You dont have javascript enabled! Please enable it!

ডাঃ আব্দুল করিম আহমদ
গ্রাম- সাপটানা
লালমনিরহাট, রংপুর

৪ ঠা এপ্রিল ১৯৭১, হানাদার বাহিনীর লালমনিরহাট প্রবেশের পূর্ব পর্যন্ত লালমনিরহাট বাসভবনে ছিলাম। হানাদার বাহিনী প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে আমি পূর্বদরজা গ্রামের বাড়ীতে আশ্রয় গ্রহণ করি। কয়েক দিন পর গোপনে আমি আমার পরিত্যক্ত বাসভবন এবং ডিসপেনসারি দেখতে আসি। লালমনিরহাট শহরের পথিমধ্যে আমি অবাঙালিদের বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দল দেখতে পাই। আমার বাসবভনে ঢোকার কিছুক্ষণ পর জনৈক ব্যক্তি আমাকে জানায় যে অবাঙ্গালীদের বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দল দেখতে পাই। আমার বাসবভনে ঢোকার কিছুক্ষণ পর জনৈক ব্যক্তি আমাকে জানায় যে অবাঙ্গালীরা আমাকে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র করেছে। এ খবর পেয়ে আমি পূর্বদিক দিয়ে দ্রুত
বের হই। অবাঙ্গালীরা আমার খোঁজ নিয়ে আমার পিছু নিয়েছিল।

৭ ই জুলাই আমি যখন আমার পূর্বদরজা গ্রাম বাসভবনে কার্যরত ছিলাম, তখন বহু হানাদার সৈন্য বিভিন্ন দলবদ্ধভাবে তিন দিক থেকে আমার বাসভবন ঘিরে আসছে দেখতে পাই। হানাদার বাহিনীর সাথে স্থানীয় কুখ্যাত অবাঙালিরা ছিল। পূর্বেই নিরাপত্তার জন্য পরিবারবর্গকে দূরে নিরাপদ স্থানে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। হানাদার বাহিনী স্থানীয় অবাঙ্গালীদের নিয়ে আমার বাড়ী ঘিরে ফেলে এবং লুটতরাজ শুরু করে। যাবতীয় মূল্যবান সামগ্রী তারা নিয়ে নেয়। ইত্যবসরে অপর একটি দল এসে পড়ে। উক্ত দলে লালমনিরহাট থানার জনৈক অবাঙালি জমিদার ছিল। এ জমিদারটি জানায় যে, আমি কেন এখনও গ্রেফতার হইনি এবং আমাকে পাকিস্তানী পতাকা প্রজ্বলন এবং আওয়ামী লীগের একজন লীডার বলে অভিযুক্ত করে। হানাদার সৈন্যরা সঙ্গে সঙ্গে আমাকে ধরে ফেলে এবং কিল, থাপ্পড়, ঘুষি, লাথি প্রভৃতি দ্বারা অবর্ণনীয় দৈহিক পীড়ন শুরু করে। অবাঙ্গালী চরেরা আমার গৃহ থেকে দুটি ভারতীয় ঔষুধ বের করে আনে। হানাদার বাহিনী আমার গ্রেফতার এবং লুটের সামগ্রীসহ মোঘলহাট রেলওয়ে স্টেশনের নিকটবর্তী রেলওয়ে সেতুর কাছে অপর একদল সৈন্যের নিকট নিয়ে আসে। এখান থেকে লালমনিরহাটে ফোন করা হয়। কিছুক্ষণ পর দুটি কামরাসহ একটি রেল ইঞ্জিন সেখানে এলে হানাদার বাহিনীর কতিপয় লোক আমাকে লালমনিরহাটে নিয়ে আসে। এখান থেকে আমার চোখ বেঁধে এরোড্রাম ঘাঁটির নিকট হানাদার বাহিনীর ঘাঁটিতে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়। এখান থেকে শুরু হয় আমার উপর দৈহিক নির্যাতন। এখানে আরো বহু লোককে নিয়ে আসা হয়েছিল।

এই ঘাঁটিতে ১৪ দিন বন্দি জীবনযাপন করি। এই সময় আমাকে দিয়ে আবর্জনা পরিষ্কার, মাঠের কাজ, কঠোর পরিশ্রমমূলক কাজ ইত্যাদি করিয়ে নেয়া হতো। তা ছাড়া চড়, কিল,ঘুষি, লাথি প্রভৃতি অতি সাধারণ ব্যাপার ছিল।

এরপর আমাকে স্থানীয় রেলওয়ে ট্রেনিং স্কুলে আনা হয়। সেখানে কয়েকটি হাজত কামরায় আরো ধৃত বাঙ্গালীদের দেখতে পাই। এখানেও আমাকে দৈহিক পীড়ন এবং কায়িক পরিশ্রমশীল কার্যে নিয়োগ করা হয়। এখানে অবস্থানকালে আমি দেখতে পাই বিভিন্ন স্থান থেকে নিরপরাধ বাঙ্গালীদের ধরে আনা হতো। বিহারীরা এদের উপর নানা প্রকার অশ্লীল মন্তব্য করতো। কখনো কখনো বিহারীরা ধৃত বাঙ্গালীদের উপর মিথ্যা অভিযোগ আনতো। সঙ্গে সঙ্গে বাঙ্গালীদের ধরে নিয়ে গিয়ে সেনাবাহিনী হত্যা করতো। এভাবে গণহত্যা ছিল নিত্যদিনের অতি সাধারণ ঘটনা।

স্বাক্ষর/-
ডাঃ আব্দুল করিম আহমদ

রকিবুল হাসান জিহান
<৮,২.২.৮৭,১৪২>
।। ৮৭।।
মোঃ লুৎফর রহমান
গ্রাম- মুন্সিপাড়া
থানা ও জেলা – দিনাজপুর

জুলাই মাসের প্রথম দিকে ভারত হতে ফিরে আসার পরে লিলি সিনেমা হলের সামনে রাত্র ৮ টার সময় ২ জন অবাঙ্গালী আবার আমাকে আটক করে। তারা বলে যে, তুমি মুক্তিযোদ্ধা, তোমার কাছে বোমা আছে, তুমি কতজন অবাঙ্গালীকে মেরেছ ইত্যাদি। তারা আমাকে মারতে মারতে তদানীন্তন সার্কিট হাউসে নিয়ে যায় এবং খান সেনাদের হাতে তুলে দেয়। খান সেনারা প্রথমে আমাকে জিজ্ঞাসা করে যে তুমি কি কাজ কর? তার উত্তরে আমি বলি যে আমি ‘পটকা, আতশবাজী’ তৈরি করি। আমার উত্তরে খান সেনারা পুনরায় জিজ্ঞাসা করে যে, পটকা কেয়া চিজ হ্যায়? উত্তরে আমি বলি যে, পটকা বিয়ের অনুষ্ঠানে ফুটানো হয় আমোদ-প্রমোদ করবার জন্য। কিন্তু খান সেনারা বলে যে, “তোম জুট বলতা হ্যায়, তোম বোম বানাতা হ্যায়।” এই বলে তারা ভীষণ মারধর আরম্ভ করে এবং সিগারেট খেয়ে জ্বলন্ত সিগারেট আমার শরীরে চেপে ধরে। ঐ সময় ছোট চাকু আমার হাতের তালুর ঢুকিয়ে দেয়। হাত পিছনে বাঁধা অবস্থায় একটা অন্ধকার কক্ষে বন্দী করে রাখে। এ অবস্থায় দুই দিন আটকে রাখে। দ্বিতীয় দিনে আমাকে কিছু রুটি খেতে দেয়।

তৃতীয় দিনে আমাকে কোমরে রশি বেঁধে জেলখানায় নিয়ে আসে। আসার সময় তারা কিল, ঘুষি, লাথি যে যা পারে মারতে থাকে। জেলখানায় আসার পর আমার দুই হাতে রশি বেঁধে একটা বীমের সাথে ঝুলিয়ে দেয়। এক সময় আমাকে উলঙ্গ অবস্থায় রাখা হয়। ঝুলানো অবস্থায় হান্টার ও রাইফেলের বাঁট দিয়ে প্রহার করতে থাকে। প্রহার করার সময় আমাকে জিজ্ঞাসা করা হয় যে, “মুক্তিযোদ্ধা কাঁহা হ্যা? হাম লোক তোমাকে বোম দেগা, তোম যাকে উলোকো মার ছাকেগা।” উত্তরে বলি যে আমি যেতে পারব না। এতে আমার শাস্তি আরো দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেয়। মারধর করার পরে আমাকে জেলখানাতেই বন্দি করে রাখে।

বলা প্রয়োজন যে, এই সময় একজন খান সেনা রাইফেলের বাঁট দিয়ে আমার মুখে আঘাত করে। ফলে আমার সামনের চারটা দাঁত ভেঙ্গে যায়। এই অবস্থায় আমার শারীরিক অবস্থা আশঙ্কাজনক মনে করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে। এই অবস্থায় আমাকে চার মাস জেলে আটকে রাখে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমি জেল হতে বের হয়ে আসি।

স্বাক্ষর/-
লুৎফর রহমান`

রকিবুল হাসান জিহান
<৮,২.২.৮৮,১৪৩>
।। ৮৮।।
নূর মোহাম্মদ
দিনাজপুর কারাগারের সিপাই

সরকারী ও বেসরকারী কর্মচারীদের কাজে যোগদানের জন্য পাক সরকার যখন নির্দেশ দেয়, তখন আমি দারুণ আর্থিক কষ্টের মধ্যে অজো পাড়াগাঁয়ে অবস্থান করছিলাম। পেটের দায় বড় দায়। কাজেই উপায়ন্তর না দেখে আমি কাজে যোগদানের জন্য শহরে আসি এবং অন্যান্য সহকারীরা যোগদান করেছে কিনা দেখার জন্য জেলখানার সামনের গেট দিয়ে আসবার চেষ্টা করি। কিন্তু সেখানে কালো পোষাক পরিহিত পাঞ্জাবী পশু ও তাদের অনুগ্রহপুষ্ট পদলেহী অবাঙ্গালীরা পাহারা দিচ্ছিল। সাহসে না কুলানোর জন্য আমি পিছনের অপ্রশস্ত রাস্তা দিয়ে ঢুকবার চেষ্টা করি। আর সে সময়ই জনৈক অবাঙ্গালী জেল হেড ওয়ার্ডার হানিফ খান আমাকে ধরে ফেলে জেল গেটে নিয়ে এসে হাত বেঁধে অমানুষিকভাবে হৃদয়হীন পদ্ধতিতে প্রহার শুরু করে। কিল, ঘুষি ও বুট দিয়ে লাথি মারে। প্রহারের চোটে আমি যখন অত্যন্ত কাতর হই, তখন আমাকে কোতোয়ালি থানায় নিয়ে যায়। যাবার পথে আমাকে সমানে প্রহার করা হয়। রাস্তার মাঝে আমার নাক ও মুখ জুড়ে এমন এক ঘুষি মারে যাতে আমার নাক ফেটে দরবিগলিত ধারায় রক্তপাত শুরু হয়। সে অবস্থায় আমাকে যখন থানায় নেয়া হয় তখন ঐ পশুরা আমি তখনও পান চিবোচ্ছি বলে রহস্য করে এবং প্রহার করতে থাকে। সেখানে ঘন্টাখানেক ঐরূপে বিরতিহীনভাবে মারধর করার পর আমাকে ক্যান্টনমেন্টে খান সেনাদের হাতে সোপর্দ করে।

ক্যান্টনমেন্টে নেবার পর জেলখানার অবাঙ্গালী সিপাই যারা মুক্তিফৌজের হাতে নিহত হয়েছে, তাদের পরিবারের মহিলারা জবানবন্দি দেয় যে, “ইয়ে শালা সতরা-আঠারো আওরতকো বেওয়া কিয়া। ইয়ে হামারা শওহরকো মারা, হামারা ভাইকো মারা।”

এ বক্তব্য শোনার পর পাক সৈন্যরা আমার উপর অমানুষিকভাবে প্রহার শুরু করে। আমাকে কেটে লবণ লাগিয়ে আস্তে আস্তে হত্যা করা হবে বলে হুমকি দেয়। তারা আমাকে নিয়ে ফুটবল খেলার মত বেশ কিছুক্ষণ খেলাও করে। এ সময় আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। অত্যাচারের এ পদ্ধতিতে তারা যখন তুষ্ট হয়ে যায়, তারপর আমাকে মেজর কামরুজ্জামানের নিকট নিয়ে যায়। সে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে এবং বলে যে তুমি কতজন বিহারী মেরেছ? নেতিবাচক উত্তর দিলে আমার বাঁধন খুলে দিতে বলে এবং আমাকে, একজন ডাক্তার ও আর এক ব্যক্তিকে জীপে তুলে নিয়ে মেজর নিজে গাড়ি চালিয়ে জেলখানায় আসে। আমাকে আলাদা রুমে বন্ধ করে রাখার নির্দেশ দেয়। সেখানে দুমাস বন্দি থাকার পর একদিন চা খাবার নাম করে বাইরে এসে পালিয়ে যাই।

স্বাক্ষর/-
নূর মোহাম্মদ

রকিবুল হাসান জিহান
<৮,২.২.৮৯,১৪৪> “তারা মেয়েদের উপর প্রথমে অত্যাচার করত, তারপর তারা গুপ্তাঙ্গের ভিতর রাইফেল-বন্দুকের নল ঢুকিয়ে দিত।“
।। ৮৯।।
মঈনুদ্দিন আহমদ
গ্রাম- আবদুলপুর
থানা- চিরিরবন্দর
জেলা- দিনাজপুর

১৪ ই আগস্ট তারিখে আমি যখন দিনাজপুরে গিয়েছিলাম তখন মহারাজা স্কুলের সামনে খান সেনাদের ক্যাম্পের কাছে রাস্তায় আমাকে গ্রেফতার করে। প্রথমে ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে পাশবিক অত্যাচার করে। সেখানে বেদম প্রহার করে। রাইফেলের নল ও গাদা দিয়ে, বেত দিয়ে অমানুষিকভাবে অত্যাচার করে। অত্যাচারের নির্মমতায় আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। উল্লিখিত পদ্ধতিতে আমাকে বহুক্ষণ ধরে অত্যাচার করে। এ সময় শরীরের বিভিন্ন স্থানে রাইফেলের বাঁট দিয়ে গুঁতাতে থাকে। রাইফেলের বাঁটের আঘাত আমার মুখের ডান দিকের দুটি দাঁত ভেঙ্গে দেয়। অত্যাচারের পর আমাকে ক্যাম্পের অদূরে জঙ্গলে গুলি করে হত্যা করবার জন্য নিয়ে যায়। জনৈক বাঙ্গালী ইপিআর সে সময় সক্রিয় সহযোগিতা করে গুলির হাত থেকে আমাকে রক্ষা করে। ক্যাম্পে সারা দিন সারা রাত অনাহারে রাখার পর আমার সাথের সমস্ত টাকা-পয়সা ও পায়ের জুতা কেড়ে নিয়ে পরদিন কোতোয়ালিতে স্থানন্তরিত করে। পরে সেখান থেকে ছেড়ে দেয়।

মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে অবাঙ্গালীরা মাঝে মাঝে গাড়ি করে বিভিন্ন এলাকায় যেত এবং গাড়ি থামিয়ে লুটপাট করত, মানুষ হত্যা করত, মেয়েদের উপর পাশবিকভাবে নির্যাতন করত এবং তাদের প্রভু খান সেনাদের জন্য উপঢৌকন হিসেবে ধরে নিয়ে যেত। তারা মেয়েদের উপর প্রথমে অত্যাচার করত, তারপর তারা গুপ্তাঙ্গের ভিতর রাইফেল-বন্দুকের নল ঢুকিয়ে দিত। এক একটি মেয়ের উপর ৭-৮ জন অত্যাচার করত। অত্যাচারের পর নির্যাতিত মহিলাদের বহুজন এমনি মারা যেত। তারা প্রকাশ্যেই এ অত্যাচার করত।

রাস্তার পথিকদের ধরে ক্যাম্পে নিয়ে যেত এবং সেখানে নির্দয় অত্যাচার করত এবং গুলি করে হত্যা করত। ঝোপ-ঝাড়ে কাউকে দেখলে সেখানেই গুলি করে হত্যা করত। তার খাসী-মুরগী-হাঁস-গরু ধরে নিয়ে যেত, ভাল ভাল কাপড়-গয়নাগাটি নিয়ে যেত।

স্বাক্ষর/-
মঈনুদ্দিন আহমদ

রকিবুল হাসান জিহান
<৮,২.২.৯০,১৪৫-১৪৭> “এরপর ঐ দুজনকে গুলি করে। একজন একটু মাথা আছড়াতে থাকলে তার মাথা লক্ষ্য করে আবার গুলি করে। ফলে তার মাথার মগজ ছিটকে চলে যায়।“
।। ৯০।।
মোঃ আছির উদ্দিন মুন্সী
গ্রাম- চিরিরবন্দর মাজাপাড়া
থানা- চিরিরবন্দর,
জেলা- দিনাজপুর

বৈশাখ মাসের প্রথম দিকে খান সেনারা চিরিরবন্দরে ক্যাম্প করে। সেখানে ক্যাম্প করার পর স্থানীয় গ্রামবাসীরা প্রাণের ভয়ে কতক ভারতে ও কতক গ্রাম থেকে গ্রামাঞ্চলে চলে যায়। এই সময়ে আমি স্ত্রী-পুত্রদের সঙ্গে নিয়ে দুই মাইল দূরে আমার শ্বশুরবাড়ি বালুপাড়ায় চলে যাই। আমি একদিন বালুপাড়া সন্নিকটে মরা নদীর ব্রিজের কাছে একদিকে চিরিরবন্দর হতে অপরদিকে পার্বতীপুর হতে এই দুই দিক হতে দুটি পাক সৈন্য বোঝাই গাড়ি এসে থামে। এখানে বলা প্রয়োজন যে, উক্ত ব্রীজটি এর পূর্বেই ইপিআর বাহিনী ভেঙ্গে দেয়। উক্ত বালুপাড়া গ্রামের ২০-২১ জন লোক ঐ গাড়ি দুটিতে বেঙ্গল রেজিমেন্ট আছে ভেবে তাদের অভিনন্দন জানানোর জন্য এগিয়ে যায়। কিন্তু নিকটে যাবার সঙ্গে সঙ্গে চারদিক হতে খান সেনারা তাদেরকে ঘিরে ফেলে। উক্ত ২০-২১ জনকে পরে ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় হত্যা করে এবং লাশগুলি কাঁকড়া নদীতে ভাসিয়ে দেয়। এই ঘটনার ৩-৪ দিন পরে বালুপাড়া গ্রামটি খান সেনারা তিন দিক হতে ঘিরে ফেলে। খান সেনাদের উপস্থিতি সম্পর্কে গ্রামবাসীরা পূর্বেই টের পেয়েছিল এবং তারা আগেই নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়। ফলে খান সেনারা সেদিন গ্রাম থেকে কাউকে ধরতে পারে না। এদিকে গ্রামবাসীরা তাদের আর উক্ত গ্রামে থাকা উচিৎ নয় ভেবে অন্যত্র যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং খান সেনারা গ্রাম হতে চলে যাওয়ার পর গ্রামবাসীরা তাদের পোটলা-পুটলি আনার জন্য রাতের অন্ধকারে প্রবেশ করে। আমি উক্ত বালুপাড়া গ্রাম হতে আমার নানাশ্বশুরের বাড়ি দুর্গাপুর (২ মাইল) যাওয়ার জন্য তৈরি হয়। এবং শেষ রাতের দিকে রওয়ানা দেই। এদিকে খান সেনারা বালুপাড়া গ্রাম ও দুর্গাপুর গ্রামের মাঝখানে ঐ রাত্রের অন্ধকারে মিশন স্কুলে পজিশন নেয়। আমি ও আমার ভাই গরু বাছুর নিয়ে যখন মিশন স্কুলের নিকটে পৌঁছাই তখন হঠাৎ করে ১৮ জন খান সেনা ও ৪ জন অবাঙ্গালী রাজাকার আমাদের দুজনকে ঘিরে ফেলে এবং একজন আমাকে লক্ষ্য করে এক রাউণ্ড গুলি ছোড়ে। কিন্তু খোদা মেহেরবান, গুলি আমাদের দুজনের একজনকে ও না লেগে আমাদের সঙ্গে আনা একটি গরুর পায়ে বিদ্ধ হয়।

পূর্ব হতেই আর ও দুজন দাড়িওয়ালা মুরব্বী গোছের লোককে উক্ত স্কুলের সামনে বেঁধে রেখেছে। খান একজন আমাকে বলে যে, “ইয়ে মৌলভী সাব, আপ কাঁহা যাতে হে?” জবাবে আমি বলি যে আমি গরু বাছুর নিয়ে জমিনে কাজ করতে যাচ্ছি। খান সেনারা পুনরায় বলে যে, “তোম ইন্ডিয়ামে বাগ যাতে হে?” জবাবে বলি যে, না ভাই আমি ইন্ডিয়া যাচ্ছি না। আমি জমিনে কাজ করতে যাচ্ছি। খান সেনারা পুনরায় আমাকে প্রশ্ন করে যে, “ইয়ে মৌলভী সাব আপ সাচ্ছা বাত বলেগা তো আপকো হাম ছোড় দেগা, আপ বলিয়ে আওয়ামী লীগকা পার্টি কাঁহা, স্কুল কলেজ কাঁহা, ছাত্র কাঁহা, মালাউন কাঁহা।” উত্তরে আমি বলি যে, যারা আওয়ামী লীগ, ছাত্র এবং মালাউন সবাই ভারতে পালিয়ে গেছে। যারা এখানে আছে তারা সকলেই খাঁটি পাকিস্তানী। এই সময় খান সেনাদের সাথী অবাঙ্গালী রাজাকাররা আমাকে বাংলায় বলে যে, “আপনি ভয় পাবেন না। আমরা ভারতীয় সৈন্য। এখানে বিহারীরা আসবার চেষ্টা করছে। তাদের বাঁধা দেওয়ার জন্য আমরা এখানে পজিশন নিয়েছি।”

আমি সরলমনে এটা বিশ্বাস করি এবং বলি যে, “ভাই আমি থাকব না। আমাকে ভারত পাঠাবার ব্যবস্থা করেন।” উত্তরে রাজাকাররা আমাকে আশ্বাস দেয় এবং বলে যে আপনি কোন চিন্তা করবেন না, সে ব্যবস্থা আমরা করছি। ঠিক সেই মুহুর্তে আমি লক্ষ্য করি যে, পূর্বেই আনা সেই দুজন মুরব্বী লোককে খান সেনারা চতুর্দিক হতে ফুটবলের মত লাথি মারছে। এভাবে মারার পর লোক দুটিকে আমার কাছে নিয়ে আসে। এবং আমার কাছ থেকে গরু বাঁধার রশি নিয়ে উক্ত মুরব্বী দুজনকে মজবুত করে বাঁধে। অতঃপর আমাকেসহ ৪ জনকে কিছু দূরে ক্যাপ্টেনের কাছে নিয়ে যায়। ক্যাপ্টেন আর্মি লোকদের কাছে জানতে চান যে, ধৃত ব্যক্তিরা কারা। জবাবে তারা বাঙ্গালী জানতে পারলে উল্লিখিত দুই বৃদ্ধকে প্রহারের নির্দেশ দেয় এবং তাদের উপর হৃদয়হীন নির্যাতন চলতে থাকে। নির্যাতন চলা অবস্থায় উক্ত ক্যাপ্টেন তাদের জয় বাংলা বলার নির্দেশ দেয়। তারা তা না বলে পাকিস্তান জিন্দাবাদ বললে তাদের উপর আরও প্রবলভাবে অত্যাচার করে। এই সময় আমাকে জয় বাংলা বলতে বলা হয়। আমি তা বলি, ক্যাপ্টেন আমাকে বলে, “ঠিক হায় মৌলভী সাব আপকো হাম ইন্ডিয়া ভি লিয়ে যায়গো।”

অতঃপর ৪ জনকেই পূর্ব দিকে নিয়ে যেতে শুরু করে। এবং একটি খালের কাছে গিয়ে থেমে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। এ সময় একটি বেয়নেট দিয়ে উক্ত বৃদ্ধদুটির শরীরের সমস্ত কাপড় কেটে উলঙ্গ করে। এবং তাদের তলপেটে থাপড়িয়ে বলে, “বাঙ্গালী আদমী খাড়া হায়, আওর ভুঢ়িনে তেল লাগাতা হায়।”

এরপর ঐ দুজনকে গুলি করে। একজন একটু মাথা আছড়াতে থাকলে তার মাথা লক্ষ্য করে আবার গুলি করে। ফলে তার মাথার মগজ ছিটকে চলে যায়। এ সময় দক্ষিণ দিক থেকে দুজন গাড়োয়ানকে গাড়িসহ ধরে আনে এবং আমার কাছ থেকে “মৌলভী সাব হামকো একটা রশি দিজিয়ে আপ” বলে রশি চেয়ে নেয় এবং তাদের হাত বাঁধে। অতঃপর তাদের একজনকে যে ৩০-৩৫ বছরের যুবক ছিলেন তাকে মারতে থাকে। মারের চোটে সে জ্ঞান হারাবার উপক্রম হলে তাকে জোর করে তুলে ধরে উলঙ্গ করে এবং তার গুহ্যদ্বারে নড়ি ঢুকিয়ে দেয়। এ পদ্ধতিতে কিছুক্ষণ অত্যাচার চালাবার পর তার হাত বেঁধে গাড়ির পিছনে বেঁধে দেয় এবং অপর ব্যক্তিকে জোরে গাড়ি হাঁকাবার নির্দেশ দেয়। এ সময় তারা আমাকে বলে, “ মৌলভী সাব আপ চালিয়ে ইন্ডিয়া।” রেল লাইনে সকলে আশা শুরু করে। রাস্তার মাঝ থেকে বেশ কয়েকটি খাসি ধরে গাড়িতে তুলে নেয়। মরা নদীর ভাঙ্গা ব্রীজের কাছে এসে জনৈক খান আমাকে তার কাছে ডেকে বসায় এবং জিজ্ঞাসা করে, “মৌলভী সাব, আপ সাচ সাচ বাতলাইয়ে আওয়ামী পার্টিকো লোক কাঁহা, স্কুল কো ছাত্র কাঁহা, মালাউন কাঁহা।” উত্তরে আমি জানাই যে “সব ইন্ডিয়ামে চল গিয়ে, কোই আদমী নেহি হ্যায়। জোভি হ্যায় ওভি পাকিস্তান কো নাগরিক হ্যায়।” এতে আমাকে মিথ্যাবাদী বলে আখ্যায়িত করে। এ সময় আমাকে একটি সিগারেট খেতে দেয় এবং উক্ত প্রশ্ন গুলি আবার জিজ্ঞাসা করে।

অতঃপর ইন্ডিয়ায় পৌছে দেবার নাম করে আমাকে, সঙ্গীত ও গাড়ির দুজনকে এবং গাড়ির গরু দুটিসহ ক্যাম্পের দিকে আসতে থাকে। ক্যাম্পের নিকট ব্রীজের কাছে এসে হুইসেল দিলে ৫০-৬০ জন খান সেনা সেখানে যায়। তারপর সকলে স্টেশনে আসে। স্টেশনে পরিচিত জনৈক অবাঙ্গালীকে দেখে আমি খানদের কাছে সুপারিশের জন্য অনুরোধ করলে সে আমাকে আওয়ামী লীগের কর্মী বলে পরিচয় করিয়ে দেয় এবং গুলি করে হত্যা করার জন্য খানদের অনুরোধ জানায়।

সেখান থেকে ধৃত সকলকে ক্যাম্পে নিয়ে যায়। গাড়োয়ান দুজনকে একটি আলাদা কুঠুরিতে বন্দী করে রাখে। এবং আমাদের ব্রীজে যে সিপাই জিজ্ঞাসা করেছিল তার ঘরে বসতে দেয়। এবং চা খেতে দেয়, সিগারেট খেতে দেয়।

কুঠুরিতে বন্দী দুজনকে পাশবিকভাবে মারা শুরু করে। উলঙ্গ অবস্থায় লাঠি, রড, রাইফেলের গাদা দিয়ে পর্যায়ক্রমে হাত বদল করে পিটাতে থাকে এবং পরিশেষে তাদেরকে ফুটবলের মত লাথি মারতে থাকে। বেলা ৪ টার দিকে লোক দুটিকে ছেড়ে দেয়।

অতঃপর আমাদের দুজনকে ওই ঘরে ঢুকায়। সেখানে একজন গুলিবিদ্ধ ভীষণভাবে আহত লোক হাত বাঁধা অবস্থায় ছিলেন। সন্ধ্যার সময় ঐ আহত লোককে ঘর থেকে বের করে পশ্চিম দিকে পুকুরের ধারে নিয়ে যায়। যাবার পথে তাঁকে বেয়নেট দিয়ে খোঁচাতে খোঁচাতে সারা পথ নিয়ে যায় এবং পুকুরের ধারে নিয়ে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। আমি এ দৃশ্য উক্ত ঘরের জানালা খুলে দেখেছি।

এশার নামাজের জন্য অজু করে আসছিলাম, তখন ক্যাম্প ইনচার্জ আমার পড়ার খবর শুনে কেরআত পাঠ শুনতে চায়। আমি তিন ঘন্টা ধরে মুখস্ত কোরআন পাঠ করে শুনিয়ে সন্তুষ্ট করি এবং পরদিন বিকাল চারটায় আমাকে মুক্তি দেয়।

স্বাক্ষর/-
মোঃ আছির উদ্দিন মুন্সী

রকিবুল হাসান জিহান
<২,২.২.৯১,১৪৮> “রোজার দিন হওয়া সত্ত্বেও তারা সেহেরী ইফতারের জন্য কোন খাবার দেয়নি। ঐ কদিন না খেয়েই রোজা থাকতে হয়েছে। বহুবার তাদের কাছে পানি চাওয়া হয়েছিল, তবুও তারা দেয় নি।“

।। ৯১।।
মোঃ সোলায়মান গণি
গ্রাম- নান্দারাই
থানা- চিরিরবন্দর
জেলা- দিনাজপুর

১৯৭১ সনের ১১ ই রমজান রোজ রবিবার বেলা ১১-৩০ মিনিট খান সেনারা ও রাজাকাররা আমাকে গৃহ থেকে গ্রেফতার করে। শান্তি কমিটির সদস্যদের ইচ্ছার আমার হাতের পিছনে দড়ি বেঁধে রাজাকার, খান সেনা ও শান্তি কমিটির সদস্যরা মিছিল সহযোগে থানায় নিয়ে যায়। রাস্তার মধ্যে রাইফেলের গাদা ও হাত দিয়ে বেদম প্রহার করে। প্রহারের সময় তারা বেয়নেট দেখাচ্ছিল এবং উল্লাস করছিল। ৪ মাইল রাস্তা তারা বিরামহীনভাবে উল্লিখিত পদ্ধতিতে প্রহার করছিল। আনার সময় আমার চোখ-মুখে চুল কালি মেখে কিম্ভুতকিমাকার চেহারায় রুপান্তরিত করে এবং শরীরের সমস্ত জায়গায় ছাপ দিতে থাকে।

এখানে বলা প্রয়োজন, ওরা আমাকে গ্রেফতার করা ছাড়া ও আমার বাড়িঘর সমস্ত লুটপাট করে এবং সবশেষে আগুন লাগিয়ে দিয়ে সমস্ত বাড়ি ভস্মীভূত করে দেয়। আমার অপরাধ, আমি আওয়ামী লীগের একজন একনিষ্ট কর্মী ছিলাম এবং অসহযোগ আন্দোলনের সময় বিশেষ কর্মতৎপরতা প্রদর্শন করেছিলাম।

থানায় নেবার পর পা উপরের দিকে তুলে লটকিয়ে লোহার রড দিয়ে মারতে থাকে। এর সাথে কিল, ঘুষি ও লাথি সমানে চলতে থাকে। এ অবস্থায় ৪-৫ ঘন্টা টাঙ্গিয়ে রাখে ও উল্লিখিত পদ্ধতিতে অত্যাচার করতে থাকে। চার দিন, চার রাত্রি থানায় ছিলাম এবং উল্লিখিত পদ্ধতিতে অত্যাচার করে। রোজার দিন হওয়া সত্ত্বেও তারা সেহেরী ইফতারের জন্য কোন খাবার দেয়নি। ঐ কদিন না খেয়েই রোজা থাকতে হয়েছে। বহুবার তাদের কাছে পানি চাওয়া হয়েছিল, তবুও তারা দেয়নি।

চতুর্থ দিনের দিনে ৫ হাজার টাকার বিনিময়ে আমাকে ছেড়ে দেয়।

স্বাক্ষর/-
মোঃ সোলায়মান

রকিবুল হাসান জিহান
<৮,২.২.৯২,১৪৯>
।। ৯২।।
মোঃ হাবিল উদ্দিন আনছারী
গ্রাম- পালপাড়া
ডাকঘর- বাংলাহিলি
থানা- হাকিমপুর
জেলা- দিনাজপুর

২২ শে এপ্রিল পাক বাহিনী হিলি বাজার দখল করে নেয়। হিলি দখল করার পর চারদিকে অগ্নিসংযোগ এবং ব্যাপক হারে গণহত্যা চালিয়ে যায়।

২৩ শে এপ্রিল পাক বাহিনী ও বিহারীরা আমাদের পালপাড়া আক্রমণ করে। তারা বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে। নিরীহ জনসাধারণকে ধরে নির্বিচারে মারধর করতে থাকে। এই সময় তারা ৭ জন লোককে হত্যা করে। এইসব লোককে প্রথমে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে, পরে গুলি করে হত্যা করে। আমি এবং আরও একজন গুরুতররূপে আহত হই। আমার সারা শরীর দিয়ে রক্ত ঝরতে থাকে। বহু লোককে এই সময় দেখতে পাই পাঞ্জাবীরা কিল, ঘুষি এবং ফুটবলের মত “কিক” করছে এবং নানারুপ অকথ্য ভাষায় গালাগাল দিচ্ছে। এই সময় ৩ জন ছেলে ঘরের ছাদের উপর উঠে আশ্রয় নিয়েছিল। তারা ৪ দিন পর্যন্ত ঐ ছাদের উপর বসে থাকে। কোনরূপ নড়াচড়া বা খাবার-দাবার নাই। ৫ দিন পর আমাদের এখানে থেকে তাদের ক্যাম্প তুলে নিলে তারা মাটিতে নেমে আসে।

অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রাণকৃষ্ণপুর (চার) গ্রাম পাক বাহিনী চারিদিকে থেকে ঘিরে ফেলে। সমস্ত পুরুষ লোকদেরকে বেছে এক লাইন করে এবং অকথ্য নির্যাতনের পর ১৪৯ জনকে লাইন করে মেশিনগানের গুলিতে হত্যা করে। তাদের বাড়িঘর লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়। গ্রাম থেকে সুন্দরী মেয়েদের ধরে নিয়ে যায় এবং অনেককে সবার সামনেই ধর্ষণ করে।

স্বাক্ষর/-
মোঃ হাবিল উদ্দিন আনছারী
০৮/১১/১৯৭৩

রকিবুল হাসান জিহান
<৮,২.২.৯৩,১৫০-১৫১> “জ্ঞান হারিয়ে ফেলার আগে আমি পানি পান করতে চাই। তখন আমাকে প্রস্রাব খেতে দেওয়া হয়।“
।। ৯৩।।
রফিকুল ইসলাম
গ্রাম- সোনাপুকুর
থানা- পার্বতীপুর
জেলা- দিনাজপুর

২৫ শে মার্চের পর দিনাজপুর যখন ইপিআর কর্তৃত্বে ছিল সে সময় আমি ইপিআর বাহিনীদের গাড়ি করে স্থান থেকে স্থানান্তরে নিয়ে যেতাম। আর এ অপরাধের জন্য আমাকে এপ্রিলের ৬ তারিখে পাক হানাদাররা দিনাজপুর শহর থেকে গ্রেফতার করে কোতোয়ালি থানার পাশের জঙ্গলে নিয়ে যায়। উদ্দেশ্য, আমাকে সেখানে হত্যা করা হবে। আমাকে ঐ খানে নিয়ে গিয়েছিল কয়েকজন সামরিক লোকজন ও কতিপয় অবাঙ্গালী দালাল। সেখানে আমাকে জবাই করার জন্য ছোরা বের করে। ঠিক সে সময় শেষবারের মত পানি পান করার সুযোগ দেয়ার জন্য তাদের প্রতি অনুরোধ জানাই। অনুরোধে তাদের মধ্যের একজন দয়াপরবশ হয়ে আমাকে পানি পান করে আসার অনুমতি দেয়। থানার প্রাচীরের পাশের টিউবওয়েলে পানি পান করি এবং বাঁচার শেষ অবলম্বন হিসাবে তাদের বোঝার আগেই প্রাচীর টপকে অপর দিকে চলে যাই। সেখানেও খান সেনারা ছিল। তারা আমাকে পুনরায় গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যায়। সেখানে আমাকে বেদমভাবে হুইপিং করা হয় এবং মুক্তিফৌজ কোথায়, ‘সুন্দরবন’ গাড়িটি কোথায়, কতজন বিহারীকে হত্যা করেছ ইত্যাদি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে। কিছুক্ষণ হুইপিং সহ্য করার পর আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। জ্ঞান ফেরার পর ঐ দিন বিকালে আমাকে আবার জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। সে সময় কিছুসংখ্যক অবাঙ্গালী মেয়ে থানায় এসে জবানবন্দী দেয় যে আমি তার স্বামী, ভাই অথবা বাবাকে হত্যা করেছি। ফলে পুনরায় আমার উপর প্রহার শুরু হয়। কিছুক্ষণ পর আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। জ্ঞান হারিয়ে ফেলার আগে আমি পানি পান করতে চাই। তখন আমাকে প্রস্রাব খেতে দেওয়া হয়।

রাত বারটায় আমি জ্ঞান ফিরে পেলাম। অতঃপর আমাকে আবার জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ওসির কক্ষে নিয়ে যায়। সেখানে জনৈক মেজরসহ, একজন ক্যাপ্টেন ও ডিএসপি ছিল। সেখানে আমার নামধাম ও আত্মীয়স্বজনের খবরাখবর আদায় করে নেওয়া হয়। সেখানে অবশ্য আরও ছয়জন আসামী ছিলেন। এরপর অফিসাররা নিজেদের মধ্যে ইংরেজিতে কিছু বলবার পর উল্লিখিত ছ’জনকে পেছনে হাত ও চোখ বেঁধে জীপে উঠিয়ে নিরুদ্দেশের পথে নিয়ে যায়। এরপর আমাকে আবার বন্দীশালায় বন্দী করে রাখে। এ অবস্থায় আমাকে থানায় রেখে দুবেলা জিজ্ঞাসাবাদ ও প্রহার করত। প্রথম সাত দিন আমাকে কিছুই খেতে দেয়নি। পানি চাইলে প্রস্রাব দিত। কয়েক দিন পর সামান্য পানি পান করতে দিত। তাও কর্তৃপক্ষের অগোচরে।

তেরদিন পর বেলা দশটায় জনৈক পাঞ্জাবী হাবিলদার এসে আমাকে দিনাজপুর কুঠিবাড়ী ক্যান্টনমেন্টে হাত পিছনে ও চোখ বাঁধা অবস্থায় নিয়ে যায়। সেখানে নিয়ে যাবার পর আমার দু’পায়ে এবং দু’হাতে কড়া বেঁধে হাত পা ফাঁক করে টানা দেয়। টানা দেওয়া অবস্থায় সিনার উপর বুট দিয়ে পাড়া দেয় এবং কতজন লোককে মেরেছি ও গাড়ি কোথায় আছে তা জানতে চায়। দু’ঘন্টা এ অবস্থায় রেখে অত্যাচার করে। এর ফলে আমার নাকমুখ দিয়ে রক্ত উঠে; আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।

ক্যান্টনমেন্টে নির্যাতন পর্ব শেষ হলে আমাকে পুনর্বার সন্ধ্যার দিকে থানায় পূর্বোক্ত পদ্ধতিতে পাঠায়। সারারাত বন্দী অবস্থায় রেখে পরদিন বেলা এগারোটার দিকে অন্য ছ’জনের সাথে আমাকে কোর্টে নিয়ে যায়। কোর্ট থেকে আমাকে জেলখানায় স্থানান্তরিত করা হয়।

দু’দিন পর জেল খানার ভিতরে ক্যাপ্টেন কয়েকজন অনুচরসহ যায়। সে সময় খাবার খেতে বসেছিলাম। না খেয়েই আমি এবং অপর একজন তার কাছে চলে যাই। সেখানে আবার একই কথাগুলি জিজ্ঞাসা করে। সন্তোষজনক উত্তর না পেয়ে আমাকে দু’ঘন্টা গাছে উল্টো দিকে করে লটকাবার নির্দেশ দেয়। নির্দেশ মোতাবেক আমাকে পা উপরে এবং মাথা নীচে করে লটকিয়ে দেওয়া হয়। ঐ অবস্থায় ওরা খুব পাশবিক উল্লাস করেছে, হাসাহাসি করেছে। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় গুতো দিয়ে মশকরা করেছে। দু’ঘন্টা পর অজ্ঞান অবস্থায় আমাকে নামানো হয়।

পরদিন আবার জনৈক অফিসার এসে ডেকে চেম্বারে নিয়ে যায়। সেখানে এক বন্ধ ঘরে উলঙ্গ অবস্থায় পা ফাঁক করে দাঁড় করিয়ে রাখে এবং পুরুষাঙ্গে দুটো ইট বেঁধে দেয়। ঐ ইটের উপর আবার পানি ঢালা হয়েছিল। সামান্য নড়াচড়া করলে লাথি, ঘুষি ও বেত প্রহার করত। এই প্রক্রিয়ায় আমাকে দেড় থেকে দুই ঘন্টা রাখা হয়। একইভাবে আরও দু’জনকে এদিন শাস্তি দেয়।

এর দু’দিন পর রাত তিনটার সময় পাঁচজন সামরিক লোক এসে আমাকে সহ ২১ জনকে ডাকে। গেটে আসার পর সকলের হাত বাঁধা হয় এবং কালো কাপড় দিয়ে চোখ, কান কষে বাঁধা হয়। অতঃপর আমাদেরকে ট্রাকে করে কোথাও নিয়ে গিয়ে নামানো হয়। অবস্থাদৃষ্টে স্থানটিকে নরম মনে হয়েছে। দু’একটি ঘাস অথবা ছোট ঘাস জন্মেছিল। সেখানে নেয়ার পর এক একজনকে সারি থেকে খুলে নিয়ে যাতে থাকে। নিয়ে যাবার পর শুধু খাসি, গরু জবাই করলে যেমন শব্দ হয় তেমনি করুন ও হৃদয়বিদারী শব্দ শোনা যেত। তারপর হাত-পা আছড়ানোর মত শব্দ কিছুটা কানে ভেসে আসত। এমনি করে ১৯ জনকে সারি থেকে নিয়ে যাবার পর আমাকেসহ আর একজনকে জেলখানায় নিয়ে আসে। সেখানে চোখ ও হাত খুলে দেয় এবং সেখানেই জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেঃ দলে কে কে আছে তাদের নাম বল এবং ‘সুন্দরবন’ গাড়ি কোথায় আছে বল। সন্তোষজনক উত্তর না পেয়ে মাথার চুলের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে প্রাচীরের সাথে আঘাত করতে থাকে এবং বুট দিয়ে ২/৩টি লাথি বুকে মারে। আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। জ্ঞান ফিরলে আমি মুখে রক্ত দেখতে পাই। ডাক্তার এসে আমাকে ঔষধাদি খাওয়ানোর পর পুনরায় হাজত খানায় পুরে রাখে। আমার সাথে জনৈক মেকানিক সিরাজ মিয়াকে ধরে অনুরূপভাবে অত্যাচার করে। হাত-পায়ে পেরেক মেরে পাছার মাংস কেটে কুকুরকে দিয়েছে। সে অবশ্য এখনো জীবন্মৃত অবস্থায় বেঁচে আছে। জেলখানার ভিতর তিনজন যুবতী মেয়েকে দেখেছি। তাদের করুণ কান্না ও চিৎকার ধ্বনি শুনেছি।

এ অবস্থায় ৭ মাস ৩ দিন থাকার পর ১৬ই ডিসেম্বর ভোর পাঁচটায় মুক্তি বাহিনীর জোয়ানরা জেলখানার তালা ভেঙ্গে আমাকে সহ সকল বন্দীকে ছেড়ে দেয়। বর্তমানে পঙ্গু অবস্থায় আছি। আমি কোন রকম কাজ করতে পারি না।

স্বাক্ষর/-
রফিকুল ইসলাম

রকিবুল হাসান জিহান
<৮,২.২.৯৪,১৫২> “… ওরা আমার স্বামীকে মেরে ফেলার পর কাজে নামি। কাজ শুরু করি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে।“
।। ৯৪।।
হাসিনা বেগম
প্রযত্নেঃ আফছার আলী খান
গ্রাম- সাধুপাড়া,
থানা ও জেলা- পাবনা

২৮ শে মার্চ, ১৯৭১। আমার স্বামী তখন বাড়িতে। বেলা ১১/১২টায় একটি পাক সেনাদের গাড়ি এসে থামে, জোর করে তারা বাড়িতে ঢুকে স্বামীকে যেতে বলে। তখন উনি মটরসাইকেল পরিষ্কার করছিলেন। লুঙ্গি পরা অবস্থায় মটরসাইকেল নিয়ে যেতে বলল। কিছুক্ষণ পরেই খবর পেলাম চাচড়ার মোড়ে আমার স্বামীকে গুলি করে মেরেছে। লাশ আনতে গেলে পায় না, মটরসাইকেল ও তারা নিয়ে যায়। তারপর বাসায় থাকা নিরাপদ মনে করলাম না। আমার দুটি ছেলে নিয়ে পথে নামি। যশোর থানা, কালিগঞ্জ থানা, কোটচাঁদপুর শ্রীপুর থানা, মাগুরা থানা, বেলেডাঙ্গা থানা, শৈলকূপা থানা, কাতলাপাড়া থানা ইত্যাদি থানাতে তখন কাজে নামি। কাজ শুরু করি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে।

আমার আব্বা ডি,এস,পি ছিলেন। সেই বরাত দিয়ে উপরিউক্ত থানাগুলিতে গেছি। পরিচয় দিয়েছি, থেকেছি এবং সেখানে থেকে থানার বর্তমান ফোর্স কত, অস্ত্র কত ইত্যাদি খবর আমি মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে পরিবেশন করতাম। তারপর মুক্তিবাহিনী ঐসব থানাগুলিতে অপারেশন চালাতো। এতে করে কাজ এগিয়ে চলছিলো। আমি বিভিন্ন থানা ঘুরে ঘুরে কাজ করতে থাকি, সাফল্য ও বেশ আসে। আমার দুটি বাচ্চা নিয়ে ঐভাবে জীবনের ঝুকি নিয়ে কাজ করছিলাম। আমি তখন শৈলকুপা থানাতে আছি এক বাড়িতে। লোকজন কেউ নেই আমি একাই ছিলাম বাচ্চা দুটি নিয়ে। চারদিকের ঘরবাড়ি সব বিধ্বস্ত, শূণ্য। নিঃসঙ্গ ভৌতিক একটি অবস্থা।

ভাদ্র মাস (তারিখ মনে নেই)। তখন বেলা ১০/১১টার দিকে ভাত রান্না করছিলাম। হঠাৎ করে ২জন পাক সেনা এবং ৪ জন রাজাকার এসে আমাকে থানাতে যেতে বলে। তারপর জোর করে ছোট বাচ্চাটিসহ থানায় নিয়ে যায়। অপর বাচ্চাটি পাক সেনা দেখে পালিয়ে যায়। থানাতে নিয়ে গিয়ে মারধোর শুরু করে। থানাতে তখন বহু পাক সেনা ও রাজাকার ভর্তি ছিল। তখন অন্য পাঁচটি ছেলেকে ধরে এনেছিল। তাদের সঙ্গে সঙ্গে গুলি করে। ঐ গুলি ছুটে এসে আমার পায়ে লাগে। পরে অপারেশন করে আমার গুলি বের করে। মারতে মারতে আমি প্রায় অজ্ঞান হয়ে পড়তাম। দারোগা আনিসুর রহমান আমাকে বাঁচাবার চেষ্টা করেন। তাঁর অনুরোধে আমাকে গুলি করে না।

ডানাতে ও মাজাতে দড়ি বেঁধে শৈলকূপা ব্রীজের পানিতী ডুবিয়ে রাখে ১৪/১৫ ঘন্টা। এ অবস্থায় আমি অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলাম। তার পরদিন পানি থেকে তুলে থানার মাঠে ফেলে রাখে। আমার তখন নড়বার মত অবস্থা ছিল না। ঐ ভাবে আছি। একজন রাজাকার এসে ‘এখনো মরেনি’ বলে আমার উপর লাথি মারে। আমার জ্ঞান ছিল না। দারোগার বারবার অনুরোধে আমার প্রাণ ভিক্ষা দেয়। আমার চিকিৎসা করায় ক্রমশ আমি সুস্থ হয়ে উঠি। আমার সেই পুরাতন বাড়িতে ফিরে আসি।

স্বাক্ষর/-
হাসিনা বেগম
২৫/০৭/১৯৭৩

রকিবুল হাসান জিহান
<৮,২.২.৯৫,১৫৩>
।। ৯৫।।
নাজির উদ্দিন মিয়া
গ্রাম- নাজিরপুর
থানা ও জেলা- পাবনা

শান্তি কমিটির লোকদের কুমন্ত্রণা ও সরবরাহকৃত তথ্যের উপর ভিত্তি করে পাকিস্তানী সৈন্যরা উল্লেখিত গ্রামটি অপারেশন করে। প্রায় ২০০/২৫০ পাক সৈন্য ও রাজাকার, আল বদর ভোরের দিকে সমস্ত গ্রাম ঘিরে ফেলে। এখানে স্মরণ করা যেতে পারে ইতিপূর্বে আরও দুবার ঐ একই গ্রাম মিলিটারীরা অপারেশন করে।

লোকজন ঘুমিয়ে ছিল। এ জন্য তাদের অধিকাংশ লোকই এই ঘেরাও জানতে পারেনি। তাই পাক সৈন্যরা প্রথমে গ্রামের লোকদের ধরা শুরু করে। তারা লোকজন ধরে তাদের মধ্য থেকে যারা অপেক্ষাকৃত স্বাস্থ্যবান অর্থাৎ যাদের তারা মুক্তিবাহিনীর লোক বলে সন্দেহ করেছে তাদেরকে আলাদা করে। অতঃপর তাদের একটি নালার নিকট নিয়ে যায় এবং গলা কেটে উক্ত নালার মধ্যে ফেলে রাখে। এছাড়া বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়েও হত্যা করে। অবশ্য কিছু লোককে গুলি করেও হত্যা করে। এমনি করে তারা সেদিন ৫৭ জন লোককে হত্যা করে।

ধৃত ব্যক্তিদের মধ্যে আমিও ছিলাম। কিন্তু আমার চেহারা রোগা হওয়ায় আমাকে বৃদ্ধ ও অপছন্দ লোকদের সারিতে রাখে। আমি পাক সৈন্যদের হত্যাযজ্ঞ নিজের চোখেই সংঘটিত হতে দেখেছি।

পাক সৈন্যদের অপর একটি দল এই সময় বাড়িঘর লুটপাট করে। প্রায় ৫০০ ঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। এ পোড়া বাড়িগুলির মধ্যে পূর্বে পোড়া বাড়িও ছিল। পূর্বের পোড়া বাড়ি যেগুলি মেরামত করেছিল সেগুলিও আবার পুড়িয়ে দেয়।

তারা বহুসংখ্যক মহিলার উপর হৃদয়হীনভাবে নির্যাতন চালায়। এই নির্যাতনের শিকারে পরিণত হয় ছেলেমেয়ের মা, সদ্য বিবাহিতা এবং কুমারী মেয়েরা। একাধিক পাক সৈন্য কারো উপর অত্যাচার করেছে বলে শোনা গেছে।

পাক সৈন্যরা ফেরার পথে গ্রাম লুট করে সোনা-দানা, টাকা-পয়সা, গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগী ধরে নিয়ে যায়। এ ঘটনার কয়েকদিন পরই দেশ স্বাধীন হয়।

স্বাক্ষর/-
নাজির উদ্দিন

রকিবুল হাসান জিহান <৮,২.২.৯৬,১৫৪>
।। ৯৬।।
আবদুল হামিদ
গ্রাম- নাজিরপুর
থানা ও জেলা- পাবনা

৪ ঠা রমজান ভোর রাতে ১২৫ জনের মত পাক সৈন্য ও রাজাকার আমাদের গ্রাম ঘিরে ফেলে। শান্তি কমিটির লোকেরা তাদের খবর দিয়েছিল যে মুক্তি বাহিনীর লোক ঐ গ্রামে থাকে এবং গ্রামবাসীরা তাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করছে। শান্তি কমিটির লোকদের দেখিয়ে দেওয়া বাড়িঘর প্রথমে লুটপাট করে। তারপর আগুন লাগিয়ে অন্যূন ৮/৯ টি বাড়ি পুড়িয়ে দেয়।

এ সময় দুজন লোক বাড়ি থেকে পালিয়ে যাচ্ছিল। মিলিটারীরা তাদের লক্ষ্য করে গুলি করে। ফলে তারা দুজনই মারা যায়। গ্রাম থেকে অন্যান্য জিনিসপত্রের সাথে গরু, ছাগল, মুরগী ধরে নেয় তাদের উদর পূর্তির জন্য।

এই অপারেশনে আমি ধৃত হই। তারা আমাকে মুক্তিবাহিনীর লোক সন্দেহে গ্রেফতার করে। ধরার পর প্রথম পর্যায়ে আমাকে চড়, থাপ্পড়, কিল, ঘুষি এবং লাথি মেরে প্রহার করতে থাকে। তারপর তারা আমার দু’হাত পিছনে বেঁধে তাদের সাথে করে সার্কিট হাউস ক্যাম্পে নিয়ে আসে।

ক্যাম্পে নিয়ে আসার পর তারা আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। আমি মুক্তিবাহিনী কি না? আমি কত জনকে হত্যা করেছি এবং আমার দলে কতজন আছে? আমার সেই সমস্ত সঙ্গীরা কোথায় আছে এবং আনার অস্ত্রশস্ত্র কোথায় আছে তা জানতে চায়। আমি মুক্তিবাহিনীর লোক নই এবং তাদের কোন খবর জানিনা বললে আমার উপর শারীরিক নির্যাতন শুরু করে। বেতের লাঠি দিয়ে এলোপাতাড়িভাবে মারতে থাকে। পর্যায়ক্রমে ২/৩ জন আমাকে মারে। এর সাথে চড়, ঘুষি, লাথি তো আছেই।

কিছুক্ষণ পর পর ৩/৪ ঘন্টা এমনিভাবে আমার উপর অত্যাচার চলে। অত্যাচার চলার সময় আমার হাত পিছনে দড়ি দিয়ে বাঁধা ছিল। অত্যাচার চালানোর পর আমাকে একটি ঘরে তিন দিন বন্দী করে রাখে। অত্যাচারের এক পর্যায়ে আমি একবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।

বন্দী অবস্থায় তারা আমাকে রুটি ও লাবড়া জাতীয় তরকারি খেতে দেয়। প্রসাব পায়খানার সময় তারা আমাকে কড়া পাহারা দিত।

তিনদিন পর আমার আত্মীয়স্বজন টাকার বিনিময়ে শান্তি কমিটির দ্বারা আমাকে মুক্ত করে নিয়ে আসে।

স্বাক্ষর/-
আবদুল হামিদ

রকিবুল হাসান জিহান
<৮,২.২.৯৭,১৫৫> “রোজা তারা রাখতে দিত না। বলতো রোজা আবার কি জিনিস।“
।। ৯৭।।
মোঃ হাসেম আলী তালুকদার
গ্রাম- রামচন্দ্রপুর
থানা ও জেলা- পাবনা

১৯৭১ সালের রমজান মাসের প্রথম দিকে পাবনা শহর থেকে বহু খান সেনারা এসে গ্রাম ঘেরাও করে রাত্রির অন্ধকারে। আমার বাড়িতে আমি ও আমার রুগ্ন স্ত্রী ছাড়া কেউ ছিল না। খান সেনারা গিয়ে আমাকে ডেকে ঘর থেকে বের করে। ধরার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দুইজনকে বেদম প্রহার করে আর বলে “তুই মুক্তিবাহিনীকে খেতে দিস, বল তারা কোথায়।” সেই সঙ্গে আমাদের গ্রামের আরো লোককে ধরে ক্যাম্পে নিয়ে আসে এবং সেখানে কয়েকজনকে হত্যাও করে। স্ত্রীর পরিণতি কি তা আর জানতে পারি নাই। ক্যাম্পে নিয়ে এসে আমাকে এবং অন্যান্য জায়গার ৫ জনকে এক ঘরে রাখলো। দৈনিক সকাল, দুপুর ও বিকাল এবং ১১/১২ টার দিকে দুই থেকে তিনজন এসে পরপর ঘর থেকে একজন করে বার করে নিয়ে যেত এবং নানা জিজ্ঞাসাবাদ করার পর তাদের খুশীমত কাউকে মারতে আবার কাউকে না মেরেই ঘরে রেখে যেত।

আমাদের কয়েকজন কড়া পাহারাদার ছিল। রোজা তারা রাখতে দিত না। বলতো রোজা আবার কি জিনিস। দৈনিক দুইবার করে আমাদের ৬ জনকে একই জায়গাই কাপড়ে অথবা মেঝের উপর খাবার দিত। পুরাতন রেশন চাউলের ভাত এবং খেসারী কলাইয়ের ডাল। গন্ধে আমরা কেউ খেতে পারতাম না। প্রতিদিনই বিভিন্ন জায়গা থেকে লোক ধরে আনতো এবং রাত্রি বেলা তাদের ক্যান্টনমেন্ট থেকে কিছু দূরে শব্দ শোনা যেত। অনেক চেনামুখ আর দেখতে পেলাম না। ১৪ দিন আমাকে তারা প্রহার করার পর ১৫ দিনের দিন তাদের অফিসারসহ ৫ জন এসে ঘর থেকে আমাকে বার করে নিয়ে যায় এবং আমাকে মুক্তিবাহিনী সম্পর্কে ও এম, পি, এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর কোন সন্ধান না পাওয়ায় মোটা রশি নিয়ে এসে আমার দুই হাত গাছের দুই ডালের সাথে এবং দুই পায়ে রশি লাগিয়ে মাটিতে খুঁটি পুঁতে ভীষণ প্রহার করে। তাদের প্রহারে অজ্ঞান হলে তারা কি করেছে জানি না। তবে যখন আমার জ্ঞান হয় তখন দেখি আমার হাতের ও বাম উরুর চামড়া ছিলিয়ে আছে। ১৭ দিনের দিন রাতে আনুমানিক ২ টার সময় আমার ঘরের ও পাশের ঘর হতে ২৪/২৫ জনকে তাদের ক্যান্টনমেন্ট থেকে কিছু দূর নিয়ে যায়। সবাইকে লাইন করে একসঙ্গে গুলি করে হত্যা করে। আল্লাহর ইচ্ছায় আমার গায়ে গুলি লাগেনা তবু ও মরার মত পড়ে যাই। খান সেনারা চলে গেলে প্রায় ভোরের দিকে কোন রকমে এক লোকের বাড়িতে আশ্রয় নেই এবং সেখান থেকে আমার আত্মীয়কে খবর দিই নিয়ে যাওয়ার জন্য। বাড়ি গিয়ে আমার স্ত্রীর সাথে আর সাক্ষাৎ ঘটে নাই। তখন সে মারা গিয়েছিল।

স্বাক্ষর/-
মোঃ হাসেম আলী তালুকদার

রকিবুল হাসান জিহান
<৮,২.২.৯৮,১৫৬>
।। ৯৮।।
মোসাম্মৎ মনোয়ারা খাতুন
গ্রাম- সলঙ্গা মধ্যপাড়া ভরমহনী
থানা- রায়গঞ্জ
জেলা- পাবনা

১৯৭১ সালের ভাদ্রমাসের ১৫ তারিখ মুসলীম লীগের অন্যতম দালাল দূরবতী তারাশ থানার ক্যাম্প থেকে একদল পাকিস্তানী খান সেনাদের সলঙ্গা বাজারে ক্যাম্প অপারেশন করার জন্য সলঙ্গা বাজারের দিকে লেলিয়ে দেয়। বলা প্রয়োজন, সেই সময় কিছু সংখ্যক মুক্তিবাহিনী সলঙ্গা বাজারে রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন করার জন্য গোপনে চারিদিক ছড়িয়ে ছিল। ঠিক ঐ তারিখেই আরও ২০/২৫ জন খান কুকুরেরা লাহড়ী মোহনপুর থেকে স্পীড বোট যোগে সলঙ্গা বাজারের দিকে চলে আসে। সলঙ্গা বাজারে এসে তারা বাজারের চতুর্দিকে প্রদক্ষিণ করে। কোন রকম দুষ্কৃতিকারীকে না পেয়ে তারা আপন ক্যাম্পের দিকে রওয়ানা হয়। যাওয়ার পথে পাক সৈন্যরা আমাদের বাড়িতে ঢুকেই আমাকে ও আমার শ্বাশুড়িকে দেখতে পায়। ইতিপূর্বেই আমার স্বামী জীবনের ভয়ে বাড়ি থেকে সরে পড়ে। পাক সৈন্য আমার শাশুড়িকে উর্দুতে বলে যে, “ইয়ে বুড়ীমা, তোম জলদী হেয়াছে ভাগ যাও।” বুড়ী জীবনের ভয়ে বাড়ির বাইরে চলে যায়। আমি তখন পাক ফৌজের হাতের তল দিয়ে দৌড়ে পাশের বাড়িতে আশ্রয় নেই। পাক ফৌজ তখন দৌড় দিয়ে সেই বাড়িতে ঢুকে পড়ে। আমি তখন উক্ত বাড়িওয়ালার যুবতী মেয়েকে জড়িয়ে ধরি। পাক ফৌজ তখন উক্ত যুবতী মেয়েকে না ধরে আমাকে জোর করে তার হাত থেকে ছিনিয়ে নেয়। আমি তখন বলি যে বাবা তুমি আমার মান হানি কোরোনা, তোমার পায়ে ধরি, মিনতি করি। তখন পাক ফৌজ উর্দুতে বলে যে, তুমি আমাকে বাবা বলো না, আমি তোমার ভাই আর তুমি আমার মায়ের পেটের বোন। এই কথা কয়টি বলে আমার হাত ধরে জোর করে পরবর্তী বাড়ি হারু কবিরাজের পাকের ঘরে ঢুকে পড়ে। তারপর আমার উপর পাশবিক অত্যাচার আরম্ভ করে। আমার শরীরের উপর অমানুষিক উপায়ে ধর্ষণ ও মর্দন করতে আরম্ভ করে দেয়। আমি তখন অচৈতন্য অবস্থায় মাটিতে পড়ে থাকি। খান পিশাচ তার বাসনা তৃপ্তি করে অপরাপর খান সেনাদের তাদের কাম বাসনা চরিতার্থ করার জন্য হুকুম দেয়। এই সংবাদ শুনে খান কুকুরদের আরও চারজন আমার কাছে এসে পড়ে। আমাকে তারা আরও বলে যে, তোমার স্বামী কোথায়, সে নাকি মুক্তি ফৌজ, সে নাকি লুট করেছে? অবশ্য সব কথা উর্দুতে জিজ্ঞাসা করে।

তখন আমি বলি যে, না না, সব মিথ্যা। বাবা, আমার স্বামী ওসব কিছুই করে নাই বা সে কোন মুক্তি ফৌজ নয়। তখন দস্যুরা আমার ঘরে ঢুকে তল্লাশী চালায়। ঘরে ঢুকে কোন রকম লুটের মালপত্র তারা দেখতে পায় না। তারা শুধু তামাক ও তামাক তৈরির মসলাদি দেখতে পায়। কারণ আমার স্বামী একজন দরিদ্র তামাক ব্যবসায়ী। খান সেনারা আমাকে জানায় যে, তুমি এখানে থাক, আমরা বাইরে থেকে এখনি আসছি। তাদের কুমতলব বুঝতে পেরে আমি দূরে একটা বাড়ির দিকে ছুটে যাই। সেখানে গিয়ে দেখতে পাই যে আরও একদল খানসেনা একটি হিন্দু মেয়েকে জোর করে টানাটানি করছে তাদের কামবাসনা মিটানোর জন্য। ঐ দেখে আমি আরও দূরের বাড়িতে আশ্রয় নেই। এর পরপরই তারা বাজার ছেড়ে ক্যাম্পের দিকে অগ্রসর হয়।

টিপসহি/-
মনোয়ারা খাতুন

রকিবুল হাসান জিহান
<৮,২.২.৯৯,১৫৭>
।। ৯৯।।
শ্রীমতি সাবিত্রী দেবী
গ্রাম- সোনাপুকুর
থানা- পার্বতীপুর
জেলা- দিনাজপুর

চৈত্র মাসে সামরিক তৎপরতা শুরু হলে অত্র গ্রামের প্রায় প্রত্যেক বাড়িতেই আত্মরক্ষার জন্য বাঙ্কার করে। এই সময় একদিন পাকবাহিনী ও অবাঙ্গালীদের দল সৈয়দপুর থেকে দিনাজপুর পথে আমাদের গ্রামের সমস্ত বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়। প্রাণভয়ে যারা পালিয়ে গিয়েছিল তারাই শুধু বেঁচেছে কিন্তু যারা সাহসে ভর করে জরুরী আত্মরক্ষার তাগিদে উল্লিখিত বাঙ্কারগুলির মধ্যে আত্মগোপন করেছিল তাদের কেউই বেঁচে নেই। ঐ দিন আমাদের পাড়ায় অন্যূন ৭ জন পুরুষ এবং মহিলা মারা যান।

এমন একটি গর্ত ছিল আমাদের বাড়িতেও। আমি এবং আমার দুই দেবর ও একজন ভাগিনাকে নিয়ে সেই গর্তে আত্মগোপন করি। অতি অল্প দূর থেকে খান সেনারা আমাদের লক্ষ্য করে গুলি করে। ঐ গুলিতে ঐ গর্তের তিনজন মারা যায়। গুরুতর আহত অবস্থায় আমি বেঁচে গেছি।
টিপসহি/-
সাবিত্রী দেবী

রকিবুল হাসান জিহান
<৮,২.২.১০০,১৫৮>
।। ১০০।।
মোঃ রজব আলী
গ্রাম- সোনাপুকুর
থানা- পার্বতীপুর
জেলা- দিনাজপুর

বৈশাখ মাসের মাঝামাঝি সময়ে খান সেনারা আমাদের গ্রাম ঘেরাও করে। আমাকে সহ আরও চার জনকে ধরে। খান সেনারা মুক্তিবাহিনীর খোঁজে এই গ্রাম ঘেরাও করে। সামরিক বাহিনী ও অবাঙ্গালীদের যৌথভাবে গঠিত এ দলটি আমাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে যে আওয়ামী লীগ নেতা কে এবং কোথায়? মুক্তিবাহিনী কোথায়? আমাদের টাকা দাও। সাথে ৪৫ টাকা ছিল। তা তারা ছিনিয়ে নেয়।

অতঃপর ধৃত পাঁচজনকে আমাদের আঙ্গিনায় প্যারেড করতে নির্দেশ দেয়। ঐ অবস্থায় সামনে থেকে লাইনে গুলি করে। চারজন ঘটনাস্থলেই মারা যায়। আমার বুকের উপর এবং বা হাতে গুলি লাগে এবং ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাই।

পশুরা ঐ দিন মেয়েদের উপর অত্যাচার করেছে। গ্রামের বাড়িঘর লুটপাট করে সম্পদ অপহরণ করতেও তারা কার্পণ্য করেনি।
স্বাক্ষর/-
মোঃ রজব আলী

রকিবুল হাসান জিহান
<৮,২.২.১০১,১৫৯>
।। ১০১।।
শ্রীমতি পদ্মমণি
গ্রাম- সোনাপুকুর
থানা- পার্বতীপুর
জেলা- দিনাজপুর

চৈত্র মাসের একটি দিনে আমি ভাতিজা সহ বাড়ির গর্তে আশ্রয় নিয়েছিলাম। সামরিক পশুরা যখন আমাদের গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়ে লোক খুঁজতে খুঁজতে আসছিল তখন আমাদের দেখতে পেয়েই কোন রকম সময়ক্ষেপণ না করে অথবা কোন বাক্য ব্যয় না করেই গুলি করে। পরপর চারটি গুলি করে গর্তের সকলকে হত্যা করে। ভাগ্যক্রমে গর্তের আর সকলে মারা গেলেও গুরুতরভাবে আহত হয়ে বেঁচে গেছি। পরবর্তী সময়ে অনেক কষ্ট করে ভারতে আশ্রয় নেই এবং দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত সেখানেই ছিলাম।
টিপসহি/-
শ্রীমতি পদ্মমণি

রকিবুল হাসান জিহান
<৮,২.২.১০২,১৬০> “তারা আমাকে নামাজ পাঠরত অবস্থায় গ্রেফতার করে। আমি ফরজ নামাজ পড়ার জন্য সময় প্রার্থনা করলেও পাক বর্বররা আমাকে সে সময় দেয় নি।“
।। ১০২।।
আক্কাস আলী
গ্রাম- সাধুপাড়া
থানা- পাবনা
জেলা- পাবনা

২৫ শে মার্চ রাতে আমি যখন ঘুমাচ্ছি, তখন ঐ এলাকার আপামর মানুষ বড় বড় গাছ কেটে, ইট দিয়ে বেরিকেড তৈরি করে। সারা রাত ধরে তারা এই কাজ করে।

পরদিন শুক্রবার ফজরের নামাজ পড়ার জন্য আমি ঘুম থেকে উঠে মসজিদে ফজরের আজান দেই। আজান শেষে আমি যখন সুন্নত নামাজ পড়ছিলাম ঠিক সে সময় ৭ ট্রাক মিলিটারী আসে। তারা আমাকে নামাজ পাঠরত অবস্থায় গ্রেফতার করে। আমি ফরজ নামাজ পড়ার জন্য সময় প্রার্থনা করলেও পাক বর্বররা আমাকে সে সময় দেয় নি। আমাকে গ্রেফতার করে মারধর শুরু করে। তারপর বাইরে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। বেরিকেড কারা তৈরি করেছে এবং তাঁরা কোথায়? আমি জানিনা বলে অস্বীকার করলে সৈন্যরা আমার উপর বেতের লাঠি দিয়ে এলোপাতাড়ি বেদম প্রহার শুরু করে। শরীরের এমন কোন জায়গা ছিল না যেখানে তাদের প্রহারের আঘাত পৌছেনি। মারের চোটে শরীরের বিভিন্ন স্থান থেকে রক্ত ঝরতে থাকে এবং বাম হাত ভেঙ্গে যায়।

মারের চোটে আমি চিৎকার করে এক সময় বলেছিলাম যে আল্লাহ যেনো এর বিচার করেন এবং তা তিনি করবেন। একথা শুনে তারা আমাকে ছেড়ে দেয়। এই সুযোগে আমি আমার বাড়ির ভিতর প্রবেশ করি।

বাড়ির ভিতর প্রবেশ করে আমি দেখতে পাই যে আমি গুলি করার জন্য ২/৩ জন সিপাই রাইফেল নিয়ে প্রস্তুত হচ্ছে। সুতরাং আমি বিলম্ব না করে প্রতিবেশী জনৈক মহিলার সাহায্যে বাড়ির পিছন দিক দিয়ে পালিয়ে অন্য গ্রামে আশ্রয় নেই। এবং তিন মাস বাইরে থেকে আমি আত্মরক্ষা করি।
স্বাক্ষর/-
আক্কাস আলী

রকিবুল হাসান জিহান
<৮,২.২.১০৩,১৬১>
।। ১০৩ ।।
মোছাম্মৎ এসবাহাতুন
গ্রাম- নতুন ভাঙ্গাবাড়ী
থানা ও ডাকঘর- সিরাজগঞ্জ
জেলা- পাবনা
১৯৭১ সালের জুলাই মাসে পাক বাহিনী আমার বাবার বাড়ি নতুন ভাঙ্গারাড়ীতে প্রায় ৫০/৬০ জন অপারেশনে যায়। আমি আমার বাবার বাড়িতে পাঁচ মাসের একটি ছেলে নিয়ে ঘরের মধ্যে বসে আছি। আমার সাথে আরও ৮/১০ জন মহিলা ঘরের মধ্যে বসে গল্প করছে। এমন সময় আমাদের বাড়ির মধ্যে দুই জন পাক সেনা ঢুকে পড়ে। তারা ঢুকে পড়ার সাথে সাথে অন্যান্য যে মেয়েরা ছিল তারা মিলিটারী দেখে দৌড়াদৌড়ি করে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। কিন্তু আমার কোলে বাচ্চা থাকার জন্য আমি বেরুতে পারি নি। পাক সেনারা দুই-দুইজন আমার ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে। আমার বাবা ও ভাই এসে বাঁধা দিতে চাইলে একজন পাকসেনা তাদের বুকে রাইফেল ধরে রাখে আর একজন আমাকে ঘরের মধ্যে ধরে ফেলে আমার নিকট হতে আমার পাঁচ মাসের বাচ্চা ছিনিয়ে নিয়ে বিছানার উপর ফেলে দিয়ে আমার উপর পাশবিক অত্যাচার করে। আমার শিশু সন্তান কাঁদতে থাকে। তারপর সে আমার বাবা ও ভাইয়ের বুকে রাইফেল ধরে। অন্য জন এসে আবার পাশবিক অত্যাচার শুরু করে। দুইজন মিলে প্রায় এক ঘন্টা আমার উপর পাশবিক অত্যাচার করে। তারপর তারা চলে যায়। আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকি। তার আধ ঘন্টা পর আমার জ্ঞান ফিরে পাই।

স্বাক্ষর/-
মোছাম্মৎ এসবাহাতুন

রকিবুল হাসান জিহান
<৮,২.২.১০৪,১৬২> “আমার শিশু সন্তানকে আমার নিকট থেকে জোর করে ছিনিয়ে নিয়ে মাটির সাথে আছাড় দিয়ে হত্যা করে।“
।। ১০৪।।

মোছাম্মৎ রহিমা খাতুন
গ্রাম- আউনদাউন
ডাকঘর- বাগবাটি
থানা- সিরাজগঞ্জ
জেলা- পাবনা

১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে একদিন ভোররাতে প্রায় ৫০/৬০ জন পাক সেনা আমার স্বামীর গ্রামে অর্থাৎ আউনদাউন নামক গ্রামে যায়। আমি ৭ মাসের শিশুসহ ঘুমিয়ে আছি। ভোর রাত্রিতে আমার স্বামী মিলিটারীর শব্দ পেয়ে ঘর হতে বেরিয়ে পালিয়ে যায়। ৭ জন পাক সেনা আমার বাড়িতে ঢুকে পড়ে এবং ঘরের দরজায় লাথি মেরে দরজা খুলে ফেলে এবং আমার শিশু সন্তানকে আমার নিকট থেকে জোর করে ছিনিয়ে নিয়ে মাটির সাথে আছাড় দিয়ে হত্যা করে। তারপর আমাকে এক এক করে ৭ জন পাক সেনা পাশবিক অত্যাচার করে। প্রায় ২/৩ ঘন্টা আমার উপর পাশবিক অত্যাচার করার পর আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। তার আধঘন্টা পর আমি জ্ঞান ফিরে পেয়ে শুনতে পাই যে আমার তিনজন জা’কে পাক সেনারা জোর করে ধরে ক্যাম্পে নিয়ে যায়। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর আর তাদের কোন খোঁজ খবর পাওয়া যায় নাই। একই দিনে ঐ গ্রামের প্রায় ১০/১২ জন মহিলার উপর পাশবিক অত্যাচার করে এবং প্রায় ৭ জন মহিলাকে তাদের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। বেশ কিছু দিন চিকিৎসা হবার পর আমি সুস্থ হয়ে উঠি/

টিপসহি/-
মোছাম্মৎ রহিমা খাতুন
১৭/১০/১৯৭৩

রকিবুল হাসান জিহান
<৮,২.২.১০৫,১৬৩>
।। ১০৫ ।।

মোঃ নজরুল ইসলাম বুলবুল
গ্রাম- চরনবীপুর
থানা- শাহাজাদপুর
জেলা- পাবনা

২৬ শে এপ্রিল পাক বাহিনী বাঘাবাড়ী ঘাঁটি অতিক্রম করে বগুড়ার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। বাঘাবাড়ী থেকে বগুড়া যাওয়ার পথে বিরাট সাঁজোয়া বাহিনীর এই দলটি প্রতিরোধের আশঙ্কায় রাস্তার দু’ধারে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে এগুতে থাকে। ২৬শে এপ্রিল সকাল ৮টার দিকে পাক বাহিনীর একটি দল করতোয়া নদীর পাড়ে গাড়াদহ খেয়াঘাটে তাবু খাটায়। এবং এখান থেকে পাশবর্তী গ্রামসমূহে মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করবার চেষ্টা করে। এদিকে পাক বাহিনীর অপর একটি অগ্রগামী দল উল্লাপাড়া স্টেশন থেকে বিশেষ ট্রেন নিয়ে সিরাজগঞ্জের দিকে যাত্রা করে। পথে ঘাটিনা ব্রিজের কাছে তারা মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। মুক্তিবাহিনী ব্রিজের অপর পাড় থেকে গেরিলা কায়দায় গুলি ছুড়তে থাকে। পাক সেনারা মুক্তিবাহিনীর এই অতর্কিত আক্রমণ বুঝতে পারেনি। ফলে যে ক’জন পাক সেনা ব্রিজ ভাল আছে কিনা দেখার জন্য ট্রেন থেকে নিচে নেমেছিল তারা সবাই নিহত হয়। এখানে নিহতের সংখ্যা ২০ থেকে ২৫ জনের মত জানা গেছে।

এরপর ট্রেনটি উল্লাপাড়া স্টেশনে ফিরে যায় এবং বিরাট একটা দল নিয়ে পুনরায় মুক্তিবাহিনীকে আক্রমণ করে। মুক্তিবাহিনী তখন সেখানে ছিল না। ফলে আশেপাশের চার পাঁচটি গ্রাম তারা পুড়িয়ে দেয়।

গাড়াদহ খেয়াঘাট থেকে ঘাটিনা ব্রিজের দূরত্ব প্রায় ৫ মাইল। পাক বাহিনী মুক্তিবাহিনীর মোকাবেলায় রকেট শেল ছুড়বার জন্য গাড়াদহে আস্তানা গাড়ে। এবং একদিন সকাল থেকে দুপুর ২ টা পর্যন্ত একটানা রকেট শেল ছুড়তে থাকে। এদিকে আশেপাশের গ্রামের জনসাধারণ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে থাকে। আশেপাশের গ্রাম থেকে লোকজন সরে যাওয়ায় লুটপাট যাতে না হয় সেজন্য চরনবীপুর প্রগতি সংঘের সদস্যবৃন্দ গ্রাম পাহারা দিতে থাকে। এসময় তারা গাড়াদহ বাজার লুট করে এবং বাজারের দোকানপাট পুড়িয়ে দেয়। এই গ্রামের প্রায় এক ডজন (১২) নিম্ন ও মধ্য শ্রেণীর হিন্দু বাড়ি পাক বাহিনী জ্বালিয়ে দেয়। এবং রাস্তার আশেপাশে যাদেরকে পায় তাদের মারধর করে।

এসময় অগ্রবর্তী দলটি উল্লাপাড়া স্টেশনে সি, এন্ড, বি এর ডাক বাংলোয় তাদের ঘাঁটি স্থাপন করে। একদিন গাড়াদহ থেকে উল্লাপাড়া যাওয়ার দুর্গানগরের কাছে রাস্তায় এক বৃদ্ধকে পাক বাহিনী গুলি করে হত্যা করে। আমাদের চরনবীপুর গ্রামের প্রাথমিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আব্দুস সামাদ তার শ্বশুরবাড়ি চড়িয়াতে ছিল। পাক বাহিনী এই গ্রামে ঢুকে গ্রামের প্রায় ৩০ জন লোককে লাইনে দাঁড় করিয়ে হত্যা করে। আব্দুস সামাদ নিজেকে বাঁচানোর জন্য একটি পুকুরের মধ্যে নেমে পড়ে এবং মাথা ডুবিয়ে রাখে। তার ছোট ছেলে বাবার খোঁজে পুকুর পাড়ে যায় এবং আব্বা আব্বা বলে ডাকতে থাকে। ঠিক এই সময় একজন পাক সেনা পুকুরের পাড়ে আসে এবং আব্দুস সামাদকে পুকুর থেকে ডাঙ্গায় তুলে। তাকে মুসলমান কিনা জিজ্ঞাসা করা হলে সে মুসলমান বলে পরিচয় দেয় এবং পবিত্র কোরআন শরীফ থেকে পড়ে শোনায়। এতেও পাক সেনাদের বিশ্বাস হয় না। পরে তাকে অজু করতে বলে। আব্দুস সামাদ যথারীতি অজু করে এবং তার গায়ে রাখা হাজী রুমালটি দিয়ে মাথা ঢাকে ও কালেমা পড়তে থাকে। কিন্তু এতে করেও পাক বাহিনী তাকে রেহাই দেয়নি। এই গ্রামের অন্য ত্রিশ জনের (৩০) সাথে তাকেও লাইনে দাঁড় করিয়ে হত্যা করে।

স্বাক্ষর/-
মোঃ নজরুল ইসলাম বুলবুল
০৮/০৫/১৯৭৪

রকিবুল হাসান জিহান
<৮,২.২.১০৬,১৬৪-১৬৫>

।। ১০৬ ।।

সামছুজ্জোহা আলমাজী
শাহজাদপুর
পাবনা

১৯৭১ সালের ৬ ই সেপ্টেম্বর ৬/৭ জন রাজাকার আমাকে দিভার রোডে ধরে এবং অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে এবং আমাকে তাদের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে নিয়ে গিয়ে আমার দুই হাত একত্রিত করে বাঁধে। তারপর রাজাকার কমান্ডার মজিবর রহমান আমাকে জিজ্ঞাসা করে তোমার কাছে কয়টা রাইফেল আছে? কয়টা গ্রেনেড আছে ও কয়টা হাত বোমা আছে এবং তুমি মুক্তিবাহিনীর সাথে যোগাযোগ করো। এবং তাদের কাছে আমাদের গোপন খবরাখবর পাঠিয়ে দাও। আমি তার জবাবে উত্তর করি আমার কাছে দুইটা বন্দুক আছে তা আমার নিজস্ব এবং তার মধ্যে একটা থানায় জমা দেওয়া হয়েছে এবং অন্যটা আমাদের বাসায় আছে। তারপর দুইজন রাজাকার এসে আমাকে কিল, চড়, ঘুষি মারতে থাকে। বেশ আধা ঘন্টা শারীরিক নির্যাতন চালানোর পর আমাকে একটা ঘরের মধ্যে নিয়ে যায়। সেখানে নিয়ে গিয়ে দুইজন রাজাকার আমাকে লাঠি দিয়ে শরীরের বিভিন্ন স্থানে প্রহার করে। তারপর সন্ধ্যা হয়ে আসাতে তারা প্রহার করা বাদ দিয়ে উক্ত ঘরের মধ্যে একটা জানালার শিকের সাথে বেঁধে রেখে ঘরে একটা বাতি জ্বেলে রেখে যায়। তার ১০/১৫ মিনিট পর একজন রাজাকার ঘরের মধ্যে প্রবেশ করেই বাতি নিভিয়ে দিয়ে যায়। তার ৫/৭ মিনিট পর এক এক করে ৪/৫ জন রাজাকার আমার উপর চড়, কিল, ঘুষি, লাথি ও লাঠি দিয়ে প্রহার করার পর তারা চলে যায়। আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। তার আধা ঘন্টা পর আমি জ্ঞান ফিরে পাই। পরদিন সকাল বেলা পাক সেনাদের দুটি গাড়ি রাজাকার ক্যাম্পে এসে পৌঁছে। এসেই আমাদেরকে হাত বাঁধা অবস্থায় দেখতে পেয়ে পাক সেনারা রাজাকারদের সাথে আমাকে নিয়ে হাস্যরস করে। তারপর রাজাকার কমান্ডারের সাথে আলাপ-আলোচনা করার পর তাদের গাড়িতে করে আমাকে ও আরও একজনকে উল্লাপাড়া নিয়ে যাবার সময় রাস্তায় পাক সেনারা কিল, ঘুষি, চড়, লাথি মারে। কিন্তু হাবিলদারের আমার প্রতি কঠোর দৃষ্টি থাকার জন্য আমাকে বিশেষ প্রহার করার সুযোগ সুবিধা পায় না। আমাকে উল্লাপাড়া নিয়ে গিয়ে একটা রুমের মধ্যে নিয়ে বন্দী অবস্থায় রেখে দেয়। রাত্রিতে ২/৩ জন পাক সেনা আমার নিকট যায় এবং লাথির পর লাথি দেবার পর আমাকে মেঝেতে শুইয়ে পাক সেনারা বুট পায়ে দিয়ে আমার বুকের উপরে উঠে পাড়াতে থাকে। এইভাবে ৪/৫ জন পাক সেনা আমার শরীরের উপর উঠলে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। তারপর কখন যে তারা আমার উপর নির্যাতন করা বাদ দিয়েছে তা আর আমার স্মরণ নেই। রাত্রি দুইটার সময় আমি জ্ঞান ফিরে পেয়ে দেখতে পাই যে কোন লোক রুমের মধ্যে নেই। পর দিন সকালে হাবিলদার আমার সাথে দেখা করে। আমি তাকে আমার নির্যাতনের ঘটনার কথা খুলে বলি। তারপর সে ক্যাপ্টেনকে সাথে করে আমার রুমে আসে এবং আমার শরীরে শত শত প্রহারের দাগ দেখে তার সিপাহীদেরকে শাসিয়ে দেয় এবং আমার উপর যেন কোন অত্যাচার বা নির্যাতন না করা হয় তাও বলে দেয়। তারপর ক্যাপ্টেনের নির্দেশে একজন ডাক্তার ঔষধপাতি নিয়ে আমার রুমে ঢোকেন এবং আমার শরীর পরীক্ষা করার পর কয়েকটা ইঞ্জেকশন ও কিছু মালিশ দিয়ে যান। তারপর আমি ঐগুলি ব্যবহার করতে থাকি। তারপর হতে আমার উপর শারীরিক কোন নির্যাতন করা হয় না। তিন দিনের দিন একজন হাবিলদার আমার নিকট যায় এবং আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে আপনার নিকট রাইফেল নাই, গ্রেনেড নাই। তার জবাবে আমি না বলাতে সে চলে যায়। তার কিছুদিন পর আমাকে বন্দীশালা হতে বের করে বাইরে নিয়ে যায়। সেই দিন শাহজাদপুর হতে একজন লোককে ধরে নিয়ে যায়। ক্যাপ্টেন খালেক আমাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করে, বাবলু এই লোকটাকে তুমি চেনো? আমি উত্তর করি না। তারপর আমাকে আমার বন্দী ঘরের মধ্যে নিয়ে রেখে দেয়। আর আমার সাথে যে লোকটা বন্দী ছিল তাকে বের করে বাইরে রাখে।

১৩ ই সেপ্টেম্বর কয়েকজন পাক সেনা বন্দী ঘর হতে বের করে নিয়ে যায় এবং আমাকে বলে তোমাকে ক্যাপ্টেন ডাকে। আমি তাদের সাথে যাই। গিয়ে দেখি সেখানে ক্যাপ্টেন, রাজাকার কমান্ডার ও হাবিলদার বসে আছে। আমি সেখানে যাওয়ার সাথে সাথে কেঁদে ফেলি। ক্যাপ্টেন আমাকে ধমক দিয়ে বলে যে তুমি পাকিস্তান জিন্দাবাদ, কায়েদ আযম জিন্দাবাদ ইত্যাদি জোরে জোরে বল। আমি উক্ত কথা বলাতে ক্যাপ্টেন আমাকে মুক্তি দেয়। এবং আমার একটা আংটি তার নিকট ছিল তাও দিয়ে দেয়। আমি বাড়ি চলে আসি। আমাকে ধরার প্রধান কারণ ছিল আমি মুক্তিযোদ্ধাদেরকে গোপনে খেতে দিতাম এবং তাদেরকে জায়গা দিতাম এবং পাক সেনা ও রাজাকারদের গোপন সংবাদ তাদের নিকট পৌঁছে দিতাম। যার ফলে রাজাকাররা আমাকে বন্দী করে এবং নিজেরা নির্যাতন করার পর পাক সেনাদের হাতে তুলে দেয়।

স্বাক্ষর/-
সামছুজ্জোহা আলমাজী (বাবলু)
শাহজাদপুর
দ্বারিয়াপুর
পাবনা
০৮/১২/১৯৭৩

রকিবুল হাসান জিহান
<৮,২.২.১০৭,১৬৬>
।। ১০৭ ।।

গোলজার হোসেন
গ্রাম- পূর্ব মহেশপুর
ডাকঘর- দুর্গানগর
থানা- উল্লাপাড়া
জেলা- পাবনা

১৯৭১ সালে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আমি, ইয়াকুব ও আবু সামা গেঞ্জির ব্যবসা শুরু করি।

আগস্ট মাসে আমরা গেঞ্জি বিক্রয় করার জন্য উল্লাপাড়া হাটের উদ্দেশ্যে বাড়ি হত্র রওয়ানা হয়ে যাই। উল্লাপাড়া পেট্রোল পাম্পের নিকট পাক হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প ছিল, তারা আমাদেরকে ধরে ফেলে এবং আমাদের অনেক প্রশ্ন জিজ্ঞাসাবাদ করে। যেমন
(ক) ভোট কাকে দিয়েছ?
(খ) নৌকায় কেন ভোট দিলে?
(গ) শেখ মুজিবকে কেন ভোট দিলে?
ইত্যাদি জিজ্ঞাসাবাদ করার পর আমাদের তিনজনের টাকা পয়সা মিলে প্রায় ১৫০ টাকা চার্জ করে নেয়। সেখানে ৪/৫ জন বিহারী উপস্থিত ছিল। তারপর আমাদের ছেড়ে দিলে আমরা ক্যাম্প পার হয়ে ৯/১০ গজ অতিক্রম করার সাথে সাথে উক্ত বিহারী কয়জন দৌড়িয়ে আমাদের নিকট যায় এবং আমাদেরকে ডেকে নিয়ে উল্লাপাড়া স্টেশন ঘরের মধ্যে নিয়ে যায়। সেখানে নিয়ে বিশ্রামাগারের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়ে বাইরে এসে আলাপ আলোচনা করে আমাদেরকে মেরে ফেলবে না বাঁচিয়ে রাখবে। আমরা দরজার নিকট এসে তাদের কথাবার্তা সব শুনতে পাই। তারপর সিদ্ধান্ত নেয় আমাদেরকে হত্যা করবে। আমরা তিনজন চিন্তা ভাবনা করি কি করা যায় এখন। এমন সময় দরজা খুলে আবু সামাকে রুম হতে গলায় দড়ি লাগিয়ে বের করে নেয় এবং আমাদেরকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে যায়। তারপর আবু সামার সমস্ত শরীরে বেয়োনেট চার্জ করে পরে গরু জবাই করার মত গলায় ছুরি দিয়ে জবাই করে তাকে হত্যা করে।

তারপর আবার এসে দরজা খোলে এবং ইয়াকুবকে বের করে নিয়ে যাওয়ার সময় আমি বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি এবং আমাকে ২/৩ জন ধরে রাখার চেষ্টা করলে মরণপণ লড়াই করে জোরপূর্বক ৪/৫ টা লাথি মেরে এক দৌড়ে বালসা বাড়ি এসে পড়ে যাই এবং জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। উক্ত গ্রামের তিনজন ছেলে আমার ক্লাসমেট ছিল। তারা আমাকে দেখে সেবা যত্ন করে। জ্ঞান ফিরে পেলে আমাকে আমাদের বাড়ি এনে রেখে যায়। ইয়াকুব তাদের হাত হতে মুক্তি পায়নি। তারা ইয়াকুবকে নিয়ে গিয়ে আবু সামার মত একই পদ্ধতিতে হত্যা করে দুইজনকে একই স্থানে ফেলে রাখে এবং আমাদের তিনজনের প্রায় ১৫০/২০০ টাকার গেঞ্জি তারা নিয়ে যায়।

আমি বাড়ি আসার পর সমস্ত ঘটনা খুলে বলি। গ্রাম হতে ৪/৫ জন লোক মিলিটারী ক্যাম্পে যায় উক্ত লাশগুলো এনে কবর দেবার অনুমতির জন্য। তারপর একটা ট্রাকে করে উক্ত লাশগুলো মহেশপুর লাইনে এনে রেখে যায়। গ্রামবাসী সেখান হতে লাশ দুটো তাদের বাড়িতে নিয়ে আসে। বাড়ি আনার পর আমরা দেখতে পাই আবু সামার ও ইয়াকুবের সমস্ত শরীরে প্রায় শতাধিক বেয়োনেটের চিহ্ন এবং গলায় ছুরি চালিয়ে হত্যা করেছে তার চিহ্ন দেখা যায়। তারপর তাদেরকে গ্রামবাসী কবর দেন। আবু সামার স্ত্রী বর্তমানে ৪/৫ জন ছেলে মেয়ে নিয়ে বিধবা হয়েছে। আর ইয়াকুব আই,এ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিল। আমি ইনশা আল্লাহ পাক হানাদার বাহিনীর সহযোগীদের হাত হতে কোন প্রকারে রক্ষা পেয়েছিলাম।

স্বাক্ষর/-
গোলজার হোসেন
২৪/১১/১৯৭৩

রকিবুল হাসান জিহান

<৮,২.২.১০৮,১৬৭>
।। ১০৮ ।।

মৌলভী মোঃ বছির উদ্দিন আহমেদ
গ্রাম- বড় মনোহারা
পোষ্ট- দুর্গানগর
থানা- উল্লাপাড়া
জেলা পাবনা

একদিন (জুলাই মাসে) উল্লাপাড়া রেল স্টেশনে দাড়িয়ে ছিলাম। এমন সময় একজন রাজাকার ও ৭/৮ জন পাক আর্মি আমাকে ধরে ফেলে এবং বলে যে আমি ভণ্ড ধার্মিক, আমি “মুক্তিকা স্পাই”। আমাকে প্রথমে উল্লাপাড়া মিলিটারী ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে আমাকে প্রথমে জিজ্ঞাসা করে যে তুমি কাকে ভোট দিয়েছ। আমি উত্তরে বলি যে “নৌকায়”। এই সময় আমাকে পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলার জন্য বলে। কিন্তু আমি তা বলি না। আমার মুখে একই বুলি ছিল যে “যা হবার তা হয়ে যাবে আল্লাহ”, “জোর করে কয়দিন রাখবে আল্লাহ”, “নৌকা মার্কায় ভোট দিছি আল্লাহ” ইত্যাদি।

তখন পাক বর্বর বাহিনী আমার হাত পিছনে বেঁধে দুই পা বেঁধে উল্টো করে গাছে সঙ্গে ঝুলিয়ে দেয়। এবং চাবুক দ্বারা প্রহার করতে থাকে। কিন্তু আমার মুখে ঐ এক কথা।

দুদিন পর আমাকে সিরাজগঞ্জ নিয়ে যায়। সেখানে আমি দাড়ি-চুল ছোট করে দেওয়া হয়। আমাকে দিয়ে সিমেন্টের বস্তা টানায়। এই সময় আমাকে নামাজ পড়তে দিত না। তারা নিয়মিতভাবে প্রহার করত। ফলে আমার পিঠে তিনটা বড় রকমের গর্ত হয়ে যায়। আমি ভীষণ ভাবে কাতর হয়ে পড়ি, তবুও আমাকে রেহাই দেওয়া হত না। আমার মুখে চুন ও কালি মেখে রাজাকাররা শহরের মধ্যে ঘুরতো। আমার কপালের উপর খাপড়া রেখে সূর্যের দিকে মুখ করে দাঁড় করিয়ে রাখতো। এই সময় আমাকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করতো।

১৫ দিন পর একটা মেজর এসে আমাকে বলে যে আমি আপনাকে বহুদিন আগে থেকেই চিনি। আপনি যে একটা “দরবেশ” লোক তাও আমি জানি। কিন্তু এরা আপনাকে না জেনে ধরে এনেছে এবং মারধর করেছে। তার জন্য আমি দুঃখিত। আমরা খাঁটি মুসলমানদের উপর কোনরূপ অত্যাচার করব না। আমরা শুধু কাফের ও হিন্দুকে মারব। এই বলে আমাকে ছেড়ে দেয় ও সিরাজগঞ্জ হাসপাতালে ভর্তি করে দেয়।

স্বাক্ষর/-
বছির উদ্দিন আহমেদ

রকিবুল হাসান জিহান
<৮,২.২.১০৯,১৬৮>

।। ১০৯ ।।

মোঃ ফজলুল করিম তালুকদার
গ্রাম- চর মোহনপুর
থানা- উল্লাপাড়া
জেলা- পাবনা

ভাদ্র মাসের ৩ তারিখে ভোর ৬টার সময় পাক দালালদের সহযোগিতায় নৌকাযোগে চর মোহনপুর গ্রাম ঘেরাও করে। গ্রামের চারিদিকে ঘেরাও করে মোট ১৭ জনকে ধরে। এর মধ্যে একজন ছিল হিন্দু। ১৭ জনকে ধরে প্রথমে লাহিড়ী মোহনপুর স্টেশনের একটা ঘরে তালাবদ্ধ করে রাখে। তারপর ব্রেক গাড়িতে উঠায়। তারপর তাদেরকে প্রথম প্রশ্ন করে যে তোমরা ভোট দিয়েছো কাকে। তার জবাবে তারা উত্তর দেন যে আমরা সবাই বাঘে ভোট দিয়েছি। তখন তারা বলে যে শালারা সবাই বাঘে ভোট দিয়েছো তবে এই এলাকায় বাঘে ৬ ভোট পেলো কি করে। এই বলেই পাক কুকুরেরা রাইফেলের বাঁট দিয়ে ও মাজার বেল্ট দিয়ে মারতে থাকে। পর্যায়ক্রমে ১০/১২ জন মিলিটারী মারধোর করে।

সারা রাত্রি তাদেরকে গাড়ির ভিতর আটকে রাখে। সকাল বেলা উল্লাপাড়া ক্যান্টনমেন্টে মেজরের সামনে হাজির করে। সেখানে তাদেরকে বলে যে তোমরা মুক্তিযোদ্ধা। তোমরা বিহারীদেরকে মেরেছো ইত্যাদি ইত্যাদি বলে তাদেরকে প্রহার করতে থাকে। একদিন পর তাদেরকে নিয়ে যায় পাকশী, সেখানে একটা অন্ধকার কক্ষে তাদের সবাইকে আটকিয়ে রাখে। ২ দিন পর একটা রুটি খেতে দেয়। যেখানে থাকা সেখানেই পায়খানা প্রশ্রাব করতে হত। তাদেরকে দুই পা ফাঁক করে এবং দুই হাত ফাঁক করে দাঁড় করিয়ে রাখতো ৫/৬ ঘন্টা করে। পাকশীতে তারা ৫ দিন ছিল। এই সময় প্রত্যেক দিন তাদের উপর অকথ্য অত্যাচার করা হত। তাদেরকে প্রশ্ন করত যে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যানকেকে হত্যা করেছে। কার কার ছেলে মুক্তিযোদ্ধা হয়েছে। কে কে আওয়ামী লীগের লিডার, কে কে হিন্দু ইত্যাদি। কিন্তু তারা সে কথা বলতে অস্বীকার করাতে তাদের উপর চালাতো অকথ্য নির্যাতন। ৫ দিন পর ২ জন বিহারী ও একজন খান তার নাম হান্নান খান তাদের সহায়তায় তাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হয়। ২ জন বিহারী ও খান সাহেব পাকশীতে গিয়ে মেজরের কাছে বলে যে এই সব লোক ভাল। এরা আমাদেরকে রক্ষা করেছে। এরা সৎ লোক। এই লোকগুলোকে যদি মারেন তাহলে আমাদের তিনজন অবাঙ্গালীকে আগে মারেন। এদের কথার পরিপ্রেক্ষিতে তাদের ছেড়ে দেয়।

তাদের যখন ছেড়ে দেয় তখন বলে দেয় যে তোমরা শান্তি কমিটির সাথে যোগাযোগ রাখ এবং লোকজনকে বুঝাও। যদি তা না কর তবে তোমাদেরকে পুনরায় ধরব এবং সেবার তোমাদেরকে হত্যা করব। চেয়ারম্যানের কথা মত সব কাজ করবে।

স্বাক্ষর/-
মোঃ ফজলুল করিম তালুকদার

রকিবুল হাসান জিহান
<৮,২.২,১১০.১৬৯> “চাকু দিয়ে সারা শরীর ফেড়ে লবণ লাগিয়ে দিতেও আমি দেখেছি।“

।। ১১০ ।।

শ্রী তারাপদ কুন্ডু
গ্রাম- আগ মোহনপুর
থানা- উল্লাপাড়া
জেলা- পাবনা

জুন মাসের মাঝামাঝি একদিন ভোর ৬ টার সময় আগ মোহনপুর গ্রামে পাক বর্বর বাহিনী ঘেরাও করে। তারা প্রথমে লুটতরাজ ও পরে অগ্নিসংযোগ করে। এই সময় আগ মোহনপুর গ্রাম হতে ৮/৯ লোককে পাক বাহিনী আটক করে। তার মধ্যে আমি ছিলাম একজন। আমার একমাত্র অপরাধ আমি তাদের কথায় “মালাউন”। আমাকে প্রথমে লাহিড়ী মোহনপুর দুধের মিলের নিকট আর্মি ক্যাম্প ছিল সেখানে নিয়ে যায়। সেখানে আমাকে হাত-পা বেঁধে দুপুরে রোদের ভিতর চিৎ করে শুইয়ে রাখে এবং পরে আমাকে চাবুক দ্বারা প্রহার করে। আমাকে যখন প্রহার করে তখন আমি মাঝে মাঝে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। সবার ভিতর হতে একজন বর্বর আমাকে জিজ্ঞাসা করে যে, ম্যায় জান্তাহু তোমহারা বড়া বড়া দো লাড়কি হ্যায়। যদি তুমি তাদের এখানে ডেকে আনতে পারো তবে তোমাকে ছেড়ে দেব।

দুইদিন আমাকে এইভাবে পিঠমোড়া করে বেঁধে রাখে। এই দুই দিন আমাকে কিছুই খেতে দেয় নাই। আমি তাদেরকে অনেক অনুনয় বিনয় করেছি যে আমি বৃদ্ধ মানুষ, আমাকে এইভাবে কষ্ট দিলে ভগবান নারাজ হবে। তবুও আমাকে খেতে দেয়নাই। দুইদিন পর আমাকে একটা রুটি খেতে দেয়।

তিনদিন পর আমাকে সিরাজগঞ্জ চালান করে দেয়। সিরাজগঞ্জ যাবার পর আমার উপর পর্যায়ক্রমে অমানুষিক অত্যাচার চলতে থাকে। আমার মত বৃদ্ধ মানুষও ঐ পাক বর্বরদের হাত থেকে রেহাই পায় নাই। সিরাজগঞ্জ জেলে থাকা অবস্থায় আমি অনেক লোককে শুধু পিটিয়ে মেরে ফেলতে দেখেছি। চাকু দিয়ে সারা শরীর ফেড়ে লবণ লাগিয়ে দিতেও আমি দেখেছি।

দুই মাস আমি জেলে ছিলাম। এই সময় আমাকে যখন তখন পিটাতো। দুই মাস পরে যখন আমি ধীরে ধীরে পীড়িত হয়ে পড়ি তখন আমাকে ছেড়ে দেয়। আমার সারা শরীরে এখনও ক্ষতের চিহ্ন বর্তমান।

স্বাক্ষর/-
শ্রী তারাপদ কুন্ডু

রকিবুল হাসান জিহান
<৮,২.২.১১১,১৭০>
।। ১১১ ।।

মোঃ হাবিবুর রহমান
গ্রাম- মাছিয়াকন্দি
থানা- উল্লাপাড়া
জেলা- পাবনা

১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসের ১৯ তারিখে সকাল বেলা দূরবর্তী ধানগড়া ক্যাম্প থেকে একদল পাকিস্তানী খান সেনা আমার বাড়ি ঘেরাও করে আমাকে ধরে নিয়ে যায়। ধানগড়া ক্যাম্পে নিয়ে যাবার সময় বুটের লাথি, রাইফেলের আঘাত এবং অসংখ্য ঘুষি ও চড় মারে। খান সেনাদের ভীষণ আঘাতের ফলে আমি মাটিতে পড়ে যাই। পুনরায় বুটের লাথিতে জীবনের ভয়ে আধমরা অবস্থায় তাদের সাথে ক্যাম্পে যেতে বাধ্য হই। ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে পুনরায় লোহার রড ও রাইফেল দিয়ে মারপিট করে। খান কুকুরেরা আমাকে এমনভাবে মেরেছিল যে আমার শরীর মাংস ঝলসে যায়। বুকে রাইফেল দিয়ে জোরে আঘাত করার ফলে আমার বুকের হাড়খানা সম্পূর্ণরূপে ভেঙ্গে যায়। প্রথম সিনে ক্যাম্পে নিয়ে যাবার পর একবারই ভীষণভাবে মারপিট করেছিল। পরে সেদিনের মত খান কুকুরেরা আর মারপিট না করে ক্ষান্ত রাখে। পরের দিন অর্থাৎ ২০ তারিখ সকালে আবার ভীষণভাবে দেহে বাঁশ দিয়ে চাপা দিয়ে শরীরের উপর দুইজন খান সেনা উঠে দাঁড়িয়ে থাকে। আমার কাছে মুক্তিদের সন্ধান চাইলে আমি অস্বীকার করার দরুন এইরূপ শাস্তি প্রদান করত। উক্ত ক্যাম্পে আমি দুই রাত ছিলাম। এই দুইদিনের ভিতর আমি অনুমান করি যে, ২৫ থেকে ৩০ জন লোক প্রত্যহ ধরে এনে বেয়োনেট এবং রাইফেল দিয়ে সারিবদ্ধ অবস্থায় গুলি করে হত্যা করে। খান সেনারা আমাকে বলে যে, তুমি যদি মুক্তিদের সন্ধান না দিতে পারো তাহলে তোমার অবস্থাও এমনি হবে। ২১ তারিখে সকাল বেলায় আমি মুক্তি পাই।

স্বাক্ষর/-
মোঃ হাবিবুর রহমান

রকিবুল হাসান জিহান
<৮,২.২.১১২,১৭১>
।। ১১২ ।।

খন্দকার জিল্লুর রহমান
গ্রাম- রামেরচর
থানা- উল্লাপাড়া
জেলা- পাবনা

১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসের ১৮ তারিখে মুসলিম লীগের দালালদের চক্রান্তের ফলে ধানগড়া খান সেনাদের ক্যাম্প থেকে ১৭ জন খান সেনা ও ৭/৮ জন রাজাকার রাত্রি ৩ টা ৩০ মিনিট সময় আমার বাড়ি ঘিরে ফেলে। এখানে উল্লেখ করা যায় যে, আমি স্থানীয় সলঙ্গা বাজারে একটি সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তুলি, তাছাড়া আমার বাড়িতেই মুক্তিরা গোপনে আসা যাওয়া করত এবং আমি সর্বরকমে তাদেরকে সহায়তা করতাম। এই সংবাদ শ্রবণমাত্রই দালালরা আমার বাড়িতে খান কুকুরদের লেলিয়ে দেয়। দূর্ভাগ্যবশত আমি ঐ রাত্রে নৌকা থেকে বাড়ির উপর উঠতেই খান দস্যুরা আমাকে ধরে ফেলে। অতঃপর তারা আমাকে কিছুপথ নৌকায় ও অবশিষ্ট রাস্তা পায়ে হাঁটিয়ে ধানগড়া ক্যাম্পে নিয়ে যায়। ধরার সাথে সাথে আমার বাড়ি থেকে ২০/২৫ হাজার টাকার সোনার গহনা খান কুকুরেরা নিয়ে যায়। ক্যাম্পে নেয়ার পর আমার চোখ-মুখ তোয়ালে দিয়ে বেঁধে মাথার উপর বালতি ভরে ভরে পানি ঢালা আরম্ভ করে। মুখ বেঁধে মাথার উপর পানি ঢাললে মানুষের কি অবস্থা হতে পারে ভুক্তভোগী ছাড়া কেউই বুঝতে পারে না।

এমতবস্থায় আমি আর নিঃশ্বাস ফেলতে পারছিলাম না, ঠিক ঐ সময় সাহসের উপর ভরসা করে বা জীবন যায় যাবে এই মত করে আমি তোয়ালে মাথা থেকে টেনে ছিঁড়ে ফেলি। অতঃপর খান কুকুরেরা আমাকে মোটা একটি বাঁশ দিয়ে পিঠের উপর ভীষণভাবে আঘাত করতে থাকে। তাছাড়া রাইফেল ও বুটের লাথিতে আমার পিঠের চামড়া ছিঁড়ে যায়। পিঠে রক্ত জমে যায়। খান কুকুররা এমনভাবে বুট দিয়ে লাথি মারে যে, ঐ লাথি খেয়েই উপুর হয়ে পড়ে যাই এবং আমার ডান হাতখানি সম্পূর্ণরূপে ভেঙ্গে যায়। এইভাবে আমাকে ভীষণ প্রহার করত। আমি যখন খান দস্যুদের ভীষণ মারপিটের ফলে অজ্ঞান হয়ে পড়তাম তখন কুকুরেরা মারপিট বন্ধ করে দিত। প্রসঙ্গত বলা যেতে পারে যে, আমার সাথে আমার ছোট ভাই তোতাকেও ধরে নিয়ে যায়। এবং তাকেও রাইফেল, বুট ও লোহার রড দিয়ে ভীষণভাবে মারপিট করে। এমনভাবে তারা মেরেছিল যে, আমার ছোট ভাইটি অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে যায়। তার সারা দেহে জখমের দাগ ছিল। খান দস্যুরা আমার ছোট ভাইকে দিয়ে লোহার রডের সাহায্যে আমাকে পিটাত। যখন সে অস্বীকার করত তখন তাকেও বেদম মারপিট করত। বাধ্য হয়ে সে সম্ভবত বড় ভাইকে মারপিট করত। অতঃপর দুই ভাইয়ের নিকট থেকে মুক্তিদের খোঁজ খবর জানার জন্য খানেরা আমাকে নিয়ে পুনরায় সলঙ্গা বাজারের দিকে চলে আসে। সেখানে গোলবার ডাক্তার নামক এক ব্যাক্তিকে ধরে ভীষণভাবে মারপিট করে ছেড়ে দেয়। পরপরই তারা মাছুয়াকান্দি গ্রামে ঢুকে পড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ধরার জন্য। কোনও রকম মুক্তিযোদ্ধাকে না পেয়ে পুনরায় আমাদেরকে ধানগড়া ক্যাম্পে নিয়ে যায়। নেওয়ার পরেও দু’ভাইকে আবার বুটের লাথি দিয়ে অজ্ঞান করে ফেলে দেয়। প্রায় দুই রাত থাকার পর শান্তি কমিটির সদস্য মৌঃ আব্দুল করিম, মৌঃ গোলাম মাহমুদ ও স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যাক্তিদের সহায়তায় আমি ও ছোট ভাই কোনরকমে প্রাণে বেঁচে বাড়ি চলে যাই। এখানে উল্লেখ করা যায় যে, উপরোক্ত ব্যাক্তিরা যদি সহায়তা না করতেন তা হলে কোন ক্রমেই খান দস্যুদের হাত থেকে আমাদের রেহাই হত না।

স্বাক্ষর/-
খন্দকার জিল্লুর রহমান

রকিবুল হাসান জিহান
<৮,২.২.১১৩,১৭২-১৭৩> “আমার সম্মুখে সিরাজগঞ্জের এসডিও জনাব শামসুদ্দিন সাহেবকে মেরে ফেলা হয়। তাকে মাগরেবের দুই রাকাত নামাজ আদায় করার পর কুকুরেরা পিটিয়ে হত্যা করে।“

।। ১১৩ ।।
এস এম আফতাব হোসেন
সাব ইন্সপেক্টর, টি এন্ড টি
গ্রাম- চর মোহনপুর
পোস্ট- লাহিড়ী মোহনপুর
থানা- উল্লাপাড়া
জেলা- পাবনা

মে মাসের ১৩ তারিখে বেলা ১০ টার সময় আমি বাড়িতে বসে ছিলাম। এমন সময় পাক বাহিনী ও অবাঙ্গালী মোট ১০০ জন আমার বাড়ি ঘেরাও করে। আমাকে প্রথমে জিজ্ঞাসা করে যে তুমি ডিউটি থেকে পালিয়ে এসেছো কেন? তার উত্তরে বলি যে সবাই কাজ ছেড়ে পালিয়ে এসেছে আমিও সেই সঙ্গে পালিয়ে এসেছি। এই কথার পরে আমাকে বাড়ি থেকে নিয়ে যায় এবং রেল গাড়িতে উঠায়। বলা প্রয়োজন যে অবাঙ্গালী ও পাক বাহিনী ট্রেন যোগে মোহনপুর আসে। ট্রেনে তোলার পর আমার উপর অমানুষিক অত্যাচার আরম্ভ করে। কিল, ঘুষি, লাথি এবং চাবুক মারতে থাকে। তারা আমাকে বলে যে,তুমি রাইফেল ট্রেনিং নিয়েছ, তুমি কর্নেল ওসমানীর আদেশ মোতাবেক ঈশ্বরদী বিমানবন্দরে ১১ জন পাইলটকে গুলি করে মেরেছো এবং আরো চারজন অবাঙ্গালীকে ছুরি দিয়ে হত্যা করেছো। এবং তুমি টেলিফোনের সাহায্যে ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ করেছো। এই সব কাজের জন্যই তুমি ভয়ে ডিউটি ছেড়ে পালিয়ে এসেছো। এই সময় কয়েকজন অবাঙ্গালী এই সব কথার উপর সাক্ষ্য প্রদান করে যারা আমারই অধীনস্থ কর্মচারী ছিল।

এই সময় আমাকে দিয়ে এই সমস্ত কথা স্বীকার করায় এবং আমাকে দিয়ে এই কথার উপর একটি লিখিত স্বীকারোক্তি আদায় করে নেয়। আমাকে পাবনাতে তিনদিন রাখে। এই সময় আমাকে একটা অন্ধকার কক্ষে বদ্ধ করে রাখে এবং সময় সময় বের করে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় গাছের সঙ্গে উল্টোভাবে ঝুলিয়ে চাবুক মারত। এখানে তিনদিন রাখার পর আমাকে নাটোর (রাজশাহী) জেলে স্থানান্তর করে। সেখানে ১৪ দিন রাখে। এই সময় আমাকে একই প্রক্রিয়ায় মারধর করে এবং পাক বাহিনীর বাঙ্কার করিয়ে নেয়।

এখানে ১৪ দিন রাখার পর আমার নামে একটা চার্জশিট দিয়ে হেলিকপ্টার যোগে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়। সেখানে আমাকে প্রথমে এমুনিশন এরিয়াতে রাখে।

এই সময় আমাকে প্রত্যেক দিন ২ ঘন্টা করে কাজ করাত। এই কাজের মধ্যে ছিল মাটি কাটা, ঘাস কাটা, বাঙ্কার কাটা ইত্যাদি। এছাড়া যখন তখন যে সে এসে আমাকে ভীষণভাবে প্রহার করত। এক এক জন আমাকে এক এক রকম প্রশ্ন করত। আমাকে বলতো, “তোম লোক বাঙ্গালী হ্যায়, তোম লোক হিন্দু হ্যায়, তোম লোককা সর্দার মজিব ভি হিন্দু হ্যায়, ও হামারা পাছ হ্যায়, থোরি দের বাদ ঘর মে লাকে কাপড়া খোলকে দেখিয়ে।” এইসব কথা বলতো আর আমাকে মারধর করত। আমি দেখেছি যে এই অবস্থায় যদি কেউ মারা যেত তবুও তাকে মৃত অবস্থায় গড়াতে গড়াতে ওয়ালের পাশে নিয়ে যেত এবং উক্ত মৃত ব্যাক্তির লাশ মেশিনগানের গুলিতে ঝাঁঝরা করে দিত। এই সময় আমাকে এক বেলা খাবার দিত। পায়খানা প্রস্রাবের কোন জায়গা ছিল না। যেখানে থাকা সেখানেই খাওয়া ও পায়খানা প্রস্রাব করতে হতো। এখানে উল্লেখ্য যে, যে ঘরে আমাকে বন্দী করে রেখেছিল, সেখানে আমার খাবার থালায় পায়খানা-প্রস্রাব করতে হতো। সকাল বেলায় তা পরিষ্কার করে তাতেই ভাত খেতে হতো।

আমার সম্মুখে সিরাজগঞ্জের এসডিও জনাব শামসুদ্দিন সাহেবকে মেরে ফেলা হয়। তাকে মাগরেবের দুই রাকাত নামাজ আদায় করার পর কুকুরেরা পিটিয়ে হত্যা করে।

আমাদের যে ঘরে রেখেছিল সে ঘরে খুব বেশী হলে ২০০/২৫০ জন রাখা যায়। সে ঘরে ৭০০ লোককে রেখেছিল।

(-এখানে সংকলনটিতে ভুলে ২০০/২৫০০ ছাপা হয়েছে।)

সময় সময় ঢাকা থেকে ক্যাপিটাল ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চে নিয়ে যেত ইন্টারোগেশন করার জন্য। এখানে নিয়ে আমাকে প্রশ্ন করা হত যে তোমার উপর যে কেস আছে তা সত্য কিনা। এই সময় একটা ছোট কক্ষে আমার হাত উপরে একটা রডের সঙ্গে বেঁধে ঝুলিয়ে দিত। এবং চোখের ৫/৬ ইঞ্চি দূরে দুই চোখের উপর দুইটা ৬০০ পাওয়ারের ইলেকট্রিক বাল্ব জ্বালিয়ে রাখতো, সেই লাইটের দিকে চেয়ে থাকতে হত। এই অবস্থায় কোন কোন সময় চাবুক মারতো।

এইভাবে ৬ মাস আমাকে আটকে রেখেছিল এবং প্রত্যেক দিনই আমাকে মারধর করত। ৬ মাস পরে একদিন আমাকেসহ আরও ৬০ জনকে ছেড়ে দেয়। এই সময় তারা বলে যে তোমাদের সবাইকে মাফ করে দেওয়া হল। পুনরায় যেন তোমরা আর ভুল না কর।

স্বাক্ষর/-
এস এম আফতাব হোসেন

রকিবুল হাসান জিহান
<৮,২.২.১১৪,১৭৪>
।। ১১৪ ।।

মোঃ লালচাঁদ খান
গ্রাম- চড়িয়া মধ্যপাড়া
ডাকঘর- সলংগা
থানা- উল্লাপাড়া
জেলা- পাবনা

১৯৭১ সালের ২৫ শে এপ্রিল পাকবাহিনী অতর্কিত আমাদের গ্রাম আক্রমণ করে। চড়িয়াসিকা সি,এন্ড,বি রাস্তায় থেকে পাকবাহিনী রকেট শেলিং আরম্ভ করে। চার দল পায়ে হাঁটিয়া আমাদের গ্রামে চলিয়া আসে। তাদের দেখিয়া আমাদের গ্রামবাসী মাঠের মধ্যে নামিয়া পড়ে। যখন গ্রামবাসী মাঠের মধ্যে নামিয়া পড়িল তখন পাকবাহিনী শিকার করার মত গুলি আরম্ভ করিল। আর একদল গ্রামের মধ্যে ঢুকিয়া পড়িল। অনেক লোক জংগলে পলাইয়াছিল। তাহাদের জংগল হইতে বাহির করিয়া এবং অনেক বাড়ি হইতে বাহির করিয়া লাইন হইতে বলিল। অনেকে প্রাণের ভয়ে লাইন হইতে না চাহিলে তাহাদের গুলি করিয়া হত্যা করে।

১৯৭১ সালের ২৫ শে এপ্রিল রোজ রবিবারের এই দিনটিতে পাকবাহিনী অতর্কিত আমাদের গ্রাম আক্রমণ করে এবং ৫৬ জনকে লাইন করিয়া গুলি করিয়া হত্যা করে। এই তারিখে আমাদের গ্রামের ১৫০ খান বাড়ি জ্বালাইয়া ভস্মীভূত করিয়া দেয়। কোন মহিলার ইজ্জতহানি করে নাই।

স্বাক্ষর/-
মোঃ লালচাঁদ খান

ইব্রাহিম রাজু
<৮,২.২.১১৫,১৭৫>
।। ১১৫ ।।
আব্দুল মজিদ মিয়া
গ্রাম- কওয়াক
ডাকঘর- উল্লাপাড়া
জেলা-পাবনা

চাঁদপুরে যখন পাকবাহিনী আসে আমি ওখানে উপস্থিত ছিলাম। চৈত্র মাসের ২২তারিখে এই ঘটনা ঘটে। আমাকে প্রথমে পাকবাহিনী ধরে চোখ বাঁধিয়া পেছন থেকে বেতের লাঠি দিয়ে বেদমভাবে প্রহার করে এবং আমাকে সঙ্গে করে আমাদের গ্রামের বাড়ির দিকে চলে আসে। আমাকে প্রথমে আমার বাড়ী নিয়ে আসে এবং আমাকে বলে তোর বাড়ী থেকে আমাদের হাঁস, মুরগী দিতে হবে। তখন আমি বলি আমার হাঁস মুরগী নাই। এই কথা বলার সাথে সাথে আমাকে এমন প্রহার করল যে তখন আমার আর কোন জ্ঞান ছিল না, আমি তখন অজ্ঞান হয়ে আমার বাড়ীর মধ্যে পড়ে রইলাম। পাকবাহিনী আমাকে তাদের পাদুকা দ্বারা সমস্ত শরীর খোঁচাতে আরম্ভ করল। এবং এমনভাবে প্রহার করল যে আমার নাক, মুখ দিয়ে রক্ত বের হয়ে আসল। পরে আমার প্রাণের ভিক্ষা চাইলাম এবং বললাম আমার দুইটা খাসী আছে আপনারা আমার খাসী দুইটা নিয়ে আমাকে মুক্তি দিয়ে দেন। তখন পাকদস্যু দল আমার দুইটা খাসী নিয়ে আমার বাড়ী থেকে চলে যায়। পাকদস্যু যাওয়ার পর আমার স্ত্রী এসে আমাকে দেখে চিৎকার আরম্ভ করল, চিৎকার শুনে পাড়া প্রতিবেশীরা এসে আমাকে ধরাধরি করে ঘরে নিয়ে গেল। আমাকে পাকদস্যু ধরে চৈত্র মাসের ২২ তারিখে সকাল ১০ টার সময়।

এ তারিখে আবার বিকাল ৪ টার সময় পাকদস্যুর অন্য একদল আমার বাড়ীতে আসে। পাকদস্যুদের আসার পূর্বে আমার স্ত্রী অন্য জায়গায় চলে যায়। পাক বর্বররা এসে আমাকে বলে তোর স্ত্রী কোথায়। এই কথা শুনে আবার অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকি। আবার জ্ঞান যখন ফিরে পাই তখনও দেখি পাক দস্যু আমার বাড়ীর মধ্যে রয়েছে। আমার স্ত্রীকে না পেয়ে আমাকে বাঁশের ফালটা দিয়ে আঘাত আরম্ভ করল। আমি আহত অবস্থায় বললাম আমার স্ত্রী আপনাদের আসা দেখে পালিয়ে অন্য বাড়ীতে গিয়েছে। এই কথা বলার সঙ্গে আমার বাড়ী থেকে অন্য বাড়ীতে চলে গেল।

চৈত্র মাসের ২৬ তারিখে পাকবাহিনী আমাদের গ্রামে আসে। রাস্তার পার্শ্বে আমার বাড়ী প্রথমে আমার বাড়ীতে পাকদস্যু এসে উঠে। উক্ত তারিখেও আমাকে সেই কথা তোর স্ত্রী-পুত্র কোথায়? আমি জবাব দেই আমার স্ত্রী-পুত্র কেউ নাই। এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে আমাকে আবার বেত দ্বারা প্রহার করল এবং পায়ের পাদুকা দ্বারা লাথি মারল। এই লাথি খেয়ে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে থাকি। এইভাবে পাকদস্যু আমাকে দুইবার শারীরিক অত্যাচার করে।

টিপসহি/-
আব্দুল মজিদ মিয়া

ইব্রাহিম রাজু
<৮,২.২.১১৬,১৭৬-১৭৭> “বাঙ্গালী দস্যুদল ওদের নাম দিয়েছিল শান্তি কমিটি, শান্তির নাম নিয়ে কত মা-বোনকে যে ওদের হাতে তুলে দিয়েছে তার হিসাব নাই।“
।। ১১৬ ।।
শ্রী রথিকৃষ্ণ সাহা
গ্রাম- ভেংড়ী
থানা- উল্লাপাড়া
জেলা- পাবনা

আমি বাড়ীর সবাইকে নিয়ে পালিয়ে আশ্রয় নিলাম উল্লাপাড়া থেকে ৩ মাইল দূরে ভেংড়ী গ্রামে। আমাদের গ্রামের প্রায় প্রতিটি পরিবারই প্রায় আশ্রয় নিয়েছিল। হারিয়ে গেল আমাদের বাড়ীঘর আর গড়ে তোলা জনসেবা শিবির।

মা-বোনদের পল্লীতে রেখে পালিয়ে পালিয়ে উল্লাপাড়া এসে দেখলাম দস্যুরা বাঙ্গালী ভাইদের ধরে নিয়ে লুট করাচ্ছে ইচ্ছামত আবার গুলি করে বাঙ্গালী ভাইদের মারছে। বিকাল চারটার দিকে দেখতে পেলাম উল্লাপাড়ায় আগুনের লেলিহান, মনে হচ্ছে আগুনও যেন ওদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। সমস্ত পাটের গুদাম, কলেজ, স্কুল, বাড়ীঘর দাউ দাউ করে জ্বলছে। মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে মানুষের আর্তনাদ।

এই আগুনের লেলিহান ৩/৪ দিন উল্লাপাড়া, ঝিকিড়া, ঘোষগাতী, ঘাটিনা, চরঘটিনা ও অন্যান্য গ্রামকে এক এক করে গ্রাস করেছে, গাছপালাগুলো পুড়ে পুড়ে হা করে দাঁড়িয়ে আছে। এমন হয়েছে যেন উল্লাপাড়াতে একটা পাখি পর্যন্ত দস্যুদের দেখে ভয়ে সবাই পালিয়ে গেছে।
এইভাবে ৭ দিন কাটতে না কাটতেই একদল কুচক্রীর দল দস্যুদের পিছু নিয়েছে। তারাও যেন দস্যু হয়ে গেল। ১ মাসের মধ্যে দেখতে পেলাম দস্যুর দল বেশ ভারী হয়ে দানা বেঁধে উঠেছে। আমার বহু বন্ধুদের ধরে নিয়ে নিয়ে পাক দস্যুদের হাতে দিচ্ছে আর দস্যুদল আমার বন্ধুদের একটু একটু করে তিলে তিলে মেরেছে। বাঙ্গালী দস্যুদল ওদের নাম দিয়েছিল শান্তি কমিটি, শান্তির নাম নিয়ে কত মা-বোনকে যে ওদের হাতে তুলে দিয়েছে তার হিসাব নাই। এই শান্তি কমিটির নায়ক ছিল কয়েকজন স্থানীয় অবাঙ্গালী ও কয়েকজন বাঙ্গালী।

এইভাবে আমাদের স্মরণীয় দিনগুলো কাটতে লাগলো। ১ মাস,২ মাস কেটে গেল। স্বাধীন বাংলার খবর শুনি, বুকে একটু বল পাই। জুনের ২৭ তারিখ ভোর ৫ টার সময় দেখতে পেলাম একদল লোক ছুটে আসছে। ভাইরা মন্তব্য করল পাক মিলিটারী হতে পারে? দেখতে না দেখতে ব্যাপারটা ফাঁস হয়ে গেল। সবাই ছুটে পালাতে লাগলাম কিন্তু হায় দেখি ভেংড়ী গ্রামের চারদিক দস্যুদল ও বাঙ্গালী দস্যুদল (শান্তি কমিটি) ঘিরে ফেলেছে। ছুটে গেলাম ব্যবসাইত পাড়ার ভিতর, ছোট জঙ্গলের ভিতর শুয়ে পড়লাম, কিন্তু দেখি আমাদের সুপরিচিত উল্লাপাড়ার কয়েকজন গুণ্ডা আমাকে দেখেই চিনে ফেলল। বলল শালা মালাউন পালিয়েছিস, বেরিয়ে আয়। নিরুপায় হয়ে এসে দেখলাম আমার বাবাকে ধরেছে, ভাইকে ধরেছে, বন্ধু অরুণকে ধরেছে, বন্ধু জীবনকে ধরেছে ও আর ৪ জনকে ধরেছে। দারুণ মার শুরু করে দিল। আমার বৃদ্ধ পিতাকে মারছে, বৃদ্ধ পিতা মার সহ্য করতে না পেরে আমার কোলে এসে আশ্রয় নিল। তখন আমাকে যে কতক্ষণ কি দিয়ে মেরেছে বলতে পারব না। ঘন্টাখানেক পরে জ্ঞান ফিরলে দেখলাম আমাদের সমস্ত জিনিসপত্র লুট করে এনে জড়ো করেছে এবং দস্যুদল খাওয়া দাওয়া করেছে। দস্যুদল খাওয়া শেষ করে আমাদের দড়ি দিয়ে বেঁধে টানতে টানতে ১২ মাইল হাঁটিয়ে হাঁটিয়ে সলঙ্গা নামক স্থানে নিয়ে গেল। ওখানে দেখতে পেলাম ৭০/৮০ জন পাকদস্যু ট্রাক নিয়ে অপেক্ষা করছে। আমাদের পেয়ে মনে হয় জীবিত মানুষগুলোকে খেয়ে ফেলবে। কিন্তু দেখলাম আমাদের ট্রাকে তুলে উল্লাপাড়া ষ্টেশন ক্যাম্পে নিয়ে এলো। হাজার হাজার মিলিটারী দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের দেখে একজন পাক ক্যাপ্টেন বেরিয়ে এলো, বললো তোমাদের নাম লিখে দাও এবং একটি পেন ও ১ টি কাগজ দিয়ে গেল। লিখে দেওয়ার পর আমাদের চারহাত-বাই চারহাত ঘরে রেখে দিল। এমনকি দরজায় পর্যন্ত তারকাটা এঁটে দিল। মনে হলো আর কোনদিন দরজা খুলবে না। সারারাত্রি বসে বসে কাটাতে লাগলাম আর শুনতে পেলাম নারী কন্ঠের আর্তনাদ, বুকফাটা কান্না, চাবুকের সপাং সপাং শব্দ , মদ্যপানের জড়ান জড়ান কথা, শুনে মন ভয়ে শিউরে উঠল।

শুধু মনে হতে লাগল, এরা বেশী দিন টিকতে পারবে না। নারী ধর্ষনে কোন জাতি টিকতে পারে নাই, পারবেও না। এইভাবে সারা রাত্রি কেটে গেল। সকাল ৮টার সময় দরজা খুলে বের করল আমাকে নিয়ে গেল ক্যাপ্টেনের কাছে। ক্যাপ্টেন বলল জয়দেব কে? আমি বললাম আমার ছোট ভাই। সে কি করে? বি, এ পড়ে। কোন পার্টি করে? আওয়ামী লীগকে ভালোবাসে। সে কোথায়? বলতে পারব না। কেন পারবে না? জানি না। এই প্রশ্নের উত্তরে ক্যাপ্টেনের মুখ দিয়ে আগুন ছুটতে থাকলো। বললো যদি বাঁচতে চাও বল জয়দেব কোথায়। কিন্তু আমার একই উত্তর জানি না। নিজে রাগ সামলাতে না পেরে একজন জোয়ানকে ডাক দিল এবং বলল চাবুকে গায়ের চামড়া তুলে ফেলতে। জোয়ান চাবুক মারতে আরম্ভ করে দিল। ওদিকে আমার বাবা চিৎকার করছে, ওকে আর মের না, আমাকে মার। কখন জ্ঞান হারিয়ে গেছে, জানি না। জ্ঞান ফিরে দেখি উল্লাপাড়ার এক পরিচিত ঘরে বিচার হচ্ছে। আমার রক্তাক্ত দেহ দেখে কারও দয়া হল, কেই বলল ভালো, কেউ বলল কিছু খারাপ, এতে শাস্তি হলো, আবার ১০ বেত। আমার বাবাকে ঘাড় ধরে তাড়িয়ে দিল। ছোট ভাইকে চাবুক মারল, জীবনকে চাবকাতে চাবকাতে গায়ের চামড়া ক্ষতবিক্ষত করে ফেলল আর আমার সেই সুপ্রিয় বন্ধু অরুণকে গুলি করে হত্যা করল। এদিকে আবার নতুন রাজাকার তৈরী করছে। বিচারে রায় দিয়েছিল উল্লাপাড়ায় থাকতে হবে নইলে গুলি করে মারবে। নজরবন্দী অবস্থায় থাকতে লাগলাম। এখন মনে হচ্ছে কেনই বা ওদের এত জয়দেবকে দরকার। জয়দেব আমার ভাই, আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ কর্মী, উল্লাপাড়াতে যত বড় আওয়ামী লীগের নেতাই আসুক না কেন, জয়দেব কে সবাই চিনতো এবং ভালোবাসতো। সে একদিন বলেছিল আমি হয়তো থাকবো না কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই। এতে কোন দ্বিমত নেই। কুচক্রীর দল সাবধান হয়েই থাকে। কিন্তু হায় জয়দেব আজ আর আমাদের সামনে নেই।

ক্ষতবিক্ষত দেহে বাড়ী ফিরলাম। নজরবন্দী অবস্থায় উল্লাপাড়ায় থাকতে লাগলাম। উল্লাপাড়ার দুঃখ দুর্দশা দেখে ঘরে বসে ডুকরে ডুকরে কাঁদতাম।

আমি দেখেছি প্রতিদিন পাক সৈন্যরা কোথা থেকে যুবক ধরে এনে মুক্তিবাহিনীর নাম দিয়ে বহু যুবককে গুলি করে মেরেছে। একদিন দেখতে পেলাম একটি যুবককে ধরে এনে আমার বাড়ীর পিছনে গুলি করে চলে গেল কিন্তু যুবকটির পেটের পার্শ্বে গুলি লেগেছে। সে শুধু বলছে আমার হাত টা ছেড়ে দেও, আমি বাঁচব,আমি কোন অপরাধ করিনি। যদি বাঁচতে না দাও আর একটা গুলি করে মেরে ফেল, যন্ত্রণা সহ্য হচ্ছে না। কিন্তু কোন লোক তাঁর কথায় কান দিল না। অবশেষে সন্ধ্যায় যুবকটি আর্তনাদ করতে শুরু করল- একটু পানি দেও, কেউ একটু পানি দাও। কিন্তু কেউ সাড়া দিল না। কারণ দস্যুদের পা-চাটা গোলাম রাজাকারদের পাহারায় রেখেছিল যেন যুবকের মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত তার পাহারায় থাকে। সন্ধ্যার পর রাজাকারদের বেয়নেটে তার প্রাণ হারায়, তার স্মৃতি চিহ্নস্বরূপ সেই অন্তিম স্থানের নাম দেওয়া হয়েছে “মা পানি জনপথ “।

স্বাক্ষর/-
শ্রী রথিকৃষ্ণ সাহা
উল্লাপাড়া
পাবনা

ইব্রাহিম রাজু
<৮,২.২.১১৭,১৭৮>
।। ১১৭ ।।
ভাগলু ঘোষ
থানা-ঈশ্বরদী
জেলা- পাবনা

১ লা বৈশাখ (রবিবার) প্রথম মিলিটারী এখানে আসে। তারা গাড়ীতে করে টহল দিয়ে এরোড্রামে যায়। বিকেল ৬টার দিকে মিলিটারীরা স্থানীয় বিহারীদের দিয়ে রেলওয়ে ডিপো থেকে কেরোসিন তেল লুট করায়। তারপর তাদের ঈশ্বরদী বাজার নির্দয়ভাবে লুট করায়। লুটপাট করার পর তারা বাজারের অনেকগুলি ঘরে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়।

অপরদিকে লাইনের পশ্চিম পাশে বিহারীদের ছেলেরা হামলা করে এবং লুটপাট করে ও লোক হত্যা করতে থাকে। আমার মহাজন কৃষ্ণ শর্মাকে নির্দয়ভাবে হত্যা করে। আমার বাসাও লুটপাট করে।

পরদিন সকালে আমি পালিয়ে যাই। বনবাদাড় দিয়ে যাবার পথে আমি দেখতে পাই ৩০/৩৫ জন বাঙ্গালী ও হিন্দুকে বিহারীরা হত্যা করেছে।

আমি আমার বাড়ী লুট হবার পর যখন পালিয়ে যাচ্ছিলাম তখন দেখতে পাই যে পশ্চিম টেংরা হিন্দু মন্দির “শিব মন্দির” বিহারীরা সম্পূর্নরুপে ধ্বংস করে। ভেঙে ফেলে মন্দিরের ভিতরের সমস্ত বিগ্রহগুলি।

টিপসহী/-
ভাগলু ঘোষ

ইব্রাহিম রাজু
<৮,২.২.১১৮,১৭৯> “তারা একই জায়গায় এবং একই খাট্যার উপর ১১৫ জনকে জবাই করিয়া হত্যা করে।“
।। ১১৮।।
জয়েন উদ্দিন
গ্রাম- মাঝদিয়া
থানা-ঈশ্বরদী
জেলা- পাবনা

পাক সৈন্য ঈশ্বরদীতে তাদের অবস্থান মজবুত করে নেবার পর আশেপাশের এলাকায় অপারেশন করা শুরু করে। এ সময় উল্লিখিত এলাকায় কোন বাঙ্গালী ছিল না। তারা প্রাণ ভয়ে ভারতে এবং অভ্যন্তরে গ্রামাঞ্চলে আত্নগোপন করেছিল। এ খবর সৈন্যরা বিহারীদের মাধ্যমে জানতে পারে। পাক সৈন্যেরা আসার পর তাদের সহায়তায় বিহারীরা সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। তারাই বাঙ্গালীদের অবস্থানের কথা পাক সৈন্যদের কাছে বলে এবং তাদের অপারেশনের জন্য প্ররোচিত করে।

বিহারীদের প্রচারণায় এবং তাদের সহযোগীতায় পাক সৈন্যরা এপ্রিলের শেষের দিকে মাঝ দিয়া গ্রামে অপারেশন করে। পাক সৈন্য ও তাদের সহযোগী বিহারীরা গোটা গ্রাম ঘেরাও করে। গ্রাম এমনভাবে ঘেরাও করে যে গ্রামের প্রায় কেহই পালাতে পারেনি। গ্রাম ঘেরাও করে গ্রামের সমস্ত লোকজন জমা করে। লোকজন ধরার মাখখানেই সমস্ত গ্রাম লুটপাট করে। বেশ কিছু বাড়ীঘর জ্বালিয়েও দেয়।

ধৃত ৪০০/৫০০ লোককে তারা হৃদয়হীনভাবে হত্যা করে। তারা ঐ সমস্ত লোককে অধিকাংশ লোক জবাই করে হত্যা করে। তারা একই জায়গায় এবং একই খাট্যার উপর ১১৫ জনকে জবাই করিয়া হত্যা করে। সমস্ত গ্রাম লাশ, লাশ আর লাশে ভর্তি হয়ে গিয়েছিল। যেদিকে চাওয়া যায় শুধু লাশ আর জমাট রক্তের ঢেলা ছাড়া আর কিছু দেখা যেত না।

এই গ্রামে অপারেশনে বহু সংখ্যক রমণীর শ্লীলতাও তারা হানি করে।

স্বাক্ষর/-
জয়েন উদ্দিন

ইব্রাহিম রাজু
<৮,২.২.১১৯,১৮০-১৮১>
।। ১১৯।।
আবদুল্লাহ খান
গ্রাম-পুবপাড়া
থানা-ঈশ্বরদী
জেলা-পাবনা

পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর পদলেহী শান্তি কমিটির সহায়তায় পাক সৈন্যরা ২৮শে জুলাই তারিখে আমাকে ঈশ্বরদী থেকে গ্রেফতার করে।

গ্রেফতারের পর আমার দুই হাত পেছনে বেঁধে দেয়। মোটা রশি দিয়ে এমনভাবে এঁটে বাঁধে যে হাতের রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বাঁধনের অসহ্য যন্ত্রণা বোধ হতে থাকে। কিন্তু তখন ও বোঝা যায় নি যে এর চেয়ে ভয়াবহ এবং কষ্টকর শাস্তি অপেক্ষা করছে।

গ্রেফতার করার পর আমার উপর নির্দয়ভাবে প্রহার শুরু করে। চড়, লাথি, কিল, ঘুষি এবং রাইফেলের বাঁট দিয়ে পিটান শুরু করে। এ সময় যে সমস্ত অবাঙ্গালী ও শান্তি কমিটির লোক ঐখানে ছিল তারা এ শাস্তি প্রাণ ভরে দেখছিল এবং তাদের তাদের চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল তারা উক্ত শাস্তি বিধান দেখে তৃপ্তি বোধ করছিল। কিছুক্ষণ এমনিভাবে প্রহার করার পর আমাকে জীপে করে পাবনা জেলখানায় নেয়া হয়। জেলখানার একটি ছোট্র আলো বাতাসহীন প্রকোষ্ঠে বন্দী করে রাখে। জেলখানার উক্ত ঘরে ঢোকার পর তিনজন সামরিক লোক আমার কাছে আসে। তারা এসে আমাকে দেওয়ালের পাশে নিয়ে যায় এবং প্রথমে সোজা হয়ে দাঁড়াতে বলে। তারপর ঐ অবস্থায় আমার মাথাকে মাটিতে ঠেকতে বলে। এ সময় আমার পাছা অসম্ভবভাবে টান হয়ে থাকতে হবে বলে তারা নির্দেশ দেয়।

যাহোক, তাদের নির্দেশ মত আমি ঐভাবে পজিশন নিলে ঐ সমস্ত লোকেরা আমার উপর অত্যাচার শুরু করে। প্রথমে আমার ঐ টান পাছার উপর ধান ভানা চাকা যে ফিতায় টানে ঐ ফিতা (সম্ভবতঃ অথবা ঐ জাতীয় মোটা ফিতা) দিয়ে শটাশট প্রহার করতে থাকে। প্রহারের যন্ত্রনায় চিৎকার করতে লাগলে অথবা শরীরকে সোজা বা মোড়া দিতে লাগলে তারা অকথ্য ভাষায় গালাগালি দিত ও প্রাণনাশের হুমকি দিত এবং ঐ রুপ না করতে বলত।

এ অবস্থায় প্রহার কিছুক্ষণ চলার পর আমি অবসন্ন হয়ে পড়ি। আমি মাটিতে পড়ে যাই। ইতিমধ্যেও যে সৈন্যটি প্রহার করছিল সম্ভবতঃ সেও ক্লান্ত হয়ে পড়ে । তখন মাটিতে পড়ে যাওয়া অবস্থায় একটি সিপাই রুলার দিয়ে আমার শরীরের বিভিন্ন জোড়ায় পেটাতে থাকে। পেটানোর যন্ত্রনার চোটে যখন আমি অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মুখোমুখি তখন আমাকে সাময়িকভাবে প্রহার বন্ধ করে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। কতজন মিলিটারী মেরেছি, বিহারী মেরেছি, মুক্তিবাহিনীর লোকেরা কোথায় আছে, অস্ত্রশস্ত্র কোথায় রেখেছি ইত্যাদি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে।

স্বাভাবিকভাবে আমি সমস্ত কিছু অস্বীকার করি। কিন্তু জিজ্ঞাসাবাদের ফাঁকে ফাঁকে তারা প্রহার করে। প্রহার ও জিজ্ঞাসাবাদের পালা শেষ হলে আমাকে পুনর্বার বন্দী করে রাখে।

অনুরুপভাবে আরো কয়েকদিন আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। বলা নিষ্প্রয়োজন যে প্রত্যেকদিনই আমার উপর অত্যাচার চালানো হয়েছে। প্রত্যেকবারই আমাকে বলা হয়েছে যে আমার সমস্ত খবরই তারা জানে। সুতরাং আমি স্বীকার না করলে হত্যা করা হবে।

বলা প্রয়োজন, আমি যে ঘরে থাকতাম এ সময়ের মধ্যে সে ঘর থেকে তিনজনকে সন্ধ্যার পর হাত রশি দিয়ে বেঁধে কালো কাপড় দিয়ে বেঁধে কোথায় যেন নিয়ে গেছে। তাঁরা আর কখনো ফিরে আসে নি। সম্ভবতঃ তাঁদের হত্যা করা হয়েছে।

প্রেসিডেন্টের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার প্রেক্ষিতে আমাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

স্বাক্ষর/-
আব্দুল্লাহ খান

ইব্রাহিম রাজু
<৮,২.২.১২০,১৮২>
।। ১২০।।
দীপক প্রসাদ গুপ্ত
গ্রাম- পশ্চিম টেংরী
থানা- ঈশ্বরদী
জেলা-পাবনা

পাক মিলিটারী এবং অবাঙ্গালীদের অত্যাচারে অত্র এলাকার নারী-পুরুষ, যুবক-যুবতী, শিশুরা দেশ ত্যাগ করে বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে ভারতে চলে যায়। ১লা বৈশাখ তারিখে পাক সেনারা এখানে প্রবেশ করে। তারা আসার পরই এলাকায় বাড়ীঘর পুড়িয়ে ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করে। অবাঙ্গালীরাও এ সময় রীতিমত লুটপাট শুরু করে। অবস্থার প্রেক্ষিতে বাধ্য হয়ে জনগণ এলাকা ত্যাগ করেন। পলায়ন লোকদের উপর হানা দিয়ে লুটপাট করে ঘরের শেষ সম্বলটুকু কেড়ে নেয় এবং অনেককে হত্যা করে।

এক দুমাসের মধ্যে শান্তি কমিটি গঠিত হয়। তারা মিলিটারীদের সাথে যোগাযোগ করত।তারা উৎসাহ দিয়ে রাজাকার তৈরি করেছিল।

রাজাকাররা গ্রামে লুটপাট করেছে, লোক ধরে মিলিটারীদের দিত। মারধর করত। গরু-বাছুর, হাঁস-মুরগী ধরে নিয়ে যেত।

মুক্তিবাহিনীদের লোকেরা গ্রাম এলাকায় থাকত। জনগন তাদের থাকতে দিত।

মিলিটারী গ্রামে এবং বিভিন্ন এলাকায় অপারেশন করত, মানুষ হত্যা করত; মেয়েদের উপর অত্যাচার করেছে। অবাঙ্গালীরা যে সমস্ত অমুসলিম পরিবার ছিল তাদের জোর করে ভয় দেখিয়ে মুসলমান করেছিল।আমি নিজেও উক্ত শিকারে পরিণত হয়েছিলাম। এমনি ১২/১৩ ঘরে ৮০/৯০ জনকে মুসলমান করেছিল। বিহারীরা মন্দির ভেঙে ফেলেছিল এবং মন্দিরের ইট দিয়ে রাস্তা করেছিল।মন্দিরের বিগ্রহগুলি হৃদয়হীনভাবে ভেঙে ফেলেছে।

ডিসেম্বরের যুদ্ধকে মানুষ স্বাগত জানিয়েছেন।এই যুদ্ধ স্বাধীনতাকে ত্বরান্বিত করবে এই বিশ্বাস সকলের মনে ছিল।

স্বাক্ষর/-
দীপক প্রসাদ গুপ্ত
।। খুলনা বিভাগ ।।

সাইফুল ইসলাম
<৮,২.৩.১২১,১৮৩>
।। ১২১ ।।
নীলিমা রাণী দাস
সাউথ সেন্ট্রাল রোড, খুলনা

যুদ্ধ বাধলে আমরা সবাই খুলনাতেই আছি। সান্ধ্য আইন চলছে, ঘরের বের হবার উপায় নেই। ৩রা চৈত্র রাত ১০-৩০ টায় ৬ জন পাক সেনা আমাদের বাড়ী ঢোকে। আমরা তখন আকাশবণীর খবর শুনছি। পাকসেনারা ঢুকে আমার স্বামীকে ডাকে, তারপরে ঘরে ঢুকে আমার সকল গহনা খুলে দিতে বলে। আমি সকল গহনা খুলে দিই আর যা টাকা-পয়সা ছিল সব নিয়ে আমার স্বামীকে নিয়ে চলে যায়। রাত ১১-৩০ টায় গুলির আওয়াজ পেলাম। পরে শুনলাম আলতাফ গলির মোড়ে ৮ জনকে গুলি করে, ৬ জন মারা যায়, ২ জন বেঁচে যায়-একজন চিত্ত, অপরজন রবি। আমার স্বামী ঐ দিন মারা যায় পাকসেনাদের গুলিতে।

তারপর আমি আমার ৪ মাসের বাচ্চা নিয়ে মাইলের পর মাইল হেঁটে আমার গ্রামের বাড়ী যাই। ওখান থেকে কয়েকদিন হেঁটে বহু লাঞ্ছনা সয়ে ভারতে যেতে পারি। দেশ স্বাধীন হলে দেশে আসি, আমার কেউ দেখার নেই, বাড়ীঘর নেই।

সম্পূর্ণ অসহায় নিঃসহায়, শুধু ভাবছি এমনি যন্ত্রণা নিয়ে আর ক’দিন বাঁচবো।

স্বাক্ষর/-
নীলিমা রাণী দাস
৭/৭/৭৩

সাইফুল ইসলাম

<৮,২.৩.১২২,১৮৪-১৮৬> “খালিশপুর নেভাল বেসে একজন পাঞ্জাবী ইমাম ছিল। সে বাঙ্গালীর প্রতি ভাল ব্যবহার করতো, সে আমাকে খাবার দিত, আমার প্রতি ভাল ব্যবহার করতো। এবং আমি যখন সেখান থেকে ছাড়া পেয়ে আসি তখন সে আমার হাত ধরে ক্ষমা চেয়ে নেয়।

।। ১২২ ।।
কাজী আব্দুল খালেক
খুলনা সদর
খুলনা

২৮ শে মার্চ দুপুর তিনটার সময় আমি ভাত খেতে যাচ্ছিলাম তখন দেখতে পাই যে আমার বাড়ীর চারিদিকে খানসেনা ও বিহারী ঘিরে ফেলেছে এবং দরজায় দমাদম লাথি মারছে। তারা দরজা ভেঙ্গে ঘরের ভিতর প্রবেশ করে এবং একজন খান সেনা একটা অটোমেটিক চাইনিজ রাইফেল আমার বুকের উপর চেপে ধরে এবং প্রথম প্রশ্ন আমাকে করে যে, ‘তোম বাঙ্গালী হ্যায়, না বিহারী হ্যায়” এর জবাবে আমি জানাই যে আমি পাকিস্তানি মোহাজির হ্যায়। দ্বিতীয় প্রশ্ন করে, “তোম আওয়ামী লীগমে হ্যায়। তোম আওয়ামী লীগমে ভোট দিয়া।“
৯৯% লোকনে আওয়ামী লীগমে ভোট দিয়া তো হামভী দিয়া, মাগার ম্যাই আওয়ামী লীগের ইলেকটেড মেম্বর নেহি হ্যায়’।

তখন তারা আমাকে বাড়ীর বাইরে নিয়ে আসে এবং একটা ট্রাকে তোলে। ঐ ট্রাকের ভিতর আরও ৭/৮ জন লোককে দেখতে পাই। তার মধ্যে খালিসপুর শহরের ডি,এস,পি ও ওয়াপদার একজন অফিসারকে দেখতে পাই। ডি,এস,পির সারা শরীরে রক্ত এবং কপালের উপর বড় একটা গর্তের মত দেখতে পাই আর ওয়াপদার অফিসারটির মুখের এক পাটির দাঁত ভাঙা দেখতে পাই। আমাদেরকে ট্রাকের উপর বসান হয় এবং দুই পাশে দুইটা মেশিনগানধারী শাস্ত্রী দাঁড়িয়ে থাকে। এই সময় একটা মিলিটারী এম,পি এসে আমাকে পুনরায় প্রশ্ন করে যে “তুম বাঙ্গালী হ্যা না বিহারী হ্যায়”।
আমি বলি যে “আমি পাকিস্তান কা মোহাজের হ্যায়”।
তখন এম,পি বলে, “তোমহারা আইডিন্টিটি কার্ড হ্যায়?”
তার উত্তরে আমি আমার অফিসের আইডিন্টিটি কার্ড তাকে দেখাই। তখন সে আমাকে ছেড়ে দেয় কিন্তু আর সবাইকে ধরে নিয়ে যায়। আমি ছাড়া পবার আরও একটা কারণ নিখুঁতভাবে উর্দু বলতে পারতাম।

৭ ই জুলাই দৌলতপুর থানা থেকে কয়েকজন পুলিশ আমাকে হাতে হাতকড়া দিয়ে খুলনাতে এস,ডি, ও কোর্টে নিয়ে যায়। কিন্তু আমি কোর্টে পৌছার আগেই কোর্ট বন্ধ হয়ে যায়। তখন আমাকে খুলনা জেল হাজতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এখানে বলা প্রয়োজন যে এই সময় দুইদিন আমাকে কিছু খেতে দেয় নাই। আমি যখন জেল হাজতে গিয়ে পৌছালাম তখন সেখানে বহু আওয়ামী লীগের নেতা, প্রফেসর এবং পুলিশের অফিসারদের দেখতে পাই। তাদের প্রত্যেকের অবস্থাই খুব শোচনীয় দেখতে পাই। তাদের কারো গায়ে চুলকানী, পাচড়া হয়ে বোঝাই হয়ে গিয়েছে আবার কেউ বা ভীষণভাবে অসুস্থ। এই সময় আমি সেখানে একজন প্রফেসরকে দেখতে পাই তাকে নাকি যশোর থেকে ধরা হয়েছিল এবং যশোর ক্যান্টনমেন্টে তাকে ভীষণবাবে অত্যাচার করা হয় যার ফলে তার মাথা খারাপ হয়ে যায়। সে ভদ্রলোককে খান সেনারা মুক্তিবাহিনীর স্পাই হিসাবে ধরে। এই ভদ্রলোক এই সময় শুধু শুধু লেকচার দিয়ে চলেছেন।

আমাকে রাত্রিতে যে ঘরে থাকতে হত সে ঘরটা ছিল খুব ছোট। সে ঘরে ভালভাবে বড়জোর ৫০ জন থাকতে পারে। সেখানে ৪ শত জন কয়েদীকে রাত্রিতে থাকতে দিত। প্রত্যেককে ‘কাত’ হয়ে শুয়ে থাকতে হত। কোনরকম নড়াচড়া করার উপায় এই সময় থাকত না।

আমি জেল হাজতে থাকা অবস্থায় দেখতে পেতাম যে প্রত্যেক দিন রাত্রিতে খান সেনারা জেল হাজত থেকে অনেক কয়েদীকে জোর করে ধরে নিয়ে যেত। তাদের আর কোন খবড় আমরা পেতাম না বা আর ফিরে আসতো না।

খান সেনারা প্রত্যেক দিন বা আশেপাশে থেকে যে সব লোককে ধরে আনতো তাদের প্রথমে খুলনা সার্কিট হাউস ময়দানে ভীষণভাবে টর্চারিং করত এবং যাদের মারা হত তাদেরকে জেল হাজতের মাঠে দিয়ে আসতো এবং নদীর পাড়ে ‘জবাই’ করা হত। তাদের কাকুতি, মিনতি বা কান্নাকাটি অনেক সময় আমরা শুনতে পেতাম। বাদ বাকীগুলিকে জেল হাজতে নিয়ে আসতো। তাদের কাছে আমরা জানাতে পরতাম খান সেনাদের অমানুষিক নির্যাতনের কতা। মানুষ হয়ে মানুষের উপর যে কত বড় নির্দয় হতে পারে তা আমার আগে জানা ছিল না। এই সময় আমাদের দিনে একবার খেতে দিত- ভাত ও ডাল, যা দেখলেই বমি হয়ে যেত, খাবার কথা তো দূরে থাক। তবুও জীবন ধারণের জন্য তাই খেতে হত।

আমরা যে চারশত লোক রাত্রিতে এক রুমে থাকতাম। পায়খানা প্রস্রাব ঐ রুমের ভিতরের এক কোনায় করতে হত, যার ফলে দুর্গন্ধে রুমের ভিতর থাকাই অসম্ভব হয়ে পড়তো।

৯ ই জুলাই আমার আত্নীয়-স্বজনের ধরপাকড়ের ফলে এস,ডি, ও কোর্ট থেকে ৫০০ টাকা সিকিউরিটির বদলে জামিন মঞ্জুর করে। এই সময় কয়েকজন লোক জেল হাজতে আসে এবং আমাকে বলে যে তোমার জামিন হয়ে গিয়েছে। তারা আমাকে জেল হাজত থেকে বের করে চালনা লাইটড্রাস-এর অফিসে নিয়ে গিয়ে পুনরায় জিজ্ঞাসা করা হয় যে আমি কতজন বিহারীকে হত্যা করেছি। আমাকে খালিসপুর “নেভাল বেস”-এর হাতে হ্যান্ডওভার করে। এই নেভাল বেস-এর কমান্ডিং অফিসার ছিল কর্নেল গুলজারী।

এখানে যাবার পর প্রথম আমাকে কর্নেল গুলজারী প্রশ্ন করে যে, তোম কালপ্রিট হ্যায়, আমি তখন বলি যে আমি এমন কোন কাজ করি নাই যার জন্য আমি কালপ্রিট হতে পারি।
তখন সে আমাকে প্রশ্ন করে যে তুমি কত বিহারীকে কেটেছো বা নির্যাতন করেছো।
তখন আমি বলি যে আমার জীবনে আমি কোনদিন কোন বিহারীকে মারি নাই বা তাদের উপর অত্যাচার করি নাই।
তখন সে আমাকে বলে যে ঠিক হ্যায়। তোম জঙ্গোল সাভ কর।
আমি তখন নেভাল বেস এর সম্মুখের সমস্ত জায়গায় জঙ্গল সাফ করতে থাকি। এই সময় কাচিঁতে আমার আঙ্গুল কেটে দুইভাগ হয়ে যায়। তিন দিন আমাকে এইভাবে কাজ করতে হয়। প্রত্যেক দিন সকাল ৬ টা থেকে ১ টা পর্যন্ত, তারপর ১ টা রুটি খেতে দিত এবং ২ টা থেকে আবার ৬ টা পর্যন্ত ঘাস কাটতে হত। কারণ তারা নেভাল বেস এ আশেপাশে সমস্ত জায়গা পরিস্কার করছে মুক্তিযোদ্ধাদের ভয়ে।

২য় দিন আমি যখন ঘাস কাটছিলাম তখন একটা শিয়াল ঘাসের ভিতর দিয়ে যাচ্ছিল যার ফলে ঘাস নড়ছিল। তখন সমস্ত খান সেনারা পজিশনে চলে যায় এবং বলে যে মুক্তিবাহিনী আগিয়া।

৩ য় দিনে আমি যখন ঘাস কাটছিলাম তখন সেখান দিয়ে ক্যাপ্টেন সাহাব উদ্দিন যাচ্ছিল। সে আমাদে দেখে সিপাইদেরকে বলে আমাকে তার চেম্বারে পৌছে দিতে। তার চেম্বারে গেলে সে আমাকে প্রথমেই রোলার দিয়ে একটা বাম কাঁধে আঘাত করে এবং বলে যে তোম শালা বহুত বাহিরীকো খতম কর দিয়া আওর বহুত বিহারীকো আওয়াতকে ইজ্জত লিয়া। এই সময় আমাকে সে কোন কথা বলার সুযোগ দেয় না। সে আমাকে রোলার দিতে আঘাতে পর আঘাত করতে থাকে। এই সময় সে তার সহযোগীকে বলে আমাকে পায়ে শিকল বেঁধে টাঙ্গিয়ে দিতে। আমাকে নিয়ে পায়ে শিখল বেধেঁ উল্টো দিকে বুলিয়ে দেয়। এই সময় ক্যাপ্টেন সাহাব উদ্দিন পুনরায় এসে আমাকে বলে “শালা তোমকো খতম করে দেগা”-এই বলে সে আমাকে মোটা রোলার দিয়ে আঘাতের পর আঘাত ও অশ্রাব্য গালিাগালি দিতে থাকে। কিছুক্ষণ মারার পর আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি। তারপর তারা আমাকে আর মেরেছে কিনা আমি জানি না। আমার যখন জ্ঞান ফিরে আসে তখন আমি দেখতে পাই যে আমি একটা কম্বলের উপর শুয়ে আছি, আমার সারা শরীরে অসহ্য ব্যাথা। এই সময় কর্নেল গুলজারী সেখানে আসে এবং আমার এই অবস্থা দেখে সে ভীষণবাবে রেগে যায় ক্যাপ্টেন সাহাবের উপর। সঙ্গে সঙ্গে সে আমার চিকিৎসার ব্যাবস্থা করে এবং পরে জানতে পারি যে ২ দিন পর কর্নেল গুলজারী ক্যাপ্টেন সাহাব উদ্দিনকে চিটাগাং নেভাল বেস-এ বদলী করে দেয়।

খালিশপুর নেভাল বেসে একজন পাঞ্জাবী ইমাম ছিল। সে বাঙ্গালীর প্রতি ভাল ব্যবহার করতো, সে আমাকে খাবার দিত, আমার প্রতি ভাল ব্যবহার করতো। এবং আমি যখন সেখান থেকে ছাড়া পেয়ে আসি তখন সে আমার হাত ধরে ক্ষমা চেয়ে নেয়।

৯ দিন পর কর্নেল গুলজারী আমাকে রিলিজ করে দেয়। এই সময় কর্নেল গুলজারী আমাকে বলে দেয় যে তুমি কোন সময়ই বিহারীদের সম্মুখে যাবে না। এবং বিহারীরা যেন তোমাকে কোন জায়গায় না দেখতে পায়। তুমি সব সময় বিহারীদেরকে এড়িয়ে চলবে।

১৯ শে জুলাই আমি নেভাল বেস থেকে মুক্ত হই। এই সময় আমার অবস্থা এত খারাপ চিল যে আমি চলতে ফিরতে পারতাম না। আমি একটা রিক্সা করে বোনের বাসায় চলে যাই। সেখানে আমার ফ্যামিলির সাক্ষাৎ পাই। দেখতে পাই যে আমার পরিবারের অবস্থা খুব খারাপ। কারণ কোনদিন না খেয়েও তারা কাটিয়েছে। আমার দুই ছেলে তখন রাস্তায় ফেরি করে যা রোজগার করেছে তা-ই দিয়ে কোন মতে খেয়ে না খেয়ে আমাদের দিন চলেছে।

স্বাক্ষর/-
কাজী আব্দুল খালেক
১১/৭/৭৩

সাইফুল ইসলাম
<৮,২.৩.১২৩,১৮৭-১৮৮> “নিয়মিত নামাজ রোজা শুরু করি বাংলাদেশের মা-বোনের ইজ্জত বাঁচাবার জন্য, সেই সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর বিজয় কামনা করে দোয়া করতাম খোদার কাছে।“
।। ১২৩ ।।
কবির আহমদ
বি, ডি, আর
খুলনা

২৭ শে মার্চ অবস্থার অবনতি আরও ঘটে। পাকসেনারা ব্যাপকভাবে সারা শহর ঘুরতে থাকে, আমাদের সঙ্গে ব্যবহারও তেমন ভাল ছিল না। আমি গোপনে ওখানে মরিচা খনন করি এবং পরবর্তী অবস্থার জন্য প্রস্তুত হই।

২৮ শে মার্চ আমাকে টেলিফোনে শাখা হেড কোয়ার্টারে ডেকে আনা হয় অন্য জায়গায় পাঠানো হবে বলে অফিসে চলে আসি। এসে দেখি আধ হাত পরপর পাকসেনা সমগ্র শাখা ঘিরে রয়েছে ভারী ভারী অস্ত্র নিয়ে আমি বুঝতে পারলাম। আমার হাতিয়ার (সামান্য রাইফেল) জমা নিয়ে নেওয়া হলো। পর পর ক্রমশঃ আমাদের ১৩৭ জনকে নিয়ে আসে এবং অস্ত্র জমা নিয়ে নেয়। আমাদের পোষাক খুলে নি এবং বেসামরিক পোষাক পরতে বলে ভিতরে থাকতে বলে। নামাজ পড়ারও সময় নির্দিষ্ট করে দিল।

৫ ই এপ্রিল পর্যন্ত আমাদের সবাইকে এখানে আটকে রাখে। বি, ও, পি, গুলির কি হলো কিছুই জানতে পারলাম না, দুনিয়ার কোন খবর প্রায় পেতাম না। বেশ বুঝলাম যুদ্ধ চলছে পাঞ্জাবীদের সাথে। আমারা বন্দী, মৃত্যু আসন্ন। সবাইকে ঢুকিয়ে দিল। ১১ নং সেলে আমাদের বন্দী করে রাখলো, পাকসেনারা পাহারায় থাকলে।

৭ ই এপ্রিল থেকে ৫/৬ জন করে বের করে আর্মিরা চাকিদিকে ঘিরে অমানুষিকভাবে প্রহার করতে থাকে। জেলখানার সিপাই লাঠি জোগাড় করে দিত। পাক সেনারা যথেষ্টভাবে মারধর চালিয়েছে।

আগষ্ট মাসের শেষের দিকে খুলনা ই,পি,আর এর উইং কমান্ডার গিয়ে আমি সহ সাতজনকে চার্জশীট দিয়ে বাকী সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে। ঐ মাসেই আমাদের সহজনকে বাদ দিয়ে সবাইকে শপথ করিয়ে নানা উপদেশ দিয়ে বাইরে বের করে নিয়ে যায়। আমরা
(১) নায়েব সুবেদার আব্দুল মান্নান,
(২) সৈয়দ আহমদ,
(৩) কবীর আহমদ হাবিলদার,
(৪) ল্যান্স নায়েক জয়নাল আবেদীন
(৫) নায়েক ক্লার্ক শামছুদ্দীন
(৬) সিপাই আব্দুল লতিফ আরমার,
(৭) সিপাই আবুল হাশেম অন্য সেলে বন্দী থাকি।

জেল পুলিশ মতিউর রহমানের মারফত বাইরের খবরাখবর সব আমরা পেতাম, বিদেশী এবং মুক্তিবাহিনীর সব খবর দিত। ডাঃ আবুল মজিদ আমাদের ভালোভাবে দেখাশোনা করেন এবং সব খবরাখবর দিতে। অষুধ দেবার নাম করে আমাদের সাথে যোগাযোগ করে খবরাখবর দিতেন।

রোদের ভিতর উপুড় করে খালি গায়ে শুইয়ে ফেলে বুট দিয়ে লাথিয়েছে, রাইফেলের বাট দিয়ে যেখানে সেখানে পিটিয়েছে, মারতে মারতে ড্রেনের মধ্যে নিয়ে গিয়ে উপুড় করে ফেলে লাঠি পিঠের উপর ভেঙেছে। সমস্ত শরীর রক্তে ভরা, অজ্ঞান হওয়ার আগ পর্যন্ত মারতো এবং যথেচ্ছভাবে গালাগালি করতো। বলত ‘বল কত বিহারী মেরেছিস’।

সেপ্টেম্বর থেকে আমর বিরুদ্ধে চার্জ দিয়ে ইন্টারোগেশন শুরু করে। আমার বিরুদ্ধে চার্জ
(১) আমি আক্রমণ করতে গেছি অবাঙ্গালীদের
(২) সীমান্তে সিপাই পাঠিয়েছি সবাইকে আসার জন্য
(৩) অস্ত্র সরবরাহ চেষ্টা এবং অস্ত্র ধ্বংস করা
(৪) সিপাইদের উস্কানী দিয়ে উত্তেজনার সৃষ্টি করেছি।
এক একটি প্রশ্ন করে আর মারতে থাকে। খুব মারধর সহ্য করতে না পেরে সব স্বীকার করে তাদের তৈরী রিপোর্ট দস্তখত করি। চার্জশীটে আমি এ্যাক্ট অনুযায়ী আমার মৃত্যু লেখা ছিল।

আমি মৃত্যুর প্রহর শুনতে থাকি আর বাইরের সব খবরাখবর আমি পেতে থাকলাম। আমি বুঝলাম আমি মারবো তবে দেশ একদিন স্বাধীন হবেই হবে।

নিয়মিত নামাজ রোজা শুরু করি বাংলাদেশের মা-বোনের ইজ্জত বাঁচাবার জন্য, সেই সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর বিজয় কামনা করে দোয়া করতাম খোদার কাছে।

১৭ ই ডিসেম্বর শুক্রবার বেলা দেড়টায় খুলনা মুক্ত হলে আমরা জেল গেট ভেঙ্গে মুক্তির নিশ্বাস নেই এবং বিজয় উল্লাসে ফেটে পড়ি।

স্বাক্ষর/-
কবির আহমদ
১৯/৬/৭৩

সাইফুল ইসলাম
<৮,২.৩.১২৪,১৮৯-১৯০> “আমি যেহেতু ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চের অফিসার, সেহেতু সব খবর জানি এই কথাই ধরে নিয়েছিল, তাই অত্যাচারের মাত্রা খুব বেশী ছিল।“
।। ১২৪ ।।
বদিউজ্জামান
হাজী মেহের আলী রোড
খুলনা

আমি ছেলেমেয়ে নিয়ে গ্রামের বাড়ী চলে যাই যশোর দখল হবার পর। টাকা-পয়সা, কাপড়-চোপড় কিছু না থাকায় ওখান থেকে ২৭শে এপ্রিল আমি শহরে আসি আমার বাসাতে কাপড় চোপড় নেবার জন্য।

২৮শে এপ্রিল খুব ভোরে থেকে আমাকে পাকসেনারা ধরে নিয়ে যায়। লেঃ কঃ তোফায়েলের কাছে হাজির করে। জিজ্ঞাসাবাদ করে এক মেজর আমাকে যশোর সেনানিবাসে নিয়ে যায়। আমাকে এফ, আই, ইউ-র মেজর খোরশেদ ওমরের কাছে দেয়।

একজন সিপাইকে বানাতে বলে। সঙ্গে সঙ্গে আমাকে শুইয়ে ফেলে লাঠি দিয়ে গরু পিটানো শুরু করে। আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। কিছুক্ষণ পরে জ্ঞান ফিরলে পা ধরে বারান্দায় টেনে এনে একজন সুবেদার কিল-চড়-ঘুষি যথেচ্ছা মারা শুরু করলো। আমি চিৎকার করতে থাকি। তারপর যেই আসুক না কেন লাথি কিল মারতে থাকে।

বিকালে আমাকে টানতে টানতে একটি ধরে রেখে আসলো। এরপর থেকে প্রত্যেহ সকাল বিকাল বের করতো এবং ভীষণভাবে মারতো। আমাকে জিজ্ঞাসা করতো এস,পি,ডি, কি করেছেন, তুমি কি করেছ? না বললেই মারতো। সমস্ত শরীর দিয়ে রক্ত না ঝরা পর্যন্ত, জ্ঞান হারা না হওয়া পর্যন্ত মারধর করতো।

আমি যেহেতু ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চের অফিসার, সেহেতু সব খবর জানি এই কথাই ধরে নিয়েছিল, তাই অত্যাচারের মাত্রা খুব বেশী ছিল। আমি পতাকা তুলে দিয়েছি সব খবর মুক্তিসেনাদের দিয়েছি ইত্যাদি। আমাকে ঐ ক্যাম্পে তিন মাস তিনদিন আটকে রাখে এবং প্রত্যেহ মারধর করতে থাকে।

আমাদের ছোট্ট একটি ধরে অফিসার, দারোগা, অধ্যাপক, মাষ্টার, পুলিশ, কৃষক, শ্রমিক সবাইকে একত্র রাখতো। সারাদিন কোন খাবার দিত না, সন্ধার আগে অল্প কিছু খাবার দিত। খুব ভোরে পায়খানা প্রস্রাব করাতে বসাতো, দেরী হলে মারধর করতো। সারাদিন রাতে একবার পায়খানা প্রস্রাব করাতো। সকালে আমাদের বের করিয়ে পায়খানা ধোয়াতো, ড্রেন পরিস্কার, জঙ্গল পরিস্কার মাল বওয়ানো অভুক্ত অবস্থায় করিয়ে নিতো। প্রস্রাব অনেকে ভিতরেই করে ফেলতো। মারের চোটে সারা শরীর ঘা হয়ে গিয়েছিল, মাছি বসে পুঁজ জমে সারা ঘরে একটি নারকীয় পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। মাঝে মাঝে এক লোক আসতো। আমরা ভালো করে বসতেও পারতাম না। সন্ধ্যার আগ দিয়ে সামান্য খাইয়ে ঘরে পুরে রাখতো। তিন মাস তিনদিন আমাকে গোছল করতে দেয়নি।

২রা মে ২৯ জনকে হাত, চোখ বেঁধে নিয়ে যায় সন্ধ্যাবেলা, বাকী থাকি আমি, একজন ড্রাইভার ও একজন সি, ও। পরে শুনলাম ওদের ট্রেন্স খুড়িয়ে নিয়ে গুলি করে হত্যা করেছে। ওর মধ্যে অধ্যাপকও ছিলেন।

তারপর থেকে প্রত্যহ রাত বারোটার পর ১০/১২ জন করে নিয়ে যেত আর ফিরতো না। প্রত্যেহ নতুন লোক এসে আবার ঘর ভরে যেতো।

জুলাই মাসের শেষের দিক হতে শুনলাম যাদেরকে গাড়ীতে করে নিয়ে যায় রাতে বহু দূরে নিয়ে গিয়ে বোয়োনেট দিয়ে খুচিয়ে হত্যা করতো।

অপারেশন স্পটে যাদেরকে ধরে আনতো তাদেরকে হাত-পা পিটিয়ে ভেঙ্গে ফেলতো। তারপর শরীরের বিভিন্ন অংশ কেটে দিত এবং গুলি করে হত্যা করতো।

আগষ্ট মাসের ২/৩ তারিখে আমাদের ১০/১২ জনকে সেনানিবাসের মডেল প্রাইমারীর এক ধরে নিয়ে যায়। এখানে নিয়ে আসার পর শুনলাম এর আগে যাদেরকে হত্যা করেছে তাদের কোন তালিকা বা হিসাব নেই। অসংখ্য মানুষকে তারা হত্যা করেছে ঐ সময়। এপ্রিলে যাদেরকে ধরেছিল একমাত্র আমিই বেঁচে ছিলাম।

এখানে আসার পর খাওয়া দাওয়া একটু ভালো হলো। মারধর কম করতে থাকে।

আগষ্ট মাসের ১২/১৩ তারিখ ইনটারোগেশনের জন্য নিয়ে যেত এবং নানা কথা-যেমন বিহারী হত্যা করেছি, পাকসেনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি, অস্ত্র যুগিয়েছি ইত্যাদির কথা লিখিয়ে আমাদের দিয়ে সই করিয়ে নেয়। চিৎ করে শুইয়ে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে বলতো, একটু হেললে লাঠি দিয়ে পিটাতো। তিন দিন ঐ ভাবে অত্যাচার চালায় অমানুষিক।

সেপ্টেম্বরের শেষ অথবা অক্টোবর মাসের প্রথমে আমার বিরুদ্ধে সামরিক কেসের চার্জ নিয়ে একটি কপি দেয় এবং তার পরপরই জেলখানায় পাঠিয়ে দেয়। ঢাকা থেকে আরও অতিরিক্ত কেস আমার বিরুদ্ধে আসে। আমার সাথে ডেপুটি ম্যাটিষ্ট্রেট সানাউল হক, ইন্সপেক্টর আক্তার চৌধুরী, নূর মোহাম্মদ, ডাঃ আনিসুজ্জামান এম, বি, বি, এস, আনিসুর রহমান ইত্যাদি লোকদের বিরুদ্ধে মামলা ওঠে।

অক্টোবর মাস থেকেই ম্যাজিষ্ট্রেট সানাউল হক সাহেবের কেস ওঠে। দুটো হিয়ারিং হবার পর কেস বন্ধ হয়ে যায়।

২৮ শে নভেম্বর চিঠি পেলাম আমি চাকরি থেকে বরখাস্ত হয়েছি। মুক্তি পাই ২৮শে নভেম্বর।

আমি মুক্তি পেয়ে বাসাতে আসি। আমার দেশের বাড়ী সব পুড়িয়ে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়। আমার পরিবার গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে পালিয়ে বেরিয়েছে।

আমি শুনতাম দৈনিক বিভিন্ন স্থান থেকে মেয়েদের ধরে আনতো এবং সেনানিবাসের ২/৩টি স্থানে রেখে বিভিন্ন সময় ইচ্ছানুসারে তাদেরকে ভোগ করতো।

স্বাক্ষর/-
বি, জামান
১৪/৭/৭৩

সাইফুল ইসলাম
<৮,২.৩.১২৫,১৯১>
।। ১২৫ ।।
শ্রী শক্তিপদ সেন
গ্রাম- কাজদিয়া,
ডাকঘর- আলাইপুর
থানা ও জেলা- খুলনা

১৯৭১ সালের ১৯ শে এপ্রিল রোজ বুধবার বেলা ১১ টার সময় খুলনা ট্রেজারীতে চাকরী কর্মরত অবস্থায় একজন পাক মিলিটারী আমাদের অফিসে আসে এবং আমাকে ডাকে। আমি তার নিকট উপস্থিত হওয়ার সাথে সাথে আমার পিছে রাইফেল ধরে সঙ্গে করে তাদের ক্যাম্প সার্কিট হাউজে নিয়ে যায়। সেখানে নিয়ে আমাকে বেশ কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে। যেমনঃ-
(ক) কাকে ভোট দিয়েছ?
(খ) কতজন বিহারী মেরেছ?
(গ) এম এম দাস কোথায়?

আমাকে নিয়ে যাওয়ার পর আমার দুহাত পিছনে দিয়ে রশি দিয়ে বেঁধে ফেলে। তারপর প্রশ্নবাদ করতে থাকে আর কাঠের রোলার, লোহার রড দিয়ে শরীরের সমস্ত জয়েন্টে প্রহার করতে থাকে। প্রহার করার মাঝে বুট দিয়ে লাথির পর লাথি মারতে থাকে। উক্ত প্রকারে প্রহার করার পর সিগারেটে আগুন ধরিয়ে আমার সমস্ত শরীর চেপে ধরে পুড়িয়ে দিতে থাকে। একটু এদিক ওদিক ব্যাথার যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগলে আবার মার শুরু করে দিত। এইভাবে সন্ধ্যা ৮-৩০ পর্যন্ত অত্যাচার করার পর তিন জন মিলিটারী আমাকে হাত খুলে দিয়ে বলে, চল শালা তোকে বাড়ী পৌছে দিয়ে আসি। এই বলে আমাকে সামনে রেখে একজন পিছে আর দুজন দুইপাশে রাইফেল ধরে ১ নং ফরেষ্ট গেটে নিয়ে যায়। তারপর সেখানে নিয়ে দুহাত পিছে দিয়ে পিঠ মোড়া করে বেঁধে ফেলে। আর দুপা একসঙ্গে করে বেঁধে ভৈরব নদীতে পিছন হতে লাথি মেরে ফেলে দেয়। ফেলে দেওয়ার পর আমি ভাসতে ভাসতে প্রায় ২০০/৩০০ গজ যাবার পর আমার পায়ের রশিটা খুলে যায়। তারপর আমি পায়ের তলায় মাটি পাই। সেখানে আশ্রয় নিয়ে হাতের রশিটি খুলে ফেলি এবং সেখানে আত্নরক্ষার জন্য পানির নিয়ে সমস্ত শরীর ডুবিয়ে রেখে কোনরকম নাক বাঁচিয়ে প্রায় ৩/৪ ঘন্টা সেখানে কাটাই। তারপর নদী হতে উঠে পালিয়ে খুলনা টাউন মসজিদে ইমাম সাহেবের সাথে মসজিদ প্রাঙ্গণে আমার দেখা হয়। মসজিদের ইমাম সাহেব আমাকে বাড়ী পর্যন্ত পৌছে দেওয়ার ব্যপারে যথেষ্ট সাহায্য করেন। তারপর এর মধ্যে দিয়ে পালিয়ে পালিয়ে আমার নিজ বাড়ী গিয়ে আশ্রয় নেই এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পূর্ব পর্যন্ত আমি বাড়ীতে থেকে যাই।

স্বাক্ষর/-
শক্তিপদ সেন
১৯/৭/৭৩

সাইফুল ইসলাম
<৮,২.৩.১২৬,১৯২> “বিভিন্ন ভাবে তারা তাদের যৌন ক্ষুধা নিবৃত্ত করতো…আমাদের গায়ে ব্লাউজ রাখতে দিত না।“
।। ১২৬।।
রেবা রাণী নাথ
ডাক ও থানা- ডুমুরিয়া
জেলা- খুলনা

জুন মাসের শেষের দিকে আমরা পাথরঘাটা হয়ে ভারতে যাচ্ছিলাম। দলে ছিলাম প্রায় ৮/১০ হাজার লোক, সবাই আমরা ভারতে যাব।

রাত থেকে সকালে ৮/৯ টার দিকে আমরা যা হোক কিছু রান্নাবান্না করছি এমন সময় ৩/৪ গাড়িী মিলিটারি আসে। সঙ্গে সঙ্গে সেনারা গুলি চালিয়ে বহু লোককে হত্যা করে এবং বহু লোককে ধরে গাড়ীতে তোলে। প্রত্যেক গাড়ীতে ১৫/২০ জন করে মেয়েদের তুলে নেয়। ওখানেই অনেকের উপর পাশবিক অত্যাচার চালায়। পাক ঘাঁটি ঝাউডাঙ্গাতে আমাদের নিয়ে যায়। ছেলেগুলিকে এক যায়গা করে গুলি করে সবাইকে হত্যা করে শুধু আমাদেরকে নিয়ে যায়। ওখানে গিয়ে ৫০/৬০ জন মেয়েকে দেখলাম বিভিন্ন যায়গার, ঝাউডাঙ্গারও অনেক মেয়ে দেখলাম। অনেক কলেজ পড়া বিশ্ববিদ্যালয় পড়া মেয়েকে দেখলাম।

পাকসেনারা আমাদেরকে ৪/৫ দিন রাখে। ওখানে ৩/৪ টি তাবু ছিল। একটি একটি সিটের কাছে ২/৩টি মেয়ে নিয়ে এসে রাখতো। পাক সেনারা জোর করে ধরলে দুটি মেয়ে কিছুতেই তাদের শিকার হতে চায় না। তখন পাকসেনারা ভীষণভাবে দৈহিক পীড়ন করে গুলি করে হত্যা করে। পাকসেনারা একদল সবসময় ঘরে থাকতো, অপর দল আসা পর্যন্ত আমাদের উপর অত্যাচার চালাতো।

আমি যে তাঁবুতে ছিলাম সেখানে ১৫/১৬টি মেয়ে ছিল। সীট ছিল ৮/১০টি। পাকসেনারা যখন তখন আমাদের উপর দৈহিক পীড়ন চালাতো। প্রয় সবসময় বিভিন্ন স্থান থেকে পাক সেনারা আসতো আর আমাদের আমাদের উপর অত্যাচার চালাতো। পাক সেনারা বলতো বাংলাদেশ হবে না, তোমাদের আমাদের সঙ্গেই থাকতে হবে, জোর করলে গুলি। আমাদের উপর একই সময় ৫/৭ টি করে পাক সেনা অত্যাচার চালাতো। বিভিন্ন ভাবে তারা তাদের যৌন ক্ষুধা নিবৃত্ত করতো। আমাদের ৪ দিনের মধ্যে ১ দিন ভাত দিয়েছিলো। একজনের সাথে অপরজনের কথা বলতে দিত না। আমরা ওখানে হিন্দু মেয়ে বেশী ছিলাম কিন্তু সবাই আমরা মুসলমান বলে পরিচয় দিই। আমাদের গায়ে ব্লাউজ রাখতে দিত না। সবাইকে কেবল শাড়ী পরিয়ে রাখতো।

আমরা থাকতে আরও প্রচুর মেয়েকে ধরে আনে। পাকসেনারা তখন আমাদের রাজাকারদের হাতে তুলে দেয়। প্রত্যেক রাজাকার এক একজনকে নিয়ে যায়। আমাকে এক রাজাকার তার বাড়ীতে নিয়ে যায়।

৩/৪ দিন রাজাকারটি আমার উপর অত্যাচার চালায়। রাজাকারটির বৌ ও মা নিষেধ করলে গুলি করতে যেতো। এরপর ওখান থেকে রাজাকারের মা এবং বৌয়ের সহায়তায় পালিয়ে ভারতে চলে যাই। সেখানে গোল পুকুর ক্যাম্পে থাকতাম। দেশ স্বাধীন হলে দেশে ফিরে আসতাম। আমি তখন ৭/৮ মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলাম।

আমি নারী পুর্নবাসন কেন্দ্রে আবেদন করি সমাজকল্যাণ দপ্তরের মাধ্যমে। ওরাই আমার চিকিৎসা এবং কাজের ব্যবস্থা করেন।

স্বাক্ষর/-
রেবা রাণী নাথ
২৫/৭/৭৩

সাইফুল ইসলাম
<৮,২.৩.১৬৩,১৯৩-৯৪> ““আমি বাঙালি। বাংলায় অনার্স পড়ি। বাংলাকে শত্রমুক্ত করতেই আজ আমার এই অবস্থা। কাজেই কিছুতেই আমি ইংলিশে লিখবো না।“
।। ১৬৩ ।।
আখতার হোসেন চৌধুরী
ডি,এস,পি,শিল্প এলাকা
খালিশপুর
জেলা- খুলনা

ছেলেমেয়েদের নিরাপত্তার জন্য আমি সবরকম তদবীর শুরু করি এবং তদবীর করতে গিয়েই আমি ২১ শে মে সকাল ৯ টায় মেজর বাবরের কবলে পড়ে যাই। আর সঙ্গে সঙ্গেই পাকসেনার পাহারাধীনে আমাকে যশোর ক্যান্টনমেন্টে পাঠিয়ে দেয়।

যশোর ক্যান্টনমেন্টে এফ-আই-ইউ (ফিল্ড ইনটেলিজেন্স ইউনিট)- এর একাটি ঘরে আমাকে আটক রাখা হয়। সেই ঘরে আমি ছাড়া আরও ৫০/৬০ জন বন্দী। এই এফ-আই-ইউ একটা বিভীকামায় স্থান। সবাই ঘরের মেঝেতে জুতার বালিশ মাথায় দিয়ে শুয়ে থাকতাম। ২৪ ঘন্টার মধ্যে মাত্র একবার সন্ধ্যয় আমাদের খেতে দিতো। পচা ভাত,ডাল, প্রায় অখাদ্য। ওরই মধ্যে আমার মন বিদ্রোহ ঘোষণা করছিল। ১২ দিন শুধু পানি খেয়েছিলাম। সারাদিন সেখান থেকে যাকে ইচ্ছা বের করে নিয়ে যেয়ে আর এক ঘরে এফ,আই,ইউ এর অফিসাররা ইন্টারোগেশন করতো এবং অমানুষিক অত্যাচার চালোতো। সন্ধ্যা আটটায় একজন জমাদার বা সুবেদার এসে একটা লিষ্ট থেকে নাম ডাকতো। এই লিষ্ট-এ ৩০ থেকে ৩৫ জনের নাম থাকতো। যাদের না ডাকতো তারা লাইন ধরে দাঁড়াতো, তারপর তাদের জামাকাপড় ছিড়ে চোখ আর পেছর দিকে হাত বেঁধে গাড়ী করে দিয়ে মেরে ফেলতো। প্রত্যেকদিন নতুন নতুন লোকদের আনা হতো। অমনি করে মেরে ফেলা হতো। একদিনের কথা আমি কোনদিন ভুলবো না। এটা ছেলে। মুক্তিবাহিনীর একজন। তাকে যখন মিলিটারী অফিসার ইংলিশে ষ্টেটমেন্ট লিখতে বলেছিল তখন সে বলেছিল-“আমি বাঙালি। বাংলায় অনার্স পড়ি। বাংলাকে শত্রমুক্ত করতেই আজ আমার এই অবস্থা। কাজেই কিছুতেই আমি ইংলিশে লিখবো না।“

তাকে যেভাবে মারা হয়েছিল সে কথা আমি লিখতে পারবো না। তারপর এফ,আই,ইউ থেকে এফ,আই,টি (ফিল্ড ইন্টারোগেশন টিম) এর আগুারে এম পি, ইউনিট-এ আমাকে আটক রাখা হয়। এই এফ,আই,টি ইউনিটে আমাকে নিজ হাতে লিখে দিতে হয় যে আমি খালিশপুর পিপলস জুটমিল ও ক্রিসেন্ট জুটমিলের ৭,০০০ হাজার বিহারী হত্যা করেছি। প্রথমে ২ দিন লিখতে চাইনি। তখন আমাকে পা উঁচু আর মাথা নিচু করে ঝুলিয়ে দেবার ব্যবস্থা কর হয়। মাত্র তিন মিনিট সময় দিয়েছিল। পাশের যেখানে লেখা আছে ‘প্যানিক চেম্বার’ সেখানে ঝুলিয়ে রাখবার ব্যবস্থা আছে। হঠাৎ ঐ ঘরের দিকে নজর পড়তেই দেখি আরও তিনজন সেখানে ঝুছে। তাদের নাক মুখ দিয়ে লালা ঝরছিল। সেই সময় এক অফিসার এসে বললো “দেখো ই-লোককো হলত দেখো। মাগর তুম নেই মানগে তুমহারা হালত এ্যাইসা হোগা” সেই মুহুর্তে আমি ঠিক করলাম ওরা যা বলেছে তাই লিখে দেবো। এখনও মনে আছে আমি ‘বিছমিল্লাহ’ বলে মিথ্যা লিখে দিলাম। একজন বিহারী ম্যাজিষ্ট্রেটের সামনে আমাকে স্বীকার করিয়া নেওয়া হয়। মার্শাল ল কোর্টে আমার বিরুদ্ধে একট কেস দায়ের করা হয়। তখনই আমি বুঝতে পারি কেন আমাকে জীবিত রেখে ছিল। আমার ষ্টেটমেন্ট পড়ে একজন মিলিটারী অফিসার আমাকে ব্যঙ্গ করে বলে- “তুম বহুত আচ্ছা ষ্টেটমেন্ট দিয়া তোমকো জলদি ছোড় দেগা।“ আমি সাত হাজার বিহারী মারা স্বীকার করেছি তারই পরিপ্রেক্ষিতে এই উক্তি, আমার এই ষ্টেটমেন্ট ডিভিশন হেড কোয়র্টারে পাঠানো হয় এবং সেখান থেকে একজন লেঃ কর্নেল আমাকে দেখতে আসি ও নানা ধরনের প্রশ্ন করে।

পরে তারই অর্ডার অনুসারে আমাকে ১ লা সেপ্টেম্বর পিপলস জুটমিলে নিয়ে এসে প্রায় আড়াই হাজার বিহারী মিল-শ্রমিকদের সামনে তাদের উৎসাহ দেবার জন্য দাঁড় করানো হয়। মেজর খরশীদ (এফ,আই,ইউ) মেজর সরহাদ (এফ,আই,টি), মেজর আখতার হোসেন (ডিভিশন হেডকোয়ার্টার যশোর ক্যান্টমেন্ট) তখন আমার পাশে। বিহারীরা আমাকে দেখে বিচার তাদের হাতে দেবার জন্য চীৎকার করতে থাকে, হঠাৎ তাদের মধ্যে থেকে এক বুড়ো বিহারী ড্রাইভার ভীড় ঠেলে মিলিটারী অফিসারদের সামনে এসে বলতে থাকে যে, সে প্রথমে আমাকে চিনতে পারেনি। কারণ আমার মাথা ন্যাড়া ছিল এবং মুখে দাঁড়ি ছিল। তবে যাবার সময় বলেছিল, “এক যদি তোমরা মারো তবে আল্লা বরদাস্ত করবে না।“ তাই বোধহয় আমাকে আবার ক্যান্টমেন্টে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল।

কেস শুরু হোল। কোর্ট বসে যশোর শহরে। আমাদের নিয়ে যেতে সুবিধার জন্য সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে আমাকে যশোর সেন্ট্রাল জেলে বন্দী করে রাখে। এই জেলখানায় এস আবার পি,আই,টি (পুলিশ ইনভেষ্টিগেশন টিম)-এর নির্মম কবলে পড়তে হয়। জেলখানা থেকে লোকদের নিয়ে যেয়ে ক্যান্টনমেন্টে তাদের ক্যাম্পে ভীষণ অত্যাচার করে নানা ধরনের তথ্য বের করতে চেষ্ট করে। এমনিভাবে জেলখানায় দিন কাটতে থাকে। বাইরের জগতের সঙ্গে আমাদের কোন যোগযোগ ছিল না, তবে নতুন যারা আসতো তাদের মুখে কিছু কিছু শুনতে পেতাম। প্রায় সাত মাস বন্দী অবস্থায় ছিলাম, তাই প্রত্যক্ষভাবে আমি দেশের কাজ করতে পারিনি। কিন্তু মনে প্রাণে কামনা করেছি বাংলার স্বাধীনতা, আমি বিশ্বাস করতাম যে এত অত্যাচারের পতন হবেই। হয়তো আমি দেখতে পাবো না কিন্তু বাংলার স্বাধীনার নতুন সূর্য একদিন উঠবেই। তাই যখন ৬ ই ডিসেম্বর ক্যান্টনমেন্ট ফল করে এবং ৭ ই ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী আমাদের জেল গেট খুলে দিলে আমরা বেরিয়ে পড়ি। জেল থেকে বেরিয়ে মাটিতে প্রথম পদক্ষেপের আগেই আমার চোখ বেয়ে দু’ফোটা অশ্রু ঝরেছিল।

স্বাক্ষর/-
আখতার হোসেন চৌধুরী
১১/৭/৭৩

সাইফুল ইসলাম
<৮,২.৩.১৬৪,১৯৫-১৯৬> “সমগ্র বাগেরহাট এলাকাতে পাকসেনার চাইতে রাজাকাররাই অত্যাচার চালিয়েছে বেশী।“
।। ১৬৪ ।।
তাহমীনা বেগম (দিপালী)
গ্রাম-বৈতপুর
ডাকঘর ও থানা- বাগেরহাট
জেলা-খুলনা

২৪ শে এপ্রিল পাকসেনারা কাড়পাড়া হয়ে বাগেরহাট আসে। এসেই কাড়াপাড় এলাকাতেই ১০০ উপরে লোকে হত্যা করে। নাগের বাজার তেলপট্টি ইত্যাদি এলাকা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া শুরু করে এবং বলে দেয় লুট করার জন্য, মুসলমানের অধিকাংশ ঘরবাড়ী সব লুট করা শুরু করে।

মে মাসে এখানে শান্তি কমিটি সেই সঙ্গে রাজাকার বাহিনী গঠন হয় পরবর্তীকালে রজব আলী ফকির শান্তি কমিটির চেয়ারম্যন নিযুক্ত হয়। সমগ্র বাগেরহাট এলাকাতে পাকসেনার চাইতে রাজাকাররাই অত্যাচার চালিয়েছে বেশী।

শ্রাবণ মাসের শেষের দিকে বাগেরহাট শহর এলাকাতে যত হিন্দু ছিল কিছু হত্যা বাদে সবাইকে মুসলমান ধর্মে দীক্ষিত করে। এরপর গ্রামের দিতে হাত বাড়ায়। গ্রামকে গ্রাম ধরে সবাইকে মুসলমান করতে থাকে।

আমি আমার স্বামী, ছেলেমেয়ে, বাবা, মা, কাকা, কাকীমা তাদের ছেলেমেয়ে সবাই ইসলাম ধর্মে দিক্ষা নিই। কিন্তু রাজাকাররা এর পরেও অত্যাচার করতে ছাড়েনি। এরপরও অসংখ্যা লোককে হত্য করেছে।

২২শে আশ্বিন রাত তিনটার দিকে ৫০/৬০ জন রাজাকার আমাদের বাড়ী ঘিরে ফেলে। প্রথমে তারা মুক্তিবাহিনী বলে পরিচয় দিয়ে থাকতে চায় রাতের মত। অনেক অনুনয়-বিনয় করে। প্রথমে আমার ভাই প্রদীপ গুহ দেখেই চিনেছিল তারা রাজাকার। তাই সে ছাদ দিয়ে গাছ বেয়ে পিছনে নামবার চেষ্টা করেছে। উপর থেকে নিচে নামলেই রাজাকাররা ধরে ফেলে। ওকে কিছু দুর নিয়ে গিয়ে বেয়োনেট দিয়ে গলা কেটে হত্যা করে। তারপর বাবা কাকা এবং পাশের বাড়ীর তিনজনকে কিছু দুর নিয়ে গিয়ে সিরাজ মাষ্টার এবং তার দল গুলি করে মাথা সব উড়িয়ে দেয়। সকালবেলা আমরা সেসব লাশ উদ্ধার করি। হত্যা করে বাড়ীঘর লুট করে সব নিয়ে চলে যায়। আমরা যারা বেঁচে ছিলাম বাগেরহাট শহরে চলে আসি। বাড়ীতে কেবল একজন কৃষাণ এবং আমার ৭০ বছরের বৃদ্ধা দিদিমাকে রেখে আসি।

কার্ত্তিক মাসের ১২/১৩ তারিখ হবে। রাজাকাররা আবার যায় আমাদের গ্রামে। দড়াটানা নদীর ওপার থেকে মুক্তিবাহিনী গোলাগুলি করতো। তাই রজব আলী অর্ডার দেয় সমস্ত এলাকা ঘরবাড়ী ভেঙ্গে ধ্বংস করে গাছপালা পরিস্কার করে ফেলার জন্য। ঐদিন আমাদের বাড়ীতে ঢোকে এবং দিদিমাকে লেপকাঁথা দিয়ে জড়িয়ে কেরোসিন তেল ঢেলে দিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করে। আগুন দিয়ে দিদিমা আমার কাকার নাম ধরে বার বার চিৎকার করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত সমস্ত এলাকা পুড়িয়ে ধ্বংস করে । ভোলা বোসকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। রাধা বল্লভ গ্রামে মেয়েদের রাজাকাররা ধরে নিয়ে আসে। রাজাকাররা সারারাত পাশবিক অত্যাচার চালিয়ে দিনের বেলা গুলি করে হত্যা করে রাস্তায় ফেলে রাখে। বলরাম সাহাকে রাজাকাররা গুলি করে হত্যা করে। তার বিরাট গদির উপরে রজব আলী বসত, চারিদিকে রাজাকার ঘিরে থাকতো। ওখানে একটি ঘরে লোকদের জবাই করতো। প্রত্যেকদিন ১০টি লোক যোগাড় করতেই হতো, ১০ টি করে জবাই করতোই। লোক না পারলে যেভাবেই হোক, ফকির হোক, এনে দিতেই হতো। আমি একদিন এক লোকের সুপারিশ করতে গিয়ে দেখলাম ঘরের ভিতর চাপ চাপ রক্ত পড়েছে। মদনের মাঠ ওয়াপদা রেষ্ট হাউসে একটি কক্ষে অসংখ্য লোককে জবাই করেছে। খাদ্দার গ্রামে এক বাড়ী থেকে সবাই ধরে এনে হত্যা করে। ডাক বাংলো ঘাটে প্রত্যেহ অসংখ্য লোককে জবাই করেছে বেয়োনেট দিয়ে।

এক বৃদ্ধ রামদা দিয়ে অসংখ্য লোককে কেটেছে। সে পিঠ সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারতো না। লোক ধরে বলতো ‘বাবা নীচু হও তা নইলে কাটতে আমার কষ্ট হয়। তাড়াতাড়ি বসে পড়ে তোমাদের কষ্টও কম হবে, আমারও কষ্ট কম হবে।‘

ইসহাক মিয়ার বাড়ীতে অনেক মেযে আশ্রয় নিয়েছিল। তা সত্ত্বেও কেউ রেহাই পায়নি। সমস্ত এলাকাতে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলো।

গ্রাম গ্রামান্তর থেকে ব্যাপকভাবে হিন্দু মেয়ে ধরে পাকসেনাদের হাতে তুলে দিতো রাজাকাররা। এছাড়া রাজাকাররা গ্রামে গ্রামে ঢুকে অধিকাংশ মেয়ের উপর পাশবিক অত্যাচার চালিয়েছে।

বাগেরহাট থানার মীর্জাপুর গ্রাম এবং সারাগ্রামে বহু মেয়ে অপমাণিত হয়ে আত্নহত্যা করেছে বিষপানে কেউ বা গলায় দড়ি দিয়ে।

রাজাকার, আল-বদর এদের মানুষ চরমভাবে ঘৃণা করতো। আমার মনে হয় সমস্ত বাংলাদেশে রাজাকাররা এমন ভাবে সন্ত্রাস আর নৃশংস অত্যাচার কোথাও চালায়নি। নদীর ঘাটে দড়ি বাঁধা অবস্থায় এক মাসে ৪/৫ টি লোককে গলা কাটা অবস্থায় পেয়েছি। গলা সম্পূর্ণ কাটতো না অল্প কেটে ছেড়ে দিতো, ছটফট করে শেষ হয়ে যেত। হাড়ি খালীতে (বাগেরহাট থানা) বিষ্ণু মহাশয়কে তার বৌয়ের কাছ থেকে জোর করে কেড়ে নিয়ে আরও পাঁচজনকে ধরে ওর স্ত্রীর সামনে গুলি করে হত্যা করে। অত্যাচার চালায় সারা গ্রামে। বি,এ,পাশ এক মেয়েকে ধরে অত্যাচার চালিয়ে ছুরি দিয়ে হত্যা করে। মদনের মাঠের এক ঘরে ওরা নিয়মিত মানুষ কেটেছে।

স্বাক্ষর
তাহমীনা বেগম (দিপালী)
৩/৮/৭৩

রকিবুল হাসান জিহান

<৮,২.৩.১৬৫,১৯৭-১৯৯>
১৬৫
মোঃ শহীদুল ইসলাম এ্যাডভোকেট
থানা- কোতোয়ালী, যশোর

এপ্রিলের ২৭ তারিখে বাসার খোঁজ নেবার জন্য শহরে চলে আসি। কিন্তু মায়ের অনুরোধে সেদিন বাসাতে রাত্রি কাটানোর জন্য থেকে যাই। কিন্তু সেই দিন রাত্রি দু’টার সময় পাকসেনারা আমাদের বাসাসহ আরও অনেকগুলো বাসা ঘেরাও করে এবং আমাদের বাসার ভিতরে যেয়ে দরজায় ধাক্কা মারতে থাকে। আমার আব্বা দরজা খুলে দেন। সঙ্গে সঙ্গে আমার আব্বাকে ধরে ফেলে এবং তার চোখ বেঁধে ফেলে। তারপর লাফ দিয়ে একজন আমার নিকট চলে আসে এবং আমাকে ধরে ফেলে এবং আমারও চোখ হাত বেঁধে ফেলে। তারপর আমাকে এবং আব্বাকে বাসার বাইরে নিয়ে যায়। আমি অনুনয়-বিনয় করে বলতে থাকি আমরা মুসলমান, আমরা মুহাজির। তারপর তারা আমাকে মুখ বন্ধ করতে বলে। আমি আর কোন কথা না বলে চুপ করে থাকি। আব্বা ধরা পড়ার সাথে সাথে জোরে জোরে কালেমা পড়তে থাকেন। আব্বার কালেমা পড়ার জন্য তাকে জোরে জোরে বন্দুকের বাঁট দিয়ে মারতে থাকে। আব্বার বয়স প্রায় ৮০/৮৫ বছর। তারপর তিনি ধীরে ধীরে কালেমা পড়তে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে আমাকেও রাইফেলের বাঁট দিয়ে মারতে থাকে এবং বলতে থাকে কালেমা মাত কর। আমাদের ঐ অবস্থা দেখে আম্মা কান্নাকাটি করতে থাকেন। আম্মার কান্নাকাটি করা দেখে একজন মিলিটারী বাসার মধ্যে চলে যায় এবং আম্মাকেও বন্দুক দিয়ে বাড়ি মারে। তার হাতের রিঙ খুলতে চেষ্টা করলে অন্য একজন মিলিটারী গিয়ে তাকে বাঁধা দেয় এবং সেখান হতে তাকে বাসার বাইরে নিয়ে আসে। আমার হাত এবং আব্বার হাত একত্র করে বেঁধে ফেলে। তারপর আমাদেরকে চোখ বাঁধা অবস্থায় ১০/১২ গজ হাঁটিয়ে নিয়ে এসে এক জায়গায় বসতে বলে। আমরা বসে পড়ি। এর মাঝে আমি পানি চাইলে আবার এসে মারা আরম্ভ করে। তারপর আমরা সেখানে বসে থাকি। তার ৪/৫ মিনিট পর আরও ৮/১০ জন লোককে ধরে মারতে মারতে আমাদের নিকট নিয়ে এসে রাখে। তারপর তারা সবাই একত্রিত হবার পর তাদের মধ্যে থেকে একজন মিলিটারী বলে ওঠে এ তো বুড্ডা একে নিয়ে কি হবে। আমাদের মধ্যে একজন ছোট ছেলে ছিল তাকে এবং আমার আব্বাকে তারা ছেড়ে দেয়।

তার প্রায় আধা ঘন্টা পর আমরা গাড়ির শব্দ পাই। একটা গাড়ি এসে আমাদের সম্মুখে থামে এবং মিলিটারীরা নিজেরাই ধরাধরি করে আমাদেরকে গাড়িতে উঠায়। তারপর গাড়ি ছেড়ে বেশ কিছু দূর গিয়ে গাড়ি থেমে পড়ে। আমাদেরকে গাড়ি হতে ধাক্কা দিয়ে নামিয়ে ফেলে। তারপর একটা ঘরের দরজার নিকট নিয়ে গিয়ে আমাদের সবার চোখ খুলে দেয় এবং ঘরের মধ্যে আমাদেরকে ঢুকিয়ে দেয়। ঘরের মধ্যে আমরা ঢুকে সবাই সবাইকে এক নজর দেখে নিলাম। তার পরপরই ভোরের আযানের শব্দ আমার কানে ভেসে আসতে লাগলো। আমরা জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখতে পাই প্রায় ২০/২৫ জন লোককে মারতে মারতে পায়খানায় নিয়ে যাচ্ছে আবার মারতে মারতে পায়খানা হতে নিয়ে আসে। তারপর আমাদেরকে পায়খানা করার জন্য বাইরে নিয়ে যায়। পায়খানা করা হলে সবাই অজু করে নেবার পর আবার উক্ত জায়গায় নিয়ে এসে রেখে দেয়। আমরা সবাই নামাজ পড়ে বসে আছি এমন সময় পাশের ঘর হতে মানুষের চিৎকার শুনতে পাই। তাতে আমরা ধারণা করলাম ওখানে মার আরম্ভ করে দিয়েছে। এর মধ্যে একজন মিলিটারী আমাদের রুমে চলে আসে এবং প্রত্যেকের পুরা ঠিকানা ও প্রত্যেকের পেশা একটা কাগজে লিখে নিয়ে যায়। সন্ধ্যার পর আমাদের জন্য খাবার নিয়ে আসে। আমরা খাবার পর সবাইকে ঘুমাতে বলে। আমরা কোন মতে রাত্রি কাটালাম।

তারপর দিন আমাদের দলের বদরউদ্দিন নামক একজন লোককে ঘর হতে বের করে নিয়ে যায়। তার সাথে কি যেন বলাবলি করার পর আবার আমাদের রুমে তাকে নিয়ে এসে রেখে যায় এবং আমাদের সবাইকে জানিয়ে যায় তোমরা কোন লোক বদরউদ্দিন সাহেবের সাথে কথা বলবে না। যদি কোন লোককে তার সাথে কথা বলতে দেখি তাকে আমরা গুলি করে মারবো। তারপর দিন রাজু নামক একজন লোককে নিয়ে যায়। কিছু সময় পর আবার তাকে নিয়ে এসে রেখে যায়।

তার তিনদিন পর আমাদের রুমে এসে জিজ্ঞাসা করে ফকু কোন হায়? তোতা কোন হায়? তারপর আমরা দুজন উঠে দাড়ালাম। তারপর আমাদেরকে বের করে নিয়ে যায়। একটা মাঠের মধ্যে নিয়ে গিয়ে আমাদেরকে শুতে বললে আমরা দুজন মাঠের মধ্যে শুয়ে পড়ি। তারপর আমাকে এমন জোরে একটা বেতের লাঠি দিয়ে পিঠে আঘাত করে যে আমি সহ্য করতে না পেরে ছুটাছুটি করতে থাকি। আবার আমাকে ডেকে নিয়ে শুতে বলে, আমি মাটিতে শুয়ে পড়ি। তারপর আমাকে কতকগুলি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে।
যেমনঃ-
(১) তোমার রাইফেল কোথায়।
(২) তুমি রাইফেল ধরেছ কিনা।
(৩) তোমার গ্রামে যে ১৫/১৬ জন লোক রাইফেল ধরেছিল তাদের নাম বলো। তাদের নেতা কে ছিল।
(৪) তোমাদের গ্রামের কারা ই,পি,আরদের খেতে দিয়েছে।
(৫) তুমি ছাত্রলীগ কিংবা আওয়ামী লীগ করো কিনা।
(৬) যশোরে মুজিবের মিটিং-এ তুমি ছিলে কি না।
(৭) মিটিং-এ সে কি বলেছিল।
(৮) মিছিলে কী কী বলা হয়।
(৯) জয় বাংলার মানে কী।
(১০) তোমার ভাই কোথায়।
(১১) তুমি কী কর।
(১২) তোমাদের গ্রামে যে মেজর যেত, তাকে তোমরা কেন মেয়ে জোগাতে না।
(১৩) ভারতে কে গিয়েছে।

সুবেদার মেজর শাহজি আমাকে সবগুলি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে। আমি মারে দরুন থাকতে না পেরে কিছু কিছু প্রশ্নের উত্তর স্বীকার করি আর যে গুলো বেশি জরুরী সেগুলো স্বীকার করি না। মারের নিয়মগুলো নিচে বর্ণনা করা হলো।

(১) প্রথমে মাটিতে উপুড় করে শুইয়ে দিত। তারপর বেতের লাঠি দিয়ে ঘাড়ে এবং পায়ের তালুতে মারতে থাকে। লাঠি দিয়ে মারা শেষ হলে আবার বুট দিয়ে পিঠের উপর উঠে খচতো বা পাড়াতো।
(২) দ্বিতীয় নিজ কায়দা হলো চুল ধরে ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে ঠাশ করে ঘাড়ে একটা চড় কশিয়ে দিয়ে ছেড়ে দিত।
(৩) পা উপরে দিয়ে মাথা নিচে দিয়ে একটা ঘরের মধ্যে রশির সঙ্গে লটকিয়ে রাখতো।
(৪) বস্তার মধ্যে পুরে দিয়ে বস্তার মুখ বেঁধে পিটিয়ে মেরে ফেলতো।
(৫) প্রত্যেক গিড়ায় গিড়ায় লাঠি দিয়ে এবং বন্দুকের বাঁট দিয়ে মারতো।
(৬) আট দশজন করে গাড়িতে তুলে নিয়ে বেয়োনেট চার্জ করে মেরে রেখে আসতো।
(৭) প্রত্যেক হাতের প্রতি আঙ্গুলে সূচ ঢুকিয়ে দিত।
(৮) নিল ডাউন করে রাখতো।
(৯) প্রতি ২৪ ঘন্টায় একবার খাবার দিত। আর পায়খনা প্রশ্রাব করাতে নিয়ে যাবার সময় মারতো আর নিয়ে আসার সময় মারতো। আমাদেরকে একমাস বার দিন রাখার পর আমাদের ১৭ জনের একটা দলকে সুবেদার মেজর শাহজি সবাইকে ডেকে লাইন করে তারপর একটা গাড়িতে আমাদেরকে উঠতে বলে। আমরা গাড়িতে উঠে পড়ি। তারপর আমাদের বাড়ির নিকট গাড়ি থামিয়ে আমাদেরকে নামিয়ে দেয়। আমাকে ধরে ২৭শে এপ্রিল আর ছেড়ে দেয় জুনের ১০ তারিখে।
স্বাক্ষর/-
মোঃ শহীদুল ইসলাম এ্যাডভোকেট
১৭/০৩/১৯৭৩

রকিবুল হাসান জিহান
<৮,২.৩.১৬৬,২০০>
১৬৬
শ্রী নরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়
শষ্টিতলা, যশোর

আমার বর্তমান বয়স ৯৮ বছর। ১৯৭১ সালের ৪ ঠা এপ্রিলে সকাল ৮-৩০ মিনিটে ভারত ও তথাকথিত পাকিস্তানের খবর রেডিওর মাধ্যমে শুনছি এমন সময় দু’জন বিহারী ও তিনজন পাঞ্জাবী আমার বাসায় চলে আসে। বিহারী দুজন আমার পাড়া প্রতিবেশী। তারা আসার সাথে সাথে আমি রেডিও বন্ধ করে দেই। তারা সোজাসোজি আমার নিকট চলে আসে এবং আমাকে জিজ্ঞাসা করে তোমার টাকা পয়সা কোথায় রেখেছ? আমি জবাব দেই আমার কোন গচ্ছিত টাকা পয়সা নাই। আমি আবার ত্রিশ বছর চাঁচরা রাজ স্টেটের ম্যানেজার ছিলাম। তারা সেই জন্য মনে করত আমার নিকট প্রচুর টাকা পাওয়া যাবে। তারপর তাদের মধ্যে থেকে একজন মিলিটারী আমার পাশের ঘর হতে আমার চাকর কালিপদ দাসকে আমার নিকট নিয়ে আসে। তারপর আমাকে এবং তাকে ভয় দেখায়। টাকা কোথায় রেখেছ যদি না বলে দাও তাহলে তোমাদের দু’জনকেই গুলি করে মারা হবে। আমরা জবাব দিলাম টাকা আমরা কোথায় পাবো। তখন আমাদের দু’জনকে পাশাপাশি দাঁড় করায়। তারপর একজন মিলিটারী কালিপদকে লক্ষ্য করে গুলি করে। সঙ্গে সঙ্গে তার বুক ভেদ করে গুলি বেরিয়ে যায়। তার পরক্ষণেই সে মারা যায়। তার পর আমাকে লক্ষ্য করে দ্বিতীয় গুলি ছোড়ে, গুলিটি আমার এক হাতে লাগে। গুলি লেগে আমার বাম হাতটা প্রায় শরীর হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তারপর আবার আরেকটা গুলি আমাকে করে। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার অশেষ করুণায় গুলিটি আমার ডান হাতের এক পাশে লাগে। সাথে সাথে আমাকে অমনি ফেলে চলে যায়। বাড়ি হতে বের হয়ে যাবার সময় আমার বাসা লুটপাট করে বাসার সমস্ত কিছু নিয়ে যায়। অবশ্য উক্ত জিনিসপত্রগুলো মিলিটারীদের সঙ্গে যে দু’জন বিহারী এসেছিল তারাই লুটপাট করে নিয়ে যায়। আমি ঘরের মেঝেতে পড়ে থাকি। মিলিটারী ঐ দিনই আমার বাড়ির আশে পাশে ১১ জনকে গুলি করে মারে। তার মধ্যে আমি শুধু বেঁচে আছি। যাদের গুলি করে মারা হল তারা হল আমার বাড়ির উত্তরে আমার বিশিষ্ট বন্ধু অবসরপ্রাপ্ত ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট রহমত উল্লাহ মন্ডল এবং তার দুই শিক্ষিত পুত্র মোছাদ্দেক ও জিন্নাহ এবং তার বাড়িতে তিনজন ভাড়াটিয়া, একজন প্রফেসর ও দুজন শিক্ষিত ভদ্রলোক। আমার বাড়ির উত্তরে ডাক্তার নাছির উদ্দিন খান এবং তার স্ত্রী ও তার বাড়িতে উপস্থিত আরও তিনজন লোক। আমার বাড়ির পূর্বে সত্য চরণ মিত্র ইত্যাদি ১২ জনকে গুলি করে তার মধ্যে ১১ জন মারা যায়। তার মধ্যে আমি পঙ্গু এবং অন্ধ অবস্থায় বেঁচে আছি। তারা চলে যাবার পর আমি আধমরা অবস্থায় পড়ে থাকি।

সেইদিন বেলা তিনটার সময় দু’জন বিহারী এসে আমার ঘর হতে কালিপদের মরা লাশ নিয়ে যায়। তারপর ৭ দিন পর্যন্ত শুধু আমি শরীরে ভীষণ জ্বর নিয়ে না খেয়ে মেঝেতে পড়ে থাকি। ৭ দিন পর ঘোপের বদরউদ্দিন সাহেবের বাড়ি হতে মহর আলী নামক একজন লোক আমার জন্য দুধ ও রুটি নিয়ে আসে। তারপর হতে তার সেবা শুশ্রুষায় আমি সুস্থ হয়ে উঠি। আমার হাতে পোকা পড়ে গিয়েছিল। তারপর আমি সুস্থ হয়ে উঠি। বর্তমানে আমি অন্ধ এবং আমার বাম হাত পঙ্গু হয়ে গেছে। আমি এখনও খোদার অশেষ কৃপায় বেঁচে আছি আর কি।
টিপ সহি/-
শ্রী নরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়
১৭/০৩/১৯৭৩

রকিবুল হাসান জিহান
<৮,২.৩.১৬৭,২০১-২০২>
১৬৭
ডাঃ এস, এম, আহাদ আলী খান
থানা- কোতোয়ালী, যশোর

এপ্রিলে পাকবাহিনী যশোর পুরোপুরি দখল করে নেয়। আমরা পালিয়ে যাই গ্রামে। সেখান থেকে ভারতে যাবার পথ না পেয়ে পুনরায় শহরে ফিরে আসি। জুলাই মাসের ১৭ তারিখে পাকসৈন্যরা আমাকে ডাক্তার খানা থেকে ধরে নিয়ে যায়। প্রথমে সার্কিট হাউসে নিয়ে গিয়ে ব্রিগেডিয়ারের সামনে হাজির করে। ব্রিগেডিয়ার আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে আমাকে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়। মেজর আনোয়ারের সামনে হাজির করাবার জন্য বসিয়ে রাখে। সেখানে সুবেদার মেজর আমীল হোসেন এবং একটি হাবিলদার ছিল নাম ইকবাল শাহ এবং আরও অনেকে ছিল। হঠাৎ করে অন্য সিপাই এসে আমাকে মারধর শুরু করে তখন সবাই মার আরম্ভ করে। আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। জ্ঞান ফিরলে আমি দেখি মেজর আনোয়ার হোসেন সামনে। মেজর আমাকে জিজ্ঞাসা করে তুমি কোন রাজনৈতিক দলে আছ? আমি উত্তর দিই ন্যাপে আছি। তারপর একটি ছোট্ট কামরাতে নিয়ে যায়, রাতে কোন খাবার এমনকি পানিও দেয়নি। প্রশ্রাব করতে চাইলেও মারধর করেছে। তারপর দিন সুবেদার ইকবাল শাহ আমাকে বলে, যেহেতু মেজর খুরশীদ আনোয়ারের মেয়েকে এক সময় চিকিৎসা করে বাঁচিয়েছি সেহেতু আমাকে নাকি মেরে ফেলা হবে না। ওকে আমি পানির জন্য অনুরোধ করি কিন্তু পানি দেয়নি। সন্ধ্যাবেলা আউন্স দুই পানি এবং একমুঠি পচা ভাত দেয়।

জুলাই মাসের ২০ তারিখে আবার মেজর সাহেবের সামনে নিয়ে যায়। সেখানে আমাকে জিজ্ঞাসা করে যখন বাঙ্গালী সৈন্যরা আমাদের সাথে যুদ্ধ করে তখন ওরা কি খেত? আমি উত্তর দেই ‘ছোলা’, অমনি সবাই মিলে মারধোর শুরু করে। দুধ, ডাব, ভাত পাঠিয়েছি কিনা জিজ্ঞাসা করে। আমি হ্যাঁ বলেছিলাম কারণ তখন পাকসৈন্যরা সব খবরই সংগ্রহ করেছে।

জুলাই মাসের ৩১ তারিখ পর্যন্ত সিপাইরা দুবেলা নিয়মিত মারধর করতো। পাঁচ মিনিট সময় দিত তার মধ্যে প্রশ্রাব, পায়খানা, হাতমুখ ধোওয়া সব করতে হতো, দেরি হলে বেত মারতো। সারাদিন খাবার দিত না, সন্ধ্যাবেলা কিছু পচা ভাত এবং আউন্স দুই পানি দিত। পানি চাইলে বলতো তোমরা আমাদের পানি বন্ধ করেছিলে।

১ লা আগস্ট আবার মেজরের সামনে হাজির করে। মেজর প্রিন্স সদর উদ্দিন আগা খাঁকে চিনি কিনা বললে আমি চিনি বললাম। মেজর আমাকে এক প্যাকেট বিস্কুট দেয়। কোর্ট থেকে নামিয়ে নিয়ে এসে সুবেদার মেজর আমীর হোসেন আমাকে ভীষণভাবে মারধর শুরু করে। আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। আমার আর চলবার ক্ষমতা ছিল না। তখন থেকে কিছু কিছু খাবার দিত। সিপাইরা মারধর করতো নিয়মিতভাবে। মফিজ চৌধুরী, নড়াইলের অধ্যক্ষ মোয়াজ্জেম হোসেন, ডাঃ মাহবুবুর রহমান এবং আজিজুর হক, এ, বি, এম, বদরুল আলম এরা সবাই আমার সাথে ছিলো।

পুরা আগস্ট মাস প্রায় আমি অজ্ঞান থাকতাম। আগস্ট মাসে আমার মেয়ে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান সাহেবের কাছে অনুরোধ করে আমার মুক্তির জন্য কিন্তু কোন কাজ হয়নি এবং অপমানিতা হয়েছে। উপর থেকে কি অর্ডার আসে জানিনা তারপর আমাকে মুক্তি দেয়। যখন মুক্তি দেয় তখন আমার জ্ঞান ছিল না। রাত সাড়ে আটটার সময় প্রত্যহ ধৃত লোকদের মুখে কালো কাপড় দিয়ে বেঁধে বাইরে নিয়ে যেত। শুনতাম অবাঙ্গালীরা ছুরি দিয়ে জবেহ করেছে। ধরে নিয়ে এসে পিটিয়ে হত্যা করেছে। উপরে পা ঝুলিয়ে মাথা নিচু করে মারতে মারতে মেরে ফেলতো। গুহ্যদ্বারের ভিতর বেয়োনেট ঢুকিয়ে দিত, খবরাখবর না দেওয়ার জন্য বরফ ঢুকিয়ে দিত। বাগছড়া হাইস্কুলের শারীরিক শিক্ষককে ধরে নিয়ে গিয়ে খবর না দেওয়ার জন্য অত্যাচার শুরু করে। বিছানার উপর শুইয়ে একটি কেমন যন্ত্র দিয়ে চাপ দিত তারপর ইলেকট্রিক শক দিত, উপরে ঝুলিয়ে মারধর করতো। মেয়েদের ধর্ষণ করে কোন কোন ক্ষেত্রে বাচ্চা ছেলেকে বসিয়ে বাচ্চাটিকে বেয়োনেট দিয়ে হত্যা করে কিন্তু মেয়েটিকে রেখে দেয়। জোর করে পাকিস্তানের পক্ষে ভালো আছি বলে জোর করে জবানবন্দী রেকর্ড করতো টেপ রেকর্ডে। গুলি করে, ছুড়ি দিয়ে হাত পা কেটে, উপর থেকে ফেলে দিয়ে হত্যা করেছে। অনুমান ৮/১০ হাজার লোক মারা যায় এখানে। কর্নেল শামস এবং মেজর বেলায়েত আলী মেয়েদের উপর অকথ্য অত্যাচার করেছে। হাজার হাজার মেয়ে ধর্ষিতা হয়েছে। স্বামীকে মারধর করে জোর করে বেয়োনেট দেখিয়ে স্ত্রীকে তুলে নিয়েছে পাকসেনারা। একই মেয়ের উপর ৫/৭ জন আর্মি ধর্ষণ করেছে।
স্বাক্ষর/-
ডাঃ এস, এম, আহাদ আলী খান
০৯/০৩/১৯৭৩

রকিবুল হাসান জিহান
<৮,২.৩.১৬৮,২০৩-২০৪>
১৬৮
সৈয়দ আলী ইমাম
এস, ডি, ও, এম, ই, এস; (আর্মি)
যশোর ক্যান্টনমেন্ট, যশোর

২০ শে মে ধরা পড়ার পর আমাকে ফিল্ড ইন্টেলিজেন্সের কাছে অর্পণ করা হয়। সেখানে হাবিলদার মেজর মাসুদ প্রথম লাঠি দিয়ে বেদম প্রহার শুরু করে। পরে শরীরের সমস্ত জামা কাপড় খুলে চিৎ করে ফেলে পায়ের তলাতে লাঠি দিয়ে বেদম প্রহার শুরু করে। সারাদিন অভুক্ত অবস্থাতেই এই প্রহার চলে। এরপর আমাকে এফ, আই এর নিকটে একটি সেলের মধ্যে পুরে রাখলো। তখন আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি। সেখানে তখন প্রায় ৩৪ জন বন্দী অবস্থায় ছিলেন। ২০ টা থালাতে এই ৬৪ জন বন্দীকে খেতে হতো। পরিষ্কার না করেই উক্ত থালাতে খেতে হতো।

সারাদিন একবার খাদ্য দিতো। নামাজের সময় অজু করার জন্য ২ মিনিট করে সময় দিতো। যদি বেশি সময় লাগতো তা হলে তার উপর মারপিট শুরু হয়ে যেত। মাঝে মাঝে বন্দীদের দিয়ে গাড়ির চাকা পরিষ্কার করাতো।

খাদ্যের দরুণ প্রায় বন্দীদের পেটের অসুখ হয়। তার ফলে তারা প্রায় ঘরের মধ্যে পায়খানা করে ফেলতো। তখন তাদের প্রহার করা হতো বেদমভাবে।

একদিন চার পাঁচজন যুবককে ধরে নিয়ে আসে। তাদের পা এমনভাবে বাঁধা ছিল যে খাড়া হয়ে তারা চলতে পারতো না। তাদের বিড়ালের মত হাঁটু ও হাত দিয়ে হেঁটে যেতে হতো। পিছনে পাকসেনারা লাঠি দিয়ে মারতে মারতে নিয়ে যেতো। মনে হতো যেন গরুর পাল তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

বন্দীদের হত্যা করার সময় মেজর ওমর খুরশীদ নিজে আসতো এবং যাদের হত্যা করা হবে তাদের নামের লিস্ট করে নিয়ে যেতো। পরে তাদের হত্যা করা হতো।

কয়েকজন মুক্তিবাহিনীর ছেলেদের উপর দিকে পা বেঁধে তাদের লাঠি দিয়ে প্রহার করতো।

একদিন সাধু প্রকৃতির একজন লোককে ধরে নিয়ে আসে। তাকে গুপ্তচর সন্দেহ করতো। দশ বার হাত দূর হতে দৌড়ে এসে উক্ত সাধু প্রকৃতির লোকের বুকে বুট সমেত লাথি মারতো আর বলতো তুমি ভারতীয় বাহিনীর গুপ্তচর। বুটের আঘাতে পড়ে গেলে তার পায়ে রাইফেলের বাঁট দিয়ে আঘাত করতো। পরে তাকে তুলে আবার বুকে বাঁট দিয়ে আঘাত করতো।

এইভাবে প্রায় আড়াই মাস ধরে অত্যাচার করে। প্রায় ৬০ জনকে এই ঘর হতে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে।

৩১শে জুলাই ১৪ জনকে বন্দীশালা হতে ক্যান্টনমেন্টের প্রাইমারী স্কুলে নিয়ে যায়। সেখানে ৩ রা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই স্কুলে বন্দী করে রাখে।

কয়েকজন মুক্তিফৌজকে ধরে নিয়ে এসে একদিন বেদম প্রহার করে। প্রত্যেকদিন মুক্তিফৌজ নামে কয়েকজন যুবককে দিনের বেলায় বাইরে বের করে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে সন্ধ্যার দিকে ঘরে নিয়ে আসতো। এই ভাবে তাদের সারা শরীর ফুলে ও পরে পচে গিয়ে পোকা হয়ে গিয়েছিলো। তাদের জিজ্ঞাসা করতো ভারতের কোথায় কোথায় ট্রেনিং চলছে। তারা এত অত্যাচারের মুখেও গোপন তথ্য প্রকাশ করতো না। এক মাস পরে তাদের একদিন রাতে নিয়ে যায়। পরে তাদের আর কোন দিন দেখা যায়নি। সন্ধ্যার দিকে যখন বন্দীদের গুনতো তখন চামচ দিয়ে প্রত্যেকের বুকে একটা করে ভীষণ জোরে আঘাত করতো। মনে হতো যেন বুকের হাড় যেন বুঝি ভেঙ্গে গেল। এইখানে বন্দী অবস্থায় একটা ২০০ গজ ট্রেঞ্চে সবার সামনেই প্রত্যেককে পাশাপাশি বসে পায়খানা করতে হতো।

৪ঠা সেপ্টেম্বর তারিখে স্কুল হতে যশোর সেন্ট্রাল জেলে নিয়ে যায়। সেখানে কতৃপক্ষ বাঙ্গালী থাকায় জেল খানাতে কোন মারপিট হয়নি।

আমাদের সাথে একজন পাঠান ছিলেন বন্দী। কারণ সেই পাঠান এক গ্রামে আগুন লাগাতে অস্বীকার করায় মেজরের সাথে গোলমাল হয় এবং মেজরকে একটা চড় লাগায়। ফলে তার নয় মাস জেল হয়েছিলো।
স্বাক্ষর/-
সৈয়দ আলী ইমাম এস, ডি, ও
২৪/০৩/১৯৭৩

রকিবুল হাসান জিহান
<৮,২.৩.১৬৯,২০৫>
১৬৯
শ্রী গণপতি সরকার
কোতোয়ালী, যশোর

১৯৭১ সালের ২৭ শে মার্চ আমি আধুনিক সেলুনে কাজ করছিলাম। বেলা ১১ টার সময় ৪ জন পাক সেনা আধুনিক সেলুনে চলে আসে এবং আমাকে, শ্রী অজীৎ ভবেন ও জগদীশকে কোন কথা জিজ্ঞাসা না করে ধরে ফেলে এবং সবাইকে কালেক্টরেটে নিয়ে যায়। সেখানে নিয়ে গিয়ে আমাকে ছাড়া বাকি তিনজনকে রাইফেল, বেতের লাঠি ও বুট দিয়ে গুঁতা, প্রহার আর লাথির পর লাথি মারতে থাকে।

তাদের এইভাবে বেলা তিনটা পর্যন্ত মারার পর জিন্নাহ রাস্তার উপর তাদের ফেলে রেখে আমাকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে যায়। তারপর আমার বাড়ি গিয়ে আমার বড় ভাইকে খোঁজ করে কিন্তু তাকে বাড়ি না পেয়ে ঘরের মধ্যে শেখ সাহেবের যে ফটো ছিল তা ভেঙ্গে ফেলে এবং পরে ওতে আগুন ধরিয়ে দেয়। আমার বড়ভাই শ্রী পশুপতি সরকার আওয়ামী লীগ করতেন। তারপর আমাকে বাড়ি হতে শহরে নিয়ে আসার সময় একজন বেলুচ মিলিটারী আমাকে মুড়ি ও গুড় কিনে দেয় খাবার জন্য। আমি মুড়ি মুখে দিতেই একজন পাঞ্জাবী মিলিটারী লাথি দিয়ে তা আমার মুখ হতে ফেলে দেয় এবং অকথ্য ভাষায় আমাকে গালাগালি দেয়। তারপর আমাকে কালেক্টরেটে নিয়ে আসে। সেখান হতে তাদের গাড়িতে করে আমাকে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়। সেখানে গাড়ি হতে নামিয়ে মার্শাল ল কোর্টে নিয়ে হাজির করে। তারপর কর্ণেল আমাকে জিজ্ঞেস করে তোমার নিকট নাকি ওয়ারলেস পাওয়া গেছে? আমি অস্বীকার করি। তারপর আমাকে একটা ঘরে নিয়ে যায় এবং সেখানে হাওলাদার আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে তোর ভাই কোথায় আমাদেরকে বলে দিবি আর না হয় স্বীকার করবি যে আমার নিকট ওয়ারলেস পাওয়া গেছে। কিন্তু আমি কোন কথাতেই রাজি না হবার দরুন আমার পাছায় ও পিঠে ২৫ টা বেত মারে এবং আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। প্রায় ঘন্টাখানেকের মধ্যে আবার জ্ঞান ফিরে পাই। তারপর প্রায় ৪০ জনকে মারতে মারতে কোয়ার্টার গার্ডে নিয়ে যায়। সেখানে নিয়ে গিয়ে আবার বেতের ছড়ি দিয়ে মারতে মারতে গাড়ি হতে নামায়। গাড়ি হতে নামিয়ে রৌদ্রের মধ্যে চিত করে শুইয়ে রাখে। তারপর বুকের উপর উঠে বুট দিয়ে খচতে থাকে। এইভাবে বেলা ১১ টা হতে বিকাল ৩ টা পর্যন্ত রৌদ্রের মধ্যে শুইয়ে রাখার পর আবার রাইফেলের গোড়া দিয়ে মারতে থাকে। মারার পর আবার গাড়িতে করে কোয়ার্টার গার্ডে নিয়ে এসে রেখে দেয়। এইভাবে প্রত্যেকদিন অত্যাচার করার দরুণ দ্বিতীয় দিন বুটের খচনের সঙ্গে সঙ্গে তিন জন আমির, লতিফ ও গৌর নামক তিন ব্যাক্তি মারা যায়। তিন দিন পর পর এক বেলা খাবার দিত। আর পানি চাইলে প্রশ্রাব করে নিয়ে এসে দিত। পায়খানা করতে চাইলে মার আরম্ভ করে দিত।

এইভাবে ৬ ই এপ্রিল পর্যন্ত আমাদের উপর একই উপায়ে অত্যাচার করার পর ৭ ই এপ্রিল মেজর আমাদেরকে ডাকে। আমরা ৩৫ জন মেজরের নিকট হাজির হই। মেজর সবার স্টেটমেন্ট নেবার পর আমাকে জিজ্ঞাসা করে, তা হলে তোমাকে কোন অপরাধে ধরে নিয়ে আসে। আমি প্রতি উত্তরে বলি স্যার আমি ওয়ারলেস চিনি না। আমার বড় ভাই আওয়ামী লীগ করেন। তাকে বাসায় না পেয়ে আমাকে ধরে আনে। তারপর মেজর ৪ জনকে রেখে ৩১ জনকে ছেড়ে দেয়। যে চারজনকে রেখে দেয় তারা হলো অরুণ, অমলা সোম, কেষ্ট এবং আর একজন নাম না জানা। ওদের চার জনকে কারেন্ট চার্জের জন্য নিয়ে যায়। তারা ফিরে আসে না। তারপর আমি ৭ ই এপ্রিল উক্ত ৩১ জনের সঙ্গে ক্যন্টনমেন্ট হতে মুক্তি পেয়ে বাড়ি চলে আসি।
স্বাক্ষর/-
শ্রী গণপতি সরকার
১৬/০৩/১৯৭৩

সাইফুল ইসলাম

<৮,২.৩.১৭০,২০৬> “একদিন দেখি যে একজন বাঙ্গলী যুবকের দেহ হতে রক্ত বের করে নিয়ে তাকে হত্যা করে। ছেলেটির শেষ কথা ছিলো “মা, স্বাধীনতা দেখে যেতে পারলাম না”।“

।। ১৭০ ।।
নূর জাহান
সুইপার, সি,এম,এইচ মহিলা বিভাগ
যশোর ক্যান্টনমেন্ট

৩০ শে মার্চ যখন গোলাগুলি শুরু হয় যশোর ক্যান্টনমেন্টে সেই সময় আমি হাসপাতালে ডিউটিরত ছিলাম। রাত আনুমানিক ১০টার দিকে ৬/৭ জনের এক পাঞ্জাবী দল হসপিটালে আসে এবং বলে তোমরা বন্দী।

৩০ তারিখের পর হতে প্রতি রাতে ৭/৮ বার করে হসপিটাল চেক করতো। তারা বলতো যে কোন পুরুষ মানুষ তোমরা লুকিয়ে রেখেছো। এটা একটা বাহানা ছিলো। ১১ই এপ্রিল তারিখে সামরিক হাসপাতালের ষ্টাফ বাদে যে সমস্ত মহিলারা প্রাণ ও ইজ্জতের ভয়ে হসপিটালে আশ্রয় গ্রহন করেন তাদের সবাইকে রাত অনুমান ১ টার দিকে নিজ নিজ ঘরে ফিরিয়ে দেবে বলে নিয়ে যায়। উক্ত মহিলারা সবাই ছিলেন ই,পি,আর ও বেঙ্গল রেজিমেন্টের ও বেসামরিক লোকদের স্ত্রী, কন্যা ও শিশু। প্রথমে তাঁদের আর্টিলারীরা ঘরে নিয়ে আটকে রাখে।

উক্ত ছয় সাত ঘরে ভদ্রমহিলারা ছিলেন। উক্ত এলাকাতে যারা পাহারা দিত সেই পাকসেনারা দু’জন ঘরের দরজা জোর করে ভেঙ্গে ঢুকে পড়ে এবং দুজন ভদ্রমহিলার উপর অত্যাচার করে। একজন ভদ্রমহিলার পেটে যে বাচ্চা ছিলো তা এই অমানুষিক অত্যাচারের ফলে নষ্ট হয়ে যায়।

এই ঘটনার পর উক্ত এলাকা হতে ৪ জন অভুক্ত রেখে বন্দী মহিলাদের সেন্ট্রাল জেলে পাঠিয়ে দেয়।

লেডী ডাক্তার এবং দুজন সিসটার এবং আয়া ছিলো তিনজন। সবাইকে হসপিটালে বন্দী করে রাখে। দুইমাস হসপিটালে সিসটার জুজুভিনের ঘরে থাকেন বাকী ষ্টাফরা। একটা ঘরে সবাইকে বন্দী করে রাখে। প্রায় প্রতিরাতে পাকসেনারা উক্ত ঘরে এসে তল্লাসী চালাতো। দুই মাস পর সবাই লেডী ডাক্তারের বাড়ীতে আশ্রয় গ্রহণ করেন।

একদিন দেখি যে একজন বাঙ্গলী যুবকের দেহ হতে রক্ত বের করে নিয়ে তাকে হত্যা করে। ছেলেটির শেষ কথা ছিলো “মা, স্বাধীনতা দেখে যেতে পারলাম না”।

ক্যান্টনমেন্টের ভিতরে ১০ নং পুকুরের ধারে দুইজন অজ্ঞাত পরিচিত মহিলাকে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়েছে। তাদের লাশ ওখানে পড়ে ছিলো। দুজন শিশুও ছিলো।

টিপসহি
নূর জাহান (সুইপার)
২২/৩/৭৩

সাইফুল ইসলাম
<৮,২.৩.১৭১,২০৭-২০৮>

।। ১৭১ ।।

মোঃ মোহসিন উল্লাহ
গ্রাম-চৌগাছা
থানা-ঝিকরগাছা, জেলা-যশোর

১৯৭১ সালের ১৫ ই অক্টোবর ২০/২৫ জন পাক মিলিটারী রাত প্রায় ১১ টায় আমাদের বাড়িতে চলে যায়। আমাদের বাড়ী ঘেরাও করে আমাকে নাম ধরে ডাকলে আমি ঘর হতে বেরিয়ে আসি। সঙ্গে সঙ্গে দুজন পাকসেনা আমার দুহাত ধরে ফেলে এবং গামছা দিয়ে পিঠমুড়া করে দুহাত বেঁধে ফেলে দেয়। তারপর ঘরের মধ্যে ঢুকে যায় এবং একজন চাকর ঘরের মধ্যে শুয়ে ছিলো তাকেও ধরে ফেলে এবং আমার নিকটে নিয়ে আসে। একজন সুবেদার আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে। তোমার ভাই মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার? তোমার গ্রামে কয়জন মুক্তিবাহিনী আছে? তুমি মুক্তিবাহিনীকে আমাদের খবরাখবর পৌছে দাও? তাদের সবগুলো কথার জবাব আমি অস্বীকার করি। তারপর আমাকে হুমায়ূন কবির নামে একজন পাঞ্জাবী ফোন অপারেটার ৪/৫ টা ঘুষি মেরে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে আমি প্রায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। তারপর আমাকে মোটা একটা কাঠের লাঠি দিয়ে সমস্ত শরীরে আঘাত করে আর জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে সত্যি করে বলো তোমার ভাই মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার নয়। তারপর আরও ৮/৯ জন মিলিটারী আমার নিকটে চলে আসে এবং তারা প্রত্যেকে কোন কথা জিজ্ঞাসা না করে বুট দিয়ে লাথির পর লাথি মারতে থাকে। তাদের মধ্যে একজন ছোট ১২/১৪ বছরের বিহারী ছেলে ছিল। সে আমাকে ২/৩ হাত দূর থেকে জাম্প করে এসে আমার বুকে আঘাত করে। তারপর আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি। প্রায় একঘণ্টা পর আবার জ্ঞান ফিরে পেলে আমাকে স্কুলের দোতালায় নিয়ে যায়। সেখানে নিয়ে গিয়ে একটা আকড়ার সাথে দুহাত ঝুলিয়ে বেতের লাঠি দিয়ে শরীরে বেদম প্রহার করার দরুন সমস্ত শরীর ফেটে রক্ত বের হতে থাকে। প্রায় ১৫/২০ মিনিট আমাকে মারার পর আমি যে কখন জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছি তা আমি বলতে পারি না। তারপর জ্ঞান ফিরে পেলে আমি দেখতে পাই আমি একটা ঘরের মধ্যে পড়ে আছি।

তারপর ৭ দিন আমাকে বিভিন্ন উপায়ে প্রহার করার পর আমি হাঁটতে চলতেও একস্থান হতে অন্যস্থারে সরে যেতে না পারার জন্য আমাকে প্রহার করা বাদ দেয়। আমি আধা মরা অবস্থায় ঘরের একটা কোণে পড়ে থাকি। আমাকে ধরার দুদিন পর আমার চাকরটাকে ছেড়ে দেয়।

তারপর মেজর ২৬শে অক্টোবর আমাকে ডাকে। ৪/৫ জন মিলিটারী ধরাধরি করে আমাকে মেজরের সামনে এসে হাজির করে। মেজর আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে তুমি সত্য করে বলো মুক্তিবাহিনী তোমাদের বাড়ীতে আসে কিনা? তোমার ভাই মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার কি না? তোমাদের গ্রামে কতজন ছেলে মুক্তিবাহিনী হয়েছে? সবগুলো প্রশ্নের উত্তর আমি অস্বীকার করি। তারপর মেজর একজন সুবেদার ডাকে। উক্ত সুবেদার মেজরের নিকট আসলে মেজর তাদের আদেশ করে এই লোক কোন দোষী নয়। একে গাড়িয়ে করে তার বাড়ীতে রেখে এসো। তারপর আমাকে গাড়িতে করে আমার বাড়ী পৌছে দিয়ে আসে। অর্থাৎ ২৬ শে অক্টোবর আমি ছাড়া পাই। তারপর আমি বাড়ী গিয়ে তিনমাস স্থানীয় চৌগাছ বাজারের একজন ডাক্তারের নিকট চিকিৎসায় ভাল হয়ে উঠি। এখন আমি চলে ফিরে খেতে পারি। কিন্তু কাজকর্ম করে খাবার মত কোন সামর্থ্য আমার নেই। এখনও মেঘ বৃষ্টি হলে আমার শরীরের বিভিন্ন স্থানে ব্যথা বেদনা করে, আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি।

চৌগাছা সরকারী ডাক বাংলোর পিছরে ২০/২৫ টা কবরে প্রায় ৭০/৮০ জনকে প্রত্যেক দিন প্রায় ৮/১০ জন করে লোককে ব্যায়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে আধা মরা করে ২/৩ জনকে একই ছালার মধ্যে ভরে ছালার মুখ বেঁধে উক্ত কপোতাক্ষ নদীতে ফেলে দিয়েছে। উক্ত নদীর উপর একটা ব্রীজ আছে, সেখানেও নিয়ে গিয়ে ব্যায়োনেট চার্জ করে নদীতে ফেলে দিয়েছে। অনেককে উক্ত নদীর উপর যে ব্রীজ পার হয়ে নদীর পশ্চিম পাড়ে প্রায় ৩০/৪০ টা করে ৮০/৯০ জন লোককে মেরে পুঁতে রেখেছে। যে সমস্ত লোক পাকসেনারা চৌগাছায় মেরেছে এবং তাদের ক্যাম্পের আশাপাশে পুতে রেখেছে এর মধ্যে অধিকাংশই শরণার্থী। কারণ তারা কাশিমপুর মাশিলা হিজলী বর্ডার দিয়ে ভারতে যাবার সময় পাকসেনারা তাদেরকে ধরে এবং চৌগাছায় তাদের ক্যাম্পে নিয়ে আসে। তারপর নৃশংসভাবে হত্যা করে পুঁতে রাখে। এইবাবে দীর্ঘ নয় মানে চৌগাছাতে পাকসেনারা ১০০/১৫০ জন লোককে হত্যা করে। তাদের মধ্যে মেয়ে ও পুরুষ উভয়ই ছিল। মেয়েদেরকে ২/৩ দিন রেখে তাদের উপর পাশবিক অত্যাচার করার পর ব্যায়োনেট চার্জ করে নদীতে ফেলে দিত। আমি যে এগার দিন ছিলাম ঐ কয়দিনে প্রায় ২০/২৫ জন লোককে ডাক বাংলোর পিছরে রাত আটটার পর প্রতিদিন ৪/৫ জন করে হত্যা করে পুঁতে রাখে।

স্বাক্ষর/-
মোঃ মহসিন উল্লাহ
১০/০৫/৭৩

সাইফুল ইসলাম
<৮,২.৩.১৭২,২০৯>

।। ১৭২।।

লুৎফর রহমান মোল্লা
মিরপুর থানা, জেলা-কুষ্টিয়া

আলমডাঙ্গা থানায় কাজ করছি এমন সময় একখানা পাক মিলিটারী গাড়ি গিয়ে থানা ঘিরে নেয় এবং আমরা থানার ষ্টাফ ৪ জনসহ মোট ১২ জন ধরা পড়ি। আমাদের প্রত্যেককে গাছের সঙ্গে দুই হাত বেঁধে বেতের লাঠি দিয়ে ভীষণ প্রহার করার পর বুট দিয়ে লাথির পর লাথি মারাতে আমার দুটা দাঁত ভেঙ্গে যায় এবং আমার সারা শরীর ফেটে রক্ত ঝরতে থাকে। তারপর একজন মিলিটারী আমার বুকের উপর উঠে বুট দিয়ে পাড়ানোর চোখে আমার বুকের হাড় ভেঙ্গে যায়। পরে আর একটা মিলিটারী আমার পায়ে ব্যায়োনেট চার্জ করে। তারপর ক্যাপ্টেন মুজাফফার হোসেন নাগভী আদেশ দেয়, ১২ জনকে ৬টা জোড়া করে দুইজন করে সামনা সামনি হাত বেঁধে হাট বোয়ালীয়া একটা নদীর ধারে নিয়ে যায় এবং সেখানে নিয়ে গিয়ে চোখ বেঁধে হাঁটু পানির ভিতর নামিয়ে গুলি করে দেয়। এইভাবে পাঁচ জোড়া লুলি করার পর সর্বশেষ জোড়ায় ছিলাম আমি ও আলমডাঙ্গা থানার ও,সি সাহেব। যখন আমাদেরকে গুলি করতে নিয়ে যায় সেই সময় ছানাউল্লাহ নামক একজন কনস্টেবল এবং ইব্রাহিম নামক একজন কসাই ও,সি সাহেবের নিকট এসে বলে যদি ১৫,০০০ টাকা দেন আপনার জান বাঁচিয়ে দেব। সঙ্গে সঙ্গে ও,সি সাহেব সম্মতি জানানোর পর ক্যাপ্টেনের নির্দেশে তাঁর হাতের বাঁধন ছেড়ে দেয় একং তাঁকে ক্যাপ্টেনের গাড়িতে নিয়ে উঠায়। তারপর আমাকে গুলি করার জন্য চোখ বেঁধে হাঁটু পানির মধ্যে নিয়ে দাঁড় করায়। তখন আমি ক্যাপ্টেন সাহেবকে বলি স্যার আমার একটা ফরিয়াদ আছে। আমি কোন দোষ করি নাই, বিহারীরা আমার নামে মিথ্যা বলে আপনার নিকট আমার সমন্ধে বলেছে। তখন ক্যাপ্টেন আমার চোখের বাঁধন খুলে দেয় এবং বলে আগামীকাল এর বিচার করা হবে, আজ একে থানায় একটা ঘরের মধ্যে নিয়ে রেখে দাও। দুইজন মিলিটারী আমাকে নিয়ে এসে একটা ঘরের মধ্যে রেখে দেয়। ঘরটার দরজা ভাঙ্গা ছিল। তারপর পাকসেনারা ৪/৫ জন মেয়েকে থানায় নিয়ে আসে এবং তাদেরকে নিয়ে তারা আনন্দ উল্লাসে মত্ত থাকে। এদিকে রাত্রিতে মুষলধারে ঝড় আর বৃষ্টি আরম্ভ হয়েছে। তখন আমি চিন্তা করি। আমাকে তো আগামীকাল গুলি করে মারবে, তাই শেষ চেষ্টা করলাম অর্থাৎ দরজাটা একটু জোরে প্রেশার দিলে দরজা খুলে যায়। আমি অমনি চোরের মতন ধীরে ধীরে ঘর হতে বেরিয়ে একটা খালের ধার দিয়ে খোলা মাঠের মধ্য দিয়ে সারারাত্রি চলার পর ভোর হয়ে গেলে একটা বৃদ্ধ লোককে দেখতে পাই। তাকে দেখে আমি জড়িয়ে ধরি এবং বলি বাবা আমাকে কিছু খেতে দেন। লোকটি আমাকে তার বাড়ী নিয়ে যায় এবং আমাকে খেতে দেয়। তারপর আমি ভারতে আশ্রয় নেই।

এরপর যশোর ক্যান্টোনমেন্ট আমাদের দখলে এসে গেলে আমি একদিন রাত্রি বেলা বাড়ীতে যাই। গিয়ে আমার ছেলেকে ডাকি আমার স্ত্রী দরজা খুলে দেয়। তখন আমি দেখতে পাই আমার স্ত্রী বিধবার কাপড় পরে আছে এবং তার গায়ের অলঙ্কার বলতে কিছুই নেই। আমাকে দেখে সে কেঁদে ফেলে এবং বলে আমি যেদিন শুনতে পাই তোমাকে পাক বাহিনী মেরে ফেলেছে সেই দিন হতে আমি বিধবার কাপড় পরিধান করেছি। তারপর আমি আমার সমস্ত ঘনটা খুলে বলি।

স্বাক্ষর /-
লুৎফর রহমান মোল্লা

সাইফুল ইসলাম
<৮,২.৩.১৭৩,২১০>

।। ১৭৩।।

শ্রী সংকর প্রসাদ ঘোষ
গ্রাম-আউড়িয়া, পোষ্ট-হাট বাড়ীয়া
থানা-নড়াইল, জেলা-যশোর

যশোরের চৌগাছায় পাকসেনাদের হাতে আমরা ধরা পড়ি। পাকসেনারা চৌগাছার হাইস্কুলে আমাদেরকে নিয়ে যায়। সেখানে নিয়ে আমাদের ঘড়ি টাকা পয়সা সব কিছু নিয়ে নেয়। তারপর প্রথমে আমাকে, জামা ও প্যান্ট খুলে, দু’জন পাকসেনা বাঁশের লাঠি দিয়ে সারা শরীরের প্রহার করতে থাকে। এই ভাবে প্রায় এক ঘণ্টা প্রহার করার পর আমার দুপা বেঁধে একটা আকড়ার সাথে পা উপর দিয়ে ঝুলিয়ে লাঠি দিতে সমস্ত শরীরের প্রহার করতে থাকে মেজর তখন চেয়ার পেতে বসে আছে। আর একদল আমাকে প্রহার করতে থাকে, আর একদল আমাকে প্রহার করা দেখে হাসতে থাকে, আর বলতে থাকে বল মাদার চোদ, টিক্কা খাঁন জিন্দাবাদ। আমারর সমস্ত শরীরে বেয়োনেট দিয়ে মারতে থাকে আর চাকু দিয়ে প্রতিটি নখ ফেড়ে দেয়। আমার সমস্ত শরীর হতে রক্ত ঝরতে থাকে তারপর যে কী হয় আমি বলতে পারি না। প্রায় তিন ঘণ্টা পর আমি জ্ঞান ফিরে পেয়ে দেখতে পাই আমার পাশে আমার দুই বন্ধু ইলিয়াছ ও সুনিল কুমার বসু পড়ে আছে। তাদের শরীর হতে আমার শরীরের ন্যায় রক্ত ঝরছে। প্রহারের দরুন তাদের ও আমার শরীর ফুলে যায়। আমরা পানি খেতে চাইলে প্রশ্রাব এনে সামনে দিত। তার গন্ধ পেয়ে আমরা মুখ বন্ধ করতে থাকলে ইট দিয়ে এসে মুখে মারতো। সন্ধ্যার পর আমাদেরকে স্কুলের পিলারের নিকট নিয়ে যায় এবং সেখানে নিয়ে গিয়ে তিনজনকে তিনটা পিলারে পিঠমুড়া করে জড়িয়ে চেপে বাঁধে। আর মাজার সাথে পিলারে বেস্টন দিয়ে বেঁধে ফেলে আবার প্রহার করতে থাকে। আমরা পিপাসায় পানি পানি করে চিৎকার করতে থাকি। তখন বৃষ্টি নামে। উক্ত বৃষ্টির পানি আমাদের মাথায় পড়ে থাকে। উহা আমাদের শরীরর বেয়ে পড়তে থাকে উক্ত পানি খেয়ে আমরা পিপাসা মিটাই। তারপর দিন, হাত পায়ের রশি খুলে দেয় এবং আবার পিটাতে থাকে। তারা জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে, তোমরা মুক্তিবাহিনী কিনা? এবং ট্রেনিং জানো কি না? তখন আমরা বলি, না, আমরা ট্রেনিং জানিনা ও আমরা মুক্তিবাহিনীও নই। তারপর মারা বাদ দিয়ে পাকসেনারা ৩/৪ জন আমাদেরকে ধরাধরি করে তাদের গাড়িতে তুলে যশোর ক্যান্টনমেন্টে পাঠিয়ে দেয়। সেখানে নিয়ে আমাদেরকে একটা ঘরে বন্দি করে রাখে। তার ১০/১৫ মিনিট পর একজন হাবিলদার ও ৭/৮ জন মিলিটারী আমাদের নিকট আসে এবং আমাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে, সত্যি করে বল, ভারতে মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিং-এ যেতে ছিলে কিনা এবং অকথ্য ভাষায় গালি দিতে থাকে। তারপর আমরা তাদের কারো কোন জবাব দেই নি। তারপর আমাদের হাত আবার পিঠমুরা করে পিলারের সাথে বেধেঁ ১০/১৫ মিনিট সময় দিয়ে বলে যে এরমধ্যে যদি সত্য কথা না বলো তা হলে গুলি করে হত্যা করবো এই বলে আমাদের দিকে বন্দকু ধরে রাখে। আমরা জবাব দেই যে আমরা সত্যি বলছি আমাদের লোক হারিয়ে গিয়েছি তাদের খোঁজে আমরা এখানে এসেছি। আমরা ভারতে যাবার উদ্দেশ্যে এখানে আসি নাই। তারপর আমাদের তিনজনকে একটা ঘরের মধ্যে ১৫ দিন রেখে দেয়। ঐ কয় দিনের প্রত্যেক দিনই খাবারের সময় এবং পায়খানা প্রশ্রাবের সময় কিল, ঘুষি, লাথি ইত্যাদি খেতে হতো। তারপর সেখান হতে যশোর কোতয়ালী থানায় পাঠিয়ে দেয়। ওখানে এক রাত্রি থাকার পরদিন কোর্টে ৫৪ ধারায় একটি মামলা দায়ের করে যশোর সেন্ট্রাল জেলে হাসপাতালে রেখে দেয়।

সেখানে বাঙ্গালী চিকিৎসক ছিলেন তারা আমাদেরকে চিকিৎসা করে সুস্থ করে তোলেন। সেখানে ১২ দিন থাকার পর কোর্ট থেকে জামিন নিয়ে মুক্তিলাভ করি। তারপর বাড়ী এসে চিকিৎসা করে সুস্থ হয়ে উঠি। জুন মাসের ২০ তারিখে আমরা ধরা পড়ি এবং সেপ্টেম্বর মাসের ২ তারিখে যশোরের প্রথম শ্রেনীর ম্যাজিষ্ট্রেট শেখ আবদুল্লা সাহেবের কোর্ট থেকে মুক্তি পাই।

স্বাক্ষর/-
শ্রী সংকর প্রসাদ ঘোষ
৬-৬-৭৩

ইব্রাহিম রাজু
<৮,২.৩,১৭৪,২১১>
।।১৭৪।।
মোঃ মানিক শিকদার
গ্রাম- চিলগাছা রঘুনাথপুর
ডাকঘর- কমলাপুর
থানা- নড়াইল
জেলা-যশোর

১৯৭১ সালের ৭ ই জুন রাত্রি প্রায় ভোর চারটার সময় ২০/২৫ জন রাজাকার ও মিলিটারী আমার বাসায় যায়। এবং বাসা ঘেরাও করে বাসার মধ্যে ঢুকে পড়ে আমাকে ধরে ফেলে। আমাকে ধরার সাথে সাথে বাঁশের লাঠি ও রাইফেলের বাট দিয়ে আমার পায়ের তালুতে, ঘারে, হাতের আঙ্গুলীতে এবং শরীরের বিভিন্ন গিড়ায় গিড়ায় প্রহার করতে থাকে আর জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে যথাঃ
ই,পি,আর কোথায়?
তোর রাইফেল কোথায়?
তোর ভাই কোথায়?
তার জবাবে আমি বলি যে, আমি কিছুই জানি না। তারপর আমার বাড়ীতে আমাকে ঘন্টাখানেক প্রহার করার পর নড়াইল নিয়ে আসে এবং সেখানে নিয়ে এসে আবার প্রহার করতে থাকে এবং ঐ একই কথা বার বার বলতে থাকে, আমি অস্বীকার করায় প্রায় দু’ঘন্টা আমার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় প্রহার করার দরুন আমার শরীর হতে রক্ত ঝরতে থাকে। আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। তার আধা ঘন্টা পর জ্ঞান ফিরে আমি দেখতে পাই আমি ডাকবাংলার একটা কক্ষে এবং সেখানে আরও ১২/১৪ জন লোক আধামরা অবস্থায় মেঝেতে পড়ে আছে। তারপর ৭ দিন উক্ত ডাকবাংলায় রাখার পর আমাকে যশোর মিলিটারীদের কাছে পাঠিয়ে দেয়।

যশোর পৌছার পর আমাকে সার্কিট হাউসে নিয়েই ৪/৫ জন মিলিটারী বুট আর বেতের লাঠি দিয়ে এক এক করে লাথি কিল, ঘুষি, আর প্রহার করতে থাকে। একজন মিলিটারী ৪/৫ হাত দূর হতে জাম করে এসে আমার মুখে লাথি মারে উক্ত লাথিতে আমার তিনটা দাঁত পড়ে যায়। আমি অজ্ঞান হয়ে যাই, তার ঘন্টাখানেক পর আমার জ্ঞান ফিরে পেলে আবার প্রহার করতে থাকে আর জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে যথাঃ
ই,পি,আর কোথায়?
রাইফেল কোথায়?
তোর ভাই কোথায়?
আমি জবাব দিই আমি কিছুই জানি না। তারপর আবার মারা শুরু করে এই ভাবে সার্কিট হাউসে দু’দিন দু’রাত ছিলাম। প্রায় সব সময়ই আমাকে প্রহার করত। উক্ত দু’দিনে আমাকে একটু পানিও পান করতে দেয় নাই। সেখান হতে আমাকে যশোর সেন্ট্রাল জেলে পাঠিয়ে দেয়। সেখানে একমাস সাতদিন থাকার পর আমি জামিন নিয়ে বের হয়ে আসি। কিন্তু প্রতিদিন আমাকে কোর্টে হাজির হতে হত। এই ভাবে ৪/৫ তারিখ কোর্টে হাজির হবার পর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যায়। আমাকে ধরার প্রধান কারন আমার বড় ভাই আওয়ামী লীগের একজন কর্মী। আর আমার ছেলে ছিল মুক্তিবাহিনীতে। এই দুইটা কারণে আমাকে ধরে এবং প্রহার করে । জেল থেকে বেরিয়ে এসে দু’মাস চিকিৎসা করার পর সুস্থ হয়ে উঠি। এখনও শরীরের বিভিন্ন স্থানে জ্বালা পোড়া করে।

স্বাক্ষর /-
মোঃ মানিক শিকদার
৮/৬/৭৩

ইব্রাহিম রাজু
<৮,২.৩.১৭৫,২১২-২১৩> “এই দা দিয়ে এই লোকগুলোকে জবাই করতে পারবে? লোকটি অস্বীকার করে। সঙ্গে সঙ্গে পিছন হতে একজন পাক সেনা রাইফেল নিয়ে দৌড়ে তার কাছে চলে আসে এবং তার ঘাড়ে এবং পিঠে দু’টা আঘাত করার সঙ্গে সঙ্গে সে মাটিতে পড়ে যায়।“
।।১৭৫।।
শ্রী বিনয় কৃষ্ণ দত্ত
মহেশপুর, যশোর

১৯৭১ সালের ১৩ শে মে রোজ রবিবার সকাল ১০ ঘটিকার সময় আমি গোসল করার জন্য বাড়ী হতে বের হই। এমন সময় দেখতে পাই দু’খানা খাঁন সেনার গাড়ি এসে আমাদের মহেশপুর টাউন কমিটি ঘরের সম্মুখে থেমে যায়। আমি ঐ গাড়ি দেখার সঙ্গে সঙ্গে গোসল না করে বাড়ী ফিরে যাই। তার ১০/১৫ মিনিট পর টাউন কমিটির চেয়ারম্যান সোজাসুজি আমার বাড়ী চলে আসে এবং আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার পর আমাকে বলে, চলো টাউন কমিটিতে, মেজর তোমাদের পরিচয় পত্র করে দিচ্ছে। তুমি উহা নিয়ে চলে আসবে। আমি সরল মনে তার সঙ্গে টাউন কমিটির সামনে চলে আসি এবং দেখতে পাই টাউন কমিটি হলের দরজা বন্ধ। তখন চেয়ারম্যান আমাকে বলে এখানে ৫ মিনিট অপেক্ষা কর, মেজর কিছুক্ষনের মধ্যে চলে আসছে। পাঁচ মিনিট যেতে না যেতেই দক্ষিন দিক হতে দুটা পাক সেনার গাড়ি এসে আমাদের সামনে থেমে যায়। আমি গাড়ির দিকে তাকাতেই দেখতে পাই ১০/১২ জন হিন্দু ও মুসলমান বসে আছে। তারপর চেয়ারম্যান মেজরকে আমাকে দেখিয়ে বলে, এ এক মালাউন হায়, অমনি একজন খাঁন সেনা গাড়ি হতে লাফ দিয়ে নেমে আমাকে গাড়িতে উঠতে বলে, আমি গাড়িতে উঠার সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি স্টার্ট করে মহেশপুর হতে আধা মাইল দূরে ভালায়পুর নামক একটা ব্রীজ আছে, তার পূর্ব দিকে আম কাঠালের বাগান আছে, সেখানে নিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে আমাদেরকে গাড়ি হতে নামায়। আমি গাড়ি হতে নেমেই দেখতে পাই, ঐ খানে একটা গাছের নিচে ৪/৫ টা ছাগল আর একটা কাঠাল গাছে একটা যুবক গাছ হতে ঐ ছাগলগুলোর জন্য পাতা পাড়ছে। মেজর তাকে দেখেই ডাকে। লোকটি অমনি মেজরের ডাকে তার কাছে চলে আসে। তার হাতে ছিল একটা দা । মেজর দা খানা তার হাত হতে নেয় এবং ২-৪ মিনিট চেয়ে দেখার পর তাকে জিজ্ঞেস করে ইয়ে কিয়া হায়? সে বলে দা। তারপর দা খানা তার হাতে দিয়ে বলে, এই দা দিয়ে এই লোকগুলোকে জবাই করতে পারবে? লোকটি অস্বীকার করে। সঙ্গে সঙ্গে পিছন হতে একজন পাক সেনা রাইফেল নিয়ে দৌড়ে তার কাছে চলে আসে এবং তার ঘাড়ে এবং পিঠে দু’টা আঘাত করার সঙ্গে সঙ্গে সে মাটিতে পড়ে যায়। তার ২-৪ মিনিট পর সে মাজা বাঁকা করে সেখান হতে চলে যায়। তারপর আমাদের সবাইকে লাইন করে দাঁড় করায়। ৮ জন পাকসেনার মধ্যে তিনজন রাইফেল নিয়ে তিন দিকে আমাদের থেকে প্রায় ২০/২৫ গজ দূরে চলে যায় এবং আমাদের দিকে পজিশন নিয়ে থাকে। আর বাকি ৫ জন পাকসেনা প্রত্যেক একটা মোটা লাঠি হাতে করে আমাদের সবাইকে ঘাড়ে এক বাড়ি আর মাজায় দু’বাড়ি মারার পরে শেষে আমাদের সবাইকে পায়ে দড়ি লাগিয়ে হেঁচড়ে টেনে একটা গর্তের ধারে নিয়ে সবাইকে বেয়োনেট চার্জ করে আমাদের সারা শরীর ক্ষতবিক্ষত করে। পরে আমাদেরকে একই গর্তের মধ্যে ফেলে দিয়ে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মাটি চাপা দিয়ে তারা চলে যায়। পাক সেনারা চলে যাবার পর প্রায় মিনিট দশেক পর আমি অতিকষ্টে ধীরে ধীরে ঐ গর্তের উপরে উঠি এবং আমার সঙ্গে আরো একজন লোক ধীরে ধীরে উপরে উঠে ক্ষতবিক্ষত দেহ নিয়েই প্রায় ২০/২৫ গজ রাস্তা চলার পর মাটিতে পড়ে যায়। তার কিছু সময় পর সে সেখানে মারা যায়। আমার পেটে একটা বেয়োনেটের খোঁচা গেলে নাড়ি বের হয়ে গিয়েছিল।আমি আমার গামছা দিয়ে পেট বেঁধে ৪০/৫০ গজ চলার পর একটা বাড়ী পাই এবং সেই বাড়ির মালিক আমাকে দেখে এগিয়ে আসে। আমাকে পানি খাওয়াবার পর আমি সেখানে থাকতে চাইলে বাড়িওয়ালা খান সেনাদের ভয়ে আমাকে রাখতে অস্বীকার করে। তারপর তারা আমাকে ধরাধরি করে ভৌবর নদীর পাড়ে হামাগুড়ি দিয়ে চলে যাই এবং সেখানে গিয়ে দেখতে পাই একজন লোক নৌকা নিয়ে জাল দিয়ে নদীতে মাছ ধরছে। লোকটা আমাকে হামাগুড়ি দিয়ে আসতে দেখে নৌকা নিয়ে নদীর তীরে আসে এবং আমার অনুরোধে আমাকে নদী পাড় করে দেয়। আমি অতিকষ্টে রামচন্দ্রপুর নামক এক গ্রামে সন্ধ্যা ৭ টার সময় এক বাড়িতে গিয়ে থাকার জন্য একটু জায়গা চাই কিন্তু ঐ বাড়িওয়ালা খান সেনাদের ভয়ে জায়গা দিতে অস্বীকার করে। আমি বলি আমার আর চলার শক্তি নাই তখন ঐ বাড়ির ৪ জন লোক একটা তক্তায় করে আমাকে নিয়ে রামচন্দ্রপুর স্কুলে রেখে আসার কথা বলে সুন্দরপুর নদীর ঘাটে ফেলে রেখে আসে। আমি সেখানে আধামরা অবস্থায় পড়ে থাকি। তখন রাত্রি ১০-৩০ মিঃ। সেই সময় কোটচাঁদপুর হাট হতে জালাল নামক একটা লোক সুন্দরপুর নদীর ঘাটে আমাকে দেখে তারাতারি করে মহেশপুর চলে এসে খবর দেয়। তৎক্ষণাৎ মহেশপুর হতে জালাল ও আরও চারজন লোক একটা বাঁশের মাচাল নিয়ে সেখানে চলে যায় এবং ঐ মাচালে করে আমাকে মহেশপুর নিয়ে আসে। আমাকে মহেশপুর নিয়ে এসে কোহিনূর বেগমের বাসায় রেখে এবং বজলু নামক একজন ডাক্তারের চিকিৎসায় ১০/১৫ দিন পর আমি সুস্থ হয়ে উঠলে ডাক্তার একটা গরুর গাড়ী ভাড়া করে আমার পরিবারের সকলকে ভারতে পাঠিয়ে দেয়। তারপর আমি ভারতে গিয়ে সিন্দ্রানী হাসপাতালে প্রায় দু’মাস চিকিৎসা করার পর সুস্থ হয়ে উঠি এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরপরই বাংলাদেশে চলে আসি। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর আমি জানতে পারি আমি জানতে পারি আমার সঙ্গে যাদেরকে ধরে নেওয়া হয়েছে এবং আমার সঙ্গে যাদেরকে একই গর্তে পুঁতে রাখা হয়েছিল আমি ছাড়া আর সবাই নাকি মারা গেছে।

স্বাক্ষর/-
শ্রী বিনয় কৃষ্ণ দত্ত
২৭/১/ ৭৩

ইব্রাহিম রাজু
<৮,২.৩.১৭৬,২১৪>
।।১৭৬।।
যশোর জেলার মহেশপুর থানার অধীন
মহেশপুর হাসপাতালে পাক সেনাদের কার্যাবলী

মহেশপুর থানা থেকে মহেশপুর হাসপাতালের দূরত্ব প্রায় কোয়ার্টার মাইল হবে। খালিশপুর হতে একটা সরকারী কাঁচা রাস্তা মহেশপুর থানার পশ্চিম পার্শ্ব নিয়ে মহেশপুর গ্রামের মধ্য দিয়ে বর্ডার পর্যন্ত গিয়েছে। মহেশপুর হাসপাতালটা পূর্ব পশ্চিম লম্বা। হাসপাতালের সামনে একটা মাঠ, পূর্বে ১০/১২ খানা মুচি বাড়ী, পশ্চিমে মহেশপুর বাজার আর উত্তরে হাসপাতালের সঙ্গেই লাগানো সরকারী রাস্তা। ঐ রাস্তার নীচেই একটা মরা নদী এবং নদীর উপরে হাসপাতাল থেকে প্রায় ১০০ গজ দুরে উত্তর দক্ষিন দিক লম্বা একটা ব্রীজ।

১৯৭১ সালের ১৫ ই এপ্রিল খান সেনারা যশোর থেকে কালীগঞ্জ, কোটচাঁদপুর, খালিশপুর হয়ে মহেশপুর চলে আসে। মহেশপুর এসেই তারা মহেশপুর হাসপাতালে ঘাঁটি স্থাপন করে। তাদের মধ্য থেকে প্রায় ১৫০ জন মহেশপুর থানায় সব সময়ের জন্য রেখে দেয়। পাঞ্জাবী খান সেনারা মহেশপুর পৌছেই হিন্দু, আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ কর্মীদের বাড়ী-ঘর লুটপাট করায় এবং মুসলিম লীগ এবং জামায়াতে ইসলামের কর্মীদের ছাড়া যাদের সম্মুখে পায় তাদেরকেই গুলি করে মারে। খান সেনাদের মহেশপুর আসার পূর্বেই কিছু লোক ভারতে চলে যায় আর যারা ভারতে যায় নাই এখানেই আশেপাশে পালিয়ে বেড়াচ্ছিল তাদেরকে ধরে নিয়ে সোজাসুজি হাসপাতলে নিয়ে যেত এবং সেখানে নিয়ে একটি রুমে বন্দী করে রাখত। মেজর আনিছ ছিলেন প্লাটুন ক্যাপ্টেন। খান সেনারা এইভাবে মহেশপুর, কোটচাঁদপুর, কালীগঞ্জ, খালিশপুর ইত্যাদি স্থান হতে লোকজনকে ধরে কাউকে সেখানেই গুলি করে মারত আর যাদের মারত না তাদের মহেশপুর হাসপাতালে নিয়ে এসে একটা বদ্ধ ঘরে বন্দী করে রেখে দিত। তারা প্রতিদিন সন্ধ্যায় ১০/১২ জনকে বের করে নিয়ে হাসপাতালের এরিয়ার মধ্যেই হাসপাতাল থেকে প্রায় ৫০ গজ দূরে ৫০/৬০ টা গর্ত করা আছে সেখানে নিয়ে কাউকে জবাই করত, কাউকে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে মারত, আবার কাউকে লাইন করে গুলি করে মারত। প্রতিদিন সন্ধ্যায় নাকি ২/৩ রাউন্ড গুলির শব্দ মহেশপুর বাজারের লোকজন পেত। প্রতিদিন সন্ধ্যায় গুলি করে লোক মারার খবর মহেশপুরের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে গেল। তখন থেকে খান সেনারা শুধু গর্তের ধারে নিয়ে জবাই করত আর বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে মারত এবং অনেককে ভালায়পুর ব্রিজের উপর নিয়ে জ্যান্ত অবস্থায় একটি বস্তায় ভর্তি করে বস্তার মুখ বেঁধে ব্রীজের উপর হতে ফেলে দিত। এ ভাবেই তারা জনসাধারনকে মেরেছে। আবার বিভিন্ন এলাকা থেকে সুন্দরী মেয়েদের ধরে এনে ৪/৫ দিন পাশবিক অত্যাচার করার পর তাদেরকেও ঐ সব গর্তে মেরে পুঁতে রাখত। এইভাবে প্রায় ৩/৪ শত লোককে একমাত্র হাসপাতালে মারা হয়েছে। কেননা বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরপরই মহেশপুরের স্থানীয় জনসাধারণ সেখানে গিয়ে নাকি দেখতে পায় হাসপাতালের পূর্ব দিকে মানুষের গন্ধে যাওয়া যায় না। অনেক কষ্টে নাকে কাপড় দিয়ে তারা গিয়ে দেখতে পায়, প্রায় ৬০ টির মত গর্ত করা প্রতি গর্তে ৫/৭ টি করে কারও মাথা, কারও ডানা, কারও পা, কারও শরীরের অংশটাই পড়ে আছে। যদিও দীর্ঘ এক বছর পার হয়ে গেছে এবং সেখানে কোন নিদর্শন থাকার কথা নয়। আমি নিজে সেখানে গিয়ে দীর্ঘ একটা বছর পরও একটা মানুষের মাথা, প্রায় ২০/২৫ টা গর্ত ও মানুষের অনেক হাড় পাই।

স্বাক্ষর/-
দেবাসীষ দাস

ইব্রাহিম রাজু
<৮,২.৩.১৭৭,২১৫>
।।১৭৭।।

আইনুল হক
গ্রাম- কচুবিল
থানা-মহেশপুর
জেলা-যশোর

মহেশপুর থানার কচুবিল পাক সেনাদের ঘাঁটিতে গনহত্যার বর্ণনা। কচুবিলে পাক মিলিটারীদের ক্যাম্প ছিল। সেখানে প্রায় ১০০ জন লোককে জ্যান্ত কবর দেওয়া হয়, প্রথমে তাদেরকে দুপা এবং দুহাত রশী দিয়ে বেঁধে একটা আম গাছের ডালে পা উপর দিকে ঝুলিয়ে রেখে লাঠি দিয়ে ও বন্দুকের বাঁট দিয়ে শুধু শরীরের বিভিন্ন জোড়ায় মারতে থাকে। প্রায় ৩ ঘন্টা মারার পর তারা অজ্ঞান হয়ে গেলে মাটিতে নামিয়ে ফেলে রেখে দেয়। জ্ঞান ফিরলে আবার তাদের মাটিতে শুইয়ে বুট দিয়ে পিঠের উপর উঠে খচতে থাকে এবং কাউকে ছুরি দিয়ে তার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় কেটে কেটে লবন মাখিয়ে দিয়ে ফেলে রাখে। তাদের উপর দৈহিক পীড়ন করার পর একটা গর্তের মধ্যে নিয়ে ফেলে রেখে কিছু বাবলার কাটা তাদের শরীরের উপর দিয়ে জ্যান্ত মাটিচাপা দিয়ে চলে আসতো। এইভাবে প্রতিটি গর্তে প্রায় ৫/৭ জনকে রেখে বিভিন্ন উপায়ে তাদের উপর অত্যাচার করার পর জ্যান্ত অবস্থায় মাটিচাপা দিয়ে রাখতো। এইভাবে প্রায় ১৫/২০ টা গর্তে ১০০ জনকে জ্যান্ত কবর দিয়েছে।

স্বাক্ষর/-
আইনুল হক

ইব্রাহিম রাজু
<৮,২.৩.১৭৮,২১৬-২১৭>
।।১৭৮।।

বনবিহারী সিংহ
নওয়াপাড়া
যশোর

১৯৭১ সালে ২৭ শে মার্চে পাক বাহিনীর একটি দল সমস্ত বেরিকেড সরিয়ে চলে আসে নওয়াপাড়াতে।তারা জনসাধারণকে জোরপূর্বক ধরে নিয়ে এসে বেরিকেড উঠানোর কাজে লাগিয়ে দেয়। সেই সময় আমি সংবাদ পাই যে চেংগুটিয়া রেলওয়ে ষ্টেশন মাষ্টার সাহেবের নিকট হতে পাকবাহিনী নওয়াপাড়ার দিকে যাচ্ছে। এই সংবাদ পেয়ে আমি স্থানীয় জনসাধারনদের জানাই। তারা নিরাপত্তার জন্য যে যতটুকু পেরেছে ততটুকু সাবধান হয়েছে। সেই সময় আমার ঘরে ছিলেন রুস্তম আলী সর্দ্দার (গার্ড ২৮ ডাউন এক্সপ্রেস), এস, এম, হক (গার্ড ৬৪ ডাউন প্যাসেঞ্জার), সালে আহম্মদ, নওয়াব আলী (চেকার), আইনুল হক (পোর্টার), ইমান আলী ও আব্দুল ওদুদ (পয়েন্টম্যান) গ্যাংসেট নবুশেখ গ্যাং, খালাসি শামছু। আমরা সবাই ডিউটিরত অবস্থায় ষ্টেশনে ছিলাম। কারন এছাড়া জীবনের আর কোন নিরাপত্তা ছিলো না আর আমরা প্রকৃতপক্ষে কোন অন্যায় করিনি বলে জানতাম। এরপর হঠাৎ ঐ দিন অর্থাৎ ২৭ শে মার্চ বেলা ১১ টার সময় এক দল পাক সেনা ষ্টেশনের অফিস কামড়ায় প্রবেশ করে। অফিসে প্রবেশ করে প্রথম চেয়ারে অবস্থানরত জনাব রুস্তম আলী সর্দ্দার সাহেব ও নওয়াব আলী সাহেবকে প্রথম হত্যা করে। আমি তাদের নিকটে ছিলাম। তারা হত্যা করেই ঘর হতে বের হয়ে গেল। কিন্তু পরক্ষণে পুনরায় ঘরে প্রবেশ করে বলে যে, কে জীবিত আছো কাছে এসো।এখানে বলা প্রয়োজন যে, উক্ত দু’জনকে হত্যা করার পর ঘরে অবস্থিত অন্য সবাই বেঞ্চের নীচে আশ্রয় করার ফলে তাদের পাক বাহিনী কর্তৃক ব্রাশফায়ারে কোন ক্ষতি করতে পারেনি। কিন্তু পরক্ষণে ঢুকেই যখন তাদের সকলকে দাঁড়াতে বলে তখন আমি একটা আলমারির ও দেওয়ালের মধ্যবর্তী স্থানে আত্নগোপন করে থাকি। দ্বিতীয়বার ঘরে প্রবেশ করে পাক বাহিনী জনাব সালে আহম্মদ ও জনাব এস, এম, হক সাহেবকে নৃসংশভাবে হত্যা করে। এবং আইনুল হক (পোর্টার) কে বাইরে বের করে গুলি করে কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে গুলিটি তার হাতে লাগে, ফলে জীবনে বেঁচে যায়।

প্রায় ২ ঘন্টা পর আব্দুর রব সাহেব (সহকারী ষ্টেশন মাষ্টার) আমার অফিস ঘরে এসে ডাক দেন আমার নাম ধরে এবং বলেন যে, পাক বাহিনী চলে গিয়েছে। তখন আমি উক্ত গোপন স্থান হতে আত্নপ্রকাশ এবং বাড়ী ফিরে এই দৃশ্যের কথা স্মরণ করে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। এইভাবে কর্মরত ট্রেনের কর্মচারীবৃন্দকে তারা হত্যা করে। তবে যারা শহীদ হন তারা নওয়াপাড়া রেলওয়ে স্টাফ নন। তারা জড়ানো দুটো ট্রেনের গার্ড সাহেব ও চেকার সাহেব। ওয়াচম্যান জনাব আতর আলী সাহেবও শহীদ হন ঐ দিন।

এই মৃত দেহগুলি প্রায় ৪/৫ দিন পড়ে থাকার দরুণ পচে যায় কিন্তু সৎকারের ব্যবস্থা হয় নি এবং সাধারন মানুষ করতে সাহস করে নি। পরে কয়েকজনকে সাথে করে আমি মৃতদেহ গুলি সৎকারের ব্যবস্থা করি এবং কবরস্থ করি। পরে পাক বাহিনী নিজেদের দোষ চাপা দেবার জন্য বলে যে, ষ্টেশনে কে হত্যা করেছে তাদের ধরিয়ে দাও। তারা মানুষকে ভুল সংবাদ পরিবেশন করার চেষ্টা করে।

এরপর মাঝে মাঝে আমি ষ্টেশনে আসতে থাকি এবং সাথে সাথে ঘরে চলে যাই। জীবনের নিরাপত্তার জন্য আমি শ্রী যতীন্দ্রনাথ চক্রবর্তী মহাশয়ের বাড়ীতে আশ্রয় করি। কিন্ত ১১ ই এপ্রিল তারিখে একজন পাক মেজর নওয়াপাড়া বাজারে আসে এবং স্থানীয় দালালদের ও দুষ্কৃতকারীদের নিয়ে একটি সভা করে যে হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ী লুট করতে হবে এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের মেয়েদের উপর অত্যাচার চালাতে হবে।

এরপর উক্ত ১১ ই এপ্রিল তারিখে নওয়াপাড়ার বিভিন্ন এলাকার ও আশেপাশে লুটতরাজ শুরু করে দেয়। এতে বিহারীরা সবচেয়ে বেশী নৃসংশতার ছাপ রাখে। আমি যে গ্রামে ছিলাম সেই গ্রাম উক্ত দিন লুটতরাজ শুরু হলে ঐ গ্রাম হতে অন্যত্র পালিয়ে যাই।

স্বাক্ষর/-
বনবিহারী সিং`
২/৫/৭৩

ইব্রাহিম রাজু
<৮,২.৩.১৭৯,২১৮-২১৯> “তারা প্রহার বন্ধ করে নির্দেশ দেয় যে, তিনজন বাঙ্গালী একে অপরের বিরুদ্ধে প্রহার শুরু করো। সেই নির্দেশমত আমাদের তিনজনের হাতে তিনটি লাঠি দিয়ে দেয় এবং বলে যে, এই লাঠি দিয়ে যদি একে অন্যকে প্রহার না করো তবে তোমাদের হত্যা করা হবে। তখন নিরুপায় হয়ে জীবন রক্ষার জন্য নিজেরা মারামারিতে প্রস্তুত হই। এইভাবে প্রায় এক ঘন্টা নিজেরা মারামারি করি। তখন পাক সেনারা এই মারামারি উপভোগ করতে থাকে এবং আনন্দ উল্লাস করতে থাকে।“

।।১৭৯।।
অনিল কুমার মন্ডল
গ্রাম- পাজিয়া
ডাকঘর- পাজিয়া
জেলা- যশোর

১৯৭১ সালের ২৬ শে জুন, শনিবার সকাল ৭ টার দিকে ৫ জনের একটা পাক সেনার দল আমাকে নিজ বাড়ী হতে ধরে ফেলে। উক্ত দিন প্রায় ৫০/৫২ জন থানা মিলিটারী গাড়ী পাজিয়া গ্রাম ঘিরে ফেলে। সকালে তারা গ্রামের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে।

পাক সেনারা প্রথম ধরে জিজ্ঞাসা করে যে, আমি হিন্দু না মুসলমান। আমি নিজেকে হিন্দু বলে প্রকাশ করায় আমার উপর রাইফেলের বাঁট দিয়ে আঘাত করে। এবং উক্ত গ্রামের শ্রী রবি কুমার বাবু কোথায় আছেন তা জানতে চায় এবং আমাকেও মুক্তিফৌজের সাহায্যককারী বলে চিহ্নিত করে। উক্ত স্থান হতে শ্রী রবি কুমার বাবুর বাড়ীতে অবস্থিত পাক মেজরের নিকট নিয়ে হাজির করে।

পাক মেজর তখন বলে যে, তুমি মুক্তিফৌজ কিনা? তুমি ভারতে যাতায়াত কর কিনা? কিন্তু আমি অস্বীকার করি এবং বলি যে, আমি স্কুলে শিক্ষকতা করি এবং দৈনিক হাজিরা খাতায় উপস্থিত আছে সুতরাং উক্ত অভিযোগ মিথ্যা। একথা বলার পর একটা কাঠের লাঠি দিয়ে ভীষণভাবে আঘাত করে ফলে আমার হাত দিয়ে প্রচুর রক্তপাত হয়। তারপর আমাকে ওখানে বসিয়ে রাখে। সেইখানে নারায়ণ প্রসাদ চক্রবর্তীকে বসিয়ে পিঠে লাঠি দিয়ে বেদম প্রহার করতে থাকলে সে বিকট চিৎকার করতে থাকে। তখন এক জন বাঙ্গালী এসে মেজরকে সংবাদ দেয় যে এক জন বাঙ্গালী বধুকে পাক সেনারা ধরে নিয়ে গিয়ে পাশবিক অত্যাচার করেছে। এই সংবাদে মেজর আমাদের বসিয়ে রেখে চলে যায়।

তখন আমাদের ধরে অন্য ঘরে নিয়ে যায়। আমাদের অন্য ঘরে নিয়ে যাওয়ার জন্য নির্দেশ করে তৎকালীন পাকিস্তানের ২ জন দালাল। ঐ ঘরে গিয়ে দেখি রামচন্দ্র বিশ্বাস নামে একজন লোককে বেদম প্রহার করে ফেলে রেখেছে। উক্ত লোকের সারা শরীর দিয়ে রক্ত ঝরছে।

আমাকে ও নারায়ণকে উক্ত ঘরে নিয়ে গিয়ে এক সেনার লাঠি, রাইফেলের বাঁট, বুট জুতা ও ঘুষি দিয়ে বিভিন্ন উপায়ে বেদম প্রহার করলো। এইভাবে দিন ৮-৩০ হতে বিকাল ৩টা পর্যন্ত বিভিন্ন পাক সেনা পর্যায়ক্রমে প্রহার করে।এইভাবে প্রহার করার পর আমাদের শরীর দিয়ে রক্ত ঝরতে থাকে। তখন তারা প্রহার বন্ধ করে নির্দেশ দেয় যে, তিনজন বাঙ্গালী একে অপরের বিরুদ্ধে প্রহার শুরু করো। সেই নির্দেশমত আমাদের তিনজনের হাতে তিনটি লাঠি দিয়ে দেয় এবং বলে যে, এই লাঠি দিয়ে যদি একে অন্যকে প্রহার না করো তবে তোমাদের হত্যা করা হবে। তখন নিরুপায় হয়ে জীবন রক্ষার জন্য নিজেরা মারামারিতে প্রস্তুত হই। এইভাবে প্রায় এক ঘন্টা নিজেরা মারামারি করি। তখন পাক সেনারা এই মারামারি উপভোগ করতে থাকে এবং আনন্দ উল্লাস করতে থাকে। নানাভাবে এই সংঘর্ষকে উৎসাহ দিতে থাকে। এইভাবে নিজেরা মারামারি করে প্রায় জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ি। পাক সেনারা আমাকে আট স্থানে বেয়োনেট চার্জ করে। বাকী দু’জনকেও ঐ একই ভাবে বেয়োনেট চার্জ করে। রামের ঘাড়ে বেয়োনেট দিয়ে প্রায় দুই ইঞ্চি মতো ক্ষত করে। তখন আমরা মৃতের মত পড়ে থাকি এবং নড়াচড়া হতে বিরত থাকি। সেই সময় আমাদের শরীর হতে রক্তক্ষরণের ফলে দেহ অসাড় হয়ে আসতে থাকে।

তখন পাক সেনারা মৃত মনে করে আমাদের উপর লেপ তোষক দিয়ে ঢেকে দেয়। লেপের উপর বিভিন্ন ধরনের কাঠ চাপ দেয়। আমরা তখন জীবিত অবস্থায় মৃতের মতো শুয়ে থাকি। আমাদের উপর চাপানো কাঠের এক প্রকার সাদা পাউডার ছিটিয়ে দেয় এবং বিভিন্ন স্থান হতে পেট্রোল ও কেরোসিনের তেল ছিটিয়ে দেয়। এই সমস্ত করার পর দেয়াশলাইয়ের সাহায্যে আগুন ধরিয়ে দেয়। উদ্দেশ্য আমাদের পুড়িয়ে মারা। তখন প্রায় ৬ টা বাজে। মেজরের বাঁশি বাজার পর পাক সেনারা ঘরের দরজা বাহির হতে বন্ধ করে চলে যায়। আমরা যাতে ঘরের বাইরে যেতে না পারি তার ব্যবস্থা করে।
যখন পাক সেনারা চলে যায় এবং আগুন জ্বলতে থাকে তখন আমরা অতি কষ্টে উঠে দাঁড়াই এবং ঘর হতে বাইরে যাওয়ার জিন্য দরজায় আঘাত করি কিন্তু বাহির থেকে বন্ধ থাকায় তা কিছুতেই সম্ভব হয় নাই। পরে নিরুপায় হয়ে ও আগুনের বিভীষিকা দেখে প্রাণ বাঁচাবার শেষ চেষ্টাস্বরূপ একটা ছোট দরজা লাথি মেরে ভেঙে ফেলি এবং অতি কষ্টে ঘর হতে বের হয়ে যাই। ঘর হতে বের হয়ে আমরা তিনজন নিকটস্থ একটা বাগানে প্রবেশ করি। বাগান হতে তিনজন তিন দিকে চলে যাই। পাক সেনারা তখন গ্রাম হতে চলে গিয়েছে। আমি মহর আলী নামে এক ব্যাক্তির বাড়ীতে আশ্রয় নেই। সেখান হতে আমার আত্নীয়রা আমাকে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করায়।

স্বাক্ষর/-
অনিল কুমার মণ্ডল
৪/৪/৭৩

ইব্রাহিম রাজু
<৮,২.৩,১৮০,২২০>
।।১৮০।।
সুধীর কুমার নাথ
গ্রাম- মদার দাঙ্গা
ডাকঘর- পাঁজিয়া
থানা- কেশবপুর
জেলা- যশোর

২৬ শে জুন, (১৯৭১) রাতে পাক বাহিনী গ্রামটিকে ঘিরে ফেলে। আমি এ সংবাদ পেয়ে পালিয়ে যাই এবং একটা ডোবাতে আশ্রয় নিই। পানিতে গলা পর্যন্ত ডুবে থেকে পাক বাহিনীর বর্বরোচিত কিছু ঘটনা অবলোকন করি।

সে দিন বৃষ্টি হচ্ছিল। অনুমান সকাল ৯ টার দিকে আমি এই ঘটনার সম্মুখীন হই। জনৈক ব্যক্তির বিধবা স্ত্রীকে এক জন পাক সেনা ধর্ষণ করে ঘরের বাইরে চলে আসে। সেই সময় স্ত্রী লোকটিও ঘর হতে বিবস্ত্র হয়ে বের হয়ে আসে। তখন আর একজন পাক সেনা তাকে ঘরে নিয়ে যায় এবং তার উপর পাশবিক অত্যাচার চালায়।

এইভাবে তিন জন পাক সেনা পর্যায়ক্রমে তার উপর অত্যাচার চালায়। তিনি তখন এর হাত হতে রক্ষা পাওয়ার জন্য পাক সেনাদের পা জড়িয়ে ধরেন। কিন্তু বর্বর পাক সেনারা তা শোনে না। তৃতীয় পাক সেনা যখন ঘর হতে বের হয়ে আসে সেই সময় আমি ওখান হতে চলে আসি। আসার পথে তাকে আমি এক ঘরের পাশে কাঁদতে দেখি এবং সারা কাপড়ে অত্যাচারের কাল রক্ত লেগে থাকতে দেখি। মহিলার বয়স অনুমান ২৮ বৎসর। তিনি স্বাস্থবতী ছিলেন বিধায় জ্ঞান হারাননি। আরেক ব্যাক্তির দু’জন অবিবাহিত কন্যার উপর ঐ দিন পাক সেনারা পাশবিক অত্যাচার চালায়। এই গ্রামে প্রায় শতাধিক মহিলার উপর পাক সেনারা পাশবিক অত্যাচার চালায় ঐ একই দিনে ।

স্বাক্ষর/-
সুধীর কুমার নাথ
৪/৪/৭৩

ইব্রাহিম রাজু
<৮,২.৩.১৮১,২২১>

।।১৮১।।
মিঃ মানিক মিয়া (পুলিশ)
থানা- মনিরামপুর
জেলা- যশোর

২৯ শে মার্চ আমি যশোর জেলার কোতয়ালী থানার বসন্দিয়া পুলিশ ফাঁড়ি হতে পাক বাহিনীর আক্রমনের খবর পেয়ে সেখান হতে লোহাপাড়া থানার অন্তর্গত কালনা নামক গ্রামে গিয়ে এক মাস অতিবাহিত করি। সেখান হতে পুনরায় লোহাগড়া থানায় চলে আসি।

মে মাসের ৯ তারিখে আমি আমার এক আত্নীয়ের খোঁজে যশোর শহরে চলে আসি। যশোর শহরের দড়াটানায় আমাকে এক বিহারী দেখে বন্দী করে। এবং আমাকে ক্যান্টনমেন্ট এ পাক সেনার নিকট পৌছে দেয় ক্যান্টনমেন্টে পৌছার পর মিলিটারি সুবেদার আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে- মুক্তিবাহিনী কোথায়? তারা কোথায় ট্রেনিং নেয়? আমি তার প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে অস্বীকার করায় আমাকে বেতের মোটা লাঠি দিয়ে, চীনা রাইফেলের বাঁট দিয়ে আমার পায়ে, হাতে ও পিঠে প্রহার করতে থাকে এবং প্রহার শেষে হাত, পা, বেঁধে আমাকে রৌদ্রে মাঠের মধ্যে ফেলে রাখে। এই ভাবে ৩/৪ ঘন্টা রৌদ্রের মধ্যে রাখার পর আবার ঘরে নিয়ে যেত। এবং আমার চারিদিক প্রহরী রেখে আমাকে কাজ করাত। কাজ করার মাঝে মাঝে লাঠি দিয়ে অথবা বন্দুকের বাঁট দিয়ে পিঠে আঘাত করত। দিন রাতের মধ্যে অনুমান দু ছটাক চাউলের ভাত খেতে দিত। আমার চোখের সামনে ৮/১০ জন লোককে শুধু লাঠি দিয়ে পিটাতে পিটাতে মেরে ফেলে দেয়। অনেক লোককে বিকাল ৬ টার পর হতে চোখ বেঁধে, হাত বেঁধে গাড়িতে উঠিয়ে ক্যান্টনমেন্টের বাইরে নিয়ে যেত। হাজত থেকে কিছু লোক তাদের দিয়ে গর্ত খোঁড়াতো এবং যাদের গাড়ীতে করে নিয়ে যেত তাদেরকে লাইন করে গুলি করে হত্যা করতো।এই ভাবে প্রত্যেক দিন রাত্রিতে মিলিটারীরা গণহত্যা করতো।

আমি এক মাস ক্যান্টনমেন্টে ছিলাম। আমি যেই কয়দিন ক্যান্টনমেন্টে ছিলাম ঐ কয়েক দিন তারা অনুমান ৭/৮ শত লোককে বিভিন্ন উপায়ে হত্যা করেছে। আমার উপর নির্যাতন চালানোর পর আমার উপর গুলির অর্ডার হয়ে যায়। আমি উক্ত খবর আমার স্ত্রীর নিকট ক্যান্টনমেন্ট হতে লোক মারফত পাঠিয়ে দিই। তারপর আমার স্ত্রী একজন পাঞ্জাবী হাবিলদারের নিকট এক জন লোক নিয়ে যায়। এবং তাঁকে অনুরোধ করার পর তিনি মেজরের নিকট গিয়ে আমার জন্য সুপারিশ করেন। তারপর মেজর আমাকে ডেকে বলে আমি তোমাকে হাবিলদারের অনুরোধে মুক্তি দিলাম। হাবিলদারটার নাম ছিল কোরবান খাঁন। মুক্তি দেবার সময় আমাকে মেজর বলে দিলেন তুমি এখনই পুলিশ লাইনে গিয়ে হাজির হবে। যদি হাজির না হও, তাহলে তোমাকে গুলি করে মারা হবে। তারপর দুজন রেঞ্জার পুলিশ আমার সঙ্গে দিয়ে আমাকে পুলিশ লাইনে পৌছে দেয়। সেখানে বিহারী সুবেদার আমির হোসেন সাহেবের নিকট আমাকে হাজির করেন। আমি সেখানে হাজির হয়ে ছুটির জন্য দরখাস্ত করি। দরখাস্ত মঞ্জুর না করে আমাকে মনিরামপুর থানায় পোষ্টিং করে। এখানে এসেই আমার অসুখ হয়। তিন মাস অসুখ অবস্থায় কাটাই। তারপর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যায়।

স্বাক্ষর/-
মানিক মিয়া
৪/৪/৭৩

ইব্রাহিম রাজু
<৮,২.৩.১৮২,২২২>

।।১৮২।।
মোঃ শহীদুল ইসলাম
গ্রাম-বেড়ী
ডাকঘর- জাদবপুর
থানা- শারসা
জেলা- যশোর

১৫ই আগষ্ট ভোর রাত চারটার সময় আমাকে এক জন রাজাকার নাভারন বাজার হতে ধরে এবং রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে নিয়েই আমাকে উক্ত রাজাকার বেতের লাঠি দিয়ে ভীষণ প্রহার করে। এরপর সেক্রেটারীর নির্দেশে আমার চোখ বেঁধে মটরে তুলে যশোর ক্যান্টনমেন্টে চালান দেয়। সেখানে নিয়ে চোখ খুলে দেয় এবং মেজরের নিকট আমাকে হাজির করে। ৪/৫ জায়গায় ষ্টেটমেন্ট দেবার পর আমাকে ক্যান্টনমেন্টে এফ, আই, ও, তে হাজতে আটকিয়ে রাখে। প্রত্যেক দিন সকাল ও বিকালে হাজত হতে বের করার সময় এবং হাজতে ঢুকানোর সময় প্রত্যেককে ভীষণ প্রহার করতো। আমাকে হাজত হতে বের করে বাহিরে নিয়ে যেত এবং প্রথমে বেতের লাঠি দিয়ে প্রহার করার পর বুট দিয়ে লাথি, চড়, কিল, ঘুষি, বুট দিয়ে শরীরের উপর উঠে খচিত এবং সর্বশেষ পায়ের তলায় রুল দিয়ে প্রহার করার পর সিগারেটের আগুন শরীরের বিভিন্ন স্থানে চেপে ধরতো। তারা আমাকে জিজ্ঞাসা করত, সত্যি করে বলো, তোমার সাথে কে কে ছিল। তারপর আমার শরীর হতে এক পাউন্ড রক্ত নিয়ে হাজতের মধ্যে রেখে দেয়।

এইভাবে আমাকে আড়াই মাস যশোর ক্যান্টনমেন্টে রাখার পর নভেম্বর মাসের প্রথম দিকে আমাকে সেখান হতে যশোর সেন্ট্রাল জেলে পাঠিয়ে দেয়। সেন্ট্রাল জেলে আসার পর পর আমার সমস্ত শরীর ফুলে যায় এবং যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকি। ঐ মাসের শেষের দিকে একজন মেজর কয়েকজন মিলিটারীকে সঙ্গে করে সেন্ট্রাল জেলে চলে আসে এবং আমাদের ২০/২৫ জনের প্রত্যেকের শরীর হতে এক পাউন্ড করে রক্ত নেয়।

তারপর ডিসেম্বরের ৭ তারিখে যশোর হতে পাঞ্জাবী সৈন্যরা অন্যত্র চলে যায়। ঐ দিন যশোর শত্রুমুক্ত হয়। মুক্তিবাহিনী জেল খানার তালা খুলে দিলে আমরা জেল হতে বের হয়ে আসি। এবং সেই দিনই আমি বাড়ী চলে আসি। আমি প্রায় আড়াই মাস যশোর ক্যান্টনমেন্ট হাজতে ছিলাম। উক্ত হাজতে আমার চোখের সম্মুখে তিনটা লোক প্রহারের দরুন মারা যায়। এবং প্রত্যেক দিন সন্ধ্যার পর হাজত হতে ২০/২৫ জন করে লোককে বের করে নিয়ে যেত, তাদেরকে আর ফিরে আনতো না। এই ভাবে বহু লোককে তারা বিভিন্ন উপায়ে হত্যা করেছে।
স্বাক্ষর/-
মোঃ শহিদুল ইসলাম
২২/৪/৭৩

ইব্রাহিম রাজু
<৮,২.৩.১৮৩,২২৩> “তারা কোন মেয়ের উপর পাশবিক অত্যাচার চালায় নাই।“
।।১৮৩।।
মোঃ মনছোর আলী
গ্রাম- হাকোবা
ডাকঘর- মনিরামপুর
থানা- মনিরামপুর
জেলা- যশোর
১৯৭১ সালের ১৪ ই আগষ্ট ৩০/৩৫ জন মিলিটারী হাকোবা হাই স্কুল হতে বেলা ১০ ঘটিকার সময় হাকোবা গ্রামে যায়। বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে তারা গ্রামের মধ্যে ঢুকে পড়ে। পাঁচজনের একটি দল আমার বাড়ীতে চলে যায় এবং আমাকে ধরে ফেলে এবং জিজ্ঞাসাবাদ করে, তুমি হিন্দু না মুসলমান? আমি উত্তর দিই দেই যে, আমি মুসলমান। তারপর আমাকে জিজ্ঞাসা করে, এই গ্রামে হিন্দু আছে কি? আমি উত্তরে বলি আছে। আমি হিন্দু পাড়া দেখিয়ে দেই। মিলিটারীরা আমাকে ছেড়ে দিয়ে হিন্দু পাড়ায় ঢুকে পড়ে। আমার বাড়ী হতে হিন্দু পাড়া যাওয়ার পূর্বে আমার পাশের বাড়ীতে একজন স্ত্রীলোক, ১ সন্তানের মাতা, ভাত রান্না করছিল। মিলিটারীরা তাকে ধরে ফেলে এবং ঘরের মধ্যে নিয়ে যায়। তার উপর প্রায় দেড় ঘন্টা সময় পর্যন্ত পাশবিক অত্যাচার করার পর যখন সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে সেই সময় তাকে ফেলে রেখে মিলিটারীরা হিন্দু পাড়ার দিকে চলে যায়। হিন্দু পাড়ায় গিয়ে উক্ত দল মুরগী খুঁজতে থাকে। বিকাল তিনটার দিকে তারা শ্রী অনিল কুণ্ডের বাড়ীতে ঢোকে। তাঁর বাড়িতে তিনজন স্ত্রীলোক ছিল। তাঁরা হলেন অনিল কুণ্ডের স্ত্রী, তাঁর মাতা, আর তৃতীয়জন তাঁর বোন। তাঁর স্ত্রী ঘরের মধ্যে কাঁথা সেলাই করছিল। তাঁর মাথা ও বোন বারান্দায় বসে ছিলো।মিলিটারীরা উক্ত বাড়ীর ভিতর ঢুকেই দুজন ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে আর একজন সেন্ট্রি দিতে থাকে, আর একজন অনিল কুণ্ডের বোনের হাত ধরে হেঁচড়ে টানতে থাকে। তা দেখে তাঁর মা চিৎকার করতে থাকে। একজন মিলিটারী তার মাতাকে লাঠি দিয়ে বেদম প্রহার করে।কিন্তু অনিল কুণ্ডের বোনকে ঘরের মধ্যে নিতে না পেরে তাকেও ভীষণ প্রহার করে। তাঁর স্ত্রীকে ৩/৪ জন মিলে প্রায় দু’ঘন্টা পাশবিক অত্যাচার করে। কিন্তু ঐ সময় অনিল কুণ্ডের বড় ভাই সুধীর কুমার কুণ্ড ও একজন বৃদ্ধলোক হরিপদ কুন্ড বাড়িতে ছিলেন। কিন্তু মিলিটারীরা তাদের বাড়ীতে ঢুকেই তাদের দুজনকে ধরে ফেলে এবং একটা ঘরের মধ্যে নিয়ে বন্দি করে রেখে দেয়। তারপর মিলিটারীরা উক্ত পরিবারের উপর পাশবিক অত্যাচার করার পর আবার হাইস্কুলে চলে আসে। কিন্তু তাদের সঙ্গে যে অন্যান্য পার্টি গ্রামের ভিতর গিয়েছিল তারা গ্রাম হতে হাঁস মুরগী ইত্যাদি ধরে নিয়ে আসে। তারা কোন মেয়ের উপর পাশবিক অত্যাচার চালায় নাই। যে দুটা মেয়ের উপর পাশবিক অত্যাচার চালানো হয় তাদের একজন মুসলমান আর দ্বিতীয়জন হিন্দু। তাদের উপর পাঁচজন মিলিটারী পাশবিক অত্যাচার করার দরুন তাদের স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়ে। অনেক ঔষুধপত্র খাওয়ানোর পর বর্তমানে তারা সুস্থ হয়ে উঠেছে। উক্ত ঘটনার এক মাস পূর্বে অনিল কুণ্ডকে পাক মিলিটারীরা রাস্তা থেকে ধরে ফেলে এবং তাকে ক্যাম্পে নিয়ে যায় এবং তাকে তারা গুলি করে হত্যা করে। তারপরই উক্ত ঘটনা ঘটে যায়।

স্বাক্ষর/-
মোঃ মনছোর আলী
৫/৪/৭

ইব্রাহিম রাজু
<৮,২.৩.১৮৪,২২৪>
।। ১৮৪ ।।
বিকাশ চন্দ্র মল্লিক
মনিরামপুর
যশোর

আমি, সিদ্দিক, ও ইউনুস এই তিনজন পাক সেনাদের হাতে বন্দী হই। তারা আমাদেরকে ঝিকরগাছা নিয়ে যায়। ঝিকরগাছা নিয়ে যাবার পথে আমাদেরকে বন্দুকের বাঁট দিয়ে ভীষণ প্রহার করতে থাকে। ঝিকরগাছা হতে চোখ বেঁধে গাড়ীতে করে সারসা তাদের ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয়। সেখানে একটা ঘরের মধ্যে দু’ফুট পানি ছিল। সেখানে দু’হাত পিছনের দিকে রশি দিয়ে বেঁধে একটা জানালার শিকের সাথে বেঁধে রাখে। রাত শেষে আবার সেখান হতে বাইরে নিয়ে গিয়ে ছড়ি দিয়ে,বেয়নেট দিয়ে, বুট দিয়ে, লাঠি দিয়ে, ভীষণ প্রহার, চর, ঘুষি, লাথি দিয়ে ৪/৫ জন মারতে থাকে আর জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে কোথায় পার্টি আছে?
কোন কোন এলাকায় অপারেশন করেছ?
কোথায় ট্রেনিং নিয়েছ?
কয়জন পাক সেনা মেরেছ?
ভারতে কার নেতৃত্বে ট্রেনিং নিয়েছ?
তুমি ভারতীয় ক্যাপ্টেন না মেজর ইত্যাদি বলতো আর অকথ্য ভাষায় গালি দিত ও প্রহার করত। জ্ঞান হারিয়ে ফেললে প্রহার করা বাদ দিত। জ্ঞান ফিরে পেয়ে দেখতে পেতাম আমার মাথায় পানি।

এইভাবে দুইদিন দুইরাত আমার উপর অমানুষিক নির্যাতন চালানোর পর ১১ ই অক্টোবর আমাকে যশোর ক্যান্টনমেন্টে পাঠিয়ে দেয়। সেখানে দুইদিন থাকার পর মেজর আমার ষ্টেটমেন্ট নেয়। তুমি যুদ্ধ করতে এসে অন্যায় করেছ, না ঠিক করেছ? তার জবাবে আমি বলি, মা-বোনদের ইজ্জত রক্ষার্থে ও মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য অস্ত্র ধরলে যদি অপরাধ হয় তাহলে আমি অন্যায় করেছি। ঐ কথা বলার পর মেজর আমার প্রহার বন্ধ করে দেয়। পুনরায় আমাকে হাজত ঘরে পাঠিয়ে দেয়। এর তিন দিন পর এক বিহারী আমাকে গোপনে হাজত হতে বের করে গুলি করতে নিয়ে যায়। গুলি করার আগে মেজর জানতে পেরে আমার নিকট চলে যায় এবং আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে আর বিহারীকে অশ্লীল ভাষায় গালি দেয়।

সেই দিন অর্থাৎ ১৭ ই অক্টোবর আমাকে ছেড়ে দিবে বলে মেজর দুইজন সেন্ট্রিসহ আমাকে যশোর শহরে নিয়ে আসে এবং সেন্ট্রাল জেলে রেখে যায়। তারপর পাক সেনারা আহত হতে থাকে।

নভেম্বরের শেষের দিকে জোর পূর্বক আমাদের প্রত্যেক আসামীর শরীর হতে এক পাউন্ড থেকে দুইপাউন্ড পর্যন্ত রক্ত জোরপূর্বক নিয়েছে। রক্ত না দিলে ভীষণ প্রহার করত।

৭ই ডিসেম্বর আমরা যশোর জেলখানা হতে মুক্তি পাই। মনিরামপুর থানা ৭ই ডিসেম্বর শত্রুমুক্ত হয়। ৮ই ডিসেম্বর আমি, রতন, আখতার এই তিনজন মনিরামপুর থানায় চলে আসি এবং ও, সি, র নিকট হতে রাজাকারদের রেকর্ডপত্র নিয়ে নেই। তারপর আমরা মনিরামপুরে ঘোষণা করে দেই যাদের নিকট অস্ত্রশস্ত্র আছে, তারা ৪/৫ দিনের মধ্যে মুক্তিফৌজ অফিসে জমা দাও। তাদেরকে কিছু বলা হবে না। ঘোষনা করার কয়দিনের মধ্যেই ৩০০/৩৫০ টি রাইফেল আমাদের অফিসে জমা হয়ে যায়।

ডিসেম্বরের শেষের দিকে ক্যাপ্টেন সফিউল্লা ই, পি, আরদেরকে সঙ্গে করে মনিরামপুর চলে আসেন আমরা তাঁর হাতে আমাদের উদ্ধার করা অস্ত্রশস্ত্র তুলে দেই। তারপর বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ঢাকা গিয়ে আমাদের অস্ত্রশস্ত্র তাঁর নিকট জমা দিয়ে আসি।

স্বাক্ষর/-
বিকাশ চন্দ্র মল্লিক
২/৪/৭৩

ইব্রাহিম রাজু

<৮,২.৩.১৮৫,২২৫>

।। ১৮৫।।
মোঃ আব্দুস সাত্তার
গ্রাম-কবুর হাট
ডাকঘর- জগতী
থানা ও জেলা-কুষ্টিয়া

১২-৬-৭১ সালে বিকাল তিনটার সময় দু’জন পাক দালাল অস্ত্রশস্ত্রসহ কবুর হাটে আমার দোকানে এসে জিজ্ঞেস করে সিরাজ মিয়া কোথায়। আমি উত্তর করি তা তো বলতে পারবো না। তারপর আমাকে বলে তোমাকে আমাদের সঙ্গে যেতে হবে। কারন মেজর সাহেব তোমাকে ডেকেছে। আমি তাদের সঙ্গে যেতে অস্বীকার করলে তারা জোর করে আমাকে একটা রিকশায় করে কুষ্টিয়া নিয়ে যাওয়ার সময় চৌহাস ও কুমার গারার ব্রীজ, যেখানে মিলিটারী পাহাড়া দিত, পৌছিবার সঙ্গে সঙ্গে একজন মিলিটারী আমার নিকট চলে আসে এবং আমাকে জিজ্ঞেস করে, ভোট দিয়েছ কোথায়? আমি উত্তর করি নৌকায় দিয়েছি। অমনি আমার গালের উপর তিন চারটা চড় কষে মারে। আমি মাটিতে পড়ে যাই। তারপর আমাকে কুষ্টিয়া পুলিশ লাইনে নিয়ে গেলে একজন মেজর এসে আমাকে জিজ্ঞেস করে তোমার বাড়ীতে কয়টা বন্দুক আছে? আমি বলি আমার বাড়িতে কোন বন্দুক নাই। আমি বন্দুক দিয়ে কি করবো। আমি বন্দুকের কথা অস্বীকার করাতে আমাকে মেজরের নির্দেশে একটা ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেই ঘরে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রায় ১৫/২০ জন মিলিটারী এসে আমাকে ঘরে নিয়ে কেউ ঘুসি,কেউ লাথি, কেউ বুট দিয়ে খচন আবার কেউ বা বেতের লাঠি দিয়ে বেদম প্রহার করতে থাকে এবং পরস্পর হাসতে থাকে। এইভাবে প্রায় ১৫ মিনিট শারীরিক অত্যাচারের পর আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। প্রায় আধ ঘন্টা পর আবার জ্ঞান ফিরে পাই। তারপর আমাকে একটা অন্ধকার কোঠায় নিয়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। আমি সেখানে গিয়ে পাই আমার মত তিনটি লোক সেই ঘরের মধ্যে অর্ধ মৃত অবস্থায় পড়ে আছে। বিকেল পাঁচটার সময় আবার একজন মিলিটারী এসে আমাকে সেখান হতে বের করে একটা বড় ঘরের মধ্যে নিয়ে যায় এবং মাটিতে উপুড় করে শোয়ায়ে দেয় তারপর একজন ঘাড়ের উপর এসে চড়ে। দুজন দুহাত পাড়া দিয়ে ধরে। দুজন দুপায়ের উপর চড়ে, আর ৪/৫ জন বুট পায়ে দিয়ে খচতে থাকে তারপর আমি অজ্ঞান হয়ে যাই। ১৫/২০ মিনিট পর জ্ঞান ফিরলে আবার বন্ধ করে রেখে দেয়।

এইভাবে ৪/৫ দিন নিয়মিত শারিরীক নির্যাতন চালানোর পর একজন ক্যাপ্টেন এসে আমাদেরকে বন্ধ ঘরে দেখে যায় এবং একজন মিলিটারীকে জিজ্ঞাসা করে এদেরকে খাবার দেওয়া হয়েছে ? মিলিটারীটা উত্তর করে, না। তখন নির্দেশ দেয় তাড়াতাড়ি এদের জন্য খাবার নিয়ে এসো। এই বলে ক্যাপ্টেন চলে যায়। মিলিটারিটা আমাদের জন্য খাবার আনে। আমার উক্ত খাবার না খেয়ে উহা ফেরত দেই।

ঐ মাসের ১৫ তারিখে ক্যাপ্টেন আমাকে থানা হাজতে পাঠায়। এবং ২০ তারিখে ক্যাপ্টেন কুষ্টিয়া হতে বদলী হয়ে যাবার সময় থানার ও,সি, কে বলে যায়, ছাত্তার নামক লোকটা সম্পর্কে ভালো করে খোঁজখবর নেবে। এই লোক যদি দোষী না হয় তাহলে একে মুক্ত করে দেবেন। তারপরও ও,সি,-এর নির্দেশে আমাকে ২১ তারিখে থানায় হাজির করা হয়। ও,সি আমাকে জিজ্ঞেস করে তোমার বাড়ী কোথায়, নাম কি,ইত্যাদি। তারপর ও,সি-এর নির্দেশে আমাকে জেলে নিয়ে রাখা হয়। সেখানে জেলের ভিতর বিহারীরা আমাকে ৩/৪ দিন পরপর মারধর করতো। এই ভাবে জেলের মধ্যে প্রায় পাঁচ মাস থাকার পর আমার গ্রামের জনসাধারণের চেষ্টায় আমাকে জামিন দেয়।

তারপর বাড়ী চলে আসি। মামলা চলতে থাকে। ৪/ দিন মামলা চলার পর মহকুমা হাকিম আমাকে বেকসুর খালাস দেয়।

স্বাক্ষর।।-
আব্দুস সাত্তার (বয়াতী)

ইব্রাহিম রাজু
<৮,২.৩.১৮৬,২২৬>

।।১৮৬।।
মোঃ জহুরুল ইসলাম
গ্রাম- কবুরহাট
ডাকঘর-জগতি
থানা ও জেলা- কুষ্টিয়া

১৯৭১ সালের ৯ ই আগষ্ট আমি সদর হাসপাতালে ঔষুধের জন্য যাই। হাসপাতালে যাবার সঙ্গে সঙ্গে ২০/৩০ জন বিহারী ও জাতীয় মিলিশিয়া এসে আমাকে ঘিরে নিয়ে ধরে ফেলে। তারপর আমার দুহাত একসঙ্গে বেঁধে ভীষণভাবে প্রহার শুরু করে এবং জিজ্ঞাসা করে তোম লোক কেতনা মিলিটারী মারা? তোম লোক কেতনা বিহারী মারা? সাচ্চা বলেগা ত ছোড় দেগা। তোম ঝুট বলেগা ত খতম কর দেয়া। আমি তাদের কথা অস্বীকার করি। তখন আমাকে শোয়ায়ে আমার বুকের উপর ৩/৪ জন মিলিটারী উঠে খচতে থাকে। আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি । প্রায় আধা ঘন্টা পর আমার জ্ঞান ফিরে আসে। তারপর ৫।৭ বিহারী এসে আবার মারতে মারতে হাউজিং অফিসে নিয়ে যায় এবং সেখানে নিয়ে গিয়ে আমার চোখ বাঁধবে, এমন সময় ও,সি সেখানে চলে আসে এবং আমাকে জিজ্ঞেস করে তোমার বাড়ীতে কয়টা বন্দুক আছে এবং তুমি কয়টা মিলিটারী এবং কয়টা বিহারী মেরেছ? আমি উত্তর করি আমি কোন বিহারী ও কোন মিলিটারী মারি নাই এবং আমার বাড়ীতে কোন বন্দুক নাই। তখন ও,সি আমাকে তার হাতে যে রুলার ছিল সেই রুলার দিয়ে আমার পিঠে ১০/১২ টা বাড়ীও ঘা মারে। থানায় নিয়ে যায়। সেখানে নিয়ে একটা বদ্ধ ঘরের মধ্যে দরজা বন্ধ করে রেখে দেয়। তার পরদিন বেলা চারটার সময় মিলিশিয়া ও,সি- এর অফিসে আমাকে নিয়ে হাজির করে। সে দিনও ও,সি আমাকে একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলো। আমি অস্বীকার করাতে সে দিনও ও,সি- এর অফিসে আমাকে লাঠি দিয়ে ভীষণ প্রহার করে। মারার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে আমি একটু পানি চাইলে ও,সি একটা মিলিসিয়াকে এক গ্লাস পানি এনে দিতে বলে। তারপর মিলিসিয়াটি আমার জন্য এক গ্লাস পানি নিয়ে আসে। আমি পানিটুকু খাবার পর আবার আমাকে নিয়ে সেই ঘরে রেখে দেয়। আমি তখন জেলা বোর্ডে চাকুরী করতাম। জেলা প্রশাসক আমার ধরা পড়ার খবর পেয়ে আমাকে মুক্ত করার জন্য থানার ও,সি,-এর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তার চেষ্টায় আমাকে ৫ দিন পর রাত্রি ৪ টার সময় বদ্ধ ঘর হতে বের করে ও,সি- এর সামনে হাজির করে। ও,সি, আমার ঠিকানা লিখে নিয়ে আমাকে মুক্তি দেয় আমি সেই দিনই একটি রিকসায় বাড়ী পৌছি। উল্লেখ্য যে থানার ও,সি ছিল বিহারী।

টিপসহি
মোঃ জহিরুল ইসলাম

ইব্রাহিম রাজু
<৮,২.৩.১৮৭,২২৭>

।।১৮৭।।
মোঃ আব্দুল রশীদ মণ্ডল
গ্রাম- নওপাড়া
ডাকঘর- মীরপুর
থানা- মীরপুর
জেলা- কুষ্টিয়া

আষাঢ় মাসের ২৫ তারিখে বেলা তিনটার সময় এক ট্রাক মিলিটারী রাজাকার মিলে প্রায় ১০০ জন আমার বাড়ি ঘিরে ফেলে। আমি তখন নওয়াপাড়া স্কুলে বিশ্রাম করছিলাম। এমন সময় কয়েকজন মিলিটারী স্কুলের ভিতরে ঢুকে আমাকে ধরে ফেলে এবং বন্দুকের বাঁট দিয়ে ভীষণ প্রহার করতে থাকে। তারপর তাদের গাড়িতে করে মিরপুর থানা শান্তি কমিটিতে নিয়ে যায়। শান্তি কমিটির চেয়ারম্যানের নাম চুনু চৌধুরী। আমাকে সেখানে নিয়ে যাওয়ার পর চুনু চৌধুরী আমাকে বললো- যাও, ডাক্তারের ঔষুধপত্র ভারতে পাঠাওগে। ডাক্তার সাহেবের ছেলে সুফি ছাত্রলীগ কর্মী ছিল। শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান নির্দেশ দিলেন আমাকে কেলুগড়া রাস্তার পার্শ্বে গুলি করে মারা হবে। কিন্তু ক্যাপ্টেন আমাকে না মেরে কুষ্টিয়া পাক হানাদারদের ঘাঁটিতে নিয়ে যায়। সেখানে নিয়ে গিয়ে বেত,লোহার রড ও বাঁশের লাঠি দিয়ে প্রহার করে, বৈদ্যুতিক শক দেওয়ার পরে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। তিন ঘন্টা পর জ্ঞান ফিরে পাই। আমার সমস্ত শরীর মারের চোটে ক্ষতবিক্ষত হয়ে বিভিন্ন জায়গা ফেটে রক্ত ঝরছিল। আমি ব্যথার যন্ত্রনায় অতিষ্ঠ হয়ে চিৎকার করতে লাগলাম। আমি একটু পানি চাইলে আমাকে পানি না দিয়ে প্রশাব এনে দিত। তিনদিন পর আমাকে মেজরের নিকট নিয়ে যায়। মেজর আমাকে দেখে তখনই তার স্টাফকে নির্দেশ দিল এ লোকটাকে এখনই হাসপাতালে ভর্তি কর। তারা আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করে দেয়। সেখানে দুমাস চিকিৎসার পর আমাকে মেজরের আদেশে কুষ্টিয়া জেলে পাঠিয়ে দেয়। থানার দারোগাকে চার হাজার টাকা দেবার পর দারোগা আমার অনুকূলে রিপোর্ট মেজরের নিকট পাঠায় এবং আমাকে নির্দোষী খালাস করে দেয়।

টিপসহি
মোঃ আব্দুল রশীদ মণ্ডল

ইব্রাহিম রাজু
<৮,২.৩.১৮৮,২২৮>

।।১৮৮।।
মোঃ আবুল কাসেম মণ্ডল
গ্রাম- ধর্ম্মদা, ডাকঘর- চর প্রাগপুর
থানা- দৌলতপুর, জেলা- কুষ্টিয়া

আমি সৈয়দপুর চাকুরী করতাম। ২৭ শে মার্চ পুলিশ লাইন পাক বাহিনীর অধীনে চলে যায়। সেই সময় পুলিশ লাইন থেকে আমাকে সহ বহু পুলিশকে পুলিশ লাইনেই অবরোধ এবং নজর বন্দী করে রাখা হয়। নজরবন্দী থাকাকালীন আমাকে দিয়ে যখন প্যারেড করিয়ে নিত। সারা দিন তাদের প্যারেড করতে হতো।

সকালে ২০ থেকে ২৫ জন পুলিশকে ধরে নিয়ে গিয়ে সৈয়দপুর এয়ারপোর্ট রানওয়ের জন্য মাটি কাটিয়ে নিত। কোন সময় দড়ি বেঁধে নিয়ে যেত। পরাজিত সৈনিকদের মত ব্যবহার করা হত। বিভিন্ন প্রশ্ন করত।কিন্তু আমি সব সময় কিছু জানিনে বলে নির্দোষ প্রমান করার চেষ্টা করেছি এবং প্রকৃতপক্ষে কিছুই জানতাম না। সামরিক ছাউনিতে আমাকে সাত (৭) দিন রাখে। সেই ৭ দিন খাবার দিত প্রত্যেকদিন সকালবেলা ১ খানা করে রুটি । ক্ষিদে কেউ যদি খাবার চেত তার উপর নেমে আসত দুর্যোগ। তাকে বেত দিয়ে,রাইফেলের বাঁট দিয়ে, ইলেকট্রিক তার দিয়ে বেদম প্রহার করা হত এবং বলতো আমাদের দেশে এইভাবেই খাদ্য দেয়। এই ভয়ে কেউ চেতো না।

সাত দিন পর আমাকে এস, পি কুঠিতে এনে নজরবন্দী করে রাখে। আমার বাড়ী পাক বাহিনী পাহাড়া দিয়ে রাখতো সেখান থেকে ঢাকাতে নিয়ে গিয়ে রাখে। এই সমস্ত পুলিশ দিয়ে এয়ারপোর্ট রাতের ডিউটি দিয়ে নিতো।

কিছুদিন এইভাবে অত্যাচার চালানোর পর এস,পি, জাকারিয়া সাহেব, আর, আই সাহেব এবং সাথে তিনজন পুলিশ ধরে নিয়ে যায় সামরিক ছাউনিতে। তিনজন পুলিশের মধ্যে এস,পি, সাহেবের দেহরক্ষী হিসেবে সামরিক ছাউনিতে আবদ্ধ করে রাখে।

আমাকে জিজ্ঞাসা করতো এস, পি সাহেব কোথায়, কোথায় কি করছে বল এবং তুমি কতজনকে হত্যা করেছো? সেই সময় আমার পায়ের তালুতে বেত দিয়ে আঘাত করত। পায়ের আঙ্গুলে বুটের চাপ দিয়ে এই সমস্ত তথ্য সঠিকভাবে বলার জন্য বল প্রয়োগ করত। পিন দিয়ে আঙুলের মাথায় আঘাত করে রক্ত বের করতো। সময় সময় ঘন ঘন পিনের আঘাত দিতো আর জানতে চেতো। সে সময় লোকজনকে মৃত লোকের খোঁজখবরের জন্য পুলিশ অফিসে পাঠিয়ে দিত। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কোন সংবাদই আমরা জানতাম না। মানুষকে কেবল ধোকা দেওয়ার জন্য এই চেষ্টা চালানো হতো। সামরিক বাহিনীর লোক বলে দিত যে তোমাদের নিহত,আহত ও নিখোঁজ লোকের সমস্ত খোঁজখবর পুলিশ অফিসে পাবে। যশোর থেকে দশ দিনের ছুটি নিয়ে আমি স্বাধীনতার দেড় মাস পূর্বে সীমান্ত পার হয়ে ভারত গিয়ে আশ্রয় নেই। সেখান হতে মাঝে মাঝে গ্রাম্য অপারেশন পার্টির সাথে তথাকথিত পূর্ব পাকিস্তানে ঢুকে বাংলাদেশের জন্য খণ্ড যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করি।

স্বাক্ষর
মোঃ আবুল কাসেম মণ্ডল
৭/১/৭১

ইব্রাহিম রাজু
<৮,২.৩.১৮৯,২২৯> “নদীর ধারে নিয়ে গিয়ে পানির ধারে এক এক করে সবাইকে গরু জবাই করার মত জবাই করে নদীতে ফেলে দেয়। এই ভাবে সবাইকে জবাই করার পর আমাকে ঠিক একই উপায়ে গলায় ছুরি চালায় এবং পানির ধারে ফেলে রেখে সবাই চলে যায়। কিন্তু তাদের ছোরাটা আমার শরীর হতে বিচ্ছিন্ন না করেই ফেলে রেখে যায়। ফলে আমি কোন অবস্থাতে আধা মরা অবস্থায় পানির ধারে পড়ে থাকি।“

।।১৮৯।।
শ্রী চিনিবাস সরকার
গ্রাম- দ্বারিকগ্রাম
শিলাইদহ
কুষ্টিয়া

১৯৭১ সালের আশ্বিন মাস রোজ রবিবার সকাল ৬ টার সময় মিলিটারী, রাজাকার, মিলিশিয়া মিলে প্রায় ৫০/৬০ জন আমাদের গ্রামে আসে এবং হিন্দু পাড়া ঘিরে নেয়। সকলেই মিলিটারীর কথা শুনে ছুটাছুটি করে পালাবার চেষ্টা করে। কিন্তু যে যেদিক দিয়ে গ্রামের বাইরে যেতে চায় সেই দিকেই মিলিটারী দিয়ে ঘেরা। আমি, কানাই, মোংলা, ভোলা, খালিশা, শ্রী পদ বাড়ী থেকে কোথাও যাই নি। তারপর পাক সেনারা এসে আমাদের কয়েকজনকে ধরে ফেলে এবং বলে শালা মালাউনকো, মুক্তি বাহিনীকো খানা খেলাও? আমরা তাদের কথা অস্বীকার করি। সাথে সাথে সেখানেই মোংলা কে গুলি করে হত্যা করে। তারপর আমাদের চারজনকে দুই হাত বেঁধে পদ্মা নদীর ধারে নিয়ে যায়। সেখানে নিয়ে আমাদের সবাইকে মাটিতে শোয়ায়। তারপর ১০/১২ জন পাক দালাল আমাদের পিঠের উপর উঠে খচতে থাকে। অবশেষে নদীর ধারে নিয়ে গিয়ে পানির ধারে এক এক করে সবাইকে গরু জবাই করার মত জবাই করে নদীতে ফেলে দেয়। এই ভাবে সবাইকে জবাই করার পর আমাকে ঠিক একই উপায়ে গলায় ছুরি চালায় এবং পানির ধারে ফেলে রেখে সবাই চলে যায়। কিন্তু তাদের ছোরাটা আমার শরীর হতে বিচ্ছিন্ন না করেই ফেলে রেখে যায়। ফলে আমি কোন অবস্থাতে আধা মরা অবস্থায় পানির ধারে পড়ে থাকি। তারপর ঘাড়ে হাত দিয়ে দেখতে পাই রক্ত ঝড়ছে। চারিদিকে তাকিয়ে দেখি কোথাও কোন লোক নেই। ধীরে ধীরে পানির ধার দিয়ে চলতে থাকি। একটা মাছ ধরার নৌকা নদী দিয়ে যাচ্ছিল। আমি নৌকার মাঝিকে অনুরোধ করে বললাম ভাই, আমাকে নদী পার করে দিবে? মাঝি আমাকে নদীর অপর পারে নামিয়ে দেয়। আমি নৌকা হতে নেমে একজন লোকের বাড়ীতে গিয়ে আশ্রয় নেই এবং একজন ডাক্তার দ্বারা চিকিৎসা করাই। আমি সেখান হতে শুনতে পাই পাক সেনারা আমাদের হিন্দু পাড়া আগুনে জ্বেলে পুড়িয়ে দিয়েছে এবং অনেক মেয়ের উপর পাশবিক অত্যাচার করেছে।

স্বাক্ষর/-
চিনিবাস সরকার

ইব্রাহিম রাজু
<৮,২.৩.১৯০,২৩০>

।।১৯০।।
মোঃ শহীদুল আলম
গ্রাম- তেবাড়িয়া
কুমার খালী
কুষ্টিয়া

১৯৭১ সালের ৮ ই ডিসেম্বর রোজ বৃহস্পতিবার সকালে ৭ টার সময় আমি ভারতের খবর শুনছি। এমন সময় ৬জন বিহারী অস্ত্রশস্ত্র সহ আমাদের বাড়ী গিয়ে আমাকে ডাকে। আমিও রেডিও বন্ধ করে তাদের সম্মুখে এসে হাজির হই। আমাকে জিজ্ঞেস করল, তোমার বাবা কোথায়? আমি জবাব দিই, ঘুমিয়ে আছেন। আমি আমার বাবাকে ডেকে দিই। বাবা তাদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তারা বাবাকে বলে তোমার বড় ছেলে কোথায়? আব্বা তার প্রতি উত্তরে বলেন, ছেলে কোথায় তা আমি বলতে পারি না। তারা আব্বা ও আমাকে সাথে করে পাকদালালরা কুমারখালী বাজারে নিয়ে আসে। সেই সময় শান্তিকমিটির দালাল একটা ফাঁকা ফায়ার করে অন্যান্য লোকজনকে সেখান হতে তাড়িয়ে দেয়। অতঃপর আব্বাসহ আমাকে ও অন্য একজনকে শান্তি কমিটির দালালের নির্দেশে গড়াই নদীর ধারে নিয়ে যায়। নদীর ধারে একটি ঘর ছিল সেখানে নিয়ে আমাদেরকে উক্ত ঘরের মধ্যে কিছু সময় রাখে। তারপর আমাকে পানির কিনারে নিয়ে যাওয়া হয়। পরিচিত এক পাক দালাল রাইফেল উচু করার সাথে সাথে আমি নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ি। সাতার কাটতে কাটতে নদীর পরপারের দিকে চলে যাই। আমাকে লক্ষ্য করে উক্ত দালাল বৃষ্টির ন্যায় এলোপাতারিভাবে গুলি ছুড়তে থাকে। আমি নদীর অপর পারে গিয়ে উঠি এবং হাটতে থাকি। এর মধ্যে একটা গুলি গিয়ে আমার হাতে লাগে। ঐ অবস্থাতেই আমি চলতে থাকি।এমন সময় অন্য একটা গুলি এসে আমার পায়ে লাগে। তখন আমি পড়ে যাই। পড়ে যাবার পরপরই দুটো ফায়ার হয়। আমার আব্বা ও সেই লোকটাকে তারা গুলি করে নদীতে ফেলে দেয়। তার কিছুক্ষন পর একজন রাজাকার নদী সাঁতরিয়ে আমাকে ধরার জন্য রওয়ানা হয়ে যায়। তখন আমি মৃত অবস্থায় বালির মধ্যে পড়ে থাকি। আমাকে মৃত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে সে নদী পার হয়ে চলে যায়। আনুমানিক ঘন্টা তিনেক পর আমার কয়েকজন প্রতিবেশী আমাকে মৃত জেনে নৌকা নিয়ে আমাকে আনার জন্য যায়। কিন্তু আমি বেঁচে আছি জেনে তারা ধরাধরি করে আমাকে নৌকায় তুলে বাড়ী নিয়ে আসে এবং আমার চিকিৎসা করায়। দেশ স্বাধীন হবার পর আমাকে কুষ্টিয়া হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য পাঠিয়ে দেয়া হয়। সেখান হতে কিছুদিন পর আমাকে রাজশাহী হাসপাতালে পাঠানো হয়। রাজশাহী হাসপাতালে পাঁচ মাস চিকিৎসা করার পর আমি বাড়ী চলে আসি।

স্বাক্ষর।।-
মোঃ শহীদুল আলম

ইব্রাহিম রাজু
<৮,২.৩.১৯১,২৩১-২৩২> “মেয়ের নাম আছিয়া। মেয়েটি অবিবাহিতা যুবতি ও সুন্দরী। সেই মেয়েটি পাক হানাদার বাহিনীর শিকার হয় এবং তার উপর পাশবিক অত্যাচার চালানোর দরুন সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে…তার কলঙ্কিত মুখ সমাজে দেখাবে না বলে রাত্রি কালে গলায় দড়ি দিয়ে মারা যায়।“

।।১৯১।।
মোঃ খন্দকার নূরুল ইসলাম
গ্রাম- বাটিয়ামারা
থানা- কুমারখালী,
জেলা- কুষ্টিয়া

১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে ৮ তারিখে বাটিয়া মারা গ্রামে ৭ জন মুক্তিযোদ্ধা এসে আশ্রয় নেয়। মিলিটারীদের ক্যাম্প ছিল কুমারখালী থানা কাউন্সিলে, আর রাজাকার বাহিনী ও মিলিশিয়াদের ক্যাম্প ছিল কুমারখালি রেল ষ্টেশনে। পাক সেনাদের মেজর ও ক্যাপ্টেন থাকতো কুমার খালী থানা ডাক বাংলোয়।

৮ ই ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনীর দল সকাল ৮/১০ টার সময় মণ্টুদের ঘরের মধ্যে ভাত খাচ্ছিলো। এমন সময় রাজাকার, মিলিটারী ও মিলিশিয়া মিলে প্রায় ৬০/৭০ জনের বাহিনী বাটিয়া মারা মণ্টুদের বাড়ী চতুর্দিকে হতে ঘিরে নিয়ে গোলাগুলি শুরু করে এবং মুক্তি বাহিনীর
প্রস্তুতি নেবার পূর্বেই পাক হানাদার বাহিনী এসে তাদেরকে হাতিয়ার সমেত ধরে ফেলে ও পরে তাদেরকে প্রহার করতে করতে থানা কাউন্সিলে নিয়ে যায়। থানা কাউন্সিলের পূর্ব দিকে একটা আম বাগানে গর্ত করে রাত্রি ৮ টার সময় তাদেরকে সেখানে নিয়ে গিয়ে লাইন করে দাঁড় করিয়ে মেশিন গানের গুলিতে হত্যা করে উক্ত গর্তের মধ্যে ফেলে মাটিচাপা দিয়ে রেখে চলে আসে।

তার পরদিন পাক হানাদার বাহিনী বাটিয়ামারা গ্রামে যায় এবং উক্ত গ্রামের প্রত্যেকটা বাড়ি আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়। মেয়েদের উপর চালায় পাশবিক অত্যাচার। আবার তারা থানা কাউন্সিলে ফিরে আসে। আজও বাটিয়ামারার অনেক বাড়িতে ঘর উঠে নাই।

তার ৪/৫ দিন পর পাক বাহিনী কল্যাণপুর গ্রামে অপারেশনে যায় এবং নাম না জানা অনেক মেয়ের উপর পাশবিক অত্যাচার করে। তার মধ্যে কল্যাণপুরের একটা মেয়ের নাম আছিয়া। মেয়েটি অবিবাহিতা যুবতি ও সুন্দরী। সেই মেয়েটি পাক হানাদার বাহিনীর শিকার হয় এবং তার উপর পাশবিক অত্যাচার চালানোর দরুন সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। পাক হানাদার বাহিনী সেই গ্রাম হতে কুমারখালী চলে আসলে সে জ্ঞান ফিরে পায় এবং তার কলঙ্কিত মুখ সমাজে দেখাবে না বলে রাত্রি কালে গলায় দড়ি দিয়ে মারা যায়।

পাক হানাদার বাহিনীর ক্যাপ্টেন থানা কাউন্সিলের যে ডাক বাংলোয় থাকতো সেই ডাক বাংলোর সম্মুখে একটি কচুরীপানায় ভর্তি পুকুর ছিল। সেই পুকুরে প্রায় ২/৪ দিন পর পর ২/৪ টা সুন্দরী মহিলার লাশ শাড়ি পরা অবস্থায় ভাসতে দেখা যেত।

আমাদের অনুমান এই যে গাড়ীতে যে সকল মহিলা চলাফেরা করতো তাদেরকে গাড়ী হতে নামিয়ে ডাক বাংলোয় নিয়ে এসে তাদের উপর পাশবিক অত্যাচার করে পরে বেয়োনেট চার্জ করে হত্যা করে উক্ত পুকুরে ফেলে রাখতো।

একদিন দু’জন মিলিটারী একটা রাজাকার কে বলছে, আচ্ছা দোস্ত আওরাত মিলিয়ে দাও না। তখন রাজাকারটা তাদেরকে একটা বাড়ীতে নিয়ে যায়। মিলিটারীদের খবর পেয়ে উক্ত বাড়ীর পুরুষ মহিলা সবাই বাড়ী ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়। রাজাকার ও মিলিটারী দুটি উক্ত বাড়ীর মধ্যে ঢুকে আর কোন লোক খুঁজে পায় না। তখন মিলিটারী দুটি উক্ত রাজাকারকে বলে আচ্ছা দোস্ত তোমার ডেরা কোথায়? তখন রাজাকারটা তাদেরকে সাথে নিয়ে নিজ বাড়ী যায় এবং পাক সেনারা তার বাড়ি গিয়েই ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে। তারা দেখতে পায়, ঘরের মধ্যে উক্ত রাজাকারের মাতা বসে আছে। তারপর একজন পাক সেনা ঘরের বাইরে চলে আসে এবং উক্ত রাজাকারের বুকে রাইফেল ধরে রাখে। আর একজন পাক সেনা তার বৃদ্ধা মাতার উপর পাশবিক অত্যাচার চালায়। তারপর দ্বিতীয় জন গিয়ে পাশবিক অত্যাচার করে। প্রথম জন এসে রাজাকারকে পাহারা দিতে থাকে। তারপর তাদের কাজ শেষ হলে তারা ক্যাম্পে চলে আসে। পরে উক্ত সংবাদ রাজাকার ক্যাম্পে ছড়িয়ে পড়লে উক্ত রাজাকার আর ক্যাম্পে না গিয়ে কোথায় যে চলে গেল তার আর কোন খোঁজ পাওয়া গেল না। উক্ত ঘটনা হতে জানা যায় যে পাক সেনাদের হাত থেকে তাদের আত্নীয় বা বন্ধুদের স্ত্রী, মা, বোন ও মেয়েরা রেহাই পায়নি। এমনকি শান্তি কমিটি জামাতে ইসলামী বা মুসলিম লীগের লোকেরাও না।

স্বাক্ষর।।-
মোঃ খন্দকার নূরুল ইসলাম

ইব্রাহিম রাজু
<৮,২.৩.১৯২,২৩৩-২৩৪>

।।১৯২।।
মোঃ বজলুল করিম
গ্রাম- দুর্গাপুর
থানা-কুমারখালী
জেলা-কুষ্টিয়া

১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসের ১০ তারিখ রোজ মঙ্গলবার আমি বাজারে রেশন তোলার জন্য যাই এবং রেশন তুলে বাড়ী আসি। দুর্গাপুর স্কুলের সামনে মুজাহিদ ক্যাম্প ছিল। দ্বিতীয়বার বাজারে যাবার সময় দুর্গাপুর স্কুলের সম্মুখের মুজাহিদ ক্যাম্প থেকে কয়েকজন মুজাহিদ আমাকে ধরে জিজ্ঞাসা করলো, “তোমাদের গ্রামে মুক্তিফৌজ আছে?” আমাকে আরও জিজ্ঞাসা করলো তোমার ভাই কোথায়? আমাদেরকে বলে দিতে হবে। উত্তরে আমি বললাম আমাদের গ্রামে কোন মুক্তিফৌজ নাই এবং আমার বড় ভাই কোথায় তা আমি জানি না। তখন তারা আমাকে ঘরের মধ্যে নিয়ে যায়। তারপর তিনখানা বাঁশের লাঠি নিয়ে এসে আমাকে মারতে থাকে। মারের চোটে তিনখানা লাঠিই ভেঙ্গে যায়। মারের যন্ত্রণায় আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাই। আবার যখন আমার জ্ঞান ফিরে আসে তখন আনুমানিক বেলা চারটা।একজন বিহারী আমার নিকট আসে এবং আমার দুহাত বেঁধে ঘরের ধর্ণার সঙ্গে ঝুলিয়ে আবার বাঁশের লাঠি দিয়ে প্রহার করতে থাকে। আমি অজ্ঞান হয়ে পড়লে আমাকে নামিয়ে মাটিতে ফেলে রাখে। তারপর আমার জ্ঞান ফিরলে আমি বললাম ভাই আমাকে এক গ্লাস পানি দেবেন? তখন সেই বিহারী উত্তর করলো, পানি হবে না। তখন তৃষ্ণায় আমি অতিষ্ট হয়ে পড়ে থাকি। সে দিনই বিকাল ছ’টার সময় মিলিটারী, রাজাকার, মুজাহিদ ও বিহারী মিলে প্রায় ৫০-৬০ জন হাশেমপুর অপারেশন করে দু’জন লোককে ধরে নিয়ে দুর্গাপুর ক্যাম্পে আসে। তারা এসে আমাকে বলতে থাকে রানু কোথায় তোমাকে বলতেই হবে। আমি অস্বীকার করি, তখনই তারা কেউ কেউ রাইফেল দিয়ে, কেউ কেউ বেতের লাঠি দিয়ে, আবার কেউ কেউ ছোরা দিয়ে আমাকে মারতে থাকে। তাদের মারের চোটে আমার সারা শরীর দিয়ে রক্ত ঝরতে থাকে। আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকি। তারপর হাশেমপুর থেকে যে দুটো লোককে ধরে নিয়ে এসেছিল তাদেরকে আমার মত মেরে আমার সঙ্গে একই জায়গায় রেখে দেয়। তারপর দিন আবার তারা ঘাসখালী অপারেশনে যায় এবং ১৪ জন লোককে ধরে নিয়ে কুমারখালী থানা কাউন্সিলে রেখে দেয়। তাদের মধ্যে ছিল ৬ জন মুক্তিবাহিনীর, উক্ত ৬ জন অস্ত্র সমেত ধরা পড়ে। এর মধ্যে আমার আব্বা আমাকে ছাড়িয়ে আনার জন্য শান্তি কমিটির চেয়ারম্যানের নিকট যান। কিন্তু চেয়ারম্যান বলে আগামী কাল যা হয় করা যাবে। তখন রাতে যাওয়া ভালো হয় না। আমার আব্বা ফিরে চলে আসেন। এর মধ্যে রাতে আমরা দেখতে পাই স্কুলের পূর্বে পার্শ্বে দুটি এবং পশ্চিম পার্শ্বে ১টা কবর খোঁড়া হয়েছে। তখন আমরা মরার জন্য দিন গুনছিলাম। আমার পিতা আমার মামাকে আমার জন্য চেষ্টা করতে বললেন। আমার মামার এক বন্ধু যশোর ক্যান্টনমেন্টের মিলিটারী ইন্সপেক্টর ছিলেন। মামা তার কাছে টেলিফোন করেন এবং একটা লিখিত চিঠি পাঠান আমাকে মুক্তি দেবার জন্য। তারপর বেলা ১২ টার সময় শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান এবং মেজর এসে আমাকে ডাকে। আমি উত্তর করি আমি হেঁটে যেতে পারি না, কারন আমার সারা শরীর মারের চোটে ফুলে গেছে এবং ব্যথা করছে সর্বাঙ্গ। তখন একজন মিলিটারী আমার নিকট পাঠিয়ে দেয়। আমি তার কাঁধে ভর দিয়ে মেজরের নিকট যাই। তারপর মেজর আমাকে বলে “তুমি মুক্তি “। তখন শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান আব্বাকে বলে “তোমার ছেলেকে নিয়ে যাও”। আমার পিতা আমাকে নেবার জন্য একটা রিক্সা ভাড়া করেন। কিন্তু রিক্সায় উঠার মত অবস্থা আমার ছিল না বলে আমি রিক্সাওয়ালাকে ফিরিয়ে দেই এবং আব্বার কাঁধে ভর দিয়ে বাড়ী আসি। বাড়ীতে আসার পর শুনতে পেলাম আমার সঙ্গে যে দু’টি লোককে ধরে রেখেছিল তাদেরকে আমি বাড়ি আসার পরপরই জবাই করে পূর্বে উল্লিখিত গর্তে পুঁতে রেখেছে। আর থানা কাউন্সিলে যে ১১ জনকে ধরে এনেছিল তাদেরকে থানা কাউন্সিলের পূর্বে একটা আম বাগানের ভিতর সবাইকে চোখ বেঁধে নিয়ে যায়। সেখানে তাদের দিয়েই গর্ত করিয়ে অবশেষে রাত আটটার সময় লাইন করে গুলি করে মেরে ফেলে। এবং পাশাপাশি দু’টি কবরের মধ্যে ১১ জনকে পুঁতে রাখে। আমি বাড়ী এসে দেড় মাস চিকিৎসা হবার পর সুস্থ হই।

স্বাক্ষর।।-
বজলুল করিম

ইব্রাহিম রাজু
<৮,২.৩.১৯৩,২৩৫>
।।১৯৩।।
মোঃ রাজাই সরদার
গ্রাম- মহেন্দ্রপুর
ডাকঘর- বানিয়াকাঁধি
থানা- কুমারখালী,
জেলা- কুষ্টিয়া

১৩৮৮ সাল ২০ শে আশ্বিন রোজ বুধবার পাক বাহিনী দালাল মারফত খবর পায় যে চর ভবানী পুরে খবির উদ্দিন বিশ্বাসের বাড়ীতে মুক্তিবাহিনী থাকে। ঐ খবর পেয়ে প্রায় ৪০/৫০ জন মিলিটারী বিহারী ও রাজাকার ঐ তারিখে ঐ গ্রামটা ঘেরাও করে এবংঐ গ্রাম থেকে ৮ জন যুবক ছেলেকে ধরে। তাদের ধরার পর জিজ্ঞেস করে তোমরা মুক্তিবাহিনী। তোমাদেরকে গুলি করে মারা হবে। কিন্তু যুবক ছেলে কয়টা উত্তর দেয় আমরা জমি চাষ করি। আমরা মুক্তিবাহিনী নই বা মুক্তি বাহিনী কেমন দেখা যায় আমরা তাদের দেখি নাই। ছেলে ৮ টা কে তখন মহেন্দ্রপুর নামক একটা গ্রামে নিয়ে যায়। এবং সেখানে নিয়ে গিয়ে নানা রকম প্রশ্ন জিজ্ঞাসাবাদের পর সবগুলিকে লাইন করে বসায়। তারপর বুট দিয়ে বল শট করার মত লাথি, গুতা এবং বন্দুকের বাঁট দিয়ে তাদের শরীরের বিভিন্ন জায়গায় মারার দরুন তাদের শরীরের বিভিন্ন স্থান ভেঙ্গে যায় এবং মারের চোটে রক্ত বেরুতে থাকে। পরে একটা আম বাগানের মধ্যে নিয়ে তাদের ৮ জনকে এক এক করে জবাই করে ফেলে রেখে তারা কুমারখালী থানা কাউন্সিলে চলে যায়।

ঐ মাসের ২৭ তারিখে দয়ারামপুরে পাক মিলিটারী যায় এবং সেই গ্রামে গিয়ে দিবুক সরদারকে জিজ্ঞাসা করে গোন্ধের বাড়ি কোনদিকে। দিবুক সরদার উত্তর করে আমি বলতে পারবো না। তখন একটা পাক মিলিটারী – বলে কি? বলতে পারবে না?- এই বলে তাকে সঙ্গে সঙ্গে বেয়োনেট দিয়ে খুচিয়ে মেরে ফেলে তারপর গোন্ধের বাড়ী গিয়ে দেখে কেউ বাড়ীতে নেই। তারপর তার বাড়ীতে আগুন ধরিয়ে দেয়। ঐ আগুন ধরিয়ে দেওয়া দেখে গ্রামের হিন্দু-মুসলমান সবাই ছোটাছুটি করতে থাকে। তারপর ৬ জন হিন্দুকে পাক মিলিটারীরা ধরে ফেলে এবং বলে এ গ্রামের সব গুলো মালাউনের বাড়ী দেখিয়ে দাও তাহলে তোমাদের ছেড়ে দেবো। লোক ৬ জন নিজেদের প্রাণের ভয়ে সবগুলি হিন্দু বাড়ী দেখিয়ে দেয়। অমনি তারা সব গুলো হিন্দু বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। গ্রামে ৫০/৫২ খানা হিন্দু বাড়ি তারা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। পরে ঐ গ্রাম থেকে যাবার সময় ঐ ৬ জন লোককে গুলি করে মেরে রাস্তায় ফেলে রেখে যায়।

স্বাক্ষর/-
মোঃ রাজাই সরদার
১৯/১২/৭২

ইব্রাহিম রাজু
<৮,২.৩.১৯৪,২৩৬>

।।১৯৪।।
মোঃ দিয়ানত আলী খান
গ্রাম- মালি গ্রাম
ডাকঘর- জানিপুর
জেলা- কুষ্টিয়া

১৩৮৮ সালের ১ লা শ্রাবণ শনিবার রাত্রি ৯ টার সময় প্রায় ৩০/৪০ জন মিলিটারী, মুজাহিদ, রাজাকার ও বিহারী মিলিয়া আমার বাড়ী ঘেরাও করে এবং আমাকে জিজ্ঞাসা করে আপনার ছেলে আলাউদ্দিন কোথায়? তার প্রতি উত্তরে আমি বলি কোথায় বলতে পারিব না। তখন তাহারা আমাকে এবং আমার মেঝ ছেলেকে ধরিয়া রাত্রি সাড়ে বারোটার ট্রেইনে কুষ্টিয়া নিয়া যায় এবং সেখানে হাজতে রাখিয়া দেয়। তার পরদিন হাজত হতে বাহির করিয়া মেজরের সামনে হাজির করে। মেজর আমাকে জিজ্ঞাসা করে আপনার ছেলে আলাউদ্দিন কোথায়? তাহাকে যদি আনিয়া দিতে পারেন আপনাকে ছাড়িয়া দিব। আমি মেজরের কথা প্রত্যাখান করি। তখন মেজরের আদেশে আমাদেরকে তাদের ক্যাম্পের দোতলায় নিয়া যায় এবং সেখানে আমাদের সঙ্গে আরও তিনজন ছিল। তার ঘন্টা খানেক পর একজন মিলিটারী সেই ঘরের দরজা খুলিয়া ঘরের মধ্যে ঢুকিয়া আমার ছেলেকে কারেন্টের তাদের সঙ্গে দুই পা ঠেকাইয়া দেয় এবং বেতের লাঠি দিয়া ভীষণ প্রহার করে। তারপর আমার অনুরোধে মারা বন্ধ করিয়া দিয়া ঘরের দরজা বন্ধ করিয়া চলিয়া যায়। সন্ধ্যার পর আমাকে এবং আমার ছেলেকে মেজরের নিকট নিয়া হাজির করে। মেজর সেই একই প্রশ্ন বার বার জিজ্ঞাসা করে। কিন্তু আমি অস্বীকার করি। তারপর আমাদের থানা হাজতে পাঠাইয়া দেওয়া দিল। সেখানে ৪/৫ দিন থাকার পর আবার জেলে পাঠাইয়া দেয়।

এর মধ্যে ডাঃ মালিক পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হইয়া ঘোষনা করে যাহাদেরকে সন্দেহ করিয়া ধরিয়া আনিয়া হাজতে রাখা হইয়াছে তাহাদেরকে ২৪ ঘন্টার মধ্যে ছাড়িয়া দেয়া হউক। আমরা কুষ্টিয়া জেলে মোট ১০১ জন আসামী ছিলাম। তাহার মধ্যে মোট ৪৭ জনকে ছাড়িয়া দেয়। আমরাঐ ৪৭ জনের সঙ্গে মুক্তি পাই। আমাকে এবং আমার ছেলেকে মোট ১ মাস ২২ দিন জেলে রাখে।

স্বাক্ষর।।-
মোঃ দিয়ানত আলী খান

ইব্রাহিম রাজু
<৮,২.৩.১৯৫,২৩৭>
।।১৯৫।।
গৌরাঙ্গ বিশ্বাস
গ্রাম- নারায়ণপুর
ডাকঘর- জানিপুর
থানা- খোকসা
জেলা- কুষ্টিয়া

১৯৭১-এর ২৩ শে মার্চ রবিবার পাক-বাহিনীর ভয়ে ভারতের দিকে যাত্রা করি। পাক-বাহিনী রবিবারে জানিপুরে এসে আশ্রয় নেয়। রবিবার পরিবারসহ খোকসা থানার অধীনে বাহরামপুরের মাঠে একটা আম গাছের নীচে রাত্রি কাটাই। সকালে আমি ও অমিয় কুমার সাহা সাইকেল আনার জন্য আবুল মিয়ার বাড়ীতে আসার পথে কমলাপুর খালের মধ্যে পাক-বাহিনীর সাথে দেখা হয়। পাক-বাহিনী রাজাকার ও শান্তি কমিটির চেয়ারম্যানসহ গ্রাম অপারেশনে যাচ্ছিল। পাক-বাহিনী আমাদের দু’জনকে আনতে বলে তখন আমরা পালাবার সুযোগ না পেয়ে থেমে যাই। পাকবাহিনী শান্তি কমিটির চেয়ারম্যানকে জিজ্ঞাসা করে এরা আদাব দিলো কেন। চেয়ারম্যান বলে যে এরা দু’জন মালাউন। অমিয় কুমারের (সি, ও অফিসের কেরানী, খোকসা) খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলো শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান। মালাউনের কথা শুনে পাক বাহিনী আমাদের বলে যে টাকা পয়সা যা আছে তা দিয়ে দাও। আমরা টাকা পয়সা সোনাদানা দিয়ে জীবন ভিক্ষা চাইলাম কথা সর্বস্ব দিয়ে দিলাম। তখন পাক-বাহিনী আমাদের হাত বেঁধে ফেললো। কমলাপুরের ব্রিজের পাশে রাস্তার ধারে লাইন করে দাঁড় করিয়ে দেয় এবং গুলি করে। অমিয় কুমার তার শিশুদের জন্য অসহায়ের মত তাদের কাছে জীবন ভিক্ষা চেয়ে ব্যর্থ হলো। গুলি হলে অমিয় কুমারের বক্ষ ভেদ করে আমার মাথায় লাগে। অমিয় কুমার নিহত হয় আর অমিয় কুমারের চিৎকার ও পাক বাহিনীর বিভৎস হাসি শুনে এবং জীবনের কথা চিন্তা করে আমি অজ্ঞান হয়ে যাই। মাথা দিয়ে রক্ত ঝরতে থাকে। দু’দিন
ঐ রাস্তার ধারে খালে অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে থাকি। দু’দিন পর আফতাব মুন্সির ছেলেরা খাল হতে পাশে পানের বরজে আশ্রয় দেয়। সেখানে আমাকে চিকিৎসা করেন।

ডাক্তারের চিকিৎসার সুযোগ ছিলো না। কারন পাক-বাহিনী বা দালালের কানে পৌছাল তার মৃত্যুর কারন হয়ে দাঁড়াতো। আফতাব মুন্সির বাড়ীতে বা তার অধীনে দীর্ঘ আড়াই মাস চিকিৎসা হবার পর সুস্থ হলে ভারতে চলে যাই।

স্বাক্ষর।।-
শ্রী গৌরাঙ্গ বিশ্বাস

ইব্রাহিম রাজু
<৮, ২.৩.১৯৬,২৩৮> “জোয়ারে অসংখ্য মৃতদেহ দেখতাম । মৃতদেহের উপর আমরা বহুবার আশ্রয় নিই।“

।।১৯৬।।

ভারতী দেবী চক্রবর্তী
বগুড়া রোড, বরিশাল

১৮ ই এপ্রিল বরিশালে পাক সেনারা ব্যাপক বোমা ফেলে । আমরা আশ্রয় নিই আলুকদিয়া গ্রামে। ওখানে এক মাস থাকি । আমার স্বামী বরিশালে আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ছিলেন । এই সংবাদ প্রচার হয়ে গেলে গৃহস্বামী আমাদের রাখতে অস্বীকৃতী জানায়। শুনলাম হিন্দুরা সব আটঘর কুড়িয়ানাতে আশ্রয় নিচ্ছে । স্থান ছিল দুর্গম, চারিদিকে জল, খানসেনা যেতে পারবে এমন ধারনা কারো ছিল না । আমরা কুড়িয়ানাতে আশ্রয় নিই। ওখানে পর পর ৩৬ টি গ্রাম সম্পূর্ণ হিন্দুর বাস । মে মাসে আমি আটঘর কুড়িয়ানাতে আশ্রয় নিই । আমরা অরূন চক্রবর্তীর বাড়িতে থাকি । ওখানে আরো প্রচুর লোক আশ্রয় নেয় ।

মে মাসের শেষের দিকে খান সেনারা কুড়িয়ানাতে পৌছে অরুণ চক্রবর্তীর বাড়ি ঢুকে মন্দির , ঘর সব ধ্বংস করে ওখানে পাক ছাউনী করে। সমস্ত গ্রাম খান সেনারা পুড়িয়ে দেয়। আমরা ২/৩ হাজার লোক পিয়ারা বাগানে আশ্রয় নিই । খান সেনারা বাগান কাটা শুরু করলো । আমরা বাগানের খালের জলের ভিতর বেলা ১০ টায় নামতাম, বেলা ৪/৫ টার দিকে জল থেকে উঠে বাগানের উঁচু জায়গায় বসতাম । সকালে এসেই খান সেনারা গুলি চালাতো । যারা একটু আধটু মাথা উচু করেছে সাথে সাথে মারা গেছে । ঐ ভাবেই দেড় মাস থাকি । দেড় মাসের মধ্যে আমরা ভাত খেতে পারি নি , পেয়ারা এবং আখের রস খেয়েছিলাম । বাগান কাটতে থাকে আমরা পিছাতে থাকি । জোয়ারে অসংখ্য মৃতদেহ দেখতাম । মৃতদেহের উপর আমরা বহুবার আশ্রয় নিই।

পাকসেনারা প্রত্যহ মানুষ ধরে হত্যা করেছে । ঐ বাগানে লাইন দিয়ে দেড় মাসের মধ্যে ২ হাজারের মত লোককে হত্যা করে । ওখানে আমাদের মত যারা আশ্রয় নিয়েছিল তারাই বেশী মারা গেছে । লাইনে দাড় করিয়ে আমাদের সবকিছুই খুলে নেয় । পাশবিক অত্যাচার চালায় অসংখ্য নারীর উপর । আমার স্বামীকে ধরে ফেলে পাক সেনারা নৃসংশভাবে হত্যা করে । গ্রামে গঞ্জে রাজাকাররা আমাদের উপর চালিয়েছে অকথ্য অত্যাচার । আটঘর কুরিয়ানা থেকে আমি হেটে হেটে মাইলের পর মেইল অতিক্রম করে বরিশালে বিভিন্ন স্থানে আত্নগোপন করে থাকি।

স্বাক্ষর/
ভারতী দেবী চক্রবর্তী
২০/৯/৭৩

ইব্রাহিম রাজু
<৮,২.৩.১৯৭,২৩৯> “লোকজন তখন ভাবতো মুসলমান হলে মারবে না । পাক সেনারা সবাইকে একত্র করে দুর্বল লোকদের ছেড়ে শক্ত সমর্থ লোকদের পুকুরে নেমে সাঁতার কাটতে বলে । সবাই সাঁতার কাটা শুরু করলে এক এক করে গুলি করে হত্যা করে, তামাশা দেখে।“

।।১৯৭।।

ইমদাদুল হক মজুমদার
অধ্যক্ষ, বজ্রমোহন কলেজ
বরিশাল

প্রতি রাতে পাক বাহিনী অসংখ্য লোককে হত্যা করেছে । দিনের বেলায় ট্রাক ভর্তি করে লোক ধরে আনতো । প্রথম দিকে গুলি করে হত্যা করতো । পরের দিকে জবাই করেছে । অসংখ্য লাশ নদীতে ভাসতে দেখেছি । বেয়োনেট দিয়ে পেট চিড়ে ফেলে রাখতো । আমার ধারণা ৭৫,০০০ মোট লোককে পাক বাহিনীরা হত্যা করছে বরিশালে ।

পাথরহাটা , বাওয়াল (পটুয়াখালী সীমান্তে) নামক স্থানে পাক সেনারা গেলে লোকজন সব দেখতে আসে । লোকজন তখন ভাবতো মুসলমান হলে মারবে না । পাক সেনারা সবাইকে একত্র করে দুর্বল লোকদের ছেড়ে শক্ত সমর্থ লোকদের পুকুরে নেমে সাঁতার কাটতে বলে । সবাই সাঁতার কাটা শুরু করলে এক এক করে গুলি করে হত্যা করে , তামাশা দেখে ।

ইয়াহিয়ার সাধারন ক্ষমা দেওয়ায় অনেকেই বাইরে বেরোয় । নজরুল , আলমগীর , হাই, শাহাবুদ্দিন (তপন) এরা স্বাধীনতা সংগ্রামে বলিষ্ঠ ভূমিকা নিয়েছিলো । বাইরে বেরোলে পাক সেনারা তাদের ধরে নিয়ে গিয়ে নৃসংশভাবে হত্যা করে ।

অসংখ্য মেয়ে ধর্ষিতা হয়েছে এই শহরে । পাক সেনারা খবর পেয়ে রাত্রে গিয়ে মেয়েদের ধরে নিয়ে আসতো এবং অত্যাচার চালাতো । বাড়ি বাড়ি ঢুকে সব লুট করে ধ্বংস করেছে জ্বালিয়েছে অসংখ্য বাড়ি ঘর । বরিশাল মহিলা কলেজের অধ্যাপিকা এবং তার সাথে আর একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রিকে অস্ত্রসহ পাক বাহিনীরা গৌরনদী অথবা উজিরপুর এলাকার কোন একটি বাংকার থেকে ধরে আনে। বহু অত্যাচার চালায় ওদের উপর তথ্য নেবার জন্য । কিন্তু কোন কথা বের করতে পারে নি । পরে ওদেরকে হত্যা করে । মেয়ে দুজন বলেছে তোমরা হত্যা কর, কিন্তু কোন কথা পাবে না । অত্যাচারের মাত্রা বেড়েছে কিন্তু কোন কথা বের করতে পারেনি। বাড়ী বাড়ী থেকে পাক সেনারা ছাগল, ডিম, এসব নিয়ে আসতো জোর করে । আমার কাছে মুক্তিবাহিনীরা আসতো তাদের জামা কাপড়, খাওয়া এবং বিভিন্ন খবর নিয়মিত দিতাম ।

স্বাক্ষর/-
ইমদাদুল হক মজুমদার

ইব্রাহিম রাজু
<৮,২.৩.১৯৮,২৪০-২৪৪> “আমি নিজ চোখে দেখেছি যে দুইজন দুই দিক থেকে একটা লোককে পা টেনে ধরত আর একজন কুঠার বা দা দিয়ে দুই ভাগ করে ফেলতো ।“

।।১৯৮।।

উপেন্দ্রনাথ দত্ত
গ্রাম -রাজারহাট
ডাকঘর ও থানা- পিরোজপুর
জেলা -বরিশাল

৪ঠা মে, পাক বাহিনী পিরোজপুর আসে। খান সেনারা শহরে প্রবেশ করে দালাল শ্রেণীর কতকগুলি লোককে শহর থেকে লুট করতে বলে । এই সময় তাদের নির্দেশ দেয় যে তোমরা লুট করো কিন্তু ঘর দুয়ার নষ্ট করো না । পাক বাহিনী রাস্তায় যে সব লোকদের পায় তাদেরই সবাইকে গুলি করে হত্যা করে । প্রথম অবস্থায় হিন্দু, মুসলমান কোন কিছু তারা নির্ণয় না করে একাধারে সবাইকে গুলি করে মেরেছে ।

একজন দালালের কাছে আমি এই সময় বলি যে ভাই আমার দোকানে পায় লাখ টাকার মাল আছে , তুমি এগুলো রক্ষা কর । প্রয়োজন হলে তোমার হেফাযত নিয়ে নাও । তার উত্তরে সে আমাকে জানায় যে, আপনার কোন চিন্তা নাই । আপনার কোন ক্ষতি আমরা করবো না । আমি আমার সমস্ত কিছু তার কাছে বুঝিয়ে দিয়ে নদীর অপর পারে চলে গেলাম ।

আমি সারাদিন নদীর অপর পারে পালিয়ে বেড়াতাম । বিকালের দিকে যখন খান সেনারা তাদের ব্যারাকে ফিরে যেত তখন আমি নদী পার হয়ে টাউনের ভিতর চলে আসতাম । এবং যতদূর সম্ভব গা ঢাকা দিয়ে শহরের ভিতর ঘুরে ঘুরে অবস্থা দেখতাম ।

পাক বাহিনী আসার পর পাক বাহিনীদের সহযোগী একটা দল সৃষ্টি হয় । পরবর্তী কালে এই দলই বিভিন্ন অত্যাচারের ক্ষেত্রে পাক বাহিনীকে পরিচালনা করেছে । প্রথম দিকে পিরোজপুরের বিভিন্ন অঞ্চলে লুট করেছে , পরবর্তী পর্যায়ে বাড়ী ঘর ভেঙ্গে নিয়ে যায় এবং জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ধ্বংস করে দেয় ।

মে মাসের শেষের দিকে ব্যাপকভাবে বিভিন্ন জায়গা হতে লোক ধরে এনে পিরোজপুর জেটি ঘাঁটে এনে গুলি করে হত্যা করেছে । এমন দিন ছিল না যে ৫০/৬০ জন লোক হত্যা না করেছে। পাক বাহিনী গড়ে প্রত্যেক দিন ১০০ করে লোককে হয়া করেছে। প্রথম দিকে যখনই লোক ধরে আনতো তখনই দিবালোকে গুলি করে হত্যা করেছে । ২য় পর্যায়ে পাক বাহিনী যে সব লোককে ধরে আনতো তাদেরকে সন্ধ্যার পরে গুলি করে মেরেছে ।

প্রথম দিকে যে সব লোক মারা হত তাদের বেশির ভাগ গুলি করেই হত্যা করেছে । শেষের দিকে যে সব লোককে ধরে আনতো তাদের প্রথম ভীষণভাবে মারধর করতো তারপর বেয়োনেট দিয়ে চার্জ কোড়ে হত্যা করত । অনেক সময় আমি নিজ চোখে দেখেছি যে দুইজন দুই দিক থেকে একটা লোককে পা টেনে ধরত আর একজন কুঠার বা দা দিয়ে দুই ভাগ করে ফেলতো ।

ইয়াহিয়া খানের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার থেকে দুই চারজন ধোপা , নাপিত , কামার , কুমার শহরে আসতে শুরু করে । যারা এই সময়ে শহরে আসতো তাদের প্রত্যেককেই শান্তি কমিটির কাছ থেকে পাকিস্তানী ব্যাজ শরীরে লাগিয়ে নিতে হতো।

শহরে রাজাকার গঠিত হবার পর শহরের পরিস্থিতি কিছুটা ঠান্ডা হলেও রাজাকারেরা ব্যাপকভাবে গ্রাম হতে গ্রামে অভিযান চালিয়ে বহু লোককে ধরে আনতো ।

পাকসেনা আসার ১ মাস ১০ দিন পর্যন্ত আমি বলেশ্বর নদীর অপর পারে আমার বিরাট ফ্যামিলি নিয়ে গ্রাম হতে গ্রামে ঘুরে কাটিয়েছি । এই সময় অধিকাংশ দিন আমাকে এক বেলা কচুর শাক এবং বিভিন্ন শাকসব্জি খেয়ে কাটাতে হয়। পরে অনন্যোপায় হয়ে আমি শান্তি কমিটির সঙ্গে যোগাযোগ করি । তারা আমাকে শহরে আসতে বলে ।

জুন মাসে ১৫ তারিখে আমি নদী পার হয়ে শহরে আসি এবং একজন লোকের সহায়তায় শান্তি কমিটির অফিসে যাই । শান্তি কমিটির সেক্রেটারী আবদুস সাত্তার মিয়া আমাকে ঘরের পিছনে দিকে এক জায়গায় বসতে দেয় । ঐ দিন শান্তি কমিটির মেম্বারদের একটা অধিবেশন ছিল । ধীরে ধীরে বহু লোক এসে কমিটির অফিসে যোগ দেয় ।

শান্তি কমিটির লোকেরা যখন সবাই বসে তখন আমি ঘরের অপর একটা রুমে বসে আছি । দালাল মোসলেম খাঁ এই সময়ে প্রস্তাব করে যে আমরা এখন পর্যন্ত হিন্দুদেরকে প্রশ্রয় দিচ্ছি । তার প্রমাণস্বরুপ আমাকে সে দেখিয়ে দেয় । এই সময় শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান সাহেব তার উত্তরে বলেন, যে আজ এ লোকের গায়ে গন্ধ, হযেছে তাই না ? কিন্তু আপনারা কে অস্বীকার করতে পারবেন ইয়ে, সে আপনাদের কাছ থেকে টাকা পাবে না ? তখন সবাই চুপ মেরে যায় ।

সাত্তার মোক্তার সাহেব আমাকে তার নিজের বাড়ীতে ঐ দিন রাত্রিতে লুকিয়ে রাখেন । পরের দি্ন ভোর হবার আগেই আমাকে নদী পার করে দেন এবং বলে দেন যে আমি পরিস্থিতি স্বাভাবিক দেখলেই আপনাকে জানাবো , আপনি তখন আমার বাসায় চলে আসবেন ।

৬ দিন পর শান্তি কমিটির সেক্রেটারী ডাক্তার মিয়া আমাকে আসার জন্য চিঠি দেন । তার চিঠি পেয়ে আমি শহরে চলে আসি এবং সেক্রেটারী সাহেবের তত্ত্বাবধানে থাকি । এই সময় কতোগুলি লোকের কথার উপির ভরসা করে আমি যে লোকের কাছে আমার সমস্ত কিছু গচ্ছিত রেখে গিয়েছিলাম সেই লোকের কাছে আমার দুরাবস্থার কথা খুলে বলি এবং তার কাছে কিছু টাকা চাই । তার উত্তরে তিনি আমাকে ভীষণ গালাগালি করেন এবং পাক বাহিনী দিয়ে আমাকে গুলি করাবেন বলে ভয় দেখান ।

২৯ শে শ্রাবণ আমি রাত্রে ৮টার সময় শহরের ভিতর একটা হোটেল থেকে কিছু খেয়ে বাসায় ফিরতেছিলাম এমতাবস্থায় পিরোজপুর জামে মসজিদের কাছে রাজাকাররা আমাকে ধরে পাক বাহিনীর ক্যাম্পে নিয়ে যায় । এই সময় তারা আমার প্রতি নানা রকম গালাগালি ও রাইফেলের বাঁট দিয়ে মারতে থাকে ।

ক্যাম্পে নিয়ে যাবার সময় খান সেনারা আমাকে বলে যে তুমি মুক্তিবাহিনী হ্যায় । তুমি দুশমন হ্যায় । এই বলে তারা আমার উপর অত্যাচার আরম্ভ করে । একটা মোটা বেতের লাঠি দিয়ে ভীষণভাবে প্রহার করে , বুট জুতা দিয়ে লাথি মারে এইভাবে আমার সারা শরীর রক্তাক্ত করে ফেলে ।

প্রায় দুই ঘন্টা আমার উপর অকথ্য অত্যাচার চালানোর পর আমাকে তাদের হাজত অর্থ্যাৎ সেকেন্ড অফিসার সাহেবের বাসায় একটা রুমে বন্দী করে রাখে । আমাকে বন্দী করার সময় পকেট থেকে ২৪ টা টাকা তারা নিয়ে নেয় ।

আমাকে যে ঘরে রাখা হয় ঐ ঘরে আরও ১৮ জন বন্দী ছিল । প্রতি ২ ঘন্টা পর ডিউটিরত সিপাই চেঞ্জ হয়ে যেত । প্রতিবারই আমার উপর সিপাইরা লাথি ঘুষি মারতে থাকে আর জিজ্ঞাসা করে মুক্তিবাহিনী কোথায় ?
এনায়েত মিয়া , ডা: আব্দুল হাই , ডা ক্ষিতিশ মণ্ডলে এই সব আওয়ামী লীগের নেতারা কোথায় আছে ?
রাইফেল কোথায় আছে ?
৩ দিন পর আমার উপর এইভাবে অত্যাচার চালায় । এই সময় আর কোন নতুন আসামী তারা ঢুকায় না । তবে ঘরের বাইরে যে লোক ধরে এনে ভীষণভাবে প্রহার করে এটা আমি হাজতের ভিতর থেকে টের পাই ।

১০ দিন পর বিভিন্ন জায়গা থেকে আরও ১৪ জন লোককে ধরে আনে এবং তাদের সঙ্গে আমাকে এসডিও সাহেবের বাসার ভিতর একটা পায়খানার মধ্যে বন্দী করে রাখে । এদের মধ্যে আলী আশরাফ নামে একজন ছেলে । ঢাকা থেকে আসার পথে ‘হুলার হাট’ লঞ্চ ঘাটে পাক সেনারা তাকে আটক করে । তাকে আটক করার পর ক্যাপ্টেন একটা হোটেলের চুলার ভিতরকার আধাপোড়া কাঠ এনে তার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় চেপে ধরে । সারা শরীরের চামড়া ও মাংস পুড়ে দুর্গন্ধ হয়ে ওঠে । এবং ছেলেটার উপর অমানুষিক নির্যাতন চালান হয় । হাজতে আনার পর আমাদের উপর নিয়মিত অত্যাচার চালাতে থাকে ।

আমাকে হাজির করার পর ক্যাপ্টেন এজাজ আমাকে প্রশ্ন করে যে, তুমি মুক্তিবাহিনী , তুমার কাছে রাইফেল আছে , তোমাদের বাহিনী কোথায় আছে আমার কাছে বল । আমি তার উত্তরে উর্দুতে বলি যে, আমি একজন সাধারন ব্যবসায়ী মানুষ , ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করি , কাজেই যদি কিছু জিজ্ঞাসা করতে হয় তবে ব্যবসা সম্পর্কে করুন । প্রায় আড়াই ঘন্টা ক্যাপ্টেন সাহেবের সঙ্গে আমার কথা কাটাকাটি হয় ।

অতঃপর ক্যাপ্টেন আমাকে প্রশ্ন করে যে , তুমি এত উর্দু কথা কেমন করে শিখছো ? তখন আমি কিছুটা ভীতু হয়ে পড়ি । কেননা আমি বৃটিশ আমলে ৭ বছর আর্মিতে চাকুরী করেছি জানতে পারলে আমাকে তখনই গুলি করে হত্যা করবে । তখন আমি বুদ্ধি খাঁটিয়ে বলতে লাগলাম যে হুজুর আমি ব্যবসায়ী লোক কাজেই আমি খুলনাতে পাঞ্জাবী ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ব্যবসা করি , তারা আমাকে খুব পেয়ার করে এবং প্রতি ৭ দিন অন্তর আমি তাদের কাছে ১ দিন থাকি- এই সব সত্য মিথ্যা বলি । এবং সেই সঙ্গে কতকগুলি পাঞ্জাবী লোকের নামে একাধারে বলে যাই ।

আমার কথা ক্যাপ্টেন বিশ্বাস করে এবং আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে যে , তোম মেরা দোস্ত হ্যায়। আরও বলে যে তুমি মুক্ত । আজ শহরে কারফিউ কাজেই সকাল বেলা তুমি তোমার ঘরে ফিরে যেও ।
এখন আরাম কর । এই বলে আমাকে পুনরায় সেই হাজত রুমে নিয়ে আসে ।

হাজত রুমে আসার পর আরও যে ১৪ জন ছিল তারা আমার কাছে আকুতি মিনতি করে নানা কথা বলতে লাগলো যে ভাই তুমি ত সকালে বাড়ী যাবে কাজেই আমাদের প্রত্যেকের বাড়িতে তুমি সংবাদ দিবে তারা যেন টাকা পয়সা যা লাগে তাই আমাদের এইখান থেকে বাচিয়ে নিয়ে যায় ।

রাত্রি ১১ টার সময় একটা প্লেটে করে ৪ টা রুটি ও একটু মাংস নিয়ে আসে একটা সিপাই আমার জন্য । তখন আমি জোরে জোরে বলি যে ও রুটি আমি খাব না , তোমরা ফিরিয়ে নিয়ে যাও । কেননা আজ ১১ দিন হলো শুধু পানি খেয়ে আছি আর আজ শুধু আমার জন্য ৪ টা রুটি এনেছো । কিন্তু এই হাজতের মধ্যে ত মোট আমরা ১৫ জন আছি, সবাই না খাওয়া , কাজেই আমি খাব না । সিপাইটি তখন ফিরে যায় এবং ক্যাপ্টেন সাহেবের কাছে সমস্ত কথা খুলে বলে ।

রাত্রি ১২ টার সময় একটা বড় ঝুড়িতে করে রুটি ও একটা বালতিতে করে আলু ও মাংস নিয়ে আসে এবং আমাকে সবাইকে সঙ্গে করে খেতে বলে ।

রাত্রি ১২ টার সময় ক্যাপ্টেন আমাকে পুনরায় তার চেম্বারে ডেকে পাঠায় । আমার তখন ভয় হয়ে যায় যে আমি প্রথমে রুটি খেতে চাইনি বলে হয়তো তার রাগ হয়েছে । কাজেই আমাকে মেরে ফেলবে । একজন সিপাই আমাকে নিয়ে ক্যাপ্টেন সাহেবের সম্মুখে হাজির করে আমাকে দেখতে পেয়ে ক্যাপ্টেন পুনরায় জিজ্ঞাসা করে তুমি খেয়েছো । আমি বলি যে হ্যা আমি এইমাত্র রুটি মাংস খেয়েছি । ক্যাপ্টেন পুনরায় হেঁকে ওঠে যে না আবার তোমাকে আমার সম্মুখে খেতে হবে । এই বলে ডাকাডাকি আড়ম্ভ করে। এই বলে একজন সিপাই দুইটা পরাটা ও একটা আস্ত মুরগীর রোস্ট নিয়ে আসে। ক্যাপ্টেনের হুকুমে আমি তা খেয়ে ফেলি । পরে আমাকে পুনরায় আরাম করার জন্য হাজত রুমে নিয়ে আসে ।

পরের দিন সকালে আমাকে পুনরায় ক্যাপ্টেনের রুমে ডেকে নিয়ে আসে এবং আমাকে কিছু খেতে দেয় । এই সময় ক্যাপ্টেন আমাকে বলে যে এখন তুমি বাড়ি যাও এবং ঠিকঠাকমত চলাফেরা করবে । আমি বাড়ীর দিকে চলে আসি এবং বাড়িতে না গিয়ে রাত্রিতে আর সব বন্দী যে সব কথা বলে দিয়েছে তাদের প্রত্যেকের বাসায় গিয়ে আমি তা বলে আসি । এই সময় যে ছেলেটিকে হুলার হাট থেকে ক্যাপ্টেন ধরে আনে তার খালুর সঙ্গে দেখা করি এবং বলি যে বন্দী আশরাফ আমার কাছে কাকুতি মিনতি করে বলে দিয়েছে যে তাকে যদি গুলি করে হত্যা করা হয় তবে যেন তার আত্নার সৎগতি করা হয় ।

রাত্রিতে আমার ঘুম আসছিল না কাজেই বসে নানা চিন্তা করছি এমনি সময় জেটিঘাটে দশ রাউন্ড গুলির শব্দ পেলাম ।

পরের দিন সকালে উঠে খবর নিযে জানতে পারি যে যাদের বন্দী করে রেখেছিল তাদের সবাইকে রাত্রিতে গুলি করে হত্যা করেছে । তখন আমার বন্দী আশরাফের করুণ স্মৃতি মনে ভেসে ওঠে এবং আমি দৌড়িয়ে জেটি ঘাটে চলে আসি । জেটি ঘাটে বেশ কয়েকটি লাশ দেখতে পাই কিন্তু আশরাফের লাশ দেখতে পাই না । একজন নৌকার মাঝির সঙ্গে আলাপ করে জানতে পারি নদীর ভাটিতে কিছুটা দূরে দুইটা লাশ ভেসে আসে । আমি জেটি ঘাটে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ি এবং নদীর ভিতর দিয়ে সাতার কেটে লাশের কাছে আসি এবং নিজ হাতে আলী আশরাফের লাশ তুলে নিয়ে তার বাবা-মার কাছে হাজির করি এবং তার শেষ অনুরোধের কথা জানাই । লাশ দেখে তার বাবা-মা ভয় পেয়ে যান যে মিলিটারী জানতে পারলে তাদের সবাইকে মেরে ফেলবে । আমি সারাদিন সে লাশ গোপনে লুকিয়ে রেখে রাত্রিতে কয়েকজন লোক ডেকে লাশ মাটির ব্যবস্থা করি । আমি শহরে বাস করতে থাকি এবং মুক্তি বাহিনীর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করে শহরের খবরাখবর আদান প্রদান করতে থাকি ।

ক্যাপ্টেন এজাজ ছুটি নিয়ে পাকিস্তান চলে যায় বিবাহ করতে । তখন ক্যাম্পের চার্জে সুবেদার সেলিম থাকে । এই সুবেদার তখন দালাল নিয়ে এক সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করল । ব্যাপক হারে মেয়েদের ধরে এনে ক্যান্টনমেন্টে ধর্ষন করতে লাগলো । হিন্দু মুসলমান বলে কোনো বিচার তখন ছিল না – যেখানে যাকে পায় তাকেই ধরে আনতে থাকে । দেখতে দেখতে শহর প্রায় জনশূন্য হয়ে গেল ।

আশ্বিন মাসের শেষের দিকে আমার বাসার সম্মুখে থেকে দুটি সিপাই আমাকে ডেকে নিয়ে যায় যে তোমাকে সুবেদার সাহেব বোলতা হ্যায় আমাকে ক্যান্টনমেন্ট নিয়ে গিয়ে সুবেদার বলে যে আমি তোমার জীবন নেব , তুমি আমাদের সঙ্গে বহুত দুশমনী করেছো । এঈ বলে তারা আমার উপর অমানুষিক নির্যাতন চালাতে থাকে । আমাকে মারতে মারতে সারা শরীর রক্তাক্ত করে ফেলে এবং এসডিও সাহেবের পায়খানার মধ্যে আটকে রাখে । ৬ দিন আমি সেখানে বন্দী থাকি । এই সময় আমি দেখতে পাই যে খান সেনারা প্রত্যেকদিন ক্যাম্পের সম্মুখে বাঙ্গালীদেরকে মিলে শূন্যে তুলে পাকা রোডের উপর আছড়িয়ে মারতো বা এইভাবে আধা মরা হয়ে গেলে বস্তাবন্দী করে তারপর বেয়োনেট চার্জ করে নদীর ভিতর ফেলে দিত । অনেককে আবার জীপ গাড়ির পিছনের দিকে বেঁধে সারা শহরের মধ্যে টানতো । এর ফলে সমস্ত মাংশ শরীর থেকে পড়ে যেত । আমি এ সব ঘটনা নিজ চোখে দেখেছি । প্রত্যেক দিন আমাকে হাজত থেকে বার করে ক্যান্টনমেন্টের সম্মুখে একটা বাদাম গাছের সঙ্গে কপি কল দিয়ে পা উল্টো দিকে বেঁধে ঝুলিয়ে দিত এবং ভীষণভাবে প্রহার করতো ।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আমি জেট ঘাটে ২,০০০ লাশ নিজের চোখে দেখেছি । প্রত্যেক দিন আমি ভোর বেলা ঘাটে গিয়ে যে সব লাশ পড়ে থাকতো তাদের উলটিয়ে পালটিয়ে দেখতাম এবং চেনা শোনা হলে তার বাড়িতে গিয়ে খবর দিতাম।

আমি নিজের চোখে মানুষকে কুপিয়ে, রাস্তায় টেনে , বস্তাবন্দী করে বেয়োনেট চার্জ করে এবং গুলি করে মারতে দেখেছি । পাক বাহিনীর চেয়ে রাজাকার, শান্তি কমিটির মেম্বার এরা অত্যাচার বেশী চালিয়েছে । পাক বাহিনী যাদেরকে ছেড়ে দিতো দালালরা তাদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করতো । পিরোজপুর জেটি ঘাটে বিভিন্ন সময়ে প্রায় ৩/৪ হাজার লোককে হত্যা করেছে । কত নারীকে যে ধর্ষণ করেছে তার কোন হিসাব নাই ।

স্বাক্ষর/-
উপেন্দ্রনাথ দত্ত
১৮/৮/৭৩

ইব্রাহিম রাজু
<৮,২.৩.১৯৯,২৪৫-২৪৬> “একমাত্র বলেশ্বর নদীর জেটি ঘাটেই ৪/৫ হাজার লোককে পাক জল্লাদরা নির্মমভাবে হত্যা করেছে। পাক ক্যাপ্টেনের একমাত্র কথাই ছিল ‘জেটিমে ভেজ দেও।”

।।১৯৯।।

আফতাব উদ্দিন আহাম্মদ
থানা-পিরোজপুর
জেলা- বরিশাল

৪ঠা মে পিরোজপুর শহরে পাক বাহিনী প্রবেশ করে। পাক বাহিনী বরিশাল হুলার হাট হয়ে পিরোজপুর প্রবেশ করে। মিলিটারী তিন দিক থেকে পিরোজপুর পুরো শহর আক্রমণ করে।

৫ ই মে পাক বাহিনী আমার বাড়ী ধ্বংস করে। প্রথমে লুটতরাজ চালায়। তারপর অগ্নিসংযোগ বাড়ী জ্বালিয়ে দেয়। এই দিনই পাক বাহিনী পিরোজপুর সেকেন্ড অফিসার, এসডিপিও ট্রেজারী অফিসারকে গুলি করে হত্যা করে।

পাক বাহিনী যখন ভান্ডারিয়া থানায় প্রবেশ করে তখন আমি আমার জীবনের নিরাপত্তার অভাব অনুভব করি। ভাণ্ডারিয়া আমার নিজ বাড়ি ছেড়ে শ্বশুরবাড়ি বরগুনা(পটুয়াখালী) চলে যাই। এখানে আমি প্রায় দেড় মাস কাল অতিবাহিত করি। তারপর আমি খুব অসুস্থ হয়ে পড়ি। শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান সাহেবের কাছে চিঠি লিখি আমার অসুস্থতার খবর জানিয়ে। আমার অসুস্থতার খবর পেয়ে চেয়ারম্যান সাহেব আমার কাছে চিঠি দেন এবং বলেন যে আমি ক্যাপ্টেন এজাজ সাহেবের সঙ্গে আপনার ব্যপারে আলাপ করেছি,কাজেই আপনি এখানে আসতে পারেন।

শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান সাহেবের চিঠি পাবার পর পিরোজপুর চলে আসি এবং চেয়ারম্যান সাহেবের সঙ্গে দেখা করি। তিনি আমাকে গোপন থাকতে বলে। তিনদিন পর চেয়ারম্যান সাহেব আমাকে ডেকে পাঠান এবং ক্যাপ্টেন এজাজের কাছে নিয়ে যান। ক্যাপ্টেন এজাজ সাহেবের কাছে আমি এই সময় একটা দরখাস্ত দেই যে আমার ছেলে ” ক্যাপ্টেন জিয়া” আমার বাধ্য নয়, সে আমার অমতে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছে।

আমি শহরে আসার ৭/৮ দিন পর জানলাম পাক বাহিনীর ক্যাপ্টেন এজাজের কাছে আমার নামে বলা হয়েছে যে, তার ছেলে প্রত্যেকদিন রাত্রিতে মুক্তিবাহিনী নিয়ে এসে তার সঙ্গে দেখা করে যায়। এরপর প্রায় ১০০ মিলিটারী নিয়ে আমার বাড়ি আক্রমণ করা হয়। আমার বাড়িতে এসে পাক বাহিনী আমার বুকের উপর, আমার স্ত্রীর বুকের উপর এবং আমার ছেলের বুকের উপর রাইফেল ধরে। এই সময় পাক বাহিনী আমাদের ঘেরাও করে যে তোমার ছেলে ক্যাপ্টেন জিয়া তোমার ঘরে আছে, তুমি তাকে বের করে দেও। আমি তার উত্তরে বলি যে আমার ছেলে বাড়ীতে নাই, তোমরা ইচ্ছা করলে আমার ঘর সার্চ করে দেখতে পারো। তখন আমার ঘর সার্চ করে তারা চলে যায়।

পাক বাহিনী সব সময়ই নারী ধর্ষণ করেছে। তারা রাজাকার দিয়ে গ্রাম থেকে সুন্দরী যুবতী মেয়েদেরকে ধরে আনতো। অনেক সময় তারা নিজেরাও কোন কোন বাড়ীর উপর চড়াও হতো এবং মেয়েদেরকে ধরে নিয়ে যেত।

পাক বাহিনী বিশেষ করে আওয়ামী লীগ, মুক্তিবাহিনী ও হিন্দু এদের খোঁজ বেশী করেছে এবং যাদের সন্দেহ হয়েছে তাদেরকেই মেরে ফেলেছে। এমন কোন রাত নাই যে পাক বাহিনী পিরোজপুর জেটি ঘাটে ৫০-১০০ জন লোককে হত্যা না করতো। শেষের দিকে নদীর ভিতর শুধু মৃত লাশ ভাসতে দেখা যেত। আমার মনে হয় একমাত্র বলেশ্বর নদীর জেটি ঘাটেই ৪/৫ হাজার লোককে পাক জল্লাদরা নির্মমভাবে হত্যা করেছে। পাক ক্যাপ্টেনের একমাত্র কথাই ছিল ‘জেটিমে ভেজ দেও।’

প্রথম অবস্থায় যে সব লোককে ধরেছে তাদেরকে জেটি ঘাটে গুলি করে হত্যা করেছে । কিন্তু শেষের দিকে তাদের বেয়োনেট দিয়ে জবাই করা হতো । যাকেই ধরা হতো তাকেই ভীষনভাবে প্রহার করতো ।

আমি নিজের চোখে ৩ জন লোককে জীপ গাড়ির পিছনে বেঁধে রাস্তায় টেনে মেরে ফেলতে দেখেছি । তাদের সেই করুণ চিৎকারের কথা আমার এখন পর্যন্ত কানে বাজে ।

শেষের দিকে নারী নির্যাতন ব্যাপকভাবে চলতে থাকে । শামসুদ্দীন তালুকদার নামে একজনকে দুই জন পাক বাহিনী দিয়ে তার দুই পা দুই দিকে টেনে ছিঁড়ে ফেলা হয় । এই সময় আবদুল গফুর মিয়া বিএ সাহেবকে সে নিজে তার মুখের মধ্যে স্প্রিট ঢেলে দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে নির্মমভাবে তাকে হত্যা করে ।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রথম ৩ মাস আমার ছেলের কোনো খবর পাই না। ৩ মাস পর একজন আমার বাসার মধ্যে প্রবেশ করে এবং বলে যে আমাকে তারাতারি কোন জায়গায় লুকান , আমি ক্যাপ্টেন জিয়ার কাছ থেকে খবর নিয়ে এসেছি । সে আমাদের কাছে ক্যাপ্টেন জিয়ার খবর দেয় এবং বলে যে সে ভাল আছে আপনি কোন চিন্তা করবেন না । দেশ খুব তাড়াতাড়ি স্বাধীন হবে । এর পর থেকে প্রায়ই সেই ছেলেটি এসে ক্যাপ্টেন জিয়ার খবর আমাদের কাছে এসে দিয়ে যেত ।

পাক ক্যাপ্টেন এজাজ একদিন ঘোষনা করে দেয় যে , ক্যাপ্টেন জিয়া মঠবাড়িয়া যুদ্ধে মিলিটারীর হাতে এরেস্ট হয়েছে এবং তাকে বরিশাল পাঠানো হয়েছে ।এই খবর আবার দালাল দিয়ে আমার কাছে পৌছে দিত যেন আমি ভেঙ্গে পড়ি । অনেক সময় দালালরা আবার এসে বলতো যে আমার ক্যাপ্টেন জিয়ার মৃত লাশ বলেশ্বর নদীতে ভাসতে দেখেছি ।

স্বাক্ষর/-
আফতাব উদ্দিন আহমদ
১৯/৮/৭৩

সাইফুল ইসলাম
<৮,২.৩.২০০,২৪৭>

।। ২০০ ।।

খাদিজা বেগম (দুলু)
থানা- পিরোজপুর
জেলা- বরিশাল

পাক বাহিনী ব্যাপক অত্যাচার চালায় সারা শহরে। কালিবাড়ী রোডের দুইধার, মাছিমপুর, পালপাড়া, শিকারপুর, রাজারহাট, কুকারপাড়া, ডুমুরতলা, কদমতলা, নামাজপুর, আলনকাঠি, ঢুলিগাতি, রানীপুর, পারের হাট, চিংড়াখালী ইত্যাদি এলাকা পাক বাহিনী সম্পূর্ণ ধ্বংস করেছে, ঘরবাড়ী লুট করে জ্বালিয়ে ধ্বংস করেছে।

পাক বাহিনীর অসংখ্য মেয়ের উপর পাশবিক অত্যাচার চালিয়েছে। রাধারমণ ঘোষ নামে এক ব্যাক্তি ও তার ছেলেকে পাক বাহিনী ধরে নিয়ে যায়। পাক বাহিনীর লোকেরা তার মেয়েদের চায়। আষাঢ় মাসের এক রাতে তিন জন মেয়েকে ধর নিয়ে যায় পাক ছাউনীতে। পর পর তিন দিন তিন রাত অমানুষিক দৈহিক অত্যাচার চালায়। তিন দিন পর শয্যাশয়ী অব্স্থায় গাড়ী করে বাড়ী দিয়ে যায়। দৈহিক অত্যাচারের ফলে মৃত অবস্থায় ছিল, পরে বহু চিকিৎসা করে বাঁচে।

সুন্দরী মেয়েকে পাকসেনারা ধরে নিয়ে যায়। বাবা, ভাই অনেক আকুতি মিনতির পর পাক সেনারা অত্যাচার চালায়। শেষ রাতে দিয়ে যায় তার পরদিন আবার ধরে নিয়ে যায়। পরপর কয়েকদিন রেখে অমানুষিক দৈহিক অত্যাচার চালিয়ে অর্ধমৃত অবস্থায় তাদের বাড়ী দিয়ে যায়।

পাকসেনারা বিভিন্ন স্থান থেকে মেয়ে ধরে পিরোজপুর সেনানিবাসে নিয়ে যেত এবং অকথ্য অত্যাচার চালাতো। ভাগিরথী নামে এক মেয়েকে মুক্তিবাহিনী পক্ষের গোয়েন্দাগিরি করার অপরাথে গাড়ীর পেছনে ১০/১২ হাত দড়ি দিয়ে বেঁধে সারা শহর ভীষণ বেগে গাড়ী চালিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে।

মন্টু নামে এক ছেলেকে পাকসেনারা ভাণ্ডারিয়া থেকে ধরে এনে উপরে পা ঝুলিয়ে দিনের পর দিন বেত পিছিয়েছে। কোন খাবার দেয়নি। শরীর কেটে কেটে লবণ দিয়েছে। তিন রাত ঐ ভাবে ঝুলিয়ে পিটিয়েছে আর নানা খবর জিজ্ঞাসা করেছে। এত অত্যাচারের পরও কোন কথা সে স্বীকার করেনি। তিন দিন পর অর্ধমৃত অবস্থায় বেয়োনেট দিয়ে চার্জ করে হত্যা করেছে।

স্বাক্ষর
খাদিজা বেগম (দুলু)
২০/০৮/৭৩

সাইফুল ইসলাম
<৮,২.৩.২০১,২৪৮> “আজ দেশ স্বাধীন কিন্তু আমি কি নিয়ে বাঁচবো বলতে পারেন?”

।। ২০১ ।।

রেনুবালা বারুই
গ্রাম- বাইনকাঠি
ডাকঘর-নাজিরপুর
জেলা-বরিশাল

পাকসেনা প্রথম আমাদের গ্রামে যায় শ্রাবণ মাসে। আমি তখন গোবর্দ্ধন গ্রামে স্বামীর বাড়ী ছিলাম। কাঠালিয়া গ্রাম, বাইনকাঠি, তারাবনে গ্রাম সম্পূর্ণ ধ্বংস করেছে। গ্রামকে গ্রাম লুট করে বাড়ীঘর ভেঙ্গে নিয়ে গেছে, জ্বালিয়ে দিয়েছে। অসংখ্য হিন্দু লোককে জোর করে মুসলমান করেছে।

অসংখ্য লোককে হত্যা করেছে। বহু মেয়েকে পাকসেনারা ধরে পাশবিক অত্যাচার চালিয়েছে। প্রায়ই ঘরের মেয়েকে পাকসেনারা ধর্ষণ করেছে। তিনজন মেয়েকে রাজাকাররা ধরে নিয়ে যায় তাদের ছাউনী নজিরপুর থানার পাশে সাত কাছিমা নামক স্থানে মাদ্রাসাতে। ক্রমাগত সাত আট দিন অসংখ্য রাজাকার তাদের উপর অত্যাচার চালায়। দিনের পর দিন দৈহিক অত্যাচার চালায়। রাজাকাররা তাদের ছাউনীতে আরও বহু মেয়ে রাখতো এবং দিনে রাতে ভোগ করতো। দেশ মুক্ত হলে অসুস্থ অবস্থায় মুক্তি বাহিনীরা মেয়ে তিনটিকে উদ্ধার করে।

আমার স্বামী কৃষক ছিলেন, জমি চাষ করা ফসল ফলানো তার কাজ ছিল। যুদ্ধ বাঁধলে আমার খুড়তুতো শ্বশুর মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়। আমার স্বামীও উৎসাহ ভরে মুক্তিবাহিনীতে নাম লেখান। তারপর থেকে বিভিন্ন জায়গায় গেছেন অপারেশনে।

২৭ শে আষাঢ় গোবর্ধন স্কুলের পাশে মুক্তি সেনাদের সাথে আমার স্বামীও ছিলেন। দলে প্রায় ৫০০ মত ছিল। ঐ দিন পাকসেনা রাজাকার মিলে ৭০০/৮০০ ছিল। তুমুল যুদ্ধ হয়। মুক্তিসেনারা তাদের ভারী অস্ত্রের সামনে টিকতে ব্যার্থ হয়ে পিছু হটে। সেই সময় আমার স্বামী পাক বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। আমার স্বামী সহ আরও ৬ জনকে ধরে। সাত জনের উপর অমানুষিক অত্যাচার চালিয়ে অর্ধমৃত অবস্থায় সবাইকে গুলি করে হত্যা করে। এরপর রাজাকাররা আমার বাড়িঘর সম্পূর্ণ ধ্বংস করে এবং অত্যাচার চালায়। শিকদার বাড়ীর সবাইকে হত্যা করে। তারপর বাড়ী ছেলে পালিয়ে যাই। গ্রামের পর গ্রামে ঘুরে পালিয়ে বেড়িয়েছি। আজ আমি অবহায় নিঃস্ব সর্বহারা। যেখানে গেছি সেখানেই দেখেছি পাক বর্বর আর পশু রাজাকারদের অত্যাচারের বীভৎস রূপ। আজ দেশ স্বাধীন কিন্তু আমি কি নিয়ে বাঁচবো বলতে পারেন?

স্বাক্ষর/-
রেনুবালা বারুই
২০/০৮/৭৩

ইশতিয়াক মাহমুদ টিপু
<৮,২.৩.২০২,২৪৯>
।। ২০২।।
আলী হায়দার খান
পিরোজপুর, বরিশাল।

কর্ণেল আতিকের নেতৃত্বে পাক সেনারা হুলার হাট আসে। ঢুকেই ঘরবাড়ী জ্বালাতে থাকে। মুসলিম লিগাররা তাদের স্বাগত জানায়। পাক সেনারা বলে হিন্দু বাড়ী কোথায়? এরপর থেকে হিন্দু ঘরবাড়ী জ্বালাতে থাকে। লুটপাট হত্যা অনবরত করতে থাকে।

পিরোজপুর মহকুমা প্রশাসক মহিবুল্লাহ শাহ (সিন্ধী, পাকিস্তানের বিশিষ্ট ন্যাপ নেতা বাকের শাহর ভাইপো) আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সম্পূর্ন সমর্থক ছিলেন। তিনি বলেছিলেন দোস্ত তোমরা স্বাধীনতা পেয়েই যাচ্ছ, আমরা পেলাম না।

৫ ই মে ষড়যন্ত্র করে ওসি ভারপ্রাপ্ত, এসডিও আব্দুর রাজ্জাক
(২) এসডিপিও ফয়জুর রহমান আহমেদ
(৩) ম্যাজিস্ট্রেট মিজানুর রহমানকে ডেকে আনিয়ে মিটিং শেষ করে তাদেরকে গুলি করে হত্যা করে। বাড়ীঘর লুট করে। এরপর অত্যাচার শুরু করে। পিরোজপুরের চৌদ্দ আনা ঘর দুয়ার ধ্বংস করেছে, লুটপাট করেছে।

পাক সেনারা হুকুম দেয় প্রতি ইউনিয়ন থেকে ২০ জন করে যুবক দিতে হবে। এই মোতাবেক গ্রাম থেকে ধরে ধরে শত শত লোককে হত্যা করেছে। চার হাজারের বেশী লোককে পাক সেনারা হত্যা করেছে। ভাগীরথী নামে একজনকে স্পাই সন্দেহে ধরে গাড়ীর পেছনে বেঁধে সারা শহর ঘুরিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। সম্পূর্ন উলঙ্গ অবস্থায় বিশিষ্ট ছাত্র ইউনিয়ন নেতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র গণপতি হালদারকে (ম্যাট্রিকে প্রথম, আইএসসিতে প্রথম) নির্মমভাবে হত্যা করেছে। দৈনিক হত্যা করেছে।

ঘাটের পাড়ে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করেছে। গাছের সাথে বেঁধে বেয়নেট চার্জ করেছে। চিৎ করে শুইয়ে বাঁশের গোড়া দিয়ে পিটিয়ে হাড় সম্পূর্ন ভেঙ্গে গেলে বেয়নেট দিয়ে হত্যা করেছে, পিটিয়ে অনেককে হত্যা করেছে। বেঁধে পায়ে আগুন চেপে ধরেছে, সুঁচ ফুটিয়েছে।

এসডিওর বাংলোতে যেখানে পাক ক্যাম্প ছিল সেখানে অসংখ্য নারীকে ধর্ষণ করেছে। ফুলু রাণী বিশ্বাসের (কলেজ ছাত্রী) উপর অমানুষিক দৈহিক নির্যাতনের ফল তার মৃত্যু ঘটে। সমস্ত থানাতেই পাক সেনারা ব্যাপক নির্যাতন চালিয়েছে।

স্বাক্ষর/-
আলী হায়দার খান
১৬/৮/৭৩

<৮,২.৩.২০৩,২৫০-৫১>
ভারতী রাণী বসু
গ্রাম – স্বরুপকাঠি
জেলা – বরিশাল

২৭শে এপ্রিল আমি কাঠালিয়া থানার মহিষকান্দি গ্রামে যাই আত্মরক্ষার জন্য। তখন চারদিকে সব বিচ্ছিন্ন অবস্থা। হিন্দু বাড়ি বিভিন্ন স্থানে লুট হচ্ছে, হত্যা চলছে। ওখানে পৌছানোর পরপরই স্থানীয় কিছু লোক হিন্দু বাড়ি লুট শুরু করে দেয়। ২০/২৫ জনের বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে সকালে, দুপুরে, রাতে, ভোরে যখন তখন বল্লম, দা এবং অন্যান্য ধারালো অস্ত্র নিয়ে হিন্দু বাড়ি আক্রমণ করে সব লুট করে ঘর বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। আমি স্বরুপকাঠিতে ফিরে আসি ৫ই মে। সেদিন ছিলো হাটবার। ঐ দিনই সমস্ত এলাকা লুট করে নেয় দুষ্কৃতিকারীরা।

৬ই মে সকালে পাক সেনা প্রথম স্বরূপকাঠিতে যায়। ওখানকার পীর শর্ষিনার বাড়ীতে গিয়ে পাক বাহিনী ওঠে। ওখান থেকে থানায় আসার পথে শর্ষিনার পুল থেকে থানা পর্যন্ত (সাহাপারা) সমগ্র হিন্দু বাড়ী প্রথমে লুট করে জ্বালিয়ে দিয়েছে। ওখান থেকে পাক বাহিনীর একটা দল অলঘারকাঠির দিকে গিয়ে ঘর বাড়ী জ্বালানো ও সেই সাথে মানুষ হত্যাও শুরু করে। আর একটা দল স্বরূপকাঠি এসে শুধু হিন্দু বাড়ী বেছে বেছে সকল হিন্দু বাড়ী লুট করে পুড়িয়ে দেয়। কালী প্রতিমার উপর অসংখ্য গুলি চালিয়ে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে। বহুজনকে হত্যা করে। তারপর পাক বাহিনী ফিরে যায়। তারপর থেকে ক্রমাগত সাত দিন পাক বাহিনী স্বরূপকাঠিতে যায়। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে আর লুট করেছে। স্থানীয় কিছু লোক এবং পীরের দল পাক বাহিনীর সাথে থাকতো। লুট করতে বলে তারা যখন লুট করতে আরম্ভ করে তখন পাক সেনারা ছবি তুলতো।

কুড়িয়ানা আটঘর, জলাবাড়ী, সমুদয়কাঠি, জুলুহারা, নান্দিঘর, সোহাগদল, ইন্দ্রিরহাট, মণিনাল, বাটনাতলা ইত্যাদি গ্রামসহ ৯টি ইউনিয়নে পাক বাহিনীরা গ্রামের প্রতিটি কোনাতে ঘুরে সব ধ্বংস করেছে, লুট করেছে।

কুড়িয়ানা আটঘরে পিয়ারার বাগানে বহুজন আশ্রয় নিয়েছিল। পাক বাহিনী হঠাৎ করে ঘিরে ফেলে অসংখ্য লোককে হত্যা করে। এক মেয়েকে পিয়ারা বাগান থেকে ধরে এনে সবাই মিলে পাশবিক অত্যাচার চালায়। তারপর তিনদিন যাবৎ ব্লেড দিয়ে শরীর কেটে কেটে লবণ দিয়েছে। অশেষ যন্ত্রণা লাঞ্ছনা দেওয়ার পর মেয়েটিকে গুলি করে হত্যা করে। মেয়েটি ম্যাট্রিক পাশ ছিল। অন্য একজন মহিলাকে ধরে নিয়ে অত্যাচার চালিয়ে গুলি করে হত্যা করে। এখানে অধিকাংশ লোককে গুলি করে এবং বেয়নেট চার্য করে হত্যা করেছে। শত শত লোককে এই এলাকাতে হত্যা করেছে।

কাউখালি স্টেশনে আমি নিজে দেখেছি একজনকে মুক্তিবাহিনী সন্দেহে রাজাকাররা কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছে। স্বরূপকাঠিতে টিকতে না পেরে মহিষকান্দিতে যাই। ওখানে গেলে আমাকে সবাই মুক্তিবাহিনীর চর মনে করলো এবং অস্ত্র আছে বললো। আমি ওখান থেকে রাতে পালিয়ে যাই রাজাপুরে।

রাজাপুর থানাতে হামিদ জমাদার সমগ্র থানাতে সন্ত্রাস সৃষ্টি করেছিল। সমস্ত বাড়িঘর লুট করে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ধ্বংস করেছে, হত্যা করেছে। হিন্দু কোন বাড়িঘর ছিল না। সব ধ্বংস করেছিল। ওখানে শুক্কুর মৃধা শান্তি কমিটির সেক্রেটারী ছিল। আমি সহ আরো তিনজন তিন হাজার টাকা দিয়ে কোন রকম সেবারের মতো বাঁচি। আমি তখন কুমারী ছিলাম। সবাইকে মুসলমান হতে হবে এবং মুসলমান ছেলেকে বিয়ে করতে হবে। এমনি একটি পরিস্থিতিতে সুনীল কুমার দাস নামে এক ভদ্রলোককে আমি বিয়ে করি সে সময় দুষ্কৃতিকারীর হাত থেকে বাঁচবার জন্য। সময়টা ছিল জুন মাসের শেষ অথবা জুলাই প্রথম।

রাজাপুরে আছি স্বামীসহ। ভোরবেলা রাজাকার, পুলিশ মিলে প্রায় ৩০/৪০ জন আমাদের বাড়ি ঘিরে ফেলে। স্বামীকে লুকিয়ে রাখি। ওরা এসে সব কিছু লুট করে গালাগালি করে চলে যায়। কিছুক্ষণ বাদে আবার এসে আর যা ছিলো সব নিয়ে অত্যাচার চালায়। পাশের একটি লোককে হত্যা করলো।

নৈকাঠি রাজাপুর থানা গ্রামে শতকরা ৯৮ জনকে হত্যা করে। ওখানকার সব হিন্দু। ৯৮% মহিলা আজ বিধবা। নৈকাঠির প্রায় সব পুরুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করে তাদের যথাসর্বস্ব আত্মসাৎ করে হামিদ জমাদার ও তার দল। ঐ বিপদের মাঝে জঙ্গলে জঙ্গলে এ বাড়ি ও বাড়ি করে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলাম। আমার সব কিছু লুটে নেয় রাজাকার আর পাক বাহিনী। আমি কোন মতে পালিয়ে বাহিরচরে যাই জুলাই মাসের ১৭ তারিখে। আমি আমার কাজে যোগ দেই। তার পরপরই আমাকে সাসপেন্ড করে রাখে তিন মাস । বাহিরচরে সমগ্র এলাকা খুন, ডাকাতিতে ভরা। সমগ্র এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলো।

অক্টোবর মাসে কুদ্দুস মোল্লাকে (মুক্তিবাহিনী) চিকিৎসা করার জন্য কর্নেল আমাদের সবাইকে ডেকে লাঞ্ছনা দেয়। যাবার পথে গানবোট থেকে আমাদের হাসপাতালে শেল ফেলে। আমরা দারোয়ান পাহারা রেখে মুক্তিবাহিনীর চিকিৎসা করেছি। আমাদের ডাঃ শামসুল হক মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে গোপনে গিয়েও তাদের চিকিৎসা করেছেন। আমরা সবাই সবকিছু দিয়ে তাদের সাহায্য করতাম।

বাহিরচরে পাক বাহিনীরা মেয়েদের উপর চালিয়াছে অকথ্য নির্যাতন। বোয়ালিয়া, কাঁদপাশা, রাজগুরু, বাবুগঞ্জ থানা, দুয়ারিকা ইত্যাদি এলাকা থেকে বহু মেয়ে ধরে এনে ভোগ করেছে। আমার জানা এক হিন্দু মহিলাকে অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় ধরে নিয়া যায়। মহিলা খুব সুন্দরী ছিল। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় চারদিন ক্রমাগত অকথ্য দৈহিক নির্যাতন চালায়। অসহ্য যন্ত্রণায় মহিলা ছটফট করেছে। চারদিন পর মহিলা ছাড়া পায়। আমরা তার চিকিৎসা করে ভালো করি।

আমি স্বামীসহ বাস করছিলাম। আমার সর্বস্ব যাওয়া সত্ত্বেও স্বামী নিয়ে কোন রকমে দিন কাটাচ্ছিলাম। আমার স্বামী স্বাধীনতা সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলেন। আমাকে প্রায় বলতেন ডিসেম্বর মাস যদি বাঁচি জানুয়ারীর মধ্যে নিশ্চয় স্বাধীনতা পেয়ে যাবো।

৯ ই ডিসেম্বর গৌরনদী থানার মাহিলারার ব্রিজের উপর দিয়ে আমার স্বামী যাচ্ছিলেন। তখন পাক বাহিনী প্রায় আত্মসমর্পণ করে এমন অবস্থায় ব্রিজে ডিনামাইট স্থাপন করে রেখেছিলো। সেই ডিনামাইট ফেটে ব্রিজ ধ্বংস হয়। আমার স্বামী ওখানেই নিহত হন। সব হারিয়ে একমাত্র স্বামী ছিলো তাও স্বাধীনতার পূর্বমুহূর্তে হারাতে হলো।

আমি বাহিরচর থেকে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর জন্য খাবার পাঠিয়েছি। রাতে যখন তখন আমার ওখানে তারা এসে থাকতো, যেতো। আমার স্বামী মুক্তিবাহিনী ক্যাম্পে মাঝে মাঝে যেতেন। আমার স্বামীর বড় সাধ ছিলো স্বাধীন বাংলার মাটিতে বাস করা। তার সে সাধ পূর্ণ হলো না।
স্বাক্ষর/-
ভারতী রাণী বসু
১৮/৮/৭৩
<৮,২.৩.২০৪,২৫২>
উষা রাণী মল্লিক
গ্রাম: জুলুঘাট, ডাকঘর: মৌশানি
থানা: স্বরুপকাঠি, জেলা: বরিশাল
২২ শে বৈশাখ ঝালকাঠি থেকে রাজাকার ও মিলিটারী স্বরুপকাঠি থানাতে আসে। প্রথম দিন স্বরুপকাঠি থানাতে প্রবেশ করে ১৮ জন হিন্দু পুরুষ ছেলেকে পাক বাহিনী নৃশংসভাবে হত্যা করে। পাক বাহিনী আমাদের বাড়ির পাশেই জুলুঘাট স্কুলে ক্যাম্প স্থাপন করে। পাক বাহিনী আসার ৩ দিন পর আমি আমার ভাইয়ের সঙ্গে গ্রাম থেকে পালিয়ে আটঘর কুড়িয়ানা চলে যাই।

প্রায় ২ মাস দেশের বিভিন্ন জায়গায় পালিয়ে থেকে শেষে বাধ্য হয়ে আমাদের গ্রামে ফিরে আসি। হিন্দু বলে লোকে আমাদের জায়গা দিতে চাইতো না। ঠিক মতো খাবার মিলতো না, লোকের কাছে চেয়ে চেয়ে খেতে হতো। সব জায়গায় ঐ একই কথা, মিলিটারি আসবে পালাও। রাজাকাররা রাত্রের অন্ধকারে গ্রামে গ্রামে ঢুকে বহু যুবতী সুন্দর নারীকে ধর্ষণ করেছে এবং ধরে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে গেছে। এই সময় তারা পুরুষদেরকে ধরে নিয়ে যায় এবং সবাইকে নির্মমভাবে হত্যা করে। যাকে একবার ধরে নিয়ে যেত সে আর ফিরে আসতো না।

আষাঢ় মাসের মাঝামাঝি একদিন পাক বাহিনী ও রাজাকাররা আমাদের গ্রাম আক্রমণ করে। আমার বাড়ির পিছনে কলাবাগানের মধ্যে লুকিয়ে থেকে সব কিছু দেখছিলাম। আমার বাড়ির উপর দিয়ে আমার পাশের বাড়িতে ঢুকে পাক বাহিনী দুইজন মেয়েছেলেকে ধরে ফেলে এবং ঘরের ভিতর জোর করে নিয়ে যায়। আমরা ঝোঁপের ভিতর থেকে দেখতে থাকি কিন্তু করার কিছুই থাকে না। মেয়ে দুইটাকে যখন ঘরের ভিতর নিয়ে যায় তখন তাদের কোলের ছোট ছেলেকে আছাড় মেরে বাইরে ফেলে দেয়। ঘরের ভিতর থেকে মেয়ে দুইটার করুণ চিৎকার ভেসে আসতে থাকে। দুইটা মেয়ের উপর পরপর ৪ জন মিলিটারি ধর্ষণ করে। মিলিটারি চলে যাবার পর আমরা মেয়ে দুইটার কাছে যেয়ে দেখি তারা অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে আছে। তাদের সারা শরীরে ক্ষতের চিহ্ন। পরনের কাপড় দূরে রয়েছে। সে এক করুণ দৃশ্য। তারা ঐদিন গ্রাম থেকে আরো কয়েকজন মেয়েকে ধরে নিয়ে যায় ক্যান্টনমেন্টে।

পাক বাহিনী থাকাকালে তারা প্রায়ই আমাদের গ্রামসহ আশে পাশের গ্রামগুলিতে আসতো। তাদের আসার খবর পেলেই সব লোক যে যেদিকে পারতো পালাতো। রাজাকাররা এই সময় সব জায়গা খুঁজে খুঁজে লোকজনকে ধরেছে। পুরুষদের সেখানেই গুলি করে হত্যা করতো আর মেয়েদেরকে ধরে নিয়ে যেত। অনেককে আবার ধর্ষণ করার পর ফেলে রেখে যেত।

শেষের দিকে রাজাকারদের অত্যাচার চরমে ওঠে। তারা প্রত্যেকদিন গ্রামের ভিতর যেতে থাকে এবং যেখানে যাকে পায় তাকেই মারতে থাকে। তখন বাধ্য হয়ে বাড়ি ছেড়ে গ্রাম থেকে গ্রামে ঘুরে বেড়াতে থাকি।

দেশ স্বাধীন হবার পর চারিদিকে আনন্দের সাড়া পড়ে যায়। মানুষ সব কষ্ট ভুলে দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করে।
স্বাক্ষর/
উষা রাণী মল্লিক
২০/৮/৭৩
<৮,২.৩.২০৪,২৫৩-৩৪>
যতিন্দ্রনাথ মন্ডল
গ্রামঃ শশীদ
ডাকঘরঃ মৌশানী
থানাঃ স্বরুপকাঠি
জেলাঃ বরিশাল
১৭ ই বৈশাখ পাক বাহিনী গানবোট নিয়ে ঝালকাঠি দিয়ে কাটাখালী নদী দিয়ে শশীদের হাটে আসে। তারা এসে হাটের পাশে গানবোট রেখে গ্রামের উপর নেমে পড়ে। পাক বাহিনী গ্রামের ভিতর প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের নারী পুরুষ প্রাণের ভয়ে যে যেদিকে পারে পালাতে চেষ্টা করে। পাক বাহিনী গ্রামে প্রবেশ করে প্রথমে দামী দামী জিনিসপত্র লুটতরাজ করে এবং পরে ৯ খানা বাড়ি অগ্নিসংযোগে ধ্বংস করে দেয়। ঐ দিন ২ জন লোককে তারা গুলি করে। এদের একজন সঙ্গে সঙ্গে মারা যায় আর একজন গুরুতর রুপে আহত হয়।

২৬ বৈশাখ পাক বাহিনী ও রাজাকাররা পুনরায় আমাদের গ্রামে আসে। তারা গানবোট ও স্পিড বোট নিয়ে ছোট খাল দিয়ে গ্রামের ভিতর ঢুকে পড়ে। মতিলাল দেবনাথ (ব্যানার্জী) ও হিরালাল দেবনাথের কাপড়ের দোকান লুট করে স্পিডবোট বোঝাই করে কাপড় নিয়ে যায়। এই সময় ওরা মতিলাল দেবনাথের কাছ থেকে নগদ ১২,০০০ টাকা নেয় এবং তাঁকে বেয়োনেট চার্জ করে পরে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করে। এই দিন আমাদের গ্রামে ১৮ জন লোককে পাক বাহিনী গুলি করে বেয়োনেট চার্জ করে হত্যা করে। এর মধ্যে জিতেন নামে একজনকে পাক বর্বর বাহিনী নারিকেল গাছের সঙ্গে দড়ি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে তার পায়ের কাছে খড়কুটো দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। তার সারা শরীরে আগুন ধরে গেলে সে ভীষণভাবে চিৎকার করতে থাকে। তখন পাক বর্বর বাহিনী গুলি করে তার মাথার অর্ধেক অংশ উড়িয়ে দেয়।

এই ঘটনা তার স্ত্রীর সম্মুখে হয়। কেননা পাক বাহিনী তার স্ত্রীকে ধরে এনে তার সম্মুখে তাঁকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এই সময় ক্ষীরদা সুন্দরী নামে বিধবা মেয়েকে পাক বাহিনী সারা শরীর বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নির্মম্ভাবে হত্যা করে। এ সময় আর এক মহিলা পাশের জঙ্গলের ভিতর পালিয়ে ছিলো তার ছোট ১ ছেলে ও ১ মেয়েকে নিয়ে। পাক বাহিনী তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লে এক গুলিতে ছেলে, মেয়ে সহ তিনজনই মারা যায়। ঐদিন আমাদের গ্রামের মোট চারখানা বাড়ি বাদে আর সব বাড়ি অগ্নিসংযোগ করে দেয়।

৫ই জ্যৈষ্ঠ পাক বাহিনী ঝালকাঠি থেকে গানবোট নিয়ে পুনরায় শশীদ হাটে আসে এবং হাটের উপর ক্যাম্প স্থাপন করে। ঐ দিনই পাক বাহিনী আমাদের গ্রাম থেকে ২ জন লোককে হত্যা করে। তার মধ্যে একজন ছিলো স্থানীয় স্কুলের সেক্রেটারী কালী কান্তা মন্ডল। এই সময় পাক বাহিনী স্কুলের লাইব্রেরী লুট করে এবং ভেঙ্গেচুরে সব তছনছ করে দেয়। লাইব্রেরীর ভিতরে ছাত্রদের দেওয়া রিলিফের গমে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। এই আগুন নেভাতে গিয়েই সেক্রেটারী সাহেব গুলি খান।

পাক বাহিনী এই সময় ১০ দিন শশীদ হাটে ক্যাম্প করে থাকে। এই সময় তারা ব্যাপক হারে নারী ধর্ষণ করে। আমাদের গ্রামের অনেক মেয়েকে পাকবাহিনী ধর্ষণ করে। পাক বাহিনী রাত্রিতে গ্রামের ভিতর ঢুকে মেয়েদের উপর পাশবিক অত্যাচার করে এবং কিছু কিছু মেয়েকে তারা ধরে ক্যাম্পে নিয়ে যায় এবং এক একজনের উপর পরপর কয়েকজন পাক পশু ধর্ষণ করে। এই সময় ১০ বছরের একটা ছোট মেয়েকে পাক বাহিনী তাদের ক্যাম্পে নিয়ে যায় এবং একাধারে তার উপর চলে পাশবিক অত্যাচার। পাক বাহিনী চলে যাবার পর এই মেয়েটিকে উদ্ধার করা হয়। ৩ মাস পর্যন্ত এই ছোট মেয়েটি হাঁটতে পারতো না।

৮ মাসের গর্ভবতী একটি মেয়ের উপর পাক বাহিনী এই সময় অমানুষিক পাশবিক অত্যাচার চালায় যার দরুন সন্তান প্রসব করার পর সে ও সন্তান মারা যায়।

২৫ শে শ্রাবণ পাক বাহিনীর দালালের সহযোগীতায় ঝালকাঠি থেকে গানবোট নিয়ে শঙ্কর ধবল গ্রামে আসে। আছমত আলি ও রহিনী মিস্ত্রিকে ধরে নিয়ে শশীদ গ্রামে আসে এবং সুনীল সরকার নামে এক ছেলেকে গুলি করে হত্যা করে। এই সময় খুব বৃষ্টি নেমে পড়ে। পাক বাহিনী তখন রহিনী কুমার মণ্ডলের ঘরে আশ্রয় নেয়। হারমোনিয়াম, ঢোল, তবলা নিয়ে খুব গান বাজনা করে এবং কলা খায়। বৃষ্টি শেষে যাবার সময় গৃহকর্তা রহিনী কুমার মণ্ডলকে গুলি করে হত্যা করে যায়। যে দুইজন লোককে তারা বন্দী করে আনে তাদের একজনকে টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেয় এবং একজনকে শশীদ হাটে বসে গুলি করে হত্যা করে। তাঁকে হত্যা করার আগে খুব মারপিট করে এবং গালাগালি দেয়। যাকে এই সময় ছেড়ে দেয় তাঁকে বলে তোমরা জয় বাংলা বলতে পারবে না। বলবে “জয় পাকিস্তান”।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে স্বরূপকাঠি থানার অশ্বথকাঠি, জিনহার, মাদ্রা, পুর্বজলা বাড়ী, মৌশানী, জুলুহার, আতা, জামুয়া, জৌসার, গণপতিকাঠি, আরামকাঠি প্রভৃতি গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়। এই সময় বহু লোককে তারা নির্মমভাবে হত্যা করে। এই সময় মাদ্রা গ্রাম থেকে দুইজন লোককে কুঠার দিয়ে কুপিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। তাদের অপরাধ ছিল পাক সৈন্য যখন একটা মেয়েকে ধর্ষণ করার জন্য যায় তখন তারা দুইজন বাধা দেয়। এই সময় তারা বহু মেয়েকে ধর্ষণ করে। একমাত্র স্বরূপকাঠি থানাতেই ১ হাজারের বেশী মেয়েকে পাকবাহিনী ধর্ষণ করেছে।

বিভিন্ন সময় আমাদের থানাতে প্রায় ২০০/৩০০ লোককে পাকবাহিনী হত্যা করে। স্বাধীনতার পর আটঘর কুড়িয়ানা স্কুল ঘরের পেছনে একটা পুকুরের ভেতর থেকে ১৫৬ টা মাথার খুলি উদ্ধার করা হয়।

পাকবাহিনী স্বরূপকাঠি দখল করার পর স্বরূপকাঠি, কুড়িয়ানা, শশীদ, বাউকাঠি, জলাবাড়ী এইসব জায়গায় ক্যাম্প স্থাপন করে এবং এখান থেকেই বিভিন্ন জায়গায় অপারেশন চালায়। জলাবাড়ী ক্যাম্প অঞ্চলে ৩৩ টা গ্রাম শুধু হিন্দু বসতি ছিল, পাকবাহিনী সব গ্রাম একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দেয়।
স্বাক্ষর/
যতিন্দ্র নাথ মন্ডল
<৮,২.৩.২০৬,২৫৫>
শ্রী ফনীন্দ্র ভূষণ পাল
ঝালকাঠি, বরিশাল
আমি পশ্চিম ঝালকাঠি গ্রামে গুরুচরণের পরিত্যক্ত বাড়ী হতে রাজাকার এবং পুলিশ দ্বারা ধৃত হই। পরে ঝালকাঠি থানার ওসি সেকান্দার সাহেবের সঙ্গে দেখা হয়। উক্ত গ্রাম হতে আজহার নামক অপর এক ব্যক্তিকে ধরে নিয়ে আসে। তাঁকে বেদম প্রহার করা ফলে তাঁর গুহ্যদ্বার দিয়ে রক্ত পড়তে থাকে। আমাকে থানায় নিয়ে আসে। সেদিন প্রায় ৪০ জন বব্দী ছিল। যাদের ধরে আনতো তাদের রাইফেল দিয়ে বেদম প্রহার করতো। এর ফলে অনেকের দাঁত, হাত, পা ভেঙ্গে যেত।

প্রত্যেক দিন ভোর রাতে বন্দীদের থানা হতে কিছু দূর এক বদ্ধভূমিতে নিয়ে গিয়ে হত্যা করতো। রাতে গোপনে একটা কমিটি বসতো ধৃত ব্যক্তিদের সম্পর্কে। যাদের ছেড়ে দেয়া প্রয়োজন বলে মনে করতো তাদের উক্ত রাতে ছেড়ে দিত, বাকীদের বদ্ধভূমিতে নিয়ে গিয়ে হত্যা করতো। আমাকে যেদিন ধরে নিয়ে যায় সেদিন আজহার ও তার পুত্র মুক্তিফৌজ জনাব রশিদকে ধরে নিয়ে আসে। আজহার তার পুত্রের চিন্তায় খাদ্য পরিত্যাগ করে। আমি তাকে বলি যে তোমার পুত্র দেশের জন্য শহীদ হচ্ছে এবং এটা বীরত্বের কথা, সুতরাং দুঃখ পাবার কিছুই নেই। তখন তার পুত্র রশিদ বলে যে, “আব্বা মরে তো যাবই, কিন্তু যাবার পুর্বে তোমার সাথে একত্রে আহার করি।” উক্ত পুত্র আমাকেও তার সাথে আহার করে বলল এবং আমাকে তাকে আহার করিয়ে দিতে বলে। তখন আমরা একত্রে আহার করি। তখনকার সেই দৃশ্য সহ্য করার মতো ছিল না। সে দৃশ্য অত্যন্ত করুণ ছিলো। সে আমাকে তার পিতাকে সাহায্য করার কথা বলে। পরে উক্ত ৪০ জনকে রাতে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে।

এরপর আমি বাড়ী যাই। পরে পাঞ্জাবী বাহিনী এসে পুনরায় শহরে লুটপাট শুরু করে এবং নারী ধর্ষণ বেশী করে। এরা মানুষকে হত্যা করে কবর দিতো। এর পূর্বে মানুষদের হত্যা করে নদীতে ফেলতো। কিন্তু তখন বিভিন্ন মিশন ঝালকাঠিতে আসতে থাকায় তাঁরা অনেক ভাসমান লাশ দেখে এবং পাকবাহিনীর অত্যাচার সম্পর্কে সন্দেহ করে। এই জন্য তাদের হত্যা করে মাটিচাপা দিয়ে পাকবাহিনী চেষ্টা করেছে তাদের কৃতকর্মের নজির চাপা দিতে। পাকবাহিনী সেই সময় শহরে অবস্থিত বহু পরিবারের নারীদের জোরপূর্বক ধর্ষণ করে। এরপর তাঁদের দালাল বাহিনী ধরে নিয়ে গলা কেটে হত্যা করে।
স্বাক্ষর/
শ্রী ফনীন্দ্র ভূষণ পাল
১৫/৮/৭৩
<৮,২.৩.২০৭,২৫৬-৫৭>
মোঃ মেমবর আলী সরদার
গ্রামঃ উত্তর তালগাছিয়া
জেলাঃ বরিশাল
অসহযোগ আন্দোলনে জনগন স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগীতা দেখিয়েছে। আমরা অফিস আদালত বন্ধ করে আন্দোলনের ডাকে সাড়া দেই।

আমি গোসল করতে যাবার সময় দেখি যে দুই ব্যক্তিদের তাদের একসঙ্গে বেঁধে গুলি করে হত্যা করে। তাদের রাস্তায় ফেলে চলে যায়।

বাগেরহাট ডাক বাংলোয় ঘাটে আমি চার/পাঁচজন মানুষকে এক সাথে হত্যা করতে দেখেছি। তার মধ্যে দুই একজন তখনো জীবিত ছিল। তারা রাস্তায় মানুষ দেখলে বাচাঁও বাচাঁও বলে চিৎকার করতো বাচঁবার আশায়। কিন্তু তাদের সাহায্য করলে পাকবাহিনী সাহায্যকারীকেও হত্যা করতো। মানুষ মুমূর্ষু ব্যক্তিকেও সাহায্য করতে পারতো না এই বর্বর পাক সেনাদের ভয়ে।

একদিন দুজন নিরীহ ব্যক্তিকে হত্যা করে তারা ডাক বাংলোর সামনে ঝুলিয়ে রেখে পিঠে কাগজ লাগিয়ে লিখে রেখেছে উক্ত ব্যক্তিদ্বয় নক্সাল। তাদের পিঠ রাস্তার দিকে ঝুলিয়ে রেখেছে। এইভাবে মৃত ব্যক্তিদের দেখিয়ে অমানুষিক ও বর্বরোচিত কার্য করে মানুষকে ত্রাসের মধ্যে রাখতে চেষ্টা করেছে।

একদিন দুজন যুবককে ধরে নিয়ে আসলো। শুনলাম তারা মুক্তিফৌজ। পাকবাহিনীর একটি জাহাজ মাইন দিয়ে ডুবিয়ে দিয়ে বাগেরহাটে এসে রাত কাটানোর সময় স্থানীয় দালাল দ্বারা ধৃত হয়ে পাকবাহিনীর হাতে পড়ে। তাদের ধরে নিয়ে এসে তাদের উপর অমানুষিক নির্যাতন চালায়। বেদম প্রহার করে তাদের নিকট মুক্তিফৌজের বিভিন্ন গোপন সংবাদ জানার জন্য। কিন্তু স্বাধীনতা সংগ্রামীরা তাদের গোপন তথ্য ও সঙ্গীদের নাম শত অত্যাচারেও প্রকাশ করেনি। তারা মৃত্যু পূর্ব মুহুর্তেও বলেছে তোমরা আমাদের মেরে ফেলতে পারো কিন্তু আমি আমার গোপন তথ্য ও সঙ্গীদের নাম বলবো না। পাকিস্তানী সেনারা তাদের পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলার জন্য চাপ সৃষ্টি করলেও তারা জয়বাংলা বলে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে।

ওয়াপদার রেস্ট হাউজ ও ব্যারাকের সমস্ত এলাকা পাকবাহিনী দখল করে সেখানে শক্তিশালী ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করে। আমার নিবাস ছিল উক্ত ক্যাম্পের অতি নিকটে। সুতরাং বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অবস্থায় আমি পাকবাহিনীর ধ্বংসাত্মক ও নির্যাতনের বহু দৃশ্য দেখেছি।

রায় সাহেব কিরণ চন্দ্র দাস মহাশয়ের বাড়ীতে একদিন একদল পাকবাহিনী প্রবেশ করে। তারা রায় সাহেবকে তার বাড়ির গোপণ স্থান সমূহ দেখাতে বলে, তিনি তা পালন করেন। পরে তাঁকে বলে যে ওটা কি? যখন তিনি সেই দিকে দৃষ্টি ফিরিয়েছেন তখন গুলি করে তাঁকে হত্যা করা হয় এবং সমস্ত মুল্যবান জিনিস লুট করে নিয়ে যায়।

ভোলা বোস নামে এক ব্যক্তিকে আহারের সময় গুলি করে হত্যা করে। ভোলা বোসের আহার সমাপ্ত করার অনুরোধও উপেক্ষিত হয় এই বর্বরদের কাছে।

পাক সেনারা গ্রামের বিভিন্ন অঞ্চল অপারেশন করে যুবতী মেয়েদের ধরে নিয়ে আসতো পাকবাহিনীর ক্যাম্পে। তাদের সারারাত ধরে অফিসারগণ উপভোগ করতো। সময় সময় নির্যাতিত মহিলাদের করুণ আর্তনাদ মাঝ রাতে শুনতে পেতাম। পরে তাদের হত্যা করতো বলে মনে হয়।

সাধারণ সৈন্যগণ দিনের বেলায় প্রকাশ্যে শহরের বস্তি এলাকায় গমন করতো এবং বস্তি এলাকার মহিলাদের উপর জোর করে পাশবিক অত্যাচার চালাত। এই দৃশ্য কখনো যদি কোন পথচারীর দৃষ্টিতে পড়ে যেত তাহলে উক্ত পথচারীকে বেদম প্রহার করতো। এইভাবে তারা মহিলাদের উপর নির্যাতন চালাতো।
স্বাক্ষর/
মোঃ মেমবর আলী সরদার
৮/৮/৭৩
<৮,২.৩.২০৮,২৫৮-৫৯>
সুধা রাণী বসু
গ্রামঃ ছাচলেপুর
ডাকঘরঃ পিংড়ী
থানাঃ ঝালকাঠি
জেলাঃ বরিশাল
১৩৭৮ সালের ৭ই জ্যৈষ্ঠ তারিখে ঝালকাঠি থানা হতে ১৪ জন বাঙ্গালী পুলিশ স্থানীয় শান্তি কমিটির দালালসহ ছাচলেপুর গ্রাম অপারেশনে যায়। সকালবেলা পুলিশগণ আমার পিতার বাড়ী আক্রমণ করে এবং তা জ্বালিয়ে দেয়। আমরা সবাই নিকটস্থ জঙ্গলে পালিয়ে যাই। আমি আমার বড় মেয়ে রমাবাতী বসুকে নিরাপত্তার জন্য মোতাহার গোমস্তার বাড়ীতে রেখে দেই। পুলিশেরা পরে উক্ত বাড়ীতে গিয়ে মোতাহারের সাহায্যে আমার মেয়ে এবং অপর দুজন মেয়ে কমলা রানী দাস (বয়স ১৭) ও কল্পনা রানী দাসকে (বয়স ১৮) ধরে নিয়ে যায়। পরে মেয়েদের খুঁজতে গিয়ে দেখি যে কমলা ও কল্পনাকে গুলি করে বিষখালি নদীর পারে হত্যা করেছে এবং রমাকে বেয়োনেট দিয়ে হত্যা করেছে। এছাড়াও আমার আত্মীয় দুর্গাশংকর দাসকেও গুল করে হত্যা করে। আমরা পরে উক্ত লাশ দেখতে পাই। উক্ত মেয়েদের নৃশংসভাবে হত্যা করে এই পুলিশ বাহিনী।

তার পরের দিন পূর্বোল্লিখিত পুলিশগণ পুনরায় উক্ত গ্রামে অপারেশনে যায়। তখন আমার স্বামী নদী পার হয়ে পিংড়ি গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নেয় এবং সেখান হতে অন্যত্র চলে যায়। বহু দিন তার কোনো সংবাদ জানতে পারিনি। পুলিশের ভয়ে আমি দুই মেয়ে এবং এক ছেলে নিয়ে চৌকিদার বাড়ীর জঙ্গলে আশ্রয় নেই। আমি আমার ছোট ২ পুত্র এক স্থানে গোপন করে থাকি। অন্যত্র আমার দুই মেয়ে আত্মগোপন করে থাকে। চৌকিদার তখন উক্ত পুলিশদের বলে যে এই হচ্ছে লিডার সঞ্জিবের মা, একে ধরো। তখন পুলিশেরা আমাকে ধরে ফেলে এবং ওসি বলে থানায় যেতে হবে।

সেই সময় আমার সঙ্গের মেয়েটি পুলিশকে বলে আমাদের মেরো না, আমার কাছে টাকা আছে নিয়ে যাও। তখন পুলিশ তার নিকট হতে ৩,০০০/= (তিন হাজার) টাকা ছিনিয়ে নেয় এবং আমাদের থানায় নিয়ে আসে। আমার অপর দুজন মেয়ে অসহায় হয়ে যায়। তারা আশ্রয়ের জন্য ঘুরতে থাকে কিন্তু ভয়ে কেউ আশ্রয় দিতে স্বীকার হয়নি। একজন তাদের কান্না দেখে সদয় হয়ে তার বাড়ীতে আশ্রয় দেয়। যাহোক আমাকে থানায় নিয়ে এসে প্রায় দেড় মাস আটকে রাখে। তখন নিম্নে বর্ণিত দৃশ্যগুলি দেখেছি।

থানা হতে পুলিশেরা বিভিন্ন গ্রামে অপারেশন চালিয়ে নিরীহ লোকদের ধরে নিয়ে গিয়েছে এবং রাত ৩ টার দিকে তাদের হাত বেঁধে দলবদ্ধ ভাবে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছে। ভোর চারটার দিকে সুগন্ধা নদীর তীরে এবং থানা হতে কিছুটা দূরে বদ্ধভূমিতে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছে। আমি থানা হতে বহু মানুষের চিৎকার ও করুণ আর্তনাদ শুনেছি। কাউকেই রক্ষা করে নি।

অনেক মানুষকে থানা হতে ঝালকাঠি মিলিটারি ক্যাম্পে নিয়ে যেত এবং সেখান হতে যখন উক্ত ব্যক্তিদের ফিরিয়ে আনতো তখন তাদের শরীরের বিভিন্ন স্থানে পোড়া ক্ষতের চিহ্ন দেখেছি। পাকবাহিনী লোহার রড গরম করে উক্ত ব্যক্তিদের শরীরের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দিতো। পরে তাদের থানায় এনে রাতে উক্ত বদ্ধভূমিতে নিয়ে গিয়ে হত্যা করতো।

একদিন প্রায় ৯৫ (পচাঁনব্বই) জন নিরীহ লোকদের ধরে নিয়ে এসে হত্যা করে। প্রত্যেক দিন ধৃত ব্যক্তিদের নাম জিজ্ঞাসা করতো। কিন্তু সেইদিন তাদের সবাইকে নিয়ে লাইন ধরে হত্যা করেছে। সকালে একজন পুলিশ এসে তৎকালীন সি,আই (পুলিশ) কে জানায় যে ৯৫ (পচাঁনব্বই) জনের মধ্যে একজন জীবিত আছে। তখন উক্ত সি,আই উক্ত ব্যক্তিকে হত্যা করার জন্য নির্দেশ দেয়। প্রত্যেক দিন এই ভাবে ভোর রাতে ধৃত ব্যক্তিদের হত্যা করেছে। সি, আই এর নির্দেশে এই এক মাসে প্রায় ১,০০০ (এক হাজার) লোককে উক্ত বধ্যভূমিতে হত্যা করেছে বলে আমার মনে হয়।

আমার নিকত হতে ৩৮ ভরি সোনা এবং ৫০০ টাকার বিনিময়ে আমাকে ছেড়ে দেয়। আমি তখন নিজ বাড়ীতে চলে যাই। আমি আসার পর আমার স্বামীর সাথে দেখা হয়নি। আমার পুত্র সঞ্জীব মুক্তিফৌজ হওয়ায় তার খোঁজ পাইনি। বড় ছেলে দীলিপের সংবাদও পাইনি। এইভাবে এক মর্মান্তিক ও করুন অবস্থায় আমার দিন কেটেছে। স্বাধীনতার পর সবাই একত্রিত হই।
স্বাক্ষর/
সুধা রানী বসু
১৩/৮/৭৩

<৮,২.৩.২০৯,২৬০>
আজাহার আলী
গ্রামঃ গবিন্দ ধবোল,
ডাকঘরঃ কীর্ত্তিপাশা
থানাঃ ঝালকাঠি, জেলাঃ বরিশাল
১৯৭১ সালের ২৭ শে এপ্রিল পাকবাহিনী ঝালকাঠি শহরে আসে। এসেই তারা ঝালকাঠি শহরে আগুন দিয়ে সমস্ত শহরটা পুড়িয়ে দেয় এবং গণহত্যা শুরু করে। পাকবাহিনী বিভিন্ন গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে আমার ছেলে মোঃ সাত্তার নিজ গ্রামে থাকা নিরাপদ নয় মনে করে ৭ই আষাঢ় বেশাই খান গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নেয়। ঐ দিন ঝালকাঠি ও স্বরূপকাঠি থানার পাকবাহিনী বেশাই খান গ্রামে গিয়ে উক্ত গ্রামটা সম্পুর্ণ ঘিরে নিয়ে গোলাগুলি শুরু করে দেয়। তারপর পাকবাহিনী আমার ছেলে সাত্তারসহ মোট ৫৫ জন যুবক ছেলেকে ধরে। এবং জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে রাইফেল কোথায়? শরোজ বাবু কথায়? এই কথা বলতে থাকে আর কিল, ঘুষি, লাথির পর লাথি, বেতের লাথি দিয়ে প্রহার আর বন্দুকের বাট দিয়ে প্রহার করার পর তাদের মধ্যে হতে ১৩ জনকে একটা খালের পাড়ে নিয়ে যায়। সেখানে নিয়ে গিয়ে এক এক করে গুলি করে হত্যা করে খালের মধ্যে ফেলে আসে। আর ৪২ জনকে গরুর দড়ি দিয়ে বেঁধে ঝালকাঠি নিতে আসার সময় গান বোটে বসে সবার সামনে সাত্তারের শরীরের বিভিন্ন স্থানে বেয়োনেট দিয়ে ফেঁড়ে ফেঁড়ে নাইট্রোজেন এসিড মাখিয়ে দেয়। তারপর তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে। এখনও বল শরোজ কোথায়, তার পরিবার কোথায় এবং মুক্তিবাহিনী কোথায়? সাত্তারের শরীরে এসিড মাখিয়ে দেয় আমাদের স্থানীয় এলাকার দুইজন কুখ্যাত মুসলিম লীগের দালাল চেয়ারম্যান আজহার কারিগর ও শাহাজউদ্দিন সরদার (সাজি)। তারপর তাদেরকে থানায় নিয়ে এসে হাজত ঘরের মধ্যে রেখে দেয়। পরদিন সকাল বেলা আমি বাজারে এসে শুনতে পাই যে আমার ছেলে সাত্তারকে স্থানীয় দালালদের নির্দেশে পাক সেনারা তাকে ধরে ঝালকাঠি থানায় নিয়ে গেছে এবং ভীষণ প্রহার করেছে। তারপর আমি থানায় চলে যাই এবং আমার ছেলে সাত্তারের সাথে দেখা করি। সাত্তার তখন আমাকে বলে পাক সেনারা আমাকে গুলি করে না মারলেও দালালরা আমাকে রক্ষা করবে না। তাই আপনি তাদের কাছ থেকে আমার জীবন ভিক্ষা চেয়ে দেখেন তারা কি বলে। আমি দালালদের নিকট চলে আসি এবং তাদের পায়ের উপর কেঁদে পড়ে আমার ছেলের জীবন ভিক্ষা চাইলে তারা আমকে লাথি দিয়ে দূরে ফেলে দেয় এবং বলে আগামীকাল সকাল বেলা এসো। তারপর আমি বাড়ী চলে যাই।

ঐ দিন রাত্রিতে আমার ছেলে সাত্তারসহ ২৮ জনকে নদীর ধারে নিয়ে যায় এবং তাদেরকে লাইন করে গুলি করে হত্যা করে। পরদিন ভোরে আমি তাদের নিকট গেলে তারা আমাকে বলে তুমি গত রাত্রিতে গুলির শব্দ শোন নাই? তমার ছেলেকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। একথা শোনার সাথে সাথে আমি অজ্ঞান হয়ে সেখানে পরে যাই। ২০/২৫ মিনিট পর আমার জ্ঞান ফিরলে আমি সাত্তারের লাশের জন্য থানায় অনুমতির জন্য যাই। তখন থানায় পুলিশকে নির্দেশ দেয় আমাকে গুলি করতে। এবং আরও বলে সে যদি এখান থেকে চলে না যায় তাকে গুলি করে হত্যা করবে। তারপর আমি সেখান হতে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ী চলে যাই। আমার ছেলের মরা লাশ সেখানে পরে থাকে। আমি বাংলাদেশের একজন গরীব কৃষক। দু’টা ছেলের মধ্যে মাত্র একজন ছেলে বেঁচে আছে। মাত্র দুই বিঘা জমি আমার। কিন্তু সংসারে ৭/৮ জন লোক। অতি কষ্টে ছেলেটাকে বি,এ, পর্যন্ত পড়া লেখা শিখিয়েছিলাম। সে ছেলেকেও হারালাম।

স্বাক্ষর/
আজহার আলী ১৭/৮/৭৩
<৮,২.৩.২১০,২৬১> ““আমি আপনাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছি। কিন্ত আমার বৃদ্ধ পিতা তো আর আপনাদের সাথে যুদ্ধ করে নাই। এর জন্য তো আমার পিতা দায়ী নয়। তাকে কেন আপনারা নির্যাতন করেন?”
।।২১০।।
আজাহার আলী মিঞা
গ্রাম-পশ্চিম ঝালকাঠি
জেলা- বরিশাল

রশিদ ও মানিক হানাদার বাহিনীর হাতে ধরা পড়ার পর দালালরা বন্দুকের বাঁট দিয়ে তাদের সমস্ত শরীরে আঘাত করে। আঘাত করার দরুন তাদের শরীরের বিভিন্ন স্থান ফেটে রক্ত ঝরতে থাকে। তারপর তাদেরকে ঝালকাঠি থানায় নিয়ে আসে। থানায় কিল, ঘুষি, লাথি, এবং শরীরের বভিন্ন স্থান চাকু দিয়ে কুচা কুচা করে কেটে লবণ দিয়ে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় হাজত ঘরের মেঝেতে ফেলে রাখে। আর ঐ দিনই ৩০/৪০ জন পুলিশ রাজাকার, মিলে মুসলীম লীগের দালালের নির্দেশে আমার বাসা ঘেরাও ৪/৫ রাউন্ড গুলি করার পর বাসার মধ্যে প্রবেশ করে এবং আমাকে রোগশয্যায় শায়িত অবস্থায় ধরে ফেলে। এবং আমার বাড়িঘর লুটপাট শুরু করে দেয়। তখন তাদের মধ্য থেকে হতে একজন হাবিলদার পুলিশ লুট করা বারণ করলে তারা লুট বন্ধ করে দেয়। তারা আমাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা না করে এরেস্ট করে। ঝালকাঠি থানায় নিয়ে আসার সময় ঝালকাঠি খেওয়া ঘাটে তাছোনউদ্দিনের চায়ের দোকানে বসে আমার ঘাড়ে, হাটুতে, হতের তালুতে ও পায়ের তালুতে এবং শরীরের প্রতিটি গাটে রাইফেলের বাঁট দিয়ে, বেতের লাঠি দিয়ে এবং বুট দিয়ে আঘাত করে। যার দরুণ শরীরের বিভিন্ন জায়গা ফেটে রক্ত ঝরতে থাকে। এবং আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।

তার বিশ পচিশ মিনিট পর জ্ঞান ফিরে পেলে আমাকে রিক্সায় করে ঝালকাঠি থানায় নিয়ে আসে। যখন আমাকে প্রহার করত তখন শুধু আমাকে বার বার বলত এমন ছেলে জন্ম দিয়েছ যে সে আজ পাকিস্তানের শত্রু। আমি থানায় এসে দেখতে পাই যে, আমার ছেলে হাত-পা বাধা অবস্থায় হাজতে আধমরা হয়ে পড়ে আছে। আমাকে থানায় নেবার পর আমার ছেলে রশীদ ক্যাপ্টেন আজমতের সাথে কথা বলতে চায়। একজন পুলিশ রশিদকে আজমতের নিকটে নিয়ে যায়। রশীদ ক্যাপ্টেনকে জানায় যে, “আমি আপনাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছি। কিন্ত আমার বৃদ্ধ পিতা তো আর আপনাদের সাথে যুদ্ধ করে নাই। এর জন্য তো আমার পিতা দায়ী নয়। তাকে কেন আপনারা নির্যাতন করেন?”

তারপর ক্যাপ্টেন কিছু সময় চিন্তা করে আমাকে হাজত থেকে মুক্তি দেয় এবং আমার ছেলেকে হাজতে রেখে দেয়। আমাকে মুক্তি দেবার পর আমি আমার ছেলের সাথে দেখা করি। তারপর চোখের জল ফেলতে ফেলতে সেখান থেকে বের হয়ে আসি। তার দুই দিন পর অর্থাৎ ১৯ তারিখে রাত্রি দুইটার সময় নদীর ধারে আরো ১২ জন সহ মানিক ও রশিদ কে নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করে। তারপর তাদেরকে একটা গর্তের মধ্যে ফেলে মাটি চাপা দিয়ে রাখে।

স্বাক্ষর /-
আজাহার আলী মিঞা
১১/৮/৭৩<৮,২.৩.২১১,২৬২>
।।২১১।।
শ্রী রমেন কর্মকার (রঙ্গ)
ঝালকাঠি
জেলা- বরিশাল

১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি পাক বাহিনী ঝালকাঠি চলে আসে। এসেই তারা ঝালকাঠি শহরে লুটপাট শুরু করে। আগুন জ্বালিয়ে ৯০% দালান ও ঘর বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। পাক বাহিনী ঝালকাঠি আসার একদিন পূর্বে আমরা তারপাশা গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নেই।

এপ্রিল মাসের ২৫/২৬ তারিখে ঝালকাঠি হতে প্রায় ৭০/৮০ জন পাক সেনা তারপাশা অপারেশনে যায়।পাক সেনারা সংবাদ পেলে আমরা তারপাশার একটা জঙ্গলের মধ্যে গিয়ে আত্মগোপন করে থাকি। তারা একজন মুসলিম লীগের দালালের সহযোগিতায় উক্ত জংগল ঘেরাও করে গোলাগুলি শুরু করে দেয়। ফলে আমরা প্রান রক্ষার জন্য ছুটাছুটি করে পালাতে চেষ্টা করলে আমাদের ১০ জন ছেলেকে তারা ধরে ফেলে। এবং আমাদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে, “ তোম মুসলমান হ্যায়? কালেমা বাতাও”।

আমরা উত্তর দেই আমরা মুসলমান কিন্ত তারা আমাদেরকে দুই হাত বেঁধে ঝালকাঠি নিয়ে আসে। এবং থানা কাউন্সিলে তাদের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। অতঃপর হাত, পা লাইট পোস্টের সাথে দড়ি দিয়ে বেঁধে পা উপরের দিকে, মাথা নিচের দিকে দিয়ে ঝুলিয়ে প্রত্যেককে বালতি ভর্তি পানিতে মাথা ডুবিয়ে রাখে ও বেতের লাঠি, লোহার শিক ও বৈদ্যুতিক তার দিয়ে প্রায় আধা ঘন্টা পর্যন্ত আমাদের সমস্ত শরীরে আঘাত করার দরুন আমাদের মধ্যে ৪/৫ জন অজ্ঞান হয়ে যায়। আঘাতের দরুণ আমাদের শরীরের বিভিন্ন স্থান হতে রক্ত ঝরতে থাকে। তারপর পুলিশ দিয়ে আমাদের থানায় নিয়ে জায়। পিটানোর সময় আমাদের শুধু বলতে থাকে মুক্তিফৌজ কোথায়? এই বলে আর প্রহার করে। আমাদেরকে থানায় নিয়ে এসে হাজতের মধ্যে রেখে দে। এবং ভোর রাত্রি চার টার সময় দু জন করে একত্রে বেঁধে মোট ৮ জন কে গুলি করে হত্যা করে। উক্ত দলের মধ্য থেকে আমাকে ও নিতাইকে হাজতে আটকে রেখে দেয় ।

এই ঘটনা ঘটার দুইদিন পর আমাকে ক্যাপ্টেনের নিকট হাজির করে। এবং ক্যাপ্টেন আমাকে জিজ্ঞাসা করে তোর কোন বোন আছে? আমি উত্তর করি আমার তিনটা যুবতী বোন আছে। আমি তোকে ছেরে দেব তুই তাদেরকে শহরে নিয়ে আসবি। আমি তোকে ঘরবাড়ি , টাকা-পয়সা সব দিব। আমি তার কথায় রাজি হয়ে যাই এবং আমাকে আর আমার চাচাত ভাই নিতাই কে ছেড়ে দেয়। তারপর আমরা ছাড়া পেয়ে চলে যাই এবং তাদের সাথে দেখা না করে পালিয়ে পালিয়ে দিন কাটাতে থাকি। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে আবার আমি ঝালকাঠি চলে আসি।

স্বাক্ষর/-
রমেন কর্মকার
১৮/৮/৭৩
<৮,২.৩.২১২,২৬৩>
।।২১২।।
সন্তষী বালা ঢালী
গ্রাম- সুবিদপুর, ডাকঘর- পাশসাতরিয়া
থানা- কাউখালী, জেলা- বরিশাল
বৈশাখ মাসের শেষের দিকে পাক সেনারা আমাদের গ্রামে গিয়ে ( নিলতাগ্রাম) সমগ্রগ্রাম পুড়িয়ে দিয়েছে। প্রথমে লুট কর পরে সমগ্র গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়। লোক পালাতে চেষ্টা করলে গুলি করে হত্যা করেছে। ছোট ছোট বাচ্চা ধরে আগুনে ফেলে হত্যা করেছে। ১০ ই জ্যৈষ্ঠ পাক সেনারা আবার আসে। গ্রামের লোকজন মনে করে যেহেতু নিলতাগ্রাম একবার পুড়িয়েছে সেহেতু সেখানে পাক সেনারা আর আসবে না। তাই সমস্ত আশে পাশের লোক ঐ গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নেয়। পাক সেনারা রাজাকার মারফত এই খবর পেয়ে যায়। তারপর তারা সমস্ত নিলতাগ্রাম ঘিরে ফেলে লুট করার পর জ্বালিয়ে দেয় একই সাথে ২০ জন লোককে গুলি করে হত্যা করে ও পাশবিক অত্যাচার চালায়।

ঐ তারিখে আমার স্বামী পালিয়ে এক পুকুরের ভিতর মাথা উঁচু করে ছিল। পাক সেনারা খুঁজতে খুঁজতে জল থেকে উঠিয়ে আনে এবং ঐ পুকুরের পারেই ভীষণভাবে মারধোর করে। হিন্দু বলে অকথ্য গালাগাল করে, অত্যাচার চালায়, পরে গুলি করে ওখানেই হত্যা করে। আমার স্বামীকে হত্যা করে পাকবাহিনী আমার বাড়ি আক্রমন করে। বাড়িঘর সব জ্বালিয়ে আমার দুটি শিশু সন্তানকে হত্যা করতে নিয়ে যায়। আমি পা চেপে কান্নাকাটি করলে আমার কাছে টাকা চায়। আমার ২০০ টাকা, দুই জোড়া রিং এবং একটি আংটি ছিল ( সোনার) সেগুলো সব দিলে আমার ছেলেদের ছেরে দেয়।

চিড়েপাড়া থেকে পাক সেনারা মেয়েদের ধরে নিয়ে যায় ভোগের জন্য। নিলতাগ্রামে লুট করে পাটি তৈরী করে এমন একটি লোকের বাড়ি ঢুকে জ্বালিয়ে দে তারপর স্বামীকে গুলি করতে গেলে স্ত্রী ছুটে গিয়ে পাক সেনাদের পা জড়িয়ে ধরে বলে, আমার বাড়ি ঘর সব গেছে এখন আমার স্বামীকে মারার আগে আমাকে মারো। সাথে সাথে পাক সেনারা মেয়েটির উপর অত্যাচার করে জ্বলন্ত আগুনে নিক্ষেপ করে এবং পরে স্বামীকেও গুলি করে হত্যা করে। তারা অসংখ্য লোককে হত্যা করেছে। গন্ধর্ব গ্রামে পাক সেনারা গিয়ে গ্রাম জ্বালিয়ে বহু লোক কে কুড়াল দিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। ধর্ষিতা হয়েছে অসংখ্য নারী। স্বামীর মৃত্যুর পর আমি গ্রামে গ্রামে পালাতে লাগলাম ছেলে দুটিকে নিয়ে। মাইলের পর মাইল না খেয়ে হেটে বহু কষ্টে শিশু সন্তান দুটিকে নিয়ে ৫ ই শ্রাবণ ভারতে যাই। সেখানে বিলাশপুর চক্রবাটা ক্যাম্পে ছিলাম। দেশ স্বাধীন হলে আমি নিজ গ্রামে ফিরে আসি।
টিপ সহি /-
সন্তষী বালা ঢালী

<৮,২.৩.২১৩,২৬৪> “গুজব রটলো, মুক্তিবাহিনীর লোক কাল গেঞ্জী পরিধান করে। তারপর দেখা গেল, খান সেনারা কাল গেঞ্জী পরা লোক দেখলেই ধরতো, অত্যাচার করতো, ও হত্যা করতো।“
।।২১৩।।
মোঃ খালেদ
নির্বাহী প্রকৌশলী
পানি উন্নয়ন বোর্ড, ভোলা, বরিশাল

৫ ই মে পাক সেনারা ভোলাতে আসে। পাক সেনারা আমাদের ওয়াপদা কলোনীতে সেনানিবাস তৈরী করে। মেজর থাকত ওয়াপদা রেস্ট হাউজে। মে মাসেই শান্তি কমিটি গঠন হয়। জুন মাস থেকে রাজাকারে লোক ভর্তি শুরু হয়।

৬ ই মে মেজর ইয়াহিয়া অফিসারদের নিয়ে সভা করে। সবাইকে দেশের জন্য কাজ করতে বলে এবং এ ওবলে হিন্দু এবং আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করা হবে। ৭/৮ ই মে গাজীপুরের রোডে ৩/৪ জন হিন্দুকে পাক সেনারা গুলি করে হত্যা করে। এর পরই পাক সেনারা নিয়মিত ভাবে লোক ধরে দুষ্কৃতিকারী বলে হত্যা করত। হত্যার স্থান ছিল ভোলা খেয়া ঘাট, ওয়াপদা কলোনী এবং শিবপুর মেঘনার পাড়।

মে মাসের শেষ সপ্তাহে বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি আসে ভোলাতে। সকালে উঠে দেখলাম একটি আর্মি নেই কলোনীতে। কোথায় গেছে জানতে পারলাম না। বিশ্ব ব্যাংকের লোক সব খবর নেয়। খাদ্যের অবস্থা, পাক সেনারা কেমন অত্যাচার করছে ইত্যাদি। তাঁরা আমাদের রেস্ট হাউজে তিন দিনের মত ছিলেন আবহাওয়া খারাপ ছিল বলে। আমি এক ভদ্রলোককে অবস্থা বুঝিয়ে বলি। শিবপুর মেঘনার পাড়ে যে গনহত্যা শুরু হয়েছিল, এখনো ২/৪ টি মৃতদেহ পরে ছিল। তারা তার ছবি তুলে নেয় এবং অবস্থা মোটামুটি বুঝতে পারে। আমি পাক সেনাদের হত্যা দেখে বিচলিত ছিলাম। আমার পকেটে সব সময় রিভলবার থাকত। যে কোন অবস্থার জন্য সর্বক্ষণ প্রস্তুত থাকতাম।

পাক সেনারা বিভিন্ন স্থান থেকে লোক ধরে আনত, তারপর এখানে তাদের গুলি করে হত্যা করত। সেপ্টেম্বর/অক্টোবর মাস থেকে হত্যা ব্যাপক ভাবে বেড়ে যায়। কারণ ঐ সময় থেকেই বিভিন্ন থানায় মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা শুরু হয়। জুন/জুলাই মাসে কাজের জন্য আমাকে বিভিন্ন থানায় আয় যেতে হত। গাড়ি দেখে প্রথমে মানুষ পালাত। পরে আমাকে দেখে কাছে আসত। অক্টোবর মাসে হত্যার সংখ্যা বেড়ে যায়। সৈন্যরা বাস থামিয়ে লোক নামিয়ে হত্যা করত। গুজব রটলো, মুক্তিবাহিনীর লোক কাল গেঞ্জী পরিধান করে। তারপর দেখা গেল, খান সেনারা কাল গেঞ্জী পরা লোক দেখলেই ধরতো, অত্যাচার করতো ও হত্যা করতো।

যাদেরকে ধরে আনত, তাদেরকে খেতে দিত না। পরে হাত, পা বেঁধে গরু পিটানো পিটাতো যতক্ষন জ্ঞান থাকত। পিটিয়ে অনেককে হত্যা করত। শেষের দিকে খান সেনারা গুলি খরচ করত না কলোনীর একটি ঘরে জবাই করত। স্বাধীনতার পরে দেখলাম ঘরটি চাপ চাপ রক্তে ভরা। আমি দেখেছি জবাই করে টানতে টানতে একটি গর্তে মাটি চাপা দিয়ে রাখত। এই ভাবে আমার ধারনা, ২০০০ লোককে তারা হত্যা করেছে।

পাক সেনারা বহু মেয়ের উপরও পাশবিক অত্যাচার চালিয়েছে। অনেক সময় বলতো দুষ্কৃতিকারীরা ভারতীয় সিপাইয়ের পাল্লায় পড়ে এরকম কাজ করেছে এদেরকে খতম করবই। মুক্তিবাহিনী আমাদের শত্রু, এদেরকে খতম করতে হবে। পাক সেনারা প্রচুর পয়সা নিয়ে অনেক লোক ছেড়ে দিয়েছিল। বোরহানউদ্দিন এবং দৌলতখান থানা দুটিতেই পাক সেনারা অত্যাচার চালিয়েছে ব্যাপক। মুক্তি এবং মিত্র বাহিনীর চাপে ৯ ই ডিসেম্বর পাক সেনারা ভোলা থেকে পালিতে যায়। শোনা যায় চাঁদপুরের কাছে মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর সাথে যুদ্ধে মেজর সহ সবাই নিহত হয়।

স্বাক্ষর /- মোঃ খালেদ ১২/৯/৭৩
<৮,২.৩.২১৪,২৬৫>

।। ২১৪।।
মোঃ ফরিকুর রহমান
কালীবাড়ি সড়ক
ভোলা , বরিশাল

পাকসেনারা ভোলায় আসার পর পরই মানুষ খুন করে। মেয়ে ধরে এনেও পাশবিক অত্যাচার করে।

সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি রাত ২ টায় হটাৎ আমার বাড়ি ঘিরে ফেলে ১০ জনের মত খান সেনা, একজন রাজাকার এবং বাঙ্গালী ড্রাইভার। তারা প্রথমে আমার আব্বার সাথে কথা বলে আমার কথা জিজ্ঞেস করলে আমি উপর থেকে নিচে নেমে আসি। সুবেদার সিদ্দিক আমাকে বন্দী করে গাড়িতে তোলে। গাড়িতে ডাঃ ফজলে হোসেন (এম, বি, বি, এস) কে বন্দী অবস্থায় দেখলাম। গাড়ি মাকছুদুর রহমান এডভোকেটের বাড়ি যায় তাকে ধরার জন্য কিন্ত তাকে না পেয়ে গাড়ি চলতে থাকে। রাইফেল পরে গিয়ে সুবেদার সিদ্দীকের পায়ের নখ উঠে যায় এবং রক্তপাত হতে থাকে। আমি এবং ডাক্তার মিলে তারাতারি করে জয়নাল ডাক্তারের কাছে নিয়ে ব্যান্ডেজ করে যত্ন করি। সুবেদারের মন একটু নরম হলো বুঝলাম। গাড়ির ড্রাইভারকে বললো গাড়ি খেয়া ঘাটে যাবে না, ওয়াপদা নিয়ে চলো। খেয়া ঘাট মানেই মৃত্যু ছিল। বুঝলাম, আপাততঃ বেঁচে গেলাম। অতঃপর তারা আমাদেরকে ওয়াপদা কলোনীতে নিয়ে যায় এবং একটি ঘরে আটকে রাখে। বাইরে পাহারা থাকে।

পর দিন চা নাস্তা খাইয়ে ক্যাপ্টেনের কাছে আমাদের কে নিয়ে যায়। সেখানে নিয়ে যাবার পর জিজ্ঞেস করে, ‘মুক্তিবাহিনী কোথায়, বল’। আমরা জানিনা বললে ভীষণ ভাবে মারধোর করে। আমরা মৃতপ্রায় হয়ে পড়ি। তখন জেলে নিয়ে আতকে রাখে। আমি এবং ডাক্তার শহরে মোটামুটি পরিচিত ছিলাম। প্রতিবাদে শহরের সকল দোকান পাট বন্ধ হয়। রিক্সা সহ সমস্ত শহর অচল হয়। ইতিমধ্যে আমার আত্মীয় স্বজন আমার জন্য চেষ্টা করতে থাকে। টাকা দিলে তাদের মন কিছুটা নরম হয়। শান্তি কমিটি শহরের এই অবস্থায় অধিবেশন ডাকে এবং আমাদের ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। আমাদের যেখানে রেখেছিল সেখানে অনেক রক্ত এবং রক্ত মাখা জামা দেখলাম। দুইদিন রাখার পর অত্যাচার করেও কোন তথ্য যখন বের করতে পারে নি তখন আমাদের দুই জনকে ছেড়ে দেয়। আমি বাড়ি চলে আসি।

১০/১২ দিন পর মিলিটারীর একান্ত সহকারীর মারফত খবর পেলাম আমাকে আবার ধরার ষড়যন্ত্র করছে। আয়ুবী আমলে আমি ডি পি আর এর আসামী ছিলাম ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী বলে।

আমি গোপনে নৌকা ভাড়া করে বরিশাল পালিয়ে যাই এরপর আর ভোলাতে আসি নি। ভোলা শত্রুমুক্ত হলে আমি ভোলাতে ফিরে আসি।
স্বাক্ষর /-
মোঃ ফরিকুর রহমান
১৩/৯/৭৩

<৮,২.৩.২১৫,২৬৬>

।। ২১৫।।
শ্রী বিমল কৃষ্ণ দাস
সরকারী স্বাস্থ্য সহকারী
ভোলা জনস্বাস্থ্য কেন্দ্র
ভোলা, বরিশাল

২৮ শে মে রাজাকাররা রাত ১২ টার দিকে আমাদের গ্রামের বাড়ি ঘিরে ফেলে
লোকজন দেখে ভাবলাম, গ্রামে পাহারা দেয় তারাই হয়ত আসছে। দারোগা এসেই আমার নাম জিজ্ঞাসা করে। নাম বলার সাথে সাথে আমাকে আটকাতে বলে। রাজাকারদের একজন আমাদের পরিচিত। এবং দুইজন আমার সহপাঠী ছিল। আমাদের বাড়ি ঢুকে সবাইকে গ্রেফতার করে বলে তোমাদের কাছে বন্দুক আছে তোমরা মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করছ। আমার দাদা বিজয় ভূষণ দাস
(২) আমি
(৩) ব্রজমোহন দাস (জ্যাঠা)
(৪) হরিপদ দাস (কাকা)
(৫) সুনীল কুমার দাস (খুড়তুতো ভাই)
(৬) সহদেব হালদার (কৃষাণ বাড়ির)
(৭) যোগেন্দ্র বৈদ্য
(৮) শ্যামল কৃষ্ণ দাস
(৯) সৈয়দ আহম্মদ
(১০) রুহুল আমীন
(১১) ইনা আলী।
দারোগা সবাইকে থানায় নিয়ে যায়। পথে বালক বলে শ্যামল কৃষ্ণ দাস, রুহুল আমীন এবং ইনা আলীকে ছেরে দিয়ে আমাদের আট জনকে থানায় নিয়ে আসে। পথে জনৈক রাজাকার বলে তোমার জ্যাঠাত বোনকে দিলে তোমাদের বাঁচিয়ে দেওয়া হবে। আমি অস্বীকার করলে আমার জ্যাঠাকে বলে। জ্যাঠা মহাশয় বলেন, ‘আমার জীবনের বিনিময়ে হলেও মেয়ের ইজ্জত দিতে পারব না, টাকা নিতে পারো’। রাজাকাররা ক্ষিপ্ত হয়ে সবাইকে হাজতে আটকে রাখে।

২৯ শে মে সকালে রাজাকার আবার এসে আমার বোনকে চায়। আমি অস্বীকার করি। রাজাকার ফিরে যায়। আমার বৃদ্ধ আরেক জ্যাঠা দারোগাকে ছেড়ে দেবার অনুরোধ করলে সে বলে, ক্যাপ্টেন বরিশাল থেকে ফিরলে তখন দেখা যাবে।

ক্যাপ্টেন ছিল কায়ানী। ২৯ মে ভোলা ডাক বাংলাতে শান্তি কমিটির সভা বসে আমাদের নিয়ে। বরিশাল থেকেও জেলা শান্তি কমিটির লোক আসে আমাদের বিষয়ে। বরিশালের শান্তি কমিটির পুরাতন অনেকেই আমার বড় জ্যাঠাকে চিনতো। তারা এসে ছেরে দেবার জন্য অনুরোধ করে। আমি একটু আশ্বাস পেলাম হয়তো বাঁচবো।

৩০ শে মে সকাল ১০ টার দিকে ক্যাপ্টেন নিজে ১০/১২ জন খান সেনা নিয়ে আমাদের দেখতে যায়। আমার ভাইপো ৭/৮ বছর বয়স, ক্যাপ্টেনের পা ধরে খুব কান্নাকাটি করলে ক্যাপ্টেন বলে, আচ্ছা ছেড়ে দেব। আমাদের শিবপুর ইউনিয়ন শান্তি কমিটির সেক্রেটারি ইলিয়াস মাষ্টার কে আমাদের পক্ষে সুপারিশ করতে নিষেধ করে। আমার জ্যাঠা ড: শশী ভূষণ দাস দারোগা কে ৫,০০০ টাকা দিতে রাজী হলে সে বলে, ‘ কালকে আসবেন’।

পাক কর্তৃপক্ষ একটি ব্যাজ দেন (সি, এস)। এই ব্যাজ কমন সারভেন্ট, সাধারণ কৃষক, মুচি, মেথর, নাপিত এদের দেওয়া হত। আমাদের বাড়ির কৃষক হিসেবে ব্রজমোহন দাস, হরিপদ কুমার দাস এবং সুনীল কৃষ্ণ দাসের নামে ব্যাজ দেবার জন্য তারা টাকা নেয়। ব্যাজ বুকে থাকলে পাক সেনারা ধরবে না বা গুলি করবে না।

৩০ শে মে রাত আট টা ১৫ মিনিটে ক্যাপ্টেনসহ ১৪/১৫ জন খান সেনা আসে। আমাদের ৫ জন করে হাত বেধে ২ টি দলে ১০ জনকে গাড়িতে তোলে। আমাদের ৮ জন ছারা আর ২ জন ছিল বাপতা গ্রামের অনিল এবং চরফ্যাশনের আর একজন।

তারা আমাদের কে বরিশাল নিয়ে যাবার নাম করে ভোলা খেয়াঘাটে নিয়ে যায়। আমাদের ৫ জনকে ট্রাকে বসিয়ে রেখে অপর ৫ জনকে নদীর কূলে নামিয়ে আমাদের সামনে এক এক করে গুলি করে হত্যা করে। ঐ ৫ জনের দলে আমার খুড় তুতো ভাই তখনো মরেনি, ‘মা’ ‘মা ‘ করে কাঁদছে, আমরা শুনতে পাচ্ছি। ঐ অবিস্থায় সারা রাত থেকে পরদিন আমার ভাই মারা যায়। আমাদেরকে তীরে নামিয়ে একেকজনের জন্য দুজন করে সেনা অস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত হয়ে আমাদের বলল জলে নামতে। খান সেনারা চায়না অটোমেটিক রাইফেল প্রস্তুত করতে থাকে। আমি বলি, দাদা, সময় যায় ঝাপ দে। দড়ি বাধা অবস্থায় আমরা ৫ জন নদীতে ঝাপ দেই। খান সেনারা গুলি চালায়। আমরা টানাটানি করে হাতের দড়ি খুলে ফেলি। আমি সাঁতার দিয়ে নদীর ওপাড়ে চলে যাই। দাদা আরেক দিকে চলে যায়। গুলি অনবরত চলছে আর খান সেনারা গালাগালি করছে। একটি কারগো লঞ্চ দাড় করানো ছিল তারা ডাকতে থাকে আমি তীরে উঠে ক্রলিং করে ধান ক্ষেতের দিকে পালাতে থাকি।

সাত মাইল দূরে টংচর গিয়ে পৌছাই এক আত্মীয়ের বাড়ি। ওখানে দুই দিন থাকি। জানাজানি হয়ে গেলে বালিয়া গ্রামে পালিয়ে যাই এক বন্ধুর বাড়ি। ওখানে কাওছর হালদারের (প্রাইমারির শিক্ষক) বাড়িতেন ২ মাস থাকি। পরে আমার আহত দাদার খোঁজ পেলাম। জানতে পারলাম আমাদের ৫ জনের মধ্যে ৩ জন বেঁচে গেছি, বাকি ২ জন মারা গেছে।

গ্রামে গ্রামে পালিয়ে দিনের পর দিন জলের ভেতর থেকে জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে ভারতে গিয়ে পৌছাই। তারা আমাদের বাড়িঘর সব লুট করে নিয়ে যায়। আমাদের গ্রামের রাজাকারদের সহযোগীতায় তারা সমস্ত গ্রামের হিন্দু পরিবারদের ধ্বংস করে। তারপর দেশ মুক্ত হলে আমি আবার বাংলাদেশে ফিরে আসি।

স্বাক্ষর /-
শ্রী বিমল কৃষ্ণ দাস।

<৮,২.৩.২১৬.২৬৮> “এই পাঞ্জাবী ক্যাপ্টেনের বিশ্বাস ছিল যারা তাস খেলে তারা দুষ্কৃতিকারী হতে পারে না। ক্যাপ্টেন বলতো, ‘বাংলাদেশ মুক্ত হবেই, আমরা আটকে রাখতে পারব না’।
।।২১৬।।
আব্দুল করিম
প্রভাষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
পিরোজপুর কলেজ, পটুয়াখালি

মে মাসে পাক বাহিনী পাথরঘাটা যায়। ঐ দিন ই ৯ জনকে গুলি করে হত্যা করে। সি, ও (রেভ), পুলিশ, জমাদার, এদেরকেও গুলি করে হত্যা করে। কনস্টেবল পালানোর চেষ্টা করলে তাকেও হত্যা করে। আমি পরিবার নিয়ে পালিয়ে বেড়াতে থাকি। সমস্ত পটুয়াখালি জেলার বিভিন্ন গ্রামে পালিয়ে বেড়াতে লাগলাম।

জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে পাক সেনাদের তরফ থেকে ঘোষনা করা হয়, অধ্যাপক করিম কে ধরে দিতে পারলে নগদ দশ হাজার টাকা এবং একটি রিভলবার পুরষ্কার দেওয়া হবে। এ সংবাদ যখন পেলাম তখন আরো ভীত হয়ে পড়ি।

তারপর আমি পিরোজপুর পালিয়ে আসি। পাথরঘাটা থানাতে ১০০ -র বেশি লোককে পাকবাহিনী হত্যা করে। অত্যাচার চালায় ব্যাপক ভাবে। চরদুয়ানী, কালীবাড়ি, কাঁঠালতলী, পাথরঘাটা ইত্যাদি এলাকা পাক বাহিনী ধবংস করে। প্রথমে লুট করে পরে জ্বালিয়ে দেয়।

বিভিন্ন সময় পাক বাহিনী অপারেশনে গিয়ে মেয়েদের উপর অত্যাচার চালায়। লক্ষণ চন্দ্র দাস নামে এক ব্যবসায়ী ৫ ছেলে ও ২ মেয়ে নিয়ে পালিয়েছিল। দালালরা সুন্দরবন এলাকা থেকে লক্ষণ দাস সহ ৫ ছেলেকে ধরে আনে। অকথ্য অত্যাচার চালাবার পর তাদেরকে বরগুনার মহকুমাতে পাঠানো হয়।

সেখানে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ছেলে, তারপর লক্ষন দাস, তারপর ছোট দুটিকে লাইন দিয়ে দাড় করায়। পরপর তিনটি ছেলেকে গুলি করলে লক্ষণ দাস হার্টফেল করে মারা যায়। পাক সেনারা কি মনে করে ছোট দুটিকে বাঁচিয়ে রাখে। তারপর ওদেরকে মুসলমান করে পাথরঘাটাতে পাঠিয়ে দেয়। একটির বয়স ৭/৮ আরেকটির বয়স ১০/১১ বৎসর হবে। অনেককেই এভাবে পাক সেনারা শেষ করেছে। কনক নামের এক ভদ্রলোককে তার স্ত্রীর কাছ থেকে জোড় করে ছিনিয়ে নিয়ে তার সামনেই গুলি করে হত্যা করেছে। প্রাইমারী শিক্ষক আব্দুল মালেক ও তার ছেলে শাহজাহানকে মুক্তি বাহিনীকে সহযোগিতা এবং স্পাইং করার জন্য পাক সেনারা বাপ ছেলেকে একসাথে গুলি করে হত্যা করে।

আমি পালিয়ে এসে পিরোজপুর তৃতীয় হাকিম আব্দুল মান্নান হাওলাদারের সাথে সব কথা বলি এবং বাঁচার উপায় আনতেন বলি। পিরোজপুরের চার্জে তখন ক্যাপটেন এজাজ। মান্নাম সাহেব বললেন, যদি এজাজকে আয়ত্ত্বে আনতে পারো, তবেই বাঁচা সম্ভব। এজাজের ছিল ক্লাবে যাওয়ার অভ্যেস। সেই সাথে জুয়ারও। আমি ক্লাবে গিয়ে তাস নিয়ে বসি। এই পাঞ্জাবী ক্যাপ্টেনের বিশ্বাস ছিল যারা তাস খেলে তারা দুষ্কৃতিকারী হতে পারে না।এই বিশ্বাসের উপর হিন্দু ড: ইন্দ্রভূষন বিশ্বাসসহ আমরা অনেকেই বেঁচে যাই। আমরা খেলার মারফত ক্যাপ্টেনের বেশ কাছে গিয়েছিলাম। ক্যাপ্টেন বলতো, ‘বাংলাদেশ মুক্ত হবেই, আমরা আটকে রাখতে পারব না’।

১৫ ই নভেম্বর পাক সেনারা আমার ভাই (বি, এস, সি, ছাত্র) আব্দুল কাইয়ুমকে ধরে পাথর ঘাটা থেকে এবং অকথ্য নির্যাতন চালায়। তার হাত পায়ের কোথাও অক্ষত ছিল না। শেষ পর্যন্ত এগার হাজার টাকা দিয়ে সে প্রাণ ভিক্ষা পায়।

স্বাক্ষর /-
আব্দুল করিম
১৮/৮/৭৩

ইব্রাহিম রাজু
<৮,২.৩.২৬৯,২৬৯> “বর্বর খান সেনারা কনককে রেহাই দেবার কথা বলেছে কিন্তু নিষ্ঠুর দালালরা তাদের প্রতি বিন্দুমাত্র সহানুভূতি না দেখিয়ে কনককে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করে।“
।।২১৭।।
মোঃ সিদ্দিকুর রহমান
থানা-বরগুনা
জেলা- পটুয়াখালী

পাক দালালরা স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের উপর অকথ্য অত্যাচার চালায়। তারা সংগ্রামী মানুষদের ধরে গুলি করে হত্যা করে । বাড়ীঘর জ্বালিয়ে দেয়। মেয়েদের উপর পাশবিক অত্যাচার চালায় । মুক্তি বাহিনীর ভয়ে সাধারনত তারা গ্রাম অঞ্চলে ঢুকতো না।

প্রথমে বরগুনাতে শান্তি কমিটি গঠন করে উক্ত দালালরা পাক বাহিনীকে পটুয়াখালী হতে বরগুনায় পথ দেখিয়ে নিয়ে আসে। তাঁদের নির্দেশ মতো পাক বাহিনী গ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে অপারেশন চালিয়েছে। দালাল শ্রেনীর লোকেরা সুযোগ পেয়ে লুটপাট করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করে।

অক্টোবর মাসের শেষের দিকে শান্তি কমিটির দালালেরা নির্দেশে পাথরঘাটার কনক নামে একজন নিরীহ মুসলমানকে হত্যা করে। হত্যার সময় কনকের স্ত্রী কান্না এবং আকুল অবস্থা দেখে বহু মানুষ চোখের জল রাখতে পারে নি। এমনকি বর্বর খান সেনারা কনককে রেহাই দেবার কথা বলেছে কিন্তু নিষ্ঠুর দালালরা তাদের প্রতি বিন্দুমাত্র সহানুভূতি না দেখিয়ে কনককে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করে। বরগুনার শান্তি কমিটি বন্দর এলাকা হতে বহু নিরীহ মানুষদের ধরিয়ে দেয় এবং পাক বাহিনী তাঁদের হত্যা করে। তারা বহু নারীর সর্বনাশ করে।

স্বাক্ষর /-
মোঃ সিদ্দিকুর রহমান
২৭/০৮/৭৩

।। চট্টগ্রাম বিভাগ ।।

গুরু গোলাপ
<৮,২.৪.২১৮,২৭০-৭১>
শ্রী অমল কান্তি সেন
অধ্যাপক
সাতকানিয়া কলেজ
চট্টগ্রাম

১৯৭১ সালের ২৩ এপ্রিল পাক বাহিনী দোহাজারীতে ঘাঁটি স্থাপন করে। ২৪ এপ্রিল পাক বর্বর বাহিনী সাতকানিয়া থানার কাঞ্চনা গ্রামে সর্বপ্রথম অগ্নীসংযোগ ও হত্যাযজ্ঞ চালায়। এই সময় তাদের সাথে তাদের পথ প্রদর্শক হিসেবে ছিল অন্যান্যদের মধ্যে সাতকানিয়ার এক দুর্বৃত্ত।

১৩ ডিসেম্বরের আগ পর্যন্ত দখলদার বাহিনী এবং রাজাকারদের সাথে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছে এবং সাতকানিয়া থানার বিভিন্ন এলাকায় হিন্দু সম্প্রদায় ও মুসলিম প্রগতিবাদী শ্রেণির লোকদের নানাভাবে হয়রানি করেছে। সে কারো কারো কাছ থেকে বিভিন্ন পরিমাণ টাকা আদায় করেছে ঘরবাড়ী করার ওয়াদা দিয়ে অথবা প্রাণ রক্ষার অঙ্গীকারে।

২৪শে এপ্রিল যে কাঞ্চনা গ্রামটি ভস্মীভূত করা হয়েছে, সে দিন আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম। ঘরে মূল্যবান জিনিস ছিল, তা প্রথমে লুট করা হয়েছে। ঘর থেকে পালিয়ে লোকজন যখন এদিক সেদিক যাচ্ছিল, তখন তাদের কাছে যা পাওয়া গেছে তাও লুট করে নিয়েছে। এই ভাবে বেশীর ভাগ লোককে সর্বস্বান্ত করা হয়েছে। তখন বৃষ্টির দিন, তখনো পোড়া বাড়িতে ঘর তৈরী করার অনুমতি দেয় নি শান্তি কমিটির লোক। কাঞ্চনাতে আক্রমণ চালাবার দিন অন্যান্য ১১ জনের মধ্যে চট্টলার সু-সন্তান, সাতকানিয়ার গৌরব রায় সাহেব কামিনী কুমার ঘোষ এম.এ.বি.এল মহাশয়কে হত্যা করে পাক বর্বর বাহিনী।

আমাদের চেমশা গ্রামে অগ্নীসংযোগ করা হয়েছে ২৫শে মে। এই দিন পাক বাহিনী দোহাজারী ঘাঁটি থেকে সকাল ৮টা নাগাত সাতকানিয়ার ভূতপূর্ব এম.এন.এ আবু সালেহর বাড়ীতে আগুন দেয় এবং দোহাজারী ফেরার পথে চেমশা গ্রামের কাছাকাছি তখন কয়েকজন দুর্বৃত্ত পাক বাহিনীকে চেমশা গ্রামের হিন্দুদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়ার জন্য তাঁদেরকে অভ্যর্থনা করে। সাথে সাথে পাক বাহিনীর জীপ দিক পরিবর্তন করে চেমশা গ্রামে ঢুকে পড়ে। পাক বাহিনী গ্রামে ঢুকে দালালদের আগুন জ্বালাবার ভার দিয়ে যায় এবং তাদের সহায়তা করার জন্য সাতকানিয়ার থানার কয়েকজন পুলিশ মোতায়েন করে। এই সুযোগে দালালরা গ্রামে প্রথমে লুটতরাজ চালায় এবং পরে গ্রামের অধিকাংশ বাড়ীতে অগ্নীসংযোগ করে। আমার প্রতিবেশী হিসেবে একজন গরীব লোক ছিল, সে রিক্সা চালিয়ে জীবিকা অর্জন করতো। তার বাড়ীও সেই দিন রেহাই পায় নাই। কিন্তু সবচেয়ে দুঃখের বিষয় এই যে, আমার প্রতিবেশী সোনা দাস কে তারা ধরে নিয়ে যায়। পরে জানতে পারি তাকে নাকি হত্যা করা হয়েছে। আজও তার কোন খবর নাই।

আমার এক ভাই বিমল কান্তি সেন সাতকানিয়া কলেজে বি.এ ক্লাসের ছাত্র ছিল। দেশে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়লে সে মুক্তিবাহিনীতে শিক্ষা গ্রহন এবং সক্রিয়ভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহনের জন্য সীমান্ত পার হওয়ার সময় মিরসরাই থানাতে পাক বাহিনীও রাজাকারদের হাতে ধরা পড়ে। ৮দিন অকথ্য নির্যাতনের পর ২৩ সেপ্টেম্বর তাদের হাতে নিহত হয়।

আমাদের গ্রামে নিহত স্বপন চৌধুরী এবং দিলীপ চৌধুরীর কথা এখনো ভুলতে পারছিনা এবং কখনো ভুলতেও পারবোনা। তারা দুজনেই দাদা বলে ডাকতো এবং তাদের “অমলদা” ডাকটি আজও আমার প্রতিনিয়ত খেয়াল হয়। অসহযোগ চলাকালে তাদের ভুমিকা ছিল খাঁটি দেশ প্রেমিকের ভুমিকা।

গ্রামে গ্রামে শান্তি কমিটি গঠন হওয়ার সাথে সাথে আমাদের গ্রামেও শান্তি কমিটি গঠিত হয়। আমাদের গ্রামে রাজাকাররা বেশ কয়েকবার অত্যাচার চালিয়েছে। সাতকানিয়া দেওয়ানী আদালতের প্রবীণতম লব্ধ প্রতিষ্ঠাতা ব্যবহারজীবি যতীন্দ্র মোহন চৌধুরী বি.এল মহাশয়কে পর্যন্ত চরমভাবে অপমান করেছে। ৯ই ডিসেম্বর আমাদের গ্রামে পুনরায় এক ব্যাপক অগ্নীসংযোগ চালায় দোহাজারী ঘাঁটির রাজাকাররা।

স্বাক্ষর/-
শ্রী অমল কান্তি সেন।
১৪/০৪/৭৩

গুরু গোলাপ

<৮,২.৪.২১৯,২৭২>

মোঃ এমদাদ মিঞা সিকদার
গ্রামঃ মনেয়াবাদ
থানাঃ সাতকানিয়া
জেলাঃ চট্টগ্রাম

আমি মুক্তি সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করি। পাক হানাদার বাহিনীর হাতে কিভাবে ধৃত হয়ে গুরুতরভাবে আহত হয়েছিলাম তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিন্মে লিপিবদ্ধ করলামঃ
জনসাধারণকে বিপদ হইতে রক্ষা করাই ছিল আমার মূলমন্ত্র। তাই ২৫শে মার্চের কালরাত্রিতে বিভীষিকার মধ্যে শপথ নিলাম সোনার বাংলাকে দস্যু কবল থেকে মুক্ত করবো। এই দুঃসাহসী কাজে নেমে গেলাম, স্ত্রী, পুত্র, ঘরবাড়ী পরিবার পরিজন ত্যাগ করে। নিজ জীবন বিপন্ন করে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়লাম।

সর্বপ্রথম নিজ ছেলে নাজিমউদ্দিনকে মুক্তিবাহিনীতে ট্রেনিং-এ যাওয়ার জন্য বিদায় দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে বাজলিয়া পুরাণঘর ইউনিয়ের শতাধিক ছেলেকে অনুপ্রেরণা যুগিয়ে দেশ মাতৃকার সংগ্রামে বন্ধুরাষ্ট্র ভারতে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং ক্যাম্পে পাঠাতে লাগলাম। আমার নিঃস্বার্থ কর্মতৎপরতায় মুক্তিযোদ্ধাদের ভূমিকা গ্রহণে এলাকা দালালদের চরম বিপর্যয়ের হাত হতে অনেকটা রক্ষা পেয়েছিল। দেশের এই চরম মুহুর্তে নির্যাতিত লোকদের রক্ষা করেই ক্ষান্ত হই নাই। শেষ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং সমাপনান্তে দেশে এলে তাদের সার্বিক সাহায্য করে দুষ্কৃতকারী দালাল রাজাকার ও মুজাহিদ বাহিনীর লোকজনদের খতম করা ইত্যাদির ব্যাপারে আমার গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা ছিল। ধোপাদুড়ীস্থ টি,এম আলীর গ্রুপ, কমলছড়ীর সুলতান গ্রুপ ও চিংড়িংমানস্থ জাহেদ গ্রুপের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপন করে, উক্ত গ্রুপ্রের মুক্তিযোদ্ধাদের রসদপত্র যোগাড় করে তাঁদের সজীব রেখে, তাঁদের সক্রিয় সহযোগীতায় সেখান থেকে বান্দরবন, হিলট্র্যাক্ট ও দোহাজারীস্থ পাক হানাদের দস্যুদেরকে অতর্কিত আক্রমন চালিয়ে তাদের প্রাণ বধ করি এবং বান্দরবন রাস্তার অনেকাংশে ব্রীজ নষ্ট করে করে দিয়ে যাতায়াতে বিঘ্ন সৃষ্টি করি। শেষ পর্যন্ত আমার ষড়যন্ত্রে পাক হানাদার দস্যুগণ অতিষ্ঠ হয়ে বান্দরবন ত্যাগ করে দোহাজারী এসে সমবেত হয়। আমার এই কার্যকলাপে দালালগণ অতিষ্ঠ হয়ে আমাকে ধরিয়ে দেয়ার গোপন চক্রান্ত চালাতে থাকে। এতে আমি বিন্দুমাত্র বিচলিত হই নাই ও নিজের জীবনের প্রতি লক্ষ্য রাখি নাই এবং দেশ মাতৃকার মুক্তি সংগ্রামে বিন্দুমাত্র ত্রুটি করি নাই।

২৮/০৯/১৯৭১ ইং আনুমানিক ১০টার সময় জাহেদ গ্রুপসহ চরাত ইউনিয়নের রাজাকারদের উপর আক্রমন চালিয়ে ফেরার পথে কুখ্যাত দালালরা ক্যাপ্টেনকে ডেকে এনে আমাকে ধরিয়ে দেয়। বাজালি হাইস্কুলে একদিন এক রাত বেঁধে রেখে বাজালিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিদ্দিক আহমদ এম.এ সহ একযোগে নিকটবর্তী দোহাজারী মিলিটারি ক্যাম্পে চালান দেয়। সেখানে আমাকে অনবরত ৪ দিন দৈহিক নির্যাতন চালিয়ে একেবারে অকেজো করে ফেলে। শেষ পর্যন্ত আমি যখন শব্দ করতে অক্ষম তখন আমাকে গুলি করার আদেশ দেয়া হয়। কিন্তু পরিবারের অনেক কাকুতি মিনতির পর পাঁচ হাজার টাকা প্রদানে ১/১০/১৯৭১ ইং তারিখে আমাকে ফেরৎ দেয়া হয়। খোদাতায়ালার অশেষ করুণায় ও সুষ্ঠ চিকিৎসার ফলে কোন রকমে বেঁচে উঠি। বর্তমানে আমি জীবন্মৃত। চলাফেরা করা কঠিন। আমার সাথে বাজালিয়ার মতিলাল বিশ্বাস ও শিবুরাম সেনও ধরা পড়েন, তাঁদেরও আমার মত অবস্থা।

স্বাক্ষর/-
এমদাদ মিঞা সিকদার
১৪/৮/১৯৭৩

গুরু গোলাপ

<৮,২.৪.২২০,২৭৩>

মোঃ গোলাম হোসেন।
গ্রামঃ লোহাগড়া।
থানাঃ সাতকানিয়া।
জেলাঃ চট্টগ্রাম।

৫ জুন ১৯৭১ রোজ শুক্রবার। তখন ভোর ৬টা। আমি ঘুম থেকে উঠে অজু করে নামাজ শেষ করে আমার বাবার মাজার জিয়ারত করার পর বাড়ীর ভেতর ফিরে আসি। তখন একদল পাক বাহিনী একটি বাস ও একটি কার নিয়ে আমার বাড়ীর সম্মুখে এসে দাঁড়ায়। তারপর তারা নেমে এসে কয়েকজন আমাদের বাড়ীর উত্তর পাশ দিয়ে ও কয়েকজন বাড়ীর সামনে দিয়ে আমাদের সম্পূর্ণ বাড়িটা ঘেরাও করে। ঐ সময় আমার বড় ভাই জালাল উদ্দিনকে ধরে ফেলে এবং তাকে বাহির বাড়িতে বেঁধে রেখে কয়েকজন বাড়ির ভেতরে ঢুকে। বাড়ীর বাহির হতে দেয় নাই। পাক দস্যু বাহিনী আমাদের বাড়ী হতে পিতলের থালা, গহনা-পত্র সোনা রুপা, শাড়িসহ প্রায় দুই লক্ষ টাকার জিনিসপত্র নিয়ে যায়। যাওয়ার সময় আমাকে এবং আমার আরেক ভাই মোঃ আবদুল বারীকেও নিয়ে যায়। যাওয়ার সময় তারা আমাদের নিকট হতে টাকা দাবী করে। টাকা দিতে অস্বীকার করায় তারা আমাদের দোহাজারী ক্যাম্পে নিয়ে যায়। ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার পর আমাদের তিন জনের কাছে ২০ হাজার টাকা দাবী করে আর বলে যে টাকা দিতে না পারলে তোদেরকে কেটে হত্যা করবো। তখন আমি বললাম এত টাকা কোথায় হতে দেব স্যার? এই কথা বলার সাথে সাথে একজন নরপিশাচ আমাদের তিন জনের উপর বেদম প্রহার আরম্ভ করে। আমরা যখন প্রায় জ্ঞান শুন্য হয়ে পড়েছি তখন ঐ অবস্থায় আমাদেরকে রেখে নরপিশাচরা চলে যায়।

তার কিছুক্ষন পর আমার আর কয়েক ভাই ঐ সংবাদ পেয়ে আমার মায়ের নিকট হতে ৫ হাজার টাকা নিয়ে দোহাজারী ক্যাম্পে যায়। পাক বাহিনীর দালাল ৫ টাকা নিয়ে আমাদেরকে ছেড়ে দেবে বলে আমার ভাইদেরকে জানায়। কিন্তু সেই সময় পাক বাহিনীর দালাল এবং চেয়ারম্যানের ছেলে এসে আমাদের কাছ হতে ১০ হাজার টাকা দাবী করে। তখন আমার ভাইয়েরা তা অস্বীকার করে এবং বলে যে এখন ৫ হাজার টাকা দিবেন ও পরে ৫ হাজার টাকা দিবেন। এই চুক্তি করে যখন তারা আমাদের নিকট যাচ্ছিল ক্যাপ্টেন স্বয়ং তখন আমাদের প্রহারে লিপ্ত। তাদের দেখে ক্যাপ্টেন সে দিকে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলো কেন এসেছ? তখন আমার ভাই রশিদ আহমদ আমাদের মুক্তির কথা বলার সাথে সাথে তাকেও প্রহার আরম্ভ করলো। পাক বাহিনীর দালাল যখন চুক্তির কথা বললো তখন ক্যাপ্টেনের মেজাজ একটু ঠান্ডা হয়ে গেল। তারপর ৫ হাজার টাকা নিয়ে আমাদের মুক্ত করে দিল। তার ৩ দিন পর দালালরা এসে বাকি ৫ হাজার টাকা নিয়ে যায়।

স্বাক্ষর/-
গোলাম হোসেন।

গুরু গোলাপ
<৮,২.৪.২২১,২৭৪>

মোঃ সফিকুর রহমান।
গ্রামঃ কাঞ্চন নগর।
থানাঃ ফটিকছড়ি।
জেলাঃ চট্টগ্রাম।

১৫/১১/১৯৭১ পাক বাহিনী আমাদের এলাকায় প্রবেশ করে। তারপর লুটপাট ও নির্যাতন আরম্ভ করে। তাঁদের ভয়ে মেয়েরা যখন ধান ক্ষেতের মাঝে লুকিয়ে পড়ে তখন হানাদার বাহিনী সেখানে গিয়ে তাদের উপর নির্যাতন চালায় এবং মেয়েদের গলার হাতের সোনার অলংকার গুলি জোরপূর্বক কেড়ে নেয়। ঐ দিন প্রায় ১৫/২০জন পাক বাহিনী ছিল।

২১/১১/১৯৭১ ইং প্রায় ২০০ জন পাক বাহিনী আমাদের এলাকায় প্রবেশ করে। তার ভেতর ১০/১৫ পাক বাহিনী এসে আমাকেসহ আরো ৪০০ শত লোককে ডেকে জমায়েত করে। প্রথম অবস্থায় তারা আরো কয়েকবার আমাদের এলাকায় আসে, তখন তারা আমাদের কাউকে কিছু বলে নাই। সেই জন্য তাদের ডাকে সবাই জমা হয়। তারপর সেখান হতে বেছে বেছে প্রায় ২০০ শত জন জোয়ান ছেলেকে লাইন করে। তারপর তোমাদের ভেতর কোন মুক্তিবাহিনী বা হিন্দু আছে কিনা? এই সময় আমাদের লাইন হতে একটি ছেলেকে লাইন করে। তারপর আমাদেরকে কালেমা পড়ার নির্দেশ দেয়া হয়। তারা আমাদেরকে এ কথাই বার বার জিজ্ঞেস করেছে যে তোমাদের ভেতর কোন মুক্তিবাহিনী বা হিন্দু আছে কিনা? এই সময় আমাদের লাইন হতে একটি ছেলে হিন্দু বলে স্বীকার করে। তখন তাকে বেয়নেট দিয়ে নানা জায়গায় কেটে কেটে হত্যা করা হয়। এ সময় উত্তর দিক হতে পাকবাহিনী আরো নয়জনকে ধরে আনেঃ
১। হেদায়তুল হক
২। নুরুল ইসলাম
৩। ফকির মুহাম্মদ
৪। ইদ্রিস আলম আরো ৫ জনের নাম জানি না।
তাদেরকে আমাদের পাশে ২০ গজ দুরে গুলি করে হত্যা করে। তারপর আমাদের গুলি করার জন্য প্রস্তুত হতে বলে। এমন সময় ৭নং ইউনিয়নের রাজাকার কমান্ডার আবু তাহের মিঞা আমাদের ভুল প্রমাণ করাতে পাক বাহিনী আমাদেরকে গুলি না করে চলে যায়। ঐ দিন পাক বাহিনী প্রায় ৫০/৬০টি বাড়ী জ্বালিয়ে দেয়। বাড়ী গুলি জ্বালাবার পুর্বে তারা লুটপাট করে নেয়।

স্বাক্ষর/-
মোঃ সফিকুর রহমান।
২২/০৭/১৯৭৩

গুরু গোলাপ
<৮,২.৪.২২২,২৭৫>

জোতিন্দ্র মোহন নন্দী।
গ্রামঃ ফতেয়াবাদ।
থানাঃ হাটহাজারী।

এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে পাক ফৌজ এই এলাকায় প্রবেশ করে। এই এলাকায় কোন প্রকার প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়নি। ৩০শে চৈত্র বিকাল ৪টার পরে পাক ফৌজ ফতেয়াবাদ গ্রামে প্রবেশ করে। নগেন্দ্র লালের মেয়েকে গুলি করে হত্যা করে। তার বাড়ী তখনই জ্বালিয়ে দেয়। তারপর আমার বাড়িতে আসে এবং আমার বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয় এবং লুটপাট করে নেয়। আমার ভাতিজা রণজিৎ লালকে গুলি করে হত্যা করে। এই গ্রামে মোট ৮ টি বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। মন্দির ধ্বংস করে, গুলি করে হত্যা করে মোট ৭ জনকে। আগুনে জ্বালায় একটি শিশুকে। গ্রামের সব ঘরবাড়ি রাজাকাররা লুটপাট করে এবং রাজাকারদের অত্যাচার এখানে খুব বেশি ছিল।

স্বাক্ষর/-
জোতিন্দ্র মোহন নন্দী।
১২/০৭/১৯৭৩

গুরু গোলাপ

<৮,২.৪.২২৩,২৭৬> “কিছু স্থানীয় মুসলমান আমাদের নিরাপত্তার জন্য এগিয়ে এসেছিল, তাই বেঁচেছি।“

শ্রী বণিক চন্দ্র।
প্রধান শিক্ষক, পটিয়া হাইস্কুল।
থানাঃ পটিয়া।
জেলাঃ চট্টগ্রাম।

১৪ই মে, শুক্রবার ১০টায় পাঞ্জাবীরা পটিয়ায় এসে স্থানীয় প্রাইমারী প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে স্থায়ী আস্তানা গাড়ে এবং ঐ দিন বিকালে পার্শ্ববর্তী দক্ষিণভূর্ষী ও কেলিশহর গ্রামে কিছু কিছু বাড়ী ঘর পুঁড়িয়ে দেয়। তারপর দিনেও তারা ঐ সমস্ত গ্রামে অত্যাচার চালায়।

১৫ মে শনিবার খবর পাই পরদিন রবিবার ওরা পটিয়া সংলগ্ন সুচক্রদণ্ডী গ্রাম জ্বালিয়ে দেবে।

এই খবর পেয়ে ১৬ই মে, রবিবার ভোরে ছেলেটিকে নিয়ে পটিয়া থেকে রিক্সা করে আবার বাড়ির দিকে রওনা হই। এখানে বলে রাখা ভালো, একজন ডাকাত আমার স্ত্রী এবং ভাইয়ের কাছ থেকে ২০০০ টাকা আদায় করে নিয়ে যায়। বাড়ীতে কিছু ধান ছিল, এই ধান বিক্রি করে তারা ডাকাতদের টাকা দেয়।

অতি ভয়ে ভয়ে ১৬ ও ১৭ই মে গ্রামে কখনো নিজ ঘর, কখনো অন্য বাড়িতে গোপনে কাটাই। ১৮ই মে মঙ্গলবার আমার জীবনের কালো দিন। ঐ দিন স্থানীয় গুন্ডারা, চেয়ারম্যান ও অন্যান্য দলীয় নেতাসহ পাঞ্জাবীরা ছনহারা, চাটরা, ধাউরডেঙ্গা, মঠপাড়া ও গুয়াতলি গ্রাম আক্রমন করে। ছনহারা গ্রামে প্রথমে ঢুকে বাড়িঘর জ্বালায় এবং পলায়নরত ৩ জনকে গুলি করে হত্যা করে ও কয়েকজনকে আহত করে।

আমি নিজ নিরাপত্তার জন্য একটা চামড়ার ব্যাগে নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু। জামাকাপড় ও শ’তিনেক টাকা নিয়ে গ্রামের পুর্বদিকে খালের নিকট ঝোপের কাছে আশ্রয় নিই। বাড়ির স্ত্রী, পুত্র, ছেলে মেয়ে যে যেদিকে পেরেছে ছিটকিয়ে পড়ে।

এমতাবস্থায় সকাল ৮টায় ৫/৬ জন গুণ্ডা প্রকৃতির লোক আমাকে আক্রমন করে। আমার সঙ্গে যা ছিল টাকা পয়সা, জামাকাপড়, ঘড়ি কলম ইত্যাদি কেড়ে নিয়ে যায়। আমাকে হত্যা করার জন্য গ্রামের দক্ষিণ দিকে রাস্তার পাশে বসিয়ে রাখে। এরা সব আমার পার্শ্ববর্তী জালিয়া পাড়া ও সর্দার পাড়ার লোক। আমাকে হত্যা করা হবে এই খবর পেয়ে জালিয়া পাড়ার কতিপয় বৃদ্ধ নরনারী দৌড়ে এসে আমাকে এদের কবল থেকে রক্ষা করে। আমি মুক্তি পেয়ে আবার পূর্বোক্ত স্থানে আশ্রয় নিই। ঐ খালের ধারে গ্রামের আবাল বৃদ্ধ বণিতা প্রায় ২০০ নরনারী শস্য ক্ষেতে, ঝোপের আড়ালে আশ্রয় নিয়েছিল। প্রায় ১টার সময় ছনহারা গ্রাম জ্বালিয়ে পাঞ্জাবীরা আমাদের গ্রামে ঢুকে ঘরবাড়ী পোঁড়ায়, জিনিসপত্র লুট করে। ৪ জন পাঞ্জাবী আমরা যেখানে ছিলাম সেখানে এসে বিভিন্ন স্থানে লুকায়িতদের তুলে নিয়ে পুকুর পাড়ে জমা করায়। এবার ধারণা হল হয়তো আমাদেরকে এক জায়গায় এনে গুলি করে মারবে, কিন্তু সৌভাগ্যের বিষয় আমাদেরকে বসিয়ে রেখে তারা খালের কূলে কূলে দক্ষিণ দিকে চলে যায় এবং খালের ভেতর কয়েকজনকে ছেড়ে দেয় এবং ৩ জনকে তুলে নিয়ে সদর রাস্তায় গুলি করে মারে। এদের নাম সারদা চরণ দে, বয়স ৬০, যোগেন্দ্রলাল মল্লিক, বয়স ৬০ ও গৌরাঙ্গ মল্লিক, বয়স ৩০/৩৫। পাঞ্জাবীদের সঙ্গে সবসময় স্থানীয় গুণ্ডারা ছিল। তারা পার্শ্ববর্তী ধাউরডেঙ্গা গ্রামের হিন্দুদের বাড়ী ঘর পুড়িয়ে দিয়ে সেখানেও ২/৩ জনকে হত্যা করে বেলা ২ টার সময় পটিয়া ফিরর আসে। মুক্তি পেয়ে বিকালে বাড়ী ফিরে দেখি বাড়িতে পোড়া ভিটা খাঁ খাঁ করছে। সে রাত্রিতে অন্য এক বাড়ীতে (যে বাড়িটিই শুধু পোড়া যায় নি) রাত্রি কাটাই। স্ত্রী-পুত্র-কন্যা যারা দিনের বেলায় এদিক-ওদিক ছিল রাত্রে এক জায়গায় ঐ বাড়িতে আশ্রয় নিই। অবশ্য এটাও সত্য কিছু কিছু স্থানীয় মুসলমান আমাদের নিরাপত্তার জন্য এগিয়ে এসেছিল, তাই বেঁচেছি। এতে প্রমান হয় দুনিয়ার সব মানুষ পশু নয়। প্রকৃত মানুষও আছে, নচেৎ ভগবানের সৃষ্টি বিফল হতো।

স্বাক্ষর/-
শ্রী বণিক চন্দ্র।
০৯/০৫/১৯৭৩

গুরু গোলাপ

<৮,২.৪.২২৪,২৭৭> “জুন মাসের ৬ তারিখে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার সময় ৩ জন শান্তি কমিটির লোক ও ইউনিয়ন চেয়ারম্যান এবং ক্যাপ্টেনসহ ১২জন মিলিটারি আসিয়া আমাকে এবং আমার বোনকে তল্লাশী করে। সেই সময়ে আমার বোন নামাজে রত ছিলেন।“

মোঃ আবুল কাশেম।
গ্রামঃ কচুয়াই।
ডাকঘরঃ চক্রশালা।
থানাঃ পটিয়া।
জেলাঃ চট্টগ্রাম।

আমার বোন মোছাম্মৎ আছিয়া বেগম বি.এ পূর্ব হইতেই একজন আওয়ামীলীগ কর্মী ছিলেন। জুন মাসের ৬ তারিখে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার সময় ৩ জন শান্তি কমিটির লোক ও ইউনিয়ন চেয়ারম্যান এবং ক্যাপ্টেনসহ ১২জন মিলিটারি আসিয়া আমাকে এবং আমার বোনকে তল্লাশী করে। সেই সময়ে আমার বোন নামাজে রত ছিলেন। তখন বাড়ি ঘেরাও করিয়া ক্যাপ্টেন বাড়ির ভিতর ঢুকিয়া পড়ে। ক্যাপ্টেন আমার বোনকে চিনিতে না পারিয়া তাহাকে জিজ্ঞাসা করে আবুল কাশেম ও আছিয়া বেগম কোথায়? তখন আমার বোন অন্য ঘরে পলায়ন করে। তাহার পর পাক বাহিনী প্রতিটি ঘরে ঢুকিয়া প্রতি ঘর হইতেই অন্য মেয়েদের অলঙ্কার ছিনাইয়া লয়। পরে নুরুল আলমকে ধরে। তাহাকে বলে যে আছিয়া ও কাশেমকে বাহির করিয়া দাও নইলে তোমাকে গুলি করা হইবে। কিন্তু আমার ভাই আলম আমাদের কথা না বলাতে তাহাকে বন্দুক দিয়া বেদম প্রহার করে। তাহারা আমার চাচা ডাঃ ইব্রাহিমকে ধরিয়া আমাদের কথা জিজ্ঞাসা করে। আমার চাচা তখন বলিয়াছেন যে, ওরা দুই জন আমার মেয়ের বাড়ি বাঁশখালিতে বেড়াইতে গিয়াছে। পাক বাহিনী তাহাকে মারপিট করিতে থাকে এবং বলে যে তাহারা কোথাও যায় নাই। তুই লুকাইয়া রাখিয়াছিস। তাহাকে যখন প্রহার করিতে করিতে অজ্ঞান করিয়া ফেলিল তখনো তাহারা তাহাকে মারধোর করেতিছিল। এমতাবস্থায় বাড়ির অন্যান্য সকলে আসিয়া তাহাদেরকে বলিল যে কাশেম ও আছিয়া বেড়াইতে গিয়াছে। তাহাকে একা না মারিয়া আমাদের সবাইকে মারিয়া ফেলেন। তখন পাক বাহিনী তাঁহাদেরকেই মারিতে লাগিলো। এমন সময় আছিয়া তাঁহাদের দুঃখ সহ্য করিতে না পারিয়া বাহির হইয়া আসে এবং বলে যে আমি আছিয়া। তখন সবাইকে ছাড়িয়া দেয় এবং তাহাকে জিজ্ঞাসা করে যে তোমার ভাই কাশেম কোথায়? তিনি বলেন যে আমার ভাই কাশেম শহরে দোকানে থাকে, বাড়িতে আসে নাই। তারপর তাহারা ও তাহার আব্বাকে কমল মুন্সির হাটে লইয়া আসে। সেখানে তাহাকে নানা প্রকার প্রশ্ন করে। বাজারের সকলেই যখন তাহার কথা ভালো বলে তখন পাক বাহিনী দুজনকেই ছাড়িয়া দেয়। তারপর রাজাকার বাহিনী পুনরায় আমার বাড়িতে যাইয়া আমার ভাই নুরুল আলমকে মারপিট করে এবং আমার বাড়িরর সিন্দুক ভাঙ্গিয়া প্রায় দুই হাজার টাকা লইয়া যায়।

তৃতীয় বার রাজাকার বাহিনী ও শান্তি কমিটির লোকসহ ১৫/১৬ জন গিয়া বাড়ি ঘেরাও করে। সেদিন তাহারা আমার ফুফুর নিকট হইতে ৫ ভরি অলংকার ও ২৭০ টাকা এবং আমার নুরুল আলমের নিকট হইতে ২০০ টাকা কাড়িয়া লয় ও আমার বোন আছিয়াকে পুনরায় তল্লাশী করে। তারপর তাহারা আমার মামির নিকট ও ভাবির নিকট হইতে ৩ ভরি অলংকার ও কিছু টাকা লইয়া যায়।

স্বাক্ষর/-
আবুল কাশেম
১০/০৫/১৯৭৩

গুরু গোলাপ
<৮,২.৪.২২৫,২৭৮-৭৯ >

শ্রী নীরদ বরণ চৌধুরী।
প্রধান শিক্ষক, আজগর আলী উচ্চ বিদ্যালয়।
গ্রামঃ পশ্চিম শাকপুরা।
থানাঃ বোয়ালখালী।
জেলাঃ চট্টগ্রাম।

আমি একজন স্থানীয় উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। বিগত ২০শে এপ্রিল ১৯৭১ ইং আমাদের গ্রামে পাক বাহিনী তাদের স্থানীয় দালালদের সহযোগীতায় অগ্নীসংযোগ, নারী ধর্ষণ, লুটতরাজ গুলি বর্ষণ আরম্ভ করে। ইহাতে আমাদের গ্রামের ৫৪ জন লোক মারা যায়। সেদিন সকালে আমি কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রী লইয়া বসিয়া দেশের এই পরিস্থিতি লইয়া আলাপ আলোচনা করিতেছিলাম। এমন সময় কয়েকজন লোক আসিয়া আমাকে বলিল যে বড়ুয়া পাড়ায় পাক সৈন্য আসিয়া ঘিরিয়া ফেলিয়াছে এবং গুলি করিয়া লোক হত্যা আরম্ভ করিয়াছে। এই কথা শুনিয়া আমি আমার পাড়ার ছেলেমেয়েদেরকে উপদেশ দিলাম যে তোমরা কৃষক সাজিয়া মাঠে নামিয়া পড়। এইভাবে আমার গ্রামের ছেলেমেয়েরা অন্য গ্রামে যাইতে পারিলো। ইতিমধ্যে আমাদের গ্রামের দালালরা পাক বাহিনীকে লইয়া অত্র গ্রামে চলিয়া আসে এবং সমস্ত ঘরবাড়ী অগ্নীসংযোগ করিয়া ভস্মীভূত করিয়া দেয়। আমাদের গ্রামের অধিকাংশ লোক আসিয়া আমাদের গ্রামে বালিকা বিদ্যালয়ে আশ্রয় লইয়াছিল। সেই নিরাশ্রয় নাম না জানা নিহতদের উক্ত সংখ্যার মধ্যে ধরা হয় নাই।

আমি তখন আমাদের বাড়ীর সম্মুখে পুর্বদিকে পুকুর পাড়ে দাঁড়াইয়া আশ্রয় প্রাপ্ত ছেলেদের উপদেশ দিতেছিলাম। দালালের ছেলেরে আমাদের লক্ষ করিয়াছিল যে আমরা কোথায় লুকাইতেছিলাম। আমরা যেখানে লুকাইয়াছিলাম সেই জঙ্গলের পশ্চিম দিক হইতে আমাদের ঘিরিয়া ফেলিয়াছে। হঠাৎ মনে হইলো সকলে এক সঙ্গে এক জায়গায় লুকানো ঠিক হইবে না। তখন আমার কথা মত যে যেখানে পারিল লুকাইয়া পড়িল। আমি ও আমার ভাই চত্ত আচার্য্য উত্তর দিকে গিয়া ছোট্ট একটি জঙ্গলে আশ্রয় নিলাম। তখন চারদিকে ভীষণ অগ্নীসংযোগ ও গুলি বর্ষণ করিতেছিল। তখন আমি আমার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করিতে পারি নাই। পাক বাহিনী অগ্নীসংযোগ করার পূর্বে আমাদের লুণ্ঠন করে। পাক বাহিনী যখন আমাদের গ্রাম ছাড়িয়া চলিয়া গেল তখন আমরা আবার গ্রামের দিকে চলিয়া আসিলাম। এমন সময় একজন পাক দালাল আসিয়া আবার প্রচার করিলো যে পাক বাহিনী আবার এই গ্রামে আসিতেছে। এই কথা শুনিয়া আমরা আবার পালাইতে আরম্ভ করিলাম। এমন সময় দালালের লোকেরা আমদের বাড়ির পোড়া টিন গুলি লইয়া গেল। তখন আমরা বুঝিতে পারিলাম যে পাক বাহিনীর কথা বলিয়া আমাদের ধোঁকা দিতেছিল। এই ঘটনার ঠিক চার দিন পর আবার পাক বাহিনী আসিতেছে এই কথা শুনিয়া আমি এবং ভাই চিত্ত আচার্য্য আমার এক মুসলিম ছাত্রের অভিভাবকের বাড়িতে আশ্রয় লইলাম। কিন্তু অল্পক্ষনে বুঝিতে পারিলাম যে এখানে নিরাপদ নয়। ওখান হইতে আবার বাড়ির দিকে চলিয়া আসিলাম এবং পরবর্তীতে কি কার্যক্রম হইবে তাহা চিন্তা করিতে লাগিলাম।

২০শে এপ্রিল রাত্রি ১২টা। এমন সময় একজন কৃষক লোক আসিয়া খবর দিল আমাদের এখানে থাকা নিরাপদ নয়। সেই কৃষক লোককে লইয়া রাত্রি ১ টার সময় বাহির হইলাম। ঘুরিতে ঘুরিতে যখন রাত্রি শেষ হইয়া গেল তখন কৃষক লোকটি আমাদের চরখিজিরপুর গ্রামে এক খামারের মধ্যে রাখিয়া আসিল। ঐখানে থাকিয়া আবার শুনিতে আমাদের বাড়ি (২১ শে এপ্রিল) আবার আক্রমণ করিয়াছে। আমার ভাইয়েরা আশ্রয় লইয়াছিল আধ মাইল দুরে অন্য একটি খামারে। আমাদের সংবাদ পাইয়া ২২শে এপ্রিল রাত্রি ৮টার সময় আমাদিগকে সেই খামারে লইয়া যায়। সেই খামারের পাশেই কর্ণফুলী নদী। ঐ কর্ণফুলী নদীতে পাক ফৌজ গান বোট লইয়া অনবরত পাহারা দিতেছিল। ঐ খামারে থাকা নিরাপদ নয় বলিয়া আমরা আবার বাঁশখালি থানার কালিপুর গ্রামে চলিয়া গেলাম। ঐ কালিপুর গ্রামে ৮/১০ দিন ছিলাম। কালিপুর গ্রামের পাক বাহিনীর দালালদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হইয়া উঠিলাম। সেখান হইতে আবার কানুনগো পাড়ায় আশ্রয় নিলাম এবং গোপনে বাড়ির সবাইকে অখানে লইয়া আসিলাম।

আমার এক ভাই ইঞ্জিনিয়ার। সে আমেরিকান ফার্মে চাকরি করিত। সেই ফার্মের আমেরিকান সাহেব আমাদেরকে তাহার গাড়িতে করিয়া চট্টগ্রামের (মিরসরাইয়ের) জোয়ালগঞ্জ পৌছাইয়া দেয়। আমরা ঐখান দিয়া ভারত সীমান্ত পার হইয়া ত্রিপুরা শরণার্থী শিবিরে গিয়া পৌছাই।

স্বাক্ষর /-
শ্রী নিরোদ বরণ চৌধুরী।

গুরু গোলাপ
<৮,২.৪.২২৬,২৮০> “আমার বয়স ৫৫ বছর, আমি একজন বৃদ্ধ লোক। পাক বাহিনী যে আমার উপর এতটা অত্যাচার করিবে তাহা আমার বিশ্বাস ছিল না।“

মোঃ আমিনুল হক।
গ্রামঃ পূর্ব গোমদস্তী
থানাঃ বোয়ালখালী।
জেলাঃ চট্টগ্রাম।

গোমদস্তী রেলওয়ে স্টেশনের উত্তর দিকে আমার বাড়ি। একরাত্রিতে মুক্তিবাহিনী আসিয়া মাইন পুঁতিয়া গাড়ি উড়াই দেয়। তারপর ভোর বেলায় পাক বাহিনী আসিয়া আমাদের গ্রাম ঘেরাও করে। গ্রাম ঘেরাও করিয়া প্রায় ৭০/৮০ জন লোককে গ্রেপ্তার করে। তার ভেতর আমি ছিলাম। আমার বয়স ৫৫ বছর, আমি একজন বৃদ্ধ লোক। পাক বাহিনী যে আমার উপর এতটা অত্যাচার করিবে তাহা আমার বিশ্বাস ছিল না। তাই সকালে ঘুম হইতে উঠিয়া ওজু করিয়া নামাজ পড়িতে বসিয়াছি এমন সময় একজন রাজাকার আসিয়া আমাকে ধরিয়া ফেলিল। তাহার সাথে পাক বাহিনীও ছিল। আমাকে ধরার পর আমার বাড়ি হইতে আরো চার জনকে গ্রেফতার করে। তাহারা আমাদিগকে এখান হইতে মারধোর করার পর পটিয়া ক্যাম্পে লইয়া যায়। সেখানে নিয়া আমাদিগকে এমনভাবে বন্দুকের বাঁট দিয়া এমনভাবে প্রহার করিল যে, আর হাঁটুবার বা উঠিবার মত শক্তি ছিল না। তাহারা আমাদিগকে মুক্তিবাহিনী এবং আওয়ামীলীগের লীডারদের কথা বার বার জিজ্ঞাসা করিয়াছে, তবুও আমরা কাহারো নাম বলি নাই। তখন পাক বাহিনী আমাদিগকে সন্ধ্যার পর ছাড়িয়া দেয়। আমরা অতি কষ্টে বাড়িতে আসি।

স্বাক্ষর/-
মোঃ আমিনুল হক।
৩০/০৪/৭৩

গুরু গোলাপ

<৮,২.৪.২২৭,২৮১>

মোঃ অলি আহমদ।
গ্রামঃ পূর্ব গোমদস্তী।
থানাঃ বোয়ালখালী
জেলাঃ চট্টগ্রাম।

১৩ ই অগাস্ট মুক্তিবাহিনী ও গেরিলারা ১৪ই অগাস্টের পাকিস্তান দিবস বানচাল করার জন্য বালুর ঘাট দোহাজারী রেল লাইনে গোমদস্তী রেল স্টেশনের কালুরঘাটের নিকট আউট সিগন্যালের কাছে মাইন পুঁতিয়া রাখে রাত্রি বেলায়। রাত ৪ টার সময় পাক ফৌজ পটিয়ার দিকে রেল লইয়া যাইতে ইঞ্জিন উড়িয়া যায় এবং রেল লাইন ধ্বংস হয়।

১৪ অগাস্ট সকালে পটিয়া এবং কালুরঘাট হইতে আরো মিলিটারি আসিয়া রাজাকাররা সহ আমাদের গ্রাম ঘেরাও দেয়। তাহাদের ৩ জন লোক আসিয়া আমাকে ধরিয়া আড়মোড়া করিয়া হাত বাঁধিয়া রাইফেল দিয়া মারিতে মারিতে গাড়িতে উঠায়। তখন আমি, নুর আহমদ, আবদুল মজিদ সহ ৫৭ জনকে হাত ও কোমর বাঁধা অবস্থায় গাড়িতে তোলা হইতেছে এবং গাড়িতে তুলিয়া বেদম মার মারিতেছে। পটয়ায় লইয়া যাইয়াও বেদম মার – রাইফেল দিয়া মারায় আমি অজ্ঞান হইয়া পড়িয়াছিলাম। জ্ঞান হইলে দেখি সবাইকে সারিবদ্ধভাবে গুলি করিয়া মারার অবস্থা হইয়াছে। এমন সময় কালুরঘাট হইতে মেজর রশিদ আসিয়া আমার কাছ থেকে মুচলেকা লেখাইয়া লয় যে, আমাদের গ্রামের পাশের রেল লাইন আমাদের পাহারা দিতে হইবে। কোন ক্ষতি হইলে আমাদের গুলি করে মারা হইবে। নিজের জান বাঁচানোর জন্য কাগজে সই দিয়া সন্ধ্যার একটু আগে সবাই মুক্ত হইয়া বাড়ি ফিরি। ৫মাস ভোগার পর সারিয়া উঠি কিন্তু কাজ করিয়া খাইতে পারি না।

স্বাক্ষর/-
মোঃ অলি আহমদ
২৯/০৪/৭৩

গুরু গোলাপ

<৮,২.৪.২২৮,২৮২-৮৩> “…আজ সে দিনের কথা মনে পড়লে আর মুক্ত বাংলার পবিত্র মাটিতে পাক দালালদের বিনা বিচারে, বিনা সাজায় আমাদের গ্রামের উপর দিয়ে যাতায়াত করতে দেখলে আমাদের গা ছম ছম করে উঠে।“

সন্তোষ কুমার
গ্রাম- পশ্চিম শাকপুরা
থানা- বোয়ালখালী
জেলা- চট্টগ্রাম।

সে দিন ছিল ২০শে এপ্রিল। আমাদের পশ্চিম শাকপুরা গ্রামের উপর চলল পাক সেনাদের রক্ত নিয়ে হোলি খেলা আর নারী নির্যাতন ও অগ্নিসংযোগ। কি বীভৎস ঘটনা। আজ সে দিনের কথা মনে পড়লে আর মুক্ত বাংলার পবিত্র মাটিতে পাক সহযোগীদের এবং দালালদের বিনা বিচারে, বিনা সাজায় আমাদের গ্রামের উপর দিয়ে যাতায়াত করতে দেখলে আমাদের গা ছম ছম করে উঠে। যারা আমাদের গ্রামে হত্যা করেছিল, বাড়ি পুড়িয়েছিল, সম্পদ লুণ্ঠন করেছিল, নিরাপরাধ গ্রামবাসির গলায় ছুরি চালিয়েছিল তারাই আবার বাংলার পবিত্র মাটিতে বাস করছে।

২০ শে এপ্রিল সূর্য উঠার আগে অন্যান্য দিনের মত কয়েকজনকে পাহারায় দিয়ে আমরা একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ সবাই হৈ চৈ করে পালাতে লাগলো। শুনতে পারলাম পাঞ্জাবীরা আসছে। তখনই তাড়াতাড়ি যে যেদিকে পারি পালাতে লাগলাম। স্থানীয় মুসলমানদের বাড়িতে গেলে তারাও তাদের বাড়ি হতে নামিয়ে দিল। আমরা তখন অন্য দিকে সরে পড়লাম। পাক সেনারা তখন চারদিক দিয়ে আমাদের গ্রাম ঘিরে ফেললো। তারপর সারাদিন চলল আমাদের গ্রামের মানুষের উপর অত্যাচার। প্রতি বাড়িতে বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিতে লাগলো, এর সোনা রুপা, রেডিও মূল্যবান জিনিস হস্তগত করতে লাগলো এবং চললো অকথ্য নির্যাতন, ধর্ষণ, হত্যা, লুণ্ঠন – সবকিছু। গ্রামের যুবক বৃদ্ধ যাকে পেল তাকেই হত্যা, স্ত্রীর সামনে স্বামীকে, মায়ের সামনে ছেলেকে হত্যা করলো। আর করলো অগ্নিসংযোগ। চারদিকে শুধু গুলির আওয়াজ আর গুলি করার সাথে সাথে পাক সেনাদের পৈশাচিক হাসি।

সারাদিন পর বিকাল সাড়ে ৪টার পর তারা গ্রাম ছেড়ে দিয়ে চলে গেল। আমরা যারা দৌড়ে পলায়ন করেছিলাম তারা আসলাম গ্রামে, দেখলাম প্রায় বাড়িতে আগুনে ভস্মীভূত দালান ঘরের টিন গুলো পড়ে আছে। কয়েকজন সবে মাত্র গুপ্তস্থান হতে বের হয়ে আসলো। কারো মুখে কোন কথা নেই। পথ দিয়ে ঘুরতে লাগলাম। দেখলাম গুলি খেয়ে রাস্তার আশেপাশে, বাড়ীর প্রাঙ্গনে, নর্দমায় পড়ে আছে মৃত দেহ। কি এক হত্যাযজ্ঞ! সবাই আমার আত্নীয় স্বজন ও গ্রামবাসী। হায় এদের কি দোষ! কোনদিন দেখিনি এভাবে হত্যা। দেখলাম বাপ ছেলে এক সাথে এক বুকে গুলি খেয়ে ঘুমিয়ে আছে।

দেখলাম কারো চোখে জল নেই, আজ সবাই পাথর হয়ে গেছে। আরো দেখলাম স্ত্রী চেয়ে রয়েছে স্বামীর দিকে, মা তাকিয়ে রয়েছে মৃত সন্তানের দিকে। স্বামী তার স্ত্রীকে ডেকে বলার সময় পায় নি, মা সন্তানকে জাগিয়ে দেয়ার সময় পায় নি, বোন ভাইকে ডাক দেবার সময় পায় নি। কি পাশবিক হত্যা, নির্যাতন ও অমানুষিক অত্যাচার। আমার ভাষা নাই, আমি লেখক নই, প্রকৃত ঘটনার কিছু মাত্র লেখার চেষ্টা করছি। আর এ ঘটনাকে ভাষায় রুপ দেয়ার ভার আপনাদের।

তারপর গ্রামের কয়েকজন মৃতদেহের কিছু কিছু সৎকার করার নিস্ফল চেষ্টা করতে লাগলাম মাত্র। গ্রামে প্রায় ১৫০ জন লোক মারা গেল। যেই আমরা গর্ত খুঁড়তে লাগলাম আর অমনি প্রতিবেশী গুণ্ডারা লুট করার জন্য এগিয়ে আসতে লাগলো আর বলতে লাগলো পাক সৈন্য আবার আসছে। পুনরায় আমরা গ্রাম হতে বের হয়ে পড়লাম। এরই মধ্যে আমরা কোন রকমে এক গর্তের ভেতরে ১০/১২ জনকে মাটি চাপা দিলাম। আর সেই মুহুর্তে আমার মনে পড়লো হাতিয়ার ঘূর্ণিঝড়ে উপদ্রুত এলাকার কথা। সেখানে আমরা ওদের দাফনের কাপড় দিয়ে দাফন করেছিলাম কিন্তু আজ আমাদের গ্রামে এদের হিন্দু ধর্মের রীতি অনুসারে কাপড় দেয়া দুরে থাক আগুন পর্যন্ত দিতে পারছিনা।

পাক সেনাদের এই অত্যাচারের পরও আমরা কোন রকমে দু’একটা বাড়ি ছিল সবাই তার মধ্যে আশ্রয় নিয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করতে লাগলাম। এভাবে এগুতে লাগলাম। সেই ৪ঠা এপ্রিলের পর থেকে দিনে পাক সেনা আর রাতে মুসলিম লীগ গুণ্ডা ও প্রতিবেশীর তিন দিক থেকে আক্রমন। রাত্রে চাল ডাল কোন রকমে দু’একটা খেয়ে সন্ধ্যা হওয়ার সাথে সাথে ঝোপে বা পানিতে ডুবে থাকা, কোন রকমে বাঁচার চেষ্টা, কিন্তু দিনের পর দিন চলল লুট আর নারী ধর্ষণ। তারা ধর্মের নামে আমাদের গ্রামের মন্দির প্রতিমা ইত্যাদি ধ্বংস করে দিল আর যাকে পেল তাকে মুসলমান হতে বাধ্য করলো। মুসলমান হলে থাকতে পারবে নতুবা কেটে ফেলবো। এভাবে কয়েকজনকে কেটেও ফেলল।

এরপর ২৩শে এপ্রিল আমাদের পশ্চিম গ্রামে আবার শুরু রক্তে খেলা, আর অবশিষ্ট বাড়ি গুলোতে আগুন লাগিয়ে দিল। পাকিস্তান কায়েম রাখার জন্য। ২৩শে এপ্রিল শাকপুরা গ্রামটা সম্পূর্ন ধ্বংস করা হয়েছে। সবাই মিলে সে দিন ভারতের দিকে রওনা হলাম।

স্বাক্ষর/-
সন্তোষ কুমার।

গুরু গোলাপ
<৮,২.৪.২২৯,২৮৪> “অনুরোধ করিতে থাকি যে আমাকে এই রুপ কষ্ট না দিয়া একেবারে গুলি করিয়া মারিয়া ফেল নতুবা বাঁধিন খুলিয়া দাও আমি ছাদের উপর হইতে লাফাইয়া পড়ি আত্মহত্যা করি।“

মোক্তার মোহাম্মাদ
পোষ্ট মাষ্টার
গ্রাম- পুছড়ী
থানা- বাঁশখালি
জেলা- চট্টগ্রাম।

শনিবার ৯ ই অক্টোবর ১৯৭১ ইং রাত ১০টা। মুক্তিবাহিনী সহ গ্রাম পাহারারত ছিলাম। নাপোড়া হইতে ঘুরিয়া সেখেরখিল হইয়া জালিয়া পাড়া রওনা হইতেছি। তখন আনুমানিক রাত বারো টা। উক্ত পাড়ায় অসংখ্য গোলাগুলির শব্দ শুনিয়া দ্রুত পেছন দিকে সরিয়া নাপোড়া পুকচালিয়া পাড়ায় চলিয়া আসি এবং এই পাড়ার দক্ষিন পার্শ্বে আসিয়া দেখিতে পাইলাম জালিয়া পাড়া দাউ দাউ করিয়া জ্বলিতেছে। মানুষ চিৎকার ও কান্নাকাটি করিয়া প্রাণভয়ে পাহড়ের দিকে পালাইয়া আসিতেছে। তখন সব মুক্তিবাহিনীকে বিদায় দিয়া একা আমি রহিয়া গেলাম এবং ব্যাপার সম্পূর্ন জানিয়া সকালে তাহাদের ক্যাম্পে জানাইবো বলিয়া কথা দিলাম। দেখিতে দেখিতে আগুন আরো বাড়িয়া গেল এবং জনসাধারণকে পালাইয়া বাঁচিবার জন্য ইশারা করিলাম।

১০ তারিখ ভোর ৫ টা হইতে না হইতে শুনিতে পাইলাম চতুর্দিকে অসংখ্য গোলাগুলির আওয়াজ। তখন আমি নিজে কিভাবে প্রান বাঁচাইবো চিন্তা করিয়া দ্রুত আমার বাড়ির পাশে পাহাড়ের জঙ্গলে আত্নগোপন করিয়া পরিস্থিতি লক্ষ করিতে লাগিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে দেখা গেল যে নাপোড়া সেখেরখিল আগুন আগুনময়। আরো দেখিলাম পাক হানাদারেরা চতুর্দিকে লোক খোঁজাখুজি করিতেছে এবং কতগুলি লোককে বন্দী করিয়া আমার বাড়ির দক্ষিণ পার্শ্বের রাস্তা দিয়া লইয়া যাইতেছে ও প্রতিটি বাড়ি তল্লাশী করিতেছে। পলায়নমান লোক দেখিয়া তাহাদিগকে গুলি করিতেছে। তখন আমি নিজেকে নিরাপদ না মনে করিয়া আরো গভীর জঙ্গলে ঢুকিয়া পড়িলাম। গোলাগুলির শব্দ বন্ধ হওয়ার পর আনুমানিক দুপুর বারটায় ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে চলিয়া আসিলাম। বাড়ি আসিয়া জানিতে পারিলাম পাক হানাদারেরা চলিয়া গিয়াছে এবং সাথে বন্দি করিয়া কতক লোক তাহাদের ক্যাম্পে নিয়া গিয়াছে।

১৩ই অক্টোবর বুধবার পার্শ্ববর্তী মিরাপাড়া গ্রামের একজন দালাল আমার গোয়েন্দাগিরি জানিতে পারিয়া হানাদার ক্যাম্পে (চাম্বল) নালিশ করিয়া দেয়। ফলে ১৪ই অক্টোবর বৃহষ্পতি বার আনুমানিক বেলা নয়টায় সতের জনের মত পাক বাহিনী ও ত্রিশ জনের মত রাজাকার আমার পাড়া ঘেরাও করিয়া আমাকে ধরিয়া ফেলে এবং নাপোড়া বাজারে নিয়া আসে। সেখানে আমি দেখিতে পাইলাম আরো ৪ জন সেখেরখিল নিবাসী
(১) একরাম মিয়া
(২) হাজী শফর মুল্লুক
(৩) দানু মিয়া – পিতাঃ নজর আলী
(৪) আহমদ হোসেন – পিতাঃ দানু মিয়া ও আমি সহ পাঁচ জনকে একই রশিতে বাঁধিয়া তিন মাইল রাস্তা হাঁটাইয়া লয় ওবং পথে পথে মারধোর করিতে থাকে। আনুমানিক বেলা এগারটায় তাহাদের ক্যাম্পে পৌছার সাথে সাথে সকলের চোখ কাপড় দিয়া বাঁধিয়া ফেলে এবং একেকজন করিয়া রশি হইতে খুলিয়া নিয়া ৩/৪ জন হানাদার মিলিয়া একেকজনকে বেদম প্রহার করিতে থাকে সাথে সাথে উর্দু ভাষায় কি জিজ্ঞাসা করিতেছে বা বলিয়েছে তাহা কিছুই বুঝিতে পারিতেছিনা। আমি শুধু চিৎকার করিয়া আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করিতেছি “হে আল্লাহ আমাকে রক্ষা কর। বাবা মারিও না আমি আর সহ্য করিতে পারিতেছি না” এই কথা বলার সাথে সাথে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পা উপরের দিকে ও মাথা নিচের দিকে করিয়া ক্যাম্পের ছাদের সাথের লটকাইয়া ফেলে। ইহাতে কয়েক মিনিটের মধ্যে আমি জ্ঞান হারাইয়া ফেলি। ফলে ইহার পর আর কি ঘটিয়াছে তাহা আমি জানিনা। যখন জ্ঞান ফিরিয়া আসে তখন বুঝিতে পারিলাম ছাদের উপরিভাগে ফ্লোরের উপরের রোদ্রের গরমে ঝলসাইয়া যাইতেছি। তখন আমি পানির পিপাসায় ও ক্ষুধায় খুব কাতর হইয়া পড়িয়াছি। নড়াচড়া করিতে পারিতেছিনা। সমস্ত শরীরে ব্যাথা ও ফুলিয়া গিয়াছে। তখন পানি পানি বলিয়া চিৎকার করিয়া খাওয়ার পানি চাহিলাম। এমন সময় একজন হানাদার আসিয়া আমার চোখের বন্ধন খুলিয়া দিয়া একটি বদনায় করিয়া পানি খাওয়াইয়া দেয় ও মাথা ধরিয়া সূর্য্যের দিকে চোখ করিয়া তাকাইয়া থাকার নির্দেশ দেয়। এইভাবে কয়েক মিনিট থাকার পর যন্ত্রণায় মাথা নাড়িয়া মুখ ফিরাইলে, তখন আরেক দফা মারধোর চলিল। সূর্য্যের দিকে তাকাইয়া থাকার অপারগতায় চোখে মরিচের গুঁড়া ছিটাইয়া দেয়। ইহাতে অসহ্য যন্ত্রণায় চিৎকার করিয়া কাঁদিয়া গড়াগড়ি করিতে থাকি। অনুরোধ করিতে থাকি যে আমাকে এই রুপ কষ্ট না দিয়া একেবারে গুলি করিয়া মারিয়া ফেল নতুবা বাঁধিন খুলিয়া দাও আমি ছাদের উপর হইতে লাফাইয়া পড়ি আত্মহত্যা করি। কিন্তু পাক বাহিনীর দালাল হানাদারদিগকে বলিয়া দেয় যে আমি আর আমার ভাই নাকি মুক্তিবাহিনী এবং আমাদের নিকট ছয়টা রাইফেল আছে এবং আমাকে গুলি করিয়া মারার অনুরোধ করিতে লাগিল। আমরা নাকি বাঁচিয়া থাকিলে তাহার জীবনের আশঙ্কা আছে। এই বলিয়া সে চলিয়া যায়। ইহার পর আরেক দফা আমার উপর শারীরিক নির্যাতন চলিল। আমি মৃতপ্রায় অবস্থায় পড়িয়া থাকিয়া মৃত্যুক্ষণ গুণিতে লাগিলাম। খোদার কৃপায় এমন সময় স্থানীয় শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান হানাদারদের সুবেদারসহ তথায় আসিয়া আমাকে সনাক্ত করিয়া নিয়া জামিন দিল এবং সাথে শর্ত দিল যে মুক্তিবাহিনীর একটি নাম তালিকা ও আমার ভাই আওরঙ্গজেবকে চার দিনের মধ্যে হাজির করিয়া দিতে হইবে নতুবা বংশের একজনও জীবিত রাখিবেনা। আমি তখন বাধ্য হইয়া তাহাদের নাগপাশ হইতে মুক্তি লাভের আশায় ইহা স্বীকার করিয়া মুক্তিলাভ করি। তারপর উক্ত ক্যাম্প হইতে একখানা রিক্সা করিয়া বাড়িতে চলিয়া আসি। শরীর ও চোখের চিকিৎসায় চার দিন কাটাইয়া একটু আরোগ্য লাভ করিয়া বাড়ি হইতে পলাইয়া গিয়া নিরাপদ জায়গায় আশ্রয় লইলাম। ইহারও দু’একদিন পর হানাদাররা চাম্বল হইতে ক্যাম্প উঠাইয়া উত্তর বাঁশখালি গুনাগরি ক্যাম্পে চলিয়া যায় এবং রাজাকার বাহিনী মোতায়েন করিয়া আমাদের গ্রামে ক্যাম্প করিয়া দেয়।

স্বাক্ষর/-
মোক্তার মোহাম্মদ

গুরু গোলাপ
<৮,২.৪.২৩০,২৮৬> “…তার সতীত্ব রক্ষার জন্য কোন উপায় না দেখে সে বিষ পান করলো!”

শ্রী বিমল কান্তি গুহ
গ্রাম- নাপোড়া
থানা- বাঁশখালি
জেলা- চট্টগ্রাম।

৯ ই অক্টোবর পাক হানাদার বাহিনী দ্বিতীয়বার বাঁশখালিতে আসে এবং গুনাগরীতে একটি আস্তানা করে। ঐ দিন তারা লোকজনের উপর কোন অত্যাচার করে নাই। কিন্তু নাপোড়া গ্রামের লোকরা পাঞ্জাবী আসার খবর পেয়ে স্ত্রী পুত্র আত্মীয়স্বজন সবাইকে নিয়ে পাহাড়ে চলে যায় এবং সন্ধ্যার পূর্বে বাড়িতে চলে আসে।

১০ অক্টোবর তারিখে ভোর পাঁচটার সময় পাক বাহিনী আমাদের গ্রামটার পূর্ব জঙ্গলের দিক হতে আক্রমণ করে। আমাদের গ্রামের লোকরা আর জঙ্গলের দিকে পালাইতে পারে নাই। নিরীহ নিরস্ত্র জনসাধারণের উপর নির্বিচারে গুলি বর্ষণ করে। আমি যখন আমার পরিবার পরিজন নিয়ে জঙ্গলের দিকে পালাচ্ছিলাম তখন একটা গুলি আমার হাতের ব্যাগের মধ্যে পড়ে এবং ব্যাগটা ছিঁড়ে হাত থেকে পড়ে যায়। আমার সামনে একজন মহিলা দুগ্ধপোষ্য শিশুসহ গুলিবিদ্ধ হয়, কিন্তু দুরে গিয়ে দেখি আরো তিন জন গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে আছে। স্ত্রী, পুত্র, আত্মীয়স্বজন কে কোথায় জানিনা, দূর পাহাড়ে চলে যাই। গ্রাম তখন জ্বলছে, লুটপাট চলছে, ধোঁয়ার কুণ্ডলী পাহাড় থেকে দেখা যাচ্ছে। আমার মত অনেকেই পাহাড়ের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। সকলের মুখে হতাশার ছবি। সবাই বলাবলি করছে মা, বাপ, ভাই সবাই মারা গেল, অবশিষ্ট কেউ নাই, খাওয়া দাওয়া নাই, অনেক লোক একত্রিত হয়েছি। গ্রামের খবরাখবর নেয়ার চেষ্টা করছি। কেউ কেউ তাদের ছেলেমেয়ে, স্ত্রীকে জঙ্গলে খোঁজ করছে, আমিও আমার স্ত্রী, একজন ছেলেকে ও এক বছরের ভগিনীকে খোঁজ করতে লাগলাম কিন্তু কোথাও পাওয়া গেল না। অনেকে স্বান্তনা দিচ্ছে পাহাড়ের কোনখানে আছে।

তিন দিন খোঁজাখুঁজির পর রেজাকাঠা নামক স্থানে তাদের সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়। দু’দিন ধরে তারা কিছু খায় নাই। তাদেরকে দেখে আমার ভীষণ কান্না এসে পড়লো, স্ত্রী, পুত্র নিয়ে আমি বেঁচে আছি দেখে আনন্দে কেঁদে উঠলাম, আমার ছেলেটিও কাঁদতে লাগলো। তারপর আমি ছেলেমেয়ে নিয়ে গ্রামে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছি। গ্রামে এসে দেখি বেশ কিছু লোক আছে। বর্বর পাক বাহিনীর হাতে মারা গেছে আমার বাড়ির পাশের ৫ জন লোক। কে? কোথায়? কিভাবে মারা গেছে তা কেউ ঠিক করে বলতে পারছে না।
যেদিন আমরা নাপোড়া বাড়িতে আসলাম, সেদিন কয়েকজন পাঞ্জাবী সেনাবাহিনী দক্ষিণ হতে জনাব একরাম মিয়া, তার ভাই দানু মিয়া ও মোক্তার আহমেদকে শরে নিয়ে নাপোড়া বাজারে রেখে গ্রামের ভেতর ঢুকলো। আমি তখন বাইরে ছিলাম। দুর থেকে বর্বর হানাদারদের দেখেছিলাম। আমার স্ত্রীও বাইরে ছিল, তাকে ইশারা করে আমি নাপোড়া বাড়ির পাশ দিয়ে চলে গেলাম। আমার স্ত্রী অন্য দিক দিয়ে অন্য জায়গায় চলে গেল। পর মুহুর্তেই দুর্বৃত্তরা আমার বাড়িতে ঢুকে পড়ে অন্যান্য যারা ছিল তাদের উপর ভীষণ মারধোর করে। আমার ভাগনী বাসন্তী রাণীর কাছে লুকায়িত বিষ ছিল। তার সতীত্ব রক্ষার জন্য কোন উপায় না দেখে সে বিষ পান করলো! দু’ঘন্টার মধ্যে সে প্রাণ ত্যাগ করে। আমার ভাগনী দ্বিতীয় বিভাগে মেট্রিক পাশ করেছিল। রাত্রে এসে আমার ভাগনীকে মৃত অবস্থায় দেখে চোখের জল ধরে রাখতে পারলাম না। রাত্রিতে গ্রামের দুই একজন লোককে ডেকে বাসন্তী রাণীকে কবর দেই।

এটা ছিল আমার গ্রামের কাহিনী।

স্বাক্ষর/-
শ্রী বিমল কান্তি গুহ।

গুরু গোলাপ
<৮,২.৪.২৩১,২৮৭> “এই হত্যাযজ্ঞ দেখিয়া পাঞ্জাবী সামরিক অফিসার ও তাদের দালালরাও ঠিক থাকিতে পারে নাই।“

মোঃ সামসুল হক
সহকারী হিসাব রক্ষক
বাংলাদেশ রেলওয়ে
পাহাড়তলী, চট্টগ্রাম।

১০ ই নভেম্বর। সেদিন ছিল ২০ রমযান। পাহাড়তলীতে বাঙ্গালী মা বোনদের উপর বিহারী ও পাক সেনারা যে নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালাইয়াছিল দুনিয়ার স্বাধীনতার ইতিহাসে তা বিরল।

১০ ই নভেম্বর খুব সকাল বেলা পাহাড়তলীর পাঞ্জাবী লাইন, ওয়্যারলেস কলোনী, বাহাদুর শাহ কলোনীর শিশু, যুবক, যুবতী, নারী, পুরুষ, বৃদ্ধকে কলোনীর বাসা হইতে জোরপূর্বক ধরিয়া আনে এবং কাহাকে কাহাকে মিলিটারি অফিসার সাহেব ডাকে বলিয়া ধোঁকা দিয়া ওয়্যারলেস কলোনীর নিকটস্থ পাহাড়ে দল বাঁধিয়া নিয়া যায়। সেখানে জল্লাদেরা ধারালো অস্ত্র ও স্বয়ংক্রীয় অস্ত্র দিয়া দয়ামায়াহীন অবস্থায় হত্যাযজ্ঞ চালায়। সকাল হইতে বেলা ৩ টা পর্যন্ত এই হত্যাযজ্ঞ অব্যাহত থাকে।

আমরা কয়েকজন আবছার উদ্দিন, আবদুস ছোবাহান ও মোঃ ছাবেদ মিয়া হত্যাযজ্ঞ পাহাড়ের জঙ্গল হইতে দেখিতে পাই। সাথে সাথে ডবলমুরিং থানার সহিত যোগাযোগ করি। কিন্তু তাহার ছলচাতুরী করিয়া আমাদিগকে বিদায় করে।

দুপুরে মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী ও পি.ডি.বির দালালদিগকেও এই নৃশংস হত্যাযজ্ঞের কথা বলিয়াছি। সেই দিন নর ঘাতকরা এক এক বারে আনুমানিক দুইশত লোককে হত্যা করিয়া তাহাদের শরীরের কাপড়গুলি একত্রিত করিয়া পেট্রল দিয়া আগুন জ্বালাইয়া দিয়াছিল।

১০ ই নভেম্বর ৩ টার সময় একজন সামরিক অফিসার সহ অনেকেও ওয়্যারলেস কলোনী দেখিতে আসে। সাথে সাথে আমরা প্রায় তিনশত লোক তাহাদের সাথে উক্ত জায়গায় গিয়া পোঁছাই। হাজার হাজার নারী পুরুষের লাশ পড়িয়া আছে। কোথাও কোথাও মৃতদেহ গুলি একত্রিত করিয়া পেট্রোল দিয়া জ্বালাইয়াছে।

এই হত্যাযজ্ঞ দেখিয়া পাঞ্জাবী সামরিক অফিসার ও তাদের দালালরাও ঠিক থাকিতে পারে নাই। নরপশুরা আত্মীয়স্বজন কে লাশ দিতে অস্বীকার করে। পাহাড়ের উপরে নির্লজ্জ অবস্থায় অনেক যুবতী ও নারীদেহ ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় পড়িয়া আছে। এমনিভাবে মা বোন দিগকে নির্মমভাবে হত্যা করা হইয়াছে।

স্বাক্ষর/-
মোঃ সামসুল হক।
৭/৪/৭৩

গুরু গোলাপ
<৮,২.৪.২৩২,২৮৮-৮৯> “জোয়ার কাছাড় গ্রামে পাক সেনারা আবদুল আলিকে মসজিদে নামাজরত অবস্থায় আকস্মাৎ আক্রমন করিয়া গুলি করিয়া হত্যা করিয়াছে।“

মোঃ ইদ্রিস
গ্রামঃ জোয়ার কাছাড়
থানা- ফেনী
জেলা- নোয়াখালী।

পাক বাহিনী অত্র এলাকায় প্রবেশ করিয়া দালালদের সহযোগীতায় প্রায় প্রতি গ্রামে প্রবেশ করে এবং আকস্মাৎ আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দের বাড়ি আক্রমন করিয়া তাহাদের বন্দি করিয়া শিবিরে লইয়া আসে এবং প্রকাশ্যে রাস্তার উপর দাঁড় করাইয়া গুলি করিয়া হত্যা করে। ইহা ছাড়া তাহারা প্রতি গ্রাম হইতে দালালদের সহযোগীতায় রাজাকার তৈরী করে। পরে উক্ত রাজাকারদের সহযোগীতায় গ্রামে গ্রামে প্রবেশ করিয়া নিরীহ জনগণকে হঠাৎ আক্রমন করিয়া গুলি, বেয়নেট চার্জ, লাঠি চার্জ বিভিন্ন উপায়ে হত্যা করে। পাক সেনারা প্রায় ৪৯ জন লোককে হত্যা করিয়াছে।

নিহতদের মাঝে কিছু সংখ্যকের নাম উল্লেখ করা যায়, যেমনঃ
১। মোমিনুল হক
২। তারিকুন নেসা বেওয়া
৩। আমিনুল হক
৪। আবুল খায়ের
৫। হোসনে আরা বেগম
৬। মোহছেনা বেগম
৭। হাজেরা খাতুন
৮। সুলতান আহমদ
৯। মুজা মিঞা
১০। মুকবুল
১১। অহিদুর রহমান
১২। আবদুল গফুর
১৩। ওবায়দুল হক
১৪। আমিনুল হক
১৫। সামসুল হক
১৬। আব্দুস সালাম
১৭। ইয়াকুব আলি
১৮। আবদুল বারিক
১৯। জুলেখা খাতুন ইত্যাদি।
ইহা ছাড়া পাক বাহিনীরা এই এলাকায় বহু অপরিচিত লোক বন্দি করিয়া প্রকাশ্যে দাঁড় করাইয়া গুলি করিয়া হত্যা করিয়াছে। মঠবাড়িয়ার জনাব হানিবউল্লাহ পাক বাহিনীর অত্যাচার হইতে আত্নরক্ষার জন্য তাহার নিজ বাড়িতে বাঙ্কারে স্বপরিবারে আত্মগোপন করেন। কিন্তু পাক বাহিনী তাহাদের ধরিয়া ফেলে। পরে তাহাদের বেয়নেট চার্জ করিয়া হত্যা করে।

পাক বাহিনীরা এই ইউনিয়নের বহু নারীর ইজ্জত হরণ করিয়াছে। ধর্মপুর ইউনিয়নে পাক সেনারা এই এলাকার জনাব আহসান সাহেবের উপর পৈশাচিক ব্যবহার করিয়া তাহাকে গুলি করিয়া হত্যা করিয়াছে। ঘটনার বিবরণে প্রকাশ যে জনাব আহসান সাহেব মুক্তি বাহিনীদের সাহায্য করিতেন। এই জন্য স্থানীয় শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ও মেম্বার তাহার উপর অত্যাচার করিতে থাকে। অবশেষে দালালদ্বয় তাহার নাম পাক সেনাদের নিকট জানাইলে, তিনি আত্মরক্ষার জন্য বন্ধু রাষ্ট্র ভারতে আশ্রয় গ্রহন করেন। কিন্তু দালালরা তাহাকে সেখান হইতে রাত্রিতে গোপনে ধরিয়া আনিয়া পাক সেনাদের নিকট হস্তান্তর করে। পাক সেনারা তাহার উপর প্রায় ৫ দিন ধরিয়া দৈহিক নির্যাতন চালায়। অবশেষে তিনি নিজের দোষ স্বীকার না করায় তাহাকে পাক সেনারা গুলি করিয়া হত্যা করে।

পাক সেনারা অনুরুপভাবে মজলিশপুর গ্রাম হইতে জনাব আবুল খায়ের নামক একজন মুক্তিবাহিনীর বাড়ি আকস্মাৎ আক্রমণ করিয়া তাহাকে বন্দি করিয়া পাক সেনাদের শিবিরে লইয়া আসে। পরে তাহাকে ঝুলন্ত অবস্থায় বেত্রাঘাত করিয়া তাহার নিকট হইতে মুক্তি বাহিনীদের গোপন তথ্য জানিতে চেষ্টা করে। প্রায় ৫ দিন ধরিয়া তাহার উপর দৈহিক নির্যাতন চালাইবার পর পাক সেনারা তাহার নিকট হইতে কোন সংবাদ জানিতে না পারিয়া তাহাকে জ্যান্ত কবর দিয়া হত্যা করিয়াছে।

পাক বাহিনী ধর্মপুর ইউনিয়নে রাজাকার ও দালালদের সহযোগীতায় প্রতিটি গ্রামে প্রবেশ করিয়া নিরীহ জনসাধারণের বাড়িতে অগ্নীসংযোগ করে। তাহারা এই এলাকায় প্রায় ৫ টি গ্রামে অগ্নীসংযোগ করিয়াছে। ধর্মপুর, জোয়ার কাছাড়, মঠবাড়িয়া, পদুয়া, মজলিশপুর। যে সমস্ত গ্রামে প্রবেশ করে নাই, সে সমস্ত গ্রামে বাস্তুত্যাগী জনগনের বাড়িঘরের ছাদের টালি, দরজা জানালা প্রভৃতি রাজাকার ও দালাল কর্তৃক লুণ্ঠন করিয়া লইয়া গিয়াছে। ইহা ছাড়া পাক সেনারা অত্র এলাকার বহু রমণীর শরীর হইতে সোনার গহনা ছিনাইয়া লইয়া গিয়াছে।

পাক বাহিনী এই এলাকায় গণহত্যা, নারী ধর্ষণ, অগ্নীসংযোগ ও লুটতরাজ করিয়াই ক্ষ্যান্ত হয় নাই। তাহারা ধর্মীয় স্থানের প্রতিও কলঙ্ক লেপন করিয়াছে। পাক সেনারা এই এলাকার প্রতিটি হিন্দু মন্দির ধ্বংস করিয়া ফেলিয়াছে। জোয়ার কাছাড় গ্রামে পাক সেনারা আবদুল আলিকে মসজিদে নামাজরত অবস্থায় আকস্মাৎ আক্রমন করিয়া গুলি করিয়া হত্যা করিয়াছে।

স্বাক্ষর/-
মোঃ ইদ্রিস।

গুরু গোলাপ
<৮,২.৪.২৩৩,২৯০> “স্বাধীনতার পর জানিতে পারি মুক্তিযোদ্ধারা সেই রাজাকার ওসমান আলীকে হত্যা করিয়াছে।

আফিজা খাতুন
গ্রাম- দঃ খানে বাড়ি
ডাকঘর- শর্শদী বাজার
জেলা- নোয়াখালী।

আমি অতিশয় দরিদ্র পরিবারে অসহায় নারী। বিগত স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় বাড়িতে ছিলাম। সংগ্রামের প্রথম দিকে এক গ্রাম হইতে অন্য গ্রামে আত্মীয় পরিজনের বাড়িতে আত্মগোপন করিয়া ছিলাম। আর্থিক অবস্থাহীন বলিয়া সীমান্ত অতিক্রম করিতে পারি নাই। বৃদ্ধ পিতা সম্পত্তিহীন কৃষক ছিল। অপরের সম্পত্তি চাষ করিয়া ও দৈনিক মজুরি দিয়া অতি কষ্টে দিন যাপন করিত।

সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিকে পাক বাহিনী দঃ খান বাড়ি গ্রামের নিকট অকাতরে রকেট শেলিং করতেছিল। তখন আমার পিতা জুলু কামাল মিঞা মাঠে জমি চাষ করতেছিল। অকাতরে রকেট শেলিং করিতে দেখিয়া ভয়ে জ্ঞান হারাইয়া মাঠে শাহাদাৎবরণ করেন।

পিতার অকালে মৃত্যুর পর আমার পরিবারে দুঃখের চাপ নামিয়া আসে। অন্যদিকে ফেনী থানায় পাক বাহিনীর নৃশংস অত্যাচারে অত্যাচারিত হইয়া আমার প্রায় সকল আত্মীয়স্বজন ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে আশ্রয় গ্রহন করে। আমি অর্থের অভাবে নিজ বাড়িতে বৃদ্ধ মাতা ও ছোট ভাইকে নিয়া ছিলাম।

অক্টোবর মাসে পাকবাহিনী শর্শদী বাজারে শিবির স্থাপন করে। পাক বাহিনী, রাজাকার ও দালালরা উক্ত এলাকার গ্রামের গ্রামের পর গ্রাম জ্বালাইয়া দিতে থাকে। অস্থায়ী সম্পত্তি লুটতরাজ করিয়া নিয়া যায়।

নভেম্বর মাসের প্রথম দিকে স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগীতায় পাক বাহিনী আমার বাড়ি ঘেরাও করে। হঠাৎ আক্রমনের ফলে আমাদের পক্ষে আত্মগোপনের সুযোগ হয় নাই। আমি ভয়ে ঘরের গোলার নিচে পালাইয়া থাকি, কিন্তু রাজাকার ও পাক বাহিনীর পিশাচরা ঘরে ও বাহিরের সকল কিছু তন্ন করিয়া পরীক্ষা করে এবং আমাকে গোলার নিচ হইতে টানিয়া বাহির করে। পাক নরপশুরা আমাকে দেখিয়া আনন্দে উৎসাহিত হইয়া উঠে ও রাজাকারকে একটি ১০ টাকার (দশ) নোট হাতে দিয়া ঘর হইতে বাহির করিয়া দেয়। আমি নরপিশাচ দিগকে দেখিয়া ভয়ে চিৎকার করিতে থাকি, কিন্তু কাহাকেও সাহায্যে আসিতে দেখলাম না। আমার ভীষণ চিৎকার দেখিয়া তাহারা বেয়নেট বাহির করিলে আমি তাহাদের পায়ে জড়াইয়া ধরিলাম এবং বহু বিনয়ের সহিত আমার পিতার মৃত্যুর কথা বলিলাম। আমি আপনাদের বোন, আমার চরিত্রে আপনারা কলঙ্ক লেপন করিবেননা। আমি দরিদ্র মেয়ে। আমার মা বহুবার তাহাদিগকে অনুরোধ করিল। ক্রন্দন করিল, তোমাদের ও তো মা বোন আছে, কিন্তু নরপিশাচরা আমার মাকে পায়ে লাথি মারিয়া ঘর হইতে বাহির করিয়া দিল এবং ঘরের দরজা দিয়া ফেলিল। আমার ভীষণ চিৎকার, আকুতি মিনতি তাহাদের হৃদয়ে একটুও মায়ার সৃষ্টি করিল না। দুই জন পাক নরপিশাচ আমার উপর নির্মমভাবে অত্যাচার করিল। নরপিশাচদের অত্যাচারে আমি জ্ঞান হারাইয়া ফেলি। প্রায় ৬ ঘন্টা পরে গভীর রাত্রে জ্ঞান ফিরিয়া আসিয়াছে আর পাশে দেখি আমার অসহায় মা মাথায় পানি দিতেছে। নির্মম অত্যাচারে আমার স্বাস্থ্য খারাপ হইয়া পড়ে। আমার অসুস্থ্য শরীরের উপর এইভাবে তিন দিন অত্যাচার করে এবং প্রতিদিন আমি জ্ঞান হারাইয়া ফেলি। রাজাকার আমাদের কড়া পাহারা দিতে থাকে। তিন দিন পর একদিন গভীর রাত্রে মা ও ছোট ভাইকে নিয়া বাড়ি হইতে অন্য গ্রামে পলায়ন করি। ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিকে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশে ফিরিয়া আসি এবং জানিতে পারি মুক্তিযোদ্ধারা সেই রাজাকার ওসমান আলীকে হত্যা করিয়াছে।

টিপসহি /-
আফিসা খাতুন।

গুরু গোলাপ
<৮,২.৪.২৩৪,২৯১> “তৎক্ষণাৎ পাক নরপশু তাহার বেয়নেট বাহির করিয়া আমার ডান হাতের একটা আঙ্গুল তুলিয়া ফেলে”
আব্দুল গোফরান
গ্রাম- পদিপাড়া
থানা- বেগমগঞ্জ
জেলা- নোয়াখালী।

২২ শে এপ্রিল ১৯৭১ সালে মাইজদি এবং চৌমুহনী বাজারে পাক সৈন্য প্রবেশ করে। আমি তখন হোটেল জায়েদীতে কাজ করি। পাক বাহিনী যখন প্রবল বাধা সত্ত্বেও চৌমুহনী বাজারে প্রবেশ করিল, তখন আমি মন স্থির করিলাম যে, কি করিয়া এই বাজার হইতে বাহির হইয়া যাইতে পারি। যখন দেখিলাম যে পাক বাহিনী রাস্তার ভেতর নাই, তখন আল্লাহর নাম স্মরণ করিয়া এক পা দু পা করিয়া হাঁটতে আরম্ভ করিলাম। কিছু দুর যাওয়ার পর একজন পাক দস্যু আসিয়া আমাকে বলিল হ্যান্ডস আপ। হ্যান্ডস আপ অর্থ কি বুঝিতে না পারিয়া সোজা হইয়া দাঁড়াইয়া রহিলাম। পাক দস্যু আসিয়া আমাকে ভীষণভাবে আমাকে চপেটাঘাত করিল। চপেটাঘাত করিবার পর আমি মাটিতে পড়িয়া যাই। যেখানে পড়িয়া যাই ঐখান হইতে আমাকে চৌমুহনী প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্তর পাশের রোডে নিয়া আসে। এখানে আনিয়া আমাকে বার বার দু প্রশ্ন করে যে, মুক্তিবাহিনী কোথায়? আমি বলি মুক্তিবাহিনী দেখি নাই। আমার জবাবে আশ্চার্যন্বিত হইয়া বলে বেটা মুক্তিবাহিনীকে মাছ ভাত দিতে পারিস আর এখন বলিস মুক্তিবাহিনী দেখি নাই। তৎক্ষণাৎ পাক নরপশু তাহার বেয়নেট বাহির করিয়া আমার ডান হাতের একটা আঙ্গুল তুলিয়া ফেলে এবং বলে এখন সত্যি কথা বল। আমি বলি না হুজুর আমি মুক্তিবাহিনী দেখি নাই। তখন আবার ডান হাতের তালু চিদ্র করিয়া দিল। এমন অবস্থাতেও আমি বলি নাই মুক্তিবাহিনী কোথায়।

স্বাক্ষর/-
আব্দুল গোফরান
২১/১/৭৩

গুরু গোলাপ
<৮,২.৪.২৩৫,২৯২>

জামাল মিঞা পাটোয়ারী।
গ্রাম- পটিকা
থানা- বেগমগঞ্জ
জেলা- নোয়াখালী।

১২/৫/৭১ রোজ মঙ্গলবার বেলা আনুমানিক ১২ ঘটিকার সময় বাড়িতে পাক বাহিনী হামলা চালাইলে আমি তাহাদের হাতে ধরা পড়ি। কে বা কাহারা আমার মেজ ছেলে রুহুল আমিনের নাম পাক বাহিনীদের নিকট দেওয়ায়, পাক বাহিনী আমার ছেলে রুহুল আমিনকে খোঁজ করে এবং আমাকে তাহার সম্পর্কে বহু কিছু জিজ্ঞেস করে। আমি তাহার সম্পর্কে সব কিছু অস্বীকার করিলে তাহার রাইফেল দ্বারা আমাকে বেদম প্রহার করে। তাহা ছাড়া পা দ্বারা বুকে লাথি মারে। আমি তাহাদের অনুরোধ করিলে তাহারা আমার উপর আরো কঠোর নির্যাতন চালায় ও আমার ঘর দরজা পোড়াইয়া দিয়া আমাকে মৃতপ্রায় ফেলিয়া যায়। তারপর আমার বাড়ির অন্যান্য লোকজন বাড়ি আসিলে আমাকে অজ্ঞান অবস্থায় দেখিয়া ডাক্তার লইয়া আসে। ডাক্তার আমাকে ঔষধ পত্র ও ইঞ্জেকশন দেওয়ার পর জ্ঞান ফিরিয়া আসে। পাক হানাদার বাহিনী মাঝে মাঝেই আমার বাড়িতে মেঝ ছেলে রুহুল আমিনকে খোঁজ করিত।

স্বাক্ষর/-
জামাল মিঞা পাটোয়ারী।

গুরু গোলাপ
<৮,২.৪.২৩৫,২৯৩>

মোঃ আনছার আলী
গ্রাম- করিমপুর
থানা- বেগমগঞ্জ
জেলা- নোয়াখালী।

২২ শে এপ্রিল ১৯৭১ সনে মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধ করা সত্ত্বেও পাক বাহিনী মাইজদি ও চৌমুহনী বাজারে প্রবেশ করে। পাক বাহিনী চৌমুহনীতে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে বাজারে কারফিউ জারি করে। তখন আমরা দোকানপাট বন্ধ করিয়া ঘরের মধ্যে বসিয়া থাকি। এই সময় আমি গুলশান চায়ের দোকানে কাজ করি। যখন কারফিউ শেষ হইলো তখন আমি দোকানে চা তৈরি করিতেছি। এমন সময় পাক নরপশুরা আমাদের দোকানে প্রবেশ করিল। দোকানে আসিয়া আমাকে বলিল বেটা একটা চা দে তো। অমনি আমি একটা চা তৈরি করিয়া দেই। চা পান করার পর আমাকে বার বার প্রশ্ন করে বেটা তোরা তো মুক্তিবাহিনীকে ভাত, মাছ দিয়াছিস, বল এখন মুক্তি কাহা হায়? আমাকে পাক বাহিনী বলে ঝুট নেহি বলতা হায়। আমি বলি না হুজুর আমি মুক্তিবাহিনী দেখি নাই। এই বলার সঙ্গে সঙ্গে পাক দস্যু আমার উপর ভীষনভাবে রাগান্বিত হইয়া বলিল ভাত মাছ দিতে পারিস আর এখন বলিস মুক্তিবাহিনী দেখিস নাই। এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে আমার শরীরের প্রতি লক্ষ করে এবং গুলি করে। গুলি আসিয়া আমার উরাতের ভেতর প্রবেশ করে। আমি তখন জ্ঞান হারাইয়া মাটিতে পড়িয়া যাই এমন সময় দুইটা লোক আমাকে দোকানের ভেতর প্রবেশ করায়। আমাকে দেখিয়া তাহারা বলাবলি করিতে লাগিলো যে লোকটা বাঁচিতে পারে। এই লোক দুইটা আমাকে চিনিত, তাহারা আমাকে ধরিয়া বাড়িতে নিয়া যায়। কিছুক্ষণ পর ধীরে ধীরে আমার বাড়িতে লোকজন আসিতে লাগিলো। তখন আমি আমার পাড়া প্রতিবেশী নজীর উদ্দিনকে ডাকিয়া বলি ভাই আমার জমি তোমায় লিখিয়া দিবো, তুমি আমার চিকিৎসার ব্যবস্থা করিয়া দাও। এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে মোঃ নজির উদ্দিন চৌমুহনী বাজার হইতে ডাক্তার ডাকিয়া আমার চিকিৎসার ব্যবস্থা করিয়া দেয়। ডাক্তার চিকিৎসা করিতে করিতে আমাকে আরোগ্য করিয়া তুলিল।

স্বাক্ষর/-
মোঃ আনছার আলী।

গুরু গোলাপ
<৮,২.৪.১,২৯৪,২৯৭>

আহছান উল্লাহ
গ্রাম- দেয়নাথ পুর
থানা- রায়পুর
জেলা- নোয়াখালী।

মে মাসের প্রথম সপ্তাহে পাক বাহিনী রায়পুর বিনা মোকাবেলায় দখল করে। বাজারের অনতিদূরে একটি হিন্দু বর্ধিষ্ণু গ্রাম জ্বালাইয়া দেয় ও দুইটি নিরাপরাধ ব্যক্তিকে হত্যা করিয়া চলিয়া যায়।

কয়েকদিন পর আবার রায়পুর থানায় আসিয়া শিবির স্থাপন করে এবং আরম্ভ হয় নারী নির্যাতন দৈহিক পীড়ন। পাক বাহিনী স্থানীয় জামাতে ইসলামী ও মুসলিম লীগ সমর্থিত দালালদের সহায়তায় আওয়ামীলীগ কর্মী ও হিন্দুদের বাড়িঘর লুন্ঠন ও প্রজ্বলন শুরু করে। রাত্রের অন্ধকারে বাড়িতে হানা দিয়ে মা বোনদের উপর নৃশংসভাবে অত্যাচার করে। তাহাদের অত্যাচারে এই এলাকায় অগণিত মা বোনের সতীত্ব নষ্ট হয়। শেষের দিকে নিরাপরাধ লোকদের বাড়িও তাহারা জ্বালাইয়া দেয় ও লুণ্ঠন করে।

আমি একজন মিস্ত্রী। সারাদিন পরিশ্রম করিয়া কোন প্রকারে জীবিকা নির্বাহ করিতাম। পাক বাহিনী ও তাহাদের দালালরা আমার সুখের সংসারে আগুন জ্বালাইয়া দিয়াছে। পাক বাহিনী রায়পুর শিবির করার পর আমার এখানে থাকা সম্ভব হইলো না। আমার কাজ একেবারে বন্ধ হইয়স গেল। বাঁচার অন্বেষণে সুদূর পল্লী গ্রামে চলিয়া গেলাম। সেখানে কাঠ মিস্ত্রীর কাজ করিয়া জীবিকা নির্বাহ করি।

মে মাসের শেষ সপ্তাহে পাক বাহিনী ও দালালরা আমাদের গ্রাম দেয়নাথ পুর আক্রমন করে। প্রতিটি বাড়ি খুঁজিয়া যুবকদিগকে হত্যা করে ও মা বোনদের উপর পাশবিক অত্যাচার করে। আমার বাড়িতে তল্লাশী করিয়া আমাকে না পাইয়া আমার স্ত্রী আরমান নেছা বেগমের উপর অত্যাচার করে। সেই সময় আমার স্ত্রী সাত মাসের গর্ভবতী ছিল। আমাকে বাড়িতে না পাইয়া মুক্তিফৌজ সন্দেহ করিল। আমার স্ত্রীর উপর নৃশংস অত্যাচার করে। তাহাদের অত্যাচারে আমার স্ত্রী আরমান নেছা ঘটনাস্থলে শাহাদাৎ বরণ করে। এইভাবে এই এলাকায় বহু নারীকে অত্যাচার করিতে করিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করিয়া বিদায় নেয়।

স্বাক্ষর/-
আহছান উল্লাহ।

গুরু গোলাপ
<৮,২.৪.২৩৮,২৯৫> “রাজাকার কমান্ডার নূর মোহাম্মদ…”

মোঃ বাদশাহ মিয়া
গ্রাম- লুধুয়া
থানা- রায়পুর
জেলা- নোয়াখালী।

৫ ই রমযান ১৯৭১ ইং সালে পাক বাহিনী লক্ষ্মীপুর হইতে আমাদের গ্রামের পার্শ্ববর্তী গ্রাম মীরগঞ্জে আসে। মীরগঞ্জে আসিয়া মিরগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মসজিদে তাহাদের শিবির স্থাপন করে। এই শিবিরে প্রায় ৩০ জন পাক নরপিশাচ এবং ৯০ জন রাজাকার ছিল।

একদিন আমি আমাদের গ্রামের পাশে সুপারি বাগানে কাজ করতেছি। এমন সময় একদল রাজাকার আসিয়া আমাকে ধরিয়া ফেলিল। রাজাকার কমান্ডার আমাকে চোখ বাঁধিয়া রাজাকার ক্যাম্পে আনিল। ক্যাম্পে আনিয়া মসজিদের সামনে যে বাঙ্কার ছিল, সেই বাঙ্কারের ভেতর হাত পা বাঁধিয়া রাখিল। রাত্রিতে আমাকে একটা রড দিয়া ভীষণ প্রহার করে এবং রাজাকার কমান্ডার বলে বেটা মুক্তিবাহিনীর লোক, বেটাকে এখন মুক্তিবাহিনীর স্বাদ মিটাইতেছি। আবার সেই রডটা আগুন দিয়া পোঁড়াইয়া আমার পায়ে ঠাসিয়া ধরিলে আমি অজ্ঞান হইয়া পড়িয়া থাকি। প্রায় ঘন্টা দেড়েক পর আমার জ্ঞান ফিরিয়া আসে। তারপর রাজাকাররা বলে তুই মুক্তিবাহিনীর লোক, তোকে আমরা আর বাঁচাইয়া রাখিবো না।

তার পরের দিন পাক বাহিনীর একজন নায়েক সুবেদার আসিয়া আমার চোখ খুলিয়া আমাকে বার বার প্রশ্ন করে মুক্তিবাহিনী কোথায় থাকে ঠিক করিয়া বল আমার কাছে বল, তোকে আমরা ছাড়িয়া দিবো। আমি তখন বলি স্যার আমি একজন নিরীহ মানুষ, মুক্তিবাহিনী কে বা কোথায় থাকে তাহা আমি জানিনা।

এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে পাক বাহিনী ভীষণভাবে চপেটাঘাত করে এবং বলে বেটা ঠিক কথা বল নইলে তোকে আমরা চির নির্বাসিত করিয়া দিবো। এমন সময় একজন পুলিস আসিলো বলিল স্যার এই নিরীহ জনসাধারণকে মারিয়া কোন লাভ হইবে না। তখন রাজাকার কমান্ডার নুর মোহাম্মদ বলে বেটারা মুক্তিবাহিনীকে ডাব, নারকেল দিবে। কাজেই বেটাকে ছাড়িয়া দেওয়া হইবেনা। তখন উক্ত পুলিসটি বলিল দিন বেটাকে আমি শেষ করিয়া দিয়া আসি। তখন পুলিসটি আমাকে। দুরে আনিয়া বলিল এক কাজ কর, কাজ হইলো এই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পিছনে যে পুল আছে ঐ পুলের নিচে কয়েকজন মরা মানুষ ভাসিতেছে, তুমি একটা বাঁশ আনিয়া মরা মানুষগুলি ভাসাইয়া দিয়া চলিয়া যাও। তখন আমি পুলিসটির কথা মত মরা মানুষ গুলি ভাসাইয়া দিয়া চলিয়া আসি। আজ পর্যন্ত আমার পায়ের সেই দাগ রহিয়াছে।

টিপসহি /-
বাদশাহ মিয়া।

গুরু গোলাপ
<৮,২.৪.১,২৭০-৭১> “রাজাকার কমান্ডার দেলোয়ার হোসেনকে দুই হাজার টাকা দিয়া আমাকে মুক্ত করিয়া আনিল।“

মোঃ আবুল কালাম
গ্রাম- উত্তর দেনাতপুর
থানা- রায়পুর
জেলা- নোয়াখালী।

ভাদ্র মাসে পাক বাহিনী আমাদের রায়পুর থানায় আসিয়া রায়পুর আলিয়া মাদ্রাসায় একটি ক্যাম্প স্থাপন করে। এই মাদ্রাসায় রাজাকার বাহিনীর জন্য একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করে।

এইখান হইতে প্রশিক্ষন প্রাপ্ত হইয়া রাজাকার বাহিনী রায়পুর থানার পার্শ্ববর্তী গ্রামে মুক্তি বাহিনী ও আওয়ামীলীগ কর্মীদের বাড়িতে যাইয়া লুটপাট আরম্ভ করে। এই ভয়ে তখন হইতে আমি আমাদের বাড়িতে রাত্রি যাপন করা নিরাপদ নয় বলে অন্য বাড়িতে রাত্রি যাপন করিতাম।

একদিন আমি আমাদের গ্রামের মোঃ রসিদ পাটোয়ারীর সাহেবের বাড়িতে ঘুমাইতেছিলাম। এমন সময় একদল রাজাকার আসিয়া আমাকে ঘুম হইতে ডাকিয়া তুলিল। তখন আমি মনে করিলাম আমার আর বাঁচার কোন পথ নাই। প্রায় ১৫ জন রাজাকার আসিয়াছিল। তার মধ্যে আমার পরিচিত ছিল চার জন।

একজন রাজাকার কমান্ডার আসিয়া আমার হাত বাঁধিয়া তাহাদের ক্যাম্পে নিয়া আসিল এবং পাক বাহিনীর হাতে অর্পন করিল। পাক বাহিনী তখন আমার চোখ বাঁধিয়া একটি অন্ধকার ঘরের মধ্যে রাখিল। প্রথম দিন আমাকে তাহারা বেত দ্বারা বেদম প্রহার করিতে থাকে। পাক বাহিনী আমাকে বলে তোদের মুক্তিবাহিনীর দল কোথায় ঠিক করিয়া বল তোকে আমরা ছাড়িয়া দিব। তখন আমি বলি না হুজুর আমি মুক্তিবাহিনীর দল দেখি নাই। এই কথা বলার সঙ্গে পাক বাহিনী তাহার পাদুকা দিয়া আমার বুকের উপর ভীষণভাবে লাথি মারিল, এই লাথি মারার সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞান হইয়া পড়িয়া থাকি।

দ্বিতীয় দিনে উক্ত রাজাকার কমান্ডার আসিয়া আমাকে তাহার চাকু দিয়া আমার বাম হাতের রগ কাটিয়া ফেলিল। রগ কাটার সঙ্গে সঙ্গে আমি আবার অজ্ঞান হইয়া পড়িয়া থাকি।

তৃতীয় দিনে পাক বাহিনী আমাকে তাহাদের হেডকোয়ার্টার মাইজদি পাঠাইবে এই খবর শুনিয়া একজন রাজাকার আমাকে বলিল এবং আমি তাহাকে বলিলাম ভাই আমি তোমাকে কিছু টাকা দিবো তুমি আমাকে মুক্ত করিয়া দাও। এই কথা শুনিয়া সেই রাজাকার আমার বাড়িতে সংবাদ দিল। আমার বাড়ি হইতে বড় ভাই ১৫ শত টাকা নিয়া আসিল।

পঞ্চম দিনে রাজাকার কমান্ডার আমার বড় ভাইয়ের সাথে সাক্ষাত করে এবং দাবি করে আমাকে দুই হাজার টাকা দিতে হইবে, না হইলে আমরা কালামকে মারিয়া ফেলিবো।

এই কথা শুনিয়া আমার বড় ভাই বাড়ি চলিয়া গেল। এমন সময় রাজাকার কমান্ডার আমার নাকের ভেতর সুঁচ দিয়া ছিদ্র করিয়া সুতা দিয়া আড়ার সঙ্গে বাঁধিয়া রাখিল। এই কথা শুনিয়া আমার বড় ভাই দুই হাজার টাকা সংগ্রহ করিয়া আবার ক্যাম্পে ফিরিয়া আসিল। রাজাকার কমান্ডার দেলোয়ার হোসেনকে দুই হাজার টাকা দিয়া আমাকে মুক্ত করিয়া আনিল।

স্বাক্ষর/-
মোঃ আবুল কালাম।

গুরু গোলাপ
<৮,২.৪.২৪০,২৯৭>

মোঃ নুরুল ইসলাম
গ্রাম- পশ্চিম লতিফপুর
থানা- লক্ষ্মীপুর
জেলা- নোয়াখালী।

পাক নরপশুরা এতদ অঞ্চলের চন্দ্রগঞ্জ হাইস্কুল ও প্রতাপগঞ্জ হাইস্কুলে আসিয়া শিবির স্থাপন করে। শিবির স্থাপন করার পূর্বে পার্শ্ববর্তী গ্রাম পশ্চিম লতিফপুরের উপর বেপরোয়া হামলা চালায়। কারন চন্দ্রগঞ্জ বাজারের পূর্ব পার্শ্বে একটা পাকা পুল ও রাস্তা কাটিয়া প্রতিরোধ আন্দোলন গড়িয়া তোলে। ফলে চন্দ্রগঞ্জ বাজারের পাশে সংলগ্ন গ্রাম পশ্চিম লতিফপুর গ্রামে হানা দেয়। প্রথমে পাক বাহিনীরা গ্রামে প্রবেশ করার পথে লোকজন সামনে যাহাকে পাইয়াছে তাহাদেরকে গুলি করিয়া হত্যা করে। আমাদের গ্রামে পাক বাহিনী নুরু মিঞা মুন্সীর বাড়িতে যায়। ঐ বাড়িতে ৬জন লোককে পায়। ৬জন লোককেই গুলি করিয়া হত্যা করে। তাহা ছাড়া উক্ত গ্রামে আরো বহু লোককে হত্যা করে। নিন্মে উক্ত গ্রামে মৃত ও আহত লোকদের নাম দেয়া হইলো।

মৃত ব্যক্তিদের নামঃ
১। শশীভূষণ পাল, পিতা- রাজমোহন পাল।
২। সেকান্দার মিঞা, পিতা- ইলিয়াস।
৩। মজিবুল্লাহ, পিতা- আহমদ উল্লাহ।
৪। শফিকুল্লাহ মুন্সী, পিতা- মৃতঃ ছালামত উল্লাহ।
৫। নুর মিঞা মুন্সী, পিতা- মহব্বত আলী।
৬। রহমত উল্লাহ, পিতা- নুর মিঞা মুন্সী।
৭। মখলেছুর রহমান, পিতা- মহব্বত আলী।
৮। জাফর আহমদ, পিতা- এমরান আলী।
৯। আবু তাহের, পিতা- ওবায়দুল্লাহ।
১০। করপুন নেছা, স্বামী- আব্দুল মান্নান।
১১। নজীর আহমদ, পিতা- আব্দুল হাকিম।
১২। শামসুল হক, পিতা- মুজা মিঞা।
১৩। খলিল, পিতা- হাবিবুল্লাহ।
১৪। আবদুর রহমান পাটোয়ারী, পিতা- বজলুর রহমান।

আহত ব্যক্তিদের নামঃ
১। জগবন্ধু পাল, পিতা- রতন কৃষ্ণ পাল।
২। অনুকূল চন্দ্র পাল, পিতা- দেবেন্দ্র কুমার পাল।
৩। নুর মোহাম্মদ, পিতা- আহমদ উল্লাহ।
৪। নুরুজ্জামান, পিতা- আনোয়ার আলী।
৫। আব্দুল হক, পিতা- নুরুজ্জামান।
৬। ইউছুপ মিঞা, পিতা মমহব্বত আলী।
৭। নুরুল আমিন, পিতা- জাফর আহমদ।
মৃত ব্যক্তিদের নাম আরো রহিয়াছে।

স্বাক্ষর/-
মোঃ নুরুল ইসলাম
২৬/০২/৭৩

গুরু গোলাপ
<৮,২.৪.২৪১,২৯৮>

মফিজ উল্লাহ মুন্সী
গ্রাম- পশ্চিম লতিফপুর
থানা- লক্ষ্মীপুর
জেলা- নোয়াখালী।

আমার মনে পড়ে জ্যেষ্ঠ মাসের মাঝামাঝি পাক বাহিনী তখন চৌমুহনী হইতে চন্দ্রগঞ্জ বাজারে আসে। চন্দ্রগঞ্জ বাজারে আসিয়া চন্দ্রগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ে তাহাদের শিবির স্থাপন করে। পাক বাহিনী শিবির খুলিয়া তাহাদের দোসর বন্ধু শান্তি কমিটি গঠন করে।

শান্তি কমিটি গঠন করিয়া পাক বাহিনী চন্দ্রগঞ্জ বাজারের উত্তর পাশে গ্রাম গুলি মুক্তিবাহিনীর তল্লাশে তছনছ করিয়া তুলিল।

এইভাবে পাক বাহিনী জনসাধারণের মধ্যে এক সন্ত্রাসের সৃষ্টি করিল। তখন হইতে আমাদের গ্রামের জনসাধারণ অন্যান্য গ্রামে পলায়ন আরম্ভ করে।

জ্যেষ্ঠ মাসের ১২তারিখ পাক বাহিনী আমাদের গ্রামে প্রবেশ করে। পাক বাহিনীকে আসতে দেখিয়া আমার বাড়ির লোকজন সবাই পলায়ন করে। শুধু আমি ও আমার ভাই মোঃ আমিন উল্লাহ মুন্সী বাড়িতে ছিলাম। যখন দেখিলাম পাক বাহিনী আমাদের পাড়ার মধ্যে প্রবেশ করিয়াছে, তখন আমরা দুই জন এক পুকুরের মধ্যে ডুব দিয়া কচুরি পানা মাথায় দিয়া লুকাইয়া থাকি। পাক বাহিনী আমাদের খুঁজিয়া বাহির করিয়া প্রথমে তাহার পাদুকা দ্বারা আমার বুকে লাথি মারিল, তারপর রাইফেল দিয়া বেদম প্রহার করিল। রাইফেল দিয়া মারার পর আমার পায়ে দড়ি দিয়া এক গাছের সঙ্গে বাঁধিল। গাছের সঙ্গে বাঁধিয়া আমার পা উপরের দিকে রাখিল এবং আমাকে জিজ্ঞাসা করিল তোদের বাড়ি কোনটা? বাড়ি দেখাইয়া দেওয়ার পর আমার বাড়ি আগুন দিয়া পোঁড়াইয়া দিল। আমাকে গাছের সঙ্গে এই অবস্থায় বাঁধিয়া রাখিয়া পাক বাহিনী চলিয়া গেল। বর্তমানে আমি অদ্যাবধি মৃতপ্রায় অবস্থায় পড়িয়া আছি।

স্বাক্ষর /-
মফিজ উল্লাহ মুন্সী
২৬/০২/৭৩

গুরু গোলাপ
<৮,২.৪.২৪২,২৯৯> “মুক্তিবাহিনীদেরকে সাহায্যের কথা অস্বীকার করলে বা মুক্তিবাহিনী কারা তাও অস্বীকার করলে পা দ্বারা বুকে জোরে লাথি মারে। নরপশুরা যাওয়ার সময় আমার একটা চোখ নষ্ট করে দিয়ে যায়।“

জগবন্ধু পাল
গ্রাম- পশ্চিম লতিফপুর
থানা- লক্ষ্মীপুর
জেলা- নোয়াখালী।

রাজাকাররা যখন পাক বাহিনীর সাথে বিশেষভাবে সহযোগিতা করতে থাকলো এই গ্রামের নিরীহ জনসাধারণের উপর রাত্রিতে জোর তল্লাশী আরম্ভ করে। লতিফপুর গ্রামটি চন্দ্রগঞ্জ বাজারের অতি নিকটবর্তী। পাক দস্যুরা ও রাজাকাররা চন্দ্রগঞ্জ হাইস্কুলের সম্মুখে শিবির স্থাপন করেছিল। রাজাকার ও পাক হানাদাররা গ্রামের দিকে আসা মাত্রই আমরা ঘরবাড়ি ছেড়ে আমরা অন্যত্র পলায়ন করি। এইভাবে আমাদের মধ্যে সর্বময় সন্ত্রাসের সৃষ্টি করতো।

ভাদ্র মাসের মাঝামঝিতে বেশ ক’জন রাজাকার রাত্রিতে আমার বাড়িতে আসে এবং আমার বাড়ি ঘিরে ফেলে। বাড়ি ঘেরাও করে ঘর হইতে আমাকে জোর করে বাহির করে এবং বন্দুকের বাঁট দ্বারা বেদম প্রহার করে। রাজাকার আমাকে প্রশ্ন করে মুক্তিবাহিনীকে কয় হাজার টাকা দিয়ে সাহায্য করেছিস? মুক্তিবাহিনীদেরকে সাহায্যের কথা অস্বীকার করলে বা মুক্তিবাহিনী কারা তাও অস্বীকার করলে পা দ্বারা বুকে জোরে লাথি মারে। নরপশুরা যাওয়ার সময় আমার একটা চোখ নষ্ট করে দিয়ে যায়। আমার কাছ হতে বহু টাকা পয়সাও জোর করিয়া কেড়ে নেয়। বর্তমানে আমার চোখ অচল। একেবারে কিছু দেখতে পাই না। তাছাড়া বেদম প্রহারের ফলে আমার একটি হাতও ভেঙ্গে যায়। বর্তমানে পৃথিবীতে থাকা না থাকা একই অবস্থা।

মুক্তিবাহিনী, পাকবাহিনী ও রাজাকারদের সবসময় নাজেহাল করতো। ফলে পাক বাহিনী ও রাজাকাররা অতিষ্ঠ হয়ে পার্শ্ববর্তী গ্রামে লতিফপুরের বহু নিরীহ জনসাধারণকে ধরে কঠোরভাবে দৈহিক নির্যাতন চালায়। পাক বাহিনী ও রাজাকাররা আমার বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। বর্তমানে আমি সর্বহারা।

স্বাক্ষর/-
জগবন্ধু পাল।
২৬/০২/৭৩

গুরু গোলাপ
<৮,২.৪.২৪৩,৩০০> “তারপর আবার একটা সুঁচ দিয়া আমার ডান হাতের আঙুলের ভেতর ঢুকাইয়া দিলে আমি অজ্ঞান হইয়া পড়িয়া থাকি।“

মোঃ আবুল কাশেম
গ্রাম- শেখপুর
থানা- লক্ষ্মীপুর
জেলা- নোয়াখালী।

পাক বাহিনী যখন চন্দ্রগঞ্জ বাজারে আসে আমি তখন চন্দ্রগঞ্জ বাজারে ছিলাম। চন্দ্রগঞ্জ বাজারে আমার একটা দোকান আছে। সেই দোকানে আমি ছিলাম। পাক বাহিনী চন্দ্রগঞ্জ বাজারে আসিয়া চন্দ্রগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ে তাহারা শিবির স্থাপন করে। তখন হইতে আমি মুক্তিবাহিনীকে আমি গোপনভাবে সাহায্য করি এবং মুক্তিবাহিনীর পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করিতে থাকি। একদিন রাত্রিতে প্রায় ১৭ জন মুক্তিবাহিনী আসিয়া আমাকে বলিল কিভাবে আমরা নোয়াপুর পুল ধ্বংস করিতে পারি? তখন আমি মুক্তিবাহিনীকে নোয়াপুর পুলের পথ দেখাইয়া দিলাম এবং তাহাদিগকে আমার দোকানে রুটি খাওয়াইয়া বিদায় করিলাম। ঐ তারিখে তাহার নোয়াপুর পুল ধ্বংস করিয়া চলিয়া যায়।

তার ঠিক দুইদিন পর একদল রাজাকার আমার দোকানে আসিয়া বলিল কাশেম নামে কোন দোকানদার আছে নাকি? তখন আমি বলিলাম হ্যাঁ আছে। রাজাকার বলিল কাশেমকে আমাদের দরকার আছে। তুমি পলায়ন করিলে দোকান পোঁড়াইয়া দেওয়া হইবে। এই কথা শুনিয়া আমি আর দুই দিন দোকানে আসি নাই।

একদিন রাত্রে পালাইয়া দোকানে আসিলাম। তৎক্ষণাৎ একদল রাজাকার আসিয়া আমাকে ধরিয়া ফেলিল এবং আমার চোখ বাঁধিয়া রাজাকার ক্যাম্পে নিয়া আসিল।

ক্যাম্পে আনিয়া কোন কথা বলার আগে আমাকে বেত দ্বারা বেদম প্রহার করিল এবং বলিতে লাগিলো বেটা কোথায় পালাইছিলি? এখন মজা দেখাইতেছি। এই কথা বলার পর পরা আবার বেত দ্বারা বেদম প্রহার করিতে লাগিল।

তারপর আমাকে বলিল যে, নোয়াপুর পুল ধ্বংস করিয়াছিস এবং মুক্তিবাহিনীকে তোর দোকানের রুটি তৈরী করিয়া খাওয়াইছিস। এখন সত্য করিয়া বল মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প কোথায়? আমি তখন কোন কথার জবাব দিতে পারি নাই।

তারপর আবার একটা সুঁচ দিয়া আমার ডান হাতের আঙুলের ভেতর ঢুকাইয়া দিলে আমি অজ্ঞান হইয়া পড়িয়া থাকি। এই খবর জানিতে পারিয়া আমার বাড়ি হইতে লোকজন আসিয়া একদল রাজাকারকে কিছু টাকা দিয়া আমাকে রাজাকার ক্যাম্প হইতে উদ্ধার করিল। আজ পর্যন্ত আমার ডান হাত দিয়া কোন কাজকর্ম করিতে পারিনা।

স্বাক্ষর/-
মোঃ আবুল কাশেম
২৬/০২/৭৩

গুরু গোলাপ
<৮,২.৪.২৪৪,৩০১>

মোঃ রফিকুল্লাহ
গ্রাম- কাদির হানিফ
থানা- সুধারাম
জেলা- নোয়াখালী।

১৫ ই এপ্রিল ১৫ জন রাজাকার আমাদের গ্রামে আসে, আমি তখন আমাদের গ্রামের দক্ষিণ চরায় ধান কাটিতেছি। রাজাকার আসিয়া আমাকে বলে যে, তোমাদের গ্রাম হইতে আমাদের চাউল তুলিয়া দিতে হইবে। তখন আমি রাজাকারকে বলি না ভাই আমি গ্রাম হইতে চাউল তুলিয়া দিতে পারিবো না। তৎক্ষণাৎ আমাকে ধরিয়া মাইজদি টাউন হল শিবিরে লইয়া যায়। শিবিরে লইয়া রাজাকার কমান্ডার মীর কালা মিয়া মেকার আমাকে পাক সেনাদের হাতে অর্পন করে। ঐ হইতে পাক সেনারা আমার শরীরের উপর দৈহিক পীড়ন আরম্ভ করে। প্রথমে আমার পায়ে দড়ি বাঁধিয়া আমাকে একটা ঘরের আড়ার উপর ঝুলাইয়া রাখে এবং বার বার আমাকে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে তুই মুক্তিবাহিনী, তোর কাছে অবশ্যই রাইফেল আছে। আমি প্রশ্নের জবাবে বলি, না হুজুর আমি কোন মুক্তি নই, আমার কাছে কোন রাইফেলও নাই। এইভাবে আমাকে ঐখানে সাত দিন বাঁধিয়া রাখে এবং দিনের শেষে বিকালে আমাকে প্রত্যেক দিন এইভাবে প্রহার করে।

১৭ই এপ্রিল তারিখে আমাকে আবার চোখ বাঁধিয়া একটি অন্ধকার ঘরের মধ্যে রাখে এবং ঐ তারিখে বেগমগঞ্জ শিবিরে লইয়া বেত দ্বারা বেদম প্রহার করিতে থাকে। এই অবস্থায় আমি অজ্ঞান হইয়া পড়ি। এই খবর শুনিয়া আমার এক আত্মীয় মোঃ সামছুল হক সাহেব আমাদের গ্রামের ও ইউনিয়নের রাজাকার কমান্ডার মোঃ মীর কালা মিয়া মেকারকে ধরিয়া ৫০০ টাকার বিনিময়ে আমাকে মাইজদি জেল খানায় লইয়া আসিল। মাইজদি জেল খানায় আসিয়া আবার পাক সেনাদের হাতে পড়ি। এই জেল খানায় আমাকে দৈনিক এক হাতে ১৫ সের আরেক হাতে ১৫ সের পানি লইয়া আধা মাইল চলিতে হইতো। এইভাবে মাইজদি জেলখানায় ৩ মাস ছিলাম। মাইজদি শহর মুক্ত হওয়ার পর আমি জেলখানা হইতে মুক্তি পাই।

টিপসহি /-
মোঃ রফিকুল্লাহ

\
গুরু গোলাপ
<৮,২.৪.২৪৫,৩০২>

মোঃ ছিদ্দিক উল্লাহ
গ্রাম- কাদির হানিফ
থানা- সুধারাম
জেলা- নোয়াখালী।

২৮/৯/১৯৭১ ইং তারিখে আনুমানিক ৫০/৬০ জন রাজাকার আসিয়া দিনের বেলায় আমার বাড়ির চারদিকে ঘেরাও করিয়া ফেলে। রাজাকাররা আসা মাত্র আমি আমার ঘরের মাচার কোণায় পালাইয়া ছিলাম। তবে আমার বিশ্বাস ছিল যে, আমি কোন মুক্তি বাহিনী নই, বা কোন অন্যায় কাজও করি নাই। তবে পাক সেনা ও রাজাকার দেখিয়া ভয় পাইতাম এই কারনে যে বর্বর বাহনী ও রাজাকারদের মতলবের কোন ঠিক ছিল না এবং সন্দেহ করিয়াই নির্বিচারে গুলি করিয়া হত্যা করিত। তারপর আমাকে বাড়িঘর তন্নতন্ন করিয়া খুঁজিয়া বাহির করিল এবং বার বার প্রশ্ন করিতে লাগিলো মুক্তিবাহিনীদের থাকার জায়গা দিয়া তাহাদের সক্রিয়ভাবে সাহায্য করিয়াছিস। মুক্তিবাহিনী কোথায় আছে বাহির করিয়া না দিলে আজকে জ্যান্ত কবর দিবো। এই সমস্ত বার বার প্রশ্ন করে এবং রাইফেলের বাঁট দ্বারা সমস্ত শরীরের সব জায়গায় বেদম প্রহার করিতে থাকে। বেদম মারের চোটে আমাকে অজ্ঞান করিয়া ফেলে এবং তারপর তাহারা আমার বাড়ি হইতে চলিয়া যায়। আমার বাবা ঐ তারিখে বাড়িতে ছিলেন না। পাড়ার প্রতিবেশী মোঃ কালামিয়া, আবদুল গণি এবং আরো অনেকে তৎক্ষণাৎ আমার বাড়িতে আসে। আমাকে অজ্ঞান অবস্থায় দেখিয়া মাথায় পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি ঢালে এবং জ্ঞান ফিরিয়া আসিলে তাড়াতাড়ি মাইজদি সদর হসপিটাল লইয়া আসে এবং ভর্তি করিয়া দেয়। সদর হসপিটালেই থাকি এবং বেশ কিছুটা আরোগ্য হই। আরোগ্য হওয়ার পর বাড়ি চলিয়া আসি। বাড়ি আসিয়া দেখি কাজকর্ম সম্পূর্নভাবে করিতে পারিনা। রৌদ্রের ভেতর কিছুক্ষণ কাজ করিলে মাথা ঘুরাইয়া পড়িয়া যাই। তারপর আমার গ্রামের ডাক্তার মোঃ নবাব আলীও চিকিৎসা করিয়াছেন

স্বাক্ষর/-
মোঃ ছিদ্দিক উল্লাহ।

গুরু গোলাপ
<৮,২.৪.২৪৬,৩০৩> “নারীদের উপর অত্যাচার হইতে বিরত থাকার জন্য পাকবাহিনীকে বিশেষভাবে অনুরোধ করা হয় এবং ধর্মেরও দোহাই দেয়া হয়। ইহাতে ক্ষুব্দ হইয়া পাক বাহিনী আমাকে কাফের বলিয়া বেদম ভাবে প্রহার করে”

মোঃ হাবিবুর রহমান
গ্রাম- মনিপুর
থানা-পরশুরাম
জেলা- নোয়াখালী।

জুলাই মাসের ১৫ তারিখ একদল পাক বাহিনী অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত হইয়া মনিপুর গ্রামের উপর আক্রমণ চালায়। আক্রমণের প্রথম ভাগে মুক্তিবাহিনীর লোকেরা তাহাদের আক্রমণের জবাব দেয়। কিন্তু তাহাদের প্রবল আক্রমণের মুখে টিকিতে না পারিয়া ভারতের রাজনগর শিবিরে প্রস্থান করে। ক্রুদ্ধ পাক বাহিনী স্থানীয় বিশিষ্ট আওয়ামীলীগ কর্মী মি. আমান উল্লাহর বাড়ি জ্বালাইয়া দিয়া আমার বাড়ির দিকে প্রবেশ করে। পাক বাহিনীর ভয়ে গ্রামের ৫ জন সুন্দরী রমণী আমার বাসগৃহে আত্মগোপন করিয়াছিল। পাক বাহিনী তল্লাশী চালাইয়া তাহাদিগকে ধানের গোলার নিচে ও ঘরের কারের হইতে জোরপূর্বক টানিয়া বাহির করে। পাক সৈন্যরা সংখ্যায় ছিল ১২ জন। তাহারা উক্ত নারীদের উপর দীর্ঘ ৫ ঘন্টা যাবৎ অতি বর্বরভাবে অত্যাচার চালায়। তাহাদের অত্যাচারে সকলেই জ্ঞান হারাইয়া ফেলে। পরে পাক বাহিনী পরশুরামে ফিরিয়া আসে। পাক বাহিনী প্রস্থানের পর স্থানীয় জনসাধারণ মাথায় পানি ঢালিয়া রমণীদের জ্ঞান ফিরাইয়া আসে।

পাক বাহিনী যখন অসহায় নারীদের উপর অত্যাচার করিবার চেষ্টা করে, তখন তাহাদিগকে অত্যাচার হইতে বিরত থাকার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করা হয় এবং ধর্মেরও দোহাই দেয়া হয়। ইহাতে ক্ষুব্দ হইয়া পাক বাহিনী আমাকে কাফের বলিয়া বেদম ভাবে প্রহার করে এবং আমি জ্ঞান হারাইয়া ফেলিলে পুকুর পাড়ে ফেলিয়া রাখে।

স্বাক্ষর/-
হাবিবুর রহমান।

গুরু গোলাপ
<৮,২.৪.২৪৭,৩০৪>

হাজী ছানু মিয়া
গ্রাম- মির্জানগর
থানা- পরশুরাম
জেলা- নোয়াখালী।

পাক বাহিনী ২৫ শে মে ফেনী হইতে পরশুরাম দখল করিয়া নেওয়ার পর আমাদের ১নং মির্জানগর ইউনিয়নের বহু লোক আত্মরক্ষার জন্য ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে আশ্রয় গ্রহন করে। আমার একমাত্র ছেলে ও ছেলের বধু এবং দুই শিশু সন্তাসহ ত্রিপুরার রাজনগরে আশ্রয় নেয়। আমি ও আমার সহধর্মিণী হালিমা খাতুন বাড়িতে ছিলাম।

প্রায় ২০০ পাক বাহিনী ১০ জুলাই মির্জানগরে প্রবেশ করে এবং সেই দিন মির্জানগর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ও গ্রামের অন্যান্য স্থানে শিবির স্থাপন করিয়া থাকে। রাত্রে পাক বাহিনী গ্রামের নিরীহ নারীদের উপর অত্যাচার করে।

১৫ জুলাই অধিক রাত্রে আমার বাড়িতেও পাক বাহিনী হামলা করে।

১৫ জুলাই রাত্রে মির্জানগর গ্রামের যুবতী বৃদ্ধা কেহই পাক নরপশুদের হাত হইতে রক্ষা পায় নাই। গ্রামের হাঁস, মোরগ, খাসী, ছাগল সবই নিয়া যায়। ভারত সীমান্ত অতি নিকটে বলিয়া মুক্তিযোদ্ধারা মির্জানগরে পাক সৈন্যদের অবস্থান জানিতে পারিয়া ভোর রাত্রে প্রবল আক্রমণ চালায়। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের সম্মুখে টিকিতে না পারিয়া ১৬ই জুলাই সকাল ৯ টায় মির্জানগর ছাড়িয়া পরশুরাম চলিয়া যায়। নরপশুদের শিবির ছাড়িয়া যাওয়ার পর প্রায় প্রত্যেক শিবির হইতে জ্ঞানহীন অবস্থায় মা বোনদিগকে মুক্তিযোদ্ধারা উদ্ধার করে।

স্বাক্ষর/-
হাজি ছানু মিয়া।

গুরু গোলাপ
<৮,২.৪.২৪৮,৩০৫>
আব্দুল মোমেন প্রধান
প্রধান শিক্ষক
দক্ষিণ বল্লভপুর উচ্চ বিদ্যালয়,
ছাগলনাইয়া, নোয়াখালী।

১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চ তারিখে অত্র এলাকায় প্রবেশ করে এবং বল্লভপুর হাইস্কুলে শিবির স্থাপন করে। দক্ষিণ বল্লভপুরের রশিদ উল্লাহ সাহেব বিশিষ্ট আওয়ামীলীগ কর্মী ছিলেন। নভেম্বর মাসের ১লা তারিখে তাহার নিজ বাড়ি হইতে বন্দী করিয়া বল্লভপুর হাইস্কুলে তাহাদের শিবিরে লইয়া যায়। ঘটনার বিবরণে প্রকাশ রশিদ উল্লাহ সাহেবকে ৫ দিন অকথ্যভাবে দৈহিকভাবে নির্যাতন চালানোর পর ১৬ই নভেম্বর তারিখে বল্লভপুর হাইস্কুলের নিকটে জীবন্ত অবস্থায় মাটি চাপা দিয়ে হত্যা করে।

পাক বাহিনী বল্লভপুর গ্রামের প্রত্যেকটি বাড়িই তল্লাশী চালায় এবং প্রতিটি বাড়ি হইতেই টাকা পয়সা, সোনা গহনা ও সঙ্গে বহন করিয়া লইয়া যাইবার মত বস্তু লুণ্ঠন করিয়া লইয়া গিয়াছে। ইহার মধ্যে আওয়ামীলীগ কর্মী ও হিন্দুদের বাড়িঘরেরই বেশী ক্ষতি সাধন করিয়াছে।

ইহা ছাড়াও পাক বাহিনী উক্ত স্কুলের শহীদ মিনারটি ধ্বংস করিয়া ফেলিয়াছে এবং যাবতীয় আসবাবপত্র, লাইব্রেরীর বই – পুস্তক, ছাত্রদের খেলার সরঞ্জামাদি ও বিজ্ঞান গবেষণার যন্ত্রপাতি আগুন দ্বারা জ্বালাইয়া দেয় এবং লুণ্ঠন করিয়া লইয়া যায়। পাক বাহিনী অযথা নিরীহ লোকদের সন্দেহের বশে বন্দী করিয়া তাহাদের শিবিরে লইয়া যায় এবং অকথ্য ভাবে দৈহিক নির্যাতন চালায়।

১৮ ই সেপ্টেম্বর তারিখে আমি নিজ বাড়িতে আমি নিজ বাড়িতে অবস্থানকালে হঠাৎ দেখিতে পাইলাম ৫ জন পাক সেনা তাহাদের শিবির হইতে গ্রামের দিকে আসিতেছে। তখন আমি আত্মরক্ষার্থে বাড়ির পাশে আত্মগোপন করি। এমন সময় আমি স্বচক্ষে দেখিতে পাইলাম যে উক্ত ৫ জন পাক সেনা আমাদের গ্রাম হইতে ৩ জন যুবতী মেয়েকে বন্দী করিয়া তাহাদের শিবিরের দিকে লইয়া যাইতেছে। মেয়ে ৩টি পাক সেনাদের মরণ ছোবল হইতে ছাড়া পাইবার জন্য ভীষণ চিৎকার করিতেছে। নরপশুরা তথাপিও জোরপূর্বক তাহাদের শিবিরে লইয়া যায় এবং প্রায় তিন দিন পাশবিক অত্যাচার চালানোর পর ছাড়িয়া দেয়।

বল্লভপুর হাইস্কুলটির চতুর্পার্শ্বে প্রায় ২৫ টি বদ্ধ পরিখা রহিয়াছে। বদ্ধ পরিখা গুলিতে এখানকার স্থানীয় ও অন্যান্য এলাকা হইতে প্রায় ১৫০জন লোককে পাক সেনারা মাটি চাপা দিয়া রাখিয়াছিল।

স্বাক্ষর/-
আব্দুল মোমেন।

গুরু গোলাপ
<৮,২.৪.২৪৯,৩০৬>

নুর জাহান বেগম
গ্রাম- পূর্ব চর চান্দিয়া
থানা- সোনাগাজী
জেলা- নোয়াখালী।

আমার স্বামী মোঃ আবদুল কুদ্দুস একজন সাধারণ কৃষক। সারাদিন পরের বাড়িতে কাজ করিয়া জীবিকা নির্বাহ করে। পাক বাহিনী সোনাগাজী থানায় শিবির স্থাপন করিলে আমরা আত্মরক্ষার জন্য পার্শ্ববর্তী এলাকায় চলিয়া যাই এবং বেশ কিছু দিন আত্মগোপন করিয়া থাকি।

১৫ ই অক্টোবর তারিখে মুক্তিবাহিনী সোনাগাজী থানা দখল করিলে আমরা নিজ বাড়িতে চলিয়া আসি। কিন্তু মুক্তিবাহিনী পরবর্তী সময়ে আর সোনাগাজী থানা দখলে রাখিতে পারিল না। তাহারা পাক বাহিনীর প্রবল আক্রমণের সামনে টিকিয়া থাকিতে না পারিয়া এ এলাকা ছাড়িয়া দিয়া বিভিন্ন জায়গায় আত্মগোপন করে।

উক্ত থানায় পাক সেনারা মুক্তিবাহিনীদের বিতাড়িত করিয়া পুনরায় স্থানীয় শিবির স্থাপন করে এবং পার্শ্ববর্তী এলাকা তছনছ করিয়া লয়। তাছাড়া পাক বাহিনীরা রাজাকারদের সহায়তায় বিভিন্ন গ্রামে অগ্নিসংযোগ করে।

২৫ শে অক্টোবর তারিখে কয়েকজন পাক সেনা রাজাকারসহ আমাদের গ্রামে জোর তল্লাশী চালায়। তন্মধ্যে তিন জন পাক সেনা এক জন রাজাকার বাড়ির আনাচে-কানাচে তন্নতন্ন করিয়া মুক্তিবাহিনী ও আওয়ামীলীগ কর্মীদের খুঁজিয়া বেড়াইতেছিল। তখনোও আমি আমার মা বাপের হাত ধরিয়া পালাইয়া আসি। আমাদের বাড়ির চারদিকে খোঁজার পর আমাদের ঘরের মধ্যে প্রবেশ করার ভাব দেখিয়া আমি বাপ- মায়ের হাত ছাড়িয়া চৌকির নিচে আত্মগোপন করি। তারপর পাক বাহিনী আমাদের ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে এবং বাপ মাকে উর্দুতে প্রশ্ন করে। কিন্তু বাপ-মা তাঁহার কিছুই উত্তর না দেওয়ায় আমার বাবার উপর রাইফেল দ্বারা বেদম প্রহার করে। আমাদের ঘর তন্নতন্ন করিয়া খোঁজার পর আমাকে চৌকির নিচ হইতে টানিয়া বাহির করে। প্রথমে আমি খুব চিৎকার করিয়া উঠি, চিৎকার শুনিয়া আমার বাপ-মা তাহাদের পা জড়াইয়া ধরে এবং আমিও তাহাদের অনেক অনুনয় বিনিয় করি। কিন্তু কিছুতেই তাহারা আমাদের কথায় কর্ণপাত করে না। পরে আমার বাপ-মাকে জোর করিয়া ঘর হইতে বাহির করিয়া দরজা আটকায় ফেলে। প্রথমে আমি তাহাদেরকে পা জড়াইয়া ধরিলে লাথি মারিয়া ফালাইয়া দেয় এবং আমার উপর নির্মমভাবে পাশবিক নির্যাতন চালায়। এইভাবে ৩ জন পাক সেনা আমার উপর অকথ্য অত্যাচার করার পর আমি সম্পূর্ন জ্ঞান হারাইয়া ফেলি। তারপর আমাকে ফেলিয়া চলিয়া যায়। বাপ-মা পরে আসিয়া আমাকে মাথায় পানি ঢালিয়া জ্ঞান ফিরাইয়া আনে। এইভাবে কয়েকদিন পর ঐ তিন জন পাক সেনা আসিয়া আমাদের উপর পাশবিক অত্যাচার ও নির্যাতন চালায়। আমাদের বাড়িতে যে তিন জন পাক সেনা ও কয়েকজন রাজাকার আসিয়া অত্যাচার চালাইছে তন্মধ্যে একজন ছিল আমার পরিচিত।

টিপসহি /-
নুর জাহান বেগম।

গুরু গোলাপ
<৮,২.৪.২৫০,৩০৭-০৮> “১৭ ই অক্টোবর রাত্রে তারাবীর নামাজ পড়া অবস্থায় মসজিদের ভেতরে আমাকে গ্রেফতার করা হয়।“

ডাঃ মোঃ ইদ্রিস মিয়া
মেডিক্যাল অফিসার
সোনাগাজী পল্লী উন্নয়ন কেন্দ্র
বোয়ালখালী, চট্টগ্রাম।

১৩ ই এপ্রিল চট্টগ্রাম সেনানিবাস হইতে বহু পাক সৈন্য আসিয়া রাঙ্গুনিয়া দখল করে ও রাঙ্গুনিয়া কলেজে শিবির করিয়া থাকে। সেই দিন আমিও প্রথমে ভয়ে রাঙ্গুনিয়া শহর ত্যাগ করিয়া চলিয়া যাই আবার বিকালে হাসপাতালের দিকে আসি। তখন হাসপাতালে কেহই ছিল না। প্রচুর ঔষধ ও বহু জিনিসপত্র ছিল। আমি সেই রাত্রে একাই হাসপাতালে রাত্রি কাটাইলাম।

১৪ই এপ্রিল সকালে শহরের অবস্থা ভালোই দেখা গেল। পাক সেনারা তখন কাহারো উপর কোন খারাপ ব্যবহার করিতেছে না দেখিয়া আমার স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে দিগকে গ্রাম হইতে বাসায় নিয়া আসিলাম।

কিন্তু সেই দিন গভীর রাত্রে ৪ জন সেনা আমার রাঙ্গুনিয়া পল্লী স্বাস্থ্য কেন্দ্রের বাসায় আসিয়া দরজা খুলিতে বাধ্য করে এবং তাহারা বলে যে তোমার বাসা হইতে গুলির আওয়াজ শুনা গিয়াছে। তোমার বাসায় রাইফেল আছে কিনা তাহা আমাদের পরীক্ষা করিতে হইবে বলিয়া ৪ জন পাক সৈন্য আমার বাসায় ঢুকিয়া পড়ে এবং আমার হাতের ঘড়ি ও আমার ভায়রা ভাইয়ের হাতের ঘড়ি ও ট্রানজিস্টারটি পাক সৈন্যরা হাতে নিয়া নেয়। আমার বাসায় আমার লাইসেন্সভুক্ত একটি বন্দুক ছিল তাহাও তাহারা চিনিয়া নেয়। বন্দুক লওয়ার পর আমাকে ও আমার ভায়রা ভাইকে দু’জন পাক সৈন্য বাসা হইতে বাহির করিয়া নিয়া গেল। আমাদিগকে পাক নরপশুরা হাত উপরের দিকে উঠাইতে বলিল এবং আমাদিগকে যে গুলি করিয়া হত্যা করিবে তাহা বুঝিতে আর দেরী হইলো না।
বহু অনুরোধ করিয়া বলিলাম আমরা মুসলমান, কলেমা পাঠ করিলাম, কোরআনের সুরা পাঠ করার পর রাইফেলের বাট দিয়া প্রহার করিয়া বলিল, আমাদিগকে গাড়িতে উঠাইয়া দিয়া আস। তাহাদের কথা মত পাক নরপশুদিগকে গাড়িতে উঠাইয়া দিয়া আসিলাম।

১৫ ই এপ্রিল পাক বাহিনীর লেঃ সেলিম আমার অফিসে আসে এবং সবসময়ের জন্য হাসপাতাল খোলা রাখার নির্দেশ দিল এবং আমার উপর কোন জুলুম হইবেনা বলিয়া আশ্বাস দিল।

এদিকে মুক্তিবাহিনীর আক্রমন দিন দিন বাড়তে থাকে। আহত মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা আসিয়া এখানে চিকিৎসা করিত এবং সপ্তাহে ২/৩ বার সেন্টার পরিদর্শনের নামে বনের ভেতরে মুক্তিবাহিনীর শিবিরে আহত মুক্তিযোদ্ধা ভাইদের চিকিৎসা করিতাম এবং প্রয়োজন মোতাবেক ঔষধপত্র মুক্তিবাহিনীর শিবিরে পাঠাইতাম। আমার সহিত পত্র যোগাযোগ হইতো রাঙ্গুনিয়ার মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার চেয়ারম্যান নজীর আহমদের। এভাবে স্বাধীনতা চলার সহিত আমার ও সংগ্রাম চলিতে থাকে।

১৭ ই অক্টোবর রাত্রে তারাবীর নামাজ পড়া অবস্থায় মসজিদের ভেতরে আমাকে গ্রেফতার করা হয়। আমাকে লেঃ সেলিমের শিবিরে নেয়া হয়। পরের দিন আর্মির ‘মার্শাল ল’ কোর্টে ক্যাপ্টেন ইসহাক পারভেজের নিকট হাজির করা হয়। বিচারে হাজিরের পুর্বে কোর্টের সম্মুখে একজন সুবেদার আমাকে বেদম প্রহার করে এবং ভারতের দালাল বলিয়া ক্যাপ্টেন ইসহাকের নিকট হাজির করে। সেখানে লেঃ সেলিম আমাকে লক্ষ করিয়া বলে উক্ত ডাক্তার মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা করে ও ভারতের হাসপাতাল হইতে ঔষধ পাঠায়। সেই সময় চেয়ারম্যান নজীর আহমদ লিখিত একখানা পত্র বাহির করিয়া ক্যাপ্টেন ইসহাক পারভেজের নিকট পেশ করে এবং বলে কাফের নজীর আহমদের সাথে এই ডাক্তারের যোগাযোগ আছে। সেই সময় একজন মুক্তিবাহিনী হইতে সারেণ্ডার করা যুবক রাজাকার সাক্ষী দেয়। এই পত্র আমার মারফতে নজীর আহমদ দিয়াছে। আমি সম্পূর্ণভাবে এই চিঠি সম্বন্ধে অস্বীকার করি। তখন ক্যাপ্টেন পারভেজ আসিয়া কানে গালে চড় দেয় এবং লেঃ সেলিম ও ক্যাপ্টেন পারভেজ হাত ও বুট দিয়া বেদম প্রহার করিয়া আমাকে বাহিরে ফেলিয়া দেয়। তখন আমার জ্ঞান ছিলনা, প্রায় একঘণ্টা পরে জ্ঞানহীন অবস্থায় সামরিক জেলখানায় পাঠানো হয়। সাথে সাথে আরম্ভ হয় দৈহিক নির্যাতন। প্রতিদিন সকাল বিকাল বেদম প্রহার করা হইতো এবং বলিত ভারতের সহিত এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সহিত যোগাযোগ আছে কিনা।

এভাবে ৪ দিন চলিয়া গেল, বাসায় কোন সংবাদ দিতে পারিলাম না যে, আমি এখনো বাঁচিয়া আছি। পরে একজন সিপাহীর মারফতে খবর দিলাম আমার ভায়রা ভাইয়ের নিকট। আমাদের প্রায় ৮০ জনকে ছোট একটি কক্ষে আলোহীনাবস্থায় রাখিত। দিবারাত্রে নির্দিষ্ট সময় ব্যতিত প্রস্রাব,পায়খানাও করা যাইতোনা। আমার ডায়াবেটিস রোগ, আমার কিছুক্ষন পর পর প্রস্রাব করিতে হয়, কিন্তু প্রস্রাবের কথা বলিলেও তাহারা দরজা খুলিত না। মাঝে মাঝে প্রস্রাবের চাপে জ্ঞানহীন হইয়া পড়িতাম। আমার সংবাদ পাইয়া আমার স্ত্রী, আত্মীয়স্বজন রাঙ্গুনীয়ার জনসাধারণ আমার মুক্তির জন্য বিশেষ চেষ্টা করে। পরে তিন হাজার টাকা পশ্চিম পাকিস্তানি পুলিশকে দিয়া ঈদের আগেত দিন রাত্রে নরপশুদের কবল থেকে মুক্তি পাই। কিন্তু তাহাদের নির্যাতনে আমার হাতের আঙ্গুল ভাঙ্গিয়া যায় এবং কানের পর্দা ফাটিয়া যায়।

স্বাক্ষর/-
ডাঃ মোঃ ইদ্রিস মিয়া।

গুরু গোলাপ
<৮,২.৪.২৫১,৩০৯> “এইভাবে সাত জন পাক সেনাই আমার শরীরের উপর পাশবিক অত্যাচার চালায়।“

মোছাঃ পিয়ারা খাতুন
গ্রাম- পূর্ব চর চান্দিয়া
থানা- সোনাগাজী
জেলা- নোয়াখালী।

আমার পিতা একজন সামান্য কৃষক, সারাদিন পরের বাড়িতে শ্রম বিক্রয় করিয়া কোন রকমে সংসার চালায়। পাক বাহিনী আমাদের সোনাগাজী থানায় শিবির স্থাপন করিলে আমরা আত্মরক্ষার জন্য অন্য এলাকায় চলিয়া যাই এবং দেড় মাসের মত আত্মগোপন করিয়া থাকি।

১৫ ই অক্টোবর তারিখে মুক্তিযোদ্ধারা সোনাগাজী থানা দখল করিলে আমরা পুনরায় নিজ বাড়িতে চলিয়া আসি। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা পরবর্তী সময়ে আর সোনাগাজী থানা দখলে রাখিতে পারিলো না। তারা পাক বাহিনীর প্রবল আক্রমণে টিকিয়া থাকিতে না পারিয়া পল্লী গ্রামের আনাচে কানাচে আত্মগোপন করে।

মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের বাড়িতে আশ্রয় লয় এবং আমি তাহাদের নিজ হাতে রান্না করিয়া কয়েকদিন খাওয়াই। মুক্তিযোদ্ধাদের এই রুপ আশ্রয় দেওয়ার সংবাদ কয়েকজন দালাল পাক বাহিনীর নিকট পৌছায়। পাক সেনারা উক্ত সংবাদ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন রাজাকার সহ ৭জন পাক সেনা রমযান মাসের ৫ তারিখে আমাদের গ্রামে আকস্মাৎ আক্রমণ করে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের তল্লাশী করিতে থাকে। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে উক্ত দিনের পূর্বেই মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের বাড়ি ত্যাগ করিয়া অন্য গ্রামে আশ্রয় লইয়াছিল। পাক সেনারা এবং রাজাকাররা অনেক খোঁজাখুজির পর যখন মুক্তিযোদ্ধাদের না পায় তখন গ্রামে লুটতরাজ আরম্ভ করে এবং আওয়ামীলীগ কর্মী ও হিন্দুদের বাড়িতে অগ্নীসংযোগ করিতে থাকে।

পাক বাহিনীদের বিভিন্ন বাড়িতে অগ্নীসংযোগ করার ফলে প্রায় সমস্ত গ্রামে ছড়াইয়া পড়ে, তখন আমি ভয়ে আমার পিতার সঙ্গে অন্য গ্রামে পালাইবার চেষ্টা করি। কিন্তু বাড়ি হইতে বাহির হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই একজন রাজাকার আমাকে আমার পিতার হাত হইতেই চিনাইয়া লয় এবং পাক বাহিনীর নিকট সমর্পণ করে। আমার পিতাকে বেদম প্রহার করিবার পর তাহাকে একটা গাছের সহিত রশি দ্বারা বাঁধিয়া রাখে। এই দিকে আমি খুব চিৎকার আরম্ভ করি। কিন্তু নরপশুরা আমার কথায় একটুও কর্ণপাত করিল না, তাহারা হিংস্র দানবের মত আমার শরীরের উপর ঝাঁপাইয়া পড়ে। এইভাবে সাত জন পাক সেনাই আমার শরীরের উপর পাশবিক অত্যাচার চালায়। আমি অজ্ঞান হইয়া পড়িলে তাহারা আমাকে ফেলিয়া রাখিয়া যায়। প্রায় ১০ঘন্টা পর জ্ঞান ফিরিয়া পাই এবং সুস্থ্যবোধ করি। পরের দিন বেলা ১০ টার সময় আবার পুনরায় উক্ত রাজাকারের চক্রান্তে আরো তিন জন পাক সেনা আমাদের বাড়িতে আসে এবং আমার শরীরের উপর পাশবিক অত্যাচার চালায়।

টিপসহি /-
মোছাঃ পেয়ারা খাতুন।

গুরু গোলাপ
<৮,২.৪.২৫২,৩১০>

ছালেহ্ আহমদ
গ্রাম- চর চান্দিয়া
থানা- সোনাগাজী
জেলা- নোয়াখালী।

২৫ শে মার্চের সময় একটা ধারণা ছিল যে, হানাদার বাহিনীরা এই নতুন এবং অচেনা, অজানা দেশে আসিয়া টিকিতে পারিবে না। সেই জন্য প্রথম দিকে ভারত যাই নাই। অবশ্যই প্রথম দিকেই ভারত যাইতে পারিতাম। কিন্তু যখন বাংলাদের মধ্যে রাজাকার, আলবদর ও হানাদার বাহিনী বিভিন্ন পল্লীর আনাচে-কানাচে ছড়াইয়া পড়িল তখন আমাদের ভারতে যাওয়া সম্ভব হইলো না। আমরা দেশের পরিস্থিতি ভাল না দেখিয়া দুরে এক আত্মীয় বাড়িতে আশ্রয় লই। আমাদের আত্মীয় বাড়িতে থাকার গোপন সংবাদ কয়েকজন রাজাকার জানিতে পারায় আমাদের তল্লাশের জন্য যায় এবং আমাদেরকে জুলাই মাসের ২৭ তারিখে ধরিয়া ফেলে। সেখান হইতে বন্দী করিয়া আমাদের চার জনকে সোনাগাজী থানায় লইয়া আসে। বহু ভয়ভীতি দেখায় যে, রাজাকারে নাম না দিলে স্থাবর অস্থাবর সব সম্পত্তি আমরা ভোগ করিবো। তাছাড়া থানায় লইয়া আসিয়া ১৫,০০০ টাকার বন্ড সই করিয়া লয় এই মর্মে যে আমাদের এলাকায় থাকিতে হইবে এবং রাজাকার ও শান্তি কমিটিতে নাম দিতে হইবে।

আমরা বন্ড সই করিয়াছি কিন্তু রাজাকার ও শান্তি কমিটিতে নাম দেওয়ার প্রশ্নে মুখে সবসময় অস্বীকার করিয়াছি। তারপর আমাদিগকে সোনাগাজী থানার সি এণ্ড বির গেস্ট হাউজে লইয়া আসে এবং মাথা নিচের দিকে রাখিয়া পা উপরের দিকে শুণ্য করিয়া রাখে। বেত ও বন্দুকের বাঁট দ্বারা বেদম প্রহার করে। আমরা চিৎকার বা কান্নাকাটি আরম্ভ করিলে আরো বেশি বা জোরে আঘাত করে। এইভাবে আমাদেরকে ৫/৭ দিন অত্যাচার বা শাস্তি দিতে থাকে। তাহা ছাড়া মাঝে মাঝে বুট দ্বারা লাথি মারে। তথাপি আমরা রাজাকার বা শান্তি কমিটি করিতে রাজি হই নাই।

আমরা কয়েকজন রাজাকারকে গোপনে কিছু টাকা দেওয়ার স্বীকার হইলাম। তারপর আমাদের নিকট হইতে ৫০০ টাকা আমাদেরকে জুলুম ও অত্যাচার হইতে রেহায় দেয়। তারপর আমরা আর বাড়ি ঘরে থাকিলাম না।

দেশ স্বাধীন হইলে আমরা আমাদের বাড়ি ফিরিয়া আসি। বাড়ি ফিরিয়া দেখি বাড়ির আসবাবপত্র রাজাকার ও হানাদার বাহিনীরা লুটতরাজ করিয়া লইয়া গিয়াছে।

স্বাক্ষর/-
ছালেহ্ আহমদ।

গুরু গোলাপ
<৮,২.৪.২৫৩,৩১১>

মোঃ আব্দুল হাদি।
গ্রাম- পূর্ব চর চান্দিয়া
থানা- সোনাগাজী
জেলা- নোয়াখালী।

পাক বাহিনী যখন সোনাগাজী থানা এমনকি বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গা দখল করিয়া বসিল তখন আমি আমার পরিবার সহ সোনাগাজী থানার পূর্ব চর চান্দিয়া গ্রাম হইতে আত্মরক্ষার জন্য দূরবর্তী আত্মীয় বাড়িতে আশ্রয় লইয়া প্রায় এক মাস অতিবাহিত করি। কিন্তু মুক্তিবাহিনীরা হঠাৎ করিয়া প্রবল আক্রমণ চালাইয়া সোনাগাজী থানা শত্রুমুক্ত করে এবং পাক বাহিনী ও রাজাকারদের বিতাড়িত করে। এইভাবে মুক্তিবাহিনী প্রথমে উক্ত সোনাগাজী থানা শত্রু মুক্ত করে। তখন আমি আমার আত্মীয় বাড়ি হইতে পরিবার সহ আমার নিজ বাড়িতে আসি। বাড়িতে কয়েকদিন অবস্থানের পর পাক বাহিনী ও রাজাকার বাহিনী চারদিক হইতে সোনাগাজী থানায় মুক্তিযোদ্ধাদের ঘেরাও করে এবং প্রবল আক্রমণ চালায়। এই প্রবল আক্রমণের সম্মুখে মুক্তিবাহিনী নাজেহাল হয়ে পড়ে ও রাজাকার বাহিনী সোনাগাজী থানা দখল করে। সোনাগাজী থানা দখল করার পর থানার পার্শ্ববর্তী গ্রাম গুলি তল্লাশী চালাইয়া মুক্তিবাহিনীদের বাহির করার জন্য তাহারা ছড়াইয়া পড়ে।

৫ই রোযার দিনে রাজাকার ও পাক বাহিনী পূর্ব চর কান্দিয়া গ্রামে প্রবেশ করে। পূর্ব চর চান্দিয়া গ্রামের জনসাধারণ প্রাণের ভয়ে বাড়িঘর ছাড়িয়া পলায়ন করে। আমিও পাক বাহিনীদের আসা দেখিয়া বাড়ির পুরুষ মানুষ সব বাড়ি ছাড়িয়া আত্মরক্ষা করি। পাক হানাদার বাহিনীরা যুবক ছাত্র দেখিলে মুক্তিযোদ্ধা বলিয়া সন্দেহজনকভাবে গুলি করিয়া হত্যা করে। কিন্তু আমার বাড়ির পরিবারবর্গ বাড়ি হইতে বাহির করবার সময়টুকু পাই নাই। তাই বাড়িতে নিজের স্ত্রীকেও ফেলিয়া বাড়ি হইতে বাহির হইয়া পড়ি। তারপর বাড়ির কোন খোঁজ খবর লইতে পারি নাই। পাক হানাদার বাহিনীরা বাড়ি তল্লাশী করিয়া চলিয়া গেলে বাড়ি রওয়ানা হই। বাড়ি গিয়া দেখি যে আমার স্ত্রী অজ্ঞান অবস্থায় পড়িয়া আছে। পাশে আমার মা তাহার মাথায় পানি ঢালিতেছেন। আমিও আসিয়া মাথায় পানি ঢালি। আমার স্ত্রীর জ্ঞান ফিরিয়া আসে। তারপর আমার স্ত্রীকে অনেক কিছু জিজ্ঞাসা করি। আমার স্ত্রী আমাকে কয়েকজন রাজাকার ও ৩ জন পাক বাহিনী আমাদের বাড়ির মধ্যে ঢুকে এবং বাড়ির আনাচে-কানাচে খোঁজাখুজি আরম্ভ করে। তখন আমি আমার মার হাত ধরিয়া বাড়ির পিছনে ঝোপের আড়ালে দাঁড়াইয়া আছি। রাজাকার ও পাক হানাদার বাহিনীরা আমাদের ঘরের মধ্যে তন্নতন্ন করিয়া তল্লাশী করে ও বাড়ির পিছে যায় এবং আমার মাকে প্রথমে দেখিতে পায় এবং পরে আমাকেও দেখিয়া ফেলে। প্রথমে একজন পাক হানাদার আমার মার হাত হইতে আমাকে ছিনিয়া আনে এবং জোরপূর্বক টানিয়া ঘরের মধ্যে লইয়া যায়। আমার মা অনেক অনুরোধ ও কান্নাকাটি করিতেছেন। আমি অনেক অনুনয় বিনয় ও চিৎকার করিতেছি কিন্তু কিছুতেই পাক হানাদার বাহিনীরা আমার এবং আমার মার কোন কথায় কর্ণপাত করিল না। বরং আমার মাকে ঘর হইতে বাহির করিয়া দরজা আটকাইয়া দিল এবং দুই জন পাক হানাদার দরজায় পাহারা দিতে লাগিল। প্রথম জন আমাকে পাইয়া আনন্দে আত্মহারা হইয়া গেল এবং আমাকে অমানুষিক উপায়ে আমার শরীরের উপর দৈহিক নির্যাতন চালাইলো। এইভাবে পর পর তিন জন নরপশু আমার শরীরের উপর নির্মমভাবে নির্যাতন করে এবং পরে জ্ঞান হারাইয়া গেলে আমাকে ফেলিয়া চলিয়া যায়। এইভাবে আমাকে দুইবার আমার শরীরের উপর নির্মমভাবে পৈশাচিক উপায়ে অত্যাচার করে।

স্বাক্ষর/-
মোঃ আব্দুল হাদি।

গুরু গোলাপ
<৮,২.৪.,২৫৪,৩১২>

আলেয়া বেগম
গ্রাম- বাঘেরিয়া
থানা- সোনাগাজী
জেলা- নোয়াখালী।

পাক বাহিনী সোনাগাজী ও মতিগঞ্জে শিবির স্থাপন করিয়া স্থানীয় দালাল ও রাজাকারদের সহায়তায় আশেপাশের গ্রামগুলি আক্রমণ করিত। হঠাৎ গ্রামে প্রবেশ করিয়া ধনরত্ন লুট করিত এবং অসহায় নারীদের উপর চালাইত নির্মম অত্যাচার। পাক বাহিনীর অত্যাচারের ভয়ে উক্ত এলাকার প্রায় সকল যুবক-যুবতীগণ নিজ বাড়ি ছাড়িয়া কেহ ভারতে এবং অন্যেরা সূদুর গ্রামে আত্মীয়-পরিজনের বাড়িতে আশ্রয় গ্রহন করে।

জুন মাসে পাক বাহিনী সোনাগাজী থানা দখল করিলে আমি আমার স্বামীর বাড়ি ত্যাগ করিয়া সূদুর পল্লী গ্রামে পালাইয়া ছিলাম। আগস্ট মাসে আমি নবজাত সন্তান প্রসব করি। সন্তান প্রশবের দুই মাস পর শরীর অসুস্থ্য থাকায় পিতার বাড়ি হইতে স্বামীর বাড়ি বাঘেরিয়ায় আশ্রয় নিই। তখন আমার স্বাস্থ্য অত্যান্ত দুর্বল ছিল। আমি তখন নিয়মিত ডাক্তারের ঔষধ ব্যবহার করিতাম।

অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে পাক বাহিনী, দালাল, রাজাকার, আল-বদর, আল-শামসের অত্যাচার খুব বৃদ্ধি পায়, পাক বাহিনীর গ্রামে প্রবেশ করার সংবাদে গ্রাম ছাড়িয়া অন্য গ্রামে আত্মগোপন করিতাম।

নভেম্বর মাসের ১৫ তারিখে পাক বাহিনী ও মিলিশিয়া আমার স্বামীর বাড়ি আক্রমণ করে। পাক বাহিনীরা আমাকে ধরিয়া ফেলে এবং হাত হইতে নবজাত সন্তানকে মাটিতে ফেলিয়া দিয়া সেখানেই পশুর মত অত্যাচার করে। তাহাদের অত্যাচারে আমি জ্ঞান হারাইয়া ফেলি। অনুমান ৪/৫ জন নরপশু আমার অসুস্থ্য দেহের উপর পাশবিক অত্যাচার করিয়া আমাকে জ্ঞানহীন অবস্থায় ফেলিয়া চলিয়া যায়। পরে আমার স্বামী অন্যান্য আত্মীয়স্বজন স্থানীয় ডাক্তারের সহায়তায় জ্ঞান ফিরাইয়া আনে।

স্বাক্ষর/-
আলেয়া বেগম।

গুরু গোলাপ
<৮,২.৪.২৫৫,৩১৩>

এডভোকেট সুরেন্দ্র চৌধুরী
জিন্দাবাজার, সিলেট।

২৬ শে মার্চ ভোর বেলা হইতেই পাক বর্বর হায়েনার দল সিলেট শহরে কারফিউ জারি করে। মাঝে মাঝে জনসাধারণের কাজকর্মের জন্য সময় দিত। কিন্তু ৪ ঠা এপ্রিল রোজ রবিবার হইতে কারফিউ আরো জোরদার করা হয়। এই সময় তাহারা এমনো করিতো যে অনবরত তিন দিন পর্যন্ত কারফিউ জারি করিয়া রাখিত।

৪ঠা এপ্রিলে তৎকালীন ন্যাশনাল ব্যাংকের সিলেট শাখার কর্মরত পুলিশের সহিত আলাপ হয়। তাহাদের মনে পুর্ব হইতেই এই সন্দেহ জাগিয়া ছিল যে হায়েনার দল ব্যাংক লুট করিতে পারে এবং তাহাদেরকে হত্যা করিতে পারে। তাই তাহারা আমাকে বলে যে যদি পাক বাহিনী আমাদের আক্রমণ করে, তাহা হইলে আমাদেরকে আশ্রয় দিবেন। আমি তখন তাহাদের এই আশ্বাস দেই যে, তোমরা যদি বিপদে পড়িয়া আমার বাসায় যাও, তাহা হইলে আমি তোমাদেরকে আশ্রয় দিবো। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ ঐ দিন বেলা ১ ঘটিকার সময় উক্ত ব্যাংক প্রহরীদেরকে বদলী করিয়া অন্য জায়গায় পাঠায় এবং সেখানে অন্য একটি প্লাটুন কাজের দায়িত্ব গ্রহন করে।

ন্যাশনাল ব্যাংক অফিসটি আমার বাড়ি হইতে প্রায় ১০০ শত গজ দুরে। ঐদিন বেলা ৩ ঘটিকার সময় পাক সৈন্য ভর্তি ৩ খানা ট্রাক ও ৪খানা জীপ ব্যাংকের সামনে দাঁড়ায়। তারপর ট্রাক হইতে প্রায় ৫০ জন পাক সৈন্য ব্যাংকের চারদিকে পজিশন নেয়। বাকি কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মচারী আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করিয়া ব্যাংকের উত্তর দিকে লোহার তার নষ্ট করিয়া ফেলে। পর মূহুর্তেই তাহারা ব্যাংকের ভেতর প্রবেশ করে। উক্ত সময় প্রহরারত পুলিশগণ চিৎকার করিতে থাকে। তখন বর্বর বাহিনী প্রহরারত পুলিশদিগকে হত্যা করিয়া তাহাদের অস্ত্রগুলি নিজেদের হস্তগত করে। বিকাল ৪ ঘটিকার সময় কারফিউ জারি করিয়া ব্যাংক হইতে পার ৬-৭ বস্তা টাকা ট্রাকে উঠাইয়া লইয়া যায়। উক্ত দিনে ৪৮ ঘন্টা কারফিউ থাকায় জনগণ বাহির হইতে পারে নাই। তাই অনেকে টাকা নেওয়া সম্বন্ধে কিছুই জানেনা।

স্বাক্ষর/- সুরেন্দ্র চৌধুরী
১৩/৯/৭৩

গুরু গোলাপ
<৮,২.৪.২৫৬,৩১৪>

ডঃ আব্দুল লতিফ।
গ্রামঃ ছিরামিসি
থানাঃ বিশ্বনাথ
জেলাঃ সিলেট।

৩১ অগাস্ট রোজ মঙ্গলবার সময় ৯ঘটিকার সময় আনুমানিক ১৫ জন পাক সেনা ও সমপরিমাণ রাজাকার ছিরামিসি বাজারে আসে। তাহার পূর্বে ঐ বাজারে পাক সৈন্য আসে নাই। রাজাকার কমাণ্ডার স্কুলের শিক্ষক, পোষ্ট অফিস ও তহসীল অফিসের কর্মরত লোকজন সকলকেই ছিরামিসি হাইস্কুলে যাইবার জন্য আদেশ দিল। সেখানে শান্তি কমিটি গঠন করা হইবে। নিরীহ জনগণ ভয়ে বিদ্যালয়ে উপস্থিত হইল। কয়েক মিনিট আলাপ-আলোচনার পর পাক বাহিনী ছিরামিসি বাজারের লোকদিগকে এক দিকে এবং সরকারি কর্মচারী ও বাহির হইতে আগত লোকদের অপর পার্শ্বে বসাইল। কিছুক্ষণের মধ্যে আমাদেরকে দুইভাগে দুই জায়গায় নিয়া যায়। আমি ঐ জায়গায় প্রায় সাত বৎসর যাবৎ ডাক্তারী করিতেছি। সরকারী কর্মচারীসহ আমাদের বহিরাগত ২৬ জনকে উক্ত স্কুলের প্রধান শিক্ষকের অফিসে নিয়া শক্ত করিয়া দড়ি দিয়া বাঁধিয়া ফেলে এবং আমাদিগকে পার্শ্ববর্তী থানা জগন্নাথপুর নিয়া ছাড়িয়া দিবে বলিয়া ঘর হইতে বাহির করিয়া নৌকায় লইয়া যায়। অপরদিগকে পার্শ্ববর্তী ছিরামিসি গ্রাম ও বাজারের ৩৭ জনকে বাঁধিয়া অপর গ্রামের দিকে লইয়া যায়। আমাদের ২৬ জনকে নৌকাযোগে কচরাকেলী গ্রামে নিয়া যায়। সেখানে আমাদিগকে পুকুরের পাড়ে কিছু পানির মধ্যে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করায়। ঐ সময় আমাদের হাত পিছনের দিকে শক্তভাবে বাঁধা ছিল। দুই দিক হইতে পাক বাহিনী ও রাজাকার গুলি করিতে থাকে। আমি হাত ও পায়ে গুলিবিদ্ধ হইয়া পুকুরের পানিতে ডুব দেই। বহু কষ্টে পুকুরের অপর পাড়ে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় শহীদ লোকদের পার্শ্বে আসি। সেখানে প্রত্যেককে ভালোভাবে লক্ষ করিয়া দেখি সকলেই নরপিশাচদের গুলিতে শাহাদাৎ বরণ করিয়াছে। অপরদিকে ছিরামিসি এলাকার ৩৭ জনকে মাঠে নিয়া অনুরুপ অবস্থায় গুলি করিয়া হত্যা করিয়াছে। আমি আহত অবস্থায় অপর গ্রামে গিয়া আশ্রয় নেই। সেই দিন যাহারা শহীদ হইয়াছে তাহাদের নাম নিন্মে দেয়া হলঃ

আব্দুল বারিক মেম্বার,
আব্দুল লতিফ,
সুন্দর মিঞা,
তহসীলদার ও তাহার দুই ছেলে,
পোষ্ট মাষ্টার ছিরামিসি বাজার,
ছিরামিসি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক,
ছিরামিসি প্রাইমারী স্কুল শিক্ষক একজন,
নজীর আহমদ,
একলাস মিঞা,
দবীর মিঞা,
রুসমত উল্লাহ,
তৈয়ুব আলী,
মোসাদ্দের আলী ও অন্যান্য।

৩১ শে অগাস্ট পাক বাহিনী ও তাহাদের অনুচরগণ ৬৩ জন নিরীহ জনগণকে হত্যা করিয়া ক্ষান্ত হয় নাই। ১লা সেপ্টেম্বর ছিরামিসি বাজার ও গ্রাম জ্বালাইয়া দেয় ও মা-বোনদের উপর পাশবিক নির্যাতন করে।

স্বাক্ষর/-
আব্দুল লতিফ

গুরু গোলাপ
<৮,২.৪.২৫৭,৩১৫>

আকাদ্দাস সিরাজুল ইসলাম
থানাঃ বিয়ানীবাজার
জেলাঃ সিলেট।

পাক বাহিনী একমাত্র বিয়ানী বাজার থানার পশ্চিম পার্শ্বের এক টিলায় ১৭২ জন নিরীহ লোককে নির্মমভাবে হত্যা করে। আজও সেখানে বহু কঙ্কাল পড়ে আছে। একমাত্র সুপাতলা গ্রামে মনোরঞ্জন ঘোষের পরিবারের ১৩ জন লোককে গুলি করিয়া হত্যা করে। নিন্মে কিছু শহীদের নাম দেওয়া হলঃ

মোঃ সিরাজ উদ্দিন-৩৮ (মাথিউরা)
মোঃ আব্দুল মান্নান-৪৭ (খাসা কসবা)
মোঃ তাহির আলী-৬০ (ফতেহপুর)
মোঃ আবুল হুসেন (নিজাম)-১৯ (ফতেহপুর)

একই পরিবারভুক্ত শহীদরা হলেনঃ

শ্রীমনোরঞ্জন ঘোষ -৪৩ (সুপাতলা),
হিরনবালা ঘোষ -৩৭ (ঐ),
মুকুল রঞ্জন ঘোষ -১৮ ছাত্র (ঐ),
অমিতা রাণী ঘোষ -৯ (ঐ),
ক্ষেত্রময়ী ঘোষ -৬৮ (ঐ),
সীতাবালা ঘোষ -৫ (ঐ),
উমানন্দ ঘোষ -৬৫ (ঐ),
চারুবালা ঘোষ -৫০ (ঐ),
মহানন্দ ঘোষ -৫০ (ঐ)
নিখিল চন্দ্র ঘোষ -১২ (ঐ),
কৃষ্ণ মোহন ঘোষ -১০ (ঐ),
বীরেন্দ্র কুমার ঘোষ -৪২ (ঐ),
নরেশ চন্দ্র ঘোষ -৫৮ (ঐ),
কমর উদ্দিন -৩৮ (মাথিউরা),
মোঃ মিছির আলী -৩০ (সুপাতলা),
মোঃ ছলু শিকদার -৪৪ (দুবাগ),
মোঃ আব্দুল হাছিম -২৫ (মাথিউরা),
মোঃ আব্দুল লতিফ -১৩ (ঐ),
গুরু প্রসন্ন দাস -৭২ (জলডুপ কিসমত),
শ্রী রাধারমন দাস -৭০ (জলডুপ-বড়গ্রাম),
শ্রীমাণ দাস -৬২ (ঐ),
মোঃ জামাল উদ্দিন -২২ (খসির কসবা),
মোঃ মকদ্দস আলী -৫০,
ইর্শাদ আলী -৩০ (সারপার),
আরব আলী -১৬ (ঐ),
মোঃ ইউসুফ আলী -৩৫ (নয়াগ্রাম),
নজির আলী -৩৬ (ঐ),
মোঃ তজিদ আলী -৩০ (পুন্নারাই),
মোঃ আইয়ুব আলী -৩৮ (ছাতলপার),
মোঃ আব্দুল রউফ -৩৫ (ইমামপুর),
মোঃ আব্দুল মুহিত -১৮ (মাইজ কাপন),
মোঃ আব্দুস সাত্তার -২০ (বাডুদা),
আব্দুল গফুর -২৫ (ঐ),
মোঃ রাতিবুর চৌঃ -২০(ঐ),
মোঃ মুস্তফা উদ্দিন -২৫ (ঐ),
মোঃ রফিক উদ্দিন চৌধুরী- ৫৫ (ঐ)
রফিক উদ্দিন- ২৫(আষ্টগরি)
আব্দুল লতিফ -৪০ (ঐ),
রাইয়ুব আলীর স্ত্রী -২২ (ঐ),
রাইয়ুব আলীর মেয়ে -৭ (আষ্টগরি),
তৈয়ব আলী -৩৫ (তাজপুর),
আঃ খালিক -১৮ (ঐ),
মুজাম্মিল আলি -৩৫ (বডুদা),
মোঃ মিছির আলী -৪৫ (ঘুঙ্গাদিয়া),
মোঃ মনোহর আলি -৪০ (ঐ),
মোঃ আকবর আলী -৩৫ (ঐ),
মোঃ গোলাম ছরওয়ার -৪০ (সারপার),
মোঃ ওয়াতির আলী -৪০ (পাথারি পাড়া),
আয়রুন বিবি -২ (ছফলা),
মো; ইয়াজ -৭২ (চুড়খাই),
মনোহর আলী (ঘুঙ্গাদিয়া) ।

স্বাক্ষর/-
আকাদ্দাস সিরাজুল ইসলাম
২৪.৯.৭৩

গুরু গোলাপ
<৮,২.৪.২৫৮,৩১৬-১৭>

আব্দুস সোবহান
সার্কেল অফিসার (উন্নয়ন)
শ্রীমঙ্গল, সিলেট।

ডাক বাংলায় থাকা অবস্থায় আমাকে নানা রকম প্রশ্ন করা হয়। আমি প্রানভয়ে সব প্রশ্নের উত্তরে কিছুই জানি না উত্তর দিতে থাকি। এতে আমার উপর অত্যাচার শুরু হয়। চড়, লাথি এবং ডাণ্ডা পিটা হয়; কিন্তু আমার কাছ থেকে না পাওয়ায় আমাকে ওয়েলফেয়ার বিল্ডিং এ স্থানান্তরিত করা হয়। সেখানে দেখতে পাই পাক জান্তারা বাঙ্গালীদের চক্রীর সাথে বেঁধে চক্র ঘুরিয়ে বেত দিতে থাকে। রাইফেলের অগ্রভাগ দিয়ে গুঁতো মারতে থাকে। রাত্রে কোথায় নিয়ে যায় এবং গুলি করে মারা শব্দ শুনা যায়। পরে জেনেছি শ্রীমঙ্গলস্থ সাধু বাবার থলি নামক স্থানে গণহত্যা করা হত। বুট দিয়ে মানুষকে লাথি দেয়া হত। জলন্ত সিগারেট দিয়ে শরীরে ফোস্কা তোলা হত। এই রকম অত্যাচারের প্রক্রিয়া দেখে আমি প্রাণভয়ে আল্লাহর কাছে প্রান ভিক্ষা করতে থাকি। কারন এ ছাড়া কোন উপায় ছিলনা।

এমনাবস্থায় ১২ মে ১৯৭১ সন পর্যন্ত থাকি এবং আমাকে নানাবিধ প্রশ্ন করা হয়। তন্মধ্যে একটা প্রশ্ন ছিল “তুম লোগ কা মেজর, কর্ণেল, ক্যাপ্টেন কিদার হ্যায়?” আমি বলতাম আমি জানিনা (অবশ্য উর্দুতে উত্তর দিতাম)। তারপর যখন আমি অসহ্য হয়ে যাই তখন আমি বললাম, হাম সরকারী দপ্তর তথ্য ইউনিয়ন কাউন্সিল কা মেকানিক হ্যায়, হাম কভি মুক্তি মে নেহি থা, ইছলিয়ে হাম কোছ নেহি জান্তা হ্যায়। এটা শোনার পর ক্যাপ্টেন তারেক আমাকে আমার উপরস্থ কর্মচারীর সার্টিফিকেট দাখিল করতে পারবো কিনা জিজ্ঞাসা করলে আমি বললাম পারবো। তখন আমাকে ২ জন সিপাহী দিয়ে সি,ও (রেভ) যিনি তখন সি,ও (ডেভ)- এর দায়িত্ব পালন করতেন তার কাছে পাঠায় এবং তার কাছ থেকে সার্টিফিকেট আনলে ১৪ ই মে ১৯৭১ ইং তারিখে আমাকে পুনরায় কাজে যোগদান করব বলে স্বীকারনামা লিখিয়ে নিয়ে ছাড়ে এবং হেঁটে হেঁটে ১০ মেইল দূরে রাজঘাট ইউনিয়নে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। আমি প্রানভয়ে পায়ে হেঁটে রাজঘাট পৌছি। কিন্তু রাজঘাট গিয়ে আমার নিস্তার হয়নি। কারন আমাকে শ্রীমঙ্গল থেকে কোন রিলিজ সার্টিফিকেট দেয়া হয় নি। তাই আবার সিন্দুরখান ক্যাম্পে আটক করা সেখানে শ্রীমঙ্গলের সাথে যোগাযোগ করার পর আমাকে ছাড়ে।

সেখানে যাওয়ার পর দেখলাম কোথা হতে বাঙ্গালী লোক এনে বাসবাড়ী নামক স্থানে গুলি করে হত্যা করে এবং মানুষকে বেঁধে ডাণ্ডা দিয়ে পিটাতে থাকে।

এই সমস্ত অত্যাচারের মধ্যে যেটা আমার কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে তা হচ্ছে নিন্ম্রুপঃ
আমি রিলিজ হওয়ার ২ মাস পরে অর্থাৎ ১৯৭১ সনের জুন মাসের শেষ দিকে রাজঘাট থেকে শ্রীমঙ্গল যাচ্ছিলাম। আমি ক্যাপ্টেন মুতালিব সাহেবের জীপে ছিলাম এবং তার ড্রাইভার আমার সাথে ছিল। আমরা কুনদড়া বাগানে যাওয়ার পথে দেখলাম কুনদড়া বাগানের পতিবরের উত্তরের পুলের উপরে কয়েকজন মিলিটারারী এবং এই মিলিটারীরা একজন শ্রমিককে একটি গাড়ির পেছনে বেঁধে প্রায় ৩০ মাইল বেগে গাড়ি চালাচ্ছে। এই অবস্থা দেখে আমি ভীত হয়ে পড়ি এবন শ্রীমঙ্গল যাওয়ার চিন্তা ত্যাগ করি। লোকটিকে গাড়ির পিছনে বেঁধে টানায় তার শরীরের সমস্ত চামড়া উঠে যায়। এই অবস্থা দেখে আমরা আবার রাজঘাট ফিরে চলে আসি। অবশ্য শেষে শুনেছি লোকটা বেঁচেছে। লোকটাকে এভাবে অত্যাচার করার কারন পরে জেনেছি। পুর্ব রাত্রে মুক্তিবাহিনী কুলাউড়া পুল ভাঙ্গায় এ অত্যাচার তাকে করা হয়েছে। কারন সে কুলাউড়া বাগানের প্রধান নেতৃস্থানীয় শ্রমিক।

নানা স্থানে পাক সেনারা মেয়ে-ছেলেকে ধরে ধর্ষণ করেছে শুনেছি, তবে স্বচক্ষে দেখিনি। ঐ সময় পাক সেনারা শ্রীমঙ্গল শহরে নেতৃস্থানীয় লোকদের বাড়ী জ্বালাতে থাকে এবং বাড়ীস্থ সকল মালামাল লুট করতে থাকে। অবশ্য তাদের লুটের পর বাঙ্গালী লোভীরা তাদের উচ্ছিষ্ট কিছু কিছু জিনিস লুটে নেয়।.

পাক বাহিনীর অত্যাচারে লোক গ্রাম হতে গ্রামান্তরে, শহর থেকে গ্রামে গ্রামে হেঁটে স্ত্রী-পুত্রসহ পলায়ন করে। কিন্তু সেখানেও রেহাই নেই। পাক সেনারা গ্রামে ঢুকে সকল ব্যক্তিদেরকে ধরে মারধোর করত ও তাদের কাজ করাত। রাত্রে মুক্তিবাহিনী যাতে না আসে এজন্য কড়া পাহাড়া দেওয়াতো। যারা পাহারায় ছিল তারাই রক্ষা পেয়েছে, বাকী যারা পাক সেনাদের কবলে পড়েছে তারা ফিরতে পারেনি।

স্বাক্ষর/-
আব্দুস সোবাহান।

গুরু গোলাপ
<৮,২.৪.২৫৯,৩১৮-২০> “ক্যাম্পের মধ্যে তাজা কুকুরে ভর্তি ছিল। এই অসংখ্য কুকুর খালের পাড়ে মানুষের তাজা রক্ত খাইয়া দিনে বেশ মোটা – তাজা হইত।“

সামসুদ্দীন আহমদ
বুকিং ক্লার্ক
শ্রীমঙ্গল রেলওয়ে ষ্টেশন
সিলেট।

২১ শে মে তারিখ শ্রীমঙ্গলের পথে গাড়িতে ব্রাক্ষ্মণবাড়ীয়া, তারপর পায়ে হাঁটিয়া প্রায় ৩৫ মেইল অতিক্রম করিয়া রেলওয়ে ষ্টেশন রশিদপুর ২২ তারিখ আশ্রয় নেই। সেখানে পৌঁছিয়াই আমরা বিপদে আসন্ন বলিয়া আভাস পাইতে থাকি। আমাকে নাকি শ্রীমঙ্গলে পাক হানাদার বাহিনী খোঁজাখুঁজি করে। আমার আর সামনে পা দেওয়া উচিৎ নহে বলিয়া রশিদপুরস্থ কর্মীবৃন্দ হুঁশিয়ার করে। এতদুর আসিয়া বাসা বা পুরাতন ভৃত্যের সন্ধান মিলিবে না বুঝিয়া অত্যান্ত ব্যতিব্যস্ত হইয়া পড়ি। একটা ট্রেন শ্রীমঙ্গল অভিমুখে যাইতেছে দেখিয়া (২৩/৫/৭১ তাং) উঠিয়া পড়ি এবং পরবর্তী স্টেশন সাতগাঁ নামিয়া পড়ি। সেখান হইতে সরাসরি আমার স্টেশন শ্রীমঙ্গলে কথা বলার সুযোগ পাইয়া সহকর্মী ও স্টেশন মাষ্টার সাহেবের সাথে কথাবার্তা বলিয়াছিলাম। আমি ও দিনের ক্লান্ত দেহে খাইয়া অনেকটা কাহিল হইয়া পড়ি এবং স্টেশন বিল্ডিং কক্ষে বিশ্রাম করিতে ছিলাম।

বেলা তখন হয়ত আড়াইটা। অতর্কিতে আমার সামনে বিভিন্ন ভারী ভারী অস্ত্রে সজ্জিত হানাদার বাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন ও তিন জন সৈনিক উপস্থিত এবং আমার নাম ধরিয়া সন্ধান জানিতে চাহে। তখন আমার মুখে কথা সরিতে ছিল না, মনে হইতেছিল যেন আমার পায়ের নিচের মাটি সরিয়া যাইতেছে। ক্ষণেকের মধ্যে স্টেশন মাস্টার সাহেবও আসিয়া উপস্থিত এবং আমারই নাম সামসুদ্দীন আহমদ সনাক্ত করিলে ক্যাপ্টেন আমাকে তাহাদের অনুসরন করিতে বলে। কয়েক কদম যাইয়াই তাদের জীপে উঠাইয়া আমাকে একটা বড় রকমের আসামী হিসেবে ঘিরিয়া রাখে। আধ ঘন্টার মধ্যে তাহারা আমাকে শ্রীমঙ্গল ওয়াপদাস্থ তাদের সামরিক আইন হেড কোয়ার্টারে নিয়া আসে।

আমাকে প্রথম লেফটেন্যান্ট আতাহারের কাছে হাজির করিলে তিনি আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ আরম্ভ করেন। তাহার জিজ্ঞাসাবাদের সংক্ষিপ্ত বিষয় ছিল চাকুরীতে যোগদান করি নাই কেন, কয়জন অবাঙ্গালী হত্যা করিয়াছি, সদ্য ভারত হইতে মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিং নিয়া আসলাম কিনা। মুক্তিবাহিনীর লোক কাহারা, তাহাদের কি পোষাক, তাছাড়া শ্রীমঙ্গল স্টেশনের তৎকালীন অবাঙ্গালী স্টেশন মাস্টার আখতার ও তাহার ছেলেপেলে কোথায়, তাদের আমি হত্যা করিয়াছি। আমার বিরুদ্ধে নাকি সরাসরি হত্যার অভিযোগ আছে। তাছাড়া তিনি আমাকে কয়েকজন সমাজকর্মীর না-ধাম, তাহাদের আচার-ব্যবহার জিজ্ঞাসাবাদ করিয়া আমাকে ছাড়িয়া অন্য রুমে চলিয়া যান।

একজন সৈনিক আসিয়া আমাকে কর্কশ স্বরে তাহার সহিত যাইতে বলে। আমি তৎক্ষণাৎ তাহার সহিত গেলাম। একটা রুমে নিয়া আমাকে বসিতে বলিল। চতুর্দিকে কেবল গোলাবারুদ আর অস্ত্রশস্ত্র ছাড়া আর কিছু নাই। আমাকে বিষণ্ন দেখিয়া একজন বিকট চেহারাধারী সৈনিক বলিল যে “যব এক দফে শের কা চক্কর মে আগিয়া, আর যানা কাহা হ্যায়”। কয়েক মিনিট পর আমাকে সেই বিল্ডিং হইতে ২-৩ মিনিটের রাস্তা দূরে অন্য এক বিল্ডিঙের ত্রিতলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আমার সুপরিচিত একজন বাঙ্গালী পুলিশের লোকের সাক্ষাৎ পাইলাম। সেই বাঙ্গালি লোকটা ২-৩ জন হানাদার বাহিনির লোক আমাকে মাটিতে বসিবার আদেশ দিয়া প্রশ্নবানে জর্জরিত করিয়া তোলে। ধমক দিতে থাকে, আর বিভিন্ন ধরনের জিজ্ঞাসাবাদ করিয়া প্রায় দুই-আড়াই ঘন্টা ব্যয় করে। সন্ধ্যা ক্রমাগত প্রায়, তখন আমাকে পার্শ্বস্থ একটা কামরায় ঢুকাইয়া বাহির হইতে তালাবদ্ধ করিয়া দিল। তখন আমার মানসিক অবস্থা কি তাহা আজ আর আমি ভাষায় প্রকাশ করিতে পারিতেছিনা। আটকাবস্থায় পড়িয়া প্রথমেই আমার স্মরণ পড়ে আমার সর্বকনিষ্ঠা মেয়ে দুলালী পারভীনের কথা। তারপর একে একে প্রতিটি সন্তান ও স্ত্রীর কথা। ক্রমে জীবনের স্মরণীয় মূহুর্তের বিভিন্ন প্রতিচ্ছবি আমার চোখের সামনে সিনেমার মত ভাসিয়া আসিতে থাকে।

আরও দুই জন ভদ্রলোককে সেখানে বন্দী হিসেবে দেখিলাম। একজনকে ভাল করিয়াই জানি, আর একজন আমার অপরিচিত। সন্ধ্যার লগ্নে আমাদের জন্য আটার রুটি ও ডাল দিয়া গেল। সাথের ঐ দুই ভদ্রলোক কয়েকদিন হইতে অভ্যস্থ বলিয়া ডাল-রুটি খাইলো। আমার দ্বারা কিছুতেই সম্ভবপর হইল না। দুই দিন পায়ে হাঁটিয়া এবং তৃতীয় দিনে আটকা অবস্থায় আমার শারীরিক অবস্থা একেবেরে শক্তিহীন হইয়া পড়ে।

রাত্র অনুমান আটটার দিকে দুজন সৈনিক আমাকে অন্য কক্ষে নিয়া যায় এবং আবার কেন চাকরীতে যোগদান করি নাই, মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করিয়াছি, কয়েকজন অবাঙ্গালী হত্যা করিয়াছি ইত্যাদি প্রশ্ন করিয়া শাসাইতে আরম্ভ করে। জিজ্ঞাসাবাদ যাহারা করিতেছিল তাহাদের জল্লাদ বলিলেও যথেষ্ঠ হইবার নহে। লাঠি দ্বারা ধাক্কা দেয়, সত্য কথা না বলিলে জীবন এখনই শেষ করিয়া দিবে বলিয়া হুঁশিয়ার করিতে থাকে। তাহাদের মন মত কোন কথাই আমার কাছ থেকে পাইতেছে না মনে করিয়া তাহারা আমার প্রতি ভীষণ চটিয়া যায়। হাত দুই লম্বা লাঠি দ্বারা আমাকে বেদম প্রহার করিতে থাকে। জীবনে কোন কারনে, কোন অবস্থায় এমন শারীরিক-মানসিক নির্যাতন সহ্য করিতে হয় নাই। তাহাদের মারের চোটে আমি কখন কোন অবস্থায় সংঞ্জা হারাইয়া ফেলি বলিতে পারি না। ভোর বেলা দেখি আমি প্রথম যে রুমে ঢুকি সেখানেই শায়িত। মার খাওয়া জায়গা গুলো কালো ও ফুলিয়া রহিয়াছে, হাত দিয়া ছুঁইতে পারিনা। রাত্রে যে রুমে নিয়া আমাকে জিজ্ঞাসা করিল তাহার চতুর্দিকের দেয়ালে রক্তের দাগে ঐ রুমটা যে জল্লাদের নির্যাতন কক্ষ তা বুঝিতে আমার বাকী ছিল না।

প্রত্যুষে তালা খুলিয়া আমাদেরকে পায়খানা প্রস্রাব করার জন্য নিকটস্থ খালের পড়ে নিয়া গেল। সেখানে পৌঁছিয়া আমরা ৮-১০ জন কয়েদী হইলাম, তাহাদের মধ্যে অনেকেই আমার মত অচল প্রায়, কথাবার্তা বলিতে পারেনা। কথা বলাও কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ছিল। এক সাথে সকলকে কোন পর্দার ব্যবস্থা ছাড়া লাইন করিয়া বসাইয়া দিল পায়খানা করিতে। কে পায়খানা করিল জানি না। আমারতো পায়খানা-প্রস্রাব কিছুই হইলো না। তাছাড়া আমি দুই দিনের উপবাসী। ২-৩ মিনিটের মধ্যে পায়খানা-প্রস্রাব ও খালে পানি খরচ করিয়া হাত মুখ ধুইয়া আসিতে হয়। বন্দুকধারী সৈনিক ও হাওয়ালদার দণ্ডায়মান।

আবার আসিয়া যার যার রুমে স্থান লইতে হইল। একটা পুরি ও এক কাপ চা খাইতে দেয়া হইল। দুপুরে আটার রুটি আর ডাইল। শরীরে জ্বর, কিছুই খাইতে পারি না। মুহুর্তে মূহুর্তে পরিবার-পরিজনদের কথাই মনে পড়িত। বিপদে পড়িয়া সর্বশক্তিমান আল্লাহর নামই আহার-বিহারে সম্বল করিয়া লইলাম। বিকালে আবার ডাল-রুটি। ভাতের নাকি ব্যবস্থা নাই, তাই ভাতের কথা উচ্চারণ করিবার সাহসও হইল না।

আমাদিগকে যে রুমে রাখিলো তাহার দুদিকে বন্দুকধারী সৈনিকরা পোষাক ও অস্ত্রশস্ত্র লইয়া শুইয়া থাকে। আমাদের দিকে প্রকারান্তরে খুব খেয়াল করিত। আমরা কি বলি না বলি তাহা শুনিতে চেষ্টা করিত। জানালায় এক প্রকার কালো তার জড়ানো ছিল, তাহাতে আমাদের মধ্যে হইতে যেন তাহারা টেপ করিয়া রাখিয়াছে। জনমানব শুন্য এলাকায় আমরা ছিলাম, রোজই বিভিন্ন চেহারার সৈনিক আসিয়া তালা খুলিয়া দিলে কয়েদী হিসাবে আমাদের সহিত ঠাট্টা-চাতুরী করিত। কোথায় তোমাদের শেখ সাহেব, কোথায় বঙ্গবন্ধু ইত্যাদি বলিয়া ব্যঙ্গ করিত। আর লম্বা লাঠি দ্বারা গুঁতা দিয়া জানোয়ার ইত্যাদি বলিত। কেউ কেউ ধীরস্থীর হইয়া আমাদিগকে হিন্দুর গোলাম, হিন্দুর পয়দা বলিয়া গালি দিত।

এক দিন আমাদের সাথের একজন লোক বেলা প্রায় ১১ টার সময় পায়খানা করার জন্য অস্থিরভাবে প্রহরারত সৈনিককে মিনতি করিতে লাগিল। এমন সময় একজন সুবেদার মেজর আসিল। কর্মরত সৈনিক লোকটার পায়খানার কথা জানায়। তাদের ভাষায় – তারা কি বলিল জানিনা। তাহাকে দুই তিন জনে পায়খানা করাইবার মানসে নিয়া বাহির হইল। উপর হইতে আমরা নজর করিয়া দেখিলাম যে, তাহার হাত রশি দিয়া বাঁধিয়া আগে-পিছে সৈনিক তাহাকে খাল পাড়ে নিল এবং গুলি করিয়া তাহাকে খতম করিয়া তাহারা ফেরৎ চলিয়া আসিল। এমনিভাবে প্রতিদিন ২-১ জনের মৃত্যু দেখিয়াছিলাম। ক্যাম্পের মধ্যে তাজা কুকুরে ভর্তি ছিল। এই অসংখ্য কুকুর খালের পাড়ে মানুষের তাজা রক্ত খাইয়া দিনে বেশ মোটা – তাজা হইত। আর সৈনিকরা মানুষের সাথে কুকুরও গুলি করিয়া হত্যা করিত।

দু-একদিন ফাঁক দিয়াই তাহারা ঐ জল্লাদখানায় নিয়া আবার নির্যাতন করিত। এমনিভাবে বিভিন্ন উপায়ে আমাকে শারিরীক অত্যাচার আজ চির রোগা করিয়া দিয়াছে। মারের চোটে শরীর হইতে রক্ত ছিটিয়া পড়িত। ক্ষণে ক্ষণে বেহুঁশ হইলেও তাহারা রেহাই দিত না। তিন/চার দিন তাহারা আমাকে দিয়া লিখিত জবানবন্দি নিয়াছে। ২-৩ দিন কথিত লেফটেন্যান্ট আতাহারের সাক্ষাৎ পাইয়াছি। তাহাকে সাহস করিয়া আমার মুক্তির কথা জিজ্ঞাসা করিলে ব্যঙ্গ হাসি হাসিয়া বলিত “সবুর কর, কোহি তকলিফ তো নেহি দ্যা রাহা”।

একদিন রাত্র অনুমান ৯ টার সময় দুজন বন্দুকধারী সৈনিক আসিয়া বিশেষ করিয়া আমাকে খুব শাসাইতে লাগিল। আমি নাকি মুক্তিবাহিনীর পৃষ্ঠপোষক ও কয়েকজন অবাঙ্গালী লোককে হত্যার ব্যাপারে অঙ্গাঙ্গিকভাবে জড়িত ইত্যাদি। তাহারা আমাকে ত্রিতল হইতে ছাদের উপর নিয়া গেল এবং সেখানে আমাকে ভীষণভাবে নির্যাতন চালাইয়া একেবারে অচল করিয়া ফেলে। কর্তব্যরত সৈনিক আমার প্রতি খানিক সদয় থাকাতে আমাকে আবার আমার রুমে আনিয়া রাখিয়া যায়। আমাকে মারিয়া ফেলিবে এই ভাবিয়া আমার সঙ্গী ৮-১০ জন কয়েদী আমি ফিরিয়া দেখি তাহারা কাঁদিতেছে আর কালেমা পড়িতেছে ও দরূদ পাঠ করিতেছে। আমাকে ফেরৎ পাইয়া তাহারা অনেকটা শান্তি লাভ করে। তাহারা হানাদারদের কথা বলিত না, আমার মাধ্যমেই তাহাদের হানাদারদের সাথে কথোপকথন হইত।

যেহেতু আমি নির্দোষ ছিলাম, কর্ণেল ফকরুল আলম আমাকে ডাকিয়া অনেক শাসাইলো। কয়েকদফা গালি দিয়া আমাকে মুক্তির আদেশ দিল এবং কাজে যোগ দিবার জন্য একজন সুবেদার মেজরকে হাওলা করিয়া আমাকে স্টেশন পাঠাইয়া দিলে কোন মতে নয়দিন থাকিয়া স্বাস্থ্যগত কারনে ছুটি লইয়া শ্রীমঙ্গল হইতে কাটিয়া পড়ি। পাক বাহিনীর হাতে আমি মোট ২১ দিন বন্দি ছিলাম।

স্বাক্ষর/-
সামসুদ্দিন আহমদ
১৭.১০.৭৩

গুরু গোলাপ
<৮,২.৪.২৫৯,৩২১>

মোঃ মাজেজুল ইসলাম
জেলা প্রশাসকের অফিস
কুমিল্লা।

সংবাদ পাইলাম জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে পাক বাহিনী ধরিয়া নিয়া গেছে। পরের দিন জেলা প্রশাসকের ব্যক্তিগত ড্রাইভার আমার বাসায় আসিয়া জেলা প্রশাসককে ও পুলিশ সুপারিনটেন্ডেন্ট কবির উদ্দিন সাহেবের মর্মান্তিক সংবাদ জানাইল। পরে পরস্পর জানিতে পারিলাম উভয়কে পাক সৈন্যরা গুলি করিয়া নির্মমভাবে হত্যা করে।

৯ এপ্রিল সকালে পাক বাহিনী আমাকে বাসা হইতে ধরিয়া তাহাদের শিবিরে লইয়া যায়। বহু প্রকার প্রশ্ন করে। উক্ত প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারায় আমাকে মৃত্যুর ভয় দেখায় এবং সেনানিবাসে নিয়া যাইবার প্রস্তুতি নেয়। সেখানে তৎকালীন অবাঙালী অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের সুপারিশক্রমে জীবন ভিক্ষা পাই এবং অফিসে কাজকর্ম করাইতে বাধ্য করে।

সার্কিট হাউজে সন্ধ্যার পর গ্রাম ও শহরের আশেপাশে হইতে মা-বোনদিগকে ধরিয়া নিয়া আসিয়া নৃশংসভাবে অত্যাচার চালাইত। রাত্রে মা-বোনদের বিকট চিৎকার শুনিতে পাইতাম। হায় আল্লাহ, ধর্মের নামে ইসলামের নামে একি অত্যাচার! পাক বাহিনীর এই নৃশংসতা দুনিয়ার অসভ্যতাকে হার মানাইছে।

স্বাক্ষর/-
মোঃ মাজেজুল ইসলাম।

গুরু গোলাপ
<৮,২.৪.২৬০,৩২২>

গোলাম রফিক
থানা- কসবা
জেলা- কুমিল্লা।

পাক সেনারা ৩০০ জন লোককে বিভিন্ন প্রকারে ধরিয়া হত্যা করে। তন্মধ্যে এই এলাকার অন্তর্গত চারগাছ গ্রামে ঘরের মধ্যে ৩৪ জন লোককে গুলি করিয়া হত্যা করে।

ঘটনার বিবরণে প্রকাশ যে, উক্ত গ্রামের জনৈক ব্যক্তি আকতার উদ্দিনের বাড়িতে সন্ধ্যার সময় বিভিন্ন পর্যায়ের লোক মিলিত হইয়া রাজাকার ও পাক সেনাদের পৈশাচিক উপায়ে নিরীহ জনসাধারণের বাড়ীঘর লুণ্ঠন, প্রজ্বলন, ধ্বংস ও বীভৎসতার সমালোচনা করিতে থাকে। কিন্তু রাজাকার এবং পাক সেনাদের শিবির উক্ত গ্রামের সন্নিকটে অবস্থিত ছিল। ঘটনার বিবরণে আরও প্রকাশ যে, উক্ত সময়েই কয়েকজন রাজাকার এবং পাক সেনা পাহারায় রত ছিল। একজন রাজাকার গোপনে উক্ত বাড়ীর আড়ালে থাকিয়া তাহাদের নিন্দার কথা শোনে এবং সমস্ত বৃত্তান্ত পাক সেনাদের কর্ণগোচরে দেয়। সঙ্গে সঙ্গেই কয়েকজন পাক সেনা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয় এবং অতর্কিতে ষ্টেনগান দ্বারা ঘরটি লক্ষ করিয়া আক্রমন চালায়। এই পৈশাচিক আক্রমনে যাহারা আত্মরক্ষার জন্য রাস্তায় বাহির হইয়া আসিয়াছিল তাহাদের মধ্যেও অনেকেই গুলির আঘাতে চির নিদ্রায় লুটিয়া পড়ে। মুমূর্ষ লোকদের উপরেও চললো বেয়নেট চার্জ। ফলে ঘটনাস্থলেই ৩৪ জন লোক শাহাদাৎ বরণ করেন। নিন্মে কয়েকজনের নাম উল্লেখ করা হইলোঃ
(১) অশ্বিনী পোদ্দার,
(২) মহানন্দ আচার্য্য,
(৩) আব্দুল মিছির,
(৪) মেথর ছামারিয়া,
(৫) কাঞ্চন মিঞা।

ইহা ছাড়াও অত্র এলাকার ও অন্যান্য এলাকার ৩০ জন লোককে সন্দেহবশতঃ জীবন্ত অবস্থায় মাটিচাপা দেয়া হয়। মণিঅন্ধ গ্রামের জনৈক ব্যক্তি জনাব গোলাম শফিককে ঘরের মধ্যে রশি দ্বারা বাঁধিয়া আগুন জ্বালাইয়া দেয়। ফলে ঘটনাস্থলেই গোলাম শফিক সাহেব আগুনে পুড়িয়া মারা যান।

মগুড়া ইউনিয়নের এবং অন্যান্য এলাকা হইতে বহু মেয়েকে ধরিয়া আনিয়া পাক পিশাচরা নির্যাতন ও পাশবিক অত্যাচার চালায়। পাক সেনাদের এই পৈশাচিক ব্যবহারে এই এলাকার শতকরা ৯০ জন লোক দেশ ত্যাগ করে।

স্বাক্ষর/-
মোঃ গোলাম রফিক

গুরু গোলাপ
<৮,২.৪.২৬১,৩২৩>

মোছাঃ চানুভান
গ্রাম- ফুলবাড়িয়া
থানা- ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া
জেলা- কুমিল্লা।

আমি দরিদ্র পিতৃহীন অবিবাহিতা নারী। বিধবা মাতা একমাত্র সংসারে আপন পরিজন। আমার কোন ভাইবোন নাই।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন আরম্ভ হইলে পাক বাহিনী পত্তন ইউনিয়নে শিবির স্থাপন করে। জুন মাসের শেষের দিকে পাক সৈন্য ও রাজাকারদের অত্যাচার ও নৃশংসতা বৃদ্ধি পায়। স্থানীয় রাজাকাররা গ্রামের ও ইউনিয়নের বহু ধনসম্পত্তি লুণ্ঠন করে।

জুলাই মাসের ১৭ তারিখ বানু মিঞা, সোনা মিঞা ও চাঁন মিঞা গভীর রাত্রে আমার নিজ বাড়ী হইতে ধরিয়া লইয়া পাক বাহিনীর শিবিরে লইয়া যায়। আমাকে দেখিয়া পাক বাহিনীরা আনন্দে নাচিয়া ওঠে, আমার ক্রন্দন তাহাদের প্রাণে একটুও মায়ার সঞ্চার করে নাই। রাজাকাররা ধরিয়া নিবার সময় তাহাদের নিকট বহু আকুতি-মিনতি ও পায়ে জড়াইয়া পড়িয়াছি। উক্ত রাজাকারদের নিকট আমি যতই ক্রন্দন করিয়াছি, রাজাকার গুলি আমার সহিত ততবেশি অমানুষিক ব্যবহা করিয়াছে।

পাঁচদিন পাক নরপিশাচরা আমাকে তাহাদের শিবিরে ও বাঙ্কারে আটকাইয়া রাখে ও আমার দুর্বল দেহের উপর অমানুষিক অত্যাচার করে ও মুক্তিবাহিনীর সংবাদ জানি কিনা জিজ্ঞাসা করে। আমি মুক্তিবাহিনীর সম্বন্ধে জানিনা বলিলে আমার উপর ক্রুদ্ধ হইয়া প্রহার করে। এই পাঁচদিন তাহারা আমাকে গোসল করিতে পর্যন্ত দেয় নাই।

আমাকে ধরিয়া দিবার পরিবর্তে রাজাকারগণ পাক-নরপিশাচদের হইতে প্রচুর মদ ও গ্রামে গ্রামে লুণ্ঠন করিবার অনুমতি পাইয়াছিল। সৈন্যদের অত্যাচারে আমি জ্ঞান হারাইয়া ফেলিয়াছি। জ্ঞান ফিরিয়া পাইলেও দেখি ও অনুভব করি আমার দুর্বল শরীরে অত্যাচার করিতেছে। এই কথা ভাবিতে আজও ভয় হয়।

আমাকে ১৭ জুলাই গভীর রাত্রে রাজাকাররা ধরিয়া নিবার পর ১৮ জুলাই আমার মা কেশবপুর গ্রামের মুক্তিবাহিনীর কমাণ্ডার নজীর আহমদ সাহেবের নিকট আমাকে পাক শিবিরে ধরিয়া নিবার করুণ সংবাদ বলিলে উক্ত মুক্তিবাহিনীর কমাণ্ডার ২১ শে জুলাই গভীর রাত্রে বহু মুক্তিযোদ্ধা নিয়া ফুলবাড়িয়া পাক সৈন্যদের শিবির ও বাঙ্কার আক্রমণ করেন। হঠাৎ আক্রমনে পাক বাহিনী ও রাজাকাররা আত্মসমর্পন করে। আক্রমনের সময় তাহারা সকলেই আমার উপর অত্যাচার করিতেছিল। মুক্তিযোদ্ধা ভাইয়েরা আমাকে সহ ১৪ জন পাক সৈন্য ও তিন জন রাজাকারকে গ্রেফতার করিয়া ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে নিয়া যান। তাহারা আমার সম্মুখে রাজাকার ও পাক নরপিশাচদের জীবন্ত মাটি চাপা দেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমি ত্রিপুরা রাজ্য হইতে নিজ জন্মভুমি ফুলবাড়িয়া ফিরিয়া আসি।

স্বাক্ষর/-
মোছাঃ চানুভান।

গুরু গোলাপ
<৮,২.৪.২৬২,৩২৪>

মোঃ বাদশাহ মিয়া
ম্যানেজার
শ্রীমঙ্গল সোনালী ব্যাংক
শ্রীমঙ্গল, সিলেট।

আমি আমার ছেলে-মেয়েদেরকে ঢাকায় পাঠানোর জন্য ঢাকা যাওয়ার রাস্তা ঠিক আছে কিনা দেখার জন্য ১৩ ই এপ্রিল হোণ্ডা নিয়া ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া চলে যাই। ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া ট্রেজারী অফিসে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে পাক বাহিনী বিমান থেকে শেলিং আরম্ভ করে। পাকবাহিনী ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া ট্রেজারী অফিস ও রেলওয়ে স্টেশনের উপরেই বেশীরভাগ শেলিং করে। এই সময় ২ জন লোক মারা যায় এবং ৫-৬ জন লোক আহত হয়। ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া থেকে রওনা হয়ে বিকালে তালশহর রেল ষ্টেশনে যখন পৌঁছাই তখন দেখতে পাই দক্ষিণে লালপুর বাজারে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প পাক বাহিনী বিমান আক্রমন চালাচ্ছে। প্রায় ১ ঘণ্টা এই আক্রমণ চলে, বিমান থেকে ব্যাপকভাবে শেলিং ও বোমা ফেলা হয়। খবর পাই এতে বহু মুক্তিযোদ্ধা হতাহত হয়।

রাত্রিতে আমি আশুগঞ্জ সোনালী ব্যাংকে অবস্থান করি। ১৪ এপ্রিল ৬ টার সময় থেকে আশুগঞ্জের উপর আক্রমন চলে। পাক বাহিনী হেলিকপ্টার করে আশুগঞ্জ ওয়াপদার পার্শ্বে অবতরন করে। পাক বাহিনীর এই অবস্থান সোনালী ব্যাংকের উপর থেকে নোয়াখালির একজন টেলিফোন অপারেটর দেখতে পায় এবং সঙ্গে সঙ্গে ভৈরব ব্রীজের পূর্ব তীরে অবস্থানরত মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে টেলিফোন যোগে খবর দেয়। সে নিজে দোতলার উপর থেকে লাফিয়ে পড়ে এবং আমাদেরকে বলে যে, যদি বাঁচতে চান তবে পালান।

মুক্তিবাহিনী তাদের অবস্থান গুটিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ব্রাক্ষ্মনবাড়ীয়ার দিকে পিছু হটে যায়। পাক বাহিনী আশুগঞ্জ অবতরণ করার পর পরেই তারা সারা শহর চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলে এবং বৃষ্টির মত গোলাবর্ষণ করতে থাকে। এই সময় সেখানে যে লোককে তারা পায় তাকেই গুলি করে হত্যা করে। আমার মনে হয় যদি পাক বাহিনীর অবস্থানের খবর টেলিফোন অপারেটর মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে না জানাত, তবে একজন মুক্তিযোদ্ধাও সেদিন পাক বাহিনীর হাত থেকে রেহাই পেত না। পাক বাহিনী পার্শ্ববর্তী গ্রাম গুলোতে অগ্নীসংযোগ করে। আমরা আগুনের লেলিহান শিখা দেখতে পাই এবং কয়েকজন আমাদের ব্যাংকের দরজা ভাঙ্গার চেষ্টা করছে, তখন আমি পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে একটা চিপা গলি দিয়ে নদীর পাড়ে চলে আসি। নদীর পাড়ে এসে আরু কয়েকজন নরনারীকে অসহায় অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পাই। নদীর মাঝখানে একটা নৌকা বাঁধা ছিল। আমি সাঁতার কেটে নৌকাটাকে নদীর পাড়ে নিয়ে আসি এবং অসহায় লোকগুলিকে নৌকায় তুলে নিয়ে উত্তর দিকে পালিয়া যাই।

আমি যখন নদীর পাড়ের দিকে যাচ্ছিলাম, তখন আমি রাস্তার উপর ১৫-১৬ জন লোককে মৃত অবস্থায় দেখতে পাই এবং অনেককে গুলি লেগে আহত অবস্থায় কাতরাতে দেখি। চারদিকে শুধু গুলি আর নারী-পুরুষদের করুণ চিৎকার ভেসে আসে।

অতঃপর আমি ব্রাক্ষ্মণবাড়ীয়া চলে আসি। আমি ব্রাক্ষ্মণবাড়ীয়া পৌঁছেই দেখতে পাই যে ব্রাক্ষ্মণবাড়ীয়া থেকে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প তুলে নিয়ে ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার উত্তর দিকে তেলিয়াপাড়ার দিকে অগ্রসর হচ্ছে।

স্বাক্ষর/-
মোঃ বাদশা মিয়া
১৭.১০.৭৩ ইং

গণহত্যা ও নির্যাতনের বিবরণ
বাংলাদেশের দৈনিক পত্র-পত্রিকা ও সাময়িকী

<৮,৩,৩২৫-৩৩০> “ক্যান্টন রেষ্টুরেন্টের বিপরীত দিকের রাস্তায় ডাস্টবিনের পাশে দেখলাম আর একটা বাঙ্গালীর লাশ। হা্তে শোল মাছের একটি কাঁচা মাথা মুষ্টিবদ্ধ। ক্যান্টনওয়ালারা মাছের মাংসটা রেখে মাথাটা ডাষ্টবিনে ফেলে দিল, কোন বুভুক্ষ হতভাগ্য হয়তো বা সেই মাথাটা কাক-কুকুরের সাথে ঝগড়া করে অধিকার করেছিলো-কিন্তু নিয়ে যেতে পারেনি-দখলীকৃত সেই উচ্ছিষ্ট মাথাটা হাতে থাকতেই সে জল্লাদ পাশবিক শক্তির উন্মত্ত শিকার।“

“এক জল্লাদ ঘুমন্ত একটি বছর দেড়েকের বাচ্চার বুকে ঢুকিয়ে দিলো তার সুতীক্ষ্ণ বেয়োনেট। তারপর বেয়োনেটের আগায় ঝুলিয়ে রাখলো ওর কচি দেহলতাটিকে। চোখের সামনে দেখলাম, সেই অবুঝ শিশুর হাড়গুলো ঝুর ঝুর করে পড়ছে জল্লাদের হাতে ধরা রাইফেলের গা বেয়ে।“
[ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যার অভিযানের ওপর একটি প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ]
“২৫শে মার্চ রাত থেকে ২৭ মার্চ শে রাত”
-নাজিমুদ্দীন মানিক
-‘বাংলাদেশের গণহত্যা’, বাংলার বাণী, বিশেষ সংখ্যা, তারিখঃ ১৯৭২।

“পঁচিশে মার্চ উনিশ’শ একাত্তর। রাত সাড়ে ১১টা কি পৌনে ১২টা। বাকি দু’টো লেখা শেষ করতে হবে। তাড়াহুড়ো করে হোটেল থেকে চারটে খেয়ে বেড়িয়েছি মাত্র অবজারভার হাউসের সামনে রাস্তায়। দেখলাম অসংখ্য মানুষের ছুটাছুটি-কেউবা ইট টানছেন, কেউ বা বিরাট বিরাট গাছ কেটে আনছেন-কেউ বা পাশের মোটর মেরামত কারখানার সামনে ফেলে রাখা পুরনো ভাঙ্গা গাড়িগুলো এনে রাস্তায় জড়ো করছেন-সবারই মুখে এক কথা –ব্যারিকেড তৈরি করো, ওদের চলার পথে বাধা সৃষ্টি করো, ওদের আসতে দেবো না আমাদের এ জনপদে। মনে পড়লো বঙ্গবন্ধুর নির্দেশঃ আমি হুকুম দেবার নাও পারি, রাস্তা-ঘাট যা কিছু আছে তোমরা সব বন্ধ করে দেবে। এ নির্দেশ অমান্য করতে পারিনি আমি নিজেও- ওদের সাথে ধরাধরি করে সবে ডিআইটি রাস্তার মুখে রেখেছি একটা গাছ। ওমনিই শোনা গেল গুলির শব্দ। রাস্তার মানুষগুলো কোন মতে আত্নরক্ষা করলো। আমি দৌড়ে চলে এলাম আমাদের পূর্বদেশ অফিসে।

অফিসের বারান্দায় আধাঁরের চাদোয়ার নিচে দাঁড়িয়ে দেখলাম হায়েনাদের একটি কনভয় এসে থমকে দাঁড়িয়েছে-দৈনিক পাকিস্তান(বর্তমানে দৈনিক বাংলা) অফিসের সামনে, কনভয়ের সামনে বিরাট ব্যারিকেড। ওরা ডিঙ্গাতে পারছিল না। তখন-তাই গুলি খাওয়া শুয়োরের মত ঘোঁৎ ঘোঁৎ করছে কনভয়ের বিরাট গাড়ীগুলো। আর গাড়ীর আরোহী পাষান্ডরা গুলি ছুড়ছে ওদের চার পাশে। হায়দার ভাইয়ের ধমক খেয়ে কামরার ভেতরে চলে এলাম। জানালা দিয়ে স্পষ্টতঃ দেখতে পেলাম গাড়ী থেকে নামলো দশ-বারোজন হার্মাদ। অনেক কষ্টে ব্যারিকেড সরিয়ে পথ করে নিলো ওদের কনভয়ের। তারপর টয়েনবি সার্কুলার রোড ধরে চলে গেলো।

টেলিফোন করলাম বেগম বদরুন্নেসা আহমদের বাড়ীতে। কেউ ধরলো না। তারপর আর কাউকে টেলিফোন করতে পারিনি। হার্মাদরা টেলিফোন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল। অফিসের সর্বত্র এক বিক্ষুদ্ধ নীরবতা আর শহরের সর্বত্র অবিরাম বোমাবর্ষণ, ফিল্ডগান, মেশিনগান, স্টেন, এস এল আর, আর চাইনিজ অটোমেটিকের একটানা শব্দ। মাঝে মাঝে কানে ভেসে আসছে গুলী খাওয়া মুমূর্ষু নরনারীর করুণ আর্তনাদ। হায়দার ভাই, সেলিম ভাই, লোহানী ভাই, রফিক, অহিদ, এরশাদ, আতিক, তওফিক, রকিব, সাদেকিন, মজিদ, আনিস, কামাল, আজমল, জিয়া আমরা সবাই হতবাক-কারো মুখে কোন কথা নেই। বোমার একটা ঘন্টা শব্দ শুনছি-আর যেনো মনে হচ্ছে নিজের হৃৎপিন্ডটাকে চিবিয়ে খাচ্ছি। অথচ আমরা তখন অসহায়-করার কারো কিছু নেই তখন।

মনে পড়লো সেদিন সন্ধ্যার কথা। রাত আটটার দিকে শেখ সাহেব ব্রীফ করেছিলেন দেশী সাবাদিকদের এর আগে চাটগাঁ, রংপুর, খুলনা, রাজশাহীতে জল্লাদের হামলার খবরে গর্জে উঠেছিলেন বঙ্গশার্দুল। এক বিবৃতি দিলেন তিনি। বললেন বাংলায় আগুন জ্বলেছ। এ আগুন নেভানোর সাধ্য কারো নেই। আমার মানুষকে নির্বিচারে এভাবে মারতে দেওয়া যাবে না। সাবধান হও জল্লাদ। শেখ সাহেবের বাড়ীতেই খবর পেলাম সন্ধ্যায় ইয়াহিয়া-ভুট্টো ঢাকার প্রেসিডেন্ট হাউস আর ইন্টারকন্টিনেন্টাল থেকে ক্যান্টনমেন্ট গিয়ে টিক্কা, ওমর, পীরজাদা, ফরমান আলী, হামিদ, খাদিম হোসেন রাজা এসবদের নিয়ে মিটিং করছে-সলা পরামর্শে বসেছে। শেখ সাহেবের প্রেস ব্রিফিংয়ের পর সলিম ভাই, আমি আর সেলিম মামা হাঁটতে হাঁটতে এসেছিলাম নিউমার্কেট পর্যন্ত। নিউমার্কেট থেকে একবার সার্জেন্ট জহুরুল হলে গেলাম। কাউকে দেখতে পেলাম না। মন এক বিরাট আশঙ্কায় দুমড়ে-মুচড়ে গেলো। অফিসে এসে একটা লেখা শেষ করছি। তারপর খেতে গিয়ে তো এ কান্ড।

সে রাতে আর কোন কাজ হলো না-কোন পত্রিকা বেরোলা না পরদিন। সারা রাত অফিসে আটকা থাকলাম। জল্লাদরা কারফিউ জারী করেছে। পরদিনও সেই অবস্থা। তবে রাজারবাগে বোমার আওয়াজ কমছে কিছুটা। কিন্তু গুলীর আওয়াজ থামেনি। থামেনি আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার আর্তনাদ। দূরে তিন-চার জায়গায় দেখলাম বিরাট বিরাট কুন্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়া উঠছে। বুঝতে পারলাম স্বদেশেও যারা মোহাজির সেসব রিকশাওয়ালা-মুটে-মজুর আর কুলী-কামিনদের বস্তিগুলো জ্বালিয়ে দিচ্ছে জল্লাদের দল।

ছাব্বিশে মার্চ নয়টায় ঢাকা বেতার থেকে ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলায় জনৈক উর্দুভাষী এলাম ফরমাইছেন, টিক্কা ঢাকা শহরে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারী করেছে। আর অনেক নতুন সামরিক আইন জারী করেছে ইত্যাদি ইত্যাদি। এর কয়েক মিনিট পরেই তদানীন্তন চতুর্দশ ডিভিশন হেডকোয়ার্টারের সামরিক পাবলিক রিলেশন অফিসার মেজর মোহাম্মদ সাদিক সালিক এক বিরাট পরোয়ানা নিয়ে অফিসে হাজির । ওর দাবী গুলো বাংলায় অনুবাদ করে প্রচার পত্র হিসাবে ছেপে দিতে হবে। সালিকের সাথে স্টেনধারী আরো তিন পাষান্ড। আমরা বললাম এসব ছাপার মালিক আমরা নই। হামিদুল চৌধুরী বা মাহবুবুল হকই পারে। ওরা চলে গেল। কিছুক্ষণ পর মাহবুবুল হককে নিয়ে ফিরে এলো। মাহবুবুল হক ছাপতে রাজী হলো-আমাদেরকে অনুবাদ করে দিতে বললো। আমরা জবাব দিয়েছিলামঃ ক্ষুন্ন পিপাসা আর নিদারুন উদ্বেগে আমরা ক্লান্ত। এখন অনুবাদ করতে পারবো না। মাহবুবুল হক এতে সালিককে কি যেনো বললো। সালিক আমাদের ধমক দিয়ে বললো –জলদী করো না-নেহী তো দেখতা হায়-পেছনের তিন পাষান্ডকে দেখালো। অগত্যা অনুবাদ করে দিলাম। পরে অবশ্য সে অনুবাদের প্রচারপত্র ছাপা হয়নি। এরপর ওরা মাহবুবকে নিয়ে আবার চলে গেলো। আমরা অফিসেই বন্দী রইলাম।

এগারোটার দিকে রফিক কোথা থেকে কয়েকটা পাউরুটি আর বনরুটি জোগাড় করেছিল। সেগুলো দিয়ে কোন মতে কিছুটা ক্ষুধা নিবারণ করলাম। এ সময় দেখি বেতার থেকে বার বার আমার সোনার বাংলা গানটির দু’তিন পঙক্তি বাজানো হচ্ছে।

পঁচিশে মার্চ রাত থেকে সাতাশে মার্চ-সকাল সাড়ে নয়টা পর্যন্ত আটকা পড়েছিলাম সেই পূর্বদেশ অফিসে। সাতাশে মার্চ সকালে ঢাকা বেতার থেকে ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলায় জনৈক উর্দুভাষী ঘোষনা করলো, টিক্কা দুপুর বারোটা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল করেছে। যে যার ঘরে ফিরতে পারবেন-পারবেন বারটা পর্যন্ত হাট বাজার করতে। তারপরই আবার স্বগৃহে অন্তরীণের পালা শহরবাসীদের। ঘোষনাটি শোনার পর আমরা অবজারভার ভবনে চার দেওয়ালের ভেতরে আটকা পড়া লোকগুলো বেরুলাম। রাস্তায় হেঁটেই যেতে হবে, কেননা রাস্তায় দখলদার বাহিনীর বিরাট বিরাট লরী আর জীপ ছাড়া অন্য কোন যানবাহন নেই। মহানগরী ঢাকার রাস্তাগুলি সকল রকমের যানবাহন শূন্য। মতিঝিল থেকে রায়ের বাজার পর্যন্ত দীর্ঘ এ মাইলের মধ্যে রাস্তায় একটা রিকশাও আমার চোখে পড়েনি।

রাস্তায় দেখলাম ঘরে ফেরার মানুষগুলোর সে কি উর্ধ্বশ্বাস চলা। কারো দিকে কারো তাকাবার সময়টা পর্যন্ত নেই। সবাই ছুটছে কোনমতে নিজের জানটুকু নিয়ে যেভাবে পারছে পালাচ্ছে। থেকে থেকে পাষান্ডদের লরীগুলো বিরাট দানবীয় শক্তিতে ছুটে চলেছে রাস্তার দু’পাশের মানুষ আর ঘরবাড়ী কাঁপিয়ে।

প্রতিটি গাড়ীর ওপরে পজিশন নিয়ে বসে আছে-চারদিকে তাক করে রেখেছে মেশিনগান, হাল্কা মেশিনগান আর কামানের মুখ। ওদের এহেন সর্তক মহড়া দেখে সেই সদা আতঙ্কিত মনেও হাসি এলো আমার। কার বিরুদ্ধে এমন সর্তকতা? বাংলাদেশের নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষের বিরুদ্ধে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সেনাবাহিনীর দাবীদারদের এহেন একতরফা বীরত্ব যদি সেই মুহূর্তে আমার কাছে হাস্যস্পদ বলে মনে হয়, তবে কি।

অবজারভার ভবন থেকে বেরিয়ে দুদিনের উপোসী ক্লান্ত দেহটাকে টেনেহিঁচড়ে যখন ন্যাশনাল কোচিং সেন্টারের সামনে হাজির হলাম, তখন অনেকটা সংজ্ঞা লোপ পাবার অবস্থা। কোচিং সেন্টারের ঠিক সামনেই ফুটপাতের ওপর দেখলাম একটা মানুষের লাশ। গুলীর আঘাতে বুকটা ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। পাশেই পড়ে রয়েছে কিছু নাড়ি-ভুড়ি। নাকে আঙ্গুল এঁটে-চোখ দুটো বন্ধ করে পাশ কাটাতে চাইলাম। কিন্তু পা এগুচ্ছিল না। হাঁটু দুটো কাঁপছে থর থর করে। নার্ভাস হয়ে গেলাম। তবুও এগিয়ে যেতে হলো।

একবার মনে করলাম রাস্তায় নেমে যাই। ফুটপাতে হাঁটতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। কিন্তু পারলাম না। রাস্তার ওপর দিয়ে পশুদের দানবীয় লরীগুলো যেভাবে ছুটছে-যে কোন সময় তার তলায় পিষ্ট হয়ে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছুই নয়। বুক সেন্টারের সামনের ফুটপাতে দেখতে পেলাম চাদর মুড়ি দেওয়া আর একটি লাশ। ওর পাশ দিয়ে হেঁটে গেলাম। বাইতুল মোকাররমের মোড়ে রাস্তার ওপর আরো দুটো নাম না জানা বাঙ্গালী বীরের নশ্বর দেহ চোখে পড়লো-চোখে পড়লো জি,পি,ও’র পেছনের গেটে এক ঝুড়ি রক্তাক্ত হৃৎপিন্ড আর নারী-ভুঁড়ি। তবু আমি হেঁটে চলেছি-হেঁটে চলছেন আমার চার পাশের মানুষগুলো। কেননা, আমি এবং আমার চার পাশের মানুষগুলো-আমরা সবাই তখন বাঁচতে চাই। এবং সে জন্যই আমাদের কারো কোন খেয়াল নেই-কারো সাথে কারো কোন কথা নেই। সবাইর চোখেই একটা সন্ত্রস্ত ভাব। সবাই ভীতি বিহ্ববল।

এ লাশগুলো দেখার পর চলার পথে আমার অবচেতন মনে বারবারই দৃশ্যগুলো ফুটে উঠতে লাগলো-মনকে বাধতে চাইলাম-রাস্তায় আর কিছুর দিকে তাকাবো না –কেবল নিজের পদক্ষেপের জায়গাটুকু ছাড়া-কেননা আমার অনুভূতি তখন ভোঁতা হতে শুরু করেছে-প্রচন্ড অন্তর্যাতনায় আমি যেন উদভ্রান্ত। পুরান পল্টন মোড় পেরিয়ে সেক্রেটারিয়েটের ফুটপাতে উঠলাম। ক্যান্টন রেষ্টুরেন্টের বিপরীত দিকের রাস্তায় ডাস্টবিনের পাশে দেখলাম আর একটা বাঙ্গালীর লাশ। হা্তে শোল মাছের একটি কাঁচা মাথা মুষ্টিবদ্ধ। ক্যান্টনওয়ালারা মাছের মাংসটা রেখে মাথাটা ডাষ্টবিনে ফেলে দিল, কোন বুভুক্ষ হতভাগ্য হয়তো বা সেই মাথাটা কাক-কুকুরের সাথে ঝগড়া করে অধিকার করেছিলো-কিন্তু নিয়ে যেতে পারেনি-দখলীকৃত সেই উচ্ছিষ্ট মাথাটা হাতে থাকতেই সে জল্লাদ পাশবিক শক্তির উন্মত্ত শিকার। আর পা চলে না-ইচ্ছে হলো ওখানেই বসে পড়ি।

প্রেসক্লাবের সামনে দিয়ে পেরুতেই একবার ক্লাব প্রাঙ্গণের দিকে তাকালাম-দেখলাম ফয়েজ ভাইয়ের (বর্তমান বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার প্রধান) পুরনো গাড়ীটা পড়ে রয়েছে। ক্লাবের পশ্চিম পাশের বাড়ীর আঙ্গিনা ভর্তি পশুদের ছাউনি-ওপাশে কমিশনার অফিস প্রাঙ্গণে ভর্ত্তি জল্লাদের দল। আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। হঠাৎ এক পথচারীর ডাকে সম্বিত ফিরে আবার চলতে শুরু করলাম।

নতুন হাইকোর্ট ভবনের সামনে দিয়ে রমনা পার্কের পাশ দিয়ে হেঁটে চলেছি আমি-আমি যেন মানুষ নই-দমদেয়া কোন যন্ত্র মাত্র। রমনা রেসকোর্সের পাশে এসে আর রাস্তা দিয়ে হাঁটতে সাহস হলো না-অন্ততঃ মাঠের মধ্য দিয়ে হেঁটে ওদের লরীগুলো যদ্দুর সম্ভব এড়িয়ে চলা যাবে, তাই করলাম। রেসকোর্সের মধ্য দিয়ে হাঁটছি-আর আমার সম্ভ্রম চেতনায় ভাস্বর হয়ে উঠছে-মাত্র আঠারো দিন আগের একটি স্মৃতি। এই সেই রেসকোর্স-যেখানে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেনঃ এবারের সংগ্রাম-মুক্তির সংগ্রাম-এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে একটি বিরাট মঞ্চ-সামনে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করেছেন বঙ্গবন্ধু-মাঠ ভর্তি লোক, এক জনসমুদ্র। আমি সেই সমুদ্রের মাঝ দিয়ে হাঁটছি-হঠাৎ মনে হলো স্বাধীনতার সংগ্রাম নিশ্চয়ই শুরু হয়ে গেছে। অন্ততঃ বিবিসি থেকে সকালে সে আভাসই দেয়া হয়েছে-বাঙ্গালী মুক্তিবাহিনী গঠিত হয়েছে-ওরা গোপন বেতার থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণা করেছে-বিবিসি তার উদ্ধৃতি দিয়েছে। গোপন বেতার থেকে দাবী করা হয়েছে, বঙ্গবন্ধু মুক্তিবাহিনীর সাথে আছেন। বঙ্গবন্ধুর খবর শুনে কিছুটা নিশ্চিত হলাম (যদিও পরে তা সত্য বলে প্রমাণিত হয়নি)।

রেসকোর্স-শাহবাগের মোড় পেরিয়ে কাঁটাবন বস্তির পাশে পৌছিলাম-এ পথে আসতে কতক্ষণ লেগেছিলো বলতে পারবো না। বস্তির পাশের রাস্তার ওপর দেখলাম রক্তমাখা বেশ ক’টি পায়ের ছাপ। রাস্তার ওপর বেশ ক’টি ব্যারিকেড চিহ্ন করতে এসে গুলী খেয়েছে। ক’জন মরলো কে জানে। রক্তমাখা পায়ের ছাপগুলোও বস্তির দিকে এগিয়ে গেছে। আর দশ পায়ের মত সামনে এসে দেখতে পেলাম ফুটপাতে আর রাস্তায় মাঝখানের নর্দমায় একটি রক্তের নহর। রাস্তা থেকে ড্রেনে জমে থাকা রক্তস্রোতে জমাট বেঁধে থক থক করছে-ক’জন বীরবন্ধু সেদিন সেখানটায় আত্নহুতি দিয়ে ছিলেন-কি নাম তাদের –নিজের দেশে মোহাজের এসব বীরদের পৈতৃক ভিটেই বা ছিলো কোথায়?

এই মুমূর্তে আমার আর কোন অনুভূতি নেই-নেই কোন উপলদ্ধিও। আমি হাঁটছি…হাঁটছি নিজের ঘরের পানে-হাঁটছি আমার নিজের এবং আমার আত্নজ-আত্নজাকে বাঁচানো এক স্বার্থপর দুর্দমনীয় মনোবৃত্তি নিয়ে-আর আমার চলার পথের এসব দৃশ্যগুলো কেবল দেখছি আর দেখছি। পুরানো রেল লাইনের (মহসীন হলের পিছনে) ওপারকার বস্তিগুলো ও তখন এক বিরাট ধ্বংসস্তুপ-বস্তির ছোট ছোট ঘরগুলো পুড়ে সুন্দর ছাইয়ের স্তুপে পরিণত হয়েছে। ক’জন ওরা এখানে মরলো-তার হিসাবই বা কে রাখে।

এলিফ্যান্ট রোড আর ল্যাবরেটরী রোডের সংযোগস্থলে দেখলাম বেশ ক’জন পাষন্ড রাস্তায় টহল দিচ্ছে। আমি অনেকটা টহলে টহলে তাদের সামনে দিয়ে পার হচ্ছি। হঠাৎ একটি বিক্ষুদ্ধ কন্ঠে থমকে পেছনে ফিরে চাইলাম। দেখলাম পাকিস্তানী সামরিক পোশাকের আবরণে বন্দি একজন বলছেন স্পষ্ট বাংলায়ঃ শালারা আমরা তো গেছি-তোদের দিনও আর বেশী বাকী নেই। এবার যেতে হবে। বুঝলাম কোন বাঙ্গালী হয়তো নিজেকে বাঁচানোর জন্যই তাদের সাথে টহল দিতে এসেছেন একান্ত অনিচ্ছায়। কথাগুলো বলেছেন, তার কোন পাঞ্জাবী হার্মাদ সহকর্মীকেই। সেই বাঙ্গালী সৈনিকটি আজ আর বেঁচে আছেন কিনা কে জানে।

বিজ্ঞান গবেষণাগারের কাছে এসে শুনলাম পাশের বাড়ীতে দু’টি লাশ রয়েছে। আগের রাতে পাষন্ডরা ওদের হত্যা করেছে-বাড়ীর ভেতর ঢুকেই। এখানেই মিরপুর রোডের ওপর এ পাষান্ড দাঁড়িয়ে মাইক দিয়ে ঘোষনা করছে, কারফিউ বিকেল চারটা পর্যন্ত শিথিল করা হয়েছে। এই ঘোষণায় আমার চলার গতিও কিছুটা শিথিল হলো। তারপর আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলাম রায়ের বাজারস্থ আমার বাসার দিকে। প্রায় বারোটায় বাসায় পৌঁছিলাম। বাসায় পৌঁছে নতুন করে আবার আতঙ্কগ্রস্থ হলাম।

সাতাশে মার্চ সকালে কারফিউ শিথিল করার পর রাস্তায় বেরিয়ে দেখলাম, যেন মানুষের মিছিল। হাজার হাজার মানুষ উর্ধ্বশ্বাসে ছুটে পালাচ্ছেন শহর থেকে গাঁয়ের দিকে। কেননা তাদের ধারনা জল্লাদ বাহিনী হয়তো বা শহরেই চালাবে তান্ডবলীলা-গ্রাম পর্যন্ত হয়তো পৌঁছুবে না-কিন্তু কালক্রমে ওদের ও ধারণা মিথ্যে বলেই প্রতিপন্ন হয়েছে। ইয়াহিয়া-টিক্কার নরখাদকরা শহরেএ চাইতেই গ্রামেই শেষের দিকে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল-বাংলাদেশের ৬৬ হাজার গ্রামের মধ্যে ৩০ হাজার গ্রাম ওরা পুড়িয়েছে-চালিয়েছে মানব ইতিহাসের সব চাইতে জঘন্য ও ঘৃণ্যতম হত্যাকান্ড।

রায়ের বাজারে নদীর ধারে গিয়ে দেখলাম এক অভূতপূর্ব মর্মান্তিক দৃশ্য। প্রাণভয়ে মানুষ যে কত অসহায়, কত কষ্ট স্বীকার করতে পারে এটা তারই একটা প্রতিচ্ছবি। কাঁধে-ঘাড়ে-হাতে ছোট ছোট বাচ্চা আর পৌঁটলা পুটলীসহ এক কোমর থেকে এক বুক পানি ভেঙ্গে নদী পার হচ্ছে হাজার হাজার নর-নারী। প্রাণ বাঁচানোর আকুল চেষ্টায় ধাবমান অনেকেরই ইজ্জত-আব্রুর দিকে কোন খেয়াল নেই। যে সব গৃহবধুকে সেদিন রাস্তায় এবং নদী পার হবার সময় এমন বিপর্যস্ত অবস্থায় দেখেছি-তাদের অনেকেই কোন দিন সূর্য্য দেখেছেন কি না বলা যায় না। অনভ্যস্ত পদে তাড়াহুড়ো করে পথ চলতে গিয়ে কত মহিলা ও শিশু যে হোঁচট খেয়ে পড়ে পা ভেঙ্গেছেন, কতজনের যে নখ উল্টে গেছে-তার খবরই বা কে রাখে। আমার আত্নীয় সেদিন এমনিভাবে পালাবার সময় আছাড় খেয়ে পড়ে পায়ের নলার হাডডি দু’টো ভেঙ্গেছে-এখনও তিনি হাঁটতে পারছেন না-কোনদিন পারবেন কিনা বলা শক্ত।

বেশীক্ষণ দাঁড়িয়ে বাঙ্গালী হয়ে বাংলাদেশের বুকে বাংলারই মা-বোন আর বাচ্চাদের এ মর্মান্তিক অবস্থা দেখতে পারিনি-পারিনি সহ্য করতে নিজের অক্ষমতার আত্নদহনের জ্বলে মরেছি কেবল। বিকেল চারটা বাজতে না বাজতেই হার্মাদের বিরাট বিরাট লরীগুলো ঐ এলাকার রাস্তা এবং ছোট ছোট জীপগুলো অলি-গলিতে ছুটোছুটি শুরু করলো। আমরা সবাই আবার গৃহে অন্তরীণ হলাম। চারটার কয়েক মিনিটের মধ্যেই নদীর পাড়ের দিকে বেশ কয়েকটা গুলীর আওয়াজ শুনতে পেলাম। পরে জানতে পেরেছিলাম, যে হতভাগীরা জানের ভয়ে শহর ছেড়ে পালাচ্ছিলো-তাদের ওপরই হার্মাদরা নির্বিচারে গুলী চালিয়েছে-কতজন যে সেদিন এখানে সেখানে শহীদ হয়েছেন কেউ তার কোন হিসাব জানে না-কোন দিন কোন ইতিহাসেও হয়তো বা ওদের কথা আর কেউ লিখবে না।

সন্ধ্যায় ঘরে বসে বসে বহু কষ্টে স্বাধীন বাংলা বেতারের খবর ধরতে সক্ষম হলাম। সেই প্রথম শুনতে পেলাম এই বেতারে খরব-শুনতে পেলাম ঘোষকের আনাড়ি কন্ঠে যে, বঙ্গবন্ধু ২৬শে মার্চ ভোরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষনা করেছেন এবং তিনি মুক্তিবাহিনীর তত্ত্বাবধায়নে নিরাপদে রয়েছেন। এই কথাটা শুনে আশ্বস্ত হয়েছিলাম-আনন্দিতও হলাম। অবশ্য পরে শেষাক্ত ঘোষনাটি সত্য বলে প্রমাণিত হয়নি। রাত যতই বাড়তে লাগলো সারা এলাকাজুড়ে জল্লাদদেরও তান্ডবলীলা আরো বাড়তে শুরু করলো। রাত ১১টার দিকে আমার বাসার সামনের গলির মুখে বাসা দু’টোয় ওরা দু’দল ঢুকলো, এ বাসা একটি কুমোরদের। অপরটিতে থাকেন দু’টো রিক্সাওয়ালাদের পরিবার। রিক্সাওয়ালাদের বাসা থেকে এরা দু’জন তরুনীকে ধরে নিয়ে গেলো। মুসলমান ধর্মের ধজ্বাধারী ইয়াহিয়া-টিক্কা-ভুট্টোর হার্মাদ বাহিনীর পাশবিকতার যূপকাষ্ঠে দু’জন বাঙ্গালী নিঃসহায় তরুনীর একমাত্র সম্বল নারীত্ব ভূলন্ঠিত হলো।

কুমোরদের বাসায় ঢুকে ওরা প্রথমে ভাঙলো ওদের ঠাকুর ঘরের দেবী-প্রতিমাগুলো। তারপর ঢুকলো অভ্যন্তরে। বাড়ির ভেতরে ঢুকে ঘর থেকে টেনে বের করলো ১০ থেকে ৬০ বছর বয়সের সকল পুরুষকে। ও বাড়ির একজন বধূ ও একজন মেয়েকে ধর্ষণ করলো তাঁদের স্বামী, মা-বাবা আর শশুর-শাশুড়ির সামনে। এক জল্লাদ ঘুমন্ত একটি বছর দেড়েকের বাচ্চার বুকে ঢুকিয়ে দিলো তার সুতীক্ষ্ণ বেয়োনেট। তারপর বেয়োনেটের আগায় ঝুলিয়ে রাখলো ওর কচি দেহলতাটিকে। চোখের সামনে দেখলাম, সেই অবুঝ শিশুর হাড়গোড়্গুলো ঝুরু ঝুর করে পড়ছে জল্লাদের হাতে ধরা রাইফেলের গা বেয়ে। বেশীক্ষণ আর সহ্য করতে পারি নি। বাসার পেছনের চোরাগলি পথে দাঁড়িয়ে দেখলাম সে দৃশ্য। আড়ষ্ট হয়ে গিয়েছিলাম। আজও ভাবী এসব দেখে কী করে সহ্য করেছি-কেন পাগল হয়ে গেলাম না। কেন আমি মানুষ হয়ে জন্মালাম!

কুমোরদের বাড়ী থেকে বেড়িয়ে আসার সময় হঠাৎ ওরা এসে তমকে দাঁড়ালো ওদের পাতিল পোড়ানোর সেই বিরাট অগ্নি কুন্ডটির সামনে। বাড়ীর সবাইকে বন্দুকের নলের মুখে ডেকে এনে জিজ্ঞাসা করলো ওটা কি? কুমোর কেউ তো উর্দু জানে না বলতেও পারে না তবুও ওরা বর্বর খান সেনাদের বোঝাতে চেষ্টা করলো। এক বর্ণও বাংলা না জানা অথচ বাঙ্গালীর দরদের খান সেনারা তাঁর একটা কথাও বুঝলো না। বুঝতে চাইলো না। শুরু হলো নির্মম মারধর আর বেয়োনেটের খোঁচা। খান সেনারা চিৎকার করে বলতে লাগলো শালালোক ঘর কা আন্দার এতনা বড়া ব্যাঙ্কার বানায়া হ্যায়। কেতনা গালিচ (মুক্তিযোদ্ধা) হ্যায় হিয়া পার। বাতাও কেতনা হ্যায় তেরা ঘরমে। কুমোরেরা যত বলে হুজুর এটা আমাদের পাতিল পোড়ার কুন্ড ততই যেন তাদের নির্মম নির্যাতনের পরিমাণ বাড়তে থাকে। চোখের সামনে স্বামী ও ছটি সন্তানের এমন নির্মম নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে শেষটায় কুমোর গিন্নী ওদের সর্দার গোছের লোকটির পায়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। এক লাথিতে তাঁকে কমপক্ষে পাঁচ হাত দূরে ঠেলো ফেলে দিলো সেই নারকীয় জল্লাদটি। তারপর কি মনে করে ঘট ঘট করে বেরিয়ে গেলো ওরা সবাই।

চোরা পথ দিয়ে দৃশ্য দেখছিলাম-আর ওরা যদি আমার বাসায় ঢুকে তবে কি করবো-সেটাই ভেবেছিলাম। বাসায় রয়েছেন আমার ষাট বছরের বুড়ো নানু- একটা মোমবাতি জ্বালায়ে তিনি সন্ধ্যা থেকেই কোরান শরীফ পড়তে শুরু করেছেন আর তাঁর চোখ বেয়ে পড়ছে অশ্রুধারা। আমার চারটি বাচ্চার মধ্যে বড়টি ছাড়া ছোট তিনটির একজনকে নিজে কোলে নিলাম অন্যটিকে ঝিয়ের কোলে এবং তখন মাত্র একুশ দিন বয়স ছোটটিকে ওর মাযের কোলে দিয়ে সেই চোরাপথটিতে দাঁড় করিয়ে রাখলাম। উদ্দ্যেশ্য জল্লাদরা আমার বাসার গেট ভাঙ্গানোর সাথে সাথেই দৌড়ে গিয়ে পিছনের পানি ভর্তি এঁদো পুকুরটিতে নেমে যাবো। অন্ততঃ বেঁচে থাকতে পারি কিনা সে চেষ্টা তো করতে হবে। নানু ঘর ছেড়ে যেতে নারাজ। তিনি বলেনঃ জল্লাদের হাতে যদি এভাবে আমার মরণ থাকে তবে মরব। তোরা আল্লাহর উপর তোয়াক্কা করে পালানোর চেষ্টা কর। তোদের ওরা রাখবে না।

আল্লাহর কি ইচ্ছা-ওরা আর আমাদের বাসার দিকে গেল না তখন। কিন্তু সারারাত ধরে আমরা ওই চোরা পথেই বসে থাকলাম। কেননা কখন ওরা বাসায় ঢুকে পড়ে। এভাবেই রাতটা কেটে গেল।

পরদিন সকালে উঠে ঠিক করে ফেললাম যে রায়ের বাজার এলাকায় আর আমার থাকা উচিত নয়। সাথে সাথে আঠার টাকা দিয়ে দুটো রিকশা ঠিক করে রায়ের বাজার থেকে মতিঝিল কলোনীর দিকে যাত্রা করলাম।

যাবার পথে রায়ের বাজারের মোড়ে দেখলাম একখানা গাড়ি। দুজন বিলাতি সাহেব গাড়িতে। ওরা আমাকে থামালেন। কোথায় যাচ্ছি কেন যাচ্ছি জানতে চাইলেন। রাতের ঘটনা তাদের জানালাম পরে জানতে পারলাম যে এ দুজন বৃটিশ সাংবাদিক। কোন মতে বৃটিশ হাইকমিশনের একখানা গাড়ি যোগাড় করে তাঁরা বেরিয়েছেন, বিধ্বস্ত ঢাকার পথ দেখতে। তাড়াহুড়ো করে ওদের সঠিক পরিচয় জানতে পারিনি। একদিকে পালাচ্ছি আর অন্যদিকে জল্লাদরাঃ তখনো টহল দিচ্ছে।

সাতাশের রাতে তারা রায়ের বাজারের পটারী সেন্টারের দেয়ালের সাথে দাঁড় করিয়ে কয়েকজনকে গুলি করেছে আজও তার কোন হিসাব পাওয়া যায়নি। কোনদিন সে হিসাব পাওয়া যাবে কিনা কে জানে।

<৮,৪,৩৩১-৩৪>
[পাকবাহিনীর ইকবাল হল আক্রমণের উপর দু’টি প্রতিবেদন]
স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম দূর্গঃ ইকবাল হল
-দৈনিক আজাদ, ১৪ ও ১৫ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২।।

গ্যারেজের উন্মুক্ত ছাদে সটান হয়ে শুয়ে পড়লেন জিনাত আলী ও তার সঙ্গী তারেক, আব্দুর রউফ ও তার ছোট ভাই জগন্নাথ কলেজের ছাত্র মোয়াজ্জেম হোসেন। আধ ঘন্টা পর অর্থাৎ একটা-দেড়টার দিকে শুরু হলো পাক হানাদারদের আক্রমণ। অন্ধকারে বুক চিড়ে ছুটছে বুলেট। স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয় অস্ত্রের ভয়াল গর্জনে সমস্ত এলাকাটা প্রকম্পমান। অক্টোপাসের মতন হানাদাররা ঘিরে ফেলেছে হল এলাকা। কামান দাগছে, গ্রেনেড ছুড়ছে এক ধরণের আগুনের বোমা। বোমাগুলো ফস করে জানালা দিয়ে ঢুকে ঘরের ভিতরে পড়তেই ঘরে আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। সে আগুনে কাপড়চোপড়, আসবাবপত্রসহ যত কিছু দাহ্যবস্ত এমনকি দালানের আস্তর পর্যন্ত পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। ইকবাল হলের তিরোধকারী তরুণেরাও বীরবিক্রমে প্রতিরোধ দিয়ে যাচ্ছে।

থ্রি নট থ্রির আওয়াজ শুনেই তা বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু যেভাবে আগুন হলের সমস্ত ঘরে তাতে কি করে বেশিক্ষণ ওদের পক্ষে প্রতিরোধ দেয়া সম্ভব হবে? আগুনের লেলিহান শিখা ক্রমেই হিস হিস করে ছড়িয়ে পড়ছে। এসেমব্লি ঘর ও পাঠাগারে আগুন জ্বলে উঠলো দাউদাউ করে। পাশের রেল সড়কের বস্তিও জ্বলছে। ওদিক থেকে ভেসে আসছে মৃত্যু যন্ত্রনাকাতর মানুষের আর্তনাদ। আকাশে উড়ছে লাল নীল রঙের অনুসন্ধানী ফানুস। এক বিচিত্র ভৌতিক পরিবেশ। সারা নগরী যেন জ্বলছে জলন্ত আগুনে, কামান, মর্টার, গ্রেনেড আর যতসব স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্রের সম্মিলিত বীভৎস গর্জন বিভীষিকাময়তার জন্ম দিয়েছে। গ্যারেজের ছাদে ওরা শুয়ে আছে চারজন মৃত্যুশীতল অনুভূতি নিয়ে। মাথার আধ হাত দিয়ে বুলেটগুলো সব উড়ে যাচ্ছে। পানির ট্যাঙ্কিতে যেন বুলেটের খই ফুটছে। তারেক এর ফাঁকেও গড়িয়ে ছাদের এমাথা-ওমাথা ঘুরে শত্রুর গতিবিধি লক্ষ্য করতে চেষ্টা করেছে।

কিন্তু কাউকেই হলের কাছাকাছি দেখতে পেল না। শুধু পুড়লো। হানাদাররা হলের ভিতরে প্রবেশ করেনি, করতে সাহস পায়নি। দূর থেকে এক যোগে দল তাক করে ছুড়ে দেয় ঝাঁকে ঝাঁকে বুলেট, কামানের গোলা, গ্রেনেড, মর্টার, রকেট। চোখ ধাঁধানো আলোর ঝলকানি দিয়ে ট্যাঙ্ক এসে থামলো পলাশির মোড়ে। শুরু হলো বিচিত্র শব্দে গোলাবর্ষণ। এমন শব্দ এর আগে কোনদিন কেউ শোনেনি।

হঠাৎ জিনাতের মনে হলো এই প্রচন্ড অগ্নিশিখা আর ঘূর্ণিঝড়ের মত গোলাগুলির আবেষ্টনীর মধ্যে পড়ে এখন কী করবে ঐ দূর্ধর্ষ তরুণ প্রতিরোধী্রা বের হয়ে যাওয়ার কোন পথ নেই। মৃত্যু যে ওদের অক্টোপাসের মত ঘিরে ধরেছে সব দিক দিয়ে। স্বাধীনতার বেদীতে তাহলে ওরা আত্মহুতি দিল মহান মর্যাদায়? চোখ জোড়া আদ্র হয়ে এলো জিনাত আলীর। হঠাৎ নিজেদের কথাও তার মনে পড়লো।

মৃত্যু তাদেরও চারদিকে ঘিরে রয়েছে। ইকবাল হলের দক্ষিণ পশ্চিম দিকে রেল সড়কের বস্তিতে যখন আগুন লাগিয়ে দেয় হানাদার বাহিনী তখন বস্তিবাসী নারী-পুরুষ শিশু বৃদ্ধ যুবা সবাই পাঁচিল ডিঙিয়ে ছুটছিল হলের ভিতর দিকে আশ্রয়ের আশায়। এমনটা ওরা সবসময় করে, ঝড় বৃষ্টি বাদলার দিনে হোক আর কোন আন্দোলনের শিকার হয়েই হোক, ইকবাল হল তাদের চিরদিনের একটি নিরাপদ আশ্রম। বলতে গেলে তাদের জন্য এটি সুরক্ষিত দূর্গ।

কিন্তু এবার সে দূর্গ তাদের রক্ষা করতে পারলো না। যেমনি দলে দলে লাফ দিয়ে পাঁচিল ডিঙিয়েছিল তেমনি দলে দলে সবাই মুখ থুবড়ে পড়লো স্বদেশের পবিত্র মাটিতে পাক হানাদারদের বুলেট খেয়ে। এই রেল সড়কের বস্তি সংলগ্ন ইকবাল হলের পিছনদিকটার হলের গৃহশিক্ষকদের কোয়ার্টার। জনৈক গৃহ শিক্ষক পড়ার টেবিলে থিসিসের সাধনায় নিমগ্ন ছিলেন।

বই আর শিক্ষা অঙ্গনই তাঁর জগৎ। এর বাইরে যা ঘটে তার আভাস ইঙ্গিত পান ঘটনার পর। যেহেতু প্রত্যক্ষভাবে বাইরের কিছুরই সাথে তিনি জড়িত নন, তাই এই কালরাতের বিভীষিকা সম্পর্কে কোনরূপ পূর্ব ধারণাই তাঁর ছিল না। রাত ৮ টার দিকে ডাকসুর সহসভাপতি আবদুর রব তাঁর ঘরে রাখার জন্য একটি ট্রাঙ্ক পাঠিয়েছিলেন। তখন গৃহ শিক্ষক অধ্যাপক চৌধুরী মনে করেছিলেন একটা কিছু হবে বোধয় আজ রাতে। এর বেশি আর ভাবনাই তাঁর আসেনি। ইতিমধ্যে কয়েকজন শিক্ষক চলে গিয়েছিলেন নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। কিন্তু অনেকেই যাননি। হলে যতক্ষণ ছাত্ররা রয়েছে ততক্ষণ তাঁদের যাওয়া কি শোভা পায়? তাঁদের প্রতি দায়িত্ব রয়েছে না শিক্ষকদের? এই দায়িত্ব বোধয় ধরে রাখে অধ্যাপক চৌধুরীকে সপরিবারে তাঁর দোতলার কোয়ার্টারে।

বস্তিবাসীদের আর্তচিৎকার আর মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরানি শুনে ধ্যান ভাঙলো চৌধুরী সাহেবের। পড়ার টেবিল থেকে উঠে জানালা দিয়ে দেখতে চাইলেন কী ব্যাপার। আঁতকে উঠলেন অধ্যাপক সাহেব। কী সর্বনাশ, এ যে বিভীষিকা! ঢাকা নগরী যেন এক রাক্ষসপুরী। চলছে পিশাচ দেবতার অর্চনা।

রাক্ষসদের চলছে মহাসমারোহে নরমাংশ ভোজোৎসব।এ হিংস্রতার এক নজীরবিহীন ইতিহাস। অধ্যাপক চৌধুরী যেদিকে তাকালেন শুধু আগুন আর গোলাগুলির বিরামহীন ভয়াল গর্জন।

২৫ শে মার্চের বিভীষিকাময় কাল রাতের অবসান হলো। কিন্তু কাক ডাকলো না সম্মিলিত স্বরে, পাখি কলকুঞ্জন দিগন্ত মুখরিত করে ২৬-শে প্রভাতকে স্বাগত জানালো না- তবু ভোর হলো এক নিস্তব্ধ শোকে মুহ্যমান শ্মশান নগরীতে এক মৃত্যুপুরীতে। বস্তুতঃ বিভীষিকাময়তার অবসান হলো না। বরঞ্চ বাংলাদেশে ইতিহাসের নজীরবিহীন হত্যাকান্ড, লুন্ঠন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, ধ্বংস আর অত্যাচার নিপীড়নের বিভীষিকাময় অধ্যায়ের এখান থেকেই শুরু। গোলাগুলি থেমে গেছে ইকবাল হল এলাকায়।

কিন্তু সান্ধ্য আইন জারী করেছে হানাদাররা সমস্তদিন ধরে। কারণ হত্যাযজ্ঞ যা চালিয়েছে তা সবটা জানাতে চায় না বিশ্ববাসীকে। তবু ভোর হবার সাথে সাথে ফাঁক বুঝে শোকে মুহ্যমান হাজার হাজার নরনারী জীবন বাঁচাবার তাগিদে ছুটছে শহর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। ইকবাল হলে ও আশেপাশে যারা তখনো বেঁচেছিলো তারাও জীবনের তাগিকে বেরুচ্ছে ফাঁকার দিকে। রাতে হানাদাররা হলের প্রতিটি ঘরে তালা ভেঙে আসবাব বিছানাপত্র পুড়িয়েছে, মূল্যবান জিনিসপত্র যা চোখে পড়েছে সব লুটে নিয়ে গেছে আর যাকে পেয়েছে সামনে তাকে হত্যা করেছে নির্মমভাবে।

এর ফাঁকে ফাঁকে দু’চারজন বেঁচে গেছে নানান কৌশল করে। যেমন বেঁচে গেছে তারেক, জিনাত আলী, রউফ, মোয়াজ্জেম গ্যারেজের ছাদে আশ্রয় নিয়ে। বেঁচে গেছে আরও একটি ছেলে আর একটা হলের কক্ষে থেকেও। সে লেপ জড়িয়ে নিঃসাড় দাঁড়িয়েছিল দেয়ালে ঠেসান দিয়ে। হানাদাররা তখন খুনের নেশায় মাতাল তাই অত খুঁটিয়ে দেখার ফুসরত তাদের ছিল না। বেঁচে গেছে কয়েকজন হলের পেছনে সাধারণ কর্মচারীর কোয়ার্টারে আত্মগোপন করে। রেল সড়কের বস্তির বাসিন্দা চম্পার মা তার ছোট ছেলেকে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল এই সাধারণ কর্মচারীদের একটি ঘরে, রাতে তার ঘরে এসে আশ্রয় নেয় আরও দু’জন ছাত্র। সেই ছাত্র দু’জনকে ঘরের ভিতর ছেড়া কাথা লেপ দিয়ে ঢেকে সারারাতটা দরজায় বসে কাটিয়েছে চম্পার মা। রাতে দু-দু’বার এসেছিল হানাদাররা।

জিজ্ঞেস করেছিল চম্পার মাকে কেউ আছে নাকি তোমার ঘরে। চম্পার মা সভয়ে উত্তর দিয়েছিলো না কেউ নেই। আমরাই শুধু। হানাদাররা ঘরে ঢুকে আর দেখেনি। হয়তো কুমতলব ছিল দস্যুদের কারো মনে কিন্তু ওদেরই একজন তাচ্ছিল্যভরে বলেছিল আরে ছোড়ো বিলকুল বুডডি হায়। চম্পার মায়ের পাশের ঘরে বাহির থেকে তালা লাগিয়ে ভেতরে আশ্রয় নিয়ে বেঁচে গিয়েছিল আরও দু’জন ছাত্র। কিন্তু বাঁচতে পারেনি স্টুয়ার্ট জলিল। চম্পার মায়ের চোখের সামনে তাকে গুলি করে হত্যা করে দস্যুরা।

এই মৃত্যুর আলিঙ্গন থেকে যারা বাঁচলো তারাই আগামীদিনে বিভীষিকাময় ইতিহাসের সাক্ষ্মী। ভোর থেকে চম্পার মায়ের কানে কাদের যেন করুণ মা-মা আর্তস্বর ভেসে এলো। চম্পার মা ভাবলো হানাদারদের বুলেটে আহত কারা যেন মৃত্যুর আগে শেষবারের মতন প্রাণ ভরে মা ডাক ডেকে নিচ্ছে। চম্পার মায়ের হৃদয় সেই ডাকে সাড়া দেবার জন্য আকুল হয়ে উঠলো। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলো চম্পার মা। দু’পা এগুতেই দেখলো পাশের তালাবদ্ধ ঘর থেকে মা ডাক ভেসে আসছে।

চম্পার মা দরজা ঠেলে ফাঁক করে দেখতে চাইলো ওরা জীবিত, অক্ষত, আহত না মৃত। না ওরা দু’জনেই জীবিত ও অক্ষত। ওরা চম্পার মাকে চ্যালাকাঠের মত শক্ত আকাটা জিভে বের করে দেখালো। কিছুই বলতে পারলো না মুখ ফুটে। চম্পার মা বুঝলো তৃষ্ণায় ওদের জিভ শুকিয়ে গেছে। ফেটে যাচ্ছে বুকের ছাতি কিন্তু পানি খাওয়াবে কীভাবে চম্পার মা ওদের? তেমন কোন পাত্র যে নেই হাতের কাছে। চম্পার মার মাতৃহৃদয় ব্যাথায় মোচড় দিয়ে উঠলো। দৌঁড়াদৌঁড়ি করে চম্পার মা তার শেতল আঁচল কলের জলে ভিজিয়ে বাড়িয়ে দিল দরজার ফাঁক দিয়ে।

সেই ভিজে আঁচল চুষে ঢোক গিলে প্রাণ এলো ছেলে দু’টোর। তারপর চম্পার মার সাহায্যে দরজা টেনে ফাঁক করে বেরিয়ে ছুটলো যেদিকে দু’চোখ গেলো। যাবার সময় চম্পার মার উদ্দেশ্যে বলে গেল, তুমি আমাদের মা, গর্ভধারিণী ,মায়ের চেয়ে আপন ও মহৎ। যতদিন বেঁচে থাকবো তোমার কথা মনে থাকবে মা। চম্পার মা জানেনা সেই দামাল ছেলেগুলো আজ কোথায়, কেমন আছে।

ইকবাল হল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে বেরুতেই হাতে খালেকের পানের দোকান। খালেক রাতেই পালিয়ে গিয়েছিল। দোকানে ছিল খালেকের কর্মচারী কিশোর ইউসুফ। ইউসুফ রাতে দোকানের ঝাঁপ ঠেলে দিয়ে তালাবদ্ধ করে ভিতরে ছিল হানাদাররা যখন গোলাগুলি ছুড়তে ব্যস্ত তখন এক হানাদারের কন্ঠ শুনেছিল ইউসুফ, শালালোক সব ভাগ গিয়া। কিন্তু ভোর বেলা হানাদাররা এসে ডেকে তুললো ইউসুফকে। কিছুই বলল না, শুধু দোকানে যা কিছু খাবার ছিল বিস্কুট, কেক, টফি সব দিতে বলল একটার পর একটা।

প্যাকেটের পর প্যাকেট সিগারেট নিয়ে নেয়। সাবান নেয়, পয়সা দেবার প্রশ্নই উঠে না। তারা খায়, ইউসুফকে বলে মন্নু এটা দাও, মন্নু ওটা দাও মন্নু। হিংস্র নেকড়ের আদরের মত তারা আদর করে ইউসুফকে ডাকত মন্নু বলে। ইকবাল হল হত্যাযজ্ঞের সারারাতের আরেক সাক্ষ্মী এই ইউসুফ। ভোর হবার সাথে সাথে জিনাত আলীরা ঝাঁপ দিয়ে নামলো গ্যারেজের ছাদ থেকে। ঝাঁপ দিয়ে নামতে গিয়ে ডান পাটা ভেঙ্গে গেল রউফের। ভেঙে ডান পায়ের গোছা থেকে সংযোগটা খুলেই গেল। রউফ আর উঠে দাঁড়াতে পারলো না।

রউফকে আপাতত ফেলে রেখেই শিক্ষকদের কোয়ার্টারে আশ্রয় নিল কারণ মৃত্যু চতুর্দিকে হায়নার মত ওঁৎ পেতে বসে রয়েছে। একজনের জন্য সবাইকে বোকার মত মৃত্যুর নীলস্পর্শে বিলীন হবার কোন যৌক্তিকতা নেই। রউফ সেই মুহুর্তে ভীষণভাবে মৃত্যু কামনা করছিল। এত যন্ত্রণার চেয়ে মৃত্যুই শ্রেয়। কিন্তু হঠাৎ মা, বাবা, ছোট ভাইবোনদের কথা আর তার ভবিষ্যৎ জীবনের কথা মনে হতেই বাঁচার আকাঙ্ক্ষা আবার তীব্র হয়ে উঠলো তার হৃদয়ে।

সে এখন বাঁচতে চায়, ভীষণভাবে বাঁচতে চায়। জীবনটা এত শিগগিরি শেষ হয়ে যেতে চাচ্ছে কেন? আশপাশ থেকে হানাদারদের পদশব্দ কানে ভেসে এলো রউফের। মৃত্যু কি অতি সন্নিকটে? তবু বাঁচার প্রয়াস। রউফ তার ভাঙা পা থেকে ক্ষতিকর রক্তাক্ত দেহকে গড়িয়ে গড়িয়ে বুকে মেখে মেখে পড়ে রইল কাত হয়ে মরার মত। খানিক পরে রউফের ছোট ভাই মোয়াজ্জেম হোসেন ও জিনাত আলী মিলে ধরাধরি করে রউফকে নিয়ে যায় জনৈক ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের ঘরে। সেখানে পাক হানাদার বাহিনীর হাতে পরবর্তী কালে শহীদ ডঃ মর্তুজার সাহায্যে প্রাথমিক চিকিৎসা ও পরে হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থা করা হত। এমনি মৃত্যু আর জীবনের এক হৃদয় বিদারক কাহিনী ছড়িয়ে রয়েছে ইকবাল হলের চারপাশে।

২৬ শে মার্চের ভোরে ইকবাল হলের যেখানেই দৃষ্টি পড়ে সেখানেই দেখা যায় শুধু লাশ। স্বদেশের সোনার ছেলেদের গুলি খাওয়া লাশ। আর আকাশে ধোয়ার কুন্ডুলী। এখান থেকেই শুরু হলো বাংলাদেশে পাক হানাদারদের বীভৎস লঙ্কা কান্ডের যাত্রা শুরু।“

<৮,৫,৩৩৫-৪৮>

[জগন্নাথ হলে পাকবাহিনীর গণহত্যার উপর কয়েকটি প্রতিবেদন]

“হানাদারদের কবলে জগন্নাথ হল-১”
“পঁচিশের সেই ভয়ংকর রাতে তিনি একটানা ১৯ ঘণ্টা ম্যানহোলে ছিলেন”
…দৈনিক পূর্বদেশ, ফেব্রুয়ারি ১৯৭২।

“ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। জগন্নাথ হল। সার্ভেন্টস কোয়ার্টার। পাশেই গোয়াল। এর নিকটে ম্যানহোলে একটানা ১৯ ঘণ্টা আত্মগোপন করে থেকে তিনি আত্মরক্ষা করেছেন। নিজেকে রক্ষা করেছেন হানাদার বাহিনীর অতর্কিত হামলা থেকে। ম্যানহোল পুতি দুর্গন্ধময়। মাঝে মাঝে তার দম বন্ধ হয়ে যেতো। মাথা ঝিমঝিম, পা রিরি করতো। উপায় নেই বেরুবার। অবিরাম গোলাগুলির শব্দ। মানুষের আর্তনাদ, কান্নার শব্দ সবই তার কানে ভেসে আসছিল।

একটু পরপর কিছু সময় অন্তর অন্তর ম্যানহোল থেকে কোন রকমে গলাটুকু পর্যন্ত বের করে তিনি শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়েছেন। এক পলক দেখে নিতে চেষ্টা করেছেন ম্যানহোলের বাহিরের দুনিয়াটাকে, যখন তখন বীভৎস হত্যালীলা চলছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের সাধারণ সম্পাদক শ্রী পরিমল গুহ আমার কাছে ২৫শে মার্চের ভয়াল ভয়ঙ্কর রাত্রের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছিলেন।

তিনি এই দুঃস্বপ্নের রাতের একজন সাক্ষী হয়ে ছিলেন। ম্যানহোলে কোন রকমে ঢুকে পড়ে মৃত্যুপুরীর নিশ্চিত পরিমাণ থেকে নিজেকে অনেকটা অলৌকিকভাবে রক্ষা করেছেন। তিনি বলেছেন ২৫শে মার্চ রাতে প্রায় ১১টার দিকে আমি প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী রথীন রায়ের লক্ষীবাজারস্থ বাসা থেকে হলে ফিরি। তখনো হানাদার সামরিক বাহিনীর লোকেরা হামলা শুরু করেনি। রাস্তায় রাস্তায় মানুষ স্বতঃস্ফুর্তভাবে বেরিকেড তৈরী করেছেন। গাড়িগুলো ক্ষীপ্র গতিতে চলাচল করছে। রথীনদার বাসা থেকে রাস্তায় পা বাড়াতেই লোকজন আমায় জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কোথায় যাবেন। আমি জগন্নাথ হলে যাব শুনে সবাই আমাকে যেতে নিষেধ করলেন। বললেন, শহরের অবস্থা খুব উত্তপ্ত, যে কোন সময় সামরিক বাহিনী নামতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাই হবে এদের প্রধান লক্ষ্যস্থল।

আপনি যাবেন না, শ্রী পরিমল গুহ বলেছেন। লোকজনের কথা শুনে আমি বেশ ভয় পেয়ে যাই। ভাবলাম রাত্রে হলে ফিরব না। হলে তখন অনেক ছাত্র। হলে অবস্থানরত ৬০/৭০ জন ছাত্রের সাথে আমার আলাপ হয়েছে। তাদের কথা ভেবে আমি হলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। মরলে সবাই একসাথে মরবো আর বাঁচলে সবাই একসাথে বাঁচবো। ওদেরকে ওভাবে ফেলে আমি নিজের প্রাণ রক্ষাকে বিরোধী ভেবে হলে ফিরি।

রাত্র তখন পুরো ১১টা। চারিদিকে থমথমে ভাব। গাড়ি ঘোড়া চলাচল বন্ধ। নিরব নিস্তব্ধ। মাঝে মাঝে কানে ভেসে আসছে দূর থেকে গগনবিদারী শ্লোগান “জয় বাংলা, বাঙালী জেগেছে- বাঙালী জেগেছে”। হলের ছাত্ররা হলের গেটে দাঁড়িয়ে আছেন। সবাই ভীতসন্ত্রস্ত! কারো মুখে কোন কথা নেই। সবাই অজানা আশংকায় শঙ্কাগ্রস্ত।

আমি তাদেরকে পরিস্থিতি বুঝিয়ে বললাম। আমার কথায় কেউ বিশ্বাস করলোনা। কেউ বললেন আমাদের উপর হামলা করার কোন কারন নেই। এর প্রায় ২৫ জন ছাত্র বাহিরে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেবার জন্য তৎক্ষণাৎ হল ত্যাগ করলেন। জানিনা তারা এখন কোথায়? সত্যিই কি নিরাপদ হতে পেরেছিলেন, না হানাদারদের লোমহর্ষক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিলেন। আমাদের হলে পাকবাহিনী আক্রমণ করে রাত সাড়ে বারটায়। এর আগেই আমরা চারদিকে গোলাগুলির আওয়াজ পাচ্ছিলাম।

সেদিন আমরা রাইফেলের গুলির শব্দ শুনিনি। শুনেছিলাম মেশিনগান, মর্টার শেলিং ও মাঝে মধ্যে ট্যাঙ্কের প্রচন্ড শব্দ। সৈন্য প্রবেশের আগে আমরা যারা হলে ছিলাম তাদের মধ্যে কেউ কেউ হলের ছাদে উঠলো, কেউ কেউ সার্ভেন্টস কোয়ার্টারে, আবার কেউ কেউ নিজেদের রুমেই আত্মগোপন করার চেষ্টা করলো আমি পিছনের দিকের ড্রেনের মধ্য দিয়ে সার্ভেন্টস কোয়ার্টারের দিকে গেলাম।

হানাদার সৈন্যরা তখন হলে ঢুকে পড়েছে। আমি দেখলাম তারা প্রতিটি রুম তন্ন তন্ন করে খুঁজছে। আমার কানে গুলির শব্দ পৌঁছাচ্ছিল। আমি পিছনের দিক দিয়ে বেরুলাম। ধীরে ধীরে সার্ভেন্টস কোয়ার্টারের ড্রেনের দিকে এগিয়া গেলাম। হানাদার সৈন্যরা হলে ঢুকে পড়েছে। আমি তখনো ম্যানহোলে ঢুকে পড়িনি। দেখলাম সৈন্যরা তন্ন তন্ন করে প্রতিটি রুম খুঁজছে।

হলে বাতি নেই। হল আক্রমণের আগেই বিদ্যুৎ যোগাযোগ ছিন্ন করে দিয়েছিল ওরা। তবুও দেখছিলাম ছাত্রদের ধরে বিজয় উল্লাসে ফেটে পড়ত, কখনো বেদম প্রহার করতো, আবার কখনো ধরে নিয়ে আসতো। এর মাঝেই কাছ থেকে গুলির শব্দ কানে আসলো। গুলির শব্দে আমার অন্তর আত্মা কেঁপে উঠলো। এর পরে আমি ম্যানহোলে ঢুকি। তখন রাত প্রায় ১টা।

২৬শে মার্চ। সকালে ভোরের সূর্য উঠলো। আমি ম্যানহোলে। সারাদিন ম্যানহোলে থাকলাম। সারাদিন আমার কানে শুধু গোলাগুলি আর মানুষের আত্মকান্না ভেসে আসছে বা এসেছে। দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা হলো। আর পারা যায়না। ১৯ ঘণ্টা পর আমি প্রাণ হাতে নিয়ে রাস্তায় গুনে গুনে পা বাড়াই। দেওয়াল টপকিয়ে নিকটবর্তী স্টাফ কোয়ার্টারে যাই। প্রফেসর সন্তোষ ভট্টাচার্যের বাসায় আশ্রয় নেই।

-দৈনিক পূর্বদেশ, ১৬ ফেব্রুয়ারী, ১৯৭২

“হানাদারদের কবলে জগন্নাথ হল-২”
-হোসেন তওফিক
জগন্নাথ হলে পাকিস্তান হানাদার সৈন্যদের অতর্কিত আক্রমণ শুরু হয় ২৫শে মার্চ রাত্র সাড়ে বারটায়। ছাত্ররা দিশেহারা হয়ে যে যেদিকে পারলেন আশ্রয় নিয়ে প্রাণ বাঁচাবার চেষ্টা করলেন। ক’জন দল বেঁধে ছাদে উঠলেন, কেউ কেউ নিজের কক্ষেই আত্মগোপন করার চেষ্টা করলেন, দু’একজন সার্ভেন্টস কোয়ার্টারের দিকে গেলেন।

জগন্নাথ হল। নর্থ হাউজ। ২৯ নং কক্ষ। কক্ষে দুজন ছাত্র থাকতেন। হরিধর ও সুনীল দাস। ২৫শে মার্চ সুনীলের একজন অতিথি এসেছিলেন। পরিমল বললো পাকিস্তানী হিংস্র হানাদারেরা নর্থ হাউজে আক্রমণ চালিয়ে প্রথমেই ঢুকলো ২৯ নং কক্ষে।

তিনজনই তখন রুমে উপস্থিত। পাকিস্তানী সৈন্যরা এত হিংস্র হতে পারে তারা তা ধারণা করেননি। তাই সরল বিশ্বাসে তারা নিজেদের রুমটাকেই সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয় ভেবেছিলেন। সৈন্যরা তিনজনকে পেয়ে গেল। শিকার ধরতে পেরে এই পশু সৈন্যদের সে কী উল্লাস, সে কী আনন্দ! পরিমল গুহ বললেন, হলে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ। সৈন্যরা সার্চলাইট সাথে এনেছিল। তিনজনকে একত্রে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ করলো তারা। একত্রে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। এরপর সৈন্যরা রুমে একটা গ্রেনেড ছুড়ে মারলো। পাছে যদি কেউ কেউ বেঁচে যায়!

ব্রাশে সুনীল ও তার অতিথি মারা গেলেন। সুনীলের খবর নিতে এসে তিনি নিজেই নরপশুদের থাবায় প্রাণ বিসর্জন দিলেন। হরিধরের গায়ে গুলি লাগেনি। মেশিনগানের গুলির শব্দে তিনিও অপর দুজনের সাথে পড়ে গিয়েছিলেন মেঝেতে। কিন্তু গ্রেনেড লাগলো তার পায়ে। তিনি মারাত্মকভাবে আহত হলেন। পরিমল গুহ বললেন, গ্রেনেড ছুড়েই হানাদার সৈন্যরা কক্ষ থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল, তারা ভেবেছিল সবাই শেষ। কেউ মেশিনগানের গুলি এবং এর পরেই গ্রেনেড চার্জে বাঁচতে পারেনা। কিন্তু অলৌকিকভাবে বেঁচে গিয়েছিলেন হরিধর। তার পা দিয়ে ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরছিল। নিজের তাজা টকটকে লাল রক্তের ধারা নিজেই চেপে ধরে থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি রক্ত বন্ধ করতে পারেননি।

হরিধর কক্ষে বসে পাহারা দিচ্ছিলেন তার বন্ধু সুনীল আর তার অতিথির মৃতদেহ। কক্ষে রক্তের স্রোত, বেরোবার উপায় নেই। হিংস্র হায়েনার দল এ কক্ষে সে কক্ষে খুঁজে বেড়াচ্ছে। যাদেরকে পেয়েছে তাদেরকেই হত্যা করেছে। হরিধর বিস্ময়ে বিমূঢ়। তার চেতনাশক্তি লোপ পাবার উপক্রম। হতবাক হয়ে বসে রয়েছেন। চিন্তা করছেন হরিধর, সুনীল ও তার অতিথি এবং অপরাপর ছাত্রদের শোচনীয় পরিনতির কথা। তিনি চিন্তা করছেন। খেই হারিয়ে যাচ্ছে তবুও ছিন্তা করছেন। হঠাৎ মনে পড়লো তার কক্ষে কয়টি শিক ভাঙ্গা। চেষ্টা করলে হয়তো বেরোনো যাবে মৃত্যুপুরী থেকে এ পথে।

তখন শেষরাত। হলের ভিতরে গোলাগুলির আওয়াজ কমে গেছে। হরিধর চেষ্টা করলেন। পাইপ বেয়ে নিচে নামলেন। কিন্তু নিরাপদ স্থান কোথায়। ধীরে ধীরে হামাগুড়ি দিয়ে এগুলেন তিনি পুকুরের দিকে। তখনো তার পা দিয়ে রক্ত ঝরছে। তবে রক্তের বেগ কমে গেছে। প্রায় পানির সাথে মিশে তিনি পুকুরের পাড়ে ঘাসের মধ্যে আশ্রয় নিলেন। এরপর এখান থেকে তিনি আর সরেননি। মার্চ সকাল পর্যন্ত হরিধর এ অবস্থায় কাটিয়েছিলেন।

সকালে কারফিউ তুলে নেওয়া হলো। জনৈক দোকানী এ পথে যাবার সময় অর্ধমৃত হরিধরকে দেখতে পান। তিনি হরিধরকে ঢাকা মেডিক্যাল হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। বেশ কয়েকদিনের চিকিৎসার পর হরিধর সুস্থ হয়ে ওঠেন।

-দৈনিক পূর্বদেশ, ২৩ ফেব্রুয়ারী, ১৯৭২

“হানাদারদের কবলে জগন্নাথ হল-৩”

২৫ জন ছাত্রের মধ্যে মাত্র একজন ছাড়া কেউ এদের ক্রুদ্ধ ছোবল থেকে রক্ষা পান নি-
হলের ছাদে লাল টুকটুকে রক্তের স্রোত

তাদের বুকের সাইজ মিলিয়ে দাঁড় করানো হলো। কয়েকটা লাইন। প্রতি লাইনে তিনজন। তারপর “দ্রিম দ্রিম” শব্দ। মেশিনগানের গুলি। সবাই একসাথে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। তারপর একটু নড়াচড়া করে মহান মৃত্যুর হিমশীতল স্পর্শে নীরব হয়ে গেলেন। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের ছাদের কথা বলছি। হানাদার পাকিস্তানী হায়েনার দল ২৫শে মার্চে শেষ রাতে হলের ছাদে আশ্রয় গ্রহণকারী বেশ কয়েকজন ছাত্রকে এমনিভাবে গুলি করে হত্যা করে।

শ্রী পরিমল গুহ বলেনঃ পাকিস্তানী নরপশুদের তান্ডব নৃত্য দেখে সত্য দাস, রবীন ও সুরেস দাস সহ জনা পঁচিশেক ছাত্র হলের ছাদে আশ্রয় নিয়েছিলেন আত্মরক্ষার জন্য। একমাত্র সুরেস ছাড়া আর কেউ ওদের ক্রুদ্ধ ছোবল থেকে রক্ষা পাননি। তিনি বলেছেন সুরেস একটু বেঁটে খাটো। বুকের সাইজ অন্যান্যদের সাথে তার মিল ছিলোনা। তাঁকে সবার পিছনে দাঁড় করানো হলো। তারপর গর্জে উঠলো মেশিনগান। সকলের বুক হানাদারদের মেশিনগানের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেলো। হলের ছাদে লাল টুকটুকে রক্তের স্রোত বইলো। সুরেস বেঁটে খাটো, তার বুকে গুলি লাগেনি। লেগেছিলো তার কাঁধে। তিনিও সকলের সাথে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন ঠিক মৃতের মতো।

মৃতের মিছিলে জীবন্ত সুরেস। আত্মরক্ষার জন্য আশ্রয় নিতে গিয়েও সবাই মৃত্যুর কাছে আত্মসমর্পন করলেন; মৃত্যুকে ফাঁকি দিতে পারলেননা। কিন্তু শুধু বেঁচে রয়েছেন তিনি। বেঁচে রয়েছেন তিনি এই নির্মম হত্যাকান্ডের জীবন্ত সাক্ষী ও প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে। পরিমল বললেন, সুরেসের কাঁধের মাংস উড়ে গেছে মেশিনগানের শক্তিশালী গুলিতে। অবিরাম ধারায় রক্ত ঝরছিল। ক্ষতস্থানে গায়ের জোরে চেপে ধরেও তিনি রক্ত বন্ধ করতে পারছিলেননা। নিজের শরীরের উষ্ণ রক্তে তিনি বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে পড়েছিলেন।

নিজের গায়ের টকটকে তাজা রক্ত অবিরাম ধারায় ঝরছে তো ঝরছেই। কিছুতেই বন্ধ হচ্ছেনা তার রক্তপাত, রক্তের বেগ কমছেনা। ব্যান্ডেজ করা দরকার। কিন্তু ব্যান্ডেজ করবেন কি দিয়ে। পরনের লুংগি আর গায়ের গেঞ্জি ছাড়া তো আর কিছুই নেই। লুংগি ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে লুংগির ছেঁড়া টুকরো দিয়েই তিনি তৈরী করলেন ব্যান্ডেজ। ছাদের উপর সারিবদ্ধ তরুণদের মৃতদেহ। প্রহরীর মত তিনি জেগে আছেন একা।

রক্তের স্রোত। হলের ছাদ লাল রক্তে ভাসে গেছে। চারিদিক নীরব নিঝুম। শুধু গোলাগুলির শব্দ ও মানুষের আর্তকান্না ছাড়া আর কিছুই শোনা যায়না। পরিমল বলেই চলেছেনঃ মৃত্যুর পাশে বসে থাকার উপর তার ধিক্কার আসছিলো,আবার কখনো তার চোখের সামনে ভাসে উঠছিলো ভীড় জমানো ফেলে আসা স্বপ্ন, রঙ্গীন মধুময় হাজারো দিনের স্মৃতি।

আছড়ে আছড়ে কেঁদে সেসব স্মৃতি ফরিয়াদ জানাতো। স্মৃতির মিছিলে সুরেস নিজেকে হারিয়ে ফেলতেন। হলের ছাদের উপর পানির ট্যাঙ্ক। হঠাৎ তার চেতনার উদয় হলো। সুরেস আর দেরী না করে পানির ট্যাঙ্কে ঢুকলেন। ২৬শে মার্চ পুরোদিন ও সারারাত তিনি পানিরট্যাঙ্কে কাটালেন আত্মগোপন করে। ২৭ তারিখ পানির ট্যাঙ্কে তার থাকা সম্ভব হচ্ছিলনা। ২৭ তারিখ ভোরের দিকে প্রাণ হাতে নিয়ে তিনি ভয়ে ভয়ে নামলেন ছাদ থেকে।

এগিয়ে গেলেন জগন্নাথ হলের উত্তর পাশের রাস্তার দিকে। সুরেস ভয়ে সোজা হননি। হামাগুড়ি দিয়ে এগুচ্ছিলেন। পরিমল গুহ তখন কারফিউ তুলে নেবার পর স্টাফ কোয়ার্টার থেকে এদিকের রাস্তায় বেরিয়ে আসেন। পরিমলের সাথে দেখা হওয়ায় সুরেস প্রাণ ফিরে পেলেন। পরিমল গুহ পরে সুরেশকে নিয়ে চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে দিয়ে আসেন। পরিমল ছাদের নারকীয় হত্যালীলার কাহিনী সুরেসের কাছ থেকে শুনেছেন।

-দৈনিক পূর্বদেশ, ২৫ ফেব্রুয়ারী, ১৯৭২

“হানাদারদের কবলে জগন্নাথ হল-৪”

অট্টহাসিতে ফেটে পড়েছিল নরপশুরা। অমানুষিক প্রহারের ফলে তারা তিনজন যখন প্রায় আধমরা
তখন তাদের লাইন বেঁধে দাঁড় করিয়ে গুলি করা হলো

২৬শে মার্চ সকাল ১১টা। হানাদার সৈন্যরা ৫ জনকে ধরে নিয়ে এলো হলের ভিতরে। তাদের দিয়ে বিভিন্ন কক্ষ, হলের ছাদ, বারান্দা থেকে ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত লাশগুলো নিয়ে ট্রাকে তুললো। হলের মাঠে মাঝখানে আগে থেকেই একটি বিরাট গর্ত খুড়ে রাখা হয়েছিলো। লাশগুলো সেখানে নিয়ে এলো মাটিচাপা দেওয়ার জন্য। এই ৫ জনকেও সেখানে নিয়ে গেল। তারপর ঠিক গর্তের পারে তাদেরকে দাঁড় করিয়ে গুলি করলো। সবাই সাথে সাথেই লুটিয়ে পড়লো।

শ্রী পরিমল গুহ বললেন ২৬শে মার্চ সকালের কথা। তিনি তখনো ম্যানহোলে। স্বচক্ষে দেখেছেন নারকীয় হত্যাযজ্ঞ, বীভৎস দৃশ্য। তিনি বলেছেন, এই ৫ জনের মধ্যে তিনি কালীরঞ্জন শীলকে চিনতে পেরেছেন। আর কাউকে চেনা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। তাদের একত্রে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ করার পর হানাদার খুনীরা চলে গেল গাড়ি হাঁকিয়ে।

হয়ত তারা আরো শিকার ধরার জন্যই গেল। মাঠের গর্তের পারে রইল অগণিত নিষ্প্রাণ দেহ। হঠাৎ এই মৃতের স্তূপ থেকে একজন লোক উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে পালালো। পরিমল গুহ বললেন, আমি স্পষ্ট দেখলাম এই ভাগ্যবান ব্যাক্তি কালীরঞ্জন শীল।

জনৈক ইঞ্জিনিয়ারের স্যালুলয়েড ক্যামেরায় যার ছবি ধরা পড়েছে তিনি কালীরঞ্জন শীল। তিনি আবার ২৬শে মার্চ ভোরের কথা বললেন। খুব ভোরে হানাদার সৈন্যরা অধ্যাপক অনুদ্বেপায়ন ভট্টাচার্যকে ধরে নিয়ে আসে মাঠে। শ্রী ভট্টাচার্য হলেন একজন হাউজ টিউটর। এসেম্বলী বিল্ডিংয়ের একটি কক্ষে থাকতেন। পরিমল গুহ দেখেছেন হলের ছাত্র বিধান রায় এবং অপর একজন লোককে তারা ধরে নিয়ে আসলো। শেষোক্ত ব্যাক্তির বেশভূষায় তাঁকে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী বলে মনে হলো।

অধ্যাপক ভট্টাচার্যের পরনে ধুতি। তিনজনকে একত্র করা হলো। প্রহারের পালা। তারা তাদেরকে বুট দিয়ে লাথি দিচ্ছিলো, রাইফেলের বাট দিয়ে মারছিলো। বেদম প্রহার। তারা চিৎকার করছিলো, বিধান প্রহারের তীব্রতা সহ্য করতে না পেরে ছেড়ে দেবার কাকুতি করছিলেন। বারবার প্রার্থনা জানাচ্ছিলেন তাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য। বিধানের কথাতে তারা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছিল। নরপশু সৈন্যরা প্রহারের তীব্রতা আরো বাড়িয়ে দিলো।

অমানুষিক প্রহারের ফলে যখন তারা তিনজন প্রায় আধমরা হয়ে গিয়েছিলেন। তখন তাদেরকে লাইন করে দাঁড় করানো হলো। তারপর সেই পরিচিত মেশিনগানের শব্দ। তারা তিনজন এলিয়ে পড়লেন মৃত্যুর কোলে। পরিমল গুহ বললেন তিনি ২৬শে মার্চ মাঠে মানবতার পূজারী প্রখ্যাত দার্শনিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যক্ষ ডক্টর গোবিন্দ চন্দ্র দেবের মৃতদেহ দেখেছেন। তার গা খালি ছিলো। সৈন্যরা তাঁকে উপুড় করে শুইয়ে রেখেছিলো মাটিচাপা দেবার জন্য।
-দৈনিক পূর্বদেশ, ২৯ ফেব্রুয়ারী, ১৯৭২”

“জগন্নাথ হলের মাঠে ২৬শে মার্চের সকালে যে মর্মস্পর্শী
দৃশ্য দেখেছি আমরা জানালা থেকে টেলিস্কোপ লাগিয়ে
মুভি ক্যামেরায় তা ধরে রেখেছি”

যিনি টেলিভিশন ক্যামেরায় ধরে রেখেছেন ২৫শে মার্চের হত্যাকান্ডের হৃদয়বিদারক দৃশ্য সেই বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎকৌশলের অধ্যাপক ডঃ নূরুল উল্লার সাথে বিশেষ সাক্ষাৎকার।

প্রশ্ন : আপনি কি ২৫শে মার্চের হত্যাকান্ডের ছবি নিজ হাতে তুলেছিলেন?

উত্তর : হ্যাঁ আমি জগন্নাথ হলের মাঠে ২৬শে মার্চের সকাল বেলা যে মর্মস্পর্শী দৃশ্য ঘটেছিলো তার ছবি আমার বাসার জানালা থেকে টেলিস্কোপ ক্যামেরায় তুলেছিলাম।

প্রশ্ন : এ ছবি তোলার জন্য কি আপনার কোন পূর্ব পরিকল্পনা ছিলো, না এমনি হঠাৎ করে মনে হওয়াতে তুলে নিয়েছেন?

উত্তর : ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ভাষণের পর থেকে আমার একটা ধারণা হয়েছিলো যে এবার একটা বিরাট কিছু পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে। তাই তখন থেকেই বিভিন্ন সভা, শোভাযাত্রা, বিক্ষোভ মিছিল, মশাল মিছিল, ব্যারিকেড ইত্যাদির ছবি আমি তুলতে আরম্ভ করি।

প্রশ্ন : ক্যামেরাটি কি আপনার নিজস্ব?

উত্তর : না ওটা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের টেলিভিশন ভিডিও টেপ ক্যামেরা। ছাত্রদের হাতে-কলমে শিক্ষা দেবার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে এমনি ধরনের আরো বহু ক্যামেরা ও জটিল যন্ত্রপাতি রয়েছে।

প্রশ্ন : ক্যামেরাটি আপনার কাছে রেখেছিলেন কেন?

উত্তর : এর জবাব দিতে গেলে আমাকে আরো পেছনের ইতিহাস বলতে হয়। ইতিহাস কথাটা বলছি এজন্য যে এগুলো ইতিহাসের পাতায় লিখে রাখা উচিৎ। ৭ই মার্চের পর আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের কিছু ছেলে এসে আমাকে ধরলো, “স্যার আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেক্ট্রিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের যন্ত্রপাতি দিয়ে একটি অয়্যারলেস স্টেশন তৈরী করতে হবে।” আমি ওদের কথা একেবারে উড়িয়ে দিতে পারলাম না। এর পরে ওরা একদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে কথা ঠিক করে আমাকে তাঁর ধানমন্ডির বাড়িতে নিয়ে গেলেন। আমাকে বঙ্গবন্ধুর বাড়ীর একেবারে ভিতরের এক প্রকোষ্ঠে নিয়ে যাওয়ার পরে আমি দেখলাম সেখানে সোফার উপর তিনজন বসে রয়েছেন। মাঝখানে বঙ্গবন্ধু। তাঁর ডানে সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেব এ বাঁ পাশে তাজউদ্দিন সাহেব।

আমি ঢুকে বঙ্গবন্ধুকে সালাম করলাম। ছাত্ররা আমাকে বঙ্গবন্ধুর সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। যদিও অনেকবার তাঁর সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল। তিনি সোফা থেকে উঠে এসে আমাকে ঘরের এক কোণে নিয়ে গেলেন। আমার কাঁধে হাত রেখে অত্যন্ত সন্তর্পণে বললেন, “নূরুল উল্লা আমাকে ট্রান্সমিটার তৈরী করে দিতে হবে। আমি যাবার বেলায় শুধু একবার আমার দেশবাসীর কাছে কিছু বলে যেতে চাই। তুমি আমায় কথা দাও, যেভাবেই হোক একটা ট্রান্সমিটার আমার জন্য তৈরী করে রাখবে। আমি শেষবারের ভাষন দিয়ে যাব।” বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠ তখন আমার কাছে বাচ্চা শিশুর আবদারের আবেগময় কণ্ঠের মত মনে হচ্ছিল। এর পরেই বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে আমাদের তড়িৎ কৌশল বিভাগের অন্যান্য শিক্ষকদের কাছে খুলে বললাম। শুরু হল আমাদের কাজ। বিভাগীয় প্রধান ডঃ জহুরুল হকসহ প্রায় সকল শিক্ষকরাই আমাকে সহযোগীতা করতে লাগলেন। ৯ দিন কাজ করার পর শেষ হলো আমাদের ট্রান্সমিটার। এর ক্ষমতা বা শক্তি ছিল প্রায় সারা বাংলাদেশব্যাপী। শর্ট ওয়েভে এর শব্দ ধরা যেত। যাহোক পরবর্তী সময়ে এর ব্যাবহার আসেনি। এরই সাথেই আমার মাথায় ধারণা এল, যদি কোন হত্যাকান্ড, অগ্নিসংযোগ বা গোলাগুলি হয় তাহলে তা আমি ক্যামেরায় তুলে ফেলব। এবং সে থেকেই ক্যামেরাটি আমার সাথে রাখতাম।

প্রশ্ন : আপনি কখন ছবি তোলা শুরু করেন?

উত্তর : রাত্রে ঘুমের মাঝে হঠাৎ বিকট শব্দ শুনে আমাদের সকলের ঘুম ভেঙ্গে যায়। অবশ্য আমরা অতটা গুরুত্ব দেইনি। আমি ভেবেছিলাম যে আগের মতই হয়ত ছাত্রদেরকে ভয় দেখাবার জন্য ফাঁকা গুলী করা হচ্ছে। অথবা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের আমাদের নির্দেশ ও সহযোগীতায় যে সমস্ত হাতবোমা তৈরী করছিল তারই দু’একটা হয়ত বিস্ফোরিত হয়েছে। সারাটা রাত একটা আতঙ্কের মধ্যে কাটালাম। জানালা দিয়ে মাঝে মাঝে জগন্নাথ হলের দিকে তাকাতাম। কিন্তু সমগ্র এলাকাটা আগে থেকেই বিদ্যুৎ লাইন কেটে দেয়াতে অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল। রাতে জগন্নাথ হলের এলাকায় কি হচ্ছিল কিছুই দেখতে পারলাম না। শুধু গোলাগুলির শব্দ শুনছিলাম। কিন্তু স্পষ্ট বুঝতে পারলাম যে ওখানে দুপক্ষেই একটা ছোটখাট লড়াই হচ্ছে। সাথে সাথে আমার ক্যামেরাটার কথা মনে পড়ে গেল। অপেক্ষা করতে লাগলাম কখন সকাল হবে আর দিবালোকে আমি ছবি তুলতে পারবো।

প্রশ্ন : আপনি যে ক্যামেরা বসিয়েছিলেন তা কি বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছিলনা?

উত্তর : এমনভাবে ক্যামেরা বসানো হয়েছিলো যে বাইরে থেকে বোঝার কোন উপায় নেই। কারণ পর্দার আড়ালে এমনভাবে বসানো হয়েছিলো যে শুধু ক্যামেরার মুখ বের করা ছিলো। পুরো ক্যামেরাটা কালো কাপড় দিয়ে মোড়ানো ছিল। আমাদের জানালাগুলো এমনভাবে তৈরী যে বন্ধ করার পরেও ধাক্কা দিলে কিছুটা ফাঁক থেকে যায়। ঐ ফাঁক দিয়ে ক্যামেরার মুখটা বাইরে বের করে রাখলাম।

প্রশ্ন : ক্যামেরা চালু করেন কখন?

উত্তর : সকাল ৭টা থেকে ৮টার মধ্যবর্তী সময়ে। জানালা দিয়ে লক্ষ্য করলাম যে জগন্নাথ হলের সামনের মাঠে কিছু ছেলেকে ধরে বাইরে আনা হচ্ছে এবং তাদেরকে লাইনে দাঁড় করানো হয়েছে, তখনই আমার সন্দেহ জেগে যায়। এবং আমি ক্যামেরা অন করি। আমাদের ক্যামেরাটির একটা বিশেষ গুন এই যে, এতে মাইক্রোফোন দিয়ে একই সাথে শব্দ তুলে রাখা যায়। তাই আমি টেপের সাথে মাইক্রোফোন যোগ করিয়ে ক্যামেরা চালু করলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখলাম যে ছেলেগুলোকে একাধারে গুলী করা হচ্ছে ও একজন একজন করে পড়ে যাচ্ছে। পাকসেনারা আবার হলের ভিতর চলে গেলো। আমি ভাবলাম আবার বেরিয়ে আসতে হয়ত কিছু সময় লাগবে। তাই এই ফাঁকে আমি টেপটা ঘুরিয়ে আমার টেলিভিশন সেটের সাথে লাগিয়ে ছবি দেখতে লাগলাম যে ঠিকভাবে উঠেছে কিনা। এটা শেষ করতেই আবার জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম যে, আবার কিছু সংখ্যক লোককে ধরে নিয়ে এসেছে। আবার লাইন করে দাঁড় করানো হচ্ছে। আমি তখন পূর্বের তোলা টেপটা মুছে ফেলে তার উপর আবার ছবি তোলা শুরু করলাম।

প্রশ্ন : আপনি পূর্বের তোলা ছবিটার টেপ কেন মুছে ফেললেন?

উত্তর : আমার মনে হচ্ছিল আমার আগের ছবিতে সবকিছু ভালোভাবে আসেনি। আর নতুন ছবি তুলতে গিয়ে আমি হয়ত আরো হৃদয়স্পর্শী দৃশ্য ধরে রাখতে পারব। আর হাতের কাছে আমার টেপ ছিলনা। মোট কথা আমি ঐ সমস্ত দৃশ্য দেখে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে পাগলের মতো হয়ে গেলাম। আজও দুঃখ করি যদি আমি নতুন টেপে ছবি তুলতে পারতাম তাহলে কত ভালো হতো। দুটো দৃশ্য মিলে আমার টেপের দৈর্ঘ্য বেড়ে যেতো। কিন্তু তখন এত কিছু চিন্তা করার সময় ছিলনা। যা হোক দ্বিতীয়বারের লাইনে দেখলাম একজন বুড়ো দাড়িওয়ালা লোক রয়েছে। সে বসে পড়ে হাত জোড় করে ক্ষমা চাইছে। আমার মনে হচ্ছিলো সে তাঁর দাড়ি দেখিয়ে বোঝাতে চেয়েছিল যে সে মুসলমান। কিন্তু বর্বর পাক বাহিনী তাঁর কোন কথাই শুনতে চায়নি। তাকে গুলি করে মারা হলো। মাঠের অপর অর্থাৎ পূর্বপার্শ্বে পাক বাহিনী একটা তাবু বানিয়ে ছাউনী করেছিলো। সেখানে দেখছিলাম, ওরা চেয়ারে বসে কয়েকজন চা খাচ্ছে আর হাসি তামাসা ও আনন্দ উল্লাসে ফেটে পড়ছে।

প্রশ্ন : লোকগুলোকে হলের ভিতর থেকে কিভাবে আনা হচ্ছিলো?

উত্তর : যাদেরকে আমার চোখের সামনে মারা হয়েছে ও যাদের মারার ছবি আমার ক্যামেরায় রয়েছে তাদেরকে দিয়ে প্রথমে হলের ভিতর থেকে মৃতদেহ বের করে আনা হচ্ছিল। মৃতদেহগুলি এনে সব এক জায়গায় জমা করা হচ্ছিলো। এবং ওদেরকে দিয়ে লেবারের কাজ করাবার পর আবার ওদেরকেই লাইনে দাঁড় করিয়ে এক সারিতে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। মনে হচ্ছিলো একটা করে পড়ে যাচ্ছে।

প্রশ্ন : জমা করা মৃতদেহের সংখ্যা দেখে আপনার ধারণায় কতগুলো হবে বলে মনে হয়েছিলো?

উত্তর : আমার মনে হয় প্রায় ৭০/৮০ জনের মৃতদেহ এক জায়গায় জমা করা হয়েছিলো।

প্রশ্ন : আপনার কি মনে হয় যে ওগুলো সবই ছাত্রদের মৃতদেহ?

উত্তর : আমার মনে হয় ছাত্র ছাড়াও হলের মালি, দারোয়ান, বাবুর্চি এদেরকে একই সাথে গুলি করা হয়েছে। তবে অনেক ভালো কাপড়চোপড় পরা বয়সী দেখে আমার মনে হয় তারা ছাত্রদের গেস্ট হিসাবে হলে থাকছিলো।

প্রশ্ন : আপনি কি দেখেছেন যে কাউকে গুলি না করে ছেড়ে দেয়া হয়েছে?

উত্তর : না তবে লাইনে দাঁড় করাবার পরে যে খান সেনাটিকে গুলি করার নির্দেশ দেয়া হচ্ছিলো সে তখন পিছনে তার অফিসারের দিকে মুহূর্তের জন্য তাকিয়েছিলো। আর এই ফাঁকে দু’জন লোক সামনে স্তূপ করা মৃতদেহগুলির মধ্যে শুয়ে পড়লো। আর বাকিগুলোকে গুলি করে মারা হলো। গুলি করে যখন খান সেনারা কয়েক ঘণ্টার জন্য এলাকা ছেড়ে চলে গেল সেই ফাঁকে ঐ দু’জন উঠে প্রাণভয়ে পালাতে লাগলো। পরবর্তীকালে তাদের একজন আমার বাসায় এসে আশ্রয় নিয়েছিলো। সে একজন ছাত্রের অতিথি হিসাবে হলে থাকছিলো। ঢাকায় এসেছিলো চাকরির ইন্টারভিউ দিতে।

প্রশ্ন : আপনি কি আপনার ইচ্ছা মতো সব ছবি তুলতে পেরেছিলেন?

উত্তর : না, আমি আগেই বলেছি যে আমি থেমে থেমে তুলছিলাম, পাছে টেপ ফুরিয়ে যায়। তাই আমি সব ছবি তুলতে পারিনি বলে আমারও ভীষণ দুঃখ হচ্ছে। কারণ পরে যখন বুলডোজার দিয়ে সব লাশগুলোকে ঠেলে গর্তে ফেলা হচ্ছিলো সে ছবি আমি তুলতে পারিনি। কারণ ওরা কিছুক্ষণের জন্য চলে যাবার পরপরই আমার পরিবারের সদস্যদের জীবনের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে আমাকে বাসা ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিলো।

প্রশ্ন : আপনি কি টেপ সাথে করে নিয়ে গিয়েছিলেন?

উত্তর : না আমি সাথে নেয়াটা আরো বিপদের ঝুঁকি বলে মনে করে বাসায়ই যত্ন সহকারে রেখে যাই। আর এ ঘটনা আমার স্ত্রী ছাড়া আর কেউ জানত না। বাইরে নিয়ে গেলে হয়তো অনেকেই জেনে ফেলতো এবং আজকে এই মূল্যবান দলিল আমি দেশবাসীর সামনে পেশ করতে পারতাম না।

প্রশ্ন : আপনি কখন এই টেপ সবার সামনে প্রকাশ করলেন?

উত্তর : যুদ্ধ চলাকালীন নয় মাস প্রতিদিন প্রতিমুহূর্ত আমার আতঙ্কের মধ্যে কেটেছে। কখন কে জেনে ফেলে। কখন আমি ধরা পড়ে যাই বা কখন এটা এসে নিয়ে যায়। এমনি মানসিক যন্ত্রণায় আমি ভুগছিলাম। যাহোক দেশ স্বাধীন হবার পরে ১৭ই ডিসেম্বর-এর দিকে আমি আস্তে আস্তে প্রকাশ করলাম আমার এই গোপন দলিলের কথা এবং ২/৩ দিন পরেই এটা আমি সবাইকে জানালাম ও কয়েকদিন পরে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক ও অন্যান্যদের এটা দেখালাম। এ খবর শুনে অনেক বিদেশী সাংবাদিক আমার কাছে বহু টাকার বিনিময়ে এই দলিলের অরজিনাল কপি অর্থাৎ আসল টেপ চাইলেন।

প্রশ্ন : আপনি কি রাজি হলেন?

উত্তর : আমার রাজি হবার প্রশ্ন ওঠে না। অরিজিনাল কপি আমি হারালে আমার দেশের জন্য বিরাট ক্ষতি হবে।

“ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় : নির্যাতনের এক অধ্যায়”

বাংলার মানস সন্তানকে বিনাশ করতে কুখ্যাত পাক সামরিক চক্র ও তাদের অনুগ্রহলোভী সহযোগীরা যে ব্যাপক চক্রান্তে লিপ্ত হয় তার অন্যতম নিদর্শন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নির্যাতন। ২৫শে মার্চ রাত্রির নির্বিচারে হত্যা থেকে শুরু করে কয়েক পর্যায়ে এই নির্যাতন সংঘটিত হয় এবং ক্রমেই তা এক সুসংহত রুপ লাভ করে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীন চিন্তার অনুসারী ও খুনি সরকারের তোষামোদবিরোধী প্রতিটি শিক্ষক তাদের রোষানলে পতিত হয় ও শেষ আঘাতে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি তাদের সবাইকে হত্যা করার এক পরিকল্পনা করা হয়।

কিন্তু বেশ কিছুসংখ্যক শিক্ষক আগেই দেশত্যাগ করায় ও পাক বাহিনীর আকস্মিক পরাজয় বরণে এই মহা পরিকল্পনার অংশবিশেষ মাত্র কার্যকরী হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নির্যাতনের একটি চিত্র নিচে দেওয়া গেল।

“মার্চ-এপ্রিলে যাদের হত্যা করা হয়”

১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ ও তার কাছাকাছি সময়ে যাদের হত্যা করা হয়েছিল তারা হলেন-
১। ডঃ গোবিন্দ চন্দ্র দেব (দর্শন),
২। অধ্যক্ষ এ এন এম মনিরুজ্জামান (সংখ্যাতত্ত্ব),
৩। ডঃ জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা (ইংরেজী),
৪। ডঃ ফজলুর রহমান খান (মৃত্তিকা বিজ্ঞান),
৫। জনাব এ মুক্তাদির (ভূবিদ্যা),
৬। জনাব শরাফত আলী (অংক),
৭। জনাব এ আর কে খাদেম (পদার্থ বিদ্যা),
৮। শ্রী অনুদ্বেপায়ন ভট্টাচার্য (ফলিত পদার্থ বিদ্যা),
৯। জনাব এম সাদাত আলী (শিক্ষা গবেষণা),
১০। জনাব এম এ সাদেক (শিক্ষা এ গবেষণা)।

“চাকুরী থেকে বরখাস্ত”

পাকিস্তানী হানাদারেরা কয়েকজন শিক্ষককে চাকুরী থেকে বরখাস্ত করে। তারা হচ্ছেন-
১। ডঃ এ বি এম হাবিবুল্লাহ (ইসলামের ইতিহাস),
২। ডঃ এনামুল হক (বাংলা)।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের সদস্যপদ থেকে বহিষ্কৃত হন-
১। ডঃ এনামুল হক ও
২। ডঃ কুদরত-ই-খুদা।

যাদেরকে গ্রেফতার করা হয় ও রমনা হাজতে, দ্বিতীয় রাজধানীতে অবস্থিত পিওডব্লিউ কেজ ও ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে রাখা হয় তারা হচ্ছেন-
১। ডঃ আবুল খয়ের (ইতিহাস),
২। জনাব রফিকুল ইসলাম (বাংলা),
৩। জনাব আহসানুল হক (ইংরেজী),
৪। জনাব সাদউদ্দিন (সমাজ বিজ্ঞান),
৫। জনাব শহিদুল্লাহ (অংক),
৬। জনাব রাশিদুল হাসান (ইংরেজী)।

যাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরওয়ানা জারি করা হয় কিন্তু আত্মগোপন করে অথবা দেশ ত্যাগ করে বাঁচেন তারা হচ্ছেন-
১। ডঃ আহমদ শরিফ (বাংলা),
২। ডঃ ওয়াজিউর রহমান।

যাদের অর্ধেক সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণ সহ ১৪ বছর সশ্রম কারাদন্ড দেয়া হয়-
১। জনাব আবদুর রাজ্জাক (রাষ্ট্র বিজ্ঞান)।
২। ডঃ মোজাফফর আহমদ চৌধুরী (রাষ্ট্র বিজ্ঞান),
৩। ডঃ সারওয়ার মুরশিদ (ইংরেজী)।

চাকুরী থেকে বরখাস্ত ও আটক রাখার আদেশপ্রাপ্ত-
১। ডঃ মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান (বাংলা)।

যাদেরকে সরকারীভাবে সাবধান করে দেয়া হয়-
১। অধ্যক্ষ মুনির চৌধুরী (বাংলা),
২। ডঃ নীলিমা ইব্রাহীম (বাংলা),
৩। ডঃ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী (ইংরেজী),

যে সমস্ত হাউজ টিউটরকে জেরার জন্য ক্যান্টনমেন্টে নেওয়া হয়-
১। জনাব গিয়াসউদ্দিন আহমদ (মহসিন হল),
২। জনাব জহুরুল হক (মহসিন হল)।

১৪ই ডিসেম্বর আল বদর কর্তৃক ধৃত হয়ে যারা নিহত হন-
১। অধ্যক্ষ মুনির চৌধুরী (বাংলা),
২। জনাব মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী (বাংলা),
৩। জনাব আনোয়ার পাশা,
৪। ডঃ আবুল খায়ের (ইতিহাস),
৫। মিঃ সন্তোষ ভট্টাচার্য (ইতিহাস),
৬। জনাব গিয়াসউদ্দিন আহমদ (ইতিহাস),
৭। জনাব রাশিদুল হাসান (ইংরেজী),
৮। ডঃ ফয়জুল মহী (শিক্ষা ও গবেষণা)।

আল বদর যাদের খুঁজে পায়নি-
১। ডঃ নীলিমা ইব্রাহীম (বাংলা),
২। ডঃ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী (ইংরেজী),
৩। জনাব আহসানুল হক (ইংরেজী),
৪। জনাব সাদউদ্দিন (সমাজ বিজ্ঞান),
৫। ডঃ মনিরুজ্জামান মিয়া (ভূগোল),
৬। জনাব শহিদুল্লাহ (অংক),
৭। জনাব ওয়াকিল আহমদ (বাংলা),
৮। ডঃ আখতার আহমদ (শিক্ষা ও গবেষণা),
৯। জনাব জহুরুল হক (দর্শন),
১০। ডঃ এস ইসলাম (ইঃ ইতিহাস),
১১। ডঃ লতিফ (শিক্ষা ও গবেষণা)।
এদের অনুসন্ধান করা ছাড়াও এদের উপর হামলার প্রমাণ পাওয়া যায়। আলবদর সদস্য আসরাফুজ্জামান খানের ডাইরিতে (পূর্বদেশ, ১১ই জানুয়ারী, ১৯৭২)।

আলবদর আরো যাদের খোঁজ করেছিল, তারা হচ্ছেন-
১২। জনাব আবদুল হাই (দর্শন),
১৩। ডঃ এম আর তরফদার (ইঃ ইতিহাস),
১৪। জনাব রফিকুল ইসলাম (বাংলা),
১৫। ডঃ তরিমত হোসেন (ভূতত্ত্ব) ইত্যাদি।

যারা দেশ ত্যাগ করেন-
১। ডঃ সরোয়ার মুরশেদ (ইংরেজী),
২। ডঃ আনিসুর রহমান (অর্থনীতি),
৩। জনাব রহমান সোবহান (অর্থনীতি),
৪। ডঃ ওয়াহিদুল হক (অর্থনীতি),
৫। ডঃ মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী (রাষ্ট্র বিজ্ঞান),
৬। ডঃ এ বি এম হাবিবুল্লাহ (ইঃ ইতিহাস),
৭। ডঃ অজয় রায় (পদার্থ বিদ্যা),
৮। জনাব নূর মোহম্মদ মিয়া (রাষ্ট্র বিজ্ঞান),
৯। ডঃ বেলায়েত হোসেন (পদার্থ বিদ্যা),
১০। ডঃ জিল্লুর রহমান খান (রাষ্ট্র বিজ্ঞান),
১১। জনাব আবদুল মান্নান চৌধুরী (বাণিজ্য),
১২। মিসেস সুলতানা সরওয়াত আরা (মনস্তত্ত্ব),
১৩। জনাব জয়নুল আবদীন (রাষ্ট্র বিজ্ঞান),
১৪। মিসেস রাজিয়া খান আমিন (ইংরেজী),
১৫। ডঃ ওয়াজিউর রহমান (শিক্ষা ও গবেষণা),
১৬। ডঃ রওনক জাহান (রাষ্ট্র বিজ্ঞান),
১৭। ডঃ জহুরুল আনোয়ার (ফলিত পদার্থ বিদ্যা),
১৮। শ্রী জয়কুমার সরোজী (পদার্থ বিদ্যা),
১৯। শ্রী দুর্গাদাস ভট্টাচার্য (বাণিজ্য),
২০। ডঃ এ টি রফিকুর রহমান (রাষ্ট্র বিজ্ঞান)।
২১। শ্রী রঙ্গলাল সেন (সমাজ বিজ্ঞান) ও আরো অনেকে।

-দৈনিক বাংলা, ৮ ফেব্রুয়ারী, ১৯৭২।

“পঁচিশে মার্চে জগন্নাথ হলের সেই ভয়াল রাতের স্মৃতি”
-কালী রঞ্জন শীল

একাত্তরের পঁচিশে মার্চ দিনটির কথা ভাবতেই আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। প্রতি বছর মার্চ মাস আসে আর মনে পড়ে পঁচিশে মার্চের সে ভয়াল রাতটির কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের উপর পাক বাহিনীর বর্বর হামলার আমি একজন প্রত্যক্ষ সাক্ষী। এখনও মাঝে মাঝে বিশ্বাস হয়না। একি সত্যি, না স্বপ্ন, না কোন ঘোরের মধ্যে সে সময়টা কাটিয়েছি।

আমি থাকতাম জগন্নাথ হলের দক্ষিণ ভবনের দ্বিতলে, ২৩৫ নং কক্ষে। মার্চের শুরুতেই ঢাকা শহর উত্তপ্ত ছিল। ঘটনা প্রবাহ খুব দ্রুত গতিতে এগুচ্ছিল। সকালে ঘুম থেকে উঠেই মানুষ নতুন নতুন খবর শোনার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকতো। শহরে নানা রকম জল্পনা-কল্পনার মধ্যে ঐ দিনটিও গড়িয়ে যাচ্ছিল। আমিও সমস্ত দিন মিটিং, প্যারেড মিছিল করে রাত ১১টার দিকে হলে ফিরলাম। খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম অল্পক্ষণের মধ্যে। হঠাৎ মাথার কাছাকাছি বোমার এক বিকট শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। সজাগ হয়েই শুনি চতুর্দিকে শুধু গগনবিদারী টর টর পর শব্দ আর মাঝে মাঝে সে শব্দকে ছাপিয়ে গুর গুর গুরুম শব্দ এবং দালান কোঠা কেঁপে কেঁপে উঠছিল। মনে হচ্ছিল হলের পুরান দালান বুঝি এক্ষুণি ভেঙে পড়বে। এমন গোলাগুলির শব্দ জীবনে শুনিনি, কল্পনাও করতে পারিনি। এই অবস্থার মধ্যে পড়ে প্রথমে একটু ঘাবড়িয়ে গেলাম। কি করা দরকার বুঝতে কষ্ট হচ্ছিল। সঠিক কিছুই স্থির করতে না পেরে রুম থেকে বেরিয়ে পড়লাম। নুয়ে নুয়ে দক্ষিণ দিকের সিড়ি বেয়ে তিন তলায় উঠলাম। সেখানে সিঁড়ির কাছে আরো কয়েকজন ছাত্র জড়ো হয়েছিল আগেই। সুশীলকে খুঁজলাম। দেখলাম তিন তলার সিঁড়ির কাছে তার রুম তালা বদ্ধ। সুশীল ছিল আমাদের হলের সহ-সম্পাদক। পরে শুনেছি সে গোলাগুলির শুরুতেই মেইন বিল্ডিং (উত্তর ভবন)-এ চলে গিয়েছিল এবং সেখানে মারা গেছে। কেউ কেউ ছাদে ওঠার কথা বললো আমাকে। কিন্তু তাদের কাছ থেকে আমি তিন তলার বারান্দা দিয়ে নুয়ে নুয়ে উত্তর দিকে লেট্রিন ও বাথরুমের কাছে গেলাম। দেখি উত্তর বাড়ীর সমস্ত আলো নিভানো। মিলিটারী হলে ঢুকে টর্চের আলোতে ছাত্রদের খুঁজে খুঁজে বের করে এনে সামনের মাঠে শহীদ মিনারের কাছে গুলি করে মারছে। এক একটা ব্রাশ ফায়ার করছিল আর চিৎকার করে কতগুলি তাজা প্রাণ শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করছিল। কেউ দৌড়ে পালাতে চেষ্টা করতেই তাকে সে অবস্থায় গুলি করে মারছে। এখনও ভাবতে পারিনা। এ দৃশ্য এতো বাস্তব ও জীবন্ত, তবুও মনে হয় স্বপ্ন। মাঝে মাঝে দালানের উপর ভারী কামানের গোলাবর্ষণ হচ্ছে। কোন কোন স্থানে আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে। এক সময় এসেম্বলির সামনে ডাইনিং হলটি জ্বলতে দেখলাম। উত্তর বাড়ীর কয়েকটি রুমেও আগুন দেখলাম। মাঝে মাঝে উপর থেকে নীচে সবুজ ও লাল রঙের আলোর গোলা নামতে দেখছি। তখন চতুর্দিক আলোকিত হয়ে উঠছিল। আর সেই আলোতে দেখা গেল উত্তর বাড়ীর সামনের মাঠে শত শত মিলিটারী মেশিনগান ও ভারী কামানের গোলাগুলি বর্ষণ করছে নির্বিচারে।

এক সময় দেখলাম এক একটি গাড়ির বহর হেড লাইট বন্ধ করে থেকে যাচ্ছে। অনেকক্ষণ থেকে আবার চলে যাচ্ছে। সম্ভবতঃ দেখে নিচ্ছে ঠিক ঠিক গুলি হচ্ছে কিনা, মানুষ মরছে কিনা। হঠাৎ এক সময় দেখা গেল সলিমুল্লাহ হলের দিক থেকে ৪০/৫০ জন মিলিটারী দক্ষিণ বাড়ীর ঘরের দিকে এলো এবং দরজা ভেঙে খাবার ঘরে ঢুকল। খাবার ঘরের আলো জ্বালল এবং এলোপাতাড়ি জানালা কবাটের উপর গুলি ছুড়তে লাগলো। কয়েকজন চিৎকার করে মারা গেল বুঝতে পারলাম। এক সময় দক্ষিণ বাড়ীর দারোয়ান প্রিয়নাথ বেরিয়ে এলো মেশিনগানের মুখে। তাঁকে দিয়ে মেইন গেট পশ্চিম দিক দিয়ে খুলিয়ে ঢুকে পড়লো হলের মধ্যে। তখন আর আমি মিলিটারীদের দেখতে পাচ্ছিলাম না। আমি প্রথমে লেট্রিনে ও সেখান থেকে জানালা পেরিয়ে তিন তলার কার্ণিশে গেলাম ও শুয়ে পড়লাম। সেখানে কয়েকটি শাল গাছ ছিল। একটি মোটা ডাল (শাখা) কার্ণিশের কাছে নুয়ে ছিল। একবার ভাবলাম গাছে উঠি। শেষ পর্যন্ত গাছে না উঠে কার্নিশে শুয়ে থাকলাম। হলের মধ্যে তখন শুধু গুলির শব্দ আর চিৎকার শোনা যাচ্ছিল। একতলা, দোতলা করে এভাবে ওরা তিনতলায় উঠল বুঝলাম। এক সময় আমার কাছেই কয়েকটি গুলির শব্দ হলো। আমার মাথা সোজা দেয়ালের বিপরীত দিকে একটা লোক গোঙাচ্ছে শুনতে পেলাম। আমি তখন ভাবছি কখন আমাকে সেখান থেকে বের করে নিয়ে আসে। কিন্তু আমাকে ওরা দেখেনি বুঝতে পারলাম। বুঝলাম ওরা নেমে গেলো। নিচ থেকে ‘ফরিদ’ বলে ডাক দিলো। একজন সৈন্য সাড়া দিয়ে দৌড়ে নেমে গেল। যেভাবে ছিলাম সেভাবে শুয়ে থাকলাম কিছু সময়। একসময় কার্নিশ থেকে উঠে আবার লেট্রিনে ঢুকলাম এবং সেখান থেকে উত্তর বাড়ী, তার সামনের মাঠ ও সলিমুল্লাহ হলের যে অংশ দেখা যাচ্ছিল সেখানে তাণ্ডবলীলা দেখতে লাগলাম আর কখন এসে আমাকে ধরে নিয়ে গুলি করবে সেই মুহূর্ত গুনতে লাগলাম।

এক সময় দেখা গেল সলিমুল্লাহ হলের দিকে আগুন। সলিমুল্লাহ হলের দক্ষিণ পূর্ব কোণের বড় একটি গাছে আগুন জ্বলতে দেখলাম। মাঝে মাঝে উত্তর বাড়ীর পশ্চিম দিকের আকাশ লাল হয়ে উঠছিল। আর বুঝতে পারছিলাম ঐদিকের কোথাও আগুন লাগিয়েছে পাক সেনারা। বাইরের মতো হলের মধ্যেও চললো সমস্ত রাত গোলাগুলি আর আগুন।

এক সময় কোন এক দিকে আজানের শব্দ শুনতে পেলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে আরো কয়েকদিকে আজান শোনা গেল। মনে হলো আজানের এমন করুণ সুর এত বিষন্ন সুর আর কোনদিন শুনিনি। গোলাগুলির শব্দ হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেলো। কিন্তু বন্ধ ছিল মুহূর্তের জন্য মাত্র। আবার চললো গোলাগুলি পুরোদমে। ভোরের দিকে মাইকে কারফিউ জারির ঘোষণা শুনলাম। তখন ভাবলাম বেলা হলে বোধহয় এমন নির্বিচারে আর মারবে না। কিন্তু একটু ফর্সা হয়ে যেতেই দেখা গেলো এখানে সেখানে পালিয়ে থাকা ছাত্রদের ধরে এনে গুলি করছে। যেন দেখতে না পায় আমাকে এভাবেই মাথা নিচু করে লেট্রিনের মধ্যে বসে রইলাম।

বেলা হলো। এক সময় আমার কাছাকাছি বারান্দায় অনেকের কথা শুনতে পেলাম। ছাত্ররা কথা বলছে তা নিশ্চিত হয়ে আমি লেট্রিনের দরজা খুলে বেরুলাম। বেরিয়ে দেখি সিঁড়ির মাথায় মেশিনগান তাক করে মিলিটারী দাঁড়িয়ে আছে আর কয়েকজন ছাত্র একটি লাশ ধরাধরি করে নামাবার চেষ্টা করছে। রাতে আমার মাথার কাছে ও দেওয়ালের ওপাশে যে গোঙাচ্ছিল এটা তারই লাশ। এবং সে আর কেউ নয়, আমাদের হলের দারোয়ান, সবার প্রিয় প্রিয়নাথদা। তাঁকে দিয়ে মেশিনগানের মুখে সব পথ দেখে নিয়ে নামার মুহূর্তে এখানে গুলি করে রেখে গেছে। আমিও আর নিষ্কৃতি পেলাম না।

আমাকেও ধরতে হলো লাশ। তিনতলা থেকে দোতলা, সেখান থেকে একতলা, দক্ষিণ দিকের ভাঙা গেইট দিয়ে ব্যাংকের (এখন যেটা সুধীরের কেন্টিন ওটা ছিল ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান) উত্তর পাশে নিয়ে রাখলাম। আরো লাশ জড়ো করা হলো সেখানে। ওখানে আমাদের বসার নির্দেশ দিলো একজন পাক সেনা।

তখন ছিলাম আমরা কয়েকজন ছাত্র, কয়েকজন মালী, লন্ড্রির কয়েকজন দারোয়ান, গয়ানাথের দুই ছেলে শংকর ও তার বড় ভাই, আর সবাই ছিল সুইপার। লাশগুলোর পাশ ঘিরে আমরা সবাই বসে ছিলাম। সুইপার গুলো তাদের ভাষায় মিলিটারীদের কাছে অনুরোধ করছিলো ওদের ছেড়ে দেয়ার জন্য। বলছিল ওরা বাঙালী নয়। সুতরাং ওদের কি দোষ? একজন মিলিটারী হয়ে বসতে বললো আমাদের কাছ থেকে। ওদের নিয়ে কয়েকজন মিলিটারী সোজা উত্তর বাড়ী মাঠে চলে গেল। ভাবলাম ওদের ছেড়ে দেবে। আমাদের আবার ঐ লাশগুলো বহন করতে আদেশ দিলো। লাশগুলি নিয়ে অ্যাসেম্বলির সামনের রাস্তা দিয়ে সোজা পূর্ব দিকের গেটের বাইরে চলে গেলাম। গেটের বাইরে দক্ষিণ পাশে একটি বড় গাছের গোড়ায় জড়ো করলাম লাশগুলো। এই সময় আমাদের সাথে প্রায় সমান সংখ্যক মিলিটারী ছিল। এবং তারা সবাই ছিল আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত। ওখানে যেয়ে মিলিটারী দাড়ালো অনেকক্ষণ। একজন সিগারেট বের করে দিলো সবাইকে। আমাদের কেউ বসে, কেউ শুয়ে থাকলো। আমিও কাত হয়ে ছিলাম গাছের শিকড়ের উপর। এখানে পাক সেনারা আমাদের উদ্দেশ্যে বিশ্রী ও অকথ্য ভাষায় ক্রমাগত গালাগালি করছিলো। যতটা বুঝতে পারছিলাম তাতে বুঝলাম, শালা! বাংলাদেশ স্বাধীন করিয়ে দেবো; বল শালারা জয় বাংলা। শেখ মুজিবকেও বাংলাদেশ স্বাধীন করিয়ে দেবো। আরো নানা অশ্লীল গালাগালি দিচ্ছিল। এ সময় একটি গাড়ীর বহর রেসকোর্সের দিক থেকে এসে ওখানে থামল। আমাদের সাথের মিলিটারীর একজন সামনের একটি জীপের কাছে গেলো। তাঁকে কিছু নির্দেশ দেয়া হলো বুঝলাম।

সেখান থেকে আমাদের কয়েকটি ভাগে ভাগ করে বিভিন্ন দিকে নিয়ে গেলো লাশ বয়ে আনতে। আমাদের অংশটিকে নিয়ে গেলো ডঃ গুহ ঠাকুরতা যে কোয়ার্টারে থাকতেন সেইদিকে। সেই বিল্ডিং-এর সিঁড়ির কাছে অনেকগুলি লাশ পড়েছিল, সিঁড়ির কাছে এনে গুলি করেছে বোঝা গেলো। একটি লাশ দেখলাম সাদা পাজামা পাঞ্জাবী পরা, মাথায় টুপি, পাতলা চেহারা। সেখান থেকে নিয়ে গেলো দোতলা, তিনতলা ও চারতলায় লাশ বয়ে আনতে। প্রতিটি তলায় ওরা খোঁজ নিচ্ছিল কোন জীবিত প্রাণী আছে কিনা। আর খুঁজছিলো দামী মালামাল, ঘড়ি, সোনাদানা ইত্যাদি। চারতলায় একটি রুমে ঢুকতে পারছিল না। কারন রুমের দরজা বন্ধ ছিলো ভিতর থেকে। দরজা ভেঙে ফেললো ওরা। ঢুকে কাউকেই পাওয়া গেল না। কতগুলি এলোমেলো কাপড়-চোপড়, বিছানাপত্র ছাড়া কিছুই ছিলনা সেখানে। একজনকে ছাদে উঠে কালো পতাকা ও স্বাধীন বাংলার পতাকা নামাতে বলল। নিচে নামলাম আমরা। সিঁড়ির কাছে লাশগুলি নিতে বললো। অনেক লাশ রাস্তায় আগেই জমা করা ছিলো। বয়ে আনা লাশগুলিও জড়ো করলাম এগুলির পাশে। পরে নিয়ে গেলো বিল্ডিং-এর সামনে দোতলা বাংলো বাড়িটিতে (তখনকার এস এম হলের প্রভোস্টের বাড়ী)। সামনে দিয়ে ঢুকতে না পেরে পিছন দিয়ে ঢুকলাম ঐ বাড়িতে। নিচতলা, দোতলার সবগুলি রুমেই খুঁজলাম। এলোমেলো কাপড়-চোপড়, সুটকেস, বাক্স, খোলা ফ্যান ছাড়া কিছুই দেখা গেল না সেখানে। মিলিটারীরা দামী জিনিসপত্র খুঁজে খুঁজে নিয়ে নিলো। কোন লাশ কিংবা রক্তের দাগ ছিল না ঐ দালানে। নেমে আসলাম আমরা সবাই এবং জড়ো হলাম আবার লাশের কাছে। মিলিটারীরা কালো পতাকা ও স্বাধীন বাংলার পতাকা পোড়ালো।

আমাদের আবার লাশ নিতে বললো। রাস্তা দিয়ে সোজা উত্তর দিকে অধ্যাপক গোবিন্দ দেবের বাসার সম্মুখ দিয়ে ইউওটিসি বিল্ডিংয়ের সামনের জগন্নাথ হলের মাঠের পূর্ব দিকের ভাঙা দেওয়াল দিয়ে ঢুকতে বললো। হলের মেইন বিল্ডিংয়ের সামনে শহীদ মিনারের সংলগ্ন লাশগুলির কাছে জড়ো করতে লাগলাম লাশগুলি। লাশ যখন নিচ্ছিলাম তখন দেখলাম ডঃ দেবের বাসা থেকে বের করে নিয়ে আসছে সেলাই মেশিন ও অন্যান্য ছোটখাট জিনিষ। রাস্তার তিন মাথায় অনেকগুলি মর্টার চতুর্দিকে তাক করে রেখেছিলো।

দুজন তিনজন করে আমরা এক একেকটা লাশ বহন করছিলাম। কোন জায়গায় বসলে কিংবা ধীরে হাঁটলে গুলি করার জন্য তেড়ে আসছিলো। সব সময়ই আমরা গা ঘেঁষে বসছিলাম ও চলছিলাম।

কতগুলো লাশ এভাবে বহন করেছি মনে নেই। শেষ যে লাশটা টেনেছিলাম তা ছিলো দারোয়ান সুনীলের। তার শরীর তখনো গরম ছিলো। অবশ্য রৌদ্রে থাকার জন্যও হতে পারে। লাশ নিয়ে মাঠের মাঝামাঝি যেতেই হঠাৎ কতগুলি মেয়েলোক চিৎকার করে উঠলো। দেখি মাঠের দক্ষিণ দিকের বস্তিটির মেয়েছেলেদের মাঠের দিকে দাঁড় করিয়েছে গুলি করার জন্য। এইসব সুইপারদেরই ব্যাংকের কাছে আমাদের থেকে আলাদা করে মাঠে নিয়ে এসেছিলো ওরা। সুইপারদের গুলি করে মারছে আর ঐ মেয়েছেলেরা চিৎকার করছে এবং ছুটে যেতে চাচ্ছে ওদিকে। বুঝলাম এবার আমাদের পালা। আমাদের আগে যারা লাশ নিয়ে পৌঁছেছিলো তাদেরও দাঁড় করিয়েছে। তাদের মধ্যে একজন খুব জোরে জোরে শব্দ করে কোরআনের আয়াত পড়ছিলো। ব্যাংকের কাছে যখন বসেছিলাম তখন জেনেছি এই ছেলেটি জগন্নাথ কলেজের ছাত্র। কিশোরগঞ্জে ছিল তার বাড়ী। আগের দিন বিকালে আরেক বন্ধু সহ এসে উঠেছিল তার হলের এক বন্ধুর রুমে। গুলি করলো তাদের সবাইকে। আমরা কোন রকমে দুজনে লাশ টানতে টানতে নিয়ে এসেছি। সামনেই দেখি ডঃ গোবিন্দ দেবের মৃতদেহ। ধুতি পরা, খালি গা। ক্ষতবিক্ষত ও বিকৃত সারা শরীর। পশ্চিম দিকে মাথা দিয়ে ফেলে রাখা হয়েছে। আমার সাথে যে ছেলেটি লাশ টানছিল সে গোবিন্দ দেবের লাশটি দেখে বললো ‘দেবকেও মেরেছে! তবে আমাদের আর মরতে ভয় কি?’ কি ভেবে, আমি দেবের লাশের পশ্চিম পাশ ঘেঁষে সুনীলের লাশ সহ শুয়ে পড়লাম। নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে থাকার অবস্থা তখন আমার ছিল না। চোখ বুজে পড়ে থেকে ভাবছিলাম এই বুঝি লাথি মেরে তুলে গুলি করবে।

এক সময় ভাবছিলাম তবে কি আমাকে গুলি করেছে, আমার তখন অনুভুতি নেই। কি হচ্ছিলো বুঝতে পারছিলাম না। এই মড়ার মতো অবস্থায় কতক্ষণ কেটেছে বলতে পারিনা। এক সময় আমার মাথার কাছে মেয়েছেলেদের ও বাচ্চাদের কান্না শুনতে পেলাম। চোখ খুলে দেখি সুইপার, দারোয়ান ও মালীদের বাচ্চারা ও মেয়েছেলেগুলি মৃত স্বামী কিংবা ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করছে। তখনো অনেকে মরেনি। কেউ পানি চাচ্ছে, তাদেরকে কেউ কেউ পানি খাওয়াচ্ছে। এই সময় দেখলাম কে একজন গুলি খেয়েও হামাগুড়ি দিয়ে শহীদ মিনারের পাশ দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। মাথা তুলে দেখি যেদিকে মিলিটারীর গাড়ি ও অসংখ্য মিলিটারী ছিলো সেদিকে কোন গাড়ি বা মিলিটারী নেই। চতুর্দিকে এক নজর দেখে নিয়ে মেয়েছেলে ও বাচ্চাদের মধ্য দিয়ে নুয়ে নুয়ে বস্তির মধ্যে গেলাম। প্রথমে গিয়ে ঢুকি চিৎবালীর ঘরে। চিৎবালী ঘরে ছিল না। এক মহিলা ভয়ে কাঁপছিল। তাঁর কাছে পানি খেতে চাইলে সে একটি ঘটি দেখিয়ে দিলো। পানি খেয়ে ঘরের কোণে যে ঘুঁটে ছিল তার নিচে লুকিয়ে থাকতে চাইলাম। মহিলাটি আমাকে তক্ষুণি সরে যেতে বললো। তখন আমি বস্তির পাশের লেট্রিনে ঢুকে পড়ি।

এই সময়ে রাজারবাগের দিকে গোলাগুলি হচ্ছিলো। এক একটা প্রচন্ড শব্দ। থেমে থেমে গোলাবর্ষণ হচ্ছিলো। একটু বাদেই দু’টি প্লেন উড়ে গেলো বুঝতে পারলাম। এভাবে অনেকক্ষণ কাটালাম সেখানে।

এক সময়ে একটা লোক এসে লেট্রিনের দরজা নাড়া দিল। দরজায় নাড়া শুনে ভাবলাম এইবার শেষ। মিলিটারী নিশ্চয় এসেছে। খুলে দেখি একটি লোক, মিলিটারী নয়। লোকটি বললো তার নাম ঈঁদু। পুরোনো বই বিক্রি করে রাস্তার ওপারে। বললো, হলে এসেছিল মেয়েদের মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যেতে। আমি আছি শুনে আমাকেও নিয়ে যাবে। প্রথমে যেতে চাইনি। বুঝতে পারছিলাম না কি করবো। বললো, সে সাথে যাবে। রাস্তা এখন পরিষ্কার- কেননা মিলিটারী নেই। গায়ে সেই চাপ চাপ রক্ত নিয়ে ওর সাথে বেরিয়ে পড়লাম। বকশি বাজারের কাছ দিয়ে যেতে দেখি ওদিকে কোন মিলিটারী যায়নি। অনেকে ওজু করছে নামাজ পড়ার জন্য। সেদিন ছিলো শুক্রবার এবং জুমার নামাজের সময়।

ঈঁদু আমাকে জেলখানার পাশ দিয়ে বুড়িগঙ্গার পাড়ে নিয়ে গেলো। এক মাঝিকে অনুরোধ করায় নদী পার করে দিলো। নদীর ওপারে দেখা হলো আমাদের হলের এক প্রাক্তন ছাত্র সুনির্মল চৌধুরীর সাথে। সে নিয়ে গেলো তার কর্মস্থল শিমুলিয়া। সেখান থেকে প্রথমে নবাবগঞ্জ ও পরে নিজ গ্রাম বরিশালের ধামুরাতে চলে যাই।

সে ভয়াল রাতে জগন্নাথ হলে যে হত্যাযজ্ঞ হয়েছিল এখন সে দৃশ্য কল্পনা করলে আমার সমস্ত মানবিক অস্তিত্ত্ব মুহূর্তে বিলুপ্ত হয়ে যায়। এখনো আমি নিজেকে বিশ্বাস করতে পারিনা… আমি বেঁচে আছি। একি সত্যি! ভাবতে গেলে তখন সবকিছু যেন তছনছ হয়ে যায়। সব কিছুই স্বপ্নের মতো মনে হয়। আমি কি কোন এক নেশার ঘোরে সেদিন হল জীবনের নিত্যসঙ্গী ও বন্ধু-বান্ধবের লাশ টেনে মাঠে নিয়ে গিয়েছিলাম। মার্চের শুরুতে এখনো মাঝে মাঝে ঐ দিনের কথা ভাবতে ভাবতে তন্ময় হয়ে যাই। সেই ঘোর এখনো আমার অস্তিত্বে তীব্র কশাঘাত করে।

‘বাসন্তিকা’
হীরক জয়ন্তী সংখ্যা
জগন্নাথ হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মে, ১৯৭২

<৮,৬,৩৪৯-৫২>
[ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকায় পাক বাহিনীর হত্যাভিযান]

পঁচিশে মার্চ ও তার পরদিন
-মঞ্জুর হাসান

ঘুমিয়ে পড়েছিলাম শহীদ মিনারের সামনে ৩৪ নম্বরের এক তলার ফ্লাট বাড়ীতে। আমাদের এ বিল্ডিং এর পশ্চিম দিকের তিন তলায় পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যক্ষ জনাব মনিরুজ্জামান সে রাত্রে বিছানায় যেয়েও ঘুমোতে পারেননি, একথা তাঁর স্ত্রীর কাছে শোনা। দিন কতক আগে এখানে রাস্তায় গাছ ফেলে যে ব্যারিকেড দেয়া হয়েছিল সেনাবাহিনীর একদল প্রথমে তা কেটে সরিয়ে দিতে আসে।

সেই সব ডালপালা কাটার শব্দ হচ্ছিলো। এর কিছু পরই পাক সৈন্যের বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আক্রমণ শুরু হয়। ছাত্রাবাসগুলোর দিক থেকে সৈন্যদের গোলাগুলির আওয়াজে মনিরুজ্জামান সাহেব অস্থির হয়ে ওঠেন এবং বদনায় পানি নিয়ে পরপর তিনবার ওজু করেন। এমন সময় জগন্নাথ হলের কাছে গর্জে ওঠে বর্বর পাক সৈন্যদের গোলার আওয়াজ।

চারপাশে গোলাগুলির শব্দে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায় এবং পর মুহূর্তে বিশ্ববিদ্যালয় মেডিক্যাল সেন্টারের পাশেই মনে হলো তোপধ্বনির আওয়াজ। আমি যে ঘরে ঘুমাতাম, তার পূর্বে বিশ্ববিদ্যালয় মেডিক্যাল সেন্টার, তার দক্ষিণে শহীদ মিনার। সেই আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে আলোকিত হয়ে উঠে মুহূর্তের জন্যে। আমি বিছানা থেকে মেঝেতে গড়িয়ে পড়ি।

আমার ছেলেটিকে আমি আর আমার স্ত্রী মেঝেতে শুইয়ে চেপে ধরি। ছোট ছেলে ভয়ে একবার শক্ত হয়ে যাচ্ছিলো আর শুয়ে থেকে শুধু কাঁদছিল। আমি মেঝেতে পড়ে থেকে কয়েক মুহূর্তে চিন্তা করতে চেষ্টা করছিলাম, কি হলো? চারদিকে অনবরত গোলাগুলির শব্দ আর রাস্তা দিয়ে ভারি গাড়ি চলার শব্দ পাচ্ছিলাম। ঠিক এমন সময় জগন্নাথ হলের পূর্ব দিকে আমাদের ৩৪ নং বাড়ির গেটে ভিতরে তিনটি মিলিটারী গাড়ি ঢোকে। তারপরই ভারি বুটের শব্দ এবং আমাদের দরজায় লাথি ও ধাক্কা শুরু হয়।– ‘দরজা খোল, দরজা খোল’।

ঠিক এর পরই সব ফ্লাটের দরজায় লাথি মারা আরম্ভ হয়ে গেছে এবং সব বাড়ির কলিং বেলগুলো ওরা বাজাচ্ছে। মা, বোনেরা এবং ছোট ভাইটি অন্য ঘর থেকে ছুটে আমার ঘরে এলো। মা বললেন, ‘বাবা ওদিক দিয়ে দেখলাম, মিলিটারিরা বাড়ি ঘিরে ফেলেছে।’ আর বিল্ডিং-এর টেলিফোনের লাইনগুলো কেটে দিল। আমার ঘরে সকলকে মেঝেতে শুয়ে যেতে বললাম। মাকে বললাম ‘ওরা যদি দরজা ভেঙ্গে আসে তাহলে আসুক, দরজা খুলব না আমরা।’

বাড়িতে আমার বয়সী এক আত্মীয় ছিলেন, উনি এই সময়ে বিল্ডিং এর ভিতরে বাঁচার আশা ত্যাগ করে বলতে লাগলেন, ‘আমি জঙ্গলে ঝোপের মধ্যে যেয়ে লুকাবো’ এবং ফ্ল্যাট ছেড়ে পিছন দিক দিয়ে বাইরে যেতে উদ্যত হলেন। আমি আর মা ওকে জাপটে ধরলাম। উনি বারান্দার নেট ছিঁড়ে ফেলতে উদ্যত হলেন। মা আর আমি ওকে জড়িয়ে ধরে বললাম, ‘যদি আমরা মরে যাই সবাই একসাথে মরে যাব।’

এমন সময় দু’টো সৈন্য আমাদের জানালার পাশ দিয়ে দৌড়ে এসে ফ্ল্যাটের পেছনের দরজায় দাঁড়িয়ে গেল। দরজাটি ছিল বাগানে যাবার জন্য খুব কম মজবুত একটা প্লাইউড দিয়ে বানানো দরজা। আমরা বারান্দা থেকে মুহূর্তে ঘরে ঢুকলাম; কিন্তু আমার ঘরের দরজা লাগাবার সাহস হলো না যদি শব্দ হয়ে যায়। এর অল্প পরই সৈন্য দু’টো চলে গেল পাশের পশ্চিম দিকে একতলার ফ্ল্যাটের পেছনে, সম্ভবতঃ ওদিককার দরজা খুলে ফেলার আওয়াজ শুনে। আমি দরজা লাগিয়ে দিয়ে মেঝেতে শুয়ে পড়লাম।

মৃত্যু আসন্ন মনে হলো, আমরা সকলে আল্লাহকে স্মরণ করতে লাগলাম। ততক্ষণে আমাদের দরজায় লাথি মারা থেমে ছিলো কিন্তু আবার শুরু হলো ‘খোল খোল’ আর লাথি। ভারি বুটের দুড়দাম করে সিঁড়ি দিয়ে ওঠা নামার শব্দের মাঝে জোরে শুনতে পেলাম মনিরুজ্জামান সাহেবের গলার আওয়াজ- ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (স.)’ চার-পাঁচবার শুনতে পেলাম উনার কালেমা পড়ার শব্দ, তারপর হঠাৎ থেমে গেলেন যেন।

বাইরে চারিদিকে গোলাগুলির আওয়াজ-এর পরই আমাদের বাইরের দরজার উপর গুলি হলো, আর কয়েকটা বুকফাটা আর্তনাদ ভেসে এলো। ১২/১৪ রাউন্ড গুলির শব্দ শুনলাম। মনে হলো, মেরে ফেললো- মরে গেলো মানুষ। রাত তখন দেড়টা। তারপর আমাদের বিল্ডিং-এ সব কিছু নিস্তব্ধ হয়ে গেলো। মিনিট দশেক পরে শুনলাম ডঃ জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরদার চিৎকার, ‘বাসন্তী-দোলা।’ তিনি স্ত্রী ও মেয়ের নাম ধরে ডেকে উঠেছিলেন। বিল্ডিং-এর সামনে তাঁকে গুলি করা হয়েছিল।

উনি ঘাসের উপর পড়েছিলেন। ডঃ জ্যোতির্ময় ২৫শে মার্চের পরও কয়েকদিন জীবিত ছিলেন এবং ২৭শে মার্চের সকালে তাঁকে মেডিক্যাল কলেজে নেয়া হয়। মনিরুজ্জামান সাহেবের ফ্ল্যাটের দরজা ভেঙ্গে গিয়েছিলো মিলিটারির বুটের ধাক্কায়। মনিরুজ্জামান সাহেবের স্ত্রী এবং তাঁর বোন, জ্যোতির্ময় বাবুর গলার আওয়াজ শুনে পানি নিয়ে নিচে নামছিলেন। তাঁরা তিনতলা থেকে আর্মিদের চলে যেতে দেখেছেন এবং তখনো বুঝতে পারেননি যে নিচে তাঁদের বাড়ির লোকজনদের একতলার দরজার উপর হত্যা করা হয়েছে।

মনে করেছিলেন এরেষ্ট করে নিয়ে চলে গেলো। নিচে নামতেই দেখতে পেলেন এক ভয়াবহ দৃশ্য। মনিরুজ্জামান সাহেবের ষোল বছরের ছেলের তখন অন্তিম মুহূর্ত। সে কষ্টে বলেছিল ‘মা পানি দাও’। মুখে পানি দেবার পর সে এক মুখ পানি নিয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। ছেলের পাশে পড়ে ছিলেন মনিরুজ্জামান সাহেব, তাঁর প্রায় ৩০ বছর বয়স্ক ছোট ভাই এবং ১৪ বছরের ভাগ্নেটি। এই চারজন শহীদের রক্তের ওপর দিয়ে হেঁটে যেয়ে মনিরুজ্জামান সাহেবের স্ত্রী জ্যোতির্ময় বাবুর মুখে পানি দেন।

পূর্ব দিকের দোতলায় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক সাহেব দেখতে পান আর্মি চলে গেছে এবং জ্যোতির্ময় বাবুর গলার আওয়াজ শোনা গেলো বিল্ডিং-এর সামনে ঘাসের ওপর থেকে। তখন রাজ্জাক সাহেবের বাসা থেকে একজন লোক নিচে নামতে যেয়ে দোতলার দরজায় এই ভয়াবহ দৃশ্য দেখে ঘরে ঢুকে পড়ে। এরপর রাজ্জাক সাহেব তাঁকে নিয়ে নিচে নেমে আসেন। এ সময় জ্যোতির্ময় বাবুর স্ত্রী, সারভেন্ট কোয়ার্টার থেকে তাঁর ড্রাইভারকেও ডেকে এনেছিলেন।

তাঁরা কয়েকজন ধরাধরি করে পশ্চিম দিকের একতলায় জ্যোতির্ময় বাবুকে তাঁর ফ্ল্যাটে নিয়ে যান। ঠিক এই সময় আবার বিল্ডিং এর গেটের কাছে আর্মি এসে পড়ে। এর আগেই রাজ্জাক সাহেব দোতলায় তাঁর ঘরে ঢুকে পড়েছিলেন এবং সকলেই দরজা বন্ধ করে ফেলেন। বাড়ির বাগানে বেরুবার পেছন দিকের দরজা দিয়ে সৈন্যরা জ্যোতির্ময় বাবুর ফ্ল্যাটে ঢোকে এবং তাঁকে ঘর থেকে বের করে নিয়ে যায়। এ কথা তাঁর কাছ থেকে শোনা। ২৭শে মার্চ জ্যোতির্ময় বাবুর স্ত্রীর সঙ্গে মেডিক্যালে দেখা হয় এবং তাঁকে সাথে করে ডঃ জ্যোতির্ময় বাবুর বেডের পাশে যেয়ে দাঁড়াই।

দেখেছিলাম তাঁর ঘাড়ের কাছে গুলি লেগে এদিক থেকে ওদিক দিয়ে বেরিয়ে গেছে এবং ডান হাত ও ডান পা অবশ হয়ে গেছে। জ্ঞান সম্পূর্ণ ছিল এবং খুব ভালোভাবে তখন আমার সাথে কথা বলছিলেন। মনের জোর তখনো অটুট ছিল। বলেছিলেন, রাইট সাইডটা পেরালাইজড কিন্তু বেশ বহাল তবিয়তেই আছি। উনি বলেছিলেন যে নাম জিজ্ঞাসা করার পরই তাঁকে গুলি করা হয়। এরপর আরম্ভ হলো আমাদের বিল্ডিং-এর উত্তর দিকে প্রায় বিশ গজ দূরে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের প্রভোস্টের বাড়ির দরজা ভাঙ্গার চেষ্টা।

‘খোল খোল, দরজা খোল’- আর দরজায় লাথি, ধাক্কা। কিছুক্ষণ চললো, তারপর থেমে গেলো। তারা বাকি রাত্রিটুকুর মধ্যে ওখানে পুরনো দিনের মজবুত দরজা খোলার আরো দু’বার চেষ্টা চালায়। চারদিকে অনবরত গুলির শব্দ। ভোর হলো। থেকে থেকে আশপাশে গুলির শব্দ হচ্ছে। সকাল ৯টার দিকে শহীদ মিনারের কাছে একটা ক্ষীণ মাইক দিয়ে এক অবাঙ্গালী বাংলাতে বললো, ‘আপনারা বাড়ির বাইরে বেরুবেন না, আপনাদের ঘেরাও করা হয়েছে।’ মেঝেতে শুয়ে নিজে নিজে মনে করলাম হয়ত কারফিউ-এর বাংলা তরজমা করতে যেয়ে ‘ঘেরাও’ বললো। মনকে প্রবোধ দিলাম, কারফিউ-এর কথাই হয়ত বলছে। এর ঘন্টাখানেক পর এত ঘন্টার পরিচিত গোলাগুলির আওয়াজের ব্যাতিক্রম ঘটিয়ে শহীদ মিনারের কাছে একটা জোর শব্দ হলো। মনে হলো হাত বোমা।

অল্পক্ষণের মধ্যে ঘরে বারুদের গন্ধ ভেসে আসলো, দরজার নীচে দরজার সামান্য ফাঁক দিয়ে পোড়া কাপড়ের মতো ছাই উড়ে এসে পড়তে লাগলো। এ হাত বোমার রহস্য উদ্ঘাটন হয়েছিল পালিয়ে যে গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিলাম, সেই ধলেশ্বরী নদীর ওপারে এক লোকের কাছ থেকে। সে আমাকে গ্রামে দেখতে পেয়ে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে। কারণ সেও অনেকের মতো শুনেছিলো, প্রফেসর আব্দুল হাইয়ের ফ্যামিলির সকলেই ওই বিল্ডিং-এ ২৫শে মার্চের রাত্রে মারা গেছে। এই লোকটি হলো হাশেম। আমাদের ৩৪ নম্বর বিল্ডিং-এর পূর্বদিকের তিনতলার ফ্ল্যাটে জার্মান প্রফেসর ওয়ান্টার শোয়েপ্পির সে বাবুর্চি ছিল। তার জীবনের চরম মুহূর্ত সেই ২৫শে মার্চের রাতেই কেটে গেছে। তাঁকে দাঁড় করানো হয়েছিলো অধ্যাপক মনিরুজ্জামান, তার ছেলে, ভাই, ভাগ্নের সঙ্গে গুলি করে হত্যা করার জন্য। আর্মি অফিসার গুলি করার হুকুম দিতেই গুলির পূর্বক্ষণে সে চিৎকার দিয়ে পড়ে যায়… তার পরই কতক গুলো গুলি হয়ে গেছে- তার শরীরের ওপর লুটিয়ে পড়েছে অন্যেরা।

গুলি শেষ করে বর্বর পশুরা মৃত দেহের উপর লাথি মেরেছিলো এবং হাশেমের কোমরে বুটের প্রচন্ড বাড়ি মারে। তারপর তারা সেখান থেকে সরে যেতেই হাশেম উঠে দাঁড়ায় এবং ছুটে তিনতলায় যেয়ে দরজা বন্ধ করে। তার সমস্ত জামায় রক্ত লেগে গেছে, সে বুঝতে পারছিলনা তার কোথায় গুলি লেগেছে। জামা খুলে হাশেম তার শরীরটা পরীক্ষা করে দেখে যে গুলি লাগেনি। আমি হাশেমকে জিজ্ঞাসা করায় বলেছিলো যে সে ঘুমকাতুরে এবং যখন দরজায় কলিংবেল বাজায়, মাত্র তখন তার ঘুম ভাঙ্গে এবং আমরা কেউ বেল বাজাচ্ছি মনে করে সে ঘুমের ঘোরে দরজা খোলে।

খুলতেই সেনাবাহিনীর লোক সাক্ষাৎ যমদূতের মতো মধ্যবয়সী হাশেমের জামার কলার চেপে ধরে বলে- ‘তোম প্রফেসর হো?’ হাশেম বলে উঠে, ‘জার্মান সাবকা নওকর হুঁ’। নিমেষে তাদের কয়েকজন ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়ে। যে তার কলার ধরেছিলো সে পকেটে হাত দিয়ে বলে, ‘জয় বাংলাকা ফোটো হ্যায়?’ তার পকেটে বেতনের কয়েকটা একশ’ টাকার নোট ছিল। জার্মান প্রফেসর হাশেমকে তার আগামী তিন মাসের বেতন দিয়ে ব্যাঙ্কক চলে গিয়েছিলো।

নোটগুলো হাতে নিয়ে ছুঁড়ে দেয় মেঝেতে। বলে ‘শালা তোম রূপিয়ে লেকে কেয়া করোগে, আভি তোমকো গুলি করেঙ্গে’। বলেই হিড়হিড় করে ওকে নিচে নামিয়ে আনে এবং দুজন ওকে ধরে রাখে। এর পরই সে দেখতে পায় মনিরুজ্জামান সাহেব এবং তাঁর বাসার অন্যান্যদের ধরে নিয়ে আসতে। শ্মশ্রূধারী মনিরুজ্জামান সাহেব উচ্চস্বরে কলমা পড়ছিলেন এমন সময় উনাকে চপেটাঘাত করে এক পাঞ্জাবী সৈন্য। এর পর মুহূর্তে গুলি করা হয়!

সেই হাশেম যখন মৃত্যুর হাত থেকে ছুটে এসে দম ফেলেছিলো তখন আবার শুনতে পায় বিল্ডিং-এ মিলিটারি আসার শব্দ। এর কিছু পরে কে যেন তাঁর ফ্ল্যাটের দরজায় কাতরাতে থাকে। ও মনে করেছিলো হয়ত এ বিল্ডিং-এর কেউ আহত অবস্থায় দরজার কাছে এসেছে। সিঁড়িতে আলো জ্বলছিলো। হাশেম কাঠের দরজার ছিদ্রপথে দেখে, এক সৈন্য অস্ত্র হাতে দরজার পাশে বসে অভিনয় করছে। হাশেম ছুটে বারান্দার প্রান্তে যায় এবং শেষ পর্যন্ত পাক সেনারা ওই ফ্ল্যাটের দরজা ভাঙ্গার চেষ্টা করেনি। এ হাশেমের কাছ থেকেই তখনি শোনা, শহীদ মিনারের অভাবিত দৃশ্যের কথা।

বেলা তখন দশটার মতো। হাশেম বলে চললো, আমি লুকিয়ে তিনতলা থেকে শহীদ মিনারের দিকে তাকিয়ে দেখছি চারজন পাঞ্জাবী সৈন্য শহীদ মিনারের ওপর দাঁড়িয়ে আমাদের বিল্ডিং-এর দিকে মুখ করে আছে। এমন সময় কি হয়ে গেলো সেখানে; বোমা ফেটে গেলো, হাতবোমা। ধোঁয়া, আর শহীদ মিনারের পেছন দিকে দু’টো লোক পালিয়ে গেলো। দেখা গেলো সে মুহূর্তে দু’জন সৈন্য শহীদ মিনার থেকে মেডিক্যাল কলেজের মোড়ের ট্রাফিক লাইটের দিকে দৌড়ে পালালো। কয়েক মিনিট পরেই এলো একটা গাড়ি। শহীদ মিনারের ওপর পড়েছিলো দু’টো মিলিটারির লাশ। সে গাড়িটি মরা সৈন্য দু’টোর অস্ত্রগুলো নিয়ে চলে গেলো। কয়েক মিনিট পর আর একটি গাড়ি এলো এবং লাশ দু’টোকে নিয়ে চলে গেলো। সেদিন ছিল ২৬শে মার্চ, শুক্রবার। শহীদ অধ্যাপক মনিরুজ্জামান সাহেবের স্ত্রীর কাছ থেকে শুনেছি।

যে, ২৬শে মার্চ শুক্রবারে তাঁর ফ্ল্যাটে বার পাঁচেক পাক সেনারা ঢোকে এবং বলতে থাকে ‘আওর এক আদমি হ্যায়, ও কিধার হ্যায়?’ উনারা জানান যে বড় পুরুষ মানুষ আর কেউ জীবিত নেই। তখন তারা সমস্ত ঘর তন্নতন্ন করে খোঁজে এবং জিনিষপত্র তছনছ করে ফেলে। হয়ত এই অপর এক আদমি ছিল হাশেম। মনিরুজ্জামান সাহেবের স্ত্রী ও হাশেম এই বিল্ডিং-এর তিনতলা থেকে জগন্নাথ হলের মাঠে বুলডোজার দিয়ে গর্ত করে বহু মৃতদেহ সে গর্তে ফেলে দিতে দেখেছিলেন।

রাজ্জাক সাহেবের সঙ্গেও গ্রামে একদিন দেখা হয়, উনিও বুলডোজার দিয়ে গর্ত করে লাশ পুঁতে ফেলার কথা বলেন। মনিরুজ্জামান সাহেবের স্ত্রী ধরা গলায় বলেছিলেন, আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। বিকেল বেলা আর্মি গেঞ্জী পরা ১২/১৪ বছরের চারটে ছেলে নিয়ে এসে মনিরুজ্জামান সাহেবের লাশ টানিয়ে নিয়ে গেলো গর্তের ওখানে। তখন বোধ হয় আর লাশ মাঠে ছিলোনা। ছেলে চারটিকে গর্তের পাশে লাইন করে ওরা গুলি করেছিলো।“

ইশতিয়াক মাহমুদ টিপু

<৮,৭,৩৫৩-৫৫>
[গণহত্যার কিছু দলিল]
-দৈনিক বাংলা, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ১৯৭২।

“নরঘাতকদের কিছু সংলাপঃ ওদের খতম কর।“

(লেখক ডঃ মোজাম্মেল হোসেন একজন বিজ্ঞানী। ২৫শে মার্চ রাতে ঢাকায় বর্বর পাকিস্তানী সেনারা যে হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল তখন পাক সেনাদের বিভিন্ন ইউনিটের মধ্যে কথোপকথন তিনি রেডিওতে শুনেন ও তার অংশবিশেষ টেপ রেকর্ডারে ধরে রাখেন। ঐ টেপের বিশেষ অংশ কপি করে বন্ধুর সাহায্যে কলকাতায় প্রেরণ করেন। মে, ১৯৭১ সালের মাঝামাঝি ‘আকাশবাণী’ কোলকাতা থেকে ‘সংবাদ বিচিত্রায়’ তা শোনানো হয়।

এছাড়াও কথোপকথনের সময় পাক সেনারা যে সব সাংকেতিক শব্দ করেছিল সেগুলিও যথাসাধ্য অনুবাদ করে অপর এক ব্যাক্তির মাধ্যমে প্রেরণ করেন। মে মাসে আকাশবাণী কোলকাতা থেকে ‘সংবাদ পরিক্রমায়’ তা শোনানো হয়। ২৩ ডিসেম্বর ‘বাংলাদেশ অভজার্ভারে’-এ এই বার্তা ছাপা হয়েছিল।)

“২৫শে মার্চ ১৯৭১ সালের কালরাত। সোয়া একটার দিকে গোলাগুলির শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল। জেগে উঠার প্রথম মুহুর্ত থেকেই মন বলেছিল এ আর কিছু নয় পাকিস্তানী সেনারা আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। পুরো মার্চ ধরে অপেক্ষা করেছি, কি হয় হয়। আমরা কি স্বায়ত্ত্বশাসন পাবো, না দেশে নামবে রক্তপাত? বিদেশীরা যখন ঢাকা ছেড়ে যাচ্ছিল তখন মন বলছিলো, ওরাতো ওদের দেশে ফিরছে বিপদের সংকেত পেয়ে।

কিন্তু বিপদ এলে আমরা এদেশেই থাকবো, আমাদের নিজের দেশ। কি হবে সেই বিপদ, কি হবে তার রুপ-তা কল্পনা করতে পারিনি। কি সেই ভয়ংকর রাতে ঘুম ভাংতেই বুঝলাম, বিপদ এসে গেছে। শুরু হলো আমাদের ভাগ্যে অমাবশ্যা। মনে প্রশ্ন জেগেছিল কবে সেই অন্ধকার কাটিয়ে আসবে আলো, আসবে স্বাধীনতা? হঠাৎ ভেঙ্গে যাওয়া ঘুমের ভাব কেটে গেল। উপলব্ধি করার চেষ্টা করলাম কি হচ্ছে? মনে তখন সবার আগে একটা প্রশ্ন, বঙ্গবন্ধু নিরাপদে আছেন তো? কিন্তু কিভাবে সে খবর? হঠাৎ মনে এলো, পাক সেনাদের বিভিন্ন ইউনিটগুলো নিশ্চয় একে অপরের সাথে রেডিও মারফত যোগাযোগ রাখবে।.

রেডিও তুলে নিয়ে ডায়াল ঘুরাতে আরম্ভ করলাম। ৯০ মিটারে পেয়ে গেলাম যা খুঁজেছিলাম। হানাদার বাহিনীর দল গুলোর একে অপরের সাথে কথাবার্তা। জোরে শোনার উপায় নেই, তাই এয়ারফোন লাগিয়ে নিলাম কানে। ভেসে আসতে লাগলো বর্বর পশুদের গলা। ইতিমধ্যে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের যুদ্ধ আরম্ভ হয়েছে। পাক সেনাদের আগমনের গোড়াতেই কেউ সাইরেন বাজিয়ে বিপদ সংকেত জানাবার চেষ্টা করেছিল। আমাদের বাসা থেকে মাইলখানেক দূরে রাজারবাগ।

সেকি প্রচন্ড গুলি, তালা লেগে যায়। মাঝে মাঝে পাক সেনারা আকাশে ফানুশ ছোড়ে। দিনের মত আলো হয়ে যায় চারদিকে। তারপর আবার বৃষ্টির মত গুলি। মাঝে মাঝে ভেসে আসে ভারী গোলার শব্দ। একটু পরে গুলির তীব্রতা কমে এল। বুঝলাম আমাদের বীর পুলিশ জন্মভূমির জন্য চরম আত্মোৎসর্গ করে শহীদ হয়েছেন। আরো একটু পরে দেখা গেল আগুনের লেলিহান শিখা- রাজারবাগ পুলিশ লাইন পুড়ছে। সে রাত্রের কথা জীবনে ভুলবো না। কখনো ছুটে যাই জানালায় আগুন দেখার জন্য। আবার ছুটে আসি রেডিও শুনার জন্য।

ইতিমধ্যে রেডিওতে শুনেছি পাক কমাণ্ডারের গলা। জানাচ্ছে, “দ্যা বিগ ফিস হ্যাজ বিন কট।“ কার কথা বলেছে তা বুঝতে এক মুহূর্তও দেরী হয় নি। কিন্তু মন কিছুতেই বিশ্বাস করতে চায় নি যে বঙ্গবন্ধু বন্দী হয়েছেন। রেডিও শুনে চলেছি আর ঢেকে রাখা অস্তমিত আলোতে প্রধান তথ্যগুলো টুকে রাখছি। হঠাৎ কানে এলো কন্ট্রোলের গলা “দেয়ার ইজ নো কোয়েশ্চেন অব টেকিং প্রিজনার। দে আর শুটিং এট ইউ। সো ওয়াইপ দেম অফ। কাউকে বন্দী করার প্রশ্ন উঠেনা, ওরা তোমাদের গুলি করেছে। সুতরাং ওদের খতম কর। কথাগুলোয় মনে প্রচন্ড আঘাত লাগলো। তাহলে এই করছে পাক বর্বররা?

এর প্রমাণ রাখতেই হবে। সঙ্গে সঙ্গে উঠে গিয়ে টেপরেকর্ডার এনে সোজাসুজি তার দিয়ে রেডিওর সাথে লাগিয়ে দিলাম। এয়ারফোনের মাধ্যমে শুনতে লাগলাম। বাবা, মা, বাড়ীর সবাই তখন চারপাশে জড়ো হয়েছেন। মাঝে মাঝে জানালায় গিয়ে বাইরের দিকে খোঁজ নেয়া হয়-কেউ ও দিকে আসছে কি না। এরপর দুইদিন ধরে প্রায় সারাটা সময়ই বাড়ীর কেউ না কেউ এয়ারফোন কানে ধরে বসে রয়েছে কি শোনা যায়। সব কিছু টেপ করা সম্ভব হয় নি। টেপ আছে ২৫শে মার্চ রাত আর ২৬শে মার্চ সকালের পাক সেনাদের নিজেদের মধ্যে কথাবার্তার অংশ।

অন্য তথ্য টেপে নেই, তবু যা আছে তা আজ এতদিন পরে শুনলেও মনে যে অনুভূতি জাগে, তা বর্ণনা করার ক্ষমতা আমার নেই। বর্বরদের সে কি উল্লাস! বাংলাদেশের পতাকা ও কালো পতাকা নামাতে হবে। রাস্তায় ব্যারিকেড সরাতে হবে। এ কথা লাউড স্পীকারের মাধ্যমে প্রচার হুকুম দিল পাক কমাণ্ডার নেটিভ টাং এজ ওয়েল এজ ইংলিশ এণ্ড উর্দুতে। নেটিভ হচ্ছি আমরা অর্থাৎ বাঙ্গালীরা।

আদেশ না মানলে কি করতে হবে তারও বিশদ হুকুম শুনলাম। আশেপাশের লোক ধরে এনে তাদের মধ্যের কয়েকজনকে পুরস্কৃত করতে হবে (কমাণ্ডারের ভাষায়)। সে পুরস্কার হবে মৃত্যুদন্ড। অন্যদের ফিরে যেতে দেয়া হবে যাতে ব্যাপারটা সবাই ভালো করে বুঝতে পারে। তাই সেই রাতে ঐ মূহুর্তেই নামিয়ে ছিলাম স্বাধীন বাংলার পতাকা ও কালো পতাকা। নামাতে বলেছিলাম প্রতিবেশীদের। সে পতাকা ফেলে দেয় নি, নষ্ট করিনি। লুকিয়ে রেখেছিলাম ঘরে।

পাক কমান্ডার আরো হুকুম দিল কিভাবে বাড়ী গুলি তল্লাশি করতে হবে। বাড়ীর সবাইকে বাইরে এনে দাঁড় করিয়ে ভেতরে খুঁজে দেখতে হবে ভালো করে। স্থানীয় সহযোগীদের দ্বারা সনাক্ত করতে হবে সেই সব ব্যক্তিদের যাদের আটক করার প্রয়োজন ইত্যাদি।

ধীরস্থির গলায় হুকুম দিচ্ছিল কমান্ডার-এতটুকু উত্তেজনা ছিলনা কণ্ঠস্বরে। পরে জেনেছিলাম ঐ গলা বিগ্রেডিয়ার আরবীর খানের। ঐ গলায় বিভিন্ন টার্গেট দখলের খবর দিচ্ছিলেন, সবাইকে জানাচ্ছিলেন যে দৈনিক পিপল পত্রিকার অফিস উড়িয়ে দেয়া হয়েছে। কি সাংঘাতিক ক্রোধ ছিল পিপল- এর উপর, ট্যাংক বিধ্বংসী কামান ব্যবহার করেছে পিপল অফিসের উপর পাক সেনারা। এটি ছিল ২৬ নম্বর ইউনিট। পরে জেনেছি এর ইমাম ছিল কর্ণেল তাজ। যার হেডকোর্টার প্রেসিডেন্ট হাউস।

এই ২৬ নম্বর ইউনিট হত্যা করেছে লেঃ কমান্ডার মোয়াজ্জেম কে। বলেছে,তাকে ধরতে যাওয়া হয়েছিল, বাধা দেওয়ায় নিহত হয়েছে। ঠাণ্ডা মাথায় তাকে হত্যা করে জীপের পেছনে দড়িতে বেঁধে রাস্তায় টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তার মৃতদেহ। এই ২৬ নম্বর ইউনিট আক্রমণ করেছে রাজারকার পুলিস লাইন। সবচেয়ে উল্লাস ছিল এই ২৬ নং ইউনিটেরই। তার বীরত্বের পুরষ্কার হিসেবে কর্ণেল তাজকে করা হয়েছিল- ডি, এস, এ, এম, এল-ডেপুটি সাব এডমিনিষ্ট্রেটর মার্শাল ল। মাঝে মাঝেই শোনা যাচ্ছিল। কন্ট্রোল বলছে ‘দ্যাট ইজ রিয়েলি গুড। দ্যাট ইজ একসেলেন্ট। বা হি ইজ ইউজিং এভরিথিং হি হ্যাজ গট’।

সেই এভ্রিথিং এ ছিল ট্যাংক, রিকয়েললেস রাইফেল, রকেট ল্যান্সার ইত্যাদি। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ঘিরে ছিল পশ্চিম দিক থেকে রেল লাইন জুড়ে ৪১ নং ইউনিট। দক্ষিণ দিক থেকে ৮৮ নং ইউনিট ও উত্তর দিক থেকে ২৬ নং ইউনিট। বাধা এসেছিল জগন্নাথ হল, ইকবাল হল ও লিয়াকত হল থেকে। সবচেয়ে বেশি বাধা এসেছিল জগন্নাথ হল থেকে। ২৬শে মার্চ সকালের দিকে কন্ট্রোল ও ৮৮ নং ইউনিটের মধ্যে যে কথপোকথন হল তা মোটামুটি এই রুপঃ

কন্ট্রোলঃ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আনুমানিক কতজন হতাহত হয়েছে?আমাকে মোটামুটি সংখ্যাটা বললেই হবে। উত্তর এলো তিনশয়ের মত।

কন্ট্রোলঃ চমৎকার। তিনশই মারা গেছে না কেউ আহত বা বন্দী হয়েছে?

উত্তরঃ আমি একটাই পছন্দ করি। তিনশ মারা গেছে।

কন্ট্রোলঃ ৮৮। আমিও তোমার একমত। ঐ কাজটিই সহজ। কিছু জানতে চাইবে না। আবার বলছি চমৎকার।

ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই উপরের কথা গুলোর। ওরা যে কোন ‘বন্দী’ নেয় নি, সবাইকে হত্যা করেছে, সে কথা এর চেয়ে স্পষ্টভাবে জানাতে পারতো না। শুনতে পেয়েছিলাম শহিদ মিনারের কথাঃ ঐ রাতেই ডিনামাই দিয়ে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে। মিনারের নিচের ঘরে ওদের কথায় ৪ জন ছাত্র লুকিয়েছিল, ৩ জনকে হত্যা করা হয়েছে। এক জন পালিয়ে গেছে। ২৭শে মার্চ সকালে দেখতে গিয়েছিলাম শহীদ মিনার। মাঝখানের মিনারটির সামান্য ক্ষতি হয়েছে।

শুনলাম যারা মিনারের নিচের ঘরে আশ্রয় নিয়েছিল তারা ছাত্র ছিল না। কিন্তু ছিল তো আমাদের দেশেরই মানুষ। দেখলাম ভাঙ্গা কাঁচ, দেয়ালে রক্ত। শনিবার রাতে প্রচন্ড বিস্ফোরণ ঘটিয়ে অবশেষে শহীদ মিনার ধ্বংশ করেছিল পাক বর্বরেরা। ২৫শে মার্চের সেই কালরাত্রি যখন শেষ হয়ে আসছিল, হুকুম এলো কন্ট্রোলের যেখানে যত মৃতদেহ আছে সব সরিয়ে ফেলতে। সরিয়ে ফেলতে হবে দিন শুরু হওয়ার আগে। লোকচক্ষুর অন্তরালে। মৃতদেহ সরাতে ব্যবহার করা হয়েছিল বাঙ্গালিদের। যে হতভাগ্যদের ব্যবহার করা হয়েছিল এই কাজে, কাজ শেষে তাদেরও হত্যা করেছিল নরপশুরা। মৃতদেহের হিসেব রেখেছিল ২৬ নম্বর ইউনিট।

কন্ট্রোল জিজ্ঞেস করেছিল ২৬ নং ইউনিটকে, রাজারবাগে পুলিশের মৃতদেহের সংখ্যা। উত্তর এসেছিল গোণা শেষ হয় নি। কিন্তু সংখ্যায় অনেক। ক্যাম্পাসের মৃতদেহ কিন্তু ঐ সময় সরানো হয় নি। ২৬শে মার্চ সারাদিন রেখে দেয়া হয়েছে। রেডিওতে শুনেছি, কমাণ্ডার গিয়ে দেখবেন ছাত্রনেতা কেউ আছেন কিনা। সেটা দেখার পরই সরানো হবে। তাই হয়েছিল।

২৭শে মার্চ সকালে দেখছিলাম, ইকবাল হলের পেছনের পুকুর পাড়ে সারি দিয়ে রাখা দশটি মৃতদেহ। যাতে বাঙ্গালীরা ভয় পায়, নতি স্বীকার করে। দেখেছিলা জগন্নাথ হলের সামনের মাঠে বুলডোজার দিয়ে তৈরী গর্ত করে দেয়া গণকবর। মাসখানেক পরে যখন দু’একজন বিদেশী সাংবাদিককে য়াসার অনুমতি দিয়েছিল পাক সরকার, তখন একদিন রাতে সেই গলিত দেহের অবশিষ্টও তুলে নিয়ে যায় পাক সেনারা।

জিঞ্জিরায় যে হত্যাকাণ্ড চালায় পাক সেনারা কদিন পরে তার পূর্বাভাসও পেয়েছিলাম ঐ রাতে। কন্ট্রোল বলেছিল ৮৮ নং ইউনিটকে যে ওখানে অস্ত্র জমা করা হয়েছে, তাই ঐ জায়গায় সেনাদের যেতে হবে আস্তে আস্তে। রাত ফুরিয়ে এলো দিনের আলো জেগে উঠলো। সারারাত ধরে যা দেখেছি, যা শুনেছি কোন কিছুই যেন বিশ্বাস করতে মন চাইছিল না।

মন চাইছিল না যে স্বীকার করতে যে এত বড় বিপদ নেমে এসেছ। মনে হয়েছিল, কবে এই অমাবশ্যা কাটবে, কবে আবার সন্মানের সাথে মানুষের মত বাঁচার সুযোগ পাবো? সে দিন একদিন আসবেই, কিন্তু ২৫শে মার্চের সেই রাতে একথাও মনে জেগেছিল, যখন সেদিন আসবে আমিও যেন থাকি তখন।“

<৮,৮,৩৫৬-৫৮>
[পাকসেনাদের হাতে লেঃ কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনের বিয়োগান্ত পরিণতির বিবরণ]

”ওরা বললো- ‘বলো পাকিস্তান জিন্দাবাদ’। কিন্তু একটা আঙ্গুল তুলে উনি তাঁর শেষ বাণী উচ্চারণ করলেন ‘একদফা জিন্দাবাদ’। সাথে সাথে গুলি করলো পিশাচ জালিমরা, উনি পড়ে গেলেন। জীবনের অস্তাচলে দাঁড়িয়ে শেষবারের মতো আবার এক আঙ্গুল উঁচুতে তুলে ধরলেন…“

(লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন, তথাকথিত আগরতলা মামলার দুই নম্বর আসামী যার চোখে দেখেছি বাংলার ছবি, যার মুখে শুনেছি প্রথম একদফা বাংলার মুক্তির কথা, তিনি আজ কোথায়? ২৫শে মার্চের কালো রাত্রে কেড়ে নিয়ে গেল তাঁকে শূণ্য করে আমার এ ঘর।

আগরতলা মামলা থেকে ছাড়া পাওয়ার পর হতেই শুরু হয়েছিল তার অক্লান্ত পরিশ্রম। অবশ্য তার পরিশ্রম অনেক দিনের। ছেলেবেলা হতেই জীবনযুদ্ধে নেমেছেন তিনি। আই এস সি পাশ করেই তিনি ঘর ছেড়েছিলেন। সাগর পাড়ি দিয়েছিলেন তিনি। বিলেতে কেটে গেলো জীবনের ৯টি বৎসর। সেখান হতেই ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেন তিনি। তারপর ছিলেন পাকিস্তানী নৌ-বাহিনীতে।)

১লা মার্চ হতেই দেখলাম তাঁর মাঝে চঞ্চলতা, কর্মব্যস্ততা। ২রা মার্চ কয়েকজন সহকর্মীসহ তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে এক বৈঠকে যোগ দেন। বৈঠকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়। ওদিকে কেন জানি না আমার মন একটা অজানা আশংকায় কাঁপছিল বারবার। উনিও খবর পেয়েছিলেন দুর্দিন আসছে। তাই কিছুটা গোপনীয়তা অবলম্বন করতেই হলো। শুরু হলো লুকিয়ে কাজকারবার করার দিন। ১৫ই মার্চ তিনি ফিরলেন। ২৭শে মার্চ পল্টনে এক জনসভার আয়োজন করা হচ্ছিলো। ২৮শে মার্চ আর তাঁর জীবনে আসেনি।

২৫শে মার্চ এলো সেই ভয়ংকর কালরাত্রি। কে জানত আমার এ জীবনের হাসি গান সবকিছু মুছে নিয়ে যাবে সেই রাত। অকালে আমার ঘর ভেঙ্গে যাবে। ঘর ভাঙ্গবে এদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষের। ২৫শে মার্চ সন্ধ্যা হতেই তিনি খুব ব্যস্ত। কিন্তু এত ব্যস্ততার মাঝেও মনে হচ্ছিলো, উনি যেন বড় ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত। রাত প্রায় ১১টায় ফোন বেজে উঠলো। আমার দুলাভাই ফোন করে ওকে সরে যেতে বলছিলেন। এমন সময় দুটো ছেলে সবাইকে ধাক্কা দিয়ে হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকে কাঁপতে লাগলো। তারা বললো মিলিটারী ওদের জীপের ওপর গুলিবর্ষন করেছে। ওদের একজনের গায়ে জ্বর ছিল। আমরা সেবা যত্ন করলাম। পরে জেনেছিলাম আমরা সেই অজানা ভাইদের মধ্যে একজন জালেমদের গুলিতে শহীদ হয়েছেন। সে রাত্রে আমরা উপর তলায় আমার এক বোনঝির ওখানে থাকি। নিস্তব্ধ রাত্রিকে সচকিত করে দিয়ে অবিশ্রান্ত ভাবে গোলাগুলি চলতে লাগলো।

উনি একটা প্যাসেজে দাঁড়িয়েছিলেন। সারাটা রাত এমনিভাবে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন। কে জানতো সে রাত্রের সে দাঁড়ানোই হবে মৃত্যুকে বরণ করার প্রতিক্ষা। ভোর হয়ে এলো। নীল আকাশের শুকতারাটি বিদায় ব্যথিত চোখে বুঝি বা শেষবারের মতো মাটির পৃথিবীকে দেখে নিচ্ছিলো। এক সময় উনি এসে জানালায় মাথা দিয়ে ক্লান্ত অলসভাবে দাঁড়ালেন। আমি তাঁকে অনেকবার বলেছিলাম পিছনের পাঁচিল টপকে পালাতে। বললেন, কোথায় যাব। তাছাড়া যোগাযোগ রাখা সম্ভব হবে না।

তিনি বুঝেছিলেন জালিমরা তাঁকে না পেলে অবুঝ অসহায় শিশুদের উপর অত্যাচার করতে পারে। তিনি পালালেন না। তাঁর ক্লান্ত ভাব দেখে তাঁকে শুতে বললাম। জবাবে উনি বললেন, অনেক কাজ, শোবার সময় নেই। বরঞ্চ বড্ড ক্ষিধে পেয়েছে কিছু খাবার ব্যবস্থা করো। টেবিলে খাবার লাগানোও হলো, কিন্তু খাওয়া তাঁর হলো না। মনে হলো বাসার চারিদিকে অনেকগুলো গাড়ী দাঁড়িয়ে গেলো।

বুটের দুপদাপ আওয়াজ শোনা গেলো। জানালার ফাঁক দিয়ে চকিতে দেখলাম একজন উপরের দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখাচ্ছে। ভয়ে হিম হয়ে বললাম, ‘তুমি পালাও’। উনি ভেতরের দিকে চলে গেলেন। জালিমরা হুড়মুড়িয়ে উপরে উঠে এসে দরজা ধাক্কা দিয়ে ভেঙ্গে ফেললো। পিশাচরা আমাদের সামনে এসে বললো, ‘কমান্ডার মোয়াজ্জেম কাঁহা, উসকো বিবি কাঁহা। আচ্ছা করকে উনকো বাঙ্গাল নাদেগা।’ দেখে মনে হচ্ছিলো সামনে পেলে যেন ছিঁড়ে খাবে।

আমার ভাগ্নী বুদ্ধি করে বললো ‘ওরা নীচে থাকেন’। কিন্তু ওরা কোন কথা শুনলো না। কজন আমার ভাগ্নী জামাইকে নীচে নিয়ে গেলো। জালিমরা তন্নতন্ন করে খুঁজে ফিরতে লাগলো সমস্ত ঘর। খুঁজতে নীচে চলে গেলো, আশ্বস্ত হবার আগেই ফিরে এলো আবার। কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না। আবারও চলে গেলো ফায়ার করতে করতে নীচের দিকে। কিছুক্ষণ পর ফায়ারিং থেমে গেলো। শোকরগোজারী করলাম আল্লার কাছে। না পেয়ে হয়তো ওরা চলে গেলো। বাইরে পর্দা সরিয়ে দেখতে গেলাম।

কিন্তু উঃ একি দেখলাম! খোদা, এর আগে যদি চোখ অন্ধও হয়ে যেতো! দু’পা দু’হাত ধরে ঝোলাতে ঝোলাতে গাড়িতে তুলছে ওকে। মাথাটা ঝুলে পড়েছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে ডান পাশটা। আছড়ে পড়লাম মাটিতে। চিৎকার করে উঠতে গেলাম। কিন্তু তার আগেই ভাগ্নী মুখ চেপে ধরলো।, ‘খালাম্মা চিৎকার করবেন না। ওরা আবার এসে যদি বাচ্চাদের মেরে ফেলে। আপনাকে যদি ধরে নিয়ে যায় টের পেয়ে’।

চমকে থমকে গেলাম। পোড়া চোখ জ্বলে ছাই হলো। বুকের ভেতরটা এক শূণ্য বেদনায় হাহাকার করে উঠলো। জ্বলে গেলাম, হায়! একটি মানুষবিহীন সর্বহারা হলাম আজ। পরে জানতে পারলাম, উনি বাথরুমের দরজার এক পাশে উপায়হীন হয়ে লুকিয়ে ছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয়বারে ওরা আবার ওর নাম ধরে জিজ্ঞাসা করে বললো, ‘তোমহারা নাম কিয়া?’ উনি নির্ভিক চিত্তে বললেন, কম্যান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন।

আবার ওরা বললো- ‘বলো পাকিস্তান জিন্দাবাদ’। কিন্তু একটা আঙ্গুল তুলে উনি তাঁর শেষ বাণী উচ্চারণ করলেন ‘একদফা জিন্দাবাদ’। সাথে সাথে গুলি করলো পিশাচ জালিমরা, উনি পড়ে গেলেন। জীবনের অস্তাচলে দাঁড়িয়ে শেষবারের মতো আবার এক আঙ্গুল উঁচুতে তুলে ধরলেন। পরপর গুলি হলো, দু’টো তাঁর মাথায় বিঁধলো। আর দু’টো ফসকে গেলো। মনে হলো বুকের রক্ত দিয়ে উনি ধুয়ে দিয়ে গেলেন পরাধীন বাংলার যত কলংক আর মলিনতা আর রক্তকণিকাগুলো।

কিন্তু মাঝে মাঝে ক্ষীণ আশা জন্মায়, তাঁকে তো মৃত দেখিনি। শুধু গুলি লাগা অবস্থায় তুলে নিয়ে যেতেই দেখেছি। তবে কি তিনি বেঁচে থাকতে পারেন না? নীচে দেখলাম রক্তের বন্যা মাটিতে, শুধু ভোরের আকাশ বাতাস হাহাকার করে উঠলো নেই-নেই-নেই। কোথা দিয়ে সারা বেলা কেটে গেলো, রাত এলো শূন্যতার হাহাকার নিয়ে, তারও শেষ হলো। সকাল হলো, কারফিউ ভাঙ্গলো কিছুক্ষণের জন্যে। কত মানুষ ছুটে এলো চেনা-অচেনা। চেয়ে দেখলাম কত মানুষ অশ্রুসজল নেত্রে রক্ত ছুঁয়ে শপথ নিলো।

বোবা কান্নায় অসহায় হয়ে ছোট তিনটি শিশু বুকে নিয়ে দুলাভাই ডাঃ কাজী আব্দুল খালেকের বাসায় ছুটে গেলাম। তারা ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেননি যে আমার এত বড় সর্বনাশ হয়ে গেছে। আবার হাহাকার আর্তনাদ উঠলো। কিন্তু কান্নার সময় কোথায়, সান্তনার অবকাশ নেই। পালাতে হবে, যদি আবার জালিমেরা আসে। তাই পাড়ি দিলাম অদৃষ্টের হাতে নিজেকে সঁপে দিয়ে অনিশ্চয়তার পথে। জিঞ্জিরা গেলাম। নৌকা পার হবার সময় গোলাগুলি আরম্ভ হলো।

মানুষের মৃত্যুর ভয়াল আর্তনাদের মধ্য দিয়ে ওপারে গিয়ে পৌঁছলাম। ওখানে কেটে গেলো তিনটি দিন। তারপর ফিরে এলাম আবার ঢাকায়। আমার বড় ভাই ডাঃ আমজাদ খবর পেয়ে ছুটে এসে নিয়ে গেলেন আমাদের। জালিমরা তারও সবকিছু পুড়িয়ে জ্বালিয়ে নিঃস্ব করে দিয়েছে। তিনিও রাজবাড়ী ফরিদপুরের মুক্তিফৌজের কমান্ডার ছিলেন এবং কয়েকটা অপারেশন করেছেন। এই হলো তাঁর অপরাধ। তাঁকেও পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছিলো।

অথচ আমাদের ফেলে তিনি, আমার অনুরোধ সত্ত্বেও, ওপারে যেতে পারেননি শেষ পর্যন্ত। আমাদের জন্যই তাঁকে কিছুদিন আগে গ্রহণ করতে হলো একটা ছোট্ট চাকুরী, যাতে সরকার তাঁর পরিচয় না পায়। নানা দুর্যোগ আর ব্যথার মধ্য দিয়ে কেটে গেলো দীর্ঘ ৯টা মাস। পথ চেয়ে বসে থেকেছি মিছে আশা বুকে বেঁধে যদি আসেন তিনি। কিন্তু কই আজো তো এলেন না তিনি। বুকে আশা নিয়ে ছুটে এসেছি এই কর্ম-কোলাহলপূর্ণ নগরীতে যদি কেউ বলে আছেন তিনি।

দেশ স্বাধীন হলো। খুশির বন্যায় প্লাবিত হলো চারিদিক। শুকরিয়া করলাম খোদার দরগায়। তাঁর আদরের সাত বছরের শিশুকন্যা শিপু ফুঁপিয়ে শুধালো ‘মাগো সবাই আজ এতো খুশী, কিন্তু আমার খুশি লাগছে না কেন? আমার যে খালি বাপির কথা মনে হচ্ছে। কেন আজও তিনি এলেন না। কেন আমার বাপি নেই মা?’ শিশুর মনের এই আকুল করা প্রশ্নের জবাব কে দেবে?

-মিসেস কোহিনুর মোয়াজ্জেম হোসেন

তানিয়া ইমতিয়াজ লিপি

<৮,৯,৩৫৯-৬৫>

[ঢাকা প্রেসক্লাবের উপর ট্যাংকের বোমাবর্ষণঃ একটি প্রতিবেদন]

২৫ শে মার্চের কালোরাত্রিতে কেমন ছিল আজকের বাংলাদেশ নিয়ন্ত্রণকারী সচিবালয় এবং প্রেসক্লাব? ’৭২ সালে বাংলার বাণীতে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের গণহত্যা’-য় সাংবাদিক ফয়েজ আহমেদের জবানীতে চলুন দেখে আসিঃ

“প্রেসক্লাবের সম্মুখ দিয়ে যে রাজপথ গেছে, সেটা ছিল সেকেন্ড অপারেশনাল রুট-রাজধানী ঢাকার উপর গণহত্যা অভিযান জল্লাদ বাহিনীর দ্বিতীয় সড়ক। এখন সেটা স্বাধীন বাংলাদেশের ফরেন অফিস এবং এক সময় কমিশনার্স অফিস বলা হতো। সেই ইমারত আজ অঙ্গন রাতারাতি গড়ে উঠেছিল গেরিলা কৌশলে ট্রেনিংপ্রাপ্ত জেনারেল মিঠায় অধিনস্থ অফিসারদের এক গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি।

ঢাকার সাংবাদিকদের ক্লাবটা তার প্রায় উল্টো দিকে গুলী গোলার পাল্লার মধ্যে।

মুক্তিযুদ্ধের ন’মাসে প্রত্যেকটি নাগরিকের চরম বিপর্যয় কাহিনীগুলো এক দিকে যেমন পৃথক পৃথক সত্তা নিয়ে প্রকাশ পায়, অপরদিকে সব ঘটনার সামগ্রিক একটা আদল আছে। ঘটনার প্রচণ্ডতা, তার বীভৎস রূপ আর পরিণতি প্রকৃত বিচারে একই। দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের উপর বিভীষিকাময় আক্রমণ ও অবিশ্বাস হত্যাকাণ্ডের সার্বিক ইতিহাসের মধ্যে প্রেসক্লাবের ঘটনা অসাধারণ উল্লেখযোগ্য কিছু নয়।

এই ক্লাবটাকে কেন্দ্র করে ইয়াহিয়ার সামরিক শাসনবিরোধী কোন ব্যাপক প্রত্যক্ষ বিদ্রোহ দেখা দিয়েছিল বা সে সময় সেখানে শাসন বিরোধী আন্দোলন অত্যন্ত প্রকট ছিল, তা নয়। তবে সৎ ও বলিষ্ঠ সাংবাদিকগণ সে সময় প্রকাশ্যভাবে বাংলাদেশের স্বাধিকারের প্রতি, মুক্তির প্রতি সমর্থন জুগিয়েছেন। তখন বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের কণ্ঠে যে ধ্বনি উঠতো সেসব সাংবাদিকের মুখমণ্ডলে তা প্রতিবাদ হতো- অনেকের কলমের ডগায় সেটা আরো স্পষ্ট ছিল। দেশের হাজার হাজার বিভিন্ন মতের প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা যেভাবে সমর্থন জুগিয়েছিল শেখ সাহেবকে তাঁর হস্ত শক্তিশালী করার জন্যে, ঢাকায় বা অন্যান্য স্থানের সাংবাদিকরাও তেমনি দিয়েছিলেন। তা’ছাড়া এমন অনেক বন্ধু ছিলেন, যারা তাস পেটানো, আড্ডা জমানো, সস্তায় খাদ্য গ্রহণ ব্যতিত কোন ঝামেলায় যেতেন না।

সাংবাদিকদের ক্লাব কক্ষের এই সাধারণ পরিবেশটা অবশ্যই অস্ত্রধারী বিদ্রোহীদের সমতুল্য নয়। এমনকি অনেকে এই ক্লাবগোয়ারদের বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ এনেছেন। বিরূপ মন্তব্য করতে কুণ্ঠা বোধ করেননি। সেক্ষেত্রে তবুও শহরের প্রাণকেন্দ্রে প্রতিষ্ঠিত প্রেসক্লাবের উপর সেল নিক্ষেপের প্রয়োজন দেখা দিল কেন? ক্লাব ইমারত ধ্বংস করে দিলেই যে সচেতন সাংবাদিকের বিলুপ্তি ঘটবে, তা’নয়। সাংবাদিক ইউনিয়ন বা ক্লাব কমিটির সদস্য বিনা দ্বিধায় সামরিক শাসকদের পদানত হয়ে সর্বক্ষেত্রেই যে কলমের ব্যবসা করবেন, সে কথাও গ্রহণযোগ্য হবে না। এবং ব্রাস হ্যাট জেনারেলগণ সে কথা জানতেন।

তবু কেবলমাত্র খেয়ালের বশে নয়, পরিকল্পিত পন্থায় প্রেসক্লাবের উপর ২৫শে মার্চের রাতে ট্যাঙ্ক থেকে শেলবর্ষণের তাগিদ দেখা দেয়।

দেড় বছর আগের প্রেসক্লাবের শেল বর্ষণের পর থেকে বন্ধু- বান্ধব ও অনেকে এই ঘটনার কারন সম্পর্কে বহু আলোচনা করেছেন। সমগ্র দেশটা পুড়িয়ে খাক করে দেয়ার, ত্রিশ লক্ষ শান্তি প্রিয় মানুষকে নির্বিচারে হত্যার যেমন কোন ন্যায়সঙ্গত ব্যাখ্যা বা যুক্তি বাইরে থেকে সভ্য সমাজের পক্ষে উপস্থিত করা সম্ভব হয়নি, প্রেসক্লাবের ব্যাপারে তাই ঘটেছে। কেউ বলেছেনঃ সাংবাদিক সমাজকে ভীত ও সন্ত্রস্ত করে তোলার জন্যে এটা ছিল তাদের আস্তানার উপর প্রতীক হামলা। আর এক লোক বলেন, প্রেসক্লাবে গেরিলারা প্রতি আক্রমণের জন্যে সুরক্ষিত চৌকি প্রতিষ্ঠা করেছিল বলে হয়তো ভুয়া তথ্য তাদের কাছে কেউ পৌঁছে দিয়েছিল। কেউ কেউ বলেন, সে রাতে প্রেসক্লাবের বহু সাংবাদিক আটক পড়েছেন বলে কোন সূত্র থেকে খবর দিয়েছিল। কেউ কেউ বলেন, সে রাতে প্রেসক্লাবে বহু সাংবাদিক আটকা পড়েছেন বলে কোন সুত্র থেকে খবর হয়তো সামরিক অফিসারদের কাছে পৌঁছেছিল। এই সুযোগটা তারা ছাড়তে চায়নি এবং খবরটা দেরীতে তারা পায় বলেই ভোরে রাতে আক্রমন হয়।

রাত তখন সাড়ে দশটা হবে, আমি প্রেসক্লাবের আশ্রয় নিয়ে বাধ্য হলাম। আর এই কারনেই সে রাতে ক্লাবে শেল নিক্ষেপের কারন সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারনা করা আমার পক্ষে অনেকটা সম্ভব হয়েছে।

এক্ষেত্রে ২৫শে রাতে প্রেসক্লাবের দু’টো রহস্যজনক টেলিফোন কলের উল্লেখ স্বাভাবিকভাবেই আসে।

ক্লাবে প্রবেশের দশ মিনিট পরেই পরপর দু’টো কল আসে এক বিশেষ আধা সাংবাদিকের নামে। এই ভদ্রলোক বিভিন্ন রাজনৈতিক মহল, উকিলদের লাইব্রেরী, সাংবাদিকদের আড্ডা ও অফিসারদের ক্লোজপার্টিসহ সর্বত্রই মোটামুটি পরিচিত। উর্দু প্রস্বর মিশ্রিত বাংলা ও ইংরেজিতে অপর প্রান্ত থেকে উক্ত আধা-সাংবাদিকের সন্ধান করা হচ্ছিল। ক্লাবের ম্যানেজার জনাব কুদ্দুস আমার হাতে ফোন তুলে দিয়ে বললেন, স্যার, চড়া গলায় কা’কে যেন খুঁজছেন ভদ্রলোক।

রুক্ষ কণ্ঠস্বর ও বিশেষ ভাষার ব্যবহার থেকে সহজেই অনুমান করা সম্ভব যে, যে সামরিক ঘাঁটি বা সেনানিবাস থেকে কেউ টেলিফোন করছে। উক্ত আধা- সাংবাদিককেই না পেয়ে সেই ভদ্রলোক ক্ষেপে উঠেছিলেন ঠিকই, তবে কণ্ঠে তার নৈরাশ্যও ছিল।
টেলিফোন কলের এই ঘটনা কোন অর্থ হয়তো বহন করে, তবে এ থেকে প্রেসক্লাব আক্রমণের কারন সন্ধান করা কষ্টকর।

এ সময়টা সমগ্র শহরের উপর সুপরিকল্পিতভাবে একযোগে আক্রমন চলছে।

তখনো ক্লাবের পেছনে বা সামনের দিকে গোলাগুলী আসেনি। তোপখানা রোডের কাছে ‘স্বরাজ’ অফিস থেকে বেরিয়ে আমি গভীর অন্ধকারে আচ্ছন্ন রাজপথে পড়ে সেকেন্ড গেটের উল্টো দিকে বোকার মতো দাঁড়িয়ে ছিলাম। একটা রিকশা ছিলনা। কিন্তু সে সময় এই আঙ্গটায় কিছুসংখ্যক দুরন্ত যুবক অন্ধকারের মধ্যে সামরিক যান চলাচল বন্ধ করার জন্যে ব্যারিকেড তৈরি করছিল, ইট ড্রাম কাঠের গুঁড়ি দিয়ে।

একটা রিক্সা এসে সেখানে আটকা পড়ল। চালক ত্বরিত গতিতে রিক্সা ঘুরিয়ে মেডিক্যাল কলেজের দিকে ছুটল। আমি জোর করে ধরে তাকে অনুরোধ করেছিলাম। আমাকে একটু আজিমপুরায় নামিয়ে দিন। পুরানো হাইকোর্টের প্রবেশ গেটের কাছে প্রথম বাঁধা পেলাম গাছ আর ড্রাম ফেলে ব্যারিকেড করা হয়েছে। সেটা পেরিয়ে কার্জন হলের গেটের সামনে গিয়ে সম্পূর্ণ থেমে যেতে হল। অন্ধকার থেকে কয়েকজন লোক একে বলল, অন্য দিকে যান। আর্মি আসবে। সেখানেও ব্যারিকেড।

রিক্সাওয়ালা বলল, স্যার, আমি আর যাব না ডর করছে।

আমি তাকে ফিরিয়ে আনলাম সেকেন্ড গেটের দিকে- আজিমপুরার বাসায় সে রাতে আর যাওয়া হল না প্রেসক্লাবের সম্মুখে আমাকে নামিয়ে রিক্সাওয়ালা উধাও হয়ে গেল।

আমি বাধ্য হলাম প্রেসক্লাবের আশ্রয় নিতে। ক্লাব ম্যানেজার কুদ্দুস আর দারোয়ান খয়ের ছাড়া কেউ তখন ছিল না। খয়ের বাইরের গেটে তালা দিয়ে রেখেছে। কুদ্দুস বাসায় ফেরার জন্য আয়োজন করছিল।

মর্নিং নিউজের শহিদুল হককে এবং অবজারভারের মুসা ও কে জিকেও কয়েকবার টেলিফোনে চেষ্টা করলাম- লাইন পেলাম না। শেষ পর্যন্ত শহিদুল হককে পেলাম, কিন্তু তখন আর আমাকে প্রেসক্লাব থেকে উদ্ধার করার উপায় ছিল না। সে উৎকণ্ঠার সাথে জবাব দিল, আমাদের সামনে চৌমাথায় আর্মি। গাড়ী বের করা যাবে না। ক্লাবের একটা কক্ষে রাত কাটানো ছাড়া তখন আর উপায় কি !!

এরপরই সে দুটো রহস্যজনক টেলিফোন কল এলো। প্রেসক্লাব আক্রমণের সাথে এই ফোন কলের কোন যোগসুত্র রয়েছে কিনা প্রতিষ্ঠা করা কষ্টকর। তবে প্রেসক্লাব আক্রমণের যত কারণই থাকুক না কেন, একটা কারণ আমার কাছে উল্লেখযোগ্য বলে মনে হয়।

দারোয়ান খয়ের আমারই নির্দেশে আমাকে দোতালায় লাউঞ্জে বাইরে থেকে তালা দিয়ে চলে গিয়েছিল। সিঁড়ি ও বাইরের গেটেও তালা ছিল। এ বাড়ীতে কেউ থাকে না, এমন একটা ধারনা দেয়ার জন্যেই সর্বদা দ্বারে বাইরে থেকে তালা দেয়া হয়। আমি তখন ক্লাবে একা নীরব নিস্তব্দ ক্লাব এলাকা। সমস্ত আলো নেভানো। গরমের মধ্যেও ফ্যান চালাইনি। বের হবার পথ বন্ধ।

চারদিকে ভয়াবহ আক্রমন চলছে। তোপখানা রোডের উপর প্লাটুন দৌড়ে যাচ্ছে। ট্র্যাকের ঘর ঘর শব্দ। আমি রাইফেল স্টেটগান, মেশিনগান আর মর্টার শেলের গগনবিদারী বীভৎস শব্দের রাজ্যে একা একটা সোফায় বসে আছি। রাজারবাগ আর বিশ্ববিদ্যালয়য় এলাকার দিক থেকে গোলার আওয়াজ আসছিল। হঠাৎ বর্তমান ফরেন অফিস ও ইউসিসের তেমাথায় একটা আলো জ্বলে উঠলো- সমগ্র এলাকাটা তখন দিনের মতো স্পষ্ট। জানালার ফাঁক দিয়ে আর্মির চলাফেরা লক্ষ্য করা সম্ভব। বহু সংখ্যক ট্রাক বোঝাই সৈন্য ক্লাবের সম্মুখ দিয়ে পুরানা পল্টনের দিকে যাচ্ছে।

একটু পরেই নবাবপুর রেল গেটের দিকে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। আকাশের দিকে কালো ধোয়া আর আগুনের শিখা উড়তে থাকে। তারপর এক সময় পুরানো শহরের মধ্যভাগ বংশাল রোডের দিকে আগুন দেখা গেল।

তখন একথা সত্যই যে, শুত্রু বাহিনী পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী ধ্বংসের অভিযানে নেমেছে- গণহত্যা চলছে। কিন্তু তখনো জানতাম না যে পিলখানায় ইপিআর বাহিনীর সাথে দখলদার সেনাদের যুদ্ধ চলছে। রাজারবাগে বীর পুলিশরা ম্যাগাজিন খুলে প্রতিরোধ লড়াই করছে। পুরনো শহরের গলিগুলোর ব্যারিকেড বিদেশী সেনাদের পথ বন্ধ করে রেখেছে আর বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় গুলিবর্ষণ হচ্ছে।
এই নিদারুণ পরিস্থিতির মধ্যেও শহরের বিভিন্ন অঞ্চলের যে সব মুক্তিকামী মানুষ হানাদারদের প্রতিরোধ করছিল তাদের একটা সাহসী দল সেকেন্ড গেটের পাশের সম্মুখে সারারাত ব্যারিকেড সৃষ্টি করে গেছে। প্রেসক্লাবের ডান দিকে সেক্রেটারিয়েটের শেষ দেয়ালের গাঁ ঘেঁষে যে কাঁচা গলিটা গেছে, তার মুখে সন্ধ্যার সময়ই একটা বড় ট্রাক রাখা হয়েছিল এবং তারা পাশে কয়েকটা রিক্সা রেখে হানাদারদের প্রবেশ পথ বন্ধ করে দেয়া হয়। আর সেখানেই একদল দুঃসাহসী যুবক, যারা দোকানদার, রিক্সাচালক গভীর অন্ধকারে গাঁ ঢাকা দিয়ে বড় রাস্তায় ব্যারিকেড তৈরি করে চলছিল।

প্রতিবার ইয়াহিয়ার বাহিনী তোপখানা রোড দিয়ে যাবার সময় এইখানা বাঁধা পেয়েছে, কনভয় থামিয়ে রাস্তা পরিষ্কার করেছে। ক্লাব দোতালার দরজায় ফাঁক দিয়ে সারারাত দেখেছি সাঁজোয়া বাহিনী বা আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত প্লাটুন এই পথ ধরে পুরানো শহরের দিকে অগ্রসর হতে গিয়ে এই ব্যারিকেডের সম্মুখীন হয়েছে।

প্রত্যেকবারই সৈন্যরা গাড়ি থেকে নেমে ব্যারিকেড সরিয়ে ফেলত। কিন্তু শেষের দিকে ব্যারিকেডের উপর স্প্রে করে আগুন ধরিয়ে দিত। বাঁধা পেয়েই তারা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠত এবং সঙ্গে সঙ্গে স্টেন আর রাইফেল শতকণ্ঠে গর্জে উঠত। বিদ্রোহিদের মনে ত্রাস সৃষ্টি করার জন্যই যে কেবল এভাবে অজস্র গুলী ছোড়া হ’ত তা নয়, কল্পিত গেরিলাদের ভয়ে আতঙ্কগ্রস্ত হানাদার সৈন্যরা নিজেদের মনোবল বৃদ্ধির জন্যেও নিষ্প্রয়োজনে ট্রিগার টিপেছে।

রাত প্রায় তিনটার দিকে বড় রাস্তা থেকে ক্লাব বিল্ডিং লক্ষ্য করে কয়েকজন সৈন্য গুলী নিক্ষেপ করে। তখনো আমি ভাবতে পারিনি যে, এটা প্রেসক্লাবের উপর আক্রমণের ওয়ার্নিং।

ব্যারিকেড উঠিয়ে বা পুড়িয়ে দিয়ে যাওয়ার পর সৈন্যরা কেউ থাকত না। দশ মিনিটের মধ্যেই পাশের গলি থেকে কিছু লোক ইট, কাঠের টুকরা, টিন এমন কি ছোট ছোট আস্ত পান বিড়ির দোকান তুলে এনে রাস্তা বন্ধ করে দিত। এটা ছিল তাদের জন্যে অসহ্য এবং কাউকে নাগালের মধ্যে না পেয়ে অন্ধকারে গুলী ছোড়া ছাড়া পথ ছিল না। কিন্তু প্রেসক্লাবের পাশের গলিতে ঢোকার সাহস তাদের ছিল না, আমি ভেবেছিলাম ক্ষিপ্ত ইয়াহিয়া- সৈন্যের এই জাতীয় গোলাগুলীর অংশ ক্লাবে এসে পড়েছিল।

ভোর রাতের দিকে ঢাকা শহরের কয়েকটা অঞ্চলের আকাশ অগ্নিশিখায় রঙিন হয়ে উঠেছিল- নাগরিকদের উপর আক্রমণের তোড়াটা তখন ছিল অনেক বেশী এবং সে সময় অসহায় হাজার হাজার নগরবাসীর কণ্ঠে ছিল নাগরিক এই করুণ ও বিভীষিকাময় পরিস্থিতির প্রত্যক্ষ সাক্ষী।
এর একটু পরই প্রেসক্লাবের উপর আক্রমণ চালানো হয়।

অন্ধকার কক্ষের মধ্যে আমি তখন একটা সোফা ছেড়ে আর একটায় গিয়ে বসছিলাম। বেরিয়ে পালিয়ে যাবার কোন উপায় তো তখন ছিল না। একটার পর একটা চিন্তা আমাকে আচ্ছন্ন করে তুলেছিল। ২৪ তারিখ রাতে ৩২নং রোডের বাড়িতে শেখ সাহেব সাংবাদিকদের একটা প্রশ্নের জবাব দিয়ে বলেছিলেনঃ আলোচনা দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে বলে ওরা সময় পাচ্ছে। এই যদি মনে কর-তবে আমি কি সময় পাচ্ছি না?

ভাবছিলাম যে সময় তিনি পেয়েছেন তা’চব্বিশ ঘণ্টা পর অত্যাধুনিক সেনাবাহিনীকে রোখার জন্যে যথেষ্ট কি না। আমার চিন্তার সুত্র ছিন্ন করে একটা ট্যাঙ্কের শব্দ ভেসে আসলো। ছুটে গেলাম একটা জানালার কাছে। সে রাতে এই প্রথম একটা ট্যাঙ্ক দেখলাম। কমিশনার অফিসের অঙ্গন থেকে ছোট একটা ট্যাঙ্ক (এম ২৪) গর্জন করে ইউসিসের সামনে এসে দাঁড়াল।

ট্যাঙ্কের নলটা ক্লাবের দিকে ঘুরিয়ে দেয়া হয়েছে। আর কয়েকজন সৈন্য ট্যাঙ্কের কাছে ছুটাছুটি করছে। তখনও আমি ভাবে উঠতে পারিনি যা, প্রেসক্লাবের উপরও তাদের সরাসরি আক্রমন চলবে। কিন্তু পর মুহূর্তেই ভাবলাম সব অবিশ্বাস্য ঘটনাই তো তাদের দ্বারা আজ রাতে সম্ভব হয়েছে।
কক্ষ থেকে বের হবার প্রশ্ন ওঠে না। বাথরুমের ব্যাকস্টেয়ার দিয়ে বেরিয়ে যাবার কথা ভাবলাম। বাথরুমের পেছনের দরজা খুলে দেখলাম, দেয়ালের উপর কতোগুলো ফেস্টুন দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে তাতে ইয়াহিয়ার কার্টুন আর সরকারীবিরোধী শ্লোগান খচিত। পেছনের সিঁড়ি বেয়ে নামতে গিয়ে দেখলাম হাতল নেই অন্ধকারে আমার চেষ্টা করা অসম্ভব। কক্ষের দিকে ফিরে আসার সময় ফেস্টুনগুলো টেনে বাথরুমে নিয়ে গেলাম। সমস্ত ঘটনাটাই মিনিটখানেকের মধ্যে।

আমি তখনো সোফার কাছে এসে পৌঁছাইনি একটা ভয়াবহ শব্দ করে প্রথম শেল এসে কক্ষের মধ্যে পড়ল। কোন কিছু চিন্তা করার পূর্বেই একটা ইসপ্লিন্টার প্রচণ্ড বেগে আমাকে উপড়ে ফেলল ফ্লোর থেকে। এই ইসপ্লিন্টারের প্রচণ্ডটা এত বেশী ছিল যে, আমি কখন ফ্লোরে পড়েছি, তা বুঝতে পারিনি। আমার উপর দিয়ে পরপর আরো তিনটে শেল নিক্ষেপ করা হয়, তারপর সব নিস্তব্ধ। দু’টো দেয়ালের কোণে আমি পড়ে ছিলাম। আঘাতে পশ্চিম দিকের দেয়াল উড়ে গেছে- বাইরে থেকে সবই দেখা যায়।

আমার উপর বাথরুমের একটা কপাট, দেয়ালের ইট পড়ে আছে। ঠিক কত মিনিট পর জ্ঞান ফিরে পেয়েছি, জানি না।

শার্ট ও প্যান্টের অনেক অংশ উড়ে গেছে, চোখে চশমা নেই, সমগ্র শরীর ইটের গুঁড়োতে লাল হয়ে আছে। পড়ে থাকা অবস্থাতেই হাত পা নেরে দেখাম কোন হাড় ভেঙ্গেছে কি না। বাঁ পা’টা উঠাতে পারলাম না একটা অংশে অনবরত রক্ত ঝরছিল। শরীরের অনেক স্থানে আঘাতের ব্যথা বেড়ে উঠতে লাগলো। ভাবলাম, জল্লাদের শেল নিক্ষেপ করেই যে ক্ষান্ত হবে, তা’ নয়। ক্লাবে শত্রুপক্ষের অবস্থান সম্পর্কে সন্দেহ করলে পরবর্তী কালে উঠে এসে স্টেন দিয়ে ব্রাস করে যাবে। আমি বাঁ পাটা টেনে টেনে বাথরুমের পেছনের দরজার দিকে গেলাম।

খয়ের ছুটে গেল একটা লুঙ্গি আনতে আমার জন্যে। কিন্তু পনের মিনিটের মধ্যেও সে ফিরে আসল না-ক্লাবের পশ্চিম কোণে তখন সৈন্যরা ঢুকেছে। তার বিলম্ব দেখে আমি এটা আঁচ করতে পেরেছিলাম। আমার পা টেনে টেনে পেছনের দরজা দিয়ে রান্না ঘরের পাশে গেলাম সেখান থেকে পুকুরের পাশে সেক্রেটারিয়েটের দেয়াল ঘেঁষে যে গলিটা গেছে সেখানে উপস্থিত হলাম বিধ্বস্ত অবস্থায়। দশ বারোজন ছোট দোকানদার ও রিক্সাচালকের আশ্রয় পুকুরের ধারের এই ঘরগুলোতে। কয়েকজন আমাকে ধরে নিয়ে একটা চৌকির নীচে লুকিয়ে রাখল। ইতিমধ্যে প্রেসক্লাবের আর তার পাশের সরকারী বাড়ীর মধ্যে সৈন্যরা প্রবেশ করেছে। আমি সেই ঘর থেকে স্পস্ট ওদের দেখতে পারছিলাম

একজন বুড়োকে বললামঃ আপনারা এখান থেকে পালান। একটু পরেই আক্রমন হবে।

বুড়োঃ যাবো কোথায়? সারারাত তো এখানেই ছিলাম- আর রাস্তা বন্ধ করেছি ব্যাটাদের। সব গাড়ি থামাতে হয়েছে ওদের, কাউকে বিনা বাধায় যেতে দেইনি।

কিন্তু এখন তো দিন আসছে, সব দূর থেকে দেখা যাবে, বললাম।

পালানোর চাইতে প্রতি আক্রমণের আগ্রহই তাদের মধ্যে প্রবল। জনৈক যুবক, হয়তো কোন দোকান কর্মচারী, সারারাত কিভাবে হানাদার সৈন্যদের সন্ত্রাসের মধ্যে রেখেছিল তার বর্ণনা দিল। প্রেসক্লাবের পেছনের অংশে প্রতিবারই তারা আশ্রয় নিয়েছে হানাদারদের তাড়া খেয়ে। সাংবাদিকদের এই প্রেসক্লাবের উপর আক্রমণের কারণটা তখন আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠলো। এই সমস্ত বীর প্রতিরোধকারীদের কোন সন্ধান তারা করতে পারেনি- তাদের উপর আঘাত হানাও সম্ভব হয়নি।

এই আক্রোশই ইয়াহিয়ার সৈন্যরা প্রেসক্লাবের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল- তোপের মুখে প্রেসক্লাবটা উড়িয়ে দিয়ে গেরিলাদের স্তব্ধ করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। সারারাত অন্ধকারের মধ্যে যে গেরিলারা তাদের সন্ত্রাসের মধ্যে রেখেছিল তাদের ধ্বংস করার জন্যে নিকটস্ত আশ্রয় কেন্দ্রে প্রেসক্লাবে শেল বর্ষণ অস্বাভাবিক কিছু নয়।

গুলী বর্ষণ সকালের দিকে কোন অঞ্চলে পুনরায় বৃদ্ধি পেতে থাকে। সৈন্যরা তোপখানা রোডের উপর দাঁড়িয়ে রাইফেলের নল উঁচিয়ে আছে।
একজন মধ্য ব্যক্তিকে বললামঃ এখানে গুলী আসবে, আপনারা সরে যান।

প্রশ্ন করলেন তিনিঃ আপনি কি করবেন?

আমাকে সামনের গাছের উপর উঠিয়ে সেক্রেটারিয়েটের মধ্যে ফেলে দিতে পারবেন?

তিন-চারজন যুবক দেয়ালের পাশের গাছটায় উঠে আমাকে টেনে দেয়ালের ওপারে নিয়ে গেল। নীচেই সরকারী মসজিদ। সেক্রেটারিয়েটের ভেতরের পরিবেশটা অন্য প্রত্যেকটি মানুষ আক্রমণের আশঙ্কায় সময় গুনছেন। প্রায় ত্রিশ চল্লিশজন লোককে দেখলাম সাদা পোশাকে নির্বাক ঘুরে বেড়াচ্ছে।

আকস্মিক ভাবে এক তরুণ এসে জিজ্ঞেস করলঃ রাতে কোথায় ছিলেন, কোথায় গুলী লেগেছে, শরীরের সর্বত্রই রক্ত কেন? কাপড় বদলানো দরকার। তার অনেক প্রশ্ন।

শান্তি তার নাম। মোতালেব কনট্রাক্টরের মিস্ত্রী। এখানেই কাজ করে থাকে। তারপর এলো আরো কয়েকজন সেই সাদা পোশাকের লোকগুলো।

একজন আমার পরিচয় জানতে চাইলেন। বললামঃ আমি কুমিল্লায় ব্যবসা করি রাতে লঞ্চ থেকে নেমে বড় ভাই এর বাড়ি যাচ্ছিলাম। এ সমস্ত কিছুই জানতাম না। রাতের বেলা তোপখানা রোডে গুলী খেয়েছি।

নিজেকে সাংবাদিক বলতে চাইনি বলে সবটাই মিথ্যে বললাম তাদের কাছে।

এখানে আক্রমন হলে আপনার পক্ষে বাঁচা সম্ভব হবে না, চলুন ঐ ন’তলায়। একজন প্রস্তাব করলেন। শান্তি ছেলেটা তক্ষুনি একটা লুঙ্গি নিয়ে এলো ওর ঘর থেকে। আমাকে দু’জনে ধরে দু’নম্বর ন’তলায় নিয়ে গেল। পয়লা মার্চ থেকে দেশে অসহযোগ চলেছে- অফিস- আদালত- বন্ধ।
সে কারনে লিফট নেই। পাঁচতলায় গিয়ে পৌছালাম। কোন কক্ষই খোলা নেই। কৃষি বিভাগের একটা বাথরুম পাওয়া গেল খোলা। তখন রক্ত ঝরছিল ক্ষত দিয়ে। এই বাথরুমেই ২৬শে মার্চ ও পরবর্তী রাত কাটাতে হয়। বাইরে মৃত্যুর বিভীষিকা।

যারা আমাকে এই স্থানে আশ্রয় দিয়ে চলে গেলেন, তারা সেক্রেটারিয়েটে প্রহরারত বিদ্রোহী পুলিশ। সকলেই পোশাক খুলে রেখে সাদা পোশাকে সেক্রেটারিয়েটে পাহারা দিচ্ছেন। প্রত্যেকের কাছে মাত্র কুড়ি রাউন্ড বুলেট ছিল। তারা ইতিমধ্যে জানতে পেরেছেন, রাজারবাগ ও পিলখানায় বিদ্রোহ হয়েছে। যুদ্ধ হয়েছে বর্বর বাহিনীর সাথে। বাঙ্গালী পুলিশ ও সেনাদের দাঁড় করিয়ে হত্যা করা হয়েছে। লড়াই না করে কেউ মৃত্যুকে স্বীকার করতে চান না।

সাততলার উপর তাদের ঘাঁটি তৈরি করা হয়েছিল। বিদেশী সৈন্যরা সেক্রেটারিয়েটে প্রবেশ করলে এই ঘাঁটি থেকে আক্রমন করার সমস্ত প্রস্তুতি তাদের ছিল। সেকেন্ড গেটের ভেতর দিকে ব্যারিকেড সৃষ্টি করে তারা প্রতিরোধের জন্য প্রস্তুত ছিলেন।

সাতাশ তারিখে দশটার দিকে একজন এসে বললেন, এখন গোলাগুলি বন্ধ। লোকজন রাস্তায় বেরিয়েছে। কারফিউ উঠিয়ে নিয়েছে বলে ঘোষণা করা হচ্ছে।

জিজ্ঞেস করলামঃ আপনারা সকলে এখানে ?

হয়তো সবাই চলে যাব, আপনাকে বড় রাস্তা পর্যন্ত দিয়ে আসি, চলুন।

দু’জনে ধরে আমাকে নিয়ে এলেন সেক্রেটারিয়েটের প্রথম গেট পর্যন্ত। শান্তি সাথে ছিল।

পরনে লুঙ্গি, গাঁয়ে গেঞ্জি অথচ তখনো আমার পায়ে ভালো এক জোড়া জুতা ছিল। শান্তিকে বললামঃ তোমার বাবার স্যান্ডেল জোড়া দাও- আমার জুতাড় সাথে বদল কর। নইলে পোশাকে বড্ড বেশী গরমিল দেখাচ্ছে।

বিব্রত শান্তি তাই করল কিন্তু সেও আমার সাথে বেরিয়ে এলো।

আব্দুল গনি রোডে একটা রিক্সা পাওয়া গেল। বিদায়ের সময় একজন বললেনঃ হাসপাতালে যাবেন না। আহতদের সৈন্যরা তুলে নিয়ে যায়।“

আলামিন সরকার এবং হৃতহৃ ইসলাম

<৮,১০,৩৬৬-৭২>
[ময়নামতি ক্যান্টমেন্ট পাকবাহিনী হত্যাযজ্ঞের উপর দুটি প্রতিবেদন]

পাকিস্তান পার্লামেন্টে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রথম প্রস্তাবকারী কুমিল্লার গর্ব ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে কিভাবে হত্যা করা হয়েছিল? চলুন দেখে আসি…
দৈনিক বাংলা, ২১ জানুয়ারি, ১৯৭২।

“২৫শে মার্চের কালোরাতে জল্লাদ ইয়াহিয়ার দখলদার বাহিনী বাংলাদেশের জনগনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার পর কুমিল্লার ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টে কি ঘটেছিল? উল্লেখযোগ্য যে হানাদার বাহিনী যে সমস্ত ক্যান্টনমেন্টে সবচেয়ে বেশী হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল, ময়নামতি তাঁর মধ্যে অন্যতম। ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টে যে সমস্ত বাঙালি সামরিক অফিসার ও জাওয়ান আটকা পড়েছিলেন তাঁদের মধ্যে প্রায় কেউই বেরিয়ে আসতে পারেননি।

বাঙালি সামরিক অফিসারদের পত্নীরা কেউ কেউ বেরিয়ে আসতে পেরেছিলেন, কিন্তু তারাও বন্দী অবস্থায় থাকায় প্রকৃত ঘটনার কথা বেশী জানতে পারেননি। কাজেই অনেক ক্ষেত্রেই ময়নামতির মত কাব্যিক নামের একটা স্থানের নরপিশাচরা যে নারকীয় হত্যালীলা চালিয়েছিল, তার প্রত্যক্ষদর্শী ১ জনার কাছ থেকে আমরা সেখানকার ঘটনার বিবরণ পেয়েছি।

এ দুজনের মধ্যে একজন হচ্ছেন, সাবেক পাকিস্তানী গোলন্দাজ বাহিনীর সেকেণ্ড লেফটেন্যান্ট ইমামুজ্জামান এবং অপর জন হচ্ছেন ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টের বেসামরিক কর্মচারী শ্রী রমনীমোহন শীল।

শ্রী রমনীমোহন শীল ক্যান্টনমেন্টে ক্ষৌর কর্ম করতেন। প্রথমোক্ত লেফটেন্যান্ট ইমাম বেঁচেছেন সম্পূর্ণ অলৌকিকভাবে। তিনি জানিয়েছেন যে, তার বেঁচে থাকার এবং মুক্তি সংগ্রামে অংশগ্রহণের কথা তার বাবা যেন এখনো বিশ্বাস করতে চান না।

২৯শে মার্চ লেফটেন্যান্ট ইমামুজ্জামানকে হানাদার বাহিনীর লোকেরা গ্রেফতার করে নিয়ে আরো ১ জন সামরিক অফিসারের সংগে একটি ঘরে বন্দী করে রেখেছিলো।

৩০ শে মার্চ বিকাল চারতার সময় একজন হানাদার সৈন্য ঘরে ঢুকে স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয় অস্ত্রের সাহায্যে এই তিনজন অফিসারের উপর গুলি চালায়। লেফটেন্যান্ট ইমামুজ্জামানের সংগী অপর ২জন অফিসার সঙ্গে সঙ্গে প্রাণ হারান। লেফটেন্যান্ট এর পায়েও গুলি লাগে এবং তিনি মনে করেন যে, তার মৃত্যুও হতে যাচ্ছে। গুলি করে সৈন্যটি বেরিয়ে যাওয়ার পর সেখানে একজন সামরিক হত্যালীলা তদারক করতে আসে।

এ সময় ইমামুজ্জামান মরার ভান করে পড়ে থাকেন। অফিসারটি তাদের দেখতে এসে বলে “ঠিক হ্যায় বাংগালী সব খতম হো গিয়া।“ এরপর পৃথিবীর বুকে নেমে আসে ঘন কালোরাত্রি। লেফটেন্যান্ট ইমাম ও অন্যান্যরা যে ঘরে ছিলেন তার বাইরে সেন্ট্রি পাহারা দিতে থাকে। ইমাম এসময় দেখেন যে, তিনি নড়াচড়া করতে পারছেন। হাতের কব্জী চোখের পাশে এবং কাঁধে গুলি লাগলেও কি আশ্চর্য ইমাম উঠে দাঁড়ালেন। বিস্ময়াভিভুত ইমাম দেখলেন শুধু উঠে দাঁড়ানোই নয়, তিনি হাঁটতেও পারছেন। মুহূর্তে সংকল্প ঠিক করলেন ইমাম যিনি কাকুলের সামরিক একাডেমিতে পাঞ্জাবী ইন্সপেক্টরদের বাঙালি দাবিয়ে রাখার চেষ্টা সত্ত্বেও তার ব্যাচে ৪র্থ স্থান লাভ করে কমিশন পেয়েছিলেন।

-(এখানেওএকটা প্রিন্টিং মিসটেক আছে। কাকুল নয় বরং কাবুল হবে)

তিনি ঠিক করলেন পালাতে হবে, বেরিয়ে যেতে হবে, এই নরক পুরী থেকে। ধীরে ধীরে এগিয়ে মৃত সহকর্মীদের দিকে আরেকবার তাকিয়ে ইমাম পিছনের জানালার কাছে গেলেন। টুক করে জানালা খোলার শব্দ হলো, বাইরে সচকিত হয়ে গেল প্রহরী। মুহূর্ত বিলম্ব না করে বাইরে লাফ দিলেন তিনি। ধপ করে আওয়াজ হওয়ায় লাশ প্রহরারত প্রহরী ভাবল ভূত দেখছে, চিৎকার করে উঠল সে। ইমাম গায়ের শক্তি দিয়ে দৌড় দিলেন, চললেন অন্ধকারে।

এর মধ্যে গুলি হতে থাকল কিন্তু ভাগ্য ভালো ইমামের, একটা গুলিও তার গায়ে লাগেনি। কখনো দৌড়ে, কখনো হেঁটে, কখনো ক্রল করে ইমাম বেরিয়ে এলেন অন্ধকার মৃত্যুপুরী থেকে। সকালের আলোয় তিনি দেখলেন এক বুক সহানুভূতি নিয়ে তাঁকে ঘিরে দাঁড়িয়ে গ্রামবাংলার অনেক মানুষ। যেন মায়ের কোলে ফিরলেন আহত ইমাম। তিনি যত্ন পেলেন, পেলেন সেবা। সীমান্ত পেরিয়ে চলে গেলেন আরো অনেক অনেক মুক্তিযোদ্ধার সংগে যোগ দিতে।

ইমাম আমাকে জানালেন, বন্দী অবস্থায় তিনি ঘরের জানালা নিয়ে বাঙালীদের গুলি করে হত্যা করতে দেখেছেন। এক জায়গায় বাঙালি ছেলেরা ভলিবল খেলছিল, তিনি দেখলেন হঠাৎ একটি হানাদার সেখানে গিয়ে গুলি চালিয়ে সবাইকে ধরাশায়ী করল। তারপর শুরু হলো প্রচণ্ড গোলাগুলি। ইমাম তার সংগীদের আর্তচীৎকার শুনেছেন এবং গুলিবিদ্ধ হয়ে মরতে দেখেছেন।

তিনি বললেন আসলে শয়তান হচ্ছে গোলন্দাজ বাহিনীর লেঃ কর্নেল ইয়াকুব মালিক। ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টে হত্যাযজ্ঞ সেই সংঘটিত করেছিল। মূলতঃ তার নির্দেশেই চলে এই হত্যাযজ্ঞ। এছাড়া মেজর সুলতান, ক্যাপ্টন জাহিদ জামান, মেজর মোহাম্মদ ইয়াসিন খোকার ( এই পশু নিজ হাতে গুলি করে মেজর আনোয়ারুল ইসলাম, লেফটেন্যান্ট সালাহউদ্দিন এবং সেকেণ্ড লেফটেন্যান্ট আতিকুর রহমান সিরাজীসহ আরো অনেককে হত্যা করেছে)।

ক্যাপ্টেন ইকতেখার হায়দার ( এই অফিসারের নেতৃত্বে কুমিল্লা পুলিশ লাইনে হামলা চালানো হয়)।

লেঃ কর্ণেল মালিকের নেতৃত্বে ২৯ শে মার্চ কুমিল্লা শহরে গোলা বর্ষণ শুরু করা হয়। ক্যাপ্টেন আগাবোখারি ও সুবেদার মেজর সুলতান এবং আরো অনেক হানাদার নরপিশাচ নারকীয় উল্লাসে মেতে নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালায় বলে ইমাম জানান।

সুবেদার মেজর ফয়েজ সুলতান সম্পর্কে লেফটেন্যান্ট ইমাম বলেন যে, এই নরপশু ক্যাপ্টেন নুরুল ইসলামসহ বহুলোককে হত্যা করেছে। পাগলা কুকুরের মত এই নরখাদক ক্যান্টনমেন্টে যত্রতত্র ঘুরে বেড়াতো এবং বাঙালি দেখলেই গুলি করে হত্যা করতো।

ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টে যে সমস্ত শহীদ বাঙালি সামরিক অফিসারদের কথা বললেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন, লেঃ কর্ণেল জাহাঙ্গীর, লেঃ কর্ণেল আনোয়ারুল ইসলাম, মেজর খালেক, মেজর শহিদুজ্জামান, ক্যাপ্টেন হুদা , ক্যাপ্টেন বদরুল আলম, লেফটেন্যান্ট ফারুক, লেফটেন্যান্ট এনামুল হক, লেফটেন্যান্ট তুর্কে ( ডাকনাম), ক্যাপ্টেন আইয়ুব আলী, লেঃ সালাউদ্দিন, সেকেণ্ড লেঃ হারুনুর রশিদ, ক্যাপ্টেন নুরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন সিদ্দিক প্রমুখ।

*প্রত্যক্ষদর্শী রমনী শীলের বিবরণ

এরপর আমাদের উল্লেখ করতে হয় নরসুন্দর রমনী শীলের কথা। অত্যাবশ্যকীয় কাজে নিযুক্ত থাকায় সম্ভবতঃ হানাদারেরা অন্যান্যদের সঙ্গে বন্দী করে নিয়ে গিয়েও একে হত্যা করেনি নিজেদেরই স্বার্থে।

হয়ত তারা ভেবেছিল পরে সুযোগ বুঝে এদের হত্যা করা যাবে। ক্ষৌর কর্মের মত অত্যাবশ্যকীয় কাজে নিযুক্ত থাকার জন্য বর্বর পশুরা তাকে বাচিয়ে রেখেছিল, কিন্তু সে সময় হয়তো তারা বুঝতে পারেনি, দেবপুর রমনশীলের চোখ আছে, অনুভূতি আছে। নরপিশাচদের এই ভুলের জন্য হয়তো রমনী শীল আজো বেঁচে আছেন, বিশ্বের ইতিহাসে কলঙ্কজনক নরহত্যার একটি জীবন্ত দলিল হিসাবে। কুমিল্লায় সামসুন নাহার রারবী শ্রী রমনী শীলের সাক্ষাৎকার গ্রহতণ করেছিলেন, আমরা তার বিবরণ পেয়েছি।

-(রারবী নয় বরং রাবরী হবে)।

রমনী জানিয়েছেন, কিভাবে বাংলার কৃতি সন্তান স্বনাম ধন্য- শ্রী ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে হানাদারেরা অত্যাচারের জর্জরিত করে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে। তিনি জানিয়েছেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে তিনি গুলি করে হত্যা করতে দেখেছেন।

ধীরেন বাবু সম্পর্কে বলতে গিয়ে রমনী শীলের চোখের জল বাঁধ মানেনি । মাফলারে তিনি চোখ মুছে বললেন আমার সে পাপের ক্ষমা নেই। বাবু স্কুল ঘরের বারান্দায় অতি কষ্টে হামাগুড়ি দিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন কোথায় প্রস্রাব করবেন আমি আঙ্গুল দিয়ে ইশারায় তাঁকে প্রসাবের জায়গা দেখিয়ে দেই। তখন তিনি অতি কষ্টে আস্তে আস্তে একটি পা ধরে সিঁড়ি দিয়ে উঠানে নামেন। তখন আমি ঐ বারান্দায় বসে এক জল্লাদের দাড়ি কাটছিলাম।

আমি বার বার বাবুর দিকে অসহায়ভাবে তাকাচ্ছিলাম বলে জল্লাদ উর্দুতে বলে, এটা একটা দেখার জিনিস নয় নিজের কাজ কর।

এরপর আর বাবুর দিকে তাকাবার সাহস পাইনি। মনে মনে শুধু ভেবেছি বাবু জনগণের নেতা ছিলেন, আর আজ তার কপালে এই দুর্ভোগ। তাঁর ক্ষতবিক্ষত সমস্ত দেহে তুলা লাগান, মাথায় ব্যাণ্ডেজ, চোখ ও হাত বাঁধা অবস্থায় উপর্যুপরি কয়দিনই ব্রিগেড অফিসে আনতে নিতে দেখি।

রমনী শীলের জবান বন্দীতে ময়নামতির মর্মান্তিক কাহিনীর আরো কিছু অংশ এখানে তুলে দিচ্ছিঃ

২৯ শে মার্চে ক্যান্টনমেন্টঃ

“গত মার্চের ২৯ তারিখে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে বাঙালি অফিসার বেসামরিক কর্মচারীসহ প্রায় তিনশত ব্যক্তিকে ব্রিগেড হেড কোয়ার্টারের তিনটি কামরায় আটক করে রাখে। বিকাল অনুমানিক সাড়ে তিনটায় ৪০ নং ফিল্ড এম্বুলেন্স ইউনিটে কিছু গোলাগুলির আওয়াজ শুনতে পাওয়া যায়। তারপর পরই আমরা দেখতে পাই ক্যান্টনমেন্টের বিভিন্ন এলাকা থেকে সমস্ত বাঙালী অফিসার ও অন্যান্য কর্মচারীকে ব্রিগেড হেড কোয়ার্টারে নিয়ে জমা করতে থাকে। এবং এই সঙ্গে আমাকেও আমার সরকারী বাসগৃহ থেকে ধরে নিয়ে আসে।“

তিনি বলেন, “বেসামরিক, সামরিক বিভাগের সাধারণ ব্যক্তিদেরকে আটক করা হয়। ৪০ নং এম্বুলেন্স এর ফিল্ড কমান্ডিং অফিসার লেঃ কর্ণেল জাহাংগীরসহ অন্যান্য অফিসারদের এনে আমাদের সঙ্গে আটক করে। পরের দিন দুপুরে প্রাশসনিক জে সি ও সুবেদার আকবর খান, লেঃ কর্ণেল জাহাংগির এর গায়ের জামা খুলে তা দিয়ে তার চোখ বেঁধে ফেলে। তখন তিনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করেন, আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো।

তার উত্তরে উক্ত জল্লাদদ্বয় তাঁকে ইস্পাহানী স্কুলে নিয়ে যাচ্ছে বলে জানায়। তারপর তাঁকে ব্রিগেড অফিস প্রাঙ্গণে আনুমানিক ২৫ গজ দক্ষিণে একটি গর্তের পাশে দাঁড় করিয়ে গুলি করা হয়। তাঁকে এইভাবে গুলি করে হত্যার দৃশ্য আমরা সকল বন্দী ও ব্রিগেড হেড কোয়ার্টারের ব্রিগেডিয়ার থেকে সকল স্টাফ অফিসার নিজ নিজ কক্ষে বসে অবলোকন করি।

এর পরপরই ১ লা এপ্রিলে অবসর প্রাপ্ত সিলেটের অধিবাসী মেজর হাসিব ( এস এস ও ) এবং শিক্ষা বিভাগের ক্যাপ্টেন মকবুলকে নিয়ে একইভাবে পরপর গুলি করে হত্যা করা হয়। ইত্যবসরে ক্যান্টনমেন্টে মুজাহিদ বাহিনীর অফিসার ক্যাপ্টেন মন্তাজ এসে উক্ত জল্লাদদ্বয়কে শাসিয়ে বলে যে, একজন একজন করে এভাবে হত্যা করলে সময়ে কুলোবে না, কারণ তিনশত এর মত বাঙ্গালিকে হত্যা করতে হবে। ক্যাপ্টেনের ধমক খেয়ে এর পর প্রতি চারজন অফিসারকে এক একটি দড়িতে বেঁধে নিয়ে একই জায়গায় হত্যা করতে থাকে। পরে অন্যান্য সকলকে এক একটি দড়িতে (১৪জনকে) বেঁধে নিয়ে হত্যা করে।

এর মধ্যে কর্ণেল জাহাংগীর, ইয়াকুব আলী, মেজর হাসিব, লেঃ বাতেন, ইঞ্জিনিয়ার্সের একজন ক্যাপ্টেন, ব্রিগেডিয়ারের সহকারী কেরানী, নায়েব সুবেদারসহ ২৫জন কেরানীকে আমি চিনতে পারি। এভাবে সন্ধ্যা পর্যন্ত হত্যাযজ্ঞ চালানোর পর ১২ জন বেসামরিক লোক থেকে যায়। সন্ধ্যার ঠিক পরপরই একটি পাঞ্জাবী নায়েক আমাদের ঘরের পিছনের জানালা দিয়ে চুপি চুপি ডেকে আমাকে বলে যে, “তুমি ঘাবড়িওনা তোমায় কিছু করা হবে না ব্রিগেডিয়ার সাহেব বলেছেন।“ এ পর্যন্ত বলে রমনী শীল জীবন মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকার সেই স্মৃতিচারণ করেন। এর মধ্যে নায়েকটি পুনরায় অভয় দিয়ে যায়।

রমনী শীল জানান তার সঙ্গে যে ১২ জন বেসামরিক লোক ছিল তারা হচ্ছেন ইস্পাহানী হাই স্কুলের সহকারী অধ্যক্ষের দুই পুত্র, রমনীসহ চারজন নরসুন্দর ও ছয়জন ঝাড়ুদার। সেই কালো রাত্রি কিভাবে তারা কাটিয়েছে তার বর্ণনা দেওয়া তখন তার পক্ষে সম্ভব হয়নি।

একদিন ভোরে মুজাহিদ বাহিনীর সেই জল্লাদ ক্যাপ্টেন মন্তাজ এসে এই বন্দী ১২ জনের সবাইকে ব্রিগেডের কর্মচারী বলে ছেঁড়ে দেওয়ার নির্দেশ দেয়, এবং নিজ নিজ কাজে যোগ দেওয়ার জন্য হুকুম দেয়। সে সময় সহকারী অধ্যক্ষের দুই ছেলেকে জিজ্ঞাসাবাদ করে যখন জানতে পারে যে, তারা ব্রিগেডের কর্মচারী নন, ঠিক তখনই তাদেরকে ঐ গর্তের পার্শ্বে নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করে। রমনী শীল জানান যে সারাদিন চোখের সামনে শত শত বাঙালি হত্যার দৃশ্য দেখা এবং সেই সঙ্গে কালো রাত্রিটি অতিবাহিত করা যতটা অসহনীয় ছিল তার চাইতেও কঠিন ও দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়ালো যখন তাঁকে ঐ সময়ই উপস্থিত জল্লাদদের দাড়ি কাটার নির্দেশ দেওয়া হলো।

অশ্রুসিক্ত রমনী শীল আরো জানান যে, তিনি শুধু বিগ্রেড হেডকোয়ার্টারের লোকজন হত্যা করতে দেখেননি, ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারের লোকজনকে হত্যা করতে দেখননি, ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারের বিপরীত দিকে ২৪ নং এফ, এফ, রেজিমেন্টের গার্ডে ক্যান্টনমেন্টের বিভিন্ন ইউনিট হতে জমাকৃত কয়েকশত বাংগালীকে ফতেহ মোহাম্মদ ষ্টেডিয়ামের দক্ষিণ প্রান্তে গুলি করে হত্যা করতে দেখেছেন।

এই কাহিনী বলতে গিয়ে রমনী শীল কখনো হু হু করে কেঁদে ফেলেছেন, কখনো এমন ভাব দেখিয়েছেন যেন এটা একটা মামুলী ব্যবপার , আবার কখনো চুপচাপ “থ” হয়ে গেছেন।

তিনি গভীর দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলেন “ বোধ হয় এসব দেখার জন্যই আমি শত শত মৃত্যুর মাঝেও বেঁচে ছিলাম এবং এখনও আছি। আমার বাসা ও ব্রিগেড কোয়ার্টারেরর মাঝামাঝি জায়গাতেই লেঃ কর্ণেল জাহাংগীরসহ ২৪ জন অফিসার ও শতাধিক অন্যান্য বাঙালিকে একটি গর্তে মাটিচাপা দিতে দেখি। ওই সব লোককে মাটিচাপা সেওয়ার সময় গর্তের পাশে দাঁড়িয়ে আমাকে কয়েকজন নরখাদকের ক্ষৌর কর্ম করতে হয়।

সেখান থেকে দেখতে পাই ফতেহ মোহাম্মহ ষ্টেডিয়ামের দক্ষিণ পাশের গর্তে নিক্ষিপ্ত কয়েকশত মৃত দেহের উপর পেট্রোল দিয়ে অগ্নিসংযোগ করা হচ্ছে। পরে বুলডোজারের সাহায্যে গর্তে মাটিচাপা দেওয়া হয়। রমনী শীল বলেন, সে সব মৃত দেহের কংকাল আমি এখনো মাটি খুঁড়ে তুলে দিতে পারব। আড়াই দিন অনাহারে থাকার পর রমনী শীল তার বাসায় পৌঁছার সময় দেখতে পান একটি বৃহদাকার ট্রাক ভর্তি মৃতদেহ ( সম্ভবতঃ কুমিল্লা শহর থেকে আনা) সেই ফতেহ মোহাম্মদ ষ্টেটিডিয়ামের দক্ষিণ পাশ দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

ট্রাকটি রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় সমস্ত রাস্তাটি রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল। গত এপ্রিল মাস থেকে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে সামরিক বাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগ এফ, আই ও-তে কাজ করার সময় তিনি যে দৃশ্য দেখেছেন তার বর্ণনা প্রসংগে রমনী শীল বলেন, এফ আইওর অত্যাচার থেকে ব্রিগেড অফিসের সামনের হত্যাকাণ্ড অনেক ভালো ছিল। মেজর সেলিমের এফ আইও ইউনিটে যাদেরকে একবার নেওয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে খুব কম লোকই ফিরে এসেছে।

গত আগষ্ট মাসে রমনী শীল সি এম এইচ –এ বদলী হন। সেখানে তার বাস গৃহের পাশেই হানাদার সৈন্যদের লাশ কবর দেয়া হত। এই সময়ের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে রমনী শীল উৎসাহব্যঞ্জক কণ্ঠে বলেন, সারাদিন কাজ করেছি আর সন্ধ্যায় ঘরে বসে পাক হানাদারদের কবরের সংখ্যা গুনেছি। লক্ষ্য করতাম দিন দিন তাদের কবরের সংখ্যা বাড়ছে। রাত্রে এ সমস্ত কবর খনন করা হত। এ দৃশ্য মনে আশার আলো নিয়ে আসত।

মনে মনে ভাবতাম, যে নির্যাতন ও রক্ত ক্ষয় দেখেছি, তা বৃথা যায়নি। প্রতিশোধ নেওয়া হচ্ছে। তা নাহলে শত শত পাক সেনা কিভাবে লাশে পরিণত হচ্ছে।

দৈনিক বাংলা , ২১ জানুয়ারী, ১৯৭২”

শুধু কংকাল আর কংকাল

কুমিল্লা, ২৯ শে জানুয়ারী। টিক্কা নেয়াজী ফরমান আলীর নরপশুরা ঠাণ্ডা মাথায় বাঙালি নিধনের পৈশাচিকতায় ইহুদী হত্যাযজ্ঞের নায়ক আইকম্যানকেও হার মানিয়েছে। জল্লাদ পাক বাহিনী যে কি নির্মম, কি বর্বর আর পাষণ্ড ছিল তা কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের হাজার হাজার বাঙ্গালির কংকাল, সামরিক, বেসামরিক পোশাক, খসে পা মাথার চুল। হাত, পা বাঁধা অবস্থায় বিকৃত লাশ, চোখ বাঁধা অবস্থায় কংকাল নিজ চোখে না দেখলে অনুমান করাও সম্ভব নয়।

ময়নামতী পাহাড়ের গর্তে লুকায়িত ছিল প্রাচীন সভ্যতার অনেক প্রতীক। ইতিহাসের পণ্ডিত ব্যক্তিগণ প্রত্নতাত্ত্বিকের সভ্য জগতের নিকট গর্বের সঙ্গে এ বহু প্রাচীন সভ্যতার দ্বার খুলে আজকের সুসভ্য মানব জাতিকে দেখাচ্ছেন হাজার হাজার বছর আগেও এ অঞ্চলে ছিল সুসভ্য সংস্কৃতিবান একটি জাতি।

কিন্তু এই ময়নামতিতেই হানাদার বাহিনী গত ২৫শে মার্চের পর থেকে যে হিংস্রতা আর বর্বরতার প্রমাণ রেখে গেছে গভীর কম্যাণ্ড পোষ্ট অগভীর মাটির নীচে, গর্তে এবং জঙ্গলের মধ্যে, আজকের মানুষই শুধু নয়, ভবিষ্যতের মানুষও তা দেখে ঘৃণায় আর ভয়ে শিউরে উঠবে।

বস্তুতঃ গোটা কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টই ছিল একটি কসাইখানা। কসাই ছিল হানাদার বাহিনী আর তাদের দালালরা। সেখানে তারা খুব করেছে হাজার হাজার বাঙালিকে। সেই বদ্ধভূমিটা আজ একটা কবরস্থান। ময়নামতি ক্যান্টনমেণ্ট এলাকাটা পাহাড়ি অঞ্চল। উঁচু নিচু। কোথাও কিছুটা সমতল ভূমি। ঘন শণ আর কাশ বনে ভরা।

গত শনিবার শ্রী রমনী শীলকে নিয়ে আমি ক্যান্টনমেণ্ট এলাকায় পৌঁছি। ক্যাণ্টিন পেছনে রেখে কয়েক গজ এগুনোর পরই হাতের ডানদিকে আমাকে দুটো কম্যাণ্ড পোষ্টের গর্ত দেখান।

মাটি সরিয়ে সেখানে যে নারকীয় হত্যাযজ্ঞের স্বাক্ষর দেখতে পাই তা যেমন ভয়ঙ্গকর তেমনি মর্মবিদারক। কংকাল। অনেকগুলোর উপরেই সামরিক পোশাক। আর আছে সামরিক টুপি, কোমরের বেল্ট, সামরিক পরিচয়ের প্রতীক। পরে কুমিল্লা পুলিশ সুপার শ্রী চিত্তাবিনোদ দাস জানান, এ গর্তটিতে পে বুক, চেক বই, কলম, হাতের ঘড়ি, চশমা, টুপি ও নষ্ট হয়ে যাওয়া কিছু টাকা পাওয়া গেছে।

উচ্চপদস্থ সামরিক অফিসাওরদের পরিচয় প্রতীক। রমনী শীল যে এ ক্যাণ্টনমেণ্টে দীর্ঘ বছর ধরে ক্ষৌর কার্যে নিয়োজিত ছিলো, ও মন্সুর আলী যে দীর্ঘ দিন ধরে এখানে জুতা মেরামতের কাজ করতো, উভয়েই এই বাঙালি নিধন পর্বের প্রত্যক্ষদর্শী। লেফটেন্যাণ্ট কর্ণেল জাহাঙ্গীর, কয়েকজন মেজর, আর্মি এডুকেশন কোরের ক্যাপ্টেন মকবুলসহ মোট ২৪ জনের লাশ একটা স্তর প্রথম গর্তে পাওয়া গেছে।

একটি লাশ মহিলার বলে মনে হয়। সারা দুপুর আমি বিস্তীর্ণ প্রান্তর ঘুরে ঘুরে দেখলাম আমার সঙ্গে নর সুন্দর রমনী শীল আর জুতা মেরামত কারী মনসুর। তারা আমাকে শত শত গর্ত দেখালো। কোন কোন গর্ত হয়ে শেয়াল লাশের কিছুটা টেনে বের করেছে। অনেক গর্ত থেকে ভেসে আসছে পূতি গন্ধ। এখানে সেখানে এলোমেলো পড়ে রয়েছে জামা কাপড়, গেঞ্জির টুকরো। ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে একটি মাঠ। সেখানে হেলিকপ্টার উঠানামা করে ।

তার দক্ষিণে আরো একটি মাঠ। সেটা কিছুটা নীচু। সমস্তটা জায়গা জুড়ে রয়েছে গর্তের পর গর্ত। প্রতিটা গর্তেই অসংখ্য কঙ্কাল। আর মাঠটায় ছড়িয়ে রয়েছে শত শত অসহায় বাঙ্গালীর হার আর মাথার খুলি। কোথাও পড়ে রয়েছে খসে পড়া মাথার চুল। পূর্বদিকে বিরাট বিরাট তিনটি ডোবা দেখালো আমাকে রমনী শীল। দেখলেই বোঝা যায় সেখানে মাটি কেটে আবার চাপা দেয়া হয়েছে। হাজার হাজার মানুষের লাশ এখানে মাটি চাপা দেয়া হয়েছে বলে তারা আমাকে জানালো।

জেলা প্রশাসন ও পুলিশের তরফ হতে এ পর্যন্ত মাত্র কয়েকটি গর্ত খোঁড়া হয়েছে। সবগুলো খুঁড়তে সময় লাগবে। নরসুন্দর রমনী শীল ৩৫/৪০ বছর বয়দের ছোটখাটো মানুষটা আর মনসুর আলী লম্বা হাল্কা গড়নের প্রৌঢ়। উভয়ে দীর্ঘ দিন ধরে এ সামরিক ছাউনীতে কাজ করতো । গত ২৭ শে মার্চ বিকাল ৫ তার দিকে কোয়ার্টার মাষ্টার মিটিং আছে বলে উভয়কে ব্রিগেড অফিসে ডেকে নিয়ে যায়।

সেদিন থেকে উনত্রিশ তারিখ পর্যন্ত তাদের ঐ অফিসে আটকে রাখা হয়। তাদের সঙ্গে আরো ৫০ জন লোক ছিল ঐ কক্ষে বন্দী। ২৯শে মার্চ বিকাল আনুমানিক চারটার দিকে তারা দেখতে পায় ব্রিগেড অফিসের পাশের কুল গাছতার নিচে তাদের প্রিয় বাঙালি উচ্চপদস্থ সামরিক অফিসারদের গুলি করে নির্মমভাবে হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়েছে। প্রথমে একজন একজন করে ও পরে তাড়াতাড়ি নিধনযজ্ঞ শেষ করার জন্য ৩/৪ জনকে এক সাথে কাপড় দিয়ে চোখ বাঁধা ও দড়ি দিয়ে শক্ত করে হাত বাঁধা অবস্থায় ঐ কুল গাছের নিচে নিয়ে এসে গুলি করে হত্যা করা হয়।
পরদিন ভোর বেলা তাদের মাটিচাপা দেয়া হয়। ওরা সবাইকে জানিয়েছে যে তাদের চোখের সামনেই অন্ততঃ তিনশুতের বেশী লোককে খুন করা হয়েছে। রমনী শীল ও মন্সুরের সাথে যারা বন্দী ছিল আদের মধ্যে অতি আবশ্যক কাজ সমাধানের জন্য দু’চারজনকে রেখে বাকী সবাইকে ৩০শে মার্চে খুন করা হয়। তাদের দুজনকে খুন করা হয়নি কিন্তু হুকুম ছিলো সামরিক ছাউনি এলাকার বাইরে তারা যেতে পারবে না।

সে হুকুমেই তারা সেদিন মেনে নিয়েছিল প্রাণে বাঁচার জন্য। তাদের চোখেমুখে সেই বিভীষিকাময় দিনগুলোর ভয়াল ছাপ আজো বিদ্যমান। এ পর্যন্ত যতটুকু জানা গেছে তাতে দেখা যায় বিশ্বের এ জঘন্যতম পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড শুরু হয় ব্রিগেডিয়ার শফির নেতৃত্বে। হত্যাযজ্ঞে তার সহযোগীরা ছিল কর্ণেল খিজির হায়াত খান, আর্টিলারীর লেফটেন্যাণ্ট মীর, মেজর সুলতান আহমদ, ক্যাপ্টেন বোখারী, ক্যাপ্টেন জাবেদ ইকবাল, লেফটেন্যাণ্ট কর্ণেল বার্কি, সিকিউরিটি বিভাগের মেজর সেলিম, মেজর মোস্তফা, মেজর সিদ্দিকী ও ক্যাপ্টেন কবির। এই নরপশুদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পৈশাচিকতায় সহযোগিতা করে কুমিল্লা ইস্পাহানী পাবলিক স্কুলের প্রিন্সিপাল অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যাণ্ট কর্ণেল এম কে আমীন ও কুমিল্লা স্ট্যাণ্ডার্ড বাঙ্কের অবাঙ্গালী ম্যানেজার আলীম।

সে আজও কুমিল্লায় পালিয়ে বেড়াচ্ছে। আলীমকে খুঁজে বের করা হলে আরো তথ্য উদঘাটিত হবে বলে স্থানীয় জনসাধারণ মনে করেন। জুতো মেরামতকারী মনসুর আলী আমাকে জানিয়েছে যে, ১১৭ নং ব্রিগেডের খান সেনারা বহু মহিলাকে এমন কি কোলে নবজাতসহ মহিলাদেরকে ক্যান্টনমেণ্টে ধরে এনেছে। এদের ভাগ্যে কি পরিণতি ঘটেছে তা সে জানে না। সামরিক ছাউনীর পাশে দ্বিতল ইস্পাহানী পাবলিক স্কুলের উপরের সব কয়টি কক্ষে বহু দিন ধরে নির্যাতিত মহিলারা বন্দী ছিলেন। তাদের অনেকের আর্তচীৎকারে আশপাশের লোকজন শিউরে উঠতো বারবার। মিত্র বাহিনী কুমিল্লা ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে ৬০/৭০ জন লাঞ্চিতা মহিলাকে উদ্ধার করেছে বলে কোতোয়ালী পুলিশ সাব ইনেসপেক্টর বজলুর রহমান আমাকে জানিয়েছেন। তাছাড়া ঐ সময় আরো অনেকে পালিয়েও গেছে। কুমিল্লা কোতোয়ালী পুলিশের মত শুধু মাত্র সামরিক ছাউনীতেই চার হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে।

ইস্পাহানী পাবলিক স্কুলের শিক্ষক মোহাম্মদ ওয়ালীউল্লাহ ক্যান্টেনমেন্ট স্কুলের অবাঙ্গালী শিক্ষককে একদিন আলোচনা করত শুনেছেন এখনে ত্রিশ হাজার বাঙ্গালীকে নিধন করা হয়েছে।

ঐ তিন শিক্ষক হচ্ছে, মঞ্জুর , সাইদ ও সোলেমান। মঞ্জুর আর সোলেমান ত্রিশ হাজার বাঙালিকে হত্যা করার ঘটনা সানন্দে প্রকাশ করার সময় সাইদ মন্তব্য করেছিল ‘ইয়ে কুছ নেহী, মামুলী হ্যায়।’ পশুদের কাছ থেকে অন্য কোন মন্তব্য আশা করা যায় কি?”

আলামিন সরকার

<৮,১১,৩৭৩>
[নারায়নগঞ্জে ২ টি ছাত্রের হত্যাকাহিনী]

“ওরা আমাকে গুলি করেছে। ডাক্তার ডাকো, ডাক্তার ডাকো” বলেছিল নারায়ণগঞ্জ ছাত্রলীগের সভাপতি ১৮ বছরের তরুণ মোশাররফ হোসেন মাশা।
-দৈনিক ইত্তেফাক, ৫ জানুয়ারি, ১৯৭২।

২৭শে মার্চ হানাদার বাহিনীর গাড়ীর শব্দে নারায়ণগঞ্জের স্তব্ধ পরিবেশ ভেঙ্গে গেলো। শহরের উপকণ্ঠ জামতলায় সবাইকে নিয়ে মোশাররফ হোসেন মাশা প্রস্তুত হয়েই ছিলো। ওদের রাইফেল গর্জে ওঠে। হানাদার বাহিনী থমকে দাঁড়ায়।

২৯শে মার্চ হানাদার বাহিনী শহরে প্রবেশ করলো। মর্টারের গর্জনে ট্যাঙ্কের নিনাদে ভীতসন্ত্রস্ত শহরবাসী পালাতে থাকে শহর ছেড়ে। এতদিনের জনকোলাহল মুখর শহরে নেমে এলো মৃত্যুর বিভীষিকা।

তখন সবেমাত্র সন্ধ্যা হয়েছে। হানাদার বাহিনীর গাড়ীগুলো ঘুরছে এদিকে সেদিকে। মাশা টানবাজারে ওদের কার্যালয়ে চিন্তাক্লিষ্ট মুখে সহকর্মীদের নিয়ে ভাবছে কি করা যায়। এমন সময় নারায়ণগঞ্জের তৎকালীন জনৈক কুখ্যাত দালালের ইঙ্গিতে হানাদার বাহিনী ওদের কার্যালয়ে প্রবেশ করে ওদের আক্রমণ করলো। হানাদার বাহিনীর গুলিতে আহত হয়ে মাশা ঢলে পড়ে। মাশার বুকের রক্তে ভিজে যায় কার্যালয়ের কক্ষতল। আহত মাশা বুক চেপে ছুটে যায় ওর মা বাবার কাছে। বলে, ডাক্তার ডাকো। আমি বাঁচবো, আমাকে বাঁচতে হবে, বাঁচাতে হবে আমার সাড়ে সাত কোটি বাঙালী ভাই-বোনকে। কন্তু কোথায় ডাক্তার! শহরে তখন ভীতির রাজত্ব, চারিদিকে তখন আর্ত মানুষের মরণ হাহাকার। ডাক্তারের অভাবে রাত ১টায় এই তরুণ দেশপ্রেমিকের প্রাণবায়ু বেদনা ব্যথিত বাংলার আকাশে মিলিয়ে গেলো। শহরের স্তব্ধ পরিবেশে জেগে উঠলো আর একটি আর্ত চিৎকার।

বিভিন্নমুখী প্রতিভার অধিকারী মাশা কেবল রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেই সুনাম অর্জন করেনি, বিদ্যালয়ে শিক্ষার ক্ষেত্রেও তার প্রতিভার পরিচয় ভাস্বর হয়ে আছে। মাশা আজ আমদের মধ্যে নেই।

ও কি জানতো, এমনি করে ওকে বিদায় নিতে হবে, ওর এত প্রিয় বাংলাদেশ থেকে। ও কি ভেবেছিলো ওরা আসবে, নিরস্ত্র মানুষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে ওদের ভিক্ষা করে আনা অস্ত্র নিয়ে।

কিন্তু ওরা এলো। ২৮শে মার্চ রাত্রে পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী ওদের উপর হীন আক্রমণ চালালো।

চিত্ত বীরের মতোই তাদের আটকাতে গিয়েছিল। গর্জে উঠলো হানাদার বাহিনীর আগ্নেয়াস্ত্র। চিত্ত ঢলে পড়লো ওদের টানবাজারের ছাত্রলীগের কার্যালয়ের কক্ষতলে। হানাদার বাহিনী একটি গুলি করেই ক্ষান্ত হয়নি, পরপর চারটি গুলি করেছে, ওর মৃতদেহটি কার্যালয়ে আগুন ধরিয়ে তার মধ্যে ছুঁড়ে দিয়েছে।

বন্দর হাইস্কুলের সাধারণ সম্পাদক এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত কর্মবীর এবং দেশভক্ত চিত্তকে আমরা ভুলবো না।“
<৮,১২,৩৭৪>
[অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো নরপশুরা]

দৈনিক বাংলা, ২০ জানুয়ারি ১৯৭২।

“ওরা যখন ওদের ফুপার রক্তাক্ত লাশ জড়িয়ে কাঁদছিল তখন পাশেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তিনটি নরপিশাচ অট্টহাসি দিয়ে ওদের বিদ্রূপ করছিল।

২৭ শে মার্চ শনিবার। হানাদার বাহিনীর ৬টি জীপ ঢাকা থেকে নদী বন্দর নারায়ণগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে দীর্ঘ ১০ মাইল পথের দু’পাশেই চালিয়েছিল হত্যাযজ্ঞ। কামানের গোলা আর মর্টারের শেল দিয়ে জ্বালিয়ে একাকার করিয়ে দিয়েছিল অসংখ্য ঘর বাড়ী। অবশেষে নারায়ণগঞ্জ শহর উপকন্ঠে এসে জেটি মাসদাইরে প্রচন্ড প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়।

পরে হানাদার দস্যুরা হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল নিরস্ত্র নিরীহ নারী-পুরুষের উপর।এতে অনেক জীবন অকালে ঝরে পড়ে পৃথিবীর বুক থেকে।মাসদাইরে ই ছিল জনাব জসিমুল হকের বাড়ি। তিনি ছিলেন জামিল ডকইয়ার্ড এর মালিক। নারায়নগঞ্জ শহরে সকলের পরিচিত।

জনাব জসিমুল হক ও তার স্ত্রী হত্যা সম্পরকে কিছু জানার জন্য আমি তাদের মাসদাইর গ্রামের বাড়িতে যাই। বাড়িতে কেউ ছিল না।ছেলে মেয়েরা সবাই অন্যত্র আত্মীয়স্বজনের কাছে আশ্রয় নিয়েছে।ঘটনাটি আমাকে জানিয়েছিল হীরা নামে একটি কিশোরী।

মিসেস হক তার ফুফু।হীরাও সেদিন জনাব হক এবং ফুফুর সাথে মৃত্যুর সারিতে দাঁড়িয়ে ছিল। তার চোখে আজও সেদিনকার ভয়ংকর দৃশ্য ছবি হয়ে আছে।কেমন করে হীরা বেচে গিয়েছিল এখন তা সে ভাল করে বলতে পারবে না।কিন্ত সেদিনকার ভয়ংকর দৃশ্য সে ভুলতে পারেনি মোটেই। হীরা বলেছিল ২৭শে মার্চ এর দুটোয় সাত আট- জন পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী আমাদের বাড়িতে হানা দিয়ে চারিদিকে গুলি করতে থাকে।তখন ঘরের মেঝেতে আমরা সবাই শুয়ে পড়ি।

কিন্ত কিছুক্ষণের মধ্যেই দরজার সামনে রাইফেল ও এল,এমজি নিয়ে এসে হানাদারেরা গালাগালি দিতে দিতে আমাদেরকে ঘরের বাইরে আসতে বলে। আমরা একে একে বাইরে আসি।হানাদারেরা আমাদেরকে বাইরে এনে আংগিনায় দু’সারিতে দাঁড় করায়। পাশের বাড়ির লোকজনও ওদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল। ওদের সবাইকে ওরা হত্যা করে রাস্তায় নিয়ে গিয়ে। অবশ্য তার আগে টাকা পয়সা লুট করতে ওরা ভুলেনি। হীরার ফুফু আসমাও রেহাই পাননি। তার বুকে বেয়নেট চারজ করে পরে গুলী করে তাকে হত্যা করে।

আমি আর শেলী (ফুফাত বোন) তখন ফুফার লাশের কাছ থেকে বাড়ির ভিতরে ফুফুর খোজে এসে এই ঘটনার সম্মুখীন হই। আমাদের দেখে ফুফু আম্মা ডাক্তার ডাকতে বলে আলমারি থেকে “নভালজীন” ট্যাবলেট দিতে বলেছিলেন। তখন ফুফু আম্মার শরীর থেকে রক্তের স্রোত বইছিল। শেলী কাপড় চাপা দিয়ে ক্ষতস্থানের রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা করছিল।আমি টেলিফোনে ডাক্তার ডাকছিলাম। ডাক্তার পেয়েছিলাম, কিন্ত এলাকাটার নিরাপত্তার কথা ভেবে ডাক্তার আসেননি। তখন চারিদিকে গোলাগুলির প্রচন্ড শব্দ আর মৃত্যুপথযাত্রীদের যন্ত্রণা ও চিৎকার যেন এক প্রলয় বইছিল বাইরে।

ইতিমধ্যে আমাদের অপর একটি ঘরে হানাদারেরা আগুন জ্বালিয়ে দেয়। ফুফু আম্মা তখন বেদনায় গোংগাচ্ছিলেন। বাঁচার চেষ্টায় তিনি অস্থির। আমাকে তিনি পাক ঘর থেকে দুধ এনে দিতে বললেন। আমি দুধ এনে ফুফু আম্মার মুখের কাছে ধরলে অতি কষ্টে দুধ পান করে ফুফা কোথায় আছেন জিজ্ঞাসা করলেন।প্রথমে শেলী ফুফার মৃত্যু সংবাদ গোপন রাখতে চেয়েছিল। কিন্ত আমি ফুফু আম্মার অন্তিমকাল বুঝতে পেরে বলেছিলাম ফুফাকে ওরা মেরে ফেলেছে।

এ কথা শুনে ফুফু আম্মা একটি দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে আমাদেরকে শুধু বললেন, তোর ফুফার কবরের পাশে বাড়ির তেতুল গাছের তলায় আমাকে কবর দিস। সন্ধ্যার দিকে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।“

আশফাকুল ইসলাম তন্ময়
<৮,১৩,৩৭৬-৭৮>
[পাকবাহিনীর জিঞ্জিরা আক্রমণ]

-দৈনিক বাংলা, ৩ এপ্রিল, ১৯৭২।
“২রা এপ্রিল ১৯৭১ সাল । একটি প্রভাত। কেরানীগঞ্জের একটি রক্তাক্ত প্রভাত । মাত্র কয়েকঘণ্টার মধ্যেই পৃথিবীর ইতিহাসের ঘৃণ্যতম পশুদের আক্রমণে ঝড়ে গেল শতশত প্রাণ; লুণ্ঠিত হল কেরানীগঞ্জ । ছাই হয়ে গেল গ্রামের পর গ্রাম । ধর্ষিতা হল কেরানীগঞ্জের অনেক মা-বোন । রক্তের বন্যা বয়ে গেল প্রতিটি গ্রাম এ । সৃষ্টি হল রক্ত-নদী, সে নদী মিশে গেল বাংলা রক্ত সমুদ্রে ।

২৫শে মার্চের কাল রাত্রিতে পাক বর্বর বাহিনী যখন আক্রমণ চালায় ঢাকা নগরীতে, যখন নরপশুরা মর্টার আর স্টিমরোলার চালায় বুড়িগঙ্গার উত্তর পাড়ের বাসিন্দাদের উপর, যখন নগরবাসিদের হাহাকার আর্তনাদ আর করুণ চিৎকার প্রতিধ্বনিত হয় নদীর দক্ষিন পাড়ে তখন কেরানীগঞ্জবাসী শুধু আশ্চর্য ও বিমূঢ়ই হয়নি, প্রতিবাদ তুলেছিল, দলে দলে জমায়েত হয়েছিল নদীর এপারে গভীর রাতের নিস্তব্ধতাকে ভঙ্গ করে ।

২৫শে মার্চের কাল রাত্রি পেরিয়ে ভোর হল । নগরবাসীরা প্রাণভয়ে নগর ছেড়ে কেরানীগঞ্জের গ্রামে এসে ভিড় করতে লাগলো । প্রত্যেকের মুখে মলিনতার ছাপ স্বজন হারানোর। গন্তব্যস্থল ঠিক নেই সম্পূর্ণ অচেনা গ্রাম, শুধু জানটুকু সম্বল, টাকা পয়সা জিনিসপত্র কিছুই নেই সাথে । শুধু একটু ঠাই, একটু বাঁচার প্রচেষ্টা । ২৬শে মার্চের পড়ে পরপর কয়েকদিনে নগরীর প্রায় সমস্ত লোক বুড়িগঙ্গা পেরিয়ে চলে এল এই কেরানীগঞ্জে । যে যেভাবেই পেরেছে ছুটে এসেছে । প্রায় প্রত্যেকেই স্বজন বিচ্ছিন্ন । আবালবৃদ্ধবনিতা প্রত্যেকেই চলে এলেন কেরানীগঞ্জে ।

আর কেরানীগঞ্জবাসী? সেবায় এলো কেরানীগঞ্জবাসী প্রত্যেকে । শহরের মাতাকে করে নিল মাতা , পিতাকে পিতা , ভাইকে ভাই, বোনকে বোন, নগরীর প্রত্যেককে বুকে করে নিলো কেরানীগঞ্জ, কারো অসুবিধে নেই, সব এক ।

অবশেষে এলো কেরানীগঞ্জের বিভীষিকাময় সেই সকালটি । পৃথিবীর ঘৃন্যতম পশুরা শহর থেকে দৃষ্টি ফেরাল । বক্র দৃষ্টি । সে দৃষ্টি কেরানিগঞ্জে । ইতিমধ্যে শহরের অনেকেই ভয়াতুর মনে চলে গেছে শহরে নিজ নিজ আবাসস্থলে । ছলছল দৃষ্টি নিয়ে বিদায় নিয়েছে তারা ।

২রা এপ্রিলের আগের রাত্রে কেরানীগঞ্জের অনেক স্থানে শোনা গেল এক চাপা কণ্ঠস্বর , মিলিটারি আসতে পারে ।

অবশেষে ভোর হল । কেরানীগঞ্জবাসী তখন ঘুমে অচেতন । সহসা শোনা গেলো কামান আর মর্টারের শব্দ । অনেকে লাফিয়ে উঠলো ঘুম থেকে । যে যেখানে পারলো ছুটাছুটি করতে লাগলো শুরু হল নৃশংস হত্যাযজ্ঞ । চারিদিকে কেবল চিৎকার শুধু প্রাণ বাঁচানোর আকুল প্রচেষ্টা । পশুরা রাত্রিভর প্রস্তুতি নিয়েছিল । কেরানিগঞ্জকে ঘিরে রেখেছিলো । ক্ষেতের মধ্যে নালা কেতে যখন তারা প্রস্তুতি নেয় তখন কেরানীগঞ্জবাসী ঘুমে অচেতন । ঝোপঝাড়, পুকুর,ঘরের ছাদ যে যেখানে পারলো সবাই আত্মগোপন করলো । কিন্তু খুনি টিক্কার কুখ্যাত ব্রিগেডিয়ার বশির রেহাই দেয়নি কাউকেই । গ্রামের পর গ্রাম তারা জ্বালিয়ে দিলো । মেশিনগান আর টমিগান এর আওয়াজে সবাই বিচলিত । সমানে চলল জিঞ্জিরা, সুভাড্যা ও কালিন্দি ইউনিয়ন লোকদের উপর গুলি, অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন , ধর্ষিতা হল কেরানীগঞ্জের মা-বোনেরা । প্রত্যেকটি ঘর আক্রান্ত হল ৩ টি ইউনিয়ন এর । অবশেষে হত্যাযজ্ঞের সমাপ্তি ঘটলো । বর্বর বাহিনী কুখ্যাত ব্রিগেডিয়ার বশিরের নির্দেশমতো থেমে গেল । রেখে গেল এক রক্তাক্ত কাহিনী ।

প্রতি গ্রাম থেকে খবর এলো অসংখ্য মৃত্যুর । শতশত লাশ । রক্তে রঞ্জিত লাশ, পিতার বুকে জড়ান শিশুর লাশ , মার কোল থেকে গুলি খেয়ে ছিটকে পরা শিশুর বিকৃত বীভৎস লাশ, মায়ের লাশ, বোনের লাশ । বর্বর পিশাচের দল রক্তের নদী বইয়ে দিলো কেরানীগঞ্জে ।

প্রতিটি ঝোপঝাড়, নালা-ডোবা আর কাশবন থেকেও পাওয়া গেল অসংখ্য লাশ । এমন কোন বাড়ি নেই যে বাড়ির ক্ষতি হয়নি । প্রতি গ্রামেই বর্বর বাহিনী বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছে । হিন্দু এলাকাগুলো পুড়িয়েছে বেশি । এমনকি মসজিদ ও বাদ যায় নি । খোলা মাঠে পড়ে থাকা লাশে নিজের হারিয়ে যাওয়া আপনজনকে খুঁজে ফিরেছে কেরানীগঞ্জের লোক । খান সেনারা প্রত্যেক গ্রামে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করেছে । শহর থেকে আসা অনেক অপরিচিত লোকের লাশকে নিজ হাতে গোর দিয়েছে এখানকার লোকেরা ।

মান্দাইল ডাকের সড়কের সামনের পুকুর পাড়ে দস্যুরা এক স্থানে প্রায় ৬০ জনকে হত্যা করে । কালিন্দির এক গ্রামে বর্বর বাহিনী পাশবিক অত্যাচার করতে গিয়ে ১১ জন মহিলাকে হত্যা করে । খোলা মাঠ ও গ্রাম দিয়ে যখন ছুটাছুটি করে প্রাণভয়ে, তখন খান সেনারা উপহাস ভরে চালিয়েছে ব্রাশ ফায়ার । বহু অপরিচিত লাশ এখানে সেখানে বিক্ষিপ্তভাবে পড়েছিল । অজানা স্থানে ইতস্তত বিকৃত বীভৎস লাশ কুকুরকে খেতে দেখেছে কেরানীগঞ্জবাসী । অনেক খুঁজাখুঁজি করে ভাইয়ের বিকৃত লাশ দেখে সংজ্ঞাহীন হয়েছে এখানকার মানুষ । মেয়েকে পিতার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া, ভাইকে বোনের সামনে মারা , সন্তানসম্ভবা মাকে ছেলের সামনে হত্যা, প্রভৃতি করুণ দৃশ্য দেখার তিক্ত অভিজ্ঞতা কেরানীগঞ্জবাসীর । সে অভিজ্ঞতা ২রা এপ্রিলের ।“
জিঞ্জিরা ধ্বংসলীলার আরো বিবরণঃ (অনুবাদ)

“২৫শে মার্চ রাতে পাক হানাদার বাহিনী শহরের ফায়ার সার্ভিসের বিপক্ষে একটা চরম পদক্ষেপ নিয়েছিল । আমি বুঝতে পারি নি কেন মানুষের সেবায় নিযুক্ত নিষ্পাপ মানুষদের এভাবে হত্যা করা হয়েছিলো। রাতের চলমান কারফিউর মাঝেই এপ্রিলে শুরু হয়েছিলো সর্বত্র অগ্নিসংযোগ, আর বুঝা যাচ্ছিলো যে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রপাতিসহ ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের ইতিহাসের নৃশংসতমভাবে হত্যা করা ছিল একটা পূর্বপরিকল্পিত পরিকল্পনা। মিলিটারি অভিযানের পরে যেন মানুষ কোনভাবেই আগুন নেভাতে না পারে সেটাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য ।

প্রত্যেক রাতেই আগুন এবং ধোঁয়া আকাশে দেখা যেত এবং ধোঁয়ার দিক দেখে মানুষ বুঝে নিতো কোন এলাকায় আগুন দেয়া হয়েছে কিন্তু কারফিউর রাতে আগুনের ব্যাপারে খোঁজ নেয়ার কিংবা নেভানোর মত কেউ ছিল না । পুরো সপ্তাহ জুড়েই ঘরবাড়ি যখন পুড়ছে তখন শহরের পুরনো এবং নতুন উভয় অংশ থেকেই অসংখ্য মানুষ শহর ছেড়ে যায় এবং এর ফলে শহরের জনসংখ্যা প্রায় ৩ ভাগের ১ ভাগ এ নেমে আসে ।প্রানের মায়ায় মানুষ বাধ্য হয়ে তাদের ঘরবাড়ি এবং মূল্যবান সম্পদ অরক্ষিত রেখেই গ্রামের দিকে ছুটছিল, ফলে অনেক লুটতরাজের ঘটনা ঘটে । পুরুষ,মহিলা,শিশু সবাই বুড়িগঙ্গা পাড়ি দিয়ে দীর্ঘ পথে যাত্রা করে । তাদের সাথে যোগদান করা থেকে বিরত থাকতে আমাদের খুব কষ্ট হয়েছিলো। ঐ সময়ে যাদের সাথেই আমাদের কথা হয়েছিলো সবাই হয় নিজেদের ফেলে রাখা বাড়ি দেখতে এসে পালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল । রাত নামতেই কারফিউর মাঝে পুরো শহর জুড়েই ভয় শঙ্কাময় অবস্থা বিরাজ করছিল। জীবন ও মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে আমরা নদীর ওপারে যাওয়ার কথা ভাবছিলাম কিন্তু আমাদের দুধওয়ালা না করে দিয়েছিলো যেতে । সে বলেছিল যারা ওখানে চলে গিয়েছে তারা অনেক সমস্যার মাঝে আছে । এত মানুষ ওখানে যাওয়ায় ঐ এলাকার পরিস্থিতি খারাপ হয়ে গিয়েছিল । হিসেবমতে জিঞ্জিরার জনসংখ্যা প্রায় ১ লাখ বেড়ে গিয়েছিল ।

এরপর ১লা এপ্রিল এর ধ্বংসলীলা আরম্ভ হল যা ২৫শে মার্চ রাতের মত ছিল । দুটো ঘটনাই ঘটেছিল বৃহস্পতিবার এবং শুক্রবারের ভোর দেখেছিল গণহত্যা । আমরা শুক্রবার ভোর ৫ টায় ফজরের সময় ঘুম ভেঙ্গে ভয়ানক শব্দ শুনতে পাই তখন ভোরের আলো ঠিকমতো ফুটেনি । বৃহস্পতিবার রাত এবং শুক্রবার ভোরই কি তথাকথিত ইসলামিক দেশের হানাদার বাহিনীর অপারেশন এর সময় ছিল?? প্রত্যেক শুক্রবার ফজরের আযান কি বন্দুকের শব্দের সাথে পরিবর্তিত হয়েছিলো? এই প্রশ্নগুলো আমরা নিজেদের জিজ্ঞেস করেছিলাম । একবার আমরা ছাঁদে গিয়ে দেখি দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে ভয়ানক শব্দ হচ্ছে এবং আগুন আর ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন শহরের ঐ অংশ । মিডফোর্ড হাসপাতালের ছাঁদে অপারেশন এর বেস ছিল এবং বন্দুক ফিট করা ছিল ।

রিপোর্ট এসেছিল জিঞ্জিরার অভিযানে হাজারো জীবন শেষ হয়েছিলো । শেষ ৬-৭ দিনে শহরের ধ্বংসলীলা থেকে যারা নিরাপত্তা খুজতে জিঞ্জিরা গিয়েছিলো তারা হয়েছিলো সহজ শিকার । যারা ভাগ্যবান তারা অলৌকিক ভাবে বেঁচে গিয়েছিলো । আমরা মানুষের কাছে ভয়াবহ দুঃখজনক একটা ঘটনা শুনেছিলাম যে কয়েক ভাই মসজিদ হতে ফজরের নামাজ পরে আসছিলো এসময় হানাদার বাহিনী তাদের কে লাইন ধরে দাড়া করিয়েছিল, যখন এই একজনের দিকে বন্দুক তাক করা হয়েছিলো মেরে ফেলার জন্যে তখন সে বড় ভাইয়ের দিকে তাকিয়েছিল তখন বড় ভাই তাকে বলেছিল আল্লাহর কথা স্মরণ করতে এবং যখন সবার শেষে বড় ভাইয়ার পালা এসেছিল তখন গুলি শেষ হয়ে গিয়েছিলো এবং সে সামান্য আঘাত পেয়ে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলো । আমরা গল্প শুনেছি মানুষ কাদামাটি কিংবা কচুরিপানার মাঝে লুকিয়েছিল, মা এবং সন্তানদের আলাদা হয়ে যাওয়ার গল্প, প্রানের ভয়ে ভাই-ভাই, বউ-স্বামী আলাদা হয়ে যাওয়ার কথা । হানাদার বাহিনী জিঞ্জিরা বাজার এ ধ্বংসলীলা চালিয়েছিল এবং বহু মানুষের সম্পদ লুট করেছিলো । বহু কোটি টাকার খাদ্যশস্য নষ্ট করেছিলো । পুরো অপারেশনটাই চালানো হয়েছিলো ঢাকা থেকে যারা পালিয়ে গিয়েছিলো তাদের কে উদ্দেশ্য করে এবং এদের মধ্যে মুক্তিবাহিনীর দুজন নেতা ছিল বলে হানাদার বাহিনীর ধারণা ছিল । তারা এই দুজনকে খোঁজার জন্যে অনেক চেষ্টা করেছিলো । এই ঘটনার অনেক দিন পরেও মানুষ বলাবলি করতো হানাদার বাহিনী ঐদিন প্রত্যেকটা মানুষকে জিজ্ঞেস করেছিলো এই দুজনের ব্যাপারে “খসরু, মন্টু কিধার হ্যাঁয়” । কিন্তু তারা এই দুজনকে না পেয়ে আর অত্যাচার আর ধ্বংসলীলায় মেতে উঠে । আমাদের হৃদয় সম্পূর্ণ হতাশায় ভোরে গিয়েছিলো । সূর্য যখন উঠেছিলো জিঞ্জিরা তখন একটা ধ্বংসস্তূপ ।“

-The Jinjira Massacre And After Experiences of an Exile At Home
মাহফুজুল্লাহ কবীর
ডিসেম্বর, ১৯৭২।

জেসিকা গুলশান তোড়া
<৮,১৪,৩৭৯>
[জল্লাদেরা স্বামীর লাশটাও একবার আমাকে দেখতে দিলো না]
…দৈনিক বাংলা, তারিখঃ ১৯ শে জানুয়ারি, ১৯৭২

“সে হৃদয় বিদারক হত্যার বর্ণনা যখন শেষ হলো মিসেস কামরুন নাহার আহমদের দুগন্ড বেয়ে অঝোরে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিলো। তীব্রশোকে বেদনায় বারবার রুদ্ধ হয়ে আসছিলো তার বাকশক্তি। কান্নাজড়িত কন্ঠে তিনি বললেনঃ তাঁকে বাঁচানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। এতদিনের তিলে তিলে গড়া সংসারের সবকিছু ফেলে শহর ছেড়ে দূরের গাঁয়ে পালিয়েছি। কিন্তু জল্লাদ সেনাদের হাত থেকে শেষ পর্যন্ত তাঁকে বাঁচাতে পারলাম না।

ব্যাঙ্কের চেকটাই তাঁর মৃত্যুর পরওয়ানা হয়ে ফিরে এলো। মিসেস কামরুন নাহার আহমেদ সাবেক পূর্ব পাকিস্তান রেলের চীফ পারসোনেল অফিসার মরহুম নাসির উদ্দিন আহমেদের বিধবা স্ত্রী। তাঁদের বাসা ছিলো চট্টগ্রামের পাহাড়তলী রেলওয়ে কলোনীতে। গত ১১ই মে রাউজানের ডাবুয়ার্গ থেকে খানসেনারা তাকে ধরে নিয়ে এসে হত্যা করে।

বিপ্লবী বাংলার বন্দর নগরী চট্টগ্রাম। বীর চট্টলার মার্চ এলো বিপ্লবীর বান নিয়ে। সর্বত্র অসহযোগ। রাস্তায় রাস্তায় বীর জনতার মিছিলের সমারোহ। জনতার পদভারে বন্দর নগরী প্রকম্পিত। বিপ্লব আর বিদ্রোহের গানে দশদিক মুখরিত। সংগ্রামের উদ্দীপনার মধ্য দিয়েই এগিয়ে চলছিলেন বীর চট্টলার অধিবাসীরা। সংগ্রামমুখর সে নগরীর লাখো পরিবারেরই একটি আহমেদের পরিবার। তারপর এলো ২৫শে মার্চ।

খানসেনারা নেকড়ে বাঘের মত ঝাঁপিয়ে পড়লো নিরস্ত্র বাঙ্গালীদের উপর। এক পৈশাচিক নরহত্যা যজ্ঞে মেতে উঠলো তারা। বাঙ্গলীর রক্তে হলি খেললো দস্যু সেনারা। মিসেস কামরুন নাহার আহমদ স্বচক্ষে দেখলেন এই হত্যাযজ্ঞ। সেই বীভৎস দিনগুলোর কথা বর্ণনা দিতে গিয়ে কামরুন নাহার আহমেদ যেন আমাকে নিয়ে গেলেন এক প্রেতপুরিতে। একের পর এক তিনি ঘটনার বর্ণনা দিতে লাগলেন আর আমি যেন মানসচক্ষে দেখতে পেলাম হত্যা আর ধংসযজ্ঞের এক লোমহর্ষ চিত্র।

কামরুন নাহার আহমেদ বললেন, আমরা থাকতাম পাহাড়তলী রেলওয়ে কলোনীতে। রেলের অবাঙ্গালী কর্মচারীরাই সংখ্যায় বেশী ছিলো সেখানে। ২৫শে মার্চের আগে আমরা তাদের রক্ষা করেছি। কিন্তু ২৫শে মার্চের পরে ঘটনাপ্রবাহ ঘুরে গেল। তারা হামলা চালালো আমাদের উপর। লুটতরাজ, নরহত্যা আর নারী নির্যাতন চললো নির্বিচারভাবে। তারপর এলো ২৭শে মার্চ, দস্যু বাহিনী শুরু করলো বোমাবর্ষণ গ্লাস ফ্যাক্টরী, মেডিকেল কলেজ ও কালুরঘাট এলাকায়।

একত্রিশে মার্চ খান সেনাদের পুরোপুরি দখলে চলে গেল চট্টগ্রাম নগরী। আবার শুরু হলো বাঙ্গালী নিধন। ২রা এপ্রিল আমরা বাসা ছেড়ে পাশের এক বাড়ীতে আশ্রয় নিলাম। কারণ খান সেনারা আর অবাঙ্গালীরা আমার স্বামীকে খুঁজছে। তার অপরাধ ছিল বাঙ্গালী কর্মচারীদের সাথে কথা বলতেন। বাংলার স্বাধীনতার স্বপক্ষে গোপনে কাজ করতেন।

এপ্রিল মাসের ৫ তারিখ পর্যন্ত আমরা সেখানেই থাকি। ৫ তারিখে আমরা জানালা দিয়ে দেখলাম আমাদের প্রতিবেশী রেলের চীফ ইঞ্জিনিয়ার মোজাম্মেল চৌধুরী, একাউন্টস অফিসার আব্দুল হামিদ, এল. আর খান এবং তাদের পরিবারের চাকরবাকর নিয়ে মোট ১১ জনকে জবাই করে হত্যা করা হলো। সকাল ১১টায় এই হত্যালীলা দেখে আমরা আঁতকে উঠলাম। সেদিনই পালিয়ে গিয়ে উঠলাম ২০ নং চৌধুরী নাজীর আহমেদ রোডে ডাঃ সামসুল আলমের বাড়ীতে। সেখানে থাকাও আমাদের নিরাপদ ছিলন। তাই ডাক্তার সাহেবের পরামর্শে পালালাম তার ডাবুয়ার্গ এর বাড়ীতে। ১১মে পর্যন্ত সেখানে আমরা থাকি। মিসেস কামরুন বলেন, এই ১১মে আমাদের জীবনে ডেকে আনলো দুঃখের অমানিশা। আমাদের হাতের অর্থ ফুরিয়ে যাওয়ায় আমার স্বামী একটি চেক ভাঙ্গানোর জন্য ডাক্তার সাহেবের ছেলেকে পাঠান চট্টগ্রাম।

রেলওয়ে বিল্ডিং এর ন্যাশনাল ব্যাঙ্কের শাখা অফিসে তার একাউন্ট ছিল। কিন্তু সেখানকার কর্মচারীরা সবাই ছিল অবাঙ্গালী। চেকের দস্তখত দেখে তারা ছেলেটিকে আমার স্বামীর খোঁজ দিতে বলে। কিন্তু চেকের ব্যাকডেট এর অজুহাত দেখিয়ে ছেলেটি কিছু জানাতে অস্বীকার করলে তারা রেলওয়ে ওয়াচ এন্ড ওয়ার্ড এর অবাঙ্গালী অফিসার ওয়ার্সীকে ডেকে আনে। ওয়ার্সী তখন ছেলেটিকে ও তার বাবা ডাঃ সামসুল আলমকে ধরে সেনাবাহিনীর সদর দফতরে নিয়ে যায়। সেখানে তাদের অকথ্য অত্যাচার নির্যাতন চালিয়ে আমার স্বামীর সন্ধান বের করে।

তারপর দুজন খানসেনাকে সঙ্গে নিয়ে ওয়ার্সী রাউজানের ডাবুয়া গ্রামে ডাক্তার সাহেবের বাড়ীতে গিয়ে হাজির হয়। তারা আমার সামনে থেকে আমার স্বামীকে নিয়ে চট্টগ্রাম অভিমুখে রওনা হয়। তাদের সঙ্গে ডাক্তার সাহেব ও তার ছেলেও ছিল। পথে সাক্তার ব্রিজের কাছে বাস থামিয়ে খান সেনারা আমার স্বামীকে নামিয়ে খানিক দূরে নিয়ে যায়। কিছক্ষণ পরেই গুলির শব্দ পান বাসে উপবিষ্ট ডাক্তার সাহেব। মিনিট দশেকের মধ্যে খান সেনারা ফিরে আসে এবং ডাক্তার সাহেবকে চট্টগ্রামে নিয়ে ছেড়ে দেয়।

আমার স্বামীকে হত্যা করে নদীতে ফেলে দেওয়া হয়েছে বলে ডাক্তার সাহেব আমাকে জানান। মিসেস কামরুন নাহার তারপর এসে উঠলেন ঢাকাতে। অনেক অনুসন্ধান করে স্বামীর সন্ধান পাননি। দস্যু সেনাদের হাতে নাসিরউদ্দিন শহীদ হয়েছে। সদা কর্মব্যস্ত বাঙ্গালী দরদী একটি জীবনের অবসান হলো। জীবন দিয়ে নাসিরউদ্দীন মূল্য দিলেন তার দেশ ও স্বজাতি প্রেমের। তিনি আর এই সুন্দর পৃথিবীতে ফিরে আসবেন না। কিন্তু রেখে গেলেন কামরুন আর স্নেহের দুটি ছোট্ট মেয়ে রিনু আর নিড্ডুকে।

অভিশপ্ত ১১ই মেতে তাদের জীবনে নেমে এলো অমানিশার নিকষ কালো রাত্রি। মে থেকে একে একে ৮টি মাস কেটে গেল। বীভৎস রজনীর অন্ধকার কেটে দশদিক আলোয় ঝলমল করে স্বাধীনতার সূর্য উঠলো। শহীদ নাসিরউদ্দিনের স্বপ্নসাধ সফল হয়েছে। মুক্তির সোনালী আলোতে রিনু আর নিড্ডুর জীবন সুন্দর হবে, সার্থক হবে। এটাই বিধবা মার একমাত্র সান্ত্বনা। কিন্তু এই সান্ত্বনার মাঝেও মিসেস কামরুন নাহারের একটি মাত্র আক্ষেপঃ জল্লাদেরা একটিবারও তার লাশটি দেখতে দিলনা। পুলের ধারে না মেরে তারা যদি আমার সামনেই তাকে হত্যা করতো আমি তো লাশটা পেতাম।“

মিরাজ সজল
<৮,১৫,৩৮১-৮৪>
[মেজর জিয়ার পরিবারের উপর পাকবাহিনীর নির্যাতনের বিবরণ]
মেজর জিয়া যখন দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন, খান সেনারা তখন তাঁর পরিবার পরিজনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।
-মঞ্জুর আহমেদ। দৈনিক বাংলা। ২ জানুয়ারি, ১৯৭২।
“বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের বির নায়ক মেজর( বর্তমানে কর্ণেল) জিয়া যখন হানাদার পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলে তাঁদের নাজেহাল করে তুলছিলেন, তখন তাঁর প্রতি আক্রোশ মেটাবার ঘৃণ্য পন্থা হিসেবে খান সেনারা নৃশংসভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তাঁর আত্নীয়-স্বজন পরিবার পরিজনের উপর।

তাঁদের এই প্রতিহিংসার লালসা থেকে রেহাই পান নি কর্নেল জিয়ার ভায়রা শিল্পোন্নয়ন সংস্থার সিনিয়র কো-অর্ডিনেশন অফিসার মোজাম্মেল হক।

চট্রগ্রাম শহর শত্রু কবলিত হবার পর, বেগম খালেদা জিয়া যখন বোরখার আবরণে আত্মগোপন করে চট্টগ্রাম থেকে স্টিমারে পালিয়ে নারায়ণগঞ্জে এসে পৌঁছেন, তখন জনাব মোজাম্মেল হকই তাকে নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। সেদিন ছিল ১৬ই মে। ঢাকা শহরে ছিল কারফিউ। নারায়ণগঞ্জেও সন্ধ্যা থেকে কারফিউ জারি করা হয়েছিল। এরই মধ্যেই তিনি তাঁর গাড়ীতে রেডক্রসের ছাপ এঁকে ছুটে গিয়েছিলেন নারায়ণগঞ্জের টার্মিনালে।

বেগম জিয়াকে নিয়ে আসার দিন দশেক পর ২৬মে হক সাহেবের কর্মস্থল ‘শিল্প-উন্নয়ন সংস্থা’-য় ‘হক’ নাম সম্বলিত যত অফিসার আছেন, সবাইকে ডেকে পাক সেনারা কর্নেল জিয়ার সাথে কারোর কোন আত্মীয়তা আছে কিনা জানতে চায়। সেনারা তার বাড়ি তল্লাশী করে। কিন্তু বেগম জিয়াকে সেখানে না পেয়ে যাবার আগে জানিয়ে যায়, সত্যি কথা না বললে আপনাকে ক্যান্টনমেন্ট নিয়ে যাওয়া হবে।

এরপরই জনাব হক বুঝতে পারেন, সর্বক্ষণ তাকে অনুসরণ করা হচ্ছে। যেখানেই যান, সেখানেই তার পেছনে লেগে থাকে ফেউ। এই অবস্থায় তিনি মায়ের অসুখের নাম করে ছুটি নেন অফিস থেকে এবং সপরিবারে ঢাকা ছেড়ে যাবার ব্যবস্থা করতে থাকেন।

১লা জুলাই গাড়ী গ্যারেজে রেখে পেছন দরজা দিয়ে বেরিয়ে তাঁর ফ্যামিলি দুটি অটোরিকশায় গিয়ে উঠেন। উদ্দেশ্য ছিল আপাততঃ ধানমন্ডি তে বেগম জিয়ার মামার বাসায় গিয়ে ওঠা। কিন্তু সায়েন্স ল্যাবরেটরি পর্যন্ত আসতেই একটি অটোরিকশা তাদের বিকল হয়ে যায়। এই অবস্থায় তারা কাছেই গ্রীনরোড এক বন্ধুর বাসায় গিয়ে উঠেন। কিন্তু এখানে তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল এক বিরাট বিস্ময়। বন্ধুর স্ত্রী তাকে জানান যে কর্নেল জিয়ার লেখা চিঠি তাদের হাতে এসেছে। চিঠিটা জনাব হককেই লেখা এবং এটি তার কাছে পাঠাবার জন্য কয়েকদিন ধরেই তাকে খোঁজা হচ্ছে।

তার কাছে লেখা কর্নেল জিয়ার চিঠি এ বাড়িতে কেমন করে এলো তা বুঝতে না পেরে তিনি যারপরনাই বিস্মিত হন এবং চিঠিটি দেখতে চান। তার বন্ধুর ছেলে চিঠিটা বের করে দেখায়। এটি সত্যি কর্নেল জিয়ার লেখা কিনা, বেগম জিয়াকে দিয়ে তার পরীক্ষা করিয়ে নেবার জন্য তিনি তার বন্ধুর ছেলের হাতে দিয়েই এটি জিওলজিক্যাল সার্ভের জনাব মুজিবর রহমানের কাছে পাঠান।

এদিকে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসায় জনাব হক তার এই বন্ধুর বাসায় রাতের মত আশ্রয় চান। তাদেরকে আরো নিরাপদ স্থানে রাখার আশ্বাস দিয়ে রাতে তাদেরকে পাঠান হয় সূত্রাপুরের একটি ছোট্ট বাড়ীতে। তার বন্ধুর ছেলেই তাদেরকে গাড়িয়ে করে এই বাড়ীতে নিয়ে আসে। এখানে ছোট্ট একটি ঘরে তারা আশ্রয় নেন।

কিন্তু পরদিনই তারা খেলতে পেলেন পাক বাহিনীর লোকেরা বাড়িটি ঘিরে ফেলেছে। জনা দশেক সশস্ত্র জওয়ান বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে। এই দলের প্রধান ক্যাপ্টেন সাজ্জাদ আর ক্যাপ্টেন আরিফ। তারা ভেতরে ঢুকে কর্নেল জিয়া ও বেগম জিয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। জনাব হক ও তার স্ত্রী জিয়ার সাথে তাদের সম্পর্কের কথা অস্বীকার করে যান। কিন্তু ক্যাপ্টেন সাজ্জাদ জনাব হ্ব বেগম হকের সাথে তোলা বেগম জিয়ার একটি গ্রুপ ছবি বের করে দেখালে তখন তারা জিয়ার সাথে সম্পর্কের কথা স্বীকার করেন। তবে তারা জানান যে, কর্নেল ও বেগম জিয়া কোথায় আছেন তা তারা জানেন না।

এই পর্যায়ে বিকেল পাঁচটায় জনাব হক ও তার স্ত্রীকে সামরিক বাহিনীর একটি গাড়ীতে তুলে মালিবাগের মোড়ে আনা হয় এবং মৌচাক মার্কেটের সামনে তাদেরকে সন্ধ্যা পর্যন্ত গাড়ীতে বসিয়ে রাখা হয়। এখানেই তাদেরকে জানানো হয় যে বেগম জিয়াকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এরপর তাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

অর্থাৎ ২ জুলাই আবদুল্লাহর সিদ্ধেশ্বরীর বাসা থেকে বেগম জিয়া, জনাব আবদুল্লাহ এবং জনাব মুজিবর রহমানকেও পাক বাহিনী গ্রেফতার করে। ৫ই জুলাই জনাব মোজাম্মেল হক অফিসে যোগ দিলে সেখান থেকেই ক্যাপ্টেন সাজ্জাদ তাকে গ্রেফতার করে।

ক্যাপ্টেন সাজ্জাদ তার কাছে পরিকল্পনার কথা জানতে চাইলে তিনি অস্বীকার করেন এবং ক্যাপ্টেন তাকে মিথ্যাবাদী বলে শাস্তি দেবার হুমকি দিলেও কথা আদায় করতে না পেরে হাজার ওয়াটের উজ্জল আলোর নিচে শুইয়ে রাখার হুকুম দেয়।

প্রায় ৪ ঘন্টা তাকে এই যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়।

পরদিন আবারও একই কাজ করা হয় ক্যাপ্টেন সাজ্জাদ বারবার জানতে চায় যে, শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে তার কি কথা হয়েছে এবং ভারত যাবার আগে কি পরিকল্পনা হয়েছে। এবং জনাব হক অস্বীকার করলে সাজ্জাদ ঘাড়ে প্রচন্ড আঘাত হানেন এবং চব্বিশ ঘন্টা হাজার ওয়াটের বাতি জ্বালিয়ে রাখার হুকুম দেয়।

অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে বারবার তিনি একটা কথাই বলতে থাকেনঃ “ আমাকে একবারেই মেরে ফেল। এভাবে তিলে তিলে মেরো না।“

এক পাঠান হাবিলদার হক সাহেবের উপর এই অত্যাচার সইতে না পেরে, সেন্ট্রিকে ডেকে হুকুম দিয়েছিল বাতি নিভিয়ে দিতে। কোন জীপ আসলেই যেন শুধু বাতি জ্বালানো হয়, চলে গেলে আবার বন্ধ করে দেওয়া হয়।

ক্যাপ্টেন সাজ্জাদ এর পর কয়দিন আরো জিজ্ঞাসাবাদ করে নতুন নির্যাতন চালায়। তাকে দিয়ে একই বিবৃতি বারবার লেখিয়ে ছিড়ে ফেলে। উনি লেখার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেন। সাথে সাথে দৃষ্টিশক্তিও প্রায় হারিয়ে ফেলেন। তখন তিনি রাত এবং দিনের পার্থক্য বুঝতে পারতেন না।

২৬সে জুলাই বিকালে তাকে ‘ইন্টার স্টেটস স্ক্রিনিং কমিটি’-তে নিয়ে যাওয়া হয়। এখানে ছোট এক কামড়ায় ১১০ জন আটক ছিলেন। বিকাল ৫টায় তাকে বের করে রান্নাঘরের বড় পানির ড্রাম ভরার কাজ দেওয়া হয় তার সাথে আর একজন থাকেন জিওলজিক্যাল সার্ভের জনাব আবদুল্লাহ। প্রায় পোয়া মাইল দুরের ট্যাপ থেকে বড় বালতিতে করে পানি টেনে তিনটি ড্রাম ভরে দিলেই তাদের রাতে লাইনে করে খাবার দেওয়া হতো। এতদিন পর তিনি প্রথম খেতে পান গরম ভাত এবং ডাল।

৬ আগস্ট এর পর তাদের নিয়ে যাওয়া হয় ফিল্ড ইনভেস্টিগেশন সেন্টারে। এখানে তাকে আবার জিজ্ঞাসাবাদ করে নির্যাতন করে বিবৃতি দিতে বলে সেই পুরাতন নির্যাতন প্রকৃয়া আবার শুরু হয়।

৩০শে অক্টোবর তিনি মুক্তি পান।

রাজাকাররা এর মধ্যে ৩ দফা তার বাড়ীতে লুটপাট চালায় এবং সর্বশেষ ১৩ই ডিসেম্বর তার গাড়ীটিও নিয়ে যায়।

আলিমুল ফয়সাল
<৮,১৬,৩৮৫-৮৬>
[বর্বরতার রেকর্ড]
-রহিম আজাদ, দৈনিক আজাদ, ৩ ফেব্রুয়ারী, ১৯৭২।

“মহাদেবের জটা থেকে নয়, বাংলা মায়ের নাড়ী ছিড়ে জন্ম নিয়েছিলেন যে সোনার মেয়ে সে ভাগীরথীকে ওরা জ্যান্ত জিপে বেধে শহরের রাস্তায় টেনে টেনে হত্যা করেছে। খান দস্যুরা হয়ত পরখ করতে চেয়েছিল ওরা কতখানি নৃশংস হতে পারে। বলতে হয় এক্ষেত্রে ওরা শুধু সফলই হয়নি, বরং বর্বরতার সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে।

অষ্টাদশী ভাগীরথী ছিল বরিশাল জেলার পিরোজপুর থানার বাঘমারা কদমতলীর এক বিধবা পল্লীবালা। বিয়ের এক বছর পর একটি পুত্র সন্তান কোলে নিয়েই তাকে বরণ করে নিতে হয় সুকঠিন বৈধব্য।

স্বামীর বিয়োগ ব্যথা তার তখনও কাটেনি। এরই মধ্যে দেশে নেমে এল ইয়াহিয়ার ঝটিকা বাহিনী। গত মে মাসের এক বিকেলে ওরা চড়াও হল ভাগীরথী দের গ্রামে। হত্যা করল অনেক কে, যাকে যেখানে যেভাবে পেল।

এই নির্বিচার হত্যাযজ্ঞের মাঝেও ভাগীরথীকে ওরা মারতে পারল না। ওর দেহলাবণ্য দস্যুদের মনে যে লালসা জাগিয়েছিল তাতেই হার মানল তাদের রক্তপিপাসা। ওকে ট্রাকে তুলে নিয়ে এল পিরোজপুরে। তারপর ক্যাম্পে তার উপর চালানো হল হিংস্র পাশবিক অত্যাচার।

সতী নারী ভাগীরথী। এ পরিস্থিতিতে মৃত্যুকে তিনি একমাত্র পরিত্রানের উপায় বলে ভাবতে লাগলেন। ভাবতে ভাবতেই এক সময় এল নতুন চিন্তা, হ্যা মৃত্যুই যদি বরণ করতে হয় ওদেরই বা রেহাই দিব কেন?

ভাগীরথী কৌশলের আশ্রয় নিল এবার। এখন আর অবাধ্য মেয়ে নয় দস্তরমত খানদের খুশী করতে শুরু করল। ওদের আস্থা অর্জনের আপ্রাণ চেষ্টা চালাতে লাগল।

বেশীদিন লাগল না। অল্প ক’দিনেই নারীলোলুপ ইয়াহিয়া বাহিনী ওর প্রতি দারুণ আকর্ষণ অনুভব করল। আর এই সুযোগে ভাগীরথী ওদের কাছ থেকে জেনে নিতে শুরু করল পাক বাহিনীর সব গোপন তথ্য।

এক পর্যায়ে বিশ্বাস ভাজন ভাগীরথী কে ওরা নিজ গ্রামে যেতেও দিল। আর কোন বাধা নেই। ভাগীরথী এখন নিয়মিত সামরিক ক্যাম্পে যায় আবার ফিরে আসে নিজ গ্রামে। এরই মাঝে চতুরা ভাগীরথী তার মূল লক্ষ্য অর্জনের পথে এগিয়েও গেল অনেকখানি। গোপনে মুক্তিবাহিনীর সাথে গড়ে তুলল ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ।

এরপরই এল আসল সুযোগ। জুন মাসের একদিন ভাগীরথী খানসেনাদের নিমন্ত্রন করল তার নিজ গ্রামে। এদিকে মুক্তিবাহিনীকেও তৈরি রাখা হল যথারিতী। ৪৫ জন খানসেনা সেদিন হাসতে হাসতে বাগনারা কদমতলা এসেছিল কিন্তু তার মাঝে মাত্র ৪/৫ জন ক্যাম্পে ফিরতে পেরেছে বুলেটের ক্ষত নিয়ে। বাকিরা ভাগীরথীর গ্রামেই শিয়াল,কুকুর, শকুনের খোরাক হয়েছে।

এরপর আর ভাগীরথী ওদের ক্যাম্পে যায়নি। ওরাও বুঝেছে এটা ওরই কীর্তি। কীর্তিমানরা তাই হুকুম দিল জীবিত অথবা মৃত ভাগীরথীকে যে ধরিয়ে দিতে পারবে তাকে নগদ এক হাজার টাকা পুরস্কার দেয়া হবে।

কিন্তু ভাগীরথী তখনও জানত না ওর জন্যে আরো দু:সহ ভবিষ্যত অপেক্ষা করে আছে। একদিন রাজাকারদের হাতে ধরা পড়ল ভাগীরথী। তাকে নিয়ে এল পিরোজপুর সামরিক ক্যাম্পে।

খান সেনারা এবার ভাগীরথীর উপর তাদের হিংস্রতার আয়োজন করল। এক হাটবারে তাকে শহরের রাস্তায় এনে দাড় করানো হল জনবহুল চৌমাথায়। সেখানে প্রকাশ্যে তার অংগাবরন খুলে ফেলল কয়েকজন খান সেনা। তারপর দু’গাছি দড়ি ওর দু’পায়ে বেধে একটি জীপে বেধে জ্যান্ত শহরের রাস্তায় টেনে বেড়াল ওরা মহাউৎসবে। ঘন্টাখানেক রাজপথ পরিক্রমার পর আবার যখন ফিরে এল সেই চৌমাথায় তখনও তার দেহে প্রাণের স্পন্দন রয়েছে।

এবার তারা দুটি পা দু’টি জীপের সাথে বেধে নিল এবং জীপ দুটিকে চালিয়ে দিল বিপরীত দিকে। ভাগীরথী দু’ভাগ হয়ে গেল। সেই দু’ভাগ দু’জীপে আবার শহর পরিক্রমা শেষ করে জল্লাদ খানরা আবার ফিরে এল সেই চৌমাথায় এবং এখানেই ফেলে রেখে গেল সেই বিকৃত মাংসগুলো।

একদিন-দুদিন করে মাংসগুলো ঐ রাস্তার সাথেই একাকার হয়ে গেল একসময়। বাংলা মায়ের ভাগীরথী আবার এমনিভাবে মিশে গেল বাংলার ধুলিকণার সাথে।

কেবল ভাগীরথী নয়, আরো দু’ জন মুক্তিযোদ্ধাকে ওরা এভাবেই হত্যা করেছে পিরোজপুর শহরে।“

অপরাজিতা নীল
<৮,১৭,৩৮৭>
[রমনা পার্কের বধ্যভূমি]
-হাসিনা আশরাফ, দৈনিক বাংলা, ৮ ফেব্রুয়ারী, ১৯৭২
“রমনা পার্কের উত্তর পূর্ব কোণটা কি পাক সামরিক চক্রের কোন বধ্যভূমি সমাধিস্থল?
রাজধানী ঢাকার কেন্দ্রস্থলে রমনা পার্কের উত্তর কোণটার যেদিকে ভূতপূর্ব প্রেসিডেন্ট হাউজের সীমানা শুরু হয়েছে, তার কিছুটা ভেতরের দিকেই এটি অবস্থিত। পরো জায়গাটাই প্রায় জুড়ে রয়েছে, বেগুনী বর্ণের বোগেন ভিলা বা বাগান বিলাসের রঙিন কুঞ্জ।
এই ঝোপটির নিচে বড় বড় কয়েকটি গর্তে এবং পাশের উঁচু স্থানে ইতস্তত ছড়িয়ে রয়েছে নরকংকালের অস্থি এবং মাথার খুলি। মাটির সাথে সমান হয়ে ছড়িয়ে আছে, হঠাৎ দেখলে বোঝা যায় না। জায়গাটা যে সত্যিকার কতখানি বিস্তৃত বার থেকে তা আজ বোঝার উপায় নেই। তবে এখানকার অনেকেই জানিয়েছে যে, পশুরা অসংখ্য মানুষকে ট্রাকে করে প্রেসিডেন্ট হাউজের মধ্যে নিয়ে হত্যা করার পর গর্তের মধ্যে পুঁতে রাখতো।
বৃষ্টির পানিতে গর্তগুলো যখন ভরে যায় তখন পানির সাথে সাথে কতগুলা আধপচা লাশ এবং সঙ্গে অসংখ্য স্কুল কলেজের বই ভেসে উঠত। এসব লাশের মধ্যে কয়েকটি লাশের লম্বা চুল এবং দেহের গঠন দেখে মহিলা বলে চেনা গিয়েছিল। রমনা পার্কের নিভৃত এই প্রান্তে কোন হতভাগা ভাইবোনদের সমাধিস্থল যে রচিত হয়েছিল, কংকালের অস্থি আর ভগ্ন খুলির মাঝে, আজ তা জানা যাবে না।
তবে প্রশ্ন জাগে মনে, এরা কি সেই হতভাগা পুলিশ ভাইদের কেউ, যারা অসহযোগ আন্দোলনের সময় দস্যু ইয়াহিয়াকে পাহারা দেবার জন্য প্রেসিডেন্ট হাউজে নিযুক্ত হয়েছিলো; প্রশ্ন জাগে মনে, এরা কি সে ছাত্র ভাইদের কেউ, যারা শুধু দেশপ্রেমের শপথ নিয়ে জীবন্ত আত্মার তাগিদে শূন্য হাতে রুখে দাঁড়িয়েছিলো জল্লাদ পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে?”

মোঃ; রাশেদ হাসান (নোবেল)
<৮,১৮,৩৮৮-৮৯> “আম কাঁঠালের আর শন বনের সাভার জনপদ আজ কাঁদছে: আমার সন্তানকে ফিরিয়ে দাও”
[সাভারের কয়েকটি হত্যাকাহিনী]

-দৈনিক সংবাদ, ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২।

“শহরের একঘেয়ে জীবনের ক্লান্তি দূর করতে আর চিত্তবিনোদনের জন্য প্রতি রোববার অসংখ্য লোকের ভিড় জমে এখানে। সেই প্রকৃতি সুন্দরী সাভার আজ হাহাকার করছে।

হারানো মানিকের দিকে যেন সাভার অপলক দৃষ্টি রেখে হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে আছে। কি যেন তার জিজ্ঞাসা বুঝা কঠিন। হয়তো বলবে আমার সোনার মাণিকদের ফিরিয়ে দাও। কত অফুটন্ত ফুলের কুড়ি অকালে ঝরে পড়েছে। কে তার হিসেব রেখেছে। বাংলার হাটে, মাঠে, ঘাটে, ছড়িয়ে অসংখ্য নরকঙ্কাল। এদের একত্র করলে হয়ে উঠবে এক কঙ্কালের পাহাড়।

বর্বরদের পৈশাচিকতার থৈ থৈ নৃত্য শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু এখন শিয়াল, কুকুর শকুনি খুঁজে বেড়াচ্ছে এর মাংস। এমনি এক অভাগিনী স্বামীহারা সাভারের হরিপদ মজুমদারের স্ত্রী। শুভ্র বসনে বসে রয়েছেন। পাশেই তার ছোট বোন সান্ত্বনা দিচ্ছে নানা কথা বলে। কিন্তু তার অবুঝ মন মানে না। কোলের শিশু নানা প্রলোভন দেখালেই কান্না থেমে যায়। হরিপদ বাবুর কথা জিজ্ঞেস করা হল, কিন্তু চকিত চাহনিতে তাকিয়ে আছে। কোন ভাষা নেই তার মুখে। কি যেন বলতে চাইছে কিন্তু কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসছে।

‘’মুন্সীগঞ্জের কেওয়াড় গ্রামের পাশে একটি খাল আছে। সেই খালের পাশে গেলে দেখতে পাবেন কতগুলো নরকঙ্কাল ছড়িয়ে রয়েছে এদিক ওদিক। ওরই মাঝে শুয়ে রয়েছে হরিপদ মজুমদারের কঙ্কালটা।‘’ অপলক দৃষ্টিতে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে কথা কটি বলল মজুমদারের শ্যালিকা।

হরিপদ মজুমদারের বয়স হয়েছিল মাত্র ৩৫ বৎসর। কর্মজীবন সবে মাত্র শুরু। ব্যক্তিগতভাবে তার সাথে মিশে দেখেছি। সদালাপী, শান্ত, দৃঢপ্রত্যয়ী এবং অমায়িক পুরুষ। ভবিষ্যৎ গড়ার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা তার ছিল। ছোট সংসার। তখন মাত্র ২ টা বাচ্চা যখন তার সাথে প্রথম পরিচয়। এখন তার ৫টি সন্তান। ফরিদপুরের মুকসুদপুরে লাইভ-ষ্টক ডিপার্টমেন্টের ফিল্ড এসিস্টেন্ট। এর উপর নির্ভর করত তার সুখের সংসার।

৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু নির্দেশ দিলেন ‘সকল কারখানা বন্ধ’। তাই কাজে যোগ দেননি। তারপর ২৫শে মার্চ নিয়ে এলো বাংলার বুকে ঘন তমসাচ্ছন্ন এক বিভীষিকাময় রাত। দিকে দিকে আগুন আর কান্নার রোল। হরিপদ মজুমদার পালাল। ‘’পালানোর পথ নেই যম আছে পিছে’’।

১৪ই মে। নেমে এলো জীবনের শেষ পরিণতি হরিপদ মজুমদারসহ আরও ২১ টি নিষ্পাপ প্রাণের। পাক মেজর জাভেদ আক্তারের পরিচালনায় গ্রাম ঘেরাও করা হল। এরা ২২ জন ধরা পড়লো। খালের পাড়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করানো হল। তারপর নৃশংস অত্যাচার। তাদের হৃদয়বিদারক চিৎকারে হয়ত তখন গাছের কচি পাতাগুলোও ঝরে পড়ছিল। কিন্তু নরপশুদের এতটুকু মমতা ছিলনা। হঠাৎ কয়েকবার গুলির আওয়াজ শুনা গেল। তারপর তাদের সেই মর্মস্পর্শী চিৎকার ধীরে ধীরে কোন অতল তলে তলিয়ে গেল বলা যায়না।

হরিপদ মজুমদার আর নেই। কিন্তু তার পরিবারের শোকের ছায়া এখনো স্তিমিত হয় নাই। বিধবা স্ত্রী উচ্চস্বরে না কাঁদলেও তার দু’গণ্ড বেয়ে অশ্রুধারা যেভাবে অঝোরে নীরবে ঝরছিল তাতেই তার শোকের পরিমাণ অনেকটা বুঝা যাচ্ছিল।

সাভারের দায়িত্বশীল ও নেতৃস্থানীয় লোকদের মুখ করলেই স্ত্রী বিরেন্দ্র কৃষ্ণ রায়ের কথা প্রথমে মনে পড়ে। ১৯৭১ সালে সাভারের নির্বাচনে যারা আওয়ামীলীগের পক্ষে প্রাণপণ লড়েছেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন জগদীশ সাহা, ডাঃ গুরুদাশ সাহা এবং বিরেন্দ্র কৃষ্ণ রায়। কিন্তু আজ? সে আজ পুত্র শোকাতুর। সাভারে নিহতদের মধ্যে অন্যতম হরিপদ মজুমদার ও বিরেন্দ্র বাবুর বাড়ি পাশাপাশি। পাশাপাশি একজন বাস করছে স্বামীহারা অবলা নারী। অপরজন পুত্রহারা নারী।

এমন স্বামীহারা, পুত্রহারায় আজ বাংলার বুক ছেয়ে গেছে। দ্বিতীয় ছেলে নির্মল রায়। বয়স মাত্র ৩২ হয়েছিল। ঢাকাতে দুলিচান ফর্মের গোডাউন ইনচার্জ। একজন ভাল খেলোয়াড়। স্থির বিনম্র দৃষ্টি। মিষ্টি ব্যবহার। সাভারের নির্মল রায় নামটি বললে সবার মানস-পটে ভেসে ওঠে সে নির্মল রায়। আজ আমাদের মধ্যে নেই। হারিয়ে গেছে লক্ষ হতভাগ্যের মাঝে।

৮ই ডিসেম্বর। ভোর রাত। অন্যান্যসহ নিরমলও তখন রয়েছে ঘুমিয়ে। হঠাৎ বাহিরে বিকট আওয়াজ। সকলেরই ঘুম ভেঙ্গে গেল। উঠে দাঁড়াতেই দেখা গেল চারিদিকে কুখ্যাত আল-বদর পাক বাহিনীর কয়েকজন তাঁদের সবার দিকে অস্ত্র নিশানা করে দাঁড়িয়ে হিংস্র দৃষ্টিতে আপাদমস্তক অবলোকন করছে।

তারপর নির্মলসহ অন্যান্য কয়েকজনকে পাশেই এক বদ্ধভূমিতে নিয়ে যাওয়া হল। কিছুক্ষন নিস্তব্ধ। তারপর কয়েকটি গুলির আওয়াজ এবং সঙ্গে সঙ্গে হৃদয়বিদারক চীৎকার। তারপর গভীর নীরবতা, সব শেষ। ছেলের এমন মৃত্যুকাহিনি বলতে এক সময় নিজেকে আর সামলাতে পারলেন না বিরেন্দ্র রায়। ছেলের ছবি বুকে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন। ‘’ যে নির্মল আজীবন স্নেহ লালিত্যে মানুষ, একটা কটু কথা যার অভ্যাস নাই আর আজ আমার নিরমলের এ কি পরিণতি।‘’

দুলীচাঁদ ফার্ম থেকে নির্মল রায়ের সাথে যারা জীবনের শেষ সঙ্গী হয়েছিলেন তাঁদের একজন হলেন সূর্য কান্ত রায়। শেষ বয়সী ভদ্রলোক। উক্ত ফার্মের একজন পদস্থ কর্মচারী। সূর্য কান্ত রায়ের স্ত্রী তার একখানা ফটো বের করে দিলেন। তারপর বিলাপ এবং কান্না।

উমেশ চন্দ্র সাহা। বয়স মাত্র ২৮ বৎসর। সংসারের দারিদ্র্যকে কাটিয়ে উঠতে ম্যাট্রিক পাশ করার পরেই এই ফার্মের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ঐ একই দিনে তাঁদের শরীক হতে হয়েছিল জয় গোপাল সাহার। ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন ধীর, স্থির, নম্র, শান্ত এবং দৃঢপ্রত্যয়ী। সর্বশেষ যে মধ্য বয়সী ব্যক্তি তিনি হচ্ছেন মতিলাল সাহা। দুলীচাঁদ ফার্মেরই একজন কর্মচারী। বর্বরদের হাতে হতে রেহাই পাননি, ওদের সবার সাথে মতিলাল সাহার আত্মাহুতি দিতে হয়েছিল ৮ই ডিসেম্বরের কালো রাতে।“

মোঃ রাশেদ হাসান (নোবেল)
<৮,১৯,৩৯০-৯১>
[রংপুর জেলাটাই যেন বধ্যভূমি]

“শিক্ষক শ্রমিক ছাত্র কিষান-কিষাণীর অতলান্ত সেই রক্তস্রোত”
-দৈনিক বাংলা, ১৯ জানুয়ারি ১৯৭২।
“আবার গোলযোগ হলে আমাদের পালানোর জায়গা আছে। ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেবো, বেঁচে যাবো। ভাই, আপনারা যাবেন কোথায়? আপনাদের যে আর কোন পথ রইলো না।” প্রিয় মুসলিম সহকর্মীদের জন্য অকৃত্রিম সমবেদনায় সহকারী অধ্যাপক রেজাউল হককে এই কথাগুলো বলছিলেন বরিশাল জেলার অধিবাসী অধ্যাপক রামকৃষ্ণ অধিকারী। ১৯৬৯ সালের মার্চ মাসে। আইয়ুবের যোগ্যতর উত্তরসূরি রক্তপিপাসু নয়া সামরিক শাসক ইয়াহিয়ার সামরিক শাসন জারীকে কেন্দ্র করেই তাদের মধ্যে কথা হচ্ছিল।

কিন্তু না। অধ্যাপক অধিকারী পালাতে পারেননি। বাঁচাতেও পারননি তার প্রাণ। তার এই তাৎপর্যবহ মন্তব্যের সাক্ষী দেওয়ার জন্য সৌভাগ্যক্রমে অধ্যাপক রেজাউল হক আজও বেঁচে আছেন।

১৯৭১ এর ২৫শে মার্চ ইয়াহিয়ার জল্লাদ বাহিনীর আক্রমণ শুরুর পর অধ্যাপক অধিকারী পালিয়ে ছিলেন। গাইবান্ধা মহকুমার সুন্দরগঞ্জে গিয়েছিলেন। যাওয়ার সময় অপর সহকর্মী অধ্যাপক আবুল কাশেমকে বলেছিলেন টাকা-পয়সা নেওয়ার জন্য কেউ যদি মেরে ফেলে তাদের হাতে মরতেও রাজী আছি। কিন্তু বর্বর খানসেনাদের হাতে নয়। বেতন নেয়ার জন্য রংপুরে এসেছিলেন। কিন্তু বেতন নিয়ে আর ফিরে যেতে পারেননি।

১৯৭১ সালের ৩০শে এপ্রিল। রংপুর কারমাইকেল কলেজের ২ মাইল দক্ষিণপূর্বে দমদমার পুলের নীচে তার অপর তিন সহকর্মী রসায়নের লেকচারার কুমিল্লার শ্রী কালিচাদ রায় ও তার পিতা, দর্শনের লেকচারার বরিশালের শ্রী শুনেল বরণ চক্রবর্তী ও গণিতের লেকচারার বরিশালের শ্রী চিত্তরঞ্জন রায়ের সাথে খুনি পাক সেনাদের গুলিতে প্রাণ হারান।

“বাড়ী গিয়েও রেহাই নেই”

রংপুর কারমাইকেল কলেজের উর্দু বিভাগের প্রধান অধ্যাপক শাহ মোহাম্মদ সোলায়মান দিনাজপুরে তার গ্রামের বাড়ীতে গিয়েছিলেন। গ্রামের বাড়ী থেকেই সেনাবাহিনী তাঁকে ধরে নিয়ে যায়। তারপর তাঁর আর কোন খোঁজ খবর পাওয়া যায়নি।

“তিনি কাজে যোগ দিতে পারেন নি”

রসায়নের লেকচারার কুড়িগ্রামের মহকুমার নাগেশ্বরীর অধিবাসী জনাব অব্দুর রহমান মে মাসের শেষদিকে কাজে যোগ দেওয়ার জন্য রওনা হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর কাজে যোগ দেওয়া হয়নি। তখন হয়ত এ দু’জন অধ্যাপক হত্যা করেছে। খান সেনাদের হাতে নৃশংসভাবে নিহত হয়েছেন রংপুর শহরের বিশিষ্ট সমাজ কর্মী ও রাজনৈতিক নেতা জনাব ইয়াকুব মাহফুজ আলী।

এপ্রিল মাসের গোঁড়ার দিকে রংপুর শ্মশান ঘাটে তাঁর সাথে আরও ১০ জনকে এক সঙ্গে হত্যা করা হয়েছে এক দিনে।

আর পাক সেনাদের আত্মসমর্পণের পূর্বমুহূর্তে ১২ই ডিসেম্বর থেকে ১৬ই ডিসেম্বরের কোন এক সময় রংপুর বার-এর বিশিষ্ট আইনজীবী একনিষ্ঠ রাজনৈতিক কর্মী রংপুর জেলা ন্যাপের ভাইস প্রেসিডেন্ট শ্রী শিবেন মুখার্জিকে সম্ভবত হত্যা করা হয়েছে। শেষ দিকে তিনি দিনাজপুরে জেলে ছিলেন। তারপর আর শিবেন বাবুর কোন খোঁজ মেলেনি।

“কত যে বধ্যভূমি”

গোটা জেলায় প্রতিটি শহরে মহকুমায়, থানায় আনাচে কানাচে, কত যে বদ্ধভূমি আছে তার অন্ত নেই। বিশ, পঁচিশ, পঞ্চাশ নয়, যেখানে শত শত এমনকি হাজারে হাজার লোককে মেরেছে এমন বদ্ধভূমিগুলির মধ্যে উল্লেখ করার মত রংপুর শহরও সদর মহকুমার নবিনহাট, জাফরগঞ্জের পুল, নিশবেতগঞ্জ, শ্মশান ঘাট (রংপুর শহরের কাছে) সাহেবগঞ্জ এবং রংপুর শহরের কাছে মডার্ন সিনেমা হলের পিছনে এবং দেবিপুর।

এসব এলাকায় মানুষের হাড়গোড় অসংখ্য পড়ে আছে। ভাল করে খনন করা হলে শত শত নয় হাজার হাজার মানুষের কংকাল খুঁজে পাওয়া যাবে। রংপুর শহরের উপকন্ঠে কুকুরণের বিলে বহু মানুষকে হত্যা করা হয়েছে।

“গাইবান্ধা”

এছাড়া গাইবান্ধা শহরের হেলাল পার্ক, লালমনির হাট শহর এবং সৈয়দপুরে হাজার হাজার নিরস্ত্র অসহায় মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। সুন্দর গানুর এলাকা থেকে বহু ঘরের মা, বোনদের ধরে এনে পাশবিক লালসা চরিতার্থ করে হত্যা করা হয়েছে। রংপুর শহরের উপকণ্ঠে অবস্থিত উত্তম নামক স্থানের রিকশাচালক আহাব উদ্দিন মডার্ন সিনেমা হলের পিছনের একদিনের হত্যাকাণ্ডের একজন প্রত্যক্ষদর্শী।

“গত নভেম্বর মাসের ৮ তারিখ আমি যখন রংপুর রেলস্টেশনে আমার রিক্সার খোঁজ পাই তখন জুম্মাপাড়া নিবাসী পাক বাহিনীর জনৈক দালাল আমাকে ন্যাপের কর্মী হিসেবে দুষ্কৃতকারী ও মুক্তি ফৌজ বলে পাক বাহিনীকে সনাক্ত করে দেয়। তখন পাক বাহিনীর জোয়ানরা আমাকে আটক করে রংপুর মডার্ন হলে নিয়ে যায়। সেখানে আমাকে ১৪ দিন আটক করে রাখে। আটক অবস্থায় পাঞ্জাবী পুলিশ আমার দু’হাত বেঁধে ঝুলিয়ে রেখে আমাকে অমানুষিক অত্যাচার করে। তের দিন পর আমাকে ও আমার সাথে আটক আরও ১৩ জন লোককে যথাক্রমে লালমনির হাটের এক ক্ষত্রিয় মেয়ে, জিনকি, মালেকা, গাইবান্ধার আলী হোসেন, ফারুক, পলাশবাড়ীর আশরাফ আলী, রংপুর উপশহরের রিকশাচালক আলী ও অন্যান্য সবাইকে রাত্রি ১০ টার সময় মডার্ন হলের পিছনে নিয়ে যায়। আমার সামনে তিনজন পাঞ্জাবী পুলিশ (এদের মধ্যে আজমল খান নামক এক সুবেদার পরে মুক্তিবাহিনীর হাতে নিহত হয়েছে) পরপর পাঁচজনকে যথাক্রমে জিনকি, মালেকা, আলী হোসেন, ফারুক ও আর একজনকে যার নাম জানি না, আমার সামনে জবাই করেছে। তখন আমি অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে প্রাণভয়ে হামাগুড়ি দিয়ে পাশের জঙ্গলে লুকিয়ে আত্মরক্ষা করি এবং সুযোগ বুঝে পালিয়ে যাই।

যখন আমি মডার্ন হলে আটক ছিলাম তখন সেখানে ৩৪০ জন লোক ছিল। তাদের উপর যে অমানুষিক অত্যাচার চালানো হয়েছে তা বর্ণনা করা যায় না।“

মোঃ; রাশেদ হাসান (নোবেল)
<৮,২০,৩৯২>
[আমার ভাইকে তোমরা হত্যা করো না]

”আমাকে হত্যা কর। আমি নিজেকে মুক্তিবাহিনীর সদস্য স্বীকার করছি। আমার ভাইকে তোমরা হত্যা কর না। তিনি নির্দোষ। আমি ছেলেমানুষ। আমি অবিবাহিত। আমাকে মেরে ফেলা হলে কারো কোন ক্ষতি হবে না। আমার ভাই বিবাহিত তিনটি শিশু সন্তানের পিতা। নিষ্পাপ শিশুদেরকে এতিম করবে না। ওদেরকে দেখাশুনা করার মতন কেউ আর পৃথিবীতে নাই।“

-দৈনিক সংবাদ, ২২ জানুয়ারি ১৯৭২।
“সৈয়দ আকবর হোসেন মিত্রবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের দুর্বার আক্রমণে পলায়নপর পাকিস্তানী বর্বর জল্লাদদের হাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া নিহত হয়েছেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া মুক্ত হওয়ার ঠিক আগের দিন নৃশংস হত্যাযজ্ঞের শিকার তিনি।

আগরতলা থেকে নভেম্বর মাসে তিনি তার গ্রাম সরাইলে ফিরে আসেন। সেখানকার অবস্থা সম্পর্কে মুক্তিবাহিনীকে প্রয়োজনীয় সংবাদ সরবারহের উদ্দেশ্যে। রাতের বেলায় হিংস্র পাকিস্তানী পশুরা অতর্কিতে তার গ্রামের বাড়ী ঘিরে ফেলে।

তার ছোট ভাই সৈয়দ আফজাল হোসেন (যিনি গেরিলা বাহিনীর সদস্য ছিলেন) তাকেও আকবর হোসেনএর সাথে গ্রেফতার করা হয়।

ডিসেম্বর মাসের ৬ তারিখ (১৯৭১) যখন উভয়কে চোখ বাঁধা অবস্থায় হত্যা করার উদ্দেশ্যে বধ্যভূমিতে নিয়ে যাওয়া হয় তখন আকবর হোসেনের ছোট ভাই আফজাল হোসেন জল্লাদদের কাছে অনুনয় করে বলেন,”আমাকে হত্যা কর। আমি নিজেকে মুক্তিবাহিনীর সদস্য স্বীকার করছি। আমার ভাইকে তোমরা হত্যা কর না। তিনি নির্দোষ। আমি ছেলেমানুষ। আমি অবিবাহিত। আমাকে মেরে ফেলা হলে কারো কোন ক্ষতি হবে না। আমার ভাই বিবাহিত তিনটি শিশু সন্তানের পিতা। নিষ্পাপ শিশুদেরকে এতিম করবে না। ওদেরকে দেখাশুনা করার মতন কেউ আর পৃথিবীতে নাই।“

সে আকুল আবেদন নির্মূল হল । গর্জে উঠলো মেশিনগান। অন্যান্য ৪০ জন বুদ্ধিজীবীর সাথে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে দুই ভাইয়ের নশ্বর দেহ। একই মায়ের দু’ছেলে একই মুহূর্তে জীবনের শেষ রক্ত বিন্দু পর্যন্ত ঢেলে দিয়ে বাংলার শস্য শ্যামল বুককে আরও উর্বর করে দিয়ে গেল। আকবর হোসেন ঢাকা হাইকোর্ট বার এর এডভোকেট ছাড়াও কুমিল্লা জেলা আওয়ামী লীগ কার্যকারী সংসদের সদস্য ও মগবাজার আওয়ামী লীগ ইউনিট এর ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন।“

মোঃ; রাশেদ হাসান (নোবেল)

<৮,২১,৩৯৩-৯৪>
[কঙ্কালের মিছিল এখানে]

-দৈনিক সংবাদ, ৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২।।
“বাংলাদেশের প্রতিটি গৃহাঙ্গন যেন এক একটি বধ্যভূমি। প্রতিটি ভিটা এক একটি শহীদ মিনার। পল্লীর শ্যামল দিগন্ত তাই বেদনায় মলিন। বিস্তৃত মাঠের মাটি ঘাসে লেগে আছে শহীদের রক্ত। নরসিংদী শহরের অদূরে নরসিংদী তারাবো রাস্তার খাটারা পুলটিও হানাদার জল্লাদদের একটি বধ্যভূমি। নরপিশাচরা এই সেতুটিকে পরিণত করেছিল নির্যাতন কেন্দ্রে ও বধ্যভূমিতে।

হায়েনার দল পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে তরুণ, তরুণী, ছেলে, বুড়ো নির্বিচারে সকলকে ধরে নিয়ে আসতো এখানে। ওদের উপর চলত নির্যাতন। নির্যাতনের পর্ব চুকলে তাঁদের হত্যা করে লাশগুলো পুলের আশেপাশে মাটিচাপা দিয়ে রাখা হতো। হত্যা লীলার নীরব সাক্ষী এই পুলের চারিদিকে বহু নর কঙ্কাল ও মাথার খুলি আজও ছড়িয়ে আছে।

ব্যাপক অনুসন্ধানে পাক বাহিনীর নিষ্ঠুরতা নির্যাতন ও পাইকারী নরহত্যার অনেক মর্মান্তিক কাহিনী প্রকাশ হতে পারে বলে সকলে মনে করেন। স্থানীয় সমাজ কর্মীরা অনুসন্ধান চালিয়ে ইতিমধ্যেই খাটার পুলের আশেপাশে পতিত জমি থেকে বহু নরকঙ্কাল উদ্ধার করেছেন। এসব নর কঙ্কালের মধ্যে একটি কঙ্কাল জনৈক মহিলার বলে অনুমান করা হচ্ছে।

কঙ্কালগুলোর আশেপাশে পাওয়া পোশাক পরিচ্ছদ ছাড়া অন্য কিছু দ্বারা হতভাগ্য ব্যক্তিকে সনাক্ত করা সম্ভব নয়। তেমনি অনুমানের ভিত্তিতে ঐ কঙ্কালটি কোন যুবতীর বলে ধারণা হচ্ছে। কারণ কঙ্কালটির হাতে কাঁচের চুড়ি রয়েছে। আরও একটি কঙ্কাল সনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে সেখানে। এই কঙ্কালটি শিবপুর থানার করার চর গ্রামের জনৈক ব্যক্তির। পোশাক পরিচ্ছদ দেখে আরও দুটি কঙ্কাল সনাক্ত করা হয়েছে। সম্ভব কঙ্কাল দুটি নরসিংদী মহাবিদ্যালয়ের নিখোঁজ দুজন হিন্দু অধ্যাপকের বলে উদ্ধারকারীরা ধারণা করছেন।

তাঁত বস্ত্রের জন্য সমাধিক প্রসিদ্ধ সেখের চরের জনৈক সমাজকর্মী আমাদের প্রতিনিধিকে জানান যে, বিভিন্ন এলাকা থেকে যুবতীদের ধরে এনে হানাদার পাক সেনারা নরসিংদী টেলিফোন এক্সচেঞ্জে নিজেদের পাশবিক প্রবৃত্তি চরিতার্থ করতো। যারা নরপশুদের কাছে আত্মসমর্পণ করতো না তাঁদের হত্যা করা হত। তারপর সেই মৃতদেহের উপর পাশবিক প্রবৃত্তি চরিতার্থ করে পাশগুলো ফেলে দেওয়া হতো।

এই এক্সচেঞ্জেই নরপশুরা ক্যাম্প খুলেছিল। এখান থেকেই নরপশুরা দালালদের সাহায্যে রাতে গ্রামে হানা দিয়ে বাঙ্গালী নর-নারীদের ধরে আনতো। তারপর তাঁদের উপর চালাত বর্বর অত্যাচার। নির্যাতন শেষে তাঁদের এই খাটারা পুলের কাছে এনে হত্যা করতো। পাচদোলাপুল ও খাটারাপুল ছাড়াও আরও কয়েকটি বধ্যভূমি রয়েছে নরসিংদীতে। সেগুলো হচ্ছে পুটিয়া পুল, সানখোলা পুল, খাসির দিয়া, রায়পুরা থানার হাঁটু ভাঙ্গা, বাদুয়ার চর রেলপুল। এসব বদ্ধভূমিতে কত বাঙ্গালী লাঞ্ছিতা, ধর্ষিতা, মা-বোনের বিদেহী আত্মা আজো হাহাকার করে ফিরছে তার হিসেব কেউ দিতে পারবে না।

বাংলার মানুষদের হত্যা করে, তাঁদের বসতবাটি জ্বালিয়ে, সম্পত্তি লুট করে কৃষকের গবাদি পশু জবাই করে, মাঠের ফসল বিনষ্ট করেই এসব নরপশুরা ক্ষান্ত হয়নি, তাদের ধ্বংসযজ্ঞ থেকে রক্ষা পায়নি শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, এমনকি মসজিদ মন্দির গির্জাও। স্যার কে, জি, গুপ্ত হাই স্কুলটিও এইসব বর্বর পশুর অগ্নিসংযোগে ভস্মীভূত করে। জিনারদি এলাকার অবিভক্ত বাংলার সন্তান স্যার কে, জি গুপ্ত ১৯১৯ সালে তারাবো রাস্তার পাশে এই স্কুলটি স্থাপন করেন। তার নামানুসারেই স্কুলটির নামকরণ করা হয়। এই স্কুলের সন্নিকটে অবস্থিত পাচদোলা পুল। এখানেই ছিল নরপশুদের একটি ক্যাম্প। নরপশুরা নারী নির্যাতন, নারী ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও গণহত্যা চালাত এখান থেকে। নর পশুদের জবাব দিচ্ছিল মুক্তিবাহিনী। মাঝে মাঝে মুক্তিবাহিনী পাক সেনাদের আক্রমণ করে উপযুক্ত প্রতিশোধ গ্রহণ করত। অতর্কিত আক্রমণের জন্য মুক্তি সেনারা স্কুলটিকে ব্যবহার করতো বর্ম হিসেবে।

তাই পাক সেনারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে অগ্নি সংযোগ করে। বর্তমানে এই স্কুলের কোন চিহ্ন অবশিষ্ট নেই। স্কুলের বিজ্ঞান বিভাগের প্রায় ২০ হাজার টাকার যন্ত্রপাতি এই সব অক্ষর জ্ঞানহীন পশুরা নষ্ট করে দিয়েছে।“

মোঃ; রাশেদ হাসান (নোবেল)

<৮,২২,৩৯৫>
[সিরাজগঞ্জ যমুনা পাড়ের কিছু হত্যা- কাহিনী]
-দৈনিক আজাদ, ২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২।
“এখানকার প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে পাকিস্তানীদের নৃশংস নর-নিধনযজ্ঞের কাহিনীগুলো একে একে বেরিয়ে আসছে। বেরিয়ে আসছে কিভাবে তারা পল্লী মায়ের নিভৃত কোল থেকে তরুণ যুবক ছেলেদের ছিনিয়ে এনে লঞ্চ ঘাটে জবাই করত আর নদীর বুকে ছুড়ে ফেলে দিত। সিরাজগঞ্জের সাব জেলটি ঠিক এমনি জবাই খানার কাজে ব্যাবহার হত।

এসব একদিন দুদিনের ঘটনা নয়। এপ্রিল মাসে হানাদাররা সিরাজগঞ্জ প্রবেশের পর থেকে নয় মাস ধরে দিনের পর দিন এর পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। আর গ্রামে গ্রামান্তরে মানুষ হতভাগ্যদের আর্তনাদে শিউরে উঠেছে।

এতে করে সিরাজগঞ্জের জবাইখানা গুলোতে কমপক্ষে ৩ হাজার লোক মারা পড়েছে। আর যে বন্দর ২৫শে মার্চের আগে অহরহ কর্মব্যস্ত থাকতো তা-ই আর ২৭শে এপ্রিলের পর এক জন মানবহীন প্রেতপুরীতে পরিণত হয়। লোকজন যতদূর সম্ভব এই ঘাট এড়িয়ে চলতে চাইত।

বার্তা প্রতিষ্ঠান বি এস এস এর প্রতিনিধি সিরাজগঞ্জের আওয়ামী লীগ , ন্যাপ, মুক্তিবাহিনী আর মুজিব বাহিনীর বহু নেতার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। তারা জানান যে ২৭শে এপ্রিল থেকে ৫ দিন ধরে তারা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে কম করে ৫ শত লোককে হত্যা করেছে।

আজ এসব কথা লিখতে বসে বারইতলা গ্রামটির কথা মনে পড়ে গেল। কাজীপুর থানার এ গ্রামে গত বছর নভেম্বরের কোন এক সময়ে তারা হামলা করে। মাত্র একটি দিনের নারকীয় যজ্ঞ। অথচ এই একটি দিনে নারী, পুরুষ ও শিশুতে মিলে ২ শত লোককে জল্লাদরা হত্যা করে। কমপক্ষে ২ শত ঘরবাড়ী জ্বালিয়ে দেয়।

এরও আগে মে মাসে সিরাজগঞ্জ থানার বাবতীতে মারা পড়ে ১৭০ জন। বারইতলা আর বাবতী এই দু জায়গাতেই মুক্তিবাহিনী বীর বিক্রমে শত্রুকে বাঁধা দিয়েছে।

এভাবে নরহত্যা, লুটতরাজ আর অগ্নিসংযোগের অমানুষিক ইতিহাস ঘাঁটলে চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক একটি গ্রামের ছবিঃ তামাই, রাজাপুর, সাইদাবাদ, সিংলাবাড়ী।“

মোঃ; রাশেদ হাসান (নোবেল)

<৮,২৩,৩৯৬>
[আর এক বদ্ধভূমি চট্টগ্রামের দামপাড়া]

ইয়াহিয়ার জল্লাদ বাহিনীরা এখানে কয়েক হাজার লোক হত্যা করেছে
-নিজস্ব প্রতিনিধি
দৈনিক বাংলা, ৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২।
“চট্টগ্রাম শহরের দামপাড়াস্থ গরীবুল্লাশাহর মাজারের পাশে একটি লোমহর্ষক বধ্যভূমি আবিষ্কৃত হয়েছে। গত ৩০শে মার্চ থেকে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত এই বদ্ধভূমিতে বর্বর পাক বাহিনী প্রায় কয়েক হাজার লোককে হত্যা করেছে বলে অনুমান করা হচ্ছে। বধ্যভূমির স্থানটি আমাকে দেখিয়েছেন গরীবুল্লাশা মাজারের সংলগ্ন দোকানদার নাসির আহমেদ।

গত ২৫শে মার্চ থেকে ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত এই হত্যাযজ্ঞের ষোল আনাই তিনি স্বচক্ষে দেখেছেন। এই দীর্ঘ সময়ে তিনি তার দোকানেই ছিলেন। নাসির আহমেদ আমাকে বলেছেন, গত ৩০শে মার্চ থেকে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত অতিরিক্ত বৃষ্টির দিন ছাড়া প্রত্যহ সন্ধ্যায় কড়া মিলিটারি পাহারায় পাঁচ থেকে ছয় ট্রাক লোক নিয়ে আসা হত।

এই হতভাগ্যদের চোখে কাপড় বাঁধা থাকতো। তাদের বধ্যভূমিতে নামিয়ে দিয়ে ট্রাকগুলি চলে যেতো। এই হতভাগ্যদের বধ্যভূমিতে লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়ে গুলী করে হত্যা করা হত। তারপর অন্য একদল মিলিটারি ট্রাক নিয়ে বধ্যভূমিতে এসে লাশগুলি ট্রাক বোঝাই করে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যেত। নাসির আহমেদ আমাকে আরও বলেছেন যে, নিয়মিত এই হত্যা যজ্ঞের শুরুতে লাশ পুঁতার জন্য বধ্যভূমির পাশে একটি গভীর গর্ত খনন করা হয়।

মাত্র কয়েক দিনে লাশে এই গভীর গর্ত ভর্তি হয়ে গেলে সদ্য মরা লাশগুলিকে ট্রাকে চড়িয়ে অন্যত্র সরিয়ে ফেলার ব্যবস্থা করা হয়। আমার অনুরোধে নাসির আহমেদ এই গর্তের মুখ থেকে সামান্য মাটি সরিয়ে পাঁচটি নরকঙ্কাল উঠান। তাঁর মতে সেই গর্তে কমপক্ষে পাঁচ হাজার নরকঙ্কাল রয়েছে। এই লোমহর্ষক বধ্যভূমি চারিদিকে পাহাড় দিয়ে ঘেরা। বধ্যভূমির চারিদিকে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে রয়েছে হতভাগ্যদের জামা- কাপড় জুতা প্রভৃতি। মাটিতে রয়েছে চাপচাপ বিস্তর রক্তের দাগ যা প্রমাণ করেছে যে গত ডিসেম্বরের প্রথম দিকে এখানে কয়েক’শ লোককে হত্যা করা হয়েছে।

বদ্ধভূমির পাশে হাটার সময়ে মাটিতে আমি গোটা-দশ স্যুটও দেখতে পেয়েছি। এতে প্রমাণিত হচ্ছে যে, রেলওয়ে পোর্ট ট্রাস্ট এবং অন্যান্য অফিসের যে সব হতভাগ্য অফিসার নিখোঁজ রয়েছেন, তাঁদের অনেককেই এই বধ্যভূমিতে হত্যা করা হয়েছে। নাসির আহমেদের মতে অত্যাচারের কালো দিনগুলোতে বর্বর পাক বাহিনী এই বদ্ধভুমিতে কয়েক হাজার লোককে হত্যা করেছে। তিনি বলেছেন যে, নিয়মিত এই হত্যাযজ্ঞের শুরুতে চোখ বাঁধা অবস্থায় বধ্যভূমিতে আনা একদল লোককে গুলী করে হত্যা করলে গুলির আওয়াজে হতভাগ্যদের লাইন করে দাঁড়ানো অন্যদল মৃত্যু ভয়ে চিৎকার করতো বলে পরে রাইফেলে সাইলেন্সর লাগিয়ে গুলি করে মারার পদ্ধতি প্রবর্তিত হয়।

নিয়মিত এই লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ডের আরও দুইজন সাক্ষী পাওয়া গেছে। এরা হচ্ছেন গরীবুল্লাহ শাহর মাজারের দারোয়ান আব্দুল, জব্বার।“

<৩,২৪,৩৯৭-৯৮>
[গ্রামে গ্রামে পথে পথে বধ্যভূমি]

-পূর্বদেশ, ৪ ফেব্রুয়ারী, ১৯৭২।
“বরিশাল, পটুয়াখালী, আশুগঞ্জ, কুষ্টিয়া এবং চট্টগ্রামের দামপাড়ায় সম্প্রতি বেশ কটি বধ্যভূমি আবিষ্কৃত হয়েছে । এ সব বধ্যভূমিতে হানাদার ইয়াহিয়ার সৈন্যরা গত ২৫ শে মার্চ থেকে শুরু করে গত ন’মাস ধরে কয়েক লাখ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করছে। বরিশাল, পটুয়াখালী অঞ্চলে কয়েকটি এলাকায় পাক হানাদার বাহিনী কয়েক লক্ষ লোক হত্যা করেছে। এ অঞ্চলে এখনো অনেক স্থানে নরকলঙ্ক ও মানুষের হাড় পড়ে আছে। বরিশালে হানাদার বাহিনী সুপরিকল্পিত উপায়ে এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায়। ওরা বরিশাল শহরে কোন ঘর-বাড়ী ধ্বংস না করে প্রমাণ করবার চেষ্টা করে যে, বরিশালে তারা কোন গণহত্যা বা ধ্বংস চালায়নি।

কিন্তু শহর থেকে একটু গ্রামের দিকে এগুলেই দেখা যাবে পশু বাহিনীর হিটলারী কার্যকলাপের চিহ্ন। বরিশাল শহরে কীর্তন খোলার তীরে অবস্থিত ওয়াপদা কলোনী এলাকায় এবং সি, এস, ডি, গোডাউন এলাকায় ও ষ্টেডিয়ামের নিকটে পশু পাক বাহিনী বাঙ্গালীদের হত্যা করতো।এই সকল এলাকায় নদীর তীরে এখনও মানুষের মাথার খুলি এবং হাড় দেখতে পাওয়া যায়। বরিশাল মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রাবাসের কতিপয় ছাত্র বদর বাহিনীর সদস্য ছিল। ঐ সকল বদর সদস্যরা বহু বাঙ্গালীকে ধরে নিয়ে হত্যা করে।

বাংলাদেশের দক্ষিণ অঞ্চলে ঝালকাঠি একটা প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্র। ঝালকাঠি বন্দরে পশু বাহিনী পেট্রোলের সাহায্যে আগুন ধরিয়ে সব ঘরগুলো পুড়িয়ে দেয়। এই বন্দরে কমপক্ষে বিশ কোটি টাকার সম্পত্তি ধ্বংস করা হয়। ঝালকাঠির অদূরে আটাঘর, কুরিয়ানার পেয়ারা বাগানে মুক্তি যোদ্ধারা সুদৃঢ় প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। এই পেয়ারা বাগানের পেয়ারা সমগ্র বাংলাদেশে সরবরাহ হয়ে থাকে। এই বাগান ‌এলাকায় একদিনেই পশু বাহিনী কয়েক হাজার লোককে হত্যা করে। এর ভিতর ষোল বছরের যুবক থেকে চল্লিশ বছরের লোকের সংখ্যাই ছিল বেশী।

পাক বাহিনী এই পেয়ারা বাগান কেটে পরিষ্কার করার জন্য পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে হাজার হাজার লোককে বলপূর্বক ধরে আনে এবং তাদেরকে দিয়ে পেয়ারা বাগান কেটে পরিষ্কার করাতে থাকে। নিরীহ গ্রামবাসী গাছ কাটতে অস্বীকার করলে তাদেরকে নির্দয়ভাবে হত্যা করা হয়। এই এলাকায় দালাল ব্যতীত অন্য কোন নিরীহ বাঙ্গালীর পক্ষে টিকে থাকা দুরূহ ব্যাপার।

কাউখালী, বরিশালের আর একটি প্রধান বন্দর। এই বন্দর হানাদাররা সম্পূর্ণভাবে জ্বালিয়ে দেয় ও গ্রামে গ্রামে ঢুকে নিরীহ বাঙ্গালীদের হত্যা করে। পিরোজপুর মহকুমা শহরে নদীর তীরে যে স্থানে বাঙ্গালীদের দাঁড় করিয়ে হত্যা করা হতো সেই জায়গায় রক্তের জোয়ার বইতো।

পিরোজপুর হানাদার বাহিনী কর্তৃক দখলকৃত হওয়ার পর সেখানে যত যুবক ছিল সবাইকে হত্যা করা হয়। রাজাপুর বানরি পাড়া মঠবাড়িয়া স্বরুপকাঠি এবং অন্যান্য এলাকায় হানাদার বাহিনী শান্তি কমিটির সহযোগিতায় বিপুলসংখ্যক বাঙ্গালীকে হত্যা করে।

পটুয়াখালী শহরেই কয়েক হাজার বাঙ্গালীকে হত্যা করা হয়। পটুয়াখালী জেলার অন্যান্য এলাকায় যে সংখ্যক নিরীহ লোকদের হত্যা করা হয় তার প্রকৃত তথ্য উদঘাটিত হলে মোট হত্যার সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পেতে পারে।“

মোঃ; রাশেদ হাসান (নোবেল) এবং অমিতাভ বড়ুয়া

<৮,২৫,৩৯৯>
[রাজশাহীর গর্তে আরো নরকংকাল]

আধমরা লোকগুলোকে পশুরা মাটিচাপা দিয়েছিল
-দৈনিক বাংলা, ৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২।
“রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় রেলওয়ে ষ্টেশনের পাশে নরকংকাল ভর্তি আরো গর্তের সন্ধান পাওয়া গেছে। দৈনিক আজাদের প্রতিনিধি ও রাজশাহী জেলা সংবাদিক ইউনিয়নের জেনারেল সেক্রেটারী জনাব মোহাম্মদ আবু সাইদকে হত্যার পর বর্বর পাক বাহিনী এই গর্তে পুতে রাখে। জানা গেছে যে, গত বছর ২৮শে জুন পাক বাহিনীর কতিপয় দালাল জনাব আবু সাইদকে ধরে নিয়ে যায়।

এই দালালদের মধ্যে তৎকালীন দৈনিক সংগ্রামের স্থানীয় প্রতিনিধিও ছিল। জনাব সাইদকে সার্কিট হাউসে নিয়ে যায় এবং সেখান থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপকের বাড়ীতে নিয়ে যাওয়া হয়। এখানে প্রায় এক সপ্তাহ আটক রাখা হয়। এরপর ৫ই জুলাই অপর ১৫ জন ব্যাক্তির সাথে জনাব সাইদকে জোহা হলে নিয়ে যাওয়া হয়।

সেখানে দিনাজপুরের জনৈক রেলওয়ে কর্মচারিকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। বর্বর পাক বাহিনী মৃতদেহটি রেলওয়ে ষ্টেশনের দিকে বয়ে নিতে বন্দীদের বাধ্য করে। ষ্টেশনের পাশে একটি বাবলা গাছের নীচে তাদের সামনেই একটি গর্ত করা হয়। এরপর তাদের সকলকে জোর করে গর্তের মধ্যে ঠেলে দিয়ে বেয়োনেট দিয়ে খোঁচানো হয়। এই সাথে পাশ থেকে মাটি নিয়ে তাদের সবাইকে অর্ধমৃত অবস্থায় গর্তের মধ্যে চাপা দেওয়া হয়।

কিন্তু এদের মধ্যে রাজশাহী জিন্না ইন্সটিটিউটের পিয়ন আব্দুল কাদের, শ্যামপুরের জনৈক রুপভান মিয়া পরস্পরের সাহায্যে গর্তের মধ্য থেকে কোন রকমে উঠে ভারতে পালিয়ে যায়। বাংলাদেশে ফিরে আসার পর এদের কাছ থেকেই এই লোমহর্ষক কাহিনী জানা গেছে।

এ ছাড়া পাক বাহিনী আত্মসমর্পণের অব্যবহিত পূর্বে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ছাত্র ও অপরাপর বুদ্ধিজীবীদের লাশ উদ্ধার করা হয়। শহরের পার্শ্ববর্তী গ্রাম সমূহের হাজার হাজার বাঙ্গালীকে বর্বর পাক বাহিনী নৃশংসভাবে হত্যা করে লম্বা গর্তের মধ্যে পুঁতে রাখে। এদেরকে গলা কেটে হত্যা করা হয় বলে জনৈক প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণীতে জানা গেছে।“

মোঃ; রাশেদ হাসান (নোবেল)
<৮,২৬,৪০০-০১>
[রথযাত্রা উপলক্ষে আর ভীড় জমবে না এখানে]

ধামরাই আজ শ্মশান
-সংবাদ, ৫ ফেব্রুয়ারী ১৯৭২।
বাংলাদেশের একটি স্থানের নাম ধামরাই। নামটাকে কেন্দ্র করে প্রচলিত আছে অনেক কিংবদন্তি। অনেক ভক্ত প্রাণ এই নামটিকে স্মরণ করে ভাবাবেগে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। এখানকার প্রাচীন কীর্তি ধামরাইয়ের রথ। বাংলাদেশের এত বড় রথ আর কোথাও ছিল না। শোনা যায় এই রথটাকে টানতে প্রায় একশত মণ পাটের দড়ির দরকার হতো।

রথযাত্রার সময় ধনাঢ্য ব্যাক্তিরা এ পাট দান করতেন। রথযাত্রা উপলক্ষে বসতো মেলা। ভক্তজনেরা এসে ভীড় জমাতো এই ধামরাইয়ে। অসংখ্য সাধু সন্ন্যাসীর পদধুলিতে পবিত্র হয়ে উঠতো ধামরাইয়ের পথ ঘাট।

গত এপ্রিলের প্রথম দিকে ধামরাইয়ে প্রবেশ করলো পাক-ফৌজের একটি দল। লুট করলো মন্দিরের সোনাদানা টাকা-পয়সা ও মূল্যবান আসবাবপত্র। বাংলার এই বিখ্যাত রথটাকে লাগালো আগুন। কয়েকদিন ধরে পুড়ে পুড়ে ছাই হয়ে গেল রথটি। পাক সেনারা রথটি পুড়িয়ে ক্ষান্ত হলো না। এর স্মৃতি বাঙ্গালীর মণ থেকে মুছে ফেলবার জন্য ছাই ও কয়লাগুলো ট্রাকে বোঝাই করে নিয়ে গেল।

বাংলাদেশ থেকে চিরদিনের জন্য নিশ্চিহ্ন করে দিল একটা ঐতিহ্যকে। ভক্তজনের কলগুঞ্জনে ধামরাই আর জেগে উঠবে না সহসা। ভক্ত রথীরা আর আসবে না এখানে। রথটিও কোনদিন নতুন করে গড়ে উঠবে না। ধামরাই কালের বুকে জেগে থাকবে ধ্বংসের ইতিহাস হয়ে। পাক হানাদার এ ঐতিহাসিক রথটিকে নিশ্চিহ্ন করে থেমে যায়নি। এখানকার বহু লোককে গ্রেফতার করেছে। নির্যাতন করেছে। হত্যা করেছে। পাক হানাদারদের সাথে জুটেছিল বাংলার কতিপয় ঘৃণ্য নরপিশাচ। তারাই পথ দেখিয়ে নিয়ে যেত হানাদারদের। এখানেও পথ দেখিয়েছিল কতিপয় এদেশী মোহাম্মদী বেগ। ধামরাইয়ে নিহত হতভাগ্য বাঙ্গালীদের মধ্যে প্রথমেই মনে পড়ে ধামরাই স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষক দীনেশ বাবুর কথা। হার্নিয়ার রোগী ছিলেন দীনেশ বাবু। তাঁর স্ত্রী মস্তিষ্ক বিকৃত। তাঁর তিনটা ছেলে। তৃতীয় ছেলে হাবুল জগন্নাথ কলেজর বাণিজ্য বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র।

বাবার সঙ্গেই বাড়ীতে ছিল গোলযোগের সময়। ৯ই এপ্রিল বেলা ১২টা। তিনি রান্না করছিলেন। এর ফাঁকে উঠতে হল তাঁকে। কারণ প্রানের ভয়ে পালাচ্ছে লোক। বেলা ১২টার মধ্যে ৩/৪ বার দৌড়ালেন আবার ফিরে এলেন। অদৃষ্টে যা আছে তা খন্ডাবে কে? পাক বাহিনী রাস্তা কেমন করে চিনবে বা তাঁকে খুঁজে বের করতে পারবে? কিন্তু ঘরের শত্রু বিভীষণ।

বাংলার মাটিতে ছিল অসংখ্য মীরজাফর আর জগত শেঠ। এই মীরজাফর, জগতশেঠের বংশধররাই একজন দীনেশ বাবুকে শনাক্ত করে দিল। দীনেশ বাবু ধরা পড়লেন। ছেলে হাবুল বাড়িতেই। তাঁর সঙ্গে ৪/৫ হাজার টাকা। হাবুল ভেবেছিল হয়ত টাকা পেলেই বাবাকে ছেড়ে দিবে। তাই এগিয়ে গিয়েছিল দালালদের হাতে পায়ে ধরে বাবাকে ছাড়াতে। তাই বুঝি কাল এসেছিল। তাকেও রেখে গেলনা বর্বর ডাল কুত্তার দল।

তাদের থানায় রেখে দেয় একরাত। দীনেশ বাবু এবং তাঁর ছেলে হাবুলের উপর অকথ্য নির্যাতন চালানো হয় এতেও দন্ড শেষ হল না দুটি নিষ্পাপ প্রাণের। দীনেশ বাবুর দিন শেষ প্রায়। হাবুলের জীবন যাত্রা হয়েছে শুরু। অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দেওয়া হয় সম্ভাবনাময় প্রাণটিকে। এদের সাথে আরো যাদের ধরা হয়েছিল তারা নিতান্তই গরীব। তাদের প্রতিদিন কাজ না করলে পেটের খোরাক জোটে না।

এরা হচ্ছেন গান্ধীপাল (দোকানদার), বুদ্ধ সূত্রধর (লোহার কামার), গনেশ পাল (পান বিক্রেতা), চিনু বণিক (হকার), গয়া রাজবংশী (মাছ বিক্রেতা), প্রবেশ সুত্রধর (লোহার কামার) আরো ৪ জন নাম না জানা লোক। দীনেশ রায় এবং ছেলে হাবুলকে সহ এদের ধামরাই থেকে ৩/৪ মাইল দূরবর্তী কামালপুর বাজারে নিয়ে যায়। সবার চোখ বাঁধা। বাজারের পাশে কালামপুর আতাউর রহমান হাইস্কুলের মাঠ। মাঠের পাশ দিয়ে একটা খাল নদীতে গিয়ে পড়েছে।

বাজার থেকে স্কুলে আসতে একটা কালভার্ট। উপরে সিমেন্টের আস্তরণ নেই। বাঁশ দিয়ে সাঁকো বেঁধে লোক যাতায়াত করার মত ব্যাবস্থা করে রাখা হয়েছে। তখনও খালে জল গড়ায়নি। কালভার্টের নীচে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করানো হল ১৪ টি মানুষকে। সবার পুরোভাগে সর্বজন শ্রদ্ধেয় দীনেশ রায় এবং তাঁর পিছনে আদরের দুলাল হাবুল।

এভাবে ১৪ জনকে দাঁড়াতে হয়েছিল। তারপর আর বলা যায় না। বাংলার বুকে হানাদার ডাল কুত্তারা কত বীভৎস কান্ডই না করেছে। সবাই শেষ বারের মত ঘুমিয়ে পড়ল বাংলা মায়ের কোলে চিরনিদ্রায়।

এ নিদ্রা থেকে আর তারা জাগবে না…”

মোঃ; রাশেদ হাসান (নোবেল)
<৮,২৭,৪০২>
[হাজীগঞ্জে খানসেনাদের হত্যাযজ্ঞের স্বাক্ষর]

-সংবাদ, ৫ ফেব্রুয়ারী ১৯৭২।।

“এ জেলার প্রসিদ্ধ ব্যবসাকেন্দ্র হাজীগঞ্জ ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকা হতে প্রতিদিন বর্বর পাক বাহিনীর হাতে নিহত মানুষের হাড়, মাথার খুলি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। প্রতিদিনই উদঘাটিত হচ্ছে নারকীয় বর্বরতার ভয়াল স্বাক্ষর। ডাকাতিয়া নদীর উত্তর তীরে অবস্থিত মাকিমাবাদের জলাভূমিতে প্রায় তিনশ মাথার খুলি এবং মানুষের হাড় বিচ্ছিন্ন ভাবে পড়ে থাকতে দেখা যায়।
বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার একজন প্রতিনিধি জানাচ্ছেন যে, বর্বর হানাদাররা এ অঞ্চলের সন্ত্রাসের রাজত্ম কায়েম করে এলাকাকে কেমন করে ধ্বংস করেছে তার অনেক কাহিনী এখন পাওয়া যাচ্ছে।

স্থানিয় হামিদা জুট মিলকে বর্বর পাক পশুরা ৩ হাজার বাঙ্গালী নিধনের বধ্যভূমিতে রূপান্তরিত করেছিল। মিলের পার্শ্ববর্তী কোন স্থানে অবস্থানরত সেকান্দর আলী সংবাদ সংস্থার প্রতিনিধিকে জানান যে, প্রতিদিন পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে বাঙ্গালী যুবকদের এখানে ধরে এনে সারা রাত পাক পশুরা নির্যাতন চালাত। তারপর তাদের কয়েকজনের হাত-পা একসাথে বেঁধে মৃত বা অর্ধমৃত অবস্থায় ডাকাতিয়া নদীতে ফেলে দিত।

হাজীগঞ্জ থানা প্রধান জনাব হাতেম আলী, একজন প্রত্যক্ষদর্শী আবদুস সোবহান এবং ৭৫ বৎসর বয়স্ক একজন, প্রতিনিধিকে আরো অনেক চাঞ্চল্যকর কাহিনীর কথা জানান। হাজীগঞ্জ থানায় লুটপাট অগ্নিসংযোগ এবং নারী নির্যাতনের কাহিনীর অন্ত নেই। একমাত্র বারকুল গ্রামেই বর্বর বাহিনী এবং তাদের ভাইয়েরা ১২০ জন আবালবৃদ্ধবনিতাকে খুন করেছে। অনেক বালিকাকে পাশবিক অত্যাচার করেছে এবং দালালদের সহযোগিতায় ৪ঠা মে গ্রামটিকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে।

এ থানায় এমন কোন গ্রাম নেই বললে চলে, যেখানে অগ্নি সংযোগ, লুট এবং নারী নির্যাতন করা হয়নি। প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণে প্রকাশ, মুজাফফরগঞ্জেই বর্বরতা চরম রুপ নিয়েছিল। এখানে এক বাড়ীতে ২ জন রাজাকার একটি বালিকাকে ধর্ষণে প্রবৃত্ত হলে বাড়ীর অন্যান্য লোক তাতে বাঁধা দেয়। পরদিন একদল রাজাকার এবং দখলদার বাহিনীর লোকজন সেই বাড়ী আক্রমন করে ৩৭ জন লোককে হত্যা করে।

শুধু এতেই নিবৃত্ত ছিল না ডাল কুত্তার দল, সেই বাড়ীর ৪টি বালিকাকে ধরে নিয়ে ধর্ষণ করতে থাকে এবং ৩/৪ দিন পর তাদের মৃতদেহ পাশের একটি খালে ভাসতে দেখা যায়।“
<৮,২৮,৪০৩-০৪>
[কিশোরগঞ্জের হত্যাকাণ্ড]

-দৈনিক বাংলা, ৫ ফেব্রুয়ারি,১৯৭২।

“ সেই রাতে ধুলদিয়া রেলওয়ে পুলের ওপর সবাইকে লাইন করে গুলি করা হলো।

কিশোরগঞ্জ বর্বর হানাদার বাহিনীর অধিনায়ক নরপশু মেজর ইফতেখার সম্পর্কে দু’ একটি তথ্য দৈনিক বাংলা এর ২৪শে জানুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। এই জঘন্য পশুর পাশবিকতা কিশোরগঞ্জ এ যে বিভীষিকা ও ভয়াবহতারর সৃষ্টি করেছিল, তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব হবে না।

১৯৭১ সনের জুলাই মাসের শেষের দিকে এই নরাকৃতি পিশাচ কিশোরগঞ্জ আসে। সে এখানে এসেই শুরু করলো তার নরমেধ যজ্ঞ। প্রত্যহ ত্রিশ, চল্লিশ, পঞ্চাশ এমনকি আরো বেশি করে লোক ধরে ধরে এনে মারতে শুরু করলো। বলা বাহুল্য যার অধিকাংশই ছিলো হিন্দু। কাজেই হিন্দু অধিবাসীরা যারা কিছুটা নির্ভয় হয়েছিলেন, তারা শহর ছেড়ে পালাতে শুরু করেন। অনেকে প্রায়ই ভয়ে মুসলমান ও হতে শুরু করলেন।

ইফতেখার দেখল হিন্দু আর পাওয়া যাচ্ছে না। কাজেই তার গণহত্যার পরিধি বিস্তৃততর করার জন্য এই নর শয়তান তথাকথিত শান্তি কমিটির মাধ্যমে হিন্দুদের আহবান করল এই বলে যে, নির্দোষ কোনো লোককে কোনো রকম হয়্রানি করা হবে না, হিন্দুরা যেনো নির্বিঘ্নে নিজ নিজ কাজ শুরু করে। শয়তান দলের এই কপটতায় অনেকেই বিভ্রান্ত হয়ে ফিরে এলেন। ভয়ে ভয়ে শহরে নিজ নিজ কাজ শুরু করলেন।ইফতেখার আর এক ফরমান জারী করল যে, সামরিক কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কাউকে ধর্মান্তরিত করা চলবে না আর হিন্দুদের ধুতি পরে থাকতে হবে। এই ভাবে নরপিশাচ তার হত্যাযজ্ঞ বিস্তৃত করার প্রাথমিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করলো। শয়তানের কপ্টতায় বিশ্বাস করায় প্রথম বলি হলেন বাবু গিরিজা মোহন চক্রবর্তী। এছাড়া কত অসংখ্য মানুষ যে নরপিশাচের হাতে প্রান দিয়েছে, তার সঠিক তথ্য বের করা অত্যন্ত দুরুহ ব্যাপার। খগেন্দ্র নাথ লৌহ নামক এক ভদ্রলোক অত্যন্ত নিরীহ মানুষ।কারো সাতেও নেই, পাচেও নেই। একটা ক্ষুদ্র চায়ের দোকান চালাচ্ছিলেন তিনি, পরিবারের অন্ন সংস্থানের একমাত্র অবলম্বন রুপে।নরপিশাচ ইফতেখার হটাত এক রাতে হানা দিয়ে এই পরিবারের সবাইকে ধরে নিয়ে গেলো। এই সংগে ধরা পড়ল হরিমোহন নামে বৃদ্ধ একজন মেইন রানার। শয়তান কাউকে রেহাই দেয় নি। নৃশংসভাবে এদের সকলকে হত্যা করে।

এদের মধ্যে খগেন বাবুর জ্যেষ্ঠ পুত্র কাজল লৌহ অলৌকিকভাবে রক্ষা পেয়ে গেলেও। কাহিনীটা তার কাছেই শোনা।গচিহাটা রেলস্টেশনের সন্নিকটে ধুলাদিয়া রেলওয়ে পুলের ওপর সকলকে লাইন করে দাড় করিয়ে জল্লাদ্রা গুলি করে হত্যা করেছে সকলকে। গুলি করার সময় কাজল লাফ দিয়ে নীচে পানিতে পড়ে যায়। অবশ্য সংগে সংগে পিশাচরা পানিতে অসংখ্যবার গুলি ছুড়েছে।কিন্তু রাখে আল্লহ মারে কে? কাজল রাতের অন্ধকারে দুব সাতার দিয়ে দিয়ে অনেকদূর গিয়ে ডাঙায় উঠে পাড়ি জমায় সীমান্তের ওপারে। কাজল ফিরে এসেছে। কিন্তু গোটা পরিবারটা যেন ছত্রখান হয়ে গেছে।

অশ্বিনী বাবু একজন গোবেচারা বৃদ্ধ আইনজীবী। স্বামী,স্ত্রী ছিলেন কিশোরগঞ্জের বাসায়, দুই ছেলে প্রবীর ও সুবীর। প্রবীর বি এস সি পাশ করে শিক্ষকতা করছিলেন করিমগঞ্জ স্কুলে, আর তার ছোট ভাই সুবীর কলেজে পড়তো। পিশাচ ইফতেখার এক রাতে অশ্বিনী বাবুকে বাড়ী থেকে ধরে নিয়ে আসে। তারপর বন্দুকের নলের মুখে অশ্বিনী বাবুকে দিয়ে দুই ছেলের কাছে চিঠি লেখায় ওদের কিশোরগঞ্জ আসার জন্য।

পিতৃভক্ত দুই ভাই এসেই জল্লাদের ফাদে পা দেয়। দুটো ছেলেকেই এই নরঘাতক হত্যা করে,অশ্বিনী বাবুকে ছেড়ে দেয়। অশ্বিনী বাবু আজও বেঁচে আছেন, তবে সে বাচা বাচা নয়, জীবন্মৃত অবস্থা শোনা যায় অশ্বিনী বাবুর দেশের বাড়ি ও সম্পত্তির লোভে জনৈক দালাল ইন্ধন যুগিয়ে ইফতেখারের মত নর রাক্ষসকে দিয়ে বৃদ্ধের দুটো ছেলেকেই খুন করিয়েছে।

পাকুন্দিয়া থানার মেডিকেল অফিসার সংস্কৃতিবান একজন হিন্দু ভদ্রলোক। দুই ছেলেসহ নিহত হলেন নরপিশাচ ইফতেখারের হাতে।তার তিন মেয়ে। দু’জন গ্রাজুয়েট আর একজন ম্যাট্রিকুলেট। ভাইপো, জামাইরা সব কাঠের মিস্ত্রী ছিলো। তথাকথিত শান্তি কমিটির আহবানে ওরা ফিরে এলো শহরে, শুরু করল কাজ কর্ম। হঠাত একদিন সবগুলো সক্ষম পুরুষকে ধরে নিয়ে গেলো জল্লাদরা। ওদের কেউ বাচতে পারেনি ঘাতক ইফতেখারের হাত থেকে।

এই জাতীয় অসংখ্য নরহত্যা করেছে ইফতেখার তার পিশাচ সহচরদের সহায়তায়।এই তো গেলো তার রক্ত লোলুপ পিশাচ মনোবৃত্তির কথা। এছাড়া তার মত লম্পট, ঘৃন্য নরপশু, নৈতিকতা বিহীন পিশাচ পৃথিবীর আর কোথাও কোনো দেশে কোনো কালে ছিলো কিনা, কেউ বলতে পারবে না। এই নরাধম কত মেয়ের যে সর্বনাশ করেছে, কত নারী যে নিধন করেছে, কত হতভাগিনীকে উন্মাদে পর্যবসিত করেছে তার কোনো সীমা নেই। তার কবল থেকে কেউ রক্ষা পায়নি। ব্রাক্ষণ, পুরোহিতদের হত্যা করে তাদের ছেলে মেয়ে দের যেমন করেছে নির্যাতন, ঠিক তেমনি হিন্দু, মুসলমান কাউকে সে রেয়াত করেনি। তার পাশব প্রবৃত্তির লেলিহান শিখায় যে সকল সদ্য স্বামী হারা, পিতৃহারা, মাতৃহারা, হতভাগিনী পুড়ে ছাই হয়ে হয়ে গেছে, আদেরকে এরপর স্থানান্তরিত করা হয়েছে মহকুমার বিভিন্ন কেন্দ্রে নরাকৃতি পশু পশ্চিমা হানাদার আর কুখ্যাত রাজাকার, মুজাহিদ, আল-বদর বাহিনীর কমান্ডার এবং স্বঘোষিত অফিসার ইন চার্জদের হাতে।

ইফতেখার লুন্ঠন চালিয়েছে অবিচারে।নিজে গ্রহন করেছে স্বর্ন, নগদ টাকা, স্বর্ণালংকার প্রভৃতি মূল্যবান জিনিস, আর তার অনুচরদের দিয়েছে বাকী সব মালামাল। এছাড়া তথাকথিত শান্তি কমিটির যোগসাজশে যাকে তাকে ধরে আটক করে, শান্তি কমিটির মাধ্যমে মোটা অংকের নগদ অর্থের বিনিময়ে দু- একজনকে ছেড়ে দিয়েছে। অনেক সময় টাকা গ্রহণ করেও সে ব্যাক্তিকে হত্যা করা হয়েছে।

বলা বাহুল্য তথাকথিত শান্তি কমিটি টাকা আদায়ের সময় নিজেদের অংশ আলাদা করে আদায় করত। হিন্দু প্রানভয়ে মুসলমান হয়েও এই নরপিশাচ এর হাত থেকে রেহাই পায়নি।তাদের ও হত্যা করা হয়েছে।

বল্লভ সাহা নামক একজন হিন্দু ব্যাবসায়ী প্রানভয়ে সপরিবারে মুসলমান হয়।তাকেও হত্যা করেছে। নরপিশাচ দীর্ঘকাল এক ত্রাস ও বিভীষিকার রাজত্ব চালিয়ে কিশোরগঞ্জকে শ্মশানে পরিণত করে।“

-কিশোরগঞ্জের দেই দালালেরা আজ কোথায়? বেঁচে আছে? কে জানে…

<৮,২৯,৪০৫-৬>
[স্বাধীনতা এলো, দানবীর আর পি সাহা আজও এলেন না]

-দৈনিক আজাদ, ৫ ফেব্রুয়ারী, ১৯৭২
“‘জেঠামণি না আসলে আমার কান্না পাবে, আমি এখানে থাকতে পারব না।’ কথা কটি বললো ভারতেশ্বরী হোমসের কিন্ডার গার্টেন দ্বিতীয় মানের ছাত্র রোকেয়া ইসলাম। বলতে বলতে কেঁদে ফেললো ৮ বৎসরের মেয়ে রোকেয়া। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। বাঁধ ভাংগা বন্যার মতো তার অশ্রু ঝরছে। এ দৃশ্য বড় বেদনাদায়ক। এ দৃশ্য বড় মর্মান্তিক। অথচ কিছুক্ষণ পূর্বেও রোকেয়া তার সহগামী বোনদের সাথে মাঠে ছুটাছুটি করছিল।

ভারতেশ্বরী হোমসের প্রতিষ্ঠাতা দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা হোমসের ছাত্রীদের সবার প্রিয় জেঠামণি। ৭১-এর মে মাসে পাক বাহিনী হোমসের ছাত্রীদের প্রিয় জেঠামণি আর তার ছেলে ভবানী আর তার ছেলে ভবানী প্রসাদ সাহাকে ধরে নিয়ে যায়।

অভিযোগ ওরা হিন্দু। ভারতের চর। আওয়ামী লীগের সমর্থক। কিন্তু হোমসের ছাত্রীরা উচ্চকণ্ঠে বলেছে “সব মিথ্যে সব মিথ্যে”। তিনি আমাদের আদর করেন। কান্না পেলে চোখের জল মুছিয়ে দেন। সত্যিই অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা একটি মহিরুহ। এ মহিরুহের ছায়াতলে বিগত ৩০ বৎসর যাবত অসংখ্য ছাত্রী জ্ঞানের আলোকে উদ্দীপ্ত হয়েছে। আর পি সাহা হোমসের ছাত্রীদের ভালবাসতেন গভীরভাবে।

তাদের শাসনও করতেন কঠোরভাবে। আবার পরক্ষণেই মাথায় হাত বুলোতেন সস্নেহে। সকল দুঃখ, সকল বেদনা আসুখ বিসুখ ভুলে যেতেন এখানে এসেই। হোমসের ছোট ছোট মেয়েরাই ছিল তার কর্মজীবনের সঞ্জীবনী শক্তি, তার কর্মবহুল জীবনের প্রেরণা। আর এদের দিকে তাকিয়েই তিনি কাজ করতেন দিনরাত অনবরত। এদের মুখে হাসি দেখলে তিনি খুশি হতেন, পুলকিত হতেন। কুসুমের মতই ছিল তার মন কোমল আর বজ্রের মতই ছিল কঠোর তার বাহিরের রুপ।

হোমসের প্রতিষ্ঠাতা দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা স্বাধীনতার পর আজ অবধি নিখোঁজ। তবে এ অন্তর্ধান সম্পর্কে কোন সঠিক তথ্যই উদঘাটিত হয়নি। হোমসের ছাত্রী শিক্ষয়িত্রী কুমুদিনি হাসপাতালের ডাক্তার, নার্স, রোগী, কুমুদিনি জনকল্যাণ ট্রাস্টের কর্মচারীসহ তার বন্ধুবান্ধব, শুভানুধ্যায়ী সবিশেষ উদ্বিগ্ন।

জেঠামণি ফিরে আসবেন। বাবু ফিরে আসবেন। আমাদের বিশ্বাস তিনি আজও বেঁচে আছেন। এ মহামানবের মৃত্যু হতে পারে না। তিনি তো মানবতাবাদী, সমাজবাদী। তার কোন শত্রু থাকতে পারে না। এ দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে সবাই অধীর আগ্রহে প্রহর গুনছে। এ প্রতীক্ষা তাদের যেন আর শেষ হতে চাচ্ছে না। গভীর উৎকণ্ঠা আর প্রতিক্ষায় তাদের দিন কাটছে। হোমসের প্রিন্সিপাল মিসেস প্রভা মুৎসুদ্দি বললেন, আপনারা চেষ্টা করে দেখুন, কোন না কোন ভাবে কাকা বাবুকে ফিরিয়ে আনা যায় কিনা।

বিক্ষিপ্তভাবে সকলেই কাতর কণ্ঠে হরেক রকম মন্তব্য করছেন। হোমসের ভাইস প্রিন্সিপাল মিস সালমা রহমান বললেন এখান থেকে বিগত দিনগুলোতে শত শত ছাত্রী জ্ঞানের আলোক নিয়ে মানবতার মশাল নিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে গ্রাম বাংলার প্রান্তরে প্রান্তরে। আর তা শুধু সম্ভব হয়েছে দানবীর রণদা প্রসাদ সাহার মহৎ অনুভূতির ফলেই। এখানে ধনী, গরীব, হিন্দু, মুসলমানের কোন পার্থক্য নেই। আমরা সবাই একই পরিবারের সদস্য। জাতি ধর্ম বর্ণের এখানে কোন বাছ বিচার নেই। হোমসের দারোয়ান ইউনুছ মিয়া আর ইমান আলী মিয়া আমাদের দেখেই প্রশ্ন করলো “আপনারা কি বাবুর কোন খবর নিয়া আইছেন?” জিজ্ঞাসা করলাম “কোন বাবু?” “আমাগো বড় বাবু”।

তারপর অনেক আলাপ আলোচনার পর তারা বললো, “আমাগো মনে অইতেছে যেন অহনো বাবু আছে। গাড়ীর শব্দ শুনলেই মনে অয় যে, এই বুঝি বাবু আইতাছে।” সত্যিই কত গভীর অনুভূতি, সবাই এ অভাব অনুভব করছে। মনে মনে প্রাণে প্রাণে সবাই আজ এই অনুভবের অনুসারী।“

<৮,৩০,৪০৭>
[কুমিল্লা ও রাজশাহীতে (বিশ্ববিদ্যালয়) গণহত্যার স্বরূপ]
রাজশাহী ভার্সিটির সাবেক উপাচার্য জল্লাদ সাজ্জাদই গণহত্যার লিস্ট তৈরি করতেন!!

স্টাফ রিপোর্টার।। বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা, ৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২।

১) #কুমিল্লাঃ, বিভিন্ন সূত্রের খবর থেকে জানা গেছে, ইয়াহিয়ার জল্লাদবাহিনী ও তার অনুগত চররা বিগত ৯ মাস ধরে এখানে ত্রাসের রাজত্ব চালিয়ে কমপক্ষে ২০,০০০ লোককে হত্যা করে। হাজার হাজার বাড়ী পুড়িয়ে দেয় এবং অগণিত পরিবারকে গৃহহারা করে দখলদার বাহিনী বাংলাদেশ ভারত সীমান্তের তিন মাইলের মধ্যে সমস্ত সম্পত্তি এবং বাড়ীঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে অথবা ধ্বংস করেছে।

এসব এলাকার মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়ীয়া এবং আখাউড়া সবচাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। জেলার প্রায় সকল হাট-বাজার লুট ও ধ্বংস করাতে সারা জেলায় চরম আর্থিক সংকট দেখা দিয়েছে। ক্ষতির পরিমাণ সম্পূর্ণরূপে নির্ধারণ করার কাজ সম্পন্ন হলে হত্যা এবং ধ্বংসের পরিমাণ বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

পাক- হানাদার বাহিনী এবং অনুচররা বিভিন্ন হাট-বাজার, ঘরবাড়ী রেল এবং বাস থেকে বহু সংখ্যক যুবককে ধরে এনে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। তাদের ভাগ্যে কী ঘটেছে সে সম্পর্কে এখনো কিছু বলা যায়নি। যাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তাদের মধ্যে একমাত্র বিষ্ণুপুরের জনাব আলী আকবার নামের এক যুবক জীবন্ত ফিরে আসতে সক্ষম হয়েছেন।

বিএসএস-এর প্রতিনিধির নিকট তিনি জল্লাদ বাহিনীর নির্মম অত্যাচারের কাহিনী বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, এপ্রিল মাসের ৮ তারিখে তাদের বাড়ী ঘেরাও করে তল্লাসী চালানো হয় এবং ২৩ বৎসর বয়স্ক বাসেতকে হত্যা করা হয় তার বাড়ী লুট করে সমস্ত কিছু সার্কিট হাউজে নিয়ে যায় এবং তাকেও ধরে নিয়ে যায়। সার্কিট হাউজে আরো ১২ জনকে ঐ সময় ধরে আনা হয় এবং সারারাত ধরে তাদের আটক রাখা হয়। পরদিন সকালে চোখ এবং হাত বেঁধে ট্রাকে করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়।

একটি গুদাম ঘরে তাদের নিয়ে আসা ও চোখ খুলে দেওয়া হয়। সেখানে তিনি বহু হতভাগ্যকে পা বাঁধা হাত বাঁধা অবস্থায় মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখতে পান। ঐ সব হতভাগ্যদের মধ্যে শহরের নামকরা আইনজীবী শ্রী যতীন্দ্র ভদ্রকে তিনি দেখতে পান। তাঁর গায়ে যথেষ্ট ক্ষত চিহ্নও তিনি দেখেছিলেন।

২) #রাজশাহী_বিস্ববিদ্যালয়ঃ সুদীর্ঘ নয় মাস পাক বাহিনীর অত্যাচারের জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩ জন শিক্ষকসহ ১৮ জন পার্সোনেলের কর্মচারী হত্যা। পাক বাহিনীর হাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব জিনিসপত্র নষ্ট হয়েছে তার মূল্যের পরিমাণ প্রায় ২২ লাখ ৬৪ হাজার টাকা।

বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার বিশেষ প্রতিনিধিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিষ্ট্রার জানান যে পাক বাহিনী কতৃক ধ্বংসকৃত জিনিসপত্রের মূল্যের পরিমাণ যথাযত নিরুপণ করতে একটি কমিটি নিয়োগ করা হয়েছে। গত এপ্রিল মাসের তৃতীয় সপ্তাহে পাক বাহিনী বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে প্রবেশ করে বিভিন্ন হল এবং স্টাফ কোয়ার্টারে ক্যাম্প স্থাপন করে। প্রথমেই বর্বর বাহিনী শহীদ মিনারটি ধ্বংস করে দেয়।

পরে জোহা হলসহ অন্যান্য অনেক হল সম্পূর্ণ ধ্বংস করে ফেলে। সকল হল স্টাফ কোয়ার্টার ও অন্যান্য কর্মচারীর বাসা এমনকি লাইব্রেরী ও লেবরেটরী পর্যন্ত হানাদার বাহিনী লুটপাট করে। সংবাদ দাতা পরিসংখ্যান বিভাগের প্রধান ডঃ হোসেন, অর্থনীতি বিভাগের প্রধান ডঃ মোশারফ হোসেন, বাংলা বিভাগের রীডার ডঃ আবু হেনা মোস্তফা কামাল এবং অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মচারীর সাক্ষাৎ গ্রহণ করেন এবং হানাদার বাহিনীর নানা প্রকার চাঞ্চল্যকর কাহিনী শোনেন।

এপ্রিল মাসে ১৪, ১৫ তারিখে যথাক্রমে অংক বিভাগের এসোসিয়েট প্রফেসর জনাব হাবিবুর রহমান, বাংলা বিভাগের এসোসিয়েট প্রফেসর শ্রী সুখরঞ্জন সমাদ্দার এবং মনস্তত্ত্ব বিভাগের ডেমনেসট্রেটর জনাব মীর আব্দুল কাইয়ুমকে বাসভবন থেকে ধরে নিয়ে হত্যা করা হয়। বর্বররা কী ধরণের নিষ্ঠুর ছিল তার এক নজীর পাওয়া যায় একজন অধ্যাপককে হত্যা করার পর তার মেয়েকে একজন মিলিটারি অফিসারের সাথে বাস করতে বাধ্য করার দৃষ্টান্ত থেকে।

বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায় যে, প্রাক্তন উপচার্য জনাব সাজ্জাদ হোসেনই ৩০ জন অধ্যাপক এবং অন্য দু’জন অফিসারকে হত্যার একটি তালিকা প্রস্তুত করেছিলেন। একে ৪ টি ভাগে ভাগ করা হয়েছিল। প্রথম শাস্তি মৃত্যুদন্ড, দ্বিতীয় কারাবরণ, তৃতীয় পদ হতে অপসারণ, চতুর্থ বেত্রাঘাত। তাছাড়া আরো জানা গেছে যে, ৪ জন অধ্যাপক ট্রাক ভর্তি করে মালপত্র নিয়ে ২৮শে এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে যায়। কিন্তু তারা আর ফিরে আসে নি। তারা পশ্চিম পাকিস্তানে চলে গেছে বলে অনুমান করা হচ্ছে। আবুল বাশার নামের এক পিয়ন সাংবাদদাতাকে জানায় যে, কেবলমাত্র জোহা হলের নিকটেই ৩ হাজার লোককে সমাধিস্থ করা হয়েছে।“

ওমর ফারুক তুষার
<৮,৩১,৪০৯-১০>
[নাটোরের ছাতনীতে পাক বাহিনীর বর্বরতা]

পাকিস্তানিরা নির্মমভাবে মনি সরকারের গায়ের চামড়া উঠিয়ে হত্যা করেছে!

-পূর্বদেশ তারিখঃ ৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২।
“হাজার মাইলের এক ছাতনী। বংগবন্ধুর আহবানে সমগ্র বাংলার মানুষ যেমন সাড়া দিয়েছিলো তেমনি ছাতনীর মানুষ ও সমস্বরে শ্লোগান দিয়েছিল : শোষকের মুখে লাথি মারো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো। আর এটাতেই সমগ্র বাংলার ধ্বংস এর মত ছাতনীর ধ্বংস ও অনিবার্য হয়ে পড়ে।

আমাকে তোমরা খুন করো,তার বিনিময়ে আমার গ্রামের মানুষকে বাঁচাও, তোমাদের খোদার কসম, তোমরা আমার মানুষদের মেরোনা। মৃত্যুমুখো যাত্রী ভাবশী গ্রামের মনি সরকার আর্তি করেছিলেন হানাদার পাক বাহিনীর সৈন্যদের নিকট।হানাদার বাহিনী তাকে হত্যা করেছে।নির্মম ভাবে গায়ের চামড়া উঠিয়ে হত্যা করেছে।ছাতনীর হত্যাকান্ডের প্রত্যক্ষদর্শী যুবক আবুল কালাম কান্নাজড়িত কন্ঠে শোনাচ্ছিলেন এই মর্মান্তদ কাহিনী।আবুল কালাম বললেন স্বাধীনতা সংগ্রামের দু’ মাস পর্যন্ত আমরা এদিক সেদিক পালিয়ে ভালোই ছিলাম। হিন্দুদের আমরা পাহারা দিয়ে রাখতাম, কিন্তু এর মধ্যেও আমাদের অনেকবার লাঠিসোটা নিয়ে প্রস্তুত থাকতে হতো,কখন হয়ত নরপিশাচ অবাঙালী জল্লাদের দল গ্রামে ঢুকে পড়ে। তাদের তিনবার যুদ্ধ করতে এগিয়ে আসতে হয়।বিংশ শতকে হালাকুর বংশধররা তিনদিন পর সশস্ত্র ভাবে ছাতনী গ্রামকে আক্রমন করতে আসে।গ্রামের মানুষ একত্রে খোদার ন্ম নিয়ে লাঠিসোটা নিয়ে দলে দলে তাদের তাড়া করে,হানাদার বাহিনী বিভ্রান্ত হয়েছে ঘটনা দেখে।তারা পিছু হঠেছে।

কিন্তু অবাঙালী পাকিস্তানি আসামরিক নাগরিকদের দ্বিতীয় পিতা, ধর্মের কুলাঙ্গার জল্লাদ হাফেজ আব্দুর রহমান এই পরাজয়কে অপমান মনে করলো। তাই প্রতিশোধ নেবার ইচ্ছা প্রবল হলো তার।খুনের নেশাখোর এই জল্লাদ তাই পথ খুঁজতে চেষ্টা করেছে সর্বক্ষন।আবার হেটেছে সেই পথে। বনবেলা ঘুরিয়ার মসজিদ থেকে টেনে বের করলো ১০৫ বছর বয়সী আওয়ামী লীগ সমর্থক বৃদ্ধ সৈয়দ আলী মুন্সিকে।ঘটনা ঘটলো ১৫ই জ্যেষ্ঠ। সৈয়দ আলী মুন্সীর লাশ দেখলো ছাতনীর মানুষ। ওরা কাঁদলো।

এর পরের ঘটনা সুপরিকল্পিত।ছাতনীর বর্তমানে সচেয়ে বয়োবৃদ্ধ ৮২ বছরের নলিনীকান্ত বললেন, অরা রাত্রে ছাতনী দীঘির পাড়ে জমা হয়। রাত তখন প্রায় দুটো। সকাল ৫টার দিকে গাঁ ঘিরে নেয়। ঘরে ঘরে ঢুকে সবাইকে বের করে হাত পেছনে বেধে নিয়ে যাচ্ছিল। বৃদ্ধের একমাত্র ছেলেকেও তারা হত্যা করেছে। শিশুকেও হত্যা করতে ছাড়েনি।বৃদ্ধ বলছিলেন ডাক্তার মনিরুদ্দিনের তিনটি বিবাহিত যুবক ভাইকে অরা হত্যা করলো।রুদ্ধ কন্ঠে বৃদ্ধ নলিনীকান্ত বললেন, পিশাচরা মেয়েদের উপর অত্যাচার করলো। লাখ লাখ অভিযোগ বর্বরদের এই রুপ কাজের। এই গ্রামের আরেক যুবক আবুল কাশেম। অনেক বুদ্ধি খাটিয়ে বেঁচেছে সে। বলল: যখন আমি বুকে ছুটে জমির আইলের পাশ দিয়ে হানাদারদের চোখের বাইরে যাচ্ছিলাম, তখন কয়েকজন যুবতীকে বিবস্ত্র অবস্থায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকতে দেখেছি। আবার দেখলাম একটি বৃদ্ধ এবং কজন লোক পিছনে হাত বাধা মরে পড়ে আছে। ওরা সংখ্যায় ছিলো কমপক্ষে ২৫০ জনের মতো। ৫০ জনের মত পাক বাহিনীর সৈন্য।অবশিষ্টরা ছোরা হাতে অবাঙালী তারা ছাতনীর সমস্ত কিছু লুট করেছে। ঘরে ঘরে তন্ন তন্ন করে পুরুষদের হত্যা করেছে।আবুল কালাম আমাকে বলেন, গ্রামের যে এলাকার বেশি লোক হত্যা, নারী নির্যাতন হয়েছে সেদিকেরই এক ধানের জমিতে পানির মধ্যে নিজেকে আড়াল করে সবকিছু দেখছেন তিনি। সৈন্যরা এসেছিলো রাইফেল হাতে নিজেদের পোষাকে। অবাঙালীরা সাদা পাজামা, পাঞ্জাবী পরনে, হাতে ছোরা, মুখে কালো মুখোশ ছিলো হাফেজ জল্লাদের।তার অল্প কিছু দূরেই এক মহিলার কোলের শিশুকে ফেলে হানাদার বাহিনীর সৈন্য জমির ওপরে মহিলাকে অত্যাচার করলো। মহিলার শাশুড়ি শিশুটিকে ওলে নিয়ে সরে গেলো। একটু পর গুলির আঘাত এ শিশুটি নিস্তব্দ হয়ে গেলো।গুলির শব্দ, শুধু গুলির শব্দ।সকাল পাঁচটা থেকে নটা। অত্যাচার হত্যার পাশাপাশি পাশবিকতার তাণ্ডবলীলা চললো।হাহাকার, আর্তচিতকার। গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিলো আরো অন্য গ্রামের আত্মরক্ষা প্রয়াসী বহু পরিবার।সব একাকার হলো, ছাতনীর মাঠ,, খালের সংগে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ালো ৪৪১ জন শিশু, যুবক, বৃদ্ধ, মধ্য বয়সী।শুধু পুরুষ দের বেছে বেছে হাত পিছনে বেধে গুলি করেছে বর্বররা।এখানেই শতাব্দীর অভিশাপ মুসলিম কলংক পাকিস্তানি বর্বর শাসক নাটোরের ছাতনীকে লক্ষ মাইলাই এ পরিণত করে গেছে।“

ওমর ফারুক তুষার

<৮,৩২,৪১১-১২>
[খান সেনারা ওকে বাঘের খাঁচায় ঢুকিয়েছিল]

-দৈনিক বাংলা, ৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২।

“বলিষ্ট দেহের অধিকারী জনাব সিরাজুদ্দৌলা ঠাকুরগাঁ শহরেরই অধিবাসী। দিনটি ছিল ২২শে জুলাই। বিকাল ৪টা। দোকানে বসেছিলেন সিরাজুদ্দৌলা। এমন সময় ৭/৮ জন খান সেনা এসে তাকে ধরে ফেলল। তিনি কথা বলার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু খান সেনারা তার কোন কথাই শুনলো না। ওরা ওকে জুতা পরতেও দেয়নি।তখনই শুরু হলো মার।

ঘুষি, কিল, চড়, থাপ্পড়। এক নাগাড়ে, বিরামহীন। ওদের একজন তার হাত দু’টো বেঁধে ফেলল। মার খেতে খেতে তিনি ধরাশায়ী হয়ে গেলেন। কে কত মারতে পারে তার প্রতিযোগিতা শুরু হলো। চলতে থাকলো সরু পায়ের লাথি। আর মুখখিস্তি। ওদের ক্যাম্পে যাওয়ার আগে চেকপোস্ট। পশুদের সেকি উল্লাস। মুখ ব্যাদান করা হাসি।

একে অপরকে বলছে, “বহুত উদমা শিকার মিল গিয়া”। সাথে সাথে পরম সুখে মারধোর চলতেই থাকলো। ওদের পায়ে পায়ে ফুটবলের মত গড়াতে গড়াতে ক্যাম্পে গিয়ে পৌঁছলাম। ক্যাম্পে আরো বিরাট চেহারার গাট্টা গোট্টা খান সেনা এগিয়ে এলো তখনো জ্ঞান হারাইনি। মনে হলো এদের মার আমি হজম করতে পারবো না। আজ আমার এখানেই শেষ।

কেন জানি, ওরা মারলো না। ঘরের বারান্দায় শুন্য পাটাতনের উপর আমাকে বসতে বললো। সাহস সঞ্চয় করে বললাম, আমি একজন মেডিকেল ছাত্র, শিক্ষিত মানুষ। চেয়ার দাও। যেন ভূত দেখেছে। এমনি দৃষ্টিতে তাকিয়ে অট্টোহাসিতে ফেটে পড়লো পশুর দল। বলল, চেয়ার? বাঙ্গালী যে অধিকার হারিয়েছে। খুঁটির সাথে আমার হাত বেঁধে ফেলা হলো।

তখন আসরের নামাজের সময় হয়েছে। তিনি অজুর পানি চাইলেন। এনে দিল, বাঁধা হাত ছাড়িয়েও দিল।

নামাজের আধঘন্টা খানেক পর থেকে শুরু হলো ওদের জিজ্ঞাসাবাদ। আমি নাকি অনেক অবাঙ্গালী হত্যা করেছি, আমি একজন সামরিক অফিসার। আমি ছেলেদের রাইফেল ট্রেনিং দিয়েছি ইত্যাদি। ওরা আমাকে খুবই পীড়াপীড়ি করতে থাকে আমি যেন সবকিছু স্বীকার করি। এরপর মনে হলো, সিকিউরিটির কিছু অফিসার এলো। তারাও একই ধরণের প্রশ্ন করতে থাকে। আমি সবকিছুই অস্বীকার করি। এবার ভয় দেখালো ওরা আমাকে মেরে ফেলবে।

এরপর ওরা কোত্থেকে একটা বানর জোগাড় করে আনলো। ওরা বানরটা আমার উপর ছেড়ে দিল। চলল বানরের অত্যাচার। কামড়, আঁচর, থাপ্পড়। একসময় বানরও শ্রান্ত হয়ে গেল। সন্ধ্যা নেমে এলো। এরপর ওরা আমাকে বাঘের খাঁচায় ঢুকিয়ে দিল। কী মর্জি হলো। ওরা আমাকে খাঁচা থেকে বের করে নিয়ে এলো।

সেই মুহুর্তে মনের অবস্থা আমি ভাষায় বোঝাতে পারবো না। নিশ্চিত বুঝতে পারছি, আমি মরছি। দেশের স্বাধীনতার জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি। খাঁচা থেকে বের করে নিয়ে এসে ওরা আমাকে পাশেই একটি কক্ষে ঢুকিয়ে দিল। খাঁচা আর কক্ষটার মাঝে শুধু একটি রেলিং। সেখান থেকে খাঁচার মধ্যে শুকিয়ে থাকা রক্তের দাগ দেখতে পাচ্ছিলাম। আচমকা বাঘটা রেলিং টপকে এসে আমাকে আক্রমণ করে বসল।

ডান হাত, ডান উরু ও ডান দিকের পিঠে তার তীক্ষ্ণ নখর বসিয়ে দিল। আবার তার স্থানে ফিরে গেল। রাত ৮ টার দিকে আমাকে সে ঘর থেকে ওরা বের করে আনলো। ভাবলাম এবার হয়ত মেরে ফেলবে। না মারলো না। নিজের হাতও দেখতে পাচ্ছিনা এমন একটি অন্ধকার ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে একজন সিপাহী বলল, দেখ বিছানা আছে-শুয়ে পড়। হাত দিয়ে যা পেলাম তা হলো একটি চটের ছালা আর ইলেক্ট্রিক হিটার। হাত দু’টো জানালার সাথে বাঁধাই রইল।

সকালে ওরা আমাকে মেজর রাজার কাছে নিয়ে গেল। সেখানে আমার বাবাকেও দেখলাম। অদ্ভুত সব প্রশ্ন মেজর রাজার। কোন জেলায় বাড়ীর সংখ্যা বেশি? বললাম, জানিনা।

ঠাকুরগাঁয়ে কত মেয়ে আছে? বললাম, আপনি বলুন।

মেজরের জবাব ঠাকুরগাঁয়ে মেয়ে বেশ, কেননা তার মতে বাঙ্গালী মেয়েরাই নাকি সেখানে অবাঙ্গালীদের মেরে ফেলেছে। এরপর কর্ণেলের কাছে আমাকে পাঠানো হলো। অনেক সদুপদেশ দিয়ে কর্ণেল আমাকে ছেড়ে দিল।

এরপর আরও একবার মেজর তাকে তলব করেছিল।“

ওমর ফারুক তুষার
<৮,৩৩,৪১৩-১৪> বাঙালিদের আধমরা করে সারা গায়ে গুড় লাগিয়ে পিঁপড়ের ঢিবিতে ফেলে রাখতো পাকিস্তানিরা!!

[হাজার প্রাণের হত্যাপুরী লাকসাম সিগারেট ফ্যাক্টরি]

-এম, এ খয়ের মিয়া, পূর্বদেশ, তারিখঃ ৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২

“লাকসাম জংশন এ দাঁড়িয়ে দক্ষিণ -পশ্চিম দিকে দৃষ্টি মেলে ধরলে দেয়াল ঘেরা সুবিশাল এলাকাজুড়ে কালো রং মাখা যে দ্বিতল প্রাসাদটি দেখা যায়, সেটি একটি সিগারেট ফ্যাক্টরি। কিন্তু তার নাম যাই থাকুক না কেনো, লাকসাম বাসীরা এটাকে হত্যাপুরী বলেই জানে। বিগত নয়টি মাসে এই ফ্যাক্টরিরর বিভিন্ন কোণায়,বিভিন্ন কক্ষে ও কোঠায় বিভিন্ন সেলে এবং ছাদে যে অত্যাচার, নারী ধর্ষণ এবং নির্বিচারে গণহত্যা চলেছিলো তার নজির পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। দিনে রাতে যখন তখন লাকসাম থানার বিভিন্ন গ্রামগঞ্জে হানা দিয়ে গ্রাম বাংলার নিরীহ নারী – পুরুষদদের ধরে এনে এবং লাকসাম জংশন এ অপেক্ষমান ট্রেন থেকে যুবক, যুবতী ও যাত্রীদের ছিনিয়ে এনে এই হত্যাপুরীতে এই হত্যাপুরীতে বর্বর খান সেনারা বিনষ্ট করেছে অগণিত মা, বোনের ইজ্জত, বধ করেছে হাজার হাজার প্রাণ।

ট্রেন থেকে মহিলা যাত্রী আর গ্রাম থেকে পল্লীবালা ও কূলবধূদেরকে ছিনিয়ে এনে ওদের উলঙ্গ করে কারখানার ছাদের উপর উঠিয়ে দুই হাত উপরে তুলে সারাদিন ভর রেলিং বিহীন ছাদের উপর হাটতে বাধ্য করা হতো। কারখানার অনতিদূরে যাত্রীবাহী ট্রেন থামিয়ে যাত্রীদের অই ছাদের উপর দৃষ্টিপাত করতে নির্দেশ দেয়া হতো। এমনিভাবে সারা দিনভর ধৃত মা – বোনদের বেইজ্জতি করে, রাতে কারখানের বিভিন্ন কোঠায় নিয়ে মেজর গার্দিজি ও তার দোসররা মা বোনদের উপর চালাত পাশবিক অত্যাচার। নিজেরা তো মদ পান করতো, নারীদেরও মদপানে বাধ্য করা হতো। চাবুকে আর চাবুকে এবং পাশবিক অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে রাত্রির গভীরতা ভেংগে প্রায়ই ভেসে আসতো মা -বোন্দের বুকফাটা করুণ আর্তনাদ।কিন্তু মদ্যপায়ী নর-পশুদের অট্টহাসিতে সবকিছু চাপা পড়ে যেত। অনেক অনেক মা-বোনকে বলাতকার স্থলেই মৃত্যুবরন করতে হয়েছে। আর যারা নামে মাত্র বেচে থাকত তাদের সংজ্ঞাহীন দেহ রাতের আধারে সে কারখানার বিভিন্ন কোণায় পুতে ফেলা হতো।

বিগত ১লা ফেব্রুয়ারি সে কারখানার প্রহরারত মিত্রবাহিনীর অনুমতি নিয়ে লাকসামের এম, সি এ জনাব আব্দুল আউয়াল ও থানার সেকেন্ড অফিসার এবং জনাকয়েক ভুক্তভোগী ও প্রত্যক্ষদর্শী সহকারে কারখানাটি দেখতে গিয়েছিলাম। পশ্চিম কারখানাটিতে ঢুকতেই ভেসে এলো পচা গন্ধ। হয়তো রক্ত পচা গন্ধই হবে, এ কারখানার যেখানেই যে কক্ষে ঘুরেছি সর্বত্রই অনুভব করতে পেরেছি রক্তের চাপ সে রক্তে র্দূগন্ধের আবাস। ভিতরে ঢুক্তেই সামনে দেখতে পেলাম দুটি জীবন্ত পেয়ারা গাছ ও সদ্য মৃত একটি কাঁঠাল গাছ। গাছ তিনটির প্রত্যেকের ডালে দেখলাম এখনো ঝুলে রয়েছে হত্যার প্রতীক কয়েকটি রশি। জনৈক প্রত্যক্ষদর্শী জানালেন এ গাছ তিনটি তে যে সমস্ত রশি এখনো ঝুলে রয়েছে সে সমস্ত রশিতে অসংখ্য নারী -পুরুষকে ঝুলিয়ে রেখে চাবুকের প্রহারে নিস্তেজ করা হতো। তারপর সে সমস্ত সংজ্ঞাহীন দেহ গুড় মেখে একটি চিলেকোঠায় ফেলে রাখা হতো। বলা বাহুল্য, সেই চিলেকোঠায় পূর্বাহ্নেই লুট করা খেজুরের গুড় বা মিষ্টি দ্রব্য ছিটিয়ে অজস্র পিপড়া জড়ো করে রাখা হতো। তারপর সেই পিপড়ার ভিড়ে সংজ্ঞাহীন দেহকে ফেলে রাখা হতো।

সারারাত বিষাক্ত পিপড়ার তীব্র দংশনে অনেককেই সেই চিলেকোঠায় নির্মমভাবে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। এমনিভাবে প্রাথমিক নির্যাতন শেষে অনেককে চোখ বেধে লাইনে দাড় করানো হত, তারপর গর্জে উঠতো হিংস্র হায়েনাদের অস্ত্র, নিমিষেই ভুলুন্ঠিত হত অগণিত প্রান। আর একটু এগিয়ে গেলাম, দেখলাম একটি পুকুর। পুকুরের পশ্চিমপাড়ে দুটি আমগাছ, এ আম গাছেও দেখলাম কয়েকটি রশি ঝুলছে আর গাছের নীচে দেখলাম আগাছায় ভরা এক ফালি জমি।

জনৈক প্রত্যক্ষদর্শী জানালেন অই সব পেয়ারা, কাঁঠাল গাছের নিচে, এই আম গাছের নিচে আর অই আগাছায় ভরা জমিটুকু খুড়লেই বের হয়ে পড়বে অসংখ্য ভাই -বোনের নরকংকাল।

আর এক প্রত্যক্ষদর্শী পুকুরের পূর্ব পাশে একটি ভরাট গর্তের চিহ্ন দেখিয়ে জানালেন যে একটি জীবন্ত লোককে হাত পা বেধে এই গর্তে ফেলে দিয়ে মাটিচাপা দিতে তিনি দেখছেন। তাছাড়া এম, সি, এ আউয়াল সাহেবও এই খবরটি বহু লোকের মুখে শুনেছেনবলে জানিয়েছেন। তারপর ঢুকলাম কারখানার ভিতরে
সংগী সেকেন্ড অফিসার সাহেব পূর্বেই শুনেছিলেন যে ইলেক্টিক হিট দিয়ে নাকি এখানে লোক মারা হতো। তাঁর নেতৃত্বে আমরা সে রুমটি খুজে পেলাম। দেখলাম একটা সুইচ বোর্ড, আর অসংখ্য বৈদ্যুতিক তার। সে ঘরটির পাশেই দেখলাম যে বেশ কিছু সামরিক ও বেসামরিক লোকের পোষাক। এখানে সামরিক ও বেসামরিক লোকদের উলঙ্গ করে ইলেক্টিক হিট দিয়ে মারা হতো।

সারাটা কারখানা ঘুরে দেখলাম। সর্বত্রই দেখা যায় ইতস্তত বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে অনেক কাগজ পত্র। খান সেনাদের চিঠি ও পারিবারিক ফটো।

লাকসাম রেলওয়ে হাসপাতালের মালী মনিন্দ্র চন্দ্র, উপেন্দ্র চন্দ্র ও শ্রী রাম চন্দ্রমালীকে বিগত কয়েকমাস ধরে এ কারখানার খান সেনাদের কাজ করতে হয়েছে বলে অনেক ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হয়ে তারা আমাকে জানিয়েছেন, এখানে অনুষ্ঠিত অত্যাচার ও হত্যাযজ্ঞ দেখে সে ভীত হত হয়ে অনেক আগেই পালাতে চেয়েছিলো, কিন্তু সুযোগ মেলেনি। মনিন্দ্র চন্দ্র আরো জানিয়েছেন যে, প্রায় রাতেই দলে দলে লোকদের চোখ বেধে জংশনের দক্ষিনের বড় হাই লাইটটির পূর্বদিকে বেলতলায় নিয়ে গিয়ে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করা হতো। যাদের হাতে দিনের বেলা গর্ত করা হতো রাত্রির বেলায় তাদেরকেই সেই গর্তে মাটি চাপা দেওয়া হতো।

মনীন্দ্র চন্দ্রের ও তার সংগীদের নির্দেশিত গর্তগুলি খুঁড়লে আজো অসংখ্য প্রমান মিলবে বলে তারা জোর দাবি জানান। লাকসাম এর প্রখ্যাত ডাক্তার জনাব মকবুল আহমেদ,মিল মালিক জনাব আব্দুর রহিম ও আব্দুল মতিন এক সাক্ষাৎকারে জনালেন যে পাক সেনাদের কুখ্যাত মেজর মুজাফফর গর্দিজি, ক্যাপ্টেন ওবায়দুর রহমান, সুবেদার মুস্তফা খান ও রেলওয়ে পুলিশ বাকাওয়ালীর নেতৃতে এবং স্থানীয় কতিপয় দালালদের যোগসাজশে লাকসামে সহস্রাধিক লোকের প্রান নাশ ঘটে।

লাকসাম থানার প্রখ্যাত আওয়ামীলীগ কর্মী ২৪নং আর্দা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জনাব আলী আশরাফ এবং লাকসামের বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালেক ও খসরুকে এই হত্যা পুরীতে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়।”

<৮,৩৪,৪১৫-১৬>
[চাঁদপুরে ৮ মাসের বিভীষিকা]

জ্যান্ত মানুষগুলোকে হাত-পা বেঁধে গায়ে সিগারেটের আগুন
দেওয়া হতো—কখনোবা নদীতে ফেলা হতো—
চোখ তুলে নেয়া হতো—দাঁত ভেঙ্গে ফেলা হতো—

-দৈনিক বাংলা, ৭ ফেব্রুয়ারী, ১৯৭২

“চাঁদপুরবাসী দীর্ঘ আট মাসের সেই বিভীষিকাময় দিনগুলোর কথা আজও ভুলতে পারেনি নরঘাতক পিশাচ পাঞ্জাবী মেজর তৈমুর ও তার দোসর সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের শওকতের অত্যাচারের কথা। তাদের বীভৎস নারকীয় তান্ডবে বহু মা সন্তানকে হারিয়েছে। বিধবা হয়েছে বহু নারী, ধর্ষিতা হয়েছে কয়েক’শ অবলা।

কচি খুকীটিও এদের বিলাস লালসার কামনা থেকে বাঁচতে পারেনি। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। মুক্তিবাহিনী, ভারতীয় দালাল ইত্যাদি আখ্যায়িত করে প্রায় পাঁচ হাজার লোকের প্রাণ নিয়েছে। মানুষকে এরা পিটিয়ে মারত। ইট ও পাথর ছুড়ে হত্যা করত।

হাত-পা বেঁধে জ্যান্ত মানুষগুলোকে নদীতে ছুড়ে ফেলত। চোখ উঠিয়ে নিত। দাঁত ভেঙ্গে দিত। মাথা নিচু করে পা বেঁধে ঝুলিয়ে রাখত। নরপশু এই মেজর শওকত মানুষ হত্যার সময় উল্লাসে মেতে উঠত। হত্যাটি ছিল তার কাছে আনন্দদায়ক। এই ঘৃণ্য চরিত্রহীন শয়তানের একান্ত প্রিয় ছিল নারী ও সুরা। নারীদের দেখলে সে পাগলা কুকুরের ন্যায় ঝাঁপিয়ে পড়ত। সে মুক্তিবাহিনীর সহায়ক ও আওয়ামীলীগের সমর্থক বলে নিরীহ লোকদের মৃত্যুর ভয় দেখিয়ে বহু টাকা আদায় করে।

এছাড়া অগ্নিদগ্ধ দোকানপাট ও ঘরবাড়ীগুলো জঙ্গী শাহীর মেজর মাসুদের কীর্তির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। সেই হলো লুটেরাদের নায়ক। তার নির্দেশেই লুন্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশের প্রখ্যাত বাণিজ্যকেন্দ্র পুরান রাজাদের লক্ষ লক্ষ টাকার সম্পদ। ৭১- এর ৭ই এপ্রিল থেকে শুরু হয় চাঁদপুরে জল্লাদ বাহিনীর নরমেধযজ্ঞ।

সেদিন সকাল ৯টা ৪৫ মিনিটে দুইটি রঙের স্যাবর জেট চাঁদপুরবাসীকে আতংকিত করে তোলে। শুরু হয় একটানা ৪০ মিনিট গুলিবর্ষণ। নিমিষের মধ্যে আকাশ ছেয়ে যায় ধোঁয়ায়। চারদিকে ধ্বনিত হয় হতভাগ্যের আর্তচিৎকার। হতাহত হয় প্রায় ৫০০ লোক। আর তারই সাথে ছুটে চলে নিরীহ মানুষের কাফেলা গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে।

এরপরদিন সন্ধ্যায় মেজর ইফতেখারের নেতৃত্বে ৫০০ সৈন্য ও অস্ত্র বোঝাই ৭৮টি ছোট বড় সামরিক অসামরিক যান চাঁদপুরে প্রবেশ করে। কুমিল্লা থেকে চাঁদপুরে আসার পথে রাস্তার দু’ধারে তারা নির্বিবাদে গুলি চালায়। চাঁদপুরে এসে টেকনিক্যাল স্কুলে আস্তানা গাড়ে। আসার অব্যহতির পর এক বৃদ্ধা গরু নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে গরুটি ছিনিয়ে রাখে এবং বৃদ্ধাকে গুলি করে হত্যা করে। এদিকে স্বাধীনতা সংগ্রামীরা তাদের আস্তানা ঘিরে ফেলে গুলি ছুড়তে থাকে।

তখন দখলদার বাহিনী মর্টার ও কামান থেকে গোলাবর্ষণ শুরু করে। রাত্রি প্রভাতেই তারা বেড়িয়ে পড়ে রাস্তায়। পুড়িয়ে দেয় পার্শ্বস্থ গ্রামের কুড়ি-পঁচিশটি বাড়ি। এরপরই ছুটে যায় শহরের অভ্যন্তরে। কয়েকঘন্টা টহল দিয়ে এরা শহরের বিভিন্ন রাস্তায় কাউকে বেয়নেট কাউকে গুলি করে মারে। সেদিন চাঁদপুর কলেজের জনৈক ছাত্রসহ ৫ জনকে খুন করে।

১০ই এপ্রিল থেকে শুরু হয় এদের কারফিউ এর পালা। কারফিউ-এর সঠিক সময়সীমা এরা জনসাধারণের কাছ থেকে গোপন রাখত। আর এ সুযোগে তাদের স্বয়ংক্রিয় রাইফেলগুলো সক্রিয় হয়ে নিধনযজ্ঞে মেতে উঠত। সেদিনই কারা ডিনামাইট দিয়ে শহরের কয়েকটি এলাকার ঘর উড়িয়ে দেয়।

শুধু তারাই নয়- কুখ্যাত আল বদর, আল শামস, রাজাকার ও দালাল কমিটির অকথ্য নির্যাতনে অতিষ্ট হয়ে পড়ে শান্তিপ্রিয় জনসাধারণ। এরা কাউকে শান্তিতে থাকতে দেয়নি। জুলুম আর অত্যাচারই ছিল এদের প্রধান ধর্ম। এরাই অধিকাংশ সম্পদ লুন্ঠন করেছে। লুন্ঠন করেছে শহরের হিন্দু অধ্যুষিত এলাকার ঘরগুলো। দালান থেকে দরজা জানালা খুলে নিয়েছে। শুধু রেখে গেছে ভিটে মাটিটুকু।

এদের ইঙ্গিতে প্রাণ হারিয়েছে দশ হাজার নিরীহ লোক। মেঘনা তীরবর্তী চাঁদপুর রেলওয়ে ষ্টেশন এলাকা ছিল খুনিদের কসাইখানা। একবার কাউকে সেখানে নিয়ে গেলে আর কোনদিন খোঁজ পাওয়া যেত না। এ এলাকা ছিল চাঁদপুরবাসীর আতংকের স্থান। প্রয়োজনেও কেউ সেই এলাকায় যেতে সাহস পেত না।

জনৈক প্রত্যক্ষদর্শী আমাকে বলেন, ওরা নির্মমভাবে চাবুক দিয়ে পিটিয়ে ক্ষত-বিক্ষত করে সিগারেটের আগুন লাগিয়ে দিত, পরে হাত-পা বেঁধে ওয়াগনের মধ্যে দু’চারদিন আবদ্ধ করে রাখত। এরপরেও যদি প্রাণ না যেত তাহলে ফেলে দিত নদীতে। এছাড়া পানিতে দাঁড় করিয়েও গুলি করা হত। এমনি সুপরিকল্পিতভাবে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে কমপক্ষে দু’হাজার লোককে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। সেইখানে হানাদার বাহিনীর এরূপ অসংখ্য বর্বরোচিত ঘটনার নীরব সাক্ষী হয়ে রয়েছে চাঁদপুর রেলওয়ে স্টেশন।“

<৮,৩৫,৪১৭>
[রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পাক বাহিনীর হত্যা, লুট ও নির্যাতন]

-দৈনিক আজাদ, ৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২।
“গত নয় মাস ধরে বর্বর পাকিস্তানী বাহিনী বাংলাদেশে যে অবাধ হত্যালীলা চালিয়েছে সে সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন শিক্ষকসহ ১৮ জন কর্মচারী নিহত হন। ঐ সময় জিনিসপত্রের দিক দিয়ে দখলদার বাহিনী ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ২২ লক্ষ ৬৪ হাজার টাকার মত ক্ষতি করেছে।

গত শুক্রবার জনৈক সাংবাদিকদের নিকট বিবরণ দানকালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার পাক বাহিনীর হাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণের জন্য গঠিত বিশেষ কমিটির অনুসন্ধানের কতিপয় বিষয় উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, বর্বর পাকিস্তানী বাহিনী গত বছর এপ্রিল মাসের তৃতীয় সপ্তাহে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে এবং জোহা হল, আব্দুল লতিফ হল, জিন্নাহ হল, আর্টস বিল্ডিং, কেমিস্ট্রি বিল্ডিং, মিলিটারী সায়েন্স ডিপার্টমেন্ট, এক্সপেরিমেন্টাল স্কুল বিল্ডিং এবং বহু স্টাফ কোয়ার্টারে তাদের ক্যাম্প স্থাপন করে।

বর্বর হানাদার বাহিনী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে এবং জোহা হল ও অন্যান্য হলসহ কতিপয় বিল্ডিং এর গুরুতর ক্ষতি সাধন করে। তারা বিশ্ববিদ্যালয় বিল্ডিং হল এবং শিক্ষকদের কোয়ার্টার ও অন্যান্য কর্মচারীদের বাসা থেকে নানাবিধ জিনিসপত্র এবং গৃহস্থালীর মালপত্র লুট করে। এমনকি লাইব্রেরী সমূহের পুস্তকাদি এবং ল্যাবরেটরী সমূহের যন্ত্রপাতিও বাদ যায়নি।

উত্ত সাংবাদিক সংখ্যাতত্ত্ব বিভাগের প্রধান ডঃ হোসেন, অর্থনীতি বিভাগের প্রধান ও বাংলাদেশ প্লানিং কমিশনের নব নিযুক্ত সদস্য মোশারফ হোসেন, বাংলা বিভাগের রীডার ডঃ আবু হেনা মোস্তফা কামাল এবং অন্যান্য শিক্ষক ও কতিপয় কর্মচারীর সাথে সাক্ষাৎ করে পাকিস্তানী বাহিনীর বীভৎস অত্যাচারের কাহিনী সংগ্রহ করেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন শিক্ষককে রাতের আঁধারে তাঁদের বাসা থেকে পাকরাও করে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়। এঁরা হচ্ছেন ম্যাথমেটিক্সের এসোসিয়েট প্রফেসর জনাব হাবিবুর রহমান, ভাষা সাহিত্যের এসোসিয়েট প্রফেসর শ্রী সুখরঞ্জন সমাদ্দার এবং মনস্তত্ত্ব বিভাগের ডেমনেষ্ট্রেটর মীর আব্দুল কাইয়ুম। গত ১৪ই, ১৫ই এপ্রিল এবং ২৫শে নভেম্বর তারিখে তাদের বাসা থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়।

এছাড়া ১৫ জন নিন্ম পর্যায়ের কর্মচারী শেখ এমাজুদ্দীন (ষ্টেনোগ্রাফার), সাইফুল ইসলাম (ইউডি এসিস্ট্যান্ট), শফিকুর রহমান (ছুতার), কলিমুদ্দিন (ওয়ার্কস এসিস্ট্যান্ট), আবদুল আলী (ড্রাইভার), আব্দুল মজিদ, মোহাম্মদ ইউসুফ (সাইকেল পিওন), মোহাম্মদ আফজাল (গার্ড), আব্দুর রাজ্জাক (গার্ড), আব্দুল ওয়াহার (আর্দালী পিওন), কোরবান আলী (বেয়ারা), আবদুল মালেক (বেয়ারা), নুরু মিয়া (গার্ড), ওয়াজেদ আলী (পিওন) এবং মোহন লালকে তারা হত্যা করে।

তারা সংখ্যাতত্ত্ব বিভাগের লেকচারার কাজী সালেহ, ম্যাথমেটিক্সের লেকচারার জনাব মুজিবুর রহমান এবং ডঃ আবু হেনা মোস্তফা কামালের উপর বর্বরোচিত অত্যাচার করে। কাজী সালেহ আহমদ ও মুজিবুর রহমানকে বন্দী শিবিরে নিয়ে গিয়ে দীর্ঘ চার মাস ধরে তাদের উপর অকথ্য নির্যাতন চালায়। তাদের অমানুষিক অত্যাচারের ফলে জনাব মুজিবুর রহমানের পুরুষাঙ্গ দিয়ে রক্তপাত হতে থাকে। ডঃ আবু হেনা মোস্তফা কামালকে ১৪ ঘন্টা পরে ছেড়ে দেয়া হয় এবং মেরে ফেলার ভয় দেখিয়ে তাঁকে কাজ করতে বাধ্য করা হয়।

ফলিত পদার্থ বিজ্ঞানের প্রধান ডঃ রফিককেও গ্রেফতার করে বন্দী শিবিরে নিয়ে গিয়ে আটক রাখা হয়। প্রায় আট দিন ধরে তাঁর উপর অকথ্য নির্যাতনের পর তাঁকে ছেড়ে দেয়া হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন কর্মচারী জানান যে, সেনারা হাবিব ব্যাংকের বিশ্ববিদ্যালয় শাখা লুট করে এবং কুমারী মেয়েসহ বহু মহিলার উপর পাশবিক অত্যাচার করে। তিনি বলেন, একজন তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারীর পত্নী এবং ৩২ বৎসর বয়সের কন্যাকেও তারা রেহাই দেয়নি। তিনি বলেন পাক সেনারা এতই নিষ্ঠুর ছিল যে একজন অধ্যাপককে হত্যা করার পর তাঁর তরুণী মেয়েদেরকে একজন সামরিক অফিসারের গৃহে গান গাইতে বাধ্য করে।

বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় অসংখ্য কবর রয়েছে যা থেকে আরও বহু লাশ উদ্ধার করা যেতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পিওন আবুল বাশার জোহা হলের নিকট বাস করতো। তাকে কবর খনন করতে বাধ্য করা হতো। তার কাছ থেকে জানা যায় যে, জোহা হলের নিকট অন্যূনপক্ষে তিন হাজার লাশের কবর দেয়া হয়েছে। “

<৮,৩৬,৪১৯> “চোখে কাজল আর কপালে টিপ দেয়া চলবে না!! “

[নৃশংসতার আরেক স্বাক্ষর ভারতেশ্বরী হোমস]

-দৈনিক আজাদ, ৮ই ফেব্রুয়ারি ১৯৭২।

“একাত্তরের মে মাসে যখন জল্লাদ বাহিনী আক্রমণ করে তখন তাদের সাম্প্রদায়িক মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল। বাংলাদেশে গণহত্যার কাপালিক দলের অন্যতম জল্লাদ ক্যাপ্টেন আয়ুব হোমসে ঢুকেই তীব্র ঘৃণা ভরে তাচ্ছিল্যের সাথে বলেছিলো এটা হিন্দু তৈরির কারখানা।

অথচ জাত ধর্মের বর্ণের এখানে কোন প্রশ্ন নেই। জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে এখানে সবাই জ্ঞান অর্জন করতে পারে। সে বলেছিল এ কারণে যেহেতু সংখ্যালঘু তথা হিন্দুদের সম্পর্কে তারা এলার্জিক, তা ছাড়া ২৫শে মার্চ রাতে যখন তাদেরকে হত্যাযজ্ঞে পাণ্ডা কুখ্যাত টিক্কা খান বলেছিলো শেখ মুজিবের নেতৃত্বে এ দেশের সব মানুষ হিন্দু হয়ে গেছে অতএব তাদেরকে শায়েস্তা করতে হবে, মুসলমান বিবর্জিত এ সব পাকিস্তানীরা তার স্বাক্ষর রেখে গেছে বাংলাদেশের সর্বত্র।

ক্যাপ্টেন আয়ুব আরো বলেছিল, পাকিস্তান মুসলমানের জন্য, হিন্দুস্থান হিন্দুদের জন্য, বার্মা বৌদ্ধদের জন্য। পাকিস্তানে থাকতে হলে সবাইকে মুসলমান হতে হবে। এক পর্যায়ে হোমসের ছাত্রীদের সে নামাজের সুরাহ কেরাত জিজ্ঞাসা করে। স্বাভাবিকভাবেই হিন্দুরা তার জবাব দিতে পারেনি। আয়ুব তখনও রাগে থর থর করে কাঁপছিলো। তার মুখ থেকে মদের গন্ধ বেরিয়ে আসছিল। বলছিল, সবাইকে নামাজের সুরাহ কেরাত শেখাতে হবে। চোখে কাজল আর কপালে টিপ দেয়া চলবে না। আর তার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছিল হোমসের ভাইস প্রিন্সিপ্যাল মিস সালমা রহমানের উপর। আয়ুবের সাহায্যকারী স্থানীয় জামাতে ইসলামের কুখ্যাত পাণ্ডা মওলানা অদুদের জনৈক ছেলে তাকে বলেছিল, “এদেরকে শায়েস্তা করতে হবে, ইসলামকে বাঁচাতে হলে এসব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে ফেলতে হবে।“ প্রিন্সিপাল মিসেস মুৎসুদ্দীকে শাসিয়ে বলেছিল, তোমরা হিন্দু, তোমরা ভারতের চর, আওয়ামী লীগের সমর্থক।

তিনি দেখেছেন কিভাবে পাক বর্বর বাহিনী মির্জাপুরের অসহায় নিরীহ বাঙ্গালীদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে, লাইন করে মেশিনগান দিয়ে শতশত বাঙ্গালীকে হত্যা করছে। বাড়িঘর লুটপাট করেছে। পশুরা হোমসের সকলকে শাসিয়েছে। ভয় দেখিয়েছে। যাওয়ার পথে হোমসের আর হাসপাতালের ক’জন দারোয়ানকে হত্যা করে গেছে।“

<৮,৩৭,৪২০> “আপনি যদি দিনাজপুর জেলার সীমান্ত এলাকায় যান তাহলে আপনার মনে হবে আপনি আফ্রিকার সাহারার কোন এলাকায় গিয়েছেন! পার্বতীপুরে খান সেনা ও তাদের দালালেরা ইঞ্জিনের বয়লারে জ্যান্ত মানুষকে ঢুকিয়ে দিয়েছে!!”
[দিনাজপুরে হত্যা ও লুণ্ঠন]

-দৈনিক বাংলা, ৯ ফেব্রুয়ারী, ১৯৭২
“বাংলাদেশের শস্যভান্ডার ধানের দেশ দিনাজপুর । কাটারিভোগের দেশ দিনাজপুর। যার দক্ষিণ-পূর্বে পলির সমতট, উত্তর-পশ্চিমে শাল বন, কাশ ঝোপ জঙ্গল লতার লাল খিরার মাটির মালভূমি। করতোয়া, মহানন্দা, কাঞ্চন পুনর্ভবা, টাউন নদীর স্বচ্ছ সলিলে সতত অবগাহমান দিনাজপুর। কাঞ্চন পুনর্ভবার তীরে তীরে একদিন ছিল সকল অনাড়ম্বর মাটির সাঁওতালদের অধিবাস।

ঘরে ঘরে চোলাই করা ধেনো মদের নেশায় মতোয়ারা আবালবৃদ্ধবণিতার আনন্দে মুখর থাকতো এই জনপদ। খোলা মৃদঙ্গের তালে তালে ঝুমুর নৃত্যরতা বিশ্ব কর্মীর নিজ হাতে গড়া খোদাই করা কালো সাঁওতাল বালাদের পায়ের ওঠানামা। বলিষ্ঠ দেহবল্লরীর ভাঁজে ভাঁজে রেখায় রেখায় জাগতো স্পন্দন। এখন নেই। না নেই । ঘর নেই। ভিটা নেই। ধান নেই। সে মন নেই।

রংপুর থেকে সৈয়দপুর। সৈয়দপুর থেকে দিনাজপুর ৪৫ মাইল। আবার দিনাজপুর থেকে ঠাকুরগাঁ ৩৬ মাইল। সৈয়দপুর শহরের বড় বড় পাটের গদীগুলো গুদাম ঘরগুলো শূন্য, খাঁ খাঁ করছে। রেল লাইন পেরিয়ে শহরের পশ্চিম প্রান্তে কাঁচা বাড়িতো নেইই-অধিকাংশ পাকা পেস্তা ইটের বাড়ীগুলো ভূশয্যা গ্রহণ করেছে। দিনাজপুর পর্যন্ত পথের দু’ধারে শত শত বাড়ী জ্বলিয়ে দেওয়া হয়েছে। শূন্য ভিটিতে একটা-দুটো করে মানুষ ফিরে এসেছে। আরো ফিরছে। দিনাজপুর শহরের পাঁচ, ছয় মাইলের মধ্যে ধ্বংসটা আরো ব্যাপক।

নেই কিছুই নেই। মানুষের বসতি ছিল তার চিহ্ন মাত্র নেই। নেই পাখ-পাখালীর কিচির-মিচির। তারাও যেন কোথায় শরনার্থী। হিলি থেকে তেঁতুলিয়া, দু’শ মাইলের বেশী সীমান্ত এলাকার অভ্যন্তরে সাত মাইল পর্যন্ত কোন জনবসতি নেই। কমপক্ষে তিন লাখ পরিবার হয়েছে ছিন্নমূল সর্বহারা। তাদের অতীত ছিল।ওরা মাঠে মাঠে বীজ বুনতো। পাকা ধান ঘরে তুলতো। হাসতো গাইতো। পালা পার্বণে ঈদে পূজায় আনন্দ করতো। নেই নেই । কিছু মানুষ নিজ দেশে পরবাসী। বাংলাদেশের সর্ব উত্তরে প্রান্তরে এই জেলাটাই বোধ হয় খান সেনাদের জবর-দখল আমলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

দিনাজপুর জেলার ডেপুটি কমিশনার বলেন, আপনি যদি দিনাজপুর জেলার সীমান্ত এলাকায় যান তাহলে আপনার মনে হবে আপনি আফ্রিকার সাহারার কোন এলাকায় গিয়েছেন। এ জেলার পচাগড় থানা এলাকায়, অমর থানায় প্রচন্ড লড়াই হয়েছে। আর সে লড়াই ছিল বেশ দীর্ঘস্থায়ী। দিনাজপুর থেকে ঠাকুরগাঁ যেতে সড়কের ডান ধারে রয়েছে ছোট ছোট শাল গাছের বন। সারাটি পথ বরাবর বনের মাঝে মাঝে বাংকার। হত্যা আর নারী ধর্ষণ, লুণ্ঠন, আর ঘর জ্বালানী। যেখানেই যাই, সেখানেই একই কথা। সব খোয়ানো মানুষগুলোর একই বিলাপ। অভিন্ন কাহিনী। দিনাজপুর শহরে খুব কম বাড়ী আছে যা লুণ্ঠিত হয়নি। অসংখ্য ঘরবাড়ী মাটির সাথে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে।

পার্বতীপুরে খান সেনা ও তাদের দালালেরা ইঞ্জিনের বয়লারে জ্যান্ত মানুষকে ঢুকিয়ে দিয়েছে। ওরা রাতের বেলা রেষ্ট হাউসে মেয়েদের নিয়ে আসতো। চালাতো পাশবিক অত্যাচার। গ্রামের ঘরে ঘরে ঢুকে মেয়েদের বের করে নিয়ে আসতো। ইরিগেশন বিভাগের ওয়ার্কশপের পিছনে খান সেনারা বহু লোককে হত্যা করেছে। হত্যা করেছে বীরগঞ্জ থানার পুলিশের সার্কেল ইন্সপেক্টর জনাব ফজলুর রহমানকে, দেবীগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ আব্দুল কাদেরকে, পার্বতীপুর থানার থার্ড অফিসার আমিনুদ্দিনকে পঁচাগড়ের এস, আই আব্দুর রশিদকে, এস, আই মকবুল হোসেন, এবং আরো বহু পুলিশ কর্মচারীকে।

পার্বতীপুর হলদী বাড়ী পল্লী স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ডাক্তার তোজাম্মেল হোসেন বলেন,- পার্বতীপুর থেকে দিনাজপুর আসার পথে রেল সেতুর কাছে ১০ জন লোকের কংকাল পাওয়া গেছে। তার মধ্যে দুটি শিশুর। বীরগঞ্জথানার ঘোড়াবান্দা গ্রামের জনৈক প্রাইমারী স্কুল শিক্ষক বললেন, নভেম্বর মাসে তার পুত্রবধূর এক আত্নীয়ার উপর খান সেনা ও তার সহযোগীরা জোর করে ঘরে ডুকে পাশবিক অত্যাচার চালিয়েছে।ডিসেম্বর ৯ তারিখে তিনজন খান সেনা ছয়ঘাটি গ্রামের জনৈক চার সন্তানের জননীর ওপর পাশবিক ক্ষুধা চরিতার্থ করেছে।“

<৮,৩৮,৪২২-২৩>
[“ওরা ছবাইকে গুলি করে মেরেছে”]

-দৈনিক বাংলা, ১০ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২

“ঢাকা ঘোড়দৌড় ময়দানের দক্ষিন প্রান্তে কালী বাড়ীর ধ্বংসস্তুপে দাঁড়িয়ে সেদিন আমাকে শুনতে হয়েছিল তাদের কথা। লালমোহন মালী “হামি তখন পালাইয়া গেছি। অরা ছবাইকে গুলি করে মেরেছে। নন্দনের গায়ে পাঁচটি গুলি লেগেছে।“
রাম প্রসাদ- হামার পোলাভি মারা গেছে। এখন শুধু তিনটি মাইয়া আচে, সাদিবি হয়নি।
সোভা রানী মজুমদার- ছার- হামারভি ছেলে মারা গেছে।
লক্ষ্মী রাণী ঘোষ- আমার- স্বামী, আর দুটি মেয়ে মারা গেছে।
সোনিয়া- হামার ছামি, এক পোলা, দুই মাইয়া মারা গেছে। এক পোলা কোলে আছে।
পুরান দাস- হামার ছেলে মারা গেছে।
লিলিয়া হামার ছামিভি মারা গেছে দুইটা মাইয়াভি মারা গেছে।
বেচন- হামার ভগনা সুরুজ ভল্লি মারা গেছে। ও যেদিন মারা গেছে ছেদিন তার মাইয়া পার্বতীর জনম হইছে।
বৃদ্ধা- নন্দুর পোলা মারা গেছে।
সকলের কণ্ঠে- ছামীভি মারা গেছে ছাব।

আরো অনেক, অনেকের কণ্ঠে শুনছিলাম আমি সেদিন কালীবাড়ীর ধ্বংসস্তুপের উপর দাঁড়িয়ে লিলিয়া, সোনিয়া, লক্ষ্মী রাণী, পুরান দাস আর শোভা রাণীর মত আপন জনদের হারিয়ে যাওয়ার বেদনামিশ্রিত কথা।

কিন্তু আমি অপারগ। তাদের সকলের নাম আর কথা সেদিন লিখে রাখতে পারিনি। সবার তো একই কথা- কারো ছেলে, কারো স্বামী, কারো বা মেয়ে, আবার অনেকেই স্বামী, পুত্র, সবাইকে হারিয়েছে। তারা তাদের আপন জনকে হারিয়েছে নরপিশাচ পাক জল্লাদের হাতে। ২৪শে মার্চের কাল রাতে হানাদার বাহিনী ধ্বংস অভিযান ঢাকা শহরের সর্বত্র শুরু করে। তাদের তাণ্ডবলীলা থেকে প্রাচীন মন্দিরও রেহাই পায়নি। রমনায় কালীবাড়ীর মন্দিরটি হানাদাররা ২৭শে মার্চের রাতে ট্যাঙ্কের সাহায্যে ধ্বংস করে দেয়।

মন্দিরসহ পুরা কালীবাড়ী আজ রম্নার মাঠ থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এর সাথে কালীবাড়ীতে আশ্রিত মোট ৫০ জনের প্রাণনাশ করেছে জল্লাদ সেনারা। আমি সেদিন রমনার কোরবানির হাটে ছবি আনতে গিয়েছিলাম। কিন্তু হাটের ছবি আর আনতে পারিনি, এনেছি তাদের ছবি যারা হারিয়েছে তাদের আপনজনকে। তারা আজ সবাই মুক্ত আকাশের নীচে আশ্রয় নিয়েছে- তাই সেদিন আমার সাতে তাদেরই একজন লালমোহন মালীকে কথা বলতে দেখে মনে করেছিলাম- আমি হয়তো রিফিল সম্পর্কে তাদের নাম ঠিকানা লিখছি। তাই অনেক নারী পুরুষ আমাকে ঘিরে বলেছিল সাব হামার নাম লিখেন হামার স্বামী, হামার ছেলে- ইত্যাদি ইত্যাদি। রমনা কালীবাড়ীতে মোট ৭০০ নারী পুরুষের বাসস্থান ছিল। তাদের মধ্যে স্বামীজি- প্রেমানন্দগিরিসহ মোট ৫০ জনকে হত্যা করা হয়েছে। স্বামীজীর বয়স প্রায় ৭০ বছর হয়েছিল। তাকে রমনার মাঠে অন্যান্যদের সাথে লাইনে দাঁড় করিয়ে হত্যা করা হয়েছে ২৮ শে মার্চে। তার স্ত্রী এবং তিন বছরের শিশু সন্তান ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল।

পিতার মৃত্যুর দিন- পার্বতীর জন্মদিন। কালীবাড়িতে আশ্রিত ছিল সুরুজভল্লি। সুরুজভল্লি সেদিন ২৭শে মার্চের রাতে অনেকের সাথে সারিতে দাঁড়িয়েও মনে করেছিল তার স্ত্রীর প্রসব বেদনার কথা। নবজাত পার্বতীর পিতা আর নেই আছে রমনার কালীবাড়ীতে পিতার জমাট বাঁধা রক্ত।

ঝরছে অশ্রু অবিরল

কালীবাড়ীর এক বৃদ্ধা নাম প্রিয়বালা ঘোষ। বয়স ৬০ বছরের মত। দুই গণ্ড বেয়ে ঝরছিল শুধু অশ্রুর ফোঁটা। আমার কাছে আসতে পারেনি ভিড় ঠেলে। তাই অনেক পরে সবার শেষে আমি তার নিকট গিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। আপনি এমন করে কাঁদছেন কেন? উত্তরে হতবাক। কিছুই প্রথমে বলতে পারেনি।

তখন চোখের পানি যেন বাঁধ ভাঙ্গা স্রোতের মত বইছিল। বৃদ্ধার পাশেই দাঁড়িয়েছিল একটি ফুটফুটে রক্ত গোলাপের মত শিশুকে কোলে নিয়ে তার পুত্রবধু লক্ষ্মীরাণী ঘোষ।

কেউ কিছু বলছে না। আমার দ্বিতীয় প্রশ্নে ৫ বছরের শিশু মন্টুচন্দ্র ঘোষ আমাকে উত্তর দিল- আমার বাবাকে মেরে ফেলেছে সে জন্য ঠাকুর মা কানছে। আঁচলে চোখ মুছে বৃদ্ধা প্রিয়বালা তখন ছেলে বৌ আর পাঁচটি শিশু সন্তানকে দেখিয়ে আমাকে বলল, সবাইকে ভাসিয়ে আমার মানিক (ছেলে সন্তোষ ঘোষ) গুলি খেয়ে মারা গেছে। দুটি নাতনী মঞ্জু, সঞ্জুও মারা গেছে। বৃদ্ধ এর বেশী আমাকে আর কিছুই বলতে পারেনি। শিশুর মত কেঁদে উঠছিল সেদিন রমনার মাঠে দাঁড়িয়ে। পুত্রহারা জননীর কান্নায় আমিও আর কিছু জিজ্ঞেস করতে পারিনি।“

তানিয়া ইমতিয়াজ লিপি
<৮,৩৯,৪২৪-২৫>
[কে ক’টা হত্যা করলো তার ওপর নির্ভর করতো খান সেনাদেন পদোন্নতি]

-দৈনিক বাংলা, ১০ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২
“একদিকটা প্রায় ৬ ফুট সমান দেয়াল ঘেরা। খোলা ফটক। ঢুকতে এক ঝলক দমকা বাতাসে রাজ্যের ধুলো উড়িয়ে নিয়ে চোখে মুখে এসে পড়ল। না বাতাস নয় যেনো এক সাথে অনেকগুলো মাংসহীন কংকালের দীর্ঘশ্বাস। এই সে স্থান- যা এক ক্রীড়ারসিক সিভিলিয়ান বৈকালিক বিহার, শরীর চর্চা ও খেলাধুলার জন্য নির্মাণ করেছিলেন। যদিও তিনি জানতেন না যে ভবিষ্যৎ এক দিন সেখানে নরমুণ্ডের গেণ্ডুয়া খেলা হবে। হবে মানুষ মারার নৃশংস খেলা।
কোনো কংকাল? হাত- পায়ের অস্থি ? চোয়ালের হাড় ? মাথার খুলি কিংবা ঠুলি?
না কিছুই পাইনি। অত কাঁচা কাজ তারা করেনি। সব পুঁতে ফেলেছে, খুঁড়লে পাওয়া যাবে।
দশ, বিশ, তিরিশ, শ, দুশ, তিনশ?
কত জানি না।

গাইবান্ধা হেলাল পার্ক এর কথা বলছি। এস, ডিও-র অনুপস্থিতিতে তার স্থলে ভারপ্রাপ্ত অফিসার জনাব আজিজুল হোক আমার প্রশ্নের জবাবে বললেন, সেখানে কত লোকের প্রাণ হনণ করা হয়েছে তা তিনি বলতে পারবেণ না। জনাব হক বললেন একদিন মেজর ডেকেছেন। একটু দূরে পাশের রুমে বসে আছি। একজন সুবেদার মেজরের ঘরে ঢুকল। মেজর প্রমাণ করলো কিতনা। সুবেদারের জবাব তেরা। মেজর সব মিলকর আবতক কিতনা। সুবেদার, তিনশ চুরানব্বই অর্থাৎ খুব কম করে হলেও পাঁচশ’ লোককে সেখানে হত্যা করা হয়েছে। জনাব হক আরো বললেন, আলাপের ধরন- ধারন দেখে মনে হলো কে কত লোককে হত্যা করতে পারল তার উপরই নির্ভর করতো ওদের পদোন্নতি।

১৮ এপ্রিল গাইনান্ধা শহর থেকে সাইকেলে চড়ে ফিরছেন বাদিয়াখালির খোকা মিয়া। হঠাৎ সামনে তাকিয়ে দেখেন দুটো ছেলে একপাল ছাগল নিয়ে প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে। পেছনে তাকিয়েই দেখলেন দুটো জীপ। রাস্তার পার্শে একটি বাড়ীতে ঢুকে পড়লেন তিনি। শুধু কয়েকটি মুরগীর বাচ্চা ছাড়া বাড়ীতে জনমানবের কোন চিহ্ন নেই। পাটকাঠির বেড়ার শুয়ে পড়লেন। ঠিক বাড়ীর সামনেই জীপ দুখানি থামলো। খান সেনারা পেছনের দিকে হাত বাঁধা সাদা কাপড় পড়া তিনজনকে জীপ থেকে নামালো। দুজন যুবক। একজনের বয়স কত তা লক্ষ্য করেননি। ওরা যুবক দুটিকে মুখ ফিরিয়ে ওদের দিকে পিঠ ফিরিয়ে দাঁড় করালো। তারপর কোমরে লাথি মারলো। লাথির ধাক্কায় দুজনে দৌড় দিতে শুরু করলো। অমনি প্রথমজনকে গুলিকরলো। হঠাৎ একটা লাফ দিয়ে সে পড়ে গেল। আর উঠলো না। দ্বিতীয়জন যেই ফিরে তাকিয়েছে অমনি তাকে গুলি করলো। একটা আলোর পাশে সে এলিয়ে পড়লো। ততখনে ওরা চলে গেছে। দেখে শুনে বের হলাম। আমার মতই কোথাও লুকিয়ে থাকা আর একটি ছেলে বেরিয়ে এলো। আলোর আশে রক্ষিত গুলি খাওয়া যুবকের কাছে গেলাম। পানি দিলাম। ঢোক গিললে কিন্তু পরক্ষনেই গলগল করে তারা লাল রক্ত বমি করলো। তারপর সব শেষ হয়ে গেল।

খোকা মিয়া আরো বললেন জুন মাসের প্রথম দিক। কারফিউ। রাস্তার পাশে দোকান ঘর। হরদম সামরিক গাড়ি আসা যাওয়া করছে। জ্যোৎস্নাপ্লাবিত রাত। তখন হবে দুটো। ঠিক আমার ঘরের কাছে দুটো জীপ থামল। গাড়ীতে চার পাঁচটি মেয়ে। চিৎকার করছে প্রাণের ভয়ে। কিন্তু গলা দিয়ে যেনো স্বর বের হচ্ছে না। জীপ চলে গেল। ওদের ভাগ্যে কি ঘটেছে জানি না। স্বাধীনতার পর হিলাল পার্কের বিপরীতে একটি দেয়াল ঘেরা স্থানের এক কোণে একটি গর্তের মাটি তাজা দেখে খনন করা হলে তার মধ্যে থেকে অনেকগুলো মেয়ের লাশও পাওয়া যায়। এরা কোন বাবা, মায়ের স্নেহের দুলালী তা জানা যাবে না কোন দিন। লাশ দেখে সনাক্ত করা সম্ভব নয়। তাদের মুখ গাল ক্ষতবিক্ষত করে বিকৃত করে ফেলা হয়েছে, স্তন ফেলা হয়েছে কেটে।“

তানিয়া ইমতিয়াজ লিপি

<৮,৪০,৪২৬-২৯> “একজন মিলিটারি লোকটাকে ওয়াগনের পিছনে দু’পা সমান করে পায়ের সঙ্গে মাথা লাগিয়ে বসিয়ে রাখলো। তারপর একজন উঠলো তার পিঠের উপর। জোর করে ওরা জীবন্ত মানুষটার হাড়গুলো এমনি করে ভেঙ্গে দিল।“
[বগুড়ায় পাক বাহিনীর হত্যাকাণ্ডের উপর ২টি প্রতিবেদন]

-সংবাদ, ২ ও ২০ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২
“আজ থেকে প্রায় সত্তর আশি বছর আগের কথা। আমাদের গুরু এসে আস্তানা পেতেছিল বগুড়া জেলার বাগাবান কারবার একটি বটগাছের ছায়ায়। বগুড়া শহরে বলতে তখন কিছুই গড়ে ওঠেনি। একটা তিনের ঘরে থানা এবং ফুলবাড়ীর রমজান মণ্ডলের একটি কাঠের কারখানা বোধহয় ছিল। আজকের সাত-মাথা তখন ছিল গাছপালা আর জঙ্গলে ভরা। আমাদের গুরু আনন্দ গোস্বামী এবং ভেরেণ্ডা গোস্বামী এই পৃথিবী ছেড়ে অনেক পূর্বেই বিদায় নিয়েছেন কিন্তু সেদিন এক সঙ্গে চলে গেল আমার দিন ভাই। হাত বেঁধে বগুড়ার সেউজাগড়ির আনন্দ আশ্রমে সকাল বেলা বসে বসে এই সাধুবাবা সব ঘটনা বলেছিলেন।

হানাদার পাক বাহিনী বগুড়া দখল করা পরও আশ্রমে চারজন সাধু ও তিনজন মাতা ছিলেন। হানাদার বাহিনীর তিনজন সাধুকে বগুড়া রেলস্টেশনের পশ্চিম দিকে ডিগ্রি কলেজ সড়কের পার্শ্বে গুলী করে হত্যা করে। এদের ভিতর ছিলেন সুন্দর সাধু, মঙ্গল সাধু এবং স্থানীয় বাদুরতলার একজন বৃদ্ধ মুনেন্দ্রনাথ সরকার। তিনজনই ছিলেন বগুড়ার প্রাক্তন অধিবাসী। এই তিন সাধু বলতে বলতে কেঁদে ফেললেন সাধুবাবা। বগুড়া অতীত ইতিহাসকে বুকে নিয়ে এই সাধু বাবা আজও বেঁচে আছেন। বগুড়ায় এমন লোক কমই আছেন যারা এই সাধুবাবাকে চেনে না। পাক দস্যুদের জঘন্য নৃশংসতার পরও আজ সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে আছেন এই সাধুবাবা।
যুগোল কিশোর গোস্বামীকে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি বাঁচলেন কেমন করে?
হেসে তিনি বললেন- ওরা আমাকে কেন যে হত্যা করেনি তা আমি বলতে পারবো না। আমরা তিনভাই তখন খেতে বসেছিলাম। হঠাৎ সেই মুহূর্তেই বাড়ীর ভিতরে ঢুকল কয়েকজন আবাঙ্গালি। ওরা আমার ভাইদের খেতে দেয়নি। এসেই ভাইদের হাত বেঁধে ফেললো। ওদের নিয়ে যাওয়ার সময় আমি বললাম, আমাকে মারো, ওদের নিয়ে যেয়ো না। বৃদ্ধ বলেই বোধহয় আমাকে ওদের সঙ্গে নেয় নি। কিন্তু আমার ভাইয়েরা আর ফিরে আসেনি। একদিনকে ধাঙ্গড় এসে আমাকে জানালো, পাক সেনারা রাস্তার ধারের গর্তে আমার ভাইদের পুঁতে রেখেছে।
সাধুবাবাকে জিজ্ঞাসা করলাম আপনারা সবাই আগে পালালেন না কেন?
সাধুবাবা প্রত্যুত্তরে বললেন, সে অনেক কথা বাবু। প্রায় সকলেই কখন শহর ছেড়ে চলে যান। ভক্তরা এসে আমাদের অনেক অনুরোধ করেছে। কিন্তু সংঘের সাধুর মাতারা নিষেধ করেছিল। আমরা কারো অন্যায় করিনি। ওরা নিষ্ঠুর ওরা কাল, ওরা অনেক অন্যায় করেছে- কথা বলতে বলতি মিষ্টভাষী সাধুবাবার মুখ চোখ লাল হয়ে উঠেছিল। সাধুবাবা বললেন, ওরা আমাকেও ছাড়েনি। মাঝে মাঝেই পাক সেনারা আশ্রমে অন্যায়ভাবে প্রবেশ করতো। আমার সামনে বন্দুক ধরে বলতো, টাকা কাঁহা টাকা দো- ওরা আমরা পাঁচশত টাকা আগেই নিয়ে গেছে। কিন্তু তারপরেও আসতো টাকার খোঁজে। এই দেখুন আমার পিঠে রড দিয়ে অনেক মেরেছে। সবসময় ওরা আমাকে ছোরার ভয়ে কাবু রেখেছে। একদিন ওরা আমাকে মন্দিরের সামনে দাঁড় করিয়ে বললো- কুয়া কাঁহা হায়? আমি ভেবেছিলাম ওরা এবার আমাকে মেরে ফেলবে। ওরা আমাকে বললো, বুডডা তুম কালেমা পড়। এরপর হঠাৎ জানিনা ওদেরকি মনে হওয়াতে আমাকে ছেড়ে দিল। আমি বেঁচে আছি, কিন্তু ওরা আমাকে যেমন অত্যাচার করেছে,তাতে বেঁচে থাকাটাই আশ্চর্য।
জানতে চাইলাম, নয়টি মাস আপনার ও মাতাদের খাবার সংগ্রহ করলেন কোত্থেকে? তিনি বললেন অনেক কষ্ট করেছি। ভিক্ষেও করেছি। পাশের গ্রামে গিয়েছি। একটু আধটু যা পেতাম তাই খেয়ে বাঁচতাম। আমাদের দশ মণ চাল, ৮টা গরু, প্রায় হাজার টাকার বাসনপত্রাদি সব লুট করে নিয়ে গেছে ওরা। চোখের সামনে দেখতাম কিন্তু কিছুই বলতে পারিনি। মাঝে মাঝে ভক্তরা গোপনে কিছু সাহায্য দিয়ে যেত। তাই দিয়ে চালিয়ে নিয়েছি।

আশ্রমের পূর্বদিকের বাগানে দেখিয়ে সাধুবাবা বললেন- ঐ যে ওখানে একটা বদ্ধ কুপ আছে। প্রায় প্রতিদিনই করুন কান্নার আওয়াজ আমি শুনেছি। একদিন এক ছোট শিশু, বাবা, মা, বাঁচাও বাঁচাও করে চিৎকার করছিল। ঐ ছেলেটাকে জবাই করে কুপে ফেলে দেয়া হয়েছে। আমি প্রায় প্রতিদিনই এরকম চীৎকার শুনেছি। সাধুবাবার অনুরোধে আমি বদ্ধকুপে হিংস্রতার অনেক চিত্র দেখেছি। আজো এই বাগানের একটি ঘরের দেয়ালে দেয়ালে মানুষের রক্ত লেগে আছে। কুপে নরকংকাল আর মাথার খুলিগুলো এখনো দেয়া যায়। কত নিরাপরাধ, নিষ্পাপ মানুষ এখানে জল্লাদের হাতে বলি হয়েছে কে তার হিসাব দিতে পারে?

বগুড়া শহরের অতি পুরাতন এবং সবার পরিচিত সাধুর আশ্রম আজ আবার ভক্ত আর গুনগ্রাহীদের আগমন ভরে উঠেছে। কিন্তু আশ্রমের সেই পরিচিত মুখগুলো আর নেই। জিজ্ঞেস করলাম দেশ সম্বন্ধে। আপনি কি ভাবছেন? উত্তরে তিনি শুধু বললেন, ওরা খুবই বেআইনী কাজ করেছে। ওরা গণভোট মানে না। শেখ মুজিবকে ক্ষমতা না দিয়ে তারা খুবই অন্যায় করেছিল। ওরা অত্যাচারী। অত্যাচারীকে শাস্তি ভোগ করতেই হবে।

আশ্রমের মন্দিরে গুরুদের আস্তানা দেখিয়ে সাধুবাবা বললেন, আমার হারিয়ে যাওয়া ভাইয়েরা এমনিভাবেই থাকত। কিন্তু দস্যুরা তাদের নির্দয়ভাবে হত্যা করেছে। মাথায় তার ছোট জুটি বাঁধা। সামান্য সাদা কাপড়ের একটি গামছা তার পরনে। তিনি বললেন, পরের অন্যায় করা আমাদের নীতি নয়। তবুও ওরা আমাদের মেরেছে। বৃদ্ধ সাধু যুগোল কিশোর গোস্বামীই শুধু তার ভাইকে হারান নাই, বগুড়াবাসীও হারিয়েছে তাদের পরিচিত শ্বেতবস্ত্রধারী তিনটি ভাইকে। তারা আর আসবে না।

বগুড়া রেলস্টেশনে চারপাশেই ছিল জল্লাদের কসাইখানা।

তখন জুন মাসের প্রথম সপ্তাহ। রাত্তিবেলা শুয়ে আছি। হঠাৎ ইন্টার ক্লাশ ওয়েটিং রুম থেকে ভেসে আসলো মানুষের করুন আর্তনাদ। ‘আমাকে বাঁচাও’ করে কে যেন চিৎকার করছিল। একটু পরেই থেমে গেল বুঝলাম সে আর নেই।
কথাগুলো বলতে বলতে শিউরে উঠেছিলেন বগুড়া রেলওয়ের একজন পদস্থ বাঙ্গালী কর্মচারী। জানতে চাইলেম আপনি দস্যুদের আর কি নৃশংসতা দেখেছেন। উত্তরে তিনি জানালেন, কি দেখি নাই বলুন। ওরা সব করেছে। বাঙ্গালীরা সবাই ছিল ওদের শত্রু কেননা, যে বাঙ্গালীই রেলস্টেশনের আশেপাশে আসতো তাঁকেই তারা হত্যা করেছে। একদিন একজন নিরীহ বাঙ্গালীকে দিয়ে কয়েকজন মিলিটারি তাদের মালপত্র ট্রেনে উঠালো। তারপর কাজ শেষ হলে শুরু হলো তার উপর আমানুশিক অত্যাচার। একজন মিলিটারি লোকটাকে ওয়াগনের পিছনে দু’পা সমান করে পায়ের সঙ্গে মাথা লাগিয়ে বসিয়ে রাখলো। তারপর একজন উঠলো তার পিঠের উপর। জোর করে ওরা জীবন্ত মানুষটার হাড়গুলো এমনি করে ভেঙ্গে দিল। মানুষটার অনুরোধ আর মিনতি ওরা শুনে নাই। এরপর লোকটাকে আর ভাইদের মত হত্যা করা হলো। পাক দস্যুরা স্টেশনের আশপাশে অহরহই মানুষদের এমনি নিষ্ঠুরভবে অত্যাচার করে হত্যা করতো।

জিজ্ঞেস করলাম, আপনাদের ওরা কিছু বলেন নাই? উত্তরে তিনি বললেন, বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলনের অংশ নেওয়ার বাঙ্গালী কর্মচারীদের ওরা ক্ষমা করে নাই। যারা সরতে পারে নাই তাদের মৃত্যু ছিল ওদের হাতে।
প্রসঙ্গক্রমে তিনি বললেন, একদিন মেজর জাকি সামরিক হেডকোয়াটারে আমাকে ডাকলো। তারপর পাশের রুমে থেকে রক্তমাখা কাপড় পরিহিত একজন বাঙালিকে ডেকে আনা হলো। তার হাত বাঁধা ছিল এবং মুখ ছিল রুমাল দিয়ে বাঁধা আমাকে মেজর বলল-এ দেখো। এরপর কড়া মেজাজে হুকুম হলো- আভি তোম যাও। আমি মেজর জাকির হাত থেকে রক্ষা পেয়েছি বটে, কিন্তু ঐ রক্তমাখা ভাইটি বেঁচে আছে তিনা জানি না। শেষের দিকে ওরা রেলওয়ের বাঙালি কর্মচারীদের হত্যা করারও ষড়যন্ত্র করেছিল। রেলস্টেশনের আশপাশে নিরীহ বাঙ্গালীদের হত্যা করেও ওদের রক্ত পানের তৃষ্ণা তখনও মেটেনি। বগুড়া ছাড়ার পূর্বেই ওদের ষড়যন্ত্র ফাঁস হাওয়ায় আমরা বেঁচে আছি। কিন্তু রেলস্টেশনের বধ্যভূমিতে হারিয়ে যাওয়া ভাইরা আর আসবে না। রেলস্টেশনে সুইপার দশন জমাদাঁর সতর্কতার ইঙ্গিত দিয়ে আমাদেরকে রক্ষা করেছেন। কিন্তু এই যুদ্ধের ৭টি মাস কেটে গেছে স্টেশনের আশপাশের মৃত বাঙ্গালীদের কবর দিতেই।

দশীন জমাদার

বগুড়া রেলওয়ে স্টেশনের একজন সুইপার। বয়স প্রায় ৭০ বছরের বেশী। এই বৃদ্ধ তার সাতটি মাস কাটিয়ে দিয়েছে বর্বর পাক দস্যুদের হত্যা করা লাশ সরিয়ে। দস্যুদের হত্যাযজ্ঞের সে একজন নীরব সাক্ষী।

“আমি পূর্বে আরো মোটাসোটা ছিলাম স্যার। আমি লাল টক টকে ছিলাম। কিন্তু বগুড়া স্টেশনের আশপাশের বাঙ্গালি ভাইদের রক্ত দেখে দেখে আমি খুব রোগা হয়ে গেছি। আমার শরীরে আগের মত মাংস নেই। আপনিই বলুন, একজন মানুষ শত শত রক্ত মাখা লাশ সরালে আর কি করে বাঁচার আশা রাখে ! জীবন নিয়ে খেলা হয়েছে সাহেব। আপনারা কিছুই জানেন না। আমি কেমন করে বেঁচে আছি জানি না- ওরা কত গবাই করেছে, কিন্তু আমি কিছু বলতে পারিনি। মুক্তি আর ইন্ডিয়ার সৈন্য আমাদের রক্ষা করল হুজুর।“
বগুড়া রেলওয়ে ষ্টেশন থেকে প্রায় ৩০০ গজ দক্ষিনে একটি বদ্ধ কুপ দেখাতে গিয়ে সুইপার দশীন কথাগুলো বলছিল।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বগুড়া রেলওয়ের এস ডি ও সাহেব পরিবারসহ এই প্রথম আসলেন তাঁর বাংলোতে। পাক বাহিনীর আমলে তার বাংলোটা সম্পূর্ণভাবে সামরিক দস্যুদের হাতে ছিল। তারা এই দু’তলা বাড়িটি ব্যবহার করতো কসাইখানা হিসেবে। নিরীহ বাঙ্গালীদের পাকদস্যু আর তার সহযোগীরা ধরে আনতো, তারপর এই বাড়ীতে জবাই করা হলো, বাড়ীর সংলগ্ন একটা বৃহৎ কুপে হত্যা করার পর মৃতদেহ ফেলে দেওয়া হতো। বাড়ীটার আউট কিচেনে সবচেয়ে বেশী হত্যা করা হতো বলে মনে হয়। কারন এখান থেকে কুপটি মাত্র ২০ গজ দূরে। বাড়ীটির চারিদিকে দীর্ঘ নয় মাস ঘাস আর জঙ্গলে প্রায় ভর্তি হয়েছিল পাকবাহিনীরা সেগুলো পরিষ্কার করতো না। কারন জঙ্গলের মাঝে এই রকম একটি বাড়ীতে তাদের বাঙ্গালীনিধনের নেশা খুবই বেড়ে যেত। শুধু তাই নয়, বর্বর পাক-সেনারা এই বাড়িটাতে মদ আর জুয়ার আড্ডাও বসাতো। দিনে রাতে তারা এখানে আসর জমাতো নির্বিঘ্নে। ওদের কেউ বাঁধা দিতে পারে নাই। রক্তের নেশায় বর্বররা হন্য হয়ে বাঙ্গালীদের খুঁজে আনতো।

দশীন জমাদেরকে জিজ্ঞেস করলাম, তুম কতজন বাঙ্গালীর মৃতদেহ এই কুপে ফেলেছ।
কি আর বলব হুজুর! বিশ্বাস করবেন না! আমার হাতেই কমপক্ষে চার-পাঁচ শত লাশ এই কুয়ায় ফেলেছি। জল্লাদরা তাকিয়ে দেখতো হুজুর, আমি কি করি। আমি লাশগুলো পুঁতে রাখতে চাইতাম। কিন্তু ওরা দেয় নাই। ওরা আমাকে বলতো- তু, শালা হিন্দু হায়। এইসে দরদ কিউ লাগদো! “জানতে চাইলে তোমার সামনেই কি ওরা হত্যা করতো”।
বৃদ্ধ বলে চলছিল- কি বলেন সাহেব! আমাকে ওরা ভয় পেত না। প্রথমে বাঙ্গালিকে ধরে আনতো, তারপর হাত বেঁধে মুখের ভিতর কাপড় গুঁজে দেয়। এরপর হয় পেটের ভিতর চাকু মারে, না হয় জবাই করে। কোনটার আবার পিছন দিক থেকে ঘাড়ে ছুরি বসিয়ে জবাই করতো। ওদের দয়া নেই। কান্নাকাটি অনুরোধ কিছুই শুনেনি। কত বাঙ্গালী যে কাঁদতো হুজুর, কি করবো। মিলিটারিরা খুশিমত মানুষকে গুলী করতো। তারপর আমাকে বলতো ‘ইছি কি হঠাদো’। আমি বাধ্য হয়ে কাজ করেছি হুজুর। কিন্তু ওরা আমাকেও ছাড়ে নাই। রেল ষ্টেশনের বাঙ্গালীদের আমি আগেই বলতাম তোমরা সরে যাও। আমি ওদের এই দিকে আসতে দেইনি। গোপনে গোপনে আমি অনেক বাঙ্গালী সাহেবকে সাবধান করেছি। কিন্তু মিলিটারিরা এটা জানতে পেরে আমাকে সন্দেহ করে ঘাড়ে রাইফেল দিয়ে মারে। শুধু লাশ সরাবার জন্যই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। ওরা হুজুর বড় বড় সাহেবকেও জবাই করেছে- গুলি করেছে। পাশে পার্ক রোডের একটি ড্রেন দেখিয়ে বলল, এখানে তিনটা, ওখানে ১টা, এই রকম অনেক সাহেবের লাশ এই ড্রেনেই আছে হুজুর। ওরা ভালভাবে পুঁতে রাখতেও আমাকে দেয়নি। আমাকে সন্দেহ করে খুব মারতো, টার উপর আমার চাকুরী নষ্ট করে দিল সাহেব। কয়েক মাস ধরে না খেয়ে আছি।

ঝাড়ুদার দাশীন পাক বর্বরদের বুলেটের সামনে না খেয়েই দিন কাটিয়েছে। চাকুরীতে পূর্ণবহালের কথা সেদিন সে মুখে আনতে পারি নাই। তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, যারা এমনিভাবে শত শত মানুষকে হত্যা করতে পারে তাদের এক মুঠো ভাতের অভাবে এক গরীবের জন্য চিন্তা করার সময় কোথায়? বগুড়া রেল এস ডি-ও বাংলোর পূর্বদিকের মাঠটা এখন কবরস্থানে পরিণত হয়েছে। বগুড়া শুত্রুমুক্ত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু এই বাংলোর প্রতি ঘরের মেঝে আর দেয়ালে মানুষের রক্তে ভেজা বহু কাপড় জামা ইত্যাদি রক্তাক্ত অবস্থায় পড়েছিল। বাংলোর উপর তলার হাউজে বর্বরতার সবচেয়ে বড় প্রমাণ পাওয়া যায়। এই হাউজটি ছিল সম্পূর্ণ মানুষের রক্তে ভরা। রক্তগুলো জমা হয়ে ক্রমশঃ জমাট বেঁধে যায়। কোদাল দিয়ে মাটি কাঁটার মত জমাট বাঁধা রক্ত কেটে এই হাউজ পরিষ্কার করা হয়েছে। জবাই করা মানুষের রক্তে স্রোত দেখার জন্যই বোধ হয় হাউজে রক্ত জমা করতো। রক্ত দেখেই হয়তো রক্তপানের তৃষ্ণা জল্লাদের বাড়তো বেশী। বগুড়া রেলস্টেশন আর ষ্টেশন সংলগ্ন রেললাইনের আশেপাশে কত নিরীহ বাঙালিকে যে পাকসেনা আর তার সহযোগীরা হত্যা করেছে হিসেব নেই। কত নিরীহ মানুষ যে এই দস্যুদের হাতে প্রাণ দিয়েছেন আর একান্ত অসহায়ভাবে মৃত্যুকে মেনে নিয়েছেন কেউ বলতে পারেনা। বগুড়ায় পাক দস্যুরা বাঙালিদের ধরে বলত- ইছিকো খরচ খাতা মে (মৃত্যু খাতা) উঠা দেও। বোধ করি রেলষ্টেশনের ও তার আশপাশের নিষ্ঠুর বর্বরতা আর হত্যাযজ্ঞের দ্বারাই তাদের খরচের খাতা পূর্ণ হয়ে গেছে।“

তানিয়া ইমতিয়াজ লিপি
<৮,৪১,৪৩০-৩১>

“খুলনা শহরের হেলিপোর্ট ও ফরেস্ট ঘাটে বাঙালিদের যে নৃশংভাবে হত্যা করা হতো, তা দেখে খুলনার তৎকালীন জেলা জজ হার্টফেল করে মারা যান।“

[খুলনায় পাক বাহিনীর নরমেধযজ্ঞ]

-দৈনিক বাংলা, ১২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২
“বর্তমানে হেলিপোর্ট ফরেস্ট ঘাটের কথা বলা যাক। হেলিপোর্ট জজকোর্টের সামনে এবং সার্কিট হাউজ সংলগ্ন। যেসব বাঙ্গালীদের উপর তাদের অত্যাধিক রাগ ছিল জল্লাদরা তাদের প্রকাশ্য দিবালোক হেলিপোর্টর প্রবেশ পথে ছাগল ঝোলা করে পা উপরে মাথা নীচে দিয়ে ঝুলিয়ে রাখতো।

আর ঐ অবস্থায় চলতো অত্যাচার- চড় ঘুষি ও চাবুকের আঘাত। কোন কোন ক্ষেত্রে ঐ অবস্থার উপর বেয়োনেট দিয়ে খোঁচানো হতো। যতক্ষণ না সে মারা যায় ততক্ষণ চলতো এই নির্যাতন। যার কাছ থেকে কোন স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা করা হতো ঐভাবে অত্যাচার করার পর অজ্ঞান হয়ে পড়লে তাকে নামানো হতো, জ্ঞান ফিরলে আবার ঝোলানো হতো পূর্ববৎ।

একদিন আমার নিজের দেখা একটি মৃত্যুর কথা উল্লেখ করছি। সকাল ১০টা হবে। হেলিপোর্ট লুঙ্গি ও গেঞ্জি পড়া দীর্ঘ সবলদেহী একজন বাঙ্গালীর পায়ে, হাঁটুতে ও অন্যান্য গিরায় কাঠের রোলার দিয়ে দু’জন সেনা পিটাচ্ছে আর দু’জন সেনা তা উপভোগ করছে। যার উপর অত্যাচার চলছে তিনি বার বার বাঁধা দিচ্ছেন আর যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। তারপর তার দু’পায়ে দড়ি বেঁধে পা উপরে মাথা নীচে দিয়ে ঝুলানো হলো।

পরনে থাকলো জাঙ্গিয়া ও গায়ে গেঞ্জি। পরে খালি গা করে গেঞ্জিটিও অপসারন করা হলো। আর চললো চাবুকের বাড়ি। প্রতিটি বাড়ির সাথে সাথে তার দেহটি মুচড়ে উঠতে লাগলো। ঐ ঝুলন্ত অবস্থাতেই তিনি হাত দিয়ে বাধা দিচ্ছেন। কিন্তু পরে আর তার হাতে সে জোর রইল না। কিন্তু চাবুকের বাড়ি চললো অব্যাহত ভাবে। আর এইভাবেই সমাপ্তি হলো একটি বাঙ্গালী জীবন। পরে তার সেই ঠাণ্ডা শীতল দেহটাকে নামিয়ে অবজ্ঞায় তারা দূরে ফেলে দিল আবার অপর একজনকে। আমি সরে পড়লাম।

রাতের বেলায় জজকোর্টের পিছনে ফরেস্ট ঘাটে বাঙ্গালীদের এনে জবাই করে হত্যা করা হতো এবং দেহগুলোর পেট চিরে নদীতে ফেলা হতো। ঘাটটি আবার জজ সাহেবের বাসার ঠিক পেছনেই। রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে সেই সব মৃত্যুপথযাত্রী বাঙ্গালীদের করুন আর্তনাদ জজ সাহেবের কানে পৌঁছাতো। দিনে হেলিপোর্টে ও রাতে ফরেস্ট ঘাটের এইসব হত্যাযজ্ঞ সহ্য করতে না পেরে জজ সাহেব তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সামরিক অফিসারকে অনুরোধ করেছিলেন যে বিচারালয়ের সামনে যেন এ ধরণের কাজ না করা হয়। তার উত্তরে তিনি পেয়েছিলেন মৃত্যুর শাসানি। কিন্তু তাদের সাধ মেটেনি। তিনি হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে একরাতে মারা গেলেন।

আর একটি বধ্যভূমি চিল গল্লামারি। খুলনা শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে মাত্র দেড় মাইল। হেলিপোর্ট ও ফরেস্ট ঘাট, কাস্টমস ঘাট প্রভৃতি জায়গায় প্রথমে বাঙ্গালীদের হত্যার জন্য বেছে নিলেও পরে বর্বর পাক বাহিনীর গল্লামারীকেই তাদের নৃশংসতার উপযুক্ত স্থান বলে বেছে নিয়েছিল।

সারাদিন ধরে শহরে ও গ্রাম থেকে বাঙ্গালীদের ধরে এনে জেলখানা হেলিপোর্ট ও ইউ, এফ, ডি ক্লাবে জমায়েত করা হত। তারপর মধ্য রাত হলে সেই সব হতভাগ্য নিরীহ নিরস্ত্র বাঙ্গালীদের পেছনে হাত বেঁধে বেতার কেন্দ্রের সামনে দাঁড় করিয়ে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দ্বারা তারা ব্রাস মারতো, রক্তপ্লুত দেখে লুটিয়ে পড়তো হতভাগ্যরা। হত্যার আগে ট্রাক ভরে যখন তাদের নিয়ে যাওয়া হতো তখন সেই সব নিরুপায় মানুষের আর্তনাদ রাস্তার আশপাশের সবাই শুনতো। কিন্তু তাদের তো বাড়ীর বাহিরে যাওয়ার উপায় নেই কারফিউ রয়েছে।

সেই আর্তনাদ সহ্য করতে না পেরে শেরে বাংলা রোডের এক ব্যাক্তি জানালা খুলে মুখ বাড়িয়েছিল মাত্র। ব্যাস, অমনি তাঁকে লক্ষ্য করে হানাদার বাহিনী গুলি ছুড়লো আর বুলেট বিদ্ধ হয়ে সে লুটিয়ে পড়লো। হানাদার বাহিনী প্রতিরাতে কম করেও শতাধিক ব্যক্তিকে হত্যা করতো। দিনের বেলায় তাদের লাশ জোয়ারের পানিতে ভেসে আসতো। কিন্তু কারও সাহস হতো না তাদের দাফন করার।

অনেকে তাদের আপনজনের লাশকে সনাক্ত করলেও সেখান থেকে তাকে উঠিয়ে নীতে পারেনি। কেননে বর্বররা জানতে পারলে তাকেও হত্যা করবে।

কিছুদিন জল্লাদরা ঠিক করলো গুলি করে আর হত্যা নয়। অন্য পন্থা। এবার থেকে শুরু হলো জবাই, কিন্তু সংখ্যায় কমলো না-সেই শতাধিক প্রতিরাতে। এরপরের ঘটনা চরম নিষ্ঠুরতার। রাত্রের বদলে হত্যার জন্য দিনের বেলাকে বেছে নিল।

সকলের চোখের সামনে দিনে পিঠ মোড়া দেওয়া ট্রাক ভর্তি বাঙ্গালী নিয়ে যাওয়া হতো আর ঘণ্টাখানেক পর শূন্য ট্রাক ফিরে আসতো- গল্লামারীতে পড়ে রইতো কিছুক্ষণ আগের যাওয়া সেইসব মানুষের শীতল দেহগুলো। খুলনা শহর মুক্ত হওয়ার পর গল্লামারী খাল থেকে দুই ট্রাক মাথার খুলি পাওয়া গিয়েছিল।

ছবি তুলবার জন্য গল্লামারীর অভ্যন্তরের ধানক্ষেতে ঢুকে দেখলাম এক নৃশংস দৃশ্য। একাধিক লাশ পড়ে আছে, সেদিকে একটি কুকুর খাচ্ছে আর দূর অপর একটি লাশের পাশে আর একটি কুকুর বসে হাঁপাচ্ছে। মনে হয় মানুষ খেয়ে তার উদর অতিমাত্রায় পরিপূর্ণ।

ভাবতেও অবাক লাগে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব বলে খ্যাত মানুষকে কুকুরে টেনে ছিঁড়ে খাচ্ছে।“

তানিয়া ইমতিয়াজ লিপি
<৮,৪২,৪৩২> শুধু চট্টগ্রামেই আনুমানিক ৩ লাখ হত্যাকাণ্ড হয়েছিল!!
[চট্টগ্রামে বদ্ধভূমির সন্ধান]

-দৈনিক পূর্বদেশ, ১৩ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২

“চট্টগ্রামের ২০টি বধ্যভূমিতে বাঙ্গালী নিধনযজ্ঞ চলেছে।
চট্টগ্রাম শহর ও শহরতলী এলাকা সমেত জেলার আরো ৯টি থানাতে হানাদার খান সেনারা সর্বমোট ২০টি বধ্যভূমিতে বাঙ্গালী নিধনযজ্ঞ অনুষ্ঠান চালিয়েছে। শহর ও শহরতলী এলাকার ১০টি বধ্যভূমির মধ্যে আটটিতে গড়ে পাঁচ হাজার করে বাঙালিকে হত্যা করা হয়েছে বলে অনুমিত হচ্ছে। এছাড়া পোর্ট এলাকা এবং নেভিব্যারাক এলাকাতে সুদীর্ঘ ৯ মাসব্যাপী মানুষকে হত্যা করে কি হারে কর্ণফুলী নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে, তার কোন হদিসও খুঁজে বের করা সম্ভব নয়।

চট্টগ্রাম শহর ও শহরতলী এলাকার ১০টি এবং গ্রাম অঞ্চলের গোটা পাঁচেক বধ্যভূমি ইতিমধ্যে আমি ঘুরে দেখেছি। এসব বধ্যভূমি বাঙ্গালী হত্যার সঠিক সংখ্যা হয়তো পাওয়া যাবে না, কিন্তু এখনো সরকার যদি ব্যাপক অনুসন্ধান ও তথ্য সংগ্রহের জন্য এগিয়ে আসেন তবে হত্যাযজ্ঞের ব্যাপকতাসহ একটা আনুমানিক সংখ্যাও নির্ণয় করতে পারবেন বলে বিশ্বাস।

কোন কোন মহল চট্টগ্রামে নিহত লোকের সংখ্যা ১লাখ হবে বলে অনুমান করেছেন। কিন্তু আমার মনে হয়, বিভিন্ন থানাসহ এ সংখ্যা অন্ততঃ তিন লাখে দাঁড়াবে। শহর ও শহরতলীর আম বাগান, ওয়ারলেস কলোনি, শেরশাহ কলোনি ও ফয়েজ লেকসহ গোটা পাহাড়তলী এলাকাতে এখনো ২০ থেকে ২৫ হাজার বাঙ্গালীর মাথার খুলি পাওয়া যাবে। এছাড়াও রয়েছে চাঁদগাও, লালখান বাজার, হালিশহর, কালুরঘাট, ও পোর্ট কলোনি ইত্যাদি বধ্যভূমি। চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট ও সার্কিট হাউসেও হাজার হাজার লোককে ধরে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে। গ্রামাঞ্চল মিরেস্বরাই ও সীতাকুণ্ডের পাহাড়, রাউজান, পটিয়া, সাতকানিয়া এবং বাঁশখালীড় বনাঞ্চলে ও হাজার হাজার বাঙালিকে হত্যা করা হয়েছে। বেসরকারি উদ্যোগে সমস্ত এলাকায় রিপোর্ট সংগ্রহ অনেকটা কঠিন কাজ। আমার ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা অনুযায়ী সারা চট্টগ্রাম জেলাতে তিন লাখ বাঙ্গালীকে হত্যা করা হয়েছে। বিভিন্ন বধ্যভূমিতে আজো বহু নরকঙ্কাল ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পাওয়া যাচ্ছে। শহরের ওয়ারলেস কলোনি ঝাউতলা ও নাসিরাবাদের পাহাড়ি এলাকাগুলোতে লুকায়িত বহু নরকঙ্কালের অস্তিত্ব আজো পাওয়া যাবে। ইতিমধ্যে ঝাউতলা এলাকার বিভিন্ন সেপটিক ট্যাঙ্ক, পাহাড়ি ঝোপ ঝাড়ের মধ্যে অনেকগুলো কংকাল দেখতে পেয়েছি। সীতাকুণ্ডের শিবনাথ পাহাড়ে কয়েক হাজার বাঙ্গালীকে হত্যা করা হয়েছে।

মিরেশ্বরাইয়ের জোরারগঞ্জ এবং ওয়ারলেস এলাকাতে মানুষ জবেহ করার স্থায়ীকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছিল। রাস্তার ট্রাক, বাস এবং ট্রেন থেকে হাজার হাজার লোককে ধরে এনে আটক করে রাখা হতো এবং প্রতিদিন ৫০ জন অথবা ১০০ জন করে হত্যা করা হতো। এ সমস্ত এলাকাতে অসংখ্য কবর আজো দেখতে পাওয়া যায়। মানুষের পরিহিত কাপড় চোপড়, জুতা স্যান্ডেল ইত্যাদি এখানে ওখানে পড়ে আছে। স্থানীয় জনসাধারণের ধারনা মতে শুধু মিরেশ্বরাই ও সীতাকুণ্ডের বধ্যভূমিগুলোতে ১৫ থেকে ২৫ হাজার লোককে হত্যা করা হয়েছে। এ ছাড়া রাউজান, পটিয়া ও বাঁশখালী ইত্যাদি থানাতেও প্রায় অনুরূপহারে গণহত্যা চালানো হয়েছে।“

তানিয়া ইমতিয়াজ লিপি
<৮,৪৩,৪৩৩-৩৪> “৭ই ডিসেম্বরেই শুরু হয়েছিল বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড।“
[চাঁদপুরে পাকবাহিনীর হত্যালীলার আরো কাহিনী]

-পূর্বদেশ, ১০ই ফেব্রুয়ারী।
“কুমিল্লা জেলার নদীবন্দর চাঁদপুর ও তার আশপাশের বর্বর বাহিনীর নৃশংসতার বহু তথ্য ধীরে ধীরে প্রকাশ পাচ্ছে। কেবল মাত্র চাঁদপুরেই দখলদার বাহিনী ও তাদের সহযোগী রাজাকার, মোজাহিদ বাহিনীর হায়েনাগুলো প্রায় ৫ হাজার নিরীহ বাঙ্গালীকে হত্যা করে নদীতে ফেলে দিয়েছে বলে আশংকা করা হচ্ছে। উপরন্ত এই ছোট বন্দর শহরটিতে আল-বদর দখলদার বাহিনীর আত্মসমপর্ণের অনতিপূর্বে (৭-১২-৭১ইং) সুপরিকল্পিত উপায়ে বহু বুদ্ধিজীবী, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হত্যা করার চাঞ্চল্যকর খবর পায়া যাচ্ছে।

জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরীর বড় ভাই ডাঃ মজিবুর রহমান চৌধুরী এক সংবাদদাতাকে বলেন, চাঁদপুর পুরান বাজারস্থিত নুরিয়া হাইস্কুলে আল- বদর বাহিনী ক্যাম্প স্থাপন করে তাদের প্রধান এর নির্দেশে অত্র এলাকায় এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। লুটতরাজ ও নির্বিচারে হত্যা তখন নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়ায় বলে তিনি জানান। একদিন আল বদর বাহিনীর কয়েকটি হায়েনা গ্রাম অঞ্চল থেকে আগত চারজন নিরীহ বাঙ্গালীকে অচেনার অজুহাতে প্রকাশ্য বাজারে গুলি করে হত্যা করে। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র পেলেই তারা ধরে নিয়ে যেত এবং এদের কাউকেই ফিরতে দেখা যায়নি বলে জানা যায়। একদিন তার অনুপস্থিতিতে তার ছেলে বাবুলকে বদর বাহিনীর কয়েকটি হায়েনা বড় ষ্টেশন ও তাদের নির্যাতন কক্ষে নিয়ে আরো প্রায় ২০-২৫টি ছেলের সাথে অকথ্য নির্যাতন করে। বহু চেষ্টা তদবিরের পর জনৈক আর্মি অফিসারের মারফতে বাবুলকে তিনি ফিরিয়ে আনলেন সত্য কিন্তু তারপর সে প্রায় এক মাস অচল হয়ে পড়েছিল। তার সঙ্গের হতভাগ্যদের কি হয়েছিল তা তিনি বলতে পারেন নি।

দখলদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের পূর্ব মুহূর্তে ফেসিস্ট আল বদর বাহিনী সুপরিকল্পিত উপায়ে বুদ্ধিজীবী নিধন শুরু করে। চাঁদপুর টেলিফোনের সহকারী ইঞ্জিনিয়ার জনাব সায়েদুল হক আল বদর বাহিনীর তৎপরতার কোথা বলতে গিয়ে তারা কি করে তার দুজন কর্মীকে হত্যা করেছে এবং তিনি কেমন করে তাদের মৃত্যু ফাঁদ থেকে বেঁচে গেছেন তা এই সংবাদদাতাকে জানান।

৭ই ডিসেম্বর তার একজন সুপারভাইজার জনাব আব্দুল খালেক ও অপারেটর জনাব মোরশেদুর রহমান শহরের উপকণ্ঠের এক গ্রাম থেকে ফেরার পথে বদর বাহিনী তাদের ধরে নিয়ে যায়। এর নুরিয়া হাইস্কুলস্থিত ক্যাম্পে আটকিয়ে রাখে। উক্ত খবর পাওয়ার পর তিনি বদর বাহিনীর সাথে টেলিফোনে যোগাযোগ করলে উল্লিখিত ব্যক্তিদেরকে সকালে মুক্তি দেয়া হবে বলে আশ্বাস দেয়া হয়। সান্ধা আইন থাকায় নিজে গিয়ে তাদের খবর নেয়া নিরাপদ কিংবা সম্ভবও ছিল না। সকাল বেলা এক বেনামী টেলিফোন থেকে জানতে পেরে তাদের খোঁজ করতে গিয়ে নুরীয়া স্কুলের নিকটবর্তী রাস্তায় তাদের মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। সেদিনই কিছু একটা বিপদের আশংকা মনে জাগলে জনাব সায়েদুল হক শহর ছেড়ে পালাতে সচেষ্ট হয়ে উঠেন এবং ঝুঁকি নিয়ে সপরিবারে নৌকা করে সরে পড়তে সক্ষম হন। পরে তিনি জানতে পারেন যে, তিনি বাসা ত্যাগ করার মাত্র কয়েক মিনিট পরেই আল বদর বাহিনীর হায়েনাগুলো তার বাসায় পৌঁছে হতাশ হয়। সেই মানবতার শত্রু হায়েনাগুলো অনেক বুদ্ধিজীবীকে তাদের নিজ নিজ বাসা থেকে ধরে এনে হত্যা করে। নিহতদের মধ্যে রয়েছেন ম্যালেরিয়া উচ্ছেদ বিভাগের এসিস্টেন্ট ম্যালেরিয়া সুপারিটেনডেন্ট জনাব জোয়রদার মতিউর রহমান, স্টোরকিপার জনাব মাকসুদুর রহমান, মেকানিক জনাব কবির আহমদ, ম্যালেরিয়া ইন্সপেক্টর জনাব সফিউদ্দিন আহমেদ, ও দুজন সুপারভাইজার বজলুল রহমান ও ইদ্রিস মিয়া। কৃষি বিভাগের একজন প্রোজেক্ট অফিসার জনাব ফয়েজ আহমেদ ও আল বদর বাহিনী কর্তৃক নিহত হন। নিহতদের মধ্যে ওয়াপদার দু’জন মেকানিকা ছিলেন, তারা হচ্ছেন নাজিমুদ্দিন ও মাহফুজুল হক।

দখলদার বাহিনী ও তাদের সহযোগী এদেশের জারজ সন্তানগুলো নারকীয় হত্যাকাণ্ড চালায় তার চাক্ষুস সাক্ষী রেলওয়ে হাসপাতালের সেনিটারি এসিস্টেন্ট জনাব ফজলুল বারী। এপ্রিল মাসে চাঁদপুর দখলদার বাহিনীর কবলে পতিত হওয়ার পরও তিনি হাসপাতালের কাজে নিযুক্ত থাকার বর্বর বাহিনীর নৃশংসতার সাক্ষী হয়ে আছেন তিনি এবং তার ডোম বাহিনীর অনেকেই। রেলষ্টেশনের অফিস সমুহে রেস্টহাউজে দখলদার ও রাজাকার বাহিনীর ক্যাম্প করা হয়। শান্তি বাহিনীর সহযোগিতায় এই সমস্ত নরপশু চাঁদপুর পুরান বাজার ও পার্শ্ববর্তী এলাকা সমুহে হত্যা, লুট, নারী নির্যাতন, ও অগ্নিসংযোগ এক নারকীয় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। নির্বিচারে গণহত্যা ও বহু নারীর সতীত্ব নষ্ট করার বিবৃতি দান করেন জনাব ফজলুল বারী। রেল, লাঞ্চ, রাস্তা ঘাট, নৌকা সমূহ ও বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলের হানা দিয়ে নিরীহ নিরপরাধ বাঙ্গালীদের ধরে এনে তাদের ক্যাম্প সংলগ্ন নির্যাতনকক্ষে আমানুসিক নির্যাতন করে হত্যা করা হতো। একটি আম গাছ নির্দেশ করে তিনি বললেন এই আম গাছটি হাজারো নরহত্যার নীরব দর্শক। আম গাছটির নীচে ফিশিং কর্পোরেশনের গুদামের পিছনেই দুর্ভাগাদের হত্যা করে ২০-২৫ জনকে একই তারে গ্রথিত করে নদীতে ফেলে দিত। যেদিন মৃত্যুর সংখ্যা বেশী হত সেদিন ডোমদের তলব করা হতো।

দুজন ডোমের বর্ণনা

রেলের ডোম ছুনুয়া ও গয়া প্রসাদ এই সংবাদাতাকে বলে যে, গভীর রাত্রে এসে পাকবাহিনীর লোক তাদের কোয়ার্টার থেকে ধরে নিয়ে যেত। ষ্টেশনের ওয়েটিং রুমে জিঃ আরঃ পিঃ হাজতে অথবা আক্কাস আলী হাইস্কুলে রক্তাক্ত মৃতের স্তুপ দেখিয়ে বলতো, ভাঙ্গি ইয়ে জলদি সাফ করো। মৃত দেহ বয়ে নদীতে ফেলতে হতো এবং ভোর না হতে উল্লেখিত নির্যাতন কক্ষের স্থান পরিষ্কার করে ফেলতে হতো। “কত আদমিকে যে এই লোক মেরেছে, কত মা বোহিনের ইজ্জত নষ্ট করেছে তা বলতে পারুম না বাবু’। আক্ষেপের সাথে বলে ছুনুয়া। অনেক সময় দু’এক কথা বলতে গিয়ে নরপশুদের হাতে ওরা মারও খেয়েছে বলে জানায়।“

<৮,৪৪,৪৩৫-৩৬> শুধু সৈয়দপুর টেকনিকাল কলেজেই ৬০০-৭০০ নারীর উপর চলে পাশবিক অত্যাচার!!
সৈয়দপুরে বাঙ্গালী নিধন অভিযানের একটি প্রত্যক্ষ বিবরণ, সংবাদ ১৪ই ফেব্রুয়ারি ১৯৭২।

দু’সন্তানের জননী বেগম সুরাইয়া রহমান। বেগম সুরাইয়া রহমান হচ্ছেন সৈয়দপুরের তদানীন্তন হাউসিং এবং সেটেলমেন্ট বিভাগের মহকুমা ইঞ্জিনিয়ার শহীদ ফজলুল রহমানের পত্নী। অশ্রুসজল চোখে বেগম সুরাইয়া রহমান সেদিন আমার কাছে তাঁর স্বামী, দেবর ও ভাগ্নের শহীদ হবার কাহিনী বলেছিলেন। তিনি বললেন, ১৯৭১ সালের ১লা এপ্রিল আমার জীবনে সেই ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনলো। আমার ব্যাক্তিগত জীবনে ঐদিনই হলো শহীদ দিবস। তিনি বলেছেন,১লা এপ্রিল বিকেলের দিকে প্রায় ২০জন হানাদার পাকিস্তানী সৈন্য আমাদের বাঙ্গালীপুরস্থ বাসভবনে আসে। তারা সবাই আমাদের লাইন করালো। আমার সাড়ে তিন বছরের শাহনাজ পারভিন (রুমা) তখন কোলে। হানাদার বাহিনীর ভয়ে সে তাকে চেপে ধরে রয়েছে। আমার স্বামীর গলায় পবিত্র কোরান শরীফ ঝোলানো।

বাচ্চাটি কোলে। কোরান শরীফ ছুড়ে ফেলে তারা বলল, কেয়া তুম জয় বাংলা বোলতা? তোম আওয়ামী লীগকে সাথ হেয়?এই বলে তারা আমার স্বামী, তার ভাই ১ম বর্ষ এম, বি, এস-এর ছাত্র রফিকুল ইসলাম, তার ভাগ্নে এস,এস, সি পরীক্ষার্থী আনোয়ার হোসেন, বাসার মালী রুহুল আমীনকে ধরে নিয়ে যায়। ছোট মেয়েটি তখন তার আব্বুর গায়ের সাথে মিশে ছিল। নামতে চায় না। কিছুতেই সে তার আব্বুকে ছাড়বে না। আমি তাকে জোর করে নামালাম তার আব্বুর কোল থেকে। হাউসিং এ- সেটেলমেন্ট বিভাগের ড্রাইভার আবাঙ্গালির আবিদ হোসেন সৈন্যদের সাথে এসেছিল। সে বাসায় ঢোকেনি, বাইরে ছিল। সে-ই হানাদারদের সব খবর দিত। তার এক ভাই নাজিরও হানাদার বাহিনীর দালালী করতো। বেগম সুরাইয়া তাঁর সুখের নীড় ভাঙ্গার কাহিনী বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিলেন। অনেক কিছু বলতে চেয়েও তিনি বলতে পারেননি।

তিনি বললেন, বাসা থেকে ওদেরকে নিয়ে বেরুবার পাঁচ মিনিট পর আমি কয়েকটা গুলির শব্দ শুনেছি। হয়তো এই গুলিতে ওদের সবাইকে এক সাথে হত্যা করা হলো। আমরা সবাই তাদের চারজনের আগমনের প্রতিজ্ঞা করছিলাম। আমার শাহনাজ তার পিতা, চাচা ও ভাইয়ের প্রত্যাবর্তনের জন্যে উন্মুখ হয়ে প্রহর গুনছিল। দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা হলো। আসলেন মেজর গুল, মেজর জাভেদ, ক্যাপ্টেন বখতিয়ার, কর্নেল শফি। তারা আমাদের ছাদের উপর কামান বসালেন। দারুণ উত্তেজনা, অশান্তি ও দুশ্চিন্তার মধ্য দিয়ে রাত্রি কাটালাম।

২রা এপ্রিল। ১৯৭১ সাল। আমার স্বামীকে ধরে নিয়ে যাবার দ্বিতীয় দিন। ড্রাইভার আবিদ জানতো আমার স্বামী, দেবর, ভাগ্নে প্রমুখের ভাগ্যে কি ঘটেছিল। সে জানতো তারা তখন কোথায়। তার তখন অবাধ সুযোগ-সুবিধা। সে ঐ দিন কয়েকজন আবাঙ্গালিকে নিয়ে এসে আমাদের বাসা লুট কর নিয়ে গেলো। আমাদের পরিবারটা ছোট। বেশ সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে ছিলাম। বাসায় প্রায় ৫০/৬০ হাজার টাকার বিভিন্ন জিনিসপত্র ছিল। সেসব কিছু নিয়ে গেল। হানাদার সৈন্য বাহিনী ঐদিনই আমাদের সৈয়দপুর টেকনিক্যাল স্কুলে নিয়ে গেলো। সেখানে শুধু মহিলা আর মহিলা। কমপক্ষে ৬০০ থেকে ৭০০। সবাই এক একটি সকরুন কাহিনীর প্রতিকৃতি, জীবন্ত সাক্ষী। সেখানে আমরা হানাদার সৈন্যদের পৈশাচিক দেখেছি, শুনেছি তাদের বিদ্রুপপূর্ণ টিটকারী। এরপর আমাদেরকে দারুল উলুম মাদ্রাসায় সরিয়ে নেয়া হয়। তারপর দু’মাস পর আমরা ঢাকায় চলে আসি।“

তানিয়া ইমতিয়াজ লিপি
<৮,৪৪,৪৩৫-৩৬> শুধু সৈয়দপুর টেকনিকাল কলেজেই ৬০০-৭০০ নারীর উপর চলে পাশবিক অত্যাচার!!

[সৈয়দপুরে বাঙ্গালী নিধন অভিযানের একটি প্রত্যক্ষ বিবরণ]

-সংবাদ, ১৪ই ফেব্রুয়ারি ১৯৭২

দু’সন্তানের জননী বেগম সুরাইয়া রহমান। বেগম সুরাইয়া রহমান হচ্ছেন সৈয়দপুরের তদানীন্তন হাউসিং এবং সেটেলমেন্ট বিভাগের মহকুমা ইঞ্জিনিয়ার শহীদ ফজলুল রহমানের পত্নী। অশ্রুসজল চোখে বেগম সুরাইয়া রহমান সেদিন আমার কাছে তাঁর স্বামী, দেবর ও ভাগ্নের শহীদ হবার কাহিনী বলেছিলেন। তিনি বললেন, ১৯৭১ সালের ১লা এপ্রিল আমার জীবনে সেই ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনলো। আমার ব্যাক্তিগত জীবনে ঐদিনই হলো শহীদ দিবস। তিনি বলেছেন,১লা এপ্রিল বিকেলের দিকে প্রায় ২০জন হানাদার পাকিস্তানী সৈন্য আমাদের বাঙ্গালীপুরস্থ বাসভবনে আসে। তারা সবাই আমাদের লাইন করালো। আমার সাড়ে তিন বছরের শাহনাজ পারভিন (রুমা) তখন কোলে। হানাদার বাহিনীর ভয়ে সে তাকে চেপে ধরে রয়েছে। আমার স্বামীর গলায় পবিত্র কোরান শরীফ ঝোলানো।

বাচ্চাটি কোলে। কোরান শরীফ ছুড়ে ফেলে তারা বলল, কেয়া তুম জয় বাংলা বোলতা? তোম আওয়ামী লীগকে সাথ হেয়?এই বলে তারা আমার স্বামী, তার ভাই ১ম বর্ষ এম, বি, এস-এর ছাত্র রফিকুল ইসলাম, তার ভাগ্নে এস,এস, সি পরীক্ষার্থী আনোয়ার হোসেন, বাসার মালী রুহুল আমীনকে ধরে নিয়ে যায়। ছোট মেয়েটি তখন তার আব্বুর গায়ের সাথে মিশে ছিল। নামতে চায় না। কিছুতেই সে তার আব্বুকে ছাড়বে না। আমি তাকে জোর করে নামালাম তার আব্বুর কোল থেকে। হাউসিং এ- সেটেলমেন্ট বিভাগের ড্রাইভার আবাঙ্গালির আবিদ হোসেন সৈন্যদের সাথে এসেছিল। সে বাসায় ঢোকেনি, বাইরে ছিল। সে-ই হানাদারদের সব খবর দিত। তার এক ভাই নাজিরও হানাদার বাহিনীর দালালী করতো। বেগম সুরাইয়া তাঁর সুখের নীড় ভাঙ্গার কাহিনী বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিলেন। অনেক কিছু বলতে চেয়েও তিনি বলতে পারেননি।

তিনি বললেন, বাসা থেকে ওদেরকে নিয়ে বেরুবার পাঁচ মিনিট পর আমি কয়েকটা গুলির শব্দ শুনেছি। হয়তো এই গুলিতে ওদের সবাইকে এক সাথে হত্যা করা হলো। আমরা সবাই তাদের চারজনের আগমনের প্রতিজ্ঞা করছিলাম। আমার শাহনাজ তার পিতা, চাচা ও ভাইয়ের প্রত্যাবর্তনের জন্যে উন্মুখ হয়ে প্রহর গুনছিল। দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা হলো। আসলেন মেজর গুল, মেজর জাভেদ, ক্যাপ্টেন বখতিয়ার, কর্নেল শফি। তারা আমাদের ছাদের উপর কামান বসালেন। দারুণ উত্তেজনা, অশান্তি ও দুশ্চিন্তার মধ্য দিয়ে রাত্রি কাটালাম।

২রা এপ্রিল। ১৯৭১ সাল। আমার স্বামীকে ধরে নিয়ে যাবার দ্বিতীয় দিন। ড্রাইভার আবিদ জানতো আমার স্বামী, দেবর, ভাগ্নে প্রমুখের ভাগ্যে কি ঘটেছিল। সে জানতো তারা তখন কোথায়। তার তখন অবাধ সুযোগ-সুবিধা। সে ঐ দিন কয়েকজন আবাঙ্গালিকে নিয়ে এসে আমাদের বাসা লুট কর নিয়ে গেলো। আমাদের পরিবারটা ছোট। বেশ সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে ছিলাম। বাসায় প্রায় ৫০/৬০ হাজার টাকার বিভিন্ন জিনিসপত্র ছিল। সেসব কিছু নিয়ে গেল। হানাদার সৈন্য বাহিনী ঐদিনই আমাদের সৈয়দপুর টেকনিক্যাল স্কুলে নিয়ে গেলো। সেখানে শুধু মহিলা আর মহিলা। কমপক্ষে ৬০০ থেকে ৭০০। সবাই এক একটি সকরুন কাহিনীর প্রতিকৃতি, জীবন্ত সাক্ষী। সেখানে আমরা হানাদার সৈন্যদের পৈশাচিক দেখেছি, শুনেছি তাদের বিদ্রুপপূর্ণ টিটকারী। এরপর আমাদেরকে দারুল উলুম মাদ্রাসায় সরিয়ে নেয়া হয়। তারপর দু’মাস পর আমরা ঢাকায় চলে আসি।“

তানিয়া ইমতিয়াজ লিপি
<৮,৪৫,৪৩৭-৪৩৮>
[জল্লাদেরা আছড়েও মানুষ মেরেছে]

-দৈনিক বাংলা, ১৫ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২।

“বাবা, মা নেই। কাকা খোঁড়া। চলতে পারেন না। জ্যাঠা পাগলা। বোন বিধবা। বাচ্চাও আছে একটা। মোট ১০জনের পরিবার। আমি এদের নিয়ে কি করব বলতে পারেন?

অটো প্রমোশনে প্রদীপ এখন নবম শ্রেণির ছাত্র। কিন্তু বেতন দেবে কোত্থেকে। না। কোথাও যাইনি। যাদের উপার্জনে সংসারের চাকাটা ঘুরতো খান সেনারা তাদের একদিন ধরে নিয়ে গেল। ধরে নিয়ে গেল, চলতি বাংলা সনের জ্যৈষ্ঠ মাসের ১৭ তারিখে। নিয়ে গেল আমার ভগ্নিপতি অমল লাল চাকী এবং পরিবারের অপর তিনজন ননী গোপাল দেব, নিরোদ বিহারী দেব, আর নিরঞ্জন দেবকে। ওরা তো ফিরে আসেনি।

হয়ত হেলাল পার্কের বধ্যভূমিতে তাদেরও হত্যা করা হয়েছে। তারপর পালিয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছি। আজ এ গ্রাম কাল সে গ্রাম এমন করে। বাড়ি লুট হয়েছে। কিছু নেই। স্কুলের বেতন দেবে তেমন কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। প্রদীপের বোনের বিয়ে হয়েছে মাত্র দু’বছর। এখন বয়স বড়জোর আঠারো উনিশ, সে এখন অর্ধ উন্মাদিনী।

“সরকারের দয়ায় মানুষের সহায়তায় হয়ত একদিন আবার আমরা দাঁড়াতে চলতে পারবো, কিন্তু আমার বোনের স্বামীকে ফিরিয়ে দেবে কে? ছোট ভাগ্নে যখন বড় হয়ে জিজ্ঞেস করবে মামা আমার বাবা কোথায় তখন আমি তাকে কি করে বোঝাবো? কোত্থেকে এনে দেব তার বাবাকে? নাম রাখা সার্থক হয়েছে। প্রদীপ পড়তে চায়। পড়া ছাড়া আর নেই কোন উপায়। যে করেই হোক তাকে পড়তেই হবে। অশিক্ষিত ছেলেকে চাকুরী দেবে না কেউ। সামান্য কিছু জমি আছে তার।

গাইবান্ধা ইমারজেন্সি ফরসে কর্মরত সুবেদার আব্দুর রাজ্জাক। নীতি খান সেনাদের বিচারের মহড়া দেখেছেন। একাত্তরের মে মাসের মাঝামাঝি। রান্নার খড়িয়ে ঘাটতি পড়েছে। মেজর আফজাল ডেকে পাঠাল। জ্বালানী কাঠের ব্যবস্থা করতে হবে।

গেলেন রাজ্জাক সাহেব। তার তখন ৮টা। রাজ্জাক সাহেব বললেন, সুবেদারের নাম এখন মনে নেই। সে মেজর আফজালের ঘর থেকে দুজন লোককে বের করে নিয়ে এল। সুবেদারকে সুধলাম, কেয়া ভাইয়া ইন দোনোকা বিচার হো গিয়া। খান সুবেদার জবাব, তোমহারে সামনে হোগা দেখো। ওদের দুজনকে মাঠে খাড়া করলো। সিপাইকে হুকুম দিল, ইন লোগকো খরচা কর দো।

লোক দুটোকে পিছন ফিরতে ও চোখ বন্ধ করতে বলা হলো। তারপর এক, দুই, তিন, চার। পরপর চারটে গুলি। কাটা মুরগীর মতো ছটফট করতে করতে মারা গেল। তারপর তাদের কফিল শাহর গুদামের মাঠে যেখানে রয়েছে আরো শত শত মানুষের সমাধি সেখানে গর্তে ফেলে মাটি দেয়া হলো। হেলাল পার্কে এবং এখানে যাদের হত্যা করা হয়েছে এই প্রাঙ্গণেই তারা শুয়ে আছে। শুয়ে আছে দশ, বিশ জনে গাদাগাদি হয়ে।

আমার যে বোনের সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে পড়ে রয়েছে তাদের পরণের শাড়ির ছিন্ন অংশ। মাথার চুল। চোখে বাঁধা রয়েছে তার রুমাল। গুদামের কক্ষগুলোতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ইট। তাতে রক্তের দাগ। অনেককে গুলি খরচ না করে ইটের উপর আছড়ে মারা হয়েছে। চিৎকার করতো বলে আর আশপাশের পাড়ার লোকের গুলির শব্দ শুনে শুনে রাখতো তাই পরের দিকে ইলেকট্রিক শক দিয়ে মেরে ফেলত।

হেলাল পার্কের সংলগ্ন ওয়াপদা রোড পাড়ার আব্দুল ওয়াদুদ খান শহীদ। কলেজের ছাত্র। মুক্তিবাহিনীর পক্ষে সে গুপ্তচরবৃত্তি করছে বলে তাকে একবার নয় দু-দুবার ধরা হয়েছিল। শেষ বার ৬ই অক্টোবর প্রথমে তার বন্ধু মকসুদার রহমান মুকুল এবং পরে শাহিনকে ধরা হয়। শাহীন আমাকে জানালো, ওরা প্রথমে আমাকে সিকিউরিটি অফিসারের কাছে নিয়ে গেল। আমি মুক্ত এলাকায় যাতায়াত করার কথা স্বীকার করি। স্বীকার করার উপায় ছিল না। ওদের লোকের আমরা যাতায়াতের সঠিক খবর রাখতো। মেজর ছিল না তাই আমাকে এক ঘণ্টার জন্য ছেড়ে দেয় হলো বলা হল, যদি না ফিরে তবে আমার বংশে বাতি দেওয়ার মতও কাউকে রাখা হবে না। অগত্যা এক ঘণ্টা পর ফিরতে হলো। মেজরের জিজ্ঞাসাবাদের পর কফিল শাহর গুদাম ঘরে হাত আর চোখ বেঁধে শুরু হলো নির্যাতন। সেই ঘরে বিমান বাহিনী থেকে অগাত একজন মুক্তি সেনাকে রক্তাপ্লুত ও উলঙ্গ অবস্থায় তিনি দেখতে পেয়েছেন। শাহীন জানাল আমার সামনেই দলে দলে লোক ধরে আনছে আর চালাচ্ছে অকথ্য অত্যাচার।

শাহীন বললো পাঞ্জাব রেজিমেন্টের মেজর মাহমুদ, বালুচ রেজিমেন্টের মেজর আফজাল, লেফটেন্যান্ট নেওয়াজ রিজভি, ২৯ ক্যাভালরির মেজর তহসিন মির্জা এবং মেজর শের খান ও ক্যাপ্টেন খককর গাইবান্ধার হেলাল পার্কের সকল হত্যাকাণ্ড ও ধর্ষণের জন্য দায়ী। মেজর শের আলী তহসিন মীর্জা কত মেয়ের যে সতীত্ব হরণ করেছে তার কোন হিসাব নেই।

ভরতখালিতে পুরাতন ফুলছড়ি ঘাট ও নয়া ঘাটের লাইনের মধ্যবর্তী স্থানে বহু লোকক্যা খান সেনারা হত্যা করেছে। বগুড়া জেলার শরিয়াকান্দি থানার লোকদেরও ধরে এনে এখানে হত্যা করা হয়েছে। নলডাঙ্গায় আওয়ামী লীগ নেতা একরাম উদ্দিনম,রংপুরের বিশিষ্ট আইনজীবী শ্রী বিজয়চন্দ্র মৈত্র, তার দু’ছেলে এবং গফুর নামক এক ব্যক্তিক্যা হত্যা করা হয়েছে।

সুন্দরগঞ্জে একদিন সভার কথা বলে ডেকে এনে চেয়ারম্যানসহ ১৩ জনকে হত্যা করা হয়। সাইমাগঞ্জের একটি বর্ধিঞ্চু পরিবারের তিনজনকে খাওয়ার দাওয়াত দিয়ে ক্যাম্পে ডেকে এনে হত্যা করা হয়েছে। তারা নাকি মুক্তি সেনাদের সহায়তা করতো।“

তানিয়া ইমতিয়াজ লিপি
<৮,৪৬,৪৩৯-৪৪০> পাকিস্তানিরা মৃতদেহগুলির পেট চিরে নদীতে ফেলে দিতো যাতে করে লাশ নদীর গভীরে তলিয়ে যায়! খুলনায় কেউ ভাবতে পারতো না যে রেল রোডের মত ব্যস্ত সড়কে এই ধরণের একটি গুদাম রয়েছে যেখানে বাঙ্গালীদের লাশ রোজই বেড়ে উঠেছে!!
[খুলনায় পাক বাহিনীর নরমেধযজ্ঞ]

-দৈনিক বাংলা, ১৫ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২

“খুলনা শহরের কেন্দ্রস্থলে রেল ষ্টেশন ও রেল লাইনের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ছিল বাঙ্গালী নিধনের আর একটি ঘাঁটি। এপ্রিল মে মাসে জল্লাদ সৈন্যরা খুলনা রেলষ্টেশন এলাকাতে বহু বাঙ্গালীকে হত্যা করেছে। এদের মধ্যে ছিল প্রদেশের অন্যত্র থেকে আসা ট্রেনের যাত্রীরা। প্রথমে তাদের সর্বস্ব লুট করা হতো। তারপর হত্যা করা হতো এবং সেই সব মৃত দেহগুলির পেট চিরে নদীতে ফেলে দেয়া হতো যাতে করে লাশ নদীর গভীরে তলিয়ে যায়।

রেলষ্টেশন ও ষ্টীমার ঘাটগুলির শক্ত সবল মুটে শ্রমিকেরাই তাদের হাতে মারা গিয়েছে সর্বাধিক। রেল কলোনী এলাকাতে প্রাধান্য ছিল পাকসেনাদের সহযোগী একডল আবাঙ্গালিদের। ঐ সময়ে রেল কলোনী এলাকাতে দিনে বা রাতে যখনই কোন বাঙ্গালী গিয়েছে, সে আর ফেরেনি কোন দিনও। তাকে হত্যা করে পুঁতে রাখা হতো। বহিরাগত লঞ্চ ষ্টীমারের যাত্রীরাই হয়েছে তাদের প্রধান শিকার।

ঐ সব কলোনীতে বসবাসকারী অনেক বাঙ্গালী রেলকর্মচারীও হয়েছে তাদের শিকার। লুণ্ঠিত হয়েছে তাদের গৃহসামগ্রী। এই এলাকা থেকে অন্যান্য গলিত দেহের সঙ্গে উদ্ধার করা হয়েছিল খুলনা থানার দারোগা জনাব কাশেমের মৃতদেহটি। ডিউটি করে বাড়ি ফেরার পথে তিনি নিখোঁজ হয়েছিলেন। এই এলাকায় আশিয়ানি হোটেলের সামনে বিরাট একটা ডোবা আছে। এই ডোবার ভেতরেও নিক্ষিপ্ত হয়েছে বহু বাঙ্গালীর মৃতদেহ।

গত ডিসেম্বরের কথা। যুদ্ধ চলছে একদিকে আর বাঙ্গালীকে হত্যা করে ভর্তি করা হচ্ছে রেল রোডের একটি গুদাম। খুলনায় বিমান হামলা চলাকালীন পথের লোকজন রেল রোডে বা রেল কলোনিতে আশ্রয় নিলেই সেখান থেকে তাদের ধরে নিয়ে হত্যা করে ঐ গুদামে ফেলে দেয়া হত। ঐ সময়ে খুলনায় কেউ ভাবতে পারতো না যে রেল রোডের মত ব্যস্ত সড়কে এই ধরণের একটি গুদাম রয়েছে যেখানে বাঙ্গালীদের লাশ রোজই বেড়ে উঠেছে।

ষ্টেশনরোডে ঐ সময়ে কেরোসিন বিক্রি হতো। কেরোসিন তখন ছিল আক্রা। তাই সুদুর গ্রামাঞ্চল থেকে ক্রেতারা এসে ভোর থেকে লাইন দিত। কিন্তু বিমান হামলার সাইরেন বাজলেই তারা আত্মরক্ষার্থে আশপাশে আশ্রয় নিত। তারা জানতো না যে যেখানে তারা আশ্রয় নিয়েছে, সেখানে রয়েছে বাঙ্গালীদের মরণফাঁদ। তাদের পাহারাদারদের সহায়তার বর্বর সেনারা বাঙ্গালীদের অর্থ লুণ্ঠন ও হত্যা করতো।

পাহারাদার খানরা পথেঘাটে, বাজারে ব্যাংকে সন্ধানী দৃষ্টি নিয়ে ঘুরে বেড়াতো। ঐ সব জায়গায় কোন বাঙ্গালীর কাছে বেশী টাকা দেখলেই তাকে মুক্তিবাহিনী বলে ধরে আনতো হেলিপোর্টে অবস্থানরত জল্লাদ সেনাদের কাছে। সেখানে তার সর্বস্ব লুট করে তারপর তাকে মেরে ফেলা হত। এ ধরণের হত্যা অনেক ঘটেছে। নিহতদের মধ্যে রয়েছে ম্যাটারনিটি রোডের ননী, স্যার ইকবাল রোডের সিমেন্ট ব্যবসায়ী কাঞ্চন মিয়া, আরও অনেকে।

এখানে শুধু ননীর মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটনার কথা বলছি। ননীদের কন্ট্রাক্টরী ও নৌপরিবহন ব্যবসা আছে খুলনাতে। ঘটনার দিন সে ব্যাংকে গিয়েছিল ব্যবসার জন্য কয়েক হাজার টাকা তুলতে। ননী টাকাটা তুলে তার সাথীকে নিয়ে ঢুকল পিকচার প্যালেসের কাছে এক রেস্টুরেন্টে চা খেতে। তখন সে বুঝতেও পারেনী এটাই হল তার জীবনের শেষ চায়ের কাপ। বাইরে অপেক্ষা করছিল দুজন খান। যেই মুহূর্তে ননী রেবিয়েছে অমিন তাকে পাকড়াও করে তুলল রিক্সাতে। রিকশা ছুটল বধ্যঘাঁটি হেলিপোর্ট, যেখানে অপেক্ষা করছিল বর্বর পাকসেনার।

১৭/১৮ বছর বয়সের ননী ছিল নির্ভীক ও তেজোদীপ্ত। মৃত্যু অবধারিত জেনেও বাঙ্গালী তরুন ননী খানসেনাদেরকে রেখে কথা বলেনি। কঠিন ভাষায় সে প্রতিবাদ করেছিল- যার প্রতিশোধ তাকে তারা হত্যা করেছিল নির্মমভাবে। বর্বররা তার পায়ে দড়ি বেঁধে হেলিপোর্টের সিলিং-এ পা উপরে মাথা নীচে দিয়ে ঝুলিয়েছিল।

তারপর চালালো তার দেহে চাবুক। চাবুকের প্রতিটি বাড়ি তার দেহে কেটে বসে যাচ্ছিল। আর সে আর্তনাদ করছিল। সময়টা ছিল দুপুর। তার সাথীরা ছিল নির্বাক পথযাত্রী বাঙ্গালী। চাবুকের বাড়িতে যন্ত্রনায় তার মুখমণ্ডল থেক চোখ দুটো বেড়িয়ে গিয়েছিল।“

তানিয়া ইমতিয়াজ লিপি
<৮,৪৭,৪৪১-৪৪২>
[নওগাঁয় পাকিস্তানিদের হত্যাযজ্ঞের আরেকটি অধ্যায়]

-পূর্বদেশ, ১৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২।

“যে কেউ নওগাঁ শহরে ঢুকলেই দেখতে পাবেন শহরের মধ্যবর্তী যমুনা নদীর যমুনা ওপর নির্মিত পুরানো অথচ অতি সুন্দর সেতুটির পাশেই বিধস্ত তাজ সিনেমা হলটি। এর দক্ষিনে দেখা যাবে অসংখ্য বাঙ্গালী বিকৃত মৃতদেহ স্তপাকৃত অবস্থায় পড়ে আছে। এরই আর মাত্র সামান্য দূরে একটি পুরানো পাকা কূপ।

সুস্বাদু পানীয় জলের এবং অন্যান্য কাজে ব্যবহারের জন্য কূপটি এলাকার মানুষের প্রভূত উপকারে আসতো। আর এক্ষণে এই কূপটির তিন হাত নীচে থেকে শেষ পর্যন্ত কেবল গলিত ও বিকৃত লাশ আর লাশই দেখা যাচ্ছে। একদা সুপেয় ছিল যার পানি সেখানে পানির চিহ্ন মাত্রও আর নেই। শবদেহ রক্তের ধারার সাথে মিশে একাকার হয়ে গেছে।

আর একটু এগিয়ে গেলেই দেখা যাবে দু’টি বড় ঢেউ টিনের ঘর। ঘরের ভেতর ঝুলে আছে বহু দড়ি। নীচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে জুতো, জামা, প্যান্ট ও অন্যান্য পোশাকে পরিচ্ছদ। এক নজরেই মনে হবে, এগুলো এক বা একাধিক লোকের নয়, শত শত মানুষের ব্যবহৃত কাপড়। আর মেঝেতে চাপ চাপ রক্ত এবং সে রক্তের বিস্তৃত কূপ পর্যন্ত লক্ষ্য করা যায়।

কূপটির ভেতরে প্রথমেই যে মৃত দেহটি চোখে পড়ে তা কোন উচ্চপদস্থ লোকের বলেই মনে হয়। এরই চারপাশে দেখা যায় বহু নিহত ব্যক্তির মাথা মাত্র। শরীরগুলো নীচের বহু লাশের ভেতরে অন্তহিত বলেই মনে হয়। সনাক্ত করার কোনই উপায় নেই।

এবার তাজ সিনেমার নিকটবর্তী পুরোনো পশু হাসপাতালটি অতিক্রম করে উত্তর দিকে কিছুদূর গেলেই দেখা যাবে বাঁয়ে ছোট্ট একটি মাসজিদ। তার পাশেই রয়েছে দালান বাড়িটি। বসবাস করত তথাকথিত কামিজ বিহারী ব্যবসায়ী। নাম ইদ্রিস। প্রতি বৎসর খাজা মঈনউদ্দিন চিশতীর মৃত্যু বার্ষিকী পালনের নাম করে তিনদিন ধরে ওরস হতো এই বিহারীর বাড়ীতে। কিন্তু তার বাসার ভেতরে যেতেই যে কেউ চমকে উঠবেন। দেখতে পাবেন দুই ঘরের ভেতরে নির্মম হত্যার প্রমাণ চিহ্ন। একটি ঘরে অনেক দড়ি ঝুলে আছে। আর অপরটিতে রয়েছে অসংখ্য বাঙ্গালীর রক্তের ছাপ। জানালা, দেওয়াল সর্বত্র রক্ত ছড়িয়ে আছে, সর্বত্র ঘরের দেয়ালে এবং চতুপার্শ্বে।

জানা গেছে, উক্ত বিহারী ব্যবসায়ী খানসেনাদের সহযোগিতায় যেসব বাঙ্গালীকে ধরে এনে জবাই করতো তাদের রক্তে তার অপবিত্র হস্ত রঞ্জিত করে তার ঘরের দরজা ও জানাল রাঙ্গিয়ে নিত। যেন আলতা দিয়ে সাজানো হয়েছে। এ নারকীয় দৃশ্য চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।

আর খান সেনারা তখন উল্লাসে মেতে উঠতো। শুধু কি তা-ই। ইদ্রিসের বাড়ীর ভেতর কাঁচা কূপটি মাটি দিয়ে ভরাট করা হয়েছে। এখনও সে কুপের ভেতর দড়ি দেখা যায়। কূপটিতে বহু অচেনা বাঙ্গালীর লাশ চাপা রয়েছে। আর এর পাশেই দেখা যায় প্রচুর রক্তের দাগ। স্থানীয় বিহারীদের সহযোগিতায় পশু সেনারা কত বাঙ্গালীর জীবন প্রদীপ নির্মমভাবে নির্বাপিত করেছে, এই ক্ষুদ্র নওগাঁ শহরে তারই একটি ক্ষুদ্র প্রমাণ তুলে ধরা হলো। গত ১৯ শে ডিসেম্বর এই পশুসেনারা এখানে আত্মসমর্পণ করে।“

তানিয়া ইমতিয়াজ লিপি
<৮,৪৮,৪৪৩> “আমার আব্বাকে কি মৃত্যুর হাত থেকে ছিনিয়ে আনা যেত না?…
…শরীরের নানা স্থানে আগুনে পোড়ানো, দেহকে বেত্রাঘাতে রক্তাক্ত করে তাতে লবণ মাখানো, একে একে তাঁর দুই পা, দুই হাত কেটে বিকলাঙ্গ দেহের ‘পরে অমানুষিক নির্যাতন চালিয়েছিল হানাদার পশুরা।“
[অমানুষিক নির্যাতনেও তাঁর মনের বলিষ্ঠতা কমে নি]

-দৈনিক বাংলা, ১৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২।

“আমার আব্বাকে কি মৃত্যুর হাত থেকে ছিনিয়ে আনা যেত না? সাক্ষাৎকারের শুরুতেই প্রশ্নটি করেছিলেন বাবুল। বাবুল আওয়ামী লীগ নেতা এবং জাতীয় পরিষদ সদস্য, যশোরের গৌরব, মরহুম মশিহুর রহমানের বড় ছেলে। তাঁর আম্মা এবং অন্য তিন ভাইবোন সহ কলকাতা থেকে ঢাকায় এসেছেন? স্বাধীন বাংলার অঙ্গনে দাঁড়িয়ে আজ বাবুল অসংখ্য প্রশ্নের আঘাতে প্রতিনিয়ত বিধ্বস্ত হচ্ছেন। বোনের বাসা ধানমণ্ডিতেই তিনি উঠেছেন।

আলাপের প্রথম দিকে স্তব্ধভাবে পাথরের মূর্তির মত বসেছিলেন তিনি। হয়ত শুনেছিলেন তাঁর আত্মজের কণ্ঠের অশ্রান্ত আর্তনাদ, এত লোক থাকতে কেন আমার আব্বা বাঁচলো না? কেন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কোন আবেদন পৌঁছালো না আব্বার অমূল্য জীবনের জন্য।

একান্ত ধীরস্থির কণ্ঠে বেগম রহমান বললেন তাঁর মহান স্বামী মরহুম মশিহুর রহমানের সাথে তার সেই অবিস্মরণীয় দিনগুলোর কথা।
তিনি বলেছিলেন কিভাবে ২৫শে মার্চের কালো রাতটাকে স্ত্রী পুত্র এবং বন্ধু বান্ধবের অসংখ্য অনুরোধ সত্ত্বেও তিনি পালিয়ে যাননি। সকলের অনুরোধের উত্তরে একবার শুধু তিনি বলেছিলেন- নির্দয় এই সেনাবাহিনীর হাটে এ দেশের সরল জনগনকে ছেড়ে দিয়ে কি ভাবে আমি শুধু নিজের জীবন রক্ষা করবো। আপন আদর্শে বিশ্বাসী জনাব মশিহুর রহমান নিজস্ব নীতি থেকে কখনো বিচ্যুত হননি।
ভীষণ যন্ত্রনা দিয়ে পাকহানাদার বাহিনী তিল তিল করে তাঁকে সংহার করেছে। বিশ্বস্ত সুত্রে জেনেছি এই ঘৃণিত পশুর দল প্রথমে তাঁকে নীতিচ্যুত করার জন্য নানা ধরণের অত্যাচার চালায়। শরীরের নানা স্থানে আগুনে পোড়ানো, দেহকে বেত্রাঘাতে রক্তাক্ত করে তাতে লবণ মাখানো থেকে আরম্ভ করে ইলেকট্রিক শক পর্যন্ত লাগানো হয়েছে। অত্যাচার যখন তার বলিষ্ঠ দেহটা ক্রমে ক্রমে নিস্তেজ হয়ে পড়ছিল তখনও তার মনের বলিষ্ঠতা একটুও কমেনি। সব সময় তিনি একই কথা বলেছেন, আমি আমার জনগণের বিরদ্ধে কিছু বলতে বা লিখতে পারবো না।

সত্যিই তিনি তা পারেননি। হানাদার বাহিনী যখন তার বাম হাত কেটে ফেলে ডান হাতে লেখার জন্য হুকুম চালায় তখন যন্ত্রনায় শুধু কেঁপেছেন তিনি। কিন্তু তার বলিষ্ঠ ঠোট দুটো একটুও কাঁপেনি। প্রতি দিনে একে একে হানাদার পশুরা তাঁর দুই পা, দুই হাত কেটে বিকলাঙ্গ দেহের ‘পরে অমানুষিক নির্যাতন চালিয়েছে তখনও একটু কেঁপে ওঠেনি তাঁর দৃঢ়ভাবে বন্ধ ঠোঁট দুটো।

বেগম রহমান জানেন তাঁর স্বামীর সেই নৃশংস মৃত্যুর কথা। তিনি সহ্য করতে পারেন না নিষ্ঠুর সেই ঘটনার কোন বর্ণনা। তবুও মাঝে মাঝে তাঁর অবুঝ মন জানতে চায় কিভাবে স্বাধীন বাংলার মাটি গ্রহণ করবে তাঁর স্বামীর মত মহান প্রেমিকের বিদেহী আত্মাকে।“

তানিয়া ইমতিয়াজ লিপি
<৮,৪৯,৪৪৪>
[মানিকগঞ্জের একটি বধ্যভূমি সাটুরিয়া হাট]

-দৈনিক বাংলা, ১৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২।

“মানিকগঞ্জ মহকুমার সাটুরিয়া থানায় একটি বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া গেছে। সাটুরিয়া হাটের নিকট মোঃ মনোয়ার হোসেন জনৈক ব্যক্তির পরিত্যক্ত বাড়ীর ভিটা খনন করে বহু লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধারকৃত লাশগুলো থেকে পাক পশুসৈন্যদের মর্মান্তিক নৃশংসতার স্বাক্ষর পাওয়া গেছে।

লাশগুলোর হাত-পা দড়ি দিয়ে বাঁধা। চোখ মুখ কাপড় দিয়ে জড়ানো। মুখের ভিতর কাপড় দেয়া হয়েছে। প্রত্যেকটি লাশ গলা কাটা অবস্থায় পাওয়া গেছে। এছাড়া অনেকগুলো মাথার খুলি ও হাড় পাওয়া গেছে। স্থানীয় দালালদের সহযোগীতায় পাক সৈন্য শত শত মানুষকে হত্যা করেছে। মেয়েদের ধর্ষণ করেছে এবং লাখো লাখো টাকা লুট করে নিয়েছে।

গত নয় মাসে এখানে বানিয়াটি গ্রাম থেকে হরিদাস সাহা ৫৫, অতুল সাহা ৪৫, নিতাই চন্দ্র সাহা ৩০, রাধুঘোষ, আওলাদ হোসেন, গাঙ্গুটিয়া গ্রাম থেকে সুধির রায়, কালু রায়, ডাঃ বিজয় সাহা, মৃণালকান্তি রায়, কমলপুর থেকে মুক্তার আলী, পারাগ্রাম থেকে কালু মিয়া, কাউননারা থেকে হালিম ফকির, আমতা থেকে যথিন্দ্র কর্মকার, নয়াপাড়া থেকে শ্যাম সাহা, হাজিপুর থেকে হযরতকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। হানাদারদের হাতে সরকারী ডাক্তার নরেন্দ্র ঘোষও রেহাই পাননি। চর সাটুরিয়ার নারায়ণবাবুর স্ত্রী আভারানী ভট্টাচার্য ৩৫ কে পশুরা ধর্ষণ করে হত্যা করে। যতীন কর্মকারের ১৫ বৎসরের নাতীকে চোখ উপড়ে ফেলে হত্যা করে।

এমনি করে ওরা কতগুলো হতভাগ্য মানুষকে এখানে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। তাঁর সঠিক পরিসংখ্যা হয়তো কোনদিনও পাওয়া যাবে না। তবে ঐ হানাদার পশুদের অত্যাচারের এক রাশ বিভীষিকাময় স্মৃতি মানব সভ্যতার দূরপনেয় কলঙ্ক হয়ে থাকবে।“

তানিয়া ইমতিয়াজ লিপি
<৮,৫০,৪৪৫-৪৬> “এমন কোন রাত ছিল না যে নরপশুরা দশ- বারোজনকে হত্যা না করেছে। বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারতো আর উল্লাসে ফেটে পড়তো।“
[মরণপুরী ভোলা ওয়াপদা কলোনি]

-হাবিবুর রহমান, দৈনিক বাংলা, ১৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২।
“ভোলায় বর্বর হানাদার বাহিনী নৃশংসতার দ্বিতীয় পর্যায়ের হত্যাকাণ্ডের অধিনায়ক নরপশু ক্যাম্পেন মুনির হোসেন ও সুবেদার সিদ্দিক। এদের গণহত্যা ও জঘন্য পাশবিকতা যে বিভীষিকা ও সন্ত্রাস সৃষ্টি করেছিল তা অবর্ণনীয়। গত জুন মাসের প্রথম দিকে এই নরপশু আর তার দোসর সুবেদার ভোলাতে আসে। সে এখানে এসে প্রথম অতি স্বাভাবিকতা দেখাতে আরম্ভ করে।

মাইক্রোফোনে শান্তি কমিটির মাধমে কেবলই ঘোষণা করতো যে, আপনাদের কোন ভয় নেই। অকুতোভয়ে প্রত্যেকে কাজ কর্ম করে যান। আর হিন্দুদের উদ্দেশে বলা হতো আপনারা গ্রাম ও চরাঞ্চল হতে শহরে প্রত্যেকে নিজ বাড়ি ঘরে ফিরে আসুন প্রেসিডেন্ট আপনাদেরকেও সাধারণ ক্ষমা করেছেন। নির্দেশিত সময়ের মধ্যে ফিরে না এলে অতঃপর বিনা বিচারে গুলি করে হত্যা করা হবে।

এ আহবান আর জল্লাদ ইয়াহিয়ার সাধারণ ক্ষমার অন্তরালে ছিল নারী ধর্ষণ, অর্থ সংগ্রহ ও লুটতরাজ এবং নরহত্যার পরিকল্পনা। এ ফাঁদের মাধ্যমেই তাদের ঘৃণা কামনা, বাসনা ও উদ্দেশ্য চরিতার্থ করেছিল। প্রথমতঃ যে পরিবারে সুন্দরী মেয়ে ছিল তার অভিভাবককে শান্তি কমিটির পাণ্ডা বা রাজাকার দিয়ে সামরিক বাহিনীর দফতর ওয়াপদা কলোনীতে ডাকা হতো। ডাকার পূর্বেই তার বাড়ি ঘরের চারদিকেই পলায়ন পথে রাজাকার আর দালালরা সাধারণ ভাবে ঘোরাফেরা করত যেনো কোথাও পালিয়ে যেতে না পারে।

অতঃপর উপায়ান্তর না দেখে দালালের সহায়তায় মরণপুরী ওয়াপদা কলোনিতে যেতে হতো। সেখানে নরপ্রকৃতি পশু মুনির আর সুবেদার বুকের কাছে বন্দুক আর বেয়োনেট ধরে জিজ্ঞেস করতো- “ভারত মে তোমহাত্যারা লাড়কা গিয়া, আওর মুক্তিবাহিনীকো হামারা খবর পৌছাতা”। এমনি করে দু’এক ঘণ্টা আটকিয়ে রেখে দালালদের মাধ্যমে প্রথমতঃ টাকা, তারপর মেয়ে দাবী করত। এদুটির একটিকে পূরণ করতেই হতো। তা না হলে রাতের অন্ধকারে নরপশুদের বেয়নেটের আঘাতে মরতে হতো। এ পরিকল্পনার শিকারে যে পড়তো কেবল সেই জানতো।

এ হত্যাকাণ্ড ও পাশবিকতার নীরব প্রত্যক্ষদর্শী ওয়াপদার এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ খালেদ, টেকনিক্যাল অফিসার জনাব সিরাজুল ইসলাম, সাবডিভিশনাল ইঞ্জিনিয়ার জনাব আবু তাহের ও মনসুর আলী এবং সহকারী ইঞ্জিনিয়ার ওয়াহিদ উদ্দিন।

সাহেদ ও আব্দুর রব খাঁন। তাঁরা গত ৪ঠা মে হতে চার দেয়ালে ঘেরা ও ওয়াপদা কলোনীর একটি দালানে বলতে গেলে অন্তরীণ অবস্থায় ছিলেন। নিতান্ত প্রয়োজনে বাইরে যেতে হলে অনুমতি নিতো হতো এবং তাদের গতিবিধির প্রতি প্রখর দৃষ্টি রাখা হতো। এ কলোনিতে নরপিচাশ ইয়াহিয়ার জল্লাদ বাহিনীর আর পদলেহী দালালের পাশবিকতা ও নরহত্যার কাহিনী এমন কোন ভাষা নেই যে পুরোপুরি ভাবে রূপ দেয়া যেতে পারে। আমরা কলোনির বাইরে বাসা নিয়ে থাকবো এবং সেখানে হতে এসে অফিস করার অনুমতি চেয়েছিলাম। কিন্তু পিশাচরা এতে আমাদের উপর বিক্ষুব্ধ ভাব পোষণ করল। তারপর প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর দিন গুনছিলাম। এ ঘটনার কয়েকদিন পর আমাদের স্প্রিডবোট ড্রাইভার আতাহারকে ধরে নিয়ে অপর দিকের দালানে ৭দিন পর্যন্ত আটকিয়ে রাখে। আতাহারের নরকিয় মৃত্যু কাহিনী বলতে গিয়ে এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার জনাব খালেদ আশ্রু সজল বাকরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন- আমি ওকে বাঁচাতে পারলাম না। আমি জানতাম হয়তো আমরা কেউ বাঁচবো না। ভাবলাম অনুরোধ করলে হয়ত সাধারণ কর্মচারী হিসেবে ছেড়ে দিতে পারে।

এ বিশ্বাস নিয়ে মেজর জেহানজেব খান কে অনুরোধ করলে এ কলোনির গোপন তথ্য ফাঁস করেছে তাদের কেউ বাদ যাবে না বলে দৃঢ়কণ্ঠে জানায় এবং সে রাতেই ওকে মেরে ফেলে। তখন আমাদের নিশ্চিন্ত মৃত্যুই ভেবেছিলাম। এমন কোন রাত ছিল না যে নরপশুরা দশ- বারোজনকে হত্যা না করেছে। বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারতো আর উল্লাসে ফেটে পড়তো।

কলোনির রেস্ট হাউস ছিলো পাশবিকতার কেন্দ্রস্থল। রাতের পর রাত দোসর সুবেদার কত মেয়ের যে সর্বনাশ করেছে, কত নারী যে নিধন করেছে, কো হতভাগিনীকে উন্মাদে পর্যবসিত করেছে তার সীমা নেই। মনির হোসেন লুণ্ঠন চালিয়েছে নির্বিচারে। নিজে গ্রহণ করেছে স্বর্ণ, নগদ টাকা প্রভৃতি মূল্যবান জিনিস, আর তার অনুচরদের দিয়েছে বাকী মালামাল।

এ ছাড়াও শান্তি কমিটির যোগসাজশে যাকে তাকে ধরে আটক করে, শান্তি কমিটির মাধ্যমে মোটা অঙ্কের নগদ অর্থের বিনিময়ে দু’একজনকে ছেড়ে দিয়েছে। অনেক টাকা গ্রহণ করেও তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। দুলারহাটের মোহাম্মদ উল্লাহ কন্ট্রাক্টর তাদের একজন। চরফেশনের শান্তি কমিটির পাণ্ডা রাজাকার ও পুলিশ দিয়ে ওকে ধরিয়ে দেয়। এমনি করে সমগ্র মহকুমায় হিংস্র নখর বিস্তার করে পাশবিকতা আর হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল। “

তানিয়া ইমতিয়াজ লিপি
<৮,৫১,৪৪৭>
[পটুয়াখালীর জেলখানায় বধ্যভূমি]
-দৈনিক বাংলা, ১৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২।
“পাকবাহিনী একাত্তরের ২৬শে এপ্রিল পটুয়াখালী শহর কব্জা করার পর গত ৮ মাসে ঠাণ্ডা মাথায় তাদের দালালের সহযোগিতায় হাজার হাজার বাঙ্গালীকে হত্যা করেছে। প্রকাশ, নিহত ব্যক্তিদের কাউকে নদীর জলে ফেলে দিয়েছে কাউকে বা বিভিন্ন স্থানে গর্ত খুঁড়ে মাটিচাপা দিয়ে রেখেছে। এই পাষণ্ডরা। সম্প্রতি পটুয়াখালী জেলার অভ্যন্তরে একটি বধ্যভূমি আবিষ্কৃত হয়েছে।

এখানে বহু কবর রয়েছে। কয়েকটি কবরের মাটি খুঁড়ে কংকালের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। একটি গর্তের মধ্যে ৩ থেকে ৪জন, কোথাও বেশী মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। অনুমান করা হচ্ছে এখানে ৫০০ শত লোককে গুলী করে হত্যা করা হয়েছে। মৃত ব্যক্তিদের অনেকেই যে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে তা কংকাল দেখে বুঝতে কষ্ট হয় না। কংকালে বুলেটের ছিদ্র স্পষ্ট দেখে যায়।

মৃত ব্যক্তিদের মধ্যে পুলিশের লোক রয়েছে, কবরের মধ্যে পোশাক দেখে বুঝা গিয়েছে। এখানেই ঘুমিয়ে রয়েছেন শ্রদ্ধেয় কম্যুনিস্ট নেতা হিরালাল দাসগুপ্ত, পাথরঘাটার সি,ও, তরুন ব্যবসায়ি নিরঞ্জন বিশ্বাস সহ নাম না জানা দেশমাতৃকার সন্তানেরা। জানা গিয়েছে এদের লাইন করে দাঁড় করিয়ে গুলি করা হতো তখন বুলেট মানুষের শরীর ভেদ করে দেওয়ালে এসে আঘাত করতো। জেল খানার অদূরে বসবাসকারী ব্যক্তিরা আমাকে জানিয়েছেন যে, যখন মানুষ গুলিকে গুলী করা হত তখন মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতর বহু লোকের আর্তনাদ তারা শুনতে পেতেন।

তারা আরো জানিয়েছেন যে দুপুর ২টা থেকে ৫টার মধ্যে কাজ হতো। জানা গিয়েছে যে বরিশাল জেলার আটঘর কুঁড়িয়ানায় পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড চালিয়ে সৈন্যরা পটুয়াখালীতে ফিরে এসেই তৎকালীন মেজর নাদির পারভেজের নির্দেশে ৬০/৭০ জন লোককে জেলের মধ্যে গুলী করে হত্যা করেছে। “

তানিয়া ইমতিয়াজ লিপি
<৮,৫২,৪৪৮> বাক্সভর্তি নরকংকাল! কুয়োভর্তি নরমুণ্ড!!
[ময়মনসিংহে খান সেনাদের বর্বরতা]

-দৈনিক বাংলা, ১৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২।
“ময়মনসিংহ শহর ও শহরতলী এলাকা সমেত জেলার ৭ টি থানাতে পাক-হানাদার বাহিনী সর্বমোট ১২ টি বধ্যভূমিতে বাঙ্গালী নিধনযজ্ঞ চালিয়েছে। শহর ও শহরতলী এলাকার ৫ টি বধ্যভূমির মধ্যে বহু নরকঙ্কাল পাওয়া গেছে। তার মধ্যে ডাকবাংলো, কেওয়াটখালী, বড় বাজার, নিউমার্কেট ও কালীবাড়ির বধ্যভুমিতে সহস্রাধিক নরকঙ্কালের সন্ধান পাওয়া গেছে।

গত এক সপ্তাহ পূর্বে ময়মনসিংহ শহরের সাহেব আলী রোডের একটি পুকুরে বাক্সভর্তি নরকংকাল পাওয়া গেছে। অনুমান করা হচ্ছে পাকসেনারা ময়মনসিংহ শহর থেকে পালিয়ে যাওয়ার আগে লাশগুলোকে টুকরো টুকরো করে বাক্সভর্তি করে পুকুরে ডুবিয়ে রাখে। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ করা যেতে পারে যে ময়মনসিংহ শহর শুত্রুমুক্ত হবার অব্যাহতি পর শহরের বাসিন্দারা কালিবাড়ী, বড় বাজার, নিউমার্কেটের অন্ধকার গলিতে দুটি কয়োভর্তি নরকংকাল, নরমুণ্ডু উদ্ধার করে।

ময়মনসিংহ মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ব্রহ্মপুত্র নদের এপার ওপার অসংখ্য গর্ত ও অসংখ্য নরকংকাল বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। নরকংকাল গুলোর উপরে ও পাশে পড়ে রয়েছে চট ও কাপড়ের টুকরো টুকরো অংশ। জানা গেছে বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন ধরে নিয়ে নদী তীরে গুলী করে হত্যা করা হতো। পরে ঐসব লাশের কতক এখানেই মাটিচাপা দিয়ে ফেলত আর কতক লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হতো।

রাম অমৃতগঞ্জের ফজর ও চর আলমগিরের মফির নামক চর এলাকার দু’জন বাসিন্দা জানায়, ৮মাস ব্যাপি তারা ব্রহ্মপুত্র নদে গলাকাটা ও হাত পা বাঁধা অবস্থায় অসংখ্য লাশ ভেসে যেতে দেখেছে। এছাড়া পাকসেনারা ময়মনসিংহের সরচা, ক্ষীরা ও সুতুয়া নদীতে কত অসংখ্য বাঙ্গালীকে হত্যা করে সে ভাসিয়ে দিয়েছে তার হদিস হয়তো বা কোন কালেই পাওয়া যাবে না।“

তানিয়া ইমতিয়াজ লিপি
<৮,৫৩,৪৪৯> “হারেস মিয়া বাঁচেনি। কাশিয়াবাড়ী উচ্চ বিদ্যালয়ের সেক্রেটারি হারেস মিয়াকে ছোরা দিয়ে ওরা জবেহ করেছে। জবেহ করেছে স্কুলের শিক্ষক গোলজার মিয়াকে এবং আরো অনেককে। ধর্ষণ করেছে ফুলবানু গিরিবালাকে। সাত মাসের গর্ভবতী ফুলবানুর উপর এক এক করে ওই পশুগুলো ধর্ষণ চালালে ফুলবানু অতিরিক্ত স্রাবে সেদিন মারা যায়। পেট থেকে গড়িয়ে পড়ে একটি ছোট মৃত শিশু। আর গিরিবালাকে ধর্ষণ করার পর হাত উঁচু করে খুঁটির সাথে বেঁধে বেয়োনেট দিয়ে বুক চিরে মেরে ফেলে।“

[অগ্নিদগ্ধ, লুণ্ঠিত, ধর্ষিত কাশিয়াবাড়ি]
-দৈনিক পূর্বদেশ। ২৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২।

“অজপাড়া গাঁ হলেও কাশিয়াবাড়ি একেবারে ছোট্ট গাঁ নয়। গাইবান্ধা মহকুমার পলাশবাড়ী থানার এই গাঁ-টাতে ছিলো ৭০০ গৃহস্থবাড়ী। হিন্দু মুসলমানের বাসস্থান। মিলেমিশে ছিলো তারা এই গাঁয়ের মাটিতে। এক সম্প্রদায়ের সাথে ছিলো আরেক সম্প্রদায়ের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। পার্শ্ববর্তী গাঁয়ের আবাঙ্গালিরা কত সময় কতবার চেষ্টা করেছে এখানে দাঙ্গা বাঁধাবার কিন্তু কোনবারই তাদের সে চেষ্টা সফল হতে পারেনি। এ গাঁয়ের সাতশো হিন্দু মুসলিম গৃহস্থ এক পরিবারের ছেলে মেয়ে মা, বাবা।

স্বাধীনতা আন্দোলনের এক পর্যায়ে বর্বর পাকবাহিনী অত্যাচার তাণ্ডব লীলা চালিয়ে পার্শ্ববর্তী থানা ঘোড়াঘাটে এসে আস্তানা গেড়ে বসে। এখান থেকে মাইল চারেকের পথ ঘোড়াঘাট। একদিন এ গাঁয়ের লোক জানতে পারলো শীঘ্রই ওই পশুগুলো আশ- পাশের গাঁগুলোতে অত্যাচার বিভীষিকার রাজত্ব সৃষ্টি করবে। কথাটা ঠিকই ফললো। ক’দিনের মধ্যেই ঘোড়াঘাট সংলগ্ন বিভিন্ন গ্রামে অত্যাচারের তাণ্ডবলীলা শুরু হলো।

ঘর বাড়ী পুড়িয়ে ছাই করতে লাগলো। মা, বোনদের ইজ্জত নষ্ট করতে লাগলো। মানুষ ধরে ধরে গুলি করে পাখি শিকারের মতো মারতে লাগলো। ঘরের জিনিসপত্র লুটতরাজ করে নিয়ে যেতে লাগলো। লোকগুলো দিশেহারা হয়ে পড়লো। অত্যাচারের বীভৎস হাওয়া কাশিয়াবাড়ীতেও একদিন এসে ধাক্কা দিলো । ঘোড়াঘাটে ছিলো আবাঙ্গালির এক কলোনী। ওই আবাঙ্গালি কলোনির দুষ্কৃতকারী পাক বাহিনীর সাহায্য সমর্থন পেয়ে রাইফেল এবং অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হানা দিতে লাগলো কাশিয়াবাড়ীর শ্যামল মাটির বুকে।

কিন্তু হারেস মিয়া বাড়ী থেকে পালায়নি। তাঁর বিশ্বাস ছিলো পাক বাহিনী কাউকে মারবে না শান্তি কমিটির সেদিনের সভাতে সে আশ্বাসই তো বক্তারা দিয়েছিলো। কিন্তু হারেস মিয়া জানতো না ওদের কথার উপর বিশ্বাস করে বাঁচাবার কারো উপায় নেই। তাই হারেস মিয়া বাঁচেনি। কাশিয়াবাড়ী উচ্চ বিদ্যালয়ের সেক্রেটারি হারেস মিয়াকে ছোরা দিয়ে জবেহ করেছে।

জবেহ করেছে স্কুলের শিক্ষক গোলজার মিয়াকে এবং আরো অনেককে। ধর্ষণ করেছে ফুলবানু গিরিবালাকে। সাত মাসের গর্ভবতী ফুলবানুর উপর এক এক করে ওই পশুগুলো ধর্ষণ চালালে ফুলবানু অতিরিক্ত স্রাবে সেদিন মারা যায়। পেট থেকে গড়িয়ে পড়ে একটি ছোট মৃত শিশু। আর গিরিবালাকে ধর্ষণ করার পর হাত উঁচু করে খুঁটির সাথে বেঁধে বেয়োনেট দিয়ে বুক চিরে মেরে ফেলে। গ্রামটা আগুন লাগিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে নরপুশুরা।

তখনো যারা পালাতে পারেনি তাদের চারদিক থেকে ঘিরে ধরে ফেলে। প্রায় ৭শত লোককে স্কুলের মাঠে নিয়ে এসে বেদম প্রহর শুরু করে।

পাকিরা বলে, তোমহারা গাঁওমে মুক্তি ফৌজ হ্যাঁয়।
-নেই স্যার।
ঝুট বোলতো। তোমহারে গাঁওছে গোলিকা আওয়াজ শোনাথা। আওর হামারা পাছ ইনফরমেশন হ্যাঁয়।

এর কদিন বাদেই এ গাঁয়ে তথাকথিত শান্তি কমিটির তরফ থেকে মিটিং করতে এলো জামাতে ইসলাম আর মুসলিম লীগের লোকেরা। তারা আশ্বাস দিয়ে গেলো এ গাঁয়ের লোকদের। আপনারা পালাবেন না, কোথাও। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী আপনাদের ধ্বংস করতে আসেনি। আপনাদের খুশি করাই তাদের কাম্য। গাঁয়ের সরল নিরীহ লোকগুলো ভাবলো কথাটা হয়তো ঠিকই বলেছে।

এবার থেকে হয়তো অত্যাচারের পালা শেষ হবে। দেশে শান্তি আসবে। কিন্তু কি যে শান্তির দিন তাদের সামনে অপেক্ষা করছিল- একদিন আগেও তারা তা বুঝতে পারেনি। কিন্তু যেদিন তারা বুঝলো সেদিন আর আত্মরক্ষা কোন পথই তাদের সামনে থাকলো না। ১১ই জুন ক্যাশিয়াবাড়ীর সরল লোকগুলো দেখলো পিল পিল করে পায়ে হেঁটে কয়েকশ পাক সৈন্য দ্রুত তাদের গাঁয়ের দিকে ছুটে আসছে।

পালাও পালাও, যে যেখানে পারো পালাও। ওই যে দূরে দস্যু পাক বাহিনী ছুটে আসছে। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে সারা গ্রামটায়। মেয়ে পুরুষ বুড়ো জোয়ান যে যেদিকে পারছে পালাচ্ছে। তাড়া খাওয়া হরিণের মতো, অন্য কোন দিকে না তাকিয়ে সবাই গাঁয়ের পার্শ্ববর্তী ক্ষুদ্র নদীর মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁতারে ওপারে পালাতে থাকে। আবার অনেকে ধান আর পাটের ক্ষেতে শুয়ে লুকিয়ে পড়ে। শিশুরা কান্না থামাতে মাকে পাগল হতে হয়। সবাই আত্মগোপনে ব্যস্ত।

বাড়ী বাড়ী ঢুকে গরু ছাগল চাল ডাল থেকে শুরু করে সামনে যা পেত তাই ছিনিয়ে নিয়ে চলে যেতো। প্রতিরোধের সর্বপ্রকার উদ্যোগ নেয়া সত্ত্বেও এই হিংস্র পশুগুলোকে কোন বাধা দেয়ার সাহস পায়নি কাশিয়াবাড়ীর অসহায় লোকগুলো। আবাঙ্গালিদের এই ধরণের অত্যাচারে ভীত হয়ে পড়লো গাঁয়ের হিন্দুরা। তারা গাঁ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়ার পরিকল্পনা করতে লাগলো। কারন তাদের উপরেই ওই দস্যুদের অত্যাচারের মাত্রাটা ছিলো বেশী। ঠিক এমনি সময় সামনে এসে দাঁড়ালেন দারাজ কবিরাজ এবং গাঁয়ের অন্যান্য মাতবর। তোমরা যাবে না এখান থেকে। আমাদের ত্যাগ করে চলে যেয়ো না তোমরা। আমাদের জান দিয়ে হলেও তোমাদের আমরা রক্ষা করবো।

থমকে দাঁড়িয়েছিল হিন্দুরা। তাই তো, এদের ছেড়ে আমরা কেমনে করে যাই। এরা কোন দিন তো তাদের ত্যাগ করেনি। কোন দিন তো বেঈমানি করেনি। তবে কেনো এই দুর্দিনে তাদের ছেড়ে তারা পালাবে। যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলো হিন্দুরা। গাঁয়ের মাতব্বরদের সিদ্ধান্ত মতে হিন্দুদের মূল্যবান জিনিসপত্র মুসলমানদের ঘরে ঘরে এনে জমা রাখা হলো যাতে আবাঙ্গালিদের কোপদৃষ্টি থেকে জিনিস পত্রগুলোকে বাঁচানো যায়। সবাই মিলে আবাঙ্গালি কলোনির সেই দুষ্কৃতকারীদের হামলাকে প্রতিরোধ করার জন্য প্রতিরোধ গড়ে তুললো।

অতঃপর আরেকদিন সেই দুষ্কৃতকারীর এ-গাঁয়ে হামলা চালাতে আসতেই চারদিক থেকে তাদের ঘিরে ফেললো গাঁয়ের লোকরা। তোমরা আর এভাবে আমাদের জান-মাল লুটতরাজ করতে পারবে না। আমরা তোমাদের ক্ষতি করিনি। আমাদের তোমরা বাঁচতে দাও। ফুঁসে উঠেছিলো সেই আবাঙ্গালি দুষ্কৃতকারীরা। কিন্তু সেদিন কিছু একটা করবার সাহস তারা পায়নি। কারন সেদিন যার যা ছিলো তা-ই নিয়েই তৈরি হয়েছিলো গাঁয়ের লোকগুলো। কিন্তু সেদিন এ-গাঁয়ের লোকরা ভাবতেও পারেনি যে, ওই দুষ্কৃতকারীরা তাদের জীবনের সর্বনাশ ঘটবার জন্য কি জঘন্য ষড়যন্ত্র করে বসেছে…(অসমাপ্ত)”

তানিয়া ইমতিয়াজ লিপি
<৮,৫৪,৪৫১> ভৈরবে একদিনেই ৪শ’ লোককে গুলি করা হয়েছে!
[ভৈরবে হত্যাকাণ্ড]

-সংবাদ, ২৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২।
“১৯৭১ সালের এপ্রিল থেকে ১৫ই ডিসেম্বর পর্যন্ত এ ৯ মাসে বর্বর পাকবাহিনীর দস্যুরা বাংলাদেশের অন্যতম নদী বন্দর ভৈরবে ত্রাস এবং বিভীষিকার রাজত্ব চালিয়েছিল। হানাদাররা হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে, ভৈরব এবং আশুগঞ্জ এলাকার শত শত মাকে করেছে বিধবা, সন্তানহারা অনাথ, আবার অনেক পিতাকে করেছে স্ত্রীহারা, সন্তানহারা।

গত ১৫ই এপ্রিল পাকবাহিনীর ছত্রী সেনারা ভৈরবের বিভিন্ন এলাকায় প্রায় চারশত নিরপরাধ লোককে গুলি করে হত্যা করেছে।

এছাড়া ভৈরব ব্রীজের কাছে রেললাইনের উপর দাঁড় করিয়ে পঁচিশ জনকে গুলি করে মেরেছে। মেজর ইফতেখার ধরে নিয়ে গিয়েছে ভৈরবের ব্যবসায়ী, শহর আওয়ামীলীগের সভাপতি জনাব মতিউর রহমানকে। ধরে নিয়ে গিয়েছে ভৈরব পৌরসভার সহসভাপতি মসলন্দ আলীকে এবং ভৈরব ইউনিয়ন কমিটির সভাপতি বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আলহাজ্ব হাফিজউদ্দিন মিয়াকে।

বাঁচাতে পারেনি প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক শ্রীমোহনবাঁশি, কলেজের ছাত্র লোকমান, স্কুলের ছাত্র সেলিম, নীরব সমাজকর্মী সাত্তার, পথের ভিখারী আওয়াল এবং মুজিব বাহিনীর তরুণ যোদ্ধা ফরহাদ আলী, আখতার মিয়াকে দস্যু জল্লাদ বাহিনীর হাত থেকে। জল্লাদ ইয়াহিয়ার খান সেনারা ভৈরব ব্রীজের নিকট চলন্ত রেলগাড়ি থামিয়ে যাত্রীদের ধরে নিয়ে যায় নিকটস্থ রেল কলোনীতে। সেখানে যাত্রীদের সর্বস্ব লুট করে বেয়নেটের আঘাতে তাদের বুক চিরে হত্যা করে মেঘনার প্রবল স্রোতে ভাসিয়ে দেয়।

গত মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের দিকে বর্বর মেজর ইফতেখার বাজিতপুর এবং নিকলী থাকার প্রায় দেড়শত লোককে ধরে এনে তাদের মধ্য থেকে প্রায় ৩৫ জন স্ত্রীলোকের উপর পাশবিক অত্যাচার চালায় এবং বাকী লোকদের আশুগঞ্জের মেঘনার চরে গুলি করে হত্যা করে। গত ১৫ই এপ্রিল থেকে ২২শে এপ্রিল পর্যন্ত একটানা সাতদিন ধরে বর্বর পাক বাহিনীর দস্যুরা ভৈরবের রাণীর বাজার, চক বাজার, মরিচ পট্টি, কলেজ রোড, মসজিদ রোড, মিউনিসিপ্যাল অফিস রোড, রসুন বাজার, মুড়ি পট্টি, বাতাসা পট্টি, সিনেমা রোড বলতে গেলে বন্দরের সর্বত্র আগুন ধরিয়ে দেয়। ফলে কোটি কোটি টাকার মালসহ শত শত গোলা-গুদাম এবং দালানকোঠা পুড়ে ছাই হয়ে যায়। ভৈরব বাজার এখন সম্পূর্ণ ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। “

আলিমুল ফয়সাল
<৮,৫৫,৪৫২>
[ফেনীতে পাক বাহিনীর নৃশংসতার কাহিনী]
-দৈনিক আজাদ, ২৪ ফেব্রুয়ারী, ১৯৭২

“লক্ষাধিক শরনার্থীর দেশে প্রত্যাবর্তন ও তথায় কর্মচাঞ্চল্য শুরু হওয়ার পর জেলার ক্ষয়ক্ষতি ও গণহত্যার আরো চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।
প্রকাশ, ফেনী মহকুমার ১ লক্ষ ২০ হাজার শরনার্থীর মাঝে ১ লক্ষ ১৮ হাজার ফিরে এসেছে। এদের লুন্ঠিত দ্রব্যাদি পুনরুদ্ধার ও দখলকৃত সম্পদ দেয়ার জন্যে গণপরিষদ সদস্যের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি গুলো দ্রুত কাজ করে যাচ্ছে। জানা গেছে যে, গত ২৩ শে এপ্রিল পাক হানাদাররা ফেনীর মহকুমায় প্রবেশকালে সর্বপ্রথম দরবেশ আবদুল কাদেরকে গুলি করে হত্যা করে। তারা ফেনী শহরে প্রবেশকালে দেওয়ানগঞ্জ, আমতলী ও শহরতলীতে কয়েকশ লোককে হত্যা করেছিল। দীর্ঘদিন পর্যন্ত দেওয়ানগঞ্জের ট্র্যাংিক রোডের পার্শ্বে বহু নরকংকাল পড়ে থাকতে দেখা যায়। শহরের উপকন্ঠে একটি সরকারী ভবন সংলগ্ন বধ্যভূমিতে শতশত দেশপ্রেমিককে ধরে এনে হত্যা করা হয়।
একই আওময়ে বর্বরেরা মার্চেন্ট সমিতির কর্মকর্তা আব্দুস সাত্তারকে অপর ৮ জনের সাথে বেধে গুলী করে হত্যা করে। ফেণী কলেজের পাশ্ববর্তী একটি গোপণ বধ্যভূমিতে বাহির থেকে বহু লোক ধরে এনে হত্যা করা হয়েছে। এ দৃশ্যের প্রত্যক্ষদর্শী একজন রেলকর্মীর কাছ থেকে এ সংবাদ পাওয়া গেছে। এছাড়া ধুমাঘাট রেলওয়ে পুলের পার্শ্বে বৃদ্ধ যুবক ও অগণিত বালককে হত্যা করে নদীতে ফেলে দেয়া হয়েছে। জনৈক উর্দুভাষী স্টেশনের অদূরে এক বাংগালী ভদ্রলোকের বাড়িতে তিনটি বয়স্কা মেয়েসহ আশ্রয় নিয়েছিল। হানাদারেরা তাকেও রেহাই দেয় নি। পরিবারের সকলকে হত্যা করে আর মেয়ে তিনটিকে নিয়ে যায়। পরে তাদের লাশ পাওয়া যায়। পাক বর্বরেরা ধুম এলাকার বিশিষ্ট ব্যক্তিসহ ৩ শতাধিক লোককে হত্যা করে আর ১০২ টি ঘর ভস্মীভূত করে দেয়। মে মাসে ফেনী স্টেশনের পেছনের ডোবায় বহু অফিসার কে হত্যা করে নিক্ষেপ করা হয়েছে।
পাক হানাদারদের সহায়তায় এগিয়ে এসেছিল কুখ্যাত মহকুমা প্রশাসক বেলাল আহমদ খান। ফেণীতে ধ্বংসযজ্ঞ পরিচালনায় নেতৃত্ব দিয়েছিল সে। ব্যক্তিগত শত্রুতার জের ধরে সে বহু বিশিষ্ট লোককে হত্যা ও তাদের বাড়িঘর বিধ্বস্ত করতে সহায়তা করেছিল। রাজাকার ও বদর বাহিনীর শয়তানেরা বহু বিশিষ্ট লোককে হত্যা করেছিল। ফেণী এলাকার খালবিলে আর নদীতে মাছ ধরার সময় এখনও বহু নরকংকাল পাওয়া যাচ্ছে বলে জানা যাচ্ছে।“

তানিয়া ইমতিয়াজ লিপি
<৮,৫৬,৪৫৩>
[বগুড়ার ‘মান্নান ভাই’ এবং আরো কয়েকজন তরুণের হত্যার বিবরণ]
-বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা, ২৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২।

“মান্নান ভাই কোথায়? বগুড়ার সবার মনেই একটি প্রশ্ন। বগুড়ার আনাচে কানাচে সবাই জানেন এই ভাইটিকে। বয়স বেশী নয়। খুব বেশী হলে বিশ-বাইশ বছর হয়েছে। মান্নান ভাই ছিলেন খুবই ব্যস্ত, ঘুরতেন কাজের নেশায়। তাঁর কাজ ছিল ছাত্রদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা। শ্রমিক আর কৃষকদের মাঝে নিবিড় করে সম্পর্ক স্থাপন করা। বগুড়া জেলার পূর্বে চন্দনবাইসা আর পশ্চিমে শান্তাহার, পাঁচবিবির প্রায় প্রতিটি ছাত্রই তাঁর পরিচিত। অপরদিকে শেরপুর থেকে বগুড়ায় ঐতিহাসিক মহাস্থান আর গোবিন্দগঞ্জ পর্যন্ত তাঁর নাম ছাত্রদের মাঝে নিবিড় হয়ে ছড়িয়ে আছে।

স্কুল জীবনেই তিনি ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বগুড়া সেন্ট্রাল হাইস্কুল থেকে এস,এস,সি পাশ করার পর তিনি বগুড়া আজিজুল হক কলেজে ভর্তি হন। তিনি বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এইচএসসি পাশ করে একই কলেজেই বি,এসসিতে ভর্তি হন।

জনাব আব্দুল মান্নান প্রথমে ছিলেন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন বগুড়া জেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক। পরে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত ছিলেন সংগঠনের সভাপতি। মান্নান ভাই এর মৃত্যু স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। বর্বর পাক দস্যুরা নির্মমভাবে হত্যা করেছে তাঁকে।

১১ই নভেম্বর তারিখে পাক দস্যুরা তাঁকে হাত বেঁধে ধরে নিয়ে যায়। শুধু তাঁকেই নয়, বগুড়া শহরের সুতরাপুর থেকে আরো তিনজনেক ঘেরাও করে পাক বাহিনী ধরে ফেলে। মান্নান ভাই সেদিন তাঁর ভাইয়ের সঙ্গেই ঘুমিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি জানতেন না যে নিষ্ঠুর আল-বদর বাহিনী পাক দস্যুদের সঙ্গে ইতিমধ্যেই ষড়যন্ত্রের জাল বুনেছে।

সেদিনের সূর্য ওঠার বহু পূর্বেই রাতের অন্ধকারে জল্লাদের তাঁর বাড়ী ঘিরে ফেলে। এরপরই মান্নান ভাইয়ের সামনে হাজির হয়েছিল একজন নরঘাতক। হাত বেঁধে ফেলল মান্নান ভাইয়ের। ছোট ভাই হান্নানও রেহাই পেল না। তাঁর হাত পাও বাঁধা হলো। ট্রাক বোঝায় করে একসঙ্গে চৌদ্দজন বাংলার দামাল ছেলেকে ছিনিয়ে নীল ওরা। মায়ের বুক খালি করে মানুষ বোঝাই ট্রাকটি চলে গেল বহুদূরে। তখনো সান্ত্বনা ছিল হয়তো তারা ফিরে আসবে। কিন্তু মিথ্যে সান্ত্বনায় কি আর মনকে প্রবোধ দেয়া যায়? খবর এলো শহর থেকে দূরে ‘রানীর হাট’ নামক জায়গার কাছে চৌদ্দ জনকেই এক লাইন করে হাত চোখ বেঁধে গুলী করে হত্যা করা হয়েছে।

খবর শুনে ছুটে গিয়েছিলেন মান্নান ভাইয়ের আত্মীয়স্বজন। তাঁরা সবাই সেদিন জল্লাদদের নিষ্ঠুরতা অবাক হয়ে স্বচক্ষে দেখেছেন। একটি দেহের উপর আর একটি দেহ জড়িয়ে ঠিক একটি লাইন হয়েই পড়ে আছে। পড়েছিল মান্নান আর হান্নান। দুই ভাই যেন গলাগলি ধরে শুয়ে আছেন আর বারটি ভাইয়ের সঙ্গে। পাক দস্যুরা একটি লাশও আত্মীয় স্বজনের পছন্দ মত জায়গায় কবর দিতে দেয়নি। বাধ্য হয়েই একসঙ্গে একস্থানে সকলকে কবর দেয়া হয়েছে।

বগুড়া জেলার এই ছাত্র সংগঠক আইয়ুব আমলের কালো দশকে ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়ায় কারাগারে গিয়েছেন। তিনি ছাত্র আন্দোলনের জড়িত থাকায় বহুবার ‘ওয়ারেন্ট’ মাথায় নিয়ে আত্মগোপন করেছেন। এবারের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত থাকায় তার উপর নেমে এসেছিল মৃত্যুর পরোয়ানা।

আত্মগোপন করে তিনি এবার অক্টোবর মাস পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। কিন্তু ১১ই নভেম্বর দালালদের সহযোগিতার ধরা পড়লেন। তাঁর সঙ্গে ধরা পড়েছিল প্রতিবেশী মুক্তিযোদ্ধা সাইফুল ইসলাম। সবার সঙ্গে মান্নান ভাই চিরতরে ঘুমিয়ে আছেন। “
অপরাজিতা নীল
<৮,৫৭,৪৫৪> জল্লাদরা শেরপুর জেটিতে দুই হাজার লোককে মেরেছে!!

[মনুব্রিজে প্রকাশ্য গণহত্যা]
-দৈনিক আজাদ, ২৬ ফেব্রুয়ারী, ১৯৭২।

পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী মৌলভীবাজার মহকুমার বিভিন্নস্থানে যে হত্যাকান্ড চালিয়েছে সেসব বধ্যভুমি ক্রমে আবিষ্কার করা হচ্ছে।

এ ধরনের একটি বধ্যভুমি শেরপুর জেটি থেকে আবিষ্কৃত হয়। তথায় প্রায় দুই হাজার লোককে হত্যা করা হয় এবং তাদের লাশ কুশিয়ারা নদীতে নিক্ষেপ করা হয়।

শেরপুরে হানাদার বাহিনীর একটি সরবরাহ কেন্দ্র ছিলো। সেখান থেকে তারা নৌ ও সড়ক পথে সমগ্র জেলায় হামলা চালিয়েছে। শেরপুরে তিন-তিনবার মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়। ফলে পার্শ্ববর্তী গ্রাম হালোরখুনা, শেরপুর, বণগাঁও, কলরগাঁও, আয়েনপুর, নতুনবস্তি, মোবারকপুর ও কাসুরপুর জনশূণ্য হয়ে পড়ে।

শেরপুরে পাক বাহিনীর সুন্দর ঘাটি ছিলো। এমনকি তথায় নৌবাহিনীও ছিলো। এখান থেকে তারা নরহত্যাসহ যাবতীয় ধ্বংসযজ্ঞ চালাতো। তারা নৌ জাহাজ ও গানবোট ব্যাবহার করতো এবং তা থেকে কূলবর্তী গ্রামে গোলাবর্ষণ করতো। তারা বিভিন্ন স্থানে হামলা চালিয়ে বিশেষতঃ মহিলাদের ধরে তাদের অন্যান্য ক্যাম্পে নিয়ে যেতো।

এছাড়া গত ১৪ই মে হানাদার সৈন্যরা মৌলভীবাজারে মনুব্রীজের উপর বিভিন্ন লোককে ধরে এনে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করে। প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় অধিবাসীরা এ হত্যাকান্ডের নারকীয়তা এখনো ভুলতে পারছে না। হানাদার জল্লাদ বাহিনী উল্লেখিত দিনে সমস্ত থানাবাসীকে উক্ত ব্রীজে সমবেত হবার নির্দেশ দেয়।

ভয়ে আতঙ্কিত প্রায় এক হাজার লোক তথায় উপস্থিত হলে তাদের সামনে হিলারপুরবাসী ময়না মিয়া, কলমদার মিয়া ও উস্তার হাজীকে আনা হয় এবং ব্রীজের উপর শুইয়ে গুলি করে হত্যা করা হয় এবং পরে তাদের পানিতে ফেলে দেয়া হয়। ময়না মিয়া প্রাণে বেঁচে গেলে তাঁকে ক্যাম্পে নিয়ে তথায় হত্যা করা হয়। “

তানিয়া ইমতিয়াজ লিপি
<৮,৫৮,৪৫৫>
[মৌলভীবাজারে আরো বধ্যভূমির সন্ধান]
-সংবাদ, ২৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২
২৫শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২ (এনা)- শেরপুর জেটিতে হানাদার বাহিনীর বর্বরতা সাক্ষী এমন একটি বধ্যভূমি আবিষ্কৃত হয়েছে। এখানে প্রায় ১হাজার ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়। তারপর মৃতদেহগুলো কুশিয়ারা নদীতে ছুড়ে ফেলা হয়।

বরুরা চা বাগানের পশ্চিমে আচেরাতে আর একটি বধ্যভূমির খবর পাওয়া গেছে। জনসাধারণের সহায়তায় পুলিশ এটি আবিস্কার করেছে। শ্রীমঙ্গল কলেজের পূর্বদিকে এই বধ্যভূমিটি ছিল। এখানে ৪৩ জন চা বাগান শ্রমিককে হত্যা করা হয়। মৃতদেহগুলো একটি গর্তে কবর দেয়া হয়।

সাধুবাবাতেও তাঁরা আর একটি বধ্যভূমি আবিস্কার করেছেন। এখানে জল্লাদরা ৫০ জন হতভাগ্যকে হত্যা করে। ভাগ্যগুনে চার জন রক্ষা পায়। তারা মরেনি কিন্তু আহত হয়েছিল। এই মর্মান্তিক ঘটনা তাঁরাই বর্ণনা করেন।

আর একটি বধ্যভূমি আবিষ্কৃত হয়েছে কুলাউরা রেল ক্রসিংএ। এখানে একটি কবরে চল্লিশটি কংকাল পাওয়া গেছে।

জল্লাদদের আর একটি বধ্যভূমি ছিল মৌলভীবাজার কোর্ট। এখানে ৩৫ জনকে হত্যা করে জল্লাদরা। তারপর মৃতদেহগুলো গর্তে কবর দেয়া হয়।

বারবাড়িতে আর একটি বধ্যভূমি আবিষ্কৃত হয়েছে। মৌলভীবাজার শহর থেকে দূরত্ব আধা মেইল। এখানে যে কত লোককে হত্যা করা হয়েছে তার সঠিক সংখ্যা এখানে জানা যায়নি। “

তানিয়া ইমতিয়াজ লিপি
<৮,৫৯,৪৫৬-৫৭> “আগে আমাকে গুলি কর। আমাকে গুলি না করে আমার লোকদের তোমরা গুলি করতে পারবে না।“
বর্বর হানাদার পাক বাহিনীর সামনে দাঁড়িয়ে কোন জননেতার উক্তি নয় এটা। এই উক্তি একজন দেশপ্রেমিক নির্ভীক বাঙালী মিল প্রশাসকের। এই প্রশাসক ছিলেন একজন লেফটেন্যান্ট, আনোয়ারুল আজিম। নাটোরের গোপালপুর সুগার মিলে আরো প্রায় তিন শতাধিক হতভাগ্য মানুষের সঙ্গে নির্দয় হানাদার বাহিনী গুলিবদ্ধ করেছিল এঁকেও।
[গোপালপুর সুগারমিলে গণহত্যা]

-দৈনিক বাংলা, ২৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২
“মিসেস আজিম। তিন সন্তানের জননী। উনাকে খুব রোগা দেখাচ্ছিল। তিনি বললেন, প্রায় দশ মাস হয়ে গেছে সে নেই-এখন স্বপ্নের মতো মনে হয় সব। দুঃখ করবো কি বলেন, শুধু তাকেই তো মারে নি।

তিনশত মানুষকে- নিরপরাধ নিরস্ত্র তিনশত মানুষকে ঠিক পাশের কলোনিতে যাদের স্ত্রী-সন্তান আর আত্মীয়স্বজন রয়েছে কেউ কেউ হয়তো দাঁড়িয়ে দেখেছেও এক সময়ে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে মেরেছে। তারপর তাঁদের লাশ ফেলে দিয়েছে পাশের পুকুরে।

মিসেস আজিম আরো জানালেন, হানাদার বাহিনী দুটি দলে বিভক্ত হয়ে ঢুকেছিল গোপালপুরে নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলে। তাদের দোসর ছিল স্থানীয় অবাঙ্গালীরা। প্রথম দলটি ঢুকেছিল মুল মিলের অভ্যন্তরে, অপর দলটি একই সঙ্গে প্রবেশ করে মিলের পাশের কলোনিতে। প্রথম দলটি মিলে ঢুকে মিলের প্রশাসক জনাব আজিম, প্রশাসনিক অফিসার জনাব শহিদুল্লা, একাউনটেন্ট জনাব সাইফুদ্দিন আহমদ, ইক্ষু সুপারিনটেনডেন্ট জনাব গুলজার হোসেন তালুকদার, সহকারী একাউন্টেন্ট জনাব মান্নান ভুঁইয়া, কৃষি অফিসার জনাব কিবরিয়া, সহকারী ইক্ষু উন্নয়ন অফিসার জনাব হাসেম ও স্টেনোগ্রাফার জনাব রউফ সহ তিনশরও বেশী কর্মচারী ও শ্রমিককে মিলের পুকুরের পাশে লাইন করে দাঁড় করায়।তারপর তাদের গুলি করে হত্যা করে। মিসেস আজিম জানালেন, গোপালপুরে এই হত্যালীলার সঙ্গে যে সমস্ত পাক সামরিক অফিসার প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল তাঁরা হচ্ছে, মেজর শেরওয়ানী, ক্যাপ্টেন মোখতার ও মেজর ইউলিয়াম (প্রিন্টিং মিসটেক মনে হচ্ছে, উইলিয়াম হতে পারে)।

এদের মধ্যে প্রথমোক্ত দু’জন থাকতো নাটোরে আর তৃতীয়জন থাকতো ঈশ্বরদীতে। মিলের আবাঙ্গালি কর্মীদের যোগসাজদের কথা বলতে গিয়ে মিসেস আজিম জানালেন, ২৫ষে মার্চের কালো রাতের পর থেকেই এখানে আবাঙ্গালির উৎপাত বেড়ে গিয়েছিল। তাঁরা হিন্দুদের আর দেশপ্রেমিক অধিকার সচেতন মানুষের বাড়িঘর দখল করতো, লুটপাট করতো বিষয় সম্পত্তি, কিন্তু কিছু বলার উপায় ছিল না, কারন তখন তাঁরাই সর্বেসর্বা। কিছু বলতে গেলে বলতো- “ইয়েচীজ কো উপর হামলাগকা হক হ্যাঁয়।“

মিসেস আজিম বলেন, এসমস্ত যোগসাজশকারী যা করেছে তা ভাষায় বর্ণনা করা যায়না। হানাদার সৈন্যরা গুলি করে তিনশ’ বাঙ্গালীকে হত্যা করার পর মিলে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। কিন্তু এসব দালাল মৃত জনদের আত্মীয় স্বজনের লাশের কাছে যেতে দেয়নি। পুকুরে এসব হতভাগ্যের লাশ পচে যখন দুর্গন্ধ ছুটছিল তখন তারা গর্ত করে সেগুলোকে মাটিচাপা দিয়ে রাখে। এর আগে লাশের মধ্যেও ঘড়ি, আংটি, কলম ও অন্যান্য মূল্যবান দ্রব্য লুটপাট করে।

এছাড়া এই পশুরা বাঙালিদের ‘মিলিটারি ফের আয়েগা’ বলে বার বার ভয় দেখায়। ফলে মিল অঞ্চলের বাঙ্গালীরা সবকিছুর মায়া ত্যাগ করে কেবল প্রাণ হাতে করে যেতে বাধ্য হয়। মিসেস আজিমও তার এক ছোট ভাইও সন্তানদের সঙ্গে করে মিল এলাকা ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন গ্রামে। মিসেস আজিম জানালেন, আজিম সাহেব গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের মিলের গাড়ী ব্যবহার করতে দিয়েছেন, সাহায্য করতে চেষ্টা করেছিলেন নানাভাবে। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের প্রথম অবস্থায় হানাদার বাহিনীর মেজর আসলাম গোপালপুরে নিহত হয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে।

তাই মিলে হত্যাকাণ্ড চালাবার আগে হানাদাররা জানতে চেয়েছিল মেজর আসলামকে কে মেরেছে। মিলের নিরীহ কর্মচারীদের বাঁচাবার আশায় রিজার্ভ বাহিনীর সাবেক লেফটেন্যান্ট আজিম বলেছিলেন, “আমি মেরেছি, আমাকে ধরে নিয়ে চল তোমরা, কিন্তু মিলের নিরীহ কর্মচারীদের মেরো না।“

কিন্তু দোয়া বলে কোন বস্তু ছিল না পশুদের অন্তরে। তাই মেশিনগান চালিয়ে পাইকারি হত্যা করে পৈশাচিকতার দৃষ্টান্ত রেখে গেছে তাঁরা গোপালপুরের বুকে। যে পুকুরটিতে নরপশুরা ফেলে দিয়েছিল হতভাগ্য মানুষের লাশ, গোপালপুরের সহানুভূতিশীল জনগণ সে পুকুরটির নাম দিয়েছিল- শহীদ সাগর। “

তানিয়া ইমতিয়াজ লিপি
<৮,৬০,৪৫৮>
[স্বাধীনতার বেদীমূলে পিতা- পুত্র]

-বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা, ২ মার্চ ১৯৭২।

“পিতা তফিজউদ্দিনের বহু স্বপ্ন লুকায়িত ছিল তাঁর তৃতীয় পুত্র আয়নাল হককে কেন্দ্র করে। শৈশব থেকে মায়ের মায়া মমতা থেকে ছিল সে পুরোপুরি বঞ্চিত। তাই বাবাকে সেই স্নেহ পূরণের জন্য এই মাতৃহীন সন্তানের সব আবদারই নীরবে সহ্য করতে হয়েছে। এমনি করে ক্রমশ কেটে যায় আয়নালের ছাত্র জীবন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করে।

পিতার ‘মা মরা’ ছেলের শেষ আবদারে তার বিয়ে হলো ফেব্রুয়ারিতে। পাবনা দখলের পর পাকসেনারা অগ্রসর হলো দাসুরিয়ার দিকে। সেটা কুষ্টিয়া, ঈশ্বরদী ও রাজশাহীর রাস্তায় সংযোগস্থল। কয়েকজন ছেলের সাথে আয়নালও অস্ত্র নিয়ে লুকিয়ে ছিল দাসুরিয়াতে এক গোপন জায়গায় সেই সময়। ওদের মধ্যে একজন হানাদারদের হত্যা করার আক্রোশ সম্বরণ না করতে পেরে গুলি ছুড়লো ভুল করে। নিমিষেই বিরাট বহর দেখে তাঁরা ভীত সন্ত্রস্ত হলো। যেদিকে তাঁরা পা বাড়ায় সেদিকেই গুলি। সমস্ত দাসুরিয়া ঘিরে ফেললো সেনারা। বের করলো লুকায়িত মুক্তি সংগ্রামীদের।

৯ই এপ্রিলের ঘটনা। এ অমানুষিক অত্যাচারের ইতিহাস প্রকাশ করা যায় না। এসিড ঢেলে দিল তাদের চোখে মুখে তারপর বেয়োনেটের অত্তাচারে জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দিল তাদের। দস্যুদের কাযকালাপ দেখলেন অদূরে দাঁড়িয়ে এক বুড়ি- যার থাকবার শেষ সম্বল কুঁড়ে ঘরখানা জ্বালিয়েছে, কিন্তু তাকে হয়তো মারেনি খুবই বৃদ্ধ বলে।

পিতা পরের দিন দেখতে পেলেন তাঁর আশা- আকাঙ্ক্ষার মানিক আয়নালের দেহ যা কোন রকমে পরের ভোররাতে চুরি করে সরিয়ে আনা হয়েছিল। এত বড় আঘাত পিতা সইবেন কেমন করে। তিনি হতবাক হয়ে পড়লেন, আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলেন “তুমি এর বিচার করো”। খোদাপাক বোধহয় নিজ কানে শুনেছিলেন তাঁর এই আকুল আর্তনাদ। তাঁদের আশা পূর্ণ হয়েছে। এরূপ লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে দেশ আজ স্বাধীন, কিন্তু দুঃখ হয় এই বুড়ো বাবাও দেখে যেতে পারেননি তাঁর সাধের স্বপ্ন।

জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ। ইতিমধ্যেই পিতা তফিজউদ্দিন আহমদের ছোট ভাই মহিউদ্দিন, ঈশ্বরদী আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি ও তাঁর ছেলে পরিবার পরিজন ছেড়ে বন্ধুরাষ্ট্র ভারতে পাড়ি দিয়েছেন। সেখানে গিয়ে প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষন নিয়ে আবার শত্রু উৎখাতের সংগ্রাম শুরু করার জন্য।

প্রায় সাড়ে চারমাস এখানে-ওখানে লুকিয়ে থাকার পর তাঁর পক্ষে আর আত্মগোপন করে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। ভাইদের পরিবার পরিজন নিজের ছেলে মেয়ে, জামাই ইত্যাদি নিয়ে প্রায় ৪০ জোনের খোরাকের চিন্তায় তিনি শহরের দিকে ছুটলেন। ইতিমধ্যে কুচক্রী ইয়াহিয়া জোর গলায় সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছে জেনে শহীদ আয়নালের বাবা মনের মধ্যে কিছুটা আশার সঞ্চারও পেয়েছেন। শহরেও দু’এক বার গেলেন। ঈশ্বরদীর অবাঙ্গালী ও দালালরা দেখে ফেলল তাকে। এই সময় রাত কাটাতেন তিনি তার দাসুরিয়াতে অবস্থিত ফার্মের মধ্যকার চাকরের একটি কুটিরে। এটাকেই তিনি সব থেকে নিরাপদ স্থান ভেবেছিলেন। কিন্তু তাবেদার ও অবাঙ্গালীরা মিলে ঘিরে ফেললো তাঁর এই আশ্রয় তাঁদের আশা- আকাঙ্ক্ষার বড় শিকার দাসুরিয়া আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা ও কর্মী শেষ করতে।

১৪ই জুনের মাঝরাতে তাঁদের আজস্র গুলির আঘাতে তিনি শাহাদাত বরণ করলেন। বিলীন হয়ে গেল একটি সুখী বাঙ্গালী পরিবার।“

ফাতেমা জোহরা
<৮,৬১,৪৫৯-৬০> হত্যা করার আগে দস্যুরা ইমাম সাহেবকে “কালেমা পড়” বললে তিনি শ্রদ্ধার সাথে পবিত্র কালেমা আবৃত্তি করে শোনান। কিন্তু জনৈক দস্যু মুখ বিকৃতি করে বলে, “শালা গাদ্দার এক মাওলানা, কালেমা ভী পড়নে নেহী স্যাকতা”।
[কেউ পাশবিকতা থেকে অব্যাহতি পায় নি]

-দৈনিক আজাদ, ৮ মার্চ, ১৯৭২।

“উধার আটঠো লাশ হ্যায়। কুত্তাছে খিলানা হ্যায়, খিলাদো। আউর না কিসিকো দেনা হ্যায় দে দো। যাও, যো তোমহারা মর্জি করো”

পাক জল্লাদদের কথাগুলো অবিকল মনে রেখেছেন আমির হোসেন। ঠিক তেমনি মুখ বিকৃত করে শব্দগুলো শোনালেন আমাদের। ক্যান্টনমেন্ট এলাকা ছেড়ে আমরা পশ্চিম দিকের মনোহরপুর গ্রামে গিয়ে উঠতেই দেখা হয়েছিল আমির হোসেনের সাথে। আমির হোসেন মুক্তি বাহিনীকে গোপনে তথ্য সরবরাহের কাজে নিয়োজিত ছিলেন। পাক বাহিনীর হাতে ধরাও পড়েন। দীর্ঘ চার মাস হানাদারদের নরকে কাটাবার পর সৌভাগ্যক্রমে ছাড়া পেয়ে যান। ছাড়া পেয়ে বাড়ি ফেরার পথে গাঁয়ের বিসু মণ্ডলের বাড়ির কাছে দেখা হয় একদল দস্যের সাথে। সেই দস্যুদের একজন আমির হোসেনকে শোনায় উপরের কথাগুলো। তিনি ক পা এগুতেই সত্যিই দেখতে পান হাত পা বাঁধা উলঙ্গ অবস্থায় আটটি মরদেহ। তাঁদের কারো কারো শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিচ্ছিন্ন করা। বিমূঢ় আমির হোসেন দেয়ালটা ভেঙে লাশগুলো মাটিচাপা দিয়ে চলে যান আপন ঘরের দিকে। নীল বেদনার্ত হৃদয়ে।

আমির হোসেনের কাছ থেকে জানা গেল ক্যান্টনমেন্টের অসংখ্য হত্যাযজ্ঞের কাহিনী। তিনি বললেন, সেভেন ফিল্ড এ্যাম্বুলেন্সের ও,সি লেঃ কর্নেল আব্দুল হাইয়ের লাশ দুদিন পর আনা হয় সি,এম,এইচ-এ। তাঁর লাশ পাওয়া যায় গ্যারিশন সিনেমা হল সংলগ্ন পশ্চিম দিকের তালতলায়। তাঁর তলপেটে সতেরোটি বুলেটের চিহ্ন ছিলো।

এই কোম্পানির কোয়ার্টার মাষ্টার ক্যাপ্টেন শেখের ভাগ্যেও এই একই পরিণতি ঘটেছিলো। আমির হোসেন তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে আরো জানালেন, সি,এম,এইচের নার্সিং স্টাফ হাবিলদার অব্দুল খালেক ও তাঁর সঙ্গী ফজর আলী ও একজন সুবেদার এম,আই রুমে ঔষধ আনতে যাবার পথে রানওয়ের নিকটবর্তী দরজার কাছে ফিল্ড এ্যাম্বুলেন্সের সিপাইরা তাঁদেরকে গুলি করে হত্যা করে। এছাড়া সি,এম,এইচ এর মসজিদের ইমামকেও তাঁরা গুলি করে হত্যা করে। হত্যা করার আগে দস্যুরা ইমাম সাহেবকে “কালেমা পড়” বললে তিনি শ্রদ্ধার সাথে পবিত্র কালেমা আবৃত্তি করে শোনান। কিন্তু জনৈক দস্যু মুখ বিকৃতি করে বলে, “শালা গাদ্দার এক মাওলানা, কালেমা ভী পড়নে নেহী স্যাকতা”।

আমির হোসেন জল্লাদদের নরহত্যার পরিকল্পনা সম্পর্কে বললেন, বাঙ্গালী ধরে এনে প্রথমে আই,এস,আই অতঃপর সেখান থেকে ৬১৪ আই,এম,ইউ এবং পরে ৪০৯ জি,এইচ,কিউ-এ পাঠিয়ে দেয়া হতো। ৬১৪ এফ,আই, ইউতেই নাকি জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কঠোর নির্যাতন চালানো হতো।

এম,ই,এসের জনৈক কর্মচারী হারেছ উদ্দীন জানান যে, ৩০ মার্চ তিনি গ্রেফতার হন। ১৪ দিন ধরে ক্যান্টনমেন্টের ভেতর পাক সেনাবাহিনীর জল্লাদেরা তাঁর উপর অমানুষিক অত্যাচার চালায়। হারেছ উদ্দীনের কাছ থেকে ক্যান্টনমেন্টে অবস্থানরত তৎকালীন সামরিক বাহিনীর বাঙালি কর্মচারীদের পরিবারের মহিলাদের একটি বন্দী শিবিরের সন্ধান পাওয়া গেছে। সে জানিয়েছে, ৫৫ নং ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারীর ফ্যামিলী কোয়ার্টারের বারো থেকে পঞ্চাশ বছর বয়সের দু’শ পঁচানব্বই জন মেয়েকে আটক করে রেখে প্রতিদিন রাতে তাঁদের উপর পাশবিক অত্যাচার চালানো হতো। তিনি আরো জানান যে, তাঁদের সেলটি কিছুটা দূরে হলেও প্রতিদিন রাতেই ভেসে আসতো মেয়েদের করুন আর্তনাদ। সেই সাথে বর্বর পাক সেনাদের পৈশাচিক উল্লাসধ্বনি বাতাসের সঙ্গে মিশে এক মর্মবিদারী দৃশ্যের সৃষ্টি করতো। প্রতিদিন বিকেলে জনৈক সুবেদার এসে এইসব মেয়েরা কে কোথায় যাবে তারই একটি তালিকা প্রস্তুত করে যেতো। অতঃপর সন্ধ্যা হলেই উক্ত লিস্ট মোতাবেক নির্ধারিত মেয়েটিকে পাঠানো হতো নির্ধারিত স্থানে। কখনো কখনো আপন খেয়াল খুশীতে বাইরে নিয়ে এসে পাহারাদার কুকুরের দল উর্যুপরি নারী ধর্ষণে লিপ্ত হতো। একদিন একটি মেয়েকে এইভাবে পরপর চৌদ্দ জন নির্যাতন চালালে মেয়েটি সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলে। কিন্তু তবুও দুর্বৃত্তরা তাঁকে রেহাই দেয়নি। অচৈতন্য অবস্থায়ই নিজেদের লালসা চরিতার্থ করেছে। মেয়েটির পুনরায় জ্ঞান ফিরে আসতে নাকি ৩৬ ঘন্টা সময় লেগেছিলো। জনাব হারেছ বলেন, চৌদ্দ দিন পর তাঁকে কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। তারপর ঐ মহিলা নন্দী শিবিরের বাসিন্দাদের পরিণতি সম্পর্কে কিছুই বলতে পারেন নি। অপর একটি মহিলা শিবিরের কথাও তিনি উল্লেখ করেন।

২৫ শে সেপ্টেম্বর জেলখানা থেকে পুনরায় তাঁকে ক্যান্টনমেন্ট নিয়ে আসা হলে সেথা এফ,আই,ইউ-এ তাঁর উপর নতুনভাবে নির্যাতন করা হয়। সেখান থেকে ১২ নং এফ আই ইউ ব্যারাকের ১০ নং রুমে বহু মহিলাকে বন্দী অবস্থায় দেখতে পান, প্রতিরাতে ঐ ঘর থেকে তাঁদের চিৎকার শুনতে পাওয়া যেতো। এবং একই উপায়ে তারা পাশবিক নির্যাতন চালাতো। এইসব মেয়েদের যৌবন সাধারণত অফিসারেরাই ভোগ করতো। এই সম্বন্ধে হারেছ উদ্দীন আরো বলেন, বন্দীশিবিরের মহিলাদের সাধারণত তিন ভাগে ভাগ করে রাখা হতো। প্রথমভাগে ছিল যুবতী, দ্বিতীয়ভাগে ছিল মধ্যবয়সী এবং তৃতীয়ভাগে কয়েক সন্তানের মাতা। তিনি স্কুল কলেজের সুন্দরী মেয়েদের প্লেনে করে ঢাকা পাঠাতেও দেখেছেন।

হারেছ উদ্দীনের বর্ণনা থেকে আরো অনেক তথ্য জানা যায়। দখলদাররা ক্যান্টনমেন্টের ভিতরে আন্ডারগ্রাউন্ড সেল তৈরী করেছিল। যশোর পতনের পর ঠিক এমনি একটি সেল থেকে ১১৩ জনকে উদ্ধার করা হয়েছিলো। সবাই জীবিত অবস্থায় থাকলেও তাঁদের মধ্যে প্রাণ ছিলো না বললেই চলে। আলো বাতাস ও খাদ্যের অভাবে মাংসহীন হয়ে তাঁদের শরীর একেবারেই ভেঙে পরেছিলো। হাড্ডি কংকালসার দেহগুলি অসহ্য নির্যাতনের জ্বালা বহন করে এনেছিল।“

অপরাজিতা নীল
<৮,৬২,৪৬১>
[পীর-দরবেশরাও রেহাই পায় নি]
-দৈনিক আজাদ, ১১ই মার্চ, ১৯৭২

“পীর কইবুল্লা সাহেব। উত্তর বাংলার আনাচে-কানাচে তার হাজার হাজার মুরীদ, সাগরেদ। তার মাঝারি ধরনের বাড়িটায় সর্বদা গমগম করতো শত শত দর্শনার্থী। কোরান পাঠ, মিলাদ, মহফিলে, ওয়াজ নসিহত আর ওয়াক্তে ওয়াক্তে নামাজ – এক স্বর্গীয় পবিত্রতায় সারাক্ষন ভরে থাকতো এই পীর বাড়ী। পীর সাহেবের ছোট আরো ৩ ভাইও ছিলেন পীর।

প্রগ্রেসিভ মনোভাবের পীর সাহেব মনে প্রানে ঘৃনা করতেন সামরিক জান্তাদের ধর্মের ধোহাই দিয়ে লাখো মানুষ খুন এবং ধর্ষনকে। মুখ ফুটে কিছু না বলতে পারলেও তিনি নিরাপরাধ মানুষের প্রাণ এবং মা-বোনদের ইজ্জত ভিক্ষা চেয়ে সৃষ্টির্তার কাছে প্রার্থনা করতেন। ১৬ই ডিসেম্বর বাঙালি জাতিকে সর্বগ্রাসী ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচিয়েছেন সৃষ্টিকর্তা, জয় হয়েছে মানবতার। কিন্তু পীরসাহেব তা দেখে যেতে পারেননি। এর আগেই কসাই খানসেনাদের হাতে মর্মান্তিকভাবে প্রাণ দিতে হয়েছে তাকে।

পীর পরিবারের এক ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। ২৫ মার্চের পর তিনি পালিয়ে যান এবং ট্রেনিং নিয়ে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার নিযুক্ত হন। এই খবর পেয়ে মিলিটারীরা রমজান মাসের একদিন শেষরাতে হঠাত তাদের গ্রাম ঘেরাও করে। সেহেরী শেষ করে এবাদতে বসেছিলেন পীর সাহেব… তার এক ভাই ভাত খাচ্ছিলেন, অন্য একজন মসজিদে কোরআন তেলোয়াত করছিলেন। এই অবস্থায় বাড়ী ঘিরে ফেলে সামরিক জান্তারা একে একে ৪ ভাইকে গুলি করে হত্যা করে। সাথে খুন করে আরো ১১ জন সাগরেদকে।

হাতে তসবীহ ধরা অবস্থাতেই বড় পীর সাহেব মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। আরেক ভাই ভাতমাখা হাতে মৃত। একজন পড়েছিলেন ওজুর ঘটির উপর। সে এক মর্মান্তিক দৃশ্য। এখানে কশাইরা পীর বংশের এক শিশুকে নির্মমভাবে হত্যা করে। বাচ্চাটা দোলনায় ঘুমাচ্ছিল। পাকবাহিনী কয়েকবার গুলি চালায় এই ঘুমন্ত শিশুটির উপর।

পরেরদিন সকালের দৃশ্য আরো মর্মান্তিক ছিলো। শোকে বিহ্বল শত শত ভক্তরা লুটিয়ে পড়ছিলেন আঙ্গিনায়।

গোকুল গ্রামের তসিম পাড়ের জনৈক এই হত্যাকান্ডের নেপথ্যে ছিলো। কালো বোরখা পরে, মেয়ে সেজে সে মিলিটারিদের সাথে এসে পীরবাড়ি সনাক্ত করে দেয়। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে সে আদেশ নির্দেশও দিয়েছিল বলে জানা যায়, যা মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতাকেও হার মানায়।“

মোঃ; রাশেদ হাসান (নোবেল)
<৮,৬৩,৪৬২> “নারকীয় তাণ্ডবের আরেক লীলাভূমি গোপালগঞ্জ ডেভেলপমেন্ট সেন্টারে আজো ছড়িয়ে আছে চুড়ি, শাড়ী আর অসংখ্য কঙ্কাল।“
[নারকীয় তাণ্ডবের আর এক লীলাভূমি]

-দৈনিক বাংলা, ২৮ মার্চ ১৯৭২
“গোপালগঞ্জ সিও ডেভেলপমেন্ট অফিস। পাকিস্তানী সেনাদের একটা শক্ত ঘাঁটি । এ ঘাঁটির নায়ক ক্যাপ্টেন ফয়েজ মোহাম্মদ কালান্তরে অন্যতম নায়ক ক্যাপ্টেন সেলিম। বাঙ্গালীর সংগ্রামী লহুতে হাত রঞ্জিত করেছে এরা।

পাক জল্লাদেরা গোপালগঞ্জের এস্থানে কসাইখানা তৈরি করেছিল। কসাইয়ের অঙ্গনে মাহবুব-উর-রহমান চৌধুরী, গোলজার চৌধুরী প্রাণ দিয়েছে ওদের হাতে। কত যে মাহবুব উর রহমান চৌধুরী এখানে দেশমাতৃকার মুক্তিসংগ্রামে প্রাণ দিয়েছেন তাঁর হিসেব নাই।

জল্লাদেরা কাকে কোথায় হত্যা করেছে সব ঘটনা মানুষ জানতে পারেনি। ৬ই ডিসেম্বর, ১৯৭১ সাল। রাতের অন্ধকারে যেমন পাক জল্লাদেরা ২৫শে মার্চ ১৯৭১ সালে হায়েনার মত ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ঠিক তেমনি এ রাতে মুক্তি বাহিনী ও মিত্র বাহিনী যৌথ আঘাতে দিশেহারা হয়ে গোপালগঞ্জের ক্যাম্প ছেড়ে লোক চক্ষুর অন্তরালে সরে পড়ে। অসংখ্য মানুষের মৃত্যু-কেন্দ্র মিলিটারি ক্যাম্পে মানুষ যাত্রা করেছে।

কেউ গিয়েছে প্রিয়জনদের স্মৃতি চিহ্নের অন্বেষণে, কেউ গিয়েছে শহীদের সংখ্যা নিরূপণ করতে। স্মৃতিচিহ্ন অনেকে পেয়েছে। ক্যাপ্টেন ফয়েজ ও সেলিমের কক্ষে মেয়েদের হাতের চুড়ির স্তূপ, ছেড়া শাড়ী অথবা ব্লাউজ অনেকেই চোখের পানি মুছতে মুছতে নিয়ে এসেছেন। কিন্তু শহীদের সংখ্যা কেউ নিরূপণ করতে পারেননি। ক্যাম্পের সামনে ইটের স্তূপে খুলি, হাড়, ক্যাম্পের সামনের খোলা জায়গায়ও খুলি হাড়ের মেলা এবং ক্যাম্পের সামনে নদীর ভিতর জালে এখনও জড়িয়ে পড়ে মানুষের মাথার খুলি অথবা মৃত মানুষের কঙ্কাল।

কি করে এর হিসেব মিলবে?”

মোঃ; রাশেদ হাসান (নোবেল) এবং গুরু গোলাপ

<৮,৬৪,৪৬৩>
[একটি হালকা মেশিনগানের জন্য বত্রিশটি জীবনের পরিসমাপ্তি]

-পূর্বদেশ, ৮ এপ্রিল ১৯৭২
“একটি মাত্র এল, এম, জির জন্য গঙ্গাসাগর সেদিন রক্ত-সাগর হয়েছিল, বলছিলেন ডাঃ মোস্তাক চৌধুরী। গঙ্গাসাগর দীঘির পশ্চিম পাড়ের বধ্যভূমিতে দাঁড়িয়ে তিনটি গণকবর খুঁড়ে ইয়াহিয়ার বর্বর কর্তৃক নিহত কিছু মানুষের লাশ উঠাবার সময়। ওদের না ছিল হৃদয় না ছিল কাণ্ডজ্ঞান। এ দু’টোর একটা থাকলেও এ মানুষগুলোকে মারতে পারত না। বস্তুত: একটি এল, এম, জির জন্যই বত্রিশ-জন লোক প্রাণ হারিয়েছিল ইয়াহিয়া- ভুট্টোর জল্লাদ বাহিনীর হাতে। সম্প্রতি আখাউড়া রেলওয়ে জংশনের অনধিক পাঁচ মাইল দক্ষিণে গঙ্গাসাগর রেলস্টেশনের পাশে তিনটি গণকবর খুঁড়ে ২৬টি লাশ উঠানো হয়।

ঘটনার বিবরণে জানা যায় যে, গত জুন মাসের মাঝামাঝি এক সময়ে দু’জন মুক্তিযোদ্ধা রেকি করার উদ্দেশ্য নিয়ে গঙ্গাসাগর এলাকায় আসেন এবং তানমান্দাইল নামক গ্রামে আশ্রয় গ্রহণ করেন। আত্মরক্ষার জন্য তাদের হাতে ছিল একটি মাত্র হালকা মেশিনগান। জানা যায় যে প্রাথমিক রেকির পর মুক্তাঞ্চলে তাঁদের কেন্দ্রে চলে যাবার পরিবর্তে তাঁরা একটি মাত্র হালকা মেশিনগান নিয়ে শতাধিক পাঞ্জাবী সেনার ছাউনি সরাসরি আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন এবং সেই অনুযায়ী রাতের অন্ধকারের সুযোগে তাঁরা ছাউনি এলাকার ভিতরে প্রবেশ করেন। ইত্যবসরে জনৈক স্থানীয় দালাল মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান সম্বন্ধে তার সামরিক প্রভুদের সংবাদ দেয়। খান সেনারা তৎক্ষণাৎ আত্মরক্ষার ব্যবস্থা নেয়। এবং মুক্তিযোদ্ধা দু’জনকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলে। বেষ্টনীতে পড়ে অস্ত্র নিয়ে পালানো অসুবিধাজনক মনে করে তারা এল, এম, জি-টি গঙ্গাসাগরের জলে ফেলে খান পশুদের চোখে ধুলা দিয়ে বেষ্টনী ভেদ করে বাইরে বেরিয়ে আসেন। কিন্তু এলো এম জি টি কোথায় ফেলা হয়েছিল শত্রুরা সে স্থান চিনে রাখতে পেরেছিল। এদিকে সেই রাতেরই শেষের দিকে অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা দুজন আবার পাঞ্জাবীদের ছাউনি এলাকায় প্রবেশ করেন এবং সন্তর্পণে তাঁদের এল এম জি-টি উঠিয়ে নিয়ে আসেন। পরদিন পাঞ্জাবী পশুরা পরিত্যক্ত অস্ত্র উঠানোর উদ্দেশ্যে পানিতে নেমে অবাক হল। সে সময় পূর্বোক্ত স্থানীয় দালালটি সংবাদ দিল যে মুক্তিযোদ্ধা দুজনই অস্ত্র উঠিয়ে নিয়ে পার্শ্ববর্তী তানমান্দাইল অথবা ডাঙ্গাইলে কারো ঘরে সেটা রেখে পালিয়ে গেছেন।

এলেমজি উদ্ধারের জন্য শুরু হল পাক জল্লাদদের তানমান্দাইল ও ডাঙ্গাইল গ্রাম-দ্বয় অপারেশন। পাক বর্বররা মুক্তিযোদ্ধা কিংবা অস্ত্র কিছুরই সন্ধান পেল না বটে, কিন্তু তাদের অমানুষিকতা থেকে রক্ষা পেলনা এই দুই গ্রামের সরল নিরপরাধ মানুষ। শিশু, বৃদ্ধ, নারী, পুরুষ সবাই হল ইয়াহিয়ার জল্লাদদের উন্মত্তার শিকার। অকথ্য নির্যাতনের পর তারা উভয় গ্রামের প্রায় সব পুরুষ মানুষ ধরে নিয়ে আসে এবং মামুলি জিজ্ঞাসাবাদের পর বত্রিশ জনকে রেখে অন্যান্যদের ছেড়ে দেয়। পরে এই বত্রিশ জনকে তারা হত্যা করে গঙ্গাসাগরের পশ্চিম পাড়ের তিনটি গণকবরে পুঁতে রাখে।

হত্যাকারী জল্লাদ বাহিনী ও তাদের পোষ্য দালালদের বিরুদ্ধে আনিত এক মামলার ব্যাপারে এই লাশগুলো উঠানো হয়। নিহতদের আত্মীয় স্বজনরা যে তেরটি মৃতদেহ সনাক্ত করতে পেরেছেন তারা হলেন:- (১) আব্দুল গনি
(২) রিয়াজ উদ্দীন
(৩) সাধন মিয়া
(৪) মুসলিম মিয়া
(৫) কমল মিয়া
(৬) আবুল বাসার
(৭) আব্দুল খালেক
(৮) তারা মিয়া
(৯) আবুল ফয়েজ
(১০) আবুল হাসেম
(১১) ওমর আলী
(১২) সালু মিয়া এবং
(১৩) গোলাম কাদের।“

তানিয়া ইমতিয়াজ লিপি
<৮,৬৫,৪৬৪>
[আর এক শহীদ গণপরিষদ সদস্য নজমুল হক সরকার]

-দৈনিক বাংলা, ১০ এপ্রিল, ১৯৭২
৩৪ বছর বয়স্ক নজমুল হক সরকার ২৫ শে মার্চের কালোরাতে রাজশাহী শহরের এক গোপন স্থানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ঐ রাতেই দেড়টার দিকে হানাদার বাহিনী জনাব সরকারের রাজশাহী শহরের রানীবাজারস্ত বাস ভবন ঘেরাও করে। সেই সময় বাড়িতে কয়েকজন দূর সম্পর্কীয় আত্মীয় ছাড়া কেউ ছিলেন না।

বিপদের আভাস পেয়ে জনাব সরকার সন্ধায় তাঁর পরিজনের বাড়ী ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে নির্দেশ দেন। এবং নিজেও আত্মগোপন করেন। কিন্তু বিবেকের দারুণ দংশন সহ্য করতে না পেরে এবং কর্তব্যের আহবানে রাত আড়াইটার দিকে রিক্সা করে আওয়ামী লীগ অফিসের দিকে যাত্রা করেন মূল্যবান কাগজপত্র সরানোর উদ্দেশ্যে।

পথিমধ্যে তিনি হানাদার বাহিনীর একটি জীপের সম্মুখে পড়ে যান। সেখানেই জল্লাদের গুলিতে তিনি শহীদ হন। গুলি করার পর হানাদাররা তাঁর লাশ ট্রাকে করে উঠিয়ে নিয়ে যায়। জনাব সরকার গত সাধারণ নির্বাচনে রাজশাহী ৮ (এনই-৩৭) থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে ছয়জন প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং রাজশাহী জেলার মধ্যে সর্বাধিক ভোট পেয়ে জাতীয় পরিষদে সদস্য নির্বাচিত হন। রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই জনাব সরকার আওয়ামী লীগের সাথে জড়িত। ১৯৬২ সালের গণআন্দোলন থেকে শুরু করে তিনি সব সময়ই বাঙালীর অধিকারের জন্য সংগ্রাম করে গেছে।

রাজশাহী কোর্টের এই তরুন এডভোকেট অতি অল্প সময়ের মধ্যেই সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। তিনি পরপর দু’বার রাজশাহী উকিল সমিতির সেক্রেটারি নির্বাচিত হন। মিষ্টিভাষী, সুবক্তা, সাহসী, নজমুল হক আওয়ামী লীগের কর্মী মহলে নজমুল ভাই নামে পরিচিত ছিলেন।

আলামিন সরকার
<৮,৬৬,৪৬৫>
[দানবীর নূতনচন্দ্র সিংহ বাঁচতে পারেন নি]

গত বছর এই দিনে খান সেনারা তাঁকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছিল
-দৈনিক বাংলা, ১৩ এপ্রিল, ১৯৭২।

“তার একমাত্র ইচ্ছা ছিলো তিনি যেনো দেশের মাটিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে পারেন। সে ইচ্ছা তার পূরণ হয়েছে। দেশের মাটিতে তিনি মরতে পেরেছেন। তবে বড় নিষ্ঠুরভাবে প্রাণ দিতে হয়েছে তাকে। কখনো কেউ যা কল্পনাও করেনি।

গত বছর এই ১৩ এপ্রিল চট্রগ্রামের অদূরে নিজের হাতে গড়া কুন্ডেশ্বরী ভবনে তাকে হত্যা করা হয়।‌ কুন্ডেশ্বরী বিদ্যাপীঠের প্রতিষ্ঠাতা বাবু নূতন সিংহের কথা বলছি। এপ্রিলের প্রথম দিকে চট্রগ্রাম শহরের পতন হয়েছিলো। ১৩ তারিখ পাক বাহিনী কুন্ডেশ্বরী আক্রমণ করে। বাবু নূতন সিংহ তখন মন্দিরে প্রার্থনা করছিলেন। স্বাধীনতা ঘোষণার পর চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৪৭ জন অধ্যাপক সস্ত্রীক আশ্রয় নিয়েছিলেন সেখানে। সৈয়দ আলী আহসান, ডঃ এআর মল্লিক, ডঃ আনিসুজ্জামান, ডঃ কোরাইশী প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। চট্রগ্রাম থেকে আগরতলা যাওয়ার পথে জনাব এম আর সিদ্দিকীও কুন্ডেশ্বরীতে আশ্রয় নিয়েছিলেন।

পাক বাহিনীর অগ্রগতির খবর শুনে সবাই কুন্ডেশ্বরী ছেড়ে ভারতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে যায়। বাবু নূতন সিংহকে যাওয়ার কথা বললে তিনি রাজী হননি। বলেছিলেন, যদি মরতে হয় দেশের মাটিতেই মরবো। অনেক পীড়াপীড়ির পরেও তাকে রাজী করানো গেলো না। এদিকে পাক বাহিনী দ্রুত এগিয়ে আসছিলো। ১৩ এপ্রিল পাক বাহিনী কুন্ডেশ্বরী ভবনে প্রবেশ করে।

ছেলেরা আগেই পালিয়ে গিয়েছিলো। বাবু নূতন সিংহ তখন মন্দিরে প্রার্থনা করছিলেন। “জনৈক সালাউদ্দিন” তাকে সেখান থেকে টেনে হিচড়ে বাইরে নিয়ে এসেছিলো। তার চোখের সামনে মন্দির উড়িয়ে দিয়েছিলো। তারপর তাকে হত্যা করা হয়েছিলো নৃশংসভাবে। মেজর তিনটি গুলি করার পরেও “সালাউদ্দিন” রিভলবারের গুলি ছুঁড়েছিলো নূতন বাবুর দিকে। তিনি লুটিয়ে পড়েছিলেন। তেমনি মুখ থুবড়ে পড়েছিলেন তিন দিন।

সংক্ষিপ্ত জীবনীঃ নূতন বাবুর জন্ম ১৯০১ সালে। শৈশবেই তিনি মাতৃ পিতৃ হারা হন। আট বছর বয়সে গৃহত্যাগ করেন। তিনি নয় বছর বয়সে বার্মা যান। সেখানে মুদির দোকানে চাকুরী করেন। ১৯২২ সালে চট্রগ্রাম ফেরেন এবং বিয়ে করেন। তারপর কলকাতা যান। ১৯৪৬ সালে ঔষধালয় প্রতিষ্ঠা করেন। বিহারের বৈদ্যনাথ ধামে গিয়ে কুন্ডেশ্বরী মায়ের কবচ গ্রহন করেন। ১৯৪৭ সালে আবার চট্রগ্রামে ফিরে আসেন।

কুন্ডেশ্বরী বিদ্যাপীঠঃ নিজের মেয়েকে লেখাপড়া শিখাতে পারেননি তিনি। সে জন্য একটা ক্ষোভ ছিলো মনে। তখন রাউজান থানায় কোনো বিদ্যালয় ছিলো না। রাউজান থানার মেয়েদের লেখাপড়ার সুযোগের জন্য তিনি গড়ে তুলেছিলেন কুন্ডেশ্বরী বালিকা মন্দির। পূর্ণাঙ্গ আবাসিক বিদ্যালয় ছিলো এটি। শুধু রাউজান থানা নয়, দেশের সব এলাকা থেকেই ছাত্রীরা যায় সেখানে লেখাপড়া করার জন্য। বিদ্যালয়ের নিজস্ব ডাকঘর, সরাসরি টেলিফোন যোগাযোগ, পানির পাম্প, জেনারেটর, বাস ইত্যাদি ছিলো। মোট প্রায় ২ লাখ টাকার সম্পত্তি নষ্ট হয়েছে সেখানে।“

<৮,৬৭,৪৬৬>
[রংপুরের দুটি গণসমাধি]

-দৈনিক পূর্বদেশ, ৩০ এপ্রিল ১৯৭২
রংপুর, ২৬শে এপ্রিল(বাসস)- এখানে দুটি গণসমাধির সন্ধান পাওয়া গেছে। একটি রংপুর ক্যান্টনমেন্টের কাছে, আরেকটি শহর থেকে চার মাইল দুরে সাহেবগঞ্জ গ্রামে। একটি বিশেষ গণহত্যা অনুসন্ধানকারী দল এ গণসমাধিগুলোর সন্ধান দেন।

ক্যান্টনমেন্টের কাছের গণসমাধিটিতে প্রায় দু’শ ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়। ডাঃ জিকরুল হক এমসিএকেও এখানে হত্যা করা হয়েছে। সৈয়দপুরের ক’জন মাড়োয়ারীকেও এখানে এখানে হত্যা করা হয়েছে বলে জানা গেছে। টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ বিভাগের সুপারিনটেনডেন্ট সেখান থেকে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিলো।

সাহেবগঞ্জ গণসমাধি হত্যাকান্ডের আরেকটি লীলাক্ষেত্র। এখানে ১৯ জন বাঙ্গালী সামরিক অফিসার ও সৈনিককে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। একজন অফিসারের পকেট থেকে একটি ফটো ও চিঠি পাওয়া গেছে। অনুমান করা হচ্ছে সে অফিসারটির একজন ক্যাপ্টেন ছিলেন। তার স্ত্রীর লেখা পত্রে তাকে চাকরি ছেড়ে পালিয়ে যাবার অনুরোধ ছিলো।

হত্যাকান্ডের শিকার সামরিক অফিসার ও জোয়ানদের হাত বাঁধা ও চোখ তুলে ফেলা হয়েছিলো বলে অনুমান করা হয়।“
\
আলামিন সরকার
<৮,৬৮,৪৬৭-৬৯> “পাকবাহিনী বাংলাদেশের জনগণের উপর ইসলাম রক্ষার অজুহাতে যে অত্যাচার, গণহত্যা আর নির্যাতন চালিয়েছিলো তা দেখে অধ্যাপক মুজিবুর রহমান ধর্মের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলেন!! যদিও ২৫ মার্চের পূর্ব পর্যন্ত তিনি ছিলেন একজন খাটি মুসলমান !!! “
[অধ্যাপক মুজিবুর রহমান দেবদাস হয়ে বেঁচে আছেন]

-দৈনিক পূর্বদেশ, ৯ মে ১৯৭২।
“রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অংক বিভাগের অধ্যাপক জনাব মুজিবুর রহমান পাক বাহিনীর অসহ্য নির্যাতনের স্বাক্ষী হয়ে আজও বেঁচে আছেন। প্রতিদিনের মত ২৫-এর রাত্রিতেও বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে বসে গল্প করছিলেন তিনি। রাত্রি গভীর হয়ে গেছে, কিন্তু সেদিকে লক্ষ্য নেই কারো।

যাদের সঙ্গে গল্প করছিলেন তাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন হিন্দু অধ্যাপক। দেশে যে সামরিক নির্যাতন শুরু হয়ে গেছে তা কারো জানা ছিলো না। গভীর রাত। একদল লোকের বুটের শব্দ শুনে সবাই আৎকে উঠলেন। ইতিমধ্যে কয়েকজন পাক সৈন্য ঢুকে পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে। অধ্যাপকবৃন্দ তখনো বসে আছেন। সৈন্যরা কাছে এসে তাদের নাম জিজ্ঞেস করতে লাগলো। হিন্দু অধ্যাপকগণ নিজেদের মুসলমান নামে পরিচয় দিলেন। কিন্তু মুশকিলে পড়েছিলেন অধ্যাপক মুজিবুর রহমান।

তিনি নিজেকে সে নামে পরিচয় দেবার সাথে সাথে সৈন্যরা তার উপর নির্যাতন চালায়। বেশ কিছুক্ষণ মারধর করে তারা চলে যায়। অধ্যাপক রহমানের একমাত্র দোষ, বঙ্গবন্ধুর নামের সাথে তার নামের মিল ছিলো। এরপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর দিয়ে অনেক ঝড় বয়ে গেছে। ৪ এপ্রিল মুক্তি মুক্তিবাহিনী রাজশাহী শহর ও বিশ্ববিদ্যায় এলাকা পাঞ্জাবীদের হাত থেকে মুক্ত করে।

১৩ এপ্রিল পাক বাহিনীর প্রচন্ড আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা শহরের কর্তৃত্ব হারায়। এরপর শুরু হয় গণহত্যা ও নির্যাতন। ১৪ এপ্রিল ভাষা বিভাগের একমাত্র হিন্দু অধ্যাপক শ্রী সুখরঞ্জন সমদ্দারকে এবং ১৫ এপ্রিল অংক বিভাগের অধ্যাপক জনাব হাবিবুর রহমানকে পাক সেনারা ধরে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে।

শহীদ সমদ্দার বাবুর মরদেহের অংশবিশেষ কাজলা গ্রাম থেকে উদ্ধার করা গেছে। কিন্তু শহীদ হাবিবুর রহমানের কোনো খবর আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথি ভবনে থাকতেন। ২৫ মার্চের দুঃসহ বেদনা সহ্য করে তিনি নিজেকে অত্যন্ত অসহায় বোধ করছিলেন।

জনাব রহমানের বন্ধুবর্গ যারা হিন্দু ছিলেন তারা সবাই সীমান্ত অতিক্রম করেছেন। এসব কথা চিন্তা করে জনাব রহমান ক্রমেই মানসিক যন্ত্রণা করতে লাগলেন। ইসলাম রক্ষার জন্য পাক বাহিনী যে পন্থা অবলম্বন করেছিলো তা দেখে মুজিবুর রহমান সাহেব ধর্মের উপর আস্থা হারাতে বসেছিলেন। যদিও ২৫ মার্চের পূর্ব পর্যন্ত তিনি একজন খাটি মুসলমান ছিলেন।

ইয়াহিয়া এবং তার লেলায়িত সেনাবাহিনী বাংলাদেশের জনগণের উপর ইসলাম রক্ষার অজুহাতে যে অত্যাচার, গণহত্যা আর নির্যাতন চালিয়েছিলো তা দেখে অধ্যাপক মুজিবুর রহমান ধর্মের উপর আস্থা হারিয়ে ফেললেন। এই কারণে তিনি ১৯৭১ সালে ১০ মে তারিখে নিজেকে মুজিবুর রহমানের পরিবর্তে ‘দেবদাস’ নামে পরিচিত হন। তার এই নাম পরিবর্তনের কথা লিখিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেন এবং এরপর থেকে তার সাথে দেবদাস নামে যোগাযোগ করার অনুরোধ জানান। ১০ মে তারিখে অধ্যাপক রহমান নিজেকে ‘দেবদাস’ নামে পরিচিত করেন।

পাক সামরিক বাহিনী ঘটনাটি জানতে পায়। ১২ মে সামরিক কর্তৃপক্ষ অধ্যাপক দেবদাসকে গ্রেফতার করে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথি ভবনের দোতলায় একটি ছোট্ট রুমে তাকে রাখা হয়। এক সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক দেবদাস আমাকে জানালেন যে, এখানে থাকা অবস্থায় সাধারণ সৈন্যরা তাকে অকথ্য নির্যাতন করেছে।

তার শরীরে, মাথায় বুটের লাথি মারা হতো। ১১ দিন ধরে অতিথি ভবনে তাকে নির্যাতন চালানো হয়। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো সহকর্মী বন্ধুই তার সাহায্যে এগিয়ে যাননি বলে তিনি আমাকে জানালেন।

ঐ সময় অতিথি ভবনে সামরিক অফিসারদের অফিস ছিলো। শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের পাক বাহিনীর সহযোগী অধ্যাপক ডঃ বারী, ডঃ মকবুল হোসেন ডঃ মতিউর রহমানকে তিনি সামরিক অফিসারদের কাছে যাতায়াত করতে দেখতে পেয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে বন্দী থাকাকালীন সামরিক অফিসাররা মোটামুটি ভাল ব্যবহারই দেখাতো। কিন্তু সাধারণ সৈন্যরা অকথ্য অত্যাচার চালাতো বলে অধ্যাপক দেবদাস জানালেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ১১ দিন বন্দী রাখার পর একটি গাড়ীতে করে সামরিক কর্তৃপক্ষ অধ্যাপক দেবদাসকে পাবনা নিয়ে যায়। পাবনায় তাকে ৩/৪ দিন রাখা হয়। এই সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক ডঃ কাজী সালেহ আহমেদকেও তার সাথে নিয়ে যাওয়া হয়।

পাবনায় সামরিক অফিসাররা অধ্যাপক দেবদাসকে নানা রকম প্রশ্ন করেন। কিন্তু তিনি তাদের অন্যায় অত্যাচারকে মাথা পেতে নিতে অসম্মতি জানায়। যার ফলে তাকে সামরিক প্রহরায় নাটোরে পাঠানো হয়। নাটোরে তাকে পুলিশ লাইনে রাখা হয়। এখানে তাকে দীর্ঘদিন ধরে অত্যাচার চালানো হয়।

কিন্তু নিজের অত্যাচারের কথা অধ্যাপক দেবদাস কিছুতেই বলতে রাজী নন। শেষে কিছুটা মৃদু হেসে তিনি বললেন, ওরা আমার উপরে যে অত্যাচার করেছে তা বলে আর কি লাভ হবে। ওরা আমার সাথে বেশ ভালো ব্যবহার দেখিয়েছে, এই বলে তিনি চুপ করে রইলেন। বুঝতে পারলাম, অত্যধিক নির্যাতনের ফলে তিনি কথার খেই মাঝে মাঝে হারিয়ে ফেলেন। ঠিকমত খেয়াল করতে পারছেন না পূর্বের সব ঘটনা।

নাটোরে অধ্যাপক দেবদাসকে তিন মাস একটি ছোট্ট কামরায় বন্দী অবস্থায় রাখা হয়। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে তার অপরাধের শাস্তিস্বরূপ নাটোর জেলখানায় তাকে আটক রাখা হচ্ছে। নাটোরে বন্দী থাকাকালীন সময়ে পাক সামরিক অফিসাররা অধ্যাপক দেবদাসকে কয়েকটি প্রশ্ন করে। সবগুলো প্রশ্নের কথা তিনি বর্তমানে মনে করতে পারছেন না। কিন্তু কয়েকটি প্রশ্নের কথা তার মনে আছে আজো।

তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিলো, “আপনাকে ছেড়ে দিলে আপনি কাজে যোগদান করবেন কি না”
উত্তরে অধ্যাপক দেবদাস বলিষ্ঠ কণ্ঠে জানান, “তোমাদের স্বৈরাচারী সরকারের অধীনে আমি কাজে যোগ দিতে রাজী নই।
দ্বিতীয় প্রশ্ন, ” আওয়ামী লীগকে বাতিল করা সম্পর্কে তোমার মতামত কি”।
উত্তরে তিনি জানান, “আওয়ামী লীগ ৬দফার ভিত্তিতে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলো এবং বিপুল ভোটে জয়লাভ করেছিলো। সুতরাং আওয়ামী লীগকে বাতিল ঘোষণা করতে হলে নির্বাচনের পূর্বেই তা করা উচিৎ ছিলো। নির্বাচনের পরে তা বাতিল ঘোষণা করার অধিকার জনতা তোমাদের দেয়নি। তাই এটা করার মোটেই যুক্তিসঙ্গত হয়নি।
তৃতীয় প্রশ্ন ছিলো, “পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হলে ভারত একে দখল করে নিবে কিনা”। উত্তরে জনাব দেবদাস জানান, “ভারতের পাশে আফগানিস্তান, কাশমীর ও বার্মার মতো ছোট ছোট রাষ্ট্র রয়েছে স্বাধীনভাবে। সুতরাং ভারত তাদের যদি দখল না করে থাকে বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও তাকে দখল করবে না।”

নাটোরে বন্দী থাকার সময় যে বাবুর্চি তাকে খাবার দিয়ে যেতো সে ছিলো বাঙ্গালী। ঐ বাঙ্গালী মাঝে মাঝে বাইরের জগতের খোঁজখবর ও সিগারেট এনে দিত বলে অধ্যাপক দেবদাস আমাকে জানালেন। এছাড়া নাটোরের ছোট দারোগা ছিলো বাঙালি। সেও মাঝে মাঝে গোপনে দেখা করতো।

নাটোর জেলে বন্দী থাকাকালে অধ্যাপক দেবদাস মিলিটারীর সরাসরি সরাসরি হাত থেকে কিছুটা মুক্তি পেয়েছিলেন। জেলখানার পাশের একটি বাসার আনোয়ার নামে একজন ছাত্র তার পরিচিত ছিলো। আনোয়ার তার পরিচিত অধ্যাপককে বন্দী দেখতে পেয়ে গোপনে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এবং তার বন্দী থাকার সংবাদটা বিশ্ববিদ্যালয় এবং গ্রামের বাড়ীতে পৌঁছে দেয়।

নাটোরে দীর্ঘ তিন মাস বন্দী থাকার পর ১৯৭১ সালের ৫ সেপ্টেম্বর তাকে মুক্ত করে দেয়া হয়। অধ্যাপক দেবদাস মুক্তি পেয়ে জয়পুরহাটে চলে যান এবং দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত জয়পুরহাটে বোনের কাছে থাকেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ফেব্রুয়ারী মাসে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে ফিরে এসেছেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত তিনি কাজে যোগ দেননি। কাজে যোগদানের ব্যাপারে তাকে প্রশ্ন করা হলে তিনি হেসে উত্তর দেন, “কি হবে কাজে যোগ দিয়ে।” বিগত নয় মাসের বেতনও তিনি এ পর্যন্ত নেননি।

অত্যধিক নির্যাতনের ফলে অধ্যাপক দেবদাস বর্তমানে গুরুতররূপে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। মাঝে মাঝে তিনি জ্বরে ভুগছেন। মাথায় মিলিটারীর বুটের আঘাতের ফলে তার মস্তিস্কের গোলযোগ দেখা দিয়েছে। পূর্বের কোনো স্মৃতিকে তিনি ভালভাবে স্মরণ করতে পারছেন না। এছাড়া বেশিক্ষণ কথা বলতেও তার পক্ষে কষ্ট হয়। এ অবস্থায় তিনি পুনরায় অধ্যাপনার কাজে অংশ নিতে পারবেন কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে। অধ্যাপক মুজিবুর রহমান দেবদাস নামে এখনো নিজের পরিচয় দিচ্ছেন।

জনাব মুজিবুর রহমান ১৯৫২ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অংক শাস্ত্রে এম এ পাশ করেন। ১৯৬৪ সনে তিনি মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অংক শাস্ত্রে এম এ ডিগ্রী লাভ করেন। করাচী ও সিলেট সরকারী কলেজে অধ্যাপনা করেন। ১৯৬৭ সনে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন।“

<৮,৬৯,৪৭০-৭১>
[গাজীপুর অস্ত্র কারখানায় কয়েকজন কর্মচারীর হত্যাকাণ্ড]

–দৈনিক পূর্বদেশ, ১০ মে, ১৯৭২।

“গাজীপুর অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের পর থেকে পাক বাহিনী বাঙ্গালী অফিসারদের সন্দেহের চোখে দেখতে থাকে। তাই প্রথমে অফিসারদের হত্যা করার উদ্দেশ্যে মেশিনগানের সামনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করানো হয়। কিন্তু এই সমস্ত অফিসারদের পরিবারের লোকজনদের কান্নাকাটি ও অনুরোধে তাদের সেই সময়ের জন্য ক্ষমা করে দেয়া হয়।

এই সময় গাজীপুর অস্ত্রাগারের আবাসিক পরিচালক ব্রিগেডিয়ার করিমুল্লাহ কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্ট থেকে হেলিকপ্টার যোগে সেখানে আসে এবং পাক বাহিনীর সেনাদের সাথে গোপন আলোচনা করে। সেই সময় বাঙ্গালী অফিসারদের নিজ নিজ কোয়ার্টারে চলে যেতে নির্দেশ দেয়া হয়। পরের দিন ৩০শে মার্চ (১৯৭১) পাক বাহিনী বাঙ্গালী অফিসারদের কোয়ার্টারে খানাতল্লাশি করার অজুহাতে তাদের মালপত্র লুট করে নেয়।

পরে ২রা এপ্রিল পর্যন্ত প্রত্যেক দিন সিপাহীরা বাঙ্গালী অফিসারদের কোয়ার্টারগুলিতে হানা দিয়ে নানারুপ অত্যাচার করতো। হানাদার পাকবাহিনীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে অনেক বাঙ্গালী অফিসার তাদের পরিবারসহ গাজীপুর ছেড়ে নানাদিকে পালিয়ে যেতে থাকেন।

৩রা এপ্রিল মধ্যাহ্নে ব্রিগেডিয়ার করিমুল্লাহ ৬ জন অফিসারকে পাকবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ঢাকা চলে যাবার নির্দেশ দেয়। এই ৬ জন অফিসার ছিলেন ওয়ার্কস ম্যানেজার জনাব এ, কে মাহবুব চৌধুরী, ডাঃ মেজর নঈমুল ইসলাম, হেডমাষ্টার কুদ্দুস সাহেব, ওয়েলফেয়ার অফিসার মাহবুবুর রহমান ও আরো দু’জন অফিসার।

এই সমস্ত অফিসার ও তাঁদের পরিবারদের একটি বাসে করে এবং দু’টি গাড়ীতে করে নিয়ে আসা হয়। বাসে বিহারী এবং পাঞ্জাবীদের সাথে পাকবাহিনী বাঙ্গালীদের পাহারা দিচ্ছিল। গাড়ীগুলো যখন কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্টে পৌঁছে তখন ব্রিগেডিয়ার করিমুল্লাহ, ওয়াহেদ নামক একটি পাঞ্জাবী অফিসারকে বাস থেকে নামিয়ে নিজের গাড়ীতে তুলে নেয়।

জনাব মাহবুব চৌধুরী তখন ব্রিগেডিয়ারকে বাঙ্গালী অফিসারদের হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে নামিয়ে দেবার অনুরোধ করেন। কিন্তু ব্রিগেডিয়ার কোন জবাব না দিয়ে গাড়ী নিয়ে ক্যান্টনমেন্ট কোয়ার্টারের দিকে চলে যায়। আর বাসটি তখন পাক বাহিনীর তত্ত্বাবধানে আবার ঢাকার দিকে চলতে থাকে।

বাস ঢাকার এম, এন, এ হোষ্টেলে এসে থামলে পাকবাহিনী সকলকে নিচে নামবার আদেশ দেয়। বাসের বিহারীরা মোহাম্মদপুর চলে যায়। অন্য অবাঙ্গালীরা পাকিস্তানে যাওয়ার জন্য একটি ট্রাকে চড়ে বিমানবন্দরের দিকে যায়। নিরুপায় হয়ে বাঙ্গালী অফিসারগণ নিজ নিজ গন্তব্যস্থলে যাবার জন্য রিকশা ডাকবার উদ্যোগ নিলে বর্বর সেনারা অফিসারদের হোষ্টেলের ভেতর যেতে নির্দেশ দেয়।

এই সব অফিসারের পরিবারবর্গ তখন হোষ্টেলের বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকে। একটি নির্জন কক্ষে অফিসারদের নিয়ে আসা হলো। জোহরের নামাজের সময় শেষ হয়ে আসছে দেখে তারা পানির অভাবে বিনা অজুতেই হেডমাষ্টারের ইমামতিতে নামাজ আদায় করে নেন। নামাজ শেষ হতেই একজন সিপাই হেডমাষ্টার সাহেবের পেন দিয়ে প্রত্যেক অফিসারের পরিচয় লিখে নেয়।

দেরী হচ্ছে দেখে অফিসারগণ উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন। সিপাইকে তাঁদের পরিবারের লোকেরা বাইরে অপেক্ষা করছেন- এ কথা জানালে পরিবারবর্গকে ভেতরে নিয়ে আসার জন্য আদেশ দেয়। কিন্তু কেউ রাজি হলেন না এ প্রস্তাবে। তখন সকলে হেডমাষ্টার সাহেবকে বাইরে গিয়ে অপেক্ষারত পরিবারের লোকজনদের সান্ত্বনা দেবার জন্য পাঠালেন।

হেডমাষ্টার সাহেব সিপাইর সাথে তখন বাইরে এলেন। সকলকে সান্ত্বনা দিয়ে তিনি আবার চলে গেলেন। কতক্ষণ পরে বর্বর সেনারা শুধু হেডমাষ্টার সাহেবকে বাইরে চলে যেতে অনুমতি দেয়। মাষ্টার সাহেব যখন চলে আসছিলেন, তিনি দেখতে পান যে সিপাহীরা বাঙ্গালী অফিসারদের কাছ থেকে সমস্ত জুতা, মোজা, ঘড়ি ও টাকা-পয়সা কেড়ে নিচ্ছে। তারপর হায়েনার দল বাঙ্গালী অফিসারদের উপর পরপর চারটি গুলি করে।

একই সময়ে বাইরে অপেক্ষারত বাঙ্গালী অফিসারদের পরিবারের লোকজনও এই গুলির শব্দ শুনতে পান। কিন্তু তখনও তারা জানতেন না যে তাদের আপনজনদের পৃথিবীর মায়া ছেড়ে বাঙ্গালী হয়ে জন্মলাভ করার অপরাধে বর্বর পশুশক্তি গুলি করে হত্যা করেছে। এম, এন, এ হোষ্টেলে গুলির শব্দের পরেই মেজর মাহবুব চৌধুরী এবং মেজর নঈমুল ইসলাম তাদের ছেলেমেয়ে নিয়ে হেডমাষ্টারের পরিবারবর্গের সাথে চলে যান।“

-এই মেম্বার অব ন্যাশনাল এসেম্বলির হোস্টেলটাই কি বর্তমান শেরে বাংলা নগরের এম্পি হোস্টেল? কেউ বলতে পারেন?

মোঃ; রাশেদ হাসান (নোবেল)
<৮,৭০,৪৭২-৭৩> নরপশুর নির্মম অত্যাচারে তিলে তিলে ও,সি খালেক মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন।
[নির্মম অত্যাচারে নিহত ওসি]

-দৈনিক পূর্বদেশ, ২০ মে, ১৯৭২।।
“গত বছর ১৬ই এপ্রিল শুক্রবার বিকেলে চট্টগ্রাম শহরের কোন প্রত্যক্ষদর্শী যদি শহরের রাজপথে খোলা এক খানি জীপ গাড়ীর সামনে দু’হাত দু’দিকে দিয়ে বিধ্বস্ত একটা লোককে বাঁধা অবস্থায় হানাদার দস্যুদের গাড়ীতে ঘোরাতে দেখে থাকেন- তবে তিনি নিশ্চয়ই বিবস্ত্র লোকটার ওপর খড়িমাটি দিয়ে সাদা অক্ষরে লেখা ক’টিও পড়ে থাকবেন, ‘’ কোতোয়ালির ওসি খালেক এরেস্টেড’’।

সম্ভবতঃ দস্যুরা গ্রেফতারের পর এভাবে আর কোন বাঙ্গালীকে প্রকাশ্য রাজপথে প্রদর্শনী সহকারে পাশবিক অত্যাচার করেনি- কিন্তু কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসার জনাব আব্দুল খালেককে নিয়ে তারা তাই করেছেন। শুধু তাই নয়, চলন্ত গাড়িতে পশুর দল রাস্তার মানুষকে সাক্ষী সাক্ষী করে ওসি খালেকের গায়ে জুতা, লাঠি, কিল, ঘুষি মারতো।

এভাবে সারা বিকেল তারা শহর প্রদক্ষিণ করিয়ে তাকে কোতোয়ালিতে এনে হাজির করে সন্ধ্যায়। তারপর সারারাত নিরামহীনভাবে খালেক সাহেবের উপর চালায় অমানুষিক অত্যাচার। এরপর পাঠানো হয় তাকে ক্যান্টনমেন্টের জল্লাদখানাতে।

১৮ই এপ্রিল বিকেল বেলা জল্লাদখানা থেকে এক ফাঁকে জনাব খালেক তাঁর কাকার বাসায় টেলিফোন করে জানান যে, কাকা যেন তাঁর মুক্তির তদ্বির করেন।

খবর পেয়ে তিনি ক্যান্টনমেন্টে যান- খালেক সাহেবের সাথে দেখা করার জন্য। কিন্তু তিনি অনুমতি তো পানই-নি, বরং খান সেনাদের অশ্রাব্য গালিগালাজ শুনে বাসায় ফিরে আসেন।

২২শে এপ্রিল সকালের দিকে তিনি আবার তাঁর কাকার বাসায় টেলিফোন করলেন, জানতে চাইলেন কাকা তাঁর জন্য কিছু করতে পেরেছেন কিনা। জনাব খালেকের কাকা করম আলী সাহেব আমাকে জানালেন, ২২ তারিখ সকালে সে টেলিফোন করেছিলেন এবং বিকাল বেলায় আর তাঁকে জীবিত রাখা হয়নি।

প্রথমে হাতের আঙ্গুল ও হাত, এরপর পায়ের আঙ্গুল ও পা কেটে এবং শেষে দু’চোখ উপড়ে ফেলে দেওয়ার পর খালেক আর বেশিক্ষণ বেঁচে থাকেননি। অশ্রুসিক্ত নয়নে বাষ্পরুদ্ধ কন্ঠে জনাব আলী বলেন, খালেক পশ্চিম মাদার বাড়ীতে আমার বাসায় আশ্রয় নিয়েছিল- সেখান থেকে বাড়ি ঘেরাও করে তাঁকে ধরে নিয়ে আসে এবং আমার টাকা- পয়সা, স্বর্ণালঙ্কার, রেডিও, সেলাই মেশিন, কাপড়-চোপড়, ট্রাঙ্ক, স্যুটকেস, দলিলপত্র এবং আমাদের যাবতীয় সার্টিফিকেট তারা নিয়ে যায়।

জনাব আলী জানান, তিনি খালেককে ছোটবেলা থেকে লালন- পালন করে মানুষ করেছেন- কারণ তিনি ছিলেন নিঃসন্তান। খালেক সাহেব চট্টগ্রামের কলেজিয়েট স্কুলে লেখাপড়া করে, চটগা কলেজ থেকে বিএসসি পাস করেছিলেন। যদিও তাঁর বাড়ি ছিল ঢাকা জেলার অন্তর্গত বৈদ্যেরবাজার থানার মুচার চর গ্রামে, তথাপি তিনি তাঁর চাচার লালন-পালনে চাটগাতেই ছিলেন আশৈশব।

জনাব আলী জানান যে, খালেক সাহেব আওয়ামী লীগ রাজনীতির সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ছাত্রজীবন থেকেই জড়িত ছিলেন। তখনকার অসহযোগ আন্দোলন-পর্ব থেকে জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত খালেকের রাজনৈতিক সমর্থন ও কার্যকলাপের ব্যাখ্যাদান বাতুলতা হবে মাত্র।

তিনি বলেন, ২৫শে মার্চের পর ২৬, ২৭ এবং ২৮শে মার্চ পর্যন্ত দক্ষিণে বার্মা সীমান্তের টেকনাফ থেকে আরম্ভ করে রাঙ্গামাটি, রামগড় ইত্যাদি প্রত্যন্ত এলাকা থেকে অসহযোগ আন্দোলনকারীদের জন্য বিপুল পরিমাণে অস্ত্র এবং গোলাবারুদ সংগ্রহের কাজ খালেক সাহেব অত্যন্ত সক্রিয় সহযোগীতে দিয়ে এসেছেন।

শহীদ খালেক তাঁর বিধবা স্ত্রী এবং তিনটি শিশুসন্তান রেখে গেছেন। এরা সবাই করম আলী সাহেবের পোষ্য হিসেবে চট্টগ্রামে বসবাস করছেন।“

মোঃ; রাশেদ হাসান (নোবেল)

<৮,৭১,৪৭৪>
[রাজশাহীতে দস্যুবাহিনীর বর্বরতার প্রাথমিক জরীপ]

-দৈনিক পূর্বদেশ, ২২ মে, ১৯৭২।
“রাজশাহী, ২১শে মে (এনা)।– ইয়াহিয়ার হানাদার দস্যুবাহিনী রাজশাহীতে যে গণহত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ, ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে গেছে তার একটি প্রাথমিক জরীপ রিপোর্ট বের হয়েছে।

সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়য়ের সমাজকল্যাণ বিভাগের ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষকগণ সপ্তাহব্যাপী এক জরীপের মাধ্যমে বহু ঘটনা উদ্ঘাটন করেছেন।

তারা পঁচিশটি গ্রাম থেকে এ ব্যাপারে বহু তথ্য সংগ্রহ করেছেন। গণবাড়ীয়ার জনৈক জেলে প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণে জানান, পবিত্র রমজান মাসের এক কালো রাতে হানাদার বাহিনী গ্রামে ঢুকে মেশিনগানের সাহায্যে পঁচিশ জনকে গুলি করে হত্যা করে। জেলেটি গুলিবিদ্ধ হওয়া স্বত্ত্বেও অলৌকিকভাবে বেঁচে যায়।

১৯৭১ সালের মে মাসে জুগিসশো গ্রামে হানাদার বাহিনী শান্তি কমিটি গঠনের নামে ১৭ জন গ্রামবাসীকে একত্রীত করে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করায়। তারপর পেছন থেকে মেশিনগানের গুলিতে সকলকে হত্যা করা হয়। এখানে ইয়াহিয়ার বর্বর সৈন্যরা ২১৪ জনের উপর নির্যাতন চালায়। এর মধ্যে ১৪৫ জনকে মারধর করা হয় এবং অবশিষ্টদের গ্রেফতার, ধর্ষণ ও নানাভাবে নির্যাতন চালানো হয়। অত্যাচারিতদের মধ্যে ১৫৯ জন পুরুষ ও ৫৫ জন মহিলা ছিলেন।

এছাড়া হানাদার বাহিনীর দালালদের হাতে ৫০ জন নির্যাতিত হয়েছেন। এসব গ্রামের ৩০৯টি ঘর আংশিকভাবে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে এবং মোট ৭০৭টি বাড়ী ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। পাক বাহিনী যেসব ঘর পুড়িয়ে দিয়েছে তাতে ৫ লক্ষ ৬৯ হাজার ২০০ টাকার মতো সম্পতি নষ্ট হয়েছে।“

মোঃ; রাশেদ হাসান (নোবেল)
<৮,৭২,৪৭৫-৭৬>
[রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজের ক’জন শহীদ]
মরণের দামে জীবনকে যারা কিনলেন- শহীদদের নামে নামকরণ করা হয়েছে ক’টি ছাত্রাবাসের
-দৈনিক পূর্বদেশ, ১১ জুন, ১৯৭২।
“ইয়াহিয়ার জল্লাদ বাহিনী অন্যান্য জায়গার মত রাজশাহী জেলার অসংখ্য মানুষকে খুন করেছে। খুন করেছে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ অঙ্গনের কাজী নুরন্নবী, আবুল আমজাদ, আলমগীর, কাজল কুমার ভাদ্র, সাইফুল, কাইয়ুম, মান্নান, মোস্তফা, মনসুর, সিরাজ ও শামসুলকে।

কাজী নুরুন্নবী।
অত্যন্ত চেনা একটি মুখ। একজন সংগ্রামী ছাত্রনেতা। ছাত্রদের অধিকার আদায়ের অগ্রনায়ক। ভয় কি জিনিস তিনি জানতেন না। ১ম বর্ষ থেকে ৫ম বর্ষ পর্যন্ত তিনি অধিকার আদায়ের বিপ্লবী যোদ্ধা।

কাজী নুরুন্নবীর বাড়ী রাজশাহী জেলার নওগাঁ মহকুমার কাজীপাড়ায়। জল্লাদ ইয়াহিয়ার পাকবাহিনী অধিকৃত আমলে তিনি (কাজী) সম্পূর্ণভাবে অসহযোগিতা করেন। এমনি সময়ে ৫ম বর্ষের পরীক্ষা শুরু হলো। তিনি পরীক্ষা দানে বিরত রইলেন। শোনা যায় সেই মুহূর্তে তিনি গোপনে রাজশাহীতে কিছু অনুসন্ধান চালান। অনুসন্ধানকালে পাকবাহিনীর একজন দালাল রাস্তায় তাঁকে দেখা মাত্র ক্যান্টনমেন্টে গার্ড দিয়ে নিয়ে যায়। তারপর তাঁর আর কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি। পাকিস্তানী পতাকা পোড়ানোর অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে আনা হয়। সম্প্রতি শহীদের মহীয়সী মা, মেডিক্যাল কলেজে প্রধান ছাত্রাবাসের ‘শহীদ কাজী নুরুন্নবী ছাত্রাবাস’ নামকরণ অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন।

অধিকার আদায়ের আরেক সংগ্রামী নায়ক ছিলেন ৫ম বর্ষের (নতুন) শহীদ আবুল আমজাদ। অত্যন্ত মিষ্টিভাষী, মিশুক ছিলেন। ডাক নাম ‘পেয়ারা’ নামে বন্ধুদের নিকট তিনি প্রিয় ছিলেন। তিনি ভাল গিটার বাজাতেন। পেয়ারার বাবা কুষ্টিয়ার মেহেরপুর কলেজের ভূতপূর্ব অধ্যাপক ছিলেন। এরপর তিনি কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট স্কুলের সহকারী অধ্যক্ষ ছিলেন। ইয়াহিয়ার আমলে দুর্যোগপূর্ণ দিনগুলোতে তিনি, পেয়ারা ও পেয়ারার ছোট ভাইকে নিয়ে আশঙ্কায় কাল যাপন করছিলেন। কিন্তু একদিন নরপশুরা এসে বাসা থেকে পেয়ারা ও তাঁর বাবাকে ধরে নিয়ে গেল। আর ফিরে এলো না।

নাটকীয় ভাবে বেঁচে গেলো তাঁর ছোট ভাই। আর তাই পেয়ারার দেশের বাড়ীতে মা, ভাই-বোনদের সব ভার এসে পড়লো ঐ ছোট ভাইটির ঘাড়ে। শহীদের নামে ‘শহীদ আবুল আমজাদ ছাত্রাবাস’ নামকরণ করা হয়েছে।

সুন্দর, সুশ্রী, এক কথায় স্মার্ট বলতে যা বোঝায় সবগুলি গুন ছিল কাজল কুমার ভদ্রের। রাজশী মেডিক্যাল কলেজের সবচেয়ে চেনা মুখ। কাজল- কাজলদা একগাল হেসে কথা বলতেন। তিনি তখন তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। দেশের গোলযোগকালে প্রথমভাগেই জল্লাদদের শিকার হলেন। কাজলের বোনের উপর অনেক অত্যাচার চলে। পরে তাদের কোন সংবাদ আমরা পাইনি।

রাজনীতির পোকা ছিলেন যিনি, তিনি হলেন আলমগীর। অসুস্থ শরীর নিয়েই তিনি রাজনীতি করতেন। তিনি ছিলেন ১ম বর্ষের ছাত্র। তাঁর বাপ মা থাকতেন বরিশালে। দুর্যোগকালে তিনি রাজশাহীতে ছিলেন। পাকবাহিনী তাঁকে পাকড়াও করলো। অনেক জিজ্ঞাসাবাদের পর ছেড়ে দেয়া হল। পরীক্ষা দিতে বাধ্য করা হল। তিনি পরীক্ষা দিলেন, পাস করলেন। তারপর ক্যান্টনমেন্টে ডেকে আনা হল। গুলি করে মারা হল। উদ্ভট উপায়ে পাকবাহিনী ঘৃণ্য ইচ্ছা চরিতার্থ করলো। মহাবিদ্যালয়য়ের ছাত্ররা একজন রাজনৈতিক নেতাকে হারালো।

শহীদের নামে আল হেলাল ছাত্রাবাসের ‘’শহীদ আলমগীর ছাত্রাবাস’’ নামকরণ করা হয়েছে।

হানাদার আমলে গোপনে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেছিলেন যে দু’জন কর্মরত কর্মচারী, তাঁরা হলেন কাইয়ুম ও সাইদুল। কাইয়ুম ছাত্রাবাসের কেরানী আর সাইদুল টাইপিষ্ট। জীবনের প্রতি ঝুকি নিয়ে কাইয়ুম, সাইদুল অনেক দুঃসাহসী কাজ করেছিলেন। কিন্তু তাদের এই কাজের একটি দুর্বল অংশ বুঝতে পারে স্থানীয় অবাঙ্গালী ছাত্রদল। তারপর আর বিলম্ব হয়নি। একদিন দু’জনেই একসঙ্গে শেষ হয়ে গেলেন। তাই ছাত্রদের মাঝে কাইয়ুম, সাইদুল স্মৃতি হয়ে থাকলেন চিরকাল।

নগরবাড়ীর পথ দিয়ে আগত হিংস্র পাকবাহিনীর হাত থেকে পরিত্রান পাবার জন্য বর্ডার- এর দিকে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছিল বাবুর্চি মান্নান ও বয় মন্টু, সিরাজ, শামশুল এবং মনসুরেরা। বিধির ইচ্ছায় পদ্মার পাড়ে বড়কুঠির সামনেই বাঘের সম্মুখে পড়ে সেইসব হতভাগার দল। তারপর এক লাইনে মেশিনগানের গুলিতে লুটিয়ে পড়ল এতগুলো প্রাণ।“

মোঃ; রাশেদ হাসান (নোবেল)
<৮,৭৩,৪৭৭-৭৮>
[পাক হানাদারদের ধবংসযজ্ঞের কবলে কয়েকটি ঐতিহাসিক স্মৃতিচিহ্ন]

-দৈনিক পূর্বদেশ, ২৩ জুন, ১৯৭২।।
“পাকিস্তানী হায়েনার দল ১৯৭১ সালের ১৪ই এপ্রিল মঙ্গলবার বিকালে সৈয়দপুর থেকে (রংপুর) বৃষ্টির মত বুলেট ছুড়তে ছুড়তে দিনাজপুর শহর যখন পুনর্দখল তখন অনেকেই ধারণা করতে পারেনি যে, তাঁরা শুধু এ দেশের মানুষের রক্ত নিয়ে হোলি খেলবে না, সব রকম ঐতিহাসিক স্মৃতিচিহ্নগুলো ধ্বংস সাধন করবে।

দিনাজপুর শহর পুনর্দখল করবার পর সম্ভাবত ১৭ই এপ্রিল রোজ শুক্রবার বেলা ৯/১০ টার দিকে পাঞ্জাবী হায়েনারা কয়েকটি সাঁজোয়া গাড়ী নিয়ে শহর থেকে এলোপাতাড়ি গুলী করতে করতে দক্ষিনের পাকা রাস্তা ধরে ভারত সীমান্তের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। কিন্তু চেরাডাঙ্গির নিকট ‘’লক্ষী জলের সাঁকো’’ বলতে একটা রাস্তার সংযোগস্থলে ঐ পল্লী এলাকার সংগ্রামী ছাত্র- জনতার নির্মিত আমগাছের একটা ব্যারিকেডে বাঁধা পেল।

রাস্তার উপর ব্যারিকেড দেখতে পেয়ে পাক দস্যুরা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো। এরই প্রতিশোধ হিসেবে ব্যারিকেডের স্থান থেকে দূরপাল্লার শক্তিশালী রকেটের দ্বারা একের পর এক মহরমপুর, পাইকপাড়া, তাজপুর ও মহব্বতপুরের কিয়দংশ জ্বলিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করেছিল। সেদিনের সবচাইতে বেদনাদায়ক ও হৃদয়বিদারক ঘটনা হল যে পাঞ্জাবী নরাধমরা পাইকপাড়া নিবাসী স্থানীয় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষক জনাব মোহাম্মদ রোস্তম আলীকে ধরে নিয়ে আসে। বয়সে তরুণ ও বলিষ্ঠ চেহারার অধিকারী যুবক রোস্তম তাঁর পরিবারের জ্যেষ্ঠ পুত্র এবং একমাত্র উপার্জনক্ষম সন্তান ছিলেন। তাঁকে তারা কি বলেছিল এবং তিনি নিজে কি বলতে চেয়েছিলেন তা আজও জানা যায়নি। পাক সেনারা ঐ স্থান ত্যাগ করে চলে যাবার পর দেখা গেল রোস্তম আলী বাড়ী ফিরছে না।

তাঁর উদ্বেগাকুল পরিবার খোঁজাখুঁজি শুরু করলে বিকেল বেলা দেখা গেল রোস্তমের তাজা লাশ লক্ষীজল সাঁকোর ধারে কয়েক রাউন্ড গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পড়ে রয়েছে। স্বভাবতই আঁচ করা গেছে যে গাছ কেটে ব্যারিকেড নির্মাণের অভিযোগে রোস্তম দেশের জন্য ঐ এলাকার বাঙ্গালীদের মধ্যে প্রথম শহীদ হন। শহীদ রোস্তম কোনকালেই রাজনীতির সাথে নিজেকে জড়িত করেননি।

হায়েনার দল যখন বেলা ১/২ টার দিকে শহরে ফিরে আসছিল তখন পথে জেলার প্রাচীনতম (১৯৩২সন) হাইস্কুল চেরাডাঙ্গীপাড়ায় তারা সাঁজোয়া বাহিনী নিয়ে ঢুকে পড়ে। চেরাডাঙ্গী হলো ইউনিয়নের বোর্ড কার্যালয় ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রাণকেন্দ্র। বোর্ড কার্যালয় ভবনটি প্রধান মিলনায়তন সহ কয়েকটি ছোট ছোট কক্ষে বিভক্ত ছিল।

এসব কক্ষে জেলার বৃহত্তম চেরাডাঙ্গী জেলার কার্যালয়, চেরাডাঙ্গী ডাকঘর, চেরাডাঙ্গী দাতব্য চিকিৎসালয় ও ইউনিয়ন কনজুমার্স ষ্টোরের অফিসগুলো বিদ্যমান ছিল। এ ছাড়াও ঐ একই এলাকায় জেলার বৃহতম বেসরকারী ১৯৩২ সালে নির্মিত চেরাডাঙ্গী উচ্চবিদ্যালয়ের এক বিরাট হোস্টেল সহ চেরাডাঙ্গী নবীন মজলিস ও পাবলিক লাইব্রেরী নামে একটি ক্লাবও রয়েছে। হানাদার বাহিনী প্রথমে চেরাডাঙ্গীতে ঢুকে বেদম এলোপাথাড়ি গুলী করে স্কুলের বিজ্ঞান ভবন ও অফিস ঘরটিতে ঢুকে পড়ে।

এর পরপরই নাকি একদল সেনা ছুটে আসে চেরাডাঙ্গী বোর্ড কার্যালয়টিতে। প্রথমে ভালভাবে পেট্রোল ভবনটির বিভিন্ন কক্ষে ছিটিয়ে দেয় এবং একসঙ্গে কয়েক স্থানে আগুন ধরিয়ে দেয়। মাত্র এক ঘন্টার মধ্যে প্রাচীনকালের এ বোর্ড ভবনটি দেখতে দেখতে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। ফলে বোর্ড ভবনে রক্ষিত ইউনিয়নের ২২ হাজার অধিবাসীর যাবতীয় রেকর্ড ও আনুষাঙ্গিক দলিল পত্র পুড়ে যায়।

বোর্ডের প্রায় ১৫ হাজার টাকার আসবাবপত্রসহ বিভিন্ন মালামাল নিশ্চিহ্ন হয়েছে। চেরাডাঙ্গী পশু মেলার একটি বিরাট লোহার সিন্দুকসহ চেয়ার টেবিল আলমারী এবং বিগত ২৫ বছরের সবরকম কাগজপত্র পুড়ে গেছে। চেরাডাঙ্গী ডাকঘরটিও সেখানে তাঁর নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে পারেনি।“

শাহরিয়ার রাফি
<৮,৭৪,৪৭৯-৮১>
[ওরা ডাক্তার মেরেছে]

-বাংলাদেশের গণহত্যা, বাংলার বাণী বিশেষ সংখ্যা, ১৯৭২।
“’শুধু শ্লোগান আর মিছিলের সংগ্রাম নয়। যত সত্বর পারো ইমার্জেন্সি মেডিকেল ফার্স্ট এইড স্কোয়াড তৈরী কর্। ব্যপক রক্তক্ষরণের জন্য প্রস্তুত থাক”- ১৯৭১ সালের ২১ শে মার্চ যখন বাংলাদেশের পথে – প্রান্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়েছে তখন সিলেট চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ের ছাত্রদের উদ্দেশ্য করে যে কথাগুলো বলেছিলেন মানবতার সেবায় আত্মোতস্বর্গকৃত নির্ভীক মহৎপ্রাণ সিলেট চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ের প্রধান শল্য চিকিৎসক অধ্যাপক ডা: শামসুদ্দিন আহমদ।

বাংলাদেশে গণহত্যার বর্বরোচিত ও নৃশংসতম উদাহরণ বিশ্বে তুলনাহীন. কয়েক মিনিটের ঘটনা কিন্তু কত ব্যাপ্ত , কত বিস্তৃত , কত মর্মান্তিক , কত দুর্ঘটনা , কত মর্মস্পর্শী দৃশ্য , কত পৈশাচিকতা ছিল এ হত্যাকান্ডে। শতাব্দীর পর শতাব্দী বিশ্বে যে ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে , বাংলাদেশের গণহত্যার কাছে সব ম্লান হয়ে গেছে। এত বড় হত্যাকাণ্ড কোন ভাষায় লিখব , কেমন করে লিখব , কি লিখব , কে লিখতে পারবে? বাংলাদেশের এক কোটি পরিবারের কথা লিপিবদ্ধ করতে হলে এক কোটি ইতিহাস লিখতে হবে। তা না হলে এ নৃশংসতার বহু অধ্যায় বাদ পড়ে যাবে। কিন্তু তা কি সম্ভব? না সম্ভব নয়। সুতরাং এ ইতিহাস অলিখিত থাকবে। এ ইতিহাস লেখা যায় না। এ ইতিহাস লেখা যাবে না। এখানে ঐতিহাসিক ব্যর্থ , এখানে ইতিহাস ব্যর্থ . এ ব্যর্থ ইতিহাসে শহীদ ডা: শামসুদ্দিন আহমদ কে প্রকাশ করাও এক ব্যর্থ প্রয়াস।

কেন তাকে হত্যা করা হল? কেমন করে তাকে হত্যা করা হল? সৌম্য দর্শন দেবতুল্য লোকটিকে পাক বর্বর পশুরা কি করে গুলী করলো? এতো মানুষকে হত্যা করা নয় , মানবতাকে হত্যা করা হয়েছে। মার্চের অসহযোগ আন্দোলন শুরু হতেই অধ্যাপক শামসুদ্দিন আহমদ নতুন এক কার্যক্রম এর অবতারণা করলেন। অসহযোগ এর ফলে অন্যান্য দের কাজ কমে গেলেও তাঁর নতুন আরো কাজ বেড়ে গেল। সামনে কি ঘটতে যাচ্ছে তা তিনি যেন চোখের সামনে স্পস্ট দেখতে পেলেন। ছাত্র ছাত্রী সেবক সেবিকাদের ডেকে ফার্স্ট এইড স্কোয়াড গঠনে প্রবৃত্ত হলেন। প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি নিয়ে অনেকগুলো প্যাকেট তৈরী করে বিভিন্ন স্থানে মওজুত করে রাখলেন। তিনি যেন দেখতে পারছিলেন ঐ যে কয়েক গজ দূরে হানাদার বাহিনী তেড়ে আসছে , এতেই আঘাত করবে , এক্ষুনি ফার্স্ট এইডের প্রয়োজন হবে। হ্যাঁ, সত্যি সত্যি নরপশুরা এসে বর্বরোচিত আক্রমণ করেছে , অসংখ্য লোককে হত্যা করেছে , অগনিত লোককে আহত করেছে আর শল্যবিদ শামসুদ্দিন আহমেদ তড়িৎ গতিতে চিকিৎসা শুরু করেছেন। কিন্তু মানুষ শামসুদ্দিন কে যখন হিংস্র দস্যুরা গুলি করেছে , গুলি করে ধরাশায়ী করেছে , হত্যা করেছে তখন তাকে কেউ ফার্স্ট এইড দিতে আসেনি। কারণ তিনিই ছিলেন শেষ মানুষ , তিনিই ছিলেন শেষ সেবক, তিনিই ছিলেন সে ইতিহাসের শেষ নায়ক।

১ লা এপ্রিল , ১৯৭১ সাল। সূর্য সারা প্রকৃতিতে ছেয়ে রেখেছে। রক্তিম রশ্মী বিচ্ছুরিত হচ্ছে চারিদিকে. সিলেট শহর আবার শত্রু কবলিত। ২৫ শে মার্চের কাল রাতের পর হতেই স্বতস্ফুর্তভাবে বেংগল রেজিমেন্ট , তখনকার ই , পি, আর , আনসার , মোজাহিদ্, ইউওটিসি , ক্যাডেট , জেসিসি , ক্যাডেট, পুলিশ , ছাত্র ও যুবকরা সিলেটের বিভিন্ন জায়গায় মুক্তিবাহিনী গঠন করে শত্রুদের উপর মারাত্মক আঘাত হানে। কয়েকদিনের মধ্যেই সিলেট জেলার তিনশত মাইল সীমান্ত এলাকা থেকে সমস্ত পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যকে হত্যা অথবা বিতাড়িত করে মার্চের মধ্যেই সমস্ত হবিগঞ্জ মহকুমা , মৌলভীবাজার মহকুমা ও সুনামগঞ্জ মহকুমা মুক্তিবাহিনীর পূর্ন কর্তৃত্বাধীনে চলে আসে।

৩রা এপ্রিল মুক্তিপাগল বাঙ্গালী বীরেরা সিলেট শহর দখল করে নেয়। হানাদার বাহিনী শালুটিকর বিমানবন্দর ও সংলগ্ন জঙ্গলে আশ্রয় গ্রহণ করে। তারপরই শুরু হয় বৃস্টির মত পাক বাহিনীর বিমান হানা। সারা শহরে ঝাকে ঝাকে গুলির ঝড়। শত শত আদম সন্তান রক্তাক্ত আহত হয়ে হাসপাতালের দ্বারস্থ হয়। মানব সেবার প্রতীক প্রখ্যাত শল্যবিদ অধ্যাপক শামসুদ্দিন শানিত ছুরি হাতে ঘড়ির কাটার সাথে তাল মিলিয়ে কাজে রত রয়েছেন। হাসপাতালে আলো নেই , পানি নেই , পথ্য নেই। তাতে কি , শামসুদ্দিন সাহেব আছেন। এক হাতে অস্ত্র চালনা, অন্য হাতে অন্যান্য সব কাজ।

**৮ই মার্চ থেকে আবার শুরু হল তুমুল যুদ্ধ।…

-(এখানে দলিলে একটা ভুল আছে। এটা ৮ই এপ্রিল হবে)

…পাক দস্যুরা স্থল ও বিমানবাহিনি নিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে মুক্তি বাহিনীর উপর ঝাপিয়ে পড়ল। সমস্ত শহর তখন জনশূন্য . প্রানপণ বাঁচার আদিম উগ্রতায় শহরবাসী চলছে গ্রামের আশ্রয়ে – দুর্গত শহরের সাক্ষী ডাঃ শামসুদ্দিন আর তার রোগী। ছাত্রদের প্রতি ডাঃ শামসুদ্দিন – ” আমরা প্রবীন। আহত বাঙ্গালীদের সেবায় আমাদের থাকতে দাও। তোমরা নবীন যুবক , নিজেদের বুদ্ধি খাটিয়ে কাজ কর্। এখানে থেকে বর্বর পশুদের শিকার হয়ে কোন লাভ নেই”

ডাক্তারদের প্রতি – ” কোথায় যাবেন আপনারা? আমরা ডাক্তার্। রোগী ফেলে আহত মানুষ ফেলে আমরা তো কোথাও যেতে পারি না। “

সেই রক্তস্নাত ৯ই এপ্রিল। ইতিহাস থমকে গেছে। আন্তর্জাতিক রীতি নীতি ভংগ করে জেনেভা কনভেনশন এর নিয়ম অমান্য করে মারণাস্ত্র সহ কতকগুলো পাক নরঘাতক সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ঘেরাও করে অভ্যন্তরে প্রবেশ করল। শল্য প্রকোষ্ঠ. বুদ্ধিদীপ্ত ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন গৌরবর্ণ সুদর্শন অধ্যাপক শামসুদ্দিন আহমদ অবিশ্রান্ত কর্মরত। ঝড়ের বেগে প্রকোষ্ঠে ঢুকে সংগীন উচিয়ে ক ‘টি পশু সেনা ডাঃ শামসুদ্দিন আহমদ কে ছোঁ মেরে নিয়ে গেল। হাসপাতালের পূর্ব -দক্ষিন কোনে অশ্রুসিক্ত সবুজ ঘাসের শীষে দাঁড় করালো তাকে। তারপর্। না , আমি সম্বিত হারিয়ে ফেলছি। কি লিখবো , কেমন করে লিখবো। লিখে কি হবে?লাভ কি? পৃথিবীর মানুষ কি বিশ্বাস করবে আমাকে? অবিশ্বাস্য ঘটনা কি বিশ্বাস করা যায়। না , অন্যের বিশ্বাস অবিশ্বাসের উপর নির্ভর করে আমি লিখবো নাকি? আমি আমাকে তো অবিশ্বাস করতে পারি না। ভগবান যীশুও ক্রুশবিদ্ধ হয়েছিলেন। হ্যা , হাসপাতালের চিরাচরিত মানবিক পবিত্রতা কে বিদীর্ণ করে গুলী করা হল। গুলি করা হল ঋষি শামসুদ্দিন কে , মানুষ শামসুদ্দিন আহমদ কে।

উনসত্ত্বরের গণআন্দোলনে ডাঃ শামসুদ্দিন বলেছিলেন – “হে সভ্য জগত, গনআন্দোলনকে দমন করতে গুলি করো না। তার বদলে ব্যবহার কর রাবার বল বা বেগে চালিত পানি। ” এক – দুই করে তিনটি গুলী করা হল তাঁকে। মৃত্যুহীন প্রাণ ক্ষনিকের ভিতর শেষ হয়ে গেল। প্রানপ্রিয় দরদী শিক্ষককে অনুসরণ করল তরুণ অস্ত্র প্রচারক ডাঃ শ্যামল কান্তি লালা , সহকারী সেবক মাহমাদুর রহমান , এম্ব্যুল্যান্স চালক কোরবান উল্লাহ। ক্লান্ত হল নরপশুদের সামরিক ক্ষুধা।

ডাঃ শামসুদ্দিন ছিলেন মানব সেবার ইতিহাসে এক বিরল আদর্শ। কি সম্মোহনী শক্তি তার ছিল জানি না। ছাত্রবেলা থেকেই তিনি ছিলেন নম্রভাষী। তাঁর কাজই কথা বলত। বিভাগ – পূর্ব ভারতে তিনি ছিলেন আসাম মুসলিম স্টুডেন্টস ফেডারেশনের সভাপতি। কলিকাতা মেডিকেল কলেজে অধ্যয়নকালে তিনি ছিলেন প্রথম শ্রেনীর ছাত্র নেতাদের অন্যতম ।

সেবাই ছিল অধ্যাপক শামসুদ্দিন আহমদের প্রধান ও প্রথম ধর্ম। তাই সেবা করতেই তিনি জীবন বিলিয়ে দিলেন। আজীবন সেবাধর্মী ডা শামসুদ্দিন ছিলেন গঠনমূলক কাজে পারদর্শী ও অভিজ্ঞ। তরুণ ডাক্তার হিসেবেই তিনি ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান মেডিকেল এসোসিয়েশন এর সাধারণ সম্পাদক . অফুরন্ত ক্ষমতাসম্পন্ন ডাঃ শামসুদ্দিন মেডিকেল সার্ভিস এসোসিয়েশন এর মৃতপ্রায় প্রতিষ্ঠান কে শক্তিশালী করে তোলেন। তিনি ছিলেন একজন বিশিষ্ট চিন্তাবিদ ও সংগঠক। তিনি বহু জনকল্যাণকর প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা। তিনিই প্রতিষ্ঠা করেন পাকিস্তান এম্ব্যুলেন্স কোর্।

১৯৬৪ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন জালালাবাদ অন্ধ কল্যাণ সমিতি। “অন্ধজনে দেহ আলো” এ মূল মন্ত্র নিয়ে এ সমিতির উদ্যোগে সিলেট , মৌলভীবাজার , শ্রীমঙ্গল , হবিগঞ্জ , কুমিল্লা ও নোয়াখালীতে এ পর্যন্ত ১৪টি চিকিৎসা শিবিরের মাধ্যমে কয়েক হাজার রোগীকে দৃস্টিশক্তি ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। দক্ষিন – পূর্ব এশিয়াব্যাপী এ প্রতিষ্ঠানের সুনাম বিস্তৃত .

ডাঃ শামসুদ্দিন আহমদের আর একটি কীর্তি হল সিলেট যক্ষা নিবারনী সমিতি। এর মাধ্যমে বহু দূরারোগ্য যক্ষা রোগীকে চিকিৎসা করা হয়ে থাকে। তিনি আরো প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রক্তচাপ ও বহুমূত্র রোগ নিরোধ কেন্দ্র। বহু লোকও এর মাধ্যমে উপকৃত হয়েছে।”

শাহরিয়ার ফারুক
<৮,৭৫,৪৮২>
[ওরা সাংবাদিক মেরেছে]

-বাংলার বাণী, বিশেষ সংখ্যাঃ ‘বাংলাদেশে গণহত্যা’, ১৯৭২।

নিজামুদ্দীন আহমেদ,সাংবাদিক জগতে একটি বিশিষ্ট নাম। এই নামটির সাথেই সম্পর্ক ছিল, পিপিআই,বিবিসি,এপিএ,ইউপি,আই’ র। বাংলাদেশের স্বাধীনতা চূড়ান্তরুপ নেয়ার প্রাকমুহুর্ত পর্যন্ত বৃটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশনের ( বিবিসি) অনুষ্টান শুনতে গিয়ে যেসব সাংবাদিকের পাঠানো সংবাদ শুনতে বহু লোক উদগ্রীব হয়ে থাকতেন তাদের মধ্যে নিজামুদ্দীন অন্যতম। এখানে বিবিসির সংবাদ ঘোষকদের কন্ঠ থেকে খবর ভেসে আসে নিয়মিত প্রতিদিন। কিন্তু শোনা যায় না একটি ঘোষনা ঢাকা থেকে আমাদের সংবাদদাতা নিজামুদ্দীন আহমেদ খবর পাঠিয়েছেন। কয়েকমাস আগে পর্যন্ত সবাই অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে থাকতো,তাঁর পাঠানো সংবাদ শোনার জন্য,আর অবাক হয়ে ভাবতো কি দূরন্ত সাহস লোকটার,সাড়ে ৭ কোটি বাঙালির স্বাধীনতার জন্য মৃত্যুকে হাতের মুঠোয় নিয়ে কেমন করে তিনি সেদিন পাঠিয়েছেন খবরের পর খবর। বাংলাদেশ পাক বর্বর বাহিনীর হত্যাকান্ড আর ধ্বংসলীলা খবর পাঠিয়ে জাগিয়ে তুলেছিল বিশ্ব মানবতাকে। আর মুক্তিযোদ্ধাদের এক একটি দু:সা্হসিক অভিযান সম্পর্কে সংবাদ প্রকাশ করে অনুপ্রানিত করে তুলেছেন বাংলাদেশের মানুষকে।

আলবদর তাকে ছিনিয়ে নিয়ে যায় ১২ ই ডিসেম্বর দুপুর ২ টায় তাঁর একান্ত প্রিয়জনের মাঝ থেকে। সেদিন তাঁর প্রিয়জন তাঁর স্ত্রী,১১ বছরের মেয়ে শিল্পী, ৯ বছরের রিমি আর ছোট্ট বাপ্পি অবাক বিস্ময়ে দেখেছিল তাদের প্রিয়জনকে খাবাত টেবিল থেকে নিয়ে যাচ্ছে দস্যুরা, ছোট্ট ছেলেমেয়েগুলোর আকুল আর্তনাদেও নরপিশাচদের মন এতটুকু টলেনি। তাকে নিয়ে যাওয়ার পর ছোট্ট শিল্পী,রিমি,বাপ্পি তাদের বাবার ফিরে আসার অধীরতর অপেক্ষায় কাল কাটিয়েছ, মিসেস আহমেদ দ্বীর্ঘশ্বাস ফেলেছেন বারবার কিন্তু সবকিছুই নিস্ফল। বাংলাদেশ হানাদারমুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এসেছিল তার বন্ধুবান্ধব তাঁর সৎ সাহসের জন্য প্রসংশা জানাতে,তাঁর নির্ভীকতার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে। কিন্তু নিজামুদ্দীন আহমেদ আর ফিরে আসেননি তার প্রিয়জনের মাঝে।

সাংবাদিক জগতে নিজামুদ্দীন পুরিচিত দীর্ঘদিনের,ছাত্রাবস্থায়ই তিনি জড়িয়ে পরেন এই পেশায়,এবং সে সময় তিনি ‘ সিভিল এন্ড মিলিটারি গেজেট’, দৈনিক মিল্লাত ইত্যাদির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হন। এরপর তিনি তদানিন্তন পিপি আইর প্রথম ও একমাত্র সাংবাদিক হিসেবে যোগ দেন ১৯৫৮ সালে। পরবর্তী পর্যায়ে ওই প্রতিষ্টানকে তিনিই সাবেক পূর্ব পাকিস্থানে গড়ে তুলেন এবং ১৯৬৪ সালে এর সম্পাদক হন। নিখোঁজ হবার দিন পর্যন্ত তিনি ছিলেন এই প্রতিষ্ঠানের সহকারী কর্মকর্তা।“

<৮,৭৬,৪৮৩-৮৪> সাধনা ঔষধালয়ের মালিক যোগেশ বাবুর হত্যাকাহিনী…
[যোগেশ বাবুর হত্যা কাহিনী]

-‘বাংলাদেশের গণহত্যা’, বাংলার বাণী বিশেষ সংখ্যা, ১৯৭২।
“শ্রী যোগেশ্চন্দ্র ঘোষ। একটি নাম। একটি ইতিহাস। দুঃস্থ অসহায় মানুষের কল্যাণে নিবেদিত একটি প্রাণ। তাঁর জীবনের একমাত্র ‘সাধনা ঔষধালয়’। যে ঔষধালয়ের বাংলাদেশ ছাড়াও সমগ্র বিশ্বজোড়া রয়েছে খ্যাতি। এমনি নব নব সৃষ্টির মাঝেই যোগেশ বাবু বেঁচে ছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি নিজেই বাঁচতে পারেননি। বর্বর খান সেনাদের হাতে তাঁকেও প্রাণ হারাতে হলো। নরপিশাচদের হাতে অবসান হলো একটি অমূল্য জীবনের।

সহকর্মীদের সবাই সেই কালরাত্রিতে কোন গতিকে প্রাণ নিয়ে বেঁচেছিল। প্রাণের মায়ায় পালাতে বাধ্য হয়েছিল তারা। শুধু যোগেশ বাবুর পোষা প্রিয় বানরটা তাঁকে ছেড়ে পালিয়ে যায়নি। প্রভূর সমূহ বিপদের আশংকায় সেদিন বনের পশুটি পর্যন্ত চীৎকার দিয়ে ঘোষনা করেছিল বিপদ বার্তা। কিন্তু যোগেশ বাবু তেমনি রইলেন। পালানোর সামান্যতম চেষ্টাও করেননি তিনি। বিপদের আশঙ্কায় তিনি শঙ্কিত হয়েছিলেন বটে, কিন্তু আকস্মিক ভয়াবহ মৃত্যুর কথা বোধ হয় ভাবতে পারেননি।

পঁচিশে মার্চ। ভয়াল বীভৎস রাত। এই দিন বাংলার বুকে নরপশু খান সেনারা যে হত্যালীলা চালিয়েছিল তার করুণ কাহিনী ইতিহাসের পাতায় কালো কালিতে বাঁধা থাকবে। রাজধানী ঢাকার সমস্ত শহরটা ভয়ে প্রকম্পিত। গ্রামে পালিয়ে যাচ্ছে নগরবাসী। সবাই পালাচ্ছেন- দূরে অনেক দূরে, নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। বর্বরদের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবার প্রত্যাশা প্রত্যেকের।

পুরান ঢাকার সূত্রাপুর এলাকার অনেকেই এরই মধ্যে শহর ছেড়ে পালিয়ে গেছে। সমস্ত এলাকার মাঝে শুধু একটি মাত্র বাড়ীই যেন একমাত্র প্রহরী। স্তব্ধ, নিঃঝুম পরিবেশ। বিরাট এলাকা জুড়ে একটা কারখানা সাধনা ঔষধালয়। সমস্ত বাড়ীটার প্রহরী যোগেশ বাবু। কারখানার নির্জন প্রকোষ্ঠে তিনি কাটিয়েছেন জীবনের সুদীর্ঘকাল। তাঁর একমাত্র সাধনাস্থল এই কারখানা। নিঃসঙ্গ জীবনের একমাত্র সাথী ছিল কারখানার শ্রমিকরা। দিন শেষে পড়ন্ত বেলায় শ্রমিকরা সবাই যখন একে একে চলে যেত, তখন রামপাল আর সুরুজ ছিল তাঁর একমাত্র সাথী।

রামপাল ও সুরুজ কারখানার দারোয়ান। তারা দীর্ঘ সতের বছর ধরে বাবুর সাথে কাটিয়েছে। পঁচিশে মার্চের পর সবাই যখন একে একে চলে গেল- তখনও ওরা বাবুকে ছেড়ে যায়নি। জীবনের ঝুঁকি নিয়েও ওরা তাঁর কাছে ছিল। রাত দুপুরে বাবু যখন উন্মনা হয়ে উঠতেন- তখন ওরাই ছিল তাঁর একমাত্র সাথী- নিঃসঙ্গ জীবনের দীর্ঘদিনের সহচর।

আলাপ করছিলাম দারোয়ান দু’জনের সাথে। তখন সূর্যদেব সবে বিদায়ের তোড়জোড় করেছেন। আধো আলো আধো আঁধারের এক প্রকোষ্ঠের মধ্যে বসে কথা হচ্ছিল আমাদের।

পঁচিশে মার্চের পরের ঘটনা। সম্ভবতঃ এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ অথবা মাঝ শেষের দিক। সেই দুর্যোগ রাতের সঠিক তারিখ আজ নাকি ওদের কারো মনে নেই। স্মরণ নেই সেই ভয়াবহ তারিখের কথা।

নিস্তব্ধ নগরী। রাত নিঃঝুম। সাধনা ঔষধালয়ের গেটে প্রহরারত দারোয়ান। রামপাল, ইউসুফ মিস্ত্রি, ভূমিসিংহ, সুরুজ সেই ভয়াল রাতের প্রহরী। সেই থমথমে পরিবেশে হঠাৎ একটি মিলিটারী জীপ এসে থামলো। তখন রাত দুপুর। পাঁচ-ছয়জন সশস্ত্র সৈনিক গাড়ী থেকে নামলো। তাদের সবার হাতে ভারী অস্ত্র। একে একে গেটের তালাগুলো আঘাতে ভেঙ্গে ফেললো ওরা। তারপর কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলী ছুড়লো। দোতলায় যোগেশ বাবু সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলেন। সুরুজ পাহাদারও সন্ত্রস্ত। বর্বরদের বিরুদ্ধে তার বন্দুকটা গর্জন করে উঠলো। পরপর কয়েক রাউন্ড গুলী ছুড়লো সে এলোপাতাড়ি। জল্লাদ খান সেনাদের উদ্যত রাইফেল গর্জিয়ে উঠলো। গুলীর মুহুর্মুহু আওয়াজে রাতের নিস্তব্ধতা যেন ভঙ্গ হলো, সারা এলাকাটা যেন কেঁপে উঠলো। উভয় পক্ষে বেশ কিছুক্ষণ হলো গুলী বিনিময়। সে রাতে খান সেনারা সুবিধা করতে পারলো না। সামান্য একজন অস্ত্রশিক্ষণীয় বাঙ্গালী পাহারাদারের কাছে পরাজিত হলো খান সেনারা। কি যেন ভেবে তারা পালিয়ে গেল।

বাঙ্গালী বীর সুরুজ সেই স্মরণীয় রাতেই বাবুকে বাড়ী ছেড়ে পালিয়ে যেতে বলেছিল। বাবু তখনও তার কথায় কর্ণপাত করেননি। ভেবেছিলেন হয়তো মরতে যদি হয়, জন্মভূমিতেই মরবো।

পরদিন সকাল। রাতের সেই ভয়াবহ ঘটনা তখনো চোখের সামনে জ্বল জ্বল করছে। সন্ত্রস্ত যোগেশ বাবু ও তাঁর ভীত সহকর্মীরা ঘটনাস্থল দেখতে নিচে নেমে এলেন। সকাল তখন প্রায় সাড়ে সাতটা। যোগেশ বাবু নিচে নেমেছেন, সবে গত রাতে খান সেনারা যে ধ্বংসের স্বাক্ষর রেখে গেছে তা অবলোকন করছেন। এমনি সময়ে তিনটি মিলিটারী জীপ কারখানার সামনে এসে থামল। গাড়ীগুলো ভর্তি সশস্ত্র সৈনিক। খান সেনা বর্বরদের সাত-সকালে আগমনে বাবু আরো ভীত হয়ে উঠলেন। এক অজানা আশঙ্কায় মনটা যেন দমে গেল তাঁর। যদিও তিনি নাকি মৃত্যুকে ভয় করেন না। তাঁর সঙ্গী সাথী (সহকর্মীরাও) কেমন যেন মুষড়ে পড়লেন। সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলেন তারাও। জল্লাদ খান সেনারা নিচে সবাইকে লাইন করে দাঁড় করাল। বর্বরদের কয়েকজন যোগেশ বাবুকে নিয়ে উপরে গেল। উদ্যত রাইফেলের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অশীতিপর বৃদ্ধ সেদিন কি বলেছিলেন কেউ জানতে পারেনি।

এদিকে নিচে সবাই ভাবল এই হয়তো সময়। মোক্ষম সুযোগ। প্রথমে একটি বাড়ীতে সুযোগ বুঝে পালাল ওরা। হয়তো বর্বরদের চোখে পড়েনি। তাই সেদিন তারা কয়েকজন নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেল। কিন্তু একজন বাঁচতে পারলেন না। যিনি ভালবাসতেন এদেশকে। এদেশের মাটিকে। দেশের জনগণকে। যোগেশ চন্দ্র ঘোষ নিহত হলেন বর্বরদের নিষ্ঠুর সঙ্গীনের খোঁচায়। জল্লাদরা তাদের হিংস্র বেয়নেটের আঘাতে একটা অনন্য জীবনের অবসান এনে দিল।

সাথীরা সেদিন সবাই প্রাণ নিয়ে বেঁচেছিল সত্যি। কিন্তু ফিরে এসে তাদের মনিবকে পায়নি তারা আর। পরে বর্বর খান সেনারা চলে গেলে অনেকে এসেছিল। এসেছিল সহকর্মীরা। পাড়া-পড়শীরা। তাদের প্রানপ্রিয় যোগেশ বাবুকে একবার দেখতে। না, শ্রদ্ধাভাজন যোগেশ বাবুকে তারা আর দেখতে পারেনি। ওরা যখন দেখতে এসেছে ডোমেরা তখন যোগেশ বাবুর লাশ নিতে এসেছে।

অবশেষে তাঁর দেহাবশেষ আবিষ্কৃত হলো রান্নাঘরের মেঝেতে। উপুড় হয়ে পড়েছিলেন। বুকে তাঁর সঙ্গীনের(বেয়োনেটের) ক্ষত চিহ্ন। রক্ত ঝরার ধারা ততক্ষণে শুকিয়ে গেছে। শুকনো কালো রক্তের মাঝে তিনি পড়ে আছেন। বর্বররা তাঁকে শুধু হত্যা করে ক্ষান্ত হয়নি, তারা বাবুর সারা জীবনের অর্জিত সকল ধন-সম্পদ নিয়ে গেছে লুণ্ঠন করে। “

<৮,৭৭,৪৮৫-৮৮> “কারো হাতে লোহার ডান্ডা, কারো বা বাঁশের লাঠি। এ ডান্ডা আর লাঠি দিয়েই মানুষ জঙ্গিশাহীর দানবদের রোধ করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। মনে মনে ভাবলাম এ কি সম্ভব? আধুনিক মরণাস্ত্রের সম্মুখে লাঠি সম্বল করে তিষ্টে থাকা কি অকল্পনীয় নয়? তবু মনে মনে আনন্দিত হলাম এই ভেবে যে, সত্যি বাঙ্গালী আজ জেগেছে।“

[‘ইত্তেফাক’-এর সাংবাদিকের লেখায় ২৫ শে মার্চের রাতের সামরিক হামলার প্রত্যক্ষ বিবরণ]

-‘বাংলাদেশে গণহত্যা, বাংলার বাণী, বিশেষ সংখ্যা, ১৯৭২

“মৃত্যুতে বিস্মিত হবার কিছু নেই, বেঁচে থাকাটাই পরম বিষ্ময়। কথাটা যে কে বলেছিলেন, ঠিক এই মুহূর্তে আমি তা স্মরণ করতে পারছি না। তবে কথাটা যে অসত্য বা অতিরঞ্জিত কিছু নয় নিজ জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা দিয়ে আমি তা মর্মে মর্মে অনুভব করেছি। আর না করেই বা উপায় কি। সাক্ষাৎ মৃতুর মুখ থেকে বেচেঁ যাওয়া সে যে কত বড় বিষ্ময় তা অনুমানের পর অনুভূতির ব্যপার, সে বিভীষিকাময় স্মৃতি যখন মনে করি , তখন প্রকৃতই নিজের জিজ্ঞেস করতে প্রবৃত্তি হয় , আমি বেচেঁ আছি তো।

এর জবাব দেয়ার জন্য আমাকে ফিরে যেতে হবে পচিঁশে মার্চের সেই ভয়ংকর রাতে। যে রাতে আমরা আটটি প্রাণী প্রাণান্তকর অবস্থার ভিতর দিয়ে অনুভব করেছি প্রতিপক্ষের মৃত্যু যন্ত্রণা। লক্ষ্য করেছি একদল মানুষ জন্তুর হু – হুংকার্। আর শ্মশানের শেষ প্রান্ত চরদের মানুষের জীবন নিয়ে কানামাছি খেলার নিদারুণ উপহাস।

দৈনিক ইত্তেফাক এর সম্পাদকীয় বিভাগের একজন সদস্য হিসাবে সাধারণত রাতের বেলা অফিসে থাকার কথা আমার ছিল না। কিন্তু স্বভাব যায় না মলে। আড্ডা মেরে যার অভ্যাস , সকাল সকাল সে বাসায় ফিরে কেমন করে। সকাল দশটার দিকে অফিসে আসতেই এডিটর সাব ডেকে বললেন , শেষ পরিনতি মোটামুটি ভালোর দিকেই মনে হচ্ছে। আপনাকে একটা এডিটরিয়াল লিখতে হবে। এডিটরিয়ালটার বক্তব্য বিষয় হবে মোটামুটি এরকম।

সাড়ে বারটার মধ্যেই আমার লেখা শেষ হয়ে গেল। গেলাম প্রেসক্লাবে এবং তারপর সেখান থেকে সবুজ শ্যামল ছাওয়া রমনা পার্কের পূর্বদিকস্থ সাবেক প্রেসিডেন্ট ভবনের( গণভবন) কাছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট ভবনের পশ্চিম দিকের ফুটপাথের উপর একদল লোক দাঁড়িয়ে আছে। আশেপাশে যতদূর চোখ যায় শুধু পুলিশ আর পুলিশ এবং সে সাথে উর্দিপরা ও সাদা পোশাক পরিহিত সামরিক সেনারা। এদের গর্হিত পদক্ষেপ আর শ্যেন দৃষ্টি কালা পাহাড়ের চিত্তকেও ভীতিবিহবল করে তোলে। সেখানে অধিক্ষণ দাঁড়ানো তাই স্বস্তিকর বোধ হল না। ফিরে এলাম প্রেসক্লাবে। কথাবার্তা এবং বাতাসে ভেসে আসা গন্ধে যেন অনুভব করলাম একটা দ্রুত পরিবর্তনের সুর্। প্রভাত সূর্য যে আশা ও সম্ভাবনার বাণী নিয়ে উদিত হয়েছিল , পড়ন্ত বেলায় যেন তা রাহুগ্রস্ত প্রায়। এ অবস্থায় বাসায় ফিরব মনে করে পথে নামতেই সিরাজ ভাই( শহীদ) ডেকে বললেন “মিলন, চল অফিসে যেতে হবে।” কেন জিজ্ঞেস না করেই রিকশায় তার পাশে যেয়ে বসলাম। তিনি বলতে লাগলেন,”সবকিছু উলট পালট হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে একটা ভীষণ পরিনতির দিকে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি।” এমনি বেশি কথা বলার অভ্যাস আমার নেই , তদুপরি বক্তব্যটির কোন সদুত্তর খুজে পেলাম না। পুনর্বার যখন অফিসে ফিরে এলাম রাত তখন ন ‘ টা। তাড়াতাড়ি প্রেস থেকে এডিটরিয়াল টা আনিয়ে আপাদমস্তক সংশোধন করলাম। তখন কে জানতো কাল প্রভাতে কেন কোন দিনই এ সম্পাদকীয় আর আলোর মুখ দেখবে না।
রাত দশটার দিকে সিরাজ ভাই কে বললাম ‘ ভাব -সাব ভারী খারাপ মনে হচ্ছে , ছলুন বাসায় ফিরে যাই। ”
তিনি জবাব দিলেন , “কেমন করে যাব, কাগজ বের করতে হবে না?”
প্রত্যুত্তরে আমি আর কিছু বলা সমীচীন বোধ করলাম না। জানতাম ইত্তেফাক সিরাজ ভাইর প্রাণ , সিরাজ ভাইর ধমনীতে এর স্রোত প্রবাহিত , সুতরাং বলে কয়ে লাভ নেই। আরো কিছুক্ষণ আলাপ করার পর তিনি বললেন ” তুই বরং চলে যা”. কিন্তু আমার জানি কেন অফিস ছেড়ে যেতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। কি ঘটে না ঘটে তা দেখার ও জানার কৌতুহলে পেয়ে বসেছিল আমাকে। তবু রাত এগারোটার দিকে আমি , আমির হোসেন আর নজরুল অফিসের পিকআপ কারে রওয়ানা হলাম মগবাজারের দিকে। কিন্তু যাওয়া আর হল না। তদানীন্তন গভর্নমেন্ট হাউস ( বঙ্গভবন ) এর কাছাকাছি যেয়ে থেমে গেল পিকআপের চাকা। প্রসারিত দৃষ্টির সম্মুখে ইট , কাঠ , লোহা – লক্কড়ের ব্যারিকেড .দশ হাত অন্তর সমস্ত পথ জুড়ে এ অবস্থা। আর ইত:স্তত চঞ্চল চরণের ভীড়। কারো হাতে লোহার ডান্ডা, কারো বা বাঁশের লাঠি। এ ডান্ডা আর লাঠি দিয়েই মানুষ জঙ্গিশাহীর দানবদের রোধ করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। মনে মনে ভাবলাম এ কি সম্ভব? আধুনিক মরণাস্ত্রের সম্মুখে লাঠি সম্বল করে তিষ্টে থাকা কি অকল্পনীয় নয়? তবু মনে মনে আনন্দিত হলাম এই ভেবে যে, সত্যি বাঙ্গালী আজ জেগেছে।

সেখান থেকে গাড়ি ঘুরিয়ে ফিরে এলাম অফিসে কিন্তু আমির হোসেন আর নজরুল ফিরলেন না। শ্রীচরণে ভরসা করে তারা চলে গেলেন যে যার গন্তব্যস্থলে। অফিসে ফিরে সিরাজ ভাইর নিচের তলার ঘরটিতে যেয়ে দেখি ঘর শূন্য। তিনি চলে গেছেন উপরে বার্তা বিভাগীয় কক্ষে। সেখানে তখন অস্বাভাবিক অবস্থা। সকলেই কলম তুলে বসে আছেন। দলে দলে লোক আসছে – যাচ্ছে। বেশিরভাগই তরুণ। তাদের চোখে মুখে ভীতি মিশ্রিত জিজ্ঞাসা। খবর পেলাম মহাখালীর দিকে নাকি মিলিটারী এগিয়ে যাচ্ছে। আর একজন তরুণ প্রায় দৌড়াতে দৌড়াতে ছুটে এসে বললেন , এই মাত্র খবর পেলাম, মিলিটারী ইকবাল হল ঘিরে ফেলেছে। সেখানে গোলাগুলি চলছে। আপনারা কিছু জানেন কি?
আমরা তাদের মতই উড়া খবরের কথা বললাম। সিরাজ ভাই তাদের যার যার ঘরে চলে যেতে পরামর্শ দিলেন। মুহুর্মুহু টেলিফোন আর সংবাদ সংগ্রহেচ্ছুক লোকজনের আগমনে ইত্তেফাক অফিস চঞ্চল হয়ে উঠল। কিন্তু সে মাত্র স্বল্পক্ষণের জন্য , রাত বারোটা বাজতেই বহির্জগতের সাথে আমরা সম্পূর্ণ যোগাযোগ হারিয়ে ফেললাম। এতক্ষণ যে টেলিপ্রিন্টারের শব্দ হচ্ছিল তা স্তব্ধ হয়ে পড়ল, ছিন্ন করে দেয়া হল টেলিফোন যোগাযোগ। আমরা তখন আটটি প্রানী অপেক্ষা করছি চরম মুহুর্তের জন্য।

রাত গভীর হতে শুরু করল। আর সে গভীরতার সাথে পাল্লা দিয়ে নিকট থেকে নিকটতর হতে লাগল মেশিনগানের কর্ণবিদারী শো শো গর্জন, অসহায় মানুষের প্রাণফাটা আর্তনাদ,মাতা,ভগ্নী ,জায়ার সকরুণ বিলাপধ্বনী। ঢাকার বুকে শুরু হল নারকীয় তান্ডবের উন্মত্ত লীলা। এরই মধ্যে আমরা নীচের ক্যান্টিন থেকে এক টিন টোস্ট বিস্কুট আর অফিস পিয়ন আমিরের দোকান থেকে আনিয়ে নিলাম কয়েক প্যাকেট সিগারেট। মৃত্যু যতক্ষণ না তার হিমশীতল বক্ষে টেনে নিচ্ছে ততক্ষন পর্যন্ত একটা কিছু খেতে হবে। এমনি প্রাণান্তকর উতকন্ঠা আর মেশিনগান ও স্টেনগানের গর্জনের ভেতর দিয়ে রাত শেষ হয়ে এল। আবছা অন্ধকারে ঢাকা রাজধানীর রাজপথের চেহারাটা দেখার জন্য সিরাজ ভাই আর রেজা ভাই যেয়ে দাড়ালেন ইত্তেফাক অফিসের পশ্চিম প্রান্তস্থ দ্বিতলের জানালার পাশে। প্রভাত রজনীর অবস্থা অন্ধকারে অবগুন্ঠনে ঢাকা সাবেক

গভর্নমেন্ট হাউসের দিক থেকে তখন ছুটে আসছে একটি সামরিক জীপ। সিরাজ ভাই আর রেজা ভাই ভাবলেন , জীপটা বোধকরি ইত্তেফাকের মোড় দিয়ে নারায়ণগঞ্জের দিকে যাচ্ছে। কিন্তু নিমিষে তাদের সে ধারণা টুটে গেল। সম্বিত ফিরে পেতে দেখলেন সিরাজ ভাই দ্বিতলে মেঝেতে পড়ে গেছেন। আর তারই পাশে রক্তাক্ত দেহ শামছু, আমাদের ক্যান্টিন বয়। মেশিনগানের শিশার বুলেট ডান কানের নীচে গন্ডদেশ বিদীর্ণ করে বেরিয়ে গেছে। কিন্তু জীবন তখনও স্পন্দনহীন হয়ে পড়েনি। কে যাবে ডাক্তার ডাকতে? কোন ডাক্তার আসবে এ সময়? আমরা কয়টি প্রাণী অশ্রুহীন অবাক দৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ করলাম নিরপরাধ শামছুর মৃত্যু। কিন্তু এখানে রুদ্ধবাক বিষ্ময়ের শেষ নয়। একজন ছুটে এসে বললেন নীচে আমাদের গেইটের সামনে একটি প্রাণহীন রক্তাক্ত দেহ পড়ে আছে। সুযোগ বুঝে এক সময় আমরা অজ্ঞাত পরিচয় সে ব্যক্তির মৃতদেহ নিয়ে এলাম অফিসের আঙ্গিনায়। সে একজন হকার্। তার পকেটে তখন আশিটি টাকা, হাতে হাতঘড়ি, আর একটা সাইকেল। কে জানে এই আশিটি টাকাই তার পরিবার – পরিজনের অন্নবস্ত্র সংগ্রহের মূলধন কি না।

বেলা অনুমান ১০ টার দিকে (২৬ শে মার্চ) এ বাড়ি ও বাড়ির উপর দিয়ে শামছুর মৃতদেহ পাঠানো হল গোপীবাগ মসজিদে। কিন্তু নাম না জানা হকার ভাইটির মৃতদেহ পাঠানো সম্ভব হল না। শামছুর মরদেহ মসজিদে অপসারণের পর আমরা আবার বার্তা বিভাগের কক্ষে যেয়ে আশ্রয় নিলাম। জীবনাভূতি বলতে যা বুঝায় কিছুই তখন নেই। সিরাজ ভাই তখন শুধু মাঝে মাঝে আক্ষেপ করছেন , ‘হায়’ বাচ্চাকাচ্চাদের দেখে যেতে পারবো কি না কে জানে। সাড়ে দশটার দিকে একটা বিশেষ শব্দে আমরা চমকিত হয়ে উঠলাম। রেজা ভাই বললেন: ‘এটা ট্যাঙ্কের শব্দ ‘. পূর্ব দিকের জানালার ফাক দিয়ে উকি মেরে দেখলাম- হ্যা তাই।তিনটি ট্যাঙ্ক মতিঝিল রোড হয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। গন্তব্যস্থল সম্ভবত : রাজারবাগ। সেখানে কি হত্যাযজ্ঞ চলছে? হানাদার পশুর দল কোন কোন এলাকাকে ধ্বংসস্তুপে পরিনত করেছে কিছুই তার জানার বা বুঝার উপায় নেই। শুধু অভিসার সিনেমা হল আর গোপীবাগের মোড়ে লক্ষ্য করা যাচ্ছে মানুষজন ভর্তি ডজন ডজন সামরিক যানের ভীড়। দক্ষিণ দিকের জানালা দিয়ে অভিসার সিনেমা হলের দিকে তাকাতে নজরে পড়ল তিন চারটি পশু সিনেমা হলের পশ্চিম দিকের একটি প্রাচীর ঘেরা বাসার প্রাচীরের উপর উঠে ভেতরে মেশিনগানের গুলি বর্ষণ করছে। রেজা ভাই সাবধান করে বললেন , খবরদার কেউ বাইরে তাকাবে না। বাইরে থেকে দেখতে পেলে আর রক্ষা নেই। রক্ষা প্রকৃতই ছিল না। কারণ লক্ষ্য করেছিলাম রাজপথে কোন বেরিকেড কিংবা কাক পাখির চিহ্ন না থাকলেও কতক্ষণ পর পরই মেশিনগান থেকে ইত্তেফাকের উপর গুলী বর্ষণ করা হচ্ছিল। এ যেন নিষ্প্রাণ জড় পদার্থের উপর জাত ক্রোধ মেটানো। মেশিনগানের গুলির চোটে ইত্তেফাকের পশ্চিম দিকের জানালার শার্শী ঝন-ঝন করে ছিটিয়ে পড়েছিল। আর সে সাথে আমরা ক ‘জন কখনো আশ্রয় নিচ্ছিলাম টেবিলের তলায় , আবার কখনো বা আলমারী-টালমারীর তলায়। জীবন মৃত্যুর এই লুকোচুরি খেলায় জঠর জ্বালার কথা স্বভাবতই মনে থাকার কথা নয় কিন্তু মনে করিয়ে দিলেন প্রেসের কয়েকজন সহকর্মী বন্ধু। হামাগুড়ি দিয়ে উপরে উঠে এসে বললেন পাশের বাসা থেকে কিছু ভাত আনার ব্যবস্থা হয়েছে। কে জানে আরো কতকাল এমনিভাবে থাকতে হবে। আপনারাও দুমুঠো খেয়ে নিন। কিছুক্ষণ পর উক্ত কর্মী বন্ধুটি একটি এলুমিনিয়ামের পাত্রে করে ভাত দিয়ে গেলেন তরকারি আনতে। কিন্তু সে যাওয়াই তার শেষ যাওয়া হল। তিনি আর তরকারি নিয়ে ফিরে আসতে পারলেন না। নীচে থেকে ভেসে আসল সুপারী ঠুকলে যে বিশেষ ধরনের শব্দ হয় তেমনি শব্দ। পরে বুঝেছি সে শব্দটা আর কিছুই না, তালা ভাঙ্গার শব্দ। সে শব্দ শেষ না হতেই আবার ভেসে আসলো সে পরিচিত আওয়াজ। দেখলাম একটা ট্যাঙ্ক এসেছে। দাড়িয়েছে ইত্তেফাক অফিসের পশ্চিম দিকের মোড়ে। তারপর আর দেখতে হল না। বিকট এক বোমার আওয়াজের সাথে সাথে থর থর করে কেপেঁ উঠল ইত্তেফাক ভবন। মাটির পুতুলের মত ঝরে পড়ল টেলিফোন এক্সচেঞ্জ কক্ষটি। আমরা উন্মাদের মত লুটিয়ে পড়লাম মেঝেতে। এ ভাবে কতক্ষণ ছিলাম মনে নেই। মনে হল রেজা ভাইর হাক ডাকে , চশমাটা চোখ থেকে নামিয়ে বললেন , দেখতো ধুয়া দেখা যাচ্ছে কি না। সঙ্গে সঙ্গে একজন পশ্চিম দিকে সরে এসে তাকালেন নীচে এবং জানালেন মেশিনঘরে আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে। অন্যের মনে তখন কি ভাবনার সৃষ্টি হয়েছিল তা অন্তর্যামী জানেন। তবে আমার মনে কেন জানি অপার্থিব একটা ভরসা এসে দানা বেধেছিল। মনে হচ্ছিল, নিশ্চয় বাঁচবো। ওরা আমাকে মারতে পারবে না। মুহূর্তে আমরা প্রস্তুত হয়ে নিলাম , স্থির করলাম , যেমন করে হোক প্রাণে বাচার চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু কি ভাবে? বার্তা বিভাগ আর হিসাব রক্ষা বিভাগের মাঝখানে একটা ছয় – সাত ফুট উচু পার্টিশান ওয়াল। স্থির হল পার্টিশান টা ডিঙ্গিয়ে হিসাব রক্ষা বিভাগে প্রবেশ করতে হবে। তারপর সেখানে লিফটের জন্য সংরক্ষিত গর্ত পথে নামতে হবে দেড় তলায় অবস্থিত জব সেকশনে। এবং জব সেকশন থেকে পেছন সিড়ি দিয়ে নেমে দেয়াল ডিঙ্গিয়ে যেতে হবে পাশের বাড়িতে। আমার জানি তখন কেমন মনে হল যে , স্যান্ডেল পায়ে এভাবে যাওয়া সম্ভব নয়। সঙ্গে সঙ্গে স্যান্ডেল গুলো বার্তা বিভাগে রেখে দিয়ে একে একে আমরা গেলাম হিসাব বিভাগে। আগুনের লেলিহান শিখার তাপ তখন আমাদের গায়ে লাগছে। কিন্তু সেদিকে আমাদের কারো ভ্রূক্ষেপ নেই। হিসাব রক্ষা বিভাগে এসে আমি আর ইয়াহিয়া বখত লিফটের গর্ত দিয়ে লাফিয়ে পড়লাম নিচে। কিন্তু বিধি বাম। জব সেকশানের দরজা জানালা বন্ধ। প্রাণপণ শক্তিতে টানাটানি করেও যখন খোলা সম্ভব হল না আবার দেয়াল বেয়ে সেই গর্ত পথে উঠে এলাম হিসাব রক্ষা বিভাগে। আজ ভাবি কেমন করে এটা সম্ভব হয়েছে? এখন কি আমার দ্বারা সম্ভব! পেছনের দরজা দিয়ে পালাবার চেস্টা ব্যর্থ হবার পর আমাদের সামনে রইল দুইটি বিকল্প, এক আগুনে আত্মাহুতি দান এবং দুই , জীবন বাজি রেখে ভেতরের সিড়ি পথে পালানোর চেষ্টা। উকি মেরে দেখলাম , মেশিনগান হাতে দুটি মানুষ জন্তু সাক্ষাৎ যমদূতের মত ইত্তেফাকের সামনের দিকের ছোট্ট খোলা আঙ্গিনায় পায়চারী করছে। তবু কি আর করা যায়। হামাগুড়ি দিয়ে আমরা আটজন হিসাব রক্ষা বিভাগ থেকে আসলাম ঢাকা টাইমস এর অফিসে এবং তারপর সেখান থেকে হামাগুড়ি দিতে দিতে ভেতরের সিড়ি দিয়ে নামলাম নীচে।

সদ্য আমদানীকৃত ইত্তেফাকের মেশিনঘর থেকে আগুন তখন ছড়িয়ে পড়েছে অস্থায়ী ঘরগুলোর মেশিন ঘরে। তারই ভেতর দিয়ে প্রায় উন্মাদের মত আমরা ছুটে গেলাম দেওয়ালের দিকে। তারপর সে ছয়ফুট দেয়াল পলকে অতিক্রম করে প্রবেশ করলাম পাশের বাড়িতে। দেখলাম, প্রেসের কর্মী ভাইয়েরা আগেই সেখানে আশ্রয় নিয়েছেন। পাশের বাড়ির ছোট ছোট মেয়ে ছেলেগুলো তখন প্রানফাটা চিতকার করছে। গৃহকর্তা পশ্চিমের ঘরটার বাশের বেড়া খুলে ফেলার প্রাণপণ চেষ্টা করছেন। কারণ আগুন তখন ইত্তেফাক অফিসের সর্বত্র পরিব্যাপ্ত। ঠিক মনে নেই কে একজন যেন বললেন, আপনারা এখান থেকে দেয়াল ডিঙ্গিয়ে ওদিকে চলে যান। বুঝলাম ইত্তেফাক কর্মী ও সাংবাদিক আমরা , তাই এত ভয় তারপর আবার শুরু হল দেয়াল টপকানোর পালা। একের পর এক দেয়াল টপকিয়ে আমরা চারজন এলাম পূর্বদিকে আর অবশিষ্ট চারজন অন্যদিকে। সিরাজ ভাই হাটুতে প্রচন্ড ব্যথা পেলেন. আমার ডান পায়ের বুড়ো আঙ্গুল থেকে তখন অঝোর ধারায় রক্তপাত হচ্ছে। ইত্তেফাকের তদানীন্তন ড্রাইভার করিম আমাদের দেখতে পেয়ে তার সাথে আরও কিছুটা নিয়ে গেল। রেজা ভাই বললেন ব্রাক্ষ্মন চিরণের কাছে আমার ছোট ভাই বেনু থাকে। সেখানে যেতে পারলে রাত কাটানো যাবে। বলা বাহূল্য তখন ২৬ শে মার্চের সন্ধ্যা। সব পথ আমাদের জানা ছিল না, করিম এগিয়ে এল আমাদের সাহায্যার্থে। এ বাড়ী ও বাড়ী এ গলি ও গলির ভেতর দিয়ে আমরা এসে পৌছালাম গোপীবাগের পূর্বদিকস্থ রেল লাইনের ধারে। দূর থেকে তখন ভেসে আসছে মুহুর্মুহু মেশিনগানের গুলির আওয়াজ। রেল স্টেশনের নির্মানাধীন ওভার ব্রীজের উপর দন্ডায়মান জল্লাদ ইয়াহিয়ার মানুষ জন্তুর বাহীনির দুজন রোজ গার্ডেনের দিকে অবিরাম গুলি ছুড়ছে। ঝন ঝন করে উঠছে টিনের ঘড়গুলো।তারই ভেতর দিয়ে ময়লা ও বিস্টায় সংকীর্ণ রেলের লাইনের ঢালু দিয়ে রাতের আবছা আধারে হামাগুড়ি দিতে দিতে যেয়ে উঠলাম ব্রাক্ষ্মন চিরনের বেনু সাবের রাস্তায়। রাতে ঘুম হল না। এদিকে গুলীর আওয়াজ, মানুষের আর্ত চিতকারে অন্যদিকে বাসার চিন্তা।

২৭ তারিখে আটটায় ঢাকা বেতার থেকে ঘোষিত হল “সকাল সাতটা থেকে সান্ধ্য আইন তুলে নেয়া হয়েছে। ” আমরা বেরিয়ে এলাম। চলে গেলাম যে যার বাসার দিকে। সেদিনই সিরাজ ভাইর সাথে আবার দেখা করেছি। দেখতে এসেছি ইত্তেফাক – এর ধ্বংসস্তূপ আর বিধ্বস্ত নগরীর অবস্থা। পথে পথে লক্ষ্য করেছি – শত শত নিরীহ নিরপরাধ মানুষের মৃতদেহ। সিরাজ ভাইর বড় আশা ছিল তার নোট বইয়ে তুলে রাখা এসব ঘটনা তিনি একদিন না একদিন ব্যক্ত করবেন। কিন্তু কে জানত সে আশা তার পূর্ণ হবার নয়।“

<৮,৭৮,৪৮৯-৯১> “সিংহ হৃদয় মহাপুরুষ কর্ণেল রহমান মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হলেন, হাত থেকে খুলে দিলেন ঘড়ি পকেট থেকে বের করে দিলেন নিজের ও কলেজের চাবি যা এতদিন ছিল তার দায়িত্বে। নিজের চোখে দেখলেন একজন সিপাই তারই চোখের সামনে থেকে তারই ঘড়ি নিয়ে নিজের হাতে পরে ঘড়ি পরা হাতটা কেমন লাগে তাই লোলুপ দৃষ্টিতে নাড়ে চেড়ে দেখছেন। দেখলেন জোওয়ানরা উল্লাসের সাথে এর দামি জিনিসপত্র ও কলেজের মূল্যবান জিনিসপত্র ট্রাকে তুলছে।এই মহাপুরুষের কোন ভাবান্তর হলো না,আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা করলেন না। করলেন না করুণা ভিক্ষা, অমূল্য ধনপ্রাণ ভিক্ষাও চাইলেন না। শুধু চাইলেন পাঁচ মিনিটের সময়। তারপর ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে গেলেন বাংলোর সামনের লনে,বসলেন গিয়ে গোলাপ গাছের পাশে, কি যেন বিড় বিড় করে পড়লেন,বোঝা গেল না-শুধু ঠোঁট নাড়া দেখে বোঝা গেল,তারপর হাততুলে আল্লাহর কাছে কি যেন ফরিয়াদ করলেন,মোনাজাত শেষে করে বললেন, I am ready।

এরপর কয়েক সেকেন্ড নিস্তব্ধতা, নিস্তব্ধতা ভাঙ্গলো গুডুম গুডুম গুডুম তিনটা আওয়াজ, নরপিশাচ মানবজাতির কলংক ইয়াহিয়ার সৈনিক ইকবালের স্টেনগানের তিনটা গুলি এক এক করে এই পবিত্র দেহে বিদ্ধ হল। শরীরটা ঢলে পড়লো। আর শোনা গেল একটি মাত্র ক্ষীণ স্বর, ” মা আয়েশা,তোমাকে দেখে যেতে পারলাম না”।

…এমনি কত জানা অজানা লোকের রক্তের স্রোতের উপর ভেসে স্বাধীনতার তরী আমাদের কাছে নতুন জীবনের সওগাত নিয়ে এসেছে। তাদের রক্ত বিফল যায়নি। যেতে পারে না। কেননা স্বাধীনতার রক্তকে উন্নত ও সজীব রাখতে সারের প্রয়োজন হয়। আর সে সার হচ্ছে অত্যাচারীর ও অত্যাচারীতের তাজা উষ্ণ লাল রক্ত।“
[ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজে পাকবাহিনীর হামলার বিবরণ]

-‘বাংলাদেশে গণহত্যা’, বাংলার বাণী, বিশেষ সংখ্যা, ১৯৭২।।

“স্বাধীনতাউত্তর বাংলাদেশের আর পাঁচটি প্রতিষ্টানের মত ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজেও কাজ চলছে পূর্ণোদ্দমে। ছাত্রদের পদাভরে কলেজ আজ সরগরম। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র যা বর্বর পাকবাহিনী তাচ্ছিল্যভাবে নষ্ট করে দিয়েছিল তা এক এক করে জোগাড় করা হচ্ছে,কলেজের শ্রীবৃদ্ধির জন্য নিরলস চেষ্টা চলছে। সবই একদিন হয়ত হবে। আর সব অভাবই একদিন পূর্ণ হবে। কিন্তু পূরণ হবে না কয়েকটি নিবেদিত প্রাণের অভাব, এরা ফিরে আসবেন না। এরা হচ্ছেন অধ্যাপক লেঃ কর্ণেল মঞ্জুরুর রহমান,অধ্যাপক হালিম খান, মালি আব্দুস সাত্তার ও চৌকিদার সইজদ্দীন।

এদের মর্মান্তিক মৃত্যের কাহিনী বলতে গেলে আরও একটু গোড়া থেকে শুরু করতে হয়। ২৫ তারিখের রাতে ঢাকার বুকে ইয়াহিয়ার সৈন্য বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের খবর যখন ঝিনাইদহ পৌঁছল তখন ঝিনাইদহের জনসাধারণের সাথে সাথে ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের সকল শ্রেণীর কর্মচারীরাও দেশের জন্য সংগ্রাম করার বলিষ্ঠ শপথ নিল। সে সময় বর্তমান প্রবন্ধকার আব্দুল হালিম খান (মরহুম) ও অধ্যাপক শফিকুল্লার (বর্তমান ক্যাপ্টেন) নেতৃত্বে ক্যাডেট কলেজ প্রতিরক্ষা দল গড়ে তোলা হলো এবং ঝিনাইদহের সেসময়ের এস.ডি.পি. ও জনাব মাহবুব উদ্দিন (বর্তমান মেজর ও বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র দপ্তরের ডেপুটি সেক্রেটারি) এর সাথে যোগা্যোগ স্থাপন করা হয় (ইনি প্রথমে ঝিনাইদহ প্রতিরক্ষা বাহিনী গড়ে তুলেন চূয়াডাঙ্গাসহ সাবেক ই.পি.আর এর মেজর আবু ওসমান এর নির্দেশ মত কাজ করেছিলেন। এক পর্যায়ে তিনি ক্যাপ্টেন পদে উন্নীত হন ও পরে মুজিব নগর থেকে মেজর পদে উন্নীত হন)।

এরপর ৩০ মার্চ গভীর রাতে কুষ্টিয়া থেকে পাক বাহিনীর ২৫ বেলুচ রেজিমেন্টের ১ কোম্পানি সৈন্য যখন অতি সন্তর্পনে ঝিনাইদহের নিরীহ নিরপরাধ জনসাধারণের উপর তাদের হিংস্র নখরঘাতের জন্য মরণাস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ধীরে ধীরে এগুচ্ছিলো,তখন ঝিনাইদহে শুধু ক্যাডেট কলেজের মুষ্টিমেয় সংগ্রামী বীর ছাড়া আর কেউ ছিল না। এরাই রাত ২ টায় তাদের প্রতিহত করে। এরপরে এই হানাদার দলকে বাংলার যে বীর সৈনিকরা নির্মূল করে তাদের অধিকাংশই ছিল এই কলেজের কর্মচারী।

এরপর ১লা এপ্রিল যখন যশোহর থেকে আগত সেনারা নতুন করে ঝিনাইদহ দখলের ব্যর্থ চেস্টা করে তখন তাদেরকে ঝিনাইদহ এর ছমাইল দূরে বিষয়খালিতে যে বাধা দেওয়া ও পর্যুদস্ত করা হয় তাতেও ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের শিক্ষক ও অন্যান্য শ্রেণীর কর্মচারী দের দান অপরিসীম। শুধু যুদ্ধ করাই নয়,নতুন্দের শিক্ষা দেওয়া,সংবাদ সরবরাহ, মুক্তিবাহিনীরর রসদ যোগানোর দায়িত্ব নেয় এই কলেজের কর্মচারীরা। ৫ শত মুক্তিযোদ্ধার খাবার তৈরি করার ভারও নেয় এই কলেজের কর্মচারীরা , অবশ্য সেসব কথার অবতারণা অন্যত্র করা যাবে।

এখন মূল প্রসঙ্গে আসা যাক,এরপর জয়ে- পরাজয়ের মাঝে চললো কিছুদিন। কখনো মুক্তিবাহিনী যশোহরের দিকে এগিয়ে যায় আবার পিছিয়ে আসে। এদিকে হানাদার বাহিনী প্রতিদিনই বিমানযোগে যশোরে প্রচুর গোলাবারুদ, অস্ত্রশস্ত্র ও নতুন সৈন্য সমাবেশ করে ফেললো। সেসময় মেজর আবু ওসমান সাহেবের নির্দেশ এ ক্যাপ্টেন মাহবুব উদ্দিন মুক্তিবাহিনী কে close up করে ভারতে চলে গেলেন। ক্যাপ্টেন পড়ে রইল অরক্ষিত অবস্থায়। পাক বাহিনী ফাঁকা মাঠ পেয়ে বীরদর্পে ঝিনাইদহ প্রবেশ করল ১৬ই এপ্রিল।

এসময় এ মহতি প্রতিষ্ঠান ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের অন্যান্য সবাই প্রাণের মায়ায় কলেজ ত্যাগ করে চলে গেলেও কয়েকটি প্রাণী এ কলেজ ত্যাগ করেননি। সম্ভবত এই কলেজের মায়ায়। এই প্রতিষ্টানের সব কিছুকে অক্ষত রাখার জন্যই তাদের ব্যর্থ চেষ্টা, এদেরই একজন চৌকিদার গাজি হলেন হানাদার বাহিনীর হাতে নিহত প্রথম প্রথম বীর সৈনিক। অধ্যক্ষ কর্ণেল রহমান তাকে নিজ সাইকেল দিয়ে পাটিয়েছিলেন ঝিনাইদহের অবস্থা দেখে আসতে। কর্তব্যনিষ্ঠ এ মহাপ্রাণ লোকটি তার দায়িত্ব পালন করতে যখন ঝিনাইদহ শহরের দিকে এগুচ্ছিলো তখন হানাদার বাহিনী নির্মম বুলেট এসে তার বক্ষ বির্দীকরে দেয়। তার প্রাণহীন গড়িয়ে পড়ে ক্যাসেল ব্রীজের তলায়,পরে বর্বর বাহিনী তার পবিত্র দেহ আরও বহু দেশপ্রেমিক বাঙ্গালির পবিত্র দেহের সাথে রাস্তা তৈরির কাজে লাগায়,আজও ক্যাসেল ব্রীজের পাশে রাস্তা খুঁড়লে অনেক কঙ্কাল পাওয়া যাবে।

এরপর ঐদিন বেলা চারটায় হানাদার বাহিনী কলেজ অধ্যক্ষ কর্ণেল রহমান (মরহুম),অধ্যাপক আব্দুল হালিম খান(মরহুম), ইলেক্ট্রিশিয়ান মোহাম্মদ আলি,ও অধ্যক্ষের বার্বুচি আবুল ফজলকে ধরে নিয়ে যায়। আর্মির একজন সিনিয়র অফিসারকে সামান্যতম সম্মানও তারা দেখায়নি। অন্যান্যদের সাথে তাকেও তারা হাত বেঁধে নিয়ে যায়। বিভিন্ন ক্যাম্পের বিভিন্ন লোকের কাছে তারা লাঞ্চিত হন। এদেরকে এরা নির্মম ভাবে প্রহার করে।

এরপর প্রহসনস্বরূপ অধ্যক্ষ ও অধ্যাপকের হাতের বাঁধন খুলে দিয়ে পাশের ঘরে নিয়ে যাওয়া হয় তদানিন্তন যশোহর গ্যারিসন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার দূররানীর কাছে। ব্রিগেডিয়ার তাদের চা পরিবেশন করেন। মৌখিক ভদ্রতা ও দেখালেন এবং সর্বোপরি ক্ষমা প্রদর্শন করে রাত বারটায় কলেজ গেটে পৌছে দেওয়ালেন। ক্লান্ত অবসন্ন ক্ষুধার্ত চারটি প্রাণী কলেজে এসে সে রাতের মত মসজিদে আশ্রয় নিলেন। পরের দিনটা ভালই কাটল।

এরপর এলো ১৮ ই এপ্রিল। কলেজে মাত্র চারটি প্রাণী আছেন। অধ্যক্ষ, অধ্যাপক হালিম খান,বাবুর্চি আবুল ফজল ও হসপিটাল এটেন্ডেন্ট শামসুল আলম, চারদিকে জনপ্রাণহীন,খাঁ খাঁ করছে। একটা থমথমে ভাব মাঝে মাঝে এ স্তব্ধতা ভেঙ্গে ঝিনাইদহ -কুষ্টিয়া সড়কে দ্রুতগামী আর্মির গাড়ির আওয়াজ। একটা অমঙ্গলের ছাপ যেন চারদিকে বিরাজ করছে। সবেমাত্র অধ্যক্ষ কর্ণেল রহমান ও অধ্যপক হালিম খান দুপুরের খাবার খেয়ে অধ্যক্ষের বাংলোর উপর তলায় বিশ্রামের জন্য গেছেন। যাবার সময় হসপিটাল এটেন্ডেন্টকে তাদের দুজনাত জন্য ঔষুধ আনিতে বলে গেছেন (আগের দিনের প্রহারে দুজনারই নাক মুখ ফুলে গিয়েছিল ও কানে ব্যথা হয়েছিল)। হসপিটাল এটেন্ডেন্ট সবেমাত্র সাইকেলে করে অধ্যক্ষের বাংলো গেট পার হয়ে কিছু দুর গেছে। এমন সময় পেছনে ১ নম্বর গেট ভেঙ্গে কয়েকটি আর্মি ট্রাক কলেজে ঢুকে পড়ে এবং অধ্যক্ষের বাংলোর দিকে এগিয়ে যায়।এই দলটি আসছিল কুষ্টিয়া থেকে,এদের অধিনায়ক ছিল ১২ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন ইকবাল। এই নরপিশাচএর আদেশে জওয়ানরা অধ্যক্ষকে,অধ্যাপক হালিম খান ও বাবুর্চি আবুল ফজলকে ঘর থেকে বের করে গেটের নিচে বসায়। হানাদার বাহিনীর সাথে ছিল তাদের চর কয়েকজন বিহারী। এদের মধ্যে সব চাইতে বেশী উদ্যোগী ছিল ঝিনাইদহএর টমেটো নামে পরিচিত বিহারিটি। এই নরপিশাচ অধ্যাপক হালিম খান ও অধ্যক্ষ কর্নেল রহমানের নামে তাঁর পরিবারবর্গ নিধনের মিথ্যা অপবাদ দেয়। আর এই মিথ্যা অপবাদের উপর ভিত্তি করেই ক্যাপ্টেন তার অনুচরদের হাতে ছেড়ে দেয় অধ্যাপক হালিম খানের প্রতিশ্রুতিশীল জীবন। অধ্যক্ষের বাংলোর পিছনে এরা অসহায় হালিম খানকে বেয়োনেট আর তলোয়ার এত নির্মম আঘাতের পর আঘাত হানতে থাকে। অধ্যক্ষ এক সময় গর্জে উঠলেন, Don t torture him, ifyou want to kill him, better shoot।তাঁদের এই নির্মম আঘাতে এক সময় এই নির্ভীক দেশপ্রেমিকের বিশাল দেহ এই দেশের পবিত্র ভূমিতে লুটিয়ে পড়ে।

তারপর চলে এই হত্যাযজ্ঞের আর এক অধ্যায়। অধ্যক্ষকে ঐ একই অপবাদ। তারপর নরপিশাচ ক্যাপ্টেন ইকবাল এর সাথ কথা কাটাকাটি হয়। কর্ণেল বলেন, “আমি আর্মি অফিসার, আমাকে এমনি মারা অন্যায়। আমার অপরাধের বিচার একমাত্র সামরিক আদালতই করতে পারে।”প্রশ্ন করলেন,”একজন আর্মি কর্ণেল, একজন ক্যাপ্টেন এর কাছ থেকে যে মর্যাদা পেতে পারে,আমাকে তা দেওয়া হচ্ছে না কেন?
কিন্তু এই নরপিশাচদের কাছে সকল যুক্তি বৃথা গেলো। সিংহ হৃদয় মহাপুরুষ মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হলেন হাত থেকে খুলে দিলেন ঘড়ি পকেট থেকে বের করে দিলেন নিজের ও কলেজের চাবি যা এতদিন ছিল তার দায়িত্বে। নিজের চোখে দেখলেন একজন সিপাই তারই চোখের সামনে থেকে তারই ঘড়ি নিয়ে নিজের হাতে পরে ঘড়ি পরা হাতটা কেমন লাগে তাই লোলুপ দৃষ্টিতে নাড়ে চেড়ে দেখছেন। দেখলেন জোওয়ানরা উল্লাসের সাথে এর দামি জিনিসপত্র ও কলেজের মূল্যবান জিনিসপত্র ট্রাকে তুলছে।এই মহাপুরুষের কোন ভাবান্তর হলো না,আত্নপক্ষ সমর্থনের চেস্টা করলেন না। করলেন না করুণা ভিক্ষা, অমূল্য ধনপ্রাণ ভিক্ষাও চাইলেন না। শুধু চাইলেন পাঁচ মিনিটের সময়। তারপর ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে গেলেন বাংলোর সামনের লনে,বসলেন গিয়ে গোলাপ গাছের পাশে, কি যেন বিড় বিড় করে পড়লেন,বোঝা গেল না-শুধু ঠোঁট নাড়া দেখে বোঝা গেল,তারপর হাততুলে আল্লাহর কাছে কি যেন ফরিয়াদ করলেন,মোনাজাত শেষে করে বললেন,I am ready,এরপর কয়েক সেকেন্ড নিস্তব্ধতা, নিস্তব্ধতা ভাঙ্গলো গুডুম গুডুম গুডুম তিনটা আওয়াজ, নরপিশাচ মানবজাতির কলংক ইয়াহিয়ার সৈনিক ইকবালের স্টেনগানের তিনটা গুলি এক এক করে এই পবিত্র দেহে বিদ্ধ হল। শরীরটা ঢলে পড়লো।আর শোনা গেল একটি মাত্র ক্ষীণ স্বর, ” মা আয়েশা,তোমাকে দেখে যেতে পারলাম না”।

এরপর প্রাণভরে লুটে নিল কলেজের দামী দামী জিনিসপত্র, বাঁধা দেওয়ার কেউ রইল না। তারপর তারা যখন উল্লাস করতে করতে ২ নং গেট দিয়ে বের হচ্ছিল সেসময় তাদের নজর পড়লো গেটে কর্তব্যরত মালী সাত্তারের উপর। তাকে তারা ধরে নিয়ে ড্রেনের পাশে দাঁড় করিয়ে পর পর দুটো গুলি করে হত্যা করলো, গুলি দুটো তার দেহ ভেদ করে দেওয়ালে বিদ্ধ হলো। তার দেহ এলিয়ে পড়লো ড্রেনের মধ্যে, এত করেও শান্তি পেল না, আশেপাশের গ্রামে খুঁজতে লাগলো কলেজের চাকুরে কে কোথায় আছে। এমনি এক গ্রাম থেকে ধরে নিয়ে আসলো হতভাগ্য চৌকিদার সইজুদ্দিন কে।তাকে ধরে নিয়ে এসে কলেজের সামনে ঝিনাইদহ-কুষ্টিয়া সড়কের পুলের তলায় দাঁড় করিয়ে গুলি করলো তার প্রাণহীন দেহ পুলের তলায় পড়ে রইল। এমনি কত জানা অজানা লোকের রক্তের স্রোতের উপর ভেসে স্বাধীনতার তরী আমাদের কাছে নতুন জীবনের সওগাত নিয়ে এসেছে। তাদের রক্ত বিফল যায়নি। যেতে পারে না। কেননা স্বাধীনতার রক্তকে উন্নত ও সজীব রাখতে সারের প্রয়োজন হয়। আর সে সার হচ্ছে অত্যাচারীর ও অত্যাচারীতের তাজা উষ্ণ লাল রক্ত।“

শাহরিয়ার ফারুক
<৮,৭৯,৪৯২-৯৪>
[একাত্তরে রংপুরের আলমনগর]

-‘বাংলাদেশে গণহত্যা’, বাংলার বাণী, বিশেষ সংখ্যা।

“তিনটে গুলি, তিনটে শব্দ, তিনটে দাগ দাসু মিঞার। একটি চোখে, একটি মুখে,একটি বুকে। বাসু মিঞার আর এক নাম মোহম্মদ ইসমাইল মিঞা। তিনি রংপুর শহরের আলমনগর নিবাসী একজন জনগনমান্য দেশবরেণ্য বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ছিলেন। তার অপরাধ তিনি ধনী এবং আওয়ামীলীগার।

তাকে যেদিন মারা হয় আমি সেদিন রংপুরে,একাত্তরের এপ্রিল মাসের প্রথমদিকে সপরিবারে নিজস্ব মোটরে করে শহর থেকে পালালেন দূর মফস্বল পদ্মগঞ্জে। বাসু মিঞা পালানোর কয়েকদিন আগেই তার বাড়ির পাশের পাড়ার (মোড়ল) আজিজ মিঞা আর ঘরে আসেননি। আমি তখন স্বয়ং প্লাটফরমে দাঁড়ানো। বাসু মিঞা পালালেন জানাজানি হয়ে গেল অবাঙ্গালিদের মধ্যে। শুরু হলো তার তল্লাশি, এদিকে শহরে ধরাপাকড় করে পথে ঘাটে সমানে গুলি করে মারছে খান সেনারা বুনো শুয়োরের মত। একদিন শহরের গণ্যমান্য সর্বপরিচিত এগারজন বাঙ্গালীকে হাত পা বেঁধে মাহিগঞ্জ শ্মশানে রাত বারটায় গুলি করে মারে।

তার মধ্যে একজন ভদ্রলোক ডাঃ মন্টু। তিনি প্রথম গুলির আওয়াজের মুহূর্তেই অজ্ঞান হয়ে পরে যান ঘাতকের অগোচরে, এগারজন এর উপরে প্রায় ৩০/৪০ টি বুলেট চালিয়ে চলে যায়। কিন্তু বিধাতার ইচ্ছা ডাঃ মন্টু মরেনি। শেষ রাতের দিকে তিনি আহত অবস্থায় জ্ঞান ফিরে পেয়ে শ্মশান ও বাঁধন মুক্ত হয়ে ভারতের কোনো এক হাসপাতালে যেয়ে ভর্তি হন। মৃত দশজনের মধ্যে জরজেট মিঞার জন্য আজও রংপুরের লোক দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।

এদিকে বাসু মিঞার তল্লাশি চলছে, “বাসু মিঞা গাদ্দার হ্যায়,ও জয় বাংলাকা আদমি”। অবাঙালি ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের মুখে ও শুনেছি। বাসু মিঞার জনৈক দালাল বন্ধু খোঁজ পেয়ে বাসু মিঞার কাছে যেয়ে টাকা খাওয়া শুরু করলো। এবং তাকে শহরের বাড়িতে ফিরে আসতে অনুরোধ জানালেন, সে দালাল বন্ধুটি অভয় দিলে মেজর, কর্ণেল সবই তার বন্ধু লোক। তাদের সঙ্গেই তিনি উঠাবসা করেন। অতএব তার কোন ভয় নেই, চিন্তা নেই, আশঙ্কা নেই। তাকে তো মারবেই না বরঞ্চ মেজর , কর্ণেল তাকে তাদের নিজের গাড়িতে করে নিয়ে ঘুরে বেড়াবেন,সে দালালের এখন যথেষ্ট আধিপত্য রংপুর শহরে, (দালালটি সম্ভবত খৃস্টান ধর্মীয় বাঙ্গালি) বন্ধুর আধিপত্য দেখে বিশ্বাস করে দীর্ঘ দেড় মাস পরে ফিরে এলেন শহরে নিজগৃহে, দালাল বন্ধুটি মিথ্যা বলেন নি, সত্যিই মেজর, কর্ণেল, নায়েক সবাই দলে দলে যাতায়াত শুরু করেন বাসু মিঞার বাড়িতে, বাসু মিঞাকে তারা দোস্ত বানল,বাসু মিঞার মাকে মা স্ত্রীকে ভাবী এবং অন্যান্যদের বেটা,মেয়ে,দোস্ত, চাচা, বন্ধু ইত্যাদি পাতিয়ে নিলো খান সেনারা। বাসু মিঞা ওদের বন্ধুত্ব পেয়ে নিশ্চিত হলেন মৃত্যুর হাত থেকে, এদিকে রোজ বাসু মিঞাকে সকাল, বিকাল ক্যান্টনমেন্টে গাড়ি করে নিয়ে যায়,আবার রেখে যায়, যখন বাড়িতে থাকে তখন অগোচরে দু’টি মিলিটারি যে তাঁকে চোখে চোখে রাখতো, তা আমি নিজে চোখে দেখছি। ক্যান্টনমেন্টে রোজ বাসু মিঞাকে নিয়ে নাচ, গান, বাজনা আর পানীয় চলতো। এতে প্রায় দৈনিক ১/২ হাজার টাকা খরচ হতো। এর সবই বাসু মিঞাকে বহন করতে হত। তাছাড়া যখন বাড়িতে আসে তখন তো গোশত, পোলাও, চা,মিষ্টি, কফি, কলা রয়েছেই। শুধু বন্ধুত্বের জন্যই এসব করেননি, প্রাণের ভয়েও করেছেন। কেননা বাঙ্গালি যাদের কাছে গাদ্দার, শত্রু বাসু মিঞা তখন বাঙ্গালি হয়ে তাদেরই অন্তরঙ্গ বন্ধু। তাই এমন খাতির করার চেয়ে না করাটাই অস্বাভাবিক।

এরই মধ্যে একদিন আমি নিজেও ধরা পড়ে গেলাম খান সেনাদের হাতে। রাত তখন নয়টা,আমার অপরাধ যুবক বাঙ্গালি এবং মুক্তিফৌজ সন্দেহে,আমাকে নিয়ে গেল। মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে অনেক এলোমেলো ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে শেখ মুজিবকে গালি দিয়ে পাকিস্তানের সুনাম কীর্তন গেয়ে ছাড়া পেলাম ঠিকই কিন্তু আমার শরীর থেকে রক্ত বের করে নিল যথেস্ট পরিমানে। এছাড়াও রংপুর মডার্ন হলের পিছনে যে বীভৎস দৃশ্য দেখেছি তা বলতেও শিহরন জাগে। বেশ বড় একটা আগাছার বন তারই মধ্যে লেপ,বালিশ, কাঁথা, তোষক পাটে পাটে সাজানো, এগুলো ধর্ষণ বা নারী সঙ্গমের শয্যা। পাশেই বেশ বড় একটা অত্যধিক ধর্ষনের গর্ত পড়ে। যেসব মেয়েরা, মা বোনেরা সঙ্গমে অপারগ হয়ে পড়তো, অক্ষমতা প্রকাশ করতো, তাদেরকে বেয়োনেট দিয়ে হত্যা করে এই গর্তের মধ্যে ফেলা হত। এদেরকে কুকুরে খেত,পোকামাকড়ে খেত। দেশী ও বিদেশী সাংবাদিকগন মেপেজুকে হিসেব বলেছিলেন এই গর্তে প্রায় চার,পাঁচশো মেয়েকে হত্যা করা হয়েছে। উক্ত গর্তের মধ্যে তাদের এলোমেলো চুল,লম্বা বাণী গাঁথা চুল, ছায়া, শাড়ি, সেলোয়ার কামিজ, মাথা, খুলি, আধাপচা গোস্তসহ পোকা ঘিন ঘিন করা মাথা, এসব নিজে দেখেছি নেড়েচেড়ে দেখেছি। মডার্ন হল ছিল উচ্চপদস্থ খানদের ক্যাম্প।

শুনেছি সেখানে নাকি কয়েক ঝুড়ি শুধু ভাঙ্গা কাঁচের চুড়ি পাওয়া গেছে।তবে নিজে দেখেছি মডার্ন হলের দেওয়াল ঘেঁষা ইন্দারার পাশে যে কুল গাছটি আজও হত্যার সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে , আছে তার ডালে লটকানো ফাঁসির দড়ি, আশেপাশে ছেঁড়া রক্তমাখা কিছু কিছু ব্লাউজ, ব্রেসিয়ার, শাড়ির পাড় এবং টুকরো টুকরো ব্যান্ডেজ আকারের অনেক সাদা কাপড়, কুল গাছটি যদি আজ কথা বলতে পারতো তবে নিশ্চয় জানা যেত কতটা অসহায় নারী কে ধর্ষন শেষে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে তার ডালে।

সেদিন একাত্তরের তিরিশে মে-র দিনগত একত্রিশে মের রাত। রংপুর ক্যান্টনমেন্টে নাচ গানের বড় আয়োজন। খানসেনারা এসে রোজকার মত গাড়ি করে নিয়ে গেল বাসু মিঞা কে। সঙ্গে গেল তার শালা হাবিবুর রহমান, ওরফে চাঁদু। এই চাঁদুকে মিলিটারিরা দোস্ত বলে ডাকতো, এসেই হাত মেলাতো, কেলি করতো, কিন্তু সেদিন রোজকার মত ঠিক সময়ে বাড়ি ফিরতে না দেখে স্ত্রী, কন্যা, মা, ভাইবোন সবাই চিন্তা আর শঙ্কার মহাসাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে। রাত তখন ঠিক সাড়ে এগারোটা। সারা রংপুর শহরে সান্ধ্য আইন থমথম করছে। ঠিক এই সময় সম্ভবতঃ ষড়যন্ত্রমাফিক দুখানা জীপগাড়ি ভর্তি পাকসেনা এসে ঘিরে ফেলল বাসু মিঞার বাড়ি। ব্যাপারটা সম্যক অনুভব করে বাসু মিঞার কনিষ্ঠ ভগ্নিপতি মিঃ নুরুল ইসলাম আকন্দ যুবতী বাসু কন্যা, জোৎস্না এবং অন্যান্য যুবতী বৌদের পাশের বাড়িতে সরিয়ে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে প্রাচীর টপকিয়ে আর গেট ভেঙ্গে ছয়, সাত জন সৈন্য ঢুকে পড়লো। ঢুকেই পেল বাসু মিঞার ছোট ভাই গেদু আর ভাগ্নে জুল্লুকে। বেঁধে ফেলল ওদের হাত আর চোখ। মুখে শালা, বাহেনচোত, খিঞ্জিরাকা বাচ্চা তুম জয় বাংলাকা আদমি হ্যায়, বাতাও বাসু মিঞা কিধার হ্যায়। ধড়াম করে মারল রাইফেলের বাট দিয়ে গেদুর ঘাড়ে। গেদু চোখ বাঁধা অবস্থায় মা বলে ডেকে উল্টে পড়ে গেল। ঠিক এমন সময় আর একটা গাড়ি এসে দাঁড়ালো বাড়ির গেটে। বাসু মিঞা আর চাঁদুকে নামিয়ে দিয়েই মুহূর্তের মধ্যে গাড়িটি হুঙ্কার দিয়ে বেরিয়ে গেল। রোজ তারা বাড়ির মধ্যে যেয়ে চা পানি পানের পর যেতো কিন্তু আজ গেল না। এটা যে এভাবেই ধরি মাছ না ছুঁই পানি ষড়যন্ত্র এর মধ্যে দিয়ে কাজ হাসিল করা হচ্ছে, তা নিশ্চয় দূর্বোধ্য নয়। বাড়ির মধ্যে চাপা কান্নার আওয়াজ শুনতে পেয়ে চাঁদু ছুটে এসে প্রবেশ করে অন্দরে। ঢুকে দেখে রোজ যারা এসে গোশত পোলাও কলা খেয়ে যেত সেইসব দোস্ত বন্ধুদেরই দল।

গেদুকে, জুল্লুকে তখনও খেয়াল করে নি।তাদের সঙ্গে করমর্দনের উদ্দেশ্য হাত বাড়াতেই দোস্তজি খপ করে হাত ধরে বলে বাহেনচোত শালা, তারপর হাত বেঁধে ফেলে। ততক্ষণে বাসু মিঞাও ঢুকে পড়েছেন এসব অবাঞ্চিত ব্যাপার দেখে সাধারণ জ্ঞান লোপ পেয়ে যেন পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন তিনি। বাসু মিঞা ধরা পড়লেন। হাত বাঁধলো, চোখ বাঁধলো নিয়ে গেল ছয় সাত মাইল দূরে দমদমা নদীর ধারে। এখানে পা রাখার জায়গা নেই। আধ হাত মাটির নীচে নীচে সোনার বাংলার মানুষ বাস করছে। নদীর পটভূমি ছোট্ট একটি কুলগাছ। সেখানে তাদের বাঁধলো এবং ওদের দিয়ে ওদের কবর খুঁড়ালো। চাঁদু, জুল্লু, আর গেদুকে সে কুল গাছের সাথে বেঁধে রেখে, কয়েকজন সেনা বাসু মিঞাকে ফিরিয়ে নিয়ে এলো, উদ্দেশ্য মোটা মালপানি কিছু নিবে, নিল সামান্য কিছু মাত্র ১৯০০.০০ টাকাই ঘরে ছিল। উদ্দেশ্য সিদ্ধি হলো। আবার হাত বাঁধলো, চোখ বাঁধতে যাবে, বাসু মিঞা কাকুতি জানালেন, এক মিনিট আমাকে সময় দিন,কথাটা রাখলো পাষণ্ডরা। মা জহুরা তখন মিলিটারির পায়ের তলায় কেঁদে কেঁদে কাকুতি মিনতি করে ছেলের প্রাণভিক্ষা চেয়ে লুটোপুটি খাচ্ছেন। মাকে বললেন, মা লিটনকে ( ছোট ছেলে) একবার নিয়ে এসো। মা কাঁদতে কাঁদতে লিটনকে নিয়ে এলেন। কিন্তু হাত তো বাঁধা। মাকে বললেন, আমার বুকের সঙ্গে একটু ঠেকাও। মা লিটনকে তার বুকের সাথে চেপে ধরলেন। চোখের সমস্ত পানি যেন শেষবারের মত বাঁধ ভেঙ্গে বেরিয়ে এল বাসু মিঞার। চোখ বেঁধে ফেলল পাষণ্ডরা। শেষ বার মাকে ডেকে বললেন, মা এই শেষ দেখা, দমদমার গর্তের কাছে ওদের বেঁধে রেখেছে, আমার গর্তও হয়ে গেছে। তোমরা সবাই মিলেমিশে থেকো। আমার মৃতদেহকে নিয়ে এসে ভালোকরে দাফন করো। কিন্তু তা আর হয়নি। পাষণ্ডরা তার মৃতদেহ আনতে দেয়নি। দমদমার ছোট কুল গাছটির তলায় যেখানে রংপুর সরকারি কারমাইকেল কলেজের তরুণ দম্পতিকে এক সঙ্গে একই গর্তে মাটিচাপা দিয়ে রেখেছে, ঠিক তারই পাশে আজ তিনটে গুলি, তিনটে শব্দ, তিনটে দাগ চিহ্নিত বাসু মিঞার দেহকে মাটিচাপা দিয়ে গেল এরা কিন্তু চাঁদু, জুল্লু, গেদুর লাশ কোথায় এই প্রশ্নের উত্তর আজও পাওয়া যায়নি।“

-আজাদ এম,কবির

অপরাজিতা নীল
<৮,৮০,৪৯৫-৯৬>
[ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনের মধুদা]

-বাংলাদেশে গণহত্যা, বাংলার বাণী, বিশেষ সংখ্যা, ১৯৭২
“মধুসূদন দে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী সকলের প্রিয় মধুদা। এই ‘মধুদা’ তার ছেলে, পুত্রবধূ এবং স্ত্রীসহ নিহত হয়েছিলেন বর্বর পাক-সেনাদের হাতে।

মধুবাবু তার পরিবার-পরিজন নিয়ে থাকতেন শিববাড়ী কোয়ার্টারে। পঁচিশে মার্চের ভয়াল বীভৎস রাতের পরদিন, তথা ২৬শে মার্চ সকালে বর্বর বাহিনী আক্রমন চালায় জগন্নাথ হলের পার্শ্ববর্তী শিববাড়ীতে। পাকবাহিনী মধুবাবুর ঘরের দড়জায় সজোরে করাঘাত করলে, দ্বিধা নিয়ে মধুবাবু দরজার কপাট খুলে দেন। সাথে সাথে একজন ভিতরে ঢুকে মধুবাবুকে টেনে বাইরে নিয়ে গিয়ে পাশের বাড়ীর আঙ্গিনায় আটকিয়ে রাখে।লোলুপ-দৃষ্টি আর পৈশাচিকতায় উন্মত্ত বর্বর পাকবাহিনীর হাত থেকে বাঁচবার আপ্রাণ চেষ্টায় ছোট ঘরের আঙ্গিনায় ছুটোছুটি করছিলেন মধুবাবুর পুত্রবধূ রানী। অসহায় গৃহবধূর আর্তি প্রমত্ত হায়েনাকে এতটুকু বিচলিত করেনি সেদিন। স্ত্রীকে রক্ষা করতে স্বামী রণজিত দে ছুটে এলে, বর্বরদের উদ্যত রাইফেলের আঘাতে তারা দুজনেই লুটিয়ে পড়ে।

দাদা-বৌদিকে রক্ষা করতে মধুর অবুঝ মেয়ে রানু সেদিন ছুটে গিয়েছিল পাশের ঘরে। সাথে সাথে বর্বরদের উদ্যত রাইফেলের গুলী তার চোয়ালে আঘাত করে। ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে যাওয়া এই রানু সেদিনের সকল ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষ সাক্ষী। আর সবাই আরো ছোট ছোট থাকলেও, তারাও সেদিন সামনে থেকে দেখেছিল তাদের আপনজনকে বর্বর নরপিশাচদের হাতে নৃশংসভাবে নিহত হতে।

রণজিত বাবু আর তার স্ত্রীকে হত্যা করে বর্বররা মধুবাবুকে আঙ্গিনায় এনে দাঁড় করায়। একজন দস্যু সেনা তার দিকে রাইফেল উঁচিয়ে ধরলে, মধুবাবুর স্ত্রী শঙ্কিত হয়ে, দৌড়ে গিয়ে স্বামীকে জড়িয়ে ধরেন। সাথে সাথে বর্বরের উদ্যত রাইফেলের গুলীবর্ষনে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। গুলীর আঘাতে হাতদুটো তার ঝাঁঝরা হয়ে যায় এবং স্বামীকে বাঁচাতে গিয়ে তিনি নিজে প্রাণ দেন। গুলীর আঘাতে মধুবাবুর দেহও জর্জরিত হয়ে গেলে, তিনিও স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে লুটিয়ে পড়েন। বর্বরদের গুলী রানুকেও তখন আহত করেছিল। একটা গুলী তার বুক ভেদ করে বেড়িয়ে যায়। বর্বররা কি ভেবে তখন চলে যায়।

গুলীর আঘাতে জর্জরিত মধুবাবু বর্বররা চলে যাবার পরও অনেকক্ষন বেঁচে ছিলেন। তার ঘন্টাখানেক পর আবার ওরা আবার এসে মধুবাবুকে নিয়ে যায়। বাবাকে রেখে যাওয়ার জন্য চীৎকার করে সেদিন রানু বলছিল, “তাহলে আমাকেও বাবার সাথে নিয়ে যাও। আমারও তো গুলি লেগেছে।”

বর্বররা তাকে নিয়ে যায়নি। আবার ফিরিয়ে দিবে আশ্বাস দিয়েছিল বলে, কচি শিশু মন সেদিন সারাদিন আর রাত ভরে অপেক্ষা করেছিল তার বাবার জন্য। বর্বররা তার আহত বাবাকে আর ফিরিয়ে দেয়নি। মধুকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় জগন্নাথ হলের মাঠে।

ঘটনার পর চৌদ্দদিন পর্যন্ত শিববাড়ীতে পড়েছিল মধুবাবুর ছেলে, পুত্রবধূ আর স্ত্রীর লাশ।“
<৮,৮১,৪৯৭-৯৮>
[লে. কর্নেল ডা. নুরুল আবসার মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর]

-‘বাংলাদেশে গণহত্যা’ বাংলার বাণী, বিশেষ সংখ্যা, ১৯৭২।।
“আমার হাতে একটা পিস্তল তুলে দিয়ে তিনি বললেন, কর্নেল শাহনুরের বদলা হয়তো আমার ওপর থেকেই ওরা নেবে। তোমাকে আত্মরক্ষার জন্যে পিস্তল দিয়ে গেলাম। ওরা তোমার ওপরও আক্রমণ চালাতে পারে। কথাগুলো বলেই তিনি বাইরে এসে দাঁড়ালেন। সশস্ত্র পাকসেনারা তাঁকে গাড়িতে তুলে নিয়ে চলে গেল। তারপর তিনি আর ফিরে আসেননি।”

পাক-হানাদার বাহিনীর হাতে নিহত ৪০ ফিল্ড এ্যাম্বুলেন্সের কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল ডা. নুরুল আবসার মোহাম্মদ জাহাঙ্গীরের পত্নী মিসেস জেবুন্নেসা জাহাঙ্গীর বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে কথাগুলো বললেন।

“বাংলার মাটি আর বাংলার মানুষের প্রতি ভালবাসাই ছিল তার সবচেয়ে বড় অপরাধ। তা না হলে কেন এমন হবে? আমার স্বামী কোনো অন্যায় করেননি। তবু কেন ওরা আমার স্বামীকে নির্মমভাবে হত্যা করলো? তিনি বাঙালী-এটাই কি তার সবচেয়ে বড় অপরাধ?” একটু থেমে থেমে কথা বলছিলেন মিসেস জেবুন্নেসা জাহাঙ্গীর।

তিনি বলেছিলেন একাত্তরের ঊনিশে মার্চের একটি ঘটনা। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে উচ্চ পদস্থ আর্মি অফিসারদের জরুরি কনফারেন্স। আলোচনার বিষয়-বাংলাদেশের যুবসমাজকে সমূলে উৎখাত করতে হবে। উক্ত কনফারেন্সে ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফি, লে. কর্নেল ইয়াকুব মালিক, মেজর আগা বোখারী, মেজর সুলতান (বেলুচ রেজিমেন্টের লোক) সহ অনেক উচ্চপদস্থ পাক আর্মি উপস্থিত ছিল। সভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হলো-বাংলার সংগ্রামী যুব সমাজকে এলোপাতাড়ি ভাবে হত্যা করা হবে। কিন্তু প্রস্তাবের বিরোধীতা করলেন লে. কর্নেল জাহাঙ্গীর। না, তা হতে পারে না, অসম্ভব। দৃঢ়প্রত্যয় নিয়ে তিনি সেদিন প্রস্তাবের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন।

আর এর পর থেকেই কোনো কনফারেন্সে জনাব জাহাঙ্গীরকে ডাকা হতো না। তিনি যেতে চাইলেও তাকে ঢুকতে দেয়া হতো না।

এর ক’দিন পর সাহেবজাদা ইয়াকুব আমার স্বামীকে ডেকে পাঠান এবং ক্যান্টনমেন্টের বাইরে যেতে বারণ করেন। বললেন মিসেস জাহাঙ্গীর।

তারপর এলো পঁচিশে মার্চ। সেদিন রাত সাতটার দিকে ব্রিগেডিয়ার শফি, লে. কর্নেল জাহাঙ্গীরকে ডেকে পাঠান ক্লাবে। ক্লাব থেকে ফিরে এসে তিনি আমাকে জানান আজ রাতের বেলায় ওরা হয়তো বাঙালীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। ওদের কথাবার্তায় তাই মনে হয়েছে। কথা শেষ না হতেই ক্যান্টনমেন্ট এলাকার বাতি নিভে গেলো। রাতে আমরা আর ঘুমাইনি। শুধু মেশিনগান, কামান আর ট্যাংকের শব্দে বারবার শিউরে উঠলাম। মাঝে মাঝে ক্যান্টনমেন্টের বাইরে আগুন দেখা গেলো। আমার স্বামী আমাদের সান্ত্বনা দিতে লাগলেন।

ভোরবেলা দেখলাম আমাদের বাসার সম্মুখে আরটিলারি গান বসিয়ে ওরা কয়েকজন বসে আছে। যেন আমরা বাইরে বেরুতে না পারি।

লে. কর্নেল জাহাঙ্গীর বুঝতে পারলেন তিনি বন্দি। আর তাই তিনি ফোন করে তার ইউনিটের বাঙালী সৈনিকদের সুযোগ বুঝে পালিয়ে গিয়ে বাংলার মুক্তি সংগ্রামে শরিক হতে বললেন। দূরালাপনীতে তিনি তার বাঙালী সৈনিকদের বললেন মরতে যদি হয় তাহলে বীরের মতোই মরো। আমিও তোমাদের কাতারে এসে শামিল হচ্ছি। কথা শেষ করে ব্রিগেডে যাবার উদ্দেশ্যে বাইরে এসে দাঁড়াতেই পশ্চিমা হানাদার বাহিনী তাকে বাধা দেয় এবং বলে, আপনার বাইরে যাওয়া চলবে না।

২৯শে মার্চ রাতে তিনি খবর পেলেন চট্টগ্রামের কুমিরায় যুদ্ধ করতে গিয়ে বাঙালী সৈনিকদের হাতে লে. কর্নেল শাহনুর নিহত হয়েছেন।

৩০ শে মার্চ খুব সকালে একদল পাঞ্জাবী দানব বাসা থেকে তাকে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে গেলো, যাবার আগে আত্মরক্ষার জন্য তিনি আমাকে একটি পিস্তল দিয়ে গেলেন। এরপর আমি তার আর কোনো খোঁজ পাইনি।

স্বামী নেই, ঘরে খাবার নেই। দুধের শিশু কাঁদছে, দুধ নেই। এক ফোঁটা পানিও নেই। ঘরের বাইরে গোলাগুলি চলছে। বাইরে বেরুবার পথ বন্ধ। এক ফোঁটা পানির জন্য ছটফট করছে আমার সন্তানরা। তবু দানবরা পানি দেয়নি। খাবার দেয়নি। কথাগুলো বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়লেন মিসেস জাহাঙ্গীর। ঠিক সেই সময় মিসেস জাহাঙ্গীরের ছোট ছেলে আরিফ বললো, পানির জন্য আমরা আল্লাহর কাছে কত কেঁদেছি। তারপর থেকেই আল্লাহ বৃষ্টি দিয়েছেন। আর আমরা সেই বৃষ্টির পানি পান করেছি। পাত্রে জমিয়ে রেখেছি।

বৃষ্টি না হলে ছেলেমেয়েদের বাঁচানো যেত না, অশ্রুসিক্ত নয়নে বললেন মিসেস জাহাঙ্গীর।

এমনিভাবে ক’দিন অনাহারে কাটার পর নরপিশাচরা তাদেরকে ক্যান্টনমেন্ট এলাকার একটি স্কুলে আটক করে রাখে। সেই স্কুলে বাঙালী আর্মি অফিসার ও সৈনিকদের অনেক পরিবারকে আটকে রাখা হয়েছিল।

তারপর এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে মিসেস জাহাঙ্গীর ক্যান্টনমেন্ট এলাকা থেকে তিন শিশু সন্তান মারুফ (১৩), আরিফ (১০) ও দু’বছরের মিমির হাত ধরে বেরিয়ে এলেন। তিন শিশু সন্তানসহ মিসেস জাহাঙ্গীর প্রাণে বাঁচলেন বটে, কিন্তু বাঁচাতে পারলেন না তাঁর প্রাণপ্রিয় স্বামীকে।

মিসেস জেবুন্নেসা জাহাঙ্গীর আমাকে জানান যে, কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে অবস্থানরত অধিকাংশ বাঙালী অফিসার ও সৈনিকদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এদের মধ্যে তাঁর স্বামী লে. কর্নেল জাহাঙ্গীরসহ লেফটেন্যান্ট ফারুক, ক্যাপটেন হুদা, ক্যাপটেন বদরুল আলম, মেজর ইসলাম, মেজর খালেক, মেজর মুহিদুল জামালের নাম তাঁর স্মরণ আছে বলে তিনি আমাকে বলেন।

উল্লেখযোগ্য যে, সবাধীনতা লাভের পর কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট এলাকা থেকে অসংখ্য বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া যায়। সে সব বধ্যভূমি থেকে লে. কর্নেল জাহাঙ্গীরসহ অগণিত বাঙালী আর্মি অফিসার ও সৈনিকদের নরকঙ্কাল উদ্ধার করা হয়।

বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে লে. কর্নেল জাহাঙ্গীরের দেহাবশেষ সমাধিস্থ করেন।“

শাহরিয়ার রাফি
<৮,৮২,৪৯৯>
[ডঃ আয়েশার হত্যাকাণ্ড]

-দৈনিক বাংলা, ২৪ জানুয়ারি, ১৯৭২
“বর্বর পাকিস্তানি বাহিনীর শেষ মুহূর্তের উন্মত্ততার একজন করুণ শিকার তদকালীন স্টেট ব্যংক এর মেডিকেল অফিসার ডাঃ আয়েশা বেদোরা চৌধুরী। জল্লাদের বুলেটে ঝাঝরা হয়ে গিয়েছিল ডাঃ আয়েশা চৌধুরীর সমস্ত শরীর। এই নির্মম হত্যাকান্ডটি ঘটেছিল ধানমন্ডি আবাসিক এলাকার ১৮ নং রাস্তায়। ঘটেছিল সেই সর্বজন পরিচিত বাড়িটির সামনে যে বাড়িতে মাসের পর মাস দু:সহ জীবন কাটিয়েছেন বেগম শেখ মুজিবুর রহমান। ঘটনাটি ঘটেছিল বেগম মুজিবের অসহায় দৃষ্টির সামনেই।

খান সেনাদের আত্মসমর্পণ এর খবর পেয়ে আরো অনেকের মতই আনন্দে উল্লসিত হয়ে উঠেছিলেন ডাঃ আয়েশা চৌধুরী। এতদিন গোপনে গোপনে তিনি যে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা করেছেন , সাহায্য করেছেন সামর্থ্য অনুযায়ী টাকা দিয়ে পয়সা দিয়ে , তাদের এই অসামান্য সাফল্যে (লেখা আছে সামান্য) উদ্বেল হয়ে তিনি সেদিন চুপ করে ঘরে বসে থাকতে পারেন নি। তিনি বেড়িয়েছিলেন তাঁর খালু সড়ক বিভাগের সাবেক চীফ ইঞ্জিনিয়ার জনাব হাতেম আলী খান কে সাথে নিয়ে তাঁর নিজের গাড়িতে। শত্রুমুক্ত ঢাকা নগরীর মুক্ত হাওয়ায় মুক্তির আস্বাদে হৃদয় কে ভরিয়ে তোলার বাসনায়।

বেগম হাতেম আলী খান এবং তাদের পুত্রবধূ মাহবুবা রশীদ চপলও সাথী হয়েছিলেন সেই সময়। তারা প্রথমেই ছুটে গিয়েছিলেন ১৮নং রাস্তার সেই বাড়িতে যে বাড়িতে বেগম মুজিব ছিলেন বন্দীনি। তাঁরা গিয়েছিলেন বেগম মুজিবকে খবর জানাতে। কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য সফল হয় নি। তখনো খান সেনারা মেশিনগান উচিয়ে পাহারা দিচ্ছিল এই বাড়িতে। আর ঠিক সেই মূহুর্তে তাদের গাড়ি বাড়িটার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই তার হাতের মধ্যে শিকার পেয়ে আনন্দে উল্লসিত হয়ে উঠেছিল। মুহুর্ত মাত্র দেরী না করেই তারা ঝাপিয়ে পড়েছিল গাড়িটার উপর্। একটানা গুলিবর্ষণে তারা ঝাঝরা করে দিয়েছিল গাড়িকে। জর্জরিত করে তুলেছিল গাড়ির আরোহীদের্। গুলির আঘাতে ডাঃ আয়েশা ঘটনাস্থলেই নিহত হন। আর নিহত হন গাড়ির চালক মুনির আহমেদ। জনাব হাতেম আলী খানের পায়ে এসে গুলি লাগে। বেগম খানের লাগে হাতে। তাদের পুত্রবধুর মাথার তালু ছুয়ে গুলি চলে যায়। অল্পের জন্য রক্ষা পান তিনি। বুলেটবিদ্ধ গুরুতরভাবে আহত জনাব ও বেগম খান এবং তাদের পুত্রবধূ কোনমতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন পাশের একটি বাড়িতে। পরে সেখান থেকে তাদেরকে পাঠানো হয় হাসপাতালে। মাত্র কয়েকটি ঘন্টা পরেই যারা হাতের অস্ত্র ফেলে দিয়ে দুহাত তুলে আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়েছিল সামান্য সময় আগেই তাদের নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞের শিকারে পরিনত হয়ে অকালে মৃত্যুবরণ করতে হল দুইটি শিশু সন্তানের জননী ডাঃ আয়েশা বেদোরা চৌধুরীকে।“

জহির রায়হান
<৮,৮৩,৫০০-৫১২>
[হানাদার বাহিনীর সহযোগী আল-বদরদের হত্যার শিকার কয়েকজন]

-১৯৭৩ সালের জাতীয় দিবসে সাপ্তাহিক বিচিত্রার বিশেষ সংখ্যা

মুনীর চৌধুরী
“চৌদ্দই ডিসেম্বর খুব ভোরে ঘুম ভাঙ্গলো মুনীর চৌধুরীর। হাতমুখ ধুয়ে ধীরে সুস্থে নাস্তা করলেন। তারপর আবার বিছানায়। রেডিও ছেড়ে শুয়ে শুয়ে খবর শুনতে লাগলেন। সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয় পাড়া নিঃঝুম। মাঝে মাঝে ভারতীয় বিমানের হামলা। দু একটা গাড়ী ভর্তি পাকিস্তানী সেনা মাঝে মাঝে ছুটে চলেছে।

বিশ্ববিদ্যালয় পাড়ায় মুনীর চৌধুরীর ফ্লাট যদিও দোতলায়, যুদ্ধের সময় তিনি নিচের একটা ফ্লাটে থাকতেন। শুয়ে শুয়ে রেডিও শুনতে শুনতে এক সময় স্ত্রীকে ডেকে বললেন, শোন, আর মাত্র আটচল্লিশ ঘণ্টা বাকী আছে দেশ স্বাধীন হতে। সে সময় গোলার স্বরে তাঁর স্থির বিশ্বাস ফুটে উঠেছিল।

এরই মাঝে স্ত্রী এসে একবার জিজ্ঞেস করলেন তিনি আর এক কাপ চা খাবেন কিনা। সম্মতি জানালেন। তারপর চা খেয়ে বিছানা ছেড়ে উঠলেন।

বিছানা ছেড়ে ওঠার পর মুনীর চৌধুরী গোসল করতে ওপরে চলে গেলেন। ময়লা কাপড়-চোপড়ও কিছু ধুলেন। কারণ পরিবারের সবাই তখন ভাগাভাগি করে সংসারের কাজকর্ম সারেন। স্নান সেরে এসে স্ত্রীকে বললেন, যাও তোমার জন্য পানি গরম করে রেখেছি। তুমি গোসল করতে যাও। বলে তিনি নিজের ঘরে গিয়ে চুল আঁচড়াতে লাগলেন। অসুস্থ স্ত্রীও গোসল করতে যাবার জন্য পা বাড়ালেন।

নিশ্চিন্ত মনে চুল আঁচড়াচ্ছেন মুনীর চৌধুরী। বেলা তখন বারো কি এক। এমন সময় নীচে লোহার গেটে শব্দ শোনা গেল। কে যেন দরজা ধাক্কাচ্ছে। মুনীর চৌধুরীর স্ত্রী উঁকি দিয়ে দেখলেন কম বয়সী কয়েকটি বাঙালি ছেলে দরজা ধাক্কাচ্ছে। মুনীর চৌধুরী সে সময় স্ত্রীকে বললেন, থাক দেখার দরকার নেই। সরে এসো। বলে তিনি আবার চুল আঁচড়াতে লাগলেন। স্ত্রীর সাথে মুনীর চৌধুরীর ঐ ছিল শেষ কথা।

এমন সময় নীচে থেকে তাঁর ভাই ওপরে এসে বললেন, মুনীর ভাই আপনাকে নীচে ডাকছে।

মুনীর চৌধুরী জিজ্ঞেস করলেন, আমার নাম করে বলেছে?

হ্যাঁ।

পাঞ্জাবী পড়ে তিনি আস্তে আস্তে নীচে নেমে গেলেন। মুনীর চৌধুরীর স্ত্রী লিলি চৌধুরী কিন্তু তখনও আতংকিত হননি। তাঁর স্বামীকে কেউ যে ধরে নিয়ে যেতে পারে একথাও তার মনে হয়নি। কারণ যারা তাঁকে ডাকতে এসেছে সবাই কম বয়সী, বাঙ্গালী।

তবুও লিলি চৌধুরী সিঁড়ি ধরে নীচে নামলেন। দেখলেন মুনীর চৌধুরী দাঁড়িয়ে আছেন নীচে। আশেপাশে বন্দুক নিয়ে আরেকটি অল্প বয়সী ছেলে। তিনি শুনলেন, মুনীর চৌধুরী তাদের একজনকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের অফিসার কোথায়?

একথা বলার সাথে সাথে একটি ছেলে তাঁর পিঠের কাছে বন্দুক উঁচিয়ে বললো, আছে, আপনি চলুন। মুনীর চৌধুরী আস্তে আস্তে হেঁটে তাদের সাথে চলে গেলেন।“

(page)
মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী

আল-বদর এবং রাজাকারেরা চৌদ্দই ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় ফ্লাটে তাঁর খোঁজ করলো। পেল না। পরে তাঁর তবলীগ পন্থী চাকরের কাছ থেকে মালিবাগের ঠিকানা জেনে সেখানে গিয়ে উপস্থিত হলো।

চৌদ্দই ডিসেম্বর দুপুরের দিকে আল-বদররা এসে হাজির হলো লুৎফুল হায়দার চৌধুরীর বাসায়। দরজায় করা নাড়ার পর লুৎফুল হায়দার দরজা খুলে দিলেন।

‘মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী কোথায়?’

‘এখানেই আছেন।’

‘আমাদের অফিসার তাঁর সাথে কথা বলবেন, তাঁকে একটু ডেকে দিন।’

লুৎফুল হায়দার ডেকে দিলেন। মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর সাথে তাঁর স্ত্রীও এলেন বাইরের ঘরে। স্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনাদের অফিসার কোথায়?’

‘গাড়ীতে আছেন।’

আপনারা যে তাঁকে নিতে এসেছেন, ওয়ারেন্ট আছে আপনাদের সাথে? মোফাজ্জল সাহেবের স্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন।

‘আছে।’

‘আপনারা কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন ওকে?’ ফের তাঁর স্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন।

‘জানি না।’

‘বাঃ, এটা কেমন কথা’। স্ত্রী অবাক হলেন, ভয় পেলেন। মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী তখন বললেন, ‘ঠিক আছে আমি কাপড় পরে নেই।’

বাথরুমে তাঁর গোসলের জন্য তখন গরম পানি তৈরী। কিন্তু তিনি আর গোসল করলেন না। স্ত্রী স্যুট বের করে দিলেন। তিনি স্যুট পরে আবার বাইরের ঘরে এলেন। তাঁর স্ত্রী তখন বললেন, ‘আমি ওর সঙ্গে যাবো।’

একজন আল-বদর জওয়াব দিল, ‘আপনি তো আমাদের মায়ের মতো। আপনি আর কই যাবেন। আর উনি তো আমাদের স্যার। আমরা এখনই ওকে ফেরত দিয়ে যাবো।’

মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী তখন হঠাৎ বললেন, ‘আমি চাট্টি খেয়ে নিতে পারি?’

‘আমাদের ওখানে সব ব্যবস্থা আছে। আপনি চলুন।’

তিনি তখন আবার হঠাৎ বললেন, ‘ঘড়িটা পরে নেই?’

‘না, না, দরকার নেই। আপনি তো এখনই আবার চলে আসবেন।’

মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী শেষ যাত্রার জন্য পা বাড়ালেন। পা বাড়াবার আগে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমি তো অন্যায় কিছু করিনি, তুমি ঘাবড়াচ্ছো কেন? আমি এখনই চলে আসবো।’”

অধ্যাপক আনোয়ার পাশা ও
অধ্যাপক রাশীদুল হাসান

(page)

একসাথে আজীবন থাকতে চেয়েছিলেন। দু’জনেই পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রায় এক সাথে চলে এসেছিলেন। একজন চাকুরী নিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে, অপরজন ইংরেজী বিভাগে। আমি অধ্যাপক আনোয়ার পাশা ও অধ্যাপক রাশীদুল হাসানের কথা বলছিলাম।

যুদ্ধের সময় রাশীদুল হাসান নিজের বাসা ছেড়ে বন্ধু আনোয়ার পাশার বাসায় চলে আসেন। দু’বন্ধু এক সাথে থাকলে বুকে আশা থাকে, সাহস থাকে।

চৌদ্দই ডিসেম্বর সকাল সাতটায় আনোয়ার পাশার ঘুম ভেঙ্গেছে। গড়িমসি করে বিছানা ছেড়েছেন আরো পরে। তারপর দু’বন্ধু মিলে ন’টার দিকে নাস্তা করেছেন, রেডিও শুনেছেন। ন’টার খানিক পরে আনোয়ার পাশার স্ত্রী পিছনের বারান্দা দিয়ে দেখলেন একটি লাল গাড়ী এসে থামলো বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকার চত্বরে। কয়েকজন রাজাকার নামলো।

আনোয়ার পাশা এরই মধ্যে স্ত্রীর সাথে দু’একটা খুচরো সাংসারিক আলাপ সেরেছেন। রাশীদুল হাসানের সাথে গল্পে বসার আগে হাসতে হাসতে স্ত্রীকে বললেন, কাসুটা উঠুক তারপর তোমার জন্য ভালো করে বাজার টাজার করে দেব। রাশীদুল হাসানের স্ত্রী তখন সংসারের অন্যান্য কাজে ব্যস্ত।

কিছুক্ষণ পর দরজায় নক। দরজা খুললেন আনোয়ার পাশার ছোট ভাই। তারা দরজার মুখে দাঁড়িয়ে। আনোয়ার পাশা আর রাশীদুল হাসান তখন ড্রইংরুমে। একজন আনোয়ার পাশাকে দেখে জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনার নাম আনোয়ার পাশা।’

‘হ্যাঁ।

‘আপনি বাইরে আসুন।’

এমন সময় তাদের চোখ পড়লো রাশীদুল হাসানের দিকে। জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনার নাম?’

‘রাশীদুল হাসান।’

‘আপনিও চলুন।’

সেই সময় রাশীদুল হাসানের স্ত্রী এসে দরজার মুখে দাঁড়ালেন। এ দৃশ্য দেখে তিনি বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। আনোয়ার পাশা এবং রাশীদুল হাসান একবার তার দিকে তাকালেন। চোখ তাঁদের ছলো ছলো। কিন্তু একেবারে নিশ্চুপ তারা। ছলো ছলো চোখে দুজনে আরেকবার তাঁর দিকে (রাশীদুল হাসানের স্ত্রী) তাকিয়ে আস্তে আস্তে আল-বদরদের সাথে পা বাড়ালেন। আনোয়ার পাশার স্ত্রী জানালা দিয়ে শুধু দেখলেন তাঁদের গায়ের চাদরে তাঁদের চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

ডঃ সিরাজুল হক খান
page

যুদ্ধ যখন চরম পর্যায়ে তখন ডঃ সিরাজুল হক খান পরিবারের সবাইকে নিয়ে রাতের বেলা ফ্লাটের নীচের তলায় থাকতেন। সকালে আবার দোতলায় নিজের ফ্লাটে চলে যেতেন। ১৪ই ডিসেম্বর খুব ভোরে তিনি ঘুম থেকে উঠে নামাজ পড়লেন। একবার ওপরে নিজের ফ্লাটে গেলেন তারপর আবার নীচে নেমে এলেন। সে সময় তার নজরে পড়লো, একটু দূরে আল-বদর বাহিনীর কিছু লোক রুমাল দিয়ে এক ভদ্রলোকের চোখ বাঁধছে। সাথে সাথে তিনি ওপরে উঠে গেলেন। সবাইকে বললেন, ‘ওরা আমাদের এলাকায় ঢুকেছে। তোমরা সাবধানে থাকো।’ তাঁর স্ত্রী তখন তাঁর জন্য নিজের হাতে ঔষধ তৈরী করছেন। তিনি ডঃ খানকে ঔষধ খেতে ডাকলেন। জবাবে ডঃ খান ‘এসে খাবো’ বলে নীচের তলায় বোটানীর অধ্যাপক জনাব ইসমাইলের ড্রইংরুমে যেয়ে বসলেন। গল্প-গুজব করতে লাগলেন। এদিকে আল-বদর বাহিনী ওপর তলায় তাঁর ফ্লাটে এসে ঢুকে জিজ্ঞেস করলো, ‘এটা ডঃ সিরাজুল হকের বাসা?’

‘হ্যাঁ।’

‘তিনি কোথায়?’

‘নীচে গেছেন।’

‘কোন বিভাগের অধ্যাপক তিনি?’

‘শিক্ষা-গবেষণা কেন্দ্র।’

‘হ্যাঁ, আমরা তাঁকেই খুঁজছি।’

এই বলে তারা ডঃ খানের ভাইকে নিয়ে ইসমাইল সাহেবের ড্রইংরুমে উপস্থিত হলো। ডঃ খানকে তাঁর নাম জিজ্ঞেস করলো। তারপর তাঁকে ঘর থেকে বাইরে এনে তাঁরই পকেটের রুমাল দিয়ে তাঁর চোখ বেঁধে অচেনা গন্তব্যের দিকে নিয়ে চললো। পরিবারের সবাই তাকিয়ে রইলো বিমূঢ় হয়ে।

ডঃ খান স্ত্রীকে বলে গিয়েছিলেন, নীচে থেকে এসে ঔষধ খাবেন। স্ত্রীর সাথে ঐ ছিলো তাঁর শেষ কথা। কিন্তু ঔষধ খেতে তিনি আর ফিরে আসেননি।

<৮,৮৩,৫০৩>
ডঃ আবুল খায়ের

ডঃ আবুল খায়েরের সম্পর্কে একটি গল্প প্রচলিত ছিল। একদিন রাস্তা দিয়ে গাড়ী চালিয়ে যাচ্ছেন। হঠাৎ লাল বাতি। গাড়ী থামালেন। এদিকে লাল বাতি সবুজ হয়ে আবার লাল হয়ে গেছে, কিন্তু তিনি চুপচাপ গাড়ী নিয়ে বসে আছেন। এমন আপন ভোলা লোককেও আল-বদররা চৌদ্দই ডিসেম্বর তুলে নিতে ভুলে যায়নি।

ডঃ খায়েরের ফ্লাট নীচের তলায়। চৌদ্দই ডিসেম্বর সকাল আটটায় পায়জামা এবং শার্ট পরে, স্ত্রীর গরম চাদর গায়ে সিঁড়ির সামনে তিনি পায়চারী করছিলেন। ভাবছিলেন, কার্ফু উঠলেই পরিবারের সবাইকে নিয়ে নিরাপদে কোন জায়গায় চলে যাবেন। এমনি সময় আল-বদরের লোক এসে হাজির। তারা তাঁকে ঐ পায়চারী করা অবস্থায় ধরে নিয়ে চলে গেল।

ডঃ খায়ের তাঁর স্ত্রীকে কিছু বলে যেতে পারেননি। আল-বদরের লোকের সঙ্গে কি কথা হচ্ছিল তাও কেউ শোনেনি।

<৮,৮৩,৫০৪>
সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্য
সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্যের অনুরাগীরা তাঁকে বারবার অনুরোধ করেছিলেন দেশ ছেড়ে চলে যেতে। কিন্তু তিনি যাননি। স্বাধীনতা দেখে যেতে চেয়েছেন এখান থেকে।

জীবনের শেষ দিন সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্য বেশ ভোরেই ঘুম থেকে উঠেছিলেন। যথারীতি নাস্তা করে রেডিও শুনেছেন। তারপর আহ্নিক করতে বসেছেন। সকাল তখন সাড়ে আট কি নয়। আহ্নিকে বসবার আগে মেয়ে স্বপ্নাকে ডেকে বলেছিলেন, দেশ স্বাধীন হয়ে যাচ্ছেরে মা, খুব শীঘ্রই তোর দাদাকে দেখতে পারবি। স্বপ্নার দাদা অর্থাৎ সন্তোষ বাবুর বড় ছেলে কলকাতায় থাকতেন।

সন্তোষ ভট্টাচার্য আহ্নিকে ব্যস্ত এমন সময় দরজায় ধাক্কা। দরজা খুলে ভিতরে ঢুকলো এক বাঙ্গালী যুবক। কাঁধে স্টেন।

উর্দুতে জিজ্ঞেস করলো, ‘কই হ্যায়?’

এমন সময় সন্তোষ বাবু বেরিয়ে এলেন। যুবকটি তাঁর নাম জিজ্ঞেস করে তাঁকে নিয়ে যেতে চাইলো।
সন্তোষ বাবু জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমার কি অপরাধ?’

‘চুপ, বেশী কথা বলবেন না।’

‘কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?’

‘যেখানে খুশী।’

তারা তাঁকে বাসা থেকে টেনে বাইরে নিয়ে গেল। চোখ বাঁধলো এবং সেই শেষ বাসে নিয়ে তুললো।

<৮,৮৩,৫০৪-০৬>
ডাক্তার আলীম চৌধুরী
২৯ নম্বর পুরানা পল্টনের দোতলায় থাকতেন মিটফোর্ড হাসপাতালের ডাক্তার আলীম চৌধুরী। তাঁর নীচের তলায় থাকতেন মওলানা আব্দুল মান্নান, নীচের তলায় আগে ডাক্তার আলীমের ক্লিনিক ছিল। কিন্তু মাওলানা সাহেব একবার বিপদে পড়ে প্রাক্তন স্পীকার এ, টি, এম, মতিনকে ধরে বসেন আশ্রয়ের জন্যে। মতিন সাহেব আলীম সাহেবকে বললেন, ডাক্তার চৌধুরী, ক্লিনিক উঠিয়ে মওলানাকে আশ্রয় দিন।

১৫ ডিসেম্বর ঢাকায় তখন ভারতীয় বিমান হরোদমে বোমা বর্ষণ করছে। কার্ফ্যুও চলছে। শুধু সকাল আটটা থেকে দুপুর বারোটা পর্যন্ত কার্ফু উঠানো হল।

আলীম চৌধুরী ভাবছিলেন, এ ফাঁকে একবার অন্য কোন জায়গায় আশ্রয় নেয়া যায় কিনা দেখে আসবেন এবং একবার হাসপাতালটা ঘুরে আসবেন।

তাঁর স্ত্রীর ইচ্ছা ছিল না তখন তিনি বের হন। আলীম চৌধুরী বেরুবেনই। স্ত্রীকে বললেন, আমাকে তো একবার হাসপাতালে যেতেই হবে। ডাক্তার মানুষ আমি যদি না যাই তো কে যাবে? তারপর বললেন, আমি যতো তাড়াতাড়ি পারি ফিরবো। তুমি তৈরী থেকো। আমি ফিরলে সবাইকে নিয়ে অন্য কোথাও চলে যাবো। আলীম চৌধুরীর স্ত্রী বললেন, তুমি ঠিক মতো ফিরবে- তাহলেই হয়েছে। তুমিও কার্ফ্যুর সময় পার করে দিয়ে আসবে আর আমাদেরও যাওয়া হবে।

আলীম চৌধুরী স্ত্রীকে বারবার কথা দিলেন যে কার্ফুর অনেক আগেই তিনি ফিরবেন। তারপর কেরোসিনের একটি টিন নিয়ে গাড়ীতে গিয়ে উঠলেন। বাসায় তখন কেরোসিনের অভাব।

গাড়ী করে হাসপাতালে গেলেন ডাঃ চৌধুরী। হাসপাতালে তাঁর সহকর্মীরা তো তাঁকে দেখে অবাক। এই দুর্যোগ আর উনি কিনা এসেছেন হাসপাতালে। তারা বললেন, ডাক্তার সাহেব, আপনি যখন এসেই পড়েছেন তখন আর বাড়ী ফিরতে পারবেন না। এখানেই থেকে যান। ডাক্তার আলীম বললেন, ‘না, না, বাসায় সবাইকে রেখে এসেছি। বাড়ী ফিরে ওদেরকে নিয়ে আবার বেরুতে হবে।’

এরপর ডাঃ চৌধুরী গেলেন মিটফোর্ড হাসপাতালের প্রিন্সিপাল ডাক্তার লতিফের সাথে দেখা করতে। উদ্দেশ্য তিনি যদি একটা সাময়িক আশ্রয়ের বন্দোবস্ত করে দেন, কারণ তখন অনেক ডাক্তার সপরিবারে হাসপাতালের কেবিনগুলোতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তখন ডাঃ চৌধুরীও সেরকম একটা আশ্রয় চাচ্ছিলেন। কিন্তু ডাঃ লতিফ আলীম চৌধুরীকে সেরকম কোন আশ্রয় দিতে সম্মত হলেন না।

অতঃপর ডাঃ চৌধুরী বিমর্ষ মনে হাসপাতাল ছেড়ে বেরুলেন। ভাইপোর বাসায় যাবেন কেরোসিন আনতে। কেরোসিন নিলেন। ভাইপোকে তেলের দাম দিলেন। ভাইপো তো হেসে অস্থির। ডাঃ চৌধুরী তখন বললেন, ‘দেখ, মানুষের মরার কথা তো বলা যায় না। এই এখন আমাকে দেখছিস কিন্তু কিছুক্ষণ পর আমি তো নাও বেঁচে থাকতে পারি।’

ডাঃ চৌধুরী বাড়ী ফেরার জন্য গাড়ীতে উঠবেন ঠিক এই সময় কার্ফুর সাইরেন বেজে উঠলো। ভাইপো তাঁর হাত ধরে তাঁকে থেকে যেতে অনুরোধ করলেন। কিন্তু তিনি বাসায় যাবেনই। তাকে বললেন, ‘আমার গাড়ীতে রেডক্রস চিহ্ন আছে। কিছু ভেবোনা। আমি ঠিক ঠিক বাসায় পৌঁছে যাবো।’

বাসায় ফিরলেন। স্ত্রী সাথে সাথে ঝংকার দিয়ে বলে উঠলেন, ‘কি বলেছিলাম, সেই কার্ফু পার করে দিয়েই তো ফিরলে।’

তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে ঠিক আছে। কাল একেবারে সক্কালেই চলে যাবো।’

বেলা দুটো থেকে আবার বোমা বর্ষণ শুরু হলো। দোতলার বারান্দায় বসে সেই বোমা বর্ষণ দেখছিলেন ডাঃ চৌধুরী। বিকাল সাড়ে চার। একটা মাইক্রোবাস এসে থামলো বাসার নীচে। কয়েকজন আলবদর নামলো। ডাক্তার চৌধুরীর স্ত্রী একটু উঁকি দিয়ে দিয়ে তাদের দেখছিলেন। তখন তিনি বললেন, অতো উঁকিঝুঁকি দিয়ো না। বোধহয় আর্মি এসেছে। বলে তিনি বাথরুমে গেলেন। ব্যাপারটার তেমন গুরুত্ব দেননি স্বামী-স্ত্রী। কারণ মওলানা মান্নানের বাসায় হরদম এ ধরনের লোকজন আসা-যাওয়া করতো।

বাথরুম থেকে তিনি বেরিয়েছেন, এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠলো।

ডাঃ চৌধুরী হঠাৎ বিমূঢ় হয়ে গেলেন। কি করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। এলোমেলোভাবে বললেন, ও, এসেছে, তা দরজা খুলে দাও।

একথা বলেই তিনি নীচে নামার উদ্যোগ নিলেন। ডাঃ চৌধুরীর মা তখন বলে উঠলেন, ‘আরে কোথায় যাচ্ছো?’

তিনি বললেন, ‘নীচে, মওলানার কাছে, কারণ মওলানা বলেছিল, এ ধরণের কোন ব্যাপার ঘটলে যেন তাকে খবর দেয়া হয়।

নীচে নেমে তিনি মওলানার দরজা ধাক্কা দিতে লাগলেন। এমনিতে মওলানার দরজা সব সময় খোলা থাকতো কিন্তু সেদিন দরজা বন্ধ। এদিকে ডাঃ চৌধুরী দরজা ধাক্কাচ্ছেন, চীৎকার করে মওলানাকে দরজা খুলতে বলছেন। কিন্তু মওলানার কোন সাড়াশব্দ নেই। খানিক পর মওলানা ভিতর থেকে বললেন, ভয় পাবেন না। আপনি যান। আমি আছি।

তিনি ফের উপরে ওঠার জন্য পা বাড়ালেন। এমন সময় আলবদরের আদেশ ‘হ্যান্ডস আপ, আমাদের সাথে এবার চলুন।’

‘কি ব্যাপার কোথায় যাবো?’ প্রশ্ন করলেন ডাঃ চৌধুরী।

‘আমাদের সাথে চলুন।’

‘প্যান্টটা পরে আসি।’

‘কোন দরকার নেই।’

আলবদররা তাঁকে ঘিরে ধরলো। আস্তে আস্তে তিনি মাইক্রোবাসের দিকে অগ্রসর হলেন।

<৮,৮৩,৫০৬-০৭>
শহীদুল্লাহ কায়সার
এমনিতে শহীদুল্লাহ কায়সার খুব কথা বলতেন। কিন্তু যেদিন যুদ্ধ শুরু হলো সেদিন থেকে তিনি চুপ। সারাদিন টেনশনে থাকেন। যুদ্ধের আগে তাঁকে অনেকে বাড়ী ছেড়ে চলে যেতে অনুরোধ করেছেন। কিন্তু তিনি রাজী হননি। কারণ তিনি ব্যস্ত ছিলেন একটি উপন্যাস রচনায়। তাই তিনি বলতেন, ‘যুদ্ধ আমাকে দেখতে হবে। কারণ তথ্যগুলো আমার উপন্যাসে লাগবে।’

চৌদ্দই ডিসেম্বর। সকাল বেলায় দেখা গেল বিদেশী দূতাবাসের নম্বর প্লেট লাগানো একটি গাড়ী এসে শহীদুল্লাহ কায়সারের বাড়ী থেকে একটু দূরে দাঁড়ালো। অনেকক্ষণ গাড়ীটা সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে তারপর একসময় চলে গেল।

সকাল ন’টা-দশটার দিকে সদরী ইস্পাহানীর টেলিফোন।

‘কি করবো কায়সার সাহেব?’

কায়সার সাহেব তাঁকে অভয় দিলেন।

বেলা তখন তিনটা। বারান্দায় স্ত্রীর সাথে বসে আছেন তিনি। এমন সময় দেখলেন টুপি মাথায় একটি লোক এক দৃষ্টে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। এ দেখে তাঁর স্ত্রী বললেন, ‘তুমি ভিতরে যাও, দেখনা লোকটা কিভাবে তাকিয়ে আছে।’

সন্ধ্যে ছ’টা। শহীদুল্লাহ কায়সার বসে বসে খবর শুনলেন। এক সময় চাকরকে ডেকে বললেন, আমার জন্য দু’টো রুটি বানিয়ো।

শহীদুল্লাহ কায়সার প্রায়ই স্ত্রীকে বলতেন, দেখো আমাকে যে কোন সময় নিয়ে যেতে পারে। সুতরাং সব সময় আমার জন্য কিছু কাগজ-কলম আর সিগারেট রেখে দেবে। আর কিছু টাকা। শহীদুল্লাহ কায়সার আর বলতেন, ‘আমি একজন সাংবাদিক। তারা আমাকে যাই করুক মারবার সাহস পাবে না।’

চাকরকে তিনি রুটি বানাবার কথা বলেছেন এমন সময় দরোজায় ধাক্কা। মিলিটারী এসেছে।

মিলিটারী এসেছে এ সংবাদ পেয়েই তিনি ইস্পাহানীকে টেলিফোন করলেন। কি কথা হয়েছে কেউ জানে না। শুধু দেখা গেল সংক্ষিপ্ত কথা শেষ হওয়ার পর তিনি চুপচাপ টেলিফোন রেখে দিচ্ছেন।

আলবদররা এদিকে দরজা ধাক্কাচ্ছে। তিনি বললেন দরজা খুলে দাও। একথা বলে উপরে বেডরুমে গেলেন; স্ত্রীকে বললেন, ‘শিগগির আমাকে কিছু টাকা দাও।’ বলে তিনি প্যান্ট পরতে লাগলেন। তাঁর স্ত্রী তখন বললেন, ‘টাকা দিতে বলে তুমি যাচ্ছো কই?’ শহীদুল্লাহ কায়সার বললেন, ‘না একটু ভালো পোশাক পরে নেই।’

স্ত্রী তাঁকে ঘরের বাইরে যেতে দেবেন না। কিন্তু তিনি যাবেনই। স্ত্রীকে বললেন, ‘আমাকে না পেলে ওরা বাসার সবাইকে মারবে।’

ইতিমধ্যে যিনি দরজা খুলে দিয়েছেন, তাকে আলবদররা সিঁড়ির কাছে বেঁধে রেখে সোজা দোতলায় উঠে তাঁর বেডরুমে ঢুকে পড়লো।

বেডরুমটা বেশ বড়। অন্য এক দরজার কাছে শহীদুল্লাহ কায়সার দাঁড়িয়ে। ঘরের মাঝামাঝি তাঁর স্ত্রী। আলবদররা ঘরে ঢুকে শহিদুল্লাহ সাহেবকে দেখতে পেলো না। তাঁর স্ত্রীকে একলা ঘরে দেখে তারা বেরিয়ে যাবার উদ্যোগ করলো। এমন সময় পর্দার কাছ থেকে শহীদুল্লাহ কায়সার সামনে এসে দাঁড়ালেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনারা কাকে চান?’

‘আপনার নাম কি?’ তারা পাল্টা জিজ্ঞেস করলো।

‘শহীদুল্লাহ কায়সার।’

সঙ্গে সঙ্গে তাঁর হাত ধরলো। ‘আপনার সাথে কথা আছে।’ বলে তারা তাঁকে বারান্দায় নিয়ে এলো।

এদিকে বাসা জুড়ে হৈচৈ চীৎকার। আলবদররা তাঁকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে।

এমন সময় শহীদুল্লাহ কায়সার কঠিন কণ্ঠে বললেন, ‘আমি তো যাচ্ছিই। আপনারা আমার হাত ধরবেন না।’ এ বলে তিনি একবার পিছন ফিরে সবাইকে দেখাতে চাইলেন। কিন্তু আলবদররা তাঁকে সেই সুযোগ দেয়নি।

<৮,৮৩,৫০৭-০৮>
সিরাজউদ্দিন হোসেন

page

[ দৈনিক ইত্তেফাকের কার্যনির্বাহী সম্পাদক জনাব সিরাজউদ্দিন হোসেনের স্ত্রী বেগম নূরজাহান সিরাজের বিবৃতির উপর ভিত্তি করে এটি লেখা হয়েছে। (ইংরেজী থেকে অনুবাদ) ]

সিরাজউদ্দিন হোসেন ছিলেন বাংলাদেশের একজন খ্যাতনামা সাংবাদিক। ইত্তেফাকের ‘মঞ্চে নেপথ্যে’ কলামটি তিনিই লিখতেন।

১৯৭১ সনের ১১ই ডিসেম্বর ভোর ২-৪৫ মিনিটে পাকিস্তানী সৈন্যদের নির্দেশে একদল উর্দুভাষী লোক তাঁকে তাঁর বাসায় আসে।

জনাব হোসেন সপরিবারে ৫ নম্বর চামেলীবাগে থাকতেন। জনৈক ডাক্তার ছিলেন এ বাসার মালিক। অন্তিম দিনে দুষ্কৃতকারীরা সেই ডাক্তারকে সঙ্গে করে তার বাসায় প্রবেশ করে। জনাব হোসেনের দ্বিতীয় ছেলে দরজা খুলে দিলে দুষ্কৃতকারীরা বন্দুক উঁচিয়ে তাকে তার বাবার ঘর দেখিয়ে দিতে বলে। ঠিক এই সময় বেগম হোসেন বেডরুমের দরজা খুলে বের হন। সিরাজউদ্দিন হোসেনের উপর তখন একজন দুষ্কৃতকারীর নজর পড়লে সে জনাব হোসেনের নাম এবং পেশা জানতে চায়। সিরাজ সাহেব জানান যে তিনি পত্রিকায় চাকরি করেন। তখন তারা তাঁকে বেডরুম থেকে বারান্দায় নিয়ে আসে। এরপর দুষ্কৃতকারীরা জনাব হোসেনের ছেলেকে একটি ন্যাপকিন আনতে বলে, পরিবারের সবাইকে ভিতরের বেডরুমে চলে যেতে নির্দেশ দেয়। তারপর সিরাজউদ্দিন হোসেনকে একটি গাড়ীতে করে নিয়ে যাওয়া হয়। কোথায় কেউ জানে না।

<৮,৮৩,৫০৮>
গিয়াস উদ্দিন আহমেদ
১৪ই ডিসেম্বর, মঙ্গলবার। ঢাকা শহরে তখন চলছে একটানা কারফিউ। সকাল সাড়ে সাতটা। একটা মাইক্রোবাস এসে দাঁড়ালো হলের হাউস টিউটরদের বাসার সামনে। বাস থেকে সশস্ত্র ৩/৪ জন লোক নেমে দাঁড়ালো। তারা ছিল ইউনিফর্ম পরা। তাদের দুইজন এসে প্রথমে নীচতলায় পরিসংখ্যান বিভাগের বজলুল হক সাহেবের বাসায় তল্লাশী চালায়। এরপর তারা উপর তলায় আমাদের দরজায় আঘাত করতে থাকে। আমার স্বামী (জনাব নুরুল হক সরকারী চাকুরে) দরজা খুলে দেন। একজন বন্দুক হাতে কালো মুখোশ পরা তাঁর বুকের সাথে বন্দুক লাগিয়ে জিজ্ঞেস করল, গিয়াস উদ্দিন কে ? উনি বললেন, বাসায় নেই, হলের কাজে গেছেন। লোক দুটো তখন বলে, আপনি চলুন আমাদের সাথে, তাঁকে খুঁজে বের করে দেবেন। আমরা থাকতাম আজিমপুর কলোনীতে। কলোনীতে মিলিটারী আসায় ভাই-এর বাসায় আমরা চলে আসি। আমার স্বামী তাদের বলল, আমরা এখানে নতুন এসেছি, হলের কোন কিছু জানি না। তারা বলল ভিতরে চলুন, এখানে গিয়াস উদ্দিন সাহেব থাকতেন। ভাই এর কামরায় এসে ওরা সমস্ত রুম তছনছ করে দিয়ে গেল। ঘরে আমার এক মামাতো ভাই ছিল, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, ওকে নিয়ে চলল-হলে ভাইকে খুঁজে দিতে। হলে গিয়ে তারা দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করলো, গিয়াস সাহেব কোথায়? তারা বলল, হলের পেছনে পানির পাম্প ঠিক করছেন। তাড়াতাড়ি সেখানে গিয়ে ভাইকে ঘরে নিয়ে এল। সামনে পড়া একজন দারোয়ানের কাছ থেকে একটা গামছা ছিনিয়ে নিয়ে চোখ বেঁধে তাঁকে নিয়ে চলল। বাসে উঠার আগে মামাতো ভাইটিকে বললেন, ‘নূরুলকে বলিস টেলিফোন করতে।’ স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কান্নাভেজা কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিন সাহেবের বোন।

এ ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের অতি পরিচিত মুখ ইতিহাস বিভাগের পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষক এবং মহসিন হলের ছাত্রদের অত্যন্ত আপন জন হাউজ টিউটর অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন সাহেবের বদর বাহিনীর হাতে মর্মান্তিক ভাবে হত্যার পূর্বকাহিনী। এর আগেও ২৭শে রমজান তারিখে গিয়াস উদ্দিন সাহেবকে, মহসিন হলের প্রভোস্ট ওদুদুর রহমান এবং আর একজন হাউজ টিউটর জনাব জহুরুল হক সাহেবকে মিলিটারীরা এসে ধরে নিয়ে দুদিন করা জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল। এর কারণ যা পরে জানা গেছে হলের ইসলামী ছাত্র সংঘের ছাত্রদের যা ইচ্ছে তা করার প্রতিবাদে হল প্রশাসন নাকি তাদের সাথে সহযোগিতা করেননি। তারও আগে সেপ্টেম্বর মাসে গিয়াসউদ্দিন সাহেব যমদূত শিরোনামায় লিখিত একটি চরমপত্র পেয়েছিলেন। কিন্তু তা তিনি তখন ততোটা আমল দেননি।

মীর শাহাবুদ্দীন মাহমুদ
দৈনিক বাংলা, ৬ই জানুয়ারি ১৯৭২।

<৮,৮৩,৫০৮-০৯>
ডঃ আবুল কালাম আজাদ
কুষ্টিয়া জেলার ভেড়ামারা থানার রামকৃষ্ণপুর গ্রামের ছেলে আজাদ ছাত্রজীবনে বরাবরই অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফলিত গণিতে রেকর্ড ভাঙ্গা নম্বর নিয়ে স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে স্বর্ণপদক পান। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে আজাদ ফ্লাইং অফিসারের পদমর্যাদা নিয়ে অধ্যাপক হিসেবে তৎকালীন পাকিস্তান বিমান বাহিনী একাডেমীতে যোগ দেন।

সেখান থেকে প্রশিক্ষণের জন্য তাঁকে যুক্তরাজ্যে পাঠানো হয়। বিমান বাহিনীতে তাঁর মেধা এবং কৃতিত্ব অবাঙ্গালীরা ভালো চোখে দেখেনি। এজন্যে তাঁর চাকুরির মেয়াদ তারা হঠাৎ শেষ করে দেয়। নিরুপায় হয়ে তিনি তখন ঢাকায় পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সভাপতির কাছে চাকুরীর সন্ধান চেয়ে চিঠি লেখেন। চিঠির উত্তরে তিনি সাক্ষাৎকারের সুযোগ পান এবং পরে বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারী মহাবিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন।

একসময় তিনি জগন্নাথ মহাবিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের অধ্যক্ষ ছিলেন। সেখান থেকে তিনি গণিত শাস্ত্রের বিশেষজ্ঞ হিসেবে উন্নয়ন বিজ্ঞান ও কারিগরি বিদ্যা শিক্ষন কেন্দ্রে (আই, এ, এস, টি, টি) যান। সেখানে তিনি বৎসর খানেক ছিলেন। অধ্যাপনা জীবনে আজাদ বৃত্তি নিয়ে আর একবার যুক্তরাজ্যে যান। এবার তিনি ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতশাস্ত্রে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী, মেঘবিজ্ঞানে ডক্টরেট এবং তরল পদার্থ সম্পর্কিত বলবিজ্ঞানে ডিপ্লোমা নেন।

এছাড়া গণিতশাস্ত্রে পাণ্ডিত্যের জন্যে তিনি লন্ডনের রাজকীয় আবহাওয়া বিজ্ঞান সমিতি, যুক্তরাজ্যের ফলিত গণিত সমিতি এবং বোস্টনের আবহাওয়া বিজ্ঞান সমিতির ফেলো নির্বাচিত হন। ম্যানচেস্টারে তিনি কিছু দিন সার্বক্ষণিক অধ্যাপক ছিলেন। সার্বক্ষণিক এবং স্থায়ী অধ্যাপকের পদও তাঁকে দেয়া হয়। কিন্তু মা, ভাইবোনদের কথা ভেবে তিনি ফিরে আসেন।

অস্বাভাবিক পরিস্থিতির দরুন যুদ্ধের আগে কয়েকদিন আজাদের সাথে আমি যোগাযোগ করতে পারিনি। হঠাৎ তাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার খবর পেলাম ১৭ই ডিসেম্বর। আমি সেদিন পাড়ার মুক্তি যোদ্ধাদের সম্বর্ধনার আয়োজনে ব্যস্ত।

কাজের চাপে সেদিন আজাদের বাসায় যেতে পারিনি, শুধু মুক্তিবাহিনীর কাছে আজাদের সন্ধানের জন্য অনুরোধ জানিয়েছি। পরদিন তার বাসায় যাওয়ার উপক্রম করছি, তখনই এলো সেই শেষ খবর। আজাদ ফিরেছেন। কিন্তু নিষ্প্রাণ, ক্ষতবিক্ষত দেহে, রায়েরবাজারের বধ্যভূমি থেকে। খবরটি শোনামাত্র আমার স্ত্রী কাঁদতে শুরু করেছিলেন।

তাঁকে নিয়ে কোনক্রমে আজিমপুরের দায়রা শরীফের দিকে ছুটছিলাম। আজাদের বাসা দরগার ভেতরে। সেই দরগার মর্যাদাহানি করে বদর বাহিনীর পাঁচটি খুনী ১৫ই ডিসেম্বর সকালে তাদের বাসায় ঢুকে পড়ে। প্রথমে তারা আজাদের সামনে রিভলবার ধরে তাঁকে নিয়ে ঘুরে ঘুরে অকারণ তল্লাসী চালায়।

তারপর নিরপরাধ আজাদকে বাসি মুখে ধরে নিয়ে যায়। ছোট বোনটি তখন তাদের পায়ে ধরেছিল। মা, বার বার তাদের বুকে জড়িয়ে ধরে বলেন, বাবা তোমরা বাঙ্গালী, তোমরাও আমার ছেলে, ওকে তোমরা ছেড়ে দাও। কিন্তু কেউ তাঁর কথা শোনেনি, নরপশুরা এই নারীকে প্রতিবারই প্রচণ্ড ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছে।

সেদিন তিন ঘণ্টার জন্য সান্ধ্য আইন উঠে যায়। তখন আজাদের ছোট ভাই ‘ইভনিং পোস্ট’ –এর সম্পাদক হাবিবুল বাশার, বড় ভগ্নিপতি ইস্টার্ন নিউজ এজেন্সির মালিক গোলাম রসুল আজাদের সন্ধান নেওয়ার জন্যে নানাভাবে চেষ্টা করেন। কিন্তু কোন ফল হয়নি। শেষ পর্যন্ত তাঁকে পাওয়া গেল ১৭ই ডিসেম্বর বিকেলে, ডঃ রাব্বি সহ আরো কয়েকজন জ্ঞানীগুণীর লাশের পাশে।

-আতোয়ার রহমান
দৈনিক বাংলা, ৭ই জানুয়ারী, ১৯৭২

<৮,৮৩,৫০৯-১০>
আ, ন, ম, গোলাম মোস্তাফা
আ, ন, ম, গোলাম মোস্তাফাকে আলবদরের জল্লাদরা ১১ই ডিসেম্বর সকাল ন’টায় তাঁর গোপীবাগের বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়। বদর বাহিনীর তিনজন জল্লাদ বাসায় এসছিল। বলেছিল, আপনার সাথে কিছু কথা আছে, বাইরে আসুন।

মোস্তাফা তখন তাঁর নয় মাসের শিশুসন্তান অভীকে কোলে নিয়ে পায়চারী করছিলেন। বাচ্চাকে নামিয়ে রেখে তিনি ঐ জল্লাদদের সাথে বেরিয়ে যান।

বেরিয়ে যাবার পরমুহূর্ত থেকে ওর খোঁজখবর শুরু হয়। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব সবাই তাঁর খোঁজে বেরিয়ে পড়েন। কিন্তু আকস্মিকভাবে কারফিউ জারী করায় সেদিনের মত অনুসন্ধান কাজ বন্ধ হয়ে যায়। এবং একটানা কারফিউ চলতে থাকায় এই অনুসন্ধান কাজ আর শুরু করা যায়নি। ইতিমধ্যে জামাতে ইসলামীর সদস্য বলে পরিচিত পূর্বদেশের স্টাফ রিপোর্টার চৌধুরী মঈনুদ্দীনের শরণাপন্ন হয়েছিল অনুসন্ধানকারীরা। হায় তখনও কে জানতো এই চৌধুরী মঈনউদ্দীনই ছিল আলবদর বাহিনীর অপারেশনাল ইনচার্জ।

মোস্তাফার খোঁজে বেরিয়েই জানা গেলো বদর জল্লাদদের আগ্রাসী ক্ষুধার কথা। জানা গেল এই দিনই ভোরে ইত্তেফাকের কার্যনির্বাহী সম্পাদক জনাব সিরাজউদ্দীন হোসেনের গ্রেফতারের কথা। আরো অনেকের বাড়ীতে তাদের হানা দেবার কথা।

তাঁর ভাইয়েরা, আত্মীয়স্বজনেরা, বন্ধুবান্ধবেরা, রায়ের বাজারের বিলের বধ্যভূমিতে পাগলের মতো খুঁজে ফিরেছে তাঁর লাশ। কিন্তু না, কোন সন্ধান তাঁর মেলেনি।

–মনজুর আহমদ
দৈনিক বাংলা, ২৪ ডিসেম্বর ১৯৭১

<৮,৮৩,৫১০-১১>
ডাক্তার মোহাম্মদ মোর্তজা
তাঁর সঙ্গে শেষবার কথা হয়েছিল একাত্তরের মার্চ মাসের সম্ভবতঃ বাইশ তারিখে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে, উত্তেজনাপূর্ণ পরিবেশে, কাগজ পড়ছিলেন; টুকরো টুকরো কিছু আলাপঃ অসহযোগ আন্দোলনের সম্ভাবনা, পরিণাম ইত্যাদি। তারপর ২৭শে মার্চ কারফিউ বিরতির সময় মোটরসাইকেলে তাঁকে ছুটে যেতে দেখেছিলাম। আমি ছিলাম সপরিবারের সশঙ্ক, আশ্রয়সন্ধানী। কথা হয়নি, পরে আর দেখাও হয়নি।

স্বাধীনতার পর বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ফিরে জানলাম, যে সমস্ত প্রিয় পরিচিত ঘনিষ্ঠ মুখ চিরতরে হারিয়ে গেছে, তিনি আছেন তাঁদের মধ্যে।

কেননা মোহাম্মদ মোর্তজা শুধু ডাক্তার ছিলেন না, ছিলেন সমাজ সচেতন, রাজনীতি সচেতন ব্যক্তি, ছিলেন লেখক।

মোহাম্মদ মোর্তজা চব্বিশ পরগনার বাদুরিয়া থানার চণ্ডীপুর গ্রামে ১৯৩১ সালের ১লা এপ্রিল জন্মগ্রহন করেন। ১৯৪৬ সালে তিনি ম্যাট্রিক পাশ করেন কলকাতা বালিগঞ্জ সরকারী হাই স্কুল থেকে। তারপর কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৯৪৮ সালে আই,এস,সি পাশ করে ঢাকায় চলে আসেন এবং ১৯৫৪ সালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে এম,বি,বি,এস ডিগ্রী লাভ করেন। ডাঃ মোহাম্মদ মোর্তজা ১৯৫৫ সালের ১৯শে নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী মেডিক্যাল অফিসার পদে যোগদান করেন এবং নিহত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ঐ পদেই অধিষ্ঠিত ছিলেন।

শুনেছি, ডাঃ মোর্তজা কিছুকাল যাবৎ ঘনিষ্ঠভাবে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন। তার কিছুটা পরিচয় মেলে ‘কপোত’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত তাঁর রাজনীতির পরিচয় প্রবন্ধে। এছাড়া অধুনালুপ্ত ‘গণশক্তি’ পত্রিকায় তিনি বেনামে প্রবন্ধ লিখতেন বলে শুনেছি। তিনি ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেনঃ সমাজতন্ত্র নামে একটা বই লিখবেন। সে ইচ্ছা পূর্ণ হয়নি।

স্বাধীনতার পূর্ব মুহূর্তে ১৯৭১ সালের ১৪ই ডিসেম্বর সকাল ৮-৩০ মিনিটে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় বাসভবন থেকে আলবদর বাহিনীর লোকেরা তাঁকে চোখ বেঁধে নিয়ে যায়। অন্যান্য শহীদ বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে মিরপুর মাজারের কাছে তাঁর মৃতদেহ পাওয়া যায় ৪ঠা জানুয়ারী, ১৯৭২ তারিখে। ৫ই জানুয়ারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের পাশে তাঁর মরদেহ দাফন করা হয়।
-ডঃ মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান
শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মরণে, বাংলা একাডেমী, ১৯৭৩
<৮,৮৩,৫১১>
ডঃ ফয়জুল মহী
পাক হানাদার বাহিনী ও বদর বাহিনীর হাতে শাহাদাত বরণ করেছেন খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক ডঃ ফয়জুল মহী।

আমাদের দুর্ভাগ্য তাঁর সেবার ও পাণ্ডিত্যের প্রয়োজন যখন দেশের সবচেয়ে বেশী- তখনই আমরা তাঁকে হারালাম। পাক হানাদার সেনারা নিশ্চিত পরাজয়ের সম্মুখীন হয়ে স্থানীয় নরপশুদের সাহায্যে আরো অসংখ্য বুদ্ধিজীবীর মত ডঃ ফয়জুল মহী সাহেবকে হত্যা করে স্বাধীনতা লাভের দুই দিন পূর্বে।

১৯৬৪ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সাথে এম,এ পাশ করেন। সঙ্গে সঙ্গে আমেরিকার কলোরেডো স্টেট কলেজে অধ্যয়ন করার জন্য একটি বৃত্তি লাভ করেন। সাফল্যের সাথে ১৯৬৭ ও ৬৮ সনে সেখান থেকে যথাক্রমে এম,এ ও ডক্টর অব এডুকেশন ডিগ্রী লাভ করেন এবং দেশে ফিরে তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধীনস্থ আই,ই, আর-এ ইন্ডাস্ট্রিয়াল আর্টস বিভাগে অধ্যাপনা শুরু করেন।

তিনি ন্যাশনাল এডুকেশন এসোসিয়েশন, আমারিকান ইন্ডাস্ট্রিয়াল আর্টস এসোসিয়েশন, আমেরিকান ভোকেশনাল এসোসিয়েশন এবং আমেরিকান এসোসিয়েশন ফর হায়ার এডুকেশন এই চারটি সংস্থার প্রফেশনাল মেম্বার ছিলেন।

সেদিন ছিল ১৪ই ডিসেম্বর। বদর বাহিনীর ৬টি খুনী সকাল ৮-৩০ মিনিটে ৩৫/জি বিশ্ববিদ্যালয় কোয়ার্টারে আসে এবং মহী সাহেবকে ডাকে। ডাকার সঙ্গে সঙ্গে তিনি ঘরের দরজা খুলে বের হন এবং অতি বিনয়ের সাথে বলেন আপনারা বসুন। বসতে তারা রাজী না হয়ে তাঁকে সাথে করে নিয়ে যায় এক অজানা জায়গায় চোখ বাঁধা অবস্থায়।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা দেখবার সাধ ছিল ডঃ মহীর। মুক্তি সংগ্রামে তিনি নানাভাবে সহায়তা করেছিলেন, কিন্তু স্বাধীনতা দেখে যেতে পারেননি। পেয়েছেন কেবল স্বাধীন বাংলার স্বাধীন মাটি। আজ স্বাধীন বাংলার মাটিকে জড়িয়ে ধরেই তিনি চিরকালের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের পাশে ঘুমিয়ে আছেন।

-মোঃ আমিনুল ইসলাম
দৈনিক পূর্বদেশ, ৬ই ফেব্রুয়ারী,১৯৭২

<৮,৮৩,৫১১-১২>
এ, কে, এম, সিদ্দিক
যে সব বুদ্ধিজীবী একাত্তরের ডিসেম্বরে শহীদ ও নিখোঁজ হয়েছেন জনাব এ, কে, এম, সিদ্দিক (হেনা মিয়া) তাঁদের অন্যতম। তিনি ছিলেন ঢাকার হাইকোর্ট ও জজকোর্টের একজন বিশিষ্ট আইনবিদ এবং প্রখ্যাত আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ জনাব আব্দুল লতিফ বিশ্বাসের জ্যেষ্ঠ পুত্র। তিনি ছিলেন সত্য ও ন্যায়নীতির প্রতীক।

১৯৭১ সালের ২রা এপ্রিল কতিপয় অবাঙ্গালী তাঁর ওয়ারীস্থ বাসভবনের সামনে একজন বাঙ্গালী যুবককে ধারালো অস্ত্র দ্বারা হত্যার আয়োজন করলে জনাব সিদ্দিক তার প্রতিবাদ জানান এবং যুবকটিকে সেদিন অনিবার্য মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেন। এতে করে পাকবাহিনীর সহযোগিতায় সেই দালালেরা কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁর বাসভবন ঘেরাও করে ৭০/৮০ রাউন্ড গুলি ছোঁড়ে। পরে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে লুটতরাজ করে এবং বাড়ির ছোট থেকে শুরু করে সকলকে বন্দুকের নলের সামনে দাঁড় করায়। ভাগ্যক্রমে সে যাত্রা জনাব সিদ্দিক এবং তাঁর পরিবারের সদস্যরা রক্ষা পান।

এ ঘটনার পর থেকেই তাঁকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলেন। কিন্তু উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘সমস্ত বাঙ্গালী যেখানে দুর্ভাগ্যের কবলে পতিত সেখানে আমি বৃথা আত্মরক্ষার চেষ্টা করবো কিভাবে?’

আত্মরক্ষা তিনি করেননি। নিয়তি তাঁকে টেনে নিয়ে গেছে। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে। আমরা সবাই যখন জল্লাদবাহিনীর আত্মসমর্পণের সংবাদ শোনার জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম ঠিক এমনি সময়ে, ১৪ই ডিসেম্বরের সন্ধ্যায় তাঁর বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো আলবদরের একটি মাইক্রোবাস। যাবার সময় তিনি বললেন, ‘এপ্রিলের দুই তারিখে যখন ফিরে এসেছি ইনশাআল্লাহ্‌ এবারও ফিরে আসবো।’ জনাব সিদ্দিকের পরিবারবর্গ ও আত্মীয়স্বজন এখনো তাঁর ফিরে আসার পথের দিকে অধীর আগ্রহে চেয়ে আছেন।

সদালাপী, মিষ্টিভাষী ও পরোপকারী জনাব সিদ্দিকের বয়স হয়েছিল মাত্র ৪৬ বৎসর। তাঁর পৈত্রিক নিবাস ঢাকা জেলার মানিকগঞ্জে।

-নার্গিস মজিদ
শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মরণে, বাংলা একাডেমী, ১৯৭৩

<৮,৮৪,৫১৩-১৬>
[বেগম মুজিব কিভাবে কাটিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো]
বেগম মুজিবের বিষাদঘন দিনগুলোর কয়েকটি কথা
-দৈনিক বাংলা, ৪ জানুয়ারী, ১৯৭২
নববর্ষের দিন সূর্যের আলোয় পথ চিনে এগিয়ে গেলাম, আঠার নং রোডের দুর্গসদৃশ সেই বাড়ীটার দিকে। বাইরের ঘরেই বসেছিলেন বেগম মুজিব। হাসিমুখেই আহবান জানালেন আমাকে। বাড়ীটার উল্লেখ করতেই হেসে বললেন- এটাতো তবুও একটা মাথা গুজবার ঠাঁই, কিন্তু ২৫ শে মার্চের পর পুরো দেড় মাস তো কোথাও পাইনি। আজ এখানে কাল সেখানে, এমনি করে সেই মাসে কম করে হলেও চৌদ্দ পনেরটা বাসা বদল করেছি।

হাসছিলেন বেগম মুজিব, কিন্তু দেখলাম হাসি মাজে কেমন জানি অস্পষ্ট এক বিষণ্নতার ছোঁয়ায় করুণ হয়ে উঠেছে তাঁর চোখের দৃষ্টি।

২৫ শে মার্চের সেই ভয়াবহ রাত। অন্ধকার শোবার ঘরটাতে শুয়ে শেখ সাহেব শুনছিলেন বাইরে বোমায় বিধ্বস্ত ঢাকার আর্তনাদ। এক এক সময় উঠে বসছিলেন তিনি।

ঠিক এমনি এক মুহূর্তে গুলির একটি টুকরো জানালা ভেদ করে ছোট ছেলে রাসেলের পায়ে আস্তে করে লাগে। অন্ধকারে হাতড়ে গুলিটা কুড়িয়ে নিয়েছিলেন শেখ সাহেব। আর সেই দুঃসহ রাতেই নরপিশাচরা তাকে বন্দী করে নিয়ে গিয়েছিল। বাড়ীতে তখন ছিলেন বেগম মুজিব, আর তার দু’ছেলে।

২৬ শে মার্চ-সমস্ত দিন ছিল কারফিউ। গোলাগুলির শব্দ তখনও থামেনি। নিস্তব্ধ বাড়ীটা জুড়ে যেনো এক ভৌতিক বিভীষিকা মাথা খাড়া করে উঠেছে। সামনে ধানমন্ডি বালিকা বিদ্যালয়ে তাক করে রাখা বড় বড় কামানের মুখগুলো আমার বাসার দিকে। ভয়ে জানালাগুলো পর্যন্ত বন্ধ করে দিতে পারিনি। দুপুরে কারফিউর মধ্যেই এ বাসা ও বাসা করে বড় ছেলে কামাল এসে পৌঁছালো।

রাত এলো। সেই আধাঁর কাল রাত। ইয়াহিয়া খানের হিংস্রভাবে চিবিয়ে চিবিয়ে বলা বিবৃতি শুনেই নিজেদের অবস্থা বুঝতে পারলেন বেগম মুজিব। তাই কালবিলম্ব না করে ছোট ছেলে আর মেঝ ছেলেকে নিয়ে পাঁচিল টপকে প্রতিবেশী ডাক্তার সাহেবের বাড়ীতে আশ্রয় নিলেন। অন্যদিকে বড় ছেলে কামাল এবং মহিউদ্দীন সাহেব পালালেন অন্যদিকের পাঁচিল ডিঙ্গিয়ে। রাত ১১টা থেকেই তোপদাগার শব্দে কানে তালা লাগার জোগার। কতকটা চেতন কতকটা অচেতন অবস্থায় বেগম মুজিব ২৬শে মার্চের সেই ভয়াবহ রাতে শুনলেন তাঁর আদরের বাড়ীতে গোলাগুলির শব্দ। রাত ১১টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত। সে রাতে এভাবে না পালালে তাঁর এবং তাঁর সন্তানদের ভাগ্যে কি যে ঘটতো আজো তিনি তা ভাবতে পারেন না।

২৭শে তারিখ সকালে বাচ্চা দু’টো সাথে নিয়ে তিনি আবার পালালেন। পুরো দেড় মাস এ বাসা ও বাসা করেন। শেষে মগবাজারের এক বাসা থেকে পাক বাহিনী তাঁকে আঠারো নং রোডের এই বাসায় নিয়ে আসে।

১৮নং রোডে আসবার পূর্বকার মুহূর্তটি স্মরণ করে গম্ভীর হয়ে গেলেন বেগম মুজিব। বললেন- ‘আমি তখন মগবাজারে একটা বাসায় থাকি। আমার বড় মেয়ে হাসিনা তখন অন্তঃসত্ত্বা। সে, জামাই, আমার দেওর, জা, মেয়ে রেহানা, পুত্র রাসেলসহ বেশ কয়েকজন একসাথে ছিলাম মগবাজারের বাসাটাতে। হঠাৎ একদিন পাকবাহিনী ঘেরাও করে ফেললো বাসাটা। একজন অফিসার আমাকে জানালো যে আমাকে তাদের তত্ত্বাবধানে অন্যত্র যেতে হবে। জানি না কি হবে। ঠিক সেই মুহূর্তটাতে ভীষণ সাহসী হয়েছিলাম আমি। কড়াভাবেই সেই অফিসারকে বললাম, লিখিত কোন আদেশপত্র না দেখালে আমি এক পা-ও বাড়াব না। উত্তরে সে উদ্ধতভাবে জানালো যে ভালোভাবে তাদের সাথে না গেলে তারা অন্য পন্থা গ্রহণ করবে। তখন বাধ্য হয়ে আমি বললাম যে, আমার মগবাজার বাসায় যারা আছেন তাদের প্রত্যককে আমার সাথে থাকতে দিতে হবে। আমার কথায় তারা নিজেরা কি যেনো আলোচনা করলো, পরে তারা রাজী হয়ে নিয়ে এলো আমাদেরকে ১৮ নং রোডের এই বাসাটাতে।

১৮ নং রোডে আসার প্রথম দিনের কথা বলতে গিয়ে আবার হেসে ফেললেন বেগম মুজিব। ময়লা আর্বজনা পূর্ণ এই বাড়ীটাতে তখন বসবার মতো কোন আসবাবপত্র দূরে থাক, একটা মাদুর পর্যন্ত ছিল না। জানালার পাশ ঘেষা ৩/৪ ইঞ্চি প্রশস্ত একফালি জায়গায় ঘেঁষাঘেঁষি করে বসেছিলেন তিনি এবং পরিবারের সমস্ত সদস্যরা।

অন্তঃসত্ত্বা মেয়েকে এইভাবে কষ্ট করে বসে থাকতে দেখে সেদিন বুক ফেটে যাচ্ছিল তাঁর। মুখ ফুটে কিছু বলতে পারেননি, শুধু অসহায়ভাবে তাকাচ্ছিলেন চারিদিক। হয়ত অসহায়ের করুণ ডাক আল্লাহতায়ালা সেদিন শুনেছিলেন। প্রহরী পাক-বাহিনীর এক পাঠান অফিসার অনুভব করেছিল তাঁর অসহায় অবস্থাকে। সেই অফিসার একজন ঝাড়ুদার সংগ্রহ করে পরিষ্কার করে দেয় ঘর দয়ার-সংগ্রহ করে দিয়েছিল কয়েকটি চেয়ার এবং একটি কম্বল।

বন্দী জীবনের নৃশংস পাক-পাহারাদার বাহিনীর মধ্যে এই অফিসারটিই ছিল কিছুটা ব্যতিক্রম।

ধানমন্ডির এই বাড়ীটার মাঝে অনেক দুঃখ দৈন্যের স্মৃতি চিরদিনের মতো বেগম মুজিবের বুকে আঁকা হয়ে গেছে তবুও এই বাসাতেই তিনি তার প্রথম আদরের নাতীকে বুকে নিতে পেরছিলেন-এ স্মৃতি তাঁর কাছে কম উজ্জল নয়।
বেগম মুজিবের সঙ্গে বিশেষ সাক্ষাতকার
ডিসেম্বরের দুপুর। বঙ্গবন্ধুর ৩২ নং রোডের বাড়ীর ভিতরের বসবার ঘরে বসে কথা বলছিলান বেগম মুজিবের সাথে। গত বছরের বন্দী জীবনে দুর্বিষহ ও ভয়ঙ্কর মুহূর্তগুলোর কথা। বর্ণনা করছিলেন তিনি…

“২৬শে মার্চের পরপরই বড় ছেলে কামাল চলে গেছে ওপারে। হাসিনার শরীর খারাপ। তবুও অসুস্থ শরীরে সেই ছিল আমার সবচেয়ে ভরসা।

মে মাসের ১২ তারিখ। ১৮ নং রোডের সেই একতলা করা গৃহে আমাদের নেয়া হয়। হানাদারদের পাহারাতে জীবন কাটাচ্ছিলাম আমি। বাসার যে সব প্রহরী ছিল, তাদের মধ্যে দু’জন সাদা পোষাকধারী সিভিল আর্মড ফোর্সের লোকও ছিল। এরা কার্যত আর্মির প্রহরীদের ঠিক রাখতো।

একদিনের ঘটনা। আমার শোবার ঘরে জামাল আর রেহানা ঝগড়া করছিল। বন্দী জীবন জামালের মত ছেলে সহ্য করতে পারছিল না। কেমন যেন ক্ষিপ্ত হয়ে গিয়েছিল।

সেদিন তাই ওদের দু’ভাই বোনের ঝগড়াটা একটু বেশী রকমে শুরু হয়েছিল। ওদের ঝগড়ার মাঝেই হুট করে ঘরের মধ্যে সিভিল আর্মড ফোর্সের একজন অফিসার ঢুকলো। চোখ লাল করে হিংস্রভাবে সে জামালকে বললো, তুমি আজকাল বেশী বাড়াবাড়ী করছ। এভাবে গোলমাল করলে আমরা তোমাকে আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে যাব। পা দু’টো উল্টো করে বেঁধে তোমাকে চাবুক মারা হবে। জীবনে আর যাতে কারো মুখ দেখতে না পাও সে ব্যবস্থাও করা হবে। বেশ চিৎকার করেই অফিসারটি কথাগুলি বলেছিল। আমি প্রথমে পাথর হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু পরক্ষণেই সামলে নিয়ে বেরিয়ে যেতে বললাম ঘর থেকে। একটা হিংস্র দৃষ্টি সে আমাদের ওপর নিক্ষেপ করে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

অফিসারটি চলে যাবার পর বেগম মুজিব তার ভবিষ্যত কর্মপন্থা স্থির করে নিলেন। সে দিনই তিনি অফিসারটির জঘন্য আচরণের সমস্ত ঘটনা প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে সমস্ত উপর মহলেই লিখে জানালেন।

কিন্তু এ ঘটনার পর থেকে‌ই জামাল যেনো আরও অশান্ত হয়ে উঠলো। পালাবার জন্য সমস্ত সময় সে সুযোগ খুঁজতো। ২৭শে জুলাই মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে হাসিনার সন্তান হলো। আমাদের জীবনে এলো প্রথম নাতী। অথচ তাঁকে দেখবার জন্য আমাদের কাউকেই অনুমতি দেওয়া হল না। ঘরের মধ্যে অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করেছিলাম সেদিন। কেঁদেছিলাম পাক করুনাময় আল্লাহতায়ালার দরগায়।

৫ই আগষ্ট জামাল পালিয়ে গেল বাসা থেকে। কয়েকদিন আগে থেকেই পালিয়ে যাবার জন্য সে চেষ্টা চালাচ্ছিল। আমাকে বলছিল আমি যদি পালাতে পারি তাহলে ৩/৪ ঘন্টা ওদেরকে কোন খবর দিও না। জামাল পালাবার পর বুঝতে পারলাম যে ও পালিয়েছে। মন আবার অশান্ত হলো। যদি ধরা পড়ে শেষ হয়ে যায়, আবার সান্ত্বনা পেলাম বাঁচলে এবার ও বাঁচার মতো বাঁচবে। বেলা দু’টায় খাবারের সময় ওর খোঁজ পড়লো। খোঁজ খোঁজ, চারদিক খোঁজ। কিন্তু জামাল কোথায়? সন্তানের খোঁজে আমি তখন দিশেহারা হবার ভান করলাম।

সরাসরি চিঠি পাঠালাম উপর মহলে। আমার ছোলেকে তোমরা ধরেছ। এবার ফিরিয়ে দাও। হানাদারদের তরফ থেকে কিছুই বলার ছিল না। কেননা আগেই আমি এ সম্পর্কে সজাগ হবার জন্য চিঠি লিখেছিলাম সর্বত্র। তদন্তের জন্য যে কর্নেলকে পাঠানো হয় সে মনে মনে শংকিত হলো। হয়তো সত্যিই ওদের বাহিনীর কেউ জামালকে গুম করেছে। আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে কর্নেল ফিরে গেলেন। কিন্তু আমাদের ওপর কড়াকড়ির মাত্রা আরেক দফা বাড়লো।

আগষ্ট মাসের শেষের দিকে জামালের চিঠি পেলাম। এ সময় আমার শাশুড়ীর শরীর বেশী খারাপ থাকায় তাকে হাসপাতা্লে ভর্তি করা হলো। প্রতিদিন দু’ঘন্টার জন্য আমাকে হাসপাতালে যাবার অনুমতি দেয়া হলো। রোগী দেখার ভান করে ওপার থেকেও অনেকে আসতো। ওদের মাথায় হাত রেখে হানাদার প্রহরীদের দেখিয়ে উপদেশ দিতাম ঠিকমতো ঘরে থেকে লেখাপড়া করার জন্য। এক ফাঁকে চিঠিটা হস্তগত করে নিজে সাথে করে নীচ পর্যন্ত পৌঁছে দিতাম ওদেরকে। ভীষণ ভয় লাগতো ওদের জন্য। কিন্তু আল্লাহকে ডাকা ছাড়া কিইবা আমি করতে পারতাম তখন।

ঠিক এভাবেই কেটে গেছে আমার দিন। সামান্য যা কিছু সঞ্চয় ছিল, তা দিয়েই চলতো আমার ছোট সংসার। দুঃখ-দৈন্য যন্ত্রণা দেহমনে সব কিছুই যেনো আটকে গিয়েছিল। প্রতি মুহূর্তে একটি সন্দেহ দিয়ে ঘেরা মৃত্যুর রাজত্বে ধুঁকে ধুঁকে দিন কাটতো আমাদের।

প্রিয়জনরা ছড়িয়ে আছে চারদিকে। জানতাম না কেমন আছে ওরা। স্বামীর জন্য আর চিন্তা করতাম না। কেননা আল্লাহ ছাড়া তাঁকে বাঁচাবার সাধ্য যে আর কারো নেই।

এ কথা নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বুঝতে পেরেছিলাম। তবু মাঝে মাঝে শিরা উপশিরাগুলো অবশ হয়ে আসতো। কোথায় আমার বুকের সন্তানেরা আর এই কারাগৃহে আবদ্ধ আমাদের জীবনের স্থায়ীত্বই বা কোথায়?

নভেম্বরের শেষের দিকেই বুঝতে পেরেছিলাম ডিসেম্বরে কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। আমার বন্দী জীবনে বাইরের সংবাদ আসার কোন উপায় ছিল না। কিন্তু ট্রানজিস্টার সেটটা ছিল। আমরা শুনেছিলাম ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে সেই দিনই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হবে। তিন তারিখের কলকাতার ঐতিহাসিক জনসভা শোনার জন্য তাই আমাদের প্রতীক্ষা ছিল একটা ভিন্নতর। ইন্দিরাজীর ভাষণ শেষ হলো। খুবই বিস্ময় লেগেছিল। কেন যেন ট্রানজিস্টারের সামনে থেকে নড়তে ইচ্ছা করছিল না। রাত বাড়ল আকাশ বাণীর সংবাদ শেষ হলো। হঠাৎ ঘোষণা করা হলো শীঘ্রই বিশেষ ঘোষণা প্রচার করা হবে। সমস্ত দিনের ক্লান্ত দেহমন। পরিবারের সকলেই ঘিরে বসলাম ট্রানজিস্টারের চারদিক। কিন্তু কোথায় সে ঘোষণা সময় কেটে যাচ্ছিল। একে একে বাচ্চারা ঘুমুতে চলে গেল। মাথার কাছে ট্রানজিস্টারটা খোলা রেখে প্রতীক্ষা করতে করতে কখন যেনো ঘুমিয়ে পড়েছি। ঘুম ভাঙ্গলো বিমানবিধ্বংসী কামানের কটকট শব্দে। বুঝলাম যুদ্ধ বেঁধে গেছে।

৬ই ডিসেম্বর ভারত স্বীকৃতি দিল স্বাধীন বাংলাদেশকে। সে এক অনন্য অনুভূতি। স্বাধীন বাংলাদেশের স্বীকৃতির সংবাদ এলোমেলো করে দিচ্ছিল আমার দেহ মনকে। বাচ্চারা কাঁদছিল ওদের আব্বার জন্য। আমি চেষ্ঠা করছিলাম ওদেরকে সান্ত্বনা দিতে, কিন্তু স্বাধীনতার স্বীকৃতি আর অতি প্রিয়জনের মুত্যুর আশঙ্কা আমার আত্নাকে যেনো অসার করে তুলেছিল।
ডিসেম্বরের দিনগুলো প্রতিদিন যেনো নতুন নতুন বিভীষিকা হয়ে দাড়াতো।

১৭ তারিখ সকালে যখন পাক আর্মিকে সরিয়ে নেয়া হচ্ছিল তখন শেখ মুজিবের বাসা থেকে শুধু মাত্র সিভিল আর্মড অফিসার দুজনকে সরিয়ে নেয়া হয়। প্রধানতঃ আর্মিকে শৃঙ্খলায় রাখার জন্য সিভিল আর্মড অফিসার নিয়োগ করা হয়। এক্ষেত্রে সিভিল আর্মড অফিসার দু’জনকে ফিরিয়ে নেয়ার সাথে সাথে আর্মি প্রহরীরা উচ্ছৃঙ্খল হয়ে পড়েছিল। প্রথম দিকে ওরা আশা করেছিল যে, ওদেরও নিয়ে যাবার ব্যবস্থা নেয়া হবে। কিন্তু দুপুর পর্যন্ত যখন চারিদিক থেকে “জয়বাংলা” ধ্বনি ভেসে আসতে লাগল তখন ভীষণ রকম ক্ষেপে গেল ওরা।

আমাদের ঘরের মধ্যে কাপড় শুকোবার জন্য তার বাধাঁ ছিল। রাতে তারটা ঝনঝন করে বেজে উঠতেই সবাই দাড়িয়ে পড়লাম। রক্তের মত লাল দু’টো চোখ। প্রহরী দলের অধিনায়ক সুবেদার রিয়াজ দাড়িয়ে ছিল বারান্দায়। কঠোর ভাবে সে বললো খোকাকে ডাকো্। ঠান্ডা হয়ে বললাম খোকা ঘুমিয়ে পড়েছে। কোন কথা থাকলে আমাকে বলতে পার। আমার মুখের দিকে কঠোর ভাবে তাকিয়ে সে বলল সাবধানে থাকো।

মেজর তারা সিং এলেন বেলা ন’টার সময়। তারা সিং সাধারণ বেশে এসেছিলেন কিন্ত পেছনে তিনি একদল সৈন্যকে পজিশন নেয়া আবস্থাতে রেখে দিয়েছিলেন চারদিকে। খালি হাতে শুধু ওয়ারলেস সেট সাথে নিয়ে তিনি গেটের সামনে দাড়িয়ে ওদেরকে বুঝাচ্ছিলেন। প্রথমে ওরা সারেনডার করতে চায়নি। শেষে দু’ঘন্টা সময় চেয়েছিল। গেটের সামনে থেকে ওদের কথা শুনে মেজর তারা সিং যেই পা বাড়ালেন অমনি ভেতর থেকে চিৎকার উঠলো বাচ্চারা আপনি যাবেন না মেজর। যাবেন না। সময় পেলেই ওরা আমাদেরকে মেরে ফেলবে। সত্যিই সময় পেলে ওরা আমাদেরকে মেরে ফেলতো। কিন্তু মেজর তারা সিং তাদের আর সে সময় দেননি। ঢুকে পড়েছিলেন গেটের মধ্যে।

পাশের বাঙ্কার থেকে কাঁপতে কাঁপতে হানাদাররা তখন বের হয়ে আসছে আত্নসমর্পণের জন্য।“

-দৈনিক বাংলা
১৫ ও ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭২

<৮,৮৫,৫১৭-১৮>
[শহীদ শামসুল হক ও নুরুল হক]

-স্বাধীনতা স্মারকসংখ্যা, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বার্তা, ১৯৭২।

১) শহীদ শামসুল হক তালুকদার

জীবনের উজ্জ্বলতা নিয়ে কুমিল্লা জেলার ছোট সুন্দর গ্রাম থেকে এসেছিল সে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করতে।

শামসুল হককে সকল ছেলেই ‘শামসু ভাই’ বলে ডাকত। তিনি ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন বিশিষ্ট ছাত্রনেতা, ছাত্র সংসদের সাবেক সম্পাদক এবং ময়মনসিংহের ছাত্র নেতৃবৃন্দের অন্যতম।

বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত হয় স্বাধীনতা আন্দোলন মার্চের প্রথম দিন থেকেই। প্রত্যক্ষ সংগ্রামের জন্য ২৫শে মার্চের (১৯৭১) পর শামসুল তাঁর নিজের গ্রাম ছোট সুন্দরে চলে যান। মুক্তিযুদ্ধে সহায়তার জন্য দিনরাত তিনি পরিশ্রম করে যুবকদের মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করতে উদ্বুদ্ধ করেন এবং অনেক তরুণ ছেলেকে ভারতে পাঠাতে সাহায্য করেন।

প্রায় ৪ মাস তিনি এভাবে কাজ করে যাচ্ছিলেন। কিন্তু রাজাকার ও বর্বর পাকসেনাদের চোখ এড়িয়ে ভারতে যাওয়া যখন কঠিন হয়ে ওঠে তখন তিনি তাঁর এক আত্মীয়ের সহযোগীতায় তথাকথিত শান্তি কমিটির কার্ড প্রত্যেক মুক্তিযোদ্ধার জন্য যোগাড় করতে সক্ষম হন এবং এভাবে পাক সামরিক এলাকার মধ্যে দিয়ে নিয়মিত তাঁর ভর্তি করা যুবকগণ ভারতে যেতে সক্ষম হতো। কিন্তু এক পর্যায়ে এ বিষয়টি নিকটবর্তী স্থান হাজীগঞ্জের রাজাকার ও দালালগণ জানতে পারে। শামসুল হক নিজেও বিপদের কথা বুঝতে পেরে কুমিল্লা চলে যান।

অবস্থা যখন খুব অসুবিধাজনক হয়ে পড়ে তখন তিনি নিজেই ভারতে চলে যাওয়ার মনস্থ করেন এবং যাবার সময় মাকে দেখতে বাড়ী আসেন। সেদিন ছিল আগষ্ট মাসের ১০ তারিখ। মার কাছে বিদায় নিয়ে চলে যাবেন এমন সময় বাড়ীর চারদিক দুশমন রাজাকার ও শত্রুসৈন্য ঘিরে ফেলে। শামসু বের হতে পারেননি। তাঁকে দুশমনরা বাড়ীর সিঁড়ির আড়াল থেকে ধরে নিয়ে আসে। তাঁর মতো আরও ১৬ জনকে অন্যান্য বাড়ী থেকে ধরে নিকটবর্তী বাজারে এনে প্রত্যেককে খুঁটির সঙ্গে হাত-পা বেঁধে একে একে গুলি করে হত্যা করে। ছোট সুন্দর গ্রামের মাটি রঞ্জিত হয় দেশ-প্রেমিকদের রক্তে।

দেশ গড়ার যে স্বপ্ন দেখেছিলেন শামসুল হক শত কোটি শামসুল হক তাঁর ওই স্বপ্ন সফল করবার জন্য এগিয়ে আসবে। শহীদের মৃত্যু নেই, নেই মৃত্যু তাঁর আদর্শের।

২) শহীদ নূরুল হক

ছাত্রদের অতি প্রিয় একটি নাম নূরু। মে মাসের ২০ তারিখে (১৯৭১) বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ডঃ আমির হুসেন তালুকদারের সঙ্গে দেখা করেছিলেন তিনি। ডঃ তালুকদারের পরামর্শ নিয়ে চলে যান তিনি নিজ গ্রাম ছোট সুন্দরে। শহীদ শামসুল হক তালুকদারের সঙ্গে ছায়ার মত থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কাজ করে যাচ্ছিলেন নূরু।

জুন মাসে নূরু এসেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা (গেরিলা) নিয়ে। পাক সামরিক অবস্থান দেখে আবার চলে যান ছোট সুন্দর। জুলাই মাসের ২৪ তারিখে আবার তিনি আসেন গ্রেনেড ইত্যাদি নিয়ে ৩/৪ জন মুক্তিযোদ্ধাসহ। ছাত্রাবাসের বাবুর্চিখানায় অবস্থান করেন দুই রাত। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় স্ত্রী, পুত্র, কন্যাসহ অবস্থানরত শিক্ষক ও কর্মচারীদের অবস্থার কথা চিন্তা করে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন ছোট আক্রমণ করা যুক্তিসঙ্গত হবে বলে মনে করেননি, তাই পরবর্তী বড় আক্রমণের সকল তথ্য যোগাড় করে আগষ্ট মাসের (১৯৭১) ২ তারিখে ছোট সুন্দর (কুমিল্লা) চলে যান। কিন্তু, তাঁদের সকল খবর পাকসেনা দালাল মারফত জানতে পারে। পাক হায়েনার দল আগষ্ট মাসের ১০ তারিখে তাঁকে এবং শামসুল হক তালুকদারসহ অনেক লোককে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে ছোট সুন্দর বাজারে হত্যা করে।

<৮,৮৬,৫১৯-২০>
[শহীদ চার ভাই]

-সচিত্র স্বদেশ বিজয় দিবস সংখ্যা, তারিখঃ ১৮ ডিসেম্বর, ১৯৭২।
“মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চার ভাইয়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ক্যাপটেন মোজাম্মেল হোসেন বললেন, “১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ। দেশ রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত সশস্ত্র বাহিনী পরিণত হলো ঘাতক বাহিনীতে। ওরা পশুশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো নিরস্ত্র জনগণের উপর। আমাদের তখন বাসা ছিল মগবাজারের মধুবাগে। রাজারবাগের পুলিশ বাহিনীর উপর খান সেনাদের আক্রমণ শুরু হলো। আমরা ক’ভাই আমাদের এম.এল, রাইফেল, দোনলা বন্দুক এবং হাতে বানানো গ্রেনেড নিয়ে এগুলাম। পজিশন নিলাম মালিবাগ মোড়ে। প্রথম কাউন্টার হতেই দেখলাম দ্রুত বেগে ট্রুপ ছুটে আসছে রাজারবাগ থেকে। পিছু হটে আসা পুলিশ সদস্যদের ফেলে যাওয়া কয়েকটা রাইফেল নিয়ে আমরা মগবাজারে ফিরে এলাম।

পরবর্তী দিনগুলো কাটলো অবর্ণনীয় ভীতির মধ্য দিয়ে। ঢাকা প্রায় জনশূন্য হয়ে আসছে। সবাই পালাচ্ছে। এমন এক সময়ে রেডিওতে মেজর জিয়ার ভাষণ শুনে ভরসা পেলাম। এদিকে পাবনা (আমাদের দেশের বাড়ি) থেকে খবর এলো, পাবনা তখনও মুক্ত। ২৬ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের একটা কোম্পানি পাবনা অপারেশনে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছে। সেখানে আমার দুই ভাই এমনকি বৃদ্ধ বাবাও যোগ দিয়েছেন প্রতিরোধ যুদ্ধে।

ঢাকায়ও প্রতিরোধ সংগ্রাম শুরু হয়েছে। মে মাসের প্রথম দিকে বিচ্ছিন্নভাবে হলেও বিস্ফোরণ এবং গুলি বিনিময় চলছে এখানে, ওখানে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি গ্রুপ ২ নং সেক্টর থেকে ঢাকায় এসে গেছে। এর মধ্যে জয়নাল গ্রুপের সঙ্গে বাড্ডায় গিয়ে দেখা হয়। এক বাড়িতে অস্ত্রশস্ত্রের সন্ধান পেলাম। ওদের কিছু অস্ত্র আমাদের বাসায় নিয়ে আসা হলো। এবং তখন থেকেই সক্রিয়ভাবে কাজ শুরু হলো। আমরা বেশ কয়েকটা অপারেশন চালিয়েছি। এগুলোর মধ্যে রয়েছে রামপুরা পাওয়ার স্টেশন এবং খিলগাঁও জেনারেটরে গ্রেনেড নিক্ষেপ, প্রভৃতি। ইতিমধ্যে নিউমার্কেট, দিলকুশা ও জিপিওর সামনে বেশ বেশ কয়েকটা বিস্ফোরণ ঘটে। আশ্বস্ত হলাম যে, যাক আমরা শুধু একা নই। অন্যত্রও চলছে প্রতিরোধের তৎপরতা। এদিকে আমাদের কথা ততদিনে জানাজানি হয়ে গেছে। খবর পেলাম যে কোনো দিন বাসায় রেইড হতে পারে। ঐ রাতেই আমরা বাড়ি ছেড়ে চলে গেলাম। স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদের অন্যত্র রেখে এসে কুমিল্লা হয়ে সীমান্ত পেরোবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলাম। খবর পেলাম পাবনার বাড়িও লুট হয়ে গেছে। আবার ঢাকা হয়ে আরিচা-নগরবাড়ির পথ ধরে পাবনা হয়ে সীমান্ত পেরোবার সিদ্ধান্ত নিলাম। নগরবাড়ি ঘাটে নামার সাথে সাথে খান সেনাদের হাতে ধরা পড়ে গেলাম। নিয়ে যাওয়া হলো স্থানীয় ক্যাম্পে। সেখানে কয়েকটা দিন কাটলো প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর আশঙ্কায়। ক্যাম্পের অনেককেই পালাক্রমে ফায়ারিং স্কোয়াডে তোলা হলো।

চতুর্থ দিন আমাদের বধ্যভূমির দিকে নিতে এসেছে। আমাদের তোলা হলো একটা ট্রাকে। এ সময় আমাদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেলো। মরতে যখন হবেই তখন শেষ চেষ্টা করে দেখা যাক। সমস্ত শক্তি আর সাহস নিয়ে মুহূর্তের মধ্যে revolt করে বসলাম। সিগারেট ধরাবার নাম করে এক সেন্ট্রির থুতনিতে মারলাম ঘুষি। চারদিনের ক্ষুৎপিপাসা ও মৃত্যুর ভয়ে জর্জরিত দেহে জানি না অতো শক্তি সেদিন কোত্থেকে পেলাম। ততক্ষণে আমার অন্যান্য সহযাত্রীরা অন্যান্য সেন্ট্রি ও চালককে ঘায়েল করে ফেলেছে। হাইওয়ে ফেলে গ্রামের রাস্তা ধরে আমরা প্রাণ নিয়ে পালালাম।

ওপারে গিয়ে দেখলাম স্বাধীনতা যুদ্ধের আর এক চিত্র। দেখা করলাম যুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন সাহেবের সাথে। তাঁকে আগে থেকে চিনতাম। গ্রুপ ক্যাপটেন এ.কে.খন্দকারের সাথে দেখা করে অকপটে জানালাম, “এখানে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। আমি একা সৈনিক। আমি যুদ্ধ করতে এসেছি, আরাম করতে আসিনি। আমাকে যুদ্ধে পাঠান।“ আমার ক্ষোভের কারণ বুঝতে পারলেন এবং ৭নং সেক্টরে সেক্টর কমান্ডার কর্নেল নুরুজ্জামানের অধীনে কাজ করার সব ব্যবস্থা করে দিলেন। মুক্তিযুদ্ধের অগ্নিঝরা দিনগুলো আমার কেটেছে ঐ ৭নং সেক্টরেই।

এদিকে মুক্তিযুদ্ধের অগ্নিঝরা দিনগুলো দ্রুত এগিয়ে চলছে। প্রতিদিন চলছে সংঘর্ষ। প্রতিদিনই কিছু না কিছু এলাকা মুক্ত হচ্ছে। এরকম সময়ে (অক্টোবরের ২০ কি ২২ তারিখ) ছোট ভাই মোস্তাকের চিঠি পেলাম-ওরা গ্রুপ নিয়ে দেরাদুনে ট্রেনিঙে যাচ্ছে। শিয়ালদা রেল স্টেশনে ওর সাথে দেখা। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, বিধ্বস্ত শরীর। ওই ওর সাথে শেষ দেখা।

আর এক ভাই (রঞ্জু) তখন লড়াই করছে ২নং সেক্টরে। মঞ্জু ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে (পরে সে সাধারণ ক্ষমার সুযোগে মুক্তি পায়)। মুকুল লড়াই করছে পাবনার রণাঙ্গনে। একদিন যুদ্ধ শেষ হলো। থেমে গেলো রণদামামা। সব পথ তখন এসে মিলেছে ঢাকায়। ঢাকার পতন তখন দিনকয়েকের ব্যবধানে। আমি কিন্তু ৭নং সেক্টরের দায়িত্ব তখনও শেষ করতে পারিনি। দেশে ফেরার পথে পাবনায় ভাইদের মর্মান্তিক মৃত্যুর কোথা শুনলাম। দেশ সম্পূর্ণ স্বাধীন হবার দিন কয়েক আগে রঞ্জুকে শেষ দেখা গেছে ঢাকার রূপগঞ্জে।

এদিকে ১০ই ডিসেম্বর অন্যান্য ভাইরা মগবাজারের বাসায় এসে পৌঁছেছে। তাদেরকে দেখতে এসেছে ভগ্নিপতি ইউসুফ। রাতে বাসা রেইড হলো। বাবা-মায়ের অনুরোধে ওরা ফায়ার এক্সচেঞ্জ করা থেকে বিরত থাকলো এবং আত্মসমর্পণ করলো খান সেনাদের কাছে। গাড়িতে ওদের তোলার সময় সর্বকনিষ্ঠ ভাইটিকে (৭/৮ বছর যার বয়স) মাত্র ওরা ক্ষমা করে ছেড়ে দিলো। কোথায় নিয়ে যাওয়া হলো ওদের কেউ জানে না, কোথায় ওদের কবর তাও কেউ জানে না। বহু লাশ ঘেটে দেখেছি, ওদের চিহ্ন খুঁজে পাইনি কোথাও। পারিনি আমার সহোদরদের লাশ সনাক্ত করতে। দুঃখ এই যে ওরা আমৃত্যু লড়াই করেও প্রাণে বেঁচেছিল। কিন্তু বিজয়ের সূর্য ওঠার পূর্বক্ষণে ওরা হানাদারদের হাতে শহীদ হয়েছে।“

[গণহত্যা ও নির্যাতনের বিবরণঃ বিদেশী পত্র-পত্রিকা]

নিটোল চন্দ্র দাশ
<৮,৮৭.১,৫২১-২২>

দা টাইমস
মার্চ ৩০, ১৯৭১

( ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের পুড়ে যাওয়া লাশ এখনো তাদের হলের বিছানার উপর পরে আছে। এক বিশাল গনকবর খুব দ্রুতই ভর্তি করা হয়েছে……)
(মিশেল লরেন্ট, এসোসিয়েটেড প্রেসের একজন ফটোগ্রাফারের বরাতে, উনি পাকিস্তান আর্মিদের লুকিয়ে ঢাকায় চলাচল করেছিলেন)

ঢাকা,মার্চের ২৯ তারিখ। প্রায় দুইদিন ধরে উপর্যুপরি গোলাবর্ষনে শুধুমাত্র ঢাকা শহরেই মারা যায় ৭,০০০ এর বেশি মানুষ।

বৃহস্পতিবার রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আমেরিকার সরবরাহকৃত M24 ট্যাংক,মেশিনগান ও পদাতিক বাহিনী নিয়ে শহরের প্রায়
বেশিরভাগ অংশে ধ্বংসলীলা চালায়।

এই আক্রমনের লক্ষবস্তু ছিল বিশ্ববিদ্যালয়, শহরের পুরাতন অংশে যেখানে আওয়ামীলীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের তুমুল জনপ্রিয়তা ছিল,এবং শহরের উপকণ্ঠে শিল্পাঞ্চলে, যেখানে প্রায় ১৫ লাখ মানুষের আবাস ছিল।

শনি ও রবিবার জ্বলন্ত শহরে ঘুরে দেখা গেল, বিনা নোটিশে শহর দখল করে নেয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে পুড়ে যাওয়া লাশগুলো তখনো বিছানার উপর পরে ছিল। হলগুলোতে সরাসরি ট্যাংক ব্যবহার করা হয়।

খুব দ্রুতই জগন্নাথ হলের সামনে একটি গণকবর ঢেকে দেয়া হয়। ইকবাল হলে প্রায় ২০০-র মত মারা গিয়েছে বলে জানা যায়। প্রায় ২০ টার মত লাশ তখনো মাঠে ও হলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী, সৈন্যরা ঢাকা মেডিকেল কলেজে বাজুকা নিক্ষেপ করেছিল। যদিও হতাহতের প্রকৃত সংখ্যা জানা যায় নি।

এত কিছুর পরেও পশ্চিম পাকিস্তান প্রশাসন থেকে বলা হয়,ঢাকা শহরের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হয়ে আসছে। যদিও হাজারো মানুষ নূন্যতম জিনিসপত্র নিয়ে শহর ছাড়ছিল। কেউ কেউ ঠেলাগাড়ি নিয়ে যাচ্ছিলো। সেগুলো ছিল খাদ্য আর বস্ত্র সামগ্রীতে পরিপূর্ণ। সামরিক সরকারের আদেশে খুব অল্প সংখ্যক মানুষই সরকারি চাকুরিতে ফেরত আসে।

পাক সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ছিল নূন্যতম। পাকিস্তানিরা মিলিটারি অর্ডারে অস্ত্র জমা দিয়ে দিয়েছিলো।

আবারো বেশিরভাগ সরকারি অফিসগুলোতে পাকিস্তানের পতাকা উড়তে দেখা গেল। যদিও মাত্র দশদিন আগেও সেখানে হলুদ ও সবুজে রাঙ্গা স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা শোভা পেত।
পুরান ঢাকার বেশিরভাগ অংশ ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। তবুও বয়স্ক পুরুষ এবং মহিলারা তাঁদের ধ্বংসপ্রাপ্ত জিনিসপত্রের মাঝে খোঁজাখুঁজি করছিলেন।

ফাঁকা সড়কগুলোতে সেনারা অস্ত্রে সজ্জিত সাজোয়া গাড়িসহ টহল দিত। লোকজন ওপেন ফায়ার থেকে রক্ষা পাবার জন্য গাড়িতে পাকিস্তানের পতকা টানিয়ে রাখতো। যত্রতত্র লাশ পড়ে থাকতে দেখা গেল,যারা কিনা পাক সেনাবাহিনীর ক্রসফায়ারে পড়ে মারা যায়। রেলস্টেশনের পাশের বস্তি পুড়িয়ে দেয়া হল। লোকজন এখন হতবিহবল।

বিদেশি সাংবাদিকদের চলাফেরার ক্ষেত্রে সরকার হার্ডলাইনে চলে গেল। যাতে করে তাদের কর্মকান্ড বিশ্ব দরবারে উঠে না আসে।

প্রায় ৩৫ জনের মত বিদেশি সাংবাদিককে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে গৃহবন্দী করে রাখা হয়। শুধু আমি এবং একজন ব্রিটিশ সাংবাদিক সেনাবলয় থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হই। পরবর্তীতে সেনারা এয়ারপোর্টে আমাকে তল্লাশী করে ছবি ও রিপোর্ট জব্দ করে।

পরবর্তীতে করাচি বিমানবন্দরে পুলিশ আমাকে আবার তল্লাশী করে, এবং বাকি ছবিগুলোও জব্দ করে।

নিটোল চন্দ্র দাশ
<৮,৮৭.২,৫২২-২৪>

দা টাইমস (লন্ডন)
২ এপ্রিল, ১৯৭১

গনহত্যার এই যুদ্ধে রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হচ্ছে
– লুইস হেরেন

পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে গনহত্যার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবিদের সমূলে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া। এর অনেকটাই অর্জন করা সম্ভব হয়েছিল।

পূর্বের সাম্প্রদায়িক বৈরিতাও প্রকাশ্যে এসেছিল। পাকিস্তানি মুসলিম সেনারা হাজারো হিন্দুকে হত্যা করে ।

একজন আস্থাভাজন ব্যক্তি মারফত আরো কিছু তথ্য আমাদের হাতে আসে। তিনি গত গত দুই বছর যাবত ঢাকায় ছিলেন এবং গত সপ্তাহে ঢাকা ছেড়ে লন্ডনে আসেন। অনিবার্য কারনবশতঃ তার নাম আমরা প্রকাশ করতে পারছি না।

তিনি নিশ্চিত করেন, পূর্ব পাকিস্তানের নেতা শেখ মুজিবর রহমান হত্যাকান্ড এড়াতে পেরেছেন। কিন্ত তার এগার জন দেহরক্ষীর মৃত্যু হয়েছে।

শেখ মুজিবুর রহমানকে গত বৃহষ্পতিবারে গ্রেফতার করা হয়। তাকে দুইদিন আদমজী স্কুলে বন্দি করে রাখা হয় এবং পরে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। তথ্যদাতা বিশ্বাস করেন যে তিনি এখন মুলতানে অবস্থান করছেন।

এই তথ্যদাতার মতে, ২৫ শে মার্চ থেকে শুরু হওয়া আক্রমনের মধ্যে কিছু ভৌত ও মনস্তাত্ত্বিক কাঠামো লক্ষ করা যায়। আর এই পর্যায়ে এসে এটা পরিষ্কার, সুনির্দিষ্ট কিছু গোষ্ঠীকে লক্ষ্য করেই এই অবর্ননীয় অত্যাচার চালানো হচ্ছে।

এদের মধ্যে আছে আওয়ামিলীগ এর নেতা, ছাত্র (লীগের বেশিরভাগ কার্যকর সদস্য ছিল তারাই), ভার্সিটির অধ্যাপক ও তাদের পরিবার-পরিজন এবং যে সকল হিন্দুকে পাওয়া যাচ্ছে, তাঁরাই।

পাক সেনাবাহিনী বুঝতে পেরেছিল, ছাত্ররাই হল ভবিষ্যত স্বাধীনতা আন্দোলনের কেন্দ্র। আর অধ্যাপকেরা হলেন বুদ্ধিবৃত্তিক সম্প্রদায়, যারা ভবিষ্যত স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রশাসনের জন্য হবেন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আওয়ামী নেতাদের হত্যার কারণ সহজেই অনুমান করা যায়। আর তথ্যদাতাদের মতে, হিন্দুদের হত্যা করার কারণ হিসেবে মনে করা হতো যে তারাই ছিল এই আন্দোলনের পিছনের মূল অপশক্তি!

সাংবাদিকদের বাইরে কাভারেজ করার অনুমতি ছিল না। কিন্ত বাস্তবে নিচের ঘটনাগুলো ঘটেছিলঃ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল হিন্দু ছাত্রদের জন্য সংরক্ষিত ছিল। পাক সেনারা ট্যাংক চালিয়ে হলের দেয়াল ধসিয়ে দেয়।

হলের বাইরে ছিল তাজা গণকবর। প্রতিটি রুম রক্তে ভেসে গিয়েছিল এবং সেখানে লুটতরাজ চলেছিল। কর্মচারী ভবনের পাশে নৃশংসভাবে হত্যাকৃত ছয়টি লাশ পাওয়া যায়।

শিক্ষকদের এপার্টমেন্টগুলোয় শিশুদের বিছানার মধ্যেই গুলি করে হত্যা করা হয়। একজন সিনিয়র অধ্যাপকের পুরো পরিবারকে হত্যা করা হয়, যাদের মৃতদেহগুলি পাশের আরেকটা ফ্ল্যাটে পাওয়া যায়।

বাইরে ছাত্রদের লাশ দেখা যায়। হাতে ধরা লাঠি কিংবা বাঁশ। কেন্দ্রীয় সিঁড়িঘরে দেখা যায় রক্তাক্ত পায়ের ছাপ। রক্তের দাগ নেমেছিল ভবনের বাইরের দেয়াল ধরে।

পুরান ঢাকার শুরুতেই দু’টি বড় বাজার ছিল। একটি ছিল হিন্দু বাজার। সেখানকার লাশগুলোর পাশ দিয়ে যাবার সময় লোকদের নাকে কাপড় চাপা দিয়ে যেতে হতো। ধ্বংসপ্রাপ্ত ভবনে এবং আস্তাকুরে কমপক্ষে ৭ থেকে ৮ টি লাশ দেখা গিয়েছিল।

আমাদের সেই তথ্যদাতা এমন একটি বাড়ি দেখেছেন, যেখানে এক লোকের স্ত্রীকে ক্রন্দনরত অবস্থায় দেখা যায়। তাঁর স্বামীকে একটু আগেই গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল।

মূলত এগুলোই হলো সেই পাঁচদিনের যুদ্ধের প্রকৃত দৃশ্যপট। এই রিপোর্টের বাকি তথ্যগুলো আমাদের সংবাদদাতা ঢাকা ছেড়ে আসার পূর্বে তার বন্ধুমারফত পেয়েছিলেন।

২৫ মার্চের মধ্যরাতের আগেই পাক সেনাবাহিনী ঢাকা শহরের গুরুতবপূর্ণ সব পয়েন্ট দখল করে নেয়। এর কয়েক ঘন্টা আগেই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান করাচির উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। ধারনা করা হয়, এই সেনা অভিযান তাঁর নির্দেশেই হয়েছে।

দাপ্তরিক মুখপাত্রের ভাষ্যমতে, প্রেসিডেন্টের যাবার পরপরই সতর্কতাবশতঃ সেনা ক্যান্টনমেন্টে আসার পথে ব্যারিকেড স্থাপনের জন্য সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দেয়া হয়। পুরো শহরে মধ্যরাত থেকে পরদিন সকাল পর্যন্ত ব্যারিকেড দেয়া হয়। ভারী মেশিনগান, আর্টিলারি আর স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের ধ্বনিতে পুরো ঢাকা প্রকম্পিত হতে থাকে।

পুরো রাতজুড়ে আগুনের লেলিহান শিখা দেখা যায় ও গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়।

পরদিন সকালে পুরো শহর হালকা ধোয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকে, যা ক্রমান্বয়ে ঢাকার উত্তর দিকের অভিজাত এলাকা গুলশানের দিকে ছড়িয়ে যায়। বিহারি এলাকাগুলোতেও আগুন দেখা যায়। সেখানে এই মাসের শুরুতেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দেখা গিয়েছিল।

পরদিন, ২৬ শে মার্চ পুরো শহরে কারফিউ জারি করা হয় এবং দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দেয়া হয়। সৈনিকদের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের সাহায্যে প্রাক্তন সেনা কর্ককর্তা কর্নেল ওসমানির বাসায় গুলি চালাতে দেখা যায়।

সারারাত ধরেই গুলাগুলি চলতে থাকে। তবে তুলনামূলকভাবে কম। যদিও ২৭ তারিখ সকালে ৫ ঘণ্টার জন্য কারফিউ কিছুটা শিথিল করা হয়।

শহরের নতুন অংশেও ধ্বংসপ্রাপ্ত ব্যারিকেড লক্ষ্য করা গিয়েছিল।

শহরের পুরাতন অংশে, বিশেষ করে পুলিশ লাইন্সের দিকে ভয়াবহ ধবংসযজ্ঞের চিহ্ন দেখা যায়। ধরে নেয়া যায় যে পুলিশ সদস্য ও ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকদের সাথে নিয়ে পাকবাহিনীকে বিরুদ্ধে এখানে কঠিন প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়েছিল।

শরণার্থীরা শহর ছাড়ছিল। তাঁদের বেশিরভাগের সাথে শুধু অল্প কিছু কাপড়চোপড় ছিল।

রবিবার কারফিউ তুলে দেখা হয়েছিল যেন লোকেরা তাঁদের পরিবারের জন্য খাবার কিনতে পারে। তবে নিউমার্কেট প্রায় সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল।

রমনা রেসকোর্সে দুটি ছোট হিন্দু অধ্যুষিত গ্রাম এবং মন্দির পুরোপুরি ধবংস করে দেয়া হয়। ধবংসস্তুপের নিচে অনেক লাশ চাপা পড়ে থাকতে দেখা যায়। বাকি জীবিত গ্রামবাসী ভয়ে ভয়ে ছিল।

শেষ কথা হিসেবে বলা যায়, পূর্ব পাকিস্তান কমপক্ষে এক দশক রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবি সংকটে পড়তে যাচ্ছে। হয়তো বা তা এক প্রজন্ম পর্যন্তও হতে পারে।।

নিটোল চন্দ্র দাশ
<৮,৮৭.৩,৫২৪-৫২৫>

দা নিউ নেশন
সিঙ্গাপুর, ৬ এপ্রিল, ১৯৭১
সম্পাদকীয়
-পূর্ব পাকিস্তানে চলমান এই হত্যাযজ্ঞ অবশ্যই বন্ধ করতে হবে-

বিদেশি নাগরিকদের থেকে প্রাপ্ত কিছু চাক্ষুষ তথ্যপ্রমান পূর্ব পাকিস্তানের উপর ঘটে যাওয়া কিছু নৃশংস দৃশপট উন্মুক্ত করে, যা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইয়াহিয়া খান তার সেনাবাহিনী কর্তৃক ঘটিয়েছিলেন।

যা ঘটছিল, তা মূলত গনহত্যার সমতুল্য। পাকিস্তানি আর্মি অসংখ্য অপ্রয়োজনীয় ও শোচনীয় হত্যাকান্ডের মাধ্যমে একটি বিদ্রোহ দমন করতে চাইছিল, যা পরবর্তীতে লাগামহীন হয়ে পড়ে।

এবং পাক সেনাবাহিনীর আচরণ থেকে এটা স্পষ্ট হয়,তাদেরকে যেকোন কিছু দমনের জন্য আইনসিদ্ধ ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল। নির্দিষ্ট পরিকল্পনামাফিক শিশু ও মহিলাসহ অন্যান্য নাগরিকদের ইচ্ছেমতো হত্যা করারও অনুমতি দেয়া হয়, যাতে জনমনে পূর্ণ ত্রাসের সৃষ্টি করা যায়।

তবে পাক সেনাবাহিনী পুরোপুরি সফল ছিল না। পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরোধ যদিও বিশৃঙ্খল ও লক্ষ্যহীন ছিল, তথাপি তা প্রতিনিয়ত অদম্য ও অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছিল। বড় শহরগুলোর বাইরে পাক সেনাবাহিনীর শাসন চলছিল না।

পূর্ব পাকিস্তানের সহজাত যাতায়াতের সমস্যার কারনে ৭০,০০০ পাকিস্তানি সেনাসদস্যের জনবল অপ্রতুল ছিল। মোট জনসংখ্যাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আর্মির সংখ্যা আরও কয়েকগুণ করা দরকার ছিল। এবং আজ থেকে ছয় সপ্তাহ পরে, বর্ষা ঋতুর আগমনের সাথে সাথে সেনাবাহিনীর অগ্রগতি যে চরমভাবে বাধাগ্রস্থ হবে, তা বলাই বাহুল্য।

অফিশিয়ালভাবে পাকিস্তানি সেনারা এটা আর লুকাতে পারছিলো না যে, তাঁরা যেই স্বভাবিক অবস্থার কথা বলছেন, তা বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে। তাছাড়া শিল্পকারখানাগুলোতে অচলাবস্থা বিরাজ করছে এবং প্রচুর পরিমানে সরকারি কর্মকর্তা কাজ থেকে বিরত আছেন।

যদি না প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া দ্রুতই তার সেনাবাহিনী অপসারন করেন, তাহলে বিশ্ববাসী এটাকে আর পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সিদ্ধান্তের উপর ছেড়ে দিতে পারেন না।

পূর্ব পাকিস্তানে ঘটতে থাকা গনহত্যা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। ইতোমধ্যে ভারত, রাশিয়া ও ব্রিটেন আওয়ালপিণ্ডির কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছে। সার্বভৌমত্যের দোহাই দিয়ে আর মানবতার হত্যা করা যাবে না মর্মে আরো দেশকে একত্রিত হয়ে আওয়াজ তোলা উচিৎ।

নিশম সরকার
<৮,৮৭.৪,৫২৫-২৭>
দা টাইমস
লন্ডন
মে ১৯, ১৯৭১
রোড টু ডেথ (মৃত্যুর পথে যাত্রা)
পিটার হ্যাজেলহার্স্ট
সাব্রুম, মে ১৮

গত দু সপ্তাহ ধরে হাজারও আতংকগ্রস্ত দুঃস্থ বাঙ্গালী ভারত পালিয়ে যাবার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু তারা অকৃতকার্য হয়েছেন এবং পথে অনেকে ক্লান্তি-ক্ষুধা-জরায় মৃত্যুবরণ করেছেন।
শরণার্থীরা আমাকে জানালেন যে, ৭৫ মাইলের ভয়ানক পথ পাড়ি দিয়ে চট্টগ্রাম থেকে ভারত বর্ডার পার হয়ে ছোট্ট ত্রিপুরা রাজ্যে আসা অনেকেই একই পরিণতি মেনে নেবে বলে ধারণা করা যাচ্ছে।
প্রায় ৫ লক্ষ মুসলিম এবং হিন্দু শরণার্থী ইতোমধ্যে ত্রিপুরা রাজ্যে প্রবেশ করেছে, এবং তাদের মধ্যে অধিকাংশই সাব্রুম পাড়ি দিয়ে এসেছে, যেখানে ভারত ও পাকিস্তানের বর্ডারের সীমানির্দেশ করেছে ফেনী নদী।
অবসাদ্গ্রস্ত, নিশ্চল শরণার্থীগণ এখান থেকে প্রায় ৬০ মাইল দক্ষিনে অবস্থিত চট্টগ্রাম থেকে তাদের বাড়ি ঘর রেখে কি মর্মান্তিকভাবে এখানে এসেছেন, তার বর্ণনা দিচ্ছিলেন।
শামসুদ্দিন আহমেদ ৪০ বছর বয়স্ক একজন কৃষক। পশ্চিম পাকিস্তানী সেনারা তাদের গ্রামে আক্রমন শুরু করলে, তিনি তার স্ত্রী ও তার পাঁচ সন্তানকে হারান। মাত্র ৩ বছর বয়েসি কনিষ্ঠতম কন্যা রুহিনাকে নিয়ে তিনি চট্টগ্রাম থেকে এখানে পালিয়ে এসেছেন। তিনি বলেন, তার পরিবার পালিয়ে যাওয়ায় তার স্ত্রীকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
একজন বাঙ্গালী দোভাষীর মাধ্যমে তিনি জানান, “পালিয়ে যাবার কারণে আমরা পরিবারের অন্যদের থেকে আলাদা ছিলাম। তাই আমি জানি না যে তাদের সাথে কি হয়েছে। তাদেরকে অনেক খোঁজাখুজি করেও না পেয়ে আমি রুহিনাকে ভারতের সীমান্তেরর দিকে হাঁটা দেই।” “আমাদের সাথে কোন খাবার কিংবা পয়সা ছিলো না। রুহিনা ছয় দিন হাঁটবার পর একদম ঢলে পরে। আমি তাকে কোলে নিয়ে লম্বা পথ হেটে আসলেও কাজ হয়নি। এক সময় সে আমার কোলে মারা যায়। পথের ধারে আমি তাকে কবর দেই। আমার এখন আর কেউ নেই।”
শোকে হতভম্ভ হয়ে যাওয়া এই কৃষক জানান যে তিনি আসার পথে শত শত লাশ দেখে এসেছেন। ভীড়ের মাঝে পরিবারের অধিক শক্তিশালী সদস্যরা কোনমতে টিকে আছে। অন্যরা মারা গেলে তাদেরকে আশে-পাশের মাঠে, ক্ষেতে কবর দিয়ে ভারতের দিকে তাঁরা আবার হাটতে থাকেন।
দুঃখজনক ঘটনাগুলো সবার ক্ষেত্রে প্রায় একই রকমের। ৪৮ বছর বয়েসি জনাব এ জেড বি রাহা চট্টগ্রাম বন্দরের একজন সুপারভাইজার। গতমাসে চট্টগ্রাম শহর থেকে ৪ মাইল দূরে তার গ্রামে পাকিস্তানী ট্যাংক প্রবেশ করলে তিনি পালিয়ে আসেন।
“আমরা উত্তরে ভারতের সীমান্ত বরাবর হাঁটা শুরু করেছিলাম। রাস্তায় আমরা প্রচুর মৃত মানুষের দেহ পরে থাকতে দেখেছি। বাকিরা পথের উপর নিথর হয়ে পরেছিলো। প্রথমে শিশুরা মারা যেত। এরপর ধীরে ধীরে বৃদ্ধ আর শিশুরা। আর শেষমেশ মেয়েরা।
ত্রিপুরার দক্ষিনাঞ্চলের দিকে অগ্রসরমান ২ লক্ষ আশ্রয়হীনাদের মধ্যে আমরা চট্টগ্রামের শুলতীপুরে বসবাসরত ডাক্তার চৌধুরীকেও দেখতে পেয়েছিলাম। তিনি প্রায় সংজ্ঞাহীন অবস্থায় ছিলেন।
তিনি বলেন যে, তিনি হতবিহবল হয়ে ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা হন। কারণ গত মাসে পাকিস্তানী সেনারা তাদের গ্রাম ঘিরে ফেলে তার পরিবারের ১৯ জনকে হত্যা করে। তিনি বলেন, “আর কিছুই অবশিষ্ট নেই”।
সাবরুমের উত্তরে আগরতলা সীমান্তস্থিত শহরের জেনারেল হাসপাতালের সুপারভাইজার ডাক্তার রথীন দত্ত এখন পর্যন্ত বুলেট আর গোলার আঘাতে আঘাত প্রাপ্ত প্রায় ৩০০ জনকে চিকিতসা করেছেন।
“এরা খুবই ভাগ্যবান”, তিনি বলেন। “কারণ, এদের বেশীরভাগই সীমান্তের কাছে বাস করতেন বলে দ্রুত আমাদের কাছে আসতে পেরেছেন আর আমরাও চিকিৎসা দিতে পেরেছি। কিন্তু, গোলা-বুলেটের আঘাতে আঘাতপ্রাপ্ত, ক্ষুধায় জর্জরিত, ক্লান্ত-শ্রান্ত কতো হাজার মানুষ যে চট্টগ্রাম থেকে আসবার পথে মারা গিয়েছে এবং মারা যাচ্ছে, ভাবতেই আমার ভয় হচ্ছে।”
২৬৭ শয্যাবিশিষ্ট তার এই হাসপাতাল এখন অতিরিক্ত ৩০০ জন আহত শরণার্থী নিয়ে জনাকীর্ণ। আহত সকলের দাবি, পাকিস্তানী সেনারা বিনা কারণে ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের গুলি করেছে।
১৬ বছর বয়সী রোহিনা বেগম ও পাঁচ বছর বয়সী জিনাত বেগম দুই বোন। তাঁরা তাদের পায়ে আর হাতে গুলির আঘাত নিয়ে এখানে এসেছে। রোহিনা বলে, গত সপ্তাহে তারা যখন ভারতের উদ্দেশ্যে ফেনী নদী পাড়ি দিচ্ছিলেন, তখন পাকিস্তানী সৈন্যরা তাদের ছোট্ট নৌকা লক্ষ্য করে গুলি করলে তার সমগ্র পরিবার সেখানেই নিহত হয়।
ডাক্তার দত্ত জিজ্ঞেস করেন, “এই বাচ্চাগুলোকে যখন আমি ডিসচার্জ দেবো, তখন আমি এদের নিয়ে কি করবো? তাদের তো কেউ নেই”।
আখাউড়ার নিকটবর্তী জাংশনের একজন রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ার, তার মাথায় বুলেটের আঘাত নিয়ে এখানে আসেন। তিনি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না যে এসব বাস্তবে ঘটছে।“
“তারা কেনো আমাকে গুলি করবে? আমি সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ন পদে চাকরি করি। তারা যখন আমার অফিসে, বাড়িতে লুটতরাজ চালাচ্ছিলো, তখন আমি তাদেরকে আমার পরিচয় জানালাম”। কিন্তু তাদের একজন সৈন্য বললো, “এই বাস্টার্ডটাকে মেরে ফেলো” এবং তারা গুলি করলে আমি সাথে সাথে মাটিতে পরে যাই এবং মৃতের ভান করে পরে থাকি।
“আমার ঘরসহ যা কিছু আছে, সব তারা জ্বালিয়ে দিয়েছে। এখন আমার কী করার আছে? আমার বয়স ৫৫, সংসারে দশজন মানুষ। আমার আর কিছুই রইলো না।”
আগরতলা থেকে আসবার পথটিও জনাকীর্ণ শরনার্থী শিবিরগুলোর মতোই দুঃখ দুর্দশাগ্রস্ত। সামান্য কিছু খাবার আর মাথা গোজার ঠাই এর আশায় শুণ্য চাহনী আর চরম হতাশাগ্রস মুখের জরাগ্রস্ত এই বাঙ্গালীরা উত্তরের দিকে যাত্রা করছিলো। এ জনপ্রবাহ যেন কখনওই থামবার নয়।
স্কুল আর সরকারি অফিসগুলোকে ডর্মিটরিতে রুপান্তরিত করা হলেও সীমিত জায়গার কারণে অধিকাংশেরই জায়গা হলো খোলা আকাশের নিচে। অনেক নারী ও শিশু জরাজীর্ণ ঘাসের কুটির তৈরী করলো।
পয়ঃনিষ্কাশনের কোন ব্যবস্থা ছিলো না। ছিল প্রচন্ড গরম। সাথে দুর্গন্ধ ছিলো অসহনীয়। যেখানে সেখানে বদ্ধ পানি দেখা যাচ্ছিলো এবং মহামারীর প্রাদুর্ভাব ছিলো শুধু সময়ের ব্যাপার।

নিটোল চন্দ্র দাশ
<৮,৮৭.৫,৫২৭-৩২>

দা সানডে টাইমস
২০ জুন, ১৯৭১

পাকিস্তানে গণহত্যা
শিক্ষক, লেখক, সাংবাদিক হত্যা
গুলিবিদ্ধ ম্যাজিস্ট্রেট, চিকিৎসক গুম
গেস্টাপো ধারার আক্রমণ, ধর্ষণ, অত্যাচার।

গত সপ্তাহে সানডে টাইমস এন্থনি মাসকারেনহাস এর একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে, যেখানে পূর্ব পাকিস্তানে সেনা বাহিনীর প্রবেশাধিক্যের কথা বলা হয়। এখন আমাদের কাছে পূর্ব পাকিস্তানে ঘটে যাওয়া আরো সাম্প্রতিক কিছু বিস্তারিত ঘটনার রিপোর্ট আছে, যা পুর্বের তুলনায় আরো ভয়াবহ। এই রিপোর্ট যদিও এন্থনি মাসকারেনহাস এর নয়, তথাপি এটি এমন প্রফেশনাল সোর্সগুলো থেকে এসেছে, যার বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নাতীত।

পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে একটি নতুন সন্ত্রাসী অভিযান চালানো হয়েছে। এর লক্ষ্য ছিল যেকোন ধরনের রাজনৈতিক, সামরিক ও বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি যেন দানা বেধে না উঠতে পারে, সেই ব্যাপারটি নিশ্চিত করা ।

ঢাকায় সেনা প্রশাসন বাংলাদেশি শক্তিকে পরাজিত করার জন্য দ্বিমুখী আক্রমনের পরিকল্পনা গ্রহন করে। প্রথমত সব সরকারি চাকুরে, শিক্ষক, লেখক ও সাংবাদিক চিহ্নিত করা।

দ্বিতীয়ত, যেকোন ব্যক্তি, যে কিনা কার্যত বিপদজনক, তাকে সরিয়ে ফেলা। আর্মি গোয়েন্দা বাহিনী ইতোমধ্যে শিক্ষক, সাংবাদিক ও অন্যান্য প্রভাবশালী বাঙ্গালিদের গ্রেফতার ও জিজ্ঞাসাবাদ করা শুরু করেছে। একটি তালিকা প্রস্তুত করা হচ্ছিল, যেখানে ছিল মূলত আওয়ামিলীগ বিচ্ছিন্নতাবাদী ও তাদের সহযোগিতাকারী হিসেবে সন্দেহভাজনদের নাম।

তাঁদেরকে তিনটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছি। সাদা, ধূসর ও কালো। সাদাদের ছেড়ে দেয়া হতো। ধূসর ট্যাগের লোকজনদের কাউকে চাকুরীচ্যুত এবং কাউকে কারাবন্দী করে রাখা হতো। আর কালোদের হত্যা করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল।

সিভিল সার্ভিসের উপর আক্রমন শুরু হয়ে গিয়েছিল। ৩৬ টি জেলার ডিস্ট্রিক ম্যাজিস্ট্রেট ও সাব-ডিভিশনাল অফিসারের সবাইকে হয় হত্যা করা হয়েছিল, নতুবা তারা ভারতে পালিয়ে গিয়েছিল।

যখন আর্মি বাহিনী কুমিল্লা, রংপুর, নোয়াখালি, কুষ্টিয়া, নোয়াখালি, ফরিদপুর ও সিরাজগঞ্জে প্রবেশ করতে লাগলো, প্রথমেই সেখানকার ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ সুপারকে হত্যা করা হতো।

ধূসর তালিকাভুক্ত সিভিল সার্ভিসের অনেক অফিসারদের পশ্চিম পাকিস্তানে ট্রান্সফার করা হয়। তাদের মধ্যে ছিলেন পুলিশের আইজিপি তসলিম আহমেদ। ২৫ শে মার্চ রাতে পাক সেনাবাহিনী যখন ঢাকা আক্রমন করে, তখন পুলিশ বাহিনী বিদ্রোহ করে এবং প্রায় ১৮ ঘন্টা যাবত প্রতিরোধ বজায় রাখে।

গেস্টাপো স্টাইলের আরেক ধরনের অভিযান চালানো হয়। কিছু লোকদের খোলাখুলি জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গ্রেফতার করা হয়। কিছু লোকদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সেনাবাহিনী ক্যান্টনমেন্টে ডেকে নিয়ে যাওয়া হতো। এই কাজটি করত সেনাবাহিনীর কিছু গোপন এজেন্ট যারা “রাজাকার” নামে পরিচিত ছিল। এই টার্মটি মূলত ব্যবহার করা হত ১৯৪৮ সালে দেশভাগের সময় হায়দ্রাবাদের নিজাম এর স্বেচ্ছাসেবকদের ক্ষেত্রে। রাজাকারের শাব্দিক অর্থ ছিল ‘দেশের বা রাজার সাহায্যকারী’।

দিনে এমনকি রাতের বেলায় ঢাকা শহরের কিছু এলাকা ঘিরে ফেলা হত এবং হিন্দু, ছাত্র ও আওয়ামিলীগ এর কর্মীদের খোঁজা হত। সকলকে একটি বাধ্যতামূলক পরিচয়পত্র বহন করতে হত। গাড়ি থামিয়ে চেক করা হতো এবং শহরের প্রতিটি প্রবেশমুখে চেকপোস্ট বসানো হয়েছিল।

যদি জাওয়ান (চেকপোস্টের রক্ষী) কাউকে আইডি কার্ড ছাড়া পেত তবে তাকে সরাসরি সেনানিবাসে পাঠিয়ে দেয়া হত।

ঢাকা শহরে কয়েকবার বোমা হামলার পরে নিরাপত্তা আরো বাড়িয়ে দেয়া হয় এবং সেনাবাহিনী “আততায়ীদের” ধরার জন্য অভিযান শুরু করে। এদেরকে মুক্তিফৌজ নামে ডাকা হত।

সেনাবাহিনীর পর আততায়ীদের নিধনের কাজের দায়িত্ব দেয়া হয় মিলিশিয়া বাহিনীর উপর। তারা ছিল রেগুলার সেনা বাহিনীর তুলনায় আরো বেশি নির্মম ও কম শৃঙ্খল। তাদেরকে দৈনিক তিন রূপি করে দেয়া হত এবং পূর্ব পাকিস্তানে লুটতরাজ করার অনুমতিও দেয়া হয়।

পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দু সম্প্রদায় ও মুক্তিকামী বাংলাদেশিদের জন্য এটি ছিল আরো ভয়ের সংবাদ।

জগন্নাথ কলেজের শঙ্কর নামের একজন ছাত্র ২৭ মার্চ পাশের একটি গ্রামে পালিয়ে যায়। দুইমাস পর সে একা ঠাঠারিবাজারে তাঁর বাড়ির অবস্থা দেখতে আসে। দুই অবাঙ্গালি লোক তাকে চিনতে পারে এবং “হিন্দু” হিন্দু বলে চিৎকার করতে থাকে। পরে তাকে পাশের মসজিদে ধরে নিয়ে গলা কেটে হত্যা করা হয়।

আবু আওয়াল ছিলেন ভোলা জেলার জেলা প্রশাসক। সরকারের প্রতি আনুগত্যের জন্য তিনি বিখ্যাত ছিলেন। তিনি অবাঙ্গালিদের রক্ষা করছিলেন এবং পুলিশ স্টেশনের অস্ত্রাগার আওয়ামিলীগ এর সদস্যদের লুটের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন।

পহেলা মে যখন তারা আক্রমণ করে, তিনি তাদের বরণ করতে গিয়েছিলেন। যখন ওই অপারেশনের বিগ্রেডিয়ার তাকে তার চাকুরী ছেড়ে দিতে বলেন। তিনি চলে আসতে চাইছিলেন। কিন্ত একজন সিপাই তাকে পেছন থেকে রাইফেল দিয়ে গুলি করে হত্যা করে।

প্রায় এক ডজন বাঙ্গালি আর্মি অফিসারকে পশ্চিম পাকিস্তানে ট্রান্সফার করা হয়েছিল। ঢাকা বিমানবন্দরে তাদের স্বজনেরা বিদায় জানাতে এসেছিলেন। তাঁরা পিআইএ-র ফ্লাইটে করাচির উদ্দেশ্যে রওনা করেন।

তাঁদের পরিবার তাঁদের সম্পর্কে খুব বেশি জানতে পারতো না। যখন তারা আর্মি হেডকোয়ারটারে খোঁজ নিতে যেত, তাদের বলা হতো যে তাঁরা পালিয়েছিলেন। একজন মেজরের ক্ষতবিক্ষত লাশ তাঁর পরিবারের কাছে প্রেরণ করা হয় এবং বলা হয় তিনি নাকি আত্মহত্যা করেছিলেন।

বিগ্রেডিয়ার মজুমদার নামক সুপরিচিত বাঙ্গালি সেনা অফিসারের অবস্থান অজ্ঞাত ছিল। যখন তাঁরা বাঙ্গালি সেনারা চট্টগ্রামে বিদ্রোহ করেছিল, তিনি তখন তাঁর পাকিস্তানি সহকর্মীদের সাথে ছিলেন। তাঁর পরিবার তাঁর সম্পর্কে জানতে চাইলে তাঁরা জানায়, এত আগ্রহ সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।

জুনের ২ তারিখ একটি আর্মি জীপ ধানমন্ডি আবাসিক এলাকায় প্রবেশ করে। হক নামের একজন সরকারি অফিসারকে তাঁর বাসা থেকে টেনে হিঁচড়ে বের করা হয় এবং তাকে কুর্মিটোলা সেনা ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়।

তাঁর স্ত্রী পূর্ব পাকিস্তানের সিভিলিয়ান প্রধান শফিউল আলমকে টেলিফোন করেন। উনি সেনাবাহিনী হেডকোয়ার্টারে যোগাযোগ করেন। তাকে বলা হয়, হক নামের কাউকে এখানে আনা হয় নি।

একজন শিল্পপতি, রনদা সাহাকে আর্মি অফিসারদের জন্য তার গ্রামের বাড়ি মির্জাপুরে একটি সন্ধ্যাকালীন উৎসবের আয়োজন করতে বলা হয়। তিনি উৎসব নিয়ে আলোচনা করতে যান এবং আর ফিরে আসেন নি।

পাকিস্তানি সেনারা আমিন নামক একজন সরকারি চাকুরিজীবীকে বাসা থেকে নিয়ে আসে। তাঁকে তাঁর স্ত্রী, তিন সন্তান এবং বৃদ্ধ পিতামাতা সহ আর্মি ট্রাকে তুলা হয়। তার ভাই বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন অফিসার ছিলেন এবং তিনি বর্তমানে কুমিল্লার কাছাকাছি বাংলাদেশের প্রতিরোধ যুদ্ধের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ২ দিন পর আমিনের পরিবার জনাব আমিনকে ছাড়াই ফিরে আসে।

১৫ মে একজন ক্যাপ্টেন দুইজন সেনা সহ মিটফোর্ড হাসপাতালে প্রবেশ করে এবং দুই নং ওয়ার্ড থেকে ডাঃ রহমান ও তার কলিগদের নিয়ে যায়। তাঁদের বলা হয় যে তাঁদের ময়মনসিংহে কাজ করতে হবে। তাঁদের খোজ আর কখনো পাওয়া যায় নি।

পরবর্তীতে সেনারা আমেরিকা পরিচালিত হলিফ্যামিলি হাসপাতালে আক্রমন চালায়। কিন্ত সেখানে কোন সার্জন ছিলেন না। হাসপাতালটি বন্ধ হয়ে যাবার অপেক্ষায়, কারণ এর অধিকাংশ ডাক্তার পালিয়ে গিয়েছিলেন, যাদের মধ্যে ছিলেন বিখ্যাত শিশু বিশেষজ্ঞ ডাঃ এম এন হক।

সিলেটে জেনারেল সার্জন ডাঃ শামসুদ্দিন ছাড়া সবাই বর্ডার পার করে ভারতে পালিয়ে গিয়েছিলেন। যখন সেনাবাহিনী শহরে প্রবেশ করে, তখন তারা ডাঃ শামসুদ্দিন কে হাসপাতালের ভেতর পায়। একজন মেজর তাঁকে পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জে গুলি করে হত্যা করে।

পিআইএ-র অধিকাংশ সিনিয়র অফিসারেরা উঠিয়ে নেবার পর থেকে নিখোঁজ ছিলেন। তাদের মধ্যে ছিলেন জনাব ফজলুল হক, পূর্ব পাকিস্তানের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর এবং চিফ সেক্টর পাইলট ক্যাপ্টেন সেকান্দার আলী। মিলিটারি দখলাদারিত্বের পর প্রায় ২,০০০ বাঙালিকে চাকুরিচ্যুত করা হয়।

রাজাকারেরা বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর খালেদ মোশাররফ এর দুই সন্তানকে বন্দি করে। কারন তিনি মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। চার ও ছয় বছরের দুই শিশুকে সেনা কাস্টডিতে নেয়া হয়। তাঁদের মা ভারতে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। প্রথমে সন্তানদের ছেড়ে দেয়া হলেও পরে আবার বন্দি করা হয়।

আত্ময়ীরা মনে করতেন, রাজাকারেরা হচ্ছে জুনিয়র সেনা সদস্য যারা স্বাধীনভাবে অবাঙ্গালিদের সাথে কাজ করছে। তাঁরা মুক্তিপণ দাবি করতো এবং একটি ক্ষেত্রে জানা যায় যে রাজাকারদের টাকাও দেয়া হয়েছিল। যদিও কোন ফলাফল আসে নি।

রাজাকারেরা খুন ও ধ্বংসযজ্ঞের পাশাপাশি তাদের কাজকে পতিতাবৃত্তি পর্যন্ত বিস্তৃত করে। চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে তারা একটি ক্যাম্প খুলে, যেখানে সিনিয়র অফিসারদের মনোরঞ্জনের জন্য যুবতী মেয়েদের রাখা হত। তারা নিজদের পার্টির জন্য মেয়েদের অপহরণ করত। ফেরদৌসি, একজন প্রতিষ্ঠিত বাঙ্গালি গায়িকা ভাগ্যগুণে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। যখন একজন সেনা অফিসার তার বাসায় প্রবেশ করছিল, তার মা তার উদ্ধারে জন্য একজন জেনারেলকে ফোন করেন যাকে তিনি চিনতেন। তাঁকে উদ্ধারের জন্য মিলিটারি পুলিস প্রেরণ করা হয়।

কিছু উল্লেখযোগ্য পরিমানে অফিসার, বিশেষ করে গোয়ান্দা বিভাগের অফিসারেরা কাজে ফিরতে শুরু করে। যাদের অনেকেই মার্চে শেখ মুজিবরের ডাকে কেন্দ্রীয় সরকারের কাজ থেকে অব্যহতি নিয়েছিলেন।

পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাদের ‘অবাঞ্চিত’ বলে ঘোষনা দেয় এবং ভুল ব্যাক্তিকে প্রবেশের আগে বাড়তি সতর্কতার ব্যবস্থা নেয়, যারা কিনা ২৫ ও ২৬ শে মার্চ রাতে চিহ্নিত হয়েছিল।

ঐ ২ রাতে আর্মিরা ২০ জনের অধিক অধ্যাপককে হত্যা করে। নামের কারণে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ডঃ মনিরুজ্জামানকে হত্যা করা হয়। একইভাবে বাংলা বিভাগের মিঃ মনিরের পরিবর্তে ইংরেজি বিভাগের মিঃ মোনায়েমকে হত্যা করা হয়।

জেনারেল টিক্কা খানের প্ররোচনায় কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ১ জুন থেকে কাজে যোগদান করেছিলেন। যদিও তাদের অনেকেই ইতোমধ্যে রাজাকারদের হাতে ধরা পড়ে গিয়েছিলেন।

রাজাকারদের কাজ জানাই ছিল। যদিও তা ছিল সেনা প্রশাসনের আওতায়। মূলত, তারা ছিল তথ্যদাতা। সম্পতি প্রশাসন প্রায় শতাধিক পাট শ্রমিককে ঢাকায় পুনরায় কাজ শুরু করার জন্য রাজি করিয়েছিল। ২৯ মে তারিখে তাদের তিনজন ট্রেড ইউনিয়নের লিডারকে আর্মি জীপে করে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। পরের দিন থেকে শ্রমিকেরা আবার পালিয়ে যায়।

৬ মিলিয়ন শরনার্থীর পুনরায় ফিরে আসাতে সমস্যা প্রকট আকার ধারন করে। ঢাকা, যশোর, রংপুর, ঈশ্বরদী, খুলনা ও চট্টগ্রামে তাদের বাড়িঘর অবাঙ্গালিদের দ্বারা বেদখল হয়ে গিয়েছিল।

২৮ এপ্রিল সেনাবাহিনীর সহায়তায় তাঁরা ঢাকার প্রায় ১৫ বর্গমাইল এরিয়া জুড়ে থাকা মিরপুর ও মোহাম্মদপুর আবাসিক এলাকা দখল করে ফেলে। বাঙ্গালিদের মধ্যে যারা চলে যাওয়ার আদেশ অমান্য করেছিলেন, তাঁদের প্রত্যেককে হত্যা করা হয়।

সেনারা যশোরে মশিউর রহমান নামের একজন আওয়ামিলীগ সদস্যের বাসা ঘেরাও করে। উনি জাতীয় পরিষদের সদস্যও ছিলেন। অবাঙ্গালিরা তার পরিবারের সবাইকে হত্যা করার চেষ্টা করেছিলেন। ১০ বছরের এক বালক দোতলা তলা থেকে লাফ দিলে বাতাসে থাকা অবস্থাতেই এক সিপাই তাকে গুলি করে।

দেশভাগের সময় যারা পুর্ব পাকিস্থানে এসেছিলেন গ্রহন করেছিলেন এবং রাজাকারদের সমর্থনে থাকা শান্তি কমিটি নামে একটি কমিটি বাঙ্গালিদের ফেলে যাওয়া বাসা ও দোকান ‘বরাদ্দ’ দেওয়ার জন্য প্রেস নোটিশ প্রচার করতে থাকে।

চিটাগাংয়ে আর্মিরা লালদিঘী ও রিয়াজুদ্দিনবাজারের সকল বন্ধ দোকানের তালা খুলে ফেলে এবং তা অবাঙ্গালিদের হাতে হস্তান্তর করে। এসব বেদখলকৃত সব দোকানে উর্দু লিখিত সাইনবোর্ড লাগানো হয়।

গ্রামের বাড়িঘরগুলো ডানপন্থি জামাত-ই-ইসলামি এবং মুসলিম লীগের সদস্যদের মধ্যে ভাগ-বটয়ারা করে দেয়া হয়েছিল। এরা শেষ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছিল।

সকল হিন্দুর ব্যাংক একাউন্ট জব্দ করা হয়, সাথে যারা আওয়ামিলীগ এর সমর্থন করতো বলে সন্দেহ করা হয়েছিল, তাদেরগুলোও। একমাত্র ঢাকায় অবস্থিত ব্রিটিশ ন্যাশনাল এন্ড গ্রিনডলে ব্যাংকের ম্যানেজার এই নির্দেশের আওতামুক্ত ছিলেন।

বাঙ্গালিদের গুরুত্বপূর্ন রেল, পোর্ট ও ডকের কাছে যাওয়া থেকে বাঁধা দেয়া হয়েছিল। যখন ৫,০০০ শ্রমিক চট্টগ্রাম ডকে কাজ করতে ফিরে এসেছিলেন, তাঁদের তাড়িয়ে দেয়া হয়। এইসব প্রতিষ্ঠান এখন মিলিটারি, নেভাল ও অবাঙ্গালি দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে।

চট্টগ্রামে রেলের সিনিয়র অফিসারদের হত্যা করা হয়। ঢাকা, ঈশ্বরদি ও সৈয়দপুরে কোন বাঙ্গালি সাহ করে কোন রেল জংশনের কাছে ভিড়ে নি।

ঢাকা ও চট্টগ্রামে বাঙ্গালিদের স্থালাভিষিক্ত হবার জন্য প্রায় ২৫০ জন শ্রমিক পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আকাশ পথে এসেছিল ।

প্রায় তিন হাজার পাঞ্জাবি পুলিশ ঢাকা শহরে টহল দিতে থাকে। এরা মূলত পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্ত এলাকার রেঞ্জার এবং উত্তর-পশ্চিম খায়বার যুদ্ধমঞ্চ থেকে এখানে এসেছে।

পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় দশ হাজার মিলিশিয়া বাহিনী বিদ্রোহ করে। যাদের অনেকে সীমান্ত পার করে পালিয়ে যায় এবং অনেকে গ্রামে গঞ্জে লুকিয়ে থাকে। তাঁদের মধ্যে যারা প্রশাসনের ১৫ তারিখের মধ্যে সারেন্ডার করার ডাকে সাড়া দেয়, তাঁদেরকে হাত পেছন দিকে বাধা অবস্থায় ট্রাকের মাধ্যমে নিয়ে যেতে যায়।

কিছুদিন বাদে প্রায় শতাধিক নগ্ন মৃতদেহ বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষা নদীতে ভাসতে দেখা যায়।

পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসের নাম বদল করে পাকিস্তান ডিফেন্স ফোর্স করা হয় এবং শতাধিক বিহারীকে নিয়োগ দেয়া হয়। তাদেরকে পিলখানায় রাইফেল ও মেশিনগানের প্রশিক্ষন দেয়া হয়।

ঢাকার খিলগাঁয়ে ২৮ শে মে একটি অবাঙালি দোকানে বোমা বিস্ফোরণের পর সন্দেহভাজন হিসেবে ১০০ জনকে ধরা হয়।

মতিঝিলে একজন অবাঙ্গালি তার প্রতিবেশি থেকে প্রায় ১০,০০০ রুপি (প্রায় ৬০০ পাউন্ড) দাবি করে এবং শাসায় যে ২৪ ঘন্টার মাঝে টাকা না দিলে তাদেরকে সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দিবে।

স্টেডিয়াম মার্কেটের একজন রেডিও ও ক্যামেরা দোকানদার দেখেন যে তার মালামাল সব গায়েব। সে মার্শাল ল’ হেডকোয়ার্টারে এই অভিযোগ দাখিল করে। ঐদিন রাতেই কারফিউ চলাকালীন সময়ে তার দোকানটি পুড়িয়ে দেয়া হয়।

মাজেদা বেগম একজন গৃহিনী। যিনি রাস্তার নলকূপ থেকে পানি সংগ্রহ করছিলেন। দুইজন পাঞ্জাবি পুলিশ তাকে জোরপুর্বক জীপে তুলে নিতে চেষ্টা করে। তার চিৎকারে লোকজন এগিয়ে আসে এবং লাঠি ও পাথর দিয়ে তাঁদের মেরে তাড়িয়ে দেয়। ঐদিন রাতে পুরো বাসাবো এলাকায় অগ্নিসংযোগ করা হয়।

ঢাকার রাস্তাঘাটে ঘড়ি পড়ে বের হওয়াও বিপদজনক ছিল। টিভি, রেডিও ও ট্রান্সমিটার বাসায় লুকিয়ে রাখতে হত। সেনারা রাস্তার মোড়ে লুট করা রেডিও ঘড়ি ৩ থেকে ৬ পাউন্ড দামে বিক্রি করত।

কর্ণেল আবদুল বারী নামক একজন অফিসার পাকিস্তান স্টেট ব্যাঙ্কে ১ কোটি রুপি বা ৮,৩৩,০০০ পাউন্ড জমা করেছিলেন।

মে মাসে কিছু বিদেশি সাংবাদিকদের ভ্রমনের পূর্বে শহর পরিচ্ছন্ন করার উদ্যোগ নেয়া হয়। জগন্নাথ হল ও ইকবাল হল থেকে ছাত্রদের মৃতদেহগুলো অপসারন করা হয়। তাঁতিবাজার, শান্তিনগর, শাখড়িপট্টি এবং রাজারবাগের ধ্বংসাবশেষ পরিষ্কার করা হয়।

স্কুল কলেজ যদিও খোলা ছিল কিন্ত উপস্থিতির হার ছিল অত্যন্ত নিম্ন। একটি স্কুলে যুদ্ধ শুরুর আগে ৮০০ জন ছাত্র ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে স্কুল খুললে সেখানে উপস্থিত হয় মাত্র ১০ জন।

১৬ থেকে ২৫ বছর বয়েসি বেশিরভাগ তরুণ সীমান্ত অতিক্রম করে মুক্তিফৌজ ট্রেইনিং ক্যাম্পে যোগদান করার জন্য রওনা হয়েছিল।

যুবকদের ধরে ধরে হত্যা করা হবে-এই ভয় চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। যদিও এই আশা তাঁদের বুকে ছিল যে, একদিন না একদিন তারা স্বাধীন বাংলাদেশে বসবাস করতে পারবে।

নিটোল চন্দ্র দাশ
<৮,৮৭.৬,৫৩২>

দা হংকং স্ট্যান্ডার্ড
২৫ জুন, ১৯৭১

আরেক চেঙ্গিস
প্রায় চারশত বছর ধরে চেঙ্গিস খান নামটি ইতিহাসে নিষ্ঠুরতা আর হত্যার প্রতিশব্দ ছিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

এই বিংশ শতাব্দিতে, মনে হচ্ছে একজন পাকিস্তানি চেঙ্গিস খানকে অতিক্রম করে ফেলবে।

‘শান্তিদাতা’ নামে পরিচিত পাকিস্তানি জেনারেল টিক্কা খান পাঞ্জাবি ও পাঠান সৈন্যদলকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, যারা তার নির্দেশে নৃশংস রক্তস্নানে মত্ত হয়ে পড়েছে।

খুন, ধর্ষন, অবুঝ শিশুকে হত্যার অসংখ্য অকাট্য প্রমান রয়েছে। এগুলো বড় অফিসারেরা করতেন কিংবা তাঁদের জন্যেই করা হতো।

চেঙ্গিস খান তার রক্তক্ষয়ী ভুলের মাধ্যমে নিজের একটি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। অপরদিকে টিক্কা খান ও তার গলাকাটা সহযোগীদের একটি দেশের অর্ধেক জনসংখ্যার হত্যার জন্য চিরকাল স্মরণ করা হবে।

নিটোল চন্দ্র দাশ
<৮,৮৭.৭,৫৩৩>

সানডে টেলিগ্রাফ
লন্ডন, ১ আগস্ট, ১৯৭১

খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের উপর পাকিস্তান আর্মির অত্যাচার
-ক্লের হোলিংওর্থ
প্রধানমন্ত্রী ইয়াহিয়া খান আগামীকাল অথবা পরবর্তী মঙ্গলবার পূর্ব পাকিস্তান ভ্রমণ করতে পারেন। তিনি সেই মুহূর্তে ঢাকায় অবতরন করবেন যখন বাংলাদেশি গেরিলা তৎপরতা তুঙ্গে উঠেছে।

এই পরিকল্পনা পশ্চিম পাকিস্তানী সরকার অথবা সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ছিল না। বরং বাঙালি জণগণকে ভবিষ্যতের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে ভীত করে তোলার একটি প্রকৃয়া ছিল।

গেরিলারা ঘোষণা দেয় তারা অতি সত্ত্বর ‘নাটকীয় একশানে’ যাচ্ছে। বাঙ্গালিদের এয়ারপোর্টের কাছে যেতে সাবধান করে দেয়া হয়।

শুক্রবার রাতে ফার্মগেটে (এয়ারপোর্ট ও শহরের মাঝের একটি শিল্পপল্লী এলাকায়) সেনাবাহিনী ও গেরিলাদের মাঝে একটি সংঘর্ষ হয়।

ভারী মেশিনগান দিয়ে পাল্টাপাল্টি গোলাগুলি চলে। বোমার তীব্র শব্দে পুরো শহর প্রকম্পিত হয়ে উঠে। ছয়জন গেরিলার মৃত্যু হয়েছে বলে রিপোর্ট পাওয়া যায়।

সেনাবাহিনী এর চেয়েও বড় ধ্বংসলীলা চালায় ঢাকা শহরের অদূরে অবস্থিত লুডারিয়া, নালচাটা, লারিপাড়া নামের তিনটি খ্রিস্টান অধ্যুষিত গ্রামে। গ্রামগুলো টঙ্গি থেকে আরিকহোল্ড পর্যন্ত চলে যাওয়া রেল লাইনের পাশের উঁচু বাঁধের উপর অবস্থিত ছিল।

কোন সম্পূর্ন খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী সম্প্রদায়ের উপর সেনা অভিযানের এটিই ছিল প্রথম ঘটনা। তারা গ্রামের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে গেরিলারা গ্রামগুলো থেকে কয়েক মাইল দূরে একটি রেলগাড়িকে লাইনচ্যুত করে দেয়। আমি এই ঘটনার ফলাফল দেখছি।

এই মুহূর্তে গ্রামগুলো সম্পূর্ণভাবে পানি দ্বারা বেস্টিত। সেই গ্রামগুলোর অনেকেই ঢাকার বিভিন্ন হোটেলে কিংবা প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করতো। তারা জানায় কমপক্ষে ৩ থেকে চার হাজার খ্রিস্টান গৃহহারা হয়েছে এবং শতাধিক লোকজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

যদিও এই ঘটনাগুলো বুধবারে ঘটে, তথাপি সেনাবাহিনীর মুখপাত্র থেকে এই বিষয়ে আমি কোন মন্তব্য জানতে পারি নি। অবশ্য এর পর থেকে তাকে দেখাও যায় নি। এলাকার পাদ্রীগন তাদের সম্প্রদায়ের উপর এই প্রথম হামলার ব্যাপারে গভীর শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।

নিটোল চন্দ্র দাশ
<৮,৮৭.৮,৫৩৩-৩৪>

আল হাওয়াইদ
লেবানন, ২০ অগাস্ট, ১৯৭১

পূর্ণ ধ্বংসের যুদ্ধ
একজন পাকিস্তানি অফিসার একটি গ্রামে যান এবং সেখানকার দরিদ্র ও অনাহারী গ্রামবাসীকে তারা পাশে জড়ো হতে বলেন। তিনি বলেন, “আমার কিছু সৈনিক আহত হয়েছে। তাই আমার রক্তের দরকার এবং আমার কিছু স্বেচ্ছাসেবী প্রয়োজন।“

কোন প্রতিউত্তর গ্রহনের পূর্বেই সেনারা ভিড়ের মধ্য থেকে কিছু যুবককে ধরে নিয়ে এসে মাটিতে শুইয়ে দেয় এবং তাদের শিরা ফুটো করে দেয়। তাদের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত রক্ত বের হতে থাকে।

পূর্ব পাকিস্তানে ঘটে যাওয়া অসংখ্য ঘটনার মধ্যে এটি ছিল কেবল একটি। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে পূর্ব পাকিস্তানের বিরোধী ‘মানুষের উপর’ পশ্চিম পাকিস্তানের এই অত্যাচার নিয়মিতভাবেই চলতে থাকে।

লাখ লাখ লোকের ভারত অভিবাসন কোন আশ্চর্যের কিছু ছিল না। লোকজন প্রাণভয়ে ও ক্ষুধার তাড়নায় তাড়িত হয়ে পালিয়ে যাচ্ছিলো।

নিটোল চন্দ্র দাশ
<৮,৮৭.৯,৫৩৪-৩৫>

এল কমার্শিও
ইকুয়েডর, ২ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

দুই লাখ বাঙ্গালির হত্যা
-(আলফানসো রোমাজো গঞ্জালেস)
পূর্ব পাকিস্তানে প্রায় ২ লাখ বাঙ্গালির হত্যাকান্ডকে কেবলমাত্র একটি শব্দ দিয়েই সঠিকভাবে চিত্রিত করা যায়ঃ গনহত্যা। এই অপরাধটি জেনারেল ইয়াহিয়ার নির্দেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক সংঘটিত হয়েছিল। এই ২ লাখের হিসাবটি দেন লিওন এফ হেসার Leon F. Hesser, Director of (USAid agency)। ব্রিটিশ ক্যালকুলেশন অনুযায়ী এই সংখ্যাটি তিন লাখের চাইতেও বেশি। “এটা অনেকটা গ্রীক ট্র্যাজেডির মতো”, বলেন একজন ব্রিটিশ এক্সপার্ট। উনি সেখানে সাহায্য নিয়ে গিয়েছিলেন।

পূর্ব পাকিস্তানের চাহিদা আসলে কি ছিল? স্বায়ত্ত্বশাসন। দেশটির পশ্চিম অংশ পূর্ব অংশ থেকে ১,৬০০ কিলোমিটারব্যাপী বিশাল ভারতীয় ভূখণ্ড দ্বারা পৃথকীকৃত ছিল। এইভাবে কি কোন দেশের অস্তিত্ব রক্ষা সম্ভব? দুইটি দেশের দুইটি ভাগ বিশাল সীমারেখা দ্বারা পৃথক হয়েও কিভাবে টিকে থাকে? এই প্রশ্নের উত্তর শেষ পর্যন্ত গত মার্চে অস্ত্র ও যুদ্ধের মাধ্যমে দেয়া হয়েছিল। আমেরিকান এক কর্মকর্তা বলেন যে, কেবলমাত্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধই এই মাত্রার অপরাধের সাথে তুলনীয়।

প্রচুর মানুষ মারা যাবার পরেও ইতোমধ্যেই ৮০ লাখেরও বেশি শরনার্থী প্রাণ বাচাতে ভারতে আশ্রয় গ্রহন করেছে। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী নিজে শরনার্থীদের দায়ভার গ্রহন করেছেন এবং ইউএসএ,ইউকে প্রভৃতি দেশ থেকেও ত্রান সামগ্রী আসা শুরু হয়েছে। এই অসহায় শরনার্থীদের বাচিয়ে রাখতে সামনের ছয় মাসে আরো মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের প্রয়োজন।

অবস্থা আরো করুন হতে লাগল। সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান দুর্ভিক্ষের দিকে ধাবিত হতে লাগলো। নভেম্বরের শেষ নাগাদ খাদ্যভাব দেখা দেবে। মোট উৎপাদন ও চাহিদার মাঝে ঘাটতি ছিল প্রায় ৪০ লাখ মেট্রিক টন ধান ও গম। যদিও বা খাদ্য ঘাটতি সামাল দেয়া হয়, যুদ্ধবিধস্ত দেশে যেখানে যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ন ভেঙ্গে পড়েছে, কিভাবে তা সরবরাহ করা হবে? মুক্তিকামী সেনারা প্রতিটি পয়েন্টে যোগাযোগ ব্যবস্থা নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার চেষ্টা করছে যাতে ইয়াহিয়ার পাকিস্তানি সেনারা তাদের তৎপরতা না চালাতে পারে। এই ধবংসলীলা তাঁদের নিজেদের জীবনেই দুর্ভিক্ষের সম্ভাবনা আরো বাড়িয়ে তুলছে।

কিন্ত এই নৃশংস যুদ্ধের মূল কেন্দ্রবিন্দুঃ মানুষকে অবহেলা করা হচ্ছে। কিন্ত এই দুর্দশাগ্রস্থ অবস্থায় অসহায়দের জন্য সাহায্য দেয়া একটি দেশও এই গণহত্যার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয় নি। কিন্ত পুরো বিশ্বের এই নির্মম গনহত্যার বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে সোচ্চার হওয়া উচিৎ। কিন্ত কেউই আওয়াজ তোলেনি, মানবাধিকারের নামে বলা কথাগুলি ছিল কেবলই ‘তত্ত্বকথা’। এই জন্যেই রাসেল বলেছিলেন, বিংশ শতাব্দির মানুষ হচ্ছে অন্য যে কোন শতাব্দির মানুষের তুলনায় নির্দয় ও সন্দেহবাতিকগ্রস্ত।

নিটোল চন্দ্র দাশ

<৮,৮৭.১০,৫৩৫>

দা এজ
অস্ট্রেলিয়া, ১১ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
হারানো মিলিয়নস
-ম্যাক্স বেটি
পূর্ব পাকিস্তানে যংসযজ্ঞের ১৬০ দিন পরেও, অসহায় বাঙ্গালি কৃষকেরা তাদের নগ্ন সন্তানদের নিয়ে ভারতের পোতাশ্রয়ে আসতে লাগলো।

অবাক করার বিষয়, প্রতিদিন ৪০ হাজারের বেশি মানুষ ভারতে পাড়ি দিচ্ছে। এরকম অভিবাসন পৃথিবীবাসী খুব বেশি দেখেনি। ভারত সরকারের মতে, ইতোমধ্যে আট মিলিয়নের মত শরনার্থী এসেছে এবং বছর শেষে এই সংখ্যা ১০ মিলিয়নে পৌছাবে।

এই সেপ্টেম্বরেও শরণার্থীরা ৫ মাস আগের শরণার্থীদের মতোই গুলাগুলি ও ধর্ষণের বর্ণনা দিতে লাগলো।

নিটোল চন্দ্র দাশ
<৮,৮৭.১১,৫৩৫>
সুম্মা ম্যাগাজিন
কারাকাস, অক্টোবর, ১৯৭১

লাশ দিয়ে পরিপূর্ন একটি দেশ

নাজি বাহিনী কর্তৃক ইহুদি নিধন, হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমানবিক বোমা হামলা, বায়াফ্রার ম্যাসাকার, ভিয়েতনাম যুদ্ধ – মানব ইতিহাসে ঘটে যাওয়া সকল বৃহৎ গণহত্যার ঘটনা আরেকটি নতুন উদাহরন পেতে যাচ্ছে বিশ্ববাসী- ‘পূর্ব পাকিস্তান’।

বিদেশি গনমাধ্যম প্রকৃত ঘটনাটি সামনে নিয়ে আসার পরেও লোকজন এর প্রকৃত গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারছিল না। এটাও জানতে পারছিল না যে, ঠিক এই মুহূর্তে এশিয়ার লাখ লাখ মানুষ তাদের জীবন ও মাতৃভূমির ধ্বংসলীলা প্রত্যক্ষ করছে।

পুরো ঘটনার সারমর্ম এরকম- প্রায় পাঁচ মাস আগে আপাত ভাতৃপ্রতীম পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর দ্বারা পূর্ব পাকিস্তানে আগ্রাসন চলে। হাজারো জনগনকে হত্যা করা হয়, নারীদের ধর্ষন করা হয়, শিশু ও বৃদ্ধরা খাদ্যভাব ও কলেরায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। বিশ্বের ইতিহাসের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য মাইগ্রেশনের ইতিহাস সৃষ্টি করে প্রায় আট মিলিয়ন অধিবাসী ভারতে চলে যায়। যা কিনা একসময় পাকিস্তানের সাথে একত্রে ছিল।

এই ট্রাজেডির সবচেয়ে লোমহর্ষক দিকটি হল, ঢাকা শহরে এক রাতের মধ্যেই প্রায় ৫০,০০০ লোককে হত্যা করা হয়। ২৬ মার্চের মধ্যরাত থেকে যার শুরু হয়, এবং এখন পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা দাড়িয়েছে প্রায় ১ মিলিয়নে। প্রতিদিন ৩০ হাজারেরও বেশি মানুষ ভারতে শরণার্থী হিসেবে চলে যাচ্ছে।

নিটোল চন্দ্র দাশ
<৮,৮৭.১২,৫৩৬>
দা নিউ ইয়র্ক টাইমস
১৭ নভেম্বর, ১৯৭১

আর্মির আক্রমণের পর পূর্ব পাকিস্তানের শহরের অবস্থা

অক্টোবরের ২৭ তারিখ, বেলা ৮ টার দিকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি টাস্ক ফোর্স শেখেরনগরে আসে এবং পুরো শহর ধবংস করে দেয়।

মূলত গ্রামে গেরিলা বাহিনী অবস্থান করছে, এইরকম একটি ভুল সংবাদের ভিত্তিতে তাঁরা গ্রামটিতে আক্রমন করে। কোন ধরনের পূর্ব সতর্কতা ছাড়াই মোটরে লঞ্চে তাঁরা আসে। যদিও ঢাকা থেকে বিশ মাইল দূরে অবস্থিত শেখেরনগরের অনেক গ্রামবাসীই লঞ্চের ইঞ্জিনের আওয়াজ শুনে পুকুর, ডোবা ও শস্যক্ষেতে লুকিয়ে যায়।

গ্রামে ঢোকামাত্র বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাঁরা গুলি করে মানুষ হত্যা করে। প্রায় প্রতিটি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। বেঁচে যাওয়া অধিবাসীরা একটি গণকবর দেখালো যেখানে প্রায় ১৯ জনের লাশ ছিল।

গ্রামের পাকা স্কুল ঘরের আসবাবপত্র এবং দরজাগুলো পাক সেনারা রান্নার জন্য চিড়ে ফেলে। একটি রাইস মিল পুড়িয়ে ফেলা হয়। গ্রামের কৃষকদের সদ্য মজুদ করা পাকা ধানের গোলা পুড়িয়ে দেয়া হয়। গ্রামের প্রায় ৩০০ গরু ও ছাগল জবাই করা হয়।

ইউনাইডেট স্টেট এইড প্রোগ্রামের আওতায় গ্রামবাসীর প্রাপ্ত বিশাল পরিমানের গম লুট করে পাক সেনাবাহিনীদের নৌকায় ভরা হয়।

ফসফেট সার দিয়ে বোঝাই একটি গুদাম পুড়িয়ে ফেলা হয়। বেশিরভাগ সারের বস্তা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।

মসজিদ সংলগ্ন অনেক বাড়িতেও আগুন লাগানো হয়। হিন্দু মন্দির,যেখানে প্রায় ৪০০ হিন্দু পরিবারের বাস ছিল তা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয় এবং হিন্দু দেব-দেবীদের মূর্তিগুলিকে গুলি করে নষ্ট করা হয়।

এমনকি গ্রাম্য পোস্ট অফিসেও লুট করা হয়। পোস্ট অফিসের স্ট্যাম্প ও জমাকৃত টাকা তারা নিয়ে যায়।

একজন গ্রামবাসী জানায়, “এখানে দেখুন, তারা এমনকি আমাদের ফলের গাছগুলোও ধবংস করেছে। কলাগাছ সহ আরো কিছু গাছ বড় হতে অনেক সময় নেয়। সেগুলোও তাঁরা ধ্বংস করেছে। তারা গাছের গোড়ায় শুকনো খড় দিয়ে আগুন লাগিয়ে দেয়।“

নিটোল চন্দ্র দাশ
<৮,৮৭.১৩,৫৩৬-৩৭>
নিউজউইক ম্যাগাজিন, ইউএসএ
নভেম্বর ২২, ১৯৭১

বাংলাদেশঃ প্রতিশোধের সময়

কিছু আগুনে পুড়ে ধবংস হয়ে যাওয়া গ্রাম জনমনে ভূতের মতো আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। জলে ভেসে যাওয়া লাশগুলো নদীর সাদা ও হাল্কা বেগুনি রঙা এর কচুরীপানার সাথে মিশে যেন শোকের এক দৃশ্যপট সৃষ্টি করেছে। আমি (লেখক) এবং ডেইলি টেলিগ্রাফের ক্লারা হলিংওর্থ (Clare Hollingrowth) রাজধানী ঢাকার বাইরে প্রায় ৪৫ মাইল জায়গা ভ্রমন করেছি। মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদের ‘স্বাধীনকৃত’ একটি এলাকায় গিয়েছিলাম। জীবিত এবং মৃত সব কিছুই জনযুদ্ধের স্বাক্ষ্য বয়ে বেড়াচ্ছিল। ৩ ঘণ্টাব্যাপী আমাদের জলাভূমির পথে শতাধিক কৃষক আমাদের জলযানটি দেখে। কিন্তু রাখাল ছেলেমেয়েরা, জাল মেরামত করা জেলে কিংবা মাটির ডেরা মেরামত করার জন্য মাটি বহন করা গৃহবধুরা পর্যন্ত আমাদের হাত নাড়া দেখে জবাবে কোন হাত নাড়ে নি। পরে মুক্তিবাহিনীর একজন আমাকে বলে, তাদের এই অবসাদের কারন তাদের মনে বড় কষ্ট।

এমন কোন বাঙালি পরিবার খুঁজে পাওয়া যাবে না, যারা তাঁদের পরিবারের কোন নাম কোন সদস্যকে হারায় নি…

ছোট ও জীর্ণ গ্রামগুলোতে গেলে, লোকজন আমাদের পাক সেনাবাহিনীর বর্বরতার দিনলিপি বলতে লাগল। একটি ছোট গ্রামের প্রায় সকলেই একটি ১৪ বছরের মেয়ের কথা জানে, যাকে ১২ জন পাক সেনা উপর্যুপুরি ধর্ষন করে এবং পরে তার একদিন বয়সী বাচ্চাসহ হত্যা করে। পাশের আরেকটি গ্রামের অধিবাসীরা জানায় যে দুইজন সৈনিকে কুমারী মেয়ে দাবী করছিলো। গ্রামবাসী তাঁদের পাকড়াও করে মার্শাল ল’ এডোমিনিস্ট্রেটরের হাতে তুলে দেয়। ঠিক এর পরদিনই পাক সেনাবাহিনী পুরো গ্রাম জ্বালিয়ে দেয় এবং ৩৮ জন মানুষ হত্যা করে।

পাক সেনাবাহিনী দোকানসহ যা ইচ্ছা তাই লুট করত। তবে বাঙ্গালিদের মতে, পাক বাহিনীর এই অত্যাচারই তাদের স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের পিছের প্রেরণা। সব জায়গায় মুক্তিযোদ্ধাদের গুণগাণ শোনা যেতে লাগল। শোনা গেল এই অত্যাচারের বিচারের আসছে।

একবার নদী পার হবার সময় দেখলাম, একজন আর্মি সার্জেন্ট বড় একটা লাঠি দিয়ে এক বাঙ্গালিকে পিটাচ্ছে। আমাকে দেখে সে থেমে যায়। পরে আমার সাথে থাকা বাঙালিটি আমাকে বলে, “এটা প্রায় রোজকার ঘটনা। কিন্ত যখন প্রতিশোধের দিন আসবে, তখন তা হবে খুবই ভয়াবহ।“

নিটোল চন্দ্র দাশ
<৮,৮৭.১৪,৫৩৭>
দা ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস
ডিসেম্বর ২০, ১৯৭১

ডাক্তার, সাংবাদিক, লেখক ও অধ্যাপকদের মৃতদেহ গর্ত খুঁড়ে পুঁতে ফেলা হয়
-সিএস পণ্ডিতের ভাষ্য অনুযায়ী, অবরুদ্ধ ঢাকা, ডিসেম্বর ১৯, ১৯৭১
আত্মসমর্পনের এক সপ্তাহ আগে প্রায় ১২০ জনের মত দেশের শীর্ষ স্থানীয় ডাক্তার, লেখক, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবিকে হত্যা করা হয়। কারফিউ চলাকালীন সময়ে নারী পুরুষ নির্বিশেষে তাঁদের বাড়ি থেকে তুলে নেয়া হয়। তাঁদের সম্পর্কে কিছুই জানা যায় নি যতক্ষন না পর্যন্ত ৩৫ জনের লাশ পেছনে হাত বাধা অবস্থায় একটি ইটের ভাটায় পাওয়া যায়।

এই খবর দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ে। মৃতদের মধ্যে একজন ছিলেন ডাঃ ফজলে রাব্বি, ঢাকা মেডিকেল কলেজের একজন স্বনামধন্য হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ। আরো ছিলেন ডাঃ আলীম চৌধুরী, চক্ষু বিশেষজ্ঞ; জনাব নিজামুদ্দিন, বিবিসির সংবাদদাতা এবং পাকিস্তানের ২ টি সংবাদ এজেন্সির একটি, পাকিস্তান প্রেস ইন্টারন্যাশনালের প্রতিনিধি; মোঃ শহীদুল্লাহ কায়সার, বিখ্যাত লেখক এবং একটি পত্রিকার যুগ্ম সম্পাদক; মিসেস আখতার ইমাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর একটি মহিলা হলের প্রভোস্ট; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী। ডঃ সন্তোষ ভট্টাচার্য, ইতিহাসের অধ্যাপক; জনাব সিরাজ উদ্দিন, দৈনিক ইত্তেফাক এর সম্পাদক সহ আরো অনেক।

নিটোল চন্দ্র দাশ
<৮,৮৭.১৫,৫৩৮>
অমৃতবাজার পত্রিকা
ডিসেম্বর ২০, ১৯৭১

আত্মসমর্পনের পূর্বে বুদ্ধিজীবি হত্যা ছিল পূর্বের পরিকল্পনা
(ঢাকা সচিবালয় থেকে অরুণ ভট্টাচার্যের ভাষ্যমতে, ডিসেম্বর ১৯, ১৯৭১)

জনাব রুহুল কুদ্দুস, বাংলাদেশ সরকারের মহাসচিব, আত্মসমর্পনের পূর্বে এইরকম বুদ্ধিজীবি নিধনের জন্য পাকিস্তানি জেনারেলদের তীব্র ভাষায় নিন্দা জানান।

জনাব রুহুল কুদ্দুস কান্নায় ভেঙে পরে জানান, বাংলাদেশকে পঙ্গু করে দেয়ার জন্য দেশের সেরা ডাক্তার, অধ্যাপক, প্রশাসক এবং বুদ্ধীজীবিদের হত্যা করা হয়। তিনি বলেন, যখন আমি এই ঘটনার জন্য পাকিস্তানি আর্মি জেনারেল রাও ফরমান আলী ও তার সদস্যদের দিকে আংগুল তুলি, তখন তারা বলে, এই কাজ আধা সামরিক ফোর্স ও রাজাকারেরা করেছে। “কিন্ত আমি জানি, মূল পরিকল্পনা করা হয়েছিল ঢাকা সেনানিবাসে। এই জেনারেলদের সুস্পষ্ট নির্দেশে আধা সামরিক বাহিনীর সদস্যরা বন্দিদের ক্যান্টনমেন্টের ভেতরেই হত্যা করত। “

নিটোল চন্দ্র দাশ
<৮,৮৭.১৬,৫৩৮-৩৯>
দা টাইমস, লন্ডন
ডিসেম্বর ৩০, ১৯৭১

আত্মসমর্পনের পূর্বেই বুদ্ধিজীবিদের হত্যা করা হয়
-পিটার হেজেলহার্টস
কেউই জানে না, কোন প্রকার সক্রিয় রাজনীতির সাথে না থাকা ঠিক কতজন বুদ্ধিজীবি, ডাক্তার, সাংবাদিক এবং যুবককে চিরদিনের জন্য গুম করা হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আনোয়ার পাশার স্ত্রী মিসেস মহসিনা পাশা তাঁর স্বামীকে খোঁজার জন্য সম্প্রতি একের পর এক গণকবরে যান। সেখানে অনেক বুদ্ধিজীবির লাশ পাওয়া যায়।

অনেকের মতোই ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে আত্মসমর্পনের মাত্র দুই দিন আগে প্রফেসর পাশাকে গ্রেফতার করা হয় এবং রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়।

সেই একই সকালে, দুজন সহকর্মী জনাব রাশিদুল হাসান, ইংরেজী বিভাগের লেকচারার এবং প্রফেসর সন্তোষ ভট্টাচার্য, ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপককে একই রাজাকার গ্রুপের সশস্ত্র সদস্যরা তুলে নেয়।

পাকিস্তানি প্রিজনার-অব-ওয়ার জানায় যে তাঁরা এই বিষয়ে কিছুই জানত না। কিন্ত প্রমাণ পাওয়া যায় যে একজন সিনিয়র অফিসারের সরাসরি নির্দেশেই রাজাকারেরা এই কাজ চালায়।

মোঃ নিজামউদ্দিন নামের একজনের নাম তাঁর ডেস্কে পাওয়া যায়। পাশে একটি মন্তব্য লেখা ছিল, “অনুপ্রাণিত করা বক্তব্য”। তাঁর নামটিকে টিক চিহ্ন দেখা হয়েছিল।

এই অভিযানের একমাত্র বেঁচে যাওয়া ব্যাক্তি, জনাব দেলোয়ার হোসেন, গ্রীনল্যান্ড মার্কেন্টাইল কোম্পানির প্রধান হিসাবরক্ষক জানান যে, ডিসেম্বরের ১৪ তারিখে একদল রাজাকার তাঁকে তাঁর বাসা থেকে তাকে টেনে হিচড়ে নিচে নামায় এবং একটি বাসে করে কালো কাপড়ে চোখ বেধে ঢাকার শহরতলীর এক রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে যায়।

পরে তাকে একটি রুমে ঢোকানো হয়। কিছুক্ষন পর তার চোখের কাপড়টি খোলা হয়। তিনি দেখতে পান তার সাথে আরো অনেক বন্দি রয়েছেন। যাদের অনেককে টর্চার করা হয়েছে, অনেকের হাত ও পায়ের নখ উপড়ে ফেলা হয়েছে।

এক ঘন্টা পরে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করা হয়। বন্দিদের বেশিরভাগ ছিলেন ডাক্তার, সাংবাদিক, আইনজীবি ও শিক্ষক। পরে তাদের বাসে করে ঢাকার পাশের একটা জলাভূমিতে নিয়ে আসা হয়।

রাজাকারেরা একটি বড় গাছের নিচে বন্দিদের একত্রিত করে, যেখানে প্রায় ১৩০ জনের মত লোক ছিল। কয়েকজন বন্দি তাদের জিজ্ঞেস করে, কেন তাদের হত্যা করা হচ্ছে। একজন রাজাকার তাদের চুপ করতে বলে এবং আদেশ দেয়, “এই বেজন্মাদের শেষ করে দাও!”
জনাব হুসাইন বলেন, “তারা রাইফেল দিয়ে বন্দিদের উপর গুলি করা শুরু করে, এবং বাকিদের বেয়নেট দিয়ে খুচিয়ে হত্যা করা হয়। আমি কোনমতে আমার হাতের বাধন খুলতে সক্ষম হই এবং নদীর দিকে দৌড় দিয়ে অলৌকিকভাবে বেঁচে যাই।

<৮,৮৮,৫৪১-৪৪>
[বাংলাদেশে শরণার্থী, গণহত্যা ও নির্যাতন প্রসঙ্গে ভারতীয় পত্র-পত্রিকায় প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ]

যুগান্তর
৩ এপ্রিল, ১৯৭১

এখান থেকে এরা কোন ভবিষ্যতে পাড়ি দেবে?

ইছামতীর তীরে সারি সারি নৌকা নোঙ্গর করেছে অনেক দিন হলো। কিন্তু ঐসব নৌকোর মধ্যে যারা রয়েছে তারা যে এরপর কোথায় পাড়ি দেবে তা তারা জানে না। অন্য কেউই কি জানে?

ঐ নৌকোগুলি করেই তারা পূর্ব বাংলা ছেড়ে এসেছে। ভিটে-মাটি, যা সামান্য সম্পত্তি ছিল তা ফেলে রেখে রাতের অন্ধকারে ওরা জন্মভূমি ছেড়েছে। পেছনে খান সেনা আর তাদের সাগরেদদের অত্যাচারের স্মৃতি, সামনে অজানা ভবিষ্যত। ভারতের তীরে এসে যখন নৌকো ভীড়লো তখন নিশ্চয়ই পায়ের তলায় শক্ত মাটি পাওয়ার আশায় ওদের বুকটা দুলে উঠেছিলো। কিন্তু শক্ত মাটি জুটলো কই? এখনও বেশ কিছু বৃদ্ধ প্রৌঢ়, যুবক, নারী ও শিশুর জীবন দিনরাত ইছামতির দোলায় দুলছে। নৌকোর মধ্যেই তাদের সংসার রান্না-খাওয়া-শোয়া। নদীর জলে স্নান। আর নদীর ধারেই স্বাস্থ্যরক্ষার সব নিয়ম-কানুন তুচ্ছ করে মলমূত্র ত্যাগ।

হাসনাবাদের মাটিতে তারা নামছে, কিন্তু সেখানে বা অদূরে টাকীর শিবিরে ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই। নতুন করে আর রেজিস্ট্রেশন হচ্ছে না।

আমরা সবে হাসনাবাদে নেমেছি, দেখি তীর থেকে বোঝা-মাথায় মানুষের সারি এগিয়ে আসছে। ওরা শুনেছে বারাসতে নাকি নতুন রেজিস্ট্রেশন হচ্ছে। সেখানে যাবে।

-হাঁটবে অতদূর?

-আর কী করা বাবু? নৌকোয় আর কদ্দিন কাটে? ছিলো সের পাঁচেক চাল। তাই এক বেলা করে খেয়ে পাঁচ সাত দিন চলছে। শুনছি ক্যাম্পে নাকি চাল-ডাল দিতে আছে।

-ঠিক জানো তো যে বারাসতে গেলে জায়গা পাবে?

-তা ঠিক জানি না। যাই, দেখি ঘুরে গদি না পাই তবে না খেয়েই মরবো। মরণ যদি কপালে থাকে এ পাড়েই মরবো।

সবাই যে হাঁটা পথ নিয়েছে তা নয়। যারা খোঁজখবর রাখে তারা কাছে রেল স্টেশন থেকে হাসনাবাদ-বারাসত ট্রেনে চেপে বসেছে। ফলে ট্রেনে ভীড় খুব। স্থানীয় লোকের যাতায়াতে অসুবিধে। কিন্তু সেও তো অজানার উদ্দেশ্যেই পাড়ি। কারণ এতদিন পায়ের নিচে মাটি না থাকা মাথার ওপরে নৌকোর ছই ছিলো। যাওয়ার আগে নৌকোগুলো ওরা জলের দরে স্থানীয় লোকের কাছে বিক্রি করে দিয়ে যাচ্ছে। ইংরেজী জানলে ওরা বলতে পারতো, “উই হ্যাভ বার্ন্ট আওয়ার বোটস”। বারাসাতে বা অন্য কোথাও ঠাঁই না পেলে ফিরে আসার জায়গা সত্যিই ওদের নেই।

তবু এক হিসেবে ওদের ভাগ্যবান বলে মনে করতে পারা যাবে বৈকি? দারুণ দূর্যোগের সময় ওরা একটা আড়ালে থাকতে পেরেছিলো। ছইয়ের ওপর মাদুর, চাদর, কোথাও বা রঙিন লেপ দিয়ে ছিদ্র ঢাকার ব্যবস্থা করেছিলো। কিন্তু আরো এগিয়ে এসে টাকী বাস স্ট্যান্ডের কাছে যাদের দেখা পেলাম তাদের মাথার ওপর ছাউনী বলতে গাছের ডাল।

ওখানে কতকগুলি পরিবার গাছতলায় দিন আষ্টেক ধরে রয়েছে। বর্ষার মধ্যেও ঐ ভাবেই কেটেছে। জলে গা ভিজেছে, যা সামান্য জামা-কাপড় আছে তাও ভিজেছে, মাদুর-চাদরো ভিজেছে। কাপড় আবার গায়েই শুকোচ্ছে। চাদর বা তোষক এ ক’দিনের মধ্যে আর শুকোয়নি। তার ওপরেই শুতে হচ্ছে, কারণ মাটি তো আরো ভিজে কাদা-কাদা। সবচেয়ে কষ্ট তো বাচ্চাগুলোর। ওখানেই তিনটের খুব জ্বর।

আমরা এগোতেই পরিবৃত হয়ে গেলাম। আমরা কি সরকার থেকে আসছি? ওদের যে এখনও টিকেট হয়নি। টিকেট না হলে তো ডোলও পাবে না। অথচ মেডিকেল হয়ে গেছে। কলেরার ইঞ্জেকশন আর বসন্তের টিকা, দুই-ই। সঙ্গে রয়েছে সেই কাগজ। কিন্তু টাকীর কোন ক্যাম্পেই তো আর নতুন লোক নেওয়া হচ্ছে না।

-আমাদের একটা টিকিট করায়ে দ্যান বাবু। অন্ততঃ কয়েকদিন চালডাল দ্যান। তারপর যেখানে পাঠাইবেন সেখানেই যাবো।

টিকিট করিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা থাকলে তখুনিই দিতাম বৈকি। ওরা ক’দিন চালডাল পেলে তার পরেই যদি অন্য কোথাও চালান হতে চায়, সেও তো খুব ভালো কথা। গাছতলা ছেড়ে, পশ্চিম বাংলার বাইরে যে কোন মাথা গোঁজবার ঠাঁইই ওদের কাছে প্রিয়তর। যখন পূর্ব বাংলার ভিটে ছাড়তে পেরেছে, তখন পশ্চিম বাংলার গাছতলাটার জন্যেই বা মায়া কিসের?

কিন্তু দেশে ফিরবে না?

না, দেশে আর ফিরবে না। কোথায় ফিরবে? যা কিছু ছিলো লুটে নিয়েছে। যখন লুটে নিলো তার পরেও তো ছিলো কিছু দিন। লুটপাটে বাধা দিতে গিয়ে মার খেয়েছে। হারাধন মন্ডলের হাঁটুতে আর কোমরের কাছে এখনও বল্লমের খোঁচার দাগ। তবুও ছিলো। কিন্তু যখন ঘরে আগুন দিলে, মেয়েদের ধরে টানতে লাগলো, ছেলেদের কাটতে লাগলো, তখনও কি আর থাকা চলে?

কিন্তু যদি আওয়ামী লীগ সরকার করে তা হলেও ফিরবে না? তা হলে ফেরা যায়, কিন্তু এখন কোথায় আওয়ামী লীগ বাবু? এখন তো সবাই মুসলিম লীগ।

আরো খানিক এগিয়ে বাঁ দিকে সৈন্যের বাগান ক্যাম্প। সামনে মারোয়াড়ি রিলিফ সোসাইটির নিশান।

এই ক্যাম্পে প্রায় সাতাশ হাজার নারী-পুরুষ-শিশু। হিন্দু-মুসলমান-খৃষ্টান। খৃষ্টান পরিবার গোটা চারেক। মুসলমান পরিবার আটশ’র বেশি। ওরা থাকে ওধারে। এদিকে হিন্দুরা। বর্ণ হিন্দু নেই বললেই চলে। বেশির ভাগ খুলনা জেলার। বেশির ভাগই চাষবাস করতো। একজন বললে, তার জমি ছিলো ৬২ বিঘে। এখন সঙ্গে আসছে শুধু খাজনার রশীদ। দলিলটা সঙ্গে করে আনতে পারে নি। তবে রশীদটা রেখেছে। যদি কখনও ফেরে তবে দাবি করতে পারবে জমিটা এইরকম আশা এখনও বুকের ভেতরে।

এখানে মাথাপিছু বরাদ্দ ৪০০ গ্রাম চাল, ১০০ গ্রাম ডাল আর ১০০ গ্রাম আলু-পেঁয়াজ। ছ’দিনের রেশন এক সঙ্গে বিতরণ করে মারোয়াড়ি রিলিফ সোসাইটি।

মাঝে একটা বড় পুকুর। আর গোটা নয়েক নলকূপ। সরকারী কর্মচারীদের ওপর চাপ খুব, কিন্তু এখনও ঐ শিবিরে কোন বড় রকমের রোগ দেখা দেয়নি, এই যা রক্ষা। এই ক্যাম্পের জমিটাও একটু উঁচু। ফলে জল দাঁড়াতে পায় না। তবে স্বাস্থ্যরক্ষার বন্দোবস্ত এমন নয় যে খুব নিশ্চিন্তে থাকা যায়। বিশেষতঃ বর্ষা বাড়লে।

যারা শিবিরে ঠাঁই পায়নি তাদের দেখে আসার পর মনে হতে পারে এখানে এরা যেন সুখে আছে। মাথার ওপর ত্রিপল, রোদ, খাবারের বাঁধা বরাদ্দ। তবে জ্বালানির অভাব। তাই খিচুড়ি ফুটিয়ে নেওয়াই রেওয়াজ। শিবিরে প্রথম দিনটি অবশ্য অনেকের কাছে বিপদের। অনেকটা পথ অর্ধাহারে-অনাহারে হেঁটে এসে অনেকেই প্রথমে লোভের বশে অনেকটা খেয়ে ফেলে। পেট এই অনিয়ম সহ্য করতে পারে না।

সরকারী কর্মীরা যথেষ্ট করেছেন, তবু সমস্যা থেকেই যায়। পরাণ মন্ডলের রেশন কার্ড হারিয়ে গেছে। মাথা খুঁড়লেও কি আর খুঁজে পাবে? সরকারী কেরাণী বাবুর পা ধরে পড়েছে, বাবু আমায় আর একটা কার্ড করায়ে দ্যান।

পরাণের কান্নার সঙ্গে অফিসের ঠিক বাইরে এক বুড়ির কান্নার অবশ্য অনেক তফাৎ। তার বিশেষ জ্ঞান আছে বলে মনে হলো না। একবার করে বড় নিঃশ্বাস নিচ্ছে। আর ডুকরে কেঁদে উঠছে। চোখ দু’টো প্রায় ঠেলে বেরিয়ে আসে আর কি। বুড়িকে ঘিরে ক্যাম্পেরই কতো লোক ভীড় করেছে। বুড়ী পূর্ব বাংলা থেকে এসেছে কাছাকাছি কোথায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে। ওরা ওকে ক্যাম্পে দিয়ে চলে গেছে। বুড়িকে দেখার কেউ নেই। ওখানেই শুচ্ছে, ওখানেই যা পারে খাচ্ছে এবং মলমূত্র ত্যাগ করছে। ক্যাম্পের ভারপ্রাপ্ত অফিসার একটা হতাশা সূচক আওয়াজ করে বললেন, একে নিয়ে কি করি বলুন তো?

বুড়ির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে দেখি ওদিকে কিছু ছেলে পান বেচছে। স্থানীয় ছেলে নাকি? না, ক্যাম্পেরই ছেলে। বাজার থেকে কিছু পান, চুন, সুপারি কিনে ঝুড়ি নিয়ে বসে গেছে। কত বিক্রি হয়? সামান্য। আজ তো মাত্র পনেরো পয়সা ব্যাচলাম।

পানওয়ালা ছেলেটা হেসে উঠেছিলো। কেমন যেন নিরুদ্বেগের হাসি। ক্যাম্পের সকলের মুখে অবশ্য সেই নিরুদ্বেগ নেই। প্রধান প্রশ্ন, এরপর কি? প্রায় সকলেই ঠিক করে ফেলেছে, দেশে ফেরা আর নয়। জানি না, সরকার এদের কি করে দেশে ফেরাবেন। সেটাও তো বোধহয় পরের প্রশ্ন। ক্যাম্পে অনেকেরই ভাবনা, এরপর সরকার কোথায় পাঠাবেন? কিছু কিছু লোক যে বাংলার বাইরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তা ওরা শুনেছে। ‘তবে যেখানেই পাঠান বাবু ভারতের মধ্যে যেখানেই পাঠান যাবো। সরকার আমাদের জন্য এত করছেন, খেতে দিচ্ছেন, পরতে দিচ্ছেন, আমরা কথা শুনবো বৈকি।’

ক্যাম্পের বাইরে ছোটখাটো জটলা। ক্যাম্পে জায়গার খোঁজে অনেকে এসেছে। কিছু লোক বারাসতের পথে থেমেছে। শুনছি, এই ক্যাম্প থেকে নাকি কাল আরো টিকিট দেবে? আরে না, না, ওসব বাজে কথা। এখানে নতুন লোক নেওয়া বন্ধ। চল, চল, বারাসতেই শেষ চেষ্টা।

ওরা যাবে অবশ্যই, ক’জন বারাসত পৌঁছবে জানি না। পৌঁছলেও হয়ত শিবিরে জায়গা পাবে না। অনেকে তার আগেই এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়বে। কোন পরিত্যক্ত বাড়িতে, অথবা কোনো বাড়ির দাওয়ায় আশ্রয়। কিম্বা হয়ত গাছতলায়। তারপর পথশ্রম বা রোগে মৃত্যু। অথবা কোন অসৎসঙ্গে পড়তেই বা বাধা কোথায়?

ফেরার পথে বারাসতে রাস্তার দু’ধারে এমন অনেককেই দেখলাম। দু’একটা স্কুল-বাড়িও এখন বেসরকারী শিবির। অসংখ্য লোক, হৈ চৈ। নোংরা হয়ে উঠছে চারদিক। এদের জন্যে কোথায় কি ব্যবস্থা?

হাসনাবাদ থেকে যারা শেষ আশায় বুক বেঁধে হাঁটতে শুরু করেছে তাদের গন্তব্যের শেষ হবে কোথায়?

-দেবব্রত মুখোপাধ্যায়

মোঃ; রাশেদ হাসান (নোবেল)
<৮,৮৮,৫৪৫-৫৪৬>
হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড
১২ এপ্রিল, ১৯৭১

বাস্তুহারাদের মুখে আর্মি বর্বরতার কাহিনী
নারায়ণ দাশ
হরিদাশপুর সীমান্ত চেকপোস্ট, এপ্রিল, ১৯৭১।

রবিবার সকালে পাকিস্তানী বাহিনী ঝিকরগাছা থেকে আরও সামনে অগ্রসর হয়েছে, পথে তারা যশোর রোডের দু ধারে শতশত ভীতসন্ত্রস্ত গ্রামবাসীকে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করেছে। রিফিউজিরা পেট্রাপোল রিসিপশন সেন্টারে আশ্রয় নিয়েছে, যা তাদের জন্য কিছুদিন আগে রাজ্যসরকার খুলে দিয়েছে। পাকিস্তানী বাহিনী মুক্তিবাহিনীর কাছে শক্ত প্রতিরোধের মুখে পড়ার পর অসংখ্য গ্রামের ঘরবাড়ীতে আগুন লাগিয়ে দেয় এবং প্রচুর মানুষ হত্যা করে। কিছু স্থানে তারা বন্দুকের মুখে মানুষকে বাধ্য করে তাদের দোকান খোলার জন্য এবং পাকিস্তানী পতাকা ওড়ানোর জন্য।

মুক্তি ফৌজের কিছু সদস্যের সাথে যশোর রোড ধরে হেটে যাবার সময় আমি দেখলাম, অনেক লোক তাদের সহায়সম্বলসহ হরিদাশপুর সীমান্তের দিকে আসছে। কিছু বাড়ীতে, মানুষদের গোছগাছ করতে দেখলাম নিরাপদ আশ্রয়ের উদ্দেশ্যে রওনা হবার জন্য। হরিদাশপুরের দিকে ফিরে আসার সময় বেনাপোলের বধ্য-বয়স্ক তোরাব আলী বললেন- ‘পৈতৃক বাড়ী ছেড়ে যাওয়া কতটা কষ্টের, আপনি কি তা চিন্তা করতে পারেন?’ এরপরেও তোরাব আলীর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে বাংলাদেশ একদিন স্বাধীন হবে এবং তারা আবার তাঁদের ঘরে ফিরবে।

প্রায় ৫ হাজারের অধিক মানুষ নবারন, ঝিকরগাছা, শারশা, বেনাপোল এবং যশোর শহর থেকে এসেছিল। তাঁদের আশ্রয় দেওয়া হয় পেট্রাপোল ক্যাম্প এবং অন্য একটি ক্যাম্পকে। সেটা ছিল বগুরা বর্ডারের কাছে। মামা ভাগনে গ্রামে। বেশীরভাগ গ্রাম ধ্বংস হয়েছিল। শুধু রবিবারেই তিনশত পঞ্চাশের অধিক পরিবার সীমান্ত অতিক্রম করে।

পাকিস্তানী বাহিনীর বর্বরতার কাহিনী বলতে গিয়ে এসকল গ্রামের একটির বাসিন্দা জনাবা হোসনে আরা এই রিপোর্টারকে বলেন যে- পাকিস্তানী বাহিনী তাঁদের গ্রামের প্রতিটি ঘরে প্রবেশ করে এবং তাঁদের ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ স্লোগান দিতে বলে। যদি কেউ স্লোগান দিতে দ্বিধা করে, তাঁকে তৎক্ষণাৎ গুলি করে হত্যা করা হয়। তারা মানুষের সহায়সম্বল লুট করে, মেয়েদের গায়ের গহনা ছিনিয়ে নেয় এবং পরে তাঁদের হত্যা করে। তিনি নিজেকে কিভাবে বাঁচালেন আমার এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন- ‘ যখন পাক আর্মি আমাদের গ্রামের দিকে ধেয়ে আসছিল আমি আমার ৩ বছরের বাচ্চাকে বুকে নিয়ে প্রাণপণ ছুটতে থাকি এবং একটা ঝোপের আড়ালে আশ্রয় নেই, আমি সেখানেই রাত কাটাই এবং পরদিন মুক্তি ফৌজের দেওয়া বাহনে করে বেনাপোলে আমার এক আত্মীয়ের বাসায় চলে আসি। চার দিন পর আমি সীমান্ত অতিক্রম করি। আমি জানি না আমার স্বামীর কি হয়েছে যে কিনা ঐদিন সন্ধ্যায় স্থানীয় হাটে গিয়েছিলেন।’ এই বলে তিনি কান্নায় ভেঙে পরেন।

৬০ বছরের বৃদ্ধ যশোরের হারমত আলী মণ্ডল তার ৩ ছেলেকে হারিয়েছিলেন। তিনি আমার সাথে কোন কথাই বলতে পারেন নি। কারণ তিনি কান্না থামাতে পারছিলেন না। কিছু মানুষ তাঁকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন।

রিলিফের পদক্ষেপ

এদিকে রাজ্য সরকার, বয়রা ক্যাম্পের অসহায় নিঃস্ব মানুষদের সাহায্যের জন্য ব্যাপক ব্যবস্থা করে। ভারত ‘সেবাশ্রম সংঘ’ অসহায় উদ্বাস্তু মানুষদের খাদ্য এবং অন্যান্য রিলিফ প্রদানের মাধ্যমে। প্রশংসনীয়ভাবে সেবা দিয়ে যাচ্ছে । সংঘের একজন স্বামীজী এই রিপোর্টারকে বললেন যে, অসুস্থদের সেবা করার জন্য দুই জন ডাক্তার দিয়ে তাঁরা ক্যাম্পে একটি মেডিক্যাল ইউনিট খুলেছেন। সংঘের দুই ডজনের অধিক ভলান্টিয়ার দিন রাত কাজ করছে রিলিফ অরগানাইজের জন্য।
ক্যাম্পের বেশীরভাগ মানুষকে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে। যথাযথ পয়ঃনিষ্কাশনের ব্যবস্থাও করা হয়েছে।

অফিসিয়াল সূত্র অনুযায়ী, গত দুদিন ধরে রাজশাহী সীমান্ত অঞ্চল দিয়ে আতঙ্কিত মানুষদের ঢলের খবর পাওয়া যাচ্ছে। যদিও বাস্তুহারা মানুষের সঠিক সংখ্যা বলা সম্ভব নয় তথাপি স্থানীয়দের মতে রবিবারে খুব সম্ভব ৬ হাজার মানুষ সীমান্ত পার করে পূর্ব বাংলার মুর্শিদাবাদের অন্তর্গত রাণিনগর, ভগবানগোলা এবং জলাঙ্গি থানায় চলে এসেছে।

মোঃ; রাশেদ হাসান (নোবেল)
<৮,৮৮,৫৪৬>
অমৃত বাজার পত্রিকা
৩০ এপ্রিল, ১৯৭১

ভারত যাবার পথে ৯০০ শরণার্থী নিহত
কুচবিহার, ২৮ এপ্রিল, প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে সংবাদ সংস্থা পিটিআই জানাচ্ছে প্রায় ৯০০ লোক যারা ট্রেকিং( পায়ে হেটে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়া) করে ইন্ডিয়ার দিকে যাচ্ছিল তাঁদের পাকিস্তানী আর্মি নির্মম ভাবে হত্যা করেছে।

ছয় জন রিফিউজি, একাধিক বুলেটের ক্ষত নিয়ে বাংলাদেশের ডোমার পুলিস স্টেশন থেকে আজ হলদিবাড়ী এসে উপস্থিত হয়েছে এবং এখন হাসপাতালে আছেন। তারা বলেছেন যে তাঁরাও ঐ আক্রান্তদের মাঝে ছিলেন যাদের পাকিস্তানী আর্মি গুলি করেছে কিন্তু কোন মতে বেঁচে পালিয়ে আসতে পেরেছেন।

তারা বলেন- একই এলাকার প্রায় ৮ হাজার মানুষ যখন ইন্ডিয়ার দিকে আসছিল তারা পাকিস্তানী আর্মির বাঁধার মুখে পড়ে এবং আর্মিরা তাঁদেরকে ক্যাম্পে যেতে বাধ্য করে। পাকবাহিনী এরপর সবল দেহের পুরুষদের গ্রুপ থেকে আলাদা করে লাইনে দাঁড়াতে বাধ্য করে এবং তারপর ব্রাশ ফায়ার করে। ভীতসন্ত্রস্ত বাকিরা আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে পড়িমরি করে ছুটতে থাকে।

আমাদের দিনহাটা প্রতিনিধি যোগকরেন- কুচবিহার রাজ্যের অন্তর্গত দিনহাটার বনশপচাই ছিটমহলের লুটতরাজসহ বিভিন্ন রিপোর্ট এখন পাওয়া যাচ্ছে। সেখানে দুই দিনের অনুপ্রবেশকালে পাকবাহিনীর এলোপাথাড়ি গুলি বর্ষণে প্রায় ১৫০ জন মানুষ মারা যায় এবং সব ঘরবাড়ী ধ্বংস হয়। এই ছিটমহলে প্রায় ৩০০ মানুষের বাস ছিল। বেঁচে যাওয়া বাকীরা দিনহাটা সীমান্ত হয়ে ইন্ডিয়াতে চলে আসে।

পাকবাহিনী আজ সকাল ১০টার সময় ইন্ডিয়ান ছিটমহলের পাশ্ববর্তী ধীরখাতা এবং শিবেরকুঠি গ্রামে প্রবেশ করে অনেক সাধারণ মানুষকে গুলি করে হত্যা করে। দিনহাটা হাসপাতালে বুলেটের ক্ষত নিয়ে আসা কিছু মানুষকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।

মোঃ; রাশেদ হাসান (নোবেল)
<৮,৮৮,৫৪৭-৪৮>
যুগান্তর
৯ মে, ১৯৭১
শরণার্থী আগমন অব্যাহত: সমস্যা বাড়ছে
কলকাতা, ৬ মে – হলদিবাড়ি শহরে বাংলাদেশ থেকে অসংখ্য শরণার্থী আসতে থাকায় এক গুরুতর সমস্যা দেখা দিয়েছে। জেলা কর্তৃপক্ষ বিষয়টি সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গ সরকার কে অবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণের অনূর্ধ্ব জানিয়ে বলেছেন, দৈনিক গড়ে ১২ হাজার মানুষ হলদিবাড়ি আসছেন। জেলা কর্তৃপক্ষ আরও বলেছেন, শহর ও সীমান্ত পরিদর্শন করে দেখা গিয়েছে বুধবার প্রায় বারো হাজার শরণার্থী এসেছেন এবং সীমান্তের ওপারে আরও বাইশ হাজার মানুষ এপাড়ে আসার জন্য অপেক্ষা করছেন।

কুচবিহার জেলার ছোট শহর হলদিবাড়িতে এ পর্যন্ত দেড় লক্ষেরও বেশী শরণার্থী এসেছেন। বিভিন্ন বিদ্যালয় কিংবা খালি বাড়ীতে প্রথম দিকে এঁদের স্থান দেওয়া হয়েছিল, এখন তাও পাওয়া যাচ্ছে না। বহু শরণার্থীকে আকাশের তলায় রাত কাটাতে হচ্ছে। এই অসহনীয় অবস্থার প্রতীকারের জন্য জেলা কর্তৃপক্ষ রাজ্য সরকারের কাছে তাঁবু এবং ওষুধপত্র চেয়েছেন।

কোচবিহারে সোয়া লক্ষ শরণার্থী

কোচবিহার থেকে প্রতিনিধি হরিপদ মুখার্জি জানাচ্ছেন, বাংলাদেশ থেকে শরণার্থীরা প্রতিদিনই কোচবিহার জেলাতে যথেষ্ট সংখ্যায় আসছে। এ পর্যন্ত কোচবিহার জেলায় বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে সোয়া লক্ষ শরণার্থী এই জেলায় আশ্রয় নিয়েছে। এই জেলার কয়েকটি শিবির ঘুরে দেখলাম, এখনও অনেক সরকারী শিবির দরকার।

সরকারী ব্যবস্থাপনায় ইতিমধ্যে ৩৫টি শিবির প্রায় পঞ্চাশ হাজার শরণার্থীকে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই গ্রামাঞ্চলের স্কুল-বাড়িগুলোই অস্থায়ী শিবিরে পরিণত হয়েছে, তারপরেও আরও বহু মানুষ রাস্তার পাশে অথবা খোলা মাঠে নিজেদের শতরঞ্জি, চাদর দিয়ে ছাউনি করে কোন মতে মাথা গুঁজবার ঠাই করে নিয়েছে। সরকারী শিবিরে নাম উঠেনি বলে তাঁদের বাইরের সেবা প্রতিষ্ঠান গুলর খয়রাতী সাহায্যের উপর নির্ভর করে থাকতে হচ্ছে।

কোচবিহার জেলার হলদিবাড়ি ও দিনহাটা সীমান্ত দিয়েই বেশী পরিবার আসছে।

এক অভিন্ন বৈশিষ্ট্য

শরণার্থীদের যারা এপারের আশ্রয় শিবিরে এসে আশ্রয় নিয়েছে, তাঁদের মধ্যে এক অভিন্ন বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা গেছে। ধর্ম ও সম্প্রদায়ের কোন পার্থক্য নেই- এক পরিচয় ওরা সবাই বাঙ্গালী। পাশাপাশি একই শিবিরে দুই সম্প্রদায়ের লোক একত্রে রান্নাবাড়া করে খাচ্ছে। খোঁজ খবর নিচ্ছে। ওপারের আত্মীয়স্বজনের খবর বিনিময় করছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যারা লড়াই করছেন, ওদের প্রাত্যহিক খবর নেবার জন্য ওরা ব্যগ্র- কবে ঘরে ফিরে যাবে তারই প্রতীক্ষা করছে। তাই এই বাংলার আতিথেয়তায় তারা মুগ্ধ, সামান্য ত্রুটিগুলি তারা ধরছেন না।

মন্টুর কথা

শিলিগুড়ির নিজস্ব প্রতিনিধি লিখেছেন: আট বছরের তয়েব বাবা- মাকে হারিয়ে আজ ইসলামপুর স্কুলে ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে। পাক দস্যুরা গুলিতে তার বাবা ও মাকে হত্যা করেছে।

তয়েবের বাবা রফিক ঠাকুরগাঁ শহরে রিকশা চালাতো। সম্প্রতি পাক সৈন্য ঠাকুরগাঁ শহরে প্রবেশ করে এবং সামনে যাকে পায় তাকেই নির্বিচারে গুলী করে হত্যা করে। পাক সৈন্য আসার পূর্বে বেশীরভাগ লোক শহর ছেড়ে চলে যায়। যারা নিঃস্ব দরিদ্র একমাত্র তারাই শহরে ছিল। মনে করেছিল পাক সৈন্য তাদের কিছু ক্ষতি করবে না। কিন্তু বর্বর পাক সৈন্যের নিকট ধনী দরিদ্রের বিচার নেই।
রফিককে গুলী করে বর্বররা তয়েবের মার দিকে বন্দুক তাক করে। তাই দেখে তয়েব কেঁদে ওঠে এবং সঙ্গে সঙ্গে বন্দুকের গুলিতে তার মা মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এই দেখে তয়েব নদীর ঘাটের দিকে পালায়। সেখানে অনেক লোক নদী পার হয়ে ভারত সীমান্তের দিকে পালাচ্ছে। তয়েব তাদের সঙ্গে ভিড়ে পড়ে। তার জীবনের মর্মান্তিক ঘটনা সকলকে স্পর্শ করে। তারা তয়েবকে সঙ্গে নিয়ে প্রায় এক সপ্তাহ নানা গ্রাম ঘুরে ইসলামপুরে আসেন এবং ‘জয় বাংলা সংগ্রাম সংহতি’ কমিটি পরিচালিত ক্যাম্পে আশ্রয় পান। এখানে ছেলেরা তয়েবের নাম দিয়েছে মন্টু। মন্টুর হৃদয়বিদারক কাহিনী এখন ক্যাম্পের সকলের মুখে। মন্টুর ক্যাম্প-বাসী ও কর্মীদের বড় প্রিয়, বড় আপনজন হয়ে উঠেছে।

দেড় লক্ষ শরণার্থী

বাংলাদেশ থেকে ইসলামপুর মহকুমায় দেড় লক্ষের উপর উদ্বাস্তু আগমন হয়েছে। ‘জয় বাংলা সংগ্রাম সংহতি কমিটি’ অনেক উদ্বাস্তুকে বিনা মূল্যে রান্না করা খাদ্য সরবরাহ করেছেন।

এই ক্যাম্পের বেশীরভাগ লোক এসেছেন বাংলাদেশের ঠাকুরগাঁও অঞ্চল থেকে। এঁদের নিকট পাক বাহিনীর বহু অকথ্য অত্যাচারের কথা জানা গেল।

ত্রিপুরাতেই ৪ লক্ষ উদ্বাস্তু

আগরতলা, ৬ই মে- বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৪ লক্ষ উদ্বাস্তু সীমান্ত পেরিয়ে ত্রিপুরায় এসে হাজির হয়েছে। ত্রিপুরার নিজস্ব লোকসংখ্যা হল ১৫ লক্ষ। সাবরুম মহকুমায় এসেছে ১ লক্ষ ৩৭ হাজার উদ্বাস্তু। এই মহকুমার নিজস্ব লোকসংখ্যা হল মাত্র ৬০ হাজার। সরকারী সূত্রে এই খবর পাওয়া গেছে।

একটি বিবৃতিতে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী শ্রী শচিন্দ্রলাল সিংহ ত্রিপুরায় আগত উদ্বাস্তুদের সাহায্যে এগিয়ে আসার জন্য রাজ্য সরকারগুলিকে এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলির প্রতি আবেদন জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, উদ্বাস্তুদের জন্য কেন্দ্রের কাছ থেকে এখন পর্যন্ত কোনও সাহায্য পাওয়া যায়নি।

করিমগঞ্জ থেকে প্রাপ্ত রিপোর্টে প্রকাশ, প্রায় ৫০ হাজার উদ্বাস্তু গত এক মাসে সীমান্ত পেরিয়ে করিমগঞ্জে এসে হাজির হয়েছে। এঁদের মধ্যে ১৬ হাজার উদ্বাস্তুকে করিমগঞ্জ মহকুমার মোট ২৭টি শিবিরে বসবাসের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে। গড়ে প্রতিদিন প্রায় ৪ হাজার উদ্বাস্তু করিমগঞ্জ সীমান্তে এসে হাজির হচ্ছে।

করিমগঞ্জে বাংলাদেশ ত্রাণ কমিটির পক্ষ থেকে আসামের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে একটি স্মারকলিপি পেশ করে বলা হয়েছে যে, সীমান্তের অপার থেকে আগত উদ্বাস্তুদের সম্পর্কে উপযুক্ত খোঁজ খবর করার পর ভারতে বসবাসের অধিকার যেন দেওয়া হয়। অন্যথায় সমাজবিরোধীরা এই সুযোগে ভারতে এসে হাজির হতে পারে।

মোঃ; রাশেদ হাসান (নোবেল)
<৮,৮৮,৫৪৮-৫৫০>
ন্যাশনাল হেরাল্ড
২২ মে, ১৯৭১
আগরতলা হাসপাতালে গণহত্যার প্রমাণ
নয়া দিল্লি, ২০ মে- আগরতলার জেনারেল হাসপাতালকে নির্দোষ পূর্ব বাঙালিদের ওপর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অমানবিক নৃশংসতার একটি ছবি হিসেবে উপস্থাপন করা যায়- পূর্বাঞ্চলের সীমান্ত এলাকা ঘুরে আসার পর এমনটিই লিখেছেন একজন ইউএনআই সংবাদদাতা।

পূর্ববাংলার সীমান্ত থেকে মাত্র ৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই ২৬০ শয্যার হাসপাতালটিতে রোগীদের স্থান সংকুলান হচ্ছিলো না। যাদের বেশিরভাগই ছিল হিংস্র পাকবাহিনীর শিকার।

যখন ইন্ডিয়ান এবং বিদেশী সাংবাদিকদের একটি দল বুধবার হাসপাতালটি পরিদর্শনে আসে তখন এর প্রতিটি ওয়ার্ড রোগীতে কানায়-কানায় পূর্ণ ছিল। এখানে ৫৩০ জন রোগী আছেন, যা এর ধারণ ক্ষমতার দ্বিগুণেরও বেশী। রোগীরা ব্যবহারযোগ্য সকল জায়গা দখল করে নিয়েছিল। সার্জিক্যাল ওয়ার্ডের ভিড়টা ছিল চোখে পড়ার মত, সেখানে ছিল গুলিতে এবং শেলে আঘাত প্রাপ্ত রোগীরা।

হৃদয়স্পর্শী ঘটনাগুলোর মাঝে ছিল একটি ১৩ বছরের ছেলে এবং একটি ৯ বছরের মেয়ের ঘটনা। দুজনেই পাকিস্তানী শেলিং-এ চোখের দৃষ্টি হারিয়েছে। তাঁদের চিকিৎসায় নিয়োজিত ডাক্তার বলেন- তার যথাসাধ্য চেষ্টার পরেও চোখের দৃষ্টি শক্তি ফিরিয়ে দেয়া প্রায় অসম্ভব।

জনাব শামসুদ্দিন আহমেদ, একজন রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারের মাথাটি ছিল শক্ত করে ব্যান্ডেজে মোড়া। তার অফিসে ঢুকে পাকিস্তানী সৈন্যরা তাকে গুলি করেছিল। অবসর গ্রহণের দ্বারপ্রান্তে থাকা জনাব আহমেদ বলেন- তিনি ত্রিপুরা সীমান্তের কাছে আখাউড়া জংশনের রেল-রোড ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। গত মাসের এক বিকালে আর্মির লোকেরা তার অফিসে ঢুকে ফাইল পত্র ছুঁড়ে ফেলে দেয়। পরে তারা গুলি বর্ষণ করা শুরু করে। তিনি এবং তার সহকর্মীরা দৌড়ে পালান। কিন্তু পালানোর আগেই তিনি গুলিবিদ্ধ হন। এপ্রিলের ১৮ তারিখ তাঁর স্বজনেরা তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসেন।

আহমেদ সাহেব বলেন, তিনি কখনো কোন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত ছিলেন না। আবেগজড়িত ক্ষুব্ধ কণ্ঠে তিনি ১০ সদস্যের পরিবারের ভরণপোষণের জন্য কি করবেন তা নিয়ে চিন্তায় পরে যান। এক মুহূর্তের ভিতর তিনি একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেছেন। কারণ অফিস কম্পাউন্ডের সাথে থাকা তার ঘর এবং আসবাবপত্র পাক সৈন্যরা জ্বালিয়ে দিয়েছে। একমাত্র সান্ত্বনা ছিল এটুকুই যে তার পরিবার নিরাপদ ছিল। ঘটনার সময় তাঁরা গ্রামে ছিলেন। পরে তারা সীমান্ত অতিক্রম করে উদ্বাস্তুদের সাথে ঘর বাঁধেন।
গণহত্যা

হালিদ হুসাইন সাহেবকে (২৭) তীব্র মানসিক ধাক্কা এবং অবসাদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছিলো। তিনি ২৭ এপ্রিল চট্টগ্রাম ছেড়ে আসেন যখন আর্মি শহরের নিয়ন্ত্রণ নেয় এবং নির্বিচারে বাঙালি নিধন শুরু করে। তিনি রাজনীতিতে একেবারেই আগ্রহী ছিলেন না। কিন্তু নিজের লোকেদের হত্যাকাণ্ড দেখার পর তিনি মুক্তি ফৌজে যোগ দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

সুসজ্জিত দখলদার বাহিনীর কাছ থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেওয়া কি মুক্তি ফৌজের পক্ষে সম্ভব হবে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে হুসাইন সাহেব মনে করিয়ে দিলেন, শক্তিশালী ফ্রান্সের সাথে আলজেরিয়ান এবং তিউনিশিয়ান বাহিনীর যুদ্ধের কথা। তিনি বলেন- যদি এই দেশগুলো স্বাধীনতা জিতে নিতে পারে তবে মুক্তি ফৌজও পাকিস্তানী আর্মির কাছ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন করতে পারবে।

তিনি বলেন পাকিস্তানী আর্মির মূল লক্ষ এখন শুধু বাঙালি নিধন সে হিন্দু বা মুসলিম যেই হোক না কেন।

১৩ বছরের এক মুসলিম বালিকা জানালো, পাক আর্মি তার বাবা-মা সহ ১২ সদস্যের পরিবারকে ঘরে ঢুকতে বলে। পরে তারা সেই ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং চলে যায়। মেয়েটি অলৌকিক ভাবে পালাতে সক্ষম হয় কিন্তু তার পরিবারের অন্য সকল সদস্য মারা পড়েন। প্রতিবেশী একজন বৃদ্ধা তাকে উদ্ধার করেন এবং আগরতলা নিয়ে আসেন।

গুলিবর্ষণ

নারায়ণ পাল (১১) তার ঘরের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। তখন সে হাঁটুতে গুলিবিদ্ধ হয়। তার ভাই তাকে কুমিল্লা হসপিটালে নিয়ে যান। পরে তাকে আগরতলা হাসপাতালে নিয়া আসা হয়। তখন তার পুরো পরিবার ইন্ডিয়া চলে আসে। কুমিল্লায় তার স্কুলে ফিরে যাবে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে পাল বলে সে যাবে না। সে ক্লাস ফোরের ছাত্র।

আরেকজন শিক্ষার্থী সুবল কান্তি নাথ (১৭)। বুলেট তার হাতের হাড় ভেঙে দিয়েছে। সে তার ঘর থেকে দূরে পালিয়ে যাচ্ছিল যখন আর্মি ঘরে ঢুকে এলোপাথাড়ি চারিদিকে গুলি ছুড়তে থাকে। সে জানে না তার পরিবারের অন্য সদস্যদের কি হয়েছে। চট্টগ্রাম শহরে তার বাবার একটা মুদি দোকান আছে।

শফিউল্লাহ (৩০) বুক এবং তলপেটে বুলেটের ক্ষত নিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে আছেন। সৈন্যরা তার বাড়ীতে আগুন লাগিয়ে দেয় এবং পালানোর সময় তাকে গুলি করে। সে নোয়াখালি জেলার ফেনি শহর থেকে এসেছে। সে জানে না তার পরিবারের বাকি সদস্যদের ভাগ্যে কি ঘটেছে। এদের মধ্যে তার স্ত্রী এবং এবং দুই সন্তান রয়েছে। কিছু স্বেচ্ছাসেবী তাকে ত্রিপুরা সীমান্তে বয়ে নিয়ে আসে।
বুদ্ধিজীবীরা

পাকিস্তানী বুদ্ধিজীবীদের একদল ত্রিপুরা শহরের নরসিংহ রিফিউজি ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছিলেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়য়ের একজন মুসলিম প্রোফেসর বলেন- পাকিস্তানী আর্মির লক্ষ ছিল সকল বুদ্ধিজীবী, টেকনিশিয়ান, ব্যবসায়ী এবং শিল্পীদের নিঃশেষ করে দেওয়া। তারা শুধু কিছু গোলাম বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছে।

ভিক্ষু মহাদেব জ্যোতি পাল, পাকিস্তানের বুদ্ধ সম্প্রদায়ের প্রধান বলেন যে- তিনি যে আশ্রমে বসবাস করতেন, সেটি এবং তার চারপাশের গ্রাম পাক আর্মি গত মাসে জ্বালিয়ে দিয়েছে। তাঁরা ৬ জন তরুণ ভিক্ষুকে হত্যা করেছে।

মিস নোমিতা ঘোষ, ঢাকা রেডিওর একজন শিল্পী, তিনি বলেন- ঘরে আগুন লাগানোর পূর্বে সৈন্যরা অল্পবয়সী মেয়েদের ধরে নিয়ে যেত।

সংবাদদাতারা যারা হাসপাতালটি এবং শরণার্থী শিবিরগুলো পরিদর্শন করেন তাঁরা গাড়িতে করে দক্ষিণ ত্রিপুরার সাবরুমেও যান। পাকিস্তানী আর্মির নিপীড়নের শিকার মানুষদের জন্য এটা ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবেশ পথ। সাবরুম থেকে সংবাদদাতারা ফেনি নদীর ওপারের শহর রামগড়কে কসাইখানা হয়ে থাকতে দেখেছেন। নদী তীরের সব কুঁড়েঘর গুলো পুড়িয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। একমাত্র অক্ষত কাঠামো হিসেবে সরকারী বিল্ডিঙের উপর একটি একাকি পাকিস্তানী পতাকা উড়ছিল। পতাকাটি ছিল মে মাসের শুরুর দিকে মুক্তি ফৌজের সাথে এক তিক্ত যুদ্ধের পর ঐ এলাকায় পাকিস্তানী দখলদারিত্বের প্রতীক।

–ইউএনআই

মোঃ; রাশেদ হাসান (নোবেল)
<৮,৮৮,৫৫১-৫২>
স্টেটসম্যান
২৩ মে, ১৯৭১
সন্ত্রাস এবং কসাইখানা থেকে পলায়ন
সংখ্যাগুরু বাংলাদেশী শরণার্থীর স্মৃতিতে আছে নির্মম শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হবার টাটকা ক্ষত এবং সামনে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ।
লিখেছেন- মনোজিত মিত্র

ত্রিপুরার সীমান্তবর্তী শহর সাবরুম এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের মাঝে দিয়ে বয়ে চলেছে সংকীর্ণ ফেনী নদী। গত সপ্তাহে এপ্রিল মাসের এক সকালে স্থানীয় নৌকাতে করে নদী পার হচ্ছিলাম। আমি আমার পিছনে দেখতে পাচ্ছিলাম হাজারো বাংলাদেশী শরণার্থী। নদী পার হবার অপেক্ষায় আমার সামনেও ছিল আরও হাজারো মানুষ এবং অগণিত মানুষ অগভীর জল মাড়িয়ে জিনিসপত্র কাঁধে করে অপর পাড়ে যাচ্ছিল। ১৫ কিলোমিটার দূরেই তুমুল গোলাগুলি চলছিল এবং তাঁদের যাত্রা ছিল অব্যাহত।

এটা ছিল সেই দৃশ্যগুলোর মাঝে অন্যতম, যা এক মুহূর্তে সব পরিষ্কার করে দেয়। আপনাকে শুধু দেখতে হবে ভিড় ঠেলে হাজারো মানুষের ছুটে চলা, তাঁদের আতঙ্কগ্রস্থ মুখচ্ছবি এবং একটু নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য তাঁদের ব্যাকুলতা এমনকি রাস্তায় রাত কাটানো। পার্বত্য সীমান্তবর্তী শহর রামগড় তখনো মুক্তি ফৌজের দখলে ছিল। কিন্তু পাকিস্তানী আর্মি সামনে এগিয়ে আসছিল। তারা নির্মমভাবে শেলিং করে গ্রামগুলো জ্বালিয়ে দিয়েছে। এই গ্রামগুলো থেকেই হাজারো লোক পালিয়ে এসেছিলেন।

এপ্রিলের ৩য় এবং ৪র্থ সপ্তাহে সাবরুম ছিল ত্রিপুরার সব চেয়ে জনবহুল সীমান্ত। তখন প্রায় ২,০০,০০০ শরণার্থী মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে এসে জড়ো হন। অন্যান্য সীমান্ত এলাকাতে শরণার্থীরা আগেই আসা শুরু করেছিলেন। হাজার হাজার মানুষ সিলেট, কুমিল্লা এবং নোয়াখালী জেলা থেকে সোনামুরা, কমলাসাগর, দবীপুর এবং অন্যান্য সীমান্ত দিয়ে এসেছিলেন। আগরতলা থেকে এই বিভিন্ন সীমান্তে পরিদর্শনের সময় আমি সবখানে দেখি শুধু শরণার্থী আর শরণার্থী; রাস্তার পাশে, তাবুতে, স্কুলে, কলেজে, ব্যাক্তিগত ঘরে, মাঠে, রাস্তায়।

সাবরুমেই আমি সবথেকে করুণ দৃশ্যটা দেখি। হাজার হাজার মানুষ রাস্তা আর থানার আঙিনায় বসবাস করছিল। সেখানে প্রকৃত শরণার্থীদের জন্য ইস্যু করা স্লিপ সংগ্রহের জন্য ছিল দীর্ঘ সারি। যখন আমি থানার ভিতরে গেলাম, তখন স্লিপ নেয়ার জন্য সাহায্য চাইতে কিছু বৃদ্ধা আমার কাছে ছুটে আসলেন। যখন পরিবারের একজন সদস্য স্লিপের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে ছিল অন্যরা খাবারের সন্ধানে চলে যায়। নিজেদের বানানো তাবুতে মুরুব্বী লোকেরা ঘুমান। শিশুরা লুকোচুরি খেলছিল, তারা পরিষ্কার ভাবে বুঝতে পারে নি যে তাঁদের উপর কি দুর্যোগ এসে পড়েছে। অনেকেই খাবারের সন্ধান করছিল। কিন্তু তাঁদের সবার কেনার সামর্থ ছিলনা। কিছু পরিবার নদী পাড়ে তাঁদের বাসনপত্র বিক্রির চেষ্টা করছিল। এগুলো ছিল তাঁদের শেষ সম্বল।

খাবার পানির তীব্র সংকট ছিল। জেলা কর্মকর্তারা অস্থির হয়ে ওঠেন। তাদের কেউ কেউ বলেন কলেরার এক বা দুইটা রিপোর্ট ইতিমধ্যে পাওয়া গেছে। আর যদি ভিড় কমানো না যায়, তাহলে অচিরেই এটা মহামারীতে রুপ নিতে পারে। শরণার্থীদের ক্যাম্পে নিয়ে যাবার জন্য নির্দিষ্ট সময় পরপর ট্রাক আসে। যারা সাথে করে সাইকেল নিয়ে এসেছিল, তাঁরা তা ট্রাকের সাইডে বেঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে যায়। নারী, শিশু এবং জরাগ্রস্ত বৃদ্ধেরা হামাগুড়ি দিয়ে ট্রাকে ওঠে। তরুণ ছেলেরা তাদের সাহায্য করে। ওরা এতকিছুর পরেও তাদের উদ্দীপনা ধরে রেখেছিল। কেউ কেউ এত ক্লান্ত ছিল যে কথাও বলতে পারতো না। মাঝেমাঝে এক বা দুজনকে চলন্ত ট্রাক থেকে গলা বাড়িয়ে বমি করে দিতে দেখতাম।

ক্যাম্প গুলো বিভিন্ন এলাকাতে গড়ে তোলা হয়েছিল। মে মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত প্রশাসনের পক্ষে ভিড় সামলানো মুশকিল হয়ে পড়ে। তাদের অনেকেই বলেন ত্রিপুরার জনসংখ্যা প্রায় দ্বিগুন হবার পথে।

বেশীরভাগ শরণার্থী দরিদ্র এবং চাষী সম্প্রদায়ের ছিলেন। তবে এখানে মধ্যবিত্ত এবং ধনীরাও ছিলেন। তাদের বেশীরভাগই আগরতলা এসেছেন এবং সেখান থেকে কোলকাতা চলে গিয়েছিলেন। আর অন্যরা গিয়েছিলেন আত্মীয়স্বজন বা পরিচিতদের কাছে। সেখানে সচ্ছল আইনজীবী, ডাক্তার এবং ইঞ্জিনিয়াররাও ছিলেন। বর্বর পাক বাহিনীর চোখে ধুলো দেবার জন্য তারা অনেক প্রতিকূল পথ পাড়ি দিয়ে এসেছেন। একজন আইনজীবী তার ২টি বাড়ী এবং ৩টি গাড়ী পিছনে ফেলে শুধু বউ আর ছেলেকে নিয়ে আগরতলা প্রবেশ করেন। একজন চলচিত্র অভিনেত্রী ৪৮ ঘন্টা পায়ে হেটে কাঁদা পানি পার করে আগরতলা এসে উপস্থিত হন। উনি আগে ৩টি সিনেমাতে কাজ করেছিলেন। যে কোন মুহূর্তে পথে মৃত্যুর ঝুকি নিয়ে একজন স্থপতি ঢাকা থেকে তার স্ত্রী এবং সন্তানকে নিয়ে এসেছেন।

তাঁদের সকলেই বিষণ্ণ ছিলেন না। বাংলাদেশের কিছু শিক্ষক এবং লেখকদের একটি দলের সাথে আগরতলার পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটে দেখা হওয়া আমার জন্য অনুপ্রেরণা দায়ক অভিজ্ঞতা ছিল। তাঁদের কেউ কেউ এসেছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তারা মুক্তিফৌজের যোদ্ধাদের সাহায্য করেছিলেন এবং সামনাসামনি যুদ্ধ দেখেছিলেন। প্রতিটি পরিবার ইন্সটিটিউটের একটা করে রুমে ছিলেন। ঐ রুমেই রান্না এবং ঘুমের ব্যবস্থা। স্পষ্টতই তারা বাংলাদেশে ভালো জীবন যাপন করে অভ্যস্ত। কিন্তু এ বিপর্যয় তাঁদের এতটুকু দমাতে পারেনি।

নিটোল চন্দ্র দাশ
<৮,৮৯,৫৫৩-৫৮>
[শরণার্থীদের উপর আই,আর,সি-র একটি রিপোর্ট]

বাংলাদেশ রেসকিউ কমিটির ইমার্জেন্সি মিশন টু ইন্ডিয়া ফর পাকিস্তানি রেফিউজিস
সূত্রঃ বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, ২৮ জুলাই, ১৯৭১।

রিপোর্টদাতাঃ মিস্টার এঞ্জিয়ার বিডল ডিউক (চেয়ারম্যান, আইসিআর)
রিপোর্ট গ্রহীতাঃ এফ, আই কেলোং (ইউএসএ সরকারের শরণার্থী বিষয়ক সেক্রেটারির অব স্টেটের স্পেশাল এসিস্ট্যান্ট)
রিপোর্ট প্রদানের তারিখঃ ২৮ জুলাই, ১৯৭১

#ভূমিকা : ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ, সময়ের সবচেয়ে বড় গণঅভ্যুত্থানের একটির সূচনা হয়,যেখানে লোকজন প্রানের ভয়ে তার পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রে পালিয়ে আসতে শুরু করে। প্রায় ৬ মিলিয়ন বাঙালি, মুসলিম, হিন্দু পূর্ব পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে আসাম,পশ্চিম বঙ্গ,মেঘালয় আর ত্রিপুরায় আশ্রয় গ্রহন করে। প্রতিদিন হাজার হাজার নতুন শরণার্থী তালিকায় যুক্ত হচ্ছে। বর্ধমান এই জনসংখ্যার এই স্রোত ইন্ডিয়ার উপর ভয়াবহ চাপের সৃষ্টি করছে।

জুলাইয়ের ৫ তারিখে,ভারতে নিযুক্ত প্রাক্তন আমেরিকান এম্বাসেডর চেস্টার বাওয়েল নিউইয়র্ক টাইমসে লিখেন,

“যদি অচিরেই দুটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহন করা না হয়, তবে দক্ষিন এশিয়া অচিরেই একটি এন্ডলেস যুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাবে।

এর প্রথমটি হল,ক্ষমতাসীন পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের তাদের এই সন্ত্রাসী কর্মকান্ড পরিত্যাগ করতে হবে এবং একটি সমঝোতায় আসতে হবে। যা পূর্ব পাকিস্তানের গৃহহারা এবং প্রানভয়ে ভীত হয়ে পালিয়ে আসা শরণার্থীদের ভারতে আসা থেকে বিরত করবে।

এবং দ্বিতীয়টি হল -বিশ্ব প্রতিনিধিদের একটি বৃহৎ পরিসরে ক্যাম্পেইন শুরু করতে হবে। যাতে করে বর্ডার পার করে আসা এই সুবিশাল ৬ মিলিয়ন শরনার্থীকে পালনের চাপ ভারত সামলে নিতে পারে।”

শরনার্থীদের ফেরত পাঠানোর ব্যপারে রাজনৈতিক সমাধান অবশ্যকরণীয়। এর সাথে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রসমূহের এই সুবিশাল শরনার্থীদের চাপ ভারতের সাথে ভাগাভাগি করে নেয়া উচিত। আমেরিকান ভলান্টারি এজেন্সির উপরেও এই দায়ভায় বর্তায়। এই মুহূর্তে মানবতাবোধ ও আত্মত্যাগের মনোভাবই বর্তমান সময়ের এই ভয়াবহ ও করুণতম শরনার্থী সমস্যার মোকাবেলা করতে পারে।

পাকিস্তান রাষ্ট্রটি মূলত দুইটি প্রদেশ নিয়ে গঠিত-পূর্ব ও পশ্চিম,যা হাজার মাইল ব্যাপী বিস্তৃত ভারতীয় ভূখন্ড দ্বারা পৃথককৃত। পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল ৭৫ মিলিয়ন (৭.৫ কোটি)।অপরদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের জনসংখ্যা ২৫ মিলিয়ন (২.৫ কোটি)। উভয় অঞ্চলেই সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল মুসলিম সম্প্রদায়। তবে পূর্ব পাকিস্তানে প্রায় ৮ মিলিয়ন (৮০ লক্ষ) হিন্দু ধর্মাবলম্বীর বাস ছিল।

১৯৭০ সালের জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের হয়ে আওয়ামীলীগ সমগ্র পাকিস্তানেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। কিন্তু নতুন সরকার ঘটনের প্রক্রিয়া ব্যহত হয় এবং অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়ে। ২৫ শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও পুলিশ পূর্ব পাকিস্তানের জনগনের উপর আক্রমন করে এবং অপরিসীম আতঙ্কের সৃষ্টি করে। এতে প্রায় ২ লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে বলে অনুমিত হচ্ছে।

এই শরনার্থী সমস্যার পরিধি ও গুরুত্ব যখন ক্রমশ বাড়তেই লাগল,”আন্তর্জাতিক ত্রান কমিটি” তখন পাঁচ জন স্বেচ্ছাসেবক নেতার সমন্বয়ে গঠিত একটি প্রতিনিধি দলকে ভারতে প্রেরণ করেন, যার নেতৃত্বে ছিলেন IRC এর সাবেক প্রেসিডেন্ট জনাব এঞ্জিয়ার বিডল ডিউক। দলের অন্যান্য সদস্যরা হলেন,ভাইস প্রেসিডেন্ট মর্টন হামবুর্গ। এছাড়া আই,আর,সি-র বোর্ড মেম্বারদের মধ্যে ছিলেন মিসেস লরেন্স কপলি থ এবং থমাস ডব্লিও ফিপস এবং আইনস্টাইন মেডিকেল স্কুলের ডা.ড্যানিয়েল এল। এই মিশনের লক্ষ্য ছিল শরনার্থীদের সম্পর্কে একটি প্রাথমিক ধারণা লাভ করা এবং পূর্ব পাকিস্তানের শরনার্থী,বিশেষ করে পেশাদার শ্রেনীদের জন্য একটি ইমারজেন্সি কর্মসূচির সূচনা করা। আইআরসি-র বোর্ড অব ডিরেক্টরের কর্মকর্তারা বুঝতে পেরেছিলেন যে সকল দিকে হাত না বাড়িয়ে আইআরসি-র সামর্থ্য অনুযায়ী সমস্যার যে কোন একটি বিশেষ অংশের দিকে মনোযোগ দেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। তাছাড়া দেশের টিকে থাকার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের ডাক্তার, শিক্ষক, লেখক, চিত্রকর, একাডেমিশিয়ান ও সাংস্কৃতিক নেতাদের টিকে থাকাও ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

পরবর্তী লেখাগুলোতে মিশনের ফাইন্ডিংস, সুপারিশ ও সম্পূর্ণ কর্মসূচির সারসংক্ষেপ তুলে ধরা হলোঃ

১) সমস্যার অবস্থা (the scope of the problem):

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বের সর্ববৃহৎ শরণার্থী সমস্যার ব্যাখ্যা করা যায়, কিন্তু দায়ভার এড়ানো যায় না। With which most of us react to what appears as an elemental disaster of unmanageable scope.

পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও পুলিশ জনমনে যে ভয়াবহ আতংক ও ত্রাসের সৃষ্টি করেছিল,তার লক্ষ্য ছিল সুনির্দিষ্ট। নিউইয়র্ক টাইমসের একটি সংবাদ ছিল এইরকম,

“লোকজন একে অপরকে হত্যা করছিল কেবল একে অন্যের প্রতি বিদ্বেষপূর্ন বর্ণভিত্তিক মনোভাব, রাজনৈতিক অন্তর্ঘাত ও সাম্প্রদায়িকতায় অন্ধ হয়ে। কোন গোষ্ঠীই পরিপূর্ণভাবে দোষমুক্ত নয়। কিন্ত হত্যা ও ঘৃণার প্রধান এজেন্ট ছিল পাকিস্তানি আর্মি। এবং এই হত্যাকান্ড ছিল উদ্দেশ্যমূলকভাবে,বাছাইকৃত। পূর্ব পাকিস্তানের এক গ্রহণযোগ্য সূত্র থেকে জানা যায়,পাক সেনাবাহিনীর মূল টার্গেট ছিল বুদ্ধিজীবী শ্রেণী, সাংস্কৃতিক নেতা, ডাক্তার, প্রফেসর,ছাত্র এবং লেখকগোষ্ঠী।” (এন্থনি লুইস, ‘দুর্দশার পরিমাপ’, দা নিউ ইউর্ক টাইমস, ৭ জুন, ১৯৭১)

ভারতে আই আর সি মিশন শরনার্থীদের সাথে বিভিন্ন সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে ওখানে আসলে কি ঘটছে,সে সম্পর্কে একটি ধারণা পায়। লোকজনকে বাসা থেকে ধরে এনে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে মেশিনগান দিয়ে হত্যা করা হয়। নারী, পুরুষ ও শিশুদের বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মারা হয়। মহিলাদের ধর্ষন করা হয়। প্রায় দুই লক্ষ মানুষ হত্যা করা হয় বলে রিপোর্ট আসে। আরো লাখ লাখ মানুষ ভারতে পালিয়ে আসে। এই পর্যায়ে কেবলমাত্র সেই সব মুসলিমরাই টার্গেট ছিল,যারা আওয়ামীলীগ এর কর্মী ছিল,অথবা পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতির বিরুদ্ধে ছিল।

পরবর্তীতে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর জিঘাংসার স্বীকার হয় সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের জনগন,যারা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ। ফরিদপুরের উপর নিউইয়র্ক টাইমসের একটি রিপোর্ট ছিল,

“যদিও হাজারো বাঙ্গালি মুসলমানকে “দেশদ্রোহী ” বলে আর্মিরা হত্যা করে, তথাপি মূল বলির পাঠা ছিল হিন্দু জনগন। সামরিক সরকার হিন্দুদের ভারতের দালাল ও স্বায়ত্ত্বশাসনের দাবির পিছের মূল চালিকাশক্তি বলে প্রচার করে। এদেশে যে সকল মুসলিম লোকজন হিন্দুদের সাথে বন্ধুভাবাপন্ন মনোভাব প্রকাশ করতো, তাদের এই বলে হুমকিও দেয়া হয় যে,যদি তারা হিন্দুদের উপর আক্রমন না করে,তবে তাদেরকেও হত্যা করা হবে। এভাবে তাঁরা মুসলিমদেরকে হিন্দুদের উপর অত্যাচার,তাদের বাড়িঘর লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করতে বাধ্য করে।” (দা নিউ ইউর্ক টাইমস, ৪ জুলাই, ১৯৭১)

ভারতীয় সরকার শরনার্থীদের সঠিক পরিসংখ্যান এর জন্য একটি কার্যকর রেজিস্ট্রেশন পদ্ধতি চালু করে। জুনের ৩ তারিখ নাগাদ,শরনার্থী সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৪.৮ মিলিয়নে। এর মধ্যে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশের জায়গা হয় আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়,পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব পূর্ব-পাকিস্তানে, প্রধানত পশ্চিম বঙ্গে। নিচে অঞ্চলভেদে শরনার্থীদের অবস্থানের একটি হিসাব দেয়া হল:

রাজ্য জেলা অভ্যর্থনা কেন্দ্রে অবস্থান (জন) বন্ধু বা আত্নীয়দের সাথে অবস্থান (জন)
আসাম – ৮১,৮০০ ৬৫,৬৭৭
ত্রিপুরা – ৩,৮১,৩৭৩ ৩,৬৩,৪৬৪
মেঘালয় – ১,৮৬,০৫২ ৪৯,৩৩২
পশ্চিমবঙ্গ নদীয়া ২,১৪,৭৮৮ ১,৭০,৯৫১
চব্বিশ পরগণা ৫,০৩,৪৬৭ ১,৭৯,২৫০
মুর্শিদাবাদ ১,৩৪,৫০৭ ১৫,৯৫৩
পশ্চিম দিনাজপুর ৭,৬৩,৬৬৪ ৫,১১,৫৫৫
জলপাইগুড়ি ১,৪০,৪০২ ১,৬৫,০০০
কুচবিহার ১,৮৯,৭৫৫ ২,১০,৮৭৫
মালদহ ৯২,১৩৯ ২,৫৪,৫১৩
মোট ২৭,০৭,৯৪৭ ২০,২২,৫৭০

(সংখ্যাগুলো পশ্চিমবঙ্গ সরকার সরবরাহ করেছে)

জুনের ১৫ তারিখের মধ্যে শরনার্থীদের সংখ্যা বেঁড়ে দাঁড়ায় ৫.৮ মিলিয়িনে,যার মাঝে প্রায় ৩.৭ মিলিয়ন শরনার্থীদের আবাস ছিল ক্যাম্পগুলোতে। জুনের প্রথমদিকে কলেরার প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়লে,সীমান্ত দিয়ে শরনার্থী প্রবেশ কিছুটা কমে আসে। কিন্ত যেই কলেরার প্রভাব কমে আসলো,শরনার্থীদের স্রোত আবারো বাড়তে লাগল। প্রতি রাতে হাজার হাজার শরনার্থী সীমান্ত পার হতে লাগল। যদিও পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সীমান্তে মর্টার নিক্ষেপ করছিলো, তথাপি তা এই জনস্রোতের ধাক্কাকে খুব কমই রোধ করতে পেরেছিলো। যদি এই গতিতে শরনার্থী সংখ্যা বাড়তেই থাকে, তাহলে তা অচিরেই ৭ মিলিয়ন এর মাইলফলক স্পর্শ করবে। যেখানে কিউবার মোট জনসংখ্যাই হল ৭ মিলিয়ন!

কে জানে এই অবস্থা কখন বিস্ফোরিত হবে? স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো তাদের মানবসেবামূলক কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তারা মূলত ভারতকে এই অভ্যন্তরীন চাপ সামাল দেয়ার জন্য সাহায্য করছে এবং একটি সমাধানের পথ খুঁজে পেতে প্রয়োজনীয় সময় দেয়ার চেষ্টা করছে। সেই হিসাবে তারা বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠাতেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে।

২) শরনার্থীরা ( The Refugees) :

শরনার্থীদের অনেকেই ১৫০ মাইলের মত পথ পায়ে হেটে অতিক্রম করে। তাদের বেশিরভাগের বাড়িই ছিল সীমান্তের কাছাকাছি । প্রশ্নাতীত ভাবে প্রচুর সংখ্যক মানুষ পালাতে পারেনি,কারন তাদের বাড়িঘর ছিল পূর্ব পাকিস্তানের অনেকটাই ভেতরের দিকে। সেক্ষেত্রে তাদের সাধারন রাস্তা ধরে যাতায়াত করে বর্ডার ক্রস করতে হত। সীমান্তে পাকিস্তানি সেনাদের তৎপরতা বেশি থাকায়,অনেকেই ১,৩০০ মাইলব্যাপী বর্ডার পার হত বিভিন্ন জঙ্গল ও জলার পথ ধরে। এইসব গ্রুপের লোকসংখ্যা মাঝে মাঝে ৫০,০০০ ছাড়িয়ে যেত। চব্বিশ ঘন্টার মাঝে তারা ভারতের বিভিন্ন রাস্তায় থিতু হয়ে যেত। যেখানে নূন্যতম থাকার যায়গা ও খাবার পানির ব্যবস্থা থাকত,তারা সেখানেই অবস্থান করত। তাঁদের অনেকেই অবশ্য শরনার্থী ক্যাম্প এভইড করেছিল এবং ভারতে জনতার সাথে মিশে গিয়েছিল। শরনার্থী ক্যাম্পগুলো নানা আকারের হত, ক্ষুদ্র গ্রুপ থেকে শুরু করে ৫০,০০০ লোকের বিশাল জমায়েত পর্যন্ত। তবে এক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ প্রশাসন ও ভারত সরকারের কাজ ছিল প্রশংসনীয়। তারা প্রতিটা ক্যাম্পে নূন্যতম খাবার ও সুপেয় পানির ব্যবস্থা করেছিল। ক্যম্পগুলো ছিল মোটামুটিভাবে গ্রাম ঘেষা। রিফিউজি ক্যাম্পগুলো উঁচু স্থানে বানানোর চেষ্টা করা হয়েছিল কিন্ত বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা ছিল অসম্ভব। আর এটা প্রায় নিশ্চিত ছিল যে বর্ষা মওসুমে প্রায় অধিকাংশ রিফিউজি ক্যাম্পই পানির নিচে তলিয়ে যাবে।

শরনার্থী শিবিরের ছাউনিগুলো মূলত তিন ভাগে বিভক্ত ছিল। ছোট কুটিরের ছাউনি- যেগুলো তৈরী করা হত স্থানীয় কাঁচামাল দিয়ে। আকারে ছোট তাবুগুলো নির্মান করা হত কাঠের কাঠামো আর শরনার্থী শিবিরের দেয়া ত্রিপল দিয়ে। আর কিছু ছিল সিমেন্ট শিট আর ড্রেইনের পানির পাইপ দিয়ে তৈরী। বর্তমানে সমগ্র ভারত জুড়েই ত্রিপল তৈরীর সামগ্রিতে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। ফলে প্লাস্টিকের জিনিসপত্র দিয়ে কাজ চালানোর চেষ্টা করা হয়। শিবিরে একটি কিংবা দুইটি পাম্পের মাধ্যমে পানির যোগান দেয়া হত। তাছাড়া কিছু এক পাম্পওয়ালা লিভারযুক্ত টিউবওয়েলও ছিল। কিন্ত পয়:নিষ্কাশনের কোন ব্যবস্থা ছিলো না বললেই চলে। শরনার্থী গ্রামগুলোর পাশেই গর্ত খুঁড়ে কিছু খোলা পায়খানার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্ত তা ছিল নিতান্তই অপ্রতুল। তাই কর্তৃপক্ষ আরো বড় করে করার সিদ্ধান্ত নেয়। অগভীর কূপ,অপরিচ্ছন্ন পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থাও শিবিরের খুব নিকটবর্তী হওয়ায় রোগ সংক্রমণ ঘটা ছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র। তাই প্রয়োজনীয় সংখ্যক সেনিটারি ব্যবস্থা ও গভীর নলকূপ স্থাপন করা অতীব জরুরী হয়ে পড়েছিলো শরনার্থী শিবিরের নূন্যতম স্বাস্থমান বজায় রাখার জন্য।

খাদ্যের জন্য শরনার্থীরা ক্যাম্পের অথরিটি ও স্থানীয় খুচরা বাজারের উপর নির্ভরশীল ছিল। মাটির পাত্রে সিদ্ধ ভাতই ছিল মূল খাদ্য। অল্প গুড়ো দুধও মিলত কালেভদ্রে। আর ছিল ডাল,যা ছিল মুসর জাতীয় দানা দিয়ে তৈরী এক প্রকার স্যুপ বিশেষ। কিছু বিশেষ জায়গায় সবজির ব্যবস্থাও করা হত। তবে এটা ছিল শিবিরের রেগুলার নিয়মের বাইরে। মোদ্দাকথা হল, যে পরিমান খাদ্যের যোগান দেয়া হত,তা ছিল চাহিদার তুলনায় নিতান্তই অপ্রতুল।

৩) স্বাস্থ্য অবস্থা (Health Condition):

স্বাস্থ্যগত দিক দিয়ে শরনার্থীদের মাঝে অধিক পরিশ্রম,কষ্ট,কম ক্যলরি গ্রহন, আর অপুষ্টির ছাপ ছিল স্পষ্ট। তাঁদের বেশিরভাগের পর্যাপ্ত পোশাক ছিল না। শিশুরা তুলনামূলক ভাবে এই পরিস্থিতে একটু ভাল খাপ খাইয়ে নিয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। কিন্ত বয়ষ্ক ও শিশু উভয়ের মাঝে চর্মরোগ, পাকস্থলীর সমস্যা,ডায়রিয়া, হুপিং কাশি সহ নানাবিধ শ্বাসকষ্ট জনিত রোগী ছিল প্রচুর পরিমানে। শিবিরের হাসপাতাল গুলোতে কলেরা ও অন্যান্য পাকস্থলীর সমস্যার রোগীও ছিল। কলেরা রোগটি যদিও এখন নিয়ন্ত্রনের মধ্যে আনা হয়েছে, কিন্ত এটি প্রতীয়মান হয় যে, অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত, হাসাপাতালের কম সুযোগ সুবিধা,তার উপর আরো বেশি শরনার্থীর আগমন কলেরার প্রকোপকে আরো বাড়িয়ে তুলবে।

শরনার্থী শিবিরগুলোতে স্বাস্থ্য সেবা অপর্যাপ্ত। কিছু কিছু ক্যাম্পে গণ টিকাদানের কিছু মোবাইল ইউনিট কার্যকর ছিল। সুনির্দিষ্ট কিছু সেবা দানে সক্ষম ছোট তাবুওয়ালা হাসপাতাল ও ছিল কিছু ক্যাম্পে। কিন্ত সেখানে রোগী রাখার জন্য সর্বোচ্চ ২০-৩০ টা সিট বা স্ট্রেচার ছিল। কিছু ইন্ট্রাভেনাস আর কিছু সিরাপ জাতীয় ওষুধপত্র ছিল কলেরা ও পাকস্থলীর নানা সমস্যা মোকাবিলার জন্য। যেহেতু পারস্পরিক সমন্বয় এর অভাব ছিল,তাই দেখা যেত এমন ঔষুধের যোগান আসছে যা কম গুরুত্বপূর্ণ। আবার অনেক বেশি জরুরী ওষুধের সংকট দেখা দিত।

এই মুহুর্তে রিফিওজিদের জন্য বেশি জরুরী ছিল তাবু নির্মাম সামগ্রী,কারন বর্ষা মৌসুম শুরু হলো বলে। আর দরকার গভীর নলকূপ স্থাপনের, যাতে করে কম সংক্রমণ এর সম্ভাবনা থাকে। পয়:নিষ্কাশনের উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহন করা উচিত। যে পরিমান খাদ্য যোগান দেয়া হতো,তা শিশু ও বৃদ্ধদের জন্যেই পর্যাপ্ত ছিল না। দিন দিন তা আরো কমতে লাগল।

শিবিরে সবচেয়ে নাজুক অবস্থানে ছিল সদ্য ভূমিষ্ঠ কিংবা ছোট বাচ্চারা। বোতলজাত তরল খাবার কিংবা শিশুখাদ্যের যোগান বলতে গেলে ছিলই না। মাতৃদুগ্ধ ছিল প্রয়োজনের তুলনায় অল্প। বাচ্চাদের খাদ্য তৈরীর জন্য গুড়া দুধ কিংবা গ্লুকোজ পাউডারের ছিল তীব্র সংকট। আর এই অপুষ্টির কারনে শরনার্থী শিবিরে মারা যায় অসংখ্য শিশু ও নবজাতক।

পরবর্তী মাসগুলোতে শরনার্থী শিবিরের পরিধি আরো বেড়ে যাবে। সেই সাথে বেড়ে যাবে অপুষ্টি আর রোগের সংক্রমন। স্থানীয় গ্রামগুলোর সাথে শিবিরের দূরত্ব ক্রমশ বেড়ে চলেছে। আর্থিক এই বিশাল চাপ পশ্চিমবঙ্গ প্রশাসন ও ভারত সরকারের জন্য ক্রমশ অসহনীয় পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। অবস্থা গুরুতর হওয়ার সাথে সাথে আত্মবিশ্বাস আর আশার পারদও ক্রমশ নিম্নগামী হতে করবে।

খাদ্য ও চিকিৎসার যোগান অবশ্যই বাইরের উৎস থেকে আসতে হবে। এইসব জিনিপত্র ভাগ করে দেয়া সম্ভব। তবে আরো প্রচুর পরিমানে কর্মক্ষম ডাক্তার ও প্যারামেডিক চিকিৎসক এর নিয়োগ অত্যাবশ্যকীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

৪) শরনার্থী ডাক্তারেরা ( The refuge Physicians):

পূর্ব পাকিস্তানের যে সকল ডাক্তারেরা দেশ ছেড়েছিলেন, তারা ভারতের ডাক্তার ও অন্যান্য পেশাজীবীদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে খুব অল্প সংখ্যকই শরনার্থী শিবিরে রয়ে গিয়েছেন। বেশিরভাগ কলকাতা শহরের আশেপাশে, বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতে চলে গিয়েছেন। মেডিকেল শিক্ষা প্রসারের জন্য পূর্ব পাকিস্তানে সাতটি মেডিকেল স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল,যা মূলত দুই ধরনের ডিগ্রী প্রদান করত। এম.বি.বি.এস ডাক্তারী সার্টিফিকেট এর জন্য ৫ বছর মেয়াদী কোর্স আর RFP এর জন্য চার বছর মেয়াদী। কিছু প্যারামেডিকেল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ছিল। অধিকাংশ অভিজ্ঞ মেডিকেল প্রফেসরদের হত্যা কিংবা গুম করা হয়। প্রায় ১,৫০০ এর মত ডাক্তার পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে চলে আসে যাদের অধিকাংশই ছিল যুবক। যেহেতু পশ্চিম বঙ্গে এই ডিগ্রি চিকিৎসা করার অনুমতি পায় না,তাই মাত্র ১৫০ জন ডাক্তারই সরকারীভাবে পশ্চিমবঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিল। অধিকাংশ শরনার্থী ডাক্তারেরা বাংলাদেশ রেড ক্রস এর অধীনে নিবন্ধিত হয়েছিল যার পরিচালক ছিলেন ডা.এ হক। এই গ্রুপে সাধারন ডাক্তারদের সংখ্যাই বেশি ছিল,স্পেশালিষ্ট ডাক্তার ছিল হাতে গোনা। তাঁদের নিজের কিছু পোশাক আর জিনিপত্র ছাড়া আর কিছুই ছিল না। ডাক্তারী সামগ্রীও বলতে গেলে কিছুই ছিল না। এমনকি তাঁরা নিজেদের পরিবারকে পর্যন্ত সাপোর্ট দিতে পারত না। অন্য পরিবারের সাথে তাঁদের মিলেমিশে থাকতে হতো।

রাইসা সাবিলা
<৮,৯০,৫৫৯-৫৭২>
[শরণার্থী ও শরণার্থী শিবির সম্পর্কিত কিছু তথ্য]

-“বাংলাদেশ ডকুমেন্টস”, বহির্বিশ্ব বিষয়ক মন্ত্রণালয়, ভারত কর্তৃক প্রকাশিত, ১৯৭২

২৫শে মার্চ থেকে ১৫ই ডিসেম্বর, ১৯৭১ পর্যন্ত শরণার্থীদের আগমনঃ

ক্রমিক নং প্রদেশ মোট আগত শরণার্থী সংখ্যা

১ পশ্চিমবঙ্গ ৭৪,৯৩,৪৭৪
২ ত্রিপুরা ১৪,১৬,৪৯১
৩ মেঘালয় ৬,৬৭,৯৮৬
৪ আসাম ৩,১২,৭১৩
৫ বিহার ৮,৬৪১
মোট- ৯৮,৯৯,৩০৫

প্রদেশ ভেদে শরণার্থীদের সংখ্যা ও অবস্থান ( ১৫ই ডিসেম্বর, ১৯৭১ সাল পর্যন্ত গণনা অনুযায়ী)

ক্রমিক নং প্রদেশের নাম শিবিরের সংখ্যা শিবিরে অবস্থানকারী শরণার্থী সংখ্যা শিবিরের বাইরে অবস্থানকারী শরণার্থী সংখ্যা মোট
১ পশ্চিমবঙ্গ ৪৯২ ৪৮,৪৯,৭৮৬ ২৩,৮৬,১৩০ ৭২,৩৫,৯১৬
২ ত্রিপুরা ২৭৬ ৮,৩৪,০৯৮ ৫,৪৭,৫৫১ ১৩,৮১,৬৪৯
৩ মেঘালয় ১৭ ৫,৯১,৫২০ ৭৬,৪৬৬ ৬,৬৭,৯৮৬
৪ আসাম ২৮ ২,৫৫,৬৪২ ৯১,৯১৩ ৩,৪৭,৫৫৫
৫ বিহার ৮ ৩৬,৭৩২ – ৩৬,৭৩২
৬ মধ্য প্রদেশ ৩ ২,১৯,২৯৮ – ২,১৯,২৯৮
৭ উত্তর প্রদেশ ১ ১০,১৬৯ – ১০,১৬৬
মোট ৮২৫ ৬৭,৯৭,২৪৫ ৩১,০২,০৬০ ৯৮৯৯৩০৫

মাসভেদে আগত শরণার্থী সংখ্যা

ক্রমিক মাস গড় সংখ্যা অনুযায়ী দৈনিক আগত শরণার্থী সংখ্যা প্রতি মাসে আগত শরণার্থী সংখ্যা (হাজারে)
১ এপ্রিল ১৯৭১ (১০ থেকে ৩০ তারিখ পর্যন্ত) ৫,৭০০ ১,৯২,১০০
২ মে ১৯৭১ ১০,২০৩ ৩,১৫,৮০০
৩ জুন ১৯৭১ ৬,৮০০ ২,০৫,৬০০
৪ জুলাই ১৯৭১ ২,৬০০ ৭৯,৭০০
৫ অগাস্ট ১৯৭১ ৩,৪০০ ১,০৫,৫০০
৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ ৫৭ ৮০,৪০০
৭ অক্টোবর ১৯৭১ ১৪ ৪২,৫০০
৮ নভেম্বর ১৯৭১ ৮ ২১,৭০০
৯ ফিরে যাওয়া ১৬,৬০০
মোট- ৯,৮৯,৯০০

শরণার্থী শিবিরের তালিকা (এপ্রিল থেকে নভেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত)

ব্লক নং জেলা শিবিরের নাম উল্লেখ নং
D4 উত্তর জেলা আম্বাসা ১
D3 কামালপুর ২
E3 কুমারঘাট ৩
D3 মাইলস ৪
D3 ৮৫ মাইলস ৫
E3 পদ্মাবিল ৬
E3 শ্রীনাথপুর ৭
E3 উপ্তাখালি ৮
D4 দক্ষিন জেলা বাগাটা ৯
D4 চন্দ্রাপুর ১০
D4 ধজনগর ১১
D4 হরিনা ১২
D4 ঋশ্যমুখ ১৩
D4 কাঁকড়াবা ১৪
D4 কলাছড়া ১৫
D4 কাউয়ামারা ১৬
D4 মাইছেরা ১৭
D4 ফুলকুমারি ১৮
D4 রাজনগর ১৯
D4 শ্রীনগর ২০
D4 পশ্চিম জেলা আমতলি ২১
D4 বড়জলা ২২
D4 ব্রজপুর ২৩
D4 ছেচুড়িয়া ২৪
D4 ধনপুর ২৫
D3 গান্ধীগ্রাম ২৬
D4 হাপানিয়া ২৭
D3 ইশানপুর ২৮
D3 খোয়াই ২৯
D4 মধুপুর ৩০
D4 মতিনগর ৩১
D4 মেলাগড় ৩২
D4 মোহনপুর ৩৩
D3 সিমনা __
D4 তেলিয়ামুরা ৩৩

আসাম

E3 চাচড় চন্দ্রনাথপুর ৩৪
E3 চারগোলা ৩৫
E3 দশগ্রাম __
E3 হরিনছেঁড়া ৩৬
E3 কাঁঠাল __
E3 লক্ষ্মীনগর ৩৭
E3 সিলকুড়ি ৩৮
E3 সোনাক্ষীরা ৩৯
B2 গোয়ালপাড়া বড়কোনা ৪০
C1 ফকিরগ্রাম ৪১
B2 মানকাচর __
C2 নিদানপুর ৪২
C1 সারফানগুঁড়ি ৪৩
E5 মিজো দেমাগিরি __
E5 পাচাং __
E5 রটল্যাং __
E2 উত্তর চাচড় হিলস হাফলং ৪৪
E1 নওাগং হোজাই ৪৫
E1 নীলবাগান ৪৬
E1 সিদা বাড়ি ৪৭

পশ্চিমবঙ্গ

A5 চব্বিশ পরগনা হাসনাবাদ __
A5 তকি (২টি ক্যাম্প) ৪৮
A5 বশিরহাট (৫টি ক্যাম্প) __
A5 স্বরূপনগর (৭টি ক্যাম্প) ৪৯
A5 বাদুরিয়া (৫টি ক্যাম্প) ৫০
A5 গোবরডাঙ্গা ৫১
A5 মসলন্দপূর ৫১
A5 কালুপুর (৪টি ক্যাম্প) ৫১
A5 মেদিয়া ৫১
A5 ইছাপুর ৫১
A5 সুনতিয়া ৫১
A5 বানিপূর ৫১
A5 পায়রাগাছি ৫১
A5 লক্ষ্মীপুর ৫১
A5 সাধনপুর ৫২
A5 সাহারা ৫২
A5 ব্যারাকপুর __
A5 ডিগবাড়িয়া ৫৩
A5 দত্তপুকুর ৫৩
A5 কানাপুকুর ৫৩
A5 বারাসাত (৩টি ক্যাম্প) __
A5 মামা ভাগিনা(২টি ক্যাম্প) ৫৪
A5 মারিঘাটা ৫৪
A4 বাগদাহা ৫৫
A4 হেলেঞ্চা ৫৫
A4 গনরাপোতা ৫৫
A5 সল্টলেক ৫৬
A5 নীলগঞ্জ ৫৬
A5 নিউ ব্যারাকপুর ৫৬
A5 দগাচিয়া ৫৭
A4 নদিয়া করিমপুর ৫৮
A4 পলাশীপাড়া ৫৮
A4 বেতাই ৫৮
A4 নাজিরপুর ৫৮
A4 বনপুর ৫৯
A4 ছাপড়া ৫৯
A4 দমপুকুরিয়া ৫৯
A4 পূর্ণগঞ্জ ৫৯
A4 জাভা ৬০
A4 ভালুকা ৬০
A4 ভাদুরপুর ৬০
A4 মুরাগাছা ৬০
A4 দক্ষিণপাড়া ৬০
A5 কল্যানী (৭টি ক্যাম্প) ৬১
A4 শিকরপুর ৬২
A4 মাজদিয়া ৬৩
A4 ভজন ঘাট ৬৩
A4 আসান নগর ৬৩
A4 বাডকুল্লা ৬৩
A4 উলাশি ৬৩
A4 রানাঘাট (২টি ক্যাম্প) __
A4 শান্তিপুর __
A3 মুর্শিদাবাদ দৌলতাবাদ ৬৪
A3 কালাডাঙ্গা ৬৪
A3 বাড়ুই পাড়া ৬৫
A3 ছোঁয়া ৬৫
A3 হরিহর পাড়া ৬৫
A3 করিমনগর ৬৫
A3 নিশ্চিন্তপুর ৬৫
A3 রোকনপুর ৬৫
A3 শাহজাদপুর ৬৬
A4 আমতলা ৬৬
A4 যৌবনা ৬৬
A4 মধুপুর ৬৬
A4 নওডা ৬৬
A4 পতিকাবাড়ি ৬৬
A4 মগন পাড়া ৬৭
A3 ভাগিরথপুর ৬৮
A3 ভাটশালা ৬৮
A3 দমকাল ৬৮
A3 কাটাকোপরা ৬৮
A3 সাদিখানদিয়ার ৬৮
A3 সাহেব রামপুর ৬৮
A3 ছোঁয়া পাড়া ৬৯
A3 হুকাহুড়া ৬৯
A3 জলঙ্গি ৬৯
A3 কাজিপাড়া ৬৯
A3 নাটিয়াল ৬৯
A3 সাগর পাড়া ৬৯
A3 সাহেব নগর ৬৯
A3 অশোক কুঞ্জ, লালবাগ ৭০
A3 কলেজ কমার্স হোস্টেল জিয়াগঞ্জ ৭০
A3 দর্পনগর প্রাইমারি স্কুল ৭০
A3 নবাব বাহাদুর ইন্সটিটিউশন ৭৯
A3 লাল বোর্ডিং ,লালবাগ ৭০
A3 মুসলিম হোস্টেল, লালবাগ ৭০
A3 মিশন হাসপাতাল জিয়াগঞ্জ ৭০
A3 কলেজ কমার্স হোস্টেল, জিয়াগঞ্জ ৭০
A3 সরকারি অবৈতনিক প্রাইমারি স্কুল নং ১, জিয়াগঞ্জ ৭০
A3 ঐ, নং ২, জিয়াগঞ্জ ৭০
A3 মহারাজ বাহাদুর হল জিয়াগঞ্জ ৭০
A3 দর্পনগর প্রাইমারি স্কুল ৭০
A3 দিলফারবাদ গঞ্জ স্কুল ৭০
A3 নাশিপুর রাজবতি ৭০
A3 নিশাদবাদ প্রাথমিক স্কুল, লালবাগ ৭০
A3 মুকুন্দবাগ জুনিয়র বেসিক স্কুল, লালবাগ ৭০
A3 শ্রিপাত কুমারপাড়া, জিয়াগঞ্জ ৭০
A3 মোহন্ত রামদাস আউলিয়া প্রাইমারি স্কুল, জিয়াগঞ্জ ৭০
A3 কুর্মিটোলা ক্যাম্প ৭০
A3 অশোককুঞ্জ, লালবাগ ৭০
A3 ম্যাকেঞ্জি হল, আজিমগঞ্জ ৭১
A3 পুরাতন ধর্মশালা, আজিমগঞ্জ ৭১
A3 নতুন ধর্মশালা, আজিমগঞ্জ ৭১
A3 নয়লক্ষ গার্ডেন, আজিমগঞ্জ ৭১
A3 ডন বস্কো ইন্সটিটিউট, আজিমগঞ্জ ৭১
A3 এম স্ত্রীমল’স গোডাউন, জিয়াগঞ্জ ৭১
A3 রাজা বিজয় সিং আস্তাবল, আজিমগঞ্জ ৭১
A3 দেবিপুর জিএসএফপি স্কুল ৭১
A3 রাজা বিজয় সিং বিদ্যামন্দির হোস্টেল, আজিমগঞ্জ ৭১
A3 এম এন একাডেমি, লালগোলা ৭২
A3 লাহোর শেড, লাল গোলা ৭২
A3 স্কুল বোর্ডিং, লাল গোলা ৭২
A3 গেস্ট হাউস, লাল গোলা ৭২
A3 বেসিক স্কুল, লাল গোলা ৭২
A3 মাদ্রাসা, লাল গোলা ৭২
A3 গার্লস স্কুল, লাল গোলা ৭২
A3 মানিক চাক ৭২
A3 যুব অভ্যর্থনা কেন্দ্র, লাল গোলা ৭২
A3 রাণি নগর, গোয়াস ৭৩
A3 রাণি নগর ৭৩
A3 নবীপুর ৭৩
A3 কাতলা মারি ৭৩
A3 রাখালদাসপুর ৭৩
A3 শেখপাড়া ৭৩
A3 রামবাগ ৭৪
A3 হাবাসপুর প্রাইমারি স্কুল ৭৪
A3 বাগ ডাঙ্গা প্রাইমারি স্কুল ৭৪
A3 পাতামারি হনুমান্ত নগর ৭৪
A3 আখেরিগঞ্জ ৭৪
A3 খারিবোনা ৭৪
A3 নাশিপুর ৭৪
A3 ভগবানগোলা হাইস্কুল ৭৫
A3 কালুখালি মাদ্রাসা ও প্রাইমারি স্কুল ৭৫
A3 ভগবানগোলা প্রাইমারি স্কুল ৭৫
A3 আসানপুর প্রাইমারি স্কুল ৭৫
A3 দারারকান্দি প্রাইমারি স্কুল ৭৫
A3 রাম চন্দ্রমতি প্রাইমারি স্কুল ৭৫
A3 ভগবানগোলা ৭৫
A3 ভুরকুন্ডা ৭৬
A3 সাহাপুর ৭৬
A3 মনিগ্রাম ৭৬
A2 মালদহ বামনগোলা ৭৭
A2 পাকুয়াহাট ৭৭
A2 মাহেশুর ৭৭
A2 গোউলজই ৭৭
A2 পল ট্রান্সিট ৭৭
A2 পাকশাঘাট উমুক্ত ময়দান ৭৭
A2 গাজল ৭৭
A2 দহিল ৭৮
A2 হাতিমারি ৭৮
A2 কুতুবশহর এবং আদিনা ৭৮
A2 কচুয়াডাঙ্গা ৭৮
A2 একলাক্ষী ৭৮
A2 রাহুতারা মিশন ৭৯
A2 কেন্দ পুকুর ৭৯
A2 বুলবুল চন্ডি (২টি ক্যাম্প) ৭৯
A2 ঋষিপুর ৭৯
A2 শিঙ্গাবাদ (২টি ক্যাম্প) ৭৯
A2 আইহো ৭৯
A2 বাহুতেরা মিশন ৭৯
A2 মালদহ হরিশচন্দ্রপুর ৭৯
A2 বিশাপুর ৮০
A2 কুশিদহ ৮০
A2 তুলসিহট্ট ৮০
A2 মসলদহ ৮০
A2 ব্রিঙ্গল ৮০
A2 বড়াই ৮০
A2 কনুয়া ৮০
A2 চন্ডিপুর ৮০
A3 গোলাপগঞ্জ ৮১
A3 কালিয়াচক ৮১
A3 মোথাবাড়ি ৮১
A3 বৈষ্ণবনগর ৮১
A3 পাগলাব্রিজ ৮১
A3 বঙ্গতলা ৮১
A3 গয়েশবাড়ি ৮১
A3 সুজাপুর ৮১
A2 কবিন্দপাড়া ৮২
A2 মালতিপুর ৮২
A2 খরবা ৮২
A2 কালিগ্রাম ৮২
A2 আশাপুর ৮২
A2 পাহারপুর ৮২
A2 নালাহার ছাত্রীমোহনি ৮২
A3 ডিইবি ডাক বাংলো ৮৩
A3 মাহাদিপুর ৮৩
A3 নঘরিয়া ৮৩
A3 রায়গ্রাম ৮৩
A3 মিল্কি ৮৩
A2 কালিন্দ্রি ৮৪
A2 মথুরাপুর ৮৪
A2 নাজিরপুর ৮৪
A2 বেচুতলা অথবা মানিকচক দিয়ারা ৮৪
A2 আড়িয়াডাঙ্গা ৮৪
A2 একবর্ণ ৮৪
A2 হরিপুর ৮৪
A2 পরাণপুর ৮৪
A2 রাতুয়া স্কুল ৮৪
A2 দেবিপুর ৮৪
A2 সামশি ৮৪
A2 বড়াল ৮৪
A2 ভালুকা ৮৪
A2 বাহাদল ৮৪
A2 ভগবানপুর ৮৪
A2 খাঁপুর ৮৪
A2 পশ্চিম দিনাজপুর কালদিঘী গোডাউন ৮৫
A2 গঙ্গারামপুর হাই স্কুল ৮৫
A2 নয়া বাজার হাই স্কুল ৮৫
A2 শিববাতি স্টেশন জুনিয়র হাই স্কুল ৮৫
A2 ছালুন হাই স্কুল ৮৫
A2 সর্বমঙ্গলা ৮৫
A2 সুকদেবপুর হাই স্কুল ৮৫
A2 ঠেঙ্গাপাড়া হাই স্কুল ৮৫
A2 নেহাম্বা জুনিয়র হাই স্কুল ৮৫
A2 বুলবাড়ি সেন্টার ৮৫
A2 জাহাঙ্গীরপুর জুনিয়র হাই স্কুল ৮৫
A2 রতনপুর ফ্রি প্রাইমারি স্কুল ৮৫
A2 তপন হাই স্কুল ৮৫
A2 দারালহাট হাই স্কুল ৮৫
A2 রামপুর হাই স্কুল ৮৫
A2 চকবলীগ্রাম বেসিক স্কুল ৮৫
A2 কারদাহা হাই স্কুল ৮৫
A2 ভিওর জালালিয়া হাই স্কুল ৮৫
A2 তিলম জুনিয়র হাই স্কুল ৮৫
A2 লস্করহাট পঞ্চায়েত অফিস ৮৫
A2 পতিরাম হাই স্কুল ৮৫
A2 নাজিরপুর অঞ্চল অফিস, ঝর্ণা ৮৫
A2 বড়কলি জুনিয়র হাই স্কুল ৮৫
A2 অমৃতখণ্ড অঞ্চল অফিস, কামার পাড়া ৮৫
A2 মালঞ্চ হাই স্কুল ৮৫
A2 জেএলপি বিদ্যাচক্র ৮৫
A2 খাদিমপুর গার্লস হাই স্কুল ৮৫
A2 চাক্কাশি হাই স্কুল ৮৫
A2 বাউল পরমেশ্বর হাই স্কুল ৮৫
A2 নদীপার এনসি হাই স্কুল ৮৫
A2 চিঙ্গিশপুর হাই স্কুল ৮৫
A2 বেলতলা পার্ক হাই স্কুল ৮৫
A2 খাশপুর হাই স্কুল ৮৫
A2 হিল্লি হাই স্কুল ৮৬
A2 ত্রিমোহনি রুরাল লাইব্রেরি ৮৬
A2 তেওর ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ ৮৬
A2 মুরালিপুর জুনিয়র ব্যাসিক স্কুল ৮৬
A2 পাঞ্জুল অঞ্চল পঞ্চায়েত অফিস, রামকৃষ্ণপুর ৮৬
A2 এগুলো পশ্চিমবঙ্গের বদলে আসাম হয়ে গেছে ধলপাড়া ফ্রি প্রাইমারি স্কুল ৮৬
A2 মুরালিপুর ফ্রি প্রাইমারি স্কুল ৮৬
A1 দাসপাড়া ৮৭
A1 লাখিমপুর ৮৭
A1 ছোপড়া ৮৭
A1 পাতাগোরা ৮৭
A1 মতিকুন্ডা ৮৭
A1 ঠাকুরবাড়ি ৮৭
A1 রামগঞ্জ ৮৮
A1 গোয়ালপোখার ৮৮
A1 দারিভির ৮৮
A1 রশখোয়া ৮৮
A1 আতিয়াখড়ি ৮৮
A1 সুজালি ৮৮
A2 ফকিরগঞ্জ অভ্যর্থনা কেন্দ্র ৮৩
A2 জয়দেবপুর মাদ্রাসা অভ্যর্থনা কেন্দ্র ৮৯
A2 সাফানগর অভ্যর্থনা কেন্দ্র ৮৯
A2 কুমারগঞ্জ অভ্যর্থনা কেন্দ্র ৮৯
A2 গোপালগঞ্জ অভ্যর্থনা কেন্দ্র ৮৯
A2 রাধানগর অভ্যর্থনা কেন্দ্র ৮৯
A2 বতুন অভ্যর্থনা কেন্দ্র ৮৯
A2 ধর্মপুর অভ্যর্থনা কেন্দ্র ৮৯
A2 মালনি ৯০
A2 নাওদা ৯০
A2 ডালিমগাঁও ৯০
A2 মহারাজাহাট ৯০
A2 রামপুরা ৯০
A2 বংশীহারি ৯০
A1 দার্জিলিং কান্তিভিলা ৯১
A1 জলপাইগুড়ি সন্যাসীকথা ৯২
A1 অময়দিঘী ৯২
A1 জাতীয়কলি ৯২
A1 মনুয়া গাছ ৯২
A1 শক্তি (২টি ক্যাম্প) ৯২
A1 বেরুবাড়ি (২টি ক্যাম্প) ৯২
A1 পাটকাটা ৯২
A1 দ্রাঙ্গি ৯৩
A1 পানিজেহাটি ৯৩
A1 রঙ ধামালি ৯৩
A1 গুমিরা পাড়া ৯৩
A1 মানিকগঞ্জ ৯৩
A1 সারুল্লা ক্যাম্প ৯৩
A1 পলিটেকনিক ৯৩
A1 বলরামহাট ৯৩
A1 পানবাড়ি ৯৩
A1 বন্ধুনগর ৯৩
A1 জল্পেশ (২টি ক্যাম্প) ৯৩
A1 মাওয়াগাছ ৯৩
A1 ডাবগাছ ৯৩
A1 ডাঙ্কিমারি ৯৩
B1 হলদিবাড়ি ৯৪
B1 দেওয়ানগঞ্জ ৯৪
A1 ডুয়ারস সমবায় চাল কল ক্যাম্প ৯৫
A1 বশিলারগঙ্গা বাগজান ৯৫
A1 ডাঙ্গি ৯৬
B1 লক্ষ্মীকান্ত ৯৭
B1 রঙ্গতি ৯৭
B1 আগরাভাসা ৯৭
A1 মাতিয়ালি ৯৮
A1 বড়দিঘী ৯৮
B1 কুচবিহার দেওয়ানহাঁট রেলওয়ে স্টেশন (২ টি ক্যাম্প) ৯৯
B1 মক্কাতি পুশ্নবঙ্গ ৯৯
B1 ধুনপুর ৯৯
B1 নাতুয়ারপার ৯৯
B1 রাজারহাট ৯৯
B1 মধুপুর ৯৯
B1 পুন্ডিবাড়ি গার্লস স্কুল (৬ টি ক্যাম্প) ৯৯
B1 পাতলাখাওয়া কমপ্লিট বেসিক স্কুল ৯৯
B1 কড়ালিরডাঙ্গা ক্যাম্প নং ১ ও ২ ৯৯
B1 দীনেশ্বরী জুনিয়র হাই স্কুল ৯৯
B1 খারিজা কাকড়িবাড়ি ৯৯
A1 দেওয়ানগজ ট্রানজিট ক্যাম্প (গিরিমঠ) ১০০
A1 সুইডিশ মিশন ক্যাম্প ১০০
A1 হাওড়াডাঙ্গা ক্যাম্প ১০০
A1 হলদিবাড়ি জুট গোডাউন (২ টি ক্যাম্প) ১০০
A1 চ্যাংড়াবান্ধা হাই স্কুল (৫ টি ক্যাম্প) ১০০
A1 জামালদহ সমি পার্মানেন্ট (৩ টি ক্যাম্প) ১০০
A1 রাণিরহাট স্কুল ১০০
A1 ধাপড়াহাট স্কুল ১০০
A1 ডাঙারবাট স্কুল ১০০
B1 জলধোয়া ১০১
B1 জোরাই ১০১
B1 বকশির হাট ১০১
B1 দেওছড়ি ১০১
B1 বলরামপুর ১০১
B1 বালাভুত ১০১
B1 ঝাওকুঠি ১০১
B1 পাগলার হাট ১০২
B1 রাথের ডাঙ্গা (২টি ক্যাম্প) ১০২
B1 নগরলাল বাজার (২টি ক্যাম্প) ১০২
B1 বড় মরিচ (২টি ক্যাম্প) ১০২
B1 গোসাইর হাট ১০২
B1 ডাকালির হাট ১০২
B1 ডাকঘর ১০২
B1 খলিশামারি ১০২
B1 ছোট শালবাড়ী ১০২
B1 বাড়াউনিডাঙ্গা ১০২
B1 কাজীর দিঘি ১০২
B1 রাণির দিঘি ১০২
B1 ঘোঘ্রাডাঙ্গা ১০২
B1 কৃষ্ণ কলোনি ১০২
B1 বসন্তবাবুর ডাঙ্গা ১০২
B1 সুয়ান ঘাট ১০২
B1 চান ঘাট ১০২
B1 নাকাতি ১০২
B1 কালীগঞ্জের ডাঙ্গা ১০২
B1 বাঘমারার দিঘী ১০২
B1 বামন ডাঙ্গা ১০২
B1 গোলেন ঘাটি (৩ টি ক্যাম্প) ১০২
B1 নগরলাল বাজার সুকান দিঘি ১০২
B1 দেওয়ান স্ট জয়দুয়ার (২টি ক্যাম্প) ১০২
B1 জাতামারি ১০২
B1 ছাতলা বাজার ১০২
B1 বড়মাসিয়া ১০২
B1 ভোগরাম গুড়ি ১০২
B1 অশোকবাড়ি ১০২
B1 অঙ্গরকাটা পরদেবী ১০২
B1 পাতা কুমারি ১০২
B1 ঘোকসার ডাঙ্গা ১০২
B1 বুড়ি হাট (২টি ক্যাম্প) ১০৩
B1 খলিশা গোসানি মারি ১০৩
B1 কালিগঞ্জ ১০৩
B1 বাসন্তির হাট (২টি ক্যাম্প) ১০৩
B1 বিনিতাগুড়ি ১০৩
B1 কিসামাতদা সাভাম (৩টি ক্যাম্প) ১০৩
B1 বড়ডাঙ্গা ১০৩
B1 নিগাম নগর (৩টি ক্যাম্প) ১০৩
B1 খরখরিয়া ১০৩
B1 বালিকা ১০৩
B1 পুটিমারি ১০৩
B1 ছাড়াবাড়ি ১০৩
B1 পেটলা ১০৩
B1 রসবাড়ির মঠ ‘এ’ ১৩৩
B1 বর্ণচেনা ১০৩
B1 ছোটফলিমারি ১০৩
B1 জমাদারের বশ (৫টি ক্যাম্প) ১০৩
B1 সিতাই স্কুল (২টি ক্যাম্প) ১০৩
B1 কায়েতের বাড়ি ১০৩
B1 চামলা ১০৩
B1 আদাবাড়ি ১০৩
B1 বালাপুকুরি ১০৩
B1 ব্রক্ষাতাহোত্রা ১০৩
B1 বিজলি ছটকা ১০৩

মেঘালয়

C2 গারো পাহাড় বাঘমারা ১০৪
C2 ডালু ১০৫
C2 চন্দাভুই ১০৬
C2 চিচেংপাড়া হাট ১০৬
C2 হালজাতি হাট ১০৭
C2 মাচাং পানি ১০৮
C2 আম্পাতি ১০৮
C2 চেবেনাং ১০৮
C2 মাইনেং ১০৯
C2 শিব বাড়ি ১০৯
C2 বিকোনা ১১০
B2 পরাকাসুয়া হাট ১১১
B2 কলাইপাড়া ১১২
B2 দোমাপাড়া ১১২
E2 খাসিয়া ও জৈন্তা পর্বত পংতুং ১১৩
E2 মদন লাইন্তদ ১১৪
E2 মদন বৈতাহ ১১৫
E2 সৌলং ১১৬
E2 আমত্রং ১১৭
E2 দিএংরাই ১১৮
E2 আম্লারেম ১২৯
E2 আমলারেম ১২৯
E2 আমসহমালেং ১২০
C2 ডালট ১২১
C2 লাল পানি ১২১
D2 মউয়াছড়া ১২২
D9 পাঞ্চারিং ১২৩
D2 মুনাই ১২৪
E2 সিন্ডাই ১২৫
D2 শেল্লা ১২৬
D2 ইশামতি ১২৬
D2 মাইল্লাম ১২৭
D2 ওয়াহ্রেংকা ১২৮

রাইসা সাবিলা
<৮,৯১,৫৭৩-৭৪>
পরিশিষ্ট-১
১৯৭১ সালে পাক বাহিনী ও তাদের দোসরদের দ্বারা নিহত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্র ও কর্মকর্তাদের নামের একটি তালিকা

-হিস্ট্রি অব দি ইউভার্সিটি অব ঢাকা, সম্পাদনা করেছেনঃ এম, এ রহীম, ১৯৮১

শিক্ষকঃ

১। অধ্যাপক ডঃ জি সি দেব , দর্শন বিভাগ
২। অধ্যাপক মুনির চৌধুরী, বাংলা বিভাগ।
৩। সহযোগী অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, ইংরেজি বিভাগ
৪। ডঃ আবুল খায়ের, ইতিহাস বিভাগ
৫। ডঃ জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, ইংরেজি বিভাগ
৬। এ এন এম মনিরুজ্জামান, পরিসংখ্যান বিভাগ
৭। সহকারি অধ্যাপক ডঃ এম এ মুক্তাদির, ভূতত্ত্ব বিভাগ
৮। ডঃ ফজলুর রহমান খান, মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগ
৯। এস সি ভট্টাচার্য, ইতিহাস বিভাগ
১০। গিয়াস উদ্দিন আহমেদ, ইতিহাস বিভাগ।
১১। ডঃ সাদাত আলি, আই ই আর
১২। আনোয়ার পাশা, বাংলা বিভাগ
১৩। ডঃ ফজলুল মাহি, আই ই আর।
১৪। সিরাজুল হক খান, আই ই আর
১৫। প্রভাষক আতাউর রহমান খান খাদিম, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ।
১৬। সরাফত আলি, গনিত বিভাগ।
১৭। অনুপাধ্যায় ভট্টাচার্য, ফলিত পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ।
১৮। রাশিদুল হাসান, ইংরেজি বিভাগ।

মেডিকেল অফিসারঃ

১। ডঃ এম মুর্তজা

ল্যাবরেটরি স্কুল শিক্ষকঃ

১। মো সাদেক

অন্যান্য কর্মকর্তাঃ

১। আবদুল্লাহ ভুঁইয়া, উচ্চতর অফিস সহকারি, আই ই আর
২। খগেন্দ্র চন্দ্র দে, বেয়াড়া, দর্শন বিভাগ
৩। আব্দুস সামাদ, গার্ড, টি এস সি
৪। দাজ্জুলাল, সুইপার, টি এস সি
৫। আব্দুস শহিদ, লেবার, টি এস সি
৬। পির মুহম্মদ, পিওন, রেজিস্ট্রার অফিস।
৭। সোলায়মান, গার্ড, রোকেয়া হল।
৮। চুন্নু মিয়া, মালি, রোকেয়া হল।
৯। আব্দুল খালেক, মালি, রোকেয়া হল।
১০। আহমদ আলি, লিফটম্যান, রোকেয়া হল।
১১। নুরুল ইসলাম, বেয়াড়া, রোকেয়া হল।
১২। হাফিজ উদ্দিন, বেয়ারা, রোকেয়া হল।
১৩। প্রিয়নাথ রয়, গার্ড, জে এন হল।
১৪। সুনিল চন্দ্র দাস, গার্ড, জে এন হল।
১৫। দুখিরাম মণ্ডল, জে এন হল।
১৬। শামসুদ্দিন, নাইটগার্ড, জে এন হল।
১৭। জওহরলাল, মালি, বোটানি বিভাগ।
১৮। দাসুরাম, মালি, বোটানি বিভাগ।
১৯। সিরাজুল হক, বেয়ারা, ঢাবি ক্লাব।
২০। আলি হুসাইন, বেয়ারা, ঢাবি ক্লাব
২১। সোহরাব আলি গাজি, বেয়ারা, ঢাবি ক্লাব।
২২। শিবপদ কাপুরি, গার্ড, জে এন হল।
২৩। শ্রী মিস্ত্রি, ইলেকট্রিক মিস্ত্রি।
২৪। আব্দুল মাজেদ গাজী, গার্ড, ইঞ্জিনিয়ারিং অফিস।
২৫। সুনিল চন্দ্র দে, গার্ড, জে এইচ হল
২৬। নামি, গার্ড, রোকেয়া হল।

ছাত্রঃ ফজলুল হক হলঃ

১। সিকান্দার আলি (এম এস সি, দ্বিতীয় বর্ষ)
২। আব্দুস সালাম, (অনার্স, ১ম বর্ষ, পরিসংখ্যান বিভাগ)
৩। নজরুল ইসলাম (অনার্স, ৩য় বর্ষ, বাংলা বিভাগ)
৪। গোলাম মাহবুব (অনার্স, ১ম বর্ষ, বায়ো কেমিস্ট্রি)
৫। মুস্তফা হোসেইন, (অনার্স, ৩য় বর্ষ, মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগ)
৬। আবুল ফজল (এম এস সি, ১ম বর্ষ, বায়ো কেমিস্ট্রি)
৭। আবুল কাশিম (অনার্স, ২য় বর্ষ)

ছাত্রঃ জহুরুল হক হলঃ

১। জাফর আলম, (এম এস সি, দ্বিতীয় বর্ষ)
২। হেলানুর রহমান, (অনার্স, ৩য় বর্ষ)
৩। জাহাঙ্গির মুনির, (অনার্স, ৩য় বর্ষ)
৪। আবুল কালাম, (এম কম, ১ম বর্ষ)
৫। আবুল তাহের পাঠান (২য় বর্ষ, আইন বিভাগ)
৬। সালেহ আহমেদ (২য় বর্ষ, আইন বিভাগ)
৭। আশরাফ আলি, (এম এ, ১ম বর্ষ)

ছাত্রঃ সূর্যসেন হলঃ

১। জিল্লুর মুরশেদ মিঠু
২। বদিউল আলম
৩। শামসুজ্জামান
৪। আব্দুর রহিম
৫। আতাউর রহমান
৬। আমিরুল সালাম
৭। আতিকুর রহমান

ছাত্রঃ হাজি মোঃ মুহসিন হলঃ

১। এ কে এম মিরাজ উদ্দিন
২। লেফটেন্যান্ট সামাদ
৩। নিজামুদ্দিন ভুঁইয়া
৪। আনোয়ার হুসেইন
৫। সৈয়দ নুরুল আমিন
৬। খন্দকার আবু তাহের
৭। জাহাঙ্গীর হায়দার খান
৮। জহিরুল ইসলাম
৯। মোশাররফ হোসেন
১০। মঞ্জুর রহমান চৌধুরী

ছাত্রঃ সলিমুল্লাহ হলঃ

১। ওয়াহিদুর রহমান (বি এ ৩য় বর্ষ, অনার্স)
২। নিজামুদ্দিন আজাদ (বি এ ৩য় বর্ষ, অনার্স)
৩। লুৎফুল আজিম (বি এ ২য় বর্ষ, অনার্স)
৪। নজরুল ইসলাম (বি এ ২য় বর্ষ, অনার্স)
৫। সিকান্দার হায়াত খান (এম, এ)
৬। শাহজাহান চৌধুরী (১ম বর্ষ, এম এস সি)
৭। শাহজাহান কবীর (অনার্স, ৩য় বর্ষ)
৮। আবদুস সালাম (২য় বর্ষ, এম, এ)
৯। নাসিম মহসীন (৩য় বর্ষ, বিএ অনার্স)

ছাত্রঃ শহীদুল্লাহ হলঃ

১। জালালুদ্দিন হায়দার, ( ফলিত পদার্থ বিজ্ঞান, এম এস সি, ১ম বর্ষ)

ছাত্রঃ জগন্নাথ হলঃ

১। স্বপন চৌধুরী
২। গনপতি হালদার
৩। মৃণাল কান্তি বোস।
৪। মনোরঞ্জন বিশ্বাস
৫। রমণী মোহন ভট্টাচার্য
৬। কিশোরী মোহন সরকার
৭। রনদাপ্রসাদ রয়
৮। সুবল চন্দ্র চক্রবর্তী
৯। ভবতোষ ভৌমিক
১০ ননীগোলাপ ভৌমিক
১১। বড়দা কান্ত তরফদার
১২। সত্যরঞ্জন দাস
১৩। কেশব চন্দ্র হালদার
১৪। নির্মল কুমার রয়
১৫। বিধান চন্দ্র ঘোষ
১৬। শিবু কুমার দাস
১৭। শিশুতোষ দত্ত চৌধুরী
১৮। রাখাল চন্দ্র রয়
১৯। উপেন্দ্রনাথ রয়
২০। সন্তোষ কুমার রয়
২১। জীবন কৃষ্ণ সরকার
২২। সত্যরঞ্জন নাগ
২৩। রুপেন্দ্রনাথ সেন।
২৪। মুরারি মোহন বিশ্বাস
২৫। বিমল চন্দ্র রয়
২৬। প্রবীর পাল
২৭। নিরঞ্জন হালদার
২৮। কার্তিক শীল
২৯। পল্টন দাস
৩০। সুজিত দত্ত
৩১। নিরঞ্জন সাহা
৩২। হরিনারায়ন দাস
৩৩। দিনেশ চন্দ্র শিকদার
৩৪। নিরঞ্জন চন্দ্র
৩৫। সুব্রত সাহা
৩৬। প্রদীপ নারায়ণ রায় চৌধুরী
৩৭। আনন্দ কুমার দত্ত
৩৮। রবিন রায়
৩৯ সুশীল চন্দ্র দাস
৪০। সুভাষ চক্রবর্তী
৪১। অজিত রয় চৌধুরী

‘বাসন্তিকা’ হীরক জয়ন্তী সংস্করনে নিম্নোক্ত নামগুলি উল্লেখ করা হয়েছে, কিন্তু এরা ছাত্র না কর্মকর্তা তা উল্লেখ করা হয় নিঃ

১। শিবু মোদক
২। মতিলাল দে
৩। বুধিরাম
৪। দেগুরাম
৫। ভিরুরাম
৬। মনভরণ রাম
৭। মনিলাল।

শহীদ অতিথি শিক্ষার্থীদের তালিকাঃ

১। লতিফুর রহমান (হাজি আসমত কলেজ)
২। বদরুদ্দোজা (জে এন কলেজ)
৩। মাহতাবউদ্দিন (বাজিতপুর কলেজ)

– ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস, ১৯৮১
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রকাশিত

শাহরিয়ার রাফি
<৮,৯২,৫৭৫-৭৮>
পরিশিষ্ট-২
শহীদ বুদ্ধিজীবী ও বিভিন্ন পেশাজীবীদের নামের আরেকটি তালিকা

-বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত, ১৬ ডিসেম্বর্ ১৯৭২

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এর শিক্ষকগণ :

প্রফেসর কাইয়ুম,
হাবিবুর রহমান,
শ্রী সুখরঞ্জন সমাদ্দার্।

M.C.A দের নামের তালিকা :

মশিউর রহমান ,
আমজাদ হোসাইন,
আমিনুদ্দীন ,
নাজমুল হক সরকার ,
আব্দুল হক ,
ড. জিকরুল হক ,
সৈয়দ আনোয়ার আলী,
এ . কে . সরদার্।

সাংবাদিকদের নামের তালিকা :

সিরাজউদ্দিন হোসেন,
শহীদুল্লাহ কায়সার,
খন্দকার আবু তালেব ,
নিজামুদ্দিন আহমেদ,
এ . এন . এম গোলাম মোস্তফা,
শহীদ সাবের,
শেখ আব্দুল মান্নান ( লাদু) ,
নাজমুল হক ;
এম আখতার;
আবুল বাশার;
চিশতী হেলালুর রহমান;
শিবসদন চক্রবর্তী;
সেলিনা আখতার্।

চিকিৎসক দের নামের তালিকা:

মোঃ ফজলে রাব্বী ,
আব্দুল আলীম চৌধুরী ;
শামসুদ্দিন আহমদ;
আজহারুল হক;
হুমায়ূন কবীর;
সুলায়মান খান;
কায়সার উদ্দিন;
মনসুর আলী;
গোলাম মুর্তজা;
হাফেজ উদ্দিন খান;
জাহাঙ্গীর;
আব্দুল জব্বার;
এস . কে . লাল;
হেম চন্দ্র বসাক;
কাজী ওবায়দুল হক;
মিসেস আয়েশা বেদোরা চৌধুরী;
আল-হাজ্ব মমতাজ উদ্দিন;
হাসিময় হাজরা;
নরেণ ঘোষ ;
জিকরুল হক;
শামসুল হক;
এ.গফুর;
মনসুর আলী;
এস.কে.সেন;
মফিজুদ্দিন;
অমূল্য কুমার চক্রবর্তী;
আতিকুর রহমান;
গোলাম সরওয়ার;
আর.সি.দাস;
মিহির কুমার সেন;
সালেহ আহমেদ;
অনীল কুমার সিনহা,
সুনীল চন্দ্র শর্মা,
আ, কে , এম গোলাম মোস্তফা,
মকবুল আহমেদ,
এনামুল হক;
মনসুর(কানু);
আশরাফ আলী তালুকদার;
লেফটেনেন্ট জিয়াউর রহমান;
লেফটেনেন্ট কর্নেল জাহাঙ্গীর;
বদিউল আলম;
লেফটেনেন্ট কর্নেল হাই;
মেজর রেজাউর রহমান;
মেজর নাজমুল ইসলাম;
আসাদুল হক;
নাজির উদ্দিন;
লেফটেনেন্ট নূরুল ইসলাম;
কাজল ভদ্র;
মনসুর উদ্দিন।

*ঢাবির শিক্ষকদের নাম পরিশিষ্ট-১-এ আছে

অন্যান্য:

জহির রায়হান( সাহিত্যিক );
পূর্ণেন্দু দস্তিদার(সাহিত্যিক );
ফেরদৌস দৌলাহ্ (সাহিত্যিক );
মেহেরুন্নেসা (সাহিত্যিক );
আলতাফ মাহমুদ(শিল্পী );
দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা(আর.পি.সাহা);
জোগেশ চন্দ্র ঘোষ( আয়ুর্বেদ শাস্ত্রী);
ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত( রাজনৈতিক নেতা) ;
শামসুজ্জামান ( চীফ ইঞ্জিনিয়ার );
মাহবুব আহমেদ( সরকারি কর্মকর্তা);
খুরশীদ আলম(ইঞ্জিনিয়ার );
নজরুল ইসলাম( ইঞ্জিনিয়ার );
মোজাম্মেল হক চৌধুরী (ইঞ্জিনিয়ার );
মহসিন আলী(ইঞ্জিনিয়ার );
মুজিবুল হক(সরকারি কর্মকর্তা)

জেলাওয়ারি শহীদ শিক্ষাবিদদের (বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বাদে) এবং আইনজীবীদের তালিকাঃ

জেলা ও বিভাগ শিক্ষাদাতা আইনজীবি
প্রাথমিক মাধ্যমিক কলেজ
১ ২ ৩ ৪ ৫
ঢাকা ৩৭ ৮ ১০ ৬
ফরিদপুর ২৭ ১২ ৪ ২
টাঙ্গাইল ২০ ৭ ২ –
ময়মনসিংহ ৪৬ ২৩ ১ ২
ঢাকা বিভাগ ১৩০ ৫০ ১৭ ১০
চট্টগ্রাম ৩৯ ১৬ ৭ ১
পার্বত্য চট্টগ্রাম ৯ ৪ ১ ১
সিলেট ১৯ ৭ – ২
কুমিল্লা ৪৫ ৩৩ ১ ৪
নোয়াখালী ২৬ ১৩ ৪ ২
চট্টগ্রাম বিভাগ ১৩৮ ৭৩ ১৩ ১০
খুলনা ৪৮ ১৫ ২ ২
যশোর ৫৫ ৩১ ৫ ৪
বরিশাল ৫০ ২১ ৪ –
পটুয়াখালী ৩ ১ – –
কুষ্টিয়া ২৮ ১৩ ৪ –
খুলনা বিভাগ ১৮৪ ৮১ ১৫ ৬
রাজশাহী ৩৯ ৮ ৩ ৫
রংপুর ৪১ ২২ ৯ ৪
দিনাজপুর ৫০ ১০ ১ ২
বগুড়া ১৪ ১২ – ২
পাবনা ৪৩ ৯ ১ ২
রাজশাহী বিভাগ ১৮৭ ৬১ ১৪ ১৫
বাংলাদেশ ৬৩৯ ২৬৫ ৫৯ ৪১
১। মোট শিক্ষাদাতা/ শিক্ষকের মোট সংখ্যা (বিশ্ববিদ্যালয় ব্যতীত) ৯৬৩
২। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাদাতা/ শিক্ষকের মোট সংখ্যা ২১
সর্বমোট ৯৮৪

সূত্রঃ নুরুল ইসলাম পাটোয়ারীর
“বুদ্ধিজীবী ও বুদ্ধিবৃত্তিক হত্যাযজ্ঞ”

মাধ্যমিক এর যোগ ভুল ছিল। এখানে সংশোধন করা আছে। তাই পুরো ছকেই এর প্রভাব পড়েছে।

**ঢাকা পোস্ট গ্র্যাজুয়েট মেডিকেল ইন্সটিটিউটের সূত্রে অতিরিক্ত আরো কয়েকজন ডাক্তারের নাম পাওয়া যায়। সেগুলো হলোঃ

লে: এ.এফ.এম ফারুক;
মুজিবুদ্দিন আহমেদ;
লে: এনামুল হক;
ডাঃ মুনসুর রহমান;
ডাঃ গোপাল চন্দ্র সাহা;
ডাঃ এ নরেন্দ্র নাথ দত্ত;
ডাঃ এ . বি .এম নুরুল আলম;
ডাঃ এ মুকতাদির;
ডাঃ রেবতী কান্ত সান্যাল;
ডাঃ ক্ষিতীশ চন্দ্র দে;
ডাঃ এ. রহমান;
ডাঃ এ.নওশের আলী;
ডাঃ সাইদ মোহিদ ইমাম;
ডাঃ মোঃ বজলুল হক;
ডাঃ মেজর আমিনুল ইসলাম, এ .এম. সি;
লে:ক: বি .এ. চৌধুরী এ , এম , সি;
লে: মোঃ আমিনুল হক;
লে: খোন্দকার নুরুল ইমাম এ ,এম, সি;
ডাঃ রফিক আহমেদ।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!