প্রচারিত হয়েছিল।

ঘোষনাটি কয়েকবার প্রচারিত হবার পর চট্টগ্রাম বিশ্ব বিদ্যালয়ের তদানীন্তন উপাচার্য এ,আর,মল্লিক আমাকে টেলিফোন করেন। লালদীঘির ময়দানে একত্রিত হওয়ার এই ঘোষনা সম্পর্কে তার সাথে আমার অনেক আলাপ হয়। তিনি আমাকে অবিলম্বে এই ঘোষনা প্রচার বন্ধ করতে বলেন। তিনি যুক্তি দেন যে, এই ঘোষনামতে যদি সবাই গিয়ে লালদীঘির ময়দানে একত্রিত হয় তাহলে হানাদাররা নিশ্চয় এই জমায়েতের ওপর পি,এন,এস জাহাঙ্গীর জাহাজ থেকে শেলিং করবে, এমনকি হাওয়াই হামলা করতে পারে। ডক্টর মল্লিকের এই যুক্তিপূর্ণ উপদেশে আবার আমাকে বেতার মারফত ‘লালদীঘির ময়দানে’ একত্রিত হওয়ার ঘোষনাটি বাতিল করে দিতে হয়।

দুনিয়ার ইতিহাসে যেসব বিপ্লব হয়েছে তাতে লক্ষ্য করা গেছে যে, প্রথমে অর্গানাইজ করা হয়েছে এবং ঘোষিত হয়েছে বিদ্রোহ, হয়েছে বিপ্লব। কিন্তু আমাদের বাংলাদেশে ব্যাপারটি ঘটেছে সম্পূর্ণ ভিন্ন রকম। এক্ষেত্রে প্রথমে ঘোষিত হয়েছে বিদ্রোহ, পরে হয়েছে সংগঠন-আমরা প্রথমে বিদ্রোহ করেছি, পরে শুরু করেছি বিদ্রোহীদের সংগঠন। ২৬শে মার্চ ভোরে যে আমাদের বিদ্রোহ করতে হবে তা আমরা অনেকেই ২৫শে মার্চের মধ্যরাতেও জানতাম না।

কুমিরার লড়াই

মেজর এম এস এ ভূঁইয়া

(‘মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস’ গ্রন্থ থেকে সংকলিত)

ইচ্ছা ছিলো সন্ধ্যার আগেই ক্যান্টমেন্ট দখল করবো। কিন্তু শত্রুর শক্তি বৃদ্ধর জন্য কুমিল্লা থেকে যে ২৪নং এফ এফ (ফ্রন্টিয়ার ফোর্স) এগিয়ে আসছে তাকে বাঁধা দেওয়াই সর্বপ্রথম কর্তব্য হয়ে দাঁড়ালো।

তখন বিকাল ৫টা। ২৪নং এফএফ’কে প্রতিহত করার জন্য কুমিল্লার দিকে অগ্রসর হলাম। বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআর’এর মাত্র ১০২ যোদ্ধা সমবায়ে সংগঠিত দল নিয়ে এই অভিযানে আমরা বের হলাম। আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পশ্চিমা হানাদার সৈন্যদলের মোকাবিলা করার আমাদের সম্বল মাত্র একটি এইচ এম জি, কয়েকটি এলএমজি আর বাকীসব রাইফেল। এতো অল্পসংখ্যক সৈন্য নিয়ে পুরো একটি সুসংগঠিত ব্যাটালিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে যাওয়ার ঝুঁকি যে কি বিরাট এবং তার পরিণাম যে কি মারাত্মক হতে পারে সেদিন তা আদৌ উপলব্ধি করতে পারি নি তা নয়। আসলে মনটা ছিলো তখন প্রতিশোধ স্পৃহায় উন্মত্ত, দেশের মুক্তি কামনায় উত্তপ্ত, ক্ষোভে ক্রোধে আবেগে উত্তেজিত। সুতরাং ঠাণ্ডা মাথায় অগ্র পশ্চাৎ বিবেচনা করে পরিকল্পনা করার আদৌ অবসর ছিলো না তখন। অন্য কিছু সম্বল না থাকলেও যুদ্ধে সবচেয়ে বড় যে জিনিস প্রয়োজন সেই সাহস, সেই উদ্দীপনা, সেই উদ্দীপ্ত প্রাণের আকাঙ্খা ছিলো আমাদের সম্বল। আমাদের এই অপরিমেয় মনোবল ও দুর্জয় আত্মবিশ্বাস সেদিন মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার শক্তি দিয়েছিলো। এছাড়া ছিলো পরম করুণাময়ের অপার করুনা যা বারবার নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে উদ্ধার করে আমাদেরকে সাফল্যের স্বর্ণদুয়ারে পৌঁছে দিয়েছে। আজ আমার এ প্রত্যয় দৃঢ়তা লাভ করেছে যে, সত্য ও ন্যায়ের সেই পবিত্রতা চিরদিনই অন্যায়কে প্রতিরোধ করতে এভাবেই সাহায্য করে থাকে।

আগেই খবর পেয়েছিলাম শত্রুবাহিনী ফেনীর কাছে শুভপুর ব্রিজ পেরিয়ে এগিয়ে আসছে। অতএব, যত দ্রুত তাদের অগ্রগতিকে প্রতিহত করা যায় ততই আমাদের জন্য মঙ্গল। আমার কথামত আওয়ামী লীগের কয়েকজন কর্মী পাঁচটি ট্রাক এনে হাজির করলেন। তখন আমাদের সৈন্যবাহিনী ও জনসাধারণের প্রত্যেকেরই যেনো একটা যুদ্ধাংদেহী ভাব। তাদের চেহারা দেখে মনে হচ্ছিলো যেনো অনেকদিনের পুঞ্জিভূত বেদনা বঞ্চনা ক্ষোভ, আক্রোশ বিদ্রোহের আগুনে ফুসে উঠেছে এবং তা দুর্জয় সংগ্রামের মাধ্যমেই যেনো স্ফুরিত হতে চায়। চব্বিশ বছরের পাকিস্তানী বুর্জোয়াদের শাসন শোষণ ও অত্যাচার উৎপীড়নের জগদ্দল পাথরকে টুকরো টুকর করে ভেঙ্গে ফেলতে আজ সবাই বদ্ধপরিকর।

আমি আমার ক্ষুদ্র দলের ১০২ জন যোদ্ধাকে ৪টি ট্রাকে উঠালাম এবং বাকি ট্রাকটিতে গুলির বাক্য উঠিয়ে দিলাম। আমি নিজে মোটর সাইকেলে চড়ে সবার আগে চললাম। উদ্দেশ্যঃ এগোনোর সাথে সাথে পথের দুপাশে এমন একটি উপযুক্ত স্থান খুজে নেওয়া যেখান থেকে শত্রুর উপর সাফল্যের সাথে প্রচণ্ড আঘাত হানা যায়। শুভপুরে সেদিন আমাদের যাত্রাপথের দৃশ্য অবিস্মরণীয়। রাস্তার দুপাশে হাজার হাজার মানুষ ভীড় জমিয়েছে। তাদের মধ্যে কল কারখানার শ্রমিকই বেশী। মুখে তাদের নানান শ্লোগান। হাজার কণ্ঠের সেই শ্লোগান আকাশ বাতাস মুখরিত করে তুলেছিল। গত রাতে শহরের বিভিন্ন স্থানে ইয়াহিয়ার লেলিয়ে দেওয়া বর্বর বাহিনী কর্তৃক অতর্কিত আক্রমণ, নির্মম হত্যা, পাশবিক অত্যাচার, বিশেষতঃ বেঙ্গল রেজিমেন্টের জওয়ানদেরকে পাশবিকভাবে হত্যা করার খবর এরই মধ্যে প্রতিটি মানুষের কানে পৌঁছে গেছে। যে কোন ভাবে এই বিশ্বাসঘাতকতার উপযুক্ত শাস্তি দেওয়ার জন্য তারা প্রস্তুত। সুতরাং যখনই তারা দেখতে পেল খাকি পোষাক পরা বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআর এর জওয়ানরা অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে শত্রুর মোকাবিলা করার জন্য এগিয়ে যাচ্ছে তখন তারা আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠলো। মুহুর্মুহু শ্লোগান দিতে লাগলো। জয় বাংলা, বেঙ্গল রেজিমেন্ট জিন্দাবাদ, ইপিআর জিন্দাবাদ। এদিকে তাদের কেউ কেউ সৈনিকদের কি দিয়ে এবং কিভাবে সাহায্য করতে পারে তাই নিয়ে মহাব্যস্ত।

আমাদের সৈন্য বোঝাই ট্রাকগুলো তখন ধীরে ধীরে এগিয়ে চলছে। এমন সময় একজন বুড়ো লোক তার পথের পাশের দোকান থেকে সিগারেট নিয়ে এসে আমার হাতে তুলে দিলো। বললো, “স্যার আমি গরীব মানুষ, কিছু দেওয়ার মতো ক্ষমতা আমার নাই, এই নিন আমার দোকানের সিগারেট (সিগারেট ৩ কার্টুন ছিল); আপনার জওয়ানদের মধ্যে বিলিয়ে দিন।“ বৃদ্ধের এই সহানুভুতি ও আন্তরিকতায় তার প্রতি কৃতজ্ঞতায় আমার মন ভরে উঠলো। আরেকজন একটি ট্রাকে করে প্রায় এক ড্রাম কোকাকোলা নিয়ে এলো। কেউ কেউ খাদ্যসামগ্রীও নিয়ে এলো।

আন্তরিকতা আর ভালবাসার সেই উপহার আমাদের মনকে আনন্দে উদ্বেল করে তুলেছিলো। কেমন করে কিভাবে তারা সেসব জিনিস যে সেদিন সংগ্রহ করেছিলেন তা ভাবলে আজও বিস্মিত হই।

সন্ধ্যা তখন ৬টা। আমরা কুমিল্লায় পৌঁছে গেলাম। শত্রুকে বাঁধা দেওয়ার জন্য স্থানটি খুবই উপযুক্ত বিবেচিত হলো। পথের ডানে পাহাড় এবং বামে আধ মাইল দূরে সমুদ্র। শত্রুর ডানে এবং বামে প্রতিবন্ধকতা আছে এবং শত্রুকে এগোতে হলে পাকা রাস্তা দিয়েই আসতে হবে। তাই সেখানেই পজিশন নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমি যেখানে পজিশন নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেই তার পিছনে একটি খাল ছিল। ঐ খাল থেকে ৫০০/৬০০ গজ সামনে অর্থাৎ উত্তর দিকে আমি পজিশন নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। খালটি একটি পদাতিক বাহিনীর জন্য তেমন একটা বাঁধা নয়। তবুও এটা পিছনেই রাখলাম। উদ্দেশ্য ছিলো যদি বর্তমান পজিশন শত্রু আমাদের ছাড়তে বাধ্য করে তখন খালের পাড়ে পজিশন নিতে পারবো। এটা ছিলো আমার বিকল্প পরিকল্পনা। জমিনের সরূপ দেখে কয়েক মিনিটের মধ্যে পরিকল্পনা তৈরী করে নিলাম। আমার তিনজন প্লাটুন কমান্ডারকে ডেকে খুব সংক্ষেপে আমার পরিকল্পনার কথা জানালাম এবং নিজ নিজ স্থানে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পজিশন নেওয়ার নির্দেশ দিলাম। আমার নির্দেশ অনুযায়ী এইচএমজি’টা ডান পাশে পাহাড়ের ঢালুতে ফিট করা হলো। স্বয়ং ইপিআর সুবেদার সাহেব ভারী মেশিনগানটির সঙ্গে রইলেন। কারণ এই ভারী মেশিনগানটিই আমাদের প্রধান হাতিয়ার এবং সবচেয়ে বড় সম্বল। আমি বামদিকের কয়েকটি এলএমজি’র পজিশন ঠিক করে দিলাম। আমার নির্দেশমত সবাই মাটিতে পজিশন নিয়ে নিলো। পজিশনের অবস্থাটা হলো অনেকটা ইংরেজী U-এর মতো। অর্থাৎ ডানে বামে এবং পিছনে আমাদের সৈন্য। যেদিক থেকে শত্রু এগিয়ে আসছে কেবল সেই সামনের দিকটা সাঁড়াশির হারের মতো খোলা।

কুমিরা পৌঁছেই মোটর সাইকেলযোগে একটি লোককে আমরা পাঠিয়েছিলাম শত্রুর অগ্রগতি সম্পর্কে খবর নিতে। এরই মধ্যে সে খবর নিয়ে এসেছে যে, শত্রু আমাদের অবস্থান থেকে আর বেশী দূরে নেই। মাত্র চার পাঁচ মাইল দূরে। তবে তারা ধীরে ধীরে গাড়ী চালিয়ে আসছে। যে লোকটিকে পাঠিয়েছিলাম সে পাঞ্জাবীদের নিকটে গিয়ে রাস্তার পাশের একটি দোকান থেকে সিগারেট কিনে ফিরে এসেছে। সে আমাকে জানালো যে, পাঞ্জাবীদের পরনে কালো বেল্ট, কাঁধে কালো বেজ এবং কি যেনো একটা কাঁধের উপরে তাও কালো। তখন আমার সন্দেহ রইলো না যে ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের সৈন্যরাই এগিয়ে আসছে।

আমাদের অবস্থানের ৭০/৮০ গজ দূরে বড় একটি গাছ ছিলো। জনসাধারণের সাহায্যে গাছের মোটা ডালটা কেটে রাস্তার ঠিক মাঝখানে ফেলা হলো। গাছের ডাল দিয়ে আমাদের সুন্দর একটা ব্যারিকেড সৃষ্টি হয়ে গেলো। জনসাধারণ আশপাশ থেকে কিছু ইট এনে ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত অবস্থায় রাখলো।

এত অল্প সময়ে জনসাধারণ কিভাবে ঐ মোটা গাছের ডালটা কেটে ফেললো এবং ইট সংগ্রহ করে ব্যারিকেড সৃষ্টি করলো তা আজ ভাবতে আশ্চর্য লাগে। সৈন্যদের জানিয়ে দেয়া হলো যে শত্রুসৈন্য যখন ব্যারিকেড সাফ করার জন্য গাড়ী থেকে নামবে এবং সাফ করার জন্য একত্রে জমা হবে তখন সকলে একযোগে শত্রুর উপর গুলি ছোড়া শুরু করবে। বিশেষ করে ভারী মেশিনগান দ্বারা অবিরাম গুলি ছুড়বে।

প্রায় এক ঘন্টা সময় আমাদের প্রতিক্ষার মধ্যে কেটে গেলো। সন্ধা তখন ৭টা। আমরা শত্রুবাহিনীর অপেক্ষায় ওৎ পেতে রইলাম। আমাদের সামনে শত্রুবাহিনীর উপস্থিতি প্রায় আসন্ন বলে মনে হলো। আরো কিছুক্ষণ প্রতিক্ষার পরই সম্মুখ সমরে ঝাঁপিয়ে পড়ার সুযোগ এলো। শত্রুবাহিনী ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। ব্যারিকেড দেখে সামনের গাড়ীগুলো থেমে গেলো। কিছুসংখ্যক সিপাহী গাড়ী থেকে নেমে ব্যারিকেডের কাছে এলো। এবং কেউ কেউ ইটগুলো তুলে দূরে ফেলে দিতে লাগলো। পিছনের গাড়ীগুলোও তখন সেই দিকেই এগিয়ে আসছিলো।

সন্ধ্যা তখন সোয়া সাতটা। শত্রুরা যখন ব্যারিকেড সাফ করতে ব্যস্ত, ঠিক এমন সময় আমাদের ডান দিকের ভারী মেশিনগানটি গর্জে উঠলো। শুরু হলো শত্রু নিধন পালা। চারিদিক থেকে কেবল গুলির আওয়াজই শোনা যেতে লাগলো। ভারী মেশিনগানটি থেকে তখন মাঝে মাঝে ট্রেসার রাউণ্ড বের হচ্ছে। উহ! সে কী দৃশ্য! শত্রুকে এত কাছাকাছি অতর্কিত অবস্থায় পেয়ে আমার মন খুশিতে নেচে উঠলো। মনে মনে বললাম- তোমরা (পাঞ্জাবীরা) এতদিন মনে করতে বাঙালিরা যুদ্ধ করতে জানে না। এখন যুদ্ধ ক্ষেত্রেই বাঙালিরা তোমাদের জানিয়ে দিবে তারা যুদ্ধ করতে জানে কিনা। হানাদার বাহিনীর অগ্রগতি রোধ করাই ছিলো আমাদের লক্ষ্য। আমাদের আকস্মিক আক্রমণে তারা তখন হকচকিত। তাদের সামনের সৈন্যগুলির অনেকেই আমাদের গুলির আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। তাদের মৃত্যুকাতর আর্তনাদ আমাদের কানে আসছিলো। যারা দিশেহারা হয়ে এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছিলো তাদের অনেকেই মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই শত্রুদের পিছনের সৈন্যরা এ অবস্থা সামলে নিয়ে মেশিনগান, মর্টার এবং আর্টিলারী থেকে অবিশ্রাম গুলি শুরু করলো। এবার উভয় পক্ষে তুমুল লড়াই লেগে গেলো। কিন্তু বহু চেষ্টা করেও শত্রুরা আমাদের ব্যূহ ভেদ করতে পারলো না। তাদের সৈন্য বোঝাই তিনটি ট্রাকে আগুন ধরে গেলো। আমাদের মেশিনগান নিউট্রালাইজ করার জন্য প্রচুর পরিমানে আর্টিলারী গোলা নিক্ষেপ করলো। কিন্তু আল্লার মেহেরবাণীতে শত্রুর সকল প্রচেষ্টা মাঠে মারা গেলো। প্রায় দুই ঘন্টা প্রাণপণ লড়াই করে তারা শেষ পর্যন্ত দুই ট্রাক অস্ত্রশস্ত্র ফেলে রণে ভঙ্গ দিলো।

ঘন্টা দুয়েক এই লড়াই চলেছিলো। উভয় পক্ষের গোলাগুলির শব্দ স্তব্ধ হয়ে গেলো। তারপর তারা পিছু হটতে বাধ্য হলো। প্রথম দিনের লড়াইয়ে অর্থাৎ ২৬ তারিখের রাতেই শত্রুবাহিনীর ভীষণ ক্ষতি হয়েছিলো। শত্রুবাহিনীর কমান্ডিং অফিসার লেঃ কর্নেল ও একজন লেফটেন্যান্টসহ বিভিন্ন পক্ষের ১৫২ জন সাধারণ সৈনিক প্রাণ হারিয়েছিলো। আমরা শত্রদের দুই ট্রাক এম্যুনিশন কবজা করেছি। আমাদের পক্ষে চৌদ্দজন বীর সৈনিক শাহাদাৎ বরণ করেন।

কুমিল্লায় লড়াই চলেছিলো সর্বমোট তিনদিন। শত্রু এই সময়ের মধ্যে তাদের আর্টিলারী ও মর্টার দিয়ে বারবার আক্রমণ চালিয়েছিলো আমাদের বাহিনীর উপর। অবশেষে ২৮ তারিখে তারা ত্রিমুখি আক্রমণ চালায়। পিছন থেকে তারা নৌবাহিনীর মাধ্যমে আক্রমণ চালায়। সাগর থেকে গানবোট দিয়ে ফায়ার সাপোর্ট দেয়। রাতের আঁধারে শত্রুরা পহাড়ের উপর অবস্থিত টিবি হাসপাতালের নিকটে মেশিনগান বসায়। ত্রিমুখি আক্রমণের মুখে আমাদের সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যেতে বাধ্য হয়। ফলে ২৮ তারিখে কুমিরা পাকিস্তানী সৈন্যদের দখলে চলে যায়। কুমিরা পতনের পর হানাদার বাহিনী চট্রগ্রাম অভিমুখে রওয়ানা হয়। তারা অগ্রসর হওয়ার সময় রাস্তার দুপাশে অবস্থিত সমস্ত গ্রাম ও হাটবাজার জ্বালিয়ে দেয় এবং সামনে যাকে দেখে তাকেই গুলি করে হত্যা করে। লোকমুখে শুনেছি কুমিল্লা পতনের পর রাস্তার দুপাশে কয়েকদিন ধরে আগুন জ্বলেছিল।

আমার মনে হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে কুমিরার যুদ্ধটাই একমাত্র প্রথম যুদ্ধ যেখানে বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও তৎকালীন ইপিআর বাহিনী সম্মিলিতভাবে হানাদার বাহিনীর উপর এক প্রচণ্ড আঘাত হানতে সক্ষম হয়েছিলো। এই যুদ্ধে ২৪ নং এফএফ-এর একটা পুরো কোম্পানী একেবারে নিশ্চিন্ন হয়ে গিয়েছিলো। একথা আমি জানতে পেরেছিলাম ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের কাছে। তিনি কুমিরার যুদ্ধে ২৪ এফএফ-এ কর্মরত ছিলেন।

—————————————

 

<৯, ২.৬, ৫১-৫৮>

চট্টগ্রামের প্রতিরোধ যুদ্ধ

সাক্ষাৎকার: লেঃ কর্নেল মাহফুজুর রহমান

(১৯৭১ সালে লেফটেন্যান্ট পদে কর্মরত ছিলেন। সাক্ষাতকারটি বাংলা একাডেমীর দলিলপত্র থেকে সংকলিত)

(অনুবাদ)

২৫-৮-৭৩

বৃহস্পতিবার, ২৫ মার্চ ১৯৭১। লেফটেন্যান্ট কর্নেল আব্দুর রশিদ জাঞ্জুয়া অষ্টম ইস্ট বেঙ্গলের সকল অফিসারকে নির্দেশ দিয়েছিল চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন স্থানে জনসাধারণের দেয়া ব্যারিকেড সরিয়ে দেয়ার। গতরাতের আঁধারে জনসাধারণ একটি আস্ত যাত্রীবাহী ট্রেনকে তুলে এনেছিল এবং ষোলশহরে আমাদের ব্যাটালিয়নের কাছে রেলওয়ে জংশনের প্রধান রাস্তায় ব্যারিকেড হিসেবে রাখা হয়েছিল। ক্যাপ্টেন (বর্তমানে মেজর) সাদেক হোসেইনের অধীনে থাকা সম্পূর্ণ কোম্পানী এবং লেফঃ কর্নেল জাঞ্জুয়াসহ ব্যাটালিয়নের প্রায় সকল অফিসার রেলওয়ে জংশনের রাস্তার ট্রেনটি সরাতে সেখানে ছিল।

চারপাশের সকল বেসামরিক লোকজন ও স্থানীয় শিল্পের শ্রমিকেরা সেখানে জড় হয়ে ব্যারিকেড সরানোর বিপক্ষে চিৎকার দেয়া শুরু করেছিল। ক্যাপ্টেন আহমেদ দ্বীন (অন্যতম পাকিস্তানী অফিসার) ক্ষুব্ধ হয়ে বলেছিলেন- “এই সকল জারজদের চুপ করানোর একমাত্র ওষুধ হচ্ছে গুলি করা।” ব্যারিকেড কতটুকু সরানো যাবে এটা নিয়ে লেফঃ কর্নেল এতোটাই চিন্তিত ছিলেন যে ক্যান্টনমেন্টের ২০ জন বেলুচ  সেনাকে তৈরী রাখা হয়েছিল যাতে যে কোন বিপদে তারা সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসতে পারে। খুব সম্ভবত তিনি তার নিজের ব্যাটালিয়নের উপরও ভরসা করতে পারছিলেন না।

যাই হোক, অনেক চেষ্টার পরে ট্রেনটি সরানো হয়েছিল। ৫-৬ ঘন্টা লেগেছিল এই কাজটা করতে। এই ব্যারিকেডের জন্য রাস্তার উভয়পাশে একশ’র বেশি গাড়ী জ্যামে আটকা পড়েছিল। আমরা ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অন্তর্ভুক্তভেবে জনসাধারণ আমাদের উপর যতসম্ভব ক্ষোভ দেখায়নি। তারা আমাদের নিয়েও খুব বেশী খুশী ছিল না। মেজর (বর্তমানে কর্নেল) শওকতকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন তরুণ ছাত্র জিজ্ঞেস করেছিল- “আপনারা কি আমাদের দলে না?” তারা যত সম্ভব আশা করেছিল যে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট তাৎক্ষনিকভাবে জনসাধারণের সাথে যোগ দিবে। মুচকি হেসে মেজর (বর্তমানে কর্নেল) শওকত উত্তর দিয়েছিলেন- “সময় এলেই দেখতে পাবে।”

আমরা বুঝতে পারছিলাম যে চারপাশের সার্বিক পরিস্থিতি আরো খারাপ হচ্ছে। শহরের সকল স্থানে জনসাধারণ ক্রমেই উত্তেজিত হয়ে উঠছিলো। একটার পর একটা মিছিল বের হচ্ছিলো, যোগাযোগ বন্ধ করার শহরের রাস্তায় রাস্তায় জন্য ব্যারিকেড দেয়া হচ্ছিল।  বেশিরভাগ দোকান-পাট বন্ধ ছিল। এদিকে-সেদিকে লোকজন দল বেধে বসে আলোচনা করছিল যে কি ঘটতে যাচ্ছে। ২০ জন বালুচ সেনার একটি কোম্পানির সাথে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গলের অন্যতম একটি কোম্পানিকে সুবেদার আবদুল কাদেরের অধীনে চট্টগ্রামের জেটিতে পাঠানো হয়েছিল অস্ত্র নামানোর জন্য যেগুলো পাকিস্তান থেকে ‘শামস’ নামক একটি মালবাহী জাহাজে করে আনা হয়েছিল। সৈন্যরা জাহাজ থেকে অস্ত্র নামানোর চেষ্টা করছিল।কিন্তু জন সাধারণ তাদেরকে এটা করতে দিচ্ছিল না। আমরা বুঝেছিলাম যে মারাত্মক কিছু ঘটবে।

সন্ধ্যায় একটা কোম্পানিসহ লেফঃ (বর্তমানে ক্যাপ্টেন) শমসের মবিন চৌধুরীর সাথে আমাকে ষোলশহর ক্যান্টনমেন্টের রাস্তায় পাহারা দিতে বলা হয় যাতে রাতে আর কোন ব্যারিকেড সেখানে না দিতে পারে। আমার সাথে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট মোহাম্মদ হুমায়ূনও (পাকিস্তানী অফিসার) ছিল। রাত এগারটার দিকে, কে রহমানের কোকাকোলার ফ্যাক্টরীতে বিশ্রাম নেয়ার সময়, শহর থেকে আমি একটা টেলিফোন পেলাম।  একজন অপরিচিত ব্যাক্তি আতঙ্কিত ও অস্থির হয়ে ফ্যাক্টরীতে তার কোন এক আত্মীয়ের কাছে গুরুত্বপূর্ণ একটি বার্তা পাঠাতে চাচ্ছিলেন এবং আমার পরিচয় জানতে চাইলেন। আমি উত্তরে বললাম যে আমি কোন দায়িত্বে নেই। সেই ব্যাক্তি আমাকে ফ্যাক্টরীর কোন এক পাহারাদার ভেবেছিল এবং বলেছিল- “ঢাকা থেকে এইমাত্র আমরা একটা টেলিফোন পেয়েছি যে সেখানে গুলিবর্ষণ শুরু হয়েছে, পাকিস্তানীরা গণহারে সাধারণ মানুষ মারা শুরু করেছে এবং সবাই তাদের মোকাবিলা করার চেষ্টা করছে।” টেলিফোনে এরকম একটা তথ্য দেয়ার জন্য আমি সেই অপরিচিত ব্যাক্তিকে ধন্যবাদ দিয়ে রিসিভার রেখে দিলাম।

ষোলশহরে আমাদের ইউনিটের দিকে কিছু আগানোর পরই দেখলাম সুবেদার সুবেদ আলি সরকার দৌড়ে আমার দিকে আসছে এবং ফিসফিস করে বাংলাতে বললো আমি যেন যথাশীঘ্র ইউনিটে পৌছেঁ যাই। আমি বাকিটুকু বুঝে গিয়েছিলাম। আমার সৈন্যদের নিয়ে তাড়াতাড়ি ষোলশহরে পৌছে দেখলাম মেজর (বর্তমানে ব্রিগেডিয়ার) জিয়াউর রহমান আমাদের সৈন্যদের একসাথে লাইনে দাঁড় করাচ্ছেন।

বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সৈন্যদের একসাথে করতে এক ঘণ্টার মত সময় লেগেছিল। মেজর (বর্তমানে ব্রিগেডিয়ার) জিয়াউর রহমান অষ্টম ইস্ট বেঙ্গলের নেতৃত্ব নিয়ে নিলেন এবং সৈন্যদের উদ্দেশ্যে কয়েক মিনিট ভাষণ দিলেন- “বাঘেরা আমার, পাকিস্তানীরা বাঙালিদের গণহারে হত্যা করা শুরু করেছে। তারা ইতিমধ্যেই ইস্ট বেঙ্গলের কয়েকটি ব্যাটালিয়নকে নিরস্ত্র করেছে। তারা আমাদের সবাইকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারা ইতিমধ্যে আমাকে ফাঁদে ফেলেছিল কিন্তু সৌভাগ্যবশত আমি রক্ষা পেয়েছিলাম। আমাদের সবাইকে তাড়াতাড়ি সংগঠিত হতে হবে এবং যেকোন মূল্যে দেশকে রক্ষা করার জন্য তাদের মুখোমুখি হতে হবে। তোমরা সবাই কি আমার সাথে এই কাজটা করতে প্রস্তুত?” আমরা সকলে রাজী হয়েছিলাম এবং সেটা করার জন্য আল্লাহর নামে শপথ নিয়েছিলাম।

অষ্টম ইস্ট বেঙ্গলের একটি কোম্পানি কিছুদিন আগে অগ্রগামী দল হিসেবে খরিয়া ক্যান্টনমেন্টে পৌছেছিল। পাকিস্তানের ইস্ট বেঙ্গলের পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম ব্যাটালিয়নের একটি কোম্পানিকে আসতে হয়েছে। তাদের খরিয়া যাবার আগেই একটি কোম্পানির শক্তিমত্তার সৈন্যরা ছুটিতে গিয়েছিল এবং সেই মুহূর্তে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গলের সর্বমোট ২৫০ জনের মত সৈন্য ছিল। কয়েকমাস আগে ১৯৭০ সালের ৩০ অক্টোবর ষোলশহরে এই ব্যাটালিয়নের জন্ম হয়। যেহেতু এই দলটি খরিয়া যাচ্ছিল তাই সেখানে সকল অস্ত্র, গোলাবারুদ, যন্ত্রপাতি, মজুদ, গাড়ি ইত্যাদি তৈরী রাখা হয়েছিল। এই ব্যাটালিয়নটি ইবিআরসি’র কাছ থেকে থ্রি নট থ্রি ধরনের ১৫০টি বন্দুক, একটি ১০৬ মিলিমিটার আর আর এবং বেলুচ ২০ থেকে কোন গোলাবারুদ ছাড়া দুইটি ৩ ইঞ্চি মর্টার প্রশিক্ষণের জন্য এনেছিল।যেগুলো সৌভাগ্যবশত ব্যাটালিয়নের সাথেই ছিল। ষোলশহরের বাজার যেখানে ব্যাটালিয়নটি বেড়ে উঠেছিল সেখানে থেকে এইসব লুকিয়ে রাখা মোটেই উপযুক্ত জায়গা ছিল না। উপরন্তু সেই মুহূর্তে কোনকিছু ছাড়া সুবিধাজনকভাবে অপারেশন চালানো ব্যাটালিয়নের পক্ষে সম্ভব ছিল না। সুতরাং, আপাততঃ শহরের বাইরে কোথাও সংগঠিত হয়ে  অপ্রথাগতভাবে অপারেশন চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হল।

ভোররাত দুইটার দিকে আমাদের সাথে থাকা অস্ত্র-গোলাবারুদ নিয়ে ইউনিট ত্যাগ করি। আমরা কালুরঘাট রাস্তার রেলওয়ে সেতু পার হয়েছিলাম এবং গ্রামে লুকিয়ে থাকার একটি অস্থায়ী স্থান খুঁজে পেয়েছিলাম। পরবর্তীকালে আমাদের সাথে ক্যাপ্টেন (বর্তমানে মেজর) হারুন আহমেদ চৌধুরী যোগ দেন যিনি ১৭ উইং ক্যাপ্টেনের কাছ থেকে তাঁর সর্বোচ্চ সংখ্যক সৈন্য, অস্ত্র, গোলাবারুদ নিয়ে পালিয়ে এসেছিলেন। এটা ছিল সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ যার জন্য আমরা বিপুল পরিমাণে এত অস্ত্র-গোলাবারুদ এবং প্রস্তুত সৈন্যদের পেয়েছিলাম। বিভিন্ন এমসিএ, নেতা এবং শুভাকাঙ্ক্ষীরা সেখানে আমাদের সাথে দেখা করেছিল। একটা খসড়া পরিকল্পনা তৈরী করা হয়েছিল এবং সন্ধ্যার অন্ধকারে আমরা আবার শহরের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।

কালুরঘাট রেলওয়ে সেতুর বিপরীত পাশের একটি গ্রামে আমি আমার কোম্পানিকে নিয়ে অস্থায়ী আশ্রয় নিলাম। আমার একজন সিপাইকে সাথে নিয়ে সম্পূর্ণ ভিক্ষুকের ছদ্মবেশে শহরে ঢুকেছিলাম এবং শহরে শত্রুপক্ষের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান চিহ্নিত করেছিলাম। কিছু উঁচু পাহাড় ও দালান শত্রুপক্ষের অধীনে ছিল যেখান থেকে তারা অনবরত গুলিবর্ষণ করছিল। অনেক উঁচু পাহাড় ও দালান তখনও কারো অধীনে ছিল না। ছাত্ররা তাদের শটগান বাইরে বের করে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ গতিতে ছাদখোলা গাড়ি চালাচ্ছিল। তারা খাবারসহ বিভিন্ন জিনিস আওয়ামী লীগ অফিস থেকে সংগ্রহ করে অনেক ছাত্র যোদ্ধা, আনসার পুলিশ, মুজাহিদ, অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা বিভিন্নদের মধ্যে বিতরণ করছিল।

২৯ মার্চ ১৯৭১, আমাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল কালুরঘাট সেতুর উভয় পাশে নিরাপত্তা দিতে এবং সেদিনের মধ্যেই এটা করা হয়েছিল। দুপুরবেলা পাকিস্তানের একটি সি-১৩০ বিমান সন্দেহের দৃষ্টিতে সেতুর উপর দিয়ে উড়ে গিয়েছিল। রাতে আমরা সবাই শুনেছিলাম যে কুমিল্লা থেকে কিছু কমান্ডো প্যারাট্রুপার আনা হয়েছিল এবং তারা চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে নেমেছিল। রাত আটটার দিকে খুবই শক্তিশালী সার্চলাইট জ্বালিয়ে একটি মোটরলঞ্চ আমাদের প্রতিরক্ষার দিকে এগিয়ে আসছিল। নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত আমাদের সৈন্যদের গুলি না করতে বললাম। দূরে নদীর তীরের একপাশে লঞ্চটি আধাঘন্টার মত দাড়িয়ে সার্বিক পরিস্থিতি দেখছিল এবং কিছুসময় পরে চলে গেল। আমরা জানতাম না কি ঘটেছিল। সৈন্যরা সারারাত উদ্বেগের সাথে সজাগ ছিল। ভোর সাড়ে চারটার দিকে আমাদের প্রতিরক্ষার খুবই কাছে কিছু গুলির শব্দ শুনেছিলাম।

একাত্তরের ৩০ মার্চ সকালের দিকে মোহাম্মদ আসাফ নামে একজন বেসামরিক ব্যাক্তি আমার সাথে দেখা করলো এবং ‘শত্রু’ ‘শত্রু’ বলে চিৎকার করা শুরু করলো। মেজর (বর্তমানে ব্রিগেডিয়ার) জিয়াউর রহমান আমার সাথে ছিল। তিনি আমার মুখের দিকে তাকালো এবং এক প্লাটুন সাথে নিয়ে তাদের মুখোমুখি হতে বললো। উচ্চ পদস্থ কমান্ডার সাথে থাকায় আমার প্রথম অপারেশনে যাবার জন্য অনেক সাহস পেয়েছিলাম। সেনাবাহিনীর একটি গাড়িতে ইস্ট বেঙল এবং ইপিআর মিলিয়ে এক প্লাটুন সৈন্য নিলাম এবং চলা শুরু করলাম। সেই বেসামরিক ব্যাক্তি মোহাম্মদ আসাফ আমাদের পথ দেখিয়ে এমন জায়গায় নিয়ে গিয়েছিল যেখানে আমার পুরো প্লাটুন সরাসরি গুলির নিচে পড়ে গেল। আমরা গাড়ি থেকে লাফ দিয়ে নেমে কিছু বাড়ি আর ঝোপেঁর পিছনে আশ্রয় নিলাম। কিছুদূর সামনে আগানোর পর আমরা শত্রুর অবস্থান নির্ণয় করতে পারলাম। এটা ছিল কৃষি বিভাগের তিনতলার বড় একটি বাড়ি যার পিছনের দিকে তারা আশ্রয় নিয়ে সেখান থেকে গুলি করছিল।

শত্রুরা আমার প্লাটুনের অবস্থান নির্ণয় করে এমজি ও এলএমজি (লাইট মেশিন গান) চালানো শুরু করেছিল। এখন আমার পুরো প্লাটুনটি শত্রুপক্ষের দালানটির ৪০০-৫০০ গজ দূরের ছোট একটি জায়গার সম্মুখভাগে চলে আসলো। আমি একবার আরেকটু কাছে যাবার চেষ্টা করলে শত্রুরা এমজি চালালো এবং আমি একটি ছোট গাছের নিচের সরে এলাম। গুলি আমাকে আঘাত করতে পারেনি। ইপিআর এর সেপাই নূর মোহাম্মদ তাঁর এলএমজি নাম্বার ২ নিয়ে আমাকে অনুসরণ করা শুরু করলো। শত্রুরা এখন তাদের সবগুলো অস্ত্র চালানো শুরু করলো। বেসামরিক ব্যাক্তি আসাফকে নিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে আমি একটি বালির স্তূপের পিছনে কিছুদূর আগালাম এবং এখন আমার এসএমজি’র নিশানার মধ্যে দালানটি চলে আসলো। দালানটা এখন ২০০-৩০০ গজদূর দিয়ে তিনদিক থেকে প্রায় বৃত্তাকারে ঘেরা ছিল। আমার প্লাটুন এবং শত্রুপক্ষের মধ্যে গুলি বিনিময় শুরু হলো। প্রথম তলা থেকে দ্বিতীয় তলার কাঁচের সারির মধ্য দিয়ে দালানের ভিতর শত্রুপক্ষের অবস্থান নির্ণয় করা আমাদের জন্য সহজ ছিল। হঠাৎ করে দালান থেকে একটি রকেট লঞ্চার ছোড়া হল এবং তাঁর নিচে একটি ছোট আমগাছের পিছনে আমার প্লাটুনের সিপাই নূর মোহাম্মদ তাঁর এলএমজি দিয়ে গুলি করছিল। দৈবক্রমে এক ও দুই নম্বর এলএমজি’তে আঘাত করেনি এটা। তারপর সাথে সাথে আমার অবস্থান লক্ষ্য করে আরেকটি রকেট লঞ্চার ছোড়া হল। সৃষ্টিকর্তা জানেন কিভাবে সেটা বালির বস্তার উপরে পড়ে গেল এবং আমার পিছনে বিস্ফোরিত হলো। আমি পড়ে গিয়ে এখন আমার রকেট লঞ্চার দালানের দিকে ছোড়া শুরু করলাম এবং সেটা খুব ভালো কাজে দিলো। সকাল সাড়ে দশটার দিকে শত্রুপক্ষের সেনাবাহিনীর দুটি বিমান আমাদের অবস্থানের উপর পৌছালো। বিমানটি আমার বর্তমান অবস্থানের প্রায় ১০০০ গজ সামনে চট্টগ্রাম বেতারে বোমাবর্ষণ করলো যেটা সুবেদার সাবেদ আলী সরকারের অধীনে আমাদের সৈন্যদের দখলে ছিল।

আমরা দিনের বেলা দালানটি দখলে নিতে পারিনি। রাত হবার সাথে সাথেই আমরা দালানটিকে চারদিক থেকে ঘিরে রাখলাম এবং পাহারা দিতে শুরু করলাম যাতে শত্রুরা পালাতে না পারে। রাতে কোন গুলি বিনিময় হয় নি। পরেরদিন সকালবেলা আমি আমার প্লাটুন নিয়ে দালানের ভিতরে চার্জ করলাম এবং ভিতরে নিন্মোক্ত জিনিস খুঁজে পেলামঃ-

পাঁচটি শত্রুপক্ষের মৃতদেহ, একজন আধমরা ল্যান্সনায়েক যে পরবর্তীতে মারা গিয়েছিল এবং একজন জীবিত কিন্তু গুরুতরভাবে আহত মোহাম্মদ আকবর নামে একজন সিপাই। যখন জিজ্ঞেস করা হল তখন সে বললো যে সে হামজা কোম্পানীর তৃ্তীয় এসএসজি (কমাণ্ড) ব্যাটালিয়নের অন্তর্ভুক্ত। ক্যাপ্টেন সাজ্জাদের নির্দেশে ৩০ জনের একটি প্লাটুন রাতে এসেছিল এবং কালুরঘাট রেলওয়ে সেতু উড়িয়ে দেবার জন্য দালানটি দখলে নিয়েছিল। শত্রুপক্ষের বাকি সৈন্যরা নিম্নোক্ত জিনিস রেখে রাতের আঁধারে পালিয়ে গিয়েছিলঃ-

মেশিন গান ওয়ান-এ-থ্রি- ১ টি

লাইট মেশিন গান-৭.৬২ চাইনিজ- ১ টি

জি-থ্রি রাইফেল- ২টি

স্মল মেশিন গান- ১ টি

স্মল মেশিন গান-৭.৬২ চাইনিজ- ২ টি

৪০ মিলিমিটার রকেট লাঞ্চার- ৩টি (রকেটসহ)

ওয়্যারলেস সেট-জিআরসি-নাইন (সকল যন্ত্রাংশ সহ)- ১টি

৯ মিলিমিটার ওয়াল্টার পিস্তল- ১ টি

অত্যন্ত হালকা পিস্তল- ২ টি

কমান্ডো নাইফ- ১ টি

কমান্ডো বেল্ট- ৭ জোড়া

কমান্ডো বুট- ৭ জোড়া

কমান্ডো বেরেট- ৮ টি

৭.৬২ এমুনিশনস- ২০০০ (বুলেট এবং ম্যাগাজিন)

এবং সেইসাথে বিপুল পরিমাণে বোমা।

হাজার হাজার জনতা দালানে জড়ো হয়ে আমাদের উৎসাহ দিতে শুরু করলো। দখলে নেয়া অস্ত্র ও গোলাবারুদ আমরা সংগ্রহ করলাম এবং আমার প্রতিরক্ষায় আনলাম। দুর্ভাগ্যবশত শত্রুপক্ষের সিপাই আকবরও ফেরার পথে প্রচণ্ড ব্যথায় মারা গেল। সেই কৃ্ষি দালানের চৌকিদার ও অন্যরা শত্রুপক্ষের মৃতদেহগুলো নিয়ে গিয়েছিল এবং দালানের উত্তর-পূর্ব কোনে কবর দিয়েছিল। মেজর (বর্তমানে ব্রিগেডিয়ার) জিয়াউর রহমান আমার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পরিদর্শন করলেন। আমার প্রথম অপারেশনের সফলতা শুনে এবং দখলে নেয়া বিপুল পরিমাণ অস্ত্র গোলাবারুদ দেখে তিনি খুবই খুশি হয়েছিলেন।

শহরেও একইসাথে যুদ্ধ চলছিল। ক্যাপ্টেন (বর্তমানে মেজর) হারুন আহমেদ চৌধুরী এবং লেঃ (বর্তমানে ক্যাপ্টেন) শমসের মবিন চৌধুরী শহরের প্রবেশমুখ চকবাজারে কঠিনতর যুদ্ধ করেছিল যেখানে বেলুচ ২০ ট্যাঙ্কও ব্যবহার করেছিল।  এক এক করে অনেক গুরুত্বপূর্ণ জায়গা আমাদের দখলে আসছিল। আমি আমার প্রতিরক্ষা বুহ্য চট্টগ্রাম বেতারে সামনে থেকে ইস্পাহানি, লিভার ব্রাদার্স, এফআইডিসি ইত্যাদি থাকা কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত বাড়িয়েছিলাম। একাত্তরে ২ এপ্রিল শত্রুপক্ষ আমাকে আঘাত করতে প্রথমবারের মত ৩ ইঞ্চি মর্টার ব্যবহার করেছিল। ফসফরাস ব্যবহার করে তারা শত শত বাড়ি, দোকান ইত্যাদি পুড়িয়ে দিয়েছিল।

আমাকে আমার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টের দিকে মুখ করে চট্টগ্রাম-কাপ্তাই রাস্তার জংশন দখলে নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। প্রায় এক মাইলব্যাপী একটি সম্পূর্ণ গ্রাম আমার একটি কোম্পানির দখলে ছিল। আমার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সামনে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট এবং পিছনে চট্টগ্রাম বেতার ছিল। নিঃসন্দেহে আমার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী ছিল কিন্তু কালুরঘাটের প্রধান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা থেকে আমার অবস্থান ছিল খুবই দূরে এবং আমার অবস্থানের পিছনে একটি বড় অংশ খালি ছিল। দুইদিন ধরে আমার সামনের শত্রুপক্ষকে ভালোভাবে আটকে রেখেছিলাম কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল সেগুলো ছিল শত্রুপক্ষের গৌণ অথবা মিথ্যা আক্রমণ। ৭ এপ্রিল শত্রুরা একটি সম্পূর্ণ ব্যাটালিয়ন নিয়ে চট্টগ্রাম বেতারে সুবেদার সাবেদ আলী’র অবস্থানে আক্রমণ করে এবং দখলে নেয়।

মেজর (বর্তমানে কর্নেল) শওকত যিনি শত্রুপক্ষের জাহাজ না ভিড়তে দেয়ার জন্য এবং পেছন থেকে অগ্রসর হবার জন্য দীর্ঘতম উপকূলীয় এলাকা পাহারা দিচ্ছিলেন। তিনি আজকে পিছু হটেন এবং অর্ধেক হারানো কালুরঘাট প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার নেতৃ্ত্বভার নেন। আমি তার সাথে যোগাযোগ করি এবং সাহায্য চাই। তিনি চট্টগ্রাম-কাপ্তাই রাস্তার মদনঘাট সেতুতে প্রধান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে যাওয়ার এবং প্রধান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ২ মাইল সামনে থেকে শত্রুপক্ষের মুখোমুখি হবার নতুন পরিকল্পনা দিয়েছিল। সাবেক কর্পোরাল করিম, যিনি একজন সাহসী মানুষ, তিনি বিভিন্ন সৈন্যের প্রায় এক কোম্পানি শক্তি নিয়ে আমার সাথে যোগ দেয়। মদনঘাট সেতুর উভয়পাশে আমি আমার স্থায়ী ও শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলি এবং সামনে থেকে শত্রুদের পাশে ও পিছনের দিকে চাপ দিতে শুরু করি।

একাত্তরের ৯ এপ্রিলের প্রথম প্রহরে মেজর (বর্তমানে কর্নেল) শওকত আমার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ২ মাইল সামনে থাকা শত্রুপক্ষের অন্যতম শক্তিশালী পোস্ট মন্টি ট্যানারীতে হানা দেয়ার একটি কাজ দেয় যার মাধ্যমে তিনি আমাকে সাহায্যের জন্য মর্টার ছোড়া এবং কালুরঘাটে শত্রুপক্ষের অবস্থানের উপর তার অন্যতম অপারেশনের সমন্বয় করতে চেয়েছিলেন। শত্রুপক্ষের অবস্থানের কাছাকাছি বানিয়াপাড়া ও চৌধুরীপাড়া নামে একটি গ্রাম ছিল যেটা লুকানোর জন্য ব্যবহৃত হবার কথা ছিল। গ্রামটি দৈর্ঘ্যে ৫০০ গজ ও প্রস্থে ২০০ গজ ছিল এবং এর চারপাশে বড় উন্মুক্ত জায়গা ছিল যা মন্টি ট্যানারীর শত্রুপক্ষের বন্দুকের নিশানার মধ্যে ছিল। দিনেরবেলা সেই বড় উন্মুক্ত জায়গাটি পার হয়ে গ্রামটি দখলে নেয়া সম্ভব ছিল না। একটি শক্তিশালী প্লাটুন নিয়ে একাত্তরের ৮ এপ্রিল প্রথম প্রহরের আগে এটা দখলে আনি এবং সারাদিন বসে সন্ধ্যা হবার জন্য প্রার্থনা করছিলাম। সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ যে শত্রুপক্ষ আমাদের অবস্থান ধরে ফেলেনি। অন্যথায় তারা খুব সহজেই আমাদের ঘিরে ফেলে হত্যা করতে পারতো। সন্ধ্যায় আমরা আমাদের লক্ষ্যের চেয়ে ৫০-১০০ গজ দূরত্বের কাছাকাছি চলে আসলাম। ১০-১২ জন সৈন্যকে আমরা একটা সেনাবাহিনীর গাড়ি থেকে নামতে দেখলাম। যেহেতু দিনেরবেলা লক্ষ্যবস্তু থেকে সরে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না সেহেতু আমি শত্রুপক্ষের অবস্থা ও তাদের শক্তিমত্তা সঠিকভাবে নির্ণয় করতে পারলাম না।

শারীরিক আক্রমণের জন্য আমি দালানের মধ্যে প্রবেশ করি নি। কিন্তু আমরা একসাথে আমাদের সকল অস্ত্র চালানো শুরু করলাম। বিহারী ল্যান্সনায়েক সালেহউদ্দিন সাকে আমি সন্দেহ করতাম তিনি শত্রুপক্ষের পরিকল্পনা আর দালানের বিরুদ্ধে ৮৩ মিলিমিটার ব্লেন্ডিসাইড ব্যবহার করে এই অপারেশনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। ৪-৫ মিনিটের মধ্যে আমরা পিছিয়ে আসলাম। এর কিছুক্ষন পর মর্টার চালু হয় এবং কালুরঘাট থেকে গুলিবর্ষণ শুরু হয়। আমরা নিরাপদ দূরত্বে সরে এসে শত্রুপক্ষের অবস্থানের উপর শেল বিস্ফোরণ দেখলাম এবং এটা পুনঃদখলে নিলাম। চট্টগ্রামের সেই অপারেশনে প্রথম শহীদ হন অষ্টম ইস্ট বেঙলের ল্যান্সনায়েক নাইব।

একাত্তরের ৯ ও ১০ এপ্রিল শত্রুপক্ষ তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিল কালুরঘাট ও মদনঘাট সেতু দখলে নেবার কিন্তু ব্যর্থ হয়েছিল। এগার তারিখে পিএনএস জাহাঙ্গীর এবং ফিল্ড আর্টিলারির একটি রেজিমেন্ট সকাল থেকে একইসাথে উভয় সাথে অস্বাভাবিক চাপ দিতে থাকে। চট্টগ্রাম-কাপ্তাই রাস্তার কোন থেকে ৩১ পাঞ্জাবের একটি অংশ সামনে থেকে চাপ দিতে থাকে। তাদেরকে আটকে রাখা আমার জন্য খুবই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়লো। সেতুর অন্যপাশ থেকে এক প্লাটুন এনে সামনে বসানো লাগলো। শত্রুপক্ষের শেলের জন্য আমাদের কি পরিমাণ আতঙ্ক কাজ করছিল সেটা বলে বোঝানো যাবে না। কালুরঘাট সেতুতে শত্রুপক্ষ আরো চাপ দিয়ে এটা দখলে নিয়ে নিল। সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করা ক্যাপ্টেন (বর্তমানে ক্যাপ্টেন) শমসের মবিন চৌধুরী আঘাত পেল এবং পাকিস্তানীদের কাছে আটকা পড়লো।

আমাদের সৈন্যের বেশিরভাগ একটা নিরাপদ দূরত্বে সরে যাওয়া পর্যন্ত আমাকে আমার অবস্থান ধরে রাখতে বলা হয়েছিল। ২ কোম্পানি সৈন্য নিয়ে আমি এখন একা মদনঘাট সেতু ধরে রেখেছি। দুপুর দুইটার দিকে সেতুর চারপাশ থেকে এবং আমার প্রতিরক্ষার ব্যবস্থার উপর শত্রুপক্ষের জাহাঙ্গীর হতে আরো বেশি চাপ দেয়া শুরু করলো। সেতুর অপর পাশে এক কোম্পানি বেশি এবং চট্টগ্রাম শহরমুখী শত্রুপক্ষের সেতুর দিকে এক কোম্পানি এর কম সৈন্য ছিল। সেতুর অন্যপাশে আব্বাস নামে এক বেসামরিক ব্যক্তিকে পেয়েছিলাম এবং আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত তাকে যেতে বারণ করেছিলাম। যখন আমি সেতু পার হয়ে আমার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সম্মুখভাবে চলে আসি তখনই শত্রুপক্ষ আমাদের অবস্থানকে আক্রমণ করে সেতুকে বন্দুকের নিশানার মধ্যে নিয়ে আসে।

যদি আমি শত্রুপক্ষকে কিছুদূর সামনে এগোতে দিতাম তাহলে তখন আমরা কখনোই নদী পার হতে পারতাম না। শত্রুপক্ষের আর্টিলারি থেকে শেল ছুড়ে আমাদের সরে যাওয়াকে বাঁধা দিতে চাচ্ছিল। সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ যে তখনই একটা ভয়ঙ্কর ঝড় শুরু হয় এবং আমি ভাবলাম আমার সামনের সৈন্যকে নৌকা দিয়ে বিকল্প পথে পিছনে নিয়ে আসার এটাই সুযোগ। দুই ঘণ্টা পর আমরা নদীর অপরপাশে আসতে পারলাম এবং কোন হতাহত ছাড়া প্রধান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সাথে যোগ দিলাম। যেহেতু সেতুটা অরক্ষিত ছিল এবং শত্রুপক্ষের শেল তখনও চলছিল তাই নদীর এই পাড়ে থাকাও সম্ভব ছিল না। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম এখান থেকে সরে গিয়ে কয়েক মাইল পিছনে উপযুক্ত জায়গায় একটি বিকল্প প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার। হঠাৎ করে আমার আব্বাসের কথা মনে পড়লো আর ভাবলাম শত্রুপক্ষের শেল দ্বারা সেই জায়গা হয়তো লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছে এবং তিনি নিশ্চয়ই সেই জায়গা অনেক আগেই ত্যাগ করেছেন। কিন্তু তারপরও সাবেক কর্পোরাল করিম ও ১৭ উইং ইপিআর এর সিপাই মানিক মিয়ার সাথে আমি সেই জায়গাটা দেখে আসার প্রয়োজন অনুভব করলাম। সেই সাহসী মানুষকে নিশ্চল পাথরের মত প্রধান রাস্তার পাশে তার গাড়ি নিয়ে দাড়িয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করতে দেখাটা ছিল আমাদের কল্পনারও বাইরে। বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় পুরো মুক্তিযুদ্ধ জুড়েই তিনি আমার সাথে ছিলেন। তিনি এটাকেই পুরষ্কার হিসেবে গ্রহন করেছিলেন।

একই দিকে প্রথম প্রহরের মধ্যে মদনঘাটের কয়েকমাইল দূরে নোয়াপাড়া কলেজে আমি আরেকটি অস্থায়ী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলি। রাতে শত্রুপক্ষ সেতু পার হয়নি। ১৪ এপ্রিল সকালবেলা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া আরো সৈন্যকে এদিক-সেদিক থেকে সংগ্রহ করি এবং তাদের আমার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সাথে যুক্ত করি। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন ব্রিগেডিয়ার এম আর মজুমদারের গাড়িচালক হাবিলদার আরব আলী। চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টের পাকিস্তানি বন্দীশালা থেকে তিনি পালিয়ে এসেছিলেন। তিনি নির্দয়ভাবে প্রহৃত হয়ে অর্ধমৃত ছিলেন।

আমার সাঙ্ঘাতিক ভুল ছিল আমার সৈন্যদের ইপিআর এর এক সিনিয়র জেসিও এর অধীনে রেখে যাওয়া এবং সাবেক কর্পোরাল করিমকে সাথে নিয়ে কাপ্তাইয়ের পিছনের দিকে আমাদের প্রধান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার অবস্থান জানতে চাওয়া যারা গতকাল চলে গিয়েছিল। কাপ্তাইয়ে পৌছার পর আমি জানতে পারলাম আমার সৈন্যরা খাগড়াছড়ি যাবার জন্য রাঙামাটির দিকে রওনা হয়েছে। আমি আমার সৈন্যদের দিগ্বিদিক ছোটাছুটি অবস্থায় খুঁজে পেলাম। শত্রুপক্ষ ইতিমধ্যে আমার অবস্থান আক্রমণ করে সবকিছু তছনছ করে দিয়েছিল। ২ কোম্পানি সৈন্যের মধ্যে আমি কষ্ট করে ২ প্লাটুন সৈন্য খুঁজে পেলাম যাদের নিয়ে আমাদের প্রধান বাহিনীর খোঁজে পিছনে সরে যেতে শুরু করলাম।

একাত্তরের ১৩ এপ্রিল খাগড়াছড়ি পৌছে আমি সকল অফিসার ও সৈন্যদের সাথে দেখা করলাম। মেজর (বর্তমানে ব্রিগেডিয়ার) জিয়াউর রহমান যিনি সোবহানপুর-ছাগলনাইয়া রাস্তা, কালুরঘাট-চট্টগ্রাম রাস্তা, নাজিরহাট-চট্টগ্রাম রাস্তার মত বিভিন্ন স্থানে শত্রুপক্ষকে ধরে রেখেছিলেন তিনি খাগড়াছড়ি আসেন এবং চেঙ্গী নদী দিয়ে রাঙামাটিকে সামনে থেকে ধরে রাখার একটি নতুন পরিকল্পনা আমাদের দেন। ১৪ এপ্রিল আমরা সকলে মহলছড়িতে ফিরে আসি এবং আমাদের কৌশলের প্রধান কার্যালয় তৈরী করি। সৈন্যদের পুনরায় সংগঠিত করে বিভিন্ন জায়গায় ভাগ করে দেয়া হচ্ছিল। ক্যাপ্টেন (বর্তমানে মেজর) খালেকুজ্জামান, ক্যাপ্টেন আফতাব কাদের এবং এক প্লাটুন সাথে নিয়ে মেজর (বর্তমানে ব্রিগেডিয়ার) জিয়াউর রহমান একাত্তরের ১৫ এপ্রিল ঘাগড়ার উদ্দেশ্যে রওনা হন। ইপিআর এর সুবেদার খাইরুজ্জামান, সাবেক কর্পোরাল করিম, দুইজন বেসামরিক ব্যাক্তি- একজন ছিল কেপিএম এর ক্যামিকেল ইঞ্জিনিয়ার জনার ইশাক এবং অন্যজন ছিল চন্দ্রঘোনার একজন আন্তর্জাতিক ফুটবল খেলোয়াড় জনাব মুরি, দুইজন সাহসী ছাত্র- একজন ছিল ফারুক আহমেদ এবং অন্যজন শওকত আলীর (উভয়েই বর্তমানে লেফটেন্যান্ট) সাথে এক প্লাটুন সৈন্য নেই এবং বুড়িঘাট বাজারের উদ্দেশ্যে রওনা দেই। কয়েকদিনের জন্য আমরা শত্রুপক্ষকে হানা, চোরাগোপ্তা হামলা ও হয়রানি করে তটস্থ করে রাখি। ১৭ এপিল শত্রুপক্ষের এক প্লাটুন আচমকা মোটরলঞ্চে করে ক্যাপ্টেন (বর্তমানে মেজর) খালেকুজ্জামান ও ক্যাপ্টেন আফতাব কাদেরের দ্বীপে ঢুকে পড়ে এবং হতাহতের ঘটনা ঘটায়। ১৮ তারিখ ২-৩ টি লঞ্চ নিয়ে শত্রুপক্ষের একটি কোম্পানি ক্যাপ্টেন (বর্তমানে মেজর) দ্বীপকে ঘিরে ফেলে আক্রমণ করে। অষ্টম ইস্ট বেঙ্গলের ল্যান্সনায়েক মুন্সী আবদুর রব সেই অপারেশনে সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে শহীদ হন। মিজোদের সাথে যোগাযোগ করে শত্রুপক্ষ গত কয়েকদিন ধরে তাদের উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। তারা মহলছড়ির কাছে আমাদের টেকনিক্যাল হেড কোয়াটারে পৌছে গিয়ে অপারেশন শুরু করে। আমাদের সবাইকে ডেকে নিয়ে টেকনিক্যাল হেড কোয়াটারে পাহারা দিতে বলা হয়।

২৭ এপ্রিল শত্রুপক্ষ ২ সৈন্যের সাথে হাজারের বেশি মিজোদের নিয়ে আমাদের টেকনিক্যাল হেড কোয়াটারের কাছে জড়ো হয়। দুর্ভাগ্যবশত পাহারা দিতে থাকা আমাদের এক বাহিনী তাদের লুকিয়ে থাকা ধরে ফেলে। কোন বিকল্প না পেয়ে টেকনিক্যাল হেড কোয়াটারের সামনে ক্যাপ্টেন (বর্তমানে মেজর) খালেকুজ্জামানের উপর অপরিকল্পিত আক্রমণ করতে হয়। ক্যাপ্টেন খালেককে শক্তিশালী করে এক প্লাটুনসহ আমাকে মেজর শওকত পাঠায়। এইসময়ের মধ্যে আমি সেখানে গিয়ে ক্যাপ্টেন খালেককে কমবেশি চারপাশ থেকে ঘেরা অবস্থায় আবিস্কার করি। আমি আমার প্লাটুন নিয়ে ক্যাপ্টেন খালেকের পরিখাগুলো দখলে করে যুদ্ধ শুরু করি। আমার ডান সেক্টরের অধীন সুবেদার সাকবেদ আলী শত্রুপক্ষের সামনে পড়ে যায় কিন্তু ক্যাপ্টেন খালেকসহ তার কিছু সৈন্যকে মুক্ত করতে ভালো একটা চেষ্টা চালায়।দুইজন সেক্টরকে সাথে নিয়ে আমি শত্রুপক্ষের সম্মুখভাগের গুলির মধ্যে চলে আসি। জঙ্গলের মধ্য থেকে শত শত মিজোরা সবুজ পোশাকের ছদ্মবেশে আমাদের দিকে ছুটে আসছিল। বাম সেক্টরে এলএমজিধারী যোদ্ধা সিপাই (বর্তমানে নায়েক) সামনে থেকে অনেককে হত্যা করে কিন্তু তার সকল গোলাবারুদ শেষ করে চিৎকার দেয়া শুরু করে। ডান সেক্টরের একটি এলএমজি তখনো চলছিল।

অনেক হতাহতের পরও শত্রুপক্ষ সামনের দিকে আগানোর চেষ্টা করছিল। যখনই আমরা কিছুটা পিছিয়ে আসি তখন টেকনিক্যাল হেড কোয়াটার থেকে মেজর শওকত শত্রুপক্ষের উপর এমজি চালানো শুরু করে। আমি আমার প্লাটুনকে সৌভগ্যবশত অক্ষত অবস্থায় নিয়ে আসি এবং মেজর শওকতের সাথে যোগ দেই। আমার সেক্টর কমান্ডারের অন্যতম ইপিআর এর সুবেদার লোনি মিয়া এই অপারেশনে অভূতপূর্ব সাহসিকতার পরিচয় দেয়। শত্রুপক্ষ তাদের গতি ধরে রেখে আমাদের টেকনিক্যাল হেড কোয়াটারের উপর ৩ ইঞ্চি মর্টার ছোড়া শুরু করে। প্রতিশোধ নেয়ার জন্য আমাদের কাছে এমনকি একটা ২ ইঞ্চি মর্টারও ছিল না। আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম পাকিস্তানি সৈন্যরা পিছন থেকে মিজোদের সামনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। শত্রুপক্ষের আগানো ঠেকানোর জন্য আমাদের সম্মুখভাগ বাম থেকে ডানে চওড়া করা এবং নিজেদের সৈন্যদের উৎসাহ দেয়া লেগেছিল। এটা ছিল আমাদের দুর্ভাগ্য যে ক্যাপ্টেন আফতাব কাদেরর ডান পাশ থেকে একটি গুলি এসে বুকের বাঁ পাশে বিদ্ধ হয় এবনহ কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই তিনি শহীদ হন। আমরা আরেকজন সাহসী যোদ্ধাকে হারাই।

শত্রুপক্ষের ভীষণ গুলিবর্ষণের মধ্যে তার মৃতদেহ দুই ছাত্রের (বর্তমানে লেফটেন্যান্ট) সাথে রামগড়ে পাঠানো হয় এবং ডাকঘরের সামনে শ্রদ্ধার সাথে কবর দেয়া হয়। প্রথম রাতের পরই সাথে সাথে আমরা পিছিয়ে আসি। যেটেকনিক্যাল হেড কোয়াটারকে আমরা অর্ধেক মাস পর্যন্ত সুরক্ষা করে রেখেছিলাম গিয়ে দেখি সেটা আগুনে দাউ দাউ করে পুড়ছে।

২৮ এপ্রিল খাগড়াছড়ি হয়ে আমরা গুইমারা পৌছি এবং আরেকটা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলি। পরেরদিন আমরা রামগড়ে পিছিয়ে আসার সংকেত পাই কারণ শত্রুপক্ষ নিজেদের সৈন্যদেরকেই কারেরহাট-নাজিরহাট দিক দিয়ে একইসাথে রামগড়ের দিকে চাপ দিচ্ছিল। ৩০ তারিখ কর্নেল (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল)  আতাউল গনি  ওসমানী সেখানে সম্মানজনক পরিদর্শন করে আমাদের সৈন্যদের সাথে দেখা করে এবং ২৪ ঘন্টার জন্য রামগড় ধরে রাখার নির্দেশ দেয়। রামগড়ের ৫ মাইল সামনে চিকনছড়ায় ক্যাপ্টেন (বর্তমানে মেজর) অলি তার সৈন্যসহ ছিলেন এবং আমি আমার সৈন্যদের নিয়ে ক্যাপ্টেন অলির অবস্থানের এক মাইল দূরে বাগানবাড়ির বিওপি তে অতিরিক্ত হিসেবে প্রতিরক্ষা গড়ে তুলি। শত্রুপক্ষ আর্টারীর সাহায্যে ক্যাপ্টেন অলির অবস্থান আক্রমণ করে। তিনি তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে শত্রুপক্ষকে আটকে রাখে এবং রামগড়ে পিছিয়ে আসে। শত্রুপক্ষ তখন আমার সামনে ছিল এবং নিয়মিত বিরতিতে চাপ দিয়ে তারা নিজেরাও বেশিসংখ্যক হতাহতের সম্মুখীন হয়।

একাত্তরের ২ মে সকাল দশটা থেকে বিকাল তিনটা পর্যন্ত আমরা শত্রুপক্ষকে খুব শক্তভাবেই ধরে রেখেছিলাম। তারপর তারা বড় আর্টারী ব্যবহার শুরু করে। অনেক শেল আমাদের কাছে পড়েছিল কিন্তু সৌভাগ্যবশত আমরা বেঁচে গিয়েছিলাম। পিছিয়ে আসার সময় রামগড়ের দুই মাইল সামনে মহামুনি বুদ্ধ মন্দিরে আমার এক প্লাটুন নিয়ে আমি আটকা পড়ি এবং মুক্ত হতে পারছিলাম না। অস্টম ইস্ট বেঙ্গলের সুবেদার আনোয়ার দুঃসাহসিকভাবে তার এলএমজি নিয়ে সরাসরি রাস্তায় চলে আসে এবং গুলির আড়াল করে দিয়ে প্লাটুনকে বের হয়ে আসতে সাহায্য করে। তখন আমরা রামগড়ে আমাদের নিজেদের এমজি’র তত্ত্বাবধানেই ছিলাম। একবার সুযোগ পেয়ে মেজর শওকত এমজি শেষবারের মত চালিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত আমরা বাংলাদেশের শেষ টুকরো ভূখণ্ড রামগড়কে ত্যাগ করি এবং সন্ধ্যায় সাব্রুমপাড়ি দেই।

 স্বাক্ষরঃ

২৫-০৮-১৯৭৩

————————————————–

<৯, ২.৭, ৫৯-৮৮>

 

চট্টগ্রামের সশস্ত্র প্রতিরোধ ও প্রাসঙ্গিক কথা

সাক্ষাতকারঃ মেজর (অবঃ) রফিক-উল-ইসলাম

(মেজর (অবঃ) রফিক-উল-ইসলাম রচিত ‘লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে’ গ্রন্থ, ১৯৮১ থেকে সংকলিত। ১৯৭১ সালের মার্চে উনি ক্যাপ্টেন পদে সাবেক ইপিআর সেক্টর হেড কোয়ার্টার চট্টগ্রামে কর্মরত ছিলেন)

 

।।চরম আঘাতের সেই রাত।।

২৫শে মার্চ, ১৯৭১ সাল। বৃহস্পতিবার।

অন্যান্য দিনের মতো সকাল ৭টায় আমি অফিসে গেলাম। সেখানে পৌঁছে দেখি পশ্চিম পাকিস্তানী মেজর ইকবাল বসে আছেন। তিনি আমাকে দেখেই বললেন, “মিঃ রফিক আপনাকে দারুন ক্লান্ত দেখাচ্ছে। অনেক খাটুনি গেছে আপনার ওপর দিয়ে, কক্সবাজার গিয়ে কয়েকদিন বিশ্রাম নিন না কেন? ইচ্ছা হলে আজই যেতে পারেন। আমি কমান্ডিং অফিসারকে বলে দেব।”

এটা ঠিক, গত কয়েক বছরের মধ্যে আমি কোন ছুটি নেই নি। বিশ্রামের আমার খুবই প্রয়োজন ছিলো। তবু মেজর ইকবালের সেদিনের অস্বাভাবিক পীড়াপিড়ি আমার ভালো লাগলো না, বরং আমার সন্দেহকে আরও ঘনীভূত করলো। তাঁকে আমি শান্ত গলায় জবাব দিলাম, “ধন্যবাদ স্যার। কিন্তু স্যার, আপনি তো জানেন গত জানুয়ারি থেকে সব ছুটি বাতিল করা হয়েছে।”

“ওকথা বাদ দিন। আমি কমান্ডিং অফিসারকে বুঝিয়ে বলতে পারবো। আমার বিশ্বাস, তিনি ছুটি মঞ্জুর করবেন।” মেজর ইকবাল তবুও বলে চললেন।

মেজর ইকবাল যে কমান্ডিং অফিসারের একজন প্রিয়পাত্র তা আমরা সবাই জানতাম। আমাকে চট্টগ্রাম শহরের বাইরে এবং আমার সৈন্যদের সংস্পর্শ থেকে দূরে রাখার জন্যে মেজর ইকবালের এ প্রচেষ্টা আমাকে ভাবিয়ে তুললো। আমি তাঁর কথায় তাল না দিয়ে প্রসঙ্গ পরিবর্তনের জন্য বললাম, “আপনি বোধকরি জানেন, গতকাল পোর্ট এলাকায় জনতার ওপর সৈন্যরা গুলি চালিয়েছে অনেক লোক মারা গেছে।”

‘অনেক নয়’- যেন তেমন কিছুই ঘটেনি এমন ভাব দেখিয়ে তিনি বললেন, “মাত্র একজন কিংবা দু’জন আহত হয়েছে।”

এরপর তিনি মুখে কৌতুহলোদ্দিপক হাসি ফুটিয়ে বললেন, “শুনলাম শেখ মুজিবর রহমান সামরিক পদক্ষেপের প্রতিবাদে আগামী ২৭শে মার্চ হরতাল ডেকেছেন।”

“আমি এখনো শুনিনি তবে পোর্ট এলাকায় যে সৈন্যরা এলোপাতারি গুলি চালিয়েছে তার শব্দ আমাদের অফিসে বসেও শোনা গেছে।”

সেদিন বেলা ২টায় আমি ই-পি আর সদর দফতর ত্যাগ না করা পর্যন্ত মেজর ইকবাল সারাক্ষণ আমাকে ছায়ার মতো অনুসরণ করলেন।

ইয়াহিয়ার সাথে মীমাংসায় পৌঁছে গেছে বলে এ সময়ে একটা গুজব ছড়িয়ে পড়ে। তবে নির্ভরযোগ্য কোন মহল থেকে এর সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেলো না। সরকারী বেতার একটা রাজনৈতিক ফয়সালার আভাস দেয়া হয়। কিন্তু এ খবরের ওপরও নির্ভর করা গেলো না। বাসা থেকে সেই মুহূর্তে আমি আমার সদর দফতরে টেলিফোন করে সকল সৈন্যকে পুরোপুরি প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দিলাম। তারপরে বাড়ির লনে অস্থিরভাবে পায়চারি করতে লাগলাম।

চট্টগ্রামের বেলা ৪টা ৩০ মিনিটের দিকে ডাঃ জাফর আমার বাসায় এলেন। লনে বসে আমরা সম্ভাব্য সবকিছু নিয়ে আলোচনা করলাম। কিন্তু তখনো ঢাকার কোন নির্ভরযোগ্য খবর আমরা পাইনি। রাত ৮টার দিকে ডাঃ জাফর ঢাকার কোন সংবাদ এসেছে কিনা জানার জন্য আওয়ামী লীগ অফিসের দিকে গেলেন। আমি আমার এক বন্ধু ক্যাপ্টেন মুসলিম উদ্দিনকে নিয়ে অন্যান্য দিনের চেয়ে একটু আগেই রাতের খাবার খেয়ে নেয়ার জন্য বাসার ভিতরে গেলাম। খাওয়া কেবল শুরু করেছি, এমন সময় একজন আওয়ামী লীগ কর্মীসহ ডাঃ জাফর আবার ফিরে এলেন। রাত তখন ৮টা ৩০ মিনিট।

“মনে হচ্ছে আলোচনা ব্যার্থ হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার গোপনে করাচী চলে গেলেন বলে শোনা যাচ্ছে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকিস্তানী সৈন্যরা ট্যাংক নিয়ে শহরের দিকে বেরিয়ে পড়েছে বলে খবর এসেছে।“ তারা দুজনই উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় এতো উত্তেজিত ছিলো যে তাদের মুখ দিয়ে যেন কথা সরছিলো না।

“আপনি কি সত্যি সংবাদ বলছেন?” তবু আমি ডাঃ জাফরকে জিজ্ঞেস করলাম।

“হ্যাঁ। ঢাকা থেকেই আমরা এ খবর পেয়েছি। খবর পেয়েই আমাদের দল জনাব সিদ্দিকীর বাসায় রুদ্ধদ্বার বৈঠকে মিলিত হই। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুসারে জনাব সিদ্দিকী আমাদেরকে অবিলম্বে আপনাকে ঢাকার সর্বশেষ পরিস্থিতি জানাতে বলেছেন এবং উপযুক্ত বেবস্থা গ্রহণ করার জন্য আপনাকে অনুরোধ জানিয়েছেন। এতগুলো কথা বলে উভয়ে একটু থামলেন এবং গভীর আশা নিয়ে আমার দিকে তাকালেন। তাদের দু’জনকেই বিষণ্ণ দেখাচ্ছিল। আমি শুনতে পেলাম, কে যেন খুব নিচু গলায় বলল, “এবার আপনার পালা।”

তখনও আমাদের হাত ভাতের থালায়। মুহূর্তের জন্য আমি গভীর চিন্তায় ডুবে গেলাম। ওদিকে আগ্রহী আগন্তকের স্থির দৃষ্টি আমার ওপর নিবদ্ধ।

সেনাবাহিনী ট্যাংক নিয়ে শহরের দিকে বেরিয়ে থাকলে নিশ্চয়ই তারা ভয়ানক কিছু ঘটাবে। সব চাইতে খারাপ কিছুর কথাই এখন আমাদের ভাবা উচিত। ৩রা মার্চ থেকেই ওরা নির্বিচারে বাঙালিদের হত্যা করেছে শুধু ২৪ শে মার্চ চট্টগ্রাম পোর্টে ২০ জনেরও বেশী লোক নিহত হয়েছে। আরো খবর পেয়েছিলাম বাংলাদেশের সর্বত্রই ওদের হত্যাকাণ্ড চলছে – ঢাকা, খুলনা, যশোর, রংপুর, সৈয়দপুর, রাজশাহীসহ আরো অনেক জায়গায় গুলি চলেছে। ২৫শে মার্চ সন্ধ্যায়ও এক বিস্ময়কর ঘটনা ঘটেছে। চট্টগ্রাম ই-পি-আর- এর দুটি ওয়্যারলেস সেটই ঢাকার পিলখানার সাথে যোগাযোগ করতে পারছিল না। এমন কোন দিন ঘটে নি। সন্দেহ আগে থেকেই গভীরতর হয়ে উঠেছিল।

এসব দ্রুত আমার মানসপটে ভেবে উঠলো। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে থেকে জেনেছি, ওদেরকে কোন জায়গায় একবার লেলিয়ে দেয়া হলে হেন নৃশংসতা নেই যা ওরা করতে পারেনা। ইয়াহিয়ার আকস্মিক ঢাকা ত্যাগ, আলোচনা ব্যার্থ হওয়া এবং ক্যান্টনমেন্ট থেকে সেনাবাহিনীর বের হওয়া – সবকিছু মিলিয়ে একটা বেপরোয়া হত্যালীলার সুস্পষ্ট আভাস পাচ্ছিলাম। আরো আশংকা করছিলাম, সামরিক বাহিনীর বাঙালি সৈন্যরাও ওদের হাত থেকে নিস্তার পাবে না।

এ সময় নিজের ভেতর থেকেই আমি যেন এক অলৌকিক সাহস অনুভব করলাম। মনে হলো আমার ভেতর থেকে কে যেন আমাকে বলছে আমার নিজের জীবন এবং আমাদের অন্যান্যর জীবন রক্ষার জন্য এ পশুশক্তির বিরুদ্ধে অবশ্যই ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। এরপর আমি ‘হয় স্বাধীনতা অর্জন, না হয় ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যু’ এ ধরনের এক চরম সিদ্ধান্ত নিলাম। ডাঃ জাফরকে বললামঃ আমাদের ষোলশহর এবং ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে বাঙালি সৈন্যদেরকে আমাদের সঙ্গে যোগ দিতে বলুন। তারপর রেলওয়ে হিলে আমার সদর দফতরে দেখা করবেন।

খাওয়া থেকে উঠেই আমি হালিশহর ই-পি-আর দফতরে ফোন করলাম। সেখানে বাঙালি জেসিও’রা আমার নির্দেশের অপেক্ষাতেই ছিলেন। তাঁদেরকে বললাম, এক্ষুনি সব ফাঁড়িতে দ্বিতীয় সাংকেতিক বার্তাটি পাঠিয়ে দিন। অস্ত্রাগার নিয়ন্ত্রণে রাখবেন। পাকিস্তানী সৈন্যদের রুম থেকে বের হতে দেবেন না। নৌ- বাহিনী সদর দফতরের দিকে থেকে হামলা হতে পারে। সেদিকে প্রতিরক্ষামুলক কিছু সৈন্য মোতায়েনের ব্যবস্থা করুন। আমি আসছি।

রাত তখন ৮টা ৪৫ মিনিট। আমি শেষবারের মত আমার সারসন রোডস্থ বাসভবন ত্যাগ করলাম। আমাদের প্রথম লক্ষস্থল ওয়ারলেস কলোনীর দিকে আমাদের গাড়ী ছুটে চললো। আমার পাশে ড্রাইভার কালাম এবং পেছনের সিটে দুজন রক্ষী। তীব্র উত্তেজনায় সবাই ঠোঁট কামড়াচ্ছিলো। রাস্তা জনমানবশূন্য। আমাদের গাড়ী যতই আয়ারলেস কলোনির এগচ্ছিলো, উত্তেজনা ততই বাড়ছিলো। একটা সরু রেল ক্রেসিংয়ের ওপর আসতেই জীপ একটু লাফিয়ে উঠলে আমার চিন্তায় ছেদ পড়লো। আমি সম্বিৎ ফিরে পেলাম। এখান থেকে আমি ওয়ারলেস স্টেশনের এনটিনা দেখতে পাচ্ছিলাম। নিরাপত্তামুলক ব্যবস্থা হিসাবে আয়ারলেস স্টেশনের চারদিকে ছিল কাটা তারে ঘেরা।যাতে কেউ সন্দেহ করতে না পারে সেজন্য আমি ড্রাইভারকে গাড়ী আস্তে চালাতে বললাম। আমাদের এখানকার সাফল্য ছিলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তামুলক ডিউটিতে নিযুক্ত ই-পি-আর-এর একটি প্লাটুনের মোকাবিলা করতে হবে আমাদের ৪ জনকে ওদেরকে নিরস্ত্র করতে হবে। আমার রেকর্ড অনুযায়ী পশ্চিম পাকিস্তানী ক্যাপ্টেন হায়াত এবং সুবেদার হাসমত এই প্লাটুনের কমান্ডে ছিলেন। বাকী সেনারা সবাই ছিলো বাঙালি। আমাদের জানামতে এখানে আরো তিনজন পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য ছিলো। অনুরুপভাবে নগরীর অন্যান্য এলাকাতেই ই-পি-আর প্লাটুন অবস্থান করছিলো। তবে আয়ারলেস কলোনীর এই প্লাটুনটিই শুধু পশ্চিম পাকিস্তানী অফিসারের কমান্ডে ডিউটিরত ছিলো।

গেটে পৌঁছতেই প্রহরারত শান্ত্রি জীপ থামিয়ে দিলো। বাঙালি শান্ত্রি প্রহরারত ছিলো। সে আমার জীপটি ভেতরে যাবার অনুমতি দিলো। আমরা ক্যাপ্টেন হায়াতের রুমের সামনে গিয়ে জীপ থামালাম। সেখানেও একজন শাস্ত্রী পাহারা দিচ্ছিলো।

সাবধানে আমি হায়াতের কক্ষের দিকে এগিয়ে গেলাম। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে মারাত্মক কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে, হয় সফল হবো, না হয় আমার মাথা ভেদ করে একটা বুলেট বেরিয়ে যাবে। শেষেরটি সত্যি হলে চট্টগ্রামের ই-পি- আর সেনা পরিচালনা করতে আর কোন বাঙালি অফিসার থাকবে না। এই চিন্তা আমাকে কিছুটা বিহবল করে তুললো ক্ষণিকের জন্য।

আমি খুব আস্তে দরজায় নক করলাম এবং বন্ধুসুলভ গলায় বললাম। “হ্যালো হায়াত ঘুমিয়ে পড়েছো নাকি?”

“এই কেবল শুয়েছি স্যার।“ আমার গলায় স্বর চিনতে পেরে সে আলো জ্বালালো। জানালার পর্দার ফাক দিয়ে আমি দেখলাম বালিশের তলা থেকে কি যেন একটা নিয়ে সে তার শোবার পোশাকের নিচে রাখছে। দরজা খোলার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, “সব কিছু ঠিকঠাক আছে তো।”

“সব ঠিকঠাক হ্যাঁয়” জবাব দিয়েই সে দরজা খুললো।

“প্লিজ ভেতরে আসুন স্যার, এবং-”

তার কথা শেষ না হতেই আমি স্টেনগান তার বুকের দিকে ধরে বললাম, “আমি দুঃখিত হায়াত, তোমাকে গ্রেফতার করতে হচ্ছে।“ হঠাৎ সে তার পিস্তল বের করার উদ্যোগ নিতেই ড্রাইভার কালাম দ্রুত এগিয়ে আসে এবং দুজনেই হায়াতের মাথায় আঘাত করি। সাথে সাথে আমরা তার হাত ও মুখ বেধে ফেললাম এবং টেলিফোনের তার কেটে দিলাম। তারপর পাশের ব্যারাকে ঘুমন্ত সুবেদার হাসমতকে ডেকে আনার জন্য লোক পাঠালাম। সুবেদার হাসমত চোখ মুছতে মুছতে উঠে এসে স্যালুট দিয়ে দাড়াতেই কালাম এবং অন্য প্রহরিরা তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। হাসমতকে আটক করে তার হাত ও মুখ বেঁধে ফেলা হলো।

হায়াতের রুমের সামনে দাঁড়ানো শাস্ত্রীটি এতক্ষন হতভম্ব হয়ে এইসব অদ্ভুত ঘটনা দেখছিল। হঠাৎ কি মনে করে সে একটি টিলার দিকে দৌড় দিলো। কালাম ফিসফিস কণ্ঠে বললে, ও পশ্চিম পাকিস্তানী এবং পড় মুহূর্তেই একটি বুলেট সাঁ করে চলে গেলো। আমরা নিচু হয়ে বসে পড়লাম। ব্যারাকগুলো থেকে সৈন্যরা বেরিয়ে পড়তে লাগলো। যথাসম্ভব স্বাভাবিক গলায় আমি বললাম, শান্ত্রি ভুল করে গুলি ছুঁড়েছে। তারপর সবাইকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানোর নির্দেশ দিলাম। অন্য তিনজন পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য আত্মসমর্পণ করলো। যে শান্ত্রি গুলি ফেলে পালিয়ে গেলো। এই প্লাটুন থেকে আমি ১০ জন সেনাকে রেলওয়ে হিলে আমার সম্ভাব্য সমর- দফতর রক্ষা করার জন্য পাঠালাম। অন্যদেরকে হালিশহরে আমার সঙ্গে যোগ দেয়ার নির্দেশ দিলাম। বিচ্ছিন্ন প্লাটুনগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য বিভিন্ন দিকে কয়েকজন বার্তাবাহককে পাঠালাম এবং চূড়ান্ত নির্দেশের জন্য সবাইকে অবিলম্বে হালিশহরে আমার সঙ্গে দেখা করার নির্দেশ দিলাম।

অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে একটি দুঃসাধ্য কাজ সমাধা হলো। ড্রাইভার কালাম এবং দুজন প্রহরীকে ধন্যবাদ, তারা জীবন বিপন্ন করে এ কাজে সহায়তা করেছে।

রাত সাড়ে নটায় আমরা হালিশহরে পৌঁছলাম। ড্রাইভার কালামকে সতর্ক করে আলো নিভিয়ে দিয়ে গাড়ী আস্তে চালাবার নির্দেশ দিলাম। হালিশহরে জেসিও এবং এনসিওরা আমরা জন্য অপেক্ষা করছিলো। তিনটি অস্ত্রাগাড়ের সবকটিই আমাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে ছিলো। বাঙালি এনারা যার যার অস্ত্রাগারের সামনে অস্ত্র ও গুলির জন্য সমবেত হয়েছে। মাত্র একমাস আগে আমরা থ্রি-নট- থ্রি রাইফেলের পরিবর্তে বিপুল পরিমান চীনা হাতিয়ার ও গোলাগুলি পেয়েছিলাম। এগুলো মিলিয়ে আমাদের মজুত ছিলো উদ্বৃত্ত, যুগ পরে খুবই কাজে লেগেছিলো।

হালিশহরের কাজটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখানে ছিল ৩০০ পশ্চিম পাকিস্তানী-ই-পি-আর সৈন্য। এদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলো সিনিয়র জেসিও এবং এনসিও। নিঃশব্দে এদের পরাভূত করতে হবে কেননা আমার সদর দফতরের চারপাশের এলাকায় ছিলো অবাঙালিদের ঘন বসতি। এছাড়া বেশ কিছুসংখ্যক কমান্ডে সেসব অবাঙালির সঙ্গে বসবাস করছে বলে আগেই খবর পেয়েছিলাম এবং কমান্ডে ও অবাঙালিরা সবাই ছিলো পুরোপুরি অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত। কাজেই এখানে কোন শব্দ হলে গোটা ব্যাপারটা পণ্ড হয়ে যাবে।

অস্ত্রাগার আমাদের কব্জায় থাকায় আমরা সুবিধাজনক অবস্থায় ছিলাম। শুধু একটি মাত্র বিপদ ছিলো, কেউ যদি গোপনিয়তা ফাঁস করে দেয় তাহলে চট্টগ্রাম সেনানিবাস থেকে নৌবাহিনী সদর দফতর থেকে পাকিস্তানী বাহিনী আমাদের প্রচেষ্টা বানচাল করতে ছুটে আসতে পারে।

আমরা প্রথমে সমগ্র এলাকা ঘেরাও করে ফেললাম যাতে কোন পশ্চিম পাকিস্তানী পালাতে না পারে। এরপর শুরু হলো শত্রু সৈন্যদের গ্রেফতারের পালা।

মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে অনেক বাঙালি জেসিও এবং এনসিওকে সীমান্ত এলাকায় পাঠিয়ে চট্টগ্রামের ই-পি-আর সদর দফতরে পশ্চিম পাকিস্তানীদের মোতায়েন করা হয়েছিলো। চট্টগ্রামের ই-পি-আর কমান্ডার ছিলেন লেঃ কর্নেল আবদুল আজিজ শেখ। নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করার জন্য ঢাকার নির্দেশে তিনি এই ব্যবস্থা করছিলেন।

এই সব বদলী ইত্যাদির ব্যাপারে প্রথমে আমি খুবই চিন্তিত হয়েছিলাম। পরে দেখলাম যে, এটা আমার পরোক্ষ উপকারেই লেগেছে। কারণ, এক জায়গায় এতগুলো শত্রু সৈন্য পাওয়া কম সৌভাগ্যের কথা নয়।

আমি কৌশলে অস্ত্রাগারে বাঙালিদের মোতায়েন রাখার ব্যবস্থা করেছিলাম। দিনের বেলা আমি শুধু বাঙালি সেনাদের চুলকাটা, পোশাক ও আচরণ পরীক্ষা করে দেখতাম। এদেরকে সংশোধনের অছিলায় শাস্তি হিসাবে অস্ত্রাগার প্রহরার অতিরিক্ত ডিউটি  দিতাম। অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাতের এই ডিউটি পড়তো। ফলে অস্ত্রাগারের কাছে আর কোন পশ্চিম পাকিস্তানীর থাকার দরকার হতো না। আমার এই ব্যবস্থা খুবই কাজে লেগেছিলো।

তখন রাত ১০টা। আমি আমার অফিসের বারান্দায় অস্থিরভাবে পায়চারি করছি। ভীষণ ক্ষুধা বোধ করছিলাম। উত্তেজনায় গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল। পানি চেয়ে পর পর দুগ্লাস খেয়ে দেখলাম। সৈন্যদের ইতিমধ্যে অস্ত্রশস্ত্র দেয়া হয়ে গেলো। নৌ-বাহিনীর সদর দফতর থেকে কোন হামলা হলে তা প্রতিরোধ করার জন্য দুটি প্লাটুন এর মধ্যেই সেদিকে পাঠানো হয়েছিলো। আমি পশ্চিম পাকিস্তানীর সবচাইতে সিনিয়র জেসিও সুবেদার মেজর ইতবার এর অপেক্ষা করছিলাম।

কোনরুপ সন্দেহ না করেই সুবেদার মেজর আমার অফিস রুমে প্রবেশ করলেন। আমি তাকে বসতে বললাম। তারপর বললাম, “সুবেদার- মেজর সাহেব, আপনি তো ঘুমাচ্ছিলেন। শহরে কি ঘটেছে জানেন কিছু ?”

“না স্যার”- সরলভাবেই তিনি জবাব দিলেন। আসলেও তিনি কিছু জানতেন না। তিনি শুধু দেখছেন যে, সৈন্যরা অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হচ্ছে এবং তিনি এটাকে আমার নেতৃত্বে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ডিউটির অঙ্গ বলে মনে করেছিলেন। পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ গণহত্যা পরিকল্পনার কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করায় ব্রিগেডিয়ারের নিচের পদের খুব কমই এ ব্যাপারে জানাতে পারে। মাত্র কয়েকজন লেফটেন্যান্ট কর্নেল এ ব্যাপারে জানতে পেরেছিলেন। এ কড়াকড়ি গোপনীয়তা প্রকারান্তরে আমাদেরি কাজে লেগেছিলো।

সুবেদার- মেজর হঠাৎ চোখ কচলে দেখলেন পাশের বিশ্রাম কক্ষ থেকে চারজন সৈন্য বেড়িয়ে এসে রাইফেলের বেয়োনেট তাঁর বুকের ওপর ধরেছে। আমি তখন দৃড়কণ্ঠে বললাম’ “সুবেদার- মেজর সাহেব, আপনাকে গ্রেফতার করা হলো। চিৎকার কিংবা পালাবার চেষ্টা করলেই প্রাণ হারাবেন।

তাঁর হাত বেঁধে বিশ্রাম কক্ষে নিয়ে যাওয়া হলো। এভাবেই অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে সকল পশ্চিম পাকিস্তানী জেসিওকে গ্রেফতারের পালা শেষ হলো। এ গোপনীয়তা রক্ষা না করলে আমাদের সমস্ত পরিকল্পনা ভেস্তে যেতো। এ ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান সুদৃঢ় হবার আগেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী কিংবা নৌবাহিনীর লোকেরা আমাদের আক্রমন করে বসতো।

এর কিছু পরেই ই-পি-আর সিগন্যাল কোম্পানির দায়িত্বে নিয়োজিত আবাঙ্গালি জেসিও সুবেদার মোবিনকে আমার কক্ষে ডাকলাম। ইতিমধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানী ই-পি-আর সেনারা কিছু একটা ঘটেছে বলে আঁচ করে ফেলে। কিন্তু নিরস্ত্র অবস্থায় তাদের আর কিছু করার ছিলো না। কেননা, গোটা এলাকা আমাদের সৈন্যরা আগেই ঘেরাও করে ফেলেছিলো।

সুবেদার অফিসে ঢুকতেই দেখি সে খুব আতঙ্কিত। ঠিক এ সময়ে মেজর ইকবালের টেলিফোন এলো। আমি রিসিভার তুলে ধরতেই ওপাশ থেকে তিনি বললেন, হ্যালো রফিক এতো রাতে ওখানে কি করছেন ?

“এখানকার গার্ডরা সতর্ক আছে কিনা, দেখতে এসেছি।“

“আচ্ছা। মুহূর্তের জন্য তিনি থামেন, তারপর হঠাৎ প্রশ্ন করেন, সুবেদার মোবিন কোথায় ?”

“তিনি হয়তো রুমে ঘুমাচ্ছেন। কথা বলবেন তাঁর সাথে?”

“হ্যাঁ, দয়া করে টেলিফোনটা তাকে দিন না।”

“আমি এক্ষুনি তার কাছে লোক পাঠাচ্ছি। তিনি এলেই আপনাকে ফোন করতে বলবো।“ সন্দেহ নিরসনের জন্য আমি আরো কিছুক্ষন তার সাথে আলাপ চালিয়ে যাই, “সৈন্যরা ডিউটি দিচ্ছে কিনা তা কয়েকটি জায়গায় দেখে এসেছি, সবকিছু ঠিক আছে।“

এরপর হঠাৎ তার প্রশ্ন শুনে ধাক্কা খেলাম। “কিন্তু ক্যাপ্টেন হায়াতের টেলিফোন কেউ ধরছে না কেন ?”

“ওহ! ওর টেলিফোনটা খারাপ। এইমাত্র ওর ওখান থেকে এলাম। সুন্দর এক কাপ চা খাওয়ালো।”

“ইয়ার! কভি হামকো ভি লে চলো চায়ে পিনে কে লিয়ে। মেজর ইকবাল বললেন।”

“কালকেই নিয়ে যাব।”

এরমধ্যে চারজন সিপাই সুবেদার মোবিনকে বেঁধে ফেললো। বাইরের কেউ জানতেও পারলো না আমার রুমে কি ঘটেছে। মেজর ইকবাল রেখে দিলেন। আমি বেয়োনেট চেয়ে নিয়ে সুবেদার মেজরের গলায় ধরে বললাম, “আমার অধীনে এতদিন কাজ করে নিশ্চয়ই বুঝেছেন আমি কেমন। এখনই মেজর ইকবালের সাথে আপনাকে কথা বলতে হবে- আমি যেভাবে বলবো ঠিক সেইভাবেই জবাব দিয়ে কথা না বললে মেরে ফেলবো। বুঝতে পারছেন ?”

ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে আমার কথায় তিনি সম্মতি জানালেন। আমি ইকবালের নম্বরে ডায়েল করে সুবেদার মোবিনের কানের কাছে রিসিভার ধরলাম।

“হ্যালো স্যার, আমি সুবেদার মোবিন বলছি।”

“মোবিন সাহেব, আপনার কাছে আর কেউ আছে কি?” মেজর ইকবাল প্রশ্ন করেন। আমি মাউথ পিসে হাত চারা দিয়ে মোবিনকে বলতে বললাম। বলুন এখানে কেউ নেই। সুবেদার আমার নির্দেশ মত তাই বললেন।

“কিন্তু ক্যাপ্টেন রফিক তো ওখানে ছিলেন, কোথায় গেলেন তিনি।“ এবারও আমি টেলিফোন চেপে ধরে তাকে যেভাবে বলতে বললাম তিনি সেভাবেই জবাব দিলেন, “ক্যাপ্টেন রফিক এই মাত্র সুবেদার মেজর ইতবারকে নিয়ে কোথায় যেন বেড়িয়ে গেলেন।“

“কোই গড়বড়?”

“না স্যার। সব কিছু ঠিকঠাক হ্যাঁয়।“ সুবেদার মোবিন অত্যন্ত অনুগত জবাব দিলেন।

“বহুত আচ্ছা। আজ রাতের জন্য আপনিই ডিউটি অফিসার। টেলিফোনের পাশেই অপেক্ষা করবেন। চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখবেন।“

“ঠিক হ্যাঁয় স্যার-“

বিরাট একটা দুশ্চিন্তা কেটে গেলো। বন্দী সুবেদার মোবিনের প্রহরায় একজন বাঙালি জেসিওকে রাখা হলো যাতে সে আর টেলিফোনে কিছু উল্টাপাল্টা বলতে না পারে।

রাত ১০টা ৪৫ মিনিটের দিকে সিনিয়র বাঙালি জেসিও সুবেদার জয়নাল খবর দিলেন যে, কাজ শেষ হয়েছে। এর মধ্যে আমরা চট্টগ্রাম শহরে ই-পি-আর এর সকল পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য আটক করতে সক্ষম হলাম। সীমান্ত ফাঁড়িগুলোতেও আমার সাংকেতিক বার্তা দুটি পৌঁছে গেছে বলে খবর পেলাম। বার্তা দুটি পেয়েই রাত ৮টা ৪০মিনিট থেকে ৯টা ৩০মিনিটের মধ্যে তারা সব ফাঁড়ির পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের পরাভুত করা হয়। ২৪শে মার্চের রাতে যখন আমি দ্বিতীয় বার্তাটি স্থগিত রাখতে বলি, সে নির্দেশ পাওয়ার আগেই প্রথম নির্দেশ অনুযায়ী কয়েকটি ফাঁড়িতে বাঙালি সেনারা কাজ সমাধা করে ফেলে। পরে অবশ্য দ্বিতীয় বার্তাটি স্থগিত হয়ে গেল তারা আর চট্টগ্রামের দিকে রওনা হয় নি।

২৫শে মার্চ রাতে দ্বিতীয় বার্তায় চূড়ান্ত নির্দেশ লাভের পর অনেক সেনাদলই চট্টগ্রামের দিকে রওনা হয়ে পড়ে।

এদিকে চট্টগ্রাম শহরের বিচ্ছিন্ন প্লাটুনগুলো খবর পেয়ে লড়াই কেন্দ্রগুলোর দিকে এগোচ্ছিলো। শুধু বিমানবন্দরের প্লাটুনটির সঙ্গে যোগাযোগ করা গেল না। এটা আমার জন্য খুবই বিপদের কারণ ছিলো। কেননা, পরিকল্পনা মোতাবেক শত্রুরা যাতে বিমান বন্দর ব্যাবহার না করতে পারে তার দায়িত্ব ছিলো এই প্লাটুনের ওপর। এখান দিয়ে সৈন্য আনা-নেয়া বন্ধ করতে পারলে বিমান বন্দর, পোর্ট এবং নৌ-বাহিনীর সদর দফতরসহ সমগ্র এলাকায় আমাদের নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা সহজতর হতো। বিমানবন্দরের টেলিফোন এক্সচেঙ্গ অপারেটরকে গোপনে চব্বিশ ঘণ্টা লাইন চালু রাখার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলাম। কিন্তু ২৫শে মার্চ সন্ধার পরই নৌ-বাহিনীর সদর দফতরের সৈন্যরা গোপনে বিমানবন্দরে গিয়ে পুরো প্লাটুনের লোকদের গ্রেফতার করে ফেলে। ফলে এখানে আমাদের বড় একটা ক্ষতি হয়ে যায়।

উপকূলীয় বাধ বারবার শত্রু সৈন্যর চলাচল প্রতিরোধ করার জন্য দুটি প্লাটুনকে পাঠানো হলো। একটি কোম্পানি রেলওয়ে হিল প্রতিরক্ষা দায়িত্বে রইলো। প্রায় ১০০ সৈন্যকে দুই অথবা তিনজনের ছোট ছোট দলে ভাগ করে আগ্রাবাদ রোড এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ এলাকার মোড়ে মোড়ে লড়াইয়ের জন্য মোতায়েন করা হলো। বাকী সৈন্যদের হালিশহরেই সংরক্ষিত রাখ হলো- যাতে কোথাও বিপদ দেখা দিলে তারা সেদিকে যেতে পারে। রামগড়ের সৈন্যদের কাছে পাঠানো বার্তায় তাদেরকে ফেনী নদীর ওপর শুভপুর সেতু ধ্বংস করে সেখানে একটি কোম্পানিকে প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থায় অবস্থান গ্রহণ করতে এবং অবশিষ্ট সৈন্যদেরকে প্রধান সড়ক দিয়ে চট্টগ্রাম চলে আসতে বলা হয়েছিল।

হালিশহর ত্যাগের আগে বন্দিদের একটি ভবন কঠোর প্রহরাধীনে রাখার এবং “শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ” করে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়ে রাত ১১ টা ৪৫ মিনিটের মধ্যে আমি রেলওয়ে হিলের সদর দফতরে পৌঁছলাম। এখানে পৌঁছে নৌ- বাহিনীর সদর দফতর, পোর্ট এলাকা এবং বিমানবন্দরের ওপর আক্রমন চালানোর উদ্দেশ্যে সীমান্ত এলাকার সৈন্যদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। আমি ভেবেছিলাম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টার এবং ষোলশহরে মোতায়েন ৮ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈন্যরা ক্যান্টনমেন্ট দখল করতে সক্ষম হবে। রেজিমেন্টাল সেন্টারের কমান্ডে ছিলেন লেঃ কর্নেল চৌধুরী এবং ৮ইষ্ট বেঙ্গল ছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান। এ দু’জায়গায় বাঙালি সৈন্যদের সংখ্যা ছিলো প্রায় ২০০০ এবং পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য ছিলো আনুমানিক ৪০০।

রাত তখন ১১টা ৩০মিনিট। হঠাৎ ২০ বালুচ রেজিমেন্টের সৈন্যরা বারাক থেকে বেড়িয়ে ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের বাঙালি সৈন্যদের ওপর হামলা চালালো। অস্ত্রাগারের গার্ডদের হত্যা করে প্রথমে তারা সেগুলো দখল করে। অন্যান্য বাঙালি সৈন্য তখনও ঘুমিয়ে ছিলো। অস্ত্রাগার দখলের পরই পাকিস্তানী সৈন্যরা নির্বিচার হত্যালীলায় মেতে উঠে। সে রাতে তারা এক হাজারেরও বেশি বাঙালি সৈন্যকে হত্যা করে। এরপর তারা বাঙালি সৈন্যদের আবাসিক কোয়াটারগুলোতে ঢুকে পড়ে এবং অস্ত্রের মুখে যাকে পায় তাকেই হত্যা করতে থাকে। নারী ও শিশুদের বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে মারা হয়।

এই হত্যালীলা থেকে যেসব বাঙালি সৈন্য জীবন রক্ষা করতে পেরেছিলো তারা চারদিকে দৌড়াতে শুরু করে। কেউ কেউ আমার দফতরে এসে সেই লোমহর্ষক ঘটনার বিবরণ দেয়। অন্যরা ষোলশহরস্থ ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দিকে ছুটে যায়। এই রেজিমেন্টের অধিকাংশ অফিসার এবং সকল সৈন্য ছিল বাঙালি।

কিছুসংখ্যক সৈনিক ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালিয়ে ষোলশহর ৮ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে রাত প্রায় একটার দিকে যোগাযোগ করে সেনানিবাসে আক্রান্ত বাঙালি সৈনিক এবং তাদের পরিবারবর্গ প্রাণ রক্ষায় এগিয়ে যাবার জন্য তাদেরকে অনুরোধ জানায়। সেই ভয়াবহ রাতে বাঙালি অফিসার ক্যাপ্টেন এনাম সেনানিবাস থেকে পালাতে সক্ষম হয়েছিলেন।

ইতিমধ্যে রেলওয়ে হিলে প্রতিরক্ষায় আমার ই-পি-আর প্লাটুনগুলোর সুসংগঠিত করে যুদ্ধ পরিচালনার জন্যে এই পাহাড়েরই একটিন আবাসিক ভবনের নিচতলায় আমার সদর দফতর স্থাপণ করলাম।

এই ভবনের রেলওয়ে অফিসারদের কয়েকটি পরিবার বাস করতেন। রেলওয়ে হিলে অবস্থান নিতেই সেখানকার অফিসার এবং তাদের পরিবারবর্গ অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে আমাদের সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন। তারা গাড়ি থেকে আমাদের জিনিসপত্র নামাতে পাহাড়ের উপর আত্মরক্ষামূলক ট্রেঞ্চ খুঁড়তে, নতুন টেলিফোন লাইন স্থাপণ করতে এবং আমাদের সৈনিকদের খাবার তৈরিতে প্রভূত সাহায্য করেন।

আগেই কোথায় কোথায় ট্রেঞ্চ খুঁড়তে হবে তা দেখে রেখেছিলাম এবং কয়েকজন জেসিওকে স্থানগুলো গোপনে দেখিয়েছিলাম। সৈনিকরা যথাস্থানে ট্রেঞ্চ খুঁড়ছে কিনা তা দেখার জন্য রেলওয়ে হিলের চারদিক ঘুরলাম। পূর্বনির্ধারিত পাহাড়ের ঢালে ৩ ইঞ্চি মর্টার স্থাপণ করা হলো। রেলওয়ে হিলে আরও কয়েকটি ভবনে বহুসংখ্যক অফিসার তাদের পরিবারবর্গকে অন্য কোন নিরাপদ স্থানে পাঠিয়ে দেয়ার জন্য অনুরোধ জানালাম। আমাদের কথামত অফিসারদের পরিবারবর্গকে অন্যত্র নিরাপদ স্থানে পাঠিয়ে দেয়া হলেও অধিকাংশ রেলওয়ে অফিসার এবং তাদের বয়স্ক পুত্রসন্তান ও পুরুষ আত্মীয়রা পাক সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আমাদের সাহায্য করার জন্য পাহাড়েই থেকে গেলেন। ইতিপূর্বে খবর পেয়েছিলাম চট্টগ্রামের সকল সীমান্তবর্তী ফাঁড়ির ই-পি-আর সৈনিকরা আবাঙ্গালি সৈন্যদের নিরস্ত্র করে আমার সঙ্গে পাক সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দেয়ার জন্য শহরের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এদিকে কেবলমাত্র নৌ-সদর দফতর এবং সেনানিবাস ছাড়া সমগ্র চট্টগ্রাম শহর এলাকা, হালিশহরস্থ ই-পি-আর লাইন এবং ই-পি-আর সদর দফতর তখন আমাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রনে। আমি ভেবেছিলাম ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের সৈনিকদের নিয়ে মেজর জিয়া এবং লেঃ কর্নেল চৌধুরী সেনানিবাস আক্রমন করবেন এবং আক্রমণে নিশ্চয়ই তারা সফলতা অর্জন করবেন। পাক সেনাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র কার্যক্রম গ্রহণের উদ্দেশো রাত ৮টা ৩০ মিনিটে যখন আমি সারসন রোডের বাসভবন ত্যাগ করি তখনই ডাঃ জাফর এবং জনাব কায়সারকে বলেছিলাম ৮ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে তারা যেন খবরটি জানিয়ে দেন। তারা আমার যুদ্ধ শুরু করার কথা এই রেজিমেন্টকে জানিয়েছিলেন। বলা প্রয়োজন যে, ঐ রাতে প্রায় ২ ঘণ্টা সময়ের মধ্যে হালিশহর এবং চট্টগ্রাম নগরীর অন্যান্য এলাকায় ৫০০ অবাঙ্গালি সৈনিক, জেসিও এবং কয়েকজন ই-পি-আর অফিসারকে আমরা নিরস্ত্র করতে পেরেছিলাম। আমার অধীনস্থ ই-পি-আর সৈনিক ও জেসিওদের সাহসিকাপূর্ণ কার্যক্রমের পূর্ণ গোপনীয়তা সুস্ঠ পরিকল্পনা জন্যই অবাঙ্গালি সৈনিক ও অফিসারদের নিরস্ত্র করা সম্ভব হয়েছিলো।

প্রাথমিক সাফল্যের পর রাত ১১টা ৪৫ মিনিটের দিকে আমি ৮ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের সৈনিকদের সাফল্যের খবর শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম আর ভাবছিলাম নিশ্চয়ই তারাও ২০ বালুচ রেজিমেন্টাক ইতিমধ্যে নিরস্ত্র করতে পেরেছেন। প্রাথমিক সাফল্যের পর পরই সদর দফতর এবং বিমানবন্দর দখলের জন্যে আমি আমার সীমান্ত ফাঁড়ির ই-পি-আর সৈনিকদের আগমন অপেক্ষায় উন্মুখ ছিলাম।

ইত্যবসরে আমি বেতার কেন্দ্র, টেলিফোন একচেঞ্জ আক্রমন ও দখল করার উদ্দেশ্যে আমার সৈন্যদের পাঠালাম। আমার এই রেলওয়ে হিল দফতরের ঠিক উল্টোদিকেই ছিলো নৌ-বাহিনীর যোগাযোগ কেন্দ্র। এখান থেকে পরিস্কার দেখা গেলো কয়েকজন পাকিস্তানী নৌ-সেনা ওখানে ঘোরাফেরা করছে। ঠিক এই সময়ে নৌ- বাহিনীর একটি গাড়ি আগ্রাবাদের দিকে এগিয়ে গেলো। আমার মর্টার জেসিও সুবেদার আইজুদ্দিন গাড়ি দেখেই তাঁর অবস্থান থেকে দৌড়ে এসে বললো- “স্যার, গাড়ীতে কয়েকজন নৌ-সেনা রয়েছে। দেবো নাকি শেষ করে ?”

আমি বললাম, “না এখন নয়। এটা বোধ হয় পর্যবেক্ষণ গাড়ী। রাস্তা পরিস্কার আছে কিনা দেখার জন্য এসেছে। মনে হয় সৈন্যদের আরো বড় দল এই রাস্তায় আসবে। সেই লক্ষ্য বস্তই হবে আমাদের জন্য উত্তম। একসঙ্গে অনেক লোককে পেয়ে যাবো।“ একটু পরেই আরেকটি গাড়ী একই পথে চলে গেলো। কিন্তু সৈন্যদের বড় দলটি আর এলো না। মিনিট দশেক পর দুটি গাড়ীই ফিরে এলো এবং ক্যান্টনমেন্টের দিকে চলে গেলো।

পরবর্তীকালে জানতে পেরেছিলাম, প্রথম গাড়ীতে করে মেজর জিয়া পোর্টের দিকে যাচ্ছিলেন। তার কমান্ডিং অফিসার লেঃ কর্নেল জানজুয়ার নির্দেশে এম, ভি, সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্রশস্ত্র নামিয়ে ক্যান্টনমেন্টে আনার জন্য তিনি রওনা হয়েছিলেন। স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের চট্টগ্রামস্থ নিউ মার্কেট শাখার ম্যানেজার জনাব কাদের যখন আমার বার্তা নিয়ে ৮ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দফতরে যান তার আগেই মেজর জিয়া তার কমান্ডিং অফিসারের আদেশে ষোলশহর থেকে বেড়িয়ে পড়েন। রেজিমেন্টের ডিউটি অফিসার আমার বার্তাটি পান। খবর পেয়েই ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান মেজর জিয়াকে থামানোর জন্য পোর্টের দিকে রওনা হয়ে যান। ২৫শে মার্চ রাত তখন প্রায় সাড়ে ১১টা। ২০ বালুচ রেজিমেন্টের সৈন্যরা এই মধ্যে ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের ওপর হামলা চালায়। ৮ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্য ও অফিসারবৃন্দ তখনো এ খবর জানতে পারেন নি। পূর্বে উল্লেখিত দ্বিতীয় গাড়ীতে ছিলেন ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান। আগ্রাবাদ পর্যন্ত গিয়ে মেজর জিয়াকে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য ব্যারিকেড পরিস্কার করেছিলেন। খালেকুজ্জামান মেজর জিয়াকে সর্বশেষ পরিস্থিতির কথা জানালে মেজর জিয়া ৮ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট লাইনে ফিরে আসার এবং তার অফিসারদের সঙ্গে পরবর্তী করনীয় সম্পর্কে আলোচনার সিদ্ধান্ত নেন। মেজর জিয়াকে বহনকারী প্রথম গাড়িটি দেখেই নায়েব সুবেদার আইজুদ্দিন উত্তেজিত হয়ে আক্রমন করতে চেয়েছিল। রেলওয়ে হিলের পাশের এই সড়কের অনেকখানি আমাদের এল-এম-জি এবং রকেট লাঞ্চারের সুনির্দিষ্ট আওতার মধ্যে ছিল। আমরা ধৈর্য্য না ধরলে মেজর জিয়া এবং ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামানকে বহনকারী গাড়ী দুটি রকেট লাঞ্চারের গোলায় উড়ে যেতো। আরো বড় শিকারের জন্য অপেক্ষা করেছিলাম বলেই অলৌকিকভাবে সেদিন তারা দুজন বেঁচে গিয়েছিলেন।

ইউনিট লাইনে ফিরে মেজর জিয়া এবং তার অফিসাররা কমান্ডিং অফিসার সহ অবাঙ্গালি অফিসারদের গ্রেফতার করার সিদ্ধান্ত নেন। অবাঙ্গালি অফিসারদের গ্রেফতার পর্ব শেষ হবার পরই তাদের কাছে ক্যান্টনমেন্টের হত্যাকাণ্ডের খবর পৌঁছে।

৮ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন অফিসার পরে স্বীকার করেছিলেন, ক্যান্টনমেন্টের ঘটনার ব্যাপারে মতদ্বৈততা দেখা দেয়। রেজিমেন্টের তরুন অফিসারদের কয়েকজন তখনই ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের সৈনিকদের জীবন রক্ষায় ছুটে যেতে চান। অন্যরা ২১০ বালুচ রেজিমেন্টকে আক্রমন করাকে আত্মঘাতি হবে বলে মত প্রকাশ করেন। এই মত পার্থক্যের ফলেই শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, এই পর্যায়ে ক্যান্টনমেন্টের দিকে যাওয়া কিংবা ২০ বালুচ রেজিমেন্টের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরা বোকামি হবে। এরপর ঐ রাতেই আমরা ষোলশহর ত্যাগ করে পটিয়ার দিকে অগ্রসর হই।

এদের এই পদক্ষেপ সম্পকে আমি আগে কিছুই জানতাম না। ৮ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে যাকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছিলাম সেই ডাঃ জাফর ফিরে এলে সব জানতে পারলাম। কিছুটা অধৈর্য্য হয়ে ডাঃ জাফরকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কি এদের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন  নি?

“আপনার খবর তো ৮ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট পৌঁছে দিয়েছি। তবু তারা শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছে। রেজিমেন্টাল সেন্টারের সাথে যোগাযোগ করতে পারি নি”- ডাঃ জাফর জবাব দিলেন।

“দয়া করে এক্ষুনি যান, গিয়ে ওদেরকে থামান। এখন সবকিছুই আমাদের নিয়ন্ত্রনে। ওদের সাথে সম্মিলিতভাবে বাকী জায়গাগুলোও আমরা মুক্ত করতে পারবো। আজকের রাতই সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ।“

।।সশস্ত্র প্রতিরোধ।।

চট্টগ্রাম, ২৬শে মার্চ। আমার দফতরে টেলিফোনে খবর এলো যে পাকিস্তানী সেনারা নৌ-ঘাঁটি থেকে  অগ্রসর হয়ে হালিশহরে আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যূহের ওপর আক্রমন চালিয়েছে। ই-পি-আর ট্রুপস এই আক্রমণ প্রতিহত করে। শুত্রুদের প্রচুর হতাহত হয়। পাকিস্তানীরা হালিশহরে কোন বাধা আশা করেনি। সংগঠিত প্রতিরোধ মোকাবেলার জন্য তারা প্রস্তুত ছিলো না। তাদের অগ্রবর্তী দলটি হালিশহরের প্রথম প্রতিরক্ষা ব্যূহের সম্মুখীন হতেই আমাদের সৈনিকরা পাকিস্তানীদের লক্ষ্য করে গুলি চালালো। পাকিস্তানীরা ঘটনার আকস্মিকতায় বিমুর হয়ে পড়ে। বহু সংখ্যক হতাহত হলো। অবশেষে তারা পিছু হটতে বাধ্য হলো। এ সময়ে অপর এক টেলিফোমে জানালাম, ৮০ থেকে ১০০টি যানের বিরাট একটি কনভয় কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রামের পথে রওনা হয়েছে। কুমিল্লা থেকে মেজর বাহার চট্টগ্রাম টেলিফোন অপারেটকে একথা জানালে সে তাৎক্ষনিক আমাকে তা অবহিত করে। সংবাদ পাওয়ার পরপরই আমি পাকিস্তানী কলামটিকে এম্বুশ করার জন্য একজন জেসিওর নেতৃত্ব হালিশহর থেকে এক কোম্পানি সৈন্য পাঠালাম। হালকা মেশিনগান এবং ভারী মেশিনগান ছাড়াও কোম্পানিটির সাথে ছিল ৩ মর্টার ও রকেট লাঞ্চার। অপারেশনাল কমান্ডার সুবেদার মুসা যাত্রার প্রাক্কালে আমাকে টেলিফোন করে বললেন, “আমাদের সাফল্যের জন্য দোয়া করবেন স্যার।“

“সকল দেশবাসী আপনাদের জন্য দোয়া করছে। যুদ্ধ চালিয়ে যান, মাতৃভুমিকে মুক্ত করেন। আমার গলার স্বর ছিলো আবেগে উদ্বেল।“

কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রামগামী শত্রুপক্ষে ছিলো ২৪ ফ্রন্টিয়ার ফোরস রেজিমেন্ট ও ফিল্ড ইঞ্জিনিয়ারদের একটি অংশ এবং তাদের সঙ্গে ১২০ মিলিমিটার মর্টারবাহী একটি দল। ২৬শে মার্চ রাত ১টার দিকে তারা চট্টগ্রামের পথে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট ত্যাগ করে। কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রামের দূরত্ব একশ মাইলের কিছু বেশি। তাদের পথে বহুসংখ্যক কাল্ভারট এবং ছোট ছোট সেতু ছিল। সৈন্য চলাচল বাধাদানের জন্যে পূর্বেই জনসাধারণের এগুলোর অধিকাংশ ভেঙ্গে ফেলেছিলো। তাই পাকিস্তানী কলামটিকে অনেক ক্ষেত্রে মুল রাস্তা ছেড়ে ছেড়ে ধীরে ধীরে অগ্রসর হতে হচ্ছিল। একই সাথে ফিল্ড ইঞ্জিনিয়ারের সৈনিকরা সেতুগুলো মেরামতও করে চলছিলো। যা হোক, পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী শুভপুরে সেতুর ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে রাখা হয়েছিল। কুমিল্লাস্থ ৫৩ ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফি নিজেই সমগ্র কলামের নেতৃত্বে ছিলেন। শুভপুর সেতু মেরামত করতে সময় লাগবে দেখে ব্রিগেড কমান্ডার পদাতিক সেনাদের নিয়ে নদী পার হয়ে চট্টগ্রামের পথে রওনা হলেন এবং পিছনে রেখে গেলেন মর্টার এবং ইঞ্জিনিয়ার ইউনিটকে। তাদের বলে গেলেন সেতু মেরামত করতে তারা যেন অগ্রবর্তী দলের সঙ্গে যোগ দেয়। সূর্য তখন অস্তপ্রায়। ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফি এবং তার বাহিনী চট্টগ্রাম থেকে ১৪ মাইল দূরে কুমিরায় পৌঁছে গেলেন।

এদিকে ইপিআর সেনারা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র রাস্তার পূর্বে পাশের একটি উঁচু জায়গায় এম্বুশ করে বসেছিলো। রাস্তার পশ্চিমে কিছু দুরেই সাগর। উঁচু জায়গাটি থেকে রাস্তা এবং সাগর বেশ পরিস্কার দেখা যাচ্ছিল। বড় সেতুগুলোর কষ্টসাধ্য বাধা পেরিয়ে আসতে পেরে ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফি খুব খুশী ছিলেন কারণ সেতুগুলো পুরোপুরি ধ্বংস হলে তাদের পক্ষে সেতু পার হওয়া সম্ভব হতো না। সমস্যার মুহূর্তে কুমিরায় পৌঁছে তিনি ধরেই নিয়েছিলেন যে আর মাত্র মিনিট পঁয়তাল্লিশের মধ্যেই চট্টগ্রামের পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাদের সঙ্গে মিলিত হতে পারবেন এবং তারপরই নামতে পারবেন বাঙালিদের শায়েস্তা করতে। কিন্তু হঠাৎ করেই তিনি জীবনের সর্ববৃহৎ চ্যালেঞ্জার মুখোমুখি হলেন। ইপিআর সেনাদের এমবুশে তিনি এবং তার প্রায় অর্ধেক সৈন্য দিশেহারা হয়ে পড়লো।

এই এমবুশে পাক সেনাদের হতাহতের খবর পরে পাওয়া গিয়েছিলো। লাইট মেশিনগানের ঝাঁক ঝাঁক গুলির শিকার হয়েছিলেন ২৪ ফ্রন্টিয়ার ফরস রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার কর্নেল শাহপুর খানসহ প্রায় ৭০ জন পাকসেনা। ধ্বংস প্রাপ্ত যানবাহনের সংখ্যাও ছিলো প্রচুর। ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফি জীবন বাঁচানোর জন্যে তখন প্রাণপণে ছুটেছিলেন পাহাড়ের দিকে। কয়েকজন সঙ্গীও তাকে অনুসরণ করলো। ভীতসস্ত্রস্ত সৈনিকরা হাতিয়ার, যানবাহন এবং অন্যান্য জিনিসপত্র ফেলেই প্রাণপণে ছুটেছিলো। শত্রুপক্ষের পিছনের অংশ যারা আমাদের অস্ত্রের আওতার বাইরে ছিল তারা সঙ্গে সঙ্গেই সুবিধাজনক স্থানে অবস্থান নিয়ে পাল্টা গুলিবর্ষণ শুর করলো। এক ঘণ্টারও বেশি সময় এই গুলি বিনিময় চললো। এই সময় আমাদের সেনারা প্রায় ৩মাইল সরে এসে পরবর্তী অবস্থানে প্রস্তুতি গ্রহণ করলো। এই ভয়াবহ সংঘর্ষে ইপিআর এর ৫জন গুরুত্বরভাবে আহত হয়।

কুমিল্লায় শত্রুর বিরুদ্ধে ইপিআর সেনাদের এই এমবুশ ছিলো আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাসে এই প্রথম সরাসরি আক্রমন। কুমিরার ঘটনার গুরুত্ব এতই সুদুরপ্রসারী ছিলো যে, এই ঘটনা পাকিস্তানী সৈন্যদের চট্টগ্রামে অবাধে কিছু করার মুল পরিকল্পনা ব্যাহত করে দেয়। চট্টগ্রামে শত্রুদের লোকবল পর্যাপ্ত ছিলো না বলে কুমিল্লা থেকে লোকবল বৃদ্ধি ছিল একমাত্র ভরসা। এই এম্বুশের পরে আমরা একটি আয়ারলেস বার্তা শুনে ফেলি। চট্টগ্রামের জৈনক কমান্ডার ঢাকায় ৯৪ ডিভিশনের কর্নেল স্টাফ হেডকোয়ার্টারের সঙ্গে কথা বলছিলেন। তিনি বলছিলেন, আমাদের অনেক লোক হতাহত হয়েছে। সীতাকুণ্ডের দক্ষিনে বাকী সৈন্যরা আটকা পড়ে আছে। বিমানে সৈন্য পাঠানোর অনুরোধ করছি। জরুরী ভিত্তিতে বিমানে করে হতাহতদের সরাবার বাবস্থা করা দরকার।

কুমিল্লায় আমারও কিছু লোক হতাহত হয়েছিল। আমারও প্রয়োজন ছিল নতুন সৈন্যের, অস্ত্র এবং গোলাবারুদের। সেই মুহূর্তে সীমান্ত এলাকা থেকে যে সব ইপি সৈন্য আসছিলো তারাই ছিলো আমার প্রধান ভরসা।

২৬শে মার্চ ভোর নাগাদ ক্যাপ্টেন হারুন শহরের পাঁচ মাইলের মধ্যে এসে পড়লেন। তাঁর সৈন্যরা উচ্চ কণ্ঠে “জয় বাংলা” শ্লোগান দিতে দিতে আসছিলো। কিন্তু শহরের উপকণ্ঠে এসেই থামতে হলো তাদেরকে। কয়েকজন সৈন্যকে শহর ছেড়ে কালুরঘাট সেতুর দিকে যেতে দেখা গেলো। কিছুক্ষনের জন্য ক্যাপ্টেন হারুন বিভ্রান্ত হয়ে পড়লেন। ভাবলেন “শত্রুরা কি তাহলে পুরোপুরি শহর দখল করে ফেলেছে?” এই ভাবনা তাঁকে কিছুটা হতবুদ্ধি করে দেয়। পরে দেখা গেলো যে, এরা বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টার এবং ৮ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের লোক। তারা সবাই পটিয়ার দিকে যাচ্ছিলো। শহরে ঢোকার আগে আরো নিশ্চিত হওয়ার জন্য তিনি কালুরঘাট ব্রিজ পেরিয়ে মেজর জিয়াউর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। তাঁকে কালুরঘাট এলাকাতেই থাকতে বলা হলো। ফলে পূর্বে পরিকল্পনা অনুযায়ী শহরের যুদ্ধে আমার সঙ্গে যোগ দেয়া তার পক্ষে আর সম্ভব হলো না।

কক্সবাজারে ইপিআর কোম্পানির কমান্ডার ছিলেন সুবেদার মফিজ। তিনি দুটি ইপিআর কোম্পানি নিয়ে আমার সঙ্গে যোগ দেওয়ার জন্য কক্সবাজার ত্যাগ করেছিলেন। তাঁকেও কালুরঘাট এলাকায় থামিয়ে সেখানেই আত্মরক্ষামূলক অবস্থান গ্রহণ করতে বলা হয়। তিনি পরে আমাকে বললেন। আপনার সাথে যোগ দিতে পারিনি এটা আমার ত্রুটি ছিলো না। মেজর জিয়া আমাকে কালুরঘাট থামিয়ে দিয়েছিলেন। আমি তাকে আপনার নির্দেশের কথা জানালে তিনি আমাকে জানান শহরে কেউ নেই। অবশ্য পরে দেখা গেলো আপনি তখনো শহরে যুদ্ধ করে চলেছেন।“

আমরা তখনো শহর ছাড়ি নি। বিভিন্ন জায়গায় প্রচণ্ড লড়াই হচ্ছিল। কিন্তু ঘটনাবলী শহরের পরিস্থিতিকে যেদিকে নিয়ে যাচ্ছিলো তা মোটেই আমার জন্য অনুকুল ছিলো না।

কক্সসবাজার এবং কাপ্তাই থেকে যে সৈন্যরা আসছিলো কালুরঘাট ব্রিজের কাছে তাদের থামিয়ে দেয়া হচ্ছিল। কুমিরায় প্রধান সড়ক বরাবর প্রচণ্ড সংঘষের দরুন রামগড়ের সৈন্যরা আসতে পারছিলো না। শহরে যে ক’জন সৈন্য ছিলো শুধু তাদের সম্বল করে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া ছাড়া আমার আর গত্যন্তর ছিলো না। নৌ- বাহিনীর সদর দফতর এবং পোর্ট মুক্ত করার পরিকল্পনা ভেস্তে গেলো।

বেলা ৯টা নাগাদ অনেক উঁচু দিয়ে শহরে হেলিকাপ্টার ঘোরাঘুরি শুরু করলো। কয়েক জায়গায় জনসাধারণ সেগুলোর দিকে বন্দুকের গুলি ছুঁড়লো। বিরাটকায় সি-১৩০ বিমানগুলো ঢাকা থেকে সৈন্য আনতে থাকলো। অসহায়ভাবে তবু আমরা সেই অবস্থান আঁকড়ে রইলাম। আমাদের প্রচেষ্টা ছিলো, ক্যান্টনমেন্ট এবং নৌ- বাহিনীর সদর দফতর থেকে শুত্রুদের বেরোতে না দেয়া। কিন্তু ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের অধিকাংশ সৈন্য নিহত হওয়ার এবং ৮ বেঙ্গল রেজিমেন্ট শহর ত্যাগ করায় ওদিকে দিয়ে পাকিস্তানী সৈন্যদের বেরোনো সহজতর হয়ে উঠেছিল। ঘটলোও তাই। ট্যাংকের ছত্রছায়ায় ২০ বালুচ রেজিমেন্টের সৈন্যরা ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেড়িয়ে পড়লো।

নৌ-বাহিনী সদর দফতরের পাকিস্তানী সৈন্যরা অবশ্য তখনো আটক অবস্থায়। সমগ্র আগ্রাবাদ রোডের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো ছিল ইপিআর সৈন্যদের দখলে। হালিশহরের কাছে সুদূঢ় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলাম বলে শত্রুপক্ষের একটি লোকের পক্ষেও চলাচল করা সম্ভব ছিলো না। এমনিভাবে ওদের নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনের প্রচেষ্টা আমরা অনেকখানি ব্যাহত করতে পেরেছিলাম।

চট্টগ্রামের পাকিস্তানীদের সাহায্যার্থে বেশ কিছু সংখ্যক সৈন্য ২৬শে এবং ২৭শে মার্চ ঢাকা থেকে বিমানযোগে চট্টগ্রাম বিমান বন্দরে এসে পৌছায়। বিমানবন্দর থেকে পাকসেনারা আগ্রাবাদ এলাকার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। পাক সেনাদের অপর একটি গ্রুপ হালিশহর ইপিআর সদর দফতরের দিকে অগ্রসর হয়। হালিশহরে আমরা ইপিআর বাহিনী আগে থেকেই শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যূহ গড়ে তুলেছিলো।

কুমিরার সংঘর্ষ মারাত্মক হয়ে পড়ে। ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফির সৈন্যদের মনোবল এতই ভেঙ্গে পড়েছিলো। যে, তাদের পক্ষে আর সামনে অগ্রসর হওয়া সম্ভব ছিলো না। এই সময় হেলিকপ্টার যোগে জেনারেল মিঠঠা খান কুমিল্লায় উপস্থিত হন এবং সৈন্যদের প্ররোচিত করার উদ্দেশ্যে এক জঘন্য মিথ্যা ভাষণে বলেনঃ “হিন্দুদের প্ররোচনায় বাঙ্গালিরা তোমাদের অফিসার, সৈন্য এবং তাদের পরিবার পরিজনকে হত্যা করে চলছে। তোমরা তাদের রক্ষা না করলে তারা সকলেই প্রাণ হারাবে। প্রতিশোধ গ্রহনের জন্য তোমরা সামনে এগিয়ে যাও। খুনের বদলে খুন। ইসলাম এবং পাকিস্তানকে তোমরা রক্ষা কর।“ প্রতিশোধ গ্রহনের এই তীব্র হলাহল পাকিস্তানী সৈনিকদের মনে ব্যাপক জিঘাংসা সৃষ্টি করে।

মূল সড়ক পথে অগ্রসর হওয়া সম্ভব না হওয়ার ব্রিগেডিয়ার শফি পাহাড়ের ভিতর দিয়ে একটি কলামকে সেনানিবাসে ২০বালুচ রেজিমেন্টের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য পাঠিয়ে দেন। অপর কলামকে উপকুল রেখা বরাবর অগ্রসর হয়ে বাধের উপর তরিত অবস্থান গ্রহণকারী আমাদের সৈন্যদের ঘিরে ফেলার নির্দেশ দেন।

সন্ধ্যা হয়ে আসে। মাঝে মাঝেই উভয় পক্ষে গুলি বিনিময় চলছিলো। সংঘর্ষ এলাকা থেকে জনসাধারণ ক্রমশঃ দূরে সরে যেতে থাকলেও এলাকার তরুনরা আমাদের সৈনিকদের সঙ্গে যোগ দিয়ে খাবার এবং অন্যান্য দ্রব্যাদি সরবারহ করতে থাকে। এমনকি তারা হতাহতদের নিরাপদ স্থানে সুচিকিৎসার ব্যবস্থাও করতে থাকে। সৌভাগ্যরে বিষয় ছিল তাদের অনেকেই শত্রু সৈন্যদের কাছাকাছি থেকে তাদের প্রতিটি অবস্থানের খবরাখবর আমাদের সরবরাহ করে চলছিল।

উপকূল বরাবর শত্রু সৈন্যদের অগ্রসর হওয়ার খবর পেয়েই আমরা আরেকটি এমবুশের আয়োজন করি। পাকিস্তানীরা আমাদের এম্বুশে পড়ে যায়। এই দ্বিতীয় এমবুশেও শত্রুসেনাদের অনেকে হতাহত হয়। ভীতু পাকিস্তানীরা তাদের মৃত সঙ্গীদের ফেলেই নানা দিকে দৌড়াতে থাকে। অনেকেই পথ ভুলে গ্রামগুলোতে ঢুকে পড়লে নিরস্ত্র বিক্ষুব্ধ জনতার হাতেই প্রাণ হারায়।

ইতিমধ্যে ইপিআর কোম্পানীর গোলাবারুদ প্রায় নিঃশেষ হয়ে আসে। অপরদিকে হালিশহর সদর দফতরেও বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করার মতো গোলাগুলি আর তেমন ছিল না। এই পরিস্থিতিতে আমি কুমিরার কোম্পানিকেও পেছনে সরে শহরের উপকন্ঠে নতুন প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান নিতে বললাম। স্থানটি হালিশহরে আমাদের অবস্থানের নিকটেই ছিল। আমরা তীব্রভাবে গোলাগুলি এবং নতুন সৈন্যের প্রয়োজনীয়তার অভাব অনুভব করি। অথচ সেই মুহূর্তে এগূলো সংগ্রহ করা দুঃসাধ্য ছিল। এদিকে রাঙামাটি থেকে আগত ইপিআর সেনারা ক্যান্টনমেন্টের অদুরে বাধাগ্রস্থ হয় এবং রামগড় এলাকার অপর দুটি ইপিআর কোম্পানিও মূল সড়ক পথ ধরে অগ্রসর হতে পারছিল না। এ সময় আমার হাতে দুটি বিকল্প পথই খোলা ছিল। হয়, ক্যান্টনমেন্টের অস্ত্রাগার দখল করা অথবা সরবরাহের জন্য ভারতের সাথে যোগাযোগ করা অন্যসব সম্ভাবনা ব্যর্থ হলে চূড়ান্ত পন্থা হিসেবে শেষেরটিই বিবেচনা করা যায় বলে মনে করলাম। আমি প্রথম পন্থা গ্রহনের সিদ্ধান্ত নেই এবং তখনই রামগড়ের একটি কোম্পানীকে মাঠের পথ ধরে অগ্রসর হয়ে ক্যান্টনমেন্টের পেছনে অবস্থানকারী আমাদের সেনাদের সঙ্গে যোগ দেয়ার নির্দেশ দিলাম। অপর কোম্পানীটিকে শুভপুর সেতু এলাকায় শক্তিশালী প্রতিরক্ষা বুহ্য গড়ে তুলতে বললাম যাতে সড়ক পথে কুমিল্লা থেকে নতুন কোন পাক সৈন্য চট্টগ্রাম আসতে না পারে।

২৬শে মার্চ সন্ধ্যা সাড়ে ৮টার দিকে নৌবাহিনীর যোগাযোগা ঘাঁটিতে পাক সৈন্যদের আনাগোনা লক্ষ করা গেল। রেলওয়ে পাহাড়ে আমার ট্যাকটিকাল হেড কোয়ার্টার থেকে পাশের একটি মসজিদে তাদের আনাগোনা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল। কয়েকজন বেসামরিক ব্যক্তিও তাদের সঙ্গে মসজিদে যোগ দেয়। এসময়ই হালকা মেশিনগান নিয়ে অবস্থানকারী আমার একজন সিপাই ট্রেঞ্চ থেকে যে মুহূর্তে মাথা তুললো অমনি একটি বুলেট তাকে আঘাত করলো। গুলিটি আসে মসজিদের দিক থেকে। সাথে সাথে শত্রুরা আমাদের অবস্থানের উপর স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের সাহায্যে বিপুলভাবে গুলি চালাতে শুরু করলো। কামানের গোলা আমাদের চতুর্দিকে পড়তে থাকে। বিস্ফোরিত গোলার মারাত্মক টুকরোগুলো ভয়াবহরূপে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই শত্রুদের একটি দল টাইগার পাস ঘাঁটি থেকে আক্রমণ চালায়। অবশ্য এই আক্রমণ সাথে সাথেই প্রতিহত করা হল। কিছুক্ষন পর অপরদিক থেকেও হামলা হতে থাকে। তবে দুটি হামলাই সামনের দিক থেকে আসছিল বলে তারা তেমন সুবিধা করতে পারেনি। বরং পাকিস্তানিরা  প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে। সামনে অগ্রসর হতে ব্যর্থ হয়ে তারা পিছু হটে গিয়ে তাদের সুদৃঢ় ঘাঁটি থেকে আমাদের অবস্থানের উপর অবিরাম গুলি বর্ষণ করতে থাকল।

অনুরূপভাবে আমাদের হালিশহর অবস্থানের উপর কয়েক দফা হামলা হলো। কিন্তু প্রতিবারই শত্রু সেনারা পিছু হটতে বাধ্য হলো। ২৬শে এবং ২৭শে মার্চের মধ্যবর্তী রাতকে মনে হচ্ছিল এ রাত যেন আর পোহাবে না। গুলির শব্দে গোলার বিস্ফোরনে সমস্ত শহর কেপে কেপে উঠছিল বারংবার।

এ সময় আমাদের অবস্থানের পেছনেই গোলার আওয়াজ পেলাম। অন্য কোন ভাবে আমাদের অবস্থান দখল করতে না পেরে শত্রুরা ক্যান্টনমেন্ট থেকে ট্যাংক নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল। রেলওয়ে হিলে আমাদের অবস্থান শত্রুদ্বারা ঘেরাও আসন্ন হয়ে উঠলো। অথচ কোন ট্যাংক বিধ্বংসী অস্ত্র আমাদের ছিল না।

প্রায় দু’ঘন্টা পর কামানের গোলা বর্ষণ একটু কমে এলো। এ সময় আহত সৈনিককে আমার কমাণ্ড পোস্টে নিয়ে আসা হলো। সে ছিল বয়সে তরুন। কাদামাটি লাগা কাপড়চোপড় রক্তে ভেজা। বুলেট তার বুকে বিদ্ধ হয়েছিলো। দারুন কষ্টে নিঃশ্বাস টানতে গিয়ে আস্ফুট কন্ঠে সে জিজ্ঞাসা করলো, “কখন আমার মৃত্যু হবে?” তার দৃষ্টিতে ছিল সারা বিশ্বের আকুল জিজ্ঞাসা। এরপর সে আর কিছু বলতে পারেনি। আরও অনেকের মতোই নিভৃত যন্ত্রণায় সেও আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে গেল।

।। ঘেরাও ।।

 

ঢাকা এবং অন্যান্য স্থানে নৃশংস অভিযানের প্রাথমিক সাফল্যে উৎফুল্ল ইয়াহিয়া তার বাহিনীকে ব্যপক গণহত্যার ছাড়পত্র প্রদান করে। পাকসেনারা তাদের অভিযান এলাকাগুলোতে প্রানী বলতে যা পেয়েছে তাই নিধন করেছেএবং এসব স্থানে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে অবলীলাক্রমে। কিন্তু তবুও লোক এবং অস্ত্রবলে বলীয়ান পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আমাদের অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধারা প্রাণপণ প্রতিরোধ চালিয়ে গড়ে তোলে। কিন্তু এই প্রতিরোধ অব্যাহত রাখা ছিল দুঃসাধ্য, কারণ অস্ত্র চালনায় জনসাধারনের একদিকে যেমন কোন ট্রেনিং ছিল না। তেমনি তাদের অস্ত্রগুলোও ছিল পুরনো আমলের। এদিকে ট্রেনিংপ্রাপ্ত আমাদের সৈনিকেরা যেখানেই সংগঠিত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চেয়েছেন সেখানেই শুরু হয়েছে কামান,ট্যাঙ্ক আর স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দ্বারা শত্রুপক্ষের সম্মিলিত আক্রমণ। এই ধরনের বারংবার হামলার মোকাবিলা করতে গিয়ে আমাদের গোলাবারুদের মজুতে টান পড়ে।

এই অবস্থায় রেলওয়ে হিলের অবস্থান ত্যাগ করার জরুরী প্রয়োজন দেখা দিল। তখন চারদিকেই শত্রুসেনা। ক্রমাগতএক ঘন্টার বেশি সময় ধরে পাকিস্তান নৌবাহিনীর কামানগুলো আমাদের উপর আক্রমণ চালিয়ে আমাদেরকে ব্যস্ত রাখে। এই সংকটময় অবস্থায় আমি আমার সৈন্যদের কোতোয়ালী থানা এলাকার দিকে স্বরে যেতে নির্দেশ দেই এবং সেখান থেকে ক্যান্টনমেন্টের পেছনে সকলকে একত্র হতে বলি। গুলি বর্ষণের ছত্রছায়ায় যখন সকলেই স্থান ত্যাগ করে চলে যায় তারপরই আমি ঘাঁটি ত্যাগ করার জন্য পা বাড়াই। একজন তরুন কলেজ ছাত্রও আমার সাথে ছিল। আমরা চলছিলাম কিন্তু মুখে কোন কথা ছল না। সমস্ত সকালটি ছিল কুয়াশাচ্ছন্ন। বিমুড় বিষণ্ণতায় সমস্ত শহর যেন আচ্ছন্ন। রাস্তাঘাট ছিল জনমানবশুন্য, মনে হচ্ছিল মৃতের নগরী। শত শত বছর পড়ে মাটির তলা থেকে খুঁড়ে যেন নগরটিকে আবিষ্কার করা হয়েছে। দূরে বন্দরে জাহাজের মাস্তুল,ক্রেন,ওধারে অন্ধকারাচ্ছন্ন গ্রাম সবকিছুই একটির পর একটি আমার চোখের সামনে ভেসে উঠতে থাকে। ভরাক্রান্ত হৃদয়ে পাহাড় থেকে নামতে গিয়ে পিছন ফিরে তাকাতেই সা করে একটি বুলেট আমাদের পাশ দিয়ে চলে গেল। সাথে সাথে আমরা নিচু হয়ে চলার গতি বাড়িয়ে দেই।

কদমতলী রেলক্রসিং এর কাছে নৌ-সেনাদের দুটি ট্রাক এ সময় অন্ধকারের মধ্যে অপেক্ষা করছিল। আমি নিঃশঙ্কচিত্তে সামনে এগোচ্ছিলাম। কোন দেশ কি আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসবে না ? বহির্জগতের কোন দেশ কি জানে না বাংলাদেশে এখন কী ঘটছে ? আমাদের বেতার ঘোষণা কী তারা শুনেছে ? এমনি নানা কথার ভীড় আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। কদমতলীর কাছাকাছি এসে আমরা এসব কথা ভাবতে ভাবতে যখনই রাস্তা পেরুতে গেছি তখনই দুটি গাড়ির হেডলাইটের তীব্র আলোয় আমার চোখ ঝলসে যায়। দুটি গাড়ি থেকেই সৈন্যরা লাফিয়ে নামতে থাকে। আমি সামনে একটি প্রাচীর দেখে সেটি পার হওয়ার জন্য দৌড় দিই শত্রু সৈন্যরাও গুলি বর্ষণ শুরু করে। একটি গুলি এসে আমার ডান হাতে থাকা এস্টেনগানে এসে লাগলে প্রচণ্ড ধাক্কায় সেটি ছিটকে পড়ে। আমি মুহূর্তে দেয়ালের উপর লাফিয়ে উঠে প্রচণ্ড বেগে ওপাশে গিয়ে পড়ি। তারপর লাফিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে আবার কখনো দৌড়ে চলতে থাকি। পেছনে শুনতে থাকি নৌ-সেনাদের এলোপাথারি গুলি বর্ষণের শব্দ। তাদের দুঃখ, শিকার তাদের হাতছাড়া হয়ে গেলো।

 আমার বাম উরুতে তখন ভয়ানক যন্ত্রনা হচ্ছিল, ভীষণ রক্ত ঝরছিল এবং ট্রাইজারের একটি অংশ হাটু পর্যন্ত ছিলে ঝুলে ছিল। দেয়াল থেকে লাফিয়ে পড়ার সময়ই বোধহয় কিছুতে লেগে এই জখম হয়েছে। কোতোয়ালী থানায় পৌছে দেখি আমার লোকেরা সবাই সেখানে জড়ো হয়েছে। ৩’’ মর্টারগুলো তখন আমাদের জন্য বোঝা হয়ে পড়েছিল। কারণ ওগুলোর কোন শেল অবশিষ্ট ছিল না। পেট্রোলের অভাবে কয়েকটি গাড়িও আমাদের ফেলে আসতে হলো। আমি টেলিফোনে জনাব সিদ্দিকীকে মর্টারগুলো নিয়ে যাওয়ার জন্য কাউকে গাড়িসহ পাঠাতে বললাম এবং সৈন্যদের পূর্বপরিকল্পিত যায়গায় গিয়ে প্রস্তুত হওয়ার জন্য নির্দেশ দিলাম। আমাদের আশা ছিল সেখান থেকে ক্যান্টনমেন্টের উপর আক্রমণ চালিয়ে ক্যান্টনমেন্ট থেকে প্রচুর গোলাগুলি উদ্ধার করতে পারবো।

আমাদের ভিন্ন রাস্তায় অগ্রসর হতে হলো। ক্যান্টনমেন্ট ও শহরের মধ্যবর্তী প্রধান শহরটি তখন শত্রুকবলিত। আমরা কিছু লোক গাড়িতে এবং কিছু লোক পায়ে হেটে গন্তব্যস্থলের দিকে রওনা হলাম। চকবাজারের কিছু সামনে শহরের উপকণ্ঠে পৌছতেই আমার একজন ইপিআর সিপাই পায়ে হেটে শহরের দিকে ফিরছে। “ওদিকে কোথায় যাচ্ছো ?” আমি চীৎকার করে জিজ্ঞাসা করলাম। বিষণ্ণ কণ্ঠে সে জবাব দিল, আপনার কাছেই স্যার। সে আরও বলল, “আপনি ক্যান্টনমেন্টের পেছনের এলাকায় গিয়ে আমাদের একত্র হতে বলেছিলেন। কিন্তু একজন অফিসার অন্যপথ দিয়ে সৈন্যদেরকে নিয়ে কালুরঘাট সেতুর দিকে চলে গেছে।“ আমি আবার চীৎকার করে জিজ্ঞাসা করলাম, “কোন অফিসার ?”

“আমি তার নাম জানি না, স্যার”

 জনাব হান্নান এবং ডাঃ জাফরকে প্রশ্ন করে জানতে পারলাম মেজর জিয়াউর রাহমান আমাদের সেনাদের কালুরঘাট সেতুর দিকে নিয়ে গেছেন। আমি আওয়ামীলীগ নেতাদের অনুরোধ করলাম তারা যেন জিয়াকে বলেন আমার সৈন্যদের ছেড়ে দিতে যাতে তারা শহরে আমার সাথে যোগ দিতে পারে। তদনুসারে ডাঃ জাফর, জনাব হান্নান, নগর আওয়ামীলীগের সেক্রেটারি জনাব মান্নান,জনাব কায়সার, আরও কয়েকজন কালুরঘাটের দিকে রওনা হয়ে যান। গোমদন্ডী ষ্টেশনের কাছে তারা মেজর জিয়া, মেজর শওকত ও আরো কয়েকজন নেতার সাক্ষাত পান। আমার সাথে শহরের লড়াইয়ে অংশ নেয়ার জন্য তারা জিয়াকে আমার সৈন্যদের ছেড়ে দিতে বলেন। মেজর জিয়া জবাব দেন যে, তার বাহিনী পুনর্গঠনের পরই তিনি আমার সংগে যোগ দেবেন। আওয়ামীলীগ নেতারা ফিরে এসে আমাকে সব কথা জানালেন। অবশ্য মেজর জিয়া এবং তার অফিসাররা শহরের লড়াইয়ে আর আসতে পারেন নি।

ঢাকা থেকে তখনও বিমান বোঝাই করে সৈন্য আনা হচ্ছিল। প্রধানতঃ কুমিল্লার ৫৩ ব্রিগেড থেকে এবং অন্যান্য স্থান থেকেও পাক সৈন্যরা চট্টগ্রামের পথে এগিয়ে আসছিল। শহরের উপর দিয়ে হেলিকপ্টার চক্কর দিচ্ছিল। এদিকে বাংলাদেশের পতাকা বিক্রি বেড়ে গেলো বহুগুণ। সর্বত্র নীল আকাশের নিচে নতুন পতাকা উড়তে দেখা গেল। কিন্তু ক্যান্টনমেন্ট থেকে শত্রুসৈন্যরা বের হয়ে সবাইকে সেগুলো নামিয়ে ফেলতে বাধ্য করতে লাগলো। যদিও প্রকৃতপক্ষে প্রতিটি বাঙ্গালির হৃদয়ে গ্রথিত বাংলাদেশের পতাকার ছাপ তারা কোনদিনই মুছে ফেলতে পারে নি।

 ক্যান্টনমেন্টের অদূরে ইপিআর সৈন্যরা আমার কথা অনুযায়ী নতুন সৈন্যদের অপেক্ষা করছিল। আমার সৈন্যদের কালুরঘাটে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। একথা তারা তখনও জানতে পারেনি। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের দিক থেকে ক্যান্টনমেন্টের উপর যে হামলা পরিচালনার পরিকল্পনা আমি ইতিপূর্বে করছিলাম তা ভেস্তে গেলো।

এমতাবস্থায় আমি অস্ত্র ও গোলাবারুদের জন্য ভারতে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। ভাব্লাম, ৬০ মাইল পথ অতক্রম করে ভারতে একবার যেতে পারলে সেখান থেকে নিশ্চয়ই অস্ত্র, গোলাগুলি এবং জরুরী জিনিসপত্র সংগ্রহ করা যাবেএবং এরপর রামগড় থেকে কিছু সৈন্য নিয়ে এসে ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করতে পারবো। অস্ত্রের জন্য ভারতে রওনা হওয়ার প্রাক্কালে আমি সীমান্ত রক্ষীদের সাথে প্রাথমিকভাবে আলোচনা করে রাখার জন্য অয়্যারলেসে রামগড়ে একটি বার্তা পাঠালাম। আমার ভারত পৌঁছানোর পর আলোচনা শুরু করতে যাতে দেরী না হয় সেজন্যই আগে থেকে এ ব্যবস্থা করলাম।

।। সরবরাহের অভাব ।।

 

       ২৮শে মার্চ ভোর নাগাদ শত্রুপক্ষ ক্যান্টনমেন্ট এবং নৌবাহিনীর ঘাটির মধ্যবর্তী প্রধান সড়কের টাইগার পাস এলাকা দখল করে নেয় এবং নগরীর কেন্দ্রস্থলে সার্কিট হাউসে তাদের সদর দফতর স্থাপন করে। কুমিরায় যে শত্রুদলটিকে আমরা প্রতিহত করেছিলাম তারাও এসে ক্যান্টনমেন্টের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে। আমাদের সেখানকার সৈন্যরা সরে এসে হালিশহর প্রধান প্রতিরক্ষা ব্যূহ অবস্থান নেয়। হালিশহরে আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যূহ দু’ভাবে কাজে লাগছিলো। প্রথমত, এ প্রতিরক্ষা ছিল বিমানবন্দর, নৌবাহিনীর সদর দফতর এবং পোর্ট এলাকায় শত্রুদের আসার পথে হুমকিস্বরূপ। দ্বিতীয়ত, শত্রুদের প্রধান অংশে আঘাত হানার জন্যও দৃঢ় ঘাঁটি হিসেবে এটা কাজে লাগছিলো। ইতিমধ্যে ইপিআর সৈন্যদের কালুরঘাটে আটকানো না হলে পোর্ট, বিমানবন্দর এবং নৌবাহিনীর সদর দফতর আক্রমণ এবং দখল করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হতো এবং তাহলেই যুদ্ধের গতিধারা পাল্টে যেত। পোর্ট এলাকা থেকে শত্রুসৈন্যরা দিনের বেলা কয়েকবারই আগ্রাবাদ রোড পরিষ্কার করে টাইগার পাস দিয়ে নৌঘাঁটির সংগে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করে। কিন্তু তীব্র প্রতিরোধের মুখে প্রত্যেকবারই তাদের পিছু হটতে হয়। শত্রুরা হয়তো মরিয়া হয়ে অগ্রসর হলে সরকটি দখল করতে পারতো। কিন্তু রাস্তায় রাস্তায় এ ধরনের সংঘর্ষে লোকক্ষয় ছিল অবশ্যম্ভাবী। লোকক্ষয় এড়ানোর জন্যই তারা সাময়িকভাবে এ প্রচেষ্টা স্থগিত রেখে কুমিল্লা থেকে অগ্রসরমান সৈন্যদের দেওয়ান হাট উপস্থিতির জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।

দামপাড়া পুলিশ লাইনের বাঙালি পুলিশরাও অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে শত্রু সেনাদের প্রতিরোধ করছিল। কিন্তু যুদ্ধের পুরো ট্রেনিং এবং অভিজ্ঞতা না থাকায় তারা বেশিক্ষন টিকতে পারেনি। সংঘর্ষে বহু বাঙালি পুলিশ হতাহত হয়। শত্রুদের ক্রমাগত চাপের মুখে বাঙালি পুলিশদের স্থানটি পরিত্যাগ করতে হয়।

পরদিন ২৯শে মার্চ। সকালে শত্রুসেনারা আগ্রাবাদ রোড অতিক্রম করতে সক্ষম হয় এবং একটি দল্কে তারা মাদারবাড়ি ও আইস ফ্যাক্টরি সড়ক হয়ে নিউ মার্কেটের দিকে পাঠিয়ে দেয়। নিউমার্কেটে অবশ্য আমাদের লোক ছিল না তবে আমি এক প্লাটুন শক্তিসম্পন্ন একটি দল্কে (প্রায় ৩০ জন) ঐ এলাকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান কোর্ট ভবন দখলে রাখার জন্য পাঠিয়েছিলাম।

 শত্রুদের আরেকটি দল স্টেডিয়ামের বিপরীত দিকের নৌ-ভবন থেকে বেড়িয়ে পি-আই-এ অফিসের নিকটবর্তী একটি লেনের মধ্যে দিয়ে ডিসি হিলের দিকে এগুতে থাকে। কয়েকজন পথচারী তাদের পথের মধ্যে পড়লে পাকিস্তানীরা তাদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এরপর একস্থানে থেমে তারা যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয় এবং দ্রুতগতিতে পাহাড়ের উপর উঠে সমস্ত এলাকাটি বিনা বাধায় দখল করে নেয়। কোর্ট বিল্ডিঙে তখন আমাদের সৈন্যরা পরবর্তী লড়াইয়ের জন্য অপেক্ষমান। তারা গভীরভাবে সাহায্যের প্রত্যাশা করছিল। এবং সাহায্য করলেই যে কোন মুল্যে তারা শত্রুদের প্রতিরোধ করতে পারতো।

 ওইদিন বিকালে এক অজ্ঞাত ব্যক্তি জাকির হোসেন রোডে অ্যাম্বুলেন্স পাঠানর জন্য মেডিকেল কলেজে ফোন করে। এ পর্যন্ত মেডিকেল কলেজ আমাদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে ছিল। কলেজের নিকটেই গুরুত্বপূর্ণ স্থান প্রবর্তক হিলে আমাদের কিছু সৈনিক মোতায়েন ছিল। আমাদের আহত সৈনিকদের নিয়ে মেডিকেল কলেজের ডাক্তার, নার্স, ছাত্রছাত্রীরা সকলেই দিনরাত ব্যস্ত ছিল।

 পূর্ব কথিত এ্যাম্বুলেন্সটি ফিরে আসতেই ডাক্তার এবং নার্সরা দ্রুত বেড়িয়ে আসেন। কিন্তু এ্যাম্বুলেন্সের দরজা খুলতেই বেড়িয়ে আসে একদল শত্রু সৈন্য, হাতে তাদে উদ্যত হাতিয়ার। ক্ষিপ্ততার সাথে তারা হাসপাতাল ভবনের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান গ্রহন করে। সন্ধ্যা নাগাদ আরও একদল সৈন্য এসে অবস্থানরত সৈন্যদের সাথে যোগ দেয়। কর্মচঞ্চল হাসপাতাল ভবন এবং তার পার্শ্ববর্তী আবাসিক এলাকায় নেমে আসে এক বিষণ্ণ নীরবতা।

হালিশহর এবং কোর্ট ভবন এ দুটি স্থানে তখনও আমাদের সুদৃঢ় ঘাটি ছিল। তাছাড়া শহরের বিভিন্ন স্থানে আমাদের ছোট ছোট বিচ্ছিন্ন দলগুলো তখনও শত্রুসেনাদের মোকাবিলা করছিল। কিন্তু শেষে কুমিল্লা থেকে নতুন শত্রুদল দেওয়ানহাট ক্রসিঙের কাছে পৌছে গেলে আগ্রাবাদ এলাকা থীকে আমাদের সৈন্যদের হালিশহর ঘাঁটিতে সরে আসা ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। শহরের অর্ধেক জনসংখ্যা ততক্ষনে গ্রামের দিকে চলে গেছে। অনেকে সরাসরি সীমান্তের দিকেও চলে যায়। সকলেই কেমন যেন হতাশ হয়ে পড়ে। জনসাধারণ ঠিকই ভেবেছিল যে, কোনরূপ সাহায্য ছাড়া যুদ্ধে জয়লাভ করা আমাদের পক্ষে দেরী হবে। কারণ ইতিমধ্যেই তারা দেখছে আমাদের সৈন্যরা ভীষণ অসহায় অবস্থার মধ্যে যুদ্ধ করছিল। আমাদের গোলাগুলির সরবরাহ ছিল খুবই কম। একজন সৈনিকের হাতের অস্ত্র অকেজো হয়ে গেলে তাকে নতুন অস্ত্র না দেয়া পর্যন্ত সেই সৈনিকটিই অকেজো হয়ে পড়ে। কেউ আহত হলেও তার প্রাথমিক চিকিৎসা কিংবা তাকে অন্যত্র স্থানান্তরের কোন ব্যবস্থা আমাদের ছিল না। এমনকি একপর্যায়ে প্রয়োজনীয় পানি ও খাদ্য সরবরাহেরও কেউ ছিল না। আমার ট্যাক্টিকাল হেডকোয়ার্টারে ওয়্যারলেস কিংবা আধুনিক কোন যোগাযোগ ব্যবস্থা পরযাপ্ত না থাকায় বিভিন্ন রণাঙ্গনে যুদ্ধরত সৈনিকদের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখতে পারিনি। ফলে সর্বশেষ পরিস্থিতি অবহিত হওয়া এবং সে অনুসারে নতুন নির্দেশ দেওয়াও সম্ভব হয়নি। এছাড়া যাতায়াতের জন্য যানবাহনের সমসসাও ছিল প্রকট। আমরা যোগাযোগ এবং পরিবহনের অভাবেই ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছি বেশি। কুমিরায় আমাদের অবস্থান বিপন্ন হওয়ার সংবাদ একজন সংবাদ বাহকের মারফত তিন ঘন্টা পর পাই। সংবাদ পাওয়ার আধ ঘন্টার মধ্যেই আমি নতুন কিছু সৈন্য কুমিরার উদ্দেশ্যে পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু তারা কুমিরার দুই মাইল দূরে পৌছানোর পূর্বেই কুমিরার পতন ঘটে। আমাদের সৈন্যরা ততক্ষনে হালিশহরের দিকে ফিরে আসতে থাকে। আরেকটি সংকট ছিল ট্রেনিংপ্রাপ্ত শত্রুসৈন্যদের সাথে যখন অব্যাহতভাবে নতুন নতুন সৈন্য এবং অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যাদির সরবরাহ যোগ হচ্ছিলো, আমি তখন অসহায়ভাবে তা দেখছিলাম। একইভাবে দল বেধে আমাদের সামরিক লোকজনও শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছিলো।

আমি যে কয়জন সৈন্য নিয়ে যুদ্ধ করছিলাম তার সঙ্গে একজনও নতুন সৈনিক কিংবা একটিমাত্র বুলেটও যোগ করতে পারিনি। ক্রমাগত শত্রুসৈন্যরা মোকাবিলা করে আমাদের ক্লান্ত, অবসন্ন হয়ে পড়েছিল। অনেকেই ২৫ তারিখের রাত থেকে এখন পর্যন্ত এক মুহূর্তের জন্যও চোখ বন্ধ করতে পারেনি। আমার রেলওয়ে ঘাঁটি  সার্কিট হাউস এলাকা, মেডিকেল কলেজ, ডিসি হিল এবং হালিশহর কোট বিল্ডিঙ্গের যুদ্ধে আমি নতুন সৈন্য ও অস্ত্র সরবারহ প্রাপ্তির প্রত্যাশায় হতাশ হয়েছি বারবার। আর এই প্রত্যাশা যুদ্ধের সেই পর্যায়ে আমার সৈন্যদের অবসাদগ্রস্ত করে তোলে সাময়িকভাবে।

 

।। চট্টগ্রাম শহরে চূড়ান্ত লড়াই ।।

 

       ৩০শে মার্চ। শহরে তখন কারফিউ চলছে। খুব ভোরে একজন ভদ্রলোক চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরী বিভাগে অস্থিরভাবে অনবরত টেলিফোন করছিলেন। একটু আগে জানালা দিয়ে তিনি নারকীয় দৃশ্য দেখেছেন। একটি গাক্সহের উপর বাংলাদেশের পতাকা উড়ছিল। কয়েকজন পাকসেনা কিশোর বয়সের একটি ছেলেকে সেই পতাকা নামিয়ে ফেলতে বলে। ছেলেটি অনিচ্ছাসত্ত্বেও গাছ বেয়ে উপরে উঠে এবং পতাকাটি আস্তে আস্তে ভাজ করতে থাকে। ঠিক এ সময়ে নিচ থেকে সৈন্যরা সুস্থ মস্তিষ্কে তার দিকে রাইফেল তাক করে গুলি ছোড়ে। গুলিবিদ্ধ ছেলেটি বৃন্তচ্যুত ফুলের মতো নিচে পড়ে যায়। সৈন্যরা হো হো করে হেসে ওঠে এবং সে স্থান ত্যাগ করে।

কোন এ্যাম্বুলেন্স কিংবা অন্য কেউ কিশোরটির সাহায্যে এগিয়ে আসেনি। হাসপাতালের সবকটি গাড়িই পাকিস্তানী সৈন্যদের বহন করছিল। বস্তুত পুরো হাসপাতালটিই মিলিটারি ক্যাম্পে পরিনত হয়েছে। বাঙালি ডাক্তার, নার্স এবং অধিকাংশ রোগীই ইতিমধ্যে হাপাতাল ত্যাগ করেছে। আর রক্তপিপাসু দানব্দের হাত থেকে বাচতে যারা একেবারেই অসমর্থ তারা অসহায়ভাবে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছিলেন।

প্রতিদিনের ব্যস্ত বিপণী কেন্দ্র নিউমার্কেট সেকিন একেবারে চুপচাপ। দুপুরের মধ্যে পাকসেনারা পোর্টের দিক থেকে বরফকল সড়ক হয়ে এখানে পৌছে যায় এবং সদরঘাট, রেলওয়ে ষ্টেশন এবং স্টেডিয়ামের দিকে তারা অগ্রসর হতে থাকে। ছোট একটি দল কোর্ট হিলের দিকেও পা বাড়ায়। কিন্তু হিলে অবস্থানরত আমাদের সৈনিকদের বুলেট বৃষ্টিতে পাকিস্তানীদের পিছু হটে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে হয়।

একই দিনে হালিশহরেও সকাল ৮টা থেকে সংঘর্ষ চলতে থাকে। পাকিস্তানীরা মরিয়া হয়ে কামান দেগে চলছিল। নৌবাহিনীর সবগুলি কামানই তখন সক্রিয় ছিল। ক্রমাগত ৬ ঘন্টা যাবত তারা হালিশহরের উপর গোলাবর্ষণ করে। কামানের ছত্রছায়ায় শত্রুরা হালিশহরের দিকে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা চালায়। কিন্তু ইপিআর সেনাদের পাল্টা আক্রমণের মুখে অগ্রগতি লাভে ব্যর্থ হয়ে শত্রুরা বিমান বাহিনীর সাহায্য প্রার্থনা করে। আধ ঘন্টার মধ্যে দুটি বিমান চলে আসে। এবং বেলা সাড়ে বারোটা থেকে আমাদের অবস্থানের উপর ক্রমাগত বিমান হামলা চলতে থাকে। আমাদের কোন বিমান বিধ্বংসী হাতিয়ার ছিল না। সেই সময় নিজেদেররও কোন বিমান থাকার কথা নয়। তাই শত্রু বিমানগুলো আকাশে তাদের আধিপত্য বিস্তার করে নির্ভিগ্নে আমাদের উপর বোমাবর্ষণ করতে থাকে। তারা তাদের ইচ্ছা মতো রনাঙ্গনের উপর আঘাত হানতে থাকলো। পরিস্কার রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিনে তারা একটার পর একটা ট্রেঞ্চ দেখে দেখে স্ট্যাম্পিং করে চলছিল। আমাদের বীর সেনানিরাও প্রাণপণে ঘাটি আঁকড়ে লড়াই করতে থাকল। লড়াই করতে করতে অনেকেই ট্রেঞ্চের মধ্যেই মৃত্যুবরণ করল। আহতও হল অনেক। কিন্তু অবিরাম বোমা বর্ষণের ফলে তাদের অপসারণ করা সম্ভব হয়ে উঠে নি। যুদ্ধরত বাকী সৈন্যরাও বুঝতে পারল তাদের আর বেশিক্ষন হালিশহর রক্ষা করা সম্ভব হবে না। গোলাগুলির মজুতও নিঃশেষ প্রায়। তারা রাইফেলের উপরে বেয়নেট লাগিয়ে নিচের শত্রুদের সাথে হাতাহাতি লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হল।

বিকালের মধ্যে শত্রুরা হালিশহর দখল করে নিল। হাতাহাতি যুদ্ধ চলল আধঘন্টার মতো। শত্রুসৈন্য সংখ্যাধিক্যের ফলে চূড়ান্ত ফলাফল কি হয়েছিল তা বোঝা গিয়েছিল। আমাদের সৈন্যরা পেছনে এসে ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কের এক স্থানে অবস্থান গ্রহন করলো সহযোগীদের লাশও ফেলে আসতে হলো।

হালিশহর পতনের পর শত্রুদের পুরো দৃষ্টি পড়লো কোর্ট হিলের উপর। এটাই ছিল শহরে আমাদের সর্বশেষ ঘাটি, সর্বশেষ আশা। বিভিন্ন দিক থেকে অবস্থানটির উপর কয়েকবারই হামলা হল। কিন্তু প্রতিবারই আমাদের সৈন্যরা তা প্রতিহত করে! এরপর এল ট্যাংক বহর। অগ্রবর্তী ট্যাংকটি পাকা রাস্তা বেয়ে উপরের দিকে উঠতেই আমাদের সৈন্যদের ট্যাংক বিধ্বংসী শেলের আঘাতে তা অকেজো হয়ে পড়লো। ট্যাংকটি অকেজো হয়ে থেমে পড়লে পেছনে অন্যান্য ট্যাংক এবং পদাতিক সৈন্যরা কিছুটা থমকে দাঁড়ালো। এ সময় সম্ভবত আমাদের শক্তির পরিমাপ করছিল। ইতিমধ্যে অবশ্য শত্রুপক্ষ আমাদের দুর্বলতা বুঝতে পেরেছিল। আমাদের সৈনিকদের তখন গোলাবারুদ নিঃশেষ প্রায়। এবং বাইরের সাথে সকল সংযোগও প্রায় সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। অদূর ভবিষ্যতে নতুন করে কোন সাহায্য লাভের সম্ভাবনা ছিল না।

২রা এপ্রিল ভোরে শত্রুরা আবার হামলা শুরু করলো। হামলা ছিল সুপরিকল্পিত। মাত্র ৩০জন সৈনিকের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল পাকিস্তানিদের পুরো একটি ব্যাটেলিয়ন। দুটি কোম্পানি মিলে প্রথম আঘাত হানলে তা সাফল্যের সাথে প্রতিহত করা হয়। এরপর আরও জোরদার হামলা চলতে থাকে। দুটি সংরক্ষিত কোম্পানি এবার অন্য দিক থেকে আক্রমণ শুরু করে। মারাত্মক গুলিবর্ষণের ছত্রছায়ায় এরা একটু একটু করে পাহাড় বেয়ে উঠতে থাকে। এদিকে আমাদের প্রতিরোধকারী সৈন্যদের গোলাগুলি নিঃশেষ হয়ে যায়। একমাত্র ট্যাংক বিধ্বংসী অস্ত্রটিও অকেজো হয়ে পড়ে। পদাতিক বাহিনীর আগে আগে এ সময় দিটি ট্যাংক উপএ উঠে আসে। বলতে গেলে অলৌকিকভাবে সেদিন আমাদের সৈনিকদের প্রায় সবাই সে স্থান ত্যাগ করে আত্মরক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিল। এভাবেই কোর্টহিলের পতন ঘটল এবং সাথে সাথে অনির্দিষ্ট কালের জন্য চট্টগ্রাম নগরীও আমাদের হাতছাড়া হয়ে গেল। তখন সময় ছিল বেলা সাড়ে ১২টা। মাত্র ৩০জন ইপিআর এর দুর্জয় সৈনিক শত্রুপক্ষের এক ব্যাটেলিয়ন সৈন্য শক্তির অব্যাহত শেলিং এবং উপর্যুপরি আক্রমণের মুখে ৩ দিনেরও বেশি তাদের অবস্থান আগলে রেখেছিল। কাজেই এই পরাজয় তাদের অদম্য সাহস ও বিক্রমের মহিমাকে ম্লান করে দিতে পারে না।

।। ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ ।।

 

       এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহেই আমি অস্ত্রসস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহের উদ্দেস্যে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য রামগড় যাই। সেখান থেকে সাবরুম গেলে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) অফিসাররা আমার সাথে কথা বলেন এবং অবিলম্বে আগরতলা নেতৃস্থানীয় কর্মকর্তাদের সাথে আমার সাক্ষাতের ব্যবস্থা করেন। প্রয়োজনবোধে ভারতীয় রাজধানীতে যাওয়ার ব্যবস্থাও তারা করে রাখেন।

২রা এপ্রিল আমি আগরতলা পৌছালে সরাসরি আমাকে সরাসরি বিএসএফ এর সিনিয়র অফিসার মিঃ কালিয়ার অফিসে নিয়ে যাওয়া হল। আমি তার কাছে আমাদের লড়াইয়ের অবস্থা বর্ণনা করে সামরিক সাহায্যের অনুরোধ জানালাম। মিঃ কালিয়া অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহে কেন্দ্রীও সরকারের অনুমোদন প্রয়োজন বিধায় আমাকে অপেক্ষা করতে বললেন। অপেক্ষা করা ছাড়া আমার কোন গত্যন্তর ছিল না। আমাকে আগরতলার এক অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হল এবং সেখানেই এক কক্ষে আমি সারাদিন রইলাম। সেখানে সাদা পোশাক পরিহিত কয়েকজন ভারতীয় অফিসার পর্যায়ক্রমে আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। তারা আমার কাছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থান,তাদের শক্তি, কোন ধরনের অস্ত্র তারা ব্যবহার করছে ইত্যাদি বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করলেন। তারা আমার অতীত জীবন এবং কী কারনে আমি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেছিলাম সে বিষয়েও প্রশ্ন করলেন, ঘটনাবলী সম্পর্কে আমার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি, পাকবাহিনীর সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এবং স্বাধীনতা অর্জনে আমরা কি কি উদ্যোগ নিয়েছি তাও জানতে চাইলেন।

এদের সঙ্গে আমার আলোচনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও আন্তরিকতার সাথে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তারা খুবই সহানুভূতিশীল ছিলেন। তবে এদের আলোচনার ধারা থেকে আমরা বুঝতে পারি, এরা সকলেই ভারতীয় সমরিক বাহিনী ও বিএসএফ-এর গোয়েন্দা বিভাগের লোক। পরেরদিন নেতৃস্থানীয় ভারতীয় অফিসারদের সঙ্গে আমার দীর্ঘ আলোচনা হল। বিকআলের দিকে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী শ্রী শচিন সিং এর সাথে আমি বৈঠকে মিলিত হলাম। তার আচরণও ছিল বন্ধুসুলভ। তার কাছেও আমি অস্ত্রশস্ত্র এবং কিছু জরুরী জিনিসপত্রের জন্য অনুরোধ জানাই।

মুখ্যমন্ত্রী আমাকে আশ্বাস দিয়ে বললেন, দিল্লী থেকে জবাব এলেই তিনি আমার জন্য কিছু সাহায্যের ব্যবস্থা করতে পারবেন। এ সময় দরকার হলে আমাকে দিল্লী যাবার জন্যও প্রস্তুত থাকতে বলা হলো।

পরদিন চট্টগ্রাম জেলার কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা আগরতলা পৌছলেন। তাদের নিয়ে পুনরায় আমি শ্রী শচিন সিং এর সাথে দেখা করলাম। তিনি আমাকে জানালেন যে, ৯২তম বিএসএফ ব্যাটেলিয়ন থেকে জরুরী ভিত্তিতে আমি কিছু অস্ত্রশস্ত্র পেতে পারি। আমার অন্যান্য জিনিসপত্রের চাহিদা সম্পর্কেও তাকে অবহিত করতে বললেন। আমি তার কামরার এক কোনায় বসে প্রায় ১০ মিনিটের মধ্যে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের একটি তালিকা প্রস্তুত করে ফেলি। আওয়ামী লীগ নেতাদের হাতে সেটি তুলে দিয়ে আমি তখনই চট্টোগ্রামের পথে আগরতলা ত্যাগ করলাম। পথে ৯২তম বিএসএফ এর কমান্ডীং অফিসার কর্নেল ঘোষের সাথে আলোচনা করলাম। তিনি ততক্ষনে আমাকে কয়েকটী লাইন মেশিনগান, রাইফেল, হ্যাণ্ডগ্রেনেড ও কিছু গোলাবারুদ সরবরাহ করার জন্য তার ব্যাটেলিয়ন কে নির্দেশ দিয়ে ফেলেছেন এবং সেগুলো ইতোমধ্যেই সাবরুম থানায় পৌঁছে গিয়েছিল। জিনিসগুলো আমাকে দেয়ার জন্য ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টার থেকে বিএসএফ এর ক্যাপ্টেন মেহেক সিং কে আমার সঙ্গেই পাঠানো হয়।

চট্টগ্রাম শহরের উপর নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠার পর পাকিস্তানীরা গ্রামাঞ্চলের দিকে ছড়িয়ে পড়ে। পাকিস্তানিদের একটি কলাম হাঠাজারি, ফটিকছড়ি, নারায়নহাট এবং হিয়াকু হয়ে রামগড়ের দিকে অগ্রসর হয়। অপরদিকে রাঙ্গামাটি,কাপ্তাই এবং কক্সবাজারের দিকেও একটি করে কলাম অগ্রসর হতে থাকে। এ সময় আমরা গ্রামাঞ্চলের উপর নিয়ন্ত্রন বলবত রাখার সিদ্ধান্ত নেই। এ উদ্দেশ্য সাধন কেবল শত্রুসৈন্যদের শহরাঞ্চলে কোণঠাসা করে রাখার মাধ্যমেই সম্ভব ছিল। এভাবে সুসংগঠিত গোরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে শত্রুর শক্তিক্ষয় করে তাদের উপর চূড়ান্ত আঘাত হানাই হবে সঠিক পদক্ষেপ। এটা আমাদের কাছে পরিষ্কার ছিল যে, এই সুদীর্ঘ প্রক্রিয়ায় আমাদের হারাতে হবে অসংখ্য জীবন। আমাদের সামনে যুদ্ধের প্রস্তুতি ব্যতিত অন্য কোন বিকল্প ব্যবস্থাছিল না। এ জন্য অবশ্য জনসাধারণকেও সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে।

রামগড় থেকে দুটি ইপিআর প্লাটুনকে চট্টগ্রাম শহরের প্রায় ৬ মাইল দূরে ভাটিয়ারি এবং ফৌজদারহাটের মধ্যে প্রতিরক্ষা মুলক অবস্থান গ্রহনের জন্য পাঠানো হয়েছিল। অন্য দুটি ইপিআর প্লাটুনকে ফটিকছড়ি হাঠাজারি হয়ে ক্যান্টনমেন্টের দিকে সহযোদ্ধাদের সাহায্যে পাঠানো হয়। ক্যাপ্টেন হারুন এবং আরও কয়েকজন অফিসার ৬টি কোম্পানি নিয়ে কালুরঘাট সেতুর নিকটেই প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান নিয়েছিল। ঠিক এ পর্যায়ে চৌঠা এপ্রিল আমরা ভারত থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদের প্রথম সংগ্রহ পাই। যুদ্ধ পরিচালনা করার জন্ন এ সময় আমার পুরো বাহিনীকে পুনর্বিন্যস্ত করা হয়। সসস্ত্র বাহিনীর বাঙালি সদস্যদের গুরুত্তহিন স্থান থেকে সরিয়ে গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ ফ্রন্টগুলোতে পাঠানো হল। ক্যাপ্টেন মতিন এবং লেফটেন্যান্ট এজাজের নেতৃত্বে এরুপ দুটি কোম্পানি ভারতীয় এলাকা দিয়ে শতাধিক মাইল দূরে চট্টগ্রাম সেক্টরকে শক্তিশালী করার জন্য সেখানে পৌছে। আমার দলের শক্তি ববৃদ্ধির জন্য পর্যাপ্ত অস্ত্র ও গোলাবারুদ সহ এদের একটি কোম্পানি ভাটিয়ারি অভিমুখে রওনা হয়। এবং অন্য একটি কোম্পানিকে নিয়ে আমি হিয়াকু,ফটিকছড়ি হয়ে পুনরায় চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টের দিকে অগ্রসর হই। এটা ছিল এক কষ্টসাধ্য অভিযাত্রা। রাস্তা ছিল অত্যন্ত খারাপ। যান্ত্রিক কনভয় বলতে ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালের কয়েকখানি জিপ, আর এই জিপ গুলোকে প্রায় অর্ধেক পথই আমাদের ঠেলে নিয়ে যেতে হচ্ছিল। আমাদের এ চলাচলের গোপন খবর রাখার উপায় ছিল না। কারণ, যেমনি দিনের বেলায় আমাদের চলতে হচ্ছিলো। তেমনি আবার ভারতের পথে পলায়নপর ভিতসন্ত্রস্ত অসংখ্য জনসাধারণ একই পথ ধরে অগ্রসর হচ্ছিল। যদিও আমরা সবাই বেসামরিক পোশাকে ছিলাম। এবং অস্ত্রশস্ত্র লুকিয়ে রেখেছিলাম। তথাপি শত্রুকবলিত একটি শহরের দিকে কিছুসংখ্যক লোকের সুসংগঠিত হয়ে চলার ভাব দেখে আশংকা ও হতাশায় নিমজ্জিত লোকদের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার হয়। আত্মতুষ্টি লাভের জন্য তারা মুক্তিযোদ্ধার সঠিক  সংখ্যার চেয়ে কয়েকগুন বাড়িয়ে শহরের দিকে তাদের যাত্রার কথা যেভাবে বলাবলি করছিল সে খবর দ্রুত শত্রু ঘাঁটিতে পৌছে যায়।

নারায়ণহাটে পৌছে আমরা সন্ধ্যার পরবর্তী যাত্রার জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। রাতের সামান্য আহার গ্রহন করি। নারায়নহাট থেকে আমাদের মুক্তিসেনাদের নাজিরহাট পর্যন্ত পৌঁছানোর জন্য কয়েকটি নৌকার বেবস্থা করা হয়। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন ছিল অন্যদিকে নৌকাগুলোরও কোন ছৈ ছিল না। ক্লান্তিতে অবসাদে আমরা সবাই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কিছুক্ষন পর মুষল ধারায় বৃষ্টি নেমে আসে। আমরা বৃষ্টিতে ভিজে উন্মুক্ত আকাশের নিচে শীতে কাপতে থাকি। নাজিরহাট পৌছাতে ভোর হয়ে গেল। এখানেই খবর পেলাম ক্যান্টনমেন্টের নিকট আমাদের যে সানাদল ছিল শত্রুর আক্রমনে তা পিছু হটে হাটহাজারীর দিকে চলে গেছে। নাজিরহাট পৌছেই আমাদের জন্য একটি সম্ভাব্য ঘাটি খুজে বের করার উদ্দেশ্যে দ্রুত পর্যবেক্ষণের কাজ শুরু করি। খোজাখুজির পর কয়েক মাইল দূরে উদালিয়া চা বাগানই উপযুক্ত স্থান হিসেবে নির্ধারণ করি। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সে দিকে রওয়ানা দিলাম। বাগানের ম্যানেজার আন্তরিকতার সাথে আমাদের স্বাগত জানালেন। সকল প্রকার সাহায্যের তিনি ব্যবস্থা করেছিলেন।

সীতাকুণ্ড পাহাড় শ্রেণীর একটি বিচ্ছিন্ন ছোট পাহাড়ের উপর গড়ে উঠেছে উদালিয়া চা বাগান। সৈন্যদের এখানে ছোট ছোট দলে ভাগ করে। প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ, খাবারের ব্যবস্থা এবং অন্যান্য কাজের ভার দেয়া হল। একশন গ্রুপকেও সদা প্রস্তুত রাখা হলো, যাতে তারা স্বল্পকালীন সময়ে শত্রুর মোকাবিলায় দ্রুত রওয়ানা হতে পারে। প্রয়োজনবোধে বিকল্প ঘাঁটি স্থাপনের স্থানটিও দেখে রাখা হল। রক্ষাবুহ্য নির্মাণের কাজ পুরোপুরি সম্পন্ন হলে এ স্থানের দায়িত্ব লেফটেন্যান্ট এজাজের উপর ন্যাস্ত করে আমি কালুরঘাটের দিকে অগ্রসর হই।

কালুরঘাটের প্রতিরক্ষামূলক অবস্থানে অধিকাংশই ইপিআর সৈনিক। প্রাথমিক পর্যায়েই আমি যখন চট্টগ্রাম শহরে পাকসেনাদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলাম। তখনই আমার সঙ্গে যোগ দেয়ার জন্য চট্টগ্রামের সীমান্ত ফাঁড়িগুলো থেকে ইপিআর সৈনিকদের অগ্রযাত্রা মেজর জিয়া থামিয়ে দেন। ইপিআর সৈনিকদের তিনি কালুরঘাটে রেখে দিয়েছিলেন। ৮ বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ইস্ত বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের কিছু সৈন্যকেও এখানে রেখে দেয়া হয়। সব মিলিয়ে কালুরঘাটে তখন ৬টি কোম্পানি ছিল যার সৈন্য শক্তি ছিল প্রায় এক হাজার।

  আমি যখন চট্টগ্রাম শহর নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য নতুন লোকবল ও অস্ত্রবলের প্রত্যাশায় অপেক্ষা করছিলাম তখন আমারই নির্দেশে আগত ইপিআর সেনাদের কালুরঘাটে আটকে রাখা হয়। আমাদের সৈন্যদের কালুরঘাটে না থামিয়ে আমার সঙ্গে শহরের যুদ্ধে যোগ দিতে দেয়া হলে আমরা সাফল্যের সাথে নৌবাহিনীর সদর দফতর, বিমান বন্দর এবং ক্যান্টনমেন্ট দখল করতে পারতাম। এর ফলে পাকিস্তানীরা আর নতুন সৈন্য আনতে পারতো না এবং আমরাও সেখানে তাদের সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দিতে পারতাম। সে ক্ষেত্রে আমাদের যুদ্ধের ইতিহাস সম্পূর্ণ ভিন্নতর।

কী কারনে জানি না, কালুরঘাট যুদ্ধ হয়েছিল দু সপ্তাহ পরে এবং এই দুই সপ্তাহ পর্যন্ত আমাদের এখানকার সৈন্যরা কোন কাজেই লাগে নি। আমাদের তরুণ অফিসাররা দুর্জয় মনোবল এবং অদম্য সাহসে সঙ্গে এখানে লড়াই করলেও সৈন্যরা কিন্তু যোগ্য সিনিয়র অফিসারের অভাব তীব্রভাবে অনুভব করছিল। অবশ্য আমাদের সিনিয়র অফিসারদের সংখ্যাও তখন খুব বেশি ছিল না। এদের মধ্যে আবার মেজর শওকত কক্সবাজার চলে গিয়েছিলেন। ভূল খবরের ভিত্তিতেই এটা হয়েছিল। তারপর তিনি নিজেই কক্সবাজার ত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়ে কালুরঘাটে আমাদের সৈন্যদের সাথে যোগ দেন।

এখানে আমাদের প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র তেমন ছিল না। ৩০৩ রাইফেল ছাড়া আর ছিল কয়েকটি হালকা মেশিনগান এবং দুটি ৩’’ মর্টার। ইপিআর মর্টার জেসিও ৩’’ মর্টার দিয়েই অবিশ্বাস্য কাজ করেছিলেন। মাত্র কয়েক রাউণ্ড মর্টার শেল দিয়েই তিনি শত্রুসৈন্যদের একাধিক যায়গায় ব্যস্ত রাখতে সমর্থ হয়েছিলেন। তিনি একাই দ্রুত স্থান পরিবর্তন করে বিভিন্ন জায়গা থেকে মর্টার দাগতে থাকলে আমাদের মর্টারের সংখ্যা ঠিক কতো পাকিস্তানীরা তা অনুমান করতে ব্যর্থ হয়। আমাদের প্রতিরোধের দুর্জয়তায় শত্রুরা বরাবরই পিছু হটতে বাধ্য হয় এবং পরিশেষে প্রায় দু  সপ্তাহ পর ১১ই এপ্রিল কালুরঘাটের যুদ্ধ চূড়ান্ত রূপ নেয়। কালুরঘাট সংঘর্ষে আমরা কেবল সইনিকই হারাই নাই, দু জন অফিসারও সেই সংকটকালে আহত হয়েছিল। ক্যাপ্টেন হারুন গুরতর অবস্থায় বার্মায় আশ্রয় নিলেন, আর লেফটেন্যান্ট শমসের মবিন গুরতর আহত অবস্থায় পাকিস্তানিদের হাতে বন্দী হলেন।

কালুরঘাট অবস্থান পরিদর্শনের পর আমি আবার রামগড় হয়ে কুমিরার দিকে অগ্রসর হই। কুমিরার সৈন্যদের জন্য আরো কিছু অস্ত্রশস্ত্র লাভের উদ্দেশ্যে রামগড়ে আমাকে কিছু সময় অপেক্ষা করতে হয়। রামগড়ে মেজর জিয়ার সঙ্গে আবার দেখা হলে তাকে আমি কালুরঘাট অবস্থানের অসারতার কথা বলি। তারপর কিছু অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে সোজা কুমিরার পথে রওনা হই। কুমিরায় তখনও আমাদের সৈন্যরা শত্রুর সাথে মরণপণ লড়ে যাচ্ছিলো।

 

।। প্রথম বাংলাদেশ সরকার ।।

৪ঠা এপ্রিল চট্রগ্রাম শহরের পতন ঘটলে পাকিস্তানীরা ক্রমান্বয়ে কালুরঘাট সেতুর দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ১০ই এপ্রিলের মধ্যে সেতুর নিকট তারা তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করে তোলে। এই সময় শত্রুরা ছিলো আক্রমণমুখী এবং আমাদের ভুমিকা ছিলো আত্মরক্ষামূলক। কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী আত্মরক্ষামূলক অবস্থানে থাকতে থাকতে আমাদের সৈন্যরা উদ্যম হারিয়ে ফেলেছিল।

১১ই এপ্রিল সকাল আটটায় শত্রুপক্ষের গোলন্দাজ বাহিনী কালুরঘাট অবস্থানের উপর আক্রমণ শুরু করে। নৌবাহিনীর কামানগুলো থেকেও গোলাবর্ষণ শুরু হয়। ক্যাপ্টেন হারুন ও লেফটেন্যান্ট শমসের সেতুর পশ্চিম পার্শ্বে (শহরের দিকে) অগ্রবর্তী দলের নেতৃত্বে ছিলেন। আমাদের প্রধান অবস্থান ছিলো সেতুর পূর্ব পার্শ্বে।

কিছুক্ষণের মধ্যে শত্রুদের গোলাবর্ষণ তীব্রতর হয়ে ওঠে। এই গোলাবর্ষণের ছত্রছায়ায় পাকিস্তানীরা সম্মূখযুদ্ধেও প্রস্তুতি নিয়ে সেতুর দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ট্রেঞ্চ থেকে হারুন শত্রুপক্ষের অস্বাভাবিক তৎপরতা লক্ষ্য করে শমসেরকে বললো তোমার বাইনোকুলারটা দাও তো, ওদের অবস্থানটা দেখি। কথা শেষ না হতেই হারুন তলপেটে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করলো। তীব্র যন্ত্রণায় হারুন কুকড়ে যাচ্ছিলো। লাইট মেশিনগানের এক ঝাঁক গুলি তাকে বিদ্ধ করেছে। দুজন ছাত্র তাড়াতাড়ি হারুনকে ধরে সেতুর গোড়ায় নিয়ে এলে সে নিজেই প্রায় দৌড়ে সেতু পার হয়ে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় পড়ে যায়। তাকে একটি মাইক্রোবাসে পটয়ায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এর অল্পক্ষণ পরেই শমসেরের হাটুতে গুলি লাগলে সেও অচল হয়ে পড়ে। তখন তার প্রায় চারপাশে লড়াই চলছিলো। শমসের শত্রুদের হাতে বন্দী হয়। দুজন অফিসারকে হারিয়ে আমাদের সৈন্যদের মনোবল সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়ে। তারা ঘাঁটি ত্যাগ করে পিছনে হাটতে শুরু করে। সেদিন বিকাল নাগাদ কালুরঘাটে আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে এবং আমাদের সৈন্যরা পার্বত্য চট্রগ্রামের পথ ধরে রামগড়ের দিকে অগ্রসর হতে থাকে।

পথে মহালছড়িতে হঠাৎ পাক বাহিনীর কমান্ডো কোম্পানীর সাথে তাদের সংঘর্ষ বেঁধে যায়। পাক বাহিনীর সাথে বিচ্ছিন্নতাবাদী মিজোরাও ছিলো। পাকিস্তান সরকার এইসব মিজোদের আশ্রয় এবং ট্রেনিং দিয়ে ভারতের বিরূদ্ধে বিদ্রোহাত্মক তৎপরতায় সহায়তা করতো।

উদালিয়া চা বাগানে আমাদের যে কোম্পানী ঘাঁটি স্থাপন করেছিলো পাকিস্তানীদের তীব্র আক্রমণে তাদের সে এলাকা পরিত্যাগ করতে হয়। ওদিকে চট্রগ্রাম ঢাকা মহাসড়কের কুমিরায় তখন প্রচণ্ড লড়াই চলছিলো। চট্টগ্রামের দিকে শত্রুদের অগ্রাভিযান প্রতিরোধ করার জন্য আমাদের যে সৈন্যরা সেখানে অবস্থান গ্রহণ করেছিলো, শত্রুবাহিনী পর্যবেক্ষণ বিমানের সহায়তায় তাদের উপর প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ শুরু করে। গোলাবর্ষণে আমাদের পক্ষের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। আরো রক্তক্ষয় এড়ানোর জন্য আমাদের সৈন্যরা সীতাকুণ্ডতে সরে আসে। শত্র সৈন্যর আগমন বিলম্বিত করার উদ্দেশ্যেই সেখানে আমাদের অল্প কয়েকজন সৈন্য থেকে যায় এবং এই অবসরে বাঙালি সৈন্যরা তাদের সীতাকুণ্ড ঘাঁটি সুদৃঢ় করে গড়ে তোলে। কিন্তু ১৬ই এপ্রিলের মধ্যে শত্রুরা আমাদের সীতাকুণ্ড অবস্থানের উপর আঘাত হানে। তারা গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায় কয়েক দফা হামলা চালায়। নৌবাহিনীর কামানগুলো তখন ব্যাপকভাবে গোলাবর্ষণ করছিলো। তবুও আমাদের সেনারা পাল্টা আঘাত হেনে শত্রুপক্ষের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি করে।

বাংলাদেশের প্রতিটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে তখন লড়াই ছড়িয়ে পড়েছে। এই সময়ে কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের বৈদ্যনাথ তলায় আমবাগানে বাঙালির জীবনে এক অনন্য সাধারণ ঘটনা ঘটে যায়। দিনটি ছিলো এপ্রিলের ১৭ তারিখ। ঐদিন সকাল আনুমানিক ৮টায় জনাব তাজউদ্দিন আহমেদ, জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কর্ণেল এমএজি ওসমানী এবং অন্যান্য রাজনৈতিক নেতারা বৈদ্যনাথ তলায় এসে পৌঁছান। নেতৃবর্গের বসার জন্য পাশের গ্রামগুলো থেকে কিছুসংখ্যক চেয়ার জোগাড় করা হলো। সেসব চেয়ারের অধিকাংশের হাতল ছিলো না। বেলা এগারোটার মধ্যে অন্যান্য নেতারা পৌঁছে গেলেন। পার্শ্ববর্তী এলাকার লোকজন এবং জনা পঞ্চাশেক বিদেশী সাংবাদিকও সবুজ শ্যামলিমায় ঘেরা আম্রকাননে উপস্থিত হলেন। এদের সামনেই সেদিন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। শেখ মুজিবের নামানুসারে এ জায়গার নামকরণ করা হয় মুজিবনগর। শেখ মুজিবুর রহমানের নাম ঘোষণা করা হয় রাষ্ট্রপতি হিসেবে। সৈয়দ নজরুল ইসলাম হন উপ-রাষ্ট্রপতি এবং ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি। কারণ শেখ মুজিবুর রহমান তখন পাক সামরিক জান্তার কারাগারে বন্দী। ইপিআরের একটি প্লাটুন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে গার্ড অব অনার প্রদান করে।

এদিকে ১৮ই শত্রু বাহিনী আমাদের সীতাকুণ্ড অবস্থান ছত্রভঙ্গ করে দিলে এখান থেকে আমাদের সৈন্যদের মীরেশ্বরাইতে পশ্চাদপসরণ করতে হলো। আমরা জানতাম মীরেশ্বরাইতেও আমরা অল্প কিছুদিনের জন্য থাকতে পারবো, তারপর আবার সরে যেতে হবে। এই দুঃখজনক অবস্থা কতদিন চলবে তা কারো জানা ছিলো না। সৈন্যরাও ক্রমে আস্থা হারিয়ে ফেলছিলো। কোনো রকম অবস্থান প্রতিরক্ষায় নিজেদের যোগ্যতা সম্পর্কে নিজেরাই সন্দিহান হয়ে উঠছিলো। লোকবল ও বিপুল অস্ত্রবলের সাহায্যে শত্রুপক্ষ প্রতিটি যুদ্ধেই ইচ্ছামতো ফলাফল নির্ধারণ করে চলছিলো। এই সংকটময় দিনগুলোতে আমাদের সবচাইতে বেশী দরকার ছিলো কিছু ভালো অস্ত্রের। চিরাচরিত পন্থায় যুদ্ধ হচ্ছিলো। অস্ত্রবল বৃদ্ধি করতে না পারলে আমাদের জয়ের কোনো আশাই ছিলো না। দুর্ভাগ্যক্রমে আমাদের বাংলাদেশ বাহিনীর কলকাতাস্থ সদর দফতরটি ছিলো রণাঙ্গণ থেকে বহুদূরে। সম্ভবতঃ এই দূরত্বের কারণেই যুদ্ধের পরিস্থিতি ও আমাদের চাহিদা সম্পর্কে সদর দফতর কিছুটা উদাসীন ছিলেন। একদিকে আমাদের সামরিক দফতর থেকে বলা হতো, “যেভাবেই হোক ঘাঁটি দখলে রাখার জন্য দৃঢ় প্রতিরক্ষাব্যুহ রচনা করো।” আবার উন্নত ধরণের অস্ত্রশস্ত্র চাইলে জবাব পেতাম, ‘এটা তো গেরিলা যুদ্ধ, ভারী অস্ত্রের তেমন প্রয়োজন নেই।’ ওই জবাব গেরিলা যুদ্ধ সম্পর্কিত বই পড়া জবাব না ভারতের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় অস্ত্র সংগ্রহে সরকারের অক্ষমতা তা আমরা জানতাম না। গেরিলা যুদ্ধে উন্নত অস্ত্রশস্ত্রের প্রয়োজন নেই, এই উক্তিটি যে কত অসার তা সে সময়ে পৃথিবীর অন্যান্য যেসব দেশে গেরিলা যুদ্ধ চলছিলো সেসব যুদ্ধ পর্যালোচনা করলেই বুঝা যায়। তাছাড়া আমরা শুধু গেরিলা যুদ্ধ করছিলাম না। সাথে সাথে প্রচলিত ধারার লড়াইও আমাদের করতে হচ্ছিলো। দেশের বেশ কয়েকটি স্থানে আমাদের সৈন্যরা প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে শত্রুপক্ষের অগ্রাভিযান প্রতিরোধেরও চেষ্টা করছিলো। প্রচলিত প্রথার এই যুদ্ধের পাশাপাশি ট্রেনিংপ্রাপ্ত ছোট ছোট গেরিলা দলকেও বাংলাদেশের ভিতরে পাঠানো হচ্ছিলো।

একাত্তরের যুদ্ধের এই বৈশিষ্ট অনেকেই পরিস্কারভাবে বুঝতে পারেনি। তাই আমাদের সরকার এবং সামরিক হেডকোয়ার্টারের কাছে আমাদের সুবিধা অসুবিধা বোধগম্য হয়নি। সবচাইতে নাজুক অবস্থা ছিলো আমাদের অর্থাৎ সমরক্ষেত্রের কমান্ডারদের যারা সৈন্য ও অফিসারদেরকেও যুদ্ধের ব্যাপারটা বুঝাতে হতো। সে সময়ের একটি ঘটনার কথা বলছি। তখন আমি সৈন্য নিয়ে মীরেশ্বরাই এলাকায় শত্রুর সাথে যুদ্ধ করছিলাম। ৩ইঞ্চি মর্টার গোলার ঘাটতি ছিলো আমাদের এবং শত্রুরা তখন আমাদের প্রতিরক্ষাব্যুহের উপর কামান দেগে চলছিলো। শত্রুদের গোলায় আহত একজন সৈনিক আমাকে জিজ্ঞেস করলো, “আপনি আমাদেরকে কামানের আশ্বাস দিয়েছিলেন, কিন্তু কাফেরদের বিরুদ্ধে আমাদের কামান ব্যবহার করছেন না কেনো?” এ প্রশ্নের কোন জবাব আমি দিতে পারি নি। তবুও আমার আশা ছিলো, শেষ পর্যন্ত প্রয়োজনীয় সাহায্য আমি পাবোই। এটা আমার দুরাশা ছিলো কিনা বলতে পারি না। পর্যাপ্ত অস্ত্র শস্ত্র পাবার ইঙ্গিতের উপর ভিত্তি করেই আমি যোদ্ধাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম।

শেষ পর্যন্ত যখন অস্ত্র পাওয়া যাচ্ছিলো না এবং যোদ্ধাদের পর্যাপ্ত অস্ত্রশস্ত্র দেয়া যাচ্ছিলো না সে অবস্থায় সৈন্যদের ঘাঁটি আগলে থাকার নির্দেশ দেয়া আমাদের জন্য খুবই অস্বস্তিকর হয়ে উঠে। এতদস্বত্বেও আমি আমার বাহিনীকে দৃঢ় মনোবল নিয়ে তাদের অবস্থান রক্ষা করতে বাধ্য করছিলাম। এছাড়া আর বিকল্প পথ ছিলো না। কোনো কোনো সময় মনে হয়েছে সৈন্যদের আমরা গিনিপিগের মতো ব্যবহার করছি। ট্রেঞ্চে বসে থেকে কেউই প্রাণ হারাতে চায় না। তারা যুদ্ধের ময়দানে যুদ্ধই করতে চেয়েছিলো, কিন্তু প্রচলিত যুদ্ধের সুযোগ ক্রমেই সীমিত হয়ে আসছিল।

২০শে এপ্রিল পাক সেনাদের দুটি ব্যাটালিয়ন সর্বশক্তি দিয়ে মীরেশ্বরাইয়ের উপর হামলা চালায়। চুড়ান্ত আঘাত হানার পূর্বে প্রায় ২৪ ঘন্টাই পাক কামানগুলো আমাদের উপর আঘাত হেনে চলছিলো। মাটি খোড়ার সরঞ্জামাদি এবং অন্যান্য প্রতিরক্ষামূলক জিনিসপত্র না থাকায় তেমন শক্তিশালী বাংকারও আমরা তৈরি করতে পারিনি। অনেক সময়েই সৈন্যদের বেয়নেট দিয়ে মাটি খুড়তে দেখেছি। উপরের আচ্ছাদন তৈরীর জিনিসপত্রও ছিলো না। তাই আমাদের বাংকার ও ট্রেঞ্চগুলো কামানের গোলায় ভেঙ্গে পরছিলো। খোলা জায়গায় আমাদের আমাদের সৈন্যরা শত্রুর সহজ শিকারে পরিণত হচ্ছিলো। যা আশংকা করেছিলাম, শত্রুরা এই সময়ে এয়ার বার্ষ্ট শেল নিক্ষেপ করতে শুরু করে। আমাদের সৈন্যরা এই ধরনের হামলার সাথে পরিচিত ছিলো না। হতাহতের সংখ্যা বাড়তে থাকায় অবস্থান থেকে তারা হটতে শুরু করে। শত্রু পক্ষেও হতাহত কম হচ্ছিলো না। পরপর তিনদফা আক্রমণে ওদের শতাধিক সৈন্য হারাতে হয়। আমাদের ট্যাংক বিধ্বংসী গোলায় পাকিস্তানী সৈন্যবাহী আটটি যান প্রায় তিন ঘন্টা যাবৎ জ্বলতে থাকে। মটরযানে অবস্থানরত বেশকিছুসংখ্যক সৈন্যও জ্বলন্ত দগ্ধ হয়। সন্ধ্যার অন্ধকারে আমাদের সৈন্যরা পরবর্তী অবস্থান মস্তাননগরে প্রতিটি রক্ষাব্যুহ গড়ে তোলে। এই সময় শত্রুপক্ষের সাথে কয়েকটি ট্যাংক এসে যোগ দিলে সংঘর্ষ তীব্রতর হয়।

আমাদের সৈন্যরা মস্তাননগরে তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করার পূর্বেই সেখানে শত্রুর কামানের গোলা এসে পড়তে থাকে। বাঙালি সেনাদের তখন খাদ্য ও পানি সরবরাহ করা যাচ্ছিলো না। এমনকি গোলাগুলির যোগান দেওয়া কঠিন হয়ে উঠছিলো। তবু তারা শেষ গুলিটি নিঃশেষ না হওয়া পর্যন্ত ঘাঁটি আগলে রাখে। শত্রুরা তখন ট্যাংক সামনে নিয়ে আমাদের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলো। মস্তাননগরে অবস্থান টিকিয়ে রাখা দুস্কর হয়ে উঠলে আমি করের হাটের কয়েক মাইল দক্ষিনে হিংগুলী এলাকায় সৈন্যদের নিয়ে যেতে মনস্থ করি। এখানে পূর্ব-পশ্চিম বরাবর একটি খাল থাকায় শত্রুদের দ্রুত অগ্রগমন সম্ভব ছিলো না। অগ্রসরমান শত্রুর ট্যাংকের অগ্রযাত্রা থামাতে হলে খালের উপর প্রধান সেতুটি ধ্বংস করা দরকার।

তখন প্রায় মধ্যরাত। আমাদের সৈন্যরা সবাই ক্লান্ত, অবসন্ন। তবুও তারা হিংগুলীতে প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান গড়ে তোলে এবং পরবর্তী লড়াইয়ের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। রাতে কারো চোখে ঘুম ছিলো না। পাকিস্তানীরা সতর্কতার সঙ্গে অগ্রসর হচ্ছিলো। হিংগুলীর অদুরেই আমরা তাদের যানবাহন এবং ট্যাংকের আওয়াজ পরিস্কার শুনতে পাচ্ছিলাম। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে আমি সেতুটি ধ্বংসের কাজে হাত দিলাম। আমাকে সহায়তা করছিলো বিএসএফের মেজর প্রধান।

রাত ৭টা নাগাদ সেতুটি ধ্বংস করার সব ব্যবস্থা সম্পন্ন হলো এবং মেজর প্রধান সেই রাতেই সাব রুমের পথে রওয়ানা হয়ে গেলেন। আমি ত্রিশ সেকেন্ডের একটি ফিউজে আগুন ধরিয়ে দ্রুত নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেই। এক এক করে সেকেণ্ড অতিবাহিত হয়, তারপর মিনিট, কিন্তু বিস্ফোরণ আর ঘটলো না। আসোলে ফিউজটি খারাপ ছিলো। আমার সঙ্গে অতিরিক্ত যে ফিউজ ছিলো তাও দেখা দেখা যয় অকেজো। ভোর হতে মাত্র দুঘন্টা বাকী। এরই মধ্যে সেতু আমাদের ধ্বংস করতেই হবে। তখন আমার সামনে হিংগুলী থেকে পঁচিশ মাইল দুরের রামগড় থেকে ফিউজ নিয়ে আসা ছাড়া অন্য কোনো পথ খোলা ছিলো না। ট্যাংক এবং অন্যান্য গাড়ী ক্রমশ নিকট থেকে নিকটতর হচ্ছিলো। রাত তিনটা। আমি তখন মরিয়া হয়ে ফিউজের জন্য খবর পাঠালাম। আমাদের নিজস্ব কোনো বিস্ফোরণের মজুত ছিলো না। ফলে সম্পূর্ণভাবে বিএসএফের উপর নির্ভর করতে হতো।

রাতে আমরা দ্রুত হিংগুলী ঘাঁটিতে অবস্থান করছিলাম। ভোরে আবার তার পুনর্বিন্যাস করা দরকার হবে। ভয় ছিলো এই পুনর্বিন্যাসের আগেই না শত্রুরা এসে পড়ে। সেতু ধ্বংস করা যায়নি। ট্যাংক এসে পড়লে পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করে। ইতিমধ্যে রামগড় ফেরার পথে মেজর প্রধান খবর পান যে, সেতুটি ধ্বংস করা সম্ভব হয়নি। এই সংবাদ পেয়ে তিনি দ্রুত কয়েকটি ফিউজ নিয়ে পুনরায় হিংগুলী অবস্থানে আসেন। রাত তখন পৌনে চারটা। এসময় রামগড়ের দিক থেকে আমার দিকে অগ্রসরমান একটি জীপের আলো আমার নজরে পড়ে। মেজর প্রধান জীপ থেকে দৌড়ে এসে আমাকে একটি ফিউজ দিয়ে বলেন, এটা আশা করি কাজ করবে। না সেটাতেও কোনো কাজ হলো না। শেষ পর্যন্ত চতুর্থ ফিউজ কাজ হলো। কর্ণবিদারী বিস্ফোরণের আওয়াজ কয়েক মাইল দূর থেকেও শোনা গেলো। সেতুটি সম্পূর্ণ ধ্বংস হওয়াতে আমাদের দুশ্চিন্তার অবসান হলো। আমরা দুজনে আনন্দে বলে উঠলাম ‘চমৎকার।‘

শত্রুসৈন্যদের মূল দল তখন মাইল খানেক দূরে। এদের পিছনেই ছিলো আর্টিলারী। দিনের প্রথম আলোয় আমরা তাড়াতাড়ি ঘাঁটি পুনর্বিন্যাসের কাজে হাত দেই।

এই সংকটময় মুহুর্তে কুমিল্লা সেক্টর থেকে পাওয়া আমাদের নিয়মিত কোম্পানীকে অন্য এক যুদ্ধ ফ্রন্টে চলে যেতে হয়। আমার কাছে হিংগুলীতে তখন একশ’র বেশী লোক ছিলো না, যাদের অধিকাংশ ইপিআর পুলিশ ও মুজাহিদ। আমাদের সৈন্যদের বেশীরভাগই মহালছড়ি এবং নারায়ণহাট এলাকার সংঘর্ষে ব্যাপৃত ছিলো। আমাদের হিংগুলীর অগ্রবর্তী অঞ্চল ছিলো প্রায় তিন মাইল বিস্তৃত। এই বিস্তীর্ণ অঞ্চল রক্ষা করা অপরিহার্য। কুমিল্লা সেক্টর কোম্পানীর কাছে কিছু ভালো অস্ত্র ছিলো তা তারা নিয়ে গেছে। আমাদের ছিলো মাত্র দুটি লাইট মেশিনগান। বাকীগুলো সবই ছিলো সেকেলে ৩০৩ রাইফেল। একটি ৩” মর্টার পাওয়া গেলেও সেটি আপন খেয়ালে চলতো। আমি বুঝতে পারছিলাম, মাত্র একশ সৈন্য নিয়ে দুই ব্যাটালিয়ন শত্রুসৈন্যকে নিশ্চই বেশিক্ষণ ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। নারায়ণহাটে সৈন্য চেয়ে আমি যে খবর পাঠিয়েছিলাম তাদের আসতে অন্তত দুদিন লাগবে। এখানে আমাকে এই দুইদিন শত্রুদের ঠেকাতে হবে। শত্রুরা আমার আসোল শক্তি সম্পর্কে বিন্দুমাত্র আভাস পেলেও তৎক্ষনাৎ আক্রমণ করে বসতো। সেতুর পূর্বদিকে পাহাড়ী এলাকা পর্যন্ত প্রায় সমতল। মাঝে মধ্যে ছোট ছোট ঢিবি, টিলা। সৈন্য চলাচলে এগুলো আড়াল হিসেবে কাজে লাগছিলো। এই সমতল এলাকাটির দৈর্ঘ্য ছিলো প্রায় দুই মাইল। সেতুর পশ্চিম দিকের এলাকা একেবারে সমুদ্র উপকুল পর্যন্ত আমাদের অরক্ষিত রাখতে হচ্ছিলো। সৈন্যসংখ্যা বেশী না থাকায় আমি জনা ত্রিশের মতো লোক নিয়ে তাদের দু’ভাগে ভাগ করি। এরপর দুদলকে পূর্ব ও পশ্চিম দিকে পাঠাই। উদ্দেশ্য ছিলো তারা এমনভাবে চলাচল করবে যাতে দুর থেকে শত্রুরা বুঝতে পারে যে, দুটি অঞ্চল জুড়েই আমরা প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান গ্রহণ করেছি। পরিকল্পনা অনুযায়ী সামনে এগিয়ে গিয়ে এক জায়গায় শুয়ে পড়ে এবং এমনভাবে হামাগুড়ি দিয়ে কোনো মাঠ বা ঝোপের পিছনে চলে আসতো যাতে শত্রুরা যাতে শত্রুরা তাদের পিছনে হটে যাওয়া দেখতে না পায়। এখান থেকে উঠে আবার একটু প্রকাশ্যভাবেই আরেক যায়গায় যেতে থাকে। গোপনে পিছন দিকে এবং প্রকাশ্যে সামনের দিকে যাওয়ার এই প্রক্রিয়া বিভিন্নস্থানে বেশ কয়েকবার করে চলে। এতে শত্রুদের ধারণা জন্মায় যে এক একটি স্থানেই পঞ্চাশ ষাটজন করে বাঙালি সেনা রয়েছে। অথচ আমাদের ছিলো মাত্র পনের জনের মতো সৈন্য। বিকাল পর্যন্ত আমরা কাজটি চালিয়ে যেতে থাকি। দূর থেকে কেউ এ দৃশ্য দেখলে নির্ঘাত মনে করবে সেতুর উভয় পার্শ্বে আমাদের পনের থেকে দুই হাজার সৈন্য প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান গ্রহণ করেছে।

এই অবস্থায় আমাদের বাদবাকী সৈন্যরা সেতুর নিকট রাস্তা কভার করে সুবিধাজনক স্থানগুলোতে প্রতিরক্ষাব্যুহ গড়ে তুলতে থাকে। সন্ধ্যা নাগাদ আমাদের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়। পদ্ধতিটি কিছু সময়ের জন্য অবশ্যই কাজে লেগেছিলো। রাতে আমাদের সাড়া সম্মুখভাগ জুড়ে শত্রুর কামানের গোলাবর্ষণ শুরু হয়। দুই দিন পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে, তবুও তারা এগিয়ে এসে আক্রমণ করলো না। এদিকে আমাদের দলেও নতুন সৈন্য এসে পৌঁছায়নি। এ সময় এক নতুন বিপদ দেখা দিলো। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিপুল সংখ্যক সৈন্য এসে পড়ায় শত্রুরা রণাঙ্গণে আরো বেশী করে সৈন্য পাঠাতে লাগলো। ১২০ এম এম মর্টারসহ আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত একটি পুরো ব্যাটালিয়ন ফটিকছড়ি, নারায়ণ হাট দিয়ে হিয়াকুর দিকে এগোয়। এদের অগ্রাভিযানের ফলে হিয়াকু এবং করেরহাট হিংগুলী এলাকার মধ্যবর্তী স্থানে আমাদের সকল সৈন্য আটকা পড়ার আশংকা দেখা দেয়। এই অবস্থায় আমি নারায়ণ হাট থেকে সৈন্য পাওয়ার আশা পরিত্যাগ করি।

।। রামগড় ভস্মীভূত ।।

২৫শে এপ্রিল পাকিস্তানীদের হাতে করের হাটের পতন ঘটে। তারপর তিনদিক থেকে রামগড় অভিমুখে অগ্রসর হয়। করেরহাট রামগড় সড়কে একদল, নারায়ণহাট হিয়াকু রামগড় পথে দ্বিতীয় দল এবং মহালছড়ি রামগড় সড়ক ধরে তৃতীয় দল অগ্রসর হতে থাকে। করেরহাট থেকে রামগড় যাওয়ার পথে পাহাড়গুলো দখল করার জন্য পাকিস্তানীরা পূর্বদিকে এগুচ্ছিলো। ফেনী নদীর শুভপুর সেতুর দিকেও কিছুসংখ্যক শত্রুসেনা অগ্রসর হচ্ছিলো। পক্ষকাল পরে এই সেতুর কাছেই এক রক্তক্ষয়ী লড়াই সংঘটিত হয়।

করেরহাট এবং রামগড়ের মাঝামাঝি স্থানে ছোট বাজার হিয়াকু। শত্রুরা কিভাবে যেনো জেনেছিলো আমরা রামগড়েই চট্টগ্রাম সেক্টরের সদর দফতর স্থাপন করেছি। কথাটি আংশিক সত্য, সম্পূর্ণ নয়। এখানে আমাদের কিছু জালানী এবং খাদ্য মজুত ছিলো। আরো ছিলো আমাদের আহতদের চিকিৎসার জন্য অস্থায়ী একটি হাসপাতাল। এছাড়া ছিলো ছোট্ট একটি ট্রেনিং ক্যাম্প। এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহের পর থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের এখানে আমরা অস্ত্র ও বিস্ফোরক ব্যবহারের ট্রেনিং দিচ্ছিলাম। তবে প্রয়োজনে এখান থেকেও সবকিছু সরানোর প্রস্তুতি আমাদের ছিলো। রামগড় অবশ্য আমাদের মান সম্মানেরও প্রতীক হয়ে উঠছিলো। কারণ এটাই ছিলো আমাদের নিয়ন্ত্রণাধীন সর্বশেষ মহকুমা সদর দফতর। তাই আমরা স্থানটি প্রতিরক্ষার জন্য সম্ভাব্য সবরকম প্রস্তুতি গ্রহণ করি। এজন্য আমরা কয়েকটি সেতু ধ্বংস করে ফেলি। সীমিত সম্পদ ও শক্তির দিকে লক্ষ্য রেখে যতদূর সম্ভব ব্যাপক এলাকা জুড়ে সম্ভাব্য শত্রু হামলার স্থানগুলোতে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা গড়ে তুলি।

রণকৌশলের দিক থেকে তখন হিয়াকু এবং করেরহাটের মধ্যে আমাদের কোনো সৈন্য রাখার উপযোগিতা ছিলো না। সৈন্যদের এখানে শত্রুবেষ্টনীর মধ্যে পড়ে যাওয়ার ভয় ছিলো। তাই সকল দিকের সব সৈন্য প্রত্যাহার করে হিয়াকু এলাকায় সমাবেশ করেছিলাম।

অন্য পথে আরো পূর্বে মহালছড়িতে আমাদের সৈন্যদের উপর ইতিমধ্যে শত্রুরা হামলা চালিয়েছিলো। আমাদের বাহিনী তখন আরো সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র চেয়ে খবর পাঠাচ্ছিল। কিন্তু আমরা তাদের কিছুই দিতে পারি নি।

এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহের দিকে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার সর্বোচ্চ সামরিক কমান্ডের মতো কিছু একটা গঠন করেন। রণাঙ্গণের কমান্ডাররা কিন্তু সর্বোচ্চ সামরিক কমাণ্ড থেকে কোনো আদেশ পান নি। বস্তুতঃ অভিযান সংক্রান্ত কোনো আদেশই তাদের ছিলো না। যে কোনো মূল্যে শত্রু আক্রমণ প্রতিহত করতে হবে। আমাদের প্রতি এটাই ছিলো সেই বিমূর্ত হাই কমান্ডের একমাত্র নির্দেশ। যুদ্ধক্ষেত্রের বাস্তব চিত্রের সাথে এই আদেশের কোনো সম্পর্ক ছিলো না। শত্রুর অগ্রাভিযান কিছু সময়ের জন্য হয়তো বিলম্বিত করা যায় কিন্তু প্রাণঘাতী লড়াইয়ের ময়দানে প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র ও রসদ ছাড়া শত্রুকে দমন করার চিন্তা আকাশ কুসুম স্বপ্নমাত্র। কেউ কেউ এই যুক্তি অনুধাবন না করেই খামখেয়ালী এবং অসঙ্গত আদেশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। অচিরেই আমাদের সৈন্যরা এই অদৃশ্য কমান্ডের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলে এবং এর আসোল অস্তিত্ব সম্পর্কেই সকলের মধ্যে সন্দেহ সন্দেহ দেখা দেয়।

পাকিস্তানীরা মহালছড়ি আক্রমণ করেছিলো ২৭শে এপ্রিল। এখানে ছিলো প্রায় তিন হাজার সৈন্যের দুটি মিজো ব্রিগেড এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি নিয়মিত কমান্ডো কোম্পানী। আমাদের সৈন্যদের পাহাড়ী এলাকায় যুদ্ধের ট্রেনিং ছিল না। অস্ত্র ও রসদপত্রের অভাব ছিলো। তাই মহালছড়িতেও আমাদের বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হয়। পাকিস্তানীরা মিজোদের সামনের সারিতে পাঠিয়ে দিয়ে একটির পর একটি হামলা চালাতে থাকে। প্রতিবার প্রথমেই তাদের সে হামলা ব্যর্থ হয়ে যায়। হামলায় মিজোরা দারুনভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। পিছনে থাকা কমাণ্ডদের চাপের ফলে মিজোরা পিছনেও সরতে সরতে পারছিল না। এমনকি কমান্ডোরা অস্ত্র দিয়ে এমন ভাব দেখাচ্ছিলো যে কোনো মিজো পালাতে চেষ্টা করলেই তাকে গুলি করা হবে। যুদ্ধ গড়িয়ে চলে।

মিজোদের কয়েকটি ছোট ছোট দল কোনোক্রমে কয়েকটি টিলা পেরিয়ে পাহাড়ের উপর সুবিধাজনক স্থান দখল করে নেয়। এদের এই জায়গা থেকে আমাদের অবস্থান এবং রামগড় অভিমুখী সড়ক পরিস্কার দেখা যাচ্ছিলো।

যুদ্ধ পরিস্থিতি ক্রমেই সঙ্গীন হয়ে ওঠে। আমাদের সৈন্য সংখ্যার চেয়ে কয়েকগুন বেশি শত্রুসৈন্য বাঙালি সৈন্যদের প্রায় ঘিরে ফেলে। তরুন অফিসার ক্যাপ্টেন কাদেরকে আমরা এখানেই হারাই। প্রচণ্ড ঝুঁকি নিয়ে একটা সুবিধাজনক স্থান দখল করার জন্য সে গিয়েছিলো যাতে বাঙালি সৈন্যদের নিরাপদ পশ্চাদপসরণে সে সাহায্য করতে পারে। কাদের সফল হয়েছিলো, কিন্তু তারপরই লাইট মেশিনগানের এক ঝাক গুলিতে তার দেহ ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। বীরের মতো মৃত্যুবরণ করেছিলো ক্যাপ্টেন কাদের। এই যুদ্ধে প্রথম একজন অফিসার হারিয়ে আমাদের সৈন্যদের মনোবল ভেঙ্গে পড়েছিলো। দু’জন মাত্র শওকত ও ফারুক (পরে দুজই সেনাবাহিনীতে কমিশনপ্রাপ্ত অফিসার হয়েছিলেন) এবং সিপাই ড্রাইভার আব্বাস শত্রুদের বৃষ্টির মতো গুলির মধ্য দিয়েই ক্যাপ্টেন কাদেরের দেহ উদ্ধার করে আনে। রামগড়ে আমরা যথাযোগ্য ধর্মীয় ও সামরিক মর্যাদায় কাদেরের মৃতদেহ দাফন করি।

এপ্রিলের ২৯ তারিখে হিয়াকুর কাছে যুদ্ধ শুরু হয়। আমাদের অবস্থান স্থলের সামনের জায়গাটি ছিলো খোলা কিন্তু দু’পাশে ছোট ছোট টিলার উপর ঘন জঙ্গল। এই জঙ্গলের আড়াল দিয়ে শত্রুরা আমাদের পিছনে চলে আসতে পারতো। সে পরিস্থিতিতে সরবরাহ ঘাঁটি রামগড় থেকে আমাদেরকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে হতো। আমাদের কাছে তখন রান্না করার মতো কিছু ছিলো না। অধিকাংশ খাবারই আসতো রামগড় থেকে। দিনটি ছিলো পরিস্কার। ভোর থেকেই আমাদের অবস্থানের উপর মর্টার শেলিংয়ের মাধ্যমে কয়েক দফা হামলা হয়। বোমাবর্ষণের ছত্রছায়ায় আমাদের দিকে অগ্রসরমান শত্রুর অগ্রভাগে ছিলো প্রায় দুইশত স্থানীয় দালাল। খোলা মাঠ দিয়ে দুই কোম্পানী পাকসেনা এগিয়ে আসছিলো। ওরা একশ গজের মধ্যে আসতেই আমাদের অস্ত্রগুলো গর্জে উঠলো। এই আকস্মিক হামলায় মুহুর্তের মধ্যে ওরা ভয় ও আতংকে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়লো। দীর্ঘ দুই ঘন্টা অবিরাম লড়াইয়ে আমাদের কয়েকজন হতাহত হবার পর অবশেষে আমাদের সৈন্যদেরকে চিকনছড়ার দিকে পশ্চাদপসরণ করার নির্দেশ দেয়া হলো।

হিয়াকুর পতনের পর রামগড়ের পতন অবসম্ভাবী হয়ে উঠলো। সবচাইতে বিপজ্জনক ব্যাপার ছিলো শত্রুরা আমাদের অসামরিক ব্যাক্তিদের বিশেষ করে বড় বড় শরণার্থী দলের ভারত গমনের পথ প্রায় বন্ধ করে দিয়েছিলো। সে সময়ে প্রতিদিন হাজার হাজার লোক ধূলিময় রাস্তা ধরে নারায়ণহাট থেকে হিয়াকুর এবং তারপর রামগড় হয়ে ফেনী নদী পেরিয়ে সাবরুমে আশ্রয় নিচ্ছিলো। কিন্তু হিয়াকুর পতনের পর সে পথ বন্ধ হয়ে গেলো।

করেরহাটের পতনের পর বুঝতে পারি বর্তমান ধারায় যুদ্ধ করে আমরা কিছুই করতে পারবো না। আমরা আমাদের বাহিনীকে সুসংগঠিত করে তুলতে পারছিলাম না। এই বাহিনীতে ছিলো বিভিন্ন ধরণের লোক। ইপিআর, পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ, সামরিক বাহিনীর লোক এবং মাত্র সপ্তাহ খানেক ট্রেনিং দেওয়ার পর রণাঙ্গণে নামিয়ে দেয়া নতুন মুক্তিযোদ্ধা। এইসব দলের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ ও শৃঙ্খলার অভাব ছিলো আমাদের বিপর্যয়ের একটি কারণ। আমাদের সকল সৈন্যদের একটা নিরাপদ শিবিরে নিয়ে তাদের জন্য বিশ্রাম ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন হয়ে পড়েছিলো। তাহলে তাদেরকে নিয়েই আবার একটা সংঘবদ্ধ ও সুসংগঠিত বাহিনী গড়ে তোলা যেতো। আমাদের অধিকাংশ সৈন্যকেই ইতিমধ্য অপুষ্টিরও শিকার হয়ে পড়তে হয়েছিলো।

সেই উদ্দেশ্যে ভারতীয় সীমানায় ছয় মাইল ভিতরে হরিনায় একটা গোপন শিবির স্থাপন করা হয়। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ থেকে কয়েকটি তাবু পেয়েছিলাম। রামগড় থেকে কিছু কিছু জিনিস এখানে নিয়ে আসা হলো। শিবিরের জন্য যে হাসপাতালের ব্যবস্থা করেছিলাম, যুদ্ধে আহতদের সেখানে আনা হয়। এরপর যুদ্ধ থেকে একটু অবকাশ পেয়েই নতুনভাবে আমাদের বাহিনী সংগঠনের কাজ পুরোদমে শুরু হয়।

মুজিবনগরে গঠিত অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার তখন অন্যান্য দেশের স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টা করছিলেন। কাজটি ছিলো খুবই দুঃসাধ্য। বাংলাদেশ বাহিনী একটা উল্লেখযোগ্য পরিমান এলাকায় তাদের দখল প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে কেউ আমাদের সরকারকে স্বীকৃতি দিবে না। যুদ্ধের প্রাথমিক অবস্থায় বাংলাদেশের যে কোনো একটি অঞ্চলে যতদূর সম্ভব সৈন্যদের জড়ো করে সেই এলাকা প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করা যেতো। সময় নষ্ট না করে সেই সময়ই এই সিদ্ধান্ত নেয়া উচিৎ ছিলো। কিন্তু দেখা গেছে কর্তৃপক্ষ সকল ফ্রন্টেই যুদ্ধ করতে আগ্রহী এবং যুদ্ধ করে জয়ী হতেও চাইছিলেন। আমাদের সৈন্যসংখ্যা এবং তাদের পরিমানের প্রেক্ষিতে রণকৌশলগত দিক থেকে এ ব্যবস্থা ছিলো অবাস্তব। সব জায়গায় যুদ্ধ করার দরুন সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। সুষ্ঠু যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবে আমাদের সেনাদের বিচ্ছিন্ন এবং স্থানীয়ভাবে লড়ে যেতে হয় এবং এই লড়ে যাওয়া অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ছিলো লক্ষ্যহীন। তাই একটির পর একটি এলাকা এলাকা আমাদের হাতছাড়া হয়ে যেতে থাকে।

৩০শে এপ্রিল মহালছড়ির সৈন্যরা রামগড় এসে পৌঁছে। এখান থেকে সকালে ছোট ছোট দলে হরিনা শিবিরের দিকে অগ্রসর হয়। ওদের আসার আগে কর্তৃপক্ষ আমাদেরকে রামগড় ছেড়ে যেতে প্রস্তুত থাকার আদেশ দিয়েছিলেন। এই আদেশে বোঝা গিয়েছিলো, হাই কমাণ্ড আমাদের প্রয়োজনীয় চাহিদা মিটাতে অসমর্থ। তখন সাহায্য ব্যতিরেকে মাত্র তিনদিনের বেশী যুদ্ধ করার সামর্থ্য আমাদের ছিল না। কিন্তু অবাক কাণ্ড, ৩০শে এপ্রিল রাতেই আরেকটি নতুন আদেশ পেলাম। বাংলাদেশ সরকারের জন্য রামগড় রক্ষা কর। ইতিমধ্যে চিকনছড়া থেকে আমরা সৈন্য সরিয়ে এনেছি। হরিণায় আমাদের নিরাপদ পশ্চাদপসরণের জন্য রামগড়ের বাইরে কিছু সৈন্য রেখেছি। যাতে শত্রুর অগ্রাভিযান কিছু সময়ের জন্য তারা বিলম্বিত করতে পারে। আমাদের সৈন্যদের অর্ধেক তখন হরিণার রাস্তায়।

অবশ্য সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নির্দেশ পাওয়ার পর রামগড় প্রতিরক্ষার জন্য উপস্থিত যাদেরকে পেলাম সবাইকে জড়ো করা হলো। পাকিস্তানী সৈন্য যাতে ভারতীয় ভূখন্ডে ঢুকে না পড়ে তা প্রতিহত করার জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি দলও সাবরুমে চলে আসে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর এই পদক্ষেপে কিছুটা ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছিলো। গুজব রটেছিলো যে, রামগড় প্রতিরক্ষায় ভারতীয় সৈন্যরাও অংশ নিতে পারে। কিন্তু সে রকম কিছুই ঘটে নি।

১লা মে থেকে শত্রুরা রামগড়ের আশেপাশের এলাকার উপর গোলাবর্ষণ শুরু করে। একটি দল মূল সড়ক ধরে অগ্রসর হচ্ছিলো। অন্য একটি দল রামগড়ের পূর্ব-দক্ষিণে পাহাড়ের দিকে এগোতে থাকে। এই পাহাড় এবং রামগড়ের মধ্যে কিছুটা জায়গা একেবারে খোলা এবং সমতল। পহেলা মে দিবাগত রাতে এই পাহাড়ে গোপনে শত্রু সমাবেশ ঘটেছিলো।

২রা মে সকালে পাকিস্তানীরা মরিয়া হয়ে রামগড়ের উপর আক্রমণ শুরু করে। কামানের প্রচণ্ড গোলার ছত্রছায়ায় তারা সড়কপথে আমাদের প্রথম প্রতিরক্ষাব্যূহ ভেঙ্গে দেয়। শেলের আঘাতে আমাদের বাংকারগুলো ভেঙ্গে পড়তে থাকে। এদিকে সেই পাহাড় এবং রামগড়ের মধ্যবর্তী স্থানটিতে ধোঁয়ার জাল সৃষ্টি করা হয়। এই ধোঁয়ার আড়ালে শত্রুদের দ্বিতীয় দলটি রামগড়ের মধ্যভাগের দিকে অগ্রসর হয়। সন্ধ্যার ঘন্টাখানেক আগে শত্রুরা শহরটির মধ্যাঞ্চলের উপর চুড়ান্ত আক্রমণ চালায়। এতে আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে। এরপর এক ঘন্টারও বেশী সময় আমাদের সৈন্যরা শত্রুর উপর গুলিবর্ষণ অব্যাহত রাখে এবং পরিশেষে গুলি ফুরিয়ে গেলে তারা অন্ধকারের আড়ালে পশ্চাদপসরণ করে।

ওদিকে সাবরুমের সকল বেসামরিক বাসিন্দাকে ইতিপূর্বে আরো অভ্যন্তরে নিরাপদ স্থানে অপসারণ করা হয়েছিলো। সারা তল্লাট জুড়ে বুলেট ছুটছিলো। ভারতীয় এলাকার বাড়িঘর এবং গাছপালায় গিয়ে গুলি লাগছিলো। ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং সীমান্ত রক্ষীবাহিনীও (বিএসএফ) ইতিমধ্যে যার যার ট্রেঞ্চের ভিতরে অবস্থান গ্রহণ করেছিলো। তবে তারা সবকিছু অবলোকন করছিলো মাত্র।

এ সময় শত্রুর একটি অয়্যারলেস বার্তা আমরা শুনতে পাই। ওতে বলছিলো, “রামগড়ের বিদ্রোহী হেডকোয়ার্টার দখল করেছি।”

২রা মে রাতে শত্রুরা রামগড়ের ঘরবাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। সমগ্র বাজার এলাকা জ্বলে উঠে। ঊর্ধ্বমূখী ধোঁয়ার কুণ্ডলী আর অগ্নিবলয়ের ভিতর দিয়ে দুরে তখন পাহাড় শ্রেণীর অস্পষ্ট রেখা চোখে পড়ছিলো সেখানেই আমাদের স্বপ্নের সেই দেশ যার জন্য আমরা যুদ্ধ করে চলেছি, অবিরাম যুদ্ধ চালিয়ে যাবো। কিন্তু কতদিন এ যুদ্ধ চলবে তা আমরা কেউ জানতাম না।

।। শুভপুর সেতুর যুদ্ধ ।।

 

রামগড় হারানোর বিপর্যয়ে আমাদের তখন মনমরা অবস্থা। হরিণায় বিকল্প সদর দফতর স্থাপন করতে পারলেও ভারতের আশ্রয়ে থেকে শত্রুর বিরূদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে এটা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলাম না। রামগড়ে আমাদের একটা সান্তনা ছিলো যে, সেটা আমাদের নিজের দেশ। সেখানকার সব কিছুই আমাদের। কিন্তু হরিণা ভারতীয় এলাকা। দুইয়ের মধ্যে বিরাট পার্থক্য। আমাদের সব স্বপ্ন বুঝি ভেঙ্গে গেলো। আমাদের কেউ কেউ শিশুর মতো কেঁদেছিলো। মানসিক আঘাতে পাথর হয়ে যাওয়া অনেককে দেখছিলাম একটা ঘোরের মধ্যে পা দুটি যেনো টেনে নিয়ে হরিণার দিকে চলছে। কাঁধে ঝুলছে পুরোনো দিনের হাতিয়ার এবং গুলিশূণ্য থলে।

এরপর প্রধান সড়কে শুভপুর সেতুর কাছে মারাত্মক লড়াই আসন্ন হয়ে উঠে। ভারতীয় বিএসএফ বাহিনীর সহযোগীতায় সেতুর একটি অংশ আমরা এর আগে ধ্বংস করে দিয়েছিলাম। এখানে আমাদের দলে লোকসংখ্যা ছিলো মাত্র একশ’র মতো। এদের অধিকাংশই ছিলো আবার সাত দিনের ট্রেনিং প্রাপ্ত বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধা। সেতু প্রতিরক্ষার দায়িত্ব পড়েছিলো ইপিআর সুবেদার ফখরুদ্দিনের উপর। আমাদের লক্ষ্য ছিলো শত্রুরা যাতে এই গুরুত্বপূর্ণ সেতু ব্যবহারের সুযোগ না পায় এবং ঢাকা ও কুমিল্লার সাথে সংযোগ স্থাপন করতে না পারে।

করেরহাটের পতনের পর সেতুর উত্তরদিক থেকে আমরা সৈন্য প্রত্যাহার করে সেতুর দক্ষিণ দিকে আমাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করি। আমরা জানতাম সেতুটি দখল করার জন্য শত্রুরা মরিয়া হয়ে উঠবে। করেরহাটে তারা কামান মোতায়েন করেছিলো। কয়েকটি ট্যাংকও নদীর পার পর্যন্ত চলে এসেছিলো। দূর থেকে শত্রুপক্ষের কামানের গোলা এসে আমাদের উপর পড়ছিলো। ট্যাংকগুলো অগ্রসর হয়ে আমাদের একটির পর একটি বাংকার ধ্বংস করে চলছিলো। আমাদের ট্যাংক বিধ্বংসী কয়েকটি ছোট হাতিয়ার থাকলেও তখন কোনো শেল আমাদের কাছে ছিল না।

ট্যাংক ও কামানের প্রচণ্ড গোলাবর্ষণের ছত্রছায়ায় পাকিস্তানীরা কয়েকবারই নদী পার হওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে। দুবার তাদের সৈন্যরা নদীপথে মাঝামাঝি পর্যন্ত এসে দু’দিকের গোলাগুলির মাঝখানে পড়ে যায়। পরিস্কার দিনের আলোয় তাদেরকে দেখে দেখে আমরা গুলিবিদ্ধ করতে থাকি। অনেকটা যেনো বেশ আরামের সাথে টার্গেট প্র্যাকটিস করার মতো। এভাবে দুই কোম্পানীরও বেশী সৈন্য আমরা নির্মূল করি। তাদের লাশগুলো নদী দিয়ে ভাসতে ভাসতে সাগরের দিকে চলে যায়। এভাবে সৈন্যক্ষয়ের পর শত্রুরা নদী পার হয়ে সেতু দখলের চেষ্টা ত্যাগ করে।

ওদিকে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে আগত পাকসেনাদের নিকট ফেনী শহরের পতন ঘটে। ১১ই মে’র মধ্যেই তারা শুভপুর সেতুর কাছে এসে পড়ে।

পাকিস্তানীদের এই কলামে শত্রুদের আনুমানিক দুটি ব্যাটালিয়ন ছিলো। পক্ষান্তরে সেতুর কাছে একশ’রও কমসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা তখন চুড়ান্ত লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত। পরের দিন শুরু হয় যুদ্ধ।

১২ই মে সকাল থেকে করেরহাটের কমাণ্ডগুলো আমাদের উপর গোলাবর্ষণ শুরু করে। অপরদিকে নদীর পাড়ে শত্রু ট্যাংকগুলোকেও দেখা যায়। পাকিস্তানীরা আমাদের অবস্থানের উত্তর ও পশ্চিম দিকে ধূম্রজালের সৃষ্টি করে। সকাল ১১ টায় পশ্চিম দিকের সেই ধোঁয়ার আড়াল থেকে বেরিয়ে দুটি কোম্পানী প্রথম হামলা শুরু করে। কিন্তু বেশ ক্ষতি স্বীকার করে তাদেরকে পিছু হটতে হয়। তারপর কিছু সময় সব চুপচাপ। বেলা তিনটার দিকে প্রচণ্ড গোলা বর্ষণের সঙ্গে সঙ্গে তারা আবার হামলা শুরু করে। দুটি শত্রু ব্যাটালিয়নকে হামলায় অংশ নিতে দেখা যায়। দিনের বাকী সময়টুকু আমাদের সেনাদেরকেও প্রচণ্ডতম গোলাবর্ষণের মোকাবিলা করতে হয়। প্রায় অর্ধেক মুক্তিযোদ্ধাই তখন শেলের আঘাতে আহত। সরাসরি আঘাতে বাংকারগুলো ধসে পড়লে অনেকেরই জীবন্ত সমাধি ঘটে। আমরা হতাহতদের সরাতে পর্যন্ত পারছিলাম না। নতুন সৈন্যও যোগ হচ্ছিলো না। দীর্ঘ সময় পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধারা খাদ্য কিংবা পানির মুখ দেখেনি। বেলা পাঁচটার দিকে কামানের গোলাবর্ষণ বন্ধ হয়। শত্রুরা তখন আমাদের অবস্থান থেকে আনুমানিক ৩০০ গজ দূরে। শুধু একটি মেশিনগান এবং দুটি লাইট মেশিনগান দিয়ে আমরা এদের মোকাবিলা করছিলাম। ট্যাংকের আঘাতে অস্ত্রগুলো ধ্বংস হওয়ার পূর্বক্ষণ পর্যন্ত সেগুলো সেগুলো সমানে শত্রু নিধন করে চলে। এরপর আমাদের সৈন্যরা শুধু ৩০৩ রাইফেল দিয়ে গুলি চালাতে থাকে। অচিরেই হাতাহাতি যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। পাকিস্তানীদের তুলনায় আমরা সংখ্যায় ছিলাম খুবই কম। আমাদের যেসব সেনা ভারতীয় সীমান্তের কাছাকাছি অবস্থানে ছিলো তারা শেষ পর্যন্ত পশ্চাদপসরণ করতে পেরেছিলো। এদের অধিকাংশই ছিলো গুরুতর আহত। তারপরেও মনোবল ভেঙ্গে পড়ে নি।

তখন সন্ধ্যা হয় হয়। শুভপুর সেতুর অদুরে ভারতের শ্রীনগর সীমান্ত ফাড়ি। এখান থেকে একটি কাঁচা রাস্তা পাহাড়ের ভিতর দিয়ে আগরতলা অভিমুখী প্রধান সড়কে গিয়ে মিশেছে। এই সন্ধ্যায় রাস্তাটিতে অন্য কোনো লোক ছিল না। শুধু রণাঙ্গণ ফেরত কিছু লোক নিঃশব্দে হেটে চলছিলো। এদের মধ্যে কেউ কেউ হাটছিলো লাঠিতে ভর দিয়ে। কয়েকজনকে আবার সহযোদ্ধারা ধরে নিয়ে যাচ্ছিলো। পথে আমাদের একজন অফিসারের সাথে তাদের দেখা হলে জনৈক মুক্তিযোদ্ধা তার বাম হাত তুলে সামরিক কায়দায় অভিবাদন জানায়। তার ঝুলন্ত ডান হাত থেকে রক্ত ঝরছিলো। শেলের বিচ্ছুরিত টুকরায় হাত প্রায় দুভাগ হয়ে গিয়েছিলো। শুধু কুঁকড়ে যাচ্ছিলো। তবু সে মুখে একটু হাসির ভাব ফুটিয়ে অফিসারকে “জয় বাংলা” বলে শুভেচ্ছা জানায়। তারপর সে অন্যদের সাথে সামনে অন্ধকারের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যায়।

————————————————

<৯, ২.৮, ৮৮-৯৫>

চট্টগ্রামের প্রতিরোধ যুদ্ধঃ
সাক্ষাৎকারঃ লেঃ জেনারেল (অবঃ) মীর শওকত আলী বীর উত্তম

(১৯৭১ সালের মার্চের মেজর পদে কর্মরত ছিলেন। সাক্ষাৎকারটি শামসুল হুদা চৌধুরী রচিত ‘একাত্তরের রণাঙ্গন’ গ্রন্থ থেকে সংকলিত)

প্রঃ কখন কিভাবে আপনি একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিলেন?

উঃ ১৯৭১ সালের জানুয়ারী মাসে কোয়েটা স্টাফ কলেজ থেকে আমাকে চট্টগ্রামের ষোলশহরে ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্টে পোস্টিং দিয়ে পাঠানো হয়। মার্চ ৭১ এর প্রথম ভাগে আমি ছুটিতে ছিলাম। ১৫ই মার্চ এর দিকে যখন অসহযোগ আন্দোলন খুব জোরদার হচ্ছিল এবং ইতিপূর্বে ৭ই মার্চ ৭১ এ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ভাষণ দিলেন, তখন থেকেই আমরা বাঙালি সৈন্যরা চিন্তা করছিলাম যে একটা গণ্ডগোল বাধাবে এবং দেশের স্বাধীনতার জন্য আমাদের সবাইকে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। চট্টগ্রামের ষোলশহরে ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডার ছিলেন তখন কর্ণেল জানজুয়া। মেজর জিয়াউর রহমান (পরবর্তীকালে লেঃ জেনারেল এবং মহামান্য রাষ্ট্রপতি ছিলেন এই ব্যাটালিয়ানের সেকেণ্ড ইন কমাণ্ড। জেনারেল জিয়া এবং আমি ছাড়াও ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্টে আরো কয়েকজন বাঙালি অফিসার ছিলেন। ১৫ই মার্চ’ ৭১ এর দিকে আমি এই ব্যাটালিয়ানে যোগদান করি। ২৫শে মার্চ’ ৭১ রাতে যখন হত্যাকাণ্ড শুরু হয়, তখন স্বভাবতই আমি বাঙালি হিসেবে আমার যা কর্তব্য সেটাই করেছি। এতে জড়িয়ে পড়ার মত কিছুই নেই। একটা কর্তব্য ছিল। সমস্ত বাঙালি সৈন্যরই কর্তব্য ছিল এটা। সবাই এতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। কিছু কিছু সৈন্য হয়তো সুযোগ পান নি কিংবা কিছু সংখ্যক সৈন্য আগেই ধরা পড়ে গিয়েছিলেন। আমাদের যেহেতু বাঙালি ব্যাটালিয়ান ছিল সেই জন্য আমরা ধরা পড়ি নি।আমরা আমাদের কর্তব্য করেছি মাত্র। ২৫শে মার্চ, ’৭১ রাতে যখন জেনারেল জিয়াকে চট্টগ্রাম বন্দরের দিকে পাঠানো হলো মূলত সেই সময় থেকেই স্বাধীনতা যুদ্ধ আমাদের পক্ষ থেকে শুরু হয়।

উক্ত দূর্যোগের রাত প্রায় ১১-৩০ মিনিট সময়ে আমরা টেলিফোনে জানতে পারলাম যে ঢাকায় হত্যাকাণ্ড শুরু হয়ে গিয়েছে। স্বভাবতঃই আমরা ধরে নিলাম ঢাকায় যখন হত্যাকাণ্ড শুরু হয়েছে, নিশ্চয় এটা সারা বাংলাদেশব্যাপী শুরু হয়ে গিয়েছে। কারণ সেনাবাহিনী তো মাত্র এক জায়গায় তাদের পরিকল্পনা কার্যকর করেনা; এ জাতীয় পরিকল্পনা সব জায়গাতেই একই সময়ে কার্যকর করাই স্বাভাবিক। আমাদের কর্তব্য আমরা আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম। কারণ ২৫শে মার্চের আগে থেকেই আন্দোলন যে রুপ নিচ্ছিল, সে সবে যখনই আমাদের নিযুক্ত করা হতো ব্যারিকেড সরানোর জন্য কিংবা জনগণকে হটানোর জন্য, তখন আমরা তাদের বিরুদ্ধে কাজ কখনো ঠিকমতো করতাম না। কার্যত আমরা সেই চূড়ান্ত অসহযোগের সময় থেকেই আন্দোলনের প্রতি আমাদের সমর্থন জানাতে শুরু করি। কাজেই ২৫শে মার্চ ৭১ রাতে যখন হানাদার বাহিনী বাঙালি হত্যাকান্ডে ঝাঁপিয়ে পড়ল, তখন আমাদেরও তাৎক্ষণকভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া বাদে অন্য কোনও বিকল্প ছিল না।

বাঙালি হত্যাকাণ্ড শুরু হওয়ার খবর দিয়ে সম্ভবত আমাদের কাছে প্রথম টেলিফোন করেছিলেন চট্টগ্রামের হান্নান ভাই (চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি)। সম্ভবত তিনিই চট্টগ্রামে সবাইকে জানিয়ে দিয়েছিলেন।

আগেই বলেছি, জেনারেল জিয়া এবং আমি একই ব্যাটালিয়নে ছিলাম। তিনি যেহেতু আমার চাইতে সিনিয়র ছিলেন, সেহেতু তিনিই আমাদের কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। আমি তার দুনম্বর হিসেবে কাজ করেছি। স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা পর্যায়ে আমরা যে একই ব্যাটালিয়নে ছিলাম, এটা অনেকেই হয়তো জানেন না। বেশীরভাগ জনসাধারণের ধারণা আমরা আলাদা ছিলাম। আমরা একই সঙ্গে ছিলাম এবং একই সঙ্গেই বিদ্রোহ করেছিলাম। জেনারেল জিয়াউর রহমানও তার বিবৃতিতে উল্লেখ করেছেনঃ “আমি বিদ্রোহ করে পোর্ট থেকে ফিরে এসেই শওকতের কাছে এলাম, এবং শওকত আমার সাথে হাত মিলালো।”

প্রঃ এই যে দুঃসাহসিক কাজ আপনারা করলেন, এর পিছনে অন্যান্য ক্যান্টনমেন্টের বাঙালি সৈন্যদেরও পূর্ণ সমর্থন ছিল এবং তারাও আপনাদের মত এগিয়ে আসছিলেন, এটা আপনারা বুঝেছিলেন কি?

উঃ এটা আমি বলতে পারবো না। কারণ রাজনীতিতে আমি কখনো জড়াতাম না। কিন্তু এটা রাজনীতি ছিল না। এটা ছিল স্বাধীনতা যুদ্ধ। এতে জাতির জীবন-মরণের প্রশ্ন জড়িতে হয়ে পড়েছিলো। তাছাড়া অন্যান্য সেক্টর থেকে বাঙালি সৈন্যরা এগুচ্ছিলেন কি না সে তথ্য আমাদের জানার উপায় ছিল না। সে তথ্য জানা না জানার গুরুত্ব দেয়ার সময়ও তখন আমাদের ছিল না। এমনকি তখন আমার বাবা মা ছিলেন আমার স্ত্রী এবং ছেলেমেয়েকে নিয়ে কুমিল্লায়। তাদের নিরাপত্তা সম্পর্কে চিন্তা করার অবকাশও তখন আমাদের ছিল না। কাজেই তাৎক্ষনিকভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে আমরা আমাদের কর্তব্য করেছি মাত্র। অবশ্য আমরা ভেবেছি অন্য সবাইও হয়তো আমাদের মত এগিয়ে আসছিলেন। শুধু ক্যান্টনমেন্টেই নয়, আমরা মনে করেছি সমস্ত বাঙালিই এই যুদ্ধে ছিলেন। কারণ এটা ছিল বাঙালি জাতির প্রশ্ন, বাঙালি জাতির অস্তিত্বের প্রশ্ন।

প্রঃ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা বেতারে কখন প্রচারিত হয়েছে বলে আপনি বলতে চান?

উঃ এটা একটি বিতর্কিত প্রশ্ন। বেতারে স্বাধীনতা ঘোষণা যেটা নিয়ে সব সময় বিতর্ক চলতে থাকে যে জেনারেল জিয়া করেছেন, না আওয়ামী লীগ করেছেন। আমার জানামতে সবচাইতে প্রথম বোধ হয় চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে হান্নান ভাইয়ের কণ্ঠ থেকেই লোকে প্রথম শুনেছিলেন। এটা ২৬শে মার্চ’ ৭১ অপরাহ্ন দু’টার দিকে হতে পারে। কিন্তু যেহেতু চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রের প্রেরক যন্ত্র খুব কম শক্তিসম্পন্ন ছিল, সেহেতু পুরা দেশবাসী সে কণ্ঠ শুনতে পান নি। কাজেই যদি বলা হয়, প্রথম বেতারে কার বিদ্রোহী কণ্ঠে স্বাধীনতার কথা উচ্চারিত হয়েছিল, তাহলে আমি বলব যে, চট্টগ্রামের হান্নান ভাই সেই বিদ্রোহী কণ্ঠ। তবে এটা সত্য যে পরদিন অর্থাৎ ২৭শে মার্চ ৭১ মেজর জিয়ার ঘোষণা প্রচারের পরই স্বাধীনতা যুদ্ধ গুরুত্বপূর্ণ মোড় নেয়।

প্রঃ ২৭শে মার্চ ৭১ মেজর জিয়াউর রহমান কি পরিস্থিতিতে কালুরঘাট ট্রানসমিটারে সংগঠিত বিপ্লবী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে গেলেন এবং স্বাধীনতা ঘোষণা পাঠ করলেন?

উঃ ২৫শে মার্চ রাতে ঢাকায় হত্যাকান্ডের খবর পাওয়ার পরই আমরা চট্টগ্রামে আমাদের অধীনস্থ সমস্ত ব্যাটালিয়নকে হাতে নিয়েছিলাম। আমরা ভেবে দেখলাম যে, নতুন পাড়া ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তান বাহিনী নিয়ন্ত্রিত ট্যাংক ছিল। আমরা ছিলাম ষোলশহরে মাত্র দু’মাইল দূরত্বে। আমরা দেখলাম, আমাদের হাতে কোন ও ট্যাংক ছিল না। এবং কোন অস্ত্রশস্ত্র ও আমাদের অর্থাৎ ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্টের হাতে ছিল না। ইতি পূর্বেই ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট পাকিস্তান চলে যাবে বলে অধিকাংশ অস্ত্রই পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। আমাদের হাতে শুধু ছিল কিছু রাইফেল এবং এল এম জি ধরনের স্বল্প সংখ্যক অস্ত্র। ভারী কোন ও অস্ত্র ছিল না। আমার সাথেই জেনারেল জিয়া আলাপ করলেন। আমরা আলাপ করে দেখলাম যে আমরা যদি ষোলশহর বিল্ডিং এর ভিতর অবস্থান করি এবং এই অবস্থায় যদি ট্যাংক আসে, তাহলে আমরা ট্যাংক ঠেকাতে পারব না। কারণ ট্যাংক ঠেকানোর মত কোন অস্ত্র ই আমাদের হাতে ছিল না। ট্যাংক থেকে দু তিনটা গোলা ছুড়লেই আমাদের অনেক সৈন্য মারা যাবে। তখন আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যে, আমাদের ঐ এলাকা থেকে বাইরে চলে যাওয়া উচিত এবং নিরাপদ দূরত্বে থেকে হেডকোয়ার্টার বেস বানানো উচিত। এ ছাড়া আমাদের অধীনস্থ জোয়ানদের শপথ নেয়া উচিত। শপথ নিয়ে পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়ে তারপর যুদ্ধে যাওয়া উচিত। আমরা সোজা প্রথমে গেলাম কালুরঘাট। সেখানে ভোররাতের দিকে আমরা মার্চ করে গেলাম। তখন খুব কুয়াশা ছিলো এবং আল্লাহর কি ইচ্ছা সেদিন অর্থাৎ ২৬শে মার্চ’ ৭১ এর সকাল ৮টা কি ৯টা পর্যন্ত কুয়াশা ছিল। কালুরঘাটে পৌঁছে আমরা সবাই কনফারেন্স করলাম। এতে কিছু বিডিআর অফিসার এবং জোয়ানও ছিলেন। এই কনফারেনসে সিদ্ধান্ত নেয়া হল যে, আমরা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে চট্টগ্রাম রক্ষার জন্যে পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণ চালাব। আমাদের আক্রমণের মূল লক্ষবস্তু ছিল পোর্ট এবং ক্যান্টনমেন্ট। এই সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় আওয়ামী লীগের কিছু নেতৃবৃন্দ আমাদের সাথে এসে যোগ দিয়েছিলেন। এই তো গেল ২৬শে মার্চ ‘৭১ এর কথা। ঐদিন আমরা খোজখবর নিয়েছিলাম কোথায় কি ঘটেছিলো। আমি একখানা জীপ নিয়ে পুরা শহর ঘুরে দেখলাম। আমি টহল দেয়ার সময় আগ্রাবাদের মোড়ে আমার জীপের ওপর একটি এল.এম.জি বার্স্ট ফায়ার এলো। আমি কোনও প্রকারে জীপ ঘুরিয়ে ফেরত গেলাম এবং জেনারেল জিয়াকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর অবস্থান সম্পর্কে অবহিত করলাম এবং সেভাবে আমাদের দলকে নিয়োজিত করলাম।

২৭শে মার্চ’ ৭১ মনে হয় জেনারেল জিয়া বুঝতে শুরু করলেন যে বেতারে একটা ঘোষণা প্রচার করা দরকার। ঐ তারিখেই সন্ধ্যায় কালুরঘাট ট্রানসমিটার থেকে এটা করলেন তিনি। বেশ কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতাও ঐ সময় খুব তৎপর হয়ে উঠেছিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন প্রফেসর নুরুল ইসলাম, আতাউর রহমান খান কায়সার, হান্নান ভাই এবং এম আর সিদ্দিকী। তারাও সম্ভবতঃ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে কিছু প্রচারিত হওয়া উচিত। অপরদিকে জেনারেল জিয়া কি বলবেন তার একটি খসড়াও প্রস্তুত করে নিলেন। ২৭শে মার্চ ৭১ সন্ধ্যার পর চট্টগ্রামের কালুরঘাট ট্রান্সমিটার থেকে প্রচারিত হল জেনারেল জিয়ার (তৎকালীন মেজর) ভাষণ।

প্রঃ আপনার কমান্ডে সবচাইতে ভয়াবহ যুদ্ধ কোথায় এবং কখন সংঘঠিত হয়েছিল?

উঃ প্রথম ভয়াবহ যুদ্ধ হয়েছিল কালুরঘাটে ১১ই এপ্রিল’ ৭১। ঐ সময় জেনারেল জিয়া আমার সাথে ছিলেন না। তিনি ৩০শে মার্চ’ ৭১ এর পর ই রামগড় চলে গিয়েছিলেন।

এই যুদ্ধ পরিচালনা আমার কমান্ডে হয়। সৈন্য ছিলেন অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেন্ট বি ডি আর এবং স্থানীয় কিছু স্বেচ্ছাসেবী যেমন ছাত্র, শ্রমিক এবং অন্যান্য যারা অস্ত্র সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন এমন কিছু লোকজন। আমার পক্ষে ছিল পাকিস্তান বাহিনীর দুটি ব্রিগেড।এ ছাড়া কর্ণফুলীতে তাদের যে নৌ জাহাজ ছিল সেটি তারা শংখ নদী হয়ে কালুরঘাটের কাছাকাছি নিয়ে এসে ওখান থেকে নেভাল গান দিয়ে আমাদের এলাকায় বম্বিং শুরু করে দিয়েছিল। তাদের ব্রিগেডের যে আর্টিলারী ছিল সেই আর্টিলারী দিয়েও তারা বম্বিং করতে থাকে ১০ই এপ্রিল ‘৭১ থেকে। ১১ই এপ্রিল তাদের কিছু সৈন্য মহিলার পোশাক এবং কিছু সৈন্য সিভিল এর পোশাক পরে জয়বাংলা বলতে বলতে আমাদের দিকে অর্থাৎ কালুরঘাটের পুলের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। চট্টগ্রামে আমাদের পক্ষে এবং তাদের বিপরীতে ছিলেন ক্যাপ্টেন হারুন, শমসের মবিন চৌধুরী, লেঃ মাহফুজ এবং অন্য কয়েকজন অফিসার। এই অবস্থায় আমাদের লোকজন প্রথমে বুঝতে পারেন নি তারা পাকিস্তানী। যখন শত্রু জয়বাংলা বলতে বলতে একেবারে কালুরঘাটের পুলের ওপর চলে এলো, তখনই মাত্র আমাদের লোকজন বুঝতে পারলেন যেতারা সিভিলিয়ান বা মহিলা কেউ নন। তখন আমাদের পক্ষ ফায়ার করতে শুরু করলেন। শত্রুপক্ষের গোলার আঘাতে ক্যাপ্টেন হারুন এবং শমসের মবিন আহত হলেন। মাহফুজ চলে আসতে পেরেছিলেন। কালুরঘাট ছেড়ে আমরা পটিয়ার দিকে চলে এলাম।

প্রঃ তখন আপনারা মোট কতজন ছিলেন?

উঃ আমরা প্রায় সাড়ে তিনশর মত ছিলাম। এই যুদ্ধে পাকিস্তান বাহিনী পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন। ব্রিগেডিয়ার মিঠঠা খান হেলিকপ্টার থেকে ওদের পক্ষে এই যুদ্ধ পরিচালনা করেছিল (পরে জেনেছি)

প্রঃ এই যুদ্ধে আপনাদের প্রধান অস্ত্র কি ছিল?

উঃ আমাদের কিছু রাইফেল ছিল, কিছু এল এম জি এবং দুটি তিন ইঞ্চি মর্টার ছিল। এই মর্টার দু’টির কোন অবলোকন ব্যবস্থা (Aiming Sight) ছিল না। আন্দাজে ছুঁড়তে হত।

প্রঃ আপনাদের পক্ষে হতাহত কেমন হয়েছে?

উঃ আমাদের পক্ষে তেমন হতাহত হয় নি, ওদের পক্ষে কতজন হতাহত হয়েছিল তাও বলা মুসকিল, তবে সংখ্যা অনেক বেশি ছিল। ইতিপূর্বে ৮ই এপ্রিল আর একটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। তখন পাকবাহিনীর একটি দল কালুরঘাটের প্রায় এক মাইল উত্তরে একটি কৃষি ভবন দখল করে নিয়েছিল। পাকবাহিনীর শক্তি ছিল একটি প্লাটুন। পাকসেনারা ওখানে এসে পড়ায় শহরের বিভিন্ন স্থানে অবস্থানরত আমাদের সৈন্যের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। আমি কয়েকজন অফিসারকে পাকবাহিনীর প্রতিরক্ষাব্যুহের ওপর আক্রমণ চালাবার জন্য বললে কেউ তখন এগুতে উৎসাহিত হলেননা। তবে আমার কথা মোতাবেক লেঃ শমসের মবিন চৌধুরী কিছু সৈন্য নিয়ে আক্রমন পরিচালনা করেছিলেন, কিন্তু কৃতকার্য হতে পারেননি। উপরন্তু এই আক্রমণ পরিচালনাকালে নায়েক নায়েব আলী পাকবাহিনীর গুলিতে নিহত হয়েছিলেন। এমনি আমি নিজে মাত্র ১০ জন সৈন্য নিয়ে ৯ই এপ্রিল হাওলাদার হামদু মিঞা, নায়েক তাহের এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কয়েকজন বি ডি আর সহ সকাল ৮:৩০ মিঃ সময়ে কৃষি ভবনে অবস্থানরত পাক ঘাটি আক্রমণ করি। আমার আক্রমণে প্রায় ২০ জন পাকসেনা (১জন ক্যাপ্টেন ও ১জন সুবেদারসহ) নিহত হয় এবং তারা ঐ পোস্ট ছেড়ে পালিয়ে যায়।

প্রঃ তারপর?

উঃ তারপর আমি কালুরঘাট ব্রীজের চট্টগ্রামের দিক পুনর্দখল করেছিলাম। ১০ই এপ্রিল ৭১ খবর পেলাম পাক সেনাবাহিনী পটিয়ার কালাপুলের দিক থেকে আমাদের ওপর আক্রমণের চেষ্টা করছে। আমি তখনই ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান চৌধুরীকে কিছু সৈন্য দিয়ে পটিয়ার কালাপুলে পাঠালাম। ১১ই এপ্রিল ভোরবেলা আমি নিজে পটিয়ায় কালাপুলের অবস্থা জানতে পেলাম। ঐ তারিখ সকাল ৮-৩০ মিঃ সময়ে ক্যাপ্টেন ওয়ালি আমাকে খবর পাঠালেন পাক সেনারা প্রায় সাত থেকে আটশত সৈন্য নিয়ে কালুরঘাট আক্রমন করেছে; ক্যাপ্টেন হারুন গুরুতররুপে আহত, লেঃ শমসের মবিন চৌধুরীর কোন খবর পাওয়া যাচ্ছে না। এ সংবাদ পেয়ে আমি ওয়ালিকে বললামঃ “আমাদের লোকদের একত্রিত করবার চেষ্টা কর, পরিস্থিতি ভালভাবে জেনে নাও, আমি আসছি”. সকাল ৯টার দিকে আমি কালুরঘাটে এসে পৌঁছাই। ওখানে গিয়ে আমি মেজর জিয়ার সাথে অয়ারলেসে যোগাযোগের চেষ্টা করলাম।

পরে আমি তাদের সবাইকে পিছনে সরে আসতে বললাম। লেঃ মাহফুজকে মদনঘাট ডিফেনসে অবস্থান করতে বললাম যতক্ষণ না আমার কালুরঘাটের ডিফেনসের সবাই পিছু হটতে পারে। আমরা সবাই কালুরঘাট থেকে পটিয়াতে একত্রিত হলাম। এবং সেখান থেকে সবাই বান্দরবন রওনা হই। আমার সাথে সৈন্য ছিল প্রায় ৪৫০ জন (তৎকালীন ইপিআর পুলিশ এবং বেঙ্গল রেজিমেন্ট সহ)।

আমরা ১২ই এপ্রিল বান্দরবান পৌঁছেছিলাম। ঐ তারিখেই কাপ্তাই হয়ে রাঙ্গামাটি পৌঁছি। রাঙ্গামাটিতে আমরা ডিফেনস নেবার পর মহালছড়িতে ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টার স্থাপন করলাম। লেঃ জেনারেল মাহফুজ শত্রুর ওপর আঘাত হেনে চলেছিল। কিন্তু পাকবাহিনীর ব্যাপক আক্রমনে টিকে থাকা দুরুহ বুঝে পার্শবর্তী নোয়াপাড়া নামক স্থানে ডিফেনস নেয়। সেখান থেকে তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাতে সার্থকভাবে ডিফেনস নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করলেন। শেষ পর্যন্ত আমার নির্দেশ ১৪ই এপ্রিল লেঃ মাহফুজ তার ২০০ এর বেশি কিছু সৈন্য নিয়ে মহালছড়িতে আমার সঙ্গে মিলিত হন। ছুটি ভোগরত ক্যাপ্টেন আফতাব কাদের (আর্টিলারী) আমার কাছে ঐ তারিখে আসেন। বঙ্গ সন্তান সাহসী বীর ক্যাপ্টেন কাদেরকে মেজর জিয়া আমার কাছে পাঠিয়েছিলেন। তাকে আমার সৈন্যদের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন অফিসারের নেতৃত্বে ডিফেন্স নিতে পাঠালাম।

আমার রক্ষাব্যুহকে যেসব স্থানে অবস্থান দিলাম সেগুলি ছিলঃ

১) ক্যাপ্টেন আফতাব কাদেরের নেতৃত্বে প্রায় ১০০ সৈনি রাঙ্গামাটির খাগড়াতে।

২) ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামানের নেতৃত্বে ১০০ সৈন্য রাঙ্গামাটির মধ্যস্থলে বুড়িঘাটে।

৩) লেঃ মাহফুজের নেতৃত্বে প্রায় ১০০ সৈন্য রাঙ্গামাটির বরকলের মধ্যস্থলে।

৪) সুবেদার মুত্তালিবের নেতৃত্বে প্রায় ১০০ সৈন্য রাঙ্গামাটির কুতুবছড়ি এলাকাতে।

অপরদিকে ১৫ই এপ্রিল পাকবাহিনী রাঙ্গামাটি শহরে পৌঁছে যায়। রাজা ত্রিদিব রায় পাকবাহিনীকে আহবান করে আনলেন।

১৬ই এপ্রিল এর মধ্যে আমাদের সবাই নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান নিলেন। ক্যাপ্টেন ওয়ালিকে মেজর জিয়ার নির্দেশানুযায়ী রামগড় পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। ঐদিন ক্যাপ্টেন কাদের তার বাহিনী নিয়ে খাগড়া রেস্ট হাউজে কজন অফিসারসহ এক প্লাটুন পাকবাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে ক্যাপ্টেন কাদের পাকবাহিনীর অফিসারসহ প্রায় ২০ জন সৈন্যকে নিহত করতে সমর্থ হন। বাকী সৈন্য পালিয়ে যায়। অপরদিকে আমাদের মুক্তিবাহিনীর পক্ষে কোন ও ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। ক্যাপ্টেন কাদের নিরাপদে তার ঘাটিতে ফিরে আসেন। ১৭ই এপ্রিল পাকবাহিনীর প্রায় ২০ জন সৈন্য একটি লঞ্চযোগে রেকি করতে বেরিয়েছিল। ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান ওত পেতে ছিলেন। কিছুক্ষণ পরই পাকসেনারা বুঝতে পেরেছিল যে তারা মুক্তিবাহিনীর রক্ষাব্যুহের কাছাকাছি চলে এসেছে। পাকসেনারা গুলি ছোড়া শুরু করে। কিন্তু ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান তবুও চুপ করেছিলেন। সম্পূর্ণ লঞ্চটি তার এলাকায় চলে আসা মাত্র তিনি গুলি চালানো শুরু করলেন। এতে লঞ্চসহ অধিকাংশ পাকবাহিনী ধ্বংস হয়ে যায়। কয়েকজন পালাতে সমর্থ হয়েছিল। এই যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর ২জন মাত্র আহত হয়েছিলেন।

১৮ই এপ্রিল পাকসেনারা দুটি লঞ্চ ও একটি স্পিডবোটে সৈন্য নিয়ে চিঙ্গী নদী দিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল। লেঃ মাহফুজের কিছু সৈন্য হঠাৎ গুলি ছুড়ে বসলেন।

পাকসেনারা কিছু ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে পিছু হটে দূরে গিয়ে ডিফেন্স নিয়ে লেঃ মাহফুজের ওপর আর্টিলারী আঘাত হানতে থাকে। উভয় পক্ষের সংঘর্ষে লেঃ মাহফুজের কোন ক্ষতি হয়নি। তবে, পাক সেনাদের কিছু ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু তাদের চাপ আমাদের ওপর ক্রমে বাড়তে থাকে।

১৮ই এপ্রিল বিকেল ৩ টায় সুবেদার মুত্তালিব তাঁর দল নিয়ে কুতুবছড়িতে পাকবাহিনীর ৬টি চলমান সৈন্যভর্তি ট্রাকের উপর এমবুশ করে। এই এমবুশে ৩০ থেকে ৪০ জন পাকসেনা নিহত ও দুই-তিনটি গাড়ী ধ্বংস হয়।

১৯শে এপ্রিল ৩ টায় পাকসেনাদের একটি বড় রকমের দল ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান চৌধুরীর ওপর বুড়িঘাটে ব্যাপকভাবে আক্রমন করে। পাকসেনারা ঐ সময় একটি জীপ থেকে তিনটি মর্টার ছুড়েছিল। তাদের বাহিনী ব্যাপকভাবে আক্রমন চালিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল। এমনি পরিস্থিতিতে ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান কিছুতেই থাকতে পারছিলেন না। তখন ল্যান্স নায়েক মুনসী আবদুর রব (৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট) অটোমেটিক হাতিয়ার মেশিনগান হাতে তুলে নিয়ে বললেনঃ ‘আমি গুলি চালিয়ে যাচ্ছি আপনি বাকী সৈন্যদের নিয়ে পিছু হটে যান।’ ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান প্রায় ১০০ মুক্তিবাহিনী নিয়ে নিরাপদে পিছু হটলেন। কিন্তু ল্যানস নায়েক মুনসী আবদুর রব পাকবাহিনীর শেলের আঘাতে প্রাণ হারালেন। সেদিন মুনসী আবদুর রব মুনসীকে সরকার বীর শ্রেষ্ঠ উপাধি দিয়েছিলেন। ২০শে এপ্রিল লেঃ জেনারেল মাহফুজ ঐ স্থানে যান এবংমুনসীর ছিন্ন দেহের অংশবিশেষ এবং কিছু গোলাবারুদ নিয়ে ঘাটিতে ফিরে আসেন।

ঐ দিনই আমি লেঃ মাহফুজকে বরকলে পাঠিয়েছিলাম মিজো উপজাতিকে আমাদের স্বার্থে কাজ করার পক্ষে মত বিনিময়ের জন্য। লেঃ মাহফুজ বহু কষ্টে সুবলম পর্যন্ত পৌঁছে খবর পেলেন যে, পাকিস্তানীরা মিজোদের ইতিমধ্যেই হাত করে নিয়েছে। আমি আরো খবর পেলাম পাকবাহিনী মিজোদের নিয়ে মহালছড়ির দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ২১শে এপ্রিল পাকবাহিনীর একটি কোম্পানী বন্দুকভাঙ্গা নামক স্থানে লেঃ মাহফুজের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। সংঘর্ষে পাকসেনারা পিছু হটে চলে যায়। আমাদের কোন ক্ষতি হয় নি।

২৩শে এপ্রিল পাকবাহিনীর প্রায় ২০০ সৈন্য রাঙ্গামাটি থেকে মহালছড়ির দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। আমি ক্যাপ্টেন কাদের এবং লেঃ মাহফুজকে পাঠালাম প্রতিরোধ করার জন্য। ২৪শে এপ্রিল কুতুবছড়ি নামক স্থানে অফিসারদ্বয় পাকবাহিনীর মুখোমুখি হন। এই যুদ্ধে পাকবাহিনী বেশ কিছু ক্ষতি স্বীকার করে।

২৫শে এপ্রিল খবর পেলাম চিঙ্গী নদী এবং নার্নিয়ার চর বাজার হয়ে পাকবাহিনী মহালছড়ি অভিমুখে অগ্রসর হচ্ছে। মহালছড়ি আমাদের ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টার ছিল।

২৬শে এপ্রিল ক্যাপ্টেন কাদের, ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান ও লেঃ মাহফুজকে কিছুটা পিছিয়ে যেতে বললাম। ঐ তারিখেই ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামানকে নানিয়াচর বাজারে বড় পাহাড়ের ওপর ডিফেনস নিতে বলেছিলাম। কারণ ঐ পথই পাক সেনাদের অগ্রসর হওয়ার সম্ভাব্য এলাকা ছিল। লেঃ মাহফুজকে ডিফেনসে রাখলাম রিজার্ভে পাল্টা আক্রমনের জন্য এবং প্রয়োজনে ক্যাপ্টেন জামানকে সাহায্যের জন্য। ক্যাপ্টেন কাদেরকে পাঠালাম সড়ক পথে পাকবাহিনীর গতিপথ রুদ্ধ করার জন্য।

২৫শে এপ্রিল ভোরবেলা হাবিলদার তাহের সিপাহী বারী এবং করপোরাল করিমের সঙ্গে ৮/১০ জনলোক দিয়ে রেকি পেট্রোলে পাঠালাম। এই দলটি ভুলবশতঃ মিজোদের আড্ডায় ঢুকে পড়েছিল। সৌভাগ্যবশত মিজোরা তখন একটি হাতি কেটে খাওয়াতে ব্যস্ত ছিল। রেকি পার্টি পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়। আমাদের দলটি পরে হেডকোয়ার্টার মহালছড়িতে পৌঁছে। ঐ তারিখ বেলা ১২ঃ৩০ মিঃ সময়ে ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান চৌধুরীর অবস্থানের ওপর মিজোরা আক্রমন চালিয়েছিল। ফলে উভয় পক্ষে সংঘর্ষ বেধে যায়। আক্রমনের চাপ বাড়তে থাকে মিজোদের পক্ষ থেকে। মিজোরা সংখ্যায় ছিল অনেক। এই অবস্থায় আমি লেঃ মাহফুজকে প্রায় ১০ জন সৈন্য নিয়ে ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামানের সাহায্যে পাঠিয়েছিলাম। লেঃ মাহিফুজ ওখানে পৌঁছেই ডিফেনস নিয়ে লক্ষস্থলে আক্রমন চালাতে থাকে। কিন্তু ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান তার সাথীদের গুলি ফুরিয়ে যাওয়ায় ভিন্ন ভিন্ন পথে পিছু হটে আসেন। আধ ঘন্টা গুলি বিনিময়ে লেঃ মাহফুজ ১৫০ জন মিজোকে হত্যা করেছিল। কিন্তু অপর পক্ষে সব বাধাকে অগ্রাহ্য করে অসংখ্য মিজো সমুদ্রের ঢেউয়ের মত সামনের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। লেঃ মাহফুজকে মিজোরা চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছিল। খবর পেয়ে ক্যাপ্টেন কাদের এবং ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান লেঃ মাহফুজকে উদ্ধার করে আনার জন্য অগ্রসর হলেন। আমরা তখন হেডকোয়ার্টারের চারপাশে ডিফেনস পাকা করছিলাম। এমনি পরিস্থিতিতে ২৭শে এপ্রিল অপরাহ্ণ ৩টায় পাকবাহিনীর ১১ এবং পাঞ্জাবের ২টি কোম্পানী সহযোগে প্রায় এগার শত মিজো ব্যাপকভাবে আমাদের ওপর আক্রমন চালায়। পাকবাহিনী ৬টি মর্টার দিয়ে আক্রমণ চালাতে থাকে। চারদিকে শুধু আগুন আর আগুন। আমি ক্যাপ্টেন খালেক, ক্যাপ্টেন কাদের, ফারুক প্রমুখকে এলাকা ভাগ করে দিয়ে মহালছড়ি হেডকোয়ার্টার রক্ষা করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করলাম। পাকসেনারা মিজোদের নিয়ে ক্রমাগত অগ্রসর হতে থাকে আধুনিক মারনাস্ত্র নিয়ে। অথচ আক্রমন প্রতিহত করার জন্য উপযোগী কোনই ভারী মর্টার আমার কাছে ছিলনা। মাত্র থ্রি নট থ্রি রাইফেল ও সামান্য হালকা মেশিনগান দিয়ে আক্রমন চালালাম। ক্যাপ্টেন কাদের তার এলাকাতে যুদ্ধ করতে করতে শত্রুর গুলিতে শহীদ হলেন। বৃষ্টির মতো গুলির মধ্যে শওকত, ফারুক ও সিপাহী ড্রাইভার আব্বাস গাড়িতে ক্যাপ্টেন কাদেরের মৃতদেহ নিয়ে রামগড় ফিরে এলেন। ক্যাপ্টেন কাদেরের মৃতদেহ রামগড় রেখে বাকী সৈন্যরা আমার কাছে চলে আসেন। আমরা তখন এমনি এক অবস্থায় ছিলাম যখন আমার সমস্ত বাহিনী নিয়ে ঐ পরিস্থিতিতে পিছু হটা সিম্ভব ছিল না। তাই সন্ধ্যা পর্যন্ত আক্রমন চালিয়ে যেতে হয়েছিল। ঐ তারিখে রাতের আধারে মহালছড়ি ছেড়ে সমস্ত সৈন্য নিয়ে আমরা খাগড়াছড়ি নামক স্থানে এসে পৌঁছলাম এবং ডিফেন্স নিলাম।

২৮শে এপ্রিল খাগড়াছড়ি থেকে আমি মেজর জিয়ার সাথে অয়ারলেসের মাধ্যমে যোগাযোগ করে আমাদের অবস্থার কথা বর্ণনা করলাম। ঐদিন পাকবাহিনীর একটি দল আমাদের অবস্থান দেখে গুইমারা হয়ে রামগড়ের দিকে অগ্রসর হিচ্ছিল। আমি আমার বাহিনী নিয়ে গুইমারাতে ডিফেন্স নিলাম। আমাদের তখন শক্তি ছিল প্রায় ৪৫০ জন। আমি মানিকছড়ির রাজার সঙ্গে দেখা করলাম। রাজা আমাদের সাথে যোগ দিলেন। তিনি আমার সাথে বিশদ আলোচনা করে মগদের সমস্ত শক্তি নিয়োগ করবেন বলে জানালেন। রাজা পাকিস্তানীদের খবরাখবর দিলেন। সমগ্র মগ উপজাতি আমাদের সাথে যোগ দিয়েছিলেন। চাকমা উপজাতিদেরও হয়তো আমাদের সাহায্যে পেতাম। কিন্তু রাজা ত্রিদিব রায়ের বিরোধিতার জন্য তারা আমাদের বিপক্ষে চলে যায়। মিজোরা বেশ কিছু আগেই আমাদের শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধের ন’মাস মগ উপজাতি আমাদের সর্বতোভাবে সাহায্য করেছে।

২৯শে এপ্রিল রাতে মেজর জিয়া আমাদের রামগড়ে চলে আসতে বললেন। কারণ ইতিমধ্যে পাকবাহিনীর একটি দল করেরহাট-হিয়াকুল হয়ে রামগড়ের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। অপর দল শুভপুর ব্রীজে ক্রমাগত আঘাত হানছিলি। আর একটি দল আমাদের পিছু পিছু আসছিল গুইমারা রামগড়ের পথে। মেজর জিয়া করেরহাটে ক্যাপ্টেন ওয়ালীকে পাঠালেন এবং আমাদের চলে আসতে বললেন। আমরা ২৯শে এপ্রিল র ওয়ানা হয়ে রাত ২টায় সমস্ত সৈন্য নিয়ে রামগড়ে পৌঁছলাম। ৩০শে এপ্রিল মুক্তিবাহিবীর প্রধান সেনাপতি কর্নেল (পরবর্তীকালে জেনারেল) এম, এ, জি ওসমানী রামগড়ে আমাদের দেখে গেলেন এবং চট্টগ্রামের সমস্ত খবরাখবর নিলেন। কর্নেল ওসমানী খুবই খুশী হলেন। আমাকে নির্দেশ দিলেন যে কোন প্রকারেই অন্ততঃ আরো দু’দিন রামগড়কে মুক্ত রাখার জন্য, যাতে করে নিরীহ জনতাসহ সবাই নিরাপদে ভারতে আশ্রয় নিতে পারি।

আমি, ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান, সুবেদার মুত্তালেব এবং লেঃ মাহফুজকে তাদের বাহিনী নিয়ে ক্যাপ্টেন ওয়ালীর সাহায্যার্থে হিয়াকুলে পাঠালাম পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ করতে। উভয় পক্ষে তুমুল সংঘর্ষ হয়। পাকবাহিনীর একটি ব্রিগেড তিন দিক থেকে রামগড় আক্রমন করে। ২রা মে আমাদের রামগড় হারাতে হয়। ঐদিনই আমরা সবাই ভারতের সাবরুমে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলাম। সময় তখন সন্ধ্যা ৬টা।

————————————————–

সশস্ত্র প্রতিরোধঃ কুমিল্লা-নোয়াখালী-ঢাকা

শিরোনাম উৎস তারিখ
৩। চতুর্থ বেঙ্গল ও অন্যান্য বাহিনীর কুমিল্লা, নোয়াখালী, ঢাকা জেলায় সশস্ত্র প্রতিরোধ সাক্ষাৎকারঃ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ১৯৭৪-১৯৭৫ ১৯৭১

<৯, ৩.১, ৯৬-১২৮>

সাক্ষাৎকারঃ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ

(খালেদ মোশারফ একাত্তরের মার্চে ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টে সেকেণ্ড ইন কমাণ্ড হিসেবে মেজর পদে ছিলেন)

১৯শে মার্চ ১৯৭১ আমাকে ঢাকা সেনানিবাস থেকে চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের হেড অফিস কুমিল্লাতে বদলী করা হয়। আমি ২২শে মার্চ আমার পরিবারকে ঢাকার ধানমন্ডিতে রেখে কুমিল্লা চলে যাই এবং সন্ধ্যা সাতটায় চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টে গিয়ে যোগদান করি। ইউনিটে পৌছার সাথে সাথেই বুঝতে পারলাম আমার সৈনিকরা বেশ উদ্বিগ্ন। আরো জানতে পারলাম পাঞ্জাবীদের কমান্ডো এবং গোলন্দাজ আর্টিলারি বাহিনী বেঙ্গল রেজিমেন্টের চতুর্দিকে পরিখা খনন করে মেশিনগান লাগিয়ে অবস্থান নিয়েছে। নির্দেশ পেলেই সবাইকে হত্যা করবে। পাঞ্জাবীরা সেনানিবাস রক্ষার অজুহাতে এসব পরিকল্পনা নিয়েছে। পাঞ্জাবীদের কার্যাবলীতে চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকদের মনে তীব্র অসন্তোষ দানা বেঁধে উঠেছিল। আমি পৌঁছাবার সঙ্গে সঙ্গে তারা জানতে চায় এখন তাদের কি কর্তব্য? আমি সকলকে সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়ে এবং আত্মরক্ষার্থে প্রহরী দ্বিগুণ করার নির্দেশ দিয়ে তাদের শান্ত করি। পরের দিন ২৩শে মার্চ ছুটির দিন ছিল। ২৪শে মার্চ সকাল ৭টায় আমি প্রথম অফিসে রিপোর্ট করি লেফটেন্যান্ট কর্ণেল খিজির হায়াত খানের কাছে। তিনি চতুর্থ বেঙ্গল কমান্ডিং অফিসার ছিলেন এবং পাঞ্জাবী ছিলেন। লেফটেন্যান্ট কর্ণেল খিজির হায়াত খান আমাকে বুঝাতে চেষ্টা করলেন যে আমার পোষ্টিংয়ে তিনি খুব খুশি হয়েছেন এবং ইউনিট সম্বন্ধে নানা বিষয়ে আলাপ আলোচনা করলেন। ঐদিনই আমি যখন আমার অফিসে সেকেণ্ড ইন কমাণ্ড উপ-প্রধানের কাজ বুঝে নিচ্ছিলাম সকাল প্রায় সাড়ে দশটায় তখন খিজির হায়াত খান ডেকে পাঠালেন। আমি অফিসের ভিতর ঢুকে দেখি খিজির হায়াত খান উদ্বিগ্ন। তিনি আমাকে বসার জন্য বললেন এবং জানান যে আমাকে গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্ব নিয়ে আজই কুমিল্লা থেকে রওনা হতে হাবে। আমি উত্তর দিলাম যে হুকুম যদি হয় আমি নিশ্চই যাব। তবে আমি একদিন হয় এসেছি এবং আমার দায়িত্ব কেবল বুঝে নিচ্ছি, এমতাবস্থায় ইউনিট থেকে অন্য জায়গায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়তো আপনার পক্ষে ভুল হবে। তাকে আরো বুঝাতে চেষ্টা করলাম ব্যাটালিয়ানে আরো অফিসার আছে, তাদেরকেও পাঠানো যেতে পারে। তাছাড়া ইউনিট প্রধানকে সাধারণত: এভাবে পাঠানো হয়না। আমার বক্তব্য শোনে তিনি বললেন ব্যাপারটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ সেজন্য তোমাকেই যেতে হবে। আমি জানতে চাইলাম আমাকে কি ধরণের দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হচ্ছে। খিজির হায়াত খান বললেন যে, খবর এসেছে সিলেটের শমসের নগর নামক একটা জায়গায় নকশালপন্থীরা বিশেষ তৎপর রয়েছে এবং পাশ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারত তাদেরকে অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে ব্যাপকভাবে সাহায্য করছে। আরো খবর আছে ভারত থেকে বেশ অনুপ্রবেশও হচ্ছে। এইসব কারণে আমাকে চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটা কোম্পানী নিয়ে সেখানে যেতে হবে এবং তাদেরকে দমন করতে হবে। আমি জবাব দিলাম একটা কোম্পানী যখন যাবে তখন কোন জুনিয়র মেজরকে সেখানে পাঠানো যেতে পারে। সাধারণত উপ-প্রধান একটা কোম্পানী নিয়ে কখনও যায়না। আমার বক্তব্যে খিজির হায়াত খান কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন এবং আমাকে বললেন ঠিক আছে আপনি যান এবং আমি আপনাকে একটু পরে ডেকে পাঠাব। কিছুক্ষণ পরে কর্ণেল আমার আমাকে ডেকে পাঠালেন এবং ব্রিগেড কমান্ডারের কাছে ইকবাল শফি এখনই আপনাকে ডেকেছেন। আমাকে নিয়ে কর্ণেল খিজির হায়াত খান ব্রিগেড কমান্ডারের কাছে গেলেন। ব্রিগেড কমান্ডার আমাকে দেখেই বললেন আমি তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। বিশেষ একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে যা একমাত্র তুমি ছাড়া কেউ সম্পন্ন করতে পারবেনা এবং সেই জন্য আমি তোমাকেই নির্বাচিত করেছি। আশা করি তুমি আমাকে নিরাশ করবে না। তিনি আরো বললেন, তোমার মত একজন সিনিয়র অফিসারকে এই জন্য মনোনীত করা হয়েছে। আমি ট্রুপস ছাড়া শমসের নগর ইপিআর-এর একটি কোম্পানী আছে। এই বড় ফোর্সের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য একজন সিনিয়র বাঙালি অফিসারের দরকার। তুমিই একমাত্র বাঙালি অফিসার কুমিল্লাতে যাকে আমি এ ব্যাপারে বিশ্বাস করতে পারি।

আমি বুঝতে পারলাম যেতে আমাকে হবেই। উপায় যখন আর নেই তখন যতটুকু তাদের কাছে আদায় করে নেয়া যায় সেইটুকুই আমার পক্ষে মঙ্গল। আমি ব্রিগেডিয়ার শফিকে বললাম, যে কাজের ভার আমাকে দিচ্ছেন শুধু একটা কোম্পানী দিয়ে তা হবেনা। কোম্পানীর চেয়ে বেশী সৈন্য আমাকে দেয়া হোক। আর হেড কোয়ার্টারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার জন্য একটা শক্তিশালী ওয়ারলেস দেওয়া হোক। এছাড়া যেহেতু আমি অনেক দুরে একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজে যাচ্ছি সেহেতু আমার ট্রুপস-এর জন্য স্বয়ংক্রিয় ভারী এবং হালকা অস্ত্রশস্ত্র এবং মর্টার ইত্যাদি এবং যথেষ্ট পরিমাণ গোলাবারুদ দেয়ার অনুমতি দেয়া হোক। ব্রিগেডিয়ার শফি প্রথমে বললেন, তোমাকে যে কাজের জন্য পাঠানো হচ্ছে, তাতে এসব ভারী অস্ত্রশস্ত্রের দরকার হবে না। আমি উত্তরে বললাম যে, আপনি যে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থার কথা চিত্রিত করেছেন তাতে আমার সামরিক জ্ঞান অনুসারে এই সমস্ত ভারী অস্ত্রশস্ত্রের দরকার হবে বিশেষ করে যেখানে হেড কোয়ার্টার থেকে তাড়াতাড়ি সাহায্য পাবার আশা কম। আমার বক্তব্যে ব্রিগেডিয়ার শফি কনভিন্সড হলেন এবং কর্ণেল খিজির হায়াতকে নির্দেশ দিলেন আমার যা প্রয়োজন তা যেন আমাকে দিয়ে দেয়া হয়। আমরা ব্রিগেডিয়ার শফির কাছ থেকে ইউনিটে ফিরে এলামা। এসই ব্যাটালিয়নের এডজুট্যান্ট ক্যাপ্টেন গফফারকে (এখন মেজর) ডেকে নির্দেশ দিয়ে দিলাম সমস্ত ব্যাটালিয়ান থেকে বেছে বেছে ২৫০ জনের মত সৈন্যকে আলফা কোম্পানীতে একত্র করার জন্য।

গাফফারকে বলে দিলাম যে, ব্যাটালিয়নের ভারী অস্ত্রশস্ত্র যতো আছে সব নিয়ে যাও। গোলাবাদরু এমনভাবে নেবে যাতে একমাস যুদ্ধ করা যায়। আমাদের ২৬টা গাড়ী ব্রিগেড থেকে দেওয়া হয়েছিল। সব বোঝাই করতে এবং অস্ত্রশস্ত্র ও সৈনিকদের তৈরী করতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। এই সময় আমি একটা অস্বাভাবিক ঘটনা দেখতে পাই। যতোক্ষণ পর্যন্ত আমি এবং আমাদের লোকজন প্রস্তুত হচ্ছিলাম ততক্ষণ পর্যন্ত খিজির হায়াত এবং অন্যান্য ব্রিগেড স্টাফের অফিসাররা বসে লক্ষ্য করতে থাকলেন।

আমি ২৪শে মার্চ সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় যাওয়ার জন্য তৈরী হই। ব্যাটালিয়নে যে সমস্ত বাঙালি অফিসার থেকে গেল তারা সবাই আমার যাবার পূর্বে মেসে এসে দেকা করে গেল। এদের মধ্যে সিনিয়র অফিসার ছিলেন ক্যাপ্টেন মতিন (বর্তমানে মেজর) তাকে আমি উপদেশ দিলাম যে আমি চলে যাচ্ছি, এতে ঘাবড়াবার কিছু নাই। এখন তুমিই সিনিয়র। যদি কোন অঘটন ঘটে তাহলে এই চতুর্থ বেঙ্গলের বাকী ট্রুপসের নিরাপত্তার পুরো বন্দোবস্ত করবে এবং যদি প্রয়োজন হয় যুদ্ধ করে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে আসবে এবং আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় আমি কনভয় নিয়ে শমসের নগরের পথে রওনা হলাম। রাত প্রায় ২টা-আড়াইটার সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের উপকন্ঠে পৌঁছলাম। সেখানে রাস্তায় অনেক ব্যারিকেড। এই প্রতিবন্ধকতার জন্য আমাদের এগোতে অসুবিধা হচ্ছিল। এই ব্যারিকেড ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে শহরের দিকে এগোচ্ছিলাম। শহরের কিনারে যে পুল আছে (নিয়াজ পার্কের কাছে) সেখানে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ছাত্র-জনতা আমাদের বাধা দেয়। হাজার হাজার লোক এবং ছাত্র রাস্তায় শোয়ে পড়ে এবং বলে যেতে দেওয়া হবেনা। আমি সেখানকার নেতৃস্থানীয় লোকদের সাথে কথা বলতে চাইলাম। ওখানেই আওয়ামী লীগের তদানিন্তন এমসিএ সাচ্চু মিয়া এবং অন্য কয়েকজন আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রনেতারা আমাকে জানান যে, পূর্ব বাংলার অনেক জায়গায় পাকসেনারা আবার গুলি চালিয়েছে এবং মিলিটারী চলাচল কেন্দ্রীয় নির্দেশে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তারা আরও বলেন আপনাদের বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকদের ইচ্ছাকৃতভাবে কুমিল্লা থেকে দুরে পাঠিয়ে দিচ্ছে এবং আপনাদের যেতে দেবনা। এই ভাবে কয়েকঘন্টা কথাবার্তা হয়। ইতোমধ্যে মেজর শাফায়াত জামিল (বর্তমানে লে: কর্ণেল), যিনি চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের আর একটা কোম্পানীসহ ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে অবস্থান করছিলেন, তিনিও ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। তিনিও তাদের বুঝাতে চেষ্টা করলেন যাতে ব্যারিকেড এবং অন্যান্য প্রতিবন্ধকতা সরিয়ে ফেলা হয়। কিন্তু তাতেও তারা আমাদের অনুরোধ রাখতে রাজী হয়না। তারপর তাদের নিয়ে মেজর শাফায়াত জামিলের ক্যাম্পে যাই। সেখানে আবার কথাবার্তা চলে এবং তাদের আমি স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিই যে, বেঙ্গল রেজিমেন্ট বাংলাদেশেরই রেজিমেন্ট, যখন দরকার পড়বে বাঙালি জাতির জন্য পিছিয়ে থাকবে না। এমতাবস্থায় আমাদের বাধা দেয়া ঠিক হবেনা। অবশেষে সকাল সাড়ে পাঁচটায় সব নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা আমাদেরকে আর বাধা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। আমরা শমসেরণগরের পথে আবার ২৫শে মার্চের সকালে রওনা দিলাম। যাওয়ার আগে মেজর শাফায়াত জামিলকে আলাদা ডেকে সতর্ক করে দিলাম এবং আমার সঙ্গে অয়ারলেস মারফত যোগাযোগ রাখার নির্দেশ দেয় গেলাম। আমি সকাল দশটা-এগারোটার সময় শ্রীমঙ্গলে পৌঁছি। সেখান থেকে শমসেরণগর যেতে হলে মৌলভীবাজার হয়ে যেতে হবে। শ্রীমঙ্গলে কনভয় দাড় করিয়ে স্থানীয় কিছু ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করি শমসেরণগরে যাওয়ার রাস্তা সম্বন্ধে এবং জানতে পারি মৌলভীবাজার হয়ে যাওয়া যায় অথবা আর একটা রাস্তা আছে সোজা শ্রীমঙ্গল হয়ে জঙ্গল এবং পাহাড়ের মধ্য দিয়ে। এই রাস্তা অপেক্ষাকৃত কম দুরত্বের আমি এই সোজা জঙ্গলের রাস্তা দিয়ে শমসের নগরের পথে রওনা হলাম। যে রাস্তা দিয়ে যাওয়ার কথা ছিল সে রাস্তা পরিত্যাগ করে পাহাড়ের পথ দিয়ে রওনা হলাম। এই রাস্তা খুব খারাপ ছিল তাই অতি কষ্টে দুপুর ২টায় শমসের নগর গিয়ে পৌঁছি। সেখানে যেয়ে ডাকবাংলোতে আমি আমার ছাউনি স্থাপন করি।

দুপুরে খেয়ে আমি এবং লে. মাহবুব শমসেরণগরের চারদিকে ঘুরে দেখে আসি পরিস্থিতি স্বাভাবিক। আর কিছু পেট্রোল পার্টি চতুর্দিকে পাঠিয়ে দিই। স্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে জানতে পারি কোন অঘটন সেখানে ঘটেনি। ইপিআর-এর যে দুটো কোম্পানীর কথা আমাকে বলা হয়েছিল তাদের কোন পাত্তা নেই। ইপিআর-এর একজন সুবেদার এবং আরো কয়েকজন সিপাই শমসেরণগর এয়ারপোর্টে অবস্থান করছিল। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সঠিক কোন উত্তর পাইনি। শমসেরণগরের টিগার্ডেনগুলো ঘুরে জানতে পারলাম। সমস্ত পশ্চিম পাকিস্থানী ম্যানেজার এবং অফিসাররা ঢাকায় চলে এসেছে। নকশালপন্থী বা অনুপ্রবেশকারীদের কোন চিহ্ন আমি খুজে পেলাম না। ২৫শে মার্চের রাতটা এভাবে খবরাখবর নিয়ে এবং পেট্রোলিং করে কেটে গেল। সমস্ত ব্যাপারটা আমার কাছে ঘোড়ালো মনে হলো। আমার মনে জাগল আমাকে এখানে কৌশল করে পাঠানো হয়েছে এবং যা কিছু তারা বলেছিল, তা সবই মিথ্যা। আমি সমস্ত সকাল অয়ারলেসের মাধ্যমে হেড কোয়ার্টারে যোগাযোগ করার চেষ্টা করি কিন্তু কোন যোগাযোগ হলনা। এইভাবে দুপুর পর্যন্ত চলে যায়। আমি এবং লে. মাহবুব ডাকবাংলোর বারান্দায় বসেছিলাম। হঠাৎ আমাদের এসে খবর দেয় এক পাঞ্জাবী অফিসার এবং বেশ কয়েকজন সৈন্য শমসেরণগর বাজারে এসেছে এবং ষোকনে কারফিউ জারি করে স্থানীয় জনসাধারণের উপর অত্যাচার করছে। সেই দলটি আমাদের ক্যাম্পের সম্মুখে দিয়ে মৌলভীবাজার যাচ্ছিল। আমাদের সেন্ট্রিকে সেই দলটির অফিসারকে ডাকার জন্য পাঠাই। এরা যখন সামনে দিয়ে যাচ্ছিল তখন সেন্ট্রি তাদের আমাদের ক্যাম্পে আসার জন্য অনুরোধ জানায়। অফিসারটি ক্যাম্পের ভিতর আসে এবং আমার সেখানে উপস্থিতি সম্বন্ধে আশ্চর্যবোধ করে। এমন ভাব দেখায় যে, আমার এখানে আছি এটা সে জানত না। কথাবার্তায় আমি জানতে পারি যে, ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের বেশ কিছু সৈন্য সিলেট থেকে মৌলভীবাজার এসে দুই দিন আগে ক্যাম্প করেছে। অফিসারের হাবভাব এবং কথাবার্তা আমাকে সন্দিহান করে তোলে। যতক্ষণ সে ডাকবাংলোয় বসেছিল ততক্ষণ সে স্টেনগানটি কোথাও না রেখে নিজের হাতে রাখে। এতে সন্দেহ আরও ঘনীভুত হয়। এদের আগমন সম্বন্ধেও আমাকে অবহিত করা হয় নি। এটাও অত্যন্ত অস্বাভাবিক। কিছুক্ষণ পরে অফিসারটি তার দলবল নিয়ে চলে যায় এবং যাওয়ার আগে আমাদেরকে পাঞ্জাব রেজিমেন্ট ক্যাম্পে যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানায়। আমি যাওয়ার আশ্বাস দিয়ে অফিসারটিকে বিদায় করলাম।

সেই দিনই বিকেলে স্থানীয় জনসাধারণের মুখে আমি জানতে পাই ঢাকাতে কিছু একটা ভয়ংকর অঘটন ঘটেছে। কিন্তু কেউ সঠিক কিছু বলতে পারেনা। আস্তে আস্তে লোকমুখে শুনতে পাই যে, ঢাকায় পাক সেনাবাহিনী হাজার হাজার লোককে গুলি করে মেরে ফেলেছে এবং মারছে। বাংলাদেশের অন্যান্য জায়গাতেও পাক বাহিনী সেই রূপ নৃশংস অত্যাচার এবং হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। হাজার হাজার লোক ঢাকা ছেড়ে জান বাঁচানোর জন্য বাইরে চলে যাচ্ছে। পাক সেনাবাহিনী ট্যাংক, কামান এবং অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে নির্দোষ, নিরীহ, নিরস্ত্র জনসাধারণের উপর বর্বরোচিতভাবে অত্যাচার করেছে। ঢাকা শহর একটা ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। আমি অনেকক্ষণ বসে থেকে চিন্তা করতে থাকলাম আমার এখন কর্তব্য কী। অয়ারলেস সেট খোলার হুকুম দিয়ে হেড কোয়ার্টারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করতে লাগলাম। অনেক চেষ্টার পরও কোন যোগাযোগ হলনা্ তবুও আবার চেষ্টা চালিয়ে যেতে বললাম। অনেকক্ষণ পর আমাকে লেঃ মাহবুব এসে খবর দিল যে হেড কোয়ার্টারের সঙ্গে অতি কষ্টে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়েছে। আমি তাড়াতাড়ি দৌড়ে গেলাম অয়ারলেসে কথা বলার জন্য। যখন আমি কথা বলতে চাই, তখনই অপরদিক থেকে কর্ণেল খিজির হায়াত কিংবা ক্যাপ্টেন আমজাদ পাঞ্জাবী জবাব দেয়। তাদের কাছে কোন কথাই খুলে বলা সম্ভব হচ্ছিলো না। শুধু এটুকু বুঝতে পারলাম কর্ণেল খিজির হায়াত এবং চতুর্থ বেঙ্গলের বাকী অংশ কুমিল্লা থেকে ২৫ তারিখে ব্রাহ্মণবাড়িয়া এসেছে। কর্ণেল খিজির হায়াত আমাকে জানালেন সব কিছু স্বাভাবিক এবং তিনি আরো জানালেন যে, অতি সত্ত্বর তিনি একবার শমসেরণগর পরিদর্শনে আসবেন। আমি তাকে জানালাম এখানে সব শান্ত এবং আমার এখানে থাকার প্রয়োজন নাই এবং আমাকে ফিরে আসার অনুমতি দেওয়া হোক। তিনি জবাবে আমাকে শমসেরণগরেই থাকতে আদেশ দিলেন। কিছুক্ষণ পর আমি আবার অয়ারলেসে কথা বলার চেষ্টা করি। এবার ক্যাপ্টেন গাফফারের (এখন মেজর) সঙ্গে কথাবর্তায় বুঝতে পারলাম যে ক্যাপ্টেন গাফফারের নিকটে কোন পাঞ্জাবী অফিসার আছে। সেজন্য সব কথা খুলে বলতে পারছিলনা। আমি শুধু বললাম যখন সুযোগ পাবে তখন মেজর শাফায়াত জামিলকে আমার সঙ্গে কথা বলতে বলবে। আরো কিছুক্ষণ পরে মেজর শাফায়াত জামিল আমার সঙ্গে অয়ারলেসে কথা বলেন এবং জানালেন ঢাকাতে পাক সেনাবাহিনী গণহত্যা চালিয়েছে এবং এখানো ধ্বংসলীলা চালিয়ে যাচ্ছে। এই কথা চলছিল ২৬শে মার্চের সন্ধ্যা বেলায়। শাফায়াত জামিল লোকমুখে শুনেছেন যে সব লোক ঢাকা থেকে পালিয়ে কুমিল্লার দিকে এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে আসছে। মেজর শাফায়াত জামিল এবং ক্যাপ্টেন গাফফার আরো জানান যে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেও সান্ধ্য আইন জারি করা হইয়াছে এবং চতুর্থ বেঙ্গলকে এটা কার্যকরী করতে বলা হয়েছে। কিন্তু ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জনসাধারণ সান্ধ্য আইন ভঙ্গ করে মিছিল বের করেছে। এমতাবস্থায় তাদের করণীয় কি তা আমার কাছে জানতে চাইলেন।

আমার পক্ষে এ প্রশ্নের জবাব দেয়া কঠিন ছিল। আমি প্রায় ১০০ মাইল দুরে অবস্থান করছি। সমস্ত বাংলাদেশে আর কোথায় কি হচ্ছে সে সম্বন্ধে কোন জ্ঞান ছিল না। ঢাকা শহরে পাক বাহিনী ব্যাপক গণহত্যা চালিয়েছে এবং আরো অনেক জায়গাতেও করেছে। রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে এই মুহুর্তে কোন প্রত্যক্ষ যোগাযোগ নেই যে তাদের কাছে কোন উপদেশ নেব। একদিকে সামরিক শৃঙ্খলা এবং কর্তব্যবোধ অন্যদিকে বিবেকের দংশন আমাকে পীড়িত করছিল। এই উভয় সংকটে পড়ে আমি আমার চিন্তাশক্তি হারিয়ে ফেলি। মেজর শাফায়াত জামিলকে বললাম, আমাকে কিছুটা সময় দাও, আমি কিছুক্ষণ পরে বলব এবং সঙ্গে সঙ্গে বললাম কোন মতেই যেন গুলি চালানো না হয়। লোকজনকে বুঝিয়ে শান্ত করার চেষ্টা কর। চিন্তায় আমি আমার কামরার চতুর্দিকে পায়চারি করতে শুরু করলাম এবং এমন অবস্থায় চিন্তায় মাথা ঘুরপাক খেতে লাগল। আমি বসে পরলাম এবং লে. মাহবুবও (বর্তমানে ক্যাপ্টেন) সেখানে বসা ছিল। আমার সঙ্গে যেসব বাঙালি সৈনিকরা ছিল তারাও উদ্বিগ্ন হয়ে আমার সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় ছিল। অবশেষে আমার বিবেক আমাকে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করল। এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। যদিও কোন রাজনৈতিক নির্দেশ সেই মুহুর্তে ছিলনা তবুও বঙ্গবন্ধুর সেই ৭ই মার্চের ঘোষণার কথা মনে পড়ে গেল। তিনি বলেছিলেন “এবার ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোল। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” আমি লে. মাহবুবকে ডেকে বললাম যে এই মুহুর্তে আমি স্বাধীন বাংলাদেশের আনুগত্য স্বীকার করলাম। এখনই সব সৈনিকদের বলে দাও আজ থেকে আমরা আর কেউ পাকিস্তানের প্রতি অনুগত নই। স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়িয়ে দাও। এখন থেকে আমরা পাকসেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ আরম্ভ করবো। সব সৈনিকদের তৈরী হতে বল। এখান থেকে আমরা ঢাকার দিকে রওনা দেব এবং চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টকে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে একত্রিত করতে হবে। লে. মাহবুব যেন এই নির্দেশের অপেক্ষায় ছিল।

সে দৌড়ে গিয়ে সবাইকে আমার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ পরেই আমি শুনতে পেলাম বঙ্গশার্দুলদের শ্লোগান “জয় বাংলা।” আমি তাদেরকে প্রথমে শান্ত করলাম এবং বুঝিয়ে দিলাম আমাদের এখন থেকে যে সংগ্রাম শুরু হল সেটা কঠিন এবং বিপদসংকুল। সকলেই নিজেকে স্বার্থের উর্দ্ধে রেখে দেশ ও জাতির এবং বাংলাদেশ সরকারের জন্য আত্মীয়-স্বজন, আর্থিক কষ্ট এবং সব কিছু সুবিধা ত্যাগ করে আত্মবিসর্জন দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। আমি দেখতে পেলাম বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকরা সবাই দৃঢ় সংকল্পে তেকে আত্মত্যাগের মনোভাব নিয়ে প্রস্তুত হয়ে আছে। প্রথমে অয়ারলেসে মেজর শাফায়াতের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করি এবং তাকে নির্দেশ দিই যেন সেও তৈরী থাকে। তাকে আরো বললাম, কুমিল্লার রাস্তার দিকে খেয়াল রাখতে। তাকে বললাম যে, আমি অতি শিগগিরই ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে পৌঁছব। ইতোমধ্যে আমার সমস্ত লোক ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে রওনা হবর জন্য তৈরী হয়ে যায়। আমি লে. মাহবুবের সঙ্গে কিছুসংখ্যক সৈন্য দিয়ে শ্রীমঙ্গলে পাঠিয়ে দেই এবং সেখানে ডিফেন্স নিতে নির্দেশ দিই যাতে আমাদের যাওয়ার পথে মৌলভীবাজার থেকে পাঞ্জাব রেজিমেন্ট এসে বাধা দিতে না পারে। শমসেরণগর থেকে জঙ্গলের পথে রাত বারোটায় আমি আমার কনভয় নিয়ে রওনা হয়ে যাই। রাস্তায় আমাদের অগ্রসর অনেক ধীর ছিল। কারণ সমস্ত রাস্তায় ব্যারিকেড এবং কোন কোন জায়গায় রাস্তা কেটেও দেয়া হয়েছিল। জঙ্গলের অনেক জায়গায় বিরাট গাছ কেটে রাস্তার উপর ফেলে দেওয়া হয়েছিল। এই সব প্রতিবন্ধক আমাদেরকে কেটে কেটে বা মাটি ফেলে পরিষ্কার করে অগ্রসর হতে হবে। সব প্রতিবন্ধকের কাছেই অনেক লোক লুকিয়ে দেখছিল আমরা কি করি। যখনই বুঝতে পারত আমরা বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ঢাকার দিকে বা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে অগ্রসর হচ্ছি তখনই তারা স্বত:স্ফুর্তভাবে এসে ব্যারিকেড সরিয়ে ফেলত এবং রাস্তাঘাট পরিষ্কার করতে সাহায্য করত। তাদের সহায়তায় এবং সক্রিয়তায় আমাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল কম সময়ের মধ্যে এগিয়ে যাবার। এভাবে অতি মন্থর গতিতে এগোতে এগোতে আমি ভোর পাঁচটায় সাতছড়িতে পৌঁছলাম। এখানে আমার সৈনিকরা কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়। এখানে এসে আমি আবার অয়ারলেসের মাধ্যমে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে যোগাযোগ করি। ঐ অবস্থাতে কর্ণেল খিজির হায়াতের সঙ্গে আলাপ হয়। তিনি আমাকে আশ্বাস দেন যে সেখানে সবকিছু ঠিকঠাক। মেজর শাফায়াত জামিলও আমার সঙ্গে কথা বলে। সে তার উদ্বেগ প্রকাশ করে এবং জানতে চায় আমি কোথায় এবং আসতে কেন দেরী হচ্ছে। আমি বললাম ভয়ের কোন কারণ নেই কেননা আমি অনেক কাছে এসে গেছি। তাকে আশ্বাস দিয়ে আবার রওনা হই। সকাল ৬টায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে দশ মাইল দুরে মাধবপুরে পৌঁছি এবং মেজর শাফায়াত জামিলের সঙ্গে অয়ারলেসে কথা বলি। তিনি আমাকে জানান, সকাল দশটার সময় কর্ণেল খিজির হায়াত একটা কনফারেন্স ডেকেছেন (আমি পরে জানতে পারি যে কুমিল্লা থেকে পাঞ্জাব রেজিমেন্টের একটা কোম্পানী সেই সময়ে আসছিল)। কনফারেন্সের কথা যখন আমি শাফায়াতের কাছে শুনতে পেলাম তখন আমি যথেষ্ট উদ্বিগ্ন হয়ে যাই এবং তাদের পরিকল্পনা সম্বন্ধে সন্দিহান হয়ে উঠি। আমি শাফায়াতকে তখনই নির্দেশ দিই আমার জন্য অপেক্ষা করনা। প্রয়োজন হলে কর্ণেল খিজির হায়াতসহ সমস্ত পাঞ্জাবী অফিসারকে গ্রেফতার করে ফেল এবং যত পাঞ্জাবী সৈনিক আছে নিরস্ত্র কর। আমি আবার রওনা হয়ে গেলাম। পরে শুনতে পেলাম ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে কি হয়েছে। দশটা বাজার দশ মিনিট আগে কর্ণেল খিজির হায়াত, মেজর নেওয়াজ, ক্যাপ্টেন আমজাদ কনফারেন্সে বসেছিল। এমতাবস্থায় মেজর শাফায়াত জামিল, লে. কবির (বর্তমানে ক্যাপ্টেন), লে. হারুন (বর্তমানে ক্যাপ্টেন) হঠাৎ সেই কামরায় প্রবেশ করেন এবং পাঞ্জাবী অফিসারদের তাদের অস্ত্র সমর্পণ করার নির্দেশ দেন। মেজর নেওয়াজ নিজে একজন কমান্ডো ছিলেন, তিনি কিছুটা বাধা দেয়ার চেষ্টা করেন কিন্তু লে. হারুনের ত্বরিত প্রচেষ্টায় তার সে চেষ্টা ব্যর্থ হয় এবং সব পাঞ্জাবী অফিসারকে তারা বাংলাদেশের নামে গ্রেফতার করে। ইতোমধ্যে বাকী বঙ্গশার্দুলরা বাইরে যেসব পাঞ্জাবী সৈনিক ছিল তাদের নিরস্ত্র করে এবং বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দেওয়া হয়। দিনটি ছিল ২৭শে মার্চ। ইতোমধ্যে আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অতি সন্নিকটে এসে গেছি। আমার বাহিনী এবং শাফায়াতের বাহিনী বেলা ১১টার দিকে সম্মিলিত হয়। আমি বুঝলাম আমার প্রথম কর্তব্য হল যে সমস্ত এলাকা মুক্ত হয়েছে তা শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করা। আমি প্রথমেই অফিসারদের নিয়ে একা বৈঠক করি এবং এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে কিভাবে কার্যকরী করতে হবে তার সম্বন্ধে আমার পরিকল্পনা জানাই। আমার এই পরিকল্পনায় সিদ্ধান্ত ছিল যে, আমরা মেঘনা নদীকে উত্তরে রেখে পশ্চিম প্রতিরক্ষা লাইন তৈরী করব এবং দক্ষিণে ময়নামতি সেনানিবাস পর্যন্ত মুক্ত করে প্রতিরক্ষা বন্দোবস্ত করব। উত্তর-পূর্বে মৌলভীবাজার থেকে সিলেট পর্যন্ত বিভিন্ন এলাকা মুক্ত করে সিলেটে আরেকটি ঘাটি স্থাপন করবো।

এই পড়িপ্রেক্ষিতে ভৈরববাজারে প্রথম দুটো কোম্পানী পাঠিয়ে দিই। আর একটা পার্টিকে কুমিল্লার দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে অগ্রসর হতে বলি। মেঘনার পূর্ব পাড়ে একটা প্রতিরক্ষাব্যুহ তৈরীর ব্যবস্তা করি। এছাড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চতুর্দিকে তিতাস নদীর চতুর্দিকে একটা আভ্যন্তরীণ প্রতিরক্ষাব্যুহ নির্মাণ করি। ক্যাপ্টেন মাহবুবের নেতৃত্বে একটা কোম্পানী দিয়ে সিলেটের দিকে অগ্রসর হবার জন্য পাঠিয়ে দেই। শ্রীমঙ্গলে তাদের সাথে স্থানীয় সংগ্রামী আনসার, মুজাহিদ এবং আরো কিছু সৈন্য কর্নেল রবের নেতৃত্বে (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল) যোগ দেয়। এই দলটির সাথে পাঞ্জাব রেজিমেন্টের যেসব সৈন্য মৌলভীবাজারে ছিল তাদের সাথে লড়াই হয় এবং পাঞ্জাবীরা অনেক হতাহত এবং ক্ষয়ক্ষতির পরে মৌলভীবাজার থেকে পালিয়ে যায়। সিলেট শহর পর্যন্ত তাদেরকে ধাওয়া করা হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে আমি বেসামরিক প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তখন মহকুমা প্রশাসক ছিলেন জনাব রকিব। তিনি অত্যন্ত উৎসাহী, সাহসী এবং সংগ্রামী ছিলেন। তিনি সবসময় আমাদের সাথে ছিলেন। তিনি যুদ্ধ প্রচেষ্টায় বেসামরিক সাহায্যের যতটুকু প্রয়োজন ছিল যেমন রসদ সরবরাহ, যানবাহন যোগাড়, সৈনিকদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা, চিকিৎসা, আর্থিক সাহায্য তিনি অত্যন্ত উৎসাহ এবং উদ্দীপনা নিয়ে করেছেন। তিনি পুলিশ অয়ারলেসের মাধ্যমে বাংলাদেশের সমস্ত জেলা এবং মহকুমা প্রশাসকদের কাছে খবর পাঠান যে, মেজর খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে চতৃর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্ট স্বাধীনতা যুদ্ধ করছে এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে সিলেট পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকা শত্রুমুক্ত করেছে। ঐ সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে আমার সাথে জনাব তাহের উদ্দিন ঠাকুর, সাচ্চু মিয়া প্রমুখ রাজনৈতিক নেতাদের সাথে আলোচনা হয় এবং তাদেরকে আমি আমার বাংলাদেশ সরকারের সাথে আমার আনুগত্যের কথা বলি। তারা আমাকে সবরকম সাহায্য-সহযোগিতা করেন। তারা আমাকে জিজ্ঞাসা করেন কিভাবে এই যুদ্ধ পরিচালনায় সহায়তা করা যায়। আমি তাদের অনুরোধ জানাই, যে কোন উপায়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্র থেকে যদি কোন অস্ত্রশস্ত্র আনার ব্যবস্থা করতে পারেন তাহলে আমি আমার এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আরো সুন্দর ও শক্তিশালী করতে পারি। আমি তখন জানতাম যে, আমার কাছে যা গোলাবারুদ আছে তা নিয়ে বেশী দিন পাক্ষিান সেনাবাহিনীকে ঠেকিয়ে রাখা যাবেনা। তারা এই বার্তা নিয়ে আগরতলাতে চলে যান।

এই সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে অগ্রসরমান পাঞ্জাবী সৈন্যদের সাথে আমার অগ্রবর্তী সৈন্যদের কোম্পানীগঞ্জে লড়াই হয়। এতে পাকিস্তানীরা অনেক হতাহত হয়ে আবার কুমিল্লা সেনানিবাসের দিকে পশ্চাদপসরণ করে। ২৯শে মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে শত্রুসেনা প্রথম বিমান হামলা চালায়। এতে আমার একজন সৈনিক শহীদ হন। সেদিনই সন্ধ্যায় পাকিস্তানীদের রেকি পার্টি (তথ্য অনুসন্ধানী দল) একজন অফিসার ও ৮ জন সিপাহীসহ ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে আসে। এই দলটি আমাদের অগ্রবর্তী ঘাটির অ্যামবুশে পড়ে যায় এবং অফিসারসহ সব শত্রুসেনা এবং একখানা গাড়ী ধ্বংস করে দিই। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উপর বিমান হামলা আরো চলতে থাকে এবং আমাদের প্রতিরক্ষা আরো অধিকতর শক্তিশালী হতে থাকে। আমি এই অবস্থাতে ভৈরব বাজার এবং নরসিংদীর ভেতরের রেলওয়ে লাইন অনেক জায়গায় বিচ্ছিন্ন করে দিই এবং আর একটা দলকে নরসিংদী পর্যন্ত অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দিই। আমার এই দলটির সঙ্গে ঢাকা থেকে আগত আর একটি সাবেক ইপিআর এবং দ্বিতীয় বেঙ্গলের কিছু সৈন্যের যোগাযোগ স্থাপন হয়। এই সম্মিলিত দলটি ঢাকা থেকে পাকসেনাদের অগ্রসরমান এক বিরাট বাহিনীকে অ্যামবুশ করে এবং ঢাকার দিকে পশ্চাদপসরণে বাধ্য করে।

আমাদের তখনো বাইরে আর কোন প্রতিষ্ঠান বা বাঙালি সেনাবাহিনীর আর কোন দলের সাথে যোগাযোগ হয়নি। অন্যান্য জায়গা সম্বন্ধে আমি সম্পূর্ণ অন্ধকারে ছিলাম।

আমি জানতে পাই যে, মেজর সফিউল্লাহ (বর্তমানে ব্রিগেডিয়ার) ময়মনসিংহ থেকে কিশোরগঞ্জে এসে তার দ্বিতীয় বেঙ্গলকে একত্রিত করেছে। আমি আরো জানতে পারলাম যে, সে তার মুষ্ঠিমেয় সৈন্য নিয়ে ঢাকা অভিমুখে যাবার পরিকল্পনা করেছে। এই সংবাদে আমি অতিশয় উদ্বিগ্ন এবং চিন্তিত হয়ে পড়ি। কারণ আমি জানতাম ঢাকাতে পাকিস্তানীদের অন্তত: দুই ব্রিগেড সৈন্য আছে। তাছাড়া সাঁজোয়া বাহিনীর ট্যাংক, গোলান্দাজ বাহিনীর বাহিনীর কামান এবং বিমান বাহিনী আছে। এসব অত্যন্ত শক্তিশালী এবং আধুনিক মরণাস্ত্রে সজ্জিত। বিরাট পাক সেনার বিরুদ্ধে অল্প সংখ্যক সৈন্য ও অস্ত্র নিয়ে আক্রমণ করার মানেই ছিল আমাদের শক্তিকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করা। আমার সঙ্গে মেজর সফিউল্লাহর যোগাযোগের কোন ব্যবস্থা ছিলনা। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে কিশোরগঞ্জ পর্যন্ত কোন সরাসরি রাস্তা না থাকায় তার সঙ্গে যোগাযোগ করা অসম্বব হয়ে পড়ে। অথচ তার সঙ্গে যোগাযোগ করা খুবই প্রয়োজন। তা না হলে এ সর্বনাশকে কিছুতেই রোধ করা যাবেনা। অনেক চেষ্টার পর আমি একটা খালি রেলওয়ে ইঞ্জিনের ব্যবস্থা করলাম। ক্যাপ্টেন মাহবুবকে সেই ইঞ্জিনে বসিয়ে সোজা কিশোরগঞ্জ পাঠিয়ে দিলাম। তাকে বিস্তারিত বুঝিয়ে দিলাম। কোন কিছু করার আগে তিনি যেন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং সম্ভব হলে আমার সঙ্গে দেখা করার অনুরোধ জানাই।

এরপর ক্যাপ্টেন মাহবুব ফিরে এসে জানায় মেজর সফিউল্লাহ এবং সমস্ত সেনাদল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে আসছে। মেজর সফিউল্লাহ তার বাহিনীকে নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌছেনে এবং তিনি আমার হেড কোয়ার্টার তেলিয়াপাড়াতে আসেন। আমাদের দুটো দলের যোগাযোগ হওয়াতে আমাদের শক্তি ও মনোবল বেড়ে যায়। এরপর আমরা বসে আমাদের ভবিষ্যত কর্মপন্থা সম্বন্ধে আলোচনা করি। আমরা জানতে পারি যে, পাকিস্তানীরা আমাদের আক্রমণ করার যথেষ্ট প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং আমরা পাকিস্তানীদের আক্রমণের কৌশল সম্বন্ধে বিশ্লেষণ করি এবং সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে, পাকিস্তানী বাহিনী আমাদের উপর বিমান, হেলিকপ্টার এবং নদীপথে ঢাকার দিকে থেকে আক্রমণ করতে পারে। নদী পথে আক্রমণ করার জন্য তারা মেঘনার পথে গানবোটে আসতে পারে এবং মেঘনার দক্ষিণ পাড়ে ল্যান্ডিং করতে পারে এবং সাথে সাথে হেলিকপ্টারযোগেও কমান্ডো এবং শত্রুবাহিনী নামাতে পারে।

যে বিস্তীর্ণ মুক্ত এলাকা আমাদের আয়ত্তাধীন ছিল, সেই সব এলাকাতে সৈন্য রাখার মতো আমার কাছে সৈন্য ছিলনা। সেজন্য আমি আমার ট্রুপসকে যেখানে পাকবাহিনীর অবতরণের এবং আক্রমণের বেশী সম্ভাবনা, সেই জায়গাগুলোতে ডিফেন্স নেয়ার বন্দোবস্ত করি। এই সময়ে আমি জানতে পাই চতৃর্থ বেঙ্গলের জনা পঞ্চাশেক সৈন্য যারা কুমিল্লার দক্ষিণে জাঙ্গালিয়া ইলেকট্রিক গ্রীড স্টেশনে প্রহরায় ছিল সেই সব সৈন্যরাও ২৫শে মার্চের পর নিকটবর্তী একটা গ্রামে আশ্রয় নিয়েছে এবং আমার নির্দেশের অপেক্ষায় আছে। আমি এই অবস্থাতে তাদের কাছে লোক পাঠিয়ে দেই এবং তাদেরকে আরও দক্ষিণে যেয়ে লাকসাম এবং কুমিল্লার মধ্যখানে লালমাই হিলের মধ্যপ্রান্তে টেম্পল পাহাড় নামক এক জায়গায় প্রতিরক্ষাব্যুহ গড়ার নির্দেশ দেই। তাদের উপর এই নির্দেশ দিলাম যে, কুমিল্লা থেকে পাক বাহিনী লাকসাম, নোয়াখালী কিংবা চাঁদপুরের দিকে অগ্রসর হলে তাদের যেন অ্যামবুশ করা এবং বাধা দেওয়া হয়। এর মধ্যে আমি খবর পাই আখাউড়া, কসবা, বুড়িচংখেলাতে পাকিস্তানী সেনা ইপিআর পোষ্টগুলোতে বাঙালি ইপিআরদের বিরুদ্ধে এখানো লড়াই করে যাচ্ছে। এই সংবাদ পেয়ে আমি ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিনকে (বর্তমানে মেজর) পাঠাই কিছু লোকজন নিয়ে যাতে বাঙালি ইপিআরদের নিয়ে সম্মিলিতভাবে এইসব পোষ্টগুলো পাঞ্জাবীদের কবল থেকে মুক্ত করা যায়। বেঙ্গল রেজিমেন্ট ইপিআর এবং স্থানীয জনসাধারণের সম্মিলিত হামলায় অনেক ক্ষয়ক্ষতি এবং হতাহতের পর পাঞ্জাবীরা এই সব অবস্থান থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এইসব খন্ডুদ্ধের পর ব্রাহ্মবাড়িয়া থেকে কুমিল্লার গোমতী পর্যন্ত আমি সমস্ত এলাকা মুক্ত করতে সমর্থ হই এবং কুমিল্লা শহরের বিবিরবাজার নামক একটা জায়গায় একটা প্রতিরক্ষাব্যুহ গড়ে তুলি।

ইতোমধ্যে তাহেরউদ্দিন ঠাকুর এবং সাচ্চু মিয়ার প্রচেষ্টায় আমাদের বন্ধু রাষ্ট্রের কিছু সাড়া পাওয়া যায়। সীমান্তে আমার সঙ্গে আগরতলার জেলা প্রশাসক মি. সাইগলের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। বাংলাদেশের ঘটনাবলী সম্বন্ধে তখনও তাদের কোনও ধারণা ছিলনা। আমার কাছে বিস্তারিত জানতে পেরে তিনি আমাকে জানালেন যে এ সম্বন্ধে তিনি তার উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাবেন। তাকে আমি অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানাই। তিনি সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলে যান। কয়েকদিন পর আবার সীমান্ত এলাকায় ভারতে সেনাবাহিনীর ৫৭তম ডিভিশনের কমান্ডার মেজর জেনারেল গানজালভেজ-এর সঙ্গে দেখা হয়। তাকেও আমি ঘটনাবলীর বিস্তারিত বিবরণ দিই। তখন পর্যন্ত আমরা কোন সাহায্য পাই নি।

এপ্রিল মাসের ২/৪ তারিখে কুমিল্লার সীমান্তে মতিনগরের নিকট কর্ণেল এম এ জি ওসমানী (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল) যখন ভারত সীমান্তে পৌছেন তখন আমার সঙ্গে তার দেখা হয়। তিনি প্রথম আমার কাছে সংক্ষেপে আমাদের বর্তমান পরিস্থিতি সম্বন্ধে ওয়াকেবহাল হন এবং তার পরই তিনি আগরতলাতে চলে যান। পরের দিন সন্ধ্যায় আমার হেড কোয়ার্টার তেলিয়াপাড়াতে কর্ণেল ওসমানী আমাকে মেজর শফিউল্লাহ লে. কর্ণেল রবকে (বর্তমানে মেজর জেনারেল) নিয়ে একটা বৈঠক করেন। এই বৈঠকে আমরা যুদ্ধের বর্তমান পরিস্থিতি সম্বন্ধে সম্পূর্ণভাবে তাকে জ্ঞাত করি। আমি তাকে আরও জানাই, আমাদের যে শক্তি আছে তা দিয়ে বেশিদিন পাকবাহিনীকে ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। অতিসত্বর বন্ধুরাষ্ট্র থেকে বা অন্য কোন জায়গা থেকে অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদের ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া তাকে আরো অনুরোধ করা হয় আরো নেতৃস্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে অতি শিগির আমাদের বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হউক যাতে আমরা বহির্জগতের স্বীকৃতি পাই এবং যুদ্ধের সময় রাজনৈতিক নেতৃত্ব পাই। তিনি আমাদের বক্তব্য বুঝতে পারলেন এবং আগরতলা থেকে কলকাতা চলে গেলেন। কিছুদিন পর ১৭ই এপ্রিল বঙ্গবন্দুর নেতৃত্বকে স্বীকার করে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দিন আহমেদকে প্রধানমন্ত্রী করে বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হয়।

এই সময় বন্ধুরাষ্ট্র থেকে বিএসএফ-এর ব্রিগেডিয়ার পান্ আমাদের হেডকোয়ার্টার আসেন এবং আমাদের সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন। তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করেন আমাদের সহায়তা করার কিন্তু সে সাহায্য ছিল নগণ্য। আমরা চাচ্ছিলাম হালকা এবং ভারী স্বয়ংক্রিয় হাতিয়ার মর্টার। কিন্তু সে সময় আমাদেরকে খুবই সামান্য ৩০৩ রাইফেল এবং সামান্য গুলি দেয়া হয়। তা ছিল আমাদের দরকারের চেয়ে অনেক নগণ্য। এই সময়ে ব্রিগেডিয়ার পান্ডে আমাদেরকে জিয়াউর রহমান সম্পর্কে বিস্তারিত জানান এবং একদিন মেজর জিয়াউর রহমান (বর্তমানে ব্রিগেডিয়ার) সঙ্গে নিয়ে আসেন। তিনি বলেন, পাক বাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণে ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্টের যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এবং যুদ্ধ করার জন্য তার কাছে অতি নগণ্যসংখ্যক সৈন্য আছে এবং তিনি আমাকে ও মেজর সফিউল্লাহকে মেজর জিয়াউর রহমানকে কিছু সৈন্য দেওয়ার অনুরোধ করেন। আমি এবং মেজর শফিউল্লাহ নিজ নিজ বাহিনী থেকে দু’টো শক্তিশালী কোম্পানী গঠন করে মেজর জিয়াউর রহমানের নিকট প্রেরণ করি।

এই সময় পাকবাহিনী আশুগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং পাশ্ববর্তী এলাকাসমূহে আমাদের সম্মিলিত বাহিনীর উপর প্রবল বিমান আক্রমণ চালাতে থাকে। এই আক্রমণ এতই ভয়াবহ রূপ ধারণ করে যে, মাঝে মধ্যে ৭ থেকে ৯ ঘন্টা অনবরত স্ট্রাপিং, রকেটিং এবং বোম্বিং করতে থাকে। এপ্রিল মাসের শেষে পাকবাহিনী বিমান বাহিনীর সহায়তায় হেলিকপ্টার এবং গানবোটের সাহায্যে আমাদের আশুগঞ্জ পজিশনে সৈন্য অবতরণ করায়। আমাদের সৈন্যরা শত্রুদের বিমান বাহিনী এবং ছত্রীদের সম্মিলিত সাড়াশি আক্রমণের মুখে অসহায় হয়ে আশুগঞ্জ থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে পিছু হটে আসে। ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেও শত্রুবাহিনীর সাথে আমাদের সম্মিলিত বাহিনীর প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয় িএবং এপ্রিল মাসের শেষ পর্যন্ত শত্রুদের সাজোয়া বাহিনী বিমান বাহিনী এবং গোলন্দাজ বাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণে আর টিকতে না পেরে আমরা দুই রাস্তায় পিছু হটে গেলাম। আমার সৈন্যরা ক্যাপ্টেন আইন উদ্দিনের নেতৃত্বে আখাউড়াতে এসে তিতাস নদীর উপর পুনরায় প্রতিরক্ষাবুহ্য রচনা করে। মেজর সফিউল্লাহ তাঁর বাহিনী নিয়ে মাধবপুরের দিকে চলে যায়। পাক বাহিনী ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে এক ব্যাটালিয়ন শক্তি নিয়ে আসে এবং আখাউড়া আক্রমণ করে কিন্তু অনেক ক্ষয়ক্ষতি এবং হতাহত স্বীকার করে তারা পশ্চাদপরণে বাধ্য হয়।

আমি এই সময়ে কুমিল্লার দক্ষিণে যে দলটি ছিল অর্থাৎ ৪ বেঙ্গলের বি কোম্পানী তাদেরকে লে. মাহবুব এবং লে. দিদারুলের (বর্তমানে উভয়েই ক্যাপ্টেন) নেতৃত্বে আরও কিছু সৈন্য পাঠিয়ে জোরদার করি।

কুমিল্লা থেকে এপ্রিল মাসের ১৫/১৬ তারিখে পাক বাহিনীর বিরাট এক কনভয় প্রায় ৩০টি গাড়িতে সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে লাকসামের দিকে যাচ্ছিল। লে. মাহাবুবের নেতৃত্বে ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বি কোম্পানীর সৈন্যরা শত্রুসেনারা এই দলটিকে দুপুর বারোটায় জাঙ্গালিয়ার নিকটে এমবুশ করে। এই এমবুশে শত্রুসেনাদের যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হয়। সংঘর্ষ প্রায় পাঁচঘন্টা স্থায়ী হয়। পাকসেনারা গাড়ী থেকে নেমে এমবুশ পার্টিকে আক্রমণ করার চেষ্টা করে কিন্তু আমাদের সৈন্যদের সাহসিকতা এবং কৌশলের কাছে পর্যুদস্ত হয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হয়। এই সংঘর্ষে লে. মাহবুব এবং লে. দিদার যথেষ্ট কৌশলের এবং যুদ্ধনিপুণতার পরিচয় দিয়েছিল। লে. মাহবুব তাঁর সৈন্যদের নিয়ে রাস্তার পূর্ব পাশে এমবুশ করে ওৎ পেতে বসেছিল। যখন শত্রুদের কনভয় তার এমবুশের মাঝে পড়ে যায়, তখন সে তাদের উপর তার লোকজন দিয়ে গুলি ছুড়তে থাকে এতে কটা গাড়ী রাস্তা থেকে একসিডেন্ট করে পড়ে যায়। বাকী গাড়ীগুলো তেকে পাকসেনারা লাফালাফি করে নীচে নামার চেষ্টা করে। এতেও তাদের যথেষ্ট হতাহত হয়। যে সব পাকসেনা গাড়ী থেকে ভালভাবে নামতে পারে তারা রাস্তার উপরে (পশ্চিম দিকে) গিয়ে একত্রিত হয় এবং লে. মাহবুবের উপর আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়। এদিকে লে. দিদারুল আলম রাস্তার পশ্চিম পার্শ্বে বেঙ্গল রেজিমেন্ট-এর সৈন্য নিয়ে তৈরী ছিল। সে পাকিস্থানীদের উপর অকস্মাৎ প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। এইভাবে দুই দিক থেকে আক্রান্ত হয়ে এবং নিজেদের হতাহত দেখে শত্রুসেনাদের মনোবল একেবারেই ভেঙ্গে যায়। মৃতদেহ ফেলে রেখে তারা কুমিল্লার দিকে পালিয়ে যায়। এই যুদ্ধের ফলে লে. মাহবুব এবং লে. দিদারুল আলমের সম্মিলিত দলটি ২টি মেশিনগান, ৬টি হালকা মেশিনগান এবং অজস্র রাইফেল আহত এবং নিহত শত্রুদের কাছে থেকে ছিনিয়ে নেয়। যে বিধ্বস্ত গাড়ীগুলো শত্রুরা ফেলে গিয়েছিল তা থেকে কয়েক হাজার এমুনিশন উদ্ধারা করা হয়। এর তিন দিন পরে স্থানীয় জনসাধারণ আরো ২টি হালকা মেশিনগান, কয়েকটা রাইফেল এবং বেশকিছু গোলাবারূদ যা শত্রুসেনা পালিয়ে যাবার সময় ধানক্ষেতে ফেলে দিয়ে গিয়েছিল তা আমাদের পৌছে দেয়। এই একশনের ফলে আমার এমুনেশনের প্রয়োজনীয়তা সাময়িকভাবে মিটেছিল এবং পাকবাহিনী বেশ কিছুদিন কুমিল্লার দক্ষিণে অগ্রসর হবার সাহস দেখায় নি।

এই সময় আখাউড়াতে পাক বাহিনী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিক থেকে আবার আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে তাদের ২৫ জনের মত হতাহত হয় এবং পাক বাহিনী আবার ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে পশ্চাদপরণ করে। এপ্রিল মাসের শেষে পাক বাহিনী কুমিল্লা থেকে উত্তর দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রাস্তায় অগ্রসর হয়ে ১২ নং ফ্রন্টিয়ার ফোর্স নিয়ে সাইদাবাদ দখল করে নেয়। পরে পশ্চিম দিক থেকে আক্রমণ চালিয়ে তারা নিয়ামতবাদ, গঙ্গাসাগর দখল করে নেয়। আমি তখন কুমিল্লার বিবিরবাজার এলাকাতে যেখানে পাকবাহিনী প্রতিদিন আক্রমণ চালাচ্ছিল সেখানে যুদ্ধ পরিচালনা করছিলাম। গঙ্গাসাগর, নিয়ামতবাদ শত্রুকবলিত শুনতে পেয়ে ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিনকে নির্দেশ দিই ৪র্থ বেঙ্গলের ডেল্টা কোম্পানী নিয়ে কসবার উত্তরে চন্ডিমুরা উচু পাহাড়ে প্রতিরক্ষাব্যুহ শক্ত করতে এবং সেই রাতেই কুমিল্লার দক্ষিণ হতে ৪র্থ বেঙ্গলের আলফা কোম্পানীকে উঠিয়ে আমার সঙ্গে নিয়ে গঙ্গাসাগরের নিকটে দুই কোম্পানীকেই একত্রিত করি। সন্ধ্যায় যখন আমি চন্ডিমুরার নিকটে পৌছি তখনই শত্রুদের অবস্থান সম্বন্ধে মোটামুটি একটা বিবরণ ইপিআরদের কাছ থেকে অবগত হই এবং সেই রাত্রেই গঙ্গাসাগর এবং নিয়ামতবাদে শত্রুদের উপর আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিই। ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিন, ক্যাপ্টেন গাফফার এবং একজন সুবেদারের নেতৃত্বে আলফা, চার্লি এবং ডেল্টা কোম্পানী নিয়ে ভোর পাঁচটায় শত্রুদের উপর আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দিই। এই আক্রমণের পরিকল্পনা ছিল যে ক্যাপ্টেন গাফফার এবং ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিন পূব দিকে থেকে শত্রুদের গঙ্গাসাগর পজিশনের পেছন দিক দিয়ে ইনফিলট্রেট করে ভিতরে ঢুকে গঙ্গাসাগরের উপর আক্রমণ চালাবে এবং এই সময়ে সুবেদার তার আলফা কোম্পানী নিয়ে নিয়ামতবাদের উপর যে জায়গাতে আমরা শত্রুদের হেডকোয়ার্টার ভেবেছিলাম, সেখানে আক্রমণ চালাবে। এ দুই আক্রমণ এক সঙ্গে চারটায় শুরু হবে। আক্রমণের ঠিক দশ মিনিট আগে সুবেদার শামসুল হকের নেতৃত্বে ৪র্থ বেঙ্গলের মর্টার এই দুই  পজিশনের উপর গোলা ছুড়বে। রাত বারোটায় এই পরিকল্পনা অনুযায়ী আমি এই তিন কোম্পানী নিয়ে শত্রুদের ঘাটিতে ঢুকে যাই। সেদিন টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছিল। চতুর্দিকে বেশ পানি জমছিল। আমাদেরকে হাটু পানি ভেঙ্গে ত্রাসের রাস্তায় অগ্রসর হতে হচ্ছিল। একসময় আমার মনে হচ্ছিল আমরা যেন আমাদের ঠিক পথে যাচ্ছিনা এবং এই সময়ে নিকটবর্তী একটা বাড়ির একটা লোকের সঙ্গে আমার দেখা হয়। সেও একজন পুরোনো অবসরপ্রাপ্ত সামরিক ব্যক্তি ছিল। এই ব্যক্তি আমাদেরকে শত্রুদের অবস্থান সম্পর্কে দিনে দুরে থেকে যা দেখেছে সে সম্বন্ধে আরো বিস্তারিত খবর দেয়। এই ব্যক্তির সাহায্যে আমি এবং আমার প্রত্যেকটি দল ভোর পাঁচটায় আমাদের লক্ষ্যস্থলে পৌঁছে যাই। আমাদের আক্রমণ করার নির্দিষ্ট সময় ছিল রাত চারটা। যেহেতু আমরা দেরীতে পৌঁছি সেহেতু পাঁচটায় পরিকল্পনা মাফিক আক্রমণ শুরু করে দিই। শত্রুসেনারা অকস্মাৎ তাদের অবস্থান এবং পিছনে ভয়াবহ গোলাগুলির শব্দে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ যুদ্ধ করার পর তারা গঙ্গাসাগর এবং নিয়ামতবাদ ছেড়ে সাইদাবাদে পশ্চদপরণ করে। আমরা পরের দিন গঙ্গাসাগরে আবার প্রতিরক্ষাব্যুহ গড়ে তুলি। শত্রুসেনারা গঙ্গাসাগরে পর্যুদস্ত হয়ে কসবার দিকে অগ্রসর হবার চেষ্টা করে। তাদের প্রথম আক্রমণ আমরা ব্যর্থ করে দিই কিন্তু পরে গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায় পাকসেনারা টি. আলীর বাড়ি পর্যন্ত অগ্রসর হয় এবং ঘাঁটি গড়ে তোলে। আমরা আমাদের কসবা পুরান বাজার পজিশন শক্তিশালী করে তুলি এবং শত্রুসেনাকে কসবার দিকে অগ্রসর হতে বাধা দিই। টি. আলীর বাড়িতে শত্রুসেনাদের যে ঘাঁটি ছিল সে ঘাটিতে ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গলের ডেল্টা কোম্পানী মর্টারের সহায়তায় ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিন অকস্মাৎ আক্রমণ করে। এই আক্রমণে শত্রুদের চার-পাঁচটা গাড়ীতে আগুন লেগে যায় এবং তাদের ২০/৩০ জন হতাহত হয়। তারা টি. আলীর বাড়ী ছেড়ে আরো পেছনে হটে যায়।

ইতোমধ্যে কুমিল্লা বিবিরবাজার পজিশনের উপর পাক বাহিনী প্রচণ্ড আক্রমণ করতে শুরু করে এবং অনেক ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে কুমিল্লা শহরের সন্নিকটে দেড় মাইল পূর্বদিকে তারন্যপুর শত্রুরা দখল করতে সমর্থ হয়। আমি ইপিআর-এর একটি কোম্পানী এবং কিছু সংখ্যক বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্য দিয়ে বিবিরবাজার প্রতিরক্ষাব্যুহ আরও ইপিআর-এর একটি কোম্পানী এবং কিছুসংখ্যক বেঙ্গল রেজিমেন্ট-এর সৈন্য দিয়ে বিবিরবাজার অবস্থানটির উপর পাকসেনাদের লক্ষ্য এজন্য ছিল যে, প্রতি রাত্রে এখান থেকে আমার ছোট ছোট কমান্ডো পার্টি গোমতী নদী অতিক্রম করে কুমিল্লা শহরে পাকিস্থানী অবস্থানের উপর অতর্কিতে হামলা চালাতো এবং ব্যতিব্যস্ত করে তুলতো। এখান হতে আমরা অনেক সময় তাদের অবস্থানের উপর মর্টার হামলাও চালাতাম। এতে প্রায়ই পাকসেনাদের অনেক লোক হতাহত হত। অবশেষে পাক বাহিনী একদিন সন্ধ্যার সময় অতর্কিতে এই পজিশনের উপর ৩৯তম বেলুচ রেজিমেন্টের সাহায্যে গোলন্দাজ বাহিনী এবং ট্যাংকের সহায়তায় প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। প্রথমে শত্রুসেনারা পূর্বদিকে আক্রমণ চালনা করে। এই আক্রমণ আমার সৈনিকেরা নস্যাৎ করে দেয় এবং শত্রুদের অনেক লোক নিহত এবং আহত হয়। এরপর শত্রুসেনারা দক্ষিণ দিক হতে আমাদের পজিশনের উপর পিছনে বাম পার্শ্বে ট্যাংক ও ৩৯তম বেলুচ রেজিমেন্টের সাহায্যে আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণ চার-পাঁচ ঘন্টা স্থায়ী থাকে। আমাদের গুলিতে শত্রুদের অন্তত ১১০ থেকে ১৫০ জন নিহত বা আহত হয়। কিন্তু ট্যাংক এবং গোলন্দাজ বাহিনীর প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ এবং পিছন দিক হতে ঘিরে ফেলার আশংকা থাকায় আমাকে বাধ্য হয়ে এই অবস্থান ছাড়তে হয়।

এই যুদ্ধে ইপিআর জওয়ানরা যথেষ্ট সাহসের পরিচয় দিয়েছে। বিশেষ করে মনে পড়ে এক নায়েকের কথা, যে শত্রুদের গুলি করতে করতে এত উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল যে, তাদের নিহতের বিপুল সংখ্যা দেখে এক পর্যায়ে ‘জয় বাংলা’ হুংকার দিয়ে দাড়িয়ে পড়ে এবং সেসময় হঠাৎ দুর্ভাগ্যবশত তার মাথায় গুলি লাগে এবং সে মারা যায়। এ যুদ্ধে আমার ৬ জন সৈন্য মারা যায় এবং ৮/১০ জন আহত হয়। সব আহতদের আমরা পেছনে নিয়ে আসি কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত: তাদের চিকিৎসার বন্দোবস্ত করতে পারি নাই। এরকম একজন আহত তরুণ ছাত্রের কথা আমার মনে পড়ে, যার পেটে গুলি লেগেছিল কিন্তু তৎক্ষণাৎ অপারেশন করার কোন ব্যবস্থা না থাকায় সে মারা যায়।

এদিকে গঙ্গাসাগরে এবং আখাউড়ায় শত্রুসেনারা আবার তৎপর হয়ে ওঠে এবং বারবার আখাউড়া এবং গঙ্গাসাগরের উপর আক্রমণ চালায়। জুন মাসের প্রথমে পাকবাহিনীর ১২তম ফ্রন্টিয়ার ফোর্স ট্যাংক, কামান এবং বিমান বাহিনীর সহায়তায় আখাউড়া রেলওয়ে স্টেশন এবং গঙ্গাসাগরের উপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে ৪র্থ বেঙ্গলের ডেল্টা কোম্পানী কিছুটা পিছু হটে আজমপুর, আখাউড়া রেলওয়ে স্টেশন থেকে আধা মাইল পূর্বে আবার প্রতিরক্ষাব্যুহ গড়ে তোলে। এই প্রতিরক্ষাব্যুহ সিলেট, চট্টগ্রাম, ঢাকা রেলওয়ে লাইনকেও শত্রুদের ব্যবহার থেকে বাধা দিতে সমর্থ। এই অবস্থানগুলির উপর পাক বাহিনী বারবার আক্রমণ চালায় এবং প্রতিবারই ৩০/৪০ জন করে সৈন্য হতাহত হওয়ায় তারা আক্রমণ থেকে নিরস্ত থাকে।

মে মাসে জেনারেল ওসমানী আমাদের হেড কোয়ার্টার-এ আসেন। সে সময় ভবিষ্যত যুদ্ধ পরিচালনা কিভাবে হবে সে সম্বন্ধে আমাদের সঙ্গে আলোচনা করেন। জেনারেল ওসমানী আমাকে নির্দেশ দেন যুদ্ধ পরিকল্পনা তৈরী করে ফেলি। এই পরিকল্পনায় আমরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে দুই বাহিনীর দ্বারা পরিচালিত করার পন্থা নিই। আমরা পরিকল্পনা করি যে, পাকিস্থানের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হলে আমাদের শক্তিকে আরো বাড়াতে হবে। দুই রকমের বাহিনী গড়ে তুলতে হবে। নিয়মিত বাহিনী, যা ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর এবং অন্যান্য আর্মস ও সার্ভিসেস-এর একটা ডিভিশন গড়ে উঠবে এবং কিছুসংখ্যক নিয়মিত সৈন্য নিয়ে প্রত্যেক সেক্টরেই কোম্পানী গঠন করা হবে এবং সেই সব কোম্পানী শত্রুদের যোগাযোগ ব্যবস্থায় কমান্ডো এ্যাকশন চালিয়ে যাবে। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের পুরানা এবং নতুন ব্যাটালিয়ান নিয়ে ব্রিগেড গঠন করে সেই সব ব্রিগেড শত্রুদের ঘাঁটির উপর আক্রমণ চালাবে এবং প্রয়োজন হলে দখলীকৃত অবস্থানগুলোতে প্রতিরক্ষাব্যুহ গড়ে তুলবে। যেসব যুবক পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার প্রতিজ্ঞা নিয়ে আমাদের কাছে এসেছে তাদেরকেও ট্রেনিং দিয়ে একটা অনিয়মিত বাহিনী গড়ে তুলতে হবে। এই অনিয়মিত বাহিনী ছোট ছোট গ্রুপ এবং কোম্পানীতে বিভক্ত হয়ে বাংলাদেশের ভিতরে প্রবেশ করে নিজ নিজ এলাকা শত্রুমুক্ত করবে। এসব নিয়মিত বাহিনীর কোম্পানী এবং গ্রুপগুলো যাতে ভালভাবে কাজ করতে পারে সেজন্য তাদের পরিচালনার জন্য নিয়মিত বাহিনী থেকে জেসিও বা এনসিওদেরকে পরিচালনার জন্য পাঠান হবে। এই পরিকল্পনাতে আমরা আরো উল্লেখ করি যে, নিয়মিত বাহিনীর অস্ত্রশস্ত্র পাকিস্থানী নিয়মিত বাহিনীর অস্ত্রশস্ত্রের মতই হবে। কিন্তু অনিয়মিত বাহিনীর অস্ত্রশস্ত্র হালকা ধরণের হবে এবং এলএমজির চেয়ে ভারী অস্ত্র দেওয়ার প্রয়োজন হবে না।

জেনারেল ওসমানী আমাদের সাথে একমত হন এবং তিনি আমাদেরকে আশ্বাস দেন যে এই পরিকল্পনা যাতে তাড়াতাড়ি কার্যকর হয় তিনি সে চেষ্টা করবেন, ইতিমধ্যে বাংলাদেশের হাজার হাজার লোক ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। অনেক যুবক আমাদের কাছে যুদ্ধ করার ইচ্ছা প্রকাশ করে। আমি আমার হেড কোয়ার্টারে একটা ট্রেনিং ক্যাম্প চালু করে দিই। এই ট্রেনিং ক্যাম্পে বিভিন্ন ধরণের ট্রেনিং-এর প্রবর্তন করি। বিশেষ করে পাক বাহিনীর যোগাযোগ ব্যবস্থাকে বিধ্বস্ত করে দেয়ার জন্য ডেমোলিশন ট্রেনিং-এর ভার ক্যাপ্টেন হায়দার (বর্তমানে মেজর) এবং হাবিলদার মুনিরের উপর ন্যস্ত করি। অতি সত্বরই আমার বেশ কিছু ডেমোলিশন টিম ট্রেইন্ড হয়ে যায়। প্রথমেই আমি এসব টিমগুলোকে ঢাকা, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণাবাড়িয়া এবং কুমিল্লা-চট্টগ্রাম রেল লাইন এবং পাক সড়কে পাঠিয়ে দিই। তাদের একাজ দিই যে যতোটুকু সম্ভব পুল এবং রেলওয়ে লাইন ধ্বংস করে দেয়ার জন্য। এসব কাজে আমাদের সবচেয়ে বড় অসুবিধার সৃষ্টি হয় ডেমোলিশন-এর সরঞ্জামাদির অভাবে। আমরা হয়তো বারুদ পাই কিন্তু ফোটানোর জন্য ডেটোনেটর পাই না কিংবা অন্য কোন সরঞ্জামাদি। এসব অসুবিধার মধ্যেও আমরা প্রত্যেকটি রেল এবং রাস্তাতে বেশ কিছুসংখ্যক পুল ধ্বংস করে দিতে সক্ষম হই যার ফলে  ঢাকার সঙ্গে এই সব প্র্রধান স্থানগুলোর পাকিস্থানীদের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিনষ্ট হয়ে যায় এবং পাকিস্থানকে বিমান ও জলপথের সাহায্য নিতে হয়। এইরূপ অবস্থা শেষ পর্যন্ত চলে।

আমি আমার হেডকোয়ার্টার তেলিয়াপাড়া থেকে সরিয়ে কুমিল্লার কাছাকাছি মতিনগর নামক স্থানে স্থাপন করি। সেখান থেকে কুমিল্লা এবং ঢাকা কাছে হওয়াতে আমার পক্ষে এসব জায়গাতে গেরিলা তৎপরতা চালানো অনেক সুবিধাজনক হয়। আমার ট্রেনিং ক্যাম্প এ সময়ে অনেক বড় হয়ে যায় এবং হাজার হাজার ছেলেদের আমি ট্রেনিং দিতে শুরু করি। এসব ছেলেদের অনেককেই আমি নিয়মিত বাহিনীর শিক্ষা প্রদান করি। প্রথম অবস্থায় সৈন্যদের এবং অনিয়মিত বাহিনীর লোকদের থাকা কাওয়ার ও চিকিৎসার অত্যন্ত অসুবিধা হয়। আমাদের কাছে না ছিল রসদ, না ছিল টাকা পয়সা, না ছিল বাসস্থান। অনেক সময় এই সব হাজার হাজার লোককে খাওয়ানোর জন্য আমাকে বাংলাদেশের ভেতর বিভিন্ন রেশন ডিপো (এলএসডি) থেকে রসদ জোরপূর্বক আনতে হয়েছিল। কোন কোন সময় রসদের ব্যবস্থা হলেও হাজার হাজার লোকের খাবার তৈরীর হাড়ি পাতিল বাসনপত্র ছিল না। তেলের ড্রাম কেটে আমরা পাত্র তৈরী করে নিই। অনেক সময় এমন দিন যায় যে ২৪ ঘন্টার মধ্যে মাত্র একবার ক্যাম্পের লোক খেতে পেয়েছে শুধু আধাসিদ্ধ ভাত, কোন সময় ডাল ছাড়াই। থাকার জন্য কোন আশ্রয় না থাকায় অধিকাংশ লোকজনকে বৃষ্টিতে ভিজতে হতো। কোন বিশুদ্ধ পানি ছিলনা নালার পানি ব্যবহার করতে হতো। তবুও এত কষ্টের ভিতরে আমি ক্যাম্পে লোকজনের মুখে সবসময় হাসি এবং উৎফুল্ল ভাব দেখতাম। এরা সবাই নিয়মিত এবং গণবিহিনী মিলেমিশে সব প্রতিকুল অবস্থার মধ্যে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিয়েছিল। আস্তে আস্তে অব্যবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়। ভারত সরকার ইউথ ক্যাম্প তৈরী করার জন্য সাহায্য দেয়। আমি আগরতলার রিলিফ ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে একটা ইউথ ক্যাম্পের অনুমোদন করিয়ে নিই। তাদের কিছুটা আর্থিক সাহায্যের ব্যবস্থা করি এবং আমার লোকদের প্রচেষ্টায় আমরা মেলাঘর নামক স্থানে একটা ক্যাম্প গঠন করি। এ জায়গাটা পাহাড়ের উপর এবং জঙ্গলের ভিতর বেশ একটা সুন্দর জায়গায় অবস্থিত ছিল। পাকিস্থানী হামলার আশংকা থেকেও বিপদমুক্ত ছিল। এখানেই আমি আমার স্থায়ী হেডকোয়ার্টার স্থাপন করি। এ ক্যাম্পটিতে বেশী জায়গা ছিল বলে আমি তিন চার হাজার লোককে একত্রে থাকা-খাওয়া এবং ট্রেনিং-এর বন্দোবস্ত করতে পারি। এ ক্যাম্পে আমি নিয়মিত ও গণবাহিনীর উভয় প্রকারের মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং শুরু করি। এ সময় কুমিল্লার দক্ষিণে আমার যে সব সেনাদল ছিল তাদেরকে নিয়ে একা সাবসেক্টর গঠন করি। এ সাব সেক্টর হেডকোয়ার্টার আমি নির্ভয়পুরে স্থাপন করি। ক্যাপ্টেন আকবর (বর্তমানে মেজর) লে. মাহবুব এবং লে. কবির এই সাবসেক্টর থেকে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিল। এখান থেকে একটি কোম্পানী সুবেদার আলি আকবর পাটোয়ারীর অধীনে লাকসামের পশ্চিমবর্তী এলাকায় তাদের গোপন ঘাঁটি স্থাপন করে এবং এখান থেকে নোয়াখালী, লাকসাম, কুমিল্লা, চাঁদপুরের রাস্তায় শত্রুসেনাদের উপর অনেক আক্রমণ চালাতে থাকে।

জুলাই মাসে শত্রুদের একটি শক্তিশালী দল এলাকাকে মুক্তিসেনাদের হাত থেকে মুক্ত করার জন্য লঞ্চযোগে চাঁদপুর থেকে ডাকাতিয়া নদীতে অগ্রসর হয়। বেদার আলী আকবর পাটোয়ারি আগে থেকে এ সম্বন্ধে খবর পেয়েছিল। সে ছাতুরার নিকট একটি সুপারির বাগানে শত্রুসেনাকে এমবুশ করার জন্য প্রস্তুত ছিল। নদীর দু’পাশে হালকা মেশিনগান লাগিয়ে শত্রুদলের অপেক্ষায় ছিল। সকাল ১১টায় শত্রুরা লঞ্চযোগে এমবুশ অবস্থানের মধ্যে পৌঁছায় এবং নদীর দুই তীর থেকে আমাদের কোম্পানীর লোকেরা শত্রুসেনার উপর অতর্কিত গোলাগুলি চালায়। এতে লঞ্চের মধ্যে অনেক শত্রুসেনা হতাহত হয়। উভয় পক্ষের এ সংঘর্ষে শত্রুসেনারা পর্যুদস্ত হয়। উপায়ন্তর না দেখে শত্রুসেনারা পিছু হটে যায় এবং আবার লঞ্চ থেকে নেমে অগ্রসর হওয়ার হওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু এবারও তারা পরাস্ত হয়ে চাঁদপুরে ফিরে যায়। এ কোম্পানী পরে চাঁদপুর থেকে কুমিল্লার বেশ কয়েকটি সেতু ও রেলসেতু ধ্বংস করে দেয়। পাকি বাহিনী পরবর্তী পর্যায়ে অনেকবার আমাদের এ মুক্ত এলাকাকে দখল করার চেষ্টা করে কিন্তু তারা অসমর্থ হয়। নির্ভয়পুর থেকে আমাদের সৈন্য এবং গেরিলা বাহিনী লাকসাম-চট্টগ্রাম রেলওয়ে সেতু এবং রাস্তার সেতু ধ্বংস করে দেয় এতে চট্টগ্রাম এবং কুমিল্লার মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়।

উত্তরাঞ্চলে কসবা, মন্দভাগ, আখাউড়া শালদানদী প্রভৃতি অঞ্চলে যখন আমার সেনাদলের সাথে পাকবাহিনীর প্রত্যহ সংঘর্ষ তীব্রতর হচ্ছিল, সে সময়ে কুমিল্লা দক্ষিণাঞ্চলে মিয়ার বাজার এবং চৌদ্দগ্রাম অঞ্চলেও আস্তে আস্তে পাকবাহিনীর সাথে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। আমার ৪র্থ বেঙ্গল-এর বি কোম্পানীর একটি প্লাটুন এবং ইপিআর ও মুজাহিদদের নিয়ে গঠিত সম্মিলিত দলটি জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে মিয়ার বাজারে ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কের উপর প্রতিরক্ষা অবস্থান গঠন করে ব্যুহকে আরো শক্তিশালী করে তোলে। এর ফলে চট্টগ্রাম-ঢাকার মধ্যে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। পাকবাহিনীর মধ্যে এ অবস্থার তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। মিয়ার বাজারের নিকট যে রাস্তায় সেতুটি ছিল, সেটাও উড়িয়ে দেয়া হয়। এছাড়া কুমিল্লার ৬ মাইল দক্ষিণে বাগমারাতে যে রেলওয়ে সেতুটি ছিল, সেটাও ভেঙ্গে দেয়া হয়। পাকবাহিনী ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক পুনরায় খোলার জন্য ৩০শে মে সকাল ছটায় দুই কোম্পানী সৈন্য নিয়ে দক্ষিণের দিকে অগ্রসর হয়। বেলা ১১ টার সময় আমাদের একটি এমবুশ দল মিয়ার বাজারে উত্তরে পাকসেনাদের উপরে অতর্কিত হামলা চালায়। শত্রু সেনাদল মিয়ার বাজারের এত আগে এ ধরণের হামলার জন্য প্রস্তুত ছিল না। ফলে তারা সম্পূর্ণ হতচিকত হয়ে যায়। তিন ঘন্টা যুদ্ধের পর শত্রুসেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে কুমিল্লার দিকে পলায়ন করে। এ যুদ্ধে শত্রুদের প্রায় ৫০ জন হতাহত হয় এবং আমাদের সেনাদল দুটি ৩টনের গাড়ী গোলাবারুদ সহ ধ্বংস করে দেয় এবং একটি গাড়ী দখল করে নেয়। আমাদের পক্ষে দুজন সৈন্য নিহত এবং একজন আহত হয়। এরপর শত্রুরা কুমিল্লা বিমানবন্দর অবস্থান থেকে আমাদের মিয়ার বাজারের প্রতিরক্ষা অবস্থানের উপর ভীষণভাবে ভারী কামানের সাহায্যে গোলাবর্ষণ করতে থাকে এবং সঙ্গে সঙ্গে এ অবস্থানের উপর পুনরায় আক্রমণ করার চেষ্টা চালায়। শত্রুদের একটি শক্তিশালী পেট্রোল পার্টি চেওরা হয়ে মিয়ার বাজারের পূর্বদিক দিয়ে আমাদের অবস্থানের ভিতর প্রবেশের চেষ্টা করে। কিন্তু লে. কবিরের নেতৃত্বে আমাদের একটা ছোট দল পাক বাহিনীর পেট্রোল পার্টিকে এমবুশ করে। এই এমবুশে পাকবাহিনীর ১০ জন নিহত হয়। লে. কবির পাকবাহিনীর পিছু ধাওয়া করে তাদের তাড়িয়ে দেয়।

মিয়ার বাজারের অবস্থানটির উপর পাকসেনাদের চাপ বাড়তে থাকে। কামানের গোলা দিনে দিনে আমাদের অবস্থানের উপর তীব্র হতে থাকে। অবস্থানটি বেশী দিন আর টিকানো যাবেনা ভেবে আমি লে. ইমামুজ্জামানকে একটু পিছু হটে চৌদ্দগ্রাম থানার বাজারের নিকট নতুন করে অবস্থান তৈরীর নির্দেশ দিই। ইমামুজ্জামান তাঁর দলকে নিয়ে চৌদ্দগ্রামে আবার এক নতুন প্রতিরক্ষাব্যুহ গড়ে তোলে। এ প্রতিরক্ষাব্যুহ তিন দিকে মুখ করে গড়ে তোলা হয়। ৪র্থ বেঙ্গলের প্লাটুনটি মিয়ারবাজারে কুমিল্লার দিকে মুখ করে পজিশন নেয়। কুমিল্লা-চট্টগ্রাম রাস্তায় মিয়ার বাজারের যে সেতুটি ছিল, সে সেতুটির দক্ষিণে অবস্থানটি গড়ে তোলে। এদের উপর দায়িত্ব ছিল কুমিল্লা থেকে পাক বাহিনীকে দক্ষিণ দিকে অগ্রসরে বাধা দেয়া। আরেকটি প্লাটুনকে পশ্চিম দিকে মুখ করে বাগমারা থেকে যে কাঁচা রাস্তা মিয়ার বাজারের দিকে আসে তার উপর প্রতিরক্ষাব্যুহ করার নির্দেশ দিই। মুজাহিদ কোম্পানির দায়িত্ব ছিল দক্ষিণ দিকে মুখ করে মিয়ার বাজার হতে আধা মাইল দক্ষিণে চট্টগ্রাম-কুমিল্লা মহাসড়কের উপর অবস্থান গড়ে তোলা এবং দক্ষিণ থেকে শত্রুসেনাদের অগ্রগতিকে বাধা দেওয়া। কিছু কিছু মাইন সরু বাঁশ কেটে আমার এ অবস্থানের চতুর্দিকে পুঁতে দিই। দুই সপ্তাহ পরে শত্রুসেনারা কুমিল্লার দিক থেকে এ অবস্থানটির উপর দুটি কোম্পানি নিয়ে আক্রমণ চালায়। কিন্তু শত্রুদের বেশ কিছুসংখ্যক সৈন্য হতাহত হওয়ার পরে তারা আক্রমণ বন্ধ করে দিয়ে পশ্চাদপরণ করে। শত্রুরা আমাদের অবস্থানের উপর তাদের কামানের গোলা চালিয়ে যায়।

১৪ জুন সকাল ৬টার সময় পাকসেনারা নয়া বাজার হয়ে চৌদ্দগ্রামের দিকে অগ্রসর হয়। কিন্তু তারা আমাদের একটা এমবুশ পার্টির ফাঁদে নয়া বাজারের নিকট পড়ে যায়। শত্রুদের ৩০ জন হতাহত হয় এবং তাদের অগ্রগতি ব্যত হয় এবং পিছু হটে যায়। ১৯শে জুন সকাল ৬টায় পাকসেনারা অন্ততপক্ষে ২টি ব্যাটালিয়ন নিয়ে দুই দিক থেকে (লাকসাম ও ফেনীর দিক থেকে) প্রবল আক্রমণ শুরু করে। তীব্র কামানের গোলার মুখে আমাদের সম্মুখবর্তী সৈনকরা পিছু হটে আসতে বাধ্য হয়। পাকসেনাদের আক্রমণ সন্ধ্যা পর্যন্ত চলতে থাকে। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা পর্যন্ত পাকসেনাদের আক্রমণে আমাদের চৌদ্দগ্রামে অবস্থানটি সংকটময় হয়ে পড়ে। আর বেশীক্ষণ এ অবস্থানটিতে থাকলে রাতের অন্ধকারে শত্রুসেনা দ্বারা পরিবেষ্টিত হবার আশংকা ছিল। যদিও পাকসেনাদের সমস্ত দিনের যুদ্ধে অন্তত ২০০ জন হতাহত হয়েছিল এবং আমাদের পক্ষে ক্ষতির সংখ্যা ছিল ২ জন নিহত এবং ৪ জন আহত। তবুও চৌদ্দগ্রাম শত্রুদের প্রবল আক্রমণের মুখ থেকে আর রক্ষা করা যাবেনা বলে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় আমাদের সেনাদল অবস্থানটি পরিত্যাগ করে।

মে মাসে যখন আমাদের শত্রুদের সঙ্গে সম্মুখসমর চলছিল, সে সময় আমার মুক্তিযোদ্ধারা শত্রু বাহিনীর পিছনে তাদের আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছিল। ২১শে মে দুজন মুক্তিযোদ্ধা জামাল এবং খোকন একটি এন্টি-ট্যাংক মাইন পুঁতে শত্রুবাহী একটি ট্রাককে কুমিল্লার নিকট উড়িয়ে দেয়। গেরিলাদের আর একটি পার্টি দেবীদ্বার থানা আক্রমণ করে ছয়জন দালাল পুলিশকে নিহত করে। গেরিলাদের হাতে হাজিগঞ্জ থানার একজন পুলিশ সাব-ইন্সপেক্টর ও দুইজন দালাল পুলিশ নিহত হয়। এ পুলিশদের নিহত হওয়ার সংবাদ পেয়ে পাকবাহিনীর একটি ছোট দল (দশজনের মত) হবিগঞ্জ থানা পাহাড়ায় নিযুক্ত হয়। গেরিলারা একদিন আক্রমণ চালিয়ে তাদের চারজনকে নিহত করে।

এ সময়ে ঢাকাতে আমাদের কমান্ডো ছেলেরা নয়টি সরকার অফিসে আক্রমণ চালিয়ে বিস্ফোরণ ঘটায়। সেগুলো ছিল সেক্রেটারিয়েট বিল্ডিং, হাবিব ব্যাংক, স্টেট ব্যাংক, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ, সদরঘাট টার্মিনাল, পাকিস্থান অবজারভার অফিস প্রভৃতি। এসব আক্রমণে চারজন পাক সেনা অফিসার এবং দুজন সৈনিক নিহত হয়।

কুমিল্লার দক্ষিণে গৌরীপুর নামক স্থানে আমাদের কমান্ডোরা পাকসেনাদের উপর অকস্মাৎ আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণেও পাকসেনাদের ৯ জন সৈন্য নিহত হয়।

পাকসেনারা ইতমধ্যে শালদানদী এরিয়াতে বিশেষভাবে তাদের সৈন্য সংখ্যা বাড়াতে থাকে। তাদের ১টা রেলওয়ে ট্রলি যা শত্রুদের জন্য রেশন এবং এমুনিশন নিয়ে যাচ্ছিল ২১শে মে আমাদের একটা ছোট এমবুশ দলের হাতে ধরা পড়ে। এর ফলে আমাদের হস্তগত হয় এমজিআইএ ৩.৭৫ এমএম এবং ১০৬ আরআর এর শেল।

২২শে মে তারিখে মুজাহিদ ক্যাপ্টেন আব্দুল হকের নেতৃত্বে একটি গেরিলা দল শালদা নদী এলাকায় অবস্থানরত শত্রুদের প্রতিরক্ষা ঘাঁটির উপর অকস্মাৎ আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণটা শত্রুদের পিছন থেকে পরিচালিত হয়। শত্রুরা এরকম আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিলনা। মুজাহিদ ক্যাপ্টেন আব্দুল হকের প্লাটুন শত্রুদের অবস্থানটি ভেদ করে ভিতরে প্রবেশ করে। শত্রুরা তাদের অবস্থানের ভিতর এ অতর্কিত আক্রমণে সম্পূর্ণ হকচকিত হয়ে যায়। এ আক্রমণের ফলে পরে আমরা জানতে পারি যে, শত্রুদের প্রায় ১৫ জন হতাহত হয়েছে এবং তাদের মধ্যে ৪ জন মারা যায়।

২৫শে মে রাত আড়াইটার সময় আমাদের এমবুশ পার্টি বাটপাড়া জোড়কাননের নিকট শত্রুদের ১টা ট্রাক এবং ১টা আরআর রাইফেল-এর জীপ এমবুশ করে। এই এমবুশে শত্রুদের প্রায় ২০ জন সৈনিক ট৬্রাক এবং জীপসহ ধ্বংস হয়ে যায়। ২৯শে মে সকাল সাড়ে ৬টায় একটা এমবুশ পার্টি সুবেদার আবদুর রহমানের নেতৃত্বে ১৫ জন লোক নিয়ে কুমিল্লার উত্তরে রঘুনাথপুর নামক স্থানে এমবুশ করে বসে থাকে। শত্রুদের একটা পেট্রোল পার্টি ১ জন অফিসার ও ২৫ জন সৈন্য নিয়ে আমাদের এমবুশের ফাঁদে পড়ে যায় এবং সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়। ২৭শে মে মন্দভাগ থেকে ১টি প্লাটুন বিকাল সাড়ে পাঁচটায় কুট শালদা নদীর সিএণ্ডবি রাস্তার উপর শত্রুদের এমবুশ করে। এ এমবুশের ফলে শত্রুদের ৯জন লোক নিহত হয় এবং ১১টা জীপ ও ১টা ডজ ধ্বংস হয়ে যায়। শত্রুরা তাদের মৃতদেহগুলো রেখেই পলায়ন করে। পেট্রোল পার্টি ২ জন পাকসেনাকে জীবিত অবস্থায় ধরতে সক্ষম হয়। মে মাসের মাঝামাঝি ফেনী এবং লাকসামের মাঝে রেলেওয়ে ব্রিজি উড়িয়ে দেওয়া হয়। রেলওয়ে ব্রিজের উপর পাকসেনাদের ১০ জন পাহারাদাড় ছিল। তাদেরকেও সে সঙ্গে মেরে ফেলা হয়।

২৬শে মে ক্যাপ্টেন আইন উদ্দিনের নেতৃত্বে ১টি শক্তিশালী দল কসবার উত্তরে ইমামবাড়ীর নিকট ১৫০ পাউণ্ড এক্সপ্লোসিভ লাগিয়ে রেলওয়ে ব্রিজ ধ্বংস করে দেয়। এরপর এ দলটির শত্রুদের জন্য এ্যামবুশ করে বসে থাকে। শত্রুরা ব্রিজের দিকে অগ্রসর হয়। শব্দ শোনে আমাদের দল তৈরী হয়। ব্রিজ পর্যন্ত পৌঁছার আগেই পাক সেনারা এমবুশ-এর ভয়ে সেখান থেকে ফেরত চলে যায়। ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিন পরে তার দলটিকে নিয়ে কর্ণাল বাজারে শত্রু অবস্থানের উপর অকস্মাৎ আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণের সময় ৭৫ এমএমআআর-এর সাহায্যে শত্রুদের কয়েকটি ব্যাংকার ধ্বংস করে দেয় এবং সঙ্গে সঙ্গে ৩ ইঞ্চি মর্টারের সাহায্যেও গোলাবর্ষণ করে। এতে শত্রুদের ৮জন সেনা নিহত হয় এবং কয়েকটি ব্যাংকার ধ্বংস হয়।

আখাউড়া থেকে আমাদের অবস্থান পরিত্যাগ করার পর আমি আমার দলকে আখাউড়ার উত্তরে আজমপুর গ্রামে সিঙ্গারবিলে পজিশন নেয়ার নির্দেশ দিই। লে. হারুনের নেতৃত্বে ১টি ইপিআর কোম্পানী এবং ৪র্থ বেঙ্গল-এর ১টি প্লাটুন আজমপুর রেলওয়ে কলোনীর পেছনে মাধবপুর সড়ক এবং রেল লাইনের উপর প্রতিরক্ষাব্যুহ গঠন করে। এ জায়গাটা ছিল একটু উঁচু এবং এর ডান দিকে তিতাস নদী থাকাতে এ অবস্থানটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। পাকসেনারা প্রথমে বুঝতে পারেনি যে আমরা এ জায়গাতে প্রতিরক্ষা অবস্থান নিয়েছি। শত্রুদল আখাউড়া দখল করার পর ভেবেছিল যে এবার তারা সিলেট আখাউড়া লাইনে ট্রেন যোগাযোগ পুনরায় চালু করবে। এ জন্য সিলেটের দিক থেকে ১টি লাইন-ইঞ্জিন এবং কয়েকটি বগিসহ মাধবপুর থেকে দক্ষিণে পাঠায়। সিঙ্গারবিল স্টেশনের কিছু উত্তরে পুলের নিকট লে. হারুন কয়েকটি এ্যান্টি ট্যাংক মাইন রেল লাইনের নীচে আগেই পুঁতে রেখেছিল। এ ট্রেনটি লাইনের উপর দিয়ে আসার সময় মাইনের আঘাতে লাইনচ্যুত হয়ে যায়। এর কিছুদিন পরে পাকিস্থান বাহিনীর কিছু সৈনিক এবং রেলওয়ে কর্মচারীরা ক্রেন নিয়ে আসে এ ট্রেনটি তোলার জন্য। কিন্তু পাক সেনাদের এ দলটি লে. হারুনের পূর্বপরিকল্পিত এমবুশে পড়ে যায়। এর ফলে প্রায় ২০ জন পাক সেনা নিহত এবং তারা রেলওয়ে কর্মচারীসহ সেখান থেকে পালিয়ে যায়। এর কিছুদিন পর লে. হারুন সিঙ্গারবিল রেলওয়ে ব্রিজ ১৪০ পাউণ্ড এক্সপ্লোসিভ লাগিয়ে উড়িয়ে দেয়। পাকবাহিনী এ সেতুটি মেরামত করার জন্য রেলওয়ে কর্মচারী ও আরো সরঞ্জাম সিঙ্গারবিল রেলওয়ে স্টেশনে জমা করে। এরপর সেসব সরঞ্জাম তারা রেলওয়ে সেতুটির নিকট নিজেদের তত্ত্বাবধানে এবং পাহারাধীনে আনে। লে. হারুনের মর্টার প্লাটুন সুবেদার শামসুল হক (বর্তমানে সুবেদার মেজর) এ সময়েরই অপেক্ষায় ছিল। পাকবাহিনী কয়েকদিন পর সকালে যখন তাদের সেতু মেরামতের কাজ আরম্ভ করেছে, ঠিক সে সময় সুবেদার শামসুল হকের মর্টার তাদের লক্ষ্য করে গোলা ছুড়তে থাকে এবং সঙ্গে সঙ্গে লে. হারুনও তার সৈন্যদের দিয়ে আক্রমণ চালায়। পাক বাহিনী এ আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে তাদের সমস্ত সরঞ্জাম ফেলে সেখান থেকে পলায়ন করে এবং সে সঙ্গে সিলেট-চট্টগ্রাম রেলওয়ে লাইন তাদের জন্য চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। এ সংঘর্ষে পাকবাহিনীর দশজন লোক নিহত হয়।

কিছুদিন পর পাকবাহিনী আমাদের আজমপুর পজিশনের উপর কামান দিয়ে গোলাবর্ষণ করতে থাকে। তারা বুঝতে পেরেছিল যে আজমপুর থেকে আমাদের অবস্থানটিকে দখল করতে না পারলে সিলেট ঢাকা রেলওয়ে লাইন তারা কখনো খুলতে পারবে না।

২৯শে মে কিছু কিছু ফাইটিং পেট্রোল তারা আজমপুর পজিশনের পশ্চিমে তিতাস নদী বরাবর পাঠায় আমাদের পজিশন বিস্তারিত জানার জন্য। কিন্তু সবেক্ষেত্রেই এসব পাকদল আমাদের হতে পর্যুদস্ত হয়ে পলায়ন করে। আমরাও পাক সেনা বাহিনীর আখাউড়া অবস্থানে ছোট ছোট দল পাঠিয়ে ব্যতিব্যস্ত করে তুলি। আমরা জানতে পারি যে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ট্রলি বা লাইট ইঞ্জিনের মাধ্যমে পাকবাহিনী তাদের রসদ এবং সরঞ্জাম আখাউড়াতে পাঠায়। এ খবর জানতে পেরে আমাদের ১টি দল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ২ মাইল দক্ষিণে রেল লাইনের নিচে মাইন পুঁতে দেয়। কিন্তু পাকবাহিনীর স্থানীয় দালালদের সহায়তায় এসব মাইন সম্বন্ধে জানতে পারে এবং সেগুলি উঠিয়ে নেয়। পাকবাহিনী এ সময়ে রেল লাইনের নিকটবর্তী গ্রামের লোকদেরকে কঠোর সতর্ক করে দেয় যে, কোন গ্রামের নিকটে মুক্তিবাহিনী যদি তাদের কোন ক্ষতিসাধন করে তবে সে গ্রাম পুড়িয়ে দেয়া হবে। এ সতর্কতার ঘোষণায় প্রতিদিন রাতে পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলো হতে লোকজন লাইন এবং সড়ক পাহারা দিত। এর ফলে আমাকে পাকবাহিনীর গতিবিধির উপর বাধাবিঘ্ন সৃষ্টি করতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল।

এ রকমের বাধাবিপত্তির সম্মুখীন আরো অনেক জায়গাতে আমি হই। আমাদের কাজ অব্যাহত রাখার জন্য যেসব জায়গায় আমার লক্ষ্যস্থল ছিল, সেখানের আমার সেনাদলগুলোকে সান্ধ্য আইন (কারফিউ) জারি করার নির্দেশ দিই এবং এ নির্দেশ বহুলাংশে সফল হয়। যদিও গ্রামবাসীদের পাকবাহিনীকে সহায়তা করার কোন ইচ্ছা ছিল না, তারা তাদের ভয়ে এসব বাধাবিপত্তির সৃষ্টি করতো। আমাদের সান্ধ্য আইনের ঘোষণায় অনেক ফল হয় এবং গ্রামবাসীরা আর বাধা ‍সৃষ্টি করে না। এরপর আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং আখাউড়ার মাঝে ২টি রেলসেতু উড়িয়ে দিই। এর ফলে আখাউড়ায় পাকসেনাদের অবস্থানটির জন্য রসদ এবং অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহে যথেষ্ট অসুবিধা হয়। এরপর তারা আখাউড়াতে হেলিকপ্টারের সাহায্যে রসদ সরবরাহ করতে বাধ্য হয়।

পাকবাহিনী আমাদের আজমপুর পজিশনের উপর তাদের চাপ বাড়াতে থাকে। তাদের ২টা কোম্পানী একদিন সকালে আজপুরের আধ মাইল দক্ষিণে দরগার নিকট আমাদের অগ্রবর্তী অবস্থানের উপর আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণ সকাল ৬টা থেকে ১১টা পর্যন্ত চলে। আমাদের সৈন্যরাও আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিল। প্রায় ৩০ জন শত্রুসেনা হতাহতের পর তারা আক্রমণ বন্ধ  করে নিয়ে আবার পশ্চাদপসরণ করে।

বেশ কিছুদিন পর জুন মাসে পাকস্থানী সৈন্য মাধবপুরের রাস্তা এবং রেল লাইনের উপর আমার পজিশনের দিকে অগ্রসর হয়। এবার পাকসেনাদের ১২ নং ফ্রন্টিয়ার ফোর্স আমাদের অবস্থানের উপর আক্রমণ চালায়। আমাদের অগ্রবর্তী দরগা পজিশন থেকে এ আক্রমণকে বেশ কয়েকদিন বিফল করে দেয়া হয়। কিন্তু জুন মাসের শেষের দিকে আক্রমণ আরো তীব্রতর হয়ে ওঠে। পাক বাহিনী আখাউড়াতে ১২০এমএম ভারী মর্টার এবং ১০৫এমএম তোপ নিয়ে আসে। এসব কামানের গোলার আঘাতে এবং ১২ নং ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের প্রবল চাপে আমাদের অগ্রবর্তী পজিশন সংকটময় হয়ে ওঠে এবং শত্রুদের অন্তত ৫০ জন হতাহতের পর আমাদের পজিশন পরিত্যাগ করতে বাধ্য হতে হয়।

এরপর কিছুদিন পর জুলাই মাসে পাক বাহিনী আবার আজমপুরের দিকে মুল অবস্থানের উপর আক্রমণ চালায়। আবারও তারা মাধবপুরের সড়ক ও রেল লাইনের উপর ১২ নং ফ্রন্টিয়ার ফোর্স এবং মিলিশিয়াসহ আক্রমণ চালায়। আক্রমণের পূর্বে প্রচণ্ড গোলাগুলি করতে থাকে। আমরা এ আক্রমণের জন্য আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলাম। আক্রমণের প্রথম পর্যায়ে যখন পাক সেনারা সারিবদ্ধ লাইনে আমাদের অবস্থানের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল, তখন আমাদের মর্টার এবং মেশিনগান তাদের অন্ততপক্ষে ১০০/১২০ জনের মত লোককে হতাহত করে। তারা আমাদের অবস্থানের কোন কোন জায়গায় ঢুকে পড়ে কিন্তু আমাদের পাল্টা আক্রমণে আমরা পাক সেনাদের হটিয়ে দিই। এ সংঘর্ষ প্রায় দুইদিন চলে। আমরাও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলাম, কোন অবস্থাতেই আমরা আমাদের ঘাঁটি ছাড়বো না। শত্রুসেনাদের যথেষ্ট হতাহত হচ্ছিল প্রতিদিনই, কিন্তু তারাও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ আমাদের এ অবস্থানটিকে দখল করার জন্য। তাদের কামানের গোলায় আমাদের অবস্থানটির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছিল কিন্তু তবুও আমাদের সৈনিকরা আত্মবিশ্বাস হারায়নি। আমাদের অবস্থানটি আমাদের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের আগরতলা বিমানবন্দরের বেশ নিকটেই ছিল। এরফলে পাকবাহিনীর কামানের গোলার স্প্লিন্টার মাঝে মাঝে বিমানবন্দরে গিয়ে পড়ছিল। পাশ্ববর্তী রাষ্ট্র আমাদের এ অবস্থাটি থেকে যুদ্ধ আরো চালিয়ে যাওয়ার আপত্তি করে। তাদের বিমানবন্দরের ক্ষতি হওয়ার আশংকায় এ আপত্তি করে। আমরা নিরূপায় হয়ে দেড় মাস যুদ্ধ চালানোর পর আজমপুর অবস্থান পরিত্যাগ করে সিঙ্গারবিলে নতুন অবস্থান গড়ে তুলি।

পাক বাহিনী মাধবপুর থেকে অগ্রসর হয়ে কমলছড়ি চা বাগান দখল করে নেয়। এই চা বাগানে তারা মিলিশিয়ার এক কোম্পানী এবং নিয়মিত বাহিনীর প্লাটুনসহ একটা শক্তিশালী ঘাঁটি গড়ে তোলে। লে. হারুন বুঝতে পারে যে, পাক সেনারা আখাউড়া থেকে (দক্ষিণ থেকে) এবং মাধবপুর থেকে (উত্তর থেকে) কমলছড়ি হয়ে তার সিঙ্গারবিল পজিশনকে ঘিরে ফেলার পরিকল্পনা করেছে। লে. হারুন পাক বাহিনীকে পৃথকভাবে উত্তর এবং দক্ষিণে আঘাত হানার এ পরিকল্পনা নেয়। এ পরিকল্পনা অনুযায়ী কমলছড়ি চা বাগান প্রথম আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। জুলাই মাসে কমলছড়ি চা বাগান এবং চা বাগানে পাক বাহিনীর ঘাঁটি সম্বন্ধে সে বিস্তারিত খবরাখবর যোগাড় করে। একদিন রাত তিনটার সময় ৪র্থ বেঙ্গল-এর ১টা প্লাটুন এবং ইপিআর-এর ১টা কোম্পানী নিয়ে গোপন পথে ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে কমলছড়ি পাকবাহিনীর অবস্থানের ভিতর সাহসের সাথে ঢুকে পড়ে। এ অকস্মাৎ গোপন আক্রমণ পাক সেনাদলকে হতভম্ব করে দেয়। তাদের কিছু বুঝাবার বা বাধা দেয়ার আগেই রে. হারুনের দল পাক বাহিনীর অন্তত ছয়টা ব্যাংকার গ্রেনেডের সাহায্যে ধ্বংস করে দেয়। এরপর সমস্ত রাত ধরে পাক বাহিনীর সঙ্গে হাতাহাতি লড়াই চলতে থাকে। পাকিস্থানী সৈন্যরা অকস্মাৎ আক্রমণের প্রথম পর্যায়ে হকচকিত হয়ে গিয়েছিল এবং তাদের মনোবল ভেঙ্গে দিয়েছিল। সে জন পরবর্তী পর্যায়ে যখন লে. হারুনের ছোট ছোট দলগুলি চা বাগানের সরু এবং গোপন রাস্তায় অগ্রসর হয়ে একটার পর একটা ব্যাংকার ধ্বংস করে যাচ্ছিল তখন উপায়ন্তর না দেখে পাক বাহিনীর সৈন্যরা মনোবল হারিয়ে পালিয়ে যেতে শুরু করে এবং এতে তাদের বেশ লোক গুলিতে নিহত হয়। সকাল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত কমলছড়ি চা বাগানটি সম্পূর্ণ লে. হারুনের দখলে এসে যায়। এ যুদ্ধের ফলে পাকিস্থানীদের ৫০ জন নিহত হয় এবং আমাদের হাতে ৪টি মেশিনগান ও ৬টি হালকা মেশিনগান, বেশ কিছু রাইফেল এবং অজস্ত্র গোলাগিুলি ও প্রচুর রসদ এবং কাপড়-চোপড় হস্তগত হয়।

ক্যাপ্টেন গাফফার এবং ক্যাপ্টেন সালেকের নেতৃত্বে মুক্তিসেনারা মন্দভাগ এবং মালদানদীতে শত্রুসেনাদের উপর অনবরত আঘাত চালিয়ে যাচ্ছিল। ২৬শে মে রাত ৯টায় সুবেদার ভুইয়ার নেতৃত্বে দুটি সেকশন রকেট লাঞ্চার নিয়ে শত্রুর শালদানদীর পজিশনের ভিতর ঢুকে যায়। এরপর শত্রুদের ২টা ব্যাংকার তারা রকেট লাঞ্চারের সাহায্যে ধ্বংস করে দেয়। শত্রুরা তাদের উপর পাল্টা আক্রমণ চালালে পেট্রোল পার্টি হালকা মেশিনগানের সাহায্যে শত্রুসেনাদের বেশ কিছু লোক নিহত করে এবং তারা পিছু হটে আসে। পরে জানতে পারা যায় যে, এ আকস্মিক হামলায় শত্রুদের ১ জন জেসিও এবং ৯ জন সৈন্য মারা যায়। ২৮শে মে রাতে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডোরা কুমিল্লর নিকট কালিকাপুর রেলওয়ে ব্রিজ উড়িয়ে দেয়। ঐ দিনই সকালে পাকিস্থানী সেনারা কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়কের কাছে রঘুরামপুরে একটি কোম্পানী নিয়ে আসে। এ কোম্পানীকে আমাদের সেনাদল সকাল সাড়ে ছটার সময় অতর্কিতে এমবুশ করে এবং এমবুশে পাকসেনাদের অন্তত একজন অফিসারসহ ৩৫ জন লোক হতাহত হয়। পাকসেনারা আঘাত খেয়ে মরিয়া হয়ে ভবনগর, শালকুমড়া, খাড়েরা, ফকিরবাজার প্রভৃতি গ্রামগুলো জ্বালিয়ে দেয়। এ ছাড়াও শত্রুসেনারা তিন ইঞ্চি মর্টার এবং ১০০এমএম ভারী মর্টারের সাহায্যে যথেষ্টভাবে পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলির উপর গোলা ছুড়তে থাকে।

২৮শে মে আরেকটি পেট্রোল পার্টি নায়েক গিয়াসুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে মনোহরপুর নামক গ্রামে শত্রুদের জন্য একটি এমবুশ পেতে থাকে। পাকসেনাদের ১টি কোম্পানী জঙ্গলবাড়ির দিকে যাচ্ছিল কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া রাস্তা দিয়ে। সকাল সাড়ে ৮টায় পাকসেনাদের কোম্পানীটি নায়েক গিয়াসুদ্দিনের এ্যামবুশের ফাঁদে পড়ে যায় এবং তাদের ২৫ জনের মত লোক হতাহত হয়। শত্রুসেনারা পিছু হটে এসে পুনরায় কামানের গোলার সাহায্যে আক্রমণের চেষ্টা করে। তখন আমাদের এমবুশ পার্টি তাদের অবস্থান পরিত্যাগ করে। শত্রুরা পার্শ্ববর্তী মনোহরপুর ইত্যাদি গ্রাম জ্বালিয়ে দেয় সাথে সাথে কামানের সাহায্যে গোলা ছুঁড়তে থাকে।

শালদানদীর শত্রু অবস্থানটির উপর আমাদের চাপ আরো বাড়াতে থাকি। ২৫শে মে আমাদের আর একটি ছোট দল অতর্কিত হামলা করে পাকসেনাদের ১জন জেসিও এবং ৫জন সৈন্যকে নিহত করে। তাদের ২টি মর্টারও ধ্বংস করে দেয়া হয়। ২৭শে মে শত্রুসেনাদের কুটি থেকে সিএণ্ডবি রাস্তায় শালদা নদীতে আরো সৈন্য আনার চেষ্টা করে। সকাল ৭টায মুক্তিবাহিনী পাকসেনাদের এ দলটিকে এমবুশ করে। এমবুশ-এর ফলে ১টা জীপ, ১টা ডজ ধ্বংস ও শত্রুদের ৯ জন লোক নিহত হয়। শত্রুরা সামনে অগ্রসর হতে না পেরে পশ্চাদপরণ করতে বাধ হয়।

২৮শে মে সকাল ৬টায় কুমিল্লার দক্ষিণে রাজারমার দীঘির শত্রুদের ১টা ব্যাংকার আমাদের ২জন সৈনিক গোপনে গিয়ে গ্রেনেড ছুঁড়ে ৪জন লোককে নিহত করে এবং তাদের রাইফেলগুলো দখল করে নিয়ে আসে। ঐ দিন সকাল ৯টায় লাকসাম-কুমিল্লা রেল লাইনের উপর আলীশ্বরের নিকট মাইন পুঁতে ১টা রেলওয়ে ইঞ্জিন ও ২টি বগি লাইনচ্যুত করে। ২৬শে মে জগন্নাথদিঘী শত্রু অবস্থানের উপর লে. ইমামুজ্জামানের প্লাটুন রাত ১১টার সময় অকস্মাৎ আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণে ১টি প্লাটুন ২টি তিন ইঞ্চি মর্টার ২টি মিডিয়াম মেশিনগান ব্যবহার করে। আক্রমণের ফলে শত্রুদের ১৯ জন লোক হতাহত হয়। আমাদের ১টি পেট্রোল পার্টি ২৬শে মে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-কুমিল্লা রোডের উপর উজানিরশা সেতুর নিকট পাকবাহিনীর পাহারারত সৈনিকদের ক্যাম্প আক্রমণের জন্য পাঠান হয়। আমাদের দলটির সঙ্গে কমান্ডো শিক্ষাপ্রাপ্ত কিছু লোকও ছিল। কুমিল্লা এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া এ দুই জায়গাতেই পাকবাহিনীর শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল। ব্রাহ্মণবাড়িয়া রাস্তা তাদের গতিবিধির জন্য বিশেষ জরুরী ছিল। উজানিরশা ব্রিজকে ধ্বংস করে পাকসেনাদের গতিবিধিকে ব্যহত করা ছিল আমাদের লক্ষ্য। আমার দলটি রাত ১১টায় উজানিরশা ব্রিজটি অকস্মাৎ হামলা করে এবং সফলতার সাথে বিস্ফোরক লাগিয়ে ১টা স্প্যান ধ্বংস করে দেয়। এ অকস্মাৎ হামলায় শত্রুদের ১৩ জন নিহত এবং ৬ জন আহত হয়।

ক্যাপ্টেন গাফফারের নেতৃত্বে ৪র্থ বেঙ্গলের সি কোম্পানী ২৯শে মে শালদানদীর পিছনে পশ্চিম শিবপুর, বাজার ও সাগরতলাতে শত্রুদের অবস্থানের পিছনে সকাল ৪টায় মেশিনগান এবং ৭৫এমএমআরআরসহ ঢুকে পড়ে। শত্রুরা তাদের পিছনে হঠাৎ মুক্তিবাহিনীর অনুপ্রবেশে বেশ হকচকিয়ে যায়। সকাল ৫টা পর্যন্ত আমাদের দলটি শত্রু অবস্থানের উপর তীব্র আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণে শত্রুদের বেশ কয়েকটা ব্যাঙ্কার ধ্বংস হয়ে যায়, বেলুচের মেজর দুররানিও নিহত হয়।

৩১শে মে আমাদের ১টা পেট্রোল পার্টি কুটির নিকট শত্রুসেনাদের অবস্থান সম্বন্ধে তথ্যানুসন্ধানে যায়। কুটির নিকটে তারা দেখতে পায় যে পাকসেনাদের ১টি জীপ ৬ জন সৈনিকসহকুটি গ্রামে প্রবেশ করছে। জীপটি গ্রামের পাশে এসে দাড়ায়। তাদের মধ্য থেকে ৬জন পাকসেনা জীপ থেকে বের হয়ে গ্রামের ভিতরে যায়। আমাদের ছোট দলটি বোমা ছুঁড়ে ড্রাইভারসহ জীপটি ধ্বংস করে দেয়।

৩১শে মে-তেই আমাদের ৬ জন সৈন্যের একটি দল সুবেদার আবদুল হক ভুঁইয়ার নেতৃত্বে শালদানদী রেলওয়ে স্টেশনের নিকট অনুপ্রবেশ করে। তারা যখন তথ্যানুসন্ধান করছিল, সে সময় পাক সেনাদের দুইজন ওপি যারা গাছের উপর বসে দুরবীণ লাগিয়ে আমাদের অবস্থান খুঁজছিল, তাদের দেখে ফেলে এবং গুলি করে মেরে ফেলে।

৪র্থ বেঙ্গল-এর আলফা কোম্পানী মেজর সালেকের নেতৃত্বে এবং চার্লি কোম্পনী ক্যাপ্টেন গাফফারের নেতৃত্বে শালদানদী এবং মন্দভাগে পাকসেনাদের উপর বারবার আঘাত হেনে যাচ্ছিলো। শত্রুরা প্রতিদিন কিছু না কিছু হতাহত হচ্ছিলো। আমাদের এই দুই কোম্পানীর সেনা দল ৩ ইঞ্চি মর্টারের সহায়তায় শিবপুর, বাগরা, গৌরঙ্গলা প্রভৃতি জায়াগ হয়ে শত্রুঅবস্থানটি প্রায় তিন দিক থেকে ঘিরে রেখেছিল এবং প্রতিদিন আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছিলো। অবস্থা এরূপ সঙ্গীন হয়ে গিয়েছিল যে, পাকসেনাদের পক্ষে তাদের বাংকার থেকে মাথা তোলারও সুযোগ ছিলনা। গুলি এবং মর্টারের গোলার সাহায্যে আমাদের সৈনিকরা তাদের সে অবস্থানে থাকাকে সম্পূর্ণ বিপদজ্জনক করে তুলেছিল। এছাড়া কুটি এবং শালদানদীর রাস্তায় আমাদের এমবুশ পার্টি ২৪ ঘন্টা এমবুশ পেতে থাকত। এর ফলে রসদ এবং অস্ত্র সরবরাহ করা তাদের পক্ষে মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা রেলওয়ে লাইন ব্যবহারের বারবার চেষ্টা করেও বিফল হয়েছে। এরপর শালদানদী দিয়ে রসদ সরবরাহ করার চেষ্টা করে। সেখানেও তারা আমাদের দ্বারা আক্রান্ত হয় এবং যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এমতাবস্থায় তাদের মনোবল সত্যিই ভেঙ্গে গিয়েছিল।

জুন মাসের ১ তারিখে আমাদের চাপের মুখে টিকতে না পেরে তারা মন্দভাগ এবং শালদানদীর অবস্থানগুলি পরিত্যাগ করে নয়নপুর রেলওয়ে স্টেশনের নিকট তাদের নতুন ঘাঁটি স্থাপন করে। সম্মুখসমরে শালদানদী থেকে শত্রুসেনাকে জুন মাসের প্রথম দিকে পর্যুদস্ত করে পিছু হঁটিয়ে দেয়া আমাদের সৈনিকদের জন্য ছিল একটা বিরাট সাফল্য ও কৃতিত্ব। এতে আমার সেক্টরের সব সৈনিকদের মনোবল পুনরুদ্ধার হয়। মার্চ মাস এবং মে মাসের প্রথম দিকে যখন পাক বাহিনী অতর্কিতে বিপুল সৈন্য, কামান, বিমান বাহিনীর সহায়তায় আমাদের উপর আক্রমণ চালায় তখন আমাদের সৈনিকরা অতি সাহসিকতা ও বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে পাক সেনাদের অনেক ক্ষয়ক্ষতি করে কিন্তু অবশেষে বেশীরভাগ সময়ে পাকবাহিনীর বিপুল শক্তি ও সরঞ্জামের সামনে বাধ্য হয়ে পিছু হটতে হয় এবং সবেক্ষেত্রেই আমরা প্রতিরক্ষা অবস্থানে থেকে যুদ্ধ করেছি এবং পাকবাহিনী আমাদের উপর বারবার আক্রমণ চালিয়েছে। শালদানদী এবং মন্দভাগে প্রথম এক মাস আমরা পাকবাহিনীর উপর প্রতি আক্রমণ চালিয়ে তাদের শক্তিশালী অবস্থান থেকে বিতাড়িত করি। শত্রুসেনা চলে যাবার পর ক্যাপ্টেন গাফফারকে মন্দভাগে প্রধান অবস্থান গড়ে তোলার এবং শালদানদীতে তাঁর অগ্রবর্তী ঘাঁটি করার নির্দেশ দিই।

যখন আমি যুদ্ধ চালাচ্ছিলাম এবং যুদ্ধ আস্তে আস্তে যখন তীব্রতর হচ্ছিল, তখন আমার সেনাদলে আহত এবং নিহতের সংখ্যাও বেড়ে চলছিল। সে সময়ে আমার সৈনিক এবং গণবাহিনীর জন্য চিকিৎসার বন্দোবস্ত ছিলনা, শুধু আমার সঙ্গে সেনাবাহিনীর ১ জন ডাক্তার ক্যাপ্টেন আখতার ছিলেন। অফিসারের স্বল্পতায় তাঁকেও আমি একটা কোম্পানীর কমান্ডার বানিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়োগ করেছিলাম এবং যুদ্ধক্ষেত্রে ক্যাপ্টেন আখতার একজন ডাক্তার হয়েও একজন যোদ্ধা হিসেবে বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন। আমার আহতের সংখ্যা যখন বেশ বেড়ে যায় এবং অনেক সময় দ্রুত চিকিৎসার অভাবে অনেক সৈনিক বা গণবাহিনীর ছেলেরা রক্তক্ষয় হয়ে মারা যেতে থাকে তখন আমি বুঝতে পারলাম যে আমার সেক্টরেই চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্য ক্যাপ্টেন আখতারকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ডেকে পাঠাই এবং অতি সত্বর আমার হেডকোয়ার্টারের নিকট একটি চিকিৎসালয় স্থাপন করার নির্দেশ দিই। ঢাকা থেকে কিছু সংখ্যক ছেলে-মেয়ে আমার সেক্টরে এসে আশ্রয় নেয়। এদের মধ্যে দুই একজন চিকিৎসা শিক্ষানবিসও ছিল। তারাও আমাকে ১টি হাসপাতাল গড়ার জন্য অনুরোধ জানায়। এসব ছেলেমেয়ে নিয়ে ক্যাপ্টেন আখতার কয়েকটি তাঁবুতে মতিনগরে আমার হেডকোয়ার্টারের নিকট মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য প্রথম বাংলাদেশ হাসপাতালের ভিত্তি স্থাপন করেন। একটা সুন্দর বাগানের ভিতর উঁচু এবং শান্ত পরিবেশে এ হাসপাতালটি অবস্থিত ছিল। প্রথমে হাসপাতালে ব্যবহারের জন্য আমাদের কাছে ঔষধপত্র বা অস্ত্রোপাচারের সরঞ্জাম কিছুই ছিলনা। কিন্তু তবুও আমাদের এই নবীন দলটি ক্যাপ্টেন আখতারের নেতৃত্বে সমস্ত বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও ধীরে ধীরে হাসপাতালটি গড়ে তুলতে থাকে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বেগম সুফিয়া কামালের দুই মেয়ে টুলু এবং লুলু, মেডিক্যাল ছাত্রী ডালিয়া, আসমা, রেশমা, ক্যাপ্টেন সিতারা বেগম, সবিতা, শামসুদ্দিন প্রমুখ। এসব ছেলেমেয়েদের দল নিজেদের সুখ ও আরাম ত্যাগ করে দিন-রাত কঠোর পরিশ্রম করে যুদ্ধক্ষেত্রে আহত সৈনিকদের এবং গণবাহিনীর ছেলেদের সেবাশুশ্রুষা ও চিকিৎসা করে যাচ্ছিলো। এরা রেডক্রস ও বন্ধুরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করে অনেক কষ্টে ওষুধপত্র যোগাড় করতো। মাঝে মাঝে আমি যতটুকু টাকা-পয়সা সেক্টর ফান্ড থেকে দিতে পারতাম তা দিয়ে ওষুধপত্র যোগাড় করত। জুন মাসের দিকে লণ্ডন থেকে ডাঃ মবিন (প্রবাসী বাঙালি) আমাদের এই হাসপাতালের কথা শোনে এখানে এসে যোগ দেন। এর কিছুদিন পর ডাঃ মবিনের আরেক বন্ধু ডাঃ জাফরুল্লাহ সংবাদ পেয়ে লণ্ডন থেকে এসে যোগ দেন। এরা দুজনেই লণ্ডনে এফআরসিএস পড়ছিলেন। দেশে মুক্তিযুদ্ধের সংবাদ শোনে তারাও এসে অংশ নেয়ার জন্য আগ্রহী ছিলেন। তারা তাদের লণ্ডনের সব সুখ ও আরাম ত্যাগ করে আমাদের এ হাসপাতালের নাম শোনে ছুটে এসেছিলেন মাতৃভূমিকে শত্রুদের হাত থেকে মুক্ত করার জন্য। তাদের সঙ্গে আমার বিস্তারিত আলাপ হয় এবং আমরা এই হাসপাতালটি গড়ে তোলার জন্য একটি পরিকল্পনা নিই। ডাঃ মবিন ও ডাঃ জাফরুল্লাহ আমাকে আশ্বাস দেন লণ্ডনে অবস্থিত প্রবাসী বাঙালীরা তাদের মাতৃভূমির জন্য সবকিছু ত্যাগ করতে প্রস্তুত আছে এবং আমরা যদি বাংলাদেশ মেডিক্যাল এসোসিয়েশনের কাছে আহ্বান জানাই তবে এ হাসপাতালে সরঞ্জামের ব্যবস্থা তারা করতে পারবে। এ পরিপ্রেক্ষিতে আমি ডাঃ মবিন ও ডাঃ জাফরুল্লাহকে বিস্তারিত সরঞ্জামের তালিকা বানানোর নির্দেশ দেই। আর সেই সঙ্গে ক্যাপ্টেন আখতারকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আর একটু পিছে বিশ্রামগঞ্জে সুন্দর জায়গায় পাহাড়ের উপর অস্থায়ী হাসপাতাল নির্মাণের জন্য পরিকল্পনা নিতে নির্দেশ দেই। আমার সঙ্গে এব্যাপারে আমাদের প্রধান সেনাপতি এম এ জি ওসমানীর (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল) সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা হয়। তাকে আমি আমার সেনাদল ও ছেলেদের চিকিৎসার শোচনীয় অবস্থার কথা জানাই। তিনি আমাকে হাসপাতাল তৈরীর পরিকল্পনায় উৎসাহ দেন এবং সঙ্গে সঙ্গে ত্রিশ হাজার টাকা মঞ্জুর দেন। একমাসের মধ্যে বাঁশ, কাঠ ও ছন দিয়ে আমরা বিশ্রামগঞ্জে ২০০ বেডের হাসপাতাল তৈরী করে ফেলি। ডাঃ জাফরুল্লাহ লণ্ডনে চলে যান হাসপাতালের জন্য ওষুধপত্র ও অস্ত্রোপাচারের সরঞ্জামাদির ব্যবস্থা করতে। আমাদের হাসপাতাল যখন তৈরী হচ্ছিল তখন আহতের সংখ্যাও দিন দিন বেড়েই যাচ্ছিল। ডাক্তারের যথেষ্ট অভাব ছিল। এছাড়াও ওষুধের অভাব ছিল আমাদের প্রকট। কিন্তু তবুও এসব অসুবিধার মধ্যেও আমাদের ছোট হাসপাতালটি আস্তে আস্তে পূর্ণাঙ্গ হয়ে উঠছিল। যদিও এগুলি বাঁশ এবং ছনের ঘর ছিল তবুও উৎসর্গিত ছেলেমেয়েদের প্রছেষ্টায় সমস্ত এলাকাটা শান্তিদায়ক হয়ে উঠছিল। সকালে উঠেই সমস্ত হাসপাতালের বিভিন্ন কাঁচা ওয়ার্ডগুলো তারা নিজ হাতে লেপতো এবং পরিষ্কার করতো। হাসপাতালের রোগীর কাপড়-ধোয়া থেকে শুরু করে তাদের রান্নাবান্না, সেবাশুশ্রুষা সব কিছু এরাই করতো। এদের সঙ্গে আরো ২০ জনের মতো ছেলেমেয়ে এসে যোগ দেয়। কিছুদিন পর ডাঃ জাফরুল্লাহ ও ডাঃ মবিনের প্রচেষ্টায় এবং লণ্ডন প্রবাসী বাঙালি ডাক্তারদের সহায়তায় আমরা এ হাসপাতালটির জন্য অস্ত্রোপাচারের সরঞ্জামাদিসহ ওষুধপত্র পেয়ে যাই। ৯ মাসের যুদ্ধে এ হাসপাতালটি কয়েক হাজার আহতকে চিকিৎসা ও অস্ত্রোপাচার করতে সক্ষম হয়। এ হাসপাতালটির আর একটি অবদান ছিল যে এটি স্থাপনের পর আমার সেনাবাহিনীর ছেলেদের ও গণবাহিনীর মনোবল আরো বেড়ে যায়। তারা বুঝতে পারে যদি তারা যুদ্ধক্ষেত্রে আহত হয় তবে চিকিৎসার অভাবে মারা যাবে না। যুদ্ধকালীন সময়ে প্রধান সেনাপতি কর্ণেল ওসমানী হাসপাতালটি পরিদর্শন করেন এবং এটাকে আরো উন্নত করার জন্য উৎসাহ দেন। সেপ্টেম্বর মাসে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমেদ হাসপাতালটি পরিদর্শন করেন এবং এর ভূয়সী প্রশংসা করেন।

২৯শে মে রাতে আমাদের একটা পেট্রোল পার্টি কুমিল্লার বাটপাড়ায় এমবুশ পেতে বসে থাকে। শত্রুদের ২টা গাড়ী ২টার সময় এমবুশ পেতে বসে থাকে। এমবুশ পার্টি সাফল্যের সাথে ২টি গাড়ী ধ্বংস করে দেয় এবং সেই সঙ্গে ৪ জনকে নিহত করে। শত্রুদের পিছনের গাড়ীটি ফাঁদে পড়ার আগেই পালিয়ে যায়। ২৯শে মে রাত ৯টায় ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিনের নেতৃত্বে ২টি সেকশন করবার পশ্চিমে টি. আলীর বাড়িতে শত্রুদের অবস্থানের উপর অকস্মাৎ অনুপ্রবেশ করে এবং আক্রমণ চালায়। সঙ্গে সঙ্গে মর্টারের সাহায্যে আড়াইবাড়ি শত্রুঅবস্থানের উপর গোলা চালায়। এ আক্রমণে শত্রুদের ১টা ব্যাংকার ধ্বংস হয়ে যায় এবং তিনজন লোক নিহত ও ২ জন শত্রুসেনা আহত হয়। এরপর আমাদের সৈন্যরা আক্রমণ শেষ করে নিজ অবস্থানে চলে আসে।

৩১ মে রাত তিনটায় একটা প্লাটুন লে. মাহবুবের নেতৃত্বে কুমিল্লার দক্ষিণে জহমোহনপুর নামক স্থানে শত্রু ঘাঁটির উপর অকস্মাৎ আক্রমণ চালায় এবং শত্রুসেনাদের ১২ জন হতাহত হয়। পাকসেনারা যখন কসবার দিকে তাদের চাপ বাড়াতে থাকে, আমি ক্যাডেট হুমায়ুন কবিরকে একটা কোম্পানীসহ কসবার উত্তরে লাটুমুরায় অবস্থান নেওয়ার নির্দেশ দিই।

৩০শে মে সন্ধ্যা ৭টায় আমাদের ১টি ছোট গেরিলা দল ইকবালের (বাচ্চু) নেতৃত্বে বিবিরবাজারে শত্রুসেনাদের অবস্থানে আঘাত হানার জন্য পাঠান হয়্ পাক সেনারা তখন তাদের অবস্থানের উপর বসে তাদের সান্ধ্যভোজনে ব্যস্ত ছিল এবং এ সময়টি সম্বন্ধে আমাদের স্থানীয় লোকের দ্বারা খবর আগে থেকেই সংগ্রহ করা ছিল। পাক সেনারা যখন খাওয়ায় ব্যস্ত ছিল, সে সময় আমাদের গেরিলা দলটি তাদের উপর হঠাৎ গোমতী বাঁধের উপর থেকে গোলাবর্ষণ করে। এতে শত্রুদের ১০ জন হতাহত হয়। ঐদিন সাড়ে ৬টার সময় আমাদের মর্টার প্লাটুন সিঙ্গারবিল শত্রু অবস্থানের উপর উপর গোলাবর্ষণ করে। এর ফলে শত্রুদের ৬ জন নিহত এবং ৭ জন আহত হয়। ২৯শে মে চৌদ্দগ্রাম বাবুর্চি রোডে হরিসর্দার বাজারের নিকট রাস্তার ব্রিজ সম্পূর্ণভাবে উড়িয়ে দেয়া হয়।

২৯শে মে বিকাল ৪টায় ৪র্থ বেঙ্গল-এর পাইওনিয়ার পার্টিকে লাকসাম-চাঁদপুর রেলওয়ে লাইনে মাইন পুঁতে রেল গাড়ী লাইনচ্যুত করার জন্য পাঠানো হয়। এ দলটি মাইন পুঁতে লাকসাম এবং নোয়াখালীর মাঝে তিনটি রেলওয়ে বগী সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত করে দেয়। ফেরার পথে পাইওনিয়ার পার্টির ছোট দলটি চৌদ্দগ্রাম-চট্টগ্রাম সড়কের উপর একটি সদ্য মেরামত করা ব্রিজের উপর মাইন পুঁতে দেয়। রাত ৮টায় একটি জিপ ৫ জন পাকসেনাসহ ফেনীর দিক থেকে আসে। জিপটি যখন ব্রিজের উপর পৌঁছে তখন মাইন বিস্ফোরিত হওয়াতে ব্রিজটি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়ে যায়। এর ফলে ১ জন অফিসারসহ তিনজন পাকসেনা নিহত এবং অন্য ২ জন গুরুতরভাবে আহত হয়। ঐ দিন সন্ধ্যায় তিনজন গেরিলাকে হ্যাণ্ড গ্রেনেডসহ চৌদ্দগ্রাম থানায় পাঠান হয়। থানার সন্নিকটে দিঘির নিকট শত্রুদের একটি ব্যাংকার ছিল। গেরিলা দলটি গ্রেনেড ছুড়ে ব্যাংকারটি ধ্বংস করে দেয়। ফলে ৩ জন শত্রুসেনা নিহত হয় এবং কিছু স্থানীয় লোকও আহত হয়। ৩০শে মে চৌদ্দগ্রামের আধ মাইল উত্তরে চৌদ্দগ্রাম মিয়ারবাজার রোডের উপর ৪র্থ বেঙ্গল-এর বি কোম্পানীর একটি প্লাটুন হঠাৎ শত্রুদের ২৭ জনের একটি দলকে দুরে থেকে আসতে দেখতে পেয়ে তাড়াতাড়ি এমবুশ পাতে। শত্রুরা যদিও এ অতর্কিত আক্রমণে হকচকিত হয়ে যায় কিন্তু তারা ত্বরিত গতিতে রাস্তার পশ্চিম পাশে সরে পড়ে। এমবুশের ফলে শুধু তিনজন শত্রুসেনা নিহত হয়। আমাদের গেরিলারা লাকসাম বাংগোড়া কাঁচা রাস্তার উপর ফেলনা গ্রামের নিকট মাইন পুতে রাখে। শত্রুদের একটি তিন টনের গাড়ী এ মাইনের সাথে সংঘর্ষে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়ে যায়। ২৯শে মে ৪র্থ বেঙ্গল-এর ব্রাভো কোম্পানীর একটা প্লাটুন ২টি ৩ ইঞ্চি মর্টারসহ সন্ধ্যায় চৌদ্দগ্রাম থানার উপর মর্টারের সাহায্যে অতর্কিত আক্রমণ চালায়। অতর্কিত মর্টারের গোলার আঘাতে এবং হালকা মেশিনগানের আঘাতে তাদের যথেষ্ট হতাহত হয়।

জুন মাসের ৪ তারিখে রাত দুটোর সময় ৪র্থ বেঙ্গল-এর ‘এ’ কোম্পানীর ২টা প্লাটুন মর্টার নিয়ে শত্রুদের অবস্থানে গোপন পথে প্রবেশ করে শালদা নদীর দক্ষিণে বাগড়া বাজার নামক স্থানে অবস্থান নেয়। ভোর বেলায় পাকসেনারা যখন তাদের ব্যাংকারের উপর অসতর্কভাবে ঘোরাফেরা করছিল ঠিক সে সময় আমাদের সৈনিকরা তাদের উপর অতর্কিত মর্টার এবং মেশিনগানের সাহায্যে আক্রমণ চালায়। পাকসেনারা এ অতর্কিত আক্রমণে সম্পূর্ণ হতচকিত হয়ে যায়। আধঘন্টা পর্যন্ত তাদের পক্ষ থেকে কোন পাল্টা জবাব আসেনা। এ আক্রমণের ফলে শত্রুদের প্রায় ১৭ জন নিহত ও ৫ জন আহত হয়। আমাদের একজন সৈন্য বুকে গুলি লেগে গুরুতরভাবে আহত হয়। এ আক্রমণের তিন ঘন্টা পরে শত্রুরা যখন ভেবেছিল আমাদের সৈন্যরা অবস্থান পরিত্যাগ করেছে এবং তাদের আহতদের পিছনে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করছিল, ঠিক সে সময় আমাদের সৈন্যরা আবার তাদের উপর দ্বিতীয় দফা আক্রমণ চালায়। এতে শত্রুদের আবারও ৫ জন নিহত হয়। এরপর আমাদের পার্টি অবস্থান ত্যাগ করে চলে আসে। ঐ দিনই সকাল ৭টার সময় আমার আর একটা পার্টি শত্রুদের রাজাপুর অবস্থানের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে ৬ জন শত্রুকে নিহত করে এবং তিনজনকে আহত করে। আমাদের আরেকটি দল রাত ১টার সময় কুমিল্লার দক্ষিণে সুয়াগাজীতে চট্টগ্রাম-ঢাকা মহাসড়কের ১টা সেতু উড়িয়ে দেয় এবং বাগমারার রেলওয়ে সেতু উড়িয়ে দেয়।

৬ই জুন একটি ডেমোলিশন পার্টিকে লাকসামের দক্ষিণে পাঠানো হয়। এই দলটি ‘খিলাতে’ লাকসাম নোয়াখালী মহাসড়কের উপর ট্যাংকবিধ্বংসী মাইন পুতে রাখে। সকাল ৫টায় কুমিল্লা থেকে শত্রুর ২টি জীপ ও একটি ট্রাক নোয়াখালী যাবার পথে মাইনের আঘাতে ধ্বংস হয়ে যায় এবং সে সঙ্গে ৪জন পাক অফিসার এবং ৭ জন সৈন্য নিহত হয়। পাক সেনাদের ২টি কোম্পানী কুমিল্লা থেকে শালদানদীর উত্তরে আসে এবং রেলওয়ে লাইনের সাথে সাথে নয়নপুর রেলওয়ে স্টেশনের দিকে অগ্রসর হবার চেষ্টা করে। ৪র্থ বেঙ্গল-এর ‘এ’ কোম্পানী শত্রুদের অগ্রগতিকে বাধা দেয় সকাল ৬টার সময় শালদানদীর পূর্ব দিক থেকে। শত্রুরা বাধা পাবার ফলে পিছু হটতে বাধ্য হয়। আমাদের গুলির মুখে পাক সেনাদের ২৫ জন লোক হতাহত হয়্ সকাল ৬টায় পাক সেনাদের আর একটি দল কুমিল্লা থেকে একটি ট্রেনে করে নয়নপুর এবং শালদানদীর দিকে আসছিল। এ ট্রেনটি নয়নপুরের দক্ষিণে আমাদের অবস্থানরত সৈন্যদের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়। আমাদের গোলাগুলির সামনে শত্রুরা টিকতে না পেরে যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতির পর রাজাপুরে পশ্চাদপরণ করে। এর ৪/৫ ঘন্টা পরে শত্রুরা কামানের গোলার সহায়তায় আবার নয়নপুর পর্যন্ত অগ্রসর হতে সক্ষম হয়। কিন্তু নয়নপুর স্টেশনে যখন তারা ব্যাংকার তৈরীতে ব্যস্ত সে সময় আমাদের মর্টার তাদের উপর ভীষণ গোলাগুলি চালায় এবং শত্রুদের যথেষ্ট ক্ষতি করে। শত্রুরা কিছু পিছু হটে নয়নপুর গ্রামের ভিতর অবস্থান নিয়ে তাদের ব্যাংকার তৈরী করতে শুরু করে। ঐদিনই শত্রুদের একটি পেট্রোল পার্টি কসবার দিকে অগ্রসর হয়। আমাদের ৪র্থ বেঙ্গল-এর ডি কোম্পানীর একটা প্লাটুন তাদেরকে অতর্কিত এমবুশ করে। পাকসেনারা এ এমবুশ-এর ফলে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় এবং তাদের অন্ততপক্ষে ২০ জন লোক হতাহত হয়। শত্রুদের দলটি আমাদের এমবুশ পার্টির তাড়া খেয়ে তাদের অবস্থান আড়াইবাড়ির দিকে পালিয়ে যায়। আমাদের একটি দল কুমিল্লার দক্ষিণে ধ্যানপুর বিওপির নিকট পাকসেনাদের জন্য এমবুশ পেতে থাকে। সকাল ৯টায় পাকসেনারা দালালদের মারফতে এ খবর পায়। কুমিল্লা থেকে পাকসেনাদের একজন অফিসারসহ ১টা প্লাটুন গ্রামের ভিতর দিয়ে এসে আমাদের এমবুশ পার্টিকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করে। এমবুশ পার্টি তৎক্ষনাৎ কিছু পিছু হটে গিয়ে শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এ যুদ্ধ ঘন্টাখানেক স্থায়ী হয়। ইতোমধ্যে আমাদের ধানপুরের কোম্পানী খবর পেয়ে লে. মাহবুব ও লে. কবিরের নেতৃত্বে তৎক্ষণাৎ এমবুশ পার্টিকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসে এবং তারা পাকসেনাদের দলটিকে ঘিরে ফেলে। পাকসেনারা দুই দিক থেকে আক্রান্ত হয়ে গ্রামের ভিতর লুকিয়ে পড়ে এবং দালালদের সাহায্যে এ ঘেরাও থেকে বেরিয়ে আসতে সমর্থ হয়। এ সংঘর্ষে পাকসেনাদের ৫ জন সৈন্য নিহত হয়।

ঐ দিনই বিকাল তিনটায় পচুয়াতে আমাদের আর একটা এমবুশ পার্টির ফাঁদে শত্রুদের একটি দলের ১০ জন হতাহত হয়। ৪ ও ৫ জুন রাতে লাকসাম চাঁদপুর রেললাইনের মাঝে মধু রোডস স্টেশনের নিকেট জমজমা রেলওয়ে সেতুটি সুবেদার পাটওয়ারীর একটি দল উড়িয়ে দেয়। ঐদিনই রাতে আর একটি দল চাঁদপুর কুমিল্লা সড়কের মহামায়া বাজারের নিকটে একটি পুল ধ্বংস করে দেয়। এর দুই দিন পরে চাঁদপুরের বৈদ্যুতিক ট্রান্সফর্মারটি ধ্বংস করে দেয়া হয়। এর ফলে সমস্ত চাঁদপুরের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। কলকারখানাগুলিও বন্ধ হয়ে যায়। পরে শত্রুরা এসে পাশের গ্রামগুলি জ্বালিয়ে দেয় এবং লুটতরাজ ও মেয়েদের উপর পাশবিক অত্যাচার করে।

আমাদের ৪র্থ বেঙ্গল ডি কোম্পানীর একটা প্লাটুন ১১ই জুন সকাল ৬টায় কসবার উত্তরে চার্নল নামক জায়গায় এমবুশ পেতে রাখে। শত্রুদের একটি কোম্পানী দুপুর ১২টার সময় এমবুশের মধ্যে পড়ে যায়। আমাদের গুলিতে তাদের ১২ জন সৈন্য নিহত হয়। এতে আমাদের একজন আহত হয় এবং পরে মারা যায়। পাকসেনারা পর্যুদস্ত হয়ে ঐ জায়গা থেকে ইয়াকুবপুরের দিকে পলায়ন করে। পলায়নের পর শত্রুদেরকে আমাদের আর একটি এমবুশ পার্টি দেখে ফেলে এবং তারাও ইয়াকুবপুরের নিকট শত্রুদের আক্রমণ করার জন্য এমবুশ পাতে। শত্রুরা এ এমবুশের ফাঁদে পড়ে যায় এবং সম্পূর্ণরূপে পরাস্ত হয়। এ এমবুশে শত্রুদের ৮জন লোক নিহত এবং ১৩ জন আহত হয়। এ দুটি এমবুশে অনেক অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ আমাদের হস্তগত হয় এবং শত্রুরা এলাকা থেকে চলে যায়।

এ সময়ে শালদানদীর দক্ষিণে রেলওয়ে ব্রিজ, কুটির রাস্তায় বাসারা গ্রামের সেতু, মন্দভাগ গ্রামের সেতু সম্পূর্ণভাবে উড়িয়ে দেয়া হয়।

আমাদের হেড কোয়ার্টারে এ খবর আসে যে পাক সেনারা তলুয়াপাড়া ফেরী ঘাট তাদের যাতায়াতের জন্য সাধারণত: ব্যবহার করে থাকে। এ সংবাদ পেয়ে আমাদের একটি প্লাটুনকে ৯ই জুন রাত্রে তলুয়াপাড়াতে পাঠানো হয়। এ প্লাটুনটি তলুয়াপাড়া ফেরী ঘাটের নিকট শত্রুদের জন্য এমবুশ পাতে। ১০ই জুন রাত ১১টার সময় শত্রুদের একটি দল সেই ফেরীঘাটে আসে এবং নৌকাযোগে পার হতে থাকে। শত্রুরা যখন নদীর মাঝখানে, এমবুশ দলটি সে সময় তাদের উপর গুলি চালাতে শুরু করে। এর ফলে নৌকাটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়। পাকসেনাদের ২০ জন লোক হতাহত হয়।

আমাদের একটি প্লাটুন লে. মাহবুবুর রহমানের নেতৃত্বে ১০ই জুন রাত্রে মিয়াবাজারের দক্ষিণে রাজারমার দিঘী ও জগমোহনপুর কাচারীর শত্রু অবস্থানের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। পাক সেনারা এই সাহসী আক্রমণে হকচকিয়ে যায়। আমাদের সৈন্যরা পাক সেনাদের ব্যাংকারে গ্রেনেড ছুড়ে ৮ জন পাকসেনাকে নিহত ও ৫ জনকে আহত করে। পাকসেনারা বাধ্য হয়ে তাদের অবস্থান ত্যাগ করে। এরপর আমাদের সৈন্যরা অবস্থানটি দখল করে ব্যাংকারগুলি ধ্বংস করে দেয় এবং শত্রুদের পরিত্যক্ত অস্ত্রশস্ত্র হস্তগত করে।

আমাদের ৩টি গেরিলা দল কুমিল্লা ও লাকসামে পাঠানো হয়। ১১ই জুন কুমিল্লাতে গেরিলা দলটি শত্রুদের বিভিন্ন অবস্থানের উপর দশটি গ্রেনেড ছোড়ে। এতে পাকসেনাদের যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং সমস্ত কুমিল্লা শহর ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। ঐ দিনই চারজন গেরিলার ডেমোলিশন পার্টি জাঙ্গালিয়ার নিকট মাইন পুঁতে একটি ডিজেল ইঞ্জিন লাইনচ্যুত করে।

লাকসামে যে গেরিলা দলটি পাঠানো হয়েছিল তার নেতৃত্বে ছিলেন আব্দুল মান্নান। পাকসেনাদের একটি গাড়ীর উপর গ্রেনেড ছোড়ে এবং এতে ৫ জন নিহত হয়। এ দলটি লালমাইয়ের নিকট পাকসেনারা যে ঘরে থাকতো তার ভিতর ২টি গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। এতেও পাকসেনাদের যথেষ্ট হতাহত হয়। এর ফলে পাকসেনারা লাকসামে ৭২ ঘন্টার জন্য সান্ধ্য আইন জারী করে করে এবং অনেক নির্দোষ লোকের উপর অত্যাচার চালায়। আর একটি দল লাকসামে পাকসেনাদের উপর গ্রেনেড ছোড়ে। এর ফলে কিছু লোক আহত হয়। আমাদের দুটি এমবুশ পার্টি ফুলতলি এবং মিয়ার বাজারের নিকট ঐ দিনই এমবুশ পেতে রাখে পাক সেনাদের দুটি গাড়ী রাত সাড়ে চারটার সময় ফুলতলিতে এমবুশের মধ্যে পড়ে যায়। এমবুশ পার্টি একটা গাড়ীকে ধ্বংস করে দেয় এবং একটা গাড়ীর ক্ষতিসাধন করে। শেষের গাড়ীটির ভিতর এমবুশ পার্টি ২টি গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। এতে শত্রুদের ৬ জন লোক নিহত হয়। মিয়ার বাজারের এমবুশেও পাকসেনাদের ৫ জন লোক নিহত হয় এবং আমাদের এমবুশ পার্টি একটি মর্টার দখল করে নেয়।

আমাদের কাছে সংবাদ আসে যে, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক টিম জুন মাসে ঢাকাতে আসছে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি সম্বন্ধে সরেজমিনে ঘটনাবলী অবগত হওয়ার জন্য। ইতোমধ্যে পাকিস্থানের প্রচারযন্ত্র সমস্ত আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বুঝাতে চেষ্টা করছিল যে, বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি স্বাভাবিক। এ খবর পাওয়া মাত্র আমি ওয়ার্ল্ড ব্যাংক টিমটির অভ্যর্থনার ব্যবস্থা করি। আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক যদি পাকিস্থানকে আর্থিক সাহায্য দেয়, তাহলে সেই আর্থিক সাহায্যে পাকিস্থানের সমরাস্ত্র কেনার ও যুদ্ধ পরিচালনার পক্ষে যথেষ্ট সুবিধা হবে। যে করেই হোক ওয়ার্ল্ড ব্যাংক টিমকে বুঝিয়ে দিতে হবে যে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি মোটেই স্বাভাবিক নয়। বরং বাংলাদেশের অধিকাংশ স্থানই পাকবাহিনীর আয়ত্তাধীনে নেই।

এ পরিপ্রেক্ষিতে আমি গেরিলার একটি দলকে ঢাকা শহরে বিভিন্ন জায়গায় বিস্ফোরণ ঘটানো এবং পাকিস্থানীদের নিহত করার জন্য পাঠিয়ে দেই্। এই দলটি ৪টা জুন ঢাকায় গোপন পথে রওনা হয়ে যায় এবং পরদিন সকালে পৌঁছে যায়। এই দলেরই ২ জন ছেলে ৮ জুন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার সময় জিন্নাহ এভিনিউর কলেজ সু স্টোরের সামনে গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটায়। আর একটি গ্রেনেড ছুঁড়ে পুরাণা পল্টনে রাত আটটায়। ঐদিনই আরেকটি ছোট দল ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ভিতর একজন পাকিস্থানী অফিসারের বাড়ীর ভিতরে দুপুর দুটোর সময় গ্রেনেড ছোড়ে, এতে অফিসারের গাড়ীটির ক্ষতি সাধিত হয় এবং একজন লোক আহত হয। পরের দিন সন্ধ্যায় মর্নিং নিউজ অফিসের ভিতর গ্রেনেড ছোড়া হয়। এতে কয়েকজন পাকিস্থানী দালাল নিহত হয়। ইতোমধ্যে দলটি খবরাখবর নেয় যে, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক টিম হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে অবস্থান করছে। এ খবর পাবার পর ২ জন গেরিলা ৯ জুন সন্ধ্যা ৮-১৫ মিনিটে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে প্রবেশ করে এবং ওয়ার্ল্ড ব্যাংক টিম-এর হোটেলে ফেরার প্রতিক্ষায় থাকে। তারা যখন তাদের গাড়ীতে করে আসেন এবং গাড়ী নীচে রেখে হোটেলের ভেতর প্রবেশ করেন সেসময় গেরিলা গলটি গাড়ী লক্ষ্য করে ৩টি গ্রেনেড ছোড়ে। এর ফলে গাড়ীটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায় এবং নিকটবর্তী একজন পাঞ্জাবী সেনাও নিহত হয়।

এ সমস্ত ঘটনাবলীতে বিশ্বব্যাংক কর্মকর্তাগণ অতি সহজেই বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হন। ইন্টারকন্টিনেন্টালের বিস্ফোরণের সময় তারা ছিলেন প্রত্যক্ষদর্শী। তারা ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন পূর্ব পাকিস্থানের (বাংলাদেশের) অবস্থা স্বাভাবিক নয়। এই ঘটনার পর বিশ্বব্যাংক টিম ফিরে গিয়ে তাদের রিপোর্টে বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্বন্ধে সঠিক ঘটনাবলী তুলে ধরেন। তারা তাদের রিপোর্টে পাকিস্থানকে আর্থিক সাহায্য না দেওয়ার সুপারিশ করেন। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এটা ছিল পাকিস্থানের পক্ষে এক বিরাট পরাজয়।

রাজাপুর রেলওয়ে স্টেশনের নিকট পাচড়া গ্রামে শত্রুদের একটি অবস্থান ছিল। এই অবস্থানটি শত্রুদের নয়নপুর এবং রাজাপুর রেলওয়ে স্টেশনের পিছন থেকে সরবরাহের জন্য ব্যবহৃত হত। মতিনগর থেকে একটি রেইডিং পার্টিকে পাঁচড়া গ্রামে শত্রু অবস্থানের উপর উপর অনুপ্রবেশ করে আক্রমণ করার নির্দেশ দেয়। ১৩ই জুন রাত নটার সময় এ দলটি গ্রামের গোপন পথে শত্রু অবস্থানের ভিতর অনুপ্রবেশ করে এবং অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এ অতর্কিত আক্রমণে শত্রুদের মধ্যে সম্পূর্ণ বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। আমাদের দলটি বেশ কিছু পাকসেনাকে হতাহত করে শত্রু অবস্থান থেকে সরে পড়ে। কিন্তু এরপরেও শত্রুদের মধ্যে রাতের অন্ধকারে প্রায় ২ ঘন্টা গোলাগুলি চলতে থাকে। পাকসেনাদের অয়্যারলেস ম্যাসেজ আমাদের অয়্যারলেসে ধরা পড়ে। এতে শোনা যায় পাকিস্থান-জিন্দাবাদ, আজিজ ভাট্টি-জিন্দাবাদ, ১৭তম পাঞ্জাব-জিন্দাবাদ ইত্যাদি। গোলাগুলির প্রচণ্ড আওয়াজ তখনও চলতে থাকে। আমরা বুঝতে পারি যে, আমাদের দলটি সরে আসার পরও পাক বাহিনী নিজেদের মধ্যে কয়েক ঘন্টা গোলাগুলি করে বীরত্বের পরিচয় দিচ্ছে। এ সংঘর্ষে পাকসেনাদের ১১ জন নিহত ও ১২ জন আহত হয়। বেশ কিছুসংখ্যাক সৈন্য তাদের নিজেদের গুলিতেই হতাহত হয়।

পাকিস্থানীরা সীমান্তের নিকটবর্তী থানাগুলোতে পশ্চিম পাকিস্থানী পুলিশ এবং মিলিশিয়া নিয়োগ করতে শুরু করে। এসব থানাগুলিতে তারা ব্যাংকার তৈরী করে অবস্থানকে শক্তিশালী করতে থাকে। কুমিল্লার উত্তরে সবগুলো থানাতেই তারা এভাবে শক্তিশালী করে। আমি এসব থানাগুলোকে আক্রমণ করে পাকিস্থানীদের শাসনযন্ত্রকে অচল করে দেয়ার একটা পরিকল্পনা করি।

আমার অবস্থানের নিকটবর্তী বুড়িচং থানা আমার জন্য একটা বাধার কারণ হয়ে দাড়িয়ে ছিল। কেননা বুড়িচংয়ের ভিতর দিয়েই আমার গেরিলারা গোপন পথে ঢাকা, কুমিল্লা এবং ফরিদপুর যাতায়াত করতো। এই থানাটির অবস্থানের গোপন পথগুলো মোটেই নিরাপদ ছিলনা। পশ্চিম পাকিস্থানী পুলিশরা পাক সেনাদের খবরাখবর পাঠাত। আমি বুড়িচং থানা আক্রমণ করার জন্য ১৬ জনের একটি দলকে পাঠাই। ১৪ই জুন রাত ১টায় এই দলটি অতর্কিত বুড়িচং থানার উপর আক্রমণ চালায়। থানায় প্রহরারত ইপকাফ এবং পুলিশ যথেষ্ট বাধা দেয়। কিন্তু অবশেষে আমাদের রেইডিং পার্টির হাতে তারা পরাস্ত হয়। এই সংঘর্ষে শত্রুদের ৮ জন নিহত হয়। আমাদের ১ জন লোক গুরুতরভাবে আহত এবং ১ জন নিখোঁজ হয়। এর ফলে বুড়িচং থানা শত্রুমুক্ত হয় এবং ঢাকা, কুমিল্লা যাবার গোপন পথ নিরাপদ হয়।

ঢাকাতে ৪ঠা জুন যে দলটিকে পাঠানো হয়েছিল সেই দলটি তাদের কার্যকলাপ চালিয়ে যেতে থাকে যাতে স্বাভাবিক পরিবেশ পাকিস্থানীরা ফিরিয়ে আনতে না পারে। ঢাকার প্রশাসন ব্যবস্থা যাতে পাকিস্থানীদের সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণে না আসে তার জন্য এই গেরিলা দল তৎপর ছিল। দলটি ১০ই জুন দুপুর ২টার সময় নিউ মার্কেটের প্রধান চত্বরে তিনটি গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটায়। এর ফলে সমস্ত লোকজন নিউ মার্কেট থেকে পালিয়ে যায় এবং দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। এর পরদিন বিকাল ৪টায় যখন অফিস শেষ হচ্ছিলো ঠিক সে সময়য় ওয়াপদা বিল্ডিং-এর সামনে ২টি গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটায়। এর ফলে ওয়াপদা ভবনের কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যায়।

এদিকে নয়নপুর রেল স্টেশনের নিকট গোডাউনের ভিতর শত্রুদের কিছুসংখ্যক সৈন্য তাদের ঘাটি গড়ে তুলেছিল। এই সংবাদ ৪র্থ বেঙ্গলের এ কোম্পানী জানতে পারে। মেজর সালেক একটি প্লাটুনের সঙ্গে আর আর রাইফেল ও মর্টার দিয়ে এ ঘাটিটি আক্রমণের জন্য পাঠায়। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় এ দলটি শত্রুদের অবস্থানের দক্ষিণ দিক দিয়ে পিছনে অনুপ্রবেশ করে এবং অতর্কিতে ঐ গোডাউনটির উপর আক্রমণ চালায়। কয়েকটি আরআর এবং মর্টারের গোলা গোডাউনটির ভিতরে পড়ে বিস্ফোরণ ঘটায় এবং গোডাউনটির যথেষ্ট ক্ষতিসাধন করে। ঐ দিন রাতেই হাবিলদার সালামের নেতৃত্বে নয়নপুরের রেলওয়ে স্টেশনের দক্ষিণে আশাবাড়ি থেকে রাত দেড়টার সময় শত্রু অবস্থানের উপর আরআর রাইফেল ও মর্টারের সাহায্যে আবার আক্রমণ চালানো হয়্ শত্রুরা এ আক্রমণের জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলনা। তারা দ্বিতীয়বার আক্রমণ আশা করেনি। এ আক্রমণের ফলেও শত্রুদের যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হয়।

এ সময় শত্রুদের অবস্থান যেখানে ছিল সেসব অবস্থানের কাছাকাছি এবং পাকসেনাদের চলাচলের রাস্তার উপর মাইন পুতে রাখা হয়েছিল। ১৪ই জুন রাতে ফকিরহাট রেলওয়ে স্টেশন থেকে ৭০০/৮০০ গজ উত্তরে শত্রুর একটি দল দুপুরে বখশিমাইল গ্রামে পেট্রোলিং-এর জন্য গিয়েছিল। আর একটি দল গাজীপুরের নিকট আমরা যে কাঠের পুল জ্বালিয়ে দিয়েছিলাম সেটি মেরামত করছিল। বখসিমাইল গ্রাম থেকে সন্ধ্যার সময় পাকসেনাদের দলটি ফকিরহাটে নিজেদের অবস্থানে ফেরার পথে আমাদের পুঁতে রাখা মাইনের মধ্যে পড়ে যায় এবং মাইনগুলি তাদের পায়ের চাপে ফাটতে থাকে। এতে তাদের অনেক লোক হতাহত হয় এবং তাদের মধ্যে ভয়ংকর বিশৃঙ্খলা শুরু হয়। এ মাইনগুলোর ফাটার শব্দ নিকটবর্তী অবস্থান থেকে পাকসেনারা শুনতে পায়। রাতের অন্ধকারে তারা ঠিক বুঝতে পারছিলো না এ বিস্ফোরণের সঠিক কারণ কি? মুক্তিবাহিনীর দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে ভেবে পাকসেনারা প্রচণ্ডভাবে গোলাগুলি ছুড়তে থাকে। এই গোলাগুলি রাত ৮টা থেকে ৩টা পর্যণ্ত চলতে থাকে। শত্রুরা নিজেদের লোকের উপর শত শত মর্টার এবং কামানের গোলা ছুড়তে থাকে। আমাদের দুরে অবস্থিত পেট্রোল “ইয়া আলী, ইয়া আলী, বাঁচাও বাঁচাও” প্রভৃতি শুনতে পায়। পরে আমরা পাশ্ববর্তী গ্রামের লোকমুখে শুনতে পাই যে আমাদের মাইনে এবং পাক সেনাদের নিজেদের গোলাগুলিতে অন্ততপক্ষে ৪০/৫০ জন পাক সেনা হতাহত হয়েছে। পরদিন সকালে পাকসেনাদের একজন ব্রিগেডিয়ার ঐ অবস্থানটি পরিদর্শন করতে কুমিল্লা থেকে আসেন।

পাকসেনারা এই দুর্ঘটনার পর রাজাপুর রেলওয়ে স্টেশনের চতুর্দিকে এবং ফকিরহাট পর্যন্ত তাদের পেট্রোলিং আরো জোরদার করে। মতিনগরে অবস্থিত আমাদের কোম্পানী শত্রুদের এই কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। ১৬ই জুন সকালে আমাদের একটি প্লাটুন পাকসেনাদের পেট্রোলিং পথের উপর এমবুশ পাতে। সকাল ৯টায় পাকসেনাদের একটি দল রাজাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে রওনা হয়। এই দলটি আমাদের এমবুশ-এর মধ্যে পড়ে যায়। অতর্কিতে আমাদের লোকেরা পাকসেনাদের উপর হালকা মেশিনগান ও অন্যান্য অস্ত্রের সাহায্যে গোলাগুলি চালায়। এই গোলাগুলিতে শত্রুদের ৮ জন নিহত ও একজন আহত হয়্ এছাড়া আমাদের লোকেরা প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র, টেলিফোন সেট, ড্রাইসেল ব্যাটারি ও আরও অনেক জিনিস হস্তগত করে।

জুন মাসের দ্বিতীয সপ্তাহে আমার কাছে খবর আসে যে, শত্রুদের গোলন্দাজ বাহিনীর একটি ব্যাটারি (দল) কুমিল্লা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সিএণ্ডবি রোড তাদের কামানের অবস্থান হিসাবে ব্যবাহার করছে। পাক বাহিনীর নয়নপুর, শালদানদী, টি. আলীর বাড়ি (কসবায়) প্রভৃতি শত্রু অবস্থানের জন্য এই কামানগুলি থেকে সাহায্যকারী গোলা নিক্ষেপ হত। এই কামানগুলির জন্য পাক বাহিনীর উপরোক্ত অবস্থানগুলির উপর আক্রমণ অনেক সময় কার্যকরী করা যেত না। আমার কাছে আরও খবর আসে যে, প্রায় ১৫০ জন পাক সেনা এই কামানগুলিকে ব্যবহার ও রক্ষণাবেক্ষণ করে। এই সংবাদ পাওয়ামাত্র আমি লে. হুমায়ুন কবিরকে এই কামানের অবস্থানটি আক্রমণ করে ধ্বংস করার জন্য নির্দেশ দিই। ৪০ জনের একটি দল (৪র্থ বেঙ্গলের ডি কোম্পানী) লে. হুমায়ুন কবিরের নেতৃত্বে ১৬ই জুন রতে সাড়ে ১০টায় শত্রু অবস্থানের দিকে অগ্রসর হয়। সমস্ত রাত চলার পর দলটি কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রাস্তার পশ্চিমে সাইদাবাদের চার মাইল উত্তরে ভোরে পৌছে এবং তাদের একটি গোপন অবস্থান তৈরী করে। ১৭ই জুন সমস্ত দিন এবং রাত লে. ‍হুমায়ূন কবির তার সঙ্গে শুধু কয়েকজনকে নিয়ে পাকসেনাদের সাইদাবাদ অবস্থানটি সম্পূর্ণরূপে অনুসন্ধান করে। এই অবস্থানটিতে পৌছার জন্য পোপন পথ কি, কামানগুলি রাতে কোন স্থানে রাখে, কোন সময়ে পাকসেনারা বেশী সজাগ এবং তাদের ব্যাংকারগুলির অবস্থান কোথায় প্রভৃতি খবরাখবর সংগ্রহ করে। এরপর লে. হুমায়ুন কবির সকাল হবার আগেই তার গোপন ঘাটিতে ফেরত আসে। ১৮ই জুন সমস্ত দিন তার দলটিকে পাকসেনাদের সম্বন্ধে বিস্তারিত খবর বলে িএবং পাক ঘাটিতে আক্রমণের পরিকল্পনা এবং কার্যাবলী সম্বন্ধে প্রত্যেককে বুঝিয়ে দেয়। সমস্ত দিন দলটি আক্রমণের জন্য প্রস্তুতি নেয়।

১৮ই জুন ভোর চারটায় লে. হুমায়ুনের নেতৃত্বে আমাদের দলটি পাকসেনাদের কামান ঘাঁটির উপর পিছন দিক থেকে অনুপ্রবেশ করে অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। পাকসেনারা তাবুর মধ্যে শুয়ে ছিল। তারা এ আক্রমণের জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না। সেদিনই কুমিল্লা থেকে পাকসেনাদের দুটি কোম্পানী যেগুলি সামনে শত্রুদের ঘাটিকে শক্তিশালী করার জন্য যাচ্ছিলো তারাও রাতের বিশ্রামের জন্য অসতর্কভাবে এ অবস্থানটিতে শুয়ে ছিল। আমাদের দলের অতর্কিত আক্রমণে পাকসেনাদের ঘাটিতে ভীষণ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় এবং অনেক শত্রুসেনা আমাদের গুলিতে প্রাণ হারাতে থাকে। আমাদের লোকেরা কয়েকটি জীপ ও ৩ টনের ট্রাকে গ্রেনেড ছুঁড়ে আগুন লাগিয়ে দেয়। পাকসেনারা এত বেশী ভীত হয়ে পড়ে যে তারা তাদের হেড কোয়ার্টারে জঙ্গী বিমানের সাহায্যের প্রার্থনা জানায়। যুদ্ধ বেশ কিছুক্ষণ ভয়ংকরভাবে চলে এবং আমাদের সৈন্যরা কামান, গাড়ি ইত্যাদি ধ্বংস করে। কিন্তু ইতোমধ্যে সকাল হয়ে যায় এবং শত্রুদের প্রতিরোধ শক্তি বাড়তে থাকে ও তাদের আবেদনে তিনটি জঙ্গী বিমান ঘটনাস্থলে পৌছে আমাদের রেইডং পার্টির উপর আক্রমণ চালায়। লে. হুমায়ুনের দলটি তখন আটকা পড়ে যাবার ভয়ে আক্রমণ শেষ করে গ্রামের গোপন পথে মেঘনার দিকে পশ্চাদপরণ করে। এই পশ্চাদপরণের সময় তারা বারবার পাকিস্থানী জঙ্গী বিমান দ্বারা আক্রান্ত হয়। তবুও সমস্ত বাধাবিপত্তি উপেক্ষা করে সাফল্যের সাথে শত্রুদের আওতার বাইরে চলে আসে। একদিন পর তারা অন্য পথে আবার কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রধান সড়কের উপর আসে এবং মতুরা সড়কের সেতুটি উড়িয়ে দিয়ে নিজ ঘাটিতে নিরাপদে ফিরে আসে।

এ আক্রমণের ফলে যদিও লে. হুমায়ুনের দলটি পাকসেনাদের কামান দখল করে আনতে পারে নি কিন্তু তবুও এ আক্রমণের ফলাফল পাকসেনাদের জন্য ছিল ভয়াবহ। অন্ততপক্ষে ৫০/৬০ জন পাকসেনা এ আক্রমণে হতাহত হয়। মৃতদেহগুলি পাকসেনারা ২টি বেসামরিক বাসে লালা ঝান্ডা তুলে কুমিল্লার দিকে নিয়ে যায়। এ খবর স্থানীয় লোকেরা জানায়। তাছাড়া গাড়ি, যুদ্ধ সরঞ্জাম ও এই অবস্থানে রাখা কামানের গোলা যেগুলি ধ্বংস করা হয়েছিল তা ছিল তাদের পক্ষে অত্যন্ত মারাত্মক ক্ষতিকর। আসার পথে দলটি যে সেতু উড়িয়ে দিয়ে আসে এতেও তাদের গতিবিধির উপর যথেষ্ট বাধার সৃষ্টি করে। এ হামলার পর শত্রসেনারা প্রায় ২/৩ সপ্তাহ সমস্ত সেক্টরে তাদের কার্যকলাপ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেয়। পাকসেনারা এরপর নিরীহ গ্রামবাসীদের উপর অত্যাচার চালায় এবং বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়।

১৬ই জুন আমাদের কসবা অবস্থান থেকে একটি ছোট দল বগাবাড়ি নামক জায়গায় এমবুশ পাতে। সকাল ৬টায় পাকসেনাদের একটি পেট্রোল পার্টি সবার দিকে তাদের টহলে আসে। পাকসেনাদের এই দলটি অসতর্কভাবে হঠাৎ আমাদের এমবুশ পার্টির ব্যাংকারের নিকট চলে আসে। আমাদের এমবুশ দলটি এ সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। অতি নিকট থেকে তাদের সমস্ত অস্ত্র-গুলি চালাতে থাকে। অতর্কিত গুলির আঘাতে প্রায় ১০জন পাকসেনা নিহত ও ৫ জন আহত হয়। শুধু ২ জন পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।

পাকসেনারা ১৮ই জুন আমাদের অবস্থান ‘কৈখোলার’ উপর গোলন্দাজ বাহিনীর সাহায্যে প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে আমাদের অবস্থানকারী প্লাটুনটি কৈখোলা ত্যাগ করে এবং সঙ্গে সঙ্গে পাকসেনাদের একটি দল কৈখোলা দখল করে নেয়। ঐদিন রাতে মেজর সালেক চৌধুরীর নেতৃত্বে আমাদের এ কোম্পানী ভোর রাতে কৈখোলায় অবস্থানরত শত্রুদের উপর প্রচণ্ড পাল্টা আক্রমণ চালায়। হাবিলদার সালামের প্লাটুন শিবপুরের দিক থেকে এবং সুবেদার আবদুল হক ভুইয়ার প্লাটুন দক্ষিণ দিক থেকে শত্রুসেনাদের অবস্থানের ভিতর অনুপ্রবেশ করে যায়। হাবিলদার সালমের সামনের অবস্থানটি পরিত্যাগ করে পিছনে পালিয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে পাকসেনাদের ভিতর বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় এবং শত্রুরা সমগ্র কৈখোলা এলাকা থেকে পালিয়ে যেতে শুরু করে। ২ ঘন্টার মধ্যে প্রচণ্ড আক্রমণের সামনে টিকতে না পেরে পাকসেনারা অবস্থানটি সম্পূর্ণভাবে পরিত্যাগকরে। এ যুদ্ধের ফলে পাকসেনাদের একজন জেসিওসহ ৩১জন সিপাই হতাহত হয় এবং অবস্থানটি থেকে অনেক অস্ত্রশস্ত্র ও যুদ্ধ সরঞ্জাম দখল করা হয়।

১৯শে জুন লে. ‍হুমায়ূন কবিরের হেডকোয়ার্টারে খবর আসে যে, পাকসেনাদের একটি প্লাটুন সাগরতলার ভিতর পেট্রোলিং করার জন্য যেতে দেখা গেছে। লে. হুমায়ুন তৎক্ষণাৎ একটি প্লাটুন নিয়ে মন্দভাগের নিকট দ্রুত এমবুশ পাতে। সন্ধ্যা ৭টায় পাকসেনারা ফেরার পথে তাদের দলটির শেষ অংশটিকে লে. হুমায়ুন এমবুশ করে। এমবুশে পাকসেনাদের ৯ জন সৈন্য নিহত হয় এবং বাকি পাকসেনারা মন্দভাগ গ্রামের দিকে পালিয়ে তাদের জীবন বাঁচায়।

জুন মাসের মাঝামাঝি লে. মাহবুব ৪র্থ বেঙ্গলের বি কোম্পানী থেকে একটি প্লাটুনকে পাকসেনাদের যাতায়াতের রাস্তা ধ্বংস করার জন্য কুমিল্লার দক্ষিণে প্রেরণ করে। এ দলটি ১৮ই জুন সন্ধ্যা ৬টায় কুমিল্লা-লাকসামের বিজয়পুর রেলওয়ে ব্রিজ, কুমিল্লা-বাগমারা রোডের সেতু উড়িয়ে দেয়। এই সেতুগুলোর ধ্বংসের ফলে কুমিল্লার দক্ষিণে সড়ক এবং রেলওয়ে যাতায়াত বন্ধ হয়ে যায়। ঐ দিনই দলটি বিজয়পুর এবং মিয়াবাজারের নিকট কয়েকটি ইলেকট্রিক লাইন উড়িয়ে কাপ্তাই থেকে ঢাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। পাকসেনাদের একটি প্লাটুন সন্ধ্যার সময় ‘চৌরা’র নিকট পেট্রোলিং-এ আসে। এই পাকসেনার দলটিকে এমবুশ করলে ২ জন সেনা নিহত হয়। পাকসেনারা পরে পাশ্ববর্তী গ্রামগুলি জ্বালিয়ে দেয় এবং অত্যাচার চালায়। আমাদের পেট্রোল পার্টি খবর আনে যে, পাকিস্থানীদের প্রায় এক কোম্পানী সৈন্য মিয়াবাজারের উত্তরে একটি গোডাউনের মধ্যে অবস্থান করছে। পেট্রোলটি এই গোডাউনটিতে পৌছবার গোপন রাস্তা, পাকসেনাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও অন্যান্য বিস্তারিত খবর নিয়ে আসে। এ সংবাদ পেয়ে লে. মাহবুব ৩৩ জনের একটি কমান্ডো প্লাটুন ব্লাকসাইড ও মর্টারসহ রাত ১২টার সময় শত্রু অবস্থানের নিকট পৌছে যায়। তারা একটি ছোট দল পাঠিয়ে অবস্থানটির সর্বশেষ খবর নেয় এবং জানতে পারে পাকসেনারা অবস্থানটিতে বেশী সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয় নি। রাত ১টায় আমাদের কমান্ডো প্লাটুনটি অতর্কিতে পাকসেনাদের প্রতিরক্ষা অবস্থানের ভিতর অনুপ্রবেশ করে এবং সঙ্গে সঙ্গে পাকসেনাদের উপর হালকা অস্ত্রের সাহায্যে গুলি চালাতে থাকে। পাকসেনারা অনেকেই গুলিতে হতাহত হয়। তারা আমাদের কমান্ডো প্লাটুনের উপর পাল্টা আক্রমণের চেষ্টা করে, কিন্তু তা ব্যর্থ হয়ে যায়।

১৮ জুন রাত ৯টায় মিয়াবাজরের দক্ষিণে আমাদের আরেকটি প্লাটুন পাকসেনাদের ২টি ব্যাংকারের উপর আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে ৭ জন পাকসেনা নিহত হয়। পাকসেনারা এরপর সমস্ত রাত অবিরাম মর্টারের গোলা ছুড়তে থাকে। আমাদের এই দলটি খিলা রেলওয়ে স্টেশনের নিকট কয়েকটি ট্যাঙ্কবিধ্বংসী মাইন রাস্তায় পুতে রাখে। পাকসেনাদের একটি জীপ রাতে ঐ রাস্তায় যাওয়ার পথে মাইনের উপর পড়ে যায় এবং সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয় এবং ৫জন পাকসেনাও নিহত হয়।

জুন মাসেই পাকসেনারা কুমিল্লা শহরে শাসনকার্য পুনরায় স্বাভাবিক করার জন্য সমস্ত রকমের ব্যবস্থা নেয়। সরকারী অফিস ভালভাবে চলার জন্য তারা সরকারী কর্মচারীদের বাধ্য করে। শহরের দোকান ও যানবাহন চালু করার বন্দোবস্ত করে। পাকস্থানীদের এ প্রচেষ্টা ব্যার্থ করার জন্য ৪জন গেরিলার একটি দলকে ৬ই জুন কুমিল্লার উত্তর দিকে গোমতী পার করে কুমিল্লা শহরে পাঠানো হয়। এ দলটি গ্রেনেড ও স্টেনগান সঙ্গে নিয়ে যায়। তিনদিন পর্যন্ত শহরের ভিতর একটি গুপ্ত অবস্থানে গলটি নিজেদের ঘাটি গড়ে। কুমিল্লা শহরের বিভিন্ন জায়গায় পাকসেনাদের টহলদার দলগুলি সম্বন্ধে তারা বিস্তারিত খবরাখবর যোগাড় করে। ১০ই জুন সন্ধ্যায় কমার্স ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, জজকোর্ট প্রভৃতি স্থানে পর পর পাকসেনাদের উপর গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। এর ফলে একজন পাকসেনা নিহত ও পাঁচজন আহত হয়। ঐ দিনই ৭ জন রেঞ্জারের একটি দলকে তারা আক্রমণ করে। এতে ২ জন মিলিশিয়া নিহত হয় এবং তাদের একটি গাড়ি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এর কয়েকদিন পর ২১শে জুন সকালে একটি আরআর রাইফেল আমাদের সৈন্যরা কুমিল্লা শহরের নিকটে বয়ে নিয়ে যায় এবং কুমিল্লা বিমানবন্দরের ও শহরের উপকণ্ঠের উপর গোলাগুলি করে এবং পাকিস্থানীরা এতে পাগলের মত ছোটাছুটি করতে থাকে। এসব কার্যকলাপের ফলে কুমিল্লা শহর ও তার নিকটবর্তী এলাকার লোকেরা আবার তাদের সাহস ফিরে পায়। অনেকেই শহর থেকে বাইরে চলে যায়। এসব আক্রমণের ফলে পাকিস্থানীদের শাসন ব্যবস্থা চালু করার প্রচেষ্টা বহুলাংশে ব্যর্থ হয়।

শালদা নদীতে পাকসেনারা জুন মাসে তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আরো শক্তিশালী করার চেষ্টা করছিল। পাকসেনাদের কার্যকলাপে বিঘ্ন সৃষ্টি করার জন্য এবং তাদেরকে ব্যস্ত রাখার জন্য মেজর সালেক ৪র্থ বেঙ্গলের এ কোম্পানীর ১ প্লাটুন মর্টারসহ শালদানদীর পশ্চিমদিকে পাঠিয়ে দেয়। এই প্লাটুনটি রাত ৩টায় পাকসেনাদের অবস্থানটি ঘুরে পিছনে যেতে সক্ষম হয়। সকাল সাড়ে ৫টার সময় পুর্বনির্ধারিত স্থানে তারা নিজেদের ঘাটি স্থাপন করে। এরপর প্রত্যুষের সঙ্গে সঙ্গেই পিছন থেকে মেশিনগান ও অন্যান্য হালকা অস্ত্রশস্ত্র এবং মর্টারের সাহায্যে শত্রু অবস্থানের উপর অতি নিকট থেকে হামলা চালায়। পাকসেনারা দিনের বেলায় তাদের অবস্থানের পিছনে এত নিকট থেকে আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিলনা এবং এর ফলে তাদের অন্ততপক্ষে ১ জন জেসিওসহ ৩২ জন হতাহত হয়। পাকসেনাদের একটি শক্তিশালী দল রাতে শালদানদীর অবস্থান হতে কসবাতে টহলের জন্য গিয়েছিল। এই সংবাদটি আমাদের লোকের জানা ছিলনা। পাকসেনাদের সঙ্গে আমাদের প্লাটুনটি যখন ভয়ংকর সংঘর্ষ করছিল, সে সময় পাকসেনাদের টহলদার দলটি কসবা থেকে ফেরার পথে আমাদের প্লাটুনটির পিছনে অবস্থান নিয়ে আমাদেরকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করে। আমাদের প্লাটুনটি সঙ্গে সঙ্গে অতিকষ্টে পাকসেনাদের ঘেরাও থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়। আসার সময় আমাদের একজন লোক আহত হয়। পাকসেনারা এরপর শালদানদীর অবস্থান আরো শক্তিশালী করে তোলে।

আমরা খবর পাই যে, পাকবাহিনী প্রায়ই হোমনা থানার নিকট কাঠালিয়া নদী এবং গেমতী নদীতে লঞ্চের দ্বারা পেট্রোলিং করে। এ খবর শোনে আমি হেডকোয়ার্টার থেকে ১টি প্লাটুন হাবিলদার গিয়াসুদ্দিনের নেতৃত্বে হোমনা থানাতে প্রেরণ করি। এই দলটি অনেক বাধাবিঘ্ন অত্রিকম করে দাউদকান্দির ৮ মাইল উত্তরে ও গৌরীপুর হতে সাত মাইল উত্তর পশ্চিমে চড়কমারী গ্রামের নিকট তাদের গুপ্ত ঘাটি গড়ে তোলে। হাবিলদার গিয়াসুদ্দিন চরকমারী গ্রামের নিকট পাকসেনাদের লঞ্চকে এমবুশ করার জন্য তার দলটিকে নিয়ে নদীর পাড়ে একটি অবস্থান গড়ে তোলে। পাকসেনারা নিত্যনৈমিত্তিক টহলে সকালে পশ্চিম হতে কাঠালিয়া নদী দিয়ে লঞ্চে অগ্রসর হয়। লঞ্চটি যখন ৫০ গজের ভিতর চলে আসে, তখন হাবিলদার গিয়াসুদ্দিনের পার্টি মেশিনগান, হালকা মেশিনগান ও অন্যান্য অস্ত্র হতে অতর্কিতে গুলি চালাতে থাকে। পাকসেনারা অনেকেই হতাহত হয়। লঞ্চটির সারেং লঞ্চটিকে একটা চরের দিকে নিয়ে ভিড়াবার চেষ্টা করে কিন্তু ব্যার্থ হয়। এরপর অনেক পাকসেনা লঞ্চ থেকে পানিতে ঝাপ দিয়ে পড়ে কিন্তু তাতেও তারা পানিতে গুলির আঘাতে মারা যায়। শুধু কয়েকজন সাতরিয়ে অন্য পাড়ে ওঠে পালাতে সক্ষম হয়। িএই লঞ্চে পাকসেনাদের অন্তত ৭০/৮০ জন লোক ছিল এবং সঙ্গে তিনজন বেসামরিক লোকও ছিল। হাবিলদার গিয়াসুদ্দিনের লোকেরা লঞ্চ থেকে অনেক অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ উদ্ধার করে। সেদিনই বিকাল ৫টার সময় পাকবাহিনীর একটি হেলিকপ্টার তাদের এই লঞ্চটি এবং লোকজনের খবরাখবর নেয়ার জন্য ঐ এলাকায় অনেক ঘোরাফিরা করে কিন্তু কোন খোঁজখবর না পেয়ে হেলিকপ্টারটি ফেরত চলে যায়। এ এ্যাকশন সকালে প্রায় এক থেকে দেড়ঘন্টা চলে, পার্শ্ববর্তী সমস্ত এলাকার স্থানীয় লোকেরা দুর থেকে তা প্রত্যক্ষ করে। পাকবাহিনীকে শোচনীয়ভাবে পর্যুদস্ত হতে দেখে স্থানীয় লোকের মনোবল আরো বেড়ে যায়। তারা মুক্তিবাহিনীর উপর আরো আস্থাশীল হয়। হাবিলদার গিয়াসুদ্দিন এখনও এই এলাকার লোকের কাছে কিংবদন্তীর নায়ক হয়ে বিরাজ করছেন।

সুবেদার আলী আকবর পাটোয়ারীর অধীনে যে কোম্পানীটি লাকসামের দক্ষিণে নোয়াখালির উত্তর পশ্চিম অঞ্চলে পাঠানো হয়েছিল, সে কোম্পানীট ও এ অঞ্চলে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে তাদের কার্যকলাপ চালায়। চাঁদপুর থেকে পাকবাহিনী যে রাস্তা নোয়াখালী যাবার জন্য ব্যবহার করত, সে রাস্তায় লক্ষীপুরের নিকট ৯০ ফুটের একটি সড়কসেতু বিধ্বস্ত করে দেয়। এর কিছুদিন পর পাকবাহিনী পশ্চাদপরণ করলে সুবেদার আলী আকবরের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী রায়পুর থানা আক্রমণ করে। এ আক্রমণের ফলে দালাল পুলিশের সাহায্যে স্থানীয় লোকদের উপর যথেষ্ট অত্যাচার করত। এ থানা দখল করে নেয়ার ফলে সমস্ত এলাকা মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।

১৬ই জুন আমাদের ২টি গেরিলা পার্টি হেডকোয়ার্টার থেকে পাঠানো হয়। ৬ জনকে কুমিল্লার দক্ষিণে ইলেকট্রিক লাইন উড়ানোর জন্য এবং অন্য ৬ জনের একটি পার্টিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উত্তরে তিতাস গ্যাসলাইন কাটার জন্য পাঠানো হয়। ২১শে জুন প্রথম পার্টিটি ২টি ইলেকট্রিক লাইন ধ্বংস করে দেয়। এর ফলে নোয়াখালীর বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যায়। দ্বিতীয় দলটি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উত্তরে তালশহরে ২৪শে জুন সন্ধ্যায় তিতাস গ্যাসের ৪ ফুট পাইপ উড়িয়ে দেয়। এর ফলে তিতাস গ্যাস ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, আশুগঞ্জ এবং সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ারস্টেশনগুলিতে সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে এসব পাওয়ার স্টেশনগুলি হতে বিদ্যুৎ সরবরাহ সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। এতে শিল্প এলাকাগুলির যথেষ্ট ক্ষতি হয়।

মতিনগর থেকে একটি প্লাটুন রাজাপুরের পাক অবস্থানের উপর হামরা করার জন্য পাঠানো হয়। এই প্লাটুনটি ২২শে জুন আমাদের ঘাটি থেকে রাজাপুরের দিকে অগ্রসর হয়। সন্ধ্যায় রাজাপুর শত্রু অবস্থানটি তারা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে রেকি করে। তারা জানতে পারে যে, পাকসেনারা বেশ অসতর্কভাবে তাদের অবস্থানে আছে। ২২শে জুন ভোর ৪টায় আমাদের দলটি অতর্কিতে গোপনপথে শত্রু অবস্থানের ভিতর প্রবেশ করে আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণে পাকসেনারা সম্পূণ হকচকিত হয়ে যায়। এই আঘাতে আমাদের লোকদের হাতে তাদের প্রায় ১৫ জন হতাহত হয়। আমাদের একজন আহত হয়। আক্রমণের প্রায় ১ ঘন্টা পর আমাদের লোকেরা পিছু হটে আসে।

আমাদের রেকি পার্টি খবর আনে যে, পাকসেনারা কসবার উত্তরে চন্দ্রপুর এবং লাটমুরার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এ সংবাদ পাবার পর লে. হুমায়ুন কবির পাকসেনাদের চতুর্দিক থেকে এমবুশ করার জন্য ৪র্থ বেঙ্গলের ডি কোম্পানীর তিনটি প্লাটুন ইয়াকুবপুর, কুয়াপাইনা এবং খৈনলে পাঠিয়ে দেয়। এই তিনটি প্লাটুন নিজ নিজ জায়গায় ২৩শে জুন সকাল ৬টার মধ্যে অবস্থান নেয়। পাকসেনারা সমস্ত রাত অগ্রসর হওয়ার পর সকালে আমাদের অবস্থানের সামনে উপস্থিত হয়।

পাকসেনারা আমাদের উপরোল্লিখিত অবস্থানের ৫০ থেকে ১০০ গজের মধ্যে এসে পড়লে তিনদিক থেকে আমাদের সৈন্যরা পাকসেনাদের উপর আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণে পাকসেনাদের ৮ জন নিহত এবং তিনজন আহত হয়। পাকসেনারা একটু পিছু হটে যেয়ে আবার আক্রমণের চেষ্টা চালায় কিন্তু সে চেষ্টাও ব্যর্থ হয়ে যায়। এরপর সমস্তদিন উভয়পক্ষে গোলাগুলি চলতে থাকে এবং সন্ধ্যার সময় পাকসেনারা পিছু হটে যায়। পাকসেনাদের পশ্চাদপরণের সময়ও আমাদের ইয়াকুবপুরের প্লাটুন তাদেরকে দক্ষিণ দিক থেকে আক্রমণ করে বেশ ক্ষতিসাধন করে। পিছু হটে গিয়ে লাটুমুড়ার উত্তরে অবস্থান নেয় এবং প্রতিরক্ষাব্যুহ তৈরী করতে থাকে। ২৪শে জুন পাকসেনারা যখন লাটুমুড়াতে তাদের প্রতিরক্ষাব্যুহ তৈরীতে ব্যস্ত ছিল, সকাল পাঁচটায় আমাদের কুয়াপাইনা ও খৈনাল এলাকা থেকে শত্রুদের বামে এবং দক্ষিণে আমাদের ৩টি প্লাটুন আবার অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণের ফলে পাকসেনাদের ৯ জন লোক নিহত হয়। আমাদের ১ জন আহত হয়।

নোয়াখালীর উত্তরে পাকবাহিনী ফেনী থেকে নোয়াখালী পর্যন্ত ট্রাকে টহল দিত। এ খবর আমাদের নোয়াখালী গেরিলা হেডকোয়ার্টারে পৌছৈ। সেখানে থেকে আমাদের ২টি এমবুশ পার্টি বোগাদিয়া এবং বজরাতে পাঠানো হয়। ২১শে জুন এই দুই পার্টি সন্ধ্যায় উপরোক্ত দুটি স্থানে এমবুশ পাতে। তারা রাস্তাতে একটি এন্টি ট্যাংক ও এন্টি পার্সোনেল মাইন পুতে রাখে। সন্ধ্যায় পাকসেনাদের দুটি ট্রাক ফেনীমুখে যাচ্ছিল। এই ট্রাক দুটি এমবুশ স্থানে পৌছালে প্রথম ট্রাকটি এন্টি ট্যাংক মাইনে পড়ে যায় এবং সঙ্গে সঙ্গেই ধ্বংস হয়ে যায়। পরের ট্রাকটি পিছু হটে যাওয়ার চেষ্টা করে কিন্ত এমবুশ পার্টি তাদের উপর গুলি চালাতে থাকে। পাকসেনারা উপায়ন্তর না দেখে ট্রাক থেকে বেরিয়ে পালাবার চেষ্টা করে। পলায়নপর শত্রুদের কিছুসংখ্যক গুলিতে মারা যায়, আর কিছু প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। এ এমবুশে পাকসেনাদের ২টি ট্রাক সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায় এবং ১২ জন নিহত হয়। আমাদের পার্টি অনেক অস্ত্রশস্ত্র হস্তগত করে এবং বজরার এ্যামবুশ পার্টিও শত্রুদের একটি টহলদার দলকে আক্রমণ করে ২ জনকে নিহত এবং ২ জনকে আহত করে। আর একটি পার্টি ২৩শে জুন পাকসেনাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা নষ্ট করে দেয়ার জন্য নোয়াখালীর সাহেবজাদা ব্রিজ, চন্দ্রগঞ্জ এবং রামগঞ্জ জেলা কাউন্সিল ব্রিজ সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেয়।

পাকসেনারা লাটুমুড়াতে তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অব্যাহত রাখে কিন্তু ৪র্থ বেঙ্গলের ডি কোম্পানী লেঃ হুমায়ুন কবিরের নেতৃত্বে তাদেরকে সবসময় ব্যতিব্যস্ত রাখে।

পাকসেনারা তাদের শালদানদী অবস্থান থেকে সবসময় মন্দভাগ দখল করে নেয়ার চেষ্টা চালাত। আমাদের ৪র্থ বেঙ্গলের সি কোম্পানী মন্দভাগ রেলওয়ে স্টেশন এবং জেলা বোর্ডের কাঁচা রাস্তা পর্যন্ত নিজেদের রেখে শক্তিশালী প্রতিরক্ষাব্যুহ গড়েছিল। এ অবস্থানটির জন্য পাকবাহিনী চট্টগ্রাম-ঢাকা রেলওয়ে লাইন চালু করতে পারছিল না।  সেজন্য সবসময়ই তাদের চেষ্টা ছিল মন্দভাগ থেকে আমাদের বিতাড়িত করা। এছাড়া এ অবস্থানটির জন্য তারা শালদানদী ছিটমহল যেখানের আমাদের মূল ঘাটি ছিল, তা তাদের দখলে আনতে পারছিল না। অনেকবার চেষ্টা করেও তাদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। ২৪শে জুন বিকেল ৩টায় তাদের শালদানদী অবস্থান থেকে পাকসেনাদের একটা কোম্পানী, কসবায় টি. আলী বাড়ী থেকে একটা কোম্পানী, এই দুই কোম্পানী দুদিক থেকে এসে কায়েমপুরের নিকট মিলিত হয়। তারপর মর্টার মেশিনগান এবং কামানের সাহায্যে আমাদের মন্দভাগ অবস্থানে আক্রমণ চালায়। প্রচণ্ড গোলার সহায়তায় পাকসেনাদের এই শক্তিশালী দলটি মন্দভাগ রেলওয়ে স্টেশনে ৩০০ গজ পশ্চিমে জেলা বোর্ডে সড়কের নিকট পর্যন্ত পৌছতে সক্ষম হয়। আমাদের সৈনিকরাও তাদের ব্যঙ্কার থেকে মেশিনগান এবং হালকা মেশিনগানের গুলিতে পাকসেনাদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি করতে থাকে। দুঘন্টা চেষ্টার পর পাকসেনারা যখন অগ্রসর হতে পারছিলনা তখন আক্রমণ বন্ধ করে দেয় এবং পিছু হটে চলে যায়। এ আক্রমণের সময় পাকসেনাদের ২৪ জন হতাহত হয়। পাকসেনারা তাদের কায়েমপুরের অবস্থানও তুলে নিয়ে শালদানদীর মূল ঘাটিতে চলে যায়।

ঢাকায় আমাদের গেরিলারা তাদের কাজ চালিয়ে যেতে থাকে। বিদ্যুৎ সরবরাহ যাতে স্বাভাবিকভাবে না চলে সেজন্য তারা ২৯শে জুন বিকেল ৫টায় সিদ্ধিরগঞ্জ এবং খিলগাঁও পাওয়ার লাইনের এইটি পাইলন ধ্বংস করে দেয়। এই বিধ্বস্থ পাইলনটি অন্য দুটি পাইলনের তার নিয়ে ছিঁড়ে পড়ে যায়। এর ফলে কমলাপুর এবং তেঁজগাঁওয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ অনেকাংশে কমে যায়। বিস্ফোরণের ঠিক পরপরই পাকসেনাদের একটি হেলিকপ্টার তৎক্ষণাৎ উক্ত এলাকায় গেরিলাদের অনেক খোঁজাখুজি করে। আমাদের গেরিলারা নিরাপদে ফিরে আসে। আর একটি গেরিলা দল সিদ্ধিরগঞ্জের মাটির তলার পাওয়ার লাইন মাতুয়াইলে উড়িয়ে দেয়। পাকসেনারা নিকটবর্তী ঘাটি হতে জীপে করে এসে দলটিকে ধরার চেষ্টা করে এবং এদের উপর গোলাগুলি করে, কিন্তু গেরিলা দলটি নিরাপদে ফিরে আসে।

স্থানীয় লোকমুখে আমরা সংবাদ পাই যে, পাকসেনাদের একটি জীপ ও টহলদার দল প্রায়ই সাঈদাবাদ থেকে কর্ণালবাজার পর্যন্ত আসে। এ সংবাদ পেয়ে ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিন খোলাপাড়ায় এবং তুলাইশমলে একটি করে প্লাটুনের সাহায্যে এমবুশ লাগায়। ২৭শে জুন সন্ধ্যার সময় পাকসেনাদের টহলদার দল খোলাপাড়ায় আমাদের এমবুশে পড়ে যায়। এতে পাকসেনাদের ৮ জন লোক নিহত হয় এবং তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যায। এর পরদিন ২৮শে জুন সন্ধ্যা ৭টায় পাকসেনাদের একটি জীপ তুলাইশমলে আমাদের এমবুশে পড়ে। এমবুশ পার্টির গুলিতে জীপটি ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে রাস্তা থেকে পড়ে যায়। জীপে পাঁচজন পাকসেনা ছিল, তারাও সঙ্গে সঙ্গে নিহত হয়। আমাদের পার্টি অস্ত্রশস্ত্র দখল করে নেয়।

পাকসেনারা কুমিল্লা শহরের পূর্বে বিবিরবাজার এলাকায় যে ঘাটি গড়েছিল, আমরা প্রায়ই আক্রমণ করে তাদের ব্যতিব্যস্ত রাখতাম। লে. মাহবুব খবর পায় যে, পাকসেনারা সন্ধ্যার পর আর তাদের ব্যাংকার থেকে বাইরে আসেনা। রাতে যেসব পাহাড়াদার থাকে তারা ব্যাংকারের মধ্যে বসে থাকে। এ সংবাদ পেয়ে লে. মাহবুব দুটি প্লাটুনকে ২৪শে জুন রাতে শত্রুদের বিবিরবাজার ঘাটির কয়েকটি ব্যাংকার ধ্বংস করার নির্দেশ দিয়ে কুমিল্লার দক্ষিণ দিকে পাঠিয়ে দেয়। এ দলটি অরণ্যপুর হয়ে শত্রুদের বিবিরবাজার অবস্থানের পিছনে পৌছে এবং রাত তিনটায় অবস্থানের ভিতর অনুপ্রবেশ করে অতর্কিত আক্রমণ চালায়। প্রথমেই তারা তাদের সামনের একটি ব্যাংকারে গ্রেনেড ছোড়ে এবং সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেয়। এরপর আরও ২/১টি ব্যাংকার ধ্বংস করে তারা সকাল হবার আগেই শত্রুঅবস্থানে ত্যাগ করে। এই অতর্কিত আক্রমণে পাকসেনাদের ২১ জন নিহত ও ৭ জন আহত হয়।

পাকসেনারা বিজয়পুরের যে রাস্তার সেতুটি আমাদের কমান্ডো পার্টি উড়িয়ে দিয়েছিল সেটি সাময়িকভাবে মেরামত করে ফেলে এবং সে রাস্তায় আবার তাদের চলাফেরা শুরু করে। লে. মাহবুব আবার একটি কমান্ডো প্লাটুন পাঠায় এবং এই প্লাটুনটি ২১শে জুন বিজয়পুর ব্রিজের নিকট এমবুশ পেতে পাকসেনাদের অপেক্ষায় থাকে। রাত ২টার সময় পাকসেনাদের দুটি গাড়ী কুমিল্লা থেকে ঐ রাস্তায় আসে। গাড়ীগুলি যখন ব্রিজের উপর দিয়ে চলা শুরু করে ঠিক তখনই আমাদের পার্টি তাদের উপর গুলি চালায়। সঙ্গে সঙ্গেই গাড়িগুলি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ব্রিজ থেকে নদীতে পড়ে যায়। এতে দুটি গাড়িই বিনষ্ট হয়ে যায় এবং ৮ জন পাকসেনা নিহত হয়।

জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে আমার হেডকোয়ার্টার থেকে গেরিলাদের ৬০ জনের একটি দলকে আমি ফরিদপুরে পাঠাই। মাদারীপুর, পালং, রাজৈর, নড়িয়া প্রভৃতি থানায় গেরিলাদের বিভিন্নভাবে বিভক্ত করে দেয়া হয়েছিল। এই দলগুলি তাদের নিজ নিজ এলাকায় গিয়ে ঘাটি গড়ে তোলে। এরপর তারা কিছুসংখ্যক পাকিস্থানী দালালকে হত্যা করে। এরপর তারা নিজ নিজ এলাকার থানাগুলি যেখনা থেকে দালালের পুলিশরা পাকিস্থানীদের খবরাখবর যোগাত, সেই থানাগুলি ভালভাবে রেকি করে। প্রথমে তারা শিবচর অয়ারলেস স্টেশনটি ধ্বংস করে দেয়। এরপর গেরিলা কমান্ডার খলিলের নেতৃত্বে পালং থানার উপর ২৭শে জুন রাত ১১টায় সময় আক্রমণ চালানো হয়। এ আক্রমণে একজন দালাল সাব-ইন্সপেক্টর ও দুজন পুলিশ নিহত হয়। গেরিলারা ৯টা রাইফেল দখল করে নেয়। তারা থানার অয়ারলেস স্টেশনটিও ধ্বস করে দেয়। নড়িয়ার গেরিলাদল খবর পায় যে, মাদারীপুরের ডিআইবি ইন্সপেক্টর ও দালাল সিআই পুলিশ একটি স্থানীয় দালালের বাড়িতে গুপ্ত আলোচনায় ব্যস্ত। এ সংবাদ পেয়ে তারা সেখানে উপস্থিত হয়ে তাদের উপর আক্রমণ চালায়। তারপরে নড়িয়ার অয়ারলেস স্টেশনটিও ধ্বংস করে দেয়।

শত্রুদের একটি ছোট দল রাজৈর থানার টাহেরহাটে এসে অবস্থান নেয়। রাজৈরের গেরিলা দলটি তাদের অবস্থানটি সম্বন্ধে পুঙ্কানুপুঙ্খরূপে খবর নেয়। ২৮শে জুন রাত ১১টার সময় ২০ জনের একটি গেরিলাদল টাহেরহাটে পাকসেনাদের অবস্থানের উপর অতর্কিত আক্রমণ করে। এ আক্রমণের ফলে পাকসেনাদের ১০ জন নিহত হয় এবং পাকসেনারা টাহেরহাট অবস্থান থেকে পালিয়ে যায়।

পাকিস্থান রেডিও থেকে ঘোষণা করা হয় যে, ২৮শে জুন সন্ধ্যায় জেনারেল মো: ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেবেন। এ সংবাদ জানতে পেরে আমি ইয়াহিয়া খানের ভাষণকে উপস্থিত সম্বর্ধনা জানানোর জন্য একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করি। এসম্বন্ধে আমি আমার সাবসেক্টর কমান্ডারদের আমার হেডকোয়ার্টারে ডেকে পাঠাই এবং তাদের সঙ্গে আলোচনা করি। আলোচনার পর এ সিদ্ধান্তে পৌছি যে, ভাষণের সময় পাকিস্থানীরা সবক্ষেত্রেই রেডিও শোনার জন্য তাদের নিজ নিজ প্রতিরক্ষা অবস্থানে একত্রিত হবে এবং সতর্কতামূলক ব্যবস্থা কিছুটা শিথিল হবে। এ সময় তাদের এ সতর্কতা আমাদের জন্য আনবে এক সুবর্ণ সুযোগ। তাছাড়া আমাদের একশনও হবে ইয়াহিয়া খাঁনের ভাষণের সমুচিত জবাব। এ জন্য আমি সব সাব-সেক্টর কমান্ডারকে নির্দেশ দিলাম, তারা সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার পর থেকে যখন ইয়াহিয়ার ভাষণ আরম্ভ হবে, ঠিক সে সময়ে আমার সেক্টরের সব এলাকায় একযোগে পাকসেনাদের উপর তীব্র আক্রমণ চালাবে। এ নির্দেশ অনুযায়ী ৪র্থ বেঙ্গলের ‘এ’ কোম্পানী নয়ানপুরে পাকসেনাদের অবস্থানের দিকে তিন দিক থেকে অগ্রসর হয় এবং ভাষণ আরম্ভ হবার কিছুক্ষণ পরেই পাকসেনাদের উপর আক্রমণ চালায়। পাকসেনারা এ অতর্কিত আক্রমণে হকচকিত হয়ে যায়। এর সাথে সাথে আমাদের মর্টারের গোলা তাদের উপর পড়তে থাকে। পাকসেনারা তাদের অবস্থানের চতুর্দিকে দৌড়াদৌড়ি এবং চিৎকার করে ব্যাংকারের দিকে যাবার চেষ্টা করে। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মেশিনগানের গুলিতে তাদের অনেকেই মারা যায়। আধঘন্টা এভাবে গলি চালানোর পর আমাদের সৈন্যরা অবস্থান পরিত্যাগ করে নিজেদের ঘাটিতে ফিরে আসে। এ যুদ্ধে ১৮ জন নিহত এবং বহু আহত হয়।

ঐ দিনই আমাদের একটি কোম্পানী মর্টারসহ লে. হুমায়ুন কবিরের নেতৃত্বে যখন তারা ইয়াহিয়ার ভাষণ শুনছিল, ঠিক ঐ সময় লাটুমুড়াতে শত্রু অবস্থানের উপর অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণের ফলে শত্রুদের মধ্যে বেশ বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। এ আক্রমণের ফলে পাকসেনাদের ৫ জন নিহত ও ১০ জন আহত হয়। আমাদের কোম্পানী শত্রুদের উপর আড়াই ঘন্টা আক্রমণ চালিয়ে নিরাপদে পিছু হটে আসে।

ঢাকাতে ঐ সময়টিকে উদযাপন করার জন্য আমি ৫০ জন গেরিলার একটি দলকে পাঠিয়ে দিই। এই দলটি ২৭শে জুন ঢাকায় পৌছে। তারপর ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে ঢাকা শহরের প্রধান স্থানগুলিতে যেমন জিন্নাহ এভিনিউ, মতিঝিল, শাহবাগ, পুরানা পল্টন, সদরঘাট, চকবাজার প্রভৃতি স্থানে একযোগে সন্ধ্যায় ইয়াহিয়া খানের ভাষণের সময় গ্রেনেড বিস্ফোরণ এবং মোটরগাড়িতে এক্সপ্লোসিভ লাগিয়ে বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে পাকসেনারা চতুর্দিকে ছোটাছুটি করে এবং সমস্ত ঢাকায় একটা আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। এ বিস্ফোরণগুলির ফলে ঢাকা আমাদের বাঙালিরা তাদের মনোবল আরো ফিরে পায় এবং তারা ইয়াহিয়ার ভাষণের সমুচিত জবাবে আনন্দিত হয়।

মতিনগর থেকে ২টি মর্টার দিয়ে একটি ছোট দলকে গোমতীর উত্তর পাড় দিয়ে কুমিল্লা শহরের দিকে পাঠানো হয়। এ দলটি কুমিল্লা শহরের নিকট গিয়ে ভাষণের ঠিক সময়ে কুমিল্লা সার্কিট হাউসের উপর মর্টার দ্বারা গোলাবর্ষণ করে। কুমিল্লা সার্কিট হাউসে পাকসেনাদের মার্শাল ল’র প্রধান অফিস ছিল। মর্টারের গোলা এসে অফিসে পড়ার পর, সেখানেও পাকসেনারা ছোটাছুটি করতে থাকে। কুমিল্লা শহরেও কয়েক মিনিটের মধ্যে নীরবতা নেমে আসে।

কুমিল্লা থেকে পাকিস্তানিদের একটি জীপ ও একটি ৩ টনের গাড়ি দক্ষিণে যাচ্ছিল। লে. মাহবুবের একটি এমবুশ পার্টি এই দলটিকে সন্ধ্যায় ফুলতলীর নিকটে আক্রমণ করে। এতে জীপটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়। এ এমবুশে পাকিস্থানীদের ২৪ জন সৈন্য ৩ জন অফিসার নিহত হয় এবং ১ জন অফিসার সহ ৪ জন আহত হয়। অফিসারটি লে. কর্ণেল ছিল।

লে. মাহবুবের আর একটি প্লাটুন ঠিক ঐ সময় বিবিরবাজার শত্রু অবস্থানের ভিতর অতর্কিতে অনুপ্রবেশ করে ১টি মেশিনগানসহ কয়েকটি ব্যাংকার ধ্বংস করে দেয়। পাকসেনাদের ১১ জন এতে নিহত হয়।

এছাড়া মিয়াবাজরে, ফেনী, বিলোনিয়া, লাকসাম, শালদানদী, চাঁদপুর ইত্যাদি স্থানেও মর্টার ও গ্রেনেডের সাহায্যে পাক অবস্থানের উপর একযোগে এইরূপে আক্রমণ চালানো হয়।

ইয়াহিয়া খান মনে করেছিল যে, তার ভাষণ দিয়ে তিনি বাঙালিদের শান্ত করবেন এবং আবার তার মিথ্যা আশ্বাসে বাঙালিরা তাদের অত্যাচারকে ভুলে যাবে। কিন্তু আমাদের সমস্ত এলাকাজুড়ে সবগুলো এ্যাকশনে তিনি নিশ্চয়ই বুঝে গিয়েছিলেন যে, বাঙালিরা তার জবাব কি দিয়েছে।

———————————————–

<৯, ৩.২, ১২৮-১৩৩>

সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধে ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্ট

সাক্ষাৎকারঃ লেঃ কর্নেল শাফায়াত জামিল

(১৯৭১ সালের মার্চে ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর পদে কর্মরত ছিলেন। সাক্ষাৎকারটি বাংলা একাডেমির দলিলপত্র থেকে সংকলিত)

১৯৭১ সনের ১লা মার্চ তারিখে আমি আমার চতুর্থ বেঙ্গলের এক কোম্পানী সৈন্য নিয়ে কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া চলে আসি আমার সাথে চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের এর একটা কোম্পানী ছিল যার কমান্ডার ছিল একজন পশ্চিম পাকিস্তানী সিনিয়র মেজর। আমাদের পাঠানোর উদ্দেশ্য ছিল ভারতের সম্ভাব্য আক্রমণ মোকাবেলা করার জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে প্রতিরক্ষাব্যূহ তৈরী করা। এখানে বলে রাখা দরকার যে, চতুর্থ বেঙ্গলে আমিই বাঙালিদের মধ্যে সিনিয়র মোস্ট ছিলাম। আমরা চলে আসার পর কুমিল্লা সেনানিবাসে চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের আরও দুই কোম্পানী সৈন্য থেকে যায়।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে আমি সব সময় কুমিল্লা সেনানিবাসের বাকি দুই কোম্পানীর সাথে যোগাযোগ করতাম। এ ব্যাপারে আমি সুবেদার আবদুল ওহাবকে ব্যবহার করতাম।

মার্চের ১ তারিখ থেকে ২৪ তারিখ পর্যন্ত কুমিল্লা সেনানিবাসের অস্বাভাবিক ঘটনাবলিঃ

১। আমাদের ইউনিট লাইনের চারদিকে পশ্চিম পাকিস্তানী অফিসার এবং জেসিওদের বিশেষ করে আর্টিলারী বাহিনীর লোকদের অস্বাভাবিক গতিবিধি বা চলাফেরা।

২। রাতের বেলায় মেশিনগান আমাদের ইউনিট লাইন, অফিসারদের বাসস্থান, অস্ত্রাগার এবং কোয়ার্টার গার্ডের দিকে পজিশন করে রাখতো। এবং দিনের বেলায় সেনানিবাসের বাহিরের দিকে পজিশন থাকতো। তাছাড়া আমাদের ইউনিট লাইনের চারিদিকে উঁচু পাহাড়ে পরিখা খনন করে। জিজ্ঞেস করলে বলতো “আমরা ট্রেনিং করছি।”

৩। ইউনিট লাইনে ব্রিগেড কমান্ডার ও অন্যান্য অফিসারদের অপ্রত্যাশিত পরিদর্শন।

৪। আমাদের খেলার মাঠের চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্ট অফিসার ও জেসিওদের সাথে ব্রিগেডের অফিসার ও জেসিদের দৈনিক খেলাধুলা প্রতিযোগিতা (যেটা স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ছয় মাসে একবার, দুইবার হয়)। খেলার মাঠ রক্ষার জন্য অন্য রেজিমেন্টের প্রটেকশন পার্টিকে অস্ত্রশস্ত্রসহ নিয়োগ করা।

৫। যদিও সম্ভাব্য ভারতীয় আক্রমণের জন্য আমাদের উপর ছুটির ব্যাপারে কোন বাধা নিষেধ আরোপ করা হয় নাই। বরং চতুর্থ বেঙ্গলের কমান্ডিং অফিসার ও ব্রিগেড কমান্ডার জোয়ানদেরকে বলেন, যার যার ইচ্ছানুযায়ী ছুটি নিতে পারে।

৬। মার্চ মাসের ১৮/১৯ তারিখে ইউনিট লাইনে রাত প্রায় বারোটার সময় গোলন্দাজ বাহিনীর একজন বাঙালি এসে খবর দেয় যে সেনানিবাসে আজ রাতে চতুর্থ বেঙ্গলের উপর পশ্চিম পাকিস্তানীরা হামলা চালাবে। এ খবর পাওয়া মাত্র ক্যাপ্টেন গফফার, লেফটেন্যান্ট মাহবুব, লেফটেন্যান্ট কবীর, বেঙ্গল রেজিমেন্টের দুই কোম্পানী (যারা সেনানিবাসের ভিতরে ছিল) নির্দেশ দেয় যে, সব জোয়ান নিজেদের অস্ত্রশস্ত্র অস্ত্রাগার থেকে নিয়ে যেন নিজেদের কাছে রাখে। চতুর্থ বেঙ্গলের সৈন্যদের দেখাদেখি সেনানিবাসের অন্যান্য পাকিস্তানি ইউনিট অস্ত্রশস্ত্র সহকারে তৈরী থাকে। সে রাতে কোন হামলা হয়নি। ২০শে মার্চ ভোরে সবাই আবার অস্ত্র জমা দেয়। রাতে অস্ত্রাগার থেকে বাহির করার জন্য কারো কাছে কোন কৈফিয়ত চাওয়া হয় নি। চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্ট কমান্ডিং অফিসার নিজে জেনেও উপরোল্লিখিত অফিসারদের কাছে কোন কৈফিয়ত চান নাই।

৭। ব্রিগেড কমান্ডার, ব্যাটালিয়ন কমান্ডার সপ্তাহে একবার সৈন্যদের উদ্দেশ্যে উপদেশ দিতেন, যেটা স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার।

৮। ১০ মার্চ (১৯৭১) ১৭টি গাড়ি (রসদপত্র, তেল বোঝাই) কুমিল্লা থেকে সিলেট পাঠানো হয়। চতুর্থ বেঙ্গলের একজন সুবেদার সামসুল হক এবং দশজন (বাঙালি) লোককে এই কনভয়কে প্রটেকশনে পাঠানো হয়। এই কনভয়ে পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যও ছিল। দুই দিনে এই কনভয় কুমিল্লা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া আসে। রাস্তায় বেরিকেড ছিল। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে এই কনভয়কে নিয়ে সিলেটের খাদিমনগরে পৌঁছাবার জন্য আমাকে নির্দেশ দেওয়া হয়। রাস্তায় রাস্তায় বেরিকেড অতিক্রম করে খাদিমনগরে পৌঁছাতে তিন দিন লাগে। ১৫ মার্চ আমি খাদিমনগর পৌঁছাই ও নির্দেশ মোতাবেক ব্রাহ্মণবাড়িয়া আসার প্রস্তুতি নিই। কিন্তু আমাকে বলা হয় যে, অনির্দিষ্টকালের জন্য আমাকে ৩১ পাঞ্জাবের সাথে থাকতে হবে। এ খবর পাওয়া মাত্র আমি কুমিল্লায় টেলিফোন করলাম। বাঙালী অফিসাররা বিশেষ করে ক্যাপ্টেন গাফফার, লেফটেন্যান্ট মাহবুব, লেফটেন্যান্ট কবীর এবং জেসিওরা কমান্ডিং অফিসাররা আমাকে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে ফিরিয়ে আনতে বাধ্য করেন। ১৭/১৮ তারিখে আমি ও আমার চতুর্থ বেঙ্গলের অন্যান্য সৈনিক ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে আমার কোম্পানিতে ফিরে আসি।

উপরোল্লিখিত আমি সন্দিহান হয়ে পড়ি। আমি সুবেদার ওহাবের মাধ্যমে কুমিল্লা সেনানিবাসে বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসার ও জেসিদের কাছে খবর পাঠাতাম যে, কোন পরিস্থিতিতেই তারা যেন আত্মসমর্পন না করে। যদি প্রয়োজন হয় অস্ত্র নিয়ে তারা যেন বেরিয়ে আসে।

এই সন্দেহ এবং অবিশ্বাস সৃষ্টি হবার পর আমার কোম্পানী এবং মেজর সাদেক নেওয়াজের কোম্পানীর উদ্ধৃত্ত অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে আনা হয়।

       ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে আমরা ওয়াপদা কলোনী সংলগ্ন স্থানে তাঁবুতে দুই কোম্পানী থাকি। আমার আশংকা ছিল, এই দুই কোম্পানী সৈন্যকে পশ্চিম পাকিস্তানীরা অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে অস্ত্র সমর্পণ করতে বাধ্য করবে। এই সম্ভাব্য আক্রমণকে প্রতিহত করার জন্য আমি আমার কোম্পানীর এবং সাদেক নেওয়াজের কোম্পানীর জেসিওদের নির্দেশ দিই, যেন তারা আত্মরক্ষার জন্য আমাদের ক্যাম্পের চারিদিকে পরিখা খনন করে রাখে। আর যদি প্রয়োজন হয় তবে ঐসব পরিখা থেকে আক্রমণ প্রতিহত করা যেতে পারে।

       আমার এই সমস্ত কাজ খুব সাবধানে ও হুঁশিয়ারের সাথে করতে হয়। কেননা, মেজর সাদেক নেওয়াজ সব সময় আমাকে চোখে চোখে রাখতো। সে প্রায়ই আমাকে জিজ্ঞেস করতো, পরিখা খনন করা, পজিশন নেয়া- এগুলোর উদ্দেশ্য কি? আমি বলতাম, ডিগিং প্র্যাকটিস এবং পজিশন নেয়ার প্রশিক্ষণ রিভাইজ করা হচ্ছে।

       ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে আত্মরক্ষামূলক বিভিন্ন কাজ এবং বিভিন্ন জেসিওদের সাথে যোগাযোগ, প্রভাবান্বিত করা এবং সতর্ক করার কাজে লেফটেন্যান্ট হারুন আমাকে সর্বতোভাবে সাহায্য করেন। সে এসব কাজে উৎসাহী ছিল এবং অন্যান্য লোকদের প্রেরণা যোগাতো।

       প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য যে কুমিল্লার সাথে আমাদের বাহ্মণবাড়িয়া ক্যাম্পের যোগাযোগ ছিল একমাত্র টেলিফোনের মাধ্যমে এবং একটি সিগন্যাল সেট যেটা অস্বাভাবিকভাবে কুমিল্লা ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারের সাথে যোগাযোগ রাখতো। এ সময় আমি খুব অস্বস্তিকর পরিবেশে ছিলাম। আমি সবসময় চিন্তা করতাম যে কুমিল্লাতে অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ এবং সৈনিক ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

       ২৪শে মার্চ সন্ধ্যায় আমরা দেখতে পেলাম কুমিল্লার দিক থেকে ৮টা গাড়ির আলো ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে আসছে। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী আমাদের ক্যাম্পের প্রটেকশন পার্টি পরিখাতে অবস্থান নেয়। গাড়ি কাছাকাছি আসার পর বুঝতে পারি, মেজর খালেদ মোশাররফ তার কোম্পানী নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ১২০ মাইল দূরে সমরেশনগরে নকশালপন্থী এবং ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীদের অশুভ তৎপরতা বন্ধ করার জন্য আসছে। এখানে বলে রাখা দরকার যে, মেজর খালেদ মোশাররফ যিনি আমার থেকে বাঙালীদের মধ্যে সিনিয়র সেদিনই ব্যাটালিয়নে ঢাকা থেকে এসে যোগদান করেন এবং একই দিনে তাঁকে কুমিল্লা থেকে ১৭০ মাইল দূরে সমশেরনগরে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এরপর চতুর্থ বেঙ্গলের একটি রাইফেল কোম্পানী আর হেডকোয়ার্টার কোম্পানী কুমিল্লা থেকে যায়।

       সেই রাতে মেজর খালেদ মোশাররফ লেঃ মাহবুবকে সঙ্গে নিয়ে আসেন এবং তার কোম্পানী আমাদের ক্যাম্পে থাকে। মেজর সাদেক নেওয়াজের সর্বক্ষণিক উপস্থিতির জন্য আমরা খোলাখুলি আলাপ-আলোচনা করতে পারি নাই। শুধু আভাষে, ইঙ্গিতে এটুকু বুঝাতে সক্ষম হই, যে কোন পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে আমরা প্রস্তুত। সত্যি কথা বলতে কি, সেদিন আমি আর লেফটেন্যান্ট হারুন খুব খুশী হই এই ভেবে যে, আমাদের পরিচালনার জন্য একজন পুরোনো অভিজ্ঞ অফিসার চতুর্থ বেঙ্গলে যোগ দিয়ে কুমিল্লা থেকে আরও একটি কোম্পানীকে মরণ ফাঁদ থেকে কনফ্রন্টেশনের আগেই বের করে নিয়ে এসেছেন।

       মেজর খালেদ মোশাররফের নিকট একটা সিগন্যাল সেট ব্রিগেড হেডকোয়ার্টার দিয়ে দেয়। আমরা সিদ্ধান্ত নিই যে আমার সেট এবং খালেদ মোশাররফের সেট যেন একই ফ্রিকোয়েন্সিতে যোগাযোগ করতে সক্ষম হয়। ২৪/২৫ তারিখ সকালে তিনি তার কোম্পানী নিয়ে সমশেরনগরের দিকে রওয়ানা হয়ে যান।

       ২৫শে মার্চ সন্ধ্যাবেলায় কুমিল্লা থেকে নির্দেশ আসলো যে, আরো লোক আসছে তাদের থাকার ও খাবার ব্যাবস্থা করতে হবে। আমরা থাকার ও খাবার ব্যবস্থা করেছি কিন্তু আমরা জানতাম না কারা আসছে। রাত আটটার সময় দেখলাম যে লেঃ কর্নেল মালিক খিজির হায়াত খান কুমিল্লায় অবস্থিত চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাকি কোম্পানীগুলো নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে উপস্থিত হয়েছেন। এসে তিনি বললেন যুদ্ধ আসন্ন। সেজন্য ব্রিগেড কমান্ডার তাঁকে কুমিল্লা থেকে চতুর্থ বেঙ্গলের প্রায় সব লোক নিয়েই পাঠিয়ে দিয়েছেন।

       খিজির হায়াত খানের আসার পর চতুর্থ বেঙ্গলের অবস্থান নিম্নরুপঃ

       (ক) এক কোম্পানী সমশেরণগরে- যার কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ।

       (খ) তিন কোম্পানী- হেডকোয়ার্টার কোম্পানী আর ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টার- ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে।

       (গ) ৭০/৮০ জন লোক কুমিল্লায় ইউনিট লাইন এর প্রহরায় নিয়োজিত।

       (ঘ) এক প্লাটুন কুমিল্লার জাঙ্গালিয়া বিদ্যুৎ গ্রীড স্টেশনের প্রহরায়। এর কমান্ডার ছিল নায়েব সুবেদার এম. এ. জলিল।

       খিজির হায়াত খান ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌঁছেই ২৫শে মার্চ রাত এগারটায় আমাকে হুকুম দিলেন যে, আমি যেন আমার কোম্পানীর সৈন্য নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ১৩ মাইল দূরে শাহবাজপুর পুলের কাছে প্রতিরক্ষাব্যূহ তৈরি করি। রাত দু’টার সময় রওনা হয়ে তিনটায় শাহবাজপুরে পৌঁছাই।

       সকাল ছ’টার সময় (২৬শে মার্চ) আবার খবর আসলো, কোম্পানী ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে ফেরত যেতে হবে। দেশে সামরিক আইন জারি করা হয়েছে।

সকাল সাতটায় রওনা হয়ে দশটায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌঁছাই। দশ মাইল আসতে তিন ঘণ্টা লাগে, কেননা জনসাধারণ বড় বড় গাছ রাস্তার উপরে ফেলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল।

ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে পৌঁছে দেখি সেখানে সান্ধ্য আইন জারী করা হয়েছে। আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌঁছার সাথে সাথে খিজির হায়াত খান আমাকে পুলিশ লাইনে গিয়ে তাদেরকে নিরস্ত্র করার নির্দেশ দিলেন। আমি তাঁকে বললাম যে নিরস্ত্র করতে গেলে খামাখা গণ্ডগোল, গোলাগুলি হবে। তার চেয়ে আমি নিজেই গিয়ে পরদিন ওদের কাছ থেকে অস্ত্র নিয়ে আসার অঙ্গীকার করলাম। খিজির হায়াত খান প্রথমতঃ চেয়েছিলেন যে মেজর সাদেক নেওয়াজ গিয়ে প্রয়োজনবোধে শক্তি প্রয়োগ করে পুলিশদের নিরস্ত্র করুক। আমি অনর্থক রক্তপাত এড়ানোর জন্য খিজির হায়াত খানের কাছে এক মিথ্যা অঙ্গীকার করলাম যে আমি নিজে গিয়ে পরদিন ওদের কাছ থেকে অস্ত্র নিয়ে আসবো। তিনি আমার কথায় রাজী হলেন।

২৬শে মার্চ বেলা বারটার সময় চতুর্থ বেঙ্গলের সিগনাল জেসিও নায়েব সুবেদার জহির আমাকে বললেন যে তিনি অয়ারলেস ইন্টারসেপ্ট করে দুটো স্টেশনের মধ্যে এই কথোপকথন শুনেছেন। তাঁকে খুব চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছিলো।

ইন্টারসেপ্টেড মেসেজগুলো ছিলঃ

(অনুবাদ)

(১) ট্যাঙ্ক গোলাবারুদ পাঠাও।

(২) হতাহতদের অপসারণ করতে হেলিকপ্টার পাঠাও।

(৩) ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৫০ জন পলাতক….. কিছু অস্ত্রসহ আর কিছু অস্ত্র ছাড়া।

এ সমস্ত মেসেজ পেয়ে আমার জুনিয়র অফিসারগণ লেঃ হারুন, লেঃ কবীর, লেঃ আখতার খুব উত্তেজিত হয়ে পড়ে। তখন আমি সিগনাল সেটে গিয়ে মেজর খালেদ মোশাররফের সাথে যোগাযোগ করি এবং অল্প চেষ্টায় তাঁর সাথে আমার যোগাযোগ হয়ে যায়। আমি তাঁকে চোস্ত ঢাকাইয়া বাংলায় ঐ মেসেজগুলো শুনাই এবং তাঁর মতামত জানতে চাই। আমি তাঁকে বলে যে, আমরা তৈরি এবং তাঁকে তাড়াতাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কোম্পানী নিয়ে আসার জন্য অনুরোধ করি। আমার সাথে যখন খালেদ মোশাররফের কথোপকথন চলে তখন সাদেক নেওয়াজ, লেঃ আমজাদ সাইদ এবং খিজির হায়াত খান আমাকে খুব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করছিল। সেই জন্য খুব বেশি কথাবার্তা চালানো সম্ভব হয় নি এবং তিনিও সমশেরনগর থেকে বেশি কথা বলেন নি। শুধু বলেছিলেন যে, তিনি রাতের অপেক্ষায় আছেন।

তারপর থেকেই আমার জুনিয়র অফিসাররা তাড়াতাড়ি যে কোন সিদ্ধান্ত নেবার জন্য আমাকে পীড়াপীড়ি করছিল। আমি ব্যাটালিয়নের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন জুনিয়র অফিসারের মতামতের অপেক্ষায় ছিলাম। কেননা, সামান্য ভুল সিদ্ধান্ত সময়োপযোগী না হলে সবকিছু পণ্ড হয়ে যাবে এবং নিজেদের মধ্যে অপ্রয়োজনীয় হতাহত হবে। আমি অন্ততঃ একজন অফিসার এবং একজন জেসিওকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবার জন্য সারারাত সময় দিই। সন্ধ্যার সময় আমি ইচ্ছাকৃতভাবে সৈনিকদের ক্যাম্পের সামনে গিয়ে দাঁড়াই। আমাকে দেখা মাত্রই বেশ কয়েকজন সৈনিক যাদের মধ্যে কয়েকজন এনসিও ছিলেন, আমাকে ঘিরে ধরেন এবং বলেন যে, “স্যার দেশের মধ্যে যে কি হচ্ছে তা আপনারা আমাদের চেয়ে অনেক ভাল বোঝেন। আমরা অফিসারদের মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। আপনাদের যে কোন নির্দেশ আমরা জীবন দিয়ে পালন করতে প্রস্তুত। আপনারা যদি বেশী দেরী করেন তবে হয়ত আমাদের কাউকে পাবেন না। আমরা আগামীকালের পরেই যে যার বাড়ির দিকে রওনা হবো। কিন্তু সঙ্গে নিজেদের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যাবো। সৈন্যদের এই মনোবল ও সাহস দেখে আমি খুব গর্বিত ও আশান্বিত হলাম এবং দু’একজন অফিসার ও জেসিও’র দ্বিধাদ্বন্দ্ব আমাকে সিদ্ধান্তে অবিচল থাকা থেকে বিরত করতে পারে নাই। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, আমার চেষ্টা সত্ত্বেও দুপুরের পরে খালেদ মোশাররফের সাথে কোন যোগাযোগ করতে পারি নি।”

২৬শে মার্চ সন্ধ্যার পরে ইয়াহিয়া খানের বেতার ভাষণ শুনে আমার বাঙালি জুনিয়র অফিসাররা আরো উত্তেজিত এবং ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো এবং আমাকে তক্ষুনি অস্ত্র হাতে তুলে নেবার জন্য পীড়াপীড়ি করতে লাগল। আমি রাতে আমার তাঁবুতে অবস্থান করলাম। সারারাত সাদেক নেওয়াজ এবং লেঃ আমজাদ আমার তাঁবুর ১০০/১৫০ গজ দূর থেকে আমাকে পাহারা দিচ্ছিল। আমার অজ্ঞাতেই তিন চারজন এনসিও (শহীদ হাবিলদার বেলায়েত হোসেন, শহীদ হাবিলদার মইনুল, হাবিলদার শহীদ মিয়া এবং হাবিলদার ইউনুস) সারারাত আমাকে পাহারা দেয় যাতে ঐ দুজন পাঞ্জাবী অফিসার আমার উপর কোন হামলা করতে না পারে। পাঞ্জাবী অফিসাররাও সারারাত সজাগ ছিল।

২৭শে মার্চ সকাল সাতটায় আমি লেঃ আখতারকে সাদেক নেওয়াজের কক্ষে পাঠাই এবং তাঁকে বলা হয় যখন সাদেক নেওয়াজ মেসে আমাদের সাথে নাস্তা করতে আসবে তখন যেন তাঁর স্টেনগান এবং ৮ ম্যাগাজিন গুলি অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়। আমার উদ্দেশ্য ছিল রক্তপাতহীন একটা অ্যাকশন পরিচালনা করা। কিছুক্ষণ পর আমি লেঃ হারুন আর লেঃ কবীর দুইজন এন-সি-ও সাথে করে অফিসার মেসের দিকে যাই। অফিসার মেসে পাঞ্জাবী অফিসারদের সাথে আমরা ব্রেকফাস্টে মিলিত হই। এন-সি-ও দের নির্দেশ দিই যে, আমাদের রক্তপাতহীন অ্যাকশনের সময় যদি কোন বাঙালি বিশ্বাসঘাতকতা করে তবে তাঁকে যেন গুলি করে হত্যা করা হয়। আমরা সকাল ৭-২০ মিনিটে ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে আছি। এমন সময় জেসিও খিজির হায়াত খানকে বলল যে, সাদেক নেওয়াজের কোম্পানীতে একটু মনোমালিন্য হয়েছে সুতরাং খিজির হায়াতকে সাদেক নেওয়াজের কোম্পানীতে এক্ষুনি যেতে হবে। একথা শোনা মাত্র খিজির হায়াত খান তক্ষুনি সাদেক নেওয়াজের কোম্পানীর কাছে যেতে উদ্যত হলো। আমি তাকে বাধা দিলাম এবং বললাম যে, পরিস্থিতি না জেনে এভাবে যাওয়া ঠিক হবে না। সুতরাং প্রথমে আমরা অফিসে যাই। ওখানে আলাপ-আলোচনার পর আমরা সকলেই সাদেক নেওয়াজের কোম্পানীতে যাবো। খিজির হায়াত এতে রাজী হলেন। সাদেক নেওয়াজ তখন তার স্টেনগান আনার জন্য তার কক্ষে যেতে উদ্যত হয়। আমি আবার বাধা দিই এবং বলি যে আমার স্টেনগানটা সে যদি চায় তবে সে সঙ্গে নিতে পারে। এতে সে আশ্বস্ত হয় এবং আমরা সকলেই অফিসে যাই। একটা তাঁবুতে অফিস করা হয়েছিল। তিনজন পশ্চিম পাকিস্তানী অফিসার তাঁবুতে ঢোকা মাত্রই লেঃ কবীর আর লেঃ হারুন তাঁবুর দুপাশে গিয়ে দাঁড়ান এবং আমি আমাদের সকলের আনুগত্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি ঘোষণা করি এবং বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে তাদেরকে বলি যে তারা আমাদের বন্দী। তদানুসারে তাদের জীবনের দায়িত্ব আমাদের এবং তারা যেন কেউ কোন বাঙালি অফিসার, জে-সি-ও, এন-সি-ওর সাথে কোন কথা না বলে। বলাবাহুল্য যে, পশ্চিম পাকিস্তানী ১২/১৫ জন সৈনিক যারা চতুর্থ বেঙ্গল এর সাথে ছিল, আমার নির্দেশের অপেক্ষা না করেই প্রায় একই সময়ে তাদেরকে বন্দী করে এক জায়গায় জমা করে রাখা হয়। বিনা রক্তপাতে আমাদের অ্যাকশন সম্পন্ন হয় এবং চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রায় সব ক’টা কোম্পানী তার সম্পূর্ণ অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ, যানবাহন, রসদপত্র নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

২৭শে মার্চ সকাল দশটার দিকে প্রায় ১০/১৫ হাজার উল্লসিত জনতা আমাদের ক্যাম্পে চলে আসে এবং ‘জয়বাংলা’ ধ্বনি দিয়ে আমাদের স্বাগত জানায়। অস্ত্র ধারণ করার পর দেখতে পেলাম আমার বেশ কয়েকজন অফিসার, জেসিও এবং এনসিও একটু অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়ছিলেন এই অল্প সময়ের মধ্যে জীবনের এই বিরাট পরিবর্তনে। কয়েকজনের ক্ষণিকের মধ্যে ১০২ থেকে ১০৪ ডিগ্রি জ্বর পর্যন্ত হয়েছিল। কয়েকজন আবোল-তাবোল বকছিল। দুইজন অফিসারকে বেশ কয়েকদিন আর চোখে পড়েনি। আমি নিজেও একটু অস্থির প্রকৃতির হয়ে পড়েছিলাম।

সকাল ১১টার দিকে আমি সব কোম্পানীকে নির্দেশ দিলাম তারা ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের চার পাশের গ্রামগুলোতে যেন অবস্থান নেয় যাতে করে পাকিস্তানী বিমান হামলা থেকে ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন না হয়। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে আমাদের ব্যাটালিয়ন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চারিপার্শ্বের গ্রামে গোপন অবস্থান নেয়। বেলা আড়াইটার সময় মেজর খালেদ মোশাররফ তাঁর কোম্পানী নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌঁছেন। রাস্তায় হাজার হাজার বেরিকেড অতিক্রম করে আসার ফলে তাঁর আসতে দেরী হয়েছিল। তিনি আসা মাত্রই আমি চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মুক্ত এলাকা তাঁর কাছে হস্তান্তর করি এবং তাঁর নির্দেশে পরবর্তী কর্মপন্থা নির্ধারণ করা হয়।

কুমিল্লা সেনানিবাসে আমাদের যে সমস্ত লোক ছিল তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা আমাদের সম্ভব হয়নি। সুতরাং তাদেরকে ২৭শে মার্চ বলতে পারিনি যে আমরা স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ গ্রহণ করেছি। যা হোক, কর্ণেল খালেদ মোশাররফ ২৯শে মার্চ জাঙালিয়াতে আমাদের প্লাটুনের সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম হন এবং তাদেরকে আমাদের সংগ্রামের কথা জানান এবং নির্দেশ দেন জাঙ্গালিয়া থেকে বেরিয়ে এসে ব্যাটালিয়নে যোগদান করতে।

আমরা পরে জানতে পেরেছি যে কুমিল্লা সেনানিবাসে আমাদের যে সমস্ত লোকজন ছিল তারা ২৯শে মার্চ আমাদের সংগ্রামের কথা জানতে পেরেছিল। কিন্তু নেতৃত্বের অভাবে তারা কোন অ্যাকশন নিতে পারে নি। ৩১শে মার্চ বিকাল চারটার সময় সেনানিবাসে অবস্থিত চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৭০/৮০ জন সৈনিকের উপর পশ্চিম পাকিস্তানীরা চারিদিক থেকে হামলা করে এবং প্রায় ছয় ঘণ্টা যুদ্ধের পর আমাদের চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্ট ইউনিট লাইন দখল করে। এই যুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানীদের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়। চতুর্থ বেঙ্গলের ৮/১০ জন জোয়ান শহীদ হন। এই যুদ্ধে নায়েব সুবেদার এম এ সালাম অসাধারণ বীরত্ব প্রদর্শন করেন।

জাঙ্গালিয়াতে যে প্লাটুন ছিল সেটা ২৯শে মার্চ বের হয়ে মুক্তিসংগ্রামে যোগ দেয় এবং কুমিল্লা-লাকসাম রোডে নায়েব সুবেদার এম এ জলিলের নেতৃত্বে কয়েকটি সাফল্যজনক অ্যামবুশ করে।

————————————————-

<৯, ৩.৩, ১৩৪-১৩৭>

কুমিল্লানোয়াখালীর সশস্ত্র প্রতিরোধ

সাক্ষাৎকার- মেজর গাফফার

(১৯৭১ সালে ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। সাক্ষাৎকারটি বাংলা একাডেমীর দলিলপত্র থেকে সংকলিত)

২৮০৮১৯৭৩

আমি মনে করেছিলাম কুমিল্লা ব্রিগেডের ইকবাল মোঃ শফি আমাদের ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টকে বিভক্ত এবং দুর্বল করে দিয়ে ধ্বংস করে দিবে। সেহেতু ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের তিনটি কোম্পানীকে বাইরে পাঠিয়ে সিলেটে অবস্থানরত ৩১তম পাঞ্জাব রেজিমেন্ট, কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে অবস্থানরত ২৪তম ফ্রন্টিয়ার ফোর্স-এর ৩ কমান্ডো ব্যাটালিয়ন দিয়ে আক্রমণ ও ঘেরাও করিয়ে ধ্বংস করাই তারা শ্রেয় ভেবেছিলো। তারা একাজ ভালোভাবেই সম্পন্ন করেছিলো, কিন্তু আল্লাহর রহমতে তাদের পরিকল্পনা সফল হয় নি। এ পরিস্থিতিতে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে গিয়ে অন্যান্য কোম্পানীর সাথে যোগ দেয়া শ্রেয় মনে করি। আমি ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রথম কমাণ্ড লেঃ কর্নেল খিজির হায়াতকে বুঝাতে থাকি ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে গিয়ে অন্যান্য কোম্পানীর সাথে মিলিত হবার জন্য। তিনি খুব ভালো লোক ছিলেন এবং আমাকে খুব বিশ্বাস করতেন। তিনি আমার কথায় কনভিন্সড হন এবং নির্দেশ দেবার জন্য ব্রিগেড কমান্ডারের কাছে যান। ব্রিগেড কমান্ডার তাকে তার বাহিনী নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাবার নির্দেশ দেন। লেঃ কর্নেল খিজির হায়াত ফোনে আমাকে ২৩শে মার্চ ১টার মধ্যে বাকী কোম্পানী নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাবার জন্য প্রস্তুত হতে বলেন। আমি দ্রুততার সঙ্গে ৩০টি ৩ টনের গাড়িতে বেশী পরিমাণে অস্ত্রশস্ত্র এবং অতিরিক্ত লোক নিয়ে যাবার জন্য প্রস্তুত হই। আমি একটা প্লাটুন জাঙ্গালিয়াতে রেখে যাই এবং আরেকটা প্লাটুনকে ভিতরে রেখে যাই ক্যান্টনমেন্টে অবস্থানরত বাঙালি অফিসারদের পরিবার পরিজনের প্রতি খেয়াল রাখার জন্য। আমরা আমাদের পরিবার পরিজনকে নিরাপদ জায়গায় সরাতে পারি নি। কেননা এটা করলে আমাদের উপর তাদের সন্দেহ হত এবং আমাদের পরিকল্পনা বানচাল হয়ে যেতো। যাবার আগে ক্যাপ্টেন উদ্দিনের (বর্তমানে মেজর) সাথে কথা বলি এবং তাকে অনুরোধ করি আমাদের পরিবারগুলির প্রতি খেয়াল রাখার জন্য এবং পারলে নিরাপদ জায়গায় যেন সরিয়ে দেন। ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিনকে সে সময় চট্রগ্রামে নবম বেঙ্গল রেজিমেন্টে বদলী করা হয়েছিলো। আমরা তাকে ক্যান্টনমেন্টে রেখে যাই। ২৭শে মার্চ শত্রুরা কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে আমাদের পরিবারদের গ্রেফতার করে এবং তাদের উপর অমানুষিক অত্যাচার চালায়। ১০ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট ঘিরে ফেললে শত্রুরা তাদের ছেড়ে দেয়। ২৮শে মার্চ ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিন কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আমাদের সাথে এসে যোগ দেন।

৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টকে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে আসার জন্য আমি লেঃ কর্নেল খিজির হায়াতকে নির্দেশ দেবার অনুরোধ করি। তিনি আমার কথামত সবাইকে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে আসার নির্দেশ দেন। একমাত্র সমশেরণগরে অবস্থিত মেজর খালেদ মোশাররফের বাহিনী ছাড়া সবাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া আসে।

২৪শে মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এমসিএ জনাব লুৎফুল হাই আমার সঙ্গে দেখা করে জানতে চান আমরা কি করবো। আমি তাকে বলি, ঠিক সময়ে আমরা আমাদের কর্তব্য সাধন করবো। তিনি চলে যাবার পর আমাদের ব্যাটালিয়নের পাঞ্জাবী অফিসারেরা এসে জিজ্ঞেস করে লুৎফুল হাই কেনো এসেছিলো। আমি তাদের বলি, সে আমার আত্মীয় এবং আমার সাথে এমনি দেখা করতে এসেছে। মিথ্যা বলে তাদের সন্দেহ দূর করি। আমি মেজর শাফায়াত জামিলকে সমস্ত পরিকল্পনার কথা বলি। সেভাবেই তিনি সমস্ত বাঙালি অফিসার, জেসিও এবং এনসিও’দের নিয়ে একটা সভা ডেকে বলেন, পরিস্থিতি খুব খারাপ- সেহেতু সবাইকে সজাগ এবং প্রস্তুত থাকতে হবে। ২৫শে মার্চ রাতে আমি মেজর খালেদ মোশাররফের সাথে অয়ারলেসে কথা বলি এবং সমস্ত পরিস্থিতি সম্বন্ধে জানাই। তিনি বলেন, আমরা সমশেরনগর থেকে আজ রাতেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পথে অগ্রসর হব এবং তোমরা যদি পারো পাঞ্জাবী অফিসারদের গ্রেফতার করো।

-(উপরে হলুদ চিহ্নিত ২৫ শে মার্চ তারিখটুকু খালেদ মোশাররফের সাক্ষাৎকারের সাথে কনফ্লিক্ট করে যা এই দলিলেই খালেদ মোশাররফের সাক্ষাৎকারে উল্লিখিত আছে। মূল দলিলের পৃষ্ঠা নাম্বার ৯৯। আমাদের হিসেবে এটা ২৬ শে মার্চ হবে। পড়ে দেখতে পারেন)

রাত ২টার সময় লেঃ কর্নেল খিজির খান, মেজর সাদেক নেওয়াজ, লেঃ আমজাদ সাইদ এবং অন্যান্য অবাঙালি সৈনিকদের গ্রেফতার করার পরিকল্পনা নেই। সে পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। কেননা মেজর সাদেক নেওয়াজ ব্রাহ্মণবাড়িয়া সিএণ্ডবি রেস্ট হাউসে আমার রুমে আমার পাশে ভর্তি করা একটা চাইনিজ স্টেনগান নিয়ে প্রস্তুত হয়ে বসে ছিল।

২৬শে মার্চ সকাল সাড়ে ৯টার সময় সভাকক্ষে সমস্ত অফিসারদের ১টা সভা ডাকা হয়। কিন্তু এর আগে ভোর সাড়ে চারটার সময় আমি অয়ারলেস সেটটি ধ্বংস করে দেই কেননা এই অয়ারলেসের মাধ্যমে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাথে কুমিল্লা ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারের কথাবার্তা হতো। সমস্ত টেলিফোন যোগাযোগও নষ্ট করে দেয়া হয়। আমাকে এটা করতে হয়েছিলো, কেননা অয়ারলেস অপারেটরদের ৩ জনের মধ্যে ২ জনই পাঞ্জাবী ছিলো। অয়ারলেসের মাধ্যমে শেষ যোগাযোগ করি মেজর খালেদ মোশাররফের সাথে। তাকে অনুরোধ করি অতিসত্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়া এসে আমাদের সাথে যোগ দেবার জন্য।

আমরা সবাই তাঁবুতে এসে জড়ো হই। সাড়ে ৯টার সময় মেজর শাফায়াত, লেঃ কবীর, লেঃ হারুন, আমি ও জেসিও’রা তাবু ঘিরে ফেলি। আমরা বিদ্রোহ করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করি এবং মেজর শাফায়াত জামিল তাদের উদ্দেশ্য করে বলেন, “আমরা আর পাকিস্তানী সৈন্য নই, আমরা এখন বাংলাদেশ সরকারের সৈনিক। আপনারা আমাদের বন্দী। পালাবার চেষ্টা করবেন না, করলে মারা যাবেন।” মুহুর্তের মধ্যে সবকিছু ঘটে যায়। ৭২ জন পাকসেনাকে হত্যা ও ৩ জন পাক অফিসারকে গ্রেফতার করে ২৬শে মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়া শত্রুদের হাত থেকে মুক্ত করি।

-(উপরে হলুদ চিহ্নিত ২৬ শে মার্চ তারিখটুকু খালেদ মোশাররফের সাক্ষাৎকারের সাথে কনফ্লিক্ট করে যা এই দলিলেই শাফায়েত জামিলের সাক্ষাৎকারে উল্লিখিত আছে। মূল দলিলের পৃষ্ঠা নাম্বার ১৩৩। আমাদের হিসেবে এটা ২৭ শে মার্চ হবে। পড়ে দেখতে পারেন)

মেজর খালেদ মোশাররফ এবং লেঃ মাহবুব রাত সাড়ে ১১টায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া এসে পৌঁছেন। মেজর খালেদ মোশাররফের হাতে ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের নেতৃত্ব দেয়া হয়। এরপর মেজর খালেদ আমাদের সবাইকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চারপাশে অবস্থান নিয়ে প্রতিরক্ষা ব্যূহ গড়ার নির্দেশ দেন, কেননা শত্রুরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া আক্রমণ করে আমাদের ধ্বংস করে দিতে পারে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আমাদের হেডকোয়ার্টার করা হয়।

আমাকে ১৮ জন সৈন্য দিয়ে গোকনঘাটে পাঠানো হয়। ঢাকা থেকে ভীতসন্ত্রস্ত জনতা পালিয়ে আসতে থাকে। আমি ২ দিনের মধ্যে ২৫০ জন পলায়নপর পুলিশ, ইপিআর’দের নিয়ে একটা কোম্পানী তৈরী করে ফেলি। তৃতীয় দিন পাক বিমানবাহিনী ৪টা স্যাবর জেটের সাহায্যে আমার এলাকায় স্ট্রাফিং করতে থাকে। এতে আমার বাহিনীর একজন আহত হয়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় স্থলপথে কোনো আক্রমণ তখনো শুরু হয় নি।

এক সপ্তাহের মধ্যে আমি আমার কোম্পানীকে ৩০৩ রাইফেলের দ্বারা সজ্জিত করে ফেলি। ৫ই এপ্রিল মেজর খালেদ মোশাররফ আমাকে আমার বাহিনী ক্যাপ্টেন মাহবুবের (পরে শহীদ হন) হাতে দিতে বলেন। তিনি ফ্রন্টিয়ার ফোর্স থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের সাথে যোগ দেন। তার হাতে দায়িত্ব দিয়ে আমি ৫ই এপ্রিল সকাল ৯টায় অস্থায়ী হেডকোয়ার্টার তেলিয়াপাড়া চা বাগানে মেজর মোশাররফের কাছে যাই।

মেজর খালেদ মোশাররফ আমাকে বলেন, ৩১তম পাঞ্জাব রেজিমেন্ট সিলেট থেকে নদীপথে ভৈরব হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে আসছে। সেজন্য ৪র্থ বেঙ্গলের একটা কোম্পানী নিয়ে আজবপুর ঘাটে যাই এবং সন্ধার মধ্যেই পজিশন নিয়ে নেই। এখানে এসে আমি ২য় বেঙ্গলের ক্যাপ্টেন নাসিমের (বর্তমান লেঃ কর্নেল) সাথে যোগাযোগ করি।, যিনি আশুগঞ্জ এলাকায় অবস্থান নিয়েছিলেন। ২য় বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর কাজী মোঃ শফিউল্লাহর নেতৃত্বে জয়দেবপুর ক্যান্টনমেন্টে বিদ্রোহ করে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে আসে। ময়মনসিংহ হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এসে তিনি আমাদের সাথে যোগ দেন। আমরা সে সময় বিরাট এলাকা কোম্পানীগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয়ে সিলেটের খোয়াই নদী পর্যন্ত শত্রুমুক্ত ও স্বাধীন রেখেছিলাম।

৭ই এপ্রিলে এক দুঃখজনক ঘটনা ঘটে। আমি ভেবেছিলাম শত্রুরা বড় নৌকা ও লঞ্চের সাহায্যে পালানোর চেষ্টা করবে। সেহেতু আমি নৌকা তল্লাশি করার নির্দেশ দেই। অতি প্রত্যুষে একটা মটর লঞ্চ আশুগঞ্জের দিকে যাচ্ছিলো। আমি তাদের থামতে বলি। লঞ্চটি না থেমে বরং আরো দ্রুত গতিতে চলতে থাকে। ওর ভিতরে পাঞ্জাবী সেনা আছে ধরে নিয়ে আমরা এমএমজি ও ৭৫ এমএমআর-এর সাহায্যে গুলি ছুঁড়তে থাকি। লঞ্চটি থেমে যায় এবং আশ্চর্যের ব্যাপার লঞ্চটি বেসামরিক ব্যক্তিদের দ্বারা ভর্তি দেখলাম। একজন আহত হয় ও তার প্রাথমিক চিকিৎসা করে সারেংকে সাবধান করে ছেড়ে দেই। এই সময় পাক বিমান আমাদের উপর আকস্মাৎ হামলা শুরু করে দেয়।

৩/৪ দিন পর ক্যাপ্টেন মতিন (বর্তমানে মেজর) ১টি কোম্পানী নিয়ে এসে আমাদের অব্যাহতি দেন। আমি আমার বাহিনী নিয়ে তেলিয়াপাড়া যাই। পরবর্তী নির্দেশ দেওয়া হয়। দুইদিন বিবিরবাজারে অবস্থানের পর তৃতীয় দিনে ৪র্থ বেঙ্গলের সি কোম্পানীকে নিয়ে মনতলি যাবার নির্দেশ দেন মেজর খালেদ মোশাররফ।

১৪ই এপ্রিল প্রথম সাফল্যজনক আক্রমণ চালাই শত্রুর বিরূদ্ধে। ঐদিন রাতে গঙ্গাসাগরে ৪টা প্লাটুন ও ১টা ৩” মর্টার সেকশনের সাহায্যে শত্রুর অবস্থানকে ঘিরে আক্রমণ চালাই। মেজর খালেদ মোশাররফ মর্টার সেকশনে নেতৃত্ব দেন। তার উপস্থিতি আমার সৈনগযদের মনোবল বাড়িয়ে তোলে। রাত দুইটার সময় শত্রুদের উপর আক্রমণ চালিয়ে ৩১ জন শত্রুসৈন্য ও ১৫/২০ জনকে আহত করি। আমরা সবাই নিরাপদে ফিরে আসি। ২ জন সামান্য আহত হয়।

চারদিন সেখানে অবস্থানের পর আমাকে কসবা-শালদানদী এলাকায় যেতে বলা হয়। ১৮ই এপ্রিল আমি কসবার পথে রওয়ানা হই এবং সেখানে ঘাটি গড়ে তুলি। গঙ্গাসগরে শত্রুদের মার দেবার পর কসবা-শালদানদীর গুরুত্ব বেড়ে গিয়েছিলো। আমার পৌঁছতে একটু দেড়ি হয়। এর আগেই শত্রুরা কসবা বাজার ও কসবা রেলওয়ে স্টেশনে ঘাঁটি গেড়ে ফেলেছে। আমি আমার ক্যাম্প ইয়াকুবপুর জাতুমুরা এলাকায় স্থাপন করি। আমি রেকি করে বুঝতে পারি আমার অবস্থান খুব একটা সুবিধাজনক নয়। ভারতে আশ্রয় না নিয়ে নিজ অবস্থানে থেকে শত্রুদের গতিবিধি লক্ষ্য করতে থাকি। পাক সেনারা কসবা এসে নিরীহ জনসাধারণের উপর অত্যাচার, লুণ্ঠন, ধর্ষণ চালাতে থাকে। ইতিমধ্যে হাজার হাজার লোক পাকসেনাদের অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচার জন্য সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে চলে যাচ্ছিলো।

১৮ই এপ্রিল রাতেই আমি কসবা বাজার ও কসবা রেলওয়ে স্টেশন আক্রমণ করার পরিকল্পনা করি। ৩ ইঞ্চি মর্টারের সাহায্যে হঠাৎ করে শত্রুদের উপর আক্রমণ শুরু করে দেই। শত্রুরা যেহেতু প্রস্তুত ছিলো না সেহেতু তারা এই আক্রমণে হকচকিত হয়ে পড়ে। এ অপ্রত্যাশিত যুদ্ধ দেড় ঘন্টা ধরে চলে এবং এর সাফল্য অপ্রত্যাশিত ছিলো। শত্রুরা তখনো পর্যন্ত কোনো বাঙ্কার তৈরি করেনি। ফলে তারা গাড়ি বোঝাই অস্ত্র ফেলে রেখে বাজারের কুঁড়েঘরে এবং দোকানে গিয়ে আশ্রয় নেয়।

রাত সাড়ে চারটাকে আবার আক্রমণ করার সময় হিসেবে বেছে নেই। আমি একটা লম্বা গাছের উপর উঠে শত্রুদের অবস্থান দেখে নেই এবং আমার সৈন্যদের প্লাটুনে ভাগ করে তিন দিক দিয়ে ঘিরে ফেলি। একটি মাত্র পথ শত্রুদের জন্য খোলা থাকে। ৩.৫ ইঞ্চি রকেট লাঞ্চার এবং ছোট অস্ত্র ও মর্টারের সাহায্যে শত্রুদের উপর গোলাগুলি ছুড়তে থাকি। এই গোলাবর্ষণের ফলে শত্রুদের ৭টা গাড়ি ধ্বংস হয়ে যায়। ৪৫/৫০ জন নিহত হয় এবং ৭০/৮০ জন আহত হয়। শত্রুরা এ আকস্মিক আক্রমণে পর্যুদস্ত হয়ে কসবা ছেড়ে আড়াইবাড়ি কুটির দিকে পালিয়ে যায় এবং সেখানে গিয়ে অবস্থান নেয়। যাবার সময় তারা বিধ্বস্ত গাড়ি ও অনেক মৃতদেহ ফেলে রেখে যায়।

এ যুদ্ধ জয়ের ফলে আমাদের সৈন্যদের মনোবল অনেক বেড়ে যায়। কসবা নতুন বাজার দখল করার পর আমার হেডকোয়ার্টার কসবাতেই স্থাপন করি। অবশ্য আমি জানতাম, শত্রুরা কসবা দখল করার জন্য আবার বিপুল শক্তি সঞ্চয় করে আমাদের উপর আক্রমণ চালাবে।

জুন মাসে মেজর খালেদের নির্দেশে মুন্সিরহাট, ফেনী, নোয়াখালী এলাকায় যাই। যাবার পূর্ব পর্যন্ত তারা কসবা দখল করতে সক্ষম হয়নি। এই ব্যাপক বিপর্যয়ের পর শত্রুসেনারা স্থানীয় দালালদের সহযোগীতা ছাড়া বাংকার থেকে বের হতো না।

——————————————-

<৯, ৩.৪, ১৩৭-১৪১>

কুমিল্লার সশস্ত্র প্রতিরোধ

সাক্ষাৎকার: মেজর আইনউদ্দিন

(১৯৭১ সালের মার্চে ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের কোয়ার্টার মাষ্টার হিসাবে ক্যাপ্টেন পদে কর্মরত ছিলেন। সাক্ষাৎকারটি বাংলা একাডেমীর দলিলপত্র থেকে সংকলিত)

২৬১০১৯৭৩

 

একাত্তরের ২৫ শে মার্চ রাত ১২ টার দিকে কুমিল্লা পুলিশ ক্যাম্প পাঞ্জাবীরা আক্রমণ করে এবং গণহত্যা করে। ২৫ শে মার্চ রাতে তারা এসপি ও ডিসিকে গ্রেপ্তার করে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে আসে। সে সময় আমি কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে ছিলাম। ২৬শে মার্চ সকালে যখন আমি আমার বাসার বারান্দায় বসে ছিলাম, তখন গাড়িতে করে সাদা পোশাক পরা কিছু লোককে ধরে আনতে দেখি। ঐ দিন আমাকে মেজর জামিল (অবাঙালি) নির্দেশ দিয়েছিলেন, তোমাকে রাতে অয়ারলেসে ডিউটি করতে হবে। আমি রাত ১১টার দিকে যখন ডিউটিতে ছিলাম ঐ সময় সিলেট থেকে পাঞ্জাবী বেলুচ রেজিমেন্ট-এর সি-ও অয়ারলেসে কথা বলেন। সে সময় আমি বুদ্ধি করে নিজের নাম ও পদ গোপন করে একজন পাঞ্জাবীর নাম করে অয়ারলেসে কথা বলি। বেলুচ রেজিমেন্টের সি-ও-র কথায় বুঝতে পারলাম যে শ্রীমঙ্গলে যে সমস্ত বাঙালি সৈন্য ছিল (খালেদ মোশাররফ সাহেব তখন শ্রীমঙ্গলে ছিলেন) তাদের আক্রমণ করবে, তার জন্য বেলুচরা রেকি করেছে। এ সংবাদ পেয়ে আমি কিভাবে এ সংবাদ শ্রীমঙ্গলে পাঠাবো তার চেষ্টা করি, কিন্তু ইতিপূর্বে বাঙালিরা টেলিফোন লাইন কেটে দেয়ায় ঐ জরুরি সংবাদটি শ্রীমঙ্গলে পৌঁছানো সম্ভব হয় নি। খালেদ মোশাররফ সাহেব খবর না পেলেও শ্রীমঙ্গল থেকে তার দলসহ সরে পড়েছিলেন।

২৭ তারিখে আমি সাধারণ পোশাক পরে আমার সৈন্যদের নির্দেশ দিয়ে যাই যে, যদি আমি রাত ১২টার ভিতর ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ফিরে না আসি তবে যেন তারা হাতিয়ার নিয়ে ক্যান্টনমেন্টের বাইরে একটি জায়গায় অপেক্ষা করে। নির্দিষ্ট জায়গাটা আমি ঠিক করে দিয়েছিলাম।

আমি সাধারণ পোশাক পরে একখানা সাইকেলে চড়ে গ্রামের ভিতর দিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে রওনা হই। দুপুর একটার দিকে পথিমধ্যে পাঞ্জাবী সৈন্যরা ট্রেঞ্চ কাটছিল। কিন্তু তারা আমাকে চিনতে পারে নি। তবে পথিমধ্যে কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া রাস্তায় কংশনগর বাজারে কিছু বাঙালি আমাকে আটক করে। তারপর আমি আমার পরিচয়পত্র দেখিয়ে       তাদের বুঝাই যে, আমি বাঙালি একজন ক্যাপ্টেন, বিশেষ কাজে ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাচ্ছি। অনেক তথ্য-প্রমাণ দেয়ার পর তারা আমাকে মোটরসাইকেলে করে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে পৌঁছিয়ে দেয়। আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় রাত দেড়টার সময় পৌঁছাই। আমি গিয়ে দেখি সকল পাঞ্জাবী সৈন্যকে বাঙালীরা গ্রেফতার করে ফেলছে এবং ছোটখাটো সৈন্যদের বাঙালি সৈন্যরা মেরে ফেলছে।

আমি যখন ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে পৌঁছাই তখন করোলা ব্রীজের কাছে দিয়ে জীপ যেতে দেখি। ঐ জীপটিকে আমি থামালাম। ঐ জীপে কয়েকজন বাঙালী সৈন্য এবং একজন ক্যাপ্টেন মাহমুদুল হাসান (পাঞ্জাবী) ছিল। আমি সূর থেকে বাঙালী সৈন্যদের ক্যাপ্টেন মাহমুদুল হাসানকে গ্রেফতার করতে বলি। কিন্তু দুঃখের বিষয় বাঙালী সৈন্যরা তাকে গ্রেফতার করতে পারেনি। ক্যাপ্টেন কৌশলে গাড়ি ব্যাক করে পালিয়ে যায়। কিন্তু ২৮ তারিখে ঐ ক্যাপ্টেন যখন বিকালে পুনরায় কুমিল্লা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে আসছিল তখন করোলা ব্রীজের নিকট ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যরা তাকে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে। ঐ গাড়িতে তিনজন বাঙালী সৈন্য মারা যায় ও দুজন আহত হয়। ঐ ক্যাপ্টেন মুসলমান ছিল, তাই বাঙালীরা দায়পরবশ হয়ে তার মৃতদেহ মুসলমান কায়দায় রাত আড়াইটায় কবর দেয়। এ ধরণের কবর দেয়া প্রথম ও শেষ। তারপরে আর কোথাও মৃতদেহকে মুসলিম কায়দায় কবর দেয়া হয় নি। (শত্রুদের আনুষ্ঠানিকভাবে কবর দেয়া নাকি জেনেভা কনভেনশনে আছে)

২৮ তারিখে আমি ৪ জন অফিসারসহ অন্যান্য সৈন্য নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ডিফেন্স নিই। ২৭ তারিখে রওনা হয়ে খালেদ মোশাররফ সাহেব শ্রীমঙ্গল থেকে পুরা কোম্পানী নিয়ে ২৮ তারিখ সকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌঁছান এবং আমাকে বলে যান, যদি কোন এম-এন-এ বা কোন বুদ্ধিজীবী আসেন তাহলে তাদের আমার (খালেদ মোশাররফ) সাথে যোগাযোগ করার জন্য যেন সিলেট তেলিয়াপাড়া টি-এস্টেটে পাঠিয়ে চলে যান। তেলিয়াপাড়ায় খালেদ মোশাররফ সাহেব ক্যাম্প খোলেন।

ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে ১৪ই এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশের পতাকা ওড়ে এবং স্থানীয় প্রশাসন ঠিকভাবে চলে। ঐ সময় এস-ডি-ও ছিলেন রকিবুদ্দিন আহমেদ। তিনি তখন স্থানীয় প্রশাসক হন।

ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে রক্ষা করার জন্য গোকনঘাটে ক্যাপ্টেন আবদুল গাফফার, ক্যাপ্টেন শহীদ ও মাহবুবুর রহমানকে ঐ ঘাট দেখাশোনার জন্য মোতায়েন করা হয়েছিল; কারণ ঐ নদীপথে পাক সৈন্যরা জাহাজে করে সৈন্য আনতে পারত। গোকনঘাট চিল একটি লঞ্চঘাট। সৈন্যরা করোলা নদীর আশেপাশে ডিফেন্স নিয়ে ছিল। তাদের তত্ত্বাবধান করেন সেকেণ্ড লেফটেন্যান্ট হারুনর রশীদ।

২৯ তারিখে বিকাল ৪টার দিকে পাকবাহিনী ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিমান থেকে দেড়-দুঘন্টা ধরে বোমাবর্ষণ করে। এর ফলে একজন বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্য শহীদ হয়। কিন্তু বেঙ্গল রেজিমেন্টের কাছে তেমন কোন অস্ত্র না থাকায় শুধু ট্রেঞ্চের ভিতর বসে থাকতে হয়।

৩১ তারিখে আখাউড়া থেকে তৎকালীন ইপি-আর (বর্তমানে বিডিআর ) নায়েক সুবেদার গোলাম আম্বিয়া আমার সাথে যোগাযোগ করে। তিনি আখাউড়াতে ডিফেন্স নিয়েছিলেন। আখাউড়াতে ইপি-আর এর সৈন্যরা পাঞ্জাবীদের ঘেরাও করে রাখে। তারপর ৩১ তারিখে সারাদিন গোলাগুলী হওয়ার পর কিছু পাঞ্জাবী সৈন্য মারা যায় ও কিছু ধরা পড়ে। কিন্তু ৭ জন পাঞ্জাবী পালিয়ে যায়। তারপর ঐ ৭ জন পাঞ্জাবী সৈন্যকে গ্রামের ভিতর বাঙালীরা ধরে মেরে ফেলে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে যে সমস্ত পাঞ্জাবী অফিসার ধরা পড়ে তারা হলোঃ

১) লেঃ কর্নেল খিজির হায়াৎ খান,

২) মেজর সাদেক নেওয়াজ,

৩) লেফটেন্যান্ট আমজাদ সাইদ।

তাদেরকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে নবীনগর, শাহবাজপুর, সরাইল হয়ে তেলিয়াপাড়া নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর তাদেরকে ভারতীয় সৈন্যদের কাছে দিয়ে দেয়া হয়। তাদেরকে বাঙালীরা হত্যা করতে পারতো কিন্তু ঐ পাঞ্জাবী অফিসাররা কোনদিন বাঙালীদের সাথে খারাপ ব্যবহার করে নি বা বেঈমানি করে নি।

১লা এপ্রিল ৭১ আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে আখাউড়া যাই। ইপি-আর সৈন্যদের সাথে যোগাযোগ করলাম। তারা বলে যে তারা আমার সাথে (মানে ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাথে) একত্র হয়ে যুদ্ধ করবে। তারা আমার কাছে কিছু অস্ত্র চাইলে আমি অস্ত্র সরবরাহ করতে রাজী হই। তারপর ইপি-আর-এর সৈন্যরা আখাউড়া, গঙ্গাসাগর ও উজানীসাহা ব্রীজের আশেপাশে ডিফেন্স নেয়। আমি আগরতলায় বিএসএফ-এর সাথে ফোনে যোগাযোগ করি এবং তাদের কাছে কিছু অস্ত্র চাই। এবং তারা তা দিতে চান। লেঃ কর্নেল দাসের সাথে রাতে ফোনে যোগাযোগ করি।

১/২ তারিখে আমি আখাউড়া আওয়ামী লীগের সহসভাপতিকে সংগে করে আগরতলায় যাই। সেখানে বিএসএফ-এর লেঃ কর্নেল দাসের আগে থেকেই পরিচয় ছিল। মিঃ দাস ১০ হাজার গুলি ও একশন ৩০৩ রাইফেল ও কিছু এক্সপ্লেসিভ দিতে অঙ্গীকার করেন এবং পরে তিনি তা দেন। এ অস্ত্র দেয়ার ব্যাপারে যে কন্ট্রাক্ট হয় সে কন্ট্রাক্ট করেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এম-এন-এ আলী আজম সাহেব। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এম-এন-এ আলী আজম ও লুৎফুল হাই সাচ্চু সাহেব বেঙ্গল রেজিমেন্টের খাওয়া-দাওয়া, গাড়ি ইত্যাদি দিয়ে প্রচুর সাহায্য করেছেন যুদ্ধ চলা অবস্থায়। সৈন্য জনাব আলী আজম ৩০ তারিখের পূর্বেই আগরতলা গিয়ে অস্ত্রের ব্যাপারে যোগাযোগ করেছিলেন।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে মেজর হাবিবুল্লাহ বাহার (যিনি কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালিয়ে এসেছিলেন-ক্যাপ্টেন এ টি এম হায়দার-কমান্ডিং অফিসার (তিনি কুমিল্লা থেকে পালিয়ে আসেন) এবং ক্যাপ্টেন সায়গলকে (যে পাকিস্তানে পালিয়ে গেছে) তেলিয়াপাড়া ক্যাম্পে অন্য কাজে পাঠিয়ে দেয়া হয়।

আমি যখন কুমিল্লা থেকে পালিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া রওনা দিই তখন যে প্রায় একশত সৈন্য রেখে আসি তারা কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে বেপরোয়া হয়ে পাঞ্জাবীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। এর ফলে প্রায় ৩-৪ শত পাঞ্জাবী সৈন্য মারা যায়। কিছু বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্য শহীদ হন।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে আমি ১৫/২০ জন এম-পি-এ কে ভারতে পাঠিয়ে দিই। এপ্রিল মাসে আমি জানতে পারি যে, সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেব ভৈরব এসেছেন। সৈয়দ সাহেবকে অবহিত করাই যে, ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে এবং বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধীনে আছে। আমি সৈয়দ সাহেবকে আনার জন্য স্পিডবোট পাঠাতে চাইলে তিনি আসতে রাজী হন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি আসেন নি। এ সময়ের মধ্যে আমি বিভিন্ন জেলায় অয়ারলেসের মাধ্যমে খবর নিতে লাগলাম যে কোথায় বাঙালীরা রিভোল্ট করল। আমি জানতে পারলাম ময়মনসিংহে মেজর সফিউল্লাহ আছেন ও নরসিংদীতে একটি কোম্পানী আছে মেজর মতিউর রহমানের নেতৃত্বে। মেজর সফিউল্লাহ একটি পরিকল্পনা করেন যে, মেজর মতিউর রহমানের বাহিনী ও তাঁর কোম্পানী মিলে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করবে ও দখল করবে। এ সংবাদ আমি মেজর খালেদ মোশাররফ সাহেবকে জানাই। তিনি এ খবর পেয়ে তেলিয়াপাড়া থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে চলে আসেন। এখানে একত্র হয়ে তারা সবাই মিলে যুক্তি করে ভালভাবে কাজ করতে পারবে। পরে সফিউল্লাহ সাহেব পুরো ব্যাটালিয়ন নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে চলে আসেন এবং মেজর মতিউর রহমান সাহেব ভৈরব ব্রীজের কাছে ডিফেন্স নিয়ে থাকেন।

এদিকে মেজর নাসিম এক কোম্পানী সৈন্য নিয়ে আশুগঞ্জ ডিফেন্স দিয়ে থাকেন ১৪ই এপ্রিল পর্যন্ত।

ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে ছিলাম আমি, ভৈরবে ছিলেন মেজর মতিউর রহমান এবং আশুগঞ্জে ছিলেন মেজর নাসিম। বাকি সবাই তেলিয়াপাড়া চলে যান।

মেজর সফিউল্লাহ ও মেজর খালেদ মোশাররফ সাহেব যখন ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে একত্রিত হলেন তখন তারা সিদ্ধান্তে আসতে চাইলেন যে, তারা কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করবেন কিন্তু পরে চিন্তা করে দেখলেন কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে বিপুলসংখ্যক পাকসৈন্য রয়ে গেছে। ঐ পাকসৈন্যের সাথে যুদ্ধ করে পারা যাবে না, এর ফলে অনেক সৈন্য মারা যাবে। শেষ পর্যন্ত মেজর খালেদ মোশাররফ সাহেব সিদ্ধান্ত নিলেন পালসেনাদের গেরিলা পদ্ধতিতে ঘায়েল করতে হবে।

১৪ তারিখে পাকসেনা ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে বিমান থেকে গুলি করে; ফলে কিছু পাবলিকসহ কিছু বাঙালী সৈন্য মারা যায়। এ সংবাদ খালেদ মোশাররফ সাহেব পেয়ে জানালেন যে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছেড়ে যেন বেঙ্গল রেজিমেন্ট আখাউড়া চলে আসে। ঐ তারিখে পাকসৈন্য প্যারাট্রুপার ফেলে আশুগঞ্জের পিছনের দিক থেকে আক্রমণ করে। এর ফলে মেজর নাসিম সাহেবের কিছু সৈন্য শহীদ হয়। ১৪ তারিখ সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত আশুগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে বিমান আক্রমণ চলে। এর পরে আশুগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাথে কোন রকম টেলি-যোগাযোগ বা কোনরকম যোগাযোগ সম্ভব হয় নি।

১৪ই এপ্রিল আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়া ব্যাংক থেকে (ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংক) ম্যানেজারকে বাড়ি থেকে ডাকিয়ে ব্যাংক খুলে ২ কোটি টাকা নিয়ে যাই। ঐ টাকা ঐদিন তেলিয়াপাড়া মেজর সফিউল্লাহ সাহেবের কাছে জমা দিই। ১৪ তারিখে সারাদিন বিমান আক্রমণ হচ্ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে। এ সমস্ত প্রতিকূল অবস্থার ভিতরে আমি বীরত্বের সাথে এ কাজ সমাধান করি। আমি বিকালেই তেলিয়াপাড়া থেকে ফিরে এসে দেখি আমার বাহিনী কিছু কিছু আখাউড়া চলে এসেছে। আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে দু’খানা মূল্যবান অয়ারলেস সেট নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে সড়ক পথে তেলিয়াপাড়া হয়ে আখাউড়া চলে আসি।

১৫ই এপ্রিলে মেজর খালেদ মোশাররফ আমাকেল বলেন, আমাকে আখাউড়ায় সৈন্যদের দেখাশোনা করতে হবে। আখাউড়াতে ৩০/৪০ জন সৈন্য ছিল। আমি ১৫ তারিখে আমার বাহিনীকে বিকালে গঙ্গাসাগরের দিকে মুখ করে ডিফেন্স নেবার কলাকৌশল দেখিয়ে দিই। ১৫ তারিখ রাতে কুমিল্লা থেকে রেলে করে পাকসৈন্য গঙ্গাসাগরে আসে এবং গঙ্গাসাগরের ব্রীজের দক্ষিণ পারে বাজারের দিকে তারা ডিফেন্স নেয় এবং বেঙ্গল রেজিমেন্ট উত্তর দিকে অর্থ্যাৎ আখাউড়ার দিকে ডিফেন্স নেয়। ১৬ই এপ্রিল সকালে যেখানে ব্রীজের নিকট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ডিফেন্স নিয়েছিল, সেখানে ঐ সৈন্যদের সাথে দেখা করার জন্য আমি ক্রলিং করে যাচ্ছিলাম। পাকসৈন্যরা আমাকে দেখে আমার দিকে অবিরাম গুলীবর্ষণ করতে থাকে, কিন্তু আমি ঐ ঝুঁকি নিয়ে ট্রেঞ্চে গিয়ে সৈন্যদের বলে আসি পাকবাহিনীকে হত্যা করে যখন তাদের সংখ্যা কমে আসবে এবং বেঙ্গল রেজিমেন্ট ট্রেঞ্চের কাছে চলে আসবে ঠিক তার অল্প কিছুক্ষণ আগে যেন তারা বিওপিতে চলে আসে।

১৬ এপ্রিল গঙ্গাসাগরের এক পাড়ে বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং অপর পাড়ে পাকবাহিনী অবস্থান করছিল। ঐ দিন বিকালে ৪টা থেকে পাকবাহিনীর গোলন্দাজ বাহিনী আধ ঘন্টা বোমাবর্ষণ করে থেমে যায়।

বিকাল ৬টা থেকে পাকবাহিনী আবার গোলা ছুড়তে থাকে এবং আক্রমণ করার জন্য এগিয়ে আসতে থাকে। বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনারা অনেকক্ষণ যুদ্ধ করে এবং বহু পাকসেনাকে খতম করে শেষে পাকসেনাদের সামনে টিকতে না পেরে সব বেঙ্গল রেজিমেন্ট সৈন্য পিছনের দিকে চলে আসে। বাকি ছিল মাত্র সিপাই মোস্তফা কামাল; সে আর ফিরে আসে নাই। তার হাতে ছিল একখানা এল-এম-জি ও ৮ হাজার গুলী। তার সাথে যে ২ জন সেনা ছিল তারাও চলে গেল। কামাল ট্রেঞ্চের ভিতর থেকে যুদ্ধ করতে থাকে। তার গোলায় পাকবাহিনীর তিনজন অফিসার মরে ও ২ জন আহত হয়। সবসুদ্ধ প্রায় সাড়ে তিনশ’ সৈন্য খতম হয়। কামালের গুলি যখন ফুরিয়ে যায় তখন শত্রুসেনারা মাত্র ৫০ গজ দূরে ছিল, তবু সে পিছনে ফিরে আসে না। দূর থেকে পাকসেনা চিৎকার করে কামালকে আত্মসমর্পণ করতে বলে, কিন্তু কামাল তা করে নাই। পরে যখন পাকসেনারা ক্রলিং করে কামালের ট্রেঞ্চের কাছে আসে, কামাল তার শেষ সম্বল দু’খানা গ্রেনেড দিয়ে কিছু পাকসেনাকে আহত করে। শেষ পর্যন্ত কামাল পাকসেনাদের কাছে ধরা পড়ে। পাকসেনারা তাকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। প্রায় সাড়ে তিনশ’ পাকসেনা মারা যায়। এ সংবাদ যখন পাকসেনারা অয়ারলেসে তাদের এড অফিসে প্রেরণ করছিল তখন বেঙল রেজিমেন্ট তাদের অয়ারলেসের মাধ্যমে সঠিকভাবে জানতে পারল যে, বেঙ্গল পাকবাহিনীর সাড়ে তিনশ’ সৈন্যকে হত্যা করেছে। এত সৈন্য মরার পর পাকবাহিনীর মনোবল ভেঙ্গে যায় যার কারণে পরবর্তী ২/৩ মাস তারা আর আক্রমণ করে নাই।

এরপর আমার বাহিনী আখাউড়া বি-ও-পিতে ডিফেন্স নেয়। পরে আমার অধীনে দ’জন লেফটেন্যান্ট নিয়োগ করা হয়। একজন ক্যাডেট অফিসার হুমায়ুন কবীর। তার এলাকা ছিল কসবা। তিনি কসবাতে সাবসেক্টর কমান্ডাড় ছিলেন। অপরজন হলেন লেফটেন্যান্ট হারুনার রশীদ। তিনি নসিঙ্গরে সাবসেক্টর কমান্ডার ছিলেন। হারুন ও কবীরের কাছে এক কোম্পানী ও আমার কাছে দুই কোম্পানী সৈন্য ছিল। কোন সময় কসবা রেলস্টেশন ও কসবা নতুন বাজার পাকবাহিনী দখল করতে পারেনি। এবং নসিঙ্গরের কালাছড়া টি এসেস্ট প্রায় সব সময় মুক্তিবাহিনীর অধীনে ছিল। আমি প্রত্যেক দিন একবার করে তিনটি ক্যাম্প পরিদর্শন করতাম।

১৭ই এপ্রিল রাত ১১টা ৩০ মিনিটে মেজর শাফায়াত পামিল ও আমিসহ পাঁচজন অফিসার ও ৬০ জন সৈন্য নিয়ে আখাউড়া পাকবাহিনীর সেনাদের দখলে ছিল। ব্রীজ উড়িয়েছিল ৬৫ জন বেঙ্গল রেজিমেন্ট সৈন্য। তারা অক্ষত অবস্থায় আখাউড়া বি-ও-পি তে ফিরে আসে।

কর্নেল বাজার অপারেশন জুন১৯৭১:

আখাউড়া পতন হওয়ার পর বাংলাদেশ বাহিনী কর্নেল বাজারে জড়ো হয়। বাংলাদেশ বাহিনীর উদ্দেশ্য ছিল পাক সৈন্যদের হত্যা করে সংখ্যা কমানো। তাই তারা ওখানে রয়ে গেল। পাকবাহিনীর সৈন্য ছিল এক কোম্পানী আর বাংলাদেশ বাহিনীর ৩টি কোম্পানী ছিল। তার ভিতর একটি ছিল অনিয়মিত বাহিনী।

আগরতলা থেকে যে রাস্তা গঙ্গাসাগরের দিকে গিয়েছে ঐ রাস্তার উত্তর মুখ হয়ে বাংলাদেশ বাহিনীর সেনারা ডিফেন্স নেয়। ঐ রাস্তার উত্তর দিকে একটি খাল ছিল। পাকবাহিনী আখাউড়া থেকে কর্নেল বাজারের দিকে অগ্রসর হয় উত্তর দিক থেকে। তারা খাল পার হয়। রাতের বেলায় এসে পূর্বদিকে অর্থ্যাৎ বাংলাদেশ বাহিনীর পিছন দিক থেকে আক্রমণ করে। এর ফলে বাংলাদেশ বাহিনীর সেনারা ছত্র ভঙ্গ হয়ে পড়ে তারা ছিল অনিয়মিত বাহিনী। যা কিছু সৈন্য ছিল তাদের মধ্যে হাতাহাতি যুদ্ধ হয়। ফলে বেয়নটের আঘাতে বাংলাদেশ বাহিনীর ৭ জন সৈন্য শহীদ হয়। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ বাহিনীর অনিয়মিত সৈন্যদের আর খোঁজ পাওয়া যায় নি। তারা যার যার মত নানা দিকে চলে যায়।

———————————————-

<৯, ৩.৫, ১৪১-১৪২>

 

সশস্ত্র প্রতিরোধে কুমিল্লা

সাক্ষাৎকারঃ মেজর ইমামুজ্জামান

(১৯৭১ সালের মার্চে কুমিল্লা সেনানিবাসে লেফটেন্যান্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সাক্ষাৎকারটি বাংলা একাডেমীর দলিলপত্র থেকে সংকলিত)

১০-০১-১৯৭৪

মেজর খালেদ মোশাররফ বেঙ্গল রেজিমেন্টের এক কোম্পানী সৈন্য আমার নেতৃত্বে কুমিল্লা চাঁদপুর সড়কে (লাকসামের কাছাকাছি) এপ্রিল মাসের ১১ তারিখে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ৬৫টা কনভয়ে এ্যামবুশ করি। এতে ৫টা গাড়ি সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হয়। বাকি গাড়িগুলো কুমিল্লাতে ফিরে যায়।

এপ্রিল মাসের ১৯ তারিখে পাকিস্তান সেনাবাহিনী গোলন্দাজ বাহিনী নিয়ে আমাদের উপর আক্রমণ চালায় বাগমারায়। আমাদের অস্ত্রশস্ত্র তখন প্রচুর ছিলো না। ভারতও তখন আমাদের অস্ত্রশস্ত্র দিচ্ছিল না। দুদিন পর্যন্ত আমরা তীব্র প্রতিরোধ করলাম। প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে আমরা পিছু হটতে বাধ্য হলাম। ওদের প্রায় ২৭০ জন মারা গিয়েছিলো। মৃতদেহ গুলো ৭/৮ টা ট্রাকে উঠানোর সময় আমরা দেখতে পেলাম।

এপ্রিলের ২১ তারিখে আমরা লাকসাম ছেড়ে যেতে বাধ্য হলাম। চাঁদপুরে তখন পাকিস্তান বিমান বাহিনী বোমা বর্ষণ শুরু করে। লাকসাম থেকে আমরা মিয়ার বাজারে চলে গেলাম। এপ্রিলের ২৭ তারিখে পাকিস্তান বাহিনী মিয়ার বাজারে আক্রমণ করে। ঐ যুদ্ধে ওদের অনেক সৈন্য হতাহত হয়েছিলো। ধানক্ষেতে পানির মধ্যে অনেক সৈন্যের লাশ পাওয়া গিয়েছিলো।

এপ্রিলের ২৯/৩০ তারিখে ওরা আবার আক্রমণ চালায়। ওদের দুটো আক্রমণই বীরত্বের সাথে প্রতিহত করা হয়। আমাদের পক্ষে অনেকেই হতাহত হয়।

আমি কাদের চৌধুরী নামে মুজাহিদ বাহিনীর ক্যাপ্টেনকে মিয়ার বাজারের প্রতিরক্ষার দায়িত্ব দিয়ে খালেদ মোশাররফের মাধ্যমে চৌদ্দগ্রামে চলে আসি এবং ডাকাতিয়া নদীর পাড়ে পরিকোট নামক জায়গায় প্রতিরক্ষা ব্যূহ তৈরি করি।

মে মাসে পাকিস্তান সেনাবাহিনী নদীর ওপারে বাংগোডা বাজারে আসে এবং বেশ গোলাগুলি করে। কিন্তু আমাদের শক্তিশালী ঘাঁটির কথা জানতে পেরে ওরা লাকসামে চলে যায়। মে মাসের ১৪ তারিখে পাকিস্তান সেনাবাহিনী গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তা নদীর ওপার থেকে আমাদের উপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে আমরা পিছু হটতে বাধ্য হই।

আমরা চৌদ্দগ্রাম চলে আসি। গোলন্দাজ বাহিনীর ভারী গোলাবর্ষণের মুখে টিকতে না পেরে আমরা ভারতের রাধানগরে চলে আসি। আমাদের কোন সরবরাহ ছিলো না। ভারী অস্ত্রশস্ত্রও ছিলো না। গুলির অভাব ছিলো না।

চৌদ্দগ্রাম থেকে মিয়ার বাজার পর্যন্ত সড়কে পাকিস্তানীরা যাতায়াতের চেষ্টা করে। ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনৌ ঐ রাস্তা দিয়ে চলাচল করতে পারেনি। প্রায় সমস্ত পুল ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছিলো।
বন্ধুরা দৌলতপুর থেকে ছাগলনাইয়া পর্যন্ত জুন মাসের প্রথম দিকে মেজর জিয়ার সেনাবাহিনী এবং ২নং সেক্টরের সেনাবাহিনী সম্মিলিতভাবে একটা মজবুত প্রতিরক্ষাব্যূহ তৈরী করেছিল।

———————————————–

 

<৯, ৩.৫, ১৪২-১৪৭>

কুমিল্লা-নোয়াখালির সশস্ত্র প্রতিরোধ

সাক্ষাতকারঃ সুবেদার মেজর লুৎফর রহমান

(বাংলা একাডেমির দলিলপত্র থেকে সংকলিত)

১৮-৯-১৯৭৩

৩০শে অথবা ৩১শে মার্চ ১৯৭১ সুবেদার সিরাজুল হককে নিয়ে আমি চৌমুহনি পৌছি। এখানে পরিষদ সদস্যদের সাথে দেশের ভয়াবহ পরিস্থিতির কথা বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করা হয়। নুরুল হক ও অন্যান্য সদস্যগন ঢাকাসহ প্রদেশের সমস্ত জায়গায় পাক পশুশক্তির বর্বরতার চিত্র তুলে ধরেন এবং বহু প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ শুনি। তারা সবাই আমাকে যে কোন প্রকারে যোদ্ধা সংগ্রহ করে শত্রুর উপর পাল্টা আঘাত হানার প্রস্তুতি নিতে বলেন। তারা সর্বপ্রকারে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতিও দেন এবং মাইজদীতে নিয়ে যান। সেখানে তৎকালীন এম-এন-এ এমপিএ’ দের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়।

২রা এপ্রিল অতঃপর আমি ফেনীতে গিয়ে মেজর জিয়াউর রহমান (বর্তমান ব্রিগেডিয়ার, ডেপুটি চিফ অব স্টাফ, বাংলাদেশ আর্মি) সাহেবের সঙ্গে বিভিন্ন পরামর্শ করি। মেজর জিয়াউর রহমান সাহেব আমাকে কালবিলম্ব না করে নোয়াখালিতে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে এবং বঘমারায় শত্রুকে বাঁধা দিতে নিষেধ করেন। তিনি সকল প্রকার অস্ত্র সরবরাহ করার প্রতিশ্রুতিও দেন। ফেনী থেকে ফিরে বেঙ্গল রেজিমেন্ট ইপি-আর এবং ৭৬ জন প্রক্রিত নিয়মিত সদস্য সংগ্রহ করি ও নোয়াখালীতে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার পরিকল্পনা করি।

৪ঠা এপ্রিল, ১৯৭১-সর্বপ্রথম বাগমারা পরিদর্শনঃ দয়াময়কে স্মরণ করে সর্বপ্রথমে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গতিবিধি লক্ষ করার জন্য লাকসামের উত্তরে বাঘমারা পরিদর্শন করি এবং সুবেদার নজরুল ও সুবেদার জব্বারকে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার স্থান নির্দিষ্ট করে দেই। এমন সময় নোয়াখালি জেলার ডেপুটি কমিশনার সাহেব এবং পরিষদ সদস্যগন এসে আমাকে জানালেন যে, দু’খান পাকসেনা বহনকারী জাহাজ রামগতির দক্ষিন পাশের নদীতে অবস্থান করছে। এ খবর শোনার পর আমি তৎক্ষণাৎ রুহুল আমিন (শহীদ), পিটি-অফিসার সাহেবসহ চারজন বুদ্ধিমান জোয়ানকে তার সত্যতা প্রমান করতে উক্ত নদীতে পাঠালাম। তারা নদী থেকে ফিরে এসে আমাকে ঘটনার নিশ্চয়তা দিয়ে জানান যে, সেখানে একখানা নৌকা ব্যাতিত কিছুই নেই। অতঃপর ৫ই এপ্রিল নোয়াখালীর অদূরবর্তী দৌলতগঞ্জের  সেতুটি ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নেই। কেননা পাকসৈন্যরা তখন লাকসামের উত্তরে বাঘমারাতে অবস্থান করছিল। কয়েকজন মোজাহিদ এবং আনসারকে হালকা অস্ত্র দিয়ে প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করি। বিকেলে অস্ত্র ও বিস্ফোরক দ্রব্য সংগ্রহের উদ্দেশে ফেনীতে যাই।

৬ই এপ্রিল, ১৯৭১: ফেনী থানা থেকে অতিকষ্টে ১৮টি হ্যাণ্ড গ্রেনেড সংগ্রহ করে কোম্পানিতে ফিরে আসি। এক’দিনে রাত-দিনের আরাম আয়েশ হারাম হয়ে পড়ে  আমার জন্য। শুধু যোদ্ধা,অস্ত্র আর এমুনিশন সংগ্রহের চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়ি। যে সমস্ত যোদ্ধা আমার সাথে ছিল তাদের হাইড-আউটের কথাও চিন্তা করি।

৭ই এপ্রিল, ১৯৭১: সারারাত যোদ্ধা,অস্ত্র আর এমুনিশন সংগ্রহের উদ্দেশে হাঁটাহাঁটি করে ভোর ছ’টায় ক্যাম্পে ফেরামাত্র খবর পেলাম ফেনীতে ইপিআর এবং অবাঙালিদের মধ্যে সংঘর্ষের। পুরা কোম্পানি নিয়ে ফেনী যাবার সিদ্ধান্ত নিলে সুবেদার সীরাজ ফেনী যাওয়া থেকে বিরত থাকতে বলেন। কেননা আমাদের হাতে কয়েকটি রাইফেল ছাড়া কিছুই ছিল না। তার কথামতো কোম্পানি রেখে আমি নিজে স্বচক্ষে পরিস্থিতি দেখার জন্য ফেনী রওনা হই। ফেনীর পরিস্থিতি দেখে চৌমুহনীতে ফিরে আসি এবং নোয়াখালীর পরিষদ সদস্য এবং আওয়ামীলীগ নেত্রীবর্গের সঙ্গে জরুরী পরামর্শে বসি।

৮ই এপ্রিল, ১৯৭১: নোয়াখালীর ডেপুটি কমিশনার জনাব মঞ্জুর সাহেব সারা দেশের পরিস্থিতি আলোচনার জন্য আমাকে ডেকে পাঠান। নোয়াখালীর প্রতিরক্ষার জন্য তাগাদা দেন। বিকেলে ক্যাপ্টেন এনামুল হক সাহেব কোম্পানি পরিদর্শন করে আমাকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেন।

৯ই এপ্রিল, ১৯৭১: শত্রুর তুলনায় সামান্য অস্ত্র এবং যোদ্ধা নিয়ে ফরোয়ার্ড লাইনের প্রায় সবটাই কভার করে দেই। এ-দিন নাথের পেটুয়া ষ্টেশনের কাছে আরও ফরোয়ার্ড ডিফেন্স স্থাপন করি।

১০ই এপ্রিল, ১৯৭১: লাকসামে প্রথম সামনাসামনি যুদ্ধঃ ১০ই এপ্রিল বর্বর পশুশক্তির বিরুদ্ধে শুরু হয় মুখোমুখি যুদ্ধ। নোয়াখালী পরিষদ সদস্যদের দেয়া চারশত টাকা ফরোয়ার্ড ডিফেন্স বাহিনীতে ভাগ করে দিতে যাই লাকসামে সকাল ১০টায়। বেলা ১২টার সময় খবর পেলাম পাকবাহিনী বাঘমারা থেকে অগ্রসর হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলার সংকল্প নেই। লাকসামের সামান্য উত্তরে পশুশক্তিকে বাঁধা দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে সেই অনুসারে পজসন নেওয়া হল। মাত্র ৭০ জন যোদ্ধা নিয়ে এই অভিযান চালাই। সঙ্গে দু’টো এল-এম-জি ছাড়া সবই ৩০৩ রাইফেল ছিল। তাই নিয়ে শত্রুর অপেক্ষায় বসে রইলাইম সন্ধ্যে ৬টা পর্যন্ত। কিছুক্ষন পর শত্রুপক্ষ যখন আমাদের রেঞ্জের ভিতর চলে আসে তখনই একসঙ্গে গোলাগুলি শুরু করি। আমার এ অতর্কিত আক্রমনে পাকবাহিনীর দু’জন লেফটেন্যান্ট সহ ২৬জন সৈন্য নিহত হয় এবং ৬০ জন আহত হয়। পর মুহূর্তে সাম্লে নিয়ে পাকবাহিনীর সৈন্যরাও মেশিঙ্গান, মর্টার ও আর্টিলারির গোলাগুলি শুরু করে বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ শুরু হল। প্রায় ৪ ঘন্টা গোলাগুলি বিনিময় হয়। শত্রুপক্ষের দুটো ট্রাকে আগুন ধরে যায়। ক্রমেই আমাদের গোলাবারুদ শেষ হতে থাকে। সরবরাহ ও সাহায্যের কোন আশা ছিল না। অপর পক্ষে পাকবাহিনী ময়নামতি থেকে সরবরাহ ও সৈন্য পেয়ে দ্বিগুণ শক্তি নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে আমাদের উপর। কাজেই অক্ষত সৈন্যদের নিয়ে পিছু হঠতে বাধ্য হই। ফলে পাকবাহিনী লাকসাম দখল করে নেয়।

রাতে নুরুল হক সাহেব,নাগাবাবু সহ অপর দুজন পরিষদ সদস্য ২টা এল-এম-জি আর ৪টা এস-এল-আর আমার হাতে অর্পন করেন। কিছু বিস্ফোরক দ্রব্য দিয়ে দৌলতগঞ্জ সেতু উড়িয়ে দেই এবং লাকসাম-নোয়াখালি সড়কের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিতে সক্ষম হই।

২০শে এপ্রিল, ১৯৭১-নাথের পেটুয়ার মুখোমুখি যুদ্ধঃ ১০ই এপ্রিল সারা রাত সেতু ধ্বংস করায় ব্যস্ত থাকায় ভোরে বিপুলাশ্বরে পৌছামাত্র মাইজদি থেকে টেলিফোনযোগে খবর পেলাম যে, লাকসামে অবস্থানরত পাকসৈন্যরা নোয়াখালীর দিকে অগ্রসর হচ্ছে। আমি তৎক্ষণাৎ কোম্পানিকে ফল-ইন করিয়ে সুবেদার সিরাজ সাহেবকে প্লাটুনের কমান্ডার নিযুক্ত করি এবং সুবেদার জব্বার সাহেবকে দ্বিতীয় প্লাটুনের কমান্ডার নিযুক্ত করে দিই। আমি নিজে তৃতীয় প্লাটুনটি গেডকোয়ার্টারসহ নিয়ে নাথের-পেটুয়া অভিমুখে দ্রুতগতিতে ছুটে গিয়ে ষ্টেশনের পূর্ব দিকের দায়িত্ব সুবেদার সিরাজ সাহেব ও জব্বার সাহেবের উপর অর্পন করি এবং আমি পশ্চিম দিক রক্ষার দায়িত্ব নেই। তাদেরকে একথাও জানাই যে, আমাদের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের যখন কোন ব্যবস্থা নেই, সেহেতু শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত যেন কেউই পশ্চাদসরণ না করেন।

আমি নিজের প্লাটুনকে প্রত্যেক সেকশনের পজিশন স্বহস্তে দেখিয়ে দেই। খনন কার্য শেষ না হতেই হঠাত নায়েক সিরাজ সতর্ক সঙ্কেত দ্বারা আমাকে দেখালেন যে শত্রুপক্ষ ক্রলিং করে আমাদের পজিশনের নিকটে চলে এসেছে আমি চেয়ে দেখি সত্য সত্যই শত্রুরা ধানক্ষেতের ভিতর দিয়ে প্রায় এক কোম্পানি ক্রলিং করে এমনভাবে আমাদের দিকে অগ্রসর হচ্ছে যা ধারনা করা যায় না। আমি তৎক্ষণাৎ এস-এল-আর এর মাধ্যমে গুলি শুরু করি। নায়েক সিরাজও এল-এম-জির মাধ্যমে শত্রুর উপর আঘাত করে। বলতে গেলে আমার সমস্ত প্লাটুনের সদস্যরা একসাথে আগত শত্রুর প্রত্যেককে আহত বা নিহত করতে সক্ষম ছিল। এরপর তাদের ফলোআপ কোম্পানি দ্বিগুণ বেগে তাদের সাপোর্টিং বা সাহায্যকারী অস্ত্রের দ্বারা দ্রুতবেগে অগ্রসর হবার চেষ্টা করে বিফল মনোরথ হয়ে আহত ও নিহত সৈন্যদেরকে সরিয়ে নিয়ে পিছনে চলে যায় এবং তারপর আমাদের উপর আর্টিলারি এবং মর্টারের গোলাবর্ষণ করতে থাকে। পূর্ব দিকে যখন আমার দ্বিতীয় প্লাটুনের এল-এম-জির ফায়ার শত্রুপক্ষের উপর পড়ছিল তখন শত্রুরা তাদের উপরও দ্বিতীয় প্লাটুনের উপর অনবরত শেলিং করতে থাকে। পরিনামে আমার একজন সৈন্য তৎক্ষণাৎ শহীদ হন এবং একজন গুরুতরভাবে আহত হন। আমি বাধ্য হয়ে প্লাটুনকে ২০০গজ পশ্চাতে একটা ডোবার পাশে দৌড়ে পজিশন নিতে আদেশ দেই। শত্রুর দুই প্লাটুনের মতো সৈন্য আমার প্রথম পজশনটি দখল করে ফেলে। এ সময় আমি আমার প্লাটুনকে আদেশের মাধ্যমে দ্বিতীয় ডিফেন্সিভ পজিশনে নিয়ে যাই। এবং পুনরায় শত্রুর গতিবিধি লক্ষ করেই গুলি আরম্ভ করি। এমন সময় হঠাৎ তিনখানা যুদ্ধ বিমান সোজা আমাদের উপর ডাইভ করে পর পর তিনবার আক্রমণ চালায়। তারা প্রচুর পরিমানে গুলি ছুড়ে এবং নাপাম বোমা ফেলতে থাকে। আমাদের সৌভাগ্য যে, সমস্ত গুলি এবং বোমাগুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় এবং অনবরত যুদ্ধ চলতে থাকে। শত্রুদের আর এক ইঞ্চি অগ্রসর হওয়ার ক্ষমতা ছিল না। তখন আমি পূর্বদিকে অবস্থানরত দুই প্লাটুনের কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে আমার একজন জোয়ানকে তাদের খবর আনতে পাঠাই। এ সময় পূর্ব দিকের গ্রামগুলি আগুনে কেবল জ্বলতে দেখি। সংবাদদাতা ফিরে এসে জানালো যে, পূর্বদিকের দুই প্লাটুন তাদের স্ব স্ব অবস্থান থেকে সৈন্য তুলে নিয়ে অন্য কোথাও চলে গেছে। এ কথা শোনার পর আমি বাধ্য হয়ে অলরাউণ্ড ডিফেন্স করি। এভাবে সন্ধ্যে পর্যন্ত গোলাগুলি বিনিময় হয়। সন্ধের পর পাকবাহিনী রেকি পেট্রোলিং শুরু করে। তারা আমাদের উপর ফাইটিং পেট্রোল পাঠায়। আমার সঙ্গে দু’ঘন্ট পর্যন্ত যুদ্ধ হয়। তারা যাবতীয় অস্ত্র দ্বারা গুলি করতে থাকে এবং কিছুক্ষন পর তারা চলে যায়।

সারাদিন ধরে যুদ্ধ করার পর অনাহার আর অবিশ্রামে আমরা অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়ি। মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছিল না আমাদের। এমতাবস্থায় পুনরায় যুদ্ধ করার মানসিকতা হারিয়ে ফেলি এবং রাত সাড়ে দশটার সময় আমি আমার যোদ্ধাদের নিয়ে সোনাইমুড়ি অভিমুখে রওনা দেই। এ সময় রাস্তায় কোন জন্সনের সাড়াশব্দ ছিল না। প্রত্যেক বাড়ির লোক ধন-সম্পদের আশা ছেড়ে দিয়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়ে চলে গেছে। সোনাইমুড়িতে পৌছে ড. মফিজ সাহেবের সাক্ষাত পাই। আমাদের বিশেষ করে আমাকে দেখে তিনি জড়িয়ে ধরেন। (ড. মফিজ খবর পেয়েছিলেন যে, আমরা পাকিস্তান বাহিনীর সাথে যুদ্ধে মারা গেছি) তারপর তিনি আমাকে ও আমার সৈন্যদের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করেন।

২১শে এপ্রিল ভোরে পুনরায় সৈন্যদের অগ্রসর হবার খবর পেলাম। পূর্বদিন যুদ্ধে আমরা অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়ি। তাছাড়া এমুনিশনও তেমন ছিল না। তব শত্রুবাহিনীর অগ্রগতি রোধ করার সিদ্ধান্ত নেই। এবং সে অনুযায়ি সোনাইমুড়ি রেলস্টেশনের আউটার সিগনালের কাছাকাছি এমবুশ পার্টি বসাই। কিছুক্ষন পর শত্রুবাহিনীর জোয়ানরা অগ্রসর হতে থাকে। প্রথমে আমরা গুলি চালাই। শত্রুপক্ষ ৩’’ মর্টার ও মেশিনগান থেকে গুলি চালায়। বেশ কিছুক্ষন যুদ্ধ চলে। বেলুচ রেজিমেন্টের কয়েকজন সদস্য হতাহত হয়। ইতিমধ্যে আমাদের এমুনিশন শেষ হয়ে গেলে আমি আমার বাহিনীকে উইথড্র করে চলে আসি। পাকবাহিনী সোনাইমুড়ি দখল করে চৌমুহনীর দিকে অগ্রসর হয়।

আমি আবিরপাড়ায় একটি গোপন বৈঠক দিই। এখানে কর্মীদের বিপুল উৎসাহ দেখা যায়। নায়েক সুবেদার ওয়ালিউল্লাহ ও ইশাক মাতৃভূমি রক্ষার্থে আমার সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যাবার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন।

২৪শে এপ্রিলঃ আওয়ামীলীগের বিশিষ্ট কর্মী জনাব আমিন উল্লাহ মিয়ার সাথে আমার সাক্ষাত হয়। তিনি বর্বর পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাবার জন্য আমাকে সাহস দেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের থাকা ও খাওয়ার নিশ্চয়তা দেন। তিনি প্রথমবারের মতো ভারত থেকে অস্ত্রসস্ত্র আনার জন্য এবং রাস্তা ঠিক করার জন্য ভারতে চলে যান। এইদিনে সুবেদার ওয়ালিউল্লাহ চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট থেকে এসে আমার কোম্পানিতে যোগদান করেন।

২৬শে এপ্রিলঃ হাবিলদার নূর মোহাম্মদকে সঙ্গে নিয়ে বিপুলাশ্বর ষ্টেশনের এক আড়ালে এমবুশ করি। সকালে পাকবাহিনীর সিগনাল ম্যান সহ দু’খানা গাড়ি যবার সময় এম-এমজি দ্বারা ব্রাশ করলে তাদের একখানা গাড়ি নষ্ট হয়ে যায় এবং দু’জন আহত হয়। পাকবাহিনী আহত ব্যক্তিদ্বয়কে নিয়ে অন্য গাড়িসহ পালিয়ে যায়। এখানে হাবিলদার নূর মোহাম্মদ অত্যান্ত সাহসিকতার পরিচয় দেন। এখানে দুটো রাইফেল উদ্ধার করি।

২৮শে এপ্রিলঃ সিপাই শাহজাহানকে নিয়ে সোনাইমুড়িতে রেকি করি। ২৯শে এপ্রল নায়েক সফি তার সেকশন নিয়ে সোনাইমুই আউটার সিগনাল পুনরায় এমবুশ করে। কিছুক্ষন পর পাকবাহিনীর তিনখানা গাড়ি অগ্রসর হতে থাকলে সফি ফায়ার শুরু করে। ফায়ারের সম্মুখের গাড়িখানা অকেজো হয়ে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে শত্রুপক্ষ পজিশন নিয়ে ফায়ার শুরু করে। দু’তিন ঘন্টা যাবত গোলাগুলি বিনিময় হয়। এখানে পাকবাহিনীর গুলিতে একটি ছেলে ও এক বৃদ্ধ মারা যায়।

১লা মে-বগাদীয়ার যুদ্ধঃ নায়েক সিরাজ এক প্লাটুন যোদ্ধা নিয়ে বগাদীয়া সেতুর কাছে এমবুশ করে। এ জায়গায় একখানা জিপসহ তিনখানা ৩-টনি লরি কিছু দুরত্ব বজায় রেখে অগ্রসর হবার সময় নায়েক সিরাজ পাকবাহিনীর উপর চরম আক্রমণ চালায় এবং প্রথম ও শেষ গাড়িখানার উপর অনবরত গুলি চালালে ৩-টনি একখানা গাড়ি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়। এখানে ১৫/২০জন খানসেনা সঙ্গে সঙ্গে নিহত হয়,কয়েকজন আহত হয়। পরক্ষনে পাকসেনারা ৩’’ মর্টার ও মেশিনগান হতে অবিরাম গোলাগুলি বর্ষণ করতে থাকে। দীর্ঘ সময় যুদ্ধের পর নায়েক সিরাজ প্লাটুন উইথড্র করে। পাকসেনারা এখানে কয়েকটি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং একজন নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করে। এ যুদ্ধে হাবিলদার নুরুল আমি ও অপর একজন মুক্তিযোদ্ধা গুরুতরভাবে আহত হয়। নায়েক সিরাজ অসীম সাহস ও বিরত্বের সাথে এ যুদ্ধ পরিচালনা করেন।

৬ই মে-ফেনাকাটা পুলে সংঘর্ষঃ চৌমুহনি-চন্দ্রগঞ্জ রাস্তায় পাকবাহিনীর চলাচল শুরু হয়। কিন্তু এমবুশ করার সুযোগ পাইনা। অবশেষে নায়েক সফির সেকশন নিয়ে এমবুশ পার্টি বসাই। বহুক্ষন অপেক্ষা করার পর তিনখানা পাকসৈন্য বোঝাই ট্রাক চন্দ্রগঞ্জ থেকে অগ্রসর হতে থাকে আমরা অতর্কিত হামলা চালাই। আমাদের এ অতর্কিত আক্রমনে পাকসেনারা কিংকর্তব্যবিমুড় হয়ে পড়ে। তাদের প্রস্তুতি নেয়ার পূর্বেই বেশ কয়েকজন খানসেনা ধরাশায়ী হয়। মুহূর্তের  মধ্যে তারা ভারী মেশিনগান দ্বারা আমাদেরকে পাল্টা আক্রমণ করে। পাকসেনাদেরমেশিনগানের গুলিতে আমাদের একই নামের দুজন বীর মুক্তিসেনা (ইসমাইল) শহীদ হন। তাদের একজনের বাড়ি আমিশাপাড়া বাজারের পশ্চিমে সাতঘরিয়া,অপরজনের বাড়ি নোয়াখালী জেলার রামগঞ্জে। এরপর আমি আমার সৈন্য তুলে নিয়ে শহীদদ্বয়ের দাফনের ব্যবস্থা করি। আওয়ামীলীগের বিশিষ্ট কর্মী চৌমুহনীর হোটেল জায়েদীর মালিক পদিপাড়ার নূর মোহাম্মদ সাহেবের তত্তাবধানে পদিপাড়াতে সমাধিস্হ করা হয়।

৮ই মে আমি মেজর খালেদ মোশারফ সাহেবের আদেশক্রমে অস্ত্র আনয়ন করি।

৯ই মে-পুনরায় বগাদীয়াতে যুদ্ধঃ ফেনাকাটা যুদ্ধ ও অপারেশনের পর জনসধারণ ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে নতুন সাহসের সঞ্চার হয়। নায়েক সুবেদার ওয়ালিউল্লাহকে বগাদীয়াতে এমবুশ করার নির্দেশ দিয়ে নায়েক সুবেদার জাবেদকে সঙ্গে নিয়ে আমি শত্রুবাহিনীতে কর্মতৎপরতা ও অবস্থান লক্ষ করার উদ্দেশ্যে চৌমুহনি রওনা দেই। চৌমুহনীতে পাকবাহিনীর গতিবিধি লক্ষি করে বগাদীয়ায় ফেরার পূর্বেই নায়েক সুবেদার ওয়ালিউল্লাহ পাকবাহিনীর একখানা পিকআপ ভ্যানের একজন জেসিও সহ ছয়জনের উপর আক্রমণ করে। সঙ্গে সঙ্গে শত্রুদের দুজন সৈন্য (জেসিও) নিহত হয়। গাড়িখানা রাস্তায় পড়ে যায়। ইতিমধ্যে আমরাও পৌছে গেলাম। ঠিক সেই সেই মুহূর্তে পাকবাহিনীর আরও দুখানা গাড়ি এসে পড়ল। আরম্ভ হয় উভয় পক্ষের মধ্যে আক্রমণ আর পাল্টা আক্রমণ। প্রায় ৪/৫ ঘন্টা গোলাগুলি বিনিময় হয়। অবশেষে শত্রুরা হতাহতদের নিয়ে চৌমুহনীর দিকে চলে যায়। এখানে শত্রুপক্ষদের যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করতে হয়। এ যুদ্ধে নায়েক সুবেদার ওয়ালিউল্লাহর কপালে গুলি লাগে এবং তিনি সামান্য আহত হন। তিনি এ যুদ্ধে অসামান্য সাহস ও বিরত্বের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। পাকবাহিনীর উক অকেজো গাড়িখানা স্বাধীনতার পরও দীর্ঘ কয়েকমাস রাস্তার পাশে উল্টে পড়ে থাকে।

তৎকালীন পাকিস্তান বাজারের পূর্ব দিকে যুদ্ধঃ পাকসেনাদের চৌমুহনী-লক্ষ্মীপুর বাজারে আনাগোনা বেড়ে যাওয়ায় সেই রাস্তায় এমবুশ করার পরিকল্পনা করি। অবশেষে ১০ই মে এমবুশ করে বসে থাকি। কিছুক্ষন পর দেখা গেল একখানা সিভিল বাসে কিছু ছদ্মবেশে ও কিছু সামরিক পোশাকে খানসেনারা লক্ষীপুরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এই বাসে ২/৩ শত গজ পেছনে সামরিক গাড়িতে আরও বহু পাকসেনা অগ্রসর হচ্ছিলো। প্রথম গাড়িকেই আমরা আঘাত করি। ফলে কয়েকজন সৈন্য প্রান হারায়। মুহূর্তে অন্য পাকসেনারা প্রস্তুত হয়ে মর্টার ও আর্টিলারির সাহায্যে পাল্টা আক্রমণ চালালে আমরা সেখান থেকে পালাতে সক্ষম হই।

১১ই মে, ১৯৭১-মীরগঞ্জে পাকবাহিনীর পরাজয়ঃ এখানে রেকী করে সুবেদার ওয়ালিউল্লাহকে এমবুশ করার নির্দেশ দেই এবং নায়েক আবুল হোসেনকে রাস্তায় মাইন পুততে নির্দেশ দেই। আবুল হোসেন মাইন বসিয়ে আত্বগোপন করে থাকে। লক্ষীপুরের প্লাটুন কমান্ডার আব্দুল মতিনও তার সেকশন নিয়ে এই অভিযানে অংশগ্রহন করে। কিছুক্ষণ পর শত্রুবাহিনী মুক্তিবাহিনীর অতর্কিত আক্রমণের ভয়ে একখানা গরুর গাড়ি সামনে রেখে অগ্রসর হতে থাকে। গরুর গাড়িখানা পুতে রাখা মাইনের উপর দিয়ে অতক্রম করার সঙ্গে সঙ্গে প্রণ্ড আওয়াজে সেটি কয়েক হাত উপরে উঠে যায়। প্রচণ্ড আওয়াজে খানসেনারা এতোটাই আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে পড়ে যে তারা কয়েকজন অস্ত্র ফেলে প্রাণপণে পালানোর চেষ্টা করে। অম্নি শুরু হয় আমাদের গোলাগুলি। কয়েকজন হতাহতও হয়। জানা যায়,শত্রুরা পালিয়ে যাবার সময় জনসাধারনের হাতে দুজন খানসেনা মাছমারা রাক্সা দ্বারা আহত হয়। শত্রুপক্ষের ফেলে যাওয়া বেশ কয়েকটি অস্ত্রশস্ত্র আমাদের হস্তগত হয়। এখানেও সুবেদার ওয়ালিউল্লাহ অসীম বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেন।

১২ই মে চৌমুহনীর দেড় মাইল উত্তরে মান্দারহাটে শত্রুদের উপর চরম আঘাত হানার জন্য এক প্লাটুন মুক্তিসেনা নিয়ে এমবুশ করার জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। তখন চৌমুহনীতে পাকবাহিনীর বিরাট ঘাঁটি অবস্থান করছিল। এসময় পাকবাহিনী গুপ্তচর দ্বারা খবর নিয়ে অতর্কিত এক ব্যাটেলিয়ন সদস্য নিয়ে আমাদেরকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করলে আমরা সেখান থেকে কোন প্রকারে পালিয়ে যেতে সক্ষম হই। কিন্তু পাকবাহিনী আমাদের ধরতে না পেরে মান্দারহাট বাজারটি পুড়িয়ে দেয়।

১৩ই মেঃ একদিন বিকাল দুটায় খবর পেলাম নোয়াখালীর এসডিও দুই গাড়ি পাকসৈন্যসহ লক্ষ্মীপুর পরিদর্শনে গেছেন । তাদের প্রত্যাগমনে বাঁধা দেয়ার জন্য হাবিলদার নূর মোহাম্মদ এক প্লাটুন সৈন্য নিয়ে চন্দ্রগঞ্জের নিকট কোন এক যায়গায় এমবুশ করেন। এ এমবুশে এসডিও সহ কয়েকজন সৈন্য আহত হয়।

১৪ই মেঃ নায়েক আবুল হোসেন বিপুলাশ্বর ষ্টেশনের কাছে কয়েকটি মাইন পুতে রাখে। কিন্তু পাকসেনাদের গাড়ি অতিক্রম করার পূর্বেই একখানা ইটবোঝাই ট্রাক সে স্থান অতিক্রম করার সময় ট্রাকটি পড়ে যায়। অন্যদিকে একই দিনে হাবিলদার নূর মোহাম্মদ তার প্লাটুন নিয়ে চন্দ্রগঞ্জে এমবুশ করে ৫/৬ জনকে খতম করতে সক্ষম হন। অসমর্থিত খবরে জানা যায়,একজন কর্নেলও নাকি নিহত হয়। পড়ে তারা দোয়াইরা গ্রামটি জ্বালিয়ে দেয়।

১৫ই মে নায়েক সুবেদার এক প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে ৭ মাইল পায়ে হেঁটে খিলপাড়ার পশ্চিমে মইলকার দীঘির পাড়ে পাকহানাদার বাহিনীর ছোট একটি ছাউনি আক্রমণ করে সেখান থেকে তাদেরকে বিতাড়িত করতে সক্ষম হন। নায়েক সুবেদার ইসহাক এখানে অত্যন্ত সাহসের পরিচয় দেয়।

১৮ই মে, ১৯৭১-সাহেবজাদার পুল ধ্বংসঃ ওয়ালীউল্লাহ মাইন দারা সাহেবজাদার পুলটি ধ্বংস করে লাকসাম-নোয়াখালীর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়।

১৯ শে মে- বগাদিয়াউ পুনরায় সংঘর্ষঃ নায়েক আবুল হোহেনকে মাইন বসানোর নির্দেশ দিয়ে গোপনে এমবুশ করে বসে থাকি। সকাল ৯টার সময় ৩জন পাকসেনা বেবি ট্যাক্সি করে লাকসাম যাবার সময় বগাদীয়ায় পৌছলে পোঁতা মাইন বিস্ফোরণে বেবি ট্যাক্সিটি কয়েক গজ দূরে উড়ে যায় এবং ৩জন খানসেনাই নিহত হয়। এ খবরপাকবাহিনীর কানে পৌছামাত্র এক কোম্পানি সৈন্য নিয়ে ঘটনাস্থনে উপস্থিত হলে আমরা গা-ঢাকা দিই।

২৬শে মে সুবেদার ওয়ালিউল্লাহ দালাল বাজার রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করে ৩০ জন রাজাকারকে হত্যা করেএবং ৬টি রাইফেল উদ্ধার করে।

২৮মে পুনরায় সেক্টর কমান্ডারের আদেশক্রমে ভারতে কনফারেন্সে যোগ দিয়ে কিছু এমুনিশন নিয়ে আসি।

২৯শে মে মীরের হাট থেকে ১৫ জনের একটি রাজাকার দল আসতে থাকলে হাবিলদার আবুল মতিন তাদেরকে আক্রমণ করে। শেষ পর্যন্ত ১৫ জন রাজাকারই হাবিলদার আবুল মতিনের হাতে ধরা পড়ে এবং নিহত হয়।

—————————————————

<৯, ৩.৬, ১৪৮-১৪৯>

সশস্ত্র প্রতিরোধে কুমিল্লা

সাক্ষাৎকারঃ সুবেদার সৈয়দ গোলাম আম্বিয়া

(বাংলা একাডেমির দলিলপত্র থেকে সংকলিত)

২০-০৭-১৯৭৬

২৬শে মার্চ সকাল বেলা আখাউড়া কোম্পানী হেডকোয়ার্টার থেকে একজন নায়েক অপারেটর সিঙ্গারবিলে আসে এবং বলে যে, ঢাকার অবস্থা খুব খারাপ। কুমিল্লাতেও লোকজনকে মেরে ফেলা হয়েছে। এ খবর পাবার পর আমি আমার লোকজনকে গোপনে ডাকি। কমাণ্ড আমি আমার হাতে নেই, আর কেউ সিনিয়র না থাকাতে। সিদ্ধান্ত হলো ৬টা বিওপিতে সমস্ত পশ্চিম পাকিস্তানী ইপিআর’কে আজ রাতের মধ্যে শেষ করতে হবে। পরদিন সকালে খবর পাঠানো হলো, সকল বিওপি ছেড়ে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আখাউড়া সিনেমা হলের সামনে সমবেত হওয়ার জন্য। ২৮শে মার্চ সবাই আখাউড়াতে গিয়ে একত্রিত হয়।

২৯শে মার্চ সমস্ত বাঙালি ইপিআর আখাউড়ার জনসাধারণের সাহায্য ও সমর্থনপুষ্ট হয়ে আখাউড়া কোম্পানী হেডকোয়ার্টারে আক্রমণ চালায়। কিছুক্ষণ যুদ্ধ চলার পর ডব্লিউপিআর’রা রাতের অন্ধকারে দুটি লাশ ফেলে পালিয়ে যায়। আখাউড়া থেকে চার মাইল দক্ষিণে জনসাধারণ তাদেরকে ঘিরে ফেলে। দুইজন লোককে পশ্চিম পাকিস্তানীরা রাইফেল দিয়ে গুলি করে হত্যা করেছিলো। তারপর আমার এক প্লাটুন ইপিআর সেখানে যাওয়াতে তারা স্থানীয় মসজিদে ঢুকে পড়ে। শত্রুর এক সুবেদার ও এক নায়েক সুবেদার সহ ১৪ জনকে সেখানে হত্যা করা হয়।

কোম্পানী হেডকোয়ার্টার থেকে সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ, অয়ারলেস সেট ও রেশন সরিয়ে আমরা সিনেমা হলের সামনের স্কুলে নিয়ে আসি। দুইজন হাবিলদারকে নায়েক সুবেদার দিয়ে ৩টা প্লাটুন খাড়া করি এবং আখাউড়া রেলওয়ে স্টেশনসহ ঐ এলাকায় ডিফেন্স তৈরি করি।

২রা এপ্রিল মেজর খালেদ মোশাররফ ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে টেলিফোনে আমার সাথে কথা বলেন। তিনি আমাকে একটা প্লাটুন দিয়ে উজানিসার ও আরেকটা প্লাটুন দিয়ে গঙ্গাসাগর রেলওয়ে স্টেশনে ডিফেন্স করার নির্দেশ দেন। ৪ঠা এপ্রিল দুটি প্লাটুন উল্লেখিত জায়গায় মোতায়েন করা হয়। ৫ই এপ্রিল আমি নিজেও উজানিসার চলে যাই।

১২ই এপ্রিল উজানিসার ও গঙ্গাসাগর ব্রীজ আংশিক নষ্ট করে দেয়া হয়-পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার জন্য যাতে তাঁরা কুমিল্লা থেকে সরাসরি ব্রাক্ষণবাড়িয়ায় আসতে না পারে।

১৪ই এপ্রিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটা ব্রিগেড কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে অগ্রসর হয়। উজানিসার ব্রীজের হাজার গজ দূর থেকে একটা কোম্পানী থেকে নেমে রাস্তার দু’পাশে নালা দিয়ে অগ্রসর হতে থাকে। ব্রীজের নিচে আমাদের বাংকার ছিল। শত্রুরা কাছাকাছি আসার পর তাদের উপর ফায়ার ওপেন করা হয়। আমাদের এই আচমকা আক্রমণে তাদের অনেকেই হতাহত হয়। নৌকাতে তারা সমস্ত লাশ বোঝাই করে নিয়ে গিয়েছিলো। ঐ নৌকার মাঝি পরে আমাদেরকে বলেছিলো যে, একজন অফিসারসহ ১৭৩ জন সৈন্য ওদের নিহত হয়েছিলো।

তারপর পাকিস্তানী সৈন্যরা পিছনে গিয়ে আর্টিলারী ও মর্টারের সাহায্যে আমাদের উপর গোলাবর্ষণ করতে থাকে। আমাদের কাছে কোনো আর্টিলারী বা মর্টার ছিলো না। ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিনের কাছে খবর পাঠানো হয়েছিলো আমাদের সাহায্য করার জন্য। আমাদের লোক ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে গিয়ে ৪র্থ বেঙ্গলের কাউকে পায়নি। জনসাধারণ বলেছে তারা নাকি আখাউড়ার দিকে চলে গেছে। পাকিস্তানীদের প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে আমরা (আমাদের দুই প্লাটুন সৈন্য) উইথড্র করে আখাউড়া রেলওয়ে স্টেশনে চলে আসি। এদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেও আমাদের কোনো ডিফেন্স নাই। তাই বাধ্য হয়ে আমরা উইথড্র করি।

উজানিসারে প্রচণ্ড মার খেয়ে পাকিস্তানী সৈন্যদের এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য গঙ্গাসাগর হয়ে আখাউড়া আসার চেষ্টা করে। আমাদের এক প্লাটুন ইপিআর হাবিলদার আসদ্দর আলীর নেতৃত্বে গঙ্গাসাগর ব্রীজে ডিফেন্স বানিয়েছিলো। পাকিস্তানী সৈন্যরা সেখানে পৌঁছুলে এক প্লাটুন ইপিআর তাদের উপর ফায়ার ওপেন করে। এই অতর্কিত আক্রমণে (১৫ই:এপ্রিল) পাকিস্তানীদের তিনজন অফিসার সহ আনুমানিক ৭০/৭৫ জন সৈন্য নিহত হয়েছিলো। তিনজন অফিসার ও সৈন্যদের কবর সেখানে পাওয়া গিয়েছিলো। প্লাটুন’টির ডিফেন্স দুদিন থাকে সেখানে। পাকিস্তানী সৈন্যরাও তাদের ডিফেন্স মজবুত করে। পাকিস্তানী ব্রিগেড কমান্ডার ঐ ব্যাটালিয়নকে উইথড্র করে নতুন আরেকটা ব্যাটালিয়নকে গঙ্গাসাগর পাঠায় এবং দুই দিনের মধ্যে গঙ্গাসাগরে মুক্তিফৌজের ডিফেন্স ধ্বংস করে আখাউড়া পৌঁছার নির্দেশ দেয়। পাকিস্তানী সৈন্যরা পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে আমাদের ডিফেন্সে চলে আসে। আর্টিলারী ও ৩” মর্টার দিয়ে তারা ওভারহেড ফায়ার অব্যাহত রেখেছিলো। ইপিআর সূফি মিয়া তখনো গুলি ছুঁড়ে চলছিলো। পাকিস্তানী সৈন্যরা বাংকারে ঢুকে তাকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। ল্যান্স নায়েক মোবাশ্বের আলীকেও বাংকারে ঢুকে বেয়নেট দিয়ে হত্যা করা হয়। সাত জনকে গুরুতররূপে আহত অবস্থায় আগরতলা হাসপাতালে পাঠানো হয়। ১৮ই প্লাটুনের অন্যান্য সৈন্য উইথড্র করে আখাউড়া চলে আসে।

১৯শে এপ্রিল পুরো ইপিআর কোম্পানীকে ক্লোজ করে আখাউড়ায় একত্রিত করা হয়। এখানে ৪র্থ বেঙ্গলের ১টা কোম্পানীও এসেছিলো ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিনের নেতৃত্বে।

২১শে এপ্রিল ঘয়েরকোট ও ইটনা গ্রামে আমরা মিলিতভাবে ডিফেন্স করি।

২২শে এপ্রিল গঙ্গাসাগরে এক এ্যামবুশে আমরা ৬ জন পাকিস্তানী সৈন্যকে হত্যা করি ও বাইশ হাজার চায়না এ্যামুনিশন উদ্ধার করি ৫টা রাইফেল ও একটা স্টেনগানসহ।

২৮শে এপ্রিল আমাদের দুটি প্লাটুনকে ক্যাপ্টেন আইনউদ্দীন আজমপুরে আসার নির্দেশ দেন।

১১ই মে আজমপুরে আমরা এক এ্যামবুশ তৈরি করি। পাকিস্তানী সৈন্যদের একটি কোম্পানী সিলেটের মুকুন্দপুর থেকে আজমপুরের দিকে আসছিলো। আমাদের দুটি প্লাটুন নরসিঙ্গর নামক জায়গায় ওদেরকে এ্যামবুশ করি। এই এ্যামবুশে ওদের ৬৩ জন নিহত হয়।

১৩ই মে সিঙ্গারবিল এলাকায় এক এ্যামবুশে ৩ জন পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয়।

১৮ই মে এই এলাকায় এক রেইডে ৬ জন পাকিস্তানী নিহত হয়। একজন আহত সৈন্যকে ধরে নিয়ে আসা হয়েছিলো।

২৭শে মে রাজাপুর এলাকায় এই রেইডে ৪ জন পাকসেনা নিহত হয়।

২৯শে মে সিঙ্গারবিল এলাকায় এক এ্যামবুশে ৬ জন পাকসেনা নিহত হয়। ৩১শে মে সিঙ্গারবিলে আরেক এ্যামবুশে ১৩ জন পাকসেনা নিহত হয়। ৪ঠা জুন দুটি এ্যামবুশে ৯ জন পাকসেনা নিহত হয় সিঙ্গারবিল এলাকায়।

————————————————–


<৯, ৩
.৭, ১৪৯-১৫৯>

 

কুমিল্লা ও নোয়াখালী জেলায় সশস্ত্র প্রতিরোধের আরও বিবরণ

(সত্যেন সেন রচিত ‘প্রতিরোধ সংগ্রামে বাংলাদেশ’, কলিকাতা, আগস্ট ১৯৭১ থেকে সংকলিত)

।।বড় কামতার যুদ্ধ।।

বর্ডার পেরিয়ে আগরতলা এসে পৌছেছি। তারপর কটা দিন কেটে গেছে। মুক্তিবাহিনীর ভাইদের স্বচক্ষে দেখবার জন্য আর তাদের মুখে মুক্তিযুদ্ধের কথা শোনবার জন্য আকুলি-বিকুলি করে মরছিলাম। কিন্তু আমাদের মত লোকদের এত তাড়াতাড়ি তাদের সন্ধান পাওয়া সহজ নয়। অতিরিক্ত আগ্রহ দেখালে হয়তোবা সন্দেহভাজন হয়ে পড়ব! শুনলাম শহর থেকে মাইল পাচেক দূরে প,বি, হাসপাতালে মুক্তিবাহিনীর দশ-বারো জন আহত যোদ্ধা রয়েছে। সেখানে গিয়ে তাদের সঙ্গে দেখা করলে আমাদের মনের আশা মিটতে পারে।

কিন্তু কাজটা কি এতই সহজ! আমরা যে পাকিস্তানের গোয়েন্দা বিভাগের লোক নই তারই বা প্রমান কি? এখানকার অবস্থায় এই সন্দেহ তো জাগতেই পারে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে নেমে দেখলাম, আমাদের খুব বেশী বেগ পেতে হোল না। আমরা যে পরিচয়সুত্রটুকু নিয়ে গিয়েছিলাম, তাতেই কাজটা সহজ হয়ে গেল। বেলা এগারোটা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আমরা তাদের মুখে নানান কাহিনী শুনলাম।আমার মনে হল তারা যেন প্রথমত কিছুটা আড়ষ্ট বোধ করছিল,পরে কথা বলাবলির মধ্যে দিয়ে আমাদের সম্পর্কটা সহজ হয়ে গেল।

সবসুদ্ধ চার জায়গায় চারজন মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে আমরা আলাপ করেছি।তিনজনের সাথে কথা শেষ করে চতুর্থ জনের সঙ্গে কথা শুরু করতেই চমকে উঠলাম। আমি প্রশ্ন করেছিলাম আপনি কোন জায়গায় লড়াই করে জখম হয়েছেন। তিনি উত্তর দিলেন- সে জায়গার নাম বড়কামতা এই কথা শোনার পর আমার চমকে উঠার কথাই তো। এই তো কদিন আগে বড়কামতায় এক রাত্রি যাপন করে এসেছি। সে কথা কি এখনই ভুলে যেতে পারি!

বড়কামতা?

হ্যাঁ, বড়কামতা। আমার মানসচক্ষে সেই স্বল্পভাষী যুবকটির মুখ ভেসে উঠছিল। আর স্মৃতিপটে ভেসে আসছিল স্খলিত কণ্ঠে বৃদ্ধের সেই ব্যাকুল প্রার্থনা, দুর্গা, দুর্গা। তাহলে আমার সেই এক রাত্রির স্নেহঘন আশ্রয় বড়কামতা গ্রামটিও যুদ্ধের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে?

ওরা কোন তারিখে হামলা করেছিল আর সেই সময় আপনারাইবা সেখান থেকে কতদুরে ছিলেন?

ওরা হামলা করেছিল ৩০-এ, অর্থাৎ ৩০-এ এপ্রিল তারিখে।

আমরা ২৫-এ তারিখে সেখানে প্রথম যাই।তারপর থেকে সেখানেই ছিলাম। কি আশ্চর্য কাণ্ড, আর কি অদ্ভুত যোগাযোগ!

আমি খুব তাড়াতাড়ি মনে মনে হিসাব করে দেখলাম আমরা চার বন্ধু সেই ২৫-এ এপ্রিল তারিখেই বড়কামতায় আশ্রয় নিয়েছিলাম। এঁরাও আমাদের কাছাকাছি ছিলেন। কিন্তু আমরা বাইরের লোক, এঁদের কেমন করে জানব।

আপনারা ক’জন ছিলেন?

আমরা মুক্তিবাহিনীর দশজন লোক সেখানে গিয়েছিলাম। কিন্তু ঐ কটি দিনের মধ্যে ঐ অঞ্চলে আরও পাঁচজন লোককে ট্রেনিং দিয়ে আমাদের দলের সঙ্গে যুক্ত করে নিয়েছিলাম বলে আমাদের মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দাঁড়াল পনের।

এই কদিন বড়কামতার লোকেরা আমাদের, নিজেদের আপন জনের মত গ্রহন করে নিয়েছিল। আমরা সবাই মিলেমিশে সংসার করছিলাম। আমরা এখান থেকে ওখান থেকে বড় বড় মাছ ধরে আনতাম। কখনো তাঁরা রান্না করতেন, কখনো বা আমরা। কিন্তু খাবার বেলায় সবাই ভাগাভাগি করে খেতাম। কিসের হিন্দু আর কিসের মুসলমান, আমাদের জাত-পাতের বালাই ছিল না।

উপরের নির্দেশ পেয়ে আমরা ২৯শে এপ্রিল তারিখে চান্দিনার পূর্বদিকে ঢাকা-কুমিল্লা সড়কে একটা পুল উড়িয়ে দিলাম। কদিন থেকেই চান্দিনা অঞ্চলে মিলিটারিরা বেশ তোড়জোর চালাচ্ছে দেখতে পাচ্ছিলাম।

কয়েকদিনের মধ্যে এরা কিছু একটা ঘটাবে সেটা মনে মনে অনুমান করেছিলাম। আমাদের এই ছোট্ দলটিও সেজন্য তৈরী ছিল। ওরা কিছু একটা অঘটন ঘটালে আমরাও একেবারে চুপ করে থাকব না। ওরা যাই মনে করে থাকুক না কেন, ব্যাপারটা একদম একতরফা হবে না।

২৯ তারিখে পুল উড়িয়ে দেবার পর ওরা কোথাও না কোথাও হামলা করবেই। কিন্তু ওদের সেই হামলাটা কোথায় হবে সেটাই হচ্ছে প্রশ্ন।

কিন্তু এ নিয়ে বেশী মাথা ঘামাতে হোল না। ওরা পরদিন সকালবেলা চারখানা সৈন্য বোঝাই গাড়ি সাজিয়ে এই বড়কামতায় এসে হানা দিল। ওরা কি তবে সন্দেহ করতে পেরেছে যে , আমরা এখানে এসে আশ্রয় নিয়ে আছি? কিন্তু তখন বেশী ভাব্বার সময় ছিল না। ওরা প্রথমেই কতকগুলি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিল। ওদের সংখ্যা পঞ্চাশ থেকে ষাট। ইতিমধ্যে আমরা মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধারা ওদের দৃষ্টির আড়ালে নিজ নিজ পজিশন নিয়ে নিয়েছি। ওরা প্রথমেই কোন বাধা না পেয়ে নিশ্চিন্ত মনে তাদের ধ্বংসের কাজে এগিয়ে চলছিল।

আমরা প্রথম সুযোগ পাওয়া মাত্র একই সঙ্গে চারটা গাড়ির উপর উপর “ব্রাশ” করে চললাম। আমাদের মিলিটারি ভাষায় “ব্রাশ” কথার মানে একই সঙ্গে স্বয়ংক্রিয়ভাবে গুলির পর গুলি চালিয়ে যাওয়া। থামিয়ে না দিলে এইভাবে ক্রমান্বয়ে গুলির পর গুলি চলতে থাকে। এই একটানা গুলিবর্ষণের ফলে সৈন্য বোঝাই চারটা গাড়িই লণ্ডভণ্ড হোতে চলল। আমাদের এই প্রচণ্ড আক্রমণ শেষ পর্যন্ত ওরা সহ্য করতে না পেরে প্রান নিয়ে পালাল।

৩০শে এপ্রিলের যুদ্ধের এটা প্রথম পর্ব। এরপরই যে দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয়ে যাবে সেটা বুঝতে বেশী বুদ্ধির দরকার করে না। এখানে ক্যান্টনমেন্ট কতই বা দুর।কিন্তু দ্বিতীয় পর্বটা যে এত তাড়াতাড়ি শুরু হয়ে যাবে তা আমরা ভাবতে পারিনি। এর এক ঘণ্টা কি দেড় ঘণ্টা বাদেই ওরা সৈন্য বোঝাই গাড়ির মিছিল সাজিয়ে চলে এল। ওদের আঠারটা ট্রাক বিকট আওয়াজে পথঘাট এই পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে দ্রুতবেগে ছুটে আসছিল। অনুমানে বুঝলাম প্রতিপক্ষ দুশ জনের কম হবে না। ওদের সঙ্গে মর্টার, মেশিনগান, রাইফেল কোন কিছুর অভাব ছিল না। ওরা এবার রীতিমত শিক্ষা দিয়ে যাবে। ওরা এসেই বেশ বড় একটা এলাকাকে ঘেরাও করে ফেলল।

আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে চারজন সেই ঘেরাও-এর মধ্যে আটকা পড়ে গেছে। আমাদের ঘেরাও-এর সুবিধা হচ্ছে এই যে, ওদের আমরা ভালভাবেই দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু এত সমস্ত লোকের ভিড়ে মুক্তিযোদ্ধারা কোথা মিশে আছে এবং তাঁরা কোথায় কোথায় পজিশন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে সম্পর্কে ওদের বিন্দুমাত্র ধারণা নেই।

বড়কামতা গ্রামের অধিবাসীদের মধ্যে বেশ বড় একটা অংশ বারুই বা বারুইজীবী শ্রেণীর লোক। সেজন্য গ্রামের এখানে ওখানে বহু পানের বরোজ আছে। এই বরোজগুলি সেদিন মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে যথেষ্ট সাহায্য করেছিল এইগুলির মধ্যে আশ্রয় নিয়ে তাঁরা শত্রুদের বেছে বেছে তাক করে মারছিল।

একটা কথা এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা দরকার পাক সৈন্যদের বিরুদ্ধে শুধু যে আমরাই লড়াই করেছিলাম তা নয়, গ্রাম থেকে দলে দলে লোক এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল। দু’একশ লোক নয়, আমার মনে হয় তাদের সংখ্যা দু-তিন হাজারের কম হবে না। লোকগুলি ক্ষিপ্তের মত ছুটে আসছিল। তাদের হাতে লাঠিসোঁটা, বর্শা-বল্লম থেকে শুরু করে বন্দুক পর্যন্ত। এই দুঃসাহসী লোকগুলি এই হাতিয়ার নিয়ে মর্টার আর মেশিনগানের বিরুদ্ধে লড়াই করতে ছুটে আসছে। এদের উন্মাদ ছাড়া আর কি বলা চলে! কিন্তু একটা কথা স্বীকার করতেই হবে যে, তাদের এই উন্মাদনা আমাদের মধ্যে নতুন শক্তি ও অনুপ্রেরনা সৃষ্টি করে তুলছিল। ওরা নানারকম জয়ধ্বনি আর বিকট গর্জন করতে করতে ছুটে আসছিল। সেই গর্জন শত্রুদের মনেও ভয়ের কাঁপন জাগিয়ে তুলছিল। ওরা কেমন যেন দিশেহারা হয়ে পড়েছিল। এ ধরনের ঘটনা যে ঘটতে পারে এটা আমরা কখনও আশা করতে পারি নি। অতি সাধরণ কিছু মানুষ যে দেশের ডাকে, স্বাধীনতার ডাকে এমন অসাধরণ ভুমিকা গ্রহন করতে পারে , এমন অভিজ্ঞতা আমাদের আর কখনও হয়নি। এইভাবে ঘণ্টা দুই ধরে দুই পক্ষে যুদ্ধ চলল।আমরা নিরাপদ আশ্রয়ে দাঁড়িয়ে শত্রুসৈন্যদের তাক করে করে মারছিলাম। আর এই ক্ষিপ্ত জনতা তাদের যৎসামান্য হাতিয়ার নিয়ে তাদের পক্ষে যেটুকু সম্ভব তা করে চলছিল। মর্টার গর্জন করছে, বোমা ফাটছে, মেশিনগান চলছে, গ্রামের পর গ্রাম আগুনে পুড়ে যাচ্ছে, কিন্তু ওরা যেন ভয় পাবার কথা ভুলেই গেছে। ভয় পেয়ে পালাবে দূরে থাক, ওদের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলছে।

এই দু’ঘণ্টার যুদ্ধে বহু সাধারণ মানুষ মারা গেছে। আমরা যে চারজন ঘেরাও-এর মধ্যে আটকা পড়ে গেছি তাদের মধ্যে দুজন জখম হয়েছে। এই দুই ঘণ্টার যুদ্ধ ওদের অনেক হিসেবই ভণ্ডুল করে দিয়েছে। হাজার হাজার সাধরণ মানুষের এই নির্ভীক ও মারমুখো মূর্তি এবং তাদের মুহুমুহ গগনভেদী চীৎকারে ওরা কেমন যেন হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। এমন অভিজ্ঞতা ওদের কখনো হয় নি। এমন দৃশ্য আমরা কোন দিন দেখি নি।

শেষ পর্যন্ত আমরাই সেদিন এই যুদ্ধে জয়লাভ করেছিলাম। আমাদের সামান্যসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা সেদিন যে বীরত্ব ও রণচাতুর্য দেখিয়েছিল সে কথা হয়তো কেউ কোন্ দিন জানবে না। কিন্তু এই অঞ্চলের সাধরণ কৃষক জনতা সেদিন যে শক্তি, সাহস আর দেশপ্রেমের দিয়েছিল, আর কেউ জানুক আর না জানুক, আমরা তা কোনদিন ভুলতে পারব না।

শেষ দৃশ্য। পাকসৈন্যরা রণক্ষেত্র ত্যাগ করে প্রান বাঁচানোর জন্য যে যেদিকে পারছে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলছে। তাদের পেছন পেছন ক্ষিপ্ত, উন্মুক্ত জনতা যার যার হাতিয়ার উঁচিয়ে তাড়া করে চলছে।

আমার কাছ থেকে বেশ কিছুটা সামনে তিনজন পাঞ্জাবী সৈন্য ওদের অজানা অচেনা পথে ছুটে চলছে। একমাত্র আমি ছাড়া ওরা যে আর কারও নজরে পড়েনি, এটা ওদের জানা নেই। কেমন করে জানবে? একবার মুখ ফিরিয়ে পেছন দিকে তাকাবার সাহস পর্যন্ত নেই। আমি সেই সুযোগটাকে ভালভাবেই কাজে লাগালাম। আমি পরপর গুলি করে একজন একজন করে ওদের তিনজনকেই ভুপাতিত করলাম। সামনে গিয়ে দেখলাম, ওদের তিনজনের মধ্যে একজন তখনও মরে নি। আমি এক গুলিতে আমার সেই অসমাপ্ত কাজটিকে সমাপ্ত করে দিলাম।

এর পরের কাজ ওদের থেকে অস্ত্র নিয়ে নেয়া। সেই অস্ত্র নিয়ে বীর জনতার হাতে তুলে দিলাম। এতক্ষন বাদে আমার নজরে পড়ল আমি নিজেও অক্ষত নই। এই যে দেখুন, আমার হাতের এই জায়গায় একটা বুলেট বিদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু এতক্ষন এত সমস্ত উত্তেজনাকর ঘটনার মধ্যে আমিও তা টের পাইনি। এরপর চিকিৎসার জন্য চলে এলাম এ হাসপাতালে।

যিনি এতক্ষন এ কথা বলছিলেন, তিনি বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন সুবেদার। এই পর্যন্ত বলে তিনি থামলেন। তার কথা বুঝলাম বড়কামতার যুদ্ধের ঐখানেই পরিসমাপ্তি।

কিন্তু আমার বোঝাটা যে কত বড় ভুল বোঝা সেটা বুঝলাম আরও কয়দিন বাদে। এবারকার এই ‘পতন-অভ্যুদয় বন্ধুর পন্থায়’ চলতে চলতে কি আশ্চর্যভাবে আর কি অপ্রত্যাশিতভাবে কতরকম লোকের সঙ্গে যোগাযোগ হয়ে যাচ্ছে! একজনের মুখে শোনা অসম্পূর্ণ কাহিনী কি বিচিত্রভাবে আর একজন এসে সম্পূর্ণ করে দিয়ে যাচ্ছে। এই তো সেদিন হঠাৎ চান্দিনা কৃষক সমিতির আমার এক পরিচিত সহকর্মীর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। তার মুখে শুনলাম, এই বড়কামতার যুদ্ধে শুধু মুক্তিযোদ্ধারা নয়, তারা নিজেরাও ভালভাবেই জড়িত ছিলেন।

৩০শে এপ্রিল তারিখে পাকিস্তানী সৈন্যরা যখন দ্বিতীয়বার বড়কামতা আক্রমণ করল তখন শুধু মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধারাই তাদের সঙ্গে মোকাবিলা করেনি, বহু সাধরণ মানুষ সেদিন এ লড়াইয়ে যোগ দিয়েছিল, এ কথা আমরা সেই মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধার মুখে আগেই শুনছিলাম। আমাদের চান্দিনার সেই পরিচিত কৃষক কর্মীটির মুখে শুনলাম প্রায় পাঁচ-ছয় হাজার কৃষক সেদিন এ লড়াইয়ে যোগ দিয়েছিল।

পরদিন ১লা মে তারিখে গতদিনের পরাজয়ের ঝাল মেটাবার জন্য সকাল দশটায় প্রায় হাজারখানেক পাকসেনা পুনরায় এই অঞ্চলে আসে। গতদিনের অভিজ্ঞতা থেকে তাদের মনে এই ধারনার সৃষ্টি হয়েছিল যে, এই এলাকায় মুক্তিবাহিনীর বেশ বড় রকমের ঘাঁটি রয়েছে। তাদের সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন করে দেবার সঙ্কল্প নিয়ে তারা বেশ বড়রকমের প্রস্তুতি নিয়ে এখানে এসে হামলা করল। তারা চান্দিনার দুই মাইল পূর্বে কোরপাই থেকে আরম্ভ করে চান্দিনার এক মাইল পশ্চিমে হাটখোলা পর্যন্ত সমস্ত পাকা রাস্তায় পজিশন নেয়। তাছাড়া কিছু দূরে মেশিনগান ও কামান পেতে রাখে। তিন-চারশ পাকসেনা বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ে এবং বাড়িগুলি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিতে থাকে। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধারা তখন ঘটনাস্থল থেকে বহু দূরে সরে গিয়ে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় খুজে নিয়েছে হামলাকারীরা বুঝতে পারল যে, তাদের হাতের শিকার ফসকে গিয়েছে। শেষ পর্যন্ত চারদিককার গ্রামবাসীদের উপর মনের ঝাল মিটিয়ে এই রক্তখাদক মানুষশিকারীর দল তাদের ক্যান্টনমেন্টে ফিরে চলে গেল।

।। মুক্তিযুদ্ধে ফেনী ।।

এপ্রিলের প্রথমভাগেই নোয়াখালীর ফেনী শহরে মুক্তিবাহিনী গড়ে উঠেছিল। বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর জিয়াউর রহমান ছিলেন এই বাহিনীর সংগঠক ও নায়ক। বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ই পি আর বাহিনীর জওয়ানরা, পুলিশ,আনসার, ছাত্র, সাধারণ মানুষ- এরা সবাই এই বাহিনীতে সামিল হয়েছিল। হাতিয়ার বলতে এদের কিছু রাইফেল আর বন্দুক। তাছাড়া বর্শা, বল্লম, লাঠিসোটা ইত্যাদিও ছিল। এই অস্ত্র সম্বল করে, সবকিছু জেনেশুনেও তারা কামান, মর্টার আর মেশিনগানের বিরুদ্ধে লড়াই করবার জন্য তৈরী হয়েছিল। তখন তারা ভাবতেও পারেনি যে, এর চেয়ে মারাত্নক অস্ত্র নিয়ে ওরা তাদের উপর হামলা করবে। কিন্তু যখন সে সময় এর, তখন তাতেও পিছ-পা হয়নি তারা।

মুক্তিবাহিনী প্রস্তুতি নেবার জন্য বেশী সময় পায় নি। এপ্রিলের প্রথম দিকেই আক্রমণকারী পাক সৈন্যের একটি দল ফেনী শহর দখন করার জন্য মার্চ করে এগিয়ে গেল। কিন্তু কাজটা যত সহজ বলে মনে করেছিল তা-ঠিক নয়, কার্যক্ষেত্রে সেটা প্রমানিত হয়ে গেল। ওরা ফেনী শহর এসে পৌঁছাবার আগেই মুক্তিবাহিনি তাদের পথ রোধ করে দাঁড়াল। যাকে বলে মুখোমুখি লড়াই তা নয়, মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধারা নিজেদের আড়ালে রেখে নানা দিক দিয়ে আক্রমণ চালিয়ে শত্রুপক্ষকে এমনভাবে অস্থির করে তুলল যে, শেষ পর্যন্ত ওরা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পেছনে হটে যেতে বাধ্য হোল। এই গেল প্রথম রাউণ্ড। কিন্তু প্রথম রাউন্ডেই জয়-পরাজয়ের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হোল না। এরপর দু,পক্ষের মধ্যে পরপর কয়েকবার সংঘর্ষ ঘটল। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধাদের হাতে প্রচণ্ড মার খেয়ে আক্রমণকারীদের মুখ চুন হয়ে গেল। এই দুর্গম পথে, জীবনপন করা দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে জয়লাভ করা সহজ কথা নয়, তা করতে গেলে যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে। এই সত্যটা নিশ্চিত হয়ে ওরা তখনকার মত স্থলপথে আক্রমনের কাজটা স্থগিত রাখল।

এইভাবেই মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধ সংগ্রামের প্রথম অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটল। কিন্তু যুদ্ধবিদ্যায় অভিজ্ঞ মেজর জিয়াউর রহমান এবং তার সহযোদ্ধারা একথা ভালভাবেই জানতেন, যুদ্ধের এইখানে ইতি নয়, সুচনা মাত্র। ওরা শীঘ্রই শক্তি বৃদ্ধি করে ফিরে আসবে। আত্মসন্তুষ্টির অবকাশ নেই, এবার প্রবলতর আক্রমণের সম্মুখীন হতে হবে। কিন্তু সেজন্য ভয় করলে চলবে না। শত্রু যতই প্রবল হোক না কেন , তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়েই যেতে হবে, আত্মবিশ্বাসে উদ্দীপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা এই দৃঢ় সংকল্প গ্রহন করেছে। ফেনী শহর ও নিকটবর্তী গ্রামঞ্চলে সাজ সাজ রব পড়ে গেল। মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড লাঠির ঘায়ে জঙ্গিবাহিনীর নেতারা ফেনী শহরকে আক্রমণ করার এবার এক নতুন পরিকল্পনা তৈরী করল।

এপ্রিল মাসের মধ্যভাগ। একদিন হঠাৎ অপ্রত্যাশিত ভাবে দুটো বিমান প্রচণ্ড গর্জন তুলে সারা শহরটাকে প্রদক্ষিন করে চলল। ওরা শুধু অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতেই আসেনি, বোমারু বিমান দুটো ঘুরে ঘুরে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যবস্তুর উপর বোমা ফেলে চলছে। বিস্ফোরণের প্রচণ্ড শব্দে সারা শহর কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল। সাধারণ মানুষ এমন একটা আকস্মিক ঘটনার জন্য একেবারে প্রস্তুতি ছিল না। তারা উদ্ভ্রান্ত হয়ে ছুটোছুটি করতে লাগল। কিছু কিছু লোক হতাহতও হোল। এইভাবে কিছুক্ষন বোমা ফেলে বিস্ফোরণ ঘটাবার পর সেই হিংস্র যন্ত্র দানবগুলি স্বস্থানে ফিরে গেল।

পরদিন আবার ওরা এল। এসেই আগেরকার দিনের মত বোমা ফেলে চললো। কিন্তু একটি দিনের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে শহরের সাধরণ মানুষ অনেক বেশী সাহস সঞ্চয় করেছে। বোমা বিস্ফোরণের মধ্যে কি করে আত্মরক্ষা করতে হয়। সেই কৌশলটাও তারা কিছুটা আয়ত্ত করে নিয়েছে। তারা দিগবিদিক জ্ঞান হারিয়ে পাগলের মত ছুটোছুটি করছিল না, অথবা বহু লোক এক জায়গায় ভিড় করে দাঁড়িয়ে ওদের হাতে আক্রমণের সুযোগ তুলে দিচ্ছিল না, তারা ঠাণ্ডা মাথায় আত্মরক্ষা করে চলেছিল। আর মুক্তিযোদ্ধারা? মুক্তিযোদ্ধারা কি করছিল?

সেই ধ্বংসলীলার মাঝখানে দাঁড়িয়ে মেজর জিয়া নির্ভীক কণ্ঠে হেঁকে উঠলেন, মুক্তিবাহিনীর জওয়ান ভাইরা, আমরা মরবার জন্য তৈরী হয়েই দস্যুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছি, তবে আর আমাদের ভয় কি! কুছপরওয়া নেই, আমরা ঐ বিমান দুটোকে পাল্টা আক্রমণ করে মাটিতে ফেলে ছাড়বো।

মুক্তিযোদ্ধারা বিস্মিতকন্ঠে প্রশ্ন করল, আমাদের হাতে তো এন্টি এয়ারক্রাফট কামান নেই, আমরা কেমন করে এই বিমানগুলিকে ধ্বংস করব?

হ্যাঁ, এন্টি এয়ারক্রাফট থাকলে আমরা আগেই ওদের দফা রফা করে দিতে পারতাম। কিন্তু নাই-বা থাকল তা, আমাদের রাইফেল তো আছে। এই রাইফেল দিয়েই আমরা ওদের এমন শিক্ষা দেব, যা ওরা কোন দিন ভুলতে পারবে না। জওয়ান ভাইসব, শহরে যে সমস্ত উচু দালান আছে, তাদের উপর উঠে ওদের তাক করে গুলি চালাতে থাক। ভিয়েতনামের মুক্তিযোদ্ধারা এই ভাবে শত শত মার্কিন জঙ্গি বিমান ফেলে দিয়েছে, আমরাই বা কেন পারব না? এক মুহূর্ত দেরী নয়, জওয়ান ভাইরা, ছুটে চল সবাই।

শুধু নির্দেশ দেওয়া নয়, মেজর জিয়া সবার আগে নিজেই রাইফেল বাগিয়ে ছুটলেন। রাইফেলধারী যোদ্ধারা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে ছুটতে ছুটতে শহরের উচু উচু দালান গুলির ছাদে গিয়ে উঠে পড়ল। এই দালানগুলি যে কোন সময় বোমার আঘাতে ধসে পড়ে যেতে পারে , কিন্তু সে জন্য মনে বিন্দুমাত্র চিন্তা নেই, বিন্দুমাত্র ভয় নাই। সবাই একমনে বিমান দুটোকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ে চলছে। তাদের এইভাবে আক্রান্ত হতে হবে বিমান চালকরা একথা কল্পনাও করতে পারেনি। তাই তারা নিশ্চিন্ত মনে রাইফেলের নাগালের ভেতরে এসে গিয়েছিল। তারা জানত যে, সে ক্ষেত্রে তারাই শুধু আক্রমণকারী। কিন্তু তারাও যে আক্রান্ত হতে পারে, এটা তাদের জানা ছিল না। কয়েকটা দালানের ছাদের উপর থেকে প্রায় একই সঙ্গে একঝাক রাইফেলের গুলি ছুটল। আর একই সঙ্গে সমস্ত মুক্তিযোদ্ধারা মুক্তিযোদ্ধারা তখনও গুলি চালিয়ে যাচ্ছে। জলন্ত বিমানটার অবস্থা দেখে অপর বিমানটা ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে পালাল, দেখতে দেখতে আকাশপথে মিলিয়ে গেল। গুলিবিদ্ধ বিমানটা উল্কার মত জ্বলতে জ্বলতে পূর্বদিকে ছুটল। ওটা একটু বাদেই জ্বলে- পুড়ে শেষ হয়ে যাবে, পরে জানা গিয়েছিল, জলন্ত বিমানটার ধ্বংসাবশেষ ত্রিপুরার সীমান্তে গিয়ে পড়েছিল।

জয়, মুক্তিবাহিনীর জয়! জয়, স্বাধীন বাংলা জয়! বিজয়গর্বে উদ্দীপ্ত হাজার হাজার জনতার জয়ধ্বনিতে ফেনী শহর মুখরিত হয়ে উঠল। সবাই মেতে উঠল উৎসবে। মুক্তনগরীর বুকে স্বাধীন বাংলার পতাকা পতপত করে উড়ছিল।

 

।। চন্দ্রগঞ্জের যুদ্ধ ।।

মুক্তিবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের চর এসে সংবাদ দিল, সামরিক ভ্যান-বোঝাই একদল পাকসৈন্য ফেনী থেকে চন্দ্রগঞ্জের দিকে আসছে। ওদের যখন চন্দ্রগঞ্জের দিকে চোখ পড়েছে, তখন ওরা সেখানে লুটপাট না করে ছাড়বে না। খবর পেয়ে লাফিয়ে উঠলেন সুবেদার লুৎফর রহমান। বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর লুৎফর রহমান , যিনি এই অঞ্চলে একটি মুক্তিবাহিনী গঠন করেছিলেন। সৈন্যদের সংখ্যা পঞ্চাশ-ষাট জনের মত হবে। এদের প্রতিরোধ করতে হলে দলে কিছুটা ভারী হয়ে নেওয়া দরকার। খোঁজ খবর অল্প সময়ের মধ্যে মাত্র ছয়জন মুক্তিযোদ্ধাদের জড় করা গেল।

সাতজন মানুষ সাতটি রাইফেল। এই সামান্য শক্তি নিয়ে ওদের সঙ্গে মোকাবিলা করতে যাওয়াটা ঠিক হবে কি? মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে একজন এই প্রশ্নটা তুলেছিলেন। কথাটা মিথ্যে নয়, এটা একটা দুঃসাহসের কাজই হবে। অথচ হাতে সময় নেই, মুক্তিবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি করার জন্য যে-সময়ের প্রয়োজন , তার মধ্যে এই লুণ্ঠনকারী দস্যুরা এদের কাজ হাসিল করে সরে পড়বে। চোখের সামনে এই ঘটনা ঘটে যাবে, আর তারা বসে বসে তাই দেখবে! না, কিছুতেই না, গর্জে উঠলেন সুবেদার লুৎফর রহমান, যেভাবেই হোক এদের প্রতিরোধ করতেই হবে। আমাদের চোখের সামনে দিয়ে ওরা অক্ষতভাবে হাসতে হাসতে চলে যাবে, এ কিছুতেই হতে পারে না। ওরা আমাদের অনেক রক্ত নিয়েছে, তার বিনিময়ে ওদেরকেও কিছুটা রক্ত দিতে হবে।

রাস্তার ধারে একটা বড় রকমের ইটের পাঁজা। কে যেন কবে একটা দালান তোলবার জন্য এখানে এই ইটগুলি এনে জড় করে রেখেছিল। অনেকদিন হয়ে গেল, সেই দালান এখনো তোলা হয়নি, ইটগুলি যেমন ছিল তেমনি পড়ে আছে। চন্দ্রগঞ্জে ঢুকতে হলে সৈন্যবাহী গাড়ীগুলিকে এই রাস্তা দিয়েই যেতে হবে। সুবেদার লুৎফর রহমান আর ছয়জন মুক্তিযোদ্ধা সেই ইটের পাঁজার পেছনে পজিশন নিয়ে দাঁড়ালেন। এখানে থেকেই তাঁরা সেই হামলাকারী দস্যুদের প্রতিরোধ করবেন, এটা খুবই দুঃসাহসের কাজ। তাঁরা জানতেন, তাঁরা তাঁদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে চলছেন। কিন্তু এমন একটা সময় আসে যখন জেনেশুনে বিপদের মুখে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের জীবন-মৃত্যু পায়ের ভৃত্য চিত্ত ভাবনাহীন। অবস্থাবিশেষে বামন হয়েও তাঁদের দানবের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ করতে হয়। মুক্তিবাহিনীর নায়েক সুবেদার লুৎফর রহমান বললেন, এখনকার অবস্থা হচ্ছে তেমনি এক অবস্থা।

কিন্তু বেশী কথা বলার সময় ছিল না। দূরে থেকে অস্ফুট সামরিক ভ্যানের গর্জন শোনা গেল। ঐ যে, ঐ যে আসছে ওরা! তাঁরা সাতজন সাতটি রাইফেল নিয়ে তৈরী হয়ে দাঁড়ালেন। সেই অস্ফুট আওয়াজ ক্রমেই স্ফুট থেকে স্ফুটতর হয়ে উঠতে লাগল। তারপর একটু বাদেই দেখা গেল সামরিক ভ্যান পথের ধুলো উড়িয়ে দ্রুতবেগে ছুটে আসছে। উত্তেজিত প্রতীক্ষায় তাঁদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ গুলি ইস্পাতের মত দৃঢ় আর কঠিন হয়ে এল।

সামরিক ভ্যান দ্রুত আসতে হঠাৎ থেমে গেল। না থেমে উপায় ছিল না, কাদের অদৃশ্য হস্তের গুলিতে গাড়ির টায়ারের চাকা ফুটো হয়ে গেছে। একই সঙ্গে কতগুলি রাইফেলের আওয়াজ। বিস্ময়ে, আতঙ্কে সৈন্যরা ঝুপঝাপ করে গাড়ি থেকে লাফিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ল। কিন্তু সেই অদৃশ্য হস্তের গুলিবর্ষণের যেন শেষ নাই। সৈন্যদের মধ্যে যারা সামনের দিকে ছিল, তাঁদের মধ্যে অনেকে হতাহত হয়ে ভুমিশয্যা নিল। একটু বাদেই রাইফেলের আওয়াজ থেমে গিয়ে পল্লী- প্রকৃতির নিস্তব্ধতা আর শান্তি ফিরে এল।

সৈন্যরা সন্ধানী দৃষ্টি নিয়ে তন্ন তন্ন করে চারদিক পরীক্ষা করে দেখতে লাগল। অদৃশ্য শত্রুরা কি তবে ভয় পেয়ে পালিয়ে গিয়েছে? না , ওদের বিশ্বাস নাই, একটু বাদেই হয়তো ওরা আরেকদিক থেকে আক্রমণ করে বসবে। রাস্তার দু পাশে অনেক ঝোপঝাড়- জঙ্গল। তাদের মাঝখানে ওরা কোথায় আশ্রয় নিয়ে বসে আছে কে জানে! তবে দলে ওরা ভারী সে বিষয়ে সন্দেহ নাই।তা না হলে তাদের বিরুদ্ধে এমন করে হামলা করতে সাহস পেত না।

চন্দ্রগঞ্জ সমৃদ্ধ অঞ্চল। এখানে এসে অবাধে লুটপাট করা যাবে, এই আশা নিয়ে তারা এখানে এসেছিল। এই অঞ্চলে তাদের একজন জামাতে ইসলাম পন্থী দালাল ছিল। তার কাছ থেকে খবর পেয়েই তারা লুটের আশায় এখানে ছুটে এসেছে। তারা শুনেছিল এখানে তাদের বাধা দেবার মত কেউ নেই। কিন্তু হঠাৎ কে জানে কোথা থেকে এই শয়তানের দল মাটি ফুঁড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে! কে জানে, হয়তো ওরা ইতিমধ্যে তাদের চারদিক দিয়ে ঘেরাও করে ফেলছে! প্রতি গাছ আর প্রতিটি ঝোপঝাড়ের আড়ালে যে একজন করে শত্রু লুকিয়ে নেই এমন কথাই বা কে বলতে পারে! ওদের রাইফেলগুলি এইভাবে বহু গুলি অপচয় করার পর থামলো।

কিছু সময় নিঃশব্দে কেটে গেল। সৈন্যরা ভাবছিল, তাদের অদৃশ্য শত্রুরা সম্ভবত পালিয়ে গেছে। এমন প্রবল গুলি বৃষ্টির সামনে ওরা কেমন করে দাঁড়িয়ে থাকবে! কিন্তু তাহলেও ওদের গতিবিধি লক্ষ্য করা দরকার। এবার বেশ হুশিয়ার হয়ে এগুতে হবে। যারা হতাহত হয়ে ভুমিশয্যা নিয়েছে, ওরা তাদের একজন একজন করে ভ্যানের উপর তুলছিল। ঠিক সে সময়ে আবার কতকগুলি রাইফেল একসঙ্গে গর্জে উঠল। গুলির পর গুলি আসছে বিরতি নেই। সৈন্যদের মধ্যে এক অংশ আছে ভ্যানের উপর, অপর অংশ রাস্তায়। অদৃশ্য হস্তগুলি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে এদের লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ছে। একটি গুলিও বৃথা যাচ্ছে না সৈন্যদের মধ্যে ভীষণ হট্টগোল পড়ে গেল। তারা একটু সামলে নিয়ে আবার প্রবলভাবে গুলিবর্ষণ করে চলল। কিন্তু তাদের সামনে কোন নিদির্স্ট লক্ষ্য নেই। এইভাবে কিছুক্ষন দুপক্ষের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলল। ইতিমধ্যে সৈন্যদের হতাহতের সংখ্যা ক্রমশ বেড়েই চলছে। অপর পক্ষে অদৃশ্য প্রতিপক্ষের কি পরিমান ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে তা বোঝার কোন উপায় ছিল না।

অবস্থা দেখে আতঙ্কিত হয়ে উঠল সৈন্যরা। কিন্তু একটু আগেই তাদের দালাল, জামাতে ইসলামপন্থী সেই লোকটি , তাদের সাহায্য করবার জন্য এসে গেছে। সে অত্যন্ত চতুর লোক, চারদিকে ভালভাবে নজর করে সে এই রহস্য বুঝতে পারল। দূরবর্তী ইটের পাঁজাটার দিকে আঙ্গুলী নির্দেশ করে সে বলল, আমার সন্দেহ হয়, ওরা ঐ পাঁজাটার পেছনে দাঁড়িয়ে গুলি চালিয়ে যাচ্ছে। ঠিক কথাই তো, এই সন্দেহটা সকলের মনে জাগা উচিত ছিল কিন্তু এতক্ষন এই কথাটা ওদের কারও মাথায় আসে নি।

এবার ওদের রাইফেলগুলি একেবারে নিঃশব্দ হয়ে গেল। সৈন্যরা তিন ভাগে ভাগ হয়ে অতি সন্তর্পণে তিন দিক দিয়ে এগিয়ে চলল। ইটের স্তূপটাকে ঘেরাও করে ফেলতে হবে। খুব সাবধান, ওদের একটাও যেন সরে পড়তে না পারে।

মুক্তিবাহিনীর জওয়ানরা ইটের পাঁজার আড়াল থেকে সব কিছুই দেখছিল। সৈন্যদের মতলব বুঝতে তাদের বাকী রইল না।

আর এক মুহূর্ত দেরী করার সময় নাই। এখনই তাদের সরে পড়তে হবে। এই সংঘর্ষের মধ্যে দিয়ে তারা যতটা আশা করছিল, তার চেয়ে অনেক  বেশী কাজ হাসিল করতে পেরেছে। এবার তারা সাচ্ছন্দে ছুটি নিতে পারে। একজন একজন করে সাতজন মুক্তিযোদ্ধা ওদের দৃষ্টি এড়িয়ে ঝোপঝাড়ের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল। কিন্তু কি দেখল এসে? দেখল পাখিগুলি তাদের একদম বোকা বানিয়ে দিয়ে মুক্ত আকাশে উড়ে চলে গিয়েছে। ইটের পাঁজার পেছনে একটি জনপ্রাণী নেই। শুধু মাটর উপরে অনেকগুলি কার্তুজের খোল ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে পড়ে আছে।

সেদিন কার যুদ্ধে সবসুদ্ধ ২৩ জন সৈন্য হতাহত হয়েছিল। আর মুক্তিবাহিনীর জওয়ান সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় বেরিয়ে আসতে পেরেছিল। যে দেশদ্রোহী দালালটি শত্রুদের সাহায্য করবার জন্য এগিয়ে এসেছিল, এর কয়েকদিন বাদেই মুক্তিযোদ্ধারা তাকেও খতম করল।

সেদিন মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ঘা খেয়ে পাক সৈন্যদের চূড়ান্তভাবে নাকাল হতে হয়েছিল। চন্দ্রগঞ্জে লুটপাট করা দূরে থাক, হতাহত বন্ধুদের নিয়ে গাড়ি বোঝাই করে ওরা মাথা হেট করে ফিরে এসেছিল কিন্তু এই অপমান আর লাঞ্ছনা ওরা ভুলে যেতে পারেনি। দিন কয়েক বাদে ওরা আবার নতুনভাবে তৈরী হতে চলল চন্দ্রগঞ্জের দিকে। তাদের মনের জ্বালাটা এবার ভাল করেই মিটিয়ে নেবে।

পাকসৈন্যরা আবার হামলা করতে আসছে, এই খবরটা পৌঁছে গিয়েছিল চন্দ্রগঞ্জে। সুবেদার লুৎফর রহমান এখন সেখানে নেই, অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যেও কেউ নেই। এবার কে তাদের প্রতিরোধ করবে? ওরা সেদিন আচ্ছামত ঘা খেয়ে ঘরে ফিরে গেছে, এবার ভাল করেই তার প্রতিশোধ তুলবে। চন্দ্রগঞ্জকে এবার ওরা ধ্বংসস্তুপে পরিণত না করে ছাড়বে না। যাকে পাবে তাকেই মারবে। ওদের হাতে কেউ কি রেহাই পাবে? সারা অঞ্চলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। চন্দ্রগঞ্জের মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে শুরু করল। ওরা ওদের যা করবার বিনা বাধায় করা যাবে।

কিন্তু চন্দ্রগঞ্জের একটি মানুষ এই কথাটাকে কিছুতেই মেনে নিতে পারলেন না। না, কিছুতেই না, গর্জে উঠলেন তিনি, এ আমি কিছুতেই হটে দেব না। আর যদি কেউ না যায়, আমি একাই যাব, একাই গিয়ে ওদের সঙ্গে লড়াই করব।

কে এই লোকটি? কি তাঁর নাম? না, তাঁর নাম আমার জানা নেই। কোন খ্যাতনামা লোক নন তিনি। একজন বৃদ্ধ প্রাক্তন সৈনিক। আর দশজন বৃদ্ধের মত তিনিও তাঁর জীবনের শেষ দিন গুলি ‘আল্লাহ আল্লাহ’ করে কাটিয়ে যাচ্ছিলেন। একজন সাধরণ মানুষ। কেউ কোনদিন তাঁর কোন অসাধারণত্তের পরিচয় পায়নি। কিন্তু আজ দেশের এক বিশেষ অবস্থায় একটি বিশেষ অনুকুল মুহূর্তে তাঁর ভেতরকার সুপ্ত আগুনকে জাগিয়ে তুলিছে। যেখানে হাজার হাজার মানুষ ভয়ে অস্থির সেখানে এই একটি মানুষ দৃঢ় নিষ্কম্প কণ্ঠে ঘোষণা করলেন, যদি একা যেতে হয়, আমি একাই যাব, আমি একাই ওদের সঙ্গে লড়াই করব।মরবার আগে এই হিংস্র পশুগুলির মধ্যে একটাকেও যদি মেরে যেতে পারি, তবে আমার জীবন সার্থক হবে।

যারা তাঁর হিতৈষী, তারা তাঁকে নিবৃত্ত করবার জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করেছিল। বলেছিল, তুমি একা মানুষ, তাঁর উপরে বুড়ো হয়েছ, তুমি কি করে ওদের সঙ্গে লড়াই করবে? কিন্তু কারও কোন বাধা তিনি মানলেন না, দৃঢ় মুষ্টিতে রাইফেলটা আঁকড়ে ধরে বেরিয়ে পড়লেন ঘর থেকে। তাঁর এই দৃষ্টান্তে অনুপ্রানিত হয়ে তাঁর তরুন ছেলে তাঁকে ডেকে বলল, দাঁড়াও আব্বা, আমিও তোমার সঙ্গে যাব।তোমার মত আমিও ওদের সঙ্গে লড়াই করব। ছেলের কোথা শুনে বাপের মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। দুজনের হাতে দুটি রাইফেল পিতাপুত্র পাশাপাশি প্রতিরোধ সংগ্রামে যাত্রা করল।

আজও ওরা সেই ইটের পাঁজার পেছনে আশ্রয় নিল। ওরা পিতা পুত্র পাশাপাশি বসে শত্রুদের আগমনের জন্য অধীর চিত্তে প্রতীক্ষা করতে লাগল। কিছুক্ষন বাদে দূর থেকে মোটর ভ্যানের গর্জন শোনা গেল। হ্যা এইবার ওরা আসছে। দেখতে দেখতে সৈন্য বাহী একেবারে কাছে এসে পড়ল। সৈন্যদের মধ্যে অনেকের কাছেই এই ইটের পাঁজাটি সুপরিচিত। ঐটিকে ভুলে যাওয়া তাদের পক্ষে কোন মতেই সম্ভব নয়, কিন্তু আজও যে কেউ তাদের আক্রমণ করবার জন্য এর আড়ালে ওৎ পেতে বসে থাকতে পারে, এটা তারা ভাবতে পারেনি। ভাবতে না পারা স্বাভাবিক ও নয়। কিন্তু ওরা এই স্তুপটার বরাবর আসতেই পর পর তিনজন সৈন্য গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে গেল। সবাই দেখতে পেল কে বা কারা তাদের লক্ষ্য করে স্তূপটার আড়াল থেকে গুলিবর্ষণ করে চলছে। এরপর সঙ্গে সঙ্গেই সৈন্যরা এর পাল্টা জবাব দিল। ইটের পাঁজাটাকে লক্ষ্য করে ঝাকে ঝাকে গুলিবর্ষণ চলল। এরপর সেই স্তুপের পেছন থেকে আর কোন গুলির শব্দ শোনা গেল না। সৈন্যরা একটু সময় অপেক্ষা করল,তারপর ছুটে গেল স্তূপটার সামনে। উদ্যত রাইফেল বাগিয়ে ধরে যখন তারা পায়ে পায়ে সেই স্তূপটার পিছনে গিয়ে দাঁড়াল, তখন দেখতে পেল, সেখানে এক বৃদ্ধের রক্তাক্ত মৃতদেহ পড়ে আছে। কিন্তু অস্ত্র বলতে কোন কিছু সেখানে নেই, শুধু কয়েকটা কার্তুজের খোল পড়ে আছে। ওরা বুঝল, এই বৃদ্ধের সঙ্গে আরও যারা ছিল তারা অস্ত্রসহ পালিয়ে গিয়েছে।

।। সোনাইমুড়ি রেলস্টেশন ।।

চন্দ্রগঞ্জের যুদ্ধের পর সুবেদার লুৎফর নোয়াখালীর বিভিন্ন অঞ্চলে শিকারের সন্ধানে ছুটে চলছিলেন। তাঁর এক মুহূর্তেও বিশ্রামের অবকাশ নেই। তিনি পাক সৈন্যদের গতিবিধি সম্পর্কে দক্ষ শিকারির মত তীক্ষ্ণ সন্ধানী দৃষ্টি নিয়ে ফিরছিলেন। মুক্তিবাহিনীর গুপ্তচরেরা নিত্য নতুন সংবাদ নিয়ে আসছে। আর সেই সুত্র অনুসরণ করে তাদের মুক্তিবাহিনী যেখানেই সুযোগ পাচ্ছে, সেখানেই শত্রুদের উপর ঘা দিয়ে চলছে।

এপ্রিলের শেষ ভাগ। খবর এল একদল সৈন্য কুমিল্লার লাকসাম থেকে ট্রেনে নোয়াখালীর সোনাইমুড়ি ষ্টেশনে এসে পৌঁছাবে। লুৎফর রহমান এই খবর পাওয়ার সাথে সাথেই তাঁর সহকর্মীদের সঙ্গে পরামর্শ করতে বসলেন। স্থির হোল, ওদের বিনা বাধায় এগুতে দেওয়া হবে না। সোনাইমুড়ি ষ্টেশনেই এই হামলাকারীদের উপর হামলা করতে হবে। রেল স্টেশনে চড়াও হয়ে আক্রমণ। হয়তো সে জন্য মুক্তিবাহিনীকে বেশ কিছুটা মূল্য দিতে হবে, অনেক ক্ষয়ক্ষতি বরণ করে নিতে হবে। তা হোক, এই শিকারকে কিছুতেই ফস্কে যেতে দেওয়া চলবে না।

কিন্তু এবার আর চন্দ্রগঞ্জের যুদ্ধের মত সাতজন মুক্তিযোদ্ধা দিয়ে চলবে না। এবার আর আগেরকার মত আড়াল থেকে যুদ্ধ নয়, যুদ্ধ বলতে দিবালোকে প্রকাশ্যে, মুখোমুখি। ওদের সৈন্য সংখ্যা বড় কম নয়, আক্রমণ করতে হলে বেশ কিছুটা শক্তি সংগ্রহ করে নিতে হবে সেই অল্প সময়ের মধ্যেই পঞ্চাশজন সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাকে সোনাই মুড়িতে এনে জড় করা গেল। অবশ্য যতদূর জানা গিয়েছে, সৈন্যদের সংখ্যা এর চেয়েও অনেকটা বেশী। তাহোক, এই শক্তি নিয়েই ওদের সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে।

নির্দিষ্ট সময়ে সৈন্য বাহী ট্রেনটা সোনাইমূড়ি স্টেশনে এসে পৌছাল। মুক্তিবাহিনী কাছেই কোন এক জায়গায় লুকিয়ে ছিল। ট্রেনটা এসে পৌঁছাবার সাথে সাথেই রাইফেলধারী মুক্তিযোদ্ধারা বিদ্যুৎগতিতে ছুটে এসে ট্রেনটাকে ঘেরাও করে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে তারা ট্রেনের আরোহীদের লক্ষ্য করে গুলি চালাতে লাগল। ওরা গাড়ির ইঞ্জিনটাকেও লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ছিল। ড্রাইভার ইঞ্জিন থেকে লাফিয়ে পড়ে প্রান নিয়ে পালাল। ফলে ড্রাইভারহীন ট্রেনটা অচল হয়ে গেল।

প্রকাশ্য দিবালোকে এইভাবে আক্রান্ত হতে হবে, পাক সৈন্যরা তা কল্পনাও করতে পারেনি। তারপর ঘটনাটা এমন দ্রুত ঘটে গেল যে একটু সময় ওরা হতভম্ব আর স্তব্দ হয়ে রইল। প্লাটফর্মের উপর নেমে পড়তে লাগল। ওদের মধ্যে কয়েকজনকে কামরা থেকে নামবার আগেই মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে প্রান দিতে হল।

এবার দু’পক্ষ শুরু হয়ে গেল যুদ্ধ। এবারকার বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে রেলস্টেশনের উপরে এ ধরনের লড়াই আর কোথাও ঘটেছে বলে শোনা যায়নি। নোয়াখালীর সোনাইমুড়ি রেলস্টেশন এজন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবে। প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে এই লড়াই চলল। এই যুদ্ধে পয়ত্রিশজনের মত পাকসৈন্য নিহত হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ছয়জন শহীদ হলেন।

ইতিমধ্যে খবরটা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছিল। খবর পেয়ে ঘণ্টা তিনেক বাদে আক্রান্ত পাক-সৈন্যদের সাহায্য করবার জন্য চৌমুহনী থেকে সামরিক ভ্যানে করে একদল সৈন্য ঘটনাস্থলে এসে পৌছল। এবার পাক- সৈন্যদের মোট সংখ্যা দাঁড়াল আড়াইশতের উপর। হতাহতদের বাদ দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা তখন আনুমানিক চল্লিশ-এ এসে দাঁড়িয়েছে। এই অবস্থায় যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়াটা নির্বুদ্ধিতার নামান্তর মাত্র। মুক্তিযোদ্ধারা এমন ভুল কখনও করে না। তারা যেমন বিদ্যুৎ গতিতে এসে আক্রমণ করেছিল। তেমনিভাবে ঘটনাস্থল থেকেই অদৃশ্য হয়ে গেল। পাক সৈন্যরা তাদের পেছন পেছন করে আক্রমণ করতে চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তাদের সে চেষ্টা ব্যর্থ হল।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!