(চিঠিঃ ১)
একাত্তরের ২৬ মার্চ রাতের হত্যাযজ্ঞের কথা উল্লেখ করে জনৈক আবদুল করিম একাত্তরের ৮ই জুন হিউম্যান রাইটস কমিশন, সুইজারল্যান্ডে একটা চিঠি পাঠান। এখানে তিনি উল্লেখ করেন যে,
পাকিস্তানি সেনারা ঐদিন রাত আনুমানিক ১০ টার দিকে ঢাকার মালিবাগে তার বাসায় হামলা করে।
বাসায় ঢুকেই তাঁর বাবাকে জিজ্ঞাসা করে, তুমি কি বাঙালি? তার বৃদ্ধ বাবা উত্তর দেয়, হ্যাঁ। তখন সেনারা সরাসরি তাঁর উপরে গুলি চালায়।
পরে তার ভাইকেও একই প্রশ্ন করা হয়, উত্তর একই হওয়ায় তাকেও গুলি করা হয়।
যখন আবদুল করিমকেও এই প্রশ্ন করা হলো, তখন আবদুল করিম চালাকির সাথে উত্তর দেন যে, সে কেবল একজন অতিথি। তারপর পাক সেনারা তাকে জিজ্ঞাসা করে, সে কি হিন্দু? জবাবে করিম বলেন যে, সে একজন মুসলিম এবং পশ্চিম পাকিস্তানে থাকেন।
পরে পাকিস্তানি সেনারা তাকে ছেড়ে দিয়ে ঘর ছেড়ে চলে যায়।
(চিঠিঃ২)
জনৈক এ, বি এম কায়সার আহমেদ একাত্তরের ১০ ই জুন হিউম্যান রাইটস কমিশন, সুইজারল্যান্ডে একটা চিঠি পাঠান। এখানে তিনি উল্লেখ করেন যে, তাঁর বাড়ি ছিল কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দিতে। মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রাণ বাঁচাতে তিনি ভারতের আগরতলায় পালিয়ে যান। তাঁর ভাষ্যেঃ
“পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বরতা ও নৃশংসতা ছিল তুলনাহীন। ঢাকা থেকে শুরু করে নারায়ণগঞ্জ, তালতলা, মুন্সিগঞ্জ, সিরাজদিঘা ও গজারিয়া পুলিশ স্টেশনে তারা অত্যাচারের অসংখ্য চিহ্ন রেখে যায়। রাতের অন্ধকারে তারা অগুনতি নিরীহ মানুষ হত্যা করে। কেবলমাত্র গজারিয়াতেই তারা ৮ শতাধিক নারী,পুরুষ ও শিশু হত্যা করে।সেই সাথে টাকা,গয়না ও মূল্যবান সবকিছু লুট করে নেয়।
প্রকাশ্য দিবালোকে তারা ১২ থেকে ৩০ বছর বয়সী মহিলা ও মেয়েদের বন্দি করে, কালো কাপড় দিয়ে চোখ বেধে মিলিটারি ক্যাম্পে নিয়ে যেত। সেখান থেকে তাদের পশ্চিম পাকিস্তানে চালান করে দেয়া হত।
কায়সার আহমেদ নিজে হাত বাঁধা অবস্থনায় শতাধিক যুবকের লাশ নারায়নগঞ্জের গোদাইলে অবস্থিত বার্মা ইস্টার্ন কোম্পানি ও ইএসএসও কোম্পানির বারান্দায় পড়ে থাকতে দেখেন। পরে এই লাশগুলো নদীতে ফেলে দেয়া হতো।
এলাকার কিশোরী থেকে ষাট বছর বয়সী কোন মহিলাকেই ছাড় দেয়া হত না। তাদের ধর্ষন ও হত্যার পর ফেলে দেয়া হত। একই ধরনের বর্বরতা তারা নারায়ণগঞ্জ টার্মিনাল জেটি ও ফতুল্লাতেও চালায়।
ইয়াহিয়া সরকার ১২ থেকে ৩০ বছরের সবাইকে সেনা ক্যাম্প থেকে আইডেন্টিটি কার্ড নেয়ার জন্য আদেশ জারি করে। কিন্ত দুর্ভাগ্যবশত তাদের কেউই আর কখনো ফিরে আসে নি। তাঁদের ভাগ্যে কি ঘটেছিল তা সহজেই অনুমেয়।
যখন মুক্তিকামী যোদ্ধারা উল্টা আক্রমন শুরু করল,পাক সেনারা তখন কেবল নিরীহ গ্রামবাসীদের মেরেই ক্ষান্ত হল না। তাদের কবল থেকে দুধের শিশু থেকে শুরু করে বয়োবৃদ্ধ, কেউই ছাড় পেল না। গ্রামের পর গ্রাম তারা জ্বালিয়ে দিতে লাগল।
৭ই মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নির্দেশে সব ধরনের কর প্রদান বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। ফলে পাকিস্তান সরকার অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দিল। শুধু তাই নয়, ঘোষনা প্রদান করল যে, ১৫ই মে ১৯৭১ এর মাঝে যারা সমস্ত কর পরিশোধ করবে না, তাঁদের স্থাবর অস্থাবর সব ধরণের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে।
এদিকে টিক্কা খানের মদদে বিশ্বাসঘাতক বিহারীরা নিরীহ বাঙ্গালিদের উপর ঝাপিয়ে পড়ল। তাদের ঘরবাড়ি লুট ও অগ্নিসংযোগ করা হল। মেয়েদের জোরপূর্বক অপহরণ ও ধর্ষন করা হল। তাদের অপরাধ সকল মাত্রা ছাড়িয়ে গেল।
তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে যুবক ছেলেদের ধরে আনতো। তাঁদের হাত পা বেঁধে, শরীরে জখম করে দেহের সমস্ত রক্ত বের করে ফেলতো এবং লাশগুলোকে জলে ভাসিয়ে দিতো।
(চিঠিঃ৩)
মুক্তিযুদ্ধের সময় কুমিল্লা জেলার কোতোয়ালি থানার অন্তর্গত বিজয়পুর হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন ফজলুল হক। বাসা বাঞ্ছারামপুর। তিনি একাত্তরের ১১ই জুন হিউম্যান রাইটস কমিশন, সুইজারল্যান্ডে একটা চিঠি পাঠান। এখানে তিনি উল্লেখ করেন যে,
১৯৭১ সালের এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে পাক সেনারা বিজয়পুরে অবস্থিত বাগমারা হাই স্কুল ও কায়েদে আজম হাই স্কুলে আক্রমণ করে।
তারা স্কুলের সব দরজা- জানালা, ল্যাবের সব যন্ত্রপাতি, আসবাব পত্র, অফিস সংক্রান্ত কাগজপত্র সবকিছু ধ্বংস করে। পরবর্তীতে তারা মীরাবাজার উচ্চ বিদ্যালয়েও একই ভাবে হামলা করে এবং পুরো স্কুলঘর জ্বালিয়ে দেয়। পাক সেনারা আলেকদিয়া গ্রাম থেকে দুইজন ছাত্রকে ধরে নিয়ে যায়। যারা আর কখনো ফিরে আসে নি।
মে মাসের শেষ সপ্তাহে পাকিস্তানি সৈন্যরা বরুরা নামক গ্রাম থেকে দুইজন কমবয়সী মেয়েকে জিপে তুলে নিয়ে লালমাই হয়ে কুমিল্লার পথে যাত্রা করে এবং ধর্মপুর নামক গ্রামের পাশে তাদের একজনকে তারা খোলা রাস্তায় ধর্ষন করে।
লালমাইয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি ঘাঁটি ছিল। সেখানে তারা ইচ্ছামত লোক ধরে আনত এবং খেয়ালখুশিমত তাদের হত্যা করত। সেখান থেকে ভাগ্যগুনে বেচে ফিরে আসা কয়েকজন তাকে এই তথ্যগুলো জানায়।
যাদেরকে হত্যা করা হত, তাদের লাশ লালমাই পাহাড়ের ভিতর অবস্থিত সি এন্ড বি ডাকবাংলোর পাশের একটি গর্তে ফেলা হত। অপহরণকৃত মহিলা ও মেয়েদের জন্য তাদের আলাদা আলাদা তাবু ছিল, যেখানে পাকিস্তানিরা তাদের যৌনলালসার নিবৃত্তি করত। সেখান থেকে একজন লোক পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়। যাকে বলা হয়েছিল একটি মেয়ের লাশ ফেলে দিয়ে আসার জন্য। মেয়েটিকে পর্যায়ক্রমে অসংখ্যবার ধর্ষন ও অত্যাচার করে হত্যা করা হয়েছিল।
চিঠি লেখাকালে লেখক পালিয়ে আগরতলা গিয়ে তদকালীন এম্পি প্রফেসর খুরশিদ আলমের সাথে আগরতলায় অবস্থান করছিলেন।
(চিঠিঃ ৪)
তাজুল ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩য় বর্ষে পড়তেন। থাকতেন সলিমুল্লাহ হলে। তিনি একাত্তরের ১৭ই জুন হিউম্যান রাইটস কমিশন, সুইজারল্যান্ডে একটা চিঠি পাঠান। এখানে তিনি উল্লেখ করেন যে,
পাকসেনারা যখন আধুনিক সব অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে আক্রমণ শুরু করে, তখন সলিমুল্লাহ হলের ছাত্রদেরকেই সবচেয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। এর এক সপ্তাহ আগেই পাক সেনারা ডাকসুর সাংস্কৃতিক পরিষদের সেক্রেটারি ইকবাল আহমেদ ও তার ছোট ভাইকে গ্রেফতার করে। যাদের খোঁজ আর কখনোই পাওয়া যায় নি। গজারিয়ায় পাকিস্তানি সেনারা অসংখ্য নিরপরাধ ও নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করে। উনি ভয়ে ইন্ডিয়া পালানোর কথা ভাবছিলেন এবং এই চিঠিটি ওখান থেকে পোস্ট করার চিন্তা করছিলেন।
ছাত্র কমিউনিটির একজন হিসাবে তিনি এ সময় এই ঘটনার বিরুদ্ধে দ্রুত কার্যকরী প্রতিরোধের দাবি জানান।
(চিঠিঃ ৫)
জনাব নুরুল আমিন থাকতেন টি এন্ড টি কলোনিতে (মগবাজার, ওয়ার্লেস)। তিনি একাত্তরের ২২ শে জুন হিউম্যান রাইটস কমিশন, সুইজারল্যান্ডে একটা চিঠি পাঠান। এখানে তিনি উল্লেখ করেন যে,
যখন ঢাকা শহরজুড়ে পূর্নমাত্রায় মিলিটারি অপারেশন শুরু হয়, তখন বাইরের জেলা থেকে অবাঙালি পশ্চিম পাকিস্তানি বিহারিরা দলে দলে ঢাকায় এসে লুটতরাজ শুরু করে।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রাও ফরমান এর নির্দেশে তারা একের পর এক হিন্দু বাড়ি দখল ও লুট করতে লাগল। অবাঙ্গালি পুলিশ সদস্যরা প্রতিনিয়ত বাঙ্গালিদের উপর অত্যাচার করতে লাগল। রাতের বেলা পাক সেনারা যাত্রাবাড়ি ও গোপীবাগ এলাকা ঘিরে ফেলে, ঘর থেকে যুবক ছেলেদের ধরে নিয়ে যায়। যাদের আর কখনোই দেখা যায় নি। রাজারবাগে পাক সেনারা সিভিল ড্রেসে টহল দিত, যদিও তাদের সাথে অস্ত্র থাকত। তারা বাড়িতে ঢুকে ঢুকে ধর্ষন করত। একই সপ্তাহে তারা নরসিংদীতেও এভাবে আক্রমন চালায়।
অবাঙ্গালি পুলিশ সদস্যরা নিউ মার্কেট সংলগ্ন এলাকায় মেয়েদের উত্ত্যাক্ত করত এবং জোরপূর্বক তুলে নিয়ে যেত।
(চিঠিঃ ৬)
একুশ বছর বয়েসি আবদুল কাদের ঢাকা বিষ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন। তার পিতার নাম ছিল মৌলভি আলী। পৈতৃক নিবাস কালিগঞ্জ থানার চরসিন্দুর উপজেলার চালনা গ্রামে। তিনি একাত্তরের ২৩ শে জুন হিউম্যান রাইটস কমিশন, সুইজারল্যান্ডে একটা চিঠি পাঠান। এখানে তিনি উল্লেখ করেন যে,
একাত্তরের মার্চের ২৫ তারিখ তিনি মালিবাগে অবস্থান করছিলেন। আনুমানিক রাত ১২ টার দিকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অত্যাধুনিক সব অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে রাজারবাগ পুলিস লাইন আক্রমণ করে।
পরদিন রাজারবাগ দিয়ে যাওয়ার সময় তিনি অসংখ্য মৃতদেহ এখানে সেখানে বিচ্ছিন্নভাবে পড়ে থাকতে দেখেন। কিছু পাকা দালান ও পুলিস সদস্যদের থাকার জন্য টিনশেড ঘরগুলো আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হয়। ২৬ তারিখে উনি ইকবার হল, এস এম হল, জগন্নাথ হল ও রোকেয়া হল পরিদর্শনে যান। দেখেন যে, ছাত্রদেরকে মেরে রাস্তায় ফেলে রাখা হয়েছে এবং তাদের বইপত্র মাঠে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে।
জগন্নাথ হলকে প্রায় পুরোপুরি ধ্বংস করা হয় এবং অসংখ্য ছাত্রকে হত্যা করা হয়। রোকেয়া হলের নিচ তালায় তারা অগ্নিসংযোগ করে। সবগুলো শহীদ মিনার ও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাশে একটি নির্মাণাধীন জামে মসজিদ তারা ধ্বংস করে।
পাক সেনারা নরসিংদী বাজার শেল, মর্টার ও অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে প্রায় সম্পূর্ন ধ্বংস করে ফেলে। স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় এলাকার প্রতিটি হিন্দু বাড়িতে হত্যা,ধর্ষন ও লুটতরাজ চালায়। এলাকার সব স্কুল, কলেজ ও শহীদ মিনারের ক্ষতি করে।
পাশ্ববর্তী গ্রামগুলোতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রদের খোজ করতে থাকে এবং পাওয়া মাত্রই হত্যা করে। যুবতী মেয়েদের ধরে নিয়ে ধর্ষন করা হত। তারা নরসিংদী, ঘোড়াশাল, ও পলাশে সেনা ক্যাম্প স্থাপন করে। যুবকদের ধরে এনে তাদের শরীর কেটে দিত এবং মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত রক্ত ঝরাতো। পুরুলিয়া, জিনারদি ও কৌশল্যা গ্রামের সকল বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয় এবং হিন্দু মুসলমান মিলিয়ে প্রায় ৪০০/৫০০ মানুষ হত্যা করা হয়। রায়পুরা হাইস্কুল সম্পূর্ণ জ্বালিয়ে দেয়া হয় এবং শহীদ মিনার ভেঙে হত্যা করা হয়।
ছাত্র, হিন্দু, আওয়ামীলীগ এর সদস্য ও মহিলারা ছিল তাদের প্রথম টার্গেট।
বিহারীরা মুসলিম লীগের অনুসারীদের চূড়ান্তভাবে পরাজিত করে। জামায়াতে ইসলামের প্রফেসর ইউসুফ আলী এবং মাহতাব উদ্দিন সংঘটনের সদস্যদের অস্ত্র শিক্ষা দিতেন এবং তাদের দিয়ে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড পরিচালনা করেন।
এই লোকেরা গত নির্বাচনে তাদের শোচনীয় পরাজয়ের বদলা নিতে থাকে এবং পাক সেনারা তাদের নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারে তাদের ব্যবহার করতে থাকে। পাকিস্তানি বাহিনী অত্যন্ত সুকৌশলে এদেশের বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠী নির্মূল করতে থাকে।
(চিঠিঃ ৭)
রনেন্দ্র দাস ছিলেন নোয়াখালী সদর পুলিসের সাব-ইনস্পেক্টর। থাকতেন মাইজদির সরকারি বাস ভবনে। পাকিস্তানিরা আক্রমণ শুরু করলে তিনি লক্ষ্মীপুরের বড়তলীতে আশ্রয় নেন। তিনি একাত্তরের ৩ রা জুন হিউম্যান রাইটস কমিশন, সুইজারল্যান্ডে একটা চিঠি পাঠান। এখানে তিনি উল্লেখ করেন যে,
মে মাসের ৭ তারিখে পাকি সেনারা তার মেয়ের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সহ আরো অনেক হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়। তারা ধান ক্ষেতে নির্বিচারে গুলি করে কৃষকদের হত্যা করে। একই দিনে তারা ২১ টি হিন্দু-মুসলিম বাড়ি পুড়িয়ে দেয় এবং ৩২ জন মানুষ হত্যা করে।
৯ তারিখে পাক সেনারা এক ধোপার বাড়িতে আক্রমণ করে এবং তিনজনকে গুলি করে হত্যা করে।একই দিনে তারা মান্দারি বাজারের নিরঞ্জন ব্যানার্জি ও এডভোকেট মোহাম্মদ উল্লাহর বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে এবং বারেক মাঝি নামের একজনকে হত্যা করে। একই দিনে তারা একজন ঝাড়ুদারকে হত্যা করে যখন তারা শারীরিক পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমান পায় যে সেই ঝাড়ুদার হিন্দু।
৭ তারিখে পাক সেনারা বড়তলী গ্রামে প্রবেশ করে এবং চারজন মুসলিম মহিলাকে ধর্ষণ করে।
করে।
(চিঠিঃ ৮)
সুপল চন্দ্র দাস থাকতেন ঢাকার তেজগাঁওয়ে। তিনি একাত্তরের ১০ই জুন হিউম্যান রাইটস কমিশন, সুইজারল্যান্ডে একটা চিঠি পাঠান। এখানে তিনি উল্লেখ করেন যে,
১৯৭১ এর মে মাসের ১১ তারিখ তিনজন সশস্ত্র পাকিস্তানি সেনা তার প্রতিবেশি জনাব কাদেরর বাড়িতে প্রবেশ করে এবং তার মেয়েকে টেনে হিচড়ে নিয়ে আসে। মেয়ের চিৎকার শুনে তিনি মেয়েকে বাঁচাতে চেষ্টা করেন এবং একজন আর্মির হাত জাপটে ধরেন। পাক সেনারা তাকেও টেনে হিচড়ে বাইরে নিয়ে আসে এবং বেয়নেট দিয়ে খুচিয়ে আহত করে। পরে তার মেয়ের সম্ভ্রমহানি করে ফেলে দিয়ে চলে আসে তারা।
গোলাম আজম নামক শান্তি কমিটির এক সদস্য আর্মি অথরিটির কাছে এই বিষয়ে নালিশ করে। তবে তাতে কোন লাভ হয় নাই।
এছাড়া সেনারা দোকান থেকে কোন মূল্য পরিশোধ ব্যতিরেকেই পণ্য নিয়ে যেত।
লুলা আউয়াল এবং শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা আছে এই মর্মে পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে তেজগা থানার বইরা গ্রামে আমন্ত্রন করে। পাক সেনারা গ্রামের নমশুদ্র পাড়ায় আক্রমণ চালায় এবং ৫০০-৬০০ মানুষ হত্যা করে। তারা তখন পথচারীদের কাছ থেকেও বিভিন্ন মূল্যবান জিনিস লুট করে।
(চিঠিঃ ৯)
শ্রী গোপাল কৃষ্ণ গুহের লেখা চিঠি। যুদ্ধকালীন ২২ জুনে লেখা। পিতাঃ মনোরঞ্জন গুহ, নয়ামাটি, নারায়নগঞ্জ। তিনি হিউম্যান রাইটস কমিশন, সুইজারল্যান্ডে এই চিঠিটি পাঠিয়েছলেন।
এখানে তিনি উল্লেখ করেন যে, ১৯ বছর বয়সী শ্রী গোপাল কৃষ্ণ গুহ ছিলেন নারায়ণগঞ্জ সরকারি তোলারাম কলেজের বিএসসি পরীক্ষার্থী। ১৯৭১ এর ২৭ শে মার্চ পাকিস্তানি সেনারা ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে নারায়ণগঞ্জ শহরে আক্রমন করে। সামনে যা পায় তাঁরা তাই ধ্বংস করে দিতে থাকে। অন্যান্য অনেকের মত নারায়নগঞ্জের নিজ বাড়ি ছেড়ে গোপচরে চলে আসেন গোপাল। পাকিদের এলোপাথারি গোলাবর্ষণে দু’জন মেয়ে গোপচর মাঠে মরে পরে ছিল। তিনি ধলেশ্বরী নদী পার হবার সময় দেখতে পান, আহত সহ অনেক মানুষ নারায়ণগঞ্জ থেকে পালিয়ে যাচ্ছেন। অবশেষে তিনি নিজ পরিবারের সদস্যদের খুঁজে পান। এর তিনদিন পর প্রচন্ড ঝুঁকির মাঝেও তিনি নারায়নগঞ্জ শহরে আসেন। তাঁদের বাড়িটি বইসহ লুট করা হয়েছিল। পাশের অনেক বাড়িঘর পুড়িয়ে ছাই করে দেয়া হয়। নারায়নগঞ্জের আওয়ামীলীগ এর কেন্দ্রীয় অফিসটিকেও সম্পূর্নরূপে ধ্বংস করে ফেলা হয়। অসংখ্য মৃতদেহ রেললাইন এর উপর পরে থাকতে দেখা যায়। পালপারা ও দেবগ্রামের বেশিরভাগ বাড়িঘর এর ক্ষতিসাধন করা হয়। বাবুরাইলে সেনাদের বিক্ষিপ্ত গোলাগুলিতে বেশ কজন নিহত হয়। শ্রীনগর পুলিশ স্টেশনের প্রতিটি হিন্দু বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয় এবং ওইসময় উপস্থিত সকল হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের হত্যা করা হয়।
পাক সেনারা আওয়ামীলীগ এর কর্মী সন্দেহ হলেই প্রতিটি ব্যক্তিকে গ্রেফতার ও হত্যা করতো।
পাকসেনারা সিংপাড়ার ডাক্তার যোগেশ ও তার আশেপাশের কয়েকটি বাড়িতে লুটপাট চালায়। তারা তার ডিসপেনসারিও লুট করে নেয়।
এইরকম অনাকাঙ্ক্ষিত হত্যাজজ্ঞের বিরুদ্ধে অতিসত্ত্বর গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থা নেয়ার জন্য জেনেভাস্থ হিউম্যান রাইটস কমিশনের নিকট তিনি দাবি জানান।
10-
১০ নং চিঠিটা দীপালি রাণি সরকারের। তিনি একাত্তরের ২৪ শে জুলাই হিউম্যান রাইটস কমিশন, সুইজারল্যান্ডে একটা চিঠি পাঠান। এখানে তিনি উল্লেখ করেন যে,
“আমি ঢাকার শাহজাহানপুর এর রেলওয়ে কলোনিতে ( 4/B-L) নং বাসায় স্বামী অমল কান্তি সরকারের সাথে থাকতাম। এপ্রিলের একেবারে শুরুর দিকে, কোন এক সকালে আনুমানিক সকাল ৮ টা থেকে ৯ টার মধ্যে আমার স্বামী বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। আমি আমার প্রতিবেশী জনাব ইদ্রিস সাহেবের বাসায় গিয়েছিলাম। তখন পাক সেনারা আমাদের বাসা লুট করে। সকাল ১০ টা বেজে গেলেও আমার স্বামী ফিরে আসেন নাই। ইদ্রিস সাহেব পরে আমাকে ইন্ডিয়ার বর্ডারে যাবার ব্যবস্থা করে দেন।
জুনের শেষের দিকে পাক সেনারা জিপে করে ডেমরা থানা ঘেরাও করে। সেখানে বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করা হয়,গুলি করে মানুষ হত্যা করা হয় এবং হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের যুবতী মেয়ে এবং মহিলাদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁদের আর কখনোই দেখা যায় নি। পাক সেনারা মেয়েদের ধরে নিয়ে ডেমরার একটি বিল্ডিং এ বন্দি করে রাখতো। সদরঘাট এলাকায় পাক সেনারা ৭ জনকে হত্যা করে ও অনেক বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে।“
১১ নং চিঠিটি স্বপন কুমার সাহার। যুদ্ধকালীন ১৮ ই জুনে লেখা। চিঠিটি হিউম্যান রাইটস কমিশন, সুইজারল্যান্ডের উদ্দেশ্যে লেখা। এখানে তিনি উল্লেখ করেন যে,
“আমি ঢাকার নরসিংদীর একজন স্থায়ী বাসিন্দা ছিলাম। ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ নরসিংদীতে বিমান থেকে বোমা হামলা করা হলে আমি ইন্ডিয়ার আগতলায় চলে আসি এবং আগরতলার নাজিপুকুরপার এলাকার গৌরাঙ্গ চন্দ্র সাহার বাড়িতে আশ্রয় গ্রহন করি।
মার্চের ২৮ ও ২৯ তারিখে বোমা হামলার ফলে পুরো নরসিংদী বাজার পুরে ছাই হয়ে যায়। নিহত হয় প্রায় ১০০ মানুষ। পাকবাহিনীর এমন আক্রমনে আমরা পাচ মাইল দূরে একটি জায়গায় আশ্রয় নেই। কিন্ত সেখান থেকেও চলে যেতে হয়, কারন সবখানে পাক সেনাবাহিনীর মদদপুষ্ট কিছু বাহিনী( রাজাকার) ছিল, যারা সব ধরনের অপরাধ করতো। কিছুদিন পর আমরা বাজিদপুর আসি এবং একই কারনে সেখান থেকেও চলে আসতে হয়। হালাজিলা আসার পর পাকবাহিনীর আক্রমনে ৫ জন নিহত হয়। আমরা একটি পাট ক্ষেতে লুকিয়ে জীবন রক্ষা করি। বাজিদপুর থেকে প্রায় ৩৫ জন মেয়েকে পাক সেনাবাহিনী তুলে নিয়ে যায়। এই অভাগীদের কাউকেই আর কখনো দেখা যায় নি।
এখানে বলে রাখা ভালো, ঘটনার সময় আমি নরসিংদী কলেজের ছাত্র ছিলাম। আমার বয়স ছিল ২২ বছর এবং প্রায় সকল স্থানেই ঘটনাপ্রবাহ ছিল প্রায় একই রকমের।“
১২ নং চিঠিটি কলিমউদ্দিন মিয়ার। যুদ্ধকালীন ৪ঠা আগস্টে হিউম্যান রাইটস কমিশন, সুইজারল্যান্ডের উদ্দেশ্যে লেখা। বয়স ৩৫ বছর। থাকতেন ঢাকার জিনজিরায়। পিতাঃ সলিম আলী। উনার ভাষ্যেঃ
“বুড়িগঙ্গা নদীর অপর পাড়ে ছিল আমাদের বাড়ি। এপ্রিলের দুই তারিখে গভীর রাতে পাকিস্তানি সেনার ভারী শেল নিক্ষেপ করতে লাগলো। প্রান বাঁচাতে অনেকেই নদী পার হয়ে পালিয়ে যেতে লাগল। বৃদ্ধ মা, স্ত্রী ও সন্তান থাকায় আমি যেতে পারলাম না। আর্মি আসার আগেই সবাইকে পালিয়ে যাবার ব্যবস্থা করে দেয়া গেল না। ছয়জন আর্মি বাসায় ঢুকল,বিনা বাক্যব্যায়ে মা ও বাচ্চাদের হত্যা করল এবং আমার স্ত্রী আমিনা বিবিকে তুলে নিয়ে গেল আমি বাইরে জিনিসপত্র গোছগাছে ব্যস্ত ছিলাম। তাই পাক সেনারা আমায় দেখতে পায় নি। পুরো ঘটনাটি ঘটতে সময় নিল মাত্র ২/৩ মিনিট। আমি জানালা দিয়ে দেখতে পেলাম,তারা আমার স্ত্রী কে উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
গণহত্যা ও নির্যাতনের বিবরণঃ বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় গৃহীত সাক্ষাৎকার
|| ঢাকা বিভাগ ||
বাংলা একাডেমী দলিলপত্র, ১৯৭২-৭৪
।১।
শ্রীমতী বাসন্তী রাণী গুহঠাকুরতা,
স্বামী ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা
প্রধান শিক্ষয়িত্রী, মনিজা রহমান গার্লস হাইস্কুল,
গেণ্ডারিয়া, ঢাকা-৪
“১৯৭১ সনের ২৫ শে মার্চ সেই কালরাতে আমরা স্বাভাবিকভাবে প্রতিদিনের মত খাওয়া-দাওয়া শেষ করে সবাই রাত নয়টার সময় রেডিও খুলে বসে ছিলাম। ঢাকা রেডিও থেকে আমরা সে রাতে দূর্যোগের কোন পূর্বাভাস পাই নাই। ভয়েস অব আমেরিকা-এর সংবাদ শুনে আমার স্বামী ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা মেয়ে ‘মেঘনার’ ঘরে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম.এ. প্রিলিমিনারী এবং অনার্স পরীক্ষার্থীদের খাতা দেখতে বসলেন। অকস্মাৎ জনতার দুপদাপ শব্দ শুনে আমার স্বামী এবং আমি দেওয়ালের বাইরে গিয়ে দেখলাম, জনতা রাস্তায় রাস্তায় বড় বড় গাছ, পানির ট্যাঙ্ক ও ইট-পাটকেল দিয়ে প্রতিরোধ তৈরি করছে। আমার স্বামী বিপদ বুঝতে পেরে আমাদের ফ্ল্যাটের প্রবেশপথ তালাবদ্ধ করেন। আমার স্বামী রাস্তার দিকে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে ভারাক্রান্ত মনে “বিপদ আরম্ভ হয়ে গেল” বলে আবার মেয়ের কক্ষে গিয়ে খাতা দেখতে বসে গেলেন। আমি আজেবাজে চিন্তা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। রাত বারটার দিকে অদূরে বোমার আওয়াজ শুনে জেগে উঠে দেখলাম, ইকবাল হল এবং রোকেয়া হলের দিক থেকে বোমার আওয়াজ ভেসে আসছে। আস্তে আস্তে অসংখ্য লাইট বোমা আকাশকে আলোকিত করে দিচ্ছে, আলোর ফুলকিতে দেখলাম বোমা ও গুলি বর্ষিত হচ্ছে। আমরা দু’জন গুলি ও বোমার কানফাটা আওয়াজ সহ্য করতে না পেরে খাটের তলায় বেড কভার বিছিয়ে নিরাপদে শুয়ে বর্বর পাক সেনাদের বীভৎসতার তাণ্ডব শুনছিলাম। পাশের কামরা থেকে আমাদের ঝিকে ডাকতে গেলে সে আসে না-আমরা সবাই গুলির অবিরাম গর্জনে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম। আমাদের ফ্ল্যাটটি কাঁপছিল-চারিদিকে দেখলাম লাইট বোমের আলোর ঝলকানি। হিস হিস শব্দ শুনে আমার গায়ের লোম শিউরে উঠলো-আমি উঠে গিয়ে জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখলাম-আমার ফ্ল্যাটের প্রবেশপথের সামনে পাক সেনা-ভারী অস্ত্রবাহী সশস্ত্র আর্মী ট্রাক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে-অল্পক্ষণ পরেই এক পাঞ্জাবী মেজর আমার গেটের লোহার জিঞ্জির হাত দিয়ে সজোরে ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে ফ্ল্যাটে প্রবেশ করে আমার মেয়ে মেঘনার কক্ষের জানালার মসকুইটো নেট বেয়নেট দিয়ে ছিঁড়ে ফেলে মাথা ঢুকিয়ে আমাকে দেখে এক দৌড় দিয়ে ঘুরে রান্নাঘরের দরজা ভেঙ্গে আমাদের ফ্ল্যাটে প্রবেশ করে। আমি আমার স্বামীকে বললাম পাক সেনারা আমাদের ফ্ল্যাট ঘেরাও করেছে- আমরা বিপদগ্রস্ত, বিপন্ন। আমার স্বামী আমার মেয়েকে অন্য কামরায় গিয়ে শুয়ে থাকতে বললেন, পাঞ্জাবী সৈন্যরা আমাদের কামরার দরজায় বুটের লাথি মারছিল। আমি দৌড়ে গিয়ে আমার স্বামীকে বললাম, পাক সেনারা এসে গেছে, হয়তো তোমাকে গ্রেফতার করবে, তুমি তৈরি হয়ে নাও, বলে একটি পাঞ্জাবী তার হাতে দিয়ে মেয়েকে নিয়ে ঘরে এসে দেখলাম- রান্নাঘরের পাশে বারান্দার দরজা দিয়ে প্রবেশ করে আমার ‘আয়াকে’ কনুইয়ের আঘাতে সজোরে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে আমার সামনে এসে জিজ্ঞাসা করলো “প্রফেসর সাহাব হায়?” আমি নিরুপায় হয়ে সত্য কথা বললাম, “হায়”। পাঞ্জাবী মেজর আবার বললো, উনকো লে যায়েগা। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “কাহা লে যায়েগা?” আমার কথার সন্তোষজনক উত্তর না দিয়ে অত্যন্ত অবজ্ঞার সুরে বললো, “লে যায়েগা।” আমার সাথে সাথে মেজর চলতে চলতে বলতে লাগলো, “ফ্লাটমে আওর কই জোয়ান আদমী হায়?” আমি বললাম-“নাহি, ত হামারা একহী লাড়কি হায়।” একথা শুনে মেজর বললো, “ঠিক হায়, লাড়কি কা ডার নাহি হায়”-আমার সাথে যে কামরায় ছিলেন সেই কামরায় প্রবেশ করে আমার স্বামী ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতাকে বাম হাত চেপে ধরে জিজ্ঞাসা করলো, “আপ প্রফেসর সাহাব হায়?” আমার স্বামী ইংরেজীতে বললেন, “ইয়েস”। পাঞ্জাবী মেজর বললো, “আপকো লে যায়েগা”। আমার স্বামী মোটা গলায় অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে বললেন, “হোয়াই?” মেজর তার প্রশ্নের কোন জওয়াব না দিয়ে টেনে বাইরে নিয়ে গেল- তাদের আমি পিছনে পিছনে কিছুদূর গিয়ে তাদেরকে আর দেখতে না পেয়ে কামরায় ফিরে এসে টেলিফোনের রিসিভার উঠিয়ে দেখলাম সবকিছু বিকল অচল হয়ে আছে। আমি এ সময় সবই বুঝতে পারলাম-আমরা বিপদগ্রস্ত, বিপন্ন। ফিরে দেখলাম-উপর তলার সিঁড়ির শেষ মাথায় মিসেস মনিরুজ্জামানকে পাঞ্জাবী জোয়ানরা “যাও, যাও, হাঁটো” বলে তাড়া দিচ্ছে। ইতিপূর্বেই পাকসেনারা ড. মনিরুজ্জামান, তার ছেলে, তার ভাগনে এবং প্রতিবেশী যুবককে টানাটানি করে ঠেলে ধাক্কিয়ে ধাক্কিয়ে নিচে নামিয়ে নিয়ে আসার জন্য জোরাজুরি করছিল। মিসেস জামান সিঁড়ির শেষ মাথায় এসে আমাকে বললেন, পাকসেনারা ওদের সবাইকে নিয়ে যাচ্ছে। আমি তাকে বললাম-নিয়ে যেতে দিন, ওদেরকে বাধা দিয়ে লাভ নাই- ওরা আমাদের ভাষা বুঝে না-জোরাজুরি করলে মেরে ফেলতে পারে। এ কথা বলতে বলতে বাইরে আমি দুটি গুলির আওয়াজ শুনে দৌড়ে বালিশ হাতে অদূরে দাঁড়ানো মেয়েকে ধরতে গিয়ে পরপর আটটি গুলির শব্দ শুনে অগ্রসর হয়ে দেখলাম-সিঁড়ির নিচে চারজনের দেহ গড়াগড়ি যাচ্ছে। গুলিবর্ষণ করার পরক্ষণেই পাকসেনারা সবাইকে কার্ফু জারীর কথা ঘোষণা করে, দ্রুত ট্রাকগুলি নিয়ে চলে গেল। মিসেস মনিরুজ্জামান তেতলা থেকে পানি নিয়ে এসে গুলিবিদ্ধ সবাইকে খাওয়ালেন-তিনি দৌড়ে এসে বললেন “দিদি আপনার সাহেব গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে আছেন, আমার সাথে কথা বলছেন, তিনি বাঁচবেন।“ একথা শুনে আমি এবং আমার মেয়ে “মেঘনা” দৌড়ে আমার স্বামীর গুলিবিদ্ধ দেহের সামনে উপস্থিত হয়ে দেখলাম- আমার স্বামীর দেহ গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে আছে। তিনি বলছিলেন, “ওরা আমাকে গুলি করেছে, আমার শরীর প্যারালাইসিস হয়ে গেছে। আমাকে তুলে ঘরে নিয়ে যাও।” আমি কান্নার শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলাম শুধু হায় হায় শব্দ করছিলাম। দোতলার যে ফ্ল্যাটে অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক সাহেব এবং অধ্যাপক আনিস সাহেব থাকতেন তাদের ব্লকের প্রবেশপথে অটোমেটিক তালা ঝুলতে থাকায় পাকসেনারা সেখানে প্রবেশ করে নাই। পাকসেনারা চলে যাওয়ার পরও ওরা কেউ আমাদের অসহায় চিৎকার শুনেও আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে নাই। আমরা কোন রকমে আমার স্বামীর রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত দেহ ধরাধরি করে আমাদের ফ্ল্যাটে নিয়ে এসে বারান্দার খাটে এলিয়ে দিলাম-আমার স্বামী জ্ঞান হারান নাই তখনও। আমার মেয়ে “মেঘনা” মনিরুজ্জামান সাহেবের ভাগনের পানি পানি বলে অসহায় আর্তনাদ শুনে আমাকে নিয়ে তার মুখে শেষ পানি দিয়ে আসলো। পরক্ষণেই ছেলেটি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
দূরে-অদূরে বৃষ্টির মত অবিরাম গুলি বর্ষণ করছিল পাকসেনারা। কিছুক্ষণ পরে দেখলাম পাকসেনারা জগন্নাথ হলের পূর্বদিকে ছাত্রদের কেন্টিনে আগুন লাগিয়ে দেয়- মাঝে মাঝে পাকসেনাদের সামরিক ট্রাকগুলি টহল দিচ্ছিল, চারিদিকে শ্মশানের হাহাকার।
পরের দিন ১৯৭১ সনের ২৬শে মার্চ এবং ২৭শে মার্চ সকাল পর্যন্ত আমার স্বামীর ক্ষত বেয়ে রক্ত ঝরছিল-বাইরে সান্ধ্য আইন বলবৎ থাকায় তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে তার চিকিৎসার কোন ব্যবস্থা করতে পারি নাই।
১৯৭১ সনের ২৭শে মার্চ সকালে কতিপয় লোকের সাহায্যে আমার স্বামীকে চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তরিত করি। হাসপাতালে কোন লোকজন ও ডাক্তার ছিল না। দায়িত্বরত নার্সরা সাধ্যমত আমার স্বামীর সেবাযত্ন করেছে।
১৯৭১ সনের ৩০শে মার্চ বিনা চিকিৎসায় আমার স্বামী মৃত্যুবরণ করেন। স্বামীর মৃত্যুর পর আমি তার মৃতদেহ হাসপাতাল থেকে সরিয়ে আনার অনুমতি পাই নাই- তার পবিত্র মৃতদেহের সৎকার করতে পারি নাই। আমার স্বামীর মৃত্যুর পরক্ষণেই পাকসেনারা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ঘেরাও করে- আমি স্বামীর মৃতদেহ নিয়ে আসার কোন উপায় না দেখে ডাক্তারদের উপদেশে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর ড. মালেকের বড় ভাই আব্দুল বারি সাহেবের স্ত্রীর সাথে তাদের গাড়ীতে আমাদের স্কুলের সেক্রেটারী ড. এম.এ. ওয়াহিদ সাহেবের ২০ নং ধানমণ্ডিস্থ বাসায় আশ্রয় লাভ করি। আমার স্বামীর লাশ চারদিন হাসপাতালে পড়েছিল-আমার ড্রাইভার ৩রা এপ্রিল পর্যন্ত হাসপাতালের ওয়ার্ডের বারান্দায় আমার স্বামী ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার মৃতদেহ দেখে এসেছে।
স্বাক্ষর
বাসন্তী গুহঠাকুরতা
২০-৫-১৯৭৪
\২\
ডঃ মোহাম্মদ আজহার আলী
সহকারী অধ্যাপক
প্রাইমারী শিক্ষা বিভাগ
শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সিটিউট
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
১৯৭১ সনের ২৫ শে মার্চ আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টাফ কোয়ার্টারের ১৪/এইচ ফ্লাটে সপরিবারে অবস্থান করছিলাম। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের টিচার্স ক্লাবে অন্যান্য বিভাগের অধ্যাপকদের সাথে বসেছিলাম। রাত নয়টার সময় প্রতিদিনের মত স্বাভাবিকভাবে আমরা ক্লাব ছেড়ে যার যার ফ্লাটে চলে গিয়েছিলাম। খাওয়া দাওয়া করে আমরা সবাই শুয়ে পড়েছিলাম। রাত আনুমানিক বারটার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস ও স্টাফ কোয়ার্টারের চারদিক থেকে অকস্মাৎ বৃষ্টির মত অবিরাম গুলিবর্ষণের শব্দ শুনে জেগে উঠি। চার তলার অপর পাশে ব্যবসা প্রশাসন বিভাগের অফিস সেক্রেটারি মিঃ মনসুর আহমেদ সাহেব সপরিবারে অবস্থান করছিলেন। আমি, আমার স্ত্রী, আমার আড়াই বছরের ছেলেটি এবং আমার ভাতিজা, কাজের ছেলে সবাই আমরা অবিরাম গুলিবর্ষণের বিভীষিকাময় শব্দে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে বসেছিলাম। সারারাত আমরা গুলিবর্ষণের আওয়াজ শুনেছি। সারারাত আমরা দরজা-জানালা বন্ধ করে বসেছিলাম-
১৯৭১ সনের ২৬ শে মার্চ সকাল ছয়টায় গুলিবর্ষণের গতি কমে গিয়েছিল। কাঁচের ফাঁক দিয়ে দেখলাম-সশস্ত্র পাঞ্জাবী সেনারা আমাদের এলাকার প্রবেশ পথ দিয়ে অভ্যন্তরে প্রবেশ করছে। পাঞ্জাবী সেনারা ১১ এবং ১২ নম্বর ফ্লাটে প্রবেশ করে এলাপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করতে থাকে। এসময়য় আমরা ফ্লাটের নীচে অবস্থানকারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী মেডিকেল অফিসার ডাঃ মুর্তজা স্টেথোস্কোপ গোলায় রেখে বাইরে পায়চারী করছিলেন। পাঞ্জাবী সেনারা ডাঃ মুর্তজাকে ও অন্যান্য আরও তিনজনকে ১২ নং ফ্লাট থেকে লাশ তুলে বাহিরে নিয়ে রাখার নির্দেশ দান করে। ডাঃ মুর্তজাকে অন্যান্য লোকজনকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডঃ মোকতাদির সাহেবের লাশ বের করতে দেখলাম। ইহার পর পাক সেনারা ১১ নং ফ্লাটে প্রবেশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেবরেটরী স্কুলের শিক্ষক মোহাম্মদ সাদেককে হত্যা করে। সাদেক সাহেবের লাশ পাক সেনারা ফেলে রেখে যায়। বিকাল চারটার সময় সাদেক সাহেবের পরিবার আমাদের ফ্লাটে চলে আসে।
২৬ শে মার্চ সারাদিন সারারাত আমরা যার যার ফ্লাটে আটকা পড়েছিলাম। ২৭ শে মার্চ সকালে কার্ফূ উঠিয়ে নিলে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে সবাই নিরাপদ স্থানে যেতে থাকে। ১১ নং ফ্লাটের নীচতলায় সাদেক সাহেবের লাশ পড়েছিল। বিভিন্ন ফ্লাট থেকে ফ্রীজের পানি এনে লাশের উপর দেওয়া হয়। সাদেক সাহেবের স্ত্রী, শ্যালক, ভাই, চার ছেলেমেয়ে লাশের চারদিকে দাঁড়িয়ে আর্তনাদ করছিল। আমি আমার এবং সাদেক সাহেবের পরিবার অন্যত্র সরিয়ে রেখে ১১ নং ফ্লাটের দক্ষিণ পার্শ্বে সাদেক সাহেবের লাশ সমাহিত করি।
স্বাক্ষর/- মোঃ আজহার আলী ৮-৬-৭৪
ইব্রাহিম ভুইয়া
লাইব্রেরীয়ান, শিক্ষা ও গবেষণা ইনষ্টিটিউট
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
১৯৭১ সনের সেপ্টেম্বর মাসে আমি গ্রামের বাড়ী যাওয়ার জন্য ঢাকা সদরঘাটের দিকে রওয়ানা হয়েছিলাম। সদর ঘাট টার্মিনালের প্রবেশ পথে পাঞ্জাবী সেনাদের প্রহরায় মোতায়েন দেখলাম। কিছুক্ষন পরে এক অতি বৃদ্ধ ভদ্রলোক মুন্সিগঞ্জ যাওয়ার জন্য টার্মিনালে আসলেন। সঙ্গে তার নবপরিণীতা পুত্রবধূ এবং যুবতী মেয়ে ছিল। পাঞ্জাবী সেনারা আমাদের সবাইকে তল্লাশি করতে বললো “ইয়ে দো আওরাত নাহি যায়েগী”। বৃদ্ধ নিরুপায় হয়ে কান্নাকাটি করে সামনে যাকে পায় তাকেই জড়িয়ে ধরে বলতে থাকেন, “আপনারা আমার মেয়ে ও পুত্রবধূকে বাঁচান।” কিন্তু আমাদের কিছুই করার ছিল না। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আমরা সেই অসহায় যুবতী মেয়ে দু’জনকে রক্ষা করার জন্য কোন কথা বলতে পারি নাই, কিছুই করতে পারি নাই। আমাদের সকলের চোখের সামনে পাঞ্জাবী সেনারা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে যুবতী মেয়ে দু’টিকে টেনে হিঁচড়িয়ে ওদের আর্মি ট্রাকে উঠিয়ে নিয়ে গেল। মেয়ে দু’টি এসময় করুন আর্তনাদে ভেঙ্গে পড়েছিল। দু’ঘন্টা পড় আবার যুবতী মেয়ে দু’টিকে ফিরিয়ে নিয়ে এল। দেখলাম, মেয়ে দুটির চলার কোন শক্তি নাই, এলোমেলো চুল, অশ্রুভরা মুখমণ্ডল। আমরা লঞ্চে রওয়ানা হয়ে গেলাম।
‘পাগলার’ এম, এম ওয়েল পার্ক আর্মি ঘাটিতে আমাদের লঞ্চ আটকিয়ে তল্লাশী চালানো হয়-পাক সেনারা যাত্রীদের মুল্যবান মামালাম লুট করে নিয়ে যায়। লঞ্চে দাঁড়িয়ে আমরা দেখলাম-ওদের কামরার জানালার সম্মুখে চারটি বাঙ্গালী যুবতী মেয়ে এলোমেলো চুলে করুণ ও অসহায় দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। জানালা দিয়ে তাদের দেহের যতটুকু দেখা গেল তাতে মনে হও তাদেরকে বিবস্ত্র করে রাখা হয়েছে। বুড়ীগঙ্গা নদীতে ১৫-২০ জন করে এক সাথে দড়ি দিয়ে বাঁধা বাঙ্গালী যুবকদের বহু লাশ ভাসতে দেখলাম।
১৯৭১ সনের অক্টোবর মাসের এক দিন আমি বাড়িতে ছিলাম। সকাল নয়টার সময় আমি বাগড়া বাজারে গিয়েছিলাম বাজার করতে। বহু লোকের সমাগম ছিল। বাজারের দক্ষিণ দিকে পদ্মা নদী। পুর্বের দিন সন্ধ্যায় পাক সেনাদের নোঙ্গর করা ষ্টিমারটি পদ্মার ঘাট ছেড়ে যাচ্ছিল-ষ্টিমারের চারিদিকে সশস্ত্র পাক সেনারা প্রহরায় মোতায়েন ছিল। অকস্মাৎ দেখলাম পাক সেনারা ষ্টিমার থেকে সজোরে টেনে একটি লাশ ফেলে দিচ্ছে-ষ্টিমার দৃষ্টির বাইরে চলে যাওয়ার পর আমরা নৌকা নিয়ে গিয়ে দেখলাম এক ক্ষত বিক্ষত যুবতীর বীভৎস উলঙ্গ লাশ। এছাড়া কাশবনের পাড়ে পড়ে আছে ফোলা বীভৎস লালের গালে ও দেহের অন্যান্য স্থানে ক্ষত চিহ্ন দেখলাম। তাঁর ডান দিকের স্তনের বোটা তুলে নেওয়া হয়েছে। স্বাক্ষর /- ইব্রাহিম ভূইয়া ৮/৬/৭৪
।। ৪ ।।
শ্রী পূর্ণ চন্দ্র বসাক, বি,এ
পিতা মৃত শ্রী বীর চন্দ্র বসাক
১৮, তাতীবাজার লেন, ঢাকা-১
আমি ১৯৭১ সনের ২৫শে মার্চ রাতে আমার ১৮, তাতীবাজারস্থিত বাসায় ছিলাম। রাত বারোটায় উত্তর দিক থেকে অকস্মাত কামানের আকাশ ফাটা গর্জন শুনে আমি তেতলার ছাদের উপর দেখলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস সমূহে আগুনের ফুলকি ও লক্ষ লক্ষ আগুনের ফুলকিতে আকাশ ভরে আছে। অনবরত কামানের ভয়াল ও ভয়ংকর শব্দ আসছে। উত্তর দিকে আকাশে দেখলাম, একটা ঘোলাটে বেলুনের মত আগুনের পিন্ড পশ্চিম দিক থেকে আস্তে আস্তে উঠে পুর্ব দিকে গভর্নর হাউজের কাছে এসে নেমে পড়ল। এই সময় দেখলাম- চারিদিকে জনপদ, বস্তি এলাকায় আগুন আর আগুন জ্বলছে, বৃষ্টির মত গুলিবর্ষন হচ্ছে, কামানের কানফাটা গর্জন ভেসে আসছে। আমি ছাদে দাঁড়িয়ে দেখলাম গুলির আওয়াজ ক্রমে ক্রমে গুলিস্তান থেকে নওয়াবপুরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। কিছুক্ষন পরই সদরঘাট খৃষ্টানদের গীর্জার সামনে সামরিক গাড়ী ও ট্যাংকের ঘর্ঘর আওয়াজ শুনলাম। এসময় শতকন্ঠের ‘মাগো বাবাগো বাঁচাও বাঁচাও’ আর্তনাদ শুনলাম। কিছুক্ষন পর সদরঘাট টার্মিনালে ভীষণ গুলিবর্ষনের আওয়াজ শুনলাম। শাখারীবাজার এর সকল হিন্দু জনতা যার যার ছাদে দাঁড়িয়ে এ বীভৎস কান্ড দেখছিল। রাত দুইটার সময় মাইকে ঘোষনা করা হল- রাজধানী ঢাকায় ২৬শে মার্চ ভোর পর্যন্ত কার্ফিউ জারি করা হয়েছে, যার যার বাড়িতে আওয়ামীলীগ ও স্বাধীন বাংলার পতাকা আছে তা নামিয়ে ফেলে পাকিস্তানের পতাকা তুলে দেয়ার নির্দেশ দেয়া যাচ্ছে। রাত দুইটার পর রাজধানীর পূর্বদিক থেকে আরেকটি জ্বলন্ত বেলুনের মত ঝলমলে গ্লোব পূব আকাশ থেকে উঠে আস্তে আস্তে সোজা পশ্চিমে ভেসে গিয়ে মিশে যেতে দেখলাম। ইহার পর আর একটি গুলির আওয়াজও কানে আসে নাই। চারিদিকে নীরব, নিস্তব্ধ, শ্মশ্মানের হাহাকার, আগুন আর আগুন জ্বলছে, রাজধানী ঢাকার চারিদিকে জনপদ ও বস্তি এলাকা জ্বলছে।
২৭শে মার্চ সান্ধ্য আইন তুলে নেয়ার পর শুনলাম, শাখারীবাজারে কোর্টে প্রবেশের পথে একটি বাড়ীতে দশজন হিন্দুকে একই ঘরে গুলিবিদ্ধ করে হত্যা করা হয়েছে এবং ডঃ শৈলেন সেনকে গ্রেফতার করে জগন্নাথ কলেজের পাক সেনাদের ছাউনিতে আটক করা হয়েছে। ইংলিশ রোড দিয়ে অগ্রসর হয়ে দেখলাম ইংলিশ রোড, ফ্রেঞ্চ রোডের দুই পাশের কোটি কোটি টাকার কাঠের কারখানা ও মেশিনপত্র ভস্ম হয়ে পাক সেনাদের বীভৎসতার স্বাক্ষর হয়ে পড়ে আছে- দুই পাশের বাণিজ্য এলাকার সকল দোকান ও বাণিজ্য কেন্দ্র নিশ্চিহ্ন হয়ে আছে। রাস্তাঘাট শূণ্য, কোথাও কোন মানুষ নাই। আমি কাজী আলাউদ্দিন রোড হয়ে বাবুপুড়া ফাড়িতে দেখলাম আটজন পুলিশী পোষাক পড়ে লাশ গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে ফাড়ির বারান্দায় ও রাস্তায় বিকৃতভাবে পড়ে আছে। রেললাইনের দুইপাশের বস্তি এলাকা ভস্ম ছাই হয়ে পড়ে আছে, দেখলাম চারিদিক জনমানবশূণ্য। আমি দ্রুত আমার বন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক জি কে নাথ, সংস্কৃতের অধ্যাপক রবীন্দ্রনাথ ঘোষ ঠাকুর, অধ্যাপক শ্রী পরেশ চন্দ্র মন্ডলের খোঁজে জগন্নাথ হলে ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের দিক থেকে প্রবেশ করে দেখলাম জগন্নাথ হলের চারিদিকের দেয়াল গুলির আঘাতে ঝাঁঝরা হয়ে আছে। হলে জানালাসমূহের কাচ ভেঙ্গে খানখান হয়ে পড়ে আছে। হলের পুকুরের পাড় দিয়ে অগ্রসর হওয়ার সময় দেখলাম হঠাৎ একজন মানুষের মাথা উপরের দিকে উঠে আসার চেষ্টা করছে, ভীতসন্ত্রস্ত, দিশেহারা, উন্মাদের মত হয়ে পানি থেকে মাথা তুলে ক্রন্দন ও বুকে চপেটাঘাত করতে করতে বলতে লাগলেন ‘দাদা ওদিকে যাবেন না, ওরা আমাদের সব মেরে ফেলছে।‘ আমি লোকটিকে উন্মাদ মনে করে তার কথায় কান দেই নাই। আমি আরও অগ্রসর হয়ে কেন্টিনের দিকে এগিয়ে গিয়ে দেখলাম একটা প্রাণীও নাই, নীরব, জনমানবশূণ্য। কেন্টিনের ভেতর দিয়ে হলের নর্থ হাইজে প্রবেশ করে দেখলাম- একজন হিন্দু যুবকের লাশ পড়ে আছে- মাথার চুল আগুনে পোড়া, সারা দেহ গুলিতে ঝাঁঝরা, আমি দোতলায় না উঠে সোজা রাস্তায় নেমে শহীদ মিনারের সামনে এসে দেখলাম- শহীদ মিনারটি ভেঙ্গে খানখান হয়ে পড়ে আছে। শহীদ মিনারের পেছনে সদ্য মাটি তোলা ১০০ ফুট এক বিরাট গর্ত দেখলাম- গর্তটি কিছুক্ষন পূর্বেই মাটি দিয়ে ভরাট করে রাখা হয়েছে। গর্তের উপরে মাটি ভেদ করে কারো হাত, পায়ের পাতা দেখা যাচ্ছে। আমি আরো উত্তর দিকে অগ্রসর হয়ে হলের শেষ মাথায় লোহার গেইটে পৌছলে পেছন থেকে এক দিশেহারা কর্কশ নারীকণ্ঠ চিৎকার করে বললেন- ‘আপ কাহা যাতে?’ আমি সেই কন্ঠের দিকে নজর না দিয়ে শামসুন্নাহার হলের দিকে অগ্রসর হয়ে জগন্নাথ হলের হাউস টিউটর মিঃ জি কে নাথ, রবীন্দ্রনাথ ঘোষ ঠাকুর, পরেশ মন্ডলের কোয়ার্টারের প্রবেশপথে গিয়ে দেখলাম- কোয়ার্টারের দরজা জানালা সব খোলা, জনমানবশূণ্য, সিড়ি বেয়ে উপড়ে উঠতে গিয়ে দেখলাম- দোতলা থেকে পচা দুর্গন্ধ ভেসে আসছে, সিড়ির উপর থেকে নিচ পর্যন্ত রক্তের দাগ জমাট বেধে আছে। আমি এ পচা, দূর্গন্ধ ও জমাট রক্ত দেখে আর উপরে উঠরে পারি নাই। বন্ধুদের খোঁজ করতে গিয়ে আমি এখানেই প্রথম ভয় পেলাম এবং ভড়কে গেলাম। আমার মাথা ঘুরতে লাগল সেই বীভৎস দৃশ্য দেখে। আমি নিচে নেমে আসলাম এবং ভীত সন্ত্রস্তভাবে যেই পথ দিয়ে এসেছিলাম, সেই পথে দ্রুত ফিরে গেলাম। ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের রাস্তা ধরে দ্রুত ঢাকা মেডিকেল কলেজের ভেতর প্রবেশ করলাম। প্রবেশ পথে জগন্নাথ হলের একজন চাপরাশীর সাক্ষাৎ পেলাম। সে বললো, আমাদের হলের প্রভোস্ট ডঃ জোতির্ময় গুহ গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালের দোতলায় ৯ নম্বর কক্ষে আছেন, তিনি জীবিত আছেন। আপনি তার সাথে সাক্ষাৎ করুন। আমি হাসপাতালের ৯ নং কামরায় প্রবেশ করতেই হাতে ব্যান্ডেজ বাধা আহত হলের একজন যুবক এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে ক্রন্দন করতে করতে বলতে থাকলেন ‘দাদা আমি কি বেঁচে আছি? দেখেন আমাকে ওরা গুলি করেছে। ঐ যে দেখুন জোতির্ময় বাবু- তাঁকেও পশুরা গুলি করেছে।‘ আমি তাকে উন্মাদের মত মনে করলাম, তার অসংলগ্ন কথায় বুঝতে পারলাম সে প্রকৃতস্থ নয়। আমি আরো অগ্রসর হয়ে দেখতে পেলাম জোতির্ময় বাবু শুয়ে আছেন জ্ঞানহারা, মাঝে মাঝে দীর্ঘ চাপা নিঃশ্বাস ফেলছেন, মাঝে মাঝে চোখ খুলে আবার বন্ধ করে ফেলছেন। আমি অনেক্ষণ তার পাশে দাঁড়িয়ে তাঁর করুণ অবস্থা দেখলাম। তিনি একবার আমার দিকে চেয়ে বললেন ‘কে?’ আমি বললাম ‘আমি বসাক, আমি পূর্ণ বাবু।‘ তিনি উত্তরে বললেন ‘ও‘। একটু পরেই বিড়বিড় করে বললেন, ‘ডাঃ গোবিন্দবাবু, ডাঃ গোবিন্দবাবু ইজ প্রসিডিং ওয়েল।‘ একথা বলেই তিনি জ্ঞানহারা হয়ে গেলেন, সঙ্গা হারিয়ে ফেললেন। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তার এই অন্তিম দৃশ্য দেখছিলাম। একটু পরেই বারান্দা থেকে তার স্ত্রী বাসন্তী দেবী ক্রন্দনরতা অবস্থায় কাতরকন্ঠে বললেন, ‘দাদা আপনি এসেছেন? আমাকে একটু সাহায্য করুন। কাল থেকে এই হাসপাতালে কিছুই নাই। আমাকে একটি এক্সরে প্লেট যোগাড় করে দিন?’ আমি উত্তরে বললাম ‘দাস কোম্পানীর দোকান খোলা পেলে এখনি এনে দিচ্ছি’- বলে তাকে প্রবোধ দিলাম। আমি তাকে ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি সমস্ত ঘটনা বললেন। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম গুলি কোথায় লেগেছে? উত্তরে বললেন, ঘাড়ে একটি গুলি বিদ্ধ হয়ে ঘাড় ভেদ হয়ে বেড়িয়ে গেছে। পেটে নাভির কাছে ব্যথার যন্ত্রনার কথা বলছেন। বোধহয় পেটের ভেতরেও গুলি লেগেছে। আমি তাকে স্বান্তনা দিয়ে চলে আসলাম। প্রবেশ পথে আসলে হলের সেই আহত গুলিবিদ্ধ ছাত্রটিকে জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি কিভাবে বাঁচলে? সে বলতে লাগল, খান সেনারা ভারী অস্ত্র নিয়ে রাত বারোটার দিকে আমাদের হলের গেট ভেঙ্গে ভেতরে প্রবেশ করে প্রত্যেক কামরায় ব্যাপক তল্লাশী চালায়- হল বন্ধ থাকলেও কতিপত অনার্স পরীক্ষার্থী ও এম, এ পরীক্ষার্থী ২০-২৫ জন হলে অবস্থান করছিল। প্রত্যেক কক্ষে প্রবেশ করে যাকে যেখানে পেয়েছে সেখানেই গুলিবিদ্ধ করে হত্যা করেছে, আমি সে সময় হলের বাথরুমে পালিয়েছিলাম। তারা আমাকে বাথরুমেই ধরে ফেলে। আমাকে ধরে ওরা বলল, ‘তোমকো কুচ নেহি বলেগা’ এবং দোতলা থেকে আরো তিনজন ছাত্রওকে নামিয়ে এনে বলল, ‘ইয়ে দেখ তোমলোগ কো কুচ নাহি করেগা। উপর যতনা লাশ হ্যায়, সব নিচে লে আও।‘ আমরা চারজন তাদের নির্দেশমত উপর থেকে সদ্য গুলিবিদ্ধ শহীদদের লাশ নিচে নিয়ে আসলাম। বীর শহীদদের সব লাশ আমরা শহীদ মিনারের গর্তের সামনে নিয়ে এসে দেখলাম- পাক সেনারা সশস্ত্র ভাবে সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। লাশগুলো ওরা গর্তের ভেতর ফেলে মাটিচাপা দিল। হত্যাযজ্ঞ শেষে আরেকদল সৈন্য আবার উপরে গিয়ে তল্লাশি চালিয়ে ফিরে আসল- আমাদের ৪ জনকে লাইন ধরে দাড়াবার নির্দেশ দিল- আমরা দাঁড়িয়ে গেলাম লাইন ধরে, এরপর আমাদের উপর গুলিবর্ষন করতে থাকল। আমাদের উপর গুলিবর্ষণ হওয়া মাত্র আমি মৃতের ভান করে পড়ে গেলাম। বীর শহীদদের সেই লাশের মাঝেই পড়ে থেকে দেখলাম- পাক সৈন্যরা আর্মি ট্রাক নিয়ে সদলবলে চলে গেল। চারদিক চেয়ে যখন নিশ্চিত হলাম তারা আর নেই- তখন সেই লাশের মধ্যে থেকে উঠে এক দৌড়ে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চলে এসেছি।
আমি বাড়িতে এসে দেখলাম শাখারীবাজারে থমথমে ভাব- শাখারীবাজারের হিন্দু অধিবাসীগন মনে করেছিল আর কোন হত্যাকান্ড হবে না। পাকপশুরা সাধারন নাগরিকদের উপর আর পাইকারী ভাবে হত্যাকান্ড ঘটাবে না। আমরা আমাদের এলাকায় ২৭ ও ২৮ শে মার্চ দিনের বেলায় কোন পাকসেনা দেখি নাই। কিন্তু কার্ফু আরম্ভ হওয়ার সাথে সাথে পাকসেনারা ঘরেঘরে প্রবেশ করে হত্যাকান্ড চালায় এবং বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে। আমরা কয়েকদিন ছাদের উপর বসে থেকে ঢাকার চারিদিকে শুধু গুলিবর্ষনের শব্দ শুনেছি। ১৯৭১ সনের ২৮শে মার্চ গুজব ছড়িয়ে পড়ে ঢাকার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিহারী জনতা হিন্দু মহল্লা হামলা করার জন্যে এগিয়ে আসছে। এ খবর পাওয়া মাত্রই আমরা তাতীবাজার থেকে সকল হিন্দু পরিবার দলে দলে একযোগে বুড়িগংগা নদী পার হয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের উদ্দেশ্যে পল্লী এলাকায় চলে যাই। আমরা কেই কারো সাথে কোন জিনিসপত্র নিয়ে যেতে পারি নাই- সবাই শূণ্যহাতে রুদ্ধশ্বাসে পালিয়েছি। কিশোর, শিশু, যুবক-যুবতী, নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ-যুবা সবাই শূণ্য হাতে পালিয়েছি। নদীর ওপার থেকে আমরা সংবাদ পেয়েছি যে ঢাকার জিন্দাবাজার মালিটোলা, বাবুবাজার এলাকায় ব্যাপক লুটতরাজ আরম্ভ হয়েছে। মুল্যবান জিনিসপত্র, সোনাদানা, তামা-কাসা, পিতল, কাপড়-চোপড়, খাট, চকি, দরজা-জানালা সব কিছু তারা লুট করে নিয়ে গেছে। লুট হওয়ার পরক্ষনেই সশস্ত্র বিহারীরা একযোগে এসে শাখারীবাজার, তাতীবাজার, সুতারনগর, গোপালনগরে সকল হিন্দুবাড়ি দখল করে বসেছে। আমরা নয় মাস নদীর অপর পাড়ে বাধৈর গ্রামে নিদারুন দুরবস্থায় অর্ধাহারে-অনাহারে কাটিয়েছি।
স্বাক্ষর
শ্রী পূর্ণচন্দ্র বসাক
২৯শে বৈশাখ, ১৩৭৮
<৮,২.১.৫,২০-২১>
আবদুল কুদ্দুস মিয়া
রিজার্ভ ইন্সপেক্টর অব পুলিশ
বি,আর পি, হেড কোয়ার্টার, রাজারবাগ, ঢাকা
১৯৭১ সনের ১৫ই মে থেকে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশের জমায়েত করা হয়। পাঞ্জাবী পুলিশ লাইনে এসেই যথেচ্ছা ব্যবহার আরম্ভ করে দেয়; কথায় কথায় পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশরা আমাদের বুটের লাথি ও বন্দুকের বাট দিয়ে পিটাতে থাকে, চোখ রাঙ্গিয়ে বলতে থাকে ‘শুয়ারকা বাচ্চা, হিন্দুকা লাড়কা, বেইমান শালা লোগ, হামলোগ আদমী নাহি মাংতা, জামিন মাংতা’’।
আমাদেরকে হেডকোয়ার্টারের সকল কক্ষ থেকে কুকুর বিড়ালের মতো তাড়িয়ে দিয়ে সেখানে পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশদের জায়গা দেয়া হয়, আমাদের পোষাক পরিচ্ছদ, কাপড় আসবাবপত্র সব বাইরে ফেলে দেয়া হয়, আমারা অসহায়ের মত আমাদের আসবাব পত্র তুলে নিয়ে আসতাবলের সামনে, ব্যারাকের বারান্দায় আশ্রয় গ্রহন করি। পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশ রাজারবাগ আসার পরেই বাঙ্গালীদের উপর নির্মম অত্যাচার নেমে আসে। প্রতিদিন, “ইয়ে শালা লোগ মুক্তি হায়” বলে বহু নিরীহ বাঙ্গালী যুবককে চোখ বেঁধে মিলিটারী ট্রাক ও জীপ থেকে আমাদের চোখের সামনে নামিয়ে হেডকোয়ার্টার বিল্ডিংয়ের উপর তলায় নিয়ে রাখা হয়। সারাদিন এভাবে চোখ বেঁধে বাঙ্গালী যুবকদের রাজারবাগ এনে জমায়েত করা হয় এবং সন্ধ্যার পর এ সব অসংখ্য বাঙ্গালী যুবককে মিলিটারী ট্রাকে করে ঢাকা সেনা নিবাসে নিয়ে হত্যা করা হয়। হেডকোয়ার্টারের তেতলা ও চারতলায় বহু যুবতী উলঙ্গ করে রাখা হয়-পাঞ্জাবী সেনা ও পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশ এসব ধরে আনা বালিকা ও মহিলাদের উপর অবিরাম ধর্ষণ চালায়। লাইনে পুলিশের কলরবের জন্য আমারা অত্যাচারিত মেয়েদের ক্রন্দন রোল শুনতে পেতাম না- লাইনে দূরে গিয়ে দাঁড়ালেই ধর্ষিতা মেয়েদের আর্তনাদ ও আহজারি শুনতে পেতাম-রাতে ধর্ষিতা মেয়েদের বুকফাটা চিৎকারে আমরা কোয়ার্টারে ঘুমাতে পারতামনা- সারারাত পরিবার পরিজন নিয়ে জেগে থাকতাম। হেড কোয়ার্টার বিল্ডিং থেকে ভেসে আসা ধর্ষিতা মেয়েদের আর্তনাদে আমরা বাঙ্গালী মেয়েদের দুর্দশা দেখে দুঃখে, ক্ষোভে, বেদনায় দিশাহারা হয়ে পড়েছিলাম। আমরা ঐ সকল অসহায় মেয়েদের উদ্ধার করার জন্য কিছুই করি নাই, করতে পারি নাই, কারণ ওদেরকে উদ্ধার করার জন্য, ওদের অত্যাচারের সহানুভুতি ও দরদ দেখানোর কোন সুযোগ আমাদের ছিল না।
হেডকোয়ার্টারের তেতলা ও চারতলায় যেখানে বাঙ্গালী মেয়েদের উলঙ্গ অবস্থায় ঝুলিয়ে রেখে ধর্ষণ করা হতো সেখানে সব সময় পাঞ্জাবী সৈন্যরা প্রহরায় মোতায়েন থাকতো। সেখানে আমাদের প্রবেশ করার অনুমতি ছিল না। মিঃ বোস্তান খাঁ নামে এক পাঞ্জাবী ভদ্রলোক এ সময় রাজারবাগ পুলিশ লাইনের রিজার্ভ ইন্সপেক্টর ছিলেন। এই ভদ্রলোক আমাদের লাইনের দায়িত্বভার গ্রহন করার পর আমাদের উপর সবদিক থেকে অত্যাচার ও দমন নীতি আরম্ভ হয়ে যায়। পুলিশ লাইনে কখন আমাদের উপর মৃত্যুর করাল গ্রাস নেমে আসে, আমরা এই ভয়ে সব সময় সন্ত্রস্ত থাকতাম।
১৯৭১ সনের ৪ঠা এপ্রিল রাজারবাগ পুলিশ লাইন থেকে তৎকালীন ষ্টোর-ইন-চার্জ পুলিশ সার্জেন্ট মিঃ মুর্তজা হোসেন এবং সুবেদার আবুল হোসেন খান এবং সুবেদার মোস্তফাকে ঢাকা সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে পাঞ্জাবী সেনারা এই তিনজন বাঙ্গালী পুলিশকে ওদের ক্যাম্পে নিয়ে নির্মম অত্যাচার চালায়-পঞ্জাবী সেনারা এই তিনজন বাঙ্গালী পুলিশকে ওদের ক্যাম্পে নিয়ে নির্মম অত্যাচার চালায়-পাঞ্জাবী সেনারা লাইন হয়ে ওদেরকে ঘেরাও করে দাড়িয়ে ফুটবলের মত বুট দিয়ে লাথি মেরে খেলতে থাকে। ওদের তিন জনের দেহ লাঠি, বেত, বুট ও বেয়নেট দিয়ে গরুর মত পিটিয়ে চুরমার করে দেওয়া হয়, সারা দেহ চাক চাক করে কেটে দেওয়া হয়। ওদের দেহ রক্তাক্ত হয়ে একেবারে অবশ ও অচল হয়ে গেলে তাদের তিনজনকে গুলি করে হত্যা করার নির্দেশ দেওয়া হয়। ওদের ক্ষতবিক্ষত দেহ দেখে যাকে তাদের হত্যা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, সেই পাঠান তাদেরকে ছেড়ে দেন। পদস্থ পাঞ্জাবী মিলিটারী অফিসারদের তাদের হত্যা করার জন্য তিনটি ফাকা গুলির শব্দ শুনিয়ে দেয় এবং দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত আত্মগোপন করে থাকার জন্য বলা হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমি উপরোক্ত তিন সহকর্মীর নিকট উক্ত ঘটনা বিস্তারিত জানতে পেরেছি।
১৯৭১ সনের ডিসেম্বরে ঢাকা রাজধানীতে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর সম্মিলিত অবিজানের মুখে আমরা রাজারবাগ পুলিশ লাইনের পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশ ও পাঞ্জাবী সেনাদের বেসামাল অবস্থায় দেখতে পাই। বাংলাদেশ মুক্ত হলে মিত্রবাহিনী ও মুক্তি বাহিনী রাজারবাগ পুলিশ লাইনের সকল পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশ ও পাঞ্জাবী সেনাদের বন্দী করে নিয়ে যায়।
স্বাক্ষর/-
আবদুল কুদ্দুস
২৬-৩-৭৪
রিজার্ভ ইন্সপেক্টর অফ পুলিশ,
বি,আর,পি,
রাজারবাগ, ঢাকা।
<৮,২.১.৬,২২-২৫>
সুবেদার খলিলুর রহমান
আর্মস এস আই, বি, আর পি,
রাজারবাগ পুলিশ লাইন, ঢাকা।
১৯৭১ সনের ২৯শে মার্চ সকাল দশটায় আমরা মিল ব্যারাক পুলিশ লাইনে উপস্থিত হয়ে আমাদের প্রিয় পুলিশ সুপার মিঃ ই, এ, চৌধুরী, পুলিশ কমান্ডেন্ট মিঃ হাবিবুর রহমান, ডি, এস, পি লোদী সাহেব, রেঞ্জ রিজার্ভ ইন্সপেক্টর মিঃ মতিউর রহমান সবাইকে উপস্থিত দেখলাম। মিঃ ই, এ, চৌধুরী সাহেব ক্ষুধার্ত, আহত, ক্ষতবিক্ষত সিপাহীদের দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। লাইনে মুহূর্তে কান্নার রোল পড়ে গেল। তিনি লাইনের মধ্যে প্রবেশ করে প্রতিটি সিপাহীর আহত, ক্ষতবিক্ষত দেহ দেখলেন, তার দু’চোখ বেয়ে অঝোরে অশ্রু পড়ছিল। তিনি অবিলম্বে আমাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করলেন। তিনি বললেন, তোমাদের কোন অসুবিধা নাই, তোমরা নীরবে তোমাদের কাজ করে যাও।” আমি তোমাদের নিরাপত্তার ব্যাপারে সতর্ক দৃষ্টি রাখবো।
আমার সাথে আরও তিনজন সুবেদার, সুবেদার সফিকুর রহমানের সহকর্মীর সাথে আটজন হাবিলদার- মোঃ ফজলুল হক, আঃ ওয়াদুদ, আবদুল কুদ্দুস ও অন্যান্য বিশজন পুলিশ কনস্টেবল দিয়ে ঢাকা কোতোয়ালী থানার দায়িত্ব দেয়া হয়। আমরা থানায় প্রবেশ করে দেওয়ালে, মেঝেতে চাপ চাপ রক্ত দেখতে পেলাম, দেখলাম থানার দেওয়াল গুলির আঘাতে ঝাঁজরা হয় আছে, বুড়ীঙ্গার পাড়ে অসংখ্য মানুষের মৃতদেহ পেলাম, আমাদের পি, এর, এফ, এর কনস্টেবল আবু তাহেরের ( নং ৭৯৮) পোশাকপরা লাশ ভাসছে, আরও বহু সিপাহীর ক্ষত বিক্ষত লাশ দেখতে পেলাম। আমার চোখ বেয়ে অশ্রু পড়ছিল, আমি দিশাহারা হয়ে কাঁদতে কাঁদতে আমার প্রিয় সিপাহী তাহেরের লাশ ধরতে গেলে পিছন থেকে এক পাঞ্জাবী সেনা গর্জ্জন করে কর্কশ ভাবে বলতে থাকে “শূওর কা বাচ্চা, তোমকো ভি পাকড়াতা হায়, কুত্তাকা বাচ্চা, তোম কো ভি সাত মে ‘গুলি করেগা” আমি আর্ম সাব ইন্সপেক্টর হওয়া সত্ত্বেও একজন সাধারণ পাক সেনা আমার সাথে কুকুরের মত ব্যবহার করলো। দুঃখে, অপমানে, লজ্জায়, আমি যেন অবশ হয়ে পড়লাম। প্রতিবাদ করতে চাইলাম সর্বশক্তি দিয়ে কিন্তু পারলাম না। প্রতিবাদ করার কোন উপায় ছিল না। তাই ওদের অসহ্য আপত্তিকর কার্যকলাপের প্রতিবাদ করি নাই, সবকিছু নীরবের সহ্য করেছি ওদের যথেচ্ছ কার্যকলাপের নীরব সাক্ষী হয়ে রয়েছি।
কোতোয়ালী থানার বরাবর সোজাসুজি গিয়ে বুড়ীগঙ্গার লঞ্চঘাটের পাড়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম বুড়ীগঙ্গার পাড়ে লাশ, বিকৃত, ক্ষত-বিক্ষত, অসংখ্য মানুষের লাশ ভাসছে পুলিসের পোশাক পড়া বীভৎস লাশ। দেখলাম বিভিন্ন বয়সের নারী পুরুষ, বৃদ্ধা-যুবা, যুবক-যুবতী, বালক-বালিকা, কিশোর-শিশুর অসংখ্য লাশ। যতদূর আমার দৃষ্টি যায় দেখলাম বাদামতলী ঘাট থেকে শ্যামবাজার ঘাট পর্যন্ত নদীর পাড়ে অসংখ্য মানুষের বীভৎস পচা ও বিকৃত লাশ, অনেক যুবতীর লাশ দেখলাম, এই পূত-পবিত্র বীরাঙ্গনাদের ক্ষত-বিক্ষত যোনিপথ দেখে মনে হলো, পাঞ্জাবী সেনারা কুকুরের মত ওদের পবিত্র দেহের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ওদেরকে যথেচ্ছভাবে ধর্ষণ করে গুলিতে ঝাঁজরা করে নদীতে ফেলে দিয়েছে। অনেক শিশুর ও বালক-বালিকাদের থেতলে যাওয়া লাশ দেখলাম। ওদেরকে পা ধরে মাটিতে আছড়িয়ে মারা হয়েছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অশ্রুভরা চোখে আমি লাশ দেখলাম- লাশ আর লাশ-অসংখ্য নিরীহ বাঙ্গালীর লাশ- প্রতিটি লাশে বেয়নেট ও বেটনের আঘাত দেখলাম, দেখলাম কারও কারও মাথা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে আছে, পাকস্থলি সমেত হৃৎপিণ্ড বের করা হয়েছে, পায়ের গিট হাতের কব্জা ভাঙ্গা, ঝুলছে পানিতে। সদরঘাট টার্মিনালের শেডের মধ্যে প্রবেশ করে শুধু রক্ত আর রক্ত দেখলাম- দেখলাম মানুষের তাজা রক্ত এই বুড়িগঙ্গা নদীর পাড়ে। এই টার্মিনাল শেড ছিল ২৫শে মার্চের কালো রাত্রিতে ওদের জল্লাদখানা। ওরা বহু মানুষকে ধরে এনে ঐ টার্মিনালে জবাই করে বেটন ও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে টেনে হিঁচড়ে পানিতে ফেলে দিয়েছে। অসংখ্য মানুষকে এভাবে নদীতে ফেলে দেওয়ার পরিষ্কার ছাপ দেখতে পেলাম সেই রক্তের স্রোতের মধ্যে। শেডের বাইরের প্রাঙ্গণে দেখলাম অসংখ্য কাক ও শকুন মানুষের সেই রক্তের লোভে ভীর করেছে। সদরঘাট টার্মিনাল থেকে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বের হয়ে পূর্বদিকে পাক সেনাদের সদর আউট পোস্টের দিকে দেখলাম নদীর পাড়ের সমস্ত বাড়িঘর ভস্ম হয়ে ওদের নৃশংসতা ও বীভৎসতার সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দেখালাম রাস্তার পার্শ্বে মিউনিসিপালিটির কয়েকটি ময়লা পরিষ্কার করার ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে, সুইপাররা হাত পা টেনে হেঁচড়ে ট্রাকে লাশ উঠাচ্ছে, প্রতিটি ঘর থেকে আমাদের চোখের সামনে বহু নারী-পুরুষ, বালক-বালিকা, কিশোর-শিশু ও বৃদ্ধ-বৃদ্ধার লাশ সুইপাররা টেনে ট্রাকে উঠাচ্ছিল। পাঞ্জাবী সেনারা নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে কুকুরের মত নির্মমভাবে প্রহরা দিচ্ছিল। ভয়ে সন্ত্রাসে আমি আর এগুতে পারলাম না। পুর্বদিকে রাস্তা দিয়ে আমি সদরঘাটের কাপড়ের বাজারের নীরব নিথর রাস্তা ধরে সদরঘাট বেপটিস্ট মিশনের চৌরাস্তার সম্মুখে দিয়ে নওয়াবপুরের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলাম। আমাদের কারো শরীরে পুলিশের পোশাক ছিল না- আমি এবং আমার সাথে আরও দু’জন সিপাহী সাধারণ পোশাক পড়ে দায়িত্ব পালন করছিলাম।
কাপড়ের বাজারের চারদিকে রূপমহল সিনেমা হলের সম্মুখে সর্বত্র বিভিন্ন বয়সের অসংখ্য মানুষের ইতস্ততঃ ছড়ানো বীভৎস লাশ দেখলাম, বহু যুবতী মেয়ের ক্ষত-বিক্ষত লাশ দেখলাম।
খৃষ্টান মিশনারী অফিসের সম্মুখে, সদরঘাট বাস স্টপেজের চারদিকে, কলেজিয়েট হাইস্কুল জগন্নাথ কলেজ, পগোজ হাইস্কুল, ঢাকা জজকোর্ট, পুরাতন স্টেট ব্যাংক বিল্ডিং, সদরঘাট গির্জা, নওয়াবপুর রোডের সর্বত্র, ক্যাথলিক মিশনের বাইরে এবং ভিতরে আদালত প্রাঙ্গণে বহু মানুষের মৃতদেহ দেখলাম। রাস্তায় রাস্তায় দেখলাম পুলিশের পোশাক পড়া বহু মৃতদেহ, রায় সাহেব বাজার ব্রিজ পার হয়ে নওয়াবপুর রোডে পা দিয়েই দেখলাম বিহারীদের উল্লাস ও উন্মত্ত লাফালাফি, ওরা পশুর মত অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে অসংখ্য বাঙ্গালীর লাশ পাড়িয়ে জয়ধ্বনি করে মিছিল করে নওয়াবপুরের রাস্তায় বের হয়ে পড়ছিল। পাঞ্জাবী সেনা কর্তৃক নির্বিচারে বাঙ্গালী হত্যার খুশীতে দেখলাম বিহারীরা রাস্তায় রাস্তায় পড়ে থাকা নিরীহ বাঙ্গালীদের লাশের উপর লাথি মারছে, কেউ প্রস্রাব করে দিচ্ছে, হাসতে হাসতে, রাস্তায় রাস্তায় বিহারী এলাকায় দেখলাম সরু বাঁশের মাথায় বাঙ্গালী বালক ও শিশুর লাশ বিদ্ধ করে খাড়া করে রাখা হয়েছে। দেখলাম উন্মত্ত বিহারী জনতা রাস্তায় পড়ে থাকা লাশ গুলিকে দা দিয়ে কুপিয়ে কুচি কুচি করে কেটে আনন্দ করছে, উশৃঙ্খল বিহারী ছেলেরা রাস্তায় বেড়িয়ে পড়ে উল্লাস করছে, রাস্তার দুই পার্শ্বে সর্বত্র আগুন আর আগুন দেখলাম। বিহারী জনতা রাস্তার পার্শ্বের প্রতিটি বাড়িতে প্রবেশ করে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল, জ্বলছিল বাঙ্গালীদের ঘর-বাড়ী ,আসবাবপত্র পণ্যদ্রব্য, পোশাক পরিচ্ছদ মুল্যবান জিনিসপত্র। ঠাটারী বাজারের ট্রাফিক ক্রসিংয়ে এসে দেখলাম একটি যুবক ছেলের বীভৎস লাশের উপর পেট চিড়ে বাঁশের লাঠি খাড়া করে লাঠির মাথায় স্বাধীন বাংলার একটি মলিন পতাকা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। লাশের উপর জয় বাংলার পতাকা ঝুলিয়ে রেখে বিহারী জনতা চারদিকে দাঁড়িয়ে থেকে হাসছে, উল্লাস করছে। দেখলাম লাশের গুহ্যদ্বার দিয়ে লাঠি ঢুকিয়ে আনন্দ প্রকাশ করছে। বিজয় নগরের রাস্তা ধরে আমি শান্তিবাগে আমার কোয়ার্টারের আসছিলাম- দেখলাম তখনও রাস্তার চারিপার্শ্বের ঘরবাড়ি জ্বলছে।
আমি কোতোয়ালী থানার দায়িত্ব পালন করতাম, ৩০ শে মার্চ কোতোয়ালী থানার মধ্যে আমরা কামরায় কামরায় প্রবেশ করে দেওয়ালের সর্বত্র চাপ চাপ রক্ত দেখলাম, দেখলাম থানার পায়খানা, প্রশ্রাবখানা ও অন্যান্য দেওয়াল গুলির আঘাতে ঝাঁজরা হয়ে গেছে।
১৯৭১ সনের মার্চ মাসের পর কোতোয়ালী থানার কোন বাঙ্গালী পুলিশকে বাহিরে টহলে পাঠানো হতো না, থানায় বসিয়ে রাখা হত। এক পাঞ্জাবী মেজর আমাদেরকে তদারক করে যেতেন মাঝে মাঝে এসে।
৫ই এপ্রিল আমাদের সবাইকে কোতোয়ালী থানা থেকে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে আনা হয়। পুলিশ লাইনে এসে আমাদের ব্যারাক কেন্টিন, আসবাবপত্র, পোশাক পরিচ্ছদ সবকিছুর ভস্ম ছাই দেখলাম। তিন নম্বর ব্যারাকে প্রবেশ করে আমার দু’জন প্রিয় সিপাহীর অগ্নিদগ্ধ লাশ দেখলাম-লাশের পায়ে শুধুমাত্র বুট ছিল, তাদের পোশাক পরিচ্ছদ সারা দেহ জ্বলে শেষ হয়ে গিয়েছিল। আমার প্রিয় সিপাহী জাহাঙ্গীর ও আবদুস সালামের বীভৎস লাশ দেখে আমি কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম। লাশের দিকে মাথা নত করে আমার দু’জন বীর সিপাহীকে সালাম জানালাম, অশ্রুসিক্ত নয়নে। পুলিশ লাইনের উত্তর পূর্বদিকের পুকুরের উত্তর পাড়ে শহীদ সিপাহীদের যথার্থ মর্যাদার সাথে সমাহিত করলাম।
পুলিশ লাইন থেকে পাঞ্জাবীরা চলে গেলেও রাজারবাগ পুলিশ লাইনে চরম ভয় ভীতি, সন্ত্রাস ও হতাশা বিরাজ করছিল। আমরা সব সময় মৃত্যু ভয়ে ভীত ও আতঙ্কগ্রস্ত থাকতাম। ঢাকা ডিস্ট্রিক্ট বিশেষ পুলিশ ফোর্সের রিজার্ভ ইন্সপেক্টর ছিলেন এ সময় বোস্তান খাঁ নামে এক চরম বাঙ্গালী বিদ্বেষী পাঠান ভদ্রলোক। এ ভদ্রলোক পুলিশ লাইনের দায়িত্বভার গ্রহন করেই চরম সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন। তিনি ৬ই এপ্রিল লাইনে বসেই বাঙ্গালী পুলিশের সাথে কুকুরের মত যথেচ্ছ ব্যবহার আরম্ভ করে দেন। লাইনে প্রবেশ করে স্বাস্থ্যবান, শক্তি সমর্থ কনস্টেবলদের ধরে, হাড়ের গিরায় গিরায় বেদম ভাবে পিটুনি দেন। খুঁজে খুঁজে তার পছন্দ ও ইচ্ছামত যাকে ইচ্ছা তাকেই ধরে মুক্তিবাহিনী বলে ঢাকা সেনানিবাসে ধরে নিয়ে গিয়েছিলেন তারা আর কোনদিন ফিরে আসেনাই। সাথে সাথে ঢাকা সেনানিবাস থেকে মিলিটারী ট্রাকে করে পাঞ্জাবী সেনারা হঠাৎ পুলিশ লাইনে উপস্থিত হয়ে বাঙ্গালী পুলিশদের তদারক আরম্ভ করে দিত। পাইকারীভাবে নাম ও নাম্বার জিজ্ঞাসা করতে করতে অকস্মাৎ অনেককে “তোম শালা মুক্তি বাহিনী হায়, চলো” বলে গরুর মত বুটের লাথি মারতে মারতে ট্রাকে উঠিয়ে নিয়ে যেত। আমি তখন পি, আর, এফ-এর ফোর্স সুবেদার ছিলাম। মিলিটারী ট্রাক লাইনে প্রবেশ করার সাথে সাথে আমি যে কোন অজুহাতে লাইনের বাইরে চলে যেতাম। পাঞ্জাবী সেনারা লাইনে প্রবেশ করলে লাইনের সর্বত্র যেন সবার মুখে মৃত্যুর কালো ছায়া নেমে আসতো। বাঙ্গালী পুলিশ যার যার মত ব্যারাকে প্রবেশ করে ওদের দৃষ্টির আড়ালে থাকার চেষ্টা করত। কারণ ওদের দৃষ্টিতে পড়ে গেলেই ওরা যে কোন অজুহাতে বাঙ্গালী পুলিশদের বিপন্ন করতো, বিপদগ্রস্ত করে তুলতো।
১৯৭১ সনের মে মাসে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে পশ্চিম পাকিস্তানী পাঞ্জাবী পুলিশ এসে গেলে রিজ্জার্ভ ইন্সপেক্টর কুকুরের মত অট্টহাসীতে ফেটে পড়ে বলতে থাকে “যাও শালা লোক শোয়ার কা বাচ্চা হামারা ব্যারাক ছোড়ো, হামারা আদমী আগিয়া, শালা লোগ, ভাগো”। একথা বলার সাথে সাথে বিহারী, পাঞ্জাবী, পাঠান পুলিশ ও পশ্চিম পাকিস্তানী পোশাক পরিচ্ছদ, আসবাবপত্র সবকিছু ব্যারাকের বাইরে ফেলে দিয়ে আমাদের ঘাড়ে ধরে বের করে দেয়। আমরা বাঙ্গালী পুলিশরা অসহায় এতিমের মত আমাদের পোশাক পরিচ্ছদ কুড়িয়ে নিয়ে লাইনের আস্তাবলে বারান্দায় গাছের নিচে উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে আশ্রয় গ্রহণ করি। রাজারবাগ পুলিশ লাইনে যোগদান করার পর আমরা দেখেছি পাঞ্জাবী সেনারা মিলিটারী ট্রাকে ও জীপে করে প্রতিদিন স্কুলে, কলেজে, ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের, ঢাকার বিভিন্ন এলাকার বালিকা, যুবতী মেয়ে ও সুন্দরী রমণীদের ধরে আনতে থাকে। অধিকাংশ বালিকা, যুবতী মেয়ের হাতে বই ও খাতা দেখেছি। প্রতিটি মেয়ের মুখমণ্ডল বিষণ্ণ, বিমর্ষ ও বিষময় দেখেছি। মিলিটারী জীপে ও ট্রাকে যখন এভাবে যুবতী মেয়েদের রাজারবাগ পুলিশ লাইনে আনা হতো তখন পুলিশ লাইনে হৈচৈ পড়ে যেত, পাঞ্জাবী বিহারী ও পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশ জিভ চাটতে চাটতে ট্রাকের সম্মুখে এসে মেয়েদের টেনে হেচড়িয়ে নামিয়ে দিয়ে তৎক্ষণাৎ দেহের পোশাক পরিচ্ছদ কাপড় চোপড় খুলে তাদেরকে সম্পূর্ণ ভাবে উলঙ্গ করে আমাদের চোখের সামনেই মাটিতে ফেলে কুকুরের মত ধর্ষণ করত। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ও অঞ্চল থেকে ধরে এ সকল যুবতী মেয়েদের সারাদিন নির্বিচারে ধর্ষণ করার পর বৈকালে আমাদের পুলিশ হেডকোয়ার্টার বিল্ডিং এর উপর তাদেরকে উলঙ্গ করে চুলের সাথে লম্বা রডের সাথে বেঁধে রাখা হতো। রাতের বেলায় এসব নিরীহ বাঙ্গালী নারীদের উপর অবিরাম ধর্ষণ চালানো হতো। আমরা গভীর রাতে আমাদের কোয়ার্টারে বসে মেয়েদের আর্ত চিৎকার শুনে অকস্মাৎ সবাই ঘুম থেকে ছেলে মেয়ে সহ জেগে উঠতাম। সেই ভয়াল ও ভয়ঙ্কর চিৎকারে কান্নার রোল ভেসে আসত। “বাঁচাও, আমাদের বাঁচাও, তোমাদের পায়ে পড়ি, আমাদের বাঁচাও, পানি দাও, এক ফোটা পানি দাও, পানি পানি।”
মিলিটারী ট্রাক ও ভ্যানে প্রতিদিন পাঞ্জাবী সেনারা রাজধানীর বিভিন্ন জনপদ, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে নিরীহ বাঙ্গালী যুবক ছেলেদের চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে হেডকোয়ার্টারে অফিসের কক্ষে কক্ষে জমায়েত করে অকথ্য অত্যাচার চালাতো। হেড কোয়ার্টারে অফিসের উপর তালায় আমাদের প্রবেশ করা একেবারে নিষিদ্ধ ছিল। দিনের বেলায় পুলিশ লাইনে প্যারেডের আওয়াজের জন্য উপরতলা থেকে নির্যাতিত বন্দীদের কোন আর্তনাদ আমরা শুনতে পেতাম না। সন্ধ্যার পর আমরা আমাদের নির্দিষ্ট কোয়ার্টার থেকে তাদের আর্তনাদ শুনতে পেতাম। সন্ধ্যার পর পাক সেনারা বিভিন্ন প্রকারের বন্দীদের উপর অত্যাচার চালিয়ে যেত। আর লোহার রডের উপর ঝুলন্ত বালিকা, যুবতী নারী ও রূপসী রমণীদের উপর চলতো অবিরাম ধর্ষণ, নির্মম অত্যাচার। বন্দীদের হাহাকারে আমরা অনেক সময় একবারে দিশাহারা হয়ে পড়তাম, অনেক সময় প্রতিবাদ করতে চাইতাম। কিন্তু ওদের শক্তির মোকাবেলায় আমাদের কিছুই করার ছিল না, আমরা কিছুই করি নাই, করতে পারি নাই। এভাবে প্রতিদিন ‘মুক্তি হায়’ বলে যে সব নিরীহ বাঙ্গালী ছেলেদের চোখ বেঁধে পুলিশ লাইনে এনে হেড কোয়ার্টার অফিসে জমায়েত করা হত রাতের শেষে পরের দিন সকালে আর এ সকল বন্দীদের দেখা যেত না এবং সে স্থানে নতুন বন্দীদের এনে রাখা হত।
স্বাক্ষর/-
খলিলুর রহমান
২-৬-১৯৭৪
মতিউর রহমান
সাব-ইন্সপেক্টর অব পুলিশ
রমনা থানা, ঢাকা
১৯৭১ সনের ২৫শে মার্চ আমি সারাদিন থানা সংলগ্ন পুলিশের সি, আই, অফিসের জন্য কাজ করছিলাম। রাত দশটা পনের মিনিট। আমার টেবিলের উপর রাখা টেলিফোনটি বেজে উঠল। কমলাপুর পুলিশের জি, আর, পি থেকে আমার এক বিশিষ্ট বন্ধু টেলিফোনে আমাকে জানালো যে, ঢাকা সেনানিবাস থেকে ভারী অস্ত্র ও কামান সেট করা সত্তরটি আর্মি ট্রাক ভর্তি সশস্ত্র পাক হানাদার এয়ারপোর্ট রোড ধরে ঢাকা শহরে প্রবেশ করছে। রাত প্রায় এগারোটার সময় পাক হানাদাররা আমাদের থানার উপর আক্রমন করে। ওরা এসেই ভারী মেশিনগানের সাহায্যে বৃষ্টির মত আমাদের থানায় গুলি বর্ষণ করতে থাকে। থানার সামনে নিয়োজিত আমাদের সশস্ত্র প্রহরী ও কতিপয় পুলিশ অফিসার পশুদের অবিরাম গুলিবর্ষণে বেশীক্ষণ টিকে থাকতে পারে নাই। পাক সেনারা থানায় ঢুকেই তাদের সবাইকে বন্দী করে। এরপর বহু পাক সেনা আমাদের দিকে গুলি বর্ষন করতে করতে অগ্রসর হতে থাকলে আমরা গুলিবর্ষন শুরু করি এবং প্রাণপণে পশুদের প্রতিরোধ করতে থাকি। এভাবে আমরা সারারাত শত্রুসেনাদের প্রতিরোধ করতে থাকি। সকালে সাড়ে পাঁচটায় ওরা থানার কলোনী সশস্ত্র ভাবে ঘেরাও করে ব্যাপক তল্লাশী আরম্ভ করে এবং আমাদের সবাইকে বন্দী করে। আমরা থানায় পুলিশের সাধারণ সিপাহী, উচ্চপদস্থ পুলিশ অফিসারসহ মোট ৪৫ জন ওদের হাতে বন্দী হয়েছিলাম। আমাদের সাথে বাইরের আরও ৫০ জন পুলিশ বন্দীকে রাখা হয়েছিল। আমাদের সবাইকে থানার সম্মুখে পশ্চিম দিকে মাঠে বেদম প্রহার করতে করতে, বুটদ্বারা লাথি মারতে মারতে নিয়ে গিয়ে “নজর নিচে দেকার মিটেট মে শো যাও” বলে আমাদেরকে উপড় করে লাথি মেরে শুইয়ে দেয়া হয়। সকাল ছয়টা থেকে নয়টা পর্যন্ত তিন ঘন্টা আমাদেরকে বেদম পিটানো হয়। হাতের বেত, বন্ধুকের নল এবং যার হাতে যা ছিল তাই দিয়ে আমাদের উপর এলোপাতাড়ি পিটুনি চলতে থাকে। “শালা মালাউন, শোয়ার কা বাচ্চা আভী জয় বাংলা বলতা নাই, শালা কাফের, হিন্দুকা লাড়কা, তোমহারা মুজিবর বাবা আভি কাহা হায়?” বলে অকথ্য গালাগালি করতে থাকে আর অবিরামভাবে প্রহার করতে থাকে। আমার ঘরে নৌকার সুন্দর আর্ট করা গ্রাম বাংলার একটি দেয়াল চিত্র দেখে আমাকে আরও বেশি প্রহার করতে থাকে। আমাদের সি, আই, মিঃ মোয়াজ্জেম হোসেন, লজ্জায় এবং অপমানে বিমুঢ় হয়ে সারাদিন হাউমাউ করে পাগলের মত কাঁদতে থাকেন। তার দু’ছেলেও তার সাথে বন্দী হয়ে চরম অত্যাচারের শিকার হয়েছিল। তিন ঘন্টা থানার সামনের মাঠে বেদম পিটুনি দেওয়ার ফলে আমাদের বহু সহকর্মী জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন। কারো মুখ দিয়ে রক্ত পড়ছিল, কারো কারো হাত পা ভেঙ্গে গিয়েছিল। এরপর আমাদের প্রায় ৪০ জনকে এলোপাতাড়ি পিটাতে পিটাতে থানার একটি আট ফুট প্রশস্ত ও দশ ফুট চওড়া ছোট কামরায় ঠাসাঠাসি করে চাউলের বস্তার মত গুদামজাত করে রাখা হয়। আমরা বেদমভাবে প্রহৃত হওয়ার পর থানার সম্মুখে প্রাঙ্গনে মানুষের তাজা রক্তে ভরপুর দেখেছি। আমাদের থানা হাজতে একজন আসামী ছিল তাকেও গুলি করা হয়। কিন্তু সে মরে নাই, আধমরা ভাবে ভীষণ যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল। আমরা ছোট কামরায় প্রবেশ করার সময় দেখলাম আমাদের দু’জন শহীদ সিপাহীর লাশ থানার পিছনের মাটিতে পোতা হচ্ছে। সারারাত আমরা সকল সিপাহী বন্দী দাঁড়িয়ে থেকে যন্ত্রণায় কেঁদেছি, সাংঘাতিক যন্ত্রণা ভোগ করেছি। ওরা মেশিনগান নিয়ে সর্বক্ষন প্রহরায় ছিল।
পরের দিন ২৭শে মার্চ সকাল দশটার সময় সকল বন্দীকে বের করে গরুর মত পিটাতে পিটাতে থানার পূর্বদিকে নিয়ে গিয়ে ছোট হাউজের দাঁড় করিয়ে রেখে বলে, “যাও শালা লোগ পিয়ো”। ঐ পানিতে পশুরা নেমে সকালে থেকে গোসল করায় পানি দূষিত ও বিষাক্ত হয়ে গিয়েছিল। আমাদের বন্দীদের মধ্যে কতক সেই পচা পানি দিয়েই হাত মুখ ধুয়ে নিল, তৃষ্ণায় একেবারে দিশাহারা হয়ে অনেকে পানি খেয়ে নিল, অনেকেই সে পানি স্পর্শ করতে পারলো না। আমরা পানির হাউজের সামনে যাওয়ার সময় লক্ষ্য করলাম পূর্বের দিন যেখানে আমাদের দু’জন শহীদ সিপাহীদের লাশ পোতা হয়েছিল সেখানে তাদের লাশ নেই, সামনেই দেখলাম সে দু’জন শহীদ সিপাহীর রক্ত মাখা পোশাক এক জায়গায় গুটিয়ে রাখা হয়েছে। পানি খাওয়ার পর আমাদেরকে পুনরায় সেই ছোট কামরায় গাদাগাদি করে রাখা হয়। কিছুই খেতে দেয়া হয় নাই দু’দিন। আমাদের কেউ কেউ ক্ষুধায় একেবারে কাতর হয়ে খেতে দেওয়ার জন্য প্রার্থনা জানালে ওরা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে বলতো, “তোমহারা মুজিবর বাবা খানা ডেজেগো”
১৯৭১ সনের ২৬শে মার্চ সকাল থেকেই ওরা তিন চার জন করে কামরা থেকে নিয়ে পাশের কামরায় বেদম পিটুনি আরম্ভ করলো। এভাবে আমাদের সকল বন্দীদের উপর অসহ্য মার পিট চললো। আমি সেই কামরায় প্রবেশ করার পর পরই দেখলাম দশ বার জন জল্লাদ পশু। ওদের হাতের ছোট ছোট লাঠি। বন্দুকের বাট, বুট, যার হাতে যা ছিল তাই দিয়ে নির্মম ভাবে পিটাতে থাকে। আমি ওদের মারে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। এরপর আমাকে পাশের কামরায় নিয়ে পুলিশের কোথায় কি আছে, কত পুলিশ অফিসার থানায় আছে, পুলিশ কি মিটিং করেছিল ইত্যাদি সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করে। কিন্তু অসহ্য পিটুনি সহ্য করার পরও আমি কোন ব্যাপারেই সঠিক তথ্য ওদেরকে সরবরাহ করি নাই।
১৯৭১ সনের ২৭শে মার্চ আমরা সকল বন্দীরা যন্ত্রণায় ছটফট করছিলাম। বিকাল তিনটার সময় টুকরীতে করে সামান্য ভাত এনে আমাদের জানালার সামনে ধরে রেখে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে বলতে থাকে, “শালা লোগ চাউল খায়েগা, চাউল।” সে ভাত আমাদেরকে খাওয়াবার জন্য আনা হতো না, বরং আমাদেরকে নিয়ে বিদ্রুপ করার জন্যই আমাদের জানালার সামনে ধরে রাখা হতো। ওরা জানালার সামনে সামান্য কিছু ভাত ধরে ঠাট্টা তামাশা করতে থাকলেও আমাদের কোন ক্ষুধার্ত বন্দীই ওদের বিদ্রুপের সামনে কোন কথাই বলে নাই। ওরা ভাত নিয়ে এমন উলঙ্গভাবে আমাদেরকে নিয়ে বিদ্রুপ করে চলে যাওয়ার পর বন্দীখানায় কান্নার রোল পড়ে যায়। আমরা সবাই কাঁদতে থাকি হাউমাউ করে। ওরা সেই ভাতগুলি আমাদেরকে দেখিয়ে বন্দীখানার সামনের গাছের নিচে ফেলে দেয়। সারারাত আমরা সকল বন্দী কাঁদতে কাঁদতে পার করে। পশুরা মেশিনগান নিয়ে সব সময় আমাদের পাহারা দিচ্ছিল।
পরের দিন ২৮ শে মার্চ আমরা জানালা দিয়ে দেখতে পাই পশুরা থানার অস্ত্রাগার ও মালখানার সকল অস্ত্র ও মালামাল সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল ওদের মটর ট্রাকে করে। হাজতে রাখা আমাদের পুর্ববর্তী আহত বন্দীকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয় আমরা জানতে পারি নাই।
২৯ শে মার্চ পর্যন্ত আমাদেরকে সারাদিন বন্দিখানায় এভাবেই দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। একফোটা পানিও দেওয়া হয় নাই কোন বন্দীকে, কোন খাদ্যও দেয়া হয় নাই।
২৯শে মার্চ বিকাল ৪ টায় তৎকালীন ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার ইমাদ আহমেদ চৌধুরী রমনা থানায় আসেন এবং আমাদেরকে তার সম্মুখে হাজির করা হয়। এমন সময় আমাদের এক বৃদ্ধ সিপাহী ক্ষুধায় এবং তৃষ্ণায় জ্ঞানহারা হয়ে মাটিতে পড়ে যান। ইমাদ আহমেদ চৌধুরী অশ্রুভরা চোখে বন্দীদের দেখছিলেন। আমার সামনে এসে আমার ক্ষতবিক্ষত দেহ দেখে তিনি আমাকে ধরে হাউ মাউ করে কেঁদে ফেললেন। পশুদের বুটের লাথি, বেয়নেটের আঘাত ও লাঠি এবং বেতের এলোপাতাড়ি আঘাতে আমার সমস্ত শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়ে রক্ত ঝরছিল। আমাদের পুলিশ সুপার কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে আমাদেরকে বললেন যাদের নিকটবর্তী বাসা আছে তারা বাসায় চলে যান, আর যাদের কোন বাসা নাই তারা থানার সামনে দারানো ট্রাকে চড়ে মিল ব্যারাকে চলে যান।” আমি থানার বাসায় গিয়ে দেখলাম, সব লুট হয়ে গেছে, পাক পশুরা সব নিয়ে গেছে। খাওয়ার কিছুই ছিল না, না খেয়ে আহত ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত দেহ নিয়ে খোদাকে আমার অত্যাচারের সাক্ষী রেখে শুন্য খাটে এলিয়ে পড়লাম। পরদিন সকালে আমি রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালের দিকে রওয়ানা হই অনেক কষ্টে। পথে দেখলাম তখনও রাজারবাগ পুলিশ লাইনে পুলিশের ব্যারাক দাউ দাউ করে জ্বলছে, জ্বলছে পুলিশের পোশাক-পরিচ্ছদ আসবাবপত্র। ব্যারাকের পিছনেই পাকা যায়গায় দেখলাম চাপ চাপ রক্ত শুকিয়ে আছে। ব্যারাকের মাঝখানে দেখতে পেলাম পায়ে বুট দেওয়া দু’টি পুলিশের লাশ তখনও জ্বলছে। পশুদের ভয়ে আর সামনে এগোতে সাহস পেলাম না। অন্য রাস্তা ধরে তাড়াতাড়ি হাসপাতালের দিকে পা’ বাড়ালাম।
স্বাক্ষর/-
মতিউর রহমান
২২-৩-১৯৭৪
<৮,২.১.৮,২৮-২৯>
\৮\
মোহাম্মদ হোসেন
পুলিশের সিপাহী
রমনা থানা, ঢাকা
১৯৭১ সনের ২৫ শে মার্চ রমনা থানার একজন সাধারণ সিপাহী হিসেবে থানার সম্মুখের প্রাঙ্গণে প্রহরারত ছিলাম। রাত দশটায় আমার কর্তব্য শেষ করে আমি ব্যারাকে চলে যাই। কিছুক্ষন পরই আমি থানার চারদিকে ভীষণ হৈচৈ, দৌড়াদৌড়ি ও গোলমালের আওয়াজ শুনে থানার সামনে দাঁড়িয়ে দেখি ইট, পাথর ও গাছ দিয়ে জনতা রাস্তার উপর বেরিকেড তৈরী করছে। এ সময় আমাদের থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার কাজী মহিউদ্দিন সাহেব থানার অস্ত্রাগার থেকে প্রত্যেকের প্রয়োজনমত অস্ত্র দিয়ে দেন। আমরা যার যা প্রয়োজন সে মত অস্ত্র নিয়ে পাক হানাদারদের হামলা প্রতিরোধ ও প্রতিহত করার জন্য থানার চারদিকে পজিশন নেই। আমরা সবাই সেদিন এই শপথ গ্রহন করেছিলাম যার হাতে যা আছে তা-ই দিয়ে পাক-পশুদের মোকাবিলা করব, প্রান দিব কিন্তু পিছু হটবো না। থানার চার দিকে আমরা সকল পুলিশ সিপাহী ও পুলিশের সকল অফিসার সশস্ত্রভাবে পাক-পশুদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। অল্পক্ষন পরে পাক পশুরা চারদিক থেকে বৃষ্টির মত গুলি বর্ষণ করতে করতে থানায় প্রবেশ করার চেষ্টা করে। আমাদের হাতে সামান্য রাইফেল দিয়ে ওদের প্রানপন প্রতিরোধ করতে থাকি। এভাবে পাক-পশুদের অজস্র গুলিবর্ষণের মুখে আমরা সারারাত ওদের প্রতিরোধ করেছি কিন্তু আত্ম-সমর্পণ করি নাই। আর প্রতিরোধ করার সময় সহস্র গুলিবর্ষণের মুখেও আমাদের কোন সিপাহী বা অফিসার আত্মসমর্পণ করার জন্য কোন দুর্বলতা প্রকাশ করেন নাই। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমরা এই দৃঢ়তা দেখিয়েছি, “প্রানপন পশুদের প্রতিহত করবো, কিন্তু পিছু হটব না।”
অতি প্রত্যুষে পশুরা থানার পিছনে যেখানে দাঁড়িয়ে আমরা ওদের প্রতিহত করছিলাম সেখানে প্রতিটি ঘরে ঘরে ব্যাপক তল্লাশী আরম্ভ করে দেয় এবং প্রত্যেক ঘর থেকে আমাদের থানার সশস্ত্র সিপাহীদের বন্দী করে গরুর মত এলোপাতাড়ি পিটাতে পিটাতে থানার পিছনের পুলিশ ব্যারাকে সামনে এনে জড়ো করে বন্দীদের অবিরামভাবে পিটাতে থাকে। ওরা আমাদেরকে উন্মত্তভাবে পিটাচ্ছিল আর বলছিল, “শালা মালাউনকা বাচ্চা, হিন্দুকা লাড়কা, শোয়ারকা বাচ্চা শালা তোমহারা মুজিব বাবা আভি কাহা হায়, শালা হারামী, আভি শালা জয় বাংলা বোলতা না-ই।” ওদের এলোপাতাড়ি পিটুনিতে আমাদের সিপাহীরা অনেকে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে যান, অনেকের মুখমন্ডল রক্তাক্ত ছিল, কারো হাত-পা একেবারে ভেঙ্গে গিয়েছিল, আমাদের অধিকাংশ বন্দীর শরীরে কোন কাপড় ছিল না। ওদের নির্মম মারের চোটে কখন যে পরণের বস্ত্র কোথায় পড়ে গিয়েছিল বলতে পারবো না কেউ। আমাদের সকলকে আবার পিটাতে পিটাতে বুটের লাথি মারতে মারতে আমাদের থানার সি, আই, সাহেবের কামরায় জুড়ে বসা পাঞ্জাবী ক্যাপ্টেনের সামনে আমাদের প্রায় উলঙ্গ দাঁড় করানো হয়। ক্যাপ্টেন তখন কর্কশ কন্ঠে চিৎকার করে বলছিল, “সব শালাকো এক গুলিতে খতম কার দেও”।
এমন সময় জনৈক পাঞ্জাবী মেজর সেখানে উপস্থিত হতে জানান যে, “জি. ও. সি সাহেব বোলা হায় ইন লোগকে রাখ দাও, গোলি মাত করো, বাদমে দেখা যায়েগা।” আমাদেরকে তখন গুলি করা হয় না, বুটের লাথি মারতে মারতে আমাদেরকে থানার সামনে দশ ফুট চওড়া ও আট ফুট লম্বা একটি ছোট কামরায় গরু ছাগলের মত গাদাগাদি করে এনে রাখা হয়। এ ছোট কামরায় আমরা পুলিশ ও পুলিশের উচ্চ পদস্থ অফিসার সহ মোট ৪৭ জন ছিলাম। আমাদের কামরার চারদিকে পশুরা মেশিনগান নিয়ে প্রহরায় মোতায়েন ছিল সবসময়। বেদম পিটুনি খাওয়ার পর বন্দীরা সবাই কান্নাকাটি করছিল, আমাদের সি, আই মোয়াজ্জেম হোসেন খান, অপমানে এবং বেদমভাবে নির্যাতিত হওয়ায় হাউমাউ করে কাঁদছিলেন। তার দুই ছেলেও নির্মমভাবে অত্যাচারিত হয়ে রক্তাক্ত আহত শরীর নিয়ে উলঙ্গভাবে দাঁড়িয়েছিল। আমরা থানার সেই ছোট কামরায় গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে থেকে সব সময় ভীতসন্ত্রস্তভাবে মৃত্যুর প্রহর গুনেছি।
এভাবে ২৭শে, ২৮শে ও ২৯শে মার্চ চলে যায়। আমাদেরকে তৃষ্ণা মিটানোর জন্য এক ফোটা পানি দেওয়া হয় নাই, আর কোন খাদ্যও দেয়া হয় নাই।
আর ২৯শে মার্চ বিকালে তৎকালীন জেলা পুলিশ সুপার ই, এ চৌধুরী সাহেব রমনা থানায় এসে আমাদের নাম তালিকাভুক্ত করলেন এবং আমাদের জন্য কিছু টাকা দিলেন নিজ পকেট থেকে। কিন্তু তখন বাহিরে কার্ফু থাকায় আমরা বেরুতে পারি নাই।
পরের দিন ৩০শে মার্চ আমি আমার তেজগাঁওস্থিত বাড়িতে চলে যাই। এরপর আমি বাংলার মুক্তি সংগ্রামকে সাহায্য করার একমাত্র আকাঙ্খায় এবং আমার পরিবারের নিরাপত্তা ও অস্তিত্ত্ব রক্ষার উদ্দেশ্যে আমি পুনরায় থানায় যোগদান করি। আমাদের থানা তখন বিহারী রাজাকার ও পাকসেনাদের দখলে ছিল। ওরাই থানার সর্বময় প্রভু ছিল। আমাদের হাতে কোন রাইফেল দেয়াও হতো না, শুধু লাঠি দেয়া হতো মাত্র। আমরা দেখেছি, প্রতিদিন অসংখ্য বাঙ্গালী যুবক, বৃদ্ধকে, অসহায় মানুষকে মুক্তিবাহিনীর মিথ্যা অজুহাতে ধরে থানায় আনা হতো, প্রতিদিন বিহারীরা এই নিরীহ বন্দীদের উপর অত্যাচার চালাতো। অনেক বন্দীকে সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া হতো। যে সকল বন্দীকে থানা থেকে নিয়ে যাওয়া হতো তাদের অধিকাংশই ফিরে আসতো না। ওদেরকে মেয়ে ফেলা হতো। পাক সেনা বিহারি ও বেইমান বাঙ্গালী রাজাকাররা এভাবে ১৯৭১ সনের নভেম্বর মাস পর্যন্ত অত্যাচার চালাতে থাকে। ডিসেম্বরে মুক্তি বাহিনী ও মিত্র শক্তির সম্মিলিত আগমনের মুখে পাক পশুরা রাজারবাগের দিকে পালিয়ে যায়।
আমরা এ থানায় কর্তব্যরত থাকাকালে মুক্তি বাহিনীকে নিয়মিত সংবাদ দিয়েছি, বন্দীদের সাহায্য করেছি- এ ভাবে আমরা বাংলার মুক্তি সংগ্রামকে মনে-প্রানে কার্যকলাপে সবদিক দিয়ে সর্বতোভাবে যথাসাধ্য সাহায্য করেছি।
স্বাক্ষর/-
মোহাম্মদ হোসেন
২১-১-৭৪
<৮,২.১.৯,৩০-৩২> “কোন হিন্দুর লাশ আমি রাস্তায় পাই নাই। সবকটি লাশ মুসলমানের ছিল।“
মোঃ সাহেব আলী
সুইপার ইন্সপেক্টর
ঢাকা পৌরসভা,ঢাকা।
আমি ১৯৭১ সন থেকে ঢাকা পৌরসভার অধীনে সুইপার ইন্সপেক্টার হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। ১৯৭১ সনের ২৫শে মার্চ আমি আমার সুইপারের দল নিয়ে দায়িত্ব পালন করে সন্ধ্যায় ৪৫/১, প্রসন্ন পোদ্দার লেনস্থিত আমার দ্বিতীয় স্ত্রীর বাড়িতে অবস্থান করছিলাম। রাত নয়টার দিকে আমি ঢাকা ইংলিশ রোডের দিকে বের হয়ে দেখলাম রাস্তাঘাট চারিদিকে থমথমে, সকল প্রকার যানবাহন দ্রুত গন্তবস্থলের দিকে যেতে দেখলাম। ছাত্র জনতাকে রাস্তায় বেরিকেড তৈরী করতে দেখলাম। প্রতিরোধ তৈরীতে ব্যস্ত ছাত্র জনতার নিকট জানতে পারলাম ঢাকা সেনানিবাস থেকে পাক সেনারা রাজধানী ঢাকার দিকে সামরিক ট্রাক নিয়ে এগিয়ে আসছে। পাক পশুদের প্রতিরোধ করার জন্য ছাত্র জনতার এই প্রচেষ্টা ও প্রয়াস। আমি সবকিছু দেখে অত্যন্ত ভারাক্রান্ত মনে বাসায় চলে গেলাম। রাত সাড়ে
এগারটার দিকে রাজারবাগ পুলিশ লাইন, পুলিশ হেডকোয়ার্টার, পুলিশ অফিস ও মালিবাগ, গোয়েন্দা অফিসের দিকে আকাশ ফাটা গোলাগুলির শব্দ শোনার সময় ঢাকা শাঁখারী বাজার প্রবেশ পথে বাবু বাজার ফাঁড়িতে ভীষণ শেলিংয়ের গর্জ্জন শুনলাম। আমি নিকটবর্তী নয়াবাজার সুইপার কলোনীর দোতলায় দাঁড়িয়ে চতুর্দিকে গোলাগুলির ভীষণ গর্জ্জন শুনলাম।
২৬শে মার্চ অতি প্রত্যুষে আমি সুইপার কলোনীর দোতলা থেকে দৌঁড়ে নেমে বাবুবাজার ফাঁড়িতে গিয়ে দেখলাম ফাঁড়ির প্রবেশ পথ, ভেতরে, চেয়ারে বসে, উপুড় হয়ে পড়ে থাকা দশ জন পুলিশের ইউনিফরম পরা গুলির আঘাতে ঝাঁজরা ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত লাশ পড়ে আছে। আমি ফাঁড়ির ভেতরে প্রবেশ করে দেখলাম ফাঁড়ির চারিদিকের দেয়াল হাজারো গুলির আঘাতে ঝাঁজড়া হয়ে আছে। দেয়ালের চারিদিকে মেঝেতে চাপ চাপ রক্ত, তাজা রক্ত জমাট হয়ে আছে, দেখলাম কেউ জীভ বের করে পড়ে আছে, কেউ হাত পা টানা দিয়ে আছে, প্রতিটি লাশের পবিত্র দেহে অসংখ্য গুলির আঘাত। মানবতার অবমাননা ও লাঞ্চনার বীভৎস দৃশ্য দেখে আমি একটি ঠেলগাড়ীতে করে সকল লাশ ঢাকা মিটফোর্ড হাসপাতালে লাশ ঘরে রেখে আবার ঠেলাগাড়ী নিয়ে শাঁখারীবাজারে প্রবেশ করে একবারে পূর্বদিকে ঢাকা জজকোর্টের কোণে হোটেলের সংলগ্ন রাস্তায় দশটি ফকির মিসকিন ও রিকশা মেরামতকারী মিস্ত্রীর উলঙ্গ ও অর্ধ উলঙ্গ লাশ উঠালাম। কোন হিন্দুর লাশ আমি রাস্তায় পাই নাই। সবকটি লাশ মুসলমানের ছিল। রাস্তায় পড়ে থাকা গুলিতে ঝাঁঝরা দশটি লাশ ঠেলাগাড়ীতে তুলে আমি মিটফোর্ড নিয়ে গিয়েছি। মুসলমানের লাশ এভাবে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেওয়া যায় না। তাই আমরা স্থানীয় জনতা সবাই মিলে লাশ গুলি তুলে মিটফোর্ডে জমা করেছি। রাজধানী ঢাকার সর্বত্র কার্ফূ থাকা সত্ত্বেও গণহত্যার সেই বীভৎস দৃশ্য দেখার জন্য ছাত্র জনতা রাস্তায় রাস্তায় বের হয়ে পড়লে পাক সেনারা ঘোষনা করে কার্ফূ বলবৎ রয়েছে, কেউ রাস্তায় বের হলে গুলি করা হবে। পাক সেনাদের এই ঘোষনার পর আমরা সরে পড়লাম। দিনের শেষে বেলা পাঁচটার সময় তাঁতিবাজার, শাঁখারীবাজার, এবং কোর্ট হাউজ স্ট্রীট এলাকায় পাক সেনারা আগুন ধরিয়ে দেয়। সাথে সাথে চলতে থাকে অবিরাম গুলি বর্ষণ। সারারাত পাক সেনারা তাঁতিবাজার, শাঁখারীবাজার ও গোয়াল নগর এলাকায় অবিরাম গুলি বর্ষণ করতে থাকে।
১৯৭১ সনের ২৭শে মার্চ বেলা একটার সময় পাক সেনারা নওয়াবপুর থেকে ইংলিশ রোডের বাণিজ্য এলাকার রাস্তায় দুদিকের সকল দোকানপাটে আগুন ধরিয়ে দেয়। বেলা তিনটা পর্যন্ত ইংলিশ রোডের রাস্তায় দুদিকে আগুন জ্বলতে থাকে। আগুনের সেই লেলিহান শিখায় পার্শ্ববর্তী এলাকার জনতা আশ্রয়ের জন্য পালাতে থাকে। পালাতে গিয়ে পাক সেনাদের গুলিতে অনেকে প্রাণ হারায় । বেলা তিনটায় পাক সেনারা তাঁতিবাজারের বাহির পথ ও মালিবাগের পুলের পশ্চিম পার্শ্বে হিন্দু মন্দিরের উপর শেলিং করে মন্দিরটি ধ্বংস করে দেয়। ইংলিশ রোদের আগুন বাসাবো এলাকাকে অতিক্রম করে সুইপার কলোনীর দিকে ধেয়ে আসতে থাকলে আমি সুইপারদের কলোনীর পানি রিজার্ব করে রাখার নির্দেশ দেই। পাক সেনাদের ডিঙ্গিয়ে সকল সুইপার মিলে সুইপার কলোনীটি রক্ষা করার জন্য অগ্রসর হলে আমরা পাক সেনাদের গুলির মুখে চলে আসি।
১৯৭১ সনের ২৮শে মার্চ সকালে রেডিও মারফত সকল সরকারী ও বেসরকারী কর্মচারীকে অবিলম্বে কাজে যোগদান করতে হবে এ নির্দেশ পেয়ে পরদিন আমি সকাল ১০টার সময় ঢাকা পৌরসভায় ডিউটি রিপোর্ট করলে ঢাকা পৌরসভার তৎকালীন কন্সারভেন্সী অফিসার মিঃ ইদ্রিস আমাকে ডোম নিয়ে অবিলম্বে ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় পড়ে থাকা লাশ তুলে ফেলতে বলেন। ইদ্রিস সাহেব অত্যন্ত ক্রুদ্ধভাবে বলতে থাকেন সাহেব আলী বের হয়ে পড়, যদি বাঁচতে চাও তবে ঢাকার রাজপথ ও বিভিন্ন এলাকা থেকে লাশ তোলার জন্য বের হয়ে পড়। কী বাঁচবেনা, কাউকে রাখা হবে না, সবাইকে পাক সেনাদের গুলি বর্ষণে মরতে হবে, সবাইকে কুকুরের মত হত্যা করা হবে। পৌরসভার তৎকালীন চেয়ারম্যান মেজর সালামত আলী খান শুর আমাদের সাথে কুকুরের মত উত্তেজিত হয়ে, অত্যন্ত কর্কশ স্বরে ক্রুদ্ধভাবে বকাবকি করতে থাকেন। সেখানে আমি, সুইপার ইন্সপেক্টর আলাউদ্দিন, সুইপার ইন্সপেক্টর কালীচরণ, সুইপার সুপারভাইজার পাঞ্চাম, সুইপার ইন্সপেক্টর আওলাদ হোসেন আমরা পাঁচজন উপস্থিত ছিলাম। আমাকে পরদেশী ডোম, লেমু ডোম, ডোম গোলাপ চান, দুঘিলা ও মধু ডোমকে নিয়ে মিটফোর্ড হাসপাতাল থেকে লাশ তুলে স্বামীবাগ আউটকলে ফেলতে বলা হয়।
১৯৭১ সনের ২৯শে মার্চ আমার দল ঢাকা মিটফোর্ড হাসপাতালের লাশ ঘর থেকে দুই ট্রাক লাশ তুলেছে। আমার দল যে সকল লাশ তুলেছে আমি স্বচক্ষে তা দেখেছি। অধিকাংশই ছিল সরকারী কর্মচারী, পুলিশ, আনসার ও পাওয়ারম্যানদের খাকী পোষাক পরা বিকৃত লাশ। লাশ তুলতে তুলতে পরদেশী নামক জনৈক ডোমের হাতে এক ষোড়শী রুপসীর উলঙ্গ ক্ষতবিক্ষত লাশ দেখলাম, দেখলাম সেই যুবতীর পবিত্র দেহে অসংখ্য ক্ষত চিহ্ন, তার বুক থেকে স্তন সজোরে তুলে নেওয়া হয়েছে, লজ্জাস্থান ক্ষতবিক্ষত হয়ে আছে, পিছনের মাংস তুলে নেয়া হয়েছে। হরিণের মত মায়াভরা মধুময় বড় বড় চোখ ঘুমিয়ে আছে, সারা দেহে সৃষ্টিকর্তা যেন দুধের সর দিয়ে আবৃত করে দিয়েছে, মাথায় কালো কালো চুল তার কোমর পর্যন্ত লম্বা হয়ে পড়ে ছিল, তার দুই গালে আঘাতের চিহ্ন দেখলাম। পরক্ষণেই দেখলাম দশ বছরের এক কিশোরীর উলঙ্গ ক্ষতবিক্ষত লাশ। অপরুপা রুপসী ফলের মত টক টকে চেহারা, সারা দেহে বুলেটের আঘাত।
১৯৭১ সনের ৩০শে মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হল থেকে ভারপ্রাপ্ত পাক সেনাদের মেজর পৌরসভায় টেলিফোনে সংবাদ দেন রোকেয়া হলের চারিদিকে মানুষের লাশের পচা গন্ধে বসা যাচ্ছে না, অবিলম্বে ডোম পাঠিয়ে লাশ তুলে ফেলা হোক। আমি ছয়জন ডোম নিয়ে রোকেয়া হলে প্রবেশ করে রোকেয়া হলের সমস্ত কক্ষে তন্ন তন্ন করে খুঁজে কোন লাশ না পেয়ে চারতলা চাদের উপর গিয়ে আঠার বছরের জনৈক রুপসী ছাত্রীর উলঙ্গ লাশ দেখতে পেলাম। আমার সাথে দায়িত্বরত জনৈক পাক সেনাকে জিজ্ঞাসা করলাম এ ছাত্রীর দেহে গুলির কোন আঘাত নাই, দেহের কোন স্থানে কোন ক্ষত চিহ্ন নাই অথচ মরে চিৎ হয়ে পড়ে আছে কেন? সে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে বলল আমরা সকল পাক সেনা মিলে ওকে ধর্ষণ করতে করতে মেরেছি। পচা-ফুলা সেই রুপসীর উলঙ্গ দেহ পড়ে আছে দেখলাম। ডাগর ডাগর চোখ ফুলে বের হয়ে আছে, মাথার চুল নিকটেই ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে, লজ্জাস্থান তার পেট থেকে ফুলে অনেক উপরে উঠে আছে, যোনিপথ রক্তাক্ত। তার দুইদিকে গালে পশুদের কামড়ের চিহ্ন দেখলাম, বক্ষের স্তনে মানুষের দাঁতের দংশনের চিহ্ন দেখলাম। আমি একটি চাদর দিয়ে লাশটি ঢেকে দিয়ে নামিয়ে নিয়ে আসি, রোকেয়া হলের সার্ভেন্ট কোয়ার্টারের ভেতরে প্রবেশ করে পাঁচ জন মালিদের স্ত্রী পরিজনদের পাঁচটি লাশ এবং আটটা পুরুষের লাশ (মালি) পেয়েছি। লাশ দেখে মনে হল মৃত্যুর পূর্বক্ষণে সবাই শুয়ে ছিল। আমি ট্রাক নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিববাড়ীর তেতলা থেকে জনৈক হিন্দু অধ্যাপক, তার স্ত্রী ও দুই ছেলের লাশ তুলেছি। স্থানীয় জনতার মুখে জানতে পারলাম তাঁর দুই মেয়ে বুলেটবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে আছেন। সংগৃহীত লাশ স্বামীবাগ আউটকলে ফেলে দিয়ে আমরা ট্রাক নিয়ে ঢাকা বুড়ীগঙ্গা নদীতে ভাসমান হাত-পা, চোখ বাঁধা অসংখ্য যুবকের লাশ তুলেছি। আমরা ৩০শে মার্চ ঢাকা বুড়ীগঙ্গা নদী থেকে তিন ট্রাক লাশ তুলে স্বামীবাগে ফেলেছি। পাক সেনারা কুলি দিয়ে পূর্বেই সেখানে বিরাট বিরাট গর্ত করে রেখেছিল।
পরের দিন মোহাম্মদপুর এলাকার জয়েন্ট কলোণির নিকট থেকে সাতটি পচা-ফুলা লাশ তুলেছি। ইকবাল হলে আমরা কোন লাশ পাই নাই। পাক সেনারা পূর্বেই ইকবাল হলের লাশ পেট্রোল দিয়ে জ্বালিয়ে ভস্ম করে দেয়। বস্তি এলাকা থেকে জগন্নাথ হলে আশ্রয়ের জন্য ছুটে আসা দশ জন নর-নারীর ক্ষতবিক্ষত লাশ তুলেছি। ফেরার পথে আমরা ঢাকা হলের ভেতর থেকে চার জন ছাত্রের উলঙ্গ লাশ তুলেছি।
১৯৭১ সনের ১লা এপ্রিল আমরা কচুক্ষেত, ড্রাম ফ্যাক্টরী, তেজগাঁও, ইন্দিরা রোড, দ্বিতীয় রাজধানী এলাকাস্থ ঢাকা বিমান বন্দরের অভ্যন্তরে, ঢাকা স্টেডিয়ামের পূর্ব দক্ষিণ দিক থেকে কয়েকজন ছাত্রের পচা লাশ তুলেছি। এরপর থেকে প্রতিদিন আমরা বুড়ীগঙ্গা নদীর পাড় থেকে হাত-পা, চোখ বাঁধা অসংখ্য যুবকের লাশ তুলেছি। রায়ের বাজার ইটখোলায় আমরা কয়েক হাজার বাঙ্গালী যুবকের লাশ তুলেছি। মিরপুর এক নম্বর সেকশনের রাস্তার পার্শ্বে ছড়ানো, ছিটানো বাঙ্গালী যুবকের লাশ তুলেছি। মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল কলেজের হল থেকে দশ জন ছাত্রের ক্ষতবিক্ষত লাশ তুলেছি। রায়ের বাজার রাস্তা, পিলখানা, গণকটুলি, ধানমণ্ডি, কলাবাগান, কাঁঠাল বাগান, এয়ারপোর্ট রোডের পার্শ্ববর্তী এলাকা, তেজগাঁও মাদ্রাসা থেকে অসংখ্য মানুষের পচা-ফুলা লাশ তুলেছি। অনেক লাশের হাত-পা পেয়েছি মাথা পাই নাই। মেয়েদের লাশ সবই উলঙ্গ ও ক্ষতবিক্ষত পেয়েছি।
কিছুদিন পর আমি কর্তৃপক্ষের নির্দেশ মত কারখানায় গিয়ে সাধনা ঔষধালয়ের মালিক প্রফেসর যোগেশচন্দ্র বাবুর বেয়নেটের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত রক্তাক্ত তাজা লাশ তুলে স্বামীবাগ ফেলেছি। পাক পশুরা যোগেশ বাবুর সর্বস্ব লুণ্ঠন করে তাকে তার নিজস্ব কামরায় বক্ষে বেয়নেট ঢুকিয়ে দিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে রেখে যায়। পরে তার পবিত্র ক্ষত-বিক্ষত লাশ নিচে নামিয়ে এনে খাটের উপর রেখে দিয়েছিল। আমরা গিয়ে দেখলাম প্রফেসর যোগেশ বাবুর লাশ জীভ বের করে হা করে আছে। গায়ে ছিল ধুতি আর গেঞ্জি।
স্বাক্ষর- মোঃ সাহেব আলী।
১৯-০৫ ৭৪
মোঃ সাহেহুজ্জামান
সাব ইন্সপেক্টর অব পুলিশ
রমনা থানা, ঢাকা।
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ সন্ধ্যায় আমি এক প্লাটুন ফোর্সসহ মিরপুর এক নম্বর সেকশনে টহলে ছিলাম। সন্ধ্যার পর পরই আমি মিরপুরের সর্বত্র থমথমে ভাব লক্ষ করেছি। রাত আনুমানিক সাড়ে দশটার সময় আমার ওয়্যারলেস সেটটি অকস্মাৎ সক্রিয় হয়ে উঠে। ওয়্যারলেস সেটে এক বাঙ্গালী পুলিশ কণ্ঠ অজানা ষ্টেশন থেকে বলছিল, “ঢাকা সেনানিবাস থেকে ট্যাঙ্ক ও কামানবাহী সশস্ত্র পাক সেনাদের ট্রাক সারিবদ্ধভাবে রাজধানীতে সদর্পে প্রবেশ করছে, বাঙ্গালী পুলিশ তোমরা সাবধান হও।” ইহার পর আমার ওয়্যারলেস সেটের মারফত ঢাকা পুলিশ কন্ট্রোল রুম থেকে মেসেজ দেয়া হয়, “পুলিশ ডিউটি উইথড্রন।” ওয়্যারলেস মারফত এসব মেসেজ আসার পরপরই আমি ঢাকা রাজধানীর আকাশে সর্বত্র আগুনের ফুলকি উঠতে দেখলাম। অকস্মাৎ রাজারবাগ পুলিশ লাইন, ইকবাল হল, ই,পি,আর হেডকোয়ার্টারে ভীষণ কামান ও ট্যাঙ্ক হামলার আকাশফাটা শব্দ শুনতে পাই। এ পরিস্থিতিতে আমি আমার টহলরত পুলিশ ফোর্সকে মিরপুরের পশ্চিম দিকে গ্রামের দিকে চলে গিয়ে প্রাণপণ প্রতিরোধ করার নির্দেশ দিয়ে আমি আমার রাইফেল ও গুলি নিয়ে থানার বাসায় চলে যাই। থানায় ফিরে আমি তৎকালীন মিরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসার মিঃ আবুল হাসেম ও অন্যান্য সাব ইন্সপেক্টর, এ,এস,আই ও বাঙ্গালী পুলিশদের আমিন অত্যান্ত বিমর্ষ অবস্থায় দেখতে পাই। থানায় বসে আমরা ওয়্যারলেসে বাঙ্গালী কন্ঠের বহু বীভৎস আর্তনাদ শুনতে পাই।
রাত সাড়ে চারটার দিকে পাক পশুরা পুলিশ কন্ট্রোল রুম দখল করে সেখানকার ওয়্যারলেসে বাইরে টহলে নিযুক্ত বাঙ্গালী পুলিশদের কর্কশ কণ্ঠে বলছিল “ বাঙ্গালী শালালোগ আভী আ-কার দেখো, তোমারা কেতনা মা বাহেন হামারা পাস হ্যায়…”। এ কথা শুনে বাঙ্গালী পুলিশদের গা শিউরে উঠে। আমি তৎক্ষণাৎ ওয়্যারলেস সেট বন্ধ করে দেই। সকাল হওয়ার পূর্বেই আমি থানা ও থানার বাসা ছেড়ে দিয়ে মিরপুরে অন্য এক বাসায় আত্মগোপন করে থাকি।
সকালে আমি দেখলাম বাঙালি ই,পি, আরদের মিরপুর ই,পি,আর ক্যাম্প থেকে বন্দী করে আমাদের থানার সম্মুখে এনে পাক-পশুরা নিরস্ত্র করে থানা বন্দী করছে। আমি আরো দেখলাম মিরপুরের সকল বাঙ্গালী বাড়ীতে বিহারীরা কপালে সাদা কাপড় বেঁধে দানবের মত উল্লাসে ফেটেপড়ে আগুন লাগাচ্ছে, লুটপাট করছে। বাড়ী বাড়ী থেকে বাঙ্গালী শিশু, যুবতী, বৃদ্ধাদের টেনে এনে রাস্তায় ফেলে ছোরা দিয়ে জবাই করছে, বাঙালী রমণীদের ধরে এনে রাস্তায় উলঙ্গ করে ফেলে উপর্যুপরি ধর্ষণ করে তৎক্ষণাৎ ধারালো ছুরি দিয়ে স্তন ও পাছার মাংস ছলাৎ করে কেটে ফেলে নৃশংসভাবে হত্যা করছে। কাউকে কুচি কুচি করে কেটে ফেলছে, কারো যোনীতে লোহার রড ঢুকিয়ে দিচ্ছে, কারো গায়ে আগুন লাগিয়ে দিয়ে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছে। ভীত সন্ত্রস্থ হাজারো মানুষ তখন প্রাণভয়ে গ্রামের দিকে পালিয়ে যাচ্ছিল। যে সকল নিরীহ মানুষ পালাতে পারছিলো না, তাদেরকে বিহারীরা নির্মমভাবে জবাই করেছিল। পাক সেনারা এ ব্যাপক বাঙ্গালী হত্যায় বিহারীদের পিছনে থেকে সাহায্য করছিল।
২৭শে মার্চ কিছুক্ষণের জন্য কার্ফূ তুলে নিলে আমি আমার পরিবার পরিজন নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে মিরপুরের বাইরে যাত্রা করি। মিরপুর গরুর হাট অতিক্রম করার সময় আমি দেখলাম পাক সেনাদের টহল ভেদ করে একটি ট্রাকে মহিলা ও শিশু মিরপুর ব্রীজের দিকে যাচ্ছিল- পাক সেনারা ঐ ট্রাকে আগুন ধরিয়ে দেয়। আর দুটি যুবতী মেয়েকে তাদের জীপে উঠিয়ে নিয়ে যায়। মেয়ে দুটি পাক পশুদের হাতে পড়ে প্রাণফাটা আর্তনাদ করছিল। আমরা দূর থেকে গরুর হাট বরাবর বোরো ধানের ক্ষেতে আশ্রয় নিয়েছিলাম। বহু দুর্দশা ও লাঞ্চনা ভোগ করে আমি আট দিন পায়ে হেঁটে ও নৌকা যোগে দেশের বাড়ীতে পৌছি।
স্বাক্ষর/-
মোঃ সালেহুজ্জামান
৭/২/৭৪
রঞ্জিত (লাল বাহাদুর) ডোম
সুইপার কলোনী,
নারিন্দা শাহ সাহেব লেন,
থানা- সুত্রাপুর, ঢাকা।
১৯৭১ সনের ২৬ শে মার্চ সকাল ১০ টার সময় ঢাকা পৌরসভার হেল্থ অফিসার আনোয়ার সাহেব ঢাকা পিলখানার চোদ্দটুলী সুইপার কলোনী থেকে আমাদের সুইপার ইন্সপেক্টর পাঞ্জা ডোম সবুজজী, দরবারী, মহাবীর ও মুসু ডোমকে নিয়ে আমাদের এই সুইপার কলোনীর দক্ষিণ দিকের প্রবেশপথের সম্মুখে দাঁড়িয়ে “গণেশ, লাল, বদনেস, রণজিৎ, কানাই” বলে চিৎকার করে ডাকতে থাকলে আমরা সবাই যার যার ঘর থেকে বের হয়ে দেখতে পেলাম ঢাকা পৌরসভার একটি জীপে ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটির তৎকালীন চেয়ারম্যান মিঃ সালামত আলী খান শুর, প্রশাসনিক অধিকর্তা মিঃ ইদ্রিস চিৎকার বলছেন, ঢাকার রাজপথে, বিভিন্ন জায়গায় বহু লাশ পড়ে আছে, তোমরা বের হয়ে আস, সে সব লাশ অবিলম্বে তুলে ধলপুর ময়লার ডিপোতে ফেলে দাও।
আমি, পরদেশি, গণেশ, চুন্নু আমরা সবাই মিটফোর্ড লাশ ঘর থেকে ২৮শে মার্চ সকালে দু’ট্রাক লাশ তুলে ধলপুর ময়লার ডিপোতে ফেলেছি। অধিকাংশ লাশ পচে, ফুলে বিকৃত ও বীভৎস হয়ে গিয়েছিল।
২৯শে মার্চ আমরা প্রথম মিটফোর্ড হাসপাতাল থেকে দু’ট্রাক লাশ তুলেছি। এরপর আমাদের দুই দিনের ছুটি দেয়া হয়।
তিনদিন পর আমরা রমনা কালীবাড়ী থেকে পাঁচটি পচা লাশ তুলে ট্রাকে কার্জন হলের দিকে অগ্রসর হতে থাকলে পাক সেনারা আমাদের ট্রাক আটক করে আমাদের ট্রাক ড্রাইভার চান মিয়া ও সুইপার ইন্সপেক্টর পঞ্চমকে ধরে মারধোর করে। সুপারভাইজারকে চপেটাঘাত করে রাস্তায় ফেলে দিয়ে কুকুরের মত চিৎকার করে বলতে থাকে “লাশ খোলা কিউ লে যাতা হ্যায়, শুয়োর কা বাচ্ছা, বাহেনচোত, শালা হারামী, শালা তেরপল লাগা লো”। পরের দিন আমি, ছাখিল, পরদেশি, চুন্নু সবাই মিলে শাঁখারী বাজারে কোর্টের প্রবেশ পথে অগ্রসর হতে চাইলে আমাদের সেখানে জ্বলন্ত আগুনের অদুরে প্রহরারত পাক সেনারা বাবুবাজার ফাঁড়ি দিয়ে শাঁখারী বাজার প্রবেশ করতে বলে কর্কশভাবে। এ সময়ে আমরা দেখলাম সারা শাঁখারীবাজারে লেলিহান আগুনের শিখা জ্বলছে, সারা শাঁখারীবাজার জ্বলছে, জ্বলছে দালানকোঠা, ঘরবাড়ী, মুল্যবান আসবাবপত্র জ্বলছে। আমরা ট্রাক নিয়ে মন্দিরের ভেতর দুজন যুবকের পচাগলা লাশ তুলেছি। লাশ পচে পোক হয়ে গিয়েছিল। গলিত লাশ দেখে আমরা ভীত হয়ে পড়েছিলাম। কোন লোকজন ছিলনা, চারিদিক নিরব নিস্তব্ধ, শ্মশানের হাহাকার দেখলাম। প্রতিটি ঘর থেকে আমরা শিশু-কিশোর, বৃদ্ধা-যুবা, যুবক-যুবতীর পচা ও গলিত লাশ তুলেছি। আমাদের সাথে আরো দুই দল ডোম ঢাকা পৌরসভার দু’টি ট্রাকে লাশ তুলে ধলপুর ময়লার ডিপোতে ফেলেছে। এরপর আমরা সদরঘাট বুড়ীগঙ্গা পাড়, শ্যামবাজার ঘাট, বাদামতলী ঘাট থেকে লাশ তুলেছি। আমরা নদীর ঘাট থেকে যে সকল পচা, ফুলা, গলিত লাশ তুলেছি তার অধিকাংশ ছিল চোখ ও হাত-পা বাঁধা যুবকের লাশ। এরপর লাল কুঠীর ভেতর থেকে লুঙ্গী পরা দু’জন যুবকের পচা ও গলিত লাশ পেয়েছি, বাংলাবাজার, প্যারীদাস রোডের কয়েকটি বাড়ী থেকে আমরা লাশ তুলেছি। এরপর আমরা বনগ্রাম এলাকার রাস্তা থেকে কয়েকটি পচা লাশ তুলেছি। কমলাপুর থেকে আমরা ট্রেন যাত্রীদের লাশ তুলেছি, আমরা মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা থেকে শ্রমিকদের বহু লাশ তুলেছি।
টিপসহি/-
রঞ্জিত
৮-৫-৭৪
বদলু ডোম
ওয়ারী সুইপার কলোনী,
ঢাকা।
আমি ১৯৭১ সনের ২৮শে মার্চ আমাদের সুইপার সুপারভাইজার পঞ্চমের দলে মিটফোর্ড হাসপাতালের লাশ ঘর থেকে লাশ তুলেছি। কয়েকদিন পরে আমি সুপারভাইজার সাহেব আলীর দলে মিলব্যারাক পুলিশ লাইনের নদীর পাড় থেকে পনের জন যুবক, একজন সাধু ও বৃদ্ধার ক্ষতবিক্ষত, ফুলা, পচা লাশ তুলেছি। প্রতিটি লাশ চোখ ও হাত-পা বাঁধা ছিল। এরপর আমরা বাবুবাজার পুলের উপর থেকে এক অন্ধ ফকিরের লাশ তুলেছি। সদরঘাট, শ্যামবাজার, ওয়াজঘাট, বাদামতলী এলাকায় আমরা নদীর পাড় ও পানি থেকে বৃদ্ধা, যুবা ও শিশুর লাশ তুলেছি। কয়েকদিন পর আমরা মন্দিরের সামনে থেকে দুধওয়ালা সাধুর লাশ তুলেছি, শাঁখারীবাজার প্রবেশ করে মন্দিরের সামনের বাড়ীর ভেতর থেকে শিশু-কিশোর, বৃদ্ধা-যুবা, যুবক-যুবতীর দশটি পোকায় খাওয়া গলিত লাশ নিয়ে এসেছি।
কয়েকদিন পর রমনা কালিবাড়ী থেকে, মন্দিরের ভেতর থেকে পাঁচটি এবং কালিবাড়ীর প্রবেশ পথে দুটি চোখ ও হাত বাঁধা পচা লাশ তুলেছি। গোয়ালঘরে তিনটি গরু গুলিতে ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখলাম। এরপর পাক সেনারা আমাদের নির্মমভাবে মারপিট করায় আমরা আর লাশ তুলতে যাই নাই।
স্বাক্ষর/-
বদলু ডোম
১১-৫-৭৪
“লাশ গলে যাওয়ায় লোহার কাঁটার সাথে গেঁথে লাশ ট্রাকে তুলেছি।“
চুন্নু ডোম,
ঢাকা পৌরসভা,
রেলওয়ে সুইপার কলোনী,
২২৩ নং ব্লক, ৩নং রেল গেট
ফুলবাড়িয়া, ঢাকা।
১৯৭১ সনের ২৮শে মার্চ আমাদের সুইপার ইন্সপেক্টর ইদ্রিস সাহেব আমাকে লাশ উঠাবার জন্য ডেকে ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটিতে নিয়ে যান। সেখান থেকে আমাকে বদলু ডোম, রঞ্জিত লাল বাহাদুর, গণেশ ডোম ও কানাইকে একটি ট্রাকে করে প্রথমে শাঁখারীবাজারে কোর্টের প্রবেশ পথের সম্মুখে নামিয়ে দেয়। আমরা উক্ত পাঁচ জন দেখলাম ঢাকা জজ কোর্টের দক্ষিণ দিকের প্রবেশপথের যে রাজপথ শাঁখারীবাজারের দিকে চলে গেছে, সে রাস্তার দু’ধারে ড্রেনের পাশে যুবক-যুবতীর, নারী-পুরুষের, শিশু-কিশোরের বহু পচা লাশ। দেখতে পেলাম বহু লাশ পচে ফুলে বীভৎস হয়ে আছে, দেখলাম শাখারীবাজারের দুদিকের ঘরবাড়ীতে আগুন জ্বলছে, অনেক লোকের অর্ধপোড়া লাশ পড়ে থাকতে দেখলাম, দুই পার্শ্বে অদূরে সশস্ত্র পাঞ্জাবী সেন্যদের প্রহরায় মোতায়েন দেখলাম। প্রতিটি ঘরে দেখালাম মানুষ ও আসবাবপত্র জ্বলছে। একটি ঘরে প্রবেশ করে এক জন মেয়ে, এক জন শিশু সহ ১২ জন যুবকের দগ্ধ লাশ উঠিয়েছি। শাঁখারীবাজারের প্রতিটি ঘর থেকে যুবক-যুবতী, বালক-বালিকা, কিশোর-শিশু ও বৃদ্ধের লাশ তুলেছি। পাঞ্জাবীরা প্রহরায় থাকাকালে সেই সব মানুষের অসংখ্য লাশের উপর বিহারীদের উচ্ছৃঙ্খল উল্লাসে ফেটে পড়ে লুট করতে দেখলাম। প্রতিটি ঘর থেকে বিহারী জনতাকে মূল্যবান সামগ্রী, দরজা, জানালা, সোনাদান সবকিছু লুটে নিয়ে যেতে দেখলাম। লাশ উঠাতে উঠাতে এক ঘরে প্রবেশ করে এক অসহায় বৃদ্ধাকে দেখলাম- বৃদ্ধা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে “পানি পানি” বলে চিৎকার করছিল, তাকে আমি পানি দিতে পারি নাই ভয়ে, বৃদ্ধাকে দেখে আমি আরো ভীত হয়ে পালিয়ে এসেছি। আমি পানি দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমাদের পিছনে সশস্ত্র পাঞ্জাবী সেনা প্রহরায় থাকায় আমি সেই বৃদ্ধাকে পানি দিয়ে সাহায্য করতে পারি নাই।
আমরা ১৯৭১ সনের ২৮শে মার্চ শাঁখারিবাজার থেকে প্রতিবারে একশত লাশ উঠিয়ে তৃতীয়বার ট্রাকে বোঝাই করে তিনশত লাশ ধলপুর ময়লার ডিপোতে ফেলেছি।
১৯৭১ সনের ২৯শে মার্চ সকাল থেকে আমরা মিটফোর্ড হাসপাতালের লাশঘর ও প্রবেশপথের দুপার্শ্ব থেকে বিশ্ববিদ্যালয় শিববাড়ী, রমনা কালিবাড়ী, রোকেয়া হল, মুসলিম হল, ঢাকা হল থেকে লাশ উঠিয়েছি। ২৯শে মার্চ আমাদের ট্রাক প্রথম ঢাকা মিটফোর্ড হাসপাতালের প্রবেশ পথে যায়। আমরা উক্ত পাঁচজন ডোম হাসপাতালের প্রবেশপথে নেমে একটি বাঙ্গালী যুবকের পচা, ফুলা, বিকৃত লাশ দেখতে পেলাম। লাশ গলে যাওয়ায় লোহার কাঁটার সাথে গেঁথে লাশ ট্রাকে তুলেছি। আমাদের ইন্সপেক্টর আমাদের সাথে ছিলেন। এরপর আমরা লাশ ঘরে প্রবেশ করে বহু যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ-কিশোর ও শিশুর স্তুপীকৃত লাশ দেখলাম। আমি এবং বদলু ডোম লাশ ঘর থেকে লাশের পা ধরে টেনে ট্রাকের সামনে জমা করেছি, আর গণেশ, রঞ্জিত(লাল বাহাদুর) এবং কানাই লোহার কাঁটা দিয়ে বিঁধিয়ে বিঁধিয়ে পচা, গলিত লাশ ট্রাকে তুলেছে। প্রতিটি লাশ গুলিতে ঝাঁঝরা দেখিছি, মেয়েদের লাশের কারো স্তন পাই নাই, যোনীপথ ক্ষতবিক্ষত এবং পিছনের মাংস কাটা দেখিছি। মেয়েদের লাশ দেখে মনে হয়েছে, তাদের হত্যা করার পূর্বে তাদের স্তন জোর করে ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে, যোনিপথে লোহার রড কিংবা বন্দুকের নল ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। যুবতী মেয়েদের যোনিপথের এবং পিছনের মাংস যেন ধারালো চাকু দিয়ে কেটে এসিড দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। প্রতিটি যুবতী মেয়ের মাথায় খোঁপা খোঁপা চুল দেখলাম। মিটফোর্ড থেকে আমরা প্রতিবারে একশত লাশ নিয়ে ধলপুর ময়লার ডিপোতে ফেলেছি।
১৯৭১ সনের ৩০শে মার্চ আমাদের উক্ত পাঁচ জনের সাথে দক্ষিণা ডোমকে সাহায্য করতে দেয়া হয়। আমাদের ট্রাক সেদিন সাত মসজিদের সম্মুখ থেকে যখন বাঙ্গালী লাশ উঠাচ্ছিলাম, তখন অসংখ্য বিহারী জনতা আমাদের চারিদিকে দাঁড়িয়ে হাসছিল, বাঙ্গালীদের পরিণতি দেখে উপহাস করছিল। আমরা সাত মসজিদের সম্মুখ থেকে আটটি বাঙ্গালী যুবকের লাশ তুলেছি, কতিপয় লাশ দেখলাম উপুড় হয়ে পড়ে আছে। সবার পিঠ গুলির অসংখ্য আঘাতে ঝাঁঝরা হয়ে আছে। পচা, ফুলা লাশ তুলতে যেয়ে দেখলাম কারো লুঙ্গী পরা, কারো পায়জামা পরা। আবার কারো দেহে হাওয়াই শার্ট এবং টেট্রনের দামী শার্ট। পানি থেকে বারটি লাশ তুলেছি; প্রতিটি লাশের চোখ এবং হাত পেছনের দিকে বাঁধা ছিল। নদীর পাড় থেকে বারটি লাশ গুলির আঘাতে ঝাঁঝরা দেখেছি। লাশ দেখে মনে হল, ভদ্র ঘরের অভিজাত বাঙ্গালী যুবকের লাশ। সাত মসজিদের সকল লাশ তুলে আমরা ধলপুর ময়লা ডিপোতে ফেলেছি। ফিরে এসে ট্রাক নিয়ে আমরা মিন্টু রোডের লাশ তুলতে গিয়েছি। মিন্টু রোডের রাস্তার পাশ থেকে প্যান্ট পরা দুটি পচা, ফুলা লাশ তুলেছি, দেখলাম লাশের পাশেই ভিক্ষার ঝুলি, টিনের ডিব্বা ও লাঠি পড়ে আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিববাড়ীর সম্মুখ থেকে দুজন রুপসী যুবতী মেয়ে এবং তিন জন যুবকের ক্ষতবিক্ষত লাশ তুলেছি। রোকেয়া হলে একটি অর্ধদগ্ধ যুবতীর লাশ তুলেছি, মুসলিম হলে প্রবেশ করে একটি পচা লাশ পেয়েছি, ঢাকা হলের ভেতর থেকে চারজন ছাত্রের লাশ তুলেছি।
পরের দিন ৩১ মার্চ বাসাবো খাল থেকে তিনটি পচা লাশ তুলেছি। সেদিন অসুস্থ্ থাকায় আমি আর লাশ তুলতে যেতে পারি নাই।
টিপসহি/-
চুন্নু ডোম
৭-৪-৭৪
<৮,২.১.১৪,৩৮> “কচি ছেলের তুলতুলে লাশ তুলতে গিয়ে আমার হৃদয় যেন কেঁপে উঠলো, হাহাকার করে উঠলো।“
ছোটন ডোম
রেলওয়ে সুইপার কলোনী
২২৩নং ব্লক, ৩নং রেল গেট
ফুলবাড়িয়া, ঢাকা।
১৯৭১ সনের ২৮শে মার্চ সকাল ৮টায় ঢাকা পৌরসভার সুইপার সুপারভাইজার পঞ্চম আমাদের নিতে আসেন। পাক সেনারা রাজধানী ঢাকার বহু লোককে নির্বিচারে হত্যা করার ফলে বিভিন্ন এলাকায় যে সকল লাশ পচে ফুলে রাস্তায় পড়ে আছে তা তুলে ধলপুর ময়লার ডিপোতে ফেলার জন্য রেলওয়ে কলোনী থেকে আমাকে ও দুখী লালকে ডেকে নিয়ে যায়। আমরা ঢাকা পৌরসভায় গিয়ে সেখানে আমার ভাতিজা ডোম গাংওয়া, আমার মেয়ে জামাই হরি ডোম, সন্টু, ফেকু ডোম, দরবারী, গণেশ, লেমু, লাল বাহাদুর, খুবী, পরদেশী, অর্জুন সবাইকে হাজির দেখেছি। আমার দলে আমরা-আমি, দরবারী, মহেশ, কানহাই, হরি, ফেকওয়া এই ছয়জন ছিলাম। সুইপার সুপারভাইজার পঞ্চম আমাদের সাথে ছিলেন। আমাদের ট্রাক ইংলিশ রোডের মুখে রায়সাহেব বাজারের প্রবেশপথ দিয়ে গোয়ালনগরের স্কুল ও মন্দিরের সুম্মখে যেয়ে থামানো হয়। মন্দিরের ভেতর প্রবেশ করে হাফ শার্ট ও হাফ প্যান্ট পরা এক চৌদ্দ বছরের সুন্দর ফুটফুটে ছেলের সদ্য মৃত লাশ দেওয়ালে ঠেশ দিয়ে পড়ে থাকতে দেখলাম- ছেলেটিকে তাড়িয়ে দিয়ে পিছন দিক থেকে হাত বেঁধে মাথার পিছন দিক থেকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। মাথার পিছন দিক দিয়ে অঝোরে তাজা রক্ত ঝরতে দেখলাম- সদ্য মৃত তাজা লাশ, হাত দিয়ে বড় আদরের সাথে ট্রাকে তুলে দিলাম। কচি ছেলের তুলতুলে লাশ তুলতে গিয়ে আমার হৃদয় যেন কেঁপে উঠলো, হাহাকার করে উঠলো। হায়, না জানি কোন মায়ের আদরের দুলাল, চোখের মনিকে পশুরা তাড়িয়ে এনে এভাবে হত্যা করে গেছে। লাশের ডাগর ডাগর চোখের দিকে তাকাতেই আমার চোখ বেয়ে পানি ঝরতে লাগলো অঝোরে, আমি কিছুতেই আমার চোখের পানি আটকে রাখতে পারলাম না। পশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়ে রাস্তার উপর আরো একটি যুবকের তাজা লাশ দেখলাম- উভয়ই মুসলমান যুবকের লাশ। গোয়ালনগরের দক্ষিণ দিকের রাস্তা দিয়ে আমরা অগ্রসর হয়ে দূর্গা মায়ের মন্দিরের নিকটবর্তী বাড়ীর অভ্যন্তরে রান্না ঘরে প্রবেশ করে সেখানে এক ঘরেই এগারটি পচা, ফুলা লাশ দেখলাম- তিনজন বাইরে- অবশিষ্টগুলি পালং- এর নিচে। একজন অর্ধ বয়সের রুপসী মহিলা মাথায় কোমর পর্যন্ত লম্বা চুল, হরিণের মত মায়াময় মুখ, লাবণ্যময় দেহ, সারা দেহের উপর যেন ভগবান দুধের সর বিছিয়ে দিয়েছিলেন। প্রবেশপথে দুটি যুবক ও একজন কিশোরের লাশ দেখলাম- ঘরের ভেতরে পালং এর নিচে থেকে আরো ছয়জন যুবক ছেলের লাশ তুলে আনলাম। পাশের ঘরে প্রবেশ করে দু’জন যুবক ছেলে ও একজন মধ্যবয়সী লোকের পচা লাশ তুলেছি। উপরোক্ত সমস্ত লাশ নিয়ে আমি ধলপুর ময়লার ডিপোতে গিয়ে দেখলাম- বড় বড় গর্ত করে কুলিরা বসে আছে- ট্রাক থামিয়ে আমরা সব লাশ গর্তে ঢেলে দিলে কুলিরা মাটি ফেলে গর্ত বন্ধ করে দিল। লাশ উঠাবার জন্য আমাদের প্রত্যেককে তিন টাকা করে দিলে আমি সারাদিন না খেয়ে লাশ তুলতে অস্বীকার করে চলে আসি। সারাদিন লাশ তুলে আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। পরের দিন থেকে আমি আর লাশ তুলতে যাই নাই।
টিপসহি
ছোটন ডোম
৭-৪-৭৪
গুরু গোলাপ
<৮,২.১.১৫,৩৯>
পঞ্চম
সুইপার সুপারভাইজার
সুইপার কলোনী, গণকটুলী
নওয়াবগঞ্জ, ঢাকা।
আমি ১৯৭১ সনের ২৫শে মার্চ কালরাতে গণকটুলী পৌরসভার সুইপার কলোনীতে ছিলাম। এখানে আমাদের পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা আমার সাথে অবস্থান করছিল। সেই দিন রাত থেকে আমাদের কলোনীর চারিদিকে সান্ধ্য আইন জারি করে বর্বর পাক সেনারা ই,পি,আর হেডকোয়ার্টারে বাঙ্গালী জোয়ানদের নির্বিচারে হত্যা করতে থাকে। আমরা কলোনীতে সকল সুইপার দরজা-জানালা বন্ধ করে মৃত্যুর প্রহর গুনছিলাম। বাইরে চলছিল চারিদিকে বৃষ্টির মত গোলাবর্ষণ।
২৭শে মার্চ সকাল নয়টায় সান্ধ্য আইন কিছুক্ষণের জন্য উঠিয়ে নিলে সবাই স্বপরিবারে ঢাকার বাংলাদেশ মাঠ (পাকিস্তান মাঠ-আগা সাদেক রোড) সংলগ্ন সুইপার বস্তিতে আশ্রয় গ্রহন করি। গণকটুলির আমাদের সুইপার কলোনীর একজন পুরুষ সুইপার মুখ ধোয়ার সময় এবং কাউসিলা দেবী নামে একজন হিন্দু সুইপারকে পাক সেনারা গুলি করে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে। “পৌরসভার সকল কর্মচারী অবিলম্বে কাজে যোগদান করতে হবে” – রেডিও মারফত আমি এই ঘোষনা শুনে চাকুরীর স্বার্থে পৌরসভায় এসে রিপোর্ট করি। অফিসে এসে দেখলাম, পৌরসভার তৎকালীন কনসারভেন্সি অফিসার ইদ্রিস সাহেব ক্রোধান্ধ হয়ে ডোমদের ডাকছেন। তার নির্দেশে আমি, সুইপার ইন্সপেক্টর রামদীন, ডোম পরদেশী, গণেশ, লেমু এবং লাল বাহাদুর- আমরা সবাই প্রথমে ঢাকা মিটফোর্ড হাসপাতালে লাশ তুলতে যাই। আমরা সেদিন মিটফোর্ড থেকে দু’ট্রাক লাশ তুলেছি- সকল লাশ আমরা ওয়ারী আউটকলে ফেলেছি। সেখানেই পূর্বেই শ্রমিকদের দ্বারা বিরাট বিরাট লম্বা লম্বা গর্ত করে রাখা হয়েছিল। আমরা লাশ নিয়ে সেই সব গর্তে ফেলেছি।
পরের দিন আমার দল আবার মিটফোর্ডে লাশ তুলতে যাই।
আমরা ২৯ শে মার্চ মিটফোর্ড লাশ ঘর থেকে দু’ট্রাক লাশ তুলেছি। পরদেশী এবং তার ভাই চুন্নু নীচে দাঁড়িয়ে পচা, ফুলা গুলিতে ক্ষতবিক্ষত লাশ তুলে ট্রাকের সম্মুখে এনেছে- রঞ্জিত(লাল বাহাদুর) ও গণেশ দু’জন ট্রাকের উপরেই ছিল। অধিকাংশ লাশ খাকী শার্ট পরা- পুলিশের ছিল। আমরা সকল লাশ ওয়ারী আউটকলে ফেলেছি।
পরের দিন আমার দল বুড়িগঙ্গা নদীর পাড় ও শ্যামবাজার থেকে লাশ তুলেছে।
তিন দিন পর আমার দল রমনা কালিবাড়ী থেকে লাশ তুলেছে। ডোম রঞ্জিত, গণেশ ও বদলু ছয়টি গন্ধ পোড়া লাশ তুলেছে। বুড়ীগঙ্গা নদী থেকে আমার দল আমার উপস্থিতিতে যে সব বাঙ্গালী যুবকের লাশ তুলেছে তার প্রায় সবই চোখ, হাত-পা বাঁধা ছিল। আমার দল বেশ কয়েকদিন পরে ঢাকা হলের ভেতর থেকে তিন জন যুবকের পচা লাশ তুলেছে।
স্বাক্ষর/-
পঞ্চম
১১-৫-৪৪
<৮,২.১.১৬,৪০-৪১> “লাশ তুলে তুলে মানুষের পচা চর্বির গন্ধে আমার পাজস্থলি বের হতে চাচ্ছিলো।“
পরদেশি
পিতা-ছোটন ডোম
সুইপার, সরকারী পশু হাসপাতাল
ঢাকা।
১৯৭১ সনের ২৭শে মার্চ সকালে রাজধানী ঢাকায় পাক সেনাদের বীভৎস হত্যাকাণ্ডের পর ঢাকা পৌরসভার তৎকালীন চেয়ারম্যান মেজর সালামত আলী খান শুরের প্রশাসনিক অফিসার মিঃ ইদ্রিস পৌরসভার আরো কয়েকজন অফিসার সঙ্গে নিয়ে একটি মিউনিসিপ্যাল ট্রাকে পশু হাসপাতালের গেটে এসে বাঘের মত “পরদেশী পরদেশী” বলে গর্জন করতে থাকলে আমি ভীত- সন্ত্রস্তভাবে আমার কোয়ার্টার থেকে বের হয়ে আসি। ইদ্রিস সাহেব অত্যান্ত ক্রুদ্ধভাবে কর্কশ স্বরে বলতে থাকেন “তোমরা সব সুইপার ডোম বের হও, যদি বাঁচতে চাও অবিলম্বে সবাই মিলে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় স্তুপীকৃত লাশ উঠিয়ে ধলপুর ডিপোতে ফেলে দাও। নইলে কাউকে বাঁচানো হবেনা, কেউ বাঁচতে পারবেনা”। পৌরসভার সেই ট্রাকে নিন্মবর্ণিত সুইপাররা বসা ছিলঃ
১। ভারত
২। লাডু
৩। কিষণ।
আমি তার নির্দেশ অমান্য করার কোন উপায় না দেখে ট্রাকে উঠে বসলাম। সেই ট্রাকে করে পৌরসভা অফিসে আমাদের প্রায় আঠারজন সুইপার ও ডোমকে একত্রিত করে প্রতি ছয়জনের সাথে দুইজন করে সুইপার ইন্সপেক্টর আমাদের সুপারভাইজার নিয়োজিত করে তিন ট্রাকে তিনদলকে বাংলাবাজার, মিটফোর্ড ও বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় প্রেরণ করা হয়। আমি মিটফোর্ডের ট্রাকে ছিলাম। সকাল নয়টার সময় আমাদের ট্রাক মিটফোর্ড হাসপাতালের সম্মুখে উপস্থিত হলে আমরা ট্রাক থেকে নেমে লাশ ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে বুকে ও পিঠে মেশিনগানের গুলিতে ঝাঁঝরা করা প্রায় একশত যুবক বাঙ্গালীর বীভৎস লাশ দেখালাম। আমি আমার সুপারভাইজারের নির্দেশে লাশ ঘরের ভিতরে প্রবেশ করে প্রতিটি লাশের পায়ে ধরে টেনে বের করে বাইরে দাঁড়ানো অন্যান্য সুইপারের হাতে তুলে দিয়েছি ট্রাকে উঠাবার জন্য। আমি দেখেছি প্রতিটি লাশের বুক ও পিঠ মেশিনগানের গুলিতে ঝাঁঝরা। সব লাশ তুলে দিয়ে একপাশে একটা লম্বা টেবিলের উপর চাদর দিয়ে ঢেকে দেওয়া একটি লাশের উপর থেকে চাদর টেনে উঠিয়ে দেখলাম, একটি ষোড়শী যুবতীর উলঙ্গ লাশ- লাশের বক্ষ, যোনিপথ ক্ষতবিক্ষত, কোমরের পেছনের মাংশ কেটে তুলে নেয়া হয়েছে, বুকের স্তন থেতলে গেছে, কোমর পর্যন্ত লম্বা কালো চুল, হরিণের মত মায়াময় চোখ দেখে আমার চোখ বেয়ে পানি পড়তে থাকলো, আমি কিছুতেই চোখের পানি ধরে রাখতে পারলাম না। আমি আমার সুপারভাইজারের ভয়াল এবং ভয়ঙ্কর কর্কশ গর্জনের মুখে সেই সুন্দরীর পবিত্র দেহ অত্যান্ত যত্ন সম্ভ্রমের সাথে ট্রাকে উঠিয়ে দিলাম। মিটফোর্ড লাশ ঘরের সকল লাশ ট্রাকে উঠিয়ে আমরা ধলপুরের ময়লার ডিপোতে নিয়ে গিয়ে বিরাট গর্তের মধ্যে ঢেলে দিলাম। দেখলাম বিরাট গর্তের মধ্যে সুইপার ও ডোমরা রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে নিয়ে আসা লাশ ট্রাক থেকে গর্তের মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। আমি অধিকাংশ লাশের দেহে কোন কাপড় দেখি নাই, যে সমস্ত যুবতী মেয়ে ও রমণীদের লাশ গর্তের মধ্যে ফেলে দেওয়া হল তার কোন লাশের দেহেই আমি কোন আবরণ দেখি নাই। তাদের পবিত্র দেহ দেখেছি ক্ষতবিক্ষত, তাদের যোনিপথ পিছন দিক সহ আঘাতে বীভৎস হয়ে আছে। দুপুর প্রায় দুইটার সময় আমরা রমনা কালিবাড়ীতে চলে আসি পৌরসভার ট্রাক নিয়ে। লাশ উঠাবার জন্য ট্রাক রমনা কালীবাড়ীর দরজায় দাঁড় করিয়ে রেখে, দু’জনকে ট্রাকে দাঁড় করিয়ে রেখে আমরা চারজন কালিবাড়ীর ভেতরে গিয়ে দেখি সবকিছু পুড়ে ভস্ম হয়ে আছে। কালিবাড়ীর ভেতরে বিভিন্ন জায়গায় ছড়ানো ছিটানো ৪১টি পোড়া লাশ আমি ট্রাকে তুলেছি। কালিবাড়ীর এসকল লাশ আমরা ধলপুরের ময়লার ডিপোতে গর্তের মধ্যে ফেলেছি। লাশ তুলে তুলে মানুষের পচা চর্বির গন্ধে আমার পাজস্থলি বের হতে চাচ্ছিল।
পরের দিন আমি আর লাশ তুলতে যাই নাই, যেতে পারি নাই, সারাদিন ভাত খেতে পারি নাই, ঘৃণায় কোনকিছু স্পর্শ করতে পারি নাই।
পরের দিন ২৯শে মার্চ সকালে আমি আবার ঢাকা পৌরসভা অফিসে হাজির হলে আমাকে ট্রাক নিয়ে লাশ তোলার জন্য আরো কয়েকজন সুইপারের সাথে ঢাকা শাঁখারী বাজার যেতে বলা হয়। জজ কোর্টের সম্মুখে আগুনের লেলিহান শিখা তখনো জ্বলছিল, আর পাক সেনারা টহলে মোতায়েন ছিল বলে আমরা ট্রাক নিয়ে সে পথ দিয়ে শাঁখারীবাজার প্রবেশ করতে পারি নাই। পাটুয়াটুলী ঘুরে আমরা শাঁখারীবাজারের পশ্চিম দিকে প্রবেশ করে পাটুয়াটুলী ফাঁড়ি পার হয়ে আমাদের ট্রাক শাঁখারীবাজার প্রবেশ করল। ট্রাক থেকে নেমে আমরা শাঁখারীবাজারের প্রতিটি ঘরে প্রবেশ করলাম- দেখলাম মানুষের লাশ নারী-পুরুষ, যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, বালক-বালিকা, কিশোর-শিশুর বীভৎস পচা লাশ, চারিদিকে ইমারত সমূহ ভেঙ্গে পড়ে আছে, মেয়েদের অধিকাংশ লাশ আমি সম্পূর্ণ উলঙ্গ দেখলাম, দেখলাম তাদের বুক থেকে স্তন তুলে নেওয়া হয়েছে। কারো কারো যোনিপথে লাঠি ঢুকান হয়েছে। বহু পোড়া, ভস্ম লাশ দেখেছি। পাঞ্জাবী সেনারা পাষণ্ডের মত লাফাতে লাফাতে গুলিবর্ষণ করছিল, বিহারী জনতা শাঁখারীবাজারের প্রতিটি ঘরে প্রবেশ করে মুল্যবান আসবাবপত্র, সোনাদান লুণ্ঠন করে নিয়ে যাচ্ছিল, আমরা অবিরাম গুলিবর্ষণের মুখে প্রাণের ভয়ে দুই ট্রাক লাশ তুলে লাশ তোলার জন্য সেদিন আর শাঁখারীবাজারে প্রবেশ করার সাহস পাই নাই।
৩০শে মার্চ সকালে আমার দলকে মিলব্যারাক থেকে লাশ তুলতে বলা হয়। আমি মিলব্যারাক ঘাটে পৌরসভার ট্রাক নিয়ে গিয়ে দেখলাম নদীর ঘাটে অসংখ্য মানুষের লাশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, বহু লাশ রশি দিয়ে বাঁধা দেখলাম, প্রতিটি রশির বন্ধন খুলে প্রতি দলে দশ জন পনের জনের লাশ বের করলাম, সব যুবক ছেলে ও স্বাস্থ্যবান বালকদের লাশ দেখলাম। প্রতিটি লাশের চোখ বাঁধা, হাত বাঁধা, শক্ত করে পিছন দিক থেকে। প্রতিটি লাশের মুখমণ্ডল কালো দেখলাম, এসিডে জ্বলে বিকৃত ও বিকট হয়ে আছে। লাশের সামনে গিয়ে ঔষধের অসহ্য গন্ধ পেলাম। লাশের কোন দলকে দেখালাম মেশিনগানের গুলিতে বুক ও পিঠ ঝাঁঝরা হয়ে আছে, অনেক লাশ দেখলাম বেয়নেটের আঘাতে বীভৎস হয়ে আছে, কারো মাথা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে মগজ বের হয়ে আছে, কারো কাটা হৃদপিন্ড বের হয়ে আছে। নদীর পাড়ে ছয়জন রুপসী যুবতীর বীভৎস ক্ষতবিক্ষত, উলঙ্গ লাশ দেখলাম। চোখ বাঁধা, হাত-পা শক্ত করে বাঁধা প্রতিটি লাশ গুলির আঘাতে ঝাঁঝরা, মুখমন্ডল, বক্ষ ও যোনিপথ রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত ও বীভৎস দেখলাম। দুইবারে দুই ট্রাকে আমি সত্তরটি লাশ উঠিয়ে আমি ধলপুর ময়লার ডিপোতে ফেলেছি। এরপর আমাকে সদরঘাট, শ্যামবাজার, বাদামতলী ঘাট থেকে লাশ তুলতে বলা হয়। আমি উপরোক্ত এলাকার ঘাট থেকে পচা লাশ তুলে ধলপুর ময়লা ডিপোতে ফেলেছি। আমি যেদিন কালিবাড়ীতে লাশ তুলেছি, সেদিন সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের পিছনে ষ্টাফ কোয়ার্টার, রোকেয়া হলের পশ্চিম দিকে জনৈক অধ্যাপকের বাসা থেকে লাশ তুলেছি। রোকেয়া হলের পিছনের ষ্টাফ কোয়ার্টারের ভেতর থেকে আমি মেয়ে, পুরুষ ও শিশু সমেত নয়টি লাশ তুলেছি। আর অধ্যাপকের বাসা থেকে সিঁড়ির সামনে লেপের ভেতর পেঁচানো জনৈক অধ্যাপকের লাশ আমি তুলে নিয়ে গেছি।
স্বাক্ষর/-
পরদেশী
২১-৩-৭৪
<৮,২.১.১৭,৪২-৪৪>
মিসেস রাবেয়া খাতুন,
সুইপার, রাজারবাগ পুলিশ লাইন, ঢাকা।
১৯৭১ সনের ২৫শে মার্চ রাতে হানাদার পাঞ্জাবী সেনারা যখন রাজারবাগ পুলিশ লাইনের উপর অতর্কিতে হামলা চালায় তখন আমি রাজারবাগ পুলিশ লাইনের এস, এফ ক্যান্টিনে ছিলাম। আসন্ন হামলার ভয়ে আমি সারাদিন পুলিশ লাইনের ব্যারাক ঝাড়ু দিয়ে রাতে ব্যারাকেই ছিলাম। কামান, গোলা, লাইটবোম আর ট্যাঙ্কের অবিরাম কানফাটা গর্জনে আমি ভয়ে ব্যারাকের মধ্যে কাত হয়ে পড়ে থেকে থরথরিয়ে কাঁপছিলাম।
২৬ শে মার্চ সকালে ওদের কামানের সম্মুখে আমাদের বীর বাঙ্গালী পুলিশ বাহিনী বীরের মত প্রতিরোধ করতে করতে আর টিকে থাকতে পারে নাই। সকালে ওরা পুলিশ লাইনের এস, এফ ব্যারাকের চারিদিকে আগুন লাগিয়ে দেয় এবং ব্যারাকের মধ্যে প্রবেশ করে বাঙ্গালী পুলিশদের নাকে, মুখে, সারা দেহে বেয়নেট ও বেটন চার্জ করতে ও বুটের লাথি মারতে মারতে বের করে নিয়ে আসছিল। ক্যান্টিনের কামরা থেকে বন্দুকের নলের মুখে আমাকেও বের করে আনা হয়, আমাকে লাথি মেরে মাটিতে ফেলে দেওয়া হয় এবং আমার উপর প্রকাশ্যে পাশবিক অত্যাচার করছিল আর কুকুরের মত অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছিল। আমার উপর পাশবিক অত্যাচার করতে করতে যখন আমাকে একেবারে মেরে ফেলে দেওয়ার উপক্রম হয়, তখন আমার বাঁচবার আর কোন উপায় না দেখে আমি আমার প্রাণ বাঁচাবার জন্য ওদের নিকট কাতর মিনতি জানাচ্ছিলাম। আমি হাউমাউ করে কাঁদছিলাম, আর বলছিলাম আমাকে মেরোনা, আমি সুইপার, আমাকে মেরে ফেললে তোমাদের পায়খানা ও নর্দমা পরিস্কার করার আর কেউ থাকবেনা, তোমাদের পায়ে পড়ি তোমরা আমাকে মেরোনা, মেরো না, মেরো না, আমাকে মেরে ফেললে তোমাদের পুলিশ লাইন রক্ত ও লাশের পচা গন্ধে মানুষের বাস করার অযোগ্য হয়ে পড়বে। তখনো আমার উপর এক পাঞ্জাবী কুকুর, কুকুরের মতই আমার কোমরের উপর চড়াও হয়ে আমাকে উপর্যুপরি ধর্ষণ করছিল। আমাকে এভাবে ধর্ষণ করতে করতে মেরে ফেলে দিলে রাজারবাগ পুলিশ লাইন পরিস্কার জন্য আর কেউ থাকবে না একথা ভেবে ওরা আমাকে ছেড়ে দিয়ে আমাকে এক পাঞ্জাবী ধমক দিয়ে বলতে থাকে, “ঠিক হায়, তুমকো ছোড দিয়া যায়েগা জারা বাদ, তোম বাহার নাহি নেকলে গা, হারওয়াক্ত লাই পার হাজির রাহেগা।“ একথা বলে আমাকে ছেড়ে দেয়।
পাঞ্জাবী সেনারা রাজাকার ও দালালদের সাহায্যে রাজধানীর স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা এবং অভিজাত জনপদ থেকে বহু বাঙ্গালী যুবতী মেয়ে, রুপসী মহিলা এবং সুন্দরী বালিকাদের জীপে, মিলিটারী ট্রাকে করে পুলিশ লাইনের বিভিন্ন ব্যারাকে জমায়েত করতে থাকে। আমি ক্যান্টিনের ড্রেন পরিস্কার করছিলাম, দেখলাম আমার সম্মুখ দিয়ে জীপ থেকে আর্মী ট্রাক থেকে লাইন ধরে বহু বালিকা যুবতী ও মহিলাকে এস, এফ ক্যান্টিনের মধ্য দিয়ে ব্যারাকে রাখা হল। বহু মেয়েকে হেডকোয়ার্টার বিল্ডিনহ- এ উপর তালায় রুমে নিয়ে যাওয়া হল, আর অবশিষ্ট মেয়ে যাদেরকে ব্যারাকের ভেতর জায়গা দেয়া গেল না তাদের বারান্দায় দাঁড় করিয়ে রাখা হল। অধিকাংশ মেয়ের হাতে বই আর খাতা দেখলাম, অনেক রুপসী মেয়ের দেহে অলঙ্কার দেখলাম, তাদের মধ্যে অধিকাংশ মেয়ের চোখ বেয়ে অঝোরে অশ্রু পড়ছিল। এরপরই আরম্ভ হয়ে গেল বাঙ্গালী নারীদের উপর বীভৎস ধর্ষণ। লাইন থেকে পাঞ্জাবী সেনারা কুকুরের মত জীভ চাটতে চাটতে ব্যারাকের মধ্যে উন্মত্ত অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে প্রবেশ করতে লাগলো। ওরা ব্যারাকে ব্যারাকে প্রবেশ করে প্রতিটি যুবতী, মহিলা, ও বালিকার পরনের কাপড় খুলে একেবারে উলঙ্গ করে মাটিতে লাথি মেরে ফেলে দিয়ে বীভৎস ধর্ষণে লাগে গেল। কেউ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেই নিরীহ বালিকাদের উপর ধর্ষণে লেগে গেল, আমি ব্যারাকে ড্রেন পরিস্কার করার অভিনয় করছিলাম আর ওদের বীভৎস পৈশাচিকতা দেখছিলাম। ওদের উন্মত্ত উল্লাসের সামনে কোন মেয়ে কোন শব্দ পর্যন্ত করে নাই, করতে পারে নাই। উন্মত্ত পাঞ্জাবী সেনারা এই নিরীহ বাঙ্গালী মেয়ে শুধুমাত্র ধর্ষণ করেই ছেড়ে দেয় নাই- আমি দেখলাম পাক সেনারা সেই মেয়েদের উপর পাগলের মতো উঠে ধর্ষণ করছে আর ধারালো দাঁত বের করে বক্ষের স্তন ও গালের মাংস কামড়াতে কামড়াতে রক্তাক্ত করে দিচ্ছে, ওদের উদ্ধত ও উন্মত্ত কামড়ে অনেক মেয়ের স্তনসহ বক্ষের মাংস উঠে আসছিল, মেয়েদের গাল, পেট, ঘাড়, বক্ষ, পিঠের ও কোমরের অংশ ওদের অবিরাম দংশনে রক্তাক্ত হয়ে গেল। যে সকল বাঙ্গালী যুবতী ওদের প্রমত্ত পাশবিকতার শিকার হতে অস্বীকার করলো দেখলাম তৎক্ষণাৎ পাঞ্জাবী সেনারা ওদেরকে চুল ধরে টেনে এনে স্তন ছোঁ মেরে টেনে ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে যোনি ও গুহ্যদ্বারের মধ্যে বন্দুকের নল, বেয়নেট ও ধারালো ছুরি ঢুকিয়ে দিয়ে সেই বীরাঙ্গনাদের পবিত্র দেহ ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছিল। অনেক পশু ছোট ছোট বালিকাদের উপর পাশবিক অত্যাচার করে ওদের অসার রক্তাক্ত দেহ বাইরে এনে দুজন দু পা দু দিকে টেনে ধরে চড়চড়িয়ে ছিঁড়ে ফেলে দিল, আমি দেখলাম সেখানে বসে বসে, আর ড্রেন পরিস্কার করছিলাম, পাঞ্জাবীরা শ্মশানের লাশ যে কোন কুকুরের মত মদ খেয়ে সবসময় সেখানকার যার যে মেয়ে ইচ্ছে তাকেই ধরে ধর্ষণ করছিল। শুধু সাধারণ পাঞ্জাবী সেনারাই এই বীভৎস পাশবিক অত্যাচারে যোগ দেয় নাই, সকল উচ্চ পদস্থ পাঞ্জাবী সামরিক অফিসাররাই মদ খেয়ে হিংস্র বাঘের মত হয়ে দুই হাত নাচাতে নাচাতে সেই উলঙ্গ বালিকা, যুবতী ও বাঙ্গালী মহিলাদের উপর সারাক্ষণ পর্যায়ক্রমে ধর্ষণ কাজে লিপ্ত থাকতো। কোন মেয়ে, মহিলা, যুবতীকে এক মুহুর্তের জন্য অবসর দেওয়া হয় নাই, ওদের উপর্যুপরি ধর্ষণ ও অবিরাম অত্যাচারে বহু কচি বালিকা সেখানেই রক্তাক্ত দেহে কাতরাতে কাতরাতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে।
পরের দিন এ সকল মেয়ের লাশ অন্যান্য মেয়েদের সম্মুখে ছুরি দিয়ে কেটে কুচি কুচি করে বস্তার মধ্যে ভরে বাইরে ফেলে দিত। এ সকল মহিলা, যুবতী ও বালিকাদের মির্মম পরিণতি দেখে অন্যান্য মেয়েরা আরো ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়তো এবং স্বেচ্ছায় পশুদের ইচ্ছার সম্মুখে আত্মসমর্পণ করতো। যে সকল মেয়ে প্রাণে বাঁচার জন্য ওদের সাথে মিল দিয়ে ওদের অতৃপ্ত যৌন ক্ষুধা চরিতার্থ করার জন্য সর্বতোভাবে সহযোগীতা করে তাদের পিছনে ঘুরে বেড়িয়েছে, তাদের হাসি তামাসায় দেহ দান করেছে, তাদেরকেও ছাড়া হয় নাই। পদস্থ সামরিক অফিসাররা সেই সকল মেয়েদের উপর সম্মিলিতভাবে ধর্ষণ করতে করতে হঠাৎ একদিন তাকে ধরে ছুরি দিয়ে তার স্তন কেটে, পাছার মাংস কেটে, যোনি ও গুহ্যদ্বারের মধ্যে সম্পূর্ণ ছুরি চালিয়ে দিয়ে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে ওরা আনন্দ উপভোগ করতো।
এরপর উলঙ্গ মেয়েদেরকে গরুর মত লাথি মারতে মারতে, পশুর মত পিটাতে পিটাতে উপরে হেডকোয়ার্টারে দোতলা, তেতলা ও চার তলায় উলঙ্গ অবস্থায় দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। পাঞ্জাবী সেনারা চলে যাওয়ার সময় মেয়েদেরকে লাথি মেরে আবার কামরার ভেতর ঢুকিয়ে তালাবদ্ধ করে চলে যেত। ইহার পর বহু যুবতী মেয়েকে হেডকোয়ার্টারের উপর তলায় বারান্দার মোটা লোহার তারের উপর চুলের সাথে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়। প্রতিদিন পাঞ্জাবীরা সেখানে যাতায়াত করতো সেই ঝুলন্ত উলঙ্গ যুবতীদের কেউ কেউ এসে তাদের উলঙ্গ দেহের কোমরের মাংস বেটন দিয়ে উন্মত্তভাবে আঘাত করতে থাকতো, কেউ তাদের বক্ষের স্তন কেটে নিয়ে যেত, কেউ হাসতে হাসতে তাদের যোনিপথে লাঠি ঢুকিয়ে আনন্দ করতো, কেউ উঁচু চেয়ারে দাঁড়িয়ে উন্মক্ত বক্ষ মেয়েদের স্তনে মুখ লাগিয়ে ধারালো দাঁত দিয়ে স্তনের মাংস তুলে নিয়ে আনন্দে অট্টহাসি করতো। কোন মেয়ে এসব অত্যাচারে কোন প্রকার চিৎকার চেষ্টা করলে তার যোনি পথ দিয়ে লোহার রড ঢুকিয়ে দিয়ে তাকে তৎক্ষণাৎ হত্যা করা হত। প্রতিটি মেয়ের হাত বাঁধা ছিল, পেছনের দিকে শুন্যে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। অনেক সময় পাঞ্জাবী সেনারা সেখানে এসে সেই ঝুলন্ত উলঙ্গ মেয়েদের এলোপাতাড়ি বেদম প্রহার করে যেত। প্রতিদিন এভাবে বিরামহীন প্রহারে মেয়েদের দেহের মাংস ফেটে রক্ত ঝরছিল, মেয়েদের কারো মুখের সম্মুখের দাঁত ছিলনা, ঠোঁটের দু দিকের মাংস কামড়ে, টেনে ছিঁড়ে ফেলা হয়েছিল, লাঠি ও লোহার রডের অবিরাম পিটুনিতে প্রতিটি মেয়ের আঙ্গুল, হাতের তালু ভেঙ্গে, থেঁতলে ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল। এসব অত্যাচারিত ও লাঞ্চিত মহিলা ও মেয়েদের প্রস্রাব ও পায়খানা করার জন্য হাতের ও চুলের বাঁধন খুলে দেয়া হত না এক মুহুর্তের জন্য। হেডকোয়ার্টারের উপর তলার বারান্দায় এই ঝুলন্ত উলঙ্গ মেয়েরা হাত বাঁধা অবস্থায় লোহার তারে ঝুলে থেকে সেখানে প্রস্রাব-পায়খানা করত- আমি প্রতিদিন সেখানে গিয়ে এসব প্রস্রাব-পায়খানা পরিস্কার করতাম। আমি স্বচক্ষে দেখেছি, অনেক মেয়ে অবিরাম ধর্ষণেরফলে নির্মমভাবে ঝুলন্ত অবস্থায়ই মৃত্যুবরণ করেছে। প্রতিদিন সকালে গিয়ে সেই বাঁধন থেকে অনেক বাঙ্গালি যুবতীর বীভৎস মৃতদেহ পাঞ্জাবী সেনাদেরকে নামাতে দেখেছি। আমি দিনের বেলায়ও সেখানে সে সকল বন্দী মহিলাদের পূতগন্ধ, প্রস্রাব- পায়খানা পরিস্কার করার জন্য সারাদিন উপস্থিত থাকতাম।
প্রতিদিন রাজারবাগ পুলিশ লাইন ব্যারাক থেকে এবং হেডকোয়ার্টার অফিসের উপর তলা হতে বহু ধর্ষিতা মেয়ের ক্ষতবিক্ষত বিকৃত লাশ ওরা পায়ে রশি বেঁধে নিয়ে যায় এবং সেই জায়গায় রাজধানী থেকে ধরে আনা নতুন নতুন মেয়েদের চুলের সাথে ঝুলিয়ে বেঁধে নির্মমভাবে ধর্ষণ আরম্ভ করে দেয়। এসব উলঙ্গ নিরীহ বাঙ্গালী যুবতীদের সারাক্ষণ সশস্ত্র পাঞ্জাবী সেনারা প্রহরা দিত। কোন বাঙ্গালীকে সেখানে প্রবেশ করতে দেয়া হত না। আর আমি ছাড়া কোন সুইপারকেও সেখানে প্রবেশ করতে দেয়া হতো না।
মেয়েদের হাজারো কাতর আহাজারিতেও আমি ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বাঙ্গালী মেয়েদের বাঁচাবার জন্য কোন ভুমিকা পালন করতে পারি নাই।
এপ্রিল মাসের দিকে আমি অন্ধকার অন্ধকার পরিস্কার হওয়ার সাথে সাথে খুব ভোরে হেডকোয়ার্টারের উপর তলায় সারারাত ঝুলন্ত মেয়েদের মলমুত্র পরিস্কার করছিলাম। এমন সময় সিদ্ধেশ্বরীর ১৩৯ নং বাসার রানু নামের এক কলেজ ছাত্রীর কাতর প্রার্থনায় আমি অত্যন্ত ব্যথিত হয়ে পড়ি এবং মেথরের কাপড় পরিয়ে কলেজ ছাত্রী রানুকে মুক্ত করে পুলিশ লাইনের বাইরে নিরাপদে দিয়ে আসি। স্বাধীন হওয়ার পর সেই মেয়েকে আর দেখি নাই।
১৯৭১ সনের ডিসেম্বরে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনী বাংলাদেশ মুক্ত করার পূর্ব পর্যন্ত পাঞ্জাবী সেনারা এসকল নিরীহ বাঙ্গালী মহিলা, যুবতী ও বালিকাদের উপর এভাবে নির্মম-পাশবিক অত্যাচার ও বীভৎসভাবে ধর্ষণ করে যাচ্ছিল। ডিসেম্বরের প্রথম দিকে মিত্রবাহিনী ঢাকায় বোমাবর্ষণের সাথে সাথে পাঞ্জাবী সেনারা আমাদের চোখের সামনে মেয়েদের নির্মমভাবে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। রাজারবাগ হেডকোয়ার্টার অফিসের উপর তলায়, সমস্ত কক্ষে, বারান্দায় এই নিরীহ মহিলা ও বালিকাদের তাজা রক্ত জমাট হয়েছিল। ডিসেম্বরে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী রাজধানীতে বীরবিক্রমে প্রবেশ করলে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের সকল পাঞ্জাবী সেনা আত্মসমর্পণ করে।
টিপসহি/-
রাবেয়া খাতুন
১৮-২-৭৪
<৮,২.১.১৮,৪৫-৪৬>
(প্রিন্টিং মিসটেকঃ ১৮কে সংকলনটিতে ৪৮ লেখা হয়েছে) পেজ- ৪৫
মোহাম্মদ আবু নূর,
শিক্ষক, সিদ্ধেশ্বরী হাই স্কুল,
ঢাকা।
আমি সিদ্ধেশ্বরী হাই স্কুলের সহকারী শিক্ষক। একদিন ভারতে যাওয়ার ব্যাপারে স্কুল থেকে কিছু পাওনা টাকা তুলতে গেছি। এমন সময় পাঞ্জাবী পুলিশের একটি দল আমাকে ও আমার বন্ধু সহকর্মী নজমুল হোসেনকে ধরে নিয়ে রাজারবাগ চলে যায়। সেখানে আমাদের অনেকক্ষন দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। তারপর তারা আমাদের টাকা-পয়সা, ঘড়ি ইত্যাদি ছিনিয়ে নিয়ে নেয়। হ্যান্ডকাফ পরিয়ে ওপরে নিয়ে গিয়ে মাটিতে বসিয়ে রাখে এবং মাঝে মাঝে চড় থাপ্পড় দিতে থাকে। সেখান থেকে আমাদেরকে রমনা থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। রমনা থানায় লকআপে থাকার সময় সেখানে আর অনেক ছেলেকে অত্যাচারে জর্জরিত অবস্থায় দেখতে পাই।
ঘন্টাখানেক পর আমাদেরকে লকআপ থেকে বারান্দায় নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে প্রথমে আমার সহকর্মীর উপর দৈহিক পীড়ন করা শুরু হয়। তাঁকে বেতের মোটা লাঠি দিয়ে অমানুষিকভাবে প্রহার করা হয়। তার পা মুষড়ে ফেলা হয়। কিন্তু তিনি এরপরও কোন গুপ্ত খবর দিতে অস্বীকার করেন। তারপর শুরু হয় আমার পালা। আমাকে তারা নিদারুন লাঠিপেটা করে এবং আমার পা-ও তারা মুষড়ে ফেলে। কিন্তু আমিও কোন গোপন কথা বলতে সম্মত হইনি।
ঘণ্টা খানেক পর একজন ডি,এস,পি এসে আমাদেরকে আবার রাজারবাগ পুলিশ লাইনে নিয়ে যায়। সেখানে অন্যান্য আরো অনেকের সঙ্গে আমাদেরকে ২৪ দিনের জন্য বন্দী করে রাখা হয়। প্রথম দিন রাতে তারা কোন এক পিতা ও তার পুত্রকে একই সঙ্গে উলঙ্গ করে ঐ অবস্থায় সবার সামনে সারারাত দাঁড় করিয়ে রাখে এবং মারধোর করে। আমাকে ও অন্যান্য সবাইকে তারা সকালে, দুপুরে ও সন্ধ্যায় নিয়মমাফিক মারধোর করতো ও জোর করে জবানবন্দী আদায় করে নিত। তবে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে আমরা সবাই সত্যকে গোপন করে যেতাম। পাঞ্জাবী পুলিশেরা ছাড়াও পাক সেনা বা ই,পি,সি,এ,এফ যারাই আসত তারাই একবার করে এসে আমাদের ধোলাই করে যেত। অনেকেই প্রহারের ফলে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলত। মাঝে মাঝে মধ্যরাতে এসে ঘুম থেকে উঠিয়ে তারা নির্যাতন চালাত। ওরা নিয়মিত আমাদেরকে কিছু খেতে দিত না। তবে মাঝে মাঝে তাদের উচ্ছিষ্ট তারা আমাদের খেতে দিত। বিশেষ করে মারধোর করার সময় পানি চাইলে তারা পানি খেতে দিত না। উল্লেখ করা যেতে পারে মাঝে মাঝে ভিখিরি ছেলেরা বিভিন্ন জায়গা থেকে খাবার ভিক্ষে করে আমাদের দিয়ে যেত।
একদিন ওরা আমার দুই হাত বেঁধে ওপরের দিকে ঐ অবস্থায় একনাগাড়ে ৪৮ ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রাখে। বাঁধন খুলে দেয়ার পরপরই আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। আমার পা ভীষন রকম ফুলে যায় এবং সাধারণভাবে চলাফেরা করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলি।
একদিন কোন এক বন্দীকে তারা পিটিয়ে মেরে ফেলে। তারপর মৃতদেহ বস্তায় পুরে তারা নিয়ে যায়। ওখানে একটা ছেলেকে পিঠমোড়া করে সারাদিন বেঁধে রাখে ফলে তার পচনক্রিয়া আরম্ভ হয়। ঐ অবস্থায় পরে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়।
একদিন সকালে পাঞ্জাবী পুলিশ এসে আমাকে বন্দুকের বাঁট দিয়ে পিটাতে শুরু করে, তখন আমার পরনে শুধু একটা জাঙ্গিয়া ছিল এবং হাত উপরের দিকে বাঁধা অবস্থায় ছিল। সে অবস্থায় একজন মিলিটারী অফিসার, ডি,এস,পি,আর,আই এবং কয়েকজন পুলিশ এসে আমাকে ঘিরে ফেলে, তারা প্রত্যেকেই আমার উপর কিল, ঘুষি, চপেটাঘাত, লাথি এবং থাপ্পড় চালাতে থাকে। আমার বুকের উপর একজন একটা রিভলবার ধরে তাদের ইচ্ছেমত স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা করে। কিন্তু আমি কোন গোপন তথ্য প্রকাশ না করলে তারা আরো কিছুক্ষণ মারধোর করে চলে যায়।
একদিন সকালে পাঞ্জাব পুলিশের একজন ডি,এস,পি (অল্প বয়স্ক) দেখতে আসে। তার সাথে কথা বলার জন্য দু-এক মিনিট কথা বলার জন্য অনুমতি চাই এবং সে এতে রাজী হয়। তাকে আমি প্রথমে বলি “শিক্ষার দিক থেকে তুমি আমার চাইতে বেশী নও, কিন্তু কি অবস্থায় আমাদেরকে রেখেছ, তোমরা মানুষ না অন্য কিছু, আমাদের বিরুদ্ধে যদি কোন অভিযোগ থাকে তা তুমি তদন্ত কর এবং আদালতে বিচার দাও। তা না হলে এভাবে আমাদেরকে রাখার কোন অধিকার তোমাদের নেই”। আমার এ কথা শুনে ভীষণ রেগে যায় এবং চিৎকার করতে থাকে। আমাকে সে একটা ছেলের পরিচয় জিজ্ঞাসা করে। আমি বললাম যে ছেলেটির নাম আমি শুনেছি তবে চিনি না। এরপ সে চলে যায়, ঐ দিনই সন্ধ্যার সময় আমাকে বেদমভাবে প্রহার করা হয়। যে ঘরে আমাদের উপর অত্যাচার চালানো হত সেখান থেকে পরে আমাদেরকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়। এখানে দুইজন পাঞ্জাবী পুলিশ মাঝে মাঝে আমাদেরকে খাবার দিয়ে যেত। সিগারেট কিনে এনে দিত, তারা আমাদের মারধোর করতো না। এদের সাহায্যে আমি হাবিব ব্যাংকে (শান্তি নগর শাখা) এক বন্ধুর কাছে ঝাড়ুদারের মারফত একটা চিঠি পাঠাতে সক্ষম হই। আমার বন্ধু ঐ ঝাড়ুদারের কাছে আমার জন্য দশটি টাকা পাঠিয়ে দেয় এবং বন্ধু বান্ধবদেরকে আমার খবর পৌছে দেয়। ছাড়া পাবার ৭/৮ দিন আগে থেকে আমাকে বলা হয় যে টাকা দিলে আমাকে ছেড়ে দেয়া হবে। আমার চেক বইটি (তল্লাশী করে তারা নিয়েছিল) আমার কাছে নিয়ে আসে এবং দু’হাজার টাকা চেক সই করে দিতে বলে। আমি তাদের শ পাঁচেক টাকা দিয়ে রাজি হই। শেষ পর্যন্ত তারা ৬০০ টাকার একখানা চেক সই করিয়ে নেয়, আমাদেরই একজন বন্দীকে নিয়ে টাকা উঠিয়ে নিয়ে আসে। সে দিনই বিকালে আমাকে ছেড়ে দেয়া হয় এবং আরো আটশ টাকা দিতে বলে। আমি পালিয়ে যাব এই ভয়ে একজন পুলিশ আমার পিছনে লাগিয়ে দেয়। পরেরদিন আমি আমার বন্ধুদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে তাদেরকে দিয়ে আসি।
দীর্ঘদিনে বন্দীশিবিরে অত্যাচার ও নির্যাতনের চিহ্ন বহন করে অবশেষে বাড়ী ফিরে যাই। এখনো আমি পুরোপুরি সুস্থ্য হয়ে উঠি নি এবং অস্বাভাবিক জীবনযাপন করছি।
স্বাক্ষর/-
মোঃ আবু নুর
৪-৪-৭৩
গুরু গোলাপ
<৮,২.১.১৮,৪৭>
মোহাম্মদ আলী নুর চোধুরী,
প্রধান শিক্ষক, ঘোড়াশাল হাই স্কুল।
১লা ডিসেম্বর ১৯৭১। সকাল ৫টায় রেলগাড়ী করে প্রায় ৫০/৬০ জন সৈনিক সাথে একজন মেজরসহ ন্যাশনাল জুট মিল (ইজব নগর, ঘোড়াশাল, ঢাকা) ঘিরে ফেলে। তখন অনেকেই নিদ্রায় মগ্ন। মিল ছিল রমজান উপলক্ষে ছুটি। বিশেষ করে মিলের স্টাফের লোকজনই সেখানে তখন ছিলেন। ঘোড়াশাল সেতুর পশ্চিম পাশে গাড়ী থামিয়ে মিছিল সহকারে প্রথমত গুলি করতে করতে পাক বাহিনী মিলে প্রবেশ করে। গুলির শব্দ শুনে মিলের আশেপাশের লোকজন দৌড়াদৌড়ি করতে থাকে। কিন্তু পাক বাহিনী ওদিকে কোন দৃষ্টিপাত করে নি। রাস্তার পাশে যে সব ঘরবাড়ী ছিল সেগুলিতে অগ্নিসংযোগ করে মাত্র। গোলাগুলির শব্দ শুনে মিলের প্রত্যেকে ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়। মিলের সহকারী ম্যানেজার শহীদ আবু তালেব পাক বাহিনীর সাথে একত্র হয়ে মিলের সবাইকে সান্ত্বনা সহকারে ডেকে আনেন। অনুমান স্টাফ দেড়শত লোক ছিল এবং তাদের পরিবার পরিজনসহ ৫০০ লোক। মেজর সবাইকে ডেকে শীতলক্ষ্যা নদীর পশ্চিম পাড়ে নিয়ে যায়। চক্ষু লাল করে ম্যানেজার সাহেবকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এখানে মুক্তিবাহিনী আছে কিনা? এবং স্টাফের সবাইকে মুক্তিবাহিনী বলে মেজর আখ্যায়িত করে। সহকারী ম্যানেজার সাহেব মেজরকে নানাভাবে তাঁর স্টাফ যে মুক্তিবাহিনী নয়, তা বোঝাতে চেষ্টা করেন এবং তার প্রমাণ দেন। ভোর ছয়টা থেকে বেলা দুইটা পর্যন্ত উভয়ের মধ্যে এসব কথা কাটাকাটি হয়। শেষ পর্যন্ত মেজর ব্যাপারটা বুঝতে সক্ষম হন। সহকারি ম্যানেজার সাহেবকে স্ব-স্ব কাজে লিপ্ত হতে আদেশ দেন। স্টাফের সবাই নিজ নিজ কাজে চলে যায়। মেজর ও তার অন্যান্য সৈন্যরা মিল প্রদক্ষিন করতে থাকে। তাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিবাহিনী অনুসন্ধান্ন করা। অবশেষে তারা আবার গাড়ির দিকে রওয়ানা হয়। যখন তারা গাড়ীর দিকে ধাবমান ঠিক সেই মুহুর্তে কোথা হতে কে যেন একে একে দুটি গুলি করে। গুলির শব্দ শুনে মেজর ও অন্যান্য সৈনিকরা তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে এবং পুনরায় মিলের দিকে রওয়ানা হয়। আর কালবিলম্ব না করে অফিসার স্টাফের প্রত্যেকের বাসায় উঠে যাকে যেভাবে দেখেছে সেভাবেই নৃশংসভাবে হত্যা করে। উল্লেখ্য যে, মিলের গেটকিপারসহ অফিসার ও স্টাফের দু’একজন ছাড়া সবাইকে পাক বাহিনী নৃশংসভাবে হত্যা করে। ঠিক সন্ধ্যা ৬টায় তারা ট্রেনে উঠে ঢাকা অভিমুখে চলে যায়।
স্বাক্ষর/-
আলী নুর চোধুরী
৪-১২-৭৩
<৮,২.১.১৯,৪৮>
মিসেস আবু তালেব
স্বামীঃ শহীদ আবু তালেব, এম,এ,
সহকারী ম্যানেজার, ন্যাশনাল জুট মিলস,
ঘোড়াশাল, ঢাকা।
১৯৭১ সালের ১লা ডিসেম্বর একদল খানসেনা অতর্কিতভাবে ঘোড়াশাল ন্যাশনাল জুট মিলস ঘিরে ফেলে এবং মিলের ১০৪ জন বিভিন্ন পদের নিরীহ নিরস্ত্র কর্মচারীকে নির্মমভাবে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে এল,এম,জির ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে। শহীদ আবু তালেব তাদের মধ্যে সবচেয়ে উচ্চপদস্থ কর্মচারী ছিলেন। তিনি দিনাজপুরে ঠাকুরগাঁ মহকুমার ধাকদনপুর গ্রামের অধিবাসী ছিলেন এবং জনাব আহমদ উদ্দিন আহমেদের সর্বকনিষ্ঠ পুত্র ছিলেন এবং ন্যাশনাল জুট মিলের সহকারী ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি পরোক্ষভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধে সহায়তা দান করেন এবং বহু জনহিতকর কাজ সম্পাদন করেন। তিনি দিনাজপুর জেলায় চিরিরবন্দর থানার নওখৈর গ্রামে “নবোদয়” নামে একটি পাঠাগারও স্থাপন করেন। তাছাড়া তার বড় পরিচয় তিনি ন্যাশনাল জুট মিল প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন এবং একজন দক্ষ ও জনপ্রিয় পরিচালক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। মাত্র ৩২ বছর বয়সে বর্বর পাক সেনাদের হাতে তাঁর প্রাণ হারাতে হয়। মৃত্যুকালে স্ত্রী ও দুই কন্যা রেখে যান। মৃত্যুর পূর্বমুহুর্তে তিনি বারবার পাক সেনাদের কাছে আবেদন জানান- “মারতে যদি হয় আমাকে মার, আমার কর্মচারীদেরকে মের না”। যেহেতু তিনি মিলটিকে গড়ে তোলেন, সেহেতু তাঁর শেষ ইচ্ছা ছিল মৃত্যুর পর যেন তাঁকে সেখানেই কবরস্থ করা হয়। কিন্তু তার শেষ ইচ্ছা পূর্ণ হয়নি।
স্বাক্ষর/-
মিসেস আবু তালেব
২০-১১-৭৩
<৮,২.১.২০,৪৯>
মোহাম্মদ মাহমুদুল আশরাফ
গ্রাম ও পোঃ ঘোড়াশাল
কালীগঞ্জ, ঢাকা।
নভেম্বর মাসের ১৭ তারিখ ঘোড়াশাল স্টেশনে মিলিটারী ক্যাম্প থেকে ৫০/৫৫ জনের একটি দল ভোর ৬ টায় ষ্টেশনের দক্ষিণ দিকের দু’তিনটা পথ দিয়ে খিলপাড়া ও আটিয়া গ্রামের দিকে অগ্রসর হয়। আমি ঘোড়াশাল থেকে তার একদিন পুর্বে বৈয়ম গ্রামে চলে যাই। পাক বাহিনী প্রথমে খিলপাড়া গ্রামে প্রবেশ করে। খিলপাড়া গ্রামের জনৈক দোকানদার ইসলামের সাথে পাক বাহিনী সাক্ষাত কর। বিশেষ করে উল্লেখ্য যে, পাক বাহিনী পূর্বেই ইসলামকে দোকানদার হিসেবে চিনত। পাক বাহিনী ইসলামকে সাহায্য করতে বলে। উপায়ন্তর না দেখে ইসলাম বাধ্য হল পাক বাহিনীর সাহায্য করতে। এরপর শুরু হয় পাক বাহিনীর ধ্বংসলীলা। একের পর এক বাড়ী ধ্বংস করতে থাকে এবং লোকজনদেরকে এক এক করে গুলি করে হত্যা করে। প্রকাশ, ইসলাম একজন ধর্মভীরু লোক। তিনি কোরআন শরীফ পাঠ করছিলেন। হয়তবা অনেক লোক পাক বাহিনীর ভয়ে পালাচ্ছে। সেই মুহূর্তে পাক বাহিনী গুলি করে ওখানেই শেষ করেছে। এমনকি শিশু, নারী-পুরুষ কেউই তাদের নৃশংস হত্যা হতে নিস্তার পায় নি। হত্যার সাথে সাথে অগ্নিসংযোগ চালিয়ে যায়। এত মর্মান্তিক ধ্বংসলীলাকে তৈমুরের ধ্বংসলীলার সাথে তুলনা করা যায়।
এমনিভাবে দু’গ্রামের প্রায় ২০০ নারী, পুরুষ ও শিশুকে হত্যা করে। অনেক লোক রাস্তায়, কেউ ঘরে আবার কেউ সেতুর নীচে মৃত অবস্থায় পড়ে থাকে। পাক বাহিনীর এই অভিযান প্রায় ৮ঘন্টা ধরে চলে। পাক বাহিনীর সাহায্যকারী ইসলাম তাদের এ অপকার্যে সাহায্য করেছিল। যখন পাক বাহিনী দেখলো তাদের সাহায্যের আর প্রয়োজন নেই তখন পাক দস্যুরা ইসলামকেও হত্যা করে। প্রায় ২০০ মৃতদেহের মধ্যে জনগণ ২ জনের মৃতদেহকে সমাহিত করেছিল।
ঘোড়াশাল রেলষ্টেশনে পাক বাহিনীর একটা ক্যাম্প ছিল। দৈনন্দিন খাওয়ার যাবতীয় জিনিসপত্র গ্রামের নিরীহ লোকদের নিকট হতে জোর করে নিয়ে যেত। পাক পশুরা তাদের পশুত্ব চরিতার্থ গ্রামের যুবতী মেয়েদের উপর মাঝে মাঝে পাশবিক অত্যাচার চালাত। সত্যি কথা বলতে কি পাক বাহিনী সমগ্র ঘোড়াশাল গ্রামে একটা সন্ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করে। ঘোড়াশাল বাজার বন্ধ হয়ে যায়, স্কুলে কোন ছাত্র আসত না। গ্রাম প্রায় জনশুণ্য ছিল। যদিও দু’একজন বাঙ্গালী দেখত, তাদের ধরে নিয়ে যেত কাজ করার জন্য। তখন মনে হতো আমার জীবনের মুল্য এক পয়সাও নয়। হঠাৎ একদিন পাক বাহিনী আমাকে এবং আর অনেক লোককে ধরে ফেলে। মুসলমান ছিলাম বলে বেঁচে যাই।
স্বাক্ষর/-
মোঃ মাহমুদুল আশরাফ
<৮, ২.১.২১,৫০>
শাহ মোহাম্মদ ফরিদ
ডি,সি, টাঙ্গাইল।
গোয়ালন্দের এস,ডি,ও থাকাকালে পাক বাহিনী আমাকে গ্রেফতার করে ঢাকা সেনা নিবাসে আটক রাখে। তারপর আমাকে ৩রা জুন ১৯৭১ সাল পর্যন্ত জয়দেবপুরে ভাওয়াল রাজার বাড়ীতে বন্দী রাখে। এই সময় নানা প্রকার শারীরিক অত্যাচারও করা হয়।
জুনের ৪ তারিখে আবার ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে একদিনের জন্য রাখে। সেই রাতে আমার উপর অনেক অত্যাচার করা হয়। পরেরদিন আমাকে সেকেন্ড ক্যাপিটালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ২১ শে সেপ্টেম্বর অবধি বন্দী রাখা হয়। এ সময় আমাকে নানা প্রকার শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার এবং প্রশ্নোত্তর করা হয়।
৩রা সেপ্টেম্বর তারিখে বিভিন্ন অভিযোগে সম্বলিত চার্জশীট দেওয়া হয়।
২১শে সেপ্টেম্বর তারিখে আমাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। কারাগারে বাঙ্গালী কর্মচারীরা আমাকে সকল প্রকার সাহায্য করে এবং যথাসাধ্য আরাম আয়েশে রাখার চেষ্টা করে। আমার সাথে অনেক সরকারী কর্মচারীদের মধ্যে ফরিদপুরের তদানীন্তন জেলা প্রশাসক (বর্তমানে রেজিস্ট্রার, কো-অপারেটিভ সোসাইটি) জনাব আ,ন,ম ইউসুফ, মাদারীপুরের মহকুমা প্রশাসক সৈয়দ রেজাউল হায়াত (বর্তমানে ঢাকার ডি,সি) বন্দী ছিলেন। আমরা সবাই বিচারাধীন আসামী ছিলাম।
১৭ই ডিসেম্বর শুক্রবার সকালে আমরা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে বেরিয়ে আসি। গোয়ালন্দে আমার হুকুমে পাক বাহিনীর সাথে যুদ্ধে কুষ্টিয়া ৩০-৩১শে মার্চ ১৯৭১ আছমত ও কুদ্দুস নামে গোয়ালন্দ মহকুমার দু’জন আনসার শহীদ হয়। গোয়ালন্দে ঘাটে ২১শে এপ্রিল পাক বাহিনীর সাথে যুদ্ধে ফকির মহিউদ্দিন নামে আর একজন আনসার শহীদ হয়। এছাড়াও তিনজন আনসার কুষ্টিয়া যুদ্ধে আহত হয়। তাদের নাম আয়িউর, রব ও জিয়াউদ্দিন। গোয়ালন্দ মহকুমার আর একজন আনসার নুরুই ইসলাম আমার সাথে বন্দী ও দীর্ঘ যন্ত্রণাভোগের পর ১৭ই ডিসেম্বর মুক্তি পায়। আমি গ্রেফতার হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত গোয়ালন্দ মহকুমার দলমত নির্বিশেষে সকল জনসাধারণের এবং সর্বস্তরের সরকারী কর্মচারীদের পূর্ণ সহযোগীতা লাভ করেছিলাম।
স্বাক্ষর/-
শাহ মোহাম্মদ ফরিদ
২৫-৭-৭৩
<৮,২.১.২২,৫১>
শরীফ উদ্দিন আহমদ
গ্রামঃ তারটিয়া
ডাকঘরঃ তারটিয়া ভাতকুড়া
টাঙ্গাইল
“১৯৭১ সনের ১০ই জুন তারিখ বিকাল ৪ টায় টাঙ্গাইল শহরের জেলা সদর রাস্তা হতে ১০ জন রাজাকার ও ৫ জন কুখ্যাত পাক বাহিনীর লোকেরা আমাকে ধরে টাঙ্গাইল জেলা সদরে তাদের আড্ডায় নিয়ে যায়। আমাকে রাস্তায় কোন দিকে তাকাতে দেয়না। আমাকে প্রথমে প্রশ্ন করে ভোট কোথায় দিয়েছ। আমি বলি নৌকায়। এই কথা বলার পর দুজন রাজাকার ও দুইজন পাক সৈনিক আমার উপর হান্টার ও চাবুক দ্বারা প্রহার আরম্ভ করে। তিনটা হান্টার ভাঙ্গার পর অজ্ঞান অবস্থায় আমাকে একটা পচা গন্ধ ভরা কামরায় রেখে চলে যায়। তিনদিন আমাকে কিছু খেতে দেয় নাই। দৈনিক তিনবার করে আমাকে প্রহার করতো। এইভাবে ৫ দিন প্রহার করার পর আমার শরীর ফুলে পচে যায়। এরপর ৬ষ্ঠ দিনে তারা আমাকে কারেন্ট মারে। কারেন্টের ধাক্কা লেগে দুইবার আমি ছিটকে পড়ে যাই। তারপর কি হয়েছে আমি জানিনা। সারাদিন পর অজ্ঞান অবস্থা থেকে জেগে উঠে দেখি আমার সর্বাঙ্গ রক্তাক্ত মেঝে রক্তে ভেসে গেছে। এরপর অত্যাচারের মাত্রা কমে যায়-দৈনিক একবার করে ১৯ তারিখ পর্যন্ত অত্যাচার চলে। ১৯ তারিখের পর আমি প্রায়ই অজ্ঞান অবস্থায় থেকেছি। এর মধ্যে আমি নিজ চক্ষে প্রতিদিন একদল করে লোক রাত্রি বারটার পর আড্ডার উত্তর দিকে নিয়ে যেতে দেখেছি। তাদের আর ফিরতে দেখি নাই। নিয়ে যাওয়ার পর দূর থেকে শুধু প্রতি মুহূর্তে বিকট একটি করে আওয়াজ শুনেছি। এই অবস্থায় ১৭ দিন আমাকে রাখার পর ২৭ তারিখে মৃত মনে করে ফেলে দেয়। আমার একজন পরিচিত লোক মৃতদেহের ভান করে আমাকে রিকশা করে বাড়ীতে পাঠিয়ে দেয়।“
স্বাক্ষর/-
শরীফ উদ্দীন আহমদ
<৮,২.১.২৩,৫২>
কামিনী কুমার দাস
সার্কেল অফিসার (ডেভেলপমেন্ট)
রায়পুরা, ঢাকা
“আমার রায়পুরা থানায় তখন ২২ টি ইউনিয়ন ছিল। বর্তমানে এখানে ২৮ টি ইউনিয়ন। এখানে ৪ লাখ লোকের বাস। রায়পুরা থানায় ২২ টি ইউনিয়নের মধ্যে মেঘনা নদীর দ্বীপ চরে ৫ টি ইউনিয়ন (বর্তমানে অবস্থিত). এলাকা ১৫৪ বর্গ মাইল। অত্র থানার পরিধির মধ্যে ৫টি রেলওয়ে ষ্টেশন আছে। আমার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে পাক বাহিনীর হেডকোয়ার্টার ছিল। তখন হেডকোয়ার্টার হতে হানাদারদের পৈশাচিক কার্যকলাপ পরিচালনা করত। চর এলাকার দু’টি ইউনিয়ন ও বাকি ইউনিয়নের মধ্যে ১৫টি ইউনিয়নে প্রজ্বলন কার্য চালায় হানাদাররা। যেহেতু রায়পুরা থানার মধ্য ভাগ দিয়ে রেল রাস্তা অবস্থিত। ফলে রেল রাস্তার উভয় দিকের গ্রাম ও অভ্যন্তরেও পাক হানাদাররা বাড়ীঘর জ্বালিয়ে দেয় ও নৃশংসভাবে জনসাধারণকে হত্যা করে। অত্র থানার বেগম ইউনিয়নে মুক্তিযোদ্ধাদের সহিত পাক বাহিনীর প্রচন্ড সংগ্রাম চলে। ইহা ব্যতীত মীর্জানগর ইউনিয়নের হাঁটুভাঙ্গা ও মোছাপুর ইউনিয়নের রামনগর গ্রামে কয়েকবার পাক বাহিনীর সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের খন্ড যুদ্ধ হয়। পাক বাহিনীকে ঘায়েল করা হয় এবং কয়েকজন পাক বাহিনী নিরস্ত্র জনতার হাতে মোছাপুর ইউনিয়নে ও মীর্জানগর ইউনিয়নে ধরা পড়ে। তাদের পরে হত্যা করা হয়। থানা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে পাক বাহিনীরা ছাউনী খুলে থানা ব্যাপী জনসাধারণের মাঝে সন্ত্রাসের সৃষ্টি করে এবং নিরীহ জনসাধারণকে হত্যা করে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে কবরস্থ করে। গণকবর এখনও বিদ্যমান রয়েছে। কয়েকজনকে জোরপূর্বক ধর্মান্তর করে। ধর্মান্তরিত লোককেও বেদম প্রহার করে অত্যাচার করে এবং একজনকে হত্যা করে। থানার প্রত্যেকটি বাজার ওরা লুট করে। এছাড়াও গ্রামে গ্রামে ঢুকে হানাদাররা রাজাকারদের সহায়তায় লুটতরাজ করেছে। থানা পুলিশ ষ্টেশনও হানাদারদের প্রজ্বলন থেকে বাদ পড়েনি।“
স্বাক্ষর/-
কামিনী কুমার দাস
৬/১১/৭৩
<৮,২.১.২৪,৫৩>
মোঃ আবদুল হাই
সাংঃ শাটিয়াচড়া
ডাকঘর-জামুকী
থানা-মির্জাপুর
জেলা-টাঙ্গাইল
আমাদের গ্রামের নিম্নলিখিত ব্যক্তিগণ শহীদ হয়েছেনঃ-
১| মোঃ জোমারত আলী দেওয়ান।
২| মোঃ নুর বকস
৩| মোঃ শাহ আলম
৪| মোঃ জাহাঙ্গীর আলম
৫| মোঃ হাবিবুর রহমান
৬| মোঃ দুলাল মিয়া
৭| মোঃ আব্দুল হাকিম
৮| বেগম আকতারুজ্জামান
৯| মোঃ লেবু মিয়া
১০| বেগম এখলাস উদ্দিন
১১| মোঃ ইব্রাহিম
১২| আব্দুল হক
১৩| বেগম মাজেম আলী
১৪| মোঃ মোতালেব হোসেন
১৫| মোঃ দুদু মিয়া
গুড়ান গ্রামের শহীদদের নামঃ-
১| মোঃ তোফাজ্জল হোসেন
২| মোঃ চেনু মিয়া
৩| মোঃ আবুল কাশেম
৪| মোঃ নূর উদ্দিন
৫| মোঃ জাহাঙ্গীর মিয়া
৬| মোঃ আবুল মাষ্টার
৭| মোঃ মজিবর রহমান
৮| মোঃ সামছুল হক
৯| বেগম নূরু ইসলাম
১০| আজমত আলী
১১| পান্না মিয়া
১২| বেগম আব্দুল বাকী মিয়া
৩রা এপ্রিল পাক বাহিনী ১৫০ খানা বাড়ীঘর সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়। পাক বাহিনীর দালাল আমাদের গ্রামের দুইজন মহিলাকে ধরে পাক শিবিরে নিয়ে তাদের উপর পাশবিক অত্যাচার করে।
<৮,২.১.২৫,৫৪-৫৫>
“পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন সব শুনে আমার সাথে হ্যান্ডশেক করে বলে তোমার বাঙ্গালীরাই তোমার শত্রু, আমরা কি করবো?”
-আবুল কালাম আজাদ, নাগপুর, টাঙ্গাইল।
“১৬ই এপ্রিল টাঙ্গাইলে ডি, সি, জালাল আহমেদ সাহেব এবং এস, পি, নুরুজ্জামান সাহেব আসেন লুঙ্গী পরা অবস্থায়। সব ঘটনা বলেন এবং ২/৩ দিন থাকেন আমার ওখানে গোপনে। ওদের বন্ধু ছিলেন টাঙ্গাইলের জনাব আযম খান। ওর সাথে আলাপ করে ঠিক করা হয় কাজে যোগ দেয়ার।
আযম খান গাড়ী নিয়ে এসে নিয়ে গেলেন। এই খবর পাক গোয়েন্দা বিভাগ জেনে ফেলে আযম খানের বাড়ী ঘিরে ফেলে। ওদের তিনজনকে ব্যাপক মারধোর করে ঢাকায় পাঠিয়ে দেয়। ঢাকাতে কয়েকদিন অত্যাচার করে জবানবন্দী নিয়ে তিন জনের জবানবন্দী এক হওয়ায় তাঁরা ছাড়া পান। প্রতিটি স্টেটমেন্টে আমার কথা ছিল। এমনকি আযম খানকে যে চিঠি পাঠিয়েছিলাম সেটিও পাক কর্তৃপক্ষের হাতে গিয়েছিল। আমি সবসময় মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত ছিলাম। শেষ পর্যন্ত ওরা মুক্তি পেয়েছেন শুনে শান্তি পেলাম। ডি, সি, ও এস, পি ৩০শে এপ্রিলের দিকে কাজে যোগ দেন।
১০ই মে ডি, সি’র ওখানে সভাতে পাক ক্যাপ্টেনের কথা গুলি বলেন। সভা শেষে ডি, সি সাহেব গোপনে আমাকে ডেকে বললেন সাবধানে থেকো আর হিন্দুদেরকে বলো সাবধানে থাকতে, পূজাগুলো এখন বন্ধ রাখতে বলো- বাঁচলে অনেক কিছু করতে পারবে। আমি সে মোতাবেক রাত ১০টায় পৌছে সবাইকে ডেকে এ খবর দেই; তারা সেই মত সাবধানতা অবলম্বন করে।
ভোর রাতে প্রচুর শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায়। বাড়ীতে সবাই কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। দেখলাম পাক সেনারা তিনদিক থেকে নাগপুর আক্রমন করেছে- অত্যাচার চালাচ্ছে। আমরা গেলাম ক্যাপ্টেনের কাছে, ক্যাপ্টেন বলল তুমিই সেই ম্যাজিস্ট্রেট যে জামুর্কীতে আমার বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা পাঠিয়েছিলে। তুমিতো গতকাল হিন্দুদেরকে পালিয়ে যেতে বলেছ। আমি চুপ থাকলাম। ক্যাপ্টেন আমাকে খুব গালাগালি করলো, সে কিছু হিন্দু ধরে এনে বেয়নেট চার্জ করতে লাগলো। আমার খবর শুনে রাতেই অধিকাংশ হিন্দু পালিয়ে গিয়েছিল। ফলে বহু লোক সেদিন বেঁচে যায়।
ক্যাপ্টেন আমাকে এক ঘণ্টা সময় দেয় যে এর মধ্যে ১০০ হিন্দু এনে দিতে হবে। নইলে একটি বুলেট তোমার জন্য বলেই এক চড় মারে। আমি এডামেন্ট হয়ে বেশ কথা কাটাকাটি করলে ক্যাপ্টেন নরম হয়ে আমাকে গাড়ী করে নিয়ে যায়। থানায় গিয়ে দেখলাম ৮/১০ জন নিরীহ লোককে হত্যা করার জন্য রেখেছে। আমি ওরা ঝাড়ুদার বলে ওদেরকে বাঁচাই। ডাঃ কাশেম (ডেন্টিস্ট) এবং ম্যারেজ রেজিষ্টার আমার বিরুদ্ধে টিক্কা খাঁর নিকট দরখাস্ত করেছিল মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে কাজ করায়।
ঐ দিন পাক সেনারা সামনে যাদেরকে পেয়েছে তাকেই গুলি করে হত্যা করেছে। থানায় যেতে গিয়ে রাস্তায় বিভিন্ন স্থানে মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখলাম। বার ঘাট, বাড়ী-ঘর সব ওরা লুট করে নেয়।
আমাকে এক জায়গায় বসিয়ে রেখে ক্যাপ্টেন চলে যায়। আধ ঘন্টা পরে ডেকে পাঠায়। যাওয়ার সাথে সাথে ক্যাপ্টেন আমার বুকে রিভিলবার ধরে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে মারধোর শুরু করে। সেখানে ২০/২৫ জন হিন্দু লোককে শুইয়ে রেখেছে দেখলাম। চারদিকে সিপাইরা বেয়নেট উঁচিয়ে ঘিরে ধরলো। আমার বিরুদ্ধে চার্জ দিল আমার বাড়ী থেকে নাকি ৬ রাউন্ড গুলি ছুড়েছে পাক সেনাদের উপর। অনেক কাকুতি করে ১ মিনিট বলবার সুযোগ পাই। বেশ কিছুক্ষণ পাকিস্তানের পক্ষে মিথ্যা-সত্য বলে ক্যাপ্টেনকে কনভিন্স করি। ক্যাপ্টেন সব শুনে আমার সাথে হ্যান্ডশেক করে বলে তোমার বাঙ্গালীরাই তোমার শত্রু, আমরা কি করবো? তারাই তোমার বিরুদ্ধে বলেছে। থানাতে গেলে ২৫/৩০ জনকে গুলি করার আদেশ দেয়। আমি বললাম এরা সবাই কৃষক, এদের মেরে কি করবে? ক্যাপ্টেন জিজ্ঞাসাবাদ করে কিছু মার দিয়ে দুই জন বাদে সবাইকে ছেড়ে দেয়। আমার বাড়ীর সবাই বেঁচে যায়। নির্ঘাত মৃত্যুর হাত থেকে সেদিন বেঁচে গেলাম।
২৮ মে মুক্তিবাহিনী নাগপুর আক্রমন করে। আমার ওখানে ওয়ারলেস সেট ছিল সেটি নিয়ে যায়। কাশেম ডাক্তারকে ধরে হত্যা করে। ম্যারেজ রেজিষ্টার পালিয়ে যায়। আমি পালিয়ে টাঙ্গাইল চলে যাই পাক সেনাদের ভয়ে।
নারী ধর্ষণ, প্রজ্জলন ধ্বংস পাক সেনারা করেছে।
স্বাক্ষর/-
আবুল কালাম আজাদ
১৬/৮/৭৩
<৮,২.১.২৭,৫৬>
মোঃ কাজেম আলী
গ্রাম- ফুলদেহের পাড়া
ডাক- পিংনা
থানা- সরিষাবাড়ী
জেলা-ময়মনসিংহ।
হানাদার বাহিনী আমাদের গ্রামের ১৪ জন যুবককে নৃশংসভাবে হত্যা করে এবং ৯জন মুক্তিফৌজকে হত্যা করে। গ্রামবাসী অনেকেই পার্শ্ববর্তী গ্রামে আশ্রয় নেয়। যুদ্ধের শেষে গ্রামে এসে দেখি রোজ কেয়ামত আর কি? দাফন কাফন করার মানুষ পাওয়া যায় না।
আমাদের গ্রামে যে কয়েকজন শহীদ হয়েছেন তাদের নাম লিপিবদ্ধ করলামঃ-
মোঃ নুরুল ইসলাম, বি,এ; মোঃ আমিনুল ইসলাম; মোঃ মতিয়ার রহমান; মোঃ কাঙালীয়া; মোঃ আবদুল হালিম; মোঃ জামাত আলী; মোঃ আনোয়ার হোসেন; মোঃ ছেকান্দর আলী; মোঃ আছমত আলী; মোঃ মোনছের আলী; মোঃ মুসলিম উদ্দিন; মোঃ বাবুল হোসেন; মোঃ আবদুস সামাদ; দুদু মিয়া।
স্বাক্ষর/-
মোঃ কাজেম আলী
<৮,২.১.২৮,৫৭> “ভূপতি বাবুর অন্তিম ইচ্ছা কি জানতে চাইলে তিনি প্রথমে প্রাণের বিমিময়ে ইসলাম ধর্মে দিক্ষা নেবার কথা জানান; কিন্তু পাক ক্যাপ্টেন তা সঙ্গে সঙ্গে নাকচ করে দেয়। তখন ভূপতি বাবু জীবনের শেষ বারের মত একটা গান গাইতে চান। উল্লেখ্য যে তিনি একজন গুণী শিল্পীও ছিলেন। তার আরজি মঞ্জুর হলে তিনি যে গানটি গান তাতে উপস্থিত জনগণ কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। পাক হানাদাররাও সঙ্গীতের মূর্ছনায় বিগলিত হয়ে পড়ে, কিন্তু এতদসত্ত্বেও ভূপতি বাবু রক্ষা পান নাই।“
খাজা কামরুল হক
গ্রাম- নওয়া
পোষ্ট- কিশোরগঞ্জ
ময়মনসিংহ।
“সর্বপ্রথম ১৯৭১ সালের ১৮ এপ্রিল পাক হানাদার বাহিনী কিশোরগঞ্জ মহকুমার সদর এলাকায় প্রবেশ করে। ভৈরব হতে ট্রেন যোগে প্রায় দুই শতাধিক হানাদার সৈন্য ভারী অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ঐদিন বিকাল ৪ ঘটিকায় কিশোরগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশনে উপস্থিত হয়। এই খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শহরের সমস্ত লোক তাদের বাড়িঘর ত্যাগ করে দিকবিদিক জ্ঞানশুন্য হয়ে গ্রামের দিকে পালিয়ে যায়। মুক্তি সংগ্রামীরাও তাদের হালকা অস্ত্র-শস্ত্র ফেলে দিয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। পাক সৈন্যরা শহরের মধ্যে প্রবেশ করে পলায়নপর লোকদের উপর নির্বিচারে গুলি চালায়। তাদের প্রথম বলি হয় জনৈক রিক্সাওয়ালা এবং একজন হিন্দু সন্যাসী। সন্ধ্যার সময় তারা মাইকযোগে স্থানীয় সকল লোককে নিজ নিজ বাসভবনে ফিরে আসার জন্য আসার জন্য আহবান জানায়; কিন্তু কেউ কর্ণপাত করে না। এ সময় জনৈক ধর্মান্ধ দালালের ইশারায় তারা এখানকার পতিতালয়টি সম্পূর্ণ ভস্মীভূত করে দেয়। পরদিন পাক সৈন্যরা মাইকযোগে পুনরায় লোকজনকে ফিরে আসার আহবান জানায়। যে সমস্ত দোকানপাট হিন্দুদের ছিল সেগুলি তালা ভেঙ্গে লুট করার জন্য জনসাধারণকে বাধ্য করতে থাকে। ভীতসন্ত্রস্ত জনগণ লুটের মাল মাথায় নিয়ে বেরিয়ে আসার সময় পাক সেনারা সে অবস্থায় তাদের কিছু সংখ্যকের ফটো তুলে নেয় এবং তারপর সঙ্গে সঙ্গে গুলি করে হত্যা করে।
মে মাসের প্রথম দিকে ভৈরব থেকে আরো কিছু সংখ্যক সৈন্য আসার পর তারা স্থানীয় ডাক-বাংলোয় ঘাঁটি স্থাপন করে এবং পি,ডি,পি জামাতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলামের লোকজনকে নিয়ে এক শান্তি কমিটি গঠন করে।
এরপর হানাদার সৈন্যরা স্থানীয় দালালদের সহায়তায় রাজাকার ও আল-বদর বাহিনী গঠন করে। এদের সহযোগে তারা বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে নির্বিচারে ও কোথাও কোথাও বেছে বেছে লোককে হত্যা করতে থাকে।
১৮ই এপ্রিল থেকে ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত এই আট মাসে পাক হানাদাররা কিশোরগঞ্জ সদর এলাকায় ৩০০ থেকে ৪০০ লোককে হত্যা করেছে এবং এক কোটি টাকার মত সম্পত্তির ক্ষতি সাধন করেছে। গাঙ্গাকিয়া গ্রামের বিশিষ্ট পরোপকারী জমিদার ভূপতি বাবুকে নির্মমভাবে হত্যা করে। জুন-জুলাই মাসের দিকে একদিন পাক সেনারা ভূপতি বাবুর বাড়ী ঘেরাও তাঁকে ধরে ফেলে। স্থানীয় জনগণকে তার বাড়ী লুট করাতে বাধ্য করে। ভূপতি বাবুর অন্তিম ইচ্ছা কি জানতে চাইলে তিনি প্রথমে প্রাণের বিমিময়ে ইসলাম ধর্মে দিক্ষা নেবার কথা জানান; কিন্তু পাক ক্যাপ্টেন তা সঙ্গে সঙ্গে নাকচ করে দেয়। তখন ভূপতি বাবু জীবনের শেষ বারের মত একটা গান গাইতে চান। উল্লেখ্য যে তিনি একজন গুণী শিল্পীও ছিলেন। তার আরজি মঞ্জুর হলে তিনি যে গানটি গান তাতে উপস্থিত জনগণ কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। পাক হানাদাররাও সঙ্গীতের মূর্ছনায় বিগলিত হয়ে পড়ে, কিন্তু এতদসত্ত্বেও ভূপতি বাবু রক্ষা পান নাই। পরে তাঁকে অমানুষিক নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। এছাড়াও কিশোরগঞ্জের গুরু দয়াল কলেজের ছাত্র চিস্তিসহ কয়েকজন ছাত্রকে পাক ফৌজরা হত্যা করেছে।
কিশোরগঞ্জ থানার বিভিন্ন এলাকা থেকে যুবতী মেয়েদেরকে তারা ধরে এনে ধর্ষণ করতো। প্রায় শতাধিক জনের উপর তারা নির্যাতন চালিয়েছে।
স্বাক্ষর/-
খাজা কামরুল হক
৫/৪/৭৩
<৮,২.১.২৯,৫৮>
শ্রী জ্ঞানেন্দ্রনাথ পোদ্দার
গ্রাম- জামুর্কী
থানা- মির্জাপুর
জেলা- টাংগাইল।
“১৯৭১ সালের ১০ই নভেম্বর পাক বাহিনী আমাদের গ্রামে আসে। আমি পালাতে চেষ্ট করছি। এমন সময় একজন পাক দস্যু আমাকে ডাকিয়ে তার সামনে হাজির করলো। আমাকে বলল, “চল বেটা আমাদের শিবিরে”। পাক শিবিরে নিয়ে পাক বাহিনী গাড়ীতে করে আমাকে অন্য এক শিবিরে পাঠিয়ে দিল। শিবিরে নিয়ে আমাকে নানা রকম প্রশ্ন করতে লাগলো। আমাকে বলে, “তোদের গ্রামে কোন মুক্তিবাহিনী হ্যায়?” তখন উত্তর দেই, আমাদের গ্রামে কোন মুক্তিবাহিনী নেই। এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে আমাকে লাঠি দিয়ে বেদমভাবে প্রহার করলো। তারপর অন্য একজন রাজাকার এসে আমাকে বলে বেটা মালাউন হ্যায়। বেটাকে নৌকা মার্কায় ভোট দেয়া দেখাচ্ছি। এই বলার সঙ্গে সঙ্গে আমাকে বেতের লাঠি দিয়ে ভীষণভাবে প্রহার করলো। আমি তখন অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে রইলাম। তারপর আমার যখন যখন জ্ঞান ফিরে এলো তখন আমাকে একটি নদীর ধারে নিয়ে গেল, আমি মনে করলাম আমার জীবনের শেষ লীলা এখানে বুঝি শেষ হবে। আমাকে প্রথমে মাটির উপর চিৎ করে শুইয়ে রাখলো। কিছুক্ষন পর এক জন পাক দস্যু এসে আমাকে ভীষণভাবে লাথি মারলো এবং বেয়নেট দিয়ে আমাকে পেটের উপর আঘাত করলো। এই আঘাতে আমার জীবন শেষ হয়ে যায়। তখন আমি কোন রকমে জল টেনে মাটির উপর ভর করে থাকি। কোন রকমে সাঁতার কেটে নদীর ওপারে যেয়ে আঘাত স্থানে গেঞ্জি দিয়ে বেঁধে বহু কষ্ট করে নদীর জল হতে উঠে কোন রকমে আমার বাড়িতে চলে আসি।
বাড়িতে ডাক্তার এসে ভালো করে ব্যাণ্ডেজ করে দিল।
আজ পর্যন্ত আমার ক্ষতস্থানে তার চিহ্ন রয়েছে।
স্বাক্ষর/-
শ্রী জ্ঞানেন্দ্রনাথ পোদ্দার।
<৮,২.১.৩০,৫৯>
মজিবর রহমান
গ্রাম- জামুর্কী
থানা- মির্জাপুর
জেলা- টাংগাইল।
১৯৭১ সালের ৭ই অগাস্ট পাক বাহিনী আমাদের গ্রামে আসে। আমি ঐ সময় আমাদের গ্রামে দক্ষিন পার্শ্বে বসে ধান কাটছিলাম। এমন সময় দুই জন পাক বাহিনী এসে আমাকে ধরে নিয়ে, “তোদের গ্রাম থেকে আমাদের হাঁস-মুরগী ধরে দিতে হবে”। আমি তখন বাধ্য হয়ে হাঁস-মুরগী ধরে পাক বাহিনীর হাতে দিলাম। তারপর আমাকে বলল তোদের গ্রাম থেকে ছাগলও দিতে হবে। ছাগল এনে হাতে দিলাম। তখন আমাকে বলল, “ছাগল নিয়ে তোকে আমাদের ক্যাম্পে যেতে হবে”। তখন আমি নিরুপায় হয়ে পাক শিবিরে চললাম।
পাক শিবিরে নিয়ে আমাকে রান্না করতে বলল। তখন আমি বললাম, “হুজুর আমি পাক করতে জানিনা”। তখন আমাকে ঘাড় ধরে পানিতে ফেলে দিল। আমাকে আর পানি হতে উঠতে দেয় না। আমি জোর করে পানি হতে উঠলে আমাকে পাদুকা দিয়ে লাথি মারলো এবং বেতের লাঠি দিয়া প্রহার করতে থাকে। বেতের লাঠি দিয়ে প্রহার করলে আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি। তখন আমাকে রেখে পাক দস্যুর দল চলে যায়। তখন আমি কোন মতে বাড়ীর পথে রওয়ানা হই। আমি বাড়ীতে এলে আমার ছেলে রেজাউল ইসলাম ডাক্তার ডেকে এনে আমার চিকিৎসার ব্যবস্থা করে।
এই চিকিৎসা বাবদ মোট ৩০০ টাকা খরচ হয়।
টিপসহি
মজিবর রহমান।
<৮,২.১.৩১,৬০-৬৩>
মোঃ ওয়াছিম উদ্দিন
গ্রাম- সরিষাবাড়ী
ডাকঘর- সরিষাবাড়ী
ময়মনসিংহ।
“আমার বাস হতে সরিষাবাড়ী থানার পাক বাহিনীর শ্রেষ্ঠ কসাইখান আরামনগর মাদ্রাসা মাত্র কয়েকশ গজ দূরে অবস্থিত। আমি ছোট বেলা থেকেই অর্থাৎ আওয়ামীলীগের সৃষ্টি হতেই তার সমর্থক।
২৫শে মার্চের কালো রাতের বিভীষিকার পর থেকেই আমি সংগ্রামে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হই। আমার ধানটা মহল্লায় গোবিন্দনগর নিবাসী অফিল উদ্দিন খান নামক একজন বাঙালী প্রাক্তন সৈনিক দ্বারা ২৫ জন যুবককে রাইফেল-ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করি। কিন্তু হঠাৎ টাঙ্গাইল, মধুপুর ও জামালপুর পাক বাহিনীর দখলে যাওয়ায় আমরা প্রকাশ্যে ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করি। সরিষাবাড়ীতে রাজাকার আল-বদরদের প্রাধান্য বাড়ে। পাক বাহিনীও যাতায়াত করতে থাকে।
২রা জুলাই ১৯৭১ইং রোজ শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর থেকে বাসায় বসে আছি। বসেছিলাম একদম নিরিবিলি। বেতারের খবর শুনতেও মন বসছিলনা। ক্রমে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হল। চোখে ঘুম নেমে এল। রাত ১০-১১টার পূর্বে কোনদিনই নিদ্রামগ্ন হইনি। কিন্তু সে দিন রাত আটটা বাজার আগেই ঘুমিয়েছিলাম।
রাত গোটা নয়েকের সময় বেশ কয়েকজনের পদচারনায় এবং আনাগোনায় আমার নিদ্রা ভঙ্গ হলো। আগুন্তকেরা পাক বাহিনীর লোক কিন্তু তারা এসেছিল মুক্তিফৌজের বেশ ধরে। তারা আমাকে চাপা গলায় ডাকতে শুরু করল। আমি তাদের অবিশ্বাস করতে পারি নি। তাই দরজা খুলে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। তারা আমার সাথে চুপিসারে কথা বলতে থাকলো। আমার নিকট মুক্তিফৌজের জন্য কিছু চাঁদার আবদার জানালো। আমার নিকট তখন মাত্র ১৫ টাকা ছিল তাই তাদের হাতে দিলাম। এরপর তারা আমাকে বাউসার রেল সেতুটা কোন পথে গিয়ে চুরমার করা যাবে তাই দেখিয়ে দিতে বলল এবং এক প্রকার জোর করেই আমাকে এগিয়ে নিয়ে চলল রেল লাইনের দিকে। আমি কোন কিছু ভাববার ফুরসত পেলাম না। আমার পরণে ছিল তখন একখানা লুঙ্গী, গায়ে ছিল গেঞ্জি, পায়ে ছিল জুতা। গায়ে জামা দিবার অবকাশ ওয়া আমাকে দেয় নি। রেল লাইনে গিয়েই আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। ওরা মুক্তিফৌজ নয়! ক্যাপ্টেন শামশাদের বাহিনী। স্থানীয় আলবদর বাহিনীর ক্যাপ্টেন মাওলানা আনছার আলী, আবু, মুসলিম লীগ দালাল আঃ হক ফেরদৌসী ও নুরুল ইসলাম খান ও আরো অনেকে। সবাই মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত, হঠাৎ আমার পার্শ্বেই একটা ফাঁকা গুলি হল। আমি রীতিমত হকচকিয়ে গেলাম। সাথে সাথে আমার হাত পিঠমোড়া দিয়ে শক্ত করে বেঁধে ফেলল ওরা। আর বার বার আমার কানের কাছে জয় বাংলা বলে উপহাস করতে লাগল। জীবনের আশা নেই নিশ্চিত হয়ে পড়লাম। অদূরে আমার বাসা হতে পরিবার পরিজনের করুন কান্না ভেসে আসছিল। ক্যাপ্টেন শামশাদের হুকুমে ওরা আমাকে নিয়ে আরামনগর মাদ্রাসায় আলবদর ক্যাম্পে রওনা দিল। আমার পায়ের তলা হতে যেন প্রতি পলে পলে মাটি সরে যেতে লাগলো। কিভাবে মাদ্রাসা ক্যাম্পে পৌছে ছিলাম তা মনে নেই। ওরা আমাকে মাদ্রাসা ক্যাম্পে পাহারায় রেখে চলে গেল সাতপোয়া গ্রামের আঃ মজিদ চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়ীতে। অল্পক্ষণের মধ্যে তাকে না পেয়ে ফিরে এলো ক্যাম্পে। এরপর আমার হাতের বাঁধন ঠিক আছে কিনা পরীক্ষা করে দেখলো। আবার যাত্রা শুরু হল রেল লাইন ধরে সোজা দক্ষিণের দিকে। এই পথে চলার সময় ওরা আমার সাথে যে ব্যবহার করেছিল, তা মনে করলে আজও আমার চোখ ফেটে কান্না আসে, আমি যেন একটা বদ্ধ পাগল। কেউ পেছন থেকে দেয় ধাক্কা কেউ দেয় রাইফেলের বাঁট দিয়ে পায়ে গুঁতা। কেউ পা দিয়ে পায়ে আঘাত করে ফেলে দিতে চায়। তাছাড়া উপহাস যা করছিল তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। আমাকে শ্বশুরবাড়ী পাঠাচ্ছে ওরা। সেখানে নাকি জয় বাংলা জয়গান শুনা যাবে ইত্যাদি। মনটা তিতিয়ে উঠলো ওদের ব্যবহারে কিতু করবার আমার কি আছে? ক্যাপ্টেন শামশাদের ৭৫ জন পাক বাহিনীর একটা দল, সাথে স্থানীয় আলবদর বাহিনী ও তাদের তাবেদার দালালবৃন্দ। এই নরপিশাচদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া একটা বন্দী মানব সন্তানের পক্ষে সম্ভব কিনা তা আপনারাই বিবেচনা করুন। কোন মুহূর্তে অবস্থার কি পতিবর্তন আসবে আমি তা ঠাওর করতে পারলাম না। ক্রমে ওরা আমাকে নিয়ে চলে চান্দ দিঘীর রেল সেতুর উপর এসে পৌছল। ওরা আবার একদফা আমার হস্তের বন্ধন পরীক্ষা করে নিল। মানুষ সাগরে ডুবতে গিয়েও তৃণখন্ডকে আশ্রয় করে বাঁচতে চেষ্টা করে এ কথা পুঁথি পুস্তকে পড়েছিলাম। ষোল আনা বিশ্বাস করতে পারি নি। পুলের উপর এসেই আমার কেন জানি মনে হল পুলের নিচে ঐ অতল জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঁচবার চেষ্টা করা যায় নাকি। কি করবো মনস্থির করতে পারলাম না। ক্যাপ্টেন শামশাদ আমার পার্শ্বে চলছে, পুল পার হয়ে গেলাম, পশ্চিম পার্শ্বেই মোজাম্মেল হোসেন তালুকদার সাহেবের বাড়ী। ওরা দুই ভাগে ভাগ হল, হঠাৎ পণ্ডিত বাড়ীতে একটা ফাঁকা গুলি হল। তাদের অগ্রগামী দলটি ঐ বাড়ীতে ঢুকে পড়ল। পিছনের দলটি মাটিতে শুয়ে পড়লো রেল লাইনে। আমাকেও শুইয়ে দিল মাটিতে। কিছুক্ষণ পর ওরা ফিরে এল তালুকদার বাড়ী হতে। মোজাম্মেল হোসেন তালুকদারকে ওরা ধরতে পারে নি। আমি নিজের অসহায় অবস্থার মধ্যেও কিছুটা তৃপ্তি পেলাম, যেহেতু তালুকদার সাহেব আমার অবস্থায় নিপতিত হননি।
আবার যাত্রা শুরু হল দক্ষিণের দিকে। বেশি দূরে নয়; পুটিয়ার পাড় গ্রামে এসে ওরা থেমে পড়ল। আবার শুয়ে পড়লো মাটিতে। কয়েকজন গেল মতিলাল রায়ের বাড়ীতে। ওদের লোক মতিলাল বাবুর বাড়ী থেকে ফিরে এসে কি যেন জানাল। রেল লাইনে কয়েকজন মেশিনগান ফিট করে পাহারায় রইলো। বাদবাকি সবাই চলল মতি বাবুর বাড়ী। ক্যাপ্টেন শামশাদ আমাকে নিয়ে গেল তার সাথে, মতি বাবুর বাড়ীর সামনে এসে সবাই আবার শুয়ে পড়লো মাটিতে, আমাকে শুইয়ে দিল। কয়েকজন চলে এল এদিকে এবং মতিবাবুর বাড়ীর মধ্যে। মতিবাবুর বাড়ীতে কাউকে ওরা পেলনা। পাশের বাড়ী হতে ধরে নিয়ে এল একজন যুবককে।ওকে আমি চিনতাম, ওর নাম রাধা। রাধাকে যখন নিয়ে এল তখন ওর গলা লেপটে ধরে ছিল ওর একমাত্র মাতৃহারা শিশু কন্যাটি। স্ত্রীর মৃত্যুর পর থেকেই ও মেয়েটিকে মাতৃস্নেহে পালন করছিল। রাধার ঠাকুর মা বুড়ি এই মর্মান্তিক ঘটনা অবলোকন করার জন্য বেঁচেছিল, বুড়ি রাধার সাথে মতিবাবুর বাহির আঙ্গিনায় এসে হাজির হল। ক্যাপ্টেন শামশাদ তখন রাধার নিকট গিয়ে বুকে জড়ানো শিশুটিকে রাধার ঠাকুর মাকে দিতে বলল।
রাধা প্রাণপণ চেষ্টা করেও শিশুটিকে তার ঠাকুর মার কোলে দিতে পারলো না। মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত শিশুটি কিছুতেই পিতৃস্নেহ হতে যেন বঞ্চিত হতে চায় না। তাই সে কোমর বেস্ট করে পিতার বুকে মিশিয়ে পিতৃস্নেহের অসীম ধারা যেন উজাড় করে নিচ্ছিল। কিন্তু সে মাত্র ক্ষণিকের জন্য মাত্র। তারপর যে চিত্রের অবতারণা হল তা মনে করলে আজও আমার সংজ্ঞা লোপ পেতে চায়। তখন আমি পাথরে পরিণত হয়ে যাই। আমার মুখের ভাষা বন্ধ হয়ে যায়। তবু আমাকে বলতেই হচ্ছে। দুরাচার ক্যাপ্টেনের ইঙ্গিতে একজন হানাদার সৈনিক রাধার শিশুটির বুকের ফাঁক দিয়ে একটা রাইফেল ঢুকিয়ে এমনভাবে ঝটকা দিল যে শিশু ৭/৮ হাত দূরে ছিটকে পড়ে পা আছড়িয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলো। আমার মনে হল আদিমাতা বিবি হাওয়া যেমনে ছিটকে পড়েছিলেন, বুড়িটাও হাউমাউ করে কেঁদে উঠে রাধার শরীর পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলেন, ক্যাপ্টেন শামশাদ পিছন ফিরে তার বুকের উপর সজোরে লাথি মেরে চিৎপটাং করে ফেলে দিল। তারপর ওখানে কোন পরিবেশের সৃষ্টি হল তা অবলোকন করার ভাগ্য আমার হয়নি। ওরা রাধা সহ আরো কয়েকজনকে পিঠমোড়া দিয়ে বেঁধে রেল লাইনে এল, আমাকেও নিয়ে এল। লাইনে এসে পুনরায় আমার হাতের বাঁধন পরীক্ষা করে দেখলো। আমি এরপর হাত দুটি একটূ জোরে অথচ ওরা যেন দেখতে না পায় এমনভাবে ঘষা দিলাম, তাতেই মনে হল হস্তের বন্ধন শিথিল হয়ে গেছে। আমি বুঝতে পারলাম হাত খসে গেছে; তবু তা বাঁধা আছে এমনভাবেই রেখে দিলাম। ইতিমধ্যেই ওরা ধরে আনা লোকদের মধ্যে হতে ৪ জনকে লাইন করে বসিয়ে মেশিনগান দিয়ে দু-তিনটি গুলি করলো। নিরাপরাধ ৪টি মানুষ হুমড়ী খেয়ে পড়ে গেল মাটির বুকে।
আমি মাত্র ৭/৮ হাত দূরে থেকে এ দৃশ্য পর্যবেক্ষণ করলাম। তখন আমি প্রকৃতস্থ ছিলাম কিনা মনে নেই। শুধু এই মনে আছে আমার মাতাপিতা, স্ত্রী-পুত্র, কন্যা, আত্মীয়-স্বজন সবাই যেন আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। সবাই যেন আমাকে বিদায় দিতে এসেছে আমি যেন মহাশুন্যের অভিযাত্রী। ওরা গুলি খেয়ে ঢলে পড়লো মাটিতে আর আমি তার আওয়াজ শুনে উঠতে থাকলাম শুন্যে। এমনিভাবে কতক্ষন গিয়েছিলাম মনে নেই পা তুলতে থাকলাম ক্রমাগত কিন্তু পায়ের নীচে মাটি আছে কিনা অনুভব করতে পারলাম না। অরা আমাকে নিয়ে ফিরে চলল উত্তরের দিকে। আমার সাথে আর একজন বাঁধা অবস্থায় এল। ওকেও আমি চিনতাম। তার নাম কালু। আমরা উভয়ে বন্দী অবস্থায় এগুতে লাগলাম পুনরায় চান্দ দিঘীর পুলের দিকে যেহেতু আমরা পূর্বপরিচিত তাই আমাদের মধ্যে পথের মাঝে কোন কথাবার্তা প্রকাশ্যে হয় নি। মনে মনে ভাবলাম মরতে তো হবেই তবু বাঁচার একটু চেষ্টা করি না কেন? তাতে ধরা পড়ি যদি তাতেই বা ক্ষতি কি? এদের হাতে গেলে জীবন যে ফিরে পাওয়া যায় না তাতো নিশ্চিত ছিলাম, তাই ভেতরে ভেতরে বাঁচবার জন্য তৈরী হয়ে নিলাম। সামনেই চান্দ দিঘীর পুল। আমার রক্ষার সোপান।
পুলের উপর পা বাড়ালাম। হানাদারেরা আমাকে মধ্যে রেখে দু’পাশ দিয়ে লাইন ধরে অগ্রসর হতে লাগল। আমি মিছিমিছিই টলতে লাগলাম। একবার এদিকে একবার ওদিকে পড়ে যাই যেন এমনিভাবে দেখাতে লাগলাম। পুলের দুই-তৃতীয়াংশ শেষে হয়ে গেল। আমার ইচ্ছের প্রতিফলন করতে পারলাম কই? ঘেমে উঠলো সারা গা নিরাশার অমানিশায়। এমন সময় হঠাৎ পুলের পূর্ব পাশ দিয়ে চলার ফুরসত পেলাম। এক পা, দু পা, তিন পা,আর নয়, সিঁড়িতে পা না দিয়ে শুণ্যস্থানে পা দিয়ে শরীর ছেড়ে দিলাম। পড়ে গেলাম পুলের নিচে। যার হাতে আমার হাত বাঁধা রশি ছিল সে আমাকে ধরে রাখতে পারল না। ওরা উপরে কি করছিল তা আমার খেয়াল নেই। আমি ততক্ষনে পুলের নিচে পাকা খাম্বার সাথে দেহটাকে মিলিয়ে আছি। সে মাত্র ক্ষণিকের জন্য পরেই ডুব। এক ডুব, দুই ডুব, তিন ডুব দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ গিয়ে মাথা ভাসিয়ে দেখি ওরা টর্চলাইট দিয়ে আমাকে খুঁজছে। টর্চের আলোটা তীক্ষ্ণ ছিলনা তাই রক্ষা। ওরা পুল পার হয়ে গেল। আমি প্রাণপণে সাঁতরাতে শুরু করলাম। কিন্তু বিপদ যখন আসে একা আসেনা। আমার হাত বাঁধা রশিটা এক হাতে বাঁধাই ছিল। সাঁতরাবার সময় সেটা যে বিপর্যয় আনতে পারে তা আদৌ মনে হয় নি। এতক্ষণে তা ক্রমাগত তা আমার উরু বেষ্টন করে সন্তরন বন্ধ করে দিতে লাগল, এক পা এবং এক পা বন্ধ হয়ে গেল। ওটা ছাড়াবার জন্য চেষ্টা করে আরো পেরেশান হয়ে পড়লাম। তখন আমি চান্দ দিঘীর মাঝখানে অতল জলে। স্রোত নেই; বাঁধা পানি গা এলিয়ে দিলে শরীর ডুবে যায়। এক হাতে আর এক পায়ে সাঁতরে চলেছি। ওরা দেখতে পেলে যেকোন মুহূর্তে গুলি করবে, এই চিন্তায় আরো অস্থির হয়ে পড়লাম। পাক বাহিনীর হাত হতে নিষ্কৃতি পেয়ে এখন বুঝি সলিল সমাধী রচিত হবে। মনে হতে লাগলো মৃত্যু অবধারিত। পাক বাহিনীর গুলি হতে নিষ্কৃতি পেয়েছিলাম, সত্য কিন্তু ওদের রশি থেকে বুঝি মুক্তি নেই। খোলা হাত দুটি আস্তে আস্তে নাড়াতে লাগলাম। খোদার নাম জপতে থাকলাম, নিরুপায় সেই অন্তিম মুহূর্তে। এখনি হয়ত ডুবে যাব চান্দ দিঘীর কাজল জলে।
হঠাৎ একটা কচুরীপানার চাকা হাতে লাগলো। ওরই উপর একটু ভর দিলাম। আমাকে আশ্রয় দিল না, ডুবে গেল। আবার পেলাম আরেকটা চাকা সেখানে ঐ অবস্থা ঘটল। তবও নিঃশ্বাস কাটার অবকাশ পেলাম। এমনিভাবে ক্রমাগত কচুরীপানার উপর ভর রেখে চান্দ দিঘীর পশ্চিমে গিয়ে অবশের মত পড়ে রইলাম। কিন্তু আমাকে পড়ে থাকলে পড়বে কেন? আমি বাঁচতে চাই। ওরা যদি আমাকে খালের ধার দিয়ে খুঁজতে আসে। আমি পাশের পাত ক্ষেতের মধ্যে গড়িয়ে পড়লাম। আমার দাঁড়াবার ক্ষমতা নেই। দু তিন বার চেষ্টা করে দেখলাম দাঁড়াতে পারিনে। শরীর অবশ হয়ে গেছে। দাঁড়াতে গেলে পড়ে যাই। ওরা যেকোন মুহূর্তে আমাকে ধরতে পারে এই ভয়ে আমি আরো অস্থির হয়ে পড়লাম। শেষে হামাগুড়ি দিয়ে অগ্রসর হতে থাকলাম ক্রমাগত দক্ষিণ দিকে। রাস্তা বা ক্ষেতের আইল বাদ দিয়ে শুধু পাট ক্ষেত গুলির মধ্য দিয়ে এগুতে লাগলাম। দু-চার গজ করে যাই আর থেমে শুনি কোথাও কেউ আসছে নাকি। ভেকের ডাকে চমকে উঠি। জীবনের মায়া আর মৃত্যু ভাওয় কতখানি সেদিন হাড়ে হাড়ে উপলব্দি করেছিলাম। হামাগুড়ি দিয়ে পাটক্ষেত গুলির মধ্য দিয়ে এঁকেবেঁকে পৌছালাম গিয়ে মূল্বাড়ী গ্রামে আলহ্বাজ মৌলভী শাহেদ আলী সাহেবের বাড়ীতে। মৌলভী সাহেব আমার ছেলেমেয়েদেরকে ডেকে এনে আমার প্রাণ রক্ষা করলেন। তারপর মৌল্ভী সাহেব আমাকে মুক্ত এলাকায় পাঠিয়ে দেন। এইভাবে আমি পাক সেনাদের হাত থেকে আমি রক্ষা পেলাম।“
স্বাক্ষর/-
ওয়াছিম উদ্দিন।
<৮,২.১.৬৪-৬৫> “পাক সেনারা আমাকে দোস্ত বলতো”
–
শ্রী মনোরঞ্জন দত্ত
গ্রাম- সরিষাবাড়ী
ডাকঘর- সরিষাবাড়ী
থানা- সরিষাবাড়ী
জেলা- ময়মনসিংহ।
“বর্বর পাক ফৌজের অত্যাচারের কাহিনী বাংলার জনসাধারণ চিরদিন ঘৃণার সঙ্গে স্মরণ করবে। মানুষ ক্ষমতা এবং স্বার্থের মোহে কেমন ব্যবহার করতে পারে সেই দৃষ্টান্ত সামনে রেখে- শোষিত, অত্যাচারিত, ভদ্র বাঙ্গালী উদার নৈতিক মনুষ্যত্বের পথকে খুঁজে নেবার সুযোগ পাবে এবং তারা স্বাধীনতার সুবর্ণ স্বাদকে সুমধুর করে উপভোগ করার যোগ্যতা অর্জন করবে।
আমার মনে পড়ে শহীদ আবদুল হামিদ মোক্তার, শহীদ হাসান খান, শহীদ সুরেন দত্ত, শহীদ ধীরেন বাবু এবং সমাজসেবক ওয়াছিম উদ্দিন সাহেব এবং সাব-রেজিষ্টার আবদুল হাই সাহেব ও আমার নিজের অমানুষিক নিপীড়নের ইতিহাস। তখনও থানা পর্যায়ে পশ্চিমা অত্যাচারের কসাইখানা খোলেনি। একদিন আমাদের থানার দারোগা আমাকে এরেস্ট করে জামালপুর হাজতে চালান দিল। অপরাধ আমরা হিন্দু তার উপর ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামীদের সহায়তা করছে- গুরতর অপরাধ সুতরাং শাস্তি মৃত্যুদন্ড। হাজত থেকে আমাকে মিলিটারী ক্যাম্পে চালান দেয়। আমি ভাঙ্গা উর্দু বলতে পারি। পশ্চিমা জল্লাদরা তাই আমাকে মেরে ফেলার আগে আমাকে দিয়ে কিছু কাজ করিয়ে নেবার ফন্দি আঁটলো। আমার আয়ু বাড়িয়ে দিল কয়েকদিন। ওরা আমাকে দোস্ত বলে। আমি কোন ভরসা পাই না- আমার আত্মারাম খাঁচা ছাড়া। আমাকে বলে শুধু আল্লাহকে ডাক, ইত্যাদি আশ্বাস দিয়ে আশ্বস্ত করে এবং দোভাষীর কাজ আদায় করে। যে সমস্ত স্বাধীনতাকামী বাঙ্গালীদের তারা একদিক থেকে হত্যা করার জন্য ফন্দি করেছিল, তাদের জবানবন্দীকে কোন রকমে উর্দু করে বুঝিয়ে দিতে হত আমাকে। দাসত্বের এতটুক স্বাধীনতার কিছু কিছু ভালো আচার ব্যবহার আমি পেতাম আমি। এই করে আমি সুষ্ঠভাবে ভাবনা চিন্তায় সহজ মানসিকতা খুঁজে পাই। কিভাবে মুক্তি পাওয়া যাবে এবং এই মৃত্যু থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে সে কথা মনে মনে সারাক্ষণ ভাবি।
দিন যেতে থাকে। আমি দিনের পর দিন অত্যাচার ও অবিচারের অমানুসিকতা প্রত্যক্ষ করতে থাকি। শিক্ষিত, অশিক্ষিত, আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা নির্বিশেষে সে কি মার, সে কি অত্যাচার- ভাষা দিয়ে সে বর্বরতা প্রকাশ সম্ভব নয়। চড়, ঘুষি, বুটের লাথি, গায়ে জলন্ত সিগারেট গুঁজে দেয়া, উপরে পা বেঁধে মাথা ণীচের দিকে ঝুলিয়ে রাইফেলের বাঁট দিয়ে বেদম প্রহার… সে ইতিহাস নাকে, মুখে রক্ত ঝরার ইতিহাস, বর্বরতার ইতিহাস তার বর্ণনা হয় না।এই অবস্থা দেখে আমার কাণ্ডজ্ঞান লোপ পায়।
অবশেষে একদিন আমাকে ও আরো একজনকে বলল যে, তোমাদের ময়মনসিংহ পাঠানো হবে। আমাদেরকে ট্রাকে উঠতে বলল। ট্রাক চলতে থাকে কিন্তু আমি তখন দেখলাম ট্রাক ময়মনসিংহের পথে না যেয়ে উপস্থিত হল শ্মশানঘাটে। তখন আমার আত্মা উড়ে গেল। স্মৃতির পটে পৃথিবীর আলো, মা, বাবা, জন্মভূমি ভিটে, স্ত্রী, সন্তানের মুখ ছায়ার মত কাঁপতে কাঁপতে ভেসে উঠলো, তারপর দুঃখের যবনিকায় হাবুডুবু খেল সব। সবাইকে লাইনবন্দী করে দাঁড় করানো হল- সামনে ধীরেন বাবু, তার পিছনে আমি নিজে, আমার পিছনে আরো বেশ কয়েকজন। ঠিক ভরা ব্রক্ষ্মপুত্রের তীর বেয়ে লাইনটি। ধীরেন বাবুর বুকের সাথে সংলগ্ন মেশিনগানের নাল। মেশিনগানধারী একজন পাক সৈনিক। প্রভুভক্ত নামধারী হিংস্র জানোয়ার। অর্ধমৃত মানুষগুলো কিছুতেই লাইন সোজা করছে না। বারবার লাইনটি শেষ নিঃশ্বাসের মত এঁকেবেঁকে যাচ্ছে। তখন আমি হঠাৎ করে দুঃসাহসিক চিন্তা করলাম। একটা মতলব করলাম ঝাঁপ দিয়ে কি করে নদীতে পরা যায়। সঙ্গে সঙ্গে বাঁচি কি মরি মেশিনগানের নাল ধরে ধাক্কা দিয়ে বন্দুকধারীকে উল্টিয়ে ফেলে আমি নদীতে ঝাঁপ দিলাম- বেশ কিছুক্ষণ গোলাগুলির শব্দের পর আমি তখন স্রোতের টানে অনেক দূরে চলে গেলাম- আর শব্দ শুনতে পেলাম না। নান্দিনার কাছে এক গ্রামে যেয়ে উঠলাম আমি। দিনে বাড়ীওয়ালার সহায়তায় রাখালের বেশ ধরে জামালপুর-টাঙ্গাইল রোড পার হয়ে সরিষাবাড়ীর দিকে পাড়ি জমালাম আমি। তারপর সরিষাবাড়ী থেকে মেয়ের বেশ ধরেকালীবাড়ী এবং তারপর ভারত সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আমি মুক্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। এই ছিল আমার জীবনের মর্মান্তিক কাহিনী।
স্বাক্ষর/-
শ্রী মনোরঞ্জন দত্ত।
<৮,২.১.৩৩,৬৬>
এম, এ, রশিদ
সার্কেল অফিসার, ভৈরব থানা
ভৈরব, ময়মনসিংহ।
পাক বাহিনী ভৈরবে যে নৃশংস ধ্বংসযজ্ঞচালায় তা এক কথায় অবর্ণনীয়। তারা প্রায় দু’হাজার বাড়ী ও দোকানপাট সম্পূর্ণ ভস্মীভূত করে। ভৈরব বাজারের লক্ষ লক্ষ টাকার মালামাল লুট করে বহু ব্যবসায়ীকে সর্বস্বান্ত করে। তারা ভৈরব থানার নিরীহ সর্বমোট ২৩৭ ব্যক্তিকে হত্যা করে ও ১০৭ ব্যক্তিকে মারাত্মকভাবে আহত করে। তন্মধ্যে স্থানীয় পরিকল্পনা অফিসার জনাব কাজী আব্দুস সামাদকেও অত্যান্ত নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে। উক্ত অফিসার যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তাঁর পরিবারের খোঁজে অফিস থেকে বের হয়ে যাবার পথে পাক বাহিনীর সামনে পড়ে। সে সময় তাঁর কাছে একটা ব্যক্তিগত টেপ রেকর্ডার ছিল। দস্যু সেনারা ওটাকে একটা ওয়ারলেস সেট মনে করে অফিস সংলগ্ন বিলের পাড়ে একটা খোলা মাঠে কোন কথা জিজ্ঞেস না করে গুলি করে হত্যা করে। এমনি ধরনের আরো অজস্র বিবরণ নিরীহ গ্রামবাসীদের হত্যায়ও পাওয়া যায়। স্থানীয় পৌরসভার প্রাক্তন সহ-সভাপতি জনাব মসলন্দ আলীকে তৎকালীন সার্কেল অফিসার (ডেভ) জনাব আমিনুল হক সাহেবের মাধ্যমে লিখিত নির্ভয়ের আশ্বাস প্রেরণ করে পাক বাহিনী সম্ভবতঃ হত্যা করে। আজ পর্যন্ত তার কোন খোঁজ নাই।
একই সঙ্গে আরো কয়েকজন বিশিষ্ট আওয়ামীলীগ নেতা ও কর্মী যথা- জনাব হাফিজ উদ্দিন মিয়া, জনাব মতিউর রহমান, জনাব রইস মিয়া ও আরো অনেককে হত্যা করে। এই ধরনের পৈশাচিক হত্যায় ভৈরবে নেতৃত্বের ক্ষেত্রে সৃষ্টি করেছে।
স্থানীয় নেতৃস্থানীয় লোকদের কেউ কেউ রাজনৈতিক ভিন্ন মত পোষণ করতঃ পাক অফিসারদের নির্দেশে বা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্যে পাক বাহিনীর ধ্বংসমুখী ক্রিয়াকলাপে সহযোগীতা করেছে। রাজাকার নিয়োগ করার ব্যাপারেও তাদের ভূমিকা ছিল অগ্রণী। তবে এসব লোকদের সংখ্যা ছিল অতি নগন্য। বর্তমানে তাদের অনেকেই বেঁচে নেই। মুক্তিবাহিনীর হাতে তাদের অনেককেই প্রাণ হারাতে হয়েছে। বাকীরা কেউ কেউ হারাতে আছে ও কেউ সম্পূর্ণ মনোভাব পাল্টিয়ে স্থানীয় নেতৃবৃন্দের করুণায় টিকে আছে।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে, পাক বাহিনীর ভৈরবে স্থিতিকালে স্থানীয় থানা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রস্থিত সরকারী অফিস সমূহের বহু রেকর্ড ও আসবাবপত্র নষ্ট করে এবং পৌরসভার ক্যাশ রুমের লোহার সিন্দুকটি ভেঙ্গে ১১,০০০ টাকার উপরে লুট করে। ঐ সঙ্গে পৌরসভার বহু আসবাবপত্রও নষ্ট করে। ভৈরব থানার কালিকাপ্রসাদ ও শিমুলকান্দি ইউনিয়নের ইউনিয়ন পরিষদ অফিস, বীজাগার ও সংলগ্ন দাতব্য চিকিৎসালয় সম্পূর্ণরুপে ধ্বংস করে।
স্বাক্ষর/-
এম, এ, রশিদ
৬/১১/৭৩
*এই খণ্ডে ২ নং দলিলের ১ নং অংশের ২৬ নং সাক্ষাৎকারটি নেই।
।। রাজশাহী বিভাগ ।।
<৮,২.২.৩৪,৬৭-৬৮> “বাঙালিরা নারীদের ইজ্জত নষ্ট করেছিলো বলে নাকি সেই মেয়েদের বাঁচাতে হাজার মাইল দূর থেকে পাকিস্তানিরা এসেছিলেন!!”
হত্যা, ধ্বংস ও নির্যাতনের বিবরণ
রাজশাহী বিভাগ
মোঃ আরশাদুজ্জামান (আশু)
দি ইউনিভারসাল রেডিও হাউস
ঘোড়ামারা, রাজশাহী
২৫শে মার্চ শহরে যখন মিলিটারীদের তৎপরতা বেড়ে যায় তখন আমি ভাঙপাড়া গ্রামে কোন এক বন্ধুর বাড়িতে আশ্রয় নেই। পাকিস্তানী বেতার থেকে ঘোষণা করা হলো যে, মালিকবিহীন দোকান পেলে তারা অন্য জনকে দিয়ে দিবে।
তার পরিপ্রেক্ষিতে ২১শে মে আমি রাজশাহীতে চলে আসি এবং ঘোড়ামারায় চাচাতো ভাইয়ের বাসায় উঠি। জুমআর নামাজ পড়ে আসার সময় একজন বাঙ্গালী পশ্চিমাদের দালাল আমাকে দেখে। দেখার পর জিজ্ঞাসাবাদে জানতে পারে যে, আমি বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেছিলাম। এরপর অকস্মাৎ দুজন বর্বর সৈন্য গাড়ীসহ দালালের বাড়ীতে যায়। ইতিপূর্বে সে ফোনে মিলিটারীদের সাথে আলাপ করেছিল। তারপরে আমার ভাইয়ের বাসায় মিলিটারীরা ঢোকে। ঢোকার পরে আমাকে নিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন একজন অধ্যাপক সাহেবের রান্নাঘরে নিয়ে যায়। সেখানে অন্য একজন কাস্টম অফিসের আবদুল ওয়াহেদ নামের একজন লোককে দেখতে পাই নামাজ পড়া অবস্থায়। তাকে (ওয়াহেদ সাহেবকে) নানা জিজ্ঞাসাবাদ করায় বাইরে পাহারারত একজন মিলিটারী এসে আমাকে নির্মম্ভাবে বুটের লাথি মারে এবং জৈনক সৈন্য বলে, “আপছমে কৈ বাত কারনে নেহী হোগা”।
তারপরে বেলা তিনটের সময় নওয়াবগঞ্জ কলেজের সহ-অধ্যক্ষ মোনামুল হক সাহেবকে মোটা শিকল দ্বারা দু’হাত বেঁধে নিয়ে আসে। তার কিছুক্ষণ পর কানে বালিওয়ালা লম্বা পাতলা মত একজন মিলিটারী আসে। হাতে কাঠের রোলার দরজা বন্ধ করে উর্দুতে বলে যে, “ত্তুম নবাবগঞ্জ কলেজ কা ভাইস প্রিন্সিপাল হ্যায়?” বলে প্রহার আরম্ভ করে। তারপর আমাকে জিজ্ঞাসা করে যে, আমি নাকি বিহারীগণকে হত্যা করেছি, নারীর ইজ্জত নষ্ট করেছি, সেই জন্য তারা দুই হাজার মাইল দূর থেকে এসেছে। তারপর কাথের রোলার দিয়ে প্রহার করে, লাথি মারে।
রাত আটটার পরে কাষ্টম অফিসের জনার ওয়াহেদ সাহেবকে বের করে অন্য ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। তার পরে আমাকে ঐ একই ঘরে রাখে এবং জিজ্ঞাসা করে জানতে চায় কাকে ভোট দিয়েছিলাম। উত্তরে আমি বলেছিলাম যে, আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছিলাম। প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে ক্যাপ্টেন জাফর। তারপরে হিংস্র পশুর মত আমাকে প্রহার করে। প্রহারের দরুন মাটিতে পড়ে যাই। তারপরে জিজ্ঞাসা করে যে, আমি বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছিলাম কিনা। আমি সম্মতি জানাই। তারপরে উক্ত ঘরে নিয়ে রাখা হয়।
পরের দিন সকালে মাটিতে একটি রুটি ও এক কাপ চা তিনজনকে খেতে দেয়া হয়। শরীরে অসুস্থতার জন্য দু’জন চা পান করছিল না বলে বর্বর সৈন্যরা লাথি মারে বেপরোয়াভাবে।
৯ টার দিকে আমাকে দিয়ে সৈন্যদের ব্যবহৃত ড্রেন, থালা বাসন, উঠান পরিষ্কার করে নেয়। বেলা তিনটার দিকে আমাকে ও ওয়াহেদ সাহেবের পিছনে হাত বেঁধে খাড়া অবস্থায় প্রায় এক ঘন্টা সময় রাখা হয়। তার পরে ক্যাপ্টেন জাফর উপর থেকে নিচে নেমে আসে। মান ধরে বলে, “তুমহারা নাম আশু হ্যায়, তুম রেডিও কা কাম জানতা হ্যায়?” উত্তরে আমি সম্মতি প্রকাশ করি। জাফর হাত খুলে দেয় এবং পরে নিয়ে যায় তার একটি রেডিওগ্রাম দেখতে বলে। দেখার পর আমি বলি উক্ত রেডিওর কোন যন্ত্রপাতি না হলে দেখা সম্ভব নয়। পরে আমাকে নিচে নামিয়ে হাত বাঁধা অবস্থায় রাখা হয়। কিছুক্ষন পরে আমাকে জিপে উঠান হয়। পরে জোহা হলের দিকে নিয়ে যায়। গাড়ি থেকে নামিয়ে হলের গেটেই সোজা করে দাঁড় করানো হয়। দাঁড় করানোর পর অনিবার্য মৃত্যু জেনে আমি ওয়াহেদ সাহেবের সাথে শেষ আলাপ করতে প্রয়াসী হই এবং প্রাণভরে বাংলাদেশকে দেখে নেই। ক্যাপ্টেন ইলিয়াসকে জাফর পরিচয় করিয়ে দেয় যে ওয়াহেদ সাহেবের মেয়ে জয় বাংলার গান গেয়েছে এবং আমি বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছি। তখন ইলিয়াস ক্যাপ্টেন জাফরের সাথে দূরে আলাপে বলে যে, বাংলাদেশের পতাকা, বাংলাদেশের সর্বত্রই উড়ানো হয়েছিল। তারপর ক্যাপ্টেন ইলিয়াস আমাকে ছেড়ে দেয় এবং ওয়াহেদ সাহেবকে উপরের তলায় নিয়ে যায়।
১৫ই আগস্ট (১৯৭১) পর্যন্ত আমি স্বগৃহে অবস্থান করি। রাত দু’টায় একটি পুলিশ জীপ এবং সঙ্গে ডি,এস,পি নাছিম সাহেব দরজায় ধাক্কা মারে। পুলিশদের নির্দেশ দেয় বাড়িটিকে ঘেরাও করার জন্য। তারপরে দরজার কাছে আমি আসি। আমার নাম জিজ্ঞেস করে। নাম জিজ্ঞেস করায় কিছুক্ষণ মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। তারপর ডাক নাম জিজ্ঞেস করে। উত্তরে জানাই যে, ডাক নাম “আশু”। অতঃপর আমাকে গাড়িতে কিছুক্ষণ রাখার পর আরও দু’জন, যথাক্রমে আব্দুর রশিদ ও আব্দুর রাজ্জাক সাহেবকে গ্রেপ্তার করে জীপে তুলে দেয়।
থানায় কিছুক্ষণ গাড়িতেই রাখার পর গাড়ি জোহা হলে নিয়ে যাওয়া হয়। এবং তিন তলায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে প্রায় অপরাপর ত্রিশজন বন্দীকে দেখতে পাই।
ভোরবেলা তিনজনকে ৩৪০ নং কোঠায় নিয়ে রাখা হয়। সেখানে ইউনুছ মিয়াকে দেখতে পাই। তিনি সেখানে প্রায় অর্ধপাগল অবস্থায় ছিলেন। আমাকে চেনার পর ইউনুছ সাহেব আমাকে পাঁচটি টাকা দিয়ে বলেছিলেন যে, সৈন্যরাতো জীবন শেষই করবে, আপনি যদি ছাড়া পান তবে টাকাগুলি গরীবদের দিয়ে দিবেন।
পরে বেলা ৯ টার দিকে মেজর সাহেবের কাছে নিয়ে যাওয়া হয় এবং জিজ্ঞাসা করে যে, আমাদের পেশা ও নাম কি? পরে ৩৪০ নং কোঠায় নিয়ে যায়। নিয়ে যাবার সময় ঘর খুলে দেখানো হয়। ঐ ঘরগুলির মধ্যে ছাত্র গোছের কতকগুলি যুবককে ঝুলন্ত অবস্থায় উলঙ্গ করে রাখা হয়েছিল। আশেপাশে ভাঙা হকিস্টিক, বাঁশের লাঠি ইত্যাদি ভাঙা অবস্থায় পড়েছিল। আমাদেরকে বলা হয়েছিল সত্য কথা না বললে আমাদের পরিণতিও ঐ একইরূপ হবে।
এক থালাতে চারজনকে এমনকি সময় সময় মেঝেতে পচা, দুর্গন্ধময়, ভাত খেতে দিত। তাও প্রায় ২৪ ঘণ্টা পরে।
৩৪০ নং কোঠার পাশ্বে একটি সেন্ট্রী রুম ছিল। সেখানে তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করত যার কিছু কিছু মাঝে মাঝে শোনা যেত।
একদিন আমাকে জোর করে বিভিন্ন রুমের বন্দীদের নাম ইংরেজীতে লেখার জন্য নিয়ে যায়। ৩৪০ এর কয়েকটি রুম পরে একটি রুমের মাঝে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে বিকৃত অবস্থায় দেখতে পাই। তাদের গায়ের চামড়া ছিল না, মাঝে মাঝে কাটা দাগ ছিল।
২৭শে আগস্ট হল থেকে আমাদের থানায় পাঠানো হয়। থানায় পাঁচদিন থাকার পর ইনকোয়ারী হয়। পরে আমাকে মুক্তি দেয়।
স্বাক্ষর/-
মোঃ আরশাদুজ্জামান (আশু)
১৯/০৮/১৯৭২
<৮,২.২.৩৫,৬৯> “যে সমস্ত নারী তাদের বেশী ভাল লাগতো তাদেরকে ক্যাম্প পর্যন্ত নিয়ে যেত।“
৩৫
মোঃ আব্দুস সামাদ
গ্রাম- নওহাটা
থানা- পবা
জেলা- রাজশাহী
১৯৭১ সালের ২৬শে মে তারিখ পাকবাহিনী নওহাটা হয়ে নওগাঁ যাওয়ার পথে অপারেশন করে যায়। নওহাটায় তারা তিনজন লোককে হত্যা করে অগ্নিসংযোগ করে দেয়। এই খান সেনারা নওহাটা বাজারের সমস্ত দোকান লুটপাট করে অগ্নিসংযোগ করে দেয়। তারপর যে সমস্ত স্থানীয় লোককে ধরে ছিল তাদের কে দিয়ে নদী পার হয়ে যাবার জন্য নৌকা গোছিয়ে নেয় এবং যাতে গাড়ি পার করে নিয়ে যেতে পারে তার সমস্ত ব্যবস্থা করে নেয়।
এরপর প্রায় দিনই তারা রাজশাহী টাউন থেকে হঠাৎ হঠাৎ এসে বাজারে যে সমস্ত লোক পেত, তাদেরকে মারপিট করে টাকা-পয়সা কেড়ে নিত এবং তা দিতে অস্বীকার করলে হত্যা করত এবং সেই সঙ্গে নারীদেরও গ্রাম থেকে ধরে নিয়ে এসে তাদের প্রতি পাশবিক অত্যাচার করে কাউকে ছেড়ে যেত এবং যে সমস্ত নারী তাদের বেশী ভাল লাগতো তাদেরকে ক্যাম্প পর্যন্ত নিয়ে যেত।
বিভিন্ন পথযাত্রীদের কাছ থেকে তাদের নগদ টাকা-পয়সা কেড়ে নিয়ে তারপর মারপিট করে ছেড়ে দিত। স্থানীয় লোকেরা তাদের অত্যাচারে অতিষ্ট হলে সকলে যুক্তি করে খান সেনাদের অল্পসংখ্যক আসলে তাদের একজনকে ধরে মাথা ফাটিয়ে দেয়। ইহার পর কিছুদিন নওহাটা বাজারের লুটপাট বন্ধ থাকে। কিন্তু ইহার অল্পদিন পরে আবার এক খান সেনার দল এসে উক্ত ব্যক্তিকে এবং তার সঙ্গে আরো কয়েকজনকে ধরে একত্র করে বেঁধে বেদম প্রহার করার পর গুলি করে হত্যা করে।
উক্ত ঘটনার পর তাদের লুটপাট বন্ধ থাকে কিন্তু তাদের অন্যান্য অত্যাচার বেড়ে যায়। তারা প্রায়ই মাঝে মাঝে রাতে আসতো এবং স্থানীয় লোক ধরে নিয়ে তাদের মাথায় গুলির বাক্স ও বিভিন্ন মালামাল বহন করে নিয়ে যাওয়ার জন্য ব্যবহার করত। রাতের অন্ধকারে বিভিন্ন গ্রাম ঘেরাও করে নিরীহ জনগণকে হত্যা করত, তাদেরকে মারপিট করত এবং তাদের মালামাল লুটপাট করত।
এইভাবে তারা বিভিন্ন জায়গায় প্রায় ২০০ লোককে হত্যা করে তাদের রাজত্বকে কায়েম রেখেছিল।
স্বাক্ষর/-
মোঃ আব্দুস সামাদ
<৮,২.২.৩৬,৭০-৭১> “লোকজনের উপর অত্যাচারের জন্য একটি স্কোয়াড থাকতো যাদের কালো ব্যাজ থাকতো।“
“নদীর অপর পাড়ে সকল গ্রামে তখন এমন কোন বাড়ি ছিলনা যে বাড়ির মেয়ে ধর্ষিত হয়নি। পাক সেনাদের চাইতে রাজাকার, আল বদর এরাই বেশি অত্যাচার চালিয়েছে। দালালরা এবং তাদের সহযোগীরা গ্রামকে লুট করেছে, ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে।“
৩৬
বীরেন্দ্র কৃষ্ণ রায়
রাণীবাজার, ঘোড়ামারা
জেলা- রাজশাহী
“জুন মাসের ১৩ তারিখে পাক দালালরা ষড়যন্ত্রমূলক আমার শ্বশুরবাড়ির একস্থানে গুলিসহ চাইনিজ রাইফেল রেখে ঐ রাতে তারা আমাদের সাথে নিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে রাইফেল তোলে। তখন আমাকে আমার দুই ছেলে, আমার সম্বন্ধী ক্ষীতিশচন্দ্র রায় ও নিরোদ কুমারকে থানাতে নিয়ে যায়। ওদের ধারণা ছিল আমাদের কাছে প্রচুর টাকা-পয়সা, সোনা আছে। বন্দী করে সেগুলো আদায় করার পরে হত্যা করবে।
রাত ১-১.৩০ দিকে আমাদের থানাতে নিয়ে যায় স্টেটমেন্ট নিবে বলে। আমাদের পাঁচজনকে চালাকি করে হাজতখানায় বন্দী করে। সারারাত কিছু খেতে দেয়নি। তার পরদিনও না। বিকালে আমার বাড়ি থেকে কিছু খাবার নিয়ে আসে। ঐদিন শেষ রাতের দিকে আমার স্ত্রী দারোগাকে বহু অনুরোধ উপরোধ করে গায়ের সমস্ত গয়না খুলে দিয়ে নগদ কয়েকশত টাকা দিয়ে বলল যেন সামরিক আইনে তার ভাই, স্বামী, ছেলেকে না দেয়। দারোগাকে টাকা ঘুষ দিলে আমাদের সবাইকে হাজত থেকে বাইরে এনে রাখার ব্যবস্থা করেছিল। হঠাৎ করে একদিন আবার হাজতে পুরতে বলে। আমার দুই ছেলে আমার সাথে কান কথা না বলে পাশের নদীতে ঝাপ দেয় বাঁচবার জন্য। পিছু পিছু পুলিশ ছুটে। ওদের চিৎকারে গ্রামের লোকজন ধরে ফেলে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। থানায় নিয়ে এসে অকথ্য অত্যাচার চালায় আমার দুই ছেলের উপর। একজন কৃষক সে আমার ছেলেদের ধরেনি বলে পুলিশ তাকে থানায় ধরে এনে ভীষণভাবে মারধর করে। এখনই ছেলেদেরকে হত্যা করবে কিন্তু টাকার বিনিময়ে নিরস্ত হয়। চার্জশীটের মধ্যেও পালানোর কথা উল্লেখ করেনি।
১৫ই জুন আমাদের সবাইকে নাটোর চালান দেয়। হাশেম দারোগা চাইনিজ রাইফেল সহ চললো। টাকা পয়সা নেয়া সত্ত্বেও আমাদের হাঁটিয়ে নিয়ে যায়। পথে পাক বাহিনীর সাথে দেখা হলেই সালাম আলায়কুম জানিয়ে বলে, “দেখিয়ে কেয়া চীজ লেআয়া হ্যায়”। দারোগা বারবার আমাদের দেখিয়ে দেয় মুক্তিফৌজ হিসেবে। থানার ওসি হাশেমকে নিষেধ করেছিল অস্ত্র ঐভাবে খোলা নিয়ে যেতে কিন্তু হাশেম দারোগা তা শোনেনি।
নাটোর কোর্টে নিয়ে যাচ্ছে এমন সময় ইন্সপেক্টর (পুলিশ) জাফর সাহেবের সাথে আমাদের দেখা। জাফর সাহেব আমার ছেলের এবং ছেলের শালার বিশেষ বন্ধু ছিল। সে দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে হাশেমকে। সামরিক কোর্টে নিয়ে যেতে বলে উনি জামাকাপড় পরে তাড়াতাড়ি কোর্টে আসেন। সামরিক কোর্টের সামনের মাঠে আমাদের বসিয়ে রাখে। পাকসেনারা আসে, নাম শোনে আর সবাইকে লাথি চড় মেরে চলে যায়। সামরিক কোর্টে ক্যাপ্টেন ও মেজর আসেন। আমরা ২৫ গজ মত দূরে বসে। চাইনিজ রাইফেলের কথা শোনার সাথে সাথে ক্যাপ্টেন খতম করার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু পুলিশ ইন্সপেক্টর অনুরোধ করে একটি ইনকোয়ারী করার জন্য কারণ ওরা ভালোমানুষ। মেজর বলেন, কেমন করে চিনলে ওদের? ঐ থানাতে আমি থানা ইনচার্জ ছিলাম বহুদিন, ইন্সপেক্টর বলেন। মেজর আমাদের ডাকেন। আমাদের বক্তব্য আমরা বলি। মেজর সব শুনে কোর্টে পাঠাতে বলে ইনকোয়ারীর ভার দিলেন।
এসডিও জেলহাজতে পাঠিয়ে দিলেন। সামান্য একটু ঘরে আমাদের রাখলো। আমরা ৩০/৩৫ জন ছিলাম, শোয়াতো চিন্তা করা যায় না, ভালো করে বসারও উপায় ছিল না। জেল ওয়ার্ডার মোজাফফর খাঁ (বিহারী) বাঁশের লাঠি দিয়ে বেদম প্রহার করে। বাইরে এম,পি (মিলিটারি পুলিশ) ছিল সেও রাইফেলের বাঁট দিয়ে মারতে লাগলো। আমাদের মধ্যে কয়েকজন কয়েদি ছিল যারা স্বাধীনতার প্রথম ক্ষণে জেল ভেঙে পালিয়েছিল। তাদের উপর অমানুষিক অত্যাচার চালায়। চিৎ করে শুইয়ে দুই হাতে লাঠি তুলে শরীরে যত শক্তি আছে তা দিয়ে ঘন ঘন আঘাত করতে থাকে।
সারারাত শুনলাম মানুষের অসহ্য যন্ত্রণার চিৎকার। আমার মত এমনি বহু অধ্যাপক, ছাত্র, অ্যাডভোকেট ইত্যাদিকে সারারাত ধরে নির্যাতন চালায়। কান্না, চিৎকারে জেল প্রকম্পিত হচ্ছিলো। পাক সেনারা মারতো আর হাসতো। লোকজনের উপর অত্যাচারের জন্য একটি স্কোয়াড থাকতো যাদের কালো ব্যাজ থাকতো। জেল ওয়ার্ডার হরমুজ আমাদের উপর অত্যাচার চালাতে থাকে। ১৬/১৭ই জুন আমাদের ১৬ জনকে একসাথে রাজশাহী সেন্ট্রাল জেলে পাঠিয়ে দেয়।
রাজশাহী জেলে বহু রকমের লোকদের দেখলাম। যাদের আনতো তাদের অধিকাংশ কারো চোখ নাই, কারো হাত পা ভাঙা। বিশেষ করে পাক সেনারা যাদের পাঠাতো তারা প্রায় মৃত বা অর্ধমৃত হয়ে আসতো। জেলে যাদেরকে দেখেছি বেশীর ভাগ শান্তি কমিটির লোকেরাই ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলো। একজন কৃষক কয়েদীর সাথে আলাপ করলাম। সে এসেছিল শহরে জমি বিক্রি করতে। মহুরির সাথে বাজারে বেড়িয়েছে এমন সময় কিছু লোক কৃষকটিকে জোর করে এক বাড়িতে নিয়ে গিয়ে বলে, “তোর ছেলে মুক্তিফৌজ”। সে বলে, “আমার বড় ছেলেই নেই”। তারপর মারধর করে জেলে পাঠিয়ে দেয়।
আমাদের কেস ইনকোয়ারীর জন্য ইন্সপেক্টর গ্রামে যান এবং আমাদের পক্ষে রিপোর্ট দেন। বর্তমান বরিশাল এসপি গোলাম মোর্শেদ তখন রাজশাহী এসপি ছিলেন। তিনি আমাদের ধরিয়ে দেবার জন্য এএসআই হাশেমকে প্রমোশন দিয়ে থানার ওসি করে দেন। নাটোর শান্তি কমিটি জাফর ইন্সপেক্টরের বিরুদ্ধে পাকসেনাদের কাছে অভিযোগ করে। জাফর সাহেবের চাকরি যাবার মত। বহু টাকার বিনিময়ে আইনুদ্দিনের (এম,এন,এ মুসলিম লীগ) তদবিরে আমাদের জামিন হয় ২৮শে সেপ্টেম্বর। পরে ইন্সপেক্টর আবার ইনকোয়ারী করে নভেম্বর মাসে আমাদের বিরুদ্ধে কিছু না পেয়ে মুক্তি দেয়। আমরা আবার গ্রামে চলে যায় (গালিমপুর)। আমাদের বাড়ি জামাতে ইসলামীর সভাপতি দখল করে নেয়, সমস্ত কিছু লুট করে রাজাকারের ক্যাম্প করে। আর একটি কক্ষে জামাতে ইসলামীর সভাপতি থাকতো। আমরা আবার গ্রাম থেকে গ্রামে পালিয়ে বেড়াতে লাগলাম।
ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে পাকসেনারা আবার আমাদের গ্রামে হামলা চালায়। সমস্ত গ্রাম লুট করে বহু জনকে ভীষণভাবে মারধর করে, কিছু লোকজনকে হত্যা করে। আমাদের সব লুটে নেয়।
তারপর দেশ মুক্ত হয়। মালঞ্চ এবং নদীর অপর পাড়ে সকল গ্রামে তখন এমন কোন বাড়ি ছিলনা যে বাড়ির মেয়ে ধর্ষিত হয়নি। পাক সেনাদের চাইতে রাজাকার, আল বদর এরাই বেশি অত্যাচার চালিয়েছে। দালালরা এবং তাদের সহযোগীরা গ্রামকে লুট করেছে, ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে।
ডিসেম্বরে যুদ্ধ বাঁধলে আমরা সবাই উল্লসিত হয়ে উঠি। একদিন গোলাগুলির শব্দ না পেলে আমাদের মন খারাপ হয়ে যেত।
১৬ই ডিসেম্বর যখন শুনলাম পাক বর্বর বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে তখন সেই রাতে আমার এই বৃদ্ধ বয়সে সারা গ্রাম হেঁকে বেড়াই পাক সেনারা আত্মসমর্পণ করেছে। মানুষজন গ্রামকে মাতিয়ে তোলে। স্বাধীনতার আনন্দে সবাই “জয় বাংলা” ধ্বনিতে গ্রামকে মুখরিত করে তোলে।
স্বাক্ষর/-
বীরেন্দ্র কৃষ্ণ রায়
৩০/০৮/১৯৭৩
<৮,২.২.৩৭,৭২> “পা কেটে কষ্ট দিয়ে না মেরে গুলি করে কেন মার না। উত্তরে জানায়, গুলি করে মারা হয়না, রাম দা দিয়ে জবাই করে মারা হয়।“
৩৭
সালু মিয়া
থানা- সদর
জেলা- রাজশাহী
জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের দিকে সাহেব বাজারের নিজস্ব দোকান থেকে জনৈক বিহারীর ইঙ্গিতে আমাকে গ্রেফতার করে বোয়ালিয়া থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। পরের দিন বিকাল পর্যন্ত থানাতেই বন্দী ছিলাম। তারপর ডিএসপি নাছিম সাহেব জিজ্ঞাসাবাদ করেন যে আপনি কয়টা বিহারী মেরেছেন; ভোট কাকে দিয়েছেন। তারপর মিলিটারী গাড়ি করে জোহা হলে নিয়ে যায়। ৭ দিন সেখানে বন্দী থাকাকালে আমাকে দিয়ে মাটি কাটিয়ে নিয়েছে এবং ত্রিপলাদি শুকিয়ে নিয়েছে। সেখানে ৭-৮ জনকে একই থালায় বসিয়ে দুর্গন্ধযুক্ত অপর্যাপ্ত ভাত দেওয়া হতো। ডাল হিসাবে শুধু পানি, লবণ, হলুদ দিয়ে সিদ্ধ করে দেওয়া হতো। আর কোন তরকারি থাকতো না।
৭-৮ দিন পরে আবার আমাকে থানায় নিয়ে আসে। সেখানে আমাকে ১৯ দিন রাখা হয়। প্রথমে ক্ষমা ঘোষণার পর বন্দী সকলেই ছাড়া পেলেও আমি এবং আর একজন অধ্যাপক ছাড়া পাননি। একদিন সিকিউরিটি অফিসার আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন এবং বলেন তোমাকে ইন্ডিয়ায় দেখেছি। না উত্তর দেওয়ায় প্রহার শুরু করে। অতঃপর ডিএসপি নাছিম সাহেব এসে সিকিউরিটি অফিসারকে জানান যে আমাকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে। অতঃপর আমাকে ছেড়ে দেয়।
এর ১৬-১৭ দিন পর এক রবিবার রাত দুইটার সময় আমাকে বাড়ি থেকে ধরে জোহা হলে বন্দী করে রাখে। সকালের মধ্যেই রাজশাহী ন্যাপ প্রধান আতাউর রহমানসহ বহুজনকে বন্দী করে নিয়ে যায়। সেখানে তাদের সবাইকে দিয়ে ঘাস কাটিয়ে নিয়েছে। এর মধ্যে রোজা এসে যায়। সময় মতো তাদের কোন খাবার দেওয়া হতো না। কোন কোন দিন সেহেরীও দেওয়া হতো না।
পহেলা রমজান রাত ১১টায় আমার রুম থেকে দুইজন, ন্যাপ প্রধানের রুম থেকে একজন, পাশের রুম থেকে তিনজনকে, আর এক রুম থেকে সাহেব বাজারের কেতু মিয়াকে হাত ও কালো কাপড় দিয়ে চোখ বাঁধা অবস্থায় নিয়ে যায়। পরদিন সকালে ঔৎসুক্যের বশবর্তী হয়ে জনৈক সেন্ট্রিকে জিজ্ঞাসা করি যে রাতে ছেড়ে দিলে তারা কোথায় গেছে। তখন উত্তর দেয় যে তাদেরকে বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে। আমি আবার জিজ্ঞাসা করি হাত, পা কেটে কষ্ট দিয়ে না মেরে গুলি করে কেন মার না। উত্তরে জানায়, গুলি করে মারা হয়না, রাম দা দিয়ে জবাই করে মারা হয়। আমি আবার জিজ্ঞাসা করি রাতে যারাই বেরুবেন তাদেরই কি মারা হবে? উত্তর পাই রাত ১১টার পর যারা বেরুবে তাদের সবাইকেই বাংলাদেশে পাঠানো হয়। এর ৪-৫ দিন পর থেকে প্রায় প্রত্যহ রাতে ৭-৮ জন করে লোক উধাও হয়ে যেতো।
২৬-২৭ দিন পর একদিন বেলা দেড়টার সময় আমাকে ছেড়ে দেয়। আসার আগে আমি আমার কাছের দশটি টাকা অন্যান্য বন্দিদের ইফতারি কেনার জন্য দিয়ে আসি। কারণ সেখানে কোন ইফতারি দেওয়া হতো না।
ছেড়ে দেয়ার দুইদিন পর পুলিশ আবার আমাকে খোঁজাখুঁজি করে এবং গ্রেফতার করে জোহা হলে মেজরের নিকট নিয়ে যায়। জিজ্ঞাসাবাদে মেজর আমাকে বলেন, “উপার যায়েগা না ঘার যায়েগা”? শেষ অবধি আমাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
জোহা হলে বন্দী থাকা অবস্থায় সারাদিন প্রশ্রাব করতে দেওয়া হতো না। তাই বাধ্য হয়ে আমি নিজের জুতার মধ্যে প্রশ্রাব করে তিন তালা থেকে ফেলতাম। পৌর এলাকার ১ নং ওয়ার্ডের ৯৮ জন ধৃত ব্যক্তির মধ্যে আমিই শুধু বেঁচে আছি।
স্বাক্ষর/-
সালু মিয়া
<৮,২.২.৩৮,৭৩-৭৪> “দুপুরে কোন রকম তারকারি ও প্লেট ছাড়াই মাটিতে লবন দিয়ে কিছু ভাত দেওয়া হয় এবং বলা হয় “তুমলোক বাঙ্গালী হ্যায়, চাউল খাও”।“
৩৮
মোঃ আবুল ওয়াহেদ
গ্রাম- সুলতানাবাদ (বেলদার পাড়া)
ঘোড়ামাড়া, রাজশাহী
২৫শে মার্চের পরে রাজশাহী শহরকে পাক বাহিনী তাদের আয়ত্তে আনে। বাংলাদেশের স্বপক্ষের বিশেষ করে আওয়ামী লীগের কর্মীবৃন্দকে খুজতে থাকে এবং ধরে নির্দয়ভাবে হত্যা করে। এপ্রিলের প্রথম দিকে বেলদার পাড়ার দুজন যুবক যথাক্রমে বাদল ও অন্যজনকে প্রকাশ্য দিবালোকে রাস্তার উপরে গুলি করে হত্যা করে।
বর্বর সৈন্যদের এলোপাতাড়ি গোলাগোলির আওয়াজে গ্রামবাসী প্রাণের ভয়ে বাড়ি-ঘর ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। আমি এপ্রিল মাসের ১২ তারিখে মা সহ ভারতে আশ্রয় নেই এবং জুন মাসের ১ তারিখে স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদেরকে নেবার জন্য বেলদার পাড়ায় আসি।
৩ দিন পর পাক বাহিনী রাত ৯টার সময় বাড়ি ঘেরাও করে আমাকে গ্রেফতার করে। অবশ্য শান্তি কমিটির দালালদের কুপ্ররোচনায়। গ্রেফতার করার সময় বাড়ির চারিদিকে এবং ছাদের উপর থেকে গোলাগোলি করে এক বিভীষিকাময় পরিবেশের সৃষ্টি করে। গ্রেফতার করার পর অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে। পরে গুলি করার জন্য আমাকে লাইনে দাঁড় করায়। কয়েকজন সৈন্যের উদারতার জন্য গুলি করতে বিরত হয় কিন্তু শারীরিক নির্যাতন চালায়। অতঃপর আমাকে জিপে করে হাত বাঁধা অবস্থায় স্থানীয় সার্কিট হাউজে নিয়ে যায়। সেখানে অন্ধকারময় বন্ধ ঘরে পিছনে হাত বাঁধা অবস্থায় দেয়ালের দিকে মুখ করিয়ে সারারাত দাঁড় করিয়ে রাখে। এবং যাতে বসতে না পারি তার জন্য সামরিক বাহিনীর লোকেরা কড়া পাহারা দিতে থাকে। সকালের দিকে এক কাপ চা ও একখানা রুটি খেতে দেয়। ঐ সার্কিট হাউজেই বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন ছাত্রকে বন্দী অবস্থায় দেখতে পাই। তাদের উপরে বর্ণনাতীত শারীরিক নির্যাতন চালায়।
নির্যাতনের এক পর্যায়ে জনৈক পদস্থ কর্মচারী ছাত্রদ্বয়কে চাকু লাগাতে নির্দেশ দেয়। কিম্ভূতকিমাকার বিশাল বপু বিশিষ্ট একজন সৈন্য অফিসারের নির্দেশের মর্মানুযায়ী তাদের পেটে কুকুরের মতো কামড়িয়ে মাংস ধরে টানাটানি করতে থাকে। ছত্রদ্বয় আর্তচিৎকার করতে থাকে। তিনজনই পূর্বপরিচিত হলেও কেউ কাউকে পরিচয় দেবো না বলে একমত হই।
পরের দিন আমিসহ দু’জন ছাত্রকে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টাফ কোয়ার্টার ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। নিয়ে যাবার পর ক্যাম্পের খোলা আঙ্গিনায় আমাদের গায়ের জামা খোলার নির্দেশ দেওয়া হয়। জামা খোলা হলে ১০/১২ জন বর্বর সৈন্য বেত, চাবুক দ্বারা এলোপাতাড়িভাবে প্রহার শুরু করে। রক্তাক্ত অবস্থায় যতক্ষণ না তারা অজ্ঞান হয় ততক্ষণ ঐ অবস্থা চালাতে থাকে। অতঃপর পা ধরে টেনে পাশের একটি ছোট কোঠায় পাশাপাশি রেখে দেয়। কিছুক্ষণ পর ছাত্রদের মধ্যের একজনকে যিনি বেশ স্বাস্থ্যবান ছিলেন তাকে পুনরায় টেনে আঙ্গিনায় নিয়ে যায় এবং পায়ে দড়ি বেঁধে উল্টোভাবে রডের সাথে টাঙ্গিয়ে দেয়। “তুমলোক লিডায় হ্যায়” বলে চাবুক দিয়ে মারতে শুরু করে। তার শরীর দিয়ে দর দর করে বিগলিত ধারায় রক্ত গড়াতে থাকে। অত্যাচারের এক পর্যায়ে হঠাৎ ছেলেটির পায়ের দড়ি ছিঁড়ে পড়ে যায়। তখন তারা সাময়িকভাবে অত্যাচার বন্ধ করে দেয়। অজ্ঞান অবস্থাতেই পুর্বোক্ত ঘরে পুর্বোক্ত পদ্ধতিতে রেখে দেয়া হয়।
সারা দিন ও রাত অভুক্ত অবস্থায় রেখে দেয়া হয়। পরদিন সকালে শুধু এক কাপ চা পান করতে দেয়। তারপর এক এক করে পাশের ঘরে সিকিউরিটি অফিসার সেলিমের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি প্রথমবারের মত বিবৃতি নিলেন। বিবৃতি নেয়ার মাঝে মাঝে অফিসারটি নিজের হাতে গ্লাভস পরে এলোপাতাড়ি ঘুষি মারতে থাকে। এর ফলে মাটিতে পড়ে গেলে বুট দিয়ে শরীরে চড়ে নির্যাতন করতে থাকে। এবং জ্বলন্ত সিগারেট শরীরের বিভিন্ন স্থানে ঠেসে ধরে। বলাবাহুল্য, অত্যাচার করে তারা পাশবিক আনন্দ উপভোগ করে। এবং নিজেদের খুশিমতো বিবৃতি তৈরী করে। বিবৃতি নেবার পর পুর্বোক্ত ঘরে আবার বন্দী করে রাখে এবং দুপুরে কোন রকম তারকারি ও প্লেট ছাড়াই মাটিতে লবন দিয়ে কিছু ভাত দেওয়া হয় এবং বলা হয় “তুমলোক বাঙ্গালী হ্যায়, চাউল খাও”।
পরের দিন সকাল আটটায় জিপে করে উক্ত সিকিউরিটি অফিসারের তত্ত্বাবধানে তিনজনকেই জুবেরী হাউসের দোতলার একটি কক্ষে রাখা হয়। এবং সেখানে কড়া সামরিক পাহারা ছিল। সেখানে পাশের কক্ষে একজন পুলিশ ইন্সপেক্টর একজন দারোগাসহ ১০/১২ জন পুলিশের লোক ইউনিফর্মসহ বন্দী ছিলেন। এদের অনেকেই আমার পরিচিত ছিলেন। আমাদের কক্ষে একজন ইউসি চেয়ারম্যানসহ আরো ৬/৭ জন সাধারণ মানুষ ছিলেন। সেখানে তিনদিন থাকাকালে কোন শারীরিক নির্যাতন করা না হলেও অপমানজনক অশ্লীল ভাষায় গালাগালি করে। যেমনঃ- “তুমলোক গাদ্দার হ্যায়, তুমলোক বেইমান হ্যায়, তুমলোক হিন্দু হ্যায়।”
ঐ তিনদিনের এক রাতে আমাকেসহ আরো দুজনের (উপরোক্ত ছাত্রদ্বয় নন) নাম ডেকে দোতলা থেকে নামিয়ে আনে এবং সাহসে ভর করে আমি তাদের জিজ্ঞাসা করেছিলাম, “হাম লোগকো কাঁহা লেয়ে যায়েংগে?” তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, “তুমলোক কালমা পড়নে পড়নে চলো, তুমলোগকো খতম করেগা।”
নীচে আসার পর সাথী দুজনের নাম ধাম জিজ্ঞাসাবাদের পর দু’জনকে নিরুদ্দেশের পথে নিয়ে যাওয়া হয়। এবং সম্ভবত তাদেরকে হত্যা করা হয়। পুনরায় বিবৃতি নেওয়া হবে এই উক্তির প্রেক্ষিতে আমাকে ফিরিয়ে আনা হয়। পরের দিন বেলা তিনটায় দুজন ছাত্রসহ আমাকে এক সঙ্গে হাত ও চোখ বাঁধা অবস্থায় মিলিটারি ট্রাকে নাটোরের পথে নিয়ে যাওয়া হয়। পথে বুট দিয়ে আমাদের উপর সীমাহীন অত্যাচার করে। জেল গেটের খাতায় “ফাইট এগেইনেস্ট গভর্নমেন্ট” লিখে নেয়। জেল গেটের আঙ্গিনায় তখন তিনজনের উপরে বেয়নেট, লাঠি, বেত, বুট ইত্যাদি দ্বারা নির্যাতন করতে থাকে।
নির্যাতনের পর বিকাল পাঁচটায় আমাদেরকে গলা ধাক্কা দিয়ে একটি কুঠুরীতে বন্দী করে। সেখানে আরো দুজনকে বন্দী অবস্থায় দেখা যায়। অবশ্য জেল গেটেই তাদের হাতের বাঁধন ও চোখের পট্টি খুলে দেয়।
নাটোর জেলখানায় তিনটি কোঠায় তিনশ জনের মত কয়েদী ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডঃ সালেহ আহমদ, অধ্যাপক মুজিবর রহমানসহ অনেক বুদ্ধিজীবীও ছিলেন। বলা প্রয়োজন যে ইপিআরদের জন্য তিনটি কোঠার একটি রিজার্ভ ছিল। প্রত্যহ পানি আনা, রাস্তা মেরামত, পুকুর পরিষ্কার, মিলিটারিদের খেলার মাঠ তৈরীসহ বিভিন্ন ধরণের কাজ তাদের দিয়ে করিয়ে নেওয়া হতো। এবং সে সময়ে তাদের উপর অত্যাচার করা হতো।
জেলখনায় মাস দুয়েক কাটানোর পর আমাকে জনৈক এফআইটি অফিসারের নিকট বিবৃতি দেওয়ার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। এবং সেখানে বিবৃতি আদায়ের ফাঁকে ফাঁকে বৈদ্যুতিক চাবুক দ্বারা প্রহার করে। শেষ পর্যন্ত যে বিবৃতিতে তারা সই করিয়ে নেয় তাতে সত্য অপেক্ষা মিথ্যাই ছিল বেশী।
নাটোর জেলখনায় মিলিটারীদের অত্যাচারের সময় জেলখানাতেই জনৈক কয়েদী মারা যান।
স্বাক্ষর/-
মোঃ আবুল ওয়াহেদ
১৬/০৮/১৯৭২
<৮,২.২.৩৯,৭৫> “এরপর সকলকে নদীর ধারে নিয়ে যায় গুলি করার জন্য। সে জায়গা খর স্রোতা নয়, লাশ জলে আটকে থাকবে এজন্য স্থান পরিবর্তন করে আর এক জায়গায় নেওয়া হয়।“
৩৯
মোঃ আফজাল আলী মন্ডল
গ্রাম- পারনাথপুর
পোঃ- রাণীনগর
রাজশাহী
“ভাদ্র মাসের শেষ সপ্তাহ মঙ্গলবার ভোর বেলায় গাড়ি থামিয়ে পাক সৈন্যরা চকউজির, বাহাদুরপুর, চক বিলাকী গ্রাম ঘেরাও করে। আমি সেদিন চক বিলাকী গ্রামে আত্মগোপন করেছিলাম। আমাকে এবং আরো দুজনকে ধরে বেঁধে রাখে। উল্লিখিত দুজনের একজনের চাচাকে বাড়িতে গুলি করে হত্যা করে রেখে তাকে বেঁধে নেয়। নদীর ধারে ঢাকা থেকে আগত কামলা ৯ জন ছিল। এরা তাদেরকেও ধরে ফেলে। আমার স্বাস্থ্য ভাল বিধায় আমাকে মুক্তিবাহিনীর নেতা বলে অকথ্য শারীরিক নির্যাতন চালায় এবং জানতে চায় মুক্তিফৌজ কোথায় এবং রাইফেলাদি কোথায়?
ইতিমধ্যে আরও তিনজনকে ধরে আনে। তাদের প্রহার করে ও আমি মুক্তিবাহিনীর নেতা কিনা তা জানতে চায়। এরপর সকলকে নদীর ধারে নিয়ে যায় গুলি করার জন্য। সে জায়গা খর স্রোতা নয়, লাশ জলে আটকে থাকবে এজন্য স্থান পরিবর্তন করে আর এক জায়গায় নেওয়া হয়। সেখানে ‘ওয়্যারলেস’ এর মাধ্যমে কথাবার্তা হতো। তারপর আমাদের একটি আম বাগানে নেওয়া হয়। সেখানে আরও তিনজনকে গ্রেফতার করে, যারা মিলিটারীকে দেখতে এসেছিল। এদের একজন অত্যাচারের অসহ্যতার জন্য বলে যে আমি আওয়ামী লীগের নেতা। যাহোক জনৈক রাজাকারের সামান্য সুপারিশে আমাকে ও উল্লিখিত দুজনকে ছেড়ে দেয়। কিছু দূর যাবার পরে আমার মনে হলো যে এ ছেড়ে দেওয়া মানে কিছু দূর যাবার পর গুলি করে হত্যা করবে। এসব ভাবতে ভাবতে আমি জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যাই। পরবর্তিকালে জ্ঞান ফিরলে দেখতে পাই যে আমি বাড়িতে আছি।
পাক বাহিনী ঐদিন গ্রামগুলি ঘেরাও করে অন্যূন ২৫০/৩০০ জন লোক ধরে এবং তাদের মধ্যে সাতজনকে গুলি করার জন্য আত্রাই নিয়ে যায়। তাদের সবাই মারা গেলেও ভাগ্যক্রমে আক্কেল আলী নামে জৈনক ছেলে গুরুতর আহত অবস্থায় বেঁচে যায়।
স্বাক্ষর/-
মোঃ আফজাল আলী মন্ডল
<৮,২.২.৪০,৭৬>
৪০
মোঃ হামিদুর রহমান
গ্রাম- কুমাইল, পোঃ- কাশিমপুর
থানা- রাণীনগর, রাজশাহী
রাণীনগর থানার আতাইকুলা গ্রামে অপ্রত্যাশিতভাবে জুন মাসে ২৯ তারিখে প্রায় ৮০ জন পাক সৈন্য প্রবেশ করে। পাক বর্বরদের সাথে বিহারীরাও ছিল। সেদিন বেলা দশটার সময় উল্লেখিত পাক বর্বররা ধ্বংস, বীভৎসতা চালানোর জন্য গিয়েছিল। গ্রামে প্রবেশ করার আগে গ্রামের সংলগ্ন যমুনা নদী পার হয়ে সশস্ত্রভাবে দৌড়ে গিয়ে গ্রামটিকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। অবশ্য গ্রামের পাল পাড়া ধ্বংস করাই উদ্দেশ্য ছিল বলে আমার মনে হয়। গ্রামের অন্যান্য পাড়ায় গুরুত্ব না দিয়ে উক্ত গ্রামের পাল পাড়াতেই বেশি তৎপরতা চালায়। পাল পাড়ায় সমস্ত জনগণকে একত্রিত হতে পাক হানাদাররা আদেশ করে। আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে উক্ত পাড়ার হিন্দু জনগণ এক জায়গাতে একত্রিত হয়। পরে পাক হানাদাররা তল্লাশি করে ও জোরপূর্বক টাকা-পয়সা, সোনার গহনা, ব্যবহারিক সৌখিন জিনিস লুট করতে থাকে। অন্যূন ৬০ হাজার টাকা উক্ত গ্রাম থেকে লুট করে নিয়েছে। বেলা ১০টা থেকে ২টা পর্যন্ত লুট পর্ব চলে। পড়ে উল্লিখিত ধৃত ব্যক্তিগণকে এক লাইনে দাঁড় করায়। লাইনে দাঁড় করানোর পরে মেশিন গানের গুলিতে ৪০ জন লোক নিহত হন।
উক্ত হত্যাকাণ্ডের আগে পাক বর্বররা গ্রামের প্রায় ৫০ জন কুলবধূকে অন্য এক জায়গায় বন্দী করে রাখে। কুলবধূগণকে গুলি করে না মারলেও তাদের অধিকাংশের শ্লীলতাহানি করে। বলা প্রয়োজন উক্ত হত্যালীলা ও ধর্ষণ চালানোর পরে উক্ত পাড়াতে ব্যাপকভাবে অগ্নিসংযোগ করে। ফলে উক্ত পাড়ায় শতকরা ৩০ ভাগ বাড়িঘর সম্পুর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়। অবশ্য গ্রামে প্রবেশ করার পূর্বে ও পরে মাঠের দিকে বিক্ষিপ্তভাবে গুলি চালালে ইরি ক্ষেতের মাঝে লুকায়িত ৬/৭ জন নিরীহ মানুষ নিহত হয়েছিলেন।
কিছুদিন পরে পশ্চিমা বর্বর বাহিনী পুনরায় উক্ত আতাইকুলা গ্রামে পাল পাড়ায় প্রবেশ করে। প্রবেশ করার আগে গ্রামের জনগণ নারী, পুরুষ নির্বিশেষে প্রাণের ভয়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। পরে কোন মানুষকে না পেয়ে কয়েকটি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে পাক পশুরা তাদের নির্দিষ্ট স্থানে চলে যায়।
আত্রাই থানায় তখন বর্বরদের ধ্বংস ও বীভৎসতা চরম ভাবে চলেছিল। বলা প্রয়োজন আতাইকুলাতে দুইবার অভিযান চলার পর পার্শ্ববর্তী গ্রামের কিছুসংখ্যক যুবক ঐ গ্রামে অভিযান হবেনা ভেবে রাত্রিতে অবস্থান করতেন। কিন্তু গ্রামে স্বার্থান্বেষী পাকিস্তানী দালালদের প্ররোচনায় তাদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছিল। পরে দালালদের আমন্ত্রণে পাক বর্বররা তৃতীয়বার উক্ত আতাইকুলা গ্রামে প্রবেশ করে পাল পাড়াতেই। বলা প্রয়োজন উক্ত পাল পাড়ায় প্রাণের ভয়ে কয়েকজন যুবক আশ্রয় নিয়েছিল। তখন কয়েকজন যুবক পাক দস্যুদের তৎপরতায় ধরা পড়ে। পাক বর্বররা উক্ত ধৃত যুবকদেরকে নৃশংসভাবে হত্যা করে।
স্বাক্ষর/-
মোঃ হামিদুর রহমান
<৮,২.২.৪১,৭৭>
৪১
মোঃ ছালামত আলী
গ্রাম- সফিকপুর
ডাকঘর- পালসা
রাণীনগর, রাজশাহী
নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহের দিকে বর্বর নরপশুরা রাজাকারসহ সশস্ত্র অবস্থায় আকস্মাত গ্রামে প্রবেশ করার পূর্বেই গ্রামের জনসাধারণ স্ত্রী-পুত্র, কন্যাসহ বিক্ষিপ্তভাবে প্রাণের ভয়ে পলায়ন করতে থাকে। পড়ে সৈন্যরা এবং রাজাকাররা নৌকা থেকে নেমেই গ্রামের প্রত্যেকটি বাড়ি তন্ন তন্ন করে তল্লাশী চালাতে লাগলো, তাদের ধারণা ছিল হয়তো কোন আওয়ামী লীগার, মুক্তিযোদ্ধা কিংবা কোন স্বেচ্ছাসেবক গ্রামের মাঝে আত্মগোপন করে আছেন। কিন্তু তাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল লুট করা। ঘরের মাঝে যে সমস্ত মূল্যবান আসবাবপত্র ছিল তা নষ্ট করে দেয়, কতকগুলি শৌখিন জিনিস নিয়েও যায়। ট্রাংক, সুটকেস খুলে খুলে কিংবা উপর থেকে আছাড় মেরে তার ভেতরে যা পায় যেমন দামি কাপড় চোপড়, গহনা পত্র, রেডিও, ঘড়ি সমস্ত লুট করে নিয়ে যায়। পঞ্চান্ন বছর বয়স্ক মজিবর রহমান নামক এক বৃদ্ধকে বেদম প্রহার করে। সেই প্রহারের ক্ষণকাল পর আমাকে ধরে চোখ বাঁধে। চোখ বাঁধা অবস্থায়ই আমাকে নৌকায় তোলে। অনেক অবাঞ্চিত কথা বলার পর পাক বাহিনীর লোকেরা আমাকে আত্রাই স্টেশনে নিয়ে যায়। আত্রাই স্টেশনে নামিয়ে চোখের বাঁধন খুলে দেয়। স্টেশন সংলগ্ন একটি কোঠায় আমাকে বন্দী করে রাখে। সেখানে আমি নাম না জানা অপরিচিত বারজন লোককে দেখতে পাই। দুদিনে দুইখানা রুটি খেতে দিয়েছে নরপশুরা। অবশ্য কোন থালা বা প্লেটে দেয়নি। হাতে হাতে দিয়েছে।
যে বার জন লোক উল্লিখিত কুঠুরিতে ছিলেন তাদেরকে নিয়ে কয়েকজন মিলিটারী প্রায় দুইশ গজ দূরে নিয়ে যায়। তখন অন্ধকার রাত ছিল। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছিল। সেই অন্ধকারের মাঝে ব্রিজের উপরে বার জন লোককে তুলে নেয়। অবশ্য ব্রিজের নিচে অথৈ পানি ছিল। একসময় গুলি করে বার জন লোককে হত্যা করে। আমি স্পষ্ট গুলির শব্দ শুনতে পাই। পরে বর্বর সৈন্যরা নির্দিষ্ট জায়গাই চলে আসে।
উল্লিখিত ঘটনার পড়ে পালা এলো আমাকে হত্যা করার। আমি চাকুরিজীবী বলে পশুরা আমাকে হত্যা করে না। আর পকেটে ছিল পরিচয়পত্র। সেই পরিচয়পত্রের পরিপ্রেক্ষিতে আমাকে রাত ৯টার সময় আত্রাই স্টেশন ক্যাম্প থেকে হানাদাররা মুক্তি দেয়।
স্বাক্ষর/-
মোঃ ছালামত আলী