You dont have javascript enabled! Please enable it!
শিরোনাম সূত্র তারিখ
১১। রাজশাহী জেলায় সংঘটিত

সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ

বাংলা একাডেমীর দলিলপত্র ১৯৭১

নওগাঁ রাজশাহীর সশস্ত্র প্রতিরোধ

সাক্ষাৎকার- ব্রিগেডিয়ার গিয়াসউদ্দিন চৌধুরী

(১৯৭১ সালের মার্চে ক্যাপ্টেন পদে কর্মরত ছিলেন। সাক্ষাৎকারটি তাঁর মেজর থাকাকালীন গৃহীত। এই প্রকল্পের জন্য ২০-০৯-১৯৮৩ তারিখে তার লিখিত ইংরেজী প্রতিবেদনের প্রথমাংশ প্রাসঙ্গিক বোধে এই সাক্ষাৎকারের সাথে সংযোজন করা হলো। প্রতিবেদনের বাকি অংশ দশম খণ্ডে সন্নিবেশিত হয়েছে)

মার্চ মাসে (১৯৭১) আমি রাজশাহীর নওগা’তে বিডিআর (তৎকালীন ইপিআর)-এর উইংয়ের সহকারী উইং কমান্ডারের দ্বায়ীত্ব পালন করছিলাম। ১৮ই মেজর নাজমুল হক (বাঙালি) সাহেবকে উইং কমান্ডার হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। ঐ পদে এর আগে একজন পাঞ্জাবী অফিসার বহাল ছিলেন। নাজমুল হক সাহেব সরাসরি পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নওগাঁতে আসেন এবং দায়িত্ব বুঝে নেবার চেষ্টা করেন। কিন্তু পাঞ্জাবী অফিসারটি দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে কিছুটা টালবাহানা শুরু করেন। কিন্তু তখন সেই এলাকায় গোলযোগপূর্ণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং আমার প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপের দরুণ পাঞ্জাবী মেজর আকরাম দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে বাধ্য হন।

মেজর আকরাম ২৩শে মার্চ ঢাকার পথে ক্যাপ্টেন নবীদ নামে সেই উইংয়ের আরেকজন পাঞ্জাবী অফিসার সহ রওয়ানা হন কিন্তু পথিমধ্য ফেরীর লোকজন তাদেরকে পার করতে অসম্মতী প্রকাশ করায় তারা ফিরে আসতে বাধ্য হন। ফিরত আসার পর আমি তাদের নিরাপত্তার অজুহাতে আমার বাসার উপরের তলায় প্রকৃতপক্ষে নজরবন্দী করে রাখি। এবং একই অজুহাতে নিচে সশস্ত্র প্রহরী মোতায়েন করি।

২৩শে মার্চ এবং ২৫শে মার্চের মধ্যে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে আমি আমার উইং-এর কমপক্ষে ১০০ জন পশ্চিম পাকিস্তানী ইপিআর, জেসিও এবং অফিসারদেরকে রাখার ফাঁদ রচনা করি। কেননা আমি বুঝতে পারি যে, তারা সবাই উইং হেডকোয়ার্টারে টালবাহানা করে একত্রিত হবার চেষ্টা করছে এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে কিছু একটা করার চেষ্টা করছে। ২৪শে মার্চ আমি উইং-এর উপপ্রধান হিসেবে অধিকাংশ অস্ত্রাগারে পাঞ্জাবী প্রহরী অধিনায়কদের সরিয়ে ফেলি এবং বেশীরভাগ বাঙালিকে নিয়োগ করি।

২৫শে মার্চ পর্যন্ত আমরা বাইরের কোনো খবর পাইনি। ২৬শে মার্চ ভোর ছয়টায় সুবেদার মেজর চুপি চুপি আমার বাসায় এসে বলে যে, আমাকে কে যেনো ঢাকা ইপিআর অয়ারলেস স্টেশন থেকে ডাকছে এবং তার মনে হচ্ছে ঢাকায় কিছু একটা ঘটেছে।

অয়ারলেসে কথা বলার সময় একজন বাঙালি ইপিআর সিগন্যালার আমাকে বললো যে, ঢাকায় গত রাতে রাজারবাগে পশ্চিম পাকিস্তানীরা হামলা চালিয়েছে এবং পিলখানার ইপিআর’রা বিদ্রোহ করেছে এবং তারা অধিকাংশ ইপিআর ক্যাম্প দখল করে নিয়েছে, আপনারা যে যেখানে আছেন আপনাদের নিজেদের কাজও শুরু করুন। কিন্তু আমি তার পরিচয় জিজ্ঞেস করলে সে পরিচয় দিতে অসম্মতি জানায়। যদিও এ খবরের সত্যতা প্রমাণ করার কোনো উপায় ছিলো না তথাপি কিছু সত্য থাকতে পারে একথা মনে করে নিজে বিদ্রোহ করতে মনে স্থির করি।

বেশ কিছুক্ষণ পরে ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে খবর শুনতে চাইলে কোনো জবাব পাওয়া গেলো না। বেশ কিছুক্ষণ পর বলা হয় ইয়াহিয়া খান ভাষণ দিবেন। কিছুক্ষণ পর ইয়াহিয়ার ভাষণ শোনা গেলো এবং সামরিক নির্দেশনাবলীও প্রচার করা হলো।

বিদ্রোহের দাবানল চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো। চারিদিকে বিহারী-বাঙালি দাঙ্গা-হাঙ্গামা শুরু হয়ে গেলো। বিশেষ করে সান্তাহারে, যেখানে ছয় হাজার বিহারী বাস করতো। আমরা দাঙ্গা বন্ধ করতে চেষ্টা করছিলাম এবং এ নিয়ে মেজর নাজমুল হক সহ কিছু স্থানীয় এমসিএ এবং এসডিও’র সাথে আমরা বৈঠক করি। মানুষের মনে যাতে কোনো সন্ত্রাসের সৃষ্টি না হয় তার চেষ্টা করি। ইয়াহিয়ার ভাষণ এবং সামরিক নির্দেশনাবলী শুনে সেদিন আমাদের মনে ক্ষোভ ও ভীতির সঞ্চার হয়।

কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় যখন সন্ধ্যার সময় বেতার কেন্দ্র খুলি তখন হঠাৎ করে মেজর জিয়াউর রহমানের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। বেতারের মাধ্যমে স্বাধীনতা ঘোষণা করা হলো। মনে সাহস হলো যে, অন্ততঃপক্ষে একজন অধিনায়ক হিসেবে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন। সকলের মনে সাহসের সঞ্চার হলো এবং আমরা স্বাধীনতা সংগ্রামে পুরোপুরিভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলাম।

আমি আমার অপারেশনাল হেডকোয়ার্টার অফিস স্থাপন করলাম এবং মেজর নাজমুল হক সহ স্বাধীনতা সংগ্রামের পরিকল্পনা শুরু করলাম। আমাদের পরিকল্পনার প্রথম পর্যায়ে ছিলোঃ

(ক) অয়ারলেস স্টেশন সারাদিন খোলা থাকবে এবং ইপিআর-এর ১৭উইং-এর খবরাখবর মনিটর করা এবং সেগুলো অপারেশনাল হেডকোয়ার্টারে জানানো।

(খ) নিজের হেডকোয়ার্টার থেকে কোনো কথাবার্তা না বলা, শুধু শোনা।

(গ) পুলিশের অয়ারলেসগুলোতেও মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করা এবং সেগুলোর মাধ্যমে যোগাযোগ করা কেননা সেখানে পশ্চিম পাকিস্তানীদের অবস্থান ছিলোনা।

(ঘ) টেলিফোন ডিপার্টমেন্টকে বলা হয় যেনো বগুড়া এবং যে সমস্ত রাস্তা দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানীদের আসার সম্ভবনা আছে সে সমস্ত জায়গায় অন্ততঃপক্ষে পঞ্চাশ মাইল পর্যন্ত কয়েকটা প্রান জায়গার সাথে আমাদের যোগাযোগ রাখে এবং সেখানকার স্থানীয় ছাত্রনেতা অথবা আওয়ামী লীগ নেতা যেনো আমাদেরকে বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত রাখে তার ব্যবস্থা করা।

(ঙ) সমস্ত বাস ট্রাক রিকুইজিশন করা হলো।

(চ) ছাত্রদের মধ্য থেকে ভলান্টিয়ার নেয়া হলো এবং কিছু কিছু আওয়ামী লীগ নেতাদেরকে ডাকা হলো যেমন- জনাব বয়তুল্লাহ (বর্তমান ডেপুটি স্পীকার) এবং ছাত্রনেতা মোহাম্মদ আব্দুল জলিলকে ডাকা হলো।

(ছ) ছাত্রদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হলো এবং তাদেরকে রাইফেল দেয়া হলো।

(জ) অস্ত্রশস্ত্র এবং গোলাবারুদ স্টোর থেকে সরিয়ে কিছু কিছু মাটির নিচে রাখা হলো যাতে করে জঙ্গী বিমানের হামলায় ক্ষতিগ্রস্থ না হয়।

(ঝ) প্রধান হেডকোয়ার্টারের কিছু দূরে পেট্রোলিংয়ের ব্যবস্থা করা হলো এবং খবরাখবর সরবরাহের জন্য রানার নিয়োগ করা হলো।

(ঞ) এবং স্থির হলো যে নওগাঁ’কে আপাতত আমাদের রিয়ার হেডকোয়ার্টার করা হবে যেহেতু এটা শত্রুবাহিনীর জন্য দুর্গম স্থান।

(ট) এদিকে আমি ৬নং ইপিআর যেটা রাজশাহী ইপিআর সেক্টর হেডকোয়ার্টারের অধীনে নওয়াবগঞ্জে অবস্থিত ছিলো তাদেরকে অয়ারলেসে বাংলায় কিছু নির্দেশাবলী দিতে শুরু করলাম। সেই উইংয়ে কোনো বাঙালি অফিসার ছিলো না। তিনজন পশ্চিম পাকিস্তানী অফিসার ছিলো। ২৬/২৭শে মার্চ রাত্রের গোলযোগের পর তারা উইং হেডকোয়ার্টার ছেড়ে রাজশাহীতে পালিয়ে আসে। সেই সুযোগে আমি সমস্ত উইং-এর লোকজনকে নওয়াবগঞ্জে একত্রিত হতে বলি বিওপি ছেড়ে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সেখানে উপস্থিত হয় তার নির্দেশ দেই।

(ঠ) সেখানে অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ সরিয়ে ফেলে নিরাপদ জায়গায় রাখার নির্দেশ দেই। দেশের পরিস্থিতি সম্বন্ধে তাদের অবহিত করা হয় এবং তাদের উপর বিওপিতে হামলা হবার সম্ভাবনা আছে সে কথাও অবহিত করি।

২৭শে মার্চ পর্যন্ত আমাদের প্রস্তুতি চলে এবং রাজশাহী এবং রাজশাহী সেক্টরের নওগাঁ এবং নওয়াবগঞ্জের সমস্ত ইপিআরকে এক জায়গায় নিজ নিজ হেডকোয়ার্টারে একত্রিত করা হয়।

২৭শে মার্চ আনুমানিক বেলা ১১টার সময় আমাকে পুলিশের অয়ারলেসেযোগে রাজশাহীর ডিসি ডাকেন। তার সাথে কথা হচ্ছিল। তিনি বললেন যে, রাজশাহী পুলিশ লাইনের চতুর্দিকে ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট ঘেরাও করে আছে এবং পুলিশদের আত্মসমর্পণ করতে আদেশ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু কেউই আত্মসমর্পণ করতে প্রস্তুত নয়। তিনি এবং এসপি তাদের সাথেই আছেন। যদি সম্ভব হয় কিছু ইপিআর-এর লোক যেন সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে। পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী আর আধঘণ্টা সময়ের মধ্যে আত্মসমর্পণ না করলে পুলিশ লাইনের উপর আক্রমণ চালাবে এবং তার মর্টার ইত্যাদি স্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু আমি তাকে বললাম কি করে এত অল্প সময়ের মধ্যে ৬০ মাইল কাঁচা রাস্তা (নওগাঁ থেকে রাজশাহী) যাওয়া সম্ভব? একথা শেষ হতে না হতে ডিসি অয়ারলেস ছেঁড়ে দিলেন এবং আমি অপারেটরের গলার আওয়াজ শুনতে পেলাম। সে বলছিল, গোলাগুলি শুরু হয়ে গেছে- এরপর আর কোন সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। অনেক চেষ্টার পরও কোন খবর পাওয়া গেল না। এদিকে আমরা খবর পেলাম যে বগুড়ার আর্টিলারী রেজিমেন্ট-এর একটা ব্যাটারী আছে যেটাকে এখন অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ডিউটির জন্য মুভ করানো হয়েছে এবং তারা সেখানকার গার্লস স্কুলে অবস্থান করছে।

প্রতিরোধের পরিকল্পনাঃ আমি মেজর নজমুল হক সহ পরিকল্পনা করলাম যে ২৮শে মার্চ প্রথমতঃ এক কোম্পানী ইপিআর ফোর্স নাটোরের রাস্তা দিয়ে সারদায় পাঠাব ক্যাডেট কলেজের এডজুট্যান্ট মেজর রশিদের কাছে। এবং রংপুর থেকে রাজশাহী যাবার রাস্তা বগুড়ায় বিচ্ছিন্ন করে দেব। অন্যথায় মেজর রশিদ তার ফোর্সসহ ঢাকা থেকে রিইনফোর্সমেন্ট নিয়ে রাজশাহী আসার রাস্তা বিচ্ছিন্ন করে দেবে।

২৮শে মার্চ বিকেলে আমি পরিকল্পনা অনুযায়ী আমার লোকজন নিয়ে বগুড়ায় পৌঁছে গেলাম যার দূরুত্ব আনুমানিক ৩০ মাইল। কিন্তু রাস্তায় ব্যারিকেড থাকাতে আমাকে সকাল দশটায় রওয়ানা হয়ে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় পৌঁছতে হয়েছিল। সেখানে গিয়ে দেখি শহরের লোকজন নেই বললেই চলে। সব মিলে হাজার খানেক লোক হবে কি না সন্দেহ। পরিবার বলতে কারোরই ছিল না। একটা থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছিল এবং গাড়ীর আওয়াজ শুনে এবং লাইট দেখে সবাই পালিয়ে গেল। কিছুক্ষণ আগেও এখানে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের সাথে স্থানীয় লোকের সামান্য গোলাগুলি হয়েছিল, সন্ধ্যা হতে না হতেই শহর অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে গেল এবং শহরের রাস্তাগুলো ছিল ব্যারিকেডপূর্ণ।

বগুড়ায় সংঘর্ষঃ আমি প্রথমে পুলিশ লাইনে গেলাম। সেখানে একজন বেশ সাহসী রিজার্ভ পুলিশ ইন্সপেক্টর এবং শ’দুয়েক পুলিশ দেখতে পেলাম। আমাদেরকে দেখতে পেয়ে তারা অনেকটা সাহস পেল এবং বর্তমান পরিস্থিতি সম্বন্ধে আমাদেরকে জ্ঞাত করল। আমি জানতে পারলাম যে তারা (আর্টিলারী ব্যাটারী) আপাততঃ রংপুর থেকে কোন ফ্রেশ সাপ্লাই পাচ্ছে না যেহেতু রাস্তাঘাট বন্ধ। তবে তারা প্রায়ই গ্রামের পথে গাড়ী নিয়ে যায় এবং তরিতরকারি ও মাংস সংগ্রহ করে নিয়ে আসে। আমার জানা ছিল যে আর্টিলারী ব্যাটারীতে ৫০/৬০ জনের বেশী লোক হতে পারে না এবং তাদের ততোটা সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হবার নিপুণতা নেই। সেহেতু প্রথমতঃ পরিকল্পনা করলাম যে গ্রামে যাবার পথে অথরা পেট্রলিং-এর সময় তাদেরকে এমবুশ করা সহজসাধ্য হবে।

পরিকল্পনা অনুযায়ী ২৯/৩০শে মার্চ রাতে একটা এমবুশ পার্টি করলাম। এতে ছিল নওগাঁ থেকে আসা কয়েকজন ছাত্র ও ইপিআর ও পুলিশের লোকজন। তিনখানা ৩ টনী গাড়ীসহ সেনাবাহিনীর কয়েকজন কমপক্ষে এক প্লাটুন পেট্রলিংয়ে বের হয় এবং রাস্তার মধ্যে আমাদের লোকজন তাদের কে এমবুশ করে। তিনটি গাড়ী বিধ্বস্ত হয়। তিনটি অয়ারলেস সেট দখল করা হয় এবং ২৩ জন নিহত হয়। বাকি লোক ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থায় রংপুরের দিকে পশ্চাদপসরণ করে। এই এমবুশে আমাদের সৈনিকদের মনোবল অনেক বৃদ্ধি পায়।

বগুড়াতে তখন একটা এমুনিশন ড্যাম্প ছিল, যেটা একজন ক্যাপ্টেন কমাণ্ড করছিল। ওখানে মাত্র ২০/২৫ জন সৈনিক প্রহরা দিচ্ছিল। আমি সবাইকে একত্রিত করে কিভাবে এমুনিশন ড্যাম্প দখল করতে হবে, বিশেষ করে এর চারিদিকে ঘেরাও করে তাদেরকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করতে হবে তার ব্যবস্থা করি। ঘেরাও করার জন্য গ্রাম থেকে কিছু লোক যোগাড় করা হল। এবং এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে ঘেরাও করে গোলাবারুদ বের করে নেয়ার জন্য নির্দেশাবলী দিয়ে আমি আমার সুবেদার সাহেবকে রেখে নওগাঁ চলে আসি, যেহেতু আমার সেখানে যাবার বিশেষ প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল।

পরিকল্পনা অনুযায়ী এমুনিশন ড্যাম্প ঘেরাও করা হয়েছিল এবং ক্যাপ্টেন তার লোকজনসহ আত্মসমর্পণ করে। অধিকাংশ গোলাবারুদ মুক্তিযোদ্ধারা ভারতে নিয়ে যায় এবং বাকিগুলো পানিতে ফেলে দেয়া হয়।

বগুড়া থাকাকালীন সময়ে অয়ারলেসে মেজর শফিউল্লাহর সাথে আমার কথা হয়। তিনি বললেন যে, কিশোরগঞ্জের কাছে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল নিয়ে যমুনা নদীর কাছে তিনি আছেন, আমরা যেন ওখানে গিয়ে তার সাথে যোগাযোগ করি। তিনি পরিকল্পনা করেছিলেন, উত্তরাঞ্চলকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার। সেখান থেকে একজন লোক পাঠিয়েছিলাম তাঁর কাছে। কিন্তু খবর পাওয়া গেল তিনি সিলেটের দিকে রওয়ানা হয়ে গেছেন।

নওগাঁতে মেজর নজমুল হকসহ আবার পরিকল্পনা শুরু করলাম। এদিকে খবর পাওয়া গেল যে, ইপিআর কোম্পানী রাজশাহীর পথে মর্টার এবং অন্যান্য ভারী অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে পাঠানো হয়েছে। সেটা রাজশাহীর নিকটবর্তী আড়ানী নামক রেলওয়ে স্টেশনের কাছে ২৫ পাঞ্জাবীর এক কোম্পানীর সাথে সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে ২৯/৩০ মার্চ রাতে তাদের সাথে কয়েক হাজার মুক্তিযোদ্ধা এবং গ্রামের লোক যোগ দিয়েছে। এই পাকিস্তানী কোম্পানীটি পাবনা থেকে পশ্চাদপসরণ করে তাদের নিজের ব্যাটালিয়নের দিকে পদব্রজে রাজশাহী আসছিল। কোম্পানীটি সম্পূর্ণরূপে ঘেরাও হয়ে যায় এবং ইপিআর কোম্পানী তাদের উপর ৩ ইঞ্চি মর্টারের গোলা বর্ষণ করতে শুরু করে। শত্রুবাহিনী দিশেহারা হয়ে গোলাগুলি শুরু করে এবং অনেকক্ষণ গোলাগুলি বিনিময় হয়। শেষ রাতের দিকে শত্রুবাহিনীর গোলাবারুদ শেষ হয়ে যায় এবং প্রাণ বাঁচাবার উদ্দেশ্যে ছত্রভঙ্গ হয়ে এদিক সেদিক পালাতে শুরু করে। কিন্তু গ্রামের লোক এবং মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে প্রায় সবাই ধরা পড়ে এবং তারা গ্রামবাসিদের হাতে নিহত হয়। মেজর আসলাম এবং ক্যাপ্টেন রেজা (উপঅধিনায়ক) মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে বন্দী হয়ে এবং আড়ানী স্টেশনের কাছে নিহত হয়।

শত্রুবাহিনীর মনোবল খুবই ভেঙ্গে পড়ে এবং সেই সুযোগে আমি এক কোম্পানী ইপিআর নিয়ে নওগাঁ থেকে ৩১শে মার্চ রাজশাহীর পথে রওয়ানা হই। নওয়াবগঞ্জের উইংকে নির্দেশ দিই তারা যেন নওয়াবগঞ্জ থেকে পদব্রজে অগ্রসর হয় এবং শত্রুও মোকাবেলা করতে যেন প্রস্তুত থাকে। অনেক ব্যারিকেড অতিক্রম করে শেষ পর্যন্ত রাজশাহীর অদূরে নওহাটা (মত্রঘাটি হতে মাত্র দুই মাইল দূরে) আমি আমার লোকজন নিয়ে অবস্থান নেই এবং অন্যদিকে অগ্রসরমান নওয়াবগঞ্জের ইপিআর উইং (যেখানে ৫০০ সশস্ত্র লোক ছিল)-এর সাথে যোগাযোগ করি।

সেই রাতে আমি কিছু লোক নওহাটায় রেখে রাজশাহী থেকে ছয় মাইল দূরে খরচক্কা (রাজশাহী-নওয়াবগঞ্জ রাস্তার উপর) নামক স্থানে ইপিআর-এ অগ্রসরমান লোকদের সাথে দেখা করি এবং সম্পূর্ণ সেনাবাহিনীকে আমার অধীনে নিয়োজিত করি। সেই রাতে ২৫ পাঞ্জাবের একটি পেট্রল বাহিনী তিনখানা গাড়ী নিয়ে সেই রাস্তায় আসে এবং আমাদের বাহিনী অতর্কিতে তাদেরকে এমবুশ করে। আমরা ওদের ৭ জনকে নিহত এবং একজনকে জীবিত ধরতে সক্ষম হই। সেই বন্দীর কাছ থেকে জানা যায় যে ক্যাপ্টেন সালমান নামক এক অফিসার তাদের পেট্রল পার্টির নেতৃত্ব দিচ্ছিল এবং একটা প্লাটুন পেট্রলিংএ এসেছিল। ওদের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং আহত-নিহতদের অধিকাংশকে নিয়ে চলে যায়। এতে আমাদের লোকজনের মনোবল অনেক বেড়ে যায়। এবং আমার লোকজন ত্বরিত বেগে রাজশাহীর দিকে অগ্রসর হয়।

১লা এপ্রিল ভোর ছটার মধ্যে আমরা রাজশাহী শহরের অদূরে আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যূহ তৈরি করি। আমাদের পেট্রোল বাহিনী নিয়োগ করি খবরাখবর আনার জন্য। আমার পূর্বদিকে মেজর রশীদের নেতৃত্বে যে সমস্ত লোকজন পাঠানো হয়েছিল তাদের তাদের সাথেও যোগাযোগ করি এবং তাদেরকে বলা হয় যেন তারা সারদা থেকে অগ্রসর হয়ে রাজশাহীর পূর্বদিকে প্রতিরক্ষা ব্যূহ তৈরি করে।

এদিকে আমার সশস্ত্রবাহিনীর সংখ্যা পুলিশ; আনসার মুজাহিদ; ছাত্র; ইপিআর মিলে একহাজারের ওপরে পৌছে যায়। শত্রুবাহিনী রাজশাহীর চারিদিকে তাদের প্রতিরক্ষা ব্যূহ আরো শক্তিশালী করে এবং তাদের স্বয়ংক্রিয় ভারী অস্ত্র প্রধান পথে মোতায়েন করে, শত্রুবাহিনী আমাদের শক্তি এবং সংখ্যা নির্ধারণ করতে সক্ষম হয় এবং তাদের জংগী বিমান ঢাকা থেকে সাহায্যের জন্য আসে। ১লা এপ্রিল থেকে ৫ই এপ্রিল প্রত্যহ দু’একবার করে বিমান হামলা চলে; কিন্তু রাজশাহীর চতুর্দিকে আম্রকুঞ্জ থাকায় এবং তার নীচে আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যূহ তৈরি হওয়ায় শত্রুবাহিনীর বিমান গুলো আমাদের অবস্থান নির্ণয় করতে পারেনি এবং আমাদের বিশেষ কোন ক্ষতি করতে পারেনি। তবে বেসামরিক অনেক লোকজন মারা যায় এবং ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়।

৩রা এপ্রিল ভারত থেকে বিএসএফ-এর একজন লেঃ কর্নেল সেন এবং মেজর ত্রিবেদী নামে দুজন অফিসার আমার সাথে দেখা করতে আসেন এবং আমার কি প্রয়োজন জিজ্ঞেস করেন। আমি তাদেরকে কিছু আর্টিলারী ফায়ার-এর সাপোর্ট দিতে বলি তাদের সীমানা থেকে। সীমান্ত নিকটে থাকায় এটা সম্ভব ছিল। কিন্তু তিনি জানালেন যে; এটা তাদের দ্বারা সম্ভব নয়; তবে তিনি কতৃপক্ষকে বলবেন তবে যদি কোন রাইফেল এলএমজি চান দিতে পারি। কিন্তু আমি তাঁকে বললাম যে; এখন আমার কাছে ১২টা ৩ ইঞ্চি মর্টার; একশোর উপর এলএমজি-এমজি এবং প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ আছে। তাই আমার এগুলো দরকার নেই। বিমান হামলা মোকাবেলা করার জন্য ভারতীয় সীমান্ত থেকে কিছু বিমান বিধ্বংসী কামান দিয়ে সাহায্য করতে অনুরোধ করলাম। আমি তাকে আরো বললাম যে ৬ই এপ্রিল আমি রাজশাহী আক্রমণ করব বলে স্থির করেছি, সে দিন যেন আমাকে আর্টিলারী ফায়ার সাপোর্ট দেয়া হয়।

রাজশাহী যুদ্ধঃ আমার পরিকল্পনা ছিল শহরে দক্ষিণ দিক থেকে আক্রমণ চালানো এক ব্যাটালিয়ন নিয়ে। আর কিছু লোক উত্তর পশ্চিম দিকে শত্রুকে ধোঁকা দেয়ার জন্য কিছু গোলাগুলি করবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী সন্ধ্যার পূর্বক্ষণে ব্যাটালিয়নকে দক্ষিণ দিকে মুভ করিয়ে আনি এবং আক্রমণের প্রস্তুতি নিই; এদিকে জানতে পারলাম বন্ধুরাষ্ট্র থেকে সাহায্য পাবার কোন সম্ভাবনা নেই এবং তা কখনো আসেনি।

আক্রমণ শুরু হয় ৬ই এপ্রিল সন্ধ্যা ৬টা-৭টার দিকে। শত্রুবাহিনী আমাদের উপর প্রবল গোলাবর্ষণ এবং স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের সাহায্যে গুলি বর্ষণ করতে শুরু করে। অদম্য সাহস মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সম্মুখে ঠেলে নিয়ে যায় এবং শত্রুদের ব্যূহ ভেদ করে তারা শহরের মধ্যে ঢুকে পড়ে। প্রায় যার ঘণ্টা লড়াইয়ের পর রাজশাহী শত্রুমুক্ত হয় এবং মুক্তিযোদ্ধারা রাজশাহীর চতুর্দিকে তাদের প্রতিরক্ষা ব্যূহ তৈরি করে ফেলে। পশ্চিম বাহিনীর বেশ কিছুসংখ্যক লোক নিহত হয়। আমাদের পক্ষে ৩০/৩৫ জন হতাহত হয়। রাজশাহী পুলিশ লাইন প্রভৃতি জায়গা থেকে বিপুল অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করি। রাজশাহী পুলিশ লাইনের অস্ত্রাগার থেকে প্রায় তিন হাজার অস্ত্র, তিন লাখ গুলি উদ্ধার করা হয়। বাকি শত্রুবাহিনী তাদের ছাউনি পশ্চাদপসরণ করে এবং সেখানে একত্রিত হয়ে আরো শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যূহ তৈরি করে। ছাউনির চারিদিকে মাইন পুঁতে রাখে এবং কাঁটা তারের বেড়া দিতে শুরু করে। শহরের লোকের মধ্যে উল্লাস সৃষ্টি হয়। এবং আমাদের পূর্ববতী কর্মসুচী ঐ ছাউনি দখল করার কাজে নিযুক্ত হয়। এদিকে শত্রুবাহিনী বিমান হামলা আমাদের উপর অব্যাহত রাখে।

৭ই এপ্রিল থেকে ১০ই এপ্রিল পর্যন্ত আমরা শত্রুবাহীর অতি নিকটে চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলি এবং ছাউনির ৩০০/৪০০ গজের মধ্যে পৌছে যাই। কিন্তু শত্রুবাহিনীর মাইন এবং কাঁটা তারের বেড়া ডিংগিয়ে ভিতরে গিয়ে আক্রমণ চালানো বেশ কষ্টকর হয়ে পড়ে। শত্রুবাহিনী সমস্ত স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রশত্র; ট্যাঙ্কবিধ্বংসী কামান; তিন ইঞ্চি মর্টার ইত্যাদি বাইরের দিকে মুখ করে বসিয়ে রাখে। সেই সময় আমরা জানতে পারি সেখানে শত্রুবাহিনীর ২৫০ থেকে ৩০০ সৈন্য আছে। বাকি নিহত; আহত অথবা নিখোঁজ। আরো জানতে পারি যে তাদের ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেঃ কর্নেল শওকত; বেলুচ; সিতারা-ই-জুরাত যিনি ৭ই এপ্রিল আমাদের সাথে যুদ্ধে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন; এবং তাকে হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। প্রচণ্ড আক্রমনের সম্মুখে শত্রুবাহিনীর মনোবল সম্পূর্ণভাবে ভেংগে যায়। শত্রুবাহিনী সে এলাকায় সমস্ত বিহারীকে বিপুল অস্ত্রশস্ত্র বিতরণ করে এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রতিরক্ষা ব্যূহ তৈরি করে তাদেরকে সাহায্য করতে নির্দেশ দেয়।

এদিকে আমরা ছাউনি দখল করার শেষ প্রচেষ্টায় নিজেদের নিয়োজিত করি। তখন খবর পাওয়া গেল যে; পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দুই ডিভিশন সৈন্য নগরবাড়ী ঘাটে অবতরণ করার চেষ্টা করছে হেলিকপ্টার; স্টীমার ফেরীর মাধ্যমে। অতর্কিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রিইনফোর্সমেন্ট-এর কথা শুনে সকলের মনোবল ভাঙ্গতে শুরু্ করে। কিন্তু সকলকে আশ্বাস দিয়ে আমি বলি যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে মোকাবিলা করার জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। তারা যেন তাদের কাজ চালিয়ে যায়।

আমি দুটো কোম্পানি সেখান থেকে উঠিয়ে নগরবাড়ীর দিকে অগ্রসর হতে নির্দেশ দিই। ১১ই এপ্রিল বিকেল বেলায় আমাদের বাহিনী যখন পাবনার অনতিদূরে পৌছে তখন পাবনা শহরের উপর শত্রুবাহিনীর মর্টার এবং আর্টিলারী ফায়ার হচ্ছিল। তখন ঐ দুই কোম্পানি মুলাহলী নামক স্থানে তাদের প্রতিরক্ষা ব্যূহ তৈরি করে কিন্তু তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। তারা শত্রুবাহিনীর জংগী বিমানের হামলা এবং আর্টিলারীর স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রশস্ত্র ও অসংখ্য সশস্ত্র সৈন্যদের বিরুদ্ধে কিছুক্ষণ লড়াইয়ের পর টিকতে না পেরে পশ্চাদপসরণ করে।

এদিকে আমি ১২ই এপ্রিল সকাল বেলায় আমার সেনাবাহিনীর মনোবল অটুট রাখার জন্য নিজে এক কোম্পানি সৈন্য নিয়ে পাবনার দিকে অগ্রসর হই এবং বাকি সংগ্রামী সৈনিকদের ছাউনির উপর তাদের চাপ অব্যাহত রাখার নির্দেশ দিই। ১০মাইল পথ অতিক্রম করার পর আমি খবর পেলাম যে শত্রুবাহিনী অতি নিকটে পৌছে গেছে এবং আসার পথে দু পাশে বাড়িঘর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে অগ্রসর হচ্ছে এবং আমি নিজেও তাঁর ধোয়া দেখতে পেলাম। এমতাবস্থায় আমি সারদা এবং রাজশাহী যাওার মোড়ে আমার শেষ প্রতিরক্ষা ব্যূহ তৈরি করি।

১২ই এপ্রিল সন্ধ্যার দিকে আমাদের প্রতিরক্ষার এক হাজার গজ দূরে রাস্তা কেটে দেয়া হল এবং বড় গাছে কেটে ব্যারিকেডের মধ্যে বুবিট্র্যাপস ও কিছু মাইন দু পাশে পুঁতে রাখলাম। ১২ই এপ্রিল সন্ধ্যা নাগাদ পাকিস্তান সেখানে পৌছাল এবং ব্যারিকেড সরাতে চেষ্টা করল। বুবিট্র্যাপ ফেটে বেশ কয়েকজন সৈন্য হতাহত হয়। আমাদের ৩ ইঞ্চি মর্টার থেকে অগ্রসরমান শত্রুবাহিনীর উপর গুলিবর্ষণ করা হল। সারা রাত দু’পক্ষের তুমুল লড়াই চলে এবং সারদার কাছে সারদা ক্যাডেট কলেজের অধ্যাপক এ;বি;সিদ্দিকী যাকে আমি বীর বিক্রম (মৃত্যুর পর) উপাধিতে ভূষিত করা হয়।

এরপর ১৩ই এপ্রিল ভোরের দিকে পাক সেনাবাহিনী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পৌছে যায় এবং অবস্থান করতে থাকে। আমার সৈন্যরা তখনও মনোবল অটুট এবং শহরের চারিদিকে প্রতিরক্ষা ব্যূহ অব্যাহত রাখে। ছাউনি দখল করার জন্য তখনও তাদের  চাপ অব্যাহত থাকে।

১৩/১৪ এপ্রিল রাত দুটোর দিকে বৃষ্টির মত গুলিবর্ষণ শুরু হয় এবং শত্রুর গোলন্দাজ বাহিনী বিপুলভাবে গোলাবর্ষণ শুরু করে। যতোই ভোর হতে থাকে আমার লোকদের সাথে আমার অয়ারলেস এবং টেলিফোন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হতে থাকে। ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এক ব্রিগেড সৈন্য আমার সৈন্যদের ওপর ঝাপিয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে আমার সৈন্যদের অপসারিত করা হয় এবং তারা নওয়াবগঞ্জের দিকে সরে আসে।

নওয়াবগঞ্জের প্রতিরোধঃ বেলা প্রায় দুই ঘটিকার সময় আমি আমার এক হাজার সেনাবাহিনীর মধ্যে মাত্র ৩ শতকে খুঁজে পাই এবং তাদের নিয়ে রাজশাহী এবং নওয়াবগঞ্জের মাঝখানে গোদাগাড়ী নামক স্থানে আমার প্রতিরক্ষা ব্যূহ পুনরায় তৈরি করি। এটা রাজশাহী থেকে ১৮ মাইল এবং নওয়াবগঞ্জ থেকে ১১ মাইল দূরে ছিল। রাজশাহীর যুদ্ধে আমার ৩৫/৪০ জন নিহত হয়। এতে আমাদের সৈন্যদের মনোবল একেবারে ভেংগে পড়ে।

আমার সাথে নুরুল ইসলাম নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিল। ১৫ই এপ্রিল সে ভারতে চলে যায় এবং ১৬ তারিখ সে আমাকে এসে খবর দেয় যে মুর্শিদাবাদ জেলার জেলা প্রশাসক এবং বিএসএফ-এর কমান্ডার আমার সাথে জরুরী কাজে দেখা করতে চান এবং তিনি আমাকে সাহায্য দিতে প্রস্তুত আছেন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও নুরুল ইসলাম নামের সেই ছাত্রটির সাথে ১৬ই এপ্রিল মু্র্শিদাবাদে ওদের সাথে দেখা করতে গেলাম। কিন্তু এতে কোন ফলই হল না। কোন সাহায্যই পাওয়া গেল না। নিরাশ হয়ে ফিরে আসলাম।

১৭ই এপ্রিল সকালের দিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আমাদের অবস্থানের উপর এবং নও্যাবগঞ্জ শহরের উপর হামলা চালাল। জংগী বিমানের সাহায্যে রকেট এবং মেশিনগানের প্রচণ্ড হামলা চালায়; কিন্তু আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যূহ ভেংগে নওয়াবগঞ্জ পৌছতে তখনও সক্ষম হয়নি।

২১শে এপ্রিল খুব ভোরের দিকে প্রচণ্ড গুলিবর্ষণ শুরু হল আমাদের অবস্থানের উপর এবং শত্রুবাহিনী আক্রমণ চালাল। আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যূহ শত্রুবাহিনী ভেদ করতে সক্ষম হল বেলা দশটার দিকে। প্রতিরক্ষা ব্যূহের নিকতেই ছিল পদ্মা নদী। সেখানে আমার সাবেক ইপিআর-এর দু খানা স্পীড বোট ছিল; যাতে করে আমি লড়াই চলাকালে সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র; গোলাবারুদ নদী পার করে বাংলাদেশের ভেতরেই চর এলাকায় পৌছে দিয়েছিলাম। শত্রুবাহিনী ত্বরিত গতিতে নওয়াবগঞ্জসহ প্রায় সমস্ত এলাকায়; নওয়াবগঞ্জের চর এলাকা ছাড়া শত্রুকবলিত হয়। সেখানেই আমার সংগ্রামের প্রথম পর্যায়ের সমাপ্তি।

ক্ষোভে; দুঃখে এবং হতাশায় আমি যখন নিমজ্জিত তখন বিএসএফ-এর কয়েকজন লোক আমাকে খবর দিল যে; আমাকে মেজর দারাস বলে একজন অফিসার আমার সাথে দেখা করতে চান। অগত্যা তার সাথে দেখা করতে গেলাম। সে আমাকে বললো; আমি যেন আমার সমস্ত জিনিস এবং অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদসহ লালগোলায় (মুর্শিদাবাদ) পৌছে যাই। ২২শে এপ্রিল আমি আমার তিন হাজারের উপর রাইফেল; স্টেনগান; এল-এম-জি এবং গোলাবারুদ নিয়ে লালগোলায় পোঁছালাম। পৌঁছুতে না পৌঁছুতে বিএসএফ-এর দুখানা ট্রাক এসে আমাদের সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র এবং গোলাবারুদ নিয়ে মুর্শিদাবাদ চলে গেল। তবে সামান্য কিছু রাইফেল আমাদের কাছে রেখে গেল।

এদিকে আমাকে খবর দেয়া হল যে কর্নেল ওসমানী আমাদের সাথে বালুর ঘাটে (দিনাজপুর) ২৩শে এপ্রিল দেখা করতে চান। তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী আমরা সেখানে পৌছলাম এবং এই প্রথম এম-সি এর সাথে দেখা হয়। কর্নেল ওসমানী সেদিন আমাকে সে এলাকার অধিনায়ক নিযুক্ত করেন এবং বলেন যে বিএসএফ আমাদের অস্ত্রশস্ত্র এবং গোলাবারুদ খাদ্য প্রভৃতি দিয়ে সাহায্য করবে।

রাজশাহীতে সৈন্যদের পুনঃসংগঠন

(অনুবাদ)

[ব্রিগেডিয়ার জেনারেল গিয়াস উদ্দিন চৌধুরীর দিনলিপি থেকে, বিবি, পিএসসি (অবঃ),

তারপর মেজর গিয়াস; কমান্ডার অফ রাজশাহী সাব-সেক্টর-২০-৯-১৯৮৩]

১৩ এবং ১৪ তারিখ রাজশাহী শহরে পাক আর্মির সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষের পর আমি আমার ট্রুপস নওয়াবগঞ্জের দিকে সরিয়ে নিয়ে আসি এবং গোদাগাড়ী এলাকাতে শক্ত ডিফেন্স গড়ে তুলি। ঐ সময়ে আমার সাথে ছিল ৬ ব্যাটেলিয়ন ইপিআর এবং ৭ ব্যাটেলিয়ন যারা নওগাঁ থেকে এসেছিল এবং কিছু যারা চারঘাট থেকে আমাকে অনুসরণ করেছিল। এর সাথে প্রায় ২০০ স্বেচ্ছাসেবী মুক্তিযোদ্ধা ট্রুপসের সাথে ছিলেন, বাকীরা রাজশাহীর প্রাথমিক যুদ্ধে পরাজয়ের পর চলে যান। পাক আর্মি ১৭ এপ্রিল নওয়াব গঞ্জে অবস্থান সংহত করার পর আমাদের কাছ থেকে রাজশাহী পুনর্দখল করে। পথে পাক আর্মি ছোট ছোট বাঁধার সম্মুখীন হয় এবং ২০/২১ তারিখ রাতে রাজশাহী ফিরে যায়; পাক আর্মি প্রাণপণ চেষ্টা করে এবং রাতে নিজেদের সৈন্য গোদাগাড়ীর কাছাকাছি নিয়ে আসে। ভোরে তারা আক্রমণ করে। আমি তাদের কাছে এটাই আশা করেছিলাম।  ২০ এপ্রিল আমি ৩০০ থ্রি নট থ্রি রাইফেল, ৯৬ বেরেটা গান এবং ৩ লাখ বিস্ফোরক নিয়ে পদ্মা নদী পাড়ি দিয়ে গোদাগাড়ীর বিপরীতে নিয়ে যাই, যখন রাজশাহী আমাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল তখন এগুলো আমি রাজশাহী অস্ত্রাগার থেকে সংগ্রহ করি। আমি আরো পার করি ৪৮টি এলেমজি, ৪ টি ভিকার মেশিনগান, ৬টি ৩ইঞ্চি মর্টার; এগুলো ৬নম্বর উইঙের জন্য উদ্ধৃত্ত হয়েছিল কারণ তারা তখন ৮১ এমএম মর্টার এবং নতুন মেশিনগান (লেটেস্ট অ্যামেরিকান ভারশন) এবং ১৪০০ রাউণ্ড মর্টার শেল ব্যাবহার করছিল। এছাড়াও আমার কাছে আরও নানা রকম বিস্ফোরক এবং অস্ত্রপাতি ছিল যেগুলো আমি মূলত ইপিআর সেক্টর থেকে সংগ্রহ করি। দখলদার বাহিনীর সাথে যুদ্ধে পরাজয়ের আগ পর্যন্ত ৬ নম্বর উইঙের হেড কোয়াটার ছিল নওয়াবগঞ্জ যেটা ২১ এপ্রিল পর্যন্ত স্বাধীন ছিল এবং আমাদের শক্ত ঘাঁটি ছিল।

ডিফেন্সে থাকা যোদ্ধাদের কাছে ছিল ৬০টি এলএমজি; ৬ টি ৮১ এমএম মর্টার, ১০ টি২ ইঞ্চি মর্টার, ৬ টি লিরাট (ব্রিটিশ রকেট লাঞ্চারের পুরাতন ভার্শন) এবং ব্যাক্তিগত অস্ত্র, গোলাবারুদ এবং গ্রেনেড ছিল প্রতি যোদ্ধার সাথে। পাক আর্মি সবসময় রীতিবিরুদ্ধ সবচেয়ে নৃশংস আক্রমণের কৌশল ব্যাবহার করতো সকল অবকাঠামো এবং গ্রামের কুঁড়েঘরে তাদের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রশস্ত্র ফায়ার করার মাধ্যমে; এবং অগ্নি-বর্ষক দিয়ে পুরো এলাকা পুড়িয়ে ছাই করে দিত যেন মুক্তি বাহিনী আশ্রয় নিতে না পারে এবং আক্রমণের কোন সুযোগ না পায়। তিন সপ্তাহের মধ্যে মুক্তিবাহিনী যথেষ্ট রিসোর্স যোগাড় করে এবং গোদাগাড়ীতে পাকিস্তানী নৃশংস দখলদার বাহিনীকে কঠিন লড়াইয়ের মুখোমুখি করে। ইপিআরের কিছু স্পিড বোটের সাহায্যে আমি পর্যায়ক্রমে আমার ট্রুপস পদ্মা নদী পার করে পরিকল্পিত ভাবে নিয়ে যেতে থাকি। ২১ এপ্রিল সন্ধ্যার ভিতর আমরা সমস্ত অস্ত্রপাতি এবং যন্ত্রপাতি সহ পদ্মার অপর পাড়ে নিরাপদে প্রত্যাহার করে নেই। এটি ছিল গোদাগাড়ি পুলিশ ষ্টেশনের ঠিক বিপরীতে। আমাদের মাত্র ৭ জন্য সামান্য আহত হয়। কিন্তু লোকাল মানুষের হতাহতের সংখ্যা ছিল খুব বেশী। আমি ২৪/২৫ জন আহত লোককে ফেরী পার হতে দেখি এবং ২/৩ টি মৃতদেহ মার্কেট এরিয়াতে বিচ্ছিন্ন ভাবে পড়ে ছিল। আমরা পর্যাপ্ত পরিমাণে চাল ও ডাল পার করি যা গোদাগাড়ী এলএসডি গোডাউনে ছিল। ১৭ থেকে ২১ এপ্রিল আক্রমণের সময় দখলদার বাহিনী আমাদের ডিফেন্সে প্রতিদিন গড়ে ৩টি করে এফ-৮৬ বিমান আক্রম চালায়। তারা বেশীরভাগ সময় এমজি এবং রকেট ব্যবহার করে আমাদের সৈন্যদের বিরুদ্ধে, এছাড়া বেসামরিক লোকজনসহ এবং নিরাপরাধ মানুষদের হত্যা করে।

—————————————————

সারদা ও অন্যান্য স্থানের সশস্ত্র প্রতিরোধ
সাক্ষাৎকার- সুবেদার আলী মোহাম্মদ মকিবর রহমান সরকার
০৬-০৬-১৯৭৩

২৫ মার্চের ঘটনায় আমরা বিস্মিত হয়ে পড়ি এবং পশ্চিমা শোষণ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য অস্ত্র দিয়ে অস্ত্রের জবাব দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হই।

সারদায় অস্ত্র সংগ্রহঃ সারদা পুলিশ একাডেমির ভাইস প্রিন্সিপাল মিঃ বড়ুয়াকে সভাপতি এবং আওয়ামী লীগের আজিজুর রহমানকে সম্পাদক করে এবং আমি স্থানীয় মুক্তিবাহিনীর প্রধান হিসেবে একটি মুক্তি সংগ্রাম পরিষদ গঠন করি। সেই মুহুর্তে আমাদের সঙ্গে পুলিশের কিছু অংশ ইপিআর, আনসার, মুজাহিদ, ছাত্র, অধ্যাপক মিলে বিরাট এক মুক্তিবাহিনী গঠন করা হয়। সারদা ক্যাডেট কলেজ থেকে ৩০৩ মার্কা রাইফেল এবং পুলিশ একাডেমি থেকে ৬০০/৭০০ রাইফেল ও গোলাবারুদ সংগ্রহ করি। এবং সারদা ও রাজশাহী রোডে বাংকার করে পজিশন নিয়ে থাকি।

রাজশাহীতে ইতিমধ্যে পাক সেনারা অবস্থান করছিলো। আমরা একটি কোম্পানী নিয়ে রাজশাহী অভিমুখে যাত্রা করি। কিছুদূর যাওয়ার পর আমরা শুনতে পাই যে, নাটোর হয়ে আরেকটি ব্যাটালিয়ান ঢাকা-পাবনা-নগরবাড়ীর পথে রাজশাহীর দিকে আসছে। ক্যাপ্টেন রশিদের নেতৃত্বে ১০০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে প্রতিরোধের জন্য পাঠানো হয়।

আমরা প্রথমে পাবনার মুলাডুলিতে পাকসেনাদের সম্মুখীন হই। সংঘর্ষে পাকসেনাদের বিপুল ভারী অস্ত্রের সামনে টিকতে না পেরে পিছু হটি। রাজশাহীতে অপর যে দলটি ছিলো তাদের সঙ্গে পাক সেনাদের নিয়মিত যুদ্ধ হচ্ছিল। সংঘর্ষে সমস্ত পাকসেনা খতম হয়।

১২ এপ্রিল রাজশাহী সম্পূর্ণ মুক্ত হয়। অপর দল যেটা মুলাডুলিতে পিছু হটেছিলোসেই দলটি নাটোরে গিয়ে পুনরায় পজিশন নেয়। সেখানেও ব্যাপক শেলিং-এর সামনে টিকতে না পেরে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে আমরা পিছু হটি। সেখান থেকে আমরা বানেশ্বরে(রাজশাহী) ডিফেন্স নেই। পাক আর্মীর একটি ব্যাটালিয়ান ৭৫ মিলিমিটার কামান এবং অন্যান্য ভারী অস্ত্র নিয়ে আমাদের উপর আক্রমণ করে।

ইতিমধ্যে আমরা খবর পেলাম আড়ানীতে ২০/২৫ জন পাক সেনা গ্রামে ঢুকে নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করছে এবং ঘরবাড়ী জ্বালিয়ে দিচ্ছে। খবর পেয়ে আমি একটা ছোট সেকশন নিয়ে গ্রাম অভিমুখে রওয়ানা হই। গ্রামে গিয়ে শোনলাম নদীর অপর পাড়ে পাক সেনারা পজিশন নিয়ে আছে। আমরা ফায়ারিং শুরু করি। বহুক্ষণ ফায়ারিংয়ের পর অপর পক্ষ থেকে কোনো জবাব না আসায় বিস্মিত হই। পরে সেখানে গিয়ে দেখলাম তারা ‘ক্যামোফ্লেজ’ করে পালিয়েছে। পাক সেনারা কলাগাছ কেটে তাতে খাকী কাপড় পড়িয়ে এবং কাঠের তৈরী রাইফেল হাতে দিয়ে নদীর পাড়ে আমাদের দিকে মুখ করে রেখে দিয়েছে। আমরা ভাবছিলাম পাক সেনারাই অস্ত্র নিয়ে পজিশনে আছে।

আড়ানী ব্রিজে প্রতিরোধঃ আমরা হতাশ হয়ে নিজেদের মধ্যে কিছু আলোচনা করে আড়ানী ব্রিজের নিচে এ্যামবুশ করতে থাকি। রাত্রি ৪টার দিকে বুঝতে পারলাম ব্রিজের উপর দিয়ে কিছু লোক যাচ্ছে। হল্ট বলার সঙ্গে সঙ্গে তারা ফায়ারিং শুরু করে। আমরা পাল্টা জবাব দেই। কিছুক্ষণ উভয় পক্ষে সংঘর্ষ হয়। ৫/৭ মিনিট পর ব্রিজের উপরে পাক সেনারা সম্পূর্ণ স্তব্ধ হয়ে যায়। আমরা সেখানে ৪টি পাক সেনার লাশ উদ্ধার করি। বাক দুই চারজন পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।

বানেশ্বরেরযুদ্ধ ও সারদায় গণহত্যাঃ আমরা সবাই রওয়ানা হয়ে ১৩ই এপ্রিল তারিখে বানেশ্বরের অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দেই। বানেশ্বরে পাক সেনাদের সঙ্গে তুমুল যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে আমাদের মুক্তি সেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। অনেক মুক্তিসেনা শাহাদাত বরণ করে। বানেশ্বর এবং সেই সাথে সারদার পতন হয়। সারদায় পাক আর্মী চলে আসায় বেসামরিক লোক ও সামরিক বাহিনীর প্রায় ১৫০০/২০০০ লোক নদীর ধারে আশ্রয় নিয়েছিলো। পাক সেনারা তাদের ঘিরে ফেলে এবং ৭০০/৮০০ লোককে নৃশংসভাবে গুলি করে পেট্রোল দিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করে। ওই দলের মধ্যে আমরা মাত্র তিন চারজন বেঁচে ছিলাম। পাক সেনাবাহিনী সন্ধ্যার দিকে রওয়ানা হয় এবং রাজশাহী দখল করে নেয়।

————————————————-

সশস্ত্র প্রতিরোধরাজশাহীবগুড়াপাবনা

সাক্ষাৎকারঃ সুবেদার খোন্দকার মতিউর রহমান বীর বিক্রম
২৪-১২-১৯৭৩

২৫শে মার্চ সন্ধ্যায় উইং কমান্ডার অভ্যান্তরীন নিরাপত্তা ডিউটির জন্য তিনটি প্লাটুন তৈরি করে রাখার নির্দেশ দেন। রাত আট ঘটিকার সময় উইং হাবিলদার মেজর সৈয়দুর রহমান (পাঠান) কে পুরো উইং কে ফল ইন করার নির্দেশ দেওয়া হয়। তখন তিনটি প্লাটুন অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তৈরি থাকে।

২৬ শে মার্চ সকাল বেলায় কোয়ার্টার গার্ড কমান্ডার মুজিবুর রহমান বাংলাদেশে পতাকা কোয়ার্টার গার্ডে গার্ড অব অনার দিয়ে উত্তোলন করে। ২৬শে মার্চ সকাল ৭ ঘটিকার সময় মেজর নাজমুল হক; ক্যাপ্টেন গিয়াস; মেজর আকরাম ও ক্যাপ্টেন নাবিদ আফজাল উইং এ আসেন এবং সুবেদার মেজর আবদুল লতিফ মোল্লাকে পুরো উইংফল- ইন করার নির্দেশ দেন। ফল ইন করা হয়। মেজর নাজমুল হক বললেন যে, যা করার আমি সব করব।

২৬শে সকাল ৮/৯ টার সময় ১০০ থেকে ১৫০ জন লোক মাইক নিয়ে আমাদের অফিসের সম্মুখে এসে ৭ই মার্চে শেখ সাহেবের টেপ রেকর্ডকৃত ভাষণ বাজাতে শুরু করে এবং শ্লোগান দিতে থাকে। মেজর নাজমুল হক অফিসের সম্মুখে হৈ চৈ গণ্ডগোল না করার জন্য জনতাকে নির্দেশ দেন। আনুমানিক১০/১১ টার সময় কোয়ার্টার গার্ডের সেন্ট্রির উপর হঠাৎ একটি গুলি আসে। এটা শোনার পর চতুর্দিক থেকে ফাঁকা আওয়াজ শুরু হয়। ১০ মিনিট গোলাগুলি চলে। উল্লেখ্য যে ২৫ মার্চ রাতে আমরা তিনটি বাঙালি প্লাটুনকে অস্ত্রশস্ত্র সজ্জিত করে রাখি (ক্যাপ্টেন গিয়াসের গোপন নির্দেশে) মারাত্নক পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে আশংকায়। ক্যাপ্টেন গিয়াস আমাকে এবং সুবেদার মনোয়ার আলীকে অফিসে ডেকে গোপনে বলেন যে; বাঁচার জন্য আপনারা তৈরি থাকেন ঢাকার অবস্থা খুবই খারাপ। এই কথা বলে তিনি ভেংগে পরছিলেন। গোলাগুলির পর মেজর আকরাম বেগ মেজর নাজমুল হককে অনুরোধ করেন যে সমস্ত পাকিস্তানী ইপিআরকে যেন একটি ব্যারাকে হেফাজত রাখেন। তখন সমস্ত পশ্চিম পাকিস্তানী ইপিআরকে একটি ব্যারাকে প্রহরী মোতায়ন করে রাখা হয়। তাদেরকে ব্যারাক থেকে বের হয়ে না আসতে নির্দেশ দেয়া হয়। পশ্চিম পাকিস্তানী ইপিআরদের পরিবারবর্গকে জেসিও মেসে রাখা হয় এবং বাংগালি ইপিআর তাদের পাহারা দেয়। মেজর নাজমুল হকের নির্দেশে তাদের অস্ত্রশস্ত্র অফিসে জমা করানো হয়। অফিসের চতুপার্শ্বে বাংগালি ইপিআর প্রহরী লাগানো হয়। বেলা বারটা- ১টার সময় বিপুল জনতা অফিসের সামনে হাজির হয়। তাঁরা ক্যাপ্টেন গিয়াস্ কে বলে যে; শান্তাহারে বিহারী অস্ত্র নিয়ে বোয়ালিয়া গ্রামের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। আপনারা এগিয়ে আসুন।

২৭শে মার্চে মেজর নাজমুল হকের নির্দেশে তিনটি প্লাটুন তিনটি অয়ারলেস সেট সহ শান্তাহার অভিমুখে আমার নেতৃত্বে রওনা হয়। শান্তাহারে চারিদিকে শুধু ধোয়া আর আগুন; গোলাগুলির আওয়াজ। আমি অয়ারলেসে নওগাঁতে মেজর নাজমুল হকের সাথে যোগাযোগ করি; বাঙালি বিহারী বহু মৃতদেহ উদ্ধার করি এবং পরিস্থিতি আমাদের আয়ত্তে নিয়ে আসি। মেজর নাজমুল হক ১৪৪ ধারা জারি করেন। সীমান্তের বিওপি গুলোতে পশ্চিম পাকিস্তানীদের বন্দী করে রাখা হয়েছিল।

৩০ শে মার্চ ক্যাপ্টেন গিয়াস ; হাবিলদার আলী আকবর (বর্তমানে নায়েক সুবেদার); এবং আমি বগুড়া অভিমুখে রওনা হই। বগুড়ার রেলওয়ের ষ্টেশন মাস্টারকে নওগাঁতে টেলিফোন এর মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষা করতে অনুরোধ করি। এরপর আমরা বগুড়া পুলিশ লাইনে যাই। হাবিলদার আলী আকবরকে পুলিশ লাইনে রাখা হয় ও তার সাথে ২৫ জন ইপিআর দেওয়া হয়। হাবিলদার আলী আকবরকে পুরোপুরি কমাণ্ড দেওয়া হয়। আমি ক্যাপ্টেন গিয়াস সহ নওগাঁতে ফিরে আসি।

৩০শে মার্চ আমি এক প্লাটুনসহ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বগুড়া রেলওয়ে ষ্টেশনে পৌছাই। হাবিলদার আলী আকবর ২৫ জন ইপিআর; কিছু পুলিশ; ছাত্র সহ মুজিবর রহমান মহিলা মহাবিদ্যালয়ে পশ্চিম পাকিস্তানীদের উপর আক্রমন চালায়। মহিলা মহাবিদ্যালয়ে ওদের ক্যাম্প ছিল। এক রেজিমেন্ট ও আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে ওরা সজ্জিত ছিল। রাত চার ঘটিকার সময় পশ্চিম পাকিস্তানীদের সৈন্যরা পার্শ্ববর্তী অয়ারলেস ষ্টেশন ও এতিমখানার পার্শে পেট্রল ডাম্পে আগুন ধরিয়ে পালিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের অতর্কিত আক্রমণে তারা ৩০/৩২ টা গাড়ী নিয়ে রংপুরের দিকে পালিয়ে যায়।

১ লা এপ্রিল বেলা ৯ টার সময় হাবিলদার আলী আকবর আড়িয়াল বাজারে এমুনিশন ডিপোর উপর আক্রমণ চালায় এবং ক্যাপ্টেন নুর আহম্মদ সহ ২৩ জন পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য ও তাদের পরিবারবর্গকে জীবিত অবস্থায় ধরে ফেলে। তাদের পরিবারবর্গকে সে নিজের হেফাজতে রেখে হাজতে নিয়ে আসে। এই আক্রমণে তিনজন পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয়। ঐখানে ৩য় বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন নায়েক সুবেদার আবুল কাশেমসহ এক প্লাটুন বাঙালি সৈন্য ছিল। তাদেরকে পরে ডেকে আনা হয়।

ঐ অ্যামুনিশন ডিপোতে ৯২ কোটি টাকার অস্ত্র শস্ত্র ছিল। ৮০ ট্রাক অস্ত্রশস্ত্র; গোলাবারুদ বগুড়াতে নিয়ে আসা হয়। এবং পুলিশের হেফাজতে দেওয়া হয়। মেজর নাজমুল হক উক্ত সংবাদ পেয়ে বগুড়াতে আসেন এবং হাবিলদার আলী আকবরকে এই দুঃসাহসিক অভিযানের সাফল্যের জন্য অভিনন্দন জানান। তিনি আমাকে বলেন যে এত অল্প লোক নিয়ে এত বড় একটা আক্রমণ চালানো কখনো সম্ভব ছিল না।

বগুড়া জেলা স্কুলে আমরা ক্যাম্প স্থাপন করি মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষন দেয়ার জন্য। হাবিলদার আলী আকবর ছেলেদেরকে দিবারাত্র প্রশিক্ষণ দিতে থাকেন। ইতিমধ্যে সকল এমসিএ; ডিসে এবং সংগ্রাম পরিষদের কর্মীগণ আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসেন। এদের মধ্যে ছিলেন পুলিশের আর-আই হাতেম আলী; তার অধঃস্থন কর্মচারীবৃন্দ ; এমসিএ ডাক্তার জাহিদুর রহমান; ডাক্তার গোলাম সরওয়ার ; এডভোকেট গাজিউল হক; এমসিএ মুজিবুর রহমান আক্কেলপুরী প্রমুখ। ছাত্র নেতৃবৃন্দ ও রাজনৈতিক দলের কর্মীগণ এ কাজে সহযোগিতা করেন।

ইতিমধ্যে মেজর নাজমুল হক কিছু লোক বাঘাবাড়ি ঘাটে পাঠাবার নির্দেশ দেন। কিছু লোক সিরাজগঞ্জে এবং কিছু লোক মহাস্থানে পাঠানো হয়। ইতিমধ্যে শুনতে পেলাম দিনাজপুরের ঘোরাঘাট থেকে ৩য় বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন আনোয়ার; ক্যাপ্টেন শওকতের চিঠি এবং একজন এমসিএ সহ হাবিলদার ও দুইজন নায়েক একটা জীপে এমুনিশন নেয়ার জন্য বগুড়াতে এসেছেন। এমসিএ গনের পরামর্শ ও মেজর নাজমুল হকের আদেশক্রমে তাদেরকে ট্রাক ও জীপে আর্মস ও গোলাবারুদ দেয়া হয়। পরে সুবেদার প্রধান পুনরায় অস্ত্র নিতে আসে। ৮ ট্রাক অস্ত্র ও দুটি ৩ ইঞ্চি মর্টার তাদেরকে দেওয়া হয়।

হাবিলদার আলী আকবরকে মহাস্থানে পাঠানো হয়। পরের দিন তাকে আবার ডেকে পাঠানো হয়। আলী আকবরকে হেডকোয়ার্টারে (বগুড়া) রেখে আমি বাঘাবাড়ি ঘাটে ডিফেন্সে যাই। এবং সিরাজগঞ্জের এসডিও জনাব সামসুদ্দিন; শাহজাদপুরের এমসিএ আব্দুর রহমান ; শাজাদপুরের প্রিন্সিপাল তাসাদ্দক হোসেন এবং আরো অন্যদের সহিত আমার নিজজ্ঞানে পরামর্শ করে আলী আকবরকে আনার জন্য বগুড়া পাঠাই। দুদিন পর আলী আকবর বগুড়া হতে এসে আমার সাথে বেড়াতে যোগদান করে। পাইকড়হাটে প্রতিরক্ষা ব্যূহ তৈরী করা হয়। পরের দিন তাকে পাকবাহিনী আক্রমণ করার জন্য সাথিয়া থানায় (পাবনা) পাঠাই। ইতিমধ্যে পাকবাহিনী নগরবাড়ি থেকে (১০ই এপ্রিল) পাবনা অভিমুখে যাত্রা করে। পরদিন আলী আকবর ফেরত এসে বলল যে গতকাল (১৩ এপ্রিল) পাক সেনাবাহিনী পাবনায় প্রবেশ করেছে এবং লোকমুখে জানা গেছে তাদের এক ডিভিশন সৈন্য এডভান্স করেছে। ১৩ই এপ্রিল পাবনার ডিসি; এসপি নদী পার হয়ে কুষ্টিয়ার দিকে চলে গেছেন। পাবনা পুলিশের অস্ত্রশস্ত্র ও এমুনিশন আর-আইয়ের নিকট থেকে টিপু বিশ্বাস নিয়ে গেছে। তখন আলী আকবরকে পুনরায় নাকালীয়া বাজারে পাঠাই। নাকালীয়াতে চেয়ারম্যান (নক্সালপন্থী) তাকে সেখানে থাকতে বাধা দেয় এবং এখানে থাকতে দেবে না বলে হুমকি দেয়। পরদিন সকালে এসে আলী আকবর আমাকে এসব জানায়। ঐ এলাকার জামাতে ইসলামী ও মুসলিম লীগপন্থী কিছু লোক আমাদের কাজে বিঘ্ন সৃষ্টি করতো।

আমি আলী আকবর এর সাথে পরামর্শ করি কিভাবে আক্রমণ পরিচালনা করা যায়। তারিখ ছিল ১৪ই এপ্রিল। আলী আকবরকে নির্দেশ দেই বগুড়াতে গিয়ে মেজর নাজমুল হকের সাথে পরামর্শ করে ফেরত আসতে। ১৭ই এপ্রিল আলী আকবর ফেরত আসে। এক প্লাটুন সৈন্যসহ তাকে নগরবাড়ী এবং পাবনা রাস্তার মধ্যে পাকসেনাদের যোগাযোগ বিছিন্ন করার নির্দেশ দেই। আলী আকবর ১৭ই এপ্রিল রাতে সেখানে যায়।

আমি জানতে পারলাম যে আমাদের যে; আমাদের সুবেদার মেজর আবদুল লতিফ মোল্লা ১৭ই এপ্রিল বাঘাবাড়ী ঘাটে এসেছেন। আমি তার সাথে দেখা করতে যাই। ২০শে এপ্রিল আমি বাঘাবাড়ী ঘাটে পৌছাই এবং দেখতে পাই হাবিলদার আলি আকবর এক আহত সৈনিককে নিয়ে ঘাটে রেখেছে। আলী আকবর বলল যে; ১৯শে এপ্রিল পাইকড়হাটে আমাদের প্রতিরক্ষাব্যূহ পাক্ সেনা অগ্রসর হচ্ছিল। সেই সময় সে পাকসেনাদের উপর গুলী ছোড়ে। পাকসেনাদের ৬ গাড়ি নষ্ট হয়েছে এবং বহু সৈন্য হতাহত হয়েছে। তার পক্ষেও অনেক হতাহত হয়েছেয়াবং ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে। আহত হাবিলদার আবদুল আলীকে নিয়ে আমরা শাহজাদপুর হাসপাতালে আসি। সেখানে তার উপর অস্ত্রোপচার করা হয় স্থানীয় ডাক্তারদের দ্বারা। হাবিলদার আলী আকবর সিরাজগঞ্জের এসডিও-র সাথে যোগাযোগ করে। ছত্রভঙ্গদের আমি একত্রিত করার চেষ্টা করি কিন্তু তা পারিনি।

আমি তারপর ৩নং সেক্টরে যোগ দেই। সেখান থেকে আমাকে কোম্পানি কমান্ডার বানিয়ে সিলেটের আসালংবাড়ী পাঠিয়ে দেয়া হয়।

————————————————–

 

চাঁপাইনবাবগঞ্জ-রাজশাহীর সশস্ত্র প্রতিরোধ

সাক্ষাৎকার- হাবিলদার মোহাম্মদ ফসিউদ্দিন

০২-০৫-১৯৭৪

চাঁপাইনবাবগঞ্জে ইপিআর-এর ৬নং উইং ছিল। ২৪শে মার্চ থেকে আমাদের কিছু লোককে বাইরে অভ্যন্তরীণ  নিরাপত্তা  ডিউটির জন্য পাঠানো হয়। এবং উইং এর কমান্ডার, সহকারী উইং কমান্ডার, ক্যাপ্টেন  সিদ্দিক ও  আর একজন ক্যাপ্টেন মেস কমান্ডার থেকে সুবেদার মেজর সবাই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানী। বাঙালিদের বদলী করে পশ্চিম পাকিস্তানীদের  নিয়োগ করা হয়। ২৫শে মার্চ থেকে বাঙালি ইপিয়ার’দের কাছে থেকে অস্ত্র কেড়ে নেবার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু বাঙালিদের সন্দেহ জাগায় অস্ত্র জমা দিতে তারা অস্বীকার করে। জনসাধারণ আমাদের উপর হামলা চালাবে এই অজুহাতে  আমরা  অস্ত্র জমা দেই নাই।

২৫শে মার্চ বিকেলে সেক্টর হেডকোয়ার্টার রাজশাহী থেকে ১৫/১৬ জন বাঙালি ইপিআর একজন সিকিউরিটিসহ  নবাবগঞ্জে আসে। মাঝে মাঝে তারা গোপন বৈঠক করতে থাকে। ২৫শে মার্চ রাতে তিনজন ক্যাপ্টেনসহ আনুমানিক ২৫/৩০ জন পশ্চিম পাকিস্তানী ইপিআর রাত প্রায় দেড় ঘটিকার সময় রহনপুর প্লাটুন হেডকোয়ার্টারে আক্রমণ চালায়। রহনপুর ক্যাম্পের বাঙালি ইপিআররা তাদের জীবন রক্ষার্থে ওদের উপর পাল্টা আক্রমন চালায়। ওদের তিনজন আহত হয়। ২৬শে মার্চ পাকিস্তানীরা রহনপুর বাজারে কিছু নিঃসহায় লোককে গুলী করে হত্যা করে। ২৬শে মার্চ দিনে নবাবগঞ্জ ক্যাম্পের সমস্ত বাঙালিকে নিরস্ত্র অবস্থায় তিন চারবার ফলইন করা হয়। কিন্তু কিছু সংখ্যক বাঙালি অস্ত্রসহ বাইরে গণ্ডগোলের অজুহাতে ক্যাম্পের আশেপাশে থাকে। আমাদের ফল-ইন করিয়ে উইং কমাণ্ডার বলেন যে, আমরা যদি বাইরের জনসাধারণের সাথে সহযোগিতা করি তাহলে আমাদের কঠিন সাজা দেওয়া হবে এবং গুলি  করে  হত্যা করা হবে। কথা প্রসংগে পশ্চিমা সুবেদার মেজর দাদু খান বলে যে তোমাদেরকে ট্যাঙ্কের সাহায্যে মাটিতে মিশিয়ে  দেয়া  হবে।

২৬শে মার্চ দিনের বেলা আমরা চট্রগ্রাম কেন্দ্র থেকে ইপিআর অয়ারলেন্সে খবর পাই যে ঢাকাতে বাঙালি  ইপিআরদেরকে খতম করা হয়েছে। বাইরে যারা আছে তাদেরকে আত্মরক্ষার জন্য সতর্ক করে দেয়া হয়।

২৬শে মার্চ সন্ধ্যা ৭টায় আমরা কয়েকজন বাঙালি এসসিও হাবিলদার মোস্তফা কামাল, হাবিলদার জমজম আলী হাবিলদার সিদ্দিকুর রহমান, হাবিলদার সৈয়দ আলী তালুকদার এবং কিছুসংখ্যক নায়েক সিপাহী পশ্চিম পাকিস্তানী কয়েকজন এনসিও-র সাথে আলাপ করেছিলাম। হঠাৎ ব্যাটালিয়ন হাবিলদার মেজর গুলজার খান পশ্চিম পাকিস্তানীদের চোখের ইশারায় ডেকে নিয়ে আসেন। তাদের এহেন আচরনে আমরা সন্দিগ্ধ হলাম। আমরা আরো সতর্ক হই। কিছুক্ষন পর রাজশাহী সেক্টর হেডকোয়ার্টার থেকে একটি মেসেজ আসে। সেটা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানী সমস্ত অফিসার এবং জোয়ান্দের পরিবারকে রাজশাহীতে সরিয়ে ফেলার জন্য এবং বাঙালিদের খতম করে রাজশাহীর দিকে যাবার জন্য। আমাদের বাঙালি অপারেটর এই মেসেজ সমস্ত বাঙালিদের জানিয়ে দেয়। এই মেসেজ অফিসারদের হাতে পড়ার সাথে সাথে আমাদের উপর হামলা শুরু হয়। গোলাগুলির মধ্যেই তিনজন অফিসার পরিবারসহ পালিয়ে রাজশাহীর দিকে চলে যায়। প্রায় দুই ঘন্টা গোলাগুলীর পর পরিস্থিতি বাঙালিদের আয়ত্তে আসে এবং অস্ত্রসহ পশ্চিম পাকিস্তানী জেসিওকে  বন্দী  করা হয়। গোলাগুলিতে তাদের কিছু লোক মারা যায়, কিছু আহত হয়। আমাদের একজন সামান্য আহত হয়।

ক্যাম্পকে সম্পূর্ণরুপে নিজ দায়িত্বে আনার পর বাইরে জনসাধারণ কে খবর দেয়া হয়। ১০/১৫ মিনিটের মধ্যে ২/৩ হাজার লোক ক্যাম্পে আসে আমাদের সাহায্য সহযোগিতা করার জন্য। সারা রাত ক্যাম্পের বাইরে  এবং  ভিতরে চতুর্দিকে ডিফেন্স করা হয় পশ্চিম পাকিস্তানীদের আক্রমন থেকে রক্ষা পাবার জন্য। তখন রাজশাহীতে ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট ছিল। আমরা সীমান্তের সমস্ত বিওপিতে অবাঙালিদের গ্রেফতার করে কিছু লোক বিওপিতে থাকি; বাকি  সবাই  উইং হেডকোয়ার্টারে সমবেত হবার জন্য অগ্রসর হই। ২৭ মার্চ বিকালে ৫ ঘটিকায় আমরা রাজশাহীর বাঙালির ইপিআর এবং বাঙালি পুলিশদের জীবন রক্ষার্থে রাজশাহীর দিকে অগ্রসর হই। রাজশাহীর সেক্টর হেডকোয়ার্টারে পাকিস্তানীরা সমস্ত গোলাবারুদ এবং বিপুল পরিমান অস্ত্রশস্ত্র জ্বালিয়ে ধ্বংস করে দেয়। সেক্টর হেডকোয়ার্টার পাকিস্তানী ক্যাপ্টেন ইসহাক সমস্ত বাঙালি ইপিআরকে সতর্ক করে দেন এবং বলেন যে; তোমাদের সাথে আমি অনেক দিন যাবৎ আছি এখানে অনেক কিছু খেয়েছি। তিনি সবাইকে আত্মরক্ষার জন্য দুই মিনিটের মধ্যে চলে যেতে বলেন। ঠিক ঐ সময়ের মধ্যে পাকিস্তানীরা গোলাগুলি এবং আগুন জ্বালানো শুরু করে দেয়।

নবাবগঞ্জ থেকে ১৮ মাইল দূরে গোদাগাড়ীতে কিছুসংখ্যক লোক ডিফেন্স তৈরি করে। রাত্রে পাকিস্তানীরা আমাদের উপর আক্রমন চালায়। উভয় পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি চলে। আমরা আস্তে আস্তে রাজশাহীর দিকে অগ্রসর হতে থাকি গোলাগুলী চলতেই থাকে। রাজশাহীর কাছিয়াডাঙ্গাতে ক্যাপ্টেন গিয়াস নওগাঁ থেকে এসে আমাদের সাথে মিলিত হন। সেই সময় আমাদের কোন অফিসার না থাকায় তিনি নেতৃত্ব দেন । রাজশাহী কোর্ট স্টেশনের নিকট ডিফেন্স থাকাকালীন আমাদের একজন নায়েক আব্দুল মালেক শহীদ হন। ক্যাপ্টেন গিয়াস সাহেবের নেতৃত্বে আমরা রাজশাহী  শহর  দখল করে নেই। এরপর রাজশাহী সেনানিবাস দখলের জন্য সাঁড়াশী অভিযান শুরু হয়। প্রায়ই আমাদের উপর বিমান হামলা হত-দিনে ৩/৪বার করে। ১৩ই এপ্রিল বিকেল পর্যন্ত আমরা সেনানিবাসের কিছু জায়গা দখল করে নেই। এই অভিযানে ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের অধিকাংশই নিহত হয়।

রাজশাহী দখলের পরই খবর আসে যে ঢাকা থেকে বিপুল সৈন্য আরিচাঘাট- নগরবাড়ি হয়ে রাজশাহীর  দিকে  অগ্রসর হচ্ছে। তাদের পথে বাধা দেয়ার জন্যে আমাদের কিছু লোক-আনসার, মোজাহিদ, পুলিশ ঐদিকে এগিয়ে যায়। নগরবাড়িতে আমাদের লোকের সাথে পাকবাহিনীর সংঘর্ষ হয়। আমাদের লোক পিছু হটতে বাধ্য হয়। পাকিস্তানীদের রাজশাহী পৌছা পর্যন্ত রাস্তার কয়েক জায়গায় আমাদের লোকের সাথে তাদের সংঘর্ষ হয়। সংখ্যায় তারা অধিক থাকায় বহু হতাহতের পরও তারা রাজশাহী পৌছে যায়- বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমাদের সুশিক্ষিত গোলন্দাজ বাহিনী তাদের অনেক গারী ধ্বংস করে/ তাদেরও অনেক হতাহত হয়। ১৩ই এপ্রিল শেষ রাতে পাকিস্তানীরা আমাদের উপর মরণপণ আক্রমন চালায়। আর্টিলারী, পদাতিক এবং বিমান হামলা চলে সম্মিলিতভাবে। তাদের প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে আমরা আত্মরক্ষার জন্য পিছু হটতে বাধ্য হই।

পুনরায় আমরা সমবেত হই-চাঁপাইনবাবগঞ্জে। গোদাগাড়ীতে পুনরায় ডিফেন্স নিই। ২২শে এপ্রিল ভোর বেলায়  পাকিস্তানীরা আমাদের উপর হামলা চালায়। এখানে পাকিস্তানীদের প্রায় ১৫০টি কনভয় আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আক্রমন চালায়। পরপর কয়েকবার আমাদের উপর পালটা আক্রমন হয়। আমাদের বহু লোক এখানে শহীদ হয়।

২৩শে এপ্রিল ভোরে আমরা পদ্মা নদী পার হয়ে হাকিমপুর, পোলাডাঙ্গা এবং সাহেবনগর চরে গিয়ে সমবেত হই। ক্যাপ্টেন গিয়াসের নির্দেশে সমস্ত লোক পোলাডাঙ্গা ক্যাম্পে একত্রিত হয়।

———————————————-

কানুপুরের যুদ্ধ

প্রতিবেদনঃ সত্যেন সেন

(দৈনিক বাংলা ২১শে মার্চ ১৯৭২-এ প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে সংকলিত)

রাজশাহী- একাত্তরের ২৯শে এপ্রিল। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শেষবর্ষের ছাত্র আসাদ আহমদ বায়রনের নেতৃত্বে একদল গেরিলা নবাবগঞ্জ মহকুমার শিবগঞ্জ থানাধীন পাগল নদীর ওপার থেকে নদী পার হয়ে কানুপুর যাত্রার জন্য তৈরি হয়। রাত তখন নয়টা বেজে ত্রিশ মিনিট, দুর্লভপুর গেরিলা শিবির থেকে বায়রণ তার দল নিয়ে যাত্রা শুরু করে। সাথীদের সকলের চোখে মুখে যেন কিছুটা নৈরাশোর ছাপ। হয়তো মনে হচ্ছিল এই দুঃসাহসিক অপারেশন বুঝি কেউ আর ফিরে আসবে না। পরক্ষনেই তাদের আবার মনে হয়েছে যেমন করেই হোক তাদের ও অপারেশনে সাফল্যলাভ করতেই হবে। কারণ দখলদাড় নরঘাতক ইয়াহিয়া বাহিনীর কবল থেকে মুক্তির আশায় বাংলাদেশের মানুষ দিন গুনছে। দুটিমাত্র ছোট নৌকা তাদের সম্ভল, অস্ত্রশস্ত্র নৌকায় রাখা আর গেরিলারা নৌকায় ভেসে চলেছে। রাতের অন্ধকার ভেদ করে এগিয়ে চলেছে পশুহত্যার উল্লাসে। রাত পৌনে এগারটা। শেষ হলো জলে ভাসা। কানুনপুরের কাছে এক আখক্ষেতে নৌকা রাখা হয়। নৌকায় রাখা অস্ত্র তারা হাতে তুলে নেয়। আবার শুরু হয় যাত্রা। এক বুক পানি ভেঙ্গে এগিয়ে চলেছে। খানিকটা দূর ঘুরে কানুনপুর গ্রামটাকে পেছনে ফেলে এক আম বাগানে প্রবেশ করে। সেখানেই প্রত্যেককে দায়িত্ব বণ্টন করে দেয়া হয়। তারা যখন আম বাগান প্রবেশ করে তখন শিবগঞ্জের খানসেনাদের ক্যান্টনমেন্ট থেকে ভেসে আসছিল মুহুর্মুহু গোলাগুলির আওয়াজ। পদপ্রদর্শক ছিল ১১ বছরের একটি বালক, এর নাম জানা যায়নি। প্রথমে যদিও এই বালকের ওপর ভরসা করা যায়নি, কিন্তু সে ভুল ভাঙতে খুব দেরি হয়নি। সে অত্যন্ত গেরিলাদের এগিয়ে নিয়ে গেল- পাঞ্জাবী আর রাজাকারদের ট্রেঞ্চ ও বাংকারগুলো খুব কাছ থেকে দেখিয়ে দিল। ক্রলিং করে গিয়ে পাহারারত রাজাকারকে কিছু করার সুযোগ না দিয়ে গলা টিপে হত্যা করে অস্ত্র কেড়ে নেয় এগারো বছরের বালকটি। এরপর শুরু হয় গেরিলাদের কাজ।

অন্যান্য গেরিলার তড়িৎবেগে দলের নেতার নির্দেশ অনুযায়ী কাজ আরম্ভ করে দেয়। যে ব্যাংকারে পাঞ্জাবী ছিল সেখানে গ্রেনেড চার্জ করা হয়। ব্যাংকারে তখন তিনজন পাঞ্জাবী ঘুমুচ্ছিল। মাত্র কয়েক সেকেণ্ড। প্রচণ্ড বিস্ফোরণের সাথে সাথে বাংকার ধসে পড়ে। পাশের বাংকার গ্রেনেড চার্জ করে হত্যা করা হয় চারজন রাজাকারকে। নিকটে এক বাড়িতে দু’জন রাজাকার ও তিনজন দালাল ছিল। তারা পালিয়ে পাঞ্জাবীদের কাছে খবর নিয়ে যাচ্ছিল। হাতের রাইফেল তাদের লক্ষ্য করে গর্জন করে উঠে। অবেরথ লক্ষ। মুহূর্তে লুটিয়ে পড়ে পাঁচজন মীরজাফর। ইতিমধ্যে পাঞ্জাবীরা টের পেয়ে যায়। প্রায় এক কোম্পানি পাঞ্জাবী ও রাজাকার আক্রমণের জন্য অগ্রসর হয়। আখক্ষেতে নৌকায় রেখে আসা হয়েছিল দু’জঙ্কে তারা তাদের সাথীদের নিরাপদে প্রত্যাবর্তনের জন্য খানসেনাদের লক্ষ্য করে গোলাগুলি ছুঁড়তে আরম্ভ করে। ফলে খানসেনারা হকচকিত হয়ে পড়ে। খানসেনারা ভালভাবে কিছু বুঝতে পারার আগেই গেরিলারা নৌকায় ফিরে শিবিরে ফিরে যায়। কানুপুর অপারেশনে বায়রনের গেরিলা দল একটি এলএমজি, দুটি চীনা স্বয়ংক্রিয় রাইফেলসহ বেশ কিছু অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করে।

—————————————-

সশস্ত্র প্রতিরোধঃ বগুড়া

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১২। বগুড়ায় সংঘটিত সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধের বিবরণ —————- ১৯৭১

বগুড়ার ছাত্র জনতার প্রতিরোধ যুদ্ধ

(‘প্রতিরোধে সংগ্রামে বাংলাদেশ’ থেকে সংকলিত)

বাংলাদেশের প্রতিরোধ সংগ্রামে বগুড়ার ছাত্রসমাজ সারা দেশের ছাত্রদের মুখ উজ্জ্বল করে তুলেছে। বগুড়ার ছাত্ররা এই সংরামের মধ্যে দিয়ে তাদের ছাত্র পতাকাকে সবার উর্ধ্বে তুলে ধরেছে। যারা এই মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস রচনা করবেন তাদের এই সত্যটি অবশ্যই স্বীকৃত দিতে হবে । শুধু কলেজের ছাত্ররাই নয় দলে দলে স্কুলের ছাত্ররাও শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পথে নেমে এসেছে ।যুদ্ধবিদ্যায় অশিক্ষিত এ কাঁচা বয়সের ছেলেরা একমাত্র দেশপ্রেমের বলে বলিয়ান হয়ে যুদ্ধবিদ্যায় অভিজ্ঞ পাক সৈন্যদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে অকুতোভয়ে প্রান নিয়েছে; প্রান দিয়েছে।

দেশকে মুক্ত করতে হলে শেষ পর্যন্ত সশস্ত্র সংগ্রামে নামতে হবে;ছাত্ররা এই সত্যটিকে ভাল করেই বুঝতে পেরেছিল। ছোট ছোট ছেলেরাও এই ট্রেনিং-এ অংশ নিত। এই ত্রেনিং-এর মধ্য দিয়ে শুধু হাত নয়,হাতের চেয়েও বড় কথা,তাদের মনটাও সংগ্রামের জন্য বড় হয়ে উঠছিলো। এটা শুধু কথার কথা নয়,তারা কার্যক্ষেত্রে এ কথাটিকে সত্য বলে প্রমাণিত করেছে।

সারাটা মাস ধরে মিছিলের পর মিছিল চলেছিল। ছাত্রদের মিছিল,শ্রমিকদের মিছিল,চাকুরেদের মিছিল ,সাধারণ মানুষের মিছিল-মিছিলের আর শেষ নেই। বগুড়ার আকাশ বাতাস মিছিলের জয়ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠেছিল। এর মধ্যে দিয়ে এল ২৫শে মার্চ,সেই অবিস্মরণীয় ২৫শে মার্চ। অবশ্য বগুড়া শহরে এই দিন্টিতে এমন কোন উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেনি।

২৬শে মার্চ সন্ধ্যাবেলা ছাত্রদের মিছিল পথে বেরোল,তারই  পাশাপাশি লাল ঝান্ডাকে সামনে নিয়ে শ্রমিকদের মিছিল চলে এল। ছাত্র আর শ্রমিকদের শ্লোগানে শ্লোগানে বগুড়া শহরের রাজপথ আর অলি-গলি ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। আসন্ন ঝড়ের আভাস পেয়ে তাদের মনে আশংকা-মিশ্রিত উত্তেজনা।

খবর এসেছে ইয়াহিয়ার সাথে শেখ মুজিবের আলোচনা ভেঙ্গে গেছে। এবার এক নতুন পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। ঘটনার গতি প্রবাহে এক ভীষণ সংগ্রামে অনিবার্যভাবে ভেঙে পড়বে।

সেই দিন রাত দুটো সময় খবর এসে পৌছাল,রংপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে একদল সৈন্য বগুড়ার উদ্দেশে যাত্রা করেছে। এর তাৎপর্য সুস্পষ্ট, ওরা ওদের হিংস্র থাবা বিস্তার করে আক্রমণের জন্য ছুটে আসছে। স্বাধীনতা সংগ্রামকে অঙ্কুরেই চূর্ণ করে ফেলবার জন্য ওরা অদের এই অভিযান শুরু করেছে।

খবরটা দেখতে দেখতে সারা শহর ছড়িয়ে পড়ল। ঘুমন্ত মানুষ শয্যা ছেড়ে উঠে বসল। ইতিমধ্যে পথে আওয়াজ উঠেছে-প্রতিরোধ চাই,প্রতিরোধ।  ছাত্র আর শ্রমিকদের মিছিল বেরিয়ে গেছে। তারা সারা শহরের পথে পথে ঘুরে প্রতিরোধ সংগ্রামের আওয়াজ তুলেছে। সেই আওয়াজে ঘরের মানুষ ঘর ছেড়ে পথে এসে দাঁড়িয়েছে।

শত্রুদের প্রতিরোধ করতে হবে। কিন্তু প্রতিরোধ করার মত অস্ত্র কোথায় ? ছাত্ররা দল বেঁধে থানায় গিয়ে সেখান থেকে সমস্ত রাইফেল বের করে নিয়ে এল। শুধু তাই নয়;শহরে যার যার হাতে বন্দুক ছিল তারা সবাই তাদের সাথে চলে এসেছে। ে অবস্থায় তারা কোন দিক থেকেই ভাবা বা আপত্তি পায় নি। সবাই যে যার বন্দুক হাতে তুলে নিয়েছে। ছাত্রেরা সে সমস্ত অস্ত্র নিযেদের মধ্যে ভাগ করে নিল। এই ক’দিনে তারা রাইফেল চালানোর ব্যাপারে যে ট্রেনিং পেয়েছে তা মোটেও আশাপ্রদ নয়। তা হোক,সংগ্রামে নেমে এসেছে এখন আর অগ্র-পশ্চাত বিবেচনার সময় নেই, তাদের যতটুক বিদ্যা সেইটুকুই কাজে লাগাতে হবে।

সারা শহরের পথে বহু ব্যারিকেড গড়ে উঠেছে। এই ব্যারিকেড গড়ে তোলার ব্যাপারে শত শত হাত অক্লান্তভাবে কাজ করে চলেছে। ছাত্র আর শ্রমিকরা সবার আগে, সাধারণ মানুষও তাদের সাথে এসে যোগ দিয়েছে । বড় বড় গাছ কেটে শহরের প্রবেশ্মুখ বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। কাজের বিরাম নেই। এভাবে রাত কেটে গিয়ে ভোর হয়ে এল,তখনও কাজ চলছে। হ্যা,সকল দিক দিয়ে ওদের চলাচলের পথ রুদ্ধ করে দিতে হবে,ওদের আক্রমণকে অচল করে দিতে হবে।

সৈন্যরা মহাস্থানগড় হয়ে বগুড়া শহরের দিকে মার্চ করে চলে আসছিল । ওরা সকালবেলা বগুড়া শহরের সামনে এসে পৌঁছুল। শহরে ঢুকার একমাত্র পথ সুবিলখালের পুল। ওরা সেই পথ দিয়েই চলে এল। ছাত্র আর শ্রমিকরা সেখানে হানাদার শিত্রু সৈন্যদের আড়ালে পজিশন নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। সৈন্যরা ব্যারিকেড সরিয়ে ক্রমে ক্রমে এগিয়ে আসছিল। গোপন আশ্রয়ের আড়াল থেকে ছাত্র আর শ্রমিকরা তাদের লক্ষ করে গুলি ছুঁড়ছিল । হানাদার সৈন্যরা কালিতলাহাত হয়ে ঝাউতলা রোড ধরে বড়গলা মোড়ে আসে। এখানে অনেক ছাত্র আগে থেকেই পজিশন নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। সৈন্যরা এখানে এসে পৌছবার সঙ্গে সঙ্গেই প্রবল গুলি বর্ষণের সম্মুখীন হল। ফলে এখানে একজন কর্নেল সহ ১১জন সৈন্য মারা যায়। সৈন্যরা এলোপাতারি গুলি ছুড়তে থাকে। একইভাবে পাক সৈন্যরা তাদের শত্রুদের বিরুদ্ধে গুলি চালিয়ে যেতে থাকে। বেলা যখন সাড়ে বারোটা তখন স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্র টিপু শত্রু সৈন্যদের গুলিতে বিদ্ধ হয়ে মারা যায়। টিপু ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক অফিসের দোতলায় দাঁড়িয়ে শত্রু সৈন্যদের বিরুদ্ধে লড়াই করছিল। মাত্র পনের বছর তার বয়স। বগুড়া শহরের স্কুলের ছাত্রদের সে ছিল নেতা। সবাই তাকে চিনতো, সবাই তাকে ভালবাসতো। গত এক মাসের মুক্তি আন্দোলনে অক্লান্ত পরিশ্রম ও সাহসের পরিচয় দিয়ে সে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের মধ্যে বিশিষ্ট স্থান দখল করে নিয়েছিল। বীর কিশোর টিপু যুদ্ধ করতে করতে প্রান দিল । শুধু সেই নয়, তার মত আরও কয়েকটি বীর সন্তানকে সেদিন এই মুক্তিসংগ্রামে প্রান দিতে হয়েছে।

আজাদুর রহমান নামের এক তরুন ইস্টার্ণ ব্যাংকিং বিল্ডিঙে আশ্রয় নিয়ে যুদ্ধ করছিল। শত্রুদের গুলিতে তার মাথার খুলি উড়ে যায়। আজাদ একটি প্রেস চালাত,সাথে সাথে লেখাপড়াও করত। বগুরার মানুষ এই সমস্ত বীর শহীদের কথা ভুলতে পারেনি। আরও একজন শহীদের নাম এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়।তার নাম হিরু। এই হিরুও সেদিন যুদ্ধ করতে করতে প্রান দিয়েছিল। হিরু কিন্তু একজন বিহারীর সন্তান। মিরপুর বিহারী কলোনিতে তার জন্ম,সেখানেই সে বাস করতো। তার পরেও জন্মভূমি বাংলাদেশকে সে তার মাতৃভূমি বলে মনেপ্রানে গ্রহন করে নিয়েছিলএবং এ মাতৃভূমির মুক্তিসংগ্রামে সে শাহাদাৎ বরণ করলো। বিহারী কলোনির মধ্যেই হিরুর মৃতদেহ কবর দেয়া হয়।

টিটু, আজাদুর রহমান এবং হিরুর মৃত্যুর পর পাকসেনারা দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে দক্ষিন দিকে এগুতে থাকে। একদল ঝাউতলার মধ্যে দিয়ে যায়,আরেকদল যায় রাজাবাজার দিয়ে। এইভাবে আক্রান্ত হয়ে সৈন্যরা বেলা দেড়টার সময় পিছনে হটতে থাকে। সৈন্যরা তাদের মনের ঝাল মেটাবার জন্য বেশ কিছু লোককে ধরে তাদের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে তারা অদের সবাইকে গুলি করে মারে এবং তাদের মৃতদেহ পেট্রোল দিয়ে পুড়িয়ে ফেলে। এছাড়াও এরা রেললাইনের কাছে পাঁচজন হোটেল বয়কে মেরে ফেলে।

তার পরদিন ২৭শে মার্চ তারিখে সৈন্যরা বগুরার কটনমিল মহিলা কলেজ,নাইট কলেজ,আজিজুল হক সরকারি কলেজের পুরাতন ভবন এবং বেতার ভবন দখল করে সেসব জায়গায় ঘাটি গেড়ে বসল। তারপর তারা মহিলা কলেজ ও রেস্টহাউজের চারতলা বাড়ি থেকে মর্টারশেল রকেট এবং মেশিনগানের সাহায্যে শহরের উপর আক্রমণ চালিয়ে যেতে থাকে। এইভাবে সারাটা দিন কাটল। এর পরদিনও তারা শহরের লোকদের উপর নানাভাবে আক্রমণ চালিয়ে যেতে লাগল।

মাঝে মাঝে এখানে ওখানে ছাত্রদের সঙ্গে গুলি বিনিময় চলছিল।দুপুরবেলা সৈন্যরা গ্রামের দিকে চলে যায় এবং সেখান থেকে কিছু লোককে ধরে নিয়ে আসে। এদের মধ্যে কিছু লোককে মেরে ফেলা হয়। এরা বাকী লোকদের সঙ্গিন উঁচিয়ে প্রানের ভয় দেখিয়ে ব্যারিকেড সরানোর কাজে লাগায়। বেলা তিন্টার সময় এই সৈন্যরা হাবিব ম্যাচ ফ্যাক্টরির সামনে দিয়ে যাচ্ছিল। সে সময় ম্যাচ ফ্যাক্টরির ভেতর থেকে ওদের উপর গুলি বর্ষণ হতে থাকে। সৈন্যরা প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে হাবিব ম্যাচ ফ্যাক্টরিতে আগুন লাগিয়ে দেয়। সেই আগুন সঞ্চিত বারুদের গাদায় গিয়ে লাগতেই বিরাট অগ্নিকান্ডের সৃষ্টি হয় এবং নিকটবর্তী বাড়ি গুলোতেও আগুন ধরে যায়।

বেতার ভবনের পেছনের পাড়াটা বৃন্দাবনপাড়া নামে পরিচিত। সৈন্যরা ২৯শে মার্চ তারিখে গিয়ে সেই পাড়ার উপর হামলা করে। সেখানে তারা চাল ডাল থেকে শুরু করে খাসি,গরু পর্যন্ত লুতপাতকরে নিয়ে আসতে থাকে। এরা সেখানে ঘরে ঘরে আগুন দিয়ে মজা দেখে এবং মেয়েদের উপর পাশবিক অত্যাচার চালায়। এর ফলে সবাই ক্ষিপ্ত হয়ে উথে এবং ছাত্রজনতা এদের বিরুদ্ধে গেরিলা আক্রমণ চালিয়ে যেতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে কলিমুদ্দিন নামক এক পুলিশ ও একজন ছাত্র নিহত হয়। এই কলিমুদ্দিনই সৈন্যদের বিরুদ্ধে গেরিলা আক্রমণ পরিচালনা করছিল।

পরদিন ৩০শে মার্চ তারিখেও এরা আগেকার মতই চারদিকে এলপাতারি আক্রমণ চালিয়ে যেতে থাকে। সেদিনও রাত্রে বেলা তারা রেস্টহাউজের উপর থেকে মর্টারশেল,বোমা ও রকেট ছুড়ে শহরের নানান জায়গায় অগ্নিকাণ্ড ঘটায়। ফলে কিছু লোকও মারা যায়। কিন্তু ওরা অস্ত্রের দাপটে যতই প্রতাপ দেখাক না কেন ,ওদের মনোবল ক্রমেই কমে আসছিল। এই ক’দিনে ছাত্র ও সাধারণ মানুষের আক্রমণের ফলে ওদের চল্লিশজন সৈন্য মারা গেছে। এমনও যে হতে পারে তারা এটা ভাবতেই পারেনি। এইভাবে যদি মৃত্যুর হার বেড়ে চলতে থাকে,তবে আর কিছুদিনের মধ্যেই সম্পূর্ণভাবে বিনাশ হয়ে যেতে হবে। ওদের মনে ত্রাসের সঞ্চার হচ্ছিল। বুঝতে পারছিল যে তারা ওদের সাথে পেরে উঠতে পারছে না। তাই শেষ পর্যন্ত তারা শহর থেকে পাত্তা গুটিয়ে পরাটাই বুদ্ধিমানের কাজ মনে করল। তার পরদিনই ওরা চোরের মত চুপি চুপি শহর ছেড়ে চল গিয়ে রংপুর ক্যান্টনমেন্টের দিকে যাত্রা করল। ওরা যে প্তহ দিয়ে যাচ্ছিল তার চারদিকের গ্রামগুলিতে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়ে উঠেছিল।

এই পলাতকের দল যখন কাতাখালিতে পৌছল তখন স্থানীয় ছাত্ররা ওদের পথরোধ করার জন্য কাটাখালি পুলতাকে ভেঙে ফেলার চেষ্টা করছিল। কিন্তু তাদের ভাগ্য ভাল,সময়ের অভাবে ছাত্ররা একটুর জন্য তাদের কাজটা শেষ করতে পারে নি।

সৈন্যরা কাটাখালি থেকে প্রান নিয়ে মানে মানে সরে পরতে পারল বটে,কিন্তু আরও কিছুদুর এগোবার পর ওদের বাঁধা পেয়ে থমকে দাঁড়াতে হল।জায়গাটার নাম গোবিন্দগঞ্জ। এখানে বহু স্থানের ছাত্র আক্রমণমুখী হয়ে ওদের পথ্রোধ করে দাড়িয়ে আছে। কী দুঃসাহসী এই ছাত্রের দল। আগ্নেয়াস্ত্র বলতে অতি সামান্যই ওদের কাছে যা ছিল। আর যা ছিল তা হচ্ছে লাঠি-সোটা,বর্শা-বল্লম এই সমস্ত হাতিয়ার। তাই নিয়ে ওরা মেশিনগানের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল। এই সংঘর্ষে অনেক ছাত্র হতাহত হল। কিন্তু সৈন্যরাও অক্ষত অবস্থায় চলে যেতে পারেনি। ওদের মধ্যে সাতজন ছাত্রদের হাতে ধরা পড়ল। বাকী সবাই প্রান নিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে পালালো।

       এদিকে বগুড়া মিলিটারি ক্যাম্পে আরেক চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটে চলছিল। ক্যাম্পটা বগুড়া শহর থেকে আট মেইল দূরে। ক্যাম্পে সৈন্যদের মধ্যে প্রায় সবাই ছিল বাঙালী। কিন্তু অফিসাররা সবাই পাঞ্জাবী।অফিসাররা বাঙালি সৈন্যদের নিরস্ত্র করে রেখেছিল। আর তাদের মধ্যে যারা তাদের নির্দেশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল,তাদের গুলি করে হত্যা করা হয়।

ব্যাপারটা ক্যাম্পের ভিতরে ঘটলেও এই খবর চাপা রইল না,দেখতে দেখতে সমস্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ল। খবর পেয়ে ছাত্ররা দলে দলে ছুটে এল। শুধু শহরের ছাত্ররা এল তাই নয়,গ্রামাঞ্চলের বহু ছাত্র এসে সেখানে জমলো।

ক্যাম্পের ভিতর অবরুদ্ধ বাঙালি সৈন্যদের এই দুর্দশার কথা জানতে পেরে গ্রামাঞ্চলের লোকদের মধ্যে উত্তেজনার ঢেউ বয়ে গেল। ক্যাম্পে পাঞ্জাবী অফিসারদের খতম করে দেয়ার জন্য তারাও এসে ছাত্রদের সাথে যোগ দিল। খালি হাতে আসেনি কেউ,যে যার হাতিয়ার নিয়ে এসেছে। কৌতূহলী দর্শক নয় তারা,জীবন পণ করে যুদ্ধ করতে এসেছে। শেরপুর,নন্দিগ্রাম প্রভৃতি অঞ্চল থেকে হাজার হাজার লোক এসে ক্যাম্পটাকে ঘেরাও করে ফেললো।

লোকসংখ্যা বাড়তে বাড়তে বিশ হাজার উঠে পড়ল। পর পর ক’দিন তারা এ অবরোধ চালিয়ে গেল।ছাত্ররা অফিসারদের আত্মসমর্পণ করতে আহ্বান জানাল। কিন্তু তারা কিছুতেই রাজী হতে চায় না। তারা ঢাকার সামরিক কর্তৃপক্ষের উপর ভরসা করে শক্ত হয়ে বসে রইল।ইতিমধ্যে এই খবর ঢাকা গিয়ে পৌছেছে। ঢাকা থেকে উড়ে এল বোমারু বিমান,জনতাকে লখকরে বোমা ছুড়তে লাগল। কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। মানুষ ক্ষেপে আগুন হয়ে উঠেছিল। শেষ পর্যন্ত হাজার হাজার উত্তেজিত জনতার চাপে অফিসারদের বাধ্য হয়ে আত্মসমর্পণ করতে হল। পরে এই অফিসারদের বগুরার রেলগেটে এনে গুলি করে মারা হয়।

 

———————————————-

 

সশস্ত্র প্রতিরোধ বগুড়া
সাক্ষাৎকারঃ গাজীউল হক
২১-০৮-৮৩

১৯৭১ সাল। ২৫শে মার্চ দিবাগত রাত সাড়ে তিনটা। এমদাদুল হক নামে এক তরুণ এসে ঘুম থেকে ডেকে তুললো। এক্ষুনি থানায় যেতে হবে; জরুরী খবর আছে। খবর এসেছে পাকসেনা বগুড়ার দিকে এগিয়ে আসছে। দু’মিনিটে তৈরি হয়ে নিলাম। চিন্তা ভাবনার ফুরসৎ নেই। ছুটতে হলো ডাঃ জাহিদুর রহমান (এমপি)তাঁর বাড়িতে ব্যালকনিতে দাড়িয়ে ছিলেন।ডাকতেই নেমে এলেন। তাকে নিয়েই ছুটতে ছুটতে থানায় হাজির হলাম।

আধো আলো আধো অন্ধকার বগুড়া কোতাওয়ালী থানার আঙ্গিনায় ২০/২৫ জন লোক দাড়িয়ে। সামনে এগিয়ে এলেন মকবুল সাহেব (ইন্টেলিজেনস ব্যাঞ্চের অফিসার)। তিনি জানালেন অয়ারলেসে খবর এসেছে পাকসেনারা রাজারবাগ এবং পীলখানা আক্রমণ করেছে। রাজারবাগ এবং পীলখানায় প্রতিরোধ চলছে। এদিকে রংপুর থেকে পাকিস্তানী সৈন্য বগুড়ার দিকে এগিয়ে আসছে।

নিজেকে ভীষণ অসহায় বোধ করছিলাম। আমি নির্বাচিত প্রতিনিধি ছিলাম না। কোন রাজনৈতিক দলের নেতাও নই। সুতরাং এ অবস্থায় আমার দায়িত্ব কতখানি বুঝতে না পেরে বিব্রত বোধ করছিলাম। ডাঃ জাহিদুর রহমানের অবস্থাও আমার চাইতে বিশেষ সুবিধার নয়। রাজনৈতিক অঙ্গনে তিনি সম্পূর্ণ নতুন। ৭০ সালেই নির্বাচনের আগে সক্রিয় রাজনীতিতে এসেছেন এবং পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। তবুও কর্তব্য সমন্ধে যেন হঠাৎ সজাগ হয়ে উঠলেন; বললেন; এখন সকলকে ডেকে সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় নেই। প্রতিটি মুহূর্তই মূল্যবান। সুতরাং আপনাকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। “মকবুল সাহেব; অফিসার ইন-চার্জ নিজামউদ্দিন সাহেব এবং থানার অন্যান্য পুলিশ কর্মচারীগণেরও একই মত। সমস্ত দুর্বলতা ঝেড়ে ফেললাম। হঠাৎ যেন মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো “অল রাইট; আই এসিউম দি কমাণ্ড। উই শ্যাল রেসিস্ট দি পাকিস্তানি আর্মি।”

কিছুক্ষণের জন্য আলোচনা হলো বগুড়া থেকে আট মাইল দক্ষিণে আড়িয়া ক্যান্টনমেন্ট। রংপুর ক্যান্টনমেন্ট উত্তরে। মকবুল সাহেব বললেন; আড়িয়াতে পাকসেনার সংখ্যা খুব বেশী নয়। সুতরাং তারা হঠাৎ কিছু করবে না। তাছাড়া; অয়ারলেসে খবর এসেছে রংপুর থেকে পাক আর্মি আসছে। মনে পড়লো ২৫শে মার্চের সন্ধ্যার সময় ছাত্রলীগের সামাদ এবং ছাত্র ইউনিয়নের রেজাউর রহমান ডিংগুর নেতৃত্বে বগুড়া আড়িয়া সড়কের মাঝখানে কটকির সংকীর্ণ পুলের উপর গাছ কেটে ফেলে এবং ইটের স্তূপ সাজিয়ে ব্যারিকেড দেয়া হয়েছিলো। সুতরাং শহরের উত্তরে বগুড়া-রংপুর সড়কের ব্যারিকেড দিতে হবে। ব্যারিকেড বাধা পেলে হয়তো রাতে তারা আর এগুবে না। শহরবাসীদের প্রতিরোধ গড়ে তুলতে অন্ততঃ সকাল পর্যন্ত সময় চাই। (আমাদের চিন্তায় ভুল ছিলনা সেটা পরে প্রমাণিত হয়েছে। শহর থেকে তিন মাইল উত্তরে মাটিডালীতে ব্যারিকেড দেখে পাকিস্তানী সৈন্যরা রাতে শহরে ঢুকতে সাহস করেনি)।

দারোগা নিজামউদ্দিন এবং নুরউল ইসলাম তিনজন কনস্টেবল সঙ্গে নিয়ে রাইফেল হাতে নির্দেশমত আজাদ গেস্ট হাউসের ছাদে ঘাটি গাড়লেন। পাকিস্তানী সেনা রেললাইন পার না হওয়া পর্যন্ত তারা আক্রমণ চালাবেন না এই নির্দেশ তাদের দেয়া হলো, পুলিশ ফোর্সের অন্যান্যদের অস্ত্রশস্ত্র পুলিশ লাইনে পাঠিয়ে দিলাম। মকবুল সাহেব চলে গেলেন অয়ারলেসে আর কোথাও যোগাযোগ করা যায় কিনা সে চেষ্টা চালাতে।

থানা থেকে বেরোতেই দেখি থানার গেটে ২০/২৫ জন ছাত্র-যুবক জমায়েত হয়েছে। খবর তারাও পেয়েছে। তাদের নিয়ে ডাঃ জাহিদুর রহমান এবং আমি ছুটলাম উত্তর দিকে। যত দ্রুত সম্ভব মাটিডালী পৌছতে হবে। ব্যারিকেড দিয়ে প্রথম বাধার সৃষ্টি করতে হবে। শেষ রাত্রির নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে স্লোগান উঠলো জাগো জাগো বীর বাঙালি জাগো জয় বাংলাঃ বীর বাঙালি হাতিয়ার ধরো; পাকিস্তানীদের প্রতিরোধ করো।

ছুটছি, রীতিমতো দৌড়চ্ছি। পাকিস্তানী সেনারা যে রাস্তা ধরে এগিয়ে আসছে সে রাস্তা দিয়ে ছুটছি। পাগলের মতো চীৎকার করছি সবাই ঘুম থেকে জেগে উঠুন। পাকিস্তানী সেনারা আসছে। যাদের বন্দুক আছে,তারা বন্দুক হাতে বেরিয়ে আসুন। পাকিস্তানী সেনাদের ঠেকাতে হবে।’

মাটিডালী এসে পৌছলাম। শহর থেকে প্রায় তিন মাইল দূরে। শ্লোগান দিতেই মুস্তাফিজুর (বাবু) সহ অনেকেই রাস্তায় বেরিয়ে এলো। ব্যারিকেড দেবার কথা বলতেই ১৫/২০ খানা কুড়াল নিয়ে গাছ কাটা শুরু হয়ে গেলো। রাস্তার দুপাশে র লোকজনদের বাড়ী ছেড়ে সরে যেতে নির্দেশ দেয়া হলো (পাক সেনারা ব্যারিকেড দেখে ওখানকার অনেক বাড়ীই পুড়িয়ে দিয়েছিলো)। একটা বিরাট গাছ রাস্তা জুড়ে পড়ার পর আবার ছুটলাম শহরের দিকে। মাটিডালীতে তখন আরো গাছ কাটা এবং ব্যারিকেড রচনার কাজ চলছে।

২৬শে মার্চের ভোর। পূর্ব আকাশে সূর্য মাত্র উকি দিয়েছে। ডাঃ জাহিদুর রহমানের বাড়ীতে সামনে রাস্তায় মাহমুদ হাসান খান একা দাঁড়িয়ে আছেন। মাহমুদ হাসান খান জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। আর সবাই কোথায়? জিজ্ঞেস করতে ঘাড় নেড়ে জানালেন, জানেন না। শুধু বললেন হাবিবুর রহমান (এমপি) আত্মসমর্পন করার পক্ষপাতী। (পরবর্তীকালে হাবিবুর রহমান পাক সেনাবাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করে তাদের সহযোগিতা করেছিলেন)।

‘না তা চলবে না।’ ডাঃ জাহিদুর রহমান রীতিমত ক্রুদ্ধ। মাহমুদুল হাসান খানকে অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পাঠিয়ে ডাঃ জাহিদুর রহমানসহ দু খানা সাইকেলে ছুটলাম পুলিশ লাইনের দিকে। পথে দেখা করলাম জেলা প্রশাসক খানে আলম খান সাহেবের সঙ্গে; দেখলাম ভীষণ উদ্বিগ্ন। বললেন সম্মুখ যুদ্ধে ওদের সাথে পারবেন না। গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিন। আপনাদের সাফল্য করি।

এরপর পুলিশলাইন। পুলিশলাইনে মকবুল সাহেবের সঙ্গে দেখা হলো। জানালেন অয়ারলেসে কুষ্টিয়া ছাড়া আর কোন যোগাযোগ হয় নি। কুষ্টিয়ার শেষ খবর হানাদার বাহিনী কুষ্টিয়া আক্রমণ করেছে। এরপর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন।

রিজার্ভ ইন্সপেক্টরের সঙ্গে পুলিশলাইনে কিছুক্ষন আলোচনা হলো। স্থির হলো ট্রেঞ্চ খুঁড়ে পুলিশ লাইনে তারা প্রস্তুত থাকবেন। সেকেণ্ড লাইন অব ডিফেন্স।

শহরে যখন ফিরে আসি তখন সকাল সাতটা। রাস্তায় লোক নেমে পড়েছে। কিন্তু অস্ত্রের সংখ্যা অতি নগণ্য। একনলা, দোনলা বন্দুক এবং টু-টু রোব রাইফেলসহ মাত্র ২৮টি। শুধু আজাদ গেস্ট হাউজের ছাদে দারোগা নিজামউদ্দীন এবং তার সঙ্গীর কাছে ৫টি ৩০৩ রাইফেল। যে দুরন্ত ২৭টি ছেলে আমার সঙ্গে ২৬শে মার্চের ভোরে অকুতোভয়ে হানাদার বর্বর পাক বাহিনীকে রুখে দাঁড়িয়েছিলো; তাদের সকলের ভাল নাম হলোঃ

(১) এনামুল হক তপন

(২) আবদুল জলিল

(৩) এমদাদুল হক তরুন

(৪) নুরুল আনোয়ার বাদশাহ

(৫) শহীদ টিটু

(৬) শহীদ হিটলু

(৭) শহীদ মোস্তাফিজ (ছনু)

(৮) শহীদ আজাদ

(৯) শহীদ তারেক

(১০) শহীদ খোকন পাইকাড়

(১১) সালাম (স্বাধীনতার পরে আততায়ীর হাতে নিহত)

(১২) বখতিয়ার হোসেন বখতু (আর্ট কলেজের ছাত্র)

(১৩) খাজা সামিয়াল

(১৪) মমতাজ (বর্তমানে বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগ সম্পাদক)

(১৫) রাজিউল্লা

(১৬) টি এম মূসা (পেস্তা)

(১৭) নান্না

(১৮) সৈয়দ সোহরাব

(১৯) শহীদ বকুল

(২০) বুবলা

(২১) জাকারিয়া তালুকদার

(২২) মাহতাব

(২৩) টাটারু

(২৪) বুলু

(২৫) বেলাল

(২৬) এ কে এম রেজাউল হক (রাজু)

(২৭) ইলিয়াস উদ্দীন আহমদ।

কালীতলা থেকে রেললাইনের ২নং ঘুমটি পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশে দেয়ালের আড়ালে ছোট ছোট দলে ভাগ করে এদের দাঁড়াবার নির্দেশ দিলাম। কিন্তু এই নির্দেশ ভেঙ্গে টিটু, হিটলু এবং মুস্তাফিজ বড়গোলায় ইউনাইটেড ব্যাংক (বর্তমানে জনতা ব্যাংক) এর ছাদে ঘাঁটি গেড়ে প্রতিরোধ করে এবং সেখানেই তারা শহীদ হন। তপন, সামিয়াল এবং বখতু ও জলিলসহ ৪জনের একটি দল কালীতলার মুখে প্রথম প্রতিরোধের জন্য ঘাঁটি গাড়লো। প্রত্যেককে নির্দেশ দিলাম গুলি করার সঙ্গে সঙ্গে স্থান ত্যাগ করে এক আড়াল থেকে সরে যেতে হবে অন্য আড়ালে। যুদ্ধ চলাকালীন যোগাযোগ রক্ষা; সংবাদ আদান প্রদান এবং নির্দেশ পৌঁছানোর দায়িত্ব নিল একরামুল হক স্বপন, মঞ্জু (শহীদ আজাদের ভাই), ছাত্রলীগের সামাদ, বিলু (মরহুম আকবর হোসেন আকন্দ সাহেবের ছেলে), সৈয়দ কেরামত আলী গোরা (পরবর্তীকালে পাক সেনাদের হাতে নিহত হন) এবং আবু সুফিয়ান (পরবর্তীকালে পাক্সেনাদের হাতে শাহাদাত বরণ করেন)। সত্যি বলতে কি আমার নিজেকে একজন সেনাপতি সেনাপতি মনে হচ্ছিলো। আমার সেই নির্বোধ সেনাপতির ভূমিকার কথা মনে হলে এখন হাসি পায়।

২৬শে মার্চের সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ পাক সেনা সুবিল পার হয়ে বগুড়া শহরে ঢুকলো। সুবিল পার হবার আগে মাটিডালী, বৃন্দাবনপাড়া এবং ফুলবাড়ি গ্রামের কিছু কিছু বাড়ী তারা আগুন জ্বালিয়ে দিল। শহরে ঢুকবার পর পাক সেনাদল রাস্তার দুপাশ দিয়ে দুটো লাইনে এগুতে শুরু করে। সুবিল (করতোয়ার একটি খাল) পার হবার পর কোন প্রতিরোধ না পেয়ে বেশ নিশ্চিন্তেই তারা এগুচ্ছিলো। রাস্তা জনশূণ্য, কোন বাধা নেই। কিন্তু কালীতলা হাট পার হবার পর পরই দেয়ালের আড়াল থেকে তপনের হাতে বন্দুক আচমকা আগুন ঝরালো। অব্যর্থ নিশানা। লুটিয়ে পড়লো একজন পাক সৈন্য। তপনই বগুড়ার প্রথম মুক্তিযোদ্ধা যার অস্ত্র বগুড়ার মাটিতে প্রথম পাক সেনার রক্ত ঝরালো। গুলি করেই তপন এবং তার সঙ্গীরা স্থান ত্যাগ করে দেয়ালের আড়ালে চলে যায়। হঠাৎ আঘাত পেয়ে বিচলিত পাক সেনা এলোপাতাড়ি গুলি চালাতে চালাতে এগিয়ে চলে। জামিলের বাড়ি পার হতেই আবার রাস্তার দুপাশে দেয়ালের আড়াল থেকে পাক সেনাদের লক্ষ্য করে নির্ভীক মুক্তিযোদ্ধাদের আগ্নেয়াস্ত্র গর্জে উঠলো। এখানে দুজন পাক সেনা গুরুতর জখম হয়। কিন্তু বগগোলা পার হবার পর প্রচণ্ড বাধার সম্মুখীন হলো পাকসেনা। ঝাউতলা বোম্বে সাইকেল স্টোরের পাশ থেকে গুলি করে সরে যাবার সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হলো আজাদ। স্বাধীনতা যুদ্ধে অস্ত্র হাতে বগুড়ার মাটিতে আজাদই প্রথম শহীদ। উক্ত পাকসেনা রাস্তার পাশের ছোট চায়ের দোকানের ঝাপ তুলে দুটো কিশোর কর্মচারীকে গুলি করে মারলো।

পাকসেনারা রেললাইনের দু নম্বর ঘুমটির কাছে আজাদ রেস্ট হাউজের ছাদ থেকে দারোগা নিজামউদ্দীন, দারোগা নুরুল ইসলাম এবং তাদের সহযোগীদের ৩০৩ রাইফেল গর্জে উঠলো।সম্মুখ দিক এবং দু পাশ থেকে আক্রান্ত হয়ে হানাদার সৈন্যরা থমকে দাঁড়ালো। কিছুটা পিছু হটে এলো তারা। এমনি সময়ে বড়গোলার ইউনাইটেড ব্যাংকের ছাদের ওপর থেকে তিনটি বন্দুক গর্জে উঠলো। উৎসাহের বলে নির্দেশ অমান্য করে সকলের অজান্তে ব্যাংকের ছাদে পজিশন নিয়েছিল টিটু, হিটলু এবং মুস্তাফিজ (ছনু)।দুজন পাক সেনা জখম হলো। পেছন থেকে হঠাৎ আক্রান্ত হয়ে হানাদার সেনাদল বিচলিত হয়ে পড়ে। পিছু হটে দ্রুত তারা ব্যাংক ভবনটি ঘিরে ফেলে। টিটু, হিটলু এবং ছনু সরে যাবার সুযোগ পেল না। শহীদ হলো বগুড়ার আর তিনটি দামাল ছেলে। বেলা সাড়ে বারোটা নাগাদ বর্বর হানাদার সেনারা দ্রুত পিছু হটে শহর ছেড়ে গেলো। সুবিলের উত্তর পাড়ে পূর্ব বিভাগের ডাকবাংলো এবং মহিলা কলেজে অবস্থান নিলো তারা।

রাস্তায় বের হয়ে এলো বগুড়া শহরের লোক। স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম দিনে আমাদের ছেলেরা প্রাণ দিয়েছে। সেজন্য চোখগুলো অশ্রুসিক্ত। কিন্তু তার সঙ্গে মিলে আছে জয়ের আনন্দ, এক অভূতপূর্ব আস্বাদ। বর্বর হানাদার বাহিনীর মোকাবেলা করেছি আমরা। তাদের হটিয়ে দিয়েছি, জয়ী হয়েছি।

২৬শে মার্চেরই অপরাহ্নে একরামুল হক স্বপন, ফজলার রহমান (ফুলবাড়ী) এবং চন্দন এসে খবর দিলো যে তারা একটি সাইক্লোস্টাইল মেশিন যোগাড় করেছে। সুতরাং বুলেটিন সাইক্লোস্টাইল করে বিলি করা যায়। বুলেটিনের খসড়া দিলাম। একপাতার বুলেটিন সন্ধ্যের সময় শহরে ছড়ানো হেডলাইন ছিলো ‘‘ প্রথম দিনের যুদ্ধে বগুড়াবাসীর জয়লাভঃ পাঁচ জন পাকসেনা নিহত ।” এরপর ছিলো এক সর্বাত্মক যুদ্ধের আহবান। সবশেষে ছিলো বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশ। একটা কথা বলতে ভুলতে গেছি। মাটিডালীতে যখন ব্যারিকেড দিয়ে ফিরে আসছিলাম তখন দত্তবাড়ির সম্মুখে অয়ারলেস অফিসের একজন লোক ডাঃ জাহিদুর রহমানের হাতে একটা কাগজ দিয়ে যায়। মেসেজটি রাতে পেয়েছিলো বলে জানায়। লাল কালিতে লেখা। যতদূর মনে হয় বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়াবেঃ “ এটি আমার নির্দেশ। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। শত্রুসৈন্য আমাদের আক্রমণ করেছে। বাংলার মানুষ তোমরা যে যেখানে আছো; যার হাতে যে অস্ত্র আছে তাই নিয়ে রুখে দাঁড়াও। হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করো। পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলার মাটি থেকে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত এবং চূড়ান্ত বিজয় না পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাবে।” এই নির্দেশটিও বুলেটিনে জুড়ে দিয়েছিলাম। বুলেটিনে অবশ্য আমাদের তরফের ক্ষয়ক্ষতির কথা উল্লেখ করি নি। কারণ ভেবেছিলাম তাতে সাধারণ মানুষ ভয় পেতে পারে। এরপর থেকে প্রতিদিন আমরা বুলেটিন বের করতাম। এমনকি প্রচুর গোলাবৃষ্টির মধ্যেও স্বপন ডিকটেশন নিতো। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বুলেটিন সাইক্লোস্টাইল মেশিনে ছাপা হয়ে শহরে ছড়ানো হতো। ২৬শে মার্চ থেকে শুরু করে ১লা এপ্রিল পর্যন্র প্রতিদিন বুলেটিন বের হতো। বুলেটিনের বিশেষ দায়িত্ব ছিলো একরামুল হক স্বপন, চন্দন ধলু এবং সৈয়দ কেরামত (গোড়া) এর উপর।

২৬শে মার্চ সন্ধ্যায় বাদুড়তলার একটি বাড়ীতে যুদ্ধ পরামর্শ সভা বসলো। আলোচনা শেষ জনাব মোখলেসুর রহমানের প্রস্তাবক্রমে পাঁচ সদস্যের একটি হাই কমাণ্ড করা হলোঃ

১) গাজীউল হক (অদলীয়), সর্বাধিনায়ক; (যুদ্ধের দায়িত্ব)

২) ডাঃ জাহিদুর রহমান (আওয়ামী লীগ) (খাদ্য এবং চিকিৎসার দায়িত্ব)

৩) জনাব মাহমুদ হাসান খান ( আওয়ামী লীগ), প্রশাসন

৪) জনাব মোখলেসুর রহমান (মোজাফফর ন্যাপ), যোগাযোগ

৫) জনাব আব্দুল লতিফ (কম্যুনিস্ট পার্টি) প্রচার। ২৬শে মার্চ রাতেই আমরা সুবিলের দক্ষিণ পাড়ে ঘাটি স্থাপন করলাম।

২৭শে মার্চ সকাল আটটা। সুবিলের উত্তর পাড় থেকে পাকসেনারা গুলীবর্ষণ শুরু করে। পাল্টা জবাব দেয় আমাদের ছেলেরা। এই দিন ঝন্টু, মাহমুদ, ডাঃ টি; আহমদের ছেলে মাসুদ, গোলাম রসুল, বিহারীর ছেলে (নামটি মনে নেই), রশীদ খানের ছেলে গুলার, রেডিও, রফিকুল ইসলাম লাল, শহীদ আবু সুফিয়ান রানা এবং আরো অনেকে যুদ্ধে অংশগ্রহন করে। সকাল সাড়ে আটটার দিকে ডঃ জাহিদুর রহমান পুলিশ লাইন থেকে বাহিনীর ৬০ জনের এক দলকে নিয়ে এলেন। ৩০৩ রাইফেল হাতে আমাদের ছেলেদের পাশাপাশি তারাও অবস্থান নিলেন। দুই পক্ষে প্রচণ্ড গোলাবৃষ্টি হলো। গোলাবৃষ্টির মধ্যেই হানাদার বাহিনী সড়ক ধরে এগিয়ে এসে শহরের উত্তর প্রান্তে কটন মিল দখল করলো। (তখন বগুড়া শহরের উত্তর সীমার প্রান্তে ছিল কটন মিল). পুলিশ এবং আমাদের ছেলেদের সম্মিলিত প্রতিরোধের মুখে শহরের ভিতরে বেশী এগিয়ে আসতে পারলোনা হানাদার। এদিনের যুদ্ধে পাকসেনারা ভারী মেশিনগান ব্যবহার করে এবং মর্টারের গোলাবষণ করে। বিকেল তিনটার মর্টারের গোলার আঘাতে শহীদ হলো তারেক; দশম শ্রেণীর ছাত্র। মৃত্যুর সময়েও তার হাতে ধরা ছিলো একনলা বন্দুক। তারেকের রক্তে ভিজে গিয়েছিলো আমার বুক। মনে পড়ে তাকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কেঁদেছিলাম।

২৭শে মার্চ বিকেলে বাদুড়তলায় খাদ্য ক্যাম্প বসানো হলো এবং তার সঙ্গে একটি প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্রও খোলা হলো। খাদ্য ক্যাম্পের দায়িত্ব নিলেন মিউনিসিপ্যাল কমিশনার জনাব আমজাদ হোসেন এবং তাঁকে সাহায্য করার জন্য মোশারফ হোসেন মণ্ডল, বাদুড়তলার আবু মিয়া, আবেদ আলী, মজিবর রহমান এবং আরও কয়েকজনকে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হলো। এরা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রান্না করা খাদ্য সরবরাহের ব্যবস্থা করতেন। প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্রের দায়িত্ব নিয়েছিলেন শহীদ ডাঃ কছিরউদ্দীন তালুকদার সাহেব। তিনি একসময় বগুড়া জেলা মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলেন। ঐ সময়ে বৃদ্ধ বয়সে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যে যেভাবে তিনি এগিয়ে আসেন একজন চিকিৎসক হিসাবে তা বিশেষ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণযোগ্য। তাঁর বাড়িটিও আমাদের শেলটার হিসেবে ব্যবহার করতে দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে পাক সেনাবাহিনীর হাতে তিনি শাহাদৎ বরণ করেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে বগুড়ায় প্রয়াত প্রবীণতম মুসলিম লীগ নেতা ডাঃ হাবিবুর রহমানও সাহায্যের জন্যে এগিয়ে আসেন। ২৭শে মার্চ রাতে খবর পেলাম একজন মেজর জিয়াউর রহমান চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করছেন।

২৮শে মার্চের সকাল। কটন মিলের গেস্ট হাউজের ছাদে পাকসেনারা মেশিনগান বসিয়েছে। তখনো গোলাগুলি শুরু হয়নি। মেশিনগানের পাশে দু’জন পাকসেনা দাঁড়িয়ে। একজন পাকসেনা ছাদের রেলিং এ ভর দিয়ে কি যেন দেখছে। দেয়াল ঘেঁষে এগিয়ে গিয়ে দুরন্ত ছেলে তপন রাইফেল তুললো। অব্যর্থ লক্ষয়। ছাদের ওপর থেকে পাকসেনাটি ছিটকে পড়লো মাটিতে। পিছু হটে তপন লাফিয়ে পড়লো রাস্তার পাশের নর্দমায়। নর্দমার দেয়াল ঘেঁষে সরে এলো আড়ালে।

 

শুরু হলো এলোপাতাড়ি গোলাবৃষ্টি। ২৮শে মার্চে মুকিসেনারাও দলে ভারী। মিন্টু, ডিউক লিয়াকত (পরে রাজাকার হয়ে যায়), আবদুর রহমান, মামুন(হক সাহেবের কম্যুনিস্ট পার্টির), হারুন(ব্যাঙ্ক অফিসার), ধুলু, বজলু, মুকুল, সাত্তার রশীদ(রশীদ গুন্ডা নামে খ্যাত ছিলো) এবং গ্রাম থেকে প্রায় শ’খানেক বন্দুকসহ এসে যোগ দিয়েছে। প্রচণ্ড প্রতিরোধ সত্ত্বেও ভারী মেশিনগানের গুলী এবং মর্টারের গোলাবর্ষণের আড়াল নিয়ে বেলা সাড়ে তিনটার পর পাকসেনারা ক্রল করে শহরে ঢুকতে শুরু করলো। প্রচণ্ড প্রতিরোধের মধ্যেও তা এগিয়ে চললো। বেচলা ডোবার একটু পর পাকসেনারা রেললাইন পার হয়ে থানার মোড়ে পৌছালো। হতাশ হয়ে গেলাম এবার বগুড়ার পতন নিশ্চিতপ্রায়। জলিল বিড়ি ফ্যাক্টরীর পিছনে একটি ছোট বাড়ীতে ছাত্রলীগের সামাদ, মাসুদ, সৈয়দ কেরামত আলী গোরা আমরা কয়েকজন জড়ো হয়েছি। মাসুদকে দেখে একটি ঘটনা মনে হয়ে গেলো। ২০শে মার্চের রাতে মাসুদ এবং মুস্তাফিজুর রহমান পটল আমাকে নিয়ে গিয়েছিলো স্টেডিয়ামের কাছে তাদের তৈরী বোমার কার্যকারিতা দেখাবার জন্যে। দুটি বোমা ফাটানো হলো। সে কি বিকট আওয়াজ। কিন্তু হতাশ হলো সবাই দেয়ালে একটুও চিড় পর্যন্ত ধরেনি, ধ্বনি সর্বস্ব বোমা।

ঘটনা মনে আসতেই মাসুদের কাছে জানতে চাইলাম সেই বোমা আছে কিনা। সামাদ জানালো ২৩টি বোমা আছে। সামাদ এবং মাসুদ ছুটলো এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই হাতবোমা দুটো নিয়ে এসে হাজির। বললাম যেমন করেই হোক দত্তবাড়ীর উত্তরে যেকোন জায়গায় রাস্তার ওপর এই বোমা দুটো ফাটাতে হবে। এবং কিছু মুক্তিসেনা কাছাকাছি জায়গায় ফাকা গুলী ছুড়বে এবং সরে পড়বে।

শেখ ইনসান হাজী সাহেবের বাড়ীর উত্তর ধারে বোমা দুটি ফাটানো হলো। সে কী বিকট শব্দ। সঙ্গে সঙ্গে এলোপাতাড়ি, কিছু একনলা দু’নলা বন্দুকের গুলীর আওয়াজ, পেছন থেকে আক্রান্ত হয়েছে ভেবে সন্ধ্যার আধো অন্ধকারে হানাদার সেনারা ঘুরে দাঁড়ালো। তারপর দ্রুত পিছু হটে কটন মিলের গেস্ট হাউজে এবং সুবিলের উত্তর পাড়ের ঘাটিতে ফিরে গেলো। সেদিনের মতো হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। এক আনাড়ি মূর্খ সেনাপতির রণকৌশলে বগুড়া শহর সেদিন পতনের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিলো।

২৮শে মার্চ রাতে সুবেদার আকবরের নেতৃত্বে ৩৯ জন ইপিআর এর একটি দল বগুড়া পৌঁছায়। অস্ত্র বলতে তাদের রাইফেল, কয়েকটি গ্রেনেড এবং তিনটি এল.এম.জি। বিনা খবরে ওরা পৌঁছায়। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই সন্দিহান হই। পুলিশ লাইনে ওদের নিরস্ত্র করে নওগাঁয় মেজর নাজমুল হকের সঙ্গে টেলেফোনে যোগাযোগ করলাম। তিনি ইপিআরদের কাজে লাগাতে বললেন এবং ৩০শে মার্চ নিজে বগুড়া আসবেন বলে জানালেন।

২৯শে মার্চ। সকাল বেলায় বিস্ময়ে দেখলাম রাতে অন্ধকারে হানাদার পাক সেনা কটনমিলের গেস্ট হাউজ ছেড়ে সুবিলের উত্তর পাড়ের ঘাটিতে ফিরে গেছে। নিশ্চই গুপ্তচর মারফত তারা ই.পি.আরদের পৌঁছানোর খবর পায়। সকাল ৯টায় সুবেদার আকবর এবং মাসুদ রেকী করতে বের হলো। বেলা ১১টায় ই.পিআর-এর কয়েকজন একটি এল.এম.জি পাকসেনাদের দিকে মুখ করে কটন মিলের ছাদে বসালেন। বেলা আনুমানিক বারোটার সময় পাকসেনারা বৃন্দাবনপাড়া প্রাইমারী স্কুলের ঘাঁটি থেকে মর্টারের আক্রমণ শুরু করে। এইবার আমাদের তরফ থেকেও তিনটি এল.এম.জির মুখ দিয়ে পাল্টা জবাব গেলো, সন্ধ্যার সময়ে দুপক্ষের গোলাগুলি বন্ধ হয়। করিম হাওলাদার নামে একজন পুলিশ মুক্তিযোদ্ধা আহত হন।

৩০শে মার্চ। বেলা ৯টায় জেলা প্রশাসক খানে আলম সাহেব খবর পাঠালেন মেজর নাজমুল হক এসেছেন। দেখা হলো মেজর নাজমুল হকের সঙ্গে। মাঝারি গড়নের শ্যামল রং এর একহারা চেহারা। সর্বাঙ্গ একটা দৃঢ় প্রত্যয়ের ছাপ। সংক্ষেপে তার কাগজে সব রিপোর্ট করলাম। শেষে বললাম ‘যুদ্ধ করা আমার কাজ নয়। আমি যুদ্ধের কৌশল জানিনে। আজই এসেছেন। এখন দায়িত্ব আপনার’।

মেজর নাজমুল মৃদুস্বরে বললেন, “দায়িত্ব আমাদের সকলের। পলিটিক্যাল হাই কমান্ডের নিযুক্ত সর্বাধিনায়ক হিসেবে আপনিই কাজ করবেন। আমি আপনার সাহায্যের জন্য রইলাম।”

অদ্ভুত ভালো লেগেছিলো এই মানুষটিকে। নিরহংকার। কোনদিন ভুলতে পারবোনা। স্বাধীন বাংলাদেশ তিনি দেখে যেতে পারেন নি। কিন্তু তাঁর চারিত্রিক দৃঢ়তা, অতুলনীয় সাহস বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক উজ্জ্বল অধ্যায়।

৩০শে মার্চ বেলা দশটায় পাকসেনারা মর্টারের প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ শুরু করে। মুক্তি সেনারাও পাল্টা জবাব দেয়। বেলা ১টা নাগাদ হঠাৎ পাকসেনারা গোলা বর্ষণ বন্ধ করে।

বেলা আড়াইটায় ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী জিন্নাহর বাসায় (নিলিন্দার গ্রামে) হাই কমান্ডের বৈঠক। বৈঠকে আলোচনা শুরু হয়েছে। হঠাৎ উড়োজাহাজের আওয়াজ পাওয়া গেলো। জিন্নাহ এসে খবর দিলো বেশ নীচু দিয়ে দুটো উড়োজাহাজ ছুটে আসছে। একটু পরেই মেশিনগানের গুলীর আওয়াজ এবং তার পর পরই বোমা বর্ষণ শুরু হলো। সবাই বিচলিত হয়ে পড়লাম।

বোমাবর্ষণ বন্ধ হবার পর ঘুরে দেখলাম বিশেষ ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। কোন লক্ষেই আঘাত করতে পারেনি। মুক্তিসেনাদের মনোবল আলো চাঙ্গা হয়ে গেছে। মেজর নজমুল হক সার্কিট হাউজে কন্ট্রোল রুম বসালেন। সন্ধ্যায় শহীদ খোকন পাইকাড় এবং সালাম একটা খাকী ফুলপ্যান্ট এবং খাকী শার্ট তৈরী করে এনে দিলো। তাদের জেদে পরতে হলো তাই। ষোলকলা পূর্ণ হলো যখন তপন এসে একটা রিভলবার ঝুলিয়ে দিলো কোমরে। হাসি পাচ্ছিলো। সর্বাধিনায়ক, সেনাপতি, জেনারেল-এ জেনারেল অব ড্রিমল্যাণ্ড।

৩১শে মার্চ। দিনের বেলা দুপক্ষই নীরব। খবর এলো ক্যাপ্টেন আনোয়ার এবং ক্যাপ্টেন আশরাফের নেতৃত্বে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট বিদ্রোহ করে বেরিয়ে এসেছে এবং ঘোড়াঘাটে অবস্থান করছেন। ৩১শে মার্চ রাতে অসীম সাহসী সুবেদার আকবরের নেতৃত্বে মুক্তি সেনারা মহিলা কলেজের ঘাটিতে গ্রেনেড চার্জ করলো। পেট্রোলের ড্রামে আগুন ধরিয়ে গড়িয়ে দেয়া হলো পাকসেনাদের ঘাঁটির দিকে। পাকসেনাদের ঘাঁটি থেকে লক্ষবিহীন গুলীর শব্দ শোনা গেলো। তারপর অন্ধকারে মোটর কনভয়ের শব্দ। কিন্তু বোঝা গেলো না। ভোরে দেখা গেলো পাক সেনা বগুড়া ছেড়ে অন্ধকারের মধ্যে রংপুরের দিকে পশ্চাদপসরণ করে গেছে।

১লা এপ্রিল। সকালেই সারা শহর রাষ্ট্র হয়ে গেলো হানাদার বাহিনী পালিয়েছে। সারা শহরে আনন্দের ঢেউ। হরিগাড়ীর গোপন আড্ডা থেকে সার্কিট হাউজ কন্ট্রোল রুমে এসেছি। সুবেদার আকবর এসে দাঁড়ালেন। স্যার আড়িয়া ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করবো, অনুমতি চাই। কিছু জানিনা বুঝি না। মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেলো, ‘চলুন’।

৩৯ জন ইপিআর, ৫০ জন পুলিশ বাহিনীর লোক এবং ২০ জন মুক্তিসেনা। বেলা সাড়ে এগারোটা নাগাদ আড়িয়া ক্যান্টনমেন্ট উত্তর, পূর্ব এবং পশ্চিম এই তিন দিক থেকে ঘেরাও করা হলো। দু’পক্ষ থেকে গুলী বৃষ্টি চলছে। এরই মধ্যে বিমান আক্রমণ শুরু হলো। কিন্তু সবকিছু উপেক্ষা করে গ্রামের হাজার হাজার লোক টিনের ক্যানেস্তারা পেটাতে শুরু করলো। বোমাবর্ষণ বন্ধ হবার পর আবার কিছুটা এগুলাম। কিন্তু পাক সেনারা অবিরাম গুলী চালিয়ে যেতে লাগলো। অবশ্য তাদের সুবিধে ছিলো। ক্যান্টনমেন্ট পর্যন্ত পৌঁছাতে হলে আমাদের একটা ফাঁকা মাঠ পাড়ি দিতে হয়। সেদিন ছিলো দক্ষিণের জোর হাওয়া। গ্রামের লোকদের অনুরোধ জানানো হলো তারা ক্যান্টনমেন্টের দক্ষিণ দিক থেকে মরিচের গুড়ো ছাড়তে পারে কিনা। ব্যস আর বলতে হলো ণা। কোথা থেকে এত মরিচের গুঁড়ো ভেসে এলো তা বলা কঠিন। ক্যান্টনমেন্ট এর ৫০০ গজ উত্তরে আমাদের চোখ মুখ জ্বলতে লাগলো। বেলা তখন আড়াইটা। আড়িয়া ক্যান্টনমেন্ট সাদা পতাকা উড়লো। আনন্দের আতিশয্যে রাইফেল হাতে লাফিয়ে অসীম সাহসী যোদ্ধা মাসুদ। আর তৎক্ষনাৎ শত্রুর নিক্ষিপ্ত শেষ বুলেটটি তাকে বিদ্ধ করলো। শহীদ হলো নির্ভীক সেনা, বগুড়ার এক বীর সেনানী। যুদ্ধে জয় হলো। পাকিস্তানী সেনারা আত্মসমর্পণ করেছে। বন্দী সেনাদের এবং আটান্ন ট্রাক ভর্তি এম্যুনিশন নিয়ে ফিরলাম। কিন্তু চোখের জল বাধা মানছিলো না। মাসুদকে হারিয়ে এলাম চিরদিনের জন্যে। সেদিনই ঘোষণা করেছিলাম আড়িয়ার নাম হবে ‘মাসুদনগর’। রাতে ২১টি গান স্যালুটের মাঝে মাসুদকে কবরে সমাহিত করলাম। দেখলাম ডাক্তার জাহিদুর রহমানের দু’চোখেও জলের ধারা নেমে এসেছে।

আড়িয়ার ক্যান্টনমেন্ট একজন পাকিস্তানী ক্যাপ্টেন (ক্যাপ্টেন নূর) সহ ৬৮ জন সৈন্য আত্মসমর্পণ করেছে। এরমধ্যে ছিল ২১ জন পাঞ্জাবী সৈন্য। জনতার ক্রুদ্ধ আক্রমণের হাত থেকে এদের রক্ষা করতে পারিনি। জেলখানার তালা ভেঙ্গে ওদের বের করে নিয়ে এসে কুড়ুল এবং বঁটি দিয়ে কুপিয়ে আমার অনুপস্থিতিতে ওদের হত্যা করে। বাঙালি সৈন্য যারা ছিলো তাদের নজরবন্দী করে রাখা হলো। আড়িয়া ক্যান্টনমেন্টে কিছু চাইনীজ রাইফেল ও গুলি পাওয়া যায়। ৫৮ ট্রাক ভর্তি এম্যুনিশন পাই, কিন্তু তা ব্যবহারের অস্ত্র ছিলোনা। অস্ত্র বিশেষজ্ঞরা বললেন, সেগুলো ছিলো ১০৫ গান এবং আর-আর-এর এম্যুনিশন।

২রা এপ্রিল। পাবনার এস-পি জনাব সাঈদ এলেন এবং কিছু রাইফেলের গুলি নিয়ে যান। তাঁকে বললাম যেমন করে হোক ক্যাপ্টেন মনসুর আলী সাহেবকে বগুড়া নিয়ে আসতে।

৩রা এপ্রিল। জনাব কামরুজ্জামান, শেখ মনি এবং তোফায়েল আহমদ বগুড়া এসে উপস্থিত হলেন। ডাঃ মফিজ চৌধুরীকে সঙ্গে দিয়ে তাদের সীমান্ত পার করে দেবার ব্যবস্থা করলাম। জনাব শেখ মনির কাছেই জানতে পারলাম বঙ্গবন্ধু পাক সেনাদের হাতে বন্দী।

৪ঠা এপ্রিল। বগুড়া আওয়ামী লীগের জনাব আব্দুর রহিম তালুকদার জীপ নিয়ে ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে নিয়ে বগুড়া পৌছালেন। তার সঙ্গে জনাব আবু সাঈদ এম পি। মনসুর ভাইকে বিশেষ করে অনুরোধ করলাম যাতে প্রোভিশনাল গভর্ণমেন্ট এর নাম ঘোষনা করেন। মনে আছে একটা সিগারেটের প্যাকেটের সাদা অংশে বি-এস-এফ-এর কর্নেল মুখার্জীকে লিখেছিলাম মনসুর ভাইকে নিরাপদে তাজউদ্দীনের কাছে পাঠানোর জন্যে।

৫ই এপ্রিল। মেজর নাজমুল হক বগুড়া এলেন। জেলা প্রশাসক জনাব খানে আলমের কুঠিতে আলোচনা সভা বসলো। মেজর নাজমুল হক জানালেন যেমন করে হোক ১০৫ কামান এবং আর-আর জোগাড় করতে হবে। তিনি বললেন হিলিতে গিয়ে বির্গেডিয়ার চাটার্জীর সঙ্গে দেখা করতে। তার সঙ্গে আলোচনায় ঠিক হলো, যদি কোন প্রকারে আমরা রংপুর ক্যান্টনমেন্ট দখল করে উত্তরাঞ্চল শত্রুমুক্ত করতে পারি তাহলে ভবিষ্যতে পাকিস্তানিদের পাল্টা আক্রমণ ঠেকাতে পারবো।

৬ই এপ্রিল। সিদ্ধান্ত মোতাবেক আমি এবং জাহিদুর রহমান হিলি যাই। পশ্চিম হিলিতে গেলে আমাদের দু’জনকে এক প্রকার নজরবন্দী করে রাখে সারাদিন। সন্ধ্যায় জানালো রাত তিনটায় ব্রিগেডিয়ার চাটার্জী আমাদের সঙ্গে দেখা করবেন। রাত তিনটায় ব্রিগেডিয়ার চাটার্জীর সঙ্গে দেখা হলো। তিনি আমাদের দু’পেটি ৩০৩ রাইফেলের গুলি দিয়ে বিদেয় দিলেন এবং ১৬ই এপ্রিল হিলিতে তার সঙ্গে আবার দেখা করতে বললেন। জানালেন তিনি ভারত গভর্ণমেন্টকে আমাদের অবস্থা জানিয়ে অস্ত্র সাহায্য করতে অনুরোধ জানাবেন।

৭ই এপ্রিল। প্রায় খালি হাতেই বিকেল বেলা আমি এবং ডাঃ জাহিদুর রহমান হিলি থেকে ফিরলাম। মুক্তিসেনারা সাগ্রহে আমাদের প্রতীক্ষা করছিলো। কিন্তু আপাতত কোন সামরিক সাহায্য না পাওয়ায় কিছুটা হতোদ্যম হলো বলতে হলো। বলতে ভুলে গেছি, ২রা এপ্রিল থেকেই মুক্তি সেনাদের কয়েকটি ক্যাম্পে ভাগ করে দিয়ে সংক্ষিপ্ত ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করেছিলাম। করোনেশন স্কুলে একটি ক্যাম্প, সেন্ট্রাল হাই মাদ্রাসার একটি ক্যাম্প এবং জিলা আনসার অফিসের মাঠে একটি ক্যাম্প। ইপিআর বাহিনীর ব্যবস্থা করেছিলাম এডওয়ার্ড পার্কের কম্যুনিটি সেন্ট্রাল হলের এক তলায়। কন্ট্রোল রুম শিফট করেছিলাম দোতলায়। বগুড়া সার্কিট হাউজে প্রশাসন কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছিল। জনাব এম আর আখতার মুকুলকে কেরোসিন, ডিজেল এবং পেট্রোল এ পারমিট ইস্যু করার দায়িত্ব দেয়া হয়। খালি হাতে ফিরে আসার খবর জেনে মুকুল একানে ডেকে নিয়ে বললো, ‘শালা সেরেছে’. এবার আস্তানা গুটাও। পাকিস্তানী খুনীরা এবার তোমার জন্যে ট্যাংক নিয়া আইবো। এদিকে তোমার মুক্তি সেনাদের থামাও। এরা কোন শৃসংখলা মানেনা। এরাই এখন প্রবলেম। দেখলাম তাই। মুক্তি সেনাদের মধ্যে একদল ভীষণ উচ্ছৃংখল হয়ে উঠেছে। এদের নিয়ন্ত্রণ রাখাই মুশকিল। তাছাড়া পাকসেনা সরে যেতেই দলীয় কোন্দল মাথাচাড়া দিয়েছে। দুষ্কৃতকারীরাও সুযোগ নেবার চেষ্টায় আছে। শৃংখলা ফিরিয়ে আনার জন্যে চেষ্টা চালালাম।

৮ই এপ্রিল থেকে ১৩ই এপ্রিল বিশেষ কোন ঘটনা ঘটলোনা। ১৩ই এপ্রিল সিরাজগঞ্জের মহকুমা অফিসার শহীদ শামসুদ্দিন সাহেব দেখা করলেন এবং সিরাজগঞ্জ-নগরবাড়ির ডিফেনসের ব্যবস্থাও বগুড়া থেকে করতে অনুরোধ জানালেন।

১৪ই এপ্রিল হিলি থেকে একটা খবর আসে। যেসব এম্যুনিশন আড়িয়া যুদ্ধে পাওয়া গেছে তার নমুনা নিয়ে অতি অবশ্য হিলিতে দেখা করতে হবে। ১৪ই এপ্রিল রাতে সুবেদার আকবরের নেতৃত্বে মুক্তি সেনার একটি দল নগরবাড়ি প্রতিরক্ষার জন্য পাঠানো হলো।

১৬ই এপ্রিল, জনাব এম. আর. আখতার মুকুল, জনাব আসাদুজ্জামান, মজিবুর রহমান এমপি, ডাঃ জাহিদুর রহমান এমপি এবং দু’জন ইপি আরকে সাথে নিয়ে এম্যুনিশনের নমুনাসহ বিকেল বেলা হিলি পৌঁছে। সেদিন বিকেলেই কর্নেল ব্লিৎস এম্যুনিশন গুলো পরীক্ষা করেন। ঐদিন রাতেই আমাদের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্যে কোলকাতা যেতে বলা হয়। ১৭ই এপ্রিল ভোরে আমরা কোককাতা রওয়ানা হই। ১৯শে এপ্রিল সন্ধ্যায় লর্ড সিনহা রোডে অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ, অর্থমন্ত্রী জনাব মনসুর আলী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব কামরুজ্জামান এবং পার্লামেন্ট সদস্য জনাব আবদুল মান্নান এবং আবদুস সামাদ এর নিকট বগুড়ার মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে প্রতিবেদন পেশ করি।

২২শে এপ্রিল বগুড়া শহরের পতন ঘটে।

—————————————-

সশস্ত্র প্রতিরোধঃ পাবনা

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৩। পাবনা জেলায় সংঘটিত সশস্ত্র প্রতিরোধের বিবরণ ‘প্রতিরোধ সংগ্রামে বাংলাদেশ’ গ্রন্থ ১৯৭১

পাবনা শহরে পুলিশ ও জনতার প্রতিরোধ যুদ্ধ

(প্রতিরোধ সংগ্রামে বাংলাদেশ’ গ্রন্থে ‘পাবনার মুক্তিযুদ্ধ’ শীর্ষক অংশ হতে সংকলিত)

ইয়াহিয়ার জঙ্গী বাহিনী ২৫শে মার্চ তারিখে পাবনা শহরে এসে ঢুকে পড়ল। শহরের মানুষ আতঙ্কিত অবস্থায় দিন কাটাচ্ছিল। শিগগিরই এই ধরনের একটা ঘটনা ঘটে যাবে।  তারা মনে মনে এই আশঙ্কা করছিল। কিন্তু সেই ঘটনা যে এত তাড়াতাড়ি ঘটবে, সেটা তারা ভাবতে পারেনি। এই তারিখেই ঢাকা শহরে আক্রমণ শুরু হয়েছিল, কিন্তু সেটা গভীর রাত্রিতে। ওরা ২৫শে মার্চ শেষ রাত্রিতে পাবনা শহরে এসে হামলা করল।

শহর থেকে মাইল চারেক দূরে হেমায়তপুরের কাছে ইপসিক এর অফিস। পাক সৈন্যরা সেখানেই এসে ঘাঁটি গেড়ে বসল। তারপর সেখান থেকে কিছু সৈন্য শহরে এসে ট্রেজারী দখল করে নিল। তাছাড়া ২৭ জন সৈন্য টেলিফোন এক্সচেঞ্জ কেন্দ্র দখল করে বসল। তারা সারা শহরে কারফিউ জারী করে দিয়েছিল।

হামলাকারী সৈন্যরা শহরে এসেই আওয়ামী লীগের নির্বাচিত এম,এল,এ আমিনুদ্দীন সাহেব, ভাসানীপন্থী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির ডাক্তার অমলেন্দু দাক্ষী এবং আরও কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীকে গ্রেফতার করল। যারা ওদের হাতে ধরা পড়ল, শেষ পর্যন্ত তাদের সবাইকে ওদের গুলির শিকার হয়ে মরতে হয়েছিল। এর কয়েকদিন আগেই শহরের ডি,সি ও এস,পি স্থির করেছিলেন যে শহর আক্রান্ত হলে তারা প্রতিরোধ দেবেন। তাদের কাছ থেকে প্রেরণা ও উৎসাহ পেয়ে পুলিশ ব্যারাকের ১০০ জন সশস্ত্র পুলিশও মনে মনে প্রতিরোধের জন্য তৈরি হয়েছিল। যতক্ষণ শক্তি আছে, ততক্ষণ এই শহরকে তারা পশ্চিমাদের হাতে ছেড়ে দেবে না। যেটুকু শক্তি আছে, তাই নিয়েই ওদের বিরুদ্ধে লড়বে।

২৭শে মার্চ তারিখে সৈন্যরা পুলিশ ব্যারাকে যায়। এবং পুলিশদের অস্ত্রাগার তাদের হাতে ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দেয়। পুলিশরা এতে অসমর্থ জানায় এবং স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয় যে ডি,সি তাদের অস্ত্রাগার সামরিক কতৃপক্ষের কাছে ছেড়ে দিতে নিষেধ করেছেন। তার এই আদেশ কিছুতেই তারা অমান্য করতে পারবে না। এই নিয়ে দুই পক্ষে প্রথমে বাক-বিতন্ডা এবং পরে গুলিবর্ষণ চলে। তখন বলা শেষ হয়ে এসেছে। এই যুদ্ধে তিনজন সৈন্য মারা যায়। পাক সৈন্যরা বাহাদুর পুলিশ ভাইদের হাতে উপযুক্ত শিক্ষা পেয়ে পিছিয়ে গেল। কিন্তু এ শিক্ষাও ওদের পক্ষে যথেষ্ট হয়নি। সেই রাত্রিত্রে তারা নতুনভাবে আক্রমণ করবার জন্য তোড়জোড় চালাতে লাগল। রাত যখন সাড়ে চারটা তখন ওরা নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করে অতর্কিতে পুলিশ ব্যারাকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কিন্তু পুলিশ ভাইয়েরাও আগে থেকেই তৈরি হয়েছিল। সৈন্যরা যে আবার ফিরে এসে আক্রমণ করবে সে বিষয়ে তাদের মনে কোন সন্দেহ ছিল না। এবার আর ব্যারাকে নয়, ব্যারাক ছেড়ে নিকটবর্তী বাড়িগুলোর ছাদে এবং পথের মোড়ে মোড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের আড়াল নিয়ে হামলাকারী শত্রুদের জন্য বাঘের মত ওত পেতে বসে ছিল। তারা তো ছিলই, জেলখানার পুলিশ ভাইয়েরাও তাদের সঙ্গে এসে যোগ দিয়েছে। এইভাবে সারাটা রাত তারা শত্রুর জন্যে মৃত্যুফাঁদ সাজিয়ে বসে ছিল। রাত সাড়ে চারটার সময় দুপক্ষে সংঘর্ষ ঘটল। সৈন্যদের পরিবর্তে পুলিশরাই প্রথম আক্রমণ করল। এইভাবে অতর্কিত চারদিক থেকে আক্রান্ত হয়ে ইয়াহিয়ার সুশিক্ষিত সৈন্যরা হতভম্ব হয়ে গেল। এই সংঘর্ষে ২১ জন সৈন্য নিহত হবার পর বাকী সৈন্যরা ঊর্ধশ্বাসে প্রাণ নিয়ে পালাল। পুলিশদের মধ্যে একজনও মারা যায়নি। সাবাস! পাবনার পুলিশ ভাইয়েরা।

২৭শে মার্চ তারিখে পাবনা শহরের বুকে এ লড়াই শুরু হয়েছিল। ২৭শে থেকে ২৯শে, এই তিন দিন ধরে লড়াই চলল। ২৬শে আর ২৭শে এই দুইদিন ওরা শহরের উপর কারফিউ জারী করেছিল। তা সত্ত্বেও ঐ অবস্থাতেই শহরের যুবক ও ছাত্ররা ২৬শে মার্চ সারাদিন ও সারারাত প্রতিরোধের জন্য ভেতরে ভেতরে প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছিল। ঐ একটি দিনের মধ্যে তারা বেশ কিছু অস্ত্র হাত করে নিয়েছিল। সেই একটি দিনে কারফিউ আইন ভঙ্গকারীদের মধ্যে ৮/১০ জন সৈন্যদের গুলিতে মারা গিয়েছে, কিন্তু প্রতিরোধকারীদের মনোবল তাতে একটুও ভেঙ্গে পড়েনি।

পাবনা শহরে প্রতিরোধের ব্যাপারে ডি,সি-র প্রথম থেকেই সক্রিয় ভূমিকা ছিল। আওয়ামী লীগের নেতা আমজাদ সাহেব আর তিনি মিলিটারীর সতর্ক দৃষ্টি এড়িয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলবার জন্য ভেতরে ভেতরে চেষ্টা করে চলেছিলেন। তাঁরা দুইজন চর-অঞ্চলের গ্রামে গ্রামে কৃষকদের মধ্যে ঘুরে বেড়িয়েছেন এবং প্রতিরোধের ব্যাপারে তাদের উদ্বুদ্ধ করে তুলেছেন। মানুষ ভেতরে ভেতরে তৈরি হয়েই ছিল। তাদের এই আহবানে উৎসাহিত হয়ে দলে দলে কৃষক এই হামলাকারী শত্রুদের খতম করে দেবার জন্য শহরের দিকে ছুটে আসতে লাগল।

২৮শে মার্চ। ২৭ জন সৈন্য টেলিফোন এক্সচেঞ্জ দখল করে নিয়ে পাহারা দিয়ে চলেছিল। চরের কৃষকরা ছুটতে ছুটতে এসে তাদের ঘেরাও করে ফেলল। তাদের হাতে লাঠিসোটা, বর্শা-বল্লম, ধনুক, তীর আরও কত রকমের হাতিয়ার। ব্যারাক থেকে সকল পুলিশ চলে এসে তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। তাছাড়া শহরের যুবক ও ছাত্ররা দলে দলে ছুটে এসে তাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়াল। শেষ পর্যন্ত জনতা প্রায় ১৫ হাজারে এসে দাঁড়াল। তাদের গগনবিদারী জয়ধ্বনিতে সারা শহর কেঁপে উঠল, থরথরিয়ে কেঁপে উঠল অবরুদ্ধ পাক সৈন্যদের মন। এবার দু’পক্ষে গুলিবর্ষণ চলল। সৈন্যদের হাতে মেশিনগান ও উন্নত ধরনের অস্ত্রশস্ত্র। পুলিশরা শুধু রাইফেল নিয়ে লড়ছিল। জনতার মধ্যে যাদের হাতে বন্দুক ছিল, তারাও সৈন্যদের লক্ষ্য করে গুলি চালাচ্ছিল। সৈন্যরা টেলিফোন এক্সচেঞ্জের সুরক্ষিত আশ্রয়ে থেকে আড়ালে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করছিল। কাজেই সংখ্যাই কম হলেও তাদের খতম করে ফেলা সহজ কাজ ছিল না। ওদের মেশিনগানের অবিরাম গুলিবর্ষণকে ভেদ করে টেলফোন এক্সচেঞ্জ কেন্দ্রের উপর ঝাঁপিয়ে পড়া জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ার মতই দুঃসাহসের কাজ। সেই কারণেই অনেকক্ষণ পর্যন্ত যুদ্ধ চলল। হাজার হাজার জনতা এই যুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে কোন কার্যকর সাহায্য করতে  না পারলেও তাদের আকাশ-ফাটানো জয়ধ্বনি পাক সৈন্যদের মনে ত্রাসের সঞ্চার করে তুলেছিল। তারা হতবুদ্ধির মত হয়ে গিয়েছিল। তাই উন্নততর অস্ত্রশত্র হাতে থাকলেও তারা তাদের যথাযত প্রয়োগ করতে পারেনি। এমনিভাবে ঘন্টা খানেকের মধ্যে এক এক করে তাদের ২৭ জনই মারা গেল। টেলিফোন এক্সচেঞ্জ কেন্দ্র মুক্তিবাহিনীর হাতে এসে গেল।

জয়োল্লাসে মেতে উঠল সারা শহরের মানুষ। বুড়ো থেকে বাচ্চারা পর্যন্ত আনন্দধ্বনি করতে করতে ঘর ছেড়ে পথে এসে দাড়িয়েছিল। যে সমস্ত সৈন্য ট্রেজারী ও শহরের অন্যান্য জায়গায় মোতায়েন ছিল মুক্তিবাহিনীর প্রতি-আক্রমণের সূচনাতেই তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক নিহত হয়েছে, বাকী সবাই পালিয়ে গিয়েছে। সারা শহরের পথে পথে জনতার বিজয় মিছিল চলছে।

শহর থেকে শত্রুসৈন্যরা নিহত ও বিতাড়িত হলেও শহর বিপদমুক্ত নয়। শহর থেকে মাইল চারেক দূরেই ইপসিক এর অফিস বাড়িতে শত্রুসেনারা মূল বাহিনীর অধিকাংশ ঘাটি করে বসে আছে। তাদের সংখ্যা দেড়শতের মত। সংখ্যার দিক দিয়ে যাই হোক না কেন অস্ত্রশস্ত্রের দিক দিয়ে যথেষ্ট শক্তিশালী। শহরকে বাঁচাতে হলে তাদের রাহুগ্রাস থেকে শহরকে মুক্ত করতে হবে। একটা কথা মনে রাখতে হবে, যে বাংলাদেশে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম পর্যায়ে যারা উজ্জ্বল ভূমিকা পালন করে আসছে, পাবনা জেলায় সেই ইপিআর বাহিনীর কোন অস্তিত্ব ছিল না। পুলিশ ভাইয়েরাই এখানকার একমাত্র সশস্ত্র যোদ্ধা কিন্তু অস্ত্রশস্ত্রের দিক দিয়ে তারা খুবই দুর্বল। হামলাকারী পাক সৈন্যদের মূল ঘাঁটি থেকে হটিয়ে দেয়া তাদের পক্ষে দুঃসাধ্য। এক্ষেত্রেও জনতাই সামনে এগিয়ে এল।

পাবনা শহরের লড়াইয়ের খবরটা শহরের বাইরে বহুদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। বাইরে গ্রামাঞ্চল থেকে বিভিন্ন কৃষক সমিতির লোকেরা শহরকে শত্রুদের হাত থেকে মুক্ত করবার জন্য সুসংগঠিতভাবে এগিয়ে আসছিল। তারা দলে দলে এসে শত্রুপক্ষের মূল ঘাঁটিকে ঘেরাও করে ফেলল। রাত্রির অন্ধকারে ঘটনাটা এমন দ্রুতভাবে ঘটে গিয়েছিল যে, ওরা কৃষক জনতার এই অবরোধ থেকে বেরিয়ে পড়বার মত সময় বা সুযোগ পায়নি। পুলিশ ভাইয়েরাও এ আক্রমণে কৃষকদের সঙ্গে এসে যোগ দিয়েছিল। তারা শত্রুপক্ষের মেশিনগানের পাল্লার বাইরে দাঁড়িয়ে প্রতিরোধ দিয়ে চলেছিল।

অবরোধকারীদের প্ল্যান ছিল এই যে, তারা এইভাবে দিনের পর দিন বাইরের সঙ্গে যোগাযোগের পথ বন্ধ করে দিয়ে ওদের না খাইয়ে মারবে। কৃষক জনতার সংখ্যা বাড়তে বাড়তে প্রায় কুড়ি হাজারে এসে দাঁড়াল। মুক্তিবাহিনীর এই বিরাট সমাবেশের দিকে তাকিয়ে এবং তাদের উন্মত্ত গর্জন শুনে অবরুদ্ধ পাক সৈন্যরা এগিয়ে এসে আক্রমণ করতে সাহস পাচ্ছিল না। দু’পক্ষ পরস্পরের সঙ্গে কিছুটা দূরত্ব রক্ষা করে গুলি বিনিময় করে চলেছিল।

সময়ের সাথে সাথে অবরোধকারীদের সংখ্যা বেড়ে চলেছিল। ওদের দিকে তাকিয়ে পাক সৈন্যরা এটা নিশিচভাবে বুঝে নিয়েছিল যে এই সুদৃঢ় প্রতিরোধ ব্যূহ ভেঙ্গে বাইরে বেরিয়ে যাওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না। তাই তারা বেতারযোগে ঢাকায় সামরিক কতৃপক্ষের কাছে সমস্ত অবস্থাটা খুলে জানাল। জানাল যে, তাদের জীবন বিপন্ন, অবিলম্বে সাহায্য দরকার।

খবর পাঠাবার কিছুকাল বাদেই আকাশে জেট বিমানের ঘোর গর্জন শোনা গেল। শব্দ শোনে চমকে উঠে সবাই উপরের দিকে তাকিয়ে দেখল, সেই বিমান সমস্ত অঞ্চলটা প্রদক্ষিণ করে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছে। একটু বাদেই প্রচণ্ড বিষ্ফোরনের শব্দ। সেই হিংস্র যন্ত্র দানবটা জনতার ভীর লক্ষ্য করে একের পর এক বোমা ফেলে চলেছে। সঙ্গে সঙ্গে ভয়ার্ত চিৎকার আর ছুটোছুটি শুরু হয়ে গেল। শুধু বোমা ফেলা নয়, প্লেনটা মাঝে মাঝে বাজপাখির মত ছোঁ মেরে নীচে নেমে আসছে, আর এক এক পশলা মেশিনগানের গুলিবর্ষণ করে চলে যাচ্ছে। বোমারু বিমানের এই অতর্কিত আক্রমণে কিছু সংখ্যক লোক হতাহত হল, জনতা ইতস্তত ছত্রভঙ্গ হয় যেতে লাগল। অবরুদ্ধ পাক সৈন্যরা এই সুযোগে অবরোধের বেড়া ভেঙ্গে ঊর্ধশ্বাসে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে গেল। কিন্তু তাদের সঙ্গী সবাই পালিয়ে যেতে পারেনি। অবরোধ ভেঙ্গে গেলেও মুক্তিবাহিনীর একদল সশস্ত্র যোদ্ধা তখনও তাদের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল। কিছুসংখ্যক সৈন্যকে হতাহত অবস্থায় রণক্ষেত্রে ফেলে রেখে অবশিষ্ট পাক বাহিনী এই মৃত্যুর হাত থেকে পালিয়ে বাঁচল।

এইভাবে শত্রু সৈন্যদের বিতাড়িত করে জয়োন্মত্ত কৃষক-জনতা উল্লাসধ্বনি করতে ফিরে এল। মুক্ত নগরী পাবনা উৎসবমুখর হয়ে উঠল। কিন্তু পরদিন এই উৎসবের আনন্দ-কোলাহলের মধ্যে বিষাদের এক কালো ছায়া নেমে এল। এই মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম নায়ক আওয়ামী লীগ নেতা আমজাদ সাহেব ২৯শে মার্চ তারিখে হটাৎ করোনারী থ্রম্বসিস রোগে মারা গেলেন। এ সম্বন্ধে কোনই সন্দেহ নেই যে, যুদ্ধাবস্থায় কঠিন পরিশ্রম ও দারুণ উত্তেজনাই তাঁর এই অকালমৃত্যুকে ডেকে এনেছিল। একথা বললে ভুল হবেনা যে, পাবনা শহরের মুক্তিযুদ্ধে যারা প্রাণ দিয়ে শহীদ হয়ে গেছেন, আমজাদ সাহেব তাঁদের মধ্যে অন্যতম।

কিন্তু এই মুক্তিযুদ্ধের এইখানেই ইতি নয়। বিতাড়িত পাক-সৈন্যরা তাঁদের ইপসিকের ঘাঁটি ছেড়ে প্রাণ নিয়ে পালাল বতে, কিন্তু শেষরক্ষা হলো না। উদভ্রান্ত ও পলাতক সৈন্যদের পালাবার পথে পর পর দু’বার – প্রথম দাশুরিয়া পরে মূলাডুলিতে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের মুখে পড়তে হয়েছিল। এই দুই জায়গাতেই প্রচণ্ড সংঘর্ষ ঘটেছিল। দুই সংঘর্ষের ফলে অবশিষ্ট পাকবাহিনীর প্রায় সকলকেই প্রাণ দিতে হলো, কেবলমাত্র চারজন প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যেতে পেরেছিল।

———————————————————-

 

সিরাজগঞ্জ এলাকার সশস্ত্র প্রতিরোধ
সাক্ষাৎকার- মোজাফফর হোসেন
২৫-০৮-১৯৭৩
(বাংলা একাডেমির দলিলপত্র থেকে সংগৃহীত)

২৫শে মার্চের ঘটনা। রাত একটার দিকে মহকুমা প্রশাসক শামসুদ্দিন সিএসপি (শহীদ) আমাকে সংগ্রাম পরিষদে জানালেন- পুলিশ, আনসার বাহিনীর যতো অস্ত্র আছে সব তোমাদের জন্য দিবো প্রতিরোধের জন্য।

২৬শে মার্চ বিভিন্ন স্থানে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। ছুটি ভোগরত পাক বাহিনীর সেনা, আনসার, পুলিশ, ছাত্র, সাধারণ লোক, অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক সব মিলে মুক্তিবাহিনী গড়ে তোলা হয়। প্রাথমিক অবস্থায় অস্ত্র হিসেবে রাইফেল, বন্দুক, টু-টুবোর রাইফেল নিয়ে যুদ্ধে নামা হয়।

বগুড়ার আড়িয়ার বাজারে আগে থেকেই পাক বাহিনীর ঘাঁটি ছিলো। মার্চ মাসের শেষের দিকে সাধারণ লোক সামান্য অস্ত্র নিয়ে পাক বাহিনীর উপর ঝাপিয়ে পড়ে। ৩০ জনের মতো পাক সেনা ছিলো সেখানে। আকাশ পথে বিমান আক্রমণ চালায় পাক বাহিনী। ওদের গুলি ওদের গায়েই লাগে। গোলার ডাম্প থেকে আগুন লেগে যায়। বিমান বাহিনীর গুলিতেই বেশ কিছু পাক সেনা খতম হয়। তারপর জনসাধারণ ঢুকে পড়ে, অনেককে আত্মসমর্পন করায়। অনেককে হত্যা করে পিটিয়ে।

আমি এবং এসডিও শামসুদ্দিন সাহেব এদিন বগুড়া গিয়ে সেখানকার মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সমঝোতা করে কিছু অস্ত্র এবং বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রায় ২০ জন এবং ইপিআর’এর প্রায় ৩০ জন নিয়ে সিরাজগঞ্জ চলে আসি। তখন আমাদের কাছে ছিলো ৭টি চাইনিজ রাইফেল, মার্ক ৪৬টি, রাইফেল ৫/৬টি।

২৬শে মার্চ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। তখন আমাদের থাকা খাওয়া, বেতন সহ যাবতীয় ব্যবস্থা আওয়ামী লীগ করতে থাকে।

সিরাজগঞ্জ যমুনার পাড়ে আমরা ৬/৭টি ছোট ধরনের কামান পেতে রাখি যার দূরত্ব এক মাইলের মতো। এই কামানগুলো তৈরী করেছিলো আমাদের স্থানীয় লোক আবুল মিস্ত্রী।

এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে খবর পেলাম টাঙ্গাইলের ঘাটে ৭টি লঞ্চ গেছে পাক বাহিনীকে নিয়ে যাবার জন্য। আমি তিনজন ছেলেকে এবং কিছু অস্ত্রসহ স্পীডবোট নিয়ে টাঙ্গাইল ঘাটে পৌঁছে ফাঁকা আওয়াজ করে সারেংদের আটকিয়ে ১১টি লঞ্চসহ সিরাজগঞ্জ ফিরে আসি।

বাঘাবাড়ীতে প্রতিরোধঃ এপ্রিল মাসের মাঝামাঝিতে প্রায় ১৫০ জন ছেলেসহ আমি বাঘাবাড়ী ঘাটে ডিফেন্স দেই। আমার সাথে লতিফ মীর্জা, গোলাম কিবরিয়া, সোহরাব হোসেনও ছিলো। পরদিন ইপিআর, আনসার, পুলিশ ও বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে প্রায় ১০০ জন যোদ্ধা আমার এখানে পাঠিয়ে দেন এসডিও সাহেব।

বাঘাবাড়ীতে নদীর পাড়ে ২ মাইলব্যাপী ২০০ গজ পরপর পাকা পরিখা খনন করে সেখানে ডিফেন্স নিয়ে থাকি। তার পরদিন এসডিও সাহেব নিজে আমাদের ডিফেন্সে আসলেন প্রায় ৫০ জন ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক নিয়ে।

আরিচা ঘাট রক্ষা করার জন্য প্রায় ১০০ জন বেঙ্গল রেজিমেন্টে এবং ইপিআর বাহিনীর লোক নিয়ে আমি এবং এসডিও সাহেব অগ্রসর হই। কাশিনাথপুর পৌঁছালে শুনলাম আরিচার পতন ঘটেছে। তখন আমরা কাশীনাথপুরে জঙ্গলের ভিতরে আমাদের ঘাঁটি করি। সেখান থেকে ১০ মাইলের মধ্যে পাক ঘাঁটি আছে শুনলাম (গ্রামের নাম মনে নাই)। এসডিও শামসুদ্দিন সাহেবের কমান্ডে আমরা ১০০ জন তিন ভাগে ভাগ হয়ে পাক ঘাঁটি আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেই। একদল আক্রমণ চালাবে, একদল গাড়ী ধ্বংস করবে এবং আরেকদল ব্রিজ ধ্বংস করবে একই সময়ে। আমরা আক্রমণ করি রাত দুইটার দিকে। একই সাথে ব্রিজ ধ্বংস, ৫টি ট্রাক ক্ষতিগ্রস্থ এবং ১৯ জন পাকসেনা খতম হয়েছে শুনলাম। পরদিন ভোরবেলা আমরা ফিরে আসি। আমাদের একজন ইপিআর জোয়ান গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়। তাকে সিরাজগঞ্জ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেই।

এপ্রিল মাসের ২৫ তারিখের দিকে এসডিও সাহেব ফিরে আসলেন বাঘাবাড়ী ঘাট থেকে। তিনি আবার গেলেন বাঘাবাড়ী ঘাটে। আমিও গেলাম এসডিও সাহেবের সাথে। তার পরদিন পাক বাহিনী দুপুর ১টার দিকে হঠাৎ করে কাশীনাথপুর ক্যাম্প আক্রমণ করে। একজন হাবিলদারকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিলো ক্যাম্পের। আমাদের জোয়ানরা বিশ্রাম করছিলো। ঠিক এমন সময় শত্রুরা মর্টার আক্রমণ চালায়। ৩০/৪০ মুক্তিযোদ্ধা এখানে শহীদ হয়। বাকিরা পালিয়ে যায় অস্ত্র ফেলে। পাক সেনারা আমাদের প্রচুর অস্ত্র উদ্ধার করে। আমি ১৫ জন উদ্ধারকর্মী নিয়ে পরদিন চারদিকে খুজতে লাগলাম আমাদের বাহিনীর লোকদের। ২ জন আহত বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ৮/১০ জন অন্যান্য জোয়ান নিয়ে বাঘাবাড়ী ঘাটে চলে আসি। আমাদের ডিফেন্স আরো জোরদার করি।

মে মাসের প্রথম সপ্তাহে লতিফ মীর্জাকে বাঘাবাড়ী ঘাটের দায়িত্ব আমি এবং এসডিও সাহেব অস্ত্র সংগ্রহের জন্য ভারতে যাই। সিদ্ধান্ত হয় যে ৪ কোটি টাকার অস্ত্র কিনা হবে। পশ্চিম দিনাজপুরে ভারতীয় কর্নেলের সাথে দেখা করেন আমাদের এসডিও সাহেব। যাবার পথে হিলি সীমান্তে ক্যাপ্টেন আনোয়ার আমাদেরকে খুব বেশী অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করতে পারবেন না জানান। তারপরই আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে দিনাজপুরে যাই। এসডিও সাহেব অস্ত্র কিনতে চান। কর্নেল জানান, এভাবে অস্ত্র বিক্রি করা যায় না। এসডিও সাহেবের না খাওয়া না স্নান। চিন্তায় মাথা প্রায় খারাপ ছিলো। তাই কর্নেল সাহেব অস্ত্র বিক্রি করতে অস্বীকার করলে এসডিও সাহেব খুব রাগারাগি করেন। বাকবিতন্ডা হয়। কর্নেল সাহেব পাক স্পাই মনে করে আমাদের দুজনকে বন্দী করেন। আমি কোনক্রমে খবর পাঠিয়ে কংগ্রেস নেতা এবং ছাত্রনেতার কাছে আমাদের অবস্থা জানাই। ছাত্রনেতা এবং কংগ্রেস এমপিদের প্রচেষ্টায় আমরা মুক্তি পাই। তারপর ফিরে আসি বাঘাবাড়ী ঘাটে।

ফিরে শুনলাম সিরাজগঞ্জে বাঙালি বিহারী মারামারি হয়েছে। বিহারীদের নিরাপত্তার জন্য ওসি সাহেব সকল বিহারীকে গ্রেফতার করে জেলখানাতে নিয়ে আসেন। এসডিও সাহেব ও আমি বাঘাবাড়ী ঘাটে ফিরে যাই আবার।

মে মাসের ২০ তারিখের দিকে বাঘাবাড়ী নদীর অপর পাড়ে পাক বাহিনী বাংকার করা শুরু করে। আমরা আক্রমণ করি। ক্রমাগত চারদিন পর তারা বিমান হামলা চালায় আমাদের উপর।

২৩/২৪ তারিখের দিকে আমরা পিছু হটে উল্লাপাড়া চলে আসি। আমরা প্রায় ১৫০ জন ছিলাম তখন। পাক বাহিনীকে সিরাজগঞ্জ পাঠানো হয়। আমরা প্রায় ৪০০ জন ছিলাম।
আমরা উল্লাপাড়া থেকে ২/৩ রাতে আকস্মাৎ বাঘাবাড়ী ঘাটে পাক বাহিনীর উপর হামলা করে পালিয়ে যাই।

ঘটনা প্রতিরোধঃ মে মাসের ২৫ তারিখে পাক বাহিনী উল্লাপাড়া আক্রমণ করলে আমরা ঘাটনা (সলপ) ব্রিজে আসি। আমরা সলপ স্কুলে আশ্রয় নেই। এসডিও সাহেব ও লতিফ মীর্জা আমাদের সাথে। এখানে ইপিআর ও বেঙ্গল রেজিমেন্টের জোয়ানরা বলে, “আমরা শেষ পর্যন্ত মারা যাবো, শেষবারের মতো স্ত্রী ছেলেমেয়েদের দেখতে দিন।” এসডিও সাহেব প্রত্যেককে ২০০/৩০০/১০০ টাকা করে দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন। বেঙ্গল রেজিমেন্টের নায়েক মহিউদ্দিন আমাদের ছেড়ে গেলেন না।

শেষ সময়ে আমরা ১০০ জন ছিলাম ঘাটনাতে। এসডিও শামসুদ্দিন সাহেব নিজে কমান্ডিং অফিসার। ৪/৫ আমরা না খেয়ে ছিলাম।

সিদ্ধান্ত হয়, এসডিও সাহেব ৪০ জন ছেলে নিয়ে অস্ত্রসহ সিরাজগঞ্জ যাবেন সিরাজগঞ্জ রক্ষার জন্য। এখানে ২০০ মুক্তিযোদ্ধা ছিলো। আমরা ৫০/৬০ জন থাকবো ঘাটনাতে। পাক বাহিনীকে বাধা দিতে শেষ পর্যন্ত সিরাজগঞ্জে এসে শেষ যুদ্ধ হবে। সেই মোতাবেক এসডিও সাহেব চলে যান। আমি, লতিফ মীর্জা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক থাকলো ঘাটনাতে। আমি এবং লতিফ মীর্জা ১০ জনের খাবার যোগাড় করে ঘাটনা ব্রিজে রওয়ানা হই। কারণ ওখানে সামাদের নেতৃত্বে ১০ জন যোদ্ধা ছিলো পাহারায়। আমরা খাবার পৌঁছিয়ে দেখতে পেলাম একটি ট্রেন আসছে ঈশ্বরদী থেকে। আমাদের আর খাওয়া হলো না। খাবার পাঠিয়ে দিয়ে আমরা ১২ জন দুদিক থেকে ডিফেন্স নেই। আমাদের ২টি এলএমজি এবং ১০টি চাইনিজ রাইফেল ছিলো। ট্রেনটি ব্রিজের কাছে আসলে দেখলাম পাক সেনাতে ভর্তি। ওরা মাইন সরাচ্ছে আর অগ্রসর হচ্ছে। পাক সেনারা নেমে এখানে ওখানে ঘুরাফিরা করছে। মিস্ত্রিরা লাইন সারছে। ক্রমশ ৪০/৫০ জন পাক সেনা ব্রিজের একস্থানে একত্রিত হতে থাকে। পাক সেনাদের সাথে বেসামরিক পোশাকে অনেক বিহারীকে দেখলাম। ৪০/৫০ জন একসাথে হলে আমি ফায়ার ওপেন করতে বলি। সাথে সাথে ১০টি চাইনিজ রাইফেল ও ২টি এলএমজি গর্জে উঠে। ক্রস ফায়ারের সাথে সাথে সবকটি সৈনিক মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। বাকীরা সব ট্রেনে উঠে ট্রেনটি পিছনে নিয়ে গিয়ে অনবরত মেশিনগান এবং মর্টার দিয়ে বৃষ্টির মতো গুলি ছুড়তে থাকে। ৩ ঘন্টা গুলি ছোড়ার পর আমরা জঙ্গল থেকে বের হই। আমরা ক্লোজ রেঞ্জে থাকায় আমাদের কোনো ক্ষতি হয়নি। কিন্তু এক মাইল দূরে আমাদের ক্যাম্প গোলা পড়াতে আমাদের ছেলেরা সবাই পালিয়ে যায়। তারা মনে করে আমরা সবাই মারা গিয়েছি। রাতে কিছুদূর এসে মনে হলো যে, বাইনোকুলার ফেলে এসেছি। বাকীদের রেখে আমি ও মহিউদ্দিন ঘাটনা ব্রিজে যাই বাইনোকুলার খুঁজতে। সেখানে পৌঁছে দেখলাম একটি নৌকা দিয়ে কিছু সেনা পার হচ্ছে। কৌতুহল বশতঃ বাইনোকুলার খোঁজা বাদ দিয়ে পজিশন নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম কি হয় দেখার জন্য। দেখলাম চার জন সেনা পারে নামলো। আকস্মাৎ তারা হারিয়ে যায়। আমরা চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণ পর পাতার মরমর শব্দ পেলাম এবং আমাদের দিকে ছায়ার মতো কিছু আসছে দেখলাম। আমাদের হাতের দুটি চাইনিজ এসএমজি একসাথে গর্জে উঠে। পতনের শব্দ পেলাম। পাল্টা কোনো গুলি হয় না। বুঝলাম সব খতম। তার পরপরই নদীর অপর পার থেকে ঝাঁক ঝাঁক গুলি আসতে লাগলো। আধ ঘন্টা পরে গুলি বন্ধ হলে ক্রলিং করে পালিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে এসে আর সব সাথীদের সাথে মিলিত হই। ক্যাম্পে এসে শুনি আমাদের ছেলেরা সব পালিয়েছে। লোকজন অস্ত্র কেড়ে নিয়েছে, জিনিসপত্র লুট করেছে। নাম সংগ্রহ করে চারজনকে ধরে গুলি করে হত্যা করা হয়। পাক বাহিনী ব্যাপকভাবে আক্রমণ চালায় দু’ঘন্টা যাবৎ। বৃষ্টির মতো মর্টার ও অন্যান্য অস্ত্রের সাহায্যে গুলি চালায়। গুলি বন্ধ হলে আমরা পালিয়ে সিরাজগঞ্জের দিকে রওয়ানা হই।

————————————————-

শাহজাদপুরসহ অন্যান্য স্থানের সশস্ত্র প্রতিরোধ
সাক্ষাৎকার-আব্দুর রহমান, প্রাক্তন গণপরিষদ সদস্য
১২-১১-১৯৭৩

(বাংলা একাডেমীর দলিলপত্র থেকে সংগৃহীত)

২৫শে মে দিবাগত রাত দুটোর সময় শাহজাদপুর থানার ওসি আমার কাছে একজন পুলিশ পাঠিয়ে সংবাদ দেন যে, “ঢাকায় সামরিক বাহিনীর বিদ্রোহ হয়েছে এবং ইয়াহিয়া খানকে বন্দী করে রাওয়ালপিন্ডি পাঠিয়েছে। আপনি অবিলম্বে থানায় এসে সকলের সঙ্গে আলোচনা করে কর্তব্য নির্ধারণ করুন।” আমি ভেবে দেখলাম এ সংগ্রামের কেবল শুরু, অনেকদিন চলবে। কাজেই উত্তেজিত না হয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। থানায় গিয়ে দেখি অনেক আওয়ামী লীগ কর্মীও এসেছেন। সকলের সঙ্গে পরামর্শ করে ঠিক হলো আমাদের প্রথম কাজ যোগাযোগের ব্যবস্থা বন্ধ করা। সেই অনুযায়ী বাঘাবাড়ীর ফেরী বন্ধ করার দায়িত্ব দিয়ে আবুল হোসেন চৌধুরীকে পাঠানো হলো। আমি উল্লাপাড়া ও তার পরবর্তী এলাকার কাজ কর্ম তদারক করার জন্য মোটর সাইকেলযোগে সেদিকে রওয়ানা দিলাম। উল্লাপাড়ার জনপ্রতিনিধি (এমপিএ) এলাকায় অনুপস্থিত থাকেন এবং রায়গঞ্জ থানার প্রতিনিধিও তাড়াশে থাকেন বিধায় ঐ এলাকার জরুরী দায়িত্ব পালন কর্তব্য মনে করে আমি ঐদিকে রওয়ানা দেই। প্রথমে আমি সরাসরি রায়গঞ্জ থানায় যেতে চাই। কিন্তু ঐ এলাকার রাস্তায় বড় বড় গাছ থাকায় রায়গঞ্জ থানা পর্যন্ত পৌঁছানো সম্ভব না হওয়ার জন্য কিছু আওয়ামী লীগ কর্মীর সঙ্গে সমস্ত বিষয় আলোচনা করে তাদের কর্তব্য নির্ধারণ করে ফিরে আসি। উল্লাপাড়া থানায় এসে সেখানকার কর্মচারীদের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের কর্তব্যও নির্ধারণ করে ফিরে আসি। আমার এই কয়েক ঘন্টার সফরে জনসাধারণের যে আন্তরিকতা দেখেছি তার তুলনা হয় না।

সম্ভবতঃ ২৯/৩০ মার্চ আমি বঙ্গবন্ধুর শেষ সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশনামা পাই। আমি এটি অনুবাদ করার ও ছাপানোর ব্যবস্থা করি। ছাপানোর দায়িত্ব এককালীন কনভেনশন লীগ নেতা ও পার্লামেন্টারী সেক্রেটারী ও পরবর্তীকালের জেলা শান্তি কমিটির প্রধান মৌলানা সাইফউদ্দিন ইয়াহিয়া সাগ্রহেই নিয়ে ছিলেন ও দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করেছিলেন।

এই সময়ে ‘শাহজাদপুর স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করা হয়। শাহজাদপুরের আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগ কর্মী ও সরকারী কর্মচারীদের মিলিত সভায় সাতজন সদস্যের সমন্বয়ে এই কমিটি গঠন করা হয়। আমি ঐ সভায় সভাপতিত্ব করি এবং স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিষদেরও সভাপতি নির্বাচিত হই। এই কমিটির সদস্যগণ ছিলেনঃ

১) জনাব আবদুর রহমান (এমপিএ)-সভাপতি

২) জনাব আবদুল লতিফ খান

৩) জনাব আবুল হোসেন চৌধুরী

৪) তাহাজ্জদ হোসেন (অধ্যক্ষ)

৫) বাবু ননী-গোপাল সাহা

৬) সিআই, পুলিশ স্টেশন

৭) ওসি, পুলিশ স্টেশন

শাহজাদপুরে স্বাধীনতা যুদ্ধের যাবতীয় কাজের দায়িত্ব এই কমিটির উপর থাকলেও অন্যান্য অত্যন্ত জরুরী কাজের জন্য কয়েকটি উপ-কমিটিও গঠন করা হয়। খাদ্য সরবরাহের দায়িত্ব দেওয়া ছিলো ১৯৫৪ সালে আওয়ামী লীগ দলীয় এমএলএ জনাব আবু মোহাম্মদ ইউনুস সাহেবের উপর। টাকা পয়সা সংগ্রহের দায়িত্ব ছিলো বাবু বিনোদবিহারী জোয়ারদারের উপর। প্রচারের দায়িত্ব ছিলো জনাব আবদুল গফুর সবরতের উপর।

আমরা প্রথম থেকেই আমাদের অস্ত্রের অপ্রতুলতার কথা জানতাম। ইতিমধ্যে সংবাদ পেলাম যে, বগুড়ার নির্মীয়মান ক্যান্টনমেন্ট ওখানকার মুক্তিযোদ্ধারা দখল করেছে। আমি বেড়ার জনপ্রতিনিধি এমএনএ জনাব আবু সাইদের সঙ্গে যোগাযোগ করে উভয়ে কয়েকজন কর্মীসহ বগুড়া গেলাম। এটা এপ্রিলের ৪ তারিখ। সেখানে গিয়ে ঐদিন লোক ও অস্ত্র না পেয়ে আমাদের কর্মীদের চান্দাইকোনা রেখে আমি ও আবুল চৌধুরী ফিরে এলাম। এলাকার কাজের জন্য আমাকে ফিরে আসতে হলো। আমি ফিরে এসে নগরবাড়ী এলাকার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দেখতে গেলাম। কারণ ঐ সময়ে নগরবাড়ী রক্ষা করা না গেলে আমাদের বাঘাবাড়ী রক্ষা প্রচেষ্টার কোনো মানেই থাকবে না। নগরবাড়ীতে কোনো জনপ্রতিনিধি না থাকায় আমার পক্ষে ঐ স্থানের কাজকর্ম বাদ দিয়ে আসা সম্ভব হলো না।

নগরবাড়ীতে আমি নিয়োজিত থাকায় বগুড়াতে না যেতে পেরে আবুল চৌধুরীকে দায়িত্ব দিয়ে পাঠালাম। সেখান থেকে আমাদের খুব সামান্য অস্ত্রই দেয়া হয়েছিলো। যাই হোক, নগরবাড়ীতে আমাকে এবং ক্যাপ্টেন (বর্তমানে মেজর) নাজমুল হুদাকে সব সময় একসঙ্গে পরামর্শ করেই কাজ করতে হতো। পাবনা থেকে বেশ কিছু মুক্তিযোদ্ধা এসেছিলো। আমি এবং ক্যাপ্টেন হুদা প্রথমেই স্পীডবোট নিয়ে সমস্ত নদী এলাকা ঘুরে দেখলাম। দেখলাম যে, পাক বাহিনী নগরবাড়ীতে সরাসরি না এসে নগরবাড়ীর ৮/৯ দক্ষিণ দিক দিয়েও পার হয়ে নগরবাড়ী-পাবনার পাকা রাস্তায় উঠতে পারে। আমরা সেজন্য ঐ সমস্ত এলাকায় গিয়ে জনসাধারণকে প্রয়োজনীয় উপদেশ দিয়ে আসি।

৯ই এপ্রিল বেলা ৪টার দিকে পাক বাহিনী বিমান আক্রমণ করে আমাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। কয়েকজন আহত হয়। বিমান আক্রমণের কথা আমরা এতটা ভাবি নাই। সতর্কতার কোনো উপায় ছিলো না। কারণ পাবনা গিয়ে আমি ও ক্যাপ্টেন হুদা মেশিনগান নিয়ে আসি। পরে দেখা গেলো সেটার পিন ভাঙ্গা। এর দুই দিন আগে ঈশ্বরদী থেকে একটা হাত সাইরেন আনা হয়েছিলো। সন্ধ্যার পর দেখা গেলো সেটার একটা পার্টস কেউ ভেঙ্গে রেখেছে যে বাজানো যায় না।

ক্যাপ্টেন হুদা বারে বারেই অস্ত্রের কথা বলছিলেন। কিন্তু পাবনা ও বগুড়া ছাড়া আর কোথাও আমার চেষ্টা করার জায়গা ছিলো না। তৎকালীন ডিসি জনাব নুরুল কাদের খানের মাধ্যমে চেষ্টা করে কুষ্টিয়া থেকে কিছু আনসার আনা হয়েছিলো। কিন্তু প্রথম দিনের বিমান আক্রমণের পরই তারা চলে যায়।

পরদিন ১০ই এপ্রিল সকালে আবার বিমান আক্রমণ হয়। ঐদিন আমাদের কেউ হতাহত হয়নি। শুধু কয়েকজন গ্রামবাসী মারা গিয়েছিলো তবে আমাদের পুরো বাহিনী বিশৃঙ্খল হয়ে যায়।

বাঘাবাড়ী প্রতিরোধঃ শাহজাদপুর এসে আমি বাঘাবাড়ীতে প্রতিরোধ গড়ার উদ্যোগ নেই। এমন সময় সিরাজগঞ্জের তৎকালীন এসডিও জনাব শামসুদ্দিন আসেন এবং যুদ্ধের প্রধান কাজকর্ম তিনি উপস্থিত থেকে করান। তিনি অবশ্য পরে শাহজাদপুরে ছিলেন না, মাঝে মাঝে আসতেন।

নগরবাড়ী থেকে আসার পর আমি বগুড়ার সাথে যোগাযোগ করি। সেখান থেকে বেশ কিছুসংখ্যক ইপিআর আসে। তাদের নিয়ে প্রথমে বেড়া যাই। পরবর্তী সময়ে জনাব শামসুদ্দিনের সঙ্গে পরামর্শ করে একদিন রাতে আমরা নগরবাড়ীতে অবস্থানরত পাক বাহিনীকে আক্রমণ করার প্রোগ্রাম করি। কিন্তু অনেকের বিশেষ করে ট্রাক ড্রাইভারের অসহযোগীতার জন্য ঐ আক্রমণ সফল হয় নাই। আমরা নিজেরা প্রায় দুই ঘন্টা ধাক্কিয়েও ট্রাক সচল করতে পারিনি। অতঃপর ভীষণ বৃষ্টি ও বাতাসে খেজুরপাতার পাটিতে খোলা ঘরের মাটিতে শুয়ে থেকে ঠান্ডায় যখন হাত পা হিম হয়ে এসেছিলো তখন আমরা কোনোক্রমে রাত ৪টায় বেড়া সিএণ্ডবি ডাকবাংলোয় চলে আসি। ঘন্টাখানেক পর সমস্ত বাহিনীও বৃষ্টিতে ভিজে ফিরে আসে। আরও কয়েকটি আক্রমণের পরিকল্পনা আমরা করলেও নানা ত্রুটির জন্য তা সফল হয় নাই।

অবশেষে ১৯শে এপ্রিল পাক বাহিনীই বেড়ার ডাব-বাগানে অবস্থানরত আমাদের বাহিনীর উপর আক্রমণ করে। উভয় পক্ষেই প্রচুর ক্ষতি হয়। পরের দিনই বাঘাবাড়ীতে অবস্থানরত আমাদের সংগৃহীত ও সিরাজগঞ্জের সশস্ত্র বাহিনী ঐ এলাকা ত্যাগ করে। তার পরদিন আমার কাছর খবর আসে যে, ডাব-বাগানে আমার পক্ষে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের কবর দেওয়া হয় নাই। আমি দুইজন কর্মী নিয়ে অমনি রওয়ানা দেই। কিন্তু বেড়া পৌঁছার পর ঐ স্থানের কর্মীরা আর আমাদের অগ্রসর হতে দেয় নাই।

২২শে এপ্রিল পাক বাহিনী বাঘাবাড়ীতে এসে শাহজাদপুরকে লক্ষ্যে করে শেল মারতে থাকে এবং তারপর বাঘাবাড়ী ও শাহজাদপুরের পতন হয়।

—————————————————–

মুক্তিপাগল এক সরকারী অফিসার

(দৈনিক বাংলা, ১৫ জানুয়ারী, ১৯৭২-এ মনজুর আহমদ প্রদত্ত প্রতিবেদন)

তিনি শুধু একজন মহকুমা প্রশাসক বা সিএসপি অফিসারই ছিলেন না, তিনি ছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একজন অগ্রসেনা, এক নির্ভীক যোদ্ধা। মুক্তি সংগ্রাম শুরুর সেই প্রথম ক্ষণেই সিরাজগঞ্জে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মুক্তিপাগল এই বীর সেনানী। শুধু সিরাজগঞ্জেই নয়, সারা উত্তরবঙ্গই উত্তাল হয়ে উঠেছিল তার সেই বলিষ্ঠ সংগ্রামী ভূমিকায়। সবাই তাকে ভূষিত করেছিল কর্নেল উপাধিতে। সবাই তাকে ডাকতো কর্নেল শামসুদ্দিন নামে। নাম ছিল তার এ, কে, শামসুদ্দিন।

শামসুদ্দিন তখন ছিলেন সিরাজগঞ্জের এসডিও। গণতন্ত্র ফিরিয়ে দেবার মিথ্যা প্রলোভনে এদেশের মানুষকে মাসের পর মাস সন্দিগদ রেখে সেই পঁচিশে মার্চের যে ভয়াল রাতে পাকিস্তানী হানাদাররা তাদের হিংস্র বিষাক্ত থাবা মেলে ঝাপিয়ে পড়েছিল গ্রামবাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ওপর, সেই ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ দিনে এদেশের অসহায় মানুষের পক্ষে হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রথম যারা রুখে দাঁড়িয়েছিলেন জনাব শামসুদ্দিন তাদের অন্যতম।

শুধু রুখে দাঁড়িয়েই তিনি ক্ষান্ত থাকেননি। তিনি রীতিমত গড়ে তুলেছিলেন এক বিরাট সংগঠন। সামান্য মাত্র অস্ত্র সম্বল করে তিনি ঝাপিয়ে পড়েছিলেন সম্মুখযুদ্ধে। বাংকারে বাংকারে নিপুন যোদ্ধার মত অস্ত্র হাতে নিয়ে চালিয়েছিলেন লড়াই, শত্রুর সাথে মোকাবিলায় দেখিয়েছেন চমৎকার নৈপুণ্য, দেখিয়েছেন পারদর্শিতা।

বাঘাবাড়ীর প্রতিরোধঃ শত্রুবাহিনীর অগ্রাভিযানের বিরুদ্ধে বাঘাবাড়ীতে যে প্রচণ্ড প্রতিরোধ তিনি গড়ে তুলেছিলেন তা এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। হানাদাররা ৯ই এপ্রিল নদী পার হয়ে চারদিকে যখন হত্যা ও ধ্বংসের হাহাকার তোলে এগিয়ে চলছিল উত্তরবঙ্গের শহর-বন্দরের দিকে তখন এই বাঘাবড়ীতেই তাদেরকে বাধা দেন জনাব শামসুদ্দিন তার সামান্য সামর্থ্য, সামান্য শক্তি নিয়ে। একদিন দুইদিন এভাবে একটানা পাঁচদিন তিনি এই প্রতিরোধ এড়াবার জন্য হানাদার বাহিনী গতি পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছিল।

সোজা পথে সিরাজগঞ্জে ঢুকতে ব্যর্থ হয়ে তারা শুরু করেছিল বোমাবর্ষণ। ২৬শে এপ্রিল সিরাজগঞ্জবাসীদের ওপর নেমে আসে হানাদারদের এই বর্বর অভিশাপ। আর এই বিমান হামলারই আবরণে সুযোগ বুঝে ২৭শে এপ্রিল তারা ঢুকে পড়ে শহরে।

জনাব শামসুদ্দিন এই সময়ে চলে যান চর এলাকায়। চর এলাকার অধিবাসীদের নিয়েই তিনি চেষ্টা করতে থাকেন একটি সশস্ত্র দল গঠনের। চেষ্ঠা করতে থাকেন অস্ত্র সংগ্রহের। এই অস্ত্র সংগ্রহের জন্যই তিনি ঘুরতে থাকেন এখানে-ওখানে। তিনি যান টাঙ্গাইলে। যোগাযোগ স্থাপন করেন সেখানকার মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে।

আর এই ঘোরাঘুরিই তার কাল হল। সর্বনাশা মৃত্যু যেন দুই ব্যাগ্র হাত মেলে বসেছিল তাকে ছিনিয়ে নিবার জন্য। আর সেই কঠিন মৃত্যুর হাতে নিজেকে সঁপে দেবার জন্যেই বুঝি তিনি ঢাকায় এসেছিলেন মে মাসের গোড়ার দিকে। এসেছিলেন তিনি গোপনে। এসেছিলেন কর্তব্যের ডাকে। এ কর্তব্য ছিল তার পরিবারের।

কিন্তু তিনি গোপনে এলেও গোপন তিনি থাকতে পারেননি। ১৭মে তিনি ধরা পড়ে যান খানসেনাদের হাতে। তার পরের ইতিহাস বর্বর খানসেনাদের নারকীয় নির্যাতনের ইতিহাস। তার পরের ইতিহাস ক্যান্টনমেন্টের একটি ছোট্ট সেলে অমানুষিক নির্যাতনে তার মৃত্যুবরণের ইতিহাস। বাঘাবাড়ী-সিরাজগঞ্জে যিনি ছিলেন খানসেনাদের ত্রাস সেই প্রতিভাধর তরুণ বাঙালি অফিসারকে হাতের মুঠোয় পেয়ে বুঝি উল্লাসে নেচে উঠেছিল হানাদারদের চোখ।

অত্যাচার-নির্যাতনে অর্ধমৃত জনাব শামসুদ্দিনের ওপর শেষবারের মতই তাদের আক্রোশ মিটিয়ে নেবার জন্যেই বোধ হয় ২৯শে মে বিকেলে সেলের ভেতরে তার ওপর লেলিয়ে দেয়া হয়েছিল মেজর সরফরাজের জল্লাদ দল- ক্র্যাক পার্টিকে। নিষ্ঠুর এক পৈশাচিকতা নিয়ে তারা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল জনাব শামসুদ্দিনের ওপর। মৃত্যুপথযাত্রী এই অসহায় মানবসন্তানের ওপর তারা তাদের আক্রোশ মিটিয়েছিল সর্বশক্তি দিয়ে।

এ অত্যাচার আর তিনি সইতে পারেননি। মৃত্যুর প্রান্তে পৌছে সেলের মধ্যে তাঁরই সাথে আটক সিলেটের এক ভদ্রলোকের কোলে মাথা রেখে তিনি খেতে চেয়েছিলেন এক ফোঁটা পানি।

—————————————————-

 

সশস্ত্র প্রতিরোধঃ বরিশাল-খুলনা-ফরিদপুর

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৪। বরিশাল-খুলনা-ফরিদপুর জেলায়

সংঘটিত সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধের বিবরণ

বাংলা একাডেমীর দলিলপত্র ১৯৭১

 

সশস্ত্র প্রতিরোধে বরিশাল

সাক্ষাৎকার- মেজর মেহেদী আলী ইমাম

(১৯৭১ সালে ক্যাপ্টেন হিসেবে কর্মরত)

 

অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে আমি আমার বাড়ী মঠবাড়িয়ার দাউদখালীতে ছিলাম। অসহযোগ আন্দোলনের সমস্ত পরিস্থিতি আমি রেডিও থেকে শুনতাম। সব সময় আশংকার মধ্যে ছিলাম যে, পাকসেনারা কখন আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এভাবেই চলে এলো ২৫শে মার্চের কালরাত্রি। রেডিও ও অন্যান্য খবর মারফত বুঝতে পারলাম ঢাকায় এবং অন্যান্য জায়গায় পাক মিলিটারীরা নিরীহ জনগণের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আমি এসব খবর শোনার পর ২৬শে মার্চ সন্ধ্যায় মঠবাড়িয়া থেকে লঞ্চযোগে বরিশালের পথে রওয়ানা হলাম।

২৭শে মার্চ সকাল ১০-১১টায় বরিশাল শহরে পৌঁছলাম। বরিশাল শহর তখন গরম। শহরের ছেলেরা রাইফেল, লাঠি, বল্লম এবং অন্যান্য অস্ত্রের সাহায্যে বরিশাল শহর পাহারা দিচ্ছিলো। লোকমুখে জানতে পারলাম মেজর জলিল নামে একজন এখানে এসেছেন এবং স্থানীয় এমসিএ নুরুল ইসলাম মঞ্জুরের বাসায় কন্ট্রোল রুম স্থাপন করা হয়েছে। এবং এখানেই আছেন মেজর জলিল। আমি এ খবর পেয়ে বেলা ১২টার সময় নুরুল ইসলাম মঞ্জুরের বাসায় গেলাম। সেখানে অত্যন্ত ভীড়। ভীড় ঠেলে ভিতরে গেলাম। সেখানে মঞ্জুর ভাই, মেজর জলিল, স্থানীয় এমসিএ আমু ভাই, শামসু মিয়া, মহিউদ্দিন ভাই, বারেক (এরা সকলে এমসিএ ছিলেন) এবং আরো অনেক স্থানীয় ছাত্রনেতা ও রাজনৈতিক নেতারা ছিলেন। সবাই দেশের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করছিলেন এবং এ পরিস্থিতিতে কি করা যায় তা ভাবছিলেন। আমি মেজর জলিল, মঞ্জুর ভাই এবং অন্যান্যদের সাথে দেখা করলাম। মেজর জলিলের সঙ্গে আমার আগে আলাপ ছিলো না। তিনি আমার সম্পর্কে প্রথমে খোজ খবর নিলেন। তারপর তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন থানা দখল করে নেবার জন্য।

২৭শে মার্চ রাতে আমরা প্রতিটি থানাতে অয়ারলেসের মাধ্যমে খবর পাঠালাম যেসব বাঙালি সৈনিকরা ছুটিতে আছেন তাদের পাঠিয়ে দেবার জন্য এবং মুজাহিদ, আনসার, উৎসাহী যুবক, অবসরপ্রাপ্ত ব্যাক্তিদের বরিশালে পাঠিয়ে দিতে নির্দেশ দিলাম এবং আসতে না পারলে সেখানেই ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করতে বলা হলো। সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র ট্রেনিং-এর জন্য দিতে বলা হলো। প্রতিটি থানা আমাদের নির্দেশ জেনে নিয়ে কাজ শুরু করে দিলো। আমরা মেজর জলিলের নির্দেশে জায়গায় জায়গায় যুবকদের ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করলাম।

২৭শে মার্চের রাতে নূরুল ইসলাম মঞ্জুরের বাড়ীতে সব আওয়ামী লীগ নেতা ও অন্যান্য দলের নেতাদের নিয়ে একটি সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। মেজর জলিলকে দক্ষিণাঞ্চলের সর্বাধিনায়ক করে কাজ শুরু করে দিলাম। দক্ষিণাঞ্চলের এলাকা বরিশাল, পটুয়াখালী ও খুলনা নিয়ে গঠিত ছিলো। এসপি’দের নির্দেশ দেয়া হলো সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র আমাদের হাতে দিয়ে দেবার জন্য। এসপি’রা নির্দেশ মেনে নিয়ে সমস্ত অস্ত্র আমাদের হাতে তুলে দেন।

সংগ্রাম পরিষদের বিভিন্ন গ্রুপ গঠন করা হয়। খাদ্য সরবরাহের জন্য একটি গ্রুপ গঠন করা হয়, যাদের কাজ ছিলো সব মুক্তিযোদ্ধার জন্য খাবার জোগাড় করে দেয়া। ট্রান্সপোর্টগুলি আমাদের কাজের জন্য নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। বেসামরিক শাসনকার্য পরিচালনার জন্যও একটি পরিষদ গঠন করা হয়। ডেপুটি কমিশনার নূরুল ইসলাম মঞ্জুর ও অন্যান্যদের নিয়ে এ কমিটি গঠন করা হয়েছিলো। এছাড়া বরিশাল শহরের কাছাকাছি বেশ কয়েকটি ট্রেনিং কেন্দ্র খোলা হয়। এগুলি ছিলো, বেলস পার্ক, সদর গার্লস হাই স্কুল, লাকুটিয়া জমিদার বাড়ী (কমান্ডো ট্রেনিং-এর জন্য), মাধবপুর ও প্তাপপুর। অন্যান্য থানাগুলোতেও এরূপ অনেক ট্রেনিং কেন্দ্র খোলা হয়। এসব কেন্দ্রে হাজার হাজার যুবক দেশকে মুক্ত করার জন্য ট্রেনিং নিতে শুরু করে। বেলস পার্কে সর্ববৃহৎ ট্রেনিং কেন্দ্র ছিলো। এখানে হাজার হাজার যুবক ট্রেনিং নিতর থাকে এবং এদের অনেককে অস্ত্রশস্ত্র দেয়া হয়। আমি সমস্ত ট্রেনিং কেন্দ্রের উপর নজর রাখতাম। ক্যাপ্টেন হুদা মেজর জলিলের সাথে থাকতেন এবং অন্যান্য দিকগুলির উপর নজর রাখতেন।

অয়ারলেসের মাধ্যমে আমরা পূর্বেই চাঁদপুর, পিরোজপুর, বাগেরহাট ইত্যাদি স্থানে যোগাযোগ স্থাপন করেছিলাম। চাঁদপুর থেকে মিজানুর রহমান চৌধুরী অয়ারলেসের মাধ্যমে খবর পাঠালেন, পাকসেনা যেকোনো মুহুর্তে চাঁদপুর আক্রমণ করতে পারে। তিনি আমাদের কিছু লোক পাঠাতে বললেন। মেজর জলিলের নির্দেশে আমি প্রায় ১০০ যুবককে অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ সহ চাঁদপুরে পাঠিয়ে দিলাম। ফরিদপুর, পটুয়াখালী, বাগেরহাট, খুলনা, পিরোজপুর প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ স্থানেও আমি প্রায় এক হাজার জনকে অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ দিয়ে শত্রুর আক্রমণ রুখতে পাঠিয়ে দিলাম। এছাড়াও বিভিন্ন থানা ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানে আরো ৫০০ জনকে অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ সহ শত্রুদের রুখবার জন্য পাঠিয়ে দেই। বজ্রমোহন কলেজের কেমিস্ট্রির একজন অধ্যাপক এবং বিঞ্জান বিভাগ ও মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রদের সহায়তায় আমরা হ্যাণ্ড গ্রেনেড, মলেটিভ ককটেল ইত্যাদি হাতবোমা তৈরী করতে শুরু করে দিলাম এবং এগুলি বিভিন্ন স্থানে পাঠিয়ে দিলাম। বরিশাল-পটুয়াখালী যেহেতু নদী প্রধান ছিলো সেহেতু শত্রুরা গানবোট নিয়ে আমাদের আক্রমণ করবে এ ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত ছিলাম। তাই গানবোট ধ্বংস করার জন্য ‘রকেট’ ধরনের বোমা তৈরী করার চেষ্টা করি। এতে কিছুটা সফল হলেও আমরা তা কার্যকর করতে পারিনি।

ইতিমধ্যে বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানে মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের প্রবল চাপের মুখে টিকতে না পেরে পিছু হটতে শুরু করেছে। পাকসেনাদের তুলনায় আমাদের অস্ত্রশস্ত্র ছিলো খুবই কম। সেজন্য অন্য কোথাও থেকে অস্ত্র যোগাড় করা যায় কিনা চিন্তা করতে থাকি। বন্ধুদেশ ভারত থেকে অস্ত্র যোগাড় করার জন্য দক্ষিণাঞ্চল কমান্ডের প্রধান মেজর জলিল আওয়ামী লীগ নেতা নুরুল ইসলাম মঞ্জুরকে ভারত পাঠান। অস্ত্রশস্ত্র যোগাড় করা ছাড়াও অন্যান্য নেতাদের সাথে যোগাযোগ করাও প্রয়োজন ছিলো। আমরা চিন্তা করে দেখলাম পাকিস্তানীদের সাথে এ অবস্থাতে পেরে ওঠা সম্ভব হবে না। তবুও সামরিক দিক দিয়ে বরিশালের গুরুত্ব ছিলো। আমরা বরিশালকে রক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেই। সেজন্য ঢাকা থেকে বরিশাল আসার পথে ২টি সড়কসেতু ধ্বংস করে দেই। ঢাকা থেকে বরিশালের সরাসরি রাস্তাযোগে কোনো যোগাযোগ না থাকলে শত্রুরা আসতে পারবে না। এই সড়কসেতু ২টি উড়িয়ে দেয়াতে শত্রুদের বরিশাল যাবার পথে বাঁধার সৃষ্টি হয়। ফেরীগুলি নষ্ট করে দেয়া হয়। পাকসেনারা যাতে বিমানে করে নামতে না পারে তার জন্য রহমতপুর এয়ার বেইসে শক্তিশালী পাহারার ব্যবস্থা করা হয়। শত্রুরা যাতে নদীপথে আসতে না পারে তার জন্য বরিশাল থেকে ৫/৭ মাইল দূর পর্যন্ত জায়গায় জায়গায় বাঙ্কার খুঁড়ে নদীপথের উভয় দিকে শত্রুদের অগ্রগতিকে বাঁধা দেওয়ার জন্য বেশ কয়েকটি অবস্থান গড়ে তুলি।

অন্যদিকে খুলনা হয়ে শত্রুরা যাতে বরিশাল ঢুকতে না পারে তার জন্যও ঝালকাঠিতে শক্তিশালী পাহারার ব্যবস্থা করার জন্য আমি সেখানে যাই। খুলনা থেকে বরিশালে নদীপথে আসতে হলে গাবখান চ্যানেল হয়ে আসতে হবে। তাই গাবখানের উভয় পাশে শক্তিশালী পাহারার ব্যবস্থা করি মধ্যে একটি ফ্ল্যাট রেখে দেই যাতে শত্রুদের গানবোট না আসতে পারে। শত্রুরা নদীপথে পার না হতে পারলে নদীর এক পাড়ে নামবে। তখন আমরা আক্রমণ চালাবো। এটা ছিলো পরিকল্পনা।

এরপর যাই পিরোজপুরে। পিরোজপুরে লেঃ জিয়ার সঙ্গে আমার দেখা হয়। মেজর জলিল তাকে পিরোজপুরের ভার দিয়ে আমাকে নিয়ে বাগেরহাটে যান। বাগেরহাটের অবস্থান শক্তিশালী করে তুলি এবং পরিকল্পনা নেই খুলনা বেতার কেন্দ্র দখল করে নেয়ার জন্য। পরিকল্পনা মোতাবেক ৩/৪ এপ্রিল রাতে বেতার কেন্দ্রে অবস্থানরত পাকসেনাদের উপর আক্রমণ চালাই এবং ২৪ ঘন্টার জন্য খুলনা বেতার কেন্দ্র মুক্ত রাখতে সক্ষম হই। কিন্তু পাকসেনাদের প্রবল চাপে খুলনা বেতার কেন্দ্র বেশীক্ষণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারিনি। খুলনা বেতার কেন্দ্রের যুদ্ধে আমাদের তিনজন শহীদ হন। পাকসেনাদের ৩৫ জনের হতাহত হতাহত হয়। আমরা বাগেরহাটে ফিরে আসলাম।

বাগেরহাটে এসে প্রথমে খুলনার এমসিএ জনাব রহমান, ছাত্রনেতা টুকু এবং অন্যান্যদের সাথে যোগাযোগ করা হয়। যোগাযোগ করে আমরা রূপসা নদী পার হয়ে রাতের আঁধারে খুলনা শহরের পিছন দিক দিয়ে গিয়ে গোল্লামারীতে অবস্থিত খুলনা বেতার কেন্দ্রের নিকটে কলাবাগানে ২টি প্লাটুনকে অবস্থান নিতে বলি। খুলনা থেকে গোল্লামারী আসার পথে একটি ব্রিজ ছিলো। সেই ব্রিজের নিচে এ্যামবুশ নেয়ার জন্য আরেকটি ছোট গ্রুপকে নিযুক্ত করি। বয়রাতে কিছু ইপিআর ছিলো। তাদের বলা হয় আমরা যখন আমরা যখন গোল্লামারী বেতার কেন্দ্রে শত্রুদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বো তখন তারা যেন সার্কিট হাউসে অবস্থানরত পাকসেনাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এদিকে খুলনা শহরের নিকটস্থ গ্রামের দেশপ্রেমিক যুবকদের (নকশালদের) সাথে যোগাযোগ করা হয়। তারা আমাদের আক্রমণে সাহায্য করার জন্য একসাথে শত্রুর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বে এই পরিকল্পনা নেয়া হয়। আমাদের পরিকল্পনা ছিলো একসাথে পাকসেনাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে খুলনা শহর শত্রুমুক্ত করবো।

পরিকল্পনামতো ৩/৪ এপ্রিল রাত ৯টার সময় গোল্লামারীতে অবস্থিত বেতার কেন্দ্রে শত্রুদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ি। গোল্লামারীতে অবস্থিত পাকসেনাদের সাহায্য করার জন্য সার্কিট হাউস থেকে আরো সৈন্য ১টা জীপ ও ২টা ডজে করে গোল্লামারীর দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। আগে থেকেই গোল্লামারী-খুলনার মধ্যে অবস্থানরত এ্যামবুশ পার্টি পাকসেনাদের গাড়ীর উপর গ্রেনেড, হাতবোমা নিক্ষেপ করতে থাকে। জীপ এবং ডজ দুটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পাকসেনারা টিকতে না পেরে ব্রিজ এবং বেতার কেন্দ্র ছেড়ে শহরে পালিয়ে যায়।

বয়রাতে অবস্থানরত ইপিআর’রা শত্রুদের উপর কোনো কারণে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারেনি, সেজন্য আমরা খুলনা শহর দখল করতে পারিনি। বেতার কেন্দ্র চালু করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হই। এই আক্রমণে শত্রুদের ৭৯ জন হতাহত হয়। এদের মাঝে একজন মেজর ছিলেন। আমাদের পক্ষে তিনজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। হাবিব নামে জনৈক তরুন ছাত্র ছিলো। সে তার পিতার রিভলবার চুরি করে এনে এই আক্রমণে অংশগ্রহন করে। তার বয়স কম দেখে আমি তাকে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে নিষেধ করেছিলাম। কিন্তু সে আমার চোখ ফাঁকি দিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। যুদ্ধের পর তাকে মৃত অবস্থায় দেখি। শহীদদের মধ্যে জনৈক অবসরপ্রাপ্ত ইএমই’র সৈনিকও ছিলেন।

পরদিন শত্রুরা খুলনা শহর থেকে মর্টারের প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ করতে থাকে এবং ৩০” এমএমজি থেকে আমাদের উপর মুষলধারে গুলি চালাতে থাকে। আমরা চিন্তা করে দেখলাম শত্রুদের বিরাট শক্তির সাথে পেরে ওঠা সম্ভব হবে না। সেজন্য কৌশলগত কারণে ৫ই এপ্রিল রাতে শত্রুসৈন্যর প্রচণ্ড চাপের মুখে টিকতে না পেরে ফিরে বাগেরহাট চলে আসি। আমাদের আক্রমণের মূল লক্ষ্য ছিলো জনগণকে আমাদের কার্যকলাপ সম্বন্ধে জ্ঞাত করা এবং শত্রুকে পর্যুদস্ত করা। সেটা আমরা করতে পেরেছিলাম।

বাগেরহাটের তৎকালীন এসডিও পরিস্থিতির জন্য ভীত ছিলেন। তিনি আমাদের ঠিকমতো সাহায্য করতে পারছিলেন না। বাগেরহাট শহরে অবস্থান নিয়ে থাকা ঠিক হবে না, কেননা শত্রুরা আমাদের অবস্থানের কথা জেনে ফেলেছিলো। তাই বাগেরহাটের ছেলেরা বলে খান জাহান আলী সাহেবের দরগার পাশে অবস্থান নিলে ভাল হবে। তাদের একটা বিশ্বাস ছিলো দরগার কাছাকাছি অবস্থান নিলে শত্রুরা আক্রমণ করতে পারবে না। সেজন্য আমি বাগেরহাটের দরগার পাশে অবস্থান নেই। বাগেরহাটের এমসিএ আবদুর রহমান অনেক সময় আমাদের কোনো নির্দেশ না নিয়ে অনেক কাজ করে ফেলতেন। আমি খবর পাই খুলনার এমসিএ শেখ আবদুল আজিজ সাহেব বাগেরহাটে এসেছেন। তার সাথে অনেক কষ্টে যোগাযোগ করি। তিনি আমাদের অনেক সাহায্য করেছেন।

একদিন খবর পাই একটা জাহাজে কিছু হাতিয়ার আছে যার কথা পাকসেনারাও জানেনা এবং জাহাজটা পরিত্যক্ত হয়ে হয়ে পড়ে আছে। এ খবর আমাকে দেন মংলা পোর্টের একজন কাষ্টম অফিসার। সেই হাতিয়ার যোগাড় করার জন্য আমি দুটি স্পীডবোট নিয়ে সুন্দরবন হয়ে ঘুরে মংলা পোর্টে যাই। পোর্টে গিয়ে একটা স্পীডবোট পরিত্যক্ত জাহাজটির কাছে যায়। আমি অন্য স্পীডবোটটি থেকে শত্রুদের উপর নজর রাখি। আগের স্পীডবোটটি যখন কয়েক বাক্স অস্ত্র নামিয়েছে তখন হঠাৎ করে গানবোট থেকে পাকসেনারা গোলা ছুঁড়তে থাকে। আমরা কোনোরকমে দ্রুত সেখান থেকে পালিয়ে আসি। পরে বাক্স খুলে দেখি সেগুলো বন্দুকের গুলি। বাগেরহাট থেকে আসার পথে দেখতে পাই চার নৌকা বোঝাই চাল চুরি হয়ে গেছে। আমরা তার অধিকাংশই উদ্ধার করে বাগেরহাটে নিয়ে আসি। গুলি নিয়ে স্পীডবোটে করে পালিয়ে আসার সময় বৈঠাঘাটা থানাতে আশ্রয় নেই। এখানে শুনতে পাই, পাকসেনারা গানবোটের সাহায্যে নদীপথ পাহারা দিচ্ছে। আমি এখানে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করে বাগেরহাটে ফিরে আসি। একদিন রাতে দালাল রজব আলী ও তার সঙ্গীরা আমাদের বাগেরহাট দরগা অবস্থানে রাতের অন্ধকারে হামলা চালায়। আমরা হামলা প্রতিহত করি। রজব আলী ও তার দলবল রাতের অন্ধকারে প্রায়ই আমাদের বিভিন্ন উপায়ে বাঁধার সৃষ্টি করতো।

নানারকম অসুবিধা, অচলাবস্থা ও সাময়িক হতাশার জন্য বাগেরহাটে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে এক হতাশার সৃষ্টি হয়। আমি তাদের মধ্যে থেকে হতাশার ভাব দূর করে মুক্তিবাহিনীকে সংগঠিত করে তুলি। তারপর মেজর জলিল আমাকে পিরোজপুর ও বাগেরহাটের ভার দেয় এবং আমাকে বরিশালের প্তিরক্ষা ব্যবস্থা সুদৃঢ় করার জন্য সেখানে যেতে নির্দেশ দেয়। তারপর আমি বরিশালে এসে আগেকার তৈরী বাঙ্কার এবং অন্যান্য স্থানে অবস্থান নেই। এছাড়া বরিশাল শহর ও অন্যান্য এলাকায় যাতে শত্রুরা প্রবেশ করতে না পারে তার জন্য শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যূহ তৈরী করতে থাকি। বরিশাল থেকে বেশ কিছু দূরে জুনাহারে কীর্তনখোলা নদীর দুই পারে বাঙ্কার খুঁড়ে শত্রুর অগ্রগতি ঠেকানোর জন্য শক্তিশালী অবস্থান গড়ে তুলতে থাকি। ঢাকা এবং ভোলা থেকে রাত্রে যাতে পাকসেনারা আসতে না পারে তার জন্য জুনাহারে অবস্থান নেই। পূর্বেই বলেছি বরিশাল হলো নদীপ্রধান। স্থলপথে পাকসেনাদের বরিশাল আসা অসম্ভব ছিলো। যেদিক দিয়েই পাকসেনারা বরিশাল আসুক না কেনো তাদের নদীপথ হয়েই আসতে হবে। পটুয়াখালী তখন আমাদের নিয়ন্ত্রণেই ছিলো। সেদিক দিয়ে পাকসেনাদের আসার কোনো সম্ভাবনা ছিলো না। আর খুলনা হয়ে এতদূর ঘুরে পাকসেনারা আসবে সেটাও সম্ভব নয়। তবুও বরিশাল থেকে কিছু দূরে আমরা বাঙ্কার খুঁড়েছিলাম পাছে খুলনার দিক থেকে কোনো আক্রমণ পরিচালনা করা হয় ভেবে। তবে অস্ত্রের অভাবে সেখানে কোনো অবস্থান নেওয়া হয়নি। জুনাহারে কীর্তনখোলা নদীর দুই পারে অবস্থান নেওয়ার পর শত্রুরা যাতে অতি সহজে নদীপথে বড় স্টীমারে না আসতে পারে তার জন্য ৯০ জনকে ৯০টি রাইফেল দেই। এর মধ্যে ৫০টি ৩০৩রাইফেল ছিলো। বাকি ৪০টি ছিলো মান্ধাতা আমলের। মেজর জলিল ইতিপূর্বে জাতীয় সংসদ সদস্য নূরুল ইসলাম মঞ্জুরকে অস্ত্রের জন্য ভারত থেকে ৫০টি এসএমজি, ২০০টি ৩০৩(থ্রি নট থ্রি) রাইফেল, ১৫টি এসএলআর, ৩০০টি ৩৬-হ্যাণ্ড গ্রেনেড ও কিছু এনারগা গ্রেনেড ও লাঞ্চার নিয়ে আসেন। তবে এসব অস্ত্রের কোনো শক্তি ছিলো না পাকসেনাদের গানবোট ধ্বংস করার। এসব অস্ত্র নূরুল ইসলাম মঞ্জুর মেজর জলিলের হাতে তুলে দেন। মেজর জলিল এসব অস্ত্রের মধ্যে আমাকে ২টা এসএলআর, ৪টা এনারগা গ্রেনেড ও ৩০টি মান্ধাতা আমলের রাইফেলের পরিবর্তে ৩০টি ৩০৩ রাইফেল দেন। ইতিপূর্বেই পাক বিমান বাহিনী বরিশাল শহরে এসে ২টা স্যাবর জেটের সাহায্যে স্ট্র্যাফিং করে। বিমান বাহিনীর বুলেট বৃষ্টির ফলে একটি যাত্রীবাহী লঞ্চ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে ৩০/৪০ জন নিরীহ লোক মারা যায়।

এ বিমান আক্রমণের ফলে জনসাধারণ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে এবং প্রাণভয়ে অধিকাংশ লোকই শহর ছেড়ে পালিয়ে যায়। বরিশাল একরকম জনশূন্য হয়ে পড়ে। বিমান হামলায় বেলস পার্কে অল্পের জন্য মেজর জলিল রক্ষা পান।

বিমান হামলার পর প্রয়োজনীয় মজুত রিজার্ভ অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ লাকুটিয়া জমিদার বাড়ী ও অন্যান্য স্থানে সরিয়ে নেয়া হয়। বরিশাল শহরের উপর আক্রমণ অত্যাসন্ন ভেবে আমরা এই ব্যবস্থা নিয়েছিলাম। পেট্রোল যোগাড় করার জন্য ২৪শে এপ্রিল সন্ধ্যায় স্পীডবোটে করে ভোলায় যাই। বহুকষ্টে সামান্য পেট্রোল সংগ্রহ করে পরদিন সকালে ফিরে আসি।

আমি যখন কন্ট্রোল রুমে বসে আছি তখন হঠাৎ বরিশালের ২০ মাইল দূরে নান্দিনাবাজারে অবস্থানরত আমাদের পার্টি খবর জানায় ৪টি গানবোট ও আরো দুটি বোটে করে পাকসেনারা বরিশালের দিকে অগ্রসর হচ্ছে এবং তারা বরিশাল আক্রমণ করতে পারে। আমি তৎক্ষণাৎ জুনাহারে আমাদের অবস্থানের দিকে চলে যাই। জুনাহারে পৌঁছতে পৌঁছতে দেখি পাকসেনারা আমাদের উপর হামলা শুরু করে দিয়েছে। আমি জুনাহারের তালতলী নদীর পারে আমাদের অবস্থানে গিয়ে দেখি সেখানে অবস্থানরত সেনারা ভয় পেয়ে গেছে। আমি তাদের সাহস দিয়ে সংগঠিত করি। শত্রুসেনারা বাঁধা পেয়ে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে নদীর উপর ব্যারিকেড সৃষ্টি করে রাখা ২টি স্টীমারের উপর হামলা চালায়। ১টি স্টীমার গোলা মেরে পুড়িয়ে এবং অন্যটি ডুবিয়ে দিয়ে তারা তালতলী নদীর ভিতরে ঢুকে পড়ে।

আমাদের হাতে ভারী অস্ত্র না থাকার ফলে আমরা গানবোটগুলো ধ্বংস করে দিতে পারিনি। আমি দ্রুত ১টি নৌকায় করে তালতলী নদী পার হবার চেষ্টা করি। এ সময় শত্রুসেনারা আমার নৌকার উপর হামলা চালায়। এতে নৌকার মাঝি আহত হয়। আমি দ্রুত নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ি এবং নদী পার হতে সক্ষম হই।

শত্রুসেনারা সে সময় আমার উপর মেশিনগানের গুলি চালাতে থাকে। আমি চরে ধানক্ষেতে প্রায় এক ঘন্টা পড়ে থাকি। তারপর আস্তে আস্তে ক্রলিং করে মূল অবস্থানে ফিরে আসি।

শত্রুদের গানবোট ধ্বংস করার জন্য আমার বাহিনীর ইপিআর-এর হাবিলদার আবদুল মান্নান অতি সাহসিকতার সাথে খুব নিকট থেকে একটি গানবোটের উপর হামলা চালায়। এতে গানবোটের যথেষ্ট ক্ষতি হয়। ১২টা পর্যন্ত মুষলধারে উভয় পক্ষে গোলাগুলি চলতে থাকে। ইতিমধ্যে হেলিকপ্টারে আরও ১০০ জনের মতো খানসেনা তালতলী পাড়ে নামানো হয়। সন্ধ্যার দিকে আমরা অবস্থান তুলে নেই। পাকসেনারা আশেপাশের গ্রামগুলির উপর অবিরাম গোলাবর্ষণ করতে থাকে। পরদিন ২৬শে এপ্রিল পাকসেনারা বরিশাল শহরে প্রবেশ করে এবং যুদ্ধের সময় যথেষ্ট গোলাগুলির ফলে পাকসেনারা বরিশাল শহরে ক্ষতি করতে পারেনি। ইতিমধ্যে সংঘর্ষের সময় বরিশাল শহরের লোকেরা নিরাপদ স্থানে পালিয়ে যায়। এ সংঘর্ষে পাকসেনাদের ২৫ জন মারা যায়। আমাদের কেউ মারা যায়নি।

——————————————–

বরিশালে প্রতিরোধের বিবরণ

সাক্ষাৎকারঃ মহিউদ্দীন আহমদ, প্রাক্তন এম-টি

২৮-০৮-১৯৭৩

   ২৫মে মার্চের ঘটনা আমি জানতে পারি টেলিফোনযোগে রাত সাড়ে নটা-দশটার দিকে। আমরা মঞ্জুর ভাই সহ বসলাম আলাপ-আলোচনার জন্য। অয়ারলেস মারফত আমরা বিভিন্ন স্থানে যোগাযোগ করে ঢাকার পুরা খবর পেলাম। রাতে আমরা সিদ্ধান্ত নিই পাকসেনা আসার আগেই আমরা সমগ্র প্রশাসনযন্ত্র তথা অস্ত্র আমাদের হাতে নিয়ে আসবো।

    মার্চ মাসের শুরু থেকেই আমিসহ আমার দলের লোকজন বিভিন্ন স্থানে জনসভা করে জনমত গঠন করে। পাক- আক্রমণ ঘটলে যেকোন জবাবের জন্য সবাইকে প্রস্তুত থাকবে হবে। সমগ্র বরিশাল জেলার বিভিন্ন থানা, ইউনিয়ন, গ্রামে সভা করে বেড়াই। মানুষ প্রস্তুত ছিল যেকোন অবস্থার জন্য।

    ২৬শে মার্চ আমি এবং নূরুল ইসলাম মঞ্জুর মিলে পুলিশ লাইনে পুলিম রিজার্ভ ফোর্সের সামনে বক্তৃতা করি। তারা সবাই হাত উঠিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিতে প্রস্তুত বলে জানায়। এস-পি’র সাথে আলাপ-আলচনা করি। আমরা সমস্ত জেলার দায়িত্ত্ব নিই। পাকসেনা ওয়াপদা কলোনীতে কিছু ছিল, তারা আমাদের ফোন পেয়ে পালিয়ে যায়।

       ২৭শে মার্চ আমরা এসপি’র কাছে থেকে চাবি নিয়ে ট্রাকে করে প্রচুর অস্ত্র উদ্ধার করে নিয়ে যাই। লাকুটিয়া জমিদার বাড়ী কাশীপুর, মঞ্জুর সাহেবের বাসাতে অস্ত্রশস্ত্র রাখি এবং ছাত্র, পুলিশ, আনসার, সাধারণ লোক, ছাত্রলীগ কর্মী, আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী, শ্রমিক সব মিলে ৪/৫ হাজার মুক্তিযোদ্ধা তৈরী করি।২৭/২৮শে মার্চ থেকে পুলিশ লাইনে এবং বেলস পার্কে(বঙ্গবন্ধু পার্ক) আর্মস ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করা হয়। উজিরপুর থানাতে মেজর জলিলের বাড়ী। জনসভা করে বের হওয়ার সময় মেজর জলিলের সাথে আমাদের পরিচয় হয়। সে আমাদের বক্তৃতায় মুগ্ধ হয়ে বলে, “আমি ছুটিতে আছি, যদি কোন কাজে লাগে ডাকবেন।” ২৮শে মার্চ আমরা চিঠি পাঠিয়ে মেজর জলিলকে নিয়ে আসি এবং কাজে লাগাই। আমরা ডিসির বাংলোতে আলাপ-আলোচনা করে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করি নূরুল ইসলাম মঞ্জুর, এম-পি-সিভিল প্রধান; মহিউদ্দীন আহমদ এম-পি খাদ্য এবং যোগাযোগ; আমির হোসেন আমু; এম-পি-সাহায্য; আমিনুল হক চৌধুরী-বিচার বিভাগ; এম-পি সার্জেন্ট ফজলুল হক, মেজর জলিল ও এস-পি-ডিফেন্স; আবদুল মালেক খান, আওয়ামী লীগ সভাপতি-অর্থ বিভাগ; সর্দার জালাল, এডভোকেট ইউসুফ, হুমায়ুন এমপি-প্রচার বিভাগ; কাজী মহিউদ্দিন-নদীপথ যোগাযোগ; হেমায়েত উদ্দীন এডভোকেট-সমন্বয় বিভাগ। প্রত্যেক বিভাগের সাথে ডিসি, এসপি, এডিসি, যাবতীয় বিভাগীয় প্রধানরা সম্পাদক হিসেবে কাজ শুরু করেন। ডিসি ছিলেন হাবিবুর রহমান, এমপি ফখরুদ্দিন আহমেদ, এডিসি কাজী আজিজুল ইসলাম (শহীদ), অতিরিক্ত জেলা পুলিশ প্রধান গোলাম আহমদ (শহীদ), জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক আসমত আলী, আনসার এ্যাডজুটেন্টরাও আমাদের সহযোগী ছিলেন। তালতলী, সাগরদি, কাশীপুর এলাকা, লাকুটিয়া ইত্যাদি স্থানে ডিফেন্স দেওয়া হয়। শহরের ভিতরেও আমাদের গোপন সেল ছিল।

    ইতিমধ্যে ঢাকা, খুলনার বিভিন্ন স্থান থেকে হাজার হাজার শরণার্থী তথা আহত লোক আসা শুরু করে। তাদেরকে কলেজসহ বিভিন্নস্থানে রাখার ব্যবস্থা করি এবং পরে তাদেরকে পৌঁছানোর ব্যবস্থা আমি নিজে করি। ফোন মারফত আমাদের বাগেরহাট, ফরিদপুর, মাদারীপুর, পটুয়াখালী, ফেনী, চাঁদপুর ইত্যাদি স্থানের সাথে আমাদের যোগাযোগ ছিল।

     এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে মঞ্জুর সাহেব (এমপি) আগরতলা যান। তিনি আগরতলা থেকে ফিরে আবার কলকাতা যান অস্ত্রের জন্য। তাঁর অনুপস্থিতিতে আমার ওপর দায়িত্ব পড়ে ডিফেন্সের। আমি ১৫০ জনের মত যোদ্ধাকে অস্ত্র, খাদ্য, ওষুধ সহ লঞ্চযোগে চাঁদপুর পৌঁছি মিজানুর রহমান চৌধুরীর অনুরোধে। এই বাহিনী কুমিল্লা সেনানিবাস আক্রমণ করে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে। আমাদের বাহিনীর ৩০ জনের মত শহীদ হয় ওখানে।

      বাগেরহাটেও আমরা পাঠিয়েছিলাম ৬০ জনের মত যোদ্ধাকে। খুলনার যুদ্ধে আমাদের ৩/৪ জন শহীদ হন। আমাদের একটি পেট্রোল পার্টি ছিল যারা মোটরসাইকেল এবং মোটর সহযোগে যোগাযোগ রাখতো। প্রতি থানাতে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করা হয়। থানার সাথে আমাদের সব সময় যোগাযোগ থাকতো। বরিশালের সকল মহকুমায় আমরা নির্দেশ এবং যোগাযোগ রাখতাম।

      ২৬শে এপ্রিল বরিশালের পতন ঘটে পাক বাহিনীর হাতে।ইতিমধ্যে এপ্রিল মাসের ১০/১২ তারিখে এবং ১৯/২০ তারিখে পাক বিমান দু’বার হামলা চালিয়ে আমাদের একটি লঞ্চ ডুবিয়ে দেয় এবং বোমার আঘাতে ২০ জনের মত লোক মারা যায়। বহু আহত হয়। পথিমধ্যেও বহু লোক মারা যায়। মঞ্জুর সাহেবের কথা মত মেজর জলিল এবং ক্যাপ্টেন হুদাকে অস্ত্রের জন্য ভারতে পাঠানো হয়। মঞ্জুর ভাই ইতিমধ্যে ২২ এপ্রিল কিছু অস্ত্র নিয়ে বরিশাল আসেন।

      ২৫শে এপ্রিল ভোরবেলা থেকে পাকসেনারা শেলিং করতে করতে আসে মুলাদির দিক থেকে। খুলনার দিক থেকেও আসতে থাকে। ফরিদপুর থেকেও স্থলবাহিনী মার্চ করে আসতে থাকে। ৪টি জেট অনবরত বোমা ফেলা শুরু করে। পর মুহুর্তে ৬টি হেলিকাপ্টারযোগে অসংখ্য ছত্রীসেনা নামিয়ে দেয়। মঞ্জুর তখন তালতলী (উত্তর দিকে) ও আমি দক্ষিণ দিকে যুদ্ধ পরিচালনা করি। পরবর্তীকালে ক্যাপ্টেন ফিরুর গুলি লাগে। পাশাপাশি মঞ্জুরও ছিল। মঞ্জুর আমাকে মেসেজ দেন ফোর্স নিয়ে লাকুটিয়া রওয়ানা হবার জন্য। আমি নিজে বাহিনীর ডাক্তারসহ লাকুটিয়া রওনা হই। কিন্তু অনবরত বোমা ফেলার জন্য লাকুটিয়া না যেতে পেরে সরদার জালাল, আমিনুল হক চৌধুরী এবং কিছু ছেলে নিয়ে কাশীপুর ক্যাম্পে চলে যাই। এর আগেই অবস্থা বুঝতে পেরে শহর থেকে বেসামরিক লোকদের সরে যেতে বলি। সরদার জালালকে রুহাতে (গ্রাম) রেখে একটি জীপ নিয়ে দু’জন মুক্তিযোদ্ধাসহ বিকাল ৫টার দিকে শহরে চলে আসি অবস্থা দেখার জন্য। শহরে ঢোকার সময় গ্রামসংলগ্ন রাস্তার দু’পাশে বেশকিছু মুক্তিযোদ্ধাকে পজিশন নিয়ে থাকতে দেখি। আমি কিছু মুক্তিবাহিনীকে নদীর ওপারে (কীর্তনখোলার ওপারে) পজিশন নিয়ে গানবোটে সুযোগ বুঝে আক্রমণ করতে বলি।

     শহর তখন শূন্য। কিছুক্ষণ পরপরই আবার ব্যাপকভাবে বোমা ফেলা শুরু হয়। আমি ও ড্রাইভার দু’জন বাংকারে আধ ঘন্টা বসে থাকি। বোমা ফেলা একটু কমলে গাড়ী নিয়ে রুহা গ্রামে রওনা হই। ছত্রীসেনা নেমে গিয়েছিল। তারা আমার গাড়ী লক্ষ্য কররে গুলি ছোড়ে। আমরা অল্পের জন্য বেঁচে যাই। রুহা গ্রামে পৌঁছালে মঞ্জুরের মেসেজ পেলাম যে আমাদের লাকুটিয়া ঘাঁটির পতন ঘটেছে। তিনি স্বরূপকাঠির দিকে যোদ্ধা নিয়ে রওনা হয়েছেন। আমাকে রাতেই তার সাথে দেখা করতে বলেন। রাতেই কিছু যোদ্ধা, জালাল আহমেদসহ রওনা হয়ে পরদিন ভোরবেলা স্বরূপকাঠি (থানা) গিয়ে পৌছাই। ২৬ তারিখে রাত ৩টার দিকে কাউখালীতে মঞ্জুরের সাথে আলাপ করি। আমরা অখান থেকে গানবোটের শেলিং শুনতে পাচ্ছিলাম।

     ২৭শে এপ্রিল রওনা হয়ে আমরা ৩টি বড় লঞ্চে বহু পরিবারসহ (২০০/৩০০) সুন্দরবন হয়ে হাসনাবাদ পৌঁছাই ২৯শে এপ্রিল। বিশ্রাম সিংহ তখন সীমান্ত রক্ষী বাহিনী প্রধান ছিলেন। তিনি আমাদের সাদরে গ্রহণ করেন। কলকাতার বালিগঞ্জে মঞ্জুরসহ মন্ত্রী পরিষদের সাথে দেখা করে আলাপ-আলচনা করি। বরিশালের সব কথা বলি। জেনারেল ওসমানীর সাথেও ওখানে সাক্ষাৎ হয়। বিশ্রাম সিংহ মিঃ মুখার্জী, নেভাল কমান্ডার কে,বি, সিংহ- এদের সাথে আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব হয়। এদের আন্তরিকতা ও সাহায্য-সহানুভূতি ভোলা যায় না।

     ১লা মে থেকে ৭ই মে পর্যন্ত হাসনাবাদ, ব্যারাকপুর পাগলের মত আমি এবং মঞ্জুর ঘোরাঘুরি করে দুই লঞ্চ আধুনিক অস্ত্র, অষুধ, ড্রাই ফুডসহ কয়েক লক্ষ টাকার জিনিস সরকারী চুক্তি ছাড়াই কমান্ডার মুখার্জী, কে,বি, সিংহ গোপনে আমাদের হাতে তুলে দেন। ৬/৭ দিন আমাদের ছেলেদের কয়েকটি গ্রুপে ভাগ করে প্রতি গ্রুপকে বিভিন্ন অস্ত্রে বিশেষ শিক্ষা দিই। আমরা নিজেরাও শিক্ষা নিই। আমি, মঞ্জুর, সরদার জালাল, প্রায় ৮০ জন যোদ্ধা, মেজর জলিল, ক্যাপ্টেন রহমান, লেঃ নাসের সহ ২টি লঞ্চ ভর্তি অস্ত্র ও অন্যান্য জিনিস নিয়ে বরিশালের দিকে রওনা হই। ৪০ হর্স-পাওয়ারের স্পীডবোটও ছিল আমাদের সাথে।

     দুপুর ২টার দিকে আমরা হাসনাবাদ থেকে রওনা হই। ২টি ভারতীয় নেভাল শীপ আমাদের পৌঁছে দিয়ে সালাম করে চলে যায়। একটি লঞ্চে মেজর জলিল, ক্যাপ্টেন রহমান এবং অন্যটিতে আমি, মঞ্জুর, লেঃ ময়নুল ছিলাম। আমরা সন্ধ্যা ৬টার দিকে বাংলাদেশে পুনঃপ্রবেশ করি।

     খুলনা জেলার সুন্দরবন এলাকায় গাবুরিয়া ইউনিয়নের বুড়িগোয়ালিনীর নিকটে তিনটি পাক গানবোট আমাদের আক্রমণ করে। আমরাও পাল্টা আক্রমণ করি। এক ঘন্টা যাবৎ দু’পক্ষে গোলাগুলি হয়। আমাদের আক্রমণে একটি গানবোট ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তখন ওরা দূরে চলে গিয়ে কামান ছুড়তে থাকে। রাত ১১টা থেকে ১টা পর্যন্ত যুদ্ধ চলে। আমাদের দু’টি লঞ্চে পিছনে যে পেট্রোল ছিল তাতে শেল পড়ে আগুন লেগে যায়। ওখানে আমাদের কয়েকজন যোদ্ধা শহীদ হয়। আমরা পানিতে ঝাঁপ দিই। আমরা কিছু সাঁতরিয়ে পাড়ে উঠি। ওয়াপদা বাঁধে আমরা পজিশন নিই। কিছু মুক্তিযোদ্ধাসহ আমি এবং মঞ্জুর পিছু হঠতে থাকি। পাকসেনারা অনবরত শেল ফেলতে থাকে গ্রামের দিকে। আমরা যে কোন স্থানে তার কিছুই বুঝছিলাম না।

    গাবুরিয়া ইউনিয়নের ঐখানে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান সোহরাব হোসেন খবর দিয়ে পাক গানবোট নিয়ে আসে। তখন ভীষণ ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছিল। মাঠের ভেতর আমি নূরুল ইসলাম মঞ্জুরকে হারিয়ে ফেলি। আমি এবং আবুল হোসেন নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা বিচ্ছিন্নভাবে একদিকে এগোতে থাকি। ভোরবেলা সর্দার জালাল, কানু, মকসেদ আলী, বাদল, ফিরোজসহ কিছু লোককে মাঠের মধ্যে দেখতে পাই এবং তাদের সাথে মিলিত হই আমরা ১৭ জন লোক। আর কারো কোন খোঁজ পাইনি। একদিকে বিদ্যুৎ, সার্চ লাইটের আলো, অন্যদিকে ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে ক্রিলিং করে এগোচ্ছিলাম। আমরা ১৭ জনই কমবেশী আহত ছিলাম। আমরা ১৭ জন গ্রামের দিকে রওনা হচ্ছিলাম। বৃষ্টি তখন সামনে হচ্ছে। আমরা পাইকগাছা থানার ভিতরে মদিনাবাদ গ্রামে কয়রা ইউনিয়নে পৌঁছাই। আমরা আমাদের পরস্পরের নাম বদল করি। গ্রামের অবস্থাও বুঝি যে তা আমাদের পক্ষে হবেনা। মওলানা সালাম ওখানে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিল। মওলানা আবদুস সালাম তার দলবল এবং অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আমাদের ঘেরাও করে বন্দী করে ফেলে।

———————————————-

প্রতিরোধ-বরিশাল

সাক্ষাৎকার- আবদুল করিম সরদার, প্রাক্তন এমপি
২২-১০-১৯৭২

২৬শে মার্চ কটকস্থল নামক স্থানে পাক বাহিনীর সাথে মুক্তিবাহিনীর এক প্রচণ্ড যুদ্ধে পাক বাহিনীর ৭ জন নিহত ও বহু আহত হয়। অপর পক্ষে মুক্তিবাহিনীর ৩ জন(পরিমল, আবদুল হাসিম ও মোশাররফ) শহীদ হয়। জুলাই মাসের শেষের দিকে কোদালদহে এক যুদ্ধে ৬ জন পাকসেনা নিহত হয়।

——————————————-

 

প্রতিরোধ – বরিশাল
সাক্ষাৎকারঃ ডাঃ মোহাম্মদ শাহজাহান
১৯৭২

মার্চ মাসে আমি বরিশাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কর্তব্যরত অবস্থায় ছিলাম। ২৫শে এপ্রিল ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বরিশাল দখল করে নেয়। বরিশাল শহরের ৪ মাইল দূরে লাকুটিয়া জমিদার বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি স্থানান্তর করা হয়। ২৫শে এপ্রিল পাকসেনাদের গুলিতে কামাল নামে একজন ছাত্র আহত হয়। আমাকে এসে খবর দেওয়া হলো। তখন সেখানকার হাসপাতালের সমস্ত ডাক্তার ভয়ে পালিয়ে যায়। আহত ছাত্রটিকে লাকুটিয়ায় নিয়ে যাওয়া হয়। জনাব নুরুল ইসলাম মঞ্জুর, আমি এবং আরো কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা লাকুটিয়া ঘাঁটিতে গেলাম।

বরিশাল শহরের পতনের পূর্বে মেজর জলিল সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করছিলেন। তিনি, লেফটেন্যান্ট হুদা এবং আরো কয়েকজন তদানীন্তন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর লোক ভারতে অস্ত্র সংগ্রহের জন্য গিয়েছিলেন। মেজর জলিল তখন বাড়িতে ছুটি কাটাচ্ছিলেন। এর আগে জনাব নূরুল ইসলাম মঞ্জুর ভারতে অস্ত্র সংগ্রহের জন্য গিয়েছিলেন। তিনিও স্বাধীনতা সংগ্রামকে ত্বরান্বিত করার জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করছিলেন।

লাকুটিয়াতে থাকা নিরাপদ নয় মনে করে আমরা সেখান থেকে মাধবপাশা চলে গেলাম। আমরা প্রায় ৩০ জন লোক ছিলাম। তাদের মধ্যে জনাব নূরুল ইসলাম মঞ্জুর, লেঃ নাসিরও ছিলেন। মাধবপাশা থেকে আমরা মামুদকাঠিতে জনাব নূরুল ইসলাম মঞ্জুরের এক আত্মীয়ের বাড়িতে গেলাম। এখানে আমরা শপথ গ্রহণ করি যে, আমরা সবাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রয়োজন হলে জীবন দিবো। এখানে বসে আমরা ভবিষ্যত কর্মপন্থা নির্ধারণ করি। দুটো ছেলেকে খবর আনার জন্য বরিশাল শহরে পাঠানো হয়।

আমরা পুলিশের এসপির লঞ্চে করে সুন্দরবনের দিকে রওয়ানা হলাম। ২৭শে এপ্রিল দুপুরের দিকে সুন্দরবনে ঢুকলাম। ৩০শে এপ্রিল পর্যন্ত সুন্দরবনের মধ্যে ছিলাম। সুন্দরবন, শরণখোলা, বুড়িগোয়ালিনী হয়ে ১লা মে ভারতীয় সীমান্ত হিংগলগঞ্জে পৌঁছালাম। সেদিনই ভারতের হাসনাবাদে চলে গেলাম কালিন্দী নদীর মধ্য দিয়ে।

এখানে এসে মেজর জলিল, লেঃ হুদা এবং আরো কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সাথে দেখা হয়। বরিশাল শহর পতনের ৪/৫ দিন পূর্বে অস্ত্র সংগ্রহের জন্য তারা ভারতে গিয়েছিলেন। তারা ভারতের কাছ থেকে বেশ অস্ত্র সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সেখানে সিদ্ধান্ত নেয়া হলো যে, এ সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সুন্দরবনের কোনো একটি জায়গায় ঘাঁটি স্থাপন করা হবে।

৬ মে দুটো লঞ্চে সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র বোঝাই করা হলো। আহত কামাল ও এবং লেঃ হুদাকে হাসনাবাদে আরো অস্ত্র সংগ্রহের জন্য রেখে আসা হলো। আমরা দুপুরের দিকে রওয়ানা হলাম। আমরা হিংগলগঞ্জে এসে সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। সন্ধ্যার দিকে কৈখালীর সীমান্ত ঘাঁটির কাছে একটা খালের মধ্যে দিয়ে ঢুকে পড়লাম। আমাদের বড় লঞ্চটা আগে ছিলো এবং মেজর জলিলের লঞ্চটা ২৫/৩০ গজ পিছনে ছিলো। লঞ্চের সমস্ত বাতি নিভিয়ে দেয়া হয়েছিলো। বড় লঞ্চে আমি, নূরুল ইসলাম মঞ্জুর, এমপি মহিউদ্দিন, সেকেণ্ড লেঃ নাসির এবং আরো অনেকে ছিলো। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন ছিলো এবং বৃষ্টি হচ্ছিলো। বুড়িগোয়ালিনীর কাছে কপোতাক্ষ নদীতে পাকিস্তানীদের দুটি গানবোট ছিলো। আমরা গানবোটগুলোর প্রায় ৫০ গজের মধ্যে চলে গিয়েছিলাম। তখন গানবোট থেকে আমাদের লঞ্চের উপর সার্চলাইট ফেলা হলো এবং একটা সিগন্যাল ফায়ারও করা হলো। লঞ্চটাকে নদীর পারে লাগিয়ে আমরা ছোট-খাট অস্ত্র এবং কিছু গুলির বাক্স নিয়ে তীরে লাফিয়ে পড়লাম। পিছনের লঞ্চ থেকে গুলিবর্ষণ করা হয়। তখন গানবোটগুলো আমাদের উপর গুলি ছুঁড়তে শুরু করে। আমরা বাঁধের অপরদিকে গিয়ে বসে পড়লাম। এখান থেকে আমরা কিছুক্ষণ গুলিবর্ষণ করি এবং পিছনের লঞ্চের কাছে যাবার চেষ্টা করি। রাত তিনটা পর্যন্ত গানবোটের সাথে আমাদের গোলাগুলি বিনিময় হয়। আমরা লঞ্চ থেকে নামার ঘন্টাখানেক পরে লঞ্চে আগুন ধরে যায় এবং সম্পূর্ণরূপে ভস্মীভূত হয়ে যায়।

আমরা ১৪/১৫ জন পিছনের লঞ্চের দিকে এগুতে থাকলাম। কিছুদূর গিয়ে আমি এবং আরেকজন মেডিক্যাল ছাত্র মইনুল পথ হারিয়ে ফেলি। পথ হারিয়ে আমরা আবার পিছনের দিকে যেতে থাকি। কিছুদূর গিয়ে একটা ডিঙ্গী নৌকা দেখতে পেলাম। আমরা নৌকায় উঠলাম। কিন্তু নদীর মাঝে যাওয়ার সাথে সাথে আমাদের উপর গানবোট থেকে সার্চলাইটের আলো এসে পড়লো। আমরা নদীতে লাফিয়ে পড়লাম এবং সাতরে নদীর অপর পাড়ে পৌঁছলাম। সেখানে একজন লোকের বাড়িতে আশ্রয় নিলাম। তখন ভোর হয়ে গিয়েছিলো। সে এলাকাটি ছিলো মুসলিম লীগের সমর্থকদের। পথে আমরা কয়েকবার মুসলিম লীগের দালালদের হাতে ধরা পড়েছি। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছি। অবশেষে আমরা আবার ভারতে চলে যেতে সমর্থ হই।

———————————————–

 

বরিশাল রণাঙ্গনে

(‘প্রতিরোধ সংগ্রামে বাংলাদেশ’ গ্রন্থ থেকে সংকলিত)

পাকসৈন্যরা এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি মাদারীপুর শহর দখল করে নিয়েছিল। এপ্রিল মাসের শেষের দিকে ওরা মিলিটারী ভ্যান নিয়ে বরিশাল জেলার সীমানায় এসে প্রবেশ করল। খবর পেয়ে তাদের প্রতিরোধ করার জন্য মুক্তিবাহিনী গৌরণদী থেকে মার্চ করে এগিয়ে চলল। এদের মধ্যে যুদ্ধ-বিদ্যায় অভিজ্ঞ কেউ ছিল না- সকলেই কাঁচা, সকলেই অনভিজ্ঞ। মাস খানেকের রাইফেল ট্রেনিং আর নির্ভীক দেশ প্রেম, এই টুকু কেউ সম্বল করে তারা এই দুর্ধর্ষ শত্রুদের মোকাবিলা করতে চলেছে।

বরিশাল আর ফরিদপুর জেলার সীমান্তরেখায় ভুরপাটা গ্রাম। পাক সৈন্যবাহিনী বেলা এগারোটার সময় এই ভুরপাটার সেতু পেরিয়ে ইল্লা গ্রামের দিকে চলে এসেছে। দু’পাশের গ্রামবাসীদের মনেও আতঙ্কের সঞ্চার করে ভ্যানগুলি গর্জন করে ছুটে আসছে। রাইফেল, মেশিনগান, মর্টার সবকিছুই আছে তাদের সঙ্গে। কুঁড়ি-পঁচিশটা রাইফেল আর বন্দুক নিয়ে যুদ্ধ-বিদ্যায় অশিক্ষিত একদল তরুন তাদের প্রতিরোধ করতে চলেছে।

মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দু’টি তরুন এই সীমান্তে এলাকার গ্রামে গ্রামে ঘুরে সংগঠনের কাজ করে চলেছিলেন। দু’জনেই কলেজের অধ্যাপক। মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য অধ্যাপনার কাজ ছেড়ে দিয়ে তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের পথে এগিয়ে এসেছেন। আজ সকল কর্তব্যের বড় কর্তব্য মুক্তিযুদ্ধে সামিল হওয়া। শত্রুসেনারা যে বরিশাল জেলার মাটির উপর এসে গেছে, এখবরটা তখনও তাঁরা জানতে পারেননি। আক্রমন আসন্ন, ভুরপাটা গ্রামের সেতুটিকে এখনই ভেঙে ফেলা দরকার। সেতুটাকে ভাল করে পরীক্ষা করে দেখবার জন্য তাঁরা দু’জন রিকশাযোগে ভুরপাটা গ্রামের দিকে চলেছিলেন। ইল্লা গ্রামে এসে পৌছতেই মিলিটারী ভ্যানের গর্জন শুনে চমকে উঠলেন তাঁরা। সরে পড়ার সময় ছিল না, কয়েক মুহুর্তের মধ্যে দ্রুতবেগে ছুটে আসা ভ্যানগুলি তাঁদের দৃষ্টিগোচরে এসে গেল। তার ঠিক সে সময় একটা বুলেট তাঁদের দু’জনের মাজখান দিয়ে রিকশার গা ভেদ করে বেরিয়ে  গেল। সঙ্গে সঙ্গে দু’জন রিকশা থেকে পথের দু’পাশে ছিটকে পড়লেন। বরিশাল জেলার বুকে শত্রুদের এই প্রথম গুলিবর্ষণ।

তাঁরা দু’জন হামাগুড়ি দিয়ে উঁচু সড়ক থেকে নীচে নেমে এলেন। তাঁদের ভাগ্য ভাল, তাঁরা শত্রুপক্ষের নজরে পড়ে যাননি। তাঁরা গুনে গুনে দেখলেন। ১০টা ভ্যান, তার পেছনে একটা এ্যাম্বুলেন্স গাড়ী। ভ্যানগুলি সম্ভবত গৌরণদীকে লক্ষ্যকরে ছুটে গেল। এঁরা দু’জন গ্রামের পথ ধরে পেছন পেছন ছুটলেন।

বার্থী গ্রামের সামনে গিয়ে ভ্যান্দুটি দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর একদল সৈন্য ভ্যান থেকে নেমে গ্রামের ভেতর ঘুরে ঘুরে এলোপাথাড়ি গুলি ছুঁড়ে চলল। যাকে সামনে পেল তাকেই মারল। তখন কালীপূজার সময়। ওরা পূজাবাড়িতে গিয়ে পূজায় রত দু’জন পুরোহিতকে হত্যা করল। এই ‘পবিত্র’ কর্তব্য সুসম্পন্ন করে ভ্যানগুলি আবার তাঁদের গন্তব্যস্থলের দিকে যাত্রা করল।

বার্থী থেকে মেইল দুই দূরে কটকস্থল নামে একটি গ্রাম। মুক্তিবাহিনীর যে যোদ্ধারা শত্রুসৈন্যদের প্রতিরোধ করবার জন্য গৌরণদী থেকে যাত্রা করেছিল, তাঁরা সেই সময় এই কটকস্থল গ্রামে পথের ধারে বসে বিশ্রাম করছিল। ভ্যানগুলি এগিয়ে আসতেই প্রতিদ্বন্দ্বী দু’পক্ষ পরস্পরকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ল। প্রতিপক্ষ যে কোন সময় তাঁদের উপর এসে চড়াও হতে পারে, এমন একটা অবস্থার জন্য মুক্তি বাহিনীর যোদ্ধারা প্রস্তুত ছিল না। সেজন্য তাঁদের মুল্যও দিতে হয়েছিল। কিন্তু একটু বাদেই তাড়া তাদের পজিশন নিয়ে নিল। তারপর পরস্পর অজস্র ধারায় গুলি বিনিময় চলল। প্রায় আধ ঘন্টা ধরে এই যুদ্ধ চলেছিল। কিন্তু পাক-সৈন্যরা যখন ভারী মেশিনগান ব্যাবহার করতে শুরু করল, তখন রাইফেল সর্বস্ব মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদের সামনে আর বেশীক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। দাঁড়িয়ে থাকাটা সমীচীনও ছিল না। তারা পাঁচজন মুক্তিযোদ্ধার দেহ পিছনে ফেলে রেখে গ্রামের অন্তরালে অদৃশ্য হয়ে গেল।

কটকস্থল গ্রামের যুদ্ধের দিন কয়েক পরে। গৌরণদী পাক-সৈন্যদের দখলে এসে গিয়েছে। এখানকার ঘাঁটি সুদৃঢ় করে নিয়ে এবার তারা বরিশাল শহর দখলের অভিযানের  বসে নেই। হামলাকারী শত্রুদের প্রতিরোধ করবার জন্য তারা তাদের পরিকল্পনা অনুসারে কাজ করে চলেছিল।

বরিশাল শহরের মুক্তিবাহিনী গৌরনদীর মুক্তিবাহিনীর তুলনায় অনেক বেশী শক্তিশালী। শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা ও অস্ত্রবলের দিক দিয়েই নয়, তাদের মধ্যে যুদ্ধবিদ্যায় শিক্ষিত এবং অভিজ্ঞ লোকও ছিল। ছাত্র ছাড়াও বেঙ্গল রেজিমেন্ট ইপিআর বাহিনীর জওয়ানরা, পুলিশ, আনসার ইত্যাদি নিয়ে এই বাহিনী গড়ে উঠেছিল।

মুক্তিবাহিনীর নেতারা প্রতিরোধ-প্রস্তুতির শেষ পর্যায়ে এসে এক নতুন রণকৌশল উদ্ভাবন করেছিলেন। এই কৃতিত্বের জন্য অবশ্যই তাদের প্রশংসা করতে হবে। সি-এণ্ড-বি রোড বরিশাল শহরকে ফরিদপুর জেলার সঙ্গে যুক্ত করেছে। শত্রুরা এই পথ দিয়ে বরিশাল শহর আক্রমণ করতে আসবে। তাদের গতিপথ কে রুদ্ধ করে দেবার জন্য এবং তাদের অচল করে ফেলবার জন্য ইতিপুর্বে এই সড়কের বিভিন্ন স্থানে নানাভাবে ব্যারিকেড সৃষ্টি করা হয়েছিল। মুক্তিবাহিনীর নির্দেশে সেই সমস্ত গ্রামের লোকেরা উদ্যোগী হয়ে সেই কাজে হাত দিয়েছিল। কিন্তু মুক্তিবাহিনী শেষ মুহুর্তে হঠাৎ তাদের এই পরিকল্পনা বাতিল করে দিয়ে এক নতুন রণকৌশল নিয়ে শত্রুপক্ষের জন্য এক মায়ার ফাঁদ পেতে বসল। দেখতে দেখতে সমস্ত ব্যারিকেডগুলিকে দরিয়ে নিয়ে এই রাস্তাকে যানবাহন চল্বার পক্ষে সুগম করে দেয়া হোল। শত্রুরা যাতে বিনা বাধায় এবং নিশ্চিন্ত মনে এগিয়ে আসতে পারে, সেজন্যই এই ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

বরিশাল শহরে আসতে হলে পর পর দুটো নদী পেরিয়ে আসতে হয়। প্রথমটা শিকারপুরের নদী, দ্বিতীয়টা দোহারিকা নদী। এই দুয়ের মাঝে দশ মেইল স্থলপথ। এইখানে মায়ার ফাঁদ পেতে রাখা হয়েছে। পথে কোথাও কোন বাঁধা পাওয়া যাবে না, কোন ব্যারিকেড সরিয়ে আসতে হবেনা, কোন ভেঙ্গে ফেলা পুল সারাই করে নিতে হবে না এমন কথা পাক-সৈন্যরা ভাবতেও পারেনি। এমন সহজ সুগম পথ পেয়ে তারা মহাখুশী। তাদের সৈন্যবাহী গাড়িগুলি স্বচ্ছন্দে শিকারপুরের নদীর পার পর্যন্ত চলে এল।

ফেরী বোটে করে এই নদী পাড়ি দিয়ে ওপারে যেতে হবে। ওরা উল্লাসিত হয়ে দেখল ফেরীবোটের মাথায় পাকিস্তানের পতাআ উড়ছে। ফেরীবোটের লোকেরা ওদের আসতে দেখে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ বলে জয়ধ্বনি তুলল। তখনকার মত দুর্দিনে এমন সাদর সংবর্ধনা পাবে, এটা ওরা কল্পনাও করতে পারেনি। আনন্দে ডগমগ হয়ে ওরা ফেরীবোটের সাহায্যে নদী পার হতে লাগল। মুহূর্তের জন্যও তারা ভাবতে পারেনি যে তারা ইতিমধ্যেই প্রতিপক্ষের রচিত মায়ার ফাদে পা দিয়ে বসেছে।

এমনি করে ক্রমে ক্রমে নব্বই জন সৈন্য আর চালকসহ ন’খানা গাড়ি দিয়ে ওপারে গিয়ে উঠল। এখানেও কোন বাধা নেই, ওরা স্বচ্ছন্দে এগিয়ে চলল। একটু দূরে গিয়েই ওরা থামল। তাদের গোয়েন্দারা চারদিকটা ভাল করে পরীক্ষা করে দেখে নিল-না, কোথাও বিপদের আশঙ্কা নেই। সবাই গ্রামে ঢুকে পড়ল, নিঃশঙ্কচিত্তে গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল। পেছনে পড়ে রইল ন’খানা মিলিটারী ভ্যান ও তাদের চালকরা। সৈন্যদের মধ্যে কেউ কেউ গৃহস্তদের দিয়ে ডাব, নারিকেল, কলা এবং নানারকম খাদ্য আনাতে লাগল, তারপর সেইখানেই তাই দিয়ে ভোজের উৎসবে মেতে গেল। কেউ কেউ গৃহস্তদের ভয় দেখিয়ে হাঁস-মুরগি, খাসি ইত্যাদি এনে জড়ো করতে লাগল। আবার একদল গৃহস্তবধূদের কাছে সোনাদানা, গয়না যা পেল সবকিছু লুটে-পুটে আনতে লাগল। এই শান্ত, ঠাণ্ডা আর ভেড়ার মত নিরীহ মানুষগুলি এর প্রতিবাদে একটি কথাও বলল না। ওরা তখনকার মত যুদ্ধবিগ্রহের কথা ভুলে গিয়ে ভোজের উৎসবে মেতে গেছে, সৈনিকের শৃঙ্খলাবোধ হারিয়ে ফেলেছে। খেয়ে-দেয়ে পরিতৃপ্ত হয়ে আরামে এলিয়ে দিয়েছে দেহ। এমন সময় হঠাৎ একই সঙ্গে বহু রাইফেলের আওয়াজ শান্ত প্রকৃতির নিস্তব্ধতাকে ভেঙ্গে চুরমার করে দিল। সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উঠল সৈন্যরা। তাদের উপর বৃষ্টিধারার মত গুলিবর্ষন চলছে। শুধু রাইফেলের আওয়াজ নয়, তারই সাথে শত শত দৃপ্তকন্ঠের ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি আকাশ বাতাস মুখরিত করে চলেছে। অস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত হতে হতে ওদের অনেক সময় কেটে গেল। অস্ত্র চালাতে গিয়েও প্রতিপক্ষের দেখা পেল না, ওরা গোপন আশ্রয়ের অন্তরালে অদৃশ্য হয়ে একটানা গুলিবর্ষণ করে চলেছে। মুক্তিবাহিনীর জয়ধ্বনির উত্তরে আহত ও মুমূর্ষ পাক-সৈন্যদের আর্তনাদ শোনা যেতে লাগল। পুরা এক ঘন্টা যুদ্ধ চলার পর আর কোন সাড়াশব্দ শোনা গেল না, শান্ত প্রকৃতি আবার শান্ত হয়ে গেছে। পাক-সৈন্যদের দুর্বল প্রতিরোধ কোন কাজেই আসেনি সেই যুদ্ধে একটি মুক্তিযোদ্ধাও মারা যায়নি।

মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ। হামলাকারী পাক-সৈন্যরা বরিশাল আর ফরিদপুর জেলার নানা জায়গায় ঘাঁটি করে গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। এই নৃশংস মানুষ শিকারীর দল গ্রামের পর গ্রামে ঢুকে নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে, লোকের যথাসর্বস্ব লুটপাট করে নিচ্ছে, আর যেখানে বিন্দুমাত্র বাঁধা পাচ্ছে, সেখানে ঘর-বাড়ী জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দিচ্ছে। এ এক অসহনীয় অবস্থা। গ্রামের লোক ভয়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। এই অসহায় আর নিরুপায় মানুষগুলি কি করবে, কোথায় যাবে পথ খুঁজে পাচ্ছে না।

গৌরনদী থানায় যে মুক্তিবাহিনী গড়ে উঠেছিল ইতিমধ্যে ভেঙে-চুরে ছত্রভঙ্গ হয়ে গিয়েছে।

এই অবস্থায় জনকয়েক তরুন কর্মী আবার নতুন করে মুক্তিবাহিনীকে গড়ে তোলবার জন্য আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিল। তবে এবার শুধু গৌরণদী থানা নয়, বরিশাল জেলার গৌরণদী আর ফরিদপুর জেলার কোটালীপাড়া ও কালকিনী এই তিন থানার কর্মীরা পরস্পরের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছিল। সেই সময় গৌরণদী থানার পুর্ব-নবগ্রামের একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করল।

পূর্ব-নবগ্রামটি বরিশাল জেলা আর ফরিদপুর জেলার সীমান্তস্থলে অবস্থিত। পূর্ব-নবগ্রামের উত্তর দিকে একটি সরু খাল তার গা ঘেঁষে চলে গেছে। এই খালেই অপর পারে ফরিদপুর জেলার নবগ্রাম। পূর্ব-নবগ্রাম থেকে মাত্র মেইল দেড়েক দূরে মেদাকুল, এখানে পাক-সৈন্যরা ঘাঁটি করে বসে আছে। এটি একটি নমঃশুদ্র অঞ্চল। এখানকার লোকদের মধ্যে অধিকাংশ কৃষক হলেও শিক্ষিত সম্প্রদায়ও আছে। তাদের মধ্যে কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাও আছে। মাত্র মেইল দেড়েক দূরে শত্রুদের ঘাঁটি। এখানকার বাসিন্দারা প্রতিমুহূর্তেই ওদের আক্রমনের আশঙ্কা করছিল। বাইরের কোন কিছু আভাস না পেলেও কয়েকদিন থেকে এদের ভেতরে ভেতরে একটি প্রতিরোধের প্রস্তুতি চলছিল।

সরকারী প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক সিদ্ধেশ্বর সরকার এ বিষয়ে উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তারা স্থির করেছিল, যদি সুযোগ পাওয়া যায় তাহলে তারা ওদের বিরুদ্ধে একহাত দেখে নিবে। পূর্ব-নবগ্রামের শিক্ষিত তরুন ও সাধারণ কৃষকরা এই উদ্দেশ্যে সংকল্পবদ্ধ হয়ে একজোট হয়ে দাড়িয়েছিল। বরিশাল আর ফরিদপুরের নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের লোকেরা ছেলেবেলা থেকেই লাঠি, সড়কি, লেজা ইত্যাদি অস্ত্র চালনায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। পূর্ব-নবগ্রামের যেসব তরুণরা উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেয়েছে তারাও এ বিষয়ে আনারি নয়, তারাও এখনো এই সমস্ত অস্ত্র চালনার অভ্যাসটা হারিয়ে ফেলেনি। এই সুঃসাহসী তরুণরা সংকল্প নিয়েছিল যে, যদি সুযোগ পাওয়া জায়ঃ তাহলে সড়কিম লেজা ইত্যাদি অস্ত্র নিয়েই ওদের রাইফেলের সঙ্গে মোকাবিলা করবে। প্রবীন সিদ্ধেশ্বর সরকারের উদ্যোগে এবং অর্থব্যায়ে এই সমস্ত অস্ত্র তৈরি হচ্ছে। উত্তেজনায় সারাটা গ্রাম গরম হয়ে উঠেছে। রাইফেলের বিরুদ্ধে সড়কি আর লেজা- এ এক নতুন অভিজ্ঞতা।

এরা উপযুক্ত সুযোগের জন্য প্রতীক্ষা করছিল। সেই সুযোগ একদিন এসে গেল। ১৩ ই মে তারিখে মেদাকুলের ঘাঁটি থেকে মাত্র চারজন সৈন্য পূর্ব-নবগ্রামে প্রবেশ করল। সাধারণ রাইফেল নয়, ওদের সঙ্গে একটি স্বয়ংক্রিয় রাইফেল ও ছিল। এখানকার গ্রামাঞ্চলে আসার পর থেকে পাক-সৈন্যরা এ পর্যন্ত কোন দিক থেকেই বাঁধা পায়নি। গ্রামে ঢুকেই ওরা প্রথমে সিদ্ধেশ্বর সরকারের বাড়িতে হামলা করল। সিদ্ধেশ্বর সরকার বাড়িতে ছিলেন না, তিনি তখন এদের উপযুক্ত অভ্যর্থনার আয়োজনে অন্যত্র ব্যাস্ত। সরকার- বাড়িতে যা কিছু মুল্যবান জিনিস পেল তা লুটপাট করে নিয়ে ওরা খালের ওপারে নবগ্রাম গ্রামের বিশ্বাস বাড়িতে লুটপাট করতে গেল। বিশ্বাস-বাড়ির চিলে কোঠাটা ছিল এখানকার ছাত্রদের বিস্ফোরক দ্রব্য তৈরি করবার ল্যাবরেটরী। দু’টি ছেলে সেখানে বসে তাদের সংগৃহীত যৎসামান্য রাসায়নিক মাল-মশলা দিয়ে হাতবোমা তৈরি করত। তাদের মধ্যে একজন ছিল পাশ-করা ডাক্তার। সৈন্যরা তাদের নাগালের মধ্যে আসতে তারা তাদের লক্ষ্য করে পরপর কয়েকটা হাতবোমা ছুড়ল। বিস্ফোরণের শব্দে গ্রামের শান্ত আবহাওয়া কেঁপে উঠল। ভয়ে কেঁপে উঠল পাকিস্তানী সৈন্যরা। ওরা প্রানের ভয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটল। কিন্তু ইতিমধ্যে উত্তর, পশ্চিম ও দক্ষিণ দিক থেকে পূর্ব-নবগ্রামে মুক্তি যোদ্ধারা আকাশ ফাটানো গর্জনধ্বনি করতে ক্রতে ছুটে আসছে।

এইভাবে আক্রান্ত আক্রমণকারী সৈন্যরা অবিরল ধারায় গুলিবর্ষণ করতে করতে পেছন হটে যেতে লাগল। যেকোন ভাবেই হোক, এখন ওদের মেদাকুলের ঘাঁটিতে ফিরে যেতে হবে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা ওদের গুলিবর্ষণকে অগ্রাহ্য করে ক্রমেই কাছে, আরও কাছে এগিয়ে আসছে। অর্ধচন্দ্রাকারে ঘেরাও করে এসেছে। সৈন্যরা কোন দিকে লক্ষ্য রাখবে ঠিক করে উঠতে পারছিল না। ইতিমধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে কয়েকজন দুঃসাহসী মৃত্যুভয়কে তুচ্ছ করে একেবারে সামনে এসে পড়েছে। তাদের মধ্যে একজন মাত্র হাত দশেক দূর থেকে একজন সৈন্যকে লক্ষ্য করে হাতের সড়কি ছুড়ল। অব্যার্থ লক্ষ্য। সঙ্গে সঙ্গে দানবের মত বিরাট দেহ সেই পাঞ্জাবী সৈন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল।

যে দুঃসাহসী যুবক সড়কিটা ছুড়েছিল, তার নাম অমূল্য মল্লিক। ইতিমধ্যে প্রফুল্ল আর একজন সৈন্য এগিয়ে এসে অমূল্যকে লক্ষ্য করে তার হাতের রাইফেলটা তুলেছে। অমুল্যকে রক্ষা করার জন্য মধ্যবয়সী দেবেন সরকার দু’লাফে সামনে এগিয়ে এল। সেই পেছন থেকে জাপটে ধরল সেই সৈন্যটিকে, কিন্তু ততক্ষনে সেই রাইফেলের গুলি তার লক্ষ্যস্থলে গিয়ে পৌঁছেছে। গুলিবিদ্ধ অমুল্য মল্লিক চিরতরে চোখ বুজল, তার মাতৃভূমির বুকে শিশুর মত ঘুমিয়ে পড়ল। ইতিমধ্যে প্রফুল্ল সেই সৈন্যের হাত থেকে সেই মৃত্যুবর্ষী রাইফেল্টাকে ছিনিয়ে নিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গেই লেজার ঘায়ে সেই সৈন্যটির ভবলীলা সাঙ্গ হোল।

চারজন সৈন্যের মধ্যে বাকি রইল দুইজন। ওরা পেছন দিকে ছুটতে ছুটতে সামনে একটা খালের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল। খালের পাড়টা খাড়া, তার মধ্যে নেমে পড়া সহজ কিন্তু সেখান থেকে ওঠাটা সহজ নয়। তাছাড়া একগল জলে দাঁড়িয়ে ওরা রাইফেল চালাতে পারছিল না। এই মরণের ফাঁদ থেকে ওরা উঠতে পারল না, মুক্তিযোদ্ধাদের সড়কির ঘায়ে সেখানেই তাদের সলিল সমাধি ঘটল।

বরিশাল আর ফরিদপুর জেলার যে কর্মীরা সম্মিলিত ভাবে মুক্তিবাহিনী গড়ে তুল্বার চেষ্টা করেছিল, পূর্ব-নবগ্রামের এই প্রতিরোধ সংগ্রামের সঙ্গে তাদের প্রথম থেকেই যোগাযোগ ছিল। পাক-সৈন্যদের নিধন পর্বের মধ্য দিয়ে তাদের উৎসাহ আরও বেড়ে গেল। ইতিমধ্যেই পূর্বোক্ত তিনটি থানার কর্মীদের নিয়ে মুক্তিফ্রন্ট সংগঠন গড়ে তোলা হয়েছে। এই তিনটি থানা থেকে পঞ্চাশ জনের মত তরুন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নাম লিখিয়েছে। এদের মধ্যে মুসলমান, হিন্দু, খৃষ্টান সকল সম্প্রদায়ের লোক আছে। ছাত্রও আছে, কৃষকরা আছে। আরও অনেক লোক দলে আসবার জন্য উন্মুখ। কিন্তু এ বড় কঠিন জিনিস, অনেকে দেখে শুনে, ভেবে-চিন্তে লোক বাছাই করতে হয়। ফ্রন্ট ও গঠিত হয়েছে, মুক্তিযোদ্ধারাও সামনে এগিয়ে এসেছে, কিন্তু না আছে অস্ত্র, না আছে ট্রেনিং। পূর্ব-নবগ্রামে যাই হোকনা কেন, ওদের বিরুদ্ধে  সত্য সত্যই তো আর সড়কি লেজা নিয়ে লড়াই করা চলবে না। চাই রাইফেল, নিদেনপক্ষে বন্দুক। যে-করেই হোক তা সংগ্রহ করতে হবে। মুক্তিফ্রন্টের সেক্রেটারী জনৈক তরুণ অধ্যাপক। এক বিরাট দায়িত্ব তাঁর মাথার উপর এসে পড়েছে।

চারজন পাক-সৈন্যকে এভাবে খতম করতে পারার ফলে পূর্ব-নবগ্রাম ও নিকটবর্তী গ্রামগুলিতে উৎসাহ ও আনন্দের ঢেউ বয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তা একটুকু সময়ের জন্যই; পরমুহুর্তেই সকলের মনে পড়ল যে সামরিক কতৃপক্ষ ব্যাপারটাকে কিছুতেই এত সহজে হজম করে নেবে না। মাত্র দেড় মেইল দূরে ওদের ঘাঁটি, এরা এক্ষনি সদলবলে এসে হানা দেবে এবং কঠিন হাতে এ প্রতিশোধ নেবে। ওদের প্রতিহিংসার আগুনে পূর্ব-নবগ্রাম আর নবগ্রাম এই দু’টি গ্রাম পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। এরপর এখানে একটি জনপ্রাণীকেও ওরা বেঁচে থাকতে দেবে না। এ অবস্থায় প্রানে বাচতে হলে এক্ষুনি, এই মুহূর্তে কোন নিরাপদ জায়গায় চলে যেতে হবে। একটি জায়গা আছে বটে, সেটা হচ্চে এখানেকার বিল অঞ্চল। সে বিস্তীর্ণ জলরাশির মধ্যে ডাঙা থেকে বহুদূরে বিক্ষিপ্তভাবেই ছড়িয়ে আছে বিল এলাকার ছোট ছোট গ্রামগুলি। সেখানে গিয়ে আশ্রয় নিলে ঝড়ের এই প্রথম ঝাপটাটা হয়তো সামলে নেয়া যাবে। পাকিস্তানী সৈন্যরা টের পেলেও ওখানে যেরে সাহস করবেনা। বেশী চিন্তা করবার সময় নেই, যা করবার এই মুহূর্তেই করতে হবে। দেখতে দেখতে সমস্ত এলাকা জনমানবশূন্য হয়ে গেল।

ওরা যা ভেবেছিল তাই ঘটল, খবর পাবার সঙ্গে সঙ্গেই হিংস্র পাক-সৈন্যরা শস্যে ক্ষেতে পঙ্গপালের মত এসে ছেয়ে ফেলল, গ্রামের পর গ্রামে হানা দিয়ে চলল। পাশাপাশি ক’টা গ্রাম একেবারে উচ্ছন্ন করে দিল।

এত বড় ঘা খেয়েও মুক্তি ফ্রন্টের লোকদের মনোবল কিন্তু ভাঙেনি। একটা জিনিসের দিকে তাদের বিশেষ লক্ষ্য ছিল, যে চারজন পাকিস্তানী সৈন্য এখানে নিহত হয়েছে তাদের প্রত্যেকের সঙ্গে রাইফেল ছিল। সেই চারটা রাইফেলের মধ্যে একটা ছিল চীনা স্বয়ংক্রিয় রাইফেল। এই অস্ত্রটি দূর্লভ। এই অস্ত্রটিকে হার করতে পারলে শুধু সেটা দিয়েই বহু কাজ হাসিল করতে পারা যাবে। ওই চারটি রাইফেল এই গ্রামেই আছে, ওইগুলিকে বের করে হস্তগত করতে পারলে মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধাদের হাতে-খড়ির কাজ শুরু হতে পারবে।

সবাই যখন জান-প্রান নিয়ে পালাতে ব্যাস্ত, মুক্তিবাহিনীর সেক্রেটারি তখন সেই রাইফেলগুলির সন্ধানে উঠে-পড়ে লেগে গেলেন। হ্যাঁতে সময় নেই, শত্রুসৈন্যরা যেকোন সময় এসে পড়তে পারে, তার আগেই এই অস্ত্রগুলিকে খুঁজে বের করতে হবে। অস্ত্রগুলির সম্পর্কে প্রথমে কেউ কোন কথা বলতে চায় না। বহু মিনতি আর রাগারাগির পর অবশেষে একটি একটি করে সব কটির সন্ধান পাওয়া গেল। সবচেয়ে আনন্দের কথা, সেই চীনা স্বয়ংক্রিয় রাইফেলটিকেও পাওয়া গেছে। মুক্তিফ্রন্টের সেক্রেটারি উত্তেজনা আর উল্লাসে অধীর। আর চিন্তা নেই, এবার এই ক’টিকে পুঁজি করেই তারা কাজ শুরু করে দেবেন।

আরও আনন্দের কথা এই যে, রাইফেলগুলির সাথে এক পেটিভর্তি বুলেটও পাওয়া গেছে, যার অভাবে রাইফেল গুলি অচল হয়ে থাকত। অস্ত্রগুলি যাদের হাতে এল, তাদের কিন্তু রাইফেল চালনা সম্পর্কে কোন ধারণাই নেই। কারও কাছ থেকে এই বিষয়ে সাহায্য নেবো, এমন লোকও হাতের কাছে নেই। কিন্তু তাতেও তারা ঘাবড়াল না। তাদের উৎসাহ অদম্য। সারারাত জেগে রাইফেলগুলিকে নিয়ে নানাভাবে নাড়াচাড়া করতে করতে রাইফেল থেকে গুলি ছুড়বার কৌশলটা বেরিয়ে এল। এ তাদের কাছে এক মহা-আবিস্কার।

সাফল্যের পর সাফল্য। ভাগ্যলক্ষ্মী তাদের উপর সুপ্রসন্ন হয়ে তাঁর ভান্ডারের বন্ধ দরজাটা এবার তাদের সামনে খুলে ধরেছেন। ইতিপূর্বে মার্চ মাসে গৌরণদী থানা এলাকায় যে মুক্তিবাহিনী গড়ে উঠেছিল তাদের হাতে বেশকিছু রাইফেল আর বন্দুক ছিল। সেই মুক্তিবাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে অধিকাংশ কে কোথায় চলে গেছে তার কোন পাত্তা নেই। তাদের মধ্যে অনেকেই হয়তো বর্ডার ওপারে নিরাপদ আশ্রয়ে আছে। কিন্তু তাদের অস্ত্রগুলিকে কোথায় রেখে গেছে তারা? শোনা যায়, এই অঞ্চলেই কোথায় নাকি লুকিয়ে রেখে গিয়েছিল। নবগঠিত মুক্তিফ্রন্ট তার জন্মের পর থেকেই এই নিরুদ্দেশ অস্ত্রগুলির অনুসন্ধান করে চলেছিল। অবশেষে সেই পুরানো দলে একটি ছেলের সাহায্য নিয়ে সেই মহামূল্য গুপ্ত সম্পদগুলিকে আবিষ্কার করা গেল। সহজ ব্যাপার নয়, রাইফেল আর বন্দুক মিলিয়ে সতেরখানা। নিহত পাকসৈন্যদের কাছ থেকে পাওয়া চারটি রাইফেল আর এই সতেরখানা, মোট একশখানা। মুক্তিবাহিনী এখন একশটি অস্ত্রের অধিকারী। অস্ত্রের সাথে বেশ কিছু বুলেটও পাওয়া গেছে। তাই দিয়ে অনেকদিন কাজ চলবে। একটা নিরালা যায়গায় টেনিং ক্যাম্প স্থাপন করে এক মাসের ট্রেনিং দেয়ার ব্যাবস্থা করা হএত লাগল। বহু খোঁজাখুঁজির পর ট্রেনিং দেয়ার জন্য একজন প্রাক্তন সৈনিকের সন্ধান পাওয়া গেল। অনেক সাধ্য-সাধনাকরে রাজী করান গেল তাকে। আপাতত প্রথম রাউন্ডে তাকে দিয়েই কাজ চালিয়ে নিতে হবে। পাশাপাশি ক’টা গ্রাম একেবারে জনমানব শুন্য। ট্রেনিং এর জন্য গোপন ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করবার মত নিরালা জায়গাও মিলল। কিন্তু সমস্যা দাঁড়াল এই যে, পঞ্চাশটি তরুণ এক মাস কাল ট্রেনিং নেবে, তারা খাবে কি? এই দুঃসময়ে যারা তাদের অর্থ দিয়ে খাদ্য দিয়ে সাহায্য করতে পারত, তাদের মধ্যে অনেকেই গ্রাম থেকে পালিয়ে বিল অঞ্চলে আশ্রয় নিয়েছে। অর্থ ও খাদ্য সংগ্রহের জন্য মুক্তিফ্রন্ট অর্থ সাব-কমিটি ও খাদ্য সাব-কমিটি গঠন করেছিল। তাদের চেষ্টার ত্রুটি ছিল না বটে, কিন্তু এই কঠিন সময়ে যথাশক্তি চেষ্টা করেও তারা তাদের দায়িত্ব পূর্ণ করতে উঠতে পারছিল না। তা সত্বেও এক মাস ধরে এই ট্রেনিং চলল। প্রতিটি স্বেচ্ছাসেবকের ঐকান্তিক নিষ্ঠা ও দৃঢ়সংকল্প এই অসাধ্য সাধন করতে সক্ষম হয়েছিল। সত্য কথা বলতে কি, তারা অধিকাংশ সময়ে আধ-পেটা খেয়ে এবং সময় সময় না খেয়েও এই সামরিক ট্রেনিং নিয়ে চলেছিল।

প্রাথমিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করে মুক্তিবাহিনী এবার কাজে নামল। তারা প্রথমে সমাজ-বিরোধী শত্রুদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভিজানে নামল। তারা এই সমস্ত দালাল ও দুর্বৃত্বদের নামের একটি কালো তালিকা তৈরি করে নিয়েছিল। পর পর কয়েকটি ঘটনা ঘটে গেল। ১২ই জুন তারিখে মুক্তিবাহিনী গইলা অঞ্চলের দুইজন কুখ্যাত দালালের বাড়িতে হামলা করল। এদের হাতে প্রথম বাড়িতে আরজান ও তার দুই ছেলে এবং দ্বিতীয় গইলার প্রতাপশালী চেয়ারম্যান আফতাবুদ্দিন মুন্সী নিহত হলো।

এইভাবে বিভিন্ন স্থানে দালাল হত্যার পর সারা অঞ্চলে সাড়া পরে গেল লোকে বুঝলো, সামরিক সরকার মুক্তিবাহিনীর হাত থেকে তাঁদের দালালদের রক্ষা করতে অসমর্থ। অবস্থা দেখে অন্যান্য দালালরাও ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। তাঁদের অনেকের কাছে মুক্তিফ্রন্টের নেতাদের নামে চিঠি আসতে লাগলো, কালো তালিকার কথাটা সকলের কাছেই প্রকাশ হয়ে গিয়েছিল। আতঙ্কগ্রস্ত দালালরা তাঁদের সেই সমস্ত চিঠিতে এই মিনতি জানাতো যে, তাঁদের নাম যেন ওই কালো তালিকা থেকে বাদ দিয়ে দেয়া হয়। মুক্তিফ্রন্ট যদি তাঁদের রেহাই দেন, তাহলে তাঁরা মুক্তিফ্রন্টকে অনেক টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করবে।

এইভাবে দালালদের দমন করে মুক্তিবাহিনী এবার তাদের আসল কাজে নামলো।

ইতিমধ্যে একটা অনুকূল যোগাযোগের ফলে মুক্তিবাহিনীর শক্তি আশাতীতরূপে বেড়ে গিয়েছিল। আপনা থেকে একটা বিরাট সুযোগ তাদের হাতে এসে গেল। মুক্তিফ্রন্ট তাদের সংগ্রাম শুরু করার কিছুটা আগে আর একটি ছোট দল অনুরূপ আদর্শ নিতে কার্যক্ষেত্রে নেমে গিয়েছিল। দলটি ছোট হলেও গুনের দিক দিয়ে উন্নত পর্যায়ের। দলের নেতার নাম হেমায়েতউদ্দীন। প্রাক্তন সৈনিক। ২৫-এ মার্চ ধাকায় যখন প্রথম আক্রমণ শুরু হোল, সেই সময় হেমায়েতউদ্দীন জয়দেবপুরে ছিলেন।

-উপরে হলুদ চিহ্নিত অংশে মূল দলিলে ঢাকা লেখা আছে। এটি ঠিক নয়। জয়দেবপুর হবে। কারণ হেমায়েতউদ্দিনের নিজের সাক্ষাৎকারেই জয়দেবপুরের উল্লেখ আছে। সেটি মূল দলিলের ৯ম খণ্ডের ৪৭৪ নং পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা আছে। অর্থাৎ এই ওয়ার্ড ফাইলের ভেতরেই আছে।

তার কিছু আগেই তিনি কি করে একটা মেশিনগান ও একটা সাবমেশিনগান যোগাড় করে নিয়েছিলেন, একমাত্র তিনিই তা জানেন। এ ছাড়া কয়েকটি রাইফেল ও তাঁর হাতে এসে গিয়েছিল। ঢাকার হামলার পর এই দু’টি ভারী অস্ত্রে সুসজ্জিত হয়ে হেমায়েতউদ্দীন চলে এলেন ফরিদপুরে। এখানে এসেই তিনি জঙ্গী বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রামে নেমে গেলেন। এই উদ্দেশ্যে তাঁর ছোট্ট দলটি গড়ে উঠল। তাঁর এই বাহিনীতে মাত্র ৭ জন মুক্তিযোদ্ধা। ৪ জন প্রাক্তন সৈন্য, আর ৩ জন বেসামরিক লোক। মুক্তিযুদ্ধের সেই প্রাথমিক অস্ত্রবলের দিক থেকে এরা ছিল খুবই শক্তিশালী। তাছাড়া এরি দলে ছিল যুদ্ধবিদ্যায় সুশিক্ষিত ৪ জন সৈন্য। কিন্তু তাদের সবচেয়ে বড় শক্তি দলের নেতা হেমায়েতউদ্দীন। পরিচালনা শক্তি, বুদ্ধি ও সাহসের দিক দিয়ে তাঁর তুলনা কমই মেলে। মুক্তিফ্রন্টের বহু ভাগ্য, এক বন্ধুর মধ্যবর্তিতায় তাদের সঙ্গে হেমায়েতউদ্দীনের যোগাযোগ ঘটল। এবং কিছুদিনের মধ্যেই এই দুই দল পরস্পরের সাথে ওতপ্রোতভাবে মিশে গেল। মুক্তিফ্রন্ট হেমায়েতউদ্দিনকে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার বা সেনাপতির পদে নির্বাচিত করল। অস্ত্রশক্তির দিক দিয়ে এবং সামরিক শিক্ষাব্যাবস্থার মুক্তিবাহিনী এবার থেকে সমৃদ্ধ হয়ে উঠল।

মুক্তিফ্রন্টের এই বাহিনীতে যোগ দেয়ার আগে হেমায়েতউদ্দীন তাঁর এই ছোট্ট দলটিতে নিয়ে নিজের বুদ্ধি অনুসারে কাজ করে চলেছিলেন। কোন রাজনৈতিক দলের লোক নন তিনি। তাহলেও সারা প্রদেশব্যাপী স্বাধীনতা আন্দোলন তাদের মুক্তিসংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করে তুলেছিল তারপর বর্বর পাকসৈন্যদের নৃশংস অত্যাচার তাঁকে ক্ষিপ্ত করে তুলেছিল। যে করেই হোক এদের হাত থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করতেই হবে- এই প্রতিজ্ঞা তাঁর ধ্যান, জ্ঞান আর জপমন্ত্র হয়ে দাঁড়াল।

এইভাবে মুক্তিমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে হেমায়েতউদ্দীনের এই ছোট্ট দলটি একান্তভাবে নিজেদের শক্তির উপর নির্ভর করেই কাজে নামল। ১৪ই মে তারিখে তারা ফরিদপুরের কোটালিপাড়া থানা আক্রমণ করেছিলেন।

(-হেমায়েতউদ্দিনের সাক্ষাৎকার ৯ম খণ্ড পেজ ৪৭৬ মোতাবেক এটি ১৪ই মে হবে)

থানায় সশস্ত্র পুলিশরা ছিল, দু’চারজন মিলিটারী লোকও ছিল। কিন্তু মেশিনগানের গুলিবর্ষনের সামনে দাঁড়িয়ে লড়াই করাবার মত হিম্মত তাদের ছিল না। তারা আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে থানা ছেড়ে প্রান নিয়ে পালাল। হেমায়েতউদ্দীন সেখানে বেশকিছু অস্ত্রশস্ত্র ও গুলি পেয়ে গেলেন।

পাক-সৈন্যরা একটার পর একটা অঞ্চল দখল করে নিয়েছিল। তাদের অধিকার পাকাপোক্ত হয়ে বসার সঙ্গে সঙ্গে তাদের মুসলিম লীগ-পন্থী ও জামাত-পন্থী দালালের দল মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে লাগল। গুন্ডা ও লুটেরার দলও তাদের সঙ্গে হাত মিলাল। হেমায়েতউদ্দীন প্রধান রোখ পড়ল এদের উপর। তিনি বললেন, এই ঘরের ইঁদুরগুলিকে খতম করতে না পারলে মুক্তিসংগ্রামের পথে এগিয়ে যাওয়া যাবে না। তাই প্রথমেই এদের শায়েস্তা করতে হবে। এ শুধু কথার কথা নয়, তিনি যা বললেন তা কাজেও পরিনত করে চললেন। অদ্ভুত তাঁর সাহস, প্রকাশ্য দিবালোকে এক হাট লোকের মাঝখানে দাঁড়িয়ে তিনি এই সমস্ত দেশদ্রোহী দালালদের উপর কড়া দাওয়াই প্রয়োগ করতেন। তাদের মধ্যে কাউকে কাউকে মৃত্যুদণ্ডও দেয়া হয়ছে।

কিছুদিনের মধ্যে মুক্তিবাহিনীর নাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। সাধারণ মানুষ উৎসাহিত হয়ে উঠল, দালালদের হৃৎকম্প জাগল। ওদিকে সামরিক কতৃপক্ষও চুপ করে বসে ছিল না। মুক্তিবাহিনীকে চূর্ণ করে দেবার জন্য তারা সদলবলে তৈরি হচ্ছিল। প্রধানত এই উদ্দেশ্যে তারা কোটালিপাড়া থানায় তাদের মূল ঘাঁটি স্থাপন করেছিল। সৈন্যরা একা, তাদের সঙ্গে ছিল পুলিশ আর রাজাকার বাহিনী।

এদিকে মুক্তিবাহিনীও তাদের সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত হয়েছিল। এবার তাদের সামনে অগ্নিপরীক্ষা। এতদিন তারা এখানে ওখানে ছোটখাটো আক্রমণ চালিয়েছে, কিন্তু এরা দস্তরমত যুদ্ধ। মুক্তিফ্রন্টের গোয়েন্দা বিভাগের চরেরা সংবাদ নিয়ে এসেছে, যে সৈন্য পুলিশ আর রাজাকার মিলিয়ে বেশ বড় একটা তাদের বিরুদ্ধে আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। একটা সুখবর, ওদের সঙ্গে মেশিনগান নেই। একমাত্র রাইফেলের উপরই তাদের নির্ভর। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর হাতে আছে একটা মেশিনগান আর একটা সাব-মেশিনগান। তাছাড়া রাইফেল তো আছেই। মুক্তিফ্রন্ট সিদ্ধান্ত নিল, আত্মরক্ষামুলক যুদ্ধ নয়, আগ বাড়িয়ে ওদের উপর আক্রমণ চালাতে হবে। ওদের অপ্রস্তুত অবস্থায় হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ে ওদের চমকে দিতে হবে। তারিখটা ছিল ৩রা জুন।

(-হেমায়েতউদ্দিনের সাক্ষাৎকার ৯ম খণ্ড পেজ ৪৭৬ মোতাবেক এটি ৩রা জুন হবে)

গভীর রাত্রিতে মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধারা নৌকাযোগে শত্রুদের মূল ঘাঁটি কোটালিপাড়া থানার দিকে যাত্রা শুরু করল। তাদের ছোট ছোট এক-মাল্লাই নৌকাগুলি রাত্রির অন্ধকারে অতি সন্তর্পনে নিঃশব্দে এগিয়ে চলেছে। কিন্তু ঠিক সেই রাত্রিতেই পাক-সৈন্য বাহিনীও আক্রমনশুলক পরিকল্পনা নিয়ে রাত্রির অন্ধকারে মুক্তিবাহিনীর ঘাঁটির দিকে এগিয়ে আসছিল। এই দুই দল হরিনাহাটি নামক গ্রামের কাছে এসে পরস্পরের সম্মুখীন হলো।

ওদের আটখানা বড় বড় ছিফ নৌকা ছপ্ ছপ্ করতে করতে এগিয়ে আসছে। নৌকাগুলির মধ্যে সৈন্য, পুলিশ আর রাজাকারেরা মিলিতে প্রায় দু’শো জন লোক ছিল। মুক্তিবাহিনীর ছোট ছোট নৌকাগুলি প্রথমে ওদের নজরে পড়েনি। ফলে মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধারা আক্রমণের সুযোগ পেয়ে গেল। এ রকম আকস্মিক আক্রমণের জন্য ওরা একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। কমান্ডার হেমায়েতউদ্দীনের দক্ষ পরিচালনায় মুক্তিবাহিনীর মেশিনগান ও সাব-মেশিনগান দু’টি একত সঙ্গে ছিপগুলিকে লক্ষ্য করে অবিরল ধারায় গুলিবর্ষন করে চলেছে। ওরা একটু বাদেই প্রথম ধাক্কাটা সামলে নিয়ে তার প্রত্যুত্তরে রাইফেল চালাতে লাগল। কিন্তু ওদের মনোবল আগেল ভেঙে গিয়েছিল। তাছাড়া ওদের পুলিশ আর রাজাকারদের মধ্যে শৃঙ্খলা বলতে কোন কিছু ছিল না। তারা সবাই যে যার প্রান বাচাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। অপর দিকে মুক্তিবাহিনীর মেশিনগান আর রাইফেলগুলি ওদের উপর অশ্রান্তভাবে মরণ-আঘাত হেনে চলেছে। এই প্রবল আক্রমণের মুখে ওরা সংখ্যায় বেশী হোলেও বেশিক্ষন লডাই চালিয়ে যেতে পারল না।  ওরা প্রান বাঁচাবার জন্য নৌকা থেকে খালের জলে ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগল। সৈন্য, পুলিশ আর রাজাকার সবাই এই একই পন্থা অনুসরণ করল। এইভাবেই হরিণাহাটি যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটল, মুক্তিবাহিনীর জয়ধ্বনিতে হরিণাহাটির নৈশ আকাশ ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে চলল।

যুদ্ধের ফলাফল দেখে মুক্তিযোদ্ধারা নিজেরাই বিস্মিত হয়ে গিয়েছিল। এত বড় সাফল্যের কথা তারা কল্পনাও করতে পারেনি। পরদিন সকালবেলা নৌকার মধ্যে ও জলের ওপর শত্রুপক্ষের ৫০টি মৃতদেহ পাওয়া গেল। ১৮ জন তাদের হাতে বন্দী হয়েছে। বাকি সবাই প্রান হাতে পালিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে মাত্র একজন মারা গেছে। তার নাম ইব্রাহীম। মুক্তিবাহিনী ওদের নৌকার ভেতর থেকে ৫ টি রাইফেল ও বেশকিছু বুলেট উদ্ধার করল।

এ-সম্বন্ধে কারও মনে কোন সন্দেহ ছিল না যে, শত্রুরা পর পর দু’বার ঘা খেয়েক ক্ষান্ত থাকবেনা, তার আক্রমণ আসন্ন। সেজন্য অবশ্যই প্রস্তুত থাকতে হবে। পরদিন ১৬ই জুন তারিখ মুক্তিবাহিনীর ঘাঁটি খালের পূর্বদিকে কোদালধোয়া গ্রামে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হোল। কিন্তু এই এই সংবাদটা শত্রুদের অগোচর রইল না। খবর পাওয়াটা গেল তারা সেদিনই তাদের বর্তমান ঘাঁটির দিকে লক্ষ্য করে এগিয়ে আসছে। ওদের লঞ্চ সেখান থেকে এক মেইল দূরে পয়সারহাট বাজারে এসে ভিড়েছে। শত্রুদের লঞ্চ এই খালের উপর দিয়ে আসবে। মুক্তিযোদ্ধারা খালের দু’পাশে স্থানে স্থানে পজিশন নিতে তৈরি হয়ে তাদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। এইভাবে ঘন্টা খানেক কেটে গেল, কিন্তু সেই লঞ্চটির আর দেখা নেই। শেষে খবর পাওয়া গেল যে, ওরা পয়সারহাট বাজারে খানাপিনার উৎসবে মেতে গেছে। এই বাজারে যে-সমস্ত খাদ্য-দ্রব্য মেলে ওরা তা জবরদস্তি করে লুটেপুটে নিচ্ছে।

কমান্ডার হেমায়েতউদ্দীন স্থির করলেন, মুক্তিবাহিনীর একটা দল এখানেই মোতায়েন থাকবে। অবশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে তিনি দু’মাইল পথ এগিয়ে যাবেন এবং সেখানে গিয়ে লঞ্চসহ শত্রুদের ঘেরাও করে ফেলবেন। এই পরিকল্পনা নিয়ে তাঁর দল সবেমাত্র কিছুদূর এগিয়ে গিয়েছে, এমন সময় শত্রুসৈন্যবাহী লঞ্চটা তাঁদের কাছাকাছি এসে পৌঁছল। জায়গাটা এমন যে, সেখানে দাঁড়িয়ে পজিশন নেওয়ার খুবই অসুবিধা। কিন্তু উপায়ন্তর না থাকায় সেখানেই তাঁদের পজিশন নিতে হোল। শত্রুরাও তাঁদের দেখতে পেয়েছে এবং দেখার সঙ্গে সঙ্গে গুলি ছুড়তে শুরু করে দিয়েছে। মুক্তিসেনাদের মেশিনগান ও রাইফেলের গুলিও তাঁর প্রত্যুত্তর দিয়ে চলল। তাঁদের প্রবল গুলিবর্ষনের ফলে লঞ্চটা জায়গায় জায়গায় ভেঙ্গেচুরে যাচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত অবস্থা বেগতিক দেখে শত্রুরাও তাঁদের লঞ্চ নিয়ে পৃষ্ঠভঙ্গ দেবার চেষ্টা করছিল। তাতে হানাদারদের মধ্যে ছয়জন সৈন্য নিহত ও অনেক সৈন্য আহত হয়।

সেইদিনই বিকালবেল দু’দল পাক-সৈন্য দু’দিক থেকে সাঁড়াশি আক্রমণের পরিকল্পনা নিয়ে মুক্তফ্রন্টের ঘাঁটি কোদলধোয়া গ্রামটিকে লক্ষ্য করে এগিয়ে আসতে থাকে। একটি দল মাদারীপুর থেকে স্পীডবোট বোঝাই করে আসছিল। তারা অনেক দূর পর্যন্ত চলে এসেছিল বটে, কিন্তু তাদের দালালদের মুখে মুক্তিবাহিনীর মেশিনগানের শক্তির পরিচয় পেয়ে তারা আর বেশীদূর এগুতে ভরসা করল না। শেষ পর্যন্ত তাদের মনের ক্ষোভ মেটাবার জন্য তারা পীড়ারবাড়ি গ্রামে হামলা করে, সেখানকার ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিয়ে স্বস্থানে ফিরে গেল। অপরদিকে গৌরণদী, উজিরপুর, কোটালীপাড়া ও গোপালগঞ্জ থেকে চারটি স্পীডবোট বোঝাইকরে বহু পাক-সৈন্য আর একদিক দিয়ে কোদালধোয়া গ্রামের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। মুক্তিফৌজ সামনে এগিয়ে গিয়ে এই হানাদার শত্রুদের প্রতিরোধ করে দাঁড়াল। দু’পক্ষে প্রবল সংঘর্ষ হয় এবং শেষ পর্যন্ত মুক্তিবাহিনী শত্রুদের পয়সাহাট থেকে আট মাইল দূরে তাড়িয়ে দিয়ে জয়-গৌরবে ফিরে আসে। এই যুদ্ধে নয়জন পাক-সৈন্য মারা যায়।

————————————————-

গৌরনদীর প্রতিরোধ

(”দৈনিক বাংলা”, ২৪ মার্চ, ১৯৭২ সালে প্রকাশিত শহীদ সেরনিয়াবাত রচিত প্রতিবেদনের অংশ)

২৫শে এপ্রিল। মিলিটারী আসছে, গৌরণদীর সর্বত্র রব উঠল। সকাল থেকে চারখানা হেলিকপ্টার বেশ উঁচু দিয়ে বার বার মাদারীপুর থেকে যে রাস্তা গৌরণদীর বুক চিরে বরিশালের দিকে চলে গেছে তার উপর দিয়ে উড়ছে। ওদিকে বরিশাল শহরের চার মাইল উত্তরে জুনাহারে প্রচণ্ড গোলা বিনিময় হচ্ছে মুক্তি বাহিনীর সাথে। কামানের গর্জন, গানবোটের শেলিং আর মর্টারের শব্দে থেকে থেকে খেপে উটছে। অপর দিকে খবর পাওয়া গেল, মাদারীপুর দুদিন পূর্বে পাকবাহিনী দখল করে নিয়েছে এবং আজকেই সড়কপথে দস্যুরা গৌরণদী হয়ে বরিশাল যাবে। কি করা যায় ভাবছে কৃষক-শ্রমিক আর রাজনৈতিক কর্মীরা মুহুর্তের মধ্যে স্থির করে নিল তারা। যে করে হোক হানাদারদের বাধা দিতে হবে। অন্তত বাধা দেওয়ার চেষ্টা করতেই হবে। বীর যোদ্ধারা জানতো, সম্মুখযুদ্ধে কয়েকটা ৩০৩ রাইফেল আর পাঁচ-দশ রাউণ্ড করে গুলি দিয়ে ভারী অস্ত্রের সামনে কিছুই করা যাবে না। তবুও সাধারণ মানুষ যাতে ভেঙ্গে না পড়ে বা ভুল না বোঝে তার জন্য চেষ্টা চালাতে হবে। তাই তারা সকাল থেকে গৌরণদীর উত্তরে কটকস্থল নামক স্থানে পজিশনে রইল। ঘন্টা কেটে যাচ্ছে তবুও শত্রুর সাথে দেখা নেই।

সকাল গড়িয়ে দুপুর। রৌদ্রের প্রখরতায় পিপাসাকাতর হয়ে পড়েছে মুক্তিযদ্ধারা। তাদের গোপন অবস্থান  থেকে (সিএণ্ডবি সড়কের পাশে) কয়েহ গজের মধ্যেই সাধারণ কৃষক জহরউদ্দীন মোল্লার বাড়ী। তাই কয়েকজন  মুক্তিযোদ্ধা পানি খাওয়ার জন্য জহর মোল্লার আঙ্গিনায় বিরাট বটগাছটার ছায়ায় বসলো। ওরা বিশ্রাম নিচ্ছে আর জহরউদ্দীন মল্লা পানি ঢেলে দিচ্ছে। যেখানে বসে মুক্তিকামী ভাইয়েরা বিশ্রাম নিচ্ছিল তার থেকে কয়েক গজ উত্তরে একটা উঁচু পুল রয়েছে। এত উঁচু যে পুলের অপর দিকে কিছুই দেখা যায় না। দুপুর গড়িয়ে বেলা তখন তিনটা। হটাৎ করে শব্দ না করে একটা এসে দাঁড়ালো অদের সামনে। পরপর আর কয়েকটা একেবারে গুনে গুনে চল্লিশটা। বর্বর সেনারা গুলি চালালো। বসা অবস্থায়ই শহীদ হলেন চারজন মুক্তিযোদ্ধা। শহিদ হল জহরউদ্দীন মোল্লা ও তার ছেলে মোবারক মোল্লা। মুক্তিবাহিনীর হাতে সেদিন খতম হল দু ‘জন খানসেনা।

সেদিন ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়া মুক্তিবাহিনী কয়েক দিনের মধ্যেই আবার একত্রিত হল। এই একত্রিত করার পেছনে যাদের অক্লান্ত প্রচেষ্টা ছিল তারা হলেন এস, এম রকিব, অধ্যাপক এনায়েত, সেন্টু ও আরও কয়েকজন। তাদের প্রচেষ্টায় ২৪টা রাইফেল ও তিনশত রাউণ্ড গুলি দিয়ে প্রথম দল গঠন করা হয়। পরে এই দল মিলিত হয় গোপালগঞ্জের হেমায়েতের সঙ্গে।

গৌরণদীর প্রতিরোধ সংগ্রামে আরও যাদের নাম অম্লান তাদের কথা কিছু লিখতেই হবে। এই দলটি সরিকলে ঘাঁটি করেছিল। এই দলটি খসরুর পার্টি নামে পরিচিত ছিল। এরা বয়েসে তরুণ এবং সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক চেতনায় অনুপ্রণিত হয়ে একটি শক্তিশালী দল হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলেছিল। এরা সাধারণত হিট এ্যাণ্ড রান করে অনেক অস্ত্র পাক সৈন্য, পুলিশ ও রাজাকারদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল। বহু দালাল এদের হাতে নিহত হয়েছে। এরা নিজ হাতে অস্ত্র তৈয়ারও করত। আজ সরিকলবাসী আলমের কথা ভোলে নি। নিজের তৈরি বোমার আঘাতেই আলম শহীদ হয়েছেন শামসু মিয়ার বাড়িতে। জনতার প্রতিরোধ শক্তিশালী,দূর্জয়। তার প্রমাণ গৌরনদীর বাকাই। বাকাইর বীর জনতা বল্লম দিয়ে মেরেছিল চার-চারটে তরতাজা পাঞ্জাবী দস্যুকে। কেড়ে নিয়েছিল চারটে চায়না রাইফেল।

সেদিন ছিল ১৪ই মে। একদল খানসেনা বাকাই গ্রামে ঢুকে পড়েছে। যেভাবে হোক তাদের রূখতেই হবে। তাই প্রস্তুত হয়ে গেল গ্রামবাসী হাতে বল্লম ও রামদা। কয়েকজন গ্রামবাসী যেখান দিয়ে খানসেনারা আসবে সেই পথের ধারে একটি গর্তের মধ্যে আত্মগোপন করে রইল। কিছুক্ষণের মধ্যেই খানসেনারা কাছে এসে গেল। মুহুর্তের মধ্যে কয়েকটি বল্লম নির্ভুল লক্ষ্যভেদ করলো। বল্লম একেবারে হানাদার চারটের বক্ষভেদ করে দিল। তারপর টুকরো টুকরো করে চড়িয়ে দিল সে মৃতদেহ চারটি। খানসেনারা ওর পর থেকে আর ঢোকেনি বাকাই গ্রামে।

———————————————–

 

খুলনার প্রতিরোধ যুদ্ধ

খুলনার মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্ব

(সত্যেন সেন রচিত “প্রতিরোধ সংগ্রামে বাংলাদেশ” গ্রন্থ থেকে সংকলিত)

২৫শে মার্চ। পরিস্থিতি গুরুতর, সেটা সবাই বুঝতে পারছে। আবহাওয়া ক্রমেই যেনো ভারী হয়ে আসছে। খুলনার রাজনৈতিক নেতারা অবস্থাটা বুঝবার জন্য ঢাকার সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করছিলেন। কিন্তু রাত্রি আটটার সময় ফোনের যোগাযোগ একেবারেই বন্ধ হয়ে গেলো। তখনই তাদের মনে সন্দেহ জাগলো ঢাকার অবস্থা ভাল নয়। একটা কিছু অঘটন ঘটতে চলেছে।

কর্মীদের চোখে ঘুম নেই। রাত্রি ১২টার সময় একটা ঘোষণার শব্দ শুনে তারা চমকে উঠলো। শুধু তারাই নয়, সারা শহরের ঘুমন্ত মানুষ শয্যা ছেড়ে উঠে বসেছে। সরকারী ঘোষণাকারীরা সারা শহর ঘুরে ঘুরে মাইকযোগে প্রচার করে ফিরছে যে, আগামী কাল ২৬শে মার্চ সকাল পাঁচটা থেকে সারা শহরে ৭২(বাহাত্তর) ঘন্টা পর্যন্ত কারফিউ জারি করা হচ্ছে। এই সময়ের মধ্যে যদি কেউ ঘর ছেড়ে বেরোয় তবে তাকে সঙ্গে সঙ্গে গুলি করা হবে।

অনেকেই অনুমান করলো, ঢাকা শহরে অথবা আর কোথাও অবশ্যই একটা কিছু হয়ে গেছে এবং তার জের সারা প্রদেশময় ছড়িয়ে পড়বে। কিন্তু প্রথম আক্রমণ করেছে কারা। পাকিস্তানী জঙ্গী বাহিনী না মুক্তিকামী জনগণ?

ইতিমধ্যে সবার অগোচরে আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে গেছে। সেটা ঘটেছে কারফিউ জারী করার বেশ কিছু আগেই। এটা একটা আশাতীত সুখবর। আজ রাত্রিতে ইপিআর বাহিনীর জনৈক পাঞ্জাবী অফিসার তার কয়েকটি প্রিয় পাত্রকে এই বলে হুশিয়ারী দিয়েছিলো যে, ইপিআরের লোকদের সামনে এক ভীষণ বিপদ ঘনিয়ে এসেছে। যদি প্রাণে বাঁচতে চাও আর দেড়ি না করে এখনই পালিয়ে যাও। স্থানীয় ইপিআর বাহিনীতে প্রায় তিন শত জন লোক। খবরটা তাদের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়লো। দেখতে দেখতে ইপিআর লাইন খালি হয়ে গেলো। তারা রাতের আঁধারে সেই স্থান ত্যাগ করে সুশৃঙ্খলভাবে দূরবর্তী গ্রামাঞ্চলে আশ্রয় নিলো। অপর দিকে কারফিউ জারি হবার পর অবস্থা সঙ্গীন বুঝতে পেরে শহরের পুলিশরাও তাদের ব্যারাক ছেড়ে পালিয়েছে।

গভীর উত্তেজনার মধ্য দিয়ে রাতটা কেটে গেলো। পরদিন সকালে কি ঘটনা ঘটে তা দেখার জন্য সবাই উদ্বিগ্ন। কারো চোখে ঘুম নেই। স্বাধীনতার সংগ্রাম কি তবে সত্যিই শুরু হয়ে গেছে? বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মীরা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন। কে কোথায় আছে তাও ভালভাবে জানে না, অথচ অবিলম্বে উদ্যোগ নিয়ে কিছু একটা করতে হবে। সাধারণ মানুষ তো তাদের মুখের দিকেই তাকিয়ে আছে। কারফিউ শুরু হবে কাল সকাল পাঁচটায়। অথচ মিলিটারীর লোকেরা ইতিমধ্যে সারা শহরের পথে পথে টহল দিয়ে ফিরছে। ওরা নিশ্চয়ই সব কিছু চোখে চোখে রাখছে। এখন বাইরে চলাচল করতে হলে সতর্কভাবে ওদের দৃষ্টি এড়িয়ে চলতে হবে।

বেশ কিছু খোঁজাখুঁজির পর তিনজন এক জায়গায় মিলিত হলেন। একজন আওয়ামী লীগের, আরেকজন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির ও একজন ছাত্রলীগের নেতা। ইতিমধ্যে একটা খবর তাদের কাছে এসে পৌঁছেছে যে, ইপিআর বাহিনীর সমস্ত লোক ইতিপূর্বে তাদের জায়গা ছেড়ে দৌলতপুরের দিকে পালিয়েছে। সংবাদটা সুসংবাদ। তারা তিনজন বসে ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা সম্পর্কে একটা পরিকল্পনা গ্রহণ করলেন। নিজ নিজ দলের মতামত নেওয়ার মত সময় ছিলো না। এখন এমন একটা সময় যখন ভুল হোক শুদ্ধ হোক যা করার নিজেদের দায়িত্বেই করতে হবে। এই পরিকল্পনা নিয়ে এই তিন জন অতি সঙ্গোপনে শহর ছেড়ে দৌলতপুরের দিকে চলে গেলেন।

ইপিআর বাহিনীর পলাতক লোকেরা দৌলতপুর থেকে চার মাইল দূরে রংপুর, শাহপুর, লতা প্রভৃতি গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলো। গ্রামবাসীদের ঘরের দরজা তাদের জন্য অবারিত ছিলো। তারা নিতান্ত আপনজনের মতো তাদের নিজেদের ঘরে আশ্রয় দিয়েছে। এতে যে বিপদের আশংকা আছে এ কথাটা তাদের জানা ছিলো না? ছিলো বৈকি। কিন্তু স্বাধীনতা সংগ্রাম করতে হলে দুঃখ আর বিপদ আর মৃত্যুর সম্মুখীন হতেই হবে। এই পলাতকের দল প্রাণ বাঁচানোর জন্য পালিয়ে এসেছিলো একথা সত্য, কিন্তু সেটাই তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। তার চেয়েও বড় কথা, তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য পশ্চিমা শাসকদের জঙ্গী বাহিনীর বিরূদ্ধে লড়াই করবে। যদি প্রাণ দিতে হয় প্রাণ দিবে। সারা বাংলাদেশের মানুষ যে অনেক আশা করে তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তাই পালিয়ে আসার সময় তারা যত বেশী সম্ভব রাইফেল, কার্তুজ আর গোটা কয়েক লাইট মেশিনগান সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে।

যে তিনজন স্থানীয় নেতা এদের সন্ধানে শহর থেকে চলে এসেছিলেন তারা এদের সঙ্গে গিয়ে দেখা করলেন। পরামর্শ করলেন এবং সিদ্ধান্ত নিলেন যে, এই বাহিনী অবিলম্বে দ্রুত মার্চ করে খুলনা শহর দখল করে নিবে।

ইপিআর আর পুলিশ মিলে এই বাহিনীতে শ’তিনেক লোক ছিলো। তাছাড়া তাদের সঙ্গে কিছু সংখ্যক সাধারণ লোকও ছিলো। যে তিনজন রাজনৈতিক নেতার কথা আগে বলেছি, তারা প্রথম থেকেই এদের সঙ্গে ছিলেন এবং এই বাহিনীকে সংগঠিত করা আর এই আক্রমণের পরিকল্পনা গ্রহণ করার পিছনে তাদের সক্রিয় ভুমিকা ছিলো। রংপুর, শাহপুর ও লতা এই তিনটি গ্রামের মাঝখানে আড়ংঘাটা ময়দান। এরা সুশৃঙ্খলভাবে সেই ময়দানে জমায়েত হলো। তারপর শহর দখলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলো। বেশ কিছুদূর এগিয়ে আসার পর তেলিগাতি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সামনে শত্রুপক্ষের সঙ্গে প্রথম মোকাবেলা করলো।

কলেজের কাছে পঁচিশ ত্রিশ জন পাক সেনা পাহারা দিচ্ছিলো। সে কথাটা এদের অজানা ছিলো না। তারা তাদের দৃষ্টি এড়িয়ে অতিসন্তপর্ণে এগিয়ে আসতে আসতে হঠাৎ তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। এভাবে আচমকা আক্রান্ত হয়ে পাক সৈন্যদের সেই ছোট দলটি কিছুটা দিশেহারা হয়ে পড়েছিলো। কিছুক্ষণের গুলিবর্ষণের পর তারা কুড়িটা মৃতদেহ ফেলে রেখে পালিয়ে গেলো। সেই সংঘর্ষে এই পক্ষের মাত্র দুইজন পুলিশ মারা গিয়েছিলো।

এরা পালিয়ে যাওয়ার ফলে একটা ট্রাক ও গোটা কয়েক জীপ মুক্তিবাহিনীর দখলে এসে গেলো। প্রায় পঞ্চাশ জন মুক্তিযোদ্ধা এই গাড়িগুলোতে চেপে পলাতক শত্রুর পিছনে ধাওয়া করে এগিয়ে চললো। মুক্তিবাহিনীর বাকী যোদ্ধারা যানবাহনের অভাবে পায়ে হেটে আসছিলো। তারা কিছুটা পিছনে পড়ে গেলো।

মুক্তিবাহিনীকে বাঁধা দেওয়ার জন্য প্রায় আড়াই শত পাক সৈন্য দৌলতপুরের বৈকালী সিনেমার কাছে অপেক্ষা করছিলো। মুক্তিবাহিনীকে এগিয়ে আসতে দেখে তারা পাবলিক লাইব্রেরী ও গার্লস কলেজে ঘাঁটি করে বসলো। এবার দুপক্ষের মধ্যে দ্বিতীয়বারের মতো সংঘর্ষ ঘটল। নিউজপ্রিন্ট পেপার মিলের সামনে কিছু সংখ্যক ইপিআর-এর লোক মোতায়েন করা ছিলো। তারা এসে মুক্তিবাহিনীর সাথে যোগ দিলো। শুধু তারাই নয়, নিউজপ্রিন্ট পেপার মিলের একদল শ্রমিকও তাদের সঙ্গে এসে শামিল হলো। এবার মুক্তিবাহিনী এক নতুন কৌশল গ্রহণ করলো। দুপক্ষে যখন যুদ্ধ চলছে তখন মুক্তিবাহিনী পিছন দিককার অংশটা প্রতিপক্ষের দৃষ্টির আড়ালে বিল অঞ্চল দিয়ে ওদের পিছন দিক দিয়ে হানা দিলো। হঠাৎ এভাবে দুদিক থেকে আক্রান্ত হয়ে পাক সৈন্যরা আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে তাদের ঘাঁটি ছেড়ে দ্রুত পশ্চাদপসরণ করলো। এই সংঘর্ষের ফলে তাদের বেশ কিছু লোক মারা গিয়েছিলো। মুক্তিবাহিনী উল্লাস ভরে জয়ধ্বনি দিতে দিতে গার্লস কলেজ ও পাবলিক লাইব্রেরী দখল করে নিলো।

কিন্তু এই তো সবে সূচনা। আসোল যুদ্ধের তখনো অনেক বাকী।

একদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের আক্রমণকারী জঙ্গী বাহিনী, অপরদিকে বাংলাদেশের মুক্তিকামী জনগণ। এ নহে কাহিনী, এ নহে স্বপন। বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতার জন্য মারতেও জানে, মরতেও জানে। খুলনা শহরের রাজপথে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে তারা এই সত্যটিকে প্রমাণ করেছিলো। এই যুদ্ধ একটানা ছত্রিশ ঘন্টা পর্যন্ত চলেছিলো।

মুক্তিবাহিনীর এই প্রবল একটানা আক্রমণের সামনে প্রতিপক্ষ শেষ পর্যন্ত দাড়াতে পারতো না। যথেষ্ট সৈন্য থাকলেও এবং উন্নততর আধুনিক অস্ত্রেশস্ত্রে সুসজ্জিত হলেও নৈতিক দিক থেকে এরা ছিলো দুর্বল। কিন্তু বাইরে থেকে আরেকদল সৈন্য এদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার ফলে ওদের শক্তি আশাতীতভাবে বেড়ে গেলো। খুলনার রক্ষাব্যবস্থাকে দৃঢ় করে তোলবার জন্য ২৪ মার্চ যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে যানবাহন ও আধুনিক সমরোপকরণে সজ্জিত এক বিরাট সৈন্যবাহিনী রওয়ানা হয়েছিলো। কিন্তু তারা বিনা বাঁধায় আসতে পারেনি। পথের মাঝখানে দেশপ্রেমিক জনতা তাদের রুখে দিয়েছিলো। তারা প্রথম বাঁধা পায় যশোর জেলার অন্তর্গত নওয়াপাড়া গ্রামে।

এখানে ইপিআর-এর কোনো সশস্ত্র লোক ছিলো না। তবুও দুঃসাহসী পুলিশ, ছাত্র ও সাধারণ মানুষ তাদের প্রতিরোধ করতে এগিয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু তাদের এই দুর্বল ও ভঙ্গুর বাঁধাকে চূর্ণবিচূর্ণ করে হামলাকারীর দল তাদের লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চললো। ওরা দ্বিতীয়বার বাঁধা পেলো খুলনা জেলার ফুলতলা অঞ্চলে। মুক্তিবাহিনী ওদের অগ্রগতিকে প্রতিরোধ করবার জন্য তাদের বাহিনীর একটি অংশকে পাঠিয়েছিলো। ফুলতলা অঞ্চলে দুপক্ষের সংঘর্ষ ঘটলো। সেখানে ১২ ঘন্টা যুদ্ধ চলেছিলো। এদের এই প্রবল আক্রমণের ফলে যশোর থেকে আগত পাক সৈন্যবাহিনী যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি ভোগ করার পর মধ্যপথে বিচ্ছিন্ন হয়ে দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেলো।

একটা অংশ তাদের হতাহত সৈন্যদের সঙ্গে নিয়ে যশোরের দিকে ফিরে চলে গেলো। কিন্তু বৃহত্তর অংশটি খুলনা শহরে রণক্ষেত্রের দিকে এগিয়ে চললো। এদের সঙ্গে ছিলো পঁয়ত্রিশটি গাড়ি বোঝাই সৈন্য আর ষোলটি কামান সজ্জিত জীপ। ফুলতলা থেকে খুলনা শহর ষোল মাইল দূরে। পথের মাঝখানে সংগ্রামী জনতা বহু বাঁধা ও ব্যারিকেডের সৃষ্টি করে তুলেছিলো। যার ফলে এই ষোল মাইল পথ অতিক্রম করতে এদের আঠারো ঘন্টা সময় লেগেছিলো।

যশোরের সৈন্যদল এসে পৌঁছাবার পর পাক সৈন্যবাহিনীর শক্তি বহু পরিমাণে বেড়ে গেলো। শুধু সৈন্য সংখ্যার দিক দিয়েই নয়, এরা ষোলটা মর্টার নিয়ে এসেছে। অপরদিকে খুলনা শহরের শ্রমিক ভাইয়েরা দলে দলে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়ে চলেছে। এরা মৃত্যুভয় ভুলে গিয়ে উন্মত্তের মতো যুদ্ধের আগুনে ঝাঁপ দিয়ে পড়ছে।

যখন দুপক্ষে প্রবল হানাহানি চলছে, তখন হঠাৎ দেখা গেলো পাক সৈন্যবাহিনী একটু পিছনে চলে গিয়ে শ্বেতপতাকা ধরেছে। তার মানে এরা আত্মসমর্পণ করতে চাইছে। থেমে গেলো যুদ্ধ। মুক্তিবাহিনীর লোকেরা জয়োল্লাসে মেতে উঠলো। তারা নিশ্চিন্ত মনে পাক সৈন্যদের বন্দী করবার জন্য এগিয়ে গেলো। কিন্তু এটা যে ওদের ছলনা মাত্র তা একটু বাদেই বুঝতে পারা গেলো। মুক্তিবাহিনী অপ্রস্তুত অবস্থায় কাছে এগিয়ে আসতেই জঙ্গবাহিনীর মেশিনগানগুলি তাদের লক্ষ্য করে একসঙ্গে গর্জে উঠলো। ফলে মুক্তিবাহিনীর বহু লোক হতাহত হলো। ওদের মর্টারগুলি একসঙ্গে অনর্গল অগ্নিগোলক উদগীরণ করে চলেছে। এর প্রত্যুত্তর দেবার মতো উপযুক্ত অস্ত্র মুক্তিবাহিনীর হাতে ছিলো না। সেই অগ্নিবর্ষণের ফলে তারা পতঙ্গের মতো পুড়ে ছাই হতে লাগলো। এরপর তাদের যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার আর উপায় রইলো না। তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যে যেদিকে পারলো পালিয়ে গেলো। একটানা ছত্রিশ ঘন্টা যুদ্ধ চলার পর খুলনা শহরের মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্বের পরিসমাপ্তি ঘটলো। এই যুদ্ধে বহু পাক সৈন্য হতাহত হয়। তাদের মধ্যে একজন মেজর মারা যায় এবং খুলনা সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার কর্ণেল শামস গুরুতরভাবে আহত হয়।

খুলনার মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় পর্ব

খুলনা শহরের মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্ব শেষ হয়ে গেলেও ছাত্ররা প্রতিরোধ সংগ্রাম থেকে নিবৃত্ত হয়নি। ২৬শে মার্চ থেকে শুরু করে ২রা এপ্রিল পর্যন্ত তারা গোপনে নানা জায়গায় পজিশন নিয়ে পাক সৈন্যদের উপর ইতস্তত চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে যাচ্ছিলো। এভাবে তারা বেশ কয়েকজন সৈন্যকে হত্যা ও জখম করতে সক্ষম হয়েছিলো। কিন্তু একথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, এই গুপ্ত আক্রমণ চালাবার কালে কোনো ছাত্র মারা যায়নি বা শত্রুর হাতে ধরা পড়েনি।

২৮শে মার্চের যুদ্ধের পর মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধারা ছত্রভঙ্গ হয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিলো। কিন্তু তাই বলে তারা হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দেননি। শত্রুর বিরুদ্ধে আক্রমণ করার জন্য তারা বাগেরহাটে গিয়ে মিলিত হলো। বাগেরহাটে প্রাক্তন সামরিক অফিসার মেজর জলিল ইপিআর ও পুলিশের লোকদের নিয়ে এক মুক্তিবাহিনী গড়ে তুলেছিলেন। খুলনা থেকে যারা বাগেরহাটে গিয়েছিলো তারা মেজর জলিলের বাহিনীর সঙ্গে যোগ দিলো। ফেলে এদের সংখ্যা দাড়ালো সাতশত। মেজর জলিল কোন দিক দিয়ে আক্রমণ করা যায় সেই পরিকল্পনা রচনা করে চলেছেন।

খুলনা শহর শত্রুপক্ষের অধিকারে থাকলেও সেখানকার কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী শত্রুদের দৃষ্টির আড়ালে গোপনে কাজ করে চলছিলেন। সেই অবস্থাতেই তাদের প্রাণপ্রিয় শহরটিকে শত্রুদের হাত থেকে মুক্ত করতে পারবেন, এই আশা বা পরিকল্পনা তাদের ছিলো না। তবুও শত্রুপক্ষকে অতিষ্ঠ করে তোলবার জন্য এবং প্রচারকাজে সুযোগ লাভের জন্য আরো একটা ঘা মারবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এটিকে খুলনা শহরের মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় পর্ব বলা চলে। শত্রু অধিকৃত শহরের বুকের উপর দাড়িয়ে যে নতুন আক্রমণ চালানো হয়েছিলো তা থেকে তাদের দুঃসাহস ও রণকৌশলের পরিচয় পাওয়া যায়।

জনৈক সুপরিচিত স্থানীয় নেতা এই পরিকল্পনাটি রচনা করেন এবং তাকে বাস্তবে রূপান্তরিত করেন। তিনি খুলনা শহর থেকে চলে গেলেন বাগেরহাটে। তারপর সেখানে মেজর জলিলের সঙ্গে তার এই নতুন পরিকল্পনা নিয়ে পরামর্শ করলেন। মেজর জলিল তার এই পরিকল্পনাকে অনুমোদন ও সমর্থন করার পর তার বাহিনী থেকে ১১০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে সঙ্গে করে নিয়ে এলেন।

এই মুক্তিযোদ্ধারা রাত্রির অন্ধকারে অতি সঙ্গোপনে খুলনা শহরে এসে প্রবেশ করলেন। পাক সৈন্যবাহিনীর কর্তারা এমন যে ঘটতে পারে সে কথা কল্পনাও করতে পারেনি। মুক্তিযোদ্ধারা জীবনের মায়া ছেড়ে দিয়েই এই দুঃসাহসিক কাজে পা বাড়িয়েছিলো। গভীর রাত্রিতে তারা শহরের বেতার ঘাঁটি আক্রমণ করলো। তারা স্থায়ীভাবে বেতার ঘাঁটি নিজেদের দখলে রাখতে পারবে এই দুরাশা তাদের ছিলো না। তাদের উদ্দেশ্য ছিলো একটি দিনের জন্য হলেও তারা এটাকে নিজেদের দখলে রাখবে এবং এর মধ্য দিয়ে সারা বাংলাদেশের মানুষের কাছে স্বাধীন বাংলার বাণী ছড়িয়ে দিবে।

সে সময় আঠারো জন পাক সৈন্য বেতার ঘাঁটি পাহারা দিচ্ছিলো। মুক্তিযোদ্ধারা আচমকা আক্রমণ চালিয়ে তাদের আঠারো জনকেই খতম করলো। পাহারাদার পাক সৈন্যরা তাদের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে নিজেরাই গুলি চালিয়ে বেতার ঘাঁটির ট্রান্সমিটারগুলিকে নষ্ট করে দিয়েছিলো। ফলে বেতার ঘাঁটি মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে এলো বটে, কিন্তু এটা তাদের কাজে লাগাতে পারলো না। বেতার ঘাঁটি দখল করার ফলে তাদের হাতে একটা মেশিনগান, ছয়টা গ্রেনেড এবং আরো কিছু অস্ত্রশস্ত্র এসে গিয়েছিলো।

রাতটা কেটে গেলো। ১১০ জন মুক্তিযোদ্ধা শত্রুপক্ষকে মোকাবিলা করার জন্য শহরের এক প্রান্তে প্রতিরোধ ঘাঁটি তৈরী করে অপেক্ষা করছিলো। এই শক্তিশালী শত্রুদের পরাজিত করতে বা হটিয়ে দিতে পারবে না একথা তারা ভালোভাবেই জানতো। কিন্তু যাবার আগে তাদের একটু শিক্ষা দিয়ে যেতে হবে।

সকাল হতে না হতেই পাক সৈন্যবাহিনী তাদের আক্রমণ করবার জন্য দ্রুত এগিয়ে এলো। প্রথমে তিন লরী বোঝাই সৈন্য, তারপর কতগুলি খালি গাড়ী এবং অবশিষ্ট সৈন্যরা মার্চ করে আসছে। ওরা নাগালের মধ্যে আসতেই মুক্তিযোদ্ধারা তিনটি লরীকে লক্ষ্য করে ছ’টি গ্রেনেড ছুঁড়লো। এই গ্রেনেডগুলিকে তারা বেতার ঘাঁটিতে পেয়েছিলো। অত্যন্ত শক্তিশালী গ্রেনেড। গ্রেনেড ছোড়ার ফলে তিনটি লরী বোঝাই সৈন্য লণ্ডভণ্ড হয়ে গেলো।

এই মারাত্মক দুর্ঘটনার ফলে তাদের পিছনে যে সৈন্যরা আসছিলো তারা থমকে দাড়িয়ে পড়লো। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে অবস্থাটা পর্যবেক্ষণ করার পর ওরা বুঝতে পারলো মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে আর গ্রেনেড নেই। এবার নিশ্চিন্ত মনে এগোনো যেতে পারে। মুক্তিযোদ্ধাদের তুলনায় এদের সৈন্য সংখ্যা অনেক বেশী। তাদের হাতে মাত্র একটি মেশিনগান। বাকী সবই রাইফেল। এই অবস্থায় দু’পক্ষে বেশীক্ষণ লড়াই চলতে পারে না। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের আশাতীত সাফল্যের পরে খুবই খুশি হয়েছিলো। এবার তারা আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যে দ্রুত সরে পড়ার চেষ্টা করলো। পাক সৈন্যরা তাদের এই উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে তাদের খতম করে দেবার জন্য দ্বিগুণ বেগে ধাবিত হলো। তাদের একটা অংশ মুক্তিযোদ্ধাদের পাশ কাটিয়ে তাদের ঘেরাও করে ফেলবার চেষ্টা করছিলো। মুক্তিবাহিনীর নেতা বুঝতে পারলেন তারা এক ভীষণ সংকটজনক অবস্থায় এসে পড়েছেন। শত্রুপক্ষের সঙ্গে গাড়ী আছে। আর তাদের ছুটতে হবে পায়ের উপর নির্ভর করে। এই অবস্থায় এদের হাত থেকে রেহাই পাওয়া সহজ কথা নয়। যদি বাঁচতে হয় তবে নতুন কৌশল অবলম্বল করতে হবে। কিছু সংখ্যক লোকের মায়া ছেড়ে দিয়ে সবাইকে বাঁচতে হবে।

দু’পক্ষের মাঝখানে তখনো কিছুটা ব্যবধান ছিলো। নেতা নির্দেশ দিলেন, কয়েকজনকে প্রাণের মায়া ছেড়ে দিয়ে ওদের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে। বাকী সবাই যতক্ষণ নিরাপদে পালিয়ে যেতে না পারে ততক্ষণ এরা যতই বিপদ ঘটুক না কেনো পিছনে হটবে না। সামনে দাড়িয়ে প্রতিরোধ চালিয়ে যেতে হবে। এর নাম সুইসাইড স্কোয়াড। এভাবে আত্মবলি দিতে প্রস্তুত আছে কারা? নেতা আহবান জানালেন। একটু সময় সবাই চুপ করে রইলো। তারপর সামনে এগিয়ে এলো ছয়জন। নিজেদের জীবনের মায়া তুচ্ছ করে আর সকলকে আত্মরক্ষার সুযোগ করে দেবে।

এই রণকৌশল সার্থক হলো। সেদিনকার সেই ছয়জন মুক্তিযোদ্ধা শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করতে করতে শত্রুদের হাতে ধরা পড়লো। বাকী সবাই নিরাপদে পশ্চাদপসরণ করে চলে এলো। এভাবেই খুলনার মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় পর্বের পরিসমাপ্তি ঘটলো।

মংলা পোর্টের বাহাদুর শ্রমিক ভাইয়েরা

খুলনা জেলার মঙ্গলা পোর্ট। চালনার মতো এই বন্দরেএ দেশ বিদেশের জাহাজ যাতায়াত করে। রফতানির মাল জাহাজে ওঠে আর আমদানির মাল জাহাজ থেকে নামে। কিন্তু অন্যান্য বন্দরের মতো এখানে জাহার ভিড়াবার মতো কোনো ডক ইয়ার্ডের ব্যবস্থা নাই। জাহাজগুলিকে মুরিং বয়ার সঙ্গে বেঁধে দিয়ে মালপত্রের ওঠানামা চলে।

মঙ্গলা পোর্ট খুলনা শহর থেকে বহু দূরে। জলপথ ছাড়া সেখানকার সঙ্গে যাতায়াতের কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে মঙ্গলা পোর্ট যেন সবকিছু থেকে একপ্রান্তে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে আছে। সারা প্রদেশজুড়ে স্বাধীন বাংলার আন্দোলন চলছে। কিন্তু এখানে তেমন কোনো আন্দোলন নেই। তারপরেও এই বাংলাদেশের যেখানেই যতদূরেই থাকুক না কেনো, আন্দোলন প্রতিটি বাঙালির মনে সাড়া জাগিয়ে তুলেছে। মঙ্গলার অধিবাসীরাও এই বিষয়ে একেবারে উদাসীন হয়ে থাকতে পারে না। আমি এখানে বিশেষ করে নীচের তলার সাধারণ মানুষের কথাই বলছি। মঙ্গলা বন্দরের শ্রমিক ভাইয়েরা এই বিষয় নিয়ে চিন্তা না করে পারলো না। এই নিয়ে তারা পরস্পরের মধ্যে নানারকম জল্পনা কল্পনা করে কিন্তু এ সম্পর্কে তাদের কী করণীয় থাকতে পারে তা তারা ভেবে পায় না।

ক’দিন হয় একটা ফ্ল্যাট এখানে এসে পাড়ে ভিড়েছে। সবাই লক্ষ্য করেছে, এই ফ্ল্যাটের মধ্যে দশ বারো জন পাঞ্জাবী সৈন্য আছে। এক এক করে ক’টা দিন কেটে গেলো, কিন্তু ফ্ল্যাট যেমন ছিলো তেমনই আছে।

এমন তো কখনো হয় না! এই সৈন্যগুলি এখানে বসে বসে করছে কী! ওদের নিশ্চয়ই খারাপ মতলব আছে। ………….

শ্রমিক ভাইয়েরা অতি সতর্কভাবে ওদের হালচাল গতিবিধি লক্ষ্য করছিলো। তারা দেখছে ফ্ল্যাটের সেই সমস্ত সৈন্যরা বড়ই হুশিয়ার। ওরা পালা করে সারা রাত জেগে পাহারা দেয়। ওটা কি শুধুই আত্মরক্ষার জন্যই। না এর পিছনে আরো কিছু আছে? শুল্ক অফিসে অনুসন্ধান নিয়ে একটা গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ পাওয়া গেলো। এই ফ্ল্যাটে নাকি অনেক গোলাগুলি মজুদ করা আছে। এই সৈন্যরা তারই জিম্মাদার।

খবরটা পেয়ে শ্রমিকরা অধির হয়ে উঠলো। এমন চমৎকার মওকা খুব কমই পাওয়া যাবে। এই সময়ে আক্রমণ করতে পারলে অতি সহজেই ওদের সব কয়টাকেই খতম করে দেওয়া যাবে আর তারই সাথে সাথে প্রচুর পরিমাণে গোলাগুলি উদ্ধার করা যাবে। এইভাবে এক বাণে দুই পাখি মারার এমন সুযোগ কিছুতেই ছেড়ে দেওয়া উচিত নয়। কিন্তু কেমন করে এই কাজ হাসিল করা যাবে?

অনেক চিন্তা ভাবনার পর অবশেষে একটা পথ পাওয়া গেলো।

এখানে বসে কিছু করা যাবে না। মুক্তিবাহিনীকে খবর দিতে হবে। তারা অবশ্যই এর উপযুক্ত ব্যবস্থা করতে পারবেই। কিন্তু কোথায় আছে মুক্তিবাহিনী, তারা কেমন করে মুক্তিবাহিনীর সন্ধান পাবে? একজন বললো, সে শুনেছে বাগেরহাট শহর এখনো মুক্তিবাহিনীর দখলে আছে। খবরটা সত্য কিনা তা জোর করে বলা যায় না। তাহলে একবার সেখানে গিয়ে চেষ্টা করে দেখা দরকার। তার এই প্রস্তাবটা সবাই একবাক্যে সমর্থন করলো।

বাগেরহাট শহর এখান থেকে বত্রিশ মাইল দূরে। বর্তমানে নৌকা ছাড়া সেখানে যাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। যদি যেতে হয় এক্ষুণি যেতে হবে। একটু দেড়ি করলেও চলবে না। অবস্থা অত্যন্ত দ্রুত বদলে যাচ্ছে। পরে এমন সুযোগ নাও মিলতে পারে। যেমন প্রস্তাব তেমন কাজ। সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন শ্রমিক নৌকা পথে বাগেরহাট রওয়ানা হয়ে গেলো।

খবরটা মিথ্যা নয়। মুক্তিবাহিনী এখনো বাগেরহাট শহর অধিকার করে বসে আছে। বরিশালের প্রাক্তন সামরিক অফিসার মেজর জলিল এই মুক্তিবাহিনী গড়ে তুলেছিলেন। এবং তিনিই ছিলেন তাদের পরিচালক।

তারা যে উদ্দেশ্যে সেখানে এসেছিলো তা সিদ্ধ হলো। মেজর জলিল তার প্রস্তাবে রাজী হয়েছেন।

তার দু’দিন বাদে মঙ্গলবার ঘুমন্ত অধিবাসীরা গভীর রাত্রিতে চমকে উঠে শয্যা ছেড়ে উঠে বসলো। মেশিনগান আর রাইফেলের শব্দ রাত্রির নিস্তব্ধতাকে ভেঙ্গে খান খান করে দিয়ে চলেছে। ভয়ে কেঁপে উঠলো তাদের মন। তবে কি বর্বর পাক সৈন্যরা বাঙালির উপর হামলা করেছে? উদ্বেগ উৎকন্ঠায় সবাই ঘর ছেড়ে ছুটে এলো বাইরে। পরে খবর শুনে অসশ্বস্ত হলো। না, পাক সৈন্যরা নয়, তাদের অতি প্রিয় মুক্তিবাহিনী সেই ফ্ল্যাটের সৈন্যদের উপর আক্রমণ করেছে।

সব ক’টা সৈন্যকে ওরা নিঃশেষ করে দিয়েছে। আরও জানা গেলো, ফ্ল্যাটের ভিতর থেকে অনেক অস্ত্র ও গোলা-গুলি উদ্ধার করা গেছে।

——————————————————

খুলনা জেলার সশস্ত্র প্রতিরোধ
সাক্ষাৎকারঃ মোমিন উদ্দিন আহম্মেদ, প্রাক্তন এমপি
০৮-০৬-১৯৭৬

(বাংলা একাডেমীর দলিলপত্র থেকে সংকলিত)

১৯৭১ সালের ২৭শে মার্চ তারিখে বয়রা গ্রামে তৎকালীন মুক্তিযোদ্ধা ইপিআর’রা ৩০৩ রাইফেল ও শটগান নিয়ে পাক ফৌজের বিরুদ্ধে এক সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এই যুদ্ধ হয় যশোর রোডে। যুদ্ধে ২টি ট্রাক ধ্বংস হয় আর পাক সৈন্যরা পালিয়ে যেতে সমর্থ হয়।

এর পরের সংঘর্ষ হয় দৌলতপুরের মিনাক্ষী সিনেমা হলের সম্মুখে ২০শে মার্চ তারিখে। রাস্তার দু’পাশ থেকে মুক্তিযোদ্ধারা পাক ফৌজের উপর আক্রমণ চালায়। পাক সেনারা তখন ট্রাকে করে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলো। আক্রান্ত পাক সেনারা রিকয়েললেস গান দিয়ে রশীদ বিল্ডিং ধ্বংস করে। সে সময় ঐ ভবনে ৩ জন লোক নিহত হয়।

এপ্রিল মাসে ৭ তারিখে পাকসেনারা ট্রাকে করে যশোর থেকে খুলনা অভিমুখে অগ্রসর হয়। খুলনার রেডিও ষ্টেশন তখন পাক সৈন্যদের দখলে ছিলো। মুক্তিযোদ্ধারা রেডিও ষ্টেশনের উপর আক্রমণ চালায়। পাক সেনারা রেডিও ষ্টেশনের ভিতর থেকে আক্রমণ প্রতিহত করার চেষ্টা করে। এভাবে এক রাত যুদ্ধ চলে। যুদ্ধে কিছু মুক্তিযোদ্ধা মারা যায়। যশোর থেকে ট্রাকে করে আগত পাকসেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের উপর আক্রমণ চালালে মুক্তিরা আস্তে আস্তে বিলের দিকে পিছু হটে। যুদ্ধে পাক ফৌজের বেশ কিছু সৈন্য নিহত হয়। খুলনা রেডিও ষ্টেশনকে রক্ষার জন্য যশোর থেকে তিন দফা সৈন্য আসে। ৭ তারিখের পর পাক সেনারা দৌলতপুরের রঘুনাথপুর গ্রামে হামলা করে। সেখানে তারা বহু লোককে হত্যা করে।

খুলনা জেলার তেরখাদা থানায় মুক্তিবাহিনীর একটি ক্যাম্প ছিলো। সেখানে প্রায় দুই হাজারের মতো মুক্তিসেনা ছিলো। তারা তেরখাদা থানাকে সব সময়ের জন্য মুক্ত রাখতে সমর্থ হয়েছিলো। ফহমউদ্দিন নামে একজন তহশিলদারের নেতৃত্বে ঐ ক্যাম্পটি পরিচালিত হয়। আব্দুল হামিদ মোল্লা নামে এক ব্যক্তি পাকসেনাদের বিরুদ্ধে বীরত্বের সাথে লড়াই করে। পরে দুষ্কৃতিকারী দ্বারা নিহত হয়।

—————————————–

ফরিদপুরের প্রতিরোধ
(সাপ্তাহিক ‘চিত্রবাংলা’ ৩ জুন ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত শরীফ আফজাল হোসেন রচিত প্রতিবেদন থেকে সংকলিত)

আকস্মিকভাবে ২৫শে মার্চ গভীর রাতে রাজধানীতে পাক হানাদার বাহিনীর হামলার খবর, রাজারবাগ পুলিশ ক্যাম্পের সদস্যদের প্রতিরোধ ও আত্মত্যাগের কথা এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘোষণা ২৬শে মার্চ সকাল বেলাতেই পেয়ে গেলাম। এ খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ফরিদপুরের পুলিশ ব্যারাক এবং বিভিন্ন থানা থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করে ফরিদপুরের প্রাথমিক প্রবেশদ্বার গোয়ালন্দ ঘাটে ছাত্র জনতা, পুলিশ ও আনসার সমন্বয়ে প্রতিরক্ষাব্যূহ গড়ে উঠলো এবং ঢাকা ফেরত কিছু ইপিআর এসে এতে যোগদান করলেন। সর্বস্তরের জনগণের সমর্থনে আমরা উৎসাহিত বোধ করলাম। আধুনিক অস্ত্রসজ্জিত পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে গোয়ালন্দ ঘাটে ছাত্রজনতার এই প্রতিরোধ শুধুমাত্র রাইফেল, বন্দুক এবং মনোবলকে সম্বল করে একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করা হয়। আশ্চর্য হলেও সত্য এবং আজো ভাবতে অবাক লাগে যে, সুসজ্জিত পাক বাহিনীর সামনে আমাদের অবস্থান ছিলো বাঘের সামনে অবোধ বালকের নুড়ি হাতে খেলা করার মতো। এসকল আয়োজনের ভিত্তি ছিলো স্বতঃস্ফূর্ত জনতার দেশপ্রেম ও মুক্তির আকাঙ্খা। ফরিদপুরের প্রত্যন্ত এলাকায় এভাবে জনতার প্রতিরোধের সাড়া পড়ে গেলো। তখন প্রয়োজন দেখা দিলো সুসমন্বয় ও প্রশাসনিক নির্দেশ প্রদানের। খুব সম্ভবত ২৯শে মার্চ তদানীন্তন নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্য কেএম ওবায়দুর রহমানকে আহবায়ক করে এ্যাডভোকেট আদেলউদ্দিন, ইমামউদ্দিন আহমেদ, শামছুদ্দিন মোল্লা, সৈয়দ হায়দার হোসেন, মোশারফ হোসেন, নূরুন্নবী, কাজী খলিলুর রহমান, মুজিবুর রহমান খান, গৌরচন্দ্র বালা, ফিরোজা রহমান, আমিনউদ্দিন, মোখলেসুর রহমান প্রমুখ স্থানীয় জননেতা ও কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নাসিরুদ্দিন মুসা, শাহ আবু জাফর, কবিরুল আলম, সালাউদ্দিন আহমদ, আবু সাঈদ, আতিয়ার প্রমুখ ছাত্র ও জনপ্রতিনিধি ও কর্মীদের নিয়ে জেলা সমন্বয় ও প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটি সার্বিকভাবে ফরিদপুরের প্রশাসন ও তদারকির কাজ পরিচালনা করতে থাকে। তখন ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক ছিলেন এএনএম ইউসুফ এবং পুলিশ সুপার ছিলেন নূরুল মোমেন খান। পরবর্তীকালে ফরিদপুরে পাক হানাদার বাহিনী প্রবেশের পরেই তারা ধৃত হন এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে দীর্ঘ নয় মাস কারাবাসের পর মুক্তিলাভ করেন। ফরিদপুরের সর্বস্তরের নেতৃবৃন্দ, বুদ্ধিজীবি, কবি-সাহিত্যিক, ছাত্র, ব্যবসায়ী এবং সাংবাদিকের মধ্যে বিশেষ করে লিয়াকত আলী হোসেন, আব্দুস সালাম মিয়া, আজম আমীর আলী, আনম আবদুস সোবহান, মিছির কর্মকার, আতাহার হোসেন, শামসুল হক, তারাপদ ঘোষ এবং আরো অনেকের কথা স্মরণ করা যায়। এছাড়াও ফরিদপুরের গোয়ালন্দ, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুরের প্রত্যেক মহকুমায় স্থানীয় প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা হয়। রাজবাড়ীতে মরহুম কাজী হেদায়েত হোসেন, মোসলেম আলী মৃধাসহ জননেতা ডাঃ এসএ মালেক, ওয়াজেদ চৌধুরী, নুরুল ইসলাম, মরহুম আবদুল জলিল, আবদুল হাই, চিত্তবাবু, আলী আক্কাস এবং স্থানীয় ছাত্রনেতা আবদুল জব্বার, নাজিবর, ফজলু, রেজা, তাপস প্রমুখ।

ফরিদপুর জেলা সমন্বয় ও প্রতিরোধ কমিটির মূল ক্যাম্প স্থাপন করা হয় ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিলের ডাক বাংলো ঝিলটুলীতে এবং সেখান থেকে প্রত্যেকটি মহকুমায় যোগাযোগ রক্ষা করার ব্যবস্থা করা হয়। হানাদার বাহিনী ফরিদপুরে প্রবেশ করার আগে পর্যন্ত এ দিনগুলো ছিলো ফরিদপুরের ইতিহাসে একটি অবিস্মরণীয় সময়কাল। ফরিদপুরের প্রতিরোধের সেই সাতাশটি দিন মনে হতো আমরা সম্পূর্ণ স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক ভূখন্ডে বসবাস করছি। কোথাও কোনো স্বাভাবিক আইন শৃঙ্খলার অবনতি পরিলক্ষিত হয়নি। এ যেন জনতার স্বতঃস্ফূর্ত নতুন জীবনের পথে স্বাভাবিক পথ চলা। ঢাকা থেকে বহু প্রত্যক্ষদর্শীর নিকট পাক হানাদার বাহিনীর অনেক কুকীর্তি শুনতে পেলাম এবং ফরিদপুরে আমরা আতংকিত হলাম। সম্ভবত পহেলা এপ্রিলে প্রয়াত নেতা প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ দিল্লীর পথে ফরিদপুরে পৌঁছালেন এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশ প্রদান করে পরের দিন চলে গেলেন। ১৭ই এপ্রিল বাংলার মাটিতে মেহেরপুরের মুজিবনগরে সর্বপ্রথম স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের ঐতিহাসিক ঘোষণার কথা জানতে পারলাম এবং ফরিদপুরকেও আমরা তখন মুক্ত এলাকার একটা অংশ হিসেবে গর্ব অনুভব করলাম। আমরা তখন ফরিদপুরে স্থানীয় প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করতাম। সে সময় ফরিদপুরবাসীদের সার্বিক সুখ দুঃখের এক উচ্ছাসময় শিহরণের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছিল। কখন হানাদার বাহিনী ঢুকে পড়ে সেটাই ছিলো সার্বক্ষণিক চিন্তা। দেশের অন্যান্য জায়গায় পাক বাহিনীর নারকিয় অমানবিক দস্যুতার খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো। আমাদের বেশি ভয় ছিলো প্যারাট্রুপ হানাদার বাহিনী নামলে প্রতিরোধ করার কোনো অস্ত্র আমাদের হাতে ছিলো না। নদীপথে গোয়ালন্দঘাট, গোপালগঞ্জ এবং মাদারীপুর ছাড়াও স্থলপথে পাংশা ও কামারখালীতে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয় যাতে করে কুষ্টিয়া কিংবা যশোর হয়ে আক্রমণের সম্ভবনা প্রতিহত করা যায়। দিবারাত্র চব্বিশ ঘন্টা ডিস্ট্রিক কাউন্সিলে কন্ট্রোল রুম কর্মব্যস্ত থাকতো এবং সেখান থেকে তাৎক্ষণিক তদারকি ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা প্রদানের নির্দেশ প্রদান করা হতো। ফরিদপুর ছিলো ভারত অভিমুখে শরণার্থীদের অনেকেরই মাঝপথ। অনেক নেতা ও কর্মী ঢাকা থেকে ভারত যাওয়ার পথে ফরিদপুরে বিশ্রাম নিয়ে যশোর হয়ে চলে যেতেন। এভাবে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের অনেক নেতৃবর্গই ফরিদপুরে অবস্থান নিলেন। এপ্রিলের মাঝামাঝি ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, রাজবাড়ী, মাদারীপুর শহর থেকে লোকজন পরিবার পরিজন সহ গ্রাম এলাকায় চলে যেতে লাগলেন। একটা সংঘাতের মুখোমুখি আমরা প্রশাসন কর্মকর্তা ও প্রতিরোধে নিয়োজিত নেতৃবৃন্দ ও কর্মীরা শহরে রয়ে গেলাম। আমরা শহরে প্রবেসের বিভিন্ন রাস্তার উপর ব্যারিকেড তৈরি করলাম। ২১শে এপ্রিল ভোর রাতে হানাদার বাহিনী সুসজ্জিত গানবোট দিয়ে প্রথম গোয়ালন্দঘাট আক্রমণ করলো। আমাদের প্রতিরোধ কর্মীরা প্রবল আত্মবিশ্বাসের সাথে আক্রমণ প্রতিহত করার চেষ্টা করে কিন্তু দূর থেকে অবিরাম মর্টারের শেল বর্ষণের মধ্যে সকাল নয়টায় হানাদার বাহিনী গোয়ালন্দঘাট দখল করলো এবং একই সঙ্গে হেলিকপ্টারে করে ফরিদপুরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহে ছত্রীবাহিনী অবতরণ করতে লাগলো। নেতৃবৃন্দ ও কর্মীরা নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ফরিদপুর শহর ত্যাগ করতে লাগলাম।

আমি সকাল দশটার দিকে ইপিআর’এর একজন প্রতিরক্ষা কর্মী সদস্য কবিরুল আলমকে সঙ্গে নিয়ে নড়বড়ে একটা জীপে করে কামারখালীর দিকে রওয়ানা হলাম এবং কেএম ওবায়দুর রহমান নগরকান্দা হয়ে গোপালগঞ্জের দিকে রওয়ানা হলেন। অন্য নেতৃবৃন্দও বিচ্ছিন্নভাবে শহর ত্যাগ করলেন।

——————————————————–

 

ফরিদপুর শহরে প্রাথমিক প্রতিরোধ
(প্রতিবেদনটি ১৯৮৪ সালের জানুয়ারী মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আহমেদ কামালের কাছ থেকে সংগৃহীত)

২৬শে মার্চ রাত প্রায় ২/৩টার দিকে কোতোয়ালীর ওসি আমাদের বাসায় আসেন। বাবা তখন এমএনএ আদিলউদ্দিন আহমেদ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। তিনি এসে জানালেন ঢাকার অবস্থা খুবই খারাপ এবং ফরিদপুরের দিকে যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাক-বাহিনী আসছে। এ অবস্থায় ও-সি সাহেব থানার চাবি আব্বাকে দিয়ে সরে যেতে চাইলেন। তখন আব্বা এ অবস্থায় থানার দায়িত্ব গ্রহণ করতে চাইলেন না। এরপর আব্বা এবং আমি ডি-সি সাহেবের বাসার দিকে রওয়ানা হলাম। ফরিদপুরের ডি-সি তখন জনাব এ, এম, এন ইউসুফ। এস-পি ছিলেন মিহির সাহেব। উভয়কে আমরা ডি-সি সাহেবের বাসার অফিসে দেখতে পাই। ডি-সি সাহেবের সাথে ঢাকা এবং ফরিদপুরের অবস্থা নিয়ে আলাপ হয়। তিনি বললেন, এখনও যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে আর্মি আসছে। তারা আজকেই শহরে এসে পৌছাবে। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগের নেতা এবং কর্মীদের শহর থেকে সরে যাওয়াই উচিত। তখন আমরা ঠিক করলাম যে, আওয়ামী লীগের এমএনএ ও এমপিদের সাথে যোগাযোগ করে একটা সিদ্ধান্তে আসা যাবে। তখন তিনি গাড়ী পাঠালেন তাদেরকে আনার জন্য। জনাব শামসুদ্দিন মোল্লা (এমএনএ), জনাব হায়দার হোসেন (এমপি) এরা সবাই আসলেন। পরিস্থিতি জানার পরে আপাতত শহর থেকে সরে যাওয়ার জন্য সকলেই সিদ্ধান্ত নিলেন। এরপর আমি একটা জীপসহ বেরিয়ে শহরের বিভিন্ন দলের ছাত্র নের্তৃবৃন্দকে ঢাকার ঘটনা জানাই এবং যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে ফরিদপুরের দিকে সেনাবাহিনীর আসার পথে বাধা দেওয়ার ব্যবস্থা করি। এতে ঐ সময়ে অনেকে ব্যাপারটিকে অবাস্তব মনে করে প্রতিরোধে অংশীদার হতে চাইলেন না। কিন্তু সৈয়দ নাসির হোসেন আহমেদ, জামাল ও আরো কয়েকজন মিলে তাৎক্ষনিক সিদ্ধান্ত নেয়া হলো যে, রাস্তায় বড় বড় গাছ কেটে সেনাবাহিনীর পথ রোধ করতে হবে। তখন গাড়ি নিয়ে আমরা দরবেশের পুলের ওপারে গিয়ে গ্রামবাসীদের ডেকে জড়ো করলাম এবং ঢাকার পরিস্থিতি ও পরিকল্পনাও জানানো হলো। এখানে গ্রামের লোকদের গাছ কাটার জন্য প্রচুর উৎসাহ দেয়া হয়। তারা নিজেরাই কুড়াল নিয়ে গাছ কাটতে শুরু করলো। এবং পরামর্শ দেওয়া হলো যে, আর্মি এলে যেন তারা গ্রাম থেকে সরে যায়। অল্প সময়ের মধ্যে তারা ২০/২৫টি গাছ কেটে রাস্তার উপরে ফেলে ব্যরিকেট সৃষ্টি করে। তারপর আমরা শহরের একটু বাইরে অপেক্ষা করতে থাকি পাক-সেনা শহরে ঢোকার আশঙ্কায়, কিন্তু সময় গড়িয়ে গেল পাক-সেনাবাহিনী আসার কোন লক্ষণই দেখা গেল না। পরদিন হঠাৎ চট্টগ্রাম  বেতারের জিয়াউর রহমানের ঘোষনায় আমরা সবাই খুব উজ্জীবিত হয়ে উঠি এবং ডি-সি সাহেবকে অনুরোধ করি শহরের প্রতিরক্ষা এবং যুদ্ধের জন্য তৈরী হতে। এ ব্যাপারে সামর্থ এবং মওজুদ অস্ত্রের পরিমান জানতে চেষ্টা করি। কিন্তু পুলিশ বাহিনী সেনাবাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধে যাওয়া সম্ভব নয় বলে মত প্রকাশ করে। আমরা এ সময়ে জানতে পারি যশোর ক্যান্টনমেন্টের জনগণ এবং পুলিশ দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে আছে।  ২৮ মার্চ ঢাকা থেকে আওয়ামী লীগ নেতা এবং ঢাকায় অবস্থানরত ফরিদপুরবাসীরা ফরিদপুর আসতে শুরু করে। তাদের মুখে ঢাকার সামরিক বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের কাহিনী শুনে আমাদের মধ্যে প্রতিরোধ স্পৃহা আরো বেড়ে ওঠে। তখন আমরা কোনরকম প্রতিরোধের তৎপরতা না দেখে শহরের কতিপয় তরুনদের সাথে এ ব্যাপারে আলাপ করি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪/৫জন ছাত্র নিয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নিই যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধের পদ্ধতি হবে গেরিলা যুদ্ধ এবং অবিলম্বে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ শুরু হওয়া উচিৎ এবং এ প্রশিক্ষনে ষোল বছরের উর্ধ্বের সকল সুস্থ্য লোকের অংশগ্রহণে আহবান জানানো উচিৎ। এই  বৈঠক চলাকালে আমাদের সাথে যোগাযোগ এবং উৎসাহিত করেন নৌ-বাহিনীর একজন প্রাক্তন সদস্য জনাব হাবিবুর রহমান। তিনি নিজেকে কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনের একজন ঘনিষ্ঠ লোক হিসেবে পরিচয় দেন। এই সিদ্ধান্ত হবার পর শহরে মাইকযোগে ঘোষনা
করা হয় যে, প্রতিরোধের যুদ্ধ অংশগ্রহণ করার জন্য সামরিক ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে এবং রাজেন্দ্র কলেজ প্রাঙ্গণে সকলকে উপস্থিত হওয়ার জন্য বলা হচ্ছে। সেইসাথে আরো ঘোষনা করা হয় যে, ছুটিরত পাক বাহিনীর বাঙালি সৈনিক ভাই এবং প্রাক্তণ সৈনিক ভাইদেরও কলেজ প্রাঙ্গণে আসার জন্য বলা হচ্ছে। এই ঘোষনার পর প্রায় দু’শো লোক কলেজ ময়দানে হাজির হয়। এদের মধ্যে ছুটিরত এবং প্রাক্তণ পাক-সেনাবাহিনীর সংখ্যাও ছিল প্রায় ৬/৭ জন। ষ্টেডিয়ামের একটি রুমকে এই প্রশিক্ষনের হেডকোয়ার্টারে রূপান্তরিত করা হয়। প্রথমে কলেজের ইউ-এ-সি ইউ-ও-সি ইউনিটের ডামি রাইফেল এবং পুলিশ লাইন থেকে রাইফেল এনে ট্রেনিংয়েন ব্যবস্থা করা হয়। ফরিদপুর মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা কমিটির নাম দিয়ে এই প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ার চেষ্টা করা হয়।

ট্রেনিংয়ের সাথে সাথে জনগণের রাজনৈতিক চেতনা বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে সাইক্লোষ্টাইল প্রচারপত্র বিলি করা হয়। এসব প্রচারপত্রের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল কি করে গেরিলা যুদ্ধ করতে হবে এবং পাকিস্তান সরকারকে অর্থনৈতিকভাবে বিপন্ন করার জন্য পাটচাষ বন্ধ করা ইত্যাদি। এই পর্যায়ে আমাদের ধারণা হয় এই যুদ্ধ হবে দীর্ঘস্থায়ী এবং সকল বাঙালী শিক্ষিত যুবকই পাক-সেনাবাহিনীর বুলেটের লক্ষ হবে। আমাদের ট্রেনিং চলাকালে কুষ্টিয়া এবং যশোরের প্রতিরোধ আন্দোলনের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করি। তার নিদের্শ অস্ত্র আনার জন্য যশোরে দুইজন সদস্যকে পাঠান হয়। কিন্তু কোন অজ্ঞাত কারণে তাদের অস্ত্র দেয়া হয়নি। ইতিমধ্যে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা হয়নি, এপ্রিলের প্রথম দিকে জয়দেবপুর থেকে পাক-সেনাবাহিনীর সদস্য হেমায়েত উদ্দিন তার তিন সদস্য সিপাহীসহ বেশকিছু গোলাবারুদ, গ্রেনেড, এস-এম-জি, চাইনিজ রাইফেলসহ পদ্মার চরে অবস্থান করছে বলে তৎকালীন দৈনিক পাকিস্তানের সাংবাদিক ভূঁইয়া ইকবাল আমাদের খবর দেন। আমরা কয়েকজন সদস্য পাঠিয়ে তাদেরকে ষ্টেডিয়ামে নিয়ে আসি এবং আমাদের এই প্রতিরোধ আন্দোলনে তাকে শরিক হতে অনুরোধ করি। কিন্তু তিনি একদিন পরে শহরের অন্যত্র অবস্থান করতে থাকেন। আমরা কামারখালী, গোয়ালন্দ এবং ভাংগা পর্যন্ত স্থানীয় প্রতিরোধ আন্দোলনের সাথে আমাদের প্রচেষ্টাকে জড়িত করার চেষ্টা করতে থাকি। দ্বিতীয়বার অস্ত্র সংগ্রহের জন্য যশোরে লোক পাঠানো হয়। কিন্তু এবারও ব্যর্থ হয়। রাজেন্দ্র কলেজ এবং ষ্টেডিয়ামের মাঠে আমাদের ট্রেনিং অব্যাহত থাকে এবং ক্রমেই ট্রেনিং গ্রহণকারীর সংখ্যা বাড়তে শুরু করে। আমাদের এই প্রচেষ্টার দুটি উল্লেখযোগ্য দিক ছিলঃ

(১) জনগনের মনোবল সুদৃঢ় করার জন্য প্রচারকাজ চালানো।

(২) ফরিদপুর শহর এবং আশেপাশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করা। অস্ত্র না পাওয়াতে এবং দীর্ঘস্থায়ী গেরিলাযুদ্ধে অংশগ্রহণের পরিকল্পনার কারণে ২২শে এপ্রিল পাক-সেনাবাহিনী শহরে প্রবেশ করার মুহূর্তে আমরা শহর ত্যাগ করি এবং ফরিদপুর জেলার বিভিন্ন গ্রামে ছড়িয়ে পড়ি। আমাদের প্রাথমিক প্রতিরোধ আন্দোলনের সাথীরা অস্ত্র যোগাড় করতে না পেরে ভারতে চলে যান এবং ট্রেনিং শেষে সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। অনেকে ফরিদপুরের গ্রামাঞ্চল থেকেই রাজাকার এবং পুলিশের অস্ত্র ছিনিয়ে নিতে এলাকাভিত্তিক প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।

——————————————–

সশস্ত্র প্রতিরোধঃ পত্র-পত্রিকার আলোকে

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৫। পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধের বিবরণ যুগান্তর, আনন্দবাজার পত্রিকা মার্চ-জুন, ১৯৭১

পাক মিলিটারী তাণ্ডবে বাঙালির রক্ত ঝরছে

       কলকাতা, ২৬শে মার্চ (ইউ,এন আই)- শেখ মুজিবর রহমান এক বার্তায় আজ বিশ্বাবাসীকে জানিয়েছেন, বাংলাদেশের মানুষ তাদের স্বাধীনতার জন্য সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। এক গোপন বেতার কেন্দ্র থেকে শেখ মুজিবরের প্রচারিত বার্তা এখানে শোনা গেছে। এই গোপন বেতার কেন্দ্রটি চট্রগাম অথবা চালনায় অবস্থিত বলে মনে করা হচ্ছে।

       ঐ বার্তায় বলা হয়েছে, গতকাল রাত ১২টার সময় পিলখানা ও রাজারবাগে পাকিস্তানী সশস্ত্র বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানী রাইফেলসের ঘাঁটি আক্রমণ করে বহু নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করে। ঢাকাতে পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস ও পুলিশ বাহিনী সঙ্গে পাক-বাহিনীর তীব্র সংঘর্ষ চলছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য সাধারণ মানুষ অসীম সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করে চলেছে। বাংলাদেশের প্রত্যেকটি অঞ্চলে বাংলাদেশের সকল শ্রেণীর মানুষ যে কোন মূল্যে শত্রুকে বাধা দেবে। স্বাধীনতার জন্য এই সংগ্রামের সর্বশক্তিমান আল্লাহ আপনাদের সাহায্য করুন।

-যুগান্তর, ২৭ মার্চ, ১৯৭১

কুমিল্লায় সংঘর্ষ

       বেসরকারী সূত্রে প্রাপ্ত সংবাদের প্রকাশ, কুমিল্লায় সৈন্যবাহিনী ও মুক্তিসংগ্রামী জনগণের মধ্যে প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানী রাইফেলস বাহিনী ও পুলিশ বাহিনী জনগণের সঙ্গে যোগ দিয়ে পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছেন। সৈন্য-বাহিনীর গুলিতে কিছু লোক আহত হয়েছে। কুমিল্লার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ সুপারকে সেনাবাহিনী গ্রেপ্তার করেছে বলে প্রকাশ।

       মুক্তিফৌজকে সাহয্য করুনঃ ভারত-পাক সীমান্তে সংগৃহীত একটি বাংলা ইস্তাহারে বলা হয়েছে যে, ২৬শে মার্চ সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় বাংলাদেশ নিজেকে স্বাধীন বলে ঘোষনা করেছে। চট্রগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে এই ঘোষণা প্রচারিত হয়েছে।

       বেতার কেন্দ্রের ঘোষক শক্রুর সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যবন্ধভাবে এগিয়ে আসার জন্য জনগণের প্রতি আহবান জানিয়েছেন।

       বেতারে বলা হয়েছে, ঝড়ের বেগে মুক্তিফৌজ এগিয়ে চলেছে। চট্রগ্রাম, কুমিল্লা ও শ্রীহট্টের সকল গুরুত্বপূর্ণ স্থান পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস বাহিনীর নিয়ন্ত্রনে আছে। অনুগ্রহ করে তাঁদের খাদ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস দিয়ে সাহায্য করুন। আমরা সম্পূর্ণ স্বাধীন। স্বাধীনতা রক্ষার জন্য এগিয়ে আসুন। আল্লাহ আপনাদেরকে সাহয্য করুন। ঢাকা কেন্দ্র ছাড়া আর সকল কেন্দ্রের রেডিও শুনুন। জয় বাংলা। গনমুক্তিবাহিনীর পক্ষে জনাব শেখ সাহেব।

-যুগান্তর, ২৮ মার্চ, ১৯৭১

ওরা লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন-আরও গুলিগোলা চাই

(রাজনৈতিক সংবাদদাতা)

       দুদিনের লড়াইয়ে গোটা পূর্ব পাকিস্তানে প্রায় এক লক্ষ লোক মারা গিয়েছেন বলে বিভিন্ন সীমান্ত এলাকা থেকে ভারত সরকারের দফতরগুলিতে খবর পৌছেছে। বিভিন্ন সীমান্ত ঘাঁটি থেকে যেসব খবর আসছে তার সারমর্মঃ মুজিবর রহমানের সমর্থক পুলিশ ও ইপিআর বাহিনীর লোকজনদের লোকজনের গুলি ফুরিয়ে এলেও তাঁরা লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। সেনাবাহিনী নির্বিচারে গুলি চালাচ্ছে।

       লড়াই এখনও সবচেয়ে বেশি চলছে ঢাকা ও রংপুরে। এই দুই এলাকায় হাজার হাজার সাধারণ মানুষও সেনাদের বিরুদ্ধে গেরিলা কায়দায় লড়াই চালাচ্ছেন। পাক সেনাবাহিনী  এই দুই এলাকায় ট্যাঙ্ক নিয়ে নেমেছে। তারাও ট্যাঙ্ক থেকে অবিরাম গুলি চালাচ্ছে।

       পূর্ব পাকিস্তানের দুটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সড়কের ওপরের কয়েকটি ব্রিজও আওয়ামী লীগের সমর্থকরা উড়িয়ে দিয়েছেন। এই দুটি সড়কই ঢাকার সঙ্গে চট্রগ্রাম এবং যশোরের যোগাযোগ রক্ষা করত। এই দুটি সড়ক দিয়ে এই সেনাবাহিনীর গাড়ি এগোতে পারেনি। এছাড়া মুজিবর রহমানের সমর্থকরা বিভিন্ন রাস্তায় সৈন্যদের চলাচলে বাধা সৃষ্টি করার জন্য নানারকমের প্রতিোধ সৃষ্টি করেছেন। বহু এলাকায় রাস্তা খুড়ে দেওয়া হয়েছে।

       শনিবার সীমান্তের বিভিন্ন এলাকায় ওপারের লোকেরা এসে এপারে গুলি চেয়েছেন। তাঁরা জানিয়েছেন যে তাঁদের গুলি ফুরিয়ে যাচ্ছে। গুলিগোলা না পেলে আর লড়াই চালাতে পারছেন না। কিন্তু তাদের সবাইকেই এপার থেকে হতাশ হয়ে ফিরতে হয়েছে। কুষ্টিয়া অঞ্চল থেকে একজন এসডিও-ও গুলি চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছেন।

-আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৮শে মার্চ, ১৯৭১

আওয়ামী লীগর নেতারা এপারে

তাঁদের আবেদনঃ অস্ত্র চাই

       আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতা সোমবার ওপার থেকে এপার এসেছেন। সকলেরই একই লক্ষ্য ভারত থেকে অস্ত্র সাহায্য সংগ্রহ করা। এদের মধ্যে একজন আছেন নবনির্বাচিত পাক জাতীয় পরিষদের সদস্য। তিনি মালদহ জেলা সীমান্ত দিয়ে ঢুকেছেন।

       এদিকে, মুক্ত কুষ্টিয়ায় এইদিন পূর্ণ কর্তৃত্ব হাতে নিয়েই আওয়ামী লীগের শাসকরা ট্রাঙ্ক টেলিফোনে ব্যবস্থা চালু করে দিয়েছেন। সোমবার দুপুরেই মুক্ত কুষ্টিয়ার প্রধান পরিচালক ডাঃ আসাবুল হক টেলিফোনে শ্রী অজয়কুমার মুখোপধ্যায়ের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাঁরও আবেদন ছিলঃ আপনারা অবিলম্বে সাহয্য পাঠান।

       ডাঃ হক জানান, এখন কার্যত হাজার নিরস্ত্র মানুষ সৈন্যদের আক্রমন করছে। এত মানুষ এসে লড়াইয়ে যোগ দিচ্ছে যে, সেনাবাহিনী মেশিনগান চালিয়েও মেরে শেষ করতে পারছে না। তিনি জানান, কুষ্টিয়া, পাবনা, যশোর, খুলনায় একদিন হাজার হাজার মানষ বল্লম ও সড়কি নিয়ে এসে সেনাবাহিনীর ঘাঁটি আক্রমন করেছে। হাজার হাজার মেরেছেও। কিন্তু তাঁরা পিছিয়ে যাননি। তিনি জানান, সোমবার রাত্রিতেই বৃহত্তম আঘাত হানা হবে ঘাঁটিগুলির উপর।

       কুষ্টিয়া মিলিটারী ব্যারাককে চর্তুদিক দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছে। সৈন্যদের বলা হয়েছে আত্নসমর্পন করতে। ডাঃ হক জানান, পাবনায় ও সেনাবাহিনীকে আত্নসমর্পণ করতে বলা হয়েছি। কিন্তু তারা করেনি। ফলে তাদের সবাইকে মরতে হয়েছে। জনতা আহত পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাদের ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে বিজয়োল্লাস করেছে।

       ডাঃ হক বলেনঃ কত হাজার হাজার মানুষের যে ইতিমধ্যে মারা গিয়েছে তার কোন গুণতি নেই। কিন্তু তবু মানুষ মরতে ভীত নয়।

       তিনি যশোর থেকে খবর পেয়েছেন যে, সেনাবাহিনী কোণঠাসা হয়েছে। খুলনায় সেনাবাহিনী সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত।

       স্টাফ রিপোর্টার জানান, বাংলাদেশের আওয়ামী লীগের বহু কর্মী এবং মুক্তিসেনা সীমান্ত পার হয়ে পশ্চিম বঙ্গে এসে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কাছে সাহায্য চাইছেন।

-আনন্দবাজার পত্রিকা, ৩০ মার্চ,১৯৭১

সীমান্তের চারদিক থেকে

       আমাদের স্টাফ রিপোর্টার, বিশেষ প্রতিনিধি, নিজস্ব সংবাদদাতা স্বাধীন বাংলাদেশের নানা সীমান্ত থেকে অজস্র সংবাদ পাঠাচ্ছেন ওখানকার মুক্তিযুদ্ধের। সব মিলিয়ে একসঙ্গে তা প্রকাশিত হল সংক্ষেপে। সব সংবাদেরই বক্তব্য, পাক ফৌজ ভেঙ্গে পড়ছে, মুক্তিফৌজ দখল করে চলেছে একের পর এক এলাকা।

       গেদে থেকেঃ কুষ্টিয়ার লড়াই-এ মুক্তিফৌজকে সাহায্যে জন্য হাজারে হাজারে অসামরিক নাগরিক পদ্মা পার হয়ে কুষ্টিয়ার দিক থেকে ছুটে যান। হারডিঞ্জ সেতু পার হবার সময় শক্র বাহিনী বোমারু বিমান থেকে বোমাবর্ষণ করে। বোমায় সেতুর একাংশ বিধ্বস্ত হয় এবং শতখানেক স্বাধীনতা সংগ্রামী প্রাণ হারান।

       পাবনায় শক্রবাহিনী ওই একই নারকীয় দৃশ্য তৈরী করেছে। তবে রক্ত দিয়ে তাদের মূল্য দিতে হয়েছে। শেষ শক্রুসৈন্যও জনতার রোষে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে।

       মুক্তিফৌজের কমান্ডার ভারতের জনগণকে তাঁর অভিনন্দন জানিয়েছেন। তিনি বলেন, রংপুর আমাদের মুক্তিফোজের দখলে এসেছে।

       খুলনায় নারী ও শিশুদের উপর পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা যে বর্বর, অমানুষিক অত্যাচার চালিয়েছে- মুক্তি ফৌজের নেতা বার বার তার উল্লেখ করেন।

       তিনি বলেন, রক্ত দিয়ে আমাদের স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে, আমরা তা জানি। কিন্তু আমাদের মা-বোন, ছেলেমেয়েদের উপর নৃশংস অত্যাচার চলতে-তা আমরা ভাবতে পারিনি।

       মেখলিগঞ্জ থেকেঃ বাংলাদেশের রংপুর, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁ এবং বগুড়া শহরে দখলদার পাকিস্তানী ফৌজ ও বাংলাদেশের মুক্তি বাহিনীর মধ্যে প্রতি মহল্লায় তুমুল লড়াই চলছে।

       দখলদার বাহিনী রংপুর শহরে ট্যাঙ্ক নামিয়েছে। দিনাজপুর ও রংপুর জেলা শাসক ও পুলিশ সুপারকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অপরদিকে মুক্তি ফৌজ পচাগড়ে অবরুদ্ধ কোম্পানী পাকিস্তানী ফৌজকে পর্যুদস্ত করে অস্ত্রশস্ত্র কেড়ে নিয়েছে এবং এই লড়াইয়ে অধিকাংশ পাকিস্তানী ফৌজ নিহত হয়েছে। রংপুর ও দিনাজপুর জেলার সীমান্ত ফাঁড়ি এখনও আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ন্ত্রণে। মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানী ফৌজকে পরাজিত করে রাজশাহী শহরকে মুক্ত করেছে।

       ইতিমধ্যে এপার বাংলার কাছে ওপার বাংলার তরুন ছাত্রদের আর্ত আবেদনঃ আমাদের অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করুন। হলদিবাড়ি সীমান্তে গতকাল চারজন চাথ্রপ্রতিনিধি আসেন অস্ত্র সংগ্রহেনর জন্য।

       দিনাজপুর শহরে মুক্তিফৌজের শক্তিবৃদ্ধির জন্য সীমান্ত বাঙালি ইপিআর সীমান্ত চৌকি ছেড়ে চলে গিয়েছে। দিনাজপুরের পথে পথে পশ্চিম ফৌজ প্রচণ্ড প্রতিরোধের সম্মুখীন। ঘোড়াঘাট ও হিলির পশ্চিমী ফৌজের একটি ট্রাক রাস্তার উপর একটি গর্তে পড়ে উলটে যায়। প্রচুর ফৌজ আহত হয়। হিলি এলাকায় ভারত-পাক সীমান্তের কাছে দুটি অবাঙালি পশ্চিত ফৌজের মৃতদেহ দেখা গিয়েছে। দুজন পশ্চিমী ফৌজ প্রাণভয়ে ভারতের এলাকায় ঢুকে পড়ে। তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে।

       সোমবার মুক্তিফৌজের তাড়া খেয়ে প্রায় ২০ জন পশ্চিম পাকিস্তানী সপরিবারে হিলি সীমান্ত দিয়ে ভারতে ঢুকে পড়ে। এরা ভারতীয় রক্ষী বাহিনীর নিকট আত্নসমর্পন করেছে।

       অন্যদিকে পশ্চিম দিনাজপুরের দিক থেকে আওয়ামী লীগের দুজন বিশিষ্ট নেতাও এপার আসেন। জলপাইগুড়ি শহরে এরা পৌঁছালে তাদের বিপুল সম্বর্ধনা জানানো হয়।

       পাকিস্তানী জাতীয় পরিষদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রধান নেতা মুহম্মদ আবিদ আলী বাংলাদেশে অবিলম্বে সাহায্যের জন্য আর্ত আবেদন জানিয়েছেন।

       হাসনাবাদ থেকেঃ সোমবার দুপুরে সাতক্ষীরা সীমান্তে খবর সাতক্ষীরা আদালত ভবন থেকে ক্রুদ্ধ জনতা পাকিস্তানী পতাকা নামিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে। সাতক্ষীরা পাঞ্জাবী মহকুমা শাসককে জনতা স্বগৃহে অন্তরীণ করে রেখেছে।

       সীমান্ত আজ মুছে একাকার হয়ে গেছে। এপার বাংলা থেকে দলে দলে মানুষ এসে সীমানার এপারে দাঁড়াচ্ছে। ওপারের মানুষ এসে দাঁড়াচ্ছে মুখোমুখি। আজ আর কেউ কারও কাছে অপরিচিত নয়।

       সোমবার সীমান্ত পার হয়ে অনেকখানি ঢুকে গিয়েছিলাম স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে। কথা হল বহু মানুষের সঙ্গে। সকলের মুখে এক কথা, শত্রুর মোকাবিলা করার জন্য আমাদের অস্ত্র দিন।

       অস্ত্র আর অস্ত্র। ওপার বাংলার মানুষ এপার বাংলার মানুষের কাছে আজ শুধু একটি জিনিসই চান। শুধু নৈতিক সমর্থন নয়, অস্ত্র না পেলে আমরা লড়ব কি করে। এই তাদের বক্তব্য।

       খুলনা থেকে দুদিন হেঁটে আজই ফিরেছেন এমন একজনের সঙ্গে দেখা হল। সমস্ত রাস্তা বন্ধ। খুলনায় এখনও চলছে জোর লড়াই। সেখানে মুক্তিফৌজ ৪০০ পাঞ্জাবী সৈন্যকে নিহত করেছে। একটি তিনতলা বাড়ীতে কিছু পাঞ্জাবী সৈন্য আশ্রয় নিয়েছি। ইষ্ট পাকিস্তান রাইফেলস তাদের ঘেরাও করে। সাদা পতাকা উড়িয়ে পাঞ্জাবী সৈন্য আত্নসমর্পন করে।

       যশোর থেকে সদ্য প্রত্যাগত একটি যুবকের কথাঃ যশোরের পথে বেশীদূর এগুতে পারলাম না। পথে পথে মৃতদেহ। দূরে গুলির শব্দ ধোঁয়া আর ধোঁয়া।

       আগরতলা থেকেঃ গতকাল চট্রগাম দখলদার সৈন্য অবতরণে অসামরিক জনগণ বাধা দিলে তাদের ওপর জাহাজের কামান থেকে গোলাবর্ষণ করা হয়। ফলে বহু লোক মারা যায়।

       ইপিআর-এর ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে দখলদার ফৌজরা গ্রেফতার করেছে। ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের যেসব বাঙালি ফৌজ ওই বাহিনী থেকে সরে আসতে পারেননি তাদের হয় গ্রেফতার করা হয়েছে অথবা নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে।

       স্বাধীন বেতারে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে পশ্চিমবঙ্গের জনগনের সমর্থনের সংবাদ ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়েছে।

       পাক বিমানবহর হেলিকপ্টারে করে সন্দ্বীপে ফৌজ নামাবার চেষ্টা করছে; নৌকা করে যশোরেও সেনা পাঠাবার। স্বাধীন বেতার কেন্দ্র আজ দুপুরে ওই খবর দেন। সঙ্গে সঙ্গে জানান, মুক্তিফৌজ তীব্র প্রতিরোধ করছে। এযাবৎ দুজায়গায় পাক বিমানবহরের চেষ্টা প্রতিহত হয়েছে।

-আনন্দবাজার পত্রিকা, ৩০মার্চ, ১৯৭১

বাংলাদেশ প্রায় পুরোই মুক্তিফৌজের কব্জায়

       আগরতলা, ৩০ শে মার্চ (পিটিআই/ইএন আই) – পূর্ব পাকিস্তানের কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে শ্রীহট্ট পর্যন্ত সমগ্র এলাকাটি বাংলাদেশের মুক্তিফৌজ কর্তৃক অধিকৃত হয়েচে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে এই সংবাদটি আজ সকালে জানা যায়। এখানে শ্রুত এই বেতার ঘোষণায় বলা হয় যে, সমগ্র এলাকায় এখন বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে।

       বাঙলার রাজধানী ঢাকা শহরসহ বাংলাদেশের প্রায় সমগ্র অঞ্চল শেখ মুজিবর রহমানের মুক্তিফৌজের নিয়ন্ত্রণে আসায় পাকবাহিনী সর্বত্র পশ্চাদপসরণ করছে বলে স্বাধীন বাংলা বেতার দাবী জানিয়েছে। ঢাকার আশেপাশে অসংখ্য মৃতদেহ পড়ে আছে। অস্থায়ী সরকারের প্রধান মেজর জিয়া আজ বেতারে বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের কাছে আবেদন জানিয়ে তাঁদের সাফল্য প্রত্যক্ষ করার জন্য আহবার জানিয়েছে।

       মুক্তিফৌজ ঢাকা দখলের পর অবশিষ্ট হানাদারদের সঙ্গে হাতাহাতি লড়ছেন। ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট ও বিমানঘাঁটি দখলের জন্য তীব্র লড়াই চলছে। পাক-বাহিনী ঢাকার উপকন্ঠে বোমাবর্ষণ করছে।

       চট্টগ্রাম বন্দর প্রায় সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে এবং বন্দর আর এখন ব্যবহার করা যাবে না বলে জানা গেছে।

       চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কুমিল্লা, যশোর, খুলনা, দিনাজপুর, রংপুর, শ্রীহট্ট, রাজশাহী, ময়মনসিংহ প্রভৃতি মুক্তিফৌজের পূর্ণ দখলে রয়েছে। বরিশাল, পাবনা ও বঙ্গবন্ধুর স্বজেলা ফরিপুরের কোন খবর পাওয়া যায়ন। মুক্তিফৌজ এখন বাংলা জলপথও সম্পূর্ণভাবে নিজেদের নিয়ন্ত্রনে এনেছেন। মুক্তিফৌজ প্রথম হানাদারদের উপর মর্টার ব্যবহার করেছেন বলে জানা গেছে। মঙ্গলবার স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ঘোষণা করেছে মুক্তিফৌজ ঢাকা শহর দখল করে নিয়েছে।

       বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের প্রধান মেজর জিয়া আজ ঘোষণা করেন যে পূর্ববঙ্গের অধিকাংশ স্থান এখন তাঁর মুক্তিফৌজের দখলে রয়েছে। বিশ্বের রাষ্ট্রসমূহ তথা বিশ্ববাসীকে তা দেখে যাবার জন্য তিনি আমন্ত্রন জানিয়েছেন। ছয়টি বেতার কেন্দ্রের মধ্যে পাঁচটি এখন মুক্তিফৌজের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

       পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা এখন মৃত্যুভয়ে পালাচ্ছে বলে তিনি জানান। বাংলাদেশ বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলা ভাষায় এক বিশেষ ঘোষণায় তিনি বলেন যে, মুক্তিফৌজ বিপুল সংখ্যায় পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের ওপর ঝাপিয়ে পড়েছেন। স্বাধীন বাংলাদেশের অধিকাংশ স্থান এখন তাদের নিয়স্ত্রণে রয়েছে।

       পাকিস্তান রেডিওর প্রচারণাকে মেজর জিয়া ডাহা মিথ্যা কথা বলে বর্ণনা করেন। পূর্ব পাকিস্তান রাইফেল বাহিনীর অন্তর্ভূক্ত দশজন পাঠান গতকাল সীমান্ত অতিক্রম করে পশ্চিম দিনাজপুরের ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী পাহিনী কাছে আত্নসমর্পণ করেছে।

চট্টগ্রাম জ্বলছেঃ চট্টগ্রাম শহর জ্বলছে। মুক্তিফৌজ সেখানে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের হাতে হাতে লড়াই করছেন। বন্দরণগরী চট্টগ্রামে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সৈন্যরা ট্যাংক ব্যবহার করছে।

       শহরের প্রধান অংশ এখন মুজিবের বাহিনীর হাতে রয়েছে বলে সংবাদ পাওয়া গেছে।

চট্টগ্রামে বিমান থেকে সৈন্য নামান হয়েছে। জাহাজ থেকে আজও গোলাবর্ষণ করা হয়েছে। এই বন্দর শহরে এখন প্রবল লড়াই চলছে। চট্টগ্রাম বন্দরকে এমনভাবে ধ্বংস করা হয়েছে যে, বন্দরটিকে ব্যবহারযোগ্য করতে কয়েক বছর সময় লাগবে।

       দিনাজপুরে প্রবল লড়াইঃ রাধিকারপুর থেকে প্রাপ্ত সংবাদে প্রকাশ, রবিবার সারারাত ধরে দিনাজপুর শহর এবং সংলগ্ন গ্রামগুলোতে প্রবল লড়াই চলছে। পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা কয়েকটি গ্রাম পুড়িয়ে দিয়েছে। বোমা ও মেশিনগানের শব্দে রাধিকাপুর ও সংলগ্ন গ্রামের জনসাধারণকে বিনিন্দ্র রাজনী যাপন করতে হয়েছে।

       রাজশাহী ও খুলনাঃ রাজশাহী ও খুলনাতে কয়েক কোম্পানী পাকিস্তানী সৈন্য বিমানে নামানো হয়েছে। রাজশাহীতে মুক্তিফৌজের প্রতিরোধ ভাঙ্গার জন্য বিমান থেকে বোমাবর্ষণ করা হয়েছে।

       উভয় স্থানে মুক্তিফৌজ সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। একটি মাত্র স্থানে স্থানে বিদেশী সৈন্যরা সীমাবদ্ধ ছিল। রাজশাহীর গোদাগাড়ি ঘাট পর্যন্ত এখন মুক্তিফৌজের নিয়ন্ত্রনে আছে। তাঁরা রাইফেল বাহিনীর সদর দপ্তর পুনরায় দখল করেছেন।

       আজ সকালে উপরোক্ত স্থানে পুনরায় সৈন্য পাঠানো হয়েছে। ইস্ট বেঙ্গল রাইফেলের ও পুলিশের সাহায্যে শেখ মুজিব বাহিনীর লড়াই অব্যাহত রয়েছে। খুলনার টেলিফোন এক্সচেঞ্জকে পাক-সৈন্যরা ধ্বংস করেছে।

       ক্যান্টেনমেন্ট দখলের চেষ্টাঃ কুমিল্লা ও যশোহর ক্যান্টনমেন্ট দখলের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য মার্কিন স্যাবর জেট থেকে বোমাবর্ষণ করছে বলে স্বাধীন বেতার কেন্দ্র থেকে ঘোষণা করা হয়েছে। প্রতিকুল অবস্থার মধ্যেও মুক্তফৌজ এই ক্যান্টনমেন্ট দুটিকে দখলে রেখেছেন।

       ঢাকাতে তীব্র সংঘর্ষঃ ঢাকা শহর ও তার আশেপাশে এবং ক্যান্টনমেন্ট বিমানবন্দর এলাকায় পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য ও মুক্তিফৌজের মধ্যে প্রবল লড়াই চলছে। পরে ঢাকা শঞর মুক্তিফৌজ দখল করেছেন বলে স্বাধীন বেতার কেন্দ্র ঘোষণা করেছেন।

       কৃষ্ণনগর থেকে প্রাপ্ত এক খবরে প্রকাশ, ঢাকা কর্পোরেশন অফিস এখন মুক্তিফৌজের দখলে। প্রশাসক মেজর এস এ খান নিহত।

       মুর্শিদাবাদ জেলার ভারতীয় সীমান্ত গ্রাম ভাগবানগোলার বিপরীত দিকে পাক-সীমান্ত প্রহরারত ২০ জন পশ্চিম পাকিস্তানী প্রহরী মুক্তিফৌজের হাতে নিহত হয়েছে।

       রাতে নৌকা চলাচল নিষিদ্ধঃ নদীমাতৃক পূর্ববাংলার জলপথে রাত্রে নৌকা চলাচলে নিষিদ্ধ করে ‘স্বাধীন বাংলাদেশের সার্বভৌম সরকার’ এক নির্দেশ জারী করেছেন।

       মুক্তিফৌজের আক্রমণে বিছিন্ন ও পর্যুদস্ত পাকিস্তানী সৈন্যরা যাতে পালাতে না পারে তার জন্যই এ ব্যবস্থা অবলম্বন করা হয়েছে।

       রংপুরঃ সমগ্র রংপুর শহর মুক্তিফৌজের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। রংপুর-কোচবিহার এলাকার পাকিস্তানী রাইফেলের টহন মুক্তিফৌজের নির্দেশ বন্ধ করা হয়েছে।

       আখাউড়াঃ আখাউড়াতে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর ছয়জন অফিসার নিহত হয়েছেন। সেখানকার আশেপাশে এখনও যুদ্ধ চলেছে।

       করাচীর ভাষ্যঃ করাচীর সরকারী সূত্রে বলা হয়েছে যে, বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ ও যান্ত্রিক গোলযোগের জন্য ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে মাঝে মাঝে সংবাদ প্রচার করা হচ্ছে। শেখ মুজিবুর রহমান কোথায় আছেন সে সম্পর্কে আজ কিছুই বলা হয়নি। পাকিস্তান রেডিও থেকে পূর্ববঙ্গের অবস্থাকে ‘সম্পূর্ণ শান্ত’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে।

-যুগান্তর, ৩১ মার্চ, ১৯৭১

সকল রণাঙ্গনেই পাকফৌজ গা বাঁচিয়ে চলছে

       মঙ্গলবার মধ্যরাত্রিতে বঙ্গ রণাঙ্গনের সমগ্র পরিস্থিতি মুক্তিফৌজের অনুকুল-বিভিন্ন খন্ডের রণক্ষেত্রে মুক্তিফৌজ প্রচণ্ডভাবে আঘাত হেনে চলেছে।

       বাংলাদেশের দুরবিস্তৃত অধিকাংশ রণাঙ্গনেই পাকিস্তানী স্থলবাহিনী কোনরকমে গা বাচিঁয়ে চলছে এবং অনন্যেপায় হয়ে বিমান বাহিনীকে ডেকে আনছে এবং তারাও নির্বিচারে সামরিক প্রয়োজন-অপ্রোজনের কথা চিন্তা না করে বোমাবর্ষণ করে ঘাঁটিতে ফিরে যাচ্ছে। দিল্লির প্রতিরক্ষা অনুশীলন সংস্থার বিশেষজ্ঞারা সমগ্র রণাঙ্গনের চিত্রটি এভাবে একেঁছেনঃ

       পূর্ব রণাঙ্গনঃ কুমিল্লা থেকে শ্রীহট্ট পর্যন্ত বিস্তৃত পূর্ব রাণাঙ্গনে মুক্তিফৌজ সীমান্তবর্তী সব কয়টি ঘাঁটি দখল করে নিয়েছে। তাদের বিমানধ্বংসী কামান হানাদার পাক বিমানকে বার বার তাড়িয়ে দিয়েছে। এই রণাঙ্গনেরই অন্তর্ভূক্ত আখাউড়ায় মঙ্গলবার সকালে পাক বিমান প্রচণ্ডভাবে বোমাবর্ষণ করেছে।

       মঙ্গলবার সবচাইতে নৃশংস সংগ্রাম চলেছে চট্টগ্রাম-এর সঙ্গে কেবলমাত্র তুলনা চলতে পারে অবরুদ্ধ ঢাকা নগরীর রাজপথের লড়াই। পাকিস্তানী বিমানবন্দর এলকায় বোমাবর্ষণ করেছে। যুদ্ধজাহাজ গোলা ছুঁড়েছে। চট্টগ্রাম জ্বলছে।

       উত্তর-মধ্য রণাঙ্গনঃ উত্তর-মধ্য রণাঙ্গনে ময়মনসিংহ মুক্তিফৌজের হাতে এসেছে।

       দক্ষিণ রণাঙ্গনঃ দক্ষিণ রণাঙ্গনে বিপন্ন পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে সাহায্য করার জন্য মধ্য রণাঙ্গন থেকে সৈন্য পাঠান হচ্ছে। নদী-নালা, খাল-বিল আকীর্ণ রণাঙ্গনে তারা রাত্রির অন্ধকারে চুপি চুপি অগ্রসর হচ্ছে।

       মুক্তিফৌজের কমাণ্ড চারিটি রণক্ষেত্রের সংগ্রামরত সৈন্যদের মধ্যে নিখুঁত যোগাযোগ রেখে চলেছেন। চট্টগ্রাম থেকে খুলনা পর্যন্ত উপকূল বরাবর বিস্তৃত দক্ষিণ রণাঙ্গনের পূর্ব প্রান্ত চট্টগ্রামের দিকে জাহাজ বোঝাই করে সৈন্য পাঠানো হয়েছে পশ্চিম প্রান্ত খুলনা থেকে।

       দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনঃ দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনে খুলনা-যশোর খণ্ডে মঙ্গলবার তেমন কোন বড় লড়াই হয়েছে বলে মনে হয়না। যশোর ক্যান্টনমেন্ট দখলের জন্য সোমবার প্রচণ্ড লড়াই হয়ে গিয়েছে। সম্ভবত উভয় পক্ষই আগামী দিনে তীব্রতর দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন।

       দূরবিস্তৃত চারটি রণাঙ্গনের সর্বত্র আক্রমণোদ্যোগ এখন মুক্তিফৌজের হাতে, পশ্চিম রণাঙ্গন বাহিনী সর্বত্র আত্মরক্ষা করে চলেছে।

       মুক্তিফৌজের স্থলসেনার অবিরাম চাপে বিব্রত পশ্চিম পাকিস্তানী স্থলবাহিনী বিমান ও হেলিক্প্টারের সাহায্য নিতে বাধ্য হচ্ছেন, কিন্তু তার ফলে পরিস্থিতি তাদের অনুকুলে যাওয়ার তেমন নেই।

-আনন্দবাজার পত্রিকা, ৩১ মার্চ, ১৯৭১

ইয়াহিয়া ফৌজের ‘বিদ্রোহী’ সেনাকে গুলি করে হত্যা

শুভ্রাংশু গুপ্ত

       মেহেরপুর (কুষ্টিয়া), ৩১ মার্চ-ইয়াহিয়া ফৌজের বিপুলসংখ্যক সেনা মুক্তিফৌজের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে অস্বীকার করেছেন। এরা বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মোতায়েন। পুলিশ লাইনেও এই শহরের একটি স্কুলগৃহে এরা ‘বিদ্রোহী’ সেনাদের প্রায় দু’শত জনকে তাদের দলপতির নির্দেশে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।

       বঙ্গবন্ধু মুজিব কোন এক গোপণ ঘাঁটিতে সপরিবারে আছেন। এখানে বঙ্গবন্ধু দু’জন সহকর্মী-আবু আহমেদ আফজল রসিদ এবং মঃ সহীউদ্দিন আমাকে এই সংবাদ দেন। তারা বলেন, মুজিবর রহমানের গ্রেফতার এবং তাঁর পুত্রের হত্যার সংবাদ সম্পূর্ণ তৈরী করা। বঙ্গবন্ধু তাঁর গোপন ঘাঁটি থেকে সর্বদাই এই সংগ্রামে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

       আগামী এক পক্ষকালের মধ্যে এই বাংলাদেশ স্বাধীন হবে এবং বঙ্গবন্ধু মুজিবর তখন আত্নপ্রকাশ করবেন বলে মুজিবের ওই সহকর্মীদ্বয় জানান।

       ওই দুই নেতা জানান, পাবনা, দিনাজপুর, শ্রীহট্ট, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও কুষ্টিয়ার প্রায় পুরো অঞ্চল এখন আওয়ামী লীগের দখলে। মঃ রসিদ জানান, তাঁরা বিপুল অস্ত্রশস্ত্রের মজুত উদ্ধার করেছেন। সেগুলির বেশির ভাগই চীনের তৈরী। তার মধ্যে হালকা মেশিনগান, স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, দুটো কামান ও প্রায় পঞ্চাশটি মিলিটারী ট্রাক করেছে।

-আনন্দবাজার পত্রিকা, ১ এপ্রিল, ১৯৭১

যশোরের বোমাবর্ষণ

       বনগাঁ, ৩১ শে মার্চ-সারা যশোর শহর দাউ দাউ করে জ্বলছে। সেই আগুনের আভা সন্ধ্যায় হরিদাপুরও থেকেও দেখা গেছে। যশোর ক্যান্টনমেন্ট পূর্ণদখলের উদ্দেশ্যে আজ বেলা সাড়ে বারটা নাগাদ পাক সামরিক বাহিনী ৫ খানি বিমানে করে ছাত্রীসৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র নামিয়ে দেয়। এরপর বিমান বাহিনী থেকে কিছু সময় পর পর বোমাবর্ষণ চলেছে বলে জানা গেছে।

       পাক বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিফৌজের তীব্র লড়াই চলছে। একদল সৈন্য শহরাঞ্চলে মর্টারের সাহায্যে আক্রমন চালায়। শহরে বহু বাড়ি ধ্বংস হয়েছে। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। সামরিক বাহিনীর লোকেরা অসংখ্য মানুষকে হত্যা করেছ। কয়েকটি গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে।

       আজ সকালের দিকে হরিদাসপুর সীমান্ত এলাকায় ৫ জন পাকিস্তানী সৈন্যের মৃতদেহ এবং একটি কাটা মুন্ডু দেখতে পাওয়া যায়। এখানে সন্দেহ করা হচ্ছে যে, বাংলাদেশের মধ্যে হত্যা করে এই মৃতদেহগুলি এখানে ফেলে দেওয়া হয়েছে।

       খুলনায় এক খবরে প্রকাশ যে, খালিশপুরে একটি চটকল ডিনামাইট উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এবং রূপসা নদীর ধারে তীব্র সংঘর্ষ চলেছে।

       আজ সকালে মুক্তিফৌজের লোকেরা বেনাপোল চেকপোস্টে পাকিস্তানী পতাকা নামিয়ে দেয়। সরকারী সূত্রে জানা গেছে যে, মোট ৩২ জন পাকিস্তানী পাঞ্জাবী সৈন্য এই সীমান্ত পার হয়ে আত্নসমর্পন করেছে।

       আগরতলা, ৩১ শে মার্চ (পিটিআই) রাজশাহী, খুলনা ও আরও কয়েকটি স্থানে পাকিস্তানী স্যাবর জেট আজ বোমাবর্ষণ করেছে। পাক বিমান বাহিনীর এই হানায় বহু নিরস্ত্র লোক নিহত হয়েছে।

       রাজশাহী, যশোর, খুলনা, কুমিল্লা ও ঢাকাতে তীব্র লড়াই চলছে।

       ঢাকা বিমানবন্দরের আশেপাশে মর্টার ব্যবহার করা হচ্ছে। কামান থেকেও পাক সৈন্যরা গোলাবর্ষণ করেছে। চট্রগ্রামে দুর্ভেদ্য দুর্গঃ যুদ্ধরত চট্টগ্রামের কয়েকস্থানে প্রতেকটি গৃহ একটি দুর্ভেদ্য দুর্গে পরিণত হয়েছে, পাক-সৈন্যরা কোথাও ঢুকতে পারছে না। রংপুর ও কুষ্টিয়া জেলা মুক্তিফৌজের পূর্ণ নিয়স্ত্রণে রয়েছে।

       ঢাকাতে ৩০ হাজার নিহতঃ ২৫ শে মার্চ থেকে দুদিনে ঢাকা ও শহরাঞ্চলে প্রায় ৩০ হাজার লোক নিহত হয়েছে বলে ত্রিপুরায় আগত পাক-সাংবাদিকরা জানান।

-যুগান্তর, ১ এপ্রিল, ১৯৭১

স্থলে, জলে, অন্তরীক্ষে পাক ফৌজের সর্বাত্মক অভিযান

       পরাস্ত, বিপর্যস্ত পাক দখলদার বাহিনী এখন মরিয়া হয়ে বাংলাদেশের সর্বত্র মুক্তিফৌজের বিরুদ্ধে সর্বাত্নক আক্রমণ চালিয়েছে। আক্রমণ-জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে। বিস্তীর্ণ রণাঙ্গানে দিশেহারা পাক-সেনাদল প্রধানত শহরাঞ্চলে অভিপত্য বিস্তার করে আত্নরক্ষায় সচেষ্ট। সর্বত্র পাক-বাহিনীর নগ্ন বীভৎস আক্রমণ। বিমান থেকে ফেলা হচ্ছে নাপাম বোমা, ট্যাংক থেকে বর্ষিত হচ্ছে গোলা, আর সেই সঙ্গে উপকুলবর্তী এলাকায় জাহাজ থেকেও ঝাঁকে ঝাঁকে এসে পড়ছে গোলা। বৃহস্পতিবার প্রায় সারাদিন স্যাবার জেট নিয়ে প্রচণ্ড আক্রমণ জালানো হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। এর মুখোমুখি মুক্তিফৌজের প্রতিরোধ আরও তীব্র, সংহত। নতুন নতুন মুক্তাঞ্চল তৈরী হচ্ছে। ঢাকার কাছে জয়দেবপুরের অস্ত্র-কারখানা মুক্তিফৌজের দখলে। এক কথায় বলা যেতে পারেঃ পাক-সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব অক্ষুন্ন আছে ঢাকা শহরের কয়েকটি এলাকায়। আর চট্টগ্রাম, রংপুর, সৈয়দপুর, যশোর, রাজশাহী ও কুমিল্লার শহরাঞ্চলে। অন্যদিকে মুক্তিফৌজের আওতায়ঃ ময়মনসিংহ জেলা পুরোপুরি, রংপুর, দিনাজপুর, রাজশাহীর অধিকাংশ। ঢাকা, কুমিল্লা ও চট্টগ্রামের শহর এলাকার বাইরে সর্বত্র। যশোর, কুষ্টিয়া ও খুলনা জেলার পশ্চিমবঙ্গ-সীমান্তবর্তী এলাকা।

       মঙ্গল ও বুধবার-দু’দিন ধরে জঙ্গীশাহী পশ্চিম পাকিস্তানে সিংহল ও চীনের মধ্যে দিয়ে বিমানে, জাহাজে প্রচুর সৈন্য, অস্ত্রশস্ত্র ও খাদ্যসামগ্রী আমদানী করেছে।

       বিভিন্ন রণাঙ্গনে সংগ্রামরত মুক্তিফৌজের ইউনিটগুলিকে একই কমান্ডের অধীনে আনা এবং পরস্পরের মধ্যে সংযোগ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলছে।

       সরাদিন ধরে মুক্তিফৌজ ও পাক-দখলদার বাহিনীর মধ্যে প্রচণ্ড লড়াই হয়েছে ঢাকা, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও খুলনায়। ক্যান্টনমেন্ট ও বিমানঘাঁটি বাদ দিয়ে যশোরের সর্বত্র মুক্তিফৌজের অভিপত্য অক্ষুন্ন। মুক্তিফৌজের আক্রমণে পিছু হটার আগে যশোর শহরে পাক-বাহিনী আগুন লাগিয়ে দে। ক্যান্টনমেন্ট-এর পাক-সেনাদের আজ বিমান থেকে অস্ত্রশস্ত্র ও খাদ্যসামগ্রী পাঠানো হয়েছে।

       কুমিল্লায় প্রচণ্ড গোলাগুলি বর্ষণ করেও মুক্তিফৌজকে কাবু করতে পারেনি। মেঘালয়ের সমীপবর্তী শ্রীহট্ট শহরেও পাক-সেনারা আজও প্রচণ্ড দাপটে আক্রমণ চালায়। এখানে পূর্ব পাক রাইফেল বাহিনী মুক্তিফৌজের সঙ্গে হাত মিলিয়ে প্রতিরোধের দুর্ভেদ্য দুর্গ গড়ে তুলেছে।

       রংপুর ক্যান্টনমেন্টের মুক্তিফৌজের অধিপত্য অক্ষুণ্ন। খাদিমনগরে পূর্ব পাক রাইফেলস এর ৬০০ জনকে শ্রম-শিবিরে আটক রাখা হয়েছে। আসাম থেকে পাওয়া খবরে প্রকাশ, রাজশাহী ও নবাবগঞ্জে প্রচণ্ড গোলাবর্ষণের ফলে মুক্তিফৌজের সহায়ক পুলিশ বাহিনীর ক্ষতি হয়েছে। প্রায় ৭০ জন পুলিশ অফিসার নিহত হয়েছেন বলে খবরে প্রকাশ। চট্টগ্রামে পূর্ব পাক রাইফেল-এর সদর দফতরটি পাক-সৈন্যরা দখল করে নিয়েছে।

-আনন্দবাজার পত্রিকা, ২ এপ্রিল, ১৯৭১

মুক্তিযোদ্ধারা যশোর দখল করেছে

(নিজস্ব সংবাদদাতা)

       বনগাঁ, ১লা এপ্রিল আর বেলা ২টার পরেই বাংলাদেশের মুক্তিফৌজ সমগ্র যশোর দখল করে নিয়েছে। পাক-সেনাবাহিনী শহরের তিন মাইল দূরে ক্যান্টনমেন্টের মধ্যে আশ্রয় নিয়েছে।

       বিশেষ নির্ভরযোগ্য সূত্রে আজ সন্ধায় এখানে ঐ খবর পাওয়া গেছে। প্রকাশ যে, সকালে মুক্তিফৌজ যশোর সেন্ট্রাল জেলে গেট খুলে ১০০০ বন্দীকে মুক্ত করে দেয়।

       আজ বনগাঁ স্টেশনে সাদা পোশাকে একজন পাকিস্তানী পাঞ্জাবী সৈন্য জনতার হাতে ধরা পড়ে। তাকে জেল হাজতে রাখা হয়েছে। ঐ সৈনিকটি নাকি বলেছে যে, খুলনায় অবস্থিত সেনাবাহিনীর সঙ্গে যশোর ক্যান্টনমেন্টের যোগাযোগ বিছিন্ন হয়ে গেছে। খুলনা থেকে বারবার সাহায্য চেয়ে যশোর থেকে কোন সাড়া পাওয়া যায়নি। তখন তাড়া ঢাকা সঙ্গে যোগাযোগ করলে ঢাকা থেকে নাকি তাদের বলা হয়েছে, যে যেভাবে পার, প্রাণ বাঁচাও। ঐ নির্দেশ পাবার পর সৈনিকটি সাদা পোশাকে কোনমতে বনগাঁয় এসেছে।

-যুগান্তর, ২ এপ্রিল, ১৯৭১

বাংলাদেশের পশ্চিম ও উত্তর এলাকা মুক্তিফৌজের দখলে

       ঢাকা, কুমিল্লা প্রভৃতি জেলা শহরগুলির ক্যান্টনমেন্ট এলাকা ও বঙ্গপসাগরের উপকুলবর্তী সামরিক ঘাঁটিগুলি ছাড়া বাংলাদেশেল সব এলাকা পাক সামরিক শাসনের হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রাম, শহর ও জনদে উড়ছে স্বাধীন বাংলার জয় পতাকা। দলে দলে পাঠান সৈন্য আত্নসমর্পন করেছে, অনেকে মুক্তিসেনাদের তাড়া খেয়ে শূণ্য হাতে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে আত্মসমর্পন করেছে।

কুষ্টিয়া, যশোর, পাবনা, রংপুর, রাজশাহী, দিনাজপুর একে একে মুক্তিফৌজের দখলে চলে আসছে। তবে জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে পাকফৌজের আক্রমণ বন্ধ হয়নি এবং ঐ আক্রমণের মোকাবিলা করার জন্য স্বাধীন বাঙলা সরকার সারা বিশ্বের স্বাধীনতাপ্রিয় দেশ ও জাতিগুলির কাছে প্রয়োজনীয় সাহায্যের আবেদন জানিয়েছে।

       সীমান্ত শহর হাসনাবাদ থেকে ইউ-এন-আই জানাচ্ছেন, গত রাত্রে যশোর জেলার মাগুরায় প্রায় ৩৫০ জন পাক-সৈন্য বিনা যুদ্ধে বাংলাদেশের মুক্তিফৌজের নিকট আত্মসমর্পণ করেছে।

       সৈন্য দলটি ১৩টি গাড়ী যোগে যশোর অভিমুখে যাওয়া সময় মুক্তিফৌজের বহু লোক ও আওয়ামী লীগের কয়েক হাজার স্বেচ্ছাসেবক তাদের ঘিরে ধরে।

       চারদিন তীব্র যুদ্ধ চলার পর গতকাল পাক-সৈন্যদল ক্যান্টনমেন্টে পশ্চাদপসরণে বাধ্য হলে যশোর শহর মুক্তিযোদ্ধাদের করতলগত হয়।

       কৃষ্ণনগর (নদীয়া) থেকে প্রাপ্ত এক খবরে প্রকাশ, রাজশাহীতে এখনও যুদ্ধ চলছে। এখানে দুইজন মেজর সহ অন্তত একশ পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয়েছে। প্রকাশ, এই এলাকায় মুক্তিফৌজের পরিচালনা করছেন বেঙ্গল রেজিমেন্টর একজন কর্ণেল। জানা গেছে, তারা শতাধিক রাইফেল শত্রুদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে।

       রাজশাহী ও লালমনিরহাটে এখন তীব্র লড়াই চলছে। গত কয়েকদিন ধরে এই দুইটি অঞ্চল পাক সৈন্যদের দখলে আছে।

       এক সূত্রে জানা গেছে, পশ্চিম পাকিস্তান রেজিমেন্টর অধিকাংশ সৈন্যই প্রচণ্ড যুদ্ধের পর মুক্তিফৌজের কাছে আত্নসমর্পণ করেছে।

       আবার বোমাবর্ষণঃ মুক্তিফৌজের করতলগত ছোট ছোট শহরগুলি পূনর্দখলের জন্য পাক-সৈন্যরা তৎপর হয়ে উঠেছে। আজ বিকেলে পাক বিমান বাহিনী আবার বাংলাদেশের কয়েক স্থানে বোমা বর্ষণ করেছে। এইসব স্থানের নাম পাবনা, বগুড়া ও দিনাজপুর।

       সীমান্ত অঞ্চল থেকৈ এখানে প্রাপ্ত প্রকাশ, পাকিস্তানী বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত বরারবর মোতায়েনের জন্য পূর্ব পাকিস্তান থেকে বিমানযোগে আধা-সামরিক বাহিনী (সীমান্ত স্কাউট ও সেঞ্জার্স) আমদানী করেছে। মুক্তিফৌজ গেরিলা যুদ্ধের কৌশল অবলস্মন করায় পাকিস্তানী তাদের মোকাবিলা করার জন্য প্রচুর গেরিলা ট্রেনিংপ্রাপ্ত সৈন্য আমদানীর কথা বিবেচনা করছে।

       পাক-সৈন্যদের আত্মসমর্পণঃ রায়গঞ্জ (পঃ দিনাজপুর), ২রা এপ্রিল-সীমান্তের অপর পার থেকৈ গতকাল নির্ভরযোগ্য সূত্রে এখানে প্রাপ্ত এক খবরে প্রকাশ, বাংলাদেশের মু্ক্তিযোদ্ধারা এখন দিনাজপুর, রংপুর, বগুলা, কুষ্টিয়া, ময়মনসিংহ ও শ্রীহট্ট সম্পূর্ণভাবে নিজ দখলে রেখে। ঐসব স্থানে পাক-সৈন্যরা বিনাশর্তে অত্নসমর্পণ করেছে এবং ঢাকা ও রাজশাহীতে এখনও তীব্র যুদ্ধ চলছে বলে ঐ সূত্র থেকে বলা হয়েছে।

       পশ্চিম দিনাজপুরের বালুরঘাট থেকে গতকাল প্রাপ্ত এক সংবাদে প্রকাশ, পাক-সৈন্যরা ৩১শে মার্চ সন্ধায় দিনাজপুর শহরে নিউ টাউন ও রাজবাড়ীতে পরাজিত হয়েছে। দিনাজপুর ও ফুলবারায় সৈয়দপুর থেকে যে সমস্ত পাক-সৈন্য এসেছি, তারা হয় নিহত নয়তো বন্দী হয়েছে। রাজশাহী জেলায় চাপাইনবাবগঞ্জে যেসন সৈন্য পাঠানো হয়েছিল, তারাও মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত নয়তো বন্দী হয়েছে। সংবাদে বলা হয়েছে যে, শ্রীহট্ট শহরে প্রচণ্ড লড়াই চলছে এবং পাক সৈন্যরা সেখানে আত্নসমর্পণ করছে।

       মৌলভীবাজারে ১৪০ জন পাক সৈন্য নিহতঃ আগরতলা থেকৈ প্রাপ্ত খবরে বলা হয়েছে যে, শ্রীহট্ট জেলার মহকুমা সদর মৌলভীবাজারে যুদ্ধ চলছে এবং এখানে ১৪০ জন পাক-সৈন্য নিহত হয়েছে। শহরটি এখও মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আছে। সংবাদে বলা হয়েছে যে, শ্রীহট্ট অবরুদ্ধ পাক-সৈন্যদের সাহায্য আরও সৈন্য প্রেরণের চেষ্টা চলছে। সৈন্যরা চরম খাদ্য সংকটে পড়েছে।

       রংপুরে তুমুল লড়াইঃ শিলিগুড়ি, ৩রা এপ্রিল-সৈয়দপুর, পার্বতীপুর ও রংপুর পাক-সৈন্য ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে লড়াই চলছে। সৈয়দপুর থেকে দিনাজপুর এই ২৪ মাইল এলাকায় অসংখ্য মৃতদেহ পড়ে আছে। রংপুরের পাঁচ মাইলের মধ্যে কোন জনবসতি আছে বলে মনে হয়না। মুক্তিযোদ্ধারা এদিন একশো পাকসেনাকে খতম করে দিয়েছে। ক্যাপ্টন নওয়াজেশের নেতৃত্বে ওরা লড়াই করছেন। এখানে ইস্ট বেঙ্গল রাইফেলসের এক হাজার নতুন লোক এসে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে।

       কয়েদী মুক্তিঃ মুক্তিযোদ্ধারা দিনাজপুর জেলাটি মুক্ত করে দিয়েছে। এখানকার কয়েদীরা বেরিয়ে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগ দেয়। এদের মধ্যে দুজন ভারতীয় ছিল। এরা ভারতে পালিয়ে এসেছে বলে জনরব।

-আনন্দবাজার পত্রিকা, ৪এপ্রিল, ১৯৭১

উত্তরাঞ্চলের চারটি জেলা মুক্তিফৌজের দখলে

       দিনাজপুর, রংপুর, ময়মনসিংহ ও শ্রীহট্ট- বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের এই চারটি জেলা সম্পূর্ণরূপে মুক্তিফৌজের দখলে এসছে বলে সীমান্তের ওপার থেকে শিলং এ কাল খবর পৌঁছেছে। এই জেলাগুলোতে পাকিস্তানী সৈন্য সম্পূর্ণরূপে ক্যান্টনমেন্ট এলাকার মধ্যে আটকা পড়েছে।

       এদিকে পাকিস্তানী সৈন্যরা চালনা থেকে খুলনা শহর পর্যন্ত মধুমতি নদীর দুতীরে গানবোট থেকে গোলা ছুঁড়ে নির্বিচারে গ্রামবাসীদের হত্যা করছে। সরবরাহ পথ যাতে বন্ধ না হয়ে যায় সেই জন্যই এই মরণপণ চেষ্টা। বোমা বর্ষণে বহু লোক নিহত হয়েছে।

পাক বিমান ধ্বংসঃ পাক বিমান বাহিনী বগুড়া ও শ্রীহট্ট থেকে মুক্তিফৌজকে হটিয়ে দেওয়ার জন্য কাল বোমা বর্ষণ করে। সোমবার রাত্রে রাজশাহীতে মুক্তিযোদ্ধারা একটি স্যাবারজেট বিমান ধ্বংস করে। এই বিমানটি একটি খাদ্যবাহী হেলিকপ্টারকে পাহারা দিয়ে যাচ্ছিল।

       যশোর শহরেও তুমুল সংঘর্ষ হচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধাদের হাত থেকে শহরটি পুনর্দখলের পর শহরটি যাতে আবার হাতছাড়া না হয় তার জন্য পাক সৈন্যরা প্রাণপণ টেষ্টা করছে। এখনও হাজার হাজার স্বাধীনতা সংগ্রামী যশোর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করে রয়েছে।

       পাকিস্তানী বিমান বাহিনী কাল ময়মনসিংহ, নারায়নগঞ্জ, বগুড়া এবং রাজশাহীতে ব্যাপকভাবে বোমাবর্ষণ করে। প্রায় একপক্ষকালীন যুদ্ধের সর্বশেষে যে সংবাদ পাওয়া গেছে তাতে বলা হয়েছে যে, স্থলপথে যাতায়াতের সমস্ত সংযোগস্থান মুক্তিফৌজের দখলে রয়েছে। ঢাকা, কুমিল্লা, যশোর, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, রংপুর, সৈয়দপুর, শ্রীহট্ট ও খুলনায় অবস্থিত পাক সৈন্যরা আত্নরক্ষার যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে। এক ডিভিশনেরও বেশী সৈন্য ঢাকায় নিযুক্ত করা হয়েছে এবং অবশিষ্টদের কুমিল্লা এবং যশোরের ক্যান্টনমেন্ট শহরে হয়েছে। সংবাদে প্রকাশ, যশোর, কুমিল্লা এবং ঢাকার সামরিক ঘাঁটিগুলি ছাড়া অবশিষ্ট এলাকাগুলি দখলে, নয়তো সেগুলিকে অব্যবহার্য করে দেওয়া হয়েছে।

       পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলার সন্নিকটে রংপুরে এবং সৈয়দপুরে আজও প্রচণ্ড লড়াই চলছ্ রাজশাহীতে পাক সৈন্য মুক্তিফ্যেজের দ্বারা বেষ্টিত হয়ে পড়েছে। আরো সৈন্য ও রসদ আমদানীতে মুক্তিফৌজ বাধা সৃষ্টি করছে।

       সমগ্র খুলনা জেলা মুক্তঃ খুলনা শহর এবং ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় পাক সৈন্যর ওপর মুক্তিফৌজ প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করেছে। জেলার অন্যান্য সমস্ত অঞ্চলই এখন মুক্ত। মুক্তিফৌজ যশোর এবং খুলনার মধ্যে সংযোগ রক্ষাকারী রাস্তাটি নষ্ট করে দেওয়ার প্রায় এক ব্রিগেড পাকিতস্তানী সৈন্য বেষ্টিত হয়ে পড়েছে।

       কুষ্টিয়া ও ময়মনসিংহ মু্ক্তঃ সংবাদের প্রকাশ, কুষ্টিয়া ও ময়মনসিংহ সম্পূর্ণ মুক্ত করা হয়েছে। পল্লী অঞ্চল মুক্তিফৌজের সম্পূর্ণ দখলে রয়েছে। শ্রীহট্ট ও কুমিল্লা শহরে প্রচণ্ড লড়াই চলছে।

-যুগান্তর, ৫ এপ্রিল, ১৯৭১

       বাংলাদেশ-পূর্ব রণাঙ্গলঃ পূর্ব রণাঙ্গনে মুক্তিফৌজ ৪৮০ কিঃ মিঃ দীর্ঘ ঢাকা-শ্রীহট্ট রেলপথটি নানা জায়গায় বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। ফলে শ্রীহট্ট শহরে অবরুদ্ধ পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর কাছে ঢাকা থেকে অস্তশস্ত্র ও রসদ পাঠানো অসম্ভব করে তুলেছে। সোমবার শ্রীহট্ট খন্ডে জোর লড়াই চলেছে।

       মুক্তিফৌজ প্রচণ্ড লড়াই চালিয়ে শ্রীহট্টের শালুটিকর বিমাক্ষেত্রটি দখল করেছে। ময়মনসিংহ মুক্তিফৌজের হাতে। সংলগ্ন নতুন জেলা টাঙ্গাইলের অবস্থাও তাই। মুক্তিফৌজ কুমিল্লা শহরও দখল করেছে। পাক ফৌজ শহর ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছে ময়নামতী ক্যান্টনমেন্টে।

       বাংলাদেশ-পশ্চিম রণাঙ্গণঃ পশ্চিম রণাঙ্গনের কুষ্টিয়ায় সোমবার প্রচণ্ড লড়াই চলছ্ যশোরের চাচড়ার মোড় পুনর্দখলের জন্য জোর লড়াই শুরু হতে চলেছে। খুলনায়ও চলছে উভয়পক্ষে মরণপণ সংগ্রাম।

       বাংলাদেশ-উত্তর রণাঙ্গণঃ সোমবার উত্তর রণাঙ্গনে মুক্তিফৌজ একটি সাফল্য অর্জন করেছে-তারা হানাদার বাহিনী হাতে রংপুর শহরটি ছিনিয়ে নিয়েছে, তিস্তা সেতু উড়িয়ে দিয়েছে, লালমনিহাট বিমানক্ষেত্র অকেজো করে দিয়েছে। সামরিক দিক থেকে এ সাফল্যের তুলনা নেই। মুক্তিফৌজ তিস্তা সেতু উড়িয়ে দিয়ে স্থলপথে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর পশ্চাদপসরণের শেষ পথটি ছিন্ন করে দিয়েছে। দিনাজপুর শহর আগেই মুক্ত হয়েছে। রাজশাহীতও জোর লড়াই চরছে। মুক্তিফৌজের সাঁড়াশি আক্রমণে হানাদাররা কোণঠাসা। বগুড়া ও পাবনা জেলার মুক্তি সংবাদ শেষ রাত্রে এসেছে।

       বাংলাদেশ-দক্ষিণ রণাঙ্গণঃ দক্ষিণ রণাঙ্গণে চট্টগ্রামে আবার প্রচণ্ড লড়াই শুরু হয়েছে হানাদার ও মুক্তিফৌজে। পাক বিমান বোমা ফেলছে চট্টগ্রাম শহরে। নোয়াখালী জেলার নানা অঞ্চলেও উভয় পক্ষ মুখোমুখি। বরিশাল জেলায় লড়াই হঠাৎ প্রচণ্ড আকার ধারণ করেছে।

       পূর্বাঞ্জল রণাঙ্গলঃ আগতলা, ৫ এপ্রিল-বড় বড় শহরের নির্দিষ্ট কয়েকটি এলাকা ছাড়া বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চল এবং মুক্তাঞ্চল। বেঙ্গল রেজিমেন্টের তিনজন মেজর সম্মিলিতভাবে এই মুক্তঞ্চলের প্রশাসন ভার গ্রহণ করেছেন। তাদের সাহায্য করছে অসামরিক অফিসার ও আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাসেবকরা। মুক্তঞ্চলের শ্রীহট্ট এলাকার অধিনায়ক মেজর খালেদ মোশাররফ, ময়মনসিংহ এলাকা মেজর শফিউল্লাহ ও চট্টগ্রামে এলাকার মেজর জিয়াউর রহমান।

       দিন কয়েক আগে মেজর জিয়াউরই স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে অস্থায়ী সরকার প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করেছিলেন। তখন তিনি নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন মেজর জিয়া বলে।

       গত শনিবার শ্রীহট্ট এলাকার কোন এক স্থানে মেজর মোশাররফের সদর দফতরে তিন মেজর এক বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠকে স্থির হয়ঃ যতদিন না জাতীয় পরিষদের অভিবেশন বসে এই ত্রয়ীই সেনাবাহিনী পরিচালনা করবেন।

       শ্রীহট্ট খন্ডের অধিনায়ক মেজর মোশাররফ ইউ এন আইয়ের প্রতিনিধিকে বলেনঃ স্বাধীনতা ঘোষণার সময় মুক্তিফৌজে পুরোদস্তর সৈন্যের সংখ্যা ছিল হাজার কয়েক মাত্র। এখন তা বহুগুণে বেড়ে গিয়েছে। তা ছাড়া আওয়ামী লীগের হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবকে নিয়মিতভাবে সামরিক তালিম দেওয়া হচ্ছে।

       মুক্তিফৌজের রণনীতি প্রসঙ্গে মেজর বলেন, মুক্তিসেনাদের সংঘবদ্ধ করা ও তাদের মধ্যে সংহতি গড়ে তোলাই এখন সবচেয়ে জরুরী। শক্রপক্ষের শক্তি কোন এলাকায় কি রকম সে-সকল খোজখবর নেওয়ার পর হানা হবে আঘাত। মেজর মোশাররফ জানান, বিভিন্ন জায়গায় লড়াই করা মুক্তিফৌজ হানাদারদের কাছ থেকে বহু অস্ত্রশস্ত্র ছিনিয়ে নিয়েছে। আরও অস্ত্রশস্ত্র দখল ও অস্ত্রাগারগুলির উপর আক্রমণ চালাবার জন্য গেরিলা বাহিনী গঠন করা হবে।

সমুদ্রবক্ষে পাক সাবমেরিনের বাঙালি নাবিকদের বিদ্রোহ

       তউলন (ফ্রান্স), ৫ এপ্রিল-পাকিস্তানী সাবমেরিন ‘মনগ্রো’র বাঙালি নাবিকরা ‘বিদ্রোহ’ করেছিলেন বলে জানা যায়। কিন্তু তৎপরতার সঙ্গে তা দমন করা হয়। ৪৫ জন নাবিকের মধ্যে ১৩ জনকে ফেলে রেখে সাবমেরিনটি এখান থেকে যাত্রা করে। সাবমেরিনটি এখান থেকে করাচির উদ্দেম্যে যাচ্ছিল। বাঙালি নাবিকরা সেটি থামাবার চেষ্টা করে।

       ১৩ জন নাবিক সুইজারল্যান্ডের দিকে যাত্রা করেছেন বলে জানা গিয়েছে। বন্দর কর্তৃপক্ষ সাবমেরিনের ঘটনা সম্পর্কে কিছু বলতে অস্বীকার করেন। তবে মনগ্রোর আশেপাশে জাহাজগুলির নাবিকেরা তাতে মহুর্মুহ চিৎকার শুনতে পান। মনগ্রো’র নিকটবর্তী দক্ষিণ আফ্রিকার একটি সাবমেরিনের একজন অফিসার বলেন, আমি মনে করেছিলাম, বুঝবার রাতে তারা পরস্পরের গলা কাটছিল।

-আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ এপ্রিল, ১৯৭১

গুরুত্বপূর্ণ রেলশহর পাবর্তীপুর মুক্ত

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

       ৬ এপ্রিল-উত্তরখন্ডের গুরুত্বপূর্ণ রেলশহর পাবর্তীপুরে আজ স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়ল। আজ ভোর না হতেই মুক্তিফৌজের পাবর্তীপুর অভিযান শুরু হয়েছি। দু হাজারের মত মুক্তিফৌজ বীরবিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়লেন পাবর্তীপুরের ওপর। অবশেষে ছিনিয়ে নিয়ে এলেন শত্রু হাত থেকে। পাবর্তীপুর আজ স্বাধীন, শক্রুমুক্ত।

       পাবর্তীপুর দখলের আগে এই শহরের দুমাইল দূরে স্থানীয় আওয়ামী লীগ অফিসে বসে মাঝে মাঝেই গুলির শব্দ শুনছিলাম। বেলা তিনটায় আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ আনোয়ার তখন দুটি ষ্টেনগান দেখিয়ে বলেন যে, ওই দুটি তারা পাকিস্তানী সৈন্যদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছেন। আলোচনার কিছু পরেই পাবর্তীপুর থেকে জয়ের খবর আসে। মুক্তিফৌজের মেজর মনসুন আলি ছুটে এসে ওই খবর দেন। আওয়ামী লীগের আর একজন নেতা এম এ কুদ্দুসকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘পাবর্তীপুর দখল’- একথা বলছেন কেন? তিনি বললেন, এই গুরুত্বপূর্ণ জায়গাটি দখলের জন্য গত রাত্রি থেকে পাক সেনারা চেষ্টা করছিল। তারা এই শহর দখলের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে।

       বিকেলে দিনাজপুরে ও বগুলা থেকেও মুক্তিফৌজের জয়ের খবর আসে। ওই দুই স্থানে পাক সৈন্য-বাহিনী প্রচণ্ড বোমা বর্ষণ করে।

       আরও খবরঃ রাজশাহী, ফরিদপুরের যে ক’টি জায়গা পাক সেনারা দখল করে রেখেছে মুক্তিফৌজ তাও দখলের টেষ্টা করছেন। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে জানানো হল যে, রাজশাহী, বগুড়া, দিনাজপুর ও পাবনার অধিকাংশ অঞ্চল মুক্তিফৌজের দখলেই।

পূর্ব রণাঙ্গনের খবর

 

       চট্রগ্রাম জলধার ক্ষতিগ্রস্তঃ আগরতলা, ৬ এপ্রিল-সীমান্তের ওপার থেকে নির্ভরযোগ্য সূত্রে খবর এসেছে, তিন দিন আগে মুক্তিফৌজ চট্টগ্রাম শহরের পশ্চিমাংশে কোর্ট এলাকায় অবস্থিত ওয়াটার ওয়ার্কস এর জলাধার ও পাওয়ার হাউস ক্ষতিগ্রস্ত করে দিয়েছেন। এই এলাকায় পাক বাহিনী দিনরাত্র ঘাঁটি আগলাচ্ছিল।

       চট্টগ্রাম শহরের ডাকঘর ও বিমানবন্দর এলাকা সম্পূর্ণরূপে পাক দখলদারদের হাতে। বন্দর এলাকা পরিত্যক্ত জনমানবশূণ্য।

       সারা নোয়াখালী জেলা, নোয়াখালীর লগোয়া কুমিল্লার কিছু অংশ এবং চট্টগ্রাম জেলা এখন সম্পূর্ণভাবে পাক সৈন্য মুক্ত। এসব মুক্তঞ্চলে বাংলাদেশ সরকারের অধীনে অসামরিক প্রশাসন ফিরে আসছে।

       আবার স্বাধীন বাংলা বেতারঃ “স্বাধীন বাংলা বেতার” কেন্দ্র আবার ফিরে এসেছে। মঙ্গলবার শর্ট ওয়েভে এর অনুষ্ঠান শুরু হয়। তবে ঘোষণাগুলি একরকমই শোনাই যায়নি। আগে এই কেন্দ্রটি ছিল চট্টগ্রামের কাছে, পরে পাক ফৌজ-এর তোপের মুখে উড়ে যায়। নতুন জীবন ফিরে পেয়ে স্বাধীন কেন্দ্রটি ঘোষণা করেছে দুএক দিনের মধ্যেই মিডিয়াম ওয়েভ-এ অনুষ্ঠান প্রচারিত হবে।

       সোমবার শিলং- এর সন্ধ্যা ছয়টায় ৮১ থেকে ৮২ মিটারে (শর্ট ওয়েভ) অনুষ্ঠান শোনা যায়। প্রচারিত গানগুলির মধ্যে “আমার সোনার বাংলা” তো ছিলই, উপরন্তু দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের “ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা” গানটি শোনা যায়।

       এই বেতার বাংলাদেশের মানুষকে মুক্তির জন্য এবং জয়ের প্রার্থনা করতে আহবান জানিয়েছে। ধিক্কার দিয়েছে বিশ্বাসঘাতক জঙ্গী স্বৈরতন্ত্রকে-যারা দেশব্যাপী রক্তস্রোতের জন্য দায়ী। আর শেষে সাড়ে কোটি মানুষের হয়ে সমস্ত বিশ্বের শুভেচ্ছা ও সহানুভূতির জন্য আবেদন জানিয়েছে।

-আনন্দবাজার পত্রিকা, ৭ এপ্রিল, ১৯৭১

সোমবার জয়-বাংলার জয়ের পালা

       রংপুর, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ মুক্ত, তিস্তা সেতু ধ্বংসঃ সোমবার জয় বাংলার শুধু জয়ের মালা, একটার পর একটা জয়ের পালা জয় রংপুর শহর-অধিকৃত। জয় কুমিল্লা শহরেও-মুক্ত। শ্রীহট্টের বিমানক্ষেত্রেও মুক্তিফৌজের করারত্ত। ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল ও ফরিদপুরে মুজিব সেনারই জয়জয়কার। সংগ্রামী সেনারই দিন এই প্রথম সব রণাঙ্গন মিলিয়ে একটি যুক্ত কমাণ্ড গড়ে তোলার পথে পা বাড়ান। এই উদ্যোগ হানাদার হটানোর লড়াইয়ে শেষ রাউন্ডের প্রস্ততি।

       মুক্তিফৌজ হানাদারের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া সাঁজোয়া গাড়ি, মেশিনগান ও অন্যান্য ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে নরসিংদী (ঢাকা থেকে ১৪ কি.মি) অভিযানে এগিয়ে চরেছেন। শ্রীহট্ট শহরের একাংশ এবং ছাউনি এলাকা বাদে পাবনা ও বগুড়ার প্রায় সব অঞ্চলই হানাদারমুক্ত।

       পাকফৌজ ও হানাদার বিমান বাহিনী তৎপরতা রোধের জন্য মুক্তিসেনারা পোড়ামাটি নীতি অনুসারে তিস্তা সেতু ধ্বংস করেছেন। অকেজো করে দিয়েছেন লালমনিরহাট বিমানক্ষেত্র, উড়িয়ে দিয়েছেন ঢাকা-শ্রীহট্ট রেলপথের (৪৮০ কিলোমিটার) বহু গুরুত্বপূর্ণ অংশ। অন্যদিকে পাকিস্তানী ফৌজ গর্তে তাড়া খাওয়া সাপের মত ছড়িয়ে পড়েছে রংপুর, দিনাজপুর, কুষ্টিয়া ও শ্রীহট্ট আর মার-খাওয়া সাপের মতই ছোবল মারছে যত্রতত্র, যা পাচ্ছে তাই ধ্বংস করছে কামান দিয়ে, মেশিনগান দিয়ে, পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে। অত্যাচার চালাচ্ছে বিশেষ করে নারীদের ওপর।

       রংপুরে পাকিস্তানীদের সঙ্গে মুক্তিফৌজের দরুন লড়াই হয়েছে। দুপক্ষের হতাহতের সংখ্যা প্রচুর। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মুক্তিফৌজই জয়ী। দখলদারদের হাত থেকে তাঁরা রংপুর শহর পুনর্দখল করেছেন। রংপুর শহরের কাছেই তিস্তা-সেতু মুক্তিফৌজ সেটি ধ্বংস করে দিয়েছেন। লালমনিরহাট বিমানক্ষেত্রটিও তারা অকেজো করে দিয়েছেন। সেতুটি ধ্বংসের ফলে পাকিস্তানীর পালাবার পথ নেই। অন্য সমস্ত পথ মুক্তিফৌজ আগেই বন্ধ করে দিয়েছিলেন।

       শ্রীহট্টেও পাকফৌজের সরবরাহের পথগুলি একে একে নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। সেখানেও তারা প্রচণ্ড অসুবিধার সম্মুখীন। সর্বত্রই মুক্তিফৌজ দখলদারদের চেয়ে সংখ্যার অনেক বেশী। ঢাকা-শ্রীহট্ট রেলপথ এখন ব্যবহারের অযোগ্য। শ্রীহট্টের শালুটিকর বিমানক্ষেত্রটি মুক্তিফৌজ প্রচণ্ড লড়াইয়ের পর দখল করে নিয়েছেন। শ্রীহট্টের শহর ছাড়া ওই জেলার কোথাও পাকফৌজের কোন নিয়ত্রণ নেই। হরিপুর (ভারত সীমান্ত থেকে ২৯ কি.মি.) পাকিস্তান পেট্রোল লিঃ এর তৈলকেন্দ্রটি মুক্তিফৌজ শনিবার উড়িয়ে দিয়েছিল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে সেখানে আগুন জ্বলতে দেখা যায়।

       লালমনিরহাট পাকফৌজের দখলে আছে। পাক বিমান বাহিনীর মদতে তারা সেখানে আছে। আনন্দবাজারের সংবাদদাতা কোচবিহার থেকে জানিয়েছেন যে, পাকিস্তানীরা লালমনিরহাট প্রচণ্ড বোমাবর্ষণ করেছে। কোচবিহারে বাংলাদেশ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার উদ্বাস্তু এসেছেন। তারা সবাই মুসলমান।

     বাংলাদেশের তিন সেনাপতিঃ বাংলাদেশের পুর্বাঞ্চলের কিচু কিছু বিচ্ছিন্ন এলাকা ও শহর ছাড়া প্রায় সবটাই এখন মুক্তিফৌজের দখলে ও প্রশাসনে। এই প্রশাসনে তিনটি সেকটরের নেতৃত্ব করছেন তিনজন সেনাপতি। এরাই মিলিতভাবে মুক্তিফৌজের নিয়ন্ত্রণ করেছেন। আওয়ামী লীগের অনুগত অসামরিক অফিসার ও কর্মচারীরা এদের সঙ্গে সর্বতোভাবে সহযোগিতা করেছেন।

       এই তিন সেনাপতি হলেন-মেজর মুশাররফ (শ্রীহট্ট সেক্টর), মেজর সফিউল্লা (ময়মনসিংহ) ও মেজর জিয়াউর রহমান (চট্টগ্রাম)। জিয়াউরই মেজর জিয়া নামে অস্থায়ী সরকারের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করেছিলেন।

       গত শনিবার শ্রীহট্টের কোন এক জায়গায় মেজর মুশাররফের সদর দফতরে ওরা তিনজন মিলিত হয়েছিলেন এবং ঠিক করেছেন যে, যতদিন না জাতীয় পরিষদের বৈঠক বসে এবং জাতীয় সরকার গঠিত হয় ততদিন তারা মুক্তিফৌজ ও প্রশাসন পরিচালনা করবেন।

       মেজর মুশাররফ সাংবাদিকদের বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গা নিজে সঙ্গে থেকে দেখান এবং জানান যে, পাকিস্তানীদের সঙ্গে যুদ্ধে তারা প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র দখল করেছেন। মুক্তিফৌজ বাংলাদেশে কত জনপ্রিয়, সাংবাদিকেরা তা নিজেদের চোখেই দেখতে পান। বিভিন্ন জায়গায় মুক্তিফৌজের নতুন স্বেচ্ছাসেবকের সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে-তাও তাঁরা দেখান।

       যশোরে সংর্ঘষঃ যশোর শহরের সর্বত্র নিজেদের কর্তৃত্ব দাবির জন্য হানাদার বাহিনী সোমবার রাত্রে মুক্তিফৌজের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। যশোর-ঢাকা সড়ক ও যশোর-বেনাপোল সড়কে দোতলা তেতলা বাড়িগুলি দখল করে হানাদাররা মেশিনগান ও মর্টার থেকে গোলাবর্ষন করে চলেছে।

       যশোরের এই খবর ছাড়াও ইউ এন-আই-পি টি আই জানান যে, বাংলাদেশের মুক্তিফৌজ কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম শহরে পাকবাহিনীর উপর প্রচণ্ড আঘাত হেনেছেন। কুমিল্লা থেকে বহু হানাদার হটে গিয়ে এখন ময়নামতির ছাউনি এলাকায় আশ্রয় নিয়েছে। মুক্তিফৌজ আঘাত করেই সরে পড়ার নীতিকে আক্রমণ চালিয়েছিল।

       কলকাতার খবর পাওয়া যায়, চট্টগ্রাম,রংপুর ও খুলনার বেতার কেন্দ্রগুলি এখন মুক্তিফৌজের হাতে। তবে হানাদাররা যন্ত্রপাতি নষ্ট করে যাওয়ায় বোধহয় প্রচার বন্ধ আছে। বন্দরগুলি সম্পূর্ণ নিজেদের আয়ত্তে আনার জন্য মুক্তিফৌজ প্রস্তুত হচ্ছেন।

       মজুদ খাদ্য ফুরিয়ে আসছে বলে হানাদাররা এখন ভেঙ্গে পড়ছে। রংপুর এমনকি ঢাকাতেও পাকসেনারা সরবরাহের সংস্থানে খুবই বিপন্ন বোধ করছে। মৌলবীবাজার ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইষ্ট পাকিস্তান রাইফেল-এর সেনারা একটি কমান্ডের অধীনে নিজেদের নতুন করে সংগঠিত করে নিচ্ছে।

       হানাদাররা ঢাকা-কুমিল্লা এবং ঢাকা-শ্রীহট্টের মধ্যে সড়ক ও রেলসংযোগ খোলার জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে। কারণ, এর ফলে সেনা চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে। হানাদাররা দুএক জায়গায় সংযোগ পুনরায় চালু করলেও মুক্তিবাহিনী আবার অন্যত্র এই সংযোগ বিছিন্ন করে দিয়েছে। আতর্কিত আক্রমণে সমশেরণগরের কাছে মুক্তিফৌজ হানাদারদের বহু গাড়ি ও অস্ত্র দখল করে নিয়েছে। রাজশাহী থেকে ঢাকাগামী একটি হেলিকপ্টার মুক্তিসেনারা গুলি করে ফেলে দিয়েছেন।

       পাকফৌজ ট্রেনের উপর গেরিলা আক্রমণঃ মোগলহটা, রংপুর (বাংলাদেশ)-লালমনিরহাট থেকে মোগলহাটের দিকে একটি ফৌজী রেল-ইঞ্জিন এগোবার পথে মুক্তিফৌজের গেরিলাদের বোমার ঘায়ে জখম হয়ে ফিরে যায়। লালমনিরহাটকে চারদিক থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। লালমনিরহাট-রংপুর ক্যান্টনমেন্ট সড়ক সংযোগ বিচ্ছিন্ন। পাকমিলিটারী বোঝাই একটি ট্যাঙ্ক এই পথে এগোতে গিয়ে অবরোধের মুখে উল্টে যায়। ২০/২৫ জন ফৌজ আহত হয়েছে। রংপুরে কোনও বিমানবন্দর নেই, আছে শুধু হ্যালিপ্যাড ফলে আকাশপথে জঙ্গী-বাহিনী কোন সুবিধা করতে পারছে না। সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে। পশ্চিমী ফৌজ ক্যান্টনমেন্টে অবরুদ্ধ।

       আজও রংপুর ও লালমনিরহাটে মিলিটারী লুণ্ঠন ও হত্যা চালায় ব্যাপক। গত তিনদিনে ৪৭ বাঙালী বুদ্ধিজীবিকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। রংপুরের ডি সি সৈয়দ আমিজ আহাসান ও এস পি আর বারিককে আজ তাদের বাড়ি থেকে ফৌজ ক্যান্টনমেন্টে ধরে নিয়ে গিয়েছে। তাদেরও হত্যা করা হয়েছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

-আনন্দবাজার পত্রিকা, ৮ এপ্রিল, ১৯৭১

সংগ্রামের তৃতীয় সপ্তাহের সূচনায় পাকফৌজের পাল্টা অভিযান

তবু মুক্তিফৌজেরই প্রাধান্য

       সমগ্র উত্তরখণ্ড এবং পশ্চিমখন্ডেরও বৃহদংশ করায়ত্ত, মুক্তিবাহিনী এই দাবিপত্রটি হাতে নিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম তৃতীয় সপ্তাহে পাদর্পণ করল। কুমিল্লায় গুরুত্বপূর্ণ বিমাণঘাঁটিটি দখলের জন্য বৃহস্পতিবার রক্তক্ষয়ী লড়াই চলে। সর্বশেষ সংবাদ, এই এলাকায় মুক্তিফৌজের চতুর্থ বেংগল রেজিমেন্টরই প্রাধান্য। এই ক্যান্টনমেন্টটি এখন সম্ববত ফৌজে হাতে। ময়নামতী চাউনি এলাকায় ঢুলুপাড়া বিমান ক্ষেত্রটি কার্যত মুক্তিফৌজের নিয়ন্ত্রণে।

       কলকাতায় জলপাইগুড়ি থেকে প্রাপ্ত একটি প্রকাশ, উত্তরখন্ডে সৈয়দপুর মুজিব সেনার অধিকারে এসে গেছে। এই ছাউনিতে দুটি ট্যাংক অধিকুত, ২০০ দখলদার সেনা নিহত। কিন্তু ফৌজী গোলায় আর বোমায় চারপাশের গ্রামের প্রায় পাঁচ হাজার লোকের প্রাণ গেছে।

       আর একটি খবর-রাজশাহী শহরের পতন। শুধু শহর নয়, রাজশাহী সেনা ছাউনিও শক্রুমুক্ত যশোরে ফৌজী বাহিনী অবস্থা সঙ্গীন। মুক্তিবাহিনী লড়াই জোরদার করার তোড়জোড় করছে। এখানে পাকসেনার দল অবরুদ্ধ ছাউনি থেকে বেরিয়ে এসে মুক্তিফৌজের কাছে আত্নসমর্পণ করে বলে জানা যায়। সৈন্যরা বন্দী হয়, তাদের অস্ত্রশস্ত্র ও রসদ বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।

       এদিনের খবরের বিপরীতে চিত্রও আছে। দখলদার বাহিনী বসে নেই। স্থলে, জলে, অন্তরীক্ষে তাদের রনংদেহি মূতি দেখা গেছে। নতুন রণসম্ভার এবং মরাণাস্ত্রে বলীয়নে পিন্ডি ফৌজ শ্রীহট্ট, যশোর, কুষ্টিয়া এবং দিনাজপুর এলাকায় বহুমুখী অভিযান চালায়। একটি বাহিনী যশোর অঞ্চল থেকে এগিয়ে অগ্রসর হতে চেষ্ট করে চুয়াডাঙ্গা দিকে। আর একটি উত্তর থেকে নেমে আসে দিনাজপুর অভিমুখে, গোয়ালন্দঘাট থেকে তৃতীয় একটি সেনাদলকে কুষ্টিয়ার দিকে অগ্রসর হতে দেখা যায়। পদ্মা দিয়ে পিন্ডি ফৌজ গোয়ালন্দঘাটে নতুন সৈন্য আর সাজসরঞ্জাম নামাতে পেরেছে। লড়াই চলছে প্রচণ্ড, তবে হানাদার সেনাদল কোথাও বিশেষ সুবিধে করে উঠতে পারেনি। পাক বিমান বাহিনী এদিনও রাজশাহী, শ্রীহট্ট, নারায়নগঞ্জের বিস্তীর্ণ এলাকায় বোমাবর্ষণ করে। তারা চারদিন কামানের গোলা ছড়িয়ে গোয়ালন্দ রসদ নামায়। কিন্তু বাধা পায় প্রবল। মুক্তিফৌজ যেন অগণিত যোদ্ধা দিয়ে একটি দুর্ভেদ্য প্রাচীর রচনা করে রেখেছিল।

       দিনাজপুর শহরের দশ মাইল এ ভীষণ সংঘর্ষ চলছে-অন্তত সন্ধ্যাবেলা পর্যন্ত সংবাদ ছিল এই। পরে আরও খবরে জানা যায়। চিরিরবন্দর পোরের কাছে বাধা পেয়ে তারা পিছু হটে যায়। চুয়াডাঙ্গা এলাকাতেও সংগ্রাম তীব্র। শোনা গেছে শুধু কামানের আওয়াজ, দেখা গেছে খালি ধোঁয়ার কুণ্ডলি। ভারত সীমান্ত নিকটবর্তী এই অঞ্চলে মেজর এম এ ওসমানের নেতৃত্ব মুক্তিফৌজ বাংলাদেশের সম্মান বাঁচাতে মরণপণ সংগ্রামে লিপ্ত। চালনার খাল দিয়ে হানাদারদের রণতরী চালানোর চেষ্টা মুক্তিফৌজ এদিন বার বার ব্যার্থ করে দেয়। পশ্চিম পাকিস্তানীরা খুলনা আর যশোর শহরে খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। দুটি শহরই হাজার হাজার মুক্তিফৌজ বস্তুত ঘিরে রেখেছে। খুলনা এলাকার শিল্পাঞ্চল দখলের জন্য প্রবল সংগ্রাম চলেছে। এই অঞ্চলে মুক্তিফৌজের অধিনায়ক শেখ মুজিবের ছোট ভাই শেখ নাসিরুদ্দীন।

দূর্গ দখলের অভিযানে সেনাপতির সঙ্গী বেগম ওসমান

       যশোর, ৮ এপ্রিল-যশোর দুর্গ দখলের জন্য দশ হাজার মুক্তিযোদ্ধা দূর্গ দখলের জন্য দশ হাজার মুক্তিযোদ্ধা দূরবর্তী চারটি কোণ থেকে রণাঙ্গনের দিকে কদমে এগিয়ে চলেছে। বুঝবার শেষ রাতে তাঁদের এই অভিযান শুরু হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের এই বিশাল বাহিনীর অভিনায়ক মেজর ওসমান। পাশে থেকে শক্তি যোগাচ্ছেন সহঅধিনায়কা বেগম ওসমান। দুর্বার বেগে এগিয়ে চলা এই বাহিনীর মুখে ধ্বনিঃ চলো, চলো দূর্গে চলো।

       দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই দুর্গ দখলের জন্য মুক্তি সংগ্রামীদের প্রস্তুতি পুরোদমে এগিয়ে চলেছে। কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে রাস্তায় রাস্তায়। নিজেরা কারফু জারি করেছেন প্রয়োজনীয় এলাকায়। সন্দেহজনক ও অচেনা মুখ দেখলেই চ্যালেঞ্জ করা হচ্ছে। বাইরের কয়েকজন বেঈমান ধরা পড়ায় তাদের চরম শাস্তি দেওয়া হয়েছে। পরিখা খোঁড়া হয়েছে বিশেষ বিশেষ জায়গায়। বিবর ঘাঁটিও হচ্ছে অগ্রবর্তী অঞ্চলে। দুর্গের চারদিকে বেষ্টনী রচনা করে ওয়ারলেস সংযোগ ব্যবস্থাও গড়ে তোলা হয়েছে। নতুন রণকৌশলে শস্ত্রুবাহিনীকে শেষ আঘাত হানা জন্য সব ব্যবস্থাই পাকা। র্বাধিনায়কের নির্দেশ পাওয়া মাত্র ঝাটিকা গতিতে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য মুক্তি সোনারা এখন তৈয়ার।

       অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানী ফৌজের নাভিশ্বাস উঠেছে। মরণ কামড় দেওয়ার জন্য তারা দুর্গের আশপাশে চালাচ্ছে পোড়ামাটি নীতি। গ্রামের পর গ্রামে আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছে। এ দিন সকাল থেকেই দাউ দাউ করে ঘরবাড়ি পুড়তে দেখা যায়। চাঙ্গুটিয়া, আরিফপুর, পতেঙ্গালি প্রভৃতি এলাকা ধ্বংসস্তুপে পরিণত। এছাড়া গুদাম, দোকানপাট লুঠ করেছে মিলিটারী সমর্থক আর একদল পশ্চিমী ঠ্যাঙাড়ে দল। হত্যা, হামলায় বিতাড়িত হয়ে হাজার হাজার শরণার্থ ভারতে এসে আশ্রয় নিচ্ছেন। আরও বহু শরণার্থ ভারত প্রবেশের অপেক্ষায় রয়েছেন।

-আনন্দবাজার পত্রিকা, ৯ এপ্রিল, ১৯৭১

ঝিকড়গাছায় পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিফৌজের প্রচণ্ড লড়াই

       ঝিকড়গাছা রণাঙ্গন, (যশোর), ৯ই এপ্রিল-পাকিস্তানী বাহিনী আজ ঝিকড়গাছা পর্যন্ত রণক্ষেত্র বিস্তৃত করেছে। কামান ও ৬ ইঞ্চির মর্টার নিয়ে পাকিস্তানী সৈন্যরা আজ ভোরে মালঞ্চ গ্রামের উপর নতুন আক্রমণ চালানে মুক্তিফৌজ গ্রাম ছেড়ে আসতে বাধ্য হয়। গ্রামটি তারা ছেড়ে দিলেও তাদের মেশিনগানের গুলিতে প্রায় একশ’ পাকসৈন্য নিহত হয়েছে।

       মালঞ্চ গ্রাম ছেড়ে মুক্তিফৌজ এখন একদিকে যশোর রোডের উপর লাউজানি লেভেল ক্রসিং গেটে এবং অন্যদিকে ঝিকরগাছা বাজারের উত্তর দিকে কপোতাক্ষ নদের পূর্ব পাড়ে পাকিস্তানীর সঙ্গে ‘ব্যাক টু দি ওয়াল’ লড়াই আরম্ভ করেছে।

       সকালের দিকে পাকিস্তানী বাহিনী যখন যশোর রোড ধরে ঝিকরগাছার দিকে এগোচ্ছিল, সে সময় মুক্তিফৌজ লাউজার ক্রসিং গেট বরাবর মেশিনগান ও ৩ ইঞ্চির মেশিনগান মর্টার দিকে পাকবাহিনীর আক্রমণ রোধ করে। কিন্তু পাকবাহিনী তখন যশোর রোডের উপর তাদের একটি দল রেখে উত্তর দিকে চষা মাঠের মধ্য দিয়ে কাটাখাল পেরিয়ে ঝিকরগাছা বাজারের উপর মর্টারে গোলা ছুড়তে আরম্ভ করে।

 

পদ্মার তীরে নতুন যুদ্ধ ফ্রন্ট

       শুক্রবার ভোর থেকে পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনী বিভিন্ন দিক থেকে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে নতুন করে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর আক্রমণ হানবার চেষ্টা করছে। গতকাল রাত থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানী সেনা ঢাকা পশ্চিমাংশে পদ্মা তীরবর্তী আরিচাঘাট, শিবালয় প্রভৃতি স্থানে জমায়েত হয়। এ খবর বাংলাদেশের। দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের কমান্ডের মুক্তিফৌজ সদস্যরা ফরিদপুরের কাছে পদ্মার তীরে বাঙ্কার তৈরী করে সারারাত ধরে পাহারা দেয়। পাকিস্তানী সৈন্যদের জলপথে সেনা জমায়েত এই প্রথম হওয়ায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধে আরো একটি নতুন যুদ্ধফ্রন্ট পদ্মা নদীর উত্তর দিক বরাবর এবং দক্ষিণ তীরের কিছু অংশে গড়ে উঠলো।

       আজ সকালে পাকিস্তানী সৈন্যরা ঢাকা জেলার আরিচাঘাট ও শিবালয় থেকে গোয়ালন্দ ও নগরবাড়ীর দিকে নদী অতিক্রম করে বরবার যাবার চেষ্টা করে। নদী পারাপার কালে পাকিস্তানী সৈন্যদের সঙ্গে মুক্তিফৌজের দীর্ঘ লড়াই হয়। সারাদিক লড়াইয়ের পর পাকিস্তান সেনাবাহিনী যমুনা নদী পার হয়ে নগরবাড়ীতে নামতে সক্ষম হয়। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম কমান্ডের সদর দপ্ত চুয়াডাঙ্গায় রাতের দিকে খবর আসে গোয়ালন্দের তীর বরাবর ফরিদপুরের দিকে পাকিস্তানী সেনারা এগুতে থাকলে বাংকারের ভেতর থেকে মুক্তিফৌজ আপ্রাণ চেষ্টায় তাদের অগ্রগতিকে প্রতিহত করেন। নদী পারাপারের সময়ে পাকিস্তানী সৈন্যরা মর্টার ও বিমানের সাহায্য নেয়। কিন্তু এত চেষ্টা সত্ত্বেও তারা গোয়ালন্দের দিকে নামতে সক্ষম হয়নি।

-যুগান্তর, ১০ এপ্রিল, ১৯৭১

হৃত সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধারে মরিয়া পাক-বিমান

শহরে শহরে মুক্তিসেনার প্রতিরোধ

       অদম্য মুক্তিফৌজের প্রবল প্রতিরোধের ফলে পাক সেনাবাহিনী দিশেহারা। এখন বর্ষার আগে শেষ ভরসা শুধু আকাশ থেকে বোমাবর্ষণ। স্বাধীনতার যুদ্ধে বাংলোদেশের মুক্তিফৌজ যে সমস্ত এলাকা দখল করে নিয়েছিল। তার কিছু কিছু অংশ পুনর্দখলের মরীয়া চেষ্টায় এদিন পাকস্থলবাহিনীকে অবিরাম মদত দিয়েছে বিমানবাহিনী।

       মুক্ত শহর রাজশাহীতে শুক্রবার পর্যন্ত মোট গোলাবর্ষণ হয়েছে ১৫ বার। লক্ষ্যস্থল ঠিক না রেখে হানাদার বিমান এলোপাতাড়ি বোমা ফেলেছে রংপুর, শ্রীহট্ট, দিনাজপুর, ফেনী, হরিপুর, কুমিল্লা, কুষ্টিয়া এবং আরও কয়েকটি জায়গায়। তৎপর মুক্তিফৌজের তাঁরা বিশেষ ক্ষতি করতে পারেনি, তবে অসামরিক ব্যাক্তিদের মধ্যে নিহতদের সংখ্যা অনেক।

       ঢাকা থেকে শুরু হয়েছে দ্বিমুখী আক্রমণ। শহর থেকে ৫৬ কিলোমিটার দূরে মানিকগঞ্জের দিকে একটি সেনাদলকে অগ্রসর হতে দেখা গেছে। আর একটি সেনাদল ময়মনসিংহের দিকে। উদ্দেশ্য, নদীপথে পুরো দখল রাখা। টাঙ্গাইলের উত্তরে একটি সোনাদলকে আক্রমণ করেছে মুক্তিফৌজ। শেষ খবরে জানা যায়, সেখানে লড়াই চলছে তুমুল।

       পাবনায় আরেকটি বড় রকমের সংঘর্ষের খবর পাওয়া যায়। যমুনা পেরিয়ে পাবনা অভিমুখী একটি পাকসেনাদের গতি আটকে দিয়েছে মুক্তিবাহিনী। স্বাধীন বাংলা বাহিনীর দক্ষিণে-পশ্চিমে এলাকার পরামর্শদাতা ডঃ আশাবুল হক জানিয়েছেন যে, ঐ অঞ্চলে পাক স্থলবাহিনীকে সাহায্য করছে নৌজাহাজ ও বিমান-গোলাবর্ষণে, বোমাবর্ষণে। কিন্তু মুক্তিফৌজ অস্ত্রশক্তিতে হীনবল হয়েও হানাদারদের গতি রুদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছে।

       দিনাজপুরের প্রবল সংগ্রামের খবর আগে, এই শহরটি পুনর্দখল করার জন্য পাকফৌজ ট্যাংক আমদানী করেছে। রংপুরে অবশিষ্ট সৈন্যবাহিনীকে সম্পূর্ণ পর্যুদস্ত করার জন্য চতুর্দিক থেকে আক্রমন কুষ্টিয়ার জঙ্গলগাছিতে পাকফৌজ নতুন করে আক্রমণ চালিয়েছে।

       কুমিল্লাঃ বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব খন্ডে কুমিল্লা শহর ও ক্যান্টমেন্ট প্রচণ্ড লড়াই চলছে। বিমান বন্দরটি এখন হানাদারদের দখলে। ঢাকা থেকে তাই রোজ সৈন্য আসছে। আসছে খাবার-দাবার। কুমিল্লা থেকে পাকসৈন্য জাঙ্গালিয়া রোড ধরে চাঁদপুরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। হয়ত তারা নদী ধরে কুমিল্লা যাওয়ার পথটি আবার চালু করার জন্য নতুন করে চেষ্টা চালাবে।

       কুমিল্লা শহর থেকে কয়েক হাজার অধিবাসী পালিয়ে গিয়েছে। পাকসৈন্যরা অবাধ্য অধিবাসীদের শায়েস্ত করতে ওই অঞ্চলে আগুন জ্বালিয়েছে। সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গাজীপুর, বিবিরবাজার ও তরুনপুর।

-আনন্দবার পত্রিকা, ১০ এগ্রিল, ১৯৭১

কামানে বিমানে আগুয়ান হানাদার বাহিনী বনগাঁ সীমান্তের কাছাকাছি

       নাভারণ (যশোর), ১০ এপ্রিল-আজ ভোরের দিকে পাকিস্তানী ফৌজ যশোর দুর্গ থেকে বেরিয়ে সাঁজোয়া বাহিনী নিয়ে এগোয়। মুক্তিফৌজ তাদের প্রবল বাধা দেয়। হানাদাররা কামান, মেশিনগান, মর্টার নিয়ে আক্রমণ চালাতে থাকে। দু’খানা জঙ্গী বিমানও ছাতার মত তাদের উপর মাথার উপর দিয়ে পাহারা দিয়ে যায়। বোমাও ফেলে মুক্তিফৌজদের লক্ষ্য করে। মুক্তিসেনারাও তার পাল্টা প্রতিরোধ জোর করে। পাকসোনারা তখন গ্রামের পর গ্রামে আগুন লাগিয়ে দেয়। তাদের অত্যাচারে হাজার হাজার মানুষ আশ্রয়ের আশায় ছোটেন। দখলদার বাহিনী এরপর ঝিকরগাছা পর্যন্ত এগিয়ে কামান দাগতে থাকে। তারপর হানা দেয় সীমান্তের কাছাকাছি। আগের দিন সন্ধায় পাকিস্তানী সৈন্যরা পিছু হটে যাওয়ার পর মাঝে মাঝে গুলির আওয়াজ ছাড়া রাতে দুই তরফে সামনা-সামনি লড়াই হয়নি। মাত্র কয়েক ঘণ্টার যুদ্ধবিরতির পর আজ আবার রণাঙ্গণ মুখর হয়ে ওঠে। তখন জোর সাড়ে চারটা। কামান গর্জন করতে থাকে। মর্টারের গোলার ঘন ঘন আওয়াজ এপার থেকে স্পষ্ট শুনতে পাওয়া যায়। এরপর পাকিস্তানী সৈন্যরা তিনটি লাইনে ঝিকরগাছার দিকে এগোতে থাকে। মাঝের লাইন থাকে যশোর রোডে। আর বাঁ দিয়ে পাশের রেলপথ বেয়ে এবং ডানদিকে মাঠের মাঝ দিয়ে দুটি লাইনে হানাদাররা হামাগুড়ি দিয়ে এগোতে থাকে। পাকিস্তানী সোনাদের সারবদ্ধ এই অগ্রগতির আকার ইংরেজি ‘ভি’ এর মত।

 

দিনাজপুর শহরের কাছে প্রচন্ত লড়াই

       নগরবাড়ী (ঢাকা-পাবনা-বগুড়া রোড)-সন্ধার পর দিনাজপুর জেলার ফুলবাড়ি সামরিক বাহিনী দখল করে নিয়েছে। প্রচণ্ড লড়াই চলছে। পাক সামরিক বাহিনী ট্যাংকও ব্যবহার করছে। বহু লোক হতাহত হয়েছে। পাক সামরিক বাহিনী বিহারী মুসলমানদের রাইফেলস দিয়ে কাজে লাগাচ্ছে।

       দিনাজপুর শহরের তিন মাইল দূরে রাণীগঞ্জে পাক সামরিক বাহিনী এসে গিয়েছে। মুক্তিফৌজ প্রচণ্ড বাধা দিয়ে যাচ্ছে। শহরের দক্ষিণে আত্রাই নদী পার হয়ে এখন কাঞ্চন নদীর তীরে প্রচণ্ড যুদ্ধ চলছে। পাক বাহিনী তিনটি রেজিমেন্টই ব্যবহার করছে। গতকাল রাত্রে পাবনায় ছয় পাউণ্ড ওজনের মটার ব্যবহার করেছে। এখানে ঢাকা-পাবনা রোডের উপর এখনও যুদ্ধ চলছে।

       পদ্মা নদীতে জলযুদ্ধঃ গৌহাটি, ১০ এপ্রিল-খুব বিশ্বস্ত সূত্রে পাওয়া সংবাদে প্রকাশ, পাবনা শহরকে শক্রুর হাত থেকে রক্ষার জন্য পদ্মা নদীতে প্রচণ্ড লড়াই চলছে। দ্বিতীয় দিনের এই জলযুদ্ধে একদিকে মুক্তিফৌজের দেশী দ্রুতগামী নৌকা আর অন্যদিকে পশ্চিম পাকসৈন্যর গানবোট।

       পূর্ব রণাঙ্গনে পাক আক্রমণঃ আগরতলা, ১০ এপ্রিল-ছাউনিতে বন্দী পাক সেনাদল মুক্তিযোদ্ধাদের কবল থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য পূর্ব রণাঙ্গনের এক বিরাট এলাকায় নতুন করে আক্রমণ শুরু করেছে। সর্বশেষ যে খবর পাওয়া গিয়েছে, তাতে জানা যায় যে, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম এবং শ্রীহট্ট প্রচণ্ড লড়াই চলছে।

-আনন্দবাজার পত্রিকা, ১১ এপ্রিল, ১৯৭১

হারাগাছ ও তিস্তা সেতু এলাকা মুক্তিফৌজের হাতে এসেছে

       উত্তরাঞ্চলের কোন স্থান, ১০ই এপ্রিল-গত রাত্রে নতুন করে আক্রমণ চালিয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী তীব্র লড়াইয়ের পর হারাগাছ এবং তিস্তা সেতু এলাকায় গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল দখলে এনেছে। পাক-হানাদাররা এই যুদ্ধে দু’কোম্পানী সেনা নিয়োগ করেছিল, তারা এখন মৃত ও আহত সেনাদের ফেলে রংপুর ক্যান্টনমেন্টের দিকে চম্পট দিয়েছে। মুক্তিফৌজ এই যুদ্ধে কিছু অস্ত্রশস্ত্র, একটি জীপ এবং রসদও দখল করেছে।

       হারাগাছ ও তিস্তা সেতু অঞ্চল মুক্তিফৌজের দখলে আসায় রংপুর লালমনিরহাট ক্যান্টনমেন্ট দুটির মধ্যে সরবরাহ পাঠাবার পথ বিছিন্ন হয়ে গেছে। পাক হানাদারদের একন বিমানে সরবরাহের উপর নির্ভর করতে হবে।

       রংপুর ক্যান্টনমেন্টকে সম্পূর্ণ বিছিন্ন করার উদ্দেশ্য মুক্তিফৌজের সেনারা ছোট দলে ভাগ হয়ে সামরিক গুরুত্বপূর্ণ দুটি রেল সেতু ও একটি চলাচলের সেতু ধ্বংস করে দিয়েছে। এই সেতুগুলি রংপুরের সঙ্গে কুড়িগ্রামের যোগাযোগ রক্ষা করতো।

       মুক্তিফৌজের অতর্কিত আক্রমণঃ ইয়াহিয়া বাহিনীর একটি দল কয়েকটি ট্রলিযোগে লালমনিরহাট থেকে মোগলহাটের দিকে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে যাচ্ছিল, পথে মুক্তিফৌজ আচমকা দলটির ওপর হানা দিয়ে কয়েকজন হানাদরকে খতম করে, বাকী হানাদররা লালমনিরহাটের দিকে পালায়।

       আত্মবলি দল গঠিতঃ আরও আশার কথা মুক্তিফৌজ এই অঞ্চলে ছোট ছোট আত্নবলি দল সংগঠন করেছে। এই দলগুলি ইতিমধ্যেই শত্রু-অধিকৃত এলাকায় সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এই আত্নবলি দলগুলির নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রখতেও সক্ষম হয়েছে। মুক্তিফৌজ এসব এলাকা সুরক্ষিত করার উদ্দেশ্য কুড়িগ্রামের দিকে পথে পথে পরিখা খনন করেছে। মুক্তিফৌজের কাছে খবর এসেছে যে, রংপুরের দিকে আগুয়ান পাক হানাদার বাহিনী রংপুর ক্যান্টনমেন্টের ওপর মুক্তিবাহিনীর ত্রিমুখী আক্রমণ আটকে দিতে পারে।

       প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, শেখ মুজিবের মুক্তিবাহিনী গত বৃহস্পতিবার রাত্রে ভারী মর্টার চালিয়ে হারাগাছ ও তিস্তা সেতু এলাকায় আক্রমণ শুরু করে, কিন্তু শক্রু বিমানাক্রমণের আশঙ্কায় শুক্রবার ভোরের দিকে জঙ্গলে আত্নগোপন করে।

       হারাগাছ হচ্ছে তিস্তা নদীর একটি ফেরীঘাট, এটি সামরিক দিক থেকে এখনও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিছুদিন আগে লালমনিরহাটের ক্যান্টনমেন্টের শক্তি বৃদ্ধির জন্য এই ফেরীঘাট দিয়ে পাকসোনা রংপুর থেকে যায়।

       রংপুর জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থিত মুক্তিবাহিনীর দলগুলির মধ্যে এখন যোগসূত্র স্থপিত হয়েছে। মুক্তিফৌজ এ অঞ্চলে প্রথম দিকে যে রকম দিশেহারা হয়ে পড়েছিল, এখন সে অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। মুক্তিবাহিনী সাধারণ যুদ্ধবিদ্যার সঙ্গে সঙ্গে গেরিলা যুদ্ধে সেনাদের সুশিক্ষিত করে তোলায় শেখ মুজিবর বাহিনীর সমরসাধ্য এখন পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে।

       পাক বাহিনী পর্যুদস্তঃ দিনহাটা থেকে নিজস্ব প্রতিনি জানাচ্ছেন, তিনি রংপুর জেলার কুড়িগ্রাম, নাগেশ্বরী ও ভূরুঙ্গামারী সফর করেন। মুজাহিদ বাহিনীর ক্যাপ্টন আবুল হোসেন তাঁকে জানান, গতকাল তুগ্রাইহাটের মুক্তিফৌজের সঙ্গে এক সংঘর্ষ পাকহানাদার ফৌজের এগারজন সেনা নিহত হয়। এ জায়গাটি কুড়িগ্রাম শহর থেকে ৪ মাইল দূরে। একজন মুক্তিসেনা আহত হয়ে কুড়িগ্রাম হাসপাতালে ভর্তি হন। পাক সেনা দলটি জীপে করে কুড়িগ্রাম যাওয়ার পথে তুগ্রাইহাটের কাছে মুক্তিফৌজ তাদের বাধা দেয়। প্রচণ্ড লড়াইয়ের পর পাকদল চম্পট দেয়।

       রংপুরের দিকে মুক্তিফৌজঃ ইপিআরের জনৈক নায়েক ভুরুঙ্গামারীতে বলেন, মুক্তিফৌজ সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট দখল করার পর রংপুরের দিকে এগিয়ে চলেছে খবর পেয়ে লালমনিরহাট থেকে একদল পাকহানাদার সোনা রংপুর রওয়ানা হয়।

       আওয়ামী লীগ নেতাদের সংবাদ অনুযায়ী, গতকাল তিস্তা সেতুর কাছে এক সংঘর্ষে ছ’জন পাকসেনা নিহত হয় একং দুটি মর্টার ও চৌদ্দ বাক্স গোলাগুলি মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে। অস্ত্রশস্ত্রগুলি কুড়িগ্রামে মুক্তিফৌজের কর্মকেন্দ্রে আনা হয়েছে। আওয়ামী নেতা দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, দু’একদিনেই সমগ্র জেলা থেকে পাকসৈন্য নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।

       রাজশাহী থেকে কুমারেশ ক্রমবর্তী লিখছেনঃ সমগ্র রাজশাহী জেলা এখন প্রায় বিল্পবী মুক্তিফৌজের দখলে। এই জেলার প্রধান চারটি মহকুমার মধ্যে নবাবগঞ্জ, নাটোর, নওগাঁ সম্পূর্ণরূপে মুক্তিবাহিনীর দখলে। আর সদর মহকুমার মধ্যে একমাত্র ক্যান্টমেন্টের কিছু অংশ ছাড়া সম্পূর্ণ সদলে স্বাধীন বাংলার পতাকা শোভা পাচ্ছে। ক্যান্টনমেন্টেই রাজশাহীর একমাত্র মিলিটারী ঘাঁটি।

-যুগান্তর, ১১ এপ্রিল, ১৯৭১

 

তীব্র সংঘর্ষ চলছে

পাবনা দখল করলো পাকবাহিনী

(অনুবাদ)

পিটিআই এবং ইউএনআই এর রিপোর্ট অনুসারে রবিবার বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সবচাইতে তাৎপর্যপূর্ণ অর্জন ছিল উত্তরাঞ্চলের লালমনিরহাট-মুঘলহাট সহ ক্যান্টনমেন্ট এবং বিমানঘাটি সমুহ পুনরায় দখল করে নেয়া। আকারে ছোট হলেও আরো একটি বিজয় অর্জিত হয় টাঙ্গাইলের কাছে, যেখানে পাকিস্তানী সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে সম্পূর্ণভাবে বিজিত হয়। দিনাজপুর, গোয়ালন্দ, রাজশাহী, কুষ্টিয়া এবং যশোর অঞ্চলে পাকিস্তানীরা ব্যাপক বিমান সহায়তা পাচ্ছে এবং পাকবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ ভাঙ্গার জন্য কতিপয় বিমান হামলা চালিয়েছে। চট্টগ্রাম শহরতলীতেও বোমাহামলা চালানো হয়।

একিসময়ে ঢাকাতেও দুইদলের মধ্যে তীব্র যুদ্ধ চলছে বলে জানানো হয়। মুক্তিবাহিনী নরসিংদিতে নতুন ঘাটি খুলেছে, যেন তারা ঢাকায় আরো বড় আকারে অপারেশন চালাতে পারে।কুমিল্লার ধুলুপারা বিমানঘাটিতেও দখল অথবা অচল করার জন্যও একি ধরনের হামলা চালানো হয়, এবং হারডিং ব্রিজের নিকতেও একি রকমের সংঘর্ষের খবর পাওয়া যাচ্ছে।

যুদ্ধরত অবস্থাতেই মুক্তিবাহিনী তাদের অধিকৃত স্বাধীন অঞ্চলসমূহ যেমন সিলেট,ময়মনসিংহ এবং কুমিল্লার কিছু অংশে পুনরায় লোকবল একত্রিত করছে।

লালমনিরহাটের সংঘর্ষে দুই কোম্পানি পাকিস্তানী সেনা বিজিত হয় এবং এদের মধ্যে বেঁচে যাওয়া সৈনিকরা পালিয়ে যাওয়ার সময় স্থানীয়দের হাতে মারা পরে।

টাঙ্গাইল এবং ঢাকার কাছাকাছি, ময়মন্সিংহের একটি সাব-ডিভিশনাল শহরে মুক্তিবাহিনী একিরকম হামলা চালিয়ে পাকিস্তানী বাহিনিকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেছে। বিজিত পাকবাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যায়। কেন্দ্রীয় পাকিস্তানী দল উক্ত বাহিনিটিকে টাঙ্গাইলের মুক্তিবাহিনীকে শায়েস্তা করতে এবং মুক্তিবাহিনীর অধিকৃত ময়মন্সিংহ শহর পুনর্দখল করতে পাঠিয়েছিল।

নরসিংদিতে নতুন ঘাটি খুলার মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে নতুন এবং আরো বড় আকারে অপারেশন চালাচ্ছে গত রবিবার থেকে, তারাপুরে তাদের সাথে পাকবাহিনীর সংঘর্ষ হয় বলে জানা যায়। পাকিস্তানী বাহিনী ডেমরা নদী পার হয়ে নরসিংদী দখল করার জন্য অগ্রসর হচ্ছে এবং তারা ভারী অস্ত্রশস্ত্রসহ যুদ্ধের জন্য অবস্থান নিয়েছে।

পাকিস্তানী বাহিনী এ যুদ্ধের জন্য যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করছে বলে জানা যাচ্ছে, তারা নরসিংদিতে মুক্তিবাহিনীর মুলঘাটির ৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছে। ঢাকার ২৫ মাইল দক্ষিনে অবস্থিত মুন্সিগঞ্জও তারা দখল করে নিয়েছে বলে জানা যায়।

রাজশাহিঃ রাজশাহী থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকবাহিনী উৎখাতের জোর চেষ্টা চালাচ্ছে মুক্তিবাহিনী। খবরসুত্রে জানা যায় যে প্রায় ১০০০ মুক্তিযোদ্ধা যমুনা নদী পার হয়ে পাবনা শহরের কাছাকাছি অবস্থান করছে এবং তারা রাজশাহির দিকে অগ্রসর হচ্ছে।

দক্ষিণপশ্চিম দিকের মুক্তিবাহিনীর কমাণ্ড এর ডঃ আশাবুল হক জানান যে, রবিবার হার্ডিংস ব্রিজের কাছে পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদারদের সাথে মুক্তিবাহিনীর সংঘর্ষ হয়। ট্রাঙ্ক টেলিফোনের কুষ্টিয়া থেকে তিনি একটি আর্মি এজেন্সির সাথে কথা বলেন এবং জানান যে পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনী এবং বিমান বাহিনী হার্ডিংস ব্রিজের উপর মর্টার শেল চার্জ করে এবং বোমা হামলা চালায়। কুষ্টিয়া থেকে ৮ মাইল দূরে অবস্থিত কুমারখালি এলাকাতেও সংঘর্ষ চলছে বলে তিনি জানান।

লালমনিরহাট বিমান ঘাটি, তিস্তা ব্রিজ এবং হারাগাছি ফেরিঘাট মুক্তিবাহিনীর দখলে যাওয়াতে পশ্চিমা বাহিনী রংপুর শহরে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। লালমনিরহাটে অবস্থানকারী মুক্তিফৌজের একটি বড় অংশ এখন রংপুরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এদিকে রংপুর থেকে দিনাজপুর দিকে অগ্রসর হতে থাকে দুই কোম্পানি পাক আর্মি অতর্কিত হামলার শিকার হয় এবং পুনরায় রংপুর ঘাটিতে ফিরে যায়।

সিলেটঃ সিলেটে মুক্তিবাহিনী দখল বজায় রাখার জন্য পুনরায় একত্রিত হচ্ছে এবং রেডিও ও রেইলস্টেশন পুনরায় দখল করে নিয়েছে। গত তিনদিন ধরে সিলেট শহর খালি অবস্থায় আছে, কেননা বেসামরিক নাগরিক্রা যুদ্ধাবস্থার কারনে গ্রামের দিকে পালিয়ে যাচ্ছে। মুক্তিবাহিনী সিলেট শহর ভালভাবেই পাহারা দিয়ে যাচ্ছে। গত শনিবার তারা কুমিল্লা থেকে সিলেটের দিকে আসা ১২ জন পাকিস্তানী আর্মির একটি দলের উপর অতর্কিত হামলা চালায় এবং সবাইকে মেরে ফেলে। জানা যায় যে, পাকবাহিনী কুমিল্লার বিমানঘাঁটি এবং ক্যান্টনমেন্ট দখল করে রাখলেও এ অঞ্চলের উত্তরাংশ এখন মুক্তিবাহিনী দখল করে নিয়েছে এবং এই ১২ জনের দলটি সেখান থেকেই সিলেটের দিকে যাচ্ছিল।

কিন্তু, মুক্তিবাহিনী কুমিল্লা ও সিলেটে পাক আর্মিদের রসদ ও প্রয়োজনীয় মালামাল সরবরাহ করার রুটগুলো দখল করে নেয়াতে এইসকল স্থানে আকাশপথে রসদ পরিবহন করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই এবং তা এপ্রিল-মে এর মত ঝড়ের মৌসুমে আরো কঠিন হয়ে পরবে। আসছে মাসে অবস্থা আরো কঠিন হবে ধারনা করা হচ্ছে।

কুমিল্লা, সিলেট এবং ময়মনসিংহের মত এলাকার গ্রামাঞ্চলের উপর দখল রাখার মানে হচ্ছে মুক্তিবাহিনী এই অঞ্চলের খাদ্যসরবরাহের উৎসগুলিকে দখলে রাখছে। পাকিস্তানে উৎপাদিত সকল চায়ের উৎসও এই অঞ্চল।

পাবনা দখলঃ দুই দিন আগে, ঢাকা থেকে পাঠানো ১০০ জনের একটি সৈন্য দল পাবনা শহর দখল করে নেয়।

পাকিস্তানী বাহিনী তিস্তা ব্রিজ এলাকায় গমন করে এবং সেখানে তারা প্রায় ১০০র মতো ঘর জ্বালিয়ে দেয় এবং নির্বিচারে মানুষ হত্যা করে।

কৃষ্ণনগর ত্রানসংস্থার কাছে থেকে পাওয়া খবরে জানা যায় যে, পাবনা থেকে পালিয়ে যাওয়া শরণার্থীরা নদীয়ার করিমপুর বর্ডার দিয়ে ভারতে প্রবেশ করছে।

বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ভারি বিমান হামলা এবং পাকিস্তানী আর্মিদের লোকবল বৃদ্ধি করার খবর পাওয়া যাচ্ছে। কুষ্টিয়া, যশোর, রাজশাহী, সিলেট, দিনাজপুর এবং ফেনিতে ভারী বোমাহামলার খবর পাওয়া যায়।

পাকিস্তানী ৫২-৫৩ বম্বার প্লেন থেকে চট্টগ্রাম শহরতলীতেও বোমা হামলা চালানো হয়, এবং এসময়ে মর্টার এবং ট্যাঙ্ক ও ব্যাবহার করা হয়। ধারনা করা হচ্ছে যে, মুক্তিবাহিনী কুমিল্লা-ফেনি-চট্টগ্রাম মহাসড়কের যে ক্ষতিসাধন করেছে তা মেরামতের জন্য এই এলাকায় ইঞ্জিনিয়ারসহ মজুরদের নিরাপদে পাঠাতেই এই হামলা চালানো হচ্ছে।

গোয়ালন্দে বোমাহামলাঃ কুষ্টিয়া জেলার চুয়াডাঙ্গা থেকে পাওয়া খবরে জানা যায় যে, রবিবার বেলা ২টার দিকে পাকিস্তানী বিমান বাহিনী ও স্থলবাহিনী গোয়ালন্দে হামলা করে। ২০০ পাকিস্তানী প্যারাট্রুপার ২ দিন আগে গোয়ালন্দে অবতরণ করে বলে জানা যায়। একি সাথে বলা হচ্ছে যে, গোয়ালন্দের এই বোমা হামলায় হতাহতের সংখ্যা প্রচুর এবং প্রচুর পরিমানে বাড়িঘর ধ্বংস হয়েছে।

-হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড, ১২ই এপ্রিল, ১৯৭১।

 

রাজশাহী শহরের প্রশাসনভার মুক্তিফৌজের হাতে

       রাজশাহী, ১২ এপ্রিল-নাটোরের কাছে মুক্তিসেনার হাতে এক’শ পাকফৌজ আজ খতম হয়েছে। রাজশাহী শহরের ক্যান্টনমেন্ট এখনও পরিত্যক্ত। মুক্তিসেনারা আজ সেখানে গিয়ে পরিখাগুলি তন্ন তন্ন করে খোঁজে বের করে খতম করে।

       মুক্তিফৌজ রাজশাহী শহরের অসাময়িক প্রশাসনের ভার নিয়েছে। দোকানপাট খোলার জন্য তারা আবেদন জানিয়েছে। কিছু কিছু দোকানপাট ইতিমধ্যে খুলেছে। হানাদাররা যাতে রাতে হানা না দিতে পারে তার জন্য শহরে কারফু জারী করা হয়েছে।

       রাজশাহী ক্যান্টনমেন্ট থেকে উৎখাত হয়ে পাকফৌজ এখন রাজশাহী শহরের এক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে গিয়ে আটক রয়েছে। মুক্তিফৌজ পাকসেনাদের পরিত্যাক্ত ছাউনির বাংকারের ভিতর হোসপাইপ দিয়ে জল ঢেলে ঢেলে পরীক্ষা করে দেখছে শক্রু লুকিয়ে আছে কিনা। আজ সকালে রাজশাহী শহরের ওপর আবার পাকিস্তানী বিমান হানা দেয়। তারা বিমান থেকে মেশিনগানের গুলি ছুঁড়ে নাগরিক ও মুক্তিফৌজের ওপর আঘাত হানা চেষ্টা করে।

       ওগিকে নগরবাড়ী দিয়ে একদল পাকফৌজ নাটোরের দিকে এগুতে থাকে। হার্ডিঞ্জ ব্রিজের কাছে মুক্তিফৌজ তাদের বাধা দেয়। সোনাবাহিনী নৌকায় করে নদী পার হবার চেষ্টা করে। চারপর থেকে কয়েক হাজার মুক্তিফৌজ ওদের ওপর আক্রমণ হানে। প্রবল আঘাতে শক্রুরা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। অধিকাংশের কপালে জোটে সলিল সামধি। বাকি সেনারা গ্রামের পথ ধরে নাটোরের দিকে এগুতে থাকে। মুক্তিসেনারা পথে তাদের বাধা দেয়। এদিকে রাজশাহী জেলায় ঝড়-বৃষ্টি নেমে গিয়েছে। পাকফৌজ এর ফলে বিপন্ন।

-আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৩ এপ্রিল, ১৯৭১

ঢাকার উপকণ্ঠে লড়াই, দিনাজপুর আবার মুক্ত-

হানাদারদের হাওয়াই হামলা

       বাংলাদেশের পূর্ব রণাঙ্গনে কুমিল্লার বেষ্টিতপ্রায় পাকফৌজকে মুক্ত করতে আর সরবরাহ সড়ক পুনরুদ্ধার করতে হানাদার বাহিনী বুধবার গোমতী নদী অতিক্রম করে প্রচণ্ড আক্রমন চালায়। তাদের সহায়তা করে চারটি জঙ্গী বিমান। ব্রাহ্মবাড়িয়া ৩৫ কিলোমিটার দক্ষিণে কসবা শহর এবং তার আশেপাশে পাক বিমান বোমা-বৃষ্টি করে চলে যায়।

       কসবা রেল ষ্টেশন আর বাজার ত্রিপুরা সীমান্তের খুব কাছে। পাকফৌজের লক্ষ্য গুরুত্বপূর্ণ আখাউড়া- ব্রাহ্মনবাড়িয়া এলাকা পুনরুদ্ধার। আখাউড়া রেল জংশন এখনও মুক্তিফৌজের হাতে। তাদের আর একটি লক্ষ্য, ঢাকা অঞ্চলে অবস্থিত সেনাদের সঙ্গে সংযোগ সাধন এবং শ্রীহট্ট, ময়মনসিংহ অঞ্চলের মুক্তিফৌজকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা।

       উত্তর খন্ডে মুক্তিফৌজ দিনাজপুর শহরসহ তাদের মুক্তি ঘাঁটিগুলি আগলে রাখে। আগের দিন রাতে তীব্র সংগ্রামে বহু পাকসৈন্য হতাহত হয়। এবং দিনাজপুর আবার বাংলা বাহিনীর অধিকারে আসে। রেডিও পাকিস্তান অবশ্য পাল্টা দাবী জানিয়ে বলেছে যে, দিনাজপুর থেকে বিদ্রোহীদের তারা সরিয়ে দিয়েছে।

       এদিন সকালে মুক্তিফৌজ খাস ঢাকা থেকে মাত্র ১৮ মাইল দূরে সাভারে একটি পাক বাহিনীর উপর প্রবল আঘাত হানে তাহেরপুরের আওয়ামী লীগ সূত্রে এই খবর পাওয়া যায়। এই এলাকাকে ঢাকা উপকণ্ঠে বলা যায়। রাজশাহী, কুষ্টিয়া, শ্রীহট্ট, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, হবিগঞ্জ তীব্র লড়াই চলেছে। মুজিব বাহিনী সারা ব্রিজ দখলে রেখেছে এবং ভেড়ামারা, কুমারখালী আর শিলাইদহ এলাকায় হানাদারদের হটিয়ে দিয়েছে। কুষ্টিয়া শহরে এদনিও বোমাবর্ষণ হয়। প্রবল ধারায় বর্ষণ চলেছে, তবু গোয়ালন্দ এখনও সংগ্রামী সেনাদেরই হাতে। নগরবাড়ী ১৫০ জন পাকসৈন্যকে তারা ঘিরে ফেলেছে। ওদিকে পাকফৌজ ঢাকা থেকে বেরিয়ে নরসিংদীর দিকে এগিয়ে যায় এবং তীব্র সংঘর্ষের পর এই বড় বানিজ্য বন্দরটি দখল করে। মুক্তিফৌজ এখন গ্রামাঞ্চলে।

       ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছাড়াও এদিন ঢাকা, চট্টগ্রাম, সৈয়দপুর, রাজশাহী, রংপুর, কুষ্টিয়া, শ্রীহট্ট, ময়মনসিংহ এবং কুমিল্লায় বোমাবর্ষণ করা হয়। শ্রীহট্ট শহর পুনর্বার মুক্ত কিন্তু আজ একটি প্রেতনগরী মাত্র। ঘরে ঘরে রাজপথে স্তুপীকৃত শব, কুড়িদিনের লড়াই-এ নিহতদের সংখ্যা অন্তত আট হাজার।

       রংপুরের শহরগুলির হানাদার ফৌজের হামলায় অন্তত দু’শ সাঁওতাল অধিবাসী নিহত হন। ফৌজী দস্যুরা তাদের গ্রামগুলিতে লুটতরাজ চালায়। আমাদের বালুরঘাট সংবাদদাতা জানাচ্ছেন যে, আজ এখানে ফুলবাড়িতে প্রচুর বিমান হামলা হয়।

       শিকারপুর থেকে আমাদের সংবাদদাতা জানান, বাংলাদেশ থেকে নদীয়ায় সীমান্ত দিয়ে একানে পাঁচ হাজার উদ্বাস্ত এসেছে। আগরতলা শ্রীহট্ট থেকে আজ কয়েকজন ব্রিটিশ চাকর এসে পৌছান। তাঁরা বলেন শ্রীহট্ট জেলা সম্পূর্ণ মুক্তিফৌজের দখলে। তাঁরা আরও বলেন, শ্রীহট্টের কোথাও সামরিক শাসনের অস্তিত্ব নেই।

-আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৫ এপ্রিল, ১৯৭১

সিলেট এবং কুমিল্লার উপর চাপ বজায় রাখছে পাকবাহিনী

ভেস্তে গেল রাজশাহী দখলের প্রচেষ্টা

আগরতলা, ১৫ই এপ্রিল- প্রথম তিন সপ্তাহের যুদ্ধের ফলাফল একত্রিত করলে মুক্তিবাহিনীর প্রাপ্তি প্রচুর বলে পরিলক্ষিত হলেও পাকবাহিনী এখনও পর্যন্ত দেশের পশ্চিম ও পুরবাঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলিতে মুক্তিবাহিনী উৎখাতের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে কিছুটা হতাশার সৃষ্টি হয়েছে।

পূর্বদিকে পশ্চিম পাকিস্তানীরা সিলেট, চাঁদপুর এবং কুমিল্লার উপর চাপ বজায় রাখছে এবং মনে হচ্ছে তারা ঢাকা এবং চট্টগ্রামের মধ্যবর্তী যোগাযোগ পুনস্থাপন করতে চাচ্ছে।

সীমান্তের ওপার থেকে আসা সংবাদমাধ্যম জানায়, মুক্তিবাহিনী আজ সারাদিনই রাজশাহীর দিকে পাকবাহিনীর এগিয়ে আসা ঠেকাতে ব্যাপক যুদ্ধাভিযান চালিয়েছে এবং এখনও শহরের বহির্ভাগে তারা পাহারা বজায় রেখেছে।

তিতাস নদীর উজনেশ্বর ব্রিজের উপর সঙ্ঘটিত এক যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী পাকবাহিনীকে হারিয়ে দিয়েছে এবং তাদের পালাতে বাধ্য করেছে। পাকবাহিনী নদী পার হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কব্জা করার সংকল্প করেছিল, যা বর্তমানে মুক্তিবাহিনীর দখলে আছে।

আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকায় ময়মনসিংহ শহরের উপর চলা পাকিস্তানী বিমান হামলা বন্ধ আছে।

পূর্বের মতই পাকবাহিনী সিলেট শহরের উত্তরাংশে তাদের শক্তিবৃদ্ধি করছে এবং মুক্তিবাহিনী সুরমা নদীর দক্ষিন ভাগ হতে নিজেদের অবস্থান সরিয়ে নিয়েছে।

কুমারদহের কাটাখালি নদীর উপর অবস্থিত ব্রিজটি উড়িয়ে দিয়েছে মুক্তিবাহিনী এবং এর মাধ্যমে বগুড়ায় তাদের দখল অক্ষত রাখছে।

সীমান্তবর্তী শহর কসবায় পাকিস্তানী আর্মি অন্তর্বর্তী জলপথ ব্যবহার করে মুক্তিবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করছে এবং তারা শহরে ভারি মর্টার শেল চার্জ করেছে।

কুষ্টিয়াতে এখনও মুক্তিবাহিনীই দখলে আছে। যদিও আজ রংপুর থেকে দিনাজপুরের অবরুদ্ধ পাকবাহিনী অবমুক্ত করতে পাঠানো একটি সশস্ত্র দল আজ শহরটিতে পৌছায় এবং মুক্তিবাহিনীর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়।

চুয়াডাঙ্গা থেকে পাওয়া এক খবরে জানা যায়, হারডিংস ব্রিজের কাছে ঈশ্বরদীতে আজ প্রবল যুদ্ধ সঙ্ঘটিত হয়েছে।

কুমিল্লা সেক্টরের গঙ্গাসাগর এলাকাতেও আজ চরম যুদ্ধ চলেছে। পাকিস্তানী আর্মি এই অঞ্চলে আক্রমনের সময় ভারী আর্টিলারি বন্দুক ব্যবহার করে, যার শব্দ আগরতলা থেকেও পাওয়া যাচ্ছিল। আগরতলা থেকে পাওয়া খবরে জানা যায়, পাক আর্মি কুমিল্লা সেক্টরের আখাউড়া নামক একটি গুরুত্বপূর্ণ রেলওয়ে জংশন দখল করতে বদ্ধপরিকর।

-হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড, ১৬ই এপ্রিল, ১৯৭১।

রণাঙ্গণের খবর

       বাংলা বাহিনী দিনাজপুর রণাঙ্গনে বড় রকমের সাফল্য অর্জন করেছেন। তারা গতকাল দিনাজপুর শহর থেকে পাক সাঁজোয়া বাহিনীকে হটিয়ে দিয়েছেন। বাংলা বাহিনী এই আক্রমণে পাক বাহিনীর বিশেষ ক্ষতি সাধিত হয়। এছাড়া রংপুর শহরের বীরগঞ্জে বাংলা বাহিনীর হাতে পাক-বাহিনী পর্যুদস্ত হয়েছে। চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও ঢাকাতে পাক বিমান বাহিনী প্রচণ্ড বোমাবর্ষণ করেছে এবং মেশিনগান থেকে গুলি চালিয়েছে। রংপুরের উপকণ্ঠে পাকফৌজ দু’শ সাঁওতালকে হত্যা করেছে। তাদের ঘরবাড়ি সব পুড়িয়ে দেয়া হয়।

       সিলেট শহরটি মুক্তিবাহিনীর দখলে রয়েছে। খবরে প্রকাশ, শতাব্দীর পুরোনো হযরত শাহ জালালের (রঃ) মাজারে উপর পাক বিমান বাহিনী বোমাবর্ষণ করেছে। আকাশাবানীর খবর প্রকাশ, বিদেশী চা-বাগানের মালিকগণ জানিয়েছেন যে, সমগ্র সিলেট থেকে কুমিল্লা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ জায়গায় পাক সামরিক শাসনের কোন অস্তিত্ব নাই। তারা আশঙ্কা করেছেন যে শ্রীঘ্রই হয়তো বড় রকমের লড়াই বাধতে পারে।

       রণাঙ্গনের দায়িত্বভারঃ গত ১৪ই এপ্রিল স্বাধীন বাংলার প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ তাঁর ঐতিহাসিক বেতার ভাষণে পাঁচজন সেনাধ্যক্ষের নাম ঘোষণা করেন। এই পাঁচজন সেনাধ্যক্ষ স্বাধীর বাংলার বিভিন্ন রণাঙ্গনে বিপুর বিক্রমে যুদ্ধ পরিচালনা করছেন। মেজর জলিলকে বরিশাল, খুলনা ও পটুয়াখালী; মেজর খালেদ মোশাররফকে সিলেট, কুমিল্লা; মেজর জিয়াউর রহমানকে চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী; মেজর সফিউল্লাহকে ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল এবং মেজর এম এ ওসমানকে কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, যশোর রণাঙ্গন পরিচালনার দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে।

       সারা ব্রীজের যুদ্ধঃ ১৫ই এপ্রিল। খবরে প্রকাশ, অদ্য রাজশাহীর ঐতিহাসিক সারা ব্রীজের দখল নিয়ে বিপ্লবী মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানী হানাদার জঙ্গী বাহিনীর মধ্যে সমস্ত দিন ধরে তুমুল লড়াই চলে। বিপ্লবী মুক্তিবাহিনী তীব্র আক্রমণের মুখে হানাদার বাহিনী নিদারুন মার খেয়ে অবশেষে পালাতে বাধ্য হয়, কিন্তু পালাতে গিয়ে বর্বর বাহিনীর কয়েকশত বর্বর পদ্মাগর্ভে পড়ে ডুবে মারা যায়। এবং মুক্তবাহিনী সগৌরবে সারা ব্রীজের দখল নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হন।

       তিনটি বিমান ধ্বংসঃ বরিশাল, ১৬ই এপ্রিল। স্বাধীন বাংলার বেতারে প্রকাশ, গত ১৬ই এপ্রিল বিপ্লবী মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমনের মুখে পাক হানাদার বাহিনী পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে। এই সময় পাক বিমানবাহিনীর তিনখানা বিমান ছত্রভঙ্গ পর্যুদস্ত শত্রুবাহিনীকে সাহায্যকল্পে এগিয়ে আসে। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর তীব্র পাল্টা আক্রমনের মুখে তিনখানা বিমান ধ্বংস হয়ে যায়। এই নিয়ে মোট ১৭ খাঁনা বিমান ধ্বংস হয়।

       মুক্তিবাহিনীর সাফল্যঃ বরিশাল, ১৬ই এপ্রিল। সংবাদের প্রকাশ, রংপুর-তিস্তা রেলসড়কের উপর বাংলা মুক্তিবাহিনী পশ্চিমা বাহিনীর একটি ট্রেনে আক্রমণ চালায়। বেশ কয়েক ঘণ্টা তুমুল যুদ্ধের পর পাকবাহিনী পরাস্ত হয়। এ যুদ্ধে ২০ জন পাক সেনা নিহত হয়।

       সর্বশেষ সংবাদঃ ব্রাহ্মণবাড়িয়া নিকটে “তিতাস সেতু” নিয়ে বাংলা বাহিনী ও পাকফৌজের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ হয়। বর্তমানে সেতুটি বাংলা বাহিনীর দখলে রয়েছে।

       বাংলাদেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে তুমুল সংঘর্ষ চলেছে। এছাড়া ঢাকার আশেপাশে মুক্তিবাহিনীর সাথে পাক বাহিনীর সংঘর্ষ চলছে। উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে পাক সৈন্যের আক্রমণ মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধ করেছে। উজিরনগর এখন বাংলা বাহিনীর দখলে রয়েছে। পাক বিমান বাহিনী ময়মনসিংহ, ফেনী, আশুগঞ্জ, সীতাকুন্ডে প্রচণ্ড বোমাবর্ষন করে।

সর্বশেষ খবরে প্রকাশ, মুক্তিবাহিনী চুয়াডাঙ্গার পাক বাহিনীর হামলা ব্যর্থ করে দিয়েছে। ময়মনসিংহ-কুমিল্লার ৯০০ কিলোমিটার পথে তুমুল যুদ্ধ চলেছে।

-বাংলাদেশ, ১ম বর্ষ, ১ম সংখ্যা, ১৭ এপ্রিল, ১৯৭১

আখাউড়া দখল নিয়ে জোর লড়াই

       লামাকামুরা, ১৭ এপ্রিল-আখাউড়া রেল ষ্টেশন দখল নিয়ে পাকফৌজের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের জোর লড়াই চলেছে। প্রতিরোধের মুখে পাক-বাহিনী এখন মরিয়া। কুমিল্লা এবং ভৈরববাজার অঞ্চলে তাদের প্রচণ্ড আক্রমনে বহু লোক মারা যায়। উজানীশাতে গত তিনদিন ধরে মুক্তিযোদ্ধারা যে প্রতিরোধ চালিয়ে যাচ্ছে তা ব্যর্থ করে দিতে না পেরে একন তারা ব্রাহ্মনবাড়িয়ার উত্তর-পশ্চিম দিকে হেলিকপ্টার ও ষ্টীমারে সৈন্য নিয়ে যাচ্ছে।

আজ বিকালে মগরাতেও তুমুল লড়াই শুরু হয়েছে। লড়াই চলছে গঙ্গা সাগরেও। পাকসেনারা সর্বত্রই পোড়ামাটি নীতি অবলম্বর করেছে। তারা ধারক্ষেতে একরকম রাসায়নিক বোমা ফেলছে, ফলে চাষ আবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

       ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ থেকে ত্রিপুরা রাজ্যে বহু উদ্বাস্তু চলে এসেছে। আজ পর্যন্ত এদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২০ হাজার। এর মধ্যে আগরতলার শরণার্থীর সংখ্যা ৫ হাজার।

পশ্চিম রণাঙ্গনে মুক্তিফৌজ গেরিলা কায়দায় লড়ছে।

       মেহেরপুর, ১৭ এপ্রিল-পাকফৌজের কামান ও বোমাবর্ষণের মোকাবিলা করার জন্য পশ্চিম রণাঙ্গনে মুক্তিফৌজ সম্পূর্ণ গেরিলা কায়দা অবলম্বন করছে। রণকৌশল হিসাব তারা শহরগুলি থেকে অসামরিক নাগরিকদের নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে দিয়েছে। ইতিমধ্যেই কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর থেকে সমস্ত অসামরিক নাগরিকদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।

       মুক্তিফৌজ শহরের গোপন জায়গাগুলিতে লুকিয়ে থেকে শক্রুর উপর আতর্কিতে হানা নীতে অবলম্বন করেছে। ইতিমধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের সমরকৌশল ফলপ্রসূ হতে শুরু করেছে। আজ সন্ধার কুষ্টিয়া শহরে পাকফৌজ ঢুকলে গড়াই নদীর পূর্ব দিক থেকে মুক্তিফৌজ আতর্কিতে আক্রমণ চালায়। ফলে হানাদাররা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। রাত্রিতে উভয়পক্ষের জোর লড়াই চলেছে।

মুক্তিফৌজের জনৈক মুখপাত্র বলেন, ক’টি বিমান বিধ্বংসী কামান এবং কয়েকটি ফাইটার ও বোমারু বিমান পেলে তাঁরা শক্রুকে সহজেই হটিয়ে দিতে পারেন। নচেৎ তাঁদের গেরিলা যুদ্ধ নীতি অব্যাহত  রাখতে হবে।

 

পাকফৌজের কুড়িগ্রামের দখলের চেষ্টা প্রতিহত

       কুড়িগ্রাম (বাংলাদেশ)- কুড়িগ্রাম থেকে ২৩ মাইল মত দূরে তোগরিহাটে গতকাল মুক্তিফৌজ ও পাকফৌজের মধ্যে জোর লড়াই হয়। পাঁচজন পাক সেনা নিহত ও আটজন আহত হয়। একজন মুক্তিযোদ্ধাও আহত হন। মুক্তিফৌজ কিছু অস্ত্রশস্ত্র কেড়ে নিয়েছে। এই লড়াইয়ে উভয় পক্ষই মর্টার, মেশিনগান এবং রাইফেল ব্যবহার করে। পরে পাকবাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। রেল লাইনের ধারে বেশ কয়েকটি বাড়িতে পাকসেনারা লুটপাট চালায় ও আগুন লাগিয়ে দেন। মুক্তিফৌজের নেতৃত্ব দেন শ্রীবোরাহানুদ্দিন ও শ্রীমেহের আলী মণ্ডল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, যুদ্ধবিরতি থাকার পর পাকসেনারা কুড়িগ্রাম দখলের যে দ্বিতীয় চেষ্টা চালায়, মুক্তিফৌজ তা ব্যর্থ করে দিয়েছেন।

-আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৮ এপ্রিল, ১৯৭১

মুক্তিফৌজের চুয়াডাঙ্গা দখল, আখাউড়ায় পাল্টা আক্রমণ

       আগরতলা, ৮ই এপ্রিল (ইউএনআই)-মুক্তিফৌজ আজ অপরাহ্নে পাকসৈন্যদের দ্বারা অধিকৃত রেল জংশনের ওপর প্রচণ্ড রকেমর পাল্টা আক্রমন শুরু করেছে। মুজিবেন সৈন্যরা জংশনে ওপর অবিশ্রান্ত মর্টারের গোলাবর্ষণ করেছে।

       কৃষ্ণনগর থেকে পাওয়া এক খবরে প্রকাশ, মুক্তিফৌজ বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে চুয়াডাঙ্গা খন্ডের ওপরও আজও প্রচণ্ড পাল্টা আক্রমণ শুরু করেছে। গত রাত্রে পাকবাহিনী মুক্তিফৌজের আক্রমণের মুখে পিছু হটতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত চুয়াডাঙ্গা ছেড়ে যেত বাধ্য হয়। ইউএনআই-র খবর, বাংলাদেশের মুক্তিফৌজ তীব্র সংর্ঘষের পর কুষ্টিয়া জেলার সদর শহর চুয়াডাঙ্গা আবার দখল করে নিয়েছে। আজ রাত্রে সীমান্তের ওপার থেকে পাওয়া খবরের ভিত্তিতে তাঁরা এটা জানিয়েছেন। মুক্তিফৌজ চুয়াডাঙ্গা শহরের প্রান্তে মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা সড়কে অবস্থিত গুরুত্বপূর্ণ মাথাভাঙ্গা সেতুটিও দখল করেছে।

       কৃষ্ণনগর থেকে পিটিআই’র খবরে বলা হয়েছে যে, পাকিস্তানী সৈন্যরা মেহেরপুর দখলের জন্য অভিযান শুরু করেছে এবং পরবর্তী সৈন্যরা মেহেরপুর থেকে চার মাইল দূরে আমজুফিতে পৌছেছে। আমজুফি থেকে ভারত সীমান্ত সাত মাইল দুরে। আমজুফি থেকে তারা মেহেরপুরের ওপর গোলাবর্ষন করছে।

       এর আগের এক খবরে বলা হয়েছিল যে, পাকিস্তানীরা কাল আখাউড়া রেল জংশন দখল করার পর আজ সকাল দশটার সময় হাওরী নদী পার হয়ে শহরে পৌঁছায়। শহরে ঢুকেই তারা ঘরবাড়ী এবং বাজারে আগুন লাগাতে থাকে। ভারত সীমান্ত থেকে আগুনের শিখা দেখা যেতে থাকে। ভারতীয় সীমান্ত এখান থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে।

       আগরতলা থেকে খবর পাওয়া গেছে যে, পাকিস্তানীরা একন আখাউড়া ও ব্রাহ্মনবাড়িয়ার মধ্যে রেলপথ মেরামত করতে শুরু করেছে এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের বন্দুক দেখিয়ে কাজ করতে বাধ্য করছে। পাকিস্তানী আক্রমণের পূর্ব পর্যন্ত মুজিবের অনুবর্তীরা আখাউড়া পর্যন্ত ট্রেন চালু রেখেছিলেন। কাল রাত্রে পাকিস্তানীরা আখাউড়া ষ্টেশনে ঢোকার আগে ষ্টেশনের সমস্ত কর্মচারীরা আগরতলায় চলে গেছে।

       বরকল জলাধার ধ্বংস করার চেষ্টাঃ শিলং থেকে নীলকমল দত্ত জানাচ্ছেন যে, মুক্তিফৌজের তৎপরতা রোধে পাকিস্তানী ক্রমাগত নোয়াখালী জেলার ফেনী ও চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর বরকল জলাধারের ওপর বিমান আক্রমণ চালাচ্ছে। চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলের কাপতাইর ওপরও তারা বিমান থেকে রকেট ও মেশিনগানের গুলিবর্ষণ করেন। এখানে কর্ণফুলী জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র অবস্থিত। বিদ্যুত কেন্দ্র দখলের জন্য কাপ্তাই ও কুমিরা অঞ্চলের ওপর তারা ছত্রীসৈন্যও নামিয়েছে।

       লাকসাম অঞ্চলে মেজর জিয়ার অধীন মুক্তিফৌজের একদল পাক-সৈন্যর ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়।

       সারা সেতুর কাছে কাছে প্রচণ্ড লড়াইঃ ভেড়ামারা থেকে আগত পুনঃগঠিত মুক্তিফৌজের আরেকটি দল পাক-বাহিনীর সরবরাহ ব্যবস্থা বিকল করে দিয়েছে। এই পাকবাহিনী পাবনা থেকে পাকসি-কুষ্টিয়া সড়কের দু’ধারে আক্রমণ চালাতে চালাতে কুষ্টিয়ার দিকে এগিয়ে আসছিল।

       হার্ডিঞ্জ সেতুর কাছে প্রচণ্ড লড়াই চলছে। মুক্তিফৌজ কুষ্টিয়া ও চুয়াডাঙ্গায় অবস্থিত পাক-বাহিনীকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে এবং গড়াই নদীর পূর্ব ধার থেকে ফরিদপুরের দিকে অগ্রসরমান শক্রসৈন্যদের গতিও প্রতিহত করেছে। সংবাদে আরও জানা গেছে যে, হাজার হাজার যুবক বাংলাদেশ সরকারের পুনর্গঠিত সেনাবাহিনীতে যোগদান করেছেন।

       পাবনা-কুষ্টিয়া সংযোগ পথ বিচ্ছিন্নঃ গৌহাটি থেকে পাওয়া পিটিআই’র খবরে প্রকাশ, আজ মুক্তিফৌজ এক ত্বরিত আক্রমণে পাবনা ও কুষ্টিয়ার মধ্যবর্তী পাকফৌজের সংযোগ রক্ষার ও সরবরাহের পথ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। সীমান্তের ওপার থেকে নির্ভরযোগ্য সূত্রে এখানে এই সংবাদ পৌঁছে। মুক্তিফৌজের এই সাফল্যের বিস্তারিত সংবাদ এখনও পাওয়া যায়নি।

       ইতিমধ্যেই কুষ্টিয়া থেকে আগত শরণার্থীদের মুখে সেখানে পাকফৌজের নিষ্ঠুর অত্যাচার নানা কাহিনী শোনা যাচ্ছে। তারা কুষ্টিয়া শহরের নিকটবর্তী গ্রামগুলির তিন হাজারেরও বেশী ঘর-বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে। পাকফৌজ পৌঁছানোর আগেই গ্রামবাসীরা গ্রাম ছেড়ে চলে গিয়েছিল। ফরিদপুর অঞ্চলে মুক্তিফৌজের প্রচণ্ড বাধার ফলে পাকফৌজের অগ্রগতি সম্ভব হয়নি।

       দিনাজপুর অঞ্চলে মুক্তিফৌজের নিয়ন্ত্রণাধীন হিলি থেকে পাঁচশ কিলোমিটার দূরে ফুলবাড়ীতে এক গ্যারিসন পাকফৌজ দেখা গেছে।

       ভারত সীমান্ত থেকে সাত মাইল দূরে লড়াইঃ আজ রাত্রে ভারতের সীমান্তবর্তী শহর কৃষ্ণনগরে খবর পৌছায় যে, ষাটটি সামরিক গাড়ীতে চেপে পাকফৌজ মেহেরপুর প্রবেশ করে এবং প্রবেশকালে দু’দিকে বেপরোয়াভাবে অসামরিক ব্যক্তিদের হত্যা করে ও গ্রামগুলিতে আগুন জ্বালায়।

       এখন মুক্তিফৌজ ও পাকফৌজের মধ্যে লড়াই চলছে ভারত সীমান্ত থেকে মাত্র সাত মাইল দূরে এবং কৃষ্ণনগর-করিমপুর সড়ক থেকে গোলাগুলির আওয়ার শোনা যাচ্ছে।

-যুগান্তর, ১৯এপ্রিল, ১৯৭১

মেহেরপুর আবার মুক্ত, শালুটিকরও বাংলাফৌজ নিয়ে নিল-

সোমবার সাফল্যের পর সাফল্য

মুক্তিফৌজের পক্ষে সোমবার সাফল্যের পর সাফল্য। আধুনিকতম মরণাস্ত্রে বলীয়ান পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রচণ্ড সংঘবন্ধ চালিয়ে মুক্তিফৌজ এদিন বাংলাদেশের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল পুনরুদ্ধার করে নিয়েছে। রবিবার দিন যুদ্ধের অবস্থা অপেক্ষাকৃত শান্ত থাকায় আজ মুক্তিবাহিনী নতুনভাবে শক্তি সঞ্চয় করে তীব্র আক্রমণে নাজেহাল করেছেন হানাদার সৈন্যদের। শ্রীহট্ট শহরের অদূরে শালুটিকর বিমানবন্দরে গত কয়েকদিন ধরে দুই পক্ষের মরীয়া আক্রমণ চলছিল। পাকফৌজ সেখানে যেতে বাধ্য হয়েছে। আমাদের সংবাদদাতা শ্রী ধ্রুব মজুমদার জানাচ্ছেন, প্রায় ১৫০ জন্য পাকসেনা আত্নসমর্পণ করেছে মুক্তিফৌজের কাছে, ওদিকে হতাহতের সংখ্যা অনেক। শালটিকর থেকে মাত্র দু’কিলোমিটার দূরে খাদিমনগরে উপস্থিত হয়ে তিনি যুদ্ধের প্রত্যক্ষ ফলাফল পেয়েছেন। পাকবাহিনী এখন বিমানবন্দর থেকে হটে গিয়ে শেষ লড়াই চালাচ্চে। এখানে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ে বৃটিশরাই একটি বিমানবন্দর বানিয়েছিল এবং পাকিস্তানী সরকার সেটিকে আধুনিক রূপ দিয়েছিল।

এদিন দুপুরের দিকে খবর আসে যে, ভারতে সীমান্তবর্তী মেহেরপুর পাকফৌজ দখল করে নিয়েছে। সন্ধ্যার পর আবার আনন্দ সংবাদ। মুক্তিবাহিনী এখান থেকে হটিয়ে দিয়েছে হানাদারদের। মেহেরপুর ট্রেজারির একজন কর্মী ভারত সীমান্তে আশ্রয় নেবার পর জানা যে, পাকফৌজ মুসলিম লীগের সহায়তায় শহরটি লুটপাট করে অনেক বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে। পরে তারা মুক্তিবাহিনীর তাড়া খেয়ে বাধ্য হয়। চুয়াডাঙ্গা শহরটি এখন মুক্তিসেনার দখলে। শহরের বাইরে যুদ্ধ চলছে।

আর একটি বড় জয় পূর্ব খণ্ডে কসবায়। আমাদের সাংবাদিক তুষার পণ্ডিত জানাচ্ছেন, আগরতলা থেকে ২০ মাইল দূরে ভারত সীমান্তের কমলাসাগরের ওপাশে কসবায় পাকবাহিনী ক’দিন ধরে ছাউনি গেড়েছিল। এই সমৃদ্ধ গ্রামটিতে পাকফৌজ যথেচ্ছ লুটতরাজ ও অগ্নিকাণ্ড চালিয়েছে। এদিন ভোর তিনটের ক্যাপ্টনে গাফফারের নেতৃত্বে মুক্তিফৌজ অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে দেড়’শ শত্রুসৈন্য নিহত করে অঞ্চলটি দখল করে নিয়েছেন। ভূতপূর্ব পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম লীগ মন্ত্রী তফাজ্জল আলীর বাড়িতে পাকফৌজ থানা গেড়েছিল। মুক্তিবাহিনী সেই বাড়িটিও উড়িয়ে দেন। এই শহরের বাড়িতে বাড়িতে যে পাকিস্তানী পতাকা ওড়ানো হয়েছিল স্বাধীন বাহিনীর সেনারা সেই সব পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দেন। সমস্ত গ্রামবাসীরাও আবার আস্তে আস্তে এখানে ফিরে আসছে।

আখাউড়া রেল স্টেশনের কাছেও প্রব্ল যুদ্ধ চলছে। এখানে দখলদার বাহিনীরাই ফাঁদে আটকা পড়ার অবস্থা। আগরতলা থেকে দশ মাইল দূরে সিঙ্গুর বিল সেতুটি মুক্তিফৌজ উড়িয়ে দিয়েছেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেও পাকফৌজ কঠিন প্রতিরোধের সম্মুখীন।

হার্ডিঞ্জ বা সারা সেতু লড়াই এখন তুমুল। ফেনীর কাছে এক আকস্মিক সংঘর্ষ দেড়শত পাকফৌজ নিহত হয়েছে। এখানে পাক বিমান বাহিনী বোমাবর্ষণ করেছে বিস্তর। রংপুর ও লালমনিরহাটের মধ্যে সড়ক ও রেলপথের যোগাযোগ ব্যবস্থাও আজ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে মুক্তিফৌজের তৎপরতায়। ঢাকা শহরের আশেপাশে এবং টাঙ্গাইলেও অবিরাম লড়াইয়ের খবর পাওয়া গেছে।

আজ পাক সামরিক কর্তৃপক্ষ স্বীকার করতে বাধ্য হন যে, বাংলাদেশের বড় বড় শহরগুলি বস্তুত জনশূণ্য। সেনাবাহিনী অধিকৃত খুলনা বেতার কেন্দ্র থেকে বলা হয়েছে যে, এই শহরের প্রায় তিন হাজার অধিবাসী গ্রামে চলে গেছেন।

রংপুর অঞ্চলে ঠাকুরগাঁও ও দিনাজপুর থেকে উত্তর অগ্রসরমান একটি পাক বাহিনীকে মুক্তিফৌজ প্রবলভাবে বাধা দেয়।

-আনন্দবাজার পত্রিকা, ২০ এপ্রিল ১৯৭১

 

বাংলাদেশে লড়াইয়ের দ্বিতীয় পর্যায়

মুক্তিফৌজের সাঁড়াশী আক্রমণে পাকবাহিনী পর্যুদস্ত

২১শে এপ্রিল-গতকাল বিকেলে বাংলাদেশে লড়াইয়ের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয়েছে। এতদিন যা হচ্ছিল, তা হল মুক্তিফৌজ কর্তৃক পাকিস্তানী সৈন্যের প্রতিরোধ করা এবং তা ছিল একরকম বিচ্ছিন্নভাবেই। অর্থ্যাৎ মুক্তিফৌজ তেমন সংগঠিত ছিল না। বিভিন্ন সেক্টরের সঙ্গে যুদ্ধনীতি অনুযায়ী সমঝোতাও ছিল না। কিন্তু গতকাল থেকে মুক্তিফৌজ পরিকল্পিতভাবে সংগঠিত হয়ে যুদ্ধনীতি অনুযায়ী পাল্টা আক্রমণ শুরু করে দিয়েছে। ইতিমধ্যে মুক্তিফৌজের সংগ্রামীরা অনেক অভিজ্ঞ গয়ে উঠেছেন। তাদের প্রথম পাল্টা আক্রমণ পশ্চিম সেক্টর থেকেই শুরু হল এবং ক্রমে অন্যান্য সেক্টরও এই পাল্টা আক্রমণ আরম্ভ হবে।

গতকাল বিকেলেই মুক্তিফৌজ বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার সীমান্তবর্তী বুড়িপোতা, গবীপুর ও দৌলতপুর দিয়ে তিন পথে এক সঙ্গে সাঁড়াশী আক্রমণ চালিয়েছে। এই সাঁড়াশী আক্রমণের উদ্দেশ্য হল- মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা অঞ্চল দখল করা এবং মেহেরপুর থেকে সাত মাইল দূরে আমঝুপিতে পাকসৈন্য যে ঘাঁটি স্থাপন করেছে তাকে দখল করা এবং যশোর ক্যান্টনমেন্ট দখল করা। আজ সকাল পর্যন্ত খবর নিয়ে জানা গেছে যে, মুক্তিফৌজ ইতিমধ্যেই কোর্ট এলাকা দখল করে নিয়েছে এবং মুক্তিফৌজের তীব্র আক্রমণের মুখে পাকিস্তানী সৈন্যরা পিছু হটতে শুরু করেছে এবং পাকবাহিনী পর্যুদস্ত হয়ে পড়েছে। মুক্তিফৌজের জনৈক মুখপাত্র জানিয়েছেন।

মুজিবনগর আক্রমণের চেষ্টা ব্যর্থ : এদিকে গতকাল মঙ্গলবার পাকিস্তানী সৈন্যরা মুজিবনগর আক্রমণের চেষ্টা ও পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু বিকেল থেকে প্রবল বৃষ্টি হওয়ায় এবং রাস্তাঘাট চলাচলের পক্ষে সুবিধাজনক না হওয়ায় পাকবাহিনীর উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়ে যায়। মুজিবনগরে মুক্তিফৌজ ট্রেনিং ক্যাম্পঃ গতকাল বাংলাদেশের মুজিবনগরে মুক্তিফৌজের ট্রেনিং ক্যাম্প খোলা হয়েছে এবং আজ সকাল থেকে তার কাজ শুরু হয়েছে। এই ক্যাম্পে ২০০ জন করে শিক্ষার্থীকে সমরশিক্ষা দেওয়া হবে এবং শিক্ষা শেষে তাদের লড়াইয়ে পাঠানো হবে।

-যুগান্তর, ২২ এপ্রিল, ১৯৭১

আরও কয়েকটি অঞ্চলে মুক্তিফৌজের সাফল্য

কসবা স্টেশন ও পাকশি সেতু পাক হানাদার কবল মুক্ত

 

আগরতলা, ২২ শে এপ্রিল বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী আজ ভোরের দিকে আখাউড়া-ব্রাহ্মণবাড়িয়া উপকণ্ঠে কসবা রেল স্টেশনটি পাকিস্তানী সৈন্যদের কবল থেকে মুক্ত করে নিয়েছেন। ময়মনসিংহ আর শ্রীহট্ট শহরটি অবশ্য গতকাল আবার পাকিস্তানী সৈন্যদের দখলে গেছে। সীমান্তের ওপার থেকে সর্বশেষ প্রাপ্ত খবরে এই তথ্য জানা গেছে বলে ইউএনআই জানিয়েছেন। কৃষ্ণনগর থেকে আমাদের নিজস্ব সংবাদদাতা জানাচ্ছেন, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম খণ্ডের অধিনায়ক এম এ ওসমান চৌধুরীর এক বিজ্ঞপ্তিতে জানা গেছে যে, মুক্তিফৌজ প্রচণ্ড লড়াইয়ের পর পাকশী সেতু থেকে সৈন্যদের হটিয়ে দিয়েছেন। উত্তর পাকশী সেতু থেকে শুরু করে দক্ষিণে শিবতলা, বড়বাজার ও ঝিকরগাছা লাইন পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল অধিকার করে নিয়েছেন।

যশোরের পাকসৈন্যরা এখন কেবল ক্যান্টনমেন্ট এলাকাতেই আবদ্ধ আছে। সীমান্তের ওপার থেকে জানা গেছে যে, বাংলাদেশের মন্ত্রীসভা আজ বাংলাদেশের এক অজ্ঞাত স্থানে তাঁদের রাজধানীতে এক গোপন বৈঠকে মিলিত হয়ে কতকগুলি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

ময়মনসিংহের পতন- ট্যাঙ্কযোগে পাক সৈন্যযোগেঃ ইউএনআই জানিয়েছেন, ঢাকা থেকে মধুপুর ক্যান্টনমেন্টে সৈন্য আমদানীর পর ময়মনসিংহের পতন ঘটে। ময়মনসিংহের পতনের ফলে গত ২৭ দিনের যুদ্ধের অবশ্য কোন হেরফের হয়নি। খবরে প্রকাশ, কতকগুলি ট্যাঙ্ক ইউনিট ঐ সৈন্যদের নিয়ে আসে। ঢাকা থেকে রংপুর, পূর্ব দিনাজপুর ও কুড়িগ্রাম অঞ্চলে ও ট্যাংক ইউনিট পাঠানো হয়েছে।

শ্রীহট্টের সড়ক পথ মুক্তিফৌজ বিনষ্ট করে দিয়েছেন বলে ঐ পরিত্যক্ত শহরটির উপর দখল নেবার জন্য বিমান থেকে বহু সংখ্যক পাকসৈন্য নামানো হয়েছে।

কসবা, আখাউড়া ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মুক্তিফৌজ রাত দুটোর কিছু আগে তিন ইঞ্চি মর্টার দিয়ে পাক সৈন্যদের উপর আচমকা আক্রমণ চালান এবং তাদের সঙ্গে ছয় ঘণ্টা লড়াই করেন। কসবায় যুদ্ধে মুক্তিফৌজ পাক বাহিনীর কয়েকজন অফিসার সহ অন্তত ৫০ জনকে গ্রেফতার করেন। পাক সৈন্যরাও মর্টার আর হালকা ফিল্ড গান থেকে গুলি চালায়।

-আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৩ এপ্রিল, ১৯৭১

ময়মনসিংহ ও ফরিদপুরে পাক আক্রমণ প্রতিহত

 

কৃষ্ণনগর, ২৪শে এপ্রিল মুক্তিফৌজ আজ বাংলাদেশের উত্তর ও দক্ষিণ খণ্ডে ময়মনসিংহ ও ফরিদপুরে পাকিস্তানী সৈন্যদের আক্রমণ প্রতিহত করেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের বাড়ি যে জেলায় সেই ফরিদপুরে মুক্তিফৌজ একটি পাকিস্তানী সৈন্যদলের সঙ্গে প্রচণ্ড লড়াইয়ে নিযুক্ত আছেন। এই সৈন্যদলটি গতকাল গোয়ালন্দঘাটে এসে নামে। তারা রাজবাড়ির দিকে অগ্রসর হলে তাদের সেই অগ্রগতি প্রতিহত করা হয়।

পাকসৈন্যরা কামারখালীতে নদী পার হবার চেষ্টা করলে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের সেই চেষ্টাও ব্যর্থ করে দেন।

ময়মনসিংহ শহরে পাক সৈন্যদল ও মুক্তিবাহিনীর মধ্যে এখন প্রচণ্ড লড়াই চলছে। কুষ্টিয়ায় পাকসৈন্য ও মুক্তিফৌজের মধ্যে যুদ্ধ চলছে বলেও খবর পাওয়া গেছে।

ময়মনসিংহে প্রচণ্ড যুদ্ধঃ সীমান্তের ওপার থেকে খবর এসেছে যে, বাংলাদেশের উত্তর খণ্ডে ময়মনসিংহে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য ও মুক্তিবাহিনীর মধ্যে প্রচণ্ড লড়াই হচ্ছে। পাকসৈন্যদের একটি অগ্রবর্তী দল গতকাল ময়মনসিংহ শহরে প্রবেশ করে এবং ডেপুটি কমিশনারের বাংলো ও বিশ্ববিদ্যালয় অঞ্চলে তুমুল লড়াই হয়।

মুক্তিযোদ্ধারা ময়মনসিংহ থেকে ৬ মাইল দূরে মধুপুর থেকে আগত আর একটি পাকসৈন্যদলের সঙ্গে এখনও লড়াই করেছেন।

-যুগান্তর, ২৫ এপ্রিল, ১৯৭১

বেনাপোলে মুক্তিফৌজের হাতে পাকিস্তানী গোলন্দাজ বাহিনী ঘায়েল

বেনাপোল, ২৫ এপ্রিল- আজ যশোর রণাঙ্গনে মুক্তিফৌজের মূল ঘাঁটি দখল করতে এসে হানাদার দলের গোলন্দাজ বাহিনী ঘায়েল হয়। মুক্তিসেনাদের প্রচণ্ড পাল্টা আঘাতে তারা আধুনিক সমর সরঞ্জাম ফেলে পালায়। কিছু চীনা অফিসার পাকবাহিনীকে নির্দেশ দিচ্ছিল, তারাও যুদ্ধক্ষেত্র থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। বাংলা বাহিনী দখলদারদের ঘাঁটিতে গিয়ে চীনের প্রচুর উন্নত অস্ত্রশস্ত্র পায়।

বনগাঁ থেকে আমাদের নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, বেনাপোলে মুক্তিফৌজ ও পাক সৈন্যের মধ্যে প্রচণ্ড যুদ্ধের পর মুক্তিফৌজ পাকিস্তানী বাহিনীর অগ্রগতি সাফল্যের সঙ্গে প্রতিরোধ করেছে। ২৫ জনের বেশী মুক্তিসেনাকে বেনাপোল থেকে এনে বনগাঁ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আরও আহত সৈনিককে নিয়ে আসা হচ্ছে।

ময়মনসিংহে বোমাবর্ষণঃ দলু (বারেঙ্গাপাড়া) ২৫ এপ্রিল পাকিস্তান বিমান বহরের বিমাঙ্গুলি গতকাল সকালে ময়মনসিংহ শহরে বোমাবর্ষণ করে। এই নিয়ে পরপর তিনদিন ময়মনসিংহ শহরে হাওয়াই হামলা হল। গারুয়াপাড়া সীমান্ত থেকে বোমাবর্ষণের শব্দ পাওয়া যায়। ময়মনসিংহ থেকে সদ্য আগত শরণার্থী জানান বৃহস্পতিবার থেকে পাক সৈন্যদল শহরটি প্রায় অবরুদ্ধ করে ফেলেছে। এইসব শরণার্থীরা শুক্রবার সন্ধ্যায় শহর থেকে পালিয়ে এসেছেন।

পাকসৈন্যদের একটি ময়মনসিংহের শহরতলিতে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ঘাঁটি স্থাপন করেছে।

-আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৬ এপ্রিল ১৯৭১

সিলেট ফ্রন্টে প্রতিরোধ ভাঙতে ব্যর্থ পাক আর্মি

(অনুবাদ)

আগরতলা, ২৬শে এপ্রিলঃ সিলেটের শেরপুর ফেরিঘাটে আজ দিনের প্রথমভাগে পাকিস্তানী বিমান ও স্থল বাহিনী একযোগে হামলা চালায়। টানা চারদিন হামলার চতুর্থদিনেও আজ বীরদর্পে পাকিস্তানি বাহিনীর হামলা রুখে দিয়েছে মুক্তিবাহিনী। সীমান্তের ওপার হতে পাওয়া সুত্র থেকে জানা যায় যে এ সপ্তাহের শুরুর দিকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী সিলেটের দিকে অগ্রসর হয়। যথেষ্ট পরিমান লোকবল এবং পিএএফ প্লেন সহযোগে ফেরি ঘাটে বোমা হামলা চালানো স্বত্বেও তারা মুক্তিবাহিনীর শক্ত প্রতিরোধ ভাঙতে পারেনি। শেরপুর ফেরিঘাট কুশিয়ারা নদীর উপরে অবস্থিত। কুমিল্লার আখাউড়া এবং সিলেটের একমাত্র যোগাযোগ মাধ্যম এই ফেরি।

এরই মধ্যে জানা যায় যে, সিলেট শহর থেকে ১৩ কিলোমিটার দক্ষিনে অবস্থিত গোপালগঞ্জ এলাকায় আজ ৪জন গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা তাদের ফায়ারিং রেঞ্জ থেকে অতর্কিত হামলা চালিয়ে ২২জন পাকিস্তানী সেনাবাহিনির একটি দলকে ঘায়েল করে। যদিও এসময় তারা পিএএফ প্লেন থেকে নিক্ষেপিত বোমার শেলে আহত হয়।

পাকিস্তানী বাহিনী, গানবোটের সাহায্যে বরিশালের মধুমতী নদীর পার হচ্ছে এবং এসময় তারা নদীর দুইপারের গ্রামে বোমা হামলা এবং অগ্নিসংযোগ করছে বলে জানা যায়। ধীরে ধীরে তারা বরিশাল শহরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এই গানবোটগুলি বংগপোসাগর থেকে মধুমতী নদীতে প্রবেশ করে, এবং এই নদীটির অসংখ্য শাখা-উপশাখা পুরো বরিশাল জেলার বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে আছে। ৩০ লক্ষ জনসংখ্যার এ গুরুত্বপূর্ণ জেলাটিতে এখনও পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধা এবং পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর মধ্যে চলমান যুদ্ধের প্রভাব খুব একটা পরেনি।

মুক্তিবাহিনীরা খুলনায়ও পাকবাহিনীর দখলকৃত রেডিও স্টেশনে গেরিলা কৌশলে হামলা চালায়। চট্টগ্রামে পাকিস্তানী বাহিনী চট্টগ্রাম-কুমিল্লা এবং চট্টগ্রাম-সিতাকুণ্ড এর মধ্যবর্তী যোগাযোগ ব্যবস্থা পুণরুদ্ধারের জন্য কঠোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মুক্তিবাহিনীর হামলায় এইসকল এলাকার রাস্তা এবং রেইলরোড চরম বিপর্যস্ত অবস্থায় রয়েছে।

সীমান্তের ওপারের মুক্তিবাহিনী থেকে পাওয়া খবরে জানা যায় যে আজ তিতাস নদীর নিকটে অবস্থিত সাবেপুরে গেরিলা মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে ৫০ জন পাকিস্তানী সেনা নিহত হয়। সকালে যখন পাকসেনারা তাদের রোজকার অনুশীলনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখনি এই গেরিলা মুক্তিবাহিনী সবার অলক্ষ্যে ক্যাম্পে প্রবেশ করে তাদের উপরে অতর্কিত হামলা চালায়।

কিছু অনিয়মিত সশস্ত্র সৈন্য ছাড়া আর সকল পাকিস্তানী সৈন্যদের আজ ভারতীয় সীমান্তের নিকটবর্তী পঞ্চগড় জেলা থেকে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে, একি ঘটনা ঘটেছে নিলফামারিতেও।

কুমিল্লা সেক্টরে লাকসাম রেলওয়ে স্টেশনের কাছে একদল পাক্ সেনার উপর অতর্কিত হামলা চালায় মুক্তিবাহিনী। সেনাদের দলটি চট্টগ্রামের দিকে যাচ্ছিল। উক্ত হামলায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পাকিস্তানী সেনা নিহত হয়েছে।

যদিও এই হামলা পালটা হামলার মধ্যে ময়মন্সিংহ জেলায় পাকিস্তানী সেনারা এখনও তাদের নিয়ন্ত্রন বজায় রেখেছে। প্রবল বোমা ও ভারী আর্টিলারি বহর হামলার মাধ্যমে তারা উক্ত জেলায় মুক্তিবাহিনীদের প্রতিহত করে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ থেকে আসা খবরে জানা যায় যে টানা এক সপ্তাহ ধরে পাকবাহিনীর সাথে প্রবল সংঘর্ষের পর  ময়মন্সিংহ অঞ্চলের পতন ঘটে। পাকিস্তানী স্থলবাহিনী এই এলাকায় প্রবেশের পূর্বে এর বহির্ভাগে প্রবল পরিমানে বিমান থেকে বোমা হামলা, ভারী আর্টিলারি বহর থেকে গোলাবর্ষণ চালায় ও মর্টারশেল নিক্ষেপ করে।

শান্তাহার এবং গোরাঘাট থেকে বগুড়ার দিকে অগ্রসরবরতী পাকবাহিনী সহজেই শহরটির দখল নিতে পেরেছে।  পাকিস্তানী বাহিনীর মজুদ গোলাবারুদের ব্যাপকতা মুক্তিবাহিনীর চেয়ে অনেক বেশি হওয়াতে উক্ত এলাকার অবস্থান থেকে মুক্তিবাহিনী আগেই নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়। বগুড়া থেকে পাকবাহিনী ক্রমশ উত্তর-পশ্চিমের জামালপুরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে বলে জানা যায়।

গত রাতে কুষ্টিয়ার ভৈরব নদীর পশ্চিমপারে অবস্থিত ইছাখালিতে পাকিস্তানী সীমান্ত ফাড়িতে মুক্তিবাহিনী চড়াও হয়ে সেখানে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে। অতঃপর তারা ফাড়ির চারপাশে পরিখা খনন করে এবং ভৈরব নদীর উপর অবস্থিত ব্রিজটি উড়িয়ে দেয়।

আজ সকাল থেকে মুক্তিবাহিনী ইছাখালি থেকে দুই মাইল দূরের মেহেরপুর শহরে অবস্থিত পাকিস্তানী সেনা ফাড়িতেও মর্টারশেল নিক্ষেপ করা শুরু করে এবং সেনাদলটি বাধ্য হয়ে মেহেরপুর থেকে ৫ মাইল দুরের মায়ামারি গ্রামের একটি বাশবাগানে অবস্থান নেয়।

-হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড, ২৭ এপ্রিল, ১৯৭১

পূর্ব ও পশ্চিম রণাঙ্গনে মুক্তিফৌজের ব্যাপক গেরিলা তৎপরতা

আগরতলা, ২৭ শে এপ্রিল (পি টি আই)- বাংলাদেশের মুক্তিফৌজ পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলে ব্যাপকভাবে গুপ্ত ও গেরিলা আক্রমণ যেমন চালিয়ে যাচ্ছেন, ওদিকে পাক্তিস্তান জঙ্গী বাহিনী আজ উত্তর-পূর্ব রণাঙ্গনে আসামের কাছাড় জেলার সংলগ্ন শ্রীহট্ট সীমান্তের দিকে নতুন অভিযান শুরু করেছে।

বাংলাদেশ থেকে আজ রাত্রে যে সংবাদ পাওয়া যায় তাতে বলা হয় যে, মুক্তিফৌজের সঙ্গে লড়াইয়ের পর পাকবাহিনী আন্তর্জাতিক সীমান্তবর্তী কুশিয়ারা নদী সম্মুখে হাজির হয়েছে।

কিন্তু শ্রীহট্টের দিক থেকে পাক বাহিনীর যে দলটি ব্রাহ্মণবাড়িয়া দিক থেকে অভিযানকারী অপর একটি ব্যাটেলিয়নের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের আশায় এক সপ্তাহ পূর্বে রওয়ানা হয়েছিল, তারা এখনও গুরুত্বপূর্ণ শেরপুর খেয়াঘাট দখলের জন্য মুক্তিফৌজের সঙ্গে লড়াইয়ে আটকে আছে।

সংবাদ এ-ও জানা যায় যে, পাক বিমানবাহিনীর বারবার বোমাবর্ষণ ও ব্যাপক ধ্বংসসাধন এবং দুরপাল্লার কামান দাগানো সত্ত্বেও মুক্তিফৌজ শ্রীহট্টের মাইল পনের দূরে অবস্থিত শেরপুরে পূর্ণ কর্তৃত্ব বজায় রেখেছেন এবং তাদের আক্রমনে পাক জঙ্গী ফৌজ বহু সংখ্যায় হতাহত হয়েছে।

উপকূলবর্তী শহরগুলি দখলের চেষ্টাঃ প্রকাশ, মধ্য রণাঙ্গনে পাকিস্তানী ফৌজ বগুড়া ও ময়মনসিংহ থেকে যমুনার উভয় তীর ধরে অভিযান চালিয়েছে। নদী তীরবর্তী শহরগুলি পূর্ণ কর্তৃত্ব হাতে পাওয়ার জন্যই তাদের এই উদ্যম। পাক বিমানবাহিনী আজকে বগুড়ার পূর্বদিকে বিস্তীর্ণ অঞ্চল বোমাবর্ষণ করে ধ্বংস করেছে। বিশেষ করে যমুনার পশ্চিম উপকূলবর্তী সিরাজগঞ্জ, কাজীপুর ও হরিপুর শহর কয়টি বিধ্বস্ত হয়।

জামালপুর তুমুল সংগ্রামঃ পূর্ব তীরে ময়মনসিংহের দিক থেকে অভিযানরত পাকিস্তানী ফৌজ জামালপুর ঢুকেছে। ওখানে মুক্তিফৌজের সঙ্গে প্রচণ্ড সংগ্রাম চলেছে এখন অবধি। সংবাদে বলা হয় যে, ঢাকা, মধুপুর ও কিশোরগঞ্জ থেকে পাকফৌজের যে দলটি ময়মনসিংহের ওপর জড়ো হয়েছিল, এতক্ষণে তারা ঐ শহরে সদর কার্যালয় স্থাপন করেছে।

বরিশাল শহর এখনও মুক্তিফৌজের হাতেঃ দক্ষিণ রণাঙ্গনে এখন পর্যন্ত বরিশাল শহরটি মুক্তিফৌজের কর্তৃত্বে। ফরিদপুর থেকে অভিযানরত পাকবাহিনীকে গেরিলারা বরিশালের পথে অনেক জায়গায় সংগ্রামের মুখে ফেলেন। নদী তীর বরাবর পাকিস্তানী গানবোট ও মুক্তিযুদ্ধাদের মধ্যে গোলাগুলি বিনিময়ের সংবাদও পাওয়া গেছে।

সৈন্যরা চট্টগ্রামে শ্রমিক পাচ্ছেনাঃ চট্টগ্রামে পাকবাহিনী নাকি ১৩,০০০ বন্দর শ্রমিকের মধ্যে বন্দুক দেখিয়ে মাত্র ১৪০০ জনকে জরুরী মালপত্র উঠানো নামানোর কাজে সংগ্রহ করতে পেরেছে। অধিকাংশ বন্দর ও ডক শ্রমিক পাকিস্তানী সৈন্যদের গুলি এড়িয়ে শহর ছেড়ে চলে গেছে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে।

চৌকি দখলের চেষ্টা বানচালঃ শিলিগুড়ি থেকে আমাদের নিজস্ব প্রতিনিধি জানাচ্ছেন, মুক্তিফৌজ বাংলাদেশের দিনাজপুরে কিশোরগঞ্জ এলাকা থেকে পাক হানাদার বাহিনীকে হটিয়ে দিয়েছে। এই এলাকাটি পশ্চিম দিনাজপুরে রাধীকাপুর সীমান্ত শহর থেকে মাত্র তিন মাইল দূরে। সীমান্তের ওপর থেকে এই খবর পাওয়া গেছে।

মুক্তিফৌজের অতর্কিত আঘাতঃ শিলং থেকে আমাদের নিজস্ব প্রতিনিধি জানাচ্ছেন, মুক্তিফৌজ বিরাট এক অঞ্চল জুড়ে তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্তা আরও জোরদার করে তুলেছে। কয়েকটি এলাকায় আজ পাকবাহিনীর উপর তারা অতর্কিতে আঘাত হেনেছে। বগুড়া শহরের দক্ষিণ-পূর্বে শেরপুরে এলাকায় মুক্তিফৌজ পাক বাহিনীর সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য করতোয়া নদী পার হওয়ার সময় এই সংঘর্ষ শুরু হয়। নিকটবর্তী কাজিপুর এবং হরিপুর এলাকায় মুক্তিফৌজ ও পাকবাহিনীর মধ্যে তীব্র সংঘর্ষ চলছে।

কুমিল্লা ফ্রন্টে গঙ্গাসাগর এবং ইমামবাড়ী স্টেশনের মধ্যবর্তী একটা এলাকায় মুক্তি সংগ্রামী ও পাকবাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষে বহু সংখ্যক পাক সৈন্য হতাহত হয়েছে। হতাহতের সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি।

কুচবিহার থেকে প্রাপ্ত একটি খবরে জানা গেছে, হানাদারের কুড়িগ্রাম দখলের চেষ্টা মুক্তিবাহিনী বানচাল করে দিয়েছেন। একটি পাক অগ্রবর্তী বাহিনীর পাঁচজন সৈন্যকে মুক্তি সংগ্রামীরা গুলি করে মেরেছেন এবং ধরলা নদীতে ডুবিয়ে দিয়েছেন। এই পাক সৈন্যেরা হাতে তৈরী নৌকাতে করে ধরল নদী পার হচ্ছিলো।

পাক বিমান ভূপাতিতঃ শিলং থেকে পিটিআই জানাচ্ছে, খাসি পাহাড়াঞ্চল ও মেঘালয়ের সীমান্তবর্তী বাংলাদেশের শ্রীহট্ট ফ্রন্টে একদল মুক্তি সংগ্রামী আজ সকালে একটি পাক জঙ্গী বিমানকে গুলি করে ভূপাতিত করেছে। বিমানটি হরিপুরে সার কারখানার দিকে যাচ্ছিল।

-যুগান্তর, ২৮ এপ্রিল, ১৯৭১

গোয়ালন্দে অনূন্য একশ পাকসৈন্য নিহত

 

মুজিবনগর, ৩০শে এপ্রিল(ইউএনআই)- গতকাল বুধবার ফরিদপুরের নিকট গোয়ালন্দে একটি যুদ্ধে অন্তত ১শ’ পাকিস্তানী সৈন্য নিহত ও অস্ত্রশস্ত্র বোঝাই একটি স্টিমার নিমজ্জিত হয়েছে বলে আজ এখানে সংবাদ পাওয়া গিয়েছে। এই যুদ্ধে প্রায় ৯ ঘণ্টাকাল স্থায়ী হয় এবং মুক্তিসেনারা অবশেষে হটে আসে। মুক্তিসেনারা পাকসেনাদের একটি ছাউনিতে আচমকা আক্রমণ করলে এই যুদ্ধ শুরু হয়।

সংবাদ জানা যায়, শেখ মুজিবরের জন্মস্থানকে ধূলিসাৎ করা হয়েছে- শুধু কুকুর ও সৈন্যরা সেখানে অবস্থান করেছে।

শহরে আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়িঘর ভূমিসাৎ করা হয়েছে এবং পাইকারী বাজারটি লুণ্ঠিত ও বিধ্বস্ত হয়েছে। ঐ দিনই ফরিদপুরের প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে গুরুত্বপূর্ণ পাট ব্যবসায় কেন্দ্র ভাঙ্গাতে ও যুদ্ধ হয়। প্রায় ২৫ লক্ষ টাকা মূল্যের পাট বিনষ্ট করা হয়েছে।

ফেনী শহরের নিকট একশ’ পাকসৈন্য নিহতঃ চট্টগ্রাম রণাঙ্গনের কোন এক স্থান থেকে মুক্তিফৌজের কমান্ডার মেজর জিয়াউর রহমান জানিয়েছেন যে, গত মঙ্গলবার নোয়াখালী জেলার ফেনি শহরের শুভপুর সেতুর জন্য সংগ্রামে প্রায় একশ’ পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয়েছে। মেজর রহমান সফররত জনৈক ইউএনআই’র প্রতিনিধিকে লিখিতভাবে জানান যে, ২৭শে এপ্রিল এক ব্যাটালিয়ন পাকিস্তানী সৈন্য শুভপুর সেতু আক্রমণ করলে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের প্রতিহত করে। শত্রুসৈন্যরা ট্যাংক এনে মুক্তিযোদ্ধাদের উপর গোলাগুলি চালায়। শুভপুর সেতুর নিকট পাকিস্তানীরা ফেনী নদী অতিক্রমের চেষ্টা করলে মুক্তিফৌজের আব্দুল আজিজ নামে জনৈক সিপাই এক প্লাটুন পাকসৈন্যকে হত্যা করেন। মেজর রহমান আরও জানান যে, কয়েকজন পাকিস্তানী সৈন্য কোনরূপে সেতু অতিক্রম করলে মুক্তিফৌজ শত্রুপক্ষের আক্রমণ প্রতিরোধ করে। সেতুটি এখনও মুক্তিফৌজেরই হাতে রয়েছে।

-যুগান্তর, ১ মে, ১৯৭১

মুক্তিফৌজের পাল্টা আক্রমণে ছদ্মবেশী পাক-হানাদাররা পর্যুদস্ত

 

বয়ড়া সীমান্ত, ৩০শে এপ্রিল-আজ বিকালে বেনাপোলের সাদিপুরে একদল পাকিস্তানী হানাদার মুক্তিফৌজের ছদ্মবেশে হাত উঁচু করে এগিয়ে এসে মুক্তিফৌজের উপরই ঝাঁপিয়ে পড়তে গেলে মুক্তিযোদ্ধারা তা সম্পূর্ণ ব্যর্থ করে দেয়। অত্যন্ত তৎপরতার সঙ্গে পাল্টা আক্রমণে বাংলা বাহিনী পাঁচজন হানাদার কে খতম ও কয়েকজনকে জখম করেন। অন্যদিকে, মহেশপুরেও মুক্তিবাহিনী ঝটিকা আক্রমণে দখলদারদের কাছ থেকে একটি ছোট ঘাটি ছিনিয়ে নেন।

এদিন বেলা তিনটা নাগাদ সাদিপুর মুক্তিফৌজ যখন টহল দিচ্ছেলেন, তখন তারা দেখতে পান সামনে দিয়ে একদল লোক মুক্তিফৌজের বেশে এগিয়ে আসছে। তাদের বুকে বড় ব্যাজ, বড়বড় হরফে লেখা ইপিআর। আর ঊর্ধ্ববাহু এই ছদ্মবেশীরা অনেকটা কাছে এগিয়ে এলে তাদের পিছন থেকে হানাদাররা হঠাৎ মুক্তিফৌজকে লক্ষ্য করে গুলি চালাতে শুরু করে। মুক্তিফৌজ সঙ্গে সঙ্গে পজিশন নিয়ে পাল্টা আক্রমণ চালাতে থাকেন। আধ ঘণ্টা লড়াইয়ে হানাদারদের কয়েকজন নিহত ও আহত হওয়ার পর তাঁরা সরে পড়ে। সাদিপুরের ১৮ মাইল উত্তরে মহেশপুরে বেলা ১২ টা নাগাদ যখন মুক্তিফৌজ ঝটিকা গতিতে দখলদারদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন, তখন দু’জন পাঠানের প্রাণ হারাবার পর তাঁরা ঘাঁটি ছেড়ে পালিয়ে যায়।

-আনন্দবাজার পত্রিকা, ১ মে, ১৯৭১

 

নোয়াখালী ও কুমিল্লায় গুরুত্বপূর্ণ সড়ককেন্দ্র মুক্তিফৌজের দখলে

 

বাংলাদেশে পাক জঙ্গীশাহীর বিরুদ্ধে বাঙালি মুক্তিফৌজের স্বাধীনতা সংগ্রামের যে সব খবর মঙ্গলবার পাওয়া গেছে, তাতে প্রকাশ, প্রচণ্ড সংগ্রামের পর মুক্তিফৌজ নোয়াখালী জেলার গুরুত্বপূর্ণ সড়ক সংযোগস্থল ছাগলনাইয়া অধিকার করেছেন, বাহাদুরাবাদ ঘাট ও চিলমারী ঘাটের (যথাক্রমে ময়মনসিংহ ও রংপুর জেলা) কয়েকটি জলযান দখল করে সরিয়ে নিয়ে গেছেন, পাকবাহিনীর বহু অস্ত্রশস্ত্র হস্তগত করে তাদের অনেককে হতাহত করেছেন। ছাগলনাইয়ার যুদ্ধে শ’তিনেক এবং কুমিল্লা-চট্টগ্রাম সড়কের ওপর মীরবাজারের যুদ্ধে শ’দেড়েক পাকিস্তানী ফৌজ নিহত হয়েছে।

এদিকে যুগান্তরে জলপাইগুড়িস্থিত সংবাদদাতা জানিয়েছেন, সীমান্ত পেরিয়ে সেখানে খবর পৌঁছেছে যে, লালমনিরহাটের কাছে পাকিস্তানী বাহিনীর মেজর এজাজ খানকে মুক্তিফৌজের গেরিলারা মেরে ফেলেছেন। মেজর এজাজ ছিলেন পাকবাহিনীর মেজর জেনারেল রিয়াজ খানের ছোট ভাই। তার স্মরণে পাক সামরিক কতৃপক্ষ লালমনিরহাট ও কাউনিয়ার মধ্যবর্তী তিস্তার রেল সেতুটির নামকরণ করেছেন এজাজ সেতু।

আগরতলা থেকে পিটিআই খবর দিয়েছেন, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাংশে নোয়াখালী জেলার গুরুত্বপূর্ণ সড়ক সংযোগ কেন্দ্রে ছাগলনাইয়াতে তিন দিন ধরে পাকিস্তানী ফৌজের সঙ্গে প্রচণ্ড সংগ্রামের পর মুক্তিফৌজ সোমবার ঐ জায়গাটি দখল করে নেন। নোয়াখালী আওয়ামী লীগ নেতা নুরুল হক  ছাগলনাইয়াতে মুক্তিফৌজের এই সাফল্যের বিবরণ দান প্রসঙ্গে বলেন, ঐ যুদ্ধে অন্ততঃ ২১ জন পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয়েছে। মুক্তিফৌজ মেশিনগান, রাইফেল, রকেট নিক্ষেপক প্রভৃতি প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাগুলি পলায়মান পাকিস্তানী বাহিনীর কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছেন। তাছাড়া গত ১লা মে নোয়াখালীর ফেনাঘাটা সেতুর কাছে মুক্তিফৌজের কমাণ্ডো বাহিনীর আক্রমণে আরও পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয়েছে।

উত্তর-পশ্চিম রণাঙ্গনেঃ বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম রণাঙ্গনে লাল্মনিরহাটের কাছে দলহাটিতে (তালাহাটি?) মুক্তিফৌজ ও পাকবাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষের খবর পাওয়া গেছে।

-যুগান্তর, ৫ মে, ১৯৭১

মুক্তিফৌজের গেরিলা তৎপরতা বৃদ্ধি, আখাউড়ায় জোর লড়াই

 

আগরতলা, ৬ মে- বাংলাদেশের সর্বত্র মুক্তিফৌজের তৎপরতা দারুণ বেড়ে গিয়েছে। মুক্তিফৌজের অতর্কিত আক্রমণে পাক-বাহিনী নাজেহাল। বহু পাক-সেনা নিহত হয়েছে। বহু জায়গায় পাক-সেনা পিছু হটেছে। বৃহস্পতিবারও আখাউড়ায় দুই পক্ষে প্রচণ্ড লড়াই চলেছে। মুক্তিফৌজ এখানে পাক-বাহিনীকে বেকায়দায় ফেলতে পেরেছে। আখাউড়ার কাছেই গঙ্গাসাগর ও উজানিশর সম্পূর্ণভাবে মুক্তিফৌজের নিয়ন্ত্রণে। মুক্তিফৌজের একজন কমাণ্ডার জানিয়েছেন, আখাউড়ার যুদ্ধে ১২০ জন পাকসেনা খতম হয়েছে। পাক-সেনাবাহিনী আখাউড়া ও কুমিল্লার মধ্যে সরাসরি সড়ক পথে সংযোগ স্থাপনে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। পশ্চিম রণাঙ্গনে মুক্তিফৌজের হাতে প্রাণ হারিয়েছে ৩৩ জন পাক সেনা। মুক্তিফৌজ এখানে দুটি গুরুত্বপূর্ণ রেল সড়ক সেতু উড়িয়ে দিয়েছে। দিনাজপুর ও রংপুরেও পাক-বাহিনীর উপর মুক্তিফৌজ গেরিলাবাহিনী বার বার আক্রমণ চালায়।

বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম রণাঙ্গনে কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাটে উভয় পক্ষে প্রচণ্ড লড়াই হয়। গেরিলা আক্রমণে পাক-বাহিনীর ক্ষয়ক্ষতি বেশী হিয়। লালমনিরহাটে ২৯জন পাক-সেনা নিহত হয়। দিনাজপুর জেলায় ঘোড়াগাড়ি ও প্রেমতলাতে মুক্তিফৌজের হাতে চারজন পাক সেনা খতম হয়েছে।

বরিশালেও মুক্তিফৌজের সাফল্য অব্যাহত। এখানে দ্বারকাপুরে পাক-সেনা বোঝাই একটি নৌকা মুক্তিফৌজ ডুবিয়ে দিয়েছে। ফলে বহু পাক-সেনার সলিলসমাধি ঘটেছে। ময়মনসিংহের উত্তর-পূর্বে আলমপুরে পাক-সেনা ও মুক্তিফৌজের মধ্যে তীব্র লড়াই হয়েছে।

মুক্তিফৌজের আক্রমণে নাজেহাল পাক-সেনাদল শ্রীহট্ট জেলার হবিগঞ্জের পশ্চিমে ২টি গ্রামে আগুন লাগিয়ে দেয়।

গত দুদিন ধরে প্রাণপণ চেষ্টা করার পর আজ পাক-বাহিনী চট্টগ্রামের দক্ষিণে কক্সবাজার দখল করে নেয়। কক্সবাজারে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য কেন্দ্র রয়েছে।

গেরিলা তৎপরতা বন্ধ করার উদ্দেশ্যে পাক-সেনা কতৃপক্ষ পশ্চিমাঞ্চলের চিলাতহ শহরে কারফিউ জারি করেছে।

দেবগ্রামে মুক্তিফৌজ ও পাক-সেনাবাহিনীর মধ্যে প্রচণ্ড লড়াই হয়। এখানে প্রায় ১০০ জন পাক সেনা নিহত হয়েছে। ধরমানি চা বাগান এলাকা থেকে প্রায় ৮০০ জনের এক পাক-সেনাদলকে মুক্তিফৌজ তীব্র আক্রমণ চালিয়ে হটিয়ে দিয়েছে। এখানে প্রায় ২০০ জন পাক-সেনা মারা গিয়েছে।

-আনন্দবাজার পত্রিকা, ৭ মে, ১৯৭১

 

বিভিন্ন সেনাঙ্গনে মুক্তিসেনাদের আমচকা আক্রমণ

 

কলাকাতা, ৭ মে (ইউএনআই)-সীমান্তের ওপার থেকে পাওয়া খবরে জানা গেছে, গত ২৪ ঘন্টায় বাংলাদেশের বিভিন্ন রণাঙ্গনে মুক্তিফৌজের পক্ষ থেকে কমাণ্ড আক্রমণে প্রায় ১৫ জন পাক ফৌজ খতম হয়েছে। এরমধ্যে ময়মনসিংহে কালুমাখানায় পাকবাহিনীর আমচকা আক্রমণ করে কমাণ্ডোরা ৮ জনকে হত্যা করে এবং ৩০টি রাইফেল ছিনিয়ে নেয়।

এর পরের উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছে রংপুরে। এখানে সরাই নামক স্থানে মুক্তিফৌজ পাকবাহিনীকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে অন্ততঃ৭ জন সৈন্যকে হত্যা করে।

শ্রীহট্ট অঞ্চলের বিবির বাজার ও কাজিপুরে জোড় সংঘর্ষ হয়। হতাতের খবর পাওয়া যায়নি।

সেতু ধ্বংসঃ রংপুরের আমরখানা, মোগলহাট, লাবলাহাট ও তুগরাইহাট অঞ্চলে মুক্তিফৌজ গেরিলা আক্রমণ চালিয়েছে। তারা ঐ জেলার বাজানপুর সেতুটি ধ্বংস করে দেয়। দক্ষিণ-পূর্ব রণাঙ্গনের রাদম্পুর ও বরিশালের মধ্যে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দেয়। পটুয়াখালির অঞ্চলে ও এখানে সেখানে যুদ্ধ চলছে।

উত্তর রণাঙ্গনে মুক্তিফৌজের সাফল্যঃ জলপাইগুড়ি থেকে যুগান্তরের নিজস্ব প্রতিনিধি জানাচ্ছেঃ মুক্তিফৌজ বিগত ৪৮ ঘন্টায় উত্তর রণাঙ্গনে নেকীপাড়া, ডানাকাটা এবং বড়শশী সীমান্ত ফাঁড়িগুলি দখল করে নিয়েছেন। তাঁরা ভালাগঞ্জ থেকে পচাঁগড় পর্যন্ত ২০ ব্যাসার্ধের মধ্যে পাক সৈন্যদের চলাচলও বন্ধ করে দিয়েছে। বহুসংখ্যক মুক্তিফৌজ এখন তেঁতুলিয়ায় গেরিলা যুদ্ধে ট্রেনিং নিচ্ছেন।

প্রখ্যাত খেলোয়াড়ের মুক্তিফৌজে যোগদান

 

নয়াদিল্লী, ৭ই মে (ইউএনআই) এখানে প্রাপ্ত এক সংবাদে প্রকাশ, বাংলাদেশের খ্যাতনামা ফুটবল খেলোয়াড় ক্যাপ্টেন হাফিজউদ্দিন আহমদ মুক্তিফৌজে যোগ দিয়েছেন। তিনি এখন বাংলাদেশের কোন এক স্থানে মুক্তিফৌজের সঙ্গে আছেন। ক্যাপ্টেন আহমদ মুক্তিফৌজে যোগ দেওয়ার জন্য পাকিস্তান বাহিনী ত্যাগ করেছেন।

-যুগান্তর, ৮ মে, ১৯৭১

 

আখাউড়ায় প্রচণ্ড লড়াইঃ ১৫০ পাক সেনা নিহত

 

আগরতলা, ৮ মে শনিবার সারাদিন ধরে বাংলাদেশের নানাস্থানে মুক্তিফৌজ ও পাক-হানাদারদের মধ্যে তুমুল লড়াই চলে। লড়াই সবচেয়ে তীব্র আকার ধারণ করে আখাউড়ায়। এখানে মুক্তিফৌজের আক্রমণে ১৫০ পাক-সেনা নিহত হয়েছে। পূর্ব ও পশ্চিম রণাঙ্গনে মুক্তিফৌজ বারবার অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে পাক-বাহিনীকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখে। মুক্তিফৌজের একজন কমাণ্ডার জানান, উত্তর-পূর্ব রণাঙ্গনে তারা চীনা পদ্ধতিতে আক্রমণ চালাচ্ছে। চীনা পদ্ধতি হলঃ শত্রুকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে সীমাবদ্ধ অঞ্চলে আবদ্ধ রাখা।

পশ্চিম রণাঙ্গনের রংপুর, রাজশাহী ও কুষ্টিয়া জেলার শনিবার উভয় পক্ষে প্রচণ্ড লড়াই চলে। রাজশাহী জেলার মোহনপুরে চারজন পাক- সেনা নিহত হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের একজন মুখপাত্র জানান, নতুন কায়দায় যুদ্ধ শুরু করে মুক্তিফৌজ গেরিলা বাহিনী সর্বত্র যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে পাক বাহিনীকে কোণঠাসা করে ফেলেছে। গত দু’দিন নানা স্থানে রেল লাইন উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

রংপুর জেলার মোগলহাটে ৩০ জন ও কুড়িগ্রামে ৭ জন পাক-সেনা গতকাল মুক্তিফৌজের হাতে প্রাণ হারিয়েছে। নিহতদের মধ্যে রিজভি নামে এক ক্যাপ্টেনও আছে। কুড়িগ্রামে মুক্তিফৌজ পাক-বাহিনীর একজন সেনা মানওয়ার আলিকে বন্দি করেছে। তার গায়ে গুরুতর আঘাতের চিহ্ন ছিল। মোগলহাটে মুক্তিফৌজ দুজন পাক-গুপ্তচরকে গুলি করে হত্যা করেছে। একজন গুপ্তচরকে বন্দী করা হয়েছে তার নাম মহম্মদ মণ্ডল। কুষ্টিয়া, যশোর ও রংপুর এলাকায় মুক্তিফৌজ পাক সেনাবাহিনীর গাড়ীগুলির উপর চোরাগুপ্তা আক্রমণ চালালে প্রচুর পাকসেনা নিহত হয়।

বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসন ব্যবস্থা চালুঃ ইউএনআই জানাচ্ছে, বাংলাদেশের রংপুর ও দিনাজপুর জেলার মুক্ত এলাকায় অসামরিক প্রশাসন ব্যবস্থা চালু হয়েছে। মুক্তিফৌজ ঐ সমস্ত এলাকা থেকে উত্তরাঞ্চলে অভিযান চালাচ্ছে।

-আনন্দবাজার পত্রিকা ৯ মে, ১৯৭১

 

কুমিল্লা ও আখাউড়ায় তিনদিন তুমুল লড়াইঃ

তিনশ’ পাকসেনা খতম

 

আগরতলা, ৯ই মে (ইউএনআই)- আখাউড়ায় মুক্তিফৌজের সঙ্গে পাকহানাদার বাহিনীর আজ তিনদিন ধরে প্রচণ্ড লড়াই চলছে। এই যুদ্ধে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর হাতে এ পর্যন্ত পাকবাহিনীর প্রায় দু’শ সেনা নিহত হয়েছে বলে মুক্তিফৌজের পক্ষ থেকে দাবী করা হয়েছে।  কোহিমায় শ্রুত স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বলা হয়েছে যে, আখাউড়া ও কুমিল্লা খণ্ডে বাংলাদেশের মুক্তিফৌজের হাতে তিনশ পাক হানাদার নিহত হয়েছে। বেতারে  আরও বলা হয়, বিপুল সংখ্যায় সেনা খতমের ফলে পাকবাহিনীর বেলুচি সৈন্যদের মধ্যে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। উক্ত সূত্রে প্রকাশ, মুক্তিফৌজের দু’জন সেনা নিহত, তিনজন আহত এবং দু’জন নিখোঁজ হয়েছেন।

পাক হানাদার বাহিনী আখাউড়া- আগরতলা চেক পোস্টের এক হাজার গজের মধ্যে এসেছে। বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী চেকপোস্টের কাছেই ঘাঁটি আগলে রয়েছে, তাই এই জায়গাটিই পাক বাহিনীর আক্রমণের লক্ষ্য। বাংলাদেশের সূত্রে প্রকাশ, পাক বাহিনীর তিন কোম্পানী সেনার দ্বারা অর্ধ চন্দ্রাকৃতি ব্যুহ রচনা করে মুক্তিফৌজের এক কোম্পানী সেনাকে চেকপোষ্ট এলাকা থেকে উৎখাত করার চেষ্টা করছে। আখাউড়া শহরে অতিরিক্ত এক কোম্পানী পাকসেনা মোতায়েন রাখা হয়েছে।

নিজস্ব সংবাদদাতা জানাচ্ছেন, ত্রিপুরা-বাংলাদেশের সীমান্তে অবস্থিত গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলি সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেবার প্রেয়াসে পাকবাহিনী বিপুলসংখ্যক সেনাদল নিয়ে প্রচণ্ড আক্রমণ শুরু করেছে। এই উদ্দেশ্যেই তারা রামগড় দখলের পর আজ হটাৎ আখাউড়া ও বিবিরবাজার এলাকায় আঘাত হেনেছে।

একটি বড়সড় পাকবাহিনী আখাউড়া শহর থেকে এগিয়ে আগরতলা চেকপোস্ট থেকে মাইল  খানেক দূরে জাঘীশার সেতুর কাছে উপস্থিত হয়েছে। বিপরীত দিকে, আজ সকালে মুক্তিফৌজ আগরতলা চেকপোস্টের আড়াই মাইল দূরে ফকিরমুড়া সীমান্ত ফাড়িটি দখল করে নিয়েছে। সকাল থেকেই আখাউড়ার রাজাপুর অঞ্চলে দু’পক্ষের মধ্যে তীব্র লড়াই চলতে থাকে।

কুমিল্লা খণ্ডে লড়াইঃ সীমানার এপারে দাঁড়িয়েও গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে কামানের গোলার শব্দ চারদিকে কাঁপিয়ে তুলছে। ওদিকে আগরতলা থেকে ৬ মাইল দূরে আখাউড়া উপখণ্ডে এখনও যুদ্ধ চলছে। মুক্তিফৌজের গেরিলা কমাণ্ডোরা সাফল্যের সঙ্গে শত্রুসৈন্যদের প্রচুর সংখ্যায় হতাহত করছেন। তবে পাকিস্তানী সৈন্যদের প্রবল গোলাবর্ষণের মুখে তারা ফকিরমুড়া থেকে প্রথম পশ্চাদপসারণ করতে বাধ্য হন। আগে ৭ই মে মুক্তিবাহিনী গেরিলা আক্রমণ চালিয়ে শত্রুসৈন্যদের কসবা ও আখাউড়ার মধ্যবর্তী রাজাপুর গ্রাম থেকে বিতাড়িত করে দেন।

কৃষ্ণনগরের খবরে প্রকাশ, বাংলাদেশের পশ্চিমাংশে কুষ্টিয়া খণ্ডে ৭ই মে মুক্তিফৌজ আর পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের মধ্যে গুলি বিনিময়ে অন্তত ৫ জন পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয়েছে ও বাংকার বিধ্বস্ত হয়েছে। রাত ১টা থেকে এক ঘন্টা ধরে এই গুলি বিনিময় চলে।

আজ সকালে সীমান্তের অপর পারের এক খবরে বলা হয়েছে যে, মুক্তিফৌজ গত শুক্রবার থেকে মেহেরপুর উপখণ্ডে ভৈরব নদীর পূর্বতীরে পাকিস্তানী সৈন্যদের ঘাটির উপর শেল বর্ষণ করছে। মুক্তিফৌজের তরফের কেউ হতাহত হননি।

মুক্তিবাহিনীর চোরাগোপ্তা আক্রমণকারীরা গতকাল সন্ধ্যায় ভৈরব নদীর পশ্চিমতীরে মেহেরপুরের একটি গুপ্ত স্থান থেকে অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে একজন সুবেদারসহ বেশ কয়েকজন পাকিস্তানী সৈন্যকে হত্যা করেন। মুক্তিফৌজের গেরিলারা গতকাল রাত্রে দক্ষিণ-পশ্চিম খণ্ডে চুয়াডাঙ্গা থেকে ৯০ কিলোমিটার দূরে জয়রামপুরের কাছে রেলসেতু উড়িয়ে দিয়েছেন। ফলে দর্শনার দিকে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে এবং পাকিস্তানের রসদ সরবরাহের পথ সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন হয়েছে।

বাংলাদেশের কোনো এক স্থান থেকে খবর পাওয়া গেছে যে, ২৫ শে মার্চ থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ১৫,০০০ পাকিস্তানী সৈন্য নিহত এবং ৩০,০০০ সৈন্য আহত হয়েছে বলে বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট নেতা জানিয়েছেন।

-যুগান্তর, ১০ মে, ১৯৭১

 

বিভিন্ন রণাঙ্গনে মুক্তিফৌজের ব্যাপক গেরিলা আক্রমণ

 

কৃষ্ণনগর, ১১ মে- বাংলাদেশের বিভিন্ন রণাঙ্গনে আজ মুক্তিফৌজ ব্যাপক গেরিলা আক্রমণ চালায়। সীমান্তের ওপার থেকে পাওয়া খবরে জানা যায়, মুক্তিফৌজ কমাণ্ডোরা রংপুর জেলার কোলাঘাট, মোগলহাট ও অমরখানায় পাকিস্তানী সামরিক ঘাঁটিগুলির ওপর আক্রমণ চালিয়ে যায়। মুক্তিফৌজের কমাণ্ডো দলের আমচকা থানায় মোহলহাটে বহু পাকিস্তানী সেনা নিহত হয়।

দিনাজপুর জেলায় মুক্তিফৌজ পার্বতীপুর-সান্তাহার রেল রুটে পঞ্চবিবি ও জয়পুরহাট শহরে পাক সামরিক ঘাঁটিগুলির ওপর আক্রমণ চালিয়ে সড়ক-যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত করে ফেলে। জয়পুরহাটের সংঘর্ষে সাতজন পাকসেনা নিহত হয়। সেখানে মুক্তিফৌজ রেলওয়ে সিগন্যাল ও বিদ্যুৎ কেন্দ্র উড়িয়ে দেয়। নিকটবর্তী উরি রেলসেতুটিও বিধ্বস্ত। হিলির পাঁচ মাইল উত্তরে পাকিস্তানী সামরিক ঘাঁটির কাছে গেরিলারা একটি ডিজেল ইঞ্জিন ও কয়েকটি বগি উড়িয়ে দেয়।

পটুয়াখালী, ভোলা ও বরিশালে মুক্তিফৌজ সক্রিয়, তৎপর। দক্ষিণ-পূর্ব রণাঙ্গনে মুক্তিফৌজে ফেনী এলাকায় শোভাপুরে পাকিস্তানীদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এতে বহু পাকসৈন্য খতম হয়।

মুক্তিফৌজ কমাণ্ডোরা কুড়িগ্রামে পাকিস্তানী ঘাঁটির ওপর আক্রমণ চালিয়ে মুক্তিফৌজের ১২ জন বন্দী জওয়ানকে ছাড়িয়ে আনে। ধরলা ও কুড়িগ্রামের মধ্যে দুটি গুরুত্বপূর্ণ সেতু কমান্ডোরা ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয়। ময়মনসিংহ জেলার দুর্গাপুর থানার কাছে পাকিস্তানী সৈন্যদের সঙ্গে এক সংঘর্ষে কমাণ্ডো দল অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ ভর্তি তিনটি জীপ আটক করে।

আখাউড়া চেকপোস্ট থেকে মুক্তিফৌজ সরে গিয়েছেঃ আগরতলার খবর পাঁচদিন ধরে হানাদার বাহিনীকে বাঁধা দেওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধারা আখাউড়া চেকপোস্ট থেকে আজ বিকালে সরে গিয়েছে। মুক্তিফৌজ মহল থেকে বলা হয়েছে, সরে আসার আগে মুক্তিযোদ্ধারা ডজনখানেক পাকসেনাকে খতম করে। মুক্তিফৌজের একজন কমান্ডার জানান, রণকৌশলের অংশ হিসেবেই এই পশ্চাদপসারণ।

-আনন্দবাজার পত্রিকা, ১২ মে ১৯৭১

মুক্তিফৌজ এখনো প্রচণ্ড লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন

মুজিবনগর, ১৩ই মে (নিজস্ব প্রতিনিধি)- দক্ষিন-পূর্ব রনাঙ্গণে কুষ্টিয়া জেলার দামুড়হুদা থানার অন্তর্গত কুতুবপুরে মুক্তিফৌজ ও পাক- সৈন্যের মধ্যে প্রচণ্ড লড়াই হয়েছে। কুতুবপুরের দিকে অগ্রসর হওয়ার সময় মুক্তিফৌজ লক্ষ্য করেন যে, পাক-সৈন্যের ওপর অতর্কিত আক্রমন চালান। মুক্তিফৌজের আক্রমণের বহু পাক সৈন্য নিহত হয়। কিছু স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রশস্ত্র ও মুক্তিফৌজের দখলে এসেছে। পাক সৈন্যরা বহু গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে।

ইউ এন আই’র সংবাদে প্রকাশ, মেঘালয়ে মুক্তপুরের বিপরীত দিকে অবস্থিত জয়ন্তিপুরে পাকসৈন্য ও মুক্তিফৌজের মধ্যে আজ আবার প্রবল গোলাগুলি বিনিময় হয়েছে।

বালকের কৃতিত্বঃ রানাঘাট, ১৩ই মে – গত রবিবার মুক্তিফৌজ ইছাখালীতে যে আটজন পাকসেনাকে মেশিনগানের গুলিতে খতম করতে সক্ষম হয় তার মুলে ছিল জৈনক গ্রামবাসী বালকের কৃতিত্ব। মেহেরপুর থেকে ওই গ্রামে এসে পাকসেনারা গ্রাম ঘুরে দেখে এক গাছতলায় ছ’জন অপেক্ষা করতে থাকে ও অপর দু’জন গাছে উঠে বাইনোকুলার দিয়ে গ্রামের চার ধার লক্ষ করছিল। সেই ঘটনা উক্ত বালকের নজরে পড়ে। সে তৎক্ষনাৎ  মুক্তিফৌজের ট্রেঞ্চে গিয়ে সেই সংবাদ দিলে মুক্তিবাহিনী অতর্কিত তাদের আক্রমণ করে। এই সংবাদ জানা গেছে সদ্য আগত ই-পি-আর বাহিনীর জনৈক কর্মীর পিতার কাছ থেকে।

-যুগান্তর, ১৪ মে, ১৯৭১

 

গেরিলা আক্রমণে রেলপথ ও সেতু ধ্বংস, তামাবিল হাতছাড়া

রায়গঞ্জ, ১৪মে- বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীরা গত ৩দিনে দিনাজপুর জেলায় রেলের ওপর কয়েক দফা গেরিলা আক্রমণ চালান বলে এখানে খবর পাওয়া গিয়াছে। গতকাল রাতে কমান্ডোর হিলির কাছে চারখাই ও ডাঙ্গাপাড়া ষ্টেশনের মধ্যে রেলপথ উড়িয়ে দেন। বুধবার তাঁরা ধামাইরহাটের কাছে একদল পাকসেনার ওপর গুলি চালিয়ে ৪জন সৈন্যকে খতম করেন। মুক্তিসংগ্রামীরা মঙ্গলবার জয়পুরহাটের কাছে ৪০ ফুট দীর্ঘ একটি রেলসেতু উড়িয়ে দেন এবং একটি পাওয়ার হাউস ধ্বংস করেন। তাছাড়া পাঁচবিবি ষ্টেশনের কাছে রেললাইন উড়িয়ে দেওয়া হয়।

দু’শরও বেশী খানসেনা খতমঃ আগরতলা, ১৪ মে আজ গভীর রাত্রে মুক্তিফৌজের সুত্রে পাওয়া খবর, চট্টগ্রাম ও ফেনীর মধ্যে শুভপুর এলাকায় মুক্তিফৌজের সঙ্গে প্রচণ্ড যুদ্ধে গতকালণ ২০০ জনেরও বেশী খান- সেনা খতম হয়েছে।

কৃষ্ণনগরের খবরঃ স্বল্পবিরতির পর মুক্তিফৌজের গেরিলা ও কমান্ডোরা বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চলে পাকিস্তানী সৈন্যদের ঘাঁটিগুলির ওপর আবার আক্রমণ করেছেন।

সীমান্তের ওপার থেকে পাওয়া খবরে জানা যায়, মুক্তিফৌজের গেরিলারা গতকাল রাতে উত্তর পশ্চিমে খণ্ডে কড়িগ্রামে পাক বাহিনীর ওপর দুবার আক্রমণ চালান। ৪জন পাকসৈন্য নিহত এবং ৬জন আহত হয়। কিছু অস্ত্রশস্ত্রও গেরিলার দখল করেছেন।

মুক্তিফৌজের একদল কমান্ডো ১২ মে রাতে কুষ্টিয়া জেলায় মেহেরপুর থেকে ৩ মাইল দূরে কালাচাঁদপুরে রাস্তার ওপর একটি বড় কালভার্ত উড়িয়ে দেন।

এদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের উঃ পঃ সীমান্তে প্রদেশ থেকে আধা- সামরিক বাহিনীর লোকদের এনে পাকবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি করা হচ্ছে। ইতিমধ্যেই কুষ্টিয়া জেলার চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর একটি বেটেলিয়ানকে মোতায়েন করা হয়েছে। মেহেরপুর সীমান্তের পশ্চিম দিকে দৌলতদারের গ্রামে এবং চুয়াডাঙ্গা শহরে পাক- সৈন্যদের একটি বিরাট দল ঘাঁটি স্থাপন করেছে। তাদের সঙ্গে রয়েছে ৬০টি ট্রাক।

চুয়াডাঙ্গা- মেহেরপুরে পাকসেনাদের নৃশংসতাঃ  কৃষ্ণনগরে আগত প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, পাক টহলদার বাহিনী রোজ মেহেরপুর- চুয়াডাঙ্গা অঞ্চলে ওঁৎ পেতে থাকে। তাঁরা বেপরোয়াভাবে নিরস্ত্র লোকদের হত্যা করে মৃতদেহগুলি গর্তে ফেলে দেয়। পাকসেনারা চুয়াডাঙ্গা মহকুমার দুটি গ্রাম বাদে আর মব এলাকা তছনছ করে দিয়েছে। ব্যাপক লুটপাট, অগ্নিসংযোগ  এবং নারী নির্যাতন তাদের দৈনিক কাজ। পাকিস্তানী বর্বররা বহু তরুণীকে ধরে নিয়ে গিয়েছে। মেহেরপুরে দুটি গ্রামে হানা দিয়া পাক সেনারা ১২ জনকে হত্যা করেছে। প্রকাশ,  মুক্তিফৌজ বিভিন্ন অঞ্চলে এর আগে যেসব পরিখা খুঁড়েছিলেন, নিহত ব্যাক্তিদের মৃতদেহ ফেলে পাকসেনারা সেগুলি ভরে তুলেছে।

তামাবিল হাতছাড়াঃ ডাওকি থেকে পাওয়া খবরে জানা যায়- তিনদিন প্রবল প্রতিরোধের পর মুক্তিফৌজ আজ তামাবিল থেকে হেটে গিয়েছে। তামাবিল এখন পাকবাহিনীর দখলে। তামাবিল শ্রীহট্ট খণ্ডে বাংলাদেশের শেষ চেকপোস্ট এবং ডাওকি থেকে মাত্র দেড় কিলোমিটার দক্ষিণে।

আজ বেলা দেড়টা নাগাদ মুক্তিফৌজ সুবিধাজনক স্থানে সরে যান। পাকসেনারা তামাবিল দখলের পর বাংলাদেশের পতাকা ফেলে দিয়ে পাকিস্তানী পতাকা তোলে।

-আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৫মে, ১৯৭১।

শুভপুর সেতুর দখল নিয়ে প্রচণ্ড লড়াই, দুশো পাক সৈন্য নিহত

আগরতলা, ১৬ই মে- দক্ষিনপূর্বে অঞ্চলে কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম জেলার সংযোগরক্ষাকারী ফেনীর গুরুত্বপূর্ণ শুভপুর সেতুটির দখল নিয়ে মুক্তিফৌজের সঙ্গে লড়াইতে পাকবাহিনীর এক ব্রিগেড সৈন্যর অন্ততঃ দুশোজন প্রাণ হারিয়েছে। গত দুদিন ধরে এখানে প্রচণ্ড লড়াই চলছে।

বিলম্ব প্রাপ্ত সংবাদে প্রকাশ, গত ১৪ই মে মুক্তিফৌজের সঙ্গে ট্যাঙ্ক ও ভারী কামানোর লড়াইয়ের পর পাকবাহিনী এখানকার গুরুত্বপূর্ণ সড়কটি দখল করে। এই যুদ্ধে মুক্তিফৌজের ৩৮ জন মারা যান। বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলে মুক্তিফৌজ পাকবাহিনীর সৈন্যদের বিপুল সংখ্যায় খতম করেছে।

রাজশাহী অঞ্চলে মুক্তিফৌজ তিনজন পাকিস্তানকে শেষ করেছে। বরিশালে মুক্তিফৌজ এক পাক শিবিরের উপর হঠাৎ ঝাপিয়ে পড়ে এবং একজন অফিসার ও পাঁচজন সৈন্যকে খতম করে।

১১টি রেলসেতু ধ্বংসঃ পাকবাহিনী যাতে এগুতে না পারে সে জন্য মুক্তিফৌজ গত দু’দিণে রংপুরের কাকিনা অঞ্চলে ১১টি রেলসেতু ধ্বংস করেছে।

-যুগান্তর, ১৭ মে, ১৯৭১

কমান্ডোদের চোরাগোপ্তা আক্রমণ বহু পাকসৈন্য খতম

বহরমপুরে (পঃবঙ্গ), ১৭ মে (পি টি আই)- গতকাল মুক্তিফৌজের কমান্ডোরা রাজশাহীতে আকস্মিকভাবে হানা দিয়ে অন্তত ২৫ পাকিস্তানী সামরিক শিক্ষার্থীকে খতম করেছে। আহত করেছে ৭০ জনকে। ওপার বাংলাদেশ থেকে পাওয়া এক খবরে আজ বলা হয়েছে যে, কমান্ডোর মর্টার ও হালকা মেশিনগান নিয়ে আকস্মিকভাবে রাজশাহী পুলিশ লাইণে হানা দিলে উক্ত সামরিক শিক্ষার্থীদের সেনারা পাল্টা মর্টার ও ভারী কামান দাগালে কমান্ডোরা পালিয়ে যায়। তাদের কোনও ক্ষতি হয়নি।

আগরতলা থেকে প্রাপ্ত খবরে জানা যায়, মুক্তিফৌজের কমান্ডোরা গতকাল ও আজ বাংলাদেশের পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব খণ্ডে বিভিন্ন সৈন্য ঘাঁটিতে হানা দিয়ে ৬টি জল ও স্থলচর ট্রাক দখল করেছেন। তাছাড়া, একটি ট্রাক ধ্বংস করে প্রায় ৮০ জন সেনাকে খতম করেছেন। মুক্তিফৌজের সহিত সংশ্লিষ্ট ঘনিষ্ঠ মহলের সুত্র থেকে পাওয়া আরও সংবাদে জানা গিয়েছে যে, কুমিল্লা জেলার কসবায় মুক্তিফৌজ তিনটি পাকিস্তানী সামরিক ট্রাক দখল করে নিয়েছেন। হঠাৎ হানা দিয়ে কমান্ডোরা একজন ক্যাপ্টেন সমেত ২৮ জন সৈন্যকে খতম করেছেন।

শ্রীহট্ট সেক্টরে ৬০ জন সৈন্যসহ একটি ট্রাক ধ্বংস হয়েছে এবং ৩টি ট্রাক কমান্ডোদের দখলে এসেছে। তবে শেষোক্ত ক্ষেত্রে কোনও সৈন্যহানি না হলেও পলায়নপর সৈন্যরা প্রচুরসংখ্যক মাঝারি মেশিনগানের বুলেট ও কয়েকটি বন্দক ফেলে রেখে যায়। ঐ একই সুত্রে জানা যায় যে, মুক্তিযোদ্ধারা লাকসাম- নোয়াখালী রোডে রাখীর কাছে একটি সেতু উড়িয়ে দেন।

ইতিমধ্যে আগরতলা থেকে আর একটি খবরে প্রকাশ, পাকিস্তানী সেনারা সীমান্ত পেরিয়ে যাবার সময় দুটি পরিবারের ১৩ ব্যাক্তিকে গুলি করে খুন করেছে।

পি-টি-আই’র এক খবরে জানা যায়, বাংলাদেশের উত্তর- পশ্চিমে রংপুর খণ্ডে স্বাধীনতা যোদ্ধারা রামনগর এলাকায় একটি পাক টহলদার বাহিনীর উপর চোরাগোপ্তা আক্রমণ চালিয়ে একজন পাকিস্তানী মেজরকে সাবাড় করেন। এই আক্রমণে কয়েকজন পাকসৈন্য আহত হয়। লালমনিরহাট এলাকায় মুক্তিফৌজ হাতবান্দা ও বাউরার মধ্যে একটি রেলসেতু উড়িয়ে দেয়।

ফেনীর দক্ষিনে পাক-সেনাদেড় সঙ্গে প্রচণ্ড সংঘর্ষ পি-টি- আই’র খবরে আরও জানা যায়, যে কুমিল্লা খণ্ডে মুক্তিফৌজ ফেনীর ২০ কিলোমিটার দক্ষিনে একটি স্থাণে একটি পাকিস্তানী সেনাদলের উপর আক্রমণ চালালে সেখানে উভয় পক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয়। গঙ্গাসাগর এলাকাতেও পাক-সেনাদের সঙ্গে মুক্তিফৌজের গুলি বিনিময় হয়।

আগরতলা থেকে ইউ-এন-আই জানাচ্ছেঃ সীমান্তের ওপর থেকে প্রাপ্ত খবরে জানা গিয়েছে যে, মাধবপুর শ্রীহট্ট সড়কে মুক্তিফৌজদেড় গেরিলা বাহিনী গত ক’দিনে পাকসেনাদের দুটি কনভয়ের উপর আক্রমণ চালিয়ে ১২০ জন পাকসৈন্যকে খতম করেছেন। প্রথম কনভয়টি আক্রান্ত হয় শ্রীহট্টের নালুয়া গ্রামের নিকট। ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান গেরিলা বাহিনীর নেতৃত্ব দেন। এই আক্রমণের প্রায় ৭০জন পাকসৈন্য নিহত হয়।

                                                                    -যুগান্তর, ১৮ মে ১৯৭১

 

এক সপ্তাহের লড়াইয়ে আরও সহস্ত্রাধিক শত্রু সৈন্য নিহত

আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা সিলেট- কুমিল্লা, চট্টগ্রাম- নোয়াখালী, ময়মনসিংহ- টাঙ্গাইল, দক্ষিণ- পশ্চিম এবং উত্তরবঙ্গ সেক্টরের বিভিন্ন রঙ্গানে দিনের পর দিন পাক- ফৌজের উপর গেরিলা কৌশলে চোরাগোপ্তা কখনো ঝটিকা না অতর্কিত হামলা অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। এতে গত এক সপ্তাহে অন্তত আরো এক সহস্ত্র পাকসৈন্য নিহত হয়েছে।

গত ৯ই মে মুক্তিবাহিনী আখাউরা সাব- সেক্টর এবং বিবিরবাজার এলাকায় পাকফৌজের উপর এক অতর্কিত হামলা চালায়। মুক্তিবাহিনী আক্রমণের ফলে পাকহানাদার বাহিনীর ৩শত সৈন্যকে প্রাণ হারাতে হয়েছে। হানাদার বাহিনীর এক কোম্পানি সৈন্য বিবিরবাজার থেকে সোনামুড়া সীমান্তের দিকে অগ্রসর হতে চেষ্টা করলে মুক্তিবাহিনী সাফল্যের সাথে তাদের অগ্রাভিযান প্রতিহত করে দেয়।

একই দিকে মুক্তিবাহিনী রংপুর জেলার দুর্গাপুর থানায় পাকফৌজের একটি ঘাঁটির উপর আকস্মিক হামলা চালায়। গেরিলা কৌশলের আক্রমণে পাক- ফৌজ দিশেহারা হয়ে পড়ে এবং এলোপাতারি গোলাগুলি ছুঁড়তে থাকে। কিন্তু তবুও মুক্তিবাহিনীর অবস্থান নির্ণয় করতে বেরথ। মুক্তিবাহিনী অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে পাক- ফৌজের ৬ জন সৈন্য প্রাণ হারায়।

মুক্তিফৌজের মেহেরপুরে উপকণ্ঠে ভৈরব নদীর পূর্ব তীরে পাক-হানাদার ঘাঁটির উপর শেল বর্ষণ করে। অন্যদিকে ভৈরব নদীর পশ্চিম তীরে মেহেরপুরের একটি গুপ্তস্থান থেকে মুক্তিবাহিনী অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে একজন সুবেদারসহ বেশ কয়েকজন জল্লাদবাহিনীর সৈন্যকে হত্যা করে।

মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা দক্ষিণ-পশ্চিম খণ্ডে চুয়াডাঙ্গা থেকে প্রায় ৭ মাইল দূরে জয়রামপুরের কাছে একটি রেলসেতু উড়িয়ে দিয়েছে। ফলে দর্শনার দিকে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে এবং পাকবাহিনীর রসদ সরবারহের পথ সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন রয়েছে।

গত ১০ই মে মুক্তিবাহিনী আখাউরা সেক্টর পাক- ফৌজের উপর আকস্মিক ভাবে এক বিরাট হামলা চালায়। এই সেক্টরের প্রচণ্ড লড়াই যে ৪ শত খান সেনা খতম হয়েছে। এ ছাড়া পাক-ফৌজের কাছ থেকে মুক্তিবাহিনী একটি শক্তিশালী ট্রান্সমিটার হস্তগত করেছে।

এদিকে সিলেট জেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি তেলিপাড়া একালায় প্রবল বৃষ্টিপাতের মধ্যেই মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাক ফৌজের প্রচণ্ড লড়াই বাধে। তেলিয়াপাড়া চা-বাগানটি পূর্ণদখল করার জন্য পাক ফৌজ প্রচুর গোলাবারুদ নিয়ে মুক্তিবাহিনীর উপর আক্রমণ করে। মুক্তিবাহিনী এর সমুচিত জবাব দেয়। এই সংঘর্ষে ১২ জন পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয়। তাদের মধ্যে দুজন অফিসারও আছে।

ইয়াহিয়া- টিক্কার জল্লাদ বাহিনী কুমিল্লা জেলার তিতাস প্লান্টটি ধ্বংস করে দিয়েছে। ফলে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের শিল্প কারখানাগুলো অচল হয়ে পড়েছে।

মুক্তিবাহিনী কুমিল্লা- চট্টগ্রাম সড়কের শুভ পুরে সেতুতে অবস্থিত হানাদার বাহিনীর উপর এক আকস্মিক হামলা চালিয়ে তাদেরকে দিশেহারা করে তোলে। মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড চাপের মুখে হানাদার বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। উত্তর পশ্চিমে সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর সাথে সংঘর্ষে আরও ৬০ জন পাকফৌজের ৭টি গাড়ীতে অগ্নিসংযোগ এবং তিনটি বাংকার ধ্বংস করে দেয়া হয়।

মুক্তিবাহিনী গত মঙ্গলবার রংপুর জেলার কোলাঘাট, মোগলাই ও ওমর থানায় পাক সৈন্য ঘাঁটিগুলোর ওপর আক্রমণ চালায়। মুক্তিবাহিনীর বীরত্বপূর্ণ আক্রমণে মোগলহাট পাক ফৌজ হতাহত হয়। দিনাজপুর মুক্তিবাহিনী পার্বতীপুর – সান্তাহার রেল রুটে এবং পাঁচবিবি ও জয়পুরহাট শহরে পাকফৌজের ঘাঁটিগুলোর ওপর আক্রমণ চালিয়ে সড়ক রেল যোগাযোগ বেবস্থা বিপর্যস্ত করে ফেলেছে। জয়পুরহাটের সংঘর্ষে ৭জন পাক হানাদার খতম হয়েছে।

মুক্তিফৌজের কমান্ডোরা কুড়িগ্রামে পাকঘাঁটির ওপর আক্রমণ চালিয়ে পাকফৌজের হাতে বন্দী ১২ জন মুক্তিসেনাকে ছিনিয়ে আনে। এছারা ধারলা ও কুড়িগ্রামের মধ্যে দুটি গুরুত্বপূর্ণ সেতু কমান্ডোরা ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয়।

গত ১২ মে মুক্তিবাহিনী কসবা অঞ্চলে পাকফৌজের ওপর হামলা চালান। মুক্তিবাহিনী এখানে দু’মুখী এমন আক্রমণ চালান যে পাকফৌজ দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে। মুক্তিবাহিনী ও পাকফৌজের মধ্যে এই ভয়াভহ আক্রমণে একশত ২৭ জন পাকফৌজ নিহত হয়। এদের মধ্যে একজন মেজরও ছিলেন।

-জয়বাংলা, ১ম বর্ষ, ২য় সংখ্যা, ১৯মে, ১৯৭১

মুক্তিফৌজের অতর্কিত আক্রমণে পাকসেনারা নাজেহাল

 

আগরতলা, ১৮ই মে (পিটিআই)- গতকাল কুমিল্লা জেলায় মুক্তিফৌজের কমাণ্ডো আক্রমণে আড়াই শতাধিক পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয়েছে। মুক্তিফৌজের জনৈক কমাণ্ডার জানান, পাকসেনাদের কয়েকটি দল যখন লাকসাম থেকে ফেনী যাচ্ছিল, সেই সময় তাদের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালানো হয়।

ইউ-এন-আই জানাচ্ছেঃ গত রবিবার সকালে মুক্তিফৌজের কমাণ্ডোরা রাজশাহীতে পাক-বাহিনীকে আক্রমণ করলে প্রায় ৫০জন পাকসৈন্য নিহত হয় বলে সীমান্তের ওপার থেকে পাওয়া খবরে জানা গেছে। প্রায় চারঘন্টা স্থায়ী এই সংঘর্ষে মুক্তিফৌজের হতাতের সংখ্যা খুবই নগণ্য। গত চারদিনে রাজশাহীর বিভিন্ন এলাকায় গেরিলারা হানা দেয়। শিবগঞ্জ থানা এলাকায় সোনামসজিদে পাক-বাহিনীর ওপর গেরিলারা আক্রমণ করলে ৫ জন পাকসৈন্য নিহত হয় এবং আরও ৫ জন আহত হয়। পাক-বাহিনীর সঙ্গে ষড়যন্ত্রের অভিযোগের মুসলীম লীগ ও জামাতে ইসালামীর ১১ জন সদস্য মনাকশায় মুক্তিফৌজের হাতে প্রাণ হারায়।

-যুগান্তর, ১৯ মে, ১৯৭১

গেরিলা বাহিনীর হাতে ৬১ জন পাকসেনা খতম

 

কৃষ্ণনগর ২০শে মে (পিটিআই)- বাংলদেশের বিভিন্ন জায়গায় পাকসৈন্যদের সঙ্গে মুক্তিফৌজের গেরিলাবাহিনীর সংঘর্ষে ৬১ পাকসৈন্য খতম হয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে খবর পাওয়া গিয়াছে। আজ সকলে বাংলেদেশের কুষ্টিয়া জেলার দর্শনায় মুক্তিফৌজ কমাণ্ডোদের আক্রমণে দু’জন পাকসৈন্য নিহত হয়েছে।

জলপাইগুড়ি থেকে আমাদের নিজস্ব সংবাদদাতা জানিয়েছেন যে, উত্তরবঙ্গে মুক্তিফৌজ আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছে এবং পাঁচগড় ও অমরখানায় পাকবাহিনীর ওপর বেশ কয়েকবার অতর্কিত আক্রমণ চালিয়েছে। পাকসৈন্যরা আতঙ্কিত হয়ে শিবির থেকে বেরিয়ে আসতে অনিচ্ছা প্রকাশ করছে। একটি সূত্র থেকে জানা গিয়েছে, পাকসেনারা দিনাজপুরের বিভিন্ন পুকুরে সাঁতার শিখছে। ঠাকুরগাঁয়ে অবস্থিত পাক সেনারা একটি গীর্জা বাড়ীকে রান্নাঘরে পরিণত করেছে।

-যুগান্তর ২১ মে, ১৯৭১

 

ঢাকায় গ্রেনেড আক্রমণের কথা পরোক্ষে স্বীকার

 

নয়াদিল্লী, ২১মে (পি টি আই)-বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা বাহিনী কতৃ‌ক খোদ ঢাকা শহরের বুকে গেরিলা আক্রমণ চালাবার যে সংবাদ ইতিপূর্বে ভারতে এসে পৌছেছিল পাকিস্তান পরক্ষে তা স্বীকার করেছে। আজ সকালে পাক বেতার থেকে বলা হয়, সামরিক আইন প্রশাসক এ বলে সতর্ক করে দিয়েছেন যে, নাশকতার কাজে লিপ্ত ব্যক্তিদের কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে। ওই ঘোষণায় আর বলা হয়েছে, ঢাকা শহরে কাউকে হাত-গ্রেনেড ছোড়ার সময় ধরা হলে তাকে ওই শাস্তি দেওয়া হবে।

পাক কর্তৃপক্ষের ওই সতর্কীকরণে আরও বলা হয়েছেঃ শান্তিপ্রিয়, নাগরিকদের মনে অভাব ও ভীতির অবস্থা সৃষ্টির জন্যই ঢাকায় এই হাত-বোমা ছোড়ার ঘটনা ঘটেছে। নাশকতার কাজে লিপ্ত ব্যক্তিদের ধরিয়ে দিলে পুরষ্কার দেওয়া হবে বলে ঘোষণা করা হয়েছে।

বেতার ঘোষণায় আরও বলা হয়েছে যে ঢাকা শহরে গ্রেনেড ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে দশ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ সপ্তাহের গোড়াতে খবর পাওয়া গিয়েছিল যে, মুক্তিফৌজের কমাণ্ডো দল ঢাকায় গভর্ণরের বাসভবন, সিভিল সেক্রেটারিয়েট ও নিউ মার্কেটে মুসলিম কমারশিয়াল ব্যাংকের ওপর হানা দিয়েছে।

-আনন্দবাজার পত্রিকা, ২২শে মে, ১৯৭১

স্টীমার আটক করে ১৭ জন পাকিস্তানীর প্রাণদণ্ডাদেশ

 

রাওয়ালপিণ্ডি, ২৩ মে (এ,পি) বাংলাদেশের মুক্তিফৌজ যাত্রীবাহী স্টীমার রকেটটি আটক করেছে এবং গণআদালতে বিচার করে স্টীমারের অবাঙালি যাত্রীদের ১৭ জনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। গতকাল কূটনৈতিক মহলেই খবর দিয়েছে।

তাঁরা বলেছেন, সেনাবাহিনী যদিও বলেছেন সমস্ত প্রতিরোধ চূর্ণ করা হয়েছে তবু ওখানে যে এখনও প্রতি আক্রমণ চলছে এটাই তার বড় প্রমাণ।

ওই মহলেরই খবরঃ এই ধরনের ঘটনাগুলি ওখানে সন্ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করা হয়েছে। কোন রাজনীতিক সামরিক শাসনের সঙ্গে সহযোগিতা করছেন না এবং যেসব পশ্চিম পাকিস্তানী পূর্ববাংলায় অসামরিক কাজকর্মে লিপ্ত তাঁরা ও নিজেদের নিরাপত্তা সম্পর্কে চিন্তিত।

ওয়াকবিহাল মহলের খবরঃ মুক্তিবাহিনী মে মাসের গোড়ার দিকে স্টীমারটিকে আটক করে। স্টীমারটি ঢাকা ও খুলনার মধ্যে নিয়মিত যাতায়াত করত। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে, খুলনাই শেখের নিজস্ব অঞ্চল।

তাঁরা কালিয়া থানার জয়নগর হাইস্কুলে আয়োজিত গণআদালতে ১৭ জনকে বেছে নিয়ে বিচার করেন। একজন প্রতক্ষদর্শীর খবর, ১৭ জনের মধ্যে ১২ জনের প্রাণদণ্ডাদেশ কার্যকর হয়েছে।

-আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৪মে, ১৯৭১

নারায়ণগঞ্জ শহরে মুক্তিফৌজ গেরিলা ‘সক্রিয়’

আগরতলা ২৩ মে (পি টি আই)-সীমান্তের ওপার থেকে এখানে বিলম্বে প্রাপ্ত এক খবরে প্রকাশ, বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জ শহরে মুক্তিফৌজ গেরিলারা ‘সক্রিয়’ হয়ে উঠেছে। জানা গেল, মুক্তিফৌজ গেরিলাদের হাতবোমায় সম্প্রতি ইংল্যাণ্ড ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট অথরিটি টারমিনাল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঢাকায় শাহজাহানপুর কমাণ্ডোরা পাকসৈন্য বোঝাই ২টি জীপ উড়িয়ে দেয়।

আর এক মহল থেকে এই মর্মে খবর পাওয়া গিয়াছে সামরিক প্রশাসন কতৃপক্ষের অবাঙালি তাঁবেদাররা সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জে লক্ষীনারায়ণ কটন মিলের বহুসংখ্যক কর্মীকে খুন করেছে। মিলের ম্যানেজার ও মেডিক্যাল অফিসারও রেহাই পাননি।

-যুগান্তর ২৪মে, ১৯৭১

জীবন দিয়ে প্রতিশোধ গ্রহণ

 

মুজিবনগর, ২৪মে (পি টি আই)-ওরা পশ্চিম বাংলাদেশের রংপুর শহরের পাঁচজন ছাত্র। তাঁরা দেখেছেন, পাকসৈন্যরা তাদের মা-বাবাকে হত্যা এবং নারীদের শ্লীলতাহানি করছে। তাঁরা সংকল্প করলেন, যেভাবেই হোক এই নারকীয় হত্যার প্রতিশোধ তাঁরা নেবেন। তাঁরা মরণপণ করে একটি কমাণ্ডো দল গঠন করলেন। শত্রুখতম করাই হল তাঁদের লক্ষ্য।

মুক্তিফৌজ থেকে তাঁরা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ও হাতবোমা সংগ্রহ করলেন। আদিতমারি ও লালমনিরহাটের মধ্যবর্তী রেল লাইনের একাংশকে তাঁরা উড়িয়ে দিলেন। ঠিক সে সময় পাকসৈন্যবাহী একটি ট্রেন পুরো বেগে ঐ লাইনে যাচ্ছিল।

ট্রেনটি লাইনচ্যুত হয় এবং বহু পাকিস্তানী সৈন্য নিহত কিংবা আহত হয়। কিন্তু দু’জন কমাণ্ডোকে গুলী করে হত্যা করে।

দু’জন সহকর্মীকে বাকী তিনজন কমাণ্ডোর সংকল্প আরও দৃঢ় হল। তাঁরা লালমনিরহাট বমানঘাঁটির দিকে রওয়ানা হলেন। তাঁরা দেখলেন একটি পাকিস্তানী জেট বিমান নামছে। একজন হালকা মেশিনগান থেকে গুলি ছুড়লেন। বাকী দু’জন বিমানঘাঁটি লক্ষ করে বোমা নিক্ষেপ করলেন। বিমানঘাঁটির বেশ ক্ষতি হয়েছে।

এবার তাঁরা প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারলেন না। পাকসৈন্যরা দু’জনকে গুলি করে মারল। আহত অবস্থায় আর একজন কোনও প্রকারে পালিয়ে একটি গ্রামে প্রবেশ করতে পেরেছিলেন। গ্রামের এক বৃদ্ধ আহতকে সেবাও করেছিলেন, কিন্তু পরে তার মৃত্যু ঘটে।

-যুগান্তর, ২৫ মে, ১৯৭১

 

খোদ ঢাকায় মুক্তিবাহিনীর হামলাঃ এক সপ্তাহে

আরো ৬ শত শত্রুসৈন্য খতম

 

গত এক সপ্তাহের সংগ্রামে মুক্তিবাহিনীর হাতে আরও ৬ শতাধিক শত্রুসৈন্য প্রাণ হারায়। মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা ঢাকায় গভর্ণর হাউস, দৈনিক পাকিস্তান, সেক্রেটারিয়েট ভবন ও নিউ মার্কেটের মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাংকে হাতবোমা দিয়ে আক্রমণ চালায়।

কুমিল্লা-চট্টগ্রামের সংযোগকারী শুভপুর সেতু দখেলের জন্য মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে গত ১৪ই ও ১৫ই মে-র লড়াইয়ে প্রায় দু’শ খানসেনা খতম হয়েছে। রাজশাহী শহরের কালীহাটায় পুলিশ লাইনে গেরিলারা দখলদার সৈন্যদের উপর হামলা চালায়। ১৬ই মে মুক্তিবাহিনীর কমাণ্ডোরা বাংলাদেশের পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে বিভিন্ন সৈন্য ঘাঁটিতে হামালা চালিয়ে ৬টি স্থল ও জলযান দখল করে নিয়েছে। এছাড়া একটা ট্রাক ধ্বংস করে প্রায় ৮০ জন সৈন্যকে খতম করা হয়। কুমিল্লা জেলার কসবায় মুক্তিফৌজ ৩টি পাকিস্তানী সামরিক ট্রাক দখল করে নেয়। এই হামলায় একজন ক্যাপ্টেনসহ ১৮ জন সৈন্য খতম করা হয়। উত্তর-পশ্চিমে রংপুর অঞ্চলে মুক্তিবাহিনী রামনগর এলাকায় একটি পাক টহলদার বাহিনীর উপর আক্রমণ চালিয়ে একজন মেজরসহ কয়েকজন পাকফৌজ হতাহত করে।

মুক্তিবাহিনী চট্টগ্রাম ও ঢাকার মধ্যে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। তাছাড়া সড়কের সেতুগুলোর ব্যাপক ক্ষতিসাধন করা হয়েছে। গত ১৭ই মে দিনাজপুর জেলার হাতীডাঙ্গায় মুক্তিবাহিনীর চোরাগোপ্তা আক্রমণে ক্যাপ্টেন পদতুল্য একজন অফিসারসহ ৩৫জন পাকসৈন্য নিহত হয়েছে। মুক্তিবাহিনী পূর্বাঞ্চল সেক্টরের আখাউড়ায় এক আকস্মিক হামলা চালিয়ে গত ১৯শে মে ও ২০শে মে ৪০ জন শত্রুসেনাকে খতম করেছে। এছাড়া ঐদিন কুষ্টিয়ার মেহেরপুর মহকুমার ব্রাহ্মণপাড়া ও জীবননগরে মুক্তিবাহিনী ও পাকসেনার মধ্যে প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয়। মুক্তিবাহিনী দুটি সড়কের কালভার্ট উড়িয়ে দেয়। গত ১৯ শে মে কুষ্টিয়া জেলার কামদেবপুর গ্রামে ইছাখালী সীমান্ত ফাঁড়িটি দখল করে।

গত ১৮ই মে মুক্তিবাহিনীর কমাণ্ডোরা দক্ষিণে রেলপথ উড়িয়ে দেয়। গেরিলারা যশোরের একটি রেলসেতু ধ্বংস এবং খুলনার একটি রেল ষ্টেশনের ক্ষতি সাধন করেছে। ময়মনসিংহ সেক্টরে মুক্তিবাহিনী তিলাকালিতে এক প্লাটুন পাক সৈন্যের  ওপর হামলা চালায় এবং উক্ত এলাকার সেতুটি ধ্বংস করে। সিলেট জেলার শমসেরনগরে মুক্তিবাহিনী আক্রমণ চালিয়ে পাকফৌজের কাছ থেকে বহু অস্ত্রশস্ত্র দখল করে নিয়েছে। সাতক্ষীরা মহকুমার ভোমরায় মুক্তিবাহিনীর হামলায় পাকফৌজ দিশেহারা ও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে। ঐখানে বেশকিছু সংখ্যক সৈন্য নিহত হয়েছে। গত ১৯শে মে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় পাকসেনাদের গেরিলারা আকস্মিক হামলা চালিয়ে রংপুর ও সৈয়দপুরের মধ্যে একটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়কসেতু উড়িয়ে দেয়। বগুড়া জেলার জয়পুরহাটের কাছে মুক্তিবাহিনী ৩৪ জন পাকসেনাকে খতম করে। এছাড়া তারা অস্ত্রশস্ত্র বোঝাই ৩টি ট্রাক দখল করে।

-জয়বাংলা, ১ম বর্ষ, ৩য় সংখ্যা, ২৬শে মে ১৯৭১

 

তামাবিল ঘাটি আবার মুক্তিফৌজের দখলে

 

ডাউকি  (মেঘালয়), ২৬ মে (ইউএনআই ও পি টি আই)- আজ ৬ ঘন্টা তুমুল লড়াইয়ের পর মুক্তিফৌজ পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে ভারতীয় সীমান্ত সংলগ্ন তামাবিল ঘাটি থেকে হটিয়ে দেয়। পাকিস্তানী সৈন্যরা সরে যাবার পর মুক্তিফৌজের সেনানীরা তামাবিল ঘাটির উপর বাংলাদেশের পতাকা উঠিয়ে দেন। এখান থেকে ঐ পতাকা দেখা যায়। প্রকাশ ঐ ঘাটি থেকে সেনারা প্রচুর পরিমানের অস্ত্রশস্ত্র পেয়েছেন। মুক্তিফৌজ মহলের খবরে জানা যায় তামাবিলের লড়াইয়ে পাকিস্তানীদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

গতকাল মাঝরাত্রি থেকে লড়াই শুরু করে এবং আজ সকাল ৬ টায় লড়াই শেষ হয়। গত ১৪মে পাকিস্তানী সেনার ঘাটিটি দখল করে নিয়েছিল। তামাবিল ঘাটি ছেড়ে পালাবার আগে পাকিস্তানী সেনার তাদের পক্ষের নিহতদের মৃতদেহগুলি নিয়ে চলে যায়। প্রকাশ, পাকিস্তানী সেনারা পিছু হটে শ্রীপুর চা বাগানের দিকে চলে গেছে।

গত দিনাজপুরে মুক্তিফৌজের আক্রমনে ৩০ জন পাকসেনা নিহত হয়। পাকিস্তানী সেনারা দুটি মিলিটারী ট্রাকে করে করে ফুলবাড়ী এলাকা দিয়ে যাচ্ছিল তখন মুক্তিফৌজ অর্তকিত তাদের উপর আক্রমন চালায়।

মুক্তিফৌজের সেনানীরা দিনাজপুরের ঠাকুরগাঁও এলাকায় সেতাবগঞ্জ ও পীরগঞ্জের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ সেতু উড়িয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশে অন্যান্য এলাকায় মুক্তিফৌজ তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। কুড়িগ্রাম এলাকার কুলঘাটের কাছে গত রাত্রি থেকে মুক্তিফৌজ ও পাকিস্তানী বাহিনীর মধ্যে প্রচণ্ড লড়াই চলছে।

-আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৭ মে, ১৯৭১

বাংলাদেশের বিভিন্ন রনাঙ্গনে মুক্তিফৌজের সফল সংঘর্ষ

 

কলকাতা, ২৭শে মে (ইউ, এন, আই)- বাংলাদেশের বিভিন্ন রণক্ষেত্রে মুক্তিফৌজ তিনদিন ধরে পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সফল সংঘর্ষ চালাচ্ছে। সীমান্তের ওপার থেকে জানা গেছে, রাজশাহী খন্ডে আহত পাক সেনা বোঝাই দুটি নৌকা আক্রমন করে চারজন শত্রুসেনাকে ক্ষতম করেছে। মহেরপুর, বগুড়া, মোগলহাট এবং বরিশালেও সংঘর্ষ বাধে। পাকসেনা খতমের হিসাব এখনো পাওয়া যায়নি। খুলনা জেলায় পাকবাহিনী তাবেদার লাগিয়ে ফসল কাটাচ্ছে। গ্রামে গ্রামে পাকসেনাদের অত্যাচার ও হত্যালীলা বৃদ্ধির পথে। সম্প্রতি ত্রিশ হাজার সাঁওতাল বাংলাদেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে।

বাংলাদেশের মুক্তিফৌজ আজ বিকালে শ্রীহট্টের শ্রীপুর চা-বাগান থেকে পশ্চিমা পাকহানাদার বাহিনীকে বিতাড়িত করেছে। এই সংঘর্ষে বেশ কিছু সংখ্যক পাক সেনা নিহত হয়। মুক্তিবাহিনী দুই ট্রাক ভর্তি অস্ত্রশস্ত্র দখল করেছে বলে বাংলাদেশ সুত্রে জানা গেছে। শ্রীপুর চা বাগান বাংলাদেশের তামাবিলের চার কিলোমিটার দক্ষিণে। গতকাল মুক্তিফৌজ তামাবিল সীমান্ত ফাড়িঁটি দখল করার সময় বিপুল সংখ্যক পাক ফৌজ নিহত হয়।

শিলিগুড়ি নিজস্ব সংবাদাতা জানাচ্ছেন, গতকাল দিনাজপুর জেলার পাঁচগড় থানা এলাকার অমরখানা সীমান্ত চৌকির দিকে আগুয়ান একদল পাকসেনার উপর মুক্তিফৌজের কমান্ডোরা প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়।

ভারতীয় সীমান্ডের গ্রাম চাউলহাটির বিপরীত দিকে এখান থেকে প্রায় পনের মাইল দূরে এই অমরখানা অবস্থিত। মুক্তিফৌজের আঘাতে চারজন পাকসেনা মারা পড়ে।

-যুগান্তর, ২৮ মে, ১৯৭১

ঢাকায় আরো তীব্র হচ্ছে গেরিলা হামলা

১৫০ পাকসেনা নিহত

(অনুবাদ)

মুজিবনগর(বাংলাদেশ), ২৮শে মে- সপ্তাহের শুরুর দিকে রংপুর সেক্টরের ধরলা নদীর পারে পাকিস্তানী এবং মুক্তিবাহিনীর মধ্যবর্তী প্রবল এক সংঘর্ষে অন্তত ১৫০ জন পাকসেনা নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে পিটিআই। পাকিস্তানী আর্মিরা নদী পার হবার চেষ্টা করলে তা বানচাল করতে মুক্তিবাহিনী হামলা চালায় এবং তা প্রতিপক্ষের গুরুতর ক্ষতিসাধন করে।

এদিকে ২৬শে মে, সিলেট সেক্টরে মুক্তিবাহিনী একটি পাকিস্তানী কনভয়ে হামলা চালালে ২৫ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং আরো ১৪ জন আহত হয়। একটি ট্রাক ও একটি জীপ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মুক্তিবাহিনী একইসাথে এই সেক্টরের রেমা চা বাগানে হামলা চালালে পাকিস্তানী বাহিনী তড়িঘড়ি করে সেখান তাদের দুইটি যুদ্ধযান রেখে পালিয়ে যায় এবং মুক্তিবাহিনী তা দখল করে নেয়।

মে এর ২৩ তারিখে, মুক্তি বাহিনীর একজন ছাত্র-যোদ্ধা চট্টগ্রাম এলাকার সাম্ব্রাম এলাকায় গ্রেনেড হামলা চালালে দুইজন পাকিস্তানী সেনা নিহত হয়। একি রাতে মুক্তিবাহিনী ছাগলনাইয়া অঞ্চলের নিকটবর্তী মুহুরি নদীতে অবস্থিত একটি ব্রিজ উড়িয়ে দেয়।

ময়মনসিংহের ভটিখালিতে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানী সেনা ফাড়িতে হামলা চালায় সিলেটে জয়নায়াপুরে একটি ব্রিজ উড়িয়ে দেয়।

কুমিল্লা সেক্টরের বাজিতপুর পুলিশ স্টেশনে হামলা চালিয়ে মুক্তিবাহিনী সেখানে মজুত সকল গোলাবারুদ লুট করে নেয়।

রংপুরের পাটেশ্বরী ঘাটেও পাকিস্তানী সেনা এবং মুক্তি বাহিনীর মাঝে প্রবল সংঘর্ষ হয়, যদিও কোন হতাহতের খবর জানা যায়নি।

আমাদের শিলং অফিস আরো জানায় যে পাকিস্তানী আর্মিদের সাথে সামান্য সংঘর্ষের পর ডাউকি-সিলেট রোডে অবস্থিত সর্ববৃহৎ সারি ব্রিজটি বীর মুক্তিযোদ্ধারা গতকাল উড়িয়ে দিয়েছে।

সিলেটের মুল ভূখণ্ড থেকে পাকিস্তানী বাহিনী এখন সম্পূর্ণভাবে বিতাড়িত। অফিসিয়াল সংবাদসুত্রটি আরো জানায় যে, গোয়ালপাড়া নামক পূর্বপাকিস্তানী সীমান্ত এলাকায় পাকিস্তানী সেনাদের অবস্থান করতে দেখা গেছে।

ডাউকি থেকে ধ্রুব মজুমদার জানান, তামাবিল এবং শ্রীপুর, এই দুই স্থানেই পাকিস্তানী আর্মি বেশ শক্ত অবস্থানে থাকলেও প্রবল সংঘর্ষের পর মুক্তিবাহিনীর হাতে তার পতন ঘটে। প্রবল যুদ্ধের পর, আন্তর্জাতিক বর্ডার থেকে ১৮ মাইল দূরে অবস্থিত জয়ন্তপুর এলাকারো দখল নিয়েছে মুক্তিবাহিনী। সীমান্ত থেকে ১০ মাইল দূরে অবস্থিত হরিপুরেও পাকিস্তানী সেনার উপর হামলা শুরু করেছে মুক্তিবাহিনী।

গত শুক্রবার সিলেটে মুক্তিবাহিনী এবং পাকবাহিনী উভয়ই বেশ একটি অস্থিতিশীল অবস্থানে ছিল বলে বলা যায়। পাকিস্তানী আর্মি তাদের অবস্থান একের পর এক হারাচ্ছিল, এবং মুক্তি বাহিনী একের পর এক যুদ্ধে বিজয় লাভ করছিল। যদিও কেউই শেষ পর্যন্ত কতখানি এলাকা দখলে রাখতে পারবে, সে বিষয়ে নিশ্চিত ছিলনা।

-হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড, ২৯ মে, ১৯৭১

মুক্তিফৌজের অর্তকিত আক্রমনে শত্রুসৈন্য অতিষ্ঠ

 

আগরতলা, ২৯ শে মে (পিটিআই)- মুক্তিফৌজের গেরিলা ও কমান্ডোরাও শ্রীহট্ট, কুমিল্লা ও নোয়াখালী সেক্টরে পাকসেনাদের ঘাটিগুলির উপর প্রচণ্ড আঘাত হেনেছেন। আজ এখানে প্রাপ্ত খবরে জানা যায় যে, শ্রীহট্টে মুক্তিফৌজের আচমকা আক্রমনে ৪০ জন পাকসেনা খতম হয়, তিনটি মোটরযান বিধ্বস্ত হয় এবং প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ মুক্তিফৌজের হস্তগত হয়। প্রকাশ, দুজন পাক অফিসার ও ৭০ জন পাকসৈন্য মারা গেছেন।

মুক্তিফৌজের গেরিলারা গত ২৫ শে মে রাত্রিতে কুমিল্লা সেক্টরে সৈদামানিতে পাকসৈন্যদের উপর আক্রমন চালান এবং ২৫ জন পাকিস্তানীকে খতম করেন। এই আক্রমনে ১৪ জন পাকিস্তানী আহত হয় ও একটি পাকিস্তানী জীপ ও একটি ট্রাক বিধ্বস্ত হয় এবং ধর্মনগরে দুটি বিধ্বস্ত হয়।

নোয়াখালী জেলার ফেনী এলাকায় মুক্তিসেনারা পাকসৈন্যদের তিনটি ঘাটির উপরও আক্রমন চালায়। বহু পাকিস্তানী সৈন্য হতাহত হয়।

মুক্তিফৌজের কমান্ডোরা যশোর এলাকার উথালীতে দুটি রেল সেতু এবং রংপুর সেক্টরে হিলি ও সান্তাহারের মধ্যে ১টি রেলসেতু উড়িয়ে দেন। রংপুর জেলার তাজপুরে পাকিস্তানীদের সঙ্গে মুক্তিসেনাদের সংঘর্ষ হয়।

মুজিবনগর থেকে ইউ-এন-আই জানাচ্ছেঃ মুক্তিফৌজের গেরিলা সৈন্যরা উত্তর ও পশ্চিম রনাঙ্গনে বিগত  ৪দিনে কয়েকটি সড়কপথ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ায় কয়েকটি স্থানে পাকসৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে।

কয়েকবার আচমকা আক্রমনে তারা অনন্তপক্ষে ৮১ জন পাকসৈন্যকে খতম করেন।

মুক্তিসেনারা বিরণ ও কাঞ্চনপাড়া ষ্টেশনের মধ্যে রেললাইন বিধ্বস্ত করে দেন। পশ্চিম রনাঙ্গনের তুলাই ও কিশোরীপুরের মধ্যেও তারা রেলপথ অকেজো করে ফেলেন। রংপুর সেক্টরে পাকসৈন্যবাহিনীর একখানি ট্রেন আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ট্রেনখানি স্বর্ণমতির দিকে যাচ্ছিল। এই ঘটনায় অনন্ত ১০ জন পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয়।

-যুগান্তর, ৩০ মে, ১৯৭১

 

“আমরা ক্ষান্ত হবো নাঃ গৌরকিশোর ঘোষ

 

বুধবার হঠাৎ যখন তাদের সঙ্গে দেখা হল, তখন বেলা সাড়ে চারটা; গরমে গলগল করে ঘামছি; ওরা মুক্তিফৌজের শ্রান্ত সৈনিকেরা খোলা জীপ নিজেদের ঘাটিতে ফিরে আসছেন, সারারাত পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে নাজেহাল করে। আগের রাতে আমার পৌছাতে দেরী হয়েছিল, তাই ওদের সঙ্গে নিতে পারিনি।

দেখে আশ্চর্য লাগে, পাকিস্তান সরকারের এত সোচ্চার প্রচারের পরও বেনাপোলে পাকিস্তান ঘাটির শীর্ষে এখনো বাংলাদেশের জয়বাংলা পতাকা পতপত করে উড়ছে।

দিনের বেলা এলে ছবি নিতে পারতেন। মুক্তিফৌজের ঘাঁটিতে একজন বললেন। বললেন, তাদের যারা মনে করছেন আমরা শেষ হয়ে গেছি, আমরা এখনো শেষ হইনি। মাতৃভূমির দখল নেবার আগে আমরা ক্ষান্ত হবো না।

-আনন্দবাজার পত্রিকা, ৩১ মে, ১৯৭১

মুক্তিফৌজের আক্রমণে ১০০ পাকসেনা নিহত

(অনুবাদ)

৩০ মে- ফেনীর ও আশুগঞ্জের বিভিন্ন জায়গায় মুক্তিফৌজের তীব্র কমান্ডো হামলায় পাক বাহিনীকে কোনঠাসা করে রাখা হয়েছে বিগত ৪৮ ঘন্টা যাবৎ। পাকিস্তানী বাহিনীর উপর হানা দিয়ে ব্যাপক হতাহত ঘটাচ্ছে মুক্তিফৌজ। সীমান্তে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ৪০ জন অফিসারসহ ১০০ এর উপরে পাকসেনা এ্যামবুশ করে হত্যা করেছে মুক্তিফৌজ।

এছাড়াও মুক্তিযোদ্ধারা তিনটি রেল ও একটি সড়ক সেতু উড়িয়ে দিয়েছে। নষ্ট করা হয়েছে রেলের ইঞ্জিন, ধ্বংস করা হয়েছে ২টি মটর ও বিভিন্ন যানবাহন।

বিভিন্ন স্থানে রেলসেতু ধ্বংস করার সফল অভিযানের পর কুমিল্লা ও আশুগঞ্জের রেল যোগাযোগ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।

-হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড, ৩১ মে ১৯৭১

ভারতীয় এলাকায় পাকসেনাদের গোলাবর্ষণ অব্যাহত

 

কলকাতা, ৩ জুন- পাকিস্তানী সেনারা ভারতীয় এলাকার মধ্যে অসামরিক অঞ্চলসমূহ যথারীতি গোলা বর্ষণ চালিয়ে যাচ্ছে। ইউএনআই জানাচ্ছে গতকাল কোচবিহার জেলার সীমান্তবর্তী চারটি গ্রামে পাকসেনাদের গোলাবর্ষনে একজন গ্রামবাসী আহত হয়। গত চারদিন ধরেই পাকসেনারা এই গ্রামগুলিতে প্রচুর গোলাগুলি চালাচ্ছে। ফলে এক বিরাট সংখ্যক মানুষ গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে।

আসামের গোয়ালপাড়া জেলার সোনাহাট ও তৎসন্নিহিত গ্রামগুলিতে গতরাতে পাকসেনারা কামান থেকে গোলা চালায়। সরকারী সুত্রের রির্পোটে জানা যায় যে গতকাল সকাল ১১ টা থেকেই পাকসেনারা ঐ অঞ্চলে মারাত্বকভাবে গুলি চালাতে শুরু করে এবং আজ সকাল পর্যন্ত চালায়।

মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে বহু পাকসৈন্য খতমঃ সীমান্তের ওপর থেকে জলপাইগুড়িতে প্রাপ্ত সংবাদে বলা হয় যে, গত ২৪ ঘন্টায় বাংলাদেশে মুক্তিবাহিনী উত্তর রনাঙ্গনে গেরিলা তৎপরতা বৃদ্ধি করেছে। কোচবিহারের অপরপারে ভুরুঙ্গামারির সীমান্ত চেকপোষ্ট থেকে তারা ইয়াহিয়া বাহিনী উত্তর রনাঙ্গনে গেরিলা তৎপরতা বৃদ্ধি করেছে। কোচবিহারের অপরপারে ভুরুঙ্গমারির সীমান্ত চেকপোষ্ট থেকে তারা ইয়াহিয়া বাহিনীকে হটিয়ে দিয়েছে। এখানকার যুদ্ধে কমপক্ষে সাতজন খান সেনা নিহত হয়।

চিলাহাটি ও ডোমার ও এরমধ্যে তিস্তার উপর এবং কাকিনা ও ভূষিরবন্দর- এর মধ্যে সানায়াজনসন নদীর উপর মোট ৩টি সেতু মুক্তিসেনারা ধধ্বং করে দেয়। ফলে লালমনিরহাটের দিকে পলায়নপর খানসেনাদের একটি দল বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। দিনাজপুর জগদলে আগুয়ান পাক সেনাদলকে মুক্তিযোদ্ধারা বাধা দেয় এবং ঠাকুরগাঁও পাওয়ার হাউসটি ক্ষতিসাধন করে। এই আকস্মিক আক্রমনের ফলে বহু পাকসেনা নিহত হয়েছে। রংপুর জেলার ডিমলা ও বয়রাতে ইয়াহিয়ার সাতজন গুপ্তচরকে মুক্তিযোদ্ধারা খতম করে এরা মুসলিম লীগ ও জামাত-ই ইসলামী দলের লোক বলেও প্রকাশ।

-কালান্তর, ১জুন, ১৯৭১

 

চুকনগরে পাকসৈন্যের বেপরোয়া গুলি

 

হাকিমপুর ৩১ মে (সংবাদদাতা)- পাকিস্তানী সামরিক বর্বরতা অবশেষে সহ্যের সীমা পেরিয়ে গেছে। গত ২০ মে খুলনার বৈঠাঘাটা, ফকিরহাট, রামপাল, নকিপুর প্রভৃতি অঞ্চল থেকে প্রায় দেড় লক্ষের মত অসহায় মানুষ সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে চলে আসার সময় চুকনগরে বর্বর বাহিনী তাঁদের ওপর মেশিনগান দিয়ে বেপরোয়া গুলিবর্ষন করে। এর ফলে সেখানে বহুসংখ্যক নারী-পুরুষ-শিশু নিহত হয়।

ঘটনার বিবরণে প্রকাশ, খুলনার দক্ষিণাঞ্চল থেকে আনুমানিক দেড় লক্ষ মানুষ সামরিক বাহিনীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে গত ১৯ মে কয়েক হাজার নৌকা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। চুকনগরের নিকটবর্তী নদীর ওপরে তাদের লক্ষ্য করে গুলি চালালে কয়েক হাজার নারী-পুরুষ ও শিশু বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং পদব্রজে রওয়ানা হয়ে যায়। চুকনগরে তারা মিলিটারীর সম্মুখীন হয়। সে সময় পিছনে যারা তাঁরা মেশিনগানের শব্দ শুনে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। চুকনগরের বাজারের বিভিন্ন ঘর গুলোতে শরণার্থীরা আশ্রয় নিলে বর্বর বাহিনী সেখানে গিয়ে ঘর থেকে বের করে তাদের অনেককে হত্যা করে।

সীমান্ত অতিক্রম করার পর শতাধিক আহতকে হাকিমপুরে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়। ২২ তারিখে গুলিতে আহত শরণার্থীর সংখ্যা প্রায় দেড়শত বলে হাকিমপুরের মুক্তিফৌজের চিকিৎসক জানান।

বাংলাদেশের বিভিন্ন রণাঙ্গনে গেরিলা বাহিনীর তৎপরতা

 

আগরতলা, ১ জুন (ইউএনআই)- মুক্তিফৌজ গেরিলা বাহিনী শ্রীহট্র সেক্টরের তেলিপাড়া ও আখাউড়ার মধ্যে সংযোগকারী রেল সেতুটি উড়িয়ে দিয়েছে। গেরিলা বাহিনী এই স্টেশন দু’টি দখলের জন্য পাকফৌজের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে।

একটি পাকিস্তানী জীপগাড়ির ওপর গেরিলা বাহিনী অতর্কিতে আক্রমণ করে শত্রুপক্ষের ২ জনকে খতম করে। কুমিল্লা সেক্টরে গেরিলাবাহিনী রেল ইঞ্জিন ও ওয়াগনকে লাইনচ্যুত করে দিতে সক্ষম হয় বলে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধাদের সংবাদে প্রকাশ। ময়মনসিংহ সেক্টরে গেরিলা বাহিনী পাকফৌজের ওপর অতর্কিত আক্রমণ করে ৭ জন পাকসৈন্যকে সশস্ত্র অবস্থায় গ্রেফতার করে। পাক ঘাঁটির পাকিস্তানী পতাকা পুড়িয়ে দিয়ে গেরিলারা সেখানে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন।

-কালান্তর, ২ জুন ১৯৭১

কমান্ডো আক্রমণে পাকসৈন্য মরছে

 

আগরতলা ৩রা জুন (ইউএনআই)- বিভিন্ন স্থানে পাকসৈন্যের ওপর মুক্তিফৌজের কমান্ডো আক্রমণে আবার জোরদার হয়ে উঠেছে। গজারিয়া, চাঁদহাট, রাজানগর ও ফরিদপুর এলাকায় মুক্তিফৌজের আক্রমণে পাকসৈন্য নাজেহাল হয়েছে।

বগুড়া অঞ্চলে পয়লা জুন মুক্তিফৌজ পাকসৈন্যের একটি সাঁজোয়া গাড়ী দখল করে নেন। ঐ গাড়ীতে তিনটি রেডিও সেট ও ছয়টি স্টেনগান ছিল। একজন কমন্ডারের গাড়ী ও মুক্তিফৌজ দখল করে নেন। পশ্চিম বগুড়ার আর একস্থানে আক্রমণ চালিয়ে তাঁরা কয়েকজন পাকসৈন্যকে খতম করেন। আর একটি সংঘর্ষে পাকিস্তানের টহলদার বাহিনীর সাতজন সৈন্য নিহত ও দুজন আহত হয়।

আসাম সংলগ্ন কানিরঘাটে মুক্তিফৌজের সঙ্গে প্রবল লড়াই চলছে। মুক্তিফৌজের এই শক্তঘাঁটিতে পাকিস্তানকে ব্যাটালিয়ন সৈন্য নিয়োগ করতে হয়েছে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে গত ২৪ ঘণ্টায় মুক্তিফৌজের কমান্ডো আক্রমণ প্রবল হয়ে উঠেছে। কোচবিহারের বিপরীত দিকে অবস্থিত ভূরুঙ্গামারী চৌকি থেকে পাকসৈন্যদের হটিয়ে দেওয়া হয়েছে।

চিলহাটি ও ডোমারের মধ্যবর্তী তিস্তাসেতু এবং কাকিনা ও ভূষিরবন্দরের মধ্যবর্তী সানিয়াজানা সেতুকে মুক্তিফৌজ উড়িয়ে দিয়েছেন। ফলে পাকিস্তানী সৈন্যরা কাকিনাতে আটক হয়ে পড়েছে। তাদের লালমনিরহাটে ফিরে যাবার পথ নেই।

দিনাজপুরের জগদলে গেরিলা বাহিনী পাকসৈন্যের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালান। প্রচুর পাকসৈন্য হতাহত হয়েছে। ঠাকুরগাঁয়ের একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রেও মুক্তিফৌজ নষ্ট করে দিয়েছেন। রংপুরজেলার ডিমলা ও বাউরাতে মুসলিম লীগের সাতজন পাকিস্তানী গুপ্তচরকে মুক্তিফৌজ খতম করেন।

গত সপ্তাহে মুক্তিফৌজের কমান্ডো আক্রমণে ফেনী এলাকায় চারজন অফিসারসহ শতাধিক পাকসৈন্য নিহত হয়েছে। কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম ও জগ্ননাথদিঘীর মধ্যবর্তী কোন একস্থানে সোমবার মুক্তিফৌজ পাকসৈন্যের একটি জীপের ওপর আক্রমণ চালান। বিদ্ধস্ত জীপের ৪ জন আরোহী নিহত হয়। পয়লা জুন কসবা ও আখাউড়ার মধ্যবর্তী গঙ্গাসাগরের কাছে মুক্তিফৌজের আক্রমণে কয়েকজন পাকসৈন্য হতাহত হয়েছে। ত্রিপুরার সাব্রুমের বিপরীত দিকে অবস্থিত চট্রগ্রামের রামগড় এলাকায়ও কয়েকটি সংঘর্ষ হয়েছে।

-আনন্দবাজার পত্রিকা, ৪জুন, ১৯৭১

মুক্তিফৌজের গেরিলা কৌশল সফলতার মুখ দেখছে

(অনুবাদ)

আগরতলা জুন ৪

চট্টগ্রাম পার্বত্য বিভিন্ন স্থান,নোয়াখালী, কুমিল্লা, সালদানদী, গঙ্গাসাগর ও আখাউড়া সেক্টরে সালদানদী এলাকায় নিযুক্ত পাকিস্তানি আর্মির উপর গেরিলা কৌশল ব্যবহার করে মুক্তি ফৌজ কমান্ডোরা হামলা চালায়। নিহত হওয়া পাকি সেনার মধ্যে এখন ছিল মেজর দোউরানি। যে মার্চ এবং এপ্রিল মাসে কুমিল্লা শহরে গণহত্যা চালিয়েছিল।

সীমান্তের ওপাশ থেকে আসা আরেকটা রিপোর্ট বলে ‘’পাকিস্তানি বাহিনী তথাকথিত বাংলাদেশের

বিভিন্ন স্থানে গঠিত হওয়া শান্তি কমিটির উপর ক্রমান্বয়ে আস্থা হারাতে শুরু করে। পাকি সেনারা ফেনী এবং লাকসামে শান্তি কমিটির কমপক্ষে পাঁচ সদস্যকে হত্যা করেছে।

জুনের ২ তারিখ পাকি সেনারা ‘’ পিজে চামার্স’’ নামের এক বিদেশি কে হত্যা করে, যিনি সিলেটের ‘নুলতা টি স্টেইট’ দেখা শুনা করতেন। তারা চা বাগানের ২০ জন শ্রমিক কে ও হত্যা করে। পাক সেনা কর্মকর্তারা মিস্টার চামার্সের কাছ থেকে সৈন্যদের জন্য রেশন, জ্বালানি এবং চা দাবি করে। কিন্তু তিনি তার অর্থনৈতিক সংকট এবং দেশের মনমরা অর্থনীতির কথা চিন্তা করে তাদের দাবি মেটানোর অক্ষমতা প্রকাশ করেন।

এজেন্সি আরো জানায়ঃ বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমে মেহেরপুর শহরের লাক্ষাছড়ি গ্রামে মুক্তি যোদ্ধাদের সাথে গুলি বিনিময়কালে একজন অফিসার সহ ৪ জন পাকি সৈন্য নিহত হয় এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়।

মুক্তি ফৌজরা কালভাট, ব্রিজ এবং পাকা সড়কের কাছে মাইন পুতে। ফরিদপুরে মুক্তি বাহিনী একটা ব্রিজ এবং একটা পাকিস্তানি পোস্ট গুড়িয়ে দেয়।

মুক্তিযোদ্ধারা রাঙ্গামাটি এলাকায় সব গুলো গ্রাম পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। পত্নিতলা থেকে ৬ মাইল উত্তরে মুক্তিযোদ্ধারা একটি সেনা চৌকি উড়িয়ে দেয়।

সিলেট সেক্তরে মুক্তিযোদ্ধারা ২ টা  ব্রিজ এবং সরলবাগে পাকি সেনাদের অবস্থানের উপর হামলার রিপোর্ট দেয়। সমশেরনগর সীমান্তের কাছে মুক্তিযোদ্ধারা পাকি সেনাদের উপর গুলি চালায়।

রংপুর সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধারা পাকি সেনাদের একটি গানবোট ডুবিয়ে দেয় এবং শিরাজগঞ্জ এলাকার কাছে একটা রেল  ব্রিজ উড়িয়ে দেয়।

কুমিল্লা সেক্টরে মুক্তিবাহিনী সেনা অবস্থানের উপর হামলা চালায় এবং ক্রনে বাজারে ২৫ পাকি সৈন্য কে হত্যা করে।

আমাদের কুচবিহার প্রতিনিধি জানায় যে পাকি সৈন্যরা মোগলহাট সীমান্ত থেকে ভারতের গিতালদাহ বর্ডার আউট পোস্তে হামলা চালায়। সীমান্ত রক্ষী বাহিনী( বিএসএফের) সাথে তাদের এক ঘন্টা গুলি বিনিময় চলে।

বাংলাদেশের কান্থালবারতি এলাকায় মুক্তুবাহিনি এবং পাকিস্তানি সৈন্যদের সাথে সংঘর্ষ কালে ভারতীয় সীমান্তের মুর্শিদাবাদ জেলার লালগোলা এলাকায় কিছু পাকিস্তানি মর্টার শেল এসে পড়ে।  এখবর বহরমপুর থেকে অফিসিয়ালি জানা গেছে।

– হিন্দুস্থান টাইমস, ৫ জুন ১৯৭১

পাকসৈন্যরা মুজিবনগর দখলে ব্যর্থ

কৃষ্ণনগর, ৫ই জুন- সীমান্তের ওপার থেকে পাওয়া সংবাদে জানা গেছে যে, পাকিস্তানী সৈন্যরা মুজিবনগর দখল করতে এলে গত দু’দিনে মুক্তিফৌজের হাতে ৩৫জন পাকসৈন্য নিহত হয় এবং বেশ কয়েকজন পাকসেনা আহত হয়। মুজিবনগর দখলের এই লড়াইয়ে পাকসেনা নাজেহাল হয়ে এবং শেষ পর্যন্ত তারা তাদের ঘাঁটিতে ফিরে যেতে বাধ্য হয়। যাবার সময় তারা তাদের হতাহত সহকর্মীদের নিজেদের ঘাঁটিতে নিয়ে চলে যায়। মুক্তিফৌজের কেউ হতাহত হয়নি।

কার্ফু করে গ্রেফতার ও হত্যাঃ এদিকে পাকসৈন্যরা শহর ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় খণ্ড খণ্ড এলাকা ধরে কার্ফু জারী করে দিচ্ছে। এবং তারপর বাড়ী বাড়ী তল্লাশী চালিয়ে যুবকদের ধরে এনে ফায়ারিং স্কোয়াডে দাড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করেছে। এ খবরটি দিয়েছেন আওয়ামী লীগের একজন মুখপাত্র।

-যুগান্তর, ৬ জুন, ১৯৭১।

 

মুক্তিযুদ্ধ চলছে

 

রায়গঞ্জ, ৬ই জুন (পি টি আই)- দিনাজপুরের পাক হিলি এলাকায় মুক্তিফৌজের গেরিলারা সম্প্রতি বিজুল শিবির আক্রমণ করেন। ৫ জন পাকসৈন্য নিহত এবং অন্য দু’জন আহত হয়। দিনাজপুর অঞ্চলে মুক্তিফৌজ বাগজানা পাক সামরিক ঘাঁটিতে তৎপরতা চালিয়ে ৬০ জন পাকসৈন্য খতম করেন। ৪ জনকে বন্দী করা হয়েছে। প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র মুক্তিফৌজের হাতে এসেছে।

কুষ্টিয়ায় গত কয়েকদিনের কলেরায় প্রায় ২০ জন পাকসৈন্য খতম হয়েছে। কলেরা মহামারী জেলার পাকসৈন্যদের মনে প্রবল ভীতির সঞ্চার করেছে।

শরণার্থী সেবাদলঃ বিভিন্ন শরণার্থী শিবির থেকে ৬০ জন শরণার্থী যুবক কলকাতায় সমাজসেবা সম্পর্কে ট্রেনিং লাভ করেছেন। গান্ধী শান্তি সংস্থা ঐ শরণার্থী যুবকদের প্রাথমিক চিকিৎসা, নার্সিং, আহার তৈরী ও বন্টন এবং স্বাস্থ্য সম্পর্কে ট্রেনিং দিচ্ছেন। এই যুবকরা বিভিন্ন শিবির খোলা হবে বলে শান্তি সংস্থার জনৈক মুখপাত্র জানান। পূর্বাঞ্চলে শরণার্থী যুবকদের জন্য ছয়টি ট্রেনিং কেন্দ্র খোলা হবে বলে শান্তি সংস্থার জনৈক মুখপাত্র জানান। পূর্বাঞ্চলে শরণার্থী যুবকদের জন্য ছয়টি ট্রেনিং কেন্দ্র খোলা হবে আশা করা যায়।

নৌকার মধ্যে ৩ হাজার শরণার্থীঃ ২৪ পরগনা জেলার হাসনাবাদ সীমান্তে ইছামতী নদীর ওপর দেশী নৌকার মধ্যে প্রায় তিন হাজার শরণার্থী বাস করছেন।

-যুগান্তর, ৭ জুন ১৯৭১

 

মুক্তিফৌজের ব্যাপক ও প্রচণ্ড আক্রমণে বহু পাকসৈন্য খতম

আগরতলা, ৮ই জুন (পি টি আই)- বাংলাদেশের পুর্বাঞ্চলে কুমিল্লা জেলার সামরিক গুরুত্বপূর্ণ কসবা এলাকায় মুক্তিফৌজ আবার নতুন করে আক্রমণ শুরু করেছে। আজ এখানে প্রাপ্ত সংবাদে জানা গেছে যে, গতকাল মুক্তিফৌজ মর্টার ও মেশিনগান নিয়ে প্রচণ্ড আক্রমণ চালালে তেত্রিশজন পাকসৈন্য নিহত হয় এবং পাকসৈন্যরা কসবা থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার দূরে সরে যেতে বাধ্য হয়। পাকসৈন্যদের জন্য যুবতী নারী সংগ্রহ করে দেওয়ার অপরাধে মুক্তিফৌজ ৬ জন পাক দালালকেও গুলি করে হত্যা করেছে।

মুক্তিফৌজ গেরিলাবাহিনীও গতকাল কসবার নিকটবর্তী গঙ্গাসাগরে ত্রিমূখী আক্রমণ চালিয়ে ২৮ জন পাকসৈন্য খতম করে।

আরও দক্ষিণে মুক্তিফৌজ গতকাল নোয়াখালী জেলার চাঁদ্গাজী, ছাগলনাইয়া, বান্ধুরা, আমতলী ও জগ্ননাথদিঘী এলাকায় তাদের তৎপরতা বিস্তৃত করে এবং পাকসৈন্যদের পশ্চাদপসরণ করে ফেনী শহরে সরে যেতে বাধ্য করে।

রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, এই সকল অঞ্চলে মুক্তিফৌজ কমান্ডো বাহিনীর সঙ্গে দু’দিনব্যাপী প্রচণ্ড যুদ্ধে বহু পাকসৈন্য হতাহত হয়েছে। ফেনী শহরের উপকন্ঠে মুক্তিফৌজের গেরিলা দল লুকিয়ে থেকে অতর্কিত সাফল্যের সঙ্গে এক প্লাটুন পাকসৈন্যকে আক্রমণ করে। পাকসৈন্যরা ঐ সময় একটা ছোট নদী পার হচ্ছিল গেরিলাদের আক্রমণে সাতজন পাকসৈন্য এবং অপর কয়েকজন আহত হয়।

রংপুর জেলায়ও তৎপরতাঃ কোচবিহার থেকে পিটিআই জানাচ্ছেন যে মুক্তিফৌজ গতকাল রাতে বাংলাদেশের রংপুর জেলার নাগেশ্বরী থানার এলাকাধীন মুকসী গ্রামে অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে অনূন্য বারজন পাকিস্তানী সৈন্য খতম করেছে। আজ এখানে সংবাদ পাওয়া গেছে যে, ঐ অঞ্চলের গ্রামে গ্রামে অগ্নিসংযোগরত একটি পাকিস্তানী সৈন্য খতম করেছে। আজ এখানে সংবাদ যে, ঐ অঞ্চলের গ্রামে গ্রামে অগ্নিসংযোগরত একটি পাকিস্তানী টহলদার বাহিনীর সৈন্যদের ওপরই মুক্তিফৌজ এই আক্রমণ চালায়। মুক্তিফৌজ ভূরুঙ্গামারীতে একটি পাকঘাঁটির ওপর হানা দিয়ে দুজন পাকসৈন্যকে গুরুতরভাবে জখম করেছে। মুক্তিফৌজ পাকসৈন্যদের সঙ্গে গুলী বিনিময় করে এবং তাহাতে কয়েকজন পাকসৈন্য নিহত হয়। এই সকল অভিযানে মুক্তিফৌজের মাত্র দু’জন আহত হয়েছে।

মুজিবনগর থেকে প্রাপ্ত খবরে বলা হয়েছে যে, রবিবার রাতে রাজশাহী খন্ডে মুক্তিফৌজ অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে জনৈক মেজর সহ ৪৯ জন পাকিস্তানী সেনাকে বন্দী করেছে।

-যুগান্তর, ৯ জুন ১৯৭১

মুক্তিফৌজ ঘনীভূত হচ্ছে

মুজিবনগর ৯ জুন

ইউ এন আইয়ের ভাষ্য মতে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি সেনাদের ছোট ছোট দল এবং সেনা চকির উপর গেরিলা হামলা জোরদার করেছে। যশোর সেক্টরে এক আর্মি লেফটেন্যান্ট কে ঘিরে ধরে কয়েকদিন আগে ফরিদপুরে মেরয় ফেলা হয়। জুনের ৬ তারিখ মুক্তিবাহিনী একটি সেনাবহরের উপর এম্ব্যুশ করে। এই হামলায় একজন জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার সহ ৮ জন সৈন্য নিহত হয়।গেরিলারা জুনের ৭ তারিখ যশোরে কিছু পাকিস্তানি সৈন্যের উপর গুলি চালায়।পঞ্চগড় এবং রুহিলে মুক্তিবাহিনী ২ টা ব্রিজ উড়িয়ে দেয় এবং রংপুর সেক্টরে পাকিস্তানি সৈন্যদের ব্যাপক হাতাহতের ঘটনা ঘটে।পত্নীতলা হতে ১৫ মাইল দূরে মুক্তিবাহিনী মর্টার এবং ছোট অস্ত্র নিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যদের উপর হামলা করে।ধরলা নদীর উত্তর পশ্চিম দিকের এলাকায় গেরিলা রা বেশ সক্রিয় ছিলো। তেঁতুলিয়া এলাকায় তারা ২ জন পাকিস্তানি এজেন্ট কে গুলি করে হত্যয় করে।অতি বৃষ্টির কারনে কঁাচা রাস্তা ঘাট কর্দমাক্ত হয়ে যা এবং যানবাহন চলাচলের অনুপযোগী হয়ে উঠে।কুমিল্লা এলাকায় পাঞ্জাবি এবং পাঠান সৈন্যদের মধ্যেদের গোলাগুলি হয়েছে। পিটিআই এর মতে গতকাল রংপুর এরিয়ায় ভুরুঙ্গামারিতে মুক্তিফৌজ এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সংঘর্ষে কালে বেশ কয়েকজন পাকি সৈন্য নিহত হয়।খুলনা কালিগঞ্জে মুক্তিবাহিনী ৮ টি সেনা বাঙ্কার উড়িয়ে দেয়। রির্পোটারের ভাষ্য মতে ৮ জন সৈন্য কে মুক্তিবাহিনী হত্যা করে। ময়মনসিংহে মুক্তিবাহিনী বিশ্বাসযোগ্য সূত্রের ভিত্তি তে রাজাকারদের খোঁজে শিবপুর গ্রামে অভিযান চালায়। এবং ৬ রাজাকার কে অতর্কিত হামলা করে হত্যা করে।বারেঙ্গাপাড়া তে মুক্তিবাহিনী একটি সেনা পোষ্টে হামলা চালায়, দুই পক্ষের গোলাগুলি তে অনেক পাকিস্তানি সৈন্যের হতাহতের ঘটনা ঘটে।জয়ন্তপুরে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি সৈন্যদের অবস্থানে অভিযান চালায়।মাইনের আঘাতে এক পাকি অফিসারের দেহ ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।ছটলেখানে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডোরা হামলা চালালে ৫ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়।

-হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড, ১০ জুন, ১৯৭১

মুক্তিযোদ্ধারা দেশের মাটি থেকে পাক হানাদারদের

উৎখাত করতে বদ্ধপরিকর

কলকাতা, ১০ জুন- গণপ্রজাতন্ত্রী স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী জনাব এম মনসুর আলী বাংলাদেশের পুর্বাঞ্চলে চার দিনব্যাপী সফরের পর আজ মুজিবনগরে প্রত্যাবর্তন করে বলেছেন, “বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা দেশের মাটি থেকে পাক হানাদারদের উৎখাত করতে বদ্ধপরিকর।”

ঐ সফরের সময় তিনি মুক্তিফৌজ নিয়ন্ত্রিত কতিপয় শিবির পরিদর্শন করেন। তিনি জানান, ঐ শিবিরসমূহে তিনি “তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে অদম্য মনোবল ও অনমনীয় দৃঢ়তা” পরিলক্ষিত করেছেন। এই খবর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রচার করেছে।

পাক’ স্বাগত কেন্দ্র গুলি বন্দী শিবিরের সঙ্গে তুলনীয়ঃ আকাশবাণী’র খবরে প্রকাশ, বাংলাদেশ সরকারের জনৈক মুখপাত্র বাংলাদেশের পাক সামরিক কর্তৃপক্ষ কর্তৃক (শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য) প্রতিষ্ঠিত তথাকথিত ‘স্বাগত কেন্দ্র’ গুলিকে বন্দী শিবিরের সঙ্গে তুলনা করেছেন।

তিনি জানান, সম্প্রতি ভারতের পথে আসার সময় বহু সংখ্যক শরণার্থীকে পাক সামরিক কর্তৃপক্ষ জোর করে ঐ স্বাগত কেন্দ্র গুলিতে ধরে নিয়ে গেছে।

ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিকের অধিকাংশ বাঙালি কর্মচারী ছাঁটাইঃ ঢাকা থেকে পাকসামরিক কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত ইংরাজী দৈনিক মর্নিং নিউজ পত্রিকার অধিকাংশ বাঙালি কর্মচারীকে কর্মচ্যুত করা হয়েছে বলে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে সংবাদ প্রচার করেছে। পাক অধিকৃত বাংলাদেশে সামরিক কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত ঐ সকল পত্রিকার কোন গ্রাহক নেই। সামরিক কর্তারা পত্রিকার ২০০০ কপি কিনে নেন, মাঝে মাঝে সেনাদের মধ্যে বিমান থেকে ওগুলো ফেলে দেওয়া হয়। কিন্তু সাধারণ নিরপেক্ষ কোন বেসামরিক পাঠক নেই।

পাক নৃশংসতার বিরুদ্ধে ডন পত্রিকার প্রাক্তন সম্পাদকের কণ্ঠস্বর করাচীর ডন পত্রিকার প্রাক্তন সম্পাদক জনাব আলী জাফরী আজ লণ্ডনে বাংলাদেশে সংঘটিত পাক নৃশংসতার বিরুদ্ধে দৃপ্ত প্রতিবাদ জানিয়ে জনসাধারণের কাছে এই মর্মে আবেদন জানিয়েছেন যে, তাঁরা যেন ইংল্যাণ্ড ও পাকিস্তানের মধ্যে অনুষ্ঠিতব্য পরবর্তী টেষ্ট ম্যাচগুলি বয়কট করেন।

জনাব আলী জাফরী ইতিপুর্বে পাকিস্তানে ব্যাক্তি স্বাধীনতা অপহরণের প্রতিবাদে পাক নাগরিকত্ব বর্জন করেছিলেন।

চুয়াডাঙ্গায় পাক সেনাদের মধ্যে “সেম সাইড’’ কলকাতা, ১০ জুন বাংলাদেশের গেরিলাবাহিনীর তৎপরতা আরো তীব্র হয়ে উঠেছে। গেরিলাদের হাতে মার খেয়ে পাক হানাদাররা নিজেদের মধ্যে সেম সাইড করে বসেছে। চুয়াডাঙ্গার কাছে দুই দল পাক সৈন্যের পরস্পর সংঘর্ষে ১৩ জন নিহত হয়েছে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র আজ সন্ধ্যায় ঐ সংবাদের কথা উল্লেখ করে চুয়াডাঙ্গার শেয়ালমারীতে গেরিলা বাহিনীর একটি উল্লেখযোগ্য সাফল্যের সংবাদ দিয়েছে।

প্রকাশ, গত ৫ জুন শেয়ালমারীতে মাইন বিস্ফোরণে ২ টি সামরিক ট্রাক ধ্বংস হয়ে ২৯ জন পাকহানাদার নিহত এবং ৪ জন আহত হয়। হানাদাররা জীবননগরের দিকে যাচ্ছিল। ঐ মাইন বিস্ফোরণের শব্দে ভীত পাক হানাদাররা  জীবননগর দর্শনা থেকে ঘটনাস্থলে দিক আসে। দুই পক্ষেই পরস্পর মুক্তিসেনা বলে ভুল করে এবং পরস্পরের উপর গুলি চালাতে থাকে। ফলে ১৩ জন পাকহানাদার নিজেদের গুলিতেই আহত হয়।

-কালান্তর, ১১ জুন ১৯৭১

পাক হানাদারদের উপর মুক্তিফৌজের পাল্টা আক্রমণ

 

কলকাতা, ১১ জুন- মুক্তিফৌজের গেরিলা তৎপরতায় চট্রগ্রাম শহর এবং পার্শবর্তী এলাকায় পাক সেনারা প্রতিদিনই নাজেহাল হচ্ছে। আজ সন্ধ্যায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রচারিত সংবাদে বলা হয়েছে যে সম্প্রতি গেরিলা বাহিনী চট্রগ্রাম শহরের নিউ মার্কেট, খাতুনগঞ্জ, চট্রেশবরী রোড, চকবাজার, লালদিঘীর মাঠ প্রভৃতি স্থানে গ্রেনেড ও হাতবোমা সহ আক্রমণ চালায়। চকবাজারে ২ জন পাক হানাদার নিহত হয়েছে।

সংবাদে বলা হয়েছে, চট্রগ্রাম এখন পরিত্যক্ত নগরী। দোকানপাট বন্ধ। শতকরা মাত্র ১৫ জন লোক দৈনন্দিন কাজে যোগ দেওয়ার জন্য পথে বেরুচ্ছেন। বেলা ৩ টার পর রাস্তায় কাউকে খুব কম দেখা যায়। বন্দর এলাকায় মাত্র ৫০ জন লোক কাজ করছে। চট্রগ্রামের হাজী এলাকায় দ্বিতীয় ক্যান্টনমেন্ট স্থাপন করা হয়েছে। বাগানবাজার ও আঁধারমানিক অঞ্চলে ২ টি পৃথক আক্রমণে গেরিলারা ৪০ জন পাক সৈন্যকে খতম করেছে। শ্যামপুরে ৮ জন দৌলতপুর-চাঁদিরহাটে ৪০ জন কুমিল্লার হরণপুর, হৃদয়পুরে ১৩ জন এবং যশোহর রণাঙ্গনে ১৫ জন পাক হানাদার গেরিলাদের হাতে নিহত হয়েছে। রামগড় থেকে গড়েরহাটের পথে ৩ জন পাক সামরিক অফিসার নিহত হয়েছে।

গেরিলা বাহিনী মুসলিম লীগের দালালসহ পাক দালালদেরও বিভিন্ন স্থানে খতম করে চলছেন। জাকিগঞ্জে ৪ জন দালাল নিহত এবং ১ জন গ্রেফতার হয়েছে। মুক্তিসেনারা জাকিগঞ্জের পুলিশ স্টেশন দখল করেছেন এবং জাকিগঞ্জে পূর্ণ কর্তৃত্ত স্থাপন করেছেন। কালিগঞ্জের মুসলিম লীগ চেয়ারম্যান অলি মণ্ডলকে মুক্তিসেনারা খতম করে দিয়েছেন। ছাগলগঞ্জ বাজারে ১ দালালকে বন্দী করা হয়েছে এবং যুবতীকে উদ্ধার করা হয়েছে। সিলেট সেক্টরে মুক্তিফৌজের হাতে একটি রেলসেতু ধ্বংস হওয়ার সংবাদ পাওয়া গেছে।

আগরতলা থেকে ইউ-এন আই জানাচ্ছেনঃ সম্প্রতি একদল সাংবাদিক বাংলাদেশের দক্ষিন রণাঙ্গনে সফরে গিয়েছিলেন। মুক্তিফৌজের জনৈক মেজর সাংবাদিকদের জানিয়েছেন যে, মুক্তিফৌজে বর্তমান পাক হানাদারদের উপর পাল্টা আক্রমণ শুরু করেছে এবং সর্বত্র পাকসেনাদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে।

উক্ত মেজর সাংবাদিকদের আরো জানিয়েছেন যে দক্ষিন রণাঙ্গনে পাঠান ও বালুচ সেনারা নিরস্ত্র বাংলাদেশ নাগরিকদের উপর গুলি করতে অস্বীকার করায় তাঁদের অন্যত্র বদলী করা হচ্ছে। সম্প্রতি প্রায় ৪০০ জন বালুচ সেনাকে জাহাজে পশ্চিম পাকিস্তানে ফেরত পাঠানো হয়েছে।

পাঞ্জাবী ও পাঠান সেনাদের মধ্যে স্নজ্ঞহরষঃ গত ৪ জুন কুমিল্লা সেক্টরে পাক সেনাবাহিনীর পাঞ্জাবী ও পাঠানদের মধ্যে এক সংঘর্ষে ৩৫ জন নিহত হয়েছে।

-কালান্তর, ১২ জুন, ১৯৭১

কুমিল্লা শহরে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা

 

আগরতলা, ১১ জুন (পি, টি, আই) বাংলাদেশের মুক্তিফৌজ কুমিল্লা শহরটি গতকাল দখল করে। আবার স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়িয়েছে। এই সঙ্গে নানা অঞ্চলে গেরিলা তৎপরতা ও তীব্রতর হয়ে উঠেছে। ইউ এন আই জানাচ্ছেন সারা বাংলাদেশ জুড়ে শেখ মুজিবের মুক্তিফৌজ গেরিলা তৎপরতা বৃদ্ধি করেছে বলে সীমান্তের ওপারে মুক্তিবাহিনীর কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে খবর এসেছে। পাক সামরিক প্রশাসন শহরে ৭১ ঘ্নটার সামরিক আইন জারী করে নির্বিচারে অধিবাসীদের বন্দী করেছে।

সীমান্তের ওপার থেকে জানা গেছে, মুক্তিফৌজ পাকিস্তান ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক, হাবিব ব্যাঙ্ক লিমিটেড, মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাঙ্ক, জজ কোর্ট এবং টাউন হল ভবনে গ্রেনেড আক্রমণ চালায়। গেরিলা বাহিনী কুমিল্লা শহরের দক্ষিণাঞ্চলে একটি রেল ইঞ্জিন উড়িয়ে দিয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিও ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।

মুক্তিবাহিনীর সূত্র থেকে জানা যায় যে গত ৬ ই জুন মুক্তিফৌজ চট্রগ্রাম জেলায় সৌলাৎপুরে পাকসেনা সমাবেশের ওপর আক্রমণ চালিয়ে ৩৬ জন শত্রুসেনাকে খতম করে। ৫ই জুন শ্রীহট্রের তেলিপাড়া খন্ডে মুক্তিফৌজের সঙ্গে পাক বাহিনীর প্রত্যক্ষ সংঘর্ষে পাকবাহিনী আক্রমণের চাপে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে পশ্চাদপসারণ করে, তবে পালাবার সময় তারা জীবন ও সম্পত্তির বেশ ক্ষতি করে যায়। গত ৩রা জুন লাকসাম অঞ্চলে মুক্তিবাহিনী হঠাৎ একটি আক্রমণ চালিয়ে পাকবাহিনীর অনেককে খতম করেছে। শত্রু পক্ষের বেশকিছু মিজো এবং চাকমা সেনাও নিহত হয়। মুক্তিবাহিনী তবলছড়িতে বেশকিছু অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ ছিনিয়ে নেয়। এই অঞ্চলে পাক সেনাদের অমানুষিক অত্যাচার স্বত্বেও বাঙালি অধিবাসীরা দৃঢ় মনোবল নিয়ে তাদের মোকাবেলা করছেন, মহিলা এবং কিশোরীরাও মুক্তিবাহিনীর সাহায্যে এগিয়ে এসেছেন।

কুমিল্লা জেলার ননীপুর ও ফকিরহাটে গুপ্তস্থান হটাৎ আক্রমণ চালিয়ে মুক্তিফৌজের গেরিলা দল ২০ জন পাকসেনাকে খতম করে। মিয়ার বাজারে ও মুক্তিফৌজের হাতে পাক হানাদার বাহিনীর আটজন মারা পড়ে। এখানে তিন ঘণ্টা লড়াই চলে। পাকসেনারা মর্টার ও মেশিনগানে চালিয়ে মুক্তিফৌজের পাঁচজন যোদ্ধাকে আহত করে। শ্রীহট্ট জেলার মির্জাপুরে মুক্তিবাহিনী মেশিনগান ও মর্টার চালিয়ে পাকসেনাদলের একজন অফিসার ও দশজন সৈন্যকে হত্যা করে।

দিনাজপুরেও গেরিলা তৎপরতাঃ রায়হগঞ্জ, ১০ জুন গেরিলা ইউনিট দিনাজপুরে জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে তৎপর হয়ে উঠছে। ছোট ছোট দল গেরিলা আক্রমণ চালিয়ে মুক্তিফৌজ পাক দখলদার বাহিনীকে যথেষ্ট বিব্রত করে তুলেছে। কয়েকদিন আগে ঠাকুরগাঁও মহকুমা এলাকায় রুহিয়া রেল স্টেশন থেকে ১ ফার্লং দক্ষিনে ৫০ ফুট দীর্ঘ রেল লাইন মুক্তিফৌজ ডিনামাইট দিয়ে উরিয়ে দেয়। পাক সেনাবাহিনীর লোকেরা গুলি চালাতে থাকে। মুক্তিফৌজ গেরিলারা পিছন থেকে পাক সৈন্যদের আক্রমণ করে ৭ জনকে হত্যা করে। ওই এলাকার মঙ্গলপুর ও বাজানহারের মধ্যবর্তী একটি রেলওয়ে ব্রিজ উড়িয়ে দেয় এবং রুহিয়া থেকে ৪/৫ মাইল দূরে একটি গুরুতবপূর্ণ সড়ক সেতুও তারা উরিয়ে দেয়। বোচাগঞ্জ, পীরগঞ্জ ও রাণীশংকৈলে গেরিলা বাহিনী বেশ কয়েকজন পাক সেনাদের তাঁবেদার গুপ্তচরকে খতম করে।

-যুগান্তর, ১২ জুন, ১৯৭১

গেরিলা আক্রমণে বাংলা বাহিনীর অপূর্ব সাফল্য

 

বর্তমানে মুক্তিফৌজ তাদের গেরিলা আক্রমণে বাংলাদেশের সর্বত্র পর্যুদস্ত করেন। গত সপ্তাহে বাংলার বিভিন্ন রণাঙ্গনে মুক্তিবাহিনী বহু পাকসৈন্যকে হতাহত ক্রেন।গত ৬ই জুন মেহেরপুরের নিকটে ইছাখালিতে এক গেরিলা যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী পাকসেনাদের একজন অফিসারসহ চারজনকে খতম করেন।যশোহর এলাকায় মুক্তিবাহিনী মেশিনগান ও মর্টারের সাহায্যে পাকবাহিনীর ১ টি শিবির অতর্কিতে আক্রমন করে কমপক্ষে ২০ জন পাক সৈন্যকে হত্যা ও অনেককে হতাহত করেন-তাদের ক’খানা গাড়ী ও বহু সংখ্যক ভারী ও হালকা অস্ত্রশস্ত্র হস্তগত করেন।কালাচাঁদপুরের দিকে পাকসেনার অগ্রতির এক খণ্ড যুদ্ধে মুক্তিফৌজ তাদের ১ জন লেঃকর্নেলকে আহত করেন।এই যুদ্ধে বাংলা বাহিনী ১ টি সেতু ও পাকসেনার ১ টি ঘাঁটি ধ্বংস করেন।

বগুড়া জেলার রাঙ্গামাটি এলাকা এখন সম্পূর্ণ মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন। সিলেটের সরলবাগে বাংলাবাহিনী পাকসেনার ১ টি ঘাঁটি দখল করে ও এর সন্নিকটে ২ টি গানবোট বিনষ্ট করে।সিরাজগঞ্জে তারা একটি রেল সেতু সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন করতে সক্ষম হন।দিনাজপুর রণাঙ্গনে মুক্তিফৌজ ৭৫ জন পাকসেনাকে হত্যা , বহু জনকে আহত ও ১৪ জনকে বন্দী করে।উত্তরাঞ্চলে উলিপুরে মুক্তিযোদ্ধারা এক ঝটিকা আক্রমনে ৪০ জন পাকসৈন্যকে হত্যা করেন।এছাড়া খুলনা,রংপুর,ময়মনসিংহ ও কুমিল্লাতে কদিনের যুদ্ধে তারা প্রায় দুশো এর অধিক পাকসৈন্য হত্যা করেছেন।

-বঙ্গবাণী, ১ম বর্ষ ৪র্থ সংখ্যা, ১৩ জুন, ১৯৭১

মেহেরপুরের পাকবাহিনীর এক প্ল্যাটুন সৈন্য খতম

কৃষ্ণনগর ১৩ জুন (পি,টি,আই) মুক্তিফৌজ গতকাল বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিম খণ্ডে বিভিন্ন এলাকায় পাকিস্তানী ফৌজের ওপর ব্যাপক আক্রমন চালায়। মেহেরপুরের অদূরে তারা পাক ফৌজের এক প্লাটুন সৈন্য খতম করে দিয়েছে। সীমান্তের অপর পার থেকে এখানে প্রাপ্ত খবরে প্রকাশ, ভারতের গোদা ঢ্যাঙ্গার বিপরিত দিকে ভোমরার নিকটে এবং পেট্রা পোলের বিপরিত দিকে বোনা পোলের নিকটে যুদ্ধ অভ্যাহত আছে। তুমুল যুদ্ধের পর মুক্তি ফৌজ মেহেরপুর শহর থেকে তিন কিলো মিটার দূরে কামদেবপুর গ্রামে ইছা খালী সিমান চৌকি দখল করে নিয়েছ। ঐ অঞ্চলে মর্টার থেকে গুলিবর্ষন করে তারা পাক ফৌজের এক প্লাটুন সৈন্য খতম করে দিয়েছে। আহত কয়েকজন পাকিস্তানী সৈন্যকে তাদের সাথীরা সরিয়ে নিয়ে গেছে। খবরে প্রকাশ, পাক সৈন্যরা এখান থেকে প্রায় একশো কিলো মিটার দূরে দখিন-পশ্চিম বাংলাদেশের প্রাগপুর এলাকায় ২৫টি বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে এবং পাঁচজনকে হত্যা করেছে।

-যুগান্তর. ১৪ জুন ১৯৭১

যুদ্ধে ব্যাপক হারে তৎপরতা মুক্তিবাহিনীর

(অনুবাদ)

মুজিবনগর, জুন, ১৫- আজকে পর্যন্ত আসা এজেন্সি রিপোর্ট হতে জানা যায় যে, জুনের ১০ তারিখ থেকে গেরিলা মুক্তিবাহিনীর পাকিস্তানী বাহিনী এবং তাদের নাশকতার বিরুদ্ধে ব্যাপক যুদ্ধ তৎপরতা শুরু হয়েছে।

পাকবাহিনীর সাথে যুদ্ধের পর গেরিলারা ময়মন্সিংহ, বরাগপাড়া প্রভৃতি জেলার সীমান্তফাঁড়ী দখল করে নিয়েছে। ঢাকার একটি হোটেলে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে মুক্তিবাহিনী, যার ফলে কিছু পাকিস্তানী আর্মিদের সহযোগী গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তি আহত হয়।

জুনের ১০ তারিখে রাজশাহীতে একটি পাকিস্তানী সীমান্ত ফাঁড়িতে আক্রমন চালায় মুক্তিবাহিনী। পরদিন মুক্তিবাহিনী ঠাকুরগাঁ এর কাছাকাছি একটি এলাকায় পাকবাহিনীর উপর হামলা চালায়। তারা একি সাথে হামলা চালিয়েছে রংপুর এবং গাইবান্ধাতেও।

চিলমারি এলাকায় গেরিলারা একটি পাকিস্তানী জীপে হামলা চালিয়ে সেটি ধ্বংস করে এবং এর যাত্রী পাকিস্তানী সেনাদের হত্যা করে। তারা হিটিবান্ধা এলাকার রেললাইন উপড়ে ফেলে এবং রংপুর ও গাইবান্ধা এলাকার মধ্যবর্তী টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়।

সিলেট সেক্টরে, গেরিলারা বড়গ্রাম এলাকায় পাকিস্তান আর্মিদের একটি দলের উপর মর্টার হামলা করে, এর ফলে দলের কতিপয় সেনা নিহত হয়।

-হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড, ১৬ জুন, ১৯৭১

 

চট্টগ্রাম এলাকায় মুক্তি ফৌজের তৎপরতা

 

আগরতলা, ১৯ জুন (পিটি আই)- সীমান্তের অপর পার থেকে পাওয়া সংবাদে জানা যায় যে বাংলাদেশের মুক্তি ফৌজের গেরিলা বাহিনী চট্টগ্রামের পশ্চিমাঅঞ্চল বিভিন্ন স্থানে গেরিলা আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। সংবাদে জানা যায় যে জুয়ালগঞ্জে গেরিলা আক্রমণে পাকিস্তানী সেনাদলের একজন মেজর নিহত হয়েছেন।

মুক্তিফৌজের গেরিলা বাহিনী নোয়াখালী- চট্টগ্রামে খণ্ড শুভপুর এলাকায় শত্রু সৈন্যের অবস্থান স্থলের উপর প্রচণ্ড আক্রমন করে । এর ফলে অনেক পাকিস্তানী সৈন্য আহত হয়েছে।

-আনন্দবাজার পত্রিকা, ২০ জুন, ১৯৭১

মুক্তিফৌজের ভয়ে পাকসৈন্য সদা-সন্ত্রস্ত

মুজিবনগর ২২ জুন (পিটি আই)-বাংলাদেশের বিভিন্ন খণ্ডে মুক্তিফৌজের গেরিলা বাহিনীর ক্রমবর্ধমান  তৎপরতায় পশ্চিম পাকিস্তানী  সৈন্যবাহিনীর টহলদার দলগুলি আতঙ্ক গ্রস্ত হয়ে পড়েছ। মুক্তিফৌজ কমান্ডার জনৈক উচ্চ পদস্ত অফিসার বলেছেন যে মুক্তিফৌজ যে মুহুর্তে আচমকা আক্রমণ চালাতে পারে মনে করে পাকিস্তানী সৈন্যরা আজকাল যতদুর সম্ভব সর্তক হয়ে চলাফেরা করছে। মুক্তিফৌজ যাতে চিনতে না পারে সেজন্য পাকসৈন্যরা সময় সময় অসামরিক ব্যক্তির ছদ্মবেশে চলাফেরা করে থাকে। সৈন্যবাহিনী যখন সৈন্য ও সরবরাহ নিয়ে নদী পারাপারের জন্য বোট ব্যবহার করে তখন গেরিলাদের আক্রমণ রক্ষা পাওয়ার জন্য সর্তকতামুলক ব্যবস্থা হিসেবে নদী ও খালের উভয় তীরের রক্ষী মোতায়েনের ব্যবস্থা করে।

ভেড়ামারায় ২০ জন পাকসৈন্য নিহতঃ কৃষ্ণ নগর ২২ শে জুন কুষ্টিয়া জেলার ভেড়ামারা থানার মহিষকুন্ডি অঞ্চলে এক কোম্পানী পাকসৈন্যের ওপর আক্রমণ চালিয়ে মুক্তিফৌজ অন্ততঃ ২০ জন পাকসৈন্যকে হত্যা ও বেশ কিছুকে জখম করেছে বলে আজ সংবাদ পাওয়া গেছে। স্থানটি কৃষ্ণ নগর থেকে ১৫০ কিলোমিটার দূরে ভারত মেঘনা সীমান্তের বিপরীত দিকে। সীমান্তের ওপার থেকে পাওয়া সংবাদে জানা যায় যে, পাকসৈন্যরা আক্রান্ত হয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরভাগে পালিয়ে যায়।

মুক্তিফৌজ গত রবিবার মেহেরপুরের কাছে একটি সৈন্যবাহী ট্রাকের উপর গোলা বর্ষন করে এবং উহার ফলে প্রায় ২৪ জন পাকসৈন্য নিহত অথবা আহত হয়। ঐ দিনই মেহেরপুরের প্রায় ১৫ মাইল উত্ত্র-পূর্বে একটি অঞ্চলে মুক্তিফৌজ একটি সৈন্যঘাঁটির ওপর গুলিবর্ষন করে। এই আক্রমণে ১১ জন পাকসৈন্য খতম হয়।

রংপুরে লালমনিরহাট খন্ডে মুক্তিফৌজ একটি সৈন্য শিবিরের ওপর আচমকা আক্রমণ চালিয়ে কিছু অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদসহ একটি ট্রাক দখল করে। এই আক্রমণে যে সকল পাকসৈন্য আহত হয় তাদের মধ্যে একজন অফিসারও আছেন।

-যুগান্তর, ২৩ জুন, ১৯৭১

 

 

খান সেনাদের ওপর মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ তীব্রতর হয়েছেঃ

আরও সাত শতাধিক সৈন্য খতম

 

স্বাধীন বাংলাদেশ বেতারের খবরে প্রকাশ,হানাদারবাহিনী বাংলাদেশে যে বর্বরোচিত ও সুপরিকল্পিত গণহত্যা চালিয়েছে তারই অংশ হিসাবে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ও তাদের সমর্থকদের উপর অকথ্য নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। এই নির্মম অত্যাচারের হাত থেকে আমাদের প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবরের বয়োবৃদ্ধ অসুস্থ পিতামাতাও রেহাই পায়নি। গত সাতদিন চট্টগ্রাম রনাঙ্গনে প্রায় একশত ৫০ জন পাক হানাদার মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদের হাতে নিহত হয়েছে এবং বহু স্থান থেকে পাকসেনা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে বলে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র জানিয়েছে। সমগ্র পুর্ব রনাঙ্গনে গেরিলাদের তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। কক্সবাজারে বহু পাকসেনা হতাহত হয়েছে। এদিকে মর্টার ও মেশিনগানসহ আক্রমন চালিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা ফেনীর উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে ২০০ জন পাকসেনাকে হত্যা করেছেন।

স্বাধীনতাকামী তরুণ যোদ্ধারা গত ১৯ শে জুন সিলেট সেক্টরে একটি এলাকায় পাক-হানাদারদের সঙ্গে এক সংঘর্ষে ১৩ জন পাক সেনা খতম করেন এবং প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদসহ ৩ জন পাকসেনাকে আটক করেছেন। এর আগেরদিন প্রচণ্ড সংঘর্ষে মুক্তিবাহিনী সিলেটের কয়েকটি স্থানে আক্রমন চালিয়ে ২২তম রেজিমেন্টের একজন সৈন্যকেও আটক করেছেন।

মুক্তিবাহিনী রংপুরে বজরাপাড়ায় পাকসেনাদের উপর অতর্কিত গেরিলা আক্রমন চালিয়ে পাকসেনাদের নাজেহাল করে ছেড়েছেন। এই আক্রমনে অনেক খানসেনা হতাহত হয়েছে। সেই দিনই পাকসেনারা মৃত সৈন্যদের লাশ ও আহত সৈন্যদের নওগাঁয় নিয়ে যায়। এই আক্রমনে একজন অফিসারসহ দুইজন পাকসেনাকে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যোদ্ধারা গ্রেফতার করেছেন। কয়েকদিন আগে মুক্তিবাহিনীর বীর যোদ্ধারা ঠাকুরগাঁওয়ের কাছে মর্টার ও মেশিনগান থেকে মুক্তি ছাউনির উপর আচমকা গুলি চালায়। চট্টগ্রামের মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা তৎপরতা বৃদ্ধি পায়। গত দুই সপ্তাহ ধরে চট্টগ্রামে অধিকসংখ্যক গাড়ী ও সৈন্য নিয়ে পাকসেনাদের চলাফেরা করতে দেখা যায়। কুষ্টিয়া রনাঙ্গনে মেহেরপুর এলাকায় এক দুঃসাহসিক আক্রমন চালিয়ে মুক্তিবাহিনী কমপক্ষে ৩০ জন পাকসেনাকে খতম করেছেন, সেখানকার কুতুবপুরে মুক্তিবাহিনী খানসেনাদের ওপর আকস্মিকভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে ১০ জন খানসেনাকে হত্যা করেন। গত ১৫ ই জুন নাজিরাকোটায় এক প্লাটুন পাকসৈন্যকে আক্রমন করে মুক্তিবাহিনীর অসমবাহিনীর যোদ্ধারা ২০ জন দুশমন সৈন্যকে খতম করেছেন।

স্বাধীন বাংলা বেতারের খবরে প্রকাশ করে, সাতক্ষীরার নিকট দুশমন সৈন্যদের ঘাটির ওপর মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমন চালিয়েছেন। এ এলাকায় কয়েকটি আউটপোষ্টেও আমাদের মুক্তিবাহিনী প্রচণ্ড আক্রমন চালিয়ে দস্যু সৈন্যদের অনেককেই হতাহত করেছেন।

গত ১২ই জুন ভোমরা সেক্টরের কলারোয়ায় মুক্তিবাহিনী প্রচণ্ড আক্রমন চালিয়ে খানসেনাকে খতম করেছেন। মুক্তিবাহীনি ঐ দিন রাতে আরেক অভিযানে ৬০ জন খানসেনাকে  হত্যা করেছেন।কলারোয়া ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ও তথাকথিত শান্তি কমিটির প্রেসিডেন্ট ওয়াজেদ আলী চৌধুরীকে মুক্তিবাহীনির গেরিলা যোদ্ধারা খতম করেছেন।

মুক্তিবাহিনী বাংলাদেশ দক্ষিণ পশ্চিম খণ্ডে খানসেনাদের উপর ব্যাপক আক্রমন চালিয়ে মেহেরপুরের নিকটে এক প্লাটুন খানসেনাকে খতম করেছেন। মুক্তিবাহিনী মেহেরপুর শহর থেকে প্রায় দুমাইল দূরে কামদেবপুর গ্রামে ইছাখালী সীমান্ত চৌকি দখল করে নিয়েছেন।এতদাঞ্চলে মর্টার থেকে গুলিবর্ষণ করে মুক্তিবাহীনি শত্রুসেনাদের এক প্লাটুন সৈন্য খতম করে দিয়েছেন।নিহতদের মধ্যে কয়েকজন পদস্থ অফিসারও রয়েছে।

-জয়বাংলা ১ম বর্ষ, ৭ম সংখ্যা, ২৫ জুন, ১৯৭১

 

মুক্তিফৌজ ২ দিনে ৬০ জন পাকসেনা খতম করেছে

(অনুবাদ)

জুন, ২৭- গত দুই দিনে পূর্ব সেক্টরে তীব্র গেরিলা আক্রমণের মাধ্যমে মুক্তিফৌজ কমপক্ষে ৬০ জন পাকসেনাকে হত্যা করেছে এবং বেশকিছু অস্ত্রশস্ত হস্তগত করেছে। সীমান্ত এলাকা থেকে প্রাপ্ত খবরে জানা যায়, পূর্ব সেক্টরের সর্বত্র গেরিলারা কার্যকর ও আচমকা আক্রমণে পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের‌ নাস্তানাবুদ করে চলছে। গেরিলারা এখন ইসলামাবাদ আর্মির আতংকের কারণ এবং ঢাকা-চট্রগ্রামের মধ্য রেল যোগাযোগ প্রতিস্থাপন করার পরিকল্পনা বাতিল করা হয়েছে।

অপরদিকে, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান শরণার্থীদের প্রত্যাগমনের ব্যাপারে যতই জোরালো কথা বলুক না কেনো বাংলাদেশে তার সেনাবাহিনী খুন, ঘর বাড়ীতে অগ্নিসংযোগ, নারী নির্যাতনের মাধ্যমে বাঙালিদের প্রস্থান হার বজায় রাখার জন্যে পূর্বের ধারা বজায় রেখেছে। আর্মিদের মনোভাব কেবল এটাই নির্দেশ করে যে হিন্দু এবং প্রগতিশীল মুসলমানদের বিতাড়িত করার জন্যে ইসলামাবাদের পরিকল্পনা অপরিবর্তিত আছে যেটা ত্রিপুরায় উদবাস্তুদের লাগাতার সমাগম থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়।

এদিকে পিটিআই’এক রিপোর্টে জানা গেছে, গতকাল পাকিস্তানী কর্মকর্তারা যখন বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম সেক্টরের কুষ্টিয়া জেলার চুয়াডাঙ্গা শহরে যাচ্ছিলো তখন মুক্তিফৌজের গেরিলারা তাদের বহনকারী জীপে এ্যামবুশ করে একজন অফিসারসহ পাঁচজন পাকসেনাকে হত্যা করেছে। সেনা জীপটি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।

-হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড, ২৮ জুন ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!