You dont have javascript enabled! Please enable it!
শিরোনাম সূত্র তারিখ
৪। জয়দেবপুর-তেলিয়াপাড়াব্যাপী সশস্ত্র প্রতিরোধে ২য় বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও অন্যান্য বাহিনী সাক্ষাতকারঃ মেজর জেনারেল (অব) কে এম সফিউল্লাহ ১৯৭১

(১৯৭১ সালের মার্চ মাসে জয়দেবপুরে ২য় বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ড হিসেবে মেজর পদে কর্মরত ছিলেন। সাক্ষাৎকারটি ১৯৭৫ সালে গৃহীত। উল্লেখ্য- মেজর জেনারেল (অবঃ) কেএম সফিউল্লাহর পত্রিকান্তরে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে বর্ণিত জয়দেবপুর সেনানিবাসের ঘটনাবলীর ব্যাপারে দ্বিমত প্রকাশ করে ২য় বেঙ্গল রেজিমেন্টের তৎকালীন অধিনায়ক লেঃ কর্নেল (অবঃ) কাজী আবদুর রকীব ১৩ মে ১৯৮৩ সালে সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রা’র ‘ভিন্নমত’ শীর্ষক কলামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। তদুত্তরে পরবর্তী সময়ে ‘বিচিত্রা’র একই কলামে মেজর জেনারেল (অবঃ) সফিউল্লাহর একটি প্রতিবাদ প্রকাশিত হয়। এগুলি এখানে একই সঙ্গে সংযোজিত হলো)

<৯, ৪.১, ১৬০-১৯৬>

১৪/১৫ই মার্চ গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে আমাদের ব্যাটালিয়নের নিরস্ত্র করা হবে। এ গুজবের মধ্যে কিছু সত্যতাও ছিল। আমাদের কাছে কিছু প্রয়োজনের অতিরিক্ত অস্ত্রশস্ত্র ছিল। সেগুলো জমা দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। আমরাও সেই নির্দেশ মানার জন্য তৈরী হচ্ছিলাম। এই গুজবের পরিপ্রক্ষিতে ১৭ই মার্চ জনসাধারণ জয়দেবপুর থেকে টঙ্গী পর্যন্ত ৫০ জায়গায় প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। এতে আমাদের খাদ্য সরবরাহে অসুবিধার সৃষ্টি হয়। এমতাবস্থায় আমি প্রথম ব্যরিকেডে গিয়ে জনসাধারণকে বলি যে, আপনারা আমাদের উপর আস্থা রাখুন। আমি ১৭ বৎসর সামরিক বাহিনীতে চাকুরী করেছি অস্ত্র ব্যবহার করার জন্য, ফিরিয়ে দেবার জন্য নয়। এই জন্য আমাদের উপর আপনাদের আস্থা রাখতেই হবে। আপনারা যদি না রাখেন তবে আমাদের উপর আস্থা রাখার মত লোক কেউ নেই। এই কথা শুনে তারা বলল যে আমরা আপনার ব্যাটালিয়ন কমান্ডারের সাথে দেখা করতে চাই। জনতার মধ্য থেকে চার- পাঁচজন গণ্য মান্য নেতা আমার সঙ্গে আসলেন ব্যাটালিয়ন কমান্ডার –এর সাথে দেখা করার জন্য। সেখানে ব্যাটালিয়ন কমান্ডার এই আশ্বাস দিলেন যে আমাদের উপর আস্থা রাখুন এবং এই প্রতিবন্ধকতা সরিয়ে ফেলুন। এতে আপনাদের সুবিধে হবে এবং আমরা কোনো নাজুক পরিস্থিতিতে পড়ব না। সমস্ত প্রতিবন্ধকতা সরিয়ে ফেলবো বলে আশ্বাস দিয়ে তারা চলে গেলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমরা নিজেরাই গিয়ে প্রতিবন্ধকতা উঠাচ্ছিলাম। কিন্তু একদিকে যেই আমরা ব্যরিকেড সরাচ্ছিলাম অপরদিকে জনসাধারণ আবার ব্যরিকেড সৃষ্টি করছিলো। এর বিরুদ্ধে কোনো কড়া ব্যবস্থা না নেওয়ায় পাক সেনাবাহিনীর চোখে আমরা সন্দেহভাজন হয়ে পড়েছিলাম।

১৯শে মার্চ সকাল দশটার দিকে ঢাকা ব্রিগেড হেডকোয়ার্টার থেকে আমাদের কাছে অয়ারলেসে এই মর্মে এক মেসেজ পাঠানো হয় যে “The commander with his escort is coming to have lunch with you. He would visit Gazipur Ordinance Factory.” (অনুবাদঃ কম্যান্ডার তাঁর প্রতিরক্ষাকারী বাহিনী সহ তোমার সাথে দুপুরে আহার করতে আসছে। তিনি গাজীপুর অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরি পরিদর্শন করবেন) এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, গাজীপুর অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিতেও এরূপ প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করা হয়। এবং সেখানে আমাদের ব্যাটালিয়ন –এর লোকজন নিয়ে গাজীপুর অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরির রেসিডেন্ট ডিরেক্টর ব্রিগেডিয়ার করিমউল্লাহ্‌ (পশ্চিম পাকিস্থানী)- কে অস্বস্তিকর পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করা হয় (তাঁকে ফ্যাক্টরীর লেবাররা ঘেরাও করে রেখেছিল)। এ ঘেরাও থেকে উদ্ধার করতে আমাদের কোনো বেগ পেতে হয়নি। ১২টার দিকে একটা মেসেজ আসে যে “I had cleared some barricade. Now I am at ‘Chowrasta’. I am using the civilians to open the  barricade. You also clear the barricade from your side and meet me enroute. If there is any opposition use maximum  force.”

(অনুবাদঃ আমি কিছু ব্যারিকেড পরিষ্কার করেছি। এখন আমি ‘চৌরাস্তায়’। আমি বেসামরিক লোকদের দ্বারা ব্যারিকেড পরিষ্কার করাচ্ছি। তুমিও তোমার দিক থেকে ব্যারিকেড পরিষ্কার কর এবং আমার সাথে পথে এই পথেই দেখা কর। কোন প্রকার বাঁধা পেলে সর্বোচ্চ শক্তি ব্যবহার করবে) এ খবর পাবার পর আমরা আমাদের লোকজনকে নিয়ে জয়দেবপুর থেকে প্রতিবন্ধকতা সরাতে সরাতে অগ্রসর হই এবং ব্রিগেড কমান্ডার –এর সাথে রাস্তায় মিলিত হই।

এই প্রসঙ্গে বলা দরকার যে, আমরা প্রতিবন্ধকতা নিজেরাই পরিষ্কার করি। কিন্তু ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আরবাব এবং তার সঙ্গীরা জনগণকে দিয়ে প্রতিবন্ধকতা পরিষ্কার করে। প্রতিবন্ধকতা সরাবার সময় বেশ কিছুসংখ্যক লোককে মারধর করা হয়। বেলা প্রায় দেড়টায় ব্রিগেড কমান্ডার তার লোকজনকে নিয়ে জয়দেবপুর পৌছে। এ প্রসঙ্গে বলা দরকার যে ব্রিগেড কমান্ডারের সাথে যে সমস্ত লোক ছিল তাদের মধ্যে একজন লেঃ কর্নেল (আর্টিলারী), একজন ক্যাপ্টেন (আর্টিলারী), একজন মেজর (আর্মার), একজন ক্যাপ্টেন  (ইনফ্যান্ট্রি), একজন ক্যাপ্টেন (কমান্ডো) এবং ৭০ জন জোয়ান চাইনিজ এলএমজিতে সজ্জিত ছিল। তিনি জয়দেবপুরে প্রবেশ করে গর্বিতভাবে বললেন, Nobody can stop us. We can move to any direction wherever we want to move.(অনুবাদঃ কেউ আমাদের থামাতে পারবে না। আমরা যখন ইচ্ছা এবং যেদিকে ইচ্ছা যাওয়ার সক্ষমতা রাখি) তার উক্তি এবং ভাবভঙ্গিতে আমার মনে হলো যেন আলেকজান্ডার ভারত জয় করল। জয়দেবপুরে এসে শুধুমাত্র অফিসাররা জয়দেবপুর রাজবাড়ীতে ঢুকল। কিন্তু ৭০ জন জোয়ান প্রাসাদের বাইরে রয়ে গেলো।

ব্রিগেড কমান্ডার যখন ঢাকা থেকে জয়দেবপুরে আসছিলেন, তখন যাতে আমাদের উপর কোনো অঘটন না ঘটে, সেজন্য আমরা সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত ছিলাম। কেননা, আমাদের নিরস্ত্র করা হবে বলে একটা আশংকা আমাদের মনের মধ্যেও ছিল। ব্রিগেড কমান্ডার প্রাসাদে ঢুকে সমস্ত জায়গা ঘুরে ঘুরে দেখলেন এবং মন্তব্য করছিলেন যে এ রকমের প্রস্তুতি কেন? তখন আমি উত্তর দিয়েছিলাম যে, এখানকার পরিস্থিতি এমন যে, যেকোন মুহুর্তে উত্তেজিত জনতা দ্বারা আক্রান্ত হতে পারি। এবং সীমান্তের পরিস্থিতি যা, তাতে অল্প সময়ের মধ্যে আমাদেরকে সীমান্ত অভিমুখে রওনা দিতে হতে পারে। উত্তর যদিও মনপূত ছিলো তবুও আমরা একে অপরের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য বুঝে ফেলেছিলাম।

ব্রিগেড কমান্ডার প্রাসাদে ঢোকার সাথে সাথেই খবর ছড়িয়ে পড়ল যে, বাঙালি সৈন্যদের নিরস্ত্র করার জন্য ঢাকা থেকে সেনাবাহিনী এসেছে। ফলে উত্তেজিত ও বিক্ষুব্ধ জনতা আবার অল্প সময়ের মধ্যে জয়দেবপুর রেলক্রসিং- এ এক বিরাট প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। একটা ভর্তি মালবাহী গাড়ী, যেটা তখন ময়মনসিংহ থেকে জয়দেবপুর এসেছিল, তা দিয়ে রেলওয়ে ক্রসিং –এর উপরে বিরাট এক প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। একথা শোনার সাথে ব্রিগেড কমান্ডার কর্ণেল মাসুদকে নির্দেশ দেন যে ২০ মিনিটের মধ্যে এই প্রতিবন্ধকতা সরিয়ে ফেলা হোক। যদি কোনো বাধার সৃষ্টি হয়, তবে যেন ম্যাক্সিমাম শক্তি প্রয়োগ করা হয়। কর্নেল মাসুদুল হাসান এই নির্দেশ পাবার সাথে সাথে মেজর মইনুল হোসেনকে (বর্তমান লেঃ কর্নেল) নির্দেশ দিলেন যে তার কোম্পানি নিয়ে যেন এই প্রতিবন্ধকতা সরিয়ে ফেলা হয়। কোনো সময় নষ্ট না করে মেজর মইন এই প্রতিবন্ধকতার সামনে পৌছান।

তিনি সেখানে গিয়ে জনতার কাছে আবেদন করেন যে, আপনাদের ঘাবড়াবার কোনো কারণ নেই। কারণ আমাদের সাথে এখনো অস্ত্র আছে। আমাদের কাছ থেকে এখনও অস্ত্র নেয়া হয় নাই। জনতা যখন শুনছিল না তখন তিনি ভীড় ঠেলে জনতার মধ্যে যারা নেতা তাঁদের সাথে আলাপ করেন। নেতাদের মধ্যে একজন ছিলেন আওয়ামী কর্মী জনাব হাবিবুল্লাহ এবং আর একজন ছিলেন শ্রমিক নেতা আবদুল মোতালেব। সেদিন ছিল শুক্রবার এবং জয়দেবপুরে হাটবার। প্রায় পঞ্চাশ হাজার লোকের সমাবেশ ছিল সেখানে। কিছু জনতা প্রতিবন্ধকতার এ পাশে ছিল আর কিছু জনতা প্রতিবন্ধকতার অপর পাশে ছিল। নেতারা ছিলেন বাজারের দিকে। মেজর মইন ইতিমধ্যে নেতাদের বুঝাতে সক্ষম হন যে আমাদের এখনো নিরস্ত্র করা হয়নি। তারা আমাদের কথা বিশ্বাস করেন। নেতারা জনসাধারণকে বুঝাবার চেষ্টা করছিলেন তারা যেন আর কোনো গণ্ডগোল না করে। জনতার মাঝে তখনও হৈ চৈ এবং গণ্ডগোল চলছিল। ইতিমধ্যে লেঃ কর্ণেল মাসুদ, ব্রিগেড কমান্ডার জাহানজেব ও তার ট্রুপস সেখানে গিয়ে পৌঁছান।

ব্যারিকেড-এর বাজারের পাশের দিকে অধিকাংশ জনতার সমাবেশ ছিল এবং অপর পাশের দিকও বেশ জনসমাবেশ ছিল। কিন্তু এ পাশের লোক বেশ উত্তেজিত ছিল। কারণ তারা জানত না যে মেজর মইনের সাথে  ব্যরিকেড- এর অপর পাশের জনতার কি কথাবার্তা হয়েছিল। জয়দেবপুর পর্যন্ত যে রাস্তা স্টেশনের দিকে চলে যায় সে রাস্তার শেষ প্রান্তে বেঙ্গল রেজিমেন্ট –এর ট্রুপস মোতায়েন ছিল। তার পিছনে হুকুম দেওয়ার ১৫ মিনিটের মধ্যে ব্রিগেড কমান্ডার জাহাজেব আরবাব তার বাহিনী নিয়ে এসে যায়। বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর বাকী সৈন্য প্যালেসে থেকে যায়। ব্রিগেড কমান্ডার আসার সাথে সাথে মেজর মইনকে আদেশ দেয় সে যেন তার সেনাবাহিনী পেছনে সরিয়ে নিয়ে এসে রেলস্টেশনে যাবার পথের উপর জনতাকে সামনে রেখে মোতায়েন করে। মেজর মইন তখন ব্রিগেড কমান্ডারকে বললেন যে নেতারা আপনার সাথে দেখা চান এবং এই উদেশ্যে তারা এদিকে আসছেন। ব্রিগেড কমান্ডার উত্তেজিত হয়ে বললেন, “ I do not want to see them. Tell them to get away and deploy troops.” (অনুবাদঃ আমি ওদের সাথে দেখা করতে চাই না। তাঁদের চলে যেতে বলো এবং সৈন্যদল নামাও)

মেজর মইন নির্দেশ মোতাবেক সৈন্যদের মোতায়েন করার আদেশ দিচ্ছিলেন। এ আদেশ শুনে এবং সৈন্যদের গতিবিধি ও ব্রিগেড কমান্ডার জাহানজেব  আরবাব -এর ক্রুদ্ধ মূর্তি দেখে নেতারা পেছনে সরে যান। নেতাদের পেছনে সরে যেতে দেখে এপাশের জনতা আরও উত্তেজিত হয়ে পড়ল। তখন ব্রিগেড কমান্ডার মেজন মইনকে নির্দেশ দেন জনতার উপর গুলি ছোড়ার জন্য। একদিকে তিনি নিজে মেজর মইনকে গুলি ছোড়ার নির্দেশ দিচ্ছিলেন কিন্তু অপর দিকে তিনি মেজর মইনকে কর্নেল মাসুদের নির্দেশ নিতে বলছিলেন। কর্নেল মাসুদ ঐখানে ছিলেন।

এখানে বলে রাখা দরকার যে, টাঙ্গাইলে আমাদের যে কন্টিনজেন্ট ছিল তাদের খাদ্য নেওয়ার জন্য একটা ট্রাক (বেডফোর্ড) টাঙ্গাইল থেকে জয়দেবপুর আসছিল। ঐ গাড়ী বাজারের নিকট এসে এক বিরাট জনতার ভিড় দেখতে পায়। তারা ভেবেছিল যে আজ হাটবার তাই এত লোক। তারা এখানকার ঘটনা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ ছিল। হঠাৎ জনতার মধ্যে থেকে কিছু লোক তাদেরকে ঘিরে ফেলে এবং বলে যে সামনে পাঞ্জাবী সৈন্যরা আমাদের গুলি ছোঁড়ার জন্য তৈরী হচ্ছে। তোমাদেরকে আমাদের সাথে যোগ দিয়ে পাঞ্জাবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে। ট্রাকের মধ্যে ড্রাইভারসহ ৭ জন বাঙালি সৈন্য ছিল। তারা হতবুদ্ধি হয়ে কি করতে হবে কিছুই ঠিক করতে পারল না। জনতা পাঁচজনকে ধরে নিয়ে যায় এবং একটি ঘরে তাদেরকে বন্ধ করে তাদের অস্ত্রশস্ত্র কেড়ে নেয়। অস্ত্রের মধ্যে চারটি চাইনিজ রাইফেল এবং চাইনীজ এসএমজি ছিল। ড্রাইভার এবং কো-ড্রাইভার কোন রকমে পালিয়ে এসে বলে যে আমাদের পাঁচজন সৈন্যকে জনতা বোধ হয় মেরে ফেলেছে এবং আমরা মারধর খেয়ে কোন রকমে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছি। তখন ব্রিগেড কমান্ডার হুকুম দেয়, “Fire and clear the barricade” (অনুবাদঃ গুলি কর এবং ব্যারিকেড পরিষ্কার কর) মেজর মইন এই হুকুম পাবার পর প্রথম বিউগল বাজালেন এবং পতাকা উঠিয়ে গুলি ছোড়া হবে বলে মাইকে ঘোষণা করলেন। এ ঘোষণায়  জনতার মাঝে কোন ভয়-ভীতির সঞ্চার হয়নি। তারপর তিনি জনতার মাঝে একজনকে লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ার নির্দেশ দেন। এ আদেশ শোনার পর জনতার মাঝে একটু ভয় ও ভীতির সঞ্চার হয়। মেজর মইন যাকে গুলি ছোঁড়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন তাকে বাংলায় বললেন যে নিচের দিকে গুলি ছুঁড়ে দাও। যেহেতু গুলিটা গিয়ে একটা গাছের মধ্যে লেগেছে সেহেতু ব্রিগেড কমান্ডার এটা দেখে খুব রাগান্বিত হলেন এবং নির্দেশ দিলেন, “Fire for effect” (অনুবাদঃ কার্যকরী ফলাফলের জন্য গুলি চালাও) এবারও জনতার মধ্যে একটু নড়চড় হচ্ছিল। এবারও তিনি বাংলায় বললেন উপর দিকে মেরে দাও। এবার যে গুলি করছিল, সে রাইফেলটাকে এমনভাবে উঠিয়ে ধরছিলো যে মনে হচ্ছিল সে আকাশের দিকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ছে। তা দেখে ব্রিগেড কমান্ডার ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন, “I want one dead body per bullet. If you cannot handle the situation I will employ my troops.” (অনুবাদঃ আমি প্রত্যেক গুলির বিনিময়ে একটি করে লাশ চাই। যদি তুমি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারো, তবে আমি আমার সৈন্যদল নামাবো) এই সময় জনতার মধ্য থেকেও গুলি ছোঁড়া হচ্ছিলো। পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করতে দেখে মেজর মইন এবার ঠিকভাবে গুলি ছোঁড়ার নির্দেশ দিলেন। গুলি একজনের গায়ে লাগে এবং সে মাটিতে পড়ে যায়। এর ফলে জনতা ছত্রভঙ্গ হতে থাকে। এ সময় জনতার মধ্য থেকেও ভীষণভাবে গুলি ছোড়া হচ্ছিল। জনতার গুলিতে বেঙ্গল রেজিমেন্ট –এর কিছু সংখ্যক সৈন্যও আহত হয়। এসময় জয়দেরপুর বাজারে অবস্থিত মসজিদের উপর থেকে ব্রিগেড কমান্ডার জাহানজেব আরবাবকে লক্ষ্য করে এস- এম-  সি ফায়ার শুরু হয়। আমাদের সৌভাগ্যশতঃ ব্রিগেডিয়ারের গায়ে তা লাগেনি। এখন জনতা এবং সৈন্যদের মধ্যে বেশ কিছুক্ষণ গুলি বিনিময় হয়। এবং সেনাবাহিনীর গুলিতে জনতা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। বেঙ্গল রেজিমেন্ট –এর বাকী সৈন্যসহ আমি তখন প্যালেসে ছিলাম এবং গুলির আওয়াজ শুনে কিছুসংখ্যক সৈনিককে জাহানজেব আরবাব –এর ট্রুপস  -এর পিছনে মোতায়েন করি। এর দুটো উদ্দেশ্য ছিল- জনতার হাত থেকে সৈনিকদের বাঁচানো এবং যদি ব্রিগেড কমান্ডারের অশুভ উদ্দেশ্য থাকে তা প্রতিহত করা।

এ খণ্ডযুদ্ধ প্রায় পনের বিশ মিনিটের মত চলে এবং এরপর সম্পূর্ণ এলাকা জনতামুক্ত। জনতা চলে যাবার পর আমরা ব্যারিকেড খুলে ফেলি। এরপর ব্রিগেড কমান্ডার ঢাকার দিকে চলে গেলেন এবং যাবার আগে নির্দেশ দিয়ে গেলেন জয়দেবপুর ও গাজীপুর চৌরাস্তা এলাকার মধ্যে সান্ধ্য আইন জারী করার জন্য এবং আরো বলে গেলেন অয়ারলেসে তাকে জানাবার জন্য কি রকম অ্যামুনিশন খরচ হয়েছে এবং কতজন হতাহত হয়েছে। আমরা তারপর খোঁজ নিয়ে জানলাম যে, দুইজন লোক নিহত হয়েছে এবং কিছুসংখ্যক আহত হয়েছে। ব্রিগেড কমান্ডার যাবার সময় চৌরাস্তায় কিছু লোক দেখতে পায়। তাদেরকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য দূর থেকে গুলি ছোড়ে এবং এতে দুজন লোক মারা যায়। আহতদের সংখ্যা জানা যায়নি।

আমরা নির্দেশ অনুযায়ী সান্ধ্য আইন জারী করি। সন্ধ্যা পাঁচটার দিকে পাঁচজন নিখোঁজ লোককে আমরা মসজিদের পাশের এক কক্ষ থেকে উদ্ধার করি। স্থানীয় নেতাদের সাহায্যে এবং আমাদের লোকদের সাহায্যে তল্লাশী চালিয়ে পরদিন দুপুর পর্যন্ত ৪টি রাইফেল উদ্ধার করতে সক্ষম হই। তিন-চারদিন পর গফরগাঁও থেকে এসএমজিটি উদ্ধার করি। অস্ত্রশস্ত্র খুঁজে বের করা পর্যন্ত ঐ বেলায় সান্ধ্য আইন বলবৎ ছিল। যদি ব্রিগেড কমান্ডার সেখানে না থাকত তাহলে আমরা ব্যারিকেড খুলে ফেলতে পারতাম। কোনো হতাহত হতো না। যেভাবে এ পরিস্থিতিকে মোকাবেলা করা হয়েছে  তাতে বেঙ্গল রেজিমেন্ট –এর সৈন্যরা বিক্ষুদ্ধ হয়ে উঠেছিল। ঐদিনই রাতে ৫ জন বাঙালি সৈন্য অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পালিয়ে যায়। এর মধ্যে ৪টি চাইনিজ রাইফেল এবং একটি এস-এম জি অ্যামুনিশনসহ ছিল। সন্ধ্যার সময় অয়ারলেসে আমরা ব্রিগেড কমান্ডারকে জানালাম যে, আমাদের ৬৩ রাউণ্ড গুলি খরচ হয়েছে এবং আমাদের কিছু সংখ্যক সৈন্য আহত হয়েছে। দুজন বেসামরিক লোক নিহত  এবং বেশকিছু সংখ্যক আহত হয়েছে। যদিও তিনি বললেন যে ভাল করেছ, কিন্তু মনে মনে তিনি খুশী হতে পারেন নি। কেননা তিনি বলেছিলেন, why 63 round spent and only to dead? (অনুবাদঃ কেন ৬৩ রাউন্ড গুলি খরচ হলো কিন্তু নিহত মাত্র ২ জন?)

ব্যাটালিয়ন কমান্ডার–এর কর্তব্য এবং দায়িত্ব তার ব্যাটালিয়নের শৃঙ্খলা রক্ষা করা। কিন্তু এমন নাজুক পরিস্থিতিতে তিনি সুস্থ মস্তিষ্কে কিছুই করতে পারেননি। ব্রিগেড কমান্ডার–এর কাছ থেকে তাঁর উপর কারণ দর্শাও নোটিশ এলো; কিভাবে ট্রাকের পাঁচজন সৈন্য থেকে অস্ত্র নিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হলো? এবং পাঁচজন কেন অস্ত্র নিয়ে পালিয়ে গেল? ব্যাটালিয়ন কমান্ডার এক্সপ্লানেশন –এর জবাব দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর জবাবে ব্রিগেড কমান্ডার সন্তুষ্ট হননি। শেষ পর্যন্ত তিনি ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারে নিজে গিয়ে তাঁর বক্তব্য পেশ করেন। যাবার পূর্বে আমার সাথে পরামর্শ করেন। আমি তাকে বলেছিলাম যে যতক্ষন পর্যন্ত  না আপনাকে ডাকছে ততক্ষণ আপনি ঢাকাতে যাবেন না। যেহেতু তিনি মানসিক অস্থিরতাতে ছিলেন সেহেতু তিনি সেই অস্থিরতা দূর করার জন্য ২৩শে মার্চ ঢাকা ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারে আসলেন। সেখানে যাবার সাথে তাঁকে ব্রিগেড কমান্ডার জাহানজেব আরবাব বললেন, তোমাকে ব্যাটালিয়নে ফিরে যেতে হবে না। তুম স্টেশন হেডকোয়ার্টারে এটাচড্‌; ব্যাটালিয়নের ঘটনাবলী নিয়ে তদন্ত হবে। তারপর থেকে ঢাকাতে থেকে যেতে বলা হয়। সেহেতু তিনি আর ব্যাটালিয়নে ফিরতে পারেন নি। আমাকে নিদেশ দেওয়া হয় যে কর্নেল মাসুদ স্টেশন হেডকোয়ার্টারে এটাচড্‌; এবং তাঁর অনুপস্থিতিতে আমি যেন ব্যাটালিয়ন–এর কার্যভার গ্রহণ করি।

২৫শে মার্চ বেলা ১১টার সময় আমাকে ব্রিগেড থেকে জানানো হয় যে, ব্রিগেডিয়ার মজুমদার, সেন্টার কমান্ড্যান্ট, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, চট্টগ্রাম ব্যাটালিয়নে আসছেন এবং সৈনিকদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন। আরো জানানো হয় নতুন ব্যাটালিয়ন কমান্ডার লেঃ কর্নেল কাজী রকিব উদ্দিন নতুন ব্যাটালিয়ন কমান্ডার হিসেবে আসছেন এবং তিনিও আজ পৌঁছে যাবেন। কর্নেল মাসুদ আমাকে ১১টার দিকে টেলিফোনে বলেন যে, লেঃ কর্নেল রকিব নতুন ব্যাটালিয়ন কমান্ডার হিসাবে আসছেন। তিনিও ভালো লোক। আমার যা হয়েছে তার জন্য কোন আফসোস নাই। খোদা যা করেন, ভালোর জন্য করেন।

বেলা প্রায় ১টায় ব্রিগেডিয়ার মজুমদার ব্যাটালিয়নে পৌঁছান এবং আমার সাথে এক ঘণ্টা পর্যন্ত আলাপ করেন। তাঁর কাছে কিছু প্রশ্ন করলে তিনি তার পুরোপুরি জবাব দিতে পারেননি। আমার মনে হচ্ছিল তিনি কিছু বলতে চাচ্ছিলেন কিন্তু ঘোলাটে পরিস্থিতিতে মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছিলেন না। বেলা প্রায় আড়াইটার দিকে লেঃ কর্নেল কাজী রকিব ব্যাটালিয়নে পৌঁছে যান। বেলা প্রায় তিনটায় ব্রিগেডিয়ার মজুমদার সৈনিকদের উদ্দেশ্যে এক ভাষণ দেন। ভাষণের মর্ম এই ছিল যে, আমরা সৈনিক, আমরা সরকারের নির্দেশ মোতাবেক চলি। এবং সরকার যা হুকুম দেন তা আমরা পালন করতে বাধ্য হই। ব্যাটেলিয়নে ঘন্টাখানেক এ পরিপ্রক্ষিতে ভাষণ দেন। তারপর লেঃ কর্নেলরকিবকে ব্যাটালিয়নের ভার বুঝিয়ে দেন। এবং সৈনিকদের বলেন, আজ থেকে লেঃ কর্নেল রকিব তোমাদের নতুন ব্যাটেলিয়ন কমান্ডার। বেলা প্রায় পাঁচটার দকে তিনি ঢাকা রওনা হয়ে যান। কিন্তু যাবার আগে আমি তাঁকে বলেছিলাম, স্যার আপনি আমাদের ব্যাটালিয়নে নতুন এসেছেন। তাই আজ রাতটা এখানে থেকে যান। কিন্তু তিনি বলেন যে ঢাকাতেতিনি তার শ্বশুরবাড়িতে থাকবেন। এখন আমি উপলব্ধি করতে পারছি যে যদি তিনি আমাদের ব্যাটালিয়নে থাকতেন, তাহলে হয়তো তিনি আজ আমাদের সাথেই থাকতেন।

ব্রিগেডিয়ার মজুমদার চলে যাবার পর আমি ব্যাটালিয়ন কমান্ডার রকিবকে দেশের তদানীন্তন গোলযোগপূর্ণ রাজনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাটালিয়নের সৈনিকদের মনোভাব জ্ঞাত করাই।২৫শে মার্চ পর্যন্ত ব্যাটালিয়ন কিভাবে মোতায়েন ছিল তাও তাঁকে বলি। ডেপ্লয়মেন্টটা এই- এক কোম্পানী ময়মনসিংহ, এক কোম্পানী টাঙ্গাইলে –এই দুই কোম্পানীর ভার ছিল আমার উপর। এক প্লাটুন ছিল রাজেন্দ্রপুর অ্যামুনিশন ডিপোতে। সেখানে আরো তিনটি পাঞ্জাবী প্লাটুন ছিল –এক প্লাটুন পাঞ্জাব রেজিমেন্ট, এক প্লাটুন বেলুচ রেজিমেন্ট এবং এক প্লাটুন ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্ট। ব্যাটালিয়নের বাকি লোক সব জয়দেবপুর প্যালেসে ছিল।

২৫শে মার্চ রাত প্রায় ১০টার দিকে কর্নেল রাকিবের ছেলে ঢাকা থেকে টেলিফোনে জানায় যে তাদের বাসায় কয়েকটা  বেনামী টেলিফোন কল এসেছে এবং ধমক দিয়ে বলা হয়েছে যে তাদের জানমালের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। ঐদিন ব্রিগেড কন্ট্রোল রুমে আমাদের ব্যাটালিয়নের একজন পাঞ্জাবী অফিসার কর্তব্যরত ছিল। কর্নেল রকিব তাকে নির্দেশ দেন সে যেন ইপিআর হেডকোয়ার্টারে টেলিফোন করে সেখান থেকে কিছু আর্মড গার্ড তার বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। তিনি ইপিআর থেকে মনে হয় এই ভরসায় সাহায্য চেয়েছিলেন যে তিনি মাত্র কিছুদিন আগে ইপিআর থেকে এসেছেন। আর্মড গার্ড তার বাসায় পাঠানো হয়েছিল কি না, তা পরে আর জানতে পারিনি।

২৫শে মার্চ রাত প্রায় ১২টায় জেনারেল টিক্কা খান ব্যাটালিয়ন কমান্ডার কর্নেল রকিবের সাথে টেলিফোনে কথা বলেন এবং বলেন যে গাজীপুর অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিতে গোলযোগ চলছে। একজন দায়িত্বশীল অফিসারের নেতৃত্বে যেন সেখানে এক কোম্পানী সৈন্য পাঠানো হয়। গাজীপুর জয়দেবপুর থেকে নিকটবর্তী। সেখানে কোন গোলযোগ হলে নিশ্চয় আমরা খবর পেতাম। কিন্তু যেহেতু টিক্কা খান নিজেই নির্দেশ দিয়েছেন সেহেতু ঐ রাতেই প্রায় তিনটায় এক কোম্পানী সৈন্য একজন অফিসারের নেতৃত্বে সেখানে পাঠানো হয়। সৈন্য পাঠাবার পর সেখানে দেখা গেল কোনো গণ্ডগোল ছিল না। আমার মনে হয়, তার উদ্দেশ্য ছিল ব্যাটালিয়নের সমস্ত সৈনিককে দেশের চারিদিকে ছড়িয়ে রাখা যাতে আমরা একত্রিত হয়ে পাকিস্থানী কর্তৃপক্ষের ২৫শে মার্চের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কোন বাধা সৃষ্টি না করতে পারি।

২৫শে মার্চ রাত প্রায় ১টায় কর্নেল মাসুদুল হাসান খান ঢাকা থেকে টেলিফোন করে জিজ্ঞেস করেন যে তোমাদের অবস্থা কি? ঢাকাতে তো বেশ গুলিগোলার আওয়াজ শুনছি। এই টেলিফোন পাবার পরপরই ঢাকার সাথে সামরিক-বেসামরিক সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ঢাকায় যে তখন কি হচ্ছিল তার কোন খবরই আমরা পাচ্ছিলাম না। ২৬শে মার্চ সকাল বেলায় ব্যাটিলিয়ন কমান্ডার রকিবকে বললাম যে গত রাতে যা কিছু ঘটনা ঘটেছে এবং চারিদিকে যেসমস্ত গুজব রটছে তার পরিপ্রেক্ষিতে একটা উত্তেজনাপূর্ণ পরিবেশ বিরাজ করছে। এ মুহুর্তে এ ব্যাপারে আমাদের চিন্তা –ভাবনা করা উচিৎ। যেহেতু ঢাকার সাথে অন্য সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় সেহেতু আমি অয়ারলেস সেটে গিয়ে ঢাকায় কি হচ্ছে তা শোনার চেষ্টা ক। ২৫শে মার্চ রাতে টেলিফোন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হবার পুর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত আমি ইউনিটে অয়ালেস সেটে যেভাবে কাজ চলছিল তার একটি বিস্তৃত বর্ণনা নিচে দেওয়া গেলঃ

ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারে- ৫৭ ব্রিগেডে ছিল কন্ট্রোল স্টেশন আর সাব- স্টেশন ছিল নিম্নলিখিত ইউনিটগুলোঃ

১। ১৮ পাঞ্জাব,

২। ৩২ পাঞ্জাব,

৩। ২২ বেলুচ রেজিমেন্ট,

৪। ১৩ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্ট,

৫। ৩১ ফিল্ড রেজিমেন্ট,

৬। ৪৩ লাইট এন্টিএয়ারক্র্যফট রেজিমেন্ট,

৭। ট্যাংকস স্কোয়াড্রন –এগুলো সব ঢাকায় ছিল,

৮। ২ ইস্ট বেঙ্গল, জয়দেবপুর,

৯। ২ ইস্ট বেঙ্গল, টাঙ্গাইল (এ সেটগুলো ঢাকা থেকে এসেছিল)।

এর অপারেটর সব পাঞ্জাবী ছিল। অয়ারলেস সেট এবং অয়ারলেস নেট কিভাবে কাজ করে সে সম্বন্ধে যারা পুরোপুরি অবগত নন তাদের অবগতির জন্য বলছি যে, অয়ারলেস নেট- এ একই ফ্রিকোয়েন্সিতে যখন এক স্টেশনে কথা বলা হয়, তখন অন্য স্টেশনের লোকজন একই সময়ে ঐ সমস্ত কথাবার্তা শুনতে পায়।

২৬শে মার্চ সকাল ৭/৮ ঘটিকার সময় আমি এবং কর্নেল রকিব অয়ারলেস সেটে যাই। সেটটা জয়দেবপুর রাজবাড়ির অফিসার্স মেস –এর পূর্বদিকে বসানো ছিল। আমরা যখন সেটে যাই তখন সেটে কথা হচ্ছিল। আমরা সেখানে পৌঁছার সাথে সাথে অপারেটর ফ্রিকোয়েন্সি পরিবর্তন করাতে অন্যান্য স্টেশনের সাথে আমাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আমি অপারেটরকে (পাঞ্জাবী ছিল) জিজ্ঞেস করি যে তুমি ফ্রিকোয়েন্সি কেন চেঞ্জ করছ? আর বাকী স্টেশন কোথায়? সে উত্তর দিল যে ঢাকা থেকে নির্দেশ দিয়েছে গোলযোগপূর্ণ আবহাওয়ার জন্য এবং এই নেটে অনেক স্টেশন হয়ে যাবার জন্য জয়দেবপুর –ঢাকা –টাঙ্গাইল এক নেটে থাকবে বলে নির্দেশ পাওয়া গেছে। আমি তাকে বললাম কিছুক্ষণ আগে অয়ারলেস সেট যে ফ্রিকোয়েন্সিতে ছিল সে ফ্রিকোয়েন্সিতে ফিরে যাও। সে উত্তর দিল যে, স্যার আমার সেট আর কোন ফ্রিকোয়েন্সিতে ছিল না। আমি তখন তাকে বললাম যে অন্যান্য ইউনিট যে ফ্রিকোয়েন্সিতে আছে সে ফ্রিকোয়েন্সিতে আছে সে ফ্রিকোয়েন্সিতে মিলাও বা সেট কর। এ উত্তর দিল “আমার সে ফ্রিকোয়েন্সি জানা নেই।“ আমি তাকে আর কিছু না বলে কর্নেল রকিবের সাথে অফিসে ফিরে আসি। আসার সময় রাস্তায় কর্নেল রকিবকে বলি, “There must have something serious happened in Dacca. That is why Dacca station does not want us to hear the conversation” (অনুবাদঃ ঢাকায় অবশ্যই গুরুতর কিছু হয়েছে। একারণেই ঢাকা স্টেশন চায় না যে আমরা আলোচনা শুনি) তারপর আম একজন বাঙালি অপারেটরকে গোপনে নির্দেশ দিই ঐ সেট এর উপর লক্ষ্য রাখার জন্য যে কি কথাবার্তা হয়। আমি অফিস যাবার সাথে সাথে আমাদেরব্যাটালিয়নের নিজস্ব অপারেটর আমাকে বলে যে ময়মনসিংহের কোম্পানী কমান্ডার মেজর নুরুল ইসলাম আপনার সাথে জরুরী কথা বলতে চান। টেলিফোন যোগাযোগ ছিল না বলে তিনি অয়ারলেসে কথা বলতে চান। ময়মনসিংহে আমাদের নিজস্ব অয়ারলেস সেট ছিল। আমি সেটে যাবার পর মেজর নুরুল ইসলাম বলে যে,  সে কয়েক হাজার লোক দ্বারা ঘেরাও হয়ে আছে। তারা বলছে যে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট তাদের সাথে যোগ দিক।

এখানে বলে রাখা দরকার ময়মনসিংহ ইপিআর হেডকোয়ার্টারে মেজর নুরুল ইসলামের নেতৃত্বে আমাদের এক কোম্পানী সৈন্য ছিল। ইপিআর উইং কমান্ডার একজন পশ্চিম পাকিস্থানী অফিসার ছিল। ইপিআর উইংয়ে তাদের যে রিজার্ভ কোম্পানী ছিল তার প্রায় অধিকাংশই বাঙালি ছিল। উইং কমান্ডার ঢাকার নির্দেশমত সমস্ত পশ্চিম পাকিস্থানী সৈনিকদের (ইপিআর) বর্ডার থেকে উইথড্র করে উইং হেডকোয়ার্টারে নিয়ে আসে। তাদের সংখ্যা উইং হেডকোয়ার্টারে ছিল প্রায় ৫০/৬০ জন। জনতা যখন উইং হেডকোয়ার্টারে ঘিরে ফেলল তখন হেডকোয়ার্টার –এর আউটার পেরিমিটারে বাঙালি সৈনিকরা পাহারারত অবস্থায় ছিল। মেজর নুরুল ইসলাম (বর্তমানে লেঃ কর্নেল) মাইক্রোফোনে উচ্চস্বরে জনসাধারণকে এ এলাকা থেকে চলে যাবার নির্দেশ দিচ্ছিলেন এবং এও আশ্বাস দেন যে, সময় আসলে আমরা আপনাদের নিরাশ করব না। সারাদিন তারা এ অবস্থায় ঘেরাও ছিল। মেজর নুরুল ইসলামের আশ্বাস পেয়ে জনতা আস্তে আস্তে সরে যায়। আমাকে যখন সে এ সমস্ত ঘটনা জানায় তখন আমি তাকে ধীরে সুস্থে কাজ কর। সময় আসলে সব কিছু বলব। সে আমাকে সেখানে আরো কিছু সৈনিক পাঠানোর জন্য অনুরোধ জানাচ্ছিল। আমি তাঁকে আশ্বাস দিয়েছিলাম যে আমি পাঠানোর চেষ্টা করব।

আমি অয়ারলেস থেকে অফিসে ফিরে আসার সাথে সাথে আমি যে একজন অপারেটরকে ঐ অয়ারলেস সেটে লক্ষ্য রাখার জন্য সে এসে আমাকে খবর দিল যে, স্যার,আপনারা চলে আসার কিছুক্ষণ পর সে আবার ফ্রিকোয়েন্সি চেঞ্জ করে অন্যান্য স্টেশনের কথা শুনছিল। আমি দূর থেকে শুধু এতটুকুই শুনতে পেরেছি কে যেন কতগুলো লোক মেরেছে। পাঞ্জাবী অপারেটর তার সম্বন্ধে নির্দেশ চাইলে ঢাকার অপারেটর ভীষণভাবে রাগান্বিত হয়, এবং বলে সে যেন আর কখনো এই ফ্রিকোয়েন্সিতে না আসে। তাকে গতকাল যেভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সে যেন সেভাবে চলে।

এ খবর পেয়ে আমি ব্যাটালিয়ন কমান্ডার কর্নেল রকিবের অফিসে যাই এবং তাকে এ সমস্ত ব্যাপার (ময়মনসিংহের ব্যাপার এবং অয়ারলেস –এর ব্যাপার) সব খুলে বলি। এবং তাকে আমি বলি যে, স্যার, আমাদের এখন কিছু একটা করা দরকার। তা না হলে পরিস্থিতি আমাদের আয়ত্তের বাইরে চলে যেতে পারে। যদি চলে যায় আপনিও কিছু করতে পারবেন না, আমিও কিছু করতে পারবো না। তিনি তখন আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, কি করা দরকার? আমি পরামর্শ দিলাম যে ময়মনসিংহের পরিস্থিতি খারাপ। ঢাকার সাথে আমাদের কোনো যোগাযোগ নেই। এই পরিস্থিতিতে ময়মনসিংহের সাহায্যের জন্য আমাদের সমস্ত সৈনিকদের নিয়ে সেখানে চলে যাই। আমার উদ্দেশ্য ছিল, আমাদের সৈনিকদের ময়মনসিংহ গিয়ে কনসেনট্রেট করা। আর পরিস্থিতি লক্ষ্য করে যদি কিছু করতে, তাহলে আমরা যেন একসাথে হয়ে করতে পারি। তিনি তখন বললেন, ঢাকা থেকে নির্দেশ ছাড়া কি ভাবে এ পদক্ষেপ নিই। আমি তখন বললাম যে, আপনি ঢাকা থেকে নির্দেশ নেন যে ময়মনসিংহের অবস্থা খুবই খারাপ, আমাদের সেখানে ইনফোর্সমেন্ট পাঠানো দরকার। তিনি আমার কথামত ঢাকাতে অয়ারলেস সেটে কথা বললেন। কিন্তু কোনো উত্তর পেলেন না। আমি তাকে বললাম যে এখন আমরা যদি কিছু না করি তাহলে আমাদের সৈনিকদের নিরাপত্তার জন্য আমাদের যে দায়িত্ব রয়েছে তা হয়ত আমরা পালন করতে পারব না। এতে তিনি একটু ঘাবড়িয়ে পড়লেন। ২৬শে মার্চ প্রায় দশটার দিকে জেনারেল টিক্কা খান তৎকালীন পূর্ব পাকিস্থানে সামরিক আইন জারী করেন এবং ঐ আইনের নির্দেশাবলী রেডিওতে প্রচার করতে থাকেন। সামরিক আইন জারীর কথা শুনে সৈনিকদের মধ্যে এক উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। ঢাকায় যে বেশ কিছু একটা ঘটেছে তার একটা আভাস পাওয়া যায়।

২৬শে মার্চ সকাল ১০/১১ টার দিকে দেখলাম একটা আর্মি হেলিকপ্টার রাজেন্দ্রপুরের দিকে একবার যাচ্ছে এবং আবার আসছে। খবর নিয়ে জানতে পারলাম তারা রাজেন্দ্রপুর থেক এমুনিশন নিচ্ছে। তাতে বুঝা যাচ্ছে ঢাকাতে যে এমুনিশন ছিল তা এত তাড়াতাড়ি কিভাবে তারা খরচ করল। এ খবর পাবার পর ব্যাটালিয়ন কমান্ডারকে আবার বললাম যে, স্যার, “There must have something serious happened in Dacca and that is why they are running short of ammunition and ammunition is being lifted by helicopter.”(অনুবাদঃ ঢাকায় নিশ্চয়ই গুরুতর কিছু হয়েছে এবং একারণেই তাঁরা গুলিস্বল্পতায় ভুগছে ও হেলিকপ্টার দ্বারা গুলি পরিবহন করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।)

২৭শে মার্চ সকাল পর্যন্ত ঢাকাতে কি ঘটেছিল তার কোনো খবর পাইনি। বিকেলের দিকে আমাদের একজন ড্রাইভার ঢাকা থেকে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়। সে খবর দিল যে ঢাকাতে বেশ গোলাগুলি হয়েছে এবং বেশকিছু লোক মারা গিয়েছে। সে আরো বলল যে, বাঙালি সৈনিকদের বেঁধে নিয়ে কোথাও নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে। সে ব্যাটালিয়নে পৌঁছার সাথে এক উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতির  সৃষ্টি হয়। তখন আমি ব্যাটালিয়ন কমান্ডারকে বলি যে, ঢাকা থেকে আপনি কোনো নির্দেশ পাচ্ছেন না। ব্যাটালিয়নের পরিস্থিতিও খারাপ। আমরা যদি কোথাও কনসেনট্রেট না হই তাহলে পরিস্থিতি হয়ত তাহলে পরিস্থিতি হয়ত আমাদের আয়ত্তের বাইরে চলে যাবে। আমি তাকে আবার বললাম যে, আমরা আমাদের সৈনিকদের নিয়ে টাঙ্গাইল এবং ময়মনসিংহ চলে যাই। তিনি উত্তরে বললেন যে আমার ছেলে পিলে আছে। বেলা প্রায় দু’টোর দিকে ঢাকা থেকে ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আরবাব ব্যাটালিয়ন কমান্ডার –এর সাথে অয়ারলেসে কথা বললেন এবং বললেন, “our troops are facing some difficulties at Tongi, Send a company to do some shooting.” (অনুবাদঃ টঙ্গীতে আমাদের সৈন্যদল কিছু সমস্যার সম্মুক্ষীণ হচ্ছে। কিছু গোলাগুলি করার জন্য একটি কোম্পানি পাঠাও) আমাকে ব্যাটালিয়ন কমান্ডার জিজ্ঞেস করলেন, কি করা যায়? জয়দেবপুরে তখন শুধু একটা রাইফেল কোম্পানী ছিল, যার কমান্ডার মইনুল হোসেন চৌধুরী। ব্যাটালিয়ন কমান্ডার রকীব বললেন এই কোম্পানীকে পাঠাবার জন্য। আমি তখন বললাম যে এখন এই কোম্পানীকে না পাঠিয়ে টংগীর খবর নিন। একজন পাঞ্জাবী অফিসার পাঠাতে বললাম। গাজীপুর অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিতে আমাদের যে কোম্পানী ছিল তার কমান্ডার ছিল একজন পাঞ্জাবী অফিসার। আমি তাকে পাঠাতে বললাম। ড্রাইভার এবং বাকী লোক ছিল বাঙালী। ঐদিনই আমরা টঙ্গীতে বেশ কিছু বড় বড় গোলার আওয়াজ শুনি। অফিসারকে আর অন্যান্যদেরকে পৃথক পৃথক ব্রিফ করে টঙ্গী থেকে খবর আনার জন্য পাঠানো হয়। বিকেলে টঙ্গী থেকে ফিরে আসার পর ঐ অফিসার কমান্ডিং অফিসারকে খবর দেয় যে সেখানে তেমন কিছু হয়নি। কিছু সংখ্যক জনতা টঙ্গী পুলের কাছে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে বলে কিছু গোলাগুলি হয়েছে। সে এও বলল যে, “Since there was a barricade near Tongi bridge the troops from Dacca did some sporadic Firing. Incidentally I was also challenged by the Dacca troops.” (অনুবাদঃ যেহেতু টঙ্গী ব্রিজের কাছে একটি ব্যারিকেড দেয়া হয়েছে, সেহেতু ঢাকা থেকে আগত সৈন্যদল কিছু বিচ্ছিন্ন গোলাগুলি করেছে। আমাকেও ঢাকার সৈন্যদল কর্তৃক প্রশ্নের সম্মুক্ষীণ হতে হয়েছে) ড্রাইভার বলল যে আমরা টঙ্গীতে যাবার সাথে সাথে পশ্চিম  পাকিস্থানী সৈন্যরা আমাদের সবাইকে (আমাদের অফিসারসহ) দুই হাত উপরে উঁচু করে বেয়নেটের ডগায় অফিসারের কাছে নিয়ে যায়। আমাদের সৈনিকদের   সবাই ইউনিফর্ম পরিহিত ছিল। অফিসারকে যখন তারা উঁচু করায় (হ্যাণ্ডস-আপ) তখন অফিসার পাঞ্জাবী ভাষায় তাদের তিরস্কার করছিল। তার কথা শুনে পাঞ্জাবী সিপাইগুলো বলছিল, “দেখ, শালা পাঞ্জাবী ভি সিখ লিয়া।“ এখন মনে হয় তাকে বাঙালি অফিসার মনে করে হাত উঁচু করিয়েছিল। এইভাবে হাত উঁচু অবস্থায় তাদের অফিসারদের সামনে যাবার সাথে সাথে তারা (তাদের অফিসাররা) দুঃখ প্রকাশ করে। আমাদের অফিসার তাদের সাথে ঘন্টাখানেক আলাপ-আলোচনার পর ফিরে আসে।

আমি এই ঘটনা ব্যাটালিয়ন কমান্ডারকে বলি এবং এও বলি যে, “Sir, it is about time that we have take some actions, otherwise it will be too late,” (স্যার, এটাই একশন নেয়ার উপযুক্ত সময়। নতুবা খুব দেরি হয়ে যাবে) তিনি তখন বললেন আমি কি করতে পারি? আমি তাকে বললাম, “If you are so afraid of taking any action then I am going to take some actions. As far as your safety is concerned you can go to cantonment and tell them that they (2E Bengal pers) have all gone and no one listens to you. You will not be blamed for it as you have come only two days before. Neither you know the troops, nor they know you. If you want we will tie you and leave in one of the rooms and the Dacca authorities will not doubt you.” (অনুবাদঃ যদি আপনি একশন নিতে এত ভয় পান, তবে আমি একশন নিবো। যেহেতু আপনি আপনার নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত, সেহেতু আপনি ক্যান্টনমেন্টে যেতে পারেন এবং গিয়ে তাঁদের বলতে পারেন যে, ২য় ইস্ট বেঙ্গলের লোকেরা চলে গিয়েছে এবং কেউ আপনার কথা শুনে নাই। আপনাকে এর জন্য দোষারোপ করা হবে না। কারণ আপনি মাত্র ২ দিন আগে এসেছেন। আপনি যদি চান, তবে আমরা আপনাকে বেঁধে একটি রুমে রেখে যাবো। তাহলে আর ঢাকার কর্তৃপক্ষ আপনাকে সন্দেহ করবে না)। এ কথা বলার পর উনাকে একটু চিন্তা করে দেখতে বললাম এবং বললাম আমি সমস্ত অফিসার জেসিও’দের এ ব্যাপারে ব্রিফ করছি। যে পাঞ্জাবী অফিসার টঙ্গীতে খবর নিতে গিয়েছিল সে গাজীপুর ফিরে না গিয়ে জয়দেবপুরে চলে আসে। জয়দেবপুরে আরো দুইজন পশ্চিম পাকিস্থানী অফিসার এবং কিছুসংখ্যক পাকিস্থানী সৈন্য ছিল। তাদের মধ্যে গোপনে শলাপরামর্শ চলছিল। আমি এটা লক্ষ্য করেছিলাম। তাই এ অফিসারকে রীতিমত অর্ডার করে গাজীপুর পাঠিয়ে দিই।

২৭শে মার্চ সন্ধ্যার দিকে কিছু লোক ঢাকা থেকে আসে। তাদের মুখে শুনতে পাই যে ঢাকাতে বেশকিছু হত্যাকাণ্ড হয়েছে। এর আগে ড্রাইভার ছাড়া আর কারো মুখে শুনতে পাইনি। ২৭শে মার্চ সকালে একজন লোক ধীরাশ্রম থেকে জয়দেবপুরে আসে। সে খবর নিয়ে আসে যে কর্নেল সালাউদ্দিন মোঃ রাজা ধীরাশ্রম রেলওয়ে স্টেশনে ঢাকা থেকে এসেছেন এবং সেখানে বসে আছেন। তিনি আমার সাথে বা লেঃ কর্নেল মাসুদের সাথে দেখা করতে চান। আমি ঐ লোকটার সঙ্গে গোপনে দেখা করি এবং লেঃ কর্নেল মাসুদ ব্যাটালিয়নে নেই, উনি ঢাকায়। বর্তমান ব্যাটালিয়ন কমান্ডার লেঃ কর্নেল রকিব। আপনি চলে আসুন, কোনো অসুবিধা হবে না। বোধ হয় লেঃ কর্নেল রকিব ব্যাটালিয়ন কমান্ডার শুনে জয়দেবপুর আসতে সাহস পাননি। তাই তাঁর সঙ্গে আর দেখা হয় নি।

২৮শে মার্চ সকালে ময়মনসিংহ থেকে মেজর নুরুল ইসলাম আমাকে খবর পাঠায় যে ২৭/২৮ শে মার্চ রাতে তাঁর সেনাবাহিনীর উপর পাকিস্থানী ইপিআররা হামলা চালিয়েছে। লড়াই এখনো চলছে। এর পরিপ্রক্ষিতে আমি ব্যাটালিয়ন কমান্ডারকে বললাম যে, আমাদের শিগগিরই ময়মনসিংহ রিইনফোর্সমেন্ট পাঠানো দরকার। আমরা শেষ পর্যন্ত এই সিদ্ধান্ত নেই যে, যেহেতু ঢাকার সাথে আমাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এবং ময়মনসিংহে আমাদের সৈন্যরা আক্রান্ত হয়েছে, সেহেতু আমাদের এখন তাদের সাহায্যে যাওয়া উচিৎ। ময়মনসিংহে যে আমাদের সৈন্যরা পশ্চিম পাকিস্থানীদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে একথা আমরা কাউকে বলিনি। আমাদের একথা গোপন রাখার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল যে জয়দেবপুর থেকে সবাইকে এক সাথে নিয়ে যাওয়া এবং পথিমধ্যে পশ্চিম পাকিস্থানী অফিসার ও সৈনিকদের নিরস্ত্র করা। এ ব্যাপারে আমরা এক পরিকল্পনা তৈরি করি। রাতে যাবার পরিকল্পনা এজন্য করা হয়েছিল যে গাজীপুর এবং রাজেন্দ্রপুরে আমাদের যেসব সৈনিকরা আছে তাদেরকেও যদি সাথে নিয়ে না যাই তাহলে তারা হয়ত আটকা পড়বে। যেহেতু দিনের বেলায় তাদের সরাতে গেলে অসুবিধা হতে পারে সেহেতু রাতে তাদেরকে সরানোর সময় বেছে নেয়া হয়। কেননা, গাজীপুর এবং রাজেন্দ্রপুরে যে সমস্ত বাঙালি সৈন্য আছে তাদেরকে গোপনে সংবাদ দিতে হবে। আমরা যে জয়দেবপুর থেকে যাচ্ছি এটা সবাই জানত। কিন্তু গাজীপুর এবং রাজেন্দ্রপুর সৈন্য সরাতে গেলে সন্দেহের সৃষ্টি হতে পারে এজন্য রাতে যেন বাঙালি সৈন্যরা গোপনে বের হয়ে আসতে পারে তার পরিকল্পনা গ্রহন করা হয়েছিল। আরো পরিকল্পনা গ্রহন করা হয়েছিল যে, আমি সারপ্লাস অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ এবং কিছুসংখ্যক সৈনিক নিয়ে সকাল দশটার দিকে ময়মনসিংহে যাত্রা করব। এবং লেঃ কর্নেল রকিব বাকী লোকদের নিয়ে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় রওনা হবেন। এই সময়টা যেন গাজীপুর এবং রাজেন্দ্রপুরকে জানিয়ে দেওয়া হয়, যাতে তারা যেন ঠিক ঐসময় বেরিয়ে আসতে পারে। ওয়াপদার সাথে এটাও ঠিক হয়েছিল যে, ঐ সময় গাজীপুর, রাজেন্দ্রপুর ও জয়দেবপুর বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেবে- যাতে এ সমস্ত জায়গা থেকে আমাদের বের হতে কোনো অসুবিধা না হয়। গাজীপুর এবং রাজেন্দ্রপুরে লোক পাঠিয়ে ওদেরকে ঐ সময়ের মধ্যে বের হবার খবর দেওয়া হয়েছিল।

২৮শে মার্চ সকাল দশটায় সমস্ত উদ্বৃত্ত অস্ত্রশস্ত্র এবং যানবহন নিয়ে আমি ময়মনসিংহ অভিমুখে যাত্রা করি। যাবার সময় লেঃ কর্নেল রকিব এই আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, ব্যাটালিয়নের বাকী লোকদের নিয়ে তিনি সন্ধ্যার সময় রওনা হবেন। আমি জয়দেবপুর থেকে বের হবার পর চৌরাস্তা থেকে সমস্ত গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা উড্ডয়ন করি। সাথে সাথে সমস্ত জোয়ানদের মাঝে এক অভূতপুর্ব আনন্দের হিল্লোল সৃষ্টি হয়। এবং সবাই উল্লাসে “জয় বাংলা” শ্লোগান দিতে থাকে। আমার কনভয় জয়দেবপুর থেকে বের হবার সাথে সাথে জনতা উল্লাসে ফেটে পড়ে এবং আমাদেরকে “জয় বাংলা” শ্লোগান দিয়ে অনুপ্রাণিত করে। তাদের মধ্যে কিছু লোক জানত আমরা কি করছি। যে সমস্ত নেতৃস্থানীয় লোক আমাদের পরিকল্পনার কিছুটা আভাস পেয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন জনাব আবদুল মোতালেব। তিনি একজন শ্রমিক নেতা ছিলেন এবং আমাদের ব্যাটালিয়নের বাকী লোকদের জন্য বেসামরিক ট্রাক, বাস, গাড়ির ব্যবস্থা করেছিলেন।

টাঙ্গাইলের কাছাকাছি যাবার পর দেখতে পেলাম অপরদিক থেকে অস্ত্রশস্ত্র সজ্জিত একটা জীপ গাড়ী আসছে। ঐ গাড়িটা আমাদের কনভয়-এর কাছে এসে দাঁড়ায় এবং আমাদের গাড়ীতে বাংলাদেশের পতাকা দেখে খুশি হয়। তারা বলে যে, আপনারা একটু অপেক্ষা করুন। আমাদের লোকজন পজিশন নিয়ে আছে। আমরা তাদেরকে খবর দিয়ে আসি, যেন কোন অঘটন না ঘটে। কিছুক্ষণ পর আমরা টাঙ্গাইল শহরে প্রবেশ করি। সেখানে ব্যাণ্ডপার্টিসহ এক উৎফুল্ল জনতা আমাদের অভ্যর্থনা করে। জনতার এই উৎসাহ উদ্দীপনা দেখে আমি খুবই অনুপ্রাণিত হই। কিন্তু মনে মনে শুধু একটা চিন্তা করছিলাম যে, আমি যা করতে চলেছি এ কাজে আমি কি শুধু একা? না আরো কেউ আছে? যদিও একদিকে খুশী ছিলাম, অপরদিকে ভাবনাও কম ছিল না। কারণ আমি জানি আমি যা করতে চলেছি তা যদি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়, তাহলে মৃত্যুদণ্ডই সাজা। কিন্তু তবু জনতার উৎফুল্লতা দেখে মনে উৎসাহের সঞ্চার হতো। টাঙ্গাইলে যাবার পর কে একজন আমাকে বললেন যে মেজর জিয়া নামে একজন চট্রগ্রাম থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। এ কথা শুনে আমার সাহস দ্বিগুণ, ত্রিগুণ বেড়ে যায়। কারণ, তখন আমার মনে এ ধারণার সৃষ্টি হয় যে, এ কাজে আমি একা নই।

টাঙ্গাইলের জনগণ আমাদেরকে যেভাবে সাহায্য করেছিল তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। এ্যমুনিশেন বোঝাই একটা গাড়ীর অ্যাক্সেল ভেঙ্গে যাবার সাথে সাথেই সে আক্সেল তারা বদলিয়ে দেয়। আমি আমার সমস্ত সৈন্য এবং যানবাহন নিয়ে টাঙ্গাইল সার্কিট হাউসে পৌঁছে যাই।

টাঙ্গাইলে আমাদের এক কোম্পানী সৈন্য ছিল, তার কমান্ডার ছিল একজন পাঞ্জাবী অফিসার। টাঙ্গাইল কোম্পানী হেডকোয়ার্টারে পৌছার সাথে সাথেই কোম্পানীর জেসিও আমাকে বলে যে , সে গত রাতে কোম্পানী কমাণ্ডারকে নিরস্ত্র করে রেখেছে। আমি তখন সমস্ত কোম্পানীকে একত্রিত করে লেঃ মোরশেদকে তাদের কোম্পানী কমণ্ডার নিয়োগ করি। আর সমস্ত কোম্পানীকে এই বলি যে তোমরা সবাই ময়মনসিংহে চলে আস এবং ময়মনসিংহ পৌছার পর তোমাদের বাকি নির্দেশ দেব। এখন থেকে লেঃ মোরশেদ (বর্তমানে ক্যাপ্টেন) তোমাদের কোম্পানী কমণ্ডার আর তোমাদের কাছ থেকে এ ওয়াদা চাই যে তোমাদের কাছে আমি তোমাদের পুরাতন কোম্পানী কমণ্ডারকে আমানত হিসেবে রেখে যাচ্ছি! তোমরা তাকে তোমাদের সাথে নিয়ে আসবে। এবং আমার কাছে ময়মনসিংহ পৌঁছাবে। যেহেতু আমি ময়মনসিংহ যাবার জন্য তাড়াহুড়াতে ছিলাম সেহেতু বেলা দুটোর দিকে আমি ময়মনসিংহ অভিমুখে রওনা হই। তাদেরকে এই নির্দেশ দিয়ে আসি যে, জয়দেবপুর থেকে লোক না আসার আগে তারা যেন টাঙ্গাইল ত্যাগ না করে।

টাঙ্গাইল থেকে কয়েক মেইল যাবার পর প্রথম প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হই। এখানে বলে রাখা দরকার, ঢাকার খবর পাবার পরপরই জনসাধারণ টাঙ্গাইল থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত রাস্তার মাঝে মাঝে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে রাখে। প্রথম যে প্রতিবন্ধকতা দেখতে পাই সেটা ছিল একটি কাঠের পুল। জনসাধারণ সেটাতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। এবং আগুন তখনও জ্বলছিল। পুলটা একেবারে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তাই আমার কনভয়কে অনেক দূর ঘুরে কোন কোন জায়গাতে নতুন রাস্তা করে যেতে হয়েছিল। রাস্তায় রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা খুলে অগ্রসর হতে আমার বেশ সময় লেগে যায় এবং রাত প্রায় তিনটায় আমি মুক্তাগাছা পৌঁছি। মুক্তাগাছায়ও টাঙ্গাইলের মত কিছু লোক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পাহারা দিচ্ছিল। তারা আমাদের উপর গুলি করার আগেই আমরা তাদেরকে বুঝাতে সক্ষম হই আমরা তাদের শত্রু নই। আমরা বাংলাদেশের সৈনিক। তখন বহু লোক বেরিয়ে আসে এবং রাস্তা দেখিয়ে দেয়। ঐ রাত আমরা মুক্তাগাছা কলেজে কাটাই। আমাদের সাথে খাবার ছিল না। জনসাধারণ আমাদের খাবার ব্যবস্থা করে।

ভোর হবার আগেই জয়দেবপুর এবং টাঙ্গাইলের লোকজন মুক্তাগাছায় পৌঁছে। মেজর মইন (বর্তমানে লেঃ কর্ণেল) আমাকে বলে যে সবাই এসে গেছে। আমি তখন জিজ্ঞেস করলাম ব্যাটালিয়ন কমাণ্ডার কোথায়। উত্তরে বলল সে আসে নাই। আমি জয়দেবপুর থেকে আসার পূর্বোল্লিখিত পরিকল্পনার কিছুটা রদবদল হয়েছিল। তা নিম্নরূপ আমাদের লোকজন জয়দেবপুর থেকে সরিয়ে আনার কথা ছিল সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায়। কিন্তু ব্যাটালিয়ন কমাণ্ডার পরে মেজর মইনকে বলেছিলেন এ সময় বদলী করে ৮ টা করার জন্য। সময় ছিল বলে ঐ পরিবর্তিত সময় সবাইকে জানানো সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু ব্যাটালিয়ন কমাণ্ডার ঠিক মত করতে পারছিলেন না। সন্ধ্যে সাতটায় মেজর মইনকে আবার বললেন যে সময়টা পরিবর্তন করে সাড়ে সাতটা করে দাও। মেজর মইন তাকে বলেছিলেন যে, এখন আর সবাইকে এই সময় সম্বন্ধে বলার সুযোগ হলো না, তাই এই সময়টা অপরিবর্তিত থেকে যায়। রাত ঘন অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল। বিদ্যুৎ বন্ধ ছিল। কেমন যেন একটা থমথমে ভাব বিরাজ করছিল। রাত ঠিক ৮টায় অয়ারলেস, যেটা অফিসার্স-মেস-এর পূর্বাংশে ছিল, সেখান থেকে একজন পাঞ্জাবী সৈনিক আমাদের সৈনিক আমাদের একজন সিপাইকে লক্ষ্য করে গুলি করে। এই গুলির আওয়াজের সাথে সাথে চারদিকে গোলাগুলি শুরু হয়ে যায়। যেহেতু আমাদের লোক একজন অপরজনের উপর মোতায়এন করা হয়েছিল এবং তারা সজাগ ছিল সেহেতু আমাদের লোকের বিশেষ ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। এই গোলাগোলিতে কিছুসংখ্যক পশ্চিম পাকিস্তানী সৈনিক মারা যায়। কথামত পৌনে ৮টায় প্যালেসের বাইরে যে জীপ গাড়ী দাঁড়ানো ছিল সে জীপে করে ব্যাটালিয়ন কমাণ্ডারের যাবার কথা ছিল। কিন্তু সে সময় তিনি গাড়ীর কাছে না গিয়ে একজন পাঞ্জাবী অফিসারের সাথে অফিসার্স মেস-এর দ্বিতলে ব্যলকনিতে দাঁড়িয়ে গল্প করছিলেন। তাই হয়ত তিনি ঐ অফিসারের হাত থেকে সরে আস্তে পারেননি। অথবা নিজে ইচ্ছে করে আসেন নি। কারণ ঐ সময় তাঁর ঐ জায়গাতে থাকার কথা ছিল না।

গোলাগুলির পর ব্যাটালিয়ন-এর লোকজন সময়মত বেরিয়ে আসতে পেরেছিল। গাজীপুর থেকে যখন লোক বেরিয়ে আসে তখন পাঞ্জাবী অফিসার বাধা দেওয়াতে তারা তাঁকে হত্যা করতে বাধ্য হয়। জয়দেবপুরের লোক টাঙ্গাইল পৌছার সঙ্গে সঙ্গে এক গোলযোগের সৃষ্টি হয়। গোলযোগের সূত্রপাত এভাবেহএছিল যে, জয়দেবপুর থেকে যখন বাঙালি সৈন্যরা বেরিয়ে আসছিল তখন পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা আমাদের উপর আক্রমণ চালায়। এ কথা বলার সাথে সাথে আমি যে অফিসারকে আমানত রেখে গিয়েছিলাম তাঁর উপর আক্রোশে গুলি চালানো হয় এবং সে মারা যায়।

এ সমস্ত ঘটনার পর আমি দৃঢ়সংকল্প গ্রহণ করলাম যে আমাদেরকে এখন মৃত্যু পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।

২৯শে মার্চ সকালে মুক্তাগাছা থেকে ময়মনসিংহ যাত্রা করি। যদিও দূরত্ব ছিল মাত্র ১০ মেইল তবুও এই পথ অতিক্রম করতে আমদের প্রায় তিন ঘন্টা লেগেছিল। ময়মনসিংহ পৌছার সাথে সাথে মেজর নুরুল ইসলাম (বর্তমান লেঃ কর্ণেল) বলল যে, গতকাল আড়াইটা পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানী ইপিআরদের সাথে লড়াই করতে হয়েছে। এ লড়াইয়ে সবাই মারা গেছে, শুধু ছয়জন ছাড়া। আমাদের কোন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।

মেজর নুরুল ইসলাম আমাকে ময়মনসিংহের ঘটনার যে বর্ণনা দেন তা উল্লেখ করছি। ২৬শে মার্চ ময়মনসিংহে ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট-এর কোম্পানী ও ইপিআর-এর লোক জনসাধারণ কর্তৃক ঘেরাও হয়েছিল। তখন ইপিআর হেডকোয়ার্টার পেরিমিটারের বাইরে বাঙালি সৈণ্যরা পাহারা দিচ্ছিল। তারা জনসাধারণকে সরে যেতে বাধ্য করতে সক্ষম হয়েছিল। এতে উইং কমাণ্ডার (পশ্চিম পাকিস্তানী অফিসার) চালাকি করে বাঙালি ইপিআর লোকদের বলে যে গতকাল তোমরা অনেক কষ্ট করেছ। আজ তোমরা রেস্ট কর। আজকের ডীউটি দেবে অন্য কোম্পানী (সে কোম্পানীটা ছিল পাঞ্জাবীদের)। আজ রাতে তোমাদের আর কোন ডিউটি হবে না। তোমরা হাতিয়ার জমা দিয়ে রেস্ট কর। যেহেতু চারদিকে একটা থমথমে পরিবেশ ছিল সে কারণে কেউ হাতিয়ার জমা দেয়নি। সবাই অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যার যার বিছনায় শুয়ে পড়ে। রাত প্রায় ১২টার মধ্যেই পাকিস্তানী ইপিআর-এর সৈনিকরা ইপিআর-এর যত অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ ছিল তা তারা ছাদের উপর নিয়ে যায় এবং সমস্ত যানবাহন সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করায় যাতে সমস্ত গাড়ী স্টার্ট করতে হেড লাইট অন করে তখন যেন সমস্ত আলো ইপিআর-এর বাঙালিরা যে ব্যারাকে ঘুমাচ্ছে সে ব্যারাকের উপর পড়ে এবং ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কোম্পানীর তাঁবুতে পড়ে। রাত প্রায় সাড়ে বারোটায় তারা টেলিফোন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। মেজর নুরুল ইসলাম ও লেঃ মান্নান ইপিআর হেডকোয়ার্টার থেকে প্রায় আধ মেইল দূরে স-এণ্ড-বি রেস্ট হাউসে ঘুমাচ্ছিলেন। রাত সাড়ে বারোটায় রেস্ট হাউস-এর উপর তাদের কামরা লক্ষ্য করে অটোমেটিক গুলি ছোড়া হয়। প্রথমে তিনি টেলিফোন কোম্পানীর সাথে কথা বলতে চেষ্টা করেন। ব্যর্থ হয়ে তিনি এবং লেঃ মান্নান পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে নদীর দিকে চলে যান। এবং সেখান থেকে ময়মনসিংহ শহরে যান। সকাল না হওয়া পর্যন্ত তিমি কোম্পানীর সঙ্গে কোন যোগাযোগ করতে পারেননি। ভোরে যখন যোগাযোগ হয় তখন ভীষণভাবে দুই দলের মধ্যে গোলাগুলি চলছিল। এই গোলাগুলি বেলা দুইটা-আড়াইটা পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। এই গোলাগুলিতে ৬ জন পাকিস্তানী ছাড়া আর সবাই মারা যায়। অবশিষ্ট ৬ জন পাকিস্তানী সৈন্যকে ময়মনসিংহ জেলে রাখা হয়। আমি ময়মনসিংহ পৌছার সাথে সাথে এ সমস্ত ঘটনা শুনতে পাই।

২৯শে মার্চ বিকেল চারটা পর্যন্ত ব্যাটালিয়ন-এর সমস্ত লোক কনসেনট্রেট হয়। রাজেন্দ্রপুর কন্টিনজেন্ট রাত্রে পৌঁছে। আমি ময়মনসিংহে পৌঁছে আমার পরবর্তী কর্মপন্থা নির্ধারণের জন্য সীমান্ত থেকে সমস্ত ইপিআরকে ময়মনসিংহে এসে কনসেনট্রেট হতে অর্ডার দিলাম। তারপর আমি ময়মনসিংহ পুলিশ অয়ারলেসে গিয়ে বাংলাদেশের যত জায়গাতে পুলিশ অয়ারলেস কমিউনিকেশন আছে সবাইকে লক্ষ্য করে এই নির্দেশ দিলাম যে, আমি মেজর সফিউল্লাহ (বর্তমানে ব্রিগেডিয়ার) দ্বিতীয় ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেছি। বর্তমানে ময়মনসিংহ এবং টাঙ্গাইল জেলা আমার নিয়ন্ত্রণাধীন আছে। আপনারা যে যেখানে আছেন, যদি বাঙালি হন, যার কাছে যে অস্ত্র আছে তাই নিয়ে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ান এবং দেশকে পাকিস্তানীদের কবল থেকে স্বাধীন করতে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করুন। প্রায় এক ঘন্টার মধ্যে আমি বেশ উৎসাহব্যঞ্জক সাড়া পেলাম। যে সমস্ত জায়গা থেকে আমি কনফারমেশন পেয়েছি যে তারা অস্ত্র নিয়ে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, সেসব জায়গা হল- দিনাজপুর, রাজশাহী, পাবনা, খুলনা, বগুড়া, কুষ্টিয়া, ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ, ফেনী এবং চট্রগ্রাম।

২৯শে মার্চ বিকেলে জেলা এডমিনিস্ট্রেশন-এর সমস্ত অফিসারবৃন্দ, জাতীয় এবং প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত এম-এন এ এবং এম-পি এদেরকে নিয়ে এক বৈঠক করি। সেই বৈঠকে কিভাবে যুদ্ধ পরিচালনা করতে হবে তাঁর পরিকল্পনা নিই। জেলার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা এবং সামরিক বাহিনীকে খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ করার ভার বেসামরিক প্রশাসন এবং এন-এম এ ও এম-পি দের উপর ন্যস্ত করা হল। তাঁরা বেশ আগ্রহের সাথে এ দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন। যুদ্ধ পরিচালনার ভার আমার হাতে রাখি। এই বৈঠকে এও সিদ্ধান্ত নেয়া হল যে, যুদ্ধ পরিচালনা করতে হলে অস্ত্রশস্ত্রের প্রয়োজন। এবং সেটা পাবার জন্য আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের কাছে আমাদের প্রস্তাব করা দরকার। তাই, এই সিদ্ধান্ত নেয়া হল যে, আমাদের একজন এম-এন-একে দিল্লী পাঠানো হবে আমাদের প্রস্তাব দিয়ে। আমরা এম-এন-এ জনাব সৈয়দ আবদুস সুলতাঙ্কে বাংলাদেশের দূত হিসেবে দিল্লীতে আমাদের এ প্রস্তাব কর্তৃপক্ষের কাছে পেশ করার জন্য পাঠাবার সিদ্ধান্ত নিই। এ সিদ্ধান্তও নেয়া হল যে তাঁকে সীমান্তের বাইরে পাঠাবার পূর্বে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর সাথে যোগাযোগ করা দরকার যে তারা আমাদের গ্রহণ করবে কিনা। এই মর্মে আমি একজন অফিসারকে (ক্যাপ্টেন আজিজুর রহমান, বর্তমানে মেজর) হালুয়াঘাটে বিএসএফ-এর সাথে যোগাযোগ করতে পাঠাই। সে ওখানে পৌছার পর বিএসএফ-এর একজন অফিসার ক্যাপ্টেন বালজিতের সাথে দেখা করে। সেখানে ক্যাপ্টেন ছাড়াও আরো দু’জন অফিসার ছিলেন। একজন লেঃ কর্ণেল সিনহা। তিনি ছিলেন ইন্টেলিজেন্স-এর লোক এবং আর একজন ছিলেন সেখানকার বিএসএফ কমান্ড্যান্ট। তাদের কাছ থেকে আশাব্যঞ্জক সাড়া মেলে। তাঁরা আমাদের সব কিছু দিয়ে সাহায্য করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন। এই প্রতিশ্রুতি পেয়ে আমি সামরিক প্রস্তুতি জোরদার করি।

৩০শে মার্চ সকাল পর্যন্ত ইপিআর, পুলিশ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং কিছু আংশিক ট্রেনিংপ্রাপ্ত বেসামরিক লোকদের নিয়ে একটি বাহিনী গড়ে তুলি। যার লোকসংখ্যা ছিল তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার। ময়মনসিংহে যখন পৌছি তখন আমার সাথে অনেক জেসিও এবং নিম্নলিখিত অফিসার ছিলেন :

১।মেজর নুরুল ইসলাম (বর্তমানে লেঃ কর্ণেল)

২।মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরী (বর্তমানে লেঃ কর্ণেল)

৩। মেজর নাসিম (বর্তমানে লেঃ কর্ণেল)

৪। ক্যাপ্টেন আজিজুর রহমান (বর্তমানে মেজর)

৫। ক্যাপ্টেন এজাজ আহমদ চৌধুরী

৬। লেঃ গোলাম হেলাল মুরশেদ (বর্তমানে ক্যাপ্টেন)

৭। লেঃ ইবরাহীম।

এছাড়া ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান (বর্তমানে মেজর) যিনি ময়মনসিংহে ছুটিতে ছিলেন তাঁকে আমি সাথে নিয়ে নিই। তাকে বলার সাথে সাথে সে আমার ব্যাটালিয়নে যোগ দেয়। এছাড়া অবসরপ্রাপ্ত কাজী নুরুজ্জামান ঢাকা থেকে ময়মনসিংহে যোগ দেন। ময়মনসিংহ থেকে যাবার পথে দুইজন মেডিকেল কলেজের ডাক্তার নিয়ে নিই। তাঁরা হদ্ধে ডাঃ আবদুর রহমান এবং ডাঃ আহমদ আলী।

ময়মনসিংহ পৌঁছে আমি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কোথায় কি করছে সে খবর নেওয়ার জন্য আমার অয়ারলেস দিয়ে মনিটরিং করি। এবং যে সমস্ত খবর পাই তন্মধ্যে ২৯শে মার্চের বিকেলের খবর বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ঐ দিন ১৪ ডিভেশন-এর হেডকোয়ার্টারের কর্নেল সাদুল্লাহ এবং যশোর বিগ্রেডের বিগ্রেড মেজরের মধ্যে যে কথাবার্তা হয় তাঁর মধ্যে নিম্নলিখিত উক্তি বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ কর্নেল ষ্টাফ রীতিমত বিগ্রেড মেজরকে গালিগালাজ করে বলেছিলেন, “You have been routed by rag-tags. You people have no shame, How could you be routed by unarmed people? You need kick. However, tell your commander, if he needs any help, we will send air stories. We are in any way sending two air-stories to Kushtia circuit house. We have been able to tackle Dacca which did not bother us much. We are really concerned about Kushtia now. We have captured 8.E.B.Hq. We are now proceeding towards Radio Station. In the process we have suffered a lot of casualties. Send a c-130 (Transport aircraft) tomorrow in Chittagong, so that the dead and the wounded can be sent in Dacca. If it cannot come then send an “Allwate” (Helicopter) to naval base at 10-30. If c-130 can come then. “Allwate” is not required.” (অনুবাদঃ তোমরা অসংগঠিত লোকদের থেকে পিছিয়ে গেছো। তোমাদের কোন লজ্জা নেই। কিভাবে তোমরা অস্ত্রহীন লোকদের দ্বারা ঘেরাও হয়ে গেলে? তোমরা লাথির যোগ্য। যাই হোক, তোমাদের কমান্ডারকে বলো, যদি তাঁর কোন সাহায্যের দরকার হয়, আমরা আকাশপথে সাহায্য পাঠাবো। আমরা কুষ্টিয়া সার্কিট হাউজে আকাশপথে সাহায্য পাঠাচ্ছি। আমরা সহজেই ঢাকা দখল করেছি। আমরা এখন কুষ্টিয়া নিয়ে চিন্তিত। আমরা ৮ম ইস্ট বেঙ্গল হেডোকোয়ার্টার দখল করেছি। আমরা এখন রেডিও স্টেশনের দিকে যাচ্ছি। এই প্রক্রিয়ায় আমাদের প্রচুর হতাহত হয়েছে। আগামীকাল একটি সি-১৩০ যোগাযোগ হেলিকপ্টার চট্টগ্রামে পাঠাও যেন মৃত এবং আহতদের আমরা ঢাকায় নিয়ে যেতে পারি। যদি এটি আসতে না পারে, তবে নৌ-বাহিনীর হেডকোয়ার্টারে একটি অলওয়েট হেলিকপ্টার পাঠাও ১০:৩০-এ। যদি সি-১৩০ আসতে পারে তবে অলওয়েটের দরকার নেই)“ এবং তারা হয়ত ঢাকা থেকে এসব জায়গায় রি-ইনফোর্সমেন্ট পাঠাবে। আমার আরো চিন্তার কারণ হয়ে পড়ে যখন জিওসিএর মেসেজ শুনলাম যে ৮ ইষ্ট বেঙ্গল হেডকোয়ার্টার দখল করা হয়েছে। তখন সাথে সাথে আমি খুবই চিন্তিত হয়ে পড়ি যে মেজর জিয়া (বর্তমানে বিগ্রেডিয়ার) তার দলবল নিয়ে হয়ত ধরা পড়ে গেছে। এমতাবস্থায় সেখানে এমন কোন অফিসার জানামত ছিল না যে নেতৃত্ব দিতে পারবে। আমি তখন এই সিদ্ধান্ত নিলাম যে অতিশীঘ্র ঢাকা আক্রমণ করা উচিত যেন কোন রি-ইনফোর্সমেন্ট বাইরে না যেতে পারে।

এই সিদ্ধান্তকে বাস্তবে রুপায়িত করার জন্য নিম্নলিখিত পরিকল্পনা নিলাম- নর্থ বেঙ্গল থেকে যাতে পাকবাহিনী ময়মনসিংহের দিকে না আসতে পারে সেই জন্য পুলিশ এবং ট্রেনিংপ্রাপ্ত বেসামরিক সৈনিকদের নিয়ে গঠিত এক কোম্পানী সৈন্য বাহাদুরবাদ ঘাটে পাঠাই। আর কোম্পানী ই-পিআর সিরাজগঞ্জ ঘাটে পাঠাই। এক কোম্পানী ইপিআর এবং আংশিক ট্রেনিংপ্রাপ্ত বেসামরিক কোম্পানী গফরগাঁওয়ে পাঠাই। এক কোম্পানী পাঠাই টাঙ্গাইলে। ৩১ শে মার্চের মধ্যে এরা এ সমস্ত জায়গায় পৌঁছে যায়। এ ছাড়া আরো দুই কোম্পানী লোক (ইপিআর) ঢাকার পশ্চিমাংশ মীরপুর, মোহাম্মদপুর এবং ঢাকা বিমানবন্দর এলাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে ১লা এপ্রিলের মধ্যে আক্রমণ করার নির্দেশ ইদ্যে পাঠাই। আমি আমার ব্যাটালিয়ান এবং ইপিয়ার-এর একটি কোম্পানী নিয়ে ঢাকার পূর্বদিক থেকে আক্রমণের পরিকল্পনা নিই। এ পরিকল্পনা আমি এই জন্য নিই যে, পাকবাহিনী প্রত্যাশা করছিল যে আমরা যদি তাদেরকে আক্রমণ করি তাহলে পশ্চিমাংশ দিয়া করব। তাই তাদেরকে ধোঁকা দেয়ার জন্য পূর্বাংশ দিয়ে আক্রমণের পরিকল্পনা করি। এদিক দিয়ে আসার জন্য আমি যে রাস্তা ব্যবহার করেছিলাম তা ছিলো ময়মনসিংহ থেকে কিহশোরগঞ্জ-ভৈরব-নরসিংদী ট্রেনে। তারপর নরসিংদী থেকে পায়ে হেঁটে ভাংগা দিয়ে শীতলক্ষ্যা পার হয়ে ঢাকায় পূর্বাংশ দিয়ে আক্রমণ করব। এই পরিকল্পনাও যেন ১লা এপ্রিলে বাস্তবায়িত হয় তারও ব্যবস্থা করি।

৩০ শে মার্চ আমি যখন জায়গায় জায়গায় নির্দেশ দিয়ে লোকজন পাঠাচ্ছিলাম তখন গাজীপুর রেলওয়ে ষ্টেশনের ষ্টেশন মাস্টার সকাল সাড়ে এগারোটায় টেলিফোনে আমার সাথে কথা বলেন এবং বলেন যে দু’খানা জেট জঙ্গী বিমান জয়দেবপুরের প্যালেস ভীষণভাবে আক্রমণ করেছে এবং স্ট্রাফিং করছে। তার প্রায় ১৫ মিনিট পর আবার টেলিফোনে বললেন যে আর একখানা জঙ্গী বিমান জয়দেবপুর প্যালেসে বড় বড় বোমা ফেলছে। তাতে বিকট আওয়াজ হচ্ছে এবং প্রাসাদে আগুন লেগে গেছে। এ সংবাদ শুনে আমি স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম এই বভেবে যে আমরা ঠিক সময় বেরিয়ে পড়তে পেরেছি। আমাদের মনে কোন দ্বিধা রইল না যে আমরা কোন ভুল করিনি। বরং ঠিকই করেছি।

আমরা পূর্বপরিকল্পনা মত লোকজন জায়গায় জায়গায় পাঠিয়ে দিই। আমি আমার বাহিনীর নিয়ে ৩০শে মার্চ ট্রেনিংযোগে নরসিংদীর দিকে রওয়ানা হই। অল্পসংখ্যক কম্পার্টমেন্টে আমরা এক সাথে সবাই যেতে পারছিলাম না। তাই অল্প অল্প করে গন্তব্যস্থানে পাঠাচ্ছিলাম।

ময়মনসিংহ থেকে চলে আসার পূর্বে আমি জনগণকে আশ্বাস দিলাম যে আমি আমার ব্যাটালিয়ন নিয়ে শত্রুবাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণ করতে যাচ্ছি। ৩০ শে মার্চ আমি আমার হেডকোয়ার্টার ময়মনসিংহ থেকে কিশোরগঞ্জ স্থানন্তরিত করি। কিশোরগঞ্জে ক্যাপ্টেন মতিন (বর্তমান মেজর) নামে আর একজন অফিসারের সাথে দেখা হয়। সে তখন বাড়িতে ছিল। তাঁকে বলার সাথে সাথে সেও আমাদের সাথে যোগ দেয়।

৩১ শে মার্চ পর্যন্ত আমাদের লোক গন্তব্য স্থানের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। যারা সর্বপ্রথম রওয়ানা হয়েছিলো ১লা এপ্রিল বিকেল পর্যন্ত ঢাকার পূর্বাঞ্চলে বসাবো, ডেমরা এ স্থানে গিয়ে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছিল। সেদিন আমি কিশোরগঞ্জে অবস্থান করছিলাম। তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে একটি খবর আসলো যে মেজর খালেদ মোশাররফ (বর্তমান কর্নেল) ব্রাহ্মণবাড়িয়া সাবডিভিশন তাঁর নিয়ন্ত্রণাধীন রেখেছেন এবং তিনি আমার সাথে কথা বলতে চান। আমি যখন তাঁকে আমার পরিকল্পনার কথা বললাম তখন তিনি আমাকে অনুরোধ করলেন যে আমি যেন ঢাকা অভিমুখে অগ্রসর না হয়ে তাঁর সাথে যোগাযোগ করি। ঐ দিনই আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে চলে যাই। আমার সৈনিকেরা যারা ঢাকার অভিমুখে অগ্রসর হচ্ছিল আমি তাঁদের আর বাঁধা দিইনি। মেজর খালেদ মোশাররফ কি বলতে চান তা জানার জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তাঁর সাথে দেখা করতে চাই। আমি যখন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পৌছি তখন খালেদ সেখানে ছিলেন না। তিনি তাঁর সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ড মেজর শাফায়াত জামিল (বর্তমান লেঃ কর্নেল)-কে মেসেজ দিয়ে পাঠান। এরপর আমি সেখানে ফিরে আসি। আমি যেদিন ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাই সেদিন ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ফেরার পথে দু’খানা জঙ্গী বিমান আমাদের তাড়া করে। বেশ কিছুক্ষণ ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে স্ট্রাফিং-এর পরে তিতাস গ্যাস অয়েল ট্যাঙ্কার-এর উপর বোমাবর্ষণ করে এবং এতে আগুন ধরে যায়। আমাদের সৈনিকেরা যারা ভৈরবে ছিল তাদেরকেও জঙ্গী বিমান দুটো খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। কিন্তু না পেয়ে তারা নরসিংদীতেও খোঁজাখুঁজি করে। আমাদের সন্দান কোথাও পায়নি। দিনটি ছিল ১লা এপ্রিল।

মেজর খালেদ মোশাররফ মেজর শাফায়াত জামিল মারফত আমার নিকট যে মেসেজ পাঠান তা ছিল নিম্নরূপঃ “Do not go towards Dacca. You will be banging your head against wall. We have liberated an area whole of Brahmanbaria Subdivision and a part of Sylhet. Before taking any further action on Dacca, we should jointly liberate this whole area and then go for Dacca. I had already contacted Indian BSF officers and they have agreed to help us. I could not come and meet you today because I am going to meet Brigadier B.C. Pabna of BSF who promised me to help us.”

(অনুবাদঃ ঢাকার দিকে যেও না। তবে তুমি দেয়ালে তোমার মাথা বাড়ি দিতে থাকবে। আমরা ব্রাক্ষণবাড়িয়া সাব-ডিভিশন এবং সিলেটের একটি পূর্ণ এলাকা মুক্ত করেছি। ঢাকায় যাওয়ার আগে আমাদের পূর্ণ এলাকা মুক্ত করা উচিৎ। আমি ইতোমধ্যে ভারতীয় বিএসএফ অফিসারদের সাথে যোগাযোগ করেছি এবং তাঁরা আমাদের সাহায্য করতে রাজী হয়েছেন। আমি আজ এসে তোমার সাথে দেখা করতে পারলাম না কারণ আমি আজ বিএসএফ-এর বি,সি পান্ডার সাথে দেখা করতে যাচ্ছি। উনি আমাদের সাহায্য করবেন বলে কথা দিয়েছিলেন)

তার পরিকল্পনা আমার মোটামুটি পছন্দ হলো। কারণ, আমি জানি যে তখন ঢাকাতে পাকিস্তানের যে সমস্ত সৈনিক এবং ভারী অস্ত্রশস্ত্র আছে আমাদের তার ১০ ভাগের  এক ভাগও নেই। তাই যাতে আমরা যুক্তভাবে একটা পরিকল্পনা নিতে পারি সেই চিন্তা আমি করেছিলাম। এবং আমি এই সিদ্ধান্তে আসি যে, আমাদের এভাবে তাড়াহুড়া করে ঢাকা আক্রমণ করা ঠিক হবে না। আমি তখন আমার অফিসারদের নির্দেশ দেই যে যারা ঢাকা অভিমুখে অগ্রসর হয়েছে তারা যেন নিম্নরূপ মোতায়েন হয়ঃ এক কোম্পানী যেন ঢাকা- নরসিংদী রাস্তা পাহারা দেয়। এক কোম্পানী আশুগঞ্জ আর বাকী লোক যেন ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে চলে আসে। ঢাকার পূর্বাংশে ও পশ্চিমাঞ্চলে যে সমস্ত সৈনিক গিয়েছিল ইয়াদের সাথে পাকবাহিনীর ছোট ছোট সংঘর্ষ হয়। আমার সাথে পর্যাপ্ত অয়ারলেস সেট না থাকায় সবার সাথে যোগাযোগ রাখতে কষ্ট হয়েছিল। বিশেষ করে পশ্চিমাঞ্চলে যারা ছিল তাদের সাথে একমাত্র দূত (রানার) ছাড়া আর কোন যোগাযোগের ব্যবস্থা ছিল না।

খালেদ মোশাররফের সাথে আমার যখন দেখা হয় তখন পরিকল্পনা নেয়া হয় যে আমরা যুক্তভাবে ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং সিলেট এই বিস্তীর্ণ অঞ্চল মুক্ত করব। এই পরিকল্পনাকে আমি বাস্তবায়িত করার জন্য আমার হেডকোয়ার্টার কিশোরগঞ্জ থেকে সিলেটের তেলিয়াপাড়া টি গার্ডেনে ৩রা এপ্রিল স্থানান্তরিত করি। এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, ময়মনসিংহ থেকে কিশোরগঞ্জ বা ভৈরববাজার যাবার সময় আমাদের যানবাহনগুলি নেবার জন্য মালগাড়ীর ওয়াগনকে ওয়েল্ডিং মেশিন দিয়ে কেটে জায়গা করা হয় এবং গাড়ি পার করার ব্যবস্থা করা হয়। ময়মনসিংহ পুলিশ লাইন থেকে সবাইকে অস্ত্রশস্ত্র দেওয়ার পর ১৫০০ রাইফেল, প্রায় ২০টা এল-এমজি, কিছুসংখ্যক স্টেনগান আর ৩ লক্ষ এ্যামুনিশন আমি আমার সাথে নিয়ে আসি। আমাদের ব্যক্তিগর অস্ত্রশস্ত্র ছাড়া এই আর্মস এ্যামুনিশন ছিল আমাদের একমাত্র সম্বল।

১লা এপ্রিল আমাদের নিয়ন্ত্রণে যে এলাকা ছিল তা এরূপঃ মেঘনার পশ্চিম পাড়ে নরসিংদী-তারাবো-ঢাকা রাস্তা আমাদের সম্পুর্ণ নিয়ন্ত্রাণাধীনে ছিল। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সাবডিভিশন মেঘনার পূর্বপাড়ে যেখানে আমি আমার সৈনিকদের মোতায়েন করেছিলাম সে জায়গাগুলো হল উত্তরে আজবপুর, তারপর আশুগঞ্জ এবং সবচেয়ে দক্ষিণে লালপুর, উত্তরে সিলেটের শেরপুর, শাদীপুর এবং শেওলা করিমগঞ্জও আমার নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পূর্ব এবং দক্ষিণাংশে মেজর (বর্তমানে কর্ণেল) খালেদ মোশাররফের সৈন্যরা ছিল। যে সব এলাকা তাদের নিয়ন্ত্রাণাধীনে ছিল তা ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর, গোকর্ণহাট, উজানিসার পুল এবং গঙ্গাসাগর। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান রেডিওর ঘোষণা অনুযায়ী ঢাকার রেসকোর্স (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বেসামরিক যানবাহন, ট্রাক, বাস একত্রিত হয়। এই ট্রাক বাস দ্বারা দুই কলাম ফোর্স তৈরী করা হয় যার এক কলাম ২রা এপ্রিল টাঙ্গাইলের দিকে রওনা হয় এবং আর এক কলাম নরসিংদীর দিকে রওয়ানা হয়। যে কলামে টাঙ্গাইলের দিকে রওয়ানা হয়েছিল আমার টাঙ্গাইলে প্রেরিত কোম্পানী তাদেরকে রাস্তায় এ্যামবুশ করে। এই কলামে প্রায় ১০০টির বেশী গাড়ী ছিল। এ এ্যামবুশ এত সুন্দর হয়েছিল যে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বেশকিছু লোক হতাহত হয়। হতাহতের সংখ্যা বলা যাবে না। তবে লোকেমুখে শোনা যায় যে আহতদের নিয়ে যাবার জন্য ছয়খানা গাড়ি ব্যবহার করা হয়েছিল। এই অপারেশনে আমাদেরও কিছু লোক মারা যায়। এই খবর পাই মেসেজের মাধ্যমে। এই পশ্চিমাংশের লোকদের খবরাখবর ততদিন পর্যন্ত পাই, যতদিন তারা মধুপুর জঙ্গল থেকে যুদ্ধ চালাচ্ছিল।

যে কলাম ঢাকা থেকে নরসিংদী রওয়ানা দিয়েছিল তারা আমাদের কোম্পানীর দ্বারা নরসিংদী এবং পাঁচদোনার মাঝামাঝি জায়গায় আক্রান্ত হয়। এই আক্রমণে পাকিস্তানের সৈন্যদের বহু ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং তাদের পিছে হটে যেতে বাধ্য করা হয়। এ ঘটনা ঘটে ২রা এপ্রিল। তারা ঢাকা থেকে বিমান বাহিনীর শায্য চায়। যেহেতু বিমান বাহিনী অন্যান্য জায়গায় ব্যস্ত ছিল সেহেতু বিমান বাহিনী সেদিন তাদের সাহায্যে আসতে পারেনি। কিন্তু পরদিন তাদের আর্টিলারি বেশ সক্রিয় হয়ে ওঠে। আমাদের সৈনিকরা যে জায়হাতে ছিল সেই জায়গাতে পাঁচদোনা- নরসিংদীতে ভীষনভাবে আর্টিলারী গোলাবর্ষ্ণ শুরু হয়। আমাদের নিকট দূরপাল্লার কোন অস্ত্রই ছিল না, রাইফেল এবং লাইট মেশিনগান ব্যতীত। তাই আমরা তাদের পাল্টা জবাব দিতে পারিনি। এভাবে তারা ৪৮ ঘন্টা যাবৎ আমাদের উপর ব্যাপক গোলাবর্ষণ করে। ৩রা এপ্রিল আর্টিলাআরী গোলাবর্ষণ ছাড়াও জঙ্গী বিমান ও আমাদের উপর ব্যাপকভাবে স্ট্রাফিং করে। শত্রুর মুখোমুখি যুদ্ধ এই ছিল আমাদের প্রথম। সৈনিকরা এ রকম গোলাবর্ষণের সম্মুখীন আর কখনো হয়নি। তাই তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পেছনে সরে আসে। আমরা বেশকিছু সংখ্যক সৈনিককে ভৈরবে একত্রিত করতে সক্ষন হই এবং পূর্বপরিকল্পনা মোতাবেক ভৈরবের পূর্বাংশে রামপুরা ব্রীজের কাছে সেনা মোতায়েন করি –যাতে পাকিস্তানী সৈনিকরা বিনা বাধায় ভৈরব পৌঁছাতে না পারে।

৩রা এপ্রিল এই পরিকল্পনা নিই যে, যেহেতু আমাদের সৈন্য কম সেহেতু পাকিস্তানী সেনাদের প্রতিরোধ করার জন্য ডিনায়াল প্ল্যান গ্রহণ করি। এর উদ্দেশ্য, রাস্তাঘাট, রেলওয়ে ব্রীজ, রোড ব্রীজ ভেঙ্গে দেয়া যাতে শত্রুরা অতি সহজে সম্মুখে আসতে না পারে। ডিনায়াল প্লান-এর প্রথম আমরা ভৈরবের কাছে রামপুরের ব্রীজ ভেঙ্গে ফেলি। আর কিশোরগঞ্জের কাছে রোড এবং রেলব্রীজ দুটোই ভেঙ্গে দিই। ভৈরবের ব্রীজ ভাঙ্গারও পরিকল্পনা নিই।

৪ঠা এপ্রিল দেখা গেল কর্নেল ওসমানী (বর্তমানে জেনারেল)-এর সাথে আমারই হেডকোয়ার্টারে তেলিয়াপাড়াতে। তিনি আগরতলা থেকে তেলিয়াপাড়াতে আসেন। আমি প্রথমে বিশ্বাস করতে পারিনি যে তিনিই সেই ওয়সমানী যাকে আমি ভালোভাবে চিনতাম। আমি তাঁকে চিনতে পারিনি এই জন্যে যে আত্মগোপন করার জন্য গোঁফ কেটে রেখেছিলেন। ঐ দিনই আমি খবর পেলাম যে জিয়াউর রহমান (বর্তমানে ব্রিগেডিয়ার) চট্রগ্রাম থেকে আমার সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য আমার কাছে আসছেন।

একটা কথা বলা দরকার, ৪ঠা এপ্রিল স্বাধীনতা সংগ্রামের এক মস্ত বড় দিন। সেদিন আমার হেডকোয়ার্টারে অনেক সিনিয়র অফিসার একত্রিত হয়েছিলেন। যারা ছিলেন তাঁরা হলেনঃ

১। কর্নেল ওসমানী (বর্তমানে জেনারেল, বিমান ও নৌযান মন্ত্রী),

২। মেজর জিয়াউর রহমান (ব্রিগেডিয়ার),

৩। মেজর খালেদ মোশাররফ (কর্নেল),

৪। লেঃ কর্নেল সালাউদ্দিন মোঃ রাজা (রিটায়ার্ড কর্নেল),

৫। মেজর কাজী নুরুজ্জামান (রিটায়ার্ড লেঃ কর্নেল),

৬। মেজর নুরুল ইসলাম (লেঃ কর্নেল),

৭। মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরী (লেঃ কর্নেল),

৮। লেঃ কর্নেল আবদুর রব (রিটায়ার্ড মেজর জেনারেল, বর্তমানে এম-পি) এবং অনেকে উপস্থিত ছিলেন।

ঐ দিন আমরা কর্নেল ওসমানীকে বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়কের দায়িত্বভার গ্রহণ করতে অনুরোধ করি। তিনি সে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। It was decided that day, that the operation for liberation war to be conducted under one command and the commander being colonel M.A.G Osmany (now rtd. General Osmany. অনুবাদঃ ঐ দিন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল যে স্বাধীনতার যুদ্ধ কেবল একটি কমান্ডের অধীনেই অনুষ্ঠিত হবে এবং তা হবে কর্নেল এম, এ, জি ওসমানীর কম্যান্ডে (বর্তমানে রিটায়ার্ড জেনারেল ওসমানী)

ঐ দিন আমরা কর্নেল ওসমানীকে এই অনুরোধ করি যে যত শীঘ্র হোক রাজনৈতিক নেতাদের দ্বারা যেন সরকার গঠন করা হয়। যতক্ষন পর্যন্ত সরকার গঠিত হচ্ছে না ততক্ষন পর্যন্ত আমরা কোন বৈদেশিক সাহায্য পাব না। ঐ দিন আন্যান্য সিদ্ধান্তের মধ্যে এটাও সাব্যস্ত হল যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সিলেট এলাকার যুদ্ধ পরিচালনার ভার মেজর (বর্তমানে কর্নেল) খালেদ মোশাররফের উপর ন্যস্ত করা হয়। চট্রগ্রাম এবং পার্বত্য চট্রগ্রামের যুদ্ধ পরিচালনার ভার ছিল মেজর (বর্তমানে ব্রিগেডিয়ার) জিয়াউর রহমানের উপর। এই সিদ্ধান্তের পর আমরা যার যার এলাকার সৈনি মোতায়েন করি।

৪ঠা এপ্রিল আমার বাহিনী নিম্নলিখিত এলাকায় নিযুক্ত থাকেঃ প্রায় দুই কোম্পানী সৈন্য নরসিংদীতে, এক কোম্পানী আজবপুরে, এক কোম্পানী আশুগঞ্জে, এক কোম্পানী লালপুরে, এক কোম্পানী সিলেটের শেরপুরে ও শাদিপুরে এক কোম্পানী সরাইলে (এই কোম্পানী আমার রিজার্ভ কোম্পানী ছিল)। তাদের উপর দুটো টাস্ক দেয়া হয়েছিল। প্রথম টাস্ক হল, যদি দরকার হয় ঢাকার দিক থেকে পাকসৈন্যরা আক্রমণ বৃদ্ধি পেলে লালপুর এবং আশুগঞ্জে যেসব সৈনিক আছে তাদের সাহায্যার্থে তালশহর এবং গোকনঘাট এলাকায় সৈন্য মোতায়েন করবে। দ্বিতীয় টাস্ক হল, যদি সিলেটের দিক দিয়ে পাক সেনাবাহিনীর আক্রমণ বৃদ্ধি পায় তাহলে শেরপুরে সৈন্যদের সাহায্যার্থে যেন মৌলভীবাজারে সৈন্য মোতায়েন রাখা হয়। এসব কোম্পানী ছাড়াও মেজর (বর্তমানে ব্রিগেডিয়ার) জিয়াউর রহমানের অনুরোধে চট্রগ্রামের সৈনিকদের রি-ইনফোর্সমেন্ট-এর জন্য আমাকে এক কোম্পানী সৈন্য তাঁকে দিতে হয়। ৫ই এপ্রিল তাঁরা আমার কাছ থেকে চট্রগ্রাম অভিমুখে রওয়ানা হয়ে যায়। এবং সে কোম্পানীর অধিনায়ক ছিলেন ক্যাপ্টেন এজাজ চৌধুরী।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে যে রাস্তা কুমিল্লার দিকে চলে গেছে সে রাস্তার উপর নজর রাখার ভার ছিল মেজর (বর্তমানে কর্নেল) খালেদ মোশাররফের উপর। তিনি সে দায়িত্ব পালন করার জন্য উজানিয়া পুলের নিকট এক কোম্পানী, গংগা সাগরে এক কোম্পানী এবং গোকনঘাটে এক কোম্পানী সৈন্য মোতায়েন করেন।

যেহেতু আমার সুদক্ষ সৈনিকের অভাব ছিল সেহেতু ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, প্রাক্তন ইপিআর, পুলিশ এবং আংশিক ট্রেনিংপ্রাপ্ত বেসামরিক লোক নিয়ে এই সমস্ত কোম্পানী পুনর্গঠন করা হয়।

সৈন্যসংখ্যা আমাদের কম থাকায় ৪ঠা এপ্রিল থেকেই আমি আমার হেডকোয়ার্টার তেলিয়াপাড়াতে একটি ট্রেনিং ক্যাম্প খুলি। ঐ ট্রেনিং ক্যাম্পে প্রায় ৭০০ থেকে ৮০০ যুবক ট্রেনিং নিচ্ছিল। অল্প সংখ্যক অফিসার এবং ইন্সট্রাক্টর নিয়ে আমি এই ট্রেনিং ক্যাম্প শুরু করি। আমার যে সমস্ত অফিসার ছিল তাঁরা তাঁদের স্ব স্ব কোম্পানী নিয়ে ৪ঠা এপ্রিল নিম্নলিখিত জায়গাতে মোতায়েন ছিলঃ ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান নরসিংদীতে , ক্যাপ্টেন নাসিম আশুগঞ্জে, লেঃ মোরশেদ লালপুরে, ক্যাপ্টেন মতিন সরাইলে, ক্যাপ্টেন আজিজ শেরপুর কাদিপুরে, ক্যাপ্টেন এজাজ চৌধুরী চট্রগ্রাম অভিমুখে, মেজর মইন তেলিয়াপাড়াতে তার কোম্পানীর সাথে, মেজর নুরুল ইসলাম ট্রেনিং দেয়ার জন্য এবং লেঃ ইব্রাহীম আমার হেডকোয়ার্টারে স্টাফ অফিসার হিসেবে। ৫ই এপ্রিল ক্যাপ্টেন নুরুজ্জামান আমার সাথে যোগ দেয়। (নুরুজ্জামান যোগ দিয়ে তার পরিবারকে আনার জন্য রায়পুরাতে চলে যায় এবং ২৬শে জুন পুনরায় যোগদান করে)

আমাকে সিলেট থেকে ভৈরব এবং নরসিংদী পর্যন্ত সৈনিকদের তত্ত্বাবধান করতে হত। এখানে একটা কথা বলে রাখা দরকার যে, জয়দেবপুর থেকে যেদিন আমরা বেরিয়ে এসেছি ঐদিন থেকে আমাদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে কোন চিন্তা করতে হয়নি। কারণ, আমরা যখন যেখানেই ছিলাম ঐ জায়গার জনসাধারণ আমাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করত। তাই খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে কোন চিন্তা করতে হয়নি। যাঁরা আমাদের খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে সাহায্য করেছিলেন তাঁদের মধ্যে কয়েকজনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্যঃ

নরসিংদীতে মিজানুর রহমান (একজন স’মিল ম্যানেজার),

আশুগঞ্জে মোঃ শফিউদ্দীন,

ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে প্রাক্তন এমপিএ সাচ্চু মিঞা এবং সিলেটের সাবু চৌধুরী ও মোহাম্মদ আলকাস মিঞা।

৪ঠা এপ্রিল আমি সিলেট অভিমুখে যাত্রা করি আমার যে কোম্পানী সৈন্য শেরপুর, শাদিপুরে পাঠিয়েছি তাঁদের যুদ্ধের পরিকল্পনা দেবার জন্য। মৌলভীবাজার গিয়ে মেজর (বর্তমানে কর্নেল) চিত্তরঞ্জন দত্তের সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়। সেখানে মেজর দত্ত, এমএনএ মানিক চৌধুরী, কিছুসংখ্যক প্রাক্তন ইপিআর এবং আংশিক শিক্ষাপ্রাপ্ত বেসামরিক লোকজনকে নিয়ে এক বাহিনী গঠন করেন। আমি মৌলভীবাজারে গিয়ে তাঁদের কাছে আমার মনের উদ্দেশ্য ব্যক্ত করি। আমার সৈনিক এবং তাঁদের গঠিত বাহিনী নিয়ে সিলেট জেলাকে শত্রুমুক্ত করার জন্য এক পরিকল্পনা গ্রহণ করি। সিলেটে তখন এক ব্যাটালিয়নেরও বেশী সৈন্য ছিল। আমার কাছে তখন আমার নিজস্ব এক কোম্পানী সৈনিক এবং কর্নেল দত্তের দ্বারা গঠিত আরো প্রায় দুই কোম্পানী সৈনিক ছিল। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যে, আমাদের নিকট যে সৈন্য রয়েছে তাঁদের দ্বারা সিলেট শত্রুমুক্ত করতে হলে আমাদের দুই পর্যায়ে এই আক্রমণ চালাতে হবে। প্রথম পর্যায়ে সুরমা নদীর দক্ষিণাঞ্চলে মুক্ত করা এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে সুরমা নদীর উত্তরাঞ্চল মুক্ত করা।

এই প্রথম পর্যায় সম্পন্ন করার জন্য পাকিস্তানী যত সৈনিক সুরমা নদীর দক্ষিণাঞ্চলে ছিল তাদের পরাজিত করতে তিনদিক থেকে আক্রমণ শুরু করি। এক কোম্পানী শেরপুর থেকে সিলেটের দিকে প্রধান সড়ক দিয়ে সিলেট অভিমুখে অগ্রসর হয়। এক কোম্পানী ফেঞ্চুগঞ্জ হয়ে রেললাইন ধরে অগ্রসর হয়, আআর এক কোম্পানী শেওলা করিমগঞ্জের দিক থেকে সুরমা নদীর দক্ষিণ পার হয়ে সিলেটের দিকে অগ্রসর হয়।

এপ্রিল মাসের পাঁচ তারিখে সুরমা নদীর দক্ষিণ পাড়ে এক খণ্ডযুদ্ধে পাকবাহিনী পরাজিত হয় এবং তাঁরা পলায়ন করে শালুটিকার বিমান ঘাঁটিতে একত্রিত হয়। ৫ই এপ্রিল সুরমা নদীর সমগ্র দক্ষিণাঞ্চল এবং সুরমা  নদীর উত্তরে দিলেট শহর শত্রুমুক্ত হয়ে আমাদের হস্তগত হয়। প্রাক্তন ইপিআর এর কিছু সংখ্যক লোক যারা সুনামগঞ্জে ছিলেন তারাও উত্তর পশ্চিম দিক থেকে সিলেটের দিকে অগ্রসর হয়। ঐ দিন পর্যন্ত আমাদের আয়ত্তাধীনে যে সমস্ত এলাকা ছিল তা হলঃ সমস্ত সুরমা নদীর দক্ষিনে এবং পশ্চিমে সমস্ত অঞ্চল, সিলেট শহর এবং খাদিমনগর। আমাদের কাছে সৈন্য ছিল মাত্র ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের এক কোম্পানি এবং প্রাক্তন ইপিআর এর তিন কোম্পানি, যারা সমস্ত এলাকাকে ঘিরে রাখে। পাকিস্তানের যে সৈনিক ছিল তা এক ব্যাটেলিয়নেরও বেশি। তারা শালুটিকার বিমান ঘাঁটিতে একত্র হয়েছিল। পাকিস্তানিদের কাছে আধুনিক, মারাত্মক এবং ভারী অস্ত্রশস্ত্র ছিল। যে ব্যাটেলিয়ন সেখানে ছিল তা হল ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট।

প্রথম পর্যায় শেষ করার পর আমি আমার সৈনিকদের নির্দেশ দিই, যে এলাকা এখন আমাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে সেখানে যেন শত্রুরা বুহ্য ভেদ করতে না পারে। সে জন্য সজাগ দৃষ্টি রেখে সে এলাকাকে সুরক্ষিত রাখতে বলি। দ্বিতীয় পর্যায় অপারেশন আমি শুরু করতে পারছিলাম না, এই জন্য যে, শত্রু সৈন্যের সংখ্যা আমাদের ছেয়ে অনেক বেশি ছিল। তাই সবাইকে পরিখা খনন করে বুহ্য প্রস্তুত করতে বলি।

পাক সৈনিকরাও তখন বেশ অসস্তিকর পরিস্থিতিতে ছিল। তাদের মনোবলও লোপ পেয়েছিল। আত্মসমর্পণের ইচ্ছা থাকলেও তাদের মনে আশংকা ছিল যে, আত্মসমর্পণ করলে তাদের সবাইকে মেরে ফেলা হবে। তাই আত্তরক্ষার জন্য তারাও চারিপাশে পরিখা খনন করে বূহ্য তৈরি করলো। আমি তখন চিন্তা করছিলাম যে অন্য কোথাও থেকে এখানে সৈন্য আনা যায় কিনা। আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং আশুগঞ্জ থেকে কোন সৈন্য সরাতে পারছিলাম না এইজন্য যে তখন নরসিংদীতে লড়াই চলছিল। পাকিস্তানিরাও তখন নীরব থাকেনি। তারা পিআই ফোকার ফ্রেণ্ডশিপ এবং সি-১৩০ বিমানের সাহায্যে সিলেটে রি-ইনপোর্সমেন্ট শুরু করে। আমাদের শুধু সৈন্যই কম ছিল না, অস্ত্রশস্ত্রেরও অভাব ছিল যথেষ্ট। আরো অধিক সৈন্য কিভাবে যোগাড় করা যায় সে ব্যাপারে আলোচনার জন্য মৌলভীবাজারে মেজর দত্ত (বর্তমানে কর্নেল দত্ত) এবং এমএনএ মানিক চৌধুরীর সাথে মিলিত হই। এই সাক্ষাৎকার ঘটে ৮ই এপ্রিল। অই দিন পর্যন্ত এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে শত্রুকে ধোকা দেয়ার জন্য বেশ কিছু বেসামরিক লোককে পাকিস্তানীদের বুহ্যের পশ্চিমাংশ দিয়ে মহড়া দেখানো বা শো করানো যেন এই সুযোগে খাদিমনগরের দিক থেকে (পূর্ব দিক থেকে) জঙ্গলের ভিতর দিয়ে শালুকাটিকার বিমান ঘাটির উপর আক্রমণ চালাতে পারি। এ সমস্ত লোককে একত্রিত করার দায়িত্ব নেন এমএনএ মানিক চৌধুরী। ৯ই এপ্রিল পর্যন্ত লোক যোগাড় করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু অন্যদিকে পাকিস্তানী রি-ইনফোর্স্মেন্ট বেশ হয়ে যায় এবং ৯ই এপ্রিল দিবাগত রাত্রে পাকিস্তানীরা আমাদের উপর আক্রমণ চালায়। এ আক্রমনে সারারাত লড়াই চলে এবং অবশেষে আমরা পিছু হটতে বাধ্য হই। এ লড়াইয়ে আমাদের দুজন সৈনিক শহীদ হন এবং পাঁচজন আহত হন। যারা শহীদ হয়েছেন তারা হলেন হাওলাদার কাজী মোস্লেহউদ্দিন এবং ল্যান্সনায়েক আবদুর রহমান। শত্রুপক্ষেরও বেশ হতাহত হয়। তাদের দূরপাল্লার কামানের গোলার মুখে আমরা টিকতে পারছিলাম না। শুধু তাই নয়, পাকিস্তানী জঙ্গি বিমানও আমাদের উপর আক্রমণ চালায়।

সেখান থেকে পিছু হটে আমরা আবার শেরপুরে বুহ্য নির্মাণ করি এবং ভবিষ্যতে যুদ্ধ পরিচালনার পরিকল্পনা করার জন্য আবার মৌলভীবাজারে মিলিত হই। ওইদিন কর্নেল ওসমানী (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল), মেজর কাজী নুরুজ্জামানও (অবসরপ্রাপ্ত লেঃ কর্নেল) মৌলভীবাজারে উপস্থিত হন। যেহেতু আমাকে সিলেট ও নরসংদিতে যুদ্ধের পরিকল্পনা তত্তাবধান করতে হয়েছিল এবং নরসংদিতে যুদ্ধ চলছিল সেহেতু মেজর কাজী নুরুজ্জামান এবং মেজর চিত্তরঞ্জন দত্তকে সিলেটের যুদ্ধের পরিচালনার ভার অর্পণ করা হয়। মেজর নুরুজ্জামান সিনিয়র হওয়াতে তাকে অধিনায়ক করা হয়। যে সমস্ত সৈন্য যুদ্ধের জন্য আমি সিলেট নিয়েছিলাম তাদেরকে রেখে আসি। ১১ই এপ্রিল পর্যন্ত ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট থেকে এক কোম্পানি সৈন্য সিলেট এবং এক কোম্পানি সৈন্য চিটাগাং পাঠাবার পর আমার নিকট মাত্র ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দুই কোম্পানি সৈন্য থেকে যায়। তাদের দ্বারা আমাদের ঢাকা থেলে অগ্রসরমান এক ব্রিগেড পাকিস্তানী সৈন্যের মোকাবিলা করতে হচ্ছিলো।

আমি এই দুই কোম্পানি সৈন্য প্রাক্তন ইপিআর এবং আংশিক শিক্ষাপ্রাপ্ত বেসামরিক জনগন দ্বারা এক ব্যাটেলিয়নের মতো সৈন্য আবার তৈরি করি। তাদের দ্বারাই আমি পাকিস্তানী সৈনিকদের মোকাবিলা করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হই। এবং আজবপুর, আশুগঞ্জ, ভৈরব, লালপূর এবং গোকনঘাটে এক বূহ্য তৈরি এবং শত্রুদের অপেক্ষায় ওঁৎ পেতে থাকি।

১১ই এপ্রিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং ভৈরব এলাকায় পাকবাহিনী হেলিকপ্টার এবং জঙ্গি বিমানের সাহায্যে আমাদের অবস্থান সম্পর্কে ব্যাপকভাবে তথ্য সংগ্রহ করতে থাকে। আমাদের নিকট কোন বিমান বিধ্বংসী কামান ছিল না বলে এর বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারিনি। পাকসেনাদের তৎপরতা বেড়ে যাওয়াতে ১৩ই এপ্রিল আমি কিছু সংখ্যক যুবককে ট্রেনিং দিয়ে ভৈরব, আশুগঞ্জের নিকট পাঠাই যেন মেঘনা নদীর পূর্বপাড়ের এলাকাগুলোতে আমরা বেশ শক্তিশালী থাকতে পারি। ঐ সমস্ত ছেলেরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলওয়ে ষ্টেশনের কাছে পাকবাহিনীর জঙ্গি বিমান দ্বারা আক্রান্ত হয়। ফলে দুজন তরুন শহীদ হয়। এর মধ্যে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন সৈনিক ছিলেন। তার নাম সিপাই মোহাম্মদ মোহসীন। ট্রেনিং প্রাপ্ত যে ছেলেটি শহীদ হয় তার নাম জানা নেই। ঐ দিন আমাদের অপারেশনাল কো-অর্ডিনেশনের জন্য মৌলভীবাজার যেতে হয়। আক্রমণের কথা শুনে আমি  মৌলভীবাজার থেকে ১৩/১৪ই এপ্রিল রাত দুটার সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে রওয়ানা হয়ে ভোরে প্রায় ৫টায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌছি। ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে সেদিন কর্নেল রেজা ছিলেন। পাকবাহিনীর আক্রমণাত্মক কার্যকলাপ বেড়ে যাওয়াতে আমি সরাইলে যে রিজার্ভ কোম্পানিকে রেখেছিলাম তিনি সেই রিজার্ভ কোম্পানিকে লালপুরে আমাদের লোকদের সাহায্যার্থে পাঠান। আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে পৌছে এই খবর পাই যে সরাইলে আমার যে রিজার্ভ কোম্পানি ছিল, তা লালপুর অভিমুখে রওয়ানা হয়ে গেছে। ওয়্যারলেস সেট না থাকাতে যোগাযোগ রক্ষা করা আমার পক্ষে বেশ কষ্টকর হচ্ছিল। কারণ, কারো কাছে কিছু কিছু বলতে হলে আমাকে রানার দ্বারা অথবা নিজে ফিয়ে যোগাযোগ করতে হত। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমি এই রিজার্ভ কোম্পানিকে ইচ্ছা থাকলেও ফিরিয়ে আনতে পারিনি। সরাইলে তাদের রাখার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল যে, যুদ্ধ যদি ব্যাপক আকার ধারণ করে তাহলে তারা যেন তালশহর ও গোকনঘাট এলাকায় বূহ্য রচনা করতে পারে। এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল শত্রু যদি মেঘনা নদীর পূর্বপারে আমরা যে বূহ্য রচনা করেছি তা ভেদ করে তা হলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌছার পূর্বে তাদের যেন বাঁধা দিতে পারি। তাছাড়া মেঘনা নদীর পূর্বপারে আমার যেসব সৈন্য মোতায়েন আছে তাদের সাহায্যে যেন তারা আসতে পারে। এই রিজার্ভ কোম্পানি লালপুর চলে যাওয়াতে আমার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হতে পারেনি।

১৪ই এপ্রিল সকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলস্টেশনে গিয়ে কিভাবে তাদের ফিরিয়ে আনা যায় তা পরিকল্পনা করছিলাম। এ সময় প্রায় সকাল ৫টায় পাক সেনাবাহিনী আমার বাহিনীর উপর ভীষণভাবে আক্রমণ করে। এই আক্রমনে পাক সেনাবাহিনীর প্রায় এক ব্যাটালিয়ন সৈনিক রেল লাইন ঘেঁষে ভৈরবের দিকে অগ্রসর হয়। এক ব্যাটেলিয়ন সৈনিক আইডব্লিটিএ”এলসিটি এবং মোটর লঞ্চের সাহায্যে মেঘনা নদী দিয়ে লালপুরের দিকে অগ্রসর হয়। ঠিক এই সময় নরসিংদীর নিকটবর্তী কোন জায়গা থেকে দূরপাল্লার কামান দ্বারা লালপুর, আশুগঞ্জ এবং ভৈরবে ভীষণভাবে গোলাবর্ষণ হচ্ছিল। শুধু তাই নয়, ছয়খানা এফ-৮৬ বিমান ব্রাহ্মণবাড়িয়া, আশুগঞ্জ,  ভৈরব এবং লালপুর প্রভৃতি জায়গাগুলোতে ভীষণভাবে আক্রমণ করে এবনফ সকাল সাড়ে পাঁচটা থেকে দুপুর সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত ক্রমাগত ছয় ঘণ্টা আমাদের উপর আক্রমণ চালায়। যখন জঙ্গি বিমানের আক্রমণ চলছিল তখন ছয়খানা হেলিকপ্টার দ্বারা কয়েকবার তারা নরসিংদী থেকে প্রায় দুই কোম্পানি কমান্ডার আমাদের পেছনে মেঘনার পূর্বপারে অবতরণ করায়। যুদ্ধ তখন তুমুলভাবে বেধে যায়। এই যুদ্ধে আমাদের নিকট কোন দূরপাল্লার কামান বা ভারী অস্ত্রশস্ত্র এবং বিমান বিধ্বংসী কামান না থাকায় আমাদের  সৈনিকদের মনোবল বেশ ভেঙে যায়। কারণ আমরা চতুর্দিক থেকে আক্রান্ত হই। এভাবে বেলা প্রায় ১২টা পর্যন্ত যুদ্ধ চলে। এই যুদ্ধে উভয়পক্ষে বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়। এবং আমার সৈনিকগণ ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। আমাদের একত্রিত করতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। যেহেতু আমার নিকট কোন রিজার্ভ ফোর্স ছিল না, তাই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নিকটবর্তী শাহবাজপুরে একত্রিত করি। শাহবাজপুর এলাকাটা প্রতিরক্ষার জন্য উপযুক্ত না হওয়ায় আমি সিলেটের মাধবপুরে আমার প্রতিরক্ষা বূহ্য নির্মাণ করতে শুরু করি। আশুগঞ্জের যুদ্ধে যারা শহীদ হয়েছিলেন তারা হলেন সুবেদার সিরাজুল ইসলাম, ল্যান্স নায়েক আব্দুল হাই, সিপাহী কফিলউদ্দিন, সিপাহী আব্দুর রহমান সরকার।

১৪/১৫ই এপ্রিল রাত প্রায় দুটায় শাহবাজপুরে তিতাস নদীর উপরে যে পুল ছিল তা ভেঙে দিই এবং তিতাস নদীর পূর্বপারে শাহবাজপুরের কাছে একটা বূহ্য নির্মাণ করি। যদিও ১৪ই এপ্রিল আমাদের ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছেড়ে দিতে হয়েছিল। কিন্তু তবুও পাকিস্তানী সৈনিকরা দুই দিন পর্যন্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে ঢুকেনি। এ দুদিন তারা অনবরত ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে গোলাবর্ষণ করেছে। তারপর তারা আস্তে আস্তে শাহবাজপুরের দিকে অগ্রসর হয়। শাহবাজপুর দখল করার জন্য তারা জল এবং স্থল উভয় পথে আসে। ২১শে এপ্রিল তারা শাহবাজপুর দখল করে। সেদিন তারা আমাদের অবস্থানের উপর বেপরোয়াভাবে দূরপাল্লার কামান দিয়ে এবং জঙ্গি বিমান দিয়ে গোলাগুলি করে। আমাদের কাছে বিমান আক্রমণ প্রতিহত করার কোন অস্ত্র না থাকায় এবং পাকিস্তানী জঙ্গি বিমানের আক্রমনে আমাদের সৈনিকরা এতই আতংকিত হয়েছিল যে তারা বিমান দেখলেই ভয় পেয়ে যেত।

পাক সৈন্যের শাহবাজপুর দখল করার সাথে সাথে আমি শাহবাজপুর থেকে তেলিয়াপাড়া পর্যন্ত প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার জন্য বেশ বিপুল সংখ্যক পুল ভেঙ্গে ফেলি। আমরা মাধবপুর বেশ বড় রকমের বূহ্য তৈরি করি। মাধবপুর দখল করার জন্য পাকবাহিনী আমাদের উপর কয়েকবার আক্রমণ করে এবং শেষ পর্যন্ত ২৮শে এপ্রিল বেলা পাঁচটায় মাধবপুর দখল করে নেয়। এই আক্রমনে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী প্রায় দুই ব্যাটেলিয়ন সৈন্য মোতায়েন করে। লড়াই সকাল ৮টা থেকে শুরু হয়। পাকবাহিনী মাধবপুর আক্রমণের জন্য দূরপাল্লার ভারী অস্ত্র ব্যবহার করে এবং যে গোলাবারুদ তারা ব্যবহার করে তা ছিল হাই এক্সপ্লোসিভ এবং আগ্নেয় ধরনের। কাজেই যেখানেই তাদের গোলা পড়তো সেখানেই আগুন লেগে যেত। পরিখা এবং বাঙ্কার তৈরি করে আমরা যে বূহ্য তৈরি করেছিলাম সেটাও ছিল বেশ মজবুত। কিন্তু আমাদের সাথে রাইফেল, এলএমজি এবং মেশিনগান ছাড়া কোন ভারী অস্ত্র ছিল না। বেলা প্রায় ১২টার মধ্যে আমাদের অবস্থানের চারপাশে শুধু আগুন জ্বলছিল। তবুও আমাদের জোয়ানরা কেউই তাদের ট্রেঞ্চ এবং বাঙ্কার ছেড়ে যায়নি। বাঙ্কার এবং ট্রেঞ্চে বসে শত্রু নিপাত করছিল। বেলা প্রায় সাড়ে ১২টায় পাকিস্তানী সৈনিকরা মাধবপুর দখল করার জন্য আমাদের অবস্থানের দিকে দলে দলে অগ্রসর হয় এবং ভীষণ যুদ্ধ বেধে যায়। আমাদের মেশিনগান, এলএমজি এবং রাইফেল তাদের অগ্রসর হতে দিচ্ছিল না। তাদের যে দলই সামনে অগ্রসর হচ্ছিল সে দলটিকেই গুলি করে ভূলুণ্ঠিত করা হচ্ছিল। মাধবপুরে যখন এভাএ মুখোমুখি যুদ্ধ চলছিল তখন আমি মাধবপুরে পশ্চিম পার্শ্ব দিয়ে অপর একটি ছোট সৈনিক দলকে লেঃ মুরশেদের নের্তৃত্বে পাঠায় যাতে সে তাদের পিছন দিয়ে আক্রমণ করতে পারে। তার আক্রমণও বেশ ফলপ্রসূ হয়। সারাদিন যুদ্ধ করার পর আমাদের গোলাবারুদ প্রায় ফুরিয়ে যায়। এবং দক্ষিন-পশ্চিমাংশের এক অংশের সৈনিকদের গোলাবারুদ একেবারেই ফুরিয়ে যায়। ওয়্যারলেস যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় তাদেরকে গোলাবারুদ পাঠানো সম্ভব হয় নাই, এমনকি তারাও কোন খবর দিতে পারেনি। এখানে একটা বেশ মজার ঘটনা ঘটেছিল। যখন আমাদের সৈনিকদের গোলাবারুদ ফুরিয়ে যায় তখন তারা অবস্থান ছেড়ে পিছিয়ে আসে। অনুরূপ পাকবাহিনীও যারা আমাদের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল তারাও গোলাগুলি না করে পিছনের দিকে চলে যায়।

এই অবস্থা সুরক্ষিত না থাকায় পর মুহুর্তে পাকবাহিনীর কিছু সৈনিক আমাদের বূহ্যের ভিতর ঢুকে পরে। এতে আমাদের অবস্থান রক্ষা করা আমাদের জন্য বেশ কষ্টকর হয়ে পড়ে। এখানে রীতিমত হাতাহাতি যুদ্ধ হয়। অবশেষে আমি তাদের হুকুম দিতে বাধ্য হই তারা যেন পেছনে চলে আসে। এই যুদ্ধে যারা অসীম সাহসের পরিচয় দিয়েছে তাদের মধ্যে নিম্নলিখিত কয়েকজনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্যঃ

১। ক্যাপ্টেন নাসিম (বর্তমানে লেঃ কর্নেল),

২। ক্যাপ্টেন মতিন (বর্তমানে মেজর),

৩। সুবেদার করিম (বর্তমানে সুবেদার মেজর),

৪। হাবিলদার এরশাদ,

৫। সিপাহী সোলেমান,

৬। সিপাহী মান্নান,

৭। সিপাহী খায়ের (শহীদ)।

এ যুদ্ধে আমার অনুমান পাকিস্তানী সৈনিক খুব হলেও ২৭০ থেকে ৩০০ জন হতাহত হয়েছিল। মাধবপুরের যুদ্ধে সিপাহী খারে এবং সিপাহী শাহজাহান শাদাত বরণ করেন। তাছাড়া বেশ কিছু সংখ্যক আহত হয়। মাধবপুর থেকে সরিয়ে আমি তাদের সিলেটের মনতলাতে নিয়ে আসি এবং নতুন করে আবার বূহ্য তৈরি করার নির্দেশ দেই।

মাধবপুরের যুদ্ধের পর যেসব এলাকা আমার নিয়ন্ত্রণাধীনে ছিল সেগুলো হল, উত্তরে শ্রীমঙ্গল, শায়েস্তাগঞ্জ এবং দক্ষিনে তেলিয়াপারা, মুকুন্দপূর, সিঙ্গারবিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঢাকার দিক থেকে শাহবাজপুর এবং মাধবপুরেরদিকে আসছিল। তাদের লক্ষ্য ছিল যত শীঘ্র হোক সিলেটের সৈন্যদের সাথে যোগাযোগ করা। তাই তারা মরিয়া হয়ে সিলেট হাইওয়ে ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া-সিলেট হাইওয়ে তাদের নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছিল।

আমাদেরও চেষ্টা ছিল যাতে করে তারা এ যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করতে না পারে। তাই সিঙ্গারবিল থেকে শাহজিবাজার পর্যন্ত এক প্রতিরক্ষা বূহ্য নির্মাণ করি। পাকিস্তানীরা কেবলমাত্র ঢাকা থেকে সৈন্য এনে সিলেটের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছিল না, তারা কুমিল্লার দিক থেকেও ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও সিলেটের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করে। কুমিল্লার দিক থেকে যে সমস্ত সৈন্য অগ্রসর হচ্ছিল তাদের বাঁধা দেয়ার জন্য মেজর খালেদ মোশারফ কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া হাইওয়ে এবং কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলওয়ে লাইনের উপর নিম্নলিখিত জায়গায় পুল ভেঙ্গে দিয়ে সৈন্য মোতায়েন করে, যাতে পাকিস্তানী সৈনিকরা বিনা বাধায় অগ্রসর হতে না পারে। যে সব পুল ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছিল সেগুলো হলঃ

উজানিসার হাইওয়ে ব্রীজ,

গঙ্গাসাগর এবং আখাউড়া রেলওয়ে ব্রীজ।

আমরা নিম্নলিখিত কারনে পাকিস্তানী সৈনিকদের অগ্রগতি রোধ করতে পারছিলাম নাঃ আমাদের সৈন্য সংখ্যা ছিল কম। তাছাড়া আমাদেরকে এই স্বল্প সংখ্যক সৈন্য নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় প্রতিরক্ষা বূহ্য তৈরি করে পাকিস্তানী সৈনিকদের বাঁধা দিতে হচ্ছিল। অপরদিকে পাকিস্তানী সৈনিকরা এক যায়গায় কন্সেন্ট্রেট ছিল এবং তাদের সৈন্য সংখ্যাও বেশি ছিল। ফলে আমাদের পক্ষেও অল্পসংখ্যক সৈন্য নিয়ে তাদের অগ্রগতিকে ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। তাদের সৈন্য সংখ্যাই বেশি ছিল না, তাদের বিপুল পরিমান অস্ত্রশস্ত্রও ছিল। যেহেতু আমরা সিলেট হাইওয়ের উপর তেলিয়াপাড়াতে প্রতিরক্ষাবূহ্য তৈরি করে রেখেছিলাম সেহেতু পাকিস্তানী সৈন্যরাও ঐ বূহ্য ভেদ করে অগ্রসর হওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছিল। কারণ সিলেটে অগ্রসর হতে হলে ঐ প্রতিরক্ষা বুহ্য ভেদ করা একান্ত প্রয়োজন ছিল।

শেরপুর এবং শাদিপুর আমাদের যে সকল বূহ্য ছিল সেগুল্র পতন হয় ২৪শে এপ্রিল তারিখে। এই যুদ্ধে পাকিস্তানীরা প্রায় দুই ব্যাটেলিয়ন সৈন্য সিলেটের দিক থেকে মোতায়েন করে। এই যুদ্ধে পাকিস্তানীদের বেশসংখ্যক সৈন্য হতাহত হয়। এই যুদ্ধে নের্তৃত্ব দিয়েছিলেন ক্যাপ্টেন আজিজ (বর্তমানে মেজর)। যুদ্ধ চলাকালে ক্যাপ্টেন আজিজ জেট জঙ্গি বিমানের গুলিতে আহত হন। আমাদের যারা শহীদ হয়েছিলেন তারা ল্যান্স নায়েক আব্দুল হাই, সিপাহী মোহসীন, সিপাহী শাহাদৎ হোসেন, নায়েক সুরত আলী, সিপাহী রহিউদ্দিন মোল্লা, মোজাহিদ সুরদন নমশুদ্র।

শেরপুর-শাদিপুর পতনের পর পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে প্রতহত করার জন্য সিলেটে আমাদের সৈন্য সংখ্যা পর্যাপ্ত ছিল না। তাই তারা অতি সহজে এবং শীঘ্রই সিলেটের দিক থেকে ঢাকার দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। তেলিয়াপাড়া তখনও আমাদের অধীন ছিল। পাকবাহিনী তেলিয়াপাড়াকে বাইপাস করে শাহজীবাজারের শায়েস্তাগঞ্জের দিকে চলে যায় এবং সিলেট থেকে আরো অগ্রসরমান পাকসেনাদের শ্রীমঙ্গলে এসে যোগাযোগ হয়। তখন থেকে ঢাকা-সিলেট রাস্তা তাদের নিয়ন্ত্রণাধীনে চলে যায়। কিন্তু তেলিয়াপাড়া আমাদের নিয়ন্ত্রণাধীনে থাকায় পাকবাহিনী সহজে চলাফেরা করতে পারতো না। কেননা তেলিয়াপাড়া থেকে চুনারুঘাট পর্যন্ত চা বাগানের ভেতর দিয়ে যে হাইওয়েটা চলে গিয়েছিল সেটা তাদের মরণ ফাঁদ ছিল। প্রত্যেক দিনই পাকিস্তানী সেনারা এমবুশের সম্মুখীন হতো এবং তারা বেশ হতাহত হত।

সিলেট হাইওয়ে আমাদের নিয়ন্ত্রণাধীনে থাকা পর্যন্ত আমরা যেভাবে যুদ্ধ করছিলাম সেটা ছিল প্রথাগত যুদ্ধ। কিন্তু সিলেট হাইওয়ে পতনের পর আমাদের যুদ্ধের পদ্ধতি বদলিয়ে ফেলে গেরিলারা ওয়ারফেয়ার শুরু করি। কিন্তু কনভেশনাল ওয়ারফেয়ার একেবারে বাদ দেইনি। তবে এখন থেকে আমাদের যুদ্ধের প্রধান পদ্ধতি ছিল গেরিলা ওয়ারফেয়ার। আমরা যে সমস্ত ক্যাম্প খুলেছিলাম তা ছিল প্রধানত গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ করার জন্য। তাছাড়া কিছু সংখ্যক ট্রেনিং ক্যাম্প কনভেনশনাল পদ্ধতিতে যুদ্ধ করার প্রশক্ষন দেয়া হত। গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষন দেয়ার জন্য যে সমস্ত ক্যাম্প খোলা হয়েছিল সেগুলোতে আমাদের ইন্সট্রাক্টর ছারাও বন্ধুরাষ্ট্র ভারত থেকে আমরা বেশকিছুসংখ্যক ইন্সট্রাক্টর পেয়েছিলাম। কিন্তু যে সমস্ত ট্রেনিং ক্যাম্পে কনভেনশনাল যুদ্ধের প্রশিক্ষন দেয়া হত সে ক্যাম্পগুলোর ইন্সট্রাক্টর সমস্ত আমাদেরই ছিল।

গেরিলা বাহিনী সম্বন্ধে দু-চারটা কথা বলা দরকার। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বা মুক্তির জন্য সমস্ত জনগন (নিয়মিত ও গেরিলা বাহিনী) মুক্তিবাহিনী হিসেবে পরিচিত ছিল। এই মুক্তিবাহিনীর দুটি অংশ ছিল। একটিকে নিয়মিত বাহিনী বলা হত। অপরটি গেরিলা-তাকে গণবাহিনী বলা হত। এ নামগুলো বাংলাদেশ সরকার দিয়েছিলেন। কিন্তু আমাদের বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের কাছে আমাদের নিয়মিত বাহিনী “মুক্তিফৌজ” নামে পরিচিত ছিল। এবং গণবাহিনী ফ্রিডম ফাইটার (এফ,এফ) হিসেবে পরিচিত ছিলেন।

এটা আমাদের জানা ছিল যে, গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে দেশ জয় করা সম্ভব নয়। দেশ জয় করতে হলে আমাদের নিয়মিত বাহিনী দরকার। আমাদের বন্ধুরাষ্ট্র কিন্তু এ ব্যপারে একমন ছিল না। যদিও এটা তাদের অজানা নয় যে দেশ জয় করতে হলে রেগুলার ফোর্সের দরকার, শুধু গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে দেশ জয় করা যায় না। আমাদের বন্ধুরাষ্ট্র ভারত রেগুলার ফোর্স বা নিয়মিত বাহিনী গঠন করার বিরুদ্ধে এই জন্য ছিল যে, তারা হয়তো মনে করতো যদি পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ বেধে যায় তাহলে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান দখল করার সুনাম সম্পূর্ণ যেন তারা নিতে পারে। কিন্তু আমরাও পেশাদার সৈনিক ছিলাম। তাই তাদের এসব পরামর্শে আমরা কখনো কর্ণপাত করিনি এবং আমরা গেরিলা বাহিনীর সাথে সাথে নিয়মিত বাহিনীও গড়ে তুলি।

তেলিয়াপাড়া-চুনারুঘাটের মরণফাদ থেকে বাচার জন্য পাকবাহিনী মরিয়া হয়ে উঠে। আমি তখন তেলিয়াপাড়ার বূহ্যকে আরো সুদৃঢ় করার জন্য বিশেষ পরিকল্পনায় ব্যস্ত থাকি। কারণ এটা শুধু আমার ডিফেন্সই ছিল না, এটা ছিল আমার হেডকোয়ার্টার।

পাকবাহিনী তেলিয়াপাড়া তাদের আয়ত্তে আনার জন্য ক্রমাগত ২১ দিন পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যায়। এ যুদ্ধ যখন চলছিল তখন আরও একজন অফিসার আমার সাথে যোগ দেয়। তার নাম ক্যাপ্টেন সুবেদ আলী ভুঁইয়া (বর্তমানে মেজর)। যেসব অফিসারের উপর তেলিয়াপাড়া রক্ষা করার ভার দেই তারা ছিলঃ ক্যাপ্টেন মতিন (বর্তমানে মেজর), লেঃ মোরশেদ (বর্তমানে ক্যাপ্টেন), এ ছাড়াও কিছু সংখ্যক কলেজের ছাত্রও ছিলেন। তাঁরা হলেন শহীদ সেলিম আহসান, আনিসুল হাসান, ফজলে হোসেন, আনিসুর রহমান (পরবর্তীকালে এরা সবাই সেনাবাহিনীর কমিশন পান এবং অফিসার হন)। এদের মধ্যে সেলিম মিরপুর অপারেশনে শহীদ হন এবং আনিস তার কলেজ জীবনে ফিরে যান।

তেলিয়াপাড়া ব্যূহ রক্ষা করার জন্য যে ২১ দিন হয়েছিল সেই যুদ্ধে এই সমস্ত অফিসার এবং সৈনিকরা মনোবল ও সাহসিকতার যে পরিচয় দিয়েছেন তা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই ২১ দিন লড়াইয়ের মধ্যে পাকবাহিনী তেলিয়াপাড়ার উপর প্রায় দুই ব্যাটালিয়ন সৈন্য দিয়ে পাঁচবার আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে তাঁরা তিনবার আমাদের কাছ থেকে তেলিয়াপাড়া দখল করে। আমরা দুবার তাদের কাছ থেকে পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হই। কিন্তু তৃতীয় বারে তাদের সৈন্যসংখ্যা ও অস্ত্রশস্ত্র এত বেশী ছিল যে তালিয়াপাড়া ঐবার আর দখল করা যায়নি। ১৯ শে মে শেষ পর্যন্ত তেলিয়াপাড়ার পতন হয়। তালিয়াপাড়ার যুদ্ধে যারা শাহাদত বরণ করেন তাঁরা হলেনঃ সিপাই মোবারক আলী, সিপাই রংগু মিয়া, নায়েক নিজাম উদ্দিন, ল্যান্স নায়েক আসলাম মিয়া, সিপাই আব্দুল গফুর মিয়া, সিপাই আলী আজম ভুঁইয়া, সিপাই জামাল উদ্দীন, সিপাই আবু মিয়া, মোজাহিদ গিয়াস উদ্দীন, মোজাহিদ আলকাস মিয়া।

এই পর্যায়ে নিম্নলিখিত গেরিলা অপারেশনগুলি বিশেষ উল্লেখযোগ্যঃ

মাধবপুর এ্যামবুশ, ১৪ মেঃ

মাধবপুরের পতনের পর পাক সেনাবাহিনী ব্রাহ্মণবাড়িয়া-সিলেট সড়ক ব্যাবহার করতে শুরু করে। যদিও ঐ সড়কের স্থানে স্থানে আমরা পুল ভেঙ্গে দিয়েছিলাম তবুও তাঁরা বিকল্প পথ তৈরী  করে যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে। তাদের যাতায়াতে বাঁধা দেবার জন্য মাধবপুরের কাছে ঐ এক বিকল্প সড়কের উপর পাকবাহিনীকে এ্যামবুশ করার জন্য ১৪ই মে তারিখে লেঃ মোরশেদের নেতৃত্বে ১২ জন সৈনিকসহ একটি দল পাঠাই। এ দল ঐ জায়গাতে রাত প্রায় দুটায় পৌঁছে এবং বিকল্প সড়কের উপর দু’খানা ট্যাংকবিধ্বংসী মাইন পেতে তারই পাশে ওত পেতে বসে থাকে। সারারাত বৃষ্টি হয়েছিল এবং সকাল প্রায় ৮টা পর্যন্ত এ সড়কে পাক সেনাবাহিনীর কোন গাড়ী না চলাতে দেখে তাদের এমনিই বসে থাকতে হয়। বৃষ্টিতে তারা সবাই ভিজে যাওয়াতে নিকটবর্তী এক গ্রামে আশ্রয় নেয়। গ্রামে এক নির্জন বাড়ীতে যখন তারা বিশ্রাম নিচ্ছিল তখন সিলেটের দিক থেকে প্রায় এক ব্যাটালিয়ন পাকবাহিনী ঢাকার দিকে যাচ্ছিল। এই কনভয়ের সবচেয়ে প্রথম গাড়ীটি ছিল একটি জীপ গাড়ী। ঐ জীপ গাড়ীটি বিকল্প পথ দিয়ে যাবার সময় ট্যাংকবিধ্বংসী মাইনের উপর গিয়ে পড়ে এবং সাথে সাথে বিধ্বস্ত হয়ে যায়। এই গাড়ীটি ধ্বংস হবার পর আমাদের সৈনিকরা সেখানে (ঐ বাড়ীতে) নীরবে বসে থাকে এবং অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। প্রথম  গাড়ীটি বিধ্বস্ত হবার পর তার পেছনের গাড়ীটি দ্রুত এগুবার চেষ্টা করে। ফলে সেটিও মাইনের উপর গিয়ে পড়ে এবং বিধ্বস্ত হবার সাথে সাথে পাক সৈনিকরা বিপদ দেখে গাড়ী থেকে দ্রুত নেমে পড়ে এবং ঐ পুরো গ্রামখানি ঘিরে ফেলার চেষ্টা করে। আমাদের এ্যামবুশ দলটিতে মোট ১২ জন লোক ছিল। আর শত্রুপক্ষের খুব কম হলেও প্রায় ৪০০ লোক ছিল। আমাদের লোকজন যখন দেখল যে তারা প্রায় ঘেরাও হয়ে যাচ্ছে, তখন তারা শত্রুদের উপর গুলি ছুড়ে ট্যাকটিক্যাল উইথড্র করে আসতে বাধ্য হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের পেছনে প্রায় তিন মাইল পর্যন্ত ধাওয়া করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের এখানেই সর্বপ্রথম ট্যাংকবিধ্বংসী মাইন ব্যবহৃত হয়েছিল। এই এ্যামবুশে দু’খানা যানবাহন একেবারে বিধ্বস্ত হয়ে যায় এবং ঐসব গাড়ীতে যারা ছিল তাদের অধিকাংশ হতাহত হয়। এই এ্যামবুশে যারা অসীম সাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে নিম্নলিখিত কয়েকজনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্যঃ

১। লেঃ মোরশেদ (বর্তমানে ক্যাপ্টেন)

২। সেলিম (ছাত্র) পরবর্তীকালে লেঃ (শহীদ)

৩। আনিস (বর্তমানে লেফটেন্যান্ট)।

নালুয়া চা বাগানের এ্যামবুশঃ

১৫/১৬ই মে, ১৯৭১ সন-১৫/১৬ই ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান ১২/১৩ জন সৈনিক নিয়ে নালুয়া চে বাগানে সিলেট সড়কের উপর এক এ্যামবুশ তৈরী করে। ঐ দিন প্রায় এক কোম্পানী পাকসেনা সিলেট থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে যাচ্ছিল। বিকেল প্রায় দুটার দিকে তারা ঐ এ্যামবুশের ভেতরে চলে আসে এবং চারিদিক থেকে আমাদের সৈনিকরা তাঁদের উপর গোলাবর্ষণ করতে শুরু করে। ঐ এ্যামবুশে ট্যাংকবিধ্বংসী মাইন ব্যবহৃত হয়। এ এ্যামবুশ এত কার্যকরী ছিল যে পাকসেনা বাহিনীর এক কোপানী সৈনিকের মধ্যে অধিকাংশই নিহত হয়। তিনখানা গাড়ী সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস  হয় এবং দু’খানা গাড়ী বিকল হয়ে যায়। আমাদের সৈন্য সংখ্যা বেশী না থাকাতে সে স্থান ত্যাগ করে পিছে চলে আসতে বাধ্য হয়। পরে চা বাগানের শ্রমিকদের কাছ থেকে জানতে পারা যায় প্রায় ৬৫ জনের মত পাকসেনা নিহত হয়েছিল। এই এ্যামবুশে যারা বীরত্বের পরিচয় দিয়েছিল তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলঃ

১। ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান (বর্তমানে মেজর)

২। হাওয়ালদার আবুল কালাম (বর্তমানে সুবেদার)।

তেলিয়াপাড়া এ্যামবুশ ১৬ই মে, ১৯৭১ সন-মতিন তখন তেলিয়াপাড়ায় নিযুক্ত ছিলেন। নালুয়া চা বাগানে এক কোম্পানী পাকসেনা এ্যামবুশ হবার পর তাদের বেশকিছুসংখ্যক হতাহত হয়। তাদের সাহয্যার্থে চুনারুঘাট থেকে আরো কিছুসংখ্যক সৈন্য একত্রিত হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। তেলিয়াপাড়ার নিকট তারা পুনরায় এ্যামবুশ হয়। এই এ্যামবুশ-এর নেতৃত্ব দিচ্ছিল ক্যাপ্টেন মতিন। এ এ্যামবুশেও ট্যাংকবিধ্বংসী মাইন ব্যবহৃত হয়। পাকসেনাদের একখানা গাড়ী ধ্বংস হয় এবং বেশ কিছু সংখ্যক সৈনিক হতাহত হয়।

যেহেতু আমাদের গেরিলা যুদ্ধের কৌশল ছিল “হিট এণ্ড রান”- শত্রুনিপাত এবং নিজের কম ক্ষতি। তাই আমাদের সৈন্যরা যুদ্ধে লিপ্ত না হয়ে শত্রুর উপর আঘাত হেনে পিছনে চলে আসত। কিছুদিন পর জানা গিয়েছে যে ঐ এ্যামবুশে প্রায় ৪০/৫০ জন পাকসেনা হতাহত হয়েছিল। তেলিয়াপাড়া এ্যামবুশঃ ১৯শে মে ১৯৭১ সন-তেলিয়াপাড়ার এই দিন পতন ঘটে। মুর্শেদ ছিলেন এর প্রতিরক্ষায় নিযুক্ত। পাকসেনারা যখন সিলেট সড়কের উপর বার বার এ্যামবুশ হচ্ছিল এবং ১৬ তারিখের এ্যামবুশে যখন তাদের বিশেষ ক্ষয়ক্ষতি হয় তখন বোধহয় তাদের সাহায্যার্থে পাকসেনাদের প্রায় দুই কোম্পানী সৈন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে সিলেট অভিমুখে আসে। সেদিন রাতেই তেলিয়াপাড়ার চা বাগানের নিকটবর্তী এলাকার চারখানা ট্যাংকবিধ্বংসী মাইন পুঁতে আমাদের সৈনিকেরা সিলেট সড়কের উপর ওত পেতে বসে থাকে। এই এ্যামবুশের নেতৃত্ব দিচ্ছিল লেঃ মোর্শেদ। দলে তার লোক ছিল ১৫ জন। কনভয়-এর প্রথম গড়িটি মাইনের উপর দিয়ে চলে যায় কিন্তু মাইন ফাটেনি। যখন দ্বিতীয়, তৃতীয় গাড়ী মাইন অতিক্রম করছিল সাথে সাথে দুখানি গাড়ীই একত্রে বিধ্বস্ত হয়। পেছনের গাড়ীতে যে সমস্ত পাকসেনা ছিল তারা গাড়ী থেকে পিছনে বেশ কিছু দূরে এক খোলা ময়দানে একত্রিত হয়। পাকসেনাদের দুর্ভাগ্যবশতঃ ঐ খোলা মাঠের নিকটবর্তী এলাকায় আমাদের একদল লোক মেশিনগান নিয়ে ওত পেতে বসেছিল। এবং পাকসেনাদের যারা এখানে একত্রিত হয়েছিল তাদের প্রায় সবাই মেশিগানের গুলিতে হতাহত হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে সৈন্য এসে সে সব মৃতদেহ ও আহত ব্যক্তিদের নিয়ে যায়। এই যুদ্ধে আমাদের একজন মোজাহেদ পাকসেনাদের হাতে ধরা পড়ে। পরে সে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়। এ এ্যামবুশে পাকসেনাদের বিপুল অস্ত্রশস্ত্র এবং একখানা গাড়ী আমাদের হস্তাগত হয়। এছাড়া তাদের তিনখানা গাড়ী বিধ্বস্ত হয়। পাকসেনাদের হতাহতের সংখ্যা ১৩০ থেকে ১৫০ জনের মত ছিল।

<৯, ৪.১.১, ১৮৩-৯২>

লেঃ কর্নেল (অবঃ) কাজী আব্দুর রকীবের প্রতিবেদন

‘বিচিত্রা’

১৩মে ১৯৮৩

২৫শে মার্চ ১৯৭১। সকাল ৯টা কি ১০টার দিকে বিগ্রেডিয়ার জাহানজেব আরবার আমাকে আমার অফিস থেকে (আমি তখন ঢাকাতে ৩২ নং ব্যাটালিয়ন পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সি-ও ছিলাম) ডেকে হুকুম করলেন যে তোমাকে সেকেণ্ড ইস্ট বেঙ্গলের সি-ও নিযুক্ত করা হল, কর্নেল মাসুদকে অপসারণ করা হয়েছে। ব্যাটালিয়নের দায়িত্বভার গ্রহণের সময় বিগ্রেডিয়ার মজুমদার (তদানীন্তন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টার কমাণ্ডার, যাকে আগের দিন অর্থাৎ ২৪ শে মার্চ চিটাগং থেকে আনা হয়েছিল) তোমাকে ব্যাটালিয়নের সাথে পরিচয় করিয়ে দিবেন। কর্নেল মাসুদ দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে যাবেন না।

ঐ হুকুম অনুযায়ী আনুমানিক বিকাল ৩টা থেকে ৪টার কোন সময় বিগ্রেডিয়ার মজুমদারের সঙ্গে জয়দেবপুরে যাই এবং ব্যাটালিয়নের সঙ্গে পরিচিত হই এবং দায়িত্বভার গ্রহণ করি। ঐসময় ব্যাটালিয়নের বিভিন্ন কোম্পানী এবং প্লাটুনের অবস্থান নিম্নরূপ ছিলঃ

(১) এক কোম্পানী ময়মনসিংহে-কোম্পানী কমাণ্ডার মেজর নুরুল ইসলাম (পরে মেজর জেনারেল এবং অবসরপ্রাপ্ত)।

(২) এক কোম্পানী টাঙ্গাইলে-কোম্পানী কমাণ্ডার মেজর কাজেম কামাল,অবাঙালি।

(৩) এক প্লাটুন রাজেন্দ্রপুর এমুনিশন ডিপোতে-গার্ড হিসাবে।

(৪) এক প্লাটুন গাজীপুরে অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরীতে-গার্ড বা প্রহরী হিসাবে।

(৫) ব্যাটালিয়নের অবশিষ্টাংশ জয়দেবপুরে। ঐ সময় জয়দেবপুরে নিম্নোক্ত অফিসারদেরকে পাইঃ

(ক)মেজর (বর্তমানে মেজর জেনারেল অবসরপ্রাপ্ত) শফিউল্লাহ, সেকণ্ড ইন কমাণ্ড।

(খ)মেজর (বর্তমানে মৃত)আসজাদ লতিফ, কোম্পানী কমাণ্ডার-অবাঙালি।

(গ)মেজর (বর্তমানে মেজর জেনারেল অবসরপ্রাপ্ত) মইনুল হাসান, কোম্পানী কমাণ্ডার।

(ঘ)ক্যাপ্টেন (বর্তমানে বিগ্রেডিয়ার) আজিজুল রহমান, এ্যাডজুট্যান্ট।

(ঙ)ক্যাপ্টেন (বর্তমানে কর্নেল) এজাজ আহমদ, কিউ, এম।

(চ)ক্যাপ্টেন (বর্তমানে বিগ্রেডিয়ার) মোহাম্মদ নাসিম, কোম্পানী অফিসার।

(ছ)ক্যাপ্টেন (বর্তমানে মৃত) মোহাম্মদ রিয়াজ, কোম্পানী অফিসার-অবাঙালি।

(জ)ক্যাপ্টেন (বর্তমানে বোধ হয় পাকিস্তানে) নকভী, কোম্পানী অফিসার-অবাঙালি।

(ঝ)সেঃ লেঃ(বর্তমানে কর্নেল) মোরশেদ, কোম্পানী অফিসার।

(ঞ)সেঃ লেঃ (বর্তমানে কর্নেল) ইব্রাহিম, কোম্পানি অফিসার, সিগন্যাল অফিসার।

(ট)একজন ডাক্তার-বাঙালি।

(৬) এই ব্যাটালিয়নের সাথে জড়িত ২০/২৫ জন অবাঙালি ছিল। এই প্রসঙ্গে আমি একটু বলতে চাই, ১৯৫১ সালে কমিশন পাওয়ার পরে পাঞ্জাব রেজিমেন্টে পোস্টিং পাই, এবং তার পর থেকে পাঞ্জাব রেজিমেন্টের বিভিন্ন ব্যাটালিয়নে কয়েক বৎসর তদানীন্তন ইপিয়ার-এ এবং অন্যান্য স্টপ জবে চাকুরী করি। বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে চাকুরীর অভিজ্ঞতা বা সম্যক পরিচয় ছিল না। ব্যাটালিয়নের লোকজনের ভিতর আমার কিছুমাত্র পূর্ব পরিচয় ছিল মেজর শফিউউলাহ এবং মেজর কাজেম কামালের (অবাঙালী অফিসার) সঙ্গে। আর আমি যখন ব্যাটালিয়নের দায়িত্বভার গ্রহণ করতে যাই তখন আমার পাক সামরিক বাহনীর প্ল্যান সম্বন্ধে কোন ধারাণা ছিল না। ঐ দিন গভীর রাত্রে তদানীন্তন ইস্টার্ণ কমাণ্ডের কমাণ্ডার জেঃ টিক্কা খান আমার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন। তিনি প্রথমে আমাকে জিজ্ঞাসা করেন ঐ অঞ্চলের বিশেষ করে গাজীপুরের খবরাখবর কি। আমি উত্তরে জানাই যে অস্বাভাবিক কিছু পরিলক্ষিত হয় নাই। তিনি হুকুম করলেন গাজীপুরে ফ্যাক্টরীতে  আমাদের সৈন্যসংখ্যা  পুরো কোম্পানীতে উন্নীত করতে এবং অন্য কোম্পানীতে তৈরী অবস্থায় থাকতে। তদনুযায়ী, যেহেতু মেজর আসজাদ লতিফের কোম্পানীর এক প্লাটুন গাজীপুরে ছিল, তাকে তার কোম্পানীর অবশিষ্টাংশ অর্থাৎ, দুই প্লাটুন গাজীপুরে পাঠিয়ে দিই এবং মেজর মইনের কোম্পানীর জন্য কোন হুকুমের জন্য তৈরী থাকতে বলে দিই। অবশ্য পরে তাঁদের সম্বন্ধে আর কোন হুকুম আসে নাই। এ সময় আমার বা আমাদের কোন ধারণা ছিল না ঢাকা শহরে কি হচ্ছে। অবশ্য সন্ধ্যার দিকে আমার বাসা থেকে (আমার ফ্যামিলির সবাই তখন ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে ২৬/২ নং তোফায়েল কলোনী, বর্তমানে আজিজ পল্লীতে) কয়েকবার টেলিফোনে কোন অজানা লোক তাদেরকে বিরক্তিপূর্ণ টেলিফোন করে উত্যক্ত করছে বলে খবর আসে।

২৬শে মার্চ ১৯৭১: ঐদিন সকালে রেডিওর খবরে জানতে পারি যে, ঢাকা শহরে “অনির্ধারিত সময়ের জন্যে” কারফিউ দেয়া হয়েছে, এবং বিভিন্ন মার্শাল ল’ নির্দেশবলী রেডিও মারফত শুনলাম। ঐ সব খবরে আমাদের নিজেদের মধ্যে ব্যক্তিগত পর্যায়ে প্রতিক্রিয়া হলেও সমষ্টিগতভাবে প্রকাশ পাওয়া সম্ভব ছিল না, কেননা তখনও আমরা নিয়মতান্ত্রিক সৈনিক হিসাবে কাজ করে যাচ্ছিলাম। আমি অয়ারলেস সেট এর কাছে গিয়ে দেখি যে, আমাদের সেটের ফ্রিকোয়েন্সি শুধুমাত্র ঢাকা কন্ট্রোল জয়দেবপুর, টাঙ্গাইল এবং ময়মনসিংহ আছে। আমাদের প্রশ্নের কোন সদুত্তর অবাঙালি অপারেটর দেয়না। ঐ সময় আমি ব্রিগেড কমান্ডারের সঙ্গে অয়ারলেসে কথা বলে অবস্থা আঁচ করতে চাই। কিন্তু তিনি কোন মন্তব্য না করে এড়িয়ে গেলেন এবং বললেন যে, যখন দরকার হবে তখন তোমাদেরকে কাজের জন্য ডাকা হবে। ঐদিন ইয়াহিয়া খানের বেতার ভাষণ সবার মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, সমষ্টিগতভাবে কিছু প্রকাশ পায়না। যাহোক, ঐ দিন সকালে এবং বিকালে জয়দেবপুর সমস্ত অফিসার, জেসিও, এনসিও এবং সৈনিকদেরকে একত্রীভূত করে তাদেরকে সামরিক শৃংখলা রাখার উপর গুরুত্ব দেই এবং বলি যে, অনেক সময় নিজেদের ব্যক্তিগত অনুভূতির উর্ধ্বে উঠে সামরিক ডিউটি পালন করতে হয়। ঐদিন দুপুরের পর থেকে লোক মারফত ঢাকার ঘটনার কিছু কিছু আমাদের কানে এসে পৌঁছায়। তাছাড়া, বিবিসি এবং আকাশবাণী খবরে আমাদের ভিতরে কিছু চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে এবং সেই সময় আমরা হতভম্ব হয়ে যাই। এক কথায় যাকে বলে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। ঐ দিন বিকালে কিছু অফিসার জেসিওদের সঙ্গে কথা বলার সময়- বিশেষ করে সুবেদার নুরুল হক (তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সুবেদার মেজর পরে অনারারী ক্যাপ্টেন হিসাবে অবসর গ্রহণ করেন- স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি বীরপ্রতীক পদক পান) সংশয় প্রকাশ করেন যে, আমাদের ব্যাটালিয়নকে নিরস্ত্র করার চেষ্টা হতে পারে। আমি এ ব্যাপারে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করি এবং ঐ দিনই সন্ধ্যায় অতর্কিত হামলার মোকাবেলা করার মত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা, অর্থাৎ অবস্থান সুদৃঢ় করা, অধিকসংখ্যক প্রহরী নিয়োগ ইত্যাদি ব্যবস্থা করি। সন্ধ্যার দিকে আমরা অয়ারলেসে খবর পাই যে, ময়মনসিংহ এবং টাঙ্গাইলে গণ্ডগোল শুরু হয়েছে এবং আরও সৈন্য পাঠিয়ে তাদের শক্তি বৃদ্ধি করতে হবে। এই অবস্থায় আমাদের দিন কাটে।

২৭শে মার্চ ১৯৭১: ঐ দিন শেষ রাত্রে আনুমানিক ভোর তিনটা সাড়ে তিনটার দিকে মেজর শফিউল্লাহ আমার কামরায় একজন এনসি ও এবং একজন সিপাহী নিয়ে আসে, বলে যে, তারা আমাদের যে প্লাটুন রাজেন্দ্রপুর এম্যুনিশন ডিপোতে ডিউটিতে আছে সেই প্লাটুনের লোক। তাদের ভাষ্যমতে, পাকিস্তানীরা অতর্কিতভাবে আমাদের প্লাটুনের উপর ঘুমন্ত অবস্থায় গুলি চালিয়ে মেরে ফেলেছে এবং শুধুমাত্র তারা দুজনই জীবন নিয়ে পালিয়ে এসেছে। তাদেরকে বেশ কিছুক্ষণ জিজ্ঞাসাবাদ করার পরও তাদের বক্তব্য সম্বন্ধে আমি সন্দিহান হয়ে উঠলাম। আমি স্থির করলাম যে, ঐ ঘটনা সরেজমিনে তদন্ত করা প্রয়োজন। আমি সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ডকে বললাম ক্যাপ্টেন রিয়াজের নেতৃত্বে একটি প্লাটুন পাঠিয়ে ঐ ঘটনার তদন্ত করতে এবং সঙ্গে ঐ লোক দুটোকে পাঠাতে। তখন উপস্থিত সকলের একটু ইতস্ততঃ ভাব দেখলাম। এবং মেজর শফিউল্লাহ আমাকে বললেন যে, আমরা হয়তো পর্যবেক্ষণের ভিতরে আছি, রাত্রে বেশ প্লেন চলাচল করেছে। দিনের আলো না বেরোন পর্যন্ত কিছু ‘মুভ’ করলে দুর্ঘটনা হতে পারে। তখন আমি নির্দেশ দিলাম যে, ক্যাপ্টেন রিয়াজের নেতৃত্বের প্লাটুন একটু পরে রওয়ানা হয়ে টঙ্গী-জয়দেবপুর রাজেন্দ্রপুর চৌরাস্তায় গিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করবে। আমি নিজে ফজরের নামাজের পর ঐ জায়গায় গিয়ে প্লাটুনের সঙ্গে মিলিত হবো এবং ঘটনার তদন্তে উপস্থিত থাকবো। ঐ মত আমি প্লাটুন নিয়ে রাজেন্দ্রপুরে সকাল ৭-৮টার দিকে পৌঁছাই। রীতি পালন করে ভিতরে গিয়ে দেখি আমাদী প্লাটুন বহাল তবিয়তে আছে এবং শুধু ঐ দুজন ই কোন ভয়ে পালিয়ে গেছে। ঐখানে পাক বাহিনীর আরও দুটি প্লাটুন ডিউটিতে আছে। যাহোক, ওখানে যাওয়ার পরেই ঢাকার আর্মি একশনের হিংস্রতা এবং নগ্নতা কিছু আন্দাজ করতে পারলাম। প্লাটুন কমান্ডার আমাকে জানালেন, গত দুই রাত এবং দিনে সমানভাবে হেলিকপ্টারযোগে গোলাবারুদ, এমনকি ১০৬ মিঃ মিঃ এন্টিট্যাঙ্ক গান এবং আর্টিলারীর গোলাবারুদ গেছে। আমরা ঐ অঞ্চলে উপস্থিত থাকতেই দেখলাম যে, একটি হেলিকপ্টার এতে নামল এবং তাতে গোলাবারুদ উঠানো হচ্ছে। ঐ ঘটনা আমার মনে চরম প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করল। আমার মনে হল, পাকিস্তানীরা মিলিটারী একশনে অবস্থা আয়ত্তাধীনে আনছেনা বরং মরণযজ্ঞে নেমেছে, কারণ আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় যুদ্ধক্ষেত্র ছাড়া অতিরিক্ত গোলাবারুদ সৈন্যদের প্রয়োজনে আসেনা বা আসার কথা না। ১৯৫৩ সালে লাহোরের মার্শাল ল’এ আমাদের “ফার্সট লাইন বা “পাউচ এম্যুনিশন ই” খরচ হয়েছিল না। মনের ভাব মনে চেপে রেখেই সঙ্গে নেওয়া প্লাটুন সমেত ওখান থেকে চলে আসলাম। ফেরার পথে ক্যাপ্টেন রিয়াজের নেতৃত্বে প্লাটুনকে জয়দেবপুর যাওয়ার নির্দেশ দিলাম এবং আমি গাজীপুর অর্ডন্যানস ডিপোতে আমার কোম্পানীকে দেখতে গেলাম। সেখানে যেয়ে দেখলাম যে ঐ কোম্পানীও বেশ কিছু শংকাজনিত চিত্তে রয়েছে। এদের কাছে অস্ত্র আছে এবং দুই-তিন সপ্তাহের স্বল্প সামরিক শিক্ষা এরা পেয়েছে। এরা সবাই বাঙালি। ওখানে সবাইকে দেখে, কিছু অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে, কিছু গতানুগতিক ভাষণ দিয়ে বেলা এগার সাড়ে এগারটার দিকে জয়দেবপুরে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে ফিরে আসলাম। রাস্তাঘাট, বাজার প্রায় জনশূন্য ছিল এবং সকলের ভিতরে একটা ভীতিজনক ভাব ছিল।

হেডকোয়ার্টারে ফিরে এসে টাঙ্গাইল এবং ময়মনসিংহের অবস্থার আরও অবনতির কথা জানতে পারলাম। এ ছাড়াও বিভিন্ন রকমের কথাবার্তাও কানে আসতে থাকল। যেহেতু তখন পর্যন্ত ঐ এলাকার কোন অঘটনা বা দূর্ঘটনা ঘটে নাই, আমি অফিসে এসে বসলাম। অফিসে বসার পর সুবেদার নুরুল হক প্রথামত ওখানকার সৈন্যদের সম্বন্ধে সমস্ত খবর দিলেন এবং অন্য দুই জায়গার খবর আমাকে দিলেন। সকলের কিংকর্তব্যবিমূঢ় ভাব ও আমাকে জানালেন। তারা চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর ক্যাপ্টেন আজিজ আমার অফিসে এসে বললেন, “আমাদের নিরস্ত্র ভাইয়েরা গুলি খেয়ে শেয়াল কুকুরের মত মরবে আর আমরা হাতিয়ার হাতে থাকা সত্ত্বেও নীরব দর্শক হয়ে থাকবো?” আমি তাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলাম এই যে, ধৈর্যহীন হয়ো না, সময়মত সবকিছুই করা হবে। তারা চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরে মেজর মইন আমার অফিস কামরায় ঢুকে এক ই ধরনের অভিব্যক্তি করলে আমি তাকে এক ই ধরনের কথা বলি। এর কিছুক্ষণ পরে মেজর শফিউল্লাহকে আমার অফিস কামরায় ডাকি এবং একথা সেকথার পরে তাকে বলি যে আমাদের ‘ইয়ং ব্লাড’ বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়েছে এবং এ অবস্থায় কি করা যেতে পারে। তিনি আমাকে বললেন যে আমাদের উত্তেজিত হওয়া শোভা পায় না; সবকিছু একটু ভেবেচিন্তে করতে হবে। (প্রসঙ্গত এটুকু বলছি যে, আমাদের উপরোক্ত কথোপকথন প্রচলিত ইংরেজী এবং বাংলা দুই ভাষাতে হয়েছে। কথোপকথনের বাংলা অনুবাদ যা দাড়ায় তা লিখেছি). ঐ অবস্থায় দুপুর গড়িয়ে গেল। ঢাকার সঙ্গে কোন সংযোগ নাই বললেই চলে। আনুমানিক তিনটা সাড়ে তিনটার সময় অয়ারলেসে ব্রিগেড কমান্ডার আমার সাথে কথা বললেন। প্রথমে জানতে চাইলেন যে আমাদের এদিকের অবস্থা কি। আমি উত্তরে জানালাম যে আমার নিকটবর্তী এলাকায় কোন অঘটন ঘটে নাই। তবে টাঙ্গাইল এবং ময়মনসিংহে অবস্থার যথেষ্ট অবনতির খবর পাচ্ছি এবং সেখানকার কোম্পানী কমান্ডাররা আরও সৈন্য চাচ্ছেন তাদের শক্তি বৃদ্ধির জন্য। তিনি বললেন যে ওখানে সৈন্য পাঠানোর দরকার নেই, তারা ঐদিকটা দেখবেন। তিনি আরও বললেন যে, “দুষ্কৃতকারীদের শায়েস্তা করা হচ্ছে” টঙ্গী ব্রিজ বিনষ্ট করে ফেলেছে। ঐ দিন সন্ধ্যায় টঙ্গী এলাকা আর্মী অপারেশন করবে; এক কোম্পানী প্রস্তুত থাকবে, যদি প্রয়োজন হয় তাহলে উত্তর দিক থেকে এসে অপারেশনে সহায়তা করবে। এই খবর দেওয়ার পর যথেষ্ট সংশয় এবং শঙ্কার সৃষ্টি হয়। উদ্বেগাকুল চিত্তে আমারা সন্ধ্যার অপেক্ষায় থাকি।

ঐ দিন সন্ধ্যায় দূর থেকে অর্থাৎ জয়দেবপুর থেকে টঙ্গীতে আর্মি একশনের প্রচণ্ডতায় আমি ক্ষুব্ধ হয়ে পড়ি। গুলি এবং তোপের আওয়াজ এবং গোলাগুলির শলাকা দেখে আমার মনে হয় পাক আর্মি আইন শৃংখলা উন্নতির জন্য সরকারকে সাহায্য করছে না, বরং পুরোপুরি বাঙালি হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছে। সারাদিনে বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া খবর মিলিয়ে দেখলাম একই দিক নির্ণয় করছে। মনে হল আমরা বোধ হয় হব পরবর্তী টার্গেট এবং এ অবস্থায় নিয়মতান্ত্রিক আনুগত্য নিরর্থক। টঙ্গীর গোলাগুলির আওয়াজ থেমে যাওয়ার পর আমি মেজর শফিউল্লাহ, মেজির মইন, ক্যাপ্টেন আজিজ এবং সুবেদার নুরুল হককে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করার জন্যে আমার নিজের কামরায় ডেকে পাঠালাম। (এই সঙ্গে জয়দেবপুরের অবস্থা সম্পর্কে একটু বলা দরকার যাতে সবাই জিনিসটা ভালভাবে বুঝতে পারেন। পুরো ব্যাটালিয়নের অবস্থান ছিল জয়দেবপুরের জমিদার বা রাজবাড়ীতে। প্রকাণ্ড চত্বরের ভিতরে অনেকগুলো বড় বড় দোতলা বিল্ডিং এর সমষ্টি। বর্তমানে এগুলো মহকুমা প্রশাসক এবং মহকুমা পর্যায়ের বিভিন্ন অফিসের কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। দক্ষিণে স্বল্প উঁচু পাঁচিল ও গেট। এই গেট দিয়ে ঢুকলে গোটা দুয়েক বাস্কেট বল/ভলিবল গ্রাউণ্ড সাইজের মাঠ। মাঠের পরেই বড় উঁচু দোতলা পুরানো কালের বিল্ডিং, নীচে অফিসের মেস এবং জুনিয়র অফিসারদের থাকার জায়গা। দোতলা মেসের ড্রয়িংরুম। পুবের দিকে টু-আই-সি এবং অন্য একজন মেজর থাকতেন। পশ্চিমের দিকে কামরা ছিল সিও’র জন্য। এ বিল্ডিং সংলগ্ন পশ্চিম এবং উত্তর কোনা থেকে শুরু করে উত্তর দিকে বিস্তৃত আর একটি বড় দোতলা বিল্ডিং ‘এল’- এর মত দেখতে। ব্যাটালিয়নের সমস্ত অফিস এই বিল্ডিং-এ ছিল। প্রথম বিল্ডিং-এর সঙ্গে দ্বিতীয় বিল্ডিং এর সরাসরি যোগাযোগ ছিল না। নীচে নেমে বাইরে থেকে ঘুরে আসতে হত। ঐ দ্বিতীয় বিল্ডিং এর উত্তরে আরও একটি বড় দোতলা বিল্ডিং পূবের দিকে বিস্তৃত ছিল। সেটা চিল ট্রপস এর বসবাসস্থান। পূবের দিকেও দেওয়াল এবং কিছু বিল্ডিং দিয়ে ঘেরা ছিল।) তারা এসে পৌঁছাতেই আমি বললাম যে, পরিস্থিতি এখন অসহ্য, আমাদের এখান থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। আপনাদের মতামত কি? কেউ কোন উত্তর দিলেন না। আমি ধরে নিলাম মৌনতাই সম্মতির লক্ষণ। আমার মনে চিন্তা খেলে গেল যে আমাদের ক্ষুদ্র এবং বিভক্ত শক্তি নিয়ে ঢাকার দিকে এগিয়ে যাওয়া আত্মহত্যার শামিল এবং আমাদের প্রয়োজন সমস্ত ব্যাটালিয়নকে এক জায়গায় একত্রীভূত করা এবং সেটা ময়মনসিংহেই সম্ভব। এ ছাড়া জয়দেবপুর রাজবাড়ীর পিছনে কিছু সরকারী কোয়ার্টারে আমাদের কিছু সংখ্যক জেসিও এবং এনসিও এবং সেপাইদের ফ্যামিলি আছে এবং আমার মনে হল যে, আমরা চলে যাওয়ার পর পাক বাহিনীর প্রথম আক্রোশ ঐসব পরিবারবর্গের উপর পরবে। সেইজন্যে আমি সুবেদার নুরুল হককে জিজ্ঞাসা করলাম, “এইসব ফ্যামিলির কি হবে?” তিনি তার উত্তরে বললেন যে, তাদের জন্য আপনি চিন্তা করবেন না। আমরা তাদেরকে আশেপাশের গ্রামে পাঠিয়ে দেব, এবং সেখানকার পাবলিক তাদের দেখাশুনা করবে। তখন আমি তাকে বললাম যে, পরের দিনের ভিতরেই যেন এ বন্দোবস্ত হয়ে যায়। তারপর আমি ক্যাপ্টেন আজিজকে (এডজুটেন্ট) গাড়ীর ‘এভাইলিবিলিটি’ অর্থাৎ কয়টা জীপ, ডজ, লরী চালি অবস্থায় আছে জানতে চাউলাম। তিনি যে পরিসংখ্যান দিলেন, তাতে আমি আন্দাজ করতে পারলাম মর্টার প্লাটুন এবং কিছু সৈন্য আন্দাজ এক রাইফেল প্লাটুন (২৫/৩০) নিজেদের হাতিয়ার এবং গোলাবারুদসহ উঠানো সম্ভব হবে। তখন একটা প্রশ্ন থেকে গেল যে, অবশিষ্ট লোকজন এবং গাজীপুরে যারা আছেন তাদেরকে কি করে নেওয়া যাবে। তখন মেজর মইন স্বেচ্ছাকৃতভাবে বললেন যে, যদি প্রয়োজন হয় তাহলে তিনি নিজে ‘ক্রস-কান্ট্রি’ পায়ে হেঁটে গফরগাঁও হয়ে ময়মনসিংহে নিয়ে যাওয়ার নেতৃত্ত্ব দেবেন। তখন আমি প্লান করে ফেললাম, আগামীকাল সকালে এক পার্টি গাড়ীতে টাঙ্গাইলে হয়ে ময়মনসিংহ যাবে এবং বাকীরা আগামীকাল সন্ধ্যায় রওনা হবে। গাড়ীর জন্য চেষ্টা করা হবে এবং যদি সম্ভব না হয় তাহলে পায়ে হেঁটে রওনা হবে। এটা স্থির করার পর, আমি তদানীন্তন মেজর শফিউল্লাহকে এই নির্দেশ দেই, যেহেতু তোমার ফ্যামিলি এখন ঢাকাতে নাই (তারা তখন কুমিল্লাতে তার শ্বশুরালয়ে ছিল), তোমার সমস্যা একটু কম। আগামীকাল সকালে অর্থাৎ ২৮শে মার্চে মর্টার প্লাটুন এবং এক রাইফেল প্লাটুন নিয়ে টাঙ্গাইল র ওনা হয়ে যাবে। রাস্তায় যদি কোন রোড ব্লক পাও সেগুলো সাফ করবে। সেখানকার স্থানীয় লোকদের সঙ্গে ‘কনট্যাক্ট’ করে বলে যাবে ঐগুলো খোলা রাখতে এবং রাত্রে আমাদের অবশিষ্ট লোক চলে যাওয়ার পর ঐগুলো বন্ধ করে দিতে। টাঙ্গাইল পৌছে সেখানকার কোম্পানীর দায়িত্বভার বা অধিনায়কত্ব নিয়ে নিবে এবং ঐ কোম্পানী সমেত ময়মনসিংহয়ে একত্রীভূত হবে। আমরা সবাই আগামীকাল, অর্থাৎ ২৮শে মার্চ’৭১, সন্ধ্যার পর এখান থেকে রওনা হব।”

মেজর মঈন, ক্যাপ্টেন আজিজ এবং সুবেদার নূরুল হককে স্ব স্ব দায়িত্বের কাজের নির্দেশ দিয়ে দিলাম। তাদের সবাইকে বলা হলো যে, আমাদের এই প্ল্যানের গোপনীয়তা যেন বজায় থাকে। নেহায়েত প্রয়োজনীয় এবং নূন্যতম লোককে বলবে। কোনোক্রমেই যেনো অবাঙালিরা (২০/২৫ জন, যারা তখনো আমাদের সঙ্গে ছিলো) যেনো জানতে না পারে, কারণ কারণ গোপনীয়তাই হবে আমাদের আপাতত কার্যসিদ্ধির একমাত্র পথ। এবং তাদেরকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য আগামীকাল ২৮শে মার্চ সকালে সব ট্রুপসকে একত্রীভূত করবে যেখানে, আমি সমস্ত্র পরিস্থিতি আয়ত্তে আনার জন্য আমার টুআইসি মেজর শফিউল্লাহকে মর্টার প্লাটুন এবং একটি রাইফেল প্লাটুন দিয়ে সেখানে পাঠাচ্ছি।

এইসব কাজ করার পরে আমার নিজের ফ্যামিলির সম্বন্ধে একটু চিন্তা হলো। তারা ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে। তাদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছিলো না। চিন্তা করলাম যে কোনোরকমে ঢাকা গিয়ে তাদেরকে এদিকে নিয়ে আসা বা ছাউনী থেকে সরিয়ে দেওয়া যায় কিনা। সেজন্যই পরেরদিন স্বল্পক্ষণের জন্য ঢাকাতে যাওয়ার অনুমতি চেয়ে এবং টঙ্গী ব্রিজে একটা জীপ রাখতে অনুরোধ করে অয়ারলেস সেটে একটা মেসেজ পাঠালাম। শেষক্ষণ পর্যন্ত কোনো উত্তর আসে নাই।

ঐ রাতে নতুন আর কোনো ঘটনা ঐ অঞ্চলে ঘটে নাই। অবশ্য দেশের বিশেষ করে ঢাকার ঘটনাবলীর বিভিন্ন বিবরণ বিভিন্ন সূত্রে আমাদের কাছে এসে পৌঁছাতে থাকায় সৈনিকদের মানসিক উত্তেজনা বেড়ে যাচ্ছিলো। বিশেষ করে ঐ দিন আমাদের ব্যাটালিয়নের একটা গাড়ীর ড্রাইভারের (গাড়ীটা কিছুদিন আগে মেরামতের জন্য ঢাকা ওয়ার্কশপে ছিলো এবং সে ঢাকাতে আটকা পড়েছিলো। ২৭ মার্চ স্বল্পকালীন কারফিউ বিরতির সময় তাকে ওয়ার্কশপের কেউ হুকুম দেয় গাড়ীটা নিয়ে ইউনিটে চলে যেতে। গাড়ী নিয়ে আসার সময় আসার সময় টঙ্গী ব্রিজের ব্লকের জন্যে আটকে যায় এবং সেখানে আর্মি এ্যাকশন শুরু হয়ে যাওয়াতে গাড়ী ফেলে পায়ে হেঁটে জয়দেবপুরে এসে পৌঁছাই।) আর্মি এ্যাকশনের প্রাথমিক বিবরণের যথেষ্ট প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হতে থাকে।

২৮শে মার্চ ১৯৭১: পূর্বপরিক্লপনা অনুযায়ী আমি আনুমানিক সকাল সাড়ে আট বা নয়টার সময় জয়দেবপুরের সমস্ত র্যাংকের ট্রুপসকে (বাঙালি অবাঙালি সব) এক জায়গায় করে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করি এবং জানাই যে, মেজর শফিউল্লাহ সাহেবকে মর্টার এবং একটি রাইফেল প্লাটুন দিয়ে টাঙ্গাইলে অবস্থার উন্নতির জন্য পাঠাচ্ছি।

আনুমানিক সকাল ১০টার দিকে যখন মেজর শফিউল্লাহ প্রায় তৈরী হয়ে গিয়েছেন রওয়ানা হবার জন্য, মনে হলো যে, গাড়ীর বন্দোবস্ত না হলে রাত্রে সিও হিসেবে ট্রুপসের সঙ্গে পায়ে হেটে রওয়ানা হতে হবে এবং সেই পরিপ্রেক্ষিতে আমার পক্ষে অতিরিক্ত ইউনিফর্ম নেওয়া সম্ভব নাও হতে পারে। তাই মেজর শফিউল্লাহকে ডেকে তার স্যূটকেসে আমার দুই সেট ইউনিফর্ম দিয়ে দেই। ঐ সময় সেখানে লেঃ মোর্শেদ উপস্থিত ছিলেন। ঐ সময় অন্যান্য কাজের ভিতরেও টাঙ্গাইল এবং ময়মনসিংহের খবরের জন্য যথেষ্ট উৎকন্ঠিত ছিলাম। সকাল থেকেই ময়মনসিংহের সঙ্গে অয়ারলেস সংযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল।

প্রায় সাড়ে দশটার দিকে মেজর শফিউল্লাহ তার পার্টি নিয়ে রওয়ানা হয়ে গেলেন। ওদের যাওয়ার সময় স্থানীয় লোকজন ‘জয় বাংলা’ ইত্যাদি ধ্বনি দিয়ে তাদের উৎসাহিত করছিলো। আমার ধারণা হলো যে, আমাদের প্ল্যান স্থানীয় লোকেরা জেনেছে এবং এই অবস্থায় আমাদের ট্রুপস গেলে অবাঙালিরা যারা তখনো আমাদের সঙ্গে আছে তারা মনে করবে যে আমাদের টাঙ্গাইল রি-ইনফোর্সমেন্ট পাঠানো একটা ভাওতা মাত্র। সেজন্যই সাধারণ পাবলিককে ধমক দিয়ে সরিয়ে দেওয়া এবং ভয় দেখানোর একটা নাটকের অভিনয়ের মতো করতে হলো। ওদের রওয়ানা হয়ে যাওয়ার কিছু পরে সরকারীভাবে আমি ব্রিগেড লিখিত মেসেজ পাঠিয়ে দিলাম এই বলে যে, টাঙ্গাইলের অবস্থার উন্নতিয় সাধনকল্পে আমি মেজর শফিউল্লাকে উপরোল্লিখিত সৈন্যসহ পাঠিয়েছি। এইজন্য করলাম যে, কোনো সন্দেহ যাতে আমাদের উপর না আসে।

এরপর আমার চিন্তা হল গাজীপুরের কোম্পানীর সঙ্গে কিভাবে “কো-অর্ডিনেন্ট ” করা যায়। আনুমানিক সাড়ে এগারটা-বারটার দিকেঐ কোম্পানী সুবেদার চাঁদ মিয়া একটা গাড়ী নিয়ে আসলেন -দুই রাত্রি আগে যে দুই পলাটুন জয়দেবপুর থেকে ওখানে যায় তাদের বিচানা নিয়ে যেতে। ক্যাপ্টেন আজিজ এবং সুবেদার নূরুল হক তাকে আমার কাছে নিয়ে আসলেন। আমি তাদেরকে বললাম যে,ওকে (চাঁদ মিয়াকে) প্লান বলে দিন। তাদের কিছুক্ষন কথা বলার পর আমি সুবেদার চাঁদ মিয়াকে নির্দেশের সারাংশ এইভাবে বলিঃ

(১) সন্ধ্যার সময় থেকে তার কাছে ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টারেরসঙ্গে যে অয়ারলেস সেটের সংযোগ আসে সেটা খুলে রাখতে।যখন সংকেত যাবে “এখন সাড়ে সাতটা বাজে” তখন থেকে তোমরা রওনা হবার এ্যাকশন শুরু করবে।

(২) এ্যাকশন শুরুর প্রথম কাজ হবে অর্ডন্যান্স ডিপোতে যে অয়ারলেস সেটের ঢাকার সঙ্গে সরাসরি যোগ আছে তাকে নষ্ট করে দেওয়া যাতে আমাদের খবর ঢাকা অথরিটি সঙ্গে সঙ্গে না পায়।

(৩) অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরীতে যত গাড়ী আছে এবং আশেপাশে যতটা সম্ভব গাড়ী দখল করে নিতে এবং ঐ গাড়ীসমূহ নিয়ে ময়মনসিংহের দিকে ‘মুভ’ করতে।

(৪) ‘মুভের’ সময় অর্ডন্যান্স ডিপোতে রক্ষিত ব্যাটালিয়নের পুরানো হাতিয়ারসমূহ এবং গোলাবারুদ যতটা সম্ভব নিয়ে যেতে।

(৫) এম,ও,ডি,সি’র লোক যতটা সম্ভব নিয়ে যেতে এবং যারা যেতে পারবে না তাদেরকে দিতে যে ঐ ডিপো থেকে দূরে সরে যেতে,কারণ পরে আর্মি এ্যাকশনের শিকার হবে।

সুবেদার চাঁদ মিয়া চলে যাওয়ার পর আমার খেয়াল হল মেজর আসজাদ লতিফ তার অবাঙালী কোম্পানী কমান্ডারকে ওখানে থেকে সরিয়ে আনার দরকার যাতে চাঁদ মিয়া নিরুপ দ্রবে তৈরী করতে পারেন। তাই আমি তাকে আমার সঙ্গে ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টারে লাঞ্চ করার জন্য ডেকে পাঠালাম। জয়দেবপুরস্থ সমস্ত বাঙালী অফিসার এবং জেসিওরা যে যার দায়িত্বমত প্রস্তুতি নিয়ে যাচ্ছিল,এবং আইরের ভাবখানা ছিল যে সবকিছুই নর্মাল বা সাধারণভাবে চলছে। আমি মোটামুটিভাবে অবাঙালী অফিসারদেরকে গল্পচ্ছালে আমার আশেপাশে রাখছিলাম, যাতে তারা এ ব্যাপার আঁচ করতে না পারে। আমি অবশ্য মাঝে মাঝে এদিকে-ওদিকে যেয়ে ছোটখাট নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছিলাম, যাকে বলে সামরিক ভাষায়,”টাইং আপ।” আমার নিজস্ব যথেষ্ট চিন্তা ছিল -অন্য জায়গায় কি হচ্ছে বা না হচ্ছে তা সঠিক জানা ছিল না – এই বিদ্রোহের পরণতি কি হবে কে জানে, যদি সফল না হয় তাহলে নিজের ফ্যামিলি এবং ছেলেরা ক্যান্টনমেন্টে, তাদের পরিণতি কি হবে, ইত্যাদি।

(আজ ১২/১৩ বৎসর পরে ঐ দিনের কথা চিন্তা করলেও যথেষ্ট আতংকিত হয়ে পড়ি। ঐ দিনে ভবিষ্যৎ ছিল অজানা-দেশাত্মবোধই ছিল একমাত্র প্রেরণা।)

এসব ছাড়াও আমার জানা প্রয়োজন ছিল যে, গতকাল রাত্রে টঙ্গীতে ‘আর্মি এ্যাকশনের’ পর কত সৈন্য আছে, কারা আছে, পজিশন তারা কতদূর পর্যন্ত নিয়েছে এবং আমাদের ‘মুভ’-এর সময় তাদের বাধা দেওয়ার ক্ষমতা কতদূর আছে।দুপুরে খাওয়ার পরে আমি নিজেই যাবার মনস্থ করেছিলাম, কিন্তুক্যাপ্টেন আজিজের ইশারায় এবং পরামর্শে মেজর আসজাদ লতিফকে কিছু সৈন্য ‘এসকর্ট’ দিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হল। তাকে বলে দেওয়া হল যে,টঙ্গীতে যেসব সৈন্য। পৌছে গিয়েছে তার সঙ্গে ‘মিলাপ’ করে এসো এবং বিশেষ আগের রাতে আমাদের ব্যাটালিয়নের একখানা ডজ গাড়ী যেটা টঙ্গী ব্রীজের কাছে ড্রাইভার ফেলে রেখে আসতে বাধ্য হয়েছিল,সেটা কি অবস্থায় আছে দেখবার জন্যে এবং সম্ভব হলে ‘রিকভার’ করার ব্যবস্থা করে আসতে। এই ব্যবস্থায় আমাদের দুইটা সুবিধা হল। প্রথমত এই অবাঙালি অফিসারকে কার কোম্পানী থেকে অধিক সময়সরিয়ে রাখা এবং টঙ্গীতে যদি কোন অঘটন ঘটে তা হলে প্রথম চোটটা অবাঙালি অফিসারের উপর দিয়ে যাবে।এ অফিসার বেলা দুটো-আড়াইটার দিকে এবং সন্ধ্যার দিকে ফিরে আসে। সে জানায় যে, টঙ্গীতে পাক আর্মি তাকে বিশ্বাসই করতে চায় না, তাকে এবং তার সঙ্গের সবাইকে ‘ডিস আর্ম’ করে জিজ্ঞাসাবাদ করে, এমনকি তার পাঞ্জাবীতে কথা বলার উপরে সন্দেহ প্রকাশ করে।

যাই হোক, ঐ অফিসার জয়দেবপুর থেকে টঙ্গী রওনা হয়ে যাওয়ার পর কিছুক্ষনের জন্য বিশ্রাম নিতে উপরে নিজের কামরায় গেলাম। কিছু সময় পরে মেজর মইন আমার কামরায় এসে বলেন যে, আমাদের প্লান নাকি পাঞ্জাবী এবং অবাঙালীদের কাছে ফাঁস হয়ে গিয়েছে, অথবা তারা আঁচ পেয়ে গিয়েছে।কারণ হিসেবে বলল যে, আমাদের কোন সেপাই ক্যান্টিনের কিছু পাঠান সিভিলিয়ানকে প্রকারান্তরে বলে ফেলেছে ঐ রাত্রে সাবধান থাকতে, এবং আমি ভাবছি এ ব্যাপারে কি করা যায়। এর কিছুক্ষন পরে ক্যাপ্টেন আজিজ আমাকে এসে বললেন যে,একজন স্থানীয় ছাত্রনেতা আমার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলতে চায় এবং দেখা করতে চায়। আমি অল্পক্ষন পরেই আসছি বলে দিতে বললাম(প্রসঙ্গত বলা যেতে পারে যে,যদিও ঢাকার সঙ্গে আমাদের টেলিফোন যোগাযোগ বিচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল তবুও জয়দেবপুর স্থানীয় এক্সচেন্জ কাজ করছিল এবং গাজীপুর ফ্যাক্টরী পর্যন্ত আমাদের যোগাযোগ ছিল) এই মনে করে যে ছাত্রনেতার সঙ্গে ‘ইউনিফর্ম পরিহিত অবস্থায় দেখা করা হয়ত ঠিক হবে না এবং আমাদের ভিতরকার অবাঙালীদেরকে প্রকারন্তরে ভাব দেখানো যে কোন কিছু অঘটন ঘটতে যাচ্ছে না, আমি ‘ইউনিফর্ম’ না পরে একটা প্রাইভেট শার্ট এবং প্যান্ট পরে নীচে নেমে আসলাম। ঐ ছাত্রনেতার (তার নাম আমার এখন মনে নাই) সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলে সন্ধ্যার সময় গেটের সামনে দেখাকরার সময় দিলাম। নীচে নেমে আসার পর থেকে প্রাইভেট পোশাকেই সুবেদার নূরুল হক এবং অন্যান্য সকলের সঙ্গে ‘ডিটেলস টাই আপ’ অর্থাৎ খুঁটিনাটি বিষয়ে নির্দেশাদি দিতে ব্যস্ত ছিলাম। এ সময় আমি যথেষ্ট চিন্তকুল এবং উদ্বিগ্ন ছিলাম। কারণসমূহ ছিলঃ

(১) মেজর শফিউল্লাহ টাঙ্গাইল পৌঁছেছেন কিনা এবং আগে কি করেছেন তার তখন পর্যন্ত পাই নাই,

(২) ময়মনসিংহ কোম্পানীর সঙ্গে সকাল থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন,

(৩) আমাদের প্লান যদি খোদা-না-খাস্তা সফল না হয় তাহলে পরিণতি কি,

 (৪)বিদ্রোহেরভবিষ্যৎ কি, এবং

(৫) আমার ফ্যামিলি এবং ছেলেরা যারা ক্যান্টনমেন্ট আছে তাদের ভাগ্যে আগামীকাল কি পরণতি ইত্যাদি।

আমার এই চিন্তাযুক্ত ভাব দেখে হয়ত কেউ সন্দেহ প্রকাশ করলেন আমি তাদের সঙ্গে যাব কিনা। আমি তাদেরকে উত্তরে বললাম যে, সব কিছু প্ল্যান করে তো পিছিয়ে থাকা যায় না, কারণ পরিত্রাণ পাওয়া যাবে না। যাক, বেলা প্রায় ৪টার দিকে খবর পাওয়া গেল যে, মেজর শফিউল্লাহ টাঙ্গাইল অতিক্রম করে ওখানকার কোম্পানী সমেত ময়মনসিংহের পথে রয়েছেন। কিছু আশ্বস্ত হওয়া গেল।

এখন আসাদের খেয়াল ‘লাষ্ট মিনিট কো-অর্ডিনেশন,’ বিশেষ করে রাজেন্দ্রপুরের প্লাটুন এবং গাজীপুরের কোম্পানীর সঙ্গে। ক্যাপ্টেন আজিজ যথেষ্ট জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাজেন্দ্রপুরের প্লাটুনকে বলে আসলেন সন্ধ্যার সময় তাদের অয়ারলেস খুলে রাখতে এবং ‘সাংকেতিক বাক্য’ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন তারা সেখানকার তার ডিঙ্গিয়ে নিজের বন্দোবস্তে বেড়িয়ে পড়েন। এম্যুনিশন ডিপোতে ঢোকার উপর সব সময় কড়াকড়ি, এবংঐ সময়ে খুব বেশী ছিল। ঐ জায়গার ও-সি বা অধিনায়ক ছিলেন এক অবাঙালী। ক্যাপ্টেন আজিজ তাকে যেয়ে বললেন যে, তিনি এসেছেন ‘সামারি অব এভিডেন্স’ রেকর্ড করতে। দুই রাত আগে যে দুইজন লোক আমাদের প্লাটুন থেকে পালিয়ে ছিল, তাদেরকে এ্যারেষ্ট করে রাখা হয়েছে এবং সি-ও সাহেব আগামীকাল তাদের ‘সামারী কোর্ট মার্শাল’ করবেন। ভিতরে ঢুকবার অনুমতি পাওয়া পর্যন্ত ক্যাপ্টেন আজিজের উপর স্টেনগান তাক করা ছিল। এইসব ঘটনাপ্রবাহে ঐ তিন গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে যায়। সন্ধ্যার সঙ্গে সঙ্গে ওখানকার অফিসাররা উতলা হয়ে ওঠেন যাওয়ার সময় সংকেত দেওয়ার জন্যে। সন্ধ্যার সময় বা কিছু আগে খবর পেলাম আমাদের ময়মনসিংহ কোম্পানীর সঙ্গে অয়ারলেস সংযোগ স্থাপন হয়েছে। ঐ কোম্পানী কমান্ডারকে নিজে সাংকেতিকভাবে জানিয়ে দিলাম যে মেজর শফিউল্লাহ তাদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য টাঙ্গাইল ছেড়ে আরও এগিয়ে গেছেন, এবং আমরাও রওনা হচ্ছি। আমি সন্ধ্যাটা একটু গাঢ় হওয়ার অপেক্ষায় ছিলাম। ঐ দিন সন্ধ্যা থেকে ঐ অঞ্চলে কারেন্ট ছিল না, অতএব ছিল গাঢ় অন্ধকার। (পরে জেনেছিলামযে, টঙ্গী থেকে আর্মি ইলেকট্রিক কানেকশন অফ করে দিয়েছিল-বোধ হয় পরের দিন আমাদের উপর অপারেশন চালানোর জন্যে, এবং অবশ্য আমরাও লাইন কেটে দিয়েছিলাম।) দিনের ভিতর মেজর মইন, অন্যান্য অফিসার এবং জেসিও’রা মিলে স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় আমাদের সকলের উঠানোর জন্যে গাড়ী বন্দোবস্ত করে ফেলেছলেন। যাই হোক,রাত্রি আটটার সময় প্রয়োজনীয় লোকদেরকে আমার অফিসে একত্রিভূত করি-মিলিটারী ভাষায় যাকে বলে ‘ও’গ্রুপ। আমি রাত ৮-৩০মিঃ সময় নির্দেশ করি অর্থাৎ ঐ সময় থেকেআমাদের ‘মুভ’-এর কার্যাবলী শুরু হবে। কিন্তু ঐ সময় আমাদের কোন একজন বলে উঠলেন সময়টা একটু পিছিয়ে দিতে, কেননা তার উপর যে একটা অর্পিত দায়িত্ব ছিল তার প্রস্তুতির জন্যে আর একটু সময়ের প্রয়োজন। আমি তখন রাত ৮টা ৪৫ মিঃ সময় নির্ধারণ করে দিলাম।

এর আগে ক্যাপ্টেন আজিজে একটা নির্দেশ দেওয়া ছিল যে, আমি আমাদের ‘মুভ’-এর অর্থাৎ যাত্রা শুরুর সময় দেওয়ার পর পরই তিনিএক সেকশন (দুটি)মেশিনগান এবং এক সেকশন (দুটি) রিকয়েললেস এ্যান্টি-ট্যাংকগান নিয়ে জয়দেবপুরের চৌরাস্তায় গিয়ে টঙ্গীর দিকে তাক রেখে রোড ব্লক সৃষ্টি করেন,যাতে আমাদের মুভের সময় টঙ্গীর দিক থেকে পাক আর্মি কোন গণ্ডগোল করতে না পারে এবং বাধা পায়। আমার ‘অর্ডার’ শেষ হওয়ার পর ক্যাপ্টেন আজিজ আমার সঙ্গে হাত মিলিয়ে তার নিজের কাজে চলে গেলেন। বলাবাহুল্য যে, ঐ সময় পর্যন্ত দুপুরে ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সময়কার প্রাইভেট জামাকাপড় পরিহিত অবস্থায় ছিলাম। অর্ডার শেষ করার পর নীচের মেসে এসে দেখি যে, অবাঙালী দু’জন অফিসার-ক্যাপ্টেন রিয়াজ এবং নকভী খাওয়ার টেবিলে বসে রাতের খাবার খাচ্ছেন। আমিও তাদের সঙ্গে বসে রাতের খাবার খেলাম এবং তাদেরকে কিছু কথাবার্তায় ব্যস্ত রাখলাম। বুঝলাম যে,আমাদের প্ল্যান সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত এবং আমাকে সিভিল কাপড়ে দেখে উৎকন্ঠা যদিও কিছু হয়ে থাকে-সরে গেল।

৮টা ৪০মিঃ কি ৮টা ৪২মিঃ -এর দিকে আমি উপরে নিজের কামরায় উঠে গেলাম পোশাক পরে তৈরি হবার জন্যে। উপরে অন্ধকার ছিল। নীচে মেসের গ্যাসের আলো থেকে উপরে উঠে অন্ধকপরটা আরও বেশী লাগছিল। আমি মনে করলাম যে, একটু অপেক্ষা করি। কেননা একটু পরেই’এ্যাকশন’ শুরু হবে এবং অবাঙালীদের নিরস্ত্র বা কিছু করার পর আমার কাছে কেউ নিশ্চয় আসবে। তখন আমি তৈরি হয়ে নেব। আমাদের প্লান ছিল যে সঙ্গেকার পাকিস্তানীদেরকে নিরস্ত্র করব, এবং যদি তারা বাধা দেয় তখর গুলি চালাতে হবে, তবে গুলি চালানো হবে যথাসম্ভব স্বল্প এবং ক্ষিপ্ত -ভবিষ্যতের জন্য গোলাগুলি বাঁচাতে হবে।

নির্দিষ্ট সময়ে বা ঐ সময়ের ৫-১০ সেকেণ্ড আহে নীচে গুলি বিনিময় শুরু হয়ে গেল। কিছুক্ষনের মধ্যে এবং প্রচণ্ডতা বেশ বেড়ে গেল। আমি তখন উপরের তলায় একটু সতর্ক হয়ে উঠলাম। আমার কাছে কোন হাতিয়ার ছিল না। অল্প কিছুক্ষন পরেই বুঝতে পারলাম যে কোন লোক সন্ত্রস্তভাবে অথচ তাড়াতাড়ি পা টিপে সিঁড়ি বেয়ে উপরের তলায় উঠে আসল। আমি একটু আশান্বিত হলাম আমাদের কেউ হবে। কিন্তু সিঁড়ি শেষ হওয়ায়তার পায়ের আওয়াজ বন্ধ হয়ে গেল। সংশয় বেড়ে গেল। কিছুক্ষন পরে আওয়াজ পেলাম আর একজন লোকের জোর কদমে উঠে আসার। শেষোক্ত লোকটা যখন মাঝসিঁড়িতে তখন প্রথমোক্ত লোকটা তার উপর টর্চ লাইটের আলো ফেলে। নীচের লোকটি তখন জিজ্ঞেস করে ওঠে “কৌন হ্যায়।” উপরের লোকটি বলে,”আমি ক্যাপ্টেন নকভী, কেন?” নীচের লোকটি বলে ওঠে, এ্যা, নকভী বেঁচে, তারপরই সে সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে নীচে নেমে গেল। আমি অনুভব করলাম যে,আগের লোকটা, অর্থাৎ যে উপরের তলায় রয়ে গিয়েছে, সে হল ক্যাপ্টেন নকভী-অবাঙালী এবং সশস্ত্র। এত কিছু করার পরেও নিজের জন্যে ভরাডুবি। পরিণতি কি আল্লাহ জানে। হঠাৎ খেয়াল হল, এমনিও শেষ, ওমনিও শেষ, ঘটনা অজানার একটু ভান করে দেখা যাক না। একটু সতর্ক থেকে, পিলারের আড়াল থেকে নকভীর সঙ্গে কথা বলে জিজ্ঞাসা করলাম “ব্যাপার কি, নীচে গোলাগুলি চলছে কেন?” সে বলল, “জানি না স্যার, ওরা আমাদের উপর গুলি করছে, দেখেন আপনি টেলিফোনে এ্যাডজুটেন্ট পান কিনা।” বুঝলাম তার বিশ্বাস যে সমস্ত ঘটনা আমার অজ্ঞাতে। তার বিশ্বাসটা আর একটু পাকা করার জন্যে আমার নিজের কামড়ায় রাখা পল্টনের এক্সচেঞ্জের টেলিফোন ঘোড়ালাম। জানতাম কেউ জবাব দেবে না। কিছুক্ষন পর বুঝতে পারলাম যে, নীচের থেকে সবাই চলে যাচ্ছে কিন্তু আমি যেতে পারছি না, আটকা পড়ে গেছি ক্যাপ্টেন নকভীর হাতে। ঐ অবস্থায় রাত কাটল।

২৯শে মার্চ ১৯৭১: সকালে দেখলাম বহু লোকজন বিভিন্ন ধরনের হাতিয়ার নিয়ে রাজবাড়ী ঘিরে রেখেছে। আমাদের উপর কড়া প্রহরা। লোকজনও বদলি হতে থাকল, আমিও চিন্তা করতে থাকলাম কিভাবে ফন্দি বের করা যায় এখান থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার। কিন্তু বাস্তবে রূপ দেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। দিন বেড়ে চলছিল। প্রায় সাড়ে এগারটার দিকে প্লেনের আওয়াজ পেলাম। কিছুক্ষন পড়ে দেখলাম যে, দু’টো এফ-৮৬প্লেন রাজবাড়ীর যে অংশে সৈন্যরা থাকত এবং আমাদের গাড়ীসমূহ থাকত, সেই অঞ্চলে স্টার্ফিং করছে। বুঝলাম ঢাকায় সব খবর হয়ে গিয়েছে এবং আর্মি শিগগিরই আসছে। বেলা দুটা-আড়াইটার দিকে দেখলাম রাজবাড়ীর সম্মুখ অংশ সৈন্যরা ঘিরে ফেলেছে এবং পোর্টেবল মাইকে ঘোষনা করা হচ্ছে,”সেকেণ্ড বেঙ্গলের যারা যারা আছো, সারেন্ডার কর।”আমারনাম ধরেও একই ঘোষনা ব্রিগেডিয়ার মজুমদারের মুখে দিয়ে শুনলাম। তখন ক্যাপ্টেন নকভী আগে এবং আমি পিছনে সারেন্ডার করতে বাধ্য হলাম। ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব, ব্রিগেডিয়ার হাসানের সঙ্গে ৮-বেলুচ রেজিমেন্ট ছিল। ব্রিগেডিয়ার মজুমদাকেও সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম।

আমি কোন বিদ্বেষ নিয়ে লিখি নাই। আমার বর্ণিত কোন ঘটনা কেও যদি অসত্য বলে প্রমান করতে পারেন তাহলে আমি মিথ্যাচারীর কালিমা নেব।

আব্দুর রকীব

লেঃ কর্ণেল (অবঃ)

(৯, ৪.১.২, ১৯২-৯৬)

মেজর জেনারেল অবঃ কে এম শফিউল্লাহর প্রতিবাদ

‘বিচিত্রা’ ১৯৮৩

১৩ মে ১৯৮৩ সংখ্যা বিচিত্রায় ‘স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা পর্ব’ এই শিরোনামে লেঃ কর্নেল (অবঃ) কাজী আবদুল রকীবের লেখা একটি নিবন্ধ আমার দৃষ্টিগোচর হয়েছে। তিনি তার নিবন্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময় তার নিজস্ব ভুমিকার উপর আলোকপাত করতে গিয়ে সব অবান্তর বক্তব্যের অবতারনা করেছেন। বর্ণিত এই নিবন্ধ অনেককেই আমার মতো আশ্চার্যন্বিত না করে পারে না। সম্পূর্ণ নিবন্ধটতেই তিনি তার মনগড়া কাহিনী ও বিভ্রান্তিকর তথ্যে ভরে‌ রেখেছেন। তার পুরো নিবন্ধটির উপর আলোচনা করার ইচ্ছা আমার নেই। শুধু দু’একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনার সত্যতা সম্পর্কে তথ্য প্রকাশ করতে বাধ্য হচ্ছি।

স্বাধীনতা-উত্তরকালে কিছু কিছু পত্র পত্রিকায় আমার সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছিলো। কিন্তু সাক্ষাৎকার কখনো কাউকে হীন করে তোলার বা নিজের কৃতিত্বকে প্রকাশ করার অভিপ্রায় ছিলো না। সাধারণভাবে যা ঘটেছে তাই তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি মাত্র।

লেঃ কর্নেল রকীব ২য় ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করার তিনদিন পর এই ব্যাটালিয়ন জয়দেবপুর ছেড়ে ময়মনসিংহ চলে যায়। তার বক্তব্যানুযায়ী এই ব্যাটালিয়ন জয়দেবপুর ছেড়ে ময়মনসিংহ যাওয়ার ব্যাপারে সম্পূর্ণ পরিকল্পনা তিনি একাই করেছেন এবং আমরা শুধু তার নির্দেশ অনুসারেই কাজ করে গিয়েছি। এর পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত এই ব্যাপারে নিজস্ব কোনো উদ্যোগ বা পরিকল্পনাই ছিলো না। তিনি ২৬শে মার্চের উদ্ধৃতি দিতে গিয়ে লিখেছেনঃ “ঐদিন বিকালে কিছু কিছু অফিসার, জেসিওদের সঙ্গে কথা বলার সময় বিশেষ করে সুবেদার নুরুল হক সংশয় প্রকাশ করেন যে, আমাদের ব্যাটালিয়নকে নিরস্ত্র করার চেষ্টা করতে পারে। আমি এ ব্যাপারে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করি এবং ঐদিনই সন্ধ্যায় অতর্কিত হামলার মোকাবেলার মতো প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা অর্থাৎ অবস্থান সুদৃঢ় করা, অধিক সংখ্যক প্রহরী নিয়োগ ইত্যাদি বন্দোবস্ত করি।“

রকিব সাহেবের এই বক্তব্যে অবাক না হয়ে পারছি না কারণ তার এই মন্তব্যে আমাদেরও অদূরদর্শিতা এবং সমর প্রস্তুতির শৈথিল্যের ইঙ্গিত বহন করে বলে আমার মনে হয়। এই ব্যাটালিয়নকে যে নিরস্ত্র করার চেষ্টা হতে পারে তা জয়দেবপুর ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকাবাসীদেরও আলোচনা ও উদ্বেগের বিষয় ছিলো। তাই ১৭ই মার্চ এলাকাবাসীরা জয়দেবপুর থেকে টঙ্গির রাস্তার উপর ৩০ থেকে ৪০টিরও বেশি ব্যারিকেড তৈরী করে রেখেছিলো। যেখানে ঐ এলাকার জনসাধারণ আমাদের নিরস্ত্র করা হবে ভেবে উদ্বিগ্ন হয়ে তাদের প্রস্তুতি হিসেবে ব্যারিকেড তৈরি করেছিলো সেখানে আমরা বিশেষ কোনো প্রস্তুতি ছাড়া ২৬শে মার্চ বিকাল পর্যন্ত নীরব, নিশ্চেষ্ট ছিলাম এটা তিনি কিভাবে কল্পনা করতে পারলেন।

জয়দেবপুরের জনগণের ব্যাটালিয়নের সমরপ্রস্তুতির কথা কখনো ভুলবো না। এমনকি রকীব সাহেবেরও ভোলার কথা নয়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, তিনি ২৬শে মার্চ বিকালেই প্রথম শুনতে পান যে, এই ব্যাটালিয়নকে নিরস্ত্র করার চেষ্টা হতে পারে আর তাই তিনি ঐদিনই তা প্রতিহত করার সমস্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।

রকীব সাহেবর অবগতির জন্য লিখছি যে, ১৯শে মার্চ ১৯৭১ সালে শুক্রবার ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আরবার স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ১৮ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের এক কোম্পানী সৈন্য নিয়ে এই ব্যাটালিয়নকে নিরস্ত্র করার অভিপ্রায় নিয়ে ঢাকা থেকে জয়দেবপুরে এসেছিলেন। সেদিন যদি এই ব্যাটালিয়ন সমরপ্রস্তুতিতে কোনো ত্রুটি বা শৈথিল্য দেখাতো তা হলে ঐদিনই এই ব্যাটালিয়ন নিরস্ত্র হয়ে যেতো। সেদিন ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আরবাব রাজবাড়ীতে ঢুকেই ব্যাটালিয়নে সুদৃঢ় প্রস্তুতি দেখে আমাদের নিরস্ত্র করার চেষ্টা থেকে বিরত থাকে। লেঃ কর্নেল মাসুদুল হাসান (তৎকালীন ব্যাটালিয়ন কমান্ডার) বস্তুতঃ সেদিনই তার ব্যাটালিয়নের কমাণ্ড হারিয়েছিলেন।

২৭শে মার্চ উদ্ধৃতি দিতে গিয়ে লেখক এক জায়গায় লিখেছেন, “টঙ্গীর গোলাগুলির আওয়াজ থেমে যাওয়ার পর আমি মেজর শফিউল্লাহ, মেজর মইন, ক্যাপ্টেন আজিজ ও সুবেদার নুরুল হককে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করার জন্য আমার নিজের কামরায় ডেকে পাঠালাম। তারা এসে পৌঁছাতেই আমি বললাম যে, পরিস্থিতি এখন অসহ্য। এখান থেকে আমাদের বেরিয়ে যেতে হবে। আপনাদের মতামত কি? কেউ উত্তর দিলেন না। আমি ধরে নিলাম মৌনতাই সম্মতির লক্ষণ।“

রকীব সাহেবের নিবন্ধের এইটুকুই সবচেয়ে বড় অসত্য উদ্ধৃতি। সঠিক কথা হলো আমি তাকে প্রথমবার সরাসরি বলি যে, আমাদের আর জয়দেবপুর থাকা উচিত নয়। তাকে আরও বলি যে, ব্যাটালিয়নকে ময়মনসিংহে একত্রিত করার সমস্ত পরিকল্পনা করে ফেলেছি। আপনিও আমাদের সঙ্গে চলুন। আমার কথায় তাকে চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন হতে দেখি। যদিও এটা উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো কথাই ছিলো কারণ আমরা যা করতে যাচ্ছি তা সহজ ভাষায় হচ্ছে বিদ্রোহ এবং বিদ্রোহের পরিণতি কি হতে পারে তাও কোনো সৈনিকের অজানা থাকার কথা নয়।

২৫শে মার্চ বিকালে যখন তিনি এই ব্যাটালিয়নের কর্তৃত্বভার গ্রহণ করেন তখন থেকেই আমি তার সঙ্গে সঙ্গে ছিলাম এবং ব্যাটালিয়নের বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতি সম্পর্কে অর্থাৎ ব্যাটালিয়নের সৈনিকরা যে পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াবার জন্য সম্পূর্ণভাবে মানসিক ও সামরিকভাবে তৈরি আছে তা তাকে আভাসে ইঙ্গিতে বোঝাতে চেষ্টা করেছি।

২৭শে মার্চেই আমরা চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেই যে, জয়দেবপুরে বসে থাকা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয় এবং সেদিনই রকীব সাহেবকেও আমাদের পরিকল্পনা সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে বলি। এ পরিকল্পনা আমাদের অনেক আগে থেকেই ছিলো এবং তা বাস্তবে পরিণত করার সিদ্ধান্ত নেই সেদিনই। এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত আমি তাকে খোলাখুলিভাবে কিছু বলতে পারিনি কারণ রকীব সাহেব এমন এক সময় এবং এমন এক পরিস্থিতিতে আমাদের ব্যাটালিয়নে এসেছিলেন যে তখন তাকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করা আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিলো না এবং তার পক্ষেও হয়তো এত অল্প সময়ের মধ্যে আমাদের মনোভাব বোঝা সম্ভব ছিলো না। তাই ২৭শে মার্চ যখন আমরা চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেই তখনই আমি তাকে খোলাখুলিভাবে বলতে সাহস পেয়েছি। তার সঙ্গে খোলাখুলিভাবে এই ব্যাটালিয়নের পরিস্থিতি ও আমাদের পরিকল্পনা সম্পর্কে আলোচনা না করার কতগুলো কারণও ছিল।

(ক) লেঃ কর্নেল মাসুদকে অপসারণ করে ২৫শে মার্চ বেলা ৪টায় লেঃ কর্নেল রকীবকে এই ব্যাটালিয়নের দ্বায়িত্বভার গ্রহণের জন্য পাঠানো হয়। লেঃ কর্নেল মাসুদকে আমরা যেভাবে বিশ্বাস করতে পারতাম সেভাবে লেঃ কর্নেল রকীবকে বিশ্বাস করতে পারি নাই। কারণ লেঃ কর্নেল মাসুদ এই ব্যাটালিয়নে প্রথম থেকেই আমাদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং তার মনোভাবও আমাদের সবার জানা ছিলো। কিন্তু লেঃ কর্নেল রকীব কমিশন পাওয়ার পর থেকেই পাঞ্জাব রেজিমেন্টে চাকুরিরত ছিলেন এবং ব্যাটালিয়নের প্রত্যেকের নিকট তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ অপরিচিত। এই অল্প সময় ও পরিস্থিতিতে তার মনোভাব সম্পূর্ণ বুঝার অবকাশ বা সুযোগ আমার হয়নি এবং তিনিও তার মনোভাব আমার নিকট প্রকাশ করেননি।

(খ) ১ মার্চ কারফিউ জারি করে পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ। ঢাকার নিরীহ জনগণের উপর যে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিলো তা ২৫শে মার্চ যখন তিনি আমাদের ব্যাটালিয়নে আসেন তখন আমি তাকে হত্যাযজ্ঞের কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম। তখন তিনি আমাকে বলেছিলেন এমন কিছুই হয়নি, ব্যাটালিয়নের লোকজন দুএকটি ফাঁকা আওয়াজ করেছে মাত্র। অথচ যেসব ব্যাটালিয়ন হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিলো তার মধ্যে লেঃ কর্নেল রকীব সাহেবের ব্যাটালিয়ন ৩২ পাঞ্জাবও ছিলো। এই কারণে তার প্রতি আমার সন্দেহের সৃষ্টি হয়। তাই তার সঙ্গে মন খুলে কথা বলতে পারছিলাম না। ঐদিন ঢাকা শহরে যে কি ঘটেছিলো তা নিশ্চয়ই আজও কেউ ভোলেনি।

রকীব সাহেব লিখেছেন ২৭শে মার্চে সন্ধ্যায় তিনি উপলব্ধি করেন যে, আর এখানে থাকা সম্ভব নয়। তাই তিনি পাকিস্তানীদের পক্ষ ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন এবং এ ব্যাপারে পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তার বর্ণনা অনুসারে তার পরিকল্পনার কার্যকারিতা শুরু হয় পরদিন সকাল ১০টা থেকে অর্থাৎ ২৮শে মার্চ সকাল ১০টা থেকে।

তিনি নিজেই লিখেছেন এই ব্যাটালিয়নের একজন অবাঙালি অফিসার কাজেম কামাল ও আমি ছাড়া বাকী সবাই ছিলো তার কাছে অপরিচিত। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, এমন একটি সম্পূর্ণ অজানা ও অচেনা পরিবেশে তিনি কি করে এত বড় পরিকল্পনা একাই করে ফেললেন! আর ২৭শে মার্চ সন্ধ্যায় তিনি আমাদের ডেকে বললেন, “পরিস্থিতি এখন অসহ্য, আমাদের এখান থেকে বেরিয়ে যেতে হবে।” আর আমরাও তার কথা মেনে নিয়ে ময়মনসিংহের দিকে রওয়ানা দিলাম।

২৮শে মার্চের যে বর্ণনা তিনি দিয়েছেন তার উপর মন্তব্য করা আমার পক্ষে ঠিক হবে না কারণ ঐদিন সকাল দশটায় আমি জয়দেবপুর থেকে ময়মনসিংহের দিকে রওয়ানা হয়ে যাই। সেদিনের ঘটনাবলীর বিবরণ তারাই দিতে পারবে যারা ঐদিন তার সঙ্গে ছিলো। যেমন মেজর মইন, ক্যাপ্টেন নাসিম, ক্যাপ্টেন এজাজ এবং সেকেণ্ড লেফটেন্যান্ট ইব্রাহিম প্রমুখ।

তিনি তার নিবন্ধের এক জায়গায় লিখেছেন, ‘এ সময় আমি যথেষ্ট চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন ছিলাম। কারণসমূহ ছিলোঃ

(১) মেজর শফিউল্লাহ টাঙ্গাইল পৌঁছালেন কিনা এবং তার আগে কি করছেন তার খবর তখন পর্যন্ত পাই নাই………। এ অংশের উপর আলোচনা করতে গিয়ে লিখতে হয় যে, ঐ সময় দ্বিতীয় ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট জয়দেবপুর, গাজীপুর, রাজেন্দ্রপুর, টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিলো। আমাদের শক্তি বৃদ্ধির জন্য আমরা চাচ্ছিলাম ছড়িয়ে থাকা অংশগুলোকে সরিয়ে নিয়ে এক জায়গায় সংঘবদ্ধ করতে। ময়মনসিংহকেই সবাই একত্রিত হওয়ার উপযুক্ত জায়গা হিসেবে বেছে নিয়েছিলাম এবং অন্যান্য অংশ কিভাবে পৌঁছাবে তার একটা পরিকল্পনা অনুযায়ী ব্যাটালিয়নের কিছু অংশ নিয়ে আমি জয়দেবপুর থেকে সকাল দশটায় ময়মনসিংহের দিকে রওয়ানা হয়ে যাই। আর বাকী অংশ ঐদিনই সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় জয়দেবপুর থেকে রওয়ানা হওয়ার কথা ছিলো। আমি বুঝতে পারছি না, চলে আসার পর রকীব সাহেব আমার জন্য কেনো এতো উদ্বিগ্ন ছিলেন। ময়মনসিংহে তো আমি শত্রুও মোকাবেলা করে যাইনি যে আমার জন্য তিনি উদ্বিগ্ন থাকবেন। উদ্বিগ্ন তো আমি ছিলাম যে, ব্যাটালিয়নের অন্যান্যরা নিরাপদে বেরিয়ে আসতে পারলো কিনা। তার উদ্বেগের প্রধান কারণ হওয়া উচিত ছিলো কিভাবে ব্যাটালিয়নের বাকী সবাইকে নিয়ে নিরাপদে ময়মনসিংহে পৌঁছানো যায়।

২৯শে মার্চ ভোরে যখন ব্যাটালিয়নের সবাই আমার সঙ্গে মুক্তাগাছায় মিলিত হয় তখন আমি তাদের জিজ্ঞাসা করি, কমান্ডিং অফিসার সাহেব কোথায়? তখন অনেকেই আমাকে এই কথা বলেছে যে, তারা রাজবাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার সময় অফিসার্স মেসের ব্যালকনিতে সিও সাহেব ও ক্যাপ্টেন নকভীকে (একজন অবাঙালি অফিসার) দাড়িয়ে থাকতে দেখেছে। কি পরিস্থিতিতে রকীব সাহেব ঐ জায়গায় রয়ে গেলেন সে ব্যাপারে তিনি যে বিশ্লেষণ দিয়েছেন সেটা কি সত্যের অপলাপ নয়? আমাদের পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক ২৮ মার্চ সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় জয়দেবপুর, গাজীপুর ও রাজেন্দ্রপুর থেকে একই সময়ে সবাইকে নিজ নিজ কর্মস্থল ত্যাগ করে ময়মনসিংহের দিকে রওয়ানা হওয়ার কথা ছিলো। রকীব সাহেব এই সময়সূচী পরিবর্তন করে সাড়ে আটটা কেনো করেছিলেন তা তিনি লিখেননি।

তার নিজের কথা অনুযায়ী সাড়ে আটটায় রাজবাড়ী থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কথা। তখন পর্যন্ত তিনি সেখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না এবং আটটা বিয়াল্লিশ মিনিটে তিনি তার কামরায় চলে যান এবং সেখানে গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন যেনো কেউ এসে সঙ্গে করে নিয়ে যাবে। যেখানে তার ৮টা ৩০ মিনিটে জয়দেবপুর ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা সেখানে তিনি ৮টা ৪২ মিনিটে তার কামরায় ফিরে গেলেন কেন? এটাই কি তার ব্যাটালিয়নের সঙ্গে যাওয়ার লক্ষণ ছিলো?

ক্যাপ্টেন নকভীর হাতে সারা রাত আটক থাকার যে বর্ণনা তিনি দিয়েছেন সেটাও কি গ্রহণযোগ্য? তার নিশ্চয়ই মনে থাকার কথা যে সেই অনিশ্চিত দিনগুলিতে আমরা সর্বক্ষণই সশস্ত্র থেকেছি, কখনো নিরস্ত্র অবস্থায় থাকিনি। সেদিনের সেই অনিশ্চয়তা ও সঙ্কটময় সময়ে তার সঙ্গে অস্ত্র না থাকা কি অস্বাভাবিক ছিল না?

তার নিকট আমার আরো জিজ্ঞাস্য যে, গোলাগুলির মুখে যখন এই ব্যাটালিয়নের সবাই চলে আসতে পারলো তখন কেনো চলে আসতে পারলেন না ব্যাটালিয়ন কমান্ডার। পাকিস্তানীরা তো জয়দেবপুর রাজবাড়ী ঘেরাও করেছিলো ২৯ মার্চ দুপুরের পর। আমাদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার ঐকান্তিকতা যদি সেদিন সত্যি তার থাকতো তাহলে ২৮ মার্চ সারারাত ও ২৯ মার্চের দুপুর পর্যন্ত সময়টুকু কি যথেষ্ট ছিলো না? ২৯ মার্চের ভোরে যখন রাজবাড়ীতে পাকিস্তানী বিমান বাহিনী স্ট্রাফিং ও বোমা বর্ষণ করেছিলো তখনও কি তিনি পারলেন না এই পরিস্থিতির সুযোগ নিতে?

২৯ মার্চ দুপুরের পর ঢাকা থেকে সেনাবাহিনী এসে জয়দেবপুর রাজবাড়ী ঘেরাও করে ও রকীব সাহেবকে বন্দী করে নিয়ে যায় এবং তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়ার পূর্ব পর্যন্ত অন্যান্য বাঙালি অফিসারদের ন্যায় তাকেও সেলে রাখা হয়। ঐ সময় সেলে থাকাকালীন সময়ে অন্যান্য বাঙালি অফিসারদের ভাগ্যে যখন নানা প্রকার লাঞ্ছনার শেষ ছিলো না তখন তার প্রতি কর্তৃপক্ষের সদয় ব্যবহারের কারণ কি ছিলো? অন্যান্য বাঙালি অফিসারদের যখন পশুর মতো ছোট একটি সেলে গাদাগাদি করে রাখা হয়েছিলো তখন তার থাকার জন্য কেন বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়েছিলো? এসবের জবাব কি তিনি দিতে পারবেন?

রকীব সাহেব তো তার দীর্ঘ নিবন্ধে কোথাও একথা লিখেননি যে, তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে তাকে নিয়ে যাওয়ার পর পাকিস্তানীরা কি ব্যবস্থা নিয়েছিলো। তিনি তো একথা লিখেন নি যে, তাকে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়ার পর আবার তাকে পাঞ্জাব ব্যাটালিয়নের কমাণ্ড দেয়া হয়েছিলো। ব্রিগেডিয়ার মজুমদার, লেঃ কর্নেল মাসুদ, লেঃ কর্নেল জলিল, লেঃ কর্নেল ইয়াসিন সহ আরও অনেককেই তো কমাণ্ড থেকে অপসারিত করে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো। তারা তো কেউই তাদের কমাণ্ড আর ফিরে পাননি। উপরন্তু তাদের উপর যে অমানুষিক ও পৈশাচিক অত্যাচার চালানো হয়েছিলো তার চিহ্ন তো আজও অনেকের শরীরে রয়ে গেছে।

লেঃ কর্নেল রকীবের উপর আমার ব্যক্তিগত কোনো ক্ষোভ বা বিদ্বেষ নেই। কিন্তু তার নিবন্ধের উপর কিছু আলোকপাত করতে গিয়ে আমাকে যেসব কথা লিখতে হয়েছে সেজন্য আমি দুঃখিত। একবার ভেবেছিলাম এই নিবন্ধের উপর কোনো মন্তব্য করবো না, করা উচিত নয়। কিন্তু পরে ভেবে দেখলাম যে প্রতিবাদ না করলে অসত্য সত্য হয়ে থাকবে। তাই আমাকে লিখতে হলো।

———————————————-

<৯, ৪.২, ১৯৬-১৯৯>

জয়দেবপুর-তেলিয়াপাড়ার প্রতিরোধ যুদ্ধ

সাক্ষাতকারঃ ক্যাপ্টেন গোলাম হেলাল মোরশেদ খান

(১৯৭১ সালের মার্চে ২য় বেঙ্গল রেজিমেন্টে লেফটেন্যান্ট হিসাবে কর্মরত ছিলেন। বাংলা একাডেমী দলিলপত্র থেকে সংকলিত সাক্ষাৎকারটি ১৯৭৩ সালে গৃহীত)

২৫ শে মার্চ সকালে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এবং টঙ্গী টেলিফোন এক্সচেঞ্জের সঙ্গে যোগাযোগ করি এবং খবরাখবর নিই। জয়দেবপুরের জনসাধারণ তখন দারুণভাবে উত্তেজিত। তারা টেলিফোনে আমাদের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য দারুণভাবে চাপ দিতে থাকে। দুপুর বারোটার সময় টঙ্গী টেলিফোন এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে জানতে পারি যে, পাঞ্জাবী কমান্ডো ব্যাটালিয়ানের কিছু সাধারণ পোশাকধারী সৈন্য টঙ্গী ব্রীজ দখল করে জনসাধারণের উপর গোলাগুলি চালাচ্ছে। তখন আমরা বুঝতে পারি এবং ধারণা করি যে পরবর্তী আক্রমণ হয়তবা আমাদের উপর করবে।

রাত্রে আমরা পাঞ্জাবীদের দ্বারা আক্রান্ত হবো মনে করে জয়দেবপুর প্যালেসের চতুর্দিকে পরিখা খনন করে পাহারা দিই। আমি কর্তব্যরত থাকাবস্থায় রাত প্রায় সাড়ে বারোটার সময় ঢাকা থেকে টেলিফোন গেল এবং সে টেলিফোন করেছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান স্বয়ং। তিনি আমার অফিসার কমান্ডিং লেঃ কঃ রকীবকে ডাকতে বলেন। আমি লেঃ কঃ রকীবের সঙ্গে টেলিফোনে আলাপ করি এবং লেঃ জেঃ টিক্কা খানের টেলিফোনের কথা জানাই। লেঃ কর্নেল রকীব অফিসে আসবার পূর্বেই পুনরায় টিক্কা খানের এডিসি টেলিফোন করেন। তিনি আমার কাছে জয়দেবপুর অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরীর খবর জানতে চান। অর্থাৎ জয়দেবপুর অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরী জনসাধারণ আক্রমণ করে অস্ত্রশস্ত্র নিতে পারে। কাজেই তাকে রক্ষা করার জন্য আমরা কিরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি সে কথা জানতে চান। তার জবাবে আমি বললাম যে জয়দেবপুর অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরীর খবর পুরাপুরি জানি না। তবে আমাদের সঙ্গে দু’টি অয়ারলেস সেট আছে। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে পরিস্থিতির কথা জানাব। এমন সময় লেঃ কর্নেল রকীব আমার অফিসে চলে আসেন এবং আমি তাঁকে টিক্কা খান ও তার এডিসির টেলিফোনের কথা জানালাম। তিনি তখন আমাকে একজন অফিসারের নেতৃত্বে এক প্লাটুন সৈন্য জয়দেবপুর অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরীতে পাঠাতে বলেন এবং অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরীতে খবর দিতে বলেন। আমি তার নির্দেশমত কাজ করলাম। কিছুক্ষণ পর কয়েকজন অফিসার আমার ডিউটি কক্ষে আসলেন। তাঁদের সঙ্গে সারারাত পরিস্থিতির উপর আলোচনা হয়।

২৬শে মার্চ সকাল আটটায় রেডিওতে সামরিক আইনের ঘোষণা শুনি। এরপর থেকে আমরা সবাই অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে পড়ি এবং কি করতে পারি সে বিষয়ে আলোচনা করি। এবং শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছলাম যে আমরা জয়দেবপুর থেকে বেরিয়ে পড়ব। কিন্তু বেরিয়ে যাওয়ার পূর্বে আমরা অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরীতে দুই প্লাটুন সৈন্য এবং রাজেন্দ্রপুর এম্যুনিশন ডিপোতে এক প্লাটুন সৈন্যের কথা চিন্তা করি এবং তাদেরকে কিভাবে আমাদের মাঝে আনতে পারি সে বিষয়ে চিন্তা করি। এভাবে ২৬শে মার্চ জয়দেবপুর কাটাই।

২৭শে মার্চ সকালে আমরা সবাই মিলে লেঃ কর্নেল রকীবকে কিছুটা জোর করে অয়ারলেসে ময়মনসিংহে অবস্থিত কোম্পানীকে জানাতে বললাম যে, তারা যেন জনসাধারণের সঙ্গে যোগ দেয় এবং সম্মিলিতভাবে কাজ করে। লেঃ কর্নেল রকীব তখন অয়ারলেসে ময়মনসিংহে মেজর (বর্তমান লেঃ কর্নেল) নূরুল ইসলামকে আমাদের কথা জানাতে বাধ্য হলেন এবং তাদেরকে জনসাধারণের সঙ্গে মিশতে বলেন।

২৮শে মার্চ ক্যাপ্টেন (বর্তমান মেজর) আজিজকে সকালে পাঠানো হল “রাজেন্দ্রপুর এম্যুনিশন ডিপোতে” এবং সেখানে তিনি গিয়ে আমাদের বাঙালি কোম্পানীকে খবর দেবেন কিভাবে তারা বের হয় এবং আমাদের পাওয়া মাত্র যেন বের হয়। এ খবর নিয়ে ক্যাপ্টেন আজিজ চলে গেলেন।

সকাল দশটার সময় ৪টা ট্রাক ও ৩টা জীপ নিয়ে আমরা এক কোম্পানী অগ্রসর হলাম ময়মনসিংহের দিকে। আমি টাঙ্গাইল থেকে গেলাম। পুরা কোম্পানী নিয়ে মেজর শফিউল্লাহ ময়মনসিংহ চলে যান। যাবার পথে বহু লোক পথের মধ্যে হাত তুলে ও ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দিয়ে আমাদেরকে স্বাগত জানায়।

আমি টাঙ্গাইল পৌঁছেই জানতে পারলাম যে টাঙ্গাইলে অবস্থিত বাঙালি কোম্পানী পূর্বেই জনসাধারণের সঙ্গে যোগ দিয়ে কাজ শুরু করেছে। তখন আমার সঙ্গে কাদের সিদ্দিকী আলাপ করতে আসেন। কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে কিছুক্ষণ আলাপ করার পর কয়েকটি গাড়ী সংগ্রহ করার প্রতিশ্রুতি দিল।

আমি আমার কোম্পানীর সৈন্যদের নিকট গিয়ে তাদেরকে আমার আয়ত্তে নিলাম। উক্ত কোম্পানীর কোম্পানী কমান্ডার ছিলেন মেজর কামাল (পাঞ্জাবী)। তাঁকে আশ্বাস দিয়ে বললাম ভয় না করার জন্য। সন্ধ্যায় ডাকবাংলোতে কাজেম কামালের সঙ্গে কিছুক্ষণ আলাপ করি। পরে আমি আমার ড্রাইভার ও গার্ডকে নিয়ে জীপে রাস্তায় বেরুলাম জয়দেবপুর থেকে আমাদের কোম্পানী আসছে কিনা দেখবার জন্য। কিছুদূর যাবার পর অনেক দূরে একটি গাড়ীর আলো দেখতে পাই। মনে হল আমাদের সৈন্যরা জয়দেবপুর থেকে আসছে। আমি ডাকবাংলোতে ফিরে আসছি এমন সময় ডাকবাংলোতে গোলাগুলির শব্দ শোনা গেল। সোজা ডাকবাংলোতে না পৌঁছে আমি আমার সুবেদারকে ডেকে ব্যাপারটি জিজ্ঞেস করলাম। সুবেদার বললো, স্যার কিছু না, সব ঠিক আছে। গোলাগুলি শেষ হবার পর ডাকবাংলোয় গিয়ে দেখি মেজর কাজেম কামাল ও তার সাথে আরও ৫/৭ জন পাঞ্জাবী সৈন্য আহত ও নিহত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে মেজর কাজেম কামাল ও তার পাঞ্জাবী সৈন্যরা আমার অনুপস্থিতিতে পালানোর চেষ্টা করে এবং গুলি শুরু করে। আমাদের সৈন্যরা পাল্টা গুলি করলে তারা আহত ও নিহত হয়। এমন সময় আমাদের জয়দেবপুরের সৈন্যরা টাঙ্গাইল পৌঁছে।

জয়দেবপুরের সৈন্যরা টাঙ্গাইল পৌঁছলে তারা আমাকে আমার কোম্পানীসহ ময়মনসিংহের দিকে অগ্রসর হতে বলে এবং তারাও ময়মনসিংহের দিকে রওনা দেয়। আমি তখন নিহত পাঞ্জাবী সৈন্যদের সরিয়ে ফেলার জন্য জনসাধারণকে অনুরোধ করি। আমার গাড়ী তখনও সংগ্রহ না হওয়ায় আমি নিজেই কয়েকটি গাড়ী তাড়াতাড়ি সংগ্রহ করি। তখন রাত প্রায় তিনটা। আমি আমার সৈন্যদের নিয়ে ময়মনসিংহের দিকে অগ্রসর হই। রাস্তায় অনেক ব্যারিকেড থাকায় বেশী দূর অগ্রসর হতে পারলাম না।

২৯শে মার্চ ভোরে আমরা মুক্তাগাছার কাছাকাছি পৌঁছলাম। আমাদের পূর্বে জয়দেবপুর থেকে যে সেনাদলটি ময়মনসিংহ রওনা দিয়েছিল তারাও মুক্তাগাছায় পৌঁছেছিল। তারা ময়মনসিংহের দিকে রওনা দেয়। আমি মুক্তাগাছাই রয়ে গেলাম। মধুপুরেও কিছু সৈন্য ছিল। সকাল দশটার দিকে মেজর নূরুল ইসলাম ময়মনসিংহ থেকে টেলিফোনে বললেন, আমাদের পিছনে ফেলে যাওয়া কালিহাতী ব্রীজ উড়িয়ে দিতে। আমি মেজর নূরুল ইসলামকে বললাম ব্রীজ উড়ানোর মত তেমন কোন এক্সপ্লোসিভ নেই। কেননা তখন আমার নিকট আশি পাউণ্ড এক্সপ্লোসিভ ছিল। তা দিয়ে সম্ভব হলে আমি চেষ্টা করবো। আমি কালিহাতী ব্রীজ উড়িয়ে দেওয়ার জন্য পিছনে ফিরলাম। কালিহাতী ব্রীজ উড়ানোর জন্য পরিকল্পনা নিচ্ছিলাম। এমন সময় কাদের সিদ্দিকী সেখানে পৌঁছেন এবং তাঁকে আমরা টাঙ্গাইলে ফেলে আসাতে দুঃখ প্রকাশ করি। গ্রামের ও আশেপাশের লোকজন তখন অনেক জমা হয়েছে। তারা আমার ব্রীজ উড়ানোর কথা শুনে আপত্তি করেন। কেননা চতুর্দিকে গ্রাম ছিল। পাঞ্জাবীরা তাদের অত্যাচার করবে, এ জন্য গ্রামবাসী ব্রীজ উড়ানোর পক্ষে মত দেন নাই। আমার নিকটও অল্প এক্সপ্লোসিভ থাকায় ব্রীজ উড়ানো সম্ভব হল না, কাদের সিদ্দিকী আমার কাছে একটা পিস্তল চাইলেন। কিন্তু পিস্তল না থাকায় তাকে দিতে পারলাম না। তারপর সেখান থেকে সোজা ময়মনসিংহ রওনা দিই। বিকেল ৩টা থেকে ৪টার মধ্যে ময়মনসিংহে পৌঁছলাম। ময়মনসিংহে চতুর্দিকে বাংলাদেশের পতাকা উড়ছিল। আমরা পাঁচটা কোম্পানী তখন ময়মনসিংহে একত্রিত হয়েছি। সেখান থেকে আমাদের অপারেশন পরিকল্পনা শুরু করি। মেজর শফিউল্লাহ তখন আমাদের কমান্ডিং অফিসার। সেখানে জনসাধারণ ও নেতৃবৃন্দ উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মচারীদের সঙ্গে আমরা আলোচনা করি।

৩০শে মার্চ ২য় বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসার ও সৈন্যরা ময়মনসিংহে ছিলাম। এই সময়ের মধ্যে বিভিন্ন জায়গায় খবর পাঠাই ও যোগাযোগ করি। সীমান্ত এলাকায় সমস্ত ইপিআরদের খবর দিই সীমান্ত এলাকা ছেড়ে ময়মনসিংহে পৌঁছার জন্য। ২য় বেঙ্গল রেজিমেন্ট ময়মনসিংহ থেকে পাকিস্থানী সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে এ খবর বিভিন্ন জায়গায় পাঠাই। অয়ারলেসের মাধ্যমে চট্টগ্রামের খবর পাই। চট্টগ্রামের ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআর-এর সঙ্গে পাকিস্থানী সৈন্যদের যুদ্ধ চলছে, সে সমস্ত খবর আমরা পাই। রাজশাহী, পাবনা, বগুড়ার সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করি। এবং জানতে পারি যে রাজশাহী, পাবনা, বগুড়ায় পাঞ্জাবী সৈন্যরা দারুণভাবে মার খেয়েছে। এ সময়ের মধ্যে বহু ইপিআর ও সাবেক সৈন্য আমাদের সঙ্গে যোগ দেয়। একজন সুবেদারের কমান্ডে এক কোম্পানী সৈন্য পাঠানো হল মধুপুর গড়ে-পাকিস্থানী সৈন্যরা ময়মনসিংহের দিকে অগ্রসর হচ্ছে কিনা তার খোঁজখবর নিতে এবং অবলম্বন করতে। তারপর আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম ২য় বেঙ্গল রেজিমেন্টের সমস্ত সৈন্য নিয়ে ট্রেনে নরসিংদী হয়ে ঢাকার দিকে অগ্রসর হবো। এমন সময় খবর পেলাম কুমিল্লার ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্ট কুমিল্লা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌঁছেছে। তখন আমরা দুটি বেঙ্গল রেজিমেন্ট একত্র হওয়ার সিদ্ধান্ত নিই এবং ঢাকার দিকে অগ্রসর না হয়ে ময়মনসিংহ থেকে ট্রেনে ভৈরব রওনা হলাম ৩১শে মার্চ রাতে। পুরা ২য় বেঙ্গল রেজিমেন্ট ভৈরব ও কিশোরগঞ্জ পৌঁছলাম ১লা এপ্রিল।

ক্যাপ্টেন (বর্তমানে মেজর) মতিয়ূর রহমানের কমান্ডে ইপিআর-এর একটা কোম্পানী পাঠান হলো নরসিংদীতে। মেজর (বর্তমানে কর্নেল) খালেদ মোশররফ ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে একজন অফিসার পাঠালেন ভৈরবে। ভৈরব থেকে তিনি কিশোরগঞ্জ চলে গেলেন মেজর শফিউল্লাহর সঙ্গে কথা বলতে। সিদ্ধান্ত হলো আমাদের ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাওয়ার। আমরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌঁছালাম। চট্টগ্রাম থেকে মেজর (বর্তমানে ব্রিগেডিয়ার এবং ডেপুটি চীফ অব স্টাফ, বাংলাদেশ আর্মি) জিয়াউর রহমানকে সিলেটের তেলিয়াপাড়া পৌঁছার কথা বলা হলো। এবং আমরা ২য় এবং ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সমস্ত সৈন্য তেলিয়াপাড়ার দিকে অগ্রসর হবার কথা জানালাম।

আমরা ২য় বেঙ্গল এবং ৪র্থ বেঙ্গল তেলিয়াপাড়া পৌঁছলাম। ২য় বেঙ্গল রেজিমেন্টের এক কোম্পানী আশুগঞ্জ পাঠান হয়। অন্য আর এক কোম্পানী সিলেট চলে যায়। আমি আলফা কোম্পানী অর্থাৎ আশুগঞ্জে পৌঁছি ৩রা এপ্রিল। আমার সঙ্গে অফিসার ছিলেন ক্যাপ্টেন নাসিম। ক্যাপ্টেন নাসিম ছিলেন কোম্পানী কমান্ডার, আর আমি ছিলাম সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ড। এখানে আমরা প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলি। জনসাধারণ আমাদেরকে যথাসাধ্য সাহায্য করেন। কিছু আনসার ও মোজাহিদ রিক্রুট করি। কিছু নিয়মিত সৈন্যসহ এক প্লাটুন সৈন্য পাঠাই লালপুরে (আশুগঞ্জ থেকে দেড় মাইল দক্ষিণ দিকে)।

আনুমানিক ৮ই অথবা ৯ই এপ্রিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী নরসিংদী দখল করে নেয়। ১৬ই এপ্রিল ভোরে ৫টার সময় পাকিস্তানী বিমান বাহিনী হঠাৎ আশুগঞ্জে আমাদের উপর বোমাবর্ষণ শুরু করে ৬টা স্যাবর জেট দ্বারা। সৈন্য বাহিনীর সঙ্গে আমাদের তখন তুমুল যুদ্ধ চলছে। পাকিস্তানী সৈন্য ভৈরব ব্রীজের পশ্চিম দিকে ছিল এক ব্যাটালিয়ন। এক কোম্পানী প্যারাস্যুটে নামিয়ে দেয় আশুগঞ্জ শহরে। অন্য একটা ব্যাটালিয়ন পাঠায় লালপুর। সকাল আটটার সময় আমরা তিনদিক থেকে পাকিস্তানী সৈন্যদের দ্বারা আক্রান্ত হই। তখন তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়েছে। বেলা তিনটে পর্যন্ত যুদ্ধ অনবরত চলতে থাকে। আমাদের ১০/১২ জন সৈন্য ঐ যুদ্ধে শহীদ হন। ১৫/১৬ জন আহত হন। আমি এবং মেজর নাসিমও সামান্য আহত হই। অন্যপক্ষে পাকিস্তানী এক প্লাটুন সৈন্য যুদ্ধে নিহত হয়।

মেজর কে এম শফিউল্লাহকে জানালাম আমাদের পরিস্থিতি। তিনি আমাদেরকে সৈন্য তুলে নেওয়ার কথা বললেন। আমরা সৈন্য তুলে নিয়ে তালশহরে যাই। তালশহরে পৌঁছবার পর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মেজর শফিউল্লাহর সঙ্গে যোগাযোগ করি। এমন সময় একজন মুক্তিবাহিনীর ছেলে একটা হোন্ডা নিয়ে আমাদের কাছে আসে। আমি উক্ত হোন্ডায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মেজর শফিউল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য যাই। কেননা আমি তখন আহত। মেজর শফিউল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। তিনি আমাকে তেলিয়াপাড়া যাবার পরামর্শ দেন। আমি ঐদিন সন্ধ্যায় তেলিয়াপাড়া হেডকোয়ার্টারে পৌঁছি।

তেলিয়াপাড়ায় আমাকে জানানো হলো মাধবপুরে ডিফেন্স দেওয়ার জন্য। ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও তেলিয়াপাড়ার মাঝখানে মাধবপুর। মাধবপুরে ২৫শে এপ্রিল আমরা আবার ডিফেন্স তৈরি করি। এবং শাহবাজপুর ব্রীজ ভেঙ্গে দিই। আমি অত্যন্ত অসুস্থ হওয়ায় আগরতলা হসপিটালে চলে যাই। হসপিটালে দু’সপ্তাহ থাকতে হয়। ১লা মে আমি আবার তেলিয়াপাড়া পৌঁছি। তখনও মাধবপুরে আমাদের ডিফেন্স ছিল। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী তখন শাহবাজপুর পর্যন্ত পৌঁছেছে। তেলিয়াপাড়ায় মেজর শফিউল্লাহ আমাকে এক প্লাটুন সৈন্য নিয়ে শাহবাজপুর পাঠান পাকিস্তানী সৈন্যদের রেইড করার জন্য। তেলিয়াপাড়া থেকে মাধবপুর হয়ে শাহবাজপুর পৌঁছতে আমার এক রাত দুই দিন লেগে যায়।

———————————————————–

<৯, ৪, ১৯৯-২০০>

ময়মনসিংহ-ঢাকা সিলেটের সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ

সাক্ষাৎকারঃ মেজর এম,এ, মতিন
১২-৪-৭৩

(১৯৭১ সালে ক্যাপ্টেন হিসাবে কর্মরত ছিলেন। সাক্ষাৎকারটি বাংলা একাডেমীর দলিলপত্র থেকে সংগৃহীত)

২৯শে মার্চ ২য় বেঙ্গল জয়দেবপুর থেকে ময়মনসিংহ হয়ে মেজর শফিউল্লাহর নেতৃত্বে কিশোরগঞ্জে আসে। মেজর মইনুল হাসান, মেজর নূরুল ইসলামও ছিলেন। আমি তাদের সাথে দেখা করে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিই স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগ দেবার জন্য। তখনই বাড়ি গিয়ে মা-বাবা কে বলে চলে আসি। পাকবাহিনী কি করে আমাদের সবার খবর পেয়েছিল। বিকাল সাড়ে পাঁচটার দিকে পাক বিমান এসে ভৈরবের ওখানে বোমা ফেলে এবং কিশোরগঞ্জের উপর দিয়ে উড়ে যায়।

রাত ১১ টার দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে রওনা হই। আমরা সংখ্যায় ৮০০’র উপরে ছিলাম। সেকেণ্ড বেঙ্গলের পুরা ব্যাটালিয়নসহ বিস্তর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যাত্রা করি।

৩০শে মার্চ ভোরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌঁছাই। ওখান থেকে তেলিয়াপাড়া চা বাগানে (সিলেট) যাই সকাল ৮টার দিকে। ওখানে মেজর খালেদ মোশাররফ আগে থেকেই ছিলেন। মেজর মোশাররফ চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে ছিলেন। ৩১শে মার্চ পর্যন্ত ওখানে ছিলাম। দুটি বেঙ্গল রেজিমেন্টের হেডকোয়ার্টার ওখানে করি।

দুটি বাহিনী মিলে আলাপ আলোচনা করে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ঐ তারিখে বিএসএফ-এর অফিসারবৃন্দ আমাদের হেডকোয়ার্টারে আসে এবং আশা-ভরসা দেয় সম্ভাব্য সব কিছু সাহায্য দেবার জন্য। কর্নেল শফিউল্লাহ মেজর জিয়াউর রহমানের সাথে আলাপ করেন এবং ক্যাপ্টেন এজাজের নেতৃত্বে দ্বিতীয় বেঙ্গলের একটি কোম্পানীকে জিয়াউর রহমানের সাহায্যার্থে পাঠানো হয় চট্রগ্রামের দিকে। অপরদিকে ক্যাপ্টেন আজিজুর রহমানের নেতৃত্বে সেকেণ্ড বেঙ্গলের অপর একটি কোম্পানীকে সিলেট পাঠানো হয়।

এপ্রিল মাসের ১/২ তারিখে কর্নেল শফিউল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী মেজর মতিউর রহমানের নেতৃত্বে তৎকালীন ইপিআর বাহিনী নিয়ে নরসিংদী পাকবাহিনীর মুখোমুখি হয়। ব্যাপক যুদ্ধ হয়। পাক বাহিনীর বহু লোক মারা যায়। অপরদিকে মুক্তিবাহিনীও কিছু লোক হারায়।

ক্যাপ্টেন এ,এস,এম নাসিমের আর একটি দলকে কর্নেল শফিউল্লাহ আশুগঞ্জে (কুমিল্লা) পাঠান পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য ১লা এপ্রিলের দিকে। ইপিআর বাহিনী ১০০ মত এবং বেঙ্গল রেজিমেন্টের ২৫/৩০ জন লোক নিয়ে একটি কোম্পানী গঠন করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমার সরাইলে পাঠানো হয় রিজার্ভ হিসাবে। সরাইলে গিয়ে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র শিক্ষা দেবার জন্য একটি ট্রেনিং সেন্টার খুলি।

১৩ই এপ্রিল আমার উপর হুকুম হলো আশুগঞ্জের সংলগ্ন লালপুরে জাবার জন্য শত্রুর মোকাবিলা করতে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া ষ্টেশন পৌঁছে আমার বাহিনী নিয়ে আমরা আলোচনা করছি এমন সময় পাক বাহিনীর ৪টি স্যাবর জেট দেড় ঘণ্টা যাবৎ আক্রমণ চালায়। আমার বাহিনীর অনেকে মেশিনগান নিয়ে বাড়ির ছাদে গিয়ে আক্রমণ চালায়। বিমান ষ্টেশন থেকে চলে যায়। ওখানে আমরা মহসিন নামে একজন সিপাইকে হারাই। রাতে আমরা রওনা হয়ে আশুগঞ্জ পৌঁছাই। মেজর নাসিমের সাথে আলাপ করে লালপুরে যাই। রাত ৪টার দিকে লালপুরে পৌঁছাই।

১৪ই এপ্রিল পাক বিমান আশুগঞ্জ ও লালপুরে গোলাবর্ষণ করে। সকাল সাড়ে নয়টার দিকে পাক বাহিনী জলযানে করে গুলি করতে করতে আসে। ভারী অস্ত্র ব্যবহারের দরুন আমাদের বেশ কিছু হারাতে হলো। পাক বাহিনী তীরে উঠে পড়লে আমরা পিছু হটতে থাকি। ঐ দিন আশুগঞ্জ ও লালপুরে পাক বিমান ব্যপকভাবে বোমাবর্ষণ করে। আমরা পিছু হটি, সেখানেও টিকতে পারিনি। ইতিমধ্যে আমাদের পেছনে হেলিকপ্টারে করে পাক বাহিনী সৈন্য নামায়। সামনে পিছনে বিমান আক্রমণে টিকতে না পেরে পিছু হটি। ওখানে বেশ কিছু লোক হারাই। ১৫ই এপ্রিল কুমিল্লা জেলার শাহবাজপুরে পৌঁছাই। আমাদের দুটো বাহিনীর প্রায় ৪০ জনের মত মারা যায়। আশুগঞ্জ ও লালপুরে অধিকাংশ বাড়িঘর পুড়িয়ে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়। লোকজনকে হত্যা করে মেয়েদের জোর করে ধরে নিয়ে যেতে থাকে। শাহবাজপুরে তিতাস নদীর উপরে ব্রীজ ভেঙ্গে ওখানে আমি অবস্থান করতে থাকি কর্নেল শফিউল্লাহর নির্দেশক্রমে। রাস্তাটি ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং সিলেটের মধ্যে যোগ ছিল।

১৭ই এপ্রিল সন্ধ্যা ৭/৮টার দিকে পাক বাহিনী এক ব্যাটালিয়ন আর্টিলারি ও অন্যান্য সব কিছু নিয়ে আক্রমণ চালায়, গানবোটও তাদের ছিল। সামনে আমাদের উপর তারা আক্রমণ চালায়। অপর পাক দল অন্য দিক থেকে নদীর পার হয়ে আক্রমণ চালায়। সারারাত যুদ্ধ হয়। আমার ৫ জন মারা যায়। পাক বাহিনীর বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়। আমরা পিছু হটে মাধবপুরে গিয়ে ঘাঁটি গাড়ি। সেখানে ক্যাপ্টেন নাসিম তার দল নিয়ে ছিলেন। আমাদের ঘাঁটি দৃঢ় করি। কর্নেল শফিউল্লাহ দেখাশোনা করেন।

২১/২২ এপ্রিল পাক বাহিনী এক বিগ্রেড সৈন্য নিয়ে আমাদের উপর আক্রমণ চালায় বেলা বারটার দিকে। তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। আর্টিলারি মর্টার নিয়ে আক্রমণ চালায়। আমাদের ২৫০ মত ছিল। এক পর্যায়ে হাতাহাতি যুদ্ধ হয়। পাক বাহিনীর ৪০০/৫০০ জন মারা যায় এবং ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। প্রধানতঃ যোগাযোগের অভাবে আমরা পিছু হটি সন্ধ্যা ৭টার দিকে। আমাদের ২০/২৫ জন মারা যায় ঐ যুদ্ধে। শেষ পর্যন্ত দুই কোম্পানীসহ তেলিয়াপাড়া পৌছাই। আমরা সিলেট হারালাম।

——————————————

<৯, ৪.৪, ২০১-২০৪>

ময়মনসিংহ ও অন্যান্য এলাকার সশস্ত্র প্রতিরোধ

সাক্ষাৎকারঃ সিপাহী আফতাব হোসেন

(বাংলা একাডেমির দলিলপত্র থেকে সংগৃহীত)

২৪১৯৭৪

ময়মনসিংহে থাকডোরে ইপিআর-এর ২ নং শাখা ছিল। উইং কমান্ডার ছিল ক্যাপ্টেন কমর আব্বাস (পঃ পাকিস্তানী), সুবেদার মেজর জিন্নত গুল (পাঠান), নায়েব সুবেদার খান বাহদুর, নায়েব সুবেদার হজরত খান, নায়েব সুবেদার রাজা বেলাল (পঃ পাকিস্তানী)।

২৬শে মার্চ  ইপিআরকে আর্মস-এম্যুনিশন দেয়া হয় অনির্দিষ্টকালের জন্য। এবং উইং হেডকোয়ার্টারের চারিদিকে পরিখা-মরিচা খনন করার নির্দেশ দেয়া হয়। ঐদিনই দুপুরের পর হাজার হাজার স্থানীয় ছাত্র-জনতা দা, লাঠি, বল্লম প্রভৃতি নিয়ে ময়মনসিংহের ইপআর হেডকোয়ার্টার ঘেরাও করার চেষ্টা করে। বাঙালি সুবেদার সি-কোম্পানী কমান্ডার ফরিদ আহমদ ছাত্র- জনতাকে উদ্দেশ্য করে মেগাফোনে বলেন যে, আপনারা চলে যান। উল্লেখ করা যেতে পারে যে ২য় বেঙ্গল রেজিমেন্টের সি কোম্পানী কমান্ডার মেজর নূরুল ইসলামের কোম্পানীও উইং হেডকোয়ার্টারের গ্রাউন্ডে তাঁবুর মধ্যে ছিল। মেজর নুরুল ইসলামও মাইকে জনতাকে চলে যেতে বলেছিলেন। কিছুক্ষণ পর জনতা চলে যায়।

২৭শে মার্চ  দুপুরের পর আমাদের উইং কমান্ডার কমর আব্বাস ইপিয়ারকে অফিসের সামনে মাঠের মধ্যে একত্রিত করেন। তারপর সমস্ত ইপিআর-এর উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। সামরিক আইনের কয়েকটি বিধিনিষেধ তিনি আমাদেরকে পড়ে শোনালেন এবং বলেন, এখন থেকে দুই জনের মধ্যে কোনো আলাপ-আলোচনা করা চলবে না, যদি কেউ করে আমি নিজে গুলি করে তাকে মেরে ফেলব। কোনো বাঙালি যদি কোনো অপপ্রচারে লিপ্ত হয় তাহলে ‘মেরা পহেলা গুলি উসকা সিনাকে সিনাছে নিকাল যায়েগি।’

২৭শে মার্চ  বিকেল বেলায় আমি, সিপাই ইদ্রিস রেডিওতে খবর শুনলাম যে ঢাকাতে পিলখানা, রাজারবাগ পাকিস্তানী সৈন্যদের নিয়ন্ত্রণে। তখন আমি সিপাহী নান্নুকে (১৪৩৬৮) বললাম যে ঢাকাতে পাকিস্তানী সৈন্যরা  বাঙালিদের উপর আক্রমণ চালিয়েছে। আমাদের নিকট থেকে হয়ত অস্ত্রশস্ত্র জমা নিয়ে নিতে পারে। এক বিন্দু রক্ত থাকতে অস্ত্রসমর্পণ করব না বলে নান্নুকে বললাম। তার কিছুক্ষণ পর নায়েক সুবেদার খান বাহদুর (পাঠান) এবং পাকিস্তানী হাবিলদার আজিম আমাদের ৭ নং প্লাটুনে আসলেন এবং সয়ংক্রিয় সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র জমা দেবার নির্দেশ দেন এবং এরিয়ার বাইরে ডিউটিতে যেতে বলেন। তখন আমি আর নান্নু বললাম, দস্তখত করে হাতিয়ার এবং এম্যুনিশন নিয়েছি। এক বিন্দু রক্ত থাকতে তা জমা দেব না। তারপর তারা চলে যায়। সন্ধ্যার সময় খানা খাবার জন্য সবাইকে ৫ মিনিট সময় দেয়া হয়। কিন্তু আমি হাল্কা মেশিনগান নিয়ে বসে রইলাম এবং নান্নু ও অন্যান্য সবাই খানা খেতে চলে যায়। হাবিলদার আজিমের সাথে আমার কথা কাটাকাটি হয়। আজিম আমাকে “তোম তো আজকাল সাচ্চা কমান্ডার বন গায়া।” বলে ঠাট্টা-পরিহাস করে। তখন আমি আজিমকে বলি যে, আমি বাঙালি ছেলে। এটা বাংলাদেশ। আমার হাতে হালকা মেশিনগান আছে। এক্ষুনি এক ব্রাশ মেরে দেব। তখন খান বাহাদুর আমাকে এই অজুহাতে বন্দী করার চেষ্টা করে। তারপর সিপাহী নান্নু খানা খেয়ে চলে আসে। দুইজন একত্রে হবার দরুন আমাকে বন্দি করতে পারে নাই। তারপর সন্ধ্যা থেকে রাত ৮/৯ টা পর্যন্ত পাকিস্তানীরা আমাদেরকে উইং হেডকোয়ার্টারের পেট্রল ডিউটি করায়। ডিউটি শেষে সমস্ত ইপিয়ারকে এক জায়গায় জমা করে। উইং কমান্ডার কমর আব্বাস এবং সুবেদার মেজর জিন্নাত গুল আমাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘জোয়ান লোগ রাত কো ডিউটি কাজ জরুরত নেহি হায়। তুম লোগ নিন্দ যাও।’ তারপর সবাই ব্যারাকে চলে যায়।

রাত প্রায় ১০ ঘটিকার সময় আমার ওস্তাদ লোকাস কুইয়া (খ্রীষ্টান) আমাদের ৭ নং প্লাটুনকে উদ্দেশ্য করে যার যার সেন্ট্রি ডিউটি আছে তাদেরকে দাঁড়াবার জন্য বলে। কিন্তু কেউ ডিউটিতে দাঁড়ালেন না। তখন আমি লোকাস কুইয়াকে বললাম আজ রাতে আমি ও নান্নু ডিউটি করব হালকা মেশিনগান নিয়ে। আমি আর নান্নু দুইজন দুই দরজায় ডিউটির জন্য দুইটা হালকা মেশিনগান নিয়ে দাঁড়ালাম। তার কিছুক্ষণ পর পাকিস্তানী হাবিলদার সিকিউরিটি নজির বাদশাহ এবং এম,টি,প্লাটুনের হাবিলদার গোলাম হায়দার (পাকিস্তানী) দুইটা চীনা স্টেনগান নিয়ে আমার প্লাটুন হাবিলদার আজিমকে গোপনে কি যেন নির্দেশ দিয়ে যায়।

আমাদের ব্যারাকের সামনে পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ১৪ নং ডিভিশনের(যারা ইলেকশন ডিউটিতে ময়মনসিংহ এসেছিল) এক প্লাটুন সৈন্য তাঁবুর মধ্যে ছিল। রাত প্রায় সাড়ে বারটার সময় হঠাৎ একটা গুলির আওয়াজ শোনা গেল। তখন লাইনের ভেতরে যে কয়েকজন অবাঙালি ইপিয়ার ছিল তাদেরকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়। নান্নু তখন সাথে সাথে তার হালকা মেশিনগান দিয়ে বারান্দা থেকে পাঞ্জাব রেজিমেন্টের প্লাটুনের উপর ফায়ার আরম্ভ করে দেয়। বিহারী সিপাহী মমতাজের নিকট থেকে আমি একটি হালকা মেশিনগান উদ্ধার করি। এই গান বাঙালি সিপাহী (১৫২৭৯) হারুনকে দেই। হারুনকে পাঞ্জাব রেজিমেন্টের  প্লাটুনের উপর ফায়ার করার জন্য নির্দেশ দিই। সিপাই মোস্তফা (১২৫২৭)-কে একটি হালকা মেশিনগান দিই দোতলা-তেতলা থেকে সিড়িঁর পথ বন্ধ করার জন্য । তখন আমি উপরতলার যত বাঙালি ইপিয়ার ছিল সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললাম, রাত্রি বেলায় বাঙালি হোক বা অবাঙালি হোক কেউ যেন নীচে নামার চেষ্টা না করে। যদি কেউ চেষ্টা করে তাকে গুলি করা হবে। তারপর পাঞ্জাব রেজিমেন্টের প্লাটুনের সাথে আমাদের সারারাত গুলি বিনিময় হয়। ভোর পর্যন্ত (২৮ এ মার্চ) পাঞ্জাব রেজিমেন্টের  সমস্ত প্লাটুনকে ধ্বংস করা হয়।

২৮ মার্চ সকালবেলা আমী হারুনকে নির্দেশ দিলাম মেগাফোন দিয়ে শ্লোগান দেয়ার জন্যঃ নারায়ে তকবির-আল্লাহু আকবর, জয় বাঙালির জয়। আরো বললাম সবাই এখন উপরতলা থেকে নিচে নামতে পারে।

তারপর আমি সিপাই নান্নু, সিপাই মোস্তফা, সিপাই হারুন এবং আরো কয়েকজন সিপাই নিয়ে সুবেদার মেজর জিন্নাত গুলের কোয়ার্টার আক্রমণ করি। সেই কোয়ার্টারে দু’জন হাবিলদারসহ চারজন পাকিস্তানী জেসিও ছিল। আমরা বাঙালিরা সবাই মিলে তাদের উপর ফায়ার করছিলাম। এমন সময় উইং কমান্ডা্র তার পার্টি নিয়ে পিছন দিক থেকে আমাদের উপর আক্রমণ করতে চেষ্টা করে। কিন্তু আমরা দেকে ফেলি। উইং কমান্ডা্র এর পার্টির সাথে আমাদের গুলি বিনিময় হয়। তার পরই উইং কমান্ডা্র তার পার্টিসহ মুক্তাগাছার দিকে পালাতে চেষ্টা করে।

ময়মনসিংহ এবং টাঙ্গাইলের বাস রোড রেল লাইনের  ক্রসিংয়ে উইং কমান্ডা্র পার্টি পজিশন নেয়। তখন সিপাই নান্নু মিয়া ক্রুলিং করে ক্যাপ্টেন কমর আব্বাসের নিকট চলে যায়। কমর আব্বাস নান্নুকে দেখে ফেলে এবং চীনা স্টেনগান নিয়ে নান্নুর উপর ব্রাশ ফায়ার করে। নান্নু পজিশন নেয়াতে তার গায়ে গুলি লাগে নাই। ক্যাপ্টেন কমর আব্বাস আবার অন্য ম্যাগাজিন গানের মধ্যে লাগাবার চেষ্টা করে। তার আগেই নান্নু ক্যাপ্টেন কমর আব্বাসকে গুলি করে মেরে ফেলে। এইভাবে তার সাথের সবাইকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়। তার সাথে সাথেই চারদিক থেকে জনতা এসে তাদের মৃতদেহ নিয়ে যায় এবং মৃতদেহ টুকরো টুকরো করে প্রদর্শন করে ঘুরে বেড়ায়। তারপর  আমরা আবার সুবেদার মেজরর পার্টিকে আক্রমণ করি। ২৮শে মার্চ বিকেল পাঁচটার সময় তারা আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। তারপর আমরা বাঙালি ইপিয়াররা সুবেদার মেজরের পার্টিকে ময়মনসিংহ জেলে পাঠাই।

এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে বেঙ্গল রেজিমেন্টের সি-কোম্পানী (২য় বেঙ্গল) অধিনায়ক মেজর নুরুল ইসলাম ও লেফটেন্যান্ট মান্নান রাত্রিবেলায় ব্রহ্মপুত্র নদের কিনারে সিএণ্ডবি’র ডাকবাংলোতে ছিলেন। যখন গোলাগুলি আরম্ভ হয় তখন আমাদের উইং কমান্ডার কমর আব্বাসের পার্টি মেজর নুরুল ইসলামের উপর ফায়ার আরম্ভ করে দেয়। তখন তারা সেখান থেকে নদী সাঁতরিয়ে ওপারে চলে যান। বেঙ্গল রেজিমেন্টের কোম্পানী গোলাগুলির সময় ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় এবং অনেকে শহরে চলে যায়। সামান্য কয়েকজন লোক  ময়মনসিংহে আমাদের এরিয়ার মধ্যে পজিশনে থাকে এবং সকাল বেলায় আমাদেরকে সাহায্য করে।

সমস্ত পশ্চিম পাকিস্তানী ইপিআরদের নিয়ন্ত্রণে আনার পর স্থানীয় জনসাধারণ আমাদের গোলাবারুদ,অস্ত্রশস্ত্র, জিনিসপত্র ময়মনসিংহ শহরের রাবেয়া স্কুলে নিয়ে যায় এবং আমাদের খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করে। ২৯শে মার্চ আমরা ময়মনসিংহ ডিফেন্স নিয়ে থাকি। ইতিমধ্যে মেজর শফিউল্লাহ(সি-ইন-সি,বর্তমানে) জয়দেবপুর থেকে তাঁর লোকজন নিয়ে টাঙ্গাইল হয়ে ময়মনসিংহ আসেন। ৩০শে মার্চ সমস্ত ইপিআর এবং বেঙ্গল রেজিমেন্টের লোকজন নিয়ে মেজর শফিউল্লাহ, ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান(ঢাকার রূপগঞ্জ থেকে এসে যোগ দিয়ে ইপিআর-এর চার্জ নেন) বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। মেজর শফিউল্লাহর নির্দেশে ক্যাপ্টেন মতিউর রহমানের নেতৃত্বে ট্রেনযোগে আমরা ঢাকার দিকে রওনা হই।

৩১শে মার্চ আমাদের দল ঢাকার নরসিংদী পৌছায়। নরসিংদী থেকে ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান কয়েকশত ইপিআর নিয়ে ঢাকা জেলার ভাঙ্গা বাজারের নিকটে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে ডিফেন্স নেয় (১লা এপ্রিল); ২রা এপ্রিল আমাদের এক সেকশন(মুক্তিযুদ্ধের প্রথম গেরিলা পার্টি, ইপিআর-এর) নং ৩১৫৭ হাবিলদার আবদুল হাকিম, ১৪৩৬৮ সিপাহী নান্নু মিয়া, ১৫২৬৯ মোহাম্মদ আফতাব হোসেন, ১৫২৭৯ হারুনুর রশীদ, ১২৫২৭ নওয়াজ, ১৫৪৯২ মোহাম্মদ আনিসুর রহমান, ১৭৩০৮ আবদুর রাজ্জাক, মোহাম্মদ মফিজউদ্দিন, সাইদুর রহমান, আবদুল সাত্তার প্রমুখ ক্যাপ্টেন মতিয়ুর রহমানের নির্দেশে ঢাকা পৌছে। শার্ট-লুঙ্গি পরে আমরা একটা চীনা স্টেনগান, হালকা মেশিনগান পাঁচটা, বাকি ৩০৩ রাইফেল, অনেক গ্রেনেড ও এম্যুনিশনের বাক্স নিয়ে ২রা এপ্রিল রাত্রের বেলা ঢাকা শহরের নিকটে আমুলিয়া গ্রামে আসি।

যাত্রাবাড়ি প্রতিরোধঃ ৫ই এপ্রিল রাত আটটার সময় যাত্রাবাড়ি রোডে পাকসেনা বোঝাই একটা গাড়ীর উপর আক্রমণ চালাই। পুরো গাড়ী সম্পূর্ণরুপে ধ্বংস হয়ে যায়। সাথে সাথে ঢাকা এবং ডেমরার দিক থেকে পাকসেনারা অনেকগুলি গাড়ী নিয়ে ঘটনাস্থলের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। সাথে প্লেন আসে এবং গোলাবর্ষণ করতে থাকে। আমরা আক্রমণ চালিয়েই সাথে সাথে আবার গ্রামে চলে যাই।

পাঁচদোনাতে প্রতিরোধঃ এপ্রিল মাসের ১১ তারিখ ঢাকার পাঁচদোনাতে আমাদের হেডকোয়ার্টার ডিফেন্স পাকিস্তানী সৈন্যরা আক্রমণ চালায়। এখানে তুমুল লড়াই চলে। এই লড়াই দু’দিন চলে। ক্যাপ্টেন মতিয়ার রহমান ও সুবেদার ফরিদের নেতৃত্বে যুদ্ধ চলে। এই যুদ্ধে ৪০০/৫০০ পাকসেনা নিহত হয়। ২০/২৫টা গাড়ী সম্পূর্ণরুপে ধ্বংস হয়ে যায়। তার পরদিন ঢাকা সেনানিবাস থেকে বিপুল সৈন্য পাঁচদোনাতে আবার আমাদের উপর হামলা চালায় এবং  তিন দিক থেকে ঘেরাও করে ফেলে। হেলিকপ্টার দিয়ে পেছনে ছত্রীসৈন্য নামাতে থাকে। পাকসেনাদের প্রচণ্ড আক্রমণে টিকতে না পেরে বাঙালি মুক্তিযোদ্ধা ও ইপিআররা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। ছত্রভঙ্গ হয়ে তারা ভারতের আগরতলাতে চলে যায়। সেখানে তারা ৩নং সেক্টরে যোগদান করে।

মনহরদীতে গেরিলা অপারেশনঃ আমাদের উপরে উল্লিখিত গেরিলা পার্টি ঢাকার মনোহরদী থানা এলাকায় যায়। প্রায় এক মাস মনোহরদীতে গেরিলা অপারেশন চালাবার পর এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহে ঢাকা জেলার পাটুলী গ্রামে সিরাজ মিয়ার বাড়িতে  হঠাৎ করে আমাদের পার্টির দু’জনের পায়ে গুলি লাগে (দুর্ঘটনায়)। এতে পুলিশের মোহাম্মদ আবদুল হক (গ্রাম-নিলক্ষ্ণীয়া, ডাকঘর-দুলালকান্দী থানা-রায়পুর ঢাকা) ও মুজাহিদ আবদুল সালাম (গ্রাম-দুলালকান্দী থানা রায়পুর) মরে যান।

কাটিয়াদী থানা অপারেশনঃ

১৯৭১ সনের মে মাসে আমার দল নিয়ে ময়মনসিংহ জেলার কাটিয়াদী থানা অপারেশন করি। এর আগের দিন সেনারা কাটিয়াদী থানার আশেপাশে ঘরবাড়ি জ্বালিয়েছিল এবং গ্রামের বেশ কয়েকজন নিরীহ লোককে হত্যা করেছিল। তারা গ্রামে ঢুকে লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগে লিপ্ত হয়েছিল। থানার বাঙালি পুলিশদের কেউ কেউ খানসেনাদের সাথে সহযোগিতা করেছিল। তারাও লুটতরাজে লিপ্ত ছিল। সিপাহী হারুনকে আমি রেকি করতে পাঠিয়েছিলাম। হারুন গিয়ে দেখে খানসেনারা লুটতরাজ-অগ্নিসংযোগ করে চলে গেছে। বাঙালি পুলিশ ও অফিসাররা লুটতরাজ করে এক ধনী হিন্দুবাড়ি থেকে টাকা-স্বর্ণ নিয়ে যাচ্ছে। সিপাহী হারুন তাদেরকে বাধা দেয় এবং বলে যে আপনারা বাঙালি হয়ে বাঙালির উপর অত্যাচার করছেন। তখন হারুনের উপর তারা ওসি’র নির্দেশে ৭ রাউণ্ড ফায়ার করে। সে কোনরকমে তার সাইকেল ফেলে চলে আসে। তখন ঐ দিন রাতেই আমরা কাটিয়াদী থানার উপর আক্রমণ করি। ভোরবেলায় বাঙালি ও-সি’ কে গুলি করে হত্যা করা হয়। ঘাতক পুলিশ পালিয়ে যায়। এখানে থেকে ১৭ টি রাইফেল ও প্রচুর গোলাবারুদ উদ্ধার করি।

-সিপাই মোঃ আফতাব হোসেন, নং ১৫২৬৯

বাংলাদেশে রাইফেলস, সেক্টর হেডকোয়ার্টার

কুটিবাড়ি, দিনাজপুর।

———————————————

<৯, ৪.৫, ২০৪-২০৬>

শত্রুর প্রচণ্ড চাপে মনতলার পতন

মেজর এম, এস, এ ভূঁইয়া

(‘মুক্তিযুদ্ধে নয় মাস’ ১৯৭৪ গ্রন্থ থেকে সংকলিত)

মে মাসের শেষের দিক। তেলিয়াপাড়া পতনের পর ক্যাপ্টেন নাসিম (বর্তমানে মেজর) সিলেটের পাকিস্তানী এলাকা মনতলায় প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা করেন। মেজর মঈন প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করেন হরশপুর এবং মুকুন্দপুরে। ঐ দিক থেকে শত্রুর প্রবল হামলার আশংকা থাকায় আমাদের দুধারের পজিশন মধ্যবর্তী স্থানে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সুদৃঢ় করার জন্য পাঠানো হলো। আমার সাথে দেয়া হলো ৫০ জন জোয়ান। সঙ্গে অস্ত্র দেওয়া হলো একটি ভারী মেশিনগান, ৭টি হালকা মেশিনগান এবং বাকীগুলি রাইফেল। জায়গার তুলনায় আমাদের সাথে লোকসংখ্যা এবং অস্ত্রের পরিমাণ ছিল নগণ্য। এত অল্পসংখ্যক লোক দিয়ে আমাকে প্রায় আড়াই মাইল ফরোয়ার্ড লাইন কভার করতে হয়েছিল। আমাদের মিলিটারী ট্রেনিং অনুযায়ী এত বিরাট এলাকা কভার করা ছিল অকল্পনীয়।

যা হোক, এই অল্পসংখ্যক লোক নিয়েই আমি মনতলা থেকে গিলাতলী এবং তারপর ইখতেয়ারপুর গ্রাম পর্যন্ত কভার করলাম। অবশ্য আমার অসুবিধা টের পেয়ে আমাকে আরও ২০ জন লোক দেওয়া হয়। এই ২০ জনের মধ্যে অনেকেই ছিলেন বিমান বাহিনীর লোক। সুতরাং পদাতিক বাহিনীর ধ্যান -ধারনা সম্পর্কে তাদের ধারনা খুব স্পষ্ট ছিল না। আমি যাওয়ার আগেই শত্রুরা সেখানে আক্রমণ চালিয়েছিল। কিন্তু তাদের আক্রমণ কার্যকর হয়নি। প্রত্যেক বারই তাদের আক্রমণ ব্যাহত হতে লাগল। বাধ্য হয়ে শত্রুরা তাদের সংখ্যাবৃদ্ধিতে ব্যাপৃত হল। শত্রুবাহিনী দিনের বেলা কয়েকবারই আমাদের উপর আক্রমণ চালালো। প্রথমে তারা আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যুহের ডান দিয়ে আক্রমণ চালায়। আমি এবং মেজর নাসিম প্রতিরক্ষা ব্যুহের ডান দিকে দুটি ভারী মেশিনগান রেখেছিলাম। ফলে শত্রু পক্ষের আমাদের অবস্থান ভেদ করে ভেতরে প্রবেশ করা সম্ভব হল না। একদিন দিনের বেলা আক্রমণের সময় শত্রুবাহিনীর প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হলো। শত্রু অনেক মৃতদেহ পিছনে ফেলে রেখে হটে যেতে বাধ্য হলো।

আরেকদিন শত্রুবাহিনীর সাথে আমাদের লড়াই হলো মুখোমুখি। এ সময়ে শত্রুর সৈন্য সংখ্যা ছিল বিপুল। শত্রুবাহিনীর সংখ্যাধিক্যে আমাদের জোয়ানরা কিছুটা ভড়কে গিয়েছিল। তাদের কেউ কেউ আমাদের কোম্পানী তুলে নেওয়ার জন্যে পর্যন্ত পীড়াপীড়ি করেছিল। মনতলা পতনের শেষ দিন সন্ধ্যায় শত্রুবাহিনী এক বিগ্রেড এবং এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য নিয়ে মেজর নাসিম, লেফটেন্যান্ট মোরশেদ এবং এবং আমার পজিশনের উপর ত্রিমুখী আক্রমণ চালাল। আমি সে সময়ে ছিলাম আমার কোম্পানী হেডকোয়ার্টারে। আমি যাচ্ছিলাম মনতলা রেলওয়ে লাইনের ডান পার্শ্বে যে দুটো সেকশন ছিল সেগুলো চেক করার জন্যে। পথে জনৈক বে-সামরিক ব্যাক্তির কাছে জানতে পারলাম মনতলা রেলওয়ে ষ্টেশনে আমাদের কোন লোক নেই। তার কথা আমার বিশ্বাস হল না, বরং পাল্টা তার প্রতি আমার বিশেষ সন্দেহের উদ্রেক হল। আমি ঐ লোকটির সঙ্গে আমার দুজন দেহরক্ষীকে দিয়ে মনতলার পজিশন চেক করার জন্য পাঠিয়ে দিলাম। ওদিকে শত্রুবাহিনী ছয়টি কামানের সাহায্যে আমাদের অবস্থানের উপর অনবরত গোলাবর্ষণ শুরু করে দিয়েছে। আমার পাঠানো দেহরক্ষী দুজন ফিরে এসে জানালো, সত্যি সত্যিই ঐ পজিশনে আমাদের কোন লোক নেই। রাত তখন ৮টা বাজে।

সেদিনকার ঘটনার একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণী দিচ্ছিঃ মেজর নাসিমের অবস্থানের উপর শত্রুবাহিনীর প্রায় এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য আক্রমণ চালায়। এক ব্যাটালিয়নের সইন্যসংখ্যা প্রায় ৮০০ শত। এই বিপুল সৈন্যের আক্রমণের মুখে মেজর নাসিম ও তাঁর সৈন্যদের অবস্থানে থাকা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। ফলে তিনি তাঁর কোম্পানী নিয়ে অবস্থান ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হন। মেজর নাসিম মেজর মঈনের কোম্পানীকে (পরে লেফটেন্যান্ট মোরশেদের দ্বারা পরিচালিত) ফরোয়ার্ড লাইনে টেলিফোনের মাধ্যমে এই সৈন্য উঠিয়ে নেওয়ার সংবাদ জানান। আমার সাথে মেজর নাসিম দুজন জওয়ান মারফত আমাকে এই সংবাদ পাঠান যে, শত্রুবাহিনীর আক্রমণ মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। খবরে আরো বলেন যে, শত্রু ত্রিমুখী আক্রমণ চালিয়েছে। মেজর নাসিম এবং লেফটেন্যান্ট মোরশেদের সৈন্যদের পজিশন ছিল আমার উভয় পার্শ্বে। তাদের পজিশনে শত্রু প্রচণ্ড আক্রমণ চালিয়েছিল। মেজর নাসিমের সৈন্যরা তুমুল লড়াই করে শত্রুর অগ্রগতিকে ব্যাহত করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করলেন। অবশেষে মেজর নাসিম নিজের ট্রুপস এবং আমার কোম্পানীর ২১ জন লোক ও সুবেদার মান্নানকে নিয়ে পঞ্চবটীতে অর্থাৎ কয়েক মাইল পেছনে সরে গেলেন। ওদিকে লেফটেন্যান্ট মোরশেদও প্রাণপণ লড়াই করার পর তাঁর সৈন্যদের নিয়ে সরে পড়তে শুরু করেছেন। আমি এসবের কোন খবরই পাইনি। তদুপরি আমার প্রতিরক্ষা লাইন ছিল কোম্পানী হেডকোয়ার্টার থেকে আড়াই মাইল আগে।

আমার সে সময়কার মনের অবস্থা সহজেই অনুমেয়। আমি তখন বলতে গেলে কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে পড়েছি। রাত দশটার দিকে আমার হেডকোয়ার্টারের উপর প্রায় দশটা কামানের গোলা এসে পড়ল। আমাদের সংগ্রামী সৈনিকরা অনেকেই একেবারে নতুন। মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্যে তারা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তাদের অনেকেই জীবনে এই প্রথম কামানের গোলার আওয়াজ শুনলো। শত্রু ডান দিক দিয়ে আমাদের উপর প্রচণ্ড চাপ দিয়ে যাচ্ছে। অধিকন্তু ফরোয়ার্ড ডিফেন্স লাইনে যারা ছিল তাদের উপর প্রচণ্ড চাপ এল। আমি হেডকোয়ার্টারে থেকে কারও সাথে যোগাযোগ করতে পারছি না। ফলে ফরোয়ার্ড ডিফেন্স লাইনে অর্থাৎ ইখতেয়ারপুর ও গিলাতলীতে যারা ছিল তাদের খবরও জানা সম্ভব হল না। কাসিমপুর রেলওয়ে ষ্টেশনের ওখানে আমার একটি অবস্থান ছিল। সেখানকার জোয়ানদের সংখ্যা ছিল প্রায় ১৫ জন। আমি তদের ওখানে দুজন রানার পাঠিয়ে দিলাম। কিন্তু শত্রুদের কামান থেকে তখন এমন অবিরামভাবে গোলা বর্ষিত হচ্ছিল যে কিছুদুর এগিয়ে যাওয়ার পর তারা থেমে যেতে বাধ্য হল।

রাত তখন দশটা বাজে। আমিও অবস্থান ত্যাগ করাই মনস্থ করলাম। সব জায়গায় লোক পাঠিয়ে তাদের জানিয়ে দিলাম, পরবর্তী অবস্থান এবং প্রতিরক্ষাব্যুহ রচিত হবে চৌমুহনীতে।

শত্রু তখন তিন দিক থেকে আমাদের উপর আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। আমি হেডকোয়ার্টার নিয়ে চৌমুহনীর দিকে রওনা হলাম। আমরা সবাই নিজ নিজ অস্ত্রশস্ত্র এবং গোলাবারুদ সঙ্গে নিলাম। বাধ্য হয়ে আমরা সে সময়ে অনেক বেসামরিক লোককেও আমাদের অস্ত্রের বোঝা বহন করার জন্য সঙ্গে নিয়েছিলাম।

আমার বাহিনীকে সরিয়ে নেওয়ার সময় অন্যান্য কয়েকটি দলও এসে আমার দলের সঙ্গে যোগ দিল। শত্রুর অগ্রগতিকে বিলম্বিত করার জন্য হালকা মেশিনগানের সাহায্যে আমরা গুলি করতে থাকলাম। রাত দুটোয় এসে আমরা পৌঁছলাম চৌমুহনীতে। আল্লাহর রহমতে আমরা সবাই সেখানে এসে একত্রিত হলাম। আমাদের কোম্পানীর সমস্ত সৈন্যই ছড়িয়ে পড়াতে আমি ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলাম। সত্যি বলতে কি- আমার অবস্থা ছিল ঝড়ের সমুদ্রের ছিন্নপাল নৌকার মাঝির মত। এখন সবাইকে এক স্থানে পেয়ে আমি খোদার কাছে অশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলাম।

চৌমুহনীতে এসে আমি কোম্পানীর সবাইকে পেলাম সত্য, কিন্তু আবার নতুন বিপদের সম্মুখীন হলাম। মেশিনগান সজ্জিত আমার কয়েকটি সৈন্যদল গুলিবর্ষণ করে শত্রুসৈন্যদের অগ্রগতিকে বিলম্বিত করতে সক্ষম হলেও, শত্রুর পার্শ্ববর্তী অগ্রগতিকে বাধা দিতে সক্ষম হল না। আর শত্রুর সবদিকের অগ্রগতিকে ঠেকিয়ে রাখাও ছিল অসম্ভব- কারণ আমাদের সংখ্যাল্পতা। সংখ্যায় শত্রুসৈন্য ছিল আমাদের তুলনায় দশগুন। ভারতীয় সীমানা থেকে চৌমুহনীর দূরত্ব মাত্র দুই মাইল। কিন্তু এই দুই মাইল রাস্তা সেদিন রাতে কাছে অন্তহীন বলে মনে হয়েছিল।

রাতের শেষের দিক তখন। তখন ভোর চারটা। শত্রুরা শুধু গুলি করতেই এগিয়ে আসছিল না, তারা এগিয়ে আসছিল ঘরবাড়ি, গাছপালা জ্বালিয়ে জ্বালিয়ে।

ভোর সাড়ে চারটার দিকে তারা ভারতীয় সীমান্তের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল। শত্রুবাহিনী তখন আমাদের পশ্চাদ্ভাগের ব্যুহ প্রায় ভেদ করে ফেলেছে। আমাদের বাহিনীর তিন দিক বেষ্টন করেছে তারা। সামনে, দক্ষিণে এবং বামে। তখন ঐ নিতান্ত ফাঁদে পড়া অবস্থার মধ্যেও আমরা মনোবল না হারিয়ে তিনদিকে হালকা মেশিনগানের সাহায্যে অবিরাম গুলি চালাতে লাগলাম। আমাদের প্রতিজ্ঞা; আমরা শত্রুদের কিছুতেই আমাদেরকে ঘেরাও করতে দেব না। আমাদের হাতে তখন ছিল মর্টার আর ৫৬টা গোলা। নিরুপায় হয়ে শত্রুসৈন্যর উপর আমি মর্টার থেকে গোলাবর্ষণ শুরু করলাম। গোলার সংখ্যা কম হওয়াতে প্রতি দু-তিন মিনিট অন্তর শত্রুর অবস্থানের উপর গোলাবর্ষণ করছিলাম। সেদিন মর্টারটি আমাদের অবস্থান থেকে সরে আদতে বিধাতার আশীর্বাদের মত সাহায্য করছিল।

সূর্য ওঠার পর দেখতে পেলাম আমাদেরকে ঘিরে ফেলার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে। প্রায় ১৪ ঘণ্টা ধরে আমাদের সঙ্গে তাদের গোলাগুলি বিনিময় চলল। অবশেষে সকাল ৯টার দিকে আমরা সিদাই থানায় পৌঁছাতে সক্ষম হলাম।

——————————————-

<৯, ৪.৬, ২০৬-২০৯>

নরসিংদীআশুগঞ্জ সশস্ত্র প্রতিরোধ

ব্রিগেডিয়ার মোঃ মতিউর রহমান বীর প্রতীক

(১৯৭১ সালের মার্চে ক্যাপ্টেন পদে কর্মরত ছিলেন। বিবরণটি দৈনিক “সংবাদ” ৩ মার্চ ১৯৮৩-এ প্রকাশিত ‘সুবেদার মেজর সুলতান আহমদ বীরবিক্রম’ শিরোনামে তাঁর রচিত প্রতিবেদন থেকে সংকলিত)

       সুবেদার মেজর সুলতানের আমলে আমার পরিচয় হয় ১৯৭১ সালের ১লা এপ্রিল নরসিংদীতে। আমি ২৫শে মার্চ ১৯৭১ সালে যশোর সেনানিবাসের ২৫ বেলুচ রেজিমেন্ট ছেড়ে ২৭শে মার্চ ময়মনসিংহ পৌঁছি। ময়মনসিংহে ইপিআর-এর সাথে যোগ দিয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করি এবং তাঁদের কম্যান্ডার নিযুক্ত হই। ইপিআর-এর এক কোম্পানী নিয়ে নরসিংদী হয়ে ঢাকার দিকে অগ্রসর হই যুদ্ধ করার জন্য। ৩১শে মার্চ নরসিংদী পৌঁছি। সুবেদার মেজর সুলতান তখন ঢাকা থেকে সামান্য কয়েকজন লোকসহ নরসিংদী পৌঁছে এবং ১লা এপ্রিল আমার সাথে যোগ দেয়। ঢাকার লোকজন যখন মার খেয়ে দিশাহারা হয়ে শহর ছেড়ে পালাইতেছিল, তখন সুলতান সাহেব আমার সাথে কয়েকজন ইপিয়ার-এর লোকজন এবং ছাত্র ও জনতার সাথে যোগ দিয়ে ঢাকার পার্শ্ববর্তী এলাকায় ঢাকা-নরসিংদী সড়কের বিভিন্ন এলাকায় সম্মুখ-সংঘর্ষে দুর্ধর্ষ শাস এবং শক্তিতে যুদ্ধ করেন। এরপর থেকে পুরো নয়টি মাস তিনি আমার সাথে সক্রিয়ভাবে যুদ্ধ করে যান। নয় মাসের তার এবং বাকী সহকর্মীদের ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। সব লিখতে গেলে অনেক দীর্ঘ এক ইতিহাস হবে। আজকের এই লেখায়, আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস লিখব না। শুধু বাংলাদেশ রাইফেলস-এর একটি বীরযোদ্ধার সামান্য একটু বলছি, তাতেই বুঝা যাবে বাংলাদেশ রাইফেলস-এর সংগঠন কত তীক্ষ্ম এবং জাগ্রত।

       ঢাকা-নরসিংদী সড়কে করইতলী, বাবুরহাট, পাঁচদোনা এবং অন্যান্য স্থানে সম্মুখ যুদ্ধের পর আমাদের নরসিংদী ত্যাগ করতে হয়।

       ১৩ই এপ্রিল সকালে আমরা আশুগঞ্জে পৌঁছানোর পর ২য় ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের এক কোম্পানীর ওখানে যাই। ব্রিগেডিয়ার নাসিম (তখন ক্যাপ্টেন) কোম্পানী কমান্ডার। তিনি আশুগঞ্জে প্রতিরক্ষা ব্যূহ রচনা করুন। আমার সাথে তখন ৪০/৫০ লোকে এবং শুধু ব্যক্তিগত অস্ত্রশস্ত্র আছে। তিনি আমাকে বললেন, আপনি ভৈরবের সামনে নরসিংদীর দিকে রামনগর রেলওয়ে ব্রীজের ওখানে যেয়ে প্রতিরক্ষা ব্যূহ রচনা করুন। পাকিস্তান আর্মির অগ্রগতিকে ওখানে রোধ করতে হবে। যতক্ষণ সম্ভব রুখতে হবে। অসম্ভব হয়ে পড়লে এখানে আসবেন, একসাথে মিলে যুদ্ধ করব।

       আমরা ১৩ই এপ্রিল বেলা ৯টার দিকে রামনগর পুলের নিক্ট পৌঁছি। এলাকায় পৌঁছে লোকজনকে স্থান নির্ধারিত করার পূর্বেই দেখতে পেলাম রেল লাইন ধরে পাকিস্তান আর্মি অগ্রসর হচ্ছে। বেলা ১০/১১টার দিকে তাদের সাথে আমাদের যুদ্ধ শুরু হয়। তারা সমস্ত দিন চেষ্টা করল, কিন্তু আর অগ্রসর হতে পারল না। পুরা রাত গোলাগুলি চলে। পরদিন সকাল ৬টা ৩০ মিনিটের সময় ৬টা পাকিস্তানী স্যাবর জেট প্রথমে একবার উপর দিয়ে ঘুরে গেল। ফেরত আসার পথে আমাদের এলাকাসহ আশুগঞ্জ ও ভৈরব বোমা দেলে এবং স্ট্রাফিং শুরু করে। আমার সামনে থেকে যে পদাতিক বাহিনী এসেছিল তারা আরও একটু এগিয়ে এসে আমাদের উপর গুলিগোলা শুরু করে ব্যাতিব্যস্ত রাখে। বাম দিকে মেঘনা নদীতে নৌবাহিনীর গানবোট থেকে নদীর পূর্বপার্শ্বে লালপুরে ব্রিগেডিয়ার আঃ মতিন (তখন ক্যাপ্টেন) ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ১ প্লাটুন নিয়ে অবস্থান করছিল। ওখানে আমাদের অবস্থানের উপর গোলাবর্ষণ শুরু হয়। তার সাথে ৬/৭টা হেলিকপ্টার দিয়ে সেনাবাহিনীর লোকজন আমাদের পিছনে ভৈরব, আশুগঞ্জের পিছনে এবং ডান পার্শ্বের বিভিন্ন এলাকায় নামানো আরম্ভ করে। আমরা সম্মুখসমরে ব্যস্থ। তার সাথে দেখছি কি সুন্দর শক্তির প্রদর্শন। জলে, স্থলে এবং আকাশ থেকে আমাদের উপর আক্রমণ। দেখছি লোকজন বিমান বাহিনীর এবং সেনাবাহিনীর আক্রমণে ঘর ছেড়ে জীবন নিয়ে দিকশূণ্য হয়ে পালাচ্ছে আর দাউ দাউ করে জ্বলছে বাড়ীঘর। আমরা সামান্য কিছু স্বাধীনতা সংগ্রামী চারদিক থেকে শত্রুদ্বারা বেষ্টিত।

       পাকিস্তান বিমান বাহিনীর আক্রমণ ১১টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত চলতে থাকে। সাথে অন্যান্য বাহিনীর আক্রমণও চলতেই থাকে। আমাদের সাথে যা গোলাবারুদ ছিল তা দুই দিনের অনবরত যুদ্ধে শেষ হয়ে গেছে। ১৪ই এপ্রিল বিকেল ৩টার সময় ভাবছি কোন মতে ভৈরব পার হয়ে আশুগঞ্জে যেয়ে ২য় ইস্ট বেঙ্গল-এর কোম্পানীর সাথে মিশতে পারব কিনা। নিজেদের অবস্থান ঘুরে দেখলাম। কারো নিকট ২/৪ রাউণ্ড গুলি আছে। কেউ বা খালি হাতে বসা। কারণ যা কাঁধে করে আগের দিন নিয়ে এসেছিলাম তাই সে সম্বল ছিল আর তো কেউ কিছুই দিয়ে যায়নি। বেলা ৩টা ৩০ মিনিটের সময় দেখতে পেলাম ইউনিফর্ম পরা একজন লোক পিছন থেকে আমার খুবই নিকটে চলে এসেছে। তাকে মারতে মানা করলাম। উদ্দেশ্য, তাকে আত্মসমর্পণ করাবো। সে আত্মসমর্পণ করার পর দেখতে পেলাম সে আমাদের ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন জওয়ান। আশুগঞ্জের পিছনে হেলিকপ্টারে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর লোক নামার পর এবং বিমান বাহিনীর আক্রমণে ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার পর কোম্পানী নিজেদের স্থান ছাড়তে বাধ্য হয়। সে রাস্তা না পেয়ে এই দিকে এসেছে। মনে করেছে এই দিক দিয়ে বিপদের আশঙ্কা কম। ভাবলাম ওদের সাথে মিলে যুদ্ধ করার কথা ছিল, তা আর হলো না। এখন আমারা শেষ মুহূর্ত গুনছি। চারদিক থেকে পাকিস্তানী বাহিনী জাল গুটিয়ে আনবে আর আমাদের জীবিত ধরবে।

       আরো যুদ্ধ চালিয়ে যাবার মত গুলিগোলা বলতে কিছুই নেই। লোক ক্ষুধায় কাতর। ১১ই এপ্রিল নরসিংদীর পতনের পূর্ব থেকে ১৪ই এপ্রিলের মধ্যে অনেকের বেলা সামান্য আহার জুটেছে। মানুষের জীবন তার অনুভূতির নিক্ট কত করূণ এবং কঠোর অনুভব হয় তখন হয়ত বুঝতে পেরেছি।  আমি কমান্ডার হিসেবে তাদেরকে গুলিগোলা দিতে পারছিনা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে। খানা দিতে পারছিনা ক্ষুধার জ্বলা মিটাতে। কেউ আমাদের সাহায্য করবে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে এ রকম আশ্বাসও দিতে পারছিনা। কারণ, তখনও জানিনা কোথাও থেকে কেউ সাহায্য করবে কিনা, কে কোথায় যুদ্ধ করছে বা লোকজন যুদ্ধ করছে কিনা তাও জানিনা।

       বিকেল ৩টা ৩০ মিনিটে আমি মনস্থির করেছি এইস্থান আমাদের ছাড়তে হবে। খালি হাতে এখানে বসে মরার কোন অর্থ নেই। সুবেদার মেজর সুলতান (তখন নায়েক সুবেদার)  সহ দু’জন আমার প্লাটুন কমান্ডার ছিলেন। আমি ব্রহ্মপুত্র নদের রামনগর ব্রীজের পার্শ্বে যেখানে আমার অবস্থান ছিল আসতে বললাম।  প্লাটুন কমান্ডার আসার পর জিজ্ঞেস করলাম কি অবস্থা। তারা বলল, স্যার আপনিতো ঘুরে দেখে এলেন।  জওয়ানরা প্রায় শূণ্য হাতে বসা।

       আমি বললাম, সুলতান সাহেব, মালেক সাহেব আমাদের এলাকা ছাড়তে হবে। খালি হাতে এখানে বসে মরার কোন অর্থ নেই। আমি কথাটা বলার সাথে সাথে দু’জনেই হাউমাউ করে শিশুর মত চিৎকার করে কেঁদে উঠল। বলল, স্যার কাপুরুষের মত পালিয়ে কোথায় যাব, দেশ কি স্বাধীন হবেনা? তাদের কান্নায় আমারও দুচোখে আশ্রু নেমে এলো। তাদের কানায় এবং আবেগে প্রায় ১৫/২০ সেকেন্ডের মত মনে হল আমি আমার চিন্তাশক্তি হারিয়ে ফেলেছি। মানুষের জীবনে অনেক স্মরণীয় মুহূর্ত থাকে। এই মুহূর্তটা আমার জীবনে কিভাবে মূল্যায়ন করব জানিনা। অনেক সময় মৃত্যু বাঞ্ছনীয় হয়ে দাঁড়ায় কিন্তু তখন জীবন মনে হয় রাবার ইলাস্টিকের মত দীর্ঘ হয়।

       একটু সুস্থির হয়ে বললাম, এখান থেকে চলে যাওয়ার অর্থ এই নয় আমরা আর যুদ্ধ করবনা। আজকে যদি এই হত আমাদের ৪০/৫০ জনকে গুলি করে মারলে তারা আমাদের স্বাধীনতা দিবে তাহলে আমি আপনাদের কমান্ডার হিসেবে কথা দিচ্ছি আমিই প্রথম মরতাম। যুদ্ধ আমাদের চালিয়ে যেতে হবে যতদিন বেঁচে থাকব, যতদিন দেশ স্বাধীন না হবে। এখান থেকে চলে যেয়ে আমরা গোলাগুলি সংগ্রহ করব, আবার যুদ্ধ করব। এখন এখানে খালি হাতে বসে থাকতে আস্তে আস্তে জাল গুটিয়ে আনবে এবং আমাদের জীবিত ধরবে আর গুলি করে মেরে ফেলবে। বুঝিয়ে বলার পর মেনে নিল। বলল, স্যার আপনি আমাদের কমান্ডার, আপনি যা ভাল বোঝেন তা আমরা নিশ্চয় মেনে চলব। তবে স্যার, আপনি ছেলেদের বুঝায়ে বলেন কারণ তারা মানসিকভাবে অতি জেদি হয়ে আছে। প্রত্যেকটা অবস্থানে যেয়ে জওয়ানদের বুঝিয়ে বলে ছোট ছোট গ্রুপে বিভিন্নভাবে অবস্থান ত্যাগ করতে বললাম। বলে দিলাম ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে যাও, শুনেছি ওখানে ২য় ইষ্ট বেঙ্গল এবং ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট আছে। ওখানে যেয়ে যোগ দাও। আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখলে আবার দেখা হবে। সুলতান সাহেব এবং মালেক সাহেবকেও তাদের লোকজনের পিছনে যাওয়ার হুকুম দিলাম। দু’জন আমার দু’কাঁধে মাথা রেখে শিশুর মত হাউ মাউ করে কাঁদল। একটা সৈনিজের এমনি এক পরিস্থিতির কান্না অনুভব করা যে কত হৃদয় বিদীর্ণকারী সে আমি বুঝেছি। যদিও এটা অতি ক্ষুদ্র ঘটনা, তবু আমার জীবের একটা বিশেষ ক্ষণ। দু’জন বলল, ‘স্যার আপনি যাবেন না?” বললাম, “আপনারা গেলে।”

ওরা চলে গেলে সমস্ত এলাকাটা ঘুরে দেখলাম এখনঈ কেউ বাকী আছে কিনা। সুলতান সাহেব যাওয়ার সময় বলে গেল, ‘স্যার আপনার জন্য অপেক্ষা করব।’

       সবাই চলে গেলে নিঃসঙ্গতা আর অবসাদ মনটাকে ছেয়ে ফেলল/ জীবনটা মনে হচ্ছিলো সত্যি খুব দীর্ঘায়িত হচ্ছে। এত গোলাগুলি হল, মরে গেলে তো রক্ষাই পেয়ে যেতাম। যাক আমি আমার কাহিনী লিখছি না, যাদের জন্য লিখছি ওখানেই ফিরে যাই। ১৪ই এপ্রিল রাতে যেয়ে কুলিয়ারচরে সুলতান সাহেব এবং তার সঙ্গী ১০/১৫ জন জওয়ানের সাথে দেখা। দেখে তাঁর কি আনন্দ। আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে হৈচৈ করে কিভাবে যে তিনি আনন্দ প্রকাশ করেছেন তা ঠিক বলতে পারব না।

       তারপর থেকে কোনদিন সুলতান সাহেব আমার থেকে আর বিচ্ছিন্ন হননি। প্রতিটি অপারেশনে তিনি আমার সাথে ছিলেন। সিলেটের নলুয়া চা বাগানে দিনের বেলায় আমরা যে এমবুশ করি তার উপর সুলতান বীরবিক্রমে পদক পান। আখাউড়া আক্রমণেও সাথে ছিলেন। তিনি বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন যুদ্ধে আমার সাথে ছিলেন।

———————————————————

<৯, ৪.৭, ২০৯-২১১>

সাটিয়াচড়ার (নাটিয়াপাড়া) যুদ্ধ

(সত্যেন সেন রচিত ‘প্রতিরোধ সংগ্রামে বাংলাদেশ’ আগষ্ট ১৯৭১, কলকাতা থেকে সংকলিত। জায়গাটির আসল নাম নাটিয়াপাড়া। ভুলক্রমে সাটিয়াচড়া নামে উল্লেখিত হয়েছে)

টাঙ্গাইল শহর তখনও মুক্ত অঞ্চল। পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্যদের বর্বর আক্রমনের বিরুদ্ধে পূর্ববঙ্গের জেলায় জেলায়, শহরে ও গ্রামাঞ্চলে প্রতিরোধ সংগ্রাম শুরু হয়ে গিয়েছে। ভারতীয় বেতার মারফত রক্ত পিপাসু পাক-সৈন্যদের হিংস্র আক্রমন আর বাংলাদেশের সংগ্রামী মানুষদের গৌরবময় প্রতিরোধের কাহিনী প্রচারিত হয়ে চলেছে।

হামলাকারীদের দল তখনও টাঙ্গাইল জেলায় এসে পৌছাতে পারেনি। টাঙ্গাইল শহরে মুক্তির উৎসব চলছে। রাজপথের দুধারে প্রতিটি ভবনে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে। “জয় বাংলা” সংগীতে সারা শহর মুখরিত। কিন্ত সমস্ত আনন্দ উৎসবের পিছনে আসন্ন বিপদের কালো ছায়া। শহরের মানুষ হাসতে গিয়েও প্রাণখোলা হাসি হাসতে পারে না। আকাশবাণী নিত্য নতুন দুঃসংবাদ বহন করে নিয়ে আসছে, মুক্ত শহরগুলি একের পর এক পাক-সৈন্যদর অধিকারে চলে যাচ্ছে। তারপর সেই হিংস্র জল্লাদের দল সেই সমস্ত শহরের অধিবাসীদের নির্মমভাবে হত্যা করে চলেছে। এখনো তারা ময়মনসিংহ এবং টাঙ্গাইল জেলা থেকে দূরে আছে। কিন্ত কতদিন তারা এভাবে থাকতে পারবে। দুদিন আগেই হোক আর পরেই হোক ওরা এখানে এসে হামল করবেই। সেদিন? সেদিন টাঙ্গাইলের মানুষ কেমন করে ওদের প্রতিরোধ করবে? কেমন করে নিজেদের স্বাধীনতা রক্ষা করবে?

আজ সারা বাংলাদেশের মানুষের মন স্বাধীনতার মন্ত্রে উদ্দীপ্তদ্ধ সারা প্রদেশের মানুষ কখনও এভাবে একতাবদ্ধ হয়ে ওঠেনি। টাঙ্গাইলের মানুষ-অতি সাধারণ মানুষও তাদের বাইরে নয়, তারাও তাদের সঙ্গে একতালে পা মিলিয়ে চলবার জন্য উন্মুক্ত। কিন্তু সেই সংগ্রামের প্রস্তুতি কোথায়? কোথায় অস্ত্র, কোথায় চালনার শিক্ষা ব্যবস্থা ? কামান বন্দুকের বিরুদ্ধে তো আরা লাঠি-সোঁটা বা বর্শা বল্লম নিয়ে যুদ্ধ করা যায় না। প্রতিরোধের দায়িত্ব সামনে আসতেই এই প্রশ্নটা সবাইকে ভাবিয়ে তুলছে।

তবু তাদের যেটুকু সম্বল তাই নিয়ে তারা প্রতিরোধের জন্য তৈরী হচ্ছে। তাদের সামনের সারিতে আছে কিছু সংখ্যক ইপিআর বাহিনীর যোদ্ধা। স্থানীয় ছাত্র ও যুবকেরা তাদের কাছ থেকে রাইফেল চালানোর ট্রেনিং নিচ্ছে। অস্ত্রশস্ত্র বলতে ইপিআর বাহিনীর সৈন্যদের হাতে কিছু রাইফেল আছে। আর আছে গুটি কয়েক পুরানো ধরনের মেশিনগান। এই নিয়েই তারা আধুনিক মরণাস্ত্রে সুসজ্জিত, সুশিক্ষিত পাক-সৈন্যদের সাথে লড়াই করবে। এই দুই অসম শক্তি-সংঘর্ষের পরিণতি কি হতে পারে, সেটা কি তারা অনুমান করতে পারে না? পারে বই কি। কিন্তু তার পরিণতি যাই হোক না কেন, প্রতিরোধ তারা তাদের মাতৃভূমিকে শত্রুর হাতে তুলে দিতে পারবে না। সারা বাংলাদেশ জুড়ে যে প্রতিরোধের সংগ্রাম চলছে তারাও সঙ্গে সামিল থাকবে।

অবশেষে সেই আশঙ্কা একদিন সত্যসত্যই প্রত্যক্ষ সত্য হয়ে দেখা দিল। নিছক জনরব নয়, প্রত্যক্ষদর্শীদের মুখে শোনা গেল পাক সৈন্যদের ট্রাকের পর ট্রাক বোঝাই করে টাঙ্গাইলের দিকে এগিয়ে আসছে। ঢাকা টাঙ্গাইল সড়কের দু’ধারে গ্রামগুলি তাদের হামলার ফলে বিপন্ন ও ব্যতিব্যস্ত। পাকসৈন্যরা এই সমস্ত গ্রামের নিরীহ অধিবাসীদের ঘরে ঘরে গিয়ে হানা দিচ্ছে, তাদের গরু বাছুর কেড়ে নিয়ে এসে নিজেদের ভোজের উৎসব চালাচ্ছে। খাদ্যশস্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র লুটপাট করে নিয়ে আসছে। ঘরের মেয়েরাও তাদের লুণ্ঠনরত হাত থেকে অব্যহতি পাচ্ছে না।

গ্রামের মানুষ প্রাণের ভয়ে আর মান-ইজ্জতের ভয়ে যে যেদিকে পারে পালাচ্ছে।

এইভাবে মানুষ নামধারী, এই হিংস্র পশুগুলি বিভীষিকা ছড়াতে চলে আসছে। ওরা ওদের রক্তাক্ত থাবা উদ্যত করে ছুটে আসছে টাঙ্গাইলের দিকে। টাঙ্গাইলের মানুষ হুঁশিয়ার। দেশপ্রেমিক সন্তানগন, শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধের জন্য তৈরী হও-সংগ্রাম পরিষদের প্রচার-ভ্যান ঘুরে ঘুরে মাইকযোগে উদ্দীপনাময়ী বাণী ছড়াতে লাগলো। আক্রমণকারী পাক-সৈন্যবাহিনী প্রথম বাধা পেল সাটিয়াচড়া গ্রামে।

ইপিআর বাহিনীর সৈন্যরা পাঁচটি ট্রেঞ্চ কেটে তার মধ্যে আশ্রয় নিয়েছিল। পথের দু’ধারে ঝোপঝাড়ের আড়ালে রাইফেলধারী ছাত্র ও যুবকেরা পজিশন নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। পাকসৈন্যরা এর আভাসটুকু পায়নি। তারা নিশ্চিন্ত মনে এগিয়ে আসছিল। এখানে যে কোন ভয়ের কারণ আছে তা তারা ভাবতেও পারেনি। হঠাৎ তাদের চমকে দিয়ে কতগুলি মেশিনগান ও রাইফেল গর্জে উঠল। বৃষ্টির মতো ঝাঁকে ঝাঁকে গুলির ঘায়ে অপ্রস্তুত পাক-সৈন্যরা ধরাশায়ী হয়ে পড়তে লাগল। নির্জন ও শান্ত পল্লীপথ এক মূহূর্তে রক্তাক্ত রণক্ষেত্রে পরিণত হয়ে গেল।

প্রতিরোধকারী দেশভক্তরা বিপুলসংখ্যক শত্রু সৈন্যর বিরুদ্ধে একটানা লড়াই করে চলেছে। বেশ কিছুকাল এই লড়াই চলেছিল।

হামলাকারী পাক-সৈন্যরা মুক্তিযোদ্ধদের কাছ থেকে কঠিন প্রতিরোধ পেয়ে একটু পেছনে হটে গেল। ইতিমধ্যেই তাদের শক্তি বৃদ্ধি করার পেছনে থেকে আরও অনেক সৈন্য এসে পৌঁছে গেছে। এবার কামান-মর্টারের সজ্জিত ছাব্বিশটি ট্রাক-বোঝাই সৈন্য সামনে এগিয়ে এল। মুক্তিযোদ্ধাদের দিকে লক্ষ্য করে তারা অবিরল ধারায় গোলাবর্ষণ করে চলল। তারা ভাবতেও পারেনি যে, মাত্র তেইশ জন ইপিআর এর যোদ্ধা ট্রেঞ্চের ভিতর থেকে তাদেরকে প্রতিরোধ করে চলেছে। তাদের সম্বল ছিল মাত্র দুটো হালকা মেশিনগান, আর কিছু রাইফেল। তাই দিয়েই তারা কামান মর্টারের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচিছলো।

জীবন পণ করে তারা শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করেছিল। কিন্তু এই প্রবল গুলিবর্ষনের মুখে এরা তাদের কতক্ষণ ঠেকিয়ে রাখবে। প্রতিরোধ যখন চুরমার হয়ে ভেঙ্গে গেল, তখন ট্রেঞ্চের এই তেইশজন যোদ্ধার মধ্যে একুশজন নিহত হয়েছে। কোথায় ছিল এদের বাড়ীঘর কে জানে। কোথায় ছিল এদের বাপ-মা, ভাই-বোন, স্ত্রী আর ছেলেমেয়েরা! এরা কোথায় কিভাবে প্রাণ দিল, সেই বীরত্বপূর্ণ কাহিনী কোন দিন এদের কাছে পৌঁছাবে কিনা, তাই বা কে জানে!

লড়াই থেমে গেছে। এদের কামানগুলি কিন্তু তখনও গোলাবর্ষণ করেই চলেছে। এবার এদের আক্রমনের লক্ষ্য সাটিয়াচড়া, গোড়াই আর তার আশেপাশের গ্রামগুলি। তাদের রকেটের আগুনে সেইসব গ্রামের ঘরবাড়ি পুরে ছাই হতে লাগলো। এরপর গোলাবর্ষণ থামিয়ে ওরা ঘরে ঘরে চড়াও হয়ে হত্যালীলা চালিয়ে যেতে লাগল। সামনে যাদের পেল তাদের কাউকে রেহাই দিল না। তাদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য গ্রামের লোকেরা যে যেদিকে পারল প্রাণ নিয়ে ছুটে পালাল।

সাটিয়াচড় গ্রামটি আমার কাছে অপরিচিত নয়। এই গ্রামেই আমার সহকর্মী ও বন্ধু বাকী সাহেবের (কৃষক নেতা খন্দকার আবদুল বাকী) বাড়ী। এই সাটিয়াচড়ে যাঁরা সেদিন পাকসৈন্যদের আক্রমনের বিরুদ্ধে এই প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল বাকী সাহেব তাদের অন্যতম। হামলাকারীরা বাকী সাহেবের বাড়িতে ঢুকে তাঁর আশি বছর বয়সের বৃদ্ধ পিতাকে বন্দুকের কুঁদা দিয়ে এমন আঘাত করল যে, তিনি জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন।

বাড়িতে আর যারা ছিল, এরা তাদের সবাইকে হত্যা করল।

————————————————–

সশস্ত্র প্রতিরোধঃ ময়মনসিংহ

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৫। ময়মনসিংহ ও অন্যান্য এলাকার সশস্ত্র প্রতিরোধের বিবরণ বাংলা একাডেমীর দলিলপত্র ১৯৭১

<৯, ৫.১, ২১২-২১৬>

ময়মনসিংহ শহর ও অন্যান্য স্থানের প্রতিরোধ

সাক্ষাৎকারঃ সুবেদার এ,কে এম ফরিদউদ্দিন
১০-১-১৯৭৫

বিগত ১৯৭১ সালের প্রথম দিকে আমি আমার ইপিআর-এর ‘সি’ কোম্পানীসহ ২নং উইং হেডকোয়ার্টার ময়মনসিংহ ছিলাম।

২৫শে মার্চ তারিখে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ঢাকা ত্যাগ, টিক্কা খানের রেডিও ভাষন ও আদেশ এবং পাক সামরিক বাহিনীর পিলখানা, রাজারবাগ আক্রমনের খবর ময়মনসিংহে পৌছাঁর সাথে সাথে ময়মনসিংহের ইপিআর-এর বাঙালি যুবকরা তাদের ভবিষ্যৎ বুঝতে পারে। অন্য দিকে তৎকালীন ২নং ইপিআর উইং এর- কমান্ডার ক্যাপ্টেন কমর আব্বাসের জোয়ানদিগকে আরাম করার আদেশ হইতে পরিস্থিতি আরো পরিস্কার হইয়া উঠে যে বাঙালিদের ভাগ্যাকাশে ঘনঘটার ছায়া জুড়িয়া বসিয়াছে।

২৭-৩-৭১ তারিখে সকাল বেলা ক্যাপ্টেন কমর আব্বাস আমাকে অফিসে ডাকাইয়া আদেশ দেন যে, আপনারা প্রায় এক মাস যাবৎ ষ্ট্যাণ্ডবাই ডিউটি করিতেছেন, এখন ষ্ট্যাণ্ডডাউন করিয়া আরাম করেন। তাহাতে আমি তার সাথে একমত না হওয়ায় দুজনের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। ঐ সময় একটি জীপে করিয়া বেশ কিছু এম্যুনিশন ক্যাপ্টেন সাহেবের বাসায় নিয়া যাওয়ার সময় আমার মনে সন্দেহ আরো ঘনিভূত হয় যে, আমাদের উপর হামলা হইবে। তারপর আমি উইং হেডকোর্য়াটারের কয়েকজন বাঙালি এনসিও, যথা হাবিলদার আরিফ, হাবিলদার সিরাজ, হাবিলদার আহাম্মদ মিয়া এবং হাবিলদার আঃ হাকিমকে নিয়া একটি গোপন বৈঠক করিয়া সিদ্ধান্ত নিই যে, হাতিয়ার দেব না। এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে কোত হইতে হাতিয়ার এ্যামুনিশন আরও যাহা ছিল বাহির করিয়া জোয়ানদের মধ্যে বিতরণ করিয়া দেই এবং যে কোন পরিস্থিতির মোকাবেলার জন্য হুকুম দিই। সমস্ত বাঙালি জোয়ানরা নতুন করিয়া শপথ নিয়া মরণ পর্যন্ত হাতিয়ার দিবে না বলিয়া আমাকে আশ্বাস দেয়।

সারা দিন দুই পক্ষের লোকদের মধ্যে একটা অর্বণনীয় পরিস্থিতি বিরাজ করে। ইতিমধ্যে অবাঙালি ফোর্স, যাহাদের মধ্যে ইপিআর, এয়ার ফোর্স, জিডি ট্রুপস, আর্মি সিগন্যাল, মুজাহিদ ইন্সট্রাক্টর এবং আর্মি সিকিউরিটি মিলিয়া প্রায় ১৩৮ জন ছিল। তাহারা একটি গোপন বৈঠক করে। ইহার খবর পাইয়া বিকাল অনুমান ৪টার দিকে আমি দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্ট ‘সি’ কোম্পানী, যাহা খাগডহর ইপিআর ক্যাম্পে ছিল, তাহার কমান্ডার তৎকালীন মেজর নূরুল ইসলাম সাহেবের সঙ্গে পরিস্থিতি সম্বন্ধে আলোচনা করি। সমস্ত গোপনীয় সংবাদ, যাহা আমার জানা ছিল, তাহাকে অবগত করাই এবং আগে আমাদের এ্যকশনের জন্য পরামর্শ করি এবং তাহার সহযোগিতা কামনা করি। তারপর অনুমান সাড়ে ছয়টায় সময় ক্যাপ্টেন কমর আব্বাসকে সাথে নিয়া আসিয়া আমার বাঙালিদিগকে ফল-ইন করিতে হুকুম দেন, কিন্ত আমি অল্প কিছু লোক যাহারা সামনে ছিল তাহাদেরকে একত্র করিয়া মেজর সাহেবকে আলাপ করিতে দেই। মেজর সাহেব বলেন যে একটি কোম্পানী বা একটি উইং কি করিয়া পাক আর্মির বিরুদ্ধে সন্দেহ প্রকাশ করিতে পারে বাচাঁর জন্য তৈরী হইতে পারে? যাহোক, মেজর সাহেব আমাদেরকে অভয় দেন যে, কোন বিপদ হবে না, ভুল চিন্তা করিবেন না। কিন্তু ঐ সময় আমি দেখিতে পাই যে, অবাঙালির ২০/২৫ জন মুজাহিদ কোতে ঢুকিয়া ডিউটি শুরু করিয়াছে। অন্যদিকে. তাহাদের কিছু জেসিও মেসে, কিছু অফিসের ভিতরে, কিছু ক্যাপ্টেন সাহেবের বাসায় এবং অন্যদিকে ২৫/৩০ জনের একটি গ্রুপ পেট্রোল ডিউটি আরম্ভ করিয়াছে। তখন কয়েকজন বাঙালি জোয়ান দৌড়াইয়া আমার নিকট আসিয়া বলে যে, আমরা কি করিব। অবস্থা খুবই খারাপ দেখিয়া আমি ওদেরকে নিজের জায়গায় থাকিতে আদেশ দেই এবং যে কোন মূল্যে কোয়াটার গার্ড নিজেদের আয়ত্বে রাখিতে আদেশ দেই।

অন্যদিকে বেঙ্গল রেজিমেন্টের কোম্পানী যাহা পুকুর পারে ছিল তাহাদের মধ্যে নায়েক সুবেদার বড়–য়া এবং নায়েক সুবেদার মোশাররফ হোসেনকে (দুই জনই বাঙালি) ডাকাইয়া অবস্থা তাহাদেরকে জানাই এবং তাহাদের মনোভাব সর্তকতার সহিত অনুভব করি, যেহেতু তাহারাও আর্মি। এইভাবে রাত্রি সাড়ে নয়টার সময় আমি পরিস্কার বুঝিতে পারি যে, আমাদের উপর হামলা হইবে।  তাই আমি পরিস্থিতি সম্বন্ধে মেজর নুরুল ইসলামকে ডাক বাংলোয় খবর পাঠাই। কিন্তু কোন উত্তর পাওয়ার আগেই রাত্রি প্রায় সাড়ে এগারোটার সময় অবাঙালিদের তরফ হইতে প্রথম ফায়ার আসে যাহাতে বাঙালি একজন জোয়ান আহত হয়। অমনি দুইদিকে হইতে তুম ুলভাবে আগ্নেয়াস্ত্রের গর্জন শুরু হয়। এই যুদ্ধ ২৭ তারিখ রাত্রি সাড়ে এগারোটা হইতে পরদিন বিকাল সাড়ে পাঁচ ঘটিকা পর্যন্ত ছিল। ইপিআর হেডকোয়ার্টারের দুই দিকের আগ্নেয়াস্ত্রের গর্জনে সারা ময়মনসিংহ কাপিয়াঁ উঠে। এই দীর্ঘ আঠারো ঘন্টার যুদ্ধে  বাঙালিরা সংখ্যায় ছিল প্রায় ২২০ জন আর অবাঙালিরা ছিল ১৩৮ জন। সারারাত যুদ্ধ চলে। সকালের দিকে শহর ও গ্রাম হইতে প্রায় ১০/১৫ হাজার বাঙালি সিভিল লোক বাঙালিদের খাবার, পানীয় ও অন্যান্য যথাসম্ভব সাহায্য করে। অবাঙালিদের মধ্য হইতে ১২১ জন মারা যায় এবং বাকী সতর জন আমার নিকট আত্মসমর্পণ করিতে বাধ্য হয়। যাহারা আত্মসমর্পণ করিয়াছিল তাহাদের মধ্যে সুবেদার মেজর জিন্নত খাঁ, নায়েক সুবেদার বোস্তান খাঁ, নায়েক সুবেদার খান বাহাদুর, হাবিলদার গোলাম হায়দার, হাবিলদার নাজির বাদশাহ প্রমুখ ছিল। যাহারা মারা যায় তাহাদের মধ্যে ক্যাপ্টেন কমর আব্বাস, একজন এয়ারফোর্সের অফিসারও ছিল। বাঙালিদের মধ্যে সিপাই দেলওয়ার, সিপাই রাজ্জাকসহ কয়েকজন আহত হন। দেলওয়ার পরে মেডিকেল কলেজে মারা যায়।

প্রকাশ থাকে যে, আমি সকাল সাড়ে আটটার দিকে উক্ত উইং- এর অধীনে বর্ডারে থাকা কোম্পানীগুলিকে একটি অয়ারলেস মেসেজ দ্বারা হেডকোয়ার্টারের পরিস্থিতি জানাই ।

(১) কোম্পানীগুলি ছিল সুবেদার হাকিম সাহেবের সাথে নকশী,

(২) সুবেদার জিয়াউল হক সাহেবের সাথে কইতরী এবং

(৩) সুবেদার আজিজুল হকের সাথে লেঙ্গুরায়।

আমি মেসেজে তাহাদেরকেও জরুরী ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবার অনুরোধ জানাই, যাহা তাহারা করেন।

এই যুদ্ধের পর আমি মোজাহিদ অস্ত্রাগার দখল করি এবং কোতে থাকা ১৪৭২টা রাইফেল, ২৮টি এলএমজি, বেশ কিছু ষ্টেনগান, এক লক্ষ পয়ত্রিশ হাজার ৩০৩ গুলি, প্রায় ছত্রিশ হাজার ৯ এমএম গুলি এবং আরো যুদ্ধসরঞ্জাম দখল করি, যাহা পরে তৎকালীন মেজর বর্তমানে মেজর জেনারেল কে,এম,শফিউল্লাহ সাহেবকে দেই।

এখানে উল্লেখ্য যে, বেঙ্গল রেজিমেন্টের সি-কোম্পানীর সাহায্যে আমি চাহিলে সিনিয়র জেসিও বড়ুয়া বলেন যে মেজর সাহেবের বিনা হুকুমে সে আমাকে সাহায্য করিতে পারিবে না। তারপর নায়েক সুবেদার মোশাররফ হোসেন সকাল প্রায় নয়টার দিকে কিছু লোক নিয়া আমার সাথে যোগ দেয়, কিন্তু ঘন্টাখানেক পর আবার বিরত হইয়া যায়। অন্যদিকে মেজর নুরুল ইসলাম, তার সঙ্গী লেফটেন্যান্ট মান্নান সাহেবের কোন খোঁজ পাওয়া যায় নাই। সন্ধ্যা প্রায় সাড়ে ছয়টার দিকে যখন আমি উইং-এর লোকেশন বদলী করার জন্য পুলিশ লাইনের ভিতর দিয়া যাইতেছিলাম তখন আমার ৪/৫ জন লোক মেজর সাহেবকে আমার সঙ্গে ঐ জায়গায় দেখা করাইলে জানিতে পারি যে মেজর সাহেব ব্রাক্ষপুত্র নদের ওপারে চলিয়া গিয়াছিলেন। আমি মেজর সাহেবকে ঘটনা পুরোপুরি বলিলে তিনি আমাকে বলেন যে, তাহার ব্যাটালিয়ান হেডকোয়ার্টার জয়দেবপুরে অয়ারলেসে আলাপ করার পর আবার আমার সঙ্গে দেখা করিবেন।

রাত্রেই আমি পুলিশ, সিভিল ও আওয়ামী লীগের লোকজনের সাহায্যে আমার উইং-এর লোকেশন বদলী করিয়া রাবেয়া হাইস্কুলে নিয়া যাই, কারণ আমি অনুমান করি যে পরের দিন পাক বাহিনী খবর পাইলে হয়তো কোন এয়ার এ্যাকশন নিতে পারে। সিভিল লোকদের মধ্যে যাহারা অগ্রভাগে কাজ করিয়া আমাকে সাহায্য করেন তাহাদের মধ্যে ছিলেন তৎকালীন এম-এন-এ (বর্তমান আওয়ামী লীগের ভাইস প্রেসিডেন্ট) জনাব রফিক উদ্দিন ভূইয়াঁ, বর্তমানে লণ্ডনে এ্যাম্বাসেডর জনাব সৈয়দ সুলতান সাহেব, বর্তমান এমপি হাতেম আলী তালুকদার সাহেব প্রমুখ।

পরের দিন ২৯-৩-৭১ তারিখে সকাল বেলা আমি রাবেয়া হাইস্কুলে ইপিআর-এর লোকসহ বাংলাদেশের পতাকাকে গার্ড অব অর্নারের সাথে সালাম দিয়া পতাকা ছুঁইয়া নতুন করিয়া শপথ নিই যে আমরা আমরণ যুদ্ধ করিব। উল্লেখ্য যে পতাকা তুলিয়াছিল হাবিলদার নিয়াজ। কারণ এখন আর গত্যন্তর নাই। অনুমান বেলা এগারোটার দিকে যখন আমি খাগডহর-এর দিকে যাচ্ছিলাম নতুন বাজারের মোড়ে একজন সাদা পোষাকে আমাকে পরিচয় দেয় যে তিনি বেলুচ রেজিমেন্টের একজন বাঙালি ক্যাপ্টেন এবং আমার সঙ্গে যোগ দিতে চান। কিন্তু আমি তাকে বিশ্বাস করতে না পারায় পরে দেখা করতে বলি, কারণ আমি খুব ব্যস্ত ছিলাম। একটু পড়েই মেজর নুরুল ইসলাম সাহেবের সঙ্গে আমার দেখা হয়। তিনি বলেন যে দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্ট ময়মনসিংহের ইপিআর-এর যুদ্ধের কথা শুনিয়াছি। তাহারা বৈকালিক দিকে ময়মনসিংহে পৌঁছাইতেছে যাহাতে কয়েকজন বাঙালি অফিসার রহিয়াছেন।

সন্ধ্যার পর ২য় বেঙ্গল রেজিমেন্ট ময়মনসিংহের রাজবাড়ীতে একত্রিত হয়। এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগ লিডারসহ একটি গোপন বৈঠক করিয়া ময়মনসিংহের প্রতিরক্ষা এবং ঢাকা আক্রমন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই বৈঠকের সিদ্ধান্ত মোতাবেক আমি নকশী কোম্পানীকে জামালপুরের দায়িত্বে, করাইতলা কোম্পানীকে সদর পশ্চিম দিকের দায়িত্বে এবং লেংগুরা কোম্পানীকে সদর দক্ষিন দিকের দিয়া আমার হেডকোয়ার্টার কোম্পানী ও উইং হেডকোয়ার্টারসহ নরসিংদী হইয়া ঢাকার পূর্বদিক দিয়া আক্রমন চালাইবার সিদ্ধান্ত নিই।

৩০-৩-৭১ তারিখে মেজর শফিউল্লাহ সকাল ৮ ঘটিকার সময় আমার ইপিআর ফোর্সের সাথে রাবেয়া হাইস্কুলে আলাপ করেন এবং তাহাদের ঢাকার দিকে রওনা হওয়ার জন্য বলেন। ঐ দিন ঐ সময় আমি আমার নিকট ক্যাপচার করা ১৪৭০ টি রাইফেল, ২৮টি এলএমজি, বহু ষ্টেনগান, এক লক্ষ পয়ঁত্রিশ হাজার ৩০৩ গুলি, ছত্রিশ হাজার  ৯এমএম গুলি ইত্যাদি তাহার নিকট হস্তান্তর করি। অন্যদিকে, বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি কোম্পানীর তৎকালীন ক্যাপ্টেন (বর্তমানে লেঃ কর্ণেল) নাসিম সাহেবের নের্তৃত্বে ট্রেনে ভৈরব হইয়া ঢাকার পথে রওনা দিই। বেলা সাড়ে বারোটার সময় এই স্পেসাল ট্রেন ময়মনসিংহ ষ্টেশন ত্যাগ করে। ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান আমাদের দলে যোগ দেন। রাত্রি প্রায় এগারোটার দিকে ভৈরব পৌছালে ক্যাপ্টেন নাসিম সাহেব তার কোম্পানীসহ ভৈরব ষ্টেশনে নামিয়া যাইতে থাকিলে আমি তাকে বলি যে, ঢাকায় যাইবেন না? তিনি উত্তরে বলেন যে, সকালবেলা একটা কোম্পানী আপনি নরসিংদীতে পাবেন। আপনি গিয়া আগের দিকে ব্যবস্থা করেন।

আমরা সকালের দিকে নরসিংদীতে পৌঁছাইয়া সড়ক পথে ঢাকার দিকে রওনা হই। কিন্তু ডেমরা ঘাট পাক ফোর্সের দখলে জানিতে পারিয়া পাঁচ দোনা বাজার হইতে আমরা ঢাকা শহরের প্রায় ১২ মাইল দূরে ভাঙ্গা নামক স্থানে জঙ্গলে শীতালক্ষ্যা নদীর পূর্বতীরে সন্ধ্যার পর অবস্থান নিই। এই ৩১-৩-৭১ তারিখের। এখানে আলীজান জুট মিলের ম্যানেজার জনাব মিজানুর রহমান সাহেবের নিকট হইতে আমরা খুব সাহায্য পাই।

এদিকে বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি কোম্পানী ক্যাপ্টেন সাইগলের নের্তৃত্বে আমাদের সঙ্গে নরসিংদীতে ৩১-৩-৭১ তারিখে বেলা প্রায় দুইটার দিকে যোগ দেয়। ডেমরার পাক ফোর্স যাহাতে আমাদের ক্ষতি না করিতে তার দায়িত্ব বেঙ্গল রেজিমেন্ট কোম্পানীকে দেওয়া হয়। এবং সিদ্ধান্ত হয় যে, তাহারা ঢাকা-নরসিংদী পাকা রাস্তায় ফোর্সের যে কোন অগ্রাভিযান প্রতিরোধ করিবে। আমরা ঢাকার পূর্বদিকে আক্রমন করিব। সেইভাবে ১-৪-৭১ তারিখে রাত্রিতে আমি ক্যাপ্টেন মতিউর রহমানসহ ৩“ মর্টার দ্বারা ঢাকায় ক্যান্টনমেন্ট এরিয়াতে ইপিআর-এর ৬০ জন লোক মিলিয়া আক্রমন করি যাহাতে পাক ফোর্সের গাড়ী ও অন্যান্য যুদ্ধসরঞ্জাম ধ্বংস করি। এই যুদ্ধ চালাইতে আমাদের সাহায্য করেন আওয়ামী লীগ নেতা জনাব লাল মিয়া সাহেব। তাহারই পরিপ্রেক্ষিতে পাক ফোর্স তাহাদের ক্ষতিপূরণ করিবার জন্য ৩-৪-৭১ তারিখে রেডিওতে হুকুম জারি করে ঢাকার সমস্ত বাস ও ট্রাক রমনা মাঠে ড্রাইভারসহ রির্পোট করিতে। এর আগে আকাশবানী কলিকাতা হইতে এ খবর প্রচার হইয়াছিল যে, একটি বিরাট মুক্তি বাহিনী দল নরসিংদী হইয়া ঢাকার দিকে অগ্রসর হইতেছে। আমরা ভাঙ্গা হইতে পরপর দুইদিন ও রাত্রিতে আক্রমণাত্মক এ্যাকশন চালাইলে পাক ফোর্স তাহার ডেমরা ঘাটির শক্তি বৃদ্ধি করিতে থাকে বলিয়া সংবাদ পাই। আরো জানিতে পারি যে, আমাদের বেইসের উপর আক্রমন করিবে। কিন্তু আমাদের ২২ জন লোকের একটি দল গেরিলা পদ্ধতিতে ঢাকার তৎকালীন পাক মোটর বর্তমানে বাংলা মোটরে ৪-৪-৭১ তারিখের রাত্রিতে এবং ঢাকা ডেমরা রোডে ৫-৪-৭১ এ রাত্রিতে দুই জায়গায় সরকারী গাড়ীসহ বেশ কিছু পাক ফোর্সকে মারে। এই দুইটা সফল অপারেশনে অংশগ্রহণ করিয়াছিল হাবিলদার হাকিম, সিপাই নান্নু মিয়া, সিপাই আফতাব, সিপাই ক্লার্ক মান্নান।

৩-৪-৭১ তারিখে বেলা অনুমান ১১/১২ টার সময় আমি একজন সিপাই এর মারফত সংবাদ পাই যে, ঢাকায় বহু ইপিআর মারা পড়িয়াছে। এবং প্রায় ১০০ লোক ঢাকার জিঞ্জিরায় সুবেদার গনি সাহেবের সাথে আছে। আমি একজন লোক মারফত চিঠি দিয়া গনি সাহেবকে আমার সহিত যোগদানের অনুরোধ জানাই। ৬-৪-৭১ তারিখে আমি নায়েক সুবেদার সুলতানের মাধ্যমে জানিতে পারি যে, সুবেদার গনি সাহেব নরসিংদীতে লোক নিয়া পৌঁছলে ঐ জায়গায় বিমান আক্রমন হয়। এবং তাহারা আবার ছত্রভঙ্গ হইয়া গিয়াছে। এবং অন্যদিকে বেঙ্গল রেজিমেন্টের কোম্পানী নয়া ক্যাপ্টেন সাইগল ঢাকা-নরসিংদী রাস্তার প্রতিরোধ ব্যবস্থা ছাড়িয়া দিয়া নরসিংদী পার হইয়া পূর্ব দিকে চলিয়া গিয়াছে। এই সংবাদ শুনিয়া আমার লোকজনের মনোবল কমিয়া যায়। আমার ২০/২২ জন লোক তখনও ভাঙ্গা বেইস হইতে ঢাকায় অপারেশনে ছিল। অন্যদিকে ২-৪-৭১ তারিখে আমি নায়েক সুবেদার সিরাজের নের্তৃত্বে ৪০ জনের একটি প্লাটুন ঘোড়াশাল রেল ষ্টেশন এরিয়া প্রতিরক্ষার জন্য পাঠাই। ৬-৪-৭১ তারিখে বেঙ্গল রেজিমেন্ট চলিয়া যাওয়ার সংবাদ পাইয়া আমি তাহাদেরকে আমার সঙ্গে পাঁচদোনায় ফেরত ডাকিয়া পাঠাইয়া নিজে ভাঙ্গার লোকজনসহ পাঁচদোনার শীলমন্দির নামক গ্রামে প্রতিরোধ ব্যবস্থা করি, অর্থাৎ ডিফেন্স লাগাই। অন্যদিকে খবর পাই যে, পাক ফোর্স ডেমরায় জমা হইয়া আমাদের উপর আক্রমন করার জন্য প্রস্তুতি নিতেছে।

৭-৪-৭১ তারিখে রাত্রে জানিতে পারি যে, পাক ফোর্স সকাল বেলা আমাদের উপর হামলা করিবে। তাই পাঁচদোনার আগে ১২-১৪জন লোক দিয়া একটি এ্যামবুশ পার্টি লাগাই যাহাতে সিপাই নান্নু, মান্নান, হাকিম ছিল। ঠিক ৮-৪-৭১ তারিখ সকাল আনুমানিক সাড়ে ছয়টায় পাক ফোর্স অগ্রসর হইতে থাকিলে এ্যামবুশ পার্টি একযোগে ৪টি এলএমজি দ্বারা আক্রমন চালায় যাহাতে পাক ফোর্সের প্রায় ১৫৫ জনের মতো লোক হতাহত হয় এবং কয়েকটি গাড়ীও নষ্ট হয়। পাক ফোর্স ঐদিন আর অগ্রসর হয় নাই।

৯-৪-৭১ তারিখ অনুমান নয়টার সময় পাক ফোর্স এয়ার ও আর্টিলারী সমর্থনপুষ্ট হইয়া আমাদের উপর হামলা চালায়। অনুমান এক হইতে সোয়া ঘন্টা যুদ্ধের পর পাক ফোর্স যাহাতে ৩১ বেলুচ রেজিমেন্ট ছিল-আক্রমন ছাড়িয়া দিয়া পাঁচদোনা হইতে পিছে চলিয়া যায়। যুদ্ধ কিছুটা স্মিতিম হইয়া পড়ে কিন্তু আর্টিলারী ফায়ার চলিতে থাকে। আমাদের তরফ হইতে চলিতে থাকে তিন ইঞ্চি মর্টার। বেলা আনুমানিক ৫ ঘটিকার সময় পাক ফোর্স আবার আমাদের উপর এয়ার ও আর্টিলারী দ্বারা সমর্থনপুষ্ট হইয়া দ্বিতীয়বার হামলা চালায়। এই যুদ্ধেও পাক ফোর্সের যথেষ্ট ক্ষতি হয়। আমাদের দুটি মেশিনগান খারাপ হইয়া যায়। পাক ফোর্স এইবারও যথেষ্ট ক্ষতি স্বীকার করিয়া আক্রমন ছাড়িয়া দিয়া সন্ধ্যার সময় গোপালদী বাজারে চলিয়া যায়। এদিকে দুইবারের আক্রমনে আমাদের কিছু হাতিয়ার খারাপ হইয়া যায়। যাহা হউক সন্ধ্যার পর আমরা সিদ্ধান্ত নিই যে আমরা এই অবস্থা ছাড়িয়া ভৈরবের দিকে যাইয়া বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাথে মিলিবো। আশুগঞ্জে গিয়া বেঙ্গল রেজিমেন্টকে পাওয়া যায়। এবং সেখানে হইতে কিছু বেঙ্গল রেজিমেন্টসহ ১৩-৪-৭১ তারিখে রামনগর পুলের নিকট আর একটি প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়িয়া তোলা হয়। কিন্তু ১৪-৪-৭১ তারিখে সূর্যাস্তের আগে হইতেই এয়ার ও আর্টিলারী সমর্থনপুষ্ট হইয়া পাক ফোর্স হামলা চালায় এবং দুপুর ১২ টার আগেই ঐ ডিফেন্স নষ্ট হইয়া যায় এবং এখানকার লোকজন ছত্রভঙ্গ হইয়া যায়। কিছু লোক মেঘনা পার হইয়া সিলেট জেলার ভিতর চলিয়া যায়।

আমি কিছু সংখ্যক লোকসহ কিশোরগঞ্জ হইয়া ময়মনসিংহে যাই, কারণ আমার ছেলেপেলে ঐখানে ছিল। তারপর ১৫-৪-৭১ তারিখ বিকালবেলা আমি মুক্তাগাছা হইয়া ময়মনসিংহ জেলার মধুপুরে জিয়াউল হক সাহেবের সঙ্গে দেখা করিলে জানিতে পারি যে,  টাঙ্গাইলের আগে জার্মুকী এলাকায় নায়েক সুবেদার হারিসের নের্তৃত্বে ইপিআর দলের সঙ্গে পাক ফোর্সের তুমুল যুদ্ধ হয় এবং দুই দিকের ভীষন ক্ষতি হয়। তাহাতে ২০/৩০ জন ইপিআর মারা যায়।

পরদিন ১৭-৪-৭১ তারিখের খুব সকাল হইতে পাকিস্তান এয়ার ফোর্সের ৪টি জঙ্গি বিমান ভীষনভাবে ময়মনসিংহ শহর এবং অন্যান্য এলাকায় আক্রমন চালায় যাহাতে কিছু সিভিল লোক শম্ভুগঞ্জ ঘাটে মারা যায় এবং কয়েকটি বাস ও দোকানঘর পুড়িয়া যায়। তাহা ছাড়া মধুপুর ও জামালপুরেও বিমান আক্রমন হইয়াছে বলিয়া সংবাদ পাই।

তারপর আমরা আমাদের অবস্থানে যে কয়েকজন লোক ছিল তাহাদের নিয়া বর্ডারে করইতলী হেডকোয়ার্টারে ফুলপুর ও হালুয়াঘাটের মাঝামাঝি সায়চাপুর ঘাটে ডিফেন্স তৈয়ার করি। কিন্তু ২২/২৩ তারিখে পাক ফোর্স আবার এয়ার ও আর্টিলারী দ্বারা সমর্থনপুষ্ট হইয়া আক্রমন চালায় সকালের দিকে। সেখানে আমরা অতি অল্প সময় টিকিতে পারি। ২৩-৭-৭১ তারিখে আমি আমার সঙ্গী লোকসহ করইতলী ক্যাম্পে থাকাকালীন সুবেদার হাকিম সাহেব আসিলে তাহাকে উইং-এর ভার দিয়া আমি আমার ফ্যামিলিসহ হিন্দুস্থানের ভিতর দিয়া গাউছূয়া পাড়া হইতে ডালু হইয়া আমরা বাংলাদেশে ঢুকিয়া বহু কষ্টে আমার ফ্যামেলি বাড়ী পৌঁছাইয়া দিয়া আগরতলা কোনাবন বর্ডার দিয়া ঢুকিয়া পুরানো ফোর্সের সাথে ৩ সেক্টরের অধীনে বেলুচরা সাবসেকটরে যাইয়া যোগদান করি। সেখানে ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান সাহেব ছিলেন। তারপর ঐ সব সেক্টরের ১৬-৫-৭১ হইতে যুদ্ধে লিপ্ত থাকি।

——————————————————

<৯, ৫.২, ২১৬-২১৮>

সশস্ত্র প্রতিরোধে ময়মনসিংহ

সাক্ষাৎকারঃ সুবেদার মেজর জিয়াউল হক
৮-৬-৭১

২৬শে মার্চ বেলা একটার সময় ঢাকা ইপিআর হেডকোয়ার্টার থেকে কমর আব্বাসকে অয়ারলেস সেটে এ কথা বলার জন্য ডাকা হয়। তখন ডিউটি অপারেটর ছিল নায়েক ফরহাদ হোসেন (বাঙালি)। ঢাকা থেকে বলা হল, অয়ারলেস সেট অন করার পর সেখানে যেন কেউ না থাকে। তাই নায়েক ফরহাদ ঝুঁকি নিয়ে পাশের ঘরে একটা জায়গায় চুপি চুপি দাড়িয়ে থাকে। সৌভাগ্যবশত সে পাঞ্জাবী ভাষা বুঝতো। ঢাকা থেকে উইং কমান্ডারকে বলা হচ্ছিলো সমস্ত বাঙালি ইপিআরকে নিরস্ত্র করার জন্য এবং কোতে, ম্যাগাজিন ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ জায়গার চাবি নিয়ে নিতে এবং বাঙালিদের কোন ডিউটি না দেয়ার জন্য। ঢাকা থেকে ইপিআর-এর ষ্টাফ কর্ণেল সিকান্দার খান তাকে আরো বলে যে, আজ রাতের মধ্যে সমস্ত বাঙালি ইপিআরকে খতম করতে হবে এবং সীমান্তবর্তী এলাকায় ইপিআরদের সমন্ধে তোমাকে পরে নির্দেশ দেয়া হবে।

নায়েক ফরহাদ হোসেন অয়ারলেস সেট-এর পেছনে চুপি চুপি এই কথাগুলো শোনে এবং সমস্ত বাঙালি ইপিআরকে তা জানিয়ে দেয়। নায়েক ফরহাদ অয়ারলেস সেটে ২৭শে মার্চ আমাকে ভোর ছয়টার সময় উক্ত মেসেজ জানায় এবং বলে যে, আপনি আপনার বন্দোবস্ত করেন যদি বাঙালি জোয়ানদেরকে বাঁচাতে চান।

সেই নির্দেশ অনুযায়ী সবাইকে নিরস্ত্র করা হয়। একমাত্র সি-কোম্পানীর এক প্লাটুন ইপিআর অস্ত্র সমর্পন করতে অস্বীকার করে। নিরস্ত্রকরণের মধ্যে সীমান্ত এলাকায় ইপিআর’রা অর্ন্তভুক্ত ছিল না। ঐ প্লাটুন-এর নেতা ছিল সুবেদার ফরিদউদ্দিন আহমদ।

এই ঘটনার পর থেকে স্থানীয় স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল কলেজের নেতৃস্থানীয় ছাত্রবৃন্দ ও আওয়ামী লীগ নের্তৃবৃন্দ, আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তাঁরা আমাদেরকে যে কোন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে সাহায্য ও সহযোগিতার আশ্বাস দেন। ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন ডাক্তার আবদুল্লা-আল-মাহমুদ ও তার সহকর্মীবৃন্দ, আর ছিলেন এডভোকেট সৈয়দ আহমেদ এবং তার সহকর্মীবৃন্দ, অধ্যক্ষ মতিয়ূর রহমান (আলমগীর মিন্টু কলেজ) সৈয়দ আবদুস সুলতান (বর্তমানে ইংল্যান্ডে হাই কমিশনার), জনাব রফিকউদ্দিন ভূঁইয়া, এডভোকেট মোশাররফ আকন্দ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং অন্যান্য স্থানীয় আওয়ামী লীগ নের্তৃবৃন্দ। মোজাফফর ন্যাপের অধ্যাপক আবদুল হান্নান ও অধ্যাপক দেওয়ান এবং ভাসানী সমর্থক ছাত্রনেতা আবদুল হামিদও ছিলেন।

২৭শে মার্চ ক্যাপ্টেন কমর আব্বাস ঢাকায় নির্দেশ অনুসারে সমস্ত পশ্চিম পাকিস্তান জেসিও-এনসিওদের বাঙালি ইপিআরদের খতম করার নির্দেশ দেন রাত এগারোটার সময়। ট্রুপস ব্যারাক, উইং কমান্ডারের বাংলো এবং কোয়াটার গার্ড কোতে এবং ম্যাগাজিনের সমস্ত এলাকায় পশ্চিম পাকিস্তানী ইপিআরদের অস্ত্রশস্ত্র এবং গোলাবারুদসহ মোতায়েন করা হয়। উইং কমান্ডার-এর বাংলোতে সি কোম্পানী এক প্লাটুনকে ডিউটির জন্য মোতায়েন করা হয়। গার্ড কমান্ডার শফি এবং অন্য দুইজনের কাছে করে ৩০৩ রাইফেল ছিল। বাকীদের কাছে কোন অস্ত্রশস্ত্র ছিল না।

রাত এগারোটার সময় হেডকোয়ার্টারের তিন তলা থেকে হাবিলদার মেজর হাসিব উল্লাহ এক রাউণ্ড গুলি ফায়ার করে। সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যেক জায়গা থেকে ফায়ারিং শুরু হয়ে যায়। হেডকোয়ার্টারে তখন ২য় ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি কোম্পানী অবস্থান করছিলো। গোলাগুলি শুরু হবার পর বাঙালি ইপিআররা ওদের সাথে মিশে যায়। ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের নায়েক সুবেদার বড়ুয়া এবং সুলতান আমাদের জোয়ানদের সঙ্গে যোগ দেয় এবং তাদের অস্ত্রশস্ত্র বাঙালি ইপিআরদের দিয়ে দেয়। গোলাগুলি চলতে থাকে । ইতিমধ্যে ইপিআরের কিছু সাহসী বাঙালি জোয়ান স্থানীয় কয়েকজন ছাত্রের সহযোগিতায় কোতে এবং ম্যাগাজিনের ভেন্টিলেশন ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকে অস্ত্রশস্ত্র বের করতে সমর্থ হয়। ২৮ শে মার্চ ভোরবেলা জনাব রফিকউদ্দিন ভূইয়া, শামসুল হক এমপি, ছাত্রনেতা আবুল হাশেম ও হামিদের সহযোগিতায় ময়সমসিংহ জেল এবং পুলিশ লাইনের অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ এনে বাঙালি ইপিআরদের দেয়া হয়।

২৮শে মার্চ বেলা ৮টা পযর্ন্ত দুই পক্ষে তুমুল লড়াই চলে। পশ্চিম পাকিস্তানীদের সংখ্যা ছিল প্রায় ৯৩/৯৪ জন। ১১ জন জেসিও-এসসিও জেসিও মেসে সারারাত ফায়ার করার পর ১৭ থেকে ১৯ বাক্স গুলিসহ আত্মসমর্পন করে সুবেদার ফরিদের কাছে। ক্যাপ্টেন কমর আব্বাস সকালবেলা সিপাহী নান্নু মিয়া এবং আফতাব হোসেনের সাথে সংঘর্ষে নিহত হয়। উল্লেখযোগ্য যে, সিপাই নান্নু এবং আফতাব স্বাধীনতা সংগ্রামে কর্ণেল নুরুজ্জামানের অধীনে এবং ডালু সেক্টরে অত্যন্ত সাহস ও বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেছে।

১১ জন জেসিও এনসিওকে সুবেদার ফরিদউদ্দিন ও অন্যান্যদের সহযোগিতায় ময়মনসিংহ জেলে বন্দী করা হয়। অতঃপর ময়মনসিংহের সকল বাঙালি জোয়ান এনসিও মেজর শফিউল্লাহর নের্তৃত্বে সংগঠিত হয়ে ৪/৬ কোম্পানী গঠন করে জয়দেবপুর ও টঙ্গী অভিমুখে যাত্রা করে।

এদিকে রংপুর সীমান্ত এলাকায় মাদারচর বিওপি থেকে সিলেট সীমান্তের মহেশখোলা বিওপি পর্যন্ত ২৪টা বিওপি’র সমস্ত বাঙালি ইপিআরকে (প্রত্যেক বিওপিতে তিনজন করে রেখে) দুই কোম্পানীতে সংগঠিত করে সুবেদার মেজর আব্দুল হাকিম এবং আমার নেতৃত্বে মুক্তাগাছা, রসুলপুর, মধুপুর, জামালপুর, ঘাটাইল এলাকা পযর্ন্ত মোতায়েন করা হয়। তখন আমাদের সঙ্গে ময়মনসিংহ শহরের শামসুল হক এমপি, মুক্তগাছার শহীদুল্লাহ এমপি, রফিকউদ্দিন ভূঁইয়া, নাগরপুর কলেজের অধ্যক্ষ হুমায়ূন খালিদ, লতিদ সিদ্দিকী এম-পি এবং কাদের সিদ্দিকী আমাদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে সাহায্য এবং সহযোগিতা করেন। এই সময় ময়মনসিংহ সদরে এসডিও, মেজর শফিউল্লাহর প্রতিনিধি ক্যাপ্টেন মতিয়ুর রহমান এবং জনাব রফিকুদ্দিন ভূইয়া, ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ক্যাপ্টেন বালাজিৎ সিং ত্যাগী ও কর্ণেল রাংগাজান (৮৩ বিএসএফ ব্যাটালিয়ন কমান্ডার) এর সাথে যোগাযোগ করেন।  সঙ্গে সঙ্গে কোন সাহায্য না দিলেও ভবিষ্যতে কর্ণেল রাংগাজান আমাদের সাহায্যের আশ্বাস দেন। তিনি আমাদের সামনে দিল্লীতে এ ব্যাপারে ম্যাসেজ পাঠান। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, রফিকুদ্দিন ভূইয়া, আব্দুল মান্নান (বর্তমানে পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রী) ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ আমার কোম্পানীর হেডকোয়ার্টার করইতলীতে (হালুয়াঘাটে) অবস্থান করছিলেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেব কে তাঁর বাড়ী থেকে আবুল হাশেম গাইড করে নিয়ে আসেন এবং আমাদের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে তাঁকে নেতা বানানো হয়। তাদেরকে কর্ণেল রাংগাজানের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয় ভারতের গাচুয়াপাড়া রেষ্ট হাউস ইন্সপেকশন বাংলাতে।

সৈয়দ নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে একদল প্রতিনিধি কলকাতাতে পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী শ্রী সিদ্ধার্থ শংকর রায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চলে যান। সীমান্ত এলাকায় বিভিন্ন ব্যাপারে সাহায্য ও সহযোগিতার ভার রফিকউদ্দিন ভূইয়ার উপর অর্পন করা হয়। অন্যকোন অস্ত্রশস্ত্র না পেলেও আমরা যথেষ্ট পরিমান হ্যাণ্ড গ্রেনেড এবং ২৭টি এলএমজি বিএসএফ ক্যাপ্টেন ত্যাগীর নিকট থেকে পাই। তিনি ছদ্মবেশে রসুলপুর এলাকাতে আমার সাথে কাজ করতে থাকেন। এছাড়াও প্রত্যেক রাত ভারত থেকে (ডালু এবং মহেন্দ্রগঞ্জ থেকে) ইন্ডিয়ান আর্মি ইঞ্জিনিয়ার টিম পুল এবং রাস্তা ধ্বংস করার জন্য আসতেন এবং কাজ সমাধা করে রাত্রেই চলে যেতেন। ২৭শে মার্চ ময়মনসিংহের উইং হেডকোর্য়াটারে পশ্চিম পাকিস্তানীদের খতম করার পর সীমান্তের সমস্ত পশ্চিম পাকিস্তানী ইপিআরদেরও খতম করা হয়।

এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় কি তৃতীয় সপ্তাহে আমাদের উপর কালিহাতি, রসুলপুর, মধুপুর, জামালপুর, মুক্তাগাছা, শম্ভুগঞ্জ, গৌরীপুর ইত্যাদি স্থানে পাকিস্তানী বিমান বাহিনী পর্যায়ক্রমে বিমান হামলা চালায়। তাদের সৈন্য সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে যেতে থাকে এবং ক্রমশ আমাদের বাঙালিদের মনোবল ভেঙ্গে যেতে থাকে বলে আমরা অনুমান করি। বিমান হামলার ফলে মেজর শফিউল্লাহ তার সৈন্যসামন্ত নিয়ে ব্রাক্ষণবাড়িয়ার দিকে চলে যান।

——————————————————————

<৯, ৫.৩, ২১৮-২২০>

মধুপুর গড়ের যুদ্ধ

(‘প্রতিরোধ সংগ্রামে বাংলাদেশ’ গ্রন্থ থেকে সংকলিত)

বিক্রমপুরের সুদূর গ্রামাঞ্চলে বসে ভারতীয় বেতারের প্রচারিত সংবাদ শুনছিলাম। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতি সম্পর্কে আকাশবাণী  ঘোষনা করছে, মংয়মনসিংহ জেলার মধুপুরগড়ে পাক সৈন্যদল আর মুক্তিবাহিনীর মধ্যে তুমুল যুদ্ধ চলছে।

শতাধিক বছর আগে এই মধুপুর গড় আমাদের দেশের রাজনৈতিক আবর্তনের ইতিহাসের পাতায় একটু স্থান করে নিয়েছিল। আজকের দিনে আমাদের কাছে সেই ঐহিত্য হয়তো তুচ্ছ মনে হতে পারে, কিন্তু সেদিন এই মধুপুর গড়ে একদল বিদ্রোহীর অভ্যূত্থান সারা বাংলার মানুষের মনে আলোড়ন জাগিয়ে তুলেছিল। সেই বিদ্রোহ আকারে ছোট হলেও তখনকার দিনের বৃটিশ রাজপুরুষরা তাই নিয়ে কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিল।

মংয়মনসিংহ শহর তথা মংয়মনসিংহ জেলা তখন মুক্ত অঞ্চল। কিন্তু তার উপর রাহু গ্রাসের ভয়াল ছায়া নেমে আসছে। দূর্দিন আসন্ন। হামলাকারী পাক-বাহিনী টাঙ্গাইল শহর হস্তগত করে মংয়মনসিংহ শহর দখল করবার  জন দ্রুত বেগে ছুটে আসছে। তাদের এই অভিসন্ধিকে ব্যর্থ করতে হলে পথের মাঝখানেই তাদের প্রতিরোধ করতে হবে। এই প্রতিরোধের ঘাটি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মধুপুরই সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান। মুক্তিবাহিনী স্থির করেছিল এইখানেই তাদের পথ রোধ করে দাঁড়াতে হবে। কিন্তু প্রতিরোধ করবে কারা? প্রতিরোধের মূল শক্তি ইপিআর এর যোদ্ধারা এক গুরুত্বপূর্ণ কাজে অন্য সেক্টরে চলে গেছে। তারা আসতে আসতে এই দুশমনরা মধুপুর ছাড়িয়ে চলে যাবে। অতএব অবিলম্বে তাদের বাধা দেওয়া দরকার। এই অল্প সময়ের মধ্যেই যেটুকু শক্তি আছে তাই নিয়ে তাদের প্রতিরোধ দিতে হবে।

মুক্তিবাহিনীর সংগঠকরা বিভিন্ন অঞ্চলের ছাত্রদের কাছে জরুরী ডাক পাঠালেন। সেই আহবানে সাড়া দিয়ে নানা জায়গা থেকে ২২ জন ছাত্র মধুপুর গড়ে এসে পৌঁছালো। এরা যুদ্ধ করার জন্য তৈরী হয়ে এলো বটে, কিন্ত এদের মধ্যে কেউ আগে থেকে অস্ত্র চালনায় অভ্যস্ত ছিল না। মাত্র দিন সাতেক আগে থেকে তারা ইপিআর-এর লোক বা প্রাক্তন সৈন্যদের কাছ থেকে রাইফেল চালনা শিখছিল। এইটুকু শিক্ষাই ছিল তাদের সম্বল। আর সম্বল ছিল অনিবার্ণ দেশপ্রেম ও দূর্জয় সাহস। একথা শুনলে কি কেউ বিশ্বাস করতে পারবে যে মাত্র ২২ জন অস্ত্র চালনায় অনভ্যস্ত ছাত্র সেদিন সেই দূর্ধর্ষ পাক-বাহিনীকে মোকাবেলা করতে দাঁড়িয়েছিল? একথা সত্য সত্যই বিশ্বাস করা কঠিন। তাহলেও এটাই ছিল বাস্তব ঘটনা।

১৩ই এপ্রিল তারিখে প্রথম সংঘর্ষ ঘটলো। দুপক্ষের মধ্যে গুলিবর্ষন চলল। ২২টি রাইফেল শত্রু পক্ষের মেশিনগানের জবাবে চলেছে। ছাত্ররা বনের আড়ালে আত্মগোপন করে যুদ্ধ করছিল। শত্রুপক্ষের প্রবল গুলিবর্ষণ সত্ত্বেও তাদের মধ্যে একজনও নিহত বা আহত হয়নি। পরে জানা গিয়েছিল এই দিনের যুদ্ধে প্রতিপক্ষের একজন ট্রাক-ডাইভার ও একজন জীপ ড্রাইভার মারা গিয়েছিল। বেশ কিছুটা দূর থেকে গুলি বিনিময় চলছিল। এইভাবে বাধা পেয়ে পাক-সৈন্যরা অবস্থা পরিবর্তনের জন্য থমকে দাড়িয়ে পড়লো। তাদের অগ্রগতি সেদিনের মতো স্থগিত হয়ে গেল। প্রতিরোধকারীদের পক্ষে এটি একটি বিরাট সাফল্য। মাত্র ২২ জন ছাত্রের এই বাহিনী শক্তিশালী শত্রুদের হাত থেকে এই সাফল্যকে ছিনিয়ে নিয়ে এলো। এসব ক্ষেত্রে প্রতিটি দিন, প্রতিটি ঘন্টা অত্যন্ত মূল্যবান। পরদিন ১৪ই এপ্রিল তারিখে এখান থেকে জরুরী ডাকে দুই ট্রাক বোঝাই ৫০/৬০ জন মুক্তিযোদ্ধা ঘটনাস্থলে এসে  পৌঁছে গেল। এদের মধ্যে অস্ত্র চালনায় শিক্ষিত ও অভ্যস্ত যোদ্ধারা ছিল। তাদের সঙ্গে রাইফেল ও হালকা মেশিনগানও ছিল। এদের পেয়ে এখানকার প্রতিরোধ বাহিনী এবার এক শক্তিশালী বাহিনী হয়ে দাঁড়ালো।

১৪ এপ্রিল সারাদিন ধরে দুপক্ষের প্রচণ্ড যুদ্ধ চলল। শেষ পর্যন্ত এদের প্রতি আক্রমন সহ্য করতে না পেরে সুশিক্ষিত ও আধুনিক মারণাস্ত্রে সুসজ্জিত পাক-সৈন্যরা প্রাণ বাচাঁনোর জন্য উর্ধ্বশ্বাসে পেছন দিকে ছুটলো। ছুটতে ছুটতে তারা পিছনে ফেলে আসা কালিহাতী, ঘাটাইল অঞ্চলে গিয়ে থামলো। প্রতিরোধকারী মুক্তিযোদ্ধারা অগ্রসর হয়ে পাক সৈন্যদের পরিত্যক্ত ঘাটিতে গিয়ে দেখলো যে, সেখানে শত্রুপক্ষের সৈন্যদের মৃতদেহগুলি ইতস্তত ছড়িয়ে পড়ে আছে। শত্রুরা প্রাণভয়ে পালাবার সময় কতগুলি অস্ত্রশস্ত্র ফেলেই চলে গেছে। ফলে তাদের পরিত্যক্ত একটি ট্রাক, একটি জীপ, ৪০টি স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, ১৫০ বাক্স মেশিনগানের গুলি, কতগুলি মর্টার শেল এবং কয়েক গ্যালন তেল মুক্তিবাহিনীর হাতে এসে গেল।

মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে এভাবে তারা খেয়ে পালিয়ে এসে পাক-সৈন্যদলের পরিচালকরা নতুনভাবে চিন্তা করতে লাগলো। তারা ভয় পেয়ে গিয়েছিল। প্রতিপক্ষ তাদের চোখের আড়ালে। আক্রমনের প্রবলতা দেখে তারা মনে করেছিল এক বিরাট সৈন্যদল তাদের পথরোধ করে দাড়িয়ে রয়েছে, কিন্তু কার্যত মুক্তিযোদ্ধাদের মোট সংখ্যা ১০০ জনও হবে না।

বেতারে সংবাদ গিয়ে পৌছালো ঢাকায়। সঙ্গে সঙ্গে একটি বোমারু বিমান এসে বনের মধ্যে আত্মগোপনকারী মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশ্যে বোমা ফেলতে লাগলো। বোমারু আক্রমনের গর্জনে আর বিস্ফোরনের শব্দে রণক্ষেত্র ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠলো। কিন্তু তাদেও ভয় পেলো না মুক্তিযোদ্ধারা। ভয় পেলো না সেই সমস্ত সহায়তাকারী সাধারণ মানুষেরা যারা পিছন থেকে মুক্তি যোদ্ধাদের রসদ যুগিয়ে চলেছিল। শত্রুপক্ষ অনেক চেষ্টা করেও প্রতিরোধ ব্যূহে ভাঙ্গন ধরাতে পারলো না। মুক্তিযোদ্ধারা জীবন পণ করে সঙ্কল্প নিয়েছিল যে তারা কিছুতেই ওদের পথ ছেড়ে দেবে না। তাদের এই সঙ্কল্প শেষ পর্যন্ত অটুট ছিল। তারা পথ ছেড়ে দেয়নি। পাক সৈন্যরা বেগতিক দেখে এ পথ ছেড়ে দিয়ে অন্য পথ ধরতে বাধ্য হয়েছিল।

এই মধুপুরের যুদ্ধের শেষ পরিণতি ঘটল।

—————————————————–

সশস্ত্র প্রতিরোধ- সিলেট

শিরোনাম সূত্র তারিখ

৬। সিলেট অঞ্চলে সংঘটিত সশস্ত্র

প্রতিরোধ যুদ্ধের বিবরণ

বাংলা একাডেমি দলিলপত্র ১৯৭১

<৯, ৬.১, ২২১-২২৮>
সিলেটের প্রতিরোধ যুদ্ধ

সাক্ষাৎকারঃ ব্রিগেডিয়ার চিত্তরঞ্জন দত্ত

২৪৭৩

(১৯৭১ সালে মেজর পদে কর্মরত ছিলেন)

২৫শে মার্চ বড় বড় শহরে পাকিস্তানীরাযে তাণ্ডবলীলা চালিয়েছিল সে খবর আমরা জানতে পারলাম ২৬শে মার্চ। সঙ্গে সঙ্গে হবিগঞ্জের আবালবৃদ্ধবনিতা প্রতিরোধ দুর্গ তৈরি করতে আরম্ভ করল। প্রতিটি হবিগঞ্জবাসী যেন এক-একটি বহিৃশিখা।

২৭শে মার্চ ১৯৭১ সন আমার বাড়িতে বসে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে কয়েকজন মিলে নানা আলাপ আলোচনা চলছে। তখন কয়েকজন ছাত্র এসে আমাকে বলল, “দাদা, পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে আমাদের সাহায্য করুন।” আমি বললাম, “আমিও তা চাই।” অপ্রাপ্তবয়স্ক ছাত্রদের মতানুযায়ী চলা ঠিক নয়। তাই আমি ওদেরকে বললাম কর্নেল রব (এমসিও)- এর কথা, যিনি বর্তমানে জেনারেল রব। কিছুদিন আগে তিনি ঢাকাতে আওয়ামী লীগের সম্মেলনে যোগদান করে এসেছেন। তাঁর কাছ থেকে ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা জানা যাবে, এই ভেবে বললাম, কর্নেল রব যদি আমাকে বলেন তাহলে আমি এই মুহূর্তে প্রস্তুত।

২৭শে মার্চ শনিবার ১৯৭১ সন। বেলা প্রায় দু’টায় জেনারেল রব তার বাড়িতে আমাকে যাবার জন্য খবর পাঠালেন। গিয়ে দেখলাম কামরার ভিতরে বসে আছে আনসার মুজাহিদের কয়েকজন, সামরিক বাহিনীর কয়েকজন যারা ছুটি কাটাতে এসেছিলেন এবং কিছু সংখ্যক ছাত্র। বাড়ির বাইরে খোলা জায়গায় বিরাট ভীর। আমাকে দেখেই সকলে ‘জয় বাংলা’ ‘জয় বাংলা’ বলে আনন্দে চিৎকার করে উঠল। দেখলাম হাতিয়ার নিয়ে প্রায় ১৫০ জনের মত লোক যাবার জন্য তৈরি। কয়েকটি বাস ও ট্রাক একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। চারধারে শুধু ধ্বনিত হতে লাগল ‘জয় বাংলা’। আমি হাত উঠিয়ে সকলকে অভিবাদন করলাম।

ঘরের ভেতরে ঢুকতেই জেনারেল রব সকলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, আজই পাঁচটায় যে লোকবল আছে তাদের নিয়ে সিলেটকে মুক্ত করবার জন্য যাত্রা করব। যুদ্ধ পরিচালনার ভার আমাকে দেয়া হল। আমি হাসি মুখে আমার সম্মতি জানিয়ে সকলকে অভিবাদন জানালাম এবং যাত্রাপথে গাড়ীতে আমাকে উঠিয়ে নিতে অনুরোধ করলাম।

জেনারেল রবের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসা মাত্র চারদিকে “জয় বাংলা” জয়ধ্বনি উঠতে লাগল। মনটা আনন্দে ভরে উঠল। হাতজোড় করে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করলাম, শক্তি দিও যেন বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে পারি।

২৭শে মার্চ বেলা পাঁচটায় একটা জীপ ও পাঁচটায় একটা জীপ ও পাঁচটা বাস ও ট্রাক আমার বাসার সামনে এসে দাঁড়াল। চারদিকে শুধু “জয় বাংলা” ধ্বনি। লোকে লোকারণ্য। আমি আমার স্ত্রী ও ছেলেমেদের বললাম, স্বাধীনতার ডাক এসেছে। আমাকে এখনি যেতে হবে। ‘জয় বাংলা’ বলে সকলের কাছ থেকে বিদায় নিলাম।

হবিগঞ্জ শহরটি যেন আনন্দে মেতে উঠেছে।

আমি, মানিক চৌধুরী ও জেনারেল রব একই গাড়ীতে বসেছিলাম। সবাই আমাদের হাত নেড়ে বিদায় সংবর্ধনা জানাল। গাড়ী ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে শায়েস্তাগঞ্জের দিকে। সেদিন আমাদের গন্তব্যস্থান ছিল  রশীদপুর চা-বাগান। কারণ, খবর পেয়েছিলাম পাকিস্তানীরা শ্রীমঙ্গলের ওপারে আছে। ভেবেছিলাম ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে রশীদপুর পৌঁছে যাব এবং পরদিনের কর্মসূচি তৈরি করতে পারব, কিন্তু পথে চলতে গিয়ে আমাদের অনেক বাধা বিঘ্নের সম্মুখীন হতে হলো। কিছুক্ষণ পরপরই রাস্তার উপরে বড় বড় গাছ, পাথর ইত্যাদি রেখে ব্যারিকেড তৈরি করা ছিল। বলা বাহুল্য, জেনারেল রব ও মানিক চৌধুরীর আদেশক্রমেই এগুলি তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি যে সম্পন্ন হবে তা কেউ ভাবেনি। স্বাধীনতাকামী প্রত্যেকটি বাঙালির মন আজ জেগে উঠেছে। যাহোক, আমি বললাম অন্য আদেশ না পাওয়া পর্যন্ত রান্তাঘাট খোলা রাখতে। কারণ আমাদের নিজেদের প্রয়োজনে যোগাযোগ করতে হবে।

রশীদপুরে পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় রাত ১১টা বেজেছিল। আমি জেনারেল রবকে বললাম, আজ রাত এখানেই থাকব এবং আগামী কাল ভোরে যারা আমাদের সঙ্গে এসছে তাদের কে এবং তারা এক সঙ্গে কি কি অস্ত্র ও হাতিয়ার এনেছে তা দেখে পরবর্তী কর্মপন্থা গ্রহণ করব। রশীদপুর চা-বাগানের ম্যানেজার মোস্তফা সাহেবকে বললাম, “ আজ রাতের জন্য ওদের শ্রমিকদের সাহায্য যেন চা-বাগানটি সুরক্ষিত রাখার ব্যবস্থা করানো হয়। এ খবরটি আমাকে কাল দুপুরের মধ্যেই দিতে হবে।”

আমাদের সবাইই আহারের ব্যবস্থা রশীদপুরেই হয়েছিল। এখানে একটা কথা বলতে চাই যে সিলেটের শমশেরনগরে বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটা কোম্পানী ছিল। সেটার কমান্ডার ছিল মেজর খালেদ মোশারারফ (বর্তমানে কর্নেল)। হবিগঞ্জ থেকে রওনা হয়ে যখন আমরা পাইকপাড়া আসলাম তখন জানতে পারলাম মেজর খালেদ মোফাররফ শমশেরনগর থেকে রওনা হয়ে কুমিল্লা সেনানিবাসের দিকে যাচ্ছে। সিলেট ছেড়ে এভাবে যাবার উদ্দেশ্যটা বোঝা যাচ্ছিল না। জেনারেল রবকে বললাম, আমাদের গিয়ে ওকে ধরতে হবে এবং সম্মিলিত চেষ্টায় সিলেট মুক্ত করতে হবে।

আমরা তাড়াতাড়ি যেতে অনেক চেষ্টা করলাম, কিন্তু পথঘাটে বাধা বিঘ্ন পেরিয়ে যখন মীরপুরের পুলে এসে পৌছলাম তখন আমি মনে মনে চিন্তা করেছিলাম যে খালেদ মোশাররফ ও তার সৈন্যসামন্ত এবং আমার সৈন্যসামন্ত নিয়ে সিলেটকে মুক্ত করব এবং সিলেটে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে সেখানে আমাদের প্রধান হেডকোয়ার্টার তৈরি করবো। সিলেট থেকে সারা বাংলাদেশকে মুক্ত করার জন্য মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করতে সুবিধা হতো। সেদিন যদি কর্নেল খালেদ মোশাররফ আমার কথা মেনে নিতেন, তাহলে আমাদের বাংলাদেশের ইতিহাস অন্যরকমভাবে লেখা হতো। বাংলাদেশের ইতিহাস অন্যরকমভাবে লেখা হতো।

জানতে পারলাম গত রাতেই মেজর খালেদ মোশাররফ তার সৈন্যসামন্ত নিয়ে মীরপুর অতিক্রম করে চলে গেছে। মেজর খালেদ মোশাররফ ও সৈন্যসামন্তদের পেলে সিলেটকে মুক্ত করে তারপর আমরা কুমিল্লার পথে গেলে সুবিধা হত। যাইহোক ওকে যখন পেলাম না তখন আমার নিজেকেই করতে হবে।

রাতে ঘুম হল না। চিন্তা করতে লাগলাম এ সামান্য অর্ধশিক্ষত সৈন্য নিয়ে কি করব। পরদিন ভোরে বেলা প্রায় সাড়ে সাতটার সময় আমি আমার স্বাধীনতাকামী সংগ্রামী ছেলেদের দেখতে গেলাম। কারণ আমাকে জানতে হবে এদের কতখানি যুদ্ধ করবার ক্ষমতা আছে এবং ওদের সঙ্গে হাতিয়ার – গোলাবারুদ কি কি আছে। আনসার, মুজাহিদ, পুলিশ ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সৈনিকেরা যারা ছুটিতে ছিল সব মিলিয়ে মোট ১৫০জন মাত্র ছিল। তাদের কাছে আছে কেবল ৩০৩ রাইফেল এবং দশ রাউন্ড গুলি। এই সামান্য সৈন্য ও হাতিয়ার নিয়ে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা নিতান্তই বোকামি।

যাইহোক, আমি সিলেটের মুক্ত করবার যে দায়িত্ব করবার যে দায়িত্ব গ্রহণ করেছি তা আমাকে যে ভাবেই হোক পালন করতেই হবে। মনে বিশ্বাস ও স্বস্তি পেলাম যখন সবাই বলল, স্যার আমরা তৈরি। যা আছে তাই নিয়ে নরপিশাচদের বধ করব এবং সিলেটকে মুক্ত করব। মনে মনে চিন্তা করতে লাগলাম এই সামান্য হাতিয়ার ও সৈন্য নিয়ে কিভাবে কি করে পাকিস্তানিদের শায়েস্তা করব। ঠিক করে ফেললাম জনগণের শক্তিই হল বড় শক্তি এবং তার জন্য স্থানীয় গ্রামবাসীদের সাহায্য আমাকে নিতে হবে। স্থানীয় গ্রামবাসীদের কাছে যা যা আছে এবং আমার কাছে যা সৈন্য আছে তাই নিয়ে আমাকে সিরেট মুক্ত করতে হবে। তাই স্থানীয় গ্রামবাসীদের ডেকে বললাম, তোমরা আমার সৈন্যদের সঙ্গে সঙ্গে “জয় বাংলা” ধ্বনি উঠিয়ে চারদিকের আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে তুলবে। এই আওয়াজ শুনে শত্রুরা মনে করে যেন অনেক সৈন্য নিয়ে আমরা এদের বিরুদ্ধে লড়তে এসেছি। মানিক চৌধুরীকে বললাম যেভাবে হোক অস্ত্রশস্ত্র এবং গোলাবারুদের ব্যবস্থা করতেই হবে।

২৮/২৯ শে মার্চ আমরা সৈন্যদের সংঘবদ্ধ করলাম। দুই প্লাটুন সাতগাঁ পাহাড়ের মধ্যে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য পাঠিয়ে দিলাম। শ্রীমঙ্গল থেকে হবিগঞ্জ ও চুনারুঘাটে যদি শত্রুর আসতে হয় তাহলে সাতগাঁ পাহাড়ের মধ্য দিয়েই আসতে হবে। কারণ, রেললাইন ও বড় রাস্তা সাতগাঁ পাহাড়ের মধ্যে দিয়েই গেছে।

শত্রুরা কোথায় আছে সঠিক কবর পাচ্ছিলাম না। ভাসা খবর এসে পৌঁছাচ্ছিল। শ্রীমঙ্গল থেকে লোকজন আসা প্রায় বন্ধ ছিল। সঠিক খবর পাবার জন্য কয়েকজনকে শ্রীমঙ্গলের আশেপাশে পাঠালাম।

এদিকে রশীদপুরে আমাদের প্রথম কাম্প বানালাম। রশীদপুরের আশেপাশে চা-বাগান ছিল, সব বাঙালী ম্যানেজাররা খুব সাহায্য করেছেন। সৈন্যদের খাওয়া-দাওয়া, থাকার ব্যবস্থা এবং ট্রেনিংয়ের জায়গা সবই তাঁরা ব্যবস্থা করেছেন। চা-বাগানের ম্যানেজার মোস্তফা, আজিজ এদের নাম করতেই হয়। মানিক চৌধুরী অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ বন্দোবস্ত করতে লাগল। বাস, ট্রাক যা পাচ্ছে আমাদের সাহায্যের জন্য এক জায়গায় করছে। আমরা আছি এ খবর জেনে নানা জায়গা থেকে যাদের একটু সামরিক প্রমিক্ষণ ছিল আমাদের সৈন্য দলে যোগ দিতে লাগলো।

এদিকে খবর পেলাম আমরুল চা-বাগানের দিকে পাকিস্তানীরা আসছে চুনারুঘাটে যাবার জন্য। ম্যাপে দেখলাম রাস্তাও একটা আছে এবং লোকজনের কাছ থেকে জানলাম এ রাস্তা দিয়ে শুধু মানুষই চলতে পারে, গাড়ী চলতে পারে না। যা কিছু সৈন্য ছিল, প্রায় দুই প্লাটুনের মত, পাঠিয়ে দিলাম আমরুল চা-বাগানের দিকে। ওরা পৌঁছার পর কবর পাঠাল যে পাকিস্তানীরা এসেছিল, আবার শ্রীমঙ্গলের দিকে চলে গেছে। আমি ওদের ফিরে আসাকে বললাম, কারণ আমার উদ্দেশ্য হল যত তারাতারি সিলেট অভিমুখে যাওয়া।

৩০ শে মার্চ খবর পেলাম পাকিস্তানীরা শ্রীমঙ্গলে এসে অত্যাচার আরম্ভ করেছে। ৩০/৩১ শে মার্চ রাতে শ্রীমঙ্গলের প্রায় দুই মাইল দূরে প্রতিরোধ গড়ে তুললাম এই উদ্দেশ্যে ৩১শে মার্চ সকালে আমি শ্রীমঙ্গল আক্রমন করব।

৩০শে মার্চ সকালে আমি আমার চার প্লাটুনকে নিয়ে চারদিকে শ্রীমঙ্গলে আক্রমণ করলাম। ভোর আটটায় শ্রীমঙ্গলে পৌঁছলাম। খবর পেলাম পাকিস্তনীরা শ্রীমঙ্গলে ছেড়ে মৌলভী বাজারের দিকে চরে গেছে। সময় নষ্ট না করে মৌলভীবাজার দখল করা শ্রেয় বলে মনে করলাম। চারধারে সৈন্য ছড়িয়ে পড়েছিল। ওদেরকে আবার একত্রিত করে মৌলভীবাজারের দিকে রওনা হলাম। রাস্তায় লোকজনের চলাচল এক রকম বন্ধ বললেই চলে। সৈন্যদের নিয়ে যখন মৌলভীবাজারের দিকে যাচ্ছিলাম জানতে পারলাম নয়নপুর চা-বাগানে পাকিস্তানীরা আছে। পেছনে দুটো প্লাটুনকে বললাম সোজা মৌলভীবাজার রাস্তায় না এসে নয়নপুর চা-বাগান শত্রুমুক্ত করে মৌলভী বাজার আসতে। নয়নপুর চা-বাগানটা শ্রীমঙ্গল থেকে ৭/৮ মাইল দূরে। নয়নপুরের কাছে আসতেই গোলাগুলির আওয়াজ শুনলাম। বেলা প্রায় আড়াইটা হবে। “জয় বাংলা” আওয়াজে পুরো নয়নপুর যেন মুখরিত হয়ে উঠল। বুঝলাম নয়নপুর আমাদের দখলে এসেছে। সংযোগের অভাবে কিছুই ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না। বাকি সৈন্যদের বললাম মৌলভীবাজারের দিকে অগ্রসর হতে। বিকেল হয়ে গেছে। পৌঁছলাম মৌলভীবাজারে। মনে হচ্ছিল মৌলভীবাজার যেন শ্মশান হয়ে গেছে। লোকজন প্রায় নেই বললেই চলে। সার্কিট হাউসে এসে উঠলাম। আমার সৈন্যরাও আসতে লাগল। জয় বাংলা ধ্বনিতে সারা শহরটা মুখরিত হয়ে উঠল। লোকজন মনোবল না পেয়ে আমাদের কাছে আসতে লাগল।

রশীদপুর থেকে ক্যাম্প উঠিয়ে নয়নপুর মৌলভীবাজারে ক্যাম্প করলাম। কারণ ওখান খেকে আমার সিলেট আক্রমন করা সুবিধা হবে। জেনারেল রবকে একথা বলতে তিনি মেনে নিলেন। মৌলভীবাজারের অবস্থানটি এমনি জায়গায় যেখান থেকে দুটো প্রধান সড়ক, সিলেট থেকে একটা কুলাউড়া হয়ে, অন্যটি শেরপুর শাহীদপুর হয়ে মৌলভীবাজারে ওদের আসতে হবে। যদি শত্রুরা স্থলপথে কুমিল্লা অথবা ব্রাক্ষ্মনবাড়িয়া যেতে চায় তাহলে মৌলভীবাজারে ওদের আসতে হবে। একথা ভেবে মৌলভীবাজার কে প্রধান ঘাঁটি করে রাখলাম। খবর নিতে আরম্ভ করলাম শত্রুরা কোথায় এবং খবর পেলাম কুলাউড়ার দিকে শত্রুরা নেই। শত্রুরা এ রাস্তা বেছে নেবার আর একটা কারণ আমার সৈন্যদের সিলেটে যেতে হলে দুটো বড় বড় নদী পার হতে হবে। এই চিন্তা করে আমার কাছে যা সৈন্য ছিল তা নিয়ে শেরপুর-শাদীপুরের রাস্তায় সিলেট যাবার জন্য মনস্থ করলাম।

মৌলভীবাজারকে শক্ত ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করার জন্য জেনারেল রব এবং মানিক চৌধুরীকে বললাম যে আমার আরো অস্ত্রশস্ত্র এবং সৈন্যের প্রয়োজন। শেরপুর-শাদীপুরের রাস্তায় সিলেট যেতে হলে দু’টো বড় বড় নদী আমাকে পার হতে হবে। যে সৈন্য আমার কাছে এখন আছে, তা দিয়ে দু’টো নদী পার হয়ে শত্রুর মোকাবেলা করে সিলেট পৌঁছানো কষ্টসাধ্য ব্যাপার। জেনারেল রব এবং মানিক চৌধুরীকে একথা বলতে তাঁরা আমাকে আশ্বাস দিলেন যে কিছু দিনের মধ্যে সৈন্য-গোলাবারুদ এসে যাবে।

পাকিস্তানীদের যুদ্ধের হাবভাব দেখে বুঝতে পারলাম ওরা বড় রকমের কোন যুদ্ধ করবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না ওরা সিলেট একত্রিত হচ্ছে। তবে শেরপুর-শাদীপুরে দুটো নদীতে ওরা ভালভাবে বাধা দেবে সেটা বুঝতে পারলাম এবং সেজন্য তৈরি হতে লাগলাম।

আস্তে আস্তে অস্ত্রশস্ত্র ও সৈন্য বাড়তে লাগল। জেনারেল রব সীমান্তে গিয়ে বিডিয়ার-এর বাঙালী ছেলেদের একত্রিত করে মৌলভীবাজারে পাঠাতে লাগলেন। মানিক চৌধুরী অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করতে লাগলেন। আমার সৈন্য তখন প্রায় ৪৫০ জনের মত হয়ে গেল।

মৌলভীবাজার ও শ্রীমঙ্গলের জনগন আমাকে অনেক সাহায্য করেছেন। গিয়াসউদ্দিন সাহেব, তোয়াবুর রহীম, আজিজ, ডক্টর আলী, আলতাফ, ইলিয়াস এবং স্কুল কলেজের ছাত্রদের কথা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি। সৈনদের দেখাশুনা, খাওয়া-দাওয়ার সব রকমের ব্যবস্থা যদি মৌলভীবাজার ও সিলেটের জনগন না করতো তাহরে সিলেটকে শত্রুমুক্ত করা সম্ভব হত না।

ইতোমধ্যে খবর পেলাম প্রায় দুই প্লাটুন পাকিস্তানী সৈন্য শেরপুরে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে এবং এক প্লাটুন-এর বেশী সৈন্য শাদীপুর রক্ষা করেছে। সৈন্যদের সমাবেশ দেখে বুঝলাম এরা বড় রকমের যুদ্ধ করবে না। আরো খবর পেলাম, পাকিস্তানীদের কাছে স্বয়ংক্রিয় মেশিনগান, তিন ইঞ্চি মর্টার, দুই ইঞ্চি মর্টার ইত্যাদি আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র আছে। লোকের আসা-যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। শেরপুর-শাহীদপুরের দুটো ফেরী ওদের কাছে আছে। কোন নৌকা এদিকে চলাচল করতে পারছে না। ওদের সঙ্গে একজন অফিসারও আছে জানতে পারলাম। যেভাবে হোক সিলেট আমাকে জয় করতে হবে।

৪ঠা এপ্রিল রাত আটটায় শেরপুরের কাছাকাছি প্রতিরক্ষারব্যূহ তৈরি করলাম। পরদিন আক্রমণ করব স্থির করলাম।

শেরপুরের প্রায় দেড় মাইল ডানে ও দেড় বাঁয়ে দুটো করে প্লাটুন পাঠান স্থির করলাম। গ্রাম বাসীদের বললাম যেন নৌকাগুলো ঠিক থাকে। রাতের অন্ধকারে সৈন্যরা চলল তাদের গন্তব্যস্থানে। বাকি সৈন্য নিয়ে মুখোমুখি আক্রমন চালাব এই স্থির করলাম। রাত প্রায় দশটায় আমরা কিভাবে শেরপুর-শাদীপুর আক্রমন চালাব তা সবাইকে বুঝিয়ে দিলাম- ডানে ও বাঁয়ের সৈন্যরা নদী পার হয়ে শত্রুদের ঘিরে ফেলবে এবং বাকি সৈন্যরা সম্মুখযুদ্ধে শত্রুদের ব্যস্ত রাখবে।

সকাল পাঁচটায় শেরপুরের সামনে আসতেই শত্রুরা গোলাগুলি ছুঁড়তে আরম্ভ করল। পাল্টা জবাব আমরাও দিতে লাগলাম।

৫ই এপ্রিল। যতই বেলা বাড়তে লাগল গোলাগুলির আওয়াজ ততই বাড়তে লাগল। শত্রুরা তিন ইঞ্চি ও দুই ইঞ্চি মর্টার ও মেশিনগানের সাহায্যে আমাদের দিকে দু-একটা বাড়িতে আগুন ধরে গেল। গ্রামবাসীরা পালাতে আরম্ভ করল। সৈন্যদের বলেছিলাম, শত্রুরা যেন কিছুতেই নদী পার হয়ে এদিকে আসতে না পারে। বেলা প্রায় বারোটার সময় ওপারে দু’দিক থেকেই “জয় বাংলা” ধ্বনি শুনতে পেলাম। বুঝতে পারলাম আমার সৈন্যরা শত্রুর কাছাকাছি চলে এসেছে। মাঝেমাঝে “ইয়া আলী” আওয়াজ ও শোনা যাচ্ছিল। তাতে বোঝা যাচ্ছিলো হাতাহাতি যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। এই আওয়াজ আসার সঙ্গে সঙ্গে এপার থেকে গোলাগুলি ছোড়া বন্ধ করে দেয়া হল। কিছুক্ষণ পরে দেখলাম আমার সৈন্যরা পৌঁছে গেছে এবং আমাদের হাতের ইশারায় ডাকছে। “জয় বাংলা” ধ্বনিতে পুরো শেরপুর গ্রাম মুখরিত হয়ে উঠলো।

ফেরীটা ভালই ছিল, তাড়াহুড়ার মধ্যে নৌকা এবং ফেরীগুলো নষ্ট করার সময় এবং সুযোগ শত্রুরা পায়নি। আমরা সবাই ওখানে গেলাম, সমস্ত সৈন্যকে আবার সংঘবদ্ধ করলাম এবং বললাম শেরপুর যেভাবে আমাদের দখলে এসেছে ঠিক সেভাবে শাদীপুরও দখল করতে হবে।

শত্রুদের গোলাগুলি আমাদের উপর আসতে শুরু হল। সময় নষ্ট না করে শাদীপুর দখলের জন্য হুকুম দিলাম। কাজ আরম্ভ হয়ে গেল। এদিকে পাকিস্তানীদের ১২টি মৃতদেহ এদিক-ওদিক থেকে পাওয়া গিয়েছিল এবং এদের সেখানই কবর দেয়া হয়েছিল। এই যুদ্ধে আমাদের তিনজন দেশের জন্য প্রাণ দিল। মৃতদেহগুলো মৌলভীবাজারে পাঠিয়ে দেয়া হল।

এদিকে খবর পেলাম তিন চারটা ট্রাক শাদীপুরে এসেছে। এর দুটো কারণ থাকতে পারে। প্রথম কারণ আরো পাকিস্তানী সৈন্য সিলেট থেকে এসেছে আর দ্বিতীয় কারণ সিলেটে পালাবার বন্দোবস্ত করেছে। যে টুকরো টুকরো খবর আসছিলো তাতে মনে হচ্ছিলো সিলেটে পালাবার বন্দোবস্তই করছিলো। যাই হোক, মানিক চৌধুরীকে তখনই খবর পাঠালাম মনুর দিক দিয়ে একটি কোম্পানীকে মৌলভীবাজার থেকে ট্রাকে করে শাদীপুরে পাঠিয়ে দিতে। যদি সিলেট থেকে শত্রুদের আরো সৈন্য এসে থাকে তাহলে আমার সৈন্যরা ঠিকমত যাতে মোকাবিলা করতে পারে এই ভেবে আমি মানিক চৌধুরীকে খবরটা পাঠালাম। এতে আমার দুটো লাভ হয়। প্রথমত- আমার সৈন্যসংখ্যা বাড়বে, দ্বিতীয়তঃ যদি শত্রুরা সিলেট থেকে সৈন্য পাঠায় তবে আমার সৈন্যসংখ্যাও এত বেশী হবে যে বরাবর যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারবো।

বেলা বাড়তে লাগলো। শত্রুদের গোলাগুলির আওয়াজও বাড়তে লাগলো। অন্ধকার হয়ে আসলো। দু’পক্ষে গোলাগুলি চলতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর শুনলাম “জয় বাংলা” ধ্বনি। এত জয়ধ্বনি হচ্ছিলো যে কিছুই বুঝা যাচ্ছিলো না কি হচ্ছে। গোলাগুলির আওয়াজ একেবারে বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। এবারও শত্রুরা ফেরী ও নৌকাগুলো নষ্ট করার সময় পায়নি।

নৌকা করে লোক যাওয়া আসা করতে লাগলো। শাদীপুর দখলে আসলো। আনন্দে মনটা ভরে উঠলো। খবরটা পাঠালাম মৌলভীবাজারে।

শত্রুদের পিছু ধাওয়া করা সমীচীন হবে না কারণ ওরা ট্রাকে করে পালিয়েছে। পায়ে হেঁটে তাদের ধরা সম্ভব না। তাই আমার সৈন্যদেরকে সংঘবদ্ধ করতে আরম্ভ করলাম। যে যেখানে আছে ওখানেই প্রতিরোধ গড়ে রাতের জন্য বিশ্রাম করতে হুকুম দিলাম। সুবেদার ফজলুল হককে ওর কোম্পানী নিয়ে শাদীপুরের প্রায় দুই মাইল আগে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে বললাম। শত্রুরা কোথায় আছে খবর নিতে আরম্ভ করলাম।

এদিকে মৌলভীবাজারের মেজর শফিউল্লাহর সঙ্গে দেখা হয়। আমি তাকে বললাম যদি পারে একটা কোম্পানী পাঠিয়ে দিতে। বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটা কোম্পানী নিয়ে আমার কাছে পৌঁছলো সিলেটের মেজর আজিজ। আমি তাকে পাঠিয়ে দিলাম কুলাউড়া-শেওলা-সাঁতারকান্দী-গোপালগঞ্জ হয়ে সিলেটের সুরমা নদীর দক্ষিণ পাড়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে। এদিকে আমি শাদীপুর-সিলেটের রাস্তা শত্রুমুক্ত করে তার সঙ্গে সুরমা নদীর পাড়ে মিলিত হবো।

ক্যাপ্টেন আজিজের সৈন্য রাস্তায় বিনা বাঁধায় গোপালগঞ্জ পর্যন্ত পৌঁছলো। কিন্তু কদমতলীর (সিলেট থেকে প্রায় তিন মাইল দূরে) কাছে যখন আসলো তখন শত্রুরা তার উপর গুলি ছুঁড়তে শুরু করলো। যাই হোক, তার সমস্ত শক্তি দিয়ে পাল্টা আক্রমণ করাতে শত্রুরা কদমতলী ছেড়ে সিলেটের দিকে পালিয়ে গেলো।

এদিকে খবর পেলাম বিশ্বনাথ এলাকায় রাস্তার দুপাশে শত্রুরা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। বিশ্বনাথ দখল করার প্রস্তুতি নিলাম। টুকরো টুকরো খবরে জানতে পারলাম বিশ্বনাথে শত্রুরা মাইন লাগিয়েছে এবং দু-একটা গরুও নাকি মারা গিয়েছে। এ খবরটা আমি আমার সৈন্যদের জানালাম না। যাই হোক সমস্ত শক্তি দিয়ে বিশ্বনাথের উপর আক্রমণ করলাম। এই যুদ্ধেও শত্রুরা সমস্ত শক্তি ব্যবহার করেছিল। তবে তাদের মনোবল ভেঙ্গে গিয়েছিল। রাতের অন্ধকারে আমাদের আক্রমণে ওরা টিকতে পারল না এবং বিশ্বনাঠ ছেড়ে পালিয়ে একেবারে সিলেটে চলে গেল।

এদিকে ক্যাপ্টেন আজিজের সৈন্য শত্রুসৈন্যকে কদমতলী থেকে তাড়িয়ে সুরমা নদীর দক্ষিণ পারে প্রতিরক্ষাব্যূহ তৈরি করল।

৭ই এপ্রিল ১৯৭১ সন। সমস্ত সিলেট জেলা আমাদের দখলে আসল।

শত্রুরা এক জায়গায় একত্রিত হল। সিলেট বিমানবন্দর এবং চা-বাগানের আশেপাশে একত্রিত হয়। বুঝলাম এখন আমার কাছে যা সৈন্য আছে তা দিয়ে শত্রুদের উপর হামলা করা ঠিক হবে না, তাই জেনারেল রব ও মানিক চৌধুরীর কাছে আরো সৈন্য এবং অস্ত্রশস্ত্র চাইলাম।

৮ই এপ্রিল সকালে বসে আমি ও ক্যাপ্টেন আজিজ জল্পনা-কল্পনা করতে লাগলাম কি করে সিলেটকে মুক্ত করা যায়। এমন সময় ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর লেঃ কর্নেল লিমাইয়া আসলেন এবং আমাকে বললেন শিলচরে যেতে। আমি বললাম, এক শর্তে আমি যাব যদি তিনি আমাকে সৈন্য দিয়ে সাহায্য করেন। তিনি বলেন, তাই হবে। আমি তখনই তাঁর সঙ্গে শিলচর রওনা হয়ে গেলাম। রাত বারটা পর্যন্ত কি কর্মপন্থা আমরা অবলম্বন করব তা ঠিকঠাক করা হল, কিন্তু সেটা কার্যকরী হবার আগেই পাকিস্তানী সৈন্যরা আমাদের উপর আক্রমণ করল। ভারতীয় সৈন্য আসার সৌভাগ্য হয়নি।

৯ই এপ্রিল পর্যন্ত পুরো সিলেট আমাদের দখলে রইল। আমার পরিকল্পনা ছিল বিমানবন্দর এবং লাক্কাতুরা চা-বাগান দখল করা। রাত প্রায় এগারটার সময় এক কোম্পানীকে পাঠিয়ে দিলাম খান চা-বাগানের দিকে। আর একটা কোম্পানীকে পাঠানো হল আখালিয়ার দিকে। আর দুই কোম্পানীকে নিয়ে লাক্কাতুরা চা-বাগান দিয়ে শালুটিকর বিমানবন্দর দখলের জন্য রওনা হলাম। ক্যাপ্টেন আজিজের উপর ভার দেয়া হল সুরমা নদীর দক্ষিণ পার অবরোধ করে রাখার।

১০ই এপ্রিল আমাদের উপর শত্রুরা প্রচণ্ড হামলা করল। শত্রুরা ইতিমধ্যে অনেক সৈন্য যোগাড় করেছিল। পুরোদিন যুদ্ধ চলল। আমাদের সৈন্যরা পাকিস্তানীদের আক্রমণের মুখে টিকতে পারল না। শত্রুরা সব রকম অস্ত্র ব্যবহার করল। আস্তে আস্তে আমার সৈন্যরা পিছু হটতে আরম্ভ করল এবং নদীর দক্ষিণ পাড়ে আসল। খাদিমনগরের কোম্পানী আসতে পারলে না। ওরা তামাবিলের (শিলং) দিকে চলে গেল। ওদেরকে আগেই বলা ছিল যদি আক্রমণ কৃতকার্য না হয় তাহলে ওরা যেন ক্যাপ্টেন মুতালিবের সঙ্গে (সে তামাবিলের দিকে যুদ্ধ করেছিল) মিলে যায়।

এসব যখন হচ্ছিল তখন আমি শিলচর থেকে অয়ারলেস যন্ত্রপাতি নিয়ে আসছিলাম। তখন এক দুর্ঘটনায় আমার গাড়ী উল্টে গিয়েছিল। সেদিন খুব সম্ভব ছিল ৮ই এপ্রিল। খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। আমি গাড়ী চালাচ্ছিলাম। আমার সঙ্গে একজন সিগন্যালমান ছিল। যখন কুলাউড়ার কাছে আসি তখন দুটো লোক আমার দিকে লক্ষ্য করে অস্ত্র ধরে এবং গুলি করার চেষ্টা করে। আমি তখন গাড়ীর স্পীড বাড়িয়ে দিলাম । কিন্তু রাস্তা খুব পিচ্ছিল ছিল এবং গাড়ীতে স্পীডও বেশী ছিল। আমার পায়ে-বুকে খুব আঘাত লেগেছিল। পরে জানা গিয়েছিল দুর্বৃত্তরা মুসলিম লীগের লোক ছিল।

যাই হোক, খোঁড়া পা নিয়ে যুদ্ধ পরিচালনা করতে আরম্ভ করলাম। তখনই একদিন জেনারেল ওসমানী এবং ব্রিগেডিয়ার পান্ডের সঙ্গে আমার মৌলভীবাজারে দেখা হয়। আমার এ অবস্থা দেখে লেঃ কর্নেল জামানকে সিলেট সেক্টরের ভার দেয়া হয় এবং আমাকে কিছু দিনের জন্য শেওলা-সুতারকান্দী-সিলেট এলাকার দায়িত্ব আমাকে দেয়া হল। কর্নেল জামানকে উত্তর বঙ্গের একটা সেক্টরের পুরো দায়িত্ব আমাকে দেয়া হল। কর্নেল জামানকে উত্তর বঙ্গের একটা সেক্টরের কমান্ডার করে পাঠিয়ে দেয়া হল।

যাই হোক নদীর দক্ষিণ পাড়ে ভীষণ যুদ্ধ হলো। দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্ট ক্যাপ্টেন আজিজের নেতৃত্বে আপ্রাণ যুদ্ধ করে যেতে লাগল। এদের উপর বিমান হামলা পর্যন্ত হয়েছিল। শত্রুদের এই আক্রমণের মুখে টিকতে পারল না। সৈন্যরা, ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। ক্যাপ্টেন আজিজ পায়ে গুলি লেগে আহত হল। এবং আস্তে আস্তে ওরা মৌলভীবাজারের দিকে পিছু হটতে বাধ্য হল। বাকি সৈন্যরা গোলাপগঞ্জ-ঢাকা দক্ষিণের দিকে পিছু হটতে লাগল।

ইয়াকিনগঞ্জ-গোলাপগঞ্জে যা ছিল আমি প্রতিরক্ষাব্যূহ তৈরি করলাম। এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি এখানে ভীষণ যুদ্ধ হয়। ইয়াকিনগঞ্জের যুদ্ধে সিলেটের বাঙালী এস-পি, যিনি পাকিস্তানীদের হয়ে কাজ করতেন, আমাদের হাতে ধরা পড়েন। পাকিস্তানীদের বাঙালীদের প্রতি দরদটা এই দৃষ্টান্ত দিয়ে বোঝা যাবে। পাকিস্তানীরা জানত না আমরা কত সৈন্য নিয়ে ইয়াকিনগঞ্জে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছি। আমাদের স্ট্যান্ডিং পেট্রল ইয়াকিনগঞ্জের প্রায় মাইল খানেক আগে ছিল। পাকিস্তানীরা সিলেটের বাঙালী এসপি সাহেবকে গোলাপগঞ্জে একটা অজুহাতে পাঠিয়েছিলেন। ইয়াকিনগঞ্জ-সিরেট সড়কে লোক চলাচল একবারে বন্ধ ছিল। শত্রুরা জানত যে সিলেট থেকে যদি কেউ গোলাপগঞ্জের দিকে যায় তাহলে তার রক্ষা নেই। ফায়ার খুললে একটি বাঙালী মরলে ওদের কিছু যায় আসে না। ওদের যা জানার দরকার তা জানতে পারলেই হলো। এসপি সাহেব স্ট্যান্ডিং পেট্রল পার হয়ে যখন মূল ডিফেন্সের মধ্যে আসল আমাদের ফায়ার খোলা হল চারদিক থেকে। তার জীপ দাঁড়িয়ে গেল। দেখালেন রুমাল। ফায়ার বন্ধ করে আমরা কয়েকজন গেলাম, ভাবলাম বড় শিকার পাব। কিন্তু আশ্চর্য! বাঙালী এসপি, কি করব, গুলি করে মারতে মনটা চাইল না। নিয়ে আসলাম ধরে। কত আকুতি-মিনতি করে বললাম, মশাই, পাকিস্তানীদের পা চাটছেন। ধরা পড়েছেন। তবে প্রাণে মাবর না, কারণে আপনি বাঙালী। হুকুম দিলঅম ওকে আমার হেডকোয়ার্টারে নিয়ে যেত। ওকে জেনারেল ওসমানী সাহেবের কাছে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাঠিয়ে দেই। ওর গাড়ীটা অবশ্য আমাদের লেগেছিল। আশ্চর্য, পরের দিনই রাতে শত্রুরা আমাদের উপর আক্রমণ করল।

প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে পিছু হটকে বাধ্য হলাম। এমনকিভাবে গোলাপগঞ্জ-শেওলা-সুতা­রকান্দী যুদ্ধ করতে এপ্রিলের শেষের দিকে ভারতের করিমগঞ্জ এলাকায় এসে ট্রেনিং ক্যাম্প খুললাম। এদিকে দ্বিতীয় বেঙ্গল ও বাকি সৈন্যরা শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করতে না পেরে আস্তে আস্তে মৌলভীবাজার-শ্রীমঙ্গল হয়ে ভারতের সীমান্তে জমা হতে লাগল।

—————————————————-

<৯, ৬.২, ২২৮-২২৯>

সিলেট সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধের ডায়েরী

 

লেঃ কর্নেল আবদুর রব

১৯৭১ এর মার্চে ক্যাপ্টেন পদে কর্মরত ছিলেন

(অনুবাদ)

 

বিডিএফ সেক্টর ৪ যুদ্ধের দিনলিপি

 

তারিখ সময় স্থান মন্তব্য
০২ এপ্রিল, ১৯৭১   শেওলাঘাট ইপিআর এর সি/৯ প্লাটুন যাদের বরগ্রাম/গাজুকাঠি মোতায়েন করা হয়েছিল। তালিয়াপাড়া হেডকোয়ার্টার তাঁদের শেওলা ঘাট আসার নির্দেশ দিয়েছে।
০৫ এপ্রিল, ১৯৭১   -ঐ- ক্যাপ্টেন আজিজ (ইবিআর) এসেছেন এবং সি/৯ প্লাটুনের দায়িত্ব নিয়েছেন।
০৫ এপ্রিল, ১৯৭১ রাত ৯.০০টা -ঐ- প্লাটুনটি রানাপিং গিয়ে ইবিআর কনভয়ের সাথে যুক্ত হয়েছে ক্যাপ্টেন আজিজের তত্ত্বাবধায়নে। সৈন্যদল সিলেটের দিকে অগ্রসর হয়েছে। এর আগে গোলাপগঞ্জ এবং রানাপিং এর মাঝে জনাব তাইমুর(এমপিএ) সৈন্যদলের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তিনি সি/৯ প্লাটুনের গাড়ি চালাচ্ছিলেন এবং পথে দুর্ঘটনার সম্মুখীন হন যাতে ৩ জন হালকা আহত হন। দুর্ঘটনার সাথে সাথে তইমুর এলাকা ত্যাগ করেন। ইবিআর কনভয় রানাপিং এর দিকে চলে যায় আর ইবিআর ঐ রাতের জন্য দুর্ঘটনা স্থলে থেকে যায়।
০৬ এপ্রিল ১৯৭১ ০৯:৩০ ঘন্টা রানাখেলি ইপিআর প্লাটুন ক্যাপ্টেন আজিজের নির্দেশে ইবিআর কনভয়ের সাথে এক ঘাটিতে মিলিত হয়। পরদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত সৈন্যরা সেখানে আশ্রয় নেয়।
০৭ এপ্রিল ১৯৭১   -ঐ- ইবিআর কনভয় ডাকা দক্ষিণের দিকে অগ্রসর হয় এবং ইপিআর, পিআই ফুলবাড়ি/ভাইটিকের এলাকায় ডিফেন্স পজিশন নেয়।
০৮ এপ্রিল ১৯৭১   -ঐ- রাতে ইবিআর কনভয় সিলেটের দিকে অগ্রসর হয়।
০৯ এপ্রিল ১৯৭১   ফুলবাড়ি ফুলবাড়িতে তেলিয়াপাড়ার নির্দেশে ইপিআর ৩নং উইং এর সি/৮ প্লাটুনের  এন/সাব মতিউর রহমান সি/৯ পিআই এর দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
১০ এপ্রিল ১৯৭১   কদমতলি সি/৯ পিআই ১২০০ঘন্টার সময় কদমতলি বাস স্ট্যান্ডে পৌছে ডিফেন্স পজিশন নেয়। ১৩০০ ঘন্টার সময় শত্রু বিমান আক্রমণ চালায় কিন ব্রিজের ইবিআর পজিশন এবং ইপিআর, পিআই এর কদমতলি পজিশনের এলাকাতে। পাক বাহিনীও হালকা অস্ত্র ( ৩ইঞ্চি মর্টার/ ৬ পিডিআর) দিয়ে হামলা শুরু করে। গুলি বিনিময় প্রায় ২১ ঘন্টা ধরে চলে এবং তারা কিন ব্রিজ অতিক্রমের চেষ্টা করে ব্যার্থ হয় এবং প্রচুর হতাহতের শিকার হয়।
১১ এপ্রিল ১৯৭১ ১০০০ ঘন্টা -ঐ- ইপিআর যখন কদমতলি এলাকাতে অভিযান চালাচ্ছিল তাদের সংখ্যা ছিল মাত্র ১৪। ১০০০ ঘন্টার সময় পাক বাহিনী ইপিআরের উপর গোলাবর্ষণ শুরু করে । কয়েক মিনিট পর পাক বাহিনীকে কিন ব্রিজ/ ভরতাখোলা এলাকা থেকে অগ্রসর হতে দেখা যায় যেখানে ইবিআর কনভয় ডিপ্লয় করা ছিল। এতে করে ইপিআর বুঝতে পারে যে ইবিআর কনভয় সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। বিমান সাপোর্ট এবং মরটার আক্রমণের আগ পর্যন্ত ইপিআর পাক বাহিনীর পথ আটকিয়ে রাখে। ইপিআর ডিফেন্স পজিশন থেকে সরে আসে এবং সন্ধ্যায় যাত্রীবাহী বাসে করে ফুলবাড়ি পৌছে সেখানে ঐ রাতের জন্য অবস্থান নেয়।
১২ এপ্রিল ১৯৭১ ০৭০০ ঘন্টা শেওলাঘাট শেওলা ঘাট এসে ডিফেন্স পজিশন নেওয়া হয়েছে।
মেজর সি আর দত্ত এসে কমাণ্ড গ্রহণ করেন। ১১ এমজেডি/ আনসার শেওলাঘাটায় যুক্ত হয়, অগ্রসর হয় এবং রানপিং এলাকায় ডিফেন্স নেয় যখন পিআই সদস্য ছিল মাত্র ২৫ জন। আবার আরো ২৯ জন মুজাহিদ/ আনসার পিআই এর সাথে যুক্ত হয়। ব্রিগেডিয়ার পান্ডে এবং অন্যরা এসে উপস্থিত হন এবং গোপালগঞ্জ এবং ফুলবাড়ি/ভাইতিকের এলাকাতে রেকি  করেন। ব্রিগেডিয়ার পান্ডের বিএসএফ ইউনিট এসে ঐ এলাকাতে মাটি খুঁড়ে ডিফেন্স নেয়। ইপিআর পিআই হাতিমগঞ্জ এলাকাতে মাস্ক পজিশন নেয় এবং এক জিপে গুলি করে যাতে ৩/৪ জন ইউনিফর্ম পরা সৈন্য ছিল। জিপ থামিয়ে তারা সিলেটের এসপি সহ হাত উচিয়ে আত্মসমর্পণ করে। তাদের গ্রেফতার করে ডিফেন্স এলাকাতে আনা হয়।
২০ এপ্রিল ১৯৭১   শেওলাঘাট ১/১০ সদস্যের এক পার্টি শেওলাঘাট ফেরী ধ্বংসের জন্য পাঠানো হয়। তারা ২০ এপ্রিল ১৯৭১ রাতে ফেরী ধ্বংস করে এবং ২ইঞ্চি মর্টার/এলমজি ফায়ার করে ৮ জন পাক বাহিনী সদস্যকে হত্যা করে। এন/সাব মতিউর রহমানকে রাতে খারগ্লিঘাট ফেরী ধ্বংসের জন্য বরইগ্রামে এক সিভিলিয়ানের সাথে বোটে করে পাঠানো হয়। উপরের ঘাট সমূহের ফেরীগুলো নিপুণ ভাবে ধ্বংস করা হয়।
২১ এপ্রিল ১৯৭১   শেওলাঘাট ক্যাপ্টেন এ. রব যোগদান করেন।

—————————————–

<৯, ৬.৩, ২৩০-২৩১>

সিলেটে সশস্ত্র প্রতিরোধ
সাক্ষাৎকার-ল্যান্স নায়েক সোনা মিয়া
০৬-১১-১৯৭৪

২৫শ মার্চ আমি সিলেটের ১২ নং শাখা খাদিম নগরে ছিলাম। আমি ইনটেলিজেন্স ইনচার্জ ছিলাম। ১৮ই মার্চ আমাদের উইং ব্যারাকের ভিতর পাকিস্তানীরা বাংকার করে। এই নিয়ে পাকিস্তানীদের সাথে আমার বচসা হয় এবং আমার বিরূদ্ধে কেস দাড় করায়। ২২শে মার্চ আমাদের সমস্ত হাতিয়ার জমা নিয়ে নেয়। উইং কমান্ডার ছিলো মেজর শওকত খান। সেকেণ্ড ইন কমাণ্ড ছিলো দুজন পাঞ্জাবী ক্যাপ্টেন। হবিগঞ্জে একজন কোম্পানী কমান্ডার ছিলো সুবেদার মজিবুর রহমান। সুনামগঞ্জের কমান্ডার ছিলো সুবেদার সুবেদার নজিবুর রহমান এবং উইং হেডকোয়ার্টারে একটি করে কোম্পানী ছিলো। কমান্ডার ছিলো একজন করে পাঞ্জাবী সুবেদার। হেডকোয়ার্টারে একটি সাপোর্ট প্লাটুনও ছিলো। কমান্ডার ছিলো আবুল ফজল মিয়া।

২২শে মার্চ তারিখে সকল অবাঙালি ইপিআরকে হেডকোয়ার্টারে নিয়ে আসা হয়। আমাদের কাছ থেকে অস্ত্র নিয়ে নিলেও অবাঙালিদের চাইনিজ অস্ত্র ইস্যু করে পাকিস্তানীরা গোপন বৈঠক করতো। এই অবস্থা দেখে আমরা ডাইরি ফার্মে গোপন আলোচনা করি। উপস্থিত ছিলো উইং হাবিলদার মেজর ওয়াহিদুল ইসলাম, নায়েক হাফিজুল্লাহ চৌধুরী এবং আমি। আমরা সিলেট ডিসি এবং এসপি’র সাথে যোগাযোগ করি। ৩নং শাখার সাথেও যোগাযোগ করি। সমস্ত বিষয় অবগত করাই। সেক্টরে গিয়ে ক্যাপ্টেন আলাউদ্দিনের সাথে যোগাযোগ করি।

৩০শে মার্চ সকাল অনুমান ৬টার সময় ১১ জন পাঞ্জাবী আমাদের উইং ঘিরে ফেলে আক্রমণ করে। আমরা উইং থেকে পালিয়ে গিয়ে বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিলাম। আক্রমণে হাবিলদার শরাফত ঘটণাস্থলেই নিহত হয়। কোয়ার্টার গার্ড হাবিলদার মজিবুর রহমান শহীদ হন।

গোয়াইন ঘাটে আমাদের ৬০/৭০ জন ইপিআর আশ্রয় নেয়। কিছু জনতা এবং কিছু মুজাহিদ আমাদের সাথে আসে। হাবিলদার মেজর ওয়াহিদুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি প্লাটূন, একটি নায়েক হাফিজুল্লার এবং আরেকটি প্লাটুনের নেতৃত্ব আমার ছিলো। সার্বিক দ্বায়িত্ব ছিলো ওয়াহিদুল ইসলামের উপর। এই তিন প্লাটুন নিয়ে আমরা সবাই জাফলং টি গার্ডেনের ম্যানেজার কায়েস চৌধুরীর কাছে যাই। ৩১শে মার্চ সেখানে পৌঁছাই। ওখানে গিয়ে বিএসএফ ক্যাপ্টেন রাওয়ের সাথে যোগাযোগ করা হয়। তারা আমাদের কিছু অস্ত্র সাহায্য করে। আমরা সিলেটের দিকে অগ্রসর হই। পথে সুবেদার মজিবুর রহমান তার কোম্পানী নিয়ে আমাদের সাথে মিলিত হয়। সুবেদার মজিবুর রহমান গোয়াইন ঘাটে থাকলেন আহার, বস্ত্র ইত্যাদির জন্য। আমরা ১৭৫ জনের মতো ইপিআর ছিলাম এবং কিছু কিছু আনসার মুজাহিদ ও ছাত্র ছিলো।

আমরা খাদিমনগরে পৌঁছলাম ২রা এপ্রিল। ৩রা এপ্রিল আমরা সিলেটের দিকে অগ্রসর হই। সিলেট বেতার কেন্দ্রের কাছে পাক বাহিনী আমাদের উপর গুলি ছোঁড়ে। আমরা ওখানে ডিফেন্স নেই। পাক বাহিনীর সাথে আমাদের সংঘর্ষ হয়। আমরা সিলেট শহর দখল করে নেই। কর্নেল চিত্তরঞ্জন দত্ত জকিগঞ্জ বাস স্ট্যান্ডের কাছে ডিফেন্স নিলেন। আমরা শহরের ভিতরে আর চিত্তরঞ্জন দত্ত বাইরে অবস্থান করছিলেন। সুবেদার বিআর চৌধুরী ইপিআর বাহিনী নিয়ে কর্নেল সঙ্গে থাকেন। সুবেদার নজিবুর রহমান ইপিআর ফোর্স নিয়ে সুনামগঞ্জ থেকে সুবোধ বাজারে ডিফেন্স নেন।

এপ্রিলের ৮/৯ তারিখে পাক বাহিনী আমাদের উপর কাউন্টার এ্যাটাক চালায়। কর্নেল দত্ত এবং সুবেদার নজিবুর রহমান তাদের কোম্পানী নিয়ে আমাদের সাহায্য করতে পারেননি। পাক সেনারা স্থল ও বিমান হামলা করে। আমরা টিকতে ব্যর্থ হই! পিছু হটে খাদিম নগরে চলে যাই। ৯ তারিখে রাতেই সুবেদার বিআর চৌধুরী তার কোম্পানী নিয়ে আমাদের সাথে মিলিত হন। সুবেদার নজিবুর রহমান সুবোধ বাজার থেকে টুকুর বাজারে ডিফেন্স স্থানান্তর করে। এ খবর আমরা পেলাম ১১ই এপ্রিল।

খাদিমনগরে পাক বাহিনী বিমান এবং স্থল আক্রমণ করে। পাক বাহিনীর ব্যাপক আক্রমণে আমরা টিকতে ব্যর্থ হই। চিকনাগুলে আমরা আবার ডিফেন্স নিলাম। এখানে আবার বিএসএফ ক্যাপ্টেনের সাথে যোগাযোগ করি। বিএসএফ ক্যাপ্টেন রাও-এর অনুরোধে ৫২৫ জনের মতো বিএসএফ সাহায্যে এগিয়ে আসে। তামাবিল সিএন্ডবি  (যেটি সিলেট থেকে শিলং গেছে) ডান দিকে ইপিআর ও বাম দিকে বিএসএফ পজিশন নেয় এপ্রিলের ২০ তারিখে।

২৪ তারিখে বিএসএফ বাহিনী ডিফেন্স ছেড়ে ভারত চলে যায়। আমরা তা জানতে পারি না। ২৫ তারিখে ভোরে পাক বাহিনীর ব্যাপক আক্রমণে আমরা টিকতে ব্যর্থ হই। ২৫/৩০ জনের মতো শহীদ হন বাংকারে। আমরা পিছু হটি। পালানোর পথে ট্রাকে রিক্সায় পলায়নরত ৭৫ জন ইপিআর এবং বেঙ্গল রেজিমেন্টের অবসরপ্রাপ্ত সুবেদার শহীদ হন।

আমরা বাকী সব মিলে ১২৫ জনের মতো জৈন্তিয়াতে আশ্রয় নেই। ২৫শে এপ্রিল পাক বাহিনী এখানে পৌঁছায়। আমরা পিছু হটি এবং ভারতীয় সীমান্ত তামাবিলে আশ্রয় নেই। পাকসেনা তামাবিল সীমান্তেও পৌঁছায়। আমরা ভারতীয় বিএসএফ ক্যাম্প লাতাং-এ আশ্রয় নেই। আমাদের যাবতীয় অস্ত্র জমা দেই। এরপরই আমরা বিএসএফের আওতায় যাই। তারা আহার ও আশ্রয় দেয় এবং আমরা ছোট ছোট দলে দলে বিভক্ত হয়ে বাংলাদেশের মধ্যে খণ্ডযুদ্ধ করি। কিছুদিন পর বিএসএফের ঊর্ধ্বতন অফিসারের সাথে কথা বলি এবং আমরা অনুমতি নিয়ে বাংলাদেশ সীমান্ত তামাবিল এবং মুক্তাপুরে ডিফেন্স করি। তামাবিলের দায়িত্ব নেন ক্যাপ্টেন মুতালিব (অবসরপ্রাপ্ত) এবং সুবেদার বিআর চৌধুরী। সার্বিক দায়িত্ব ক্যাপ্টেন মুতালিবের উপর থাকে। দল পুনর্গঠন করে যুদ্ধ শুরু করি।

———————————————–

<৯, ৬, ২৩১-২৩৩>

 

সশস্ত্র প্রতিরোধ সিলেট

 

সাক্ষাৎকারঃ সিপাই শফিক আহমেদ

 

১১১৯৭৪

       আমি ২৫শে মার্চের পূর্ব থেকেই সেক্টর হেডকোয়ার্টার সিলেটে ছিলাম। সিলেটের অধীন তখন ৩টি উইং ছিল- ১নং, ৩নং এবং ১২ নং উইং। ১নং উইং কুমিল্লার কোটবাড়ীতে ছিল। ৩নং উইং এবং ১২নং উইং ছিল সিলেট শহরে। সেক্টর কমান্ডার ছিলেন লেঃ কঃ সেকান্দার খান (অবাঙালি), সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ড ছিলেন মেজর করিম (অবাঙালি), এ্যাডজুটেন্ট ছিল ক্যাপ্টেন নসির নাজির (পাঞ্জাবী)। কোয়ার্টার মাস্টার ছিল একমাত্র বাঙালি অফিসার ক্যাপ্টেন আলাউদ্দিন। মেজর এম, এ, কুদ্দুস সেই সময় এ, এম, সি ছিলেন। সিগনাল অফিসার ছিল আহসান কাদির ফয়েজ। উল্লেখ্য যে, ভারতীয় বিমান হাইজ্যাকের পর থেকেই সিলেটের খাদিমনগরে একটি রেজিমেন্ট থাকতো। এখানে ৩১ পাঞ্জাব এবং এফ-এর একটি কোম্পানী থাকতো।

       সেক্টর হেডকোয়ার্টারে ইপিআর প্রায় ছিল না। সিগনালের একটি এবং সহকারী (কেরানী) সহ আমরা ৫০/৬০ জন ছিলাম। ১৯/২০ মার্চ থেকে ৩১ পাঞ্জাব-এর ১টি প্লাটুন ইপিআর সেক্টর হেডকোয়ার্টারে থাকা শুরু করে। ১২ নং শাখার ১টি প্লাটুন ২৪ শে মার্চ তারিখে সেক্টর হেডকোয়ার্টারে আসে। সেখানে মাত্র ৪/৫ জন বাঙালি ছিল, বাকী সবাই ছিল অবাঙালি।

       ২৬ শে মার্চ বিভিন্ন গ্রাম থেকে ঢাল, সড়কি, বল্লম নিয়ে হাজার হাজার জনতা সিলেট শহরে আসতে থাকে। পাক সেনারা তাদের উপর গুলি চালায়, বহু বেসামরিক নিরীহ লোক নিহত হয়। শহরে তখন কারফিউ চলছিল। ২৬ তারিখে যে সকল ইপিআর অফিসে অনুপস্থিত ছিল তাদেরকে কর্তৃপক্ষ ডেকে আনতে বললেন। ২৬ শে মার্চ আমাদেরকে একটি করে লাঠি দেয় আকস্মিক আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য।

২৮শে মার্চ কিছু বাঙালি ইপিআর অফিসে আসে। আমরা ঐ দিন অফিসে আসিনি। পরে আমাদের গাড়ীতে করে নিয়ে আসা হয়। ২৮ তারিখেই আলমারীর এবং অন্যান্য চাবি নিয়ে নেয় হয় এবং বলা হয় ‘তোমরা অফিসে এসো না, দরকার হলে আসতে বলবো’। ক্যাপ্টেন নসির নাজির এটা বলেন।

৩রা এপ্রিল পাঞ্জাব ১২নং উইং আক্রমণ করে সকালে। এই খবর এখানকার এপিআররা আগে থেকেই জানতে পেরে ঐ দিন অস্ত্রশস্ত্রসহ পাহাড়ে গিয়ে আশ্রয় নেয়। ঐ দিন ঐ উইংয়ে পাঞ্জাবীদের আক্রমণে ৩জন ইপিআর গার্ড শহীন হন। আখালিয়াতে সেক্টর হেডকোয়ার্টারের একটি ৬ পাউন্ডের প্লাটুন থাকতো ট্রেনিং এর জন্য। ৩নং শাখার একটি কোম্পানী আখালিয়াতে থাকতো।

৪ঠা এপ্রিল ভোরের দিকে ৩১ পাঞ্জাব আখালিয়া আক্রমণ করে। ১২নং শাখার হেডকোয়ার্টার এভাবে পাকবাহিনীর হাতে চলে যায়। আখালিয়াও পাক সেনার হাতে চলে যায়। ৪ঠা এপ্রিল সিলেট সেক্টর থেকে আবাঙালি ইপিআরররা চলে যায়। পাক সেনারা ঐ তারিখের পর থেকে খাদিমপুরে থাকা শুরু করে।

উল্লেখ্য যে, ২৭শে মার্চ ক্যাপ্টেন গোলাম রসুল (১২নং শাখার সহকারী উইং কমান্ডার) বাঙালি মিশিয়ে একটি প্লাটুন শমসেরগন বিমান ঘাঁটিতে নিয়ে যায়। এই প্লাটুনের অগ্রবর্তী দলটি ১০/১২ জন ডজ গাড়ীতে করে শমসেরগন ডাকবাংলোতে আসে। এই দলের ড্রাইভার অগ্রণী হয়ে বলে, দ্বিতীয় দলে ক্যাপ্টেন সাহেব আসলে আমাদের বন্দী করতে পারে। অতএব, এখনই ক্যাপ্টেনকে খতন করে দিই। সাথে সাথে বাঙালি ইপিআররা ডাকবাংলোর ছাদের উপর উঠে যায় এবং লাইট মেশিনগান নিয়ে পজিশন নেয়। সাথে দুজন পাঞ্জাবী সিপাই পালিয়ে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যে ক্যাপ্টেন গোলাম রসুল দ্বিতীয় গাড়ীতে আসে। ইপিআর দলটি উপর থেকে ফায়ার ওপেন করে। সাথে সাথে ক্যাপ্টেনসহ প্রায় সবাই নিহত হয়। ২/১ জন আহত অবস্থায় পালিয়ে যায়।

৩নং শাখা কমান্ডার জাবেদ বরকত চৌধুরী ঐ তারিখে একটি ইপিআর এর দল নিয়ে শমসেরণগর রওয়ানা হয়েছিল। পথে ক্যাপ্টেন গোলাম রসুলের মৃত্যুখবর শুনে ফিরে আসে। ৪ঠা এপ্রিলের পর থেকেই পাকসেনারা গাড়ী করে শহরে মাঝে মাঝে টহল দিতে থাকে।

অসহযোগ আন্দোলনের সময়েই সামরিক অফিসারের পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। কেবল জেসিও-এনসিওদের পরিবার ছিল।

৭ই এপ্রিল সকল পাকসেনা সিলেট শহরের খাদিমপুর ছেড়ে সালুটিকর বিমান বন্দরে ঘাঁটি গাড়ে। ঐ রাতে ন্যাশনাল ব্যাঙ্কের ১১জন পুলিশকে পাকসেনারা হত্যা করে। সিলেট শহরে কিছু আনসার, মুজাহিদ, ইপিআর প্রবেশ করে।

পাকসেনারা সালুটিকর বিমান বন্দর থেকে গাড়ী করে সিলেট শহরে পেট্রোলিং করেতে আসতো। ৯ই এপ্রিল থেকে ১২ই এপ্রিলের মধ্যে পাকসেনারা সিলেট শহরে প্রবেশ করে। মুক্তিবাহিনীর সাথে খণ্ড যুদ্ধ। হয়।

সুরমা নদীর দক্ষিণ পাড়ে বেঙ্গল রেজিমেণ্টের একটি কোম্পানী ছিল। ইপিআর, আনসার, মুজাহিদ মিলে একটি কোম্পানীও ওখানে ছিল। পাকসেনাারা উত্তর দিক থেকে মুক্তিবাহিনীর উপর আক্রমণ চালায় ঐ তারিখে।

১২/১৩ এপ্রিল পাকসেনারা বিমান হামলাও চালায়। মুক্তিবাহিনী সব ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় পাকবাহিনীর প্রবল আক্রমনে। কিছু ইপিআর শেওরা নামক স্থানে আসে, সেখানে মেজর সি, আর দত্ত ছিলেন।

২৩ শে এপ্রিল তারিখে ইপিআর-আনসার মিলে ৩০০ এবং ভারতীর বিএসএফ বাহিনীর ৩০০ মত সৈন্য মিলিত হয়ে গোপালগঞ্জ নামক স্থানে ডিফেন্স নেয়। ২৪ শে এপ্রিল পাকসেনারা গোলাপগঞ্জের মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের উপর আক্রমণ চালায় সকাল ৯/১০ টার সময়। আমাদের পার্টি পাল্টা আক্রমণ চালায়। যুদ্ধ আধঘণ্টা স্থায়ী হয়। পাকসেনারা পিছু হটে যায়। এরপর ভারতীয় বিএসএফ ভারতে চলে যায়। আমরা ইপিআর-রা শেওলাতে গেলাম।

২৭/২৮ এপ্রিল আমরা মাত্র একটি প্লাটুন ইপিআর ছিলাম শেওলাতে। আনসার ৪-৫ জন ছিল। পাকসেনারা আবার আমাদের দিকে অগ্রসর হচ্ছে শুনে আমরা টিকতে পারবো না ভেবে বড়গ্রাম বিওপিতে চলে গেলাম। মেজর দত্ত ও ক্যাপ্টেন রব আমাদের ঐ ক্যাম্পে যান। আমাদের হেডকোয়ার্টার করলেন বাংলাদেশ চেকপোস্ট সুতারকান্দি চেকপোস্টে। আমরা তখন ৫০ জনের মত ইপিআর হলাম। আমরা ডিফেন্স নিলাম বড়গ্রাম, মনিরং, কোনাগ্রাম এবং সুতারকান্দি চেকপোস্টে। পাক বাহিনী ইতিমধ্যে শেওলা দখল করে নেয়।

মে মাসের প্রথম থেকে ক্যাপ্টেন রব থাকতেন সুতারকান্দি চেকপোস্টে। ক্যাপ্টেন রব আমাদের নির্দেশ দিলে ‘হিট এণ্ড রান’ পদ্ধতিতে যুদ্ধ করতে। আমরা হঠাৎ করে পাক আর্মির উপর আক্রমণ করে আবার ঘাঁটিতে ফিরে আসি।

মে মাসের ২৩ তারিখে সব অবস্থান থেকে কিছু কিছু করে ইপিআর নিয়ে একটি প্লাটুন তৈরী করে হাবিলদার শামসুল হকে নেতৃত্বে লাতু নামক স্থানে যাই পাকসেনাদের আক্রমণ করতে। ঐ তারিখ রাতে আমরা পাক ঘাঁটির উপর ৩” মর্টার দিয়ে আক্রমণ করি। কিছু লোক ওখানে থাকে সকালে পর্যন্ত আক্রমণের ফলাফল দেখার জন্য। আমরা ১৪ জনের মত রাতেই ফিরে আসি।

২৪ শে মে ভোরে কয়েকশত পাকসেনা পুরা ভারী অস্ত্র নিয়ে আমাদের দিকে এগোতে থাকে। আমরা প্রথমে দেখতে পাইনি। আমাদের বড়গ্রাম, মন্দিরপোর্ট, কোনাগ্রাম পিছে ফেলে আমাদের চেকপোস্টে হামলা চালায়। আমরা তখন তিনটি ঘাঁটি থেকে একই সময় রাস্তার উপর দিয়ে অগ্রসরমান পাকসেনাদের আঘাত হানতে থাকি। চারিদিকের আক্রমণে বহু পাকসেনা নিহত হয়। পাকসেনারা পিছু হটে ফায়ার স্টপ করে। আমরা গুলির শব্দ না পেয়ে তিন পার্টিই রাস্তার উপর উঠে পড়ি, এমন সময় পিছন দিক থেকে আমার গুলির শব্দ পেলাম। পিছে গিয়ে দেখলাম, সমগ্র বড়গ্রাম ৩০০ মত পাকসেনা ঘিরে ফেলেছে, অপর দিকে কোনাগ্রামও ঘিরতে চেষ্টা করছে পাকসেনাদের অপর দল। আমাদের তখন একটাই পথ খোলা ছিল। আমাদের তখন গোলাবারুদ প্রায় শেষ, অস্ত্রও অনেক অকেজো। আমরা পিছু হটে পালাতে টেষ্টা করি। পাকসেনারা আমাদের পিছু ধাওয়া করে। এই সময় বেসামরিক বেশ কিছু লোক পাকবাহিনীর হাতে নিহত হয়। আমরা ৯জন রাস্তা ধরে ভারতের অর্ধ মাইল ভিতের চলে যাই। পাকসেনা তখনও গুলি ছুড়তে ছুড়তে এগিয়ে আসছিল। আমাদের আর পিছু হটার ক্ষমতা ছিল না। ৭/৮ জন পাকসেনারা গুলি করতে করতে ভারতে ঢুকে পড়ে। আমরা ভারতের ঐ স্থানে ৫টি এল-এম-জি পড়ে থাকতে দেখি একসাতে প্রস্তুত অবস্থায়। আমরা তখনই ৫টি এলএমজি নিয়ে পজিশন নিই। আমাদের কাছাকাছি আসলে আমরা গুলি চালাই। একজন সঙ্গে সঙ্গে পড়ে যায়। বাকিরা সব পালাতে থাকে। আমরা পাকবাহিনীর পিছু ধাওয়া করি। যে পাক সেনাটি পড়ে যায় তাকে আহত অবস্থার বন্দী করি। সে ছিল ৩১ পাঞ্জাবের হাবিলদার দোস্ত মোহাম্মদ। এই সময় ভারতীয় বিএসএফ বাহিনীর একজন কর্ণেল এসে বন্দীসহ আমাদেরকে ভারতে ফকিরাবাজার নিয়ে যান। এরপর পাকসেনারা এই এলাকা দখল করে নেয়। আমরা সবাই ভারতে আশ্রই নিই। আমি ৪নং সেক্টরে কর্নেল সি,আর, দত্তের নেতৃত্বে যুদ্ধ করি। আমার কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন রব।

———————————————

 

 

সশস্ত্র প্রতিরোধঃ কুষ্টিয়া-চুয়াডাঙ্গা

 

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৭। কুষ্টিয়া-চুয়াডাঙ্গার সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ বাংলা একাডেমীর দলিলপত্র ১৯৭১

 

<৯, ৭.১, ২৩৪-২৪৭>

চুয়াডাঙ্গা-কুষ্টিয়ার প্রতিরোধ যুদ্ধের বিবরণ

সাক্ষাৎকারঃ লেঃ কর্নেল এম এ ওসমান চৌধুরী

(১৯৭১ সালে মেজর পদে কর্মরত ছিলেন)

৩১-১-১৯৭৪

আমি ইপিআর, ৪র্থ উইং-এর ভার গ্রহণ করার পূর্ব থেকেই ওখানে (চুয়াডাঙ্গায়) ছিলেন দুইজন ক্যাপ্টেন-সহকারী উইং কমান্ডার হিসাবে। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন বাঙালি। নাম তার ক্যাপ্টেন এ আর আজম চৌধুরী (বর্তমানে মেজর), দ্বিতীয় জন ছিলেন অবাঙালি, তার নাম ক্যাপ্টেন (মরহুম) সাদেক।

এই উইং-এর অধীনে ছিল ৫টি কোম্পানী। ১টি কোম্পানী চুয়াডাঙ্গা হেডকোয়ার্টারে, অন্য চারটি ছিল সীমান্ত এলাকায়। উইং-এর সীমান্ত এলাকা ছিল দক্ষিণে মাসলিয়া বিওপি থেকে উত্তরে মহেশকুন্ডি বিওপি পর্যন্ত। প্রত্যেকটি কোম্পানীর কমান্ডার ছিল একেকজন সুবেদার। মোট সৈন্যসংখ্যা ছিল প্রায় ৮৫০। তার মধ্যে আনুমানিক অবাঙালি সেনার সংখ্যা ছিল ১৫০।

২০শে মার্চ ১৯৭১ সন। চট্টগ্রাম থেকে আমার ব্যক্তিগত গাড়ীটি সড়ক পথে চুয়াডাঙ্গা এসে পৌঁছল। ২৪শে মার্চ সকাল ১০টায় ওই গাড়ী করেই আমার স্ত্রী কন্যাদের নিয়ে মেহেরপুরের পথে কুষ্টিয়া রওনা হই। আমার পরনে ছিল ইপিআর পোশাক। সাথে চলল ইপিআর জীপে চড়ে ৪ জন সশস্ত্র ইপিআর সৈনিক। উদ্দেশ্য ছিল, আমার সরকারী বাড়ী মেরামত করার খরচ হিসাবে কুষ্টিয়ার ডিসি’র কাছ থেকে ৫ হাজার টাকা সংগ্রহ করা। ইচ্ছা ছিল, ঐ দিনই কাজ সেরে কুষ্টিয়ায় রাত্রি যাপন করার পর ২৫শে মার্চের পূর্বাহ্নেই চুয়াডাঙ্গা ফেরত আসার। কিন্তু মেহেরপুরে গিয়েই গাড়ীটা আমার নষ্ট হয়ে গেল। কিছুতেই দোষ খুঁজে পেলাম না। জীপ ফেরত পাঠিয়ে চুয়াডাঙ্গা থেকে মেকানিকস আনালাম। গাড়ী ঠিক হতে হতে বিকেল ৩টা বেজে গেল। আবার রওনা কুষ্টিয়া অভিমুখে। আরো ১৫ মাইল যাবার পর খারাপ হয়ে গেল। বাধ্য হয়ে আশে-পাশের বাড়ী থেকে পাটের রশি সংগ্রহ করে জীপের পেছনে গাড়ীকে বেঁধে কুষ্টিয়া পৌঁছলাম। উঠলাম কুষ্টিয়া সার্কিট হাউসে।

পরদিন ২৫শে মার্চ সকাল সাড়ে ৯টায় ডেপুটি কমিশনার সাহেবের অফিসে গেলাম। ডেপুটি কমিশনার ছিলেন জনাব শামসুল হক। তাঁর অফিস ও বাসস্থান ছিল একই প্রাঙ্গণে। তিনি আসলেন, কথাবার্তা হল, চায়ের পর্ব শেষ হল। তারপর পিয়নের মারফত ডাকলেন ল্যাণ্ড একুইজিসন অফিসারকে। এল এ সাহেব আসলেন, সব শুনলেন, তারপর গেলেন অফিসে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও চেকবুক আনবার জন্য। অসহযোগ আন্দোলনের প্রতিবন্ধকতা সেরে আমাকে চেক ইস্যু করতে করতে বেলা দেড়টা বেজে গেল। তখনকার ন্যাশনাল ব্যাংক বন্ধ হয়ে গেল, তাই টাকা আর উঠানো গেল না। চুয়াডাঙ্গায় এমন কোন জরুরী অবস্থা ছিল না তাই টাকা সাথে করে নিয়ে যাবো মনে করেই ২৫শে মার্চ রাতেও কুষ্টিয়া সার্কিট হাউসে রয়ে গেলাম।

২৬শে মার্চ ভোর ৬টায় ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় গিয়ে দেখতে পেলাম অল্প দূরেই রাস্তার উপর মিলিটারী জীপে করে পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর লোক টহল দিচ্ছে আর জানিয়ে দিচ্ছে ৩০ ঘণ্টার জন্য কারফিউ। কুষ্টিয়ার জনসাধারণ ঘরে বসেই দরজা জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখছে। ব্যাপারটা কেমন যেন ঘোলাটে মনে হল। ডিসি’কে টেলিফোন করে জেনে নিতে চাইলাম ব্যাপার কি? কিন্তু টেলিফোন উঠিয়ে এটার কোন সাড়াই পেলাম না। বুঝতে পারলাম লাইন কেটে দিয়েছে। পিছনে চেয়ে দেখলাম সামরিক বাহিনী সার্কিট হাউসের ঠিক পিছনেই তথা জিলা স্কুলে করেছে তাদের সদর দপ্তর। কি করব বুঝতেই পারলাম না। এই বিভ্রান্তিকর অবস্থাতেই কেটে গেল তিন ঘণ্টা। রেডিও লাগান ছিল, ঢাকা বেতারের নিয়মিত প্রোগ্রামটা শুনে যাচ্ছিলাম। তা থেকে শুভাশুভ কিছুই বুঝতে পারলাম না। সাড়ে ৮টা কি ৯টার দিকে হঠাৎ ঘোষণা করা হল নতুন নতুন ‘মার্শাল ল’ আইন। কেঁড়ে নিল আমাদের ব্যক্তি ও বাক স্বাধীনতা। বুঝতে পারলাম, বোধ হয় এসেছে আমাদের সেই চরম ও পরম পরীক্ষার দিন। আর এক মুহূর্তও কুষ্টিয়ায় থাকা সমীচীন মনে করলাম না। জীপের পেছনে আবার গাড়ীটাকে বেঁধে এবার উল্টাদিকে অর্থাৎ ঝিনাইদহের দিকে যথাসম্ভব তীব্র গাড়ী চালিয়ে দিলাম। ভাগ্য ভাল কুষ্টিয়ার সার্কিট হাউস ছিল শহরের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত। কাজেই কুষ্টিয়া শহরের সীমা অতিক্রম করতে আমাদের এক মিনিটের বেশী সময় লাগেনি। দূর থেকে ইপিআর-এর পোশাক পরা অবস্থায় আমাদের দেখেও আমাদের কিছুই ওরা বলেনি। কেন বলেনি সেটা পরে যতবার ভেবেছি, ততবারই ওদের বোকামি ছাড়া কিছুই মনে করতে পারিনি। তবে আমি মনে করি এটা বোধ হয় আল্লাহরই মহিমা। বেলা ১১টায় ঝিনাইদহ পৌঁছে দেখি শহর লোকে লোকারণ্য। আমার জীপকে আসতে দেখে তারা রাস্তা ছেঁড়ে দিল।

এখানে একটু বলে রাখা ভাল যে, চুয়াডাঙ্গার ইপিআর-এর ৪র্থ উইং-এর ইতিহাসে আমি ছিলাম প্রথম বাঙালি কমান্ডার। আমার বা আমার পরিবারের কারও গায়ের রং দেশে স্থানীয় লোক বিশ্বাসই করতে পারেনি যে আমরা বাঙালি। তাছাড়া এই স্বল্প সময়ে জনসাধারণের সাথে পরিচয় করাও সম্ভব হয়নি। স্থানীয় লোকজনের সাথে পরিচয় করার ওটাই একটা সুবর্ণ সুযোগ মনে করে আমি গাড়ী থেকে নেমে বাংলা ভাষায় লোকজনকে ডাকলাম। লোকজন সবাই দৌড়ে আসল। পরিচয় পেয়ে উৎসাহিত হল। আমার আহবানে সমস্ত সহযোগিতার আশ্বাস দিল। আমি তাদেরকে প্রস্তুত থাকবার উপদেশ দিয়ে সেখান থেকে চুয়াডাঙ্গা অভিমুখে রওনা দিলাম।

আনুমানিক বেলা ১টায় চুয়াডাঙ্গা আমার সদর দপ্তরের সামনের রাস্তায় পৌঁছলাম। আমার গাড়ী দাঁড়াবার সাথে সাথেই আমার বাঙালি উইং হাবিলদার-মেজর মজিবর রহমান এসে অভিবাদন করে ঢাকার ঘটনার আনুপূর্বিক বিবরণ দিল। আরও জানাল যে, ক্যাপ্টেন আজম চৌধুরীর কোনরকম নির্দেশ ছাড়াই উইং হেডকোয়ার্টারের সমস্ত অবাঙালি সেনাদের সে আটক করে রেখেছে এবং অস্ত্রাগার থেকে সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র সরিয়ে নিরাপদ স্থানে লুকিয়ে রেখেছে।

হাবিলদার মেজর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দুরভিসন্ধির খবরও আমাকে জানাল। সেটা হল যে ২৫শে মার্চ বিকেলবেলা হঠাৎ করে যশোর থেকে তৎকালীন ইপিআর সেক্টরের উপ-অধিনায়ক অবাঙালি মেজর সরদার আবদুল কাদের চুয়াডাঙ্গা এসেছিল যশোরে একটা অত্যন্ত জরুরী মিটিং-এর অজুহাতে আমাকে নিয়ে যানার জন্য। কিন্তু যখন শুনল আমি চুয়াডাঙ্গায় নেই তখন সে ক্যাপ্টেন সাদেকের বাসায় রাত্রি যাপন করে ২৬শে মার্চ ভোর ৪টার সময় ক্যাপ্টেন সাদেক ও তার পরিবারবর্গকে নিয়ে যশোরে পালিয়ে যায়।

যাই হোক, হাবিলদার মেজরের কাছ থেকে আনুপূর্বিক সমস্ত ঘটনা জানতে পেরে আমি মনে মনে একটা সিদ্ধান্তে প্রায় পৌঁছতে পারলাম। তবুও তাদেরকে সর্বতোভাবে তৈরি থাকতে নির্দেশ দিয়ে আমি আমার বাসভবনে চলে গেলাম। সেখানে গিয়েই আমি আমার অফিসার ক্যাপ্টেন আজম চৌধুরী ও আওয়ামী লীগের স্থানীয় এমপি ডাঃ আসহাবুল হক ও স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তা, বেসামরিক কর্মচারী প্রমুখদের জরুরীভাবে তলব করে পাঠালাম। ডাঃ আসহাবুল বোধ হয় তৈরিই ছিলেন আমার অপেক্ষায়। খবর পেয়ে ৫ মিনিটের মধ্যে তিনি এসে উপস্থিত হলেন। অন্যান্য সবাই আসার পর আমি তাদেরকে নিয়ে একটা রুদ্ধদ্বার বৈঠক করলাম। ২৫শে মার্চ রাত ১২টার পর থেকে তখন পর্যন্ত ঢাকা এবং অন্যান্য জায়গায় আনুপূর্বিক সমস্ত ঘটনা ও দুর্ঘটনা নিয়ে আলোচনা করলাম। সর্বসম্মতিক্রমে স্থির করা গেল, এ অন্যায় আমরা সইব না। শপথ নিলাম আমরা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করব, যুদ্ধ করব এবং যেমন করেই হোক নিজের প্রানের বিনিময়ে হলেও মাতৃভূমিকে এই পশুশক্তির কালো হাত থেকে রক্ষা করব। সবাই আমাকে সমস্ত সামরিক ও বেসামরিক কার্যকলাপের প্রধান বলে মেনে নিলেন। আমিও নির্দেশ জারি করলাম যে, সেই থেকে আমার নির্দেশ মতই সবাইকে আপন আপন কাজ সমাধা করতে হবে। সমস্ত সিদ্ধান্তের পর আমি সমস্ত সামরিক ও বেসামরিক কর্মচারীদের সমভিব্যহার আমার উইং-এর কোয়ার্টার গার্ডে বাংলাদেশের পতাকা সসম্মানে উত্তোলন করে ওটাকে জাতীয় অভিবাদন দিলাম। এটা যে একটা কত বড় জীবনের ঝুঁকি, বিশেষ করে যখন কোন রকম সংযোগবিহীন অবস্থায় বিনা নির্দেশে এবং আর কেউ বিদ্রোহ করেছে কিনা, সেটা না জেনেই সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত চেতনায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মত একটা এতবড় শক্তিশালী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা যে কত বড় চ্যালেঞ্জ, বিজ্ঞজন মাত্রেই তা অনুধাবন করতে পারবেন।

তারপর আমি আমার সৈন্য ও ভারী অস্ত্র নানা গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় অবস্থান করানো এবং গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ব্যারিকেড সৃষ্টি করা ইত্যাদি সামরিক ও বেসামরিক নির্দেশ দানে প্রায় অর্ধারাত অতিবাহিত করি। ইতিমধ্যে অয়ারলেস মারফত সীমান্তের আমার সৈন্যদেরকেও অবস্থা বর্ণনা করে সজাগ থাকতে নির্দেশ দিই। এইভাবে অতিবাহিত হল ২৬শে মার্চ।

২৭শে মার্চ সকাল ৭ ঘটিকায় মাসলিয়া বিওপি কোম্পানী হেডকোয়ার্টার থেকে কোম্পানী কমান্ডার সুবেদার আব্দুল মজিদ মোল্লা অয়ারলেস মারফত জানালেন যে ক্যাপ্টেন সাদেক তিনজন সৈনিকসহ যশোর থেকে সীমান্ত রাস্তা দিয়ে মাসলিয়া বিওপিতে প্রবেশ করেছে। আমি তাকে ক্যাপ্টেন সাদেকের উপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখার নির্দেশ দিলাম। খবরটা পেয়ে আমি অনুমান করেছিলাম যে, হয়তবা ২৬শে মার্চ ভোর ৪টা পর্যন্ত কুষ্টিয়া থেকে আসতে পারিনি লক্ষ্য করেই বোধ হয় ক্যাপ্টেন সাদেক ভেবেছিল যে, সীমান্তের সৈন্যদেরকে নিশ্চয় কোন রকম সজাগ থাকার আদেশ দেওয়া হয়নি। তাই তার মাসলিয়া যাবার উদ্দেশ্য সৈন্যদেরকে চতুরতার সাথে নিরস্ত্র করা।

যাই হোক, প্রায় ১০ মিনিট পর সুবেদার মজিদ মোল্লা জানান যে, ক্যাপ্টেন সাদেক আদেশ পালন না করার অপরাধে একজন বাঙালি সিপাহি-এর উপর পিস্তলের গুলি করে যশোর অভিমুখে জীপে করে পালিয়ে যায়। অবশ্য, এরপর আমার নির্দেশ অনুসারে পরবর্তী বিওপিকে খবর দিয়ে গুলির বিনিময়ে তাদের গতি রোধ করা হয়। গোলাগুলিতে ক্যাপ্টেন সাদেক ও তার সঙ্গীরা মারা যায়। কিছুক্ষণ পর সুবেদার মজিদ মোল্লা অত্যন্ত ভীতস্বরে অয়ারলেসে আমাকে এ খবর জানায়। আমি তাকে অভয় দিয়ে মৃতদেহগুলি পুঁতে ফেলার আদেশ দেই। এইখানেই শুরু হয় আমার এলাকায় পদ্মার ওপারে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হনন পর্ব। এখানেই বুঝতে পারলাম- “I am in a point of no return. Either I have to kill the enemy or get killed.” (অনুবাদঃ এখন আর ফেরার কোন উপায় নেই। হয় আমাকে শত্রুকে মারতে হবে, অথবা মরতে হবে)

কুষ্টিয়া পুনর্দখলের পরিকল্পনাঃ ডাঃ আসহাবুল হক সাহেবকে খবর দিলাম। দুই কমরেড মিলে ছক আঁকলাম-কুষ্টিয়া আমাকে পুনরুদ্ধার করতেই হবে। পরিকল্পনা করলাম পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে। সীমান্তের সৈন্যবাহিনীকে জরুরী ভিত্তিতে চুয়াডাঙ্গায় জমায়েত হবার নির্দেশ দিলাম। ফিলিপনগর কোম্পানীকে একটা নির্দিষ্ট সময়ে কুষ্টিয়া শহরের অদূরে একটা নির্দিষ্ট স্থানে সমবেত হবার পর পরবর্তী আদেশের অপেক্ষা করতে নির্দেশ দিলাম। এই কোম্পানীর কমান্ডার ছিলেন সুবেদার মোজাফফর আহমেদ (বর্তমানে লেঃ ইপিআর)। দুই কমরেড মিলে ঐ এলাকার নামকরণ করলাম- “সাউথ ওয়েস্টার্ণ কমাণ্ড দক্ষিণ পশ্চিম রণাঙ্গন” কমান্ডার হলাম আমি মেজর মোহাম্মদ আবু ওসমান চৌধুরী (বর্তমানে লেঃ কর্নেল)।

এখানে কুষ্টিয়ার শত্রুর সৈন্যসংখ্যা ও তাদের শক্তির উপর কিছুটা আলোকপাত করা দরকার। যশোর ব্রিগেড থেকে ২৭ বেলুচ রেজিমেন্ট তথা রিকনাইসেন্স ও সাপোর্ট ব্যাটালিয়নের এক কোম্পানী-অর্থাৎ প্রায় ২০০ সৈন্য কুষ্টিয়া অধিকার করে ২৫/২৬শে মার্চ রাত দেড়তায়। তাদের সাথে ছিল পর্যাপ্তসংখ্যক ১০৬ এম-এম আর-আর (জীপে সংস্থাপিত) চীনা এইচ-এম-জি, এলএমজি, এসএমসি ও অটোমেটিক রাইফেলসমূহ। তার সাথে প্রচুর পরিমাণ গোলাবারুদ, গাড়ী ও বেতারযন্ত্র ছিল। তুলনামূলকভাবে রেকি ও সাপোর্ট কোম্পানীর ফায়ার পাওয়ার একটা সাধারণ ইনফ্যানট্রি ব্যাটালিয়নের প্রায় সমপরিমাণ এই সত্য আমার ভাল করেই জানা ছিল। আমি জানতাম, যুদ্ধের প্রচলিত নিয়ম অনুসারে আমি অন্ততঃপক্ষে সমান ধ্বংসাত্মক মরণাস্ত্র নিয়ে তিনগুন সৈন্যের কম হলে ওদেরকে আক্রমণ করতে পারি না। কুষ্টিয়ার শত্রুদের অধিনায়ক ছিলেন মেজর শোয়েব। তার সাথে উপ-অধিনায়করা ছিল ক্যাপ্টেন শাকিল, ক্যাপ্টেন সামাদ ও লেঃ আতাউল্লাহ শাহ্‌।

আমার মোট সৈন্যসংখ্যা ছিল প্রায় ৭০০ জন ইপিআর সৈনিক। তাদের অস্ত্র বলতে ছিল ৩০৩ রাইফেল, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ৩০৩ এলএমজি, এমজি ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের মর্চে পড়া ৪টা ৩.৫ রকেট লাঞ্চার। গোলাবারুদের সংখ্যা একেবারেই ছিল অপর্যাপ্ত। তদুপরি ছিল আধুনিক যুদ্ধে অনভিজ্ঞ ও অশিক্ষিত লোকজন। অফিসার বলতে আমার সাথে ছিল একমাত্র ক্যাপ্টেন আজম চৌধুরী। তবে ভরসা ছিল এই যে আমার সাথে ছিল সমস্ত জনসাধারণ।

তবুও পরিকল্পনা অনুযায়ী আমি কিছু সংখ্যক আনসার ও মুজাহিদকে একদিনের ট্রেনিং –এর পর আমার বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করি। স্থানীয় পুলিশ ও আনসারদের ৩০৩ রাইফেলগুলো দ্বারা এই বাহিনীকে সজ্জিত করি।

আমার কাছে কোন রকম ফিল্ড অয়ারলেস বা ফিল্ড টেলিফোন কম্যুনিকেশনের ব্যবস্থা ছিল না। তাই টেলিফোন বিভাগের সাহায্যে পোড়াদহের খোলা প্রান্তরে ফিল্ড এক্সচেঞ্জ লাগিয়ে দেওয়া হয়। সেনাবাহিনীর ন্যায় খাদ্য সরবরাহের কোন রকম নিয়মিত পদ্ধতি না থাকায় ভলান্টিয়ার গ্রুপের কিছু লোকে কুষ্টিয়ায় পাঠিয়ে সেখানকার আওয়ামী লীগ দলের গণ্যমান্যদের সাহায্যে আমার সমস্ত সৈন্যবাহিনীর খাদ্যের পুরোপুরি ব্যবস্থা করা হয়। আরও ব্যবস্থা হয় সেচ্ছাসেবক বাহিনীকে প্রয়োজনমত যথাস্থানে ব্যবহার করার। স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর হাতিয়ার বলতে ছিল বাঁশের লাঠি।

২৮শে মার্চ দুপুর ১২টা পর্যন্ত সীমান্তের সমস্ত কোম্পানী আদেশক্রমে চুয়াডাঙ্গায় সমবেত হয়। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী এক কোম্পানী সৈন্য আমি ঝিনাইদহে পাঠিয়ে দিই ও যশোর-ঝিনাইদহ রাস্তা অবরোধ করে রাখি, যেন যশোর থেকে কোন রকম সৈন্য বা অস্ত্র কুষ্টিয়াকে সরবরাহ করতে না পারে। আর এক কোম্পানী সৈন্যকে ঐদিন বিকেল বেলা ক্যাপ্টেন আজমের নেতৃত্বে চুয়াডাঙ্গা-পোড়াদহ কাঁচা রাস্তা দিয়ে আমি পোড়াদহ পাঠিয়ে দেই। ক্যাপ্টেন আজমের প্রতি নির্দেশ ছিল তার গন্তব্যস্থানে পৌঁছবার পরেই সে যেন সুবেদার মুজাফফরের কোম্পানী কুষ্টিয়ার পুলিশ লাইনের দিক দিয়ে আক্রমণ করবে, ক্যাপ্টেন আজমের কোম্পানী শহরের দক্ষিণ পশ্চিম কোণে অর্থাৎ সার্কিট হাউসের দিক দিয়ে আক্রমণ করবে এবং একটা প্লাটুন ও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর কিছু সংখ্যক লোক পূর্ব দিক থেকে মোহিনী মিল ও অয়ারলেস স্টেশনের উপর আক্রমণ চালাবে। আক্রমণ হবে সংযুক্তভাবে একই সময়ে তিন দিক থেকে।

আক্রমণের সময় ও তারিখ ছিল ২৯শে মার্চ ভোর ৪টা। পরিকল্পনায় এটাও ঠিক করে রাখা হয়েছিল যে, আক্রমণ শুরু হওয়ার প্রাক্কালে আমার বাহিনীর পশ্চাদভাগে যেন কমপক্ষে ৫ হাজার বেসামরিক লোক আক্রমণের সাথে সাথেই জয়ধ্বনি দিতে দিতে আক্রমণকারী বাহিনীকে অনুসরণ করে। এসময় বেসামরিক ব্যবস্থার ভার ছিল ডাঃ আসহাবুল হকের উপর যিনি তাঁর দলীয় লোক, স্থানীয় ছাত্র ও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সাহায্যে খুব সুষ্ঠুভাবেই সম্পন্ন করেছিলেন।

আক্রমণের সমস্ত আয়োজন সম্পূর্ণ, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল, চলাচল অসুবিধার জন্য ও একটা গাড়ী দুর্ঘটনার কবলে পতিত হওয়ার দরুন সুবেদার মুজাফফরের কোম্পানী নির্দিষ্ট স্থানে নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছতে পারেনি। তাই বাধ্য হয়ে আমি আক্রমণের দিন ও সময় ২৪ ঘণ্টা পিছিয়ে দিই। অর্থাৎ আক্রমণের নতুন দিন ও সময় স্থির করি ৩০শে মার্চ ভোর ৪টায়।

প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য যে, ২৬শে মার্চ সকাল ১০টায় আমার মাসলিয়ায় অবস্থানরত কোম্পানী কমান্ডার সুবেদার মজিদ মোল্লা অয়ারলেসে খবর পাঠালেন যে, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রথম ব্যাটালিয়ন, যারা সিনিয়র টাইগার নামে পরিচিত, তাদের সমস্ত সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র সহকারে বাঙালি কমান্ডার লেঃ কর্নেল রেজাউল জলিলের নেতৃত্বে চোগাছায় অবস্থান করছে। এই ব্যাটালিয়ন নাকি ২৪শে মার্চ তারিখে বাৎসরিক ফিল্ড এক্সসারসাইজের জন্য চৌগাছায় এসেছিল যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে। খবর শুনে আমার মনে বিরাট একটা ভরসা আসল। আমি অয়ারলেসে সুবেদার মজিদ মোল্লাকে দিয়ে আমার তরফ থেকে লিখে পাঠালাম লেঃ কর্নেল জলিলের কাছে। ঐ খবরে আমি লিখেছিলাম যে, ‘দেশের ও দেশের লোকের নিরাপত্তা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে বিপর্যস্ত, মা বোনদের ইজ্জত লুণ্ঠিত, জ্ঞানী-গুণী ও ছাত্ররা হতাহত হচ্ছে। তাই এর বিরুদ্ধে আমি আমার ইপিআর বাহিনীকে নিয়ে বিদ্রোহ করেছি, বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছি। আর কে কি করেছে জানি না। কিন্তু আপনি সিনিয়র, আপনার কাছে সৈন্য আছে, হাতিয়ার আছে। আপনি আসুন অধিনায়কত্ব গ্রহণ করুন। আমরা সম্মিলিত ভাবে এদের হনন করতে সক্ষম হব।’ সুবেদার মজিদ মোল্লা ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রথম ব্যাটালিয়নে গিয়ে এ সংবাদ তাঁর কাছে পৌঁছায়। কিন্তু অনেক অপেক্ষা করেও তাঁর কাছ থেকে কোন সদুত্তর পাওয়া যায়নি। আমাকে এ খবর দেয়ার পর ২৮শে মার্চ আবার এই মর্মে চিঠি লিখে দানেশ নামক এক বিশেষ মুক্তিযোদ্ধাকে তার মোটরসাইকেলে করেই লেঃ কর্নেল জলিলের কাছে পাঠাই। চিঠি তাঁর কাছে পৌঁছানো হয়, কিন্তু নিস্ফল সব আশা। তিনি কোন রকম আশ্বাস দেয়া দূরের কথা, আমার কার্যকলাপকে আদৌ গুরুত্ব না দিয়ে সেদিনই বিকেল বেলা যশোর ক্যান্টনমেন্টে তাঁর জীপে করে চলে যান এবং ২৯শে মার্চ পত্রবাহক মারফত ব্যাটালিয়নের কাছে সংবাদ পাঠান যে, যশোর ক্যান্টনমেন্টে কোন রকম গোলমাল নেই এবং তার আশঙ্কাও নেই, তার পুরো ব্যাটালিয়ন যেন যশোর ক্যান্টনমেন্টে সেদিনই ফেরত আসে। তদনুযায়ী এই ব্যাটালিয়ন ২৯শে মার্চ বিকেল পর্যন্ত যশোর ক্যান্টনমেন্টে ফেরত গিয়ে অস্ত্রশস্ত্র জমা করে আপন কাজে লিপ্ত হয়। শুনেছি, ব্রিগেডিয়ার সরদার আব্দুর রহিম দুররানী নাকি রাত্রেই তাদের অস্ত্রাগারের চাবি হস্তগত করে। পরদিন ৩০শে মার্চ সকাল ১০টায় এই ব্যাটালিয়নের অস্ত্রবিহীন সৈন্যদের উপর চতুর্দিক থেকে আক্রমণ ও গোলাগুলি বর্ষণ করা হয়। এই আক্রমণে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রথম ব্যাটালিয়নের অধিকাংশ সৈন্যই নিরীহভাবে মারা যায়। শুধু লেঃ হাফিজউদ্দিন (বর্তমানে ক্যাপ্টেন) ও ১৪৮ জন জেসিও এবং অন্যান্য সাধারণ সৈন্য জীবন নিয়ে পালিয়ে এসে আবার ঐ চৌগাছা এলাকায় সমবেত হয়। তাদের অস্ত্র নেই, খাবার নেই, পরনে কাপড় নেই। তারা বহুকষ্টে সীমান্তে ভারতীয় সীমান্ত বাহিনীর লোকজনের সাথে যোগাযোগ করে খাদ্য সংগ্রহ করে।

এদিকে কুষ্টিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রের ঘটনা হলো, ২৮শে মার্চ রাত থেকে ২৯শে মার্চ রাত পর্যন্ত অত্যন্ত গোপনীয়ভাবে আমাদের সৈন্যদের কুষ্টিয়া শহর থেকে অদূরে মাঠে ময়দানে ও জঙ্গলে অবস্থান করতে হয়। সুবেদার মুজাফফরের কোম্পানী নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছতে সক্ষম হয় ২৯শে মার্চ ভোরবেলা। নিয়মিত যোগাযোগ করে তাদেরকে আক্রমণের পরিকল্পনা সুষ্ঠুভাবে বুঝিয়ে দেয়া হয় এবং যথারীতি অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ, ঔষধপত্র ও বেসামরিক লোক সরবরাহ করা হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী ৩০শে মার্চ সকাল ৪টায় তিন দিক থেকে অতর্কিতভাবে কুষ্টিয়া আক্রমণ করি। আক্রমণের সাথে সাথে অনুসরণকারী জনগণের গগনবিদারী জয়ধ্বনিতে বোধ হয় শত্রুপক্ষের মনোবল ভেঙ্গে যায়। প্রায় ঘণ্টাখানেক তুমুল যুদ্ধের পর আমাদের সৈন্যরা পুলিশ লাইন ও অয়ারলেস কেন্দ্রের ভিতর ঢুকে পড়ে শত্রু হনন করতে থাকে। উপায়ান্তর না দেখে সামান্য সংখ্যক শত্রু সৈন্য তাদের অস্ত্রশস্ত্র ফেলে দিয়ে দ্রুতগতিতে তাদেরই সদর দপ্তরের দিকে পালিয়ে যায়। পালাবার প্রাক্কালেও অনেকে নিহত হয়। পুরোদিনের যুদ্ধে একমাত্র তাদের সদর দপ্তর ও পার্শ্ববর্তী এলাকা ব্যতীত সমস্ত শহরই আমাদের হস্তগত হয়। আমার সৈন্যরা শত্রুদেরকে ৩০শে মার্চ সারারাত চতুর্দিক থেকে ঘিরে রেখে মুহুর্মুহু জয়ধ্বনি সহকারে গোলাবর্ষণ করতে থাকে। শত্রুরা অয়ারলেস সেটের মারফত শত্রুপক্ষের অয়ারলেসের আবেদন মনিটরিং করে যশোরের দেওয়া প্রত্যুত্তর আমাদের হস্তগত হয়। যশোরের প্রত্যুত্তর ছিল- “Reinforcement not possible. Try to live on your own.” (অনুবাদঃ সহায়তা দেয়া সম্ভব নয়। তোমরা নিজেরা নিজেদের মতো বাঁচতে চেষ্টা কর)

পরদিন ৩১শে মার্চ ভোরবেলা আমাদের আক্রমণ পুরোপুরি সফল হতে পারেনি। তুমুল গোলাগুলির সাহায্যে শত্রুপক্ষ আমাদের মাথা নিচু রাখতে বাধ্য করে। সারাদিনের যুদ্ধের পর আনুমানিক জীবিত শত্রুর সংখ্যা ছিল ৪০/৪৫ জন। তার মধ্যে অফিসাররা সকলেই জীবিত ছিল। গত্যন্তর না দেখে রাতের অন্ধকারে তারা দুইটি জীপ ও একটি ডগ গাড়ীতে আরোহণ করে আমাদের ব্যূহ ভেদ করে তীব্র গতিতে ঝিনাইদহের দিকে পালিয়ে যেতে চেষ্টা করে। আমার সৈন্যরা সাথে সাথে তাদেরকে অনুসরণ করে। শত্রুদের ভাগ্য মন্দ। শৈলকূপার পুলের গোড়ায় আমরা গর্ত খনন করে তার-পোলিন দিয়ে সেই গর্তকে ঢেকে রেখেছিলাম সেটা তারা জানত না। তাদের প্রথম ২টা জীপ উপর্যুপরি গর্তে পড়ে গিয়ে মারাত্মকভাবে দুর্ঘটনায় পড়ে। মেজর শোয়েব ও কয়েকজন শত্রুসেনার সেখানে ভবলীলা সাঙ্গ হয়। বাকিরা আশেপাশের গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে, কিন্তু সজাগ মুক্তিযোদ্ধা, স্বেচ্ছাসেবক ও জনগণের হাত থেকে একটি শত্রুসেনাও বাঁচতে পারে নি। আমার নির্দেশে উৎসাহিত হয়ে তারা এক একজনকে হত্যা কতে তাদের হাতিয়ার এনে আমার সদর দপ্তরে জমা দেয়। এমনও হয়েছে একটি ছেলে একটা শটগান দিয়ে একজন এলএমজিধারী শত্রুসৈন্যকে হত্যা করে তার হাতের একটি আঙ্গুল ও এলএমজি আমার সদর দপ্তরে জমা করে। এই ছেলেটির বয়স ছিল ১৮/২০ বছর। নাম তার সুলতান আলী জোয়ারদার। যুদ্ধের প্রচণ্ডতা ও হৈ-হুল্লোড়ে এই ছেলেটির সাথে দেখা করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি।

সেই রাত্রেই লেঃ আতাউল্লাহ শাহ্‌ ধরা পড়ে। তাকে ঝিনাইদহে প্রাথমিক চিকিৎসার পর ২রা এপ্রিল বিকেলের দিকে আমার সদর দপ্তরে আনা হয়।

১লা এপ্রিল কুষ্টিয়া সম্পূর্ণরূপে আমাদের হাতে মুক্ত হয়। এরপর সামান্য সংখ্যক সৈন্য কুষ্টিয়ায় রেখে বাকি সৈন্যদের আমি ঝিনাইদহের দিকে পাঠিয়ে দেই। কিছু সংখ্যক সৈন্য মাগুরা, কিছু সংখ্যক ঝিনাইদহের দক্ষিণে বিশাখালী ও কিছু সংখ্যক সৈন্য কোটচাঁদপুরে অবস্থান করে। উদ্দেশ্য, যশোর থেকে উত্তর দিকে শত্রুদের অগ্রসর হবার সব পথ অবরোধ করে রাখা।

এদিকে ২৮শে মার্চ তারিখেই কলিকাতা হয়ে বহির্বিশ্বের সাথে টেলিফোন যোগাযোগ স্থাপন করা হয়। আমার মনে আছে টেলিফোনে আমি ও ডাঃ আসহাবুল হক পালাক্রমে কলিকাতার বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার কাছে যুদ্ধের খবর সরবরাহ করতাম।

এক রাত্রের কথা আমি ভুলব না। সেদিন বোধ হয় ২৮ কি ২৯ তারিখ রাত্রের ঘটনা। ঢাকা থেকে খবর পেলাম যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টরেট উপাধিধারী বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের নিজ নিজ ঘরে পাক সেনাবাহিনী অত্যন্ত ঘৃণ্যতমভাবে হত্যা করেছে। কলকাতার স্টেটসম্যান পত্রিকাকে টেলিফোনে এ খবর দিতে দিতে আমি ও ডাঃ আসহাবুল হক কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিলাম। সেদিন তাদেরকে এও বলেছিলাম যে, আমরাও এর প্রতিশোধ সমভাবেই গ্রহণ করব। কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গার অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ তথা জনাব ইউনুস আলী এমপিও, ব্যারিস্টার বাদল রশীদ, প্রিন্সিপাল ফুলে হোসেন, ইঞ্জিনিয়ার সাইফ উদ্দিন ও আরো অন্যান্যকে নানা বেসামরিক সংযোগ, অভ্যর্থনা, সাহায্য গ্রহণ ইত্যাদি কাজকর্মে নিযুক্ত করা হয়েছিল। স্থানীয় জনসাধারণ ও ছাত্র সমাজ প্রত্যেকেই আপন আপন সামর্থ্য ও সাধ্যানুযায়ী এই যুদ্ধের আয়োজন ও সরঞ্জামে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দিনরাত সাহায্য করেছিল।

বিদ্রোহ করার অব্যবহিত পড়ে বর্তমান রাষ্ট্রবন্ধু ভারতের সাথে সংযোগ হওয়ার সাথে সাথেই আমার স্ত্রীকে সেখানকার কোন নিরাপদ স্থানে পাঠিয়ে দিতে চেয়েছিলাম, বেশ পরে অনেক সুহৃদই এই প্রস্তাব করেছিল। কিন্তু আমার স্ত্রী ও মেয়েরা আমার সাথে যুদ্ধক্ষেত্রেই হাসিমুখে যেকোন পরিস্থিতিতেই থাকবার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল, তাই আর যাওয়া হল না। থাকল ওরা আমারই ট্যাক্টিক্যাল হেডকোয়ার্টারের একটি কামরায়। সেখানে থেকেই মিসেস ওসমান স্থানীয় সেনাদের খাবার ও পানীয় সরবরাহের কর্তৃত্ব গ্রহণ করে তা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করেন। এ কাজের ভার তাকে সঁপে দিতে হয় নি, নিজেই চিন্তা করে তা শুরু করেন। এমনকি সে রণাঙ্গনের যেসব সেনাদের স্ত্রী-পুত্র-পরিবার সেখানে থাকত, তাদের খাবার ও পানীয়, টাকা-পয়সা পৌঁছিয়ে দেবার দায়িত্বও তিনি পরিচালনা করেন। তার উপর হেডকোয়ার্টারে আমাকে বা প্রয়োজনবশত ডাঃ আসহাবুল হক ও অন্যান্য অফিসারদেরকে নানাভাবে সাহায্য করতে দ্বিধা করেননি। প্রয়োজনবশত মাটিতে পজিশন নেওয়া, পরিখাতে ঢুকে সতর্ক পাহারা দেওয়া, ঔষধপত্রের ব্যবস্থা করা, এমনকি অস্ত্রশস্ত্র-গোলাবারুদের ও সেনাসামন্তের মেইন্টেন করা, এ জাতীয় বহু কাজেও আমাদেরকে সক্রিয়ভাবে সাহায্য করতে তিনি অত্যন্ত আনন্দবোধ করেছিলেন। তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ করেননি সত্য, কিন্তু যুদ্ধের যে সরঞ্জাম তিনি দিয়েছিলেন, তা সক্রিয়ভাবে যুদ্ধ করার চেয়ে কোন অংশে কম নয়।

পরিকল্পনা ও নির্দেশ অনুযায়ী কুষ্টিয়ার সৈন্যদের তুলে নিয়ে ঝিনাইদহের দক্ষিণ-পশ্চিম ও পূর্ব-দক্ষিণের ভিন্ন ভিন্ন সামরিক গুরুত্বপূর্ণ স্থানে নিয়োগ করা হয়। যশোর সেনানিবাস থেকে শত্রুপক্ষ যাতে কোনো দিক দিয়ে পালিয়ে আমাদের পেছনে বা মধ্যে আসতে না পারে তার জন্য জোর পেট্রলিং করা হচ্ছিল।

এদিকে পূর্বনির্দেশ অনুযায়ী ক্যাপ্টেন আজম চৌধুরী কুষ্টিয়ায় অধিকৃত সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ ও গাড়ী ৩রা এপ্রিল অতি প্রত্যুষে হেডকোয়ার্টার চুয়াডাঙ্গা অভিমুখে পাঠিয়ে দেয়। সেদিন আমি ও ডাঃ আসহাবুল হক সাহেব যখন আমাদের পরবর্তী পরিকল্পনার খসড়া তৈরি করেছি, এমন সময় সেখানে এসে উপস্থিত হলো ফরাসী টেলিভিশন কর্পোরেশনের ভ্রাম্যমাণ দল। তারা আমার কাছে বিশ্বময় টেলিভিশন পাবলিসিটির জন্য আমার সাক্ষাৎকার চাইলেন। আমি চিন্তা করে দেখলাম, যে পর্যন্ত একমাত্র বিবিসি ও আকাশবাণী ছাড়া আর কোথাও আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সঠিক রূপ প্রকাশ পায়নি। এমনকি বিবিসি থেকেও ২/৪টা খুচরো সংবাদ ছাড়া বিশেষ কিছু প্রকাশ পেত না। অতচ বিশ্ববাসী আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সঠিক রূপ এবং যুদ্ধ চালিয়ে যাবার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞার বিষয়ে জানতে না পারলে তাদের সমর্থন পাওয়া অসম্ভব। বিশ্বের সমর্থন ছাড়া যে কোন মুক্তিযুদ্ধ লোকালাইজড হতে হতে শেষ পর্যন্ত নিঃশেষ হয়ে যেতে বাধ্য হয়। তাই এ সুযোগ আমি হেলায় ফেলতে পারলাম না। দীর্ঘ ১৫ মিনিট পর্যন্ত আমার সাক্ষাৎকার নেয়া হল। আমার ৬ বছরের ছোট মেয়ে, দাকনাম তার কলি, তখন কাগজের উপর বাংলাদেশের পতাকা বানিয়ে সেটাকে ছোট একটা কঞ্চিতে লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। এত কচি শিশুর এত উদ্দিপনা ও মনোবল তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। সেই মুহূর্তেই তারা কলির সেই ভঙ্গিমার মুভি শট নিলেন, আরও নিলেন আমার স্ত্রী, বড় মেয়ে চম্পা এবং অন্যান্য আরও দু’চার-জনের সংক্ষিপ্ত কথা ও ছবি। আমাদের সৈনিকদের মনোবল দেখানো হলো নানাস্থানে ভারী অস্ত্রে সজ্জিত অবস্থান। বেলা তখন প্রায় সকাল ১০টা। এসে গেল কুষ্টিয়া হতে প্রেরিত অধিকৃত অস্ত্রশস্ত্র ও যানবাহনের কনভয়। কুষ্টিয়ার যুদ্ধে আমাদের অভাবনীয় জয়ের সেগুলি ছিল জীবন্ত নিদর্শন। টেলিভিশন কর্পোরেশনের সদস্যরা বেশ উৎসাহিত হলেন। সাথে সাথে সমস্ত ‘কনভয়’কে হেডকোয়ার্টারের সম্মুখে অবস্থিত রাস্তার উপর সার বাঁধিয়ে বড় বড় কামান ও মেশিনগুলির ভাল করে ডিসপ্লে করে রাখা হল। একের পর এক সুষ্ঠুভাবে তারা নিলেন এগুলোর জীবন্ত ছায়াছবি। আমাদের হাতে বন্দী লেঃ আতাউল্লাহ শাহ্‌কেও আনিয়ে মাথার ব্যান্ডেজ বাধা অবস্থায় সেই লাইনের অধিকৃত একটি জীপের পাশে বসিয়ে দেয়া হল। দীর্ঘ ১৫ মিনিট পর্যন্ত ধরা পড়ল তার জীবন্ত সাক্ষাৎকার।

আল্লাহ্‌র কি ইচ্ছা, শুটিং শেষ করে কর্পোরেশনের সদস্যরা তাদের টেপরেকর্ডার ও মুভি ক্যামেরা গুটাতে যাবে, ঠিক এমনি সময় আসল চুয়াডাঙ্গার উপরে পাকিস্তান বিমান বাহিনীর বিমান হামলা। চলল বিমানে-জমিনে লড়াই। কর্ণবিদারী আওয়াজে মুখরিত হয় চুয়াডাঙ্গা। এই সুযোগের অপচয় করেননি ফরাসী টেলিভিশন কর্পোরেশনের নির্ভীক সদস্যরা। অসম সাহসের সাধে তারা নিতে লাগলেন বিমানের উড্ডয়ন, বোমা ও রকেট নিক্ষেপ, জমিনমুখী গুলি ও এন্টি-এয়ারক্রাফট ফায়ার-এর ছবি ও আওয়াজ। ধরা পড়ল তাতে সৈন্যদের ব্যস্তসমস্ত অ্যাকশন ও রিঅ্যাকশনের জীবন্ত ছবি। বাংলার মাটিতে নিক্ষিপ্ত হল প্রথম নাপাম বোমা চুয়াডাঙ্গার ইপিআর উইং-এর প্রাক্তন হেডকোয়ার্টার ভবনে। ধরে গেল আগুন। কর্পোরেশনের সদস্যরা ভাগ্যবশত ঠিক সেখানটায় উপস্থিত ছিলেন। নাপাম বোমার নিক্ষেপ থেকে শুরু করে টার্গেট হিট, আগুন ধরা সবকিছুর জীবন্ত ছবি উঠে গেলো তাদের ক্যামেরায়। ওরা এত নির্ভীক যে ত্রস্ত গতিতে গাছের উপর উঠেও তারা এই আকাশ ও জমিনের যুদ্ধের ছবি তোলা পরিচালনা করেন।

এই যুদ্ধে আমাদের বিশেষ কিছু ক্ষতি হয় নি, শুধু একজন স্বেচ্ছাসেবকের গায়ে বোমার সামান্য একটা টুকরা লেগে সামান্য আহত হয়। তবে চুয়াডাঙ্গা শহরের ঠিক দক্ষিণ ভাগে একটা বাড়ীর কুঁড়েঘরে নাপাম বোমা নিক্ষিপ্ত হলে সে ঘরটা পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এত সুষ্ঠুভাবে এত সাহসের সহিত টিভির সদস্যরা এই জীবন্ত ছবি তোলার কাজ সমাপন করেন যে তাদেরকে আমি সালাম না জানিয়ে পারিনি।

আমার মনে আছে, এই মুভি রীলের মধ্যে আমি জোর দিয়ে একটা কথা পরিষ্কারভাবে বিশ্বকে জানিয়ে দিতে চেয়েছি যে, আমরা পৃথিবীর স্বাধীন দেশগুলোর শুধু নৈতিক সমর্থন চাই, বস্তুগত সমর্থনের দরকার আমাদের নেই, কারণ আমার হাতের চীনা এসএমজি’টা দেখিয়ে ওদেরকে শত্রুর অস্ত্র দিয়েই আমরা শত্রুকে হনন করবো।

পরিশেষে এই টিভি সদস্যদল আমাদের কাছে বিদায় গ্রহণ করে কলিকাতা যান। বলে গেলেন যে, তারা প্যারিসে সেদিনই চলে যাবেন এই অ্যাকশন ফিল্মের পাবলিসিটি দেবার জন্য।

পরবর্তীকালে এই সদস্যদলের দ্বিতীয়বার আগমন জানাতে পারলাম, তাঁরা নাকি এই ফিল্মের কপি আরও ৫১টি বিদেশী রাষ্ট্রের কাছে বিক্রি করেছে। আরো জানতে ও শুনতে পেলাম নামকরা চলচ্চিত্র পরিচালকের মাস্টার পিস ফিল্ম প্রোডাকশনের মত এই যুদ্ধের ফিল্মটিও সারা বিশ্বে সুপারহিট করেছিল, কারণ এটাই সে পর্যন্ত বহির্বিশ্বে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা ও প্রতিজ্ঞা সাফল্যজনকভাবে বিশ্বের স্বাধীনচেতা লোকদের মনোযোগ ও সমর্থন আকর্ষণ করতে পেরেছেন। লণ্ডন, ওয়াশিংটন ও অন্যান্য জায়গা থেকে সামরিক ও বেসামরিক অফিসাররাও এই সত্যের স্বীকৃতি দিয়েছিলেন।

ইতিমধ্যে ভারতীয় সীমান্ত বাহিনীর কাছ থেকে কিছু কিছু ৩০৩ রাইফেল, ২/১টা এলএমজি, কিছু স্টেনগান ও সামান্য পরিমাণ গোলাবারুদ পেয়েছিলাম। অনেকে ভারত থেকে আমার কাছে এসেছিলেন দেখা করতে সামান্য কিছু রিলিফ সামগ্রী নিয়ে। তাঁদের মধ্যে বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির খ্যাতনামা সেক্রেটারী শ্রী এম কে ভিমানী এবং বিহারের মুখ্যমন্ত্রী এসে আমার কাছ থেকে আমার কি কি প্রয়োজন তার একটা ফর্দ করে নিয়ে গেলেন। কিন্তু ঐ ফর্দের কোন জিনিসই কোন কালে পেলাম না, তাদেরও আর সাক্ষাৎ পেলাম না। অবশ্য শ্রী ভিমানী আমার সৈন্যদের যে পরিমাণ রিলিফ সামগ্রী পাঠিয়েছিলেন, তাতে যুদ্ধক্ষেত্রে বুট, কাপড়, ঔষধপত্র থেকে আরম্ভ করে ওদের কোন কিছুরই অভাব হয়নি।

ভারতের সাথে যোগাযোগ

৫ই এপ্রিল, ১৯৭১ সন, সময় সকাল ১০টা। সীমান্তবর্তী জীবননগর থানা থেকে খবর আসল আমার সদর দপ্তরে যে, মাননীয় তাজউদ্দীন সাহেব এবং ভারতীয় কয়েকজন উচ্চপদস্থ অফিসার আমার সাথে দেখা করার জন্য জীবননগর সীমান্তে অবস্থান করছেন। যথাসম্ভব দ্রুতগতিতে আমার সেখানে যাওয়া উচিৎ। একটি জীপে চড়ে ২জন সৈনিক সাথে করে রওনা হলাম। সীমান্ত পার হয়ে ভারতের মাটিতে পা দিতেই লেঃ কর্নেল এইচ আর চক্রবর্তী (সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর ৭৬ নং ব্যাটালিয়ন কমান্ডার, কৃষ্ণনগর) আমাকে জোর আলিঙ্গন করে গ্রহণ করেন ও আমার বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধের ভূয়সী প্রশংসা করেন। সেখানে দেখা হয় তাজউদ্দীন সাহেব এবং ভারতের সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর আই-জি সাহেবের সাথে। মনোযোগ সহকারে তাঁরা শুনলেন আমার রণাঙ্গনের আদ্যোপান্ত ইতিহাস। শুনতে চাইলেন আমার যশোর আক্রমণের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। আরও শুনতে চাইলেন ঐ পরিকল্পনাকে সার্থক করতে হলে আমার কি কি প্রয়োজন। বললাম সবকিছু। তাজউদ্দীন সাহেব আশ্বাস দিলেন যে, যথাশীঘ্রই আমরা সব পাব। লেঃ  কর্নেল চক্রবর্তী এত বেশী আবেগপ্রবণ হয়ে গেলেন যে, তখনই তিনি সাথে করে আনা একটি চেকোস্লোভাকিয়ান এলএমজি দিতে চাইলেন। এটার ব্যবহারকৌশল আমার জানা ছিল না বলে তিনি আমাকে দুপুরের খাবারের পর নিয়ে গেলেন ওটার কৌশল শিখাবার জন্য। এমন সময় আমার সদর দপ্তর চুয়াডাঙ্গা থেকে টেলিফোনে খবর আসল যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটা বড় দল ঝিনাইদহের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এখানে একটু বলে রাখা ভালো যে, ৩রা এপ্রিল চুয়াডাঙ্গায় বিমান হামলা চলাকালীন যশোর থেকে পাক সেনাবাহিনীর একটা দল অগ্রসর হতে গিয়ে কালীগঞ্জ এলাকায় আমাদের ফাইটিং পেট্রোলের এমবুশে পড়ে কিছুসংখ্যক প্রাণ হারিয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। যাই হোক, খবর পেয়ে আমি আমার একজন সৈনিককে ঐ চেকোস্লোভাকিয়ান এলএমজি’র কৌশল শিখিয়ে ওটা নিয়ে আসবার জন্য ওখানে রেখে আমি সদর দপ্তরের দিকে দ্রুতগতিতে চলে আসি। সদর দপ্তরে তখন ছিলেন  আসহাবুল হক সাহেব ও আমার স্ত্রী। এই খবর স্বাভাবিকভাবেই ওরা একটু মুষড়ে পড়েছিল। যাই হোক, আমি যাবার পর প্রয়োজনীয় খবরাখবর ও সৈন্য মোতায়েন করার পর অবস্থা আয়ত্তে আসে। পাকিস্তানীরা আর অগ্রসর হয়নি। বুঝতে পারলাম এটা ছিল তাদের নকল আক্রমণের প্রহসন।

জীবননগর থেকে চলে আসার পূর্বে লেঃ কর্নেল এইচ,আর, চক্রবর্তী আমাকে সবরকম আশ্বাস দিয়ে বললেন যে, আচিরেই আমরা আমাদের ভারী অস্ত্রাদি পাব, যার জন্য তিনি আমাকে আইজি-এর অফিসে মেজর বি,এন, ভট্রাচার্যের সাথে সর্বক্ষণ যোগাযোগ রাখার উপদেশ দিলেন। তাঁর নিজের টেলিফোন নাম্বারও দিলেন। সেই থেকে প্রতিক্ষণ ইন্ডিয়ান বিএসএফ-এর আইজি সাহেবের অফিসে মেজর ভট্রাচার্যের কাছে টেলিফোনে সর্বশেষ অবস্থা কি জানতে চাইতাম। তিনি আমাকে প্রতিবারই আশ্বাস দিয়ে বলতেন যে আমার ডিমাণ্ড দিল্লীর অফিসে বিবেচনাধীন আছে, শীঘ্রই এসে যাবে।

এদিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী যশোর থেকে ৬ই এপ্রিল ভোরবেলা আমার বিশাখালী সৈন্যাবস্থান আক্রমণ করে, কিন্তু তাদের ভাগ্যের পরিণতি কে এড়াবে! কিন্তু আমার বাহিনী সর্বোতভাবে প্রস্তুত ছিল, সতর্ক ছিল। এদের পালটা আক্রমণে পাকিস্তানীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। ছত্রভঙ্গ হওয়ায় তাদের বহু প্রাণের ক্ষয়ক্ষতি হয়, কেবল সামান্য কিছু লোক যশোর সেনানিবাসে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যেতে সমর্থ হয়। এটা ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মুখে আমাদের সামরিক সুরুত্বপূর্ণ প্রথম বিজয়, যার জন্য আমার সেনাবাহিনী ও স্থানীয় জনসাধারণের মনের বিশ্বাস ও উদ্দীপনা আকাশচুম্বি অবস্থা গ্রহণ করে। আমিও এই সুযোগে আমার বাহিনীর অবস্থান সীমা পরিবর্তন করে কালীগঞ্জের দক্ষিণে যশোর সেনানিবাস থেকে ৫ মাইল দূরে অর্ধবৃত্তাকারে অবস্থান করি। ব্যাপকভাবে পেট্রলিংও কায়েম রাখি যার জন্য যশোর পাক-বাহিনী বের হতে আর সাহস করেনি।

অন্যদিকে জীবননগরের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আশ্বস্ত হয়ে আমি দর্শনা-গেদের রেলওয়ে স্টেশনের মধ্যবর্তী উঠিয়ে ফেলা রেললাইন জোড়া দিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে রেল যোগাযোগ স্থাপন করি এবং ৭ ই এপ্রিল অপরাহ্নে একটা লম্বা খালি মালবাহী ট্রেন গেদে স্টেশন দাঁড় করিয়ে রাখি আমাদের ইস্পাত ভারী অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ বহন করে নিয়ে আসার দুরাশায়। এটা যে সত্যি দুরাশা ছিল, তখন ভেবে দেখার ফুসরত পাইনি, সন্দেহও হয়নি।  এদিকে ৬ ই এপ্রিলের পর থেকে তীব্র গতিতে চলতে লাগল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রি-ইনফোর্সমেন্ট প্রোগ্রাম-জল ও আকাশপথে। আকাশপথে বাধা দিবার আমার কোন শক্তি ছিল না। জলপথেও বাধা দিতে পারিনি, কেননা যশোর সেনানিবাস থেকে আরম্ভ করে দক্ষিন দিকে খুলনা মংলা বন্দর পর্যন্ত আমার আয়ত্ত্বাধীন ছিল না।

ইপিআর-এর ৫ নং উইং-এ অবস্থান ছিল খুলনায়। তার কমান্ডার ছিল অবাঙালি। তারা পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী সেখানে ইপিআর সেনাবাহিনীকে প্রায় পুরোপুরিভাবে নিরস্ত্র করে রেখেছিল। লড়াই লাগার সাথে সাথে অনেকে প্রাণ দিল, অনেকে আত্নগোপন  করে রইল। যারা আত্নগোপন  করে রইল তাদের সামান্য সংখ্যকের কাছে রাইফেল ও স্টেনগান ছিল।

তৎকালীন ইপিআর সেক্টর হেডকোয়ার্টার ছিল যশোর। বেশীর ভাগই বাঙালি। ক্যাপ্টেন হাশমত (পদাতিক বাহিনী) ও ক্যাপ্টেন আওলাদ হোসেন (সিগন্যালস) এই দুজনে ছিলেন বাঙালি অফিসার। ২৬ শে মার্চ আমি ক্যাপ্টেন হাশমতের কাছে আমাদের বিদ্রোহ করার খবর জানিয়ে তাদেরকেও জরুরী অবস্থা গ্রহণ করতে অয়ারলেসে খবর পাঠাই। কিন্তু দুর্ভাগ্য, আমার সেখানকার বাঙালি সুবেদার ও জওয়ানদের দৃঢ় মনোবল সত্ত্বেও এই দু’জন অফিসার আত্মগোপন করে। পরবর্তী এক সপ্তাহকাল পর্যন্ত এই ক্ষুদ্র সৈন্যদল নায়েব সুবেদার আব্দুল মালেকের নেতৃত্বে সীমিত কিন্তু প্রচণ্ডভাবে লড়াই শেষে পালিয়ে যেতে  বাধ্য হয়। তারা বেনাপোলের দিকে পালিয়ে যায়। সেখানেও তারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে খণ্ড খণ্ড যুদ্ধে লিপ্ত হয় এবং এপ্রিল মাসের ২০ তারিখ পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে নাভারণ থেকে দূরে রাখতে সমর্থ হয়।  তৎকালীন লেঃ হাফিজের মুখে শুনেছি, ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীর ব্যাটালিয়ন কমান্ডার  লেঃ মেঘ সিং- তার এক কোম্পানী সৈন্য নিয়ে লেঃ হাফিজ ও ইপিআর বাহিনীর সাহায্যার্থে বাংলাদেশের মাটিতে ঢুকে পরেন এবং নাভারনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত  লেঃ কর্নেল মেঘ সিং-এর ২/৩ জন সৈন্য পাক-বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে, যার পরিণামে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক মহলে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। তবে ভারত তাদের সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর প্রত্যক্ষভাবে বাংলার মাটিতে ঢুকে যুদ্ধে লিপ্ত হবার কাহিনী অস্বীকার করে।  লেঃ কর্নেল মেঘ সিং তার সৈন্যদের নিয়ে নিজের মাটিতে ফিরে যেতে বাধ্য হন।

অপরিহার্য কারণবশত বেনাপোল-যশোর রোডসহ দক্ষিণাঞ্চল সরাসরি এবং প্রত্যক্ষভাবে আমার নিয়ন্ত্রণে আসেনি এপ্রিল মাসের ১৯ তারিখ পর্যন্ত।

এদিকে মেহেরপুর তদানীন্তন এসডিও জনাব তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী ও ঝিনাইদহের তদানীন্তন এসডিপিও জনাব মাহবুবউদ্দিন আহমদ আমার সাথে যোগদান করেন। মাহবুব উদ্দিন সাহেব পুলিশ অফিসার বিধায় আমি তখনই তাঁকে ঝিনাইদহ রক্ষণাবেক্ষণের ভার ও ঝিনাইদহে প্রেরিত সকল সৈন্যের নেতৃত্ব প্রদান করি। কুষ্টিয়া যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মাহবুল সাহেব সুনিপুণভাবেই ঝিনাইদহে প্রেরিত সকল সৈন্যের নেতৃত্ব প্রদান করি। কুষ্টিয়া যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মাহবুল সাহেব সুনিপূনভাবেই ঝিনাইদহে তাঁর কর্তব্য পালন করেন। এপ্রিল মাসের ২/৩ তারিখে ঝিনাইদহ ক্যাডেট  কলেজের প্রফেসর সফিকুল্লাহ সাহেব ও আমার সাথে যোগদান করেন । এদের আমি অশেষ দেশপ্রেম ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে যুদ্ধের কঠিন সংকল্প দেখতে পেলাম। আগেই বলেছি আমার কাছে ক্যাপ্টেন আজম ছাড়া দ্বিতীয় কোন অফিসার ছিল না। তাই ৭ই এপ্রিল সেক্টর অর্ডার- এর মাধ্যমে যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্যবাহিনী পরিচালনা করার জন্য আমি তাদেরকে সরাসরি ক্যাপ্টেন র‍্যাঙ্ক পড়িয়ে দিই। সেক্টর অর্ডারে আমি লিখেছিলাম – “On behalf of the Bangladesh High Command I hereby award Commission to the following persons directly in the rank of Captain to meet operational requirements:-

(a) Mr. Toufiq Elahi Chowdhury.

(b) Mr. Mahabubuddin ahmed.

(c) Mr. Md. Safiqullah

(অনুবাদঃ বাংলাদেশ হাই-কমান্ডের পক্ষে আমি কাজের চাহিদার প্রেক্ষিতে নিম্নোক্ত লোকজনকে সরা সয়াসরি ক্যাপ্টেন র‍্যাঙ্কে উন্নীত করলামঃ

 ক। মোঃ তৌফিক ইলাহী চৌধুরী

খ। মোঃ মাহবুবুদ্দিন আহমেদ

গ। মোঃ শফিকুল্লাহ)

এই তিনজন অফিসারই পরবর্তীকালে যুদ্ধের শেষ দিন পর্যন্ত সেক্টরে কোম্পানী কমাণ্ডার হিসাবে যুদ্ধ করেছেন। তাদের বীরত্ব ছিল সত্যিই অতুলনীয়।

কুষ্টিয়া যুদ্ধের পর ২রা এপ্রিল প্রথম বঙ্গ শার্দুলদের দুঃখময় পরিণামের খবর আমার গোচর করা হয়। আরও বলা হয় যে তাদের কিছুসংখ্যক  লোক পালিয়ে চৌগাছায় একত্রিত হয়েছে এবং লেঃ হাফিজ নামে একজন বাঙালি অফিসারও সেখানে আছে। ঐদিনই আমি আমার কাছে উপস্থিত হবার জন্য লেঃ হাফিজকে লোক মারফত চিঠি দিয়ে নির্দেশ দিলাম, কিন্তু হাফিজ আসেনি। ৪ঠা এপ্রিল তাই ঝিনাইদহের কমান্ডার মিঃ মাহবুবকে লেঃ হাফিজের খোজে পাঠাই। লেঃ হাফিজ তার ২/৩ জন লোক সাথে করে মাহবুবের গাড়ী করে আমার কাছে উপস্থিত হয়। তার কাছে প্রথম বঙ্গ শার্দুলদের করুণ কাহিনী বিস্তারিত জানতে পারলাম এবং আমার খবর পাওয়া সত্বেও আমার সাথে দেখা না করার একটা কারণ খুজে পেলাম। যাই হোক, আমার পরিস্কার মনে আছে যে আমার অধিনস্থ ইপিআর বাহিনীর জামা-কাপড়, ইউনিফর্ম, বুট, ইকুইপমেন্ট এবং কুষ্টিয়া থেকে অধিকৃত ভারী ও হালকা অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ এবং গাড়ী দিয়ে ওদেরকে সজ্জিত করে চৌগাছা এলাকায় সন্নিবেশিত করলাম।

পূর্বেই বলেছি যে, বিশাখালী (ঝিনাইদহ থেকে ৩ মাইল দক্ষিণে) যুদ্ধের পর আমার সৈন্যদের ডিফেন্স লাইনকে অগ্রগামী করে যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে মাত্র ৫ মাইল দূরে রেখেছি। তার কারণ ছিলো এই যে, ক্যান্টনমেন্ট থেকে আমার অবস্থান তাদের দূরপাল্লার কামানের আওতার বাইরে রাখা। দ্বিতীয়ত আমার কোনো ভারী অস্ত্রশস্ত্র না থাকায় প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সীমান্তে মাননীয় তাজউদ্দীন সাহেবের প্রতিশ্রুত ভারী অস্ত্রাদির অপেক্ষায় থাকা ও একই সঙ্গে ক্যান্টনমেন্টের উপর চাপ সৃষ্টি করে রাখা। পরিকল্পনা ছিলো, ভারত থেকে কিছু ভারী অস্ত্রাদি পেলেই আমরা যশোর ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করবো। এদিকে ঐ অস্ত্র আসার অপেক্ষায় থাকতে থাকতে বুঝতে পেরেছিলাম যে প্রতিদিনই পরিস্থিতি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অনুকুলে চলে যাচ্ছে। কারণ জল ও আকাশপথে তাদের রি-ইনফোর্সমেন্ট পুরোদমেই চলছিলো। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ভারপ্রাপ্ত অফিসারের কাছে প্রতি পলে সিচ্যুয়েশন রিপোর্ট দিয়েও শুধু আশ্বাস ছাড়া আর কিছুই পাইনি। অবশ্য এটা যে শুধু আশ্বাসই ছিলো তখন তা বুঝতে পারিনি। এভাবে কেটে গেলো ১১ এপ্রিল ১৯৭১ সন।

 

গোয়ালন্দ প্রতিরোধ

১২ এপ্রিল খবর আসলো যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটা বিরাট অংশ আরিচা থেকে জলপথে গোয়ালন্দের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। বুঝতে পারলাম এদেরকে যদি গোয়ালন্দে নামতে দেয়া হয় তাহলে আমার যশোরের পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে। আমার ক্ষুদ্র সেনাবাহিনী থেকে কোনোরকমে এক প্লাটুন সৈন্য ২টি এলএমজি, ১টি ও একটি ট্যাংক বিধ্বংসী ছোট কামান সহকারে পাঠিয়ে দিলাম নায়েক সুবেদার শামসুল হকের নেতৃত্বে গোয়ালন্দে। তাদের উপর আমার নির্দেশ ছিলো যে, পাক সেনারা যাতে কোনমতেই পদ্মার এপারে অবতরণ করতে না পারে। ১৩ই এপ্রিল এই অগ্রগামী সৈন্যের সাথে পদ্মার পারে আমার ক্ষুদ্র সেনাদলের এক তীব্র সংঘর্ষ হয়। এতে পাক বাহিনীর একটি জাহাজ ডুবে যায় এবং তারা উত্তরাভিমুখে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। পরে খবর পেলাম যে, পাকবাহিনী একই সময়ে নগরবাড়ীতে অবতরণ করার চেষ্টা করছে। বুঝতে পারলাম নগরবাড়ীতে যদি পাকবাহিনী বিনা বাঁধায় নামতে পারে, তাহলে তারা পাবনা ঈশ্বরদী হয়ে আমার পিছন দিক থেকে আক্রমণ চালাতে পারে। তাতে আমার পজিশন অত্যন্ত সংকটময় হয়ে যাবে। তাই রাজশাহীতে যুদ্ধরত মেজর মরহুম নাজমুল হককে টেলিফোন করে নগরবাড়ীতে এক কোম্পানী সৈন্য জরুরী ভিত্তিতে পাঠাবার জন্য অনুরোধ করলাম। কিন্তু তিনি যদিও  এক প্লাটুন সৈন্য পাঠিয়েছিলেন তারা সময়মত পৌঁছতে পারেনি।

এদিকে শুনতে পেলাম তদানীন্তন অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন খোন্দকার নাজমুল হকের নেতৃত্বাধীন এক কোম্পানী পরিমাণ মুজাহিদ ছিলো নগরবাড়ী রক্ষণাবেক্ষণে লিপ্ত। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২/৪টা গোলা নগরবাড়ীতে পড়ার সাথে সাথেই তারা সব পালিয়ে যায় এবং পাকবাহিনী ১৫ই এপ্রিল পুরোপুরিভাবে নগরবাড়ীতে অবতরণ করতে সক্ষম হয়। অবতরণের পর পরই পাকসেনারা তীব্র গতিতে পাবনার দিকে অগ্রসর হয়। ১৬ই এপ্রিল ভেড়ামারায় অবস্থিত আমার ক্ষুদ্র সেনাদলের সাথে প্রচণ্ড গোলাগুলির পর পাকবাহিনী ভেড়ামারায় অবতরণ করে। ভেড়ামারার কমান্ডে তখন ছিলো সুবেদার মেজর মুজাফফর। উপায়ন্তর না দেখে সে তার সৈন্যদল নিয়ে পিছু হটে যায়।

ওদিকে যুগপৎভাবে পাক সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনী যশোর থেকে আমাদের উপর হামলা চালায়। এই দুই দিক থেকে (সামনে ও পিছন দিক থেকে) হামলা প্রতিহত করার মতো সৈন্যবল ও অস্ত্রবল আমার ছিলো না। কাজেই আমার সম্মুখভাগ (ফ্রন্ট লাইন) সঙ্কুচিত করার উদ্দেশ্যে দুই দিক থেকেই সৈন্যদের অপসারণ করে পিছিয়ে নিয়ে আসি পর্যায়ক্রমে এবং পুনঃপ্রতিরক্ষাব্যূহ গঠন করি কোটচাঁদপুর, ঝিনাইদহ, শৈলকুপা (রাস্তা), পোড়াদহ লাইনে। কিন্তু ১৬ই এপ্রিল অপরাহ্নেই পাকবাহিনীর হাতে ঝিনাইদহের পতন হয়।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার উদ্বোধনঃ অপরপক্ষ ১০ই এপ্রিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠনের পর চুয়াডাঙ্গাকে বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানী ঘোষণা করার সাথে সাথেই চুয়াডাঙ্গার উপরে চলতে থাকে তীব্র বিমান হামলা। এতদসত্ত্বেও বাংলাদেশ সরকার মনস্থীর করলেন যে চুয়াডাঙ্গার কোনো মুক্ত এলাকাতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হবে ১৭ই এপ্রিল। নির্বাচন করা হলো আমারই পূর্বতন ইপিআর কোম্পানী হেডকোয়ার্টার বৈদ্যনাথতলার আম্রকানন। সময় সকাল ১০ ঘটিকা। আমি যুদ্ধে ওতপ্রোতভাবে লিপ্ত থাকা বিধায় স্টেজ ও আনুষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনার ভার নিলেন ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর ৭৬ ব্যাটালিয়ন কমান্ডার লেঃ কর্নেল চক্রবর্তী। স্থানীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও করলেন তিনি। আমাকে শুধু নির্দিষ্ট সময়ে উপস্থিত হবার জন্য খবর দেয়া হলো। ওদিকে প্রতিকুল পরিবেশের মধ্যে ঐ রাতেই সদর দপ্তর মেহেরপুর থেকে ভৈরব নদীর অপর পারে ইছাখালী বিওপি’তে স্থানান্তরিত করি। এই বিওপি থেকে ভারতীয় বিওপি’র দুরত্ব ছিলো প্রায় ৬০০ গজ। বিওপি’তে থাকবার মতো কোনো ব্যবস্থা না থাকায় সৈন্যদের যথাক্রমে প্লেস করিয়ে গাড়ীতে করে আমার স্ত্রী কন্যাদের নিয়ে এই প্রথমবারের মতো ভারতে পদার্পণ করি।

সে রাতে সামান্য একটা ঘটনার কথা কোনোদিন ভুলতে পারবো না। ঘটনাটা হলো এই যে, ভারতীয় মাটিতে পদার্পণ করার সাথে সাথেই আমার স্ত্রী নিজেকে অত্যন্ত অসহায় অনুভব করে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেন। সাথে সাথে কন্যাদের অবস্থাও তথৈবচ। আমার স্ত্রী যতক্ষণ সম্ভব বাংলার মাটিতে কাটাবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়। তাই ফিরে আসা হলো সেই ইছাখালীতে। বিওপি’র ভাঙ্গা ঘরে ছিলো না কোনো বিছানাপত্র, ছিলো না কোনো শোবার জায়গা। মাটিতে শুয়ে ওরা রাত কাটিয়ে দিলো।

পরদিন ১৭ই এপ্রিল সকাল ১০টায় বৈদ্যনাথতলার আম্রকানন লোকে লোকারন্য। অথচ তখনো আমি মেহেরপুরে। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী নবগঠিত সরকারকে সালাম দেবার কথা আমাদেরই। কিন্তু এদিকে নিশ্চিত না করে রওয়ানা করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। ওদিকে দেশ বিদেশের সাংবাদিক সমভিব্যহারে বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে পৌঁছে যান অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ এবং অন্যান্যরা। ভাগ্যবশতঃ তৌফিক এলাহি ও মাহবুবকে আমি ভোর ৭টায় পাঠিয়ে দিয়েছিলাম ওখানে। ত্রস্ত গতিতে মাহবুব উপস্থিত কিছু সংখ্যক যুদ্ধক্লান্ত ইপিআর ও আনসার-মুজাহিদের মিলিত সৈন্যদের একত্রিত করে সদ্য আগত প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীকে সালাম প্রদান করেন। তার কিছুক্ষণ পরেই আমি, ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন (বর্তমানে মেজর), ক্যাপ্টেন হাফিজ, আমার স্ত্রী কন্যা এবং সমান্য সৈন্য সমভিব্যহারে সেখানে উপস্থিত হই। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ঘোষণা ও সনদপত্র পাঠের পর এই নবগঠিত সরকারকে আমি অভিবাদন দেই। তারপর আনুষঙ্গিক আলাপ-আলোচনা, পরিচয়, ভাষণ ও সবশেষে মধ্যাহ্ন ভোজের পর এই উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষ হয়।

গৌরবের বিষয় যে, পলাশীর আম্রকাননে বাংলার স্বাধীনতা লুপ্ত হবার পর আবার বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে স্বাধীনতার উন্মেষ অনুষ্ঠানের মতো এতবড় একটা ঐতিহাসিক পর্বে স্বাধীনতা যুদ্ধে লিপ্ত কমান্ডারদের মধ্যে একমাত্র আমিই বাংলার নারী জাতির প্রতিনিধি হিসেবে আমার স্ত্রী সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

ফিরে এলাম আমার অস্থায়ী আড়ম্বরহীন সদর দপ্তর ইছাখালী বিওপি’তে।

এখানে একটা কথা বলে রাখা আবশ্যক যে, ১৬ই এপ্রিলে যখন দেখতে পেলাম সদর দপ্তর চুয়াডাঙ্গা থেকে সরিয়ে নিতে হবে, ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তখনই নির্দেশ দিলাম সমস্ত স্থানীয় ও দূরবর্তী ব্যাংকের টাকা পয়সা সোনা গয়না সাথে নিয়ে নেয়ার জন্য। নির্দেশ অনুযায়ী ডাঃ আসহাবুল হক, ক্যাপ্টেন তৌফিক এলাহী, ক্যাপ্টেন মাহবুব এবং আরো কয়েকজন গণ্যমান্য লোকের প্রচেষ্টায় আনুমানিক সাড়ে চার কোটি টাকা ও আধা মণ সোনা আমরা সাথে নিয়ে যাই। স্থানীয় যত গুদামে চাউল ও আটা ছিলো সবগুলো আমাদের গাড়ীতে উঠিয়ে নেই।

১৮ই এপ্রিল সকালবেলা ঐ সীমান্তে ক্যাপ্টেন আজমের নেতৃত্বাধীন এক কোম্পানী সৈন্য রেখে বাকী ও সদর দপ্তর নিয়ে আমি চলে যাই বেনাপোল এবং সেখানে স্থাপন করি আমার সদর দপ্তর। ঐ দিনই আমি বেনাপোল ও যশোর রোড এবং তার দক্ষিণাঞ্চলের কর্তৃত্বভার প্রত্যক্ষভাবে নিজের অধীনে নিয়ে বেনাপোল থেকে পূর্বদিকে কাগজপুকুর এলাকায় আমার প্রতিরক্ষাব্যূহ গঠন করি। ২০শে এপ্রিল সকাল ১০টায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নবনিযুক্ত সেনাপতি কর্নেল এমএজি ওসমানী (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল) বেনাপোলে আমার সদর দপ্তর পরিদর্শনে আসেন। বেনাপোলে তাকে যথাযথভাবে সামরিক সালাম দেওয়া হয়। আমি সেনাপতিকর প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা বুঝিয়ে দেই এবং আমার সামরিক সরঞ্জামাদির অভাব সম্বন্ধে তাকে অবগত করাই।

বেনাপোল থেকে পূর্বদিকে কাগজপুর এলাকায় আমার প্রতিরক্ষাব্যূহ স্থাপন করি কিন্তু প্রথাগত প্রতিরক্ষার জন্য অস্ত্রশস্ত্র ও সাজ-সরঞ্জামাদি যে আমার ছিলো না, তা পূর্বেই বলেছি। এই প্রতিরক্ষাব্যূহের সবচেয়ে মারাত্মক দুর্বলতা ছিলো যে প্রতিরক্ষার জন্য আমাদের সাপোর্টিং অস্ত্রশস্ত্র ছিলো না এবং ফিল্ড অয়ারলেস বা ফিল্ড টেলিফোন এবং ডিগিং যন্ত্রপাতির মারাত্মক অভাব। এতদসত্ত্বেও ২টি কোম্পানী ইপিআর সৈন্য নিয়ে আমি এই প্রতিরক্ষাব্যূহ যথাযথ সম্ভব পরিপূর্ণভাবে গড়ে তুলতে চেষ্টা করি। আমার কাছে মাত্র ২টি ৩ ইঞ্চি মর্টার ও কিছুসংখ্যক গোলা ছিলো। সেগুলো আমি রিজার্ভে রেখেছিলাম স্থান ও কালভেদে প্রয়োজন মতো ব্যবহার করার আশায়। এই প্রতিরক্ষাব্যূহে আমার সাথে ক্যাপ্টেন তৌফিক, ক্যাপ্টেন মাহবুব, ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন (বর্তমানে মেজর) ও ডাঃ আসহাবুল হক উপস্থিত ছিলেন। উল্লেখ্য যে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন ও ক্যাপ্টেন মুস্তাফিজুর রহমান (বর্তমানে মেজর) ১০ই এপ্রিল ঢাকা থেকে পালিয়ে এসে আমার সাথে যোগদান করেন। প্রথম বঙ্গশার্দুল থেকে পালিয়ে আসা ১৫০ জন সৈন্য নিয়ে হাফিজকেও বেনাপোল কাস্টম কলোনীর দক্ষিণভাগে রিজার্ভ বাহিনী হিসেবে পজিশন নেবার জন্য নির্দেশ দেই।

২৩শে এপ্রিল সকাল ১০টায় তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী মাননীয় তাজউদ্দিন আমার সদর দপ্তর বেনাপোল এসে উপস্থিত হন বাংলার মাটিতে ব্রিটিশ এমপি মিঃ ডগলাস ম্যানকে স্বাগত জানানোর জন্য। দীর্ঘ ৩ ঘন্টা অপেক্ষা করার পর ব্রিটিশ অতিথি আমার সদর দপ্তরে এসে মাননীয় তাজউদ্দিন সাহেবের সাথে ১ ঘন্টাব্যাপী আলোচনা করেন। সুখের বিষয় এই যে, ব্রিটিশ এমপি ভারত থেকে বাংলায় এসে পদার্পণ করার সাথে সাথেই আমার সদর দপ্তরে উড্ডয়নরত বাংলার জাতীয় পতাকা দেখতে পান ও তার পতপত আওয়াজ শুনে অনেকটা আশ্বস্ত হন আমাদের ভবিষ্যৎ স্বাধীনতাপ্রাপ্তির সম্ভবনায়। মাননীয় অতিথি বিদায় নেবার ১ ঘন্টা পরে জনাব তাজউদ্দিন মুজিবনগরে চলে যান। তিনি বিদায় নেবার ঠিক ১৫ মিনিটের মধ্যে ২৩শে এপ্রিল বিকেল সাড়ে ৩টায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী আমাদের উপর আঘাত হেনে আমাদের প্রতিরক্ষাব্যূহ কাগজপুকুর থেকে বেনাপোলের পূর্ব সীমানা পর্যন্ত সঙ্কুচিত করতে বাধ্য করে। যাই হোক রাতারাতি আবার আমরা নতুন করে প্রতিরক্ষা পজিশন সংগঠিত করে নেই।

২৪ শে এপ্রিল ভোর ৪টায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দুই ব্যাটালিয়ন সৈন্য সহকারে আমাদের পজিশনে আক্রমণ করে। আমার বাম দিকের কোম্পানী পজিশনে প্রথম আক্রমণ করা হয়। দুই কোম্পানীর মধ্যে যোগাযোগ করার জন্য রানার ব্যতিরেকে আমার আর কোনো ব্যবস্থা ছিলো না। অন্ধকারে এই কোম্পানীর সাথে তুমুল যুদ্ধ চলে। ভোর ৬টায় একটা ১টন ডজ গাড়ীতে করে ৩ ইঞ্চি মর্টারগুলো পাঠিয়ে দেই তাদের সাহায্যার্থে। তারা কিছুটা সুবিধাজনক স্থানে পজিশন নিয়ে শত্রুর উপর মুহুর্মুহু গোলাবর্ষণ করতে থাকে। এমন সময় শত্রুর আক্রমণের চাপে আমার ভাইটাল পজিশন থেকে এমজিওয়ালা তার এমজি সহকারে পশ্চাদপসরণ করার চেষ্টা করে। কিন্তু ঠিক সে সময় পূর্বতন হাবিলদার-মেজর তখনকার নায়েক সুবেদার মুজিবল হক সেখানে উপস্থিত হয় এবং তার কাছ থেকে এমজি ছিনিয়ে নিয়ে ঐ ভাইটাল পজিশন থেকে ক্ষিপ্র গতিতে অগ্রগামী শত্রুর উপর সুইপিং ফায়ার চালাতে থাকে। সুবিধা ছিলো এই যে, শত্রুর অবস্থান ছিলো তখন খোলা এবং নিচু জায়গায়। মুজিবুল হকের এই তীব্র আক্রমণে শত্রুপক্ষের অধিকাংশ সৈন্য ধরাশায়ী হয় এবং তাদের আক্রমণ প্রায় ব্যর্থ হবার উপক্রম হয়।

ওদিকে পাকিস্তান বাহিনীর দ্বিতীয় ব্যাটালিয়ন আমার ডানদিকের কোম্পানীর উপর আক্রমণ চালায় সকাল ৬টায়। তারা এসেছিলো ইপিআর পোশাক পড়ে। কাজেই প্রথমতঃ আমার ইপিআর বাহিনী ধোঁকা খেয়ে যায়। কিন্তু পরক্ষণেই তারা এই চালাকি বুঝতে পেরে তাদের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য তীব্র প্রচেষ্টা চালায়। ওদিকে মুজিবুল হকের একক অথচ তীব্র এমজি’র সুইপিং ফায়ারে যখন শত্রুসৈন্য বিধ্বস্ত প্রায়, তখনই ডানদিক থেকে ইপিআর পোশাকের বেশে এক প্লাটুন শত্রুসৈন্য তার দিকে অগ্রসর হয়। মুজিবুল হক তাদেরকে দেখতে পেয়েও ইপিআর বাহিনী ভ্রমে তাদের উপর ফায়ার করেনি। এটাই হলো তার ও আমাদের চরম দুর্ভাগ্য। প্রকৃত এমজি ম্যান ল্যান্স নায়েক বার বার মুজিবুল হককে হুশিয়ার করা সত্ত্বেও সে ইপিআর বাহিনী বলে শত্রুর উপর ফায়ার করতে অস্বীকার করে কিন্তু মিনিট পরেই এই ইপিআর-বেশধারী শত্রু প্লাটুন তার উপর হামলা চালায়। শত্রুর এলএমজি’র বুলেট মুজিবুল হকের বক্ষ ভেদ করে তৎক্ষণাৎ তার জীবন শেষ করে দেয় (ইন্না……………….রাজেউন)। এলএমজি ম্যান হামাগুড়ি দিয়ে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়। নায়েক সুবেদার মুজিবুল হকের অপরিসীম সাহস, কৃতিত্ব ও আত্মত্যাগের ঋণ বাংলার জনসাধারণ কোনকালেই শোধ করতে পারবে না। প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণে জানা যায়, মুজিবুল হকের এমজি সহকারে তীব্রযুদ্ধে আনুমানিক ১৫০ জন শত্রুসৈন্য নিহত হয়, যার জন্য সাময়িকভাবে শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত হয়। ইত্যবসরে, আমার বামদিকের কোম্পানী মুজিবুল হকের ফায়ারের আড়ালে থেকে সীমান্তবর্তী এলাকায় পশ্চাদপসরণ করতে সক্ষম হয়। ওদিকে ডানদিকের কোম্পানীও সাপোর্ট ফায়ারের অভাবে ক্ষণিক যুদ্ধের পর সীমান্তবর্তী এলাকায় অপসারণ হয়। দুঃখের বিষয়, মুজিবুল হকের পতনের সাথে সাথেই আমার মর্টার বাহিনী মর্টার গুটিয়ে গাড়ীতে করে পশ্চাদপসরণ করার চেষ্টা করে। কিন্তু অল্প দূরে শত্রুসৈন্যের অবস্থান দেখতে পেয়ে ড্রাইভার গাড়ী দাড় করিয়ে রাস্তার আড়ালর হামাগুড়ি দিয়ে পিছনে পালিয়ে যায়। উপায়ন্তর না দেখে মর্টার বাহিনীর কমান্ডার মোমিনুল হককেও একই পদ্ধতিতে পশ্চাদপসরণ করতে হয়। গাড়ী ও মর্টার শত্রুর হস্তগত হয়।

এদিকে সীমান্ত এলাকাতে আমার বাহিনী প্রাণপণে শত্রুর মোকাবেলা করতে থাকে। সমস্ত দিন গোলাগুলির পরেও শত্রুসেনারা আমার বাহিনীকে সম্পূর্ণভাবে উৎখাত করতে পারেনি এবং আমার সদর দপ্তরে উড্ডয়নরত বাংলার জাতীয় পতাকার পতপত ধ্বনিকে শত চেষ্টা সত্ত্বেও তারা কোনো দিন স্তব্ধ করতে পারেনি। স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষদিন পর্যন্ত ঐ পতাকা উড্ডয়নরত থাকে।

——————————————————

 

<৯, ৭.২, ২৪৭-২৫০>

চুয়াডাঙ্গাকুষ্টিয়া প্রতিরোধ

সাক্ষাৎকার- মেজর এ আর আজম চৌধুরী

২৬০৩১৯৭৩

আমি তখন চুয়াডাঙ্গা ইপিআর ৪নং উইং-এ একজন ক্যাপ্টেন হিসেবে কাজ করছি। ২৩শে মার্চ আমাদের সীমান্ত পরিদর্শনে যাই। ফিরি ২৫শে মার্চ রাত সাড়ে এগারোটার দিকে। মেজর ওসমান চৌধুরী ২৪শে কুষ্টিয়া গিয়েছিলেন। ২৬শে মার্চ ১২টার দিকে চুয়াডাঙ্গাতে আসেন।

যশোর ইপিআর হেডকোয়ার্টার থেকে ইপিআর মেজর চুয়াডাঙ্গাতে যান আমাদের সকল অফিসারকে আনবার জন্য কনফারেন্সের নাম করে ২৫ তারিখ সকাল ১০টার দিকে।

রাতে ফিরে শুনলাম যশোরের মেজর চুয়াডাঙ্গায় অবাঙালি ক্যাপ্টেন মোঃ সাদেকের বাসায় আছেন। ২৬শে মার্চ সকাল সাড়ে ছ’টার দিকে মেজরসহ ক্যাপ্টেন সাদেক ও তার পরিবার আমার বাড়িতে আসে। আমি বাথরুমে ছিলাম। বের হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে মেজর বললো, ‘এতনা জলদী আগিয়া?’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, কাজ শেষ হয়ে গেছে।’ আমি মেজরকে দুপুরের খানা খেয়ে যেতে বললাম। অবাঙালি মেজর রাজী হলো না।

১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর হতে আমাদের কাছে চিঠি আসে কতজন পাঠান এবং পাঞ্জাবী পরিবার পূর্ব পাকিস্তানে আছে তার একটা তালিকা পাঠাতে। আমরা পৃথক পৃথক ভাবে সামরিক কর্তৃপক্ষের নির্দেশক্রমে সে তালিকা পাঠিয়ে দেই। ২৬শে সকালে ক্যাপ্টেন সাদেকের স্ত্রী আমার আম্মার সাথে কান্নাকাটি করলেন। কিছুতেই যেতে চাচ্ছিলেন না। তিনি শেষবারের মতো বললেন, ঢাকাতে যদি থাকি তো আবার দেখা হবে। ক্যাপ্টেন সাদেকের ফ্যামিলিকে একেবারেই শেষে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠাবার ব্যবস্থা করা হয়।

আমি সকাল সাড়ে আটটায় অফিসে যাই এবং ইপিআর সুবেদার আমাকে বললো যে, পাঞ্জবী মেজর এখানে সকল পাঞ্জাবী এবং পাঠানদের ডেকে পাঞ্জাবীতে কি বলে গেছে। আমার তাতে সন্দেহ দৃঢ় হলো।

২৬শে মার্চ সকালে আমাদের অফিসে অয়ারলেসের মাধ্যমে জানলাম ঢাকা পিলখানা এবং রাজারবাগ পুলিশ লাইনকে পাক আর্মি ট্যাংক দিয়ে আক্রমণ করে ধ্বংস করতে চলেছে-খবর আসলো ৮/৯টার দিকে।

সকাল নয়টার দিকে হাবিলদার মুজিবর রহমান আমাকে এসে বলে যে, আমরা বিদ্রোহ করবা। আমি মুজিবরকে নিষেধ কি এবং বলি যে কোতের চাবি তুমি (কোতের চাবি আমি যখন সীমান্তে যাই তখন ওর কাছে দিয়ে গিয়েছিলাম।) কোয়ার্টার গার্ডে যে পাঞ্জাবী আছে তাদের ছুটি দিয়ে দাও এবং সকল পাঠানদের উপর নজর রাখো। শহীদ মুজিব আমাকে আরো খবর দেয় যে, অবাঙালিদের কার কার কাছে গুলি এবং অস্ত্র আছে। আমি বললাম আমার উর্ধ্বতন অফিসার মেজর ওসমান যখন বাঙালি তখন তার আসা পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করা উচিত।

আমি ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বাড়ি যাই। ১১/১২টার দিকে মেজর ওসমান আসার সাথে সাথে আমরা স্বাধীন বাংলার পতাকা তুলি এবং রাজকীয় মর্যাদা দেই। অবাঙালি যত ছিলো তাদের অস্ত্রহীন করে একটি ঘরে বন্দী করে রাখি।

২৬শে মার্চ বেলা ১১টার দিকে যশোর হেডকোয়ার্টার থেকে লেঃ কঃ মোঃ আসলাম (অবাঙালি) যাত্রা করে চুয়াডাঙ্গার উদ্দেশ্যে কিছু সৈন্য, দুটো গাড়ি এবং অয়ারলেস সহ। এই খবর আমরা যশোর ইপিআর ক্যাম্প থেকে পেলাম অয়ারলেসের মাধ্যমে। সঙ্গে সঙ্গে মেজর ওসমান আমাকে এক প্লাটুন সৈন্য নিয়ে পজিশন নিতে বলেন। যশোর হেডকোয়ার্টার হয়তো খবর পেয়েছে যে, আমরা বিদ্রোহ করেছি। লেঃ কঃ আসলাম বারবাজার পর্যন্ত এসে এই সংবাদ শুনে ফিরে যায়।

ইতিমধ্যে আমরা ভারতীয় সীমান্তের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করি। ৭৬ বিএসএফ কমান্ডার লেঃ কঃ চক্রবর্তী এবং আইজি, ডিজি সবাই গেদেতে রয়েছেন। বিভিন্ন পত্রপত্রিকার সাংবাদিকেরা উপস্থিত ছিলেন। আমাকে মেজর ওসমান বেলা চারটার দিকে গেদেতে যাবার জন্য বলেন। আমি রওয়ানা হয়ে গেলাম। আমরা সাউথ ওয়েষ্ট কমাণ্ড হিসেবে পরিচয় দিয়ে কাজ করতে থাকি। বেলা পাঁচটার দিকে গেদে পৌঁছলাম। ভারতীয় অফিসারদের সাথে সাক্ষাৎ করলাম। আমার পুরা ইউনিফর্ম ও আর্মসহ তিনজন গার্ড ছিলো। আমাদের অভ্যর্থনা জানালো ভারতীয় বিএসএফ ক্যাপ্টেন মহাপাত্র। ক্যামেরাম্যানরা আমার ছবি তুলবে বলে আমি গামছা ছিয়ে মুখ ঢেকে বর্ডার পার হই। মেজর ওসমানের পত্র দেই। সেখানে একটি আর্টিলারী ব্যাটারী, এক স্কোয়াড্রন ট্যাংক, এক ইনফ্যাইন্ট্রি ব্যাটালিয়ন সৈন্য যশোর আক্রমণের জন্য চাইলাম। ভারতীয় প্রধান বলেন, আমরা সরাসরি সাহায্য করতে পারছি না। তবে গোপনে আপনাদের সাহায্য করবো এবং আপনাদের এই চাহিদা দিল্লী নিয়ে যাচ্ছি আলোচনার জন্য। আমি আবার দেখা হবে বলে চলে আসি।

২৮শে মার্চ থেকে ট্রেন চালু হয়ে যায় ভারত সীমান্ত থেকে। ইতিমধ্যর ভারতীয় নাগরিকরা সাবান, পেট্রোল, খাবার, ঔষধপত্র ইত্যাদি যাবতীয় জিনিস নিয়ে এসে আমাদের সাহায্য করতে থাকে।

২৬শে মার্চ রাতে মেহেরপুরের এসডিও তৌফিক এলাহী সাহেব এবং ঝিনাইদহের এসডিপিও মাহবুবউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে আলোচনা করা হয় কুষ্টিয়া সম্পর্কে। কুষ্টিয়াতে ইতিমধ্যে পাক সৈন্য চলে এসেছিলো। কিভাবে আক্রমণ করা হবে এ বিষয়ে আমরা মত বিনিময় করি।

কুষ্টিয়াতে কতজন পাকিস্তানী সৈন্য আছে তা জানার জন্য ইপিআর ক্লার্ক বারি এবং আরো দু একজনকে পাঠাই। কুষ্টিয়াতে কত সৈন্য ছিলো তার সঠিক সংখ্যা পেলাম না। মেজর ওসমান আমাকে ২৯ তারিখ কুষ্টিয়া আক্রমণ করতে বললেন।

তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে কুষ্টিয়া আক্রমণের প্ল্যান করা হয়। একটি দল যায় ভেরামারা তারাগঞ্জ হয়ে এবং দ্বিতীয় দল নিয়ে আমি নিজে চুয়াডাঙ্গা-পোড়াদহ হয়ে যাই। তৃতীয় দল যায় ঝিনাইদহ এবং কুষ্টিয়ার মাঝে তারাগঞ্জ দিয়ে। সার্বিকভাবে দলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলাম। আমরা প্রাথমিক অবস্থায় ২০০ জনের মতো ছিলাম। পরাগপুর ও ভেড়ামারার নেতৃত্ব দিচ্ছিলো সুবেদার মজাফফর আহমেদ।

২৯ তারিখে আক্রমণের কথা ছিলো। কিন্তু নানা কারণে ওই তারিখে সম্ভব না হওয়ায় ৩০শে মার্চ ভোর পাঁচটার সময় আমরা একই সময় তিন ভাগ থেকে আক্রমণ চালাই। সারাদিন আক্রমণ চলে।

৩১শে মার্চ কুষ্টিয়া সম্পূর্ণ মুক্ত হয়। ২৫০ জন পাক সৈন্য মারা যায়। কিছু ধরা পড়ে, লেঃ আতাউল্লাহ তাদের মধ্যে একজন। আমাদের মুক্তিবাহিনীর ২জন মারা যায়। কিছু আহত হয়।

৩১শে সকাল ১০টার দিকে পাক বাহিনীর বিমান এসে বোমাবর্ষণ করে প্রায় এক ঘন্টা ধরে। কেউ মারা যায়নি। ঐদিনই আমি টেলিফোন মারফত মেসেজ পেলাম আমাকে যশোরের দিকে অগ্রসর হতে হবে। আমি ১ এপ্রিল যশোরের দিকে রওয়ানা হই।

৩১শে মার্চ সকাল ৯টার দিকে বিশখালীতে যে দল আমাদের ছিলো তাদের সাথে যশোর থেকে আগত পাক বাহিনীর সংঘর্ষ বাঁধে। যশোর বাহিনী কুষ্টিয়ার দিকে যাচ্ছিলো সাহায্যর জন্য। কিন্তু ব্রিজের ওখানে ব্যারিকেড থাকায় তারা যেতে পারেনি। ওখানে মুক্তিবাহিনীর ২জন মারা যায় এবং ৩/৪জনকে পাকবাহিনী ধরে নিয়ে যায়। যশোর সেনানিবাস থেকে সাত মাইল দূরে আমরা পজিশন নেই। মেজর ওসমানের নির্দেশক্রমে আমরা দূরে ঘাঁটি গাড়ি। কেননা ভারত থেকে ভারী অস্ত্রের অপেক্ষা করছিলাম। আমার হেডকোয়ার্টার ছিলো ঝিনাইদহ। আমার একটি পেট্রল ছিলো মাগুরার এসডিও’র সহযোগীতায় লেবুতলায়। সুবেদার আব্দুল মুকিদ ছিলো কমান্ডিং অফিসার। ৫/৬ এপ্রিল পাক বাহিনীর একটি সার্চিং পার্টি লেবুতলার দিকে নিয়ে আসে রেকি করতে। আমাদের দল তৈরী ছিলো। কারণ আগে থেকেই আমরা জানতাম যেহেতু যশোর-কুষ্টিয়া রোডে আমরা আছি তাই অন্যদিকে নিশ্চয় গ্যাপ খুঁজতে আসবে। এ্যামবুশে পাকবাহিনীর ১৫/১৬ জন মারা যায় একজন লেফটেন্যান্ট সহকারে। আমরা বহু ম্যাপ, নোটবুক উদ্ধার করি। মর্টার ফায়ার করে পাক বাহিনী তাদের মৃতদেহ নিয়ে যায়।

ইতিপূর্বে ২৭/২৮ তারিখের দিকে লেঃ কঃ জলিলের (১ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট) কাছে আমরা দু’বার মেসেজ পাঠাই আমাদের সাথে যোগ দেবার জন্য। কিন্তু তিনি রাজি হননি। তখন কর্নেল জলিল সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মাসলিয়াতে ছিলেন।

৫ নং খুলনা উইং-এ আমরা ২৭/২৮ তারিখেই খবর পাঠিয়েছিলাম বেনাপোলে জমায়েত হবার জন্য। নির্দেশ দিলো, ইতিমধ্যে যদি কোনো অবাঙালি অফিসার তোমাদেরকে নিরস্ত্র করতে চায় তাহলে তাকে বন্দী অথবা হত্যা করবে।

ক্যাপ্টেন মোঃ সাদেক ২৭শে মার্চ খুলনা বিওপিতে যায় নিরস্ত্র করবার জন্য। কিন্তু রক্ষী তাকে চ্যালেঞ্জ করলে ক্যাপ্টেন পিস্তল দিয়ে তাকে হত্যা করে। পরে বিওপির ভিতর থেকে গুলি করে পাঞ্জাবী ক্যাপ্টেনকে হত্যা করা হয়। ক্যাপ্টেনের সঙ্গীরাও প্রাণ হারায়। সমগ্র যশোর ক্যান্টনমেন্ট এলাকা আমাকে দেখতে হতো। ফলে কোথাও ২/৪ ঘন্টার বেশী অবস্থান করতে পারতাম না।

১০ই এপ্রিল ঝিকরগাছা যাই ৫ নং উইং দেখার জন্য। কিন্তু পাকবাহিনী তখন অগ্রসর হয়ে পথ বন্ধ করে ফেলে এবং সংঘর্ষ হয়। আমি ভারত সীমান্ত ঘুরে ১১ই এপ্রিল বেনাপোল আসি।

১১ তারিখে ৭২নং বিএসএফ-এর কর্নেল কেবি সিংহ বিএসএফ আইজি, ৫নং গার্ডসদের সাথে আলাপ আলোচনা করি এবং গতকালের যুদ্ধের ঘটনা বলি। আমি দর্শনা হয়ে চুয়াডাঙ্গা আসি এবং মেজর ওসমানকে যুদ্ধের কথা বলি। ঝিকরগাছা থেকে ওই দিনই ঝিনাইদহে রাত দশটায় পৌঁছে যাই।

১২ এপ্রিল বারবাজার থেকে ক্যাপ্টেন শফিউল্লাহর মেসেজ পেলাম যে ওখানে ভীষণ আর্টিলারী এবং ভারী অস্ত্রের আক্রমণ চালাচ্চে পাকবাহিনী। সে আমার কাছে মতামত চাইলো। আমি তাকে কালিগঞ্জ চলে আসতে বলি এবং আমাদের বাহিনীকে কালিগঞ্জ এবং বারবাজারের মধ্যখানে থাকতে বলি। ওখানেও আমাদের বাহিনী বেশ কিছু অস্ত্র এবং সেনা হারিয়ে ফিরে আসে।

১৩ এপ্রিল পাকবাহিনী কালিগঞ্জ দখল করে নেয়। ১৪ এপ্রিল আমি চুয়াডাঙ্গা আসি। ১৪ এপ্রিল পাক বাহিনী ঝিনাইদহ চলে আসে। ১৫ এপ্রিল আমরা মেহেরপুরে ঘাঁটি সরিয়ে নেই।

১৬ এপ্রিল মেহেরপুরে থাকলাম। ঐদিন রাতে ইছাখালী বিওপিতে থাকি। ১৭ এপ্রিল খুব ভোরে মুজিবনগরে বৈদ্যনাথতলা যাই মন্ত্রীপরিষদের শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দেবার জন্য। ইপিআরের একটি কোম্পানী নিয়ে গিয়েছিলাম। বিচ্ছিন্ন ইপিআর বাহিনী সব বেতাইয়ে একত্র হয়। সমস্ত এপ্রিল মাসটা সৈন্য সংগ্রহ করা হয়। মে মাস থেকে কোম্পানী ভাগ করে দেওয়া হয়।

————————————————

<৯, ৭.৩, ২৫০-২৬০>

কুষ্টিয়া-যশোরের সশস্ত্র প্রতিরোধ

সাক্ষাৎকার : মোহাম্মদ তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী

১৪-১০-১৯৭৩

২১/২২/২৩শে মার্চ আমরা নিম্নলিখিত কয়েকজন অফিসার তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য তদানীন্তন এসডিপিও জনাব মাহবুবউদ্দিন আহমেদের বাসায় (ঝিনাইদহে) একত্র হই:

১। তৌফিক এলাহী, এসডিও, মেহেরপুর

২। কামালউদ্দিন সিদ্দীকী, এসডিও, নড়াইল

৩। ওয়ালিউল ইসলাম, এসডিও, মাগুরা

৪। শাহ মোহাম্মদ ফরিদ, এসডিও, গোয়ালন্দ।

আলোচনায় আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে একটা সামরিক সংঘর্ষ অবধারিত। এই বৈঠকে নিজ নিজ এলাকায় প্রতিরোধ গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। আমি আমার এলাকায় সমস্ত থানার পুলিশদের প্রস্তুত রাখি।

২৫শে মার্চ রাতে নুরুল হক এমপি আমকে টেলিফোনে জানালেন যে, ঢাকায় পাক সেনাবাহিনী বের হয়ে পড়েছে এবং জনগণের উপর আক্রমণ চালিয়েছে। আমি তাকে আমার বাসায় অবিলম্বে আসতে অনুরোধ করি। অনুসন্ধান করে জানতে পারলাম যে, ঢাকা টেলিফোন এক্সচেঞ্জ কুষ্টিয়াকে ঢাকায় সেনাবাহিনীর আক্রমণের খবর জানিয়েছেন এবং কুষ্টিয়া এক্সচেঞ্জ মেহেরপুরে এই খবর জানিয়েছে। প্রথমে কুষ্টিয়ার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করলাম। কিন্ত যোগাযোগ তার আগেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। একজন অজ্ঞাতনামা অপারেটর রাজারবাগ থেকে উত্তর দেয়, ‘যা বলার বলেছি তো, আর বিরক্ত করবেন না’। আবার অনুরোধ করার পর আর কোন উত্তর পাওয়া গেল না।

২৫শে মার্চ রাত বারোটায় মাইকে কুষ্টিয়া শহরের জনগণকে ঢাকাতে পাক বাহিনীর নৃশংস হত্যাকান্ডের কথা জানিয়ে দেয়া হল। সেই মুহুর্ত থেকে আমি আর পাকিস্থানী সরকারী কর্মচারী রইলাম না এবং জনগণের আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করলাম।

২৫শে মার্চ রাতে মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা পাকাসড়কে গাছ কেটে ব্যারিকেড তৈরী করা হয় এবং মেহেরপুরকে চুয়াডাঙ্গার সাথে বিচ্ছিন্ন করা হয়। মেহেরপুর-কুষ্টিয়া রাস্তায় খলশাকুন্ডী কাঠের পুল ভেঙ্গেচুরে দেয়া হল। এক দল যুবক এই পুলটা ভেঙ্গে দিয়েছিল।

মেহেরপুরে আনসার কমান্ডারকে আমি আদেশ দিই ২৬শে মার্চের মধ্যে মেহেরপুর মহকুমার সমস্ত আনসার ও মুজাহিদকে একত্র করার জন্য।

২৬শে মার্চ ভোরবেলা। আমার ধারণা হয়েছিল মেহেরপুরকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। আমার মনে হল সমস্ত জনতার মধ্যে এক অভাবনীয় পরিবর্তন এসেছে এবং প্রত্যেকে তার একক সত্ত্বাকে বিসর্জন দিয়ে এক সম্মিলিত সত্ত্বায় রূপান্তরিত হয়েছে। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রেরণা এবং এর অবশ্যম্ভাবী বিজয়ের শক্তি এই জনতার মধ্যে নবরূপান্তরিত সত্ত্বার মধ্যে নিহিত ছিল। প্রত্যেকটা লোক এবং প্রত্যেকটা ছেলে আমার কাছে নতুনভাবে ধরা দিয়েছিল। গায়ের বধুরা পর্যন্ত স্বতস্ফুর্ত গনজাগরণে অঙ্গাঅঙ্গীভাবে একাত্মতা অনুভব করছিল। সেই মুহুর্তে আমি যেন দিব্যচক্ষে পৃথিবীর বড় বড় বিপ্লবকে চাক্ষুষ দেখতে গেলাম।

সমগ্র পরিস্থিতির আমার ব্যক্তিগত মূল্যায়নে আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হিই যে, আমাদের যে কোন জায়গা থেকে অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করতে হবে এবং শুধুমাত্র ভারতই আমাদের এই সাহায্য করতে পারে। দ্বিতীয়ত: ভারত-পাকিস্থানের ঐতিহাসিক পটভূমিকায় এটা সুস্পষ্ট ছিল যে, বাংলাদেশের যে কোন সামরিক বা গণঅভ্যুত্থান ভারতের সমর্থন পাবেই। তাই ২৬শে মার্চ সকালে আমি দুরকমের চিঠি ভারতে পাঠাই। একটা চিঠি পাঠানো হয়েছিল নদীয় জেলা প্রশাসকের কাছে, যার একটা অনুলিপি পাঠাই লেফটেন্যান্ট কর্ণেল চক্রবর্তী (সিও, ৭৬ বিএসএফ, বা মেহেরপুর সীমান্তের ভারতে মোতায়েন ছিল) এর কাছে। দ্বিতীয় চিঠি ভারতের জনগণকে উদ্দেশ্য করে পাঠাই। দুটো চিঠিতেই আমি আমার দস্তখত এবং সরকারী সীলমোহর ব্যবহার করি। দ্বিতীয় চিঠিটা ‘অমৃতবাজার’ এবং ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ২৭/২৮/২৯/৩০ মার্চ-এর সংখ্যাগুলোতে। ‘ডেস্টিনেশন মুজিবনগর’ বইটিতে একটা চিঠির ফটোস্ট্যাট কপি মুদ্রিত রয়েছে।

প্রথম চিঠিটা নদীয়ার জেলা প্রশাসক মি: মুখার্জীর কাছে লেখা হয়েছিল। কর্ণেল চক্রবর্তী আমাকে বলেছিলেন যে এই চিঠিটা দিল্লীর উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে অনতিবিলম্বে প্রেরণ করা হয়েছিল এবং তারই ফলস্বরূপ ২৯শে মার্চ বেতাই (ভারতে) বিওপিতে আমাকে দেখা করার খবর পাঠানো হয়।

২৯শে মার্চ আমি বেতাই বিওপিতে যাই নদীয়া জেলা প্রশাসক এবং কর্ণেল চক্রবর্তী আমাকে সাদরে গ্রহণ করেন এবং স্থানীয় বিএসএফ-এর একটি ছোট দল গার্ড অব অনার প্রদর্শন করে। আমি এবং কর্ণেল চক্রবর্তী গার্ড অব অনার পরিদর্শন করি। নদীয় জেলা প্রশাসক আমাকে আনঅফিসিয়াল দূত হিসেবে মর্যাদা দেন।

আমাদের বৈঠক এক ঘন্টাকাল স্থায়ী হয়। আপ্যায়নের মাধ্যমে মি: মুখার্জী আমাকে জানান যে, আমার চিঠির উত্তরে ভারত সরকারের প্রতিক্রিয়া আমাকে শীঘ্রই জানানো হবে এবং তারা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নির্দেশনার অপেক্ষা করছেন। ব্যক্তিগতভাবে তিনি আমাদের সংগ্রামে ভারতে জনগণের ও সরকারের সমর্থন জানান এবং চুয়াডাঙ্গা সীমান্তে চেংখালী চেক পোষ্টের অদুরে ভারতীয় বিওপিতে কোন একজন সামরিক অফিসারকে সাথে নিয়ে দেখা করি আমাদের সামরিক প্রয়োজন সম্পর্কে আলাপ আলোচনা করার জন্য। ইতিমধ্যে চুয়াডাঙ্গার তদানীন্তন ইপিআর-এর উইং কমান্ডার মেজর ওসমানের সাথে আমার যোগাযোগ স্থাপিত হয়।

৩০শে মার্চ সকালে মেহেরপুর থেকে ১৮ মাইল দুরে চুয়াডাঙ্গায় মেজর ওসমানের সাথে এ ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা করতে যাই। চুয়াডাঙ্গায় মেজর ওসমান কুষ্টিয়া আক্রমণের প্রস্তুতি নিয়ে অত্যন্ত ব্যস্ত থাকায় তিনি পরামর্শ দেন যে আমি মাহবুব উদ্দিন আহম্মদ (তদানীন্তন ঝিনাইদহের এসডিপিও)-কে সাথে নিয়ে যাই। আমি মাহবুবকে টেলিফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করি। কিন্তু অল্প সময় পরে হঠাৎ সে মেজর ওসমানের চুয়াডাঙ্গা অফিসে আবির্ভুত হয়। মাহবুবকে আমি ভারতীয় উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনার বিষয়বস্তু সম্পর্কে অবহিত করি এবং তাকে বলি ঐদিন সন্ধ্যায় ভারতের চেংখালী চেকপোষ্ট বিওপিতে কিছু সামরিক অস্ত্রশস্ত্র নিতে আমার সাথে আসতে এবং এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের সাথে বিশদ আলোচনা করতে। আমি তখন অত্যধিক উত্তেজিত ছিলাম। আমি লক্ষ্য করলাম মাহবুবও কম উত্তেজিত ছিল না। কারণ একটু পরে বুঝতে পারলাম মাহবুব আমাকে অদুরবর্তী একটি জীপের কাছে নিয়ে চলল এবং খুব গোপনে বলল (মেজর ওসমানও এ ঘটনা সম্বন্ধে তখন অবহিত ছিলেন না) যে, ঐ জীপের ভিতরে ২জন খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বসে আছেন এবং তারা হচ্ছেন জনাব তাজউদ্দিন আহমদ (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী) এবং ব্যরিষ্টার আমিরুল ইসলাম (বর্তমান খাদ্যমন্ত্রী)। আমরা দু’জনে জীপের ভিতরে প্রবেশ করলাম। শার্ট এবং লুঙ্গি পরিহিত এবং পুটুলি হাতে পরিশ্রান্ত ক্লান্ত এই দুই ব্যক্তিই অবশ্য পরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন।

আলাপ-আলোচনার পর বুঝতে পারলাম তাঁরা বিভিন্ন জনপদ ঘুরে ঝিনাইদহে এসেছেন এবং সেখান থেকে মাহবুব তাদেরকে মেহেরপুরে নিয়ে আসে এই উদ্দেশ্যে যে, তাদেরকে যেন সীমান্ত পারি দিয়ে ভারতে পৌঁছানো যায়। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্থান সরকারের বিশ্বাসঘাতকতা এবং সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ এবং আক্রমণকে পরাভূত করে বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করার জন্য বন্ধু-প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে সাহায্য এবং সহযোগিতার ব্যবস্থা করা। সত্যি বলতে কি, তাঁদের এই বৃহত্তর প্রচেষ্টার তাৎপর্য আমি তখনো উপলদ্ধি করতে পারিনি। সিদ্ধান্ত হল যে, ভারত সরকারের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে আমাদের পূর্বসিদ্ধান্ত অনুযায়ী বৈঠকে মিলিত হব। জনাব তাজউদ্দীন আহমদ এবং ব্যরিষ্টার আমিরুল ইসলামের সীমান্তের অপর দিকে যাবার ব্যবস্থা করা হবে। শর্ত হল একটা, আমরা যাদের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি তাদের কাছে এই দুই জনের পরিচয় গোপন রাখব। তারা জানতে চাইলে আমরা বলব, এই দুই ব্যক্তি আমাদের পরিচিত।

বিকালে সীমান্তের উদ্দেশ্যে দুটো জীপ রওয়ানা দেয়। পথে নানারকম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছিল। আমরা ব্যারিকেডে সরিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলাম আমাদের গাড়ীতে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড্ডীয়মান ছিল। রাস্তার দু’পাশে জনতা মুহুর্মুহু জয় বাংলা শ্লোগান দিয়ে আমাদেরকে সম্বর্ধনা জানাচ্ছিল। এই দুটো জীপ গাড়ী যেন তাদের কাছে স্বাধীনতার শক্তিশালী প্রতীক হিসেবে প্রতীয়মান হচ্ছিল। এরা অনেকেই আমাদেরকে চিনত। গ্রামবাসীরা বুঝতে পেরেছিল যে, আমরা কোন গোপন মহৎ সামরিক উদ্দেশ্যে সীমান্তে ঘোরাফেরা করছি। পথে পথে দেখতে পেলাম স্বত:স্ফুর্ত জনতা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল, অস্ত্র বলতে হয়তো একটা দুটো শর্টগান। তখনই এদের মধ্যে জন্ম নিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের নিউক্লিয়াস এবং আমরা পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম যে ভবিষ্যত প্রস্তুতি, সামরিক প্রতিরোধ এবং সংঘর্ষে জনশক্তি এবং এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অথচ দলবদ্ধ জনতাই জোগাবে।

সন্ধ্যার পরে পরে আমরা চেংখালী চেকপোষ্ট পৌঁছালাম। বড় বড় শিরিষ গাছের সারি দু’পাশ থেকে রাস্তার উপরে একটা ছাতার মত আবরণ সৃষ্টি করেছিল। কোন লোকালয় জনপদ দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল না, চারদিক পরিবেশ ধু-ধু খা-খা করছিল। শুক্লপক্ষের ম্লান চাঁদের আলো পরিবেশকে আারো গভীরতর করে তুলেছিল। পিছনে গাড়ী দুটো রেখে আমি এবং মাহবুব ধীরে এবং সতর্কতার সাথে অপরিচিত গন্তব্যস্থানের দিকে আন্দাজের উপর ভর করে এগুচ্ছিলাম। বারবার আমাদের গায়ের লোম শিউরে উঠছিল। প্রায় আধ ঘন্টা চলার পর সামনে একটা পাকা ঘরের ধ্বংসস্তুপ দেখতে পেলাম, আমরা বুঝতে পারছিলাম না আমরা কোথায় যাচ্ছি। হঠাৎ সেই ভুতুড়ে ধ্বংসস্তুপ থেকে যেন এক অশরীরী আত্মার আওয়াজ শুনতে পেলাম ‘হল্ট’। যদিও আমরা একটু ভড়কে গিয়েছিলাম তবুও অনতিবিলম্বে ঝোপের আড়াল থেকে একটা মানুষের ছায়া বের হয়ে আসল এবং সেটা ছিল ভারতীয় বিএসএফ-এর একজন সিপাহী, আমাদের পরিচয় দেবার পর সে আমাদেরকে তাদের বিওপিতে নিয়ে চলল। আরো আধা মাইল চলার পর আমরা বিওপিতে পৌঁছালাম এবং আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানালেন বিএসএফ-এর উচ্চপদস্থ কর্মচারী জনাব গোলক মজুমদার এবং লেফটেন্যান্ট কর্ণেল চক্রবর্তী। আনুসঙ্গিক আলোচনার পর দুটো সিদ্ধান্ত নেয়া হলো-

১। আমাদেরকে আগামীকাল থেকে সামরিক অস্ত্রশস্ত্র দেয়া হবে এবং

২। ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সাথে আওয়ামী লীগের রাজনীতিবিদদের যোগাযোগ করিয়ে দেয়া হবে এবং যথাসম্ভব প্রচেষ্টা চালাতে হবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সাথে যোগাযোগ করার। তখনো তারা জানতেন না যে আমাদের সাথে জনাব তাজউদ্দিন এবং ব্যরিষ্টার আমিরুল ইসলাম রয়েছেন।

আমি এবং মাহবুব নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে ঠিক করলাম যে, আমাদের সাথে যে তাজউদ্দিন রয়েছেন তা গোলক মজুমদারকে জানাব এবং গোলক মজুমদারকে জানালাম। তিনি আনন্দে উচ্ছসিত হয়ে তাড়াতাড়ি তাজউদ্দিন সাহেবকে তার কাছে নিয়ে আসতে বললেন। আমরা তাজউদ্দিনকে তার কাছে নিয়ে আসলাম। তারা একে অপরকে আন্তরিকভাবে করমর্দন এবং আলিঙ্গন করলেন। গোলক মজুমদার আমাদেরকে বলছিলেন যে, কলকাতার দমদম বিমানবন্দরে একটি সামরিক জেট অপেক্ষা করছে। যদি কোন রাজনীতিবিদ আসে তাকে যেন তক্ষুনি দিল্লীতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। হয়ত ঐ প্লেনেই জনাব তাজউদ্দিন এবং ব্যরিষ্টার আমিরুল ইসলাম দিল্লীতে গিয়েছিলেন।

রাতে আমরা এক সাথে খাবার খাই। গোলক মজুমদার তাজউদ্দিন এবং ব্যরিষ্টার আমিরুল ইসলামকে নিয়ে যান এবং আমরা চুয়াডাঙ্গা অভিমুখে যাত্রা করি।

এই রাতে সাক্ষাৎকারের পর থেকে ভারত থেকে কমবেশী অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ এবং জ্বালানী পেতে থাকি। আমি নিজে প্রায় এক পক্ষকাল ধরে এই সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র ভারত থেকে নিযে আসতাম। এই সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র চেংখালী চেকপোষ্টের বিপরীত দিকে ভারতীয় বিওপি থেকে নিয়ে আসতম। আমি প্রায় প্রত্যেক সন্ধ্যায় ভারত সীমান্ত অভিমুখে চুয়াডাঙ্গা থেকে যাত্রা করতাম। সাথে থাকত ইপিআর-এর দুটো এসকর্ট পেট্রল, কয়েকটা ট্রাক এবং কোন কোন সময় দর্শনা চিনিকলের ট্রাক্টর এবং তার সাথে লাগানো ট্রলি। এই অস্ত্রশস্ত্র গ্রহণ করার সময় আমি ভারতীয় কাগজপত্রে দস্তখত করে নিতাম এবং মেহেরপুর এসডিও’র সরকারী সীলমোহর ব্যবহার করতাম।

মধ্যরাত্রের দিকে আমরা ভারতীয় বিওপিতে পৌছাতাম এবং চুয়াডাঙ্গায় ফেরত আসতে আসতে অধিকাংশ সময়েই ভোর হয়ে যেত। এই সময় এক নাগাড়ে আমি দশ দিন বিছানায় গা লাগাতে পারিনি। অস্ত্রশস্ত্র দেবার সময় অনেক সময় কর্ণেল চক্রবর্তী থাকতেন এবং সবসময় ক্যাপ্টেন মহাপাত্র থাকতেন। এপ্রিল মাসের ১০ তারিখ থেকে আমরা অস্ত্রশস্ত্র বেতাই বিওপি (যা মেহেরপুর মহকুমার সংলগ্ন ছিল) থেকে সংগ্রহ করতাম।

২৫শে মার্চ রাতে মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা এবং কুষ্টিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়। কুষ্টিয়া এবং চুয়াডাঙ্গার খবরাখবর আমরা নিতে থাকি। আমরা খবর পাই যে, চুয়াডাঙ্গায় অবস্থিত ইপিআর বাহিনী বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে এবং মেজর ওসমান চুয়াডাঙ্গায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আমি জানতে পেরেছিলাম যে, চুয়াডাঙ্গার সাধারণ ইপিআর-এর জোয়ানরা সম্মিলিতভাবে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে এবং বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেছে। চুয়াডাঙ্গার এই সিদ্ধান্তে ইপিআর-এর সাধারণ সৈনিকদের মধ্যে ভূমিকা এবং ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদের এই সাহসিকতা এবং দেশপ্রেম বাংলাদেশের এই এলাকার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখা উচিত। চুয়াডাঙ্গায় অবস্থিত ইপিআর-এর ক্যাপ্টেন আজম চৌধুরীর ভূমিকা এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মেজর ওসমান কুষ্টিয়া থেকে ২৭/২৮ মার্চ চুয়াডাঙ্গায় আসেন এবং তিনিও এই সিদ্ধান্তের প্রতি দৃঢ় সমর্থন জানান। দুইজন সামরিক অফিসারের নেতৃত্বে থাকি পোশাক পরিহিত এবং সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এই ইপিআর বাহিনী কুষ্টিয়া জেলা, পাবনা জেলার বহুলাংশ, যশোহরের কিয়দংশ এমনকি ফরিদপুরের গোয়ালন্দ ঘাট পর্যন্ত বাংলার সাধারণ জনগণের চোখে স্বাধীনতার সুর্যসৈনিক হিসেবে প্রতীয়মান ছিল। আজো শহীদ হাবিলদার মেজর মুজিবর রহমান, সুবেদার মুজাফফর, সুবেদার মুকিত এবং আরো অনেক চেনা মুখের কথা বার বার মনে পড়ছে। সেই দুর্যোগপূর্ণ মুহুর্তে এরা আমার জন্যও আশার প্রতীক হিসেবে প্রোজ্জ্বল ছিলেন।

দু’একদিনের মধ্যেই চুয়াডাঙ্গার সাথে মেহেরপুরের যোগাযোগ স্থাপিত হয় এবং আমি মেজর ওসমানের সাথে চুয়াডাঙ্গায় সাক্ষাৎ করি। ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সাথে আলাপ-আলোচনার বিষয়বস্তু তাকে অবহিত করি। মেজর ওসমান আমাকে প্রয়োজনীয় সামরিক অস্ত্রসম্ভার সম্বন্ধে ধারণা দেন।

এখানে উল্লেখযোগ্য যে, গোয়ালন্দের তৎকালীন এসডিও জনাব মোহাম্মদ ফরিদ সস্ত্রীক মেহেরপুরে বেড়াতে এসে আটকা পড়ে যান। তাকে মার্চের ২৭/২৮ তারিখে গোয়ালন্দে ফেরত যাবার বন্দোবস্ত করি। জনাব ফরিদ তার স্বীয় মহকুমায় এই স্বাধীনতা সংগ্রামকে জোরদার করার জন্য অত্যধিক উৎসাহ দেখান এবং এই দুর্যোগের সময় গোয়ালন্দে ফেরত যান। তিনি পরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়েন এবং অমানুষিকভাবে নির্যাতিত হন। তিনি ১৯৭১-এর ডিসেম্বর মাসে মুক্তি পান।

চুয়াডাঙ্গাতে ইতিমধ্যে কিছু সিদ্ধান্ত এবং কর্মসূচী নেয়া হিয়েছিল:

১। ইপিআর উইং হেডকোয়ার্টার চুয়াডাঙ্গা এবং তার অধীনস্ত সমস্ত বিওপিতে অবাঙালি ইপিআরকে নিরস্ত্র করা,

২। কুষ্টিয়া জেলায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মোতায়েন সম্বন্ধে বিশদ খবরাখবর সংগ্রহ করা,

৩। কুষ্টিয়ার উপর একটা আক্রমণ পরিকল্পনা প্রনয়ন এবং তা বাস্তবায়ন করা। এই মিশনে এর জনশক্তি যোগাবে একদিকে ইপিআর, অন্যদিকে আনসার মুজাহিদ এবং সাধারণ ছাত্রজনতা। আক্রমণ এবং অবরোধ মোটামুটি ত্রিমুখী হবে। একদিকে জনাব মাহবুবউদ্দিন আহম্মদ ঝিনাইদহ কুষ্টিয়া রাস্তা অবরোধ করবেন এবং ইপিআর আনসার মুজাহিদদের একটি দল অভিমুখে যাবে। অপরদিকে প্রাগপুর-ভেরামারা-কুষ্টিয়া থেকে ইপিআর বাহিনী কুষ্টিয়া অভিমুখে অগ্রসর হবে। এই সম্মিলিত বাহিনীর নেতৃত্ব দেবেন ক্যাপ্টেন আজম চৌধুরী।

প্রথমে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল যে এই আক্রমণ ২৯শে মার্চ ভোর পাঁচটার সময় শুরু করা হবে। পরে এই সিদ্ধান্ত ২৪ ঘন্টা পিছিয়ে দেয়া হয়।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২২ ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের অনধিক দুই কোম্পানী সৈন্য কুষ্টিয়ার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো পাহারা দিচ্ছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, ২২ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেকি এবং সাপোর্ট ব্যাটালিয়ানের একটা অংশ ছিল। এদের ফায়ার, পাওয়ার, মোবিলিটি এবং কমিউনিকেশন পাকিস্তানের অন্যান্য সাধারণ পদাতিক ব্যাটালিনের চেয়ে অনেক বেশী। শহরের উপকন্ঠে, অনেকটা অপরাধের মত, প্রথমে মুক্তি বাহিনীকে যার মধ্যে ইপিআররা ছিলেন মুলশক্তি, মোতায়েন করা হয়। আমাদের অস্ত্রশস্ত্রের মধ্যে ছিল পুরানো ৩০৩ রাইফেল এবং কিছু পুরোনো এসএমজি। ইপিআর ছাড়া আনসার এবং মুজাহিদদের কাছে ১০ রাউণ্ড বা অনুর্ধ্ব ২০ রাউন্ডের মত গুলি ছিল।

৩০শে মার্চ সকালে অবরোধের স্থানগুলো থেকে যুগপৎভাবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিভিন্ন অবস্থানের উপর অতর্কিতে গুলিবর্ষণ শুরু করা হয় এবং সাথে সাথে আমাদের প্রত্যেকটির অবস্থানের পিছনে সমবেত হাজার হাজার লোক গগনবিদারী আওয়াজে ‘জয়বাংলা’ ধ্বনি তোলে এবং শ্লোগান দিতে দিতে মুক্তিযোদ্ধারা অগ্রসর হতে থাকে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী এই অতর্কিত আক্রমণে, জনতার এই আকাশফাটা চিৎকারে এবং রাইলে ছাড়াও কিছু স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের আওয়াজে দিশেহারা এবং ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়্ এটা তাদের কল্পনাতীত ছিল যে, বাঙালি ইপিআর-এর জোয়ানরা ঐ অল্প সময়ের মধ্যে তাদের নিজেদেরকে সংগঠিত করে সুসজ্জিত বিক্ষিপ্ত দলগুলো এই আক্রমণের মুখে তাদের কুষ্টিয়া সেনাবাহিনী সদর দফতরের দিকে পিছিয়ে পড়তে থাকে। তাদের এই পশ্চাদপরণে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস ও মনোবল দ্বিগুণ বৃদ্ধি পায়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জন্য এই আক্রমণ ছিল সম্পূর্ণ বিভ্রান্তিজনক। কারণ, তারা বুঝতে পারেনি কারা কোথা থেকে তাদের উপর এই আক্রমণ চালাচ্ছে এবং কেন? এই পশ্চাদপরণই তাদের জন্য কাল হল। কারণ প্রত্যেকটি ঘটনার সাথে সাথে তাদের মনোবল ভেঙ্গে যাচ্ছিল এবং আমদের মনোবল উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছিল। এভাবে যুদ্ধ সারাদিন চলতে থাকে। সন্ধ্যার দিকে তারা তাদের অবস্থান থেকে পুল আউট করে কুষ্টিয়া জেলা স্কুল এবং সার্কিট হাউসে একত্রিত হতে থাকে এবং এটাই তাদের জন্য কাল হয়। আমরাও তাদের দিকে অগ্রসর হতে থাকি। আমাদের অবরোধের তিন দিক থেকে জেলা স্কুল এবং সার্কিট হাউস ঘিরে ফেলে, যদিও তখন পর্যন্ত কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ রাস্তার কয়েক মাইল জনশক্তির অভাবে আমাদের আয়ত্তাধীন ছিল না। পরে অবশ্য আমরা এই দল থেকে বন্দী লেফটেন্যান্ট আতাউল্লাহর কাছে থেকে জানতে পারি যে, মেজর শোয়েব এবং অন্যান্য অফিসাররা রি-ইনফোর্সমেন্ট-এর জন্য বারবার অনুরোধ জানাচ্ছিলেন যশোহর সদর দফতরকে। কিন্তু যশোহর সদর দফতর তাদেরকে কোন সাহায্যের আশ্বাস দিচ্ছিল না্ এতে তথাকথিত দুর্ধর্ষ ২২ এফএফ একেবারে ইঁদুরের মত হয়ে যায়। তারা পালাবার পথ খুঁজতে শুরু করে। ৩১শে মার্চ থেকে তারা পলায়ন করতে শুরু করে।

মুক্তিবাহিনীর সাথে সংঘর্ষে আনুমানিক ২০ জন পাকিস্তানী সৈন্য হতাহত হয়েছিল। বাকী দুই কোম্পানির অনধিক সৈন্য সবাই জনতার সাথে সংঘর্ষে নিহত হয়্ এখানে উল্লেখযোগ্য যে, কুষ্টিয়া হতে ঝিনাইদহের পথে একটা পুলের উপর মুক্তিবাহিনী একটা বিরাট খাদ খনন করে ক্যামোফ্লেজ করে রেখেছিল। মেজর শোয়েব এবং ২২ এফএফ-এর কিছু অফিসার এবং সৈনিক গাড়ীতে করে যশোহরের দিকে পশ্চাদপরণ করার সময় এই খাদে পড়ে যায় এবং তারপর যারা বাঁচতে পেরেছিল তারা পাশ্ববর্তী গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। বাংলার সাধারণ মানুষের এই সময়কার সাহসিকতা পৃথিবীর ইতিহাসেও বিরল। তাদের স্বয়ংক্রিয় মারণাস্ত্রের বিরুদ্ধে বাংলার গ্রামের আবাল-বৃদ্ধবণিতা সমষ্টিগতভাবে রুখে দাঁড়ায়। এই সংঘর্ষে যদিও অনেক সাধারণ বাঙালি নিহত হয় তবুও ২২ এফএফ কেউ যশোহর ফিরে যেতে পারেনি। কুড়াল, কাস্তে বা কোন সময় একেবারে খালি হাতে কোন সময় গাছ থেকে অতর্কিতে সাধারণ জনগণ এদের মোকাবেলা করে। আমরা ১লা এপ্রিল থেকে অনবরত এই গ্রামের লোকজনের কাছ থেকে অস্ত্রশস্ত্র পেতে থাকি যা তারা পাক সেনাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল।

আজো একটি কিশোরের কথা মনে পড়ে, যে একটা শর্টগান দিয়ে তিনজন পাকসেনাকে অনুসরণ করে, যাদের হাতে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ছিল। সে নিজের বুদ্ধিবলে শর্টগান দিয়ে তিনজন পাকসেনাকে খতম করে এবং ওদের অস্ত্রশস্ত্র আমাদের কাছে জমা দেয়। পরে কুষ্টিয়া মুক্তিবাহিনীর দখলে আসার পর আমাদের দখলীকৃত অস্ত্রসম্ভারের হিসাব নিতে গিয়ে আমরা আশ্চর্য হয়ে যাই। যে অস্ত্রশস্ত্র ফেলে ২২ এফএফ পশ্চাদপরণ করে মনোবল থাকলে ঐ অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে তারা এক পক্ষকাল যুদ্ধ করতে পারত। হয়ত আমাদেরকে পরাজিত করতে পারত। ২২ এফএফ-এর এই পরায়জয় এবং মুক্তিবাহিনীর জয়ে আমাদের মনোবল দ্বিগুণ বেড়ে যায়। আমরা বিশ্বাস করতে থাকি আমাদের বিজয়ের গতি অপ্রতিহত থাকবে এবং অচিরেই পদ্মার পশ্চিমাঞ্চলকে আমরা পুরোপুরি মুক্ত করতে পারব। কিন্তু সামরিক জ্ঞানের অভাবে আমরা বুঝতেই পারিনি যে এক সুসজ্জিত সেনাবাহিনী কিভাবে আবার মরণ কামড় হানতে পারে।

আমার যতদুর মনে পড়ে কুষ্টিয়াতে আমরা ৩৫টি গাড়ী, ৬টি আর-আর গানসহ শতাধিক রাইফেল, এলএমজি এবং ভারী মেশিনগান এবং গোলাবারুদ দখল করি, যা দিয়ে আমরা মুক্তিবাহিনীকে সুসজ্জিত করতে থাকি। এই দখলকৃত অস্ত্রসম্ভার এবং গাড়ী আমরা চুয়াডাঙ্গায় এনে জনগণকে প্রদর্শন করি, যা অনেক বিদেশী সাংবাদিক এবং টেলিভিশন সংস্থা পর্যবেক্ষণ করে।

এই সময় এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে কোন একদিন একটি ফরাসী-স্পেনিশ টেলিভিশন সংস্থার প্রতিনিধির সাথে সাক্ষাৎকার দেয়ার সময় ৩টি পাকিস্তানী স্যাবর জেট চুয়াডাঙ্গা আক্রমণ করে এবং আধঘন্টা পর্যন্ত বোমা বর্ষণ করে। এই টেলিভিশন সংস্থা অন্তত্য সাহসিকতার সাথে এই ঘটনার পুরোপুরি আলোকচিত্র গ্রহণ করে যা সারা বিশ্বে তুমুল আলোড়নের সৃষ্টি করেছিল। এই ছবিগুলো নিশ্চই বিশ্ব বিবেককে জাগ্রত করতে বিশেষ ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিল।

এই সময় মুক্তিবাহিনীর ক্ষুদ্র একটি দলকে কুষ্টিয়ায় রেখে আমরা নতুন সমর পরিকল্পনা গ্রহণ করি। আমরা যশোহর থেকে মাত্র কয়েক মাইল উত্তরে বিশাখালীতে আমাদের প্রতিরক্ষাব্যুহ গড়ে তুলি। মাহবুব এই এলাকার সামরিক নেতৃত্ব গ্রহণ করে। বিশাখালীতে আমাদের দুই কোম্পানিরও কম সৈন্য ছিল। উত্তর-পূর্বে আমরা হার্ডিঞ্জ ব্রিজের উভয় পার্শ্বে ঢাকা হতে আক্রমণা প্রতিহত করার প্রতিরক্ষাব্যুহ তৈরী করি। হার্ডিঞ্জ ব্রিজে আমাদের দুই প্লাটুনেরও কম ইপিআর জোয়ান ছিল। এই সময়কার টেলিফোন কর্মচারীদের সহায়তা এবং তাদের দেশপ্রেম আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

উপরোল্লিখিত কয়েকটি জায়গার সাথে আমরা সব সময় যোগাযোগ রক্ষা করেছিলাম। রাজশাহী এবং পাবনায় পাক সেনাদের তৎপরতা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের পরিকল্পনা সম্বন্ধে অবহিত ছিলাম। গোয়ালন্দ মহকুমার প্রশাসক শাহ মোহাম্মদ ফরিদের অনুরোধে আমরা একটি ক্ষুদ্র ইপিআর বাহিনীকে গোয়ালন্দে শত্রকে মোকাবেলা করার জন্য প্রেরণ করি। এমনকি আমরা পাবনা দখলের পর নগরবাড়ি ঘাটে শত্রুর মোকাবিলা করার জন্য ক্ষুদ্র একটি বাহিনী প্রেরণের প্রস্তুতি নিই। আমাদের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল যশোহরে পাকসেনাকে কোণঠাসা করা এবং ঢাকা হতে কোনরকম রিইনফোর্সমেন্ট বা আক্রমণকে প্রতিরোধ করা।

সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যে কোন ব্যক্তির কাছে এটা প্রতীয়মান যে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়া ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইপিআর বাহিনীর পক্ষে এই সামরিক ভূমিকা পালন করা অসম্ভব ছিল এবং কোন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেনাবাহিনী এই প্রস্তুতি নিতে কোন দিনই সাহস পেতোনা তবুও দেশপ্রেমের উন্মাদনা আমাদেরকে পেয়েছিল, তাই যা করা সম্ভব নয় তা করার সাহস এবং প্রস্তুতি আমরা নিয়েছিলাম।

এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে আমরা কুষ্টিয়া, যশোর (শুধু সেনানিবাসকে বাদ দিয়ে), ফরিদপুর, পাবনা, রাজশাহীকে মুক্তাঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করি এবং আমাদের নিজস্ব সীলমোহরও বানাই। শুধু তাই নয়, গোয়ালন্দ থেকে কুষ্টিয়া এবং কুষ্টিয়া থেকে দর্শনা পর্যন্ত ট্রেন চলাচল চালু করতে শুরু করি। আমরা এই সময় ব্যাংকেও নির্দেশ দিই ৫০০ টাকার উপরে কাউকে কোন পেমেন্ট না করতে। এমনকি ভারতে সাথে আমাদের এই বোঝাপড়া হয় যে আমার সরকারী সীলমোহর এবং দস্তখত করা সার্টিফিকেট মোটামুটি পাসপোর্টের মর্যাদা পাবে। এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত এটা বলবৎ ছিল- অর্থাৎ আমরা একটি স্বাধীন সার্বভৌম সরকারের প্রশাসন ব্যবস্থা চালাচ্ছিলাম। আমি এই সময় মেহেরপুরের প্রশাসনভার মেহেরপুরের সেকেণ্ড অফিসারকে দিই এবং নিজে সামরিক পরিকল্পনা প্রণয়নে সামরিক অফিসারের ভূমিকা পালন করি।

এখানে উল্লেখযোগ্য যে, এই সময় শত শত ভারতীয় এবং বিদেশী সাংবাদিক, টেলিভিশন সংস্থা আমাদের সাক্ষাৎকার নেয় এবং এই মুক্তাঞ্চল পরিদর্শন করে। তাদের সবারই একই প্রশ্ন ছিল যে, তোমাদের সরকার কোথায়?

আমরা উত্তরে জানাই যে, অতি শীঘ্রই আমাদের বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা করা হবে। এই সময় আমরা ভারতে টুংগী বিওপি’তে জনাব তাজউদ্দীন আহমেদ ও ব্যারিষ্টার আমিরুল ইসলামের সাথে সাক্ষাৎও করি এবং সমগ্র পরিস্থিতির পর্যালোচনা করি। তাঁরা আশ্বাস দেন যে অতি শীঘ্রই সরকার ঘোষণা করা হবে।

এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে ও শেষদিক থেকে যুদ্ধ একটি নতুন মোড় নেয়। এই সময় শত্রুসৈন্য যশোর সেনানিবাসে নতুনভাবে সমর প্রস্তুতি নিতে শুরু কর্ আমার অভিমত যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী কোনদিন কল্পনা করতে পারেনি যে, বাঙালিরা তাদের সুশিক্ষিত বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্রের ভাষায় জবাব দিতে পারে। কুষ্টিয়ার গ্লানি নিশ্চয়ই তাদের মনোবল ভেঙ্গে দিয়েছিল। তাই প্রচুর রিইনফোর্সমেন্ট ঢাকা থেকে যশোহর আনা শুরু হয়। আমরাও উর্ধ্বশ্বাসে তাদের নতুন তৎপরতার জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। আমরা একসময় ভাবছিলাম যে জনতার সমুদ্র নিয়ে যশোহর সেনানিবাসে ঝাঁপিয়ে পড়ব। যশোহর সেনানিবাস তখন আমাদের কাছে বাস্তিলের কারাগারের মত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সামরিক গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটির প্রতীক মনে হচ্ছিল। কিন্তু লক্ষ লক্ষ জনতা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার একটা ঝুঁকি ছিল যে হয়ত যশোহর আমরা দখল করতে পারব কিন্তু তা হবে হাজার হাজার লোকের প্রাণের বিনিময়ে। এতবড় একটা ঝুঁকি নিতে আমরা প্রস্তুত ছিলাম না।

এই সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে আমাদের প্রথম সংঘর্ষ হয় বিশাখালীতে। এইখানে পাকিস্তান সেনাবাহিনী গোলন্দাজ বাহিনীর সহযোগিতায় আমাদের প্রতিরক্ষাবুহ্যের উপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। এটা ছিল এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহের শেষের দিকে। আমাদের ইপিআর বাহিনী অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে এই আক্রমণ মোকাবিলা করে। হানাদার বাহিনীর শতাধিক সৈন্য হতাহত হয়। প্রায় ২৪ ঘন্টার এই আক্রমণ প্রতিহত করার পর আমরা বিশাখালী থেকে প্রতিরক্ষাবুহ্য পিছিয়ে আনতে বাধ্য হই। এই প্রথম ট্যাকটিক্যাল রিট্রিট আমাদের মনোবলের উপর মারাত্ম প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। এই প্রথম আমরা উপলদ্ধি করি যে শত্রুর দুরপাল্লার ভারী কামানের জবাব দেবার মত অস্ত্র আমাদের ছিলনা। অন্যদিকে শত্রু এই কামানের আক্রমণ দ্বারা আমাদেরকে পিনডাউন করে রেখে সেই আর্টিলারী কভারের সাহায্যে আমাদের অবস্থানের উপর তাদের সুবিধা অনুযায়ী আক্রমণ চালাতে থাকে। শুধু তাই নয়, প্রত্যেক আক্রমণে তারা প্রচুর সৈন্য ব্যবহার করছিল। প্রত্যেক আক্রমণের সাথে আমাদের মনোবলও ভেঙ্গে যাচ্ছিল এবং আমরা ভবিষ্যত বিজয়ের কোন সামরিক সমাধান খোঁজে পাচ্ছিলাম না। তদুপরি আমদের অগ্রবর্তী ঘাঁটিগুলোর সাথে যোগাযোগ রক্ষা করাও সম্ভব হচ্ছিল না এবং কোন রণাঙ্গণে অগ্রবর্তী অথবা পশ্চাদবর্তী অবস্থানগুলোর সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে তাতে যুদ্ধ দক্ষতা এবং মনোবলের উপর যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে তা যারা যুদ্ধে অভিজ্ঞ তারাই বলতে পারবে। এই রকম একটি অগ্রবর্তী অবস্থান থেকে আমি নিজেও অসহায় অবস্থায় পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হই। তদুপরি এই সময় বর্ষার অশুভ আগমন শুরু হয়। আমাদের অবস্থানগুলোতে খাদ্যদ্রব্য এবং গোলাবারুদের অভাব দেখা দেয়। বিচ্ছিন্ন অবস্থানগুলোতে এই বিরূপ পরিস্থিতিতে সৈন্যদের মনোবল ভেঙ্গে যেতে শুরু করে। আমাদের পশ্চাদপসরণ অব্যহত থাকে। এছাড়া আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসারও কোন সুব্যবস্থা ছিলনা। ঔষধের অভাবে অনেকেই মারা যায়। এটা সহজেই অনুধাবনযোগ্য যে গোয়ালন্দের মত জায়গায় ক্ষুদ্র একটি প্রতিরক্ষাবুহ্য কি রকম আত্মঘাতী ছিল। এদের পেছনে পাক ছত্রীসৈন্য অবতরণ করে অনায়াসে ঐ ঘাঁটিকে উড়িয়ে দেয়। একইভাবে নগরবাড়ি ঘাট এবং অবশেষে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ শত্রুর আয়ত্তে চলে যায়। আমাদের খবর অনুযায়ী জেনারেল মিঠা খান পাবনা হার্ডিঞ্জ ব্রিজ এ্যাসিক্স-এর অপারেশন চালান।

চতুর্দিকে শত্রুর প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে আমাদের সংঘটনও দুর্বল হয়ে পড়েছিল। প্রত্যেকটি ঘাঁটি থেকে পশ্চাদপসরণে বাধ্য হয়ে আমরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ি। আস্তে আস্তে ঝিনাইদহ আমাদের আয়েত্তর বাইরে চলে যায়। শত্রুসৈন্য কুষ্টিয়াও দখল করে ফেলে এবং চুয়াডাঙ্গার দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। আমরা এই শত্রুর আক্রমণের মুখে পুনর্গঠন এবং পুনর্বিন্যাসের সময় এবং সুযোগ পাচ্ছিলাম না। চতুর্দিকে প্রচুর বিভ্রান্তি দেখা দেয়। সাধারণ জনগণের মনোবলও ভেঙ্গে পড়তে থাকে। চুয়াডাঙ্গা যখন শত্রুর আক্রমণের আওতায় চলে আসে তখন আমরা সদর দফতর চুয়াডাঙ্গা থেকে সরিয়ে পেছনে মেহেরপুরে নিই।

প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্ট: প্রথম বেঙ্গল রিজেমেন্ট যশোর সেনানিবাসে অবস্থান করছিল। লেফটেন্যান্ট কর্ণেল জলিল প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার ছিলেন। ২৫শে মার্চের আগেই প্রথম বেঙ্গলকে এক্সারসাইজের জন্য ঝিকরগাছার দিকে পাঠানো হয়। আমরা প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করি। আমি, মাহাবুব এবং মেজর ওসমান চিঠির মাধ্যমে বর্তমান পরিস্থিতি এবং ভবিষ্যত কর্মসূচী সম্বন্ধে তাকে অবহিত করি স্বতন্ত্রভাবে চিঠির মাধ্যমে। প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টকে আমাদের সঙ্গে যোগ দেয়ার আহ্বান জানাই। দুর্ভাগ্যবশত আমাদের কোন চিঠিরই জবাব পাইনি। এর পরপরই প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্ট যশোর সেনানিবাসে ফিরে গেলে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের নিরস্ত্র করার চেষ্টা করলে তুমুল সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষে একজন তরুণ বাঙালি লেফটেন্যান্ট আনোয়ার শাহাদাত বরণ করেন। প্রচুর বাঙালি সৈন্য হতাহত হয়। এই সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে ক্যাপ্টেন হাফিজ প্রায় ৩০০ বাঙালি সৈন্যকে নিয়ে চৌগাছার দিকে অগ্রসর হয়। প্রত্যেক অস্ত্র হাতে নিয়ে বেরিয়ে এসেছিল।

ক্যাপ্টেন হাফিজের সাথে আমার প্রথম দেখা হয় চুয়াডাঙ্গায়। সে তখন প্রথম বেঙ্গলের বিক্ষিপ্ত, বিচ্ছিন্ন লোকদের নিয়ে চৌগাছায় একত্রিত করছিল। আমাদের সশস্ত্র যুদ্ধের কিছু খবর পেয়ে সে আমাদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে চুয়াডাঙ্গায় আসে। তার কাছে আমি জানতে পারি যে তারা তখন ভারত সরকারের কাছে অস্ত্রশস্ত্রের জন্য চেষ্টা করছিল। আমরা তখন যৌথভাবে সামরিক পরিকল্পনার প্রস্তুতি নিতে থাকি।

প্রথম বাংলাদেশ সরকার গঠন: এই সময় আমরা জনাব তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিষ্টার আমিরুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ অব্যাহত রাখি। আমরা আশা করছিলাম যে, অনতিবিলম্বে বাংলাদেশ সরকার গঠন এবং ঘোষণা করা হবে। এই সময় আমাদের মুক্তাঞ্চলে প্রতিদিন অনেক বিদেশী সাংবাদিক এবং টেলিভিশন দল আমদের মুক্তাঞ্চল ঘুরেফিরে দেখছিলেন এবং এত প্রতিকুল অবস্থার ভেতরেও আমরা যে শুধু পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণের বিরুদ্ধে নিজেদেরকে প্রতিরক্ষা করছিলাম তা নয়, আমরা এরকম একটা সুসজ্জিত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক অভিযান চালিয়ে জয়ী হয়েছিলাম। এই সামরিক বিজয় জনগণের উচ্ছ্বাস, উন্মাদনা ও দৃঢ় সংকল্প তাদের সবাইকে বিমোহিত করেছিল।

মেহেরপুরের কোন এক স্থানে বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণের প্রস্তাবের কথা আমরা এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের দিকে জানতে পারি। আমরা চুড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য গভীর আগ্রহে প্রতিক্ষা করতে লাগলাম। এই সময় যশোরের কাছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আমাদের প্রতিরক্ষাবুহ্য ভেদ করে এগিয়ে আসছে। এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে শত্রুবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে আমরা পশ্চাদপসরণ শুরু করি। ওদের সৈন্যসংখ্যা আমাদের তুলনায় বেশী। আমাদের রণকৌশলগত পশ্চাদপসরণ ছিল প্রথম পর্যায়ের যুদ্ধে অনিবার্য পরাজয়ের সূচনা মাত্র।

১২ই এপ্রিল- দিনের পর দিন মরণপণ যুদ্ধের পরও আমরা যখন কোন স্বীকৃতি পাচ্ছিনা তখন আমাদের মনোবল ভাঙ্গতে শুরু করে। একটা পর্যায় পর্যন্ত মানুষের মনোবল অক্ষুণ্ণ থাকে। যুদ্ধক্ষেত্রে অনেকগুলি ব্যর্থতা আমাদের যোদ্ধাদের মনেও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছিল। এমন এক সংকটজনক দিনে আমরা খবর পেলাম, বাংলাদেশ সরকার ১৬ই কিংবা ১৭ই এপ্রিল শপথ গ্রহণ করবেন। তার আগেই আমি প্রাথমিক ব্যবস্থাদি সম্পন্ন করে ফেলেছিলাম। তিনটি বিষয়ের ভিত্তিতে আমাদের স্থান নির্ধারণের কাজ শুরু হয়েছে- শহর থেকে দুরত্ব বজায় রাখা এবং ভারতীয় এলাকা থেকে বিদেশী সাংবাদিকরা যাতে সহজে আসতে পারেন এবং শত্রুর সম্ভাব্য বিমান আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য ছদ্মাবরণের ব্যবস্থা করা।

১৬ই এপ্রিল মাহাবুব (ঝিনাইদহ মহকুমা পুলিশ অফিসার ছিলেন, পরে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর একজন অফিসার হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন) ও আমি চুড়ান্ত ব্যবস্থা সম্পন্ন করার জন্য নির্দিষ্ট স্থানের দিকে যাত্রা করি। তখন ছিল অত্যন্ত সংকটময় সময়। তখন আমরা আমাদের বাহিনীর পশ্চাদপসরণের খবর পাচ্ছি। অগ্রবর্তী এলাকার সাথে আমাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। আমাদের সেনারা বিচ্ছিন্ন হয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে পরিণত হয়ে বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। মেজর ওসমান তখন আমাদের বাহিনীর প্রধান। তিনি তাঁর সদর ঘাঁটি মেহেরপুরে সরিয়ে এনেছেন। মেজর ওসমান ভীষণ ব্যস্ত এবং চিন্তান্বিত। পাকিস্তান বাহিনী একের পর এক আমাদের প্রতিরক্ষাব্যুহ ভেদ করে এগিয়ে আসছে। আমরা তখনো জানতামনা আর কতদিন মাতৃভূমির বুকে আমাদের শেষ ঘাঁটি টিকিয়ে রাখতে পারবো। আমরা দুপুর নাগাদ আমাদের গন্তব্যস্থলে পৌঁছলাম। একটা সাধারণ মঞ্চ তৈরী হচ্ছে, বাঁশ দিয়ে ঘেরা। এলাকাটি সীমান্ত ঘেঁষা বলে আমরা ভারতের সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর ৭৬তম ব্যাটালিয়নের লে: কর্ণেল চক্রবর্তীর সাথে এই উপলক্ষ্যে যোগাযোগ রক্ষা করে কাজ করছিলাম।

১৭ই এপ্রিল আমি আর মাহবুব সেই ঐতিহাসিক স্থানে ছুটলাম। অনাড়ম্বর আয়োজন সম্পন্ন হয়েছে। সকাল ৯টার দিকে জনাব তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম অন্যদের সাথে নিয়ে সেখানে পৌঁছলেন। আমি তাঁদের নিয়ে এলাম বদ্যনাথতলার মণ্ডপে। ওখানে আশেপাশের গ্রাম থেকে কিছু চেয়ার সংগ্রহ করে আনা হয়েছে। সংগৃহীত চেয়ারের মধ্যে সবগুলো পূর্ণাঙ্গ নয়। কোনটার একটা হাতল নেই, কোনটার একটা পায়া খোয়া গিয়েছে। মণ্ডপ পাহাড়া দেবার জন্য নিয়োজিত আনসারদের জন্য কিছু রান্না হয়েছিল। মাহাবুব আর আমি দ্রুত একটা অনুষ্ঠানসূচী প্রণয়ন করে ফেললাম। অন্যদেরও তা দেখালাম। আমরা নেতৃবৃন্দকে গার্ড অব অনার দেবার মত কয়েক প্লাটুন ইপিআর ও মুজাহিদ মোতায়েন করি। মাহাবুব তাদের নিয়ে গার্ড অব অনার দেবার মহড়া শুরু করলো্ আমি তখন কর্ণেল ওসমানী ও অন্যদের সাথে ককেটি সমস্যা নিয়ে আলোচনা করছিলাম। হাজার দুয়েক লোক জমায়েত হয়েছে অনুষ্ঠানে। তাদের মধ্যে অন্তত: শতাধিক বিদেশী সাংবাদিক, ফটোগ্রাফার ও টিভি ক্যামেরাম্যান।

নীরব আম্রকুঞ্জ। সমবেত গ্রামের মানুষের নিকট অতীতেও এমন কোন অনুষ্ঠান দেখার সুযোগ হয়নি। আমরাও অনুষ্ঠানের কথা গোপন করে রেখেছিলাম। গ্রামের মানুষের শূন্যদৃষ্টির ভাষা আমরা বুঝতে পেরেছি। তারা যেন এক অঘটন ঘটতে দেখেছে- বিস্ময়াবিষ্ট, নিষ্পলক।

বেলা ১১ টা নাগাদ বহুপ্রতীক্ষিত অনুষ্ঠানের সূচনা হল। আমি জীপে করে জনাব তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, জেনারেল এমএজি ওসমানী ও অন্যান্য কয়েকজনকে মঞ্চের ৫০ গজের মধ্যে তোরণের কাছে নিয়ে এলাম। মাহাবুব গার্ড অব অনারের নেতৃত্ব দিল। সৈয়দ নজরুল ইসলাম অভিবাদন গ্রহণ করলেন। পিছনে দাঁড়িয়ে জেনারেল ওসমানী। সৈয়দ নজরুল ইসলাম যখন পতাকা উত্তোলন করছিলেন তখন সাংবাদিকরা তাদের চতুর্দিকে ঘিরে দাঁড়িয়েছিলেন। একটা ছোট দল জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা’ গাইলো। একটা জাতির জন্মলগ্ন প্রত্যক্ষ করলাম। এমন জন্মের কাহিনী ইতিহাসে বহুবার পড়েছি। কিন্তু বিশ্বাস হয়না চোখের সম্মুখে একটি জাতি জীবনের স্পন্দনে স্পন্দিত হচ্ছে। গার্ড অব অনারের পর ভাবী মন্ত্রিসভার সদস্যরা মঞ্চে উপবেশন করলেন। সৈয়দ নজরুল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করলেন। তারপর এক এক করে মন্ত্রিসভার সদস্যদের পরিচয় করিয়ে দিলেন তিনি। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভাষণ দান করলেন। রাষ্ট্রপতির পর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ সাংবাদিক সম্মেলনে বক্তৃতা করেন। ঘোষণা করা হলো, লক্ষ লক্ষ মৃতদেহের নীচে পাকিস্তান সমাধিস্থ হয়েছে। আর এই সমাধির উপরে একটি জাতি প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। সেই জাতি হলো বাংলাদেশ। মানুষ এই ঘোষণাকে অভিনন্দিত করলো।

আমাদের মধ্যে কয়েকজন সম্মেলন কেন্দ্র ছেড়ে চলে গেলেন। ক্যাপ্টেন হাফিজ তার সহযোদ্ধারা প্রতিরক্ষাবুহ্য রচনা করে বসে রয়েছেন। মাহাবুব আর আমি চললাম আমাদের কর্মক্ষেত্রে। পথে আমরা উপলদ্ধি করলাম, একটি জাতি আজ জন্ম নিল বটে কিন্তু আজ যে শিশু জন্ম নিল সেই শিশুকে বিশ্বসভায় আসন গ্রহণের জন্য অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আমরা জানি এই পথ পাড়ি দেবার জন্য আরও রক্তমূল্য দিতে হবে। আমাদের কাহিনী রক্তাক্ষরে লিখতে হবে। এই মুহুর্তে আমাদের চিন্তা হলো, সদ্যজাত জাতি বড় হবে যেদিন, যেদিন বিশ্বসভায় মর্যাদার আসন পাবে, সেদিন কি আমরা তা আজকের মত দেখার জন্য বেঁচে থাকবো?

সরকার গঠনের পর আমাদের সাথে প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টের একত্রীকরণ হয়। মেজর ওসমানের নেতৃত্বাধীনে আমাদের সৈন্য শার্শা-নাবারণ এলাকায় মোতায়েন করা হয়। এই সময় উল্লেখযোগ্য যে, ক্যাপ্টেন সালাউদ্দীন এবং ক্যাপ্টেন মুস্তাফিজ ঢাকা সেনানিবাস থেকে পালিয়ে মেহেরপুরে এসেছিলেন তারাও এপ্রিলের আনুমানিক দশ তারিখে চুয়াডাঙ্গায় আমাদের সাথে যুদ্ধে যোগ দেন। এই সময় আরো দুজন সামরিক অফিসার আমাদের সাথে যোগ দেন। তাঁরা হলেন ক্যাপ্টেন হুদা, যিনি পাবনা থেকে পিছু হটে আমাদের সাথে যোগ দেন। আর অন্যজন ছিলেন ক্যাপ্টেন ওহাব। যিনি যশোহর সেনানিবাস থেকে পালিয়ে আসেন। শার্শা নাভারনের নতুন প্রতিরক্ষাবুহ্যকে আমরা শক্তিশালী করতে থাকি। এই সময় আমরা আর একজন নতুন মুক্তিযোদ্ধাকে পাই, যাকে পরে আনুষ্ঠানিকভাবে সামরিক বাহিনীতে নেয়া হয়। তার সাথে পরিচয় হয়। তিনি সরাসরিভাবে প্রতিরক্ষাবুহ্যতে মোতায়েন ছিলেন। তিনি হচ্ছেন ক্যাপ্টেন শফিউল্লাহ। তিনি ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের শিক্ষক ছিলেন।

এপ্রিল মাসের তৃতীয় সপ্তাহের দিকে এই সময়েই ক্যাপ্টেন হাফিজ নাভারনে শত্রুবাহিনীর ঘাঁটির উপর একটা সাফল্যজনক দু:সাহসিক রেইড চালান। এই রেইডে প্রথম বেঙ্গলের লোকজন ছিল। এতে করে যদিও শত্রুর কিছু ক্ষয়ক্ষতি হয় তবুও তারা আমাদের অবস্থান সম্বন্ধে সচেতন হয়ে ওঠে এবং তারপর পাকিস্তান সেনাবাহিনী বিরাট আকারে আমাদের অবস্থানের উপর আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে শত্রুবাহিনী গোলন্দাজ বাহিনীর সাহায্য নিয়েছিল, যার প্রত্যুত্তরে আমাদের কিছুই ছিলনা। তাই আক্রমণকারী বাহিনীর উপর চাপ সৃষ্টি করে আমরা পিছু হটতে থাকি। এই সময় হাবিলদার মেজর মুজিবুর রহমান সহ আরও অনেক মুক্তিযোদ্ধা এই যুদ্ধে শহীদ হন। অনেকেই হতাহত হন। আমরা পরে জেনেছিলাম শত্রুর ক্ষয়ক্ষতি হতাহত মিলিয়ে প্রায় দুই শতাধিক ছিল। সেই এলাকায় এক মৃত মেজরের নামে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এক ছোট মেমোরিয়াল তৈরী করেছিল।

আমাদের পশ্চাদপসরণ বিশৃঙ্খলভাবে হয়েছিল। পশ্চাদপসরণের সময় কিছু মূল্যবান হাতিয়ার খোয়া যায়। বেনাপোল চেকপোষ্টে আমাদের দফতর স্থানান্তরিত করা হয়। ঐদিন জনাব তাজউদ্দীন আহমদ বৃটিশ এমপি টমাসম্যানসহ চেকপোষ্টে আসেন এবং ঐখানে তার বিবৃতি দনে। ঐদিন পরে শত্রুবাহিনী আমাদের হেডকোয়ার্টারের উপর গুলিবর্ষণ করে। এই অতর্কিত আক্রমণের জন্য আমরা মোটেও তৈরী ছিলাম না। শত্রুর আক্রমণে আমরা বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি এবং বাংলাদেশের মাটিতে শেষ ঘাঁটিটুকু ছেড়ে দিয়ে ভারতে পশ্চাদপসরণ করি।

—————————————

(৯,৭.৪,২৬০-৬২)

প্রতিবেদনঃ মেজর (অবঃ) রফিক-উল-ইসলাম

কুষ্টিয়ার যুদ্ধ

(লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে গ্রন্থ থেকে সংকলিত)

 কুষ্টিয়াতে ২৮শে মার্চ সকালে কারফিউ উঠাতেই জনসাধারণ পাকিস্তানী সৈন্যদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ৩০শে মার্চ সকালে পুলিশ ও ইপিআর সদস্যরা অসামরিক লোকজনদের সহায়তায় কুষ্টিয়া শহরে অবস্থানরত ২৭তম বালুচ রেজিমেন্টের ওপর আক্রমণ চালিয়ে অবস্থানটি দখল করে নেয়।

চুয়াডাঙ্গাস্থ ৪র্থ ইপিআর উইংয়ের উইং কমান্ডার মেজর ওসমান সরকারী কাজে কুষ্টিয়া গিয়ে সার্কিট হাউসে উঠেছিলেন। পাকিস্তানীদের হামলার সময় তিনি কোন প্রকারে কুষ্টিয়া থেকে আত্মরক্ষা করে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হন। ২৬শে মার্চ বেলা ১টার দিকে তিনি চুয়াডাঙ্গা পৌঁছে ইপিআর সেনাদের সংগঠিত করেন এবং স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারীদের সঙ্গে আলোচনায় মিলিত হন। ৪র্থ উইংয়ের সদর দফতর থেকে ওয়ারলেসে ঐ এলাকার সীমান্তবর্তী সকল ফাঁড়ির ইপিআর সদস্যদের জনগণের সহযোগিতায় পাকিস্তানী সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করার নির্দেশ দেয়া হয়। ২৭শে মার্চ সকালে মেজর ওসমান ১ বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল রেজাউল জলিলের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পাকিস্তানীরা কায়দা করে ২৪শে মার্চ এই রেজিমেন্টকে চৌগাছা পাঠিয়ে দিয়েছিলো। মেজর ওসমান সংক্ষেপে সর্বশেষ পরিস্থিতি বর্ণনা করে ইপিআর সুবেদার মজিদ মোল্লার মারফত লেঃ কর্নেল জলিলের কাছে একটি চিঠি পাঠান। এই চিঠি তিনি লেঃ কর্নেল জলিলকে প্রতিরোধ আন্দোলনে যোগ দিয়ে এই অঞ্চলের সার্বিক কমাণ্ড গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানান। কিন্তু চিঠির কোন জবাব পাওয়া গেলনা। ২৮শে মার্চ মেজর ওসমান দানেশ নামে জনৈক মুক্তিযোদ্ধার মাধ্যমে তার কাছে পুনরায় বার্তা পাঠান। শোনা যায় মুক্তিযোদ্ধা দানেশ পুনরায় অনুরোধপত্র নিয়ে লেঃ কর্নেল জলিলের সামনে উপস্থিত হলে তিনি প্রথমে চিঠিটি পড়েন এবং তার পক্ষে বিদ্রোহে যোগ দেওয়া সম্ভব নয় বলে দানেশকে জানিয়েদেন। এভাবে তাঁর সাথে দেখা না করার জন্যও তিনি দানেশকে সতর্ক করেদেন। এর পরিণতি হয়েছিল করুণ। এই দিন অর্থ্যাৎ ২৮শে মার্চেই লেঃ কর্নেল জলিলের কাছে ব্যাটালিয়ন নিয়ে তাকে যশোর ফিরে যাওয়ার এবং অস্ত্রশস্ত্র জমা দেয়ার নির্দেশ আসে।

যশোর ক্যান্টনমেন্টে ১ম ফিল্ড এম্বুলেন্স দলের বাঙালি সৈন্যরা আসন্ন বিপদ অনুভব করতে পেরেছিলো। ২৯শে মার্চ রাতে প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনারা চৌগাছা থেকে ক্যান্টনমেন্টে ফিরে এলে ফিল্ড এম্বুলেন্সের লোকেরা বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকদের অস্ত্র জমা না দেয়ার আহবান জানায়। কিন্তু দুর্ভাগ্য, এর আগেই অস্ত্র জমা দেওয়া শেষ করে সৈনিকরা ব্যারাকে ফিরে বিশ্রাম নিচ্ছিলো। ২৯শে মার্চ দিবাগত রাতে পাকিস্তানীরা হঠাৎ প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টের ঘুমন্ত সৈন্যদের উপরে হামলা করে। বিশ্বাসঘাতকদের এই আক্রমণে অনেক বাঙালি সেনা প্রাণ হারায়। প্রাণ নিয়ে পালাতে পেরেছিলো এমন কয়েকজন পরে চুয়াডাঙ্গা গিয়ে মেজর ওসমানের সৈন্যদের সাথে যোগ দেয়।

১ম বেঙ্গল রেজিমেন্টের ওপর হামলার সময় পাকিস্তানীরা শুধু সেনাদেরই হত্যা করেনি, তাদের পরিবার-পরিজন, নারী-শিশুদেরও হত্যা করে। পাকিস্তানীদের হত্যা ও অত্যাচারের হাত থেকে দুগ্ধপোষ্য নবজাতকেরাও রেহাই পায়নি। ফিল্ড এম্বুলেন্সের বাঙালি কমান্ডিং অফিসার কর্নেল এস এ হাই এবং তার বাঙালি সহকর্মী ক্যাপ্টেন কালামকে ওরা দুঃসহ নির্যাতনের পর হত্যা করে। এই পরিস্থিতিতে চুয়াডাঙ্গায় মেজর ওসমান এবং তার সহযোদ্ধা ক্যাপ্টেন আজম ইপিআর সৈন্যদের নিয়ে কুষ্টিয়া মুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেন। কুষ্টিয়ার ২৭তম বালুচ রেজিমেন্টের দুইশত সৈন্য থানা, পুলিশ লাইন এবং জেলা স্কুলে অবস্থান গ্রহণ করছিলো। মেজর ওসমান তিনটি ঘাঁটিতেই পর্যায়ক্রমে আঘাত হানার সিদ্ধান্ত নেন। ২০শে মার্চ ভোর ৪টায় প্রথম আঘাত শুরু হয়। সারাদিন যুদ্ধের পর ৫টায় পুলিশ লাইন মুক্ত হয়।

এখানে অনেক পাকিস্তানী নিহত হয়, কয়েকজন আবার পালিয়ে গিয়ে জেলা স্কুলের প্রধান ঘাঁটিতে যোগ দেয়। ৩১শে মার্চ কুষ্টিয়া শহরের পাকিস্তানী অবস্থান গুলোর আবার নতুন আক্রমণ শুরু হয়। পাশ্ববর্তী এলাকার হাজার হাজার লোক পুলিশ-ইপিআর এর সহায়তায় এগিয়ে আসে। তাদের হাতে ছিল বাঁশের লাঠি, বন্দুক এবং কয়েকটি ৩০৩ রাইফেল। জনতার ভীড় বেড়ে গেল। দুপুরের মধ্যে বিক্ষুদ্ধ জনসাধারণের বিরাট দল পাকিস্তানীদের দ্বিতীয় ঘাঁটি দখল করে নেয়।

শত্রুরা তখন পিছু হটে আত্মরক্ষার চেষ্টা করতে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই লোকজন চারদিক থেকে তাদের ঘিরে ফেলে। ২৭-বালুচ রেজিমেন্টের কোম্পানীর অন্তিম মূহুর্ত ঘনিয়ে আসে। ঘেরাওয়ের মধ্যে থেকে কোনভাবে প্রাণে রক্ষা পাওয়া কিছু পাকিস্তান সেনা দুটি জীপ এবং দুটি ডজ গাড়িতে করে রাতের অন্ধকারে ঝিনাইদহের দিকে পালাতে চেষ্টা করে। খবর পেয়ে জনসাধারণও পথের বিভিন্ন স্থানে ব্যারিকেড সৃষ্টি করে। একদল মুক্তিযোদ্ধা শৈলকুপা সৈতুর (যশোর জেলার ঝিনাইদহে) নিকট অবস্থান গ্রহণ করে।

সেতুর নিকট পৌঁছাতেই পাকিস্তানীরা মুক্তিযোদ্ধাদের এ্যামবুশের ফলে বেশ কয়েকজন হতাহত হয়। কয়েকজন পালাবার চেষ্টা করলে জনসাধারণ তাদের পিছু ধাওয়া করে। পথে তারাও জনতার হাতে প্রাণ হারায়। তবে এই সময়ের মধ্যে ২৭-বালুচ রেজিমেন্টের ডেল্টা কোম্পানীর হাতে দুই শতাধিক বেসামরিক বাঙালি প্রাণ হারিয়েছে, আহত আরো বেশী।

২রা এপ্রিল ভোরের দিকে বালুচ কোম্পানীর অবশিষ্ট সৈন্য কুষ্টিয়া থেকে বেরিয়ে পড়ে। রাস্তার ব্যারিকেডের জন্য যানবাহন চলাচলে বিঘ্ন ঘটায় তারা গ্রামের পথ ধরে পালাবার চেষ্টা করে। পথে কাউকে দেখতে পেলেই তারা গুলি ছুড়তে থাকে। কিন্থু শিগগীরই তারা হতাশা ও ক্লান্তিতে দুর্বল হয়ে পড়ে এবং গোলাগুলীও ফুরিয়ে যায়। জনসাধারণ সহজেই তাদের বন্দী করে। তারপর পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর তালিকা থেকে ২৭-বালুচ রেজিমেন্টের ডেল্টা কোম্পানীর নাম চিরতরে মুছে যায়।

————————————————-

 

সশস্ত্র প্রতিরোধঃ যশোর

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৮। যশোর-নড়াইল-গোপাল্গঞ্জের সশস্ত্র প্রতিরোধের বিবরণ বাংলা একাডেমীর দলিলপত্র ১৯৭১

 

<৯, ৮.১, ২৬৩-২৬৫>

যশোর- গোপালগঞ্জের প্রতিরোধ যুদ্ধ

সাক্ষাৎকারঃ মেজর আবদুল হালিম

২২-১১-১৯৭৩

অসহযোগ আন্দোলন চলাকালীন সময়ে আমি আমার নিজ বাড়ি ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জে ছুটি ভোগ করছিলাম। ২৫শে মার্চের পাকবাহিনীর নির্মম হত্যাকান্ডের সংবাদ পাওয়ার সাথে সাথে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সিদ্ধান্ত নেই। প্রথমে গোপালগঞ্জ মহকুমা আওয়ামী লীগ অফিসের নেতৃবৃন্দের সাথে মুক্তিযুদ্ধ কিভাবে পরিচালনা করতে হবে তা নিয়ে আলোচনা করি। সাথে সাথে ছুটি ভোগকারী সৈনিক ও ইপিআর দিগকে গ্রাম-গঞ্জ ও শহর থেকে একত্রিত করি। সেই সময় গোপালগঞ্জ আওয়ামী লীগ নেতা ডাঃ ফরিদ আহমদ ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ সর্ব প্রকার সাহায্য করেন।

২৮শে মার্চ গোপালগঞ্জ থানা থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে তৎকালীন কালিয়া থানার এম-পি-এ সাহেবের সহযোগিতায় যশোর জেলার নড়াইল মহকুমা শহরে ৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে পৌছি। সেই সময় নড়াইলে এস-ডি-ও কামাল সিদ্দীকি ও যশোর জেলার এ্যাসিস্টান্ট কমিশনার শাহাদৎ হোসেন সর্বপ্রকার সাহায্য করেন।

২৯শে মার্চ নড়াইল গিয়ে জানতে পারলাম, যশোরে পাকবাহিনীর সহিত মুক্তিবাহিনীর ভীষণ যুদ্ধ চলছে। তাই , নড়াইল থেকে যশোর অভিমুখে রওনা হই। পরে হামিদপুরে এক প্লাটুন পাকসেনা ডিফেন্স নিয়ে ছিল। আমার প্লাটুন সেই এলাকার ছাত্র, পুলিশ ও কিছু বেঙ্গল রেজিমেন্টের জোয়ান সহ ঐদিনই রাত্রি সাড়ে তিনটায় তাদের ডিফেন্সের চারদিক থেকে হামলা করি। আমাদের আক্রমণে ভয় পেয়ে তারা পেছনের দিকে পালিয়ে যায়।

৩০শে মার্চ সকালে আমার প্লাটুন ও হামিদপুর এলাকার অসংখ্য ছাত্র-যুবক সহ যশোর রওনা হই। সকাল ৯টার দিকে যশোর শহরে পৌছি। সেই সময় যশোর শহর আমাদের বাহিনীর আয়ত্বে ছিল। যশোর শহরে ইপিআর সেক্টর হেডকোয়ার্টারে ক্যাপ্টেন হাসমত ও ক্যাপ্টেন আওলাদের সাথে দেখা করি এবং আমি ও আমার প্লাটুনের জোয়ানদেরকে কি করতে হবে তা অবগত করি।

সেই সময় ইপিআর সেক্টর হেডকোয়ার্টার থেকে জানতে পারি যশোর –কলিকাতা রোডের শঙ্করপুর নামক স্থানে পাকবাহিনীর সহিত ইপিআর বাহিনীর ভীষন যুদ্ধ চলছে। রাত্রে অয়ারলেসে যুদ্ধের অগ্রগতি সম্বন্ধে যোগাযোগ করি।

৩১শে মার্চ সকালে শঙ্করপুর চলে যাই। সেখানে ইপিআর বাহিনী কে পুনরায় নতুনভাবে গুরুত্বপুর্ণ এলাকায় ডিফেন্স করে দেই। সেখানে ইপিআর বাহিনীর সুবেদার মালেক অসিম সাহসের সহিত যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিল। এদিকে ক্যাপ্টেন আওলাদ ও ক্যাপ্টেন হাসমত কে আর খুঁজে পাওয়া গেল না, এবং স্বাধীনতা আন্দোলনেও তাদেরকে সক্রিয় অংশ নিতে দেখা গেল না।

৩১শে মার্চ থেকে ৩রা এপ্রিল পর্যন্ত যশোর সেনানিবাসের চতুর্দিক ঘিরে রাখা হয়। সকল গুরুত্বপুর্ণ পথে ব্যারিকেড সৃষ্টি করা হয় ও ডিফেন্স তৈয়ার করা হয়। সেই সময় ভারতের সহিত যোগাযোগ করা হয় আধুনিক অস্ত্র ও গোলাবারুদের জন্য, কিন্তু প্রথম দিকে সাহায্য পাওয়া যায় নাই। আমাদের হাতে তখন আধুনিক অস্ত্রের সংখ্যা ছিল খুবই নগণ্য।

৩রা এপ্রিল বিকাল ৩ ঘটিকার সময় পাকবাহিনী যশোর সেনানিবাসের দুইদিক থেকে আক্রমণ করে। যশোর কলিকাতা রোডের উপরে শঙ্করপুর দিয়ে ও যশোর ঢাকা রোড দিয়েও তারা আক্রমণ করে। প্রথমে আর্টিলারী নিক্ষেপ করে ও মর্টার হতে গোলা নিক্ষেপ করতে থাকে। গোলা নিক্ষেপ করে পাকসেনারা সম্মুখে অগ্রসর হতে থাকে। আমাদের সম্বল ছিল দুইটি ৬ পাউন্ডার। দুইটিকে দুই রণাঙ্গনে বসানো হলো। ৬ পাউন্ডার থেকে পাকবাহিনীর উপরে গোলাবর্ষন করে বেশ কিছুক্ষন তাদের অগ্রগতিকে রোখা গেল। এইদিকে শঙ্করপুরের ৬ পাউন্ডারটি থেকে কয়েকটী গোলা নিক্ষেপের পরে জ্যাম লেগে যাওয়ায় আর গোলা নিক্ষেপ করা যাচ্ছিল না। তাই বাধ্য হয়ে ঢাকা –যশোর রোডের ৬ পাউন্ডার টাকে নিয়ে আসার জন্য অয়ারলেসে বলা হলো। কিন্তু দুর্ভাগ্য, নিয়ে আসবার পথে পাকবাহিনী চালক সহ ৬ পাউন্ডার টি আটকে ফেলে। এই সংবাদ পেয়ে আমাদের পক্ষে বাধা দেবার আর কোন উপায় রইল না। এদিকে পাকবাহিনীর আর্টিলারীর শেলে আহত হয়ে কিছু ছাত্র- যুবকেরা হাতিয়ার ফেলে পিছনে চলে আসতে বাধ্য হয়। সন্ধ্যার দিকে পাকবাহিনী আমাদের হেডকোয়ার্টারের উপরে  গুলি নিক্ষেপ করতে থাকে। এমতাবস্থায় আমরা আস্তে আস্তে পিছনের দিকে চলতে থাকি। ৩রা এপ্রিল সারারাত উভয় পক্ষে গুলি বিনিময় হয়। আমাদের পক্ষে দুই কোম্পানীর মত ইপিআর ও আনসার-মুজাহিদ-ছাত্র যুদ্ধ করে। এই যুদ্ধে বিশেষ অসুবিধা ছিল। আমি ইপিআর বাহিনীর ক্যাপ্টেন নই, তাছাড়া সকল সৈনিকের ছিল সিভিল পোশাক। তাই সুষ্ঠুভাবে যুদ্ধ পরিচালনায় কিছু অসুবিধা হয়। এই যুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসালী লেঃ মতিউর রহমান এমপিএ বীরত্বের সহিত যুদ্ধ করেন। এই যুদ্ধে আমাদের পক্ষের ১৫ জন মুক্তিসেনা বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে শাহাদৎ বরণ করেন। এদিকে পাকবাহিনী যশোর দখল করে নেয়। ৪ঠা এপ্রিল আমরা সকলে নড়াইলে পুনরায় একত্রিত হই। সেখানে নতুনভাবে মনোবল নিয়ে নড়াইল-যশোর রোডে দাইতলা নামে বিকালে ডিফেন্স নিই। সেই সময় আমাদের জোয়ানদের মোট সংখযা ছিল এক কোম্পানী। অপরদিকে সকল আনসার ও মুজাহিদ নিজ নিজ এলাকায় চলে যায়। দাইতলা আমাদের ডিফেন্স খুব শক্ত করে গঠন করি।

৭ই এপ্রিল পাকবাহিনী বিকালের দিকে পুনরায় আক্রমণ করে, কিন্তু আমাদের প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে পাকসেনারা টিকে থাকতে পারল না। তারা পিছনে ফিরে চলে যায়। এই যুদ্ধে পাকবাহিনীর আনুমানিক ৩০ জনের মত নিহত হয়। তারা আপ্রাণ চেষতা করেও আমাদের ডিফেন্স নষ্ট করতে পারেনি। আমাদের পক্ষে কোন হতাহত হয়নি।

৮ই এপ্রিল পাকবাহিনী পুনরায় আমাদের উপরে আক্রমণ করে। সেদিন তারা আর্টিলারী ও মর্টার ব্যাবহার করে। আমরাও তাদের আক্রমণ প্রতিহত করি। প্রায় ৫ ঘন্টা উভয়পক্ষে ভীষন যুদ্ধ হয়। পরে আমাদের গোলাবারুদের অভাবে আর টিকে থাকা গেল না। আমরা পিছনের দিকে চলে আসতে বাধ্য হলাম। নড়াইলে আমার কোম্পানী নিয়ে রাতে অবস্থান করি।

৯ই এপ্রিল পাকবাহিনী নড়াইলের মহকুমা শহরে বিমান হামলা চালায় ও সাথে সাথে দাইতলা থেকে পাকবাহিনী এসে নড়াইলে শহর দখল করে নেয়। আমার কোম্পানী ছত্রভংগ হয়ে যায়। কিছু ইপিআর জোয়ান ভারতে চলে যায়।

আমি পুনরায় গোপালগঞ্জে চলে আসি। সেই সময় গোপালগঞ্জ শত্রুমুক্ত ছিল। গোপালগঞ্জে পুনরায় ছাত্র, যুবক, ইপিআর ও সামরিক বাহিনীর জোয়ানদের নিয়ে দুটি কোম্পানী গঠন করি। তাদের রিতিমত প্রশিক্ষনের ব্যাবস্থা করি। প্রথমে আমার কোম্পানীর হেডকোয়ার্টার গোপালগঞ্জ শহরে গঠন করি। পরে আমার নিজ গ্রাম মানিকহার হাইস্কুলে হেডকোয়ার্টার স্থাপন করি। মে মাসের প্রথম দিকে পাক বাহিনীর নির্মম অতযাচারের সংবাদ জেনে স্থানীয় জনসাধারনের মধ্যে আমাদের নিয়ে নানা জল্পনাকল্পনা চলতে থাকে।

৮ই মে গোপালগঞ্জ থেকে ৫ মাইল দূরে তালা নামক স্থানে ৫ টি বার্জ বোঝাই পাট খুলনার দিকে যাচ্ছিল। আমরা তা আক্রমণ করি ও বার্জ গুলো কে ডুবিয়ে দেই। বার্জগুলো বহন করে নিয়ে যাওয়া “বিরলা” নামের ছোট জাহাজটিকে আমাদের নদীতে পেট্রোলিং এর কাজে ব্যাবহার করি।

১১ই মে সকালে ঢাকা থেকে খুলনা অভিমুখে রকেট স্টীমার যাওয়ার পথে তালা ঝাজঘাটে জোরপুর্বক আটকিয়ে রাখি। প্রত্যেকটি যাত্রীকে জাহাজ থেকে নামিয়ে দেই, কারণ অধিকাংশ যাত্রী পাক সরকারের পক্ষে চাকুরীতে যোগদানের জন্য খুলনা যাচ্ছিল। জাহাজটিকে নদীতে ডুবিয়ে দেয়া হয় এবং জাহাজের যাত্রীদের সরকার চাকুরীতে যেন যোগদান না করে এই শপথ করিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়।

১১ই মে বিকালে পাকসেনারা স্থানীয় কিছু দালালের সহায়তায় প্রথমে গোপালগঞ্জে প্রবেশ করে। পরে আমাদের হেডকোয়ার্টার মানিকহার আক্রমন করে। প্রথমে আমরা তাদের তীব্র আক্রমণ প্রতিহত করি, কিন্তু পরে তাদের আধুনিক অস্ত্রের সামনে টিকে থাকা সম্ভব হয় না। আমাদের পক্ষে একটি মাত্র এল-এম-পি ছিল। তার চালক নায়েক রব গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ায় আমরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ি। পাকবাহিনী মানিকহার গ্রামটি জ্বালিয়ে দেয়।

গোপালগঞ্জ পতনের পর ভারত অভিমুখে রওনা হই। পথে বহু বাধা বিপত্তির মধ্যে দিয়ে ২২শে মে পশ্চিমবঙ্গের বয়রা সিমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করি।

———————————————————

 

<৯, ৮.২, ২৬৫-২৬৮>

যশোর সেনানিবাস ও অন্যান্য স্থানে

১ম বেঙ্গল রেজিমেন্টের তৎপরতা

সাক্ষাৎকারঃ ক্যাপ্টেন হাফিজউদ্দিন আহমেদ বীরবিক্রম

(সাক্ষাৎকারদাতা যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে ৩০ মাইল দূরে কোটচাঁদপুর ও জগদীশপুর এলাকায় কালেকটিভ ট্রেনিঙে ছিলেন )

২৮-০৯-১৯৭৩

২৫শে মার্চ ঢাকা সহ প্রদেশের অন্যান্য জায়গায় কি ঘটেছিল তা আমার সম্পূর্ণ অজানা ছিল। সেখানে কোন লোকজনের সাথেও আমার সাক্ষাত হয় নি। কেননা ঐ জায়গা টা ছিল জঙ্গলের মধ্যে। এমনকি ২৭শে মার্চ মেজর (বর্তমানে ব্রিগেডিয়ার ডেপুটি চিফ অফ স্টাফ বাংলাদেশ সেনাবাহিনী) জিয়াউর রহমান সাহেবের স্বাধীনতা ঘোষনা করার কথাও আমি জানতে পারিনি। আমার সৈন্যরা অনেক কিছু জানতে পারলেও আমাকে কিছু জানায়নি।

২৯শে মার্চ ১২ টার সময় অয়ারলেস এর মাধ্যমে পাকিস্তানী ১০৭ নং ব্রিগেডের ব্রিগেডিয়ার আব্দুর রহিম দুররানী আমাদেরকে যশোরে পৌছতে বলায় আমরা সঙ্গে সঙ্গে জগদীশপুর থেকে যশোরের অভিমুখে রওনা দেই। যশোর ক্যান্টনমেন্টে রাত ১২ টায় পৌছি। যদিও ব্যাটালিয়নে মোট ৭৫০/৮০০ সৈন্য থাকে, কিন্তু অনেক সৈন্য ছুটিতে থাকায় আআমদের ব্যাটালিয়নে সৈন্য ছিল ৪০০ জন। (ব্যাটালিয়নের পশ্চিম পাকিস্তানে যাবার কথা ছিল তাই প্রায় অর্ধেক ছুটিতে ছিল)

৩০শে মার্চ, ১৯৭১ তারিখে ব্রিগেডিয়ার দুররানী আমাদের ব্যাটালিয়ন অফিসে যান এবং কমান্ডিং অফিসার লেঃ কর্নেল জলিল কে বলেন যে, আমাদের ব্যাটালিয়ন কে নিরস্ত্র করা হলো এবং আমাদের অস্ত্রশস্ত্র জমা দিতে বলেন। ব্রিগেডিয়ার দুররানী আমাদের ব্যাটালিয়ন অস্ত্রাগারে অস্ত্র জমা করে চাবিগুলি নিজ হাতে নিয়ে নেন। মুহুর্তের মধ্যে এ খবর আমাদের ব্যাটালিয়নের সৈন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।

ব্রিগেডিয়া দুররানী চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সৈন্যরাও তৎক্ষনাৎ “জয় বাংলা” ধ্বনি দিতে দিতে অস্ত্রাগারের তালা ভেঙ্গে অস্ত্র যার যার হাতে নিয়ে নেয় এবং আমরা চতুর্দিকে আমাদের পজিশন নিই। আমাদের বিদ্রোহের খবর পাওয়ার সাথে সাথে পাকিস্তানী দুই ব্যাটালিয়ন (২৫ বালুচ রেজিমেন্ট এবং ২২তম ফ্রন্টিয়ার ফোর্স) সৈন্য তিনদিক থেকে আমাদের আক্রমণ করার চেষ্টা করে। কিন্তু আমাদের জোয়ানেরা অত্যন্ত দৃঢ়তা ও দক্ষতার সাথে তাদের আক্রমণ কে প্রতিহত করে। এ সময় কমান্ডিং অফিসার লেঃ কর্নেল জলিল আমাদের নেতৃত্ব দিতে অস্বীকার করেন ও অফিসে বসে থাকেন। তখন আমি ব্যাটালিয়নের নেতৃত্ব দেই এবং পাঞ্জাবীদের আক্রমণ প্রতিহত করার প্রস্তুতি নেই, সেভাবেই সৈন্যদের পুনর্গঠন করি। সেকেন্দ লেফটেন্যান্ট আনোয়ার হোসেন ও আমার সঙ্গে বিদ্রোহে যোগদান করে।

এভাবে সকাল আটটা থেকে দুপুর দুইটা পর্যন্ত পাঞ্জাবীরা বার বার আমাদের উপরে আক্রমণ করে, কিন্তু প্রত্যেকবারই আমরা তাদের আক্রমনকে প্রতিহত করি। পাকিস্তানীরা আগে থেকেই আমাদের উপরে আক্রমনের প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা নিয়েছিল, কারণ তারা মর্টার আক্রমন করে এবং আমাদের ব্যাটালিয়নের উপরেই করে। যেহেতু তাদের পুর্ব পরিকল্পনা ছিল, তাই আমরা তাদের সাথে বেশীক্ষন যুদ্ধ চালাতে পারব না মনে করে আমি ব্যাটালিয়ন নিয়ে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেই।

পাকিস্তানী সৈন্যরা আমাদেরকে উত্তর, পূর্ব ও দক্ষিন দিক থেকে আক্রমন করেছিল। পশ্চিম দিক খালি থাকলেও তারা পশ্চিমের খোলা মাঠের দিকে অবিরাম বৃষ্টির মত গুলি বর্ষন করছিল। আমরা পশ্চিম দিক থেকে কভারিং ফাইটের সাহায্যে বের হবার সিদ্ধান্ত নিলাম, সে উদ্দেশ্যে আমরা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হই। (চৌগাছা যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে ১০ মাইল দক্ষিন-পশ্চিমে) ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হবার সময় আমি আমার কমান্ডিং অফিসার লেঃ কর্নেল জলিলকে আমাদের সাথে বিদ্রোহে যোগ দেবার জন্য বার বার অনুরোধ করি। কিন্তু তিনি মোটেই রাজি হন নি।

যশোর ক্যান্টনমেন্ট যুদ্ধের সময় সেকেণ্ড অফিসার লেফটেন্যান্ট আনোয়ার হোসেন শহীদ হন। তিনি অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করেন। তার সাহসিকতার জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে “বীর উত্তম” উপাধিতে ভূষিত করেন। সেকেণ্ড লেফটেন্যান্ট আনোয়ারই প্রথম অফিসার যিনি যুদ্ধে শহীদ হন। তাছাড়া এই যুদ্ধে আমার ৪০ জন সৈন্য শহীদ হন। পাকিস্তানী সৈন্যও প্রায় ৪০ জন শহীদ হয়।

চৌগাছায় একত্রিত হবার পরে আমরা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলি। এসময় আমি একমাত্র অফিসার ছিলাম। দশজন জুনিয়র কমিশন অফিসার ও আমার সাথে প্রায় ২২৫ জন সৈন্য ছিল।

৩০শে মার্চ, ১৯৭১, এইদিন রাত্রে জনসাধারনের মারফতি প্রথম জানতে পারলাম যে, কেজর জিয়াউর রহমান সাহেব চট্টগ্রাম থেকে বিদ্রোহ ঘোষনা করেছেম এবং যুদ্ধের জন্য সকল বাঙালি সৈন্যদের আহবান করেছেন। কয়েকজন সাংবাদিক ও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তাদের নিকট জানতে পারলাম যে বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়েছে এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআর বাহিনীর সৈন্য ও অফিসাররা পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহন করেছে। এ খবর পাবার পর আমার এবং আমার সৈন্যদের মধ্যে বিপুল উৎসাহ দেখা যায় এবং মনোবল অত্যন্ত দৃঢ় হয়।

৩১শে মার্চ, ১৯৭১, এইদিন আমার ব্যাটালিয়নে সমস্ত সৈন্যদের একত্রিত করে রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং মুক্তি সংগ্রাম সম্পর্কে তাদের অবহিত করলাম। তাদের উদ্দেশ্য করে সংক্ষিপ্ত ভাষনে জানালাম যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয়েছে। স্ব-ইচ্ছায় যে বা যারা দেশের স্বাধীনতার জন্য আত্মবিসর্জন দিতে প্রস্তুত শুধু তারাই আমার ব্যাটালিয়নে থাকতে পারবে। এবং আরো বললাম, যদি কারো যুদ্ধ করার ইচ্ছা না থাকে তাহলে সে কেটে পড়তে পারে। আমার বক্তব্য শুনে প্রত্যেক জোয়ানের মুখে নতুন করে উদ্দীপনা দেখা দেয়। তারা সবাই দেশের জন্য আত্মবিসর্জন দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে শপথ গ্রহন করে।

চৌগাছায় আমার ও আমার ব্যাটালিয়নের যুদ্ধ করার মত কোন গোলাবারুদ ছিল না। আমাদের সঙ্গে যে সমস্ত গোলাবারুদ ছিল তা যশোর ক্যান্টনমেন্টের যুদ্ধেই প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল। তাছাড়া সকলেরই একটা করে পোশাক ছিল। খাওয়া-দাওয়ার অসুবিধা দেখা দেয়। মোটকথা, বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হই। কিন্তু ছাত্র ও জনতার সক্রিয় সাহায্যে আমাদের খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা হয়।

২রা এপ্রিল, ১৯৭১, চৌগাছা থেকে সলুয়া নামক গ্রামে নায়েক সুবেদার এ বি সিদ্দিকের কমান্ডে এক কোম্পানী সৈন্য পাঠাই প্রতিরক্ষা ব্যাবস্থার জন্য।( সলুয়া গ্রাম যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে ৫ মাইল পশ্চিম দিকে) চৌগাছা তখন আমার হেডকোয়ার্টার। এখান থেকে যশোর ক্যান্টনমেন্টের পশ্চিম ও উত্তর দিকের গ্রামগুলোতে পেট্রোলিং শুরু করি। হাবিলদার আবুল কাশেম (টি-জে) এবং হাবিলদার মোহাম্মদ ইব্রাহীমদের নেতৃত্বে যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে প্রায় এক মাইল পশ্চিমে খিতিবদিয়া নামক গ্রামে অ্যামবুশ পার্টি পাঠাই। হাবিলদার আবুল কাশেম এবং হাবিলদার ইব্রাহীম একটি পাকিস্তানী পেট্রোল পার্টিকে অ্যাম্বুশ করে। এতে ৬ জন পাকিস্তানী নিহত হয় এবং ৮ জন গুরুতর আহত হয়।

ইতিমধ্যে ৭ই এপ্রিল খবর পেলাম যে, মেজর ওসমান চোউধুরী (বর্তমানে লেঃ কর্নেল) চুয়াডাঙ্গায় তার ইপিআর বাহিনী নিয়ে মুক্তিসংরামে যোগদান করেছেন। ওইদিন আমি একটা জীপ নিয়ে চুয়াডাঙ্গায় মেজর ওসমান চৌধুরীর সাথে দেখা করতে যাই। তার সাথে সাক্ষাৎ করে তার  নিকট থেকে কিছু চাইনিজ এমুনিশন, এক্সপ্লোসিভ, কয়েকটি জীপ এবং কয়েকটি রিকয়েললেস রাইফেল নিয়ে চৌগাছায় ফিরে আসি।

১০ই এপ্রিল ১৯৭১, নায়েক সুবেদার আহমেদউল্লাহ এর নেতৃত্বে কয়েকজন সোইন্যকে পাঠালাম চোত হায়বতপুর গ্রামের ব্রীজ ধ্বংস করার জন্য। ব্রীজটি যশোর-ঝিনাইদহ বড় রাস্তায় যশর ক্যান্টনমেন্ট থেকে ৫ মাইল দূরে অবস্থিত ছিল। ভোর তিনটের সময় নায়েক সুবেদার আহমেদউল্লাহ উক্ত ব্রীজটি উড়িয়ে দেন। ব্রিজটি ভাঙ্গার ফলে এবং চতুর্দিকে আমার ব্যাটালিয়ন সৈন্যদের পেট্রোলিং এর দরুন পাকিস্তানী সৈন্যরা ক্যান্টনমেন্ট এলাকা থেকে ভয়ে কিছুদিন বের হতে পারেনি।

১১ই এপ্রিল, ১৯৭১, সিপাই ড্রাইভার কালা মিয়াকে পাঠাই কোটচাঁদপুর থানায় কয়েকটি জীপ ও ট্রাক সংগ্রহ করে আনতে। কালা মিয়া কোটচাঁদপুর যাবার পথে খবর পায় যে , পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটা কনভয় কালিগঞ্জের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। উক্ত খবর পাবার পর কালা মিয়া আশেপাশের গ্রাম থেকে দশজন মুজাহিদকে নিয়ে কালিগঞ্জের দিকে একমাইল দূরে এম্বুশ করে। উক্ত এম্বুশে তিনটা গাড়ি বিধ্বস্ত হয় এবং দশজন পাকিস্তানী সৈন্যও নিহত হয়। কালা মিয়া একটা হ্যাণ্ড গ্রেনেড নিয়ে যখন একটা গাড়ির দিকে ছুড়তে যায় তখন তার বুকে পাঞ্জাবীদের গুলি বিদ্ধ হয় এবং সে সাথে সাথে শহীদ হয়।

১৪ই এপ্রিল, ১৯৭১, ইতিমধ্যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সৈন্যরা বেনাপোলের দিকে অগ্রসর হচ্ছে, এ খবর পেয়ে ১৪ই এপ্রিল আমি আমার ব্যাটালিয়ন চৌগাছা থেকে তুলে নিয়ে বেনাপোলের ৩ মাইল পুর্বে কাগজপুকুর গ্রামে হেডকোয়ার্টার স্থাপন করি এবং যশোর-বেনাপোল রাস্তার দু’ধারে প্রতিরক্ষা ব্যাবস্থা নেই। এই সময় ইপিআর বাহিনীর দু’ট কোম্পানী যোগদান করে। আমাদের সৈন্যসংখ্যা প্রায় ৫৫০ জনে দাঁড়ায়। এ সময় শত্রুর শক্ত ঘাটি ছিল নাভারনে। (নাভারণ বেনাপোল থেকে ১২/১৩ মাইল পূর্ব দিকে)। আমি শত্রুর গতিবিধি লক্ষ্য করার জন্য নাভারণ এলাকায় পেট্রলিং শুরু করি।

২১শে এপ্রিল,১৯৭১, ঐদিন ভোর আড়াইটার সময় আমি নিজে ২০ জন্য সোইন্য নিয়ে নাভারণ মূল ঘাঁটিতে পাকিস্তানী সৈন্যদের উপরে রেইড করি। আমার রেইডে ১০ জন পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয় এওবং ১৫ জন আহত হয়। উক্ত রেইডে আমরা মর্টার ব্যাবহার করি। আমার ৪ জন সৈন্য আহত হয়। উক্ত রেইডে যথেষ্ট কষ্ট সহ্য করতে হয় আমাদের, কেননা কাদামাটি এবং খালবিল পেরিয়ে আমাদের রেইড করতে হয়েছিল।

২৩শে এপ্রিল, ১৯৭১, (কাগজপুকুরের যুদ্ধঃ) ২৩শে এপ্রিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দুই ব্যাটালিয়ন সৈন্য কাগজপুকুর গ্রামে আমাদের মূল ঘাঁটির উপর হামলা করে। তারা আর্টিলারীর সাহায্য নেয়। এখানে দীর্ঘ ছয়ঘন্টা যুদ্ধ চলে। আমি আমার সৈন্যদের কে নিয়ে পরে বেনাপোল কাস্টম কলোনি ও চেকপোস্ট এলাকায় বিকল্প প্রতিরক্ষা ব্যাবস্থা নিতে বলি। কাগজপুকুরের এই যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রায় ৫০ জন্য সৈন্য নিহত হয় ও অনেক আহত হয়। আমার ২৫ জন সোইন্য শহীদ হয়। অনেক বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করায় বাংলাদেশ সরকার তাঁদের “বীরবিক্রম” উপাধি প্রদান করেন।

এর পরবর্তী পনেরদিন ধরে শত্রুপক্ষ বেনাপোল কলোনী ও চেকপোস্ট এলাকা দখল করার জন্য বহুবার আক্রমণ করে। কিন্তু প্রত্যেকবারই তাদের আক্রমনের পাল্টা জবাব দেই এবং প্রতিহত করি। উক্ত পনের দিনের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রায় ১০০ জন সৈন্য নিহত হয়। এই আক্রমনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল তারা বেনাপোল দখল করে সেখানে পাকিস্তানী পতাকা উত্তোলন করবে। কিন্তু তাদের সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়। এবং বাংলাদেশের পতাকাই উড়তে থাকে। উপরন্তু এ এলাকা তারা কখনও দখল করতে পারে নাই। বেনাপোলের যুদ্ধে আমার দশজন সৈন্য শহীদ হন। এ সংঘর্ষে হাবিলদার আব্দুল হাই, হাবিলদার আবুল হাশেম (টি-জে), হাবিলদার মোহাম্মদ ইব্রাহীম, ল্যান্স নায়েক ইউসুফ আলী, লযান্স নায়েক মুজিবুর রহমান, সিপাই আব্দুল মান্নান অভূতপূর্ব দক্ষতা ও সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করে অসীম বীরত্বের পরিচয় দেয়। বড়আঁচড়া গ্রামে এম্বুশ করে হাবিলদার ফয়েজ ১৫ জন পাকিস্তানী সৈন্য নিহত করে।

—————————————-

 

<৯,৮.৩ ২৬৮-২৭৮>

প্রতিরোধ যুদ্ধে যশোর ও অন্যান্য এলাকা

যশোর রণাঙ্গণে

(সত্যন সেন রচিত ‘প্রতিরোধ সংগ্রামে বাংলাদেশ’ শীর্ষক গ্রন্থ থেকে সংকলিত)

২৩শে মার্চ তারিখে ইপি-আর বাহিনীর জওয়ানরা তাদের ক্যাম্পে স্বাধীন বাংলার পতাকা তুলল, আর সেই পতাকার সামনে শ্রেণীবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে “গার্ড অব অনার” দিল। অবাঙালিরা প্রতিবাদ তুলেছিল, কিন্তু তাদের সেই আপত্তি টিকল না। ২৫শে মার্চ তারিখে ঢাকা শহরে ইয়াহিয়ার জংগী-বাহীনির বর্বর আক্রমণের খবর যখন পৌছাল, যশোরের মানুষ তাতে ভয় পাওয়া দূরে থাক, বিক্ষোভে ফেটে পড়ল, ক্রোধে গর্জন করে উঠল- এর উপযুক্ত প্রতিশোধ চাই। যশোর ক্যান্টনমেন্টে কামান , মর্টার আর মেশিনগানে সজ্জিত হাজার হাজার পাক সৈন্য মোতায়েন আছে, যে কোন সময় তারা অগ্নিস্রাবী প্লাবন নিয়ে নেমে আসতে পারে, এ কথা চিন্তা করেও তারা ভয়ে পিছিয়ে গেল না। ২৬, ২৭ ও ২৮শে মার্চ এই তিনদিনে ইপিআর এর চারটি ক্যাম্পে জওয়ানরা প্রতিরোধের দৃঢ় সংকল্প নিল।

প্রথম সংঘর্ষ ঘটল ২৯শে মার্চ তারিখে- শহরের উপরে নয়, শহর থেকে বাইরে যশোর ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে। সেদিন ক্যান্টনমেন্টের ভেতর বেঙ্গল রেজিমেন্টের এক ব্যাটালিয়ন সৈন্যকে নিরস্ত্র করা হয়েছিল। দিনের অবস্থা বদলে গেছে, মুক্তি আন্দোলনের হাওয়া ক্যান্টনমেন্টের ভেতরেও এসে ঢুকেছে- নিরস্ত্র বাঙালি সৈন্যরা বিদ্রোহ ঘোষনা করল। এর পরিণাম কি হবে, তা তারা ভাল করেই জানত, তা সত্ত্বেও এই লাঞ্ছনাকে তারা মাথা পেতে নেয়নি।

সতর্কতামূলক ব্যাবস্থা হিসেবে ওরা আগেই বেঙ্গল রেজিমেন্টের ম্যাগাজিনের চাবিটা কেড়ে নিয়েছিল। বিদ্রোহীরা তাতেও দমল না, তারা ম্যাগাজিন ভেঙ্গে কিছু অস্ত্র বার করে নিয়ে এল। তারপর ক্যান্টনমেন্টের ভেতরেই দু’পক্ষে শুরু হয়ে গেল তুমুল যুদ্ধ। একদিকে কামান, মর্টার, মেশিনগান প্রভৃতি ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত হাজার হাজার পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য অপর দিকে হাল্কা হাতিয়ার সম্বল করে এক ব্যাটালিয়ন বাঙালি সৈন্য। এই যুদ্ধ কতক্ষন চলতে পারে! স্বাভাবিক ভাবেই এই সংঘর্ষে বহু বাঙালি সৈন্য মারা গেল। বাকী সৈন্যরা যুদ্ধ করতে করতে ক্যান্টনমেন্টের বন্ধ দরোজা ভেঙ্গে বাইরে পালিয়ে গেল।

       এই সংবাদ দেখতে দেখতে শুধু যশোর শহর নয়, সারা জেলায় ছড়িয়ে পড়ল। সবাই বুঝল, এবার মুক্তিসংগ্রাম শুরু হয়ে গিয়েছে, আর বসে থাকার সময় নেই। ইপি-আর বাহিনী আগে থেকেই পরিকল্পনা নিয়ে তৈরী হয়েছিল। এবার শহরের পুলিশ বাহিনী যুদ্ধ ঘোষনা করল। এই পুলিশ বিদ্রোহে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে তিনটি নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁরা হলেন হিমাংশু ব্যানার্জী, আকমল হোসেন আর পীযুষ। শহরের বিশিষ্ট ফুটবল খেলোয়ার হিসেবে হিমাংশু ব্যানার্জী পুলিশদের মধ্যেই নয়, শহরের সাধারণ মানুষের মধ্যেও জনপ্রিয়। সেই জনপ্রিয় খেলোয়ারটি এবার নতুন এক খেলায় নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে এলেন।

       পুলিশ ম্যাগাজিনের চাবি ছিল অবাঙালি জমাদারের হাতে। হিমাংশু, আকমল ও পীযুষ তাকে বন্দী করে তার হাত থেকে চাবি কেড়ে নিয়ে ম্যাগাজিন খুলে ফেললেন। সেখান থেকে তাঁরা সাতশ রাইফেল, ছয়শ শটগান, কিছু সংখ্যক ব্রেনগান এবং যথেষ্ট পরিমাণ কার্তুজ উদ্ধার করলেন। তারপর এই অস্ত্রগুলিকে বিদ্রোহী পুলিশ আর বিদ্রোহী জনতার মাঝে বিলি করে দেয়া হল। স্থির হল, এদের এখনই অস্ত্র চালনা শিক্ষা দেয়া হবে। মুক্তি সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়ার জন্য ব্যাগ্র পুলিশ আর জনতা নিউ টাউনের নোয়াপাড়ার আমবাগানে ঘাঁটি করে বসেছিল। এখানে জনতার মাঝে তিনশ জনকে বাছাই করে নিয়ে ষাটজন পুলিশ তাদের রাইফেল চালনা শিক্ষা দিল। মাত্র একঘন্টার মত সময় পেয়েছিল তারা। এইটুকুর মধ্যেই তারা রাইফেল চালনার অ, আ, ক, খ টুকু আয়ত্ত্ব করে নিল।

       সেদিন সেই আমবাগানেই এই নবদীক্ষিত শত শত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করা হয়েছিল। জনসাধারণ স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে তাদের আহার্য-দ্রব্য জোগান দিয়েছিলেন। সে এক অপূর্ব দৃশ্য! ঘরের মেয়েরা বেরিয়ে এসে এই স্মরণীয় আমবাগানের মধ্যে তাঁদের এই মুক্তিসংগ্রামী ভাইদের জন্য রান্না করেছিলেন। এই স্বেচ্ছাসেবী নারী বাহিনীকে পরিচালনা করছিলেন হিমাংশু ব্যানার্জীর স্ত্রী।

       সেই দিনই ইপি-আর বাহিনী, ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালিয়ে আসা বেঙ্গল রেজিমেন্টের দু;শর উপরে সৈন্য, পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ এবং ছাত্র-যুবকদের নিয়ে মুক্তিবাহিনী গড়ে তোলা হল।

       ক্যান্টনমেন্ট থেকে চারটি সৈন্যবাহী জীপ সম্ভবত শহরের অবস্থা পর্যবেক্ষন করতে বেরিয়েছে। মুক্তিবাহিনী তাদের মধ্যে তিনটি জীপকে খতম করে দিল। এখান থেকে মুক্তিবাহিনীর সংগ্রাম শুরু। সেদিন রাত দু’টার পর থেকে ভোর পর্যন্ত ক্যান্টনমেন্টের শালতলা এলাকায় পাক-সৈন্য ও মুক্তিবাহিনীর মধ্যে প্রচুর গুলি বিনিময় হয়।

       সেই রাত্রিতেই যশোর জেলের কয়েদীরা বাইরের খবর শুনে চঞ্চল হয়ে উঠে। তারা জোর করে জেল ভেঙ্গে বেরিয়ে আসতে চায় এবং তাই নিয়ে জেল প্রহরীদের সাথে দাঙ্গা হাঙ্গামা হয় ও গুলি চলে। শেষ পর্যন্ত তার পরদিন রাত্রিতে সেখানকার ১৩৭৫ জন বন্দী জেলের দরজা ভেঙ্গে বেরিয়ে আসে। তাদের মধ্যে সতের জন ছিলেন নিরাপত্তা বন্দী। এতা ৩০ তারিখ রাতের ঘটনা।

       ৩০শে মার্চ ভোরবেলা দু’দল পাক-সৈন্য ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে এসে জীপে করে দু’দিকে যাত্রা শুরু করে। একদন এখানকার চাঁচড়ার দিকে, আরেকদল খুলনার দিকে। মুক্তিবাহিনীও দু’দলে ভাগ হয়ে তাদের প্রতিরোধ করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ল। খুলনার দিকে যে দলটি যাত্রা করেছিল, তাদের সাথে পুরাতন কসবার পুলের কাছে মুক্তিবাহিনীর সংঘর্ষ ঘটল। এই সংঘর্ষে পুলিশদের নেতা হিমাংশু ব্যানার্জী নিহত হলেন। চাঁচড়ার যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর হাতে আচ্ছামত ঘা খেয়ে পাক-সৈন্যরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে ঢুকে পড়ল। মুক্তিবাহিনী ক্যান্টনমেন্ট অবরোধ করে রইলো।

       ৩১শে মার্চ শহর থেকে চারমাইল দূরে যশোর –মাগুরা রোডের ধারে হালিমপুর গ্রামে মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিং সেন্টার খোলা হয়। ইপি-আর বাহিনীর জওয়ানদের নেতৃত্বে এই ট্রেনিংদানের কাজ চলতে থাকে। শোনা যায় জেল ভেঙ্গে বেরিয়ে আসা প্রায় পাঁচশ কয়েদী স্বেচ্ছায় এই ট্রেনিং সেন্টারে যোগ দিয়েছিল।

       কিন্তু প্রতিরোধ সংগ্রামের সমরসজ্জা শুধু যশোর শহরেই সীমাবদ্ধ ছিলনা বরং একই সাথে মহকুমা শহরগুলোতেও প্রতিরোধের প্রস্তুতি চলছিল। নড়াইলের এসডিও এবং এখানকার বিশিষ্ট নাগরিকদের উধ্যগে এক শক্তিশালী মুক্তিবাহিনী গড়ে তোলা হয়েছিল। যশোর শহরে সংগ্রাম শুরু হয়ে গেছে, এ খবর পেয়ে তারা শত্রুদের আক্রমন করার জন্য যশোর শহরের দিকে মার্চ করে চলল। নড়াইল মহকুমার হাজার হাজার লোক যার হাতে যা ছিল তাই নিয়ে এই যুদ্ধ মিছিলে যোগ দেয়। যশোর-নড়াইলের দু’ধারের গ্রামগুলো তাদের ঘন ঘন জয়ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয়ে উঠতে লাগল।

       নড়াইল মহকুমার লোহাগড়া অঞ্চলেও একটি শক্তিশালী মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধের জন্য প্রতুতি নিচ্ছিল। নোউ বিভাগের প্রাক্তন অফিসার শামসুল আলমের উদ্যগে এই শক্তিশালী মুক্তিবাহিনী টি গড়ে ওঠে। শামসুল আলম সামরিক বাহিনী থেকে অবসর গ্রনের পরে একটি বযাঙ্কে চাকরি নিয়ে দশজনের মত সাধারণ জীবন যাপ ই করছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতার আহবানে উদ্দীপ্ত হয়ে তিনি চাকরীর মায়া ছেড়ে প্রতিরোধ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। দেখতে দেখতে তাঁর নেতৃত্বে প্রায় ৫০০ জনের এক মুক্তিবাহিনী গড়ে উঠল। এই বাহিনীর জন্য থানা এবং বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে দুশর উপরে রাইফেল ও বন্দুক সংগ্রহ করা হয়েছিল।

       যশোর শহরের সংবাদ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লোহাগড়ার এই মুক্তিবাহিনীও যশোরের দিকে দ্রুত মার্চ করে চলল। শামসুল আলম নিজ হাতে ট্রেনিং দিয়ে মুক্তিবাহিনীদের তৈরী করে তুলছিলেন। এখানেও হাজার হাজার লোক তাদের যুদ্ধ যাত্রার সাথী হয়েছিল। তারা তাদের ভীমগর্জনে পথঘাট মুখরিত করতে করতে যুদ্ধের উন্মাদনায় উন্মত্ত হয়ে ছুটে চলেছিল।

       এই যুদ্ধ-মিছিল সম্পর্কে একতা কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এগারজন মেয়ে নিয়ে গঠিত একটি নারী বাহিনী মুক্তিবাহিনীর অংশ হিসেবে এই যুদ্ধ-মিছিলে অংশগ্রহণ করেছিল। এরা সবাই স্কুল-কলেজের ছাত্রী। মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধাদের জন্য রান্না করা এবং যুদ্ধের সময় আহতদের সেবা শুশ্রুষা করা, এটাই ছিল তাঁদের কাজ। এই এগারটি বীরকন্যা মৃত্যুভয়কে তুচ্ছ করে মুক্তিবাহিনীর সাথে দির্ঘপথ অতিক্রম করে যশোরে গিয়েছিল।

       মাগুরা ও ঝিনাইদহ মহকুমায় যাঁরা মুক্তিবাহিনী গড়ে তুলেছিলেন এবং মুক্তি সংগ্রাম পরিচালিত করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে একটি লোকের নাম বিশেষ করে উল্লেখ করতে হয়, তিনি হচ্ছেন মাগুরার তরুণ এসডিও ওয়ালীউল ইসলাম। এই ব্যাপক অঞ্চলের প্রতিরোধ সংগ্রাম কার্যকরভাবে অংশগ্রহণ করে তিনি যথেষ্ট কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন।

       ১লা এপ্রিল থেকে ৩রা এপ্রিল, এই তিনটা দিন হাজার হাজার পাকসৈন্য খা৬চার পাখির মত ক্যান্টনমেন্টের মধ্যে অবরুদ্ধ হয়ে রইল। ইতিপুর্বে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে বারকয়েক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পরে ওরা একেবারে ঘর নিয়েছে, বেরোবার নামটি করে না।

       সৈন্যসংখ্যার দিক থেকে এবং আধুনিক অস্ত্রসজ্জার দিক থেকে শক্তি ওদের প্রচণ্ড। তাহলেও মুক্তিযোদ্ধাদের মরিয়া আক্রমনে, আর তাদের চেয়েও বেশী হাজার হাজার ক্ষিপ্ত জনতার ভিমগর্জনে ওরা যেন স্তম্ভিত হয়ে গিয়ে ওদের মনোবল হারিয়ে ফেলেছে।

       যশোর শহর মুক্তিবাহিনীর হাতে। এই তিনটি দিন শহরের মানুষ খুব অদ্ভুত দৃশ্য দেখেছে। এ এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। গ্রামাঞ্চল থেকে হাজার হাজার মানুষ, কখনও দলে দলে, কখনো বিচ্ছিন্ন ভাবে যে যার হাতিয়ার উঁচু করে শহরের দিকে ছুটে আসছে। আওয়ামী লীগ ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির কর্মীরা গ্রামে গ্রামে ঘুরে প্রতিরোধের বাণী ছড়িয়ে বেড়াচ্ছিল। তাদের সেই সংগ্রামী আহবান ব্যার্থ হয় নি। সেই ডাকে সাড়া দিয়ে দলে দলে ছুটে আসছে মানুষ। তারা এই বর্বর হামলাকারীদের নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে এই সোনার দেশকে মুক্ত করবে, স্বাধীন করবে।

       ঘরের মেয়েরাও এগিয়ে আসতে চাইছে। এই মুক্তিসংগ্রামকে সফল করে তুলবার জন্য তাঁরাও কিছু করতে চায়। তাই মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ঘরে ঘরে রান্নার আয়োজন চলছে। কেউ তাদের বলুক আর নাই বলুক, তারা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ঘরে খাবার  তোইরী করে চলছে। যে যা পারছে সে তাই দিয়ে চলেছে। নিজেরা এগিয়ে গিয়ে খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছে। এই সুযোগ থেকে কেউ বঞ্চিত হতে চায়না।

       পরপর তিনদিন ধরে অবরোধ চলছে। হাজার হাজার লোক ঘিরে আছে ক্যান্টনমেন্টকে। দিনরাত্রি অষ্টপ্রহর পাহারা দিয়ে চলেছে। ক্যান্টনমেন্টের পিছন দিকে বিল অঞ্চল। সেখানেও পাহারা চলছে, যাতে এরা কোনভাবেই বেরোবার পথ না পায়। রাইফেল বন্দুক আর ক’জনের হাতেই বা আছে! গ্রামের মানুষ হাতিয়ার বলতে যার যা সম্বল তাই নিয়ে ছুটে এসেছে। বর্শা, বল্লম, রামদা, লেজা থেকে শুরু করে লাঠিসোঁটা পর্যন্ত। শুধু তাই নয়, পথের মোড়ে মোড়ে গাছের উপরে অনেকে তীর ধনুক নিয়ে বসে আছে। দুশমনরা একবার শুধু ওদের কট ছেড়ে বেরোলেই হয়। একটাকেও জ্যান্ত ফিরে যেতে দেয়া হবে না।

       যশোর ক্যান্টনমেন্ট বিরাট ঘাটি। এখানে প্রায় সতের হাজার সৈন্য থাকার ব্যাবস্থা আছে। তাছাড়া ট্যাঙ্ক ও ভারি অস্তশস্ত্রে এরা সুসজ্জিত। কয়েকশ রাইফেল, কয়েকটা লাইট মেশিনগান আর কেবল্মাত্র একটা পাচপাউণ্ড গোলা কামান দিয়ে এদের প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। যুদ্ধের ব্যাপারে সাহস অত্যন্ত প্রয়োজন, কিন্তু এ যুগে শুধু সাহস দিয়েই যুদ্ধ জয় করা চলে না। এই প্রতিরোধ সংগ্রামে যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তারা হয়ত এ ব্যাপারে পুরোপুরি সজাগ ছিলেন না।

       তাছাড়া মুক্তিবাহিনীর আরেকটা দুর্বলতা ছিল তাদের যোগাযোগের অভাব। বীর জনতা তিনদিন ধরে যশোর কযান্টনমেন্টে পাক বাহিনী কে অবরুদ্ধ করে রাখল, অথচ সেই খবর টা সময় মত তাদের সদর দফতর চুয়াডাঙ্গায় পৌঁছাল না। আর যদি পৌঁছেও থাক, মূল নেতৃত্ব তাতে সাড়া দেয়নি। সে গুরুত্বপূর্ণ সংকট মুহূর্তে তাদের শক্তি সম্পদ এনে যশোরে সমাবেশ করা প্রয়োজন ছিল। তাহলে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য অভিজ্ঞ যোদ্ধারা থাকতেন এবং আরো কিছু ভারী অস্ত্রশস্ত্রও ব্যাবহার করা যেত। অবশ্য তাহলেই যে তারা যুদ্ধ জয় করতে পারতেন, এমন কথা বলছি না। তবে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে , তার ফলে যশোর শহর এক প্রচণ্ড যুদ্ধক্ষেত্রে পরিনত হতে পারত এবং তারা বহু শত্রুসৈন্যকে খতম করতে পারত।

       অবরোধের তৃতীয় দিনে অবরোধকারীদের সংখযা কমতে কমতে অবরোধের বেষ্টনিটা একটু পাতলা হয়ে এসেছিল। উপযুক্ত সময় বুঝে অবরুদ্ধ পাক-সৈন্যরা কামানের গোলায় পথ করতে করতে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বাইরে বেরিয়ে এল। তারপর দু’পক্ষে চলল যুদ্ধ। কামান, মর্টার আর মেশিনগানের বিরুদ্ধে রাইফেলের লড়াই, এ এক দুঃসাহসিক অথচ মর্মান্তিক দৃশ্য। এই যিদ্ধে দেশপ্রেমে উদবুদ্ধ মুক্তিযোদ্ধারা অদ্ভুত বিরত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন। কিন্তু এ সব অগ্নিস্রাবী কামান আর ভারী মেশিনগানের সামনে এই প্রতিরোধ কতক্ষন টিকতে পারে? যশোরের রাজপথ রক্তে লাল হয়ে গেল, কত দেশপ্রেমিক এই যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছিলেন তার হিসেব কেউ দিতে পারবে না। যুদ্ধ সমস্ত শহরময় ছড়িয়ে পড়ছিল, শহ্রের পথগুল অসংখ্য দেশভক্তের মৃতদেহে বিকীর্ণ হয়ে গিয়েছিল। সেই যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে যারা বেঁচে ছিলেন, তাঁরা মুক্তিযুদ্ধকে পুনর্গঠিত করার সংকল্প নিয়ে শহর ছেড়ে বাইরে চলে গেল। এইভাবে যশোরে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্বের পরিসমাপ্তি ঘটল।

       এপ্রিলের মধ্যভাগ। ইতিমধ্যে পাকসেনারা যশোরের গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন অঞ্চলে আত্মগোপন করে চোরা-গোপ্তা আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। যশোর শহর থেকে দশ-বারো মাইল দূরে মুরাদপুর গ্রাম। বারো বাজারের পাশেই মুরাদগড়। এখানে মুক্তিবাহিনীর একটা গোপন খাঁটি ছিল। খবর পাওয়া গেল যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে কিছু পাকসেনা মুরাদগড়ের দিকে আসছে। সুখবর! এই শিকার যেন ফসকে না যায়। স্থির হলো এদের উপরে অতর্কিত হামলা দিতে হবে। ভাগ্যক্রমে এদের হাতে একটা লাইট মেশিনগান ছিল। এমন সুযোগ কি সবসময় মেলে? কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা সংখ্যায় মাত্র তিনজন। একজন ক্যাপ্টেন আর দুইজন তার সহকারী। খবর পাওয়া গেছে ওদের পাঁচখানা জীপ, একটা ট্রাক। সৈন্য সব মিলিয়ে শ খানেক হবে। একশজনের বিরুদ্ধে তিনজন। তা হোক, এ নিয়েই তারা ওদের বাধা দেবে।

       যথাসময়ে ওদের সেই ‘কনভয়’ মুরাদগড়ে পৌছালে ওরা কালীগঞ্জের দিকে চলছিল। মুরাদগড়ের পুলটার একপাশে অনেক ঝোপঝাড়, তারই আড়ালে তিনজন মুক্তিযোদ্ধা গা ঢাকা দিয়ে বসে ছিল। পাকসেনারা নিশ্চিন্ত মনে এগিয়ে চলছিল। ওদের বাধা দেবার মত কারো দুঃসাহস থাকতে পারে, তা তারা স্বপ্নেও ভাবে নি। সবে তাদের দু’টো জীপ পুল পেরিয়ে ওপাশে গেছে, এমন সময় মুক্তিযোদ্ধাদের মেশিনগানটি তাদের লক্ষ্য করে গর্জন করে উঠলো।

       এভাবে অতর্কিত আক্রমণে পাকসেনারা হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। এদিকে ওদের মেশিনগান অবিরল ধারায় গুলি বর্ষন করে চলেছে। ফলে আতঙ্কিত হয়ে তারা যেদিক থেকে এসেছিল, সেদিকেই ছুটে পালাল।

       একটু পরেই এই ভগ্নদূতের দল হাঁপাতে হাঁপাতে ক্যান্টনমেন্টে এই সংবাদ পৌছুলো। দেখতে দেখতে এক বিপুল বাহিনী বেরিয়ে এল ক্যান্টনমেন্ট থেকে। তারা মুরাদগড়কে কেন্দ্র করে বিরাট একটা অঞ্চল ঘেরাও করে ফেলল। মুক্তিযোদ্ধারা এই ঘেরাও এর ভেতরে আটকা পড়ে গিয়েছিল। বেরোবার পথ ছিল না। শেষ পর্যন্ত সেই তিন বীরযোদ্ধা যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হলো।

মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রউফ

       বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হবার ঠিক অল্প কিছুকাল আগেই কর্তৃপক্ষ আবদুর রউফ কে পাকিস্তান থেকে তাঁর স্বদেশে নিয়ে আসে। তারপর থেকে যশোর ক্যান্টনমেন্টে বেঙ্গল রেজিমেন্টের দলভুক্ত হয়েছিলেন। ইতিমধ্যে সারা বাংলাদেশে স্বাধীনতা আন্দোলন উত্তাল তরঙ্গ নিয়ে গর্জন করে উঠেছে। স্বাধীনতার এই দুর্বার কামনা কে দমন করার জন্য সামরিক সরকার ২৫শেমার্চ রাতে ঢাকা শহরের বুকে হত্যা ও ধ্বংসের তাণ্ডব নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে সারা প্রদেশময় এর প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল জনতা, দিকে দিকে বিক্ষোভের আগুন জ্বলে উঠতে লাগল।

       যশোর ক্যান্টনমেন্টে তখন বেঙ্গল রেজিমেন্টের এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য। পশ্চিম পাকিস্তানের ফ্রন্টিয়ার ও বেলুচ বাহিনীর হাজার হাজার সৈন্যের মধ্যে তারা একেবারেই সংখ্যালঘু। তাই ভেতরে ভেতরে বিক্ষোভে ফেটে পড়লেও তারা প্রথম দিকে অসন্তষ বা বিদ্রোহের ভাব প্রকাশ করেনি।

       কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক অফিসারেররা তাদের বিশ্বাস করতে পারেনি। ২৯শে মার্চ পর্যন্ত মানুষের মনের অবস্থা যাই থাকুক না কেন, যশোরে নাগরিক জীবন স্বাভাবিক ভাবেই বয়ে চলছিল। কিন্তু ৩০শে মার্চ এ যশোর ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে বাঙালি- অবাঙালি সৈনিকদের মধ্যে এক প্রচণ্ড সংঘর্ষ ঘটল। পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক অফিসাররা বেঙ্গল রেজিমেন্টের অস্ত্রাগারের চাবি কেড়ে নিয়ে সমস্ত বাঙালি সৈন্যদের নিরস্ত্র করে ফেলল। তার মিনিট কয়েক পরেই বিক্ষুব্ধ বাঙালি সৈন্যরা মরিয়া হয়ে বিদ্রোহ ঘোষনা করল এবং জোর করে তাদের নিজেদের অস্ত্রাগার দখল করে নিল।

       এবার দু’পক্ষে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। পাকিস্তানী সৈন্যদের সংখ্যা বাঙালিদের চেয়ে বহুগুণে বেশী। তাছাড়া কামান, মর্টার, ভারী অস্ত্রশস্ত্র সবকিছুই তাদের হাতে। ফলে যা পরিণতি ঘটা স্বাভাবিক তাই ঘটল। ঘন্টাকয়েক ধরে যুদ্ধ চলল। দু-তিনশ বাঙালি সৈন্য নিহত হল। অবশিষ্ট বাঙালি সৈন্যরা ছত্রভংগ হয়ে ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে পালিয়ে গেল। যশোর জেলার মুক্তিসংগ্রামের এটাই হল সুচনা।

       এই পালিয়ে আসা বাঙালি সৈন্যদের মধ্যে কোন শৃঙ্খলা ছিল না। যে যেদিকে পারল সেদিকে পালাল। আবদুর রউফ ও তাঁর দুজন সাথী তাদের সবার মধ্যে থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এই বিচ্ছিন্ন অবস্থাতেও তাঁরা মনোবল হারাননি। তাঁরা এই তিনজন মিলে নিজেদের একটা ইউনিট গঠন করলেন। এবং শপথ নিলেন যে, তাঁরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য শেষ পর্যন্ত সংগ্রাম করে যাবেন। এই সঙ্কল্প লইয়ে তাঁরা যশোর শহরে ফিরে মুক্তিবাহিনী তে যোগদান করলেন। তখন যশোর শহর মুক্তিবাহিনীর অধিকারে এসে গেছে। মুক্তিবাহিনীতে যোগদানের পর থেকে আবদুর রউফ ও তাঁর দুজন সাথী একই সঙ্গে লড়াই করে এসেছেন এবং আবদুর রউফ আহত হয়ে রণক্ষেত্র ছেড়ে চলে আসার আগ পর্যন্ত তাঁরা একই সঙ্গে ছিলেন।

       ৩রা এপ্রিল তারিখে এক রক্তাক্ত যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে পাকসেনারা যশোর শহর পুনর্দখল করে নিল। মুক্তিবাহিনী শহর ত্যাগ করে নিড়াইল গিয়ে তাদের ঘাঁটি স্থাপন করল। কিন্তু যশোর শহ্র ছেড়ে গেলেও মুক্তিবাহিনীর একটা অংশ শহর থেকে মাত্র মাইল দেড়েক দূরে দুই তালা ফতেহপুরে পাকসেনাদের প্রতিরোধ দেবার জন্য তৈরী হয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। তাদের সাথে ছিল তিনটা মেশিনগান। এই তিনটা মেশিনগানের মধ্যে একটা ছিল আবদুর রুফ ও তাঁর দুই সাথীর হাতে। ইপি-আর বাহিনীর ৮/১০ জন যোদ্ধা বাকি দুইটি পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন। এদের সাহায্য করার জন্য গোটা পঞ্চাশেক ছাত্রও ছিল। এই প্রতিরোধের দলটি দুইতালার যেখানে ঘাটি করেছিল, সেখানে অপেক্ষা করতে লাগল।

       আবদুর রউফ বলেছিলেনঃ ১১ই এপ্রিল পর্যন্ত শত্রুপক্ষের কারো সাথে আমাদের দেখা হয়নি। ১২ই এপ্রিল বেলা একটার সময় যখন আমরা খেতে বসেছি, এমন সম লক্ষ্য করলাম শহরের দিক থেকে একটা কালো রঙ এর জীপ আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। একটু দূরে থাকতেই জীপটা থেমে গেল। মনে হল, জীপের আরোহীরা আমাদের দেখতে পেয়েছে, তাই ওখানে থেমে গিয়েছে। আমরা দেখা মাত্রই খাওয়া ছেড়ে লাফিয়ে উঠলাম। সাথে সাথে আমাদের তিনটা মেশিনগান একই সাথে গর্জন করে উঠল। কিন্তু ওরা আগে থেকেই হুশিয়ার হয়ে জীপটা একটা গাছের পিছনে দাড়া করিয়েছিল। তাই আমাদের গুলী ওদের স্পর্শ করতে পারল না। জীপটা কিছুক্ষন ওভাবেই দাঁড়িয়ে রইল। বোধহয় আমাদের অবস্থান টা পর্যবেক্ষন করে নিচ্ছিল। তারপর গাড়িটা যেদিক থেকে এসেছিল, সেদিকেই দ্রুতবেগে চলে গেল।

       জীপটা চলে যাবার মিনিট কয়েক পরেই ক্যান্টনমেন্ট থেকে কামানের গোলা বর্ষন শুরু হল। গোলাগুলি আমাদের সামনে এসে পড়ছিল। আমরা উপযুক্ত জায়গা খুঁজে নিয়ে আত্মরক্ষার জন্য আশ্রয় নিলাম। ঘন্টাখানেক ধরে এভাবে গোলাবর্ষন চলল। ওরা মনে করল, এই গোলাবর্ষনের পরে রাস্তা নিশ্চয়ই পরিস্কার হয়ে গেছে, তাদের প্রতিরোধ করার মত কেউ নেই। তাই ওদের একটা পদাতিক দল নিশ্চিন্ত মনে যশোর নড়াইল সড়োক দিয়ে আসতে লাগল। আমরা ধ্যোইর্য ধরে অপেক্ষা করছিলাম, আসুক, অরা আরো কাছে এগিয়ে আসুক, তারপর ওদের একবার দেখে নেয়া যাবে। উপযুক্ত সময় আসতেই আমরা মুহুর্তের মধ্যেই পজিশন নিয়ে দাঁড়িয়ে মেশিনগান চালাতে শুরু করলাম। ওরা এ জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিল না, তাই আমাদের তিনটা মেশিনগানের অবিরল গুলিবর্ষনের ফলে ওদের প্রচুর লোক মারা গেল। বাকী সবাই উর্ধ্বশ্বাসে প্রাণ নিয়ে পালালো।

       ওরা পালিয়ে গেল বটে, কিন্তু আমাদের নিশ্চিন্ত মনে বিশ্রাম নিতে সুযোগ দিল না। একটু বাদেই ওদের একটা বড় দল আমাদের উপর এসে হামলা করল। ওরা অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত হয়েই এসেছিল, সঙ্গে মেশিনগানও ছিল, কিন্তু ওরা এবার বরাবর সোজা পথ ধরে আসে নি। আমরা প্রথমে বুঝতে পারিনি, পরে দেখলাম, ওরা দুটো দলে ভাগ হয়ে দুদিক থেকে সাঁড়াশি আক্রমণ করেছে এবং আমরা প্রায় ঘেরাও হয়ে যেতে বসেছি।

       আমাদের উপর দুদিক থেকে গুলিবর্ষন চলছে, আমরা যেন গুলির বেড়া জালের মধ্যে আটকে পড়তে বসেছি। আমাদের সাহায্য করার মত যারা ছিল সবাই ছত্রভংগ হয়ে পালিয়ে গিয়েছে। আমাদের মধ্যে একে একে পাঁচজন যোদ্ধা শহীদ হলেন। কিন্তু তবু আমরা মনোবল হারাইনি। আমাদের তিনটি মেশিনগান অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সাথে গুলি করতে করতে পিছিয়ে যাচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত আমরা যথেষ্ট কৌশলের পরিচয় দিয়ে সেই মৃত্যুফাঁদ থেকে বেরিয়ে এলাম।

       শত্রুপক্ষ বুঝল, লড়াইয়ের পথ এখনো তাদের জন্য কণ্টকমুক্ত নয়। তাই তারা আর বেশীদুর না গিয়ে যশোর শহরে ফিরে গেল। ইতিমধ্যে নড়াইলে গুজব ছড়িয়ে পড়েছে যে, পাকসৈন্যদের এক বিরাট বাহিনী নড়াইল আক্রমন করতে রওনা হয়েছে। শহরের মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পালাতে শুরু করল। আবার সেই রাত্রিতেই ওরা নড়াইলের উপরে মারাত্মক রকম বোমা বর্ষন করল। বিস্ফোরনের আগুনে জ্বলতে লাগল নড়াইল শহর। অবস্থা গুরুতর দেখে মুক্তিযোদ্ধারা নড়াইল ছেড়ে লোহাগড়ার দিকে চলে গেল।

       পরদিন যশোর থেকে বিরাট মিলিটারি বাহিনী এসে নড়াইলে হামলা করল। তাদের সঙ্গে ছিল তাদের বিহারী ও বাঙালি দালালরা। ওরা লুতের লোভে উন্মত্ত হয়ে ছুটে এসেছে। ওদের বাধা দেয়ার মত কেউ ছিল না। ওরা নিশ্চিন্ত মনে নড়াইল শহরে লুটপাট চালিয়ে ফিরে গেল যশোর শহরে। তখন নড়াইলে সামরিক-বেসামরিক কোনরকম শাসনই রইল না। কুখ্যাত গুন্ডা টগর সেই সুযোগে সারা শহরের উপরে তার আধিপত্য বিস্তার করে যা খুশি তা’ই করে চললো।

       মূল মুক্তিবাহিনী চলে গেছে লোহাগড়া। আমাদের সঙ্গে যারা ছিল তারাও ছত্রভংগ হয়ে কে কোথায় চলে গেছে। এবার আমরা তিনজন মুক্তিবাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লাম, আমরা স্থির করলাম আমাদের নিজেদের এবার নিজেদের পথ বেছে নিতে হবে, নিজেদের উদ্যগে মুক্তিসংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। শত্রুপক্ষ যতই প্রবল হোক না কেন, বা অবস্থা যতই প্রতিকুল হোক না কেন, আমরা কিছুতেই এই সংগ্রাম ছেড়ে পিছু হটে যাব না। আমরা তিনজন আর আমাদের মেশিনগানটি, এই আমাদের সম্বল। এই নিয়ে আমরা নতুন পথে যাত্রা শুরু করলাম।

       আমাদের প্রথম কাজ হল নড়াইল গিয়ে টগর গুন্ডা কে উচিত শিক্ষা দেওয়া। আমরা সোজা গিয়ে তার মোকাবিলা করলাম। টগর তার দলবল নিয়ে অবাধে লুটপাট চালিয়ে যাচ্ছিল। তাদের সাথে বাক্যবিনিময়ের ইচ্ছা বা সুযোগ কোনটাই আমাদের ছিল না, দেখা হওয়া মাত্রই গুলি বিনিময় চলল, কিন্তু আমাদের মেশিনগানের সামনে ওরা কি করে দাঁড়াবে? টগর প্রাণের ভয়ে আত্মসমর্পন করল। আমরা দেশের শত্রু সেই শয়তানের মৃত্যুদন্ডের ব্যবস্থা করলাম। তার পরপই তার মতই কয়েকটি দেশদ্রোহী কে হত্যা করা হলো।

       এবার আমরা নড়াইল ছেড়ে লোহাগড়ার কাছে দীঘলিয়া গ্রামে চলে গেলাম। আমরা স্থির করেছিলাম, এবার আমরা নিজেদের উদ্যগে একটা নতুন মুক্তিবাহিনী গড়ে তুলব। এই অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীতে যোগদানের ইচ্ছুক ছাত্র ও যুবকের অভাব ছিল না। সামরিক ট্রেনিং পাবার জন্য তারা অধীর হয়ে উঠেছিল। আমার ডাকে দেখতে দেখতে অনেক ছাত্র ও যুবক এসে জুটল। আমি দীঘলিয়াতে ট্রেনিং সেন্টার স্থাপন করে এই সমস্ত শিক্ষার্থীদের ট্রেনিং দিয়ে চললাম। শেষ পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের সংখ্যা চল্লিশ-পঞ্চাশ জনে দাড়াল।

       এদিকে পাকসেনাদের জয়লাভের ফলে স্থানীয় দালালেরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। তাদের সাথে যোগ দিয়েছিল চোর, ডাকাত, লুটেরা আর গুন্ডা বদমাসের দল। ওরা এই সুযোগে নিজেদের ফায়দা উসুল করে নিচ্ছিল। ওদের পিছনে সামরিক সরকার সমর্থন রয়েছে, তাই তারা নিশ্চিন্ত ছিলযে, তারা যাই করুক নাকেন, কেউ তাদের বাধা দিতে সাহস পাবেনা। দীঘনিয়ার কুখ্যাত চেয়ারম্যান নওশের আলী ছিল তেমনই এক নামকরা দালাল। আমাদের মুক্তিবাহিনীর কথা শুনে তার টনক নড়ল। সে টাকাপয়সা ছড়িয়ে চারদিক থেকে হাজারদুয়েক গুন্ডা এনে আমাকে ধরতে এলো। আমাকে ধরা এত শজ নয়, তা সে বুঝতে পেরেছিল, তাই এত তোড়জোর। আমি খবর পেয়েই দীঘলিয়া বাজারে “কারফিউ” জারি করে দিয়েছিলাম। আমাদের মুক্তিবাহিনীর ছোট একটা গ্রুপ নিয়ে ওদের সঙ্গে মোকাবিলা করলাম। কিন্তু যুদ্ধ করার প্রয়োজন হলো না, আমাদের মেশিনগানের আওয়াজ শুনেই দালাল নওশের আলীর ভাড়াটে গুন্ডাগুলি দেখতে দেখতে ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে গেল।

       কিন্তু বুঝতে পারছিলাম যে, জায়গাটা আমাদের পক্ষে আর নিরাপদ নয়। আমাদের অন্যত্র সরে যাওয়া টাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। কিন্তু যাবার আগে দালাল নওশের আলির লীলাখেলা শেষ করে দিয়ে যাব। এই সঙ্কল্প নিয়ে তখনকার মত আমার বাহিনী কে ভেঙ্গে দিলাম। তারপর সে অঞ্চলে পনের ষোল দিন আত্মগোপন করে ছিলাম। একদিন উপযুক্ত সুযোগে নওশের আলীকে হত্যা করা হয়। তারপর আমি আর আমার দুই সাথী সেই অঞ্চল ছেড়ে এলাম ফরিদপুরের গোপালগঞ্জে।

       আমরা গোপালগঞ্জ মহকুমার চন্দ্রদিঘী গ্রামে এসে আশ্রয় নিলাম। দেখতে দেখতে এখানেও এক মুক্তিবাহিনী গড়ে উঠল। আমাদের দৃষ্টি রইল গোপালগঞ্জ শহরের দিকে। সেখানে তখন মুসলিম-লিগপন্থী, জামাতপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল দেশদ্রোহীদের অপ্রতিহত রাজত্ব চলছে। পুরানো এসডিও কে সরিয়ে দিয়ে অবাঙালি একজনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। গোপালগঞ্জ শহর তখন শত্রুপক্ষের দুর্ভেদ্য দুর্গ স্বরূপ। পরিকল্পনা নিলাম, ওদের দুর্গের ভেতরে ঢুকে ওদের উপরে হামলা চালাব। এই পরিকল্পনা যদি সফল হয়, তবে সমস্ত মহকুমা জুড়ে মুক্তিবাহিনীর প্রভাব ও মর্যাদা বহুগুণে বেড়ে যাবে।

কিন্তু শুধু আমরা তিনজনই সেখানে যাব, যা করবার তিনজনই করব, বাহিনীর আর কাউকে সঙ্গে নেব না। এ কাজ করতে হবে অত্যন্ত কৌশলে। ওরা যদি আগে থেকে টের পেয়ে যায়, তাহলে একজনকেও আর প্রাণ নিয়ে ফিরে আসতে হবে না। আমার প্যারাট্রুপারের ট্রেনিং এর অভিজ্ঞতা টা এবার কাজে লাগাতে হবে। খুবই দুঃসাহসের কাজ। আমরা তিনজন সেই বিপজ্জনক পথে পা বাড়ালাম।

গভীর রাত্রিতে অতি সন্তর্পনে আমরা তিনজন গোপালগঞ্জ শহরে গিয়ে ঢুকে পড়লাম। শান্ত শহর ঘুমিয়ে আছে, কোথাও কোন সাড়া শব্দ নেই। আমাদের ভাগ্য ভাল, আমরা কোথাও কোন পাহারাদারের নজরে পড়ে যাই নি। কি করে দ্রুত ও সতর্কতার সাথে শত্রুপক্ষের যোগাযোগ ব্যাবস্থাকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে হয়, সেই শিক্ষা আমার ভাল করেই জানা ছিল। এবার তা কাজে লেগে গেল। আমরা যন্ত্রের মত কাজ করে চলছিলাম। দেখতে দেখতে ওদের বেতার প্রেরণ ব্যবস্থাকে নষ্ট করে দিলাম, কেটে ফেললাম টেলিফোন আর টেলিগ্রামের তার। গোপালগঞ্জ শহরের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। কিন্তু এমন সতর্কতার সাথে এই কাজগুলি করেছিলাম যে, একটি জনপ্রাণী ও টের পায়নি। এইভাবে আমাদের প্রাথমিক কাজ সমাপ্ত করে নিয়ে আমরা তিনটি নিশাচর প্রাণী দিবালোকের অপেক্ষায় রইলাম।

অবশেষে রাত্রির অন্ধকার কেটে দিনের আলো দেখা দিল। ক্রমে বেড়ে উঠল বেলা। আমরা আমাদের গোপন আশ্রয় ছেড়ে প্রকাশ্যভাবে বেরিয়ে এলাম পথে। পথের মানুষ আমাদের দেখে চমকে উঠল। ভয় পেয়ে দু ধারে সরে গিয়ে আমাদের পথ করে দিল। আমরা আমাদের মিলিটারী বুটের খট খট শব্দে রাজপথ ধ্বনিত করে সোজা পুলিশ ব্যারাকে উঠলাম। ব্যারাকে ঢুকেই চমকে উঠলাম আমি। সংবাদ পেয়েছিলাম যে , মাত্র জনাকয়েক পুলিশ আছে। কিন্তু ঢুকে দেখি জনা তিরিশেক অবাঙালি পুলিস আমদানি করা হয়েছে। আমাদের পক্ষে ভয় পাবারই কথা। কিন্তু আমরা এক অগ্নিপরীক্ষার সামনে দাঁড়িয়ে, আমাদের ভয় করলে চলবে না, এখন যা হবার তা হোক।

আমাদের দেখে ওরা সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়িয়ে স্যালুট দিল। ওরা আমাকে পাঞ্জাবী অফিসার বলে মনে করেছিল। অনেকেই এই ভুলটা করে থাকে। এরই উপরে ভরসা করে আমি দুঃসাহসিক প্ল্যান নিয়ে গোপালগঞ্জে এসেছি। বলতে গেলে জেনেশুনেই বাঘের মুখে দাঁড়িয়েছি। আমি মিলিটারি অফিসারের গাম্ভীর্য নিয়ে পরিস্কার উর্দু ভাষায় বললাম, আমি সামরিক হেডকোয়ার্টার থেকে এসেছি। তোমাদের উপরে নির্দেশ, তোমরা এখনই তোমাদের অস্ত্র আমার সামনে এসে জমা করবে।

ওরা আমার নির্দেশ শুনে অবাক হয়ে একে অপরের মুখের দিকে তাকাল। তারা এই অর্ডারের মানে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিল না। তারাত বাঙালি পুলিশ নয়, তাদের এভাবে নিরস্ত্র করা হচ্ছে কেন? আমি তাদেরকে বেশী ভাববার সময় না দিয়ে বজ্রগর্জনে সেই নির্দেশের পুনরাবৃত্তি করলাম। এবার ওরা ঘাবড়ে গিয়ে সুরসুর করে আমার নির্দেশ পালন করল। পাশেই ছোট একটা ঘর, সেই ঘরে রাইফেল স্তুপীকৃত হয়ে উঠল। এবার আমরা ওদের একটা হলঘরে ঢুকিয়ে দরজা তালাবন্ধ করে গট গট করে হেঁতে চলে এলাম বাইরে। এইখানে প্রথম দৃশ্যের শেষ।

এবার দ্বিতীয় দৃশ্য। আমরা যে পরিকল্পনা নিয়ে এসেছিলাম, তার মধ্যে ট্রেজারি আর ব্যাঙ্ক লুট করার কথাও ছিল। কিন্তু এখন বুঝলাম অবস্থা গুরুতর। আপাতত সোদের পরিকল্পনা থেকে সে দুটো ছাঁটাই করে দিতে হবে। এবার পুলিশ ব্যারাক পেছনে ফেলে নবনিযুক্ত এসডিও এর কুঠিতে গিয়ে উঠলাম। খবর পাঠাবার একটূ বাদেই সেই এসডিও হাপাতে হাপাতে আমাদের সামনে এলো। আমার দিকে চোখ পড়তেই সসম্মানে স্যালুট দিল। আমি তাকে উর্দুতে বললাম, য়ামি সামরিক কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে জরুরী নির্দেশ নিয়ে এসেছি। এখুনি মুসলিম লিগের আফসার উদ্দিন মোল্লা ও সিদ্দিক সিকদার কে ডেকে পাঠান। একটা বিষয় নিয়ে ওদের সাথে পরামর্শ করতে হবে। এসডিও অতি সমাদরে আমাদের একটা ঘরে নিয়ে বসালেন। একটু বাদেই যাদের ডেকে পাঠান হয়েছিল তারা এসে উপস্থিত হলো। ঘরে এসে ঢুকবার সাথে সাথেই আমরা তিনজন উঠে দা৬ড়িয়ে ওদের দিকে রাইফেল উচু করে ধরলাম। একই সাথে তিনটা রাইফেল গর্জে উঠল। ওদের কথা বলবার সময়টুকু পর্যন্ত ছিল না, একই সঙ্গে তিনটি দেহ ভূমিশয্যায় লুটিয়ে পড়ল। এমনি করে পর পর তিনবার গুলি ছুড়লাম, তারপর কাজ শেষ করে দ্রুত ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম।

পেছনে লোকজনের কোলাহল আর হট্টগোল শোনা যাচ্ছে। এতক্ষনে মনে পড়েছে, একটা কাজ বাকি রয়ে গেছে; সেটিকে শেষ করে যেতে হবে। আমরা ছুটতে ছুটতে গিয়ে মুসলিম লিগ নেতা ওয়াহিদুজ্জামানের বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়লাম। সামরিক সরকারের বড় দালাল ওয়াহিদ্দুজামান। কিন্তু সেখানে গিয়ে হতাশ হতে হল। খবর নিয়ে জানলাম ওয়াহিদুজ্জামান বর্তমানে গোপালগঞ্জে নেই। না-ই বা থাকল ওয়াহিদুজ্জামান, তার ভাই ফায়েকুজ্জামান তো আছে। সেও তো এই অপকর্মে তার ভায়ের সাথী। আপাতত তাকে দিয়ে আমাদের কাজ চলবে। কিন্তু কি আশ্চর্য, ফায়েকুজ্জামান দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়িয়ে আমাদের মুখের দিকে তাকাতেই, কে জানে কি করে আমার আসল রূপ আর উদ্দেশ্য টা ধরে ফেলল। এতগুলি লোককে ঘোল খাইয়ে এলাম, কিন্তু তার সাবধানী চোখদুটিকে ফাকি দিতে পারিনি। আতঙ্কিত দৃষ্টি নিয়ে একলাফে ঘরে ঢুকে পড়ল সে, তারপর দরজার পাট দুটো আমাদের মুখের সামনে দড়াম করে বন্ধ করে দিল।

ইতিমধ্যে ঘরের ভেতর থেকে গুলিবর্ষন শুরু হয়ে গেছে। আমাদের ও কেমন জিদ চেপে গেছে, বাইরে থেকে পালটা গুলি চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু একটু বাদেই নিজেদের ভুলটা বুঝতে পারলাম। ইতিমধ্যে সারা শহর চঞ্চল হয়ে উঠেছে। পথের মোড়ে মোড়ে ভীড় জমে যাচ্ছে। এর পর আর শহর ছেড়ে বেরিয়ে যাবার উপায় থাকবে না। অবস্থার গুরুত্ব বুঝতে পেরে কাজ অসমাপ্ত রেখেই আমরা ছুটে বেড়িয়ে পড়লাম। আমরা ছুটছি, ফাকা আওয়াজ করছি, আর রাস্তা সাফ হয়ে যাচ্ছে।

নিরাপদে, সম্পূর্ণ অক্ষত দেহে শহরের বাইরে বেরিয়ে এলাম মৃত্যুর গহবর থেকে।

প্রকাশ্য দিবালোকে গোপালগঞ্জ শহরের বুকের উপরে এই ঘটনা ঘটে যাবার পর অবস্থা গরম হয়ে উঠল। সামরিক বাহিনী আর তাদের দালালেরা মুক্তিবাহিনী কে নির্মূল করার জন্য উঠেপড়ে লাগল। আমরা যে অঞ্চলে ছিলাম সেখানকার জনসাধারনের উপরে নানারকম জুলুম আর অত্যাচার চলল। শেষ পর্যন্ত আমরা তিনজন অই অঞ্চল ছেড়ে মাণিকহার গ্রামে চলে এলাম। আমরা যেখানেই যাই স্থানীয়ভাবে মুক্তিবাহিনী গড়ে উঠে। তাছাড়া দিঘলিয়া আর চন্দ্রদীঘলিয়ার মুক্তিযোদ্ধাদের সাথেও যোগাযোগ রক্ষা করে চলছিলাম।

মাণিকহারে এসে একটা মস্ত খবর পেয়ে গেলাম। নারায়নগঞ্জ থেকে আটটা ফ্ল্যাট প্রায় দেড়লক্ষ মণ পাট বোঝাই হয়ে খুলনার দিকে যাচ্ছে। আমাদের শত্রুরা আমাদের এই পাট বিদেশে রফতানি করে মুনাফা লুটবে, আর হয়ত সেইটাকা দিয়ে আমাদের মারবার জন্য অস্ত্র আমদানী করবে। ফ্ল্যাটগুলি এই মধুমতির তীর ঘেষেই যাবে।

এই খবর পেয়ে আমরা একদল মুক্তিযোদ্ধা এই ফ্ল্যাটগুলিকে অভ্যর্থনার জন্য মাণিকদা গ্রামে গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকি। যথাসময়ে ফ্ল্যাটগুলি মাণীকদার কাছে তালাঘাটে ভিরল। আমরা আগে থেকেই ফ্ল্যাটগুলির উপর হামলা করার জন্যতৈরী হয়ে ছিলাম। ওরা পালিয়ে যাবার জন্য চেষ্টা করেছিল, পারল না। আমরা ওদের সব পাট পুড়িয়ে ছাই করে দিলাম।

১০ই মে নারায়নগঞ্জ থেকে রকেট স্টিমারটি সৈন্যদের রসদে বোঝাই হয়ে খুলনার দিকে যাচ্ছিল। তাছাড়া স্টিমারে একজন মেজরের নেতৃত্বে ৫০ জনের মত সৈন্যও যাচ্ছিল। এই সৈন্যদের সাথে অস্ত্রশস্ত্র তেমন ছিল নাএবং তারা সাদা পোশাকেই চলছিল। রকেট স্টিমারটি তালাঘাটে ভিরল। আমরা তখনও মানিকদা তেই ছিলাম। এই খবরটাও আমাদের কাছে পৌছে গিয়েছিল। স্টিমার ঘাটে ভেরার সাথে সাথেই আমাদের মুক্তিবাহিনী সেটা ঘেরাও করে ফেলে। ওদের আত্মসমর্পণ করা ছাড়া উপায় ছিল না। আরোহীদের নদীর তিরে নামিয়ে দিয়ে স্টিমারটাকে ডুবিয়ে দিলাম। তারপর মেজর সহ সৈন্যদের খতম করে দেয়া হল।

সেই দিন রাত্রিতেই খুলনা থেকে একটা রসদ বোঝাই লঞ্চ এবং বরিশাল থেকে একটা সৈন্যবাহী লঞ্চ গোপালগঞ্জের দিকে যাচ্ছিল। আমরা প্রথমে খাদ্যবাহী লঞ্চ টা কে ডুবিয়ে দিলাম। তারপর প্রবল গুলিবর্ষনের ফলে সৈন্যবাহী লঞ্চ টাও ডুবে যায়। এই অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর উৎপাতে সামরিক কর্তৃপক্ষ অতিষ্ট হয়ে উঠেছিল। গোপালগঞ্জের এসডিও হত্যা, দেড় লক্ষমণ পাট পুড়িয়ে দেয়া, সৈন্যবাহী লঞ্চ ডোবানো।– পর পর এই সমস্ত ঘটোনা মুক্তিবাহিনীর প্রভাব বাড়িয়ে চলছিল; অপরপক্ষে সামরিক কর্তৃপক্ষের মর্যাদার হানি ঘটোছিল। তাই আমাদের নির্মূল করে দেয়ার জন্য তারা উঠে পড়ে লাগল।

সেই দিনটা ছিল ১১ই মে। এই তারিখটা আমার পক্ষে ভুলে যাওয়া সম্ভব না। অদের গুপ্তচরের মুখে ওরা আমাদের অবস্থান টা জানতে পেরেছিল। সেদিন আমাদের জায়গা থেকে বেশ অনেকটা দূরে ওরা আমাদের অবস্থান টা জানতে পেরেছিল। সেদিন আমাদের জায়গা থেকে বেশ খানিকটা দূরে ওরা লঞ্চ বোঝাই করে সৈন্য নামাল। ব্যাপারটা আমরা একেবারেই টের পাইনি। যখন টের পেলাম, তখন প্রায় ঘেরাও হয়ে এসেছি। সেই ঘেরাও থেকে বের হয়ে আসা সহজ কথা নয়। আমার কথা বলি, আমি ওদের একটা সোইন্যদলের একেবারে কাছাকাছি গিয়ে পড়েছিলাম। আমার ভাগ্য ভাল, ওরা আমাকে ওদের একজন বলেই ভুল করে বসেছিল। ফলে আমার কাছ থেকে কোনরকম আক্রমণ ওরা আশা করেনি। আর আমিও ওদের অপ্রস্তুত অবস্থায় একপশলা গুলিবর্ষনের সুযোগ পেয়ে গেলাম। ফলে ওদের অনেক সৈন্য হতাহত হলো। সেদিন আমরা গুলি চালাতে চালাতে বহু কষ্টে বেরিয়ে আসতে পেরেছিলাম।  কিন্তু আমি নিজে একেবারে অক্ষত অবস্থায় বেরিয়ে আসতে পারিনি। এতদিন এত সমস্ত সংঘর্ষ্র মধ্যেও আমার গায়ে এতটুকু আঁচড় পরেনি। কতবার কত গুলি কানের পাশ ঘেষে বেরিয়ে গেছে, কতবার কত গুলিবৃষ্টির মাঝে অক্ষত অবস্থায় বেরিয়ে এসেছি। ফলে আমার মনে মনে এমন একটা বিশ্বাস জন্মে গিয়েছিল যে, অদের গুলি আমাকে স্পর্শ করতে পারবে না। কিন্তু এবার যেন শত্রুরা আমার দেখে ওদের দাঁত বসিয়ে দিল। বেরিয়ে এসে দেখি আমার এই হাত থেকে অবিরাম ধারায় রক্ত ঝরছে, তিন তিনটি গুলি একই সাথে আমার হাতে এসে বিদ্ধ হয়েছে।

বলতে বলতে মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রউফ তাঁর ব্যান্ডেজ বাঁধা হাতখানি আমার সামনে তুলে ধরলেন।

-কি করলেন তারপর? জখম হাতটার কি ব্যবস্থা করলেন? প্রশ্ন করলাম আমি।

-আমি যে জখম হয়েছি, ওরা এই খবর টা জানতে পেরেছিল। আমি কে সেটাও ওদের অজানা ছিল না। ইতিমধ্যে এখানকার মুক্তিযুদ্ধের নেতা হিসেবে আমার নামটা এখানকার সর্বত্র প্রচার হয়ে গিয়েছিল। ওরা মনে করেছিল, আমি নিশ্চয়ই আমার এই জখমটার চিকিৎসার জন্য কোন ডাক্তার খানায় অথবা ডাক্তারের কাছে যাব। তাই ওরা আমাকে ধরার জন্য সে সব জায়গায় ও হামলা করেছিল। ফলে আমার পক্ষে ওসব জায়গায় যাবার পথ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আট-দশ দিন বিনা চিকিৎসাতেই কাটল। ফলে আমার হাতটা সেপটিক হয়ে পেকে উঠল। ঐ অবস্থায় আর কিছুদিন থাকলে নির্ঘাত মারাই যেতাম।  তখন বন্ধুরা সিদ্ধান্ত নিলেন জখম চিকিৎসার জন্য বর্ডারের ওপারে চলে যেতে হবে। আমার অবস্থা যে রকম দাঁড়িয়েছিল, তাতে এ ছাড়া আমার বাঁচার আর কোন উপায় ছিল না।

—————————————-

 

সশস্ত্র প্রতিরোধঃ রংপুর-দিনাজপুর

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৯। রংপুর-দিনাজপুর জেলায় প্রতিরোধের বিবরণ বাংলা একাডেমীর দলিলপত্র ১৯৭১

<৯, ৯.১, ২৭৯-২৮২>

সশস্ত্র প্রতিরোধে ৩য় বেঙ্গল

সাক্ষাৎকার:মেজর মোঃ আনোয়ার হোসেন

…… ১৯৭২

(১৯৭১ সালে ক্যাপ্টেন হিসাবে কর্মরত ছিলেন)

       ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ আমি সৈয়দপুর সেনানিবাস ৩য় বেঙ্গল রেজিমেন্টের কোয়ার্টার মাস্টার হিসাবে নিযুক্ত ছিলাম। ১লা মার্চ ইয়াহিয়া খানের জাতীয় পরিষদ অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষনার পরিপ্রেক্ষিতে সৈয়দপুরে বাঙালি ও অবাঙালিদের ভিতরে প্রথমে তীব্র অসন্তোষ দেখা দেয় ও পরে অবাঙালিরা বাঙালিদের উপরে হত্যাযজ্ঞ চালায়। এই পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাটালিয়নের জোয়ান ও অফিসারদের মধ্যে অস্ত্র ও গোলাবারুদ সব সময়ের জন্য দিয়ে দেয়া হয়। কারণ, যে কোন সময়ে দেশের আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করতে হবে।

সেই সময়ে আমাদের কমান্ডিং অফিসার লেঃ কর্নেল ফজল করিম (পাঞ্জাবী), ২য় অধিনায়ক মেজর আকতার (পাঞ্জাবী) ও ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার আবদুল্লাহ খান মালিক (পাঞ্জাবী) আমাদের ব্যাটালিয়ন ছত্রভঙ্গ করার উদ্দেশ্যে বাঙালি অফিসার দ্বারা বিভিন্ন কোম্পানী কে অসহযোগ আন্দোলনের সময় বিভিন্ন জায়গায় দেশের আইন-শৃংখলা বজায় রাখার জন্য পাঠায়।

 ১। মেজর নিজাম, লেঃ মোখলেস ও ২য় লেঃ রফিক সহ বিওডি কোম্পানী কে রংপুর জেলার ঘোড়াঘাটে পাঠানো হয়;

২। ক্যাপ্টেন আশরাফকে সৈয়দপুর ও দিনাজপুর রোডের মধ্যবর্তী মগুলপাড়া নামক স্থানে বৈদ্যুতিক সংযোগস্থল পাহারার জন্য ৪০ জন জোয়ান দিয়ে পাঠানো হয়;

৩। সুবেদার রহমতউল্লাহ ও অবাঙালি মেজর শাফায়াত হোসেন কে নিয়ে ১ প্লাটুন পার্বতীপুর পাঠানো হয়;

৪। মর্টার প্লাটুনের জোয়ানদের কে মর্টার রেখেদিয়ে শুধু রাইফেল দিয়ে শহরের অনতিদূরে পাওয়ার হাউস পাহারায় পাঠানো হয়। ১৭ মার্চ অয়ারলেস সেট ও ভারী হাতিয়ারগুলি ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টার থেকে ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারের নিয়ন্ত্রনে নিয়ে আসা হয়।

আামি কোয়ার্টার মাস্টারের দায়িত্বে থাকায় ব্যাটালিয়ন হেড কোয়ার্টারের কাছে নিয়োজিত ছিলাম। সেই সময় দেশের পরিস্থিতি খুবই ভয়ংকর ছিল। ২৪শে মার্চ আমাকে এবং আমাদের ব্যাটালিয়নের সুবেদার মেজর হারি কে ব্রিগেডিয়ারের অফিসে ডাকা হয়। ব্রিগেডিয়ার আমাকে ও সুবেদার মেজর সাহেবকে বাইরের গুজব না শুনে শৃংখলার সাথে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেন, কিন্তু আমাদের ২য় অধিনায়ক মেজর আক্তারের সাথে রূদ্ধদ্বার কক্ষে বহু সময় আলাপ আলোচনা করেন। এতে আমাদের মনে আরো সন্দেহের ভাব উদয় হল।

২৮শে মার্চ মগুলপাড়া থেকে ক্যাপ্টেন আশরাফ অফিসে এসে দেশের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে জানায়। তখন ২৩ ফিল্ড রেজিমেন্টের একজন বাঙালি অফিসার লেঃ সালামকেও ডাকা হয়। আমরা তিনজন রূদ্ধদ্বার কক্ষে ভবিষ্যতে কি কর্মপন্থা অবলম্বন করতে হবে তা নিয়ে আলোচনা করি। সৈয়দপুর সেনানিবাসে অপর যে দুইটি ব্যাটালিয়ন ছিল তাদের ৩১শে মার্চ রাতে বগুড়ায় চলে যাবার কথা ছিল। আমরা অই সময় সৈয়দপুর সেনানিবাস দখল করার সিদ্ধান্ত নেই। সেই অনুযায়ী ক্যাপ্টেন আশরাফ কে এক ট্রাক গোলাবারুদ মগুলপাড়া নিয়ে যাওয়ার জন্য দিয়ে দেই।

৩১শে মার্চ রাত্রি আড়াই ঘটিকার সময় ২৬এফ-এফ ব্যাটালিয়ন ও ২৩ ফিল্ড রেজিমেন্ট গোলন্দাজ বাহিনী আমাদের ব্যারাকের উপরে অতর্কিত হামলা চালায়। কিন্তু আমরা সতর্ক থাকায় সকাল ১০টা পর্যন্ত উভয় পক্ষে গুলি বিনিময় হয়, এবং তারা আমাদের ব্যারাকে প্রবেশ করতে ব্যার্থ হয়। পাক বাহিনী মাইক দ্বারা প্রচার করতে থাকে যে, তোমরা আত্মসমর্পণ করো, তোমাদের কে কিছু করা হবে না। সেই সময় আমাদের অবস্থানের চারিপাশ তারা ঘিরে ফেলতে চেষ্টা করে। আমরা তখন বাধ্য হয়ে সেনানিবস ছেড়ে ফুলবাড়ী নামক স্থানে ডিফেন্স নেই। সাথে সাথে আমাদের বাইরে অবস্থানরত সকল কোম্পানী কে এই ঘটনা অবগত করি।

১লা এপ্রিল সুবেদার রহমতুল্লাহ তার অবাঙালি মেজর সাফায়েৎ হোসেনকে হত্যা করে এবং সমস্ত জোয়ান নিয়ে ফুলবাড়ীতে চলে আসে।

৩রা এপ্রিল ঘোড়াঘাটে অবস্থানরত বিওডি কোম্পানী ফুলবাড়ী এসে পৌছে। সেই সময় আমাদের মোট শক্তি ছিল ৪৫০ জনের মত। ৪/৫ তারিখে ব্যাটালিয়নকে পুনর্গঠন করা হয় ও তিনটী কোম্পানীতে ভাগ করা হয়।

ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক নিযুক্ত করা হয় মেজর নিজাম সাহেব কে। ১টি কোম্পানীর দায়িত্ব দেয়া হয় ক্যাপ্টেন আশরাফকে। লেঃ মোখলেস কে দেওয়া হয় ১টি কোম্পানীর দায়িত্ব। অপর কোম্পানীর দায়িত্ব ন্যস্ত হয় আমার উপরে। ক্যাপ্টেন আশরাফ তার কোম্পানী নিয়ে দিনাজপুরের পথ দিয়ে সৈয়দপুর আসবে বলে স্থির হয়। সৈয়দপুর থেকে তিন মাইল দূরে ৮ই এপ্রিল তার কোম্পানীর সাথে পাকবাহিনীর ভয়াবহ যুদ্ধ বাধে। এখানে পাকবাহিনীর তিনটি গাড়ি সহ বহু পাকসেনা হতাহত হয়। লেঃ মোখলেস তার কোম্পানী নিয়ে নিলফামারী হয়ে সৈয়দপুর আসবে ঠিক হয়। আমার কোম্পানী এবং হেডকোয়ার্টার কোম্পানী নিয়ে আমি ফুলবাড়ী থেকে খোলাহাটিতে শিবির স্থাপন করি।

৭ই এপ্রিল সুবেদার রহমতউল্লাহ ১ টি প্লাটুন নিয়ে পার্বতীপুর চলে যায়। আমি সেইদিনই আমার কোম্পানী নিয়ে বদরগঞ্জ ডিফেন্স করি।

৯ই এপ্রিল পাকবাহিনী বদরগঞ্জে আমাদের ডিফেন্সের উপরে হামলা করে। এই যুদ্ধে পাকবাহিনীর পক্ষে ব্রিগেডিয়ার আব্দুল্লাহ খান মালেক যুদ্ধ পরিচালনা করেন। সকাল ৯ টা থেকে বিকাল ৪ টা পর্যন্ত যুদ্ধ চলে। শেষে পাকবাহিনীর তীব্র আক্রমনের মুখে টিকতে না পেরে আমাদের জওয়ানেরা পিছু হটতে শুরু করে। এই সময় আমি এক ডিফেন্স থেকে অন্য ডিফেন্সে যাওয়ার সময় বদরগঞ্জ বাজারে পাক বাহিনীর ঘেরাও এ পড়ে যাই। তখন তারা আমাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়লে আমাদের ড্রাইভার মারা যায়। আমি গাড়ি থেকে লাফিয়ে পড়ে অন্য দিকে বদরগঞ্জ বাজারের ভিতরে ঢুকে পড়ি। সেখান থেকে বহু কষ্টে বের হয়ে বদরগঞ্জ রেলস্টেশন হয়ে আড়াই মাইল গ্রামের ভেতরে চলে যাই। সেখানে গিয়ে আমাদের জোয়ানদের দেখতে পাই। তখন আমার শরীর রক্তাক্ত ছিল ও পায়ে গুলিবিদ্ধ ছিল। সেখান থেকে আমাকে ফুলহাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে আমাদের কোম্পানী খোলাহাটিতে চলে যায়।

১০ই এপ্রিল সকালে পাকবাহিনী খোলাহাটি আক্রমণ করে। সেখানে পাকবাহিনীর সাথে আমার কোম্পানী টিকতে না পেরে ফুলবাড়ী তে চলে যায়। এদিকে ক্যাপ্টেন আশরাফ ও লেঃ মোখলেসের কোম্পানী ও ফুলবাড়ীতে চলে আসে।

১১ই এপ্রিল পাকবাহিনী ফুলবাড়ি আক্রমণ করে। ফুলবাড়ীতে পাকবাহিনীর সাথে আমাদের ব্যাটালিয়নের ভীষন যুদ্ধ হয়। কিন্তু পাকবাহিনীর তীব্র আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে আমাদের পুরো ব্যাটালিয়ন চরখাইয়ে চলে যায়। চরখাইয়ে ডিফেন্স করে কোম্পানী গুলো কে নিম্নলিখিত গুরুত্বপূর্ণ পথে ডিফেন্স বসানো হয় যেন পাকবাহিনী চরখাই আক্রমণ না করতে পারে।

১। ক্যাপ্টেন আশরাফের কোম্পানীকে ফুলবাড়ী-চরখাই রোডে বসানো হয়।

২। আমি আমার কোম্পানী নিয়ে ঘোড়াঘাট-চরখাই রোডে ডিফেন্স নেই।

৩। লেঃ মোখলেসের কোম্পানীকে ডেপথ কোম্পানী হিসেবে রাখা হয়।

১৩ই এপ্রিল সংবাদ পাওয়া গেল পাকবাহিনী বগুড়া দখল করে নিয়েছে। তাই পাকবাহিনী বগুরা জয়পুরহাট ও পাঁচবিবি রোড হয়ে হিলি দখল করে নিতে পারে ভেবে ১৪ই এপ্রিল আমি আমার কোম্পানী নিয়ে পাঁচবিবি- হিলি রোডে ডিফেন্স নেই। অপর দুই কোম্পানী চরখাইতেই ডিফেন্স নিয়ে থাকে।

১৯শে এপ্রিল পাকবাহিনী পাঁচবিবির দিক থেকে হিলি আক্রমণ করে। সেইদিন পাকবাহিনীর সাথে আমাদের চার ঘন্টা যুদ্ধ চলে এই যুদ্ধে পাকবাহিনীর অনেক সৈন্য নিহত হয় ও আমাদের তীব্র আক্রমণের মুখে তারা পিছু হটোতে বাধ্য হয়। সেই দিন চরখাই থেকে ২ কোম্পানী কে হিলি চলে আসার নির্দেশ দেই। সেই সময় ক্যাপ্টেন আশরাফ ও লেঃ মোখলেস তাদের জোয়ানদের ফেলে চলে যায়।

২০শে এপ্রিল সুবেদার হাফিজ, নায়েক সুবেদার করম আলী, নায়েক সুবেদার শহীদুল্লাহ দুই কোম্পানী সহ হিলি তে আমার নিকট পৌছে। সেইদিন খুব ভোরে পাকবাহিনী আমাদের উপরে আক্রমণ করে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পাকবাহিনীর সাথে আমাদের তীব্র যুদ্ধ চলে। অবশেষে পাকবাহিনী পিছন হটোতে বাধ্য হয়। এদিকে পাকবাহিনীর মর্টার ও শেলিং এ ভারতিয় সীমান্তের কয়েকজন ভারতিয় নাগরিক নিহত হয়। ফলে, ভারতীয় বি-এস-এফ কর্নেল মুখার্জী, পশ্চিম দিনাজপুরের ডি-এম ও পুলিশ সুপারের অনুরোধে ২০ তারিখ গভীর রাতে আমাদের ডিফেন্স ভেঙ্গে দিয়ে হিলি থেকে ১৩ মাইল দূরে ভারতের কামাল্পাড়া নামক স্থানে কুরমাইল বেসিক ট্রেনিং ইন্সটিটিউটে ২৫০ জনের মত জে,সি,ও, ও জোয়ান আশ্রয় নিই। এই যুদ্ধে ৬ জন জোয়ান শাহাদত বরণ করে। সীমান্ত অতিক্রম করার পূর্বে চরখাই ও হিলি সরকারী গুদাম থেকে চারশত বস্তা চাউল নিয়ে যাই। ২১শে এপ্রিল পাকবাহিনী হিলি দখল করে নেয়।

ভারতে অবস্থানকালে এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহে কামারপাড়া, সোবরা ও আঙ্গিনাবাদে তিনটি অপারেশন ক্যাম্প স্থাপন করি। সুবেদার হাফিজ কে আঙ্গিনাবাদ ক্যাম্প কমান্ডার, সুবেদার আলী নেওয়াজ কে কামাড়পাড়া ক্যাম্প ও জয়পুরহাট চিনি মিলের একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারকে সোবরার ক্যাম্প কমান্ডার হিসাবে নিযুক্ত করে আমি উক্ত তিনটি শিবির পরিচালনা করি।

সেই সময় বাংলাদেশের কমান্ডার ইন চীফ কর্নেল এম, এ, জি , ওসমানী বালুরঘাট আসেন এবং আমাকে হিলি সেক্টর কমান্ডার হিসেবে নিযুক্ত করেন। ১৩ই মে পর্যন্ত আমি হিলি সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করি। আমি সেক্টর কমান্ডার থাকাকালে আরো তিনটি ক্যাম্প স্থাপন করি- মালন ক্যাম্প, তরঙ্গপুর ক্যাম্প ও তপন ক্যাম্প। মেজর নাজমুল আমার নিকট থেকে দায়িত্বভার বুঝে নেন এবং তৎকালীন মেজর বর্তমান কর্নেল শাফায়েত জামিল ৩য় বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক নির্বাচিত হন। আমি আঙ্গিনাবাদ ক্যাম্প কমান্ডার হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করি।

(-উপরে হলুদ মার্ক করা অংশটুকু নিয়ে আমাদের সন্দেহ আছে। কারণ মেজর শাফায়েত জামিল ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টে কুমিল্লা অঞ্চলে ছিলেন)

এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে মে মাসের ২য় সপ্তাহ পর্যন্ত গেরিলা পদ্ধতি গ্রহণ করা হয় ও পাকবাহিনীর চলাচলের পথে এম্বুশ করে পাকবাহিনী কে নাজেহাল ও তাদের ক্ষতি সাধন করা হয়। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য, জয়পুরহাট রেলওয়ে স্টেশন অপারেশন করে পাকবাহিনীকে সেখান থেকে প্রতিহত করে ২ ট্রাক ঔষধ, ৬০ বস্তা চিনি ও কিছু কাপড় নিয়ে আসা হয়।

২৯শে মে গোপন সূত্রে খবর পেয়ে এক কোম্পানী বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিয়ার এর জোয়ান নিয়ে হরতকিডাঙ্গা নামক স্থানে পাকবাহিনীর উপরে এম্বুশ করি। সেই সময় পাকবাহীনির এক কনভয় উক্ত পথ দিয়ে যাচ্ছিল। আমাদের অতর্কিত আক্রমণে পাকবাহিনীর একজন অফিসার সহ আনুমানিক ৩০ জন নিহত হয় ও একটি জীপ ধ্বংস হয়। আমাদের পক্ষের ইপিআর এ জলিল শাহাদৎ বরণ করেন। সেখানে একটি পিআরসি-১০ অয়ারলেস সেট ও একটি এস-এম-জি উদ্ধার করি।

২৮শে মে দিনাজপুর-ফুলবাড়ী রোডে মোহনপুর ব্রীজ এক্সপ্লোসিভ দ্বারা উড়িয়ে দেওয়া হয় এবং সেখানেই এম্বুশ বসানো হয়। ২৯শে মে ১০ঃ১০ মিনিটে পাকবাহিনীর এক কোম্পানী ঐ পথে অগ্রসর হবার সময় আমরা অতর্কিত আক্রমণ করি। সেখানে পাকবাহিনীর সাথে আমাদের চারঘন্টা গুলি বিনিময় হয়। এখানে পাকবাহিনীর ১১ জন নিহত ও ২০ জন আহত হয়। আমাদের পক্ষের ২ জন শহীদ ও একজন আহত হয়। এছাড়া জুন মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত রামগতি, ফুলবাড়ী, চরখাই, রামনগর, জলপাইতলী, বাজাই, আমবাড়ী, গৌরীপুর, মন্মথপুর রেলওয়ে স্টেশনে রেইড, কমান্ডো ও এম্বুশ করে পাকবাহিনীর বহু ক্ষতি সাধন করি।

———————————————————-

<৯, ৯.২, ২৮২-২৮৩>

সশস্ত্র প্রতিরোধ-রংপুর
সাক্ষাৎকার-লেঃ মোঃ আবদুস সালাম
০৭-০৬-১৯৭৩

২৬শে মার্চ সকাল বেলা রেডিওতে ইয়াহিয়া খানের মার্শাল ল’ জারী করার কথা শুনতে পাই। এই সময় হাজার হাজার ক্রুদ্ধ জনতা শ্লোগান দিতে দিতে টোগরাই হাট রেল স্টেশনে আসে এবং ৩ মাইল পর্যন্ত রেল লাইন তুলে ফেলে এবং যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে ফেলে।

২৭শে মার্চ রংপুর থেকে একজন আর্মী ক্যাপ্টেন (নওয়াজেশ) আমাদের এখানে পালিয়ে এসে মহকুমা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোক্তার আহম্মদ হোসেন সরকার সাহেবের বাড়িতে আশ্রয় নেন। ক্যাপ্টেনের কাছে ক্যান্টনমেন্টের ঘটনা বিস্তারিত জানি। ঢাকা থেকে একটা টেলিফোন এসেছিলো। ফোনে ক্যাপ্টেন নওয়াজেশকে মেরে ফেলতে বলা হয়। ঘটনাচক্রে সেই ফোনে ক্যাপ্টেন নওয়াজেশই কথা বলছিলো। তিনি টেলিফোনে উত্তর দিলেন, “এখনই ক্যাপ্টেন নওয়াজেশকে হত্যা করছি।”

ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ বিভিন্ন জায়গা থেকে পলায়নরত বাঙালি পুলিশ, ইপিআর ও বেঙ্গল রেজিমেন্টসহ ছাত্র জনতাকে নিয়ে একটা বাহিনী গঠন করেন এবং ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করেন। ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ সাহেবের সঙ্গে আমি থানাতে গিয়ে ওসিকে কিছু রাইফেল দিতে বলি। কিন্তু ওসি রাইফেল দিতে অসম্মত হলে পরে তাকে রাইফেল দিতে বাধ্য করা হয়। থানা থেকে আমরা ২৫০টি রাইফেল জোগাড় করি।

ক্যাপ্টেন নওয়াজেশের নেতৃত্বে আমরা তিস্তা নদীর পাড়ে ডিফেন্স নেই। নদীর অপর পাড়ে অবস্থানরত খান সেনারা রাত্রে আমাদের উপর শেলিং আরম্ভ করে। বলা প্রয়োজন যে, ঐ দিন সকাল দশটায় যখন আমরা চুপচাপ ডিফেন্স নিয়েছিলাম তখন খান সেনারা আমাদের অবস্থান জানতে না পেরে তিস্তা রেল ব্রিজের উপর দিয়ে কিছু খান সেনা এপারে চলে আসে। সঙ্গে সঙ্গে আমরা তাদের উপর আক্রমণ চালাই। ঘটনাস্থলেই একজন মেজরসহ আট জনকে হত্যা করতে সক্ষম হই। যে মেজরকে হত্যা করি তার নাম এজাজ। পরবর্তীকালে তিস্তা ব্রিজের নাম পাল্টিয়ে খান সেনারা মেজর এজাজের নাম অনুসারে ব্রিজের নাম “এজাজ ব্রিজ” রাখে।

এখানে পাক বাহিনীর শেলিং-এর মুখে টিকতে না পেরে আমরা পিছু হটে কুড়িগ্রামে ডিফেন্স নেই। ৮ই এপ্রিল খান সেনারা কুড়িগ্রাম আক্রমণ করে। কুড়িগ্রামের তিন মাইল দূরে আমরা টকতে না পেরে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ি। ৮ তারিখে খান সেনারা কুড়িগ্রাম দখল করে এবং ব্যাপক গণহত্যা সংঘটিত করে। বাড়ি ঘর আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। তারা পরে সোনালী ব্যাংকও লুট করে। ৯ তারিখে ছাত্র এবং গ্রামবাসী মিলে টোগরাইহাট থেকে তিস্তার প্রায় দশ মাইল রেল লাইন তুলে দেই যাতে খান সেনারা আমাদের এলাকায় তাড়াতাড়ি প্রবেশ করতে না পারে।

টোগরাইহাটের যুদ্ধঃ আমরা পুনরায় প্রায় ১৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা একত্রিত হই এবং ১৫ তারিখে আমরা টোগরাইহাটে ডিফেন্স নেই। খান সেনারা কুড়িগ্রাম থেকে একটা ট্রেন নিয়ে লাইন সারতে সারতে তিস্তার দিকে যাচ্ছিলো। ট্রেনটা যখন টোগরাই হাটের নিকট আসে তখন আমরা খুব দূরে থেকে কয়েক রাউণ্ড গুলি ছুড়ি। এই গুলির আওয়াজে খান সেনার গাড়ি থেকে নেমে পজিশন নেয়। পুনরায় আরো কয়েক রাউণ্ড গুলি ছুড়লে খান সেনারা শব্দের উৎসস্থল লক্ষ্য করে ধাওয়া করে। তারা যখন আমাদের নিকটবর্তী হয় তখন আমরা তাদের উপর আক্রমণ করি। উভয় পক্ষে সমান তালে যুদ্ধ চলতে থাকে। এই যুদ্ধ চৌদ্দ ঘন্টা স্থায়ী হয়। এই যুদ্ধে বহু খান সেনা নিহত হয় বলে আমরা খবর পাই। আর বাদ বাকী সৈন্য পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।

যুদ্ধ শেষে আমরা যখন তিস্তা ব্রিজের দিকে যাচ্ছিলাম তখন রাস্তায় খান সেনাদের তিনটা দালালকে ধরতে সক্ষম হই। এরা ঐ অঞ্চলে লুটতরাজ, ডাকাতি, নারী ধর্ষণ হত্যা ইত্যাদির সঙ্গে জড়িত ছিলো। ঘটনাস্থলেই তাদের পিটিয়ে হত্যা করা হয়।

——————————————–

<৯, ৯.৩ ২৮৩-২৮৭>

সৈয়দপুর-রংপুর প্রতিরোধে ৩য় বেঙ্গল রেজিমেন্ট

সাক্ষাৎকার : সুবেদার মেজর মোহাম্মদ আবদুল খালেক

১১-১০-১৯৭৩

৩য় বেঙ্গল রেজিমেন্টকে বিচ্ছিন্ন করার উদ্দেশ্যে দুটো কোম্পানী লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফজল করিমের নেতৃত্বে (যিনি ৩য় বেঙ্গলের কমান্ডিং অফিসার ছিলেন) বগড়াতে চলে যায়্ দুটো কোম্পানী মেজর নিজামউদ্দীনের নেতৃত্বে ঘোড়াঘাটে (দিনাজপুর) পাঠানো হয় অনির্ধারিত সাঁতার প্রশিক্ষণের জন্য্ দু’জন অফিসার এবং কয়েকজন জেসিও-ও সাথে ছিল। হেডকোয়ার্টার কোম্পানী ইউনিট লাইনকে রক্ষা করার জন্য সৈয়দপুর থেকে যায়।

২১শে ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহের দিনগুলোতে প্রতিবেশী ইউনিট ২৬ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্ট এবং ২৩ ফিল্ড গোলন্দাজ বাহিনীর কোন নির্ধারিত প্রশিক্ষণ সূচী ছিলনা। ২৩ ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্ণেল আরশাদ কোরেশীকে সৈয়দপুরে গ্যারিসন কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়। সুতরাং হেডকোয়ার্টার কোম্পানীর সবাইকে নিজেদের কাজকর্ম ছাড়াও তার নির্দেশমত কাজ করতে হত। ২৬ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স-এর কিছু লোক আমাদের কার্যকলাপ লক্ষ্য করার জন্য অস্ত্রশস্ত্র এবং অয়ারলেস সেটসহ পানির ট্যাঙ্ক পাহারা দেয়ার ভান করে ইউনিটে থাকতে আরম্ভ করে। অপরপক্ষে ২৩ গোলন্দাজ বাহিনী তাদের কিছুসংখ্যক মেশিনগানকে আমাদের ইউনিটের অস্ত্রাগার, খাদ্য গুদাম, গ্যারেজ প্রভৃতি লক্ষ্য করে তাক করে রাখে। এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তারা বলে যে, আমরা এই এলাকা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য এগুলো লাগিয়েছি।

এছাড়াও তারা স্থানীয় জনসাধারণের উপর নানারকম নির্যাতন চালাচ্ছিল। অসহযোগ আন্দোলনের সময় জনসাধারণ সেনানিবাসে সৈনিকদের রসদপত্র সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছিল। তাই পশ্চিম পাকিস্থানী সৈন্যরা গ্রামে গিয়ে জোর করে গ্রামবাসীদের কাছ থেকে হাঁস মুরগী, ডিম, তরকারী নিয়ে আসত। কিন্তু বাঙালি সৈন্যরা গ্রামে গেলে জনগণ তাদেরকে সবকিছু দিয়ে সাহায্য করত।

এই সময় বগুড়ার ছাত্ররা বগুড়াতে যেখানে আমাদের কমান্ডিং অফিসার অবস্থান করছিলেন সেই ভবনের উপর বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে। তারা সিওকে ঘেরাও করে রেখেছিল। কমান্ডিং অফিসার বগুড়া থেকে ঘোড়াঘাটে চলে যান। সেখানে আরো দুটো কোম্পানী ছিল।

১৫ই মার্চ আর্টিলারী রেজিমেন্ট আমাদের ইউনিটের চারিদিকে পরিখা খনন করতে শুরু করে। আমরা ঘোড়াঘাটে আমাদের সিওকে এ খবর জানালাম। কমান্ডিং অফিসার কর্ণেল শফি (২৩ আর্টিলারী রেজিমেন্ট)কে এগুলো বন্ধ করতে অনুরোধ জানালেন। তাঁর অনুরোধে এ সমস্ত কাজ বন্ধ করা হয়েছিল।

মেজর আখতার ওসি হিসেবে রিয়ারে রয়ে গিয়েছিল। সে তার বাসায় টেলিফোন বসিয়েছিল। এমনকি গোপন অয়ারলেসের সাহায্যে ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী ইউনিট-এর খবরাখবর এবং যোগাযোগ রাখত। সে অনেক সময় কমান্ডিং অফিসারের নির্দেশ পালন করত না। আমরা এ সমস্ত খবরাখবর মেজর আখতারের উপস্থিতিতে আমাদের সিওকে জানালাম। এ সমস্ত কার্যকলাপের কথা শোনে সিও আর ঘোড়াঘাটে গেলেন না। তিনি ইউনিটে রয়ে গেলেন। তিনি আমাদেরকে সব সময় সান্ত্বনা দিতে এবং আমাদের উপর কোন হামলা হবে না আশ্বাস দিতেন।

রংপুরের ব্রিগেড কমান্ডার আমাদের সিওকে ঠাকুরগাঁ, বগুড়া, দিনাজপুর এবং পার্বতীপুরে যে সমস্ত সৈন্য আটকা পড়ে আছে তাদেরকে উদ্ধার করার জন্য বলেন।

৩১শে মার্চ বেলা সাড়ে বারটার দিকে রংপুর থেকে ব্রিগেড কমান্ডার সিওকে টেলিফোনে ডাকেন। তিনি ব্রিগেড কমান্ডারের সাথে কথা বলেন এবং দু’টার সময় অফিসে আসেন। সুবেদার মেজর হারিস মিয়াকে তিনি ডেকে পাঠান এবং তাঁরা রূদ্ধদ্বার কক্ষে আলোচনা করেন। বের হয়ে সকলের উদ্দেশ্যে তিনি এক ভাষণ দেন- ‘হাজেরানে অফিসার, সরদার আওর জোয়ানো, আপ সবকে লিয়ে ম্যায় এক খোশখবর লে আয়া হুঁ। ওয়হ ইয়ে হ্যায় কে কোর কমান্ডার, জিওসি আওর ব্রিগেড কমান্ডার কি তরফছে আপ সবকো মোবারকবাদ হায়। ইস লিয়ে কে ইস ওয়াকত তক কিছি পলিটিকাল পার্টিও নে হিসসা নিহি লিয়ে, আওর ম্যায় দাওয়া কে সাথ কাহ সেকতা কে থার্ড ব্যাটালিয়ান হর তরফছে পাকিস্থান সরকারকে ওফাদার রাহেগী। ম্যায় আপসে ওয়াদা করতে হুঁ আপ বরদাস্ত করে আওর মুঝ পর ভরোসা রাক্ষে- উছ ওয়াকত তক আপকো কুয়ি কুছ নেহি বোলেগা যব তক মুঝ পর কুইভি কুছ না বোলে।’ তারপর তিনি এ্যাডজুট্যান্ট লেফটেন্যান্ট সিরাজুল ইসলাম এবং তিনজন এনসিও ও ৩০ জন সিপাই সাথে নিয়ে রংপুর রওনা হয়ে যান এবং সেখান থেকে তিনি বগুড়া যান ২৬ এফএফ এবং ২৩ ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারী সৈন্যদের ফিরিয়ে আনার জন্য যারা বগুড়াতে ইপিআরদের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালিয়েছিল।

সেদিনই বেলা সাড়ে চারটার সময় ২৬ এফএফ এবং ফিল্ড রেজিমেন্ট (আর্টিলারী) ৬৪টা কনভয় নিয়ে ঘোড়াঘাটের দিকে যায়। সেখানে ৩য় বেঙ্গলের দুটো কোম্পানী ছিল। তারা তাদের উপর অতর্কিতে ভীষণভাবে গোলাগুলি ছুড়তে থাকে। অনন্যোপায় হয়ে বেঙ্গল রেজিমেন্টের লোকেরা ছোট অস্ত্র দিয়ে প্রত্যুত্তর দেয়। ঘটনাস্থলে ওদের ১৩ জন নিহত হয়। গ্যারিসন কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্ণেল কোরেশী এবং আরো কয়েকজন সাদা পতাকা উত্তোলন করে বরং অস্ত্র সমর্পণ করে এবং বলে যে তারা মনে করেছিল এখানে ইপিআর-এর লোকজন আছে। তারা মেজর নিজামের সাথে আলাপ করল। মেজর নিজাম তাদেরকে চা পানে আপ্যায়িত করেন। লেফটেন্যান্ট রফিক তাদেরকে এগিয়ে দিয়ে যায়। যখনে লে. রফিক কোরেশীর সাথে করমর্দন করছিল তখন কোরেশী তাকে তাঁর জীপে উঠিয়ে নেয় এবং দ্রুত চলে যায়। সাথে সাথে এলএমজি থেকে কয়েক রাউণ্ড গোলা বর্ষণ করা হয় এবং আমাদের তিনজন খেলোয়ার ঘটনাস্থলে মারা যায়।

আমাদের কমান্ডিং অফিসার যখন রংপুর থেকে ৩০ মাইল দুরে পলাশবাড়ীর নিকটে আসেন তখন তিনি কোরেশীর কনভয়গুলো দেখতে পান। তারা সিও’র জীপ এবং অন্য ‍দুটো ডজ গাড়ী থামায় এবং কমান্ডিং অফিসারসহ সমস্ত বাঙালি সৈনিককে গাড়ী থেকে নামানো হয় এবং নিরস্ত্র করা হয়। বঙ্গশার্দুলদের তিনটা গাড়ী তাদের কনভয়-এর মাঝখানে রেখে তারা রংপুরের দিকে চলে যান। এই সময় লে. রফিক লে. সিরাজুল ইসলামের সাথে আলাপ করতে সমর্থ হয়। রে. রফিক লে. সিরাজুল ইসলামকে কানে কানে ঘোড়াঘাটের ঘটনা বলেন।

কনভয়গুলো রংপুরে ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারে রাত ৮টার সময় পৌছে এবং কর্ণেল কোরেশী ব্রিগেড কমান্ডারের সাথে আলাপ করে। কিছুক্ষণ পর আবার কনভয়গুলো সৈয়দপুরের দিকে রওয়ানা হয়। সৈয়দপুরের দু’মাইল নিকট চেকপোষ্ট তৈরী করা হয়। সেখানে বঙ্গশার্দুলদের (৩৩ জন) ছিল সবাইকে একটা অন্ধকার দালানে তালাবন্ধ করে রাখা হয়। লে. সিরাজুল ইসলাম এবং রফিককে অন্য কোন জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়।

আমাদের কাছে কোন অয়ারলেস সেট না থাকাতে বাইরের কোন খবর পাচ্ছিলাম না। ঢাকা থেকেও কোন খবর পাই নাই। কিন্তু সৈয়দপুরে আমরা মোট ১২০ জন ছিলাম। আমরা সব সময় সতর্ক ছিলাম। আমাদের অনেকেই পরিবার নিয়ে সেখানে ছিল।

২০শে মার্চ থেকে ৩১শে মার্চ পর্যন্ত আমরা কোন চিঠিপত্র পাচ্ছিলাম না। ৩১শে পর্যন্ত প্রচুর চিঠিপত্র আসল। আমি ওগুলো দেখতে পারলাম না, কেননা মেজর আখতার, ক্যাপ্টেন মালিক এবং আরো অনেকে আমার কোয়ার্টারে এসেছিল।

তারা বেলা ১টার সময় আমার বাসা থেকে চলে যায়। তারপর আমি অফিসে গেলাম। মেইল দেখে বাসায় ফিরছিলাম। মেজর আখতারকে আমাদের কমান্ডিং অফিসারের গাড়ীতে করে ঘুরতে দেখলাম।

আমি বাড়ীতে পৌছলাম এবং খেতে বসলাম্ তখনও আমি জীপের আওয়াজ শুনছিলাম। আগে থেকেই মেজর আখতারের কার্যকলাপ সন্দেহজনক ছিল। তাই খাওয়া ছেড়ে আমি বেরিয়ে আসলাম। সুবেদার আলী আহম্মদকে জীপটা সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করলাম। সে বলল যে, মেজর আখতার সুবেদার মেজর হারিস মিয়াকে ২৬ এফএফ-এর কমান্ডিং অফিসারের কাছে নিয়ে গিয়েছে। আমি তাড়াতাড়ি সেখানে গেলাম এবং সুবেদার মেজর এবং ক্যাপ্টেন আনোয়ার হোসেনকে সেখানে দেখলাম। আমাদের কমান্ডিং অফিসার ২২৬ এফএফ রেজিমেন্ট অফিস থেকে ক্যাপ্টেন আনোয়ার ও সুবেদার মেজর হারিস মিয়াকে উপস্থিতির জন্য আদেশ দিয়েছিলেন। সে সংবাদ আমাকেও তারা জানান। ওখানে বসা অবস্থায় আবারও কমান্ডিং অফিসারের টেলিফোন আসে। তিনি ক্যাপ্টেন আনোয়ারকে ২৬ এফএফ-এর অফিসে ‍সুবেদার মেজরসহ যাওয়ার জন্য পীড়াপিড়ি করছিলেন। কিন্তু ক্যাপ্টেন আনোয়ার তাতে সায় দেন নাই। বরং তিনি সিওকে নিজেদের অফিসে আসার জন্য অনুরোদ করছিলেন। কমান্ডিং অফিসারের নির্দেশ অমান্য করার প্রধান কারণ হল মেজর আখতারের সন্দেহজনক কার্যকলাপ – যেহেতু তিনি নিজ অফিস সত্ত্বেও এক মুহুর্তের জন্যও তাঁর জীপ অফিসের সামনে দাঁড় করান নাই। কমান্ডিং অফিসার আবার ক্যাপ্টেন আনোয়ারকে টেলিফোনে বলেন, ‘আনোয়ার, অনুগ্রহ করে তুমি তাড়াতাড়ি চরে আস, ম্যায় তোমহারা ভালাই কা লিয়ে বোলা রাহা হোঁ।’ আমি ক্যাপ্টেন আনোয়ারের টেলিফোন হ্যাণ্ডসেটের সংলগ্ন থাকায় কমান্ডিং অফিসারের কণ্ঠস্বর শুনতে পাই। সে কণ্ঠস্বর কাঁপছিল বরে মনে হচ্ছিল। সুতরাং আমি তাদের যাবার জন্য সায় দিলাম না। তৎক্ষণাৎ সেখানে নায়েক সুবেদার (এডজুটেন্ট) শহীদউল্লা ভুইঞা (শহী) উপস্থিত হন্ আমরা সবাইকে সতর্ক থাকতে উপদেশ দিয়েছিলাম। আনুমানিক ১৫/২০ মিনিটের মধ্যে সমস্ত পরিবারবর্গ আমার বাসায় সমবেত হয়।

ঠিক ১লা এপ্রিল রাত ২টা ৪৫ মিনিটের সময় গোলন্দাজ বাহিনীর শেল বা গোলা আমাদের মোটর ট্রান্সপোর্ট গ্যারেজ ও পেট্রল পাম্পে এসে পড়ে। সেখানে সমস্ত যানবাহন আগুন লেগে ভস্মীভুত হয়্ এত ভীষণভাবে গোলাবর্ষণ হচ্ছিল যার দরুন রাস্তার উপর বৈদ্যুতিক তারসমূহ ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। কয়েকটা দালান, অস্ত্রাগার, খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ গুদাম ধ্বসে পড়ে যায়। তবুও অসমসাহসী ১২০ জন বঙ্গশার্দুল সকাল ৮টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত বীর বিক্রমে তাদের ওপর এই কাপুরুষোচিত আক্রমণকে প্রতিহত করে। জনশক্তি কম থাকায় এবং অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ না থাকায় তারা পশ্চাদপরণ করতে বাধ্য হয়। শত্রুর সংখ্যা ১৬০০ ছিল এবং তারা আধুনিক ভরী এবং স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ছিল।

১লা এপ্রিল ভোর ৫-৩০টা নাগাদ আমি সমস্ত পরিবা-পরিজনকে (তারা প্রায় ৩০০ জন ছিল) নিকটবর্তী গ্রামের দিকে পাঠিয়ে দিতে সক্ষম হই।

এরপর আমি আমার বাসার নিকটবর্তী পরিখায় ১টা স্টেনগান, ১টা এলএমজি এবং কিছু গোলাবারুদসহ অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু সকাল ৮-৩০টার সময় আমার সামনে একটা মর্টারের গোলা এসে পড়ে। সুতরাং আমি পরিখা ত্যাগ করে গ্রামের দিকে অন্যান্য সঙ্গীদের খোঁজে চলে যাই।

আনুমানিক ১২-৩০টার সময় সেনানিবাস থেকে প্রায় ৫/৬ মাইল দুরে ক্যাপ্টেন আনোয়ার সাহেবের সঙ্গে আমার দেখা হয়্ তিনি তখন আমার সুবেদারের পদবী কাঁধ থেকে অপসারিত করেন এবং সান্ত্বনা দেন। আমরা আমাদের সৈন্যসংখ্যা গণনা করে মাত্র ৫০ জন দেখতে পেলাম। তারপর আমরা অন্যান্যদের খোঁজে বেরুলাম। কিছুসংখ্যক গুলিবিদ্ধ সৈন্যকে নিকটবর্তী বদরগঞ্জ বেসামরিক হাসপাতালে পাঠানো হয়। পাঁচজন বঙ্গশার্দুল শহীদ হয়। বাকি সবাইকে দুরদুরান্ত থেকে একত্র করা হয়।

পূর্বে রাত্রে প্রায় ৪-৪৫টার সময় আমি সুবেদার রহমতউল্লার কাছে একটি চিরকুট পার্বতীপুর পাঠাই। সেখানে মেজর শাফায়াত হোসেনের (পশ্চিম পাকিস্থানী) অধীনে প্রায় ৫০ জন বঙ্গশার্দুল ছিলেন। উক্ত চিরকুট তার কাছে বেলা ৮ ঘটিকায় পৌঁছে এবং তার মর্মানুসারে তিনি মেজর শাফায়াতকে হত্যা করে আমাদের সাহায্যের জন্য গ্রামের পথে অগ্রসর হন। সৌভাগ্যবশত: তার সাথে পথিমধ্যে আমাদের দেখা হয়। অনুরূপ সংবাদ ঘোড়াঘাটে মেজর নিজামউদ্দিন আহম্মদের কাছেও পাঠানো হয়। কিন্তু মেজর নিজামউদ্দিন উক্ত সংবাদ পাওয়া সত্ত্বেও কমান্ডিং অফিসারের বিনা অনুমতিতে সেখান থেকে আসতে অস্বীকার করেন।

ঘোড়াঘাটের সংঘর্ষে যে তিনজন বঙ্গশার্দুল শাহাদাৎবরণ করেন তাদের দাফনের জন্য সুবেদার আওয়াল খান (পাঠান)কে দায়িত্ব দেয়া হয়। তার সাথে ১২ জন প্রহরী দেয়া হয়েছিল। সে তখন মৃতদেহ নিয়ে কারমাইকেল কলেজের (রংপুর) সামনে আসে ও রাস্তা অতিক্রম করতে থাকে তখন পথিমধ্যে বাধাপ্রাপ্ত হয়। সে গাড়ী থেকে নামার সাথে সাথে পাকসেনারা গুলি ছুড়তে শুরু করে। গুলিতে ১১ জন বঙ্গশার্দুল নিহত হয়। আওয়াল খান গ্রামের দিকে পালিয়ে যায়। তাকে ছাত্ররা ধরে পিটিয়ে হত্যা করে।

খান সৈন্যদের হত্যাযজ্ঞ: যাদেরকে (৩৩ জন) সৈয়দপুরের দু’মাইল দুরবর্তী অন্ধকার দালানে তালাবদ্ধ অবস্থায় রাখা হয়েছিল তাদের সবাইকে রাত ২টা ৪৫ মিনিটে গুলি করে হত্যা করা হয়। সেখানে আব্দুল কাদের নামক একজন সিপাহী মৃতদেহের স্তুপের মধ্য থেকে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিল। আমাদের ব্যাটালিয়নের প্রায় শতকরা ৭৫ ভাগ সৈন্য বদরগঞ্জের নিকটবর্তী কোলাহাটি নামক জায়গায় একত্র হয়।

আমরা ২/৩রা এপ্রিল পার্বতীপুর আক্রমণ করি এবং পাকবাহিনীকে প্রতিহত করা হয়। কিন্তু পার্বতীপুর শহর দখল করতে ব্যার্থ হই।

১২ এপ্রিল বদরগঞ্জে পাকবাহিনীর সাথে (১৫টি ট্রাক বোঝাই) আমাদের সংঘর্ষ হয়। পাকবাহিনীকে পর্যুদস্ত করা হয়। আমি এবং সুবেদার শহীদুল্লাহ এই যুদ্ধের কমাণ্ড করেছিলাম।

১৩ই এপ্রিল পাকবাহিনী ট্যাংক নিয়ে আমাদের উপর আক্রমণ চালায়। তীব্র আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে আমরা পশ্চাদপরণ করতে বাধ্য হই। বদরগঞ্জ সংঘর্ষ শুরু হওয়ার প্রায় দু’ঘন্টা আগে রংপুর থেকে রংপুরের তৎকালীন এসপি বদরগঞ্জ থানা পরিদর্শনের উদ্দেশ্যে ২৯ ক্যাভলরির একজন মেজরকে পাঠান ড্রাইভারের বেশে বদরগঞ্জে নিয়ে আসে। এসপি’র সাথে কথোপকথনের পর উক্ত ড্রাইভারের পরিচয় জানতে চাওয়ায় তাকে অবসরপ্রাপ্ত পুলিশের ড্রাইভারের পরিচয় দেয়া হয়। কিন্তু উক্ত মেজর (ড্রাইভার) আমার আগের পরিচিত ছিল। আমি তাকে চ্যালেঞ্জ করায় সে স্বীকার করে। পরে তাকে আমাদের ক্যাম্পে পাঠানো হয় ও হত্যা করা হয়। এসপিকেও গ্রেফতার করা হয়েছিল। কিন্তু সে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।

তারপর আমরা ফুলবাড়িতে এসে ক্যাম্প করলাম। কিন্তু মুসলীম লীগাররা আমাদের অবস্থান পাকবাহিনিীর গোচরীভুত করে। সেখানেও তারা ট্যাংক নিয়ে আমাদের উপর আক্রমণ চালায়। তারপর আমরা চরকাই (হিলির সীমান্তের কাছাকাছি)তে স্থানান্তরিত করি এবং আমাদের কন্ট্রোল রুমসহ হেডকোয়ার্টার তৎকালীন পাকিস্থানের হিলিতে স্থাপন করি।

২২শে এপ্রিল ১৯৭১ পাকবাহিনী আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে বর্ডার বেল্টের ভেতরে আমাদের উপর আক্রমণ করে। তখন অনন্যপায় হয়ে আমরা ভারতের হিলিতে আশ্রয় নিই এবং আমাদের যথারীতি কার্যকলাপ চালিয়ে যেতে থাকি।

২৪শে এপ্রিল ১৯৭১ তারা ভারতের হিলির উপরও আক্রমণ করতে দ্বিধাবোধ করে নাই। ঐ দিন অত্যন্ত ঝড়বৃষ্টি ছিল এবং আমাদের সৈন্যরা তাদের সঙ্গে টিকতে না পেরে এদিক সেদিক ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে।

২৫শে এপ্রিল ৩য় বেঙ্গলের শার্দুলগণ পশ্চিম দিনাজপুরের কামাপাড়া স্কুলে ক্যাম্প স্থাপন করেন। এরা ৪র্থ এবং ৫ম সেক্টরে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।

———————————————–

<৯, ৯.৪, ২৮৭-২৮৮>

সশস্ত্র প্রতিরোধে রংপুর

সাক্ষাৎকারঃ হাবিলদার জয়নাল আবেদীন

-১১-১৯৭৪

২৫শে মার্চ আমি ১০ নং শাখার রংপুর ডবল সুতি বিওপি’তে হাবিলদার পদে বহাল ছিলাম। ৭ই মার্চের পর পাঞ্জাবী অফিসাররা ক’দিন পরপর গোপনে মিটিং করত , সেখানে বাঙালিদের ডাকতো না।এইসব দেখে আমাদের ধারণা হয়েছিল একটা কিছু হতে পারে।

১০ নং শাখার কমান্ডার ছিল একজন ইউপি। সহকারী ক্যাপ্টেন ২জন ছিল।

(১)ক্যাপ্টেন ভুট্টো খান ছিল (পাঞ্জাবী) এবং

(২) অপরজন বাঙালি নওয়াজেশউদ্দিনের ৫টি কোম্পানী ছিল এই শাখাতে। একটি সাপোর্ট প্লাটুনও ছিল। কোম্পানীগুলো  ছিলঃ চিলমারী, কমান্ডার ছিল সুবেদার আবদুল মান্নান, অপরটি বাগভান্ডারে  যার কমান্ডার ছিল বিহারী। মোগলহাটে অপর আরেকটি কোম্পানী ছিল যার কমান্ডার ছিল সুবেদার আরব আলী। পাটগ্রামে একটি কোম্পানী ছিল, কমান্ডার ছিল সুবেদার বোরহান উদ্দিন। উইং হেডকয়ারর্টার কোম্পানী কমান্ডার ছিল এতয়ার খান। সাপোর্ট প্লাটুন কমান্ডার ছিল সুবেদার নূর মোহাম্মদ।

২৬শে মার্চ বিকালে ঢাকার পিলখানার হত্যাযজ্ঞের খবর পেলাম। ঠাকুরগাঁওয়ে ৯নং শাখা ছিল। তারা ২৬ শে মার্চ বিদ্রোহ করে। এ খবর আমরা পেলাম।

২৭শে মার্চ সেক্টর কমান্ডার তারিখ রসুল ১০ নং শাখাতে টেলিফোন করেন। সেই টেলিফোন ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ ধরেন। সেক্টর কমান্ডার জিজ্ঞাসা করেন, ‘তুমি কে? নওয়াজেশ বললেন  ‘আমি ভুট্টো – এখনই ক্যাপ্টেন নওয়াজেশকে হত্যা কর’।

ক্যাপ্টেন নয়াজেশ পাকিস্তানীদের মতলব বুঝে জীপ নিয়ে সীমান্তের দিকে চলে যান। নায়েক সুবেদার নূর মহাম্মাদও (সাপোর্ট প্লাটুন কমান্ডার) গাড়ী নিয়ে সীমান্তে যায়। গাড়ীতে বাংলাদশের পতাকা নিয়ে সকল কোম্পানীকে তিস্তা ব্রিজে ক্লোজ হতে বলেন।

মোগলহাট কোম্পানী লালমনিরহাট আসলো। পাটগ্রাম কোম্পানী তিস্তা চলে আসে ।চিলমারী কোম্পানীর কিছু তিস্তার পারে চলে আসে। আমরা তিস্তার পারে ৪০০/৫০০ জনের মত ইপিআর ডিফেন্স নিই ব্রিজ পর্যন্ত। নেতৃত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ। ৩০শে মার্চ থেকে ৪ঠা এপ্রিল পর্যন্ত এখানেই পাকবাহিনীর সাথে প্রায় রোজ যুদ্ধ হয়েছে। পাকবাহিনী ব্রিজ অতিক্রম করে এপারে আসতে পারেনি। ৫ই এপ্রিল পাকবাহিনীর ব্যাপক আক্রমণে আমরা পিছু হটি। আমরা ফুলবাড়ি থানাতে ডিফেন্স নিই ছোট্ট একটি নদীর পারে। তিস্তা থেকে কুড়িগ্রাম রোড আমরা অবরোধ করে থাকি। ১৩ /১৪ এপ্রিল আমরা ৩টি কোম্পানী নিয়ে লালমনিরহাটে আসি পাক ঘাঁটি আক্রমণের জন্য। আমরা ঐ যুদ্ধে টিকতে ব্যর্থ হই। আমাদের ৬/৭ জন শহীদ হন। আমরা আবার ফুলবাড়ী চলে আসি।

এপ্রিলের ২৫ তারিখে ১০নং শাখার সকল ফোর্স পাটেশ্বরীতে নিয়ে আসেন ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ। নাগেশ্বরী থানাতে হেডকোয়ার্টার করা হয়। এখানে আমরা পাক্কা ডিফেন্স করি। আনসার-মুজাহিদসহ ১২০০ জনের মত ফোর্স ছিল। ২৫ এপ্রিল থেকে ২৬শে জুন পর্যন্ত বিভিন্ন সময় পাকবাহিনীর সাথে খণ্ড যুদ্ধ হয়।

২৪শে জুন থেকে পাকবাহিনী ব্যাপকভাবে চারিদিক থেকে শেলিং ও বিমান হামলা করে। ২৬শে জুন আমাদের সকল ডিফেন্স থেকে মুক্তি বাহিনী পিছু হটতে থাকে এবং পাকবাহিনীর ব্যাপক আক্রমণে দিশেহারা হয়ে পড়ে। এখানে কিছু শহীদ হন। এখান থেকে সুবেদার বোরহান উদ্দিনের সাথে আমাদের কোম্পানী সোনারহাট সেক্টরে চলে যায়। সুবেদার আরব আলী এবং অন্যান্যরা ভারতের শ্যামগঞ্জ পৌঁছায়। আমরা সোনারহাটে নদীর পারে ডিফেন্স নিই ৩০শে জুন। আগস্টের ২২ তারিখ পর্যন্ত এখানে আমরা ডিফেন্স করে থাকি। এই সময়ের মধ্যে সোনারহাট ব্রিজে কয়েকদন পর পর পাকবাহিনীর সাথে সংঘর্ষ বাধতো।

—————————————————-

 

<৯, ৯.৫, ২৮৮-২৮৯>

সশস্ত্র প্রতিরোধে রংপুর
সাক্ষাৎকার- মোঃ নুরুজ্জামান
১৫-০৭-১৯৭৮

(স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস প্রকল্প কর্তৃক সংগৃহীত)

২৭শে মার্চ রাত ৮ ঘটিকার দিকে আমরা প্রায় ২০/২৫ বাঙালি ইপিআর সমবেত হয়ে পরামর্শ সভা করি। নায়েক সুবেদার নুর মোহাম্মদ এই পরামর্শ সভায় উপস্থিত ছিলেন। তিনি সবাইকে সাহস দিয়ে বলেন যে, যেহেতু তিনি সবারই সিনিয়র সেহেতু কোনো ক্ষতি হলে আগে তারই হবে। কিন্তু আমি ভিন্নমত পোষণ করি ও জানাই যে, অস্বস্তিকর অবস্থায় আর বসে থাকা সম্ভব নয়। এখন আমরা নিরস্ত্র। যে কোনো সময় আমাদের বিপদ হতে পারে। এখানকার অস্ত্রাগার ভেঙ্গে অস্ত্রসজ্জিত হয়ে আমাদের পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এই পরামর্শ সভায় আমরা সবাই বিপদ বুঝতে পারি কিন্তু তৎক্ষণাৎ কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারি নাই।

আমরা জানতে পেলাম যে, সাবেক বাঙালি ইপিআর ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ সাহেব নিখোজ হয়েছেন। এই সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের পুনরায় পরামর্শ সভা হয়। অস্ত্রসজ্জিত হয়ে পাঞ্জাবী সৈন্যদের আঘাতের স্বপক্ষে আমি উক্ত সভায় সোচ্চার হই। আমাদের পরামর্শ সভা যখন চলছিলো তখন শহরের সেনাবাহিনীর গ্যারিসনের সৈন্যরা উত্তর দিকের একটি পুলের নিকটবর্তী গৃহস্থ বাড়ীতে অগ্নিসংযোগ করছিলো। আমরা আগুন দেখার সাথে সাথে সৈন্যদের মেশিনগানের গুলির শব্দও শুনতে পাই। হঠাৎ দেখতে পাই পাঞ্জাবী সৈন্যদের জীপগুলো আমাদের ব্যারাকের দিকে এগিয়ে আসছে। সবাইকে গ্রামের দিকে ঢুকে পড়তে বলা হয়। আমি নিজেও নূরুল হক নামে একজন অসুস্থ বাঙালি ইপিআর’কে নিয়ে নিকটবর্তী গ্রামে ঢুকে পড়ি। ব্যারাক থেকে উত্তরে প্রায় ৫ মাইল দূরে জনৈক হিন্দু গৃহস্থ বাড়ীতে প্রথমে আশ্রয় নেই।

২৮শে মার্চ ভোরবেলা কালীগঞ্জ থানার এমসিএ করিমউদ্দিন সাহেবের নিকট উপস্থিত হই। তার সাথে পরামর্শ করে প্রায় ৩০ জন ছাত্রকে জোগাড় করা হয়। সীমান্তবর্তী ভারতীয় ফাঁড়ি থেকে কিংবা ভারতের স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করে মাইন ও এক্সপ্লোসিভ আনার জন্য ছাত্রদেরকে পাঠানো হয়। এরপর তাড়াহুড়ো করে স্থানীয় আনসার মুজাহিদ ও ছাত্রদের সমন্বয়ে প্রায় ৩০০ জন মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রহ করে আমরা তাদেরকে প্রশিক্ষণ প্রদানের কাজ শুরু করি। এমসিএ করিমউদ্দিন সাহেব মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার সরবরাহের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। ঐ দিনই রংপুর জেলার ভারত সীমান্তবর্তী পাটগ্রাম, লালমনিরহাটে, হাতিবান্ধা, কালীগঞ্জ থানার সমস্ত ইপিআর ফাঁড়িগুলোতে সংবাদ পাঠানো হয়। এই সংবাদে সাবেক ইপিআর’দেরকে সশস্ত্র অভিযানের জন্য সংগঠিত হয়ে একযোগে রংপুর শহরে অবস্থিত সামরিক গ্যারিসনের দিকে অগ্রসর হবার জন্য আবেদন জানানো হয়েছিলো।

১লা এপ্রিল, সাবেক ইপিআর কোম্পানী প্রধান সুবেদার বোরহান উদ্দীন বাঙালি ইপিআর’দের সংঘবদ্ধ করে পাকিস্তানী সৈন্যদের অগ্রাভিযান প্রতিরোধের জন্য কাকিনা রেলওয়ে স্টেশনের কাছে ডিফেন্স দেন। এদিকে আমি দ্রুত মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি কোম্পানী গড়ে তুলি। এই কোম্পানী দু’টির কমান্ডার ছিলেন যথাক্রমে মুজাহিদ তমিজ উদ্দিন এবং আনসার কমান্ডার রিয়াজ উদ্দিন। মুজাহিদ ক্যাপ্টেন তমিজ উদ্দিন পরে পাকিস্তানী সৈন্যদের সাথে সংঘর্ষে নিহত হন। মুজাহিদ ক্যাপ্টেন তমিজ উদ্দিন তার কোম্পানীসহ সুবেদার বোরহানের দল অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিলো। কমান্ডার রিয়াজউদ্দিনকে তার কোম্পানীসহ গঙ্গাচড়া ও কালীগঞ্জ থানার তিস্তা নদীর তিনটি ঘাঁটি পাহারায় নিয়োজিত করা হয়েছিল।

৮ই এপ্রিল রাত একটার দিকে সুবেদার বোরহানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি কোম্পানী লালমনির থানা হেডকোয়ার্টারে অবস্থানরত পাকিস্তানী সৈন্যদের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। আক্রমণের পরপরই সুবেদার বোরহান তার কোম্পানীকে সরিয়ে কুড়িগ্রাম মহকুমা শহরের দিকে নিয়ে যান।

৯ই এপ্রিল পাকিস্তানী সৈন্যরা কালী বাজারের কাছাকাছি এসে পড়লে আমরা সবাই সরে পড়ি। ১৪ই এপ্রিল ফুলবাড়ী থানায় উপস্থিত হই। এই ফুলবাড়ী থানাতেই সাবেক ইপিআর ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ সাহেবের সাথে আমার দেখা হয়। ক্যাপ্টেন নওয়াজেশের সাথে ঐ সময় দ্বিতীয় কোনো অফিসার ছিলো না। তিনি আমাকে ভারত সীমান্তবর্তী থানা ভূরুঙ্গামারীতে নিয়ে যান। আমি নওয়াজেশ সাহেবের সহকারী হিসেবে কার্যভার গ্রহণ করি। প্রকৃতপক্ষে ভূরুঙ্গামারী থানা হেডকোয়ার্টার ঐ সময় মুক্তিযোদ্ধাদের একটি পুরো সেক্টরে পরিণত হয়েছিলো। রংপুর জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে সাবেক ইপিআর মুজাহিদ আনসার এবং স্কুল কলেজের ছাত্রবৃন্দ দলে দলে ভূরুঙ্গামারী থানায় আসতে থাকে। আমরা তাদেরকে নিয়ে ছয়টি কোম্পানী গঠন করি। প্রাথমিক প্রশিক্ষণ ভূরুঙ্গামারী থানা সদরেই দেয়া শুরু হয়। সুবেদার বোরহান পাঁচগাছি থেকে কাউয়াহাগা পর্যন্ত ধরলা নদীর বিস্তৃত নদী তীর এলাকাজুড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের তিনটি কোম্পানী মোতায়ন করেন। অপরদিকে সাবেক ইপিআর সুবেদার আরব আলী কাউয়াহাগা থেকে গোরল মঞ্জিল পর্যন্ত অঞ্চল জুড়ে দুটি কোম্পানী মোতায়ন করেন।

কুড়িগ্রাম মহকুমা শহরে পাকিস্তানী সৈন্যরা অবস্থান গ্রহণ করার পর ভূরুঙ্গামারী থানার ট্রেনিংপ্রাপ্ত গেরিলা যোদ্ধাদের পাঠানো হয়। তারা অধিকৃত কুড়িগ্রাম ও পার্শ্ববর্তী উলিপুরে সাফল্যের সাথে গেরিলা আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে বেশ কিছু সংখ্যক পাকিস্তানী সৈন্য হতাহত হয়।

নবগঠিত বাংলাদেশ বাহিনীর সি-ইন-সি কর্নেল ওসমানী ২৪শে মে ভূরুঙ্গামারী থানা হেডকোয়ার্টার পরিদর্শনে আসেন। পাকিস্তানী সৈন্যদের সাথে প্রতিরোধ যুদ্ধের জন্য এবং কুড়িগ্রাম শহরের সাথেই প্রবাহিত ধরলা নদীর উত্তর তীরস্থ আমাদের প্রতিরোধ ঘাঁটি মজবুত করার জন্য ভারী অস্ত্র প্রদানের আহবান জানাই। এর ফলে আমরা ভারত থেকে দুটি এসএমজি ও দুটি ৮১এম-এম মর্টার পাই। এই অস্ত্র দুটি ধরলা নদীর উত্তর তীরস্থ পাটেশ্বরী ডিফেন্স ও কাউয়াহাগা ডিফেন্সে ব্যবহার করা হয়। হানাদার বাহিনী প্রতিরোধে এই অস্ত্র খুবই ফলপ্রসূ হয়েছিলো। কিন্তু হঠাৎ করে ভারতীয় সামরিক কর্তৃপক্ষ প্রদত্ত উক্ত এসএমজি দুটো ফেরত প্রদানের নির্দেশ দেয়। ফলে এসএমজি দুটো তাড়াহুড়ো করে ফেরত দেওয়া হয়।

এদিকে ২৬শে মে পাকিস্তানী সৈন্যরা ভারী কামানের সাহায্যে পাটেশ্বরী প্রতিরোধ ঘাঁটিতে তীব্র আক্রমণ চালায়। পাকিস্তানী সৈন্যরা ধরলা তিস্তা নদীর তীর থেকে শেল বর্ষণ শুরু করে। মুক্তিযোদ্ধারা ভারী অস্ত্রের অভাবে বাংকার থেকে উঠে ভূরুঙ্গামারীর দিকে ফিরে আসতে থাকে। মূলতঃ ঐদিনই পাটেশ্বরী প্রতিরোধ ঘাঁটি ভেঙ্গে যায়।

——————————————-

সশস্ত্র প্রতিরোধঃ ঠাকুরগাঁ-দিনাজপুর

 

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১০। দিনাজপুর-ঠাকুরগাঁ অঞ্চলে সংঘটিত সশস্ত্র প্রতিরোধ বাংলা একাডেমীর দলিলপত্র ১৯৭১

 

<৯, ১০, ২৯০-২৯৯>

সশস্ত্র প্রতিরোধে ঠাকুরগাঁ-দিনাজপুর

সাক্ষাৎকারঃ সুবেদার মেজর কাজিম উদ্দিন

১২-৬-১৯৭৪

       ২৫ শে মার্চের বিকালে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা, পিলখানা হইতে প্রেরিত বেতার সংকেত কিছুই আমাদের কানে পৌঁছে নাই। হঠাৎ মাঝরাতে কি এক জরুরী ডাকে আমাদের নবম শাখার ছোট কর্তা ক্যাপ্টেন নাবিদ আলম এক প্লাটুন লোক নিয়ে দিনাজপুর গেলেন। সেক্টর কমান্ডার লেঃ কর্নেল তারেক রসুল কোরেশীর সঙ্গে কি যেন আলোচনা হইল। ভোর রাত্রে সদলবলে তিনি ফিরিয়া আসিলেন। ২৬শে মার্চের ভোর। আসিয়াই ক্যাপ্টেন ঠাকুরগাঁ হেডকোয়ার্টারে উপস্থিত তামাম জুনিয়র কমান্ডারগনকে অফিসে ডাকিয়া পাঠাইলেন। জরুরী সভা করিয়া সরকারের আদেশ সবাইকে জানাইয়া দিয়া হাজির রিজার্ভ কোম্পানীসহ বাকী সবাইকে অতি অল্প সময়ের মধ্যে পূর্ণ সামরিক সাজে সজ্জিত হইতে আদেশ দিলেন। উপস্থিত সকলেই “বহুত আচ্ছা সব” বলিয়া যে যার কাজে লাগিয়া পড়িল।

   এদিকে উইং অধিনায়ক মেজর মোহাম্মদ হুসেন সীমান্ত পরিদর্শনে পঞ্চগড়ের দিকে বাহিরে ছিলেন। তাহাকে বিশেষ করিয়া ডাকিয়া পাঠান হইল। সকলেই রণ সাজে সজ্জিত হইয়া গভীর আগ্রহে বসিয়া আছে। ঠাকুরগাঁ টাউন ততক্ষণে ফাটিয়া পড়িয়াছে, জনতার বান ডাকিয়াছে, রাস্তাঘাটে ব্যারিকেড তৈরী করা হইতেছে ইট পাথর ও অন্যান্য জিনিস দিয়া শত শত গাছ কাটিয়া। উইং হেডকোয়ার্টারে আত্মরক্ষামূলক সামরিক ব্যূহ রচনা করিয়া পাহারার বন্দোবস্ত করা হইল। এমন সময় প্রায় ৯ টার দিকে মেজর আসিলেন, আবার জরুরী সভা বসিল। খামাখাই ছুতানাতায় নেহাৎ ভাল মানুষ বলিয়া সুপরিচিত মেজর বিষম রাগত হইয়া উঠিলেন সবার প্রতি, আর রিজার্ভ কোম্পানীর অধিনায়ক সুবেদার হাফিজকে তো একেবারে হাজতে দিবেন বলিয়া শাসাইলেন। তাহার অপরাধ কোম্পানী রণপ্রস্তুতি নিতে একটু দেরী করিয়া ফেলিয়াছে। মওকা বুঝিয়া ক্যাপ্টেনও এক ধাপ আগ বাড়িলেন-বলিলেন, “ও দিন ভূল যাও – আওয়ামী লীগ-মীগ নেহী চলে গা।” তাহাদের মনের খবর পাওয়া গেল। আমরা চুপচাপ শুধু নীরব শ্রোতা। দীর্ঘশ্বাসটি পর্যন্ত না ফেলিয়া কাজ করিয়া যাইতে লাগিল আমাদের লোক। তবে বাঙালি সৈনিকের অবস্থাতা বেশ আঁচ করিতে পারিল। ডাক-তাড় না থাকিলেও বাতাস যেন কানে কানে চুপে চুপে সব খবর দিয়া যাইতে লাগিল। এমনিভাবে সমূদয় বাঙালি সৈনিকের মন পুরাদস্তুর বারুদের ঘর হইয়া উঠিল। অপেক্ষা একটু মাত্র ইঙ্গিতের কিন্তু আমি লোকদিগকে সান্ত্বনা দিতে লাগিলাম।

       এদিকে কালবিলম্ব না করিয়াই বড় কর্তার আদেশে টাউনে পেট্রল পাঠানো হইল, আর কারফিউ জারী থাকিল দিন-রাত। কিন্তু হাজার হাজার বিক্ষুদ্ধ জনতা সকল আদেশ অমান্য করিয়া শোভাযাত্রা বাহির করে এবং নানা জায়গায় ব্যারিকেড স্থাপন করিয়া চলিল। মেজর ও ক্যাপ্টেন আমাকে সঙ্গে নিয়া শহরে গেলেন এবং পরিস্থিতি আয়ত্তে আনিবার চেষ্টা নেন। সেইদিন বেলা দশ ঘটিকার সময় মিছিলের উপর গুলি চালানো হয়। ফলে রিকশাওয়ালা মোহাম্মদ আলী ঘটনাস্থলেই নিহত হয়। আমাদের লোক আরও খাপ্পা হইল; আমি তাহাদিগকে সান্ত্বনা দিয়া আমার কয়েকজন সহকর্মী সহ পরিস্থিতি সম্পর্কে পরামর্শ করিলাম এবং সকল আলোচনা গোপন রাখা হইল।

       আবার সেই দিনই (২৬শে মার্চ) দিবাগত রাত্রে বাঙালি ক্যাপ্টেন নজির আহমেদ সুবেদার আতাউল হকসহ ৩০ জনের একটি প্লাটুন সেক্টর সদর দিনাজপুর হইতে আমাদের সাহায্যার্থে ঠাকুরগাঁ আসিয়া হাজির হইলেন। এই দলে পশ্চিমারা ছিল প্রায় ডজন খানেক। আমাদের হেডকোয়ার্টার সংরক্ষণ ও টাউন পেট্রল ডিউটি সমানে চলিতে লাগিল। প্রায় এক কোম্পানী লোক ইহাতে নিয়োজিত রহিল। ২৭তারিখ আবার ঠাকুরগাঁ টাউন রক্তে রঞ্জিত হইল আমাদের নির্মম গুলির আঘাতে। এই একটি নিষ্পাপ শিশু নিহত হইল। আমাদের ডিউটি চলিতে লাগিল। ইতিমধ্যে জনসাধারণের মনোবল ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে, তাহারা ততক্ষণে টাউন ছাড়িয়া পালাইতে শুরু করিয়াছে।

       আমি সেই দিনই সুবেদার হাফিজ, সুবেদার আতাউল হক, নায়েক সুবেদার মতিউর রহমান, হাবিলদার আবু তালেব ও নায়েক আব্দুল হাকিমকে নিয়া এক গোপন আলোচনা সভায় বসিয়া সিদ্ধান্ত নিলাম পরদিন ভোর ৬টায় পশ্চিমাদের উপর আমাদের তরফ হইতে আক্রমণ চালানো হইবে। কিন্তু হায়, পরিকল্পনা অনুসারে সুবেদার হাফিজ যখন পশ্চিমানিধনে উদ্যত হইলেন তখন জনৈক বাঙালি হাবিলদারের অসহযোগিতার দরুন তাহা বাধাপ্রাপ্ত হইয়া সেই দিনকার মহত আক্রমণ স্থগিত রহিল। আমরা বিশেষ চিন্তিত হইলাম, কারণ, একেত শুরুতেই বাধা আসিল, দ্বিতীয়তঃ যদি আমাদের উদ্দেশ্য ফাঁস হইয়া যায় তবে আর রক্ষা থাকিবে না।

       খোদার উপর ভরসা করিয়া সেই দিন চুপ থাকিলাম। কিন্তু সহকর্মীদেরকে নির্দেশ দিলাম সকলেই যেন জরুরী নির্দেশের অপেক্ষায় সব সময় সজাগ থাকে। এই সময় স্থানীয় আওয়ামী লীগ আমাদের কর্মসূচী জানিবার জন্য বার বার আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে, কিন্তু তাহাদেরকে বলি সুযোগ আসিলেই তাহা করা হইবে এবং আপনারা সজাগ থাকিয়া আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখিবেন।

       ২৮শে মার্চ ভোরেও বিশেষ কারনে পরিকল্পনামাফিক আমাদের পশ্চিমাদের উপর আক্রমণ চালানো সম্ভব হইল না। মনটা একেবারে বিগড়াইয়া গেল। খোদা না করুন আমাদের পরিকল্পনা ফাঁস হইয়া গেলে এর পরিণাম কি হইবে! আবার ঐদিকে আমাদের পাঞ্জাবী মেজর ও ক্যাপ্টেনসহ পশ্চিমাদের তৎপরতা বেশ বাড়িয়া উঠিল। আমরা সরকারী কার্যের মধ্য দিয়া খুব সতর্ক থাকিলাম। সেই দিন রিজার্ভ কোম্পানী কমান্ডার সুবেদার হাফিজ সেইদিনকার মত টাউন ডিউটি শেষ করিয়া ভারাক্রান্ত হৃদয়ে নিজ বিছানায় শুইয়া নানা চিন্তায় মগ্ন। প্রোগ্রাম মাফিক তার পরবর্তী ডিউটি ছিল পরদিন অর্থাৎ ২৯শে মার্চ সকাল পৌনে সাতটায়, কিন্তু সেই দিন হঠাৎ করিয়া বিকাল পৌনে চারটায় তাহাকে জরুরী পেট্রলে পাঠানো হয় ঠাকুরগাঁও- দিনাজপুর হাইরোড পর্যবেক্ষন ও পরিষ্কার করার উদ্দেশ্যে। মেজর হুসেন নিজে তাহাকে পেট্রল সম্বন্ধে বিস্তারিত বুঝাইয়া দিয়াছিলেন। সুবেদার হাফিজ প্রভুর ইশারায় বলিতে গেলে আদেশ বহির্ভুত কাজ করিয়া অনেক দূর পথ অগ্রসর হইলেন। ফলে পথিমধ্যে দিনাজপুর হইতে পলায়নপর বাঙালি ইপিআর জোয়ানদের নিকট জানিতে পারেন সেই দিন দুপুরেই দিনাজপুর সেক্টর হেডকোয়ার্টার কুটিবাড়ীতে বাঙালি ইপিআর লোকদের সঙ্গে আর্মি ও ইপিআরের পশ্চিমাদের তুমুল সংঘর্ষ শুরু হইয়া গিয়াছে। এক নিমেষে মনে মনে তিনি নিজ কর্তব্য স্থির করিয়া তাড়াতাড়ি উইং সদরে ফিরিয়া আসেন। তখন সন্ধ্যা সমাগত প্রায়। আসিয়াই তিনি মাগরিবের নামাজের জন্য আমাকে মসজিদে উপস্থিত পান এবং উপরোক্ত বিষয় অবহিত করেন। অপরদিকে কিছুক্ষনের মধ্যেই বিশ্বস্তসূত্রে জানিতে পারিলাম রাত্রি পৌনে ১১ টায় উইং- এর শেষ পেট্রল লাইনে ফিরে আসার পরপরই বাংগালীদের উপর হামলা শুরু করার নির্দেশ এবং আমাকে গ্রেফতার করার আদেশ সৈয়দপুর আর্মি হেডকোয়ার্টার দিয়া দিয়াছে।  অতএব আমার বাসায় সুবেদার হাফিজ, ৮উইং- এর সুবেদার আতাউল হক, নায়েক সুবেদার মতিউর রহমান ও আরও জন তিনেক জোয়ান একত্রিত হইয়া মিনিট কয়েকের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিলাম বিপ্লব ঘটাইবার এবং সেই রাতেই। এমন সময় উইং কমান্ডার হইতে আদেশ আসিল সব হাতিয়ার ম্যাগাজিনে জমা দিতে হইবে। মুহুর্তে খানদের চক্রান্ত সম্বন্ধে আমার দ্বিধা দূর হইল। আমি আরও শক্ত হইয়া বাঙালি সহকর্মীদিগকে অস্ত্র জমা না দিবার নির্দেশ দিলাম। পরম পরিতোষের বিষয় সকলেই একবাক্যে আমার আদেশ মান্য করিল এবং হাতিয়ার জমা দেওয়া হইল না একটিও। বিপ্লব করিতেই হইবে, অথচ এদিকে অসুবিধা ছিল ঢের। গোটা এক প্লাটুন টাউনে গিয়াছে পেট্রলে, বাকী সব লোক উইং সদরের চতুর্দিকস্থ পরিখা-বিবর ঘাঁটিতে ডিউটিরত। লাইনে হাজির লোক খুব কম, আবার ওদের সঙ্গে উঠাবসা-শোয়ার ব্যবস্থা। তথাপি কমান্ডারগণ নির্দেশ মাফিক আপন-আপন গ্রুপের লোকজনদের গোপনে ইশারায় সব বলিয়া দিলেন। অতি সতর্কতার সহিত প্রস্তুতি চলিল। প্রচুর উৎসাহ- উদ্দীপনা থাকা সত্ত্বেও অনেককেই এই সময় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া পড়িতে দেখা গেল। তবে মঙ্গলময়ের আশীর্বাদপুষ্ট হইয়া সুবেদার হাফিজ খুবই সক্রিয় ছিলেন। তিনি উইং- এর পুরা রক্ষাবূহ্য ঘুরিয়া প্রতিটি মরিচায় যাইয়া প্রতিটি বাঙালির কাছে পৌঁছাইয়া দিলেন অপারেশনের নির্দেশ এবং বাহিরে পেট্রল পার্টির সাথে যোগাযোগ রাখা হইল। খোদাকে ধন্যবাদ কেহ সেই দিন না বলে নাই, যদিও মনে মনে ঘাবড়াইয়া গিয়াছিল অনেকেই।

       রাত ১০টা ১৮ মিনিট। চারিদিকে অন্ধকার, থমথমে ভাব। সুবেদার হাফিজের হস্তস্থিত ছোট্র স্টেনগানটা হঠাৎ গর্জিয়া উঠিল। মেজর আর ক্যাপ্টেনের দেহরক্ষীদলের অধিনায়ক হাবিলদার মোহাম্মদ জামান বুকে গুলিবিদ্ধ হইয়া পরকালের যাত্রী হইল তাহারই গার্ড-রুমের বিছানায়। ইশারা বুঝিয়া পর মুহুর্তে আরও অনেক ক্ষুধার্ত হাতিয়ার গর্জিয়া উঠিল একসঙ্গে। বেশ কজন পশ্চিমা পরপারের যাত্রী হইল। আমাদের লোক ‘জয় বাংলা’ ধবনি দিয়া বিজয় বার্তা ঘোষনা করিল। থামিয়া সারা রাত ধরিয়া ফায়ার চলিল, যদিও আমার মতে আদৌ এর দরকার ছিল না। ঐদিকে গোলাগুলির ফাঁকে এক সময় বর্ডার কোম্পানীগুলিকে নির্দেশ দেওয়া হইল সব পশ্চিমা খতম করতঃ সামান্যসংখ্যক লোক পিছনে রাখিয়া অধিকাংশকে ঠাকুরগাঁ পাঠাইয়া দিতে। রাতের অন্ধকারে তেতলা দালান, বাসাবাড়ী ইত্যাদী বিভিন্ন স্থানে চতুর্দিকে লোক ছড়াইয়া ছিল, তাই একেবারে পশ্চিমা নিধন পর্ব শেষ হইল না। অধিকন্তু নানা সুযোগে নানা জায়গায় কিছুসংখ্যক পশ্চিমা হাতে অস্ত্র তুলিয়া নেয়। তাই আরও কিছুটা সময় লাগিল আমাদের। এই এলোপাতাড়ি পাতলা ফায়ারের ভিতর দিয়া আমাদের বাঙালি পরিবারগুলিকে শহরে স্থানান্তরিত করিয়া দিলাম। শহরবাসীরা প্রথমে গোলাগুলির শব্দে ভীতসন্ত্রস্ত হইয়া পড়িলেও অনতিবিলম্বে আমাদের বিজয় সংবাদ শ্রবণে হাজার হাজার মুক্তিপাগল মানুষ সমবেত কন্ঠে ‘জয় বাংলা’ ধবনিসহ বিভিন্ন শ্লোগানে আকাশ-বাতাস মুখরিত করিয়া তুলিল এবং তাহারা বিভিন্ন প্রকারে আমাদের সাহায্য করিতে লাগিল। সেই দিন ভোররাত্রে বাঙালি ক্যাপ্টেন নজীর আহমদ অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়া ক্যাপ্টেন নাবিদ আলম ও তাহার স্ত্রীকে নিয়া ছদ্মবেশে পলায়ন করিতে থাকেন সম্ভবতঃ সৈয়দপুর যাওয়ার উদ্দেশ্যে। কিন্তু পদব্রজে সামান্য কিছুদুর যাওয়ার পরই ক্ষীপ্ত জনসাধারণের হাতে মারা পড়েন। ওদিকে সেইদিন ভোররাত্রেই ৮-উইং হইতে আসা সুবেদার আতাউল হক শহীদ হন। এই বিপ্লবে তাহার ভূমিকা অতি প্রশংসনীয়। তাহাঁরই যোগসূত্র ক্রমে সেই রাত্রেই হাজার হাজার লোক টাউনে বাহির হইয়া পড়ে এবং তাহারা আমাদের সহযোগিতা পাইয়া আবার শতগুণ উৎসাহে মাতিয়া উঠে এবং আমাদের সাহায্যার্থে আগাইয়া আসে।

       ২৯শে মার্চ সকাল বেলা সামান্য গোলাগুলি চলিতে লাগিল। অবশিষ্ট খানরা দালানকোঠায় থাকিয়া ফায়ার করাতে তাহাদিগকে কাবু করা গেল না। আমরা ছাত্র, জনসাধারণ ও স্থানীয় বিভিন্ন বিভাগের নিন্মপদস্থ কর্মচারী বিশেষ করিয়া ওয়াপদা বিভাগের লোকদের সহায়তায় ছাউনি হইতে আমাদের প্রয়োজনীয় সব হাতিয়ার, গোলাগুলি ও অন্যান্য বহু জিনিসপত্র অন্যত্র সরাইয়া নিলাম।

       ২৯শে পার হইয়া ৩০শে মার্চের সকাল। আমি সুবেদার মতিউর রহমানকে এক প্লাটুন লোকসহ ঠাকুরগাঁ হেডকোয়ার্টারকে শ্ত্রুমুক্ত করার নির্দেশ দিলাম। তিনি সঙ্গে সঙ্গে তাহাঁর দলবল নিয়া অগ্রসর হইলেন কিন্তু অনেক্ষন চেষ্টার পর খানদের ব্যূহ ভেদ করিতে না পারিয়া ফেরত চলিয়া আসিলেন। তখন সুবেদার হাফিজ তাহাঁর কোম্পানীর কিঞ্চিদধিক এক প্লাটুন লোক নিয়া ঝাঁপাইয়া পড়েন এবং বিকাল প্রায় তিনটা নাগাদ তেতলা দালানের শেষ দুশমনটি পর্যন্ত খতম করিয়া তাহা পরিষ্কার করেন। তাহাঁরই আদেশে প্লাটুন কমান্ডার বজল আহমদ চৌধুরী একদল লোক নিয়া উইং অধিনায়কের বাসভবন মুক্ত করেন। মেজর হোসেন এই সময়ই নিজ বাসভবনে নিহত হন। একই সময় যুগপৎ আক্রমণ করিয়া নায়েক সুবেদার মতিউর রহমান পাক আর্মির গেরিলা সুবেদার ও তাহাঁর সঙ্গীদের খতম করিয়া জেসিও মেস পরিষ্কার করেন। পাবলিকের সহায়তায় অল্প সময়ের মধ্যে সমস্ত মৃতদেহ অন্যত্র সরাইয়া দাফন করিয়া ফেলা হয়। আর এদিকে দ্রুতগতিতে লাইনের ভিতরকার সবকিছু যথাসম্ভব গোছগাছ করিয়া নিয়া হেডকোয়ার্টারের চতুর্দিকে দৃঢ় প্রতিরক্ষাব্যূহ রচনা করা হইল। সুবেদার হাফিজের নেতৃত্বে তাহাঁর নিজস্ব ডি কোম্পানী ব্যতিত আরও কিছু আনসার-মুজাহিদ এই প্রতিরক্ষা ঘাঁটিতে মোতায়েন রহিল।

       ওদিকে স্থানীয় এম-সি-এ জনাব ফজলুল করিমের নেতৃত্বে ঠাকুরগাঁ শহরে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করা হইল। আমাদের দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ স্বেচ্ছায়ই তাহারা গ্রহণ করিলেন। তাহাদের কর্তব্য ছিল শহরের শান্তি-শৃংখলা ও নিরাপত্তা বজায় রাখা এবং প্রয়োজনমত যুদ্ধরত লোকদের নানা কাজে সাহায্য করা। ছাত্র-জনতা আমাদের পাশে থাকিয়া যে সাহায্য করিয়াছে তাহা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। স্থানীয় নারী সমাজ পর্যন্ত এই সংগ্রামে প্রচুর সাহায্য ও সমর্থন দিয়াছে। ঐ দিন (৩০শে মার্চ) সন্ধ্যা পর্যন্ত সীমান্তস্থ কোম্পানীসমূহের লোকজন ঠাকুরগাঁয় আসিয়া সমবেত হয়। আমাদের জোয়ানরা ও স্থানীয় জনসধারণ আমাকে মেজর পদে বরিত করিয়া যুদ্ধের পূর্ণ দায়িত্ব আমার উপর অর্পণ করিলেন। বৃদ্ধ বয়সে ঘোর দুর্যোগের সময় এত বড় দায়িত্ব আমাকে বহন করিতে হইল। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালার নাম স্মরণ করিয়া জনসাধারণের শুভাশীষ নিয়া আমি আমার ব্যাটালিয়নকে পুনর্গঠন করিয়া আগামী দিনের জন্য সকলকে তৈয়ার করিতে লাগিলাম এবং সামান্য ভাষনের মাধ্যমে আমরা সমবেতভাবে শপথ নিলাম।

       এই দিন বিকালেই সুবেদার আব্দুল খালেকের নেতৃত্বে আমাদের দুই কোম্পানী এবং এক কোম্পানী মুজাহিদকে সাধ্যানুযায়ী সুসজ্জিত করিয়া ঠাকুরগাঁর ২৩ মাইল আগে ভাতগাঁও পুল প্রতিরক্ষার্থে পাঠানো হয়। নায়েক সুবেদার বদিউজ্জামানের অধীনে আমাদের সি কোম্পানীকে এক কোম্পানী মুজাহিদসহ দেবীগঞ্জে পাঠানো হইল। হাবিলদার নুর মোহাম্মদের অধীনে এক প্লাটুন মুজাহিদ শিবগঞ্জ বিমান বন্দর প্রতিরক্ষার জন্য পাঠানো গেল। বাকী সদর কার্যালয়ের সঙ্গে এক কোম্পানী অতিরিক্ত হিসাবে রাখা হইল। সে রাতেই আনসার- মুজাহিদ ভাইয়েরাও অধিক মাত্রায় আসিয়া একত্রিত হইতে লাগিল। সহকারী আনসার এ্যাডজুটেন্ট (মহকুমা) জনাব কবির তাহাদিগকে পুনর্গঠন করিয়া আমার পাশে থাকিয়া অনেক সাহায্য করিতে লাগিলেন। আমরা সীমান্ত এলাকাকে দুইটি সাব সেক্টরে ভাগ করিয়া সুবেদার আবুল হাশেম ও নায়েক সুবেদার হাজী মুরাদ আলীকে যথাক্রমে পঞ্চগড় সাব সেক্টর ও রুহিয়া সাব সেক্টরের দায়িত্বভার অর্পণ করি এবং নিন্মোক্ত বিষয়গুলি তাহাদের দায়িত্বের অন্তর্গত করিয়া দিইঃ

(১) সীমান্ত রক্ষণাবেক্ষণ করা আঞ্চলিক আনসার-মুজাহিদদের সহযোগিতায়;

(২) এলাকায় জনসাধারণের এবং সরকারী বেসরকারি সম্পত্তির নিরাপত্তা বিদান করা;

(৩) আনসার মুজাহিদদের পুনর্গঠন, স্বেচ্ছা সেবক বাহিনী এবং ছাত্রদের সামরিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা;

(৪) বন্ধুরাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা এবং প্রয়োজনীয় বিষয়াদি সদর কার্যালয়ে অবহিত করা।

(৫) বন্ধুরাষ্ট্রের যে কোন সাহায্যের জিনিসপত্র সমিতির মাধ্যমে সুষ্ঠভাবে বন্টনের তদারক করা;

(৬) রণাঙ্গনের খবর কতিপয় নির্দিষ্ট লোককে জ্ঞাত করানো।

এমনিভাবে সবরকম আদেশ উপদেশ দিয়া তাহাদেরকে নিজ নিজ জিম্মাদারী এলাকায় মোতায়েন করা হইল।

       ইতিমধ্যে হেডকোয়ার্টার এবং বর্ডারের বিভিন্ন স্থানে সংগঠিত বিপ্লব অপারেশনের বিস্তারিত খবর আমাদের নিকট আসিয়া পৌঁছিল। হিসাবে দেখা গেল, এই অপারেশনে  বর্ডারে আমাদের একজন মাত্র লোক আহত হইয়াছে। সে হাবিলদার আব্দুল আজিজ। হেডকোয়ার্টারে চারজন ঘোরতর জখম ও দুই জন শহীদ।

জখমীঃ

(১) হাবিলদার দীন মোহাম্মদ

(২) সিপাহী ওলিউল্লাহ ভূঁইয়া

(৩) সিপাহী আবু তাহের

(৪) একজন মুজাহিদ কমান্ডার

এবং শহীদ হনঃ

(১) সুবেদার আতাউল হক

(২) ল্যান্স নায়েক জয়নাল আবেদীন।

এই সামান্য ক্ষতির বিনিময়ে আমরা এক মেজর ও এক ক্যাপ্টেনসহ প্রায় ১১৫ জন খান সেনাকে খতম করি- যাহাদের অধিকাংশই ছিল কমিশনড, জুনিয়র কমিশিনড ও নন কমিশনড অফিসার এবং বয়সে প্রবীণ, অভিজ্ঞতায় পরিপক্ক ও সামরিক প্রশিক্ষনে নিপুণ আর সর্বোপরি এই এলাকার রাস্তাঘাট ও অবস্থান এবং আমাদের বৈশিষ্ট্য সমন্ধে ছিল বিশেষ ওয়াকিবহাল। তাই সার্বিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ইহা আমাদের পক্ষে ছিল বিরাট সাফাল্য। পশ্চিমা হতাহতদের মধ্যে ছিল ইপিয়ার-এর ১০৪, আর্মির ৮ এবং বিমান বাহিনীর ৩ জন।

       ৩০শে মার্চ হইতে সকল গ্রামেগঞ্জে, স্কুল কলেজে যুবকদের সামরিক শিক্ষা চলিতে লাগিল। আমার ব্যাটালিয়ন ছাড়া একদিনের মধ্যেই এক ব্যাটালিয়ন আনসার ও এক ব্যাটালিয়ন মুজাহিদ পুনর্গঠিত হইল। এক ব্রিগেডের মত শক্তি নিয়া (অবশ্যই শুধু সংখ্যানুপাতিক) আমরা বিখ্যাত সৈয়দপুর শত্রু ছাউনি আক্রমণ করিবার পরিকল্পনা গ্রহণ করিলাম। এই দিকে দিনাজপুর হইতেও সাহায্য পাইবার আশ্বাস পাইলাম। পরিকল্পনা অনুসারে ইপিআর, আনসার ও মুজাহিদদের মিলিত বাহিনীকে প্রয়োজনভিত্তিক প্লাটুন ও কোম্পানী পর্যায়ে বিভিন্ন স্থানে মোতায়েন করা হইল। বিশেষ করিয়া সৈয়দপুর-ঠাকুরগাঁর মধ্যে যোগাযোগকারী বিভিন্ন রাস্তার উপর অবস্থিত গুরুত্ব পূর্ণ স্থানসমূহে। এইভাবে ক্রমে ক্রমে ডাইনে বীরগঞ্জ, শালবাগান, ভাতগাঁ এবং বাঁয়ে খানসামা, দেবীগঞ্জ, জয়গঞ্জ, ঝারবাড়ী প্রভৃতি স্থানে অনেকগুলি রক্ষাব্যূহ তৈয়ার করিয়া আরও অগ্রসর হইবার প্রয়াস পাইলাম। অবশ্য স্থানগুলি ছিল একে অন্য হইতে বহু দূরে এবং যোগাযোগের দিক দিয়া একেবারেই বিচ্ছিন্ন। না ছিল কোন পজিশন অন্য পজিশনের বদলী বা অবস্থান- প্রস্থানের কিছুই জানিত না। অথচ আধূনিক সমরে এ রীতি সম্পূর্ণ অচল। খাদ্য এবং অন্যান্য সামরিক সরবরাহের ব্যাপারও ছিল সম্পূর্ণভাবে জনসাধারণের উপর নির্ভরশীল। কাজেই অনাহার- অর্ধাহার ছিল নিত্যসঙ্গী।

       ইতিমধ্যে সৈয়দপুরে ৩নং বেঙ্গল রেজিমেন্টের লোকদের সঙ্গে যোগাযোগ করিলাম, তবে মাত্র তাহাদের সি কোম্পানীর লোকজন সেখানে ছিল। তাঁহারাও ততক্ষণে খানদের দ্বারা একবার আক্রান্ত হইয়া বিধ্বস্ত অবস্থায় সেখান হইতে বাহির হইয়া আসিয়াছে। তাহাদের কোম্পানীর লোকজন পুরা ছিল না এবং তাহার নেতৃত্ব দিতেছিলেন ক্যাপ্টেন আশরাফ। যাহাই হউক, তাহাদের সহযোগিতায় সৈয়দপুরের দিকে অগ্রাভিযানের প্রস্তুতি চলিতে লাগিল। পিছনের দিকে পূর্বে কথিত হাবিলদার নূর মোহাম্মদের নেতৃত্বাধীন প্লাটুনদ্বয় ঠাকুরগাঁ বিমানবন্দরের হেফাজত করিতে লাগিল এবং তথাকার ম্যানেজার আতাউর রহমান ও স্থানীয় জনগণের সহায়তায় বিমানবন্দরকে নানা উপায়ে শ্ত্রুর ব্যবহারের অনুপযুক্ত করিয়া ফেলা হইল।

       ৩১শে মার্চ। বন্ধুরাষ্ট্রের ৭৫ নং বিএসএফ ব্যাটালিয়নের কমান্ডার কর্নেল ব্যানার্জী সাহেবের সঙ্গে যোগাযোগ করিলাম। তিনি সব রকম সাহায্য দানের প্রতিশ্রুতি দিলেন। পহেলা এপ্রিল রাত্রে কর্নেল ব্যানার্জী সাহেবকে আমাদের অগ্রবর্তী ঘাঁটিগুলি পরিদর্শন করাইলাম, তিনি আমাদের কাজের বিশেষ প্রশংসা করতঃ তাঁহার নিজের কিছু পরিকল্পনা ব্যক্ত করিলেন। আমরা তাঁহার উপদেশ মত নিজ বাহিনীকে সৈয়দপুরের আরও কাছাকাছি নিয়া যাইবার পরিকল্পনা নিলাম। ২রা এপ্রিল হঠাৎ আমরা পুরানো কমান্ডিং অফিসার পাক আর্মির অবসরপ্রাপ্ত মেজর এম, টি হুসেন আমার সহিত দেখা করিয়া আলাপচারী হইলেন। তাঁহার প্রাথমিক আলাপের অবিকল উদ্ধৃতি নিন্মে দেওয়া হইলঃ “সুবেদার মেজর সাহেব, আপনি আপনার লোকজন সহ দেশের মুক্তি আন্দোলনে ঝাঁপ দিয়াছেন তাহা সত্যি অদ্ভুত। আপনি আমাকে আপনার সঙ্গে কাজ করিবার সুযোগ দিবেন কি।” আমি আনন্দের সঙ্গে তাহাকে গ্রহণ করিলাম ও আমাদের কমান্ডিং হিসাবে নিযুক্ত করিলাম।

       এক্ষণে আমরা আরও নতুন উদ্যম নিয়া কাজ করিতে লাগিলাম। পরদিন ৩রা এপ্রিল আমরা দিনাজপুর গেলাম এবং সেখানকার সরকারী ও বেসরকারী নেতা ও কর্মচারীবৃন্দকে নিয়া একটি সভা করিয়া আগামী দিনের পরিকল্পনা নিয়া আলোচনা করিলাম। পরিকল্পনা মাফিক ঐদিন ৩রা এপ্রিল ঠাকুরগাঁর রক্ষাব্যূহ উঠাইয়া ফেলা হয় আর সুবেদার হাফিজকে তাহার ডি কোম্পানীসহ সবার আগে দশ মাইল তে-রাস্তার মোড়ের প্রায় দেড় মাইল পূর্বে দিনাজপুর-সৈয়দপুর প্রধান সড়কের উপর করা হইল। সেখানে গিয়া তাঁহারা ক্যাপ্টেন আশরাফের ৩ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সি কোম্পানীর সহিত মিলিত হন। তাহারা মিলিতভাবে সৈয়দপুরগামী সড়কে অক্ষরেখা ধরিয়া সৈয়দপুরের দিকে অগ্রসর হইতে থাকে। ৪ঠা এপ্রিল তাহারা ভূষির বন্দরে প্রতিরক্ষা ঘাঁটি নির্মাণ করে। আবার ঐ দিন দিনাজপুর ও ঠাকুরগাঁ ইপিআর, আর্মি, আনসার ও মুজাহিদ বাহিনী নিয়া একটা যৌথ কমাণ্ড গঠিত হইল। আর ভাতগাঁও পুলের নিকট একটি জরুরী সভা ডাকিয়া তাহাতে যৌথ কমান্ডের অধীনে সৈয়দপুর আক্রমণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হইল।

       ৫ই এপ্রিল ৮ উইং দিনাজপুরের সুবেদার আবদুল মজিদের নেতৃত্বে এক কোম্পানী ইপিআর ৯ উইং-এর একটি ইপিআর প্লাটুনসহ সৈয়দপুর- নীলফামারী সদর রাস্তায় সৈয়দপুরের অদূরে দরোয়ানির নিকট প্রতিরক্ষা ঘাঁটি নির্মাণ করে। উক্ত তারিখে ভূষির বন্দরে আমাদের সঙ্গে শত্রুদের সংঘর্ষ হয় এবং তাহারা পালাইয়া যায়। সেইদিনই আমাদের বাহিনী একনাগাড়ে প্রায় ১০ মাইল আগাইয়া চম্পাতলী নামক স্থানে গিয়া পৌঁছে। তখন রাত্রি ১১টা। একেত অপরিচিত স্থান, তদুপরি গাঢ় অন্ধকার ও মুষলধারে বৃষ্টি। যাহা হউক ভোর পর্যন্ত প্রতিরক্ষার অনেকটা ব্যবস্থা হইয়া গেল। কিন্তু ৬ই এপ্রিলের সূর্য উঠিতে না উঠিতেই দুশমনরা গোলন্দাজ বাহিনীর সাহায্যে আমাদের উপর তীব্র আক্রমণ চালায়। তারপর ‘ইয়া আলী’ হুঙ্কার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ইপিআর ও রেজিমেন্টের জোয়ানরা মিলিতভাবে পাল্টা ‘ইয়া আলী’ বলিয়া সিংহনাদে দুশমনের উপর ঝাঁপাইয়া পড়ে। বঙ্গশার্দুলের থাবায় নয়জন খানসেনা প্রান হারায়, বাকী ক্ষত- বিক্ষত অবস্থায় প্রাণ নিয়া পালাইয়া যায়। খানিক পরে ক্যাপ্টেন আশরাফ পরামর্শ সভা ডাকিলেন, জানা গেল তার কাছে গোলাবারুদ একেবারেই কম, কোনমতে সেদিনকার মত চলিতে পারে। তিনি সেইদিনই সন্ধ্যা পর্যন্ত পশ্চাদপসরণ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু ততক্ষণ আর অপেক্ষা করিতে হইল না। হঠাৎ করে শুরু হইল শত্রুর গোলন্দাজ বাহিনীর অজস্র শেলিং, পিছনে আসিল কয়েকটি ট্যাঙ্ক, সঙ্গে ৮১ মিলিমিটার মর্টার। অনেক্ষন সংঘর্ষ চলিল। উভয় পক্ষেই হতাহত হইল এবং ছত্রভঙ্গ হইয়া অনেক লোক দলত্যাগী হইবার সুযোগ পাইল। আমরা ভূষির বন্দর প্রতিরক্ষা ঘাঁটিতে পজিশন নিলাম। পরদিন সেখানে তুমুল যুদ্ধ হইল। আমাদের নিকট ভারী এবং প্রতিরোধক অস্ত্র না থাকায় আবার পশ্চাতে আসিতে বাধ্য হইলাম।

       এই সময় সুবেদার হাফিজ কোম্পানীর অধিকাংশ দেবীগঞ্জ হইয়া খানসামায় প্রতিরক্ষাব্যুহ রচনা করে। ওদিকে নীলফামারী রাস্তায় মজিদ কোম্পানীর সঙ্গে ৭ এবং ৮ এপ্রিল দুশমনদের তুমুল সংঘর্ষ হয়। সেখানে আমাদের তিনজন শহীদ কয়েকজন আহত ও বহু হাতিয়ারপত্র খোয়া গেলেও দুশমনরাও বিশ-পঁচিশ জন হতাহত নিয়া অনেক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এইখানেও ট্যাঙ্ক এবং গোলন্দাজ হামলার মোকাবিলা করিতে না পারিয়া ক্যাপ্টেন আশরাফ, সুবেদার মেজর আব্দুর রব, ক্যাপ্টেন নজরুল হক এবং আমার উপস্থিতিতে ৪ঠা এপ্রিল ভাতগাঁয়ে অনুষ্ঠিত কনফারেন্সের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা আমাদের কাজ চালাইয়া যাইতে লাগিলাম এবং পিছনে হাটিয়া দশ মাইল স্ট্যান্ডে শক্ত ঘাঁটি গাড়িলাম।

       ১০ই এপ্রিল সকাল ৯ ঘটিকায় শত্রুরা ট্যাঙ্ক ও গোলন্দাজ বহর নিয়া আমাদের উপর ভীষন আক্রমণ চালাইল। প্রথম বার আমরা তাহাদের আক্রমণ প্রতিহত করিলাম। দ্বিতীয় বার বেলা ২ ঘটিকার সময় আক্রমণ চালায়। শত্রু পক্ষের গোলার আঘাতে আমাদের দুইটি ছয় পাউন্ডার গান-ই নষ্ট হইয়া যায়। তুমুল যুদ্ধের পর এখানে আমাদের চারজন লোক শহীদ হয় এবং কিছু লোক আহত হয়। ফলে আমাদের লোক দুই ভাগে বিভক্ত হইয়া দিনাজপুরের লোক দিনাজপুরের দিকে ঘাঁটি পরিবর্তন করে ও ঠাকুরগাঁয়ের লোক ভাতগাঁও পুলের নিকট দৃঢ় অবস্থান নেয়। দশ মাইল স্ট্যান্ডের যুদ্ধে আমাদের ভীষন ক্ষতি হইল, কেননা বাহির হইতে অনেক গোলাবারুদ আমরা এখানে আনিয়া জমা করিয়াছিলাম এবং আমাদের কাছে থাকা কয়েক শত রাইফেল বন্দুকও সেখানে রাখা ছিল। সকলেরই ধারনা ছিল আমাদের এই স্থান ছাড়িতে হইবে না কিন্তু ট্যাঙ্ক বহরের আক্রমণের চাপে ঐ স্থানও ছাড়িতে হইল। লোকের মনোবল যথেষ্ট ছিল কিন্তু ভারী অস্ত্র না থাকায় আবার সরিয়া আসিতে হইল।

       আমরা আবার ভাতগাঁয়ের পুলের নিকট শক্তিশালী ঘাঁটি স্থাপন করিলাম। মেজর এম,টি, হোসেনসহ কর্নেল কোন কাজে আসিল না। আমি ব্যানার্জী সাহেবকে বলিয়াছিলাম যে, ভাতগাঁয়ের পতন হইলে আমাদের লোকজনের মনোবল নষ্ট হইবে এবং ঠাকুরগাঁ শহরকে রক্ষা করা সম্ভব হইবে না । তাই যেভাবেই হউক ভাতগাঁওকে রক্ষা করিতে হইবে। আমরা দুইজনে ভারী অস্ত্র সংগ্রহ করিবার অনেক চেষ্টা নিলাম কিন্তু কিছুই হইল না। বিহারের মুখ্যমন্ত্রী কর্পূরী ঠাকুর আমাদিগকে যে কোন সাহায্য দিতে আশ্বাস দিয়াছিলেন। কিন্তু তাহা পাইতে অনেক দেরী হইয়া গেল।

       ১৩ই এপ্রিল ভাতগাঁয়ে সম্মুখ সমরে না আসিয়া খান সেনারা রাস্তা ধরিয়া পিছন দিক হইতে আক্রমণ করিবার পরিকল্পনা নিল। শত্রুদের পরিকল্পনা আমরা অনেকটা বুঝিতে পারিলাম। খানসামায় তখন আমাদের কোন লোক ছিল না। তাই আমরা তাড়াহুড়ো করিয়া গোপনে সুবেদার হাফিজের নেতৃত্বে এক কোম্পানি সেখানে পাঠাইলাম। ১৩ তারিখ সন্ধ্যায় তাহার কোম্পানী বীরগঞ্জ হইতে পদব্রজে অগ্রসর হইয়া খানসামায় পৌঁছে। শত্রু সেনার দুইটি কোম্পানী যখন নদী পার হইতেছিল তখন তাহারা সুযোগ বুঝিয়া তাহাদের উপর অতর্কিতে আক্রমণ চালাইয়া তাহাদের ৮ বেলুচ ডি কোম্পানীকে সম্পূর্ণ রুপে পর্যদুস্ত করিয়া দেয়। প্রচুর হতাহত করা ছাড়াও তাহারা দুশমনের নিকট হইতে ১০ গাড়ী মালামাল হস্তগত করে যাহার মধ্যে অনেক গোলাবারুদ, ৭৫টি বিছানা, প্রচুর রেশন, পাকের সরঞ্জাম, একটি অয়ারলেস সেট, একটি মোটর সাইকেল ও আরও বিবিধ দ্রব্যাদি ছিল। সুবেদার হাফিজের বলিষ্ঠ নেতৃত্বই ছিল এই কোম্পানীর সাফল্যের কারণ। শত্রুর এই আক্রমণ প্রতিহত করিয়া পাল্টা তাঁহাদের যে ক্ষতি সাধন করা হইয়াছিল তাহাতে শত্রুর মনোবল যথেষ্ট ক্ষুন্ন হইয়া যায়, ফলে তিনদিন পর্যন্ত শত্রুদের তরফ হইতে আর কোন সাড়াশব্দ ছিল না এবং পশ্চাৎ আক্রমণ হইতেও আমাদের ঘাঁটি মুক্ত রহিল।

       ১৭ই এপ্রিল আমি বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের তিন সদস্যের একটি দলকে নিয়া ভোর পাঁচটায় রয়ানা হই সীমান্তের দিকে তাহাদিগকে গন্তব্য স্থানে পৌঁছাইয়া দিতে। মেজর এম,টি, হোসেন সাহেব থাকিলেন রণাঙ্গনের দায়িত্ব নিয়া। আমি প্রায় দুপুর তিনটায় রুহিয়া পৌঁছি এবং ঠাকুগাঁও কমাণ্ড পোস্টের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করিবার চেষ্টা করি কিন্তু কোন সাড়া না পাইয়া আমার মনে সন্দেহ জাগে এবং আমি তাড়াতাড়ি পঞ্চগড় হেডকোয়ার্টারে চলিয়া আসি। এখানে আমাদের অল্পসংখ্যক লোককে দেখিতে পাইয়া জিজ্ঞেসাবাদে জানিতে পারি ভাতগাঁও ঘাঁটিতে প্রচণ্ড সংঘর্ষের ফলে আমাদের লোকজন ছত্রভঙ্গ হইয়া পড়িয়াছে। মেজর এমটি হোসেনের কোন খবর নাই, তবে শুনিলাম, তিনি একটি বড় বাস ও একটি জীপ নিয়া অর্ধ লক্ষ টাকাসহ ভারতে চলিয়া গিয়াছেন হাতিয়ার ও গোলাবারুদ আনার জন্য। কিন্তু এখানে উল্লেখ্য যে, দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত তিনি আর দেশে ফিরিয়া আসেন নাই। যাহাই হউক ভাতগাঁও ঘাঁটির নেতৃত্ব ছিল নায়েক সুবেদার আব্দুল খালেকের উপর। তাহার নিকট সমস্ত ঘটনা জানতে পারিলাম। তিনি জানাইলেন শত্রুরা সকাল আটটার সময় প্রচণ্ড বেগে আক্রমণ চালায় ট্যাঙ্ক সাঁজোয়া ও গোলন্দাজ বাহিনীর সাহায্যে। তাহারা প্রথমে কান্ত মন্দিরের পাশ দিয়া ঢুকিয়া সোজা বীরগঞ্জ দখল করিতে চেষ্টা করে কিন্তু আমাদের জোয়ানদের প্রবল প্রতিরোধের মুখে তাহা ভন্ডুল হইয়া যায়। এরপর শত্রুরা শক্তি বৃদ্ধি করতঃ দ্বিতীয় দফা আক্রমণ করে। আমাদের বাহিনীও অসীম সাহসিকতার সঙ্গে বাধা দেয় এবং প্রায় ৫ ঘণ্টা ধরিয়া তুমুল সংঘর্ষের পর আমাদের লোকজন ছত্রভঙ্গ হইয়া অনেকে দলত্যাগী হইয়া ভারতের দিকে চলিয়া যায় এবং অনেকে পচাঁগড় হইয়া জমায়েত হইতে থাকে। এখানে আমাদের ৩ জন শহীদ হন। তাহারা বীরবিক্রমে লড়াই করিয়া শত্রুপক্ষের অন্ততঃ ২৫/৩০ জনকে আহত করেন। সিপাহী আব্দুল মান্নান, সিপাহী গুল মোহাম্মদ ভূঁইয়া ও হাফিজ আবদুর রহমান এই যুদ্ধে অসীম সাহসীকতার পরিচয় দিয়েছেন। আহতদের মধ্যে সিপাহী আবদুল মান্নান আহত অবস্থায় শত্রুর হস্তে বন্দী হয়- বর্বর পশুরা তাহাকে গুলি করিয়া মৃত মনে করিয়া পুকুরে ফেলিয়া দেয়। স্থানীয় জনসাধারণের সহযোগিতায় এবং তাহাদের প্রাণভরা সেবা ও দয়াময়ের কৃপায় সে সুস্থ হইয়া উঠে ও অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি তেতুঁলিয়াতে আমাদের সাথে যোগদান করে। বাকী দুইজন শাহাদাৎ বরণ করিয়া অমর হইয়া আছেন।

       অন্যদিকে খানসামাতে ১৩/১৪ তারিখের সংঘর্ষে হাফিজ কোম্পানী পাক আর্মিকে তিনদিন পর্যন্ত জব্দ করিয়া রাখিলেও আমাদের ভাগ্যলক্ষী প্রসন্ন ছিল না। একেত খানরা মার খাইয়া ততক্ষনে ভারী মর্টার ও গোলন্দাজ বাহিনী নিয়া আসিল, তদুপরি সেইদিন একই সময়ে খবর পাওয়া গেল ভাতগাঁয়ের প্রধান প্রতিরক্ষা ঘাঁটি ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে। তাই ডি কোম্পানীও খানসামা ছাড়িয়া চলিয়া আসিল। তবে এই কোম্পানী ঐ স্থানে মোতায়েন থাকায় ভাতগাঁও শত্রুর পাশ অথবা পশ্চাৎ আক্রমণ হইতে নিশ্চিতভাবে রক্ষা পাইয়াছিল।

       এই কোম্পানীর পশ্চাদপসরণের সঙ্গে সঙ্গে জয়গঞ্জ, ঝারবাড়ী, দেবীগঞ্জ প্রভৃতি স্থানের ছোট ছোট রক্ষাব্যূহগুলিরও পিছু হটিতে বাধ্য হইল। এইভাবে শ্ত্রুসেনার অগ্রাভিযান আর আমাদের পশ্চাদপসরণের পালা চলিতে থাকিল। তবে সান্তনা এই হতাহতের দিক দিয়া শত্রু সংখ্যা বরাবরই ভারী ছিল। আমরা দিনবদিন হাতিয়ার আর গোলাবারুদ হারাইয়া দুর্বল হইতে থাকিলাম- স্বাধীন এলাকার পরিধিও কমিয়া আসিতে লাগিল, জনসাধারণের মনোবল ভাঙ্গিয়া পড়িল- খাদ্য সরবরাহও আমাদের প্রায় বন্ধ হইয়া আসিল। আমরা প্রমাদ গুনিলাম এবং আরও পিছে হটিয়া আসিলাম।

       প্রায় ২০/২১ দিন মুক্ত থাকার পর ঠাকুরগাঁয়ের পতন হইল। স্থানীয় জনসাধারণ শহর ছাড়িয়া গ্রামে ও ভারতে আশ্রয় নিতে লাগিল। সামরিক নিয়মে সামরিক বাহিনী কোন স্থান ছাড়িয়া দেয় আবার কোন স্থান দখল করে এবং তাহা পরিকল্পনা মাফিক হইয়া থাকে। আমাদেরও তেমন পরিকল্পনা ছিল কিন্তু আমার অনুপস্থিতিতে সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হইতে পারে নাই। যাহা হউক, যতদুর সম্ভব গোলাবারুদ, রেশনপত্র সঙ্গে নিয়া গিয়াছি কিন্তু আরও সরকারী বেসরকারী জিনিস নেওয়ার ব্যবস্থা করা উচিৎ ছিল। মেজর এম,টি হোসেনের অনুপস্থিতিতে আবার আমাকেই দায়িত্বভার নিতে হইল। আমি সুবেদার হাশেম, নায়েক সুবেদার মতিউর রহমানকে আরও ২২ জন লোকসহ মেশিনগান ও অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র দিয়া ঠাকুরগাঁ পাঠাইলাম ব্যাঙ্কের টাকা পয়সা ও মূল্যবান গহনাপত্র যাহা পাওয়া যায় তাহা নিয়া আসার জন্য। তাহারা ঠাকুরগাঁ আসিয়া স্টেট ব্যাঙ্কের সীলমোহর যুক্ত একত্রিশ বাক্স টাকা লইয়া পঁচাগড়ে ফিরিয়া আসিয়া একটি গাড়ীতে বোঝাই অবস্থায় আমার কাছে অর্পণ করে। আমি ১২ জন লোকের একটি গার্ড দিয়া রেশনের গাড়ীতে ঐ গাড়ীটিও রাখিয়া দিই। কিছু দিন পরে এই টাকা ক্যাপ্টেন নজরুল, জনাব সিরাজুল ইসলাম এমসিএ, জনাব আবদুর রউফ এমসিএ-দের উপস্থিতিতে কর্ণেল ব্যানার্জীর হেফাজতে রাখি এবং পরে অর্থমন্ত্রী জনাব মনসুর আলী সাহেব স্বয়ং আসিয়া ঐ টাকা মুজিবনগরে নিয়া যান। আমিও তাঁহার সঙ্গে যাই টাকা জমা দিতে। সেখানে প্রায় ১ কোটির মত টাকা ছিল যাহার হিসাব অর্থমন্ত্রীর কাছে দেওয়া হয়।

       ১৭ই এপ্রিল নাগাদ আমাদের কোম্পানীগুলি বিভিন্ন প্রতিরক্ষা ঘাঁটি হইতে পঞ্চগড়ে আসিয়া পৌঁছিল। তাহারা পরস্পরের সহযোগিতায় সেখানে প্রতিরক্ষা ঘাঁটি নির্মাণ করিতে শুরু করিল। ১৭ এবং ১৮ তারিখ বিভিন্ন কোম্পানীর বেশ কিছু লোক যাহারা নানাস্থানে নানাভাবে বিচ্ছিন্ন হইয়াছিল অথবা আটকা পড়িয়াছিল পঞ্চগড় আসিয়া উপস্থিত হইল। আমাদের লোক নতুন উৎসাহ নিয়া কাঞ্চন নদীর তীরে দৃঢ় প্রতিরক্ষা ঘাঁটি নির্মাণে তৎপর হইল। ১৮ তারিখ ছোট ছোট কয়েকটি দল আগে পাঠাইলাম, অনেক দূর আগাইয়াও শত্রুর কোন আনাগোনা দেখা গেল না। আমাদের প্রায় ১০৬ টি পরিবার ছেলেমেয়ে সহ ছিল। এই সুযোগে তাহাদিগকে সরাইয়া নিরাপদ স্থানে নিবার ব্যবস্থা করিলাম। চিকিৎসাধীন কিছু রোগী এবং আহতকেও হাসপাতালে স্থানান্থরিত করা হইল। এই সময় আমাদের কাছে কোন ডাক্তার ছিল না। একমাত্র কম্পাউন্ডার মনসুরই ছিল আমাদের প্রধান অবলম্বন এবং তাহার সঙ্গে কয়েকজন নার্স ছিল। কম্পাউন্ডার মনসুর বিপদের সময় যে কাজ করিয়াছেন, যেভাবে রোগীদের সেবা যত্ন নিয়াছেন তাহা সত্যিই প্রশংসনীয়।

       পরের দিন ২৯ শে এপ্রিল দুপুর। আমার সহকর্মী কমান্ডারদের নিয়া নতুন পরিকল্পনা সম্বন্ধে আলোচনার্থে সবেমাত্র ডাকবাংলায় বসিয়াছি এমন হঠাৎ কয়েকটি গোলার শব্দ শোনা গেল। আমার আলোচনা স্থগিত করতঃ বাহির হইয়া পড়িলাম। অবস্থা আঁচ করিতে না করিতেই আরও কয়েকটা শেল আমাদের ডাইনে- বাঁয়ে- পিছনে আসিয়া পড়িল, বুঝিতে বাকী রহিল না দুশমনের প্রত্যক্ষ আক্রমণ অত্যাসন্ন। কমান্ডাররা যে যার স্থানে চলিয়া গেলেন। ইতিমধ্যে দুশমনের একটি গোলা আমাদের একটি গাড়ীর উপর আঘাত করিল এবং তাহাতে আগুন ধরিয়া গেল। গাড়ীটিতে খানসামায় দুশমনদের নিকট হইতে আটককৃত গোলাবারুদ রক্ষিত ছিল, উহার পার্শ্বেই আমার জীপগাড়ীটিও ছিল, কোনমতে তাহা সরাইয়া নিতে সক্ষম হইলাম। আমরা শত্রুর আক্রমণের জবাব দিতে লাগিলাম। চার ঘণ্টা ধরিয়া চলিল, সুবেদার আবুল হাশেমসহ কয়েকজন আহত হন। ইহাদেরকে পরে হাসপাতালে পাঠানো হয়। অবশেষে ট্যাঙ্ক সহ শত্রু বাহিনী আমাদের উপর ঝাঁপাইয়া পড়ে এবং আমরা পশ্চাদপসরণ করিতে বাধ্য হই। এইবার আরও হাতিয়ার গেল। গোলাবারুদ গেল, বাহিনীর বহু লোক পালাইয়া গেল। নায়েক সুবেদার খালেক ও সুবেদার হাফেজ সাহসে ভর করিয়া ঐ দিন সন্ধ্যায়ই কিছু লোকজনসহ ভজনপুর গিয়া পৌঁছিলেন। এপ্রিলের ২০ তারিখের ভোর হইতে না হইতে তাহারা ভজনপুর ঘাঁটি নির্মাণের কাজ শুরু করিয়া দিলেন। আমি তাহাদেরকে যথারীতি উপদেশ দিয়া নানা জরুরী কাজে ও বিচ্ছিন্ন লোকদেরকে জড় করার উদ্দেশ্যে পিছনে গেলাম। এই দিকে দুশমনরাও অতি তাড়াতাড়ি জগদল এবং ওমরখানায় তাহাদের শক্ত ঘাঁটি গাড়িয়া বসিল। ওমরখানা পর্যন্তই শেষ ঘাঁটি ছিল। দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত এই অবস্থা বিদ্যমান ছিল।

       তারপর ঐ মাসের অর্থাৎ এপ্রিল মাসের এক শুভক্ষণে জানিতে পারিলাম যে স্বাধীন বাংলার সরকার গঠিত হইয়াছে। এমতাবস্থায় মে মাসের ৮ তারিখ আমাদের মুক্তিবাহিনী প্রধান তদানীন্তন কর্ণেল এম এ জি ওসমানী আমাদেরকে ভারতের কদম তলায় ডাকিয়া পাঠান। সেখানে এক জরুরী সভা হইল। তাহাতে যোগ দিলেন ক্যাপ্টেন নজরুল হক, ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ এবং কয়েকজন ভারতীয় অফিসার। মুক্তিবাহিনী প্রধান বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ  হইতে যুদ্ধের পরিকল্পনা ব্যাখ্যা করিলেন। এরপর তিনি তার পরিকল্পনা অনুসারে আমাদিগকে নির্দেশ দান করিলেন। আমরাও আমাদের অভাব অভিযোগ জ্ঞাপন করিলাম, তিনি যথাসাধ্য পূরণ করার আশ্বাস দিলেন। উক্ত সভায় তিনি ক্যাপ্টেন নজরুল হক সাহেবকে আমার ব্যাটালিয়নের দায়িত্বভার অর্পণ করিলেন। তারপর ঐ দিনই সন্ধ্যায় তিনি আমাদের ভজনপুর ঘাঁটিতে আগমণ করিলেন। তাহার দর্শন লাভে উৎসাহ ও উদ্দীপনায় আমরা আরো সতেজ হইলাম, তার উপদেশের মাধ্যমে পথের দিশা পাইলাম। অধিকন্তু তিনি ক্যাপ্টেন নজরুল সাহেবকে আমাদের অধিনায়ক রুপে নিয়োগ করায় আমরা আরো উৎসাহিত হইলাম। এর কিছুদিন পর প্রধান সেনাপতি আবার ভজনপুর আসেলেন, সঙ্গে বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ। ইহাতে জোয়ানরা খুব খুশী হইল, তাহাদের মনোবল দৃঢ়তর হইল। ততক্ষনে ভারত হইতে অপ্রচুর হইলেও বিভিন্ন রকম সাহায্য আসিতে আরম্ভ করিয়াছে। অতএব মুক্তি সংগ্রামীদের মনোবল উর্ধ্বমূখী হইয়া উঠিল।

       ৯ই মে ক্যাপ্টেন নজরুল আমার ব্যাটালিয়নের দায়িত্বভার গ্রহণ করিলেন এবং আমি তাহার সহকারী হিসাবে কাজ করিতে লাগিলাম। এ সময় দুশমনরা ওমরখানার জগদল এলাকায় দৃঢ় প্রতিরক্ষা ঘাঁটি নির্মাণ করিয়া ফেলিয়াছে। তাই আমরা আমাদের মূল ঘাঁটি ভজনপুরের ৩/৪ মাইল আগে মাগুরমারী ও ময়নাগুড়ি নামক স্থানে দুইটি পোষ্ট খুলিয়া দুইটি ক্ষুদ্র সৈন্যদল পাঠানোর ব্যবস্থা করিলাম। ২৬শে এপ্রিল হাবিলদার দেওয়ানের নেতৃত্বে ১০ জনের একটি ছোট দল প্রথম ওমরখানার কাছে মাগুরমারীতে পাঠানো হইয়াছিল। তাহারা দুশমনের গতিবিধি নিরীক্ষন করিত এবং পিছনে আমাদেরকে খবর দিত। ৩০শে এপ্রিল শত্রুদের হঠাৎ আক্রমণে এই ছোট দলের ২ জন শহীদ এবং অন্য ২ জন গুরুতরভাবে আহত হইয়া হাসপাতালে নীত হয়। যাহা হউক, মাগুরমারীতে ক্রমান্বয়ে লোকসংখ্যা বাড়াইয়া শেষ পর্যন্ত দেড় কোম্পানীর মত করা হয়। এর এক কোম্পানী নতুন সি কোম্পানী নাম নিয়া নায়েক সুবেদার হাজী মুরাদ আলীর নেতৃত্বে দুশমনের ওমরখানা ঘাঁটির সন্নিকটে প্রতিরক্ষা ঘাঁটি নির্মাণ করে। ২রা মে হইতে জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহ নাগাদ তাহারা সেখানে অবস্থান করে এবং দুশমনদের শতাধিক সৈন্য ও চার পাঁচখানা গাড়ী ধ্বংস করাসহ অশেষ ক্ষতি সাধন করিয়া তাহাদিগকে নির্বাক নির্বীয করিয়া রাখে। আমার হিসাব মতে সিপাহী আবুল হোসেন একাই সত্তর জনের মত শত্রুসেনা খতম করিয়াছে। তবে এই দলকে বহু কষ্টের মধ্যে দীর্ঘ দুই মাস কাটাইতে হইয়াছে, কেননা উন্মুক্ত আর নীচু জায়গায় পজিশন থাকা বিধায় দিনের বেলা এরা সামান্য নড়াচড়া পর্যন্ত করিতে পারিত না- শুধু রাত্রেই এদের খাওয়ার সুযোগ ঘটিত। আমি মাঝে মাঝে এই কোম্পানীর সহিত সাক্ষাৎ করিতে যাইতাম। কোন কোন সময় আমি দেখিয়াছি বৃষ্টির মত গোলাগুলির মধ্যেও হাজী মুরাদ আলী তাহার লোকজনের তদারকি করিয়া ফিরিতেছেন। আমার মতে হাজী মুরাদ আলীর বলিষ্ঠ নেতৃত্বেই এই ক্ষুদ্র দলটি নির্ভীক সৈনিকের ভূমিকা পালন করিতে অনুপ্রাণিত হইয়াছিল।

————————————-

 

<৯, ১০.২, ২৯৯-৩০০>

 

দিনাজপুর ইপিআর সেক্টর হেডকোয়ার্টারের ঘটনাবলী

সাক্ষাৎকারঃ নায়েক সুবেদার মোহাম্মদ আনসার আলী

১৯-১১-১৯৭৩

২৫ শে মার্চ থেকেই দিনাজপুর শহরে ছাত্র-জনতার মিছিল বের হতে শুরু করে। ২৬ শে মার্চ সকালেই আমরা সামরিক শাসন জারী করার কথা শুনি।এটা শুনে আমাদের সাথের পশ্চিম পাকিস্তানীরা আনন্দিত হয়েছিল এবং বাঙালিদের বিরুদ্ধে নানা কথা বলছিল। ২৬ শে মার্চ বেলা দশটার দিকে আমি ৩০/৪০ জন লোক নিয়ে নিউ টাউনে ডিউটি করতে যাই।

২৭ শে মার্চ ১/২ টার দিকে বিহারীরা প্রায় ১২/১৩ জন বাঙালিকে হত্যা করে।এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সেখানে উত্তেজনা বিরাজ করছিল।

২৭ শে মার্চ বেলা ১২/১ টার সময় তিনজন মেজর,কর্নেল এবং দুই/তিনজন ক্যাপ্টেনসহ পশ্চিম পাকিস্তানীরা এক বৈঠক করে।বেলা সাড়ে তিনটার সময় বৈঠক শেষ হয়।শেষ হবার পর ঢাকার সাথে যোগাযোগকারী সিগন্যাল সেটের কমান্ডারকে জীপে উঠিয়ে নেয় এবং তার বাসার দিকে রওয়ানা হয়।সেক্টর হেডকোয়ার্টারে ১৫/২০ জন বাঙালি ছিল।কোয়ার্টার মাষ্টার আবু সাইদ খোন্দকার,হাবিলদার ভুলু এবং প্লাটুন হাবিলদার নাজিমও ছিল।বাকি সবাইকে ডিউটিতে বিভিন্ন জায়গায় পাঠিয়ে দেওয়া হয় যাতে তারা এক জায়গায় একত্রিত না হতে পারে।জীপটা যখন অফিস থেকে রওয়ানা হয় সেই সময় আমাদের ৬-পউন্ডার প্লাটুন হাবিলদার নাজিম উদ্দিন ঐ জীপকে লক্ষ্য করে গোলা বর্ষন করে।কিন্তু গুলীটা জীপে না লেগে অফিসের কর্নারে লেগে যায়। তখন চারিদিক থেকে গোলাগুলি শুরু হয়ে যায়।বিকাল পাঁচটার মধ্যে সমস্ত পশ্চিম পাকিস্তানীদের হত্যা করা হয়।জনগণ হেডকোয়র্টারে এসে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যায়।সেক্টর হেডকোয়ার্টারের একটু দূরে সার্কিট হাউসে ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের প্রায় ১৫০ জন সৈন্য রিজার্ভ ছিল।

কাঞ্চন নদীর ওপারে গিয়ে আমরা অবস্থান নিতে শুরু করি।অস্ত্রগার থেকে সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র নদীর ওপারে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।নদীর ওপারে গিয়ে আমরা রিজার্ভে ১৫০ জনের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হই।এই সংঘর্ষ দুই তিন দিন চলেছিল।

এপ্রিলের ৩ তারিখে ২/৩ টা জীপে করে সার্কিট হাউস থেকে তারা পলায়ন করে দক্ষিণ দিকে পার্বতীপুর যাওয়ার জন্য অগ্রসর হয়।মোহনপুরের আগে যাওয়ার পর সুবেদার শুকুর সাহেবের কোম্পানী তাদেরকে বাধা দেয়।তারা আবার দিনাজপুরে ফিরে আসে,ফিরে আসার পর শালবাগানে তাদের অনেককেই জনসাধারণ এবং বাঙালি ইপিআর মেরে ফেলে।কর্নেল তারেক রসুল জীপ নিয়ে পার্বতীপুরে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল।

২৭ শে মার্চ দিনাজপুরের সীমান্ত এলাকায় সমস্ত বিওপিতে সংবাদ পাঠিয়ে দেয়া হয় এবং সেখানে যত পশ্চিম পাকিস্তানী ইপিআর ছিল সবাইকে হত্যা করা হয়।

এপ্রিল মাসে দিনাজপুর টাউন শত্রুমুক্ত হবার পর পুলিশকে দিনাজপুর হস্তান্তর করে আমাদের কিছু লোক পার্বতীপুরের দিকে এবং কিছু লোক সৈয়দপুরের দিকে রওয়ানা হয়ে যায়।

এপ্রিল মাসের ১২/১৩ তারিখে সৈয়দপুরের কিছু দূরে পাকিস্তানীদের সাথে আমাদের সংঘর্ষ হয়।শেষ পর্যন্ত প্রচণ্ড আক্রমনের মুখে টিকতে না পেরে আমরা পশ্চাদপসরণ করি।

পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ১৫ এপ্রিল তারিখে দিনাজপুর শহর পুনরায় দখল করে নেয়।

—————————————-

 

<৯, ১০.৩, ৩০০-৩০১>

 

দিনাজপুর জেলা সশস্ত্র প্রতিরোধ

সাক্ষাৎকারঃ সুবেদার আরব আলী

১৯৭

২৫ শে মার্চের পাকবাহিনীর পৈচাশিক ঘটনার কথা আমরা ২৬ শে মার্চ সকালবেলা জানতে পারি এবং সঙ্গে সঙ্গে আমরা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে যাই।এই দিন থেকে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে জনগন খানসেনা আসার সম্ভাব্য সকল রাস্তায় বেরিকেড রচনা করে।এই সময় জনগন ক্রুদ্ধ হয়ে পড়ে এবং জনসাধারণের মনে প্রতিহিংসার আগুন জ্বলতে দেখা যায়।চারদিকে একটা মার-মার,কাট-কাট অবস্থার সৃষ্টি হয়।

২৭ শে মার্চ পাঞ্জাবী বাহিনী দিনাজপুর কুটিবাড়ী ইপিআর হেডকোয়ার্টার আক্রমন করে এবং সমস্ত ইপিআরকে নিরস্ত্র করার চেষ্টা করে।এই সময় ইপিআররা পাঞ্জাবীদের প্রতি পাল্টা আক্রমন চালায়।উভয় পক্ষ মর্টার ও কামান মারতে থাকে।আমরা বর্ডার থেকে মুহুর্মুহু কামানের গর্জন শুনতে পাচ্ছিলাম।এই সময় দেখতে পাই হাজার হাজার নিরিহ শহরবাসী ভারতের দিকে রওনা দিচ্ছে। এই সময় আমি আমার উপরস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে পাক হিলি বর্ডারে যোগাযোগ করি।

২৯ শে মার্চ ভোরে ভাইগর বিওপিতে অবস্থানরত একজন পাঞ্জাবী ইপিআর হাবিলদার ও একজন নায়েককে গুলি করে হত্যা করা হয়।এই দুইজনকে খতম করে আমি রুধরানী বিওপিতে চলে যাই।সেখানে অবস্থানরত একজন পাঞ্জাবী হাবিলদার ও একজন সিপাইকে জিন্দা বন্দী করি।এরপর আমি রানীনগর প্লাটুন হেডকোয়ার্টারে চলে আসি।এখানে একজন পাঞ্জাবী ল্যান্স নায়েককে গুলি করে হত্যা করা হয় এবং একজন সিপাইকে জিন্দা বন্দী করে তাকে পাবলিকের হাতে তুলে দিই।পরে জনসাধারণ তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলে।

ফুলবাড়ী সংঘর্ষঃ ২৯ শে মার্চ উপরোক্ত ঘটনার পর আমি আমার সমস্ত জাওয়ানদেরকে একত্রিত করি।ফুলবাড়ী আসার দুই মাইল দূরে থাকতে খবর পাই যে পাঞ্জাবী সৈন্যরা দিনাজপুর থেকে ইপিআর-এর হাতে মার খেয়ে পার্বতীপুর যাবার জন্য ফুলবাড়ির দিকে অগ্রসর হচ্ছে।এই কথা শোনার পরপরই ভীষণ গোলাগুলির আওয়াজ শুনতে পাই।খবর নিয়ে জানতে পারি যে ফুলবাড়ি থেকে ইপিআররা পাকবাহিনীর গতিরোধ করেছে।এই খবর পাবার পর খুব তাড়াতাড়ি আমি আমার জওয়ানদেরকে নিয়ে ফুলবাড়ি যাবার পথে হাসপাতালের কাছে রোড ব্লক করলাম।আমরা পজিশন নেবার পরপরই পাঞ্জাবীরা অবস্থা বেগতিক দেখে পিছু হটতে আরম্ভ করে এবং কিছু সৈন্য গাড়ী ফেলে কোনাকুনি মাঠের মধ্য দিয়ে পার্বতীপুরের দিকে অগ্রসর হয়।আমরা তাদের পিছু নেই এবং আক্রমন চালাই।এই যুদ্ধে ফুলবাড়ি বাজারের মোড়ে ৭ জন খান সেনার লাশ পাওয়া যায়। একজন সিগন্যাল ম্যানকে আহত অবস্থায় পাওয়া যায় এবং সঙ্গে ২ টা চাইনিজ মেশিনগান ও ৫ টা রাইফেল আমরা হস্তগত করি।এই সময় ১ টা জীপ ও ২ টা ডজ গাড়ী আমাদের হাতে আসে।

পার্বতীপুরে বিহারীদের লুটপাট ও সংঘর্ষঃ অতঃপর এপ্রিল মাসের ৭ তারিখে আমরা জানতে পারি যে পার্বতীপুরের বিহারীরা নিকটবর্তী গ্রামগুলিতে ব্যাপক হারে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করছে।তারা নিরীহ গ্রামবাসীকে নির্মমভাবে হত্যা করছে।এই খবর পাবার পর আমি আমার প্লাটুন নিয়ে পার্বতীপুরের নিকটে গ্রামগুলির নিরাপত্তা বিধানের জন্য যাই।আমরা যাবার পর প্রায়ই বিহারীরা আমাদের উপর গোলাগুলি নিক্ষেপ করতে থাকে এবং সুযোগ বুঝে লুটপাট চালাতে থাকে।

১০ ই এপ্রিল স্থানীয় হাজার হাজার লোক এসে আমাকে জানায় যে বিহারীরা অত্যাচারের চরম সীমায় পৌঁছেছে।কাজেই তাদের যে কোন প্রকারে শায়েস্তা করতে হবে।তখন আমি হাজার হাজার জনতার সঙ্গে একত্রিত হয়ে আমার বাহিনী নিয়ে পার্বতীপুরের বিহারীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ি প্রথমদিকে বিহারীরা আমাদের প্রতি গোলাগুলি নিক্ষেপ করতে থাকে,কিন্তু কিছুক্ষণ পর তারা আমাদের গোলার মুখে টিকতে না পেরে পিছু হটতে থাকে।বিহারীরা এই সময় লাইন ধরে সৈয়দপুরের দিকে যেতে থাকে।হিংস্র জনতা পলায়নরত বিহারীদের উপর চড়াও হয় এবং যাকে যাকে পায় পিটিয়ে মেরে ফেলে।ঐদিন আনুমানিক প্রায় ৪০০/৫০০ লোক মারা যায়।এই সময় পার্বতীপুর পুরাপুরি আমাদের আয়ত্তে এসে যায়।

১১ ই এপ্রিল সৈয়দপুর থেকে ৩ টনী ৩টা গাড়ী, ২টা জীপ বোঝাই খানসেনা পার্বতীপুর আসে এবং আমাদের উপর প্রবলভাবে গোলা বর্ষণ করতে থাকে ঐদিন সন্ধ্যার পর উভয় পক্ষ থেকে গোলাগুলি বন্ধ করা হয়।এই সময় আমাদের কাছে গোলাবারুদ প্রায় শেষ হয়ে আসে।সারা রাত্রি আমরা বহু জায়গায় যোগাযোগ করেও কোন গোলাবারুদ জোগাড় করতে পারিনি।

১২ ই এপ্রিল সকাল ৮ টার সময় সেনারা পুনরায় আমাদের অবস্থানের উপর গোলাবর্ষণ করতে থাকে।এই সময় তারা মর্টার থেকে আমাদের উপর গোলাবর্ষণ করে।কিছুক্ষন যুদ্ধ চলার পর আমরা আর টিকতে পারি না,বাধ্য হয়ে পিছু হটতে থাকি।এখানে আমার একজন সিপাই মারা পড়ে এবং খোলাহাটিতে ৩ নং বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন আনোয়ার সাহেবের কাছে যাই এবং তার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করি।কিন্তু সে জানায় যে,তার কাছে তেমন কোন অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ নাই।তখন বাধ্য হয়ে আমরা ফুলবাড়ি হেডকোয়ার্টারে চলে যাই।অতঃপর আমি ফুলবাড়ি ক্যাম্প থেকে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ওখান থেকে আরও জওয়ান ও আনসার নিয়ে ১৫ই এপ্রিল পুনরায় পার্বতীপুরের দিকে যাত্রা করি।এবং আমরা পার্বতীপুরের আগের রেলস্টেশন ভাবানীপুরের হাওয়া গ্রামে ডিফেন্স করি।

১৬ ই এপ্রিল খান সেনারা পার্বতীপুর থেকে ১টা ট্যাঙ্কসহ ভারী ভারী অস্ত্রশস্ত্র সজ্জিত হয়ে সকাল ১১ টার দিকে আমাদের উপর আক্রমন চালায়।প্রায় ১ ঘন্টা যুদ্ধ চলার পর খান বাহিনীর ট্যাঙ্কের গোলার মুখে পরপর আমার ৩ জন আনসারসহ ৫ জন সিপাই মারা যায়।এই সময় আমার সিপাই মোঃ হোসেনের মাথার উপর ১ টা মর্টারের গুলি এসে পরে এবং সঙ্গে সঙ্গে সে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়।বাধ্য হয়ে আমরা পিছু হটে ফুলবাড়ির দিকে যাত্রা করি এবং এই সময় আমাদের পিছু পিছু খানসেনারা ফুলবাড়ির দিকে যাত্রা করে।

ঐদিনই বিকাল প্রায় ৫টার দিকে খানসেনারা ফুলবাড়িতে আমাদের হেডকোয়ার্টারের উপর প্রবল আক্রমন চালায়।এই সময় তারা ট্যাঙ্ক,মর্টার,কামান,মেশিনগান ব্যবহার করে।রাত ৮টা পর্যন্ত খানসেনাদের সঙ্গে চলে যাই।এই সময়ও আমাদের মনোবল অটুট থাকে।

১৮ই এপ্রিল খান সেনারা হিলি আক্রমণ করে। এখানে ভীষন যুদ্ধের পর আমরা ভারতের দিকে চলে যাই।

—————————————

 

 

<৯, ১০.৪, ৩০২-৩০৩>

 

সশস্ত্র প্রতিরোধে দিনাজপুর

সাক্ষাৎকারঃ হাবিলদার বাসারত উল্লাহ

১৬-১১-১৯৭৪

২৫শে মার্চ আমি  দিনাজপুর ৪নং সেক্টর কুটিবাড়ীতে ৮নং উইং এর ‘সি’ কোম্পানীতে ছিলাম।আমরা তখন উইং হেডকোয়ার্টারে ছিলাম। ৮নং শাখার কমান্ডার ছিল মেজর আমীন তারিক (পাঞ্জাবী)। সহ উইং কমান্ডার ছিল বাঙালি নজরুল ইসলাম এবং অপরজন পাঞ্জাবী ছিল।উইং হেডকোয়ার্টারে ‘সি’ কোম্পানী ছিল। কমান্ডার ছিল আতাউল হক। ‘বি’ কোম্পানী হিলি এলাকাতে ছিল, কমান্ডার ছিল সুবেদার আবদুস শুকুর। ‘এ’ কোম্পানী ছিল চাপাসারে, কমান্ডার ছিল আখতারুজ্জামান। ‘ই’ কোম্পানী ছিল বিরলে, কমান্ডার ছিল সুবেদার বাদশা আহমদ (বিহারী)।

দিনাজপুর সার্কিট হাউসে বেলুচ রেজিমেন্টের এক প্লাটুনের কিছু বেশী পুরা আধুনিক অস্ত্রে জানুয়ারী থেকে অবস্থান করছিল।পাক আর্মির ৩জন অয়ারলেস সেট নিয়ে উইং হেডকোয়ার্টারের মধ্যে থাকতো।৩জন আর্মির মধ্যে একজন বাঙালি সিগন্যালম্যান ছিল।আমি ওখানে গেলে তারা কথাবার্তা বন্ধ করে দিত।বাঙালি অপারেটরটি অপর দুজন পাঞ্জাবীকে ২৮ তারিখ দুপুরে ‘তোমরা অগ্রসর হও আমি যাচ্ছ’, এই বলে আমাদের সিগনাল সেন্টারে আসে এবং বলে ‘যদি পাকিস্তানীদের আক্রমণ করতে হয় তবে এখনই করো, পাকসেনারা কিছুক্ষনের মধ্যে তোমাদের উপর আক্রমণ করবে’। আমরা তখন সিদ্ধান্ত নিলাম আক্রমণের।

হাবিলদার ভুলু মিয়া, নায়েক সুবেদার মোসলেম, সুবেদার মোমিনুল হক এদের নেতৃত্বে ২৮শে মার্চ রবিবার প্রায় ২টা৪৫মিনিটে উইং –এর সকল অবাঙালি ইপিআরদের উপর আক্রমণ করি। আমরা উইং এবংসেক্টর হেডকোয়ার্টার দখল করে নিই সন্ধ্যার মধ্যে। সকল অস্ত্র আমরা আমাদের আওতায় নিয়ে আসলাম। ঐ তারিখেই পাকসেনারা আমাদেরকে আক্রমণের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় ।

৩১শে মার্চ পর্যন্ত আমরা কুটিবাড়ীতেই (উইং হেডকোয়ার্টারে) ছিলাম।সীমান্ত এলাকার কোম্পানীগুলো কুটিবাড়ীতে চলে আসে। ৩১শে মার্চ বিকাল থেকে হাবিলদার নাজিমউদ্দিন ৬পাউন্ডার ছুঁড়তে থাকে পাক ঘাঁটির উপর।একই সাথে আমরা ব্যপকভাবে আক্রমণ করি। ঐ তারিখ রাতেই পাকসেনারা দিনাজপুর থেকে পালিয়ে যায়। পাকসেনারা পার্বতীপুরের দিকে যায়। পথে বহু পাকসেনা জনতার হাতে নিহত হয়।

নায়েক সুবেদার কাউসারের নেতৃত্বে একটি প্লাটুন রংপুরের বদরগঞ্জ পৌঁছায়। সৈয়দপুর থেকে পাকসেনারা যাতে দিনাজপুরে না আসতে পারে সেজন্য বদরগঞ্জে ডিফেন্স নিই।আমাদের সামনে নদীর পাড়ে এক প্লাটুনের মত বেঙ্গল রেজিমেন্টের অংশ ছিল।

অনুমান ৮/৯ ই এপ্রিল বদরগঞ্জের পতন ঘটে পাক বাহিনীর হাতে। আমরা পিছু হটে ফুলবাড়ীতে আসলাম। ওখানে সুবেদার শুকুর সাহেব তার ফোর্স  নিয়ে আগে থেকেই ছিল। বেঙ্গল রেজিমেন্টের কিছু সৈন্য ও ছিল। পরদিন আমরা দিনাজপুর চলে আসলাম। এরপর কাউঘর মোড়ে যাই। হাবিলদার আবদুস সোবাহানের নেতৃত্বে ঐ মোড়ে  ডিফেন্স নিই।নায়েক সুবেদার মোমিনুল হক সাপোর্ট প্লাটুন নিয়ে আমাদের পিছনে থাকলো। ফুলবাড়ী- দিনাজপুর আমরা ডিফেন্স নিলাম। এখান থেকে শিয়ালগাজী মাজারের পার্শ্বে নায়েক সুবেদার মোয়াজ্জেমের নেতৃত্বে ডিফেন্স নিই।

১৩ই এপ্রিল সাড়ে ১২ টার সময় রাজবাড়ীর দিক থেকে শহরের পূর্বপাশ দিয়ে সৈয়দপুর- দিনাজপুর রাস্তার বাম দিক থেকে পাকবাহিনী আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আর্টিলারী ও ট্যাঙ্ক নিয়ে। পাকবাহিনীর ব্যাপক আক্রমণে এখানকার বিভিন্ন আমাদের লোকেরা বিচ্ছিন্নভাবে পিছু হটতে থাকে ।সন্ধ্যার পূর্বেই পাকসেনা দিনাজপুর শহর দখল করে নেয়।

শহর পতনের পর আমরা নদীর অপর পাড়ে আশ্রয় নিই। আমরা বিরল সীমান্তের দিকে অগ্রসর হই। বিরলে (ভারতীয় সীমান্ত থেকে ৬ মাইল ভিতরে) ডিফেন্স নিই। বিরলে ২০০ মত ইপিআর আসে।

১৭/১৮ই এপ্রিল পাকবাহিনী আমাদের বিরল ডিফেন্সের উপর  আক্রমণচালায়।  মুসলিম লীগ ও জামায়েত ইসলামীর লোকেরা আমাদের অবস্থানগুলো পাকবাহিনীর কাছে প্রকাশ করে দেয়। এই যুদ্ধে বিরলের পতন ঘটে।এখান থেকে কিশোরীগঞ্জ এলাকাতে ডিফেন্স নিই।

২০/২১শে এপ্রিল পাকসেনা আমাদের কিশোরীগঞ্জ ডিফেন্স আক্রমণ করে। কিশোরীগঞ্জের পতন ঘটলো পাকবাহিনীর হাতে।আমরা আরও পিছু হটলাম।একদম সীমান্ত বরাবর আমরা ডিফেন্স লাগালাম। পাকসেনারা কিশোরীগঞ্জ থেকে মাইকযোগে আমাদের গালাগালি করতে থাকে। ৮নং শাখার সহকারী উইং  কমান্ডার ক্যাপ্টেন চিমা, নায়েক সুবেদার নিয়ামতউল্লা আমাদের গালাগালি করতে থাকে। পাকসেনারা প্রতিটি জায়গা দখলের পর আগুন লাগিয়ে সমগ্র এলাকা ধ্বংস করে হত্যাযজ্ঞ চালায়, তারা হাজার হাজার মণ চাউল পুড়িয়ে দেয়।

অনুমান ২৪শে এপ্রিল ফ্ল্যাগ মিটিং হয়। সেখানে পাকসেনারা ইপিআর’দের হ্যাণ্ডওভার করার জন্য জানায়। ২৫/ ২৬ শে এপ্রিল রাধিকাপুর এবং আমাদের অবস্থানের উপর বিমান হামলা চালায়। বি এস এফ অবস্থানের উপরও বোমা ফেলে।আমরা ভারতে আশ্রয় নিলাম এক আমবাগানে। আমাদের সাথে প্রচুর গোলাবারুদ ছিল। ডালিমগাঁও যাই,সেখানে সকল অস্ত্র জমা দেই।ট্রেনিং ক্যাম্প খুলে দেওয়া শুরু হয়। দেশ মুক্ত হওয়া পর্যন্ত মেজর জিয়াউর রহমানের সাথে থাকি।

——————————————–

 

<৯, ১০.৫, ৩০৩-৩০৬>

 

সশস্ত্র প্রতিরোধে দিনাজপুর

সাক্ষাতকারঃ সুবেদার আহম্মদ হোসেন

১৮-১১-১৯৭৪

আমি একাত্তরের মার্চে ৯ নং উইং হেডকোয়ার্টার ঠাকুরগাঁতেছিলাম। উইং- এর অধীনে ৫টি কোম্পানী ও একটি সাপোর্ট ছিল। হেডকোয়ার্টারে ছিল ‘ডি’ কোম্পানী, কমান্ডার ছিল এম এ হাফিজ। রুহিয়াতে ছিল ‘এ’ কোম্পানী, কমান্ডার ছিল সুবেদার কালা খান (পাঞ্জাবী)। ‘বি’ কোম্পানী ছিল চিলাহাটিতে, কমান্ডার ছিল একজন বিহারী। ‘সি’ কোম্পানী ছিল তেতুঁলিয়ায়, কমান্ডার ছিল (ভারপ্রাপ্ত) পাঞ্জাবী নায়েক সুবেদার মীর্জা খান। ‘ই’ কোম্পানী ছিল পঞ্চগড়ে, কমান্ডার ছিল মেজর মোহাম্মদ হোসেন। সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ড ছিল ক্যাপ্টেন নাবিদ আলম। নির্বাচনের পর থেকেই আমরা ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে আলাপ-আলোচনা করতাম।

২৫ শে মার্চের রাতে ‘ডি’ কোম্পানী উইং হেডকোয়ার্টারে ছিল। আমাদের উইং হেডকোয়ার্টারে ম্যাগাজিনের সঙ্গে মুজাহিদের জন্য একটি ম্যাগাজিন ছিল।৫জন পাকসেনারা দায়িত্বে থাকতো। পাক বিমান বাহিনীর চারজন লোক ও থাকতো। যারা সকল বিমানের গতিবিধি লক্ষ্য করতো এবং ঢাকা সেনানিবাসে রিপোর্ট করতো।

২৬শে মার্চ আমরা ঢাকায় পাক আক্রমণের খবর পেলাম।

৭ই মার্চের পর থেকে আমাদের আই- এস- ডিউটি বেড়ে যায়। তখন থেকেই অস্ত্র আমাদের সঙ্গে থাকতো।২৩শে মার্চ থেকেই কয়েকবার আমাদের কাছ থেকে অস্ত্র জমা নিয়ে নেবার চেষ্টা হয়। কিন্তু আমরা অস্ত্র কোতে জমা দেইনি।

আগে থেকেই জেনেছিলাম ২৮ শে মার্চ রাতে পাক বাহিনী আমাদের উপর আক্রমণ করতে পারে।তাই আমরা সুবেদার হাফিজের নেতৃত্বে ২৮শে মার্চ রাত সাড়ে ১০টায় উইং হেডকোয়ার্টারে অবস্থানরত সকল অবাঙালি ইপিআর বাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ি। আই- এস ডিউটির জন্য আগে থেকেই উইং- এর চারপাশে বাঙ্কার তৈরী ছিল।

সুবেদার হাফিজ প্রথম উইং কমান্ডার ও সহকারী উইং কমান্ডারের গার্ডের উপর গুলি ছোড়েন। ২৫শে মার্চ ১০ টার কিছু আগে আমরা ক’জন যেমন- আমি, নায়েক সুবেদার মতিউর রহমান, বজল আহম্মদ চৌধুরী, সুবেদার এম এ হাফিজ এবং আতাউল হক মিলে সুবেদার মেজর কাজিমুদ্দিন সাহেবের বাসাতে গিয়েছিলাম আলাপ- আলোচনার জন্য। তখনই হাবিলদার আবু তালেব আমাদের কাছে এসে খবর দেয়, সুবেদার মেজর কাজিমুদ্দিনকে বন্দী করতে আসছে পাকসেনারা ৪ জন। আমরা তখনই বেরিয়ে আসি এবং যার যার অস্ত্র নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। সুবেদার হাফিজ তখনই চাইনিজ মেশিনগান নিয়ে মেজর সাহেবের বংলোতে যান এবং গুলি ছোড়েন। তারপর সারারাত ধরে উভয় পক্ষে গোলাগুলি চলতে থকে।কোতের দায়িত্বে ছিল সব অবাঙালি। ২৯শে মার্চ সুবেদার আতাউল হক ভূল বুঝাবুঝির জন্য বাঙালিদের গুলিতে মৃত্যুবরণ করেন। ঘটনাটি ছিল নিন্মরূপঃ

২৯শে মার্চ ভোরবেলা সুবেদার আতাউল হক ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন কি অবস্থা, এমন সময় সিদ্দিক নামে এক সিপাই বাঙ্কার থেকে উঠে এসে সুবেদার আতাউলহক সাহেবের দিকে অগ্রসর হতে থাকে।সিপাই সিদ্দিক ভেবেছিল সুবেদার হয়তোকিছু বলবেন না।সুবেদার আতাউল হক সম্পূর্ণ নতুন, সবাইকে চিনতেন না ফলে সিদ্দিককে বিহারী মনে করেন এবং উর্দুতে ‘তুমি এখনও বেঁচে আছ’ বলেই স্টেন তোলে। সিদ্দিক ও সাথে সাথে রাইফেল তুলে গুলি চালায়। সুবেদার আতাউল হক ওই গুলিতে মৃত্যুবরণ করেন।

অবাঙালি ইপিআর থাকতো প্রধানতঃ তিনতলার উপর এবং কোয়ার্টার গার্ডে। এর ফলে তাদেরকে আয়ত্তে আনা কঠিন ছিল। ১লা এপ্রিল বেলা ৪টার মধ্যে আমরা উইং সম্পুর্ণ দখল করতে সক্ষম হই। অবাঙালি ক্যাপ্টেন নাবিদ আলম এবং ক্যাপ্টেন নজির আহমদ পালাতে গিয়ে জনতার হাতে ধরা পড়েন এবং সবাই মৃত্যুবরণ করেন।

২রা এপ্রিলের মধ্যে সীমান্তের সমস্ত ইপিআর উইং হেডকোয়ার্টারে চলে আসে সুবেদার মেজর কাজিমুদ্দিন সাহেবের নির্দেশক্রমে। আমাদের আনসার-মুজাহিদও এসে জমায়েত হয়।

সুবেদার হাফিজের নেতৃত্বে আমরা একটি কোম্পানী  সৈয়দপুরের দিকে অগ্রসর হই ৩রা এপ্রিল। ৪ঠা এপ্রিল ভূষিরবন্দরে পুলের পাশে প্রতিরক্ষা ব্যূহ রচনা করি।

২৯শে মার্চ আমরা খবর পেলাম ৮/১০টি ট্রাক করে পাকসেনা ঠাকুরগাঁ- এর দিকে অগ্রসর হচ্ছে।আমরা তখনই যার যার মতো পজিশন নিয়ে তৈরী থাকলাম। দেখলাম সত্যই তারা আসছে। কিছুক্ষন পর সকাল ৯টার দিকে জানলাম তারা বেঙ্গল রেজিমেন্টের লোক।ক্যাপ্টেন আশরাফ সুবেদার মেজর খবর দেন আমরা শিবগঞ্জে বিমানবন্দরে আইএস ডিউটি করতে যাচ্ছি। কাজিমুদ্দিনের সন্দেহ হয়, তাই পুনরায় একটি সিপাইকে মোটর সাইকেল যোগে বেঙ্গল রেজিমেন্ট সম্পর্কে নিশ্চিত হতে বলেন।ক্যাপ্টেন আশরাফ নিজের সকল জোয়ানকে দেখিয়ে বলেন আমরা সবাই বেঙ্গল রেজিমেন্টের লোক। সিপাই ফিরে এসে সুবেদার মেজরকে রিপোর্ট করলে ক্যাপ্টেন আশরাফ তার কোম্পানী নিয়ে শিবগঞ্জ চলে যান। সুবেদার মেজর কাজিমুদ্দিন অনেক অনুরোধ করেন তাদের সাথে কাজে যোগ দেবার জন্য। কিন্তু ক্যাপ্টেন আশরাফ বিশ্বাস করতে পারেননি সব ঘটনা। ক্যাপ্টেন আশরাফ তার কোম্পানী নিয়ে শিবগঞ্জে পৌঁছালে তাঁর বেঙ্গল- এর ৩/৪ জন জোয়ানের দেখা পান। তারা উপরে পাকবাহিনীর আক্রমণের ঘটনার কথা জানায়। এই ৪ জন বলে, আমরা ২০/২৫ জন ছিলাম। কিন্তু দশমাইল নামক স্থানে পাঞ্জাবীরা আমাদের ঘেরাও করে। আমরা ক’জন পালাতে পেরেছি; অবশিষ্টদের খবর জানি না। ক্যাপ্টেন আশরাফ তখন ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বীরগঞ্জে থেকে যান। আমরা সৈয়দপুরের দিকে অগ্রসর হতে বীরগঞ্জে উপস্থিত হলে ক্যাপ্টেন আশরাফের সাথে সাক্ষাৎ হয়। সুবেদার হাফিজ এবং ক্যাপ্টেন আশরাফ আলোচনা করেন। সৈয়দপুরের পথে ভূষিরবন্দর পুলের পাশে পৌঁছাই। পুলের বাম পাশে সৈয়দপুর- দিনাজপুর রাস্তায় আমরা এবং ডান পাশে আশরাফ তার কোম্পানী নিয়ে প্রতিরক্ষা ব্যূহ রচনা করলেন।

৫ই এপ্রিল পাকবাহিনী ১১টি গাড়ী নিয়ে আমাদের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ৩য় বেঙ্গল প্রথমে মেশিনগানের গুলি ছোঁড়ে। পাকসেনারা সামনে অগ্রসর না হয়ে সৈয়দপুরে পালিয়ে যায়।

৫ই এপ্রিল তারিখে আমরা আরও ৬ মাইল সামনে চম্পাতলী নামক স্থানে যাই এবং রাতের মধ্যে ডিফেন্স নিই।

৬ই এপ্রিল পাকসেনারা সেনানিবাস থেকে দিনাজপুরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। আমাদের রাইফেলের আয়ত্তের মধ্যে আসলে আরম্ভ করি। দুই- তিন ঘণ্টা উভয় পক্ষে তুমুল যুদ্ধ চলে। পাকসেনারা ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে সেনানিবাসে চলে যায়।

ঐ তারিখেই বেলা আড়াইটা- তিনটার দিকে পাকসেনারা একটি ট্যাঙ্ক নিয়ে আমাদের দিকে অগ্রসর হয়। আমরা তখন সৈয়দপুর থেকে দুই মাইলের ভিতর। যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। পাকবাহিনীর আক্রমণে আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই এবং বিচ্ছিন্ন অবস্থায় পিছু হটতে থাকি। বামদিকে নীলফামারীর দিকে পিছু হটি। ৩য় বেঙ্গল এখান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

পাকসেনারা অগ্রসর হতে থাকে। বাড়িঘরে সব আগুন লাগাতে থাকে। সুবেদার হাফিজ আমাদের নিয়ে রাত ১১টায় দারয়ানী স্টেশনের পশ্চিম পাশে এক গ্রামে আকবর আলী চেয়ারম্যানের বাড়ীতে আশ্রয় নেন। আমরা তখন ৭০/৮০ জন ছিলাম।সেই রাতে আকবর আলী সকলের খাবারের ব্যবস্থা করেন। রাতে ওখানে থাকি।

৭ই এপ্রিল আমরা খানসামা নামক স্থানে গেলাম। সেখান থেকে খবর পেলাম নীলফামারীর ৮নং শাখার যে কোম্পানী ছিল তারা পাকবাহিনীর কব্জায় চলে যায়। খানসামাতে নদীরপাড়ে আমাদের ৯নং উইং –এর একটি প্লাটুন আগে থেকেই  ডিফেন্সে ছিল। আমরা এই প্লাটুনের সাথে একত্রিত হই। প্লাটুনকে রেখে আমরা বীরগঞ্জে চলে আসি। সেখানে ৮নং শাখার সুবেদার মেজর রব সাহেবের নির্দেশক্রমে খানসামাতে আমরা ডিফেন্স নিই এবং খানসামাতে অবস্থানরত দশমাইল স্ট্রং ডিফেন্স পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

১০ই এপ্রিল পাকসেনারা দশ মাইল  ডিফেন্সের উপর আক্রমণ করে। দশ মাইলে আমাদের বাহিনী টিকতে  ব্যর্থ হয়। সবাই ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। পাকসেনারা ভাতগাঁও নামক স্থানে আসে। ভাতগাঁওতে আমাদের ডিফেন্সের পতন ঘটে।

১০ই এপ্রিল রাতে আমরা খানসামা ছেড়ে দেবীগঞ্জ পৌঁছাই। ১১ই এপ্রিল সেখানে আমাদের উইং এর একটি কোম্পানী ও একটি প্লাটুন ছিল। আমরা দেবীগঞ্জ পথের পাশে ডিফেন্স নিলাম। ঠাকুরগাঁও থেকে খবর পেয়ে আমরা ১৩ই এপ্রিল ঠাকুরগাঁ পৌঁছাই। সেখান থেকে আমরা বীরগঞ্জ পৌঁছাই।

১৩ই এপ্রিল তারিখে খানসামাতে পাকবাহিনীর সামনেই  প্রতিরক্ষা ব্যূহ রচনা করি। রাত ৩টা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত ফায়ারিং চলে। সকাল ৮ টায় আমরা পাকবাহিনীর মেশিনগানের অবস্থান জানতে পারি। আমি ২” মর্টার দিয়ে মেশিনগানের উপর গোলা ছুড়তে থাকি। পাকবাহিনী বহু ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে পালাতে থাকে। বহু পাকসেনা এখানে নিহত হয়।এখানে আমরা পাকবাহিনীর ঘাঁটি দখল করে নিই। দুই ট্রাক ভর্তি পাকবাহিনীর মালামাল উদ্ধার করি।

১৪ই এপ্রিল আমরা এই এলাকা দখল করে অসতর্ক অবস্থায় বসে ছিলাম। সেই সময় হঠাৎ করে পাকসেনারা নীলফামারী থেকে এসে আমদের উপর আক্রমণ করে বসে ।আমরা হঠাৎ আক্রমণে ছত্রভঙ্গ হয়ে যাই। সবাই বিছিন্ন অবস্থায় পিছু হটতে থাকি এবং ১৬ই এপ্রিল পঞ্চগড় পৌঁছাই। তখন আমরা ৫০/৬০ জনের মতো ছিলাম। পঞ্চগড়ে ঠাকুরগাঁ থেকে সুবেদার মেজর কাজিমুদ্দিন সমস্ত গোলাগুলি, রেশন এবং সৈন্য নিয়ে অবস্থান করছিল। ১৭ই এপ্রিল আমরা এখানে ডিফেন্স নিই। তখন আমাদের কাছে একটি মেশিনগান ছিল । ১৯ শে এপ্রিল পাকসেনারা  আমাদের উপর আক্রমণ করে। ৯টায় এখানে ২/৩ ঘণ্টা যুদ্ধ হবার পর আমরা পিছু হটে ভজনপুর নামক স্থানে চলে যাই। এখানে নদীর পাড়ে ২০ শে এপ্রিল সকালে ডিফেন্স নিই। অন্যান্য স্থান থেকে টহল দিয়ে বেড়াতো। আমরা ভজনপুর থেকে বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে পাকবাহিনীর উপর হঠাৎ হঠাৎ আক্রমণ চালাতে থাকি। ৮নং শাখার পতন ঘটলে ক্যাপ্টেন নজরুল আমাদের এখানে আসেন। তিনি দায়িত্ব নেন আমাদের। কিছুদিন পর  প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন এবং এম এ জি ওসমানী আসেন এবং ভাষন দেন। আমরা পুনরায় ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে পাকসেনাদেরকে খতম করতে এগিয়ে যাই। ভজনপুর সব সময় মুক্ত ছিল। আমরা বাংলাদেশের মাটিতে থেকেই দেশ মুক্ত হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ করেছি।

———————————————-

 

<৯, ১০.৬, ৩০৬-৩০৭>

সশস্ত্র প্রতিরোধে ঠাকুরগাঁ– দিনাজপুর

সাক্ষাৎকারঃ নায়েব সুবেদার আবু তালেব শিকদার

১৬-৭-১৯৭৪

ইপিআর-এর ৯ নং শাখা ঠাকুরগাঁতে ছিল। উইং কমান্ডার ছিলেন মেজর মোহাম্মদ হোসেন (পশ্চিম পাকিস্তানী), সহকারী উইং কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন নাবিদ আলম। কোয়ার্টার মাষ্টার ছিলেন ক্যাপ্টেন নজীর আহমদ (বাঙালি)।

২৬শে মার্চ সকালবেলা সামরিক বিধি জারী হওয়ার পর প্রায় ১০/১২ হাজার লোক ঠাকুরগাঁ ইপিআর হেডকোয়ার্টার ঘেরাও করার চেষ্টা করে। বাঙালি ইপিআররা জনসাধারণকে সেখান থেকে চলে যেতে বলাতে তারা চলে যায়। ঠাকুরগাঁ  শহরে কারফিউ জারী করা হয়। ২৭শে মার্চ একজন পশ্চিম পাকিস্তানী ইপিআর ঠাকুরগাঁ শহরে একজন রিকশাওয়ালাকে গুলি করে হত্যা করে। ২৮শে মার্চ একজন দোকানদারের ছেলেকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

২৮শে মার্চ বিকেল ৬টার সময় আমরা গোপন সূত্রে জানতে পারলাম যে পাকিস্তানীরা আমাদের বাঙালি জেসিওদের গ্রেফতার করবে রাত ১২ ঘটিকার সময়। ২৮শে মার্চ রাত আটটায় চট্রগ্রাম বেতার থেকে আমরা খবর পেলাম পশ্চিম পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার জন্য। রাত ৯টার সময় সমস্ত বাঙালি ইপিয়ারদের অস্ত্র জমা দেবার জন্য মেজর মোহাম্মদ হোসেন নির্দেশ দেন। আমরা রাত ১০-৩০ মিনিটে বাঙালি সুবেদার মেজর কাজিমউদ্দিন এবং সুবেদার হাফিজ ও অন্যান্য বাঙালি জেসিওদের নেতৃত্বে পশ্চিম পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ি। সমস্ত পশ্চিম পাকিস্তানী ইপিআরকে খতম করা হয়। ওদের প্রায় ৭০/৮০ জন ছিল। বেলুচ রেজিমেন্টের একজন সুবেদার এবং কিছু সৈন্যও ছিল। এয়ার ফোর্সের কয়েকজন সৈনিক ছিল। রাত ১১টার সময় আমরা বাঙালি ইপিআর কোতে ও ম্যাগাজিন ভেঙ্গে অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে নিই।

২৯শে মার্চ বেলা তিনটার সময় মেজর মোহাম্মদ হোসেনকে তার বাসভবনে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরিবার পরিজনসহ ক্যাপ্টেন নাবিদ আলম ঐ দিন রাত্রে পালিয়ে সৈয়দপুর যাবার চেষ্টা করলে স্থানীয় জনসাধারনের হাতে সে খোচাবাড়ি এলাকাতে ধরা পড়ে। জনগণ বাঙালি ইপিআরদের কাছে তাঁকে ও তার পরিবারবর্গকে সোপর্দ করে। ঘটনাস্থলে সবাইকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

২৯শে মার্চ ঠাকুরগাঁর অধীনে সমস্ত বিওপিএ (৩৪টা) সমস্ত পশ্চিম পাকিস্তানী ইপিআরকে হত্যা করা হয়। কিছুসংখ্যক  বাঙালি ইপিআর বিওপিতে  থাকে । বাকি সবাই ঠাকুরগাঁ এসে একত্রিত হয়।

৩০শে মার্চ সমস্ত বাঙালি ইপিআর সুবেদার মেজর কাজিমউদ্দিনের নেতৃত্বে ভাতগাঁও পুলে প্রতিরক্ষা ব্যূহ তৈরি করে। ঐদিনই দিনাজপুরের কুঠিবাড়ী থেকে  ৮ নং উইং –এর ক্যাপ্টেন নজরুল ইসলাম, সুবেদার মেজর এবং অবসর প্রাপ্ত মেজর এম টি হোসেন, ক্যাপ্টেন আরশাদ (৩য় বেঙ্গল রেজিমেন্ট) ভাতগাঁও পুলের কাছে আসেন। এখানে সবাই কনফারেন্স করেন।

৩০শে মার্চ বিকেলে সবাই সৈয়দপুরের দিকে অগ্রসর হয়। ভূষিরবন্দর ব্রীজে আমরা ডিফেন্স তৈরী করি। ৩১শে মার্চ সৈয়দপুর থেকে বেলুচ এবং পাঞ্জাব রেজিমেন্টের কিছু সৈন্য আমাদের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ভূষিরবন্দরে প্রায় দুই ঘণ্টা ওদের সাথে আমাদের গুলি বিনিময় হয়। তারা আবার সৈয়দপুর চলে যায়। আমরা ভূষিরবন্দর থেকে একটু এগিয়ে চম্পাতলীতে ডিফেন্স তৈরী করি।

১লা এপ্রিল সকালবেলায় চম্পাতলীতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে আমাদের তুমুল যুদ্ধ হয়। পাকিস্তানীরা মিডিয়াম গান ব্যবহার করে। ১২টা পর্যন্ত আমাদেরকে ওখান থেকে হটাতে না পেরে বেলা দুইটার সময় তারা ট্যাংক নিয়ে অগ্রসর হতে থাকে। বিকেল ৬টা পর্যন্ত তাদের সাথে আমাদের যুদ্ধ চলে। কিছুসংখ্যক বাঙালি ইপিআর সেখানে শাহাদাৎ বরণ করেন। পাকিস্তানীদের দুটো ট্যাংক আমরা ৬- পাউন্ডার গোলার সাহায্যে ধ্বংস করতে সমর্থ হই। আমরা পিছিয়ে এসে ভূষিবন্দরে ডিফেন্স তৈরী করি।

২রা এপ্রিল আমাদের কিছু বাঙালি ইপিআর নীলফামারী হয়ে সৈয়দপুরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। সৈয়দপুর থেকে দুই মাইল আগে তাদের সাথে সারাদিন তুমুল যুদ্ধ চলে। রাত্রিবেলা বাঙালি ইপিয়াররা সেখান থেকে ঠাকুরগাঁ এসে একত্রিত হয়। ৩রা এপ্রিল ভূষিরবন্দরে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের সাথে আবার যুদ্ধ শুরু হয়। সারাদিন যুদ্ধ চলে। রাতে আমরা দশ্মাইলে গিয়ে ডিফেন্স তৈরী করি।

৫ই এপ্রিল পাকিস্তানীদের সাঁজোয়া এবং গোলন্দাজ বাহিনী দশমাইলে আমাদের উপর অতর্কিতে হামলা চালায়। দশ মাইলে অনেক বাঙালি ইপিআর শাহাদাৎ বরণ করেন। অনেকেই আহত হন। কুঠিবাড়ীর বাঙালি ইপিআররা আবার দিনাজপুরের দিকে চলে যায়। ঠাকুরগাঁর বাঙালি ইপিআররা আবার ব্রীজে অবস্থান নেয়।

৭ই এপ্রিল পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য ভাতগাঁর উপর হামলা চালায়। এখানেও বাঙালি ইপিআর হতাহত হয়। পেছন থেকে কোন সাহায্য না পাওয়াতে আমরা সেখান থেকে পিছু হটতে বাধ্য হই। পঁচাগড়ে গিয়ে আমরা একত্রিত হই এবং সেখানে ডিফেন্স তৈরী করি। ১৪ই এপ্রিল পঁচাগড়েও পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা আমাদের উপর আক্রমণ করে এবং আগুনে বোমার সাহায্যে পঁচাগড় শহরকে সম্পূর্ণরুপে জ্বালিয়ে দেয়। পঁচাগড় থেকে বাঙালি ইপিআররা অমরখানাতে গেয়ে শেষ ডিফেন্স তৈরী করে। সুবেদার মেজর কাজিমউদ্দিনের নেতৃত্বে প্রতিজ্ঞা নেয়া হয় যে একটা লোক জীবিত থাকা পর্যন্ত এখান থেকে কেউ পিছু হটবে না। আল্লাহর রহমতে দেশ স্বাধীন হবার পূর্ব মূহূর্তে পর্যন্ত অমরখানা আমাদের দখলে থাকে।

————————————–

<৯, ১০.৭, ৩০৭-৩০৮>

সশস্ত্র প্রতিরোধে দিনাজপুর

সাক্ষাতকারঃ খন্দকার আবদুস সামাদ

২২-৭-১৯৭৪

২৫শে মার্চ ১৯৭১ সালে আমি দিনাজপুর জেলার পঁচাগড় থানার ভারপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার ছিলাম। ২৫ শে মার্চের পরপরই যখন ঢাকায় সৈন্যদের অতর্কিত আক্রমণের খবর পাই তখনই থানার ৫ জন অবাঙালি সিপাইকে নিরস্ত্র করে ঠাকুরগাঁ জেলখানায় পাঠিয়ে দেই। থানার বাঙালি সিপাহীরা স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে সহযোগিতা করে। এপ্রিলের প্রথমেই থানা ক্যাম্পাসে মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষন কেন্দ্র খোলা হয়। স্থানীয় নেতৃবৃন্দ, ইপিআর ও পুলিশ একযোগে প্রশিক্ষন কেন্দ্রে কাজ করে। ঠাকুরগাঁ উইং হেডকোয়ার্টার থেকে বাঙালি ইপিআরগণ তাদের অস্ত্রাদি নিয়ে পঁচাগড় চলে আসেন। থানার রাইফেলগুলো প্রশিক্ষন কেন্দ্রে দেয়া হয়। পঁচাগড় থানা ক্যাম্পাসে প্রশিক্ষন কেন্দ্র স্থাপন ও পরিচালনার ব্যাপারে আমি নিজেও সক্রিয় ছিলাম। এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু ছিল।

এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে দিনাজপুর- পঁচাগড় রাস্তায় ভাতগাঁও নামক স্থানে একটি পুলে পাকিস্তানী সেনাদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরাট সংঘর্ষ হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সেনাবাহিনী, ইপিআর, পুলিশ ও ছাত্র- জনতা ছিল। সৈন্যদের ভারী অস্ত্রের মোকাবেলা করতে না পেরে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে এসে পঁচাগড়ে ডিফেন্স দেয়। উদ্দেশ্য, পাকিস্তানী সৈন্যদেরকে পঁচাগড়ে প্রবেশে বাধা দেয়া। ঐ সময়ই নিরাপত্তার জন্য আমি আমার পরিবারের লোকজনকে ভারত সীমান্তের কাছে ভিতরগড় নামক স্থানে স্থানান্তরিত করি। আমি নিজে পঁচাগড়েই অবস্থান করতে থাকি।

২১শে এপ্রিল সৈন্যরা গোলাবর্ষন করতে করতে পঁচাগড়ে ঢুকে পড়ে। মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে সংঘর্ষ হবার পর সৈন্যরা পঁচাগড় থানা বাজারটি সম্পূর্ণ পুড়িয়ে দেয়। বহু লোক মারা যায়। মুক্তিযোদ্ধারা গ্রুপ হয়ে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে এবং ভারতে প্রবেশ করে।

————————————

 

<৯, ১০.৮, ৩০৮-৩০৯>

মুক্তিযুদ্ধে দিনাজপুর

প্রতিবেদনঃ সত্যেন সেন

(‘প্রতিরোধ সংগ্রামে বাংলাদেশ’ থেকে সংকলিত)

গভীর রাত্রিতে ওরা দিনাজপুর শহরে এসে ঢুকল। এ রাত্রি সেই ২৫-এ মার্চের রাত্রি, যে রাত্রির নৃশংস কাহিনী পাকিস্তানের ইতিহাসকে পৃথিবীর সামনে চির-কলঙ্কিত করে রাখবে।

ওরা সৈয়দপুর থেকে এসে অতি সন্তর্পণে শহরের মধ্যে ঢুকল। শ’খানেক পাঞ্জাবী সৈন্য। শহরে ঢোকার মুখে প্রথমেই থানা। সৈন্যরা প্রথমে থানা দখল করে নিয়ে সেখানে তাদের ঘাঁটি করে বসল। তারপর তারা তাদের পূর্ব- নির্ধারিত পরিকল্পনা অনুসারে শহরের টেলিগ্রাম ও টেলিফোনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিল। সেইদিনই শেষ রাত্রিতে দিনাজপুরের বিখ্যাত কৃষক নেতা গুরুদাস তালুকদার এবং আরও কয়েকজন বিশিষ্ট হিন্দু নাগরিক তাদের হাতে গ্রেফতার হলেন। এমন নিঃশব্দে ও সতর্কতার সঙ্গে এ সমস্ত কাজ করা হয়েছিল যে, শহরের অধিকাংশ লোক তার বিন্দুমাত্র আভাস পায়নি। পরদিন সকাল বেলা তারা ঘুম থেকে জেগে ওঠে জানল, পাকসৈন্যরা তাদের দিনাজপুর শহর দখল করে নিয়েছে। আরও শুনল, বেলা ১১টা থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ আদেশ ঘোষনা হচ্ছে। দিনরাত অষ্টপ্রহর ধরে কারফিউ চলবে। শহরের রাজপথ জনশূন্য, কোথাও জনপ্রাণীর সাড়া- শব্দ নেই। সবাই যে যার ঘরে মাথা গুজে বসে তাদের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জল্পনা- কল্পনা করে চলেছিল। সারাটা দিন এইভাবে কাটল কিন্তু রাত্রি বেড়ে উঠার সাথে সাথে এই ভীতসন্ত্রস্ত মানুষগুলির মনের পরিবর্তন দেখা দিতে লাগল, তারা মাথা তুলে উঠে দাঁড়াল। শহরের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মুহুর্মুহু ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি শোনা যেতে লাগল। শহরের যে- সব জায়গায় মেহনতী মানুষদের বাস, সেই সব জায়গা থেকে সবচেয়ে বেশী আওয়াজ উঠছিল। দম বন্ধ করা সেই ভয় ও দুর্ভাবনার বোঝাটা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে মানুষ প্রাণ খুলে তার প্রাণের কথা বলতে চাইছিল। রেল চলাচল, ডাক। টেলিগ্রাফ, সবকিছু বন্ধ অথচ খবরগুলি যেন বাতাসে উড়ে এসে ছড়িয়ে যাচ্ছে। কেমন করে সেই সমস্ত সংবাদ এল কেহই তা স্পষ্ট করে বলতে পারে না, কিন্তু ২৭ তারিখের মধ্যেই এ কথাটা মোটামুটি সবাই জেনে ফেলেছে যে, বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম শুরু হয়ে গেছে। শহরের লোকদের চাঞ্চল্য আর উত্তেজনা তাদের ভয়কে ছাপিয়ে উঠেছে। এটা সবাই তীব্রভাবে অনুভব করছে যে, এই মুক্তিসংগ্রামে সকলেরই যোগ দেওয়া উচিত, কিন্তু সাধারণ মানুষ, নিরস্ত্র মানুষ, তারা কি করে জঙ্গী বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করবে।

২৬শে মার্চ থেকে ২৮শে মার্চ পর্যন্ত একটানাভাবে দিনরাত কারফিউ চলছিল, মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে, উত্তেজনায় ফেটে পড়তে চাইছে। এদিকে পাক- সৈন্যরা নিশ্চিন্ত ছিল না। জনসাধারণ জানুক আর- না-ই জানুক এক মহাসঙ্কট সৈন্যদের মাথার উপর খড়গের মত ঝুলছিল। এক প্রবল বিরোধী শক্তি উদ্যত হয়ে আছে, যে কোন সময় তা এসে তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। দিনাজপুর ইপিআর বাহিনীর পাঁচশ জওয়ান আছে। সৈন্যদের সংখ্যা মাত্র একশ। এখানে আপাতত তারা শান্ত হয়ে আছে বটে, কিন্তু তাদের মনোভাব অজানা হয়। পূর্ববঙ্গে সর্বত্র এই ইপিআর বাহিনী বিদ্রোহীদের পক্ষে প্রধান শক্তি। কাজেই সময় থাকতেই এদের নিরস্ত্র ও বন্দী করে ফেলা দরকার। প্রয়োজন হলে এদের কচুকাটা করে নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে। কিন্তু মাত্র একশ সৈন্য ইপিআর- এর পাঁচশ জওয়ানকে নিরস্ত্র করবে অথবা বন্দী করবে, অথবা কচুকাটা করবে; এটাইবা কেমন করে সম্ভব? সৈন্যদের নেতৃস্থানীয়রা বুদ্ধি করল, এক্ষেত্রে সরাসরি বল প্রয়োগ না করে ওদের কৌশলে ডেকে এনে ফাঁদে ফেলতে হবে। এই উদ্দেশ্য নিয়ে একটা বড় রকম ভোজের আয়োজন করে তারা ইপিআর বাহিনীর জওয়ানদের সাদর আমন্ত্রণ জানাল। সৈন্যদের পক্ষ থেকে হঠাৎ এমন আদর- আপ্যায়নের ঘটা দেখে ইপিআর বাহিনীর লোকেরা মনে মনে হাসল। ওদের মতলবখানা বুঝতে কারও বাকী ছিল না। ওরা এই ক’দিন ধরে ভেতরে প্রস্তুতি  নিয়ে চলেছিল। এবার আর দেরী না করে তারা স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়িয়ে দিয়ে বিদ্রোহ ঘোষনা করল।

আমন্ত্রিতেরা সদলবলে তাদের ঘাঁটি থেকে দিনাজপুর শহরে চলে এল। তারা ২৮শে মার্চ বেলা ২ টায় ‘জয় বাংলা” ধ্বনিতে সারা শহর মুখরিত করে শত্রুদের বিরুদ্ধে ঝটিকার বেগে আক্রমণ করল। হঠাৎ এভাবে আক্রান্ত হয়ে উদভ্রান্ত পাক- সৈন্যদের অধিকাংশ ‘সার্কিট’ হাউসে গিয়ে সেখানে তাদের ঘাঁটি করে বসল। অন্যান্যরা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে শহরের নানা জায়গায় আশ্রয় নিল। কিন্তু শহর থেকে প্রাণ নিয়ে বেরিয়ে যাওয়া কারও পক্ষে সম্ভব ছিল না। ইপিআর বাহিনীর যোদ্ধারা আর শহরের মানুষ এই পলাতক দস্যুদের সেই সমস্ত আশ্রয় থেকে টেনে বার করতে লাগল। তাদের খতম করে ফেলতে খুব বেশী সময় লাগল না। কিন্তু সার্কিট হাউসের মধ্যে অবরুদ্ধ পাক সৈন্যরা ৩০ মার্চ পর্যন্ত আত্মরক্ষা করে চলেছিল। এই তিন দিনের যুদ্ধে তাদের মধ্যে মাত্র সাতজন ছাড়া আর সবাই মারা পড়ল। ৩১ই মার্চ তারিখে সেই সাত জন সৈন্য মরিয়া হয়ে একটা গাড়ি নিয়ে অবরোধ ভেঙ্গে বেরিয়ে পড়ল। এইভাবে তারা মৃত্যুর গহ্বর থেকে প্রাণ বাঁচাল। শোনা যায় ঐ গাড়ির মধ্যে কর্ণেল তারেকও নাকি ছিলেন।

——————————————————-

(৯, ৮.৯, ৩০৯-২০)

দিনাজপুর জেলায় সশস্ত্র প্রতিরোধের আরও বিবরণ

সাক্ষাতকারঃ সুবেদার মেজর এ, রব (ডি-এ-ডি)

২৪-২-১৯৭৯

(অনুবাদ)

 ৯-৩-৭১ থেকে ৮ উইং কমান্ডার মেজর আমীন তারিক বাঙ্গালী গার্ড কমান্ডার, কোট এবং ম্যাগাজিন এনসিওএস পরিবর্তন করলো এবং তাদের স্থলে পাঞ্জাবীদেরকে দায়িত্ব দিল। সে তিনজন বাঙ্গালী আর্মি অফিসার,  বাঙ্গালী জেসিও, এনসিও এবং আমার (এসএম) বিরুদ্ধে নিরাপত্তা হিসেবে অল্প কয়জন ইপিআর বিহারী নিযুক্ত করলো যা কিনা আমাদের মাঝে উদ্বেগ বাড়িয়ে দিল। ঐ সময়টাতে ক্যাপ্টেন নাজির আহমেদ এবং ক্যাপ্টেন নজরুল হক ছিল এমকিউ এবং এডজুটেন্ট কারণ তারা দুজনেই ছিল বাঙ্গালী। আমি সব ঘটনা তাদের কাছে রিপোর্ট করতাম।

যখন ৮ উইং কোট, ম্যাগাজিন এনসিও এবং গার্ড কমান্ডার পরিবর্তন করা হল, আমি সহ আতাউল হক শহীদ, এন/সাব লুতফুর রহমান, এন/সাব মোয়াজ্জেম হোসেন, সেক্টর কিউএম/হ্যাভ খোন্দকার আবু সায়ীদ, ৮নং উইং এর কিউএম/হ্যাভ ভুলুমিয়া, সেক্টর এন্টি ট্যাংক প্লাটুনের হ্যাভ নাজিম এবং আরো এনসিও সহ অন্যান্যরা পরিকল্পনা করলাম যে যদি কোন অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে সেক্টর এসএম (এরব) অস্ত্র এবং গোলাবারুদের জন্য অস্ত্রাগারের চাবি সরবরাহ করবে। আমাদের এই পরিকল্পনা খুব অল্প কিছু লোকের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল।

.

১৭-৩-৭১ তারিখে সেক্টর কমান্ডার কিউএম ক্যাপ্টেন নাজির আহমেদকে যাবতীয় গ্রেনেড এবং চাইনীজ অস্ত্র গুলো দিনাজপুরের ২৬ এফএফ রেজিমেন্ট জওয়ানদের কাছে হস্তান্তর করার নির্দেশ দিল। পালাক্রমে কিউএম ক্যাপ্টেন সেক্টর কমান্ডার, কিউএম/হ্যাভ আবু সায়ীদ কে নির্দেশ দিল কিন্তু সে হস্তান্তর করল না।

.

৭১ সালের মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে কিছু অবাঙ্গালী জেসিও/এনসিও এবং ওআর সেক্টর হেডকোয়াটারে এনে অবাঙালি শক্তি কিছুটা বাড়ানো হল এবং সবসময় তাদের অস্ত্র সরবরাহ করা হল। ১৮-৩-৭১ তারিখে আবু সায়ীদকে অস্ত্রাগারের চাবি এন/সাব-কিউএম মোঃ ইব্রাহীম (অবাঙ্গালী) এর কাছে হস্তান্তর করার নির্দেশ দেয়া হল কিন্তু সে তা না করে সব চাইনীজ অস্ত্রগুলো বাঙ্গালী পরিবারের লোকদের কে দিল যেটার দায়ে তাকে ২৪-৩-৭১ তারিখে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। দিনদিন পরিস্থিতির অবনতি দেখে শত্রুর মোকাবেলা করার পরিকল্পনা করলাম।

.

অস্ত্রের নিয়ন্ত্রণ আমাদের ক্ষমতার বাইরে চলে গেলে কর্নেলের সাথে এক আলোচনায় আমি কৌশলে বললাম যে অবাঙ্গালী নিরাপত্তা-কর্মীরা শহর থেকে রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঠিক তথ্য জানাতে পারছেনা কারণ তারা স্থানীয় লোক দের সাথে মিশতে অপারগ। সে ক্ষেত্রে আমি কিছু বিশ্বস্ত বাঙ্গালী নিয়োগ দেয়ার পরামর্শ দিলাম যাতে তার সঠিক তথ্য সংগ্রহ করতে পারে। সেক্টর কমান্ডার আমার পরামর্শ গ্রহণ করলেন এবং দুই-তিন জন বাঙ্গালী ছেলে এই কাজের জন্যে নিয়োগ দিতে বললেন। নির্দেশ অনুযায়ী আমি এল/এনকে আবুল মান্নান, এল/এনকে মোতাহার এবং সিপাহী মুস্তাফিজুর রাহমানকে নিয়োগ দিলাম এই বলে যে তারা যেন সরাসরি সেক্টর কমান্ডারের কাছে রিপোর্ট করে। আমি তাদেরকে এও বললাম যে রিপোর্ট করার সময় তারা যেন বলে যে রাজবাড়ি আমবাগানে এবং শহরের বাইরে বিভিন্ন জংগলে ভারতীয় প্রতিনিধিরা আওয়ামীলীগ স্বেচ্ছাকর্মী, ছাত্র এবং ন্যাপ কর্মীদের গভীর রাতে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে এবং অস্ত্র সরবরাহ করছে। তারা যেকোনো সময় ইপিআর সেক্টর হেডকোয়ার্টারে, অফিসার দের ক্লাব ও বাংলোতে হামলা চালাতে পারে। তাদেরকে এই কথা বলার পিছনে আমার উদ্দেশ্য ছিল যে তা শুনে সিও আমাকে এবং অন্য অফিসারদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্যে ডাকবে। ঐ মুহূর্তে আমার উপদেশ হবে যেন হেডকোয়ার্টার, অফিসার্স ক্লাব এবং তাদের বাংলোর চারিদিকে নিরাপত্তা বেষ্টনী দেয়া হয় কারণ তাহলে সব অস্ত্রশস্ত্র পাঞ্জাবীদের পরিবর্তে আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। সেক্টর কমান্ডার আমার কথা মানলেন এবং তদনুযায়ী কাজ করার নির্দেশ দিলেন। আমিও পরিকল্পনা অনুযায়ী সব কিছু করলাম। মহান আল্লাহর রহমতে যুদ্ধ ছাড়া একজন বাঙালি ইপিআরও প্রাণ হারায়নি। এর সাথে এমএনএ/এমপিএ এবং ছাত্র নেতাদের রক্ষা করা সম্ভব হয়।

.

১৮-২-৭১ তারিখে সেক্টর কমান্ডার, দিনাজপুরের ডিসি মিঃ ফাইজুদ্দিন আহমদের উপর জোরপূর্বক দিনাজপুরে কারফিউ জারি করতে বললেন কিন্তু ডিসি তা প্রত্যাখ্যান করলেন। বিষয়টি প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর অবাঙ্গালী ইপিআরেরা (যাদের অধিকাংশই ছিল বিহারী) ডিসিকে অপসারণের উদ্দেশ্যে দাঙ্গা শুরু করলো যেন কারফিউ জারি করা হয়। তারপর আমি মিঃ জামানের বাড়িতে গিয়ে অধ্যাপক ইউসুফ আলীকে ব্যাপারটি জানালাম। পাশাপাশি আওয়ামীলীগ এমএনএ এবং অন্যান্য নেতাদের বিভিন্ন সূত্রের মাধ্যমে অবগত করলাম।

.

১৯/২০মার্চ ৭১’এ ক্যাপ্টেন এডজুটেন্ট নজরুল ইসলামকে অপসারিত করে পাঞ্জাবী ক্যাপ্টেন জাভেদ ফিরোজকে এডজুটেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেয়া হল। অন্যদিকে বাঙ্গালী কমান্ডার এন/সাব মোয়াজ্জেম হোসেনের পরিবর্তে একজন বিহারী কমান্ডার নিয়োগ করা হল। যার ফলে বাঙ্গালী ইপিআর সৈন্যরা একটা পর্যায়ে কিছুটা হতাশ হয়ে পড়ল। এটা লক্ষ্য করে আমি তাদের হতাশ না হয়ে বরং সুসংগঠিত ও সতর্ক থাকার নির্দেশ দিলাম।

.

২৩-৩-৭১ তারিখ বেলা সাড়ে নয়টার দিকে সেক্টর কমান্ডার আমাকে ফোনে সৈন্যদের জন্যে ‘বড়খানা’ এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে বললেন। দুপুরে সেক্টর কমান্ডার আমাকে ২৬ এফএফ রেজিমেন্টের সৈন্যদের বড়খানায় নিমন্ত্রণের নির্দেশ দিলেন। বেলা চারটার দিকে আমি গোপন সূত্রে খবর পেলাম যে বড়খানায় এফএফ রেজিমেন্টের অর্ধেক লোক উপস্থিত থাকবে এবং বাকিরা সশস্ত্র এসে আমাদের কোট ম্যাগাজিন দখল করবে। সাথে সাথে আমি আমার বাঙ্গালী সৈন্যদের সতর্ক করে দিলাম। আল্লাহর রহমতে ঐ রাতে কোন দুর্ঘটনা ঘটেনি।

.

২৪-৩-৭১ তারিখে শহরে উদ্বেগ সৃষ্টি করতে পাক বাহিনীর ফাকা গুলিবর্ষণ আমাদের মধ্যে একটু মানসিক অস্থিরতা তৈরি করল। ২৩শে মার্চ থেকে পাকিস্তানী আর্মিদের উপর সতর্ক দৃষ্টি রাখার জন্যে আমি আমার রাত্রিকালীন প্রহরীর সংখ্যা বৃদ্ধি করলাম।

.

২৪শে মার্চ পাক আর্মি আমাদের সীমারেখার দিকে তাক করে দিনাজপুর সার্কিট হাউজ কম্পাউন্ডে কিছু স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র বসাল।

.

২৫শে মার্চ রাত ১টা ৩০ মিনিটে ঘুম থেকে উঠে আমি তাহাজ্জুদ নামাজে দাড়াতেই এডজুটেন্ট ক্যাপ্টেন জাভেদ ফিরোজের কাছ থেকে ফোন আসল এবং তিনি আমাকে তৎক্ষণাৎ ইউনিফরম পড়ে সাক্ষাৎ করতে বললেন যা আমাকে কিছুটা হতভম্ব করল। যাই হোক আমি গুলিভর্তি একটি রিভলভার সহ ইউনিফর্ম পড়ে বের হতেই একটা জীপ এসে হাজির হল। গাড়িতে দুজন অবাঙ্গালী যাত্রাসঙ্গি বসে ছিল। গাড়িতে করে আমি যখন দিনাজপুর ডিসি এর বাসস্থান অতিক্রম করে যাচ্ছিলাম তখন দেখলাম তার বাংলো পাক আর্মিরা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ে ঘেরাও করে রেখেছে। সেক্টর কমান্ডারের বাড়িতে পৌঁছে দেখলাম আমাদের অফিসারেরা আলোচনা সভার আয়োজন করেছে। সেখানে বাঙ্গালী অফিসারদের দেখে আমার মানসিক অস্থিরতা কিছুটা কমল। সেক্টর কমান্ডার আমাকে জানালেন যে ঢাকা, চিটাগাং, রাজশাহী, খুলনা এবং অন্যান্য জেলায় প্রশাসনের ব্যর্থতার কারণে অগ্নিকান্ড, লুটপাট, নারী ধর্ষণসহ অসংখ্য অসামাজিক ঘটনা ঘটেছে। রাষ্ট্র ও জনগণের স্বার্থে পাক আর্মি এবং ইপিআর পূর্ব পাকিস্তানের প্রশাসনের ক্ষমতা দখল করে নিয়েছে। সেক্টর কমান্ডার আমাকে লাইনে থাকা সৈন্যদের বিনোদন কক্ষে একত্রিত করার নির্দেশ দিলেন। তদনুযায়ী আমরা ইপিআর পৌঁছলাম এবং সেক্টর কমান্ডার সবাইকে শহরের মূল পয়েন্টগুলো পিকেট দিয়ে বন্ধ করে দিতে বললেন (শ্রোতাদের অধিকাংশই ছিল অবাঙ্গালী)। আমি যখন বিশ্রামের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, তখন সার্কিট হাউজে অবস্থিত আর্মি হেডকোয়ার্টার থেকে আমাকে ফোনে ডেকে পাঠানো হল।সেখানে যাওয়ার পর সেক্টর কমান্ডার, নিরাপত্তা অফিসার মেজর রাজা সিদ্দিক এবং মেজর দুররানী হাসিখুশি মুখে স্বাগত জানিয়ে দিনাজপুর জেলায় কারফিউ জারির একটি নির্দেশনামা বাঙ্গালায় লিখে দিতে বললেন। আমি আদেশ অনুযায়ী কাজটি করলাম। আমাকে বাংলায় কারফিউ জারির ঘোষণা দিতে বললেন। কারফিউ জারির ঘোষণা দেয়ার সময় আমার সাথে উপরোক্ত অফিসারেরা ছিল এবং এফএফ রেজিমেন্টের একজন গার্ড আমার পিছনে ছিল। রাত তিনটায় ঘোষণা আরম্ভ হল শেষ হল বেলা সাড়ে নয়টায়। তারপর আমাকে সারাদিন বিশ্রাম দেয়া হল।

.

২৬-৩-৭১ তারিখে সারা দিন ধরে আর্মি এবং ইপিআর শহর এবং চারপাশের এলাকা সমূহে পাহারারত ছিল। কিছুকিছু এলাকায় সারাদিন ধরে পিকেট বসিয়ে রাখা হল এবং কিছু এলাকায় জনগণ রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছিল বলে আর্মিরা কয়েকজনকে গুলি করে হত্যা করেছে। রাতে আর্মিরা এবং ইপিআরের অবাঙ্গালী অফিসারেরা গুরুদাস তালুকদার, বড়দা চক্রবর্তীসহ অন্যান্য নেতাকর্মী ও কয়েকজন হিন্দু বণিকদের গ্রেপ্তার করে।

.

২৭-৩-৭১ তারিখে ৮ উইং কমান্ডার এবং এডজুটেন্ট আমাকে বললেন প্রচার অফিসারকে শহরে কারফিউ ঘোষণা করার সময় সাহায্য করতে। আমি কাজ শেষ করে সাড়ে ১১টায় ফিরলাম। তারপর সেক্টর কমান্ডার আমাকে লাইনে থাকা সৈন্যদের জড়ো করার নির্দেশ দিলেন এবং তিনি আওয়ামীলীগ ও বঙ্গবন্ধুকে অভিযুক্ত করে বলা ইয়াহিয়া খানের কথা গুলোকে সবার সামনে পুনরায় বললেন।

.

তারপর কিউএম ক্যাপ্টেন নাজির আহমেদ এবং সাব আতাউল হককে এক প্লাটুন সৈন্যসহ ঠাকুরগাঁও পাঠানো হল। আমি আতাউল হকের অভাব অনুভব করছিলাম যেহেতু সে ছিল দিনাজপুর যুদ্ধে আমার ডানহাত। পিকেট কমান্ডার এন/সাব লুতফর রহমান আমাদের ২১/সি এর আবাসস্থলে আক্রমণ করার জন্যে জনগণকে ফুসলিয়েছে এই অজুহাতে সেক্টর কমান্ডার অযথা তাকে হুমকি দিল। এটা ছিল তাকে সরিয়ে একজন অবাঙ্গালী নিয়োগ দেয়ার ফন্দি মাত্র। দিনের মধ্যভাগে কিছু বিহারী এসে সেক্টর কমান্ডারকে জানাল যে কাঞ্চন নদীর নিকটে এবং অন্যান্য দূরবর্তী এলাকা গুলোতে বিহারীদেরকে আক্রমণ করার উদ্দেশ্যে বাঙ্গালীরা একত্রিত হচ্ছে। আমি খোজ নিয়ে সেক্টর কমান্ডারকে অবগত করলাম যে ব্যাপারটি মিথ্যা। সারাদিন আর্মি এবং ইপিআররা শহরে প্যাট্রল দিল। ১২ বছরের এক শিশু রাস্তা পারাপারের সময় আর্মিরা তাকে গুলি করে হত্যা করে।

.

২৭-৩-৭১: সন্ধ্যায় সেক্টর কমান্ডার তার অবাঙ্গালী অফিসারদের কুমন্ত্রণায় রংপুর ব্রিগেড থেকে আরো কিছু সৈন্য আনার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে পাহারারত সৈন্য দিয়ে বন্ধ রাস্তার আশেপাশে ১৪জনকে গুলি করে হত্যা করে।

.

২৭/২৮ মার্চ রাতে পাক আর্মিরা ছেহেল গাজী ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের ভাই হাবিব সহ তাদের তালিকাভুক্ত আরো কয়েকজনকে ধরে নিয়ে হত্যা করে। তাদের মৃতদেহ রাজবাড়ি জঙ্গল, ফুলহাট ব্রিজ এবং ওয়াপদার খাদ থেকে উদ্ধার করা হয়। সকালে এ সকল লাশ দেখে মানুষ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে।

.

ইতোমধ্যে আমি গোপনসূত্র খবর পেলাম যে, সকল এমএনএ ও এমপিএ এবং শহরের মান্যগণ্য নেতাকর্মীদের আর্মি হেডকোয়ার্টারে ডেকে হত্যা করা হবে। এর পর ১৭টার সময় আক্রমণ চালিয়ে সকল বাঙালী ইপিআর হত্যা করা হবে। কিন্তু আমি তাদেরকে গোপনে এ খবর পৌঁছে দিলাম। তারা হেডকোয়ার্টারে আসেনি।

.

২৮-৩-৭১ (রবিবার): প্রায় সাড়ে ১০টায় হ্যাভ নাজিম আমার কাছে এসে জানাল যে তার আগের দিন পাক আর্মিরা ২০০ বাঙ্গালীকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। বলতে গিয়ে সে কেঁদে ফেলল। পরবর্তী পদক্ষেপ কি হবে সেটা জানার জন্যে ৮ উইং কমান্ডার হ্যাভ মুসলিম আলী তাকে আমার কাছে পাঠিয়েছে। আমি নাজিমকে ইশারায় অপেক্ষা করতে বললাম এবং বললাম যে তারা যেন আমাদের গোপন পরিকল্পনা অনুযায়ী এগিয়ে যায়। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে বিহারী সুবেদার বাদশা আহমাদকে তার বর্ডার কয় থেকে ডেকে পাঠানো হয়েছে। মার্চের ২৮ তারিখ যদিও রবিবার ছিল, তবুও সেক্টর কমান্ডার এবং অন্যান্য অবাঙ্গালী অফিসারেরা বেলা ২টা পর্যন্ত মিটিং করলো। মিটিং শেষ করার পর বাদশা আহমাদকে বাইরে ব্যবহারের জন্যে একটি পিআই সরবরাহ করাহল। দিনাজপুরে আর্মি আসার পর থেকেই ইপিআরে আর্মি সংকেত দেয়া ছিল। দায়িত্ব প্রাপ্ত এনসিও কে সার্কিট হাউজে ডাকা হল এবং তিনি এসে বাঙালি সৈন্যদের সেট বন্ধ করে দিতে বললেন। বাদশা আহমেদ ওয়্যারলেস সেট বন্ধ করাসহ ৩” মর্টার, এমএমজি, এলএমজি এবং একটি পিআই দাবী করার কারণে আমরা ‘H’ ঘণ্টা, এক ঘণ্টা ১৫ মিনিট আগেই স্থানান্তরিত হতে বাধ্য হলাম। অফিসারেরা অফিস ত্যাগ করা মাত্রই পরিকল্পনা অনুযায়ী বাদশা আহমাদের সৈন্যদের দেয়া অস্ত্র আমরা আমাদের সৈন্য দিলাম। আমাদের সৈন্যরা তাদের অবস্থান নেয়া মাত্রই সার্কিট হাউজ থেকে গুলি শুরু হল। আমাদের একদল সৈন্যকে অবাঙ্গালী ইপিআর দের দমন করার জন্যে পাঠিয়ে দিয়ে আমরাও পাল্টা গুলি শুরু করলাম। গোলাগুলি এতটাই তীব্র ছিল যে আমি আমার আরভি-তে পৌছাতে পারলামনা কারণ আমার কোয়ার্টার ছিল সার্কিট হাউজ এবং ইপিআরের মাঝে। গোলাগুলি একটু থামার পর আমি আরভি- তে পৌঁছেই অপারেশন শুরু করার নির্দেশ দিলাম। ফেরিঘাট ও রেলওয়ে ব্রিজ দিয়ে শত্রুর আক্রমণ ঠেকানোর জন্যে কাঞ্চন ব্রিজে একটি এমএমজি ৩” মর্টার বসানো হল। প্রত্যেক বিওপি’তে দুজন করে লোক রেখে বাকিদের আমাদের সাথে যোগ দিতে বললাম।

.

২৯-৩-৭১ তারিখে দিনাজপুরে যুদ্ধ শুরু হলে আমাদের সবাই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল এমন কি দিনাজপুরের যুবক শ্রেণী ও আমাদের যথেষ্ট সাহায্য করেছিল।

.

৩০-৩-৭১: সারাদিন যুদ্ধ চললো। বাঙ্গালী ইপিআর ৬ পাউন্ডর এন্টি-ট্যাংক গান ব্যবহারসহ সর্বচ্চ শক্তি দিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে গেল। আমরা এন্টি-ট্যাংক গান ব্যবহারের ফলে পাক জান্তা ধারনা করে নিলো যে ভারতীয় আর্মি ট্যাঙ্ক দিনাজপুরে ঢুকে পড়েছে। ইতোমধ্যে শহর ও পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে অসংখ্য পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ আমাদের সাথে যোগ দিয়েছে।

.

৩০শে মার্চ সন্ধ্যা নাগাদ আমরা আমাদের যাবতীয় অস্ত্র ও গোলাবারুদ কাঞ্চন ব্রিজের বিপরীত পাশে সরিয়ে নিলাম। আমরা সেখানে রিয়ার হেডকোয়ার্টার স্থাপন করলাম সেখানে শত্রুরা আমাদের উভয় দিক থেকেই আক্রমণ করে ব্যর্থ হল। ৩০শে মার্চ পর্যন্ত অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে আমরা যুদ্ধ চালিয়ে গেলাম।

.

৩১শে মার্চ ভোরে সাব এমজি, এন/সাব আমির আলী এসকে, এন/সাব মোয়াজ্জেম হোসাইন, এন/সাব মীর মোকাদ্দাস, এন/সাব মমিনুল হক তাদের সৈন্যসহ আমাদের সাথে যোগ দিল। প্রায় ৪০০/৫০০ সৈন্য নিয়ে আমরা শত্রুকে কোণ ঠাসা করে ফেললাম। অন্যদিকে Coy কমান্ডার sub সুকুর পার্বতীপুরের দিকে এগিয়ে গেল।

.

২৯/৩০ মার্চ রাতে সৈয়দপুর থেকে পাক সৈন্যদের জন্যে ফিল্ডগান পাঠানো হলেও রাস্তাঘাট বন্ধ থাকার কারণে সেগুলি তাদের কাছে পৌঁছেনি। ৩১শে মার্চ দুপুরে শত্রুপক্ষ ভয়াবহ আক্রমণের স্বীকার হল। সৈয়দপুর থেকে পাকবাহিনীর জন্যে আসছে জেনে পাক সেক্টর কমান্ডার কর্নেল কোরায়েশী অসংখ্য সৈন্য নিয়ে ফুলবাড়ি রোড দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল কিন্তু সেখানে তারা সাব সুকুরের কয়দের দ্বারা বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে শত্রুরা রাস্তা পরিবর্তন করে মোহনপুর ব্রিজের কাছাকাছি যাওয়ার পর সেখানে আমাদের আরেক দল সৈন্য তাদের আক্রমণ করে। সেখানে বাধাগ্রস্ত হয়ে পাকবাহিনী রাজবাড়ি-রানীনগর সড়ক দিয়ে সৈয়দপুরের দিকে গেল। ভুষির বন্দর এরিয়ায় শত্রুরা আমাদের উপর গুলি ছুড়তে আরম্ভ করে ফলে আমরা আর বেশি দুর তাদের ধাওয়া করতে পারিনি।

.

৩০/৩১ মার্চ পুরো রাত বাঙ্গালী ইপিআর গুলি চালালো কিন্তু পাক সৈন্যদের কোন পালটা জবাব না পেয়ে আমাদের সৈন্যরা আরো ১০ কি.মি.  সামনে এগিয়ে গেল। শত্রুর মোকাবেলা করার জন্যে রাজবাড়ি দিঘীর ডানপাশে রানীনগর ভুষি এলাকায় এন/সাব লুতফর রহমানের নেতৃত্বে একটি পি.আই রাখা হল এবং আমরা দিনাজপুর শহরে শত্রুর সব প্রবেশপথ দখল করে ফেললাম। ৩১ তারিখ দুপুরের মধ্যে আমরা পুরো দিনাজপুর শহর শত্রু মুক্ত করলাম।

.

৩১-৩-৭১ তারিখে সবই পিআর সৈন্য এবং প্রায় ১৫০/২০০ পুলিশ, আনসার ও জিহাদি প্রতিরক্ষা বুহ্য গড়ে তুলল। বেলা নয়টার দিকে দিনাজপুর জেল খুলে দেয়া হলে মি. গুরুদাস তালুকদার, বড়ুদা ভূষণ চক্রবর্তী, ছাত্রসহ সব রাজনৈতিক নেতারা মুক্তি পেল। সকল সরকারী এবং বেসরকারি ভবনে বাংলাদেশের পতাকা উড়ানো হল এবং এসডিও, পুলিশ এবং বেসামরিক কর্মকর্তাদের যার যার দায়িত্ব পালন পুনরায় শুরু করার নির্দেশ দেয়া হল।

.

৩০/৩১ মার্চ সন্ধ্যায় হ্যাভ ইদ্রিসের প্যাট্রোল পার্টি মেজর এম এইচ চৌধুরী, ক্যাপ্টেন নজরুল হক, মি. ফাইজুদ্দিন আহমেদ, জেলা জজ মি. শাহাদাত হোসেন সহ আরো কয়েক জনকে সপরিবারে উদ্ধার করলো যদিও আমরা খবর পেয়েছিলাম যে ২৮/২৯ তারিখে পাক আর্মিরা তাদের সবাইকে হত্যা করে ফেলেছে।

.

ঠাকুরগাঁও অপারেশনে পাঞ্জাবী ক্যাপ্টেন নাভীদ আলম ও তার স্ত্রীকে বাচাতে গিয়ে আমাদের বাঙ্গালী কিউ এম ক্যাপ্টেন নাজির আহমেদ জনগণের হাতে খুন হয়। সে দায়ী করেছিল যে নাভিদের স্ত্রী তার বোন হয়। সাব আতাউল হক, এল/এন কে জয়নাল আবেদীনও একই ভাবে খুন হয়।

.

১-৪ এপ্রিল পর্যন্ত দিনাজপুরে আমরা পুলিশের সহায়তা নিয়ে শহর ও আশেপাশের এলাকাগুলোতে চিরুনি অভিযান চালালাম এবং সবাই নিজ নিজ কাজ নিরাপদে শুরু করল। পরিবহন পুনরায় চালু করা হল।

.

১লা এপ্রিল আমি রিয়ার হেডকোয়ার্টারে ক্যাপ্টেন নজরুল হককে রেখে আমার শহরের হেডকোয়ার্টারে গেলাম। সেখানে প্রতিরক্ষা বুহ্য আরো প্রসারিত করলাম। ভুষির বন্দর থেকে সৈন্যদের আরো ১০ মাইল এগিয়ে নিলাম। পার্বতীপুর ও সৈয়দপুর দিয়ে শত্রুর আগমন দমাতে প্রতিরক্ষা রাজবাড়ি থেকে শিবপুর নালা পর্যন্ত প্রসারিত করলাম। ফুলবাড়ি রুট এবং ট্রেন দিয়ে আসা শত্রুর আগমন ঠেকাতে প্রতিরক্ষা আনন্দনগর থেকে ছিরির বন্দর পর্যন্ত বিস্তৃত করা হল।আরও দিকে সাব শুকুর পার্বতীপুর আক্রমণ করলো।

.

৩/৪ এপ্রিল ক্যাপ্টেন আশরাফের একটি পি.আই এবং শিবগঞ্জ এয়ারপোর্ট সম্পর্কে তথ্য নেয়ার জন্যে ৩য় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট অনেক প্ররোচনার পর আমাদের সাথে যোগ দিল। এয়ারপোর্ট সম্পর্কে তথ্য নিয়ে সৈয়দপুর ফিরে যাওয়ার পথে সমস্যা শুরু হল। ফলে তারা ঠাকুরগাঁওয়ে আটকে গেল।

.

২/৩ থেকে ৪/৫ এপ্রিল পর্যন্ত, যখন আমাদের সীমান্তবর্তী সব লোকজন দিনাজপুর পৌঁছল, আমরা আমাদের পিআই/কপি দের চিনতে পেরে তাদেরকে দিনাজপুর জেলার বিভিন্ন ফ্রন্টে নিয়োজিত করলাম। এই কাজে এমএনএ/এমপিএ, সাধারণ জনগণ এবং ছাত্র সমাজ যথাসম্ভব আমাদের সাহায্য করেছিল।

.

৩/৪ এপ্রিল আমি সাব মেজর কাজিমুদ্দিন, ক্যাপ্টেন নজরুল হক, ক্যাপ্টেন আশরাফ, মেজর এমএইচ চৌধুরী এবং মেজর এমটি হোসাইন (অবঃ)ভাটগাও ব্রিজে আমাদের পরবর্তী কর্মপরিকল্পনা নিয়ে বৈঠক করলাম।

.

মেজর এমটি হোসাইন এর মত বিখ্যাত এবং অভিজ্ঞ অফিসার পেয়ে আমরা ব্যাপক আকারে অপারেশন চালিয়ে শত্রুদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়ার পরিকল্পনা হাতে নিলাম। পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা মূল পয়েন্টে আমাদের সৈন্য মোতায়েন করলাম এবং শক্তিশালী বুহ্য গড়ে তুললাম।

.

হানাদার বাহিনী যাতে জংগল দিয়ে দিনাজপুর শহরে ঢুকতে না পারে সেজন্য এন/সাব লুতফর এবং হ্যাভ কিবরিয়ার নেতৃত্বে আমরা রাজবাড়ি ও রানীনগর রোডে সৈন্য মোতায়েন করলাম। ক্যাপ্টেন নজরুল হককে ইপিআর সৈন্যদের অপারেশন কমান্ডার হিসেবে নিয়োগ করা হল। হেডকোয়ার্টারে প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রাখা হল মেজর ওসমান গনিকে। আমি তখন দিনাজপুর শহর ও তার আশেপাশের এলাকা এবং রানীনগর এলাকার কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করছিলাম। ২/৩ এপ্রিল থেকে ৭৭/৭৮ বিএসপি অফিসারেরা আমাদের সাথে নিয়মিত দেখা করে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিত। আমরা তাদের কাছে ভারি অস্ত্র সাহায্য চেয়েছিলাম কিন্তু তারা আমাদের কোন এক কারণে ছোট ছোট অস্ত্র সরবরাহ করলো। আমরা ঘোরাঘাট এবং ভাটাগাও ব্রিজ এলাকায় সৈন্য মোতায়েন করলাম।

.

নীলফামারী সংঘর্ষঃ ৬ এবং ৭ এপ্রিল ৮ উইং এর সাব এমজি দের ৭১ কয় এর সাথে শত্রুপক্ষের বিভীষিকাময় যুদ্ধে একজন ইপিআর জওয়ান এবং দুজন আনসার নিহত হল এবং কয়েকজন আহত হল। যুদ্ধে আমাদের আইএমজি [ভিকার] ও একটি ৩” মর্টার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় আমাদের সৈন্যরা সেখান থেকে দেবীগঞ্জের দিকে গেল। হানাদারেরা নীলফামারীতে ঢুকে সাধারণ মানুষের উপর পাশবিক তান্ডব চালালো।

.

বদরঞ্জযুদ্ধঃ  ৮ এপ্রিল, হানাদার বাহিনীর সাথে বদরগঞ্জে তুমুল সংঘর্ষ বাঁধল। আমাদের অবস্থান সম্পর্কে রাজাকাররা তাদের আগেই জানিয়ে দিয়েছিল। ফলে আমাদের সৈন্যরা আকস্মিক আক্রমণের শিকার হয়েছিল রংপুরে। যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর ক্যাপ্টেন নিহত হল এবং  এসপি’কে আটক করা হল। আমাদের দুজন সিপাহী এবং একজন গাড়িচালক নিহত হল এবং ক্যাপ্টেন আনোয়ার পায়ে আঘাত পেয়েছিল। পাক বাহিনীর ক্ষয়ক্ষতি ছিল বর্ণনাতীত। পরে সৈন্যদের বদরগঞ্জ থেকে ফুলবাড়ি ডিফেন্সে নিয়ে যাওয়া হল। ফুলবাড়ি থেকে গিয়ে এন/সাব কাউছারের ইপিআর সৈন্যরা মোহনপুর ব্রিজে প্রতিরক্ষা ঘাটি তৈরি করল। একইসাথে এন/সাব মমিনুল হক তার পি.আই  নিয়ে নওগাঁ এলাকায় স্থানান্তরিত হল।

.

ভুষির বন্দরঃ ৭ এবং ৮ তারিখে পাক বাহিনীর সাথে যুদ্ধে আমরা মেজর আশরাফকে হারালাম। ভুষির বন্দর থেকে আমরা আমদের সৈন্যদের দশমাইল-এ (টি জাংকশন) মোতায়েন করলাম। সেখান থেকে একটি সড়ক দিনাজপুরের দিকে গেছে আরেকটি গেছে ঠাকুরগাঁও উপ-বিভাগে।

.

আমি ৮ এপ্রিল সেখানে কমান্ডারে দায়িত্ব নিলাম। ঐদিন সন্ধ্যা থেকেই পাক বাহিনী আমাদের উপর ফিল্ডগান দিয়ে বোমা বর্ষণ শুরু করে। ৭/৮ এপ্রিল বিবিসির  একটি টিম আমাদের এলাকা পরিদর্শনে আসে।

.

দশমাইলঃ ভুষির বন্দরের পর আমাদের সৈন্যরা আরো শক্তি বাড়িয়ে দশ মাইল এলাকায় নিরাপত্তা বেষ্টনী গড়ে তোলে। ক্যাপ্টেন নজরুল ইসলামের অনুপস্থিতিতে আমি ৮ এপ্রিল সেখানে কমান্ডারের দায়িত্ব নিলাম। বিখ্যাত কান্তনগর মন্দির এলাকা থেকে নাশিপুর পাট গবেষণা এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। রানীনগর রাজবাড়ি সড়কে প্রতিরক্ষার দায়িত্বে ছিল এন/সাব এল রহমান এবং কিবরিয়া। হানাদারদের সাথে যুদ্ধে আমাদের অস্ত্রের পরিমাণ অপর্যাপ্ত হয়ে গেল। তবুও আমি দশমাইল থেকে দুই মাইল সামনে শত্রুদের আগমন ব্যাহত করতে কিছু সৈন্য পাঠালাম।

.

৯ তারিখ সকাল থেকে ১০ তারিখ বিকেল পর্যন্ত পাক আর্মিরা তিনটি অক্ষ থেকে আর্টিলারি গান দিয়ে আমাদের উপর লাগাতার গোলাবর্ষণ করলো। আমাদের দশজন সৈন্য নিহত হল এবং  তুললাম ফলে শত্রুরা আর এগোতে পারল না। আমরা দশমাইল এলাকায় যুদ্ধ করার সময় মি. রহিম এমপিএ ব্যতীত অধিকাংশ এমএনএ/এমপিএ এবং জেলা কর্মকর্তা ভারত চলে যায় যেটা সৈন্যদের মনোবলে একটা কুপ্রভাব ফেলেছিল। দুঃখজনক ব্যাপার হল ভারি অস্ত্রের অভাবে আমরা যুদ্ধে বারবার পরাজিত হতে লাগলাম।

.

ভাটাগাও ব্রিজ ছিল পাক আর্মিদের সৈয়দপুর থেকে দিনাজপুরে ঢুকার সম্ভাব্য প্রবেশ পথ। সেখানে আমরা শত্রুকে প্রতিহত করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। ১০ এপ্রিল দশমাইল এবং ভাটাগাও এলাকায় পরাজিত হয়ে ৯ উইং কন্টিনজেন্ট ঠাকুরগাঁয়ে অবস্থান নিলো। তারা কিছুক্ষণের জন্যে পাক বাহিনীকে তারা খানসামা ও দেবীগঞ্জ এলাকায় প্রতিহত করতে পেরেছিল। দশমাইল এলাকার পরাজিত হওয়ার পর দিনাজপুর এবং ঠাকুরগাঁও ফোরসের মধ্যে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।

.

দিনাজপুর শহরের পতনঃ ১৪-০৪-৭১ তারিখে ৭/৮ ঘণ্টা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর বেলা তিনটার দিকে  পাক বাহিনী উভয় দিক থেকে ট্যাংক ও আর্টিলারি নিয়ে দিনাজপুর শহরে প্রবেশ করলো এবং মানুষের উপর পাশবিক তান্ডব চালাল। এই যুদ্ধে আমাদের ৫ জন সৈন্য নিহত হল। বাঁ প্রান্তে থাকা আমাদের সৈন্যরা বিরাল সীমান্তের দিকে গেল আর আমরা বড়গ্রাম সীমান্তের দিকে পিছিয়ে গেলাম। প্রায় রাত তিনটায় আমিসহ কয়েকজন বড়গ্রাম পৌছলে গ্রামবাসী আমাদের আশ্রয় দিল। বড়গ্রামের বিপরীত পাশে আম্লিয়া নামে বিএসএফের একটি ক্যাম্প ছিল। আমাদের সৈন্যরা সীমান্তবর্তী বিওপিতে অবস্থান নিলো। বাকিরা ১৪ তারিখ সন্ধ্যার মধ্যে বিভিন্ন রুট দিয়ে বড়গ্রাম পৌঁছল।

.

বিরাল যুদ্ধঃ পাক বাহিনী দিনাজপুর দখল করে নেয়ার পর আমরা দুই অক্ষে বিভক্ত হয়ে গেলাম। একটা অংশ বড়গ্রাম, খানপুর, মোহনপুর এবং আম্লিয়ার বর্ডারের দিকে গেল। আরেক অংশ গেল বিরাল বর্ডারের দিকে যেখানে নজরুল হক এবং ওসমান গনির তত্বাবধানে আমাদের রিয়ার হেড কোয়ার্টার ছিল। বিরাল ছিল কাঞ্চন নদীর পশ্চিম পাশে সেখানে স্থানীয়রা আমাদের সার্বিক সহায়তা করেছে। ১৬/১৭ তারিখে বিকেল ৪ টায় পাক বাহিনী বিরালে আক্রমণ চালিয়ে বিরাল দখল করে নেয়। প্রাক্তন ইপিআরের Hav নাসির আলী যুদ্ধে শহীদ হয়।

.

বিরাল থেকে আমরা  বাংলাদেশের শেষ সীমান্ত পাঁচপাড়া গ্রামে পিছিয়ে গেলাম। ক্লান্ত-অবিশ্রান্ত সৈন্যরা সব ব্যাপারে হতাশ হয়ে গেল। বিএসএফ আমাদের অস্ত্র ও খাদ্য দিয়ে সহায়তা করল ফলে আমরা আবার পাক আর্মিদের বিরুদ্ধে আক্রমণের প্রস্তুতি নিলাম। ইতোমধ্যে বিরাল দখলের পর হানাদাররা কিশোরগঞ্জ দখল করে নিয়েছে। আমাদের পরিকল্পনা ছিল  কিশোরগঞ্জ ও পাঁচপাড়া এলাকা শত্রু মুক্ত করা। তদনুযায়ী আমরা ২রা মে কিশোরগঞ্জ বিওপি এলাকায় আক্রমণ করলাম তিন অক্ষ থেকে। দিনাজপুরের ছাত্ররাও আমাদের সাথে যোগ দিল। ১০/১৫ কি. মি. দুর থেকে হানাদারেরা রাধিকাপুরে ভারতীয় সরকারের প্রতিষ্ঠিত উদ্বাস্তু ক্যাম্পে দুর পাল্লার গোলা বর্ষণ করল ফলে একজন নিহত ও কয়েকজন আহত হল। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ মুক্তি বাহিনীকে যুদ্ধ বন্ধ করার চাপ দিল। যাইহোক বহু চেষ্টার পর বাঙ্গালী ইপিআর, আনসার, মুজাহিদ এবং ছাত্ররা দখল করলো।

.

৩রা মে বিএসএফ মেজর বেদি রাধিকাপুর এসে মেজর ওসমান গনিকে সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে পাক বাহিনীর উপর হামলা চালাতে নিষেধ করলেন। কিছুদিন গেরিলা যুদ্ধ চলল। এতে আমাদের সিপাহী তোতা মিয়া শহীদ হল।

.

পরদিন পাক আর্মি বিএসএফকে বাঙ্গালী ইপিআরদের তাদের কাছে হস্তান্তর করার জন্য পতাকা বৈঠকে আহবান জানাল। তারা দাবি করলো যে তার আগের দিনের যুদ্ধে বাঙালি ইপিআর তাদের ৫০ জন সৈন্যকে হত্যা করেছে। বিএসএফ সেখানে কোন বাঙ্গালী সৈন্য অবস্থানের কথা সরাসরি অস্বীকার করল। তারপর থেকে আমরা জুন পর্যন্ত পাক সৈন্যদের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে গেলাম।

.

মেজর রবের অধীনে যে সৈন্যরা বড়গ্রাম, খানপুর এবং আম্লিয়া সীমান্তে অবস্থান নিয়েছিল তাদেরকে ঐ এলাকায়    শত্রু আক্রমণ ঠেকাতে পাহারায় রাখা হল। মেজর নিজাম ও ক্যাপ্টেন আনোয়ারের অধীনে ৩য় বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি শক্তিশালী দল ফুলবাড়ি এবং পাহাড়ি এলাকায় ইপিআরের সাথে যোগ দিল। পাহাড়ি এলাকায় পরাজয়ের পর তারা ভারতের পাহাড়ি এলাকায় অবস্থান নিলো।

.

ভারতীয় হিলি এলাকায় আমাদের সৈন্যরা কুরমাইল টেকনিক্যাল স্কুল এবং সুব্রা এলাকায় সমবেত হল। উল্লেখ্য যে আমার সাথে দশ মাইল এলাকায় যুদ্ধ করা এন/সাব নাসির মিয়ার অধীনে থাকা ৩য় ইপিআর সৈন্যদল ও আমার সাথে ছিল এবং তারা বর্ষগ্রাম এলাকায় সক্রিয় ছিল।

.

আমরা নওগাঁ ইপিআর ফোরসের সাথে কুরমাইল এবং সুব্রা এলাকা থেকে মোহনপুর ব্রিজ, ফুলবাড়ি, পাঁচবিবি, জয়পুরহাট, ধামুরহাট পড়শিপাড়া এলাকা ও হিলির আশপাশের এলায় পাক আর্মিদের উপর অতর্কিত হামলা চালাতে লাগলাম। মি. এম এ জলিল, মি. বায়তুল্লাহ এমএনএ, জাহাঙ্গীর এমএনএ এবং আমজাদ হোসেন এই এলাকায় এসে ২/৩টা যুব ক্যাম্প খুলল এবং সৈয়দ হায়দার আলী এমএনএ এবং সিরাজগঞ্জের অধ্যাপক আবু সায়ীদ এমএনএ গেরিলাদের প্রশিক্ষণ দিতে দুইটা যুব ক্যাম্প খুলল। ৭ উইং ইপিআর ওয়ান এর লে. (অপসারিত) ইদ্রিস বি ইউ স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করলো। সে ছিল একজন বীর যোদ্ধা।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!