শিরোনাম সূত্র তারিখ
১০৫। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন : সদস্যদের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে দৈনিক পাকিস্তান ১৮ই নভেম্বর, ১৯৭১
জাতীয় পরিষদের অধিবেশন:
সদস্যদের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে
ইসলামাবাদ, ২৭শে নভেম্বর, (এপিপি)।- প্রেসিডেন্ট কর্তৃক পরিষদ অধিবেশনের তারিখ ২৭ শে ডিসেম্বর নির্বাচিত হয়েছে। এ খবর জানিয়ে জাতীয় পরিষদ সদস্যদের সেক্রেটারিয়েট নির্বাচিত পরিষদ সদস্যের নিকট পত্র পাঠিয়েছে।
প্রেসিডেন্ট যখন পরিষদের অধিবেশন ডাকবেন তখন সদস্যেদের নিকট আনুষ্ঠনিক নোটিশ ও আলোচ্যসূচী পাঠানো হবে।
পরিষদ ও অধিবেশনের স্থান এখনও ঠিক হয়নি। তবে জাতীয় পরিষদ অধিবেশন ইসলামাবাদে বসতে পারে। এখানকার স্টেট ব্যাংক ভবনে তার ব্যবস্থা সম্পন্ন হয়েছে।
.
শিরোনাম সূত্র তারিখ
১০৬। ভারতে সোভিয়েত অস্ত্র: সরকারী মুখপাত্রের তথ্য প্রকাশ দৈনিক পাকিস্তান ২৮ নভেম্বর, ১৯৭১
সরকারী মুখপাত্রের তথ্য প্রকাশ
ভারতে সোভিয়েত অস্ত্র: পাকিস্তান সকলকে অবহিত করেছে
রাওয়ালপিন্ডি, ২৭ নভেম্বর, (এপিপি)। পাকিস্তান ‘সকল উপযুক্ত মহলে’ ভারতের সোভিয়েট ইউনিয়নের অব্যাহত সামরিক সাহায্যের বিষয়টি গোচরীভূত করেছে। আজ সন্ধ্যায় একজন মুখপাত্র এ কথা জানিয়েছেন। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, সোভিয়েট ইউনিয়ন কয়েক বছর ধরে ভারতকে অস্ত্র সরবারহ করছে।
এসব সরবারহ এখন ভারতের কাছে দ্রুত গতিতে পৌঁছাচ্ছে। এগুলো পুরোনো অথবা নতুন চুক্তি অনুযায়ী ভারতে আসছে কিনা তা বলা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, আমরা সকল বৃহৎ শক্তি ও অন্যান্য দেশকে বলছি, পাকিস্তান অস্ত্রশস্ত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। পক্ষান্তরে ভারত বিভিন্ন উৎস থেকে সামরিক সরঞ্জাম পাচ্ছে।
এমনকি পাকিস্তানে পাশ্চাত্যের অস্ত্র সরবারহ বন্ধের পরও ভারত তা পাচ্ছে। আমরা আমাদের চাহিদা পূরণের জন্য যা করা সম্ভব সবই করছি। তিনি বলেন, পাকিস্তান সকল বৃহৎ ও বন্ধু দেশকে আরো জানিয়ে দিয়েছে যে, ভারতের প্রতি সোভিয়েটের সামরিক সাহায্য নয়াদিল্লীকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে শত্রুতা করার উৎসাহ যোগাচ্ছে, তার মনোভাব কঠোর করেছে এবং পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে তাকে গভীরভাবে জড়িয়ে ফেলেছে। তিনি বলেন, মস্কোর পাকিস্তানী রাষ্ট্রদূত জনাব জামসেদ মার্কার এখন ইসলামাবাদে আছেন। তিনি পররাষ্ট্র দফতরের সাথে এই উপমহাদেশে সোভিয়েত নীতির বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে এসেছেন।
সোভিয়েটের পত্র
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দুই দিন আগে সোভিয়েট রাষ্ট্রদূত প্রেসিডেন্টের কাছে একটি চিঠি দিয়েছেন। সংক্ষিপ্তভাবে এতে সোভিয়েটের আগের চিঠির বক্তব্যই বলা হয়েছে, তবে ভাষায় খানিকটা বিভিন্নতা থাকতে পারে। ‘এর দ্বারা আমাদের অবস্থানের পরিবর্তন বোঝায় না। সাজ্জাদ হায়দার-শরণ শিং বৈঠক সম্পর্কে মুখপাত্র বলেন, নয়াদিল্লী যে ধারনাই দিক বর্তমান উত্তপ্ত পরিস্থিতি প্রশমনের সমস্যা সমাধানের কোন গঠনমূলক প্রস্তাব দেয়া হয়নি।
তিনি বলেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আগে উত্তেজনা হ্রাসের সুস্পষ্ট প্রস্তাবে সীমান্ত থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের কথা বলেছেন।
প্রশ্ন: ভারতীয় আক্রমনের বিষয়টি পাকিস্তান কর্তৃক নিরাপত্তা পরিষদে পেশ করার বাধা কোথায়?
মুখপাত্র: কোন বাধা নেই। তবে এটা খুব সহজ ব্যাপার নয়।
কতগুলো অবস্থার আলোকে এবং বৃহৎশক্তিগুলোর মতামতের ভিত্তিতে নিরাপত্তা পরিষদ বিষয়টি বিবেচনা করবে। এসব শক্তি সমস্যাটি সমাধানের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। জাতিসংঘ সাধারন পরিষদে চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রীর বক্তব্য সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘গনচীন পরিস্থিতি সম্পর্কে নিজস্ব সিদ্ধান্তে পৌছেছে।’ যখন সোভিয়েট অস্ত্র সমানে ভারতে আসছে তখন মস্কো-দিল্লী চুক্তি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নয়- সোভিয়েটের এই অভিমত পাকিস্তান কি করে বিশ্বাস করবে।
জবাবে মুখপাত্র বলেন, ‘আমাদের আগের ধারনা’ পরিস্থিতি আমাদের বিশ্লেষণভিত্তিক ছিল। কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখছি চুক্তিটি ভারতকে উৎসাহ যোগাচ্ছে, তারা শত্রুতা বাড়িয়েছে, তারা মনোভাব কঠোরতর করছে।
বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী হীথ পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে মধ্যস্থতার কোন প্রস্তাব করেছেন কিনা তার জবাবে মুখপাত্র বলেন, এ রকম প্রস্তাবের কথা আমি জানি না।
.
.
শিরোনাম সূত্র তারিখ
১০৭। জরূরী অবস্থা ও পাকিস্তান প্রতিরক্ষা আইন জারি মর্নিং নিউজ ২৯ নভেম্বর, ১৯৭১
পাকিস্তান প্রতিরক্ষা আইন জারি
রাওয়ালপিন্ডি, নভেম্বর ২৮ (এপিপি)- পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকার দ্বারা পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশ এর অধীনে তৈরি পাকিস্তান প্রতিরক্ষা আইন জারি এবং প্রচার করা হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট এই অধ্যাদেশ সম্পর্কে অবগত আছেন। এমনকি এই আদেশ সম্পর্কিত একটি গেজেটও গতকাল প্রকাশ করা হয়েছে।
দেশের বর্তমান পরিস্থিতি বোঝানোর উদ্দ্যেশ্যেই এই আইনটি জারি করা হয়েছে, যা সর্বমোট ২১৩ টি।
গেজেটটি প্রকাশ করা হয় নভেম্বর ২৩, ১৯৭১ তারিখে। গেজেটটি এমন একটি সময়ে প্রকাশ করা হয় যখন বহিঃশক্তির আক্রমনের শংকা তৈরি হয়েছে এবং এ কারনেই জরুরী অবস্থা প্রচার করা হচ্ছে।
পাকিস্তান এর প্রেসিডেন্ট কতৃক
জরুরী অবস্থা সম্পর্কিত সরকারি ঘোষনা- নভেম্বর ২৩, ১৯৭১
যেহেতু, প্রেসিডেন্ট পাকিস্তান এর উপর বহিশত্রুর আক্রমন এর গভীর আশংকা পোষণ করছেন।
এখন সেকারণেই প্রদেশের সংবিধান অনুযায়ী এবং ১৯৬৯ এর মার্চের ২৫ দিনের দফা লাভের উদ্দ্যেশ্যে প্রেসিডেন্ট তার সকল ক্ষমতা প্রয়োগ মারফত জরুরী অবস্থা ঘোষনা করছেন।
.
.
শিরোনামঃ ১০৮। ভারতীয় ‘অনুপ্রবেশ’ সম্পর্কে সরকারী মুখপাত্রের বিবরণ
সূত্রঃ দৈনিক পাকিস্তান
তারিখঃ ২৯ নভেম্বর, ১৯৭১
.
সরকারী মুখপাত্রের বিবরণ
পূর্ব পাকিস্তান এর অভ্যন্তরে ভারতীয় অনুপ্রবেশ চেষ্টা ব্যার্থ
রাওয়ালপিন্ডি, ২৮শে নভেম্বর, (এপিপি)- আজ এখানে একজন সরকারী মুখপাত্র বলেন যে, কুমিল্লা -নোয়াখালী সেক্টরে পাকিস্তানী সৈন্যদের সাথে বিভিন্ন সংঘর্ষে আরো ৩০ জন ভারতীয় সৈন্য নিহত হয়েছে। গত ২৪ ঘন্টায় এসব ভারতীয় সৈন্য মারা যায়।
কুমিল্লা-নোয়াখালী সেক্টরের গুলবানিয়ায় ভারতীয়রা নতুন করে ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয় সেখানে তাদের ১০ জন সৈন্য নিহত এবং তাদের দুটি হালকা মেশিনগান ও ৭টি রাইফেল আটক করা হয়েছে। ময়মনসিংহ সেক্টরে আরো ২০ জন ভারতীয় সৈন্য নিহত হয়েছে।
ভারতের নিয়মিত সৈন্য ও তাদের চরেরা এই সেক্টরে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করে। কিন্তু পাকিস্তানো সেনাবাহিনী ও রাজাকারদের হাতে তারা প্রচুর ক্ষতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়।
মুখপাত্রটি আরো বলেন যে, ভারতীয়রা দিনাজপুর জেলার পচাগড়ে প্রচন্ড গোলাবর্ষণ করে। কিন্তু পরে তাদের প্রতিহত করা হয়। এই সংঘর্ষের বিস্তারিত বিবরণ এখনও পাওয়া যায় নি। তিনি বলেন, ভারতীয়রা সারা সীমান্তে উত্তেজনা বজায় রাখে এবং ময়মনসিংহ জেলার বরমারী, আকিপাড়া ও কমলপুর, দক্ষিন সিলেট এলাকার কেরামতনগর ও ফুলতলা, কুমিল্লা জেলার ব্রাক্ষনবাড়িয়া এলাকার কায়েমপুর ও যশোরের হিরণ, জীবনন্যার ও বাকশায় গোলাবর্ষণ করে। মুখপাত্রটির মতে ভারতীয় সৈন্যরা গত ২৪ ঘন্টায় পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোর উপর আক্রমণ ও প্রচন্ড গোলাবর্ষণ করে। ভারতীয়দের আক্রমনের প্রধান লক্ষ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানের পশ্চিম সীমান্ত যশোর। সেখানে দুই কোম্পানি ভারতীয় সৈন্য ট্যাংকের সাহায্যে চৌগাছা এলাকায় বুইন্দার দিকে আরো এগিয়ে যাবার চেষ্টা করে।
পাকিস্তানী সৈন্যরা তাদের প্রচেষ্টা ব্যার্থ করে দেয়। একই সেক্টরে ভারতীয়রা দুই কোম্পানি সৈন্য ও ট্যাংকের সাহায্যে শিমুলিয়া ও নবগ্রামে আক্রমন চালালে আমাদের সৈন্যদের সক্রিয় ও সময়মত কামানের গোলাবর্ষণে ভারতীয়রা পিছু হটতে বাধ্য হয়। মুখপাত্রটি বলেন, দুটি ভারতীয় কোম্পানী কুমিল্লা এলাকার চাদগাজীপুরে অগ্রসর হবার চেষ্টা করলে পাকিস্তানী সৈন্যরা তাদেরকে প্রতিহত করে।
প্রশ্ন: ভারতীয়রা কোন বিমান অবতরণ কেন্দ্রে বা বিমান বন্দরে আক্রমন করেছে কি?
উত্তর: গত ২২শে নভেম্বর যশোরে প্রথম আক্রমন শুরু হবার পর ভারতীয় প্রচেষ্টা প্রতিহত করা হচ্ছে। কিন্তু সংঘর্ষের সাধারন ধরন একই রুপ ছিল। সীমান্ত সংঘর্ষের তীব্রতাও একই রূপ। সীমান্ত এলাকা থেকে এই সংঘর্ষ অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ে নি। ভারতীয়দের পূর্ব পাকিস্তানের গভীর অভ্যন্তরে অনুপ্রবেশ অথবা তাদেরকে নতুন কোন এলাকা দখল করতে দেয়া হয় নি। যশোর সেক্টরের চৌগাছা এখনো ভারতীয়দের নিয়ন্ত্রনে রয়েছে।
দৈনিক ১২ লাখ টাকার গোলাবর্ষণ
প্রশ্ন: ভারতীয় গোলার তীব্রতাটা কি?
উত্তর: ভারত পাকিস্তানী এলাকায় প্রতিদিন ৬ হাজারেরও বেশি গোলাবর্ষণ করছে। আর প্রতিদিন বর্ষিত এই গোলার দাম হচ্ছে প্রায় ১২ লাখ টাকা।
প্রশ্ন: দুই সপ্তাহের আগের তুলনায় বর্তমান সংঘর্ষের মাত্রা কি?
উত্তর: গোলাবর্ষণ অব্যাহত রয়েছে। পাকিস্তানের উপর ভারতীদের নিয়মিত আক্রমনের আগে তারা পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিদিন ১ থেকে ৪ হাজার পর্যন্ত গোলাবর্ষণ করত।
প্রশ্ন: পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরে রাষ্ট্রবিরোধী ব্যক্তি ও চরদের তরপরতার অবস্থাটা কি?
উত্তর: বিদ্রোহীদের কিছুটা তরপরতা’ রয়েছে, বিক্ষিপ্ত দুর্ঘটনা ঘটেছে এবং এতে বেসামরিক নাগরিকদের কষ্ট হচ্ছে। তবে এটা কোন ভাবেই বলা যায় না যে সেখানে একটি বিদ্রোহ ঘটেছে। তিনি বলেন, মুক্তিবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের জনগনের সমর্থন পাচ্ছে না।
পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস, ইস্ট বেংগল রেজিমেন্ট, পুলিশ ও আনসার বাহিনোর দলত্যাগীদের নিয়েই মুক্তিবাহিনী গঠিত। তারা ভারত সরকার ও নিয়মিত ভারতীয় সৈন্যদের সক্রিয় সমর্থনে কোন কোন সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে। তারা একাকী কোন জায়গাতেই আক্রমন চালাতে পারে নি।
প্রশ্ন: মুক্তিবাহিনীর সং্খ্যা কত?
উত্তর: পূর্ব পাকিস্তান থেকে বিভিন্ন বাহিনীর দলত্যাগীদের নিয়েই এই বাহিনী গঠিত। ভারতে গেরিলাদের ট্রেনিং দেবার জন্যে ৪৮টি শিবির প্রতিষ্ঠা করেছে। তাদের কতজনকে ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে বা কতদিন পরপর ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে তা অনুমান করা সম্ভব নয়।
প্রশ্ন: পূর্ব পাকিস্তানের কাছে কোন বিদ্রোহী আত্মসমর্পণ করেছে?
উত্তর: হ্যা। কয়েকজন বিদ্রোহী আত্মসমর্পণ করেছে এবং আরো করছে।
প্রশ্ন: ভারত দাবী করছে, পূর্ব পাকিস্তানের উদ্বাস্তুরা সীমান্ত পার হয়ে এখনো চলে যাচ্ছে একথা ঠিক?
উত্তর: না। এ দাবী সম্পূর্ণ মিথ্যা। কেউ ভারতে যাচ্ছে না।
প্রশ্ন: ভারতীয় বেতার দাবী করেছে যে, পূর্ব পাকিস্তানের যশোর এবং পশ্চিম পাকিস্তানের শিয়ালকোট থেকে বেসামরিক নাগরিকদের অপসারন করা হয়েছে এটা কি সত্য?
উত্তর: এসব এলাকা থেকে লোকজন অপসারণ করা হয় নি। বেসামরিক লোকদের এলাকা ছেড়ে চলে যাবার জন্যে সরকারী আদেশ দেয়া হয় নি। তবে কোন লোক ব্যাক্তিগতভাবে এলাকা ছেড়ে চলে যেতে পারে।
.
.
শিরোনামঃ ১০৯। পরিস্থিতি দ্রুত ক্রমানবতির প্রতি উ থান্ট এর দৃষ্টি আকর্ষণ
সূত্রঃ দৈনিক পাকিস্তান
তারিখঃ ৩০ নভেম্বর, ১৯৭১
.
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া পরিস্থিতি দ্রুত ক্রমানবতির প্রতি উথান্টের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন
পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তে জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক মোতায়েনের প্রস্তাব
ইসলামাবাদ, ২৯শে নভেম্বর। পাকিস্তানী এলাকায় বিনা উস্কানিতে ভারতীয় বাহিনীর ব্যাপক হামলার ফলে উপমহাদেশের পরিস্থিতি দ্রুত ক্রমানবতির প্রতি উ থান্টেএ দৃষ্টি আকর্ষণ করে প্রেসিডেন্ট জেনারেল এ এম ইয়াহিয়া তার কাছে একটি লিপি পাঠিয়েছেন।
গতকাল উ থান্টের নিকট প্রেরিত লিপিতে প্রেসিডেন্ট পাকিস্তানী এলাকার সীমানা লংঘন পর্যবেক্ষন করা ও সে সম্পর্কে রিপোর্ট দানের জন্যে পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তের পাকিস্তানী এলাকায় জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক মোতায়েনের প্রস্তাব করেছেন।
.
.
শিরোনামঃ ১১০। স্বস্তি পরিষদের বৈঠক প্রসংগে সরকারী মুখপাত্র
সূত্রঃ দৈনিক পাকিস্তান
তারিখঃ ৩০ নভেম্বর, ১৯৭১
.
সরকারী মুখপাত্র: স্বস্তি পরিষদের বৈঠক প্রসংগে এখনও পাকিস্তান চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি।
রাওয়ালপিন্ডি ২৯শে নভেম্বর এপিপি আজ এখানে একজন সরকারী মুখপাত্র এখানে বলেন যে, সরকার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতীয় হামলা বিবেচনার জন্যে নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক অনুষ্ঠানের আহবান জানানোর ব্যাপারে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মুখপাত্রটি বলেন যে, পাকিস্তান এ ব্যাপারে বৃহত শক্তিবর্গের সাথে আলোচনা করছে ও তাদের মনোভাব পর্যবেক্ষন করছে। সরকার নিরাপত্তা পরিষদের বিতর্ক পাকিস্তানের পক্ষে আরো ক্ষতিকর হবে বলে মনে করেন কিনা, জানতে চাওয়া হলে মুখপাত্রটি বলেন যে আমরা এভাবে চিন্তা করছি না।
আমরা যা চিন্তা করছি তা হলো, নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে সুনির্দিষ্ট কোন ফল পাওয়া যাবে কিনা। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতি, জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল, যে কোন বৃহত শক্তি, যে কোন সদস্য রাষ্ট্র অথবা বিরোধ সংশ্লিষ্ট দেশের যে কেউ নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক অনুষ্ঠানের আহবান করতে পারেন।
মুখপাত্রটি আরো বলেন যে পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয় হামলার পর পাকিস্তান এর মধ্যে কতগুলো কূটনৈতিক উদ্যোগ নিয়েছে। প্রেসিডেন্ট বৃহত শক্তিবর্গের রাষ্ট্র প্রধানদের কাছে চিঠি লিখেছেন এবং বিভিন্ন দেশে পাকিস্তানের প্রতিনিধিগণ প্রতিদিনের ঘটনাবলী রাখছেন।
প্রকৃতপক্ষে এ ব্যাপারে সম্ভবপর আওব উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
.
.
শিরোনামঃ ১১১। প্রতিরক্ষা অর্ডিন্যান্স ও প্রতিরক্ষা আইন বলবৎ
সূত্রঃ দৈনিক পাকিস্তান
তারিখঃ ১ ডিসেম্বর, ১৯৭১
.
সমগ্র দেশে প্রতিরক্ষা অর্ডিন্যান্স ও প্রতিরক্ষা আইন একযোগে বলবৎ
রাওয়ালপিন্ডি, ৩০শে নভেম্বর (পিপিআই)।- সারাদেশে জরুরী অবস্থা ঘোষনার সাথে সাথে ১৯৭১ সালের পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অর্ডিন্যান্স ও পাকিস্তান প্রতিরক্ষা আইন একযোগে বলবত করা হয়েছে। উক্ত আইনের বলে জনসাধারনের নিরাপত্তার ও দেশের প্রতিরক্ষার তাগিদে বিশেষ অপরাধের জন্যে শাস্তি বিধানের ব্যবস্থা থাকিবে। উপরোক্ত আইনের আওতাভুক্ত মূল বিষয়গুলো নিম্নে প্রদত্ত হইল:
(ক) সশস্ত্র বাহিনীর নিরাপত্তা ও সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা থাকিবে। (খ) সশস্ত্র বাহিনীর অন্তর্গত বিভিন্ন শাখায় নিয়োজিত লোকজনদের শিক্ষা অথবা স্বাস্থ্য ও শৃঙ্খলা রক্ষার ব্যবস্থা থাকিবে। (গ) স্টেট ব্যাংক অফ পাকিস্তান সার্ভিসে নিযুক্ত অথবা এই সার্ভিসে যোগদানের ইচ্ছুক ব্যক্তিদের রাষ্ট্রানুগত্যের প্রতি বিরোধিতা করা চলিবে না। (ঘ) শত্রুদের সাহায্য করা চলিবে না, অথবা সামরিক তরপরতা বা যুদ্ধ পরিচালনায় কোন অসুবিধা সৃষ্টি করা চলিবে না।
(ঙ) মালিকানা, ব্যবস্থাপনা বা দলীয় স্বত্ব, শত্রু সম্পত্তির বাজেয়াপ্তির পরিচালনা, রক্ষণাবেক্ষণ বা হস্তান্তর করা চলিবে না। (চ) গুজব অথবা কতৃপক্ষীয় সূত্রের বরাত ছাড়া যে কোন অসন্তোষ বা ভীতির সৃষ্টি করিতে পারে যে, যেগুলো বিদেশের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্কের অবনতি ঘটাইতে পারে, যেগুলো পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে নিরাপত্তা, জনগনের নিরাপত্তা অথবা সুযোগ-সুবিধা বিঘ্নিত করিতে পারে সেসকল গুজব ও সংবাদ প্রচার করা নিষিদ্ধ থাকিবে।
(ছ) যে সকল অঞ্চলে প্রয়োজন মনে করা হইবে সরকার সেই সকল অঞ্চলের জনগনের কর্তব্যকর্ম নির্ধারণ করিতে পারিবেন।
(জ) জল-স্থল পথ অথবা বিমান পথের সকল গুরুত্বপূর্ণ স্থান যেমন বন্দর, ডকইয়ার্ড, বিমানবন্দর, রেলপথ ও নৌপথ এবং অন্য সকল প্রকার যানবাহনের চলাচলের পথ সরকার কতৃক নিয়ন্ত্রিত হইবে।
(ঝ) ডাক ও তার বিভাগ সরকারী নিয়ন্ত্রনে থাকিবে।
(ঞ) এই আইনের বলে অধিকারপ্রাপ্ত ব্যক্তি যে সকল লোক বিদেশের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্কের অবনতি ঘটাইবে, জনগনের নিরাপত্তা এবং সুখ সুবধা বিঘ্নিত করিবে, দেশের কোন অংশের নিরাপত্তার প্রতি সন্দেহভাজন হইবে অথবা যাহারা দেশের অভ্যন্তরীণ চাকুরী বা যোগাযোগ ব্যবস্থার বিঘ্ন ঘটাইবে সেই সকল ব্যাক্তিকে আটক করিতে পারিবেন।
(চ) পাকিস্তানের প্রত্যাগত বা পাকিস্তান হইতে বিদেশ গমনকারী সকল ব্যাক্তি এবং যে সকল বিদেশী পাকিস্তানে বসবাস করেন অথবা পাকিস্তানে ছিলেন তাদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রিত করা হইবে।
(ছ) খবর ও তথ্য পরিবেশন সরকারের নিয়ন্ত্রণ এ থাকিবে।
(জ) সরকার ইচ্ছানুযায়ী ডাক, তার ও বেতার যোগাযোগ নিয়ন্ত্রন করিবে। উক্ত আইনের বলে বিভন্ন অপরাধের জন্যে ৫ বতসর কারাদণ্ড হইতে মৃত্যুদণ্ড দেয়া যাইতে পারে। ইহা ছাড়া অর্থদণ্ড অথবা একই সাথে অর্থদন্ড ও কারাদণ্ড দুই-ই দেওয়া যাইতে পারে।
.
.
শিরোনামঃ ১১২। ভারতীয় বিমানের আকাশ সীমা লংঘন ও চৈগাছার বিমান যুদ্ধ সম্পর্কে সরকারী মুখপাত্র
সূত্রঃ দৈনিক পাকিস্তান
তারিখঃ ২ডিসেম্বর, ১৯৭১
.
ভারতীয় বিমানের আকাশ সীমা লংঘন ও চৌগাছার বিমান যুদ্ধ সম্পর্কে সরকারী মুখপাত্র
রাওয়ালপিন্ডি, ১লা ডিসেম্বর (এপিপি)।- গতপ মংগলবার ভারতীয় বিমান বাহিনো কতৃক পাকিস্তানের আকাশ সীমা লংঘন সম্পর্কে জনৈক সরকারী মুখপাত্র আজ নিম্নোক্ত বিবৃতি দিয়েছেন।
গতকাল বেলা সাড়ে ১১টা হইতে ১২-২ মিনিটের মধ্যে ৪টি ভারতীয় জংগী বিমান ও একটি আলোকচিত্র গ্রহণকারী বিমান শিয়ালকোর্ট এলাকায় পাকিস্তানের আকাশসীমা লংঘন করে। তাহাদের গতিরোধের জন্য পাকিস্তান বিমান বাহিনীর ফাইটার ইন্টার সেক্টর বিমান দেখামাত্র বিমানগুলো দ্রুত নিজেদের আকাশ সীমায় সরিয়া পড়ে।
চৌগাছায় ‘স্যাবর’ বিমান ধ্বংস প্রসংগ প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরনের ভিত্তিতে এক্ষনে একথা উল্ল্যেখ করা যায় যে, আক্রমনকারী ভারতীয় ন্যাট জংগী বিমানের গুলীতে ভূপাতিত হইয়া নয় বরং শত্রুর গ্রাউন্ড ফায়ারেই পাকিস্তান বাহিনীর ২টি স্যাবর গত ২২শে নভেম্বর চৌগাছায় ধ্বংস হয়।
এই ঘটনা সম্পর্কে ভারতীয় পত্রিকার পরস্পরবিরোধী খবরেও ইহার সত্যতা সমর্থিত হইয়াছে। গত ২৩শে নভেম্বর ভারতীয় পত্রিকাগুলো দাবী করে যে, পাকিস্তানী স্যাবর বিমানসমূহ তাড়াইয়া দেওয়া হইয়াছে এবং কোনটাই ভারতীয় ন্যাটের গুলিতে ভূপাতিত হয় নাই।
কিন্তু দুই দিন পর ভারতীয়রা যখন দেখিল দুই জন পাকিস্তানী পাইলট ভারতীয় বাহিনীর হাতে ধরা পড়িয়াছে, তখন ভারতের স্টেট মন্ত্রী দাবী করেন যে, ভারতীয় ন্যাট স্যবর গুলিকে গুলী করিয়া ভূপাতিত করিয়াছে।
কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে, ঐ বিমান যুদ্ধের নীট ফল হইল: পাকিস্তান বিমান বাহিনীর স্যবর বিমান একটি ন্যাটকে (যথারিতী যাচাই করা হইয়াছে) গুলি করিয়া ভূপাতিত করে। পক্কান্তরে আমাদের স্যাবর বিমান সমূহের ২টি গ্রাউন্ড ফায়ারে ধ্বংস হয়।
.
.
শিরোনামঃ ১১৩। যুদ্ধ পরিহার সম্পর্কে সরকারী মুখপাত্র
সূত্রঃ দৈনিক ইত্তেফাক
তারিখঃ ২ডিসেম্বর, ১৯৭১
.
সরকারী মুখপাত্র বলেন- পাকিস্তান এখনও পূর্ণাংগ যুদ্ধ পরিহারের পক্ষপাতী
রাওয়ালপিন্ডি, ১লা ডিসেম্বর। অদ্য অপরাহ্নে জনৈক সরকারী মুখপাত্র বলেন যে, পাকিস্তান একান্তভাবেই পূর্ণাংগ যুদ্ধ পরিহারের পক্ষপাতী এবং যতক্ষন পর্যন্ত ইহার অনুকূল পরিস্থিতি বজায় থাকিবে পাকিস্তান ততক্ষন এই নীতিতে অবিচল থাকিবে।
মুখপাত্র বলেন, আমরা এখনও আশা করি যে, কূটনৈতিক প্রচেষ্টা, জাতিসংঘের উদ্যোগ এবং আমাদের বহুমূখী পদক্ষেপের মাধ্যমে সংঘর্ষের অবসান এবং যুদ্ধ বিরতির আয়োজন করা যাইতে পারে।
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতীয় আক্রমন বন্ধ করার কোন আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক উদ্যোগ নেওয়া হইয়াছে কিনা এবং গত মংগলবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্ধিরা গান্ধী প্রদত্ত বিবৃতিতে সরকারী প্রতিক্রিয়া কি সাংবাদিকদের এই জাতীয় প্রশ্নের উত্তর দান করিতেছিলেন।
উল্ল্যেখ্য যে, গত মংগলবার এর বিবৃতিতে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী হইতে সৈন্য প্রত্যাহারপূর্বক প্রদেশটিকে বাংলাদেশ বিদ্রোহীদের হাতে ছাড়িয়া যাওয়ার আহবান জানান।
মুখপাত্র প্রশ্ন করেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ধীর প্রতিক্রিয়ার প্রেক্ষিতে পাকিস্তান উপমহাদেশে শান্তি বজায় রাখার ব্যাপারে আন্তর্জাতিক উদ্যোগের জন্যে আর কতকাল অপেক্ষা করতে হবে।
তিনি বলেন, ভারত সংঘর্ষ তীব্রতর করায় আমরা ব্যপক যুদ্ধের দিকে ধাবিত হইতেছি। অবশ্য এই বিপদ পরিহারের জন্যে আমরা সকল কূটনৈতিক পদ্ধতি ও রীতিনীতির অনুসরণ করিয়া যাইতেছি। কিন্তু দেশকে পূর্ণ রূপে রক্ষা করার সময় উপস্থিত হইলে আমরা তাহা করিব বলিয়া তিনি দৃঢ় মত প্রকাশ করেন।
.
.
শিরোনামঃ ১১৪। নিরাপত্তা পরিষদে পাকিস্তান প্রতিনিধি আগাশাহীর বিবৃতি
সূত্রঃ জাতিসংঘ দলিলপত্র উদ্ধৃতিঃ বাংলাদেশ ডকুমেন্টস
তারিখঃ ৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১
.
পাকিস্তানের প্রতিনিধি আগা শাহীর বিবৃতি
ডিসেম্বর ৪, ১৯৭১
পরিষদের এই বৈঠকে পাকিস্তানের প্রতিনিধি দলকে আমন্ত্রন জানানোর জন্য আমি জনাব রাষ্ট্রপতি এবং নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি। নিরাপত্তা পরিষদের এই বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে জাতিসংঘের ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পরিস্থিতি নিয়ে। জাতিসংঘের একটি সদস্য রাষ্ট্র হয়েও ভারত অপর একটি সদস্য রাষ্ট্র পাকিস্তানের মাটিতে কেবল উস্কানীমূলক হামলাই চালাচ্ছে না, বরং তারা চায় পাকিস্তানে জাতিসংঘের সদস্যপদ নিজে থেকে ছেড়ে দিক, এবং দেশের সেই অংশ ছেড়ে দিক যেখানে দেশের সবচেয়ে বেশি জনগনের বাস।
এটা কেবলই একটি অভিযোগ নয়, যা আমি পরিষদের সামনে উপস্থাপন করছি। সারা বিশ্বই জানে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী বিবৃতি সম্পর্কে, ১ ডিসেম্বর দেয়া যে বিবৃতিতে তিনি বলেছেন দেশের পূর্ব অংশ থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করা উচিৎ পাকিস্তানের। বিশ্ব এটাও জানে যে, ভারতীয় সেনারা পাকিস্তানের মাটিতে প্রবেশ করে আগ্রাসন চালাচ্ছে ২১ নভেম্বর থেকে। এই বিষয় দুটি কোনভাবেই এড়িয়ে যাওয়া যায় না এবং ভারত এগুলো স্বীকারও করেছে। বর্তমান পরিস্থিতি অপরিহার্য এই দুই সত্যকে বিবেচনায় রাখা নিরাপত্তা পরিষদের ভিত্তি হওয়া উচিৎ। কেননা সমকালীন সময়ে এইরকম পরিস্থিতি আর উদ্ভূত হয় নি।
জাতিসংঘের আর কোন সদস্য রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এমন উদাহরন খুজে পাওয়া যাবে না, যেখানে সাধারন কূটনৈতিক সম্পর্কের মধ্যেই একটী আরেক দেশকে তার নিজ এলাকা থেকে সেনা প্রত্যাহার করতে চিঠি দিয়েছে, এমন দখলদারিত্ব আর কতৃত্ব ফলানোর নজিরও আর নেই। ভারত কেবল এমন চাহিদাই জানাচ্ছে না, বরং তারই ধারাবাহিকতায় পাকিস্তানের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টিতে আগ্রাসনও ছড়িয়ে দিচ্ছে। এই অবস্থায় পাকিস্তানের দিকে এক ধরনের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়া হয়েছে এবং পাকিস্তান তার মোকাবেলা করবে বলেই ঠিক করেছে।
এই দিক দিয়ে দেখতে গেলে, নিরাপত্তা পরিষদের সামনে যে পরিস্থিতির কথা উপস্থাপন করা হয়েছে, সেখানে পাকিস্তান কেবল একাই জড়িত নয়। এখানে সেইসব রাষ্ট্রও জড়িয়ে পড়ে, যারা একটি রাষ্ট্র এর সীমানার অখন্ডতায় বিশ্বাসী, আর এটা জাতিসংঘ সনদের অন্যতম মৌলিক বিষয়ও বটে। এর মধ্যে দিয়ে তারাও সচেতন হবে, যারা তাদের তুলনায় বড়, অধিক শক্তিশালী আর লুন্ঠনকারী রাষ্ট্র দ্বারা পদদলিত হয়ে আসছে।
যদিও বিষয়টি নিয়ে পাকিস্তান উদ্বিগ্ন, তবে আমি অংগীকার করছি যে পাকিস্তান আত্মসমর্পণ করবে না। কালকে যে পরিস্থিতিই আসুক না কেন, তা পাকিস্তানের আত্মসমর্পণ হবে না। আমাদের স্বাধীনতা আমাদের কাছে বহু মূল্যবান, এটা নিয়ে দর কষাকষি চলে না। জাতীয় অখণ্ডতা রক্ষায় আমাদের পণ আমাদের কাছে অনেক বড়, এটাকে আমরা কোনভাবেই হোচট খেতে কিংবা হেরে যেতে দিতে পারি না। যাই হোক, এই অবস্থায়ও যদি পরিস্থিতি নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদ আজকাল করে, যদি বাকচাতুরী করে, যদি পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়, যদি এই আগ্রাসন থামাতে ব্যর্থ হয়, তাহলে একটি ব্যাপার অবশ্যই ঘটবে। জাতিসংঘ সনদ বন্ধ হয়ে যাবে।
জাতিসংঘ পরিচালনায় যে মূল বিষয়গুলো কাজ করে তা ধ্বংস হয়ে যাবে। আন্তর্জাতিক নির্দেশনাবলীর ক্ষেত্রে জাতিসংঘের যে নীতি রয়েছে তার এমন ক্ষতি হবে যা কখনই ঠিক করা সম্ভব হবে না। এটাই ভারত, যে কিনা জাতিসংঘ সনদের সম্পূর্ণ বিরোধে গিয়ে পাকিস্তানের আঞ্চলিক অখণ্ডতা আর রাজনৈতিক স্বাধীনতার বিরুদ্ধে বড় আকারে সৈন্য নিয়োগ করেছে, সেই তারাই এখন পাকিস্তানের পূর্ন আক্রমনের বিরুদ্ধে কথা বলছে। তাই ২১ নভেম্বর এর পর গেল দুই সপ্তাহের ঘটনা পরম্পরা মাথায় রাখা দরকার।
গত ২১ নভেম্বর থেকে পাকিস্তানের পূর্ব প্রদেশ ভারতের সেনা, ট্যাংক আর বিমান দিয়ে বড় আকারের আক্রমনের শিকার হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তান ঘিরে ভারতীয় স্থল সীমানার তিন দিক থেকে একই সময়ে অন্তত ৬টি পয়েন্টে এই আক্রমন চালানো হয়েছে।
ভারতের এই হামলা ছিল কোন ধরনের উস্কানী ছাড়াই; এটা ছিল বড় মাত্রায়, এটা ছিল পরিকল্পনামাফিক; হামলা হয়েছে ভারী কামানের গোলা দিয়ে এবং এটা করা হয়েছে আকাশ সীমায় নিরাপত্তা রেখেই। এটা অবশ্যই সেই অবস্থায় নেই, যেখানে প্রাথমিকভাবে ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী গেরিলাদের লেলিয়ে দিয়ে পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে চেয়েছে। ভারত এবং পাকিস্তানের সেনাবাহিনী মুখোমুখি মোকাবেলায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর অন্তত কয়েকটি ইউনিটের অস্তিত্ব আমরা পেয়েছি, তাদের হত্যা করে বা আটক করে।
২১ নভেম্বর ভারতীয় সেনাবাহিনী যে আক্রমনগুলো চালিয়েছে তা হলো। পূর্ব পাকিস্তানের দক্ষিন-পূর্ব অংশে পার্বত্য চট্টগ্রামে ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি ব্যাটালিয়ন গ্রুপ প্রবেশ করেছে। তাদের নিরাপত্তা দিয়েছে অস্ত্রবাহী হেলিকপ্টার। তারা আমাদের সীমান্ত চৌকি দখল করে পাকিস্তানের সীমানার অন্তত ১০ মাইল অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে। একই সেক্টরের উত্তরে পাকিস্তান সীমানার ৮ মাইল অভ্যন্তরে প্রবেশ করে নোয়াখালী জেলার বিলোনিয়ায় বহির্মূখী আক্রমন চালায় ভারতীয় ২৩ ডিভিশনের এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য। বিলোনিয়ার উত্তর-পশ্চিম অংশে ব্রাক্ষনবাড়িয়া সাব-ডিভিশনে আমাদের তিউকান্দি ও সালদন্দি সীমান্ত চৌকিতে ভারতীয় ৫৭ ডিভিশনের একটী ব্যাটালিয়ন হামলা চালিয়ে দখল করে নেয়। এছাড়া উত্তরদিকে ময়মনসিংহের যেটা মমিনশাহি জেলা নামেও পরিচিত সেখানকার কারিটোলা সীমান্ত চৌকিতে পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ব ফ্রন্টের ওপর হামলা চালায় ভারতীয় বাহিনী। পূর্ব পাকিস্তানের উত্তর-পুর্ব কোনে সিলেট জেলার মৌলভীবাজার সাব-ডিভিশনের ধলই, আটগ্রাম এবং জকিগঞ্জ সীমান্ত চৌকিতে অন্তত দুটি ভারতীয় ব্যাটালিয়ন হামলা চালায়। এই ভারতীয় বাহিনীর সাথে গুর্খাদের অন্তত দুটি কোম্পানীও ছিল। পূর্ব পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম অংশে ভারতীয় বাহিনী আরেক হামলা চালায় রংপুর জেলায়। ভুরুংগামারী সীমান্ত দিয়ে ভারতীয় সেনারা পাকিস্তানের মধ্যে অন্তত ১৫ মাইল অনুপ্রবেশ ঘটীয়ে নাগেশ্বরী পর্যন্ত চলে আসে। দক্ষিন-পশ্চিম সীমান্তে যশোরেও হামলা চালানো হয়। চৌগাছার বিপরীত দিকে ঐ হামলায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর নবম ডিভিশনের একটি দল অংশ নেয়, তাদের সমর্থন দেয় অস্ত্রবাহী যুদ্ধবিমান। ভারতীয় ট্যাংকও পাকিস্তান সীমান্তের আট মাইল অভ্যন্তরে অনুপ্রবেশ করে। ভারতীয় বিমান বাহিনীর একটি হামলা ঠেকিয়ে দেয় পাকিস্তান বিমান বাহিনী। যেখানে ভারতীয় বাহিনীর একটি বিমান বিধ্বস্ত হয়। আর আমরা আমাদের এলাকায় দুটি বিমান হারিয়েছি। ঐ সম্মূখ যুদ্ধে ভারতের ৬ টী ট্যাংক ধ্বংশ হয়েছে, আর আমাদের ৮টি ট্যাংক অচল হয়ে যায়। যশোর বিমান বাহিনীর এলাকায় শেলিং চালিয়েছে ভারত। গত ২১ নভেম্বর এই সব হামলা একই সময়ে এবং বিরাট একটি এলাকাজুড়ে চালানো হয়েছে।
যতদূর জানা যায় ২১ নভেম্বর পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে হামলায় ভারতীয় বাহিনীর অন্তত ১২ ডিভিশন অংশ নেয়। এছাড়া সেখানে ভারতীয় সীমান্তবর্তী বাহিনীর ৩৮টি ব্যাটালিয়নও জড়িত ছিল। ভারতীয় মাউন্ট ডিভিশনের ২য় ও ৫ম দল যারা আগে ভারতীয় উত্তর-পূর্ব ফ্রন্টিয়ার এজেন্সির ছিলো, তারাও পূর্ব পাকিস্তানে হামলায় অংশ নেয়। ছয়টি ব্রিগেড নিয়ে গঠিত মাউন্টেন ডিভিশনের ৮ম দলকে পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তের সিলেটে নিয়ে আসা হয় নাগাল্যান্ড থেকে। ভারতীয় বিমানবাহিনীর ১২ টী স্কোয়াড্রন পূর্ব পাকিস্তান ঘিরে মোতায়েন করে হয়েছে। ভারতীয় নৌবাহিনীর একটি বিমানবাহী ফ্রিগেট, যুদ্ধ জাহাজ এবং ২টি সাবমেরিন বঙ্গোপসাগরের নিকটে ভিশাকাপত্তমে নিয়োগ করা হয়েছে, যা চট্টগ্রাম এবং চালনা বন্দরের জন্যে মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করেছে। চালনা বন্দরে মাইন হামলা চালিয়েছে ভারতীয় বাহিনী। যার ফলশ্রুতিতে দুটী পণ্যবাহী জাহাজের ক্ষতিসাধন হয়েছে। ঐ জাহাজ দুটিতে পূর্ব পাকিস্তানের বিপর্যস্ত খাদ্য পরিবহন ঠিক করতে ছিল প্রচুর পরিমানে খাদ্য পণ্য এবং প্রয়োজনীয় আরো অনেক পণ্য।
এই হলো ২১শে নভেম্বর এর পরিস্থিতি। সেই তখন থেকে ভারতীয় বাহিনী আমাদের আন্তর্জাতিক সীমান্ত লংঘন করে তাদের আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে এবং আমাদের মাটির ওপর শত্রুতামূলক ব্যবস্থা নিয়েছে। গত দুই সপ্তাহ ধরে পাকিস্তানী বাহিনী সবগুলো সেক্টরেই ভারতীয় আগ্রাসন রুখে দিয়েছে। বর্তমান যুদ্ধবিগ্রহমূলক অবস্থা বুঝতে হলে ঐ যুদ্ধটি সম্পর্কে মাথায় রাখতে হবে যেটি অগ্রবর্তী হয়ে এবং চরম আকার ধারন করে ৩ ডিসেম্বর পুর্ণ মাত্রায় যুদ্ধে পরিণত হয়েছে।
আমার প্রথমেই যশোর কথা উল্ল্যেখ করা দরকার। পূর্ব পাকিস্তানের এই দক্ষিন-পশ্চিম ফ্রন্টে ২১ নভেম্বর থেকে ভারতীয় বাহিনী ট্যাংক এবং ভারী কামানের গোলার মাধ্যমে আক্রমন চালাচ্ছে। এর মধ্যে কয়েকটি হামলার ধরণ ছিল ব্রিগেড আকারে। পাকিস্তানি বাহিনীর অল্প বিস্তার থাকা কয়েকটি অঞ্চলে ভারতীয় বাহিনী সফলও হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে চৌগাছা, যেটা আমাদের সীমান্তের ৬ মেইল অভ্যন্তরে এবং জীবন নগরও। এছাড়া বুইন্দা, শিমুলিয়া, কৃষাণপুর, জামালপুর এবং নবগ্রামে তাদের হামলাগুলো ছিল ভোতা ধরনের। যশোর সেকশনে সংঘর্ষে অন্তত দেড়শ’ ভারতীয় সেনা নিহত হয়েছে, আহত হয়েছে পাচ শতাধিক। বেশ কয়েকটি ভারতীয় ট্যাংক ধ্বংস হয়েছে। যশোর সেক্টরে বেশ কয়েকটি ভারতীয় ইউনিটকে শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে, ১৪ তম পাঞ্জাব রেজিমেন্ত, ১ম জোম্মূ ও কাশ্মীর ব্যাটালিয়ন, নবম ভারতীয় পদাতিক বাহিনীর ৩৫০ তম ব্রিগেড। অপরদিকে উত্তর-পূর্ব ফ্রন্টে দিনাজপুর-রংপুর সেক্টোরে হিলিতে গেল কয়েকদিন যাবত উপর্যুপরি হামলা চালাচ্ছে ভারত। এছাড়াও যেসব এলাকায় সংঘর্ষ চলছে তার মধ্যে রয়েছে পঞ্চগড়, নাগেশ্বরী, বাদতারা এবং মির্জাপুর। এসব হামলায় ভারতীয় ট্যাংক এবং যুদ্ধবিমান ব্যবহার করা হয়েছে। দিনাজপির-রংপুর সেক্টরে যেসব ভারতীয় ইউনিট সনাক্ত করা হয়েছে তার মধয়ে রয়েছে দশম ভারতীয় মাইন্টেন ডিভিশনের ১৬৫ তম মাউন্টেন ব্রিগেড, চতুর্থ রাজপুত রেজিমেন্ট, সপ্তম মারহাট্টা হালকা পদাতিক বাহিনী এবং নবম ভারতীয় মাউন্টেন ডিভিশন।
পূর্ব পাকিস্তানে হামলা শুরুর প্রথম দিন থেকেই উত্তর-পূর্ব অংশের সিলেট সেক্টরে জোরালো প্রেশার সৃষ্টি করেছে ভারত। সেখানে বড় আকারের যুদ্ধ হয়েছে পাকিস্তান সীমান্তের দুই মেইল ভেতরের আটগ্রামে। এছাড়া যুদ্ধ হয়েছে জকিগঞ্জ, রাধানগর, কানাইঘাট, গৌরিপুর, চান্দেরপুর, লক্ষীপুর, লাটুমূড়া এবং শমশেরনগরে। এসব হামলায় ২২৫ জনেরও বেশি ভারতীয় নিহত হয়েছে, আহত হয়েছে কয়েকশ’। সিলেটে সেক্টরে যেসব ভারতীয় ইউনিট শনাক্ত করা হয়েছে তার মাঝে রয়েছে, ৮১ তম মাউন্ট ব্রিগেডের ৪র্থ কুমাওন এবং ৮২৫ তম ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী।
কুমিল্লা সেক্টর, পূর্ব পাকিস্তানের এই অংশে ভারতীয়রা প্রচন্ড বল প্রয়োগ করেছে কশবা, আখাউড়া, অংগদার বাজার, ফাতাবানগর, গাজীপুর, চৌদ্দগ্রাম এবং মোরাচালে। এর মধ্যে একটি যুদ্ধে ৫৭ তম মাউন্টেন ডিভিশনের ১৯ তম পাঞ্জাব ডিভিশন এর অন্তত ১৯৭ ভারতীয় সেনা নিহত হয়। এছাড়া কুমিল্লা সেক্টরে আর যেসব ভারতীয় ইউনিট শনাক্ত করা হয়েছে তার মধ্যে জম্মুতে বেড়ে ওঠা দগ্রা ব্যাটালিয়ন। এছাড়া এই সেক্টরে গেল কয়েকদিনে ভারতীয় বাহিনীর নতুন একটি ইউনিট পদাচরণ করছে এমন প্রমাণ আমরা পেয়েছি।
পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ব ফ্রন্টে ময়মনসিংহ জেলায়, যেটা মমিনশাহী নামেও পরিচিত, সেখানকার কামালপুর এলাকায় যুদ্ধে অংশ নিয়েছে ভারতীয় বাহিনীর ব্যাটালিয়ন অব থার্টিন গার্ডস। এছাড়া ২ ডিসেম্বর এই সেক্টরে নতুন করে ভারতীয় সেনারা প্রবেশ করে।
পূর্ব পাকিস্তানের দক্ষিন-পূর্ব অংশের পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় মূল যুদ্ধটা হয়েছে ছোটা হরিণা এলাকায়। ঐ যুদ্ধে নবম গুর্খা ব্যাটালিয়নকে শনাক্ত করা হয়েছে।
গেল দুই সপ্তাহে পাকিস্তানের পূর্ব অংশে ভারতের আগ্রাসন এবং আমাদের সীমান্তের মধ্যে ও সম্মূখভাগে ভারতীয় সেনাদের আক্রমণের বিস্তারিত উপাত্ত এগুলো। এই বিষয়টি প্রতিস্থাপিত হয়ে গেছে যে, ২১ নভেম্বর থেকে ভারতীয় বাহিনী তাদের বিমান বাহিনীর ছত্রছায়ায় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যে আগ্রাসন চালাচ্ছে তা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। ভারত-পাকিস্তান এবং উপমহাদেশের উন্নয়নে যেসব সরকার রয়েছে তারা তাদের নিজস্ব তথ্যের মাধ্যমেই এই উস্কানিবিহীন বড় আকারের হামলা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয়েছে।
৩ ডিসেম্বর বিকেলে ভারত তাদের বাহিনীর নতুন ফ্রন্ট খুলেছে, এবার পশ্চিম পাকিস্তনের বিরুদ্ধে। এই হামলা চালানো হয়েছে বিমান বাহিনীর সহায়তায় ভারতের স্থল বাহিনীর দ্বারা এবং টানা চারদিন পশ্চিম পাকিস্তান জুড়ে আগ্রাসনমূলক বিমান হামলা চালানো হয়েছে। বিকেলের দিকে ভারতীয় বাহিনী পাকিস্তান সীমান্তের দিকে অগ্রসর হয়। এসময় পাকিস্তানী রেঞ্জাররা বাধা দিলে তারা হালকা অস্ত্র দিয়ে গুলি চালায়। এতে আমাদের বেশ কয়েকজন আহত হয়। আত্মরক্ষার্থেই রেঞ্জাররা ভারতীয়দের উপর গুলি চালায়। এমন ঘটনা পর্যায়ক্রমে ঘটেছে শাকারগড়, কাসুর, হুসাইনিওয়ালা এবং ভারতের রাজস্থান প্রদেশের বিপরীতে রহিম ইয়ার খানে।
বিরোধপুর্ণ জম্মু ও কাশ্মীরের পুঞ্চ এলাকায় পাহাড়ে সেনা একশন চালায় ভারতীয়রা। দুই ঘন্টা বাদে ভারতীয়রা ভারী কামান নিয়ে বড় আকারের হামলা চালায়। এই হামলা সরাসরি চালানো হয়েছিল বিরোধপূর্ণ জম্মু ও কাশ্মীরের ছাম্ব এলাকায়, এবং আন্তর্জারিক সীমানা তিন এর শিয়ালকোট এলাকায়। হামলা চালানো হয়েছে জাশার ব্রিজ ও লাহোরের মধ্যবর্তী এলাকায়ও। এছাড়া রাজস্থানে সীমান্তের বিপরীত দিকে রহিম ইয়ার খানেও। ভারতীয় সেনাবাহিনীর এই হামলা চালানো হয়েছে ভারতীয় বিমানবাহিনীর ছত্রছায়ায়।
৫শ’ মাইল সীমানাজুড়ে এই পূর্বপরিকল্পিত হামলার জবাবে বাধ্য হয়েই বিপরীত হামলা চালিয়েছে পাকিস্তানী বাহিনী। পরবর্তীতে বিমান বাহিনী পাকিস্তান সীমান্তের শ্রীনগর এবং ভারত অধিকৃত কাশ্মীরে এবং পাঠানকোট ও অমৃতসরের বিমানফিল্ডে হামলা চালায়।
এই অবিশ্বাস্য ভারতীয় আগ্রাসন থেকে এটা পরিস্কার যে এই হামলার পরও ভারত অনধিকার এবং দায়িত্বহীন মিথ্যা ব্যাখ্যা চালিয়ে যাচ্ছে। ২১ নভেম্বর থেকে পাকিস্তানের মাটিতে ভারতীয়দের আগ্রাসন অস্বীকার করার মধ্য দিয়েই এই মিথ্যা বলছে তারা। ২২ নভেম্বর ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয়ের এক মুখপাত্র বলেন, আমাদের সেনাদের সীমান্ত অতিক্রম না করতে কঠোর নির্দেশ দেয়া আছে।
এই বিবৃতি এমন একটি সময়ে দেয়া হয়েছে, যখন ভারতীয় সেনারা এরই মধ্যে সীমান্ত অতিক্রম করে ফেলেছে এবং সংঘর্ষ চালিয়েছে পাকিস্তানের এলাকারই বিভিন্ন অংশে। ২৪ নভেম্বর রয়টার্সে ডাকে পাঠানো একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছেঃ
“ভারত সরকারের একজন মুখপাত্র আজ জানিয়েছেন, গেল রোববার (যেটা ২১ নভেম্বর) ভারতীয় ট্যাংক পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তে প্রবেশ করেছে, যেখানে তারা ১৩টি পাকিস্তানী ট্যাংক ধ্বংস করেছে। ঐ মুখপাত্র আরো বলেন, ভারতীয় সেনাদের দেয়া নির্দেশনায় সংশোধন আনা হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে, আত্মরক্ষার্থে তারা সীমান্ত অতিক্রম করতে পারবে। তিনি নিশ্চিত করেছেন, আমাদের (ভারত) ট্যাংক রোববার আত্মরক্ষার্থেই যুদ্ধে অংশ নেয়। তাকে যখন প্রশ্ন করা হয়, তারা পুর্ব পাকিস্তানে গিয়েছে কি না, তখন জবাবে তিনি বলেন স্বাভাবিকভাবেই তারা সীমান্ত অতিক্রম করতে বাধ্য হয়েছে।“
মিস্টার প্রেসিডেন্ট এবং নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের প্রতি আমি অনুরোধ জানাবো ভারতের অস্বীকার এবং স্বীকারের প্রতি যেটা স্পষ্টতই প্রতীয়মান তার প্রতি এই চতুর্মূখী প্রতিরোধ বজায়ে রাখুন।
যখন তারা বাধ্য হল তখনই কেবল স্বীকার করল যে তারা পাকিস্তানের সীমানায় যুদ্ধ করেছে। ভারত যদিও বলছে এটা তাদের আত্মরক্ষার্থে। কিন্তু যখন থেকে জাতিসংঘ সনদ অনুমোদন হয়েছে, তারপর কি জাতিসংঘের কোন সদস্য রাষ্ট্র আত্মরক্ষার নামে অন্য কোন দেশে আক্রমন চালাতে পারে? এটা খুবই চমকপ্রদ যে, পাকিস্তান যা আকারে ভারতের চারভাগের একভাগ, যাদের সেনাবাহিনী ভারতের সেনাবাহিনী থেকে পিছিয়ে আছে কি জনশক্তি কিংবা অস্ত্র শক্তিতে, যে দেশ বর্তমানে নিজেই প্রবল আভ্যন্তরীন সংকটে ভুগছে, তারা কিভাবে নভেম্বরে ভারতের উপর আক্রমন চালায়। পূর্ব পাকিস্তানের ভূমি, যা তিনিদিক থেকে ভারতীয় সীমান্ত দিয়ে ঘেরা এবং পুরো উত্তর ভারতের মাত্র ১.১১ শতাংশ ঘিরে রয়েছে পশ্চিম অঞ্চলে। অবৈধভাবে আকাশপথ বন্ধ করে দেয়ার মধ্য দিয়ে গেল ফেব্রুয়ারীতে পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে সরাসরি আকাশ যোগাযোগ ভারত বন্ধ করে দেয়।
তাছাড়া আমাদের সেনাবাহিনীর খুব ক্ষুদ্র একটি অংশ পূর্ব পাকিস্তানে নিয়োজিত রয়েছে। এই অবস্থায় পাকিস্তানী বাহিনীর পক্ষে ভারতে আক্রমন করার মত যুক্তি কি ই বা হতে পারে? অবশ্য এটা অনুমান করাই কঠিন যে সামান্য ছুতা ধরে আত্মরক্ষার নামে অদ্ভূত পদক্ষেপ নিতে পারে।
স্বাভাবিকভাবেই এটা প্রত্যাশিত ছিল যে, ভারত পাকিস্তানে হামলা চালানোর জন্যে যুক্তি দাড় করাবে যে, পাকিস্তানের বাহিনী ভারতীয় সীমান্তের নির্দিষ্ট স্থানে ও সময়ে অনুপ্রবেশ করেছে। মিথ্যা হওয়া সত্তেও এসব অভিযোগ আমলে নেবার সময় নিরাপত্তা পরিষদকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে তাদের সেই মূলনীতিকে, যেখানে বলা হয়েছে, একটি রাষ্ট্র যে তার নিজের এলাকাতেই অনিয়মিতভাবে অন্য দেশের সরাসরি প্ররোচনায় এবং সহায়তায় পরিচালিত সন্ত্রাসীদের দ্বারা নির্যাতিত, সেই রাষ্ট্র তার অস্তিত্ত্ব রক্ষায় এবং তার প্রতিষ্ঠান রক্ষায় যে কোন ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারে। এই নীতিটি আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত, বিভিন্ন মহাদেশের বিভিন্ন রাষ্ট্র এবং রাজনৈতিক মিত্রদের কাছে আগ্রাসনের সংজ্ঞা হিশেবে জ্ঞাত।
পাকিস্তান কোন অর্থেই সশস্ত্র ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে দমনে এমন পদক্ষেপ নেয়নি যার উদ্দ্যেশ্য ছিল দেশের বিভাজন। ৩ ডিসেম্বরের পূর্বে ঘটে যাওয়া ঘটোনাবলীর মাধ্যে বিতর্কের উর্ধ্বে থাকা সত্য বিষয়গুলো হলঃ
প্রথমত, ভারতের প্ররোচনায় সশস্ত্র গোষ্ঠীর মাধ্যমে যুদ্ধ, ধ্বংস এবং সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের শিকার হয়েছে পাকিস্তান।
দ্বিতীয়ত, এই কর্মকান্ডে যেই সব নিষিদ্ধ সংগঠন অংশ নিচ্ছে তাদের পরিচালনা করা হচ্ছে ভারতীয় অঞ্চল থেকে এবং তাদের ভিত্তিও ভারতে।
তৃতীয়ত, পাকিস্তানের আভ্যন্তরীন নিরাপত্তার জন্য, ঐসব নিষিদ্ধদের ধরা এবং নির্বাসনে পাঠানো জরুরী হয়ে পড়েছিল। আমি নির্দ্বিধায় এবং পূর্ণ দায়িত্বের সাথে বলতে পারি, কোন সময়ে এবং কোন স্থানে আত্মরক্ষা এবং আভ্যন্তরীন নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ছাড়া পাকিস্তানী বাহিনী পূর্ব অংশে কোন ধরনের পদক্ষেপ নেয়নি।
তারপরও বাস্তবতার বিপরীতে গিয়ে যদি এটাও ধরে নেয়া হয় যে, কিছু ক্ষেত্রে আঞ্চলিক আক্রমন ঠেকাতে সীমান্ত জুড়ে কোথাও বাড়তি পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। তারপরও ভারতের কোন ক্ষমতা নেই আত্মরক্ষার নামে পাকিস্তানে চালানো হামলাকে স্বীকৃতি দেবে।
ভারতের অভিযোগ এবং তার সমর্থনে পাকিস্তানের আক্রমন অসাড় আর অনৈতিক ছাড়া কিছুই নয়, কেননা তারাই পাকিস্তানের সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন দিচ্ছে। যদি এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো ভারত দ্বারা এবং ভারতের মাটি থেকে পরিচালিত না হয়, তবুও ভারত তাদের সম্পর্কে জানে, তাদেরকে অস্ত্র এবং অন্যান্যভাবে সহায়তা করা পাকিস্তানের আভ্যন্তরীন ব্যাপারে কেবল নাক গলানই নয় বরং পরোক্ষভাবে এটা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আগ্রাসনও বটে। তখন থেকেই এই ব্যাপারটা সুনিশ্চিত যে, এইসব সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর প্রশিক্ষন, সংগঠিত হওয়া, অর্থ, অস্ত্র এবং অন্যান্য সব সরঞ্জামই ভারত দিয়েছে। এমনকি তাদের অভিযানগুলোও সরাসরি ভারত দ্বারা পরিচালিত হয়েছে, তারা আর কিছুই না বরং অনিয়মিত ভারতীয় বাহিনী। তারা নিয়মিতভাবে অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকান্ড এবং আক্রমন চালিয়ে যাচ্ছে এবং ভারতের নিয়মিত সেনাবাহিনীর সেনা কর্মকান্ড দ্বারা সমর্থিত হচ্ছে। এসব সন্ত্রাসী গোষ্ঠী যে ভারতের দ্বারা সমর্থিত, সংগঠিত এবং পরিচালিত হচ্ছে তা প্রমান করতে আমাকে কোন উদ্দৃতি দিতে হবে না। এটা তারা নিজেরাই স্বীকার করে নিয়েছে। ২০ জুলাই ভারতের পার্লামেন্টে ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “ভারত তার সামর্থ্যের সবকিছু করছে, আমি আবারো বলছি সামর্থ্যের সবকিছু মুক্তিবাহিনীকে সমরত্থন দিতে”।
নিরাপত্তা পরিষদের সামনে যে পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়েছে তা হল শুরুতে যেমন বলছি, শান্তির লংঘন হচ্ছে। এটা আর কিছুই নয় পাকিস্তানের আভ্যন্তরীন বিষয়ে ভারতের নাক গলানো এবং একের পর এক ভয় প্রদর্শনমূলক কর্মকান্ড। পাকিস্তানের আভ্যন্তরীন সংকট নিরাপত্তা পরিষদের চিন্তার বাহিরে। নয়াদিল্লী সরকারের পাতা কোন ফাদে পা দেয়া আমার উচিৎ নয়, যে কিনা তার নাক গলানো আর আগ্রাসনকে বৈধতা দিচ্ছে পাকিস্তানের আভ্যন্তরীন সংকটে হস্তক্ষেপের মধ্য দিয়ে। আমি আশা করি এবং আস্থা রাখি যে নিরাপত্তা পরিষদ একইভাবে জাতিসংঘের বিচারব্যবস্থার আওতার বাইরের ক্ষেত্রবিশেষ নিয়ে উঠতি বিতর্কের দিকেও নজর রাখবে।
পরিষদ একইভাবে জাতিসংঘের বিচারব্যবস্থার আওতার বাইরের ক্ষেত্রবিশেষ নিয়ে উঠতি বিতর্কের দিকেও নজর রাখবে।
নিম্নে ৩ ডিসেম্বর এর পূর্ববর্তি অবস্থা সম্পর্কে কিছু তথ্য তুলে ধরা হলো। উল্লেখ্য, এগুলো সম্পর্কে বিতর্ক বা সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।
প্রথমত, পাকিস্তান বিভিন্ন সশস্ত্র দলের নাশকতা এবং সন্ত্রাসী কার্যক্রমের শিকার। আর এদের সংগঠিত করার পিছনে দায়ী ভারত।
দ্বিতীয়ত, এ সব নাশকতামূলক কার্যক্রমের মাঝে ছিল বহিরাগত কিছু গোষ্ঠীর অনুপ্রবেশ , যাদের ঘাঁটি ছিল ভারতে এবং সেখান থেকেই তারা তাদের কার্যক্রম চালাতো।
তৃতীয়ত, অভ্যন্তরীন নিরাপত্তা রক্ষার জন্য সর্বপ্রথমেই যে পদক্ষেপটি নেয়া দরকার তা হলো, এ সমস্ত দলগুলোকে আটক অথবা পাকিস্তান থেকে বহিষ্কার।
আমি সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিয়েই বলতে চাই, পাকিস্তানে অবস্থানরত সামরিক বাহিনীর সদস্যবৃন্দঅভ্যন্তরিন নিরাপত্তা এবং দেশের সীমান্ত রক্ষার জন্য যা প্রয়োজন তার বাইরে একটি পদক্ষেপও নেয় নি।
কিছু না ঘটা সত্ত্বেও শুধুমাত্র যদি তর্কের খাতিরে ধরে নেই যে সীমান্তের কিছু জায়গাতে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু সীমালংঘনের ঘটনা ঘটেছে, তারপরও ভারতের এই দাবি কোনভাবেই সমর্থনযোগ্য নয় যে আত্মরক্ষার খাতিরেই পাকিস্তানের অভ্যন্তরে আক্রমণ চালাতে হয়েছে।
ভারতিয়দের আরেকটি উদ্ভট ও অগ্রহণযোগ্য দাবি হলো, তাদের এই আক্রমণ যুক্তিসংগত কারণ তারা পাকিস্তানের অভ্যন্তরে বিদ্রোহিদের সমর্থন দিচ্ছে। কিন্তু এই বিদ্রোহিরা যে ভারতের অভ্যন্তরে অবস্থান করছে বা সেখান থেকে তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে, এমনটি কিন্তু নয়। উপরন্তু, ভারত তাদের অস্ত্র দিয়ে এবং বিভিন্ন উপায়ে সাহায্য করে চলেছে-তাদের এই স্বীকারোক্তি থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে তারা যে শুধুমাত্র পাকিস্তানের অভ্যন্তরিন বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেছে তাই নয়,পরোক্ষভাবে তারা আগ্রাসনও চালাচ্ছে। এ বাহিনীগুলো ভারতের দ্বারা প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত,সংগঠিত,আর্থিকভাবে সাহায্যপ্রাপ্ত। তাদেরকে অস্ত্র ও বিভিন্ন সরঞ্জাম সরবরাহ করে এবং ঘাঁটি তৈরি করে দিয়েও সাহায্য করেছে ভারত। এমনকি তাদের কার্যক্রমও ভারতের দ্বারাই নির্দেশিত-যা থেকে স্পষ্টই বোঝা যায় এরা ভারতের এক প্রকার অনিয়মিত বাহিনী ছাড়া আর কিছুই নয়।ভারতিয় সামরিক বাহিনী দ্বারা সমর্থিত তাদের এই উপর্যুপরি আক্রমণ এবং অনুপ্রবেশ আসলে ভারতের নিয়মিত সামরিক বাহিনি দ্বারা সরাসরি আক্রমণেরই নামান্তর।
ভারতিয়রা যে বিদ্রোহিদের অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করছে এবং নিয়মিত দিক নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছে, আমার মনে হয় না আমার এই দাবির পিছনে কোন প্রমাণ এখানে তুলে ধরার প্রয়োজন আছে। কেননা, তারা নিজেই তা স্বীকার করেছে। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রি ২০ জুলাই পার্লামেন্টে বলেন,
“মুক্তিবাহিনিকে সাহায্য করার জন্য ভারতের পক্ষে যা যা করা সম্ভব,সব ই করছে।” আমি আবার বলছি, “যা যা করা সম্ভব, সব ই করছে।”
নিরাপত্তা পরিষদের সামনে শুরুতেই আমি একটি ঘটনা তুলে ধরেছিলাম,যা আসলে একের পর এক শান্তি লংঘনকারি ঘটনা সমূহের মাঝে মাত্র একটি ঘটনা। ইহা আসলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতিয়দের দ্বারা সংঘটিত একের পর এক নাশকতামূলক কার্যক্রমসমূহেরই ফসল, যার উদ্দেশ্যই ছিল পাকিস্তানের অভ্যন্তরিন কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটানো।ভারত তার অযাচিত হস্তক্ষেপ এবং আগ্রাসনকে বৈধতা দিতে চাইছে পাকিস্তানের অভ্যন্তরিন সংকটকে অজুহাত হিসেবে দেখিয়ে। নয়াদিল্লি সরকারের তৈরি করা এই ফাঁদে পা দিতে আমি রাজি নই। পাকিস্তানের অভ্যন্তরিন সংকট নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদের হস্তক্ষেপের কোন প্রয়োজন নেই। আমি আশা করবো, জাতিসংঘের এক্তিয়ারের বাইরের বিষয় নিয়ে অহেতুক বিতর্ককে নিরাপত্তা পরিষদ নিরুৎসাহিত করবে। নিরাপত্তা পরিষদের কাজ আন্তর্জাতিক শান্তির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, কোন সদস্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরিন শান্তি বা রাজনিতির সাথে নয়। পাকিস্তানের অভ্যন্তরে যা ঘটছে এ নিয়ে কারো ব্যক্তিগত মতামত যাই হোক না কেন, কোন কাজগুলো ভুল বা সঠিক হয়েছে এ নিয়ে যে যেমনটাই ভেবে থাকেন না কেন, তার কোন কিছুই ভারতের অযাচিত হস্তক্ষেপকে বৈধতা দেয় না।
বিশ্ব শান্তি বজায় রাখার অন্যতম একটি শর্ত হলো, কোন রাজনৈতিক,অর্থনৈতিক,কৌশলগত,সামাজিক বা আদর্শগত বিবেচনা দ্বারা এক রাষ্ট্রের প্রতি অন্য রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ আক্রমণ অথবা অভ্যন্তরিন বিষয়ে অযাচিত হস্তক্ষেপকে বৈধতা দেয়া যাবে না। আমরা জানি সাধারণ পরিষদের অনেকগুলো ঘোষণাও এই নীতিকে মেনে নিয়েছে। আমি এখানে সবগুলোর কথা উল্লেখ করবো না কারণ এই নীতির স্বীকৃতি এবং জাতিসংঘে তার আইনগত প্রয়োগ ঐ সমস্ত ঘোষণাসমূহের উপর নির্ভর করে না। ‘কোন দেশের অভ্যন্তরিন বিষয়ে হস্তক্ষেপের অগ্রহণযোগ্যতা’ এবং তাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য ১৯৬৫ সালে সাধারণ পরিষদ যে ঘোষণা দিয়েছে, আমার মনে হয় শুধুমাত্র তার উল্লেখ করাই এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট হবে।(General Assembly Resolution 2131(XX))
উক্ত ঘোষণার কার্যকরি অনুচ্ছেদ ১ এ উল্লেখ আছেঃ
“কোন রাষ্ট্রই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অন্য কোন রাষ্ট্রের বাহ্যিক বা অভ্যন্তরিন বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না,কারণ যাই হোক না কেন। সেই সাথে সশস্ত্র বা যে কোন ধরণের আগ্রাসন অথবা কোন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বা তার রাজনিতি,অর্থনিতি বা সংস্কৃতির বিরুদ্ধে কোন ধরণের হুমকি প্রদান সম্পূর্ণরুপে অগ্রহণযোগ্য।”
কার্যকরি অনুচ্ছেদ ২ এ উল্লেখ আছেঃ
“………… সন্ত্রাসি বা ধ্বংসাত্মক কাজের মাধ্যমে কোন রাষ্ট্রের সরকার উৎখাতের চেষ্টা হলে তাতে অন্য কোন রাষ্ট্র কোন প্রকার আর্থিক বা সাংগঠনিকবা অন্য কোন প্রকার সাহায্য দিতে পারবে না। এমনকি কোন রাষ্ট্রের অভ্যন্তরিন কোন দ্বন্দ্বেও অন্য কোন রাষ্ট্র কোন প্রকার হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। ”
কার্যকরি অনুচ্ছেদ ৪ এ উল্লেখ আছেঃ
“……… অযাচিত হস্তক্ষেপের এই চর্চা যে যে শুধুমাত্র জাতিসংঘের মূলনিতি বা এর সনদের অবমাননা তা নয়, উপরন্তু এ থেকে এমন সব পরিস্থিতির উদ্ভব হবে যা “আন্তর্জাতিক শান্তি এবং নিরাপত্তা”কে ও বিঘ্নিত করবে।
আমার মনে পড়ছে, ‘কোন রাষ্ট্রের অভ্যন্তরিন বিষয়ে হস্তক্ষেপের অগ্রহণযোগ্যতা বিষয়ক ঘোষণা’ তৈরিতে যে কমিটি ভূমিকা রেখেছিল তাতে ভারত ও উপস্থিত ছিল। অন্যের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার নীতি সমর্থনের জন্যও জাতিসংঘের মাঝে ভারত বেশ সুপরিচিত। এই নীতি মেনে চলার ব্যাপারে কেন তাদের এত আগ্রহ তা কারও কাছেই গোপন নয়, এবং আমরা পাকিস্তানিরা তা বেশ ভাল করেই জানি। তারা ভুলে যাচ্ছে যে জম্মু এবং কাশ্মির ততক্ষন পর্যন্ত ভারতের অংশ হিসেবে গণ্য হবে না যতক্ষন পর্যন্ত নিরপেক্ষ গণভোটের মাধ্যমে রাষ্ট্র তাদেরকে ভারতের সাথে যুক্ত হওয়ার জন্য রায় দেবে। এমনকি জম্মুর জনগণের জন্য পকিস্তানের পক্ষ থেকে নৈতিক এবং রাজনৈতিক সাহায্য পৌঁছানোর রাস্তাও ভারত বন্ধ করে দিয়েছে।যাই হোক, এই মূহুর্তে আমি এসব বিষয়ের অবতারণা করতে চাচ্ছি না। লক্ষণীয় বিষয় হলো, এ বিষয়ে ভারতের আগ্রহ এত বেশি যে ভারত যে সমস্ত পরাশক্তিকে তার বন্ধু বলে দাবি করে তাদের সাথে সুসম্পর্কের চেয়েও বিষয়টিতে নাক গলানো তাদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ১৯৬৮ সালের ২১ আগস্ট তারিখে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল, যার বিষয়সমূহের মাঝে ছিল চেকোস্লোভাকিয়ার উন্নয়ন। উক্ত সভায় ভারতিয় প্রধানমন্ত্রির লিখিত একটি বিবৃতি পাঠ করেন ভারতিয় প্রতিনিধি। নিম্নে তার কিছু অংশ তুলে ধরা হলোঃ
“রাষ্ট্রসমূহের মাঝে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য প্রধান শর্ত হলো একে অপরের অভ্যন্তরিন বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকা। আমরা বিশ্বাস করি,ছোট বা বড় যে কোন রাষ্ট্রেরই স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বজায় রাখা উচিৎ। কোন রাষ্ট্র যাতে তার নিজস্ব ঐতিহ্যের উপর ভিত্তি করে এবং তার নিজস্ব মেধার উপর নির্ভর করে একটি পৃথক সত্ত্বা হিসেবে গড়ে উঠতে পারে,সে বিষয়ে আমরা সর্বদাই সচেতন। যখনই কোথাও এই নীতির ব্যত্যয় ঘটেছে ভারত তখনই এর প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছে।
অন্যান্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরিন বিষয়ে হস্তক্ষেপের ব্যাপারে এই ছিল ভারতিয় প্রধানমন্ত্রির বক্তব্য।
উপরোক্ত বক্তব্য প্রদান সত্ত্বেও শুরু থেকেই ভারত নির্লজ্জের মত পাকিস্তানের অভ্যন্তরিন বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে আসছে। এ বছরের শুরু থেকে তা বেশ গুরুতর আকার ধারণ করে যা পাকিস্তানের অভ্যন্তরিন সমস্যার জন্যও দায়ি। উদ্দেশ্য একদম স্পষ্ট, পাকিস্তানের রাজনৈতিক এবং সাংবিধানিক অবস্থার পরিবর্তনের ফলাফল যেন পাকিস্তানের বিভক্তিকরণের মধ্য দিয়েই শেষ হয়।
পাকিস্তানের অভ্যন্তরিন বিষয়ে ভারতের কিছু অযাচিত হস্তক্ষেপের কথা আমি সংক্ষেপে তুলে ধরছিঃ
প্রথমত,১৯৭০ সালে পাকিস্তানে নির্বাচনের পূর্বেই ভারত এদেশের বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদিদের সাথে অস্ত্র এবং গোলাবারুদ সরবরাহের জন্য যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে তোলে।
দ্বিতীয়ত,১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জম্মু এবং কাশ্মির হতে আগত একটি বিমান ছিনতাই করে ভারত। ছিনতাইকারিরা ছিল ভারতিয় গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভারত তার ভূখন্ডের উপর দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান হতে পূর্ব পাকিস্তানে বিমান চলাচল বন্ধ করে দেয়। সম্পুর্ণ অবৈধ এই নিষেধাজ্ঞার কারণে পাকিস্তানের দুই অংশের মাঝে আকাশপথে সরাসরি যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ভারতের সরকারি সূত্রে এমনটিও বলা হয়েছে যে,যদি আকাশপথে যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনরায় চালু করে দেয়া হয় তবে তা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মনে সন্দেহের উদ্রেক করবে।
তৃতীয়ত,পাকিস্তানের সংবিধানের ভবিষ্যৎ নিয়ে রাজনৈতিক মতৈক্যে পৌঁছানোর জন্য যে আলোচনা চলছিল তা ব্যর্থ হওয়ার পরপরই ভারত তার পার্লামেন্টে একটি বিশেষ দলকে সমর্থন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। আমি নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের সামনে একটি প্রশ্ন রাখতে চাই, আপনাদের প্রতিবেশি কোন রাষ্ট্রের এরকম কোন অভ্যন্তরিন সমস্যার ক্ষেত্রে কি আপনাদের সরকার কি এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা ভাবতে পারতো?
চতুর্থত, পূর্ব পাকিস্তানের এই অভ্যুত্থানে সাহায্য করে ভারতের মিথ্যা প্রচারণা, যার জন্য এই অভ্যুত্থান মারাত্মক আকার ধারণ করে। ভারতিয় প্রচার মাধ্যমের এসব প্রচারণা ছিল সম্পূর্ণ অতিরঞ্জিত। আর এই অতিরঞ্জিত প্রচারণার ফলে বিদেশি সংবাদ মাধ্যমও এ নিয়ে প্রচার শুরু করে দেয়। ভারতিয় সংবাদ মাধ্যমের সাথে বিদেশি সংবাদ মাধ্যমেরও প্রচারণা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মাঝে ব্যাপক ভীতির সঞ্চার করে এবং যার ফলাফল স্বরুপ বিপুল সংখ্যক মানুষ দেশ ছেড়ে চলে যায়।
পঞ্চমত,ভারত এই শরণার্থি সমস্যা থেকে সামরিক,রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক সুবিধা নেয়া শুরু করে। সামরিকভাবে নেয়া সুবিধাটি হলো, দেশ ছেড়ে আসা এসব মানুষদের নিয়ে ভারত একটি অনিয়মিত সশস্ত্র বাহিনী তৈরি করে।
রাজনৈতিকভাবে নেয়া ফায়দাটি হলো,শরণার্থিদের মাঝে ভারত একটি ধারণা ঢুকিয়ে দেয়-তারা যখন দেশে ফিরে যাবে তখন তারা পাকিস্তানের কোন একটি অংশে ফিরে যাবে না, তারা ফিরে যাবে একটি সম্পূর্ণ নতুন সার্বভৌম রাষ্ট্রে। ভারতের কেন্দ্রিয় সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রিরা প্রকাশ্যে এরকম বহু উক্তি করেছেন।কূটনৈতিকভাবে, শরণার্থি সমস্যাকে কাজে লাগিয়ে পাকিস্তানে সব ধরণের আর্থিক সাহায্য পাঠানো বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছে ভারত।
ষষ্ঠত, পাকিস্তানের সমস্যা যাই হোক না কেন, ভারতের জন্য তা মোটেও হুমকি ছিল না। কিন্তু ভারত পাকিস্তানের অভ্যন্তরে পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হওয়ার পর বিন্দুমাত্র দেরি করে নি। অত্যন্ত দ্রুততার সাথে তারা ৫টি ডিভিশন পুর্ব পাকিস্তানের সীমান্তে বা তার কাছাকাছি এলাকায় মোতায়েন করে ফেলে।পূর্ব পাকিস্তানের গ্যারিসনে মোতায়েন করা সৈন্যরা যখন সশস্ত্র বিদ্রোহ সামলাতে ব্যস্ত, ঠিক তখনই ভারত তার সামরিক শক্তি প্রদর্শন শুরু করে। পাকিস্তানকে পরোক্ষভাবে হুমকি দেয়া এবং নাশকতাকারি ও বিদ্রোহিদের উৎসাহ দেয়া ছাড়া ভারতের এই পদক্ষেপের আর কোন উদ্দেশ্য থাকতে পারে কি?
পাকিস্তানের যেসব অভ্যন্তরিন বিষয়ে ভারত হস্তক্ষেপ করেছে,উপরোক্ত ঘটনাগুলো তার ক্ষুদ্র অংশ মাত্র, বর্তমানে যা গুরুতর আকার ধারণ করে আগ্রাসনে রুপ নিয়েছে। পাকিস্তানের অন্তর্দ্বন্দ্বের ফসল স্বরুপ এমন একটি সমস্যার উদ্ভব হয়েছে যা সত্যিকার অর্থেই একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা এবং আমরা তা স্বীকার করতেও প্রস্তুত। আর তা হলো বিপুল সংখ্যক মানুষের পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে ভারতের মটিতে আশ্রয় নেয়া। সমস্যাটা আন্তর্জাতিক হলেও কিন্তু রাজনৈতিক নয়। পাকিস্তান যদি এ সমস্ত ছিন্নমূল মানুষদের বাড়ি ফেরার অধিকার কেড়ে নিত, ভিটেবাড়ি ফিরিয়ে না দিত কিংবা নিজ দেশে সম্মান এবং নিরাপত্তার সাথে বেচে থাকার অধিকার না দিত-তখন তাকে আন্তর্জাতিক সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করা যেত। এই মানুষগুলোকে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার তো প্রশ্নই আসে না, উপরন্তু পাকিস্তান যত দ্রুত সম্ভব তাদেরকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে প্রস্তুত। এছাড়াও পাকিস্তান জাতিসংঘের সাথে যৌথভাবে কাজ করছে স্বেচ্ছায় স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকারিদের যত দ্রুত সম্ভব পুনর্বাসনের জন্য। এ সব কিছু থেকে স্পষ্টই বোঝা যায়, সমস্যাটি সম্পূর্ণই মানবিক-যার সমাধান সমবেদনা এবং সহানুভূতির দ্বারাও সম্ভব। শুধু তাই নয়, এ সমস্যা সমাধানের জন্য ভারত ও পাকিস্তানের মাঝে এবং জাতিসংঘ ও দুই দেশের মাঝেও সহায়তা প্রয়োজন। আর যাই হোক, অন্তত এই সমস্যাটি নিয়ে রাজনিতি কোন ভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়।
কিন্তু ঠিক এই কাজটিই করে যাচ্ছে ভারত। বাস্তুচ্যুত মানুষগুলোর পাকিস্তান ফেরার পথ রুদ্ধ করার মাধ্যমে ভারত পাকিস্তানকে বিভক্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
বলা হয়ে থাকে, বাস্তুচ্যুত মানুষদের ঘরে ফিরিয়ে আনার জন্য এমন পরিবেশ প্রয়োজন যা দেখে সে ভরসা করতে পারে। এই বক্তব্যকে ভুল বোঝার কোন অবকাশ নেই, যদি “এমন পরিবেশ প্রয়োজন যা দেখে সে ভরসা করতে পারে” কথাটির অর্থ কেউ বুঝে থাকে। পাকিস্তান সরকার তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে সেরকম পরিবেশ তৈরি করার। এই চেষ্টাগুলো কি আরও ফলপ্রসূ হতো না যদি ভারত তাদের সাহায্য করতো? জাতিসংঘ এবং পূর্ব পাকিস্তানে জাতিসংঘের অবস্থান কি আরও শক্ত হতো না যদি ভারত তাদের সহযোগিতা করতো? তাদের এই সহযোগিতা কি দেশে ফেরার মত পরিবেশ পাওয়ার ব্যাপারে শরণার্থিদের আরও আশ্বস্ত হত সাহায্য করতো না? ভারত যদি তার একরোখা নীতিতে অটল না থাকতো তাহলে বর্তমান পরিস্থিতি কতটা ভিন্ন হতে পারতো তা বিবেচনার ভার আমি নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের হাতে ছেড়ে দিলাম।
সংক্ষেপে বলতে গেলে, পাকিস্তানের প্রতি ভারতের এই শত্রুভাবাপন্নতা আন্তর্জাতিক শান্তি এবং নিরাপত্তাকেই হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। এই শত্রুতা কিন্তু পাকিস্তানের অন্তর্দ্বন্দ্ব থেকে শুরু হয় নি। পাকিস্তানের এই দুঃসময় ভারতকে তার পরিকল্পনাসমূহ বাস্তবায়নের জন্য এক অভূতপূর্ব সময় ও সুযোগ এনে দিয়েছে মাত্র। Indian Institute of Defense Studies and Analysis এর প্রধান বলেছেন,
“ভারতের বোঝা উচিৎ, পাকিস্তানের ভাঙন আমাদের স্বার্থের অনুকূলেই যাবে। এমন সুযোগ কিন্তু দ্বিতীয়বার আর আসবে না।”
একজন ভারতিয় রাজনীতি বিষয়ক লেখক, জনাব এস. এস. সোয়ামি,নয়াদিল্লী থেকে প্রকাশিত “Motherland” নামক পত্রিকায় ১৫ জুন একটি কলামে লিখেনঃ
“পাকিস্তানের ভাঙন শুধুমাত্র আমাদের বাইরের নিরাপত্তার স্বার্থের সাথেই সম্পর্কযুক্ত নয়, আমাদের অভ্যন্তরিন নিরাপত্তার স্বার্থের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। এর ফলে ভারত একটি পরাশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারবে এবং সেজন্য জনগণকে জাতিয়ভাবে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। তার জন্য সর্বপ্রথমে পাকিস্তানের ভাঙন অত্যন্ত জরুরি।”
আরেকজন লেখক, জনাব জে. এ. নাইক, পাকিস্তানের ভাঙ্গনকে এই অঞ্চলে ভারতের পরাশক্তি হিসেবে উত্থানের পথ হিসেবে দেখছেন। পাকিস্তানে অভ্যন্তরিন সংকট দেখা দেওয়ার পরপরই ১ এপ্রিল নয়াদিল্লীতে এক রাজনৈতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সে সম্মেলনের উপর হিন্দুস্তান টাইমসের রিপোর্টে দেখা যায় সম্মেলনে সবাই একটি ব্যাপারে একমত হয়েছিলেন। তা হলো-“এই শতাব্দির শ্রেষ্ঠ সুযোগটিকে যেভাবেই হোক কাজে লাগাতে হবে।”
এ কথা মনে করার কোন কারণ নেই যে এগুলো তাত্ত্বিক রাজনিতিবিদদের অবাস্তব কল্পনা। নিম্নে আমি ভারতের কিছু সরকারি কর্মকর্তাদের বক্তব্যের কথা তুলে ধরছিঃ
“The Statesmen” পত্রিকার খবর অনুযায়ী, ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রি জনাব জগজীবন রাম,১১ আগস্ট নয়াদিল্লীতে রোটারি ক্লাবের উদ্দেশ্যে বলেন,
“বাংলাদেশকে বাস্তব রুপ দিতেই হবে এবং তা বাস্তবায়িত হবেই, নয়তোবা ভারতের উপর বিপদ কিন্তু অবশ্যম্ভাবি।” এ দ্বারা স্পষ্টই বোঝা যায়, পাকিস্তানের অখন্ডতাকে ভারত হুমকি স্বরুপ মনে করে। এমনকি ১ ডিসেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রি পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তান সেনাবাহিনির উপস্থিতিকে ভারতের নিরাপত্তার জন্য হুমকি স্বরুপ বলে উল্লেখ করেন, যদিও তারা পাকিস্তান এর নিজস্ব এলাকার ভিতরেই ছিল।
১৮ সেপ্টেম্বর,ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রি কিছু কথা বলেন, যা ১৯ সেপ্টেম্বর এর“The Statesmen” পত্রিকায় প্রকাশিত হয়”
“পাকিস্তান সহজেই বাংলাদেশকে স্বাধীনতা দিয়ে দেবে, এটা অতি কল্পনা। তাই আমাদেরকে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে হবে যাতে করে পাকিস্তানের সামনে আর কোন উপায় না থাকে।”
সেই পরিস্থিতি ঠিক কেমন হবে তা Indian Institute of Defense Studies and Analysis ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিয়েছে, যা আমি একটু আগেই উল্লেখ করেছি। ১৫ আগস্ট উক্ত সংস্থাটির প্রধান “Illustrated Weekly of India” নামক সাপ্তাহিকে একটি কলাম লিখেন, যার শিরোনাম ছিল “যুদ্ধই কি আমাদের সামনে একমাত্র পথ?” সেখানে বলা ছিল, “পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ হলে তা হবে ক্ষণস্থায়ি।” যদি কখনও এরকম ক্ষণস্থায়ি যুদ্ধের সম্মুখীন হতে হয় তাহলে তার ঘটনাপ্রবাহ কেমন হবে তার একটা খসড়া তৈরি করে Indian Institute for Defense Studies । আমি নিশ্চিত, নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যবৃন্দ উক্ত খসড়ার কিছু অংশ পড়ে বেশ আগ্রহ বোধ করবেনঃ
“নিরাপত্তা পরিষদ দুই দেশের সাথে সাক্ষাৎ করবে এবং দুই দেশের প্রতিই আহবান জানাবে যুদ্ধ থামানোর জন্য। যুদ্ধ দ্রুত শেষ হয়ে যাবে নাকি দীর্ঘ সময় ধরে চলবে তা নির্ভর করবে ভারতের উপর। এই পর্যায়ে ভারতের চেষ্টা করতে হবে যাতে করে বাংলাদেশ এই দ্বন্দ্বের মাঝে একটি স্বীকৃত পক্ষ হিসেবে পরিচিতি পায়। প্রকৃতপক্ষে, এটাই বাংলাদেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার যথাযথ উপায়। আর একটা জিনিস সবার কাছে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিতে হবে,যুদ্ধবিরতি চুক্তি ততক্ষন পর্যন্ত স্বাক্ষর হবে না যতক্ষন পর্যন্ত না বাংলাদেশের কমান্ডারকে একজন স্বাধীন সেক্টর কমান্ডার হিসেবে গন্য করা হচ্ছে। সেই সাথে বাংলাদেশ সরকারকে একটি স্বতন্ত্র পক্ষ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যবস্থাও করতে হবে।”
১৩ই জুলাই,”লন্ডন টাইমস” পত্রিকাটি থেকে উদ্বৃতিটি সম্পূর্ণরূপে রিপোর্ট করা হয়েছিল। পুনরায় বলছি, এখানে সন্দেহ করার কোন অবকাশই নেই যে সরকারী নীতির সাথে কোন সামঞ্জস্য ছিল।
অক্টোবরে, ইন্ডিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রী, মিঃ জাগজিভান রাম এর কাছে উদ্বৃতি করার জন্য পুনঃ পুনরায় ক্ষমা পারথি, যদিও তার বাচালতায় কিছু দরকারি উপাদান দিয়ে সাজানো কিন্তু এখানে চিন্তা করা যাবে না যে বিষয়গুলো সরকারের চিন্তাভাবনা প্রকাশ করেছে , যদিও তিনি রাষ্ট্রের একজন বিশিষ্ট সদস্য! তার বক্তব্য অনুযায়ী পাকিস্তানের নিজের মাটিতে যে কোন যুদ্ধে এবং ইন্ডিয়া উক্ত সমস্যার সময় দখলকৃত অঞ্ছল খালি করবে না। তিনি আরও বলেন , “ আমরা প্রয়োজনে লাহোর এবং শিয়ালকোট পর্যন্ত যাব এবং যে কোন ফলাফলেই পিছনে ফিরে আসব না।“
এটা পরিষ্কার যে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যায় ইন্ডিয়া যুদ্ধমান অবস্থার মাত্রা দিয়েছে অন্যথায় যা কখনোই হতো না। বলা যায় এই সমস্যাটি আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির আলোকে করা। এই সঙ্কটটি যা আমরা এই বছর সম্মুখীন হয়েছি তা আমাদের দেশের জন্য সর্বোচ্চ সমস্যা। কিন্তু আমি কি প্রশ্নও করতে পারি না যে অন্য জাতিটি যারা এখন সংযোগের মডেল তারা নিজেরাও অতীতে একই আঘাতমূলক অভিজ্ঞতার মাঝে অতিবাহিত করেছে ? একটাই পার্থক্য যেতারা আন্তর্জাতিক প্রচারের বিকৃতি থেকে পলায়ন করতে পেরেছে যার শিকার আজ পাকিস্তান। অন্য এবং বৃহত্তর পার্থক্য হলও তারা তাদের প্রতিবেশী দ্বারা আক্রান্ত হয়নি। যারা প্রথমে তাদের অসামরিক বিবাদ কে উদ্দিপিত করে এবং তা আরও বর্ধিত করে এবং পরবর্তীতে আগ্রাসন সংঘটিত হয় যেমনটি ইন্ডিয়া আমাদের বিষয়ে করেছে।
২০শে জুলাইয়ের স্মারক লিপিতে সাধারণ- সচিব, নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতিকে উল্লেখ করে বলেন,……………
“…………সমস্যাটি দীর্ঘকাল স্থায়ী এবং অমীমাংসিত ভাবে ইন্ডিয়া –পাকিস্তানের মাঝে বিছানো হয় যার ফলে যুদ্ধ বিগ্রহ খেলা বৃদ্ধি পেয়েছে, এবং তা শুরু হয় মাত্র ছয় বছর আগে।“
১৯৪৮ সাল থেকে নিরাপত্তা কাউন্সিলের কাছে ইন্ডিয়া- পাকিস্তান প্রশ্নটি একটি বিষয়সূচি হয়ে আছে। জম্মু এবং কাশ্মীর রাজ্যের উপর দুই রাষ্ট্রের বিন্যাসের অসমাপ্ত বিষয়ে বিরোধ নিরাপত্তা কাউন্সিলে শতাধিক সভা আলোচনা করা হয়েছে এবং এই বিষয়ে ২২টির অধিক রেজুলেশন এবং ২ টি বিবৃতিতে নিরাপত্তা কাউন্সিলের ঐক্যমত দেওয়া হয়। আমাকে বিষয়টি পরিষ্কার করে বলতে দিন যে ভারত পাকিস্তানের মাঝে কখনোই শান্তি স্থাপিত হবে না এবং হ্যাঁ আমি “শান্তি” শব্দটি ব্যবহার করছি। যুদ্ধের অনুপুস্থিতিতে এই বিতর্ক সমাধান ইন্ডিয়া পাকিস্তানের ইচ্ছায় হবে না; না কোন বৈদেশিক শক্তির অথবা জোট শক্তির ইচ্ছায় হবে । কিন্তু জাম্মু এবং কাশ্মিরের ইচ্ছায় তা সমাধান হবে। একটি বিদ্যমান আন্তর্জাতিক চুক্তি যা জাতিসংঘের পৃষ্ঠপোষকতায় সমাপ্ত হয়। জাতিসংঘের পৃষ্ঠপোষকতায় রাষ্ট্রের বিন্যাস নির্ধারণ করা হবে নিরপেক্ষ গণভোটের দ্বারা। ইন্ডিয়া এই চুক্তি বাস্তবায়নে নিরবিচ্ছিন্নভাবে অস্বীকার করেছে। এই সহজ কারনে ইন্ডিয়া –পাকিস্তান গত ২৩ বছরে কখনো সহজ হতে পারে নি যদিও পুরো পৃথিবী হয়ত কাশ্মীর বিতর্ক ভুলে গেছে কিন্তু তা না কাশ্মিরের জনগন ভুলেছে আর না তা পাকিস্তানের সহধর্মীরা কখনো তা ভুলবে। যদিও বিতর্কটি কিছুই না কিন্তু ইন্ডিয়ার উগ্র জাতিয়তাবাদ এবং পাকিস্তানের সাথে ন্যায়সঙ্গত বন্দোবস্ত অস্বীকার যা স্থায়িত্তের ভিত্তিতে দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক তৈরি করত।
এই বছর এর ঘটনাগুলিই ইন্ডিয়া -পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ বিগ্রহের মুল কারন নয়। যেমন, পাকিস্তানের আন্তর্জাতিক অধিকার এবং প্যাসিফিক উপনিবেশের পরিচিত পদ্ধতি অনুসারে দুই দেশের মধ্যে অসামান্য বিষয় সমাধান করতে অস্বীকার। দক্ষিণ এশিয়ার এই দুই প্রতিবেশীর মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক অবস্থায় একটি জাদুর কাঠির তরঙ্গের মাধ্যমে আসবে না, ঘোষণার সঙ্গেও না, কোন না- যুদ্ধ চুক্তির সঙ্গেও; কিন্তু উভয় পক্ষের ঘর্ষণ পরিস্থিতির সমাধানে তৈরি থাকাই বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য নামমাত্র উপায়। জাতি সংঘে পদ্ধতি ৩৩ নিযুক্ত করা হয়েছিল তালিকা তৈরির জন্য।
পাকিস্তান সরকার ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দ্বারা যুদ্ধ বিগ্রহের অগ্ন্যুৎপাত এড়াতে সকল পস্তাব অবশ্যই উত্তর দিয়েছিল যার দ্বারা ইন্ডিয়া- পাকিস্তানের পরিস্তিতির শান্তি পূর্ণ সমাধান হবে। কিছু মাস পূর্বে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি ইন্ডিয়ার প্রধান মন্ত্রীর সাথে যেকোনো সময় যে কোন স্থানে দেখা করার জন্য তৈরি ছিলেন। ইন্ডিয়ার কাছ থেকে এর প্রত্রিক্রিয়া সম্পূর্ণে নেতিবাচক ছিল। ২০শে নভেম্বর, পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি ইন্ডিয়ার জন্য বন্ধুতের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল এবং এর উত্তরে তার পরের দিন থেকে পাকিস্তানের উপর সশস্ত্র হামলা চালু করেছিল।
সর্বশেষ, ২০শে অক্টোবর , নিরাপত্তা পরিষদ থেকে সচেতন হয়ে সাধারণ সচিব পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি এবং ইন্ডিয়ার প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে একটি চিঠি পাঠান যেখানে তিনি বলেন,
“ এই সম্ভাবনাময় বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে সাধারণ সচিব হিসাবে আমি মনে করি এটা আমার কর্তব্য তাৎক্ষনিক ভাবে সরকারকে সাহায্য করা যাতে দূযোগ হতে পারে টাইপ অবস্থায় যে কোন ধরনের বিপর্যয় এড়ানো যায়। আপনার মহত্ত জানতে আমি ইচ্ছুক, যে আমার দক্ষ দপ্তর আপনার কর্মে সম্পুরনভাবে আছে, যদি আপনি বিশ্বাস করেন যে তারা যে কোন সময় সহায়ক।
পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি অবিলম্বে প্রস্তাবটিকে স্বাগত জানানসাধারন-সচিবকে আলোচনা করার জন্য , এবং ইন্ডিয়া- পাকিস্তান সফর এবং উভয় পক্ষের উভয় সীমা থেকে শক্তি সমূহকে তুলে নেয়ার জন্য। কিন্তু কি প্রতিক্রিয়া ছিল ইন্ডিয়ার ? ১০ই নভেম্বর , সাধারণ সচিব চিঠির উত্তর দেন। প্রতিদিন বৃদ্ধিমান চাপা উত্তেজনাময় পরিস্থির ২৭ দিন পরে এবং তার চিঠিতে অভিযোগ ছিল যে “ পাকিস্তান গুরুতর ভাবে ইন্ডিয়ার সাথে বড় আকারের সংঘাতের প্রস্তুতি নিচ্ছে।”
এখন যদি অভিযোগটা সঠিক হয় তাহলে উপমহাদেশ পরিদর্শন করতে সাধারণ সচিবকে আমন্ত্রন করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রন করাটা আরও যুক্তিপূর্ণ হতো। কিন্তু ইন্ডিয়ার প্রধান মন্ত্রী ঐ আবস্থায় সাধারণ সচিবের দক্ষ সহায়তায় সমস্যা অতিক্রম করতে পারত। তিনি সনিনয়ে কিন্তু ভ্রান্ত ভাবে দাবী করেন, সাধারণ সচিব এর “সমস্যাটি দৃষ্টান্ত রুপে দেখা এবং তিনি পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেছেন পূর্ব পাকিস্তানে সমঝোতা তৈরির মাধ্যমে। বলা বাহুল্য , বার্তাটি ছিল, সাধারণ সচিব তখনই আমন্ত্রিত যদি তিনি ইন্ডিয়ার রাজনৈতিক পরিকল্পনা সম্পাদন করতে পারেন, অন্যথায় নয়।
কিছু সপ্তাহ ভারতীয় ঘোষণাগুলোর মধ্যে বিরত ছিল যে, ভারতের সঙ্গে পাকিস্তান বড় মাপের সংঘর্ষের প্রস্তুতি নিচ্ছে ।কিন্তু অক্টোবরে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি উভয় দেশের সীমানা থেকে পারস্পরিকভাবে পিছিয়ে আসার প্রস্তাব করেন। যদি ইন্ডিয়ার নেতাদের তাদের নিজেদের তৈরি প্রচারনার উপর বিশ্বাস থাকে তাহলে তাদের অবশ্যই প্রস্তাবটি স্বাগত জানানো উচিত। কিন্তু ইন্ডিয়ার প্রধানমন্ত্রী এই ভিত্তিতে সংক্ষেপে বাতিল করেছিলেন যে “ সীমান্তে পাকিস্তানের যোগাযোগের লাইন ভারতের লাইনের চেয়ে সংক্ষিপ্ত ছিল।”
বিতর্ক এড়াতে মঙ্গলকামী পাকিস্তানী রাষ্ট্রপতি তার পরামর্শ পরিবর্তন করেন এবং তিনি বলেন যে যদি শান্তির সময় ঘাটি প্রত্যাহার করা সম্ভব না হয়ে থাকে তাহলে অন্তত সৈন্য ও তার সাথে সাথে অস্ত্রশস্ত্র এবং কামান উভয় পাশের সীমান্তের সম্মতিতে নিরাপদ দূরতে সরিয়ে রাখা যেতে পারে যা উভয় পক্ষেরই নিরাপত্তা প্রদান করে।
এর চেয়ে কিছু ন্যায্য হতে পারে? আরও ভালো কোন জামিন প্রমান করতে পারে যে পাকিস্তান ইন্ডিয়া র সঙ্গে যুদ্ধ এড়াতে চাচ্ছে ? সংক্ষেপে বলা যায় বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবেলায় নিরাপত্তা পরিষদের এক সদস্য রাষ্ট্র সকল ধারনা অবলম্বন করে সর্বোতমউপায়ে সশস্ত্র আক্রমন করে অন্য সদস্য রাস্ত্রকে ভেঙ্গে ফেলেছে। ইন্ডিয়ার আক্রমন সফল হতে পারত যদি না পাকিস্তান তার বিরোধিতা করত । পাকিস্তান তার অধিকার পরিত্যাগ না করে উপযুক্ত পাল্টা ব্যবস্তা গ্রহন করে। এখন নিরাপত্তা পরিষদ ইন্ডিয়ার আগ্রাসী যুদ্ধ ক্ষান্ত করতে উপায় খুজছে । একমাত্র নিরাপত্তা পরিষদ চিন্তিত আমাদের স্বাধীনতা, সারভোমত্ত ও অখণ্ডতা নিয়ে এবং সঙ্গে সঙ্গে সামঞ্জস্য পূর্ণ সদস্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার নীতি যা আমার সরকারকে সমর্থন ও সহযোগিতার আদেশ দিচ্ছে।
শেষ করার পূর্বে আমি কিছু বিতর্কের উপর পর্যবেক্ষণ করতে বাধ্য হচ্ছি যে এই কাউন্সিলে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিনিধির প্রস্তাব উঠেছিল যেখানে তথাকথিত অস্তিত্তের জন্য প্রতিনিধিদের আমন্ত্রন করা হয়। ……… ভারতের প্রতিনিধি অকেজো ছিল যখন সে এই প্রশ্নে হস্তক্ষেপ করে কারন একমাত্র নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য পদ্ধতিগতবিতর্কে অংশ গ্রহন করতে পারেন । কার্যপ্রণালী রুল ৩৯ আমন্ত্রন প্রসারিত করতে উদ্যত হয়েছে। কিন্তু আমি নিরাপত্তা পরিষদকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে কার্যপ্রণালী রুল অবশ্যই অধস্তন এবং অনুগত হতে হবে জাতিসংঘের সনদ প্রবন্ধের এবং সনদের একটি মৌলিক নীতি হল যে সদস্য রাষ্ট্রের অখণ্ডতা । কার্যপ্রণালী কাউন্সিলের নিয়ম ৩৯ এর অধীনে কোন পদক্ষেপ যা এই মৌলিক জাতিসংঘের এবং নিরাপত্তা পরিষদের সনদের নীতি কে বিপরীত দিকে পরিচালিত করে কারন নিরাপত্তা পরিষদকে তার নিয়ম ব্যাখ্যা করতে হবে সনদের মৌলিক বিধান দৃঢ়তা করতে ।
তথাকথিত প্রতিনিধিদলকে প্রস্তাব প্রশ্নে আমন্ত্রন জানানো আপাতদৃষ্টিতে শুধুমাত্র তা নির্দোষ মনে হয় । আমাদেরকে বলা হয়েছে যে কাউন্সিলের তথ্য দ্বারা নেতৃত্ব স্থানীয় অধোগামী ইন্ডিয়া পাকিস্তানের মধ্যে সংঘর্ষের পরিস্থিতি বিষয়ে উপকৃত হবে।
কিন্তু এই ধরনের তথ্য দিয়ে নিরাপত্তা পরিষদের সব সদস্য এবং সাধারণ পরিষদ এবং বেসরকারি সংগঠনের উপচিয়ে উপাদান তথাকথিত বিশেষ সত্তার প্রতিনিধিদের কাছে উপস্থাপিত হয়েছে এবং প্রেসের কাছে যে কোন উদ্দেশে কার্যকরী ভাবে স্বীকৃতি দান এবং নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য দ্বারা নথি পরিবেশিত ।
আমি বলছি যে এই প্রস্তাব আপাতত দৃষ্টিতে নির্দোষ , কারন মৌলিক ভাবে এটার অর্থ হবে যে একটি আঘাত। এই ধরনের তথাকথিত প্রতিনিধিদের দ্বারা নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য রাষ্ট্রের অখণ্ডতা আঘাত পাবে এবং পাকিস্তানকে স্বীকৃত এই ধরন অনুসারেই বিভাজন করার চেষ্টা করেছিল।
ইন্ডিয়ার প্রতিনিধি দলের পক্ষ থেকে এই সত্তা তাদের প্রচারিত নথি যা এখন এই কাউন্সিল টেবিলে উপবিষ্ট করা এবং শুনানির দাবী করা হচ্ছে ? এটা ইন্ডিয়ার কিছু মানুষদ্বারা মতলব করা , সংগঠিত করা এবং প্রতিষ্ঠিত করা । একটি দেশ যারা ধংস বহন করে আনছে, এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অপসরন এবং বিরুধাচরন করেছে। এবং এই দলের মানুষদের কোলকাতায় আসন আছে। আমরা আরও জানি নিউ ইয়র্ক ঠিক এখানে সংগঠনের আরও কিছু সংখ্যা আছে এবং এর সত্তা নিশ্চিত ভাবে বৈধ সরকারের নাম গুলোতে কথা বলতে দাবী করে অথবা তথাকথিত বৈধ সরকার তারা আমাদেরকে উপচিয়ে পড়া উপাদান এবং অনুরোধ করে যাতে জাতি সংঘের বিভিন্ন সরকারী ডকুমেন্ট হিসাবে প্রচার করা হয়।আমাদের কি এই লঙ্ঘনের এই নীতিগুলো তাদের অনুরোধের সঙ্গে মেনে চলার এই অনুশীলনটি অবলম্বন করতে শুরু করা উচিত ?
এই বিবাদটি করা হয়েছে যে নিরাপত্তা পরিষদের একটি মিটিং এর জন্য। নয় (৯) প্রতিনিধিদলকে জিজ্ঞাসা করে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে……… সম্প্রতি নিম্নগামী পরিস্থিতি যেটি ইন্ডিয়া এবং পাকিস্তানের মধ্যে সশস্ত্র সংঘর্ষের নেতৃত্ব দিয়েছে (এস / ১০৪১১ )। নয়(৯) প্রতিনিধিদলকে মিটিঙের জন্য করার পরিস্থিতি কি ছিল? পাকিস্তানের পরিস্তিতি ২০শে জুলাই এর স্মারক লিপিতে নিরাপত্তা পরিষদ (বি)} সাধারণ সচিব এর সদস্য বৃন্দের মনোযোগ আনা হয়েছিল, নভেম্বরে পুনরায় নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য বৃন্দের তথ্যের ভিত্তিতে দেখা করতে অস্বীকার করেছিল যে এবং সেই ঘটনা সাধারণ সচিব দ্বারা সরবরাহ করা হয়েছিল যদিও স্পষ্টভাবে তা ছিল না বরং সনদের দ্বারা ৯৯ এর অধীনে তার দায়িত্ব পালন করেছে, দলিলের অধীনে তার দায়িত্ব পালন করেছে, দলিলের অধীনে আর কোন বিধান নেই যাতে সাধারণ সচিব এই পরিস্থিতিতে শান্তি এবং নিরাপত্তার জন্য কোন অনুভুতি আনতে পারেন। পরিস্থিতি এখন (৯) প্রতিনিধি দলের চিঠির উপলক্ষ ছিল। যা গতকাল বিস্ফোরণ হয় এর কারন ইন্ডিয়া পাকিস্তানের মাঝে পূর্ণ পাত্রার শত্রুতা। আমি দাখিল করব যে নিরাপত্তা পরিষদের এই ডকুমেন্টটি যথাযথভাবে ব্যাখ্যা করা উচিত এবং শুধুমাত্র অতীত ঘটনা সম্পরকের প্রভাবে নয় কারন এটা চিন্তা করা হয়নি যে সাধারণ সচিবের দ্বারা নিরাপত্তা পরিষদ এই অবস্থাটি বিবেচনা করা হবে।
পরিশেষে আমারা বিশ্বাস করি উদ্বাস্তু সমস্যা একটি মানবিক সমস্যা। আমরা যে কোন কিছু করতে তৈরি আছি যা আন্তর্জাতিক সংস্থা আমাদেরকে করতে অনুরোধ করেছে মানবিকতার ভিত্তিতে যাতে সম্মানের সাথে তাদের প্রত্যাবাসন এবং জীবনের নিরাপত্তা ও সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়। এখন বলতে হয় যে উপমহাদেশের এই পরিস্থিতিতে যখন ৭০০ মিলিয়ন জনগণকে যুদ্ধের শিখায় আচ্ছাদন করা হয়। উদ্বাস্তু যারা ইন্ডিয়া তে আছে তাদেরকে নিরাপত্তা পরিষদের পূর্বের প্রতিনিধিত্তের সাথে এর ধরন একই হওয়া উচিত। এই বিষয়টি যা খুবই অভূতপূর্ব যে নিরাপত্তা পরিষদ এর কার্যের ফলাফল গভীর ভাবে বিবেচনা করা হবে। আমি একটি দাখিল তৈরি করেছি যে নিরাপত্তা পরিষদের কার্যকর্ম সনদের মৌলিক নীতির দায়িত্ব এবং সম্মানের সাথে চিন্তা রেখে পরিচালিত হয়। এবং একটি বিপজ্জনক নজির নিযুক্ত করা উচিত এবং পাকিস্তান নিরাপত্তা পরিষদ এবং জাতি সংঘের কো -অপারেশন গুরুতরভাবে পুনরায় মূল্যায়ন করবে।
.
.
শিরোনাম সূত্র তারিখ
১১৫। জেনারেল ইয়াহিয়ার বেতার ভাষণঃ ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা ডন-করাচী ৫ ডিসেম্বর ৪ ডিসেম্বর , ১৯৭১
জাতির উদ্দ্যেশ্যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া’র ভাষণ
আমাদের শত্রু আবার আমাদের বিরুদ্ধে গিয়েছে। ভারতীয় আর্মি পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রান্তে সর্বশক্তি দিয়ে আক্রমন শুরু করেছে। পাকিস্তানের প্রতি ভারতের শত্রুতা ও ঘৃণা সম্পর্কে পৃথিবীর সকলেই অবগত আছেন। পাকিস্তানকে দুর্বল ও ধ্বংস করাই তার প্রধান উদ্দ্যেশ্য। আমাদের প্রতি ভারতের সর্বশেষ ও মারাত্মক হানাটি ছিল সবচেয়ে বড় এবং আমাদের উপর চূড়ান্ত আক্রমন। আমরা ধৈর্য্যের শেষ সীমায় এসে পৌছেছি। শত্রুদের উপর এখন চূড়ান্ত আক্রমন করার সময় এসেছে। ১২ কোটি মুজাহিদ, আপনারা সবসময় আল্লাহ’র রহমত পেয়ে থাকেন। আপনাদের অন্তর নবীর প্রতি ভালবাসায় পূর্ণ। আমাদের শত্রুরা আরো একবার আমাদের আত্মসম্মান এর প্রতি আঘাত হেনেছে। শত্রুদের প্রতি আমাদের লৌহকঠিন মনোভাবে সম্মান ও বেচে থাকার অভিপ্রায় নিয়ে একযোগে প্রতিরোধ করতে হবে। আপনারা ন্যায় ও সত্যের পক্ষে আছেন। সাহস ও দৃঢ় সংকল্পে উদ্বুদ্ধ হয়ে মিথ্যার বিরুদ্ধে সর্বশক্তি দিয়ে যুদ্ধ শুরু করুণ।
শত্রুকে জানিয়ে দিন নিজ মাতৃভূমিকে রক্ষার তাগিদে প্রতিটি পাকিস্তানী মৃত্যর জন্যে তৈরি আছে। অভূতপূর্ব বীরত্ব ও সাহসিকতা প্রদর্শনের মাধ্যমে আমাদের সাহসী জওয়ানেরা অগ্রসরমান শত্রুদেরকে আটকে দিয়েছেন। ইসলামে গাজী’দের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে আমাদের জওয়ানেরা, শত্রুরা আমাদের চাইতে শক্তিশালী হলেও তাদের বিরুদ্ধে অটলভাবে অকুতোভয়ে যুদ্ধ করে যাচ্ছেন। তারা জানেন যে, বিজয় শুধুমাত্র সংখ্যা বা সরঞ্জাম এর উপর নির্ভর করে না। বরং নির্ভর করে বিশ্বাস ও আদর্শের শক্তি এবং সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছার উপর।
আমাদের সেনারা শুধুমাত্র পরাজিত করার প্রতিজ্ঞাবদ্ধই নয়, বরং তারা শত্রুদেরকে শত্রুসীমায় ধাওয়া করবে এবং তাদের ধ্বংসও করবে। আল্লাহর ইচ্ছায় আমাদের সেনাদের সিংহ এর মত সাহস রয়েছে যার ফলে তারা শত্রুদের দুইভাগে বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে। আল্লাহর ইচ্ছায় এবার আমরা আগের চাইতেও আরো শক্তিশালী ভাবে আক্রমন করব।
আমরা এমন একটি যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছি যেখানে আমাদের শত্রুরা ধূর্ত ও নিষ্ঠুর। আমরা আমাদের দেশকে যে কোন মুল্যে, সর্বশক্তি দিয়ে হলেও রক্ষা করব। আমরা নিশ্চিত দেশের অখণ্ডতা রক্ষার এই যুদ্ধে আমরা সকল বন্ধু ও বন্ধুপ্রতীম রাষ্ট্রগুলোর সাহায্য-সহযোগীতা পাব, যারা সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে থাকবেন। তারা সন্দেহাতীতভাবে ভারতীয় আক্রমণের নিন্দা জানাবেন এবং আমাদের রাষ্ট্র রক্ষা করার এই চেষ্টাকে সমর্থন দিবেন।
আমার প্রিয় দেশবাসী ও প্রিয় আর্মি, নেভী ও বিমানবাহিনীর মুজাহিদগণ, দেশের এমন পরিস্থিতিতে জাতিকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যের উদ্দ্যেশ্যে নক্ষত্রের মত উজ্জ্বল হয়ে থাকতে হবে। সাহস ও বিশ্বাসের ক্ষমতার মাধ্যমে সকল বাধা পেছনে ফেলে অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জন করতে হবে।
আপনাকে ধীর-স্থির হতে হবে, আপনাদের প্রত্যেককেই দেশকে রক্ষার জন্যে কাজ করে যেতে হবে। জাতীয় ঐক্য রক্ষা করুন এবং মনে রাখবেন আল্লাহ বলেছেন- আল্লাহ তাকেই প্রতিদান দেন যে নিজে চেষ্টা করে।
সামনে এগিয়ে যান। আল্লাহু আকবর বলে শত্রুকে সর্বোচ্চ প্রতিহত করুণ। আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন। পাকিস্তান পায়েন্দাবাদ।
.
.
শিরোনামঃ ১১৬। নিরাপত্তা পরিষদে পাকিস্তান প্রতিনিধি আগাশাহীর বিবৃতি
সূত্রঃ জাতিসংঘ দলিলপত্র উদ্ধৃতিঃ বাংলাদেশ ডকুমেন্টস
তারিখঃ ৫ ডিসেম্বর, ১৯৭১
.
জনাব আগা শাহীর বিবৃতি, পাকিস্তানের প্রতিনিধি
৫ ডিসেম্বর, ১৯৭১
আমার বর্তমান বক্তব্যে, আমি শুধু কিছু নির্দিস্ট বিষয়াবলি স্পষ্ট করার ব্যপারেই সচেতন থাকবো যেগুলোকে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ভারতের প্রতিনিধিদের বক্তব্যসমূহে দুঃখজনকভাবে বিভ্রান্তিপূর্ণ এবং বিকৃত করা হয়েছে।
গতকাল সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিনিধি, রাষ্ট্রদূত মালিক, নথী S/10412 থেকে পাঠ করেছিলেন, যেটিতে কাশ্মীরের অস্ত্র-সংবরণ রেখার পরিস্থিতির ওপর মহাসচিবের একটি প্রতিবেদন অন্তর্ভুক্ত ছিলো। এটি উল্লেখ করতে হয় যে, প্রতিবেদনটি জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের সাথে সম্পর্কিত, যেটি একটি বিতর্কিত এলাকা। এটিও উল্লেখ করতে হয় যে, এই প্রতিবেদনটি নিরাপত্তা পরিষদের পৃষ্ঠপোষকতায় গৃহিত ১৩ আগস্ট ১৯৪৮, এবং ৫ জানয়ারী ১৯৪৯ এর ভারত ও পাকিস্তানের জন্য জাতিসংঘের রেজুলেশনের বিধমালা ছাড়া রজু করা যেত না।
সোভিয়েতের প্রতিনিধি স্মরণ করতে পারবেন যে, ভারত-পাকিস্তান প্রশ্নটি বিগত ২৩ বছর যাবত নিরাপত্তা পরিষদের আলোচ্য বিষয়সুচীতে রয়ে গেছে এবং ১০০টিরও অধিক সভায় পরিষদের মনোযগকে আকর্ষণ করেছে। তিনি এটিও স্মরণ করে থাকবেন যে, এটি তারই প্রতিনিধিদল ছিলো যে নিরাপত্তা পরিষদে তিনটি প্রস্তাবনায় ভেটো দিয়েছিলো যেগুলো জম্মু ও কাশ্মির বিতর্কের একটি নিষ্পত্তিকে সহজতর করতো। জম্মু ও কাশ্মীর অস্ত্র সংবরণ রেখায় কথিত উল্লঙ্ঘনবিষয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তিনি যে অভিযোগ করেছেন, তাকে প্রতিহত করে সেই একই নথীর (S/10412) দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ থেকে আমায় উদ্ধৃত করতে দিনঃ
‘… (c) ভারতীয় সামরিক কর্তৃপক্ষ স্বীকার করেছিলো যে, ২০ অক্টোবর ১৯৭১ থেকে তারা জম্মু ও কাশ্মীরে তাদের বাহিনীকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় জোরদার করেছিলো, এতদনুসারে করাচী চুক্তির অধীনে জম্মু ও কাশ্মীরে অনুমোদিত সেনা স্তরকে ছাড়িয়ে রয়েছে এবং তারা এটি চালিয়ে যাবে যেহেতু ভারতীয় অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য এটি প্রয়োজনীয় বিবেচিত হয়েছে।
“(d) প্রধান সামরিক পর্যবেক্ষক দেখলেন যে পাকিস্তানও সেই অস্ত্র সংবরণ রেখায় নিজেদের দিকে অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন করেছিলো… কিন্তু ‘অনুমোদিত স্তরকে অতিক্রম করা ছাড়াই।”
এট উল্লেখ করা যেতে পারে যে, যে তারিখে ভারত করাচী চুক্তির উল্লঙ্ঘন করে, ২০ অক্টোবর, আর যখন পকিস্তান ইতিরিক্ত বাহিনী ,ওতায়েন করে, কিন্তু অনুমোদিত সীমার মধ্যে, সেই ২৯ নভেম্বর চল্লিশ দিন ব্যবধানে। করাচী চুক্তির উল্লঙ্ঘনের চল্লিশ দিন বাদেই কেবল পাকিস্তান ভারসাম্য পুনঃস্থাপনের দিকে গিয়েছিলো, এবং তার পরেও চুক্তির অধীনে অনুমোদিত সীমার ভেতরে থাকার ব্যাপারে সে সতর্কতা অবলম্বন করেছিলো।
সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিনিধির দ্বারা ব্যক্ত সেই বিশেষ তথাকথিত উল্লঙ্ঘন প্রসংগে, কথিত অস্ত্র সংবরণ রেখার অতিক্রম সম্পর্কে আমাকে পরিষদকে অবহিত করতে দেয়া যাক যে, এই ধরণের উল্লঙ্ঘন ভারতের দ্বারা প্রায় প্রতিদিনই সম্পন্ন হচ্ছে, UNMOGIP এই ধরণের প্রতিবেদন পাঠাচ্ছে, এবং মহাসচিবের কার্যালয়ের মাধ্যমে সেগুলো সহজলভ্য করা যেতে পারে। সুতরাং, সীমা অতিক্রমের একটি ছোট কথিত ঘটনাকে পৃথক করা, যাকে বলা হচ্ছে পাকিস্তানের ভার আক্রমণের অভিপ্রায়, আমি দুঃখের সাথে জানাচ্ছি, কোন মাত্রাবোধের পরিচায়ক নয়।
সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিনিধি পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে তার অনেকগুলো মধ্যবর্ত্তিতায় অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়ে গেছেন, এবং তিনি পাকিস্তানের বৈদেশিক সম্পর্কগুলোরও কতিপয় দিক নিয়ে বলেছেন। শরণার্থীদের সমস্যা সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন যে, পাকিস্তান সীমান্তে সেনা বর্ধিতকরণে ভারতকে সমর্থন করা হয়েছিলো কারণ, রাষ্ট্রদূত মালিকের উদ্ধৃতিতে, একটি আত্ম-মর্যাদাবোধ সম্পন্ন রাষ্ট্র যে কিনা তার নিরাপত্তার ব্যাপারে সতর্ক, সে এমন একটি অঞ্চলে কী তার সেনা দ্বারা স্থানাপন্ন করবে না যেখানে ১০ মিলিয়ন শরণার্থীর স্রোত এগিয়ে এসেছিলো? যদি এটি ন্যায়সঙ্গত হয়ে থাকে তাহলে আমদের জিজ্ঞেস করতে হয় যে পূর্ব পাকিস্তানে নাশকতা ও ধ্বংসলীলা পূরণকল্পে সশস্ত্র গেরিলাদের জন্য ঘাঁটি তৈরী করা, তাদের সজ্জিত করা, প্রশিক্ষিত করা আর লেলিয়ে দেয়াও কিভারতের জন্য ন্যায়সংগত ছিলো? ভারতে ১০ মিলিয়ন শরনার্থী আছেএই কারণেএটিও কি ন্যায়সঙ্গত? এবং এটিও কি ন্যায়সঙ্গত যে অবশেষে ২১ নভেম্বর ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী বিরাট আকারে সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টে পাকিস্তান আক্রমণ করেছিলো- যেটি ভারতীয় প্রতিনিধির দ্বারা স্বীকৃত হয়েছে?
আমরা দুঃখ প্রকাশ করি যে সোভিয়েত প্রতিনিধি পরিস্থিতিটির সেই অন্যান্য দিকগুলোকে গ্রাহ্য করে নি। কিন্তু একটি বিষয়ে আমি তার বিবৃতিকে স্বাগত জানাই। এ বছরের এপ্রিল থেকে আমরা ভারতের কাছ থেকে বারংবার গণহত্যার অভিযোগ পেয়েছি যে, পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে শয়ে শয়ে এবং হাজারে হাজারে নারী, পুরুষ ও শিশুদের হত্যা করেছিলো, তারা অকথিত সব ধরণের পাশবিকতা চালিয়েছে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিনিধির বিবৃতিতে এবং তার সরকারের বিবৃতিতে সতর্কতা এবং দায়িত্বজ্ঞান লক্ষ্য করে আমরা আনন্দিত, যখনই তারা পরিস্থিতিটি নিয়ে কথা বলেছেন তারা এ বিশৃঙ্খলায় হাজার হাজার হত্যার কথা উল্লেখ করেছেন- যদিও তারা ১০ মিলিয়ন শরনার্থীর কথা বলেছেন।
পরিষদকে আমার জানাতে হয় যে, আমার কোন ইচ্ছা নেই ভারতের প্রতিনিধির সাথে এই করুণ পরিস্থিতির ব্যাপারে কোন বচসায় যেতে। নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক, যেমন লন্ডন গার্ডিয়ানের সংবাদদাতাগন, এমনকি দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের কিছু সংবাদদাতা ২৫শে মার্চের আগে পূর্ব পাকিস্তানে রাষ্ট্রবিরোধী এবং বিচ্ছন্নতাবাদী উপাদানদের দ্বারা চালানো এই গণোহত্যার ব্যাপারে প্রতিবেদন করেছিলো। এবং যদি ভারতের প্রতিনিধি চিত্রের অন্য পাশটিকে উপেক্ষা করার কথা ভেবে থাকেন, আমরা শুধুই বলতে পারি যে এই নিরাপত্তা পরিষদে তার উপস্থাপনকে ভারসাম্যপূর্ণ ও ন্যায়স্ংগত বিবেচনা করা যায় না। এই ব্যাপারে আমি তার মনযোগ এই প্রতিবেদনগুলোর ওপর আকর্ষণ করাতে পছন্দ করবো যেগুলো বিশ্ব সংবাদে উঠে এসেছে, যা জন মতামতের সবচেয়ে দায়িত্বপূর্ণ এবং সম্মানিত মাধ্যম।
সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিনিধি ভীষণ একটি রৈখিক চিত্র এঁকেছিলেন যখন তিনি বলেছিলেন যে ১০ মিলিয়ন রিফিউজি জাতিসংঘের ৮৮ সদস্য রাজ্যের জনসংখ্যার চে বড় একটি জনসংখ্যা গঠন করে। সন্দেহাতীতভাবে, এটি একটি বিরাট সংখ্যা। চলে যাওয়া শরনার্থীর আসল সংখ্যা নিয়ে কোন বিতর্কে না যেয়ে আমাকে বরং প্রদর্শন করতে দেয়া হোক যে পাকিস্তানি শরণার্থীদের মানবিক সহায়তার প্রশ্নে থার্ড কমিটি বিতর্কে উগান্ডার প্রতিনিধি বলেছিলেন, তার দেশ প্রতিবেশী আফ্রিকান দেশগুলো থেকে ১৮৮,০০০ শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছিলো। এবং একই সময়ে উগান্ডার প্রতিনিধি এটিও উল্লেখ করেন যে তার সরকার কঠিন পূর্বসতর্কতা অবলম্বন করেছিলো এটি দেখতে যেন সেসব শরনার্থীদের কেউ সসস্ত্র না থাকে এবং উগান্ডার প্রতিবেশীদের বিরুদ্ধে ধ্বংসাত্বক কাজ সম্পন্ন করতে যেন কাউকে পাঠানো না হয়।
ভারতের জনসংখ্যার সাথে শতকরার অনুপাতে শরনার্থীরা, যেমনটি অর্থনৈতিক এবং সামাজিক পরিষদের বিতর্কের ৫১তম সেশনে গ্রীসের প্রতিনিধির দ্বারা দেখানো হয়েছিলো, ভারতের জনসংখ্যার ২ শতাংশ গঠন করে। কিন্তু আমরা স্বীকার করি যে এটি অনেক বড় একটি সংখ্যা, যাদেরকে সুরক্ষা ও নিরাপত্তার শর্তে ফিরিয়ে নিতে আমরা সবচেয়ে চিন্তিত যা জাতিসংঘ সত্য বলে জ্ঞান করতে পারে, যদি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় প্রকৃতই সমস্যাটির একটি মানবিক সমাধানের প্রতি আগ্রহী হয়ে থাকে এবং একে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর আঞ্চলিক অখন্ডতায় বিভাজন সৃষ্টির অস্ত্র হিসেবে এটিকে ব্যবহার করে না থাকে।
আমি অন্য কোথাও জনগোষ্টীর উৎখাত সম্পর্কে, ব্যাপক আকারে মানুষের স্থানান্তর সম্পর্কে, এমন কি একটি প্রজন্মের পর তাদের ঘরে ফিরে যাওয়ার অধিকার প্রত্যাখ্যান সম্পর্কে বলতে পারতাম, তবে আমি মনে করি না যে এই ধরণের বিতন্ডায় গিয়ে কোন উদ্দেশ্য সফল হবে, কাজেই, এই বিষয়ে আমি আর কিছু না বলি।
আমরা পূর্ব পাকিস্তানে একটি রাজনৈতিক মিমাংসার প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারেও অনেক কিছু শুনেছি। অবশ্যই আমরা জানি যে এটি শুধু পূর্ব পাকিস্তানেরই না, পশ্চিম পাকিস্থানেরও টিকে থাকার জন্য অত্যাবশ্যক, কিন্তু আমাদের বলা হয়েছে নাগরিকদের মানবিক অধিকার নিয়ে, জাতীয় মুক্তির আন্দোলন নিয়ে, এবং গনতন্ত্র নিয়ে। আমরা জানি, জাতিসংঘের অনেক সদস্য রাষ্ট্রই সমশ্রেনীভুক্ত নয়। আসলে, তাদের অনেকেই বহুত্ববাদী সমাজের অথবা বহুজাতিক রাষ্ট্রের হওয়ার দাবি রাখে, কিন্তু প্রশ্ন ওঠে যখন পাকিস্তানকে বলা হয় যে এর উচিৎ নয় স্বায়ত্বশাষনকে দমন করা, এর উচিৎ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে শ্রদ্ধা জানানো- আমরা প্রশ্ন করি কতটা মাত্রায় (we ask to what extent the right to autonomy demands respect does?) আমাদেরকে যারা এটি বলে এমন অনেক রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরাই জানেন যে তাদের নিজেদের দেশে কোন স্বায়ত্বশাষণ নেই; তারা একক রাষ্ট্র যদিও আপাতদৃষ্টিতে তারা গঠনে ফেডেরাল হয়ে আছে।
আমরা পাকিস্তানের ভেতর সমস্যাটির মিমাংসা করে ফেলতে সক্ষম হতাম যদি দাবিটি পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতা পর্যন্ত না গড়াতো, একটি ফেডারশন থেকে একটি কনফেডারেশনে। আমরা আশা করবো যারা বস্তুনিষ্ঠ, এবং যারা সত্যিই বহুত্ববাদী সমাজের সমস্যাগুলো বোঝার চেষ্টা করেন যেখানে নানান বৈচিত্রের মানুষ রয়েছে, যেখানে সমাজ দ্বি-বিভাজিত, যে তারা সহায়ক হবার এবং বোঝার চেষ্টা করবেন এবং একটি স্বায়ত্তশাসনের দাবিদার রাষ্ট্রের প্রাদেশিক অখন্ডতা ও জাতীয় ঐক্য অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য প্রয়োজনীয়তার সমন্বয়সাধনের এই উভয়সংকটের একটি সমাধান খুঁজবেন যেটি সন্দেহাতীতভাবে অকৃত্রিম। কিন্তু, তার বদলে আমরা আক্রান্ত হচ্ছি প্রোপাগান্ডার দ্বারা এবং তাদের দ্বারা যারা জোটের স্বার্থে, রাজনীতির স্বার্থে সেই পক্ষাবলম্বন করতে চাচ্ছে যে পাকিস্তানের উচিৎ চরমপত্র মেনে নেয়া যেগুলো জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে সামনে আনা হয়েছে, স্বায়ত্বশাসনের জন্য নয়, বিভাজনের জন্য।
আমরা পাকিস্তানে একটি রাজনৈতিক সমঝোতা প্রণয়ন করছি, কিন্তু হতাশাজনকভাবে এটি কোন রাজনৈতিক মিমাংসা নয়, এটি হবে ভারতের পছন্দানুযায়ী যে চায়ই পাকিস্তানের বিভাজন। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতিতে এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত ভারতীয় নেতাদের বিবৃতিতে এই সম্পর্কে কোন সন্দেহ থাকতে পারে না, যেগুলো রাষ্ট্রদূত মালিক সম্পূর্ণই অবজ্ঞা করার কথা ভেবেছেন। তিনি মনে করেন যে, পাকিস্তান অপরাধী পক্ষ, এবং এর অপরাধের জন্য জোরপূর্বক বিভাজনের জন্য সমর্পন করানোর মাধ্যমে একে শাস্তি দেয়া উচিৎ। সে যাই হোক, আমি বলতে চাইবো যে, আমাদের টিকে থাকার একটা ইচ্ছা আছে, এবং আমরা যেকোন এলাকা থেকে আমাদের প্রাদেশিক অখন্ডতা ধ্বংস করতে আসা সকল চেষ্টাকে প্রতিহত করবো। যে কারণে ভারত এই সময়ে আমাদের বিপক্ষে আগ্রাসন শুরুর সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে তার একটি কারণ হলো পাকিস্তানে একজন প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার অভিষিক্ত করানোর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের প্রস্তুতকৃত নির্ঘন্টকে ব্যাহত করা যেটি এ মাসের ২০ থেকে ২৭ তারিখের মাঝে ধার্য করা হয়েছিলো। ইতিহাস বৃহৎ এবং ক্ষমতাবান রাষ্ট্রসমূহের অভিপ্রায় থেকে উদ্গত বিপদজনক সব ফাঁদে পূর্ণ, যেগুলো তুলনামূলক ছোট ও দূর্বল প্রতিবেশীদের ওপর রাজনৈতিক বন্দোবাস্ত চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে, মিউনিখ একটি প্রথম শ্রেণির উদাহরণ। আমরা জানি যে ভারত পাকিস্তানের আস্তিত্বকে এর নিরাপত্তার নিকট একটি হুমকিস্বরূপ বিবেচনা করে, কিন্তু এখন যে সোভিয়েত ইউনিয়ন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জন্য নতুন নিরাপত্তা তত্ত লিপিবদ্ধ করেছে, এটি কী ভবিষ্যতবাণী করতে পারে তা সম্ভবত আমাদের সকলেরই উচিৎ গুরুত্বের সঙ্গে ভাবা। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিনিধি তাসখন্ডের মূলভাবের কথা বলেছিলেন, কিন্তু সেই মূলভাব (স্পিরিট) ইন্দো-সোভিয়েত চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার অনেক আগেই প্রভাবশালী ছিলো, যেটি সম্পর্কে কোমলভাবে বলা হয় বধুত্বের ও সহযোগিতার একটি চুক্তি। বিশয়বস্তু এবং প্রভাবে, এটি একটি সামরিক জোট ছাড়া কিছুই নয়। ঘটনাবলি অবশেষে একে এমনটাই প্রমাণ করেছে। কথায় নয়, কাজে পরিচয়, বন্দুকে আরও বেশি। এ কাজগুলো কী ছিলো? এই চুক্তি স্বাক্ষরের পর পরই মস্কো আর নয়াদিল্লীতে চুক্তির অনুচ্ছেদ ix এর অধীনে কয়েকটি উত্তেজনাপূর্ণ সামরিক আলোচনা অনুষ্টিত হয়েছিলো, যা আলোচনার পক্ষগুলোকে কূটনৈতিক ভাষায় গ্রহণ করার জন্য প্রতিশ্রুতি দেয়, তা যেকোন শান্তিচুক্তিকে অপসারণ করার একটি কার্যকরী উপায় হিসেবে বর্ণিত হয়েছে। আমাদের সামরিক চুক্তির যথেষ্ট অভিজ্ঞতা রয়েছে যাতে করে জানা যায় যে একই রকমের ক্লজ সেই দলিলগুলোতে থাকে, এবং বৈশ্বিক মতবাদ ও দলগুলো নিজেরা এই ধরণের ভাষাগুলোকে একটি সামরিক চুক্তি গঠন করার জন্য যথাযোগ্যভাবে বিশ্লেষণ করে। উন্নত যুদ্ধোপকরণের সরবরাহ, যথাঃ মিগ-২৩এস, ট্যাঙ্ক এবং অন্যান্য সামরিক যন্ত্রপাতি খুবই দ্রুততার সাথে কলকাতা এবং অন্যান্য ভারতীয় বন্দরগুলোতে প্রেরিত হয়েছিলো। এইরূপে উপমহাদেশের ক্ষমতার ভারসাম্যকে বিপর্যস্ত করে, ইন্দী-ভারতীয় চুক্তি ভারতীয়দেরকে আত্মরক্ষার বাহানা দেখিয়ে একটি সামরিক বহিরাক্রমণের জন্য উৎসাহিত করেছে। অক্টোবরে প্রথম কমিটিতে, এবং গতমাসের প্লেনারি সভায় আমি বলেছিলাম যে, চুক্তিটিকে অবশ্যই এর পরিণতির দ্বারা বিচার করতে হবে, এটি কি যুদ্ধে বাধা হিসেবে কাজ করবে নাকি যুদ্ধকে থিতিয়ে দেবে। আমাদের এখন উত্তর আছে, এটি আমরা পাই ভারতের আগ্রাসনে এবং যুদ্ধবিরতি এবং প্রত্যাহারের প্রস্তাবনায় গত রাতে সোভিয়েতের ভেটোতে। ইন্দো-সোভিয়েত চুক্তিতে একটি দ্বৈত ভনিতা রয়েছে। এক পক্ষ অন্য পক্ষের জন্য একটি তৃতীয় রাষ্ট্রের বিপক্ষে ধ্বংস ও আগ্রাসনের সূত্রপাতকে সম্ভব করে তোলে এবং তারপরেও তাসখন্ডের মূলভাবকে আবাহন করে। আর অন্য পক্ষ নিজেকে একটি সামরিক জোটে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে ফেলে এবং তারপরেও পক্ষপাতহীন হবার দাবি করে। এইসব ভনিতাকে না দেখার মত সরল কে আছেন? যদি আরও প্রমাণাদি প্রয়োজনীয় হতো, সোভিয়েতের বিবৃতির দ্বারা সেটিও প্রদান করা হয়েছে, যেটি তাস সংবাদ সংস্থা থেকে এই সকালেই প্রচারিত হয়েছে। কার্যত বিবৃতিটি বলে যে, পাকিস্তান নিজেকে রক্ষার একটি বিপজ্জনক পথ অনুসরণ করছে, এবং একটি সামরিক দখলদারিত্ব প্রতিহত করছে, এবং আভাস দিয়েছিলো যে, পাকিস্তানের কাজকর্ম এমনকি সোভিয়েত ইউনিয়নের নিরাপত্তা স্বার্থের প্রতিও হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি নিবেদন করি, কীভাবে আমরা আর তাসখন্ড স্পিরিটের অস্তিত্বকে বিশ্বাস করতে পারি? সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিনিধি কয়েকমাস আগে তার বিবৃতিতে উল্লেখ করেছিলেন যাকে তিনি বলেছিলেন ৩ ডিসেম্বরে পাকিস্তানের দ্বারা একটি আক্রমণ। উনি পূর্ব পাকিস্তানেঢ় ওপর সব দিক থেকে সেই বড় আকারের আক্রমণগুলো সম্পর্কে একেবারেই উল্লেখ করেন নি, যেটি ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর কথায় ২১ নভেম্বর শুরু হয়েছিলো, পাকিস্তানের জন্য ধ্বংস সৃষ্টি করা অথবা যুদ্ধে যাওয়া ছাড়া আর কোন বিকল্পই রাখে নি।
এটি বারবার জোর দিয়ে বলতে হয় যে, পরিষদ শুধুমাত্র একটি সাধারণ পরিস্থিতি বা বিতর্কে নিয়েই চিন্তিত নয়, বরং একটি যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তিত। শরনার্থীদের ফিরে আসার কোন সম্ভাবনা কি থাকতে পারে যদি না এবং যতক্ষণ পর্যন্ত না আন্তর্জাতিক শান্তি নিশ্চিত হচ্ছে? কোন সন্দেহের ছায়ায় না রেখে আমাকে এটি খুবই পরিষ্কার করে বলতে দিন যে এই সংঘাতের কোন নিষ্পত্তির প্রস্তাবই কোন প্রভাব তৈরী করবে না যদি এটি ভারতীয় অনুপ্রবেশের এবং একই মাত্রায় ও একই বাহিনীর দ্বারা পরোক্ষ আগ্রাসনের অবসান নিশ্চিত না করে, যেহেতু এটি সংঘাতের নিবৃতিকে আহবান করে।
নিরাপত্তা পরিষদের এই ধরণের একটি সিদ্ধান্তের জন্য জিজ্ঞাস্বরুপ আমরা পরিষদের কোন সদস্যের কাছ থেকে কোন পক্ষীয় সমর্থন চাচ্ছি না, বা সহানুভুতি চাচ্ছি না। আর আমি আমার ভালো বন্ধু জনাব জানিল বারুদিকে বলতে চাইবো আমাকে যা বলতে হচ্ছে তার ভালো নোট নিতে। আমরা পরিষদের সদস্যদের কাছ থেকে কোন পক্ষীয় সমর্থন চাচ্ছি না, আমরা জাতিসংঘের আইনকে আবাহন করছি। আমরা নীতির বিধিসম্মত ঘোষণা জারি করছি- হস্তক্ষেপহীনতার ঘোষণা, আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা জোরদার করার ঘোষণা, রাষ্ট্রসমূহের ভেতর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের নীতিকে প্ররোচিত করার ঘোষণা- কিন্তু যখন সময় আসে সেই নীতিগুলোকে প্রয়োগ করার, আমরা সেগুলোকে সরিয়ে রাখতে চাই। এটাই কি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আদর্শগুলোকে প্রতিপালন করার জন্য আবশ্যক নয় যে কোন রাষ্ট্র অন্যের এলাকায় আত্মবিরোধ উসকে দেবে না, যে কোন রাষ্ট্র অন্যটিতে ধ্বংস ও নাশকতাকে মদদ ও সাহায্য প্রদান করবে না? যৌক্তিকভাবেই কি এমনটি অনুসরণ করা উচিৎ নয় যে, একে এই ধরণের কাজের জন্য নিন্দা পেতে হবে? ‘নিন্দা’ শব্দটি রাষ্ট্রসমূহের অভ্যন্তরীণ বিষয়াবলিতে হস্তক্ষেপহীনতার বিবৃতিতে ব্যবহৃত হয়েছে। যদি নিরাপত্তা পরিষদ নিন্দা জানাতে ইচ্ছা পোষণ না করে, তার কি উচিৎ নয় ভারতকে অন্ততপক্ষে পাকিস্তানের ব্যাপারে সশস্ত্র অনুপ্রবেশ থেকে বিরত হতে বলা?
এটি হয়েছিলো কারণ যে খসড়া রেজুলেশনটিতে গত রাতে ভোট দেয়া হলো এই প্রসংগে সেটি ছিলো অসম্পূর্ণ- এবং আমাকে স্পষ্ট হতে হবে- যে এর কার্যকারিতা সম্পর্কে আমাদের গুরুতর সন্দেহ রয়েছে। এটি আগ্রাসনকে নিন্দা জানায় নি। আমি আবার বলি, পক্ষগুলোকে লড়াই বন্ধ করতে বলাই যথেষ্ট নয়। বরং দ্বন্দ্ব প্রকৃয়াটির দ্বিতীয় স্তর, যেটি শুরু হয়েছিলো ভারতের সামরিক হস্তক্ষেপ এবং পাকিস্তানে ভারতের অনুপ্রবেশের সাথে।
যেমনটি আমি আগে বলেছি, যুক্তরাষ্ট্রের খসড়া রেজুলেশল ভারতকে তার আগ্রাসনের জন্য শাস্তি দিতে ব্যর্থ হয়েছিলো, যেহেতু ভারতের সাজাপ্রাপ্ত হওয়া উচিৎ ছিলো। এটি স্পষ্টভাবে ভারতকে পাকিস্তানের বিভেদ সৃষ্টি করার প্রচেষ্টাসমূহ থেকে বিরত থাকতে আহবান জানায় নি, যেমনটি নিরাপত্তা পরিষদের দাবি করা উচিৎ। তা সত্ত্বেও, সেই খসড়া রেজুলেশনের ভিত্তিতে আমরা নিরাপত্তা পরিষদকে সহযোগিতা করতে চাচ্ছিলাম, কারণ এটি পরিষদের ১১ জনের মত সদস্যের সমর্থন বহন করেছিলো। এটিই পাকিস্তানের আচরণ।
পরিষদের সদস্যরা এই আচরণকে পাকিস্তানের আচরণের সাথে তুলনা করুক। অস্ত্র সংবরণের কোন প্রশ্নই আসে না, ভারত বলে। ভারতের প্রতিনিধি গতকাল নিরাপত্তা পরিষদকে সতর্ক করেছিলো যে, ভারত পাকিস্তানবিরোধী আগ্রাসন চালিয়ে যাবে। পরিষদের এই সভা ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিতে পারুক আর না পারুক, ভারতের এই বার্তাটি পরিষদের সদস্যদের কানে বাজতে থাকার কথা।
ভারতের প্রতিনিধির কিছু বক্তব্যের দিকে ফিরে আমি তার বিবৃতির দিকে মনযোগ আকর্ষণ করবোঃ
“… আমরা পাকিস্তান অঞ্চলের ভেতরে গিয়েছিলাম ২১ নভেম্বর। আমরা গিয়েছিলাম, আমি অস্বীকার করি না।”
এবং তবুও, যুক্তরাষ্ট্রীয় খসড়া রেজুলেশন আমার প্রতিনিধিদলের জমা দেয়া ভারতীয় আগ্রাসন সম্পর্কে তথ্যগুলো সম্পর্কে প্রমাণ এবং ভারতের স্বীকারোক্তি হিসাবে নেয় নি। আরো কোন প্রমাণ প্রয়োজনীয় ছিলো?
ভারতের প্রতিনিধি পাকিস্তান অঞ্চলের জন্য ব্যাখ্যা প্রদান করেছিলো যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী ‘আমাদের বেসামরিক গ্রামগুলোতে গোলাবর্ষণ শুরু করেছিলো’। ‘আমাদের জন্য আর কী প্রতিকার ছিলো?’ সে প্রশ্ন করেছিলো। এবং সে বলেছিলো, প্রতিকারটি ছিলো পাকিস্তান আক্রমণ করা।
সভাপতি জনাব, আপনি স্মরণ করে থাকবেন যে, পাকিস্তান এই প্রস্তাবে রাজী হয়েছিলো যে, ভারত ও পাকিস্তানের সশস্ত্র সামরিক বাহিনীর উচিৎ সীমান্ত থেকে তাদের শান্তিকালীন ঘাঁটিতে পিছিয়ে আসা। প্রস্তাবটি ভারতের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলো। ভারতের কি এই বিকল্পটি ছিলো না যাতে করে পাকিস্তানের দিক থেকে গোলাবর্ষনের যে অভিযোগ তিনি করেছেন সেটি প্রতিরোধ এবং বন্ধ করা যেতো? ভারতের সন্ধির উপায় ছিলো, কিন্তু যুদ্ধ বেঁছে নিয়েছে।
পরিশেষে, আমি শুনেছি যে একজন প্রতিনিধি এই সভায় আগেই এটি বলেছেন যে বাংলাদেশের সমস্যাটি জাতিসংঘে আলোচিত হয়েছে। আমাকে খোলাখুলিভাবে বলতে দিন যে, এই তথাকথিত সমস্যা জাতিসংঘে আলোচিত হয় নি, অথবা যদি এই ধরণের কোন আলোচনা সংঘটিত হয়ে থাকে, পাকিস্তানের প্রতিনিধিদের এই সম্পর্কে কোন ধারণা ছিলো না এবং কখনোই এতে অংশগ্রহণের জন্য রাজী হতে পারতো না।
আমাকে স্মরণ করতে দিন যে পাকিস্তান সংক্রান্ত মাত্র দুইটি সমস্যা এখন পর্যন্ত জাতিসংঘে আলোচিত হয়েছে। একটি হচ্ছে শরনার্থীদের মানবিক সমস্যা, এবং এটি অর্থনৈতিক এবং সামাজিক পরিষদে এবং সাধারণ সমাবেশের তৃতীয় কমিটিতে আলোচিত হয়েছিলো। অপরটি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার পরিস্থিতি যেটি এই মুহুর্তে নিরাপত্তা পরিষদের দ্বারা আলোচিত হচ্ছে। এগুলোর কোনটিই বাংলাদেশের সংকট হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না।
আর্জেন্টিনার প্রতিনিধির দ্বারা যে কারণগুলো এতোটা অলংকারপূর্ণভাবে পেশ করা হয়েছে সেগুলো ছাড়াও প্রস্তাবনাটি যেটি এ সভায় পূর্বে আলোচিত হয়েছে, আমাকে নিরাপত্তা পরিষদকে তথ্যগুলো আবার মনে করিয়ে দিতে দিন যে এই আপাতদৃষ্টিতে নির্দোষ প্রতাবনাটিতে পাকিস্তানের বিভাজনকে প্ররোচিত করার একটি অশুভ নকশা ওৎ পেতে আছে। গতকাল, আমি ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব ডিফেন্স স্টাডিজ অ্যান্ড অ্যানালাইসিসের একটি কাগজ থেকে জাতিসংঘে পূর্ব পাকিস্তান পরিস্থিতি নিয়ে কীভাবে ভারতের রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করে এগোনো উচিৎ এ সম্পর্কে উদ্ধৃত করেছিলাম। আমার রচনাংশটি আবার উদ্ধৃত করতে চাইতে হয়ঃ
‘এতে কোন সন্দেহই নেই যে নিরাপত্তা পরিষদ উভয় জাতিকে যুদ্ধ শেষ করার আহবান জানাতে মিলিত হবে। যুদ্ধটি কি অবিলম্বেই সমাপ্ত হওয়া উচিৎ নাকি কিছু সময়ের জন্য অব্যাহত থাকা উচিৎ, এটি ভারতের বিবেচনা করার বিষয়।
এই পর্যায়ে, ইন্ডিয়ার প্রচেষ্টা থেকে থাকবে বাংলাদেশকে এ দ্বন্দ্বের একটি স্বীকৃত পক্ষ হিসেবে পাওয়া। আসলে, এটিই হবে বাংলাদেশের জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি জয়ের উপযুক্ত পথ। এটা পরিষ্কার করা উচিত যে, বাংলাদেশ সেক্টরে যুদ্ধবিরতিতে স্বাক্ষর করা যাবে না যদি না বাংলাদেশের কমান্ডার যুদ্ধুবিরতির উদ্দেশ্যে একজন স্বাধীন সেক্টর কমান্ডার হিসেবেস্বীকৃত হয়, এবং বাংলাদেশ সরকার এই বিতর্কটির একটি পক্ষ হিসেবে স্বীকৃত হয়।”
ভারতের প্রতিনিধি এই বক্তব্যকে তাত্ত্বিক ও শিক্ষাবিদদের উদ্গীরন বলে খারিজ করে দিয়েছে, কিন্তু এই বিতর্কে আপনার একেবারে চোখের সামনে যে কার্যধারা উন্মোচিত হচ্ছে তা এই বিবৃতির প্রতিটা শব্দ ও বর্ণকে নিশ্চিত করে। এই ধারাটিই অনুসরণ করা হচ্ছে, একজন নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে শুনানির জন্য দিতে অনুরোধের ভারতের প্রতিনিধির জামিনদারিত্বে শুরু হচ্ছে- এবং আপনি যদি সেই ব্যক্তির শুনানির জন্য অনুরোধটিকে পরীক্ষা করেন, আপনি দেখবেন যে তিনি বাংলাদেশের জনগণের ও সরকারের নামে কথা বলার দাবি করছেন।
আমরা আমাদের সেই বিশিষ্ট সহকর্মীদের জিজ্ঞেস করতে চাইবো যারা খসড়া রেজলুশন প্রণয়ন করছে, আপনারা কি খসড়া রেজলুশনটি বিচ্ছিন্নতাবাদী বাহিনী এবং পাকিস্তানের বিপক্ষে তাদের অভিসন্ধিকে উৎসাহ দিতে তৈরি করা পরিকল্পনাকে ছদ্মাবরণ দিতে সেই খসড়া রেজুলেশনগুলো প্রণয়ন করছেন?
আমি সকল খসড়া রেজলুশনের স্পন্সরদেরকে পরামর্শ দেবো যে আমার প্রতিনিধি এই সকল প্রস্তুতিসমূহকে সতর্কভাবে দেখবে যেন পরিশেষে জাতিসংঘের চার্টারের উল্লঙ্ঘন করতে এই সকল অস্পষ্টতাগুলোর যেন সুযোগ নেয়া না হয়।
.
.
শিরোনামঃ ১১৭। নিরাপত্তা পরিষদে আগাশাহীর বিবৃতি
সূত্রঃ জাতিসংঘ দলিলপত্র উদ্ধৃতিঃ বাংলাদেশ ডকুমেন্টস
তারিখঃ ৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১
.
পাকিস্তানের প্রতিনিধি জনাব আগা সাই ৩ এর বক্তব্য
ডিসেম্বর ৬, ১৯৭১
মাত্র গতকাল, আমি নিরাপত্তা পরিষদের নিকট একটি প্রয়োজনীয় কাগজ হতে পাকিস্তান বিভাজন ঘটানোর এবং অপসরণকারী রাষ্ট্র বাংলাদেশ সৃষ্টিকে বৈধকরণে নিরাপত্তা পরিষদকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার ভারতের পরিকল্পনা সম্পর্কিত সংগ্রহীত অংশ দ্বিতীয়বারের মত উদ্ধৃত করেছিলাম, যা ভারতীয় সরকারী বিভাগের নিকট সর্বাধিক গুরুত্ববহ বিবেচিত হচ্ছে। আমি নিশ্চিত যে আমি যা উদ্ধৃত করেছিলাম তা অবশ্যই পরিষদের সদস্যদের পরিষ্কার মনে আছে এবং আমি তা পুনরায় উদ্ধৃত করতে বিরত থাকছি।
মাত্র গতকাল এবং তার আগেরদিন, ভারতীয় প্রতিনিধি মন্তব্য করলেন যে এসব ছিল ভারতের তত্ত্ববাদী এবং সভ্য সুশীল সমাজের ধারণা, কিন্তু এখন এটি পরিষ্কার যে পরিকল্পনাটি নির্ভুল যথাযথতায় এগিয়েছে এবং ভারতীয় সরকার বাংলাদেশের স্বীকৃতি ঘোষণা করেছে।
শ্রীমতী গান্ধীর গতকালের বক্তব্য হতে ভারতীয় প্রতিনিধি পূর্ণদৈর্ঘে উদ্ধৃত করে পাকিস্তানের বিপক্ষে যুদ্ধে যাওয়ার কারণ প্রদর্শন করেছেন। তিনি বলেন যে এটি একটি সাহসী সংগ্রাম ছিল যা স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায়ের উন্মোচন করেছে। এবং একথা উল্লেখ করা হোক যে এই নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল ধ্বংসযজ্ঞ এবং আগ্রাসনের মধ্য দিয়ে।
যদি পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঘোষিত করে, এবং যদি আমার দেশের অভ্যন্তরীন রাজনৈতিক দলগুলোর মতবিরোধের জের ধরে শেখ মুজিবুর রহমানের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিকল্পনা বাস্তবে রূপান্তরিত না হয়, তবে কি তা একটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের একটি সশস্ত্র সামরিক বিবাদ প্ররোচিত করা এবং পাকিস্তানের উপর উদ্দেশ্যমূলক হামলা করাকে ন্যায্যতা প্রতিপাদন করে? যদি একটি দেশে কোন রাজনৈতিক দলের, এমনকি সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতাকে সরকার গঠনের জন্যে কোন কমিশন দেয়া হয়ে থাকে, এবং কোন না কোন কারণে, সে কারণ ভুল-শুদ্ধ যাই হোক না কেন, তা যদি বাস্তবায়িত না হয়, তবে কি অন্য কোন রাষ্ট্র সেই রাষ্ট্রে স্বাধীনতা উন্নীত করতে আগ্রাসন এবং ধ্বংসযজ্ঞে নিযুক্ত হয়?
এখন, আমাদের বলা হয়েছে যে নিরাপত্তা পরিষদকে অবশ্যই বাস্তবতার মুল্যায়ন করতে হবে এবং ভারতীয় প্রতিনিধি মুক্তিবাহিনীর সাফল্য নিয়ে কথা বলে গেছেন। আবৃত বাস্তবতা হল এই যে মুক্তিবাহিনীর কেবলমাত্র ১২০০০ ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর সহায়ক যা পাকিস্তানের উপর সশত্র হামলা লেলিয়ে দিয়েছে। এটি কেবলমাত্র একটি সহায়ক ভুমিকাই পালন করতে পারে। মুক্তিবাহিনী এখানে শুধুই ভারতীয় সেনাবাহিনীর অধীনে কাজ করবে। এবং এটি দখলদার কর্তৃপক্ষের সরকারী প্রতিস্থাপনা যে নিরাপত্তা পরিষদের নিকট স্বীকৃতি না হলেও কোনরকমের মেনে নেয়ার প্রস্তাবনা আশা করা হচ্ছে।
আমাদেরকে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, স্বাধীনতা এবং আরও কত কিসের আড়ম্বরপূর্ণপ্রচারণাবলা হয়েছে। কিন্তু আমরা জানি যে বলা এবং করা সমতুল্য নয়। কতটা সংবিধানে, পৃথিবীর প্রতিটি দেশের কতগুলো মতবাদে এবং প্রচারণায় এসব শব্দের ব্যবহার নেই? আমাদের কি তবে শুধুমাত্র অলংকারশাস্ত্র এবং বাকপটুতা দ্বারা পথপ্রদর্শন করা হচ্ছে? ভারতেই গনতন্ত্র এর বিভিন্ন প্রদেশে কাজ করে না; তারা সরাসরি রাষ্ট্রপতি শাসনের অধীনে আছে। এবং ধর্মনিরপেক্ষতা পালনের চেয়ে লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে বেশী মর্যাদা পায়। যুদ্ধরত দলসমূহকে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের হত্যা এবং জবাই করতে ছেড়ে দেয়া হয়-এবং আমাদেরকে বলা হয়েছে কৃতকর্মের জবাবদিহি করতে।
আমাদেরকে আরও বলা হয়েছে বাংলাদেশের বৈদেশিক সম্পর্ক এবং জোট-নিরপেক্ষতা সম্বন্ধে। ঐ সরকারের পরামর্শদাতা ইন্দো-সোভিয়েত সামরিক জোটের নিষ্পত্তিকরণের মাধ্যমে জোট-নিরপেক্ষতার উদাহরণ প্রতিষ্ঠা করেছেন।
ভারতীয় প্রতিনিধি বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা বলেন। ১৯০৫ সালে ঐ একই পূর্ব পাকিস্তান, যা কিনা বেঙ্গল প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত ছিল, কলকাতার পুঁজিবাদী ও জাত হিন্দুদের দ্বারা অর্থনৈতিক শোষণ ও শাসনের শৃঙ্খল হতে মুক্ত হয়, এবং ভারতের একটি আলাদা প্রদেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়-যা ব্রিটিশ সরকার দ্বারা ১৯০৫ সালে সংঘটিত হয়েছিল। কিন্তু ভারতের ঐ একই পুঁজিবাদী, শিল্পপতি এবং জাত হিন্দুরা হত্যা, গুপ্তহত্যা এবং সন্ত্রাসের একটিবিরামহীন আন্দোলন পরিচালনা করে এবং ব্রিটিশ সরকারকে দ্বিবিভাজন খণ্ডিত করতে বাধ্য করে। ফলে দুই শতাব্দী ধরে ব্রিটিশ সরকার এবং পরবর্তীকালে ভারতের সুবিধাভোগী শ্রেণীসমূহ উভয়ের দ্বারা শোষিত হওয়ার পর ১৯০৫ সালে পূর্ব পাকিস্তানের যে পৃথকীকরণ হয়েছিল তা খণ্ডিত হয়ে যায় এবং পূর্ব পাকিস্তানকে আবারো বাংলার অংশ করে দেয়া হয় যাতে সুবিধাভোগী শ্রেণীর শাসন পুনরায় আরোপিত হয়। পাকিস্তানের রাজনৈতিক ধারার প্রভাবশালী অংশীদার এবং প্রভাবশালী অঙ্গ হিসেবেপাকিস্তানী জনগণ এবং তাদের শক্তিই এই ধরণের শাসনের পুনরায় আরোপ এবং পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের স্বাধীনতার উন্নয়নের মধ্যে এসে দণ্ডায়মান হয়।
তারপর ভারতীয় প্রতিনিধি স্বায়ত্তশাসনের জন্য আন্দোলনের ইতিহাসে চলে যান, ছয় দফা দাবী নিয়ে কথা বলেন এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে উদ্ধৃত করেন। এখানে, ছয় দফা দাবী নিয়ে আমি কিছু কথা বলি।
২৩শে মার্চ, বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দ্বারা রচিত অবাঙ্গালীদের হত্যাকাণ্ড দমনে ফেডারেল সেনাবাহিনী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে যাওয়ার দুইদিন আগে, বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নেতাবৃন্দ, বা আওয়ামীলীগের নেতাবৃন্দ রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খানের নিকট একটি খসরা ঘোষণাপত্র উপস্থাপন করেন এই মর্মে যে এটাই তাদের শেষ কথা এবং পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি চাইলে এটা মেনে নিতেও পারেন কিংবা নাও নিতে পারেন; এতে তারা এও বলেন যে পাকিস্তানকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে একটি সংঘ হতে হবে, এবং এটি একটি সংঘে রূপান্তরিত হতে যাচ্ছে। অপর রাজনৈতিক দলগুলো বিশ্বাস করে যে সংঘ হচ্ছে দুইটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের একটি সমিতি, কোন এককের দুইটি প্রদেশ কিংবা রাজ্য নয়। নিশ্চিতভাবে, এটি একটি বৈধ দৃষ্টিকোণ ছিল যার কাছে কেউ সহমত প্রকাশ করতে পারে আবার নাও করতে পারে, কিন্তু এটি কিভাবে ভারতের উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়ালো? অন্যভাবে বলা যায়, পাকিস্তানকেদুইটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের একটি সংঘতে রূপান্তর হওয়ার চূড়ান্ত প্রস্তাবনা মেনে নেয়ার কথাপাকিস্তান সরকারকে বলা হয়েছে। এবং এখনো, ভারতীয় প্রতিনিধি আমাদেরভাষণ দিচ্ছেন কিভাবে আমরা আমাদের সাংবিধানিক এবং রাজনৈতিক জীবন শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়ে পরিচালনা করব। উনাকে আগে নিজের সংবিধান পড়তে দেয়া হোক এবং প্রদেশগুলোকে কতখানি স্বায়ত্তশাসন ক্ষমতা দেয়া আছে তা দেখতে দেয়া হোক। ভারতীয় সংঘে তার নিজের প্রদেশ পশ্চিম পাকিস্তানের কতটুকু স্বায়ত্তশাসন ক্ষমতা আছে? বাঙলা এবং আসামের পুঁজির কতখানিই বা ওইসব প্রদেশে ব্যয় করা হয়?
এছাড়াও, যেকোনো রকমের ভারতীয় প্রতিনিধিগণ পাকিস্তানী সশস্ত্রবাহিনী দ্বারা নিহত শত-সহত্র মানুষের পুনরাবৃত্তি করে থাকেন। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দ্বারা নিহতদের জন্যে তাদের কোন মানবতা লক্ষ্য করা যায় না। তথাকথিত বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের মধ্যে এমন মানুষ ওখানে ছিল যারা কসাইখানা স্থাপিত করেছিল যেখানে সহস্র মানুষের হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয় ২৫শে মার্চের আগে যখন সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হয় এবং তারপরেও। এবং সেইসকল মানুষ এখন বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করতে আসে। এসব নৃশংসতার জীবন্ত প্রমান আছে, এবং যদি নিরাপত্তা পরিষদ প্রচারণা এবং কলামিস্টরা যা লিখছে তা হতে মুখ ফিরিয়ে নিজেরা খুঁজতে চায়, আমাদের উচিৎ তা করার মাধ্যম সরবরাহ করা।
ভারতীয় প্রতিনিধি সেদিন তার প্রতিনিধিদলের দেখানো চলচিত্রের কথা বলছিলেন। আমাদের কাছে এমন চলচিত্র আছে, কিন্তু আমরা আপনাদের অনুভূতিকে নিষ্কৃতি দিয়েছি। কিন্তু, আপনারা যদি চান তবে আপনাদের সেগুলো দেখতে আসতে স্বাগত জানাচ্ছি। পাকিস্তান মৃত এবং প্রোথিত তাই তার উৎসাহআমি বুঝতে পারি। আমি তাকে বলতে চাই, পাকিস্তান বেঁচে আছে এবং ভারতের হিংস্রতার পরেও বেঁচে থাকবে।
তারপর, সে নিউইয়র্ক টাইমস থেকে কিছু একটা উদ্ধৃত করে। এটি হল কলামিস্ট অ্যান্টনি লেওয়িস এর একটি প্রবন্ধ। আমি ইতিপূর্বে তার অনেক প্রবন্ধ পড়েছি। কিন্তু, এটি হচ্ছে একজন ব্যাক্তির অভিমত মাত্র। সে কি চিত্রের অন্যপাশটি খুঁজে দেখার জন্য পাকিস্তান গিয়েছিল? যুক্তরাষ্ট্রের অর্ধ মিলিয়ন পাঠকের দ্বারা পঠিত একটি সংবাদপত্রে তার প্রবন্ধ ছাপানোর আগে সে কি আসল তথ্যগুলো সম্পর্কে অবগত হওয়ার জন্যে একটুও যত্নশীল হয়েছিল? সে কিসমানভাবে সম্মানিত অন্যান্য পত্রিকার সংবাদদাতাদের সাথে তথ্য মিলিয়ে তুলনা করেছিল, যেমন ম্যানচেস্টার গার্ডিয়ান যারা সম্পূর্ণ ভিন্নমত পোষণ করছে। এইধরনের প্রচারণাই ভারতীয় প্রতিনিধি অবলম্বন করে ভারতের আক্রমণ এবং আমাদের এলাকা দখল হতে পরিষদের মনোযোগ সরিয়ে দিতে। আমরা যদি সংবাদদাতাদের উদ্ধৃত করতে শুরু করি, তাহলে আমরা শেষ করব কোথায়? ঠিক আছে, আপনারা যদি সংবাদদাতাদের উদ্ধৃত করতে চান তবে আমি জেমস রেস্টনকে উদ্ধৃত করব যিনি গতকালের নিউইয়র্ক টাইমসে বলছেন,
“প্রধানমন্ত্রী গান্ধীর পাকিস্তানের অসচ্চরিত্র ও অনর্থক আক্রমণ নিয়ে কথা বলা, যেখানে তার নিজের সরকারের সেনাবাহিনীরা সর্বক্ষণ পূর্ব পাকিস্তানের ভেতরে অবস্থান করছে, এবং তার সহকর্মীগণের পূর্ব পাকিস্তানের বিদ্রোহীদের প্রতি সহযোগিতাতে আর কোন গোপনীয়তা রাখেনি অথবা তাদের পূর্ব পাকিস্তানের পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিভক্ত হওয়া দেখার ইচ্ছা দেখা বিশ্বের বুদ্ধিমত্তার প্রতি প্রকাশ্যে অপমানজনক।
এবং ভারতীয় প্রতিনিধি তার বিশিষ্ট গোয়েন্দাবাহিনীকে ও অগাস্ট জমায়েতকে এতোটাই খাটো মনে করেন যে তিনি তার ভুল উপস্থাপনায়ই নিবিষ্ট আছেন। আমি উদ্ধৃতিটি অব্যাহত রাখছিঃ
“শ্রীমতী গান্ধী জাতিসংঘের পর্যবেক্ষকদের ভারত-পাকিস্তানের সীমান্তে কি চলছে তা দেখার অনুমতি দেয়ার কথা গ্রাহ্যও করেননি, যা কিনা আকর্ষণীয়, যেহেতু তিনি এখন এই যুদ্ধকে পাকিস্তানী আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে নৈতিক ধর্মযুদ্ধ হিসেবে সমর্থন করছেন।
ভারতীয় প্রতিনিধি পাকিস্তান সরকারকে সামরিক গুপ্তসভা ছাড়া কিছু সম্বোধন করতে পারেন না। বেশকিছু সদস্য রাষ্ট্র শাসিত হয়েছে—এবং এটি আমার কথা নয়, কিন্তু তার কথা—সামরিক গুপ্তসভা দ্বারা, এবং তিনি আরও বলেন,
“রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান নির্বাচনের ফলাফল জোরপূর্বক মুছে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।”
প্রথমত, যদি রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং উন্নীত করতে না চাইতেন তবে কেন তিনি নির্বাচন সংগঠিত করাতেন এবং কেন তা সংগঠিত হবে একটি স্বাধীন পরিবেশে যা তিনি নিজেই পরবর্তীতে আহ্বান করেন? বাঙালীদের আকাঙ্ক্ষা বিনষ্ট করা কি তার জন্যে নির্বাচনের আগেই সহজতর হত না, এতে পৃথিবীতে এতো নাকিকান্নার জন্মও হত না?
তথাপি, ভালো এবং সৎ উদ্দেশ্যগুলো যদি অনুধাবন করতে বাঁধা দেয়া হয়, তখন সেগুলোই নিন্দিত হয় এবং অসৎ উদ্ধেশ্যগুলো আরোপিত হয়। এবং তারা আসে কোত্থেকে? ভারত থেকে। আমরা জানি যে আমরা ভারত থেকে স্থায়ী শত্রুতা ব্যাতিত কিছু আশা করতে পারি না।
সিনেটার গির্জা যা বলতে পারত সেই প্রসঙ্গে আমার অনুশোচনা এইখানে যে সিনেটার গির্জার পরাভবতা এবং আক্রমনতা নিয়ে কিছু বলার ছিল না। সে পাকিস্তানের পরিস্থিতির কিছু নির্দিষ্ট দিক নিয়ে মতামত প্রকাশ করেছে, কিন্তু এমন অনেক বিষয় নিয়ে সে নিশ্চুপ থাকা শ্রেয় মনে করেছে যেসব বিষয় নিয়ে আমরা নিরাপত্তা পরিষদে এইমুহূর্তে বিবেচনা করছি।
অবশেষে, ভারতীয় প্রতিনিধির উত্তর হিসেবে বলছি, তিনি অভিযোগ করেছেন যে পাকিস্তান আক্রমণের জন্যে চিৎকার করেছে এবং নিরাপত্তা পরিষদের সভা নিয়ে কোন দাবী তুলেনি। রাষ্ট্রদূত ভিঞ্চি অগাস্টে নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতি ছিলেন এবং একটি মধ্যস্থ প্রভাব চর্চার তাগিদে নিরাপত্তা পরিষদকে সচল করতে এবং উত্তেজনার হ্রাস উন্নীত করতে আমার সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী আমার প্রচেষ্টা সম্পর্কে অবগত আছেন। কিন্তু কেন নিরাপত্তা পরিষদের কোন সভার আয়োজন করা হল না? ভারতের বিরোধিতা এবং ভারতেরমিত্রদের জন্য। এবং এখন আমরা সকলেই জানি, যখন আমরা অবশেষে নিরাপত্তা পরিষদের সামনে আসি তখন তার পরিণাম কি-একটি নিষেধাজ্ঞা।সুতরাং নিরাপত্তা পরিষদের সামনে আসার কথা আমরা আর নাই বলি।
ভারতীয় প্রতিনিধি থেকে এবার আসা যাক সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিনিধি গতকাল এবং আজকে একটু আগে কি বলেছেন। আমি অবশ্যই তার সংশোধনীসমূহ নিয়ে মন্তব্য করব না, কারণ আমি বিশ্বাস করি ওরা আর আমাদের সামনে নেই খসড়া সমাধানের জন্য যার কাছে সংশোধনী হিসেবে জমা দেয়া অপসারিত হয়েছে। আমরা সেই খসড়া সমাধানের উত্থাপকদের তাদের প্রস্তাব অপসারণের জন্য ধন্যবাদ প্রদান করছি। কিন্তু এখানে, রাষ্ট্রদূত মালিক তার সংশোধনীসমূহ বর্ণনা করার সময় যা বলেছিলেন সেই প্রসঙ্গে বলছি যে আমি এই সুযোগটি দুইএকটি ক্ষেত্রে মন্তব্য না করে অগ্রসর হতেদিতে পারছি না। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিনিধি বলেছেন যে নিরাপত্তা পরিষদের এই কার্যকলাপ নিশ্চয়ই হিন্দুস্তান উপমহাদেশের বাস্তব পরিস্থিতি অনুযায়ী করা হয়েছে। হিন্দুস্তান উপমহাদেশের বাস্তব পরিস্থিতি এখন ভারতের পরাভবতা, সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সহায়তা, সশস্ত্র হস্তক্ষেপ এবং হিংস্রতা এসবের সংঘটন। অন্যভাষায়, নিরাপত্তা পরিষদ কি এখনবৈধতা দিতে যাবে এই তথাকথিত বাস্তবতাকে, চিরস্থায়ী ভোগদখল এবং হিংস্রতার ফলের নিশ্চয়তা এবং শক্তির অবৈধ প্রয়োগকে?
সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিনিধি বলেছেন যে এই শত্রুতার নিবৃত্তি অবশ্যই সংঘটিত হতে হবে একটি রাজনৈতিক সমঝোতার মধ্য দিয়ে। অন্যভাবে বলা যায়, সোভিয়েত সংশোধনীসমূহ, সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিনিধির বর্ণনা অনুযায়ী, পাকিস্তানের পূর্ব পাকিস্তানের খণ্ডনে, পাকিস্তানের বিভাজনে এবং ঐ যুদ্ধ ও সামরিক ভোগদখলেঅবশ্যই দ্রুত সহমত হতে হবে।
আমি মন্তব্য করতে বাধ্য হচ্ছি যে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিনিধির বক্তব্যে পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে ক্রমাগত নিবিষ্টতা রয়েছে আজকে উপমহাদেশে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে, এবং সপ্তাহের পর সপ্তাহ এবং মাসের পর মাস ধরে বিরাজ করেছে তার সবকটি দিক বর্জন করে। এবং আমরা সর্বাধিক উদ্বিগ্ন এই নিয়ে যে নিরাপত্তা মতবাদের সাথে, যা আমি গতকাল উল্লেখ করেছিলাম, সোভিয়েত প্রতিনিধির ঘোষণাসমূহ মনে হচ্ছে আমার দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক জীবনের নিষ্পত্তিকারী হিসেবে নিজেদের দাবী করছে।
আমি পরে খসড়া সমাধানের উপর মন্তব্য করব, কিন্তু আমি মনেকরি আমার উচিৎ কিছু নির্দিষ্ট তথ্য লিপিবদ্ধ করা। আমি গতকাল এমনটি করা থেকে বিরত থেকেছি, কারণ আমি পরিষদ কর্তৃক গৃহীত সময় দীর্ঘায়িত করতে চাইনি, এর আগে খসড়া সমাধানের উপর একটি ভোট পেতে। আমি নিরাপত্তা পরিষদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই ভারতের একটি ভুল বিবৃতির প্রতি যা সেক্রেটারি জেনারেলের প্রতিবেদন অন্তর্ভুক্ত। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে একটি বার্তা অনুযায়ী, যে মৌখিক ভাবে মহা সচিব ব্যাক্ত করেন, যেখানে দাবী করা হয় যে পাকিস্তান বিমান বাহিনী ২রা ডিসেম্বর বিকেলে বিতর্কিত অঞ্চল জম্মু ও কাশ্মীর এর শ্রীনগর-পাঠান কোটে এবং অমৃতসরে অবস্থিত ভারতের সামরিক ঘাঁটি আক্রমণ করে। এটি সম্পূর্ণভুল। আমি এখন পর্যন্ত দাবিটির বিরোধিতা করিনি কারণ আমি সঠিক সত্য পরীক্ষণ করছিলাম। আমার সরকারের নির্দেশাবলী অনুযায়ী, এখন আমি বলতে চাই যে পাকিস্তান বিমান ৩ রা ডিসেম্বর এই বিমান বাহিনীর বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণ, এবং শুধু মাত্র ভারতের ছয় বা সাত ঘণ্টা আগে পশ্চিমে ৫০০ মাইল দীর্ঘ সামনে বরাবর পাকিস্তানের বিপক্ষে সশস্ত্র আক্রমণ করার পর।
আমি এই প্রসঙ্গে আরও বলতে চাই, আমিরাষ্ট্রদূতমালিককে অনুরোধজানাচ্ছি যে যখন তিনি আমার কোন মন্তব্য উদ্ধৃত করবেন, দয়া করে তাদের প্রেক্ষাপটে উদ্ধৃত করবেন, শুধু মাত্র এটাই বলতে চাই যে এটা পরিতাপের বিষয়যে, তিনি আবার গতকাল একটি বিবৃতি দিয়েছেন যা আমি একদিন আগেই সঠিক করিয়ে দিয়ে ছিলাম। সেটি ছিল পাকিস্তানে একটি অভ্যন্তরীণ সঙ্কটের অস্তিত্ব সম্পর্কে আমি যা বলেছিলাম সেই প্রসঙ্গে। রাষ্ট্র সমূহের রাজনৈতিক জীবনে, অভ্যন্তরীণ সংকট একটি বিরল ঘটনা নয়। কিন্তু সঙ্কট নিরসনভার ঐ দেশের জনগণের উপর ; এবং বিদেশী ক্ষমতা অভ্যন্তরীণ বিভাগের বর্ধিত করা , অপসরণ এবং সশস্ত্র বিদ্রোহ প্রচার, এবং অবশেষে সশস্ত্র হামলা চালানো ও অন্যান্য রাষ্ট্রের রাজনৈতিক জীবনে একটি অভ্যন্তরীণ সঙ্কটকে হস্তক্ষেপবাদী তত্ত্ব গুলোর জন্য যুক্তি হিসাবে ব্যবহার করার জন্য নয়।
উপরন্তু , আমি এই পরিষদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাই গতকাল ভারতের একটি বিশ্রাম শোচনীয় কর্মের প্রতি। ৪ঠা ডিসেম্বর, সেক্রেটারিজেনারেল, একটি জরুরী টেলিফোনে বার্তার মধ্যদিয়ে আমাকে জাতিসংঘের কর্মী বৃন্দের নিরাপত্তার জন্য তার উদ্বেগ প্রকাশকরেন এবং তাদের ব্যাংককে সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত জানান। তিনি অনুরোধ করেন পাকিস্তান সরকার যাতে দেখে যে ৫ই ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের সময় সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে ঢাকায় একটি যুদ্ধবিরতির ব্যবস্থা করা যেতেপারে কিনা এবং বিমানবন্দরে একটি বিমান অবতরণ করিয়ে জাতিসংঘের কর্মী বৃন্দকে নিরাপদ স্থানে পাঠানো যায় কিনা। মহাসচিব এছাড়াও জ্ঞাপিত যে তিনি ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি মহাসচিবকেও একই অনুরোধ করবেন। মহা সচিব অনুরোধ সবার সঙ্গে পাকিস্তান সরকারের কাছে জরুরি ভিত্তিতে পৌঁছে ছিল। এটা ইসলামাবাদে করা টেলিফোনে বার্তা সহ পাকিস্তান মিশন দ্বারা অনুসরণ করা হয়েছে। এটা বোঝা যায় যে পাকিস্তান ও ভারত উভয় সরকারই জাতিসংঘের কর্মীদের এবং বিদেশী কূটনীতিকদের সরিয়ে নেয়ার জন্য ৩টি নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্যের সময়ের জন্য ঢাকায় একটি যুদ্ধ বিরতিকরতে রাজি হয়। তবে, বিশ্ব এখন জানে যে ভারতের বিমান বাহিনী ঠিক জাতিসংঘের কর্মীদের উদ্বাসন মুহূর্তকেই ঢাকায় বেসামরিক বিমান বন্দরে আক্রমণ করতে বেছে নিয়েছে। এই আক্রমণের বিশ্বাসঘাতক প্রকৃতিকে সর্বাত্মক শক্তিশালী উপায়ে নিন্দা করতে হবে। এই মুহূর্তে কি ধরনের মনোভাব ভারতকে নিয়ন্ত্রণ করছে তা আমাদের বলা থেকে এটিই ভালো ভাবে প্রদর্শন করছে। ভারতের বিমানবাহিনী পাকিস্তান সীমানার ওপর আক্রমণ এমন সময়ে আরম্ভ করে যখন তারা জানে পাকিস্তানের বীরবাহিনী যুদ্ধবিরতি পর্যবেক্ষণ করতে প্রতিশ্রুতি বদ্ধ। এই ক্ষেত্রে নিরীহ আন্তর্জাতিক কর্মকর্তা বৃন্দ ও কূটনীতিকদের পরিস্থিতির শিকার হতে হয় এবং এটা একটি সৌভাগ্য যে দুর্ঘটনায় কোন প্রাণহানি ঘটেনি।
অবশেষে, আমি একটি বিশেষ স্বত্বার এখানে আসার আমন্ত্রণ ব্যাপ্ত করণ প্রশ্নে সম্পর্কে বলতে চাই যে, আমি নির্দেশ করছি এটি শুধু মাত্র নিরাপত্তা পদ্ধতির শর্তাধীন নিয়ম ৩৯ এর লঙ্ঘনই হবেনা, এটি সনদেরও লঙ্ঘন হবে। যা অন্যদের মধ্যে আর্জেন্টিনার প্রতিনিধি দ্বারা যথেষ্ট শক্তি প্রয়োগ করে বের করে আনা হয়েছে। ভারতের ক্রিয়া গতকাল যাই হয়ে থাকুক না কেন যা পরিষদে উত্থাপনের প্রতি আহ্বান জানান হয়েছে তা কোনমতেই যুক্তির বল পরিবর্তন করা বুদ্ধিমানের নয়, এবং পরিষদের একটি বেআইনী কাজ করা উচিত কিনা এবং আমাদের বিবেচনা করা উচিত যে পাকিস্তান সরকার প্রতি একটি অসদাচরণ করা হচ্ছে।
যাতে সভার সময় আর নানিতে হয়, আমি ফ্রান্সের প্রতিনিধির তার চরিত্রগত বাগ্মিতা, নির্ভুলতা ও বৈধতা দ্বারা প্রস্তাবিত খসড়া রেজল্যুশন উপর আমার মতামত দিতে সংক্ষিপ্ত ভাবে চাই। আমরা তার প্রতিনিধি দলের এবং ব্রিটিশ প্রতিনিধিদলের উদ্বেগ নিয়ে সচেতন যে পরিষদের সম্পূর্ণ রূপে নিষেধাজ্ঞা দ্বারা না পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে কিছু ফলাফল অর্জন করা উচিত। তথাপি, আমরা যখন আপনাদের প্রশংসনীয় উদ্দেশ্যের প্রশংসাকরি , এবং শান্তির জন্য উদ্বেগ নিয়ে তাকে একটি প্রস্তাব করার অনুরোধ জানাই, আমরা বুঝতে বাধ্য হচ্ছি যে আগ্রাসনের প্রমাণিত সত্য সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি, এবং বাস্তবতা এই যে, ভারত এই আগ্রাসন স্বীকার করেছে। পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের নিবৃত্তি এবং পরাভব এবং ভারত সশস্ত্রবিদ্রোহের উস্কানি সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি। উপরন্তু, খসড়া প্রস্তাবে সশস্ত্র ব্যক্তিদের কে এবং বাহিনী প্রত্যাহারে করা হয়নি। অন্য কথায়, দখল অব্যাহত থাকবে এবং তারপর, নিরাপত্তা পরিষদ যতক্ষণে পরিস্থিতি বিবেচনায় অগ্রসর হবে, পাকিস্তানকে তার নিজস্ব বিভাজন মেনে নিতে আহবান জানান হবে।
আমরা উল্লেখ করছি যে খসড়াটি পর্যবেক্ষণ করে যে পরিষদের আবার মিলিত হওয়া উচিৎ এই বিষয়ে সনদের কাঠামোর মধ্যে কি পদক্ষেপ হতে পারে তা বিবেচনার স্বার্থে যা শত্রুতার জন্ম দেয়। কিন্তু আমরা খুব ভালো করেই জানি যে দখলদার বাহিনী প্রত্যাহারের জন্য কোনো প্রস্তাব একটি নিষেধাজ্ঞা আকৃষ্ট করতে পারে। এবং নিরাপত্তা পরিষদ বাহিনী প্রত্যাহারের প্রশ্ন মোকাবেলা করার মত অবস্থানে থাকবে না। এক সঙ্গে যুদ্ধবিরতির এবং প্রত্যাহার প্রশ্নে একযোগে আচরণ না করে, পরিষদ সামরিক দখল দারিত্ব বৈধকরবে এবং এটা চিরস্থায়ী হবে।
এই কারণে, আমরা আশা করি যে পরিষদ বিবেচ্য বিষয় গুলো কে গুরুত্ব দিবে। আমি প্রতি আহ্বান জানাইয়েছি এবং সচেতনও হয়েছি যে যেহেতু শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য যেমন এটির একটি দায়িত্ব আছে, একটি ভেটো ক্ষমতা নির্বিচারে প্রয়োগ করা হচ্ছে বলে জাতিসংঘ পুরো দায়িত্ব থেকে নিজেকে মুক্ত হতে পারবেনা।
.
.
শিরোনামঃ ১১৮। নিরাপত্তা পরিষদে পাকিস্তানী প্রতিনিধি আগাশাহীর বিবৃতি
সূত্রঃ জাতিসংঘ দলিলপত্র উদ্ধৃতিঃ বাংলাদেশ ডকুমেন্টেস
তারিখঃ ৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১
.
পাকিস্তানের প্রতিনিধি জনাব আগাশাহী’র ভাষণ
৬ ডিসেম্বর,১৯৭১
পুনরায় কথা বলার সুযোগ নেয়া আমার উদ্দেশ্য ছিল না,কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের দূত আমার উদ্দেশ্যে একটি সরাসরি প্রশ্ন করেছেন,যেটি উত্থাপিত হয়েছে,সোভিয়েত খসড়া সমাধান প্রস্তাব দলিল-S/10428 থেকে, যেটি তিনিই প্রচার করেছেন।
প্রশ্নটি ছিল,কেন আপনারা পূর্ব পাকিস্তানের জনগনের ইচ্ছার প্রকাশকে ভয় পান?আমি বিশ্বাস করি এই প্রশ্নের উত্তর তার প্রাপ্য এবং আমি তাকে সত্য কথাই বলব।কিন্তু সেটা করার আগে,আমি তার উপস্থাপিত খসড়া প্রস্তাবের ব্যাপারে দুটি কথা বলব।
যেহেতু সাধারণ নীতি হচ্ছে,যখন কোন দেশ দখলদার কতৃক আক্রান্ত হয় সেখানে কোন রাজনৈতিক সমাধান হতে পারেনা এবং দুঃখজনকভাবে আমরা জাতিসংঘের নীতিতে সেটা সেই সাধারণ নীতি খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয়েছি-সেটা সোভিয়েতের খসড়া প্রস্তাব দ্বারা প্রত্যাখ্যাত।
জাতিসঙ্ঘের যতগুলো খসড়া সমাধান বিবেচনা করা হয়েছে,প্রত্যেকটিতে আমার এই ব্যাপারটা নজরে আনা উচিত।অপসারণ এর সাথে অস্ত্র-সংবরণ একটি অলঙ্ঘনীয় চর্চা এবং আমরা এখন পর্যন্ত সোভিয়েতের নীতির অবস্থানকে স্বাগত জানাই,কারণ তারা সর্বদা যুদ্ধবিরতি এবং অপসারণ এর মধ্যে একটি স্বাভাবিক সম্পর্ক স্বীকার করে এসেছে।কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে আমরা বর্তমান প্রেক্ষাপটে সোভিয়েতের সেই নীতির ধারাবাহিকতা খুজে পাইনি।
যেমন আমি বলেছিলাম,পূর্ব পাকিস্তান যে পাকিস্তানের অংশ এটি সকল সদস্য রাষ্ট্রদ্বারা স্বীকৃত, ২১ নভেম্বর থেকে পুর্ব পাকিস্তানের উপর সামরিক আক্রমণ সম্পূর্ণ পাকিস্তানের উপর আক্রমন।
সোভিয়েতের প্রতিনিধি এই অভিযোগ এনেছেন যে ,পাকিস্তান এইসব ৩ ডিসেম্বর শুরু করেছে।কিন্তু আমাদের অবশ্যই এই তারিখের পূর্বে নজর দিতে হবে।আমার মনে করিয়ে দেয়া উচিত যে ২১ নভেম্বর পাকিস্তানের উপর আক্রমন শুরু হয়েছে যেটি কিনা একটি একক রাষ্ট্র।
আমাদের অভ্যন্তরীণ সংকটের ব্যাপারে আমি যা বলেছিলাম তা পরিষ্কার করতে চাই।আমাদের অভ্যন্তরীণ সঙ্কটটি একটি রাজনৈতিক সংকট।এই রাজনৈতিক সঙ্কটটি আমাদের ঘরোয়া ব্যাপার।এই সঙ্কটটির আন্তর্জাতিক দিক
হলো-এর একটি মানবিক দিক আছে,সম্পূর্ণভাবে মানবিক দিক এবং এর আরেকটি আন্তর্জাতিক দিক আছে যেটা ভারতের তৈরি করা-সশস্ত্র বিদ্রোহীদের উত্থান ঘটানো এবং পুর্ব পাকিস্তানে তাদের ঢুকিয়ে দেয়া এবং শেষ পর্যন্ত পুর্ব পাকিস্তানে তাদের(ভারতের)হামলা।আমার আরো একবার সবার কাছে পরিষ্কার করা উচিত যে,কোনটা আমাদের সঙ্কটের অভ্যন্তরীণ দিক ও কোনটা আন্তর্জাতিক দিক,যাতে আর কোন ভুল বোঝাবুঝি না থাকে।
এখন এই প্রশ্নে আসা যাক আমরা পাকিস্তানের জনগনের ইচ্ছার প্রকাশে ভীত কী না। না,এটি একটি বিরাট ট্র্যাজেডি যে, এই ইচ্ছার রাজনৈতিক প্রকাশ সংসদ অধিবেশনে হতে পারে নি,যেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর মতবিভেদ নিষ্পন্ন হতে পারত।কিন্তু কিছু সময়ের জন্য সেটা্র বিরতির ফল হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদীতার উত্থান হয় সরকারকে কর প্রদানে অস্বীকার,কর্তৃপক্ষের কর্তৃত্ব অস্বীকার এবং ১৮,০০০ অপরাধীকে মুক্ত করার মাধ্যমে । যেকাজগুলো নিয়ে গেছে একটি নৃশংস হত্যার উৎসবে।
এই হচ্ছে সত্য।যদি প্রমাণের প্রয়োজন হয়,তাহলে যে কেউ সঙ্কট এর শুরুর মুহূর্ত ,জানুয়ারী-ফেব্রুয়ারী থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্গুলো ঘাটলেই পেয়ে যাবে।এটি একটি তিক্ত সত্য যা শুধু জাতিসঙ্ঘের সদস্যরাই নন,সেই হাজার হাজার সশস্ত্র অপরাধী যারা নৃশংস হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে –তারাও অবগত এবং দুঃখজনকভাবে কিছু নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিও এই অপরাধের সাথে জড়িত।কোন সংসদ সদস্য তার রাজনৈতিক ভিন্নমতের জন্য বহিষ্কৃত হয়নি।
খুনিদের কসাইখানাগুলোর প্রমাণ আছে,আমি বিস্তারিত এখানে বলতে চাই না।আর যারা এর জন্য দায়ী তাদের অনুরোধ করা হয়েছে এখানে আসতে এবং তাদের এই অভিযোগ গুলোর বিপরীতে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করতে।বর্তমান পরিস্থিতিতে,যেখানে রাজনৈতিক অপরাধীদের দায়মুক্তির সুযোগ দেয়া হচ্ছে,আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কি দাবি করবে যে এই সংঘবদ্ধ অপরাধীদেরও এই সুযোগ দেয়া হোক?
সোভিয়েত খসড়া সমাধান প্রস্তাবের অভ্যন্তরীণ বৈপরীত্য এর ব্যাপারে আমার আরো নজরে কিছু ব্যাপার আনা উচিত।তাহলো,সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদ কিছু বিশেষ উদ্দেশ্যে একটি দল তৈরি করেছে, এবং এরপরে সেখানে পূর্ব পাকিস্তানের জনগনের ইচ্ছার স্বীকৃতি পাওয়ার চাহিদা তৈরি হয়েছে।যদি বিচ্ছিন্নতাবাদীরা তাদের বিচ্ছিন্ন হওয়ার উদ্দেশ্য ত্যাগ করে এবং পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের যে ইচ্ছা নির্বাচনের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে তাতে আস্থা রাখে,তাহলে আমরা হয়ত এই অন্ধকার সময় ও বিষন্নতা থেকে উদ্ধার পাব,যদি নিরাপত্তা পরিষদের প্রত্যেক সদস্য খসড়া সমাধান প্রস্তাবে ভোট প্রদানের আগে নিজেকে একবার জিজ্ঞেস করেন।
.
.
শিরোনাম সূত্র তারিখ
১১৯। পূর্ব পাকিস্তানে উপনির্বাচন স্থগিত দৈনিক ইত্তেফাক ৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১
পূর্ব পাকিস্তানে উপনির্বাচন স্থগিত
ইসলামাবাদ, ৬ই ডিসেম্বর (এপিপি)। – নির্বাচনী কমিশন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে আজ পূর্ব পাকিস্তানের উপনির্বাচন স্থগিত ঘোষণা করিয়াছেন।
নির্বাচনী কমিশনের উক্ত ঘোষণায় বলা হয় যে, যুদ্ধের দরুন নির্বাচনী কমিশন পূর্ব পাকিস্তানের সকল প্রাদেশিক ও জাতীয় পরিষদের উপনির্বাচন স্থগিত রাখিয়াছেন।
উক্ত নির্বাচন ৭ই হইতে ২০শে ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল । পরিবর্তিত তারিখ যথাসময়ে ঘোষণা করা হইবে বলিয়া উহাতে বলা হয়।
.
শিরোনাম সূত্র তারিখ
১২০। পাক – ভারত কুটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন দৈনিক ইত্তেফাক ৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১
পাক-ভারত কুটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন
ইসলামাবাদ, ৬ই ডিসেম্বর (এপিপি)। -আজ পাকিস্তান সরকার ভারতের সাথে কুটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করিয়াছেন। আজ অপরাহ্নে প্রকাশিত এক সরকারী হ্যাণ্ড আউটে বলা হয় যে, ভারত সরকার তথাকথিত বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দান করায় সম্পর্ক ছিন্ন করা হইয়াছে।
ভারতে নিযুক্ত সুইচ দূতকে ভারত-পাকিস্তানের বিষয়াদি দেখার দায়িত্ব প্রদান করা হইয়াছে।
মার্কিন কর্মকর্তা কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের সমালোচনা
ওয়াশিংটন হইতে রয়টারের খবরে বলা হয়, মার্কিন সরকারী কর্মকর্তারা আজ ভোরে এখানে বলেন যে, ভারত কর্তৃক ‘বাংলাদেশ’ সরকারকে স্বীকৃতি দানের ফলে উপমহাদেশের অবনতিশীল পরিস্থিতি সুস্পষ্টভাবে আরও একধাপ খারাপ হইয়া উঠিবে। জনৈক কর্মকর্তা বলেন, তাঁহারা অবশ্য ভারতের এই উদ্যোগকে কোন গুরুতর নয়া পর্যায় বলিয়া মনে করেন না। কেননা পাক-ভারত সম্পর্ক গত কয়েকদিন যাবৎই অত্যন্ত খারাপ।
মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের জনৈক কর্মকর্তা বলেন যে, মার্কিন সরকার সরকারীভাবে অবহিত না হওয়া পর্যন্ত তারা ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কর্তৃক ‘বাংলাদেশ’ সরকারকে স্বীকৃতি দানের ঘোষণা সম্পর্কে কোন মন্তব্য করতে অপারগ।
ভারতীয় কুটনীতিকরা সকল সুবিধা ভোগ করিতেছে
রাওয়ালপিন্ডি, ৬ই ডিসেম্বর এপিপি জনৈক সরকারী মুখপাত্র আজ এখানে বলেন যে, ভারতীয় কুটনীতিকদের সাতটি বাড়ীতে থাকার ব্যবস্থা করা হইয়াছে। উক্ত ব্যবস্থা তাহাদের ইচ্ছানুযায়ী করা হইয়াছে। সাবেক হাইকমিশনার জেনারেল কে অটলের অধিকারে যে ভবনটি ছিল তিনি সেখানেই বাস করিতেছেন- ভারতীয় কুটনীতিকদেরকে তিনটি ভবনে আটক করিয়া রাখা হইয়াছে বলিয়া ভারতীয় বেতারে যে উক্তি করা হয় উক্ত মুখপাত্র তাহা অস্বীকার করেন ।
পাকিস্তান সরকার তাহাদের নিরাপত্তা এবং দেখাশোনার কাজ করিতেছেন। সাবেক ভারতীয় হাই কমিশনার কর্মচারীদের খাদ্যদ্রব্য সংগ্রহ এবং মেডিক্যালের সুযোগ-সুবিধা রহিয়াছে। সাবেক হাই কমিশনার নিজে স্বীকার করিয়াছেন যে, তাহারা কোনরূপ শারীরিক কষ্ট বা অসুবিধা ভোগ করিতেছেন না। উক্ত মুখপাত্র বলেন, নয়াদিল্লীস্থ পাকিস্তানী কূটনীতিকদের নিরাপত্তা সম্পর্কে কোন সংবাদ পাওয়া যায় নাই।
১৬ জন ভারতীয় অফিসার ইসলামাবাদ কূটনৈতিক মর্যাদা ভোগ করিতেছেন। করাচীতে তাহাদের কতজন কর্মচারী রহিয়াছে, তাহা জানা নাই। তিনি বলেন যে, ভারতীয় কর্মচারীদের সংবাদাদি পাওয়া সহজ। যেহেতু বৃটিশ হাইকমিশনার ভারতীয় কর্মচারীদেরকে দেখাশোনা করিতেছে। সেইহেতু উক্ত মিথ্যা সংবাদের জন্য বৃটিশ হাই কমিশন দায়ী কি না এই মর্মে এক প্রশ্নের উত্তরে উক্ত মুখপাত্র বলেন যে, এ ব্যাপারে কোন মন্তব্য নাই। পাকিস্তানস্থ ভারতীয় কর্মচারীদের দেখাশোনার জন্য ভারত সরকার ব্রিটিশ হাইকমিশনকে অনুরোধ করিয়াছে বলিয়া কথিত সংবাদ উক্ত মুখপাত্র সমর্থন বা অস্বীকার করা হইতে বিরত থাকেন।
.
.
শিরোনামঃ ১২১। কেন্দ্রে কোয়ালিশন সরকারঃ নুরুল আমিন প্রধানমন্ত্রী, ভূট্টো উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী
সূত্রঃ পাকিস্তান অবজারভার
তারিখঃ ৮ডিসেম্বর,১৯৭১
.
আমিন,ভূট্টোকে জোট গঠনের প্রস্তাব
রাওয়ালপিন্ডি, ডিসেম্বর ৭
এপিপি এর সূত্র অনুযায়ী, জনাব নুরুল আমিন এবং জনাব জেড. এ. ভূট্টোকে কেন্দ্রে জোট সরকার গঠনের জন্য আহ্বান জানান রাষ্ট্রপতি।
জনাব নুরুল আমিন হবেন প্রধানমন্ত্রী এবং জনাব ভূট্টো হবেন উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
রাষ্ট্রপতির বক্তব্য নিম্নে তুলে ধরা হলোঃ
“আমি জনাব নুরুল আমিন এবং জনাব জেড. এ. ভূট্টোকে আহ্বান জানিয়েছি কেন্দ্রে একটি জোট সরকার গঠনের জন্য, যেখানে জনাব নুরুল আমিন হবেন প্রধানমন্ত্রী এবং জনাব জেড. এ. ভূট্টো হবেন উপ-প্রধানমন্ত্রী।”
“যুদ্ধ এবং দেশের দুই অংশের মাঝে যোগাযোগের ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান অসুবিধার জন্য আমি একটি জোট সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি এবং ২৭ ডিসেম্বর এর পর তা গঠন করা হবে। কেন্দ্রিয় সরকারের নেতৃবৃন্দ দেশের দুই অংশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মধ্য থেকে কেন্দ্রিয় সরকারের সদস্যদের বাছাই করবেন।”.
.
শিরোনামঃ ১২২. সাধারণ পরিষদে পাকিস্তানের বক্তব্য পেশের জন্য ভূট্টোর নেতৃত্বে প্রতিনিধিদল প্রেরণ
সূত্রঃ দৈনিক ইত্তেফাক
তারিখঃ ৯ ডিসেম্বর.১৯৭১
.
সাধারণ পরিষদে পাকিস্তানের বক্তব্য পেশের জন্য ভূট্টোর নেতৃত্বে প্রতিনিধিদল প্রেরণ
রাওয়ালপিন্ডি, ৮ ডিসেম্বর এপিপি
পাক ভারত যুদ্ধের ব্যাপারে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে পাকিস্তানের বক্তব্য পেশ করার উদ্দেশ্যে ৭ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদলের নেতা হিসেবে পাকিস্তানের ভাবি সহকারি প্রধানমন্ত্রি ও জনাব জেড. এ. ভূট্টো আজ সকালে নিউ ইয়র্ক যাত্রা করিয়াছেন।
প্রতিনিধিদলের সহকারি সদস্যগণ হইতেছেনঃ রাবাতেনিযুক্ত পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত জনাব এ. এইচ. বি. তাইয়েবজী। বেলগ্রেডে নিযুক্ত পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত জনাব আই. এ. আখুন্দ, জেনেভায় নিযুক্ত পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত এবং তথায় জাতিসংঘ পাকিস্তানের স্থায়ি প্রতিনিধি জনাব নিয়াজ আহমেদ নায়েক এবং ওয়াশিংটনে পাকিস্তানি দূতাবাসের মিনিস্টার জনাব আকরম জাকি।
বেসরকারি সদস্যগণ হইতেছেনঃ পুর্ব পাকিস্তানের নবনির্বাচিত এম. এন. এ. জনাব মুজিবুর রহমান কাইয়ুম গ্রুপ , নবনির্বাচিত এম. এন. এ. জনাব মুজাফফর উদ্দিন আহমদ পিপিপি , এবং জনাব রফি রাজা পিপিপি।
.
.
শিরোনামঃ ১২৩- জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছে জাতিসংঘে পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধির চিঠি
সূত্রঃ জাতিসংঘ দলিলপত্র উদ্ধৃতিঃবাংলাদেশ ডকুমেন্টস
তারিখঃ ৯ ডিসেম্বর,১৯৭১
.
জাতিসংঘ এবং জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছে জাতিসংঘে পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধির চিঠি
A/8567 S/10440,
ডিসেম্বর ৯,১৯৭১
.
সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী আমি আপনাদের জানাতে যাচ্ছি যে, ৭ ডিসেম্বর,১৯৭১ তারিখে অনুষ্ঠিত সভায় অনুমোদনকৃত রেজোলিউশন ২৭৯০(XXIV) এ ভারত কর্তৃক পাকিস্তানে যে আগ্রাসন চালানো হয়েছিল তার কথা উল্লেখ করা হয়নি(আগ্রাসনের কথা ভারত স্বীকার করা সত্ত্বেও)। তার পরওপাকিস্তান সরকার উক্ত রেজোলিউশন এর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অবিলম্বে অস্ত্র বিরতি এবং সৈন্য প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। রেজোলিউশনে বলা হয়েছে অবিলম্বে দুই পক্ষকেই যার যার সীমান্ত থেকে সৈন্য প্রত্যাহার এর জন্য। যদিও পাকিস্তানের হাতে এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য যথেষ্ট সময় নেই তারপরও অযথা রক্তপাত এড়ানোর স্বার্থে সময়স্বল্পতার সমস্যা আমরা উপেক্ষা করতে প্রস্তুত।
সাধারণ সভা,
৪. সম্পূর্ণ নিশ্চয়তা দেয় যে, যে কোন রাষ্ট্রকে সর্বদাই অন্য রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের প্রতি সম্মান দেখাতে হবে এবং সেই সাথে সে দেশের জনগণকে তার নিজের ভাগ্য নিজে গড়ে নেয়ার সুযোগ দিতে হবে। তাদের উপর বাইরে থেকে কোন প্রকার হস্তক্ষেপ করা যাবে না, কোন কিছুতে বাধ্য করা যাবে না, প্রকাশ্য বা গোপনে কোন প্রকার বা বলপ্রয়োগ করা যাবে না । এমনকি কোন দেশের জাতীয় ঐক্য এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতা ক্ষুণ্ণ হয় এমন কোন পদক্ষেপও নেয়া যাবে না।
৫. সম্পূর্ণ নিশ্চয়তা দেয় যে, কোন রাষ্ট্রের আঞ্চলিক অখণ্ডতা এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতার উপর অপর কোন রাষ্ট্র কর্তৃক কোন প্রকার হুমকি বা বলপ্রয়োগ করা যাবে না। জাতিসংঘ সনদেএকটি নীতির উল্লেখ আছে-বলপ্রয়োগের মাধ্যমে অন্য কোন রাষ্ট্রের ভূখণ্ড দখল করে নেয়া যাবে না এবং এই উপায়ে দখল অভিযান চালানোকে এবং দখলকৃত ভূখণ্ডকে কোনভাবেই বৈধতা দেয়া হবেনা,সেই সাথে কোন রাষ্ট্রের ভিতরে অন্তর্দ্বন্দ্ব তৈরি হয় এমন কোন কাজ করা বা কোন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোন প্রকার সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালানো বা তাতে সহায়তা করা থেকেও বিরত থাকতে হবে। উক্ত নীতিমালা লঙ্ঘন করেকোন ভাবেই কোন রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে জোরপূর্বক সেনা অভিযান চালিয়ে তা দখল করা যাবে না।
৬. বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তার প্রতি হুমকি হতে পারে এমন যে কোন বিরোধ বা ঘটনা জাতিসংঘ সনদের সর্বোত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে নিষ্পত্তির জন্য সদস্য রাষ্ট্রগুলোর প্রতি জোর আহ্বান জানাচ্ছে জাতিসংঘ। সেটা আলোচনা,অনুসন্ধান,মীমাংসা বা ওই অঞ্চলে স্থানীয় ভাবে আইনি প্রক্রিয়ায় সমাধান,অন্যান্য যে কোন স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান এর প্রধান যেমন জাতিসংঘের মহাসচিব এর মধ্যস্থতায় অথবা নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী যে কোন শান্তিপূর্ন উপায়েওসমাধান করা যেতে পারে।তবে নিরাপত্তা পরিষদ যখন এসব বিষয় নিয়ে কাজ করবে তখনতাদের উচিৎ হবে আইনি বিরোধপূর্ণ বিষয়সমূহআন্তর্জাতিক আদালতের বিধান অনুযায়ী আন্তর্জাতিক আদালতের কাছে পাঠিয়ে দেয়া।
সম্প্রতি জাতিসংঘের পক্ষ থেকে একটি ঘোষণা এসেছে যে শীঘ্রই জাতিসংঘ সীমান্তের সশস্ত্র সৈন্য প্রত্যাহার করবে এবং পর্যবেক্ষক নিয়োগের মাধ্যমে সীমান্তের উভয় পাশে অস্ত্রবিরতি এবং সৈন্য প্রত্যাহারের বিষয়টি তত্ত্বাবধান করবে। শত্রুতার অবসান এবং নিরাপত্তা রক্ষায় জাতিসংঘের ভূমিকা এবং এর প্রতি সিংহভাগ সদস্যদের অকুণ্ঠ সমর্থন দেখতে পেয়েপাকিস্তান অত্যন্ত আশাবাদী।
চিঠিখানা সাধারণ সভা এবং নিরাপত্তা পরিষদে দলিল হিসেবে সকলের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য অনুরোধ রইল।
.
.
শিরোনামঃ ১২৪। প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক সংঘবদ্ধভাবে ভারতীয় হামলা মোকাবিলার আহ্বান।
সূত্রঃ দৈনিক ইত্তেফাক
তারিখঃ ১১ ডিসেম্বর ১৯৭১
.
প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক সংঘবদ্ধভাবে ভারতীয় হামলা মোকাবিলার আহ্বান
.
পাকিস্তানের নবনিযুক্ত প্রধানমন্ত্রী জনাব নূরুল আমিন গত বৃহস্পতিবার রাতে জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত বেতার ভাষণে সংঘবদ্ধভাবে জাতীয় অখণ্ডতা রক্ষা ও ভারতীয় মোকাবিলায় আগাইয়া আসার জন্য জনগনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, আসুন আমরা সম্মুখপানে অগ্রসর হই এবং সেনাবাহিনীর সহিত কাঁধে কাঁধ মিলাইয়া কাজ করি। জনাব নূরুল আমীন বলেন, ভারত পাকিস্তানকে ধ্বংস করার চেষ্টা চালাইতেছে। ভারতীয়দের হামলায় পূর্ব পাকিস্তানীরাই অধিক ক্ষতিগ্রস্থ হইয়াছে। তাহারা আমাদের নিরীহ জনগনের উপর নির্বিচারে বোমা বর্ষণ করিতেছে।
বহু রক্তের বিনিময়ে অর্জিত পাকিস্তানের আজাদী সংগ্রাম কায়েদে আজমের সহিত তাহার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা উল্লেখে করিয়া প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির এই আজাদীকে যে কোন মূল্যে রক্ষা করার জন্য আমাদিগকে ঐক্যবদ্ধভাবে আগাইয়া আসিতে হইবে।
——–
.
.
শিরোনামঃ ১২৫। পাকিস্তান যুদ্ধবিরতি ও সৈন্য প্রত্যাহারের জাতিসংঘ প্রস্তাব গ্রহণ করিয়াছে
সূত্রঃ দৈনিক ইত্তেফাক
তারিখঃ ১১ ডিসেম্বর ১৯৭১
.
পাকিস্তান যুদ্ধবিরতি ও সৈন্য প্রত্যাহারের জাতিসংঘ প্রস্তাব গ্রহণ করিয়াছে
জাতিসংঘ, (নিউইয়র্ক), ১০ই ডিসেম্বর (এপিপি)।– পাকিস্তান সাধারণ পরিষদের আশু যুদ্ধবিরতি ও সৈন্য প্রত্যাহারের প্রস্তাব গ্রহণ করিয়াছে বলিয়া গতকাল এখানে আনুষ্ঠানিকভাবে উল্লেখ করা হয়। এপিপির বিশেষ সংবাদদাতা চৌধুরী ইফতেখারের তারবার্তায় এ কথা জানা গিয়াছে। জাতিসংঘে নিযুক্ত পাকিস্তানী রাষ্ট্রদূত জনাব আগা শাহী গতকাল বিকালে সেক্রেটারী জেনারেল উ থান্টের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া তাঁহার সরকার কর্তৃক এই প্রস্তাব গ্রহণের কথা তাঁহাকে অবহিত করেন। গত মঙ্গলবার সাধারণ পরিষদে অবিলম্বে পাক-ভারত যুদ্ধবিরতি এবং সৈন্য প্রত্যাহারের প্রস্তাবটি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে পাস হয়।
———
.
.
শিরোনামঃ ১২৬। ইউনেষ্কোর নিকট পাকিস্তানের তার গুরুত্বপুর্ণ সাংস্কৃতিক স্থানসমুহরক্ষার আবেদন
সূত্রঃ দৈনিক ইত্তেফাক
তারিখঃ ১১ ডিসেম্বর ১৯৭১
.
ইউনেষ্কোর নিকট পাকিস্তানের তার গুরুত্বপুর্ণ সাংস্কৃতিক স্থানসমুহরক্ষার আবেদন
.
ইসলামাবাদ, ৯ই ডিসেম্বর (এপিপি)।- পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সেক্রেটারী জনাব সুলতান মোহাম্মদ খান ইউনেস্কোর ভারপ্রাপ্ত ডিরেক্টর জেনারেলের নিকট প্রেরিত এক তারবার্তায় বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুর উপর ভারতীয় বিমান ও গোলন্দাজ বাহিনীর বেপরোয়া বোমা এবং গোলাবর্ষণের ফলে পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক গুরুত্বপুর্ণ স্থানগুলি যে ব্যাপক ক্ষতিসাধিত হইয়াছে তাহার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছেন। আজ প্যারিসে ইউনেস্কোর সদর দফতর প্রেরিত তারবার্তায় তিনি বলেনঃ বিগত ১৯৫৪ সালে হেগ শহরে সশস্ত্র সংঘর্ষের সময় সাংস্কৃতিক স্থানসমূহ রক্ষার রক্ষার জন্য যে নীতি অবলম্বন করা হইয়াছে যে সম্পর্কিত গত ৭ই ডিসেম্বর তারবার্তার জন্য ধন্যবাদ জানাইতেছি।
পাকিস্তান সরকার আপনার মতই এই সকল সাংস্কৃতিক স্থান রক্ষার জন্য উদ্বিগ্ন। আমরা হেগ সম্মেলনের নীতি মানিয়া চলার জন্য ইতিপূর্বেই যথোপযুক্ত ব্যবস্থাবলম্বন করিয়াছি।
এই ব্যাপারে একটি বিষয়ে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করিতে চাই। ভারতীয় বিমান বাহিনীর বেপরোয়া বোমা বর্ষণ এবং গোলন্দাজ বাহিনীর গোলা নিক্ষেপের ফলে পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক স্থানসমূহ এক বিরাট ধ্বংসের সম্মুখীন হইয়াছে। পাকিস্তানের এই সম্পত্তি ধ্বংস করা হইতে বিরত থাকার জন্য ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে আহ্বান জানাইলে আমি আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকিব।
.
.
শিরোনামঃ ১২৭।যুক্ত বাহিনীর কাছে পাক সামরিক বাহিনীর আত্মসমর্পণের দলিল এবং আত্মসমর্পণের ঘটনাবলীর ওপর একটি প্রবন্ধ।
সূত্রঃ উইটনেস টু সারেন্ডারঃ সিদ্দিক সালিক
তারিখঃ ১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৭১
.
আত্মসমর্পণের দলিলের মূল পাঠ
পূর্ব পাকিস্তানের কমান্ডর বাংলাদেশে অবস্থিত পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীকে লেফট্যানেণ্ট- জেনারেল জাগজিত সিং আরোরা কাছে আত্মসমর্পণ করতে সম্মত হয়েছে। তিনি পূর্ব থিয়েটারের ইন্ডিয়া এবং বাংলাদেশের জেনারেল চীফ কমান্ডিং অফিসার হিসাবে দায়িত্ব প্রাপ্ত। এই আত্মসমর্পণে পাকিস্তানের জমি , বায়ু এবং নৌ বাহিনীর সাথে সাথে সকল আধা সামরিক এবং বেসামরিক সশস্ত্র বাহিনী অন্তর্ভুক্ত। এই বাহিনীগুলো বর্তমানে অবস্থিত নিকটবর্তী সাধারণ সেনাদল যারা লেফট্যানেণ্ট – জেনারেল জাগজিত সিং আরোরা অধীনে আছে তাদের কাছে অস্ত্র এবং নিজেদের সমর্পণ করবে।
পাকিস্তানের পূর্ব কমান্ডেরলেফট্যানেণ্ট – জেনারেল জাগজিত সিং আরোরা কাছে যত শীঘ্রই সম্ভব এসে কার্যসম্পাদনে স্বাক্ষর করবে। আদেশ অমান্য কারীদের আত্মসমর্পণ লঙ্ঘনকারী হিসাবে গণ্য করে যুদ্ধের রীতি নীতি দ্বারা আইনত ব্যাবস্থায় মোকাবিলা করা হবে । লেফট্যানেণ্ট – জেনারেল জাগজিত সিং আরোরা সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হিসাবে গণ্য হবে। এখানে আত্মসমর্পণের ধারাতে কোন ধরনের সন্দেহ জাগা উচিত নয়।
লেফট্যানেণ্ট – জেনারেল জাগজিত সিং আরোরাকর্মীগণদের বিধি সম্মত আশ্বাস প্রদান করেছেন, যে আত্মসমর্পণ করবে তাদের মর্যাদা এবং সম্মানের সাথে গণ্য করা হবে, যা জেনেভা কনভেনশনের বিধান মালায় সৈন্যদের জন্য অভিহিত করা হয়েছে এবং পাকিস্তানী সামরিক এবং আধা সামরিক বাহিনীর যারা আত্মসমর্পণ করবে তাদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেওয়া হচ্ছে। লেফট্যানেণ্ট – জেনারেল জাগজিত সিং আরোরার আদেশে পশ্চিম পাকিস্তানের সকল বিদেশী নাগরিক, জাতিগত সংখ্যা লঘু এবং কর্মীবৃন্দকে রক্ষা করা হবে।
স্বাক্ষর/-
(জগজিৎ সিং আরোরা)
লেফট্যানেণ্ট – জেনারেল
জেনারাল অফিসার কমান্ডিং ইন চীফ
ইন্ডিয়া এবং বাংলাদেশী বাহিনী
পূর্ব থিয়েটার
১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ স্বাক্ষর/-
(আমীর আবদুল্লাহ খান নিয়াজি)
লেফট্যানেণ্ট – জেনারেল
সামরিক আইন পরামর্শক জোন বি এবং কমান্ডর পূর্ব কমান্ড (পাকিস্তান)
১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১
.
মেজর জেনারেল রহিম চাঁদপুর থেকে পলায়নের সময় ছোটখাটো আঘাতে ভুগছে তাকে জেনারেল ফারমানের বাসভবনে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়ার পর ক্রমে স্বাস্থ্য ফিরে পাচ্ছে। তাকে বাড়ির একটি নির্জন অংশে রাখা হয়েছে এবং ফারমান তার সঙ্গে ছিলেন। এটা ছিল ১২ই ডিসেম্বর অর্থাৎ “ অল আউট ” যুদ্ধের নবম দিন। তাদের হৃদয় ও মন স্বাভাবিকভাবেই সবচেয়ে গুরুত্ব পূর্ণ বিষয়ে আবর্ততিত হয় : ঢাকা কি সমর্থন যোগ্য ? তারা একটি অকপট মতামত বিনিময় করেছিল। রহিম বিশ্বাস করেছিল যুদ্ধ বিরতি একাই তার উত্তর দিয়েছে। ফারমান , রহিমের পরামর্শ শুনে অবাক হয়েছিল, যে সব সময় ইন্ডিয়ার বিপক্ষে একটি দীর্ঘায়িত এবং নিষ্পত্তিমূলক পরামর্শ দিত। তিনি বিদ্রূপাত্মক আমেজের সাথে বলেন, ( বাস ডানে নিওক গায়ে ইতনিজলদি ) ( আপনি আপনার স্নায়ু এতো তাড়াতাড়ি হারালেন ) রহিম জোর দিয়ে বলেন এটা ইতিমধ্যে অনেক দেরি হয়ে গেছে।
আলোচনা চলাকালীন সময়ে , লেফট্যানেণ্ট – জেনারেল নিয়াজি এবং মেজর জেনারেল জামসেদ “ আহত জেনারেল ” কে দেখার জন্য রুমে প্রবেশ করেন। রহিম তার পরামর্শ নিয়াজিকে পুনরাবৃত্তি করেন, যাতে নিয়াজি কোন প্রতিক্রিয়া দেখাননি। তখন থেকে বৈদেশিক সাহায্য গ্রহন প্রশমিত করা হয় নি। বিষয়টি এড়ানোর জন্য ফারমান সংযুক্ত রুমে পলায়ন করেন।
জেনারেল নিয়াজি কিছুটা সময় রহিমের সাথে কাটানোর পর ফারমানের রুমে যান এবং, রাওয়ালপিন্ডিতে সংকেত পাঠানোর জন্য বলেন।এটা আবির্ভূত হোল যে তিনি জেনারেল রহিমের উপদেশ গ্রহন করেছেন যা তিনি শান্তির সময়ে সব সময় করতেন। জেনারেল নিয়াজি সদর দপ্তর থেকে সরকারী বাসভবনে স্থগতির নির্দেশ পাঠাতে চেয়েছিলেন। জেনারেল নিয়াজি পূর্ব কমান্ডে নির্দেশ পাঠাতে জোর দেন। “ না সংকেত এখান থেকে যাক আর ওখান থেকে যাক এটা খুবই অল্প পার্থক্য তোলে । ” আমার অন্য কোথাও আসলেই গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে, তুমি এখান থেকে পাঠাও। ফারমান পুনরায় “ না “ বলার পূর্বেই চীফ – সেক্রেটারি মুজ্জাফার রুমে প্রবেশ করেন এবং নিয়াজির কথোপকথন আকস্মিকভাবে শুনে বলেন নিয়াজি আপনি সঠিক। সংকেতটি এখান থেকেই পাঠাতে হবে। ” যা সংঘাতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ।
জেনারেল ফারমান যুদ্ধ বিরতির বিষয়ে বিরোধিতা করছিলেন না, কিন্তু করতিপক্ষকে বিধিমত প্রতিশ্রুতি দেওয়ার বিষয়ে বলেছিলেন। তিনি পূর্বেই এই একই বিষয়ে সংকেত দিয়েছিলেন যা রাওয়ালপিন্ডি তে নাকচ হয়েছিল – একবার দংশিত, দ্বিতীয়বার লজ্জিত। জেনারেল নিয়াজি তার “ জরুরী কাজে ” উপস্থিত থাকার জন্য অদৃশ্য হয়ে যায় যখন মুজ্জাফার হোসেন ঐতিহাসিক নোটের খসড়া করছিলেন। এটা ফারমানের দ্বারা লেখা এবং গভর্নরের কাছে প্রেরণ করা হয়, যে এই ধারনাটি কে অনুমোদন করেন এবং একই সন্ধ্যায় রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠান ( ১২ই ডিসেম্বর)। নোটে ইয়াহিয়া খান কে সম্ভাব্য নির্দোষ জীবন বাঁচানোর আহ্বান জানিয়েছেন।
পরদিন গভর্নর এবং তার প্রধান সহযোগীরা রাওয়ালপিন্ডি থেকে আদেশ আসার জন্য অপেক্ষা করছিলেন কিন্তু রাস্ত্রপতিকে দেখে মনে হচ্ছিল সিধান্ত নেয়ার জন্য তিনি খুবই ব্যস্ত । পরদিন (১৪ই ডিসেম্বর ) খুবই উচ্চ পর্যায়ের একটি মিটিং বসানো হয়। তিন (৩) ইন্ডিয়ান এম এই জি এস সরকারী বাসভবন আক্রমন করে সকাল ১১তা ১৫ মিনিটে এবং তা প্রধান হলে বিশাল ফাটল সৃষ্টি করে। গভর্নর বিমান আক্রমন থেকে আশ্রয় পাওয়ার জন্য পলায়ন করে এবং তাড়াহুড়ো করে তার পদত্যাগ পত্র লেখেন। প্রায় সকল ক্ষমতায় থাকা আসনের নিবাসীরা এই অভিযানে বেঁচে যান শুধুমাত্র অলংকরনের জন্য থাকা কিছু মাছ ব্যতীত। বাকিরা গরম পাথর কুচিতে এপাশ ওপাশ হয় এবং তাদের শেষ ভরসনাৎকরে।
গভর্নর তার মন্ত্রী সভা এবং পশ্চিম পাকিস্তানী বেসামরিক সারভেন্টরা ১৪ই ডিসেম্বর হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টাল এ চলে আসে যা আন্তর্জাতিক রেড ক্রস দ্বারা “ নিরপেক্ষ জোন “ হিসাবে নির্ধারিত। পশ্চিম পাকিস্তানী ভি আই পি যাদের মাঝে চীফ -সেক্রেটারি , পুলিশের ইন্সপেক্টর – জেনারেল, কমিশনার, ঢাকা ডিভিশন প্রদেশের সেক্রেটারি এবং কিছুরা অন্তর্ভুক্ত, তারা লিখিত ভাবে পাকিস্তানী গভর্নমেন্টের সাথে “পৃথক হলো ” নিরপেক্ষ জোনে প্রবেশ করার মাধ্যমে। কারন কোন ব্যক্তি যুদ্ধমান রাষ্ট্রে অবস্থান করলে রেড ক্রস তার নিরাপত্তা অধিকারদান করে না ।
১৪ই ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তানী সরকারের ধ্বংসাবশেষে সরকার ও সরকারী বাড়ি ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। শুধুমাত্র জেনারেল নিয়াজি এবং তার বিশৃঙ্খল বাহিনীকে প্রতিরোধ করে সিজারিয়ানের মাধ্যমে বাংলাদেশের জন্ম দেখার জন্য শত্রুরা ছিল। এখন পর্যন্ত জেনারেল নিয়াজিও বৈদেশিক সাহায্য পাওয়ার সকল আশা হারিয়ে ফেলেছিলেন । তিনি অতি দ্রুত তার আগের মেজাজ, নিরাশায় ফিরে আসছিলেন এবং খুব কম তার শক্তিশালী কেবিন থেকে বের হচ্ছিলেন । তিনি গতি বা দিক নিয়ন্ত্রন ছাড়াই যুদ্ধ রথে আরোহণ করেছিলেন।
সুতরাং তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে তথ্য সংক্রান্ত নীতির অবস্থান থেকে ( যে আরও ছিল কমান্ডর – ইন – চীফ ) এবং গভীর ভাবে নির্দেশাবলীর অপেক্ষা করছিলেন। আমার উপস্থিতিতে তিনি রাতে আহ্বান করেছিলেন (১৩/১৪ ডি সেম্বর ) এবং বলেন, স্যার আমি কিছু নিদিরস্তপ্রস্তাব রাষ্ট্রপতির কাছে প্রেরণ করছি। দয়া করে আপনি দেখবেন যাতে শিগ্রই কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক কিছু সময় পেয়েছিল তার বহুবিধ কর্মের মাঝে এবং তিনি গভর্নরকে নির্দেশ দেন । এবং জেনারেল নিয়াজি পরের দিন যুদ্ধ বন্ধ এবং জীবন সংরক্ষনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। তার শ্রেণী বিভক্ত করা হয়নি এমন সংকেতে জেনারেল নিয়াজি কে বলা হয়েছিল :
গভর্নরের ফ্ল্যাশ বার্তাতে আমাকে উল্লেখ্ করা হয়েছে। তোমরা অস্বাভাবিক অপ্রতি রোধ্যের বিরুদ্ধে বীরত্ব পূর্ণ যুদ্ধ করেছ। জাতি আপনাদের নিয়ে গর্বিত এবং পৃথিবী জুড়ে আপনাদের তারিফ চলছে। আমি সমস্যার সমাধানের জন্য গ্রহণযোগ্য সম্ভাব্য সকল মানুষোচিত চেষ্টা করছি। আপনারা এখন যে অস্থায় পৌঁছেছেন সেখানে আর মানুষোচিত উপায়ে প্রতি রোধ করা সম্ভব না আর তা না কোন দরকারি উদ্দেশ্যে পরিবেশন করা যাবে। এটা শুধুমাত্র জীবন আর ধ্বংসের দিকে পরিচালিত করবে। আপনাদের এখন সম্ভাব্য সকল ধরনের পদক্ষেপ যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য গ্রহন করা উচিত এবং সশস্ত্র বাহিনীর জীবন সংরক্ষণ করার জন্য যারা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এসেছে এবং সকল অনুগত উপাদানও । এদিকে আমি ইউ এন এ অগ্রগমন করছি ইন্ডিয়া কে প্ররোচনা করার জন্য যাতে পূর্ব পাকিস্তানের শত্রুতা অবিলম্বে বন্ধ করা হয় এবং সশস্ত্র বাহিনীকে নিরাপত্তা দেওয়া হয় এবং অন্য সকল ব্যক্তি যারা বদমাশ হিসাবে টার্গেট হতে পারে।
এই গুরুত্বপূর্ণ টেলিগ্রামটি রাওয়ালপিন্ডি থেকে ১৪ই ডি সেম্বর ১৩৩০ ঘণ্টায় তৈরি করা হয় এবং ঢাকায় ১৫৩০ ঘণ্টায় পৌঁছে । ( পূর্ব পাকিস্তানের সময়ের মানদণ্ডে )
রাষ্ট্রপতির টেলিগ্রামের তাৎপর্য কি ? তিনি জেনারেল নিয়াজি কি “ আত্মসমর্পণের নির্দেশ “ বুঝিয়েছেন বা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারো যদি তা তার এতই আকাঙ্ক্ষিত হয় ? আমি উপরের টেলিগ্রামটি পাঠকের নিজের উপর ভাষান্তরিত করার জন্য ছেড়ে দিলাম এবং নিজস্ব উপসংহার টানার জন্য।
জেনারেল নিয়াজি একই সন্ধ্যায় যুদ্ধ বিরতি অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহনের সিধান্ত নিয়েছেন । মধ্যস্তাকারী হিসাবে প্রথমে তিনি সোভিয়েত এবং চীনের কূটনৈতিকদের চিন্তা করেন কিন্তু পরিশেষে মিঃ স্পিভেক, ঢাকার ইউ এস কনসাল জেনারেল কে পছন্দ করেন। জেনারেল নিয়াজি , জেনারেল ফারমান আলীকে মিঃ স্পিভেকের সঙ্গী হওয়ার নির্দেশ দেন কারন তিনি গভর্নরের উপদেষ্টা হিসাবে বিদেশী কূটনৈতিকদের লেনদেন করতেন। যখন তারা মিঃ স্পিভেকের অফিসে পৌছায় ফারমান পূর্ব রুমে অপেক্ষা করছিলেন যখন নিয়াজি ভিতরে প্রবেশ করেন। ফারমান আড়ি পেতে মিঃ স্পিভেকের সহানুভুতি জিততে নিয়াজির জাঁকালো অসূক্ষ্ম প্রস্তাব শুনতে পায়, যখন তার মনে হয় যে “ বন্ধুত্ব “ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তিনি তাকে তার হয়ে ইন্ডিয়ার সাথে যুদ্ধ বিরতির টার্ম নিয়ে আলচনার অনুরোধ করলেন। মিঃ স্পিভেক সকল সহানুভূতিতে লাথি মেরে কায়দা করে বলেন , “ আমি তোমার পক্ষ হয়ে যুদ্ধ বিরতি নিয়ে মধ্যস্থা করতে পারব না । আমি শুধু মাত্র একটি বার্তা পাঠাতে পারব যদি তুমি চাও। “
জেনারেল নিয়াজি ইন্ডিয়ান আর্মির সামরিক বাহিনীর প্রদানকে ডাকার আহ্বান করে একটি বার্তা খসড়া করেন। তিনি পুরো পেজ জুড়ে তাৎক্ষনিক যুদ্ধ বিরতির নির্দেশ না দিয়ে বরং পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনী এবং আধা সামরিক বাহিনীর নিরাপত্তার জামানত চান। অনুগত বেসামরিক বাহিনী যাতে মুক্তি বাহিনীদ্বারা প্রতিহিংসা মূলক আচরনের শিকার না হয় এবং অসুস্থ ও আহতদের চিকিৎসা প্রদান করা হয়।
খুবই তাড়াতাড়ি খসড়া চূড়ান্ত করা হয়। মিঃ স্পিভেক বলেন, এটা ২০ মিনিটের মাঝে প্রেরণ করা হবে। জেনারেল নিয়াজি এবং ফারমান ওখান থেকে চলে আসেন এবং ক্যাপ্টেন নিয়াজি সহয়তাকারি শিবিরে উত্তরের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন ।তিনি সেখানে রাত ১০ তা পর্যন্ত বসে থাকেন কিন্তু কিছুই ঘটেনি। ঘুমাতে যাওয়ার পূর্বে তিনি পুনরায় চেক করতে বলেন। রাতের মাঝে কোন উত্তর পাওয়া যায় নি।
আসলে মিঃ স্পিভেক বার্তাটি জেনারেল ( পরে ফিল্ড মার্শাল ) মানেকসা এর কাছে প্রেরণ করেননি । তিনি ওয়াশিংটনে বার্তাটি পাঠান । যেখানে ইউ এস সরকার কোন ব্যবস্থা গ্রহনের পূর্বে ইয়াহিয়া খানের সাথে পরামর্শ করতে চান । কিন্তু ইয়াহিয়া খানকে পাওয়া যায় নি । তিনি কোথাও দুঃখে ডুবে ছিলেন। আমি পরে জানতে পারি ডিসেম্বরের ৩ তারিখ থেকেই তিনি যুদ্ধের বিষয়ে সকল আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন এবং আর কখনোই তার অফিসে ফিরে আসেননি। তার সাধারণ সচিব সাধারন্ত একটি মানচিত্র বহন করে নিয়ে আসতেনএবং মার্ক করে যুদ্ধের সর্বশেষ সংবাদ জানাতেন। তিনি মাঝে মাঝে এটার দিকে তাকাতেন এবং একবার তিনি মন্তব্য করেছিলেন, “ আমি পূর্ব পাকিস্তানের জন্য কি করতে পারি ? “
মানেকসা ১৫ই ডিসেম্বর একটি নোটে বলেছিলেন যুদ্ধ বিরতি গ্রহন করতে হবে এবং নোটে আরও উল্লেখ করা হয় যে কর্মীদের নিরাপত্তা দেওয়া হবে যদি পাকিস্তানী সেনাবাহিনী আমার অগ্রগামী সেনাদলের কাছে আত্মসমর্পণ করে। তিনি কোলকাতায় আরও একটি রেডিও কম্পাঙ্কক দিয়েছিলেন। ইন্ডিয়ান পূর্ণকমান্ডের আসন , বিশদ বর্ণনায় কো – অরডিনেশন এর জন্য যোগাযোগ করা যাবে। মানেকসার বার্তা রাওয়ালপিন্ডিতে পাঠানো হয়েছিল। পাকিস্তান আর্মির চীফ অব স্টাফ ১৫ই ডিসেম্বর সন্ধ্যায় এর উত্তরে বলেন , প্রসঙ্গত সকল শর্ত মেনে আপনি যুদ্ধ বিরতি গ্রহন করলে তারা আপনার সুপারিশকৃত সব কিছু মেনে নিবে। যা হোক এটা দুই কমান্ডর এর মধ্যে একটি স্থানীয় ব্যবস্থা হবে। যদি জাতিসংঘের সমাধান খুঁজার ক্ষেত্রে কোন সংঘাত হয় তাহলে এটি ফাঁকা এবং শূন্যস্থান ধরা হবে ।
অস্থায়ী যুদ্ধ বিরতি ১৫ই ডিসেম্বর বিকাল ৫টা থেকে রাত ৯ টা পর্যন্ত রাখতে সম্মত হয়েছিল এবং পরবর্তীতে তা পরের দিন দুপুর ৩ টা পর্যন্ত বাড়ানো হয়। ১৬ই ডিসেম্বর যুদ্ধ বিরতি চূড়ান্ত করার জন্য সময় আরও বৃদ্ধি করা হয়। যখন জেনারেল হামিদ যুদ্ধ বিরতি শর্ত মেনে নেয়ার জন্য নিয়াজিকে পরামর্শ দেন। চিঠিটি এর “ অনুমোদন “ হিসাবে নেওয়া হয়। এবং ব্রিগেডিয়ার বাকের চীফ অব স্টাফ কে ডেকে বিষয়টি গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশ তৈরি করতে বলেন । একটি পূর্ণ পৃষ্ঠার সংকেত পাঠানো হয় সেনাদলের কাছে “ বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধ “ করার জন্য এবং স্থানীয় কমান্ডরকে ডেকে যুদ্ধ বিরতির ব্যবস্থা করার জন্যইন্ডিয়ান পাল্টা অংশের সাথে যোগাযোগ করতে বলা হয়। এটাতে আত্মসমর্পণ বলেনি কিন্তু বাক্যে আই শব্দ ব্যতীত বলা হয়েছে “দুর্ভাগ্যবশত এটা আরও অস্ত্র সমর্পণের সাথে জড়িত। ”
ইতিমধ্যে মধ্য রাত ( ১৫/১৬ ই ডি সেম্বর ) হয়ে গেছে যখন সংকেত পাঠানো হয়। প্রায় একই সময়ে লেফট্যানেণ্ট কর্নেল লিয়াকত বোখারি , অফিসার কমান্ডিং , ৪ এভিয়েশন দলকে তার শেষ ব্রিফিং করার জন্য তলব করা হয়েছিল। তাকে বলা হয়েছিল ৮ জন পশ্চিম পাকিস্তানী নার্স এবং ২৮ টি পরিবার নিয়ে এবং একই সময়ে আকিয়ারব ( বার্মা ) থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম পার হতে। লেফট্যানেণ্ট – কর্নেল লিয়াকত আলী নির্দেশটি তার স্বাভাবিক শান্ত ব্যবহারের সাথে গ্রহন করলেন , যা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে প্রায়ই দেখা যেত। তার হেলিকপ্টার যুদ্ধের এই ১২ দিনের মাঝে দেখা যাচ্ছে একমাত্র প্রপ্তিসাধ্য বাহন যার দ্বারা পূর্ব কমান্ডের মানুষদের পার করা যাবে । গোলাবারুদ আব্বং অস্ত্র আঘাতে খারাপ হয়ে গেছে। তাদের একের পর এক দীর্ঘ দুঃসাহসিক অভিযানের বীরত্ব যা খুবই উদ্দীপক তা এখানে সংকলন করা যাবে না ।
১৬ই ডিসেম্বর খুবই অল্প সময়ের মাঝে ২ টি হেলিকপ্টার চলে যায় যখন ৩য় টি দিবালোকে উড়ছিল । তারা মেজর জেনারেল রহিম খান এবং অন্য কিছু লোককে বহন করছিল কিন্তু নার্সদের পিছনে ফেলে আসতে হয়েছিল কারন তারা তাদেরকে হোস্টেল থেকে সংগ্রহ করার সময় পায়নি । সকল হেলিকপ্টার নিরাপদে বার্মাতে পৌছায় এবং অবশেষে করাচিতে পৌঁছে।
ঢাকায় ফিরা যাক, অবশ্যম্ভাবী সময় কাছে চলে এসেছে । যখন শত্রুরা টাঙ্গাইল থেকে টঙ্গীতে আগ্রগামী হল, তারা আমাদের ট্যাঙ্ক ফায়ার দ্বারা গৃহীত হল। দুঃসাহসীদের দ্বারা টঙ্গী – ঢাকা রোড বেশ সুরক্ষিত ছিল । ৬ই ডিসেম্বর কর্নেল ফজলে হামিদ তাড়াহুড়ো করে পশ্চাদপদ অনুসরন করে খুলনা থেকে পরিত্যাক্ত ইন্ডিয়ার পার্শ্বসোপনযুক্ত পথ ধরে মানিকগঞ্জের দিকে অগ্রসর হয় । ফজলে হামিদের সেনাবাহিনীর অবর্তমানে শত্রু মুক্ত জোন হিসাবে উত্তর- পশ্চিম দিক থেকে ঢাকা শহর মুক্ত হয় । ব্রিগেডিয়ার বশির যে প্রাদেশিক রাজধানী প্রতিরক্ষার জন্য দায়ী ছিল ( ক্যান্টনমেন্ট ব্যতীত )। ১৫ই ডিসেম্বর সন্ধ্যায় সে জানতে পারে ঢাকা মানিকগঞ্জ রোড পুরোপুরি অরক্ষিত । সে রাতের প্রথমার্ধ অতিবাহিত করে ই পি সি এ এফ এর বিক্ষিপ্ত উপাদান জমা করে কোম্পানিকে শক্তিশালী করার জন্য। এবং তাদের মিরপুর ব্রিজ এ মেজর সালামত এর দিকে ঠেলে দেয় যা শুধুমাত্র শহরের বাইরে ছিল। ইন্ডিয়ান সেনাবাহিনীর কমান্ডো বাহিনী যাদেরকে মুক্তি বাহিনী বলেছিল যে ব্রিজটি অসংরক্ষিত আছে। ১৬ই ডিসেম্বর স্বল্প সময়ের মাঝে শহরের দিকে চালিত হয়েছিল এবং সেখানে মেজর সালামতের ছেলেরা অবস্থান করছিল এবং তারা অন্ধভাবে আগমনরত সৈন্যদের দিকে গুলি ছুড়তে থাকে। তারা দাবী করে যে কিছু শত্রু পক্ষের সৈন্যদের হত্যা করেছে এবং ২ টি ইন্ডিয়ান জীপ বন্দী করেছে ।
১০১ কমিউনিকেশন জোনের মেজর জেনারেল নাগরা যারা অগ্রগামী কমান্ডো বাহিনীকে অনুসরন করছে । সেতুর প্রতিসংহৃত পাশ থেকে লেফট্যানেণ্ট জেনারেল আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজির কাছে একটি চিরকুটে পাঠান, তিনি লেখেন যে “ প্রিয় আব্দুল্লাহ আমি মিরপুর ব্রিজে আছি, আপনার প্রতিনিধি পাঠান । ”
মেজর জেনারেল জামশেদ , মেজর জেনারেল ফারমান এবং রিয়ার – অ্যাডমিরাল শরিফ তখন মেজর নিয়াজির সাথে ছিল যখন তিনি নোটটি গ্রহন করেন, প্রায় তখন সকাল ৯ টা । ফারমান যে “যুদ্ধ বিরতি আলোচনার “ বার্তা নিয়ে তখনও আটকে আছেন । তিনি কি নাগরার টীম মধ্যস্থতা করছেন ? জেনারেল নিয়াজি কোন মন্তব্য করেন নি। সুস্পষ্ট প্রশ্নও ছিল তাকে কি গ্রহন করা হবে না প্রত্যাহার করা হবে ? তিনি ইতিমধ্যে ঢাকার সীমাস্থলে ছিলেন ।
জেনারেল নিয়াজি কে জেনারেল ফারমান জিজ্ঞাস করেন,“ আপনার কাছে কোন মজুদ আছে? “নিয়াজি পুনরায় চুপ করে থাকেন । রিয়ার অ্যাডমিরাল শরীফ পাঞ্জাবীতে অনুবাদ করে বলেন, “ কুচ পাল্লেমে হেয় , ( আপনার থলের মধ্যে কিছু আছে ?) “ নিয়াজি ঢাকার ডিফেন্ডার জামশেদ এর দিকে তাকালেন , সে মাথা নেড়ে জানালেন “ কিছুই নাই “ যদি তাই হয় তাহলে যান এবং তাই করেন ( নাগরা ) তিনি যা জিজ্ঞাস করেছে । “ ফারমান এবং শরীফ একযোগে বললেন ।
জেনারেল নিয়াজি নাগারাকে গ্রহন করতে জেনারেল জামসেদকে পাঠান । সে আমাদের মিরপুরের বাহিনীকে যুদ্ধ বিরতির প্রতি সম্মান রেখে নাগরাকে শান্তিপূর্ণ পথে উত্তরন করানোর জন্য অনুমতি চান। ইন্ডিয়ান জেনারেল কিছু সংখ্যক সৈন্য এবং গর্ব নিয়ে ঢাকাতে প্রবেশ করেন ।এটা ছিল ঢাকার ভার্চুয়াল পতন । এটার অনুভুতি ছিল হৃদ রোগীর মতো শান্ত ভাবে। না এটার অঙ্গ পতঙ্গ কাঁটা হয়েছিল না শরীরে গভীর ক্ষত হয়েছিল । এটি শুধু মাত্র একটি স্বাধীন দেশ হিসাবে নিরস্ত্র করা হয়েছিল । সিঙ্গাপুর , প্যারিস অথবা বার্লিনের পতনের গল্প এখানে পুনরাবৃত্তি হয় নি ।
এদিকে যুদ্ধ- কৌশল সংক্রান্ত পূর্ব কমান্ডের সদর দপ্তর গুটানো হয়েছিল। সকল অপারেশনের মানচিত্র সরানো হয়েছে। প্রধান সদর দপ্তর থেকে ধুলা সরানো হয়েছে ইন্ডিয়ানদের গ্রহন করতে কারন ব্রিগেডিয়ার বারেক বলেছিলেন, “ এটা আরও ভালো হয় যদি সজ্জিত করা হয়। ” সংযুক্ত অফিসার আগাম সতর্ক করে দিয়েছিলেন “ মেহমানদের ” জন্য খাবার প্রস্তুত করার বিষয়ে। বকর প্রশাসনিক কাজে খুবই দক্ষ ছিল।
মধ্যাহ্নের সামান্য কিছু সময় পর ব্রিগেডিয়ার বারেক এয়ারপোর্ট গিয়েছিলেন ইন্ডিয়ান প্রতিরুপ মেজর – জেনারেল জেকবকে গ্রহন করতে। এদিকে নিয়াজি তার জোকস দিয়ে নাগরাকে বিনোদন দিচ্ছে। আমি ক্ষমাপার্থী যে তাদেরকে এখানে রেকর্ড না করার জন্য কিন্তু তার কোনটাই মুদ্রন যোগ্য নয় ।
মেজর জেনারেল জেকব “ আত্মসমর্পণের দলিল “ বহন করে এনেছিলেন যা জেনারেল নিয়াজি এবং চীফ অব স্টাফ “ খসড়া যুদ্ধ–বিরতি চুক্তি ” বলতে পছন্দ করেছিলেন । জেকব পেপারগুলো বকরের কাছে হস্তান্তর করে যা পূর্বে মেজর জেনারেল ফারমানের কাছে উপস্থাপন করেছিলেন। জেনারেল ফারমান লক্ষ করে দেখেন দফাটি , “ ইন্ডিয়া এবং বাংলাদেশের যৌথ কমান্ড ” হিসাবে গণ্য করা হয়েছে। জেকব বলেন, “ কিন্তু এইটা এই ভাবেই দিল্লী থেকে এসেছে ।” ইন্ডিয়ান সামরিক গোয়েন্দা কর্নেল খেরা যে ওখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন এবং তিনি বলেন , “ ওহ এটা হল ইন্ডিয়া এবং বাংলাদেশ এর অভ্যন্তরীণ ব্যপার। আপনারা শুধুমাত্র ইন্ডিয়ান আর্মির কাছে আত্মসমর্পণ করবেন ।” ডকুমেন্ট গুলো নিয়াজির কাছে দেয়া হয়েছিল, যে কোন মন্তব্য ছাড়াই দেখেছিলেন এবং টেবিলের উপর দিয়ে ধাক্কা দিয়ে ফারমানের কাছে পাঠান ।। ফারমান বলেন , “এটা কমান্ডরের জন্য, যে এটা গ্রহন করবে নাকি প্রত্যাখ্যান করবে ।” নিয়াজি কিছুই বললেন না , তাই ভাবে এটাকে গ্রহন করা হয়েছে হিসাবে নেওয়া হল ।
বিকালের শুরুতে জেনারেল নিয়াজি এয়ারপোর্টের দিকে গেলেন লেফট্যানেণ্ট – জেনারেল জাগজিত সিং আরোরা , ইন্ডিয়ান পূর্ব কমান্ডের কমান্ডরকে গ্রহন করার জন্য । সে তার স্ত্রী সহ হেলিকপ্টারে পৌঁছেছিলেন । বাঙ্গালিদের বেশ বড় অঙ্কের ভীড় সামনের দিকে ছুটে যাচ্ছিল তাদের মুক্তি দাতার দিকে ফুলের মালা নিয়ে এবং তার স্ত্রীর দিকেও । নিয়াজি তাকে একটি সামরিক অভিবাদন এবং হ্যান্ড সেক করছিলেন । এটা খুবই মর্মস্পর্শী দৃশ্য ছিল । বিজয়ী এবং পরাজিতদের পূর্ণ দৃশে বাঙ্গালীরা দাঁড়িয়ে ছিল। যারা কোন ভুলই করেনি তাদের চরম ভালবাসা এবং চরম ঘৃণা যথাক্রমে আরোরাএবং নিয়াজিকে প্রকাশের ক্ষেত্রে।
চিৎকার এবং শ্লোগান এর মধ্যে তারা রমনা রেস কোর্স ( সোহরাওয়ারদী গ্রাউন্ড ) এর দিকে চালিত হয়েছিল, যেখানে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের জন্য মঞ্চ তৈরি ছিল। সুবিশাল মাঠ আবেগী বাঙ্গালিদের ভিড়ে পূর্ণ ছিল। তারা সকলেই অধীর আগ্রহে পশ্চিম পাকিস্তানের জেনারেলের জনসম্মুখে অপমান দেখার জন্য অপেক্ষা করছিল । অনুষ্ঠানটি বাংলাদেশের জন্ম হিসাবেও বিধি বদ্ধ হয়েছিল।
একটি ছোট শর্ত সাপেক্ষে পাকিস্তানী আর্মির আগমন হয়, গার্ড অব অনার বিজয়ীদের উপস্থাপন করার জন্য অন্যদিকে পরাজিতদের বিচ্ছিন্ন করার জন্য ইন্ডিয়ান সৈন্যরা পাহারা দিয়েছিল। আত্মসমর্পণের দলিলে লেফট্যানেণ্ট – জেনারেল আরোরা ও লেফট্যানেণ্ট – জেনারেল নিয়াজি দ্বারা সাক্ষরিত হয় প্রায় ১০ লক্ষ বাঙ্গালি এবং বিদেশী মিডিয়ার জনসাধারনের সামনে । তারপর তারা উভয়েই উঠে দাঁড়ালেন । জেনারেল নিয়াজি তার রিভলবার বের করে আরোরা কাছে হস্তান্তর করলেন ঢাকার কাছে আত্মসমর্পণের প্রতীক হিসাবে । এর সাথে তিনি পূর্ব পাকিস্তানকেও হস্তান্তর করলেন । ঢাকার সৈন্যদেরকে মুক্তি বাহিনীর কাছ থেকে তাদের নিজ রক্ষার্থে ব্যক্তিগত অস্ত্র রাখার অনুমতি দেওয়া হয় যতক্ষণ পর্যন্ত ইন্ডিয়ান সৈন্য বাহিনী আছে। পর্যাপ্ত সংখার উপর নিয়ন্ত্রন নেওয়া হয়েছিল ।১৯ শে ডিসেম্বর সকাল ১১ টায় সৈন্যদল আনুস্থানিকভাবে ক্যান্টনমেন্টএর গলফ কোর্সে আত্মসমর্পণ করেন । ঢাকার বাইরের সৈন্য বাহিনী ১৬ থেকে ২২শে ডিসেম্বরের মাঝে স্থানীয় কমান্ডরের আয়োজিত উপযুক্ত সময়ে তাদের অস্ত্র শায়িত করে ।
ইন্ডিয়ার সকল বেতার ১৪ই ডিসেম্বরের শুরু থেকেই আত্মসমর্পণের খবর সম্প্রচার শুরু করেছিল। এই খবর ঢাকার অবাঙ্গালি এবং অন্য জায়গার লোকদের ভীত করে তুলেছিল । তাদের অধিকাংশই ঘর বাড়ি ছেড়ে ক্যান্টনমেন্টের দিকে চলে এসেছিল পাকিস্তানী সৈন্যদের সাথে তাদের ভাগ্য শেয়ার করার জন্য। মুক্তি বাহিনী দ্বারা এদের হাজার হাজার ধরে নিয়ে যাওয়া হয় এবং হত্যা করা হয়। আমি তাদের গায়ের লোম দাঁড়ানোর মতো নিরশংসতার কাহিনী শুনেছি। তারা একাই যথেষ্ট ছিল রক্ত শিতল করার জন্য এবং তাদের তৈরি অনেক তালিকা এখনও আছে।
ইন্ডিয়ার এই নিরীহ মানুষের জীবন রক্ষা করার জন্য কোন সময়ই ছিল না। ইন্ডিয়া তাদের বিজয়ের লুটতরাজ সরানোতে ব্যস্ত ছিল। ট্রেন ও ট্রাকের বিশাল কনভয়ে করে মিলিটারি হার্ড ওয়্যার ,খাদ্য সামগ্রী , শিল্প উৎপাদন ও গৃহ স্থালী পণ্য যেমন ফ্রিজ, কার্পেট এবং টেলিভিশন সেট নিয়ে যাচ্ছিল । বাংলাদেশের রক্ত পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে শুষে নেওয়ার ফলে শুধু মাত্র এর কঙ্কাল রয়ে গিয়েছিল “ স্বাধীনতার” ভোর উদযাপনের জন্য এক বছর পরে বাঙ্গালিরা এই বিষয়গুলো উপলব্ধি করতে পেরেছিল।
যখন ইন্ডিয়া বাংলাদেশের সম্পদ তাদের নিজস্ব অঞ্চলে ট্রান্সফার করেছিল তারা আসলে কি করত বাংলাদেশের সম্পদ নিয়ে ? তারা ইন্ডিয়ান পি ও ডাবলিউ ক্যাম্পে যুদ্ধ বন্দী পাকিস্তানিদের হস্তান্তর শুরু করে।। এই প্রক্রিয়া ১৯৭২ সালের জানুয়ারির শেষ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। ভি আই পি দের মাঝে লেফট্যানেণ্ট– জেনারেল নিয়াজিও, মেজর জেনারেল ফারমান , রিয়ার অ্যাডমিরাল শরীফ এবং এয়ার কমান্ডর ইনাম- উল- হক ও ছিল, যাইহোক তারা যে কোন ভাবে ২০শে ডিসেম্বরের মাঝে কোলকাতার দিকে উড়ে । আমিও তাদের সঙ্গে ……
কোলকাতার উইলিয়াম দুর্গে পৌঁছানোর সাথে সাথে আমি যুদ্ধ নিয়ে অলোচনার সুযোগ নিয়েছিলাম । জেনারেল নিয়াজি অতীতের দিকে দৃষ্টিপাত করেন, পূর্বে হয়ত তার সময় ছিল অথবা প্রয়োজন ছিল পাকিস্তানের অনুসন্ধান কমিশনের জন্য তার যুদ্ধ গননার পুনর্নির্মাণের জন্য । তিনি অকপটে এবং তির্যক ভাবে কথা বলেছিলেন। সে কোন অনুতাপ করেন নি এবং বিবেকের কাছে কোন সংশয়ও ছিল না । তিনি পাকিস্তানের বিভাজনের জন্য দায়িত্ব গ্রহন করতে অস্বীকার করেছিলেন । এবং এর জন্য সমানভাবে ইয়াহিয়া খান কে দোষারোপ করেছিলেন । এখানে আমাদের কথোপকথনের কিছু নির্যাস রয়েছে । আমি জিজ্ঞাস করেছিলাম , “ আপনি কি কখনো ইয়াহিয়া খান বা হামিদ কে বলেননি যে মিশনের জন্য বরাদ্দ সম্পদ পর্যাপ্ত ছিল না ।”তারা কি বেসামরিক নাগরিক নয় ? তারা কি জানত না যে ৩ (তিন ) পদাতিক সৈন্যবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ও এর সাথে সাথে বাহ্যিক বিপদের জন্য যথেস্ত নয় ? যাই হোক আপনার অক্ষমতা রক্ষার জন্য ঢাকা থিয়েটার কমান্ডর হিসাবে আপনার বিরুদ্ধে সব সময় লাল মার্ক থাকবে । যদিও নগরদুর্গ প্রতিরক্ষা এই পরিস্থিতির অধীনে শুধুমাত্র একটা সম্ভবনা ছিল, আপনি ঢাকাকে নগরদুর্গ হিসাবে বিকশিত করতে পারেন নি। এখানে কোন সেনাদল ছিল না, রাওয়ালপিন্ডিকে এর জন্য দায়ী করা যায়। তার প্রত্তিজ্ঞা করেছিল আট (৮) পদাতিক সৈন্য বাহিনী মধ্য নভেম্বরের মধ্যে পাঠাবে কিন্তু মাত্র পাঁচটি (৫) পাঠিয়েছিল । অবশিষ্ট তিনটি (৩) আমাকে কোন পূর্ব নোটিশ দেয়া ছাড়াই তখন এসে পৌঁছেছিল যখন পশ্চিম পাকিস্তানের সামনে আর কোন পথই খোলা ছিল না। আমি চেয়েছিলাম বাকি এই ৩ ব্যাটালিয়ানকে ঢাকায় রেখে দিব। কিন্তু যখন তোমরা জানতে ডিসেম্বর ৩ এরপর পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আর কিছুই আসবে না। কেন আপনারা আপনাদের নিজেদের সম্পদ থেকেমজুদ সৃষ্টি করেন নি ? কারন, সকল সেক্টর একই সময় চাপের মুখে এসে পরেছিল। সৈন্য দল সব জায়গায়ই প্রত্তিজ্ঞা বদ্ধ হয়েছিল। কিছুই বাদ দেয়া যেত না । “ ঢাকাতে অল্প যা কিছু ছিল তা দিয়ে হয়ত যুদ্ধ আরও কিছু দিনের জন্য দীর্ঘায়িত করতে পারতাম ।” আমি জানতে চেয়েছিলাম, কিসের জন্য ?তিনি জবাব দিয়েছিলেন, “এর দ্বারা আর ও অনেক মৃত্যু ও ধ্বংস বয়ে আনতে পারত। ঢাকার ড্রেন রুদ্ধ হতে পারত, মৃত দেহ রাস্তায় স্তূপ করে রাখা যেত। নাগরিক সুবিধা প্লেগ এবং অন্যান্য রোগের ধসে ছড়িয়ে পরতে পারত। যদিও এর শেষ একই রকম হতো। ৯০,০০০ হাজার বিধবা এবং অর্ধ মিলিয়ন অনাথ এর মুখোমুখি হওয়ার চেয়ে আমি ৯০,০০০ যুদ্ধ বন্দী পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যেতে পারতাম । আত্মত্যাগের কোন মূল্যই ছিল না ।” “যদিও এর শেষ একই হতো। পাকিস্তানী আর্মির ইতিহাস ভিন্ন হতো , এটা সামরিক অপারেশনের বর্ষ বিবরণীতে উদ্দীপক অধ্যায় হিসাবে লিখা থাকতো ।” জেনারেল নিয়াজি কোন উত্তরই দিলেন না ।
.
.
শিরোনামঃ ১২৮। আত্মসমর্পণ ঢাকায় পাক সামরিক শক্তির একটি তালিকা
সূত্রঃ পাকিস্তান্স ক্রাইসিস ইন লিডারশিপ- ফজল মুকিম খান
তারিখঃ ডিসেম্বর ১৯৭১
.
আত্মসম্পর্পনের সময় ঢাকায় সৈন্যবাহিনিঃ
১। কেন্দ্রীয় দফতর (হেডকোয়ার্টার)
ক। ইস্টার্ন কমান্ড কেন্দ্রীয় দফতর
খ। রির কেন্দ্রীয় দফতর ১৪ ডিভিশন
গ। কেন্দ্রীয় দফতর ৩৬ (অ্যাড হোক) ডিভিশন মূলত ইপি সিএএফ
ঘ। পূর্ব পাকিস্তান লজিস্টিক এলাকা কেন্দ্রীয় দফতর
ঙ। স্টেশন কেন্দ্রীয় দফতর
চ। ফ্লাগ অফিসার কমান্ডিং’এর কেন্দ্রীয় দফতর, পূর্ব পাকিস্তান
ছ। এয়ার অফিসার কমান্ডিং’এর কেন্দ্রীয় দফতর, পূর্ব পাকিস্তান
জ। পশ্চিম পাকিস্তান পুলিশ কেন্দ্রীয় দফতর
ঝ। ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কেন্দ্রীয় দফতর, রাজাকার
২। সেনাদল- নিয়মিত এবং প্যারা
সশস্ত্র সোইন্যদল (অ্যাড হোক ট্যাঙ্ক সেনাদল) ৫০
আর্টিলারি (৬ এলএএ রেজিমেন্ট, HQ Arty. অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন ৭০০
প্রকৌশলি (বিবিধ ইউনিটের প্রতিপালিত পক্ষ, HQ Engrs ৫০০
সংকেত (৩ বাহিনী ও বিবিধ স্থিত ইউনিট) ২০০০
পদাতিক সেনা (৯৩ বিগ্রেডের অবশিষ্টাংশ যারা ১৯৭১এর ১৩ ডিসেম্বর ঢাকায় পৌঁছেছিলো এবং অতিরিক্ত মোতায়েনকৃত সেনা) ৪৫০০
সার্ভিস (অর্ডন্যান্স এবং সাপ্লাই প্রতিস্থাপন। কর্মশালা) ১০০০
নৌবাহিনী ৫০০
পিএএফ ৫০০
ইপি সিএএফ ৪০০০
মুজাহিদ ১৫০০
রাজাকার ৭০০০
পশ্চিম পাকিস্তান পুলিশ ২৫০০
শিল্প নিরাপত্তা বাহিনী ১৫০০
মোট ২৬,২৫০
৩। উপরোল্লিখিত তথ্যসমূহে অসুস্থ ও আহত এবং হাসপাতাল স্টাফ অন্তর্ভুক্ত নয়।
৪। অস্ত্র
ট্যাংক ৩
অ্যান্টি এয়ারক্রাফট বন্দুক ৪৯
হেভি মর্টার ৪
৬ পাউন্ডার বন্দুক ৪
৩-ইঞ্চি মর্টার ২০
রিকয়েললেস রাইফেল ২৫
রকেট লঞ্চার, ২-ইঞ্চি মর্টার এবং মেশিন গান পর্যাপ্ত সংখ্যক
হালকা ধরণের অস্ত্র পর্যাপ্ত সংখ্যক
নদীতে চলার নৌকা ১০
(অতিরিক্ত সংযোজিত অংশে দেয়া চিত্রটি একজন স্টাফ অফিসারের প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী যে আত্মসমর্পনের পর ঢাকা থেকে পালিয়ে যায়/অব্যাহতি নেয় [escaped])
.
শিরোনামঃ ১২৯। স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানের সৈন্যক্ষয়ের একটি হিসাব
সূত্রঃ পাকিস্তান্স ক্রাইসিস অন লিডারশিপ- ফজল মুকিম খান
তারিখঃ ডিসেম্বর ১৯৭১
.
হতাহতের সংক্ষিপ্তসার
পশ্চিম পাকিস্তান-(৩ থেকে ১৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১)
অফিসার জেসিও ওআর সর্বমোট
যুদ্ধে নিহত (শহিদ) ৬২ ৫২ ১২৯১ ১৪০৫
আহত ১৩৩ ১২৩ ২৮২২ ৩০৭৮
নিখোঁজ ৪ ২ ১২০ ১২৬
নিখোঁজ, মৃত বলে ধারণাকৃত – ৫ ১২৯ ১৩৪
নিখোঁজ, যুদ্ধবন্দী ধারণাকৃত ৩ ৭ ২০৫ ২১৫
মোট ২০২ ১৮৯ ৪৫৬৭ ৪৯৫৮
পূর্ব পাকিস্তান-(মার্চ ১৯৭১ থেকে ডিসেম্বর ১৯৭১)
অফিসার জেসিও ওআর সর্বমোট
যুদ্ধে নিহত (শহিদ) ৯০ ৪১ ১২৬২ ১২৯৩
আহত ১৩২ ৮০ ২৩২৭ ২৫৩৯
নিখোঁজ ৯ ১ ২৫ ৩৫
নিখোঁজ, মৃত বলে ধারণাকৃত ৩ ৭ ৩৩০ ৩৪০
নিখোঁজ, যুদ্ধবন্দী ধারণাকৃত ১৪ ১ ৩ ১৮
মোট ২৪৮ ১৩০ ৩৮৪৭ ৪২২৫
২। অফিসার/জেসিও এবং ওআরদের হতাহতের অনুপাতঃ (এখানে কোন ১নম্বর দেখি নি)
পশ্চিম পাকিস্তান ১:১২
পূর্ব পাকিস্তান ১:১০
নিহত (শহিদ) অফিসার/জেসিও এবং ওআরদের অনুপাতঃ
পশ্চিম পাকিস্তান ১:১১
পূর্ব পাকিস্তান ১:৯
আহত (শহিদ) অফিসার/জেসিও এবং ওআরদের অনুপাতঃ
পশ্চিম পাকিস্তান ১:১৭
পূর্ব পাকিস্তান ১:১১
৩। অফিসারদের হতাহতের চিত্রটিতে একজন নিহত (শহীদ) ও দুইজন আহত জেনারেল, এবং দশজন নিহত (শহীদ) ও এগারোজন আহত লেফটেন্যান্ট কর্নেল অন্তর্ভূক্ত। অসিফার-জওয়ান হতাহতের অনুপাত পূর্বপ্রত্যাশিতই ছিলো যেহেতু তারা সর্বদা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেন।
৪। পূর্ব পাকিস্তানে আরও অধিক ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে যেহেতু যুদ্ধের শেষ দিনের ক্ষয়ক্ষতিগুলোর প্রতিবেদন তৈরী নাও হতে পারে।
৫। সেই সাথে ভারতীয় ৩০,০০০ হতাহতের অনুমান করা হয়।
.
.
শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৩০। জাতির উদ্যেশে জেনারেল ইয়াহিয়ার অপ্রচারিত ভাষণ দি এন্ড, অ্যান্ড দি বেগিনিং হার্বার্ড ফিল্ডম্যান ১৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১
জাতির উদ্যেশে জেনারেল ইয়াহিয়ার অপ্রচারিত ভাষণ
রাওয়ালপিন্ডি, ১৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১
প্রেসিডেন্ট জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের আজ ইস্যু কৃত বিবৃতিটি নিম্নে উল্লেখ করা হল:
আপনারা স্মরণ করতে পারেন, আমার ১২ অক্টোবর জাতির উদ্যেশে দেয়া ভাষণে, আমি ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে আমার পরিকল্পনার বিস্তারিত অবহিত করেছিলাম এবং বলেছিলাম যে নতুন সংবিধান ২০ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকাশ করা হবে। বিশ্বাসঘাতক ভারত তার আগ্রাসন দ্বারা আমার সে পরিকল্পনা সম্পূর্ণরূপে ভেস্তে যেতে দিতে চেয়েছিল। তবুও এটি এবং অন্যান্য বেশ কিছু ভোগান্তি সহ্য করেও আমি ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে আমার পরিকল্পনা অটুট রেখেছি। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য ইতোমধ্যে একটি জোট সরকার গঠনের লক্ষ্যে উভয় অংশের প্রতিনিধিত্বমূলক প্রধান দলসমূহের নেতাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছি। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত সরকার এই সঙ্কটের সময়ে জাতিকে পরিচালনার দায়ভার গ্রহণ করবে। যে সংবিধানের সংক্ষিপ্ত রূপরেখা আমি এখন তুলে ধরব তা জাতির প্রতি কর্তব্য পালনের ক্ষেত্রে এই সরকারের ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে।
এটা আমার জন্য কিছুটা দুঃখেরই ব্যাপার যে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা সংবিধান প্রস্তুতকরণের যেই প্রক্রিয়াটি আমি শুরু করেছিলাম তা সবারই জ্ঞাত কিছু কারণবশত বাধা প্রাপ্ত হয়েছে।তবে এই দু:খজনক ঘটনা আমার ক্ষমতা হস্তান্তরের সংকল্পকে বিলম্বিত করতে পারেনি বরং আমাকে পাকিস্তানের জনগণকে একটি সংবিধান উপহার দিতে আরো উদ্বুদ্ধ করেছে। একই সঙ্গে, একটি সংবিধান জোর করে চাপিয়ে দেবার কোন ইচ্ছাই আমার নেই। সংবিধানটি সেজন্যই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে এবং তাদের অংশগ্রহণে প্রথম ৯০ দিনের মধ্যে একটি সহজ সংশোধনী পদ্ধতির ব্যবহার অনুমোদন করে যা হবে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে ও এই সংযুক্ত রাষ্ট্রটির অংশগুলোর প্রতিনিধিদের অন্তত ২৫ শতাংশের ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে গঠিত।
আমি দেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলেছি এবং বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাপ্ত বহু দৃঢ় ধারণা ও পরামর্শ বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। এর উদ্দেশ্য ছিল যেন সংবিধানটি জনমতের ভিত্তিতে প্রণীত হয় এবং জনগণের প্রত্যাশা ও দেশের চাহিদা পূরণ করতে পারে।
সংবিধান সম্পর্কে প্রকাশ্য বিতর্কে আমি লক্ষ্য করেছি যে নিম্নলিখিত চারটি উপাদান সম্বন্ধে একটি সাধারণ ঐক্যমত রয়েছে যা সংবিধানটিতে প্রতিফলিত হয়েছে-
১) এটা ইসলামী প্রজাতন্ত্র পাকিস্তানের আদর্শের সংরক্ষণ ও বিস্তার ঘটাবে।
২) দেশের প্রয়োজন একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় সংসদ ব্যবস্থা যা জনগণের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করবে।
৩) দেশ একটিই, এই ধারণার মধ্যে থেকে সর্বোচ্চ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে।
৪) সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মানুষের নতুন নতুন প্রত্যাশাকে বাস্তবে রূপ দিতে একে তার সক্ষমতার পরিচয় দিতে হবে।
সংবিধানটি কেন্দ্র এবং প্রদেশ উভয় ক্ষেত্রেই সংসদীয় প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার গঠনের বন্দোবস্ত রেখেছে। রাষ্ট্রপতি এমন একজনকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেবেন যিনি জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। অন্যান্য মন্ত্রীরা জাতীয় পরিষদের সদস্য হবেন। অবশ্য পরিষদের সদস্য নন এমন কেউও মন্ত্রী হতে পারবেন, তবে সর্বোচ্চ ছয়মাসের জন্য। সকলে সম্মিলিতভাবে মন্ত্রীপরিষদ হিসেবে জাতীয় পরিষদের নিকট দায়বদ্ধ থাকবেন। কেবলমাত্র একটি ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী অপসারিত হতে পারবেন। আর তা হল যদি তার উপর জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য অনাস্থা জ্ঞাপন করেন।
প্রধানমন্ত্রীকে একজন উপপ্রধানমন্ত্রী সহায়তা করবেন, যিনি প্রধানমন্ত্রী যে পক্ষ থেকে এসেছেন তার বিপরীত পক্ষের হবেন। রাষ্ট্রপতিকে তার মন্ত্রীপরিষদের পরামর্শ মোতাবেক কাজ করতে হবে। তবে যেসকল ক্ষেত্রে প্রদত্ত পরামর্শ পদ গ্রহণকালীন গৃহীত তার শপথের বিরুদ্ধে যাবে অথবা দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর সংগঠন বা উচ্চ পর্যায়ের সক্ষমতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করবে সেসকল ক্ষেত্রে তিনি এর ব্যতিক্রম ঘটাতে পারবেন।
এই সংবিধানে প্রদত্ত মৌলিক অধিকারসমূহ পূর্ববর্তী সংবিধান সমূহে অন্তর্ভুক্ত বিধান থেকে উন্নততর হবে। এতে অনেক ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রীয় নীতির নিয়ন্ত্রক মতবাদ সমূহকে ভিন্ন ভাবে বর্ণনার মাধ্যমে আরো জোরদার করা হয়েছে। শ্রমিক এবং কৃষকদের জীবনযাত্রার মান ও কর্মপরিবেশের উন্নতির দিকে রাষ্ট্রকে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে।
আগের সংবিধান গুলো থেকে আরেকটি বড় পার্থক্য হল উপরাষ্ট্রপতি পদের প্রবর্তন। উল্লেখ করা হয়েছে যে উপরাস্ট্রপতিকে অবশ্যই রাষ্ট্রপতি যে পক্ষের তার বিপরীত পক্ষ থেকে আসতে হবে এবং তার সদর দপ্তর হবে ঢাকা। তার প্রধান কাজ হবে সিনেটের সভাপতি হিসেবে, এবং এই নতুন সংসদীয় সভা পূর্ববর্তী সংবিধান সমূহ থেকে আলোচ্য নতুন সংবিধানের আরেকটি বড় পার্থক্য। দ্বিতীয়হাউসফেডারেলরাষ্ট্রেরএকটিপ্রয়োজনীয়বৈশিষ্ট্য। দ্বিতীয় সংসদীয় সভা যেকোনো যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে একটি প্রয়োজনীয় সংগঠন, যা আমাদের সংবিধানগুলো বহুকাল পাশ কাটিয়ে গেছে। সাধারণভাবে এই দ্বিতীয় সভাটির কাজ হবে যুক্ত রাষ্ট্রটির বিভিন্ন অঞ্চলের সমপ্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা। আলোচ্য সংবিধানটি এটি নিশ্চিত করে যে সিনেটে প্রতিটি প্রদেশের প্রতিনিধির উপস্থিতি থাকবে। উপরন্তু, সামাজিক ও পেশাগত জীবনে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের প্রতিনিধিত্ব রাখবার জন্য আমি এরকম পনের জনকে মনোনয়নের ব্যবস্থা করেছি যাদের মধ্যে দশজন পূর্ব পাকিস্তান থেকে এবং অবশিষ্ট পাঁচ জন হবেন পশ্চিমপাকিস্তানী। পাকিস্তানের উপরাষ্ট্রপতি সিনেটের সভাপতির দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তার উপর আইন দ্বারা অর্পিত অন্যান্য দায়িত্ব এবং রাষ্ট্রপতি কর্তৃক আদেশকৃত কার্যাবলীর পালন করবেন। রাষ্ট্রপতি ও উপরাষ্ট্রপতি সিনেট, জাতীয়পরিষদ ও সকল প্রাদেশিক পরিষদ নিয়ে গঠিত ইলেকটোরাল কলেজ(নির্বাচনের জন্যে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিনিধি) কর্তৃক বিকল্প ভোট পদ্ধতিতে নির্বাচিত হবেন।
সুতরাং এরূপে পাকিস্তানের দুইটি সংসদীয় সভা থাকবে, তবে প্রধান আইন প্রণয়নকারী হবে জাতীয় পরিষদ। সিনেট জাতীয় পরিষদ দ্বারা গৃহীত আইনের ক্ষেত্রে ভেটো দিতে পারবেনা, তবে জাতীয় পরিষদ কর্তৃক পাশ করা যেকোনো বিল এর সংশোধনীর আবেদন করতে পারবে যা রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে জাতীয় পরিষদের নিকটে পৌঁছাবে। রাষ্ট্রপতি নিজেও অবশ্য সংশোধনীর পরামর্শ দানের সাধারণ ক্ষমতার অধিকারী হবেন। এরপর চূড়ান্ত আইন প্রণয়নের ক্ষমতা জাতীয় পরিষদের হাতেই ন্যস্ত করা হয়েছে। আইন বিষয়ক ক্ষেত্রে দুই সংসদীয় সভা একত্রে মিলিত হয়ে আলোচনা করতে পারে কেবলমাত্র যখন সিনেট জাতীয় পরিষদ দ্বারা সংবিধানে আনীত কোনো সংশোধনীর ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করবে। সেক্ষেত্রে একটি যৌথ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে এবং দুই সভার মোট সদস্যের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও সর্বমোট প্রতিনিধিদের শতকরা কমপক্ষে পঁচিশজনের ঐক্যমত্য প্রয়োজন হবে বিবেচিত সংশোধনীটি পাশ করাবার জন্যে। এছাড়া রাষ্ট্রপতি ও উপরাষ্ট্রপতির অভিশংসন প্রস্তাব উত্থাপিত হলেও এই দুই সভা একত্রে আলোচনায় বসতে পারে।
যেহেতু আমি সংবিধানের সংশোধনী বিষয়ে কথা বলছি সেহেতু আরো উল্লেখ করা যায় যে নতুন সংবিধান কর্তৃক প্রদেশগুলোকে প্রদত্ত বৃহদাকার স্বায়ত্তশাসনের ক্ষমতাকে সংহত রাখবার জন্যে সংবিধানে একটি বিষয় যুক্ত করা হয়েছে। তা হল যদি জাতীয় পরিষদ সংবিধান কর্তৃক প্রদত্ত এই স্বায়ত্তশাসন ক্ষমতার কোনো নির্দিষ্ট অংশের জন্য সংশোধনী প্রস্তাব গ্রহণ করে তবে সেই প্রস্তাব বিবেচনা ও পরামর্শের নিমিত্ত শুধু সিনেটই নয় বরং প্রতিটি প্রদেশের প্রাদেশিক পরিষদেও পাঠাতে হবে। প্রদেশসমূহের মতামত এক্ষেত্রে সিনেটের মতের উপরে স্থান পাবে এবং সিনেট পরবর্তীতে সংশোধনী সম্পর্কে নিজস্ব প্রস্তাবনা প্রণয়ন করবে। এইসকল মতামত ও প্রস্তাবনা রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে জাতীয় পরিষদের নিকটে পৌঁছাবে। সংসদের দুই সভার মাঝে মতের অমিল দেখা দিলে তার সুরাহার জন্যে একটি যৌথ অধিবেশনের আয়োজন করা হবে। প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের জন্যে আরেকটি রক্ষাকবচ হল যদি রাষ্ট্রপতি মনে করেন যে কোনো প্রাদেশিক পরিষদ কর্তৃক উত্থাপিত আপত্তি প্রস্তাব যথাযথভাবে মূল্যায়িত হয় নি তবে তিনি এই সংশোধনীর ক্ষেত্রে তার সম্মতি প্রদান করা থেকে বিরত থাকতে পারবেন।
যে সকল ক্ষেত্রে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের আওতা বৃদ্ধি পেয়েছে সেগুলো উল্লেখের পূর্বে আমি প্রাদেশিক সরকারের প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্য সমূহ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোকপাত করতে চাই। প্রতিটি প্রদেশের জন্য প্রাদেশিক পরিষদ ইতোমধ্যেই নির্বাচিত হয়েছে। সংবিধান অনুযায়ী প্রত্যেক গভর্নরের একটি করে মন্ত্রীপরিষদ থাকবে এবং তিনি তার মন্ত্রীপরিষদ থেকে প্রাপ্ত উপদেশ অনুযায়ী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করবেন। প্রাদেশিক পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের প্রধানকে একটি মন্ত্রণালয় গঠন করতে আহবান জানানো হবে এবং তিনি সেই পদে আসীন থাকবেন একটি মাত্র শর্তে; আর তা হল প্রাদেশিক পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থা হারালে তাকে পদচ্যুত করা হতে পারে।
কেন্দ্র এবং প্রদেশের সম্পর্ক বিধানকারী সংবিধানের অংশগুলোয় বিস্তারিত বিবরণ প্রদানপূর্বক বহু বিষয় কেন্দ্র সরকার থেকে প্রাদেশিক সরকারের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে। ডাকঘর, শেয়ার বাজার এবং ভবিষ্যতের বাজার ও বীমা ব্যবস্থা – যেখানে প্রকৃতপক্ষে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ অপরিহার্য সেখানে সে নিয়ন্ত্রণের বিধান সংবিধানে রাখা হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের বিশেষ অবস্থান বিবেচনা করে এরূপ বিধান রাখা হয়েছে যে প্রদেশটির অনুরোধপূর্বক কেন্দ্রীয় সরকার সে অঞ্চলে তার নির্বাহী কর্মকাণ্ডের ভার প্রাদেশিক সরকারের কাছে হস্তান্তর করবে। সংবিধানের এই বিশেষ অংশে বর্ণিত বিষয়গুলোতেই কেবল কেন্দ্রীয় আইনসভার ক্ষমতা সীমাবদ্ধ, তা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করে দেয়া হয়েছে। ১৯৬২ এর সংবিধানে বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় আইনসভাকে প্রাদেশিক বিষয়ে আইন প্রণয়নের যে ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছিল তা প্রত্যাহার করা হয়েছে। এখন শুধুমাত্র প্রাদেশিক পরিষদ বা পরিষদসমূহ অনুরোধ করলে কেন্দ্রীয় আইনসভা এরূপ কর্মকাণ্ডে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পারবে, এছাড়া নয়। আর্থিকক্ষেত্রে, কর আরোপণের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা প্রদেশসমূহের হাতে স্থানান্তর করা হয়েছে। এ ব্যাপারে এবং তদসঙ্গে বৈদেশিক বাণিজ্য ও সাহায্য, প্রদেশসমূহকে প্রদত্ত অনুদান, আন্তঃপ্রাদেশিক বাণিজ্য ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আমি আলাদাভাবে একটু পরে আলোচনা করব।
পশ্চিম পাকিস্তান একীভবন আদেশ ১৯৭০ মোতাবেক পশ্চিম অংশের ছয়টি স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার দায়িত্ব ৪টি প্রদেশের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতি পালন করবেন। বছরজুড়ে তাদের কর্মকাণ্ডের আলোকে দেখা গেছে যে এদের থেকে ৩টি সংস্থাকে বিলীন করে দিয়ে তাদের দায়িত্ব চারটি প্রদেশের কাছে হস্তান্তর করা সম্ভবপর হবে। এরা হল কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন, ক্ষুদ্র শিল্প কর্পোরেশন এবং সংশ্লিষ্ট সিমেন্ট কোম্পানী। এখন একীভবন আদেশে বর্ণিত ব্যবস্থাগুলো শুধুমাত্র পশ্চিম পাকিস্তান রেলওয়ে, পশ্চিম পাকিস্তান বিদ্যুৎ ও উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং পশ্চিম পাকিস্তান শিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশন এর মত গুরুত্বপূর্ণ ও ভিত্তিমূলক শিল্পগুলোর ক্ষেত্রে সীমিত আকারে ক্রিয়াশীল থাকবে যার সাথে পশ্চিম অংশের চারটি প্রদেশের স্বার্থ সমানভাবে জড়িয়ে রয়েছে।
সংবিধান অনুযায়ী কেন্দ্র সকল প্রদেশকে বহিরাক্রমণ এবং অভ্যন্তরীণ গোলযোগ থেকে রক্ষা করার জন্য দায়বদ্ধ থাকবে। কেন্দ্র এও নিশ্চিত করবে যেন এই দায়িত্ব পালন করতে যেয়ে তার গৃহীত পদক্ষেপসমূহ সংবিধান অনুসারী হয়। এই দায়িত্ব বাস্তবায়নের জন্য দুটি বিশেষ বিধানের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়েছে। এক, যখন কেন্দ্রীয় সরকার এই মর্মে নিশ্চিত হবে যে কোনো প্রাদেশিক সরকারকে সংবিধানের বিধান অনুযায়ী পরিচালনা করা সম্ভবপর হচ্ছে না, তখন কেন্দ্র সেই প্রদেশের গভর্নরকে প্রাদেশিক সরকারের সম্পূর্ণ কর্মকাণ্ডের ভার গ্রহণের অনুমতি দিতে পারে। এর সময়সীমা হবে সর্বোচ্চ এক বছর। কোনো প্রদেশ আর্থিক স্থিতাবস্থা হারিয়ে ফেললে কেন্দ্রীয় সরকার সে প্রদেশের উপর তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। আপনারা জানেন এমন বিধান আরো অনেক সংবিধানেই রয়েছে।
যে বিষয়টি মানুষের মনে সবচেয়ে বেশী উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে তা হল কেন্দ্র ও প্রদেশের মধ্যেকার সম্পর্ক এবং প্রদেশগুলোকে ঠিক কতটুকু ক্ষমতা প্রদান করলে তা দেশের একতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। সে বিবেচনা থেকেই কেবলমাত্র কিছু বিশেষ ব্যাপারে কেন্দ্রের হাতে ক্ষমতা থাকবে, আর অন্যদিকে বাকি সব ক্ষমতাই প্রদেশের হাতে ন্যস্ত থাকবে।
আর্থিক স্বায়ত্ত্বশাসন প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের একটি অপরিহার্য অঙ্গ। প্রদেশের আর্থিক সম্পদ সমূহের উপর প্রদেশেরই নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিৎ। বর্তমানে সম্প্রসারণশীল রাজস্ব উৎসের বেশীরভাগই কেন্দ্রে অবস্থিত হওয়ায় নিজেদের উন্নয়নের জন্য সম্পদ ব্যয়ের সুযোগ প্রদেশগুলোর জন্যে খুবই কম। কিন্তু নতুন সংবিধানে এক্ষেত্রে প্রভূত বদল সাধিত হয়েছে। চরমপন্থিরা দাবী করে কেন্দ্রের হাতে কর সংক্রান্ত কোনো ক্ষমতাই রাখা উচিৎ নয়। কিন্তু তা গ্রহণযোগ্য নয় কারণ প্রদেশের পাশাপাশি কেন্দ্রেরও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা দরকার সংবিধান অনুযায়ী তার দায়দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করবার জন্য। নতুন সংবিধান বর্তমানে প্রাদেশিক সরকারের হাতে ন্যস্ত করের উৎসগুলোর পাশাপাশি নিম্নে উল্লিখিত উৎসগুলোও কেন্দ্র থেকে প্রদেশে স্থানান্তরিত করবে –
১) বিক্রয় কর
২) তেল ও তামাক উৎপাদন ব্যতিত অন্য সকল উৎপাদনের উপর প্রযুক্ত আবগারি শুল্ক
৩) সম্পত্তি ও উত্তরাধিকার কর
৪) উপহার কর
উপরে উল্লিখিত কেন্দ্র নিয়ন্ত্রিত করের উৎসগুলো পুরোপুরি প্রদেশের কাছে হস্তান্তরের পাশাপাশি নিম্নলিখিত তিনটি কর কেন্দ্রের মাধ্যমে সংগ্রহ সুবিধাজনক হওয়ায় সংবিধান অনুযায়ী কেন্দ্র তাদের সংগ্রহ করে সম্পূর্ণ অংশই প্রদেশের হাতে হস্তান্তর করবে-
১) রপ্তানি কর
২) অপ্রক্রিয়াজাতকৃত তামাকের উৎপাদনের উপর প্রযুক্ত আবগারি শুল্ক
৩) প্রাকৃতিক গ্যাস ও অপরিশোধিত খনিজ তেলের ওপর প্রযুক্ত কর
অন্যভাবে বলা যায়, কেন্দ্র শুধুমাত্র নিম্নলিখিত করের উৎসগুলোকে নিজের কাছে রাখবে-
১) আয়, কর্পোরেশন ও সম্পদ কর
২) শুধুমাত্র দুটি ক্ষেত্রের আবগারী শুল্ক যথা-পেট্রোলিয়াম পণ্য এবং প্রক্রিয়াজাতকৃত তামাক
৩) রপ্তানি শুল্ক ব্যতীত অন্যান্য কাস্টম শুল্ক
প্রদেশগুলোতে করের এই প্রধান উৎস সমূহ স্থানান্তরের পাশাপাশি সংবিধান অনুযায়ী স্বল্পোন্নত প্রদেশগুলো কেন্দ্র থেকে বিশেষ অনুদান লাভ করবে। এই অনুদানের পরিমাণ হবে বছরে ন্যূনতম ৭০ কোটি রুপি, যার মধ্যে ৬০ কোটি রুপি বা পূর্ব পাকিস্তান থেকে কাস্টম শুল্ক হিসেবে সংগৃহীত সম্পূর্ণ শুল্ক – এর মধ্যে যেটি পরিমাণে বেশী হবে – সেটি পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ করা হবে। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তান প্রত্যেকে কমপক্ষে ৫ কোটি রুপির অনুদান পাবে।
পূর্ব পাকিস্তানক এত বিশালাকার বিশেষ অনুদান দেবার উদ্দেশ্য হল প্রদেশটির উন্নয়ন ঘটানো। কেন্দ্রীয় সরকার কর বাবদ প্রতি বছর পূর্ব পাকিস্তান থেকে গড়ে ১৩০ কোটি রুপি আয় করছে। নতুন সংবিধান মোতাবেক এই ১৩০ কোটি রুপির মাঝে ১০০ কোটি রুপিরও বেশি পূর্ব পাকিস্তান পাবে। এর মানে হল কেন্দ্রীয় ব্যয়ের ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের অবদান হবে ৩০ কোটি রুপির আশেপাশে, যা কেন্দ্রের বর্তমান মোট ব্যয়ের প্রায় ৫ শতাংশ। এই তথ্যই নির্দেশ করে যে নতুন সংবিধান পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদ সমূহের জন্য কতটা অর্থনৈতিক সমর্থন যোগাতে যাচ্ছে।
সাংবিধানিক বিধান এখন থেকে প্রদেশগুলোতে সম্পদের এইরূপ বরাদ্দ নিশ্চিত করবে। এতে করে অর্থ কমিশন স্থাপন পূর্বক সময় সময় তা পর্যালোচনা করার দরকার পড়বে না।
এছাড়া সংবিধানে উল্লেখ আছে যে প্রাদেশিক সরকারগুলো কেন্দ্র থেকে নির্ধারণ করে দেয়া বিস্তৃত সীমার মধ্যে থেকে অভ্যন্তরীণ খাত হতে ধার নিতে পারবে। প্রতিবার ঋণ গ্রহণের সময় কেন্দ্রে একটি করে ঋণ প্রস্তাব উত্থাপন করা হবে। সংবিধান পূর্ব পাকিস্তানকে এই নিশ্চয়তা দেয় যে প্রদেশটি দেশের সবগুলো প্রদেশের মোট সরকারি ঋণের শতকরা অন্তত ৫৪ ভাগ গ্রহণের অনুমতি পাবে।
বাহ্যিক সাহায্যের ক্ষেত্রে, যা দেশের পররাষ্ট্র নীতির সাথে সংশ্লিষ্ট, কেন্দ্রের ভূমিকা কেবলমাত্র দেশের জন্য সামগ্রিক সাহায্যের বন্দোবস্তের ব্যাপারে সীমাবদ্ধ থাকবে। এখানেও পূর্ব পাকিস্তান কোনো এক বছরে দেশের প্রাপ্ত মোট সাহায্যের ন্যূনতম ৫৪ শতাংশ লাভ করবে। এই বরাদ্দ দিয়ে বিভিন্ন প্রকল্প ও কার্যক্রম পরিচালনার ব্যাপারে প্রদেশগুলো সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করবে।
বৈদেশিক মুদ্রা আয় দেশের মুদ্রাকে শক্তিশালী করতে সাহায্য করে, এবং সে কারণে একে কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্ব হিসেবেই রাখতে হবে। তবে নিজেদের সাধারণ দায়িত্ব পূরণের পর কী পদ্ধতিতে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান নিজেদের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবহার করবে তা সংবিধানে উল্লেখ রয়েছে।
প্রাদেশিক সরকারগুলো তাদের নিজস্ব রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য প্রচার কর্মকাণ্ড চালাবার ক্ষমতা প্রাপ্ত হবে। দেশের সাধারণ চাহিদা মেটাবার পর তাদের অর্জিত বাকি বৈদেশিক মুদ্রা ও বৈদেশিক সাহায্যের পরিমাণের উপর নির্ভর করে নিজেদের আমদানি নীতিমালাও তারা প্রণয়ন করতে পারবে। পশ্চিম পাকিস্তানে এই ব্যবস্থা স্পষ্টতই একটি আঞ্চলিক ভিত্তিতে পরিচালিত হবে। তবে যেহেতু বৈদেশিক বাণিজ্য দেশের সামগ্রিক পররাষ্ট্র নীতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত তাই প্রাদেশিক সরকারগুলো কোন রূপরেখায় তাদের নিজস্ব বাণিজ্য নীতি পরিচালনা করবে তা আইন প্রণয়ন করে নির্দিষ্ট করে দেবার ক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে ন্যস্ত থাকবে। এই সাংবিধানিক বিধানটি পালন করার জন্যে প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রশাসনিক পরিবর্তন সমূহ আনয়নের লক্ষ্যে পাট বোর্ড এর মত প্রতিষ্ঠান সমূহকে পূর্ব পাকিস্তানে বদলি করা হবে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের বাণিজ্য নীতি গুলোর সমন্বয় বিধানের লক্ষ্যে সেখানে একটি বাণিজ্য বোর্ড স্থাপন করা হবে। কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমতি সাপেক্ষে পূর্ব পাকিস্তানের পক্ষে বিদেশে বাণিজ্য প্রতিনিধি নিয়োগ করার বিধানও রাখা হয়েছে।
দেশের দুই অংশের মাঝে আন্তঃবাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করার জন্য একটি বিশেষায়িত বাণিজ্য বোর্ড গঠন করা হবে। বোর্ডটি সবকটি প্রদেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত হবে, যার অর্ধেক আসবে পূর্ব পাকিস্তান থেকে। এই বোর্ড যেকোনো প্রদেশের কাছ থেকে তাদের কাছে এই বাণিজ্য সম্পর্কিত কোনো প্রশ্ন উত্থাপিত হলে সে ব্যাপারে সমীক্ষা চালাবে। এভাবে প্রদেশগুলো নিশ্চিত করতে পারবে যে দুই অংশের মধ্যেকার এই আন্তঃবাণিজ্য ন্যায্য এবং পারস্পারিক সুবিধাজনক রূপেই পরিচালিত হবে।
মুদ্রাব্যবস্থা স্পষ্টতই পাকিস্তান স্টেট ব্যাংকের অধীনে একটি কেন্দ্রীয় দায়িত্ব হিসেবে রয়েছে কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকিং পদ্ধতির অন্যান্য কর্মকাণ্ডের বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে দেশের দুই অংশের প্রতিটিতে একটি করে মোট দুটি আঞ্চলিক রিজার্ভ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হবে। এই আঞ্চলিক রিজার্ভ ব্যাংকগুলোতে সম্পূর্ণরূপে তাদের নিজ নিজ প্রাদেশিক সরকারের প্রতিফলন ঘটবে। এরা নিজ এলাকায় বাণিজ্যিক ও সমবায় ব্যাংক সমূহের নিয়ন্ত্রণ করবে এবং স্টেট ব্যাংক অফ পাকিস্তানের তৈরি রূপরেখার অভ্যন্তরে থেকে নিজেদের ঋণনীতির পরিচালনা করবে।
পরিকল্পনা প্রণয়নের ক্ষেত্রে বিকেন্দ্রীকরণ ঘটবে যেখানে বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ সম্পদ সমূহের উপর ভিত্তি করে নিজ নিজ উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নে প্রদেশগুলো সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করবে। প্রাদেশিক পরিকল্পনাসমূহ সুসংহত করার মাধ্যমে কেন্দ্র কোনো নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে জাতীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন করবে। পরিকল্পনা ক্ষেত্রে বিকেন্দ্রীকরণের দিকে পদক্ষেপ হিসেবে কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা কর্মীদল, জাতীয় অর্থনৈতিক কাউন্সিল ও তার নির্বাহী কমিটিকে ভেঙে দেয়া হবে। সুতরাং প্রাদেশিক সরকারগুলো কোনোরূপ আর্থিক সীমা মেনে চলা ছাড়াই পরিকল্পনা প্রণয়ন ও অনুমোদনে পূর্ণ কর্তৃত্বের অধিকারী হবে।
নির্বাচনের পদ্ধতি প্রসঙ্গে আমি বলতে পারি যে, সবকটি পরিষদ প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটের ভিত্তিতে আইনী কাঠামোর ভেতরে থেকে নির্বাচিত হবেন। নতুন সংবিধানেও এই একই পদ্ধতি বজায় থাকবে। তবে সিনেট নির্বাচন হবে প্রাদেশিক পরিষদ সমূহের দ্বারা, একক বদল যোগ্য ভোটের মাধ্যমে। তাতে করে দলীয় ব্যবস্থার অধীনে একক ভোট পদ্ধতি অপেক্ষা বৃহদাকার প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হবে। .
নির্বাচনের প্রসঙ্গে আমি আরো উল্লেখ করতে পারি যে সংবিধানে অধিক সংখ্যক রাজনৈতিক দল অথবা সংকীর্ণ আঞ্চলিক ভিত্তিতে তাদের বিস্তারকে নিরুৎসাহিত করে বিধান রাখা হয়েছে। সংসদীয় ব্যবস্থার সুস্থ বিকাশ এবং জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গীর উৎসাহ ও বৃদ্ধির লক্ষ্যে এরূপ সংস্কারের প্রয়োজনীতা আছে বলে আমি মনে করি। এইসকল বিধান স্বাভাবিকভাবেই এসব নির্বাচনে প্রযুক্ত হবে।
পূর্বের সংবিধান অনুযায়ী চলমান ইসলামী প্রতিষ্ঠানগুলো আগের মতই তাদের কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাবে। আরো বলা রয়েছে যে কোনো প্রাদেশিক সরকার অনুরোধ করলে সেই প্রদেশে ইসলামিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের একটি শাখা প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। নীতিনির্ধারণী ক্ষেত্রে বহু জায়গায় ইসলামিক বিধানকে আরো শক্তিশালী করা হয়েছে।
সবশেষে আমি বলতে চাই যে সংবিধান অনুযায়ী ইসলামাবাদ ও ঢাকায় দুইটি রাজধানী থাকবে। ঢাকার সম্মান রক্ষার্থে ‘দ্বিতীয় রাজধানী’ কথাটি বাদ দেয়া হয়েছে। বরঞ্চ প্রতিটি রাজধানীতেই কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্ব পালনের জন্য যথাযথ প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থা রাখার বিধান রাখা হয়েছে। সংসদের মূল অবস্থান হবে ঢাকায়।
এই হল সংবিধানের মূল বৈশিষ্ট্য সমূহ। এর মুদ্রিত কপি ২০ তারিখ থেকে পাওয়া যাবে। আমি জাতীয় ঐক্য বজায় রেখে যথাসম্ভব বেশি প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রদানের চেষ্টা করেছি। কর্মকাণ্ডের বিকেন্দ্রীকরণের পেছনে আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি এবং সে পর্যায় পর্যন্ত গিয়েছি যার থেকে আর আগাবার চেষ্টা করলে সম্পূর্ণ ব্যবস্থাটাই অক্ষম হয়ে পড়বে বলে আমার অনুভূত হয়েছে। বিকেন্দ্রীকরণের দরকার রয়েছে এবং তা বাস্তবায়নও করা হয়েছে। কিন্তু অবশ্যই এটি এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় যেখানে এটি ভাঙ্গনের শুরু হিসেবে ভূমিকা করবে। আমি বোধ করি এই সংবিধানটি অন্য যেকোনো সংবিধানের তুলনায় সামনের দিকে একটি সাহসী পদক্ষেপ। কিন্তু অন্যদিকে আমাদের সমস্যাগুলোও অনন্য। তাই এদেশ যেসব সমস্যা মোকাবেলা করছে তার জন্যে আমাদের ব্যতিক্রমি এবং সাহসী সমাধানই খুঁজতে হবে। আমার আন্তরিক আশা ও প্রার্থনা, যে অবিশ্বাস ও তিক্ততা আমাদের খাদের কিনারায় গিয়েছে তার থেকে এই সংবিধান মুক্তির পথ দেখাবে এবং জাতীয় জীবনে ঘুমিয়ে থাকা একত্রীকরণ শক্তিগুলোকে বলশালী করার মাধ্যমে এক নতুন যুগের সূচনা করবে।
পাকিস্তান জিন্দাবাদ
.
.
শিরোনামঃ ১৩১। একাত্তুরের মার্চ মাসের ঘটনাবলী সম্পর্কে পাকিস্তান সরকারের ভাষ্য
সূত্রঃ প্রচার পুস্তিকাঃ পাকিস্তান দূতাবাস, ওয়াশিংটন
তারিখঃ ৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১
.
পাকিস্তানে ফেডারেল হস্তক্ষেপ
ক্রমান্বয়ে
পরিচিতি
.
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ,ক্রমবর্ধমান বিশৃঙ্খলা লুটপাট এবং চরমপন্থি গ্রুপের অগ্নিসংযোগ এবং হত্যার মুখে আইনশৃঙ্খলা দ্রুত ফিরিয়ে আনার জন্য পাকিস্তানি ফেডারেল সেনাবাহিনী এগিয়ে আসে।সামনের পাতাগুলোতে ক্রমান্বয়ে ঘটা মার্চ মাসের ঘটনাসমুহ ফেডারেল বাহিনীর পাল্টা কর্মকান্ডের সাক্ষ্য বহন করে।
এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে ঘটনাগুলোর জন্ম ডিসেম্বর ৭,১৯৭০ সালে,যখন ৫৩ মিলিয়ন পাকিস্তানি গনপরিষদ নির্বাচিত করতে ভোট দিতে গিয়েছিল।ভোট প্রক্রিয়া ছিল গোপন এবং সার্বজনীন ভোটাধিকার নীতি “এক ব্যাক্তি এক ভোট” এর উপর প্রতিষ্ঠিত। “দেশে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের পুনরুদ্ধারের” অঙ্গীকার সফলভাবে সম্পন্ন করবার জন্য ইয়াহিয়া খান এই ভোটের আয়োজন করেন। এই অঙ্গীকারকে কাজে লাগানো হয় মার্চ ৩০,১৯৭১ সালে,লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার (এলএফও)(LFO),যার মাঝে অন্তর্ভুক্ত ছিল নির্বাচন এবং ব্যালটিঙ্গের জন্য মেশিন বহন।
১,৫৭০ জন প্রার্থি গণপরিষদের ৩১৩ টি আসনের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। দেশের ৫টি প্রদেশের ২৫টি ভিন্ন রাজনৈতিক দল এছাড়াও দলের অনুমোদন ব্যতীত ৩১৯জন স্বতন্ত্র এলএফও(LFO) এর শর্তের অধীনে এই আসনের জন্য প্রচারণা অভিযান শুরু করেন।সকল পদ প্রার্থি এলএফও(LFO) এর এই মৌলিক নীতিতে আবদ্ধ হন যে ,নতুন সংবিধান জাতির “স্বাধীনতা,অখন্ডতা এবং জাতীয় সংহতি” তে কোনরূপেই ক্ষতি সাধন করবে না। এই সাধারণ উপলব্ধি থেকেই মানুষ নির্বাচণে অংশগ্রহণ করে।
নির্বাচনের সাফল্য ছিল অভাবণীয়।নির্বাচণের দিন উৎসবে পরিণত হয়।ভোটগ্রহণ ছিল অবাধ ও শান্তিপুর্ণ। ১১টি ভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং ১৫টি স্বতন্ত্র আসন গণপরিষদে বহির্গত হয়। পাকিস্তানি আওয়ামী লীগ পার্টি শেখ মুজিবুর রহমানের নেত্রিত্বে ১৬৭ আসন নিয়ে বিপুল ভোটে জয় লাভ করেন। এবং তার পরবর্তি আসনে পাকিস্তানি পিপলস পার্টি জুলফিকার আলি ভুট্টোর নেত্রিত্বে ৮১ আসনে জয় লাভ করেন।
গণপরিষদ বৈঠক নির্ধারিত হয় রাষ্ট্রপতি কর্তিক মার্চের ৩তারিখে। এই অন্তর্বর্তি সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ,বিশেষ করে শেখ মুজিব এবং জুলফিকার ভুট্টো,সংবিধান তৈরিতে সকল প্রকার প্রশ্নের প্রেক্ষিতে একটি যুক্তিসঙ্গত সিদ্ধান্তের জন্য গনপরিষদের বৈঠকের পুর্বেই সাক্ষাৎ করেন। (উদাহরণস্বরূপ,নতুন সংবিধানের বিভিন্ন ধারা সাধারণ সম্প্রদায় দ্বারা গৃহীত হবে নাকি বড় এককে ইত্যাদি)।এলএফও এর অধীনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ১২০ দিনের মধ্যে নতুন সংবিধান সুনিশ্চিত করবার আদেশ দেয়া হয়। ফেব্রুয়ারির শেষ নাগাদ আলোচনার অচলাবস্থার কারণে পরিষদে সাক্ষাতের আগে সংবিধান তৈরির সমাধান প্রক্রিয়ায় যৌথ পরামর্শের জন্য জনাব ভুট্টো অতিরিক্ত সময় চেয়ে আবেদন করেন।
এই মুহুর্তে এসে মার্চের ঘটনাবলী শুরু হয়।
মার্চ ১,১৯৭১
মার্চের ৩ তারিখে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এই মর্মে স্থগিত ঘোষণা করে যে,সংবিধানের কার্যবিধি যুক্তিসম্মত ও গ্রহনযোগ্য করবার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনায় সময় দেয়া প্রয়োজন। দেশব্যাপি বিবৃতিতে প্রেসিডেন্ট জাতীয় এবং প্রাদেশিক নির্বাচন আটকে রাখার কারণ ব্যাখ্যা করেন এবং ২৫শে মার্চ ১৯৬৯ এ রাষ্ট্রপতি হবার পর ক্ষমতা হস্তান্তরের যে প্রতিজ্ঞা তিনি করেছেন তাঁর ঊল্লেখ করেন।এবং তিনি তাঁর প্রতিশ্রুতি রাখতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞবদ্ধ বলে ব্যাক্ত করেন।
মার্চ ২
আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিবুর জাতীয় পরিষদের উদ্বোধনী অধিবেশন স্থগিতের সমালোচনা করেন,এবং এর প্রেক্ষিতে পূর্ব পাকিস্তানে একটি সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেন।তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকাতে পরিপূর্ণ ধর্মঘট পালিত হয়। লুটপাট,অগ্নিসংযোগ এবং সহিংসতার কিছু ঘটনা ঢাকা এবং অন্যান্য প্রদেশ থেকে জানান হয়।অবাঙ্গালি ব্যাবসায়ি মালিকানাধীন দোকান লুটপাট হয়* পূর্ব পাকিস্তানে পরিবহন,ব্যবসা,শিল্প এবং আকাশ সেবা সম্পূর্নভাবে বন্ধ হয়ে যায়। মুজিবুর রহমান জাতীয় পরিষদের অনুষ্ঠান স্থগিতের কারনে ফেডারেল সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলন চালু করবেন বলে পুনর্ব্যাক্ত করেন। তিনি মার্চের ৩ তারিখে প্রদেশ ব্যাপী হরতালের আহ্বান করেন এবং মার্চের ৭ তারিখে প্রকাশ্যে তিনি তাঁর কর্মসুচি ব্যাক্ত করবেন। ঢাকার কিছু অংশে সংঘর্ষের কারনে ইস্পাত শিরোস্ত্রান পরিহিত দাঙ্গা পুলিশের টহল চলে বিকালে এবং সন্ধ্যায় মুজিবুর রহমানের অনুগামীদের দ্বারা লুটপাটের এবং ঢাকায় আরোপিত সহিংসতার কারনে কারফিউ জারি হয়।
মার্চ ৩
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আজ সংসদীয় দলের নির্বাচিত ১২ সদস্যকে সংবিধানের অচলাবস্থা নিরসনের উপায় নিয়ে আলোচনার স্বার্থে জাতীয় পরিষদে সাক্ষাতের জন্য ঢাকায় মার্চের ১০ তারিখে আসবার ব্যাক্তিগত আমন্ত্রণ জানান।তিনি আরও বলেন যে ঢাকায় আমন্ত্রিত সাংসদীয় নেতাদের প্রত্যাশিত গোলটেবিল বৈঠকের আহ্বানের পর জাতীয় পরিষদের প্রস্তাবনায় অগ্রগতি হবে বলে তিনি মনে করেন। অন্যান্য সকল রাজনৈতিক নেতারা আমন্ত্রন গ্রহণ করলেও শেখ মুজিবুর রহমান ,আওয়ামী লীগ সভাপতি, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের গোলটেবিল বৈঠক প্রত্যাখ্যান করেন। শেখ মুজিবুরের আহ্বানে প্রদেশব্যাপী পালিত হওয়া ধর্মঘটের জের ধরে পূর্ব পাকিস্তানে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে সাধারণ হরতাল পালিত হয় এবং কিছু জায়গায় অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনাও পরিলক্ষিত হয়।দাঙ্গাকারীরা অ-বাঙ্গালী মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোতে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ অব্যাহত রাখল। আওয়ামী লীগ ক্যাডারদের দাঙ্গা থেকে বেসামরিক প্রশাসনদের বিরত করা হয়েছে।
[ ফুট নোটঃ বিহারি এবং অন্যরা যারা ৫,০০০,০০০ এর ও বেশি সংখ্যালঘুতা সৃষ্টি করে পুর্ব পাকিস্তানে]
মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন যে তিনি বাংলাদেশের (পূর্ব পাকিস্তান) জনগনের অধিকার আদায়ের জন্য সত্যাগ্রহ (অসহযোগ আন্দোলন) আয়োজন করেন।
মার্চ ৪
পাকিস্তান সরকারের সাথে অসহযোগের জন্য আওয়ামী লীগের সহায়তায় পূর্ব পাকিস্তানে ডাকা ধর্মঘটের পর্যালোচনা করা হয়। প্রদেশের অভ্যন্তর থেকে ব্যাপক সহিংসতার ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করা হয়।
মার্চ ৫
পূর্ব পাকিস্তানে ধর্মঘট অব্যহত থাকল আর বেসামরিক প্রশাসন হয়ে রইল পক্ষাঘাতগ্রস্ত। আওয়ামী লীগের অসহযোগ আন্দোলনের ফলে পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের দূরালাপনি অবস্থা স্থির হয়ে রইল। ঢাকা শহরে সহিংসতা নিয়ন্ত্রনে আনতে দুই দিন পূর্বে মোতায়েন করা সেনা ইউনিট কে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। ব্যাপক সহিংসতা ও অনাচারের ভিত্তিতে রাজশাহী ও রংপুরের জনবহুল এলাকাগুলোতে সান্ধ্য আইন জারি করা হয়। অবাঙালী মালিকানাধীন বানিজ্যিক স্থাপনাগুলোতে বাঙ্গালিরা লুন্ঠন চালায়। শুধুমাত্র আওয়ামী লীগের ঘোষিত আন্দোলনের সমর্থনে সমগ্র পুর্ব পাকিস্তানের যোগাযোগ ব্যাবস্থা বহির্বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয় যেন বাহিরের কোন বার্তা গ্রহণ এবং প্রেরন করা সম্ভবপর না হয়।
মার্চ ৬
জাতির উদ্দেশ্যে সম্প্রচারিত এক ভাষণে,প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করেন প্রথম সংবিধান তৈরির জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ২৫শে মার্চ অনুষ্ঠিত হবে। তিনি জাতীয় পরিষদের ৩মার্চের অধিবেশন স্থগিত করায় আওয়ামী লিগের নেতৃত্বের অযৌক্তিকতা নিয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যাক্ত করেন। আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের ১০ই মার্চ ঢাকায় সংসদীয় নেতাদের সাথে গোলটেবিল বৈঠকের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যানের ব্যাপারেও তিনি আক্ষেপ প্রকাশ করেন। তিনি জানান জনগনের নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের শান্তিপুর্ণ পদক্ষেপ তিনি গ্রহণ করেছিলেন।তিনি আরও জোর দিয়ে বলেন,লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্কের পরিচারণায় সঙ্গতিপুর্ণভাবে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে তাঁর সাথে পাকিস্তানের জাতীয় অখন্ডতা সংরক্ষনে তিনি পরমভাবে অঙ্গিকারবদ্ধ।
আওয়ামী লীগের আদেশে পূর্ব পাকিস্তানে ধর্মঘট এখনো আব্যাহত। প্রশাসনেও নিশ্চুপ অবস্থা বিরাজমান। স্বাভাবিক ব্যাংকিং কর্মকান্ড আওয়ামী লীগের হস্তক্ষেপে বাধাগ্রস্থ হচ্ছিল। অনাচার,অগ্নিসংযোগ ও সহিংসতার আরও খবর দেশের অভ্যন্তর থেকে আসতে থাকে। বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যাক্তি মালাকানাধীন বাড়ি –ঘর লুটপাট হতে থাকে। উৎপাদন শিল্প সংক্রান্ত কার্যকলাপ বন্ধ হয়ে যায়। ঢাকায় অবস্থিত ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের ৩২৫ জন বন্দী অতিরিক্ত ক্ষমতাসীন কারাগার রক্ষীবাহিনীর মাধ্যমে জেল থেকে পালিয়ে যায়। সাত জন বন্দী পালাবার সময় কারারক্ষী বাহিনীর হাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। পরবর্তিতে,পালাতে সক্ষম হওয়া বন্দিদের ঢাকার রাস্তায় মিছিল করতে দেখা যায় এবং স্থানীয় পুলিশ এই ব্যাপারে ব্যাবস্থা গ্রহণ করতে আতঙ্ক বোধ করে।
আওয়ামী লীগ একটি সম্পূর্ণ সদ্রিশ্য প্রশাসন ব্যাবস্থা গড়ে তোলে।
.
৭ই মার্চ
ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের এক জনসভায়, আওয়ামীলীগের সভাপতি শেখ মুজিবর রহমান বক্তৃতা দান কালে ঘোষনা করেন যে,তার দ্বারা প্রস্তাবিত ৪টি শর্ত পূরন করা না হলে,নির্ধারিত ২৫শে মার্চের জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে তিনি যোগদান করবেন না । শর্ত ৪টি হলো-
সামরিক আইনের প্রত্যাহার
ব্যারাকে সৈন্য প্রেরন
সেনা বাহিনীর গুলিতে হত্যা মামলার তদন্ত
জনসাধারনের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে তাৎক্ষনিক ক্ষমতা হস্তান্তর
তিনি আরো বলেন, পরবর্তী পদক্ষেপ হিসাবে অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। দাবী মানার লক্ষ্যে, চাপ সৃষ্টির জন্য শেখ মুজিব পুর্ব পাকিস্তানের জনগনকে কর প্রদানে বিরত থাকতে বলেন এবং প্রশাষনিক ও বিচার সংক্রান্ত দপ্তর সমুহে কাজ না করার নির্দেশ জানানো হয় আওয়ামী লীগ থেকে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোকে বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়া হয়। সরকারী বেসরকারী ভবন গুলোতে কালো প্রতিবাদ পতাকা উত্তোলনের নির্দেশ দেয়া হয় । প্রেস বিজ্ঞপ্তি তে বলা হয় এই অসহযোগ আন্দোলন এবং ব্যাবসা বানিজ্যের কাজ বন্ধের ফলে কোটি কোটি ডলারের লোকসান হয়।
৮ই মার্চ
আওয়ামী লীগের অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহত। ঢাকার সামরিক আইন প্রশাষনের এক ঘোষনায় বলা হয় ৬ দিন ব্যাপী বিক্ষোভের ফলে প্রদেশে ১৭২ জন নিহত এবং ৫৮ জন আহত হয়েছে। বিবৃতিতে আরো বলা হয় যে , সেনা মোতায়েন এর ফলে হতাহতে সংখ্যা মৃত ২৩ জন এবং আহত ২৬ জন।
পূর্ব পাকিস্তান হতে এক বিদেশী সংবাদ পত্রের প্রতিবেদনে বলা হয় ২ মার্চ আওয়ামী লীগের সকাল সন্ধ্যা হরতাল আহবানে ব্যাপক দৌরাত্ন , অগ্নি সংযোগ , লুটপাট হয়।
সাংবিধানিক বিশেষজ্ঞদের মতে, আওয়ামী লীগের অবিলম্বে সামরিক আইন প্রত্যাহারের দাবী এবং জাতীয় সমাবেশে জনগন নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর ছিলো অযৌক্তিক। কারন এটি ১৯৭০ এর মার্চে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের জারি কৃত আইনের কাঠামোর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা। যার ভিত্তিতেই ডিসেম্বরের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
মার্চ ৯
পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামি লীগের অবরোধ অব্যাহত থাকার পাশাপাশি আওয়ামী লীগ ক্যাডার রা প্রশাষনিক কার্যক্রম ও চালিয়ে যায়। অগনিত সহিংসতা ও অগ্নিসংযোগের রিপোর্ট পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন জায়গা হতে গৃহীত হয়। অর্থনৈতিক অবস্থার দিনকে দিন অবনতি হতে থাকে। শিল্প ও বানিজ্য বিকল হয়ে পরে। উচ্ছৃংখল চরমপন্থীরা অবাংগালীদের সাথে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারনে, তারা পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করা আরম্ভ করে। আওয়ামী লীগের অবরোধের কারনে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার যাবতীয় ব্যাংকিং কার্যক্রম স্থগিত হয়ে পড়ে
মার্চ ১০-১৪
আওয়ামী লীগের অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহত। বেসামরিক প্রশাষন পঙ্গু হয়ে পরেছে। আদালতের কাজ স্থগিত। ভয়ে, আওয়ামী লীগের আহবানে সাড়া দিয়ে জনগন পশ্চিম পাকিস্তান কে বকেয়া যুক্ত রাষ্ট্রীয় কর প্রদান বন্ধ করে দেয়। ঢাকা বিমান বন্দরে ভীত সন্ত্রস্ত অবাংগালী লোকদের পাকিস্তান এয়ারলাইন্সে পূর্ব পাকিস্তানের জনাকীর্ন ফ্লাইটে প্যাসেজের দাবীতে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। আওয়ামী লীগের অসহযোগ আন্দোলনের ফলে পূর্ব পাকিস্তান এবং পাশ্চিম পাকিস্তানের ৪টি প্রদেশে টেলি যোগাযোগ ব্যাবস্থা বন্ধ হয়ে যায়। চরমপন্থীরা বিশাল আকারে অনেক স্থানের বানিজ্যিক ব্যাবস্থাপনা ও ব্যাবসায়ে লুটপাট শুরু করে। ক্রম বর্ধ্মান অরাজকতার জন্যে বিদেশী নাগরিক এবং জাতিসংঘের কর্মীরা সবাই পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করা শুরু করে। সেনাবাহিনী সাধারন জনতার সাথে সংঘর্ষ গুলো এড়িয়ে চলে এবং ফেডারেল সরকারের নির্দেশানুযায়ী সাড়া দিয়ে সেনানিবাসেই অবস্থান করে নিজেদের কঠোর সংবরন করে। আওয়ামী লীগ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ৪টি প্রদেশের মধ্যকার ব্যাংকিং ও বানিজ্যিক লেনদেনে বাতা প্রদান করে এবং আন্ত টেলিযোগাযোগ ব্যাবস্থার অনুপস্থিতিতে শিল্প ও বানিজ্য ব্যাবস্থা পঙ্গু হয়ে যায়। অবাঙ্গালিদের বিরুদ্ধে হিংস্রতা ও অনাচার ছড়িয়ে পড়ার প্রতিবেদন গুলো সমস্ত পুর্ব পাকিস্তান হতে গৃহীত হয়। অনেক জায়গায় আসামীরা জেইল থেকে পালিয়ে যায়।
মার্চ১৫-২০
শেখ মুজিবর রহমানের সাথে আলাপ করতে ১৫ই মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় আসেন ,যাতে শেখ মুজিব জাতীয় পরিষ্পদের অধিবেশনে যোগদান করেন এবং অসহযোগ আন্দোলন বন্ধ করেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান রাষ্ট্রপতি ভবনে শেখ মুজিবের সাথে আলাপ করেন। পরবর্তীতে, পাকিস্তানের সাবেক প্রধান বিচারপতি ( বিচারপতি এ আর কর্নেলিয়াস) সহ প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টাদের একটি দল কে মনোনীত করা হয়, শেখ মুজিবর রহমান কতৃক নিযুক্ত মধ্যস্থতাকারী একটি দলের সাথে আলোচনা পরিচালনা করার জন্য সেই সাথে ৪টি পূর্ব শর্ত গ্রহন পুর্বক শেখ মুজিব কে জাতীয় সমাবেশে অংশগ্রহনের সুযোগ দেয়া হবে। শেখ মুজিব আবারো দাবী করেন ছয় দফার কর্মসূচির আওতায় পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাষন ব্যাবস্থা। তার সাথে আলাপের পর, সেনা বাহিণী ) পুলিশের গুলিবর্ষনের অভিযোগ তদন্তের জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সশস্ত্র বাহীনীর প্রতিনিধি, সিভিল প্রশাষন এবং আওয়ামী লীগ নিয়ে একটি উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন তদন্ত কমিটি গঠন করেন। কিন্তু শেখ মুজিব ঘোষনা দেন তিনি এই তদন্ত কমিটি নিয়ে সন্তুষ্ট নন তাই তিনি সহিযোগিতা করতে অস্বীকৃতি জানান। এর মধ্যে প্রেসিডেন্ট এবং মুজিবর রহমান এবং তাদের সংশ্লিষ্ট দল গুলোর মধ্যে আলোচনা চলতে থাকে। পূর্ব পাকিস্তানের আর অনেক জায়গা থেকে সহিংসতা ও লুন্ঠনের খবরা খবর নিশ্চিত হয়। সৈন্য বাহিনী তাদের ব্যারাকেই অবস্থান করে বেরিয়ে আসে যতক্ষন না বড় ধরনের সহিংসতার সূত্রপাত হয়। বিদ্রোহী ছাত্রদল গুলো ঘোষনা করে “বাঙ্গালী “ এবং আগামী মোংগলবার থেকে স্কুল, কলেজ, সরকারী বেসরকারী ভবন গুলোতে পাকিস্তানের পতাকা উড়বে না। লুটপাট, অরাজকতা ও সন্ত্রাস পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পরে এবং বেসামরিক প্রশাষন অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে আওয়ামী লীগের অব্যাহত কর্ম সূচির কারণে।
বানিজ্য ও শিল্পে ছত্রভঙ্গ অবস্থা , বিশাল অর্থনৈতিক লোকসান অব্যাহত। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এর সাথে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের আলাপ ও আওয়ামী লীগ কর্তৃক প্রস্তাবিত সাংবিধানিক আইন এর আলোকে আলোচনার জন্য তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের সাংসাদীয় দল সমূহের নেতাদের ঢাকায় আসার আমন্ত্রন জানান।
পুলিশ অস্ত্রাগার ও অস্ত্রের দোকান গুলো থেকে বন্দুক লুটপাট এর প্রতিবেদন গ্রহন করা হয়।
.
মার্চ ২১-২২
পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো সহ অন্যান্য পশ্চিম পাকিস্তানী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ঢাকায় এসেছেন রাষ্ট্রপতির সাথে আলোচনার জন্য।
রাষ্ট্রপতির বাসভবনে ইয়াহিয়া খানের সাথে মুজিবুর রহমান এবং জুলফিকার আলী ভুট্টোর যৌথ সাক্ষাত হয়েছে।
শেখ মুজিবুর রহমানের প্রস্তাব,যা জুলফিকার আলী ভুট্টো নাকচ করে দিয়েছিলেন তা হলো জাতীয় সংসদ দুই ভাগে বিভক্ত হওয়া উচিত,একটি কমিটি পূর্ব পাকিস্তানের জন্য এবং অপরটি পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য। প্রেস রিপোর্ট নির্দেশ করে সমস্যার আপোষে সমাধান এর একটি উপায় বের করা হচ্ছিল।
মার্চ ২৩
২৩ মার্চ,১৯৪০ তারিখে উপমহাদেশের মুসলিম লীগ নেতাদের পাকিস্তান সংকল্প গ্রহণকে স্মরণীয় করে রাখতে ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবস হওয়া সত্ত্বেও শেখ মুজিবুর রহমান এই দিনকে “সংগ্রাম দিবস” হিসেবে পালন করার নির্দেশ দেন।
সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে প্রতিবাদ মিছিল আয়োজন করা হয়েছিল। শেখ মুজিবুর রহমান এক বিশাল গণমিছিলে উপস্থিত ছিলেন যেখানে সবুজ-সোনালী এবং লাল রঙের বাংলাদেশী পতাকাটি উন্মোচন করা হয়। তিনি সেখানে ঘোষণা দেন যে “বাংলাদেশক” অর্জন করতে হলে এখনো আত্মত্যাগ করে যেতে হবে।আওয়ামীলীগ এর ক্যাডাররা এবং ছাত্র প্রতিনিধিগণ পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে সোভিয়েত এবং ব্রিটিশ মিশন সহ কিছু বিদেশী কার্যালয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। উগ্রবাদী আওয়ামীলীগ সমর্থক এবং প্যারা-মিলিটারি বাহিনী কাষ্ঠখন্ড এবং শটগান নিয়ে পাকিস্তান জাতির প্রতিষ্ঠাতা পিতা কায়েদ এ আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর ছবি পদদলিত করে এবং অস্ত্রের দোকান ও অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র লুট করে মিছিল করে যায় “বাংলাদেশ” লাভ এর জন্য।
মার্চ ২৪
জুলফিকার আলী ভুট্টো শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে সরাসরি কথা বলার দাবী জানান কিন্তু শেখ মুজিব সম্মত হননি।
শেখ মুজিবুর রহমানের মনোনীত আওয়ামী নেতৃবৃন্দের একটি দল রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টাদের সাথে চূড়ান্ত আলোচনায় বসেন। সেই দলের নেতা তাজউদ্দীন আহমেদ ঘোষণা দেন যে রাত এগারোটার পর আর কোন আলোচনা হবে না।
সহিংসতা এবং আইনিহীনতার আরো রিপোর্ট পাওয়া গিয়েছে। সৈন্যদল একটি বিশাল দলের উপর গুলিবর্ষণ করে যারা শেখ মুজিব এবং রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টাদের মিটিং এর সময়ে ঢাকার নিকটে অবস্থিত একটি অস্ত্র তৈরির কারখানায় হামলা করতে এসেছিলো। আওয়ামী লীগ এর মনোভাব আরো কঠোর হল। আওয়ামী লীগের আপোষহীন মনোভাব এর কারণে সাংবিধানিক আলোচনাগুলো বারবার ভেঙে যাচ্ছিল।
.
২৫ মার্চ
আওয়ামীলীগ নেতারা ২৭শে মার্চ নতুন ধর্মঘটের ডাক দেন। আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। আওয়ামীলীগ নেতারা কোন ধরেনের ছাড় অস্বীকৃতি জানান। তাঁদের দাবি ছিল সামরিক আইন প্রত্যাহারের ঘোষণা এবং পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামীলীগ সরকারের ক্ষমতায়ন। এই পরিস্থিতিতে ঐ দিন সন্ধ্যায় রাষ্ট্রপতি করাচী ফিরে যান।
পরের রাতে, সামরিক বাহিনী আওয়ামীলীগ চরমপন্থিদের বিরুদ্ধে অভিযান চালায়। মধ্যরাতের কিছু পরেই শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ঢাকার বাসভবনে গ্রাফতার হন।
২৬শে মার্চ
রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। তিনি ঢাকায় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্থান্তরের জন্য শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে সমঝোতায় আসতে কি কি পদক্ষেপ নিয়েছেন তার একটি সারসংক্ষেপ দেন। তিনি বলেন, আওয়ামীলীগের বিদ্রোহ বিশ্বাসঘাতকতা। তিনি বলেন, সামরিক বাহিনীর উপর নির্দেশ ছিল পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষা করা। আওয়ামীলীগের অবাধ্যতা বন্ধ করতেই সামরিক ব্যাবস্থা নেয়া হয়। সব ধরণের রাজনৈতিক কর্মকান্ড নিষিদ্ধ করা হয় কিন্তু জাতিয় এবং প্রাদেশিক সমাবেশ বাতিল করা হয় নি। রাষ্ট্রপতি বলেন যে তার উদ্দেশ্য হল নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার সাথে সাথে ক্ষমতা হস্তান্তর করা এবং এর জন্য প্রয়োজনীয় সব ধরণের ব্যাবস্থা তিনি নেবেন।
.
.
শিরোনামঃ ১৩২। পূর্ব পাকিস্তান সংকট সম্পর্কে পাকিস্তান সরকারের বক্তব্য
সূত্রঃ পাকিস্তান সরকারের প্রচার পুস্তিকা
তারিখঃ ৫ মে, ১৯৭১
.
পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান সংকট ১৪ আগস্ট ১৯৪৭ সালে দশকের পর দশক নিরন্তর সংগ্রামের পর এই উপমহাদেশের মুসলমানদের সামগ্রিক ইচ্ছের পরিপ্রেক্ষিতে সার্বভৌম পাকিস্তান রাষ্ট্রের পথ চলা শুরু। পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানেরাই পাকিস্তানের জন্য আন্দোলনের সম্মুখভাগে ছিলো কারন হিন্দু সাম্রাজ্যবাদীদের হাতে তারাই সবচেয়ে বেশি নিগৃহীত হচ্ছিলো, যারা শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে কলকাতার শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য কাঁচামালের যোগান দিয়ে আসছে। হিন্দু নেতৃত্ব থেকে নিষ্কৃত হবার এটি ছিলো তাদের দ্বিতীয় প্রচেষ্টা। প্রথমবার ৪২ বছর আগে পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্বেই তারা পশ্চিমবংগ থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিলো। বাঙালী মুসলমানদের আতঙ্কজনক দুর্দশা দেখে ইন্ডিয়ার ব্রিটিশ ভাইসরয় লর্ড কার্জন ১৯০৫ সালে পূর্ব বাংলায় একটি পৃথক প্রদেশ গঠন করেন। বাঙালী হিন্দু, যারা বেপরোয়া ভাবে সমগ্র বাংলার শিল্পব্যবস্হা কব্জায় নিতে চাচ্ছিল, তাদের তীব্র বিক্ষোভের মুখে ৬ বছর পরেই বংগভঙ্গ রদ হয়ে যায়। ইন্দো পাকিস্তান সমস্যার মূল কারন ছিলো ইন্ডিয়া কখনো পাকিস্তানকে গুরুত্ব দিতে চাইতোনা। এমনকি বল্লবভাই প্যাটেলের মতো তাদের দ্বায়িত্বশীল উচ্চপদস্হ নেতা প্রকাশ্যে ভারতকে পুনরায় একত্রিত করে এর নাম দিতে চায় ‘হিন্দু মাতৃভূমি’। এই ইচ্ছে পূরণ করার জন্যে ইন্ডিয়া পাকিস্তানের জনগনের আনুগত্য ধ্বংসের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সে পাকিস্তানে আসা জলপ্রবাহ বন্ধ করে দিয়েছে। এবং সে তার অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে বলে চিত্কাের করে লাখ লাখ মুসলমান শরনার্থীকে পাকিস্তান পাঠিয়ে দিচ্ছে। ১৯৬৫ সালে আন্তর্জাতিক সীমানায় সে সরাসরি অনধিকার হস্তক্ষেপ করে পশ্চিম পাকিস্তানে অবরোধ আরোপ করে। এখন পূর্ব পাকিস্তানকে ধ্বংস করে সে আবার পাকিস্তানের ঐক্য বিনষ্ট করতে চায়। অন্য একদিন ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ ডিফেন্স স্টাডিজ এর পরিচালক মিস্টার সুব্রামানিয়াম ইন্সটিটিউটের এক আন্তজার্তিক বিষয়ক এক অনষ্ঠানে বলেন, “ইন্ডিয়াকে যে বাস্তবতাটা অনুধাবন করতে হবে তা হলো পাকিস্তান ভেঙে যাওয়া আমাদের জন্য লাভজনক, এবং এরচেয়ে ভালো সুযোগ আর কখনোই আসবেনা।” এই সুযোগ গ্রহন করে ইন্ডিয়া পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তে শুধু একলাখ সৈন্য জমা করেনি, পূর্ব পাকিস্তানে ধীরে ধীরে অস্ত্র অণুপ্রবেশ করিয়ে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো প্রকাশ করে যাচ্ছে, দীর্ঘসময় ধরে পূর্বপাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ইন্ডিয়ার কাছ থেকে অস্ত্র পেয়ে আসছে। এবং তথাকথিত বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীরা কলকাতার একটি সরকারী হোস্টেলে দিনযাপন করছে। এটা পরিষ্কার এবং প্রমানিত হচ্ছে, ইন্ডিয়ার মাটি পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলনের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
এটা অগ্রাহ্য করা যাবেনা যে ইন্ডিয়া তার সাথে পূর্ব পাকিস্তানের কিছু প্রতারক এবং সহযোগী পেয়েছে।
.
.
পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ অকৃত্তিম শোক এবং সমবেদনার এই সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানের সকল কিছু স্বাভাবিক করতে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ।কিন্তু সমস্যা হচ্ছে দুই দশকের অবহেলা দুই শতাব্দীতে মিটে যাবার নয়।এবং এর জন্য কোন তাৎক্ষণিক সাংবিধানিক অথবা অর্থনৈতিক সমাধানের উপায় নেই।হিন্দু শিল্পপতিদের কারণে এই এলাকা পশ্চাদপদ হয়ে থাকে এবং ব্রিটিশ আমলে পাট উতপাদনের মাধ্যমে নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষনের জন্য।ঢাকার প্রেসও এমনকি পাকা করার অনুমতি দেয়া হয় নি।বিভক্তির সময় থেকে পুর্ব পাকিস্তান একবারে শুরু থেকে শুরু করল।আজ পাকিস্তান হাজার হাজার শিল্প ইউনিট থেকে শুরু করে বিশ্বের সর্ববৃহৎ পাটকল,বৃহত্তম সার কারখানা এবং তার প্রথম স্টিল প্ল্যান্টে বিস্তার ঘটিয়েছে।এই ব্যাপারগুলো কোন প্রসন্নতার কারণে উল্লেখ করা হচ্ছে না,বরং বুঝানো হচ্ছে যে পূর্ব পাকিস্তান কে কোন পর্যায় থেকে শুরু করে পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে এক কাতারে দাঁড়াতে হয়েছে,ইতোমধ্যে স্বাধীনতার স্বাদে আস্বাদিত হওয়া হওয়া স্বত্তেও সত্যটা হল,পাকিস্তান বহু বছর ধরে রাজ্যের প্রধান এবং প্রধানমন্ত্রীদের দ্বারা পূর্ব পাকিস্তান থেকে শাসিত হয়েছে।
এছাড়াও পূর্ব পাকিস্তানে সবচেয়ে মারাত্মক সমস্যা হল জনসংখ্যা সমস্যা প্রতি বর্গমিটারে ১৪০০জন,বিশ্বের সর্বোচ্চ ঘনবসতিমূলক এলাকা।আরও একটি বড় সমস্যা হল ঘূর্ণিঝড় ও বন্যার প্রকোপ,যা মানুষ এখনও আয়ত্বে আনতে পারে নি।
এখানেও ভারতের একগুঁয়েমির কারণে পাকিস্তানের কাজকে কঠিন করেছে।তারা উজানে গঙ্গার উপরে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করে,নিম্ন তিরবর্তী এলাকার উপর পাকিস্তানের অধিকারের আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘণ করে।পূর্ব পাকিস্তানের মঙ্গল কামনায় ভারতের দায়বদ্ধতার কতটুকু হৃদ্যতার পরিচয় দিয়েছে তা এই একটি কাজেই পরিষ্কার হয়ে যায়।এই বাঁধের কারণে পূর্ব পাকিস্তানের হাজার হাজার একর জমি ঝুঁকির মুখে পড়বে আর অনাহারে পরবে লাখ লাখ মানুষ।
এইসব তথ্য পূর্ব পাকিস্তানের অসন্তোষ ঘোলাটে করবার জন্য বলা হচ্ছে না বরং, আওয়ামী লীগ ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে বের হয়ে কিভাবে অর্থনৈতিক অসন্তোষকে কাজে লাগিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পরিপূর্নভাবে আন্দোলনের সৃষ্টি করেন,যেহেতু বিষয়টা রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ধারার ছয়টি বিষয়ের সাথে জড়িত এবং ভোটসংগ্রহের একটি উপায়।
মুলত দাবী করা হয়,ছয়টি দফা দাবী আসলে পূর্ব পাকিস্তানের উপর স্বায়ত্বস্বাশনের মূলনকশা ব্যাতিত কিছুই নয়।উপরন্তু ভোটের প্রচারাভিযান,যা কিনা এক বছর ধরে চলছিল এর মাঝে আওয়ামীলীগ নেতৃত্ব এটা প্রমাণ করতে স্বমর্থ হয় যে, তাদের ছয়-দফা দাবী “ঈশ্বরের বাক্য” নয় এবং তারা আপোষের জন্য তৈরি এবং সমালোচকদের মতে পাকিস্তানের অবকাঠামোর বাইরে কিছু করা হলে ছয়-দফা দাবী ক্ষতিকর হতে পারে।এই ব্যাপারটিই আওয়ামী লীগ কে নির্বাচনে এগিয়ে রাখল, এবং সেই অনুসারে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে আপোষের জন্য বিবৃতি জারি করল,উভয়ই প্রস্তুত ছিল লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্কের আন্ডারে সংবিধান গঠন করতে এবং সরকার প্রতিষ্ঠা করতে।
এটাকে বলা যেতে পারে লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক এর উল্লেখ করা যেতে পারে যার অধীনে আওয়ামী লীগ এবং অন্যান্য বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলো পরিচ্ছন্ন ও দ্ব্যার্থহীনভাবে নির্বাচনে অংশ নেয় যেখানে একতা,সংহতি এবং পাকিস্তানের অখন্ডতা যে কোণ সাংবিধানিক ব্যাবস্থার উপর করা যেতে পারে।
.
তবে,যত দ্রুত শেখ মুজিবুর রহমান স্বায়ত্বশাসনের পক্ষে নির্বাচকমণ্ডলীর রায় সুরক্ষিত করেন,তেমনি ছয়টি বিষয়ের এমনভাবে সম্প্রসারণ এবং ব্যাখ্যা করেন যেন নির্বাচকমণ্ডলীর এই বিষয়ে কোন চুক্তি করেন নাই,এবং এমন অনড় একটি অবস্থার সৃষ্টি করেন যেখানে আপোষের জন্য আর কোন সুযোগ নেই।তার ভঙ্গী ছিল এমন যে,’হয় গ্রহণ করুন অথবা বর্জন করুন’।একের পর এক রাজনৈতিক নেতা এমনকি পশ্চিম পাকিস্তানের বড় বড় রাজনৈতিক দলের নেতারা ঢাকায় আসছিলেন তার সাথে এই ব্যাপার নিয়ে সমঝোতা করবার জন্য।পাকিস্তানের রাস্ট্রপতি বেশ কয়েকবার সাক্ষাত করতে আসেন কিন্তু কোন লাভ হয় নি।জনগণ সমর্থিত প্রধানমন্ত্রী হতে যাওয়া শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের এইসকল বিষয়ে কোন প্রকার আগ্রহ প্রকাশ করেন নাই যা কিনা দেশের সাধারণ জনগণ উৎসুকভাবে আশা করছিল।তিনি পশ্চিম পাকিস্তান সফরও প্রত্যাখ্যান করেন।জাতীয় পরিষদের সাময়িক স্থগিতকরণ ঘোষণা করেন এবং আইনসম্মতভাবে সংবিধান তৈরির জন্য অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের সাথে আলোচনার ব্যবস্থার সিধান্ত গ্রহণ করেন।
কি অনুসৃত হচ্ছিল সবার জানা ছিল।সকল ধরনের অপরাধ বেড়ে চরম আকার ধারণ করে।জনগণ রাস্তায় নেমে আসে,আগ্নিসংযোগ,হত্যা,লুন্ঠন হতে থাকে।পুর্ব-পরিকল্পনা অনুযায়ী শ্রমিকরা কারখানা থেকে বের হয়ে যায়,ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায় এবং সরকারি চাকুরিজিবিরা অফিসে অনুপস্থিত হতে থাকেন।যারা স্বেচ্ছায় এই সহযোগিতা করতে পারছিল না তাদেরকে নাৎসি সেনাবাহিনীর অস্ত্রের মুখে এইসব করতে বাধ্য করা হয়।এরকম সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের কারণে সাধারণ জীবন যাপন স্থবির হয়ে যায়।আইনগত ভাবে গঠিত সরকারি চলমান প্রশাসনের পরিবর্তে আওয়ামী লীগের সদর দপ্তর থেকে ট্যাক্স এবং অর্থ স্তানান্তরকরণের উপর ফরমান জারি করা হয় যেন কেউ কেন্দ্রীয় কোষাগার থেকে প্রাদেষিক একাউন্টে প্রেরনের জন্য সরকারি ব্যাংকের বদলে বেসরকারি ব্যাংক ব্যাবহার করে।১লা মার্চ থেকে ২৫শে মার্চ বেসামরিক প্রশাসন পুরো পঙ্গু হয়ে পড়ে।হত্যা, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ, লুন্ঠনের খবরের প্রতিবেদন আসতে থাকে প্রদেশ জুড়ে -ঢাকা, খুলনা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট শহ অন্যান্য শহরে ফ্যাসিস্ট হিস্টরিয়ার ঢেঊ উঠে।সেনাবাহিনী যদিও মানসিকভাবে বিচলিত হয়ে ওঠে এবং জাতীয় পতাকা পুড়িয়ে ফেলার খবরে উত্তেজিত হয়ে পড়ে এবং কায়েদ-এ-আযমের ছবি পদদলিত করা হয় এইরকম সময়ে শীর্ষস্থানীয়ভাবে কঠোর আদেশে সম্পুর্নভাবে কোন বিশৃঙ্খলা না করবার জন্য বলা হয়,যেন রাজনৈতিক নেতারা আলোচনার মাধ্যমে আপোষে আসতে পারেন।
নিজের ছয় দাবী নিয়ে অসন্তোষ থাকা শেখ মুজিবুর রহমান এতে আরও ৪টি বিষয় যোগ করেন যেখানে সামরিক আইন এবং অবিলম্বে প্রেসিডেন্সিয়াল ঘোষনার মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।এই অবস্থায় তিনি মূল স্রোতের বিপরীতে যেখানে জাতীয় পরিষদের মাধ্যম ব্যাতিত ক্ষমতা হস্তান্তর সম্ভবপর না সেখানে ঘোষনা দেন যে,যেই পর্যন্ত তার হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা না হবে সেই পর্যন্ত তিনি জাতীয় পরিষদে যাবেন না সংখ্যাগরিষ্ঠ সার্বজনীন প্রাপ্ত বয়স্কতার ভিত্তিতে এবং একজন এক ভোটের মাধ্যমে নিরঙ্কুশ ভাবে জয়লাভ করা সত্ত্বেও।
এটা বুঝাই যাচ্ছে যে,অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়ে জোর প্রদান করেন যেন জাতীয় পরিষদের ব্যাপারটিত অন্তর্বর্তিকালিন সংবিধান তৈরি করে রাষ্ট্রপতির কাছে উত্থাপন করে সম্মতি পাসের আধ্যম ব্যাপারটির বাস্তবায়ন ঘটে।তারা দাবী করেছিলেন যে এই ঘোষণা যে কোন প্রকার আইনি অনুমোদন ব্যাতিত হতে হবে।বিষয়টা মার্শাল ল’ কিংবা জনগণের ইচ্ছের উপর ভিত্তি করে করা হবে না,এতে শূন্যস্থান তৈরি হবে এবং বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হবে।
প্রেসিডেন্ট আরও একবার ঢাকায় আসেন এবং ১০দিনের বৈঠকের পর সমঝোতার প্রচেস্টায় আপোষে আসেন গণতন্ত্র প্রক্রিয়া সংরক্ষণ,ক্ষমতা হস্তান্তর সহজীকরন।আলোচনার সময় শেখ মুজিবুর রহমান চুক্তির মাধ্যমে দুর্বল রাস্ট্রের উপর থেকে সবল রাষ্ট্রের ক্ষমতায়ন সরিয়ে স্বায়ত্বশাসনের ব্যাপারে জোর প্রদান করেন।এর অর্থ দাঁড়ায় প্রস্তাবিত ঘোষণার পর মার্শাল আইন নির্বাপন এবং ক্ষমতা হস্তান্তরের পর, পাকিস্তানের পাঁচটি প্রদেশের এই ভাসমান অবস্থার নিরসন হবে এবং জাতীয় সার্বভৌমত্ব কার্যত বিলীন হবে।
শেখ মুজিবুর রহমান প্রথমাবধি এই দাবী করেন যে জাতীয় পরিষদের জন্য দুইটি কমিটি বসাতে।যার একটি পূর্ব পাকিস্তানের সদস্য এবং অন্যটি পশ্চিম পাকিস্তানের সদস্য নিয়ে গঠিত।পরবর্তিতে তিনি এী দাবীর সংস্কার করে একে দুটি নিয়ম অনুযায়ী দুটি নতুন সংবিধান গঠনের কথাও বলেন।
উদ্দেশ্য ছিল পরিষ্কার;আওয়ামী লীগের চরমপন্থি নেতারা বুঝতে পারেন যে রাস্ট্রপতি কিংবা অন্যান্য রাজনৈতিক নেতারা “সাংবিধানিক বিভক্তি” কখনই একমত হবে না,এবং তাই এই চরমপন্থিরা কোন ধরণের তথ্য কিংবা অনুমোদন ছাড়া এমনকি কোন পদমর্যাদা কিংবা সৈন্যবাহিনী ছাড়া গোপনীয়ভাবে ষড়যন্ত্র হোক অথবা জোর উপায়ে নিজেদের লক্ষ্য অর্জনে অনেকদিন থেকেই প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন,এই গোপন প্রস্তুতি মুলত আগরতলা মামলায় ফাস হলেও ততদিনে এটি পুরোপুরি ভাবে শুরু হয়ে যায়।ভলান্টিয়ার রা প্রতি জেলায় সংগ্রাম পরিষদের অধীনে প্রশিক্ষণ নিচ্ছিল।অস্ত্র এবং গোলাবারুদ ভারত থেকে পাচার করা হয় এবং পুরো প্রদেশ জুড়ে জায়গায় জায়গায় মজুদ করা হয়,এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলেও।২৫ হতে ২৬শে মার্চ মাত্র ৩ঘন্টার ব্যবধানে সুচিন্তিত এবং সুগঠিত ভাবে জগন্নাথ হলের থেকে কামানের বর্ষনের মাধ্যমে পুরো পরিস্থিতি বানচাল করে দিয়ে পুরো শহরের চেহারা পালটে দেয় পশ্চিম পাকিস্তানিরা।
যদিও আওয়ামী লীগের প্ররোচণা ব্যার্থ হয় কিন্তু এটা ছিল অন্বেষিত নাৎসি-কৌশলের আক্রমণ।সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম এবং অকথ্য ন্রশংসতা।আওয়ামী লীগের ফ্যসিবাদি হত্যাকান্ডের প্রকৃত কারণ এখন সুস্পষ্ট।
সকল প্রমাণাদি এই সাক্ষ্যই দিচ্ছিল যে,২৬শে মার্চের স্বল্প কয়েক ঘন্টা সশস্ত্র বিদ্রোহের শুন্য ঘন্টা হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছিল এবং “স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের” আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনী ছিল।এর প্রধান কারন ছিল ঢাকা এবং চট্টগ্রাম দখল করা যেখানে সেনাবাহিনীর আকাশ এবং সমুদ্র বাহিনি পশ্চিম পাকিস্তানের অনুকুলে।সেই সময় সেনাবিহিনি গঠিত হয় ১৮ব্যাটালিয়ন নিয়ে বিভক্ত ছিল যেখানে পশ্চিম পাকিস্তানের ছিল ১২ ব্যাটালিয়ন যারা ধীরে ধীরে ক্যান্টনমেন্টের ভেতর সহ ভারতের বর্ডারে ছড়িয়ে পড়ে।আর তাদের বিরুদ্ধে ছিল ভারত থেকে অনুপ্রবেশকারী এবং পুর্ব পাকিস্তান থেকে পলাতক রা,ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং অন্যান্য সহকারি যোদ্ধারা ভারী মর্টার শেল,আধুনিক অস্ত্র,এবং ভারত সীমান্ত থেকে নির্দিধায় সরবরাহ করা হচ্ছিল।
আওয়ামী লীগের পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সরে আসার পাঁয়তারা তখনও বিদ্যমান।আর ইতিমধ্যে শান্তিপূর্নভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের সব পন্থাই বিফল হয়েছিল;প্রেসিডেন্ট তাই আর্মড ফোর্সকে তার কর্তব্য পালন করতে এবং সম্পুর্নভাবে সরকারের কর্তৃত্ব পুনরুদ্ধারের নির্দেশ দেন।
সেই ডাক আসতেও বেশি দেরি হয় নি।এবং আওয়ামী লীগের কর্মকান্ডের শুন্য ঘন্টা অল্প কিছু সময় আগে আর্মড ফোর্স স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মার্চের ২৫-২৬শে’র মধ্যরাতে পালটা আঘাতের একটি সিরিজের উদ্যেগ নেয় দেশকে বাঁচাবার জন্য।
ভবিষ্যতে কী হবে? ২৬শে মার্চে জাতির উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রপতির আহব্বানের ইঙ্গিত ছিল পরিস্কার:
‘আমি তোমাদের কথা দিচ্ছি, আমার মূল লক্ষ্য একই থাকবে অর্থাৎ জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের। যত তাড়াতাড়ি পরিস্থিতি অনুকুলে আসবে আমি এই বিষয়ের দিকে নতুন পদক্ষেপ নিব।
ফিল্মস বিভাগের দ্বারা পরিচারিত
প্রকাশনা,পাকিস্তান সরকার
করাচি।
.
.
শিরোনামঃ ১৩৩। পুর্ব পাকিস্তানে সন্ত্রাস
সূত্রঃ সরকারী প্রচার পুস্তিকা
তারিখঃ মে, ১৯৭১
পুর্ব পাকিস্তান ডকুমেন্টেশন সিরিজ
আওয়ামী লীগ এবং তার সহযোগীদের দ্বারা সংঘটিত নৃশংসতার উপর বিদেশী সংবাদপত্রের প্রতিবেদন
পুর্ব পাকিস্তানে সন্ত্রাস
ডেইলি মেইল, লন্ডন, ৩ এপ্রিল ১৯৭১:
ব্রায়ান রাইমারঃ
হতভাগ্য মানুষগুলো ছিলো ১৪ জন পাঞ্জাবী ব্যবসায়ী যারা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এসে পূর্বাঞ্চলের যশোর শহরে বসবাস করত।
যশোরে পৌঁছে বিবিসি প্যানারোমা দলের তোলা ছবিতে দেখা যাওয়া এই ব্যবসায়ীদের মিলিশিয়া বাহিনীর সদস্যেরা একত্রিত করে একসাথে বেঁধে হাঁটিয়ে নিয়ে যায়।
কিছুক্ষণ পর পশ্চিমা প্রতিবেদকেরা তাদের লাশ খুঁজে পায়।
তাদের দেহে মারধোর এবং ছুরিকাঘাতের চিহ্ন ছিল। একজন তখনো মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল।
সানডে টাইমস লন্ডন, ৪ এপ্রিল ১৯৭১:
নিকোলাস টমালিনঃ
আমি সেখানে বিবিসি প্যানারোমার সাংবাদিক এলান হার্ট এবং একজন বাংলাভাষী চিত্রগ্রাহক মোহাম্মাদ আমিন এর সাথে ছিলাম।
আমরা ভেবেছিলাম যে সৈন্যরা এবং স্থানীয় জনগণ আক্রমণ শুরু করবে কিন্তু তাদের পরিকল্পনা ছিল ভিন্ন।
সদর দপ্তরে আসা প্রতিটি বহরেই লম্বা, সাধারণত দাঁড়িওয়ালা পাঞ্জাবীরা ছিল। তাদের হাত ছিল বাঁধা এবং বন্দুকের বাট দিয়ে নৃশংসভাবে ঠেলে ঠেলে তাদের এগিয়ে নেয়া হচ্ছিল।
আমরা ভেবেছিলাম পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্যরা আক্রমণ করেছে এবং সে হিসেবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। কিন্তু রাস্তার পাশে সবুজ ফালিতে তাজা ছুরিকাঘাত এবং মুগুর পেটার শিকার মানুষদের তখনো বহমান রক্তের পুকুরে পড়ে থাকতে দেখি।
তাদের মাঝে চারজন তখনো জীবিত ছিল এবং পাশ ফিরে হাত পা ছুঁড়ছিল। কিন্তু কেউ কোন শব্দ করছিল না।
এমতাবস্থায় আমাদের আওয়ামী লীগ গাইড হিস্টিরিয়া গ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং আমাদের দ্রুত ফেরত নিয়ে যেতে চায়। সে বলল যে এই জায়গাটা নিরাপদ নয়, পশ্চিম পাকিস্তানিরা আক্রমণ করছে। সে আমাদেরকে প্রায় ঠেলেই মৃতদেহগুলোর কাছ থেকে সরিয়ে নিল।
কিন্তু হঠাৎ করেই আমি, এলান হার্ট এবং মোহাম্মাদ বুঝতে পারলাম যে এই মৃত এবং মৃতপ্রায় লোকগুলো আসলে কারা। তারা বাঙ্গালী ছিলো না। আমরা নিশ্চিত ছিলাম যে এক ঘন্টা আগে আমরা যেসকল বন্দী পাঞ্জাবীদেরকে দেখেছিলাম, এরাই তারা।
এই নিহতদেরকে স্থানীয় বাঙালি অনিয়মিতদের কেউই হত্যা করেছিল কারণ ঐদিন কেন্দ্রীয় যশোরে একমাত্র তাদেরই উপস্থিতি ছিল।
আওয়ামী রাজনীতিক ও জনতার সন্ত্রাস ও আচরণ অবস্থানগত প্রমাণ হিসেবে কাজ করে এবং আমাদের চিত্রগ্রাহক আমিন, যে পাকিস্তানিদের ধরণ জানত, সেও নিশ্চিত করে যে নিহত ব্যাক্তিরা পাঞ্জাবীই ছিল।
স্থানীয় লোকেরা আমাদের হুমকি দেয়া শুরু করলে আমরা সেই স্থান ত্যাগ করতে বাধ্য হই। তবে চলে আসবার সময়েও আমরা দেখতে পাই আরও ৪০ জন পাঞ্জাবী `গুপ্তচর’ কে সারিবদ্ধভাবে সে একই সবুজ ফালির দিকে হাত মাথার উপর তুলে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড, কলকাতা, ৪ এপ্রিল ১৯৭১:
তুষার পাত্রানাভিসঃ
দর্শনা চিনি কারখানার প্রায় ৫০০ অবাঙ্গালী শ্রমিক এখন একটি কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে বন্দী আছে।
স্টেটসম্যান, নয়াদিল্লি, ৪ এপ্রিল ১৯৭১:
পিটার হ্যাজেলহার্ট:
এখন পূর্বাংশে আটকে পড়া লক্ষ লক্ষ অবাঙালি মুসলমান সর্বদাই পূর্ব-পশ্চিমের মধ্যেকার উত্তেজনার ফলে ভোগান্তির স্বীকার হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে আশংকা করা হচ্ছে যে বাঙ্গালীরা এই সুবিশাল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
দ্যা টাইমস, লন্ডন, ৬ এপ্রিল ১৯৭১:
দেশ বিভাগের সময় যে হাজার হাজার অসহায় মুসলিম উদ্বাস্তু বাংলায় স্থায়ী হয়েছিল খবরে প্রকাশ গত এক সপ্তাহ ধরে তারা ক্ষিপ্ত বাঙালিদের হাতে গণহত্যার স্বীকার হচ্ছে।
এ সপ্তাহে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে ঢুকে পড়া বিহারী মুসলিম উদ্বাস্তু আজ হিলি দিয়ে ইন্দো-পাকিস্তান ফ্রন্টিয়ার অতিক্রম করা এক কমবয়সী ব্রিটিশ টেকনিশিয়ান গণহত্যার খবরটি নিশ্চিত করেছে।
টেকনিশিয়ান ছেলেটি গৃহযুদ্ধ শুরু হলে বাংলার উত্তরাঞ্চলে আটকা পড়ে গিয়েছিল। সে তার নিজের পরিচয় প্রকাশ করতে চায়নি কারণ তাকে বাংলায় ফিরতে হবে।
তার কথামতে কেবলমাত্র উত্তর-পশ্চিমের এক শহর দিনাজপুরেই শত শত অবাঙালি মুসলমানের মৃত্যু ঘটেছে। “সৈন্যরা চলে যাবার পর ক্ষুদ্ধ জনতা বিহার থেকে আগত অবাঙালি মুসলমানদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। আমি জানিনা কতজন মারা গিয়েছে, কিন্তু আমি সারারাত ধরে তাদের আর্তচিৎকার শুনতে পেয়েছি।”
ডেইলি টেলিগ্রাফ, লন্ডন, ৭ এপ্রিল ১৯৭১:
স্টাফ রিপোর্টারঃ
তিনি (ডান্ডির একজন অধিবাসী) বর্ণনা দেন ইয়াহিয়ার ২৫ মার্চের ভাষণের পর কেমন করে ক্ষুদ্ধ জনতা কারখানায় প্রবেশ করে।
“গুন্ডারা তাণ্ডলীলা শুরু করে। তারা কারখানা ও অফিসে লুটপাট চালায়, সামনে পেয়েছে এমন সকল পশুকে হত্যা করে এবং তারপর তারা মানুষ হত্যা করতে শুরু করে।”
“তারা আমার ৪ জন পশ্চিম পাকিস্তানী পরিচালকের বাড়িতে যায়, সেখানে আগুন লাগিয়ে দিয়ে তাদেরকে পরিবারসহ(সব মিলিয়ে ৩০ জন) জীবন্ত পুড়িয়ে মারে। যারা দৌড়ে পালিয়ে যেতে চাচ্ছিল, তাদেরকে খুন করা হয়।”
নর্দান ইকো, ডার্লিংটন, ডারহাম, ৭ই এপ্রিল ১৯৭১:
গতকাল কোলকাতায় নোঙ্গর করা একটি বৃটিশ জাহাজের যাত্রীরা পূর্ব পাকিস্তানের চট্টগ্রাম বন্দরে সংগঠিত গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজের বিবরণ দেন।
ইউএস এইড প্রোজেক্টে কর্মরত লিওন লামসডেন নামক একজন আমেরিকান প্রকৌশলী বলেন যে গত সপ্তাহে সেনাবাহিনী এসে পৌঁছার আগের দুই সপ্তাহ ধরে চট্টগ্রামের বাঙালি অধ্যুষিত জনগোষ্ঠী বন্দর এলাকায় পশ্চিম পাকিস্তানীদের জবাই করে হত্যা করছিল।
ডেইলি রেকর্ড গ্লাসগো, ৯ই এপ্রিল ১৯৭১:
স্টাফ রিপোর্টারঃ
পূর্ব পাকিস্তানে সংগঠিত একটি হত্যাকাণ্ড থেকে বেঁচে যাওয়া স্কটল্যান্ডের একজন নাগরিক গত রাতে বর্ণনা করেন কিভাবে তার চোখের সামনেই ক্ষুদ্ধ জনতা তার সকল কর্মীদের পিটিয়ে মারে।
“আমার মিলের কর্মীরা কোনো বাহিনীর সদস্যদের হাতে নয়, বরং কিছু লাগামছাড়া দুষ্কৃতকারীদের হাতে নিহত হয়।”
“তারা আমার লোকেদের লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে মারে। হঠাৎ করে লক্ষ করলাম পুরো মিলের মাঝে আমিই একমাত্র জীবিত ব্যাক্তি।”
নিউজ লেটার, বেলফাস্ট, ৯ এপ্রিল ১৯৭১:
আর এবারনিথিঃ
আমি খুশি হব যদি আপনি আমাকে আপনার সংবাদপত্রের মাধ্যমে ২ এপ্রিল ১৯৭১, শুক্রবার রাত ৯ টার বিবিসি সংবাদের প্রতি সাধারণভাবে জনগণের এবং বিশেষভাবে স্কার-ম্যান ট্রাইব্যুনালের মনোযোগ আকর্ষণের অনুমতি প্রদান করেন।
সংক্ষেপে বলতে গেলে, সেদিন টিভির খবরে দেখা যায় পূর্ব পাকিস্তানের যশোর শহরে দাঙ্গাবাজ জনতা ঘুরে বেড়াচ্ছে। শহরটি সম্পূর্ণভাবে তাদের দখলে ছিল এবং নিরপরাধ প্রতীয়মান হয় এমন একটি বড় সংখ্যক পশ্চিম পাকিস্তানী নাগরিকদের একসাথে জড়ো করে ক্যামেরা কর্মীদের সামনেই কেটে টুকরা টুকরা করে ফেলা হয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ক্যামেরা ঘোরানো ছাড়া এই অনাচার প্রতিরোধের কোনো চেষ্টাই তারা সেদিন করেনি।
সিনার হারাপান, জাকার্তা, ২৪ এপ্রিল, ১৯৭১:
জপি লাস্যুটঃ
বিহারীরা হল সবচাইতে বড় ভুক্তভোগী। তাদের সংখ্যা প্রায় ৮ মিলিয়ন এবং বিশ্বাসের দিক থেকে তারা মুসলিম। দেশ বিভাগের দিনে মানুষগুলো ভারত ছেড়ে চলে আসে। এখন এ মানুষগুলোর জীবন ঝুঁকির সম্মুখীন, কারণ পূর্ব বাংলার লোকেরা এদেরকে গুপ্তচর বলে মনে করছে।
পূর্ব বাংলার লোকেরা প্রতিশোধ নিতে উদগ্রীব, কিন্তু তুলনামূলক ভারী অস্ত্রসমৃদ্ধ পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাদের হত্যা করবার খুব বেশি সুযোগ তারা পায় না। সবচেয়ে সহজ উপায় হল বেসামরিক পাঞ্জাবী এবং বিহারীদের পিছু ধাওয়া করা। এমনকি পার্সিয়ানরাও তাদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়।
একবার সীমান্ত অঞ্চলে আমার এক পার্সিয়ান পরিবারের সাথে পরিচয় হয়। তারা ভারতীয় অভিবাসন চেকপয়েন্ট বেনাপোলের দিকে পালিয়ে যাচ্ছিল। পূর্ব বাংলার লোকেরা তাদের পিছু করছিল এবং তাদের হাতে পরিবারটির মৃত্যুর সম্ভাবনাও ছিল।
ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউ, হংকং, ২৪ এপ্রিল ১৯৭১:
টি আই এস জর্জ
যখন ইপিআর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস) বিদ্রোহ করে তখন তাদের প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল তাদের নিজেদের মধ্যেকার অবাঙালিদের সরিয়ে দেয়া।
১০,০০০ থেকে ১৫,০০০ সদস্য নিয়ে গঠিত এই ইপিআর এর শতকরা ৪০ শতাংশ সদস্য ছিলো পশ্চিম পাকিস্তানী, বেশীরভাগ কর্মকর্তাই সেখান থেকে এসেছিলেন।
একদিন রাতে সীমান্তের ওপারে ভারতীয় চেকপয়েন্ট শহর হরিদাসপুরের কাছাকাছি ইপিআর এর সদস্যরা এক ঠেলাগাড়ি ভর্তি লাশ ফেলে রেখে যায়।
সংখ্যায় কয়েক মিলিয়ন বিহারীরা অবাঙালি হবার কারণে পশ্চিম পাকিস্তানের সরকারের সমর্থক তথা গুপ্তচর হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে।
তাদের মাঝে অনেকেই বাঙালিদের হাতে খুন হয়। অনেককে সম্ভবত পশ্চিম পাকিস্তানে রয়ে যাওয়া বাঙালিদের জন্য জিম্মি হিসাবে বন্দীশিবিরে আটক রাখা হয়।
নিউ ইয়র্ক টাইমস. নিউ ইয়র্ক, ২৮ এপ্রিল ১৯৭১:
এরিক পেস:
পশ্চিম পাকিস্তানের হিসাব মতে বাঙালি সেনা, পুলিশ ও জঙ্গি বেসামরিক নাগরিকদের হাতে ৩৫,০০০ বিহারি, বেশ কয়েক হাজার পাঠান ও অন্যান্য অ-বাঙ্গালী জাতিগোষ্ঠীর মানুষ নিহত হয়।
এদের অধিকাংশ ২৫ মার্চের আগেই মৃত্যুবরণ করে।
ডেইলি টেলিগ্রাফ, লন্ডন, ২৯ এপ্রিল ১৯৭১:
কূটনৈতিক স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সমর্থনকারীরা চট্টগ্রামে বহু পূর্ব পাকিস্তানীকে জবাই করে হত্যা করেছে।
এক ঘটনায় একটি পাটকলের অন্তত ২৬ জন শ্রমিককে একটি আঙ্গিনার ভেতরে গুলি করে হত্যা করা হয়। কিছু পশ্চিম পাকিস্তানী সেনা কর্মকর্তার স্ত্রী এবং সন্তানদেরকেও হত্যা করা হয়েছে বলে খবরে প্রকাশ পেয়েছে।
ফাইনানশিয়াল টাইমস, লন্ডন, ৭ মে ১৯৭১:
হার্ভি স্টকউইনঃ
ঢাকা বিমানবন্দরে ঢুকবার মুখে বেশকিছু ছোট ছোট পুড়ে যাওয়া ঘরবাড়ি এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত জনবসতি দেখা যায়। এই এলাকাটি একটি বিহারি আবাসিক এলাকা ছিল এবং ক্ষয়ক্ষতি সাম্প্রদায়িক সহিংসতারই প্রমাণ দেয়।
অটোয়া জার্নাল এবং টরেন্টো ডেইলি স্টার, ৮ মে ১৯৭১:
এ পি এ রিপোর্ট
দায়িত্বশীল সরকারী ও অন্যান্য সূত্রের হিসাব মতে পূর্ব পাকিস্তানে জাতিগত দাঙ্গায় ১ মার্চ থেকে কমপক্ষে ৩০ হাজার লোক নিহত হয়েছে।
যশোর থেকে পাওয়া এসোসিয়েটেড প্রেস রিপোর্ট – ওয়াশিংটন পত্রিকায় ছাপানো
৮ মে, ১৯৭১:
খুলনায় ভ্রমণকালে সংবাদকর্মীরা আজ এমন এক জায়গায় আসেন যে জায়গাকে একজন অবাঙালি অধিবাসী মানুষ জবাইয়ের স্থান হিসেবে বর্ণনা করেন। তিনি জানান এখানের ছাউনিগুলোতে মার্চ ও এপ্রিলের প্রথম দিকে পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু বাঙালিরা ভারত থেকে আসা বিহারি অভিবাসী, পশ্চিম পাকিস্তানী ও অন্যান্য অবাঙ্গালিদের গণহত্যা সংগঠন করত।
সংবাদকর্মীদেরকে কাঠের ফ্রেমের উপরে বেঁধে রাখা শিকল দেখানো হয় যেখানে মহিলা ও শিশুদের ছুরি দিয়ে শিরচ্ছেদ করা হত বলে খবর রয়েছে।
লাশগুলোকে একটি নিচু দেয়ালের ওপর দিয়ে পাশে বয়ে চলা নদীতে ফেলে দেয়া হত।
নিউ ইয়র্ক টাইমস, নিউ ইয়র্ক, ৯ মে, ১৯৭১
মেলকম ডব্লিউ ব্রাউনঃ
যখন সহিংসতার সূত্রপাত হয় বাঙালিরা পূর্ব পাকিস্তানে কম সংখ্যায় বিদ্যমান পশ্চিম পাকিস্তানীদের মুখোমুখি দাঁড়ায়।
সরকারি কর্তৃপক্ষ এবং ব্যক্তিবর্গের সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায় যে নারী ও শিশুসহ হাজার হাজার অবাঙালি অধিবাসী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হাতে নিহত হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে হত্যার পূর্বে তাদের নির্যাতনও করা হয়েছে।
খুলনায় সংবাদকর্মীদের এমন কিছু স্থাপনা দেখানো হয়েছে যেখানে বন্দীদের শিরচ্ছেদের সুবিধার জন্যে কাঠামো তৈরী করা ছিল। সেখানে রক্তাক্ত পোশাক এবং নারীদের চুলের টুকরো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে দেখা যায়। জায়গাগুলো বাঙালি বিদ্রোহীরা হাজার হাজার অবাঙালি বাসিন্দাদের হত্যার জন্য ব্যবহার করেছে বলে জানা যায়।
নিউ ইয়র্ক টাইমস, নিউ ইয়র্ক, ১০ মে ১৯৭১:
মেলকম ডব্লিউ ব্রাউন
শত শত সাক্ষীর সাক্ষ্যের উপর ভিত্তি করে এই ধারণা হয় যে যখন বোঝা গেল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতে যাচ্ছে তখন কিছু কিছু সম্প্রদায়ের বাঙালিরা বিহারীদের ঘরবাড়িতে লুটতরাজ ও অগ্নিসংযোগ করে এবং তাদের অধিবাসীদের জবাই করে।
সান, সিঙ্গাপুর, ৯ মে ১৯৭১:
মরিছ কুয়ান্টান্স
সেনাবাহিনী যখন ময়মনসিংহে পৌঁছায় তখন তথ্যদাতাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যমতে তারা একটি স্থানীয় মসজিদের ভেতর আশ্রয় নেয়া প্রায় ১৫০০ বিধবা ও অনাথদের খুঁজে পায়।
ময়মনসিংহের সহকারী পোস্টমাস্টার হিসেবে শনাক্ত হওয়া একজন ব্যক্তি তার ঘাড়ে আঘাতের চিহ্ন দেখিয়ে বলেন যে তাকে বেয়নেট দিয়ে খোঁচানো হয়েছে।
লোকটি জানায় যে সে শান্তি নামে পরিচিত একটি কলোনিতে বাস করত। এপ্রিলের ১৭ তারিখের গণহত্যায় সেখানে বসবাসরত ৫০০০ অবাঙালির মধ্যে মাত্র ২৫ জন বেঁচে যায়। নিজের পরিবারের হত্যাকাণ্ড ও অঙ্গচ্ছেদের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি হঠাৎ কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন আর সাক্ষাৎকার চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি।
ময়মনসিংহ জেলার কমান্ডিং অফিসার হিসেবে দায়িত্বে থাকা জেনারেল বলেন হত্যাকাণ্ড শুরু হয় মার্চের দ্বিতীয়ার্ধে। এসকল হত্যা ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের বিচ্ছিন্নতাবাদী আওয়ামী পার্টির সশস্ত্র শাখা আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবক এর কাজ।
পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস এবং রেজিমেন্টের যেসকল সেনা বিচ্ছিন্নতাবাদী কাজে জড়িয়ে পড়েছে তারাও এতে জড়িত ছিল।
অবাঙালি এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতায় দক্ষ মানুষদের ধারাবাহিকভাবে জবাই করা হয় বলে তিনি জানান।
ব্যাংকক ওয়ার্ল্ড, ব্যাংকক, ১০ মে ১৯৭১:
খুলনা, পূর্ব পাকিস্তানের দ্বিতীয় প্রধান বন্দর এবং তৃতীয় বৃহত্তম শহর। এখানে প্রতিবেদকেরা একজন স্থানীয় অবাঙালি অধিবাসীর বর্ণনানুসারে একটি মানুষের জবাইঘরের সম্মুখীন হন।
মার্চ এবং এপ্রিলের শুরুতে এইসব ঘর, ছাউনি এবং নির্যাতনের যন্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে বাঙালিরা ভারত থেকে আগত বিহারি অভিবাসী, পশ্চিম পাকিস্তানী এবং অন্যান্য অবাঙালি অভিবাসীদের ব্যাপক সংখ্যায় হত্যা করে।
সাংবাদিকদের যেখানে একটি কাঠের ফ্রেমের সাথে বাঁধা শিকল দেখানো হয় যেখানে তথ্য অনুযায়ী নারী ও শিশুদের ছুরি দিয়ে শিরচ্ছেদ করা হত।
সেখানে একটি গাছের সাথে শ্বাসরোধকারী একপ্রকার যন্ত্র স্থাপন করা হয়েছিল। অধিবাসী ব্যক্তিটির দেয়া তথ্য অনুযায়ী এখানে ধরে আনা মানুষদের শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হত। একটি গাছের গায়ে লাগানো দড়িকে ঝুলন্ত ফাঁস হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।
বলা হয় যে লাশগুলোকে একটি নিচু পাঁচিলের ওপর দিয়ে পাশে বয়ে চলা নদীতে ফেলে দেয়া হত।
প্রাচীরের পাশে একটি গাছে প্রচুর পরিমাণ মানুষের চুল পাওয়া যায়। রক্তাক্ত কাপড়-চোপড় এবং বাচ্চাদের জুতা পুরো আঙ্গিনা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল।
গার্ডিয়ান, লন্ডন, ১০ মে ১৯৭১:
একজন সংবাদ দাতাঃ
একজনের কানে সবচাইতে ভয়ঙ্কর গল্পগুলো আসে। এত বিশাল আকারে হত্যা, ধর্ষণ, ধ্বংস ও লুটতরাজ ঘটেছে আর তার পরিমাণ এতটাই বেশি ছিল যে এসকল ভয়ঙ্কর গল্প কোনো ভাবাবেগ না দেখিয়েই শুনে যেতে হয়। অবধারিতভাবে এই রক্তাক্ত নাটকের মূল চরিত্র ছিল অসহায় বিহারীরা।
কিন্তু বিহারি সম্প্রদায়ের জন্য আসল ট্র্যাজেডি নিহত মানুষের হত্যার সংখ্যা নয় বরং হত্যার বিভীষিকাময় পদ্ধতিগুলো। ২টি আতঙ্কের রাতের মধ্যেই একটি শহরের দশ হাজার মানুষের হত্যা এমন একটি গল্প যা এক সপ্তাহ স্থায়ী হবে।
বিহারীদের তাদের ঘর থেকে ধরে টেনে বা লোভ দেখিয়ে কসাইখানাতে নিয়ে গিয়ে ছুরি দিয়ে তাদের ধীরে ধীরে জবাই করা হয়েছিল। প্রত্যক্ষদর্শীরা এ ঘটনার সত্যতা বিষয়ে সাক্ষ্য দিতে প্রস্তুত।
ময়মনসিংহে একজন পূর্ব পাকিস্তানী সেনা কর্মকর্তা পশ্চিম পাকিস্তানী এক সেনা কর্মকর্তার পরিবারের সঙ্গে আনন্দঘন সকালের নাস্তা করা শেষে পরিবারের সদস্যদের গুলি করে হত্যা করে।
মানুষজনকে পা থেকে শুরু করে কুপিয়ে টুকরো টুকরো করে হত্যা করা হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানী এক গর্ভবতী মহিলাকে দুর্বৃত্তরা রাস্তায় টেনে এনে তার পেট কাটে এবং অনাগত সন্তানকে বেয়নেট দিয়ে আঘাত করে হত্যা করে। মহিলাটি বেঁচে আছে কিন্তু তার বেঁচে থাকার কোনো ইচ্ছাই আর অবশিষ্ট নেই।
এক মহিলাকে হত্যা করা হয় কিন্তু তার তিন মাস বয়সী শিশুটিকে এক হাত কেটে নিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়।
একজন ডাক্তার একটি সিরিঞ্জ দিয়ে লোকের শরীর থেকে রক্ত বের করে নিয়ে তাদের মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়।
ময়মনসিংহে বিহারিদের শরণার্থী শিবিরের একজন ব্যক্তি তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করার সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন। এসময় শিবিরের দায়িত্বে থাকা সেনা কর্মকর্তা আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন। অশ্রু লুকাতে তিনি তার মুখ ফিরিয়ে নেন।
পরবর্তীতে এই কর্মকর্তা, যিনি ময়মনসিংহে প্রবেশ করাদের মধ্যে একদম প্রথম দিকেই ছিলেন, আমাকে একপাশে ডেকে নিয়ে ফিস ফিস করে বলেন “ঐ লোকটি যা বলেছে তা ময়মনসিংহে আমার দেখা ঘটনার শতভাগের এক ভাগও নয়।”
নিউ ইয়র্ক টাইমস, নিউ ইয়র্ক, ১১ মে, ১৯৭১:
ম্যালকম ব্রাউনঃ
সেনাবাহিনী পৌঁছার পূর্বে চট্টগ্রাম বিচ্ছিন্নতাবাদী আওয়ামী লীগ ও তার মিত্র বাঙালি শ্রমিকদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল। ভারত থেকে আসা বিহারী অভিবাসীদের অধিকতর উন্নতিতে ক্ষুদ্ধ হয়ে তারা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিহারীকে হত্যা করেছে বলে জানানো হয়।
কর্তৃপক্ষ চট্টগ্রামের বৃহত্তম কারখানা, চট্টগ্রাম পাট উৎপাদন কারখানায় বাঙালি শ্রমিকদের হাতে বিহারী তত্ত্বাবধায়ক ও তাদের পরিবারের নিহত হবার কথা জানিয়েছে। সংবাদকর্মীদের কবর দেখিয়ে বলা হয় যে সেখানে আক্রান্ত ১৫২ জনের লাশের দাফন হয়েছে।
স্থানীয় একটি ব্যাংকের এক ইউরোপীয় পরিচালক বলেন “এখানে কর্মরত প্রত্যেক ইউরোপিয়ানের কাছে সেনা বাহিনীর পৌঁছানোটা সৌভাগ্যের প্রতীক। তারা সময় মত না আসলে আমি এই কথাগুলো বলার জন্যে বেঁচে থাকতাম না।”
ওয়াশিংটন পোস্ট, ওয়াশিংটন, ১২ মে ১৯৭১
অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস রিপোর্ট:
গতকাল এই গুরুত্বপূর্ণ বন্দরটি পরিদর্শন করা সংবাদকর্মীরা বলেন যে সেখানে প্রচুর গোলার আঘাত ও আগুনে পুড়ে হওয়া ক্ষয়ক্ষতি দৃশ্যমান ছিল। বিদ্রোহীদের দ্বারা বেসামরিক নাগরিকদের নির্বিচারে গণহত্যার প্রমাণও তারা পান।
প্রভাবশালী ইস্পাহানী পরিবারের মালিকানাধীন পাটকলে সংবাদকর্মীরা ১৫২ জন নিহত অবাঙালি নারী ও শিশুদের গণকবর দেখতে পান যাদের মিলের বিনোদন ক্লাবে গত মাসে বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহীরা হত্যা করেছে বলে খবর পাওয়া যায়।
গুলিতে ঝাঁঝরা মেঝেতে তখনো রক্তাক্ত পোশাক ও খেলনা পড়ে ছিল। দায়িত্বশীল সূত্র জানায় ২৫ মার্চ পশ্চিম অংশ থেকে স্বাধীনতা লাভের উদ্দেশ্যে পূর্ব পাকিস্তানে বিদ্রোহ শুরু হবার পর থেকে ১১ এপ্রিল সেনাবাহিনী শহরটি পুনর্দখলের আগ পর্যন্ত হাজার হাজার পশ্চিম পাকিস্তানী এবং ভারতীয় অভিবাসীদের হত্যা করা হয়।
অধিবাসীরা একটি পোড়া অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের দিকে নির্দেশ করে বলে যে সেখানে বাঙালিরা প্রায় ৩৫০ জন পশ্চিম পাকিস্তানী পাঠানকে পুড়িয়ে মেরেছে।
ওয়াশিংটন, ইভিনিং স্টার, ওয়াশিংটন, ১২ মে ১৯৭১:
মর্ট রোজারব্লান্ট
বন্দরনগরী চট্টগ্রামে একটি পাটকলের বিনোদন ক্লাবে পোশাক ও মল-মূত্রের স্তুপের মাঝে একটি রক্তমাখা পুতুল পড়ে রয়েছে। এই ক্লাবটিতে বাঙালিরা ১৮০ জন নারী ও এবং শিশুকে জবাই করে।
উগ্র জাতীয়তাবাদের অকস্মাৎ জাগরণে বাঙালিরা কিছু পশ্চিম পাকিস্তানীকে হত্যা করে।
বেসামরিক বাঙালি ও স্বাধীনতার স্বপক্ষের সৈনিকেরা ভারতের বিহার থেকে আসা প্রচুর মোহাজির (ভারতীয় অভিবাসী) দের হত্যা করে। তারা হাট-বাজার ও বাড়ীঘরের মধ্যে দিয়ে ছুরিকাঘাত, গুলিবর্ষণ ও অগ্নি সংযোগ করতে করতে ছুটে যায়; কখনো কখনো থামে কেবল ধর্ষণ এবং লুটতরাজের উদ্দেশ্যে।
ইন্দোনেশীয়ান অবজারভার, জাকার্তা, ১২ মে ১৯৭১:
অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস রিপোর্ট:
প্রতিবেদকেরা পরে ঢাকায় একটি শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করে যেখানে ময়মনসিংহ থেকে আগত ৩,০০০ গৃহহীন লোক আশ্রয় গ্রহণ করেছে।
ডাক্তাররা তাদের মতে বিগত সপ্তাহগুলোতে বাঙালিদের হাতে গুলি, ছুরি এবং কুঠারে আহত হওয়া অবাঙালি ২৫ জন পুরুষ ও ১৫ জন মহিলাকে চিকিৎসা দিচ্ছিলেন।
একটি সাত বছর বয়সী ছেলে তার চার বছর বয়সী ভাইয়ের সঙ্গে হাসপাতালের একটি বিছানায় চুপ করে বসে আছে। ডাক্তাররা জানান যে তাদের পরিবারে আর কেবলমাত্র তাদের ১৩ বছর বয়সী আরেকটি ভাই জীবিত আছে।
এক নারীর শরীরে গুরুতর ছুরিকাঘাতের চিহ্ন ছিল। অন্য আরেকজনের হাত কুড়ালের আঘাতে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
তারা দুজনেই বলেন যে বাঙালি যুবকেরা তাদের এই অবস্থা করেছে।
এক উনিশ বছর বয়সী বিহারী ছাত্রের পেটের মধ্যে দিয়ে গুলি গিয়েছে। সে বলে যে বাঙালি গুন্ডারা সে শান্তির যে অঞ্চলে থাকত সেখানকার সকল পুরুষ সদস্যকে বাইরে আসতে বলে। আর তারপর তারা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দিয়ে গুলি ছুঁড়তে শুরু করে।
সে তিনবার আঘাতপ্রাপ্ত হয় এবং অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়। বিদ্রোহীরা তাকে মৃত ভেবে চলে গেলে সে বেঁচে যায়।
আরো অনেকের শরীরে গুলির আঘাতের চিহ্ন ছিল।
ওয়াশিংটন পোস্ট, ওয়াশিংটন, ১৩ মে ১৯৭১:
অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস রিপোর্ট:
দৃঢ়ভাবে একটি পৃথক পূর্ব পাকিস্তানের দাবী করা বাঙালিরা সে অঞ্চলের প্রায় ৬ মিলিয়ন অবাঙালি জনসংখ্যার অনেককে হত্যা করেছে।
দ্যা টাইমস, লন্ডন, ১৫ মে ১৯৭১:
পিটার হ্যাজেলহার্স্ট:
এটা সমানভাবেই স্পষ্ট যে বেশিরভাগ হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়েছে গত মাসের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রতিশোধ হিসেবে, যেখানে বাঙালিরা ধারাবাহিকভাবে পূর্ব পাকিস্তানের অবাঙালি মুসলমান অভিবাসী (বিহারী)দের উপর গণহত্যা চালায়।
“কোন বিহারী উদ্বাস্তু নেই” একজন বাঙালি সমাজ কর্মী আমাকে নিঃসংকোচে বলেন, “দুদিন আগে তাদের চৌদ্দ জন পশ্চিমবঙ্গে আসতে চেষ্টা করেছিল কিন্তু বাঙ্গালীরা তাদের বর্শা ও পাথর মেরে হত্যা করে।”
সিলন, ডেইলি নিউজ, কলম্বো, ১৫ মে ১৯৭১:
মরিস কুয়াইনট্যানস:
প্রমাণ আছে যে অবাঙালি জনগোষ্ঠী, যাদের বেশিরভাগই ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর ভারত থেকে অভিবাসী হিসেবে এসে আশ্রয় নিয়েছিল তাদের উপর আক্রমণ চলছে; তাদের কুপিয়ে হত্যা করা হচ্ছে এবং তাদের ঘরবাড়ি ক্ষুদ্ধ জনতা পুড়িয়ে দিচ্ছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন যে উত্তরের ময়মনসিংহে অস্ত্রধারী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হাতে তাদের স্বামী ও পিতা নিহত হলে প্রায় ১৫০০ বিধবা এবং অনাথ একটি মসজিদে পালিয়ে যেয়ে আশ্রয় নেয়।
একজন কারখানা ব্যবস্থাপক সাংবাদিকদের একটি গণকবর দেখান যেখানে তিনি বলেন যে ১০০ এরও বেশি নারী ও শিশুর দাফন করা হয়েছে।
সেনাবাহিনীর আসার ঠিক আগে আগে কারখানাটির বিনোদন হলে এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এ সপ্তাহে যেদিন সাংবাদিকেরা জায়গাটি দেখেন, সেখানে মৃত্যুর তীব্র গন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল। মানুষের চুল এবং রক্তের দাগ পুরো ভবনের চারপাশে ছড়িয়ে ছিল।
ময়মনসিংহের সহকারী পোস্টমাস্টার সাংবাদিকদের তার ঘাড়ে ক্ষত এবং বেয়নেটের আঘাতের চিহ্ন দেখান।
অশ্রু সংবরণ করতে করতে তিনি বলেন যে আওয়ামী লীগ সমর্থক ও সেনাবাহিনীর পক্ষত্যাগীদের দ্বারা আক্রান্ত ৫,০০০ অবাঙ্গালির মাঝে যে ২৫ জন কেবল বেঁচে ফিরতে পারে, তিনি তাদের একজন।
এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ সামান্য যে বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপগুলো দ্বারা এরূপ কিছু নিষ্ঠুরতা সংঘটিত হয়েছে। সাধারণত এই ধরনের হত্যাকাণ্ড দোকানের প্রধান কর্মী বা জুটমিলের প্রশাসকদের ওপর ক্ষোভ পুষে রাখা বাঙালি কর্মীদের দ্বারা সংগঠিত হয়েছে। এদের অনেকেই ছিল বিহারী – ভারত থেকে আসা মুসলিম অভিবাসী। তারা পূর্ব পাকিস্তানে ভালভাবেই এগিয়ে যাচ্ছিল এবং তা তুলনামূলকভাবে কম সফল বাঙালিদের ক্ষোভের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
মেজর ওসমান চৌধুরী, পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা যুদ্ধের দক্ষিণ-পশ্চিম ভাগের কমান্ডার আজ বিকেলে স্বীকার করেন যে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস ও বাঙালি স্বেচ্ছাসেবকেরা সংখ্যালঘু বিহারি মুসলমাদের আক্রমণ ও হত্যা করছিল “কারণ তারা গুপ্তচর ও পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করেছে”।
ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস এর মেজর চৌধুরী এখানে ইন্দো-পাকিস্তান সীমান্তে সাংবাদিকদের সাথে দেখা করেন। তিনি বলেন যে বিহারি মুসলমানরা যারা ভাষাগত ও জাতিগত ভাবে পশ্চিম পাকিস্তানীদের সাথে চিহ্নিত হয়, তারা বাঙালি গণহত্যার কাজে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সৈন্যদের সাহায্য করেছিল। বাঙালি এই কর্মকর্তাকে এরূপ সংবাদ প্রতিবেদন ও আশঙ্কার আলোকে প্রশ্ন করা হচ্ছিল যে প্রায় ৫০ লক্ষ জনসংখ্যার অবাঙালি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অনেককে প্রতিহিংসামূলক কারণে হত্যা করা হয়েছে।
বিহারিদের স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগদানের কোন প্রশ্নই উঠে নি। তিনি বলেন “যদি আমরা একজন বিহারিকে পাই, তবে তাকে আমরা হত্যা করি। এছাড়া আমরা বিহারীদের ঘরবাড়ি আক্রমণ করেও তাদের হত্যা করি।”
নিউ ইয়র্ক টাইমস, নিউ ইয়র্ক, ২০ মে ১৯৭১ :
হোমার এ জ্যাক
পূর্ব অংশে হত্যাকাণ্ডের শিকার ছিল বিহারীরা, বিহার ও অন্যান্য ভারতীয় রাজ্য থেকে দেশ বিভাগের সময় পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসা মুসলিম যারা এখনো বাংলা সংস্কৃতির মধ্যে একাত্ম হয়ে যেতে পারেনি।
করাচিতে সবাই সেনাবাহিনী নয়, বরং স্বায়ত্তশাসন তথা বিচ্ছিন্নতাবাদী আওয়ামী লীগের কিছু সদস্যের দ্বারা সংগঠিত বিহারিদের গণহত্যায় মর্মাহত। তবে প্রায় সকলেই সেনাবাহিনীর হাতে বাঙালিদের যে গণহত্যা চলছে তা অস্বীকার করেন।
এই সেনা কর্মকাণ্ডের পূর্বে ও পরে পূর্ব পাকিস্তানের কিছু অংশ খুব কম সময়েই অহিংস এই উপমহাদেশে নিজেরাই গণহত্যায় মেতে উঠেছে।
দ্যা ফাইনানশিয়াল টাইমস, লন্ডন, ২১ মে ১৯৭১:
হার্ভে স্টকউইন:
আঞ্চলিক স্বাধীনতার বাঙালি আদর্শের অন্ত হয়েছে খুব বিয়োগান্তক ভাবে এবং অবাঙালিদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক বর্বরতার মূর্খতার কালিমা জড়িয়ে।
দীর্ঘদিন ধরে লালিত বাঙালি স্বকীয়তাবোধ ও উগ্র জাতীয়তাবাদের উপর ভিত্ত করে গড়ে ওঠা এসব মনোভাব পূর্বাংশে ২৫ মার্চের আগেকার বিস্ফোরক পরিস্থিতি তৈরীর পেছনে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে কাজ করেছে। এরা বাঙালি-বিহারী ভ্রাতৃঘাতী সম্পর্কের উদ্ভবেরও ব্যখ্যা দেয় যা ছিল এই বিপর্যয়ের এক অবিচ্ছেদ্য কিন্তু উপেক্ষিত অংশ।
এটা বলতেই হয় যে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কর্মকাণ্ডই বাঙালি সেনাদের বিপরিত পথে চলতে বাধ্য করেছে। আর এরাই পরবর্তীতে মোহাজির ও অন্যান্য অবাঙালি অভিবাসীদের হত্যাকাণ্ডে একটি বড় ভূমিকা পালন করেছে।
এ সবই এখন যা দেখা যাচ্ছে তার পটভূমি মাত্র। আর বর্তমান ঘটনাবলি কেবলমাত্র একটি সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ বা গৃহযুদ্ধের ঘটনা নয়; বরং এটি ১৯৪৭ এর দেশ বিভাগের সময়কার দাঙ্গার এক নতুন সংস্করণ মাত্র। এভাবেই বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রচেষ্টা, যদি তা কোনকালে বর্তমান থেকে থাকে, কখনো ঢাকায় পশ্চিম পাকিস্তানী কর্তৃত্ব গ্রহণের বিরুদ্ধে প্রতিশোধস্পৃহায় আবার কখনো বা মুখোমুখি সংঘর্ষে পরাজয়ের হতাশা থেকে সাম্প্রদায়িক রক্ত-পিপাসায় পরিবর্তিত হয়।
কারণ ও প্রভাবের নির্ভুল ক্রম হিসেব করলে অবশ্য তা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পরিবর্তিত হয়। সাধারণভাবে বলা যায়, ঢাকার বাইরে বাঙালিরাই এই হত্যাকাণ্ড শুরু করে।
অন্যদিকে বিদ্রোহীরা তাদের নিজস্ব শক্তি সম্পর্কে অতি উচ্চ ধারণা ধারণ করত। ফলে তারা একই সাথে সেনাবাহিনী এবং পূর্ব পাকিস্তানের বেসামরিক সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ হানবার মরণঘাতী ভুলটি করেছে।
দ্যা সানডে টাইমস, লন্ডন, ২ মে ১৯৭১:
অ্যান্থনি মাসকারেনহাস:
সশস্ত্র আওয়ামী লীগ সদস্য ও ছাত্র সমর্থিত ১,৭৬,০০০ অস্ত্র ও ট্রেনিং সম্বলিত বিদ্রোহী বাঙালি আর্মি ইউনিট, প্যারা মিলিটারি ফোর্স, পুলিশ বাহিনী সকলে মিলে শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগের মিছিলের স্লোগান “বাংলাদেশ খালি কর, পাঞ্জাবী মারো” কে একটি ভয়ানক বাস্তবতায় রূপ দিতে চেষ্টা করেছে।
৮০ টিরও বেশি সাক্ষাৎকারে প্রত্যক্ষদর্শীরা নারী ও পুরুষের ধর্ষণ, নির্যাতন, চোখ উপড়ে ফেলা, জনসম্মুখে মারধোর; নারীদের স্তন ছিঁড়ে ফেলা এবং গুলি করে বা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করার আগে হাত-পা কেটে ফেলার ভয়ঙ্কর সব বিবরণ দিয়েছেন।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় পাঞ্জাবী সেনা ও সরকারী কর্মচারী এবং তাদের পরিবারকে বিশেষভাবে নির্যাতনের জন্য নির্বাচিত করা হচ্ছে।
চট্টগ্রামে মিলিটারি একাডেমীর দায়িত্বে থাকা কর্নেলকে হত্যা করা হয়। তার আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে ধর্ষিত হন এবং তার পেটে বেয়নেট চার্জ করা হয়।
চট্টগ্রামের অন্য আরেকটি অংশে একজন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস কর্মকর্তার ছাল জীবন্ত অবস্থাতেই ছাড়িয়ে নেয়া হয়। তার দুই পুত্রের শিরচ্ছেদ করা হয়, তার স্ত্রীকে বেয়নেট দিয়ে আঘাত করা হয় এবং তারপর তার ছেলের কাটা মাথা তার নগ্ন শরীরের উপর স্থাপন করে তাকে মারা যাবার জন্যে ফেলে রেখে যাওয়া হয়।
অনেক তরুণী মেয়েদের লাশ পাওয়া যায় যেখানে তাদের যোনিতে বাংলাদেশের পতাকা গেঁথে দেয়া অবস্থায় ছিল।
সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত শহরগুলো ছিল চট্টগ্রাম ও খুলনা, যেখানে পশ্চিম পাকিস্তানীরা কেন্দ্রীভূত ছিল। চট্টগ্রামের জন্য সরকারি ভাবে মৃতের সংখ্যা ছিল ৯,০০০ এবং খুলনাতে তার চেয়ে কিছু কম।
তবে অন্যান্য স্থানেও গণহত্যার খবর মিলেছে। দিনাজপুরের কাছাকাছি ঠাকুরগাঁও এ প্রায় ৩,০০০ নারী ও শিশুর লাশ পাওয়া যায়। যশোরের কাছাকাছি ঈশ্বরদীতে সংখ্যাটি প্রায় ২০০০, ঢাকার উত্তর-পূর্ব দিকে ভৈরব বাজারে ৫০০ এবং কালুরঘাটে পাটকল এলাকায় ২৫৩ টি লাশ পাওয়া যায়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য এর সীমান্তের এপারে যার অবস্থান, আমি ৮২ টি শিশুর মরদেহ দেখতে পাই যাদের লাইন করে দাঁড়া করিয়ে গুলি করা হয়েছে। বাঙালি আসামিরা মুক্ত হয়ে যাবার পরে অবাঙালিদের যে জেলে এসে বসতি স্থাপনে বাধ্য করা হয় তার চারপাশে প্রায় ৩০০ অবাঙালির লাশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে ছিল। আসন্ন পশ্চিম পাকিস্তানী আগ্রাসনের হাত থেকে পালিয়ে যাবার সময় বিদ্রোহীরা এদেরকে গুলি করে হত্যা করে গিয়েছে।
পাকিস্তান পাবলিকেশন্স
পি ও বক্স ১৮৩
করাচী
.
.
শিরোনামঃ ১৩৪। পূর্ব পাকিস্তানের সংকটে ভারতের ভূমিকা
সূত্রঃ সরকারী প্রচার পত্রিকা
তারিখঃ জুন ১৯৭১
.
পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান সংকটের পেছনে ভারতের ভূমিকা
একটি আইনী এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষণ
-কেমাল এ ফারুকি
(পাকিস্তান আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ইনস্টিটিউট করাচী-তে ১৯৭১ সালের ৭ই মে শুক্রবার নিম্ন লিখিত বক্তব্যটি পাঠ করা হয়।)
[ * কেমাল এ ফারুকি সাউদার্ণ ইউনিভার্সিটি অফ সাউদার্ণ ক্যালেফর্নিয়া থেকে সমাজবিদ্যায় স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন, এরপর মিডেল টেম্পল লন্ডন থেকে আইনের ওপর পড়াশোনা করেন। এছাড়াও তিনি আমেরিকারন ইউনিভার্সিটি অফ বৈরুত (লেবানন) থেকে মধ্যপ্রাচ্য বিষয়াদির ওপর স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি করাচী বারের একজন কর্তব্যরত আইনজীবী, ইসলাম বিষয়ক গবেষণা সংস্থার আইনী উপদেষ্টা এবং করাচী এম. ল. কলেজের অধ্যাপক। আলজেরিয়ার স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ইংল্যান্ডে আলজেরিয়ার সংগঠিত কমিটির প্রথম সভাপতি ছিলেন তিনি। এছাড়া তিনি বিভিন্ন সাময়িকীতে ইসলামিক বিভিন্ন বিষয়াদির ওপর প্রবন্ধ লিখেছেন। তার লেখা বই গুলোর ভেতরে রয়েছে- “Islamic Constitution” (1952); “Ijma and the Gate of Ijtihad” (1954); “Islamic Jurisprudence” (1962) and “The Evolution of Islamic Constitutional Theory and Practice” (1971)। ]
১.গুরুত্বপূর্ণ পটভূমি
আন্তর্জাতিক আইন এবং ভারত পাকিস্তান প্রবাহমাণ সম্পর্কের আলোকে বলা যায় পাকিস্তানের সাম্প্রতিক সংকটের পেছনে ভারতের মনোভাব ও কর্মকাণ্ড গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
কিন্তু এই দুটি দিক বিবেচনায় নেয়ার আগে পূর্বের ঘটনা গুলোও বিবেচনায় আনা জরুরী। আমি এখানে বিস্তারিত বিবরণে যাবো না তবে পাঠকদের এ বিষয়টি মনে রাখা প্রয়োজন যে পাকিস্তানের অস্বাভাবিক ভৌগলিক অবস্থান এটাই নির্দেশ করে যে পাকিস্তান পৃথিবীর বিরলতম একটি রাষ্ট্র যেটি শুধু গণতন্ত্রের মাধ্যমেই অস্তিত্ব পায়নি বরং গণতন্ত্রের মাধ্যমে এর সীমানাও নির্ধারিত হয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে, ভৌগলিক গ্রহণযোগ্যতার উপর সন্দেহ পোষণ করাতে চাইলে, জনগণ বাস্তবে যা চায় এবং পায়, সেগুলোকে গুরুত্ব না দিয়ে, জনগণের ইচ্ছাকে (যা গণতন্ত্রের একটি অন্যতম চিহ্ন) দ্বিতীয় স্থানে রাখতে হবে, অথবা পূর্বের অন্ধবিশ্বাসকেই একটি রাষ্ট্রের গঠনে গুরুত্ব দিতে হবে।
এই সত্যকে কেউ অস্বীকার করতে পারবে না যে স্বাধীনতার প্রথম দুই দশকে পাকিস্তানকে সংবিধান তৈরির কাজে লাগামহীন অসুবিধার সম্মুখিন হতে হয়েছে, যেই আদর্শে এটি প্রতিষ্ঠিত তাকে আইনী ও ব্যবহারিক অভিব্যাক্তি প্রদান কে কেন্দ্র করে এসব সমস্যার সৃষ্টি এবং পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি নিয়ে ঐক্যমতে পৌঁছাতেও সমস্যা দেখা যায়।
এসব আসলে এত বড় ধরনের সমস্যা ছিল যে গত ২০ বছরে ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য কোন মুল্যেই কিছু ব্যক্তিস্বার্থের জন্য এর আসল প্রকৃতি আড়াল করা উচিত হবে না।
এই সরকার ১৯৬৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই ঘোষণা করে যে তারা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বেসামরিক ও গনতান্ত্রিক সরকার এর প্রচল করার জন্য সংবিধান তৈরীর এই জটিল প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখবে, পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসে যা কখনোই ঘটেনি।
প্রাথমিক কার্যাবলী সমাধা করার পর ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথমবারের মত সারা দেশ ব্যাপী প্রত্যক্ষ ভাবে প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের ভোটাধিকার প্রয়োগের মধ্যে দিয়ে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় যার স্বচ্ছতা বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হয়।
কিন্তু এটি যে একটি দুর্ভাগ্যের বিষয় যেটা আগে ধারনা করা যায়নি, এই নির্বাচনটি দুটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের উত্থান ঘটায় যেগুলোর শক্তি দুইটি অংশের যে কোন একটিতে সীমাবদ্ধ।
অচিরেই বোঝা যায় যে সংবিধান তৈরির কাজটি সহজ হবে না। পরন্তু, সমস্ত রাজনৈতিক দল গুলো ভোটের আগে পাকিস্তানের মতাদর্শ এবং অখণ্ডতা যেন সংরক্ষিত রাখার জন্যে নিজেদের নিয়োজিত করেছে । এবং এর ওপর ভিত্তি করে তারা দেশের মানুষের ভোট পেয়েছিলেন। যদিও কিছু মানুষ হয়তো রাষ্ট্রের বিকেন্দ্রিকরনের পক্ষে সমর্থন জুগিয়েছিল।
আঞ্চলিক দলগুলোর মেরুকরণের ফলে দুইটি শাখার বিস্তৃতি হয়।
হয় সংবিধান তৈরির সাথে জড়িত ব্যাক্তিরা, এই বিতর্ক হয়তো সম্পূর্ন ভিন্ন ও বিপরীত মতাদর্শকে একত্রিত করতে পারবে এমন কোন নিশ্চয়তা ছাড়াই দ্রুত গঠিত হবে, অথবা সরকারের সাহায্যে প্রাথমিক মীমাংসা করতে হবে, তাহলে যখন জাতীয় সমাবেশ হবে তা যেন হয় হুমকির মুখে থাকা সবচেয়ে সবেদনশীল বিষয়টিতে ঐক্যমত নিয়ে।
চাপ প্রয়োগ কৌশল
দ্বিতীয় পদক্ষেপটি সঠিক ফলাফলের দিকে নিয়ে যেতে পারে যদি মাঠ পর্যায়ে দলের নিয়ম শৃঙ্খলা সঠিক ভাবে নিয়ন্ত্রন করা যায়।
কিন্ত কার্যত ১৯৭১-এর মার্চে, বিশেষ করে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের চরমপন্থিদের কর্ম-প্রক্রিয়া সাধারনের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে, যা তত্ত্বাবধায়ক প্রশাসন হঠকারী মুকাবিলা করতে অনিচ্ছুক ছিল। এতে যে কোমল বোঝাপোড়াটা হচ্ছিল তা ভন্ডুল হতে পারে সেই তোয়াক্কা না করেই।
দু-পক্ষেরই ভুল ত্রুটি থাকতে পারে তবে এটি একেবারেই অসম্ভাব্য এবং ব্যাখ্যাতীত যে, আপোষহীন মতবাদ নিয়ে এই ছোট উগ্রবাদী দলের উত্থান ঘটে ও রাষ্ট্রের প্রতি বিশ্বস্ততার ভান কে এবং প্রতিষ্ঠাতার প্রতি তার সম্মান কে তারা ছুড়ে ফেলে, সেই সাথে ইচ্ছা করেই তারা নিজেদের পথ থেকে সরে আসে শুধুমাত্র পুর্বাঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকের আবেগ কে আঘাত করার জন্য ও উস্কানি দেয়ার জন্য, যারা বিশ বছর আগে পাকিস্তানের জন্য ভোট দিয়েছিলো।
এ দেশ বিরোধী দলটিকে ছোট বলা হলেও একটা বিষয় পরিস্কার করা দরকার যে এদের ছোট বলা হয় পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর ভিত্তি করে এবং দেশের অন্যান্য সমস্ত মানুষের বিবেচনায় এ দেশ বিরোধী দলটি বেশ বড়ই ছিলো।
একত্রীকরণের প্রস্তাবনা
নিঃসন্দেহে এটার পেছনের কারণ সেই পুরনো সত্য যে- পূর্ব বাংলার প্রায় ১৫ ভাগ মানুষ হিন্দু যা প্রায় ১ কোটিরও বেশি। তারা কখনোই ১৯৪৭ সালের পাকিস্তান গঠনের আন্দোলনে শরীক হয়নি। আমি মনে করি এটাই যুক্তিযুক্ত যে এই হিন্দুদের উল্লেখযোগ্য অংশই ভাঙ্গনের এই প্রস্তাবকে স্বাগত জানায়। এর কারণ হতে পারে ভারতের হিন্দুদের সাথে পুনর্মিলন অথবা পূর্ব এবং পশ্চিম বঙ্গকে মিলিয়ে একটি আলাদা প্রজাতন্ত্র তৈরির ষড়যন্ত্র যেখানে হিন্দুরাই প্রভাবশালী হবে।
এটা স্পষ্ট যে এই কাজ গুলো সফল করা হচ্ছিল বিভিন্ন কর্মসূচির দ্বারা। মার্চের উত্তাল সময়ের পর থেকেই তাদের আগ্রহের বিষয় ছিল বাঙ্গালীদের অবাঙ্গালীদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়া এবং এই শত্রুতাকে এখন কোন ভাবেই মীমাংসা করা সম্ভব নয়।
মার্চের ২৩ তারিখ প্রজাতন্ত্র দিবস। যে দিনটি হবার কথা ছিল পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের দিন। অথচ বিচ্ছিনতাবাদী আন্দোলনকারীরা সঙ্খ্যালঘুদের প্রভাবে এ দিনটিকে ঠিক উল্টোভাবে ব্যবহার করে। এটি শুধু আন্দোলনের কঠোর ভাষা প্রয়োগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না বরং আন্দোলনকারীরা এমন সব কাজ করেছিলো যে জনগণের জীবন, সম্মান এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি হুমকির মুখে পড়ে।
১৯৭১ সালে মার্চের এই আকস্মাত পরিবর্তনে শুধু পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসন এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষেরাই অবাক হয়নি অবাক হয়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের সেই মানুষেরাও যারা এই বিশ্বাসে নির্বাচনে ভোট দিয়েছিলেন যে তাদের মনোনীত প্রার্থীরা যে কোন মূল্য পাকিস্তানের আদর্শ এবং অখণ্ডটাকে বজায় রাখবেন।
সবাই বিস্ময়ে হতবাক হল যখন আন্দোলনকারীরা পাকিস্তানের জাতীয় পতাকাকে অসম্মান করা শুরু করলো। দেশ বিরোধীরা তাদের বক্তব্যে নিজেদের প্রকৃত উদ্দেশ্যকে গোপন রেখে সাধারণ মানুষকে প্রতারিত করতো। যারা কখনো কল্পনাও করতে পারেনি যে দেশ বিরোধীরা এইসব সাধারন মানুষদের বিকেন্দ্রীকরণের স্বপ্নকে ব্যাবহার করে নিয়ে যাচ্ছে সেই শত্রুদের কাছে যাদের বিরুদ্ধেই ১৯৪৭ সালে এইসব মানুষেরা স্বাধীনতা এনেছিলেন।
এসব ছিল মূলত পকিস্তানের অভ্যন্তরের বিষয়ে ভারতের হস্তক্ষেপের ফলাফল। এ ক্ষেত্রে ভারতের ভূমিকা আসলে কি হতে পারত সেটা জানার জন্য আমাদের জানতে হবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে আন্তর্জাতিক বিধি-নিষেধ সম্পর্কেঃ আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে, জাতিসংঘ অনুসারে, বিভিন্ন দেশের আঞ্চলিক সম্পর্ক ও অঙ্গিকার অনুসারে।
২. আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে
কোন রাষ্ট্র এবং তার আশেপাশের রাষ্ট্রের ওপরে সেই রাষ্ট্রের এখতিয়ার সম্পর্কে আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে স্পষ্ট বাধ্যবাধকতা রয়েছে । ১৯২৭ সালের লোটাস কেইস এর ক্ষেত্রে “স্থায়ী আন্তর্জাতিক আদালত” আমাদের জানায়- “একটি রাষ্ট্র তার শক্তি কোন মতেই ওপর কোন রাষ্ট্রের সীমানায় প্রয়োগ করতে পারে না।” এবং এটি আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে কোন রাষ্ট্রের ক্ষমতা প্রয়োগের ওপর প্রথম এবং প্রধান বাধা।
এরই সাথে সম্পর্কিত আরেকটি আইন অনুসারে “প্রত্যেক রাষ্ট্রকে তার ভূখণ্ডের ক্ষতিকর ব্যবহার রোধ করতে হবে।” এখানে আরেকটি মামলার কথা বলা যায়; ১৯৪৯ সালে কর্ফু চ্যানেল কেইস-এ আদালত এই স্বীকৃতি প্রদান করে যে- “প্রত্যেক রাষ্ট্র কখনোই তার জ্ঞাতসারে তার ভূ-খণ্ডতে অন্যান্য রাষ্ট্রের অধিকার পরিপন্থী কাজ করতে পারবে না।”
সুতরাং এই কথা প্রতিষ্ঠিত যে প্রত্যেকটি রাষ্ট্রের একটি আইনগত দায়িত্ব হচ্ছে তার ভূখণ্ডের অভ্যন্তরে উসকানি মূলক কর্মকাণ্ড প্রতিরোধ করা এবং এ-ধরণের অপরাধকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গন্য করা।
তারপর- তদন্ত কমিশন (জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত) গ্রীসের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে সংগঠিত গৃহযুদ্ধ প্রসঙ্গে আমাদের জানায় যে “গ্রীসের বর্তমান সংকটের পেছনে তার উত্তরাঞ্চলের তিন প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভূমিকা রাখছে। কারণ রাষ্ট্রগুলো তাদের ভূ-খণ্ডের ভেতরের গেরিলা কার্যক্রম বন্ধের কোন ব্যাবস্থা নেয়নি বরং গ্রীক গেরিলাদের সরাসরি সমর্থন জুগিয়েছে।”
.
গণবিরোধ
“আরও কিছু চুক্তির ক্ষেত্রেও এই বাধ্যবাধকতা কার্যকর করা হয়েছে, যার মধ্যে কিছু দীর্ঘস্থায়ী চুক্তিও রয়েছে, যেমন গৃহযুদ্ধ চলাকালীন সময় সংশ্লিষ্ট রাজ্যসমূহের দায়িত্ব ও অধিকার বিষয়ক হাভানা সনদ-১৯২৮, যা কিনা স্বাক্ষরকারী রাজ্যগুলোকে তাদের ভূখণ্ডে বসবাসকারী যেকোন নাগরিক অথবা বহিরাগতদের গৃহযুদ্ধ শুরু করার অথবা উসকে দেয়ার উদ্দেশ্যে কোনো কার্যে অংশ নেয়া, সীমান্ত অতিক্রম করে কোনো উপাদান সংগ্রহ অথবা তাদের সীমানায় থেকে কার্যাবলী পরিচালনা করা হতে বিরত রাখার জন্য যেকোনো উপায় অবলম্বন করার বাধ্যবাধকতা দিয়েছিল ।”
১৯৩৬ সাল পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হওয়া বিভিন্ন কনভেনশনের আলোচনার বিষয় ছিল যেকোনো ভূখণ্ডের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ আচরণে ঐ ভূখণ্ডের জনগণকে উৎসাহিত করণে সম্প্রচার মাধ্যম ব্যবহার সংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞা।
একই ধরণের ভাবধারা ব্যক্ত করা হয়েছে জাতিসংঘের ১৯৪৫ সালের সনদের ধারা ২(৭) এ, যেখানে বলা হয়েছে যে, “বর্তমান সনদের কোনো কিছুই জাতিসংঘকে কোনো রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়াদিতে হস্তক্ষেপ করার অনুমতি দেয় না।”
এটা স্পষ্ট যে, যে ধরণের হস্তক্ষেপকে প্রতিরোধের কথা উপরে উল্লেখ করা হয়েছে, বিশ্ব সম্প্রদায়ের উচিত সে ধরণের হস্তক্ষেপের কঠোর এবং কার্যকর নিন্দা করা।
এ ক্ষেত্রে ব্রিটিশদেরকে উদ্ধৃত করা উত্তম। ১৯৫৬ সালে সুয়েজ খাল সংক্রান্ত বিষয়ে তাদের নেতিবাচক হস্তক্ষেপের দুই বছর পর জুলাই, ১৯৫৮ সালে মধ্যপ্রাচ্যের গৃহযুদ্ধে বহিঃশক্তির হস্তক্ষেপ প্রসঙ্গে আলোচনায় হাউস অব কমন্সে বৃটিশ পররাষ্ট্রসচিব কর্তৃক হস্তক্ষেপের ধরণের ব্যাখ্যা ছিল নিম্নরূপঃ
“এই পরোক্ষ আগ্রাসনের সাথে জড়িত সমস্যাগুলো হাউসকে মোকাবেলা করতে হবে…”
“কী ঘটে যখন একটি বিদেশি সরকার সংকল্প নেয় অপর একটি দেশের ভেতরের ভিন্নমতাবলম্বী অংশকে ব্যবহার করে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে ঐ দেশের সরকারকে হটানোর। এ ক্ষেত্রে কৌশল হচ্ছে অস্ত্র ও বিস্ফোরক চোরাচালান, গুপ্তচর বিয়োগ, ব্যাপক অপপ্রচার, অভ্যুত্থানের প্ররোচনা, এবং পরিশেষে, সাংবিধানিক নেতাদের বিরুদ্ধে প্রাণনাশী চক্রান্ত। এটিই কৌশল, এবং এটিই সমস্যা।“
“আমাদেরকে স্বীকার করতে হবে যে এখনও পর্যন্ত এর কোনো সমাধান পাওয়া যায়নি। আমি বিশ্বাস করি যে এর একটি সমাধান যতদিন না পাওয়া যাচ্ছে, ততদিন একের পর এক ক্ষুদ্র স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও অখণ্ডতা হুমকির মুখে পড়তে থাকবে এবং পরিশেষে তারা ধ্বংস হতে থাকবে।“
“…পরোক্ষ আগ্রাসন সংক্রান্ত সাধারণ নীতিগত অবস্থান থেকে আমি বিশ্বাস করি, যখন কোনো রাষ্ট্র নিজেকে বিপদগ্রস্ত মনে করে তখন তার অধিকার আছে অন্য রাষ্ট্রের কাছে সাহায্য চাওয়ার। আমি বিশ্বাস করি যে, একটি রাষ্ট্রের অধিকার আছে আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সাহায্য চাওয়ার, তা প্রত্যক্ষ হোক, অথবা পরোক্ষ। আমি এটাও বিশ্বাস করি যে, অপর রাষ্ট্রটির অধিকার আছে এ ধরণের সাহায্যের আবেদনে সাড়া দেবার, এবং এ ধরণের সাড়া প্রদান সনদের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
“আমি বিশ্বাস করি যে, এটি সুপ্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক আইনসমূহের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। যদি না রাষ্ট্রগুলো এ ধরণের আবেদনে সাড়া দিতে প্রস্তুত থাকে, আমাদেরকে এ ধরণের আগ্রাসনের মুখে একের পর এক রাষ্ট্রের পতন দেখতে হবে এবং আত্মশাসন প্রতিষ্ঠায় বিভিন্ন সরকারের অধীনে যে সকল পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, যা কিনা নিজেদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সম্পূর্ণ সাবভৌম একাধিক স্বাধীন রাষ্ট্র জন্ম দিয়েছে, সে সকল পদক্ষেপই ব্যর্থ প্রমাণিত হবে।
এই একই বিতর্কের প্রেক্ষিতে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বলেনঃ
“আমার মনে হয়, একটি বৈধ সরকারের অধিকার আছে বিপদের সময়ে বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্রসমূহের কাছে সাহায্য চাওয়ার। সাহায্য আসুক বা না আসুক, অবশ্যই এটি বিবেচনা করে দেখার বিষয়, কিন্তু আমি মনে করি না, এমন একটি জাতি যা বহিঃশক্তির আগ্রাসন মোকাবেলা করছে, যার সাথে বাইরের শক্তিসমর্থিত অভ্যন্তরীণ গোলযোগও রয়েছে, তাদের জন্য সাহায্য চাওয়া আইনত অনুচিত কিছু। আমি মনে করি এটি সাধারণভাবে স্বীকৃত।”
হস্তক্ষেপ
১৯৫০ এর দশক এবং ৬০ এর দশকের শুরুর দিকের সময়টাকে বহিঃশক্তির হস্তক্ষেপের সময় হিসেবে বর্ণনা করা যেতে পারে, কারণ সে সময়ে পূর্ব প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক আইন ও আচরণ সংক্রান্ত নিয়মাবলি থাকা সত্ত্বেও এ ধরণের হস্তক্ষেপের অসংখ্য প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হয়, বিশেষত, আফ্রিকায়, এক রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীন বিষয়সমূহে অপর রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের মাধ্যমে।
এনক্রুমা (Nkrumah) এর শাসনাধীন ঘানা বিভিন্ন সময়ে বিচ্ছিন্নতাবাদীদেরকে আর্থিক সহায়তা, প্রশিক্ষণ, অভিযানের ঘাঁটি প্রদান, ইত্যাদি প্রক্রিয়ায় ক্যামেরুন, নাইজার, আপার ভোল্টা, আইভরি কোস্ট, নাইজেরিয়া, কঙ্গো এবং টোগো এর অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের প্রচেষ্টা চালিয়েছে। এর পরিবর্তে টোগো প্রতিশোধ হিসেবে ঘানার বিরুদ্ধে একই প্রচেষ্টা চালিয়েছে; তানজানিয়া চেষ্টা করেছিল মালাউয়ি এর বিরুদ্ধে; মালি সেনেগালের বিরুদ্ধে; বুরুন্ডি রুয়ান্ডার বিরুদ্ধে; জাম্বিয়া, তানজানিয়া, আইভরি কোস্ট এবং গ্যাবন, নাইজেরিয়ার বিরুদ্ধে চেষ্টা চালিয়েছিল বায়াফ্রা বিদ্রোহের সময়; এবং সম্বে (Tshombe) এর শাসনামলে কমপক্ষে নয়টি আফ্রিকান রাষ্ট্র কঙ্গোর অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের প্রচেষ্টা চালায়। তবে আফ্রিকার ক্ষেত্রে এ ধরণের বিরোধের কারণ ছিল প্রধানত এই যে তাদের আন্তঃরাষ্ট্রীয় সীমানাগুলো ছিল খেয়ালখুশি মত নির্ধারিত এবং প্রকৃতপক্ষে সম্পূর্নই কৃত্রিম।
অধিবাসীদের ধর্মীয়, জাতিগত ও সাংস্কৃতিক সম্বন্ধের সাথে এই সীমানা নির্ধারণের কোনো সম্পর্ক নেই এবং বিভিন্ন ইয়োরোপীয় শহরে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর দ্বারা তাদের ঔপনিবেশিক দখলের নির্ধারণী সীমানার সাথেও এদের মিল নেই। তবে যাই হোক, এই সীমানার কৃত্রিমতা সত্ত্বেও, স্বাধীনতার পর থেকে আফ্রিকান রাষ্ট্রগুলো ক্রমবর্ধমান হারে বৈরী মনোভাব দেখিয়েছে হস্তক্ষেপের বিষয়ে, এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রীয় সীমানার অখণ্ডতার প্রতি হুমকির বিষয়ে
ইমানুয়েল ওয়ালারস্টেইন যেমন স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন তাঁর গ্রন্থ ‘আফ্রিকাঃ স্বাধীনতার রাজনীতি’তে, “সকল আফ্রিকান রাষ্ট্রের আছে তার নিজস্ব কাতাঙ্গা…।বিচ্ছিন্নতাবাদীদের যুক্তি একবার মেনে নিলে তার পরিণতি অরাজকতা ছাড়া আর কিছু হতে পারে না।”
অবশ্যই, এ ক্ষেত্রে আফ্রিকা একা নয়। এশিয়াতেও একটি বড় অংশে রয়েছে মিশ্র সমাজ, এমনকি ইউরোপেও উদাহরণ রয়েছে এমন রাষ্ট্রের যেখানে অধিবাসীদের ধর্ম, ভাষা, জাতীয়তা এবং সংস্কৃতি সম্বন্ধযুক্ত নয়।
বলকান ও পশ্চিম ইউরোপের সর্বত্র ছড়িয়ে আছে এ রকম উদাহরণ; নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড ছাড়াও আছে ব্যাংকুয়েস, কাতালান এবং ওয়ালুন। প্রকৃতপক্ষে, বয়েন যুদ্ধের দু’শ আশি বছর পরও ধর্ম, বর্ণ, জাতীয়তা এবং ভাষা সংক্রান্ত দ্বন্দে অ্যাংলো-আইরিশ প্রশ্ন এখনও প্রাণবন্ত যা কিনা পাকিস্তান অঞ্চলে প্রকাশিত কিছু সম্পাদকীয় সংবাদকে অর্থহীন, হাস্যকর এমনকি অসৎ প্রমাণ করে।
এই সকল সমস্যা- এসকল সম্ভাব্য কাতাঙ্গা ও বিয়াফ্রা- শান্তির প্রতি হুমকিস্বরূপ হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে এক ক্রমবর্ধমান উদ্বেগ, এবং তার সাথে ক্রমশ সরব উদ্যোগের জন্ম দিয়েছে। ১৯৬৫ সালের ডিসেম্বরে, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে একটিমাত্র ভিন্নমতের ভোট বাদে সর্বসম্মতিক্রমে, রেজল্যুশনে গৃহীত হয় ‘রাষ্ট্রসমূহের অভ্যন্তরীণ বিষয়সমূহে হস্তক্ষেপের অগ্রহণযোগ্যতা এবং তাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের সুরক্ষা সংক্রান্ত ঘোষণাপত্র’।
এর পাঠ বর্ণনা করছে, “সশস্ত্র হস্তক্ষেপ এবং অন্যান্য প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ অনধিকারচর্চা রাষ্ট্রসমূহের সার্বভৌমত্ব এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতাকে ‘বিশ্ব শান্তির প্রতি ক্রমবর্ধমান হুমকি’ রূপে হুমকি দিচ্ছে”।
এতে অর্গানাইজেশন অব আমেরিকান স্টেটস, আরব লীগ এবং আফ্রিকান ঐক্য সংস্থার সনদসমূহের ‘হস্তক্ষেপ না করার’ ঘোষণার মূলনীতি, এবং সেই সাথে বান্দুং এ অনুষ্ঠিত এশিয়ান-আফ্রিকান কনফারেন্স, বেলগ্রেড ও কায়রোতে অনুষ্ঠিত জোট নিরপেক্ষ রাষ্ট্রপ্রধানদের সম্মেলনের সিদ্ধান্তকেও পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে।
১৯৬৫ সালে তৎকালীন জাতিসংঘ ঘোষণার প্রথম দফা অনুযায়ীঃ
“কোনো রাষ্ট্রের অধিকার নেই, যেকোনো কারণে হোক, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অপর কোনো রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বা বৈদেশিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার। ফলশ্রুতিতে, কোনো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, অথবা এর রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সংস্কৃতিতে সশস্ত্র হস্তক্ষেপ এবং অন্যান্য সকল প্রকার অনধিকারচর্চা অথবা হুমকি প্রচেষ্টা নিন্দনীয়।
ঘোষণার দ্বিতীয় দফা অনুযায়ীঃ
“কোনো রাষ্ট্র অপর কোনো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নাশকতামূলক, সন্ত্রাসী বা সশস্ত্র কোনো কর্মকাণ্ড সংগঠিত করবে না, তাতে সহায়তা, উসকানি প্রদান করবে না, অর্থায়ন করবে না, উৎসাহ যোগাবে না অথবা এমন কোনো কর্মকাণ্ড সহ্য করবে না, অথবা অপর কোনো রাষ্ট্রের গৃহযুদ্ধে হস্তক্ষেপ করবে না।
পরিশেষে, চতুর্থ দফাটি হচ্ছেঃ
“জাতিসমূহের পরস্পর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করার জন্য এই বাধ্যবাধকতাগুলো কঠোরভাবে পালন করা একটি অপরিহার্য শর্ত, যেহেতু, যেকোনো প্রকার হস্তক্ষেপের চর্চা শুধু জাতিসংঘ সনদের চেতনা এবং বক্তব্যকেই লঙ্ঘন করে না, বরং তা এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করে যা বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়।”
এটি স্মরণ করিয়ে দেয়া যায় যে, ভারত এই কমিটির সদস্য ছিল যা কি না এই ঘোষণাপত্রটি প্রস্তুত করেছে।
.
(৩)সংকট কালে ভারতের ভুমিকা
রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় আন্তর্জাতিক আইন ও মানের সামাজিক আচরনের সুষ্পষ্ট বিধি অনুযায়ী পুর্ব পাকিস্তানের সংকট নিয়ে পাকিস্তানের ব্যাপারে ভারতের ভুমিকা ব্যাখ্যা করা উচিত। যদি কেউ ভারতের ভুমিকার আপত্তিকর ইস্যু গুলোকে এক পাশে রেখে বিতর্কিত নয় এমন বিষয় গুলোকে আলাদা করলে বিষয়টি ক্লিয়ার হবে। বিতর্কিত বিষয়গুলো ছিলো, ১৩ ই মার্চ, ২০ শে মার্চ, ২৪ শে মার্চ এবং ২৭ শে মার্চে ভারত সরকারের সাথে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক দায়ের কৃত প্রতিবাদ লিপিতে পাকিস্তানের আভ্যন্তরীন বিষয়ে ভারতের জোরপূর্বক এবং অন্যায় হস্তক্ষেপ। ৩০ শে মার্চের আরেকটি প্রতিবাদ লিপিতে আগের প্রতিবাদ লিপির সারমর্ম পুনর্ব্যাক্ত করা হয় এবং বিপজ্জনক নজির প্রতিষ্ঠিত হয়।
এটা অনস্বীকার্য সত্য যে ২৯শে মার্চে দেওয়া ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মিসেস গান্ধীর বক্তব্যে, ভারতীয় পার্লামেন্ট একটি সমাধান প্রস্তাবের সম্মতি হয় যে তারা বেনামে সমর্থন দিবে পূর্ব পাকিস্তানের এই “স্বাধীনতা সংগ্রাম” এ, এবং দাবী করে যে পরিস্থিতি নাগালের বাইরে যাবার আগেই ভারত সময় মত সিদ্ধান্ত নিবে (এবং ক্ষেত্রবিশেষে তার কর্মের ও ) এই ব্যাপারে। পরের দিন বিহার ও আসামের রাজ্য পরিষদ সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাব দেয় যে ভারত সরকার যেন ” গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ ” এর প্রাদেশিক সরকারকে স্বীকৃতি দেয় এবং একই মনোভাব তামিলনাড়ু ও মধ্য প্রদেশের প্রধানমন্ত্রীগণও প্রকাশ করেন। বলতে গেলে পরের দিনই ,৩১শে মার্চ ভারতীয় সংসদের উভয় কক্ষেই সর্বসম্মতভাবে পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রতি তাদের ” পূর্ণহৃদয় সমর্থন” ব্যক্ত করে। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী এই সিদ্ধান্তকে এভাবে ব্যক্ত করেন “ভারত ও তার আশেপাশের উপমহাদেশের মানুষের সাথে তার শতাব্দী পুরাতন ইতিহাস,সংস্কৃতি ও রীতিনীতির যে সম্পর্ক,ভারতীয় আইন সভা কিছুতেই , ভারতীয় সীমান্তের এতো কাছে কি হচ্ছে সে ব্যাপারে নিঃস্পৃহ থাকতে পারে না।
পুনরায় ৪র্থ এপ্রিল , সর্বভারতীয় কংগ্রেস কমিটির সাথে এক বৈঠকে বলার সময় ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী দাবী করেন ” এটা ঠিক নয় এবং সম্ভবও নয় ” যে ভারত চুপ বসে থাকবে ।
“গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ ” এর প্রাদেশিক সরকারের জন্য এটা অস্তিত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ, বিশ্ব সংবাদসংস্থার রিপোর্ট অনুসারে, মার্চ এর শেষের দিকে ভারত সীমান্ত হতে আধ মেইল দূরে একটি আমবাগানে, ভারতীয় সামরিক কর্মচারীগণ গার্ড অফ ওনার প্রদান করে।
এছাড়াও এটি সাধারণ অভিমত যে এই তথাকথিত সরকার (পাকিস্তানি মাটিতে এর প্রতীকী ঘোষণার পরপরেই ) কলকাতায় বিনা ভাড়ায় ভারতীয় কর্তৃপক্ষের ভাড়াটিয়া হিসেবে রাষ্ট্রীয় অতিথিশালায় থাকা শুরু করে যেখানে একজন ভারতীয় সরকারী কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয় তাদের সহায়তার জন্য এবং সেই সাথে কোন সন্দেহ নেই যে তাদের উপর নজরদারী করতেও।
১৯ শে এপ্রিল প্রকাশিত ফরাসি পত্রিকা কমব্যাট এর একটি প্রতিবেদন অনুসারে এই ” সরকার ” এর প্রধানমন্ত্রী তার শাসনব্যবস্থাকে মৃদুভাবে বলতেন ” দ্রুত প্রসারণশীল ” । যদিও, ২৩ শে এপ্রিল লন্ডন টাইমস এই বিষয়টাকে সরাসরি এভাবে প্রকাশ করে যে এই দেশের প্রধান হচ্ছে ” রাষ্ট্রবিহীন রাষ্ট্রপতি ” ।
আমরা যখন ভারতের হস্তক্ষেপের বিষয়ে পাকিস্তানের দাবীসমূহকে মূল্যায়ন করতে যাই ,প্রত্যক্ষভাবে বা পরোক্ষভাবে , সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারীদের মাধ্যমে, সশস্ত্র স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে ,বিচ্ছিন্নতাবাদিদের জন্য নিরাপদ আশ্রয় প্রদানের মাধ্যমে ,বিদ্রোহীদের অস্ত্রসস্ত্র প্রদানের মাধ্যমে এবং পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধে উস্কানি প্রদানের মাধ্যমে, কোন প্রকার ভারতীয় সম্পৃক্ততা নাকচ করার প্রশ্নই উঠে না , যেখানে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নিজেই বিভিন্ন কথায়, ভারতীয় সংসদ এবং ভারতীয় আঞ্চলিক পরিষদে এবং শাসক কংগ্রেস দলের বিভিন্ন দাবীতে এটা উঠে এসেছে ।
.
ভারতীয় কতৃর্পক্ষ নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে বিচ্ছন্নতাবাদী গোষ্টীগুলোকে সরাসরি ইন্ধন দিয়ে যাচ্ছে যা আভ্যন্তরীন কোন্দলকে তরান্বিত করছে। ভারতীয়রা যদি এ সিদ্ধান্ত থেকে কখনও পিছু হটে তার মানে হবে এই যে তারা অবশেষে বুঝতে পেরেছে যে তারা, সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সাপোর্ট পাওয়া সত্ত্বেও, এই বিচ্ছন্নতাবাদী গোষ্টীগুলোর শক্তিকে অতিরিক্ত প্রাধান্য দিয়ে ফেলেছিল।
.
আন্তর্জাতিক আইনের অবমাননা আগেও হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে, কিন্তু তুলনামূল ভাবে আরও বেশী বিমূর্ত ভাবে। কিন্তু যদি ইন্ডিয়ার সেন্ট্রাল গভার্মেন্ট বাহ্যিক ভাবে আরও গ্রহণযোগ্য আন্তর্জাতিক আচরণ বিধি অনুসরণের চেষ্টা করতে বিলম্ব করে, তবে এমন সন্দেহই ইন্ডিয়ার আঞ্চলিক কর্তৃত্বকে বাধাগ্রস্থ করতে পারবে না।
২৪শে এপ্রিল , দ্যা ইকোনমিস্ট অফ লন্ডন পশ্চিম বঙ্গের ডেপুটি চীফ মিনিস্টার, মিঃ বিজয় সিং নাহেরের ঘোষণার উপর প্রতিবেদন প্রকাশ করে। যেখানে বলা হয়েছিল, ‘ আমরা পশ্চিমবঙ্গ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছি, যদিও কেন্দ্রীয় সরকার তা এখনও দেয়নি।
একজন শুধু আশা করতে পারে যে এটা রাজ্য সমূহের স্বীকৃতি দান শুরু করার কোন উদ্ভট টুইস্ট প্রচেষ্টার উদাহরণ না। যেমন টেক্সাস শুধু ফারমোসার স্বীকৃতিতে জোর দিচ্ছিল যখন যুক্তরাষ্ট্রের বাকি অংশ স্বীকৃতি দেয় গণপ্রজাতন্ত্রী চীনকে। অথবা ইউক্রেন বিবেচনা করেছিল বার্লিন প্রেক্ষাপটের নীতিমালা এবং জার্মানরা প্রশ্ন তোলে যখন সমগ্র সোভিয়েত ইউনিয়ন অন্য নীতি বিবেচনা করে। কিংবা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার ইউনিয়ন প্রদেশ আত্মস্থ করেছিল বাকি সমগ্র গণপ্রজাতন্ত্রী চীন হতে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক নীতিমালা।
.
প্রধান/ লক্ষণীয় পয়েন্ট
পূর্ব পাকিস্তান সংকটের ব্যাপারে ইন্ডিয়ার ভূমিকার লক্ষণীয় বিষয়গুলো স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে, কারণ ইন্ডিয়া অফিশিয়ালি এবং আনফিসিয়ালি, প্রকাস্বে এবং গোপনে, কেন্দ্রীয় এবং আঞ্চলিক লেভেলে, দুটি দেশের মাঝে শান্তিপূর্ন সম্পর্কের সকল নিয়ম নিতির প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করে চলেছে ঠিক সেই স্টেজে যাকিনা পৃথিবীর ইতিহাস সাক্ষ দেয় যে একবার এমন পর্যায়ের হস্তক্ষেপ শুরু করলে তা পরে ফ্রাংকেন্সটাইন হয়ে দেখা দেয় এবং এ কারণেই তা উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বস্তুত আন্তর্জাতিক মামলা, চার্টার এবং ঘোষণার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত প্রতিটি নিয়ম নিতি গত কয়েক বাসে ইন্ডিয়া অমান্য করেছে।
এটা বলা যায় যে যদিও ইন্ডিয়ার কার্যক্রম হস্টাইল কর্মের ক্যাটাগরিতে পড়ে ‘অনেকটা যুদ্ধের মত’ তথাপি এটা সম্ভব হয়েছে পাকিস্তানের সংযমের কারণে।
.
আন্তর্জাতিক আইন সমূহের গুরুত্বপুর্ন বাঁধাসমূহ
ঠিক একই কারণে ভারতের হস্তক্ষেপের বিষয়ে আন্তর্জাতিক মহলের নীরবতা আন্তর্জাতিক আইন আদেশ ও শান্তির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। বিশ্বের নিন্দা ও নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বের ভারতের এমন আচরণ কেবলই অন্যান্য রাষ্ট্রকে তাদের প্রতিবেশীর প্রতি বিরোধপূর্ণ আচরণকে উৎসাহিত করে তুলতে পারে; যখন তাদের প্রতিবেশীরা সম্পৃক্ত থাকে তাদের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নিয়ে কিংবা প্রাদেশিক দাবী বিষয়ে একে অপরকে সন্তুষ্ট করতে।
এটা বরাবরই প্রকাশ করে যে অনেক রাষ্ট্ররই নিজস্ব কাটাঙ্গা (Katangas একটি নাম) সমস্যা রয়েছে কিন্তু সকল রাষ্ট্রই এধরণের পরোক্ষ আগ্রাসন প্রকাশ করবে না যা কিনা ভারতের এই ক্ষিপ্র এবং অসংযত হস্তক্ষেপকে বাধাগ্রস্থ করার জন্য পাকিস্তান করেছিল।
.
ঠিক এক বছর আগেও, বায়াফ্রা একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃত ছিলো, যারা ওই সময় তাদের নিয়ন্ত্রনের মধ্যে ছিলো এবং একটি সুদীর্ঘ কালব্যাপী পরিষ্কার ভাবে চিহ্নিত একটি রাজ্যসীমা ছিলো। এমনকি, ১৯৩৬ সালের ২৬শে জুলাইয়ের আগ পর্যন্ত হিটলার ও মুসোলিনী আন্তর্জাতিক আইনের সমর্থক ছিলেন না যতক্ষন স্পেনের এক তৃতীয়াংশ জাতীয়তা বাদের নিয়ন্ত্রনে ঢুকে পড়ে।
সামগ্রিক বিশ্ব সম্প্রদায়ের জন্য এসব কিছুই যথেষ্ট দুঃখজনক কিন্তু ভারত নিজেই তার নিজের জন্য বড় বিদ্রুপ, সেই সাথে বহুভাষা পূর্ন এবং বহু ধর্মী। এই ব্যাপারে আন্তর্জাতিক আইন ভাঙ্গার ভালো প্রমান হিসাবে ভারত হতে পারে সবচেয়ে বড় ভুক্ত ভুগী।
প্রদত্ত এইসব এবং যেটি পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষমতাবান কাটাংগাকে ক্ষিপ্রতার সাথে নিয়ন্ত্রন করা হয়েছিল। এবং প্রশ্ন উঠে কেন ভারতীয় নেতৃত্বের উচিত এ বিষয়ে তীব্র বেগে অগ্রসর হওয়া। বাতাসে হুশিয়ারি প্রদান এবং আন্তর্জাতিক আইন এ কর্ম উপেক্ষা করার পরিনতি এবং আন্তর্জাতিক শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য এবং সেই সাথে অবশ্যই আভ্যন্তরীন ভারতীয় স্থিতীশীল অবস্থার জন্য।
৪। ভারতীয় কর্মকান্ডের উপর রাজনৈতিক প্রভাব
সাম্প্রতিক পাকিস্তান সংকটে ভারতের ভুমিকা রাজনৈতিক প্রভাব নিয়ে এসেছে।
পাকিস্তান এবং ভারত বিভেদের অন্যতম প্রধান কারন হিসেবে পাকিস্তান কথনে ১৯৪৭ সাল থেকে বারংবার যে বিষয়টি কেন্দ্রীকরন করা হচ্ছিল তা হচ্ছে, ১৯৪৭ সালের উপমহাদেশের বিভক্তির পর থেকে ভারত কখনোই পূনর্মিলিত হতে চায়নি।
ভারতের এর জবাবে বলেছিলো (যা দূর্ভাগ্যবশত পৃথিবীর বিভিন্ন অংশের সবচাইতে দুর্বল শ্রোতাদের কাছ থেকেই পাওয়া গিয়েছিলো) ভারত সব শেষে মেনে নিয়েছে পাকিস্তানের বাস্তবতা এবং যার বিরোধে পাকিস্তানের অভিযোগ কঠিন নিপীড়নের আরেকটি উপাদান।
কিন্তু বিগত কয়েক মাসের ঘটনায় দেখা যায় পাকিস্তানের অভিযোগ আরেক বার সত্য হয় এবং পাকিস্তান প্রসঙ্গে ভারতের উদ্দেশ্য আরো স্পষ্ট ভাবে প্রকাশিত হয়। উল্লেখ্য এ ছাড়াও ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির এ অনুমিত বন্ধন যা উপমহাদেশের মানুষকে একত্রে বেধে BIND (বেধে রাখা শব্দ টি মার্ক করুন) রেখেছিলো, যা ৩১ শে মার্চ ভারতের সাংসদীয় বিশ্লেষনের অন্তর্ভুক্ত, দিল্লীর ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ ওয়ার্ল্ড এফেয়ার্সের ঘোষনার আগেই ঠিক একই সমইয়ে মিঃ সুভ্রামানিয়ান, উল্লেখিত পাকিস্তানের আভ্যন্তরীন সমস্যায় ভারতের মনোভাব সম্পর্কে স্পষ্ট ভাবে তার বক্তব্যে বর্ণনা করেন। যিনি ছিলেন ইন্ডিয়ান ইন্সটিউটের প্রতিরক্ষা শিক্ষার পরিচালক। এটি এমন একটা প্রতিষ্ঠান যার উদ্দেশ্য হচ্ছে দীর্ঘ সময়ের জন্য ভারতীয় সামরিক কর্তৃপক্ষকে পরামর্শ দেয়া।
মিঃ সুভ্রামানিয়ান বলেন, “ভারতকে যে সত্যটা উপলব্ধি করতে হবে তা হচ্ছে পাকিস্তানের ভাঙনে আমাদের স্বার্থ আছে এবং আমাদের আছে এমন একটা সুযোগ যা আর কখনো আসবে না।
যে কাউকেই সঠিক এবং নিরপেক্ষভাবে অবহিত করা হচ্ছে যে, শুরু থেকে এখনো পর্যন্ত কাশ্মির দ্বন্দ নিয়ে ইন্দো পাকিস্তান সম্পর্কের এই গল্পের জট খুলতে গেলে পাকিস্তানের প্রতি ভারতীয় নীতির এই উপাদান গুলি কে অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে।
.
পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশের সাম্প্রতিক সংকটে ভারতের আচরণ নাটকীয় এবং পাকিস্তান ধ্বংস করে বৃহত্তম অখন্ড হিন্দুভারত প্রতিষ্ঠার অনিরাময়যোগ্য বদ্ধমূল সংস্কারের চূড়ান্ত প্রমাণ বহন করে। এ লক্ষ্যে প্রথম ধাপ হলো পূর্ব পাকিস্তানে একটি পুতুল সরকার প্রতিষ্ঠায় উত্সাহ এবং সহযোগিতা করা যারা ভারতের সুবিধানুযায়ী কাজ করে যাবে।
প্রচুর পরিমানে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা মিস্টার সুব্রামানিয়ামের মতো লোকের কাছ থেকে ১৯৭১ এর প্রথম সপ্তাহ গুলোতে এসেছে। এখন পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়িত হচ্ছে। মার্চেয় প্রথমদিকে পাকিস্তান সরকারের কাছে প্রচুর সংখ্যক প্রতিবাদী স্মারকলিপি এসেছে, শুধুমাত্র প্রচারণা নির্ভর এবং ধ্বংসকে উত্সাহিত করার মনোভাব থেকে।
ভারতীয় হিসেবনিকেশ
আইনগত কর্তৃপক্ষের পতন এবং রাজপথে সৃষ্ট হুজুগে বিশৃংখলা ভারতের নেতারা দৃঢ়ভাবে অনুসরণ করছিলো এবং পরিকল্পিত ভাবে যোগাযোগ ব্যাবস্হায় বাধা সৃষ্টি করে সরকারের স্বাভাবিক কাজকর্ম বজায় রাখা অসম্ভব করে তুলেছিলো। বাঙালী এবং অবাঙালীদের মধ্যে বিরোধ তৈরির মাধ্যমে পাকিস্তানের পূর্ব অংশের নাগরিকদের মাঝে আতঙ্ক সৃষ্টি করে এই অরাজকতায় মৌনসম্মতি আদায় করে নিচ্ছিলো।
ভারতীয় কর্তৃপক্ষ ধরে নিয়েছিলো সাফল্য তাদের আয়ত্তাধীন এবং শেষ মিনিটের সিদ্ধান্তে পাকিস্তান আর্মি স্বাভাবিকতা পুনঃপ্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হতে বাধ্য ছিলো। যার ফলে ভারতের প্রচেষ্টা আরো চড়ারূপ পায় মার্চের শেষের দিকে এবং এপ্রিলেও। ভারতের রেডিও এবং সংবাদপত্র গুলো বিচ্ছিন্নতাবাদী মিলিটারী শক্তির বিজয়ের কথা লাগাতার প্রচার করে প্রতারণা করে যাচ্ছিলো যে পাকিস্তানী বাহিনীতে ভয়াবহতা এবং বিশৃখলা ছড়িয়ে পড়েছে।
এখানে এটি একটি গভীর পরিতাপের বিষয় যে বিদেশী সংবাদপত্রগুলো ভারতের দৃঢ়ভাবে প্রচারিত কথাগুলোই বাইবেলের মতো সত্য বলে গ্রহন করছিলো।
এরমধ্যে পাকিস্তানের মনোযোগ ছিলো স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনায়, যাতে প্রদেশের অর্থনৈতিক অবস্হা আত্মঘাতী বাধা না হয়ে ওঠে। বিচ্ছিন্নতাবাদীরা এবং মধ্যস্ততাকারীরা যাতে ব্যর্থহয়ে পশ্চাদপসরণ করে এবং পোড়ামাটি নীতি অনুসরণ করতে না পারে সেই লক্ষে কাজ করে তাদের নিঃসঙ্গ করে দেয়া।
এপ্রিলের ভিতর ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে এটি পরিষ্কার হয়ে যাবে যে পাকিস্তান ভেঙে দেয়ার চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। কারন তাদের সংবাদমাধ্যম এবং রেডিও নতুন পথে হাঁটছে। তাদের ভাষায় ‘পশ্চিম পাকিস্তানের সাম্রাজ্যবাদী, দখলদার শক্তি’ এসবের জায়গা নিয়েছে শরনার্থীদের দুর্ভোগ এবং দুর্ভিক্ষের করুন বর্ননা।
যদিও এখানে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই যে গত কয়েকমাসে পূর্ব পাকিস্তানে মানবিক বিপর্যয় ঘটেছে।
যে প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে তা হলো, এটা কি করে হলো এবং এজন্য কে দায়ী, এবং এখানে ক্ষীণ সন্দেহ আছে যে এটা পূর্ব পাকিস্তানে বিপ্লবের পরিকল্পনা, উত্সাহ্ এবং তা বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নেয়ার সরাসরি ভারতের প্রচেষ্টার ফলাফল। খাদ্যশস্য এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি গুদাম থেকে দরকারী জায়গায় পৌঁছে দিতে বাধার সৃষ্টি করে যাচ্ছিলো।
.
.
সংরক্ষিত এই খাদ্য আনাহারের ভয়ে ছুটতে থাকা মানুষের জন্য পর্যাপ্ত হতে পারত।কিন্তু আতংক সৃষ্টিকারী বিমান ছিল ভারতীয় বেতারের কৃতিত্ব যখন পাকিস্থানি বেতার মহড়ার খবর প্রকাশ করা খুব সামান্যভাবেই সক্ষম হয়েছিল চতুরপাশে ঘটতে থাকা ঘটনা সম্পর্কে জনসাধারণকে আশ্বস্ত করতে। এর মাধ্যমেই পূর্ব পাকিস্থানের মুসলমান এবং হিন্দুরা বুঝতে সক্ষম হয়েছিল যে দেশের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসছে এবং কর্তৃপক্ষ এ বেপারে কোন প্রচেষ্টটাই চালাছে না।
একজন বহিরাগত নিরপেক্ষ প্রত্যক্ষদর্শীর মতে, সত্যিকার অর্থে উদ্বাস্তুদের দায়দায়িত্ব নিরূপণ করা ছিল অনেকটাই অসম্ভব, কিন্তু মাঝেমাঝে তথ্যের সত্যতা পরিবর্তিত হতে পারে সম্ভাব্য দলের উদ্দেশ্য অধ্যয়ন এবং অতীতের আচরণের কারনে।
পরিষ্কারভাবেই পাকিস্থানি কর্তৃপক্ষের সম্ভাব্য সবকিছুই অর্জন করা দরকার ছিল পূর্ব পাকিস্থানে স্বাভাবিক, শান্তিপূর্ণ জীবনমাত্রা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার জন্য। অন্যদিকে ভারতের বিগত কয়েক মাসের কার্যক্রমে আবারও বোঝা যায় পূর্ব পাকিস্থানের কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের ভাঙ্গনই তার দীর্ঘমেয়াদি উদ্দেশ্য সাথে মানানসই।
পঞ্চমঃ ভারতের পদক্ষেপ- দক্ষিণ এশিয়ার স্থায়িত্তের প্রতি হুমকি
অবশ্যই ইহা পুরোই ছিল ভারতের দীর্ঘমেয়াদী মুল উদ্দেশ্য যা দক্ষিণ এশিয় অঞ্চলের পুনঃগঠনের জন্য হুমকি সরূপ (সম্ভবত তারও বেশি কিছু)।
পাকিস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে ভারতের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনাগুলো প্রতিহত করা সম্ভব হবে- এ বিষয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয় যার অন্তর্ভুক্ত ছিলঃ কাশ্মীর বিতর্ক, ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ, ভারতীয় মুসলমানদের পর্যায়ক্রমিক প্রোগ্রাম, অতিরিক্ত বিমান মহড়া নিষেধাজ্ঞা মাধ্যমে পাকিস্থানের দুই অংশকে বিছিন্ন করা, ক্রমাগত খোঁচানো/উস্কানো এবং জ্বালাতন করা, বড়ছোট যে কোন ক্ষেত্রেই; আর এখন নির্বিশেষে সমস্ত আন্তঃরজাতিক আইন ধর্মীয় অনুশাসন ও আচার এবং এর পরিক্রিয়া উপেক্ষা করে পূর্ব পাকিস্থানের বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা।
ভারতকে বুঝানো সম্ভব ছিল যে পাকিস্থান এসেছে থাকতে, স্বাধীন সমতা ও নিরপেক্ষ শ্রদ্ধার ভিত্তিতে প্রতিবেশী দেশ হিসেবে অবস্থান করবে এবং যার মাধ্যমে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে?- এটা আশা করা কি খুব বেশি কিছু ছিল?
এক্ষেত্রে ভারতের পক্ষে একমাত্র আশ্বস্ত করার মতন নতুন পদক্ষেপ হতে পারত যদি বিরাজমান সমস্যার দিলে আলপাত করে দুই দেশের মধ্যকার দীর্ঘমেয়াদী বিবাদ নিরসনে অস্ত্রের মাধ্যমে পাকিস্থানকে প্রতিহত এবং ধাপে ধাপে পুনঃশোষণ প্রচেষ্টা না করা। বরং সেই সকল সমস্যাগুলার দিকে নজর দেয়া যেসব সমানভাবে দুইদেশের স্বার্থ রক্ষার্থে স্থায়ীভাবে সমাধান যোগ্য এবং সেই সকল সমস্যা যা প্রক্রিতভাবেই সহ্য করা অযোগ্য; শান্তি ও স্থায়ীতের পথে অন্তরায়। যেখানে ভারতের জন্য মহাবিপদ নিহিত; সাথে সাথে অন্যদের স্থায়ীতের প্রতিও হুমতি সরূপ।
নির্মাণে,
চলচিত্র ও প্রকাশনা বিভাগ, পাকিস্থান সরকার
জুন, ১৯৭১
.
.
শিরোনাম সুত্র তারিখ
১৩৫। পুর্ব পাকিস্তানের সংকটে ভারতের ভূমিকা সরকারি প্রচার পত্রিকা জুন ১৯৭১
.
পুর্ব পাকিস্তানের সংকটে ভারতের ভূমিকা
শেখ মুজিবুর রহমান ভারতের যুদ্ধ করছেঃ ৮ এপ্রিল ১৯৭১ নয়া দিল্লীতে অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটির পশ্চিম বাংলা শাখার সধারন সম্পাদকের কাছ থেকে এই স্পষ্ট এবং সরাসরি স্বীকারোক্তি আসে । প্রকৃত ঘটনা যখন আড়াল রাখা যেত যে ,ইন্ডিয়া সরাসরি পাকিস্তানের পুর্ব প্রদেশে ১৯৭১ এর মার্চ এপ্রিলে সংঘঠিত সশস্ত্র বিদ্রোহের সাথে জড়িত ছিলো।কয়েক দিনের মধ্যেই বিদ্রোহ খুব দ্রুত শেষ করে দিয়েছিলো করিতকর্মা পাকিস্তান আর্মি ।এবং যখন পুর্ব পাকিস্তানের শহর এবং গ্রামাঞ্চলে ও জীবনযাত্রা দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে আসছে । এই বিদ্রোহের ধরন , প্রধান উদ্দেশ্য এবং পদ্ধতি নির্নয় করা খুবই সম্ভব ।একটা কারনে এটি স্পষ্ট যে ,যে যুদ্ধের জন্য ইন্ডিয়ার নেতারা এতোটা নির্লজ্জভাবে একে জনগণের কৃতিত্ব বলে প্রচার করছে, তা ছিলো সন্দেহাতীতভাবে ইন্ডিয়ার নিজস্ব । এই বিদ্রোহের পিছনে কেবলমাত্র ইন্ডিয়ার সেনাবাহিনীর অনুপ্রবেশই দায়ী নয় বরং ইন্ডিয়ান সংবাদ মাধ্যম বিশেষ করে সরকার নিয়ন্ত্রিত বেতারগুলো বিদ্রোহের পর থেকে কল্পিত অঞ্চলে কল্পিত যুদ্ধ বাঁধিয়ে যাচ্ছিলো ।অথচ বিদ্রোহিরা তখন হয়তো আত্মসমর্পন করছে অথবা পিছু হটে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে চলে যাচ্ছে।
পাকিস্তানকে বিভাজনের জন্য ইন্ডিয়ার পরিকল্পনা কতো গভীর এবং সুদূরপ্রসারী ছিলো ,তা এখন বোঝা যাচ্ছে। ১ এপ্রিল ১৯৭১, “ব্রিটিশ ডেইলি ইয়ররকশায়ার পোষ্ট” জানায়, পাকিস্তানকে ধ্বংস করার ইন্ডিয়ার চেষ্টা পুর্ব পাকিস্তানে শুধু সামরিকভাবেই নয়,আই যে ষড়যন্ত্রের পিছনে অনেক ঐতিহাসিক কারন ও রয়েছে। ১৯৪৭ এ পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই তারা এসব শুরু করেছে । তখন থেকেই পাকিস্তানের সাথে বিরোধ দূর করতে তারা কোন পদক্ষেপ ই নেয়নি ,বরং এই দেশকে খোঁড়া বানাতে সব্রকম পরিকল্পনা প্রয়োগ করেছে।
লন্ডন “ডেইলি টেলিগ্রাফ” এর সাংবাদিক ডেভিড লোসাক লেখেন যে ,ভারত এর প্রধান প্রতিদন্ধীর বিচ্ছিন্ন হওয়া বা দুর্বল হবার ভিতরেই কেবলমাত্র নিজের ভালো দেখতে পায়।তিনি আর ও বলেন নিরপারাধ জঙ্কগনের জন্য দুশ্চিন্তার পিছনে যে মিথ্যাটা ছিলো,তা হলো এই যুদ্ধটা বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে হচ্ছে বলে প্রচারণা করা ।অন্য একজন অস্থায়ী এশিয়া বিষয়ক ব্রিটিশ মুখপাত্র মশেল এডওয়ার্ডস বিবিসির “word Today” প্রোগ্রামের আলোচনায় ১ এপ্রিল ১৯৭১ এ বলেন যে ,পশ্চিম বাংলার বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং গোষ্ঠীর ভিতর পুর্ব পাকিস্তানে সমস্যা তৈরি কারীদের জন্য সহানুভূতি প্রকাশের প্রতিযোগিতা চলছে এবং তাদেরকে সংগঠিত করে সাহায্য সহযোগিতা করা হচ্ছে ।
রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক বিবেচনায় পশ্চিম বাংলা পুর্ব পাকিস্তানের সাথে সমন্বয় সাধন করতে অনুপ্রাণিত হয়েছিলো ।বিভাজন করে পশ্চিম বাংলার নেতারা আশা করছিলো পুর্ব পাকিস্তানের উপর নিজেদের কৃতিত্ব আরোপ করে তাদের কলকারখানার কাঁচামাল সংগ্রহ করতে।
ইন্ডিয়ার উদ্দেশ্যসমুহ বিশ্লেষণ করে পুর্ব পাকিস্তানের অন্যতম প্রধান পত্রিকা “দ্যা পাকিস্তান অবজার্ভার” চিহ্নিত করে ইন্ডিয়ার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হলো পাকিস্তানকে দুর্বল দেখা যার পরিণতিতে পাকিস্তান ভেঙ্গে যায়।তারা পুর্ব পাকিস্তানকে দখল করতে অর্থনৈতিকভাবে প্রনোদনা দেবার চেষ্টা করে যাচ্ছে।বিশ্ব পাট বাজারে ইন্ডিয়া কঠিন সময় পার করছে শুধুমাত্র পুর্ব পাকিস্তানের পাট শিল্পের কারনে ।কলকাতার অনেক পাটকল যেগুলো পুর্ব পাকিস্তানের পাট দিয়েই প্রতিষ্ঠিত এবং চালিত হতো ,সেগুলো পাকিস্তান সৃষ্টির পর বন্ধ করে দিতে হয়েছিলো কারন তখন আর পুর্ব পাকিস্তানের পাট পাওয়া যেত না ।যেখানে পাকিস্তান সৃষ্টির আগে দূর দুরান্ত থেকে কলকাতা বন্দরে পাট পৌছে যেতো ।পাটিশানের পর পুর্ব পাকিস্তানের নিজস্ব পাটশিল্প গড়ে উঠেছে ।ইন্ডিয়ার দৃষ্টি এখন পুর্ব পাকিস্তানের পাটের উপর ।এইসব অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য,সেইসাথে পরিকল্পনায় যুক্ত হয়েছে পাকিস্তানের সাথে রাজনৈতিক বিরোধিতা ,সব মিলিয়েই ভারত চায় পাকিস্তানের পুর্ব অংশকে আলাদা করতে ।এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতেই যে পুর্ব পাকিস্তানে সশস্ত্র বিদ্রোহ ঘটানোর জন্য অস্ত্র এবং সৈন্য পাঠাতে শুরু করেছে ।এটা এখন পরিষ্কার যে, বিভিন্ন সময় সর্বতভাবে পুর্ব পাকিস্তানে রাষ্ট্র বিরোধী ষড়যন্ত্র করে আসছে ।জোর পুর্বক পূর্ব পাকিস্তানকে দখল করার জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্র এবং অর্থের যোগান দিয়ে একটা গোপন সংগঠন গড়ে তুলতে চেষ্টা করছে।
“আগরতলা ষড়যন্ত্রে মুজিব জড়িত”
১৯৬৭ সালে যখন আগরতলা ষড়যন্ত্র উদ্ঘাটিত হয় তখন ভারতের এই ষড়যন্ত্রে সরাসরি জড়িত থাকার এবং রাষ্ট্র বিরোধী কর্মকান্ডের প্রত্যক্ষ প্রমান আলোতে আসে ।এছাড়া বিভিন্ন প্রত্যক্ষদর্শী এই ষড়যন্ত্রে মুজিবের জড়িত থাকার ব্যাপারে সাক্ষ্য দেয় ১৯৬৪ সালের প্রথম দিকেই ।এটি হলো সেই সময় যখন ষড়যন্ত্রকারী গ্রুপ করাচীতে “পুর্ব পাকিস্তানকে আলাদা করতে একটি বৈপ্লবিক সংগঠন গড়ে তোলার” জন্য শেখ মুজিবের আহবানে সমবেত হয়েছিলো।
আগরতলা ষড়যন্ত্রের প্রধান পরিকল্পনা ছিলো সেনাবাহিনীর অস্ত্রাদি দখল করে তাদের খোঁড়া করে দেওয়া ।কমান্ডো স্টাইলে এবং হটাত করেই এসব আক্রমণ ঘটছিলো এবং জনবলের অভাবে ক্ষতিপূরণ করা সম্ভব হচ্ছিলোনা।এইসব বিষয় লক্ষ্য করেই একটি মিটিং আহবান করা হয়েছিলো ,যেখানে বিচ্ছিন্নতাবাদী ষড়যন্ত্রকারীদের প্রতিনিধিদের সাথে ছিলো পাকিস্তানে বিভিন্ন কর্মকান্ডে জড়ানো ভারতীয় প্রতিনিধি যারা অস্ত্র এবং গোলা বারুদ সরবরাহ করতো।এই মিটিং ১৯৬৭ সালের ১২ জুলাই ভারতের আগরতলায় অনুষ্ঠিত হয় ।
১৯৬৭ সালে যখন ষড়যন্ত্রকারীরা আটক হয় আটক কারীদের একজন ফাঁস করে দে যে , পুর্ব পাকিস্তানে একটি সশস্ত্র বিদ্রোহ ঘটানোর জন্য ভারত অস্ত্র এবং অর্থনৈতিক সাহায্যের ব্যাপারে কথা দিয়েছে।ভারত তাদেরকে বলেছে ভারত সরকার পুর্ব পাকিস্তানের সাথে পশ্চিম পাকিস্তানকে সংযোগকারী নৌ এবং আকাশপথ বন্ধ করে দিবে ।
“ব্যাপক অস্ত্রশস্ত্র মজুদ হুমকি স্বরূপ”
এটি ছিলো চার বছর আগের কথা ।কিন্তু ইন্ডিয়া ১৯৭১ এর ফেব্রুয়ারীতেই হুমকি হয়ে দেখা দিলো ।যখন ইন্ডিয়া অধ্যুষিত কাশ্মীরের দুই দুর্বৃত্ত পুর্ব পরিকল্পিতভাবে পাকিস্তানের মাটিতে একটি ভারতীয় এয়ারক্রাফট উড়িয়ে দেয়।
১৯৭১ এর ফেব্রুয়ারীর দিকে ইন্ডিয়া পশ্চিম বাংলা প্রদেশে নির্বাচনী প্রয়োজনে লোকদেখানো অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার কথা বলে বড়ো আকারের সেনাবাহিনী জড়ো করছিলো। নির্বাচন শেষ হয়ে যাবার পর, অতিরিক্ত আর্মি ফিরে যাওয়ার পরিবর্তে ভারত থেকে পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশ করছিলো। ১৯৭১ এর মার্চের শেষের দিকে পর্বতারোহী, ছত্রীসেনা, এবং বিমানবাহিনীর সহযোগিতায় সৈন্যরা সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করে।
যুগপত্ভা বে পাকিস্তানের রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকান্ডকে সহযোগিতা করতে ভারতীয় বাহিনী সিভিল ড্রেসআপে পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তের কাছাকাছি বিভিন্ন জায়গায় অবস্হান করতো। যুদ্ধবিমান এবং অন্যান্য আকাশযান সীমান্তবর্তী অঞ্চলে ঘোরাফেলা করছিলো এবং এর ভিতর অন্তত ছয়টা পশ্চিম পাকিস্তান অভিমুখে যুদ্ধ সতর্কাবস্হায় রাখা ছিলো।
পশ্চিম বাংলায় পাঁচ ডিভিশন সেনা জড়ো করে পরিতৃপ্ত হতে না পেরে ইন্ডিয়ান কর্তৃপক্ষ বিএসএফ এর আরও বাড়তি দল নিয়ে আসে যারা ইতিমধ্যেই পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন জায়গায় অবস্হান করছিলো। এভাবে প্রায় পঁচিশ ব্যাটালিয়ন সৈন্য সীমান্তে জড়ো করা হয়েছে। বিদ্রোহী এবং বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সহযোগিতা করতে পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন জায়গায় বিএসএফ অনুপ্রবেশ করে। সীমানা চিহ্ন মুছে দিয়ে জীপ সহ অন্যান্য যানবাহন বেসামরিক রংয়ে পুনরায় রং করে।এরপর অতিরিক্ত সীমান্তরক্ষী বাহিনী যারা দিল্লী থেকে এসেছিলো তাদের সব কোর্স বাদ দিয়ে দেয়া হয়েছে এবং পুলিশের ছুটি বাতিল করেছে।
পূর্ব পাকিস্তানের সাথে যোগাযোগ এবং পরিবহন ব্যবস্হা বাধাগ্রস্ত করতে ইন্ডিয়া তার আকাশপথ থেকে পাকিস্তানের সকল এয়ারক্রাফটের ফ্লাইটসমূহ বাতিল করা আরও দৃঢ়তর করতে সমুদ্র পথেও কর্ষিকা বাড়িয়েছে। ২ এপ্রিল ৭১ এ ইন্ডিয়ার যুদ্ধজাহাজ সমুদ্রে পাকিস্তানের নৌযান গুলোকে হয়রানি করে দীর্ঘসময় ধরে। দ্বারকায় ইন্ডিয়ার নৌঘাঁটি থেকে ৭০ মাইল দূরে তারা আক্রমন চালায়। নৌযানটি ইন্ডিয়ান জাহাজের পশ্চাত্ধারবনের কারনে করাচি ফিরে যেতে বাধ্য হয়। তিনদিন পর তারা চিটাগাং অভিমুখে চলতে থাকা ‘সাফিনা ই আরব’ নামক নৌযানকেও হয়রানি করে। পাকিস্তানের বেসামরিক এয়ারক্রাফট গুলোকে জোরপূর্বক দক্ষিণ থেকে দূরে চলাচল করাতে ইন্ডিয়ার উপকূল থেকে ১২৩ মাইল দূরে মাটি থেকে আকাশে ক্ষেপনাস্ত্র নিক্ষেপকারী একটি দল ফারারিং অনুশীলন শুরু করেছে।
ভারতীয় বিমান বাহিনীতেও সম্ভাব্য আক্রমনের জন্য সুনির্দিষ্ট প্রস্তুতি নিতে দেখা গেছে। পাশাপাশি পূর্ব পাকিস্তানের পুবদিকে বাড়তি যুদ্ধবিমানের চলাচল বেড়ে গেছে। এছাড়া উত্তর এবং পশ্চিম দিকেও ভারতের বিমান বাহিনী যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছে। কলকাতার কাছে ব্যারাকপুরে সমুদ্রে রেকি করা কিছু এয়ারক্রাফট বংগোপসাগরে চলাচলকারী পাকিস্তানের জাহাজ গুলোকে রাখছে কড়া নজরদারীর উপর। এছাড়া পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত অঞ্চলে ব্যাপক টহল বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
পূর্ব পাকিস্তানে বিএসএফ এর অণুপ্রবেশঃ ভারতের সেনাবাহিনীর সক্রিয় সহযোগিতায় বিএসএফের সদস্যরা পূর্ব পাকিস্তানে অনুপ্রবেশের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছে। তাদের পরিবহন এবং যোগাযোগ ব্যবস্হায় সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করতে ভারত সরকার, পাকিস্তানের দৃষ্টি আকর্ষণ করে যাচ্ছিলো। তারা অস্ত্র এবং গোলাবারুদ পাঠাতেও শুরু করেছে।
.
.
[পূর্ব পাকিস্তানে
বিএসএফ কর্মীদের অনুপ্রবেশ ]
ভারতীয় সেনাবাহিনীর সক্রিয় সমর্থন পেয়ে বিএসএফ কর্মীবৃন্দ পূর্ব পাকিস্তানে অনুপ্রবেশের তীব্র প্রচেষ্টা শুরু করেন ।তাদের অভিযান সহজতর করতে পূর্ব পাকিস্তানের অগ্রসরমান যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন ভারতীয় কর্তৃপক্ষের নজর কেড়েছে । তারা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কাছে চোরাগূপ্তা উপায়ে অস্ত্র ও গোলাবারুদ পাঠানো শুরু করেছে ।ঈসাপুর রাইফেল কারখানা চিহ্নিত বিপুল সংখ্যক রাইফেল জব্দ করা হয়েছে ।পাশাপাশি কিরকি কারখানা চিহ্নিত গোলাবারুদের মজুদ ও ধরা হয়েছে । এটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে ৭৬ ,৮১ ,৮৩,১০১ ও ১০৪ সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ব্যাটালিয়ন পূর্ব পাকিস্তান অভিযানে নিযুক্ত করা হয়েছিল ।পরবর্তী তথ্যের সূত্রমতে আরো ২টি ব্যাটালিয়নকে নিযুক্ত করা হয়েছিল ; ৭৩ বিএসএফ ব্যাটালিয়ন মখিলগন্জ্ঞ (কোচ বিহার ) এলাকায় , ৭৭ বিএসএফ ব্যাটালিয়ন দিনাজপুরের পশ্চিমে এবং ১৮ বিএসএফ ব্যাটালিয়ন যশোরের পশ্চিম এলাকায় বানগন্জ্ঞে ।সিনিয়র সেনা কমান্ডারদের তত্ত্ববধানে অভিযান পরিচালিত হয় । তাদের মধ্যে একজন ৬১ মাউন্টেন ব্রীজ এর কমান্ডার ছিলেন ও সম্প্রতি তিনি দিমাগিরিতে রাঙামাটির ২৫ মাইল উত্তর পূর্বে স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন ।পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী এলাকাসমূহে ভারতীয়দের কর্তৃক বেশ কিছু শরণার্থী শিবির প্রতিষ্ঠা ও তাদের অধীনে পূর্ববাংলা থেকে আসা তথাকথিত উদ্বাস্তুদের ত্রাণ প্রদান একটি চতুর পদক্ষেপ । এখানকার বেশকিছু ক্যাম্প অনুপ্রবেশ ঘটানো ,পূর্ব পাকিস্তানে রাষ্ট্রবিরোধীদের অস্ত্র ও মজুদ সরবরাহে ব্যবহৃত হচ্ছে । শরণার্থী শিবির তত্ত্বাবধানের এই ফাঁকে ভারতের বিভিন্ন স্থানে তহবিল সংগ্রহের কাজ চলছে এবং এর পাশাপাশি এসব ক্যাম্পে গেরিলা প্রশিক্ষণ ও প্রদান করা হচ্ছে ।
দালিলিক প্রমাণ ‘ যদি কোন প্রমাণ বা তথ্যচিত্র প্রয়োজন হয় যে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারত হস্তক্ষেপ করছে তবে রাজশাহীতেই তা পর্যাপ্ত পরিমাণে রয়েছে’ এপিপি সংবাদদাতা রাজশাহীতে যা প্রত্যক্ষ করেছেন তার প্রাথমিক বর্ণনায় বলেন ।বেশকিছু সংবাদপত্রে প্রকাশিত তার কিছু উদ্ধৃতি এখানে তুলে ধরা হলো : ‘সেনাবাহিনী এক গাদা ভারতীয় অস্ত্র ও গোলাবারুদ জব্দ করেছে ।চেক চিহ্নিত একটি ভারী অস্ত্র স্থানীয় সেনাবাহিনীর কমান্ডার দেখিয়েছিলেন যা যুদ্ধক্ষেত্রের ১টি উল্লেখযোগ্য অস্ত্র ।চেক অস্ত্র ভারতীয় সেনাবাহিনীর দ্বারা ব্যবহৃত হয় যা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিকট কখনোই ছিল না ।এটা নবাবগন্জ্ঞ এলাকার অনুপ্রবেশকারীদের কাছ থেকে জব্দ করা হয় ‘ আমি সেনাকর্মকর্তার অধিকার করা একটি ডকুমেন্ট দেখেছি যা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সশস্ত্র ভারতীয় উত্থানের চাইতেও গুরুতর কিছুকে ইঙ্গিত করে ।এই নথি আরো প্রমাণ করে যে আওয়ামীলীগের কিছু বিচ্ছিন্ন গ্রুপ ভারতের সাথে জোটবদ্ধ হয়ে অখন্ড পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ।সীমান্তে একজন ভারতীয়র সাথে ভারী অস্ত্র সরবরাহের ব্যাপারে আলোচনা করার জন্য এই গোপন নথিটি একজন স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতা কর্তৃক রাষ্ট্রবিরোধী একজন ব্যক্তির ঠিকানায় প্রেরিত হয় ।এটা রাজশাহী শহরের ডা . বাচ্চু কর্তৃক হাতে লিখা হয় যেটি ভারতীয় সীমান্তের ১৩ মাইল দূরত্বে মুর্শিদাবাদ জেলার নবাবগন্জ্ঞে বসবাসকারী কাশেম সাহেবের নিকট প্রেরণ করা হয় । ‘চিঠির বিষয়বস্তু পড়ে একজন ব্যক্তি সামান্য পরিমাণ বুদ্ধিমত্তার সাথে বলতে পারেন যে ভারতের লোক আওয়ামীলীগের অনুকূলে কাজ করছে ‘ যে সংগ্রহটি বর্হিবিশ্বের নিক চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিবে নিতে তা পরিবেশন করা হল.
জরুরি . . .কাশেম সাহেব. . . অপরপক্ষের একজন প্রতিনিধি অনানুষ্ঠানিকভাবে এখানে এসেছিলেন এবং জানান যে কেউ একজন অথবা অধিনায়ক সাহেব আমাদের সঙ্গে ভারী অস্ত্র সরবরাহের বিষয়ে জরুরী আলোচনার জন্য সাক্ষাত করবেন ।আমি তাকে সময় দিয়েছি যে আপনি এবং আমি আগামীকাল রাত ১২ টায় মহিদপুরে পৌঁছাব ।এটি আমাদের নিকট অনানূষ্ঠানিক অস্ত্র সহায়তা ।তাই দয়া করে রাতের মধ্যেই এখানে পৌঁছাবেন । . . . . . . . . .ডা . বাচ্চু বি দ্র : মন্টু আজকে আবার অপরপক্ষে গিয়েছিল ‘ চিঠিতে উল্লেখিত ঠিকানা জনাব কাসেমের বাসা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ।৮ এপ্রিল ১৯৭১ তারিখ উল্লেখিত ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামীলীগ ,নওয়াবগন্জ্ঞ ,রাজশাহী বিভাগ’ সম্বলিত একটি ছাপানো প্যাডে এটি লিখা হয়েছে ।এর বাম পার্শ্বে নওয়াবগন্জ্ঞ আওয়ামীলীগ এর প্রেসিডেন্ট ও সাধারণ সম্পাদকের নাম ছাপানো আছে ।প্রেসিডেন্ট এর নাম আলহাজ রাইসুদ্দিন আহমেদ ,MNA এবং সম্পাদকের নাম ডা . এ. এম. মিসবাহ উল হক ,MPA. ‘ বেসামরিকদের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত যারা সশস্ত্র ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীদের সাক্ষী তারা হলেন : জনাব আকতার আহমেদ ,একজন রাজনীতিবিদ যিনি উত্তর বাংলাকে পৃথক প্রদেশ করার একজন সমর্থনকারী ;জনাব মারগুব মোর্শেদ ,অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনার এবং পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক প্রধান বিচারপতির ছেলে; বেগম হুসেন আরা রাশিদ ,রাজশাহীর ডেপুটি কমিশনারের স্ত্রী এবং জনাব মুহম্মদ সাইফুল্লাহ ,রেডিও পাকিস্তানের রাজশাহী স্টেশনের আঞ্চলিক পরিচালক ।আমি এদের সকলের সাথেই পৃথকভাবে এবং আরো অনেকের সহিত সাক্ষাত করেছি ‘
কেন্দ্রীয় ভারতীয় উপভাষীয় পুরুষদের বন্দুকবাজ দল ‘জনাব আহাদ আজ বেঁচে থাকতেন না কিন্তু কুটনৈতিক বিচক্ষণতায় তিনি একটি মারাত্মক পরিস্থিতি সামাল দিয়েছেন ।তিনি ও আরো চারজন আওয়ামীলীগ এর কর্মীদের দ্বারা জ্বালাতনের শিকার হয়েছিলেন এবং তাকে সেনাবাহিনীর নিকট হস্তান্তর করা হয়েছিল যাদের ইউনিফর্ম জনাব আক্তারের মতে জোরালো দৃষ্টিতেই ভারতীয় ছিল । তারা টমি বন্দুক বহন এবং ছদ্মবেশরূপী ইস্পাতের হেলমেট পরতেন ।ঐসকল ভারতীয় সেনাপুরুষেরা কেন্দ্রীয় ভারতীয় উপভাষায় কথা বলত যারা নিজেরাই একটি বন্দুকবাজ দল গঠন করেছিল এবং ৫ জন ক্ষতিগ্রস্তদের নিউ মার্কেটের কাছে উন্মুক্ত একটি জায়গায় বসিয়ে রেখেছিল ।’ ‘ তাদের ৫ জনকে মাথা নত করতে বলা হয়েছিল ।আক্তার আহাদ বলেন তিনি জানতেন মৃত্যু দুয়ারে কড়া নাড়ছে কিন্তু কিছু করার ছিল না । হঠাত্ তিনি ভারতীয় টমি বন্দুকের ফায়ার শুনেন এবং বাকি ৪ জনের মতই লুটিয়ে পড়েন ।’ ‘ জনাব আহাদ অবিলম্বে অনুভব করেন তিনি জীবিত কিন্তু মৃত ভান করেন ।তারপর বন্দুকবাজ দলের লোকদের বলতে শোনা গেল ,তাদের সময় ফুরিয়ে এসেছে এবং প্রায় ৭ মিনিট পর তারা ঐ স্থানটি ত্যাগ করল ।যখন তারা চলে গেল তিনি দেখলেন তার সমস্ত চোয়াল এবং উরুতে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে ।আমি যখন তার বন্ধুর বাসায় তাকে দেখতে যাই তখন তাকে চোয়াল ও উরুতে ব্যান্ডেজ পরিহিত অবস্থায় চেয়ারে বসে থাকতে দেখি ।তিনি আমাকে বললেন তিনি এখন বিপদমুক্ত কিন্তু কুষ্টিয়ায় তার বোনের জন্য তিনি অত্যন্ত চিন্তিত যার ঠিকানা তার জানা ছিল না
.
মিসেস রশিদ কিছু সংখ্যক মানুষকে আশ্রয় দিয়েছিলেন । তারা যখন বাড়িতে দুইবার হানা দিয়েছিল জনাব মারঘাব এবং মিসেস রশিদ দেখলেন জলপাই সবুজ রঙের পোশাকধারী (ভারতীয় সেনাদের অফিশিয়াল পোশাক) দুইজন ভারতীয় সেনা তাদের সমর্থন জানাচ্ছে । এই অংশে মিসেস হাসান নির্দোষ মানুষদের হত্যা করতে চাওয়া সশস্ত্র দুর্বৃত্তদের কাছে আত্মসমর্পণের অস্বীকৃতি জানিয়ে অসাধারন সাহসিকতার পরিচয় দেন ।
“দুর্বৃত্তরা তাকে জানায় যে তারা তার স্বামীকে অপহরন করেছে এবং সে যদি আশ্রিত ১৬ জনকে আলাদা করে দেয় তাহলে তার স্বামীকে ছেড়ে দেয়া হবে”
“কিন্তু তিনি তাদেরকে বললেন ১৬ জনকে হত্যা করার আগে যেন তাকে হত্যা করা হয়”
ভারত থেকে তিনজন রেডিও ইঞ্জিনিয়ার আনা হয়েছিল
“জনাব সাইফুল্লাহ আমাকে বলেছিলেন, টেলিফোন ট্রান্সমিটার নষ্ট হলে সেনারা ভারত থেকে তিনজন ইঞ্জিনিয়ার নিয়ে আসে শহরের সম্ভাব্য সব জায়গায় সেটাকে ব্যবহার উপযোগী করে তোলার জন্য । ইঞ্জিনিয়ারেরা সেটার ক্রিস্টালের অনুপস্থিত জনিত খুঁত বের করে যা ট্রাস্নমিটারের একটি অপরিহার্য উপাদান” ।
“ভারতীয় ইঞ্জিনিয়ারেরা কলকাতা থেকে নিজস্ব ক্রিস্টাল নিয়ে আসে কিন্তু তা ফিট হচ্ছিল না । তারা যখন অন্য ধরনের প্রতিস্থাপনের চেষ্টা চালাচ্ছিল ততক্ষণে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী শহর দখল করে ফেলে এবং তাদের ফিরে যেতে বাধ্য করে । জনাব সাইফুল্লাহ বলেছিলেন কোন এক অসতর্ক মুহূর্তে একজন ইঞ্জিনিয়ার নিজের নাম দিয়েছিল- শাক্তি দেভ অব দি এয়ার” ।
‘রাজশাহী পরিদর্শনের সময় তিনজন পাহারাদার ও ওয়ার্ড কর্মকর্তা আমাকে কিছু জায়গা দেখায়, তাদের ভাষ্যমতে যা ভারতীয় শিখ সেনারা নির্দেশনা অনুযায়ী কিছু সময়ের জন্য দখলে রেখেছিল” ।
“এমনকি কয়েকজন জেলা প্রশাসন কর্মকর্তা আমাকে জানায়, ভারতীয় সেনারা সাথে করে কয়েকজন চিকিৎসক নিয়ে এসেছিল যাদের মধ্যে একজন মহিলা চিকিৎসক ও ছিল” ।
“বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে জড় করা হিসেব মতে, আমি প্রায় ৪০০০ থেকে ৫০০০ সেনাদের সাথে কাজ করেছি যারা রাজশাহী আসে বিদ্রোহী ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সাহায্য করার জন্য”।
বিদ্রোহীদের কলকাতার সাথে সংযোগস্থাপন
পূর্ব পাকিস্তানের সংকটের শুরু থেকে ভারতের ভূমিকার মূর্ত প্রমাণ বিভিন্ন ভারতীয় ও বিদেশি গণমাধ্যম ।
এমনকি ২৯ শে মার্চ ১৯৭১ এর প্রথম দিকে একজন ভারতীয় সংবাদ প্রতিনিধি কলকাতা থেকে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে নিশ্চিত করে যে, বিদ্রোহীরা ( মুক্তিসেনা নামে পরিচিত) কলকাতার সাথে সংযোগ স্থাপন করেছে । ‘দি ডেইলি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বোম্বে’ অনুযায়ী সংবাদ প্রতিনিধির উদ্ধৃতি, কুষ্টিয়ায় শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার ঘোষণা দেয় কুষ্টিয়া থেকে প্রতিপক্ষ সেনাবাহিনীর দুটি ইউনিট হয় মারা গেছে নয়তো প্রত্যাহার করা হয়েছে । নদিয়া জেলা বর্ডারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় কমান্ডার কলকাতার সাথে টেলিফোনে যোগাযোগ করে । সে প্রথমে জনাব অজয় মুখারজীর সাথে কথা বলে যে পরবর্তী সপ্তাহে নতুন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শিরোনাম হবে এবং
কমান্ডার ভারতীয়দের কাছে বাংলাদেশের শুভেচ্ছাবার্তা পৌঁছে দেন এবং জনাব মুখার্জীকে চিকিৎসা ত্রাণ পাঠানোর জন্য তাড়া দেন। এর পরের দিনই (৩০শে মার্চ), ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যের অর্থমন্ত্রী জনাব বলওয়ান্ত সিং ভারতের নিজস্ব আইন যা যেকোন শরণার্থীদের ব্যাপারে ওকালতি নিষেধ করে,তা সরাসরি উপেক্ষা করে,পাকিস্তানের শরণার্থীদের সাহায্য করেন এবং “বাংলাদেশ” এর অস্থায়ী সরকার এর পরিচিতি দিতে চান। বেশ কিছু ভারতীয় সংসদ যার মধ্যে রয়েছে তামিলনাড়ু,বিহার,আসাম,কেরালা,রাজস্থান,উত্তরপ্রদেশ,গুজরাট এবং ত্রিপুরা বাংলাদেশকে সমর্থনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রেক্ষিতে কেরালা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী জনাব অছুত্তা মেননও একই রকমের অনুভূতি প্রকাশ করেন। পশ্চিমবঙ্গের উপ-মূখ্যমন্ত্রী ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ এর পরিচয় প্রদানের মত চেষ্টাও করেছিলেন।
ইতোমধ্যে,স্বয়ং ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী দ্বারা পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থার উপর ভিত্তি করে একটি সিদ্ধান্ত ভারতীয় সংসদের উভয় হাউজ কর্তৃক পাশ হয়,তা ছিলো পাকিস্তানের প্রতি সরাসরি শত্রুভাবাপন্ন আক্রমণ।এই সিদ্ধান্তটি পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি গাঢ় করুণা এবং ঐক্য প্রকাশ করে এবং তিনি পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীদের উদ্দেশ্যে বলেন যে তাদের এই সংগ্রামে ভারতীয়দের সাহায্য এবং ভালোবাসা তারা সবসময় পাবে।
সিদ্ধান্তের ব্যাপারে বলতে হলে,ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রী স্বরান সিং “পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনা পাকিস্তানের ভেতরকার ব্যাপার”;পাকিস্তানের এই বক্তব্য নাকচ করে দেন।এই বক্তব্য তাদের নিজেদের বক্তব্যকেই খন্ডন করে যা তারা পহেলা মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ভাষণে নিয়েছিলো। ২রা মার্চ অল ইন্ডিয়া রেডিওতে প্রেসিডেন্ট এর ভাষণ এর ব্যাপারে ভারতীয় মতামত জানানো হলো,”বৈদেশিক মন্ত্রণালয় এর একজন কর্মকর্তা নয়াদিল্লী তে বলেন যে,ভারত পাকিস্তানের উন্নতিকে তাদের ভেতরকার ঘটনা হিসেবে স্বাগত জানায়।আমাদের কোন ইচ্ছা নেই তাদের ঘরোয়া ব্যাপারে নাক গলানোর।ভারতের এই নিরপেক্ষতার রূপকথা খুব তাড়াতাড়িই বিস্ফোরিত হলো।এবং ভারত তার নিজের রূপে ফিরে এলো। একই দিনে যখন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত সংসদে পাশ হয়,তখন রিপোর্ট এ বলা হয়,পশ্চিম বাংলার জনগণ পূর্ব বাংলার প্রতি ঐক্য প্রকাশ করার জন্য একটি পূর্নাঙ্গ প্রতিবাদ করে।কলকাতায় সবচেয়ে বেশী শোনা যাওয়া স্লোগানটি ছিলো,”এপার বাংলা,ওপার বাংলা,দুয়ে মিলে সোনার বাংলা।”
ভারত কর্তৃক বিদ্রোহীদের অস্ত্র সরবরাহ
৪ এপ্রিল ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর মুজিবকে সাহায্য করার জন্য তহবিল গঠন করার আবেদনে সরকার অনুমোদনকৃত কমিটিসমূহ সারা ভারতে খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিলো।তারা পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীদের জন্য অর্থ ও অস্ত্রশস্ত্র যোগাড় করতে লাগলো।বিহার রাষ্ট্রের মূখ্যমন্ত্রী করপুরি ঠাকুর ঘোষণা করলেন যে,তার রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এই তহবিলে পঁচিশ লক্ষ টাকা সাহায্য হিসেবে দিবে এবং বেশ কিছু সংগঠন তহবিল গঠন করতে শুরু করেছে।৬ এপ্রিল,১৯৭১ “দ্য ইন্ডিয়ান নেশান,বোম্বে” উদ্ধৃত করলো যে,মুখ্যমন্ত্রী ঠাকুর বলেছেন,তার দৃঢ় সংকল্প বাংলাদেশের মুক্তিফৌজগুলোকে যথাসাধ্য শ্রেষ্ঠ অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সাহায্য করা।জনাব ঠাকুর আরো বলেন,”পরিণতি যাই হবে,আমি মেনে নিবো।আমি দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
.
এই তহবিল উঠানো হয়েছিল ” মুক্তিবাহিনী” র জন্য অস্ত্র কেনা এবং পূর্ব পাকিস্তানে সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারী পাঠানোর লক্ষ্যে । ভারতের বেশ কিছু সংখ্যক পত্রিকায়, এমনকি ” দ্য স্টেটসম্যান ” এও প্রকাশিত হয় যে
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে ৫ই এপ্রিল যখন জিজ্ঞাসা করা হয় যে এসকল রসদ সরবরাহ করার জন্য কোন যন্ত্রপাতির ব্যবস্থা করা হয়েছে কিনা ; তখন বলা হয় যে ” তিনি এই বিষয়ে প্রকাশ্যে কোন বক্তব্য দিতে অপারগ ,
যেহেতু এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার । তবে তিনি তহবিল উত্তোলনকে সমর্থন করেন । ” একই দিনে , ত্রিপুরার প্রধান সচিব সংবাদ সম্মেলনে বলেন ” সীমান্তে ১১ টি প্রবেশদ্বার এবং ৯ টি ক্যাম্প খোলা হয়েছে
পূর্ব পাকিস্তানের শরনার্থিদের অভ্যর্থনার জন্য । ”
অনেক ক্ষেত্রেই এসকল ক্যাম্প পূর্ব পাকিস্তানে কর্মীদের অনুপ্রবেশ এবং অস্ত্র পাচারের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হতো । এটা ভারতভিত্তিক বেশ কিছু সংখ্যক বিদেশি প্রতিনিধিদের সাক্ষ্য দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে ।
বিদেশি প্রতিনিধিদের সাক্ষ্য
পূর্ব পাকিস্তানের বিদ্রোহীদের কাছে ভারতীয় অস্ত্রের সরবরাহ বেশ কজন বিদেশি সাংবাদিকের প্রতিবেদনে বিশদভাবে উঠে এসেছে । কলম্বিয়া ব্রডকাস্টিং সার্ভিসের প্রতিনিধি আরনেস্ট ওয়েদার অল ৩১শে মার্চ নয়াদিল্লীতে রিপোর্ট করেন
” সকল সংকেত এই যে মুজিব এবং তার বিতাড়িত আওয়ামী লীগ সতর্কতার সাথে সামরিক অভিযান পূর্বেই পরিকল্পনা করে রেখেছিল । এই মুক্তিবাহিনীর প্রথম লক্ষ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানের চট্টগ্রামের একমাত্র গভীর পানির বন্দর ।
একবার এই বন্দর ধ্বংস হয়ে গেলে প্রেসিডেন্ট (ইয়াহিয়া খান) পূর্বপাকিস্তানে তার সৈন্যদের রসদ সরবরাহে মুশকিলে পড়বে । এর পরবর্তি ধাপ ছিল ঢাকা কব্জা করা এবং একে পাকিস্তানি আর্মিদের কর্মকাণ্ডের
মূল ঘাটি হিসেবে ব্যবহার করাকে প্রতিহত করা । এটা বিশ্বাস করা হয় যে মুজিব বাইরের উৎস থেকে একটা লম্বা সময় ধরে রসদ সরবরাহ পেয়ে আসছিল এবং এগুলা ইয়াহিয়ার কাছ আক্রমণ আসার আগ পর্যন্ত
গোপন ছিল । নয়াদিল্লীর অনেক পশ্চিমা কূটনীতিক এটা ধারণা করতেন এই অস্ত্রগুলা কেবল মাত্র ভারত থেকেই আসা সম্ভব ।
এটা ছিল সেইসব সশস্ত্র বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে পাকিস্তান আর্মির নেওয়া পদক্ষেপ , এবং সেসব তথাকথিত ” নিরপরাধ নিরস্ত্র নাগরিক ” দের বিরুদ্ধে নয় যা ভারতীয় প্রেস ও রেডিও বহির্বিশ্বকে বিশ্বাস করাতে
চাইছিল ।
১৯৭১ সালের ৩রা এপ্রিলে ডোনাল্ড সিম্যান , ডেইলি এক্সপ্রেস লন্ডনের সংবাদদাতা কলকাতা থেকে রিপোর্ট করেন যে “গোপনে প্রচুর অস্ত্রের সরবরাহ চলছে ” । দ্য টাইমস এবং গার্ডিয়ানও একইরকম প্রকাশ করে।
পশ্চিমবঙ্গের ২৪ পরগনা জেলায় দায়িত্বরত লন্ডন টাইমস এর প্রতিনিধি পিটার হাজেলহার্স্ট , প্রচ্ছদপৃষ্ঠায় প্রকাশ করেন যে বোমা ও গুলি ” সীমান্ত জুড়ে ঢেলে ” দেওয়া হয়েছে পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিমবঙ্গের
গেরিলাদের যার নিদর্শন পাওয়া যায় ” পূর্ব বাংলার কাছে বেনাপোল সীমান্তচৌকিতে ” । যশোরের কাছে ভারতীয় সীমান্ত থেকে পাঠানো এক বিবরণে, গার্ডিয়ান পত্রিকার প্রতিনিধি মারটিন উলাকট ব্যক্ত করেন
যে তিনি একজন পশ্চিমবঙ্গের উকিল এবং একজন ব্যবসায়ীর সাথে দেখা করেছেন যারা ” পেট্রল , ডায়নামাইট বোমা আর বন্দুকের ফরমাশ নিয়েছেন ” ।
রেডিও অস্ট্রেলিয়াও পূর্ব পাকিস্তানের অস্ত্রের সরবরাহের কথা উল্লেখ করে । তাদের নয়াদিল্লীর প্রতিনিধির উদ্ধৃতি দিয়ে ১৭ই এপ্রিল রেডিওটি জানায় যে ” ভারতীয় অঞ্চলের কিছু এলাকায় পশ্চিমা প্রতিনিধিরা
বিভিন্ন রকম সরবরাহ দেখেছেন যাতে অস্ত্র ও গোলাবারুদ ছিল , যা পূর্ব পাকিস্তানে নেওয়া হচ্ছিল । ” পশ্চিম পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর হাতে ধৃত দুই ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যদের দিকে ইঙ্গিত করে ,
যারা স্বীকার করেছিল যে তারা পূর্ব পাকিস্তানে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত ; রেডিওটি নিশ্চিত করে যে ” এই পরিস্থিতিতে এটা অনিবার্য যে ভারতীয় সৈন্যরা হয়তো পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পরেছে । ”
ফরাসী বার্তা সংস্থা এএফপি , ১৮ই এপ্রিল ভারত- পাকিস্তান সীমান্ত হতে পাঠানো প্রতিবেদনে জানায় যে একটি ফরাসী টিভি দল বাস্তবেই ভারতীয় অস্ত্রের ছবি তুলেছে যা ” মেহেরপুরের কাছে পূর্ববাংলা
মুক্তিবাহিনীর নতুন সদরদপ্তরে এসে পৌঁছেছে । এছাড়াও এই টিভি দলের সদস্যরা গোপনে ভারতীয় সৈন্যদের ক্যাম্প হতে ১০০ গজ দুরেই অবস্থানরত বাঙালি সৈন্যদের ছবিও তুলেছে। ”
যখন এটা পরিষ্কার হয়ে গেলো যে পূর্ব পাকিস্তানে সকল ছোটখাটো বিদ্রোহ দমন করা হয়েছে ; ভারতীয় সেনাবাহিনী তখন বিদ্রোহীদের এক ” পাল্টা আক্রমণ ” এর জন্য প্রস্তুত করে তুলতে লাগলো ।
এটা এএফপির প্রতিনিধি ব্রায়ান মের প্রতিবেদনে উঠে আসে , যিনি ২১ মে পাঠানো এক বার্তায় বলেন ” মুক্তিবাহিনীর সৈনিকেরা বাটাইতে অস্ত্র ও গোলাবারুদ বোঝাই করছিল ভারতীয় কর্মকর্তাদের
তত্ত্বাবধানে ” , যারা আমাকে কাছে যেতে বাঁধা দেয় , কিন্তু আমি অন্ততপক্ষে এক ডজন মেশিন গান লাইন ধরে রাখা অবস্থায় দেখেছি। হতোদ্যম বিদ্রোহীরা যারা ভারতীয় মাটিতে আশ্রয় নিয়েছিল
তারা এই সামরিক অস্ত্রবহর অত্যন্ত আনন্দের সাথে পরীক্ষা করছিলো । ভারতীয় কর্মকর্তারা কোন তথ্য দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল কিন্তু এটা পরিষ্কার যে ভারতীয় সেনাবাহিনী বিদ্রোহীদের একটা পাল্টা আঘাত
হানার জন্য সকল রকম সহায়তাই করছিলো ।
এক সপ্তাহ পরে, ২৭শে এপ্রিল ব্রিটিশ দৈনিক স্কটসম্যান একজন এসোসিয়েটেড প্রেস প্রতিনিধির উদ্ধৃতি দিয়ে প্রতিবেদনে বলে যে সীমান্ত পরিদর্শনকালে তিনি ” একটি ট্রাকের সম্মুখিন হন যেটাতে
অন্ততপক্ষে ৫০০০০ রাইফেল, সাথে হালকা ও ভারি মেশিনগান ছিল ।” সেই প্রতিনিধি আরও জানান যে ট্রাকের সাথে যাওয়া একজন ভারতীয় চর তাকে বলেন যে এগুলো রাইফেল, গ্রেনেড ও গোলাবারুদের
একটি গোপন চালানের অংশবিশেষ যা ভারতের পক্ষ থেকে পূর্বপাকিস্তানের বিদ্রোহীদের সহায়তার জন্য পাঠানো হচ্ছে , এবং একজন ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর বিদ্রোহীদের ভারত থেকে পাঠানো এসব অস্ত্র
চালানোর প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন । একই সময়ে , এএফপি নয়াদিল্লী থেকে পাঠানো এক বার্তায় এটা নিশ্চিত করে যে ” ১০০০০ সাবেক- কর্মকর্তা কর্মচারি পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধের জন্য একত্র হচ্ছে । “
কলকাতায় বাংলাদেশ সরকার
ভারতে দায়িত্বরত বিদেশী প্রতিনিধিরাও পূর্ব পাকিস্তানের কোথাও তথাকথিত বাংলাদেশ প্রাদেশিক সরকার গঠন সম্পর্কে চালানো ভারতীয় প্রচারণায় একটি মিথ্যা বলে। কলকাতা থেকে পাঠানো এক
বার্তায় ,যা লন্ডনের দ্য গার্ডিয়ানে ১৪ই এপ্রিল ১৯৭১ সালে ছাপা হয় , এর প্রতিনিধি মার্টিন উলকট ” নিছক কল্পনা ” বলে বিবৃত করেন। ভারতীয় বার্তাসংস্থা জানায় যে এই প্রাদেশিক সরকারের সকল
সদস্য বাংলাদেশেই কোথাও আছেন ‘ এবং এটা নিশ্চিত করে যে তাদের সকলেই কলকাতায় আছেন যেখানে তাদেরকে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে রাখা হয়েছে । সেই প্রতিনিধি আরও বলেন যে ভারতীয়রা
ইহাদেরকে ” মঞ্চ পরিচালনায় ” সহায়তা করেছে যেটাকে তিনি বলেন ” চেয়ার ও অন্যান্য আসবাবপত্র সরবরাহ করে গত শুক্রবারে স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া এবং ভারতীয় সেনাদের
বেসামরিক পোষাকে উপস্থিত থেকে অনুষ্ঠানের নিরাপত্তা জোরদার করা ” ।
১৯৭১ সালের ১৫ই এপ্রিল লন্ডনের দ্য টাইমস এক প্রতিবেদনে বলে ” গঠন হওয়ার পর থেকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ গত তিন সপ্তাহে যেটুকু দিন পেরিয়েছে তা সীমিত । বিদ্রোহী সরকারের যার
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জনাব তাজউদ্দীন আহমেদ মনোনীত হয়েছেন, অনুমিতভাবে এর সদরদপ্তর কুষ্টিয়া জেলার চুয়াডাঙ্গায় অবস্থিত যা ভারত সীমান্তের কাছে । যদিও এমন কোন প্রমাণ নেই যে
, নবগঠিত সরকারের কোন সদস্য আসলেই চুয়াদাঙ্গায় আছেন কিনা । ” এর পরের দিন, ১৬ই এপ্রিল নিউইয়র্কের কলম্বিয়া ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন নিশ্চিত করে যে ” পূর্ব পাকিস্তানের বিদ্রোহ
প্রায় শেষের দিকে এবং এর প্রাদেশিক সরকারের নেতারা এখন ভারতে অবস্থানরত । ”
.
.
দুইদিন পরে , ১৮ এপ্রিল ১৯৭১, নিউ ইয়র্ক টাইমস ভারতীয় শহর বৈদ্যনাথতলা থেকে প্রানবধ একটি প্রেস যুক্ত করে যা বলে ‘ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা অনুষ্ঠানে ভারতীয় অর্ধ সীমান্ত থেকে একটি প্রধান ভূমিকা পালন করেছে, এবং ২০ এপ্রিল ফরাসি দৈনিক লি মণ্ডে প্যারিস সাক্ষ্য দেয় যে “ ভারতীয় সীমান্ত থেকে এক মাইল দূরে একটি আম গাছের নিচে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার ঘোষণা করে, কিন্তু যদিও সরকার ছিল কোলকাতায় গঠিত, এই বিদেশী সংবাদপত্রের কল্যাণে কাজ ছিল পূর্ব পাকিস্তানের অস্তিত্বে জোর দেয়া।
বিদ্রোহীদের জন্য নিয়োগ এবং প্রশিক্ষণ শিবির
ভারতও পূর্ব পাকিস্তানের কষ্ট তৈরির জন্য নিয়োগ এবং প্রশিক্ষণের খেলা চালিয়ে যায়। এটা দ্য টাইমস, লন্ডন, যারা নিয়োগ কেন্দ্র পরিদর্শন করে তাদের দ্বারা রিপোর্ট করা হয়েছিল ১৯৭১ ের ১৮ জুন। তিনি বলেন, যে কর্মরত কর্মকর্তা তথকথিত “বাংলাদেশ” সেনাবাহিনীর সকল প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে “বাংলাদেশের কোথাও” অবস্থিত থাকার চার্জ দাবি করে, কিন্ত যখন সংবাদদাতারা পূর্ব পাকিস্তানের ক্যাম্পের ভেতরকার সঠিক অবস্থান জানতে চায় তখন তিনি সোজাসাপটা বলে দিয়েছিলেন “ এটি একটি সামরিক গোপনীয়তা” সংবাদদাতা আরও বলেন” বোধয় ভারতীয় পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ১০০ সাইট ছিল” সংবাদদাতা জানিয়েছে যে একটি প্রতিজ্ঞা পর্যন্ত নিয়োগ অফিস স্থাপন করা হয়েছে, যা “ যা ব্যহত নিবন্ধনের জন্য একটি অফিস থেকে অনুমিত ছিল” তিনি বলেন “যাদের নিয়োগের জন্য নিয়ে আসা হয় তাদের একবার মুক্তিবাহিনীর ফৌজ এ যোগদান করলে তা ছেড়ে না দেয়ার জন্য সতর্ক করা হয়। যদি তারা চেষ্টা করে তাহলে তাএর গুলি করা হবে“
এর আগে, গার্ডিয়ান, লন্ডন, তার সংবাদদাতা থেকে একটি নিশ্চিত তথ্য নিয়ে এসেছিল যে ভারতীয়রা প্রকাশ্যে “পূর্ব পাকিস্তানের সশস্ত্র বিদ্রোহীদের গ্রুপ, যোদ্ধা এবং যারা সাম্প্রতিক কালে অনিয়মিতভাবে সীমান্ত অতিক্রম করে” তাদের আশ্রয় দিচ্ছিল। সংবাদদাতা জানান, “তিনি একটি সীমান্ত ক্রসিং পয়েন্ত দেখেন” ভারতীয় সশস্ত্র শিবির তাঁবু খাটিয়ে সেখানে অবস্থান করে।
১৪ই মে, নাইজেরিয়ান ট্রিবিউন বলে “ ভারত ছয় রাইফেল স্পত স্থাপন করে” পূর্ব পাকিস্তান-ভারতীয় সীমান্তে ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী পূর্ব পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে মুহুরমুহ গোলাবারুদ নিক্ষেপ করা হয়। তারপর মাউন্ত পাকিস্তানের একটি প্রচার প্রচারণার দৃষ্টিভঙ্গি আন্তর্জাতিক ব্যঘাতের শুরু করে। “
ভারত সশস্ত্র সংঘাতের জন্য তোলা
২০ মে, দ্য টাইমস, লন্ডন, সংবাদদাতা জনাব পিটার হেজেলহার্টস থেকে প্রকাশিত, পাকিস্তান সীমান্তের বিরুদ্ধে ভারতের সারগর্ভ পদক্ষেপ। “ ১৫ মাইল কলকাতার উত্তর সীমান্ত থেকে প্রায় ৩০ মাইল দূরে ব্যরাকপুরে অধিকাংশ সৈন্য নিহত হয়” এছাড়াও নির্দেশাবলী রয়ছে যে পূর্বাঞ্চলীয় পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তে ভারতীয় সেনাবাহিনী সৈন্য আগরতলায় একটি বৃহৎ বিচ্যুতি সংস্থিত হয়েছে।
.
.
চারদিন পর ২৪ মে ‘দ্য টাইমস্’ প্রতিনিধি কলকাতা থেকে এক তড়িৎ বার্তায় নিশ্চিত করে য, গতকাল সকালে এয়ারপোর্টের পূর্ব পার্শ্বে এয়ারক্রাফট বিধ্বংসী যানের নড়াচড়া লক্ষ্য করা যায়। গোলন্দাজ বাহিনী সারিবদ্ধ হয়ে দ্রুত তাদের রাডার পশ্চিমমুখী করে স্থাপন করছিলো। এটা নির্দেশ করে যে ইন্ডিয়ান সরকার নিজেদের একটি সীমিত সীমান্ত সংঘর্ষের চেয়ে বড়ো কিছুর জন্য নিজিদের তৈরি করছে। প্রতিনিধি আরও জানান উত্তর ভারত থেকে অন্তত তিনটি রেজিমেন্ট, পাঞ্জাব, রাজপুত এবং মারাঠার পদাতিক সৈন্যবাহিনী যশোর ফ্রন্টের সম্মুখভাগে রয়েছে। বর্ডার থেকে ৫০ গজ দূরে জীপের উপর ট্যাংক বিধ্বংসী অস্ত্র তাক করা হয়েছে। ভারত এবং পূর্ব বাংলাকে সংযুক্ত করা অব্যবহৃত রেললাইনে ট্রেঞ্চ করে র্দু নির্মাণ করতে দেখা গেছে শিখ এবং রাজপুতদের।
পাকিস্তানের সীমানা লঙ্ঘন
পূর্ব পাকিস্তানে সশস্ত্র ধ্বংসাত্মক কৌশলে ব্যর্থ হয়ে ইন্ডিয়া এখন একটি সামরিক সমাধান স্থাপনের চেষ্টা করছে। ১৯৭১ এর মে মাসের প্রথম দিকে বিদেশী প্রতিনিধি ভারতের পাঁচ কিলোমিটার ব্যাপী সীমান্ত লঙ্ঘনের ব্যাপারে সংবাদ প্রকাশ করে যাচ্ছিলো। এতে মনে হচ্ছিলো দুই সীমান্তে সংঘর্ষ অনিবার্য। দ্য লন্ডন টাইমস ২ মে ১৯৭১ সালে রিপোর্ট করে যে, ইন্ডিয়া গত কয়েক সপ্তাহ ধরে নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় পাকিস্তানের সীমানা লঙ্ঘন করে যাচ্ছে। সর্বশেষ ঘটনাটি ঘটে ১৯ জুন ১৯৭১, যখন ইন্ডিয়ান বাহিনী সিলেট জেলা দিয়ে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে অনুপ্রবেশ করে।
লাঠিটিলা অঞ্চলে একটি পাকিস্তানী টহলবাহিনী টহলরত অবস্থায় ভারতীয় সৈন্যদের সাথে সম্মুখযুদ্ধে লিপ্ত হয় সবুজ ইউনিফর্মে। যুগপৎভাবে পাকিস্তানী টহলবাহিনীকে লক্ষ্য করে ইন্ডিয়ান সৈন্যরা মর্টার নিক্ষেপ করে।
একই দিনে, (১৯ জুন) যশোর জেলার মানিকপুর অঞ্চলে ভারতের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী অনধিকার প্রবেশ করে এবং আগুন ধরিয়ে দেয়। যখন পাকিস্তানী বাহিনী পাল্টা গুলি বর্ষন করে ইন্ডিয়ানরা সীমান্ত থেকে দ্রুত সরে যায়।
ইন্ডিয়ানরা বিনা উস্কানিতে সীমান্তের বিভিন্ন জায়গায় অগ্নি সংযৈাগ করে যাচ্ছিলো। ১৯ জুন খুলনায় বাইকারি সীমান্ত ফাঁড়িতে তিন ইঞ্চি মর্টার শেল নিক্ষেপ করে। একইভাবে সিলেটের কাতলামারি এবং জয়পুর ফাঁড়িতে হালকা মেশিন গান এবং অস্ত্র নিয়ে আক্রমন চালায় এর আগে ১৮ জুনে যশোরের বেনাপোলে পাকিস্তান ফাঁড়িতে ভারী মর্টার শেল নিক্ষেপ করে।
পাকিস্তান বৃহৎ শক্তিধর দেশগুলোর মনোযোগ আকর্ষণ করছিলো পূর্ব পাকিস্তানে ভারতের ক্রমবর্ধমান মিলিটারী সংশ্লিষ্টতা এই উপমহাদেশে শান্তির জন্য এক বিরাট হুমকি হয়ে উঠছে। সাম্প্রতিক সপ্তাহ গুলোকে পূর্ব পাকিস্তানে ইন্ডিয়ান আর্মির কার্যক্রম এটাই প্রমান করে। প্রায় প্রতিদিনই ভারতীয়রা সীমান্তে গুলিবর্ষণ করছে এবং ভারতীয় বাহিনী পাকিস্তান অঞ্চলে নিজেদের উপস্থিতির ব্যাপ্তি বাড়াচ্ছে। কংগ্রেস এখন খোলামেলাভাবে “বাংলাদেশের” পক্ষে ভারতীয় বাহিনীকে ব্যবহারের পক্ষে কথা বলছ্ ে
পাকিস্তান, অবশ্যই ইন্ডিয়ায় প্রতিবাদ লিপি পাঠিয়েছে। ২১ এবং ২২ জুন ১৯৭১ যে ঘটনাগুলো লিপিবদ্ধ করা হয় ঃ
১। ১৬ জুন ইন্ডিয়ার সশস্ত্র বাহিনী ৩ ইঞ্চি মর্টার শেল নিক্ষেপ করে। পাকিস্তানের (ছঞ ৭৬৪২) অঞ্চলে, যশোরের বেনাপোলে কোনরকম উস্কানি ছাড়াই।
২। ১৭ জুন ময়মনসিংহের ফুডিমারীতে (জঋ ৬৮৯৮) ইন্ডিয়ান বিএসএফ অবেধ অনুপ্রবেশ করে এবং দুজন গ্রামবাসীকে হত্যঅ করে।
৩। ১৭ জুন ময়মনসিংহের ইঙচ কামালপুরে (ছঊ ৮৫১২) বিনা উস্কানীতে ০৫৩০ থেকে ০৬০০ এবং আবারো ১১৪০ থেকে ১২০০ টা পর্যন্ত মর্টার নিক্ষেপ এবং গোলাবর্ষন করা হয়। এই ঘটনায় দুইজন মারা যায়।
৪। ১৭ জুন, যশোরের বেনাপোলে পাকিস্তানী টহলবাহিনীর উপর গুলিবর্ষন করা হয়।
৫। ময়মনসিংহৈর কামালপুরে ১৭ এবং ১৮ জুনের মধ্যবর্তী রাতে বিনা উস্কানিতে ভারী মর্টার শেল নিক্ষিপ্ত হয়।
৬। ১৮ জুন কুমিল্লায় ইন্ডিয়ান বাহিনীর নিক্ষিপ্ত মর্টারের আঘাতে চার জন আহত হয়।
৭। ১৮ জুনে কুমিল্লার সালদানদী অঞ্চলে (জগ ২৮১৮) যশোরের বেনাপোল এবং মসলিয়া অঞ্চল (ছঞ ৮৬৬৫) এবং সিলেটের চাতালপুর অঞ্চলে (জঐ ১৭০৩) ইন্ডিয়ান সেনাবাহিনী গুলি এবং মর্টার শেল নিক্ষেপ করে কোন উস্কানি ছাড়াই।
.
ভারতের মূল উদ্দেশ্য
ভারতের মূল উদ্দেশ্য কি? ২রা এপ্রিল,১৯৭১ এ একটি ভারতীয় পত্রিকা ” ফ্রি প্রেস জার্নাল ” এর প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয় , ” আমাদের (ভারতের) অত্যন্ত সচেতনতা ও বুদ্ধিমত্তার সাথে পদক্ষেপ নেয়া উচিৎ যা পাকিস্তানকে দুর্বল করতে সহয়তা করবে। এবং কৃতজ্ঞতাস্বরূপ পূর্ব বঙ্গ কাশ্মীরে ভারতীয় সার্বভৌমত্বের স্থায়ী স্বীকৃতি দানে সম্মত হবে। ” দুই দিন আগে, ৩০ শে মার্চ ১৯৭১ এ, বম্বে ডেইলি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পূর্ব পাকিস্তানে ভারতের সশস্ত্র হস্তক্ষেপের সমর্থন জানিয়ে প্রকাশ করে , ” এটা সত্যিকার অর্থেই ঐতিহাসিক মুহূর্ত এবং পদক্ষেপ নেবার সঠিক সময় এখনই।” এবং ৭ই এপ্রিল, ১৯৭১ এ ভারতীয় সামরিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচালক শ্রী সুব্রামনিয়াম পূর্ব পাকিস্তানের ভারত সমর্থিত সশস্ত্র বিদ্রোহের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, ” ভারতের উপলব্ধি করা উচিৎ পাকিস্তানের এই ভাঙ্গন আমাদের স্বার্থের পক্ষে এবং আমাদের এমন একটা সুযোগ এসেছে যা আর কখনোই আসবে না। ”
সম্প্রতি ১৫ই জুন,১৯৭১ এ ইন্ডিয়ান ডেইলি মাদারল্যান্ড এ প্রকাশিত এক বিবৃতিতে ভারতীয় ভাষ্যকার সুব্রামনিয়াম স্বামী উল্লেখ করেন, ” পাকিস্তানের আঞ্চলিক অখণ্ডতা আমাদের ভাবনার বিষয় না। এটা পাকিস্তানের ব্যাপার। আমাদের এখন দুটি প্রশ্ন নিয়ে ভাবা উচিৎ। পাকিস্তানের এই ভাঙ্গন কি আমাদের দীর্ঘস্থায়ী জাতীয় স্বার্থের পক্ষে? যদি তাই হয়, তবে আমরা কি এই ব্যাপারে কিছু করতে পারি? ” এবং ভাষ্যকার আরও উল্লেখ করেন, ” পাকিস্তানের এই বিভাজন শুধু আমাদের বাহ্যিক নিরাপত্তার স্বার্থের সাথেই জড়িত নয়, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার সাথেও জড়িত। ভারতের উচিৎ আন্তর্জাতিকভাবে মহাশক্তি হিসেবে উত্থান ঘটানো এবং জাতীয়ভাবে আমাদের জনগণকে এই কাজে নিয়োজিত করতে হবে। এই কারণে পাকিস্তানের বিভাজন এক প্রয়োজনীয় পূর্ব শর্ত।”
পাকিস্তান প্রকাশনী কতৃক উত্থিত
পি. ও. বক্স – ১৮৩। করাচী । জুন, ১৯৭১
.
.
শিরোনামঃ ১৩৬। শরণার্থী সমস্যার পাকিস্তানী ব্যাখ্যা
সূত্রঃ প্রচার পুস্তিকা – পাকিস্তান দূতাবাস, ওয়াশিংটন
তারিখঃ জুন, ১৯৭১
পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ
শরণার্থী সমস্যা
-প্রতিবেদন পটভূমি ৫
মুখবন্ধ
.
ভারত পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধের হুমকি দিচ্ছে। ¬ভারত চাইছে তার পছন্দ মতো শরণার্থী সমস্যার একটা রাজনৈতিক সমাধান পাকিস্তানের ওপর চাপিয়ে দিতে, যা আসলে বিদ্রুপকারী শোষণের নামান্তর। ভারত শরণার্থীদের বুঝিয়ে এবং ভয় দেখিয়ে ফিরে যেতে নিরস্ত করছে, যাতে তাদের পুনর্বাসনের কথা বলে পূর্ব পাকিস্তানের একটা অংশ দাবী করতে পারে এই বলে যে, তারা পাকিস্তানে ফেরত যাবে না যদিনা বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যদি এই দাবী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে না উত্থাপন করে, তাহলে তার ফলাফল কি হবে এই সম্পর্কেও ভারত সতর্ক করে দিচ্ছে।
পাকিস্তান যুদ্ধ চায় না। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বেশ কয়েকবারই শরণার্থীদের পাকিস্তানে ফেরত যাবার আমন্ত্রন জানিয়েছেন। শরণার্থীরা ফিরলে তাদের পুনর্বাসনের জন্য ইয়াহিয়া সরকার আন্তরিক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, আর তাকে সহযোগিতা করছেন জাতিসংঘ মহাসচিব ও জাতিসংঘের অন্যান্য অঙ্গসংগঠন যেমন ইউনিসেফ, জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা, ফাও প্রভৃতি। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তান সমস্যার দ্রুত রাজনৈতিক নিস্পত্তির জন্যও কাজ করে যাচ্ছেন এবং ২৮জুন আরও একবার ঘোষণা দিয়েছেন যে তিনি তিন চার মাসের মধ্যেই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রস্তুতি নিচ্ছেন,এমনকি তাঁর আগেও হতে পারে যদি অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান তৈরির জন্য নিযুক্ত কমিশন তাদের কাজ শেষ করতে পারে।
বিশ্ব নেত্রীবৃন্দের দায়িত্ব ভারতকে নিবৃত্ত করা ও যুদ্ধের প্রাদুর্ভাব রোধ করা, যেটা কিনা ব্রিটিশ পররাষ্ট্র সচিবের সাম্প্রতিক বক্তব্য মতে, “একটা দুঃখজনক ঘটনা সর্বনাশে রুপ নিতে পারে”।
উদ্বাস্তুঃ পাকিস্তান কী করেছে
বিপদজনক পরিস্থিতিতে যে সকল পাকিস্তানী নাগরিক দেশ ছেড়েছিল তাদের দেশে ফিরতে উদ্বুদ্ধ করার জন্য পাকিস্তান সরকার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চলাচ্ছে। এই নিমিত্তে সরকার নিম্নে বর্ণিত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করেছেঃ
-২১মে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট দেশের সকল প্রকৃত নাগরিকদেরকে তাদের বাড়িতে ফেরার আহ্বান জানিয়েছেন।
-২৪মে রাষ্ট্রপতি এই আহ্বান নবায়ন করেছেন এবং যারা পথভ্রষ্ট হয়েছে তাদের ক্ষমা প্রদান করেছেন।তিনি আরও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ফেরত আসা সকল শরণার্থী ত্রাণ, পুনর্বাসন এবং সম্পূর্ণ নিরাপত্তা পাবে।
-১জুন, ভারত থেকে ফেরার প্রধান রুটে ২০টি ত্রাণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেওয়া হয়। এই ত্রাণ শিবিরের প্রধান উদ্দেশ্য হল যারা ফিরে আশ্ছে তাদের পূর্ণ সুরক্ষা এবং পুনর্বাসন সুবিধা প্রদান করা।
– ১০জুন, পূর্বপাকিস্তানের গভর্নর সাধারন ক্ষমা ঘোষণা করেন এবং বলেন যে এই ক্ষমা সকল স্তরের মানুষের জন্য- ছাত্র, শ্রমিক, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, নাগরিক কর্মচারী, সশস্ত্র বাহিনী ও অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য যেমন পুলিশ যারা পক্ষ ত্যাগ করেছে, পাশাপাশি রাজনৈতিক নেতাকর্মীরাও এই ক্ষমার অন্তর্ভুক্ত।
-জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাই কমিশনার প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খান এবং মহাসচিবের বিশেষ প্রতিনিধি জনাব ইসমত কিতানি উভয়েই পাকিস্তান সফর করেছেন এবং সকারের তরফ থেকে শরণার্থীদের ফেরা ও পুনর্বাসন সংক্রান্ত ব্যাপারে পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস প্রদান করা হয়েছে।
– জাতিসংঘ মাসচিবের একজন প্রতিনিধি পূর্ব পাকিস্তানে পৌঁছেছেন এবং ঢাকা থেকে সরসরি পূর্ব পাকিস্তানে আন্তর্জাতিক ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করছেন।
-১৯ জুন, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট তাঁর ২১মে ও ২৪ মে এর আপিলের কথা স্মরণ করে একটি নতুন আপিল জারি করেন, এবং বিশেষভাবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে(হিন্দু) বলেন ফিরে আসতে যারা বাড়িঘর সহায় সম্পত্তি ফেলে রেখে চলে গিয়েছিলেন। তিনি আশ্বাস দেন যে তাদের পাকিস্তানের অন্যান্য সকল নাগরিকের মতই পূর্ণ নিরাপত্তা এবং সুযোগ সুবিধা দেওয়া হবে এবং জাতি বা ধর্মভিত্তিক কোনও বৈষম্যের কোনও প্রশ্ন নেই। তিনি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে পাকিস্তানের বাইরের কোনও অপপ্রচারে বিভ্রান্ত না হবার জন্য অনুরোধ জানান।
-২৮জুন, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট চার মাসের মধ্যে একটি নতুন সংবিধানের অধীনে একটি বেসামরিক সরকার ফিরিয়ে আনার জন্য তাঁর পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করেন। প্রেসিডেন্ট ইঙ্গিত দেন যে, যুক্তরাষ্ট্রীয় সংবিধান সর্বোচ্চ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করবে, যেমনটা নির্বাচনী ইশতেহার এ বলা হয়েছে।
২
ভারত সমস্যাকে কাজে লাগাচ্ছে
যখন পাকিস্তান শরণার্থীদের ফিরিয়ে আনার জন্য আন্তরিক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে এবং জাতিসংঘের মহাসচিবের বিশেষ প্রতিনিধি ও জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাই কমিশনারের সাথে সম্পূর্ণ সহযোগিতা করছে, তখন অন্যদিকে ভারত বার বার যুদ্ধের হুমকি দিচ্ছে এবং শরণার্থী সমস্যার তাদের পছন্দমতো রাজনৈতিক নিষ্পত্তির চেষ্টা চালাচ্ছে। এমনকি ভারত তার খমতার রাজনৈতিক খেলায় এই দুর্ভাগা মানুষগুলোকে দাবার ঘুঁটির মতন ব্যবহার করছে ও তাদের ফিরে যেতে বাঁধা দিচ্ছে।
১৬ জুন নয়া দিল্লি থেকে রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী সংসদে বলেছেন, “ভারত শরণার্থীদের শুধু জীবন নয়, কল্যান নিয়েও চিন্তিত ছিল।” পূর্ব পাকিস্তান সমস্যা নিষ্পত্তির ব্যাপারে তিনি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সকল পরামর্শই নাকচ করে দিয়েছেন। “রাজনৈতিক নিষ্পত্তি হলে তা হবে চাপে পড়া মানুষদের সাথে।“ তিনি বলেন, “ভারত এমন কোনও নিষ্পত্তি মেনে নেবে না যার অর্থ দাঁড়ায় “বাংলাদেশের মৃত্যু” এবং যুদ্ধরত মানুষ ও গণতন্ত্রের খেলাপ।“
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, “বাংলাদেশে যা হচ্ছে তার ফলাফল ভোগ না করে আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আমরা চলে যেতে দেব না, তারা সমস্যার নিস্পত্তিতে সাহায্য করুক বা না করুক এই ঘটনার পরিণতিতে তাদের ভুগতে হবে।” তিনি আরও বলেন, “শরণার্থীদের ভারতে রেখে দেয়ার কোনও উদ্দেশ্য আমাদের নেই, তাই বলে জবাই হয়ে যাবার জন্য তাদের আমরা বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে পারি না।”
একই দিনে, ১৬জুন, জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাই কমিশনার প্রিন্স সদরুদ্দিন কিছু শরণার্থী শিবির পরিদর্শন শেষে রিপোর্টারদের বলেন, তিনি পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতির উন্নতি লক্ষ্য করেছেন এবং শরণার্থীদের ফিরে আসার কোনও বাঁধা নেই।
জাতিসংঘের হাই কমিশনার যদিও বলছেন তিনি সন্তুষ্ট যে শরণার্থীরা এখন পূর্ব পাকিস্তানে ফেরত যেতে পারবে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী জাহির করছেন যে তিনি শরণার্থীদের ফিরে যেতে দেবেন না যতক্ষণ পর্যন্ত তার পছন্দমত একটা রাজনৈতিক সমাধান পূর্ব পাকিস্তানের ওপর চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। তিনি প্রচার করছেন বাংলাদেশের মৃত্যু হয় এমন কোনও নিষ্পত্তি তিনি মেনে নেবেন না এবং এর পরিণতি সম্পরকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে হুমকি দিচ্ছেন।এটা বোঝা জাচ্ছে না যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী কোন আন্তর্জাতিক আইন বা রীতিতে এই ধরনের কোনও দাবি করছেন।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রী সরদার স্বরন সিং ১৭জুন ওয়াশিংটনে জাতীয় প্রেসক্লাবে ঘোষণা করেন, “মূল সমস্যা হল রাজনৈতিক” এবং মিসেস গান্ধির বক্তব্যের সমর্থন দিয়ে বলেন, “ভারত বিশেষ করে উদ্বাস্তুদের জীবন ও কল্যাণ নিয়ে উদ্বিগ্ন।” তিনি বলেন, ৬০লক্ষ শরণার্থী পাকিস্তান সরকারের খমার ঘোষণা বিশ্বাস করে না, এবং এই পরিকল্পনার কথা ব্যক্ত করেন যে, আন্তর্জাতিক তত্তাবধানে পাকিস্তানের একটি এলাকা উদবাস্তদের নিজেদের দারা শাসিত হবে এবং এই অস্থায়ী ক্যাম্পগুলো সেখানে সরিয়ে নেয়া হতে পারে। মিঃ সিং আরও সুপারিশ করেন যে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত পাকিস্তানের সব সাহায্য বন্ধ রাখা এবং শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে সমঝোতায় আসা, এবং সতর্ক করেন যে, “আমরা চুপচাপ বসে থাকব না।”
ভারত দেশভাগের সময় যা অর্জন করতে পারেনি, এখন যুদ্ধের হুমকি দিয়ে আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে তা অর্জন করতে চায়।
এতে কোনও সন্দেহ নেই যে পূর্ব পাকিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহের ব্যর্থতায় ভারতীয় নেতারা হতাশ হয়েছেন, কেননা এতে তারা অস্ত্র, গোলাবারুদ ও অনুপ্রবেশকারী পাঠিয়ে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছিলেন। বিদ্রোহের ধ্বসের পর ২০ এপ্রিল তারা কলকাতা অতিথিশালার মদ্ধে তথাকথিত “বাংলাদেশ সরকার” গঠনের জন্য বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সাহায্য করেছিলেন, দেশ বিহীন সরকারের কল্পকাহিনী বানিয়েছিলেন। এখন তারা সেই তথাকথিত সরকারের জন্য কিছু অঞ্চল নিরাপদ করার চেষ্টা করছেন।
.
.
গেরিলাদের সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া, সীমান্তে অস্থিরতায় উস্কানি দেওয়া এবং ভারতে পাকিস্তানি কূটনীতিকদের প্রবেশে বিধিনিষেধ আরোপের মাধ্যমে ইতিমধ্যে এর সূচনা হয়েছে। এই সব ঘটনার কারনে দুই দেশের মধ্যে অস্থিরতা তৈরী করছে। এরপরে, গেরিলা যুদ্ধের গল্প প্রচার করা হচ্ছে এবং নৃশংসতার বানোয়াট গল্প বলা হচ্ছে। সীমান্তের জেলাগুলোর নিরীহ মানুষের মাঝে নিরাপত্তাহীনতা তৈরী হচ্ছে এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এইভাবেই পূর্ব পাকিস্থান থেকে প্রস্থান শুরু হয়েছে।
সীমানার দাবী সংক্রান্ত সমস্যা ভারত বিবর্ধিত করছে
এটা কৌতুহলোদ্দীপক যে ১৫ই মে, যখন ভারত শরণার্থীদের প্রশ্নে পাকিস্তানকে প্রতিবাদলিপি পাঠিয়েছে এমন ঘোষনা হলো, রয়টার্স সংবাদ সংস্থা তখন প্রতিবেদন করেছে একজন ভারতীয় মুখপাত্র কলকাতায় বলেছেন যে পঞ্চাশ থেকে ষাট লক্ষ শরণার্থী খুব জলদিই পাকিস্তান থেকে ভারতে প্রবেশ করবে।
কলকাতা ও নয়া দিল্লী থেকে রয়টার্স সংবাদ সংস্থা প্রতিবেদনে বলেছে, “ওয়াকিবহাল মহল বলছে যে পাঠানো এই চিঠি হয়তো শরণার্থীদের জন্যে পাকিস্তানের কিছু জায়গা ছেড়ে দেওয়া উচিৎ জানানোর প্রথম পদক্ষেপ।” অন্য কথায় বলতে গেলে, ভারত যখন শরণার্থী সমস্যার কথা তুলেছে, তারা ষাট লক্ষ লোককে জায়গা দেওয়ার অজুহাতে পাকিস্তানী সীমান্ত থেকে জায়গা দাবী করবে যেখানে তারা এই নিরাশ্রয় ষাট লক্ষ শরণার্থীকে জায়গা দিবে। ১৬ জুনের মধ্যে সরকারী সংখ্যা ষাট লক্ষ করে দেওয়া হয়েছিলো বাস্তবতা বা প্রকৃত ঘটনা অগ্রাহ্য করে।
রয়টার্স সংবাদ সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী ১৬ জুনের আগে পূর্ববর্তী ১২ দিন ধরে শরণার্থীদের সংখ্যা কমে খুবই এসেছিলো, কিন্তু ভারতীয় সংখ্যা অবিরত বেড়েই চলেছিলো। ১৮ মে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বলা সংখ্যা ছিলো দশলক্ষের উপরে। এটা দুর্বোধ্য যে ১৮ মে থেকে ২৪ মে-এর মাঝে দশলক্ষ থেকে কি করে প্রতিদিন গড়ে ৬০০০০ করে বেড়ে পয়ত্রিশ লক্ষ হলো। জুনের ৭ তারিখে ভারতীয় হিসাব বেড়ে ৪৭ লক্ষে দাড়িয়েছিলো। ১১ জুনে এই সংখ্যা ছিলো ৫৫ লক্ষ ও ১৬ জুনে দাঁড়ায় ৬০ লক্ষ যা ১৫ মে-এর নির্ধারিত লক্ষ্য ছিলো।
১৭ জুন সরদার সারয়ান সিং ওয়াশিংটনে জনসম্মুখে ঘোষনা দেন যে,“পাকিস্তানের একটি এলাকা হয়তো শরণার্থী শিবিরের জন্যে আলাদা করে দিতে হবে।” পাকিস্তানের এই জায়গা চাওয়ার পিছনে কারন তিনি ২৫ মে সংসদে দেওয়া বক্তব্যে খোলসা করেন, যখন তিনি বলেন “সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে দ্বিধা করবে না।” এবং এই সব ব্যাপারগুলো আমলে নেওয়া দরকার ছিলো যেমন “নিয়ন্ত্রিত এলাকার ব্যাপ্তি”।
ড্যানিয়েল পেইরিসের নয়াদিল্লী থেকে করা এক প্রতিবেদন, যা ২৮ মে খ্রিস্টান সায়েন্স মনিটরে প্রকাশিত হয়, বলে যে ভারত তিনটি কার্যধারা অনুসরনের কথা চিন্তা করছেঃ
“১। বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়া এবং প্রশিক্ষিত গেরিলা সরনার্থী পাঠানো”
“২। ভারতে আশ্রয় নেওয়া ৩,৫০০,০০০ শরনার্থীর জন্যে পূর্ব বাংলায় ৫০ মাইল জায়গার জন্যে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে “সীমিত যুদ্ধ” চালানোর জন্যে আদেশ দেওয়া।”
“৩। বাংলাদেশকে সর্বাত্মক সামরিক সাহায্য দেওয়া ও অস্থায়ী সরকারকে পুরো পূর্ব বঙ্গ থেকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে সরানোতে সাহায্য করা।”
অন্যান্য আরো অনেক সূত্র থেকে পাওয়া প্রতিবেদন অনুযায়ী নিশ্চিত করা যায় যে ভারত এই কর্মপন্থাগুলো অনুসরন করছে। তিনি ভিন্নমতালম্বীদের এখন ভারতে সামরিক প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। তিনি পাকিস্তান সীমান্তের একটি অংশ বাজী ধরেছেন এবং বারংবার যুদ্ধের হুমকি দিচ্ছেন।
গত কয়েকদিনের ধরেই ভারতীয় সশস্ত্র অনুপ্রবেশ ও উপুর্যুপরি সীমান্তে গোলাগুলির তাজা খবর পাওয়া যাচ্ছে যা এটাই ইঙ্গিত করে যে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সময়ে সময়ে দেওয়া যুদ্ধের হুমকি অনুসারে ভারত একটি খন্ড বা পূর্ন যুদ্ধের জন্যে প্ররোচিত করছে।
সমাপ্তি
.
পাকিস্তান যুদ্ধ চায় না।
২৪ মে, মিসেস গান্ধীর হুমকির পরে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের কোন সম্ভবনা রয়েছে কিনা, যখন একজন সাংবাদিক জিজ্ঞেস করেন তার উত্তরে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি বলেন, “আমি তাকে হুমকি দিচ্ছি না, আমি কোন হুমকিও দেই নি; আমরা তাদের বলে আসছি যে যুদ্ধ কোন সমাধান নয় এবং এটা কোন কিছুর মীমাংসা করবে না। আমরা বারবার বিশ্ববাসীকে বলে আসছি আমরা ভারতের সাথে কোন যুদ্ধ করতে চাই না।”
পাকিস্তান রাজনৈতিক সমাধানের জন্যে কাজ করছে।
পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি তার জনগনের নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রতিশ্রুতিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এমনকি ২৫ মার্চে যখন তিনি সশস্ত্র বাহিনীকে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে বলেন তিনি উপরোক্ত মর্মে একটি সুনিশ্চিত আশ্বাস দেন। মে মাসের ২৪ তারিখে তিনি নতুন করে অঙ্গীকার করেন যে জনগনের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে। গনমাধ্যম প্রতিবেদন করছে যে রাষ্ট্রপতি পূর্ব পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ ও আওয়ামী লীগের চরমপন্থী ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের থেকে নিজেদের আলাদা করে নেওয়া নির্বাচিত নেতাদের সাথে পরমর্শ করছে এবং পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক প্রশাসনকে প্রদেশের জন্যে সাংবিধানিক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্যে সহযোগিতা করছে।
রাজনৈতিক সমাধান বন্ধ করতে ভারত যুদ্ধের হুমকি দিচ্ছে।
জুনের ২৮ তারিখে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিকল্পনা ঘোষনা করেন। তাই ভারত উদ্বিগ্ন এবং রাষ্ট্রপতির পরিকল্পনা ব্যর্থ করতে বাধা তৈরী করছে। তিনি ইতিমধ্যে রাষ্ট্রপতির ২৮ জুনের প্রতিজ্ঞা প্রত্যাখান করেছেন এবং শরনার্থীদের ফিরতে না দিয়ে তাদের আলাদা রাষ্ট্র বাংলাদেশের স্বপ্ন জীবিত রেখে আটকে রাখছেন। তিনি মানবতাকে একবারেই আমলে না নিয়ে ঘৃনাপূর্ণ রাজনৈতিক খেলা খেলছেন যা শুধুমাত্র শরনার্থীদের কষ্টই বাড়াবে এবং তাদের জন্যে অবর্ননীয় কষ্ট নিয়ে আসবে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব
ভারতকে পাকিস্তানের আভ্যন্তরীন ব্যাপারে নাক গলাতে সংযত করা এবং এর মাধম্যে যুদ্ধ শুরু হওয়া বন্ধ করা, যা, ব্রিটিশ পররাষ্ট্র সচিব যেমন বলেছেন, যা এখন বেদনাদায়ক তা হয়তো মহাবিপর্যয়কারী ঘটনায় রূপ নেবে।
পরিশিষ্ট
ভারতের দেওয়া শরনার্থীর সংখ্যা
২৬ এপ্রিল, ১৯৭১ – রয়টার্স/ কলকাতা
শরনার্থীদের জন্যে প্রাদেশিক কমিশনার জনাব বি.বি. মন্ডলের ভাষ্য অনুযায়ী ৫২৩,০০০ শরনার্থী ভারতে প্রবেশ করেছে।
১৫ মে, ১৯৭১ – রয়টার্স/ নয়াদিল্লী
ভারত আজ পাকিস্তানকে ইচ্ছাকৃতভাবে ২০ লক্ষ পাকিস্তানিকে ভারতে আসতে বাধ্য করেছে এবং এই সমাধান দক্ষিন এশিয়ার শান্তি বিঘ্ন ঘটাতে পারে। এই ফলাফলের ব্যাপারে একটি কূটনৈতিক মন্তব্য পাকিস্তানকে দেওয়া হয়েছে খবর পাওয়া গেছে। একই প্রতিবেদন পরবর্তীতে বলে, “নির্ভরশীল সূত্র বলেছে এটা হয়তো শরণার্থীদের জন্যে পাকিস্তানের কিছু জায়গা ছেড়ে দেওয়া উচিৎ জানানোর প্রথম পদক্ষেপ।”
১৫ মে, ১৯৭১- রয়টার্স/কলকাতা
ফ্রেড ব্রিজল্যান্ডের প্রতিবেদন, একজন ভারতীয় মুখপাত্র আজ এখানে বলেছেন যে অতিসত্বর পঞ্চাশ থেকে ষাট লক্ষের মত শরনার্থী পাকিস্তান থেকে ভারতে প্রবেশ করবে। একই প্রতিবেদন নির্দেশনা দেয় যে ভারত পাকিস্তানকে কুটনৈতিক চিঠি দিয়েছে এবং নির্ভরশীল সূত্রকে উদ্ধৃত করে বলে যে, “এই চিঠি হয়তো শরণার্থীদের জন্যে পাকিস্তানের কিছু জায়গা ছেড়ে দেওয়া উচিৎ জানানোর প্রথম পদক্ষেপ।”
১৮ মে, ১৯৭১- রয়টার্স/ওয়াশিংটন – (রাত্র সাড়ে ৮ টার জন্যে অগ্রিম প্রকাশিত)
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী, মিসেস ইন্দিরা গান্ধী, আজ পাকিস্তানকে পূর্ব পাকিস্তানে উদ্ভুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনের মাধ্যমে শান্তি বিনষ্টের অভিযোগে অভিযুক্ত করেন। মিসেস গান্ধী আরো বলেন, “আমরা ইতিমধ্যে দশ লক্ষাধিক শরনার্থী জায়গা দিয়েছি।” খবর পাওয়া গেছে তিনি আরো বলেছেন, “ভারত লড়াইয়ের জন্যে সম্পূর্ন প্রস্তুত।”
মে ২১, ১৯৭১
পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি সকল প্রকৃত নাগরিককে পাকিস্তানে ফিরতে আবেদন জানিয়েছেন।
২৪ মে ১৯৭১ – রয়টার্স/নয়াদিল্লী – জেরার্ল্ড র্যাজিনের প্রতিবেদন
মিসেস গান্ধী যেমন বলেছেন উদ্ধৃতি করে, “৩৫ লক্ষ লোক গত দুই মাসে পূর্ব পাকিস্তান হতে ভারতে পালিয়ে এসেছে এবং প্রতিদিন ৬০০০০ করে আসছে।” তিনি আরো বলেছেন যে, রাজনৈতিক সমাধান তারাই করবে যাদের তা করার ক্ষমতা আছে। এবং যোগ করেন, অধিক ক্ষমতার অধিকারীদের বিশেষ দায়িত্ব আছে।
“যদি বাকী বিশ্ব নিশ্চিত নিরাপত্তা দেওয়ার মত অবস্থায় শরনার্থীদের ফেরত যেতে কাজ না করে, ভারত তাহলে এদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনের নিরাপত্তা, সংরক্ষণ ও উন্নয়নের জন্যে কাজ করবে,” তিনি বলেন।
পাদটীকাঃ ১৮ মে মিসেস গান্ধী শরনার্থী সংখ্যা বলেন দশ লক্ষাধিক এবং ২৪ মে বলেন ৩৫ লক্ষন যেখানে প্রতিদিন ৬০০০০ লোক প্রবেশ করছে।
২৫ মে,১৯৭১ – রয়টার্স/নয়াদিল্লী
ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরকার সারান সিং বলেন, “বিধানসভাকে নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে যে যদি জাতীয় স্বার্থে প্রয়োজন মনে হয় তবে সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে দ্বিধা করবে না।” কিন্তু জানা যায় তিনি হুশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, “কিছু ব্যাপার আমলে নিতে হবে, যেমন পূর্ব পাকিস্তানীদের নিয়ন্ত্রিত এলাকা ও পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে ভারতের সম্পর্ক।”
২৫ মে, ১৯৭১ – রয়টার্স/নয়াদিল্লী
“প্রধানমন্ত্রী ইন্ধিরা গান্ধী আজ ক্ষমতাশীলদের পূর্ব পাকিস্তানে হস্তক্ষেপ করতে বলেছেন যেমন তার পররাষ্ট্র মন্ত্রী বলেছে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীরা পাকিস্তানি সৈন্যদের সীমান্ত অতিক্রম করলেই ফেরত পাঠাচ্ছে”
৭ জুন, ১৯৭১ – রয়টার্স/নয়াদিল্লী
স্বাস্থ্যমন্ত্রী উমাশংকর দীক্ষিত আজ লোকসভাকে বলেন, সংসদের নিম্নকক্ষ, যে ৪ জুন, শুক্রবারের মধ্যে, ৭৩৮০৫৪ জন শরনার্থী পূর্ব পাকিস্তান থেকে প্রবেশ করেছে।
১১ জুন, ১৯৭১ – রয়টার্স/নয়াদিল্লী – রাম সুরেশের প্রতিবেদন
কেন্দ্রীয় সরকার ঘোষনা করেছে যে ২৫ মার্চ হতে শরনার্থীদের অন্তঃপ্রবাহ ৫৫ লক্ষ পার করেছে এবং এই সংখ্যাও পুরানো।
১৬ জুন, ১৯৭১ – রয়টার্স/নয়াদিল্লী
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্ধিরা গান্ধী ও জাতিসংঘের শীর্ষ কর্মকর্তা পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা নিয়ে বিপরীতধর্মী মূল্যায়ন দিলে প্রত্যাবাসন করা প্রায় ষাট লক্ষ শরনার্থীদের নিয়ে বিবাদের ছায়া তৈরী হয়।
১৬ জুন, ১৯৭১ – বয়রা বাজারঃ ইন্দো-পাকিস্তান সীমান্তের উপরে
নতুন করে শরনার্থীরা পূর্ব পাকিস্তানের যশোর জেলা দিয়ে ভারতে ঢুকছে বারো দিনের স্তিমিত শরনার্থী স্রোতের পরে।
পাদটীকাঃ এটা খুব কৌতুহলোদ্দীপক যে, রয়টার্স সংবাদ সংস্থার অনুযায়ী ১৬ জুন পর্যন্ত ১২ দিন শরনার্থী প্রবেশ কমে গিয়ে পানি টিপ টিপ করে পরার হয়ে গিয়েছিলো যেখানে ভারতীয় সংখ্যা ক্রমাগত বেড়েই চলছিলো। ১৮ মে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর কথা অনুযায়ী শরনার্থীর সংখ্যা ছিলো দশ লক্ষাধিক, ২৪ মে ২৫ লক্ষ; ৭ জুন ৪৭ লক্ষ; ১১ জুন ৫৫ লক্ষ; ১৬ জুন ৬০ লক্ষ। যেই সংখ্যা ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী দিল্লীতে এবং ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রী ১৭জুন ১৯৭১, ওয়াশিংটনে ন্যাশনাল প্রেস ক্লাবকে দেওয়া ভাষনে বলেন।
ভারতের দেওয়া শরনার্থীদের সংখ্যা অতিরঞ্জিত বললে পাকিস্তানকে দোষ দেওয়া যাবে কি?
.
.
শিরোনামঃ ১৩৭। পূর্ব পাকিস্তানের সংকটের উপর কিছু প্রশ্ন ও পাকিস্তান সরকারের জবান
সূত্রঃ সরকারী প্রচার পুস্তিকা
তারিখঃ জুন, ১৯৭১
.
পূর্ব পাকিস্তান সংকট
প্রশ্নোত্তর
.
(পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রতিক উন্নতির কারনে দেশি এবং বিদেশি বিভিন্ন সংবাদপত্রের প্রতিনিধিদের দ্বারা বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়েছে। এই প্রশ্ন গুলোর জবাব পাকিস্তান সরকারের মুখপাত্র দ্বারা দেওয়া হয়েছে। এই প্রশ্ন এবং উত্তরের গুরুত্বপূর্ন/সারমর্ম অংশ এখানে দেওয়া হলো।)
প্রশ্ন ১ – ১৭ জানুয়ারি ১৯৭১ এর সাধারন নির্বাচনের পরের অধিবেশনেই কেন ন্যাশনাল এসেম্বলির অধিবেশন আহবান করা হয়নি? শেখ মুজিবুর রহমান প্রকাশ্যে অভিযোগ করেন পশ্চিম পাকিস্তানী পক্ষের সুবিধার্থে এবং সে অনুসারে তিনি একজন সংখ্যা গরিষ্ঠ দলের নেতা হওয়া সত্ত্বেও ৩ মার্চের তারিখ সংশোধনের বিষয়ে তার সাথে কোন আলোচনা করা হয়নি।
উত্তরঃ নির্বাচনের পূর্বে (৩রা ডিসেম্বর ১৯৭০) জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষনে প্রেসিডেন্ট সকল রাজনৈতিক দলের নেতাদের কাছে প্রস্তাব করেছিল যে, প্রত্যেকের সাথে একটি কার্যকরি আলোচনা হবে এবং ভবিষ্যৎ সংবিধানের মূল শর্ত গুলোর উপর ঐক্যমতে পৌছাবে। যেহেতু এই আলোচনা ভবিষ্যৎ সংবিধান প্রনয়নের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ন তাই এই জন্য যথেষ্ট সময় প্রয়োজন।এইজন্য ন্যাশনাল এসেম্বলির মিটিং ৩ই মার্চে নির্ধারন করা হয়।
প্রশ্ন২ঃ কেন ৩ই মার্চের ন্যাশনাল এসেম্বলির নির্ধারিত অধিবেশন স্থগিত করা প্রয়োজন ছিল?এটা কি সত্য যে জনাব ভূট্রো ন্যাশনাল এসেম্বলির অধিবেশন বয়কট করার হুমকি দিয়েছিল?
উত্তরঃ সংঘর্ষ থেকে রক্ষার জন্য কারন কোন সংখ্যাগরিষ্ঠ দলই পুরো পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করতে পারেনি এবং উভয় সংবিধানের বিষয়ে পরস্পর বিরোধী অবস্থান নিয়েছে। আওয়ামীলীগের সদস্যরা প্রকাশ্যে শপথ গ্রহণ করেছিল যে তারা ছয় দফা থেকে এক ইঞ্চিও নড়বে না এমতাবস্থায় পিপলস পার্টি জোড় দিয়ে বলে তারা অযথা এমনকি শুনানির সুযোগ ছাড়া কোন সিদ্ধান্ত গ্রহনে এসেম্বলিতে যাবেনা।
দৃশ্যত বাস্তব প্রেক্ষাপট থেকেই জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া অনিবার্য হয়ে উঠে। উভয় দলের পূর্ব সমঝোতা ছাড়া এবং এরই সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের অনেক প্রতিনিধি হাউস থেকে দূরে।উদ্ভোধনী অধিবেশন যদি পূর্ব নির্ধারিত তারিখ অনুযায়ী ৩ই মার্চ অনুষ্ঠিত হত তাহলে অধিবেশনে বিশৃঙ্খলা তৈরি হত এবং ক্ষমতা হস্তান্তরের শান্তিপূর্ন প্রক্রিয়া নষ্ট হয়ে যেত। রাজনৈতিক নেতাদের সংবিধান বিষয়ে একটি কার্যকরি সমাধানে পৌছানোর এবং তাদের জেদকে নিয়ন্ত্রনের জন্য আরো সময়ের প্রয়োজন ছিল।
প্রশ্ন৩ঃ জাতীয় পরিষদের বাইরে কেন আপোষের প্রয়োজন ছিল যেখানে স্পষ্টভাবে সংবিধান প্রনয়নের জন্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহবান করা হয়েছে।
উত্তরঃ কারন সমঝোতার অভাবে অনুষ্ঠিত এসেম্বলির অধিবেশন হাউজেই ব্যর্থ হয়ে এসেম্বলি নিজেই ভেস্তে যেত।
প্রশ্নঃ পিপল’স পার্টির চেয়ারম্যান মিঃ ভুট্রো সরকারের নিকট দুটি বিকল্প নিয়ে উপস্থিত হয়েছিল – ১,ন্যাশনাল এসেম্বলির অধিবেশন স্থগিত করা ২, সংবিধান প্রনয়নের জন্য ১২০ দিনের সময়সীমা শিথিল করা। কেন প্রথম বিকল্পটি গ্রহণ করা হলো দ্বিতীয়টি নই?
উত্তরঃ এই সংকটে সরকার কোন রাজনৈতিক নেতা অথবা অন্য কাউকে সন্তুষ্ট করতে চায়নি কিন্তু একটি সংবিধান প্রনয়নের জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে চেয়েছে। অতিরিক্ত সময়ের মধ্যে পূর্ব বোঝাপড়া ছাড়া হাউজে বিতর্ক দীর্ঘায়িত হতো এবং সংবিধান প্রনীত হতো না।
প্রশ্ন৫ঃ আওয়ামীলীগ ছয় দফার উপর ভিত্তি করে নির্বাচনে অংশগ্রহন করে। যদি পাকিস্তানের অখন্ডতার জন্য এই দফা গুলো হুমকি হয়, তাহলে কেন A% আওয়ামীলীগের ছয় দফার ভিত্তিতে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়নি।
উত্তরঃ ছয়দফা মূলত দাবি হিসেবে একটি বৃহৎ আকারের রাষ্ট্রের কাঠামোর মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসণ প্রদানের প্রক্রিয়া ছাড়া আর কিছুই ছিল না। তাছাড়া, গত এক বছর আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দ কতৃক সর্বত্র নির্বাচনী প্রচারনায় জোড় দেওয়া ছয় দফা “ঈশ্বরের বাণী” ছিলো না,সেগুলো “আলোচনার জন্য উন্মুক্ত ছিলো” এবং বিশ্লেষকদের বক্তব্য ছিলো ছয় দফা দৃশ্যত পাকিস্তানের অস্তিত্বের জন্য “অকল্যানকর”। এইদিকে আওয়ামীলীগের অবস্থান নির্বাচনমুখী ছিলো এবং প্রকাশিত বিবৃতিতে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দের সাথে শেখ মুজিবুর রহমানের কর্মপদ্ধতি প্রণয়নের বিষয়টি প্রকাশ পায়। উভয়ে আইনী কাঠামোর মধ্যে সংবিধান এবং সরকার গঠনের বিষয়টি ব্যক্ত করে।আইনগত কাঠামোর আওয়াতাধীন আদেশের মাধ্যমে আওয়ামীলীগ এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দল স্বচ্ছ এবং নিরেপেক্ষ নির্বাচনে লড়াই করতে এবং সাংবিধানিক ব্যবস্থার অধীনে পাকিস্তানের অখন্ডতা এবং ঐক্য গড়তে চায়।
প্রশ্ন৬ঃ মুজিবের ছয় দফায় অর্থনৈতিক শোষণ মুক্তির কথা বলা হয়েছে যদি তাই হয়, সরকার কিভাবে তা দূর করবে?
উত্তরঃ পূর্ব পাকিস্তান নামক এই অঞ্চল শতাব্দী ধরে কলকাতার পশ্চাৎ ভূমি ছিলো এবং বৃটিশ সাম্রাজ্যেবাদ এবং কলকাতার মারওয়ারি ব্যবসায়ী কতৃক শোষিত হয়েছে। দুই শতকের দুই দশকের মধ্যে দূর করা সম্ভব না। স্বাধীনতার পূর্বে পূর্ব পাকিস্তানে একটি পাকা পাটের গাইট প্রেস পর্যন্ত ছিলো না। এখন বিশ্বের সর্ববৃহত পাটকল রয়েছে, পাকিস্তানের প্রথম স্টিল মিল এবং দেশের সর্ববৃহত সারকারখানা এবং আরো অনেক নির্মানাধীন রয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার বিশদ পরিকল্পনা পক্রিয়াধীন রয়েছে।
প্রশ্ন৭ঃ আওয়ামীলীগের ছয় দফা যদি LFO অস্বীকার না করে থাকলে কেন ছয় দফাকে সাংবিধানিক আইনগত অধিকার হিসেবে দেখতে অস্বীকার করে। যেখানে ন্যাশনাল এসেম্বলিতে তাদের নিরুঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে।
উত্তরঃ একটি সংবিধান ঐক্যমতের ফসল। এটা কোন সাধারন বিল নই যে দেশের একটি অঞ্চলের প্রতিনিধিত্বমূলক সহজ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দ্বারা গ্রহণ করা হবে। এক ব্যক্তির এক ভোট নীতি পরিষ্কার করে প্রেসিডেন্ট তার আস্থা এবং বিশ্বাসের অবস্থা পরিষ্কার করেছে। বিনিময়ে তিনি আশাব্যক্ত করেন, আঞ্চলিক সংখ্যা গরিষ্ঠতা আনুপাতিক হারে ব্যবহার করে রাষ্ট্রের সকল অংশের জন্য একটি গ্রহণযোগ্য সংবিধান প্রণয়ন করা হবে। আওয়ামীলীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও ইহা মানতে অস্বীকার করলো। যদিও ক্ষমতা হস্তান্তরই জাতির কাছে প্রথম অঙ্গীকার ছিলো তার পূর্বে একটি সাংবিধানিক কাঠামোর মাধ্যেমে ক্ষমতা হস্তান্তর সঠিক স্থানে ক্ষমতা হস্তান্তরের নীতি নির্ধারন করতে হবে।
প্রশ্ন৮ঃ ইহা একটা বিশ্বস্ত সূত্রের আবাস যে প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে আলোচনাকালীন সময়ের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশটি আর্মি কর্তৃক দখল করার জন্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে জনবল এবং সরঞ্জামাদি নিয়ে আসার পরিকল্পনা করেন। ইহা কতটুকু সত্য?
উত্তরঃ বিশ্বাস করা পুরোপুরি অযৌক্তিক, গত এক বছরেরও বেশি সময় স্থায়ী দেশে প্রথমবারের মতো সর্বাত্নক সাধারণ নির্বাচন চলেছে। এরই মধ্যে এক ব্যক্তি এক ভোট নীতি করা হয়েছে এবং পূর্ব পাকিস্তানে সেনাবাহিনী নিয়োগের অবস্থা এখন যেমন পূর্বেও তেমন ছিলো।
প্রশ্ন৯ঃ প্রেসিডেন্ট ২৬শে মার্চ তার ভাষণে বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে তার আলোচনা কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে এবং তিনি(প্রেসিডেন্ট)শান্তিপূর্নভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য নৈতিকভাবে প্রস্তুত। কিছু গুরুতর জটিলতা থাকা সত্ত্বেও শেখ মুজিবুর রহমান একটি ঘোষনার মাধ্যেমে সামরিক আইন তুলে নেওয়ার প্রস্তাব করেন এবং সকল রাজনৈতিক দল তাতে সম্মতি দেয়।প্রেসিডেন্ট কতৃক অনুমোদিত নীতির সাথে এই প্রস্তাব কিভাবে সাংঘর্ষিক বলে মনে করা হয়?
উত্তরঃ প্রাথমিক পর্যায়ে কনফেডারশনে কোন আলাপ হয়নি।তাছাড়া দ্বিতীয় পর্যায়েও “সংবিধানের কনভেনশন” নিয়ে আনুষ্ঠানিক কোন আলোচনা হয়নি। কিছু গুরুতর সংকট থাকা সত্ত্বেও আইনী অন্যান্য বিষয়াদি বিবেচনা করে প্রেসিডেন্ট নীতিগতভাবে শান্তিপূর্নভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরে রাজি ছিলেন কিন্তু একটি শর্তে। এই শর্তটি শেখ মুজিবুর রহমানের নিকট পরিষ্কারভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে, প্রেসিডেন্ট চেয়েছিলেন তাতে সব রাজনৈতিক দলের পূর্বোনুমোদন এবং নি্রেপেক্ষ সম্মতি থাকবে। সে অনুসারে এই প্রস্তাব অন্যান্য রাজনৈতিক 1P-ders এর সঙ্গে আলোচনা করা হয়। প্রেসিডেন্টের ঘোষণার বিষয়ে তাদের যে প্রস্তাব তাতে যে কোন আইনগত বৈধতা নেই তাতে তারা সর্বসম্মত হয়। ইহা সামরিক আইনকেও কাভার করবে না জনগনের ইচ্ছার উপর ভিত্তি করেও হবে না এভাবে একটা শূন্যতা তৈরি হবে এবং বিশৃঙ্খলা ঘটবে। তারা মনে করেছিল বিদ্যমান পরিস্থিতিতে একটি ঘোষণার মাধ্যেমে ন্যাশনাল এসেম্বলির দুই অংশের বিভেদকে আরো উস্কে দিতে পারে। তারা তারপর অন্তর্বর্তী সময়ে সামরিক আইন তুলে নিয়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিকট হস্তান্তরে মতামত ব্যক্ত করে। ন্যাশনাল এসেম্বলি একটি কার্যকরি সাংবিধানিক বিল পাস এবং প্রেসিডেন্টের অনুমোদনের জন্য মিলিত হয়। প্রেসিডেন্ট সম্পূর্নভাবে তাদের এই ভাবনার সাথে একমত হয় এবং এই বিষয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রকৃত মনোভাব সম্পর্কে তাদের জিজ্ঞাসা করে। তিনি নেতৃবৃন্দকে তাদের পরিকল্পনা ব্যক্ত করতে বলেন যেখানে একছত্র ক্ষমতার সকল উৎস ধ্বংস হবে, যেমন ন্যাশনাল এসেম্বলির কার্যকরী অধিবেশনের মাধ্যেমে সামরিক আইন এবং অন্যান্য সংকটে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটবে।
তারা শেখের সাথে বসতে আগ্রহী হলো, তাদের অবস্থান ব্যাখ্যা করলো এবং ন্যাশনাল এসেম্বলি কতৃক সৃষ্ট ক্ষমতা হস্তান্তরে অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা মেনে চলতে সম্মত হলো। শেখ মুজিবুর রহমানের ভাবনার কারনে ন্যাশনাল এসেম্বলি শুরুর সাথে সাথে দুটি ভাগে বিভক্ত হতে পারে বলে রাজনৈতিক নেতারা উদ্বিগ্ন ছিলো। তারা অনুভব করলো, এ ধরনের পরিস্থিতি সম্পূর্ন পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষায় হুমকি হবে। শেখ মুজিবুর রহমান এবং প্রেসিডেন্টের সাথে আলোচনার সময়ও পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান শেখকে তাদের এই মতামত ব্যক্ত করেন। ২৩শে মার্চ সন্ধ্যায় রাজনৈতিক দলের নেতারা প্রেসিডেন্টক্বে জানান যে শেখ মুজিব তার পরিকল্পনা পরিবর্তনে আগ্রহী নই। সকলে জানান তিনি চেয়েছেন রাষ্ট্রপতি সামরিক শাসন প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়ে ক্ষমতা তার নিকট হস্তান্তর করবে।
প্রশ্ন১০ঃ ইহা কি সত্য প্রেসিডেন্ট এবং শেখ মুজিবুর রহমান নিম্নোক্ত চারটি পয়েন্টে সম্মতিতে পৌছায়-
১, প্রেসিডেন্টের ঘোষণার মাধ্যেমে সামরিক আইন প্রত্যাহার এবং বেসামরিক সরকারের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর।
২, প্রদেশ গুলোতে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর।
৩, রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রপতিই থাকবেন এবং কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রন নিবেন।
৪, হাউসের যুগ্ন অধিবেশনে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের সদস্যরা চূড়ান্ত সংবিধানের জন্য পৃথকভাবে প্রস্তুতি নিবে।
উত্তরঃ ক্ষমতা হস্তান্তর এবং তার গ্রহণের মূল বিষয় সেখানে উল্লেখ আছে, আলোচনা অনুযায়ী সরকারের পক্ষে রাষ্ট্রপতি এই বিষয়ে তার সিদ্ধান্ত ব্যক্ত করেছেন। সেখানে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক চূড়ান্ত কোন সিদ্ধান্তে পৌছার প্রশ্নই আসেনা। যখন তিনি নির্বাচনের নির্দেশ দেন তখন তার ক্ষমতা হস্তান্তরের দায়বদ্ধতা জন্মে। ভবিষতে কি প্রয়োজন এই জন্য কিছু পরিকল্পনা কেন্দ্র এবং প্রদেশ উভয়ের মধ্যে ছিলো। সেখানে সামরিক আইনের অথবা ন্যাশনাল এসেম্বলির অঙ্গীকারের বিষয়ে একটি ঘোষণার কোন গুরুত্ব নেই। আপনাকে অন্তর্বর্তী ক্ষমতা সামরিক আইন অথবা সাংবিধানিক প্রক্রিয়া এই দুয়ের একটিতে রূপান্তরিত করতে হবে।
প্রশ্ন১১ঃ এটা কি সত্য প্রেসিডেন্ট পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান মি.জেড.এ. ভূট্রোকে ন্যাশনাল এসেম্বলির পৃথক অধিবেশনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন? পরবর্তীতে জানা যায় ছয় দফার আলোকে সংবিধান প্রনীত হলে কেন্দ্র ও পূর্ব পাকিস্তানের সম্পর্কের উপর প্রভাব পড়বে। পশ্চিমে গুরুতর বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে। এই কারনে পশ্চিমের MNAS যৌথভাবে ছয় দফার আলোকে সংবিধান প্রণয়ন এবং ঐক্য রক্ষার্থে নতুন পন্থায় আগ্রহী হয়।
উত্তরঃ প্রেসিডেন্ট এমন কোন প্রস্তাব করেনি।
প্রশ্ন১২ঃ এটা কি সত্য ক্ষমতা বন্টনে সম্মত হয়ে তারা যৌথভাবে একবার সমঝোতায় পৌঁছেছিল। ছয় দফার উপর ভিত্তি করে তারা যেমনটি চেয়েছিল যতটুকু সম্ভব ন্যাশনাল এসেম্বলি কর্তৃক চূড়ান্ত সংবিধান প্রণয়নের কাছাকাছি পৌঁছেছিল।
উত্তরঃ দল গুলোর পারষ্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে ক্ষমতা বন্টনের যে কোন কাজই প্রেসিডেন্টের নিকট স্বীকৃত ছিলো, দলগুলো যা করতে চেয়েছে LFO ও তাই করেছে।
প্রশ্ন১৩ঃ এটা বলা কি উচিত হবে “ প্রেসিডেন্ট অথবা তার দলের চূড়ান্ত অবস্থান কি সে সম্পর্কে কোন ধারনা ছিলো না”।
উত্তরঃ রাষ্ট্রের অখন্ডতা বিলোপ হতে পারবে না অথবা করবে না এটাই প্রেসিডেন্টের চূড়ান্ত অবস্থান ছিলো।
প্রশ্ন১৪ঃ এটা বলা কি উচিত হবে প্রেসিডেন্ট এবং তার দল প্রেসিডেন্সিয়াল ঘোষণা ১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইনের অনুযায়ী ক্ষমতা হস্তান্তরে আগ্রহী ছিলো?
উত্তরঃ প্রেসিডেন্ট ন্যাশনাল এসেম্বলির আইন অনুযায়ী ক্ষমতা হস্তান্তরে আগ্রহী ছিল। ১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইন ঘোষণা ছিলো না একটি পার্লামেন্টের আইন ছিলো।
প্রশ্ন১৫ঃ ইহা বলা উচিত যে ক্ষমতা হস্তান্তরের ক্ষেত্রে “ অন্যের জন্য নিজের অতিরিক্ত” আইনী পক্রিয়া সম্পর্কে মি.ভূট্রোর মধ্যেও পর্যায়ক্রমে প্রশ্ন জেগেছিলো যেগুলো সম্বন্ধে শুরু থেকেই শেখ মুজিবের বিরোধ ছিলো।
উত্তরঃ একটি আইনী পক্রিয়া সবসময় প্রয়োজন ছিলো।
প্রশ্ন১৬ঃ ইহা অভিযোগ করা হয় যে যখন অন্তর্বর্তী সংবিধান খসড়া প্রনয়নের পরিকল্পনা যখন চূড়ান্ত হয় এবং এই বিষয়ে আর কোন বাধাই ছিলো না তখন আলোচনা ইচ্ছাপূর্বক ভেঙ্গে দেওয়া হয়। ইহা কি সঠিক?যদি না হয়, প্রকৃত ঘটনা কি?
উত্তরঃ চূড়ান্ত পর্যায়ে আওয়ামী নেতাদের এক গুয়েমি ছাড়া আর কোন বাধা ছিলো না, অন্যান্য দলের নেতারা প্রেসিডেন্টকে জানান যে,আলোচনা প্রত্যাখ্যান করেছে, সমাঝোতায় কথা না বলার জন্য তারা অনমনীয় ভঙ্গি অবলম্বন করেছিল।
.
.
প্রশ্ন ১৭: আওয়ামী লীগারদের ভাষ্যমতে ক্ষমতার হাতবদলের জন্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের দরকার এমন কোন কিছু তাদের আগে থেকে জানানো হয় নি। এটা কি বাস্তবসম্মত অবস্থান? দাবী করা হয়ছে যে এরূপ কোনো তথ্য আওয়ামী লীগের কাছে পৌঁছানো হয় নি এবং “এত ছোটখাট আইনী ব্যাপারে তারা আলোচনা ভেঙে দেবে না”।
উত্তরঃ তারা এ বিষয়ে সম্পূর্ণ অবগত ছিল কিন্তু নিজেদের দেয়া শর্ত পূরণ না হলে তারা জাতীয় পরিষদে যেতে রাজি ছিল না। কিন্তু তাদের দাবীদাওয়া মেনে নিলে সেখানে একটি শূন্যতার সৃষ্টি হত যা রাষ্ট্রপতি অথবা অন্যান্য দলের নেতৃবৃন্দ, কারো কাছেই গ্রহণযোগ্য ছিল না।
প্রশ্ন ১৮: শেখ মুজিবুর রহমান খোলাখুলিভাবেই তিনি বিচ্ছিন্নতা চান এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। “সংখ্যাগুরু অংশ কিভাবে বিচ্ছিন্নতা চাইতে পারে?” তিনি প্রশ্ন করেছেন। পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে প্রধানমন্ত্রীত্ব গ্রহণের জন্য রাষ্ট্রপতি নিজে তাকে আহবান করেছেন। তাহলে হঠাৎ করে কিভাবে তাকে একজন বিচ্ছিন্নতাবাদী ও বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে?
উত্তরঃ সংখ্যাগুরু অংশ বিচ্ছিন্নতা চাইতে পারে না, আরো সঠিকভাবে বলতে গেলে চায় না। কিন্তু কোনো বিশেষ গোষ্ঠী তা চাইতে পারে এবং তারা তা চেয়েছেও। অখণ্ড পাকিস্তানের অভ্যন্তরেই স্বায়ত্বশাসন লাভের অঙ্গীকারের উপর ভিত্তি করে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ নির্বাচনে জয়লাভ করেছেন। এ ঘটনারই যুক্তিসঙ্গত অনুসিদ্ধান্ত হিসেবে তিনি পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রপতি হিসেবে বর্ণিত হচ্ছিলেন। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান সমগ্র পাকিস্তানের জন্য কোনো ভূমিকা পালন করতে এমনকি পশ্চিম পাকিস্তান পরিদর্শন করতেও তার অপারগতার কথা জানান। মধ্যবর্তী সময়ে কেন্দ্রে একটি সরকার গঠনের সিদ্ধান্তও তিনি নাকচ করে দেন। বরঞ্চ তিনি এই উপদেশ দেন যে উপদেষ্টাদের সাহায্য নিয়ে রাষ্ট্রপতির নিজেরই কেন্দ্রীয় সরকার চালানো উচিৎ। কিন্তু তিনি বিদেশী শক্তির মুখাপেক্ষী হয়ে থাকাটা অধিকতর ভাল মনে করেন। এর ফল স্বরূপই তিনি পাকিস্তানের ১ নম্বর গণশত্রু হিসেবে ঘোষিত হন। যারা এরূপ কোনো প্রতিবেশীর কাছ থেকে সামরিক সাহায্য চায়, নিজ দেশের সামরিক বাহিনীর মাঝে বিদ্রোহের প্ররোচণা দেয় এবং একটি সমান্তরাল সরকার প্রতিষ্ঠা করে, তাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী ছাড়া আর কিছু বলা যায় না।
(২৪ মার্চ তার প্রধান প্রতিনিধি তাজউদ্দীন এই বলে সতর্ক করে দেন যে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ঘোষণা আসতে দেরি হলে অবস্থা আরো খারাপের দিকে মোড় নেবে। শেখ মুজিবুর রহমান ২৭ তারিখে ধর্মঘট আহ্বান করেন। নিজেদের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকতে তিনি জনগণের প্রতি আহ্বান জানান এবং বলেন যে এবারই শেষ বার।)
প্রশ্ন ১৯: কেন তিন সপ্তাহের বেশি সময় ধরে শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃপক্ষকে তুচ্ছ করে হানিকারক কর্মকাণ্ড চালিয়ে গেলেও তার বিরুদ্ধে কোনো তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি? কোনো প্রকার চ্যালেঞ্জ ছাড়াই প্রদেশটিতে তার রাজত্ব প্রতিষ্ঠা কি আইনসঙ্গত কর্তৃপক্ষের উপর থেকে মানুষের বিশ্বাস টলিয়ে দেয় নি?
উত্তরঃ সরকার চাইলে শেখ মুজিবুর রহমান ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারত। কিন্তু ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিকল্পনা যেন বাধাগ্রস্ত না হয় সেজন্য উদ্ভূত পরিস্থিতির মোকাবেলায় সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছিল। এ কারণেই সরকার একের পর এক বেআইনি কার্যকলাপ সহ্য করে যাচ্ছিল আর একই সাথে একটি যুক্তিসঙ্গত সমাধানে পৌঁছার আশায় সম্ভাব্য সকল রাস্তা বিবেচনা করছিল।
প্রশ্ন ২০: সরকার যদি ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে এতটাই আগ্রহী থেকে থাকে যে এর জন্য তারা কর্তৃত্বের অমান্যতাও মেনে নেয়, তবে সরকার এবং আওয়ামী লীগের মাঝে চূড়ান্ত ভাঙ্গনের কারণটা কী ছিল?
উত্তরঃ নিজের ছয় দফা ছাড়াও শেখ মুজিবুর রহমান আরো চার দফা দাবী পেশ করেন, যাতে তাৎক্ষণিক ভাবে সামরিক আইন তুলে নেয়া এবং সর্বোচ্চ দ্রুততায় রাষ্ট্রপতির ঘোষণার মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবী অন্তর্ভূক্ত ছিল। জাতীয় পরিষদের মাধ্যমেই শুধুমাত্র ক্ষমতা হস্তান্তর সম্ভব, তার এই আগের অবস্থান থেকে সরে এসে তিনি ঘোষণা দেন যে ক্ষমতা হস্তান্তর না হওয়া পর্যন্ত তিনি জাতীয় পরিষদে যাবেনই না, যদিও সার্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকার এবং এক ব্যক্তি-এক ভোট পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মাধ্যমে জাতীয় পরিষদে তার নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল।
বোধগম্যভাবেই অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো জোর দেয় যে ক্ষমতার হস্তান্তর হবে জাতীয় পরিষদের মাধ্যমে, যারা মিলিত হয়ে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধানকে ছাড়পত্র দেবে যা তখন সম্মতির জন্যে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হবে। তাদের মতে প্রস্তাবিত ঘোষণার কোনো আইনগত ভিত্তি থাকবে না; এটি না হবে সামরিক আইনের সমর্থন না হবে এতে জনমতের প্রতিফলন। বরং এতে এক শূন্যতার সৃষ্টি হবে যার সাথে সাথে আসবে বিশৃঙ্খলা।
রাষ্ট্রপতি আবারো ঢাকা উড়ে যান এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতির সুরক্ষা ও ক্ষমতা হস্তান্তরে অগ্রগতি অর্জনের লক্ষ্যে একটি সমঝোতায় পৌঁছার আশায় ১০ দিন ধরে আলোচনা চালানো হয়। আলোচনা চলাকালে শেখ মুজিবুর রহমান তার আগেকার স্বায়ত্তশাসনের দাবীকে কনফেডারেশনের দাবীতে উন্নীত করেন। এর অর্থ ছিল প্রস্তাবিত ঘোষণার মাধ্যমে সামরিক আইন রহিতকরণ ও ক্ষমতা হস্তান্তরের পর পাকিস্তানের পাঁচটি প্রদেশ ভাগ হয়ে যাবে এবং জাতীয় সার্বভৌমত্ব কার্যত বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
শেখ মুজিবুর রহমান আরো দাবী করেন যে জাতীয় পরিষদকে প্রথম থেকেই দুটি কমিটিতে ভাগ হয়ে বসতে হবেঃ একটি হবে পূর্ব পাকিস্তানের সদস্যদের জন্য, অপরটি হবে পশ্চিম পাকিস্তানের সদস্যদের। পরবর্তীতে তিনি তার দাবীকে দুটো সাংবিধানিক সম্মেলন ও ভিন্ন ভিন্ন সংবিধান প্রণয়নের দাবীতে উন্নীত করেন।
প্রশ্ন ২১: “বিধিবদ্ধ কর্তৃপক্ষের অনুপস্থিতি সত্ত্বেও পুলিশের সহায়তায় আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাসেবকেরা আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির এমন মান ধরে রাখতে সক্ষম হয় যা অন্যান্য সময়ের চাইতে তুলনামূলকভাবে ভাল ছিল” – এ ব্যাপারে কোন মন্তব্য?
উত্তরঃ হ্যাঁ; খুন, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ বাদ দিলে বাকি সবকিছু ভালই ছিল।
প্রশ্ন ২২: “এটা এখন পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে যে সঙ্কটজনক পরিস্থিতির উদ্ভবের আগেই এরূপ পরিস্থিতি মোকাবেলার লক্ষ্যে পরিকল্পনা প্রস্তুত করে রাখা হয়েছিল। মার্চের এক তারিখের কিছু আগে সীমান্ত রক্ষায় রংপুরে প্রেরিত ট্যাঙ্কগুলোকে ঢাকায় ফিরিয়ে আনা হয়” – এটা কী সত্য?
উত্তরঃ না। সম্ভবত পাকিস্তান সরকারের চাইতে আওয়ামী লীগের পরিকল্পনার বিস্তৃতি বেশি কৃতিত্বের দাবীদার।
প্রশ্ন ২৩: সাংবিধানিক সমস্যার সমাধান বা রাজনৈতিক দাবীদাওয়া পূরণে বলপ্রয়োগের আশ্রয় নেয়া কেন?
উত্তরঃ পূর্ব পাকিস্তানে সরকারকে বলপ্রয়োগের আশ্রয় নিতে হয়েছে কারণ সে পর্যায়ে এসে আওয়ামী লীগের অভিপ্রায় সম্বন্ধে সন্দেহের কোনো অবকাশ ছিল না। আওয়ামী লীগের মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ নেতৃত্ব অনুধাবন করতে পারে যে রাষ্ট্রপতি বা অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর কেউই পাকিস্তানের সাংবিধানিক সর্বনাশ ঘটানোতে রাজি হবেন না। নিজেদের রাজনৈতিক কর্মীদের অজ্ঞ রেখে তাদের অনুমতির তোয়াক্কা না করেই এসকল চরমপন্থীরা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে নিজেদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গোপনে প্রস্তুতি নিচ্ছিল। আগরতলা মামলার মাধ্যমে প্রথমবার জনসম্মুখে আসা এই ষড়যন্ত্র এ পর্যায়ে এসে তার সর্বোচ্চ বেগে পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। “সংগ্রাম পরিষদ” এর আবরণে প্রতি জেলায় স্বেচ্ছাসেবকেরা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছিল। ভারত থেকে অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদের চালান চোরাই পদ্ধতিতে এনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলসহ প্রদেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে জমা করে রাখা হয়েছিল। আওয়ামী লীগের এই চালটি কতটা সুপরিকল্পিত ও সুসংগঠিত ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় ২৫ ও ২৬ মার্চের মাঝের রাতে জগন্নাথ হল থেকে মর্টারের গোলাবর্ষণ এবং সে রাতেই ৩ ঘণ্টার মাঝে ঢাকার সর্বত্র অসংখ্য ব্যারিকেডের উদ্ভব ঘটার মাঝে।
প্ররোচনার মাধ্যমে নিজেদের কাঙ্ক্ষিত ফললাভে ব্যর্থ হয়ে আওয়ামী লীগ তা নাৎসিদের পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে করায়ত্ব করতে চেয়েছিল। সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হয় এবং অসংখ্য অরাজকতার ঘটনা ঘটে। আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী অংশের দ্বারা সংগঠিত হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত রূপ ধীরে ধীরে আমাদের সামনে ফুটে উঠছে।
সকল প্রমাণাদি এটাই নির্দেশ করে যে ২৬ মার্চের শুরুর সময়টুকুকে এক সশস্ত্র আন্দোলনের ‘জিরো আওয়ার’ হিসেবে নির্বাচন করা হয়েছিল। সে সময়েই আনুষ্ঠানিকভাবে “স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ” এর যাত্রা শুরু হত। ঢাকা এবং চট্টগ্রাম দখল করে আকাশ ও জলপথের মাধ্যমে সেনাবাহিনীকে কোনরূপ সরবরাহ বা সহযোগিতা পোঁছাবার পথ রুদ্ধ করে দেয়ার পরিকল্পনা ছিল। এ অংশে সেনাবাহিনী বলতে তখন ছিল ১৬টি ব্যাটালিয়ানের একটি ডিভিশন, যার মধ্যে ১২টি ছিল পশ্চিম পাকিস্তানী। তারা অঞ্চলটির অভ্যন্তরের বিভিন্ন সেনানিবাসে ও ভারতের সাথের সীমান্তে অপ্রতুল সংখ্যায় নিয়োজিত ছিল। তাদের বিরুদ্ধে ছিল ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও অন্যান্য সহযোগী বাহিনী থেকে বেরিয়ে যাওয়া সদস্যরা যারা মর্টার, রিকয়েললেস রাইফেল, ভারী ও হালকা মেশিনগান এবং, যথেষ্ট প্রমাণাদির ভিত্তিতেই বলা যায়, ভারতীয় সীমান্তের ওপার থেকে আসা অকুণ্ঠ সরবরাহের মাধ্যমে সজ্জিত ছিল। বিচ্ছিন্নতার সপক্ষে আওয়ামী লীগের প্রস্তাব বাস্তবে রূপ নিতে শুরু করেছিল। শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের সকল পথ রুদ্ধ হয়ে যাওয়ায় রাষ্ট্রপতি সশস্ত্র বাহিনীকে “তাদের কর্তব্য পালন এবং সরকারের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে” আহ্বান জানান।
প্রশ্ন ২৪: এটা বলা কি সঠিক হবে যে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে সরকার একটি সুষ্ঠ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের প্রদত্ত রায়কে নস্যাৎ করতে চাইছে?
উত্তরঃ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ অখণ্ড পাকিস্তানের কাঠামোর ভেতরে থেকে স্বায়ত্ত্বশাসন লাভের পক্ষে ভোট দিয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের দেয়া সকল গণবিবৃতিতেই অখণ্ড পাকিস্তানের অঙ্গীকার রয়েছে। সরকার সামরিক ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয় যখন উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করা যায় যে আওয়ামী লীগের চরমপন্থীরা প্রাদেশিক স্বায়ত্ত্বশাসনের পক্ষে জনগণের রায়কে উপেক্ষা করে একপাক্ষিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে বদ্ধপরিকর। জনগণ কখনোই দেশ বিভাগের পক্ষে ভোট দেয় নি।
প্রশ্ন ২৫: এটা বললে কি ঠিক হবে যে বলপ্রয়োগের ফলে অখণ্ড পাকিস্তানের ধারণাটির মেরামত অযোগ্য রূপে ক্ষতি সাধিত হয়েছে? পূর্ব পাকিস্তানে চলমান সামরিক অভিযান কি সামরিক যন্ত্র নিয়ন্ত্রণকারী সংখ্যালঘুদের (পশ্চিম পাকিস্তানে বসবাসকারী) কর্তৃক সংখ্যাগুরুদের (পূর্ব পাকিস্তানের অভিবাসী) বিরুদ্ধে চালিত দখল অভিযান নয়?
উত্তরঃ না, তা ভুল। একই ভাবে এমন ধারণাও অসত্য যে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের অধিকাংশই বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থন দিচ্ছিল। কারণ তা হলে কোনো সেনাবাহিনীই পরিস্থিতিকে এত দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনতে পারত না। এটা শুধু এ জন্যেই সম্ভবপর হয়েছিল কারণ সশস্ত্র বাহিনীর পক্ষে পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ জনগণের সমর্থন বিদ্যমান ছিল।
.
.
জনগন নয়, শত্রুদের বিরুদ্ধেই আর্মি আক্রমনে গেছে, যেখানে আছে ভিতর এবং বাইরের বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং ভারতীয় অণুপ্রবেশকারী। পূর্ব পাকিস্তান যেমন পাকিস্তানের অন্য যেকোন অঞ্চলের মতোই একটা অংশ, এর প্রতিটা ইঞ্চি রক্ষা করা তাই জাতীয় আর্মির কর্তব্য।
পূর্ব পাকিস্তানের দেশপ্রেমিক জনগণ যাদের ভয় দেখিয়ে নাজি স্টাইলে দুর্বৃত্তপনা করে নিজেদের জাহির করছে আওয়ামী লীগ। তাদের সক্রিয় সহযোগিতায় সেনাবাহিনী অণুপ্রবেশ এবং রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকান্ড কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে।
“মার্চের ২ এবং ৩ তারিখে নিরস্ত্র জনগনের উপর ঠান্ডা মাথায় গুলিবর্ষণের ফলে ইতিমধ্যে হাজার হাজার হতাহত হয়েছে।” এটা কি সত্যি?
উত্তরঃ না, সৈন্যরা সাধারণ জনগনের উপর গুলিবর্ষণ করেনি, শুধুমাত্র লুট, অগ্নিসংযোগ এবং হত্যার সাথে জড়িত ডাকাত শ্রেনীর লোককেই গুলি করেছে।
প্রশ্নঃ ২৭. অভিযোগে বলা হয়েছে লে. জেনারেল টিক্কা খান কর্তৃক ইস্যুকৃত সামরিক আইন প্রচারিকায় ২৬ মার্চ সকালে বলা হয়, প্রচুর নারী পুরুষ এবং শিশু নৃশংসতার শিকার হয়েছে। আসলে কী ঘটেছে?
উত্তরঃ আর্মি ঐদিন ভোর রাত তিনটায় শুধুমাত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী, কর্তব্য ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া ষড়যন্ত্রকারীদের উপর অবরোধ করেছিলো। ষড়যন্ত্রকারী, যারা সশস্ত্র প্রতিবাদ করেছিলো তারা নারী বা শিশু নয়, কিন্তু ইপিআর এবং ইবিআর থেকে সশস্ত্র এবং সুসজ্জিত হয়ে কাজ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া সৈনিক। তারাই হতাহত হয়েছে কিন্তু সংখ্যাটা ব্যাপকভাবে অতিরঞ্জিত।
প্রশ্নঃ ২৮. আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, “পাকিস্তান সেনাদের উদ্দেশ্য ছিলো গণহত্যা এবং বাঙালী সৈনিকরা ধ্বংস হওয়া অথবা বেরিয়ে না আসা পর্যন্ত ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া। পাকিস্তান সরকার আশা করেছিলো এই সময়ের মধ্যে রাজনৈতিক নেতা, বুদ্ধিজীবী এবং প্রশাসনকে পঙ্গু করে দিয়ে আমাদের শিল্পকারখানাকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেউলিয়া করা, এবং সবশেষে আমাদের শহরগুলো এবং ভূখন্ডকেই নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া। ইতিমধ্যেই দখলদার আর্মি একাজে অনেকদূর এগিয়ে গেছে।” সঠিক অবস্হাটা কি?
উত্তরঃ দূর থেকে কেউ একজন ৭০ মিলিয়ন লোককে নিশ্চিহ্ন করতে চেষ্টা করছে, এখন পর্যন্ত যতো প্রমাণ পাওয়া গেছে যদি গণহত্যার চেষ্টা হয়ে থাকে তবে তা আওয়ামী লীগের বিক্ষুব্ধ সেনারাই করেছে, যারা দেশের যোগাযোগ ব্যবস্হাকেও ধ্বংস করতে চায়।
প্রশ্নঃ ২৯. চট্টগ্রাম বন্দরে ভেড়া MV Swat থেকে হঠাত্ করেই অস্ত্রশস্ত্র খালাস না করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, এই সিদ্ধান্তের পূর্বে বিগ্রেডিয়ার মজুমদার নামের একজন বাঙালী অফিসার কে তার দ্বায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় এবং একজন পশ্চিম পাকিস্তানীকে তার স্হলাভিষিক্ত করা হয়েছে। কোন মন্তব্য?
উত্তরঃ জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাস না করার হঠাত্ সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন করার কিছু নেই। প্রত্যেক সৈনিকেরই নিয়মিত ভাবে অস্ত্র গোলাবারুদসহ অন্যান্য সরঞ্জাম দরকার যাতে সে তার সীমান্ত কে রক্ষা করতে সক্ষম হয়। আমাদেরও ঠিক তাই।
প্রশ্নঃ ৩০. পাঞ্জাবী অধ্যুষিত আর্মিকে বলা হয়েছে নিরস্ত্র বেসামরিক জনগনকে হত্যা বন্ধ করতে, বিশেষ করে বুদ্ধিজীবীদের যাদের ভিতর আছে অধ্যাপক, শিক্ষক, ছাত্র, আইনজীবী ইত্যাদি। কারণ ইতিমধ্যেই ব্যাপক সংখ্যক বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়েছে।
এই ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কে বিভিন্ন দেশ জাতিসংঘের দৃষ্টি আকর্ষণ করছিলো।এটা কি করে পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যের ভ্রাতৃত্বের কিংবা সরকারের গণতান্ত্রিক আচরণের নিদর্শন হয়?
উত্তরঃ এটা নিরস্ত্র জনগনের উপর কোন বাছবিচারহীন বা ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ ছিলোনা। পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস এবং ইস্ট বেংগল রেজিমেন্ট থেকে পালিয়ে যাওয়া সৈনিকরা ছিলো সম্পূর্ণ প্রশিক্ষিত, রাইফেল, মেশিনগান এবং মর্টার দিয়ে সুসজ্জিত। তারা বিদ্রোহ করেছিলো এবং প্রয়োজনীয় বলপ্রয়োগ করেই তা দমন করা হয়েছে। এবং বুদ্ধিজীবীরা যে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ নিয়ে চিন্তিত, তাদের অনেকেই কেবলমাত্র ঢাকা থেকে টেলিভিশনে আবির্ভূত হয়েছে, অন্যরা বিদেশে ইন্ডিয়ার টাকায় ভালোসময় কাটাচ্ছিলো। তারপরও অন্যরা এটাকে অতিরঞ্জিত করে বিবৃতি প্রদান করে যাচ্ছে।
প্রশ্নঃ ৩১. এটা কি ঠিক যে ১৯৭১ এর ২৫ মার্চের আগে এক ডিভিশনের বেশি সৈন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সহ পূর্ব পাকিস্তানে এনে জড়ো করা হয়েছিলো?
উত্তরঃ আমাদের সীমান্তে বিএসএফ এর সাথে বাড়তি একলাখ ভারতীয় সৈন্য মোতায়েন হয়েছে। দেশের নিরাপত্তার জন্যেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
প্রশ্নঃ ৩২. অভিযোগ আছে, বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত একটি এসএসজি কমান্ডো গ্রুপ পূর্ব পাকিস্তানের কেন্দ্রবিন্দুতে পাঠানো হয়েছে অন্তর্ঘাত মূলক কর্মকান্ড এবং গুপ্তহত্যার জন্য এবং ধারনা করা হয়, দুদিন পূর্বে ঢাকা এবং সাইদপুরে আক্রমনের জন্য এরাই দায়ী। এরা এটা করেছে যাতে স্হানীয় এবং আগতদের মাঝে সংঘর্ষ বাধে যাতে সেনাবাহিনী হস্তক্ষেপ করার সুযোগ পায়। এটা সত্য থেকে কতোটা দূরে?
উত্তরঃ একটি সার্বভৌম দেশের সেনাবাহিনীর নিজ দেশে আইন এড়ানোর কৌশলের কোন প্রয়োজন নেই।
প্রশ্নঃ ৩৩. এটা বিবেচনায় নেওয়া যায় যে, পূর্ব পাকিস্তানীরা সেনাবাহিনীতে আরও বেশি করে যোগ দেবে। যদি তাই হয় অথবা আগের চেয়েও বেশি সংখ্যায় যোগ দেয়, তাহলে কেমন হবে?
উত্তরঃ সকল নাগরিকের ই দেশরক্ষার কাজে অংশগ্রহনের অধিকার আছে। পূর্ব পাকিস্তানীরাও এ কাজে পূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
প্রশ্নঃ ৩৪. অন্যভাবে দেখলে যোগাযোগ ব্যবস্হার দুরাবস্হা এবং প্রকট সরবরাহ সমস্যা নিয়ে সেনাবাহিনী কতোদিন ধরে একটি বেসামরিক তখা গেরিলা যুদ্ধে কার্যকরভাবে তাদের কার্যক্রম টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হবে?
উত্তরঃ এখানে কোন বেসামরিক যুদ্ধ হচ্ছেনা। কিছু সৈন্য বিপথগামী হয়ে বিদ্রোহ করেছিলো, তাদের দমন করা হয়েছে। গেরিলা যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় জনপ্রিয়তা তাদের নেই। আসলে জনগন তাদের বিশ্বাসের সাথে প্রতারণা করা লোকেদের উপর ক্ষেপে আছে।
প্রশ্নঃ ৩৫. বেসামরিক, সামরিক, কূটনৈতিক এবং পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিবিদদের দলত্যাগ কতো বড়ো সমস্যা?
উত্তরঃ ইপিআর, ইবিআর এবং আনসারের মতো সহযোগী বাহিনীর বড়ো অংশ দলত্যাগ করলেও বেসামরিক এবং কূটনীতিকদের মাঝে অল্পসংখ্যক ই তা করেছে।
প্রশ্নঃ ৩৬. সামরিক বাহিনী কি পাকিস্তানের দুই অংশের বিভক্ত হওয়া ঠেকাতে পারবে?
.
.
প্রশ্ন ৩৬: সামরিক শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে কি দুই শাখার বিভক্তি বা বিচ্ছেদ প্রতিহত করা সম্ভব ?
উত্তরঃ দুর্বৃত্ত এবং হানাদার বাহিনী সামরিক শক্তি প্রয়োগে বিতাড়িত হলে সাধারণ জনতার দলগুলো নিজে থেকেই আবার কার্যক্রম শুরু করবে, যেটা ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে।
প্রশ্ন ৩৭:আওয়ামী লীগের জাতীয়তাবাদী এবং ডানপন্থী শুক্তিগুলোকে নির্মূলনের মাধ্যমে সরকার কি বামপন্থী, বিশেষত নকশালপন্থীদের জন্য ক্ষেত্র তৈরি করে দেয়নি?
উত্তরঃ আমরা শুধুমাত্র অপসৃতদল এবং বিশ্বাসঘাতকদের নির্মূল করেছি, অন্যরা এখনও দেশপ্রেমিক সাধারণ জনগণের সাথে রয়েছে।
প্রশ্ন ৩৮: পুর্ব-পশ্চিম মতভেদ, যার মূল এখনও গভীরে প্রোথিত এবং সাম্প্রতিক ঘটনাস্রোতে আরও তীব্র- দীর্ঘমেয়াদিভাবে মিলিত হতে পারে কি?
উত্তর: যে আদর্শগত মিল তাদেরকে একত্রিত করেছিল, তা এখনও যথেষ্ট শক্তিশালী।
প্রশ্ন ৩৯: যেমন দাবী করা হচ্ছে তেমন সুষ্ঠুভাবেই যদি সবকিছু চলছিল, তবে পুর্ব পাকিস্তান থেকে বিদেশী প্রতিনিধিদের বহিষ্কার করার দরকার হল কেন?
উত্তর: তাদের নিরাপত্তার জন্য, ৪৮ ঘণ্টার জন্য পরিস্থিতি ঝুঁকিপূর্ণ ছিল।
প্রশ্ন ৪০: আপনার কি ধারনা, পুর্ব পাকিস্তানের বর্তমান সংকট, নিকট অথবা দূর ভবিষ্যতে বৃহত্তর বাংলা গঠনের পথে চালিত করতে পারে কি?
উত্তর: পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ইতিমধ্যে দুইবার এবিষয়ে তাদের সিদ্ধান্ত জানিয়েছে; প্রথমবার ১৯০৫ সালে, যখন তারা বাঙালি হিন্দু জমিদারদের অত্যাচার থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য লর্ড কার্জনকে বঙ্গভঙ্গে বাধ্য করে, এবং চূড়ান্তভাবে ১৯৪৭ সালে, যখন তারা তাদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গ থেকে আলাদা হয়ে পাকিস্তানের অংশ হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
প্রশ্ন ৪১: এই ধারনা ক্রমেই মজবুত হচ্ছে যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ামাত্র ভবিষ্যতের জন্য রাষ্ট্রপতির নির্দিষ্ট পরিকল্পনা রয়েছে। এই ধারনা কি সত্যি?
উত্তর: নিঃসন্দেহে, আমরা যেখানে থেমেছিলাম সেখান থেকেই গণতন্ত্র পুনর্বহালের প্রক্রিয়া শুরু করব।
প্রশ্ন ৪২: ভবিষ্যৎ সংবিধান প্রণয়নের প্রক্রিয়া কি হবে? রাষ্ট্রপতি কোন অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান জারি করবেন কি?
উত্তর: রাষ্ট্রপতির জনগণের কাছে যত দ্রুত সম্ভব ক্ষমতা হস্তান্তরের বদ্ধ পরিকর মানসিকতার ধারাবাহিকতায় সরকার প্রবল উদ্যমে সাংবিধানিক সংকট নিরসনের সকল উপায় খতিয়ে দেখছে।
প্রশ্ন ৪৩: পূর্ব পাকিস্তানের চলমান রাজনৈতিক অচলবস্থায় পশ্চিম পাকিস্তানে জনপ্রিয় সরকার সংকটাপন্ন হবে কি?
উত্তর: সমগ্র পরিস্থিতি নিবিড় পর্যবেক্ষণে রয়েছে।
প্রশ্ন ৪৪: আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে ভিন্ন উপায় খুঁজে পাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত আঞ্চলিক ফেডারেশনই একমাত্র বিকল্প। প্রকৃতপক্ষে এটা কি?
উত্তর: এটার মানে যাই হোক, কারো উপর কিছু চাপিয়ে দেয়ার মনোবৃত্তি নেই, জনগণ নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেবে।
প্রশ্ন ৪৫: অঞ্চলগুলোর স্বায়ত্তশাসন বাস্তবায়নের জন্য, অর্থাৎ ফেডারেল কাঠামো গঠনে কোন পদক্ষেপ নেয়া হবে কিনা? যদি না হয়, তবে স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশগুলোর মূলনীতি এবং ব্যাপ্তি কি হবে- একটি কনফেডারেট কাঠামো?
উত্তর: এবিষয়টি LFO তে পরিষ্কার নির্দেশনা রয়েছে। আমরা একটি ফেডারেল সংসদীয় পদ্ধতির জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ যেখানে শক্তিশালী পাকিস্তানের অস্তিত্ব বজায় রেখে ফেডারেশনগুলো সর্বোচ্চ স্বায়ত্তশাসন ভোগ করবে।
প্রশ্ন ৪৬: রাষ্ট্রের আদর্শগত প্রকৃতির কথা ভেবে পূর্ব পাকিস্তানে ভিন্ন নির্বাচন পদ্ধতি বিবেচনা করা হবে কি?
উত্তর: জনগণ নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেবে তারা কোন পদ্ধতি গ্রহণ করবে।
প্রশ্ন ৪৭: আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হওয়ায় পাকিস্তান পিপলস পার্টি স্বয়ংক্রিয়ভাবেই দেশের প্রধান রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হচ্ছে। তারা কি সমাজতান্ত্রিক ব্লকের দিকে ঝুঁকবে?
উত্তর: দুইটি শক্তিশালী রাজনৈতিক দলের উত্থান দেশের উন্নয়নের জন্য সবাই স্বাগত জানিয়েছিল। কিন্তু দুঃখজনকভাবে দুইটি দলের কোনটিই সমগ্র পাকিস্তানের দল হয়ে উঠতে পারেনি- যেটা সকল সমস্যার মূল কারণ। আমরা পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি অগ্রাহ্য করে কিছুই ঘটেনি মনোভাব নিয়ে আগাতে পারিনা। যতক্ষণ পর্যন্ত বৈদেশিক সম্পর্কের উপর প্রভাব বিবেচ্য, পাকিস্তান একটি স্বাধীন বৈদেশিক নীতি অবলম্বন করছে এবং কেউই এর থেকে সরে আসার কোন কারণ দেখছেনা, যে দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন।
প্রশ্ন ৪৮: সরকার কি পুর্ব পাকিস্তানসহ প্রদেশগুলোতে রাজনীতি ফেরাতে চায়? যদি চায়, তবে কবে নাগাদ?
উত্তরঃ হ্যাঁ। আমাদের লক্ষ্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জনগণের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শুরু করা।
প্রশ্ন ৪৯: সরকার কি সব রাজনৈতিক দলকে আবার আইনগত বৈধতা দেয়ার প্রস্তাবনা রাখবে নাকি শুধু আওয়ামী লীগ বাদে বাকি সব দলকে বৈধতা দেবে?
উত্তরঃ আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কোন দলকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়নি।
প্রশ্ন ৫০: ভবিষ্যতের জন্য কোন ধরনের সংবিধানে কথা ভাবা হচ্ছে?
উত্তরঃ যে ধরনের সংবিধানের জন্য LFO এর বিধিতে রাষ্ট্রপতি দায়বদ্ধ- শক্তিশালী পাকিস্তানের অস্তিত্বের সাথে সামঞ্জস্য রেখে সর্বোচ্চ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করে এমন।
প্রশ্ন ৫১: এরকম সম্ভাবনা আছে কি, সংশোধনী সাপেক্ষে পুর্ব পাকিস্তানের জন্য ৬ দফা মেনে নেয়া হবে?
উত্তরঃ কোন রাজনৈতিক দলের প্রস্তাব গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান করা সরকারের কাজ নয়। জাতীয় আইন পরিষদের সদস্যদের বৈঠকে প্রচুর ‘দেয়া-নেয়ার’ মাধ্যমে স্বায়ত্তশাসন এবং অখণ্ডতার একটি সুষ্ঠু সমাবেশ ঘটিয়ে সমাধান করা হবে।
.
.
সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট কে জবাবে তিনি বললেন যত দ্রূত সম্ভব পূর্ব পাকিস্তানের উপযুক্ত প্রতিনিধিদের সাথে সংলাপ শুরু করার উদ্যোগ নিতে হবে। এটি কি সরকারী নীতিতে কোনো রকম পরিবর্তন ছিল? এটা কি ইঙ্গিত করে যে সরকার নতুন নিরবাচন চায়. এতে করে আসলে প্রকাশ পায় বর্তমান সরকার নবনিযুক্ত প্রতিনিধিদের চায় না ।
রাষ্ট্রপতির সাথে সংলাপ চালালে অবস্থার কোনো অবস্থার সন্তোষজনক পরিবর্তন আসতে পারে কি?
এই ব্যাপারে আসলে কোনো মতভেদ ছিলনা। রাষ্ট্রপতি খমতা অন্যার হাতে দিতে চাচ্ছিলেন না এবং এ ব্যাপ্রে তিনি পূরব পাকিস্তানের অনেক নেতাদের সাথে আলোচনা করেন। নেতাদের তাদের খমতা থেকে রদবদলের কোনো ইচ্ছাই ছিলনা, শুধু মাত্র তাদের ছাড়া যারা কোনো অপরাধ কর্মে জড়িত ছিল। এমনিতেও পূর্ব পাকিস্তানে নানা বিষয়ে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছিল।
মানুষ আওয়ামীলীগ এর অভাবনীয় বিজয় দেখে অবাক হয়েছিল , রাষ্ট্রপতি কে তাই যেকোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে পূর্ব পাকিস্তানের নেতাদের সাথে আলোচনা করে নিতে হচ্ছিল।
৫৩–পশ্চিম পাকিস্তানে কিভাবে জনগনের মনোনীত সরকার কে ক্ষমতায় আনা যায় তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল, যেহেতু এর আগে আসা সব সরকার ই ছিল বে আইনী
অনেক সংখ্যক মুসলিম পার্টির কেন্দ্রিয় নেতা নিজেদের আওয়ামীলীগ থেকে পুরাপুরি বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছিল।
৫৪- সরকার কি আবার নতুন ভাবে নির্বাচন চায়? চাইলে কবে?
না, নতুন নির্বাচন এর কোনো প্রয়োজন আর নেই।
৫৫- আওয়ামীলীগ কে নিষিদ্ধ করা হলে, পূর্ব পাকিস্তানে কি একটা বিশাল শূন্যতা তৈরিহবেনা? সেই শূন্যতা কিভাবে পূরন করা যায়?নতুন নেত্রিত্ত কি কোনো পরিবর্তন আনবে?
সব শূন্যস্থান ই পূরন হয়, এটিও সেভাবেই হয়ে যাবে।
৫৬- সরকার একইসাথে বড় দুইটি দুর্যোগ কিভাবে মোকাবেলা করবে? একটি হল রাজনৈতিক অস্থিরতা আরেকটি হল অর্থনৈতিক মন্দা?
এটি একটি ভরসার কথা যে দুই দিকের মানুষ ই খুব সাধারন। ধর্মভীরু পাকিস্তানীরা যেভাবে ১৯৪৭ সালে ভারত কে হটিয়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়েছিল, পূনরায় তাই হবে।
নির্বাচনে জয়লাভ করার জন্য আওয়ামীলীগ এর এটা নিশ্চিত করা দরকার ছিল যে স্বৈরতন্ত্র সরানোর জন্য ৬ দফা কতটা উপযোগী পদক্ষেপ । একটি শক্তিশালী পাকিস্তান গড়ে তুলতে যে একতার দরকারছিল তা ছিল অনুপস্থিত, বরং নানা রকম মতাদর্শ ছিল। সেখানে নানা ভাবে নানা বিষয়ে সমঝোতার চেষ্টা করা হচ্ছিল। সেই সমঝোতায় আসতে প্রেসিডেন্ট কিছুদিনের জন্য সংসদ অধিবেশন পিছিয়ে দেন। আওয়ামীলীগ নেতা রা তার বিরোধিতা করে। পূর্ব পাকিস্তানের জনগন এর কোনো বিরোধিতা করেনাই, বরং তারা ভারতের দাসত্ব থেকে সবে মাত্র বের হয়ে আসার শান্তিতে ছিল।
পশ্চিম পাকিস্তানের লোকজন পূর্ব পাকিস্তানের এই রাজনৈতিক অস্থরতা নিয়ে খুব শঙ্কিত ছিল।
এই দুইটি বিষয় তাদের মানসিকতায় বিশাল পরিবর্তন আনে যা হয়ত ভবিষ্যতে নতুন কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় সাহায্য করবে। রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার রদবদেল্র সিদ্ধান্তেও তার প্রভাব পরবে।
পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়েও বেশি চিন্তিত হবার কিছু নেই কারন প্রতিটি উন্নয়নশীল দেশ ই এই ধরনের ঝামেলায় পরে ও তার মোকাবেলা করে। আমরা নিশিচত যে খুব দ্রুতই আমরা এর থেকে বের হয়ে এসে শক্তিশালী অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তুলতে পারব।আইন শৃঙ্খলা ব্যাবস্থাও তার আগের অবস্থায় ফিরে যাচ্ছে।
৫৭- পাকিস্তান কিভাবে তার এই অর্থনৈতিক দূরদশা থেকে বের হয়ে আসবে? তারা কি কোনো আন্তর্জাতিক সাহায্য নিবে নাকি নিজেদের লোক বলই তাদের জন্য যথেষ্ট?
-নিজেদের লোকবল এর মাধমেই তারা এই সমস্যা থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করবে, কিন্তু আন্ত্রজাতিক কোনো মাধ্যমের সাহায্য আসলেও তা সাদরে গ্রহন করা হবে।
৫৮- ইন্ডিয়ার প্রধানমন্ত্রী জানান পূর্ব পাকিস্তান যদি তাদের বিশাল সংখ্যক রেফুজি কে ঈন্ডিয়া পাঠানো বন্ধ না করে বা সরিয়ে না নেন, তবে তিনি নিজেই তা প্রতিহত করবেন। কারন এতে ইন্ডিয়ায় অরথনইতিক দুর্দশা দেখা দিচ্ছে। এখন পাকিস্তান কি মানবতার খাতিরে ও ইন্ডিয়ার সাথে তাদের বিরোধ থামাতে এই রেফুজি দের ফেরত আনবে?
ইন্ডিয়া আগেও দেখেছে আমরা তদের কোনো হুমকি তে দমে যাইনি, সব সময় তা প্রতিহত করেছি। সুতরাং আমরা তাদের হুমকিতে দমে গিয়ে আময়াদের দুর্দশা গ্রস্ত গৃহহীন রেফুজিদের ফেরত আনছিনা।
.
.
দ্ব্যর্থহীন শর্তাবলী: “পাকিস্তানের আইন মান্যকারী নাগরিকদের স্ব স্ব বাড়িতে ফিরে আসার প্রতিসংহার অনুমতির কোন প্রশ্ন নেই। ” এ লক্ষ্যে সকল প্রধান জায়গায় অভ্যর্থনা কেন্দ্রসমূহ স্থাপন করা হয়। পাকিস্তান তার নাগরিকদের পুনরায় স্বাগত জানাতে পারতো কিন্তু যেকোন পঞ্চম কলাম অথবা পশ্চিমবঙ্গের নিজস্ব কিন্তু বিরাট জনতা ঘরহীন, চাকরীবিহীন, আশ্রয়হীন মানুষের উপর থেকে নিশ্চিতভাবেই কোন ভারত ছাড়পত্রের অনুমতি দেওয়ার কোন চূড়ান্ততা নেই।
প্রশ্ন ৫৯: এটা কথিত যে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পরিকল্পনা করে পূর্ব পাকিস্তানে ভিন্নমতাবলম্বী উপাদানসমূহকে পরাস্ত করতে ঠাণ্ডা রক্তপূর্ণ নীতিতে অনাহার কে যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। পাকিস্তানের এই ধরণের কার্যভারে বৈদেশিক উপশম সহায়তা ঝণ গ্রহণে অস্বীকার অথবা অনিচ্ছা নেই? উত্তর: অভিযোগটি সম্পূর্ণরূপে মিথ্যা। ভিন্নমতাবলম্বী উপাদানসমূহ ইতিমধ্যেই পরাজিত হয়েছে এবং কাছাকাছি কোথাও কোন অনাহার নেই। বিপরীতে খাদ্যশস্যের বিরাট ভাণ্ডার সহজলভ্য এবং যাতায়াতের পথ ভাঙন যা ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী এবং তাদের সহযোগীদের কারণে হয়েছিল, প্রদেশের সব অংশে খাদ্যশস্য বহনে পদক্ষেপসমূহ চালু হয়েছে। যেখানে বৈদেশিক উপশম সহায়তা গ্রহণে অস্বীকার বা অনিচ্ছা নেই। পাকিস্তান জাতিসংঘ মহাসচিবকে সঠিকভাবে বলেছে যা সে চায়, অর্থ্যাৎ, তিন অথবা চার মাস পরে আরো খাদ্যশস্য এবং আরো উপকূলবাহী পোত এবং তুষারস্তুপ তাদেরকে বিতরণ করতে। বিবরণ ইতিমধ্যেই কাজ করেছে এবং রিলিফ তার পথে।
প্রশ্ন ৬০: আমেরিকা সরকারের উপর শক্তিশালী চাপ রয়েছে শক্তিশালী উপাদানসমূহ হতে পাকিস্তানের প্রতি সব ধরণের সামরিক আরো যেমন আর্থিক সাহায্য থামাতে। যদি এটা ঘটে, পাকিস্তান সরকারকে বাঁধা দেওয়ার জন্য কি এটা সম্ভব হবে? উত্তর: নির্ধারিত মানুষের ইচ্ছা যে কোন কিছুকে বাঁধা দিতে পারে।
প্রশ্ন ৬১: বৈদেশিক উপশম সহায়তার প্রতি বৈদেশিক তত্ত্বাবধান পাকিস্তানের লক্ষ্যবস্তু। এক্ষেত্রে দুইটা প্রশ্ন: কেন একজন সুইস অথবা একজন সুইড অথবা একজন আমেরিকান তার কঠিনভাবে অর্জন করা টাকা কাজে লাগাবে যদি না সে নিশ্চিত হয় যে এটা সঠিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে সেই উদ্দেশ্যের জন্য যার জন্য সে এটা দিয়েছিল। এবং ২য় কেন পাকিস্তান এসব আইনগত পরিভাষায় কৌশলে পরিহার করছে না যখন ৭০ মিলিয়ন মানুষ জীবন সঙ্কট এবং মৃত্যুর সম্মুখ?
উত্তর: রিলিফ সরবরাহের সঠিক বন্টন নিশ্চিত করতে কিছু দাতাদের নীচতা যা অর্ন্তদৃষ্টিসম্পন্ন। পাকিস্তানের সত্যিই কোন আপত্তি নেই জাতিসংঘের কিছু ব্যক্তির উপর যারা নিজেরাই সন্তোষজনক যে সাহায্য সঠিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু দেশটি প্রচুর বিদেশি পর্যবেক্ষককে তার পথের মধ্যে পেয়ে অথবা অভ্যন্তরীণ বিষয়ে জড়িত পেয়ে তার সমগ্র কাঁধের উপর নিতে পারে না।
প্রশ্ন ৬২: শেখ মুজিবুর রহমান এর জেরা করা কি চালু থাকছে এবং যদি হয় সুতরাং সামরিক শাসন অথবা সাধারণ অপরাধী আইনের অধীনে?
উত্তর: দেশ এখনো সামরিক শাসনের অধীন।
প্রশ্ন ৬৩: মুজিবের সহযোগীদের ঠিকঠিকানা এবং পরিণতি কি? উত্তর: তাদের বেশিরভাগই কলকাতাতে ভাল সময় কাটাচ্ছে।
অনুরূপ অপরাধের অপরাধী, পৃথিবীর অন্যত্র মানুষের তুলনায় খারাপ না এবং তাদের উত্তম ব্যবস্থা করা হবে।
প্রশ্ন ৬৪: মুজিবের পূর্ব পাকিস্তানি সহযোগীদের আদালতের বিচারের সম্ভাবনা কি?
উত্তরঃ কোন জাদুকরী অনুসন্ধান হতে যাচ্ছে না, এখানে অথবা ওখানে দেশের আইনের অধীনে জনসাধারণ তাদের কার্যকলাপের ফলাফলের মুখোমুখি হবে।
প্রডিউসড বাই
চলচ্চিত্র এবং প্রকাশন বিভাগ
পাকিস্তান সরকার
জুন, ১৯৭১।
.
.
শিরোনামঃ ১৩৮। প্রত্যাবর্তনকারী নাগরিকদের প্রতি পাকিস্তানের স্বাগতম
সূত্রঃ সরকারী প্রচার পুস্তিকা
তারিখঃ জুলাই, ১৯৭১
.
প্রত্যাবর্তনকারী নাগরিকদের প্রতি পাকিস্তানের স্বাগতম
বরাবরের মতো উপমহাদেশের বিভাগ, যেখানে নব্য স্বাধীন রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ গতিবিধি আছে। এই ক্ষেত্রে, তরুণ রাষ্ট্রের খুব শৈশবে একটি আদেশ ভেদে ১৯৪৭ সালে ভারত কতৃক প্রায় ১০ মিলিয়ন মুসলিম শরণার্থীকে পাকিস্তানে প্রেরণ করা হয়েছিল। এরমধ্যে বিপরীত চলাচলে, কোনভাবেই তা লক্ষ নয় মুসলিম ভারতে গিয়েছিল এবং এই অন্তঃপ্রবাহ ও বহিঃপ্রবাহ অব্যাহত ছিল বরাবরের মতো : পূর্ব পাকিস্তান গ্রহণ করেছিল এক মিলিয়নেরও বেশি এবং অর্ধেক ব্যক্তিই পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরার। প্রতিবার একটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ভারতে সহসা আবির্ভূত হয়(ভারতীয় পত্রিকাসমূহ অনুযায়ী, ১৯৫১ সাল পর্যন্ত ভারতে ৩,৪৭৭ টি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয় যেখানে ৭,৪৭৬ ব্যাক্তি নিহত এবং ৩২.৪৪ জন আহত হয়) হাজার হাজার মুসলিম পাকিস্তানে অভিগমনে বাধ্য হয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে, অসতর্ক বেসরকারি গমনপথ এড়ানো দ্বারা পাকিস্তান সরকারের ভারতের উদ্বাস্তুদের প্রবেশে সাধারণ নিষেধাজ্ঞা। ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাসমূহ যেমন বারংবারের ঘটনা – যেখানে ৫১৯ ছিল এই সময়ে, কেবল ১৯৭০-৭১ সালে, ভারতীয় আইনসভার নিজস্ব বিবৃতি অনুযায়ী ভারত হতে উদ্বাস্তু অন্তঃপ্রবাহ অধিক অথবা অব্যাহত প্রক্রিয়া থেকে কম। সেই বৃহত্তর সেই বিশাল হত্যাকাণ্ডের যে সবচেয়ে সাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত ছিল যেটা আহমেদাবাদে, মহারাষ্ট্রে হয়েছিল ভারতের উদ্বাস্তুদের বৃহত্তর বন্যা। *যাত্রা উৎসাহিতকরণে ভারতের নীতি* পাকিস্তানের উদ্বাস্তুদের অন্তঃপ্রবাহ নিরুৎসাহিতকরণ নীতির প্রতি তীব্র বৈষম্য প্রদর্শন করে, ভারত সরকার পূর্ব পাকিস্তান হতে হিন্দুদের আমন্ত্রণ জানানোর একটি ইচ্ছাকৃত নীতি অনুসরণ করেছিল। একক সমষ্টিগত অর্থ, জমি এবং শিল্পসংক্রান্ত একক প্রদানের প্রতিশ্রুতি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল এ প্রলোভনে। অর্থনেতিক বিশেষজ্ঞদের বিশ্বাস যে সংখ্যালঘু সমষ্টির সদস্যদের দ্বারা স্বর্ণ ও অন্যান্য অস্থাবর সম্পত্তি চোরাচালান পূর্ব পাকিস্থান হতে ভারতে সম্পদ হস্তান্তরে বৃহৎ মাপনী প্রসূত হয় এবং পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনেতিক উন্নতিতে বাঁধা প্রদানকারী অনেকগুলো বৃহৎ কারণের একটাতে পরিণত হয়। মূলত সর্বশেষ নির্বাচনী প্রচারণার সময়ে, পূর্ব পাকিস্তানের অনেক রাজনৈতিক দলসমূহ দুঃখ প্রকাশ করে সত্য যখন শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার আওয়ামী লীগ কঠোর সমালোচনা করে পূর্ব পাকিস্তান হতে পশ্চিম পাকিস্তানে সম্পদ হস্তান্তরে, পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে সীমান্তে সম্মুখীন জাতীয় সম্পদের অনেক বৃহত্তর প্রবাহে তারা সন্দেহজনকভাবে নীরব থাকে। এই বছরের প্রথমাংশে এই প্রক্রিয়া শিখর ছুঁয়ে যায় যখন আওয়ামী লীগ বিদ্রোহী এবং তাদের সহযোগীরা পশ্চিমবঙ্গে বাহিত হয় কেবল বৃহদায়তন খাদ্যশস্য এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সরবরাহের ভাণ্ডার নয় বরং একটি খুব বড় সংখ্যক ট্রাক, বাস, জীপ
.
এবং অন্যান্য যানবাহনসমূহও। তারা এমনকি পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার বিভাজন থেকে অব্যবহৃত রেললাইন পুনরুদ্ধার করেছিল ইন্জিন এবং ঘূর্ণায়মান স্টক অপসারণ করতে। এই প্রসঙ্গ যেখানে চলমান উদ্বাস্তু সমস্যা, পৃথিবীব্যাপী ভারতের দ্বারা শোষিত, দেখার প্রয়োজন রয়েছে।
অবাধ পরিসংখ্যান
এই সত্য অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে বৃহৎ সংখ্যক পাকিস্তানি নাগরিক দেশ ত্যাগ করেছে ১৯৭১ সালের মার্চ এবং এপ্রিলে। সীমান্তের অন্যপাশে কোন যন্ত্রপাতির অস্তিত্ব না থাকায় হিসাব রাখা আর সঠিক সংখ্যা প্রদান করা সম্ভব নয়। সম্প্রতি যখন কানাডার আইনসভার একজন সদস্য উল্লেখ করেছিলেন সংখ্যাটা ৫ অথবা ৬ মিলিয়ন, বিখ্যাত ব্রিটিশ অধ্যাপক রুশব্রুক উইলিয়ামসের স্ত্রী তাকে রূঢ়ভাবে জিজ্ঞাসা করেন, “তুমি কিভাবে জানো, তুমি গণনা করেছিলে?” এই স্থানচ্যুত কিছু মানুষের গল্প সম্পর্কে সম্পর্কিত জিজ্ঞাসায় তার সমানভাবে প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন ছিল। “তুমি কি তাদের ভাষা বুঝতে পেরেছিলে?”, সে জিজ্ঞাসা করেছিল। “যদি না হয়, কে দোভাষী সরবরাহ করেছিল? ভারতীয়রা? তারা নয় কি?”, সে জিজ্ঞাসা করেছিল; এবং আইনসভার সদস্যকে স্বীকার করতে হয়েছিল যে, তাদের ভারতীয় কর্তৃপক্ষ সরবরাহকৃত দোভাষীর উপর নির্ভর করতে হয়েছিল। যথাযথ সংখ্যা যাইহোক, সীমান্তের সম্মুখীন সংঘটিত এই আন্দোলনের কারণসমূহ যথেষ্ট কষ্ট স্বীকারের যোগ্য নিরূপক। *পাকিস্তান বিচ্ছিন্নে ভারতের বিদার প্রস্তাব* বহিরাগত চাপ এবং অভ্যন্তরীণ ধ্বংস দ্বারা পাকিস্তান বিচ্ছিন্নে আঁকা ভারতের নকশাসমূহ কারণসমূহ হতে পারে। তার উদ্দেশ্য পরিস্কারভাবে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন ভারতের প্রতিরক্ষা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক মি. সুব্রমানয়ম আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী ইনস্টিটিউট এর ঠিকানায় ১৯৭১ সালের ৭এপ্রিল যেখানে তিনি বলেন, “ভারত কে এই সত্য অবশ্যই উপলব্ধি করতে হবে যে, পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতাই আমাদের আগ্রহ, একটি সুযোগ যা একইভাবে কখনোই পুনরায় আসবে না। ” এই উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য যে পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়েছিল তা শুরু হয়েছিল যেইমাত্র সমগ্র ভারতীয় কংগ্রেস এর পশ্চিমবঙ্গ শাখার সাধারণ সম্পাদক মি. কে কে শুক্লা যিনি ১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল ঐ কমিটি সম্ভাষণে স্পষ্টভাবে ঘোষণা করলেন যে, “শেখ মুজিবুর রহমান ভারতের যুদ্ধে লড়ছেন।” পূর্ব পাকিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সাথে ভারতের সরাসরি সম্পৃক্ততা বাদে এবং পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের বাঙালি জাতি, ভাষা এবং সংস্কৃতির নামে তার নিরবিচ্ছিন্ন বর্ণবাদী প্রজ্ঞাপন প্ররোচক ছিল এবং ভারতীয় আশ্রয়স্থলে সীমান্ত সম্মুখীন নিরাপদ পরিবহন এবং উষ্ণ সাদর অভ্যর্থনা প্রদানে প্রলুব্ধ করে, যেখানে ছিল নির্দিষ্ট অন্যান্য কারণসমূহ যা কাজে দিয়েছিল। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ শুরু, যেখানে ছিল ব্যাপক লুটপাট, জাতিগত সংখ্যালঘু এবং ভারত সাহায্যপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগ এবং তার সহযোগী রাজনৈতিক “অনুগামী ব্যাক্তিদের” জ্বালিয়ে দেওয়া এবং হত্যা। একটি সাধারণ আইন এবং আদেশ অনুসরণ ধ্বংস হয় ফলে বৃহদায়তন আইন অমান্য আন্দোলন চালু হয় আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের দ্বারা।
.
আওয়ামী লীগ এর জেল ভাঙা এবং হত্যাকাণ্ড
সমগ্র প্রশাসন পক্ষঘাতগ্রস্থ হতে থাকে, পূর্ব পাকিস্তানে বহু সংখ্যক জেল ভাঙা হয় ফলে নিশ্চিত অপরাধী যাদের অন্তর্ভুক্ত ছিল খুনী, গলাকাটা এবং না যেয়ে উপায় ছিল না যারা স্বেচ্ছায় দেশব্যাপী ঘুরে বেড়িয়েছিল তাদের মুক্তি, হনন, হরণ এবং ধর্ষণ। হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন হয়েছিল ভারত ওরিয়েন্টেড ঝড়সৈনিক দ্বারা সর্বত্র বিভাগে মার্চ – এপ্রিল এই সময়ে, ব্যাপক হত্যা এড়াতে বহুসংখ্যক মানুষকে সীমান্তে হঠাৎ সম্মুখীন হতে বাধ্য করা হয়েছিল। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পরবর্তী সময়ে, সেনাবাহিনী এবং সশস্ত্র বিদ্রোহী এবং দলত্যাগীদের মধ্যে সংঘর্ষ ছিল। এটা নির্দিষ্ট এলাকাসমূহে সাধারণ জনগণকে নিরাপত্তাহীন করে তোলে। সশস্ত্র বিদ্রোহীরা নিজেদের সংখ্যা করে ২০০, ০০০, যুদ্ধে ধ্বংস হয় এবং প্রতিফল এড়াতে পালিয়ে ভারত সীমান্ত সম্মুখীন হয়। সশস্ত্র বিদ্রোহী ব্যতীত, অন্যান্য আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ এবং কর্মীরা, যারা বিচ্ছিন্নতাবাদী নকশার প্রতি প্রতিজ্ঞাবদ্ধতায় অনেক দূরে ছিল, এবং তাদের পলায়নে ভাল প্রস্তুতি নিয়েছিল। সারাক্ষণ, কলকাতা রেডিও থেকে ব্যাধিযুক্ত সুদীর্ঘ বক্তৃতা এবং অধ্যাবসায়ী ভারতীয় প্রজ্ঞাপন ছিল। এই প্রজ্ঞাপন সিদ্ধিলাভ করেছিল আতঙ্ক ব্যাপ্তিতে বিশেষত হিন্দু সংখ্যালঘুদের মধ্যে, এবং যথেষ্ঠ প্রস্থানে যোগ করেছিল যা উৎসাহিত হয়েছিল সীমান্ত উন্মুক্ত রাখা হচ্ছে এমন পুনরাবৃত্ত ভারতীয় ঘোষণা দ্বারা। ভারতীয়দের লক্ষ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতিকে আংশিকভাবে চূর্ণ-বিচূর্ণ করতে জনগণের একটি ব্যাপক আন্দোলন উৎসাহিতকরণ, এবং আংশিকভাবে পাকিস্তান সরকারের সম্মানহানি দেখানো যে প্রদেশে নিয়ন্ত্রক পরিবেশের অধীনে বসবাসে বৃহৎ সংখ্যার জনগণ অনিচ্ছুক ছিল। ঠিক সেই সময়ে ভারত বিচ্ছিন্নতাবাদী শাসন নির্বাসন গঠনে সঙ্ঘটিত, এর মধ্যে উদিত হয় তার আগ্রহে মানবীয় উৎপাটনের ব্যপ্তি বিবর্ধিত করে আন্তর্জাতিক মনোযোগ এবং সহানুভূতি উভয়কেই আকর্ষণ করে।
পাকিস্তানের মনোভাব
পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ প্রাথমিকভাবে আচ্ছন্ন ছিল আইন ও আদেশ পুনরুদ্ধারে, প্রশাসনিক কলকব্জা পুনর্বাসনে যা পক্ষঘাতগ্রস্থ হয়েছিল সশস্ত্র বিরুদ্ধাচরণে। শুধুমাত্র প্রদেশসমূহে সর্বত্র তাদের কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠাকরণের পরে যেখানে তারা ব্যবস্থাসমূহ আরম্ভ করতে সক্ষম ছিল নাগরিকদের আকর্ষণ করতে যারা পরিত্যাগ করেছিল তাদের বাড়ি ফিরে আসতে। এইসব ব্যবস্থাসমূহের মধ্যে ছিল নাগরিকদের প্রতি ফিরে আসার আবেদন, তাদের মধ্যে একটি আত্মবিশ্বাসের অনুভূতি পুনরাধিষ্ঠিত করতে একটি রাজক্ষমা। ১৯৭১ সালের ২১মে, পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি একটি আকুল আবেদন তাড়ন করেন প্রকৃত পাকিস্তানি নাগরিকদের কাছে, যারা পূর্ব পাকিস্তানের উপদ্রুত পরিবেশে পরিত্যাগ করেছিল, তাদের বাড়ি ফিরে আসতে। রেডিও পাকিস্তানের সব স্টেশনে সম্প্রচারিত একটি বিবৃতিতে, এবং যা কিছু সংখ্যক বিদেশি সংবাদ মিডিয়া দ্বারা বাহিত হয়, রাষ্ট্রপতি বলেন যে পূর্ব পাকিস্তানে আইন ও আদেশ পুনরুদ্ধার করা হয়েছে, এবং জীবনযাত্রার ধরণ দ্রুত স্বাভাবিক হয়েছে। তিনি জনগণকে রাষ্ট্রবিরোধী উপাদানসমূহ দ্বারা অধ্যাসিত মিথ্যা প্রজ্ঞাপন দ্বারা ভ্রান্ত পথে চালিত না হতে তাড়িত করেন, এবং তাদের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে ফিরে আসতে বলেন। তিনি একটি নিঃশর্ত প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন যে, “পাকিস্তানের আইন মেনে চলা জনগণ তাদের স্ব স্ব বাড়িতে ফিরে আসার জন্য কোন প্রতিসংহার অনুমতির প্রশ্ন নেই।”
.
এটা দুর্ভাগ্য ছিল যে ভারত সরকার একটি অত্যন্ত ক্ষতিকারক এবং বিকৃত ঘটনাবলী বর্ণনার প্রচারক হয়ে গিয়েছিল এসব সীমান্ত লঙ্ঘনে। বহুসংখ্যক মানুষ যারা পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে অতিক্রান্ত হয়েছিল তারা একত্রে স্ফীত হয়েছিল বেকার এবং পশ্চিমবঙ্গের ভূমিহীন সংখ্যা দ্বারা যেখানে, কেবল কলকাতাতেই, যারা ফুটপাতের উপরে বসবাস করতো এবং ঘুমাতো তাদের সংখ্যা দুই মিলিয়ন অতিক্রম করেছিল। এটা ছিল সুস্পষ্ট যে ভারত ইচ্ছাকৃতভাবে উদ্বাস্তু প্রশ্নে কেলি করেছিল শুধুমাত্র পাকিস্তানকে শাসানোর জন্য নয়, বরং পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে তার নিজস্ব অব্যাহত হস্তক্ষেপকে সমর্থন করার জন্য। “এটা সর্বোচ্চ অনুশোচনার “, পাকিস্তান রাষ্ট্রপতির হিসেবে, “এটা মানবিক ভিত্তিতে উদ্বাস্তুদের উপরে অকৃত্রিম আচরণের পরিবর্তে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এই ইস্যু কাজে লাগানো ভারতের দ্বারা চালু একটি অনুভূতিহীন প্রচারণা। ” রাষ্ট্রপতি এটা পুনর্ব্যক্ত করেন ৩দিন পরে করাচিতে তার সংবাদ সম্মেলনে, ১৯৭১ সালের ২৪ মে এবং বাস্তুচ্যুত মানুষকে আশ্বস্ত করেন যে তাদের প্রত্যাবর্তন এবং পুনর্বাসনে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করা হবে। ১৯৭১ সালের ২৯মে, একজন সরকারী মুখপাত্র পাকিস্তান রাষ্ট্রপতির নিবেদন পুনর্ব্যক্ত করেন এবং বলেন যে সকল খাঁটি পাকিস্তানি, যারা পাকিস্তান পরিত্যাগে বাধ্য হয়েছিল হুমকী বা জবরদস্তিতে, অথবা বলপূর্বক তাদের বাড়ি থেকে চালিত হয়েছিল বিদ্রোহী এবং দুর্বৃত্তদের দ্বারা তারা পাকিস্তান পুনঃপ্রবেশে পুরোপুরিভাবে মুক্ত ছিল, তাদের পাকিস্তানি জাতীয়তা নিশ্চিত করতে সাধারণ রুটিন-চেক অবশ্যই বাধ্য ছিল।
পূর্ব পাকিস্তানে অভ্যর্থনা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা
এইসব ঘোষণা একযোগে, ফিরে আসা পাকিস্তানি নাগরিকদের জন্য বহুসংখ্যক অভ্যর্থনা কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছিল ভারত থেকে পাকিস্তান প্রবেশের গুরুত্বপূর্ণ রুটসমূহে, জনগণের মুক্তি এবং তাদের বাড়িতে ফিরে আসার অভ্যর্থনার জন্য পূর্ণ ব্যবস্থা ছিল। প্রাথমিকভাবে, এসব কেন্দ্রসমূহ স্থাপিত হয়েছিল খুলনার সাতক্ষীরা, যশোরের বেনাপোল, কুষ্টিয়ার চুয়াডাঙ্গা এবং মেহেরপুর, রাজশাহীতে গোদাগাড়ী, রোহানপুর এবং ধামৈরহাট, রংপুরে খানপুর, ঠাকুরপুর এবং কালীগঞ্জ, ময়মনসিংহে নলিতাবাড়ি এবং দূর্গাপুর, সিলেটে জৈয়িন্তিয়াপুর, কুলাউড়া এবং চুনারুঘাট, কুমিল্লাতে আখাউড়া এবং বিবিবাজার, নোয়াখালীতে ফেনী, এবং চট্টগ্রামের টেকনাফে। ফিরে আসা পাকিস্তানিদের ফরিয়াদ সুবিধার জন্য পরবর্তীতে অতিরিক্ত কেন্দ্রসমূহ স্থাপন করা হয়েছিল। পলাতকদের তাদের পরিবারে যোগদানে অনুমতি প্রদান ১৯৭১ সালের ৪জুন, ঢাকা থেকে তৈরীকৃত একটি সরকারি ঘোষণায়, পাকিস্তান আশ্বাস প্রদান করে যে সশস্ত্র বাহিনী এবং পুলিশ থেকে পলাতকরা তাদের পরিবারে যোগদান করতে পারবে যদি তারা স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করে। এই ঘোষণা অনুবর্তী কর্মৃবৃন্দের একটি সংখ্যা ব্যাখ্যা করেছিল, যা ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কিছু অর্ন্তভুক্ত করেছিল। পূর্ব পাকিস্তান পরিত্রাণ এবং চরমপন্থী এবং রাজদ্রোহী নেতৃবৃন্দ পুলিশকে ইউনিট থেকে পরিত্যক্ত করেছিল বিপথে চালিত হতে, আউটপোস্ট সীমান্তে এবং থানাসমূহে ১৯৭১ এর মার্চ – এপ্রিল সময়ে রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড অংশগ্রহণে। এই ধরণের ব্যাক্তিরা অধিকাংশ, যেমন তাদের চাকুরী নথিতে টানা, বিশ্বস্ত এবং স্বদেশপ্রেমী কিন্তু পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল কিছু উচ্চাভিলাষী, লোভী এবং স্ব সচেষ্ট উপাদান দ্বারা যা একটি ভুল পথ নিতে তাদের জোর করেছিল, এবং তারা বিভক্ত হয়েছিল তাদের
.
পরিবার থেকে। এসব পরিস্থিতিতে যেসব উপাদানসমূহ পথভ্রষ্ট করতে তৈরি করা হয়েছিল, স্বেচ্ছায় নিকটবর্তী সামরিক কর্তৃপক্ষ অথবা পুলিশ স্টেশনে তাদের অস্ত্রসহ বা অস্ত্রছাড়া আত্মসমর্পণে তাদের আশ্বস্ত করা হয়েছিল যে তাদের ঘটনাসমূহ সমবেদনার হিসেবে বিবেচিত হবে। বিবৃতিতে যোগ করা হয়েছিল, তাদের মনে রাখা উচিত যে এটা তাদের সাহায্য করবে তাদের বাড়িতে তাদের পরিবারের সাথে যোগ দিতে এবং রাষ্ট্রের মুক্ত নাগরিক হিসেবে বসবাস করতে।
পাকিস্তানি নাগরিকদের তাদের বাড়িতে ফিরে আসা আরম্ভ
এসব ইতিবাচক ঘোষণা এবং ক্রিয়াকলাপসমূহের উপকারী ফলাফল ছিল এবং বৃহৎ সংখ্যায় পাকিস্তানি নাগরিকরা তাদের বাড়ি ফিরে আসতে শুরু করেছিল। ১৯৭১ সালের ৬জুন, প্রায় ১,০০০ পূর্ব পাকিস্তানিরা পাকিস্তান এলাকায় অতিক্রান্ত হয়েছিল নিকটবর্তী কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুরে এবং তাদের দ্রুত পুনর্বাসনে অবিলম্বে প্রস্তুতি হাতে নেওয়া হয়েছিল। ১৯৭১ সালের ৮জুন, আরো ৭০ পরিবার পূর্ব পাকিস্তানে তাদের বাড়িতে ফিরে যায় দিনাজপুর জেলার ফুলবাড়ী এলাকায়। ১৯৭১ সালের ৯জুন, প্রায় ৪,০০০ মানুষ দিনাজপুরে পৌঁছেছিল, যাদের অনুসরণ করেছিল ১৫০ জন রাজশাহী উপরিভাগের নওয়াবগঞ্জে গোদাগাড়ী অভ্যর্থনা কেন্দ্রে, এবং ২০০ জন কুষ্টিয়া জেলার চুয়াডাঙ্গা এবং মেহেরপুর উপরিভাগে। ১৯৭১ সালের ১০জুন, দ্যা পাকিস্তান অবর্জাভার, ঢাকা, রিপোর্ট করেছিল যে, “সীমান্ত থেকে পূর্ব পাকিস্তানের পশ্চিমাংশের জেলাসমূহে বহুসংখ্যক মানুষ ফোঁটায় ফোঁটায় নির্গত হতে শুরু করেছিল। ১৫০ জন রাজশাহীতে রিপোর্ট করেছিল, ৫০০ জন দিনাজপুরে, এবং ১২০ জন সাতক্ষীরাতে। ” এইরকম আঘাতমূলক ঘটনাবলীর পরে ফিরে আসা মানুষের শারীরিক প্রয়োজনীয়তা সেইসাথে মানসিক চাহিদার অভিজ্ঞতা অর্জনে, অভ্যর্থনায় প্রস্তুতি ও সুযোগ সুবিধা ছিল। কেন্দ্রসমূহ পরিদর্শন এবং উপযুক্ত রদবদল এবং উন্নত করা হয়েছিল। এটা নির্ধারণ করা হয়েছিল যে প্রতি অভ্যর্থনা কেন্দ্রে সরবরাহ করা হবে গড়পড়তা দুই থেকে তিন হাজার মানুষের আচ্ছাদিত বাসস্থান, প্রতিদিনের অন্তঃপ্রবাহে ৫০০ থেকে ১০০০ মানুষের খাদ্যাদি পরিবেশন সাথে খাবার সরবরাহে পর্যাপ্ত আয়োজন, এসব ফিরতিদের বাসস্থান এবং ঔষধ সম্পর্কিত আচ্ছাদন। এছাড়াও তাদেরকে তাদের বাড়িতে নিয়ে যেতে পরিবহন সরবরাহ করা হবে। সীমান্তে গ্রহণ সময় ছিল প্রতিদিন সকাল ৮টা – বিকাল ৪টা, এবং সকল প্রকৃত পাকিস্তানিদের উপদেশ দেওয়া হয়েছিল পাকিস্তান পুনঃপ্রবেশে নির্দিষ্ট পথ নিতে, যাতে অপ্রয়োজনীয় কষ্ট এড়ানো যায়।
সাধারণ রাজক্ষমা ঘোষিত ১৯৭১ সালের ১০জুন, পূর্ব পাকিস্তানের শাসক, জেনারেল টিক্কা খান সাধারণ রাজক্ষমা ঘোষণা করেন সব মানুষের প্রতি যারা তাদের বাড়ি থেকে চলে গিয়েছিল মিথ্যা এবং বিদ্বেষপরায়ন প্রজ্ঞাপনের প্রভাবে এবং তাদের বাড়িতে ফিরে আসতে তাড়িত করেন। রাজক্ষমাটি অন্তর্ভুক্ত করেছিল সব শ্রেণীর মানুষকে, তা ছাত্র, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, সরকারি কর্মচারী, সশস্ত্র বাহিনী এবং অন্যান্য আইন প্রণয়নকারী সংস্থাসমূহ (ইবিআর, ইপিআর, পুলিশ, মুজাহিদ এবং আনসার ইত্যাদি) আরো যত রাজনৈতিক কর্মীবৃন্দ এবং নেতৃবৃন্দ যারা তাদের পরিবারে যোগদানে এবং তাদের জীবনের সাধারণ বৃত্তি পুনরাম্ভ করাতে সবাই স্বাগত ছিল। “এটা সঠিকভাবে উপলব্ধ “, সাধারণ রাজক্ষমা ঘোষণায় বলা হয়েছিল, ” যে তারা, অপরিহার্যতা ব্যতীত, অপুষ্টি এবং অসুখের ঝুঁকি সহ্য করছে। তাদের ফিরে আসা উচিত এবং জাতীয় পুনর্গঠনে দেশবাসীর সাথে সমান অংশীদ্বারের ন্যায় অংশগ্রহণে এগিয়ে আসা উচিত।
.
.
. ১০ জুন ১৯৭১ সালে, দিনাজপুরের বিভাগীয় খাদ্য নিয়ন্ত্রক, চৌধুরী মতিউর রহমান গ্রেফতার হয়েছেন বলে খবর পাওয়া যায় । উনাকে পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে আসার ব্যাপারে বাঁধা দেয়া হয় ।জনাব রহমান সাম্প্রতিক গোলযোগের কারনে বর্ডার পার হয়ে দেশে ফিরে আসতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ইন্ডিয়ান অথরিটি উনাকে তা করার অনুমতি দেন নি।
১৪ জুন, ১৯৭১ এ ফেরত আসা কিছু মানুষ জানায় যে ভারতীয়রা পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসিয়াল দের উপর অনেক নির্যাতন চালাচ্ছে যাদের মধ্যে যিনি Swedish Institute of Kaptai এর মহাপরিচালক ডা ফারুক ও ছিলেন যিনি আসলে ভারতীয় অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে ভারতে প্রবেশ করেন এবং ভারতীয় পুলিশ কর্তৃক গ্রেপ্তার হয়।
১৫ জুন, ১৯৭১ এ সংবাদসংস্থা APP এর ঢাকা প্রতিনিধি জানায়- আমি মেহেরপুর অভ্যর্থনা কেন্দ্র থেকে দুই ঘন্টা ধরে নারী পুরুষের বিশাল ঢল কে ধান ক্ষেতের আঁকাবাঁকা পথের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যেতে দেখেছি । ফেরত আসা মানুষ গুলোর চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, পাকিস্তানীদের সাথে বিশেষ করে মুসলিম দের সাথে ইন্ডিয়ান ক্যাম্প গুলোতে কেমন ব্যাবহার করা হয়েছিল অথচ এই ইন্ডিয়ান সরকার ই বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে থেকে মানবতার নামে ২০ কোটি টাকা জড়ো করেছিল ।
“অসদাচরণ, নির্যাতন. শ্লীলতাহানি ”
ফেরত আসা মানুষ দের সাক্ষাৎকার নেয়ার সময় আমি সেচ্ছাসেবী ও হিন্দুদের দ্বারা তাদের উপর করা অবর্ণনীয় অত্যাচারের কথা শুনছিলাম বিশেষ করে সীমান্ত এলাকার পার্শ্ববর্তী তথাকথিত ‘রেফুজি ক্যাম্প’ গুলোতে। মেহেরপুর শহরের মধ্য বয়স্ক বাসিন্দা মীর আইজুদ্দিন বলেন, তিনি তার পরিবারের ১০ জন সদস্য নিয়ে ইন্ডিয়া যান। তিনি আসলে প্রতারনার স্বীকার হয়ে সেখানে যান। অশ্রুসিক্ত নয়নে তিনি জানান, পাকিস্তানী মুসলিম দের জন্য সে ক্যাম্প গুলো ছিল নরক সমতুল্য ।
একই এলাকার বাসিন্দা জিল্লুর রাহমান এর কাছ থেকে জানা যায়- তিনি তেহট্ট থানায় বেটাই ক্যাম্পে দুই মাসের জন্য ছিলেন। তিনি দুঃখের সাথে জানান যে জিনিস্পত্র বা টাকা পয়সা তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন তাই তথাকথিত ‘স্বেচ্ছাসেবী ‘ দের দ্বারা লুট হয়ে যায়। তিনি ও তার পরিবারের সদস্য রা বহুদিন না খেয়ে ছিলেন। না তাদের কোনো কাপড় চোপড় দেয়া হয়েছিল না উপযুক্ত মেডিকেল সেবা।
যশোর বিভাগের মনিরাম্পুর থানার অন্তর্ভুক্ত স্রানপুর গ্রামের ২৬ বছর বয়সি শিক্ষক জনাব আব্দুর রহিম ১৯৭১ সালের ১৬ জুন একটি সাক্ষাৎকার দেন। তিনি জানান, দুই মাস Mama Bhanc ক্যাম্পে থেকে তিনি বুঝতে পারেন কিভাবে ইন্ডিয়া সারা বিশ্ব কে এই বুঝিয়ে ধোঁকা দিচ্ছিল ইন্ডিয়ায় অবস্থান কারী পাকিস্তানীদের পিছনে তাদের কি প্রচুর পরিমান অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, ক্যাম্পে বসবাসকারী ৫০ শতাংশ লোক ই ছিল কলকাতার বস্তিবাসী এবং সীমান্ত এলাকার কাছে থাকা বেকার লোকজন।
বরিশাল জেলার উজিরপুর থানা নিবাসী রাম বৈরাগী নামের একজন হিন্দু ব্যাক্তি ও তথ্য গুলোর সত্যতা নিশ্চিত করেন। তিনি জানান, প্রানভয়ে যশোর ছেড়ে তিনি ইন্ডিয়ার বনগাঁও ক্যাম্পে আশ্রয় নেন। যেখানে শত শত লোক মানবেতর অবস্থায় দিন কাটাত, স্যানিটারি সিস্টেমের দুরব্যাবস্থার কারনে কলেরার প্রকোপ দেখা দিলে বহু মানুষের প্রানহানী ঘটে।অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটিয়ে উনি অবশেষে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন। ফিরে আসার সময় তিনি নিজের সাথে নিয়ে যাওয়া কোনো জিনিস ই সাথে করে নিয়ে আসতে পারেন নি কারন তথাকথিত স্বেচ্ছাসেবী রা তা কেড়ে নেন। তিনি শুধু তার পরনের ময়লা ধুতি পরে ফিরে আসতে বাধ্য হন।
এদিকে , ভারতীয় সূত্রের বরাত দিয়ে বিদেশি সংবাদ প্রতিনিধি জানায় যে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে উদ্বাস্তু আসা বন্ধ হয়ে গেছে। ১৯৭১ সালের ১৪ জুন লন্ডোন টাইমসের সংবাদ প্রতিনিধি বলেন- একজন ইন্ডিয়ান সিনিয়র কর্মকর্তা যিনি প্রায় ই পূর্ব বাংলার দক্ষিনাঞ্চল ভ্রমন করেন তিনি আমাকে আজকে (১৩ জুন ১৯৭১) জানা, হঠাত করেই দেশান্তর হউয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে, তিনি আরো বলেন, সীমান্তবর্তী শহরের উত্তরাঞ্চলের কর্মকর্তারা ও জানান নাটকীয় ভাবেই দেশ ত্যাগের ঘটনাটি বন্ধ হয়ে গিয়েছে ।
সীমান্তবর্তী এলাকায় পাকিস্তানী জনসংখ্যার চাপ বৃদ্ধি পাওয়ার কারনে তাদের পাকিস্তানে ফিরে যাওয়ার আহবান করা হয় এবং যারা পশ্চিম পাকিস্তানের এই ঘটনার কারনে দূরাবস্থার স্বীকার হয়েছে তাদের জন্য ৩.৯ মিলিয়ন ডলার নগদ অনুদান ও বাসস্থান এর জন্য ১.১ মিলিয়ন ডলার অনুদান মঞ্জুর করেন। এর পাশাপাশি ৮০হাজার ঢিবি গম বিনামূল্লে বিতরন করা হয় ।
রাষ্ট্রপতির আশ্বাস , বিশেষ করে সংখ্যা লঘুদের প্রতি-
১৮ জুন ১৯৭১ সালে, রাওয়ালপিন্ডিতে দেয়া এক বিবৃতি তে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি বলেন, ১৯৭১ সালের ২১ মে তিনি যেসব পাকিস্তানী লোক নানা কারনে ইন্ডিয়া চলে গিয়েছিল তাদের উদ্দেশে বার্তা দিয়েছিলেন যে তারা যন তাদের দেশে ফিরে এসে সাভাবিক কাজকর্ম শুরু করে । তিনি আরো জানান, অনেক লোকের অনেক রকম বাঁধা সত্ত্বেও অনেক পাকিস্তানীরা তাদের ঘরে ফিরে এসেছে এবং অনেকেই এখন ফেরার পথে। আমি নিশ্চিত যে বাকিরাও তাদের অনুসরন করে ফেরত আসবে। এবং পাকিতানী নাগরিক দের তাদের নিজের দেশে ফিরে আসার এই অনুমতি কখনো উঠিয়ে নেয়া হবেনা বরং পূর্ব পাকিস্তান সরকার তাদের ফিরিয়ে আনার জন্য পর্যাপ্ত ব্যাবস্থা গ্রহন করেছেন ও তাদের পুনর্বাসন এর ও ব্যাবস্থা গ্রহন করেছে।
রাষ্ট্রপতির বিশেষ করে সংখ্যালঘুদের উদ্দেশ্য করে বলেন, আমার এই আবেদন জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল পাকিস্তানীদের প্রতি। বিশেষ করে সংখ্যা লঘুরা যেন পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে আসতে বিন্দুমাত্র দ্বিধায় না ভুগে। তাদের ও বাকি সব নাগরিক দের মত সমান অধিকার আছে এবং তাদের প্রতি বিন্দুমাত্র বৈষম্য করা হবেনা। তিনি তাদের বহির্বিশ্বের কোনো রকম প্রতারনায় কান না দিতে অনুরোধ করেন।
জাতিসংঘের সহযোগীতা ছাড়াও পাকিস্তান সরকার এই সংকট মোকাবেলায় নানা রকম উপযোগী পদক্ষেপ গ্রহন করেন।
১৯৭১ সালের ১৪ জুলাই, পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি ডা। এ এম মালিক নামক একজন পূর্ব পাকিস্তানী নাগরিক কে রিলিফ ও পূনবাসন ব্যাবস্থার বিশেষ সহকারী হিসেবে নিযুক্ত করেন। বিশেষ সহকারী হিসেবে ডা মালিকের পদমর্যাদা ছিল, একজন কেবিনেট মন্ত্রীর সমান যিনি রিলিফ ও পূনবাসন ব্যাবস্থার উন্নতি ও সব খবরাখবর রাষ্ট্রপতিকে দিতেন।
.
.
ভারতীয় ছলচাতুরী
দুভার্গ্যবসত প্রয়োজনের সময় ভারতের অসহযোগী আচরন শুধু মাত্র পাকিস্তানের প্রতি প্রচন্ড শত্রুতামূলক ছিলো না বরং পাকিস্তানের নাগরিকদের ফেরার মত মানবিক প্রশ্নে নেয়াহেত খলও ছিলো।
একটা ব্যাপার হলো ভারতীয়রা পূর্ব পাকিস্তান থেকে চলে আসা উদ্বাস্তুদের একটা কাল্পনাপ্রসুত সংখ্যা দিয়েছে। তারা বিদেশী সাংবাদিক ও কুটনৈতিক উপস্থিতির সুযোগ নিয়েছে, যাদের তারা এইসব ক্যাম্পের কয়েকটায় নিয়ে গিয়েছে “নমুনা” দেখানোর জন্য, এবং কোথাও একটি দলকে দেখা গেলে তার সংখ্যাকে হাজার গুণ পর্যন্ত বাড়িয়ে এমন একটা সংখ্যায় উপনীত করা হবে যেন তা ভারত দ্বারা বর্ণিত পরিসংখ্যানের কাছাকাছি হয়! আন্তর্জাতিক পৃষ্ঠপোষকতায় উদ্বাস্তুদের এখন পর্যন্ত গননা হয়নি। এবং এই ধরনের কোন গননা ছাড়া ভারতের একতরফা ভাবে দেওয়া সংখ্যাকে খুব খামখেয়ালী বলা যায়। এর একটা ভালো উদাহরণ হিসাবে তিনজন বৃটিশ এমপির কথা বলা যায় তারা যখন জুলাই ৫, ১৯৭১ লন্ডন বিমানবন্দরে সংবাদ সম্মেলনে স্বীকার করেছেন যে তারা অবস্থার সঠিক মূল্যায়ন করেননি এবং তাদের মতামত ছিলো ভারতীয় সরকারের অনুবাদকের মাধ্যমে পশ্চিম বঙ্গের শরনার্থীদের সাথে বলা কথার উপর ভিত্তি করে।
দ্বিতীয়ত, যখন ভারতীয় কর্তৃপক্ষ পূর্ব পাকিস্তানের উদ্বাস্তুদের নিয়ে হইচই করছিলো তারা কাউকেই সন্দেহ করতে দেয়নি যে তাদের আসল উদ্দেশ্য এই উদ্বাস্তুদের পাকিস্তানে তাদের ঘরে ফিরতে না দেওয়া। ৩ জুন, ১৯৭১ ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জগজীবন রাম আসানসোলে এক ভাষণে বলেনঃ “আমরা এই উদ্বাস্তুদের ইয়াহিয়া খানের পাকিস্তানে ফিরতে দেবো না বরং তাদের শেখ মুজিবর রহমানের বাংলাদেশে ফিরতে দিবো।” ভারতের এই পরিকল্পনা আরো সুস্পষ্ট হয়ে উঠে যখন ২০ জুন ১৯৭১, শ্রীনগরের কাছে, হানদুয়ারাতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নিজে বলেন যে তার সরকার চায় “তাদের পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শিকার হতে দেবেন না।” “আমরা তাদের কচুকাটা হতে ধাক্কা দেবো না”, যা ছিলো রাজনৈতিক শ্রুতিকটু শব্দের বদলে কোমল শব্দের ব্যবহার, অর্থাৎ তিনি পাকিস্তানীদের ঘরে ফিরতে দেবেন না।
তৃতীয়ত, ভারত বেশী বেশী করে পূর্ব পাকিস্তানি উদ্বাস্তুদের মধ্য প্রদেশের মত ভিতরের দিকে সরিয়ে নিচ্ছে। পর্যবেক্ষকরা বলেন যেহেতু বেশী বিদেশী সাংবাদিক ও কুটনৈতিকরা এই সব শরনার্থী শিবির পরিদর্শন করছে, ভারতীয় প্রচারকদের প্রচার করা কল্পিত সংখক শরনার্থী তাই দেখানো ভারতের জন্যে কঠিনতর হয়ে যাচ্ছিলো। তাই ভালো থাকবার জায়গা দেওয়ার অজুহাতে শরনার্থীদের বিভিন্ন প্রদেশে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছিলো। এই প্রক্রিয়ায়, প্রকৃত পাকিস্তানী নাগরিকদের সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে দূরে দূরে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছিলো, যার ফলে তাদের পক্ষে ফিরে আসা প্রায় অসম্ভব হয়ে পরে। এতে আশ্চর্যের কিছু নেই যে, রয়টার্স সংবাদ সংস্থা ১০ জুন,১৯৭১ নয়া দিল্লী থেকে প্রতিবেদন দেয়, “পশ্চিম বঙ্গ স্বাস্থ্য মন্ত্রী বলেছেন রাজ্য সরকার খতিয়ে দেখছে যে কিছু শরনার্থী সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে যেতে অনিচ্ছুক ছিলো এবং কিছু ট্রেনে চড়ানোর পরে ঝাপিয়ে নেমে যায়।”
উদ্বাস্তুদের থেমে যাওয়া অন্তঃপ্রবাহ
পরিশেষে, ভারত পাকিস্তানীদের ফিরে আসা কঠিন থেকে কঠিনতর করে তুলছে। সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে ঢাকায় প্রাপ্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, উদ্বাস্তুদের পূর্ব পাকিস্তানে তাদের ঘরে ফিরে আসা রোধ করতে সকল রকম বাধা দেওয়া হচ্ছে। ২২ জুন একটি দিনাজপুরের প্রতিবেদন বলে যে, ১৭ জুন ১৯৭১, ২৫০ পাকিস্তানী উদ্বাস্তু পাকিস্তানী সীমান্ত অতিক্রম করার চেষ্টা করলে ভারতীয় বিএসএফ তাদের বাধা দেয় এবং তাকে ভারতীয় হিলি ক্যাম্পে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। আগরতলা ফেরত একজন কুমিল্লার আইনজীবী ২২ জুন ১৯৭১ সংবাদ মাধ্যমকে জানান যে, ভারতে থাকা পূর্ব পাকিস্তানী শরনার্থীদের রুদ্ধ করে রাখা হয়েছে এবং যারা ফিরতে চাইছে তাদের বাধা দেওয়া হচ্ছে এমনকি মেরে ফেলার হুমকিও দেওয়া হচ্ছে।
ভ্রমনরত অস্ট্রেলীয় সংসদ সদস্য মি. লিওনার্দ স্ট্যানলী রেইড ১৪ জুলাই ১৯৭১, ঢাকায় এক সাক্ষাতকারে বলেন, তিনি সীমান্তের দুই পাশেই অবস্থা পর্যবেক্ষন করেছেন এবং জমাট বাধা দুঃশ্চিন্তা দূর করা ভারতের দ্বায়িত যা সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে আশ্র নেওয়া পাকিস্তানী নাগরিকদের ফিরে আসা থেকে আটকাচ্ছে। মি. রেইড আরো যোগ করেন যে তিনি বহু সংখ্যক পূর্ব পাকিস্তানী সরকারের অভ্যর্থনা কেন্দ্র পরিদর্শন করেছেন এবং দেখেছেন যে বসবাস ও চিকিৎসা সেবার জন্যে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা আছে এবং তাদের দ্রুত পুনর্বাসনের জন্যে সব রকম চেষ্টাই করা হচ্ছে।
ধীরস্থির ভাবে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন এগুচ্ছে
সীমান্তে বিভিন্ন রকম বাধার সম্মুখীন হয়েও, হিন্দু এবং মুসলিম উভয় উদ্বাস্তুরা পরিচিত অপরিচিত বিভিন্ন রাস্তা দিয়ে বর্ধিত সংখ্যায় পূর্ব পাকিস্তানে ফিরছে। এদের মধ্যে অনেকেই অপরিচিত রাস্তা বেছে নিচ্ছে এবং রাতের বেলা যাত্রা করছে ভারতীয় ও তাদের চরদের দেওয়া বাধা এড়ানোর জন্যে। এটা সরকার ঘোষিত পাকিস্তানে প্রত্যাবর্তনকারী মানুষের সংখ্যা এবং অভ্যর্থনা কেন্দ্রে প্রকৃতপক্ষে নিবন্ধিত মানুষের সংখ্যার পার্থক্যের কারন ব্যাখা করে।
আরো ১৬৫০ জন পাকিস্তানী উদ্বাস্তু সীমান্ত পার হয়ে জুন ১৯৭১ এর শেষ সপ্তাহে তাদের ঘরে ফিরে এসেছে। এদের মধ্যে ১০০ জন সিলেট জেলার কাতালমোড়া সীমান্ত, ৩৬০ জন দিনাজপুর জেলা এবং বাকিরা বিভিন্ন কেন্দ্র দিয়ে ফিরেছে। এদের মধ্যে সাতক্ষীরা দিয়ে ফিরে আসাদের মধ্যে ২৩৮ জন সংখ্যালঘু ছিলো। রংপুরের ৮০ শতাংশ উদ্বাস্তু পাকিস্তানী ইতিমধ্যে তাদের ঘরে ফিরে এসেছে।
অন্যান্য বিভাগেও উদ্বাস্তুদের ফিরে আসা জারি আছে। এমন ৭০০ প্রত্যাবর্তনকারী খুলনা জেলার চুয়াডাঙ্গা মহকুমা দিয়ে ফিরেছে। আরো ৯০০ জন উদ্বাস্তু ফিরেছে, এদের ৬৭০ জন দিনাজপুর জেলার খানপুর, ঠাকুরগাঁও, এবং পঞ্চগড় দিয়ে, ১৭৫ জন ঝিকরগাছা দিয়ে এবং বাকিরা সাতক্ষীরা এবং ছাগাছি দিয়ে ফিরেছে। ফিরে আসা উদ্বাস্তু যারা এই সব কেন্দ্রে নিবন্ধন করেছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী, পুরুষ এবং শিশু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের।
ভারতের প্রত্যাবর্তনে বাধা দেওয়ার পিছনের কারন
এই সব পাকিস্তানী নাগরিকদের প্রত্যাবর্তনে বাধা দেওয়ার পিছনে ভারতের কারন কি? এটা মনে রাখা আবশ্যক যে ভারত ইতিমধ্যে ১২ কোটি বৈদেশিক মুদ্রা পূর্ব পাকিস্তানী উদ্বাস্তুদের খাওয়ানোর জন্যে সাহায্য পেয়েছে। এই টাকা ২০ কোটি বৈদেশিক মুদ্রার অংশ যা তারা মানবতার ভিত্তি পেলেও প্রচ্ছন্নভাবে তাদের বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি পুরুন করছে। বিদেশী সংবাদ সংস্থা ইতিমধ্যে প্রতিবেদন করেছে যে ভারত এই সব শরনার্থী শিবিরের লোক সংখ্যা পশ্চিম বঙ্গ ও অন্যান্য প্রতিবেশি প্রদেশের বেকার লোকজন দিয়ে বাড়িয়ে তুলছে। লন্ডন ডেইলি টেলিগ্রাফের সাংবাদিক পিটার গিলের ৬ জুলাই,১৯৭১ ডাকবার্তায় প্রেরিত এবং পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, “পশ্চিম বঙ্গের কলকাতার সর্বস্বান্তদের এই সব শরনার্থী শিবিরে পাঠানো হয়”। এই সাংবাদিক কলকাতার সল্টলেক শহরতলী এলাকার শিবিরের দ্বায়িত্বে থাকা অবসরপ্রাপ্ত ভারতীয় সেনা বাহিনীর কর্মকর্তা মেজর এস.কে. দেবার স্বীকারোক্তির উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, “কপর্দকহীন কলকাতার অস্বাস্থ্যকর রাস্তায় বসবাসরত হাজার হাজার ভারতীয় শহরের উপকণ্ঠে পূর্ব পাকিস্তানী শরনার্থী শিবিরে আশ্রয় চাইছে।” তিনি আরো যোগ করেঃ “তাদের এই শরনার্থী শিবিরে যেতে লোভী করে তুলেছে বিনে পয়সায় খাদ্য, যেহেতু প্রতিজন প্রাপ্তবয়স্ক শরনার্থী রশিদ জমা দিয়ে প্রতিদিন ৪০০ গ্রাম চাল, ১০০ গ্রাম সবজি এবং ৩০০ গ্রাম ডাল পেয়ে থাকে। এটা কলকাতায় বসবাসকারী অনেকের খাদ্য তালিকা থেকে অনেক উন্নত। ”
ভারত তাই দেখছে শরনার্থী জুজু টিকিয়ে রেখে তাদের উভয় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ফায়দা রয়েছে এবং তাই পাকিস্তানের তাদের নিজের ঘরে পূর্ব পাকিস্তানে ফেরানোর নিরলস প্রচেষ্টায় বাধা দিচ্ছে ও নাশকতা করছে। পাকিস্তানের উপরে বেশী বেশী চাপ তৈরীর জন্যে সম্ভবত ভারত এই ঘটনার সমাধান হতে দিচ্ছে না। এইভাবে হয়তো ভারত তাদের মার্চ-এপ্রিল ১৯৭১-এ ভারতীয় অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে বিদ্রোহ করে পাকিস্তানকে ভাঙ্গবার ব্যর্থ চেষ্টা সফল করার চেষ্টা করছে।
পাকিস্তানের সমাধান
যেখানে পাকিস্তান তার নাগরিকদের সহজে ফেরার জন্য জাতিসংঘের পূর্ন সহযোগীতা ও অংশগ্রহনের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ নিচ্ছে সেখানে পাকিস্তান সরকার তাদের অভ্যন্তরীন ব্যাপারে বাইরের কারো হস্তক্ষেপ সমর্থন করবে না। এটা উপলব্ধি করতে হবে যে ভারত একটি মানবিক সমস্যাকে ব্যবহার করে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ সংস্থাপনার উপর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের ন্যায্যতা দেখাতে চাইছে। পাকিস্তান সরকার তার নাগরিকদের নিজ বাড়িতে ফিরতে দেখতে অধীর হয়ে আছে এবং তাদের ফিরে আসা ও পুর্নবাসনকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছে। কিন্তু সরকার ভারতের নিজস্ব নীতি ও অপপ্রচারের কারনে প্রকট আকার ধারন করা উদ্বাস্তু সমস্যাকে রাজনৈতিক ফাঁদে ফেলার অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার হতে দেবে না।
তৈরীতে
চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর
পাকিস্তান সরকার
জুলাই ১৯৭১
.
.
শিরোনামঃ ১৩৯। ‘পূর্ব পাকিস্তানে’ সামরিক হস্তক্ষেপের পটভূমিকার ওপর পাকিস্তান সরকারের শ্বেতপত্র
সূত্রঃ পাকিস্তান সরকারের প্রচার পুস্তিকা
তারিখ ৫ আগষ্ট ১৯৭১
পাকিস্তান সরকার
পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্কট সম্পর্কে
শ্বেতপত্র
৫ আগষ্ট, ১৯৭১
ভূমিকা
.
এই শ্বেতপত্র পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান সঙ্কটের ঘটনাবলীর সর্বপ্রথম পূর্ণ বিবরণ। আওয়ামী লীগ নেতাদের মনোভাবের দরুন নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিরা একটি ফেডারেল শাসনতন্ত্রের মূল বিষয়সমূহের ব্যাপারে একটা মতৈক্যে পৌঁছুতে ব্যর্থ হলে এই সঙ্কটের উদ্ভব হয়। আওয়ামী লীগ নেতারা স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে জনগণের রায়কে একটা বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে পরিবর্তিত করার প্রয়াস পান।
এ-সব ঘটনার প্রতি বহির্বিশ্বের দৃষ্টি আকৃষ্ট হছে। অবশ্য, এ পর্যন্ত বিশ্বকে অসম্পূর্ণ এবং পক্ষপাতদুষ্ট তথ্যই সরবরাহ করা হয়েছে। এই শ্বেতপত্রে সেইসব ঘটনাবলীর বিস্তারিত পটভূমিকা দেওয়া হয়েছে বা শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানকে খন্ড-বিখন্ড করার উদ্দেশ্যে একটি সশস্ত্র বিদ্রোহের রূপ নেয়।
পূর্ব পাকিস্তান সঙ্কট হৃদয়ঙ্গম করার জন্য অপরিহার্য মূল বিষয়গুলো হচ্ছে:
(১) ১৯৭০ সালের আইনকাঠামো আদেশের ভিত্তিতেই পাকিস্তানের সাম্প্রতিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগসহ সব রাজনৈতিক দলই এই আইন-কাঠামো গ্রহণ করেছিলেন। এই আদেশ থেকে সন্দেহাতীতভাবে বোঝা যায় যে, পাকিস্তানের সংহতি ও অখন্ডতা হচ্ছে যে কোন ভবিষ্যত শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থার মৌলিক পূর্ব-শর্ত।
(২) ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ ফেডারেল সরকার যে ব্যবস্থা শুরু করেন তার লক্ষ্য ছিলো আইন-শৃঙ্খলা পুন:প্রতিষ্ঠা, কারণ আওয়ামী লীগের ‘অহিংস-অসহযোগ’ আন্দোলনের সময় আইন-শৃঙ্খলার কাঠামো সম্পূর্ণরূপে ভেঙ্গে পড়েছিলো। এই সময়ে যে গোলযোগ এবং নৃশংস কার্যকলাপ চালানো হয় এই শ্বেতপত্রে তা বিবৃত করা হয়েছে।
(৩) হিন্দুস্তান হস্তক্ষেপ না করলে এবং প্ররোচনা না যোগালে পরিস্থিতি বেশ শিগগিরই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যেতো।
প্রথম অধ্যায়
সংঘর্ষ অভিমুখে
১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আন্দোলনের পরিণতিতে জাতি এক মারাত্মক সঙ্কটের সম্মুখীন হয় যার ফলে ১৯৬৯ সালের ২৬শে মার্চ সামরিক আইন জারী করা প্রয়োজন হয়ে পড়ে। জাতির উদ্দেশ্যে তাঁর সর্বপ্রথম ভাষণে, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল এ. এম. ইয়াহিয়া খান বলেন, “আমি আপনাদের কাছে সম্পূর্ণ পরিষ্কার করে দিতে চাই যে, একটি শাসনতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার অনুকূল পরিবেশ গড়ে তোলা ছাড়া আমার অন্য কোন উচ্চাকাঙ্খা নেই। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, সুস্থ ও গঠনমূলক রাজনৈতিক জীবন এবং প্রাপ্ত বয়স্ক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে অবাধে ও নিরপেক্ষভাবে নির্বাচিত গণ প্রতনিধিদের কাছে নির্বিঘ্নে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য অপরিহার্য পূর্ব শর্ত হচ্ছে একটি সুষ্ঠু, নিষ্কলঙ্ক এবং সৎ সরকার। এই নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাজ হবে দেশকে একটি ব্যবহারযোগ্য শাসনতন্ত্র দেয়া এবং যে-সব রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যা গণমনকে আলোড়িত করছে তার একটা সমাধান বের করা”।
এই লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে রাজনৈতিক তৎপরতা চালানোর অনুমতি দেয়া হয় এবং প্রেসিডেন্ট সব রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিকে আশ্বাস দিয়ে বলেন, “আমার সরকার আপনাদের ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষতার নীতি অনুসরণ অব্যাহত রাখবেন”। তিনি অবশ্য জোর দিয়ে বলেন, “কোন ব্যক্তি, দল কিংবা গোষ্ঠী যারাই ইসলামের মূলনীতিসমূহ এবং পাকিস্তানের আদর্শ ও সংহতি বিরোধী প্রচারণা চালাবে কিংবা আমাদের জনগণের ঐক্যে ফাটল ধরানোর চেষ্টা করবে, তারাই জনগণ ও তাদের সশস্ত্র বাহিনীর ক্রোধভাজন হবে”।
এরপর কয়েকমাস ধরে প্রেসিডেন্ট সারাদেশে রাজনীতিবিদ এবং জনমতের প্রতিনিধিত্বকারী নেতাদের সঙ্গে ব্যাপক আলোচনা-পরামর্শ চালান। কিন্তু ১৯৬৯ সালের ২৮শে নভেম্বর তিনি দু:খ প্রকাশ করেন যে, রাজনৈতিক নেতাদের প্রতি পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলদ্ধি করে জাতীয় রাষ্ট্রনেতার মতো শাসনতান্ত্রিক প্রশ্নটির সমাধানের জন্য তাঁর জরুরী আবেদন সত্ত্বেও এ ব্যাপারে কোনরকম মতৈক্য দেখা যাচ্ছে না।
তিনি দুটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্তও ঘোষণা করেন। প্রথমটি হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানে এক ইউনিট বাতিল করে দেয়া এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে ভবিষ্যত জাতীয পরিষদের নির্বাচনের জন্য “একজন লোক – একটি ভোট” এই নীতি গ্রহণ। এর ফলে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে Parity বা সমতার যে নীতি আওয়ামী লীগসহ সব রাজনৈতিক দলই মেনে নিয়েছিলেন এবং যা ১৯৫৬ এবং ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রেও গৃহীত হয়েছিল তা পরিত্যক্ত হলো। প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্তের ফলে এই প্রথমবারের মত জাতীয় পরিষদের পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠতা স্থায়ীভাবে কায়েম হলো। রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে এবং জনগণের সুস্পষ্ট ইচ্ছে অনুসারে প্রেসিডেন্ট কতকগুলো বিষয়কে স্থিরীকৃত বলে ঘোষণা করেন। এসব বিষয় হচ্ছে:
(১) ফেডারেল পার্লামেন্টারী ধরণের সরকার।
(২) প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকারভিত্তিক প্রত্যক্ষ নির্বাচন।
(৩) নাগরিকদের মৌলিক অধিকার দান এবং আইন-আদালতের মাধ্যমে এই অধিকার-রক্ষার নিশ্চয়তাবিধানের ব্যবস্থা।
(৪) বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং তাকে শাসনতন্ত্র-রক্ষকের ভূমিকা নেয়া।
(৫) যে আদর্শের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা অক্ষুন্ন রাখার জন্য একটি ইসলামী ভাবাদর্শভিত্তিক শাসনতন্ত্র প্রণয়ন।
প্রেসিডেন্ট আরো প্রকাশ করেন যে, ১৯৭০ সালের ৩১শে মার্চ নাগাদ একটি আইন কাঠামো এবং জুন মাস নাগাদ ভোটার তালিকা তৈরী করে ১৯৭৩ সালের ৫ই অক্টোবর সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হবে। জাতীয় পরিষদকে তার প্রথম অধিবেশন থেকে শুরু করে ১২০ দিনের মধ্যে একটি শাসনতন্ত্র তৈরী করতে হবে।
প্রেসিডেন্ট বলেন, তাঁরা যদি এই কাজ সম্পন্ন করেন তাহলেও আমি সুখী হবো। কিন্তু তাঁরা যদি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এই কাজ সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হন, তাহলে পরিষদ ভেঙ্গে দেয়া হবে এবং আবার নতুন করে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আমি আশা করি এবং কামনা করি যেনো তা না ঘটে এবং এই জন্যই আমি ভবিষ্যত গণপ্রতিনিধিদের পূর্ণ দায়িত্ববোধ এবং দেশপ্রেমের সঙ্গে এই কাজ হাতে নেয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি।
১৯৭০ সালের পয়লা জুন সারাদেশে সাধারণ নির্বাচনের জন্য নির্বাচনী অভিযান শুরু হয়। এই সময় প্রেসিডেন্ট সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থ এবং ব্যক্তিগত ও স্থানীয় বিবেচনার উর্ধ্বে ওঠার জন্য সব দলের প্রতি আবেদন জানান। সংবাদপত্র, রেডিও টেলিভিশনকে প্রতিদ্বন্ধিতায় অবতীর্ণ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মতামত প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়া হয়। সব সরকারী কর্মচারীকেই পূর্ণ নিরপেক্ষতা বজায় রাখার কড়া নির্দেশ দেয়া হয়। ১৯৭০ সালের ২৮শে মার্চ জাতির উদ্দেশ্যে এক ভাষণে প্রেসিডেন্ট বলেন, “আমি আরেকবার আপনাদের আশ্বাস দিতে চাই যে, যতদুর পর্যন্ত নির্বাচনী অভিযানের সম্পর্ক রয়েছে, বর্তমান সরকার আগেও সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ছিলেন এবং ভবিষ্যতেও থাকবেন। সরকার অবশ্য আশা করেন যে, কোন রাজনৈতিক দল কিংবা ব্যক্তি পাকিস্তানের আদর্শ ও সংহতি বিরোধী প্রচারণা কিংবা কার্যকলাপ চালাবেন না”।
একই ভাষণে প্রেসিডেন্ট আইনকাঠামো আদেশ (১৯৭০)-এর মুল ধারাগুলো ঘোষণা করেন। এই আদেশের ভিত্তিতেই সব রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নেন। এই “আইনকাঠামো আদেশ”-এর উপক্রমণিকায় বলা হয় যে, জাতীয় পরিষদের প্রথম কর্তব্য হচ্ছে “এই আদেশের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র তৈরী করা”। আদেশের ১৪(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়, “জাতীয় পরিষদ-সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন শেষ হওয়ার পর পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র তৈরীর কাজ সম্পাদনের উদ্দেশ্যে প্রেসিডেন্ট তাঁর বিবেচনা মতো উপযুক্ত তারিখ, সময় ও স্থানে পরিষদের অধিবেশন ডাকবেন”। আরো ঠিক করা হয় যে, জাতীয় পরিষদ তার প্রথম অধিবেশনের ১২০ দিনের মধ্যে “শাসনতন্ত্র বিল” নামে একটি বিলের আকারে শাসনতন্ত্র তৈরী করবেন এবং তা করতে ব্যার্থ হলে পরিষদ ভেঙ্গে যাবে। জাতীয় পরিষদের পাশ করা শাসনতন্ত্র-বিল প্রেসিডেন্টের অনুমোদন লাভ না করা পর্যন্ত জাতীয় পরিষদ ফেডারেশনের প্রথম আইন পরিষদ হিসেবে তার কাজ শুরু করতে পারবেন না এবং প্রাদেশিক পরিষদগুলোর অধিবেশনও ডাকা হবে না।
ফেডারেল শাসনতন্ত্র তৈরীর একটা ঐতিহাসিক রীতি এই যে, শাসনতন্ত্রের পেছনে হয় ফেডারেটিং ইউনিটগুলোর সর্বসম্মত সমর্থন কিংবা ফেডারেটিং ইউনিটগুলোর বেশীরভাগের সম্মতি থাকতে হবে। এটাই বোঝাতে চাওয়া হয়েছিলো প্রেসিডেন্টের নিম্নোক্ত মন্তব্যে- “শাসনতন্ত্র হচ্ছে একটা পবিত্র দলিল এবং একত্রে বসবাসের মৌলিক চুক্তি। কোন সাধারণ আইনের সঙ্গে তার তুলনা করা চলেনা”।
আইন-কাঠামো আদেশ শাসনতন্ত্রে অন্তর্ভুক্ত করার কতকগুলো মূলনীতি দেয়া হয়। এসব মূলনীতির মধ্যে ছিলো:
(১) “জনসংখ্যা এবং প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্দিষ্ট মেয়াদ পর পর ফেডারেল ও প্রাদেশিক পরিষদসমূহের অবাদ প্রত্যক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে গণতন্ত্রের মূলনীতিসমূহ অনুসরণের নিশ্চয়তা বিধান করা হবে।”
(২) “নাগরিকদের অধিকার বিধিবদ্ধ করা হবে এবং এই অধিকার ভোগের নিশ্চয়তা বিধান করা হবে।”
(৩) “মামলা-মকদ্দমার বিচার এবং মৌলিক অধিকার রক্ষার ব্যাপারে বিচার-বিভাগকে স্বাধীনতা দেয়া হবে।”
(৪) “আইন-তৈরী সংক্রান্ত, প্রশাসনিক এবং আর্থিক ক্ষমতাসহ সব রকম ক্ষমতাই ফেডারেল সরকার এবং প্রদেশগুলোর মধ্যে এমনভাবে ভাগ করা হবে যে, প্রদেশগুলো সর্বাধিক স্বায়ত্তশাসন অর্থাৎ সর্বাধিক পরিমাণ আইন-প্রণয়ন সংক্রান্ত, প্রশাসনিক এবং আর্থিক ক্ষমতা ভোগ করবেন কিন্তু একইসঙ্গে ফেডারেল সরকারও বাইরের ও অভ্যন্তরীণ বিষয়াদিতে তার দায়িত্ব পালন এবং দেশের স্বাধীনতা ও আঞ্চলিক অখন্ডতা অক্ষুণ্ন রাখার জন্য পর্যাপ্ত আইন-প্রণয়ন ক্ষমতা, প্রশাসনিক ক্ষমতা ও আর্থিক ক্ষমতা পাবেন।”
(৫) “নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে যেনো-
ক) পাকিস্তানের সব এলাকার জনগণ সব রকম জাতীয় প্রচেষ্টায় পুরোপুরি অংশগ্রহণ করতে সক্ষম হয়।
এবং
খ ) একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আইন করে এবং অন্যান্য ব্যবস্থার মাধ্যমে বিভিন্ন প্রদেশের মধ্যে এবং প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন এলাকার মধ্যে অর্থনৈতিক এবং অন্য সবরকম বৈষম্য দুর করা হয়।”
(৬) “শাসনতন্ত্রের উপক্রমণিকায় এই মর্মে ঘোষণা থাকতে হবে যে-
ক)পাকিস্তানের মুসলমানরা ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত পর্যায়ে, পবিত্র কোরান ও সুন্না মোতাবেক ইসলামের শিক্ষা অনুসারে তাদের জীবন গড়ে তুলতে পারবেন।
এবং
খ)সংখ্যালঘুরা অবাধে তাদের ধর্ম-পালন এবং পাকিস্তানের নাগরিক হিসেবে সব রকম অধিকার, সুযোগ-সুবিধা এবং নিরাপত্তা ভোগ করতে পারবেন।”
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই যে, এই আদেশে বলে দেয়া হয়, “পাকিস্তানে বর্তমানে যে সব প্রদেশ ও এলাকা রয়েছে কিংবা পরে যে সব প্রদেশ ও এলাকা অন্তর্ভুক্ত হতে পারে তারা সবাই একটি ফেডারেশনের অধীনে এমনভাবে ঐক্যবদ্ধ হবে যেনো পাকিস্তানের স্বাধীনতা, আঞ্চলিক অখন্ডতা এবং জাতীয় সংহতি নিশ্চিত হয় এবং ফেডারেশনের সংহতি কোন রকমেই ব্যাহত না হয়।”
প্রেসিডেন্ট তাঁর ২৮শে মার্চের ভাষণে বলেন, আমাদের জনগণ গভীর দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ। সুতরাং তারা পাকিস্তানের অখন্ডতার বিরুদ্ধে কোন কাজ ছাড়া প্রায় সব জিনিষই বরদাশত করবে। যদি কেউ মনে করে যে, সে দেশ কিংবা জনগণের স্বার্থবিরোধী কাজ করতে পারবে কিংবা কেউ যদি আমাদের জনগণের মৌলিক ঐক্য নষ্ট করতে পারবে মনে করে, তবে সে বড় ভুল করবে। জনগণ এটা কোন প্রকারেই বরাদশত করবে না। … দেশের শাসনতান্ত্রিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক সমস্যার সমাধান দেয়ার অধিকার প্রত্যেকেরই রয়েছে। কিন্তু পাকিস্তানের জনগণের সংহতির উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে এমন কোন সমাধান দেয়ার অধিকার কারুরই নেই। কেউই তা বরদাশত করবে না।”
আওয়ামী লীগ তাদের ৬ দফা যেভাবে জনগণের কাছে পেশ করেন তাতে পাকিস্তানের সার্বভৌম মর্যাদায় কোনরকম পরিবর্তন সাধনের দাবী ছিলনা। প্রথম দফায় বলা হয়, “সরকারের ধরণ হবে ফেডারেল ও পার্লামেন্টারী পদ্ধতির”। শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর নির্বাচনী বক্তৃতাসমূহে বারবার জোর দিয়ে বলেন যে, তিনি কেবল প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন চাচ্ছেন, দেশকে ভাগ করা কিংবা তার ইসলামী আদর্শকে দুর্বল করা তাঁর লক্ষ্য নয়। ১৯৭০ সালের ২১শে সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জে এক বক্তৃতায় তিনি বলেন, “৬ দফা কার্যক্রম বাস্তবায়িত করা হবে এবং তাতে পাকিস্তানের সংহতি কিংবা ইসলাম বিপন্ন হবেনা”। ১৯৭০ সালের ২৪শে সেপ্টেম্বর তিনি নির্বাচনকে “প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে একটি গণভোট” বলে অভিহিত করেন। ৬ই নভেম্বর ১৯৭০ সিলেটে আরেক ভাষণে তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগের ৬ দফা কার্যক্রমের উদ্দেশ্য হচ্ছে কেবল আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের মাধ্যমে শাসনতন্ত্রে পূর্ববঙ্গের স্বার্থরক্ষার নিশ্চয়তাবিধান করা”। আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতারাও একই ধরণের কথা বলেন। পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের সেক্রেটারী জনাব তাজউদ্দিন আহমদ ১৯৭০ সালের ২১শে সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জে বলেন যে, “৬ দফা আদায়ের প্রশ্নটি অখন্ডতা ও সংহতির সঙ্গে বিশেষভাবে জড়িত”।
নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব এ. এইচ. এম. কামরুজ্জামান ১৯৭০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে লাহোরে এক জনসভায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন যে, পাকিস্তানকে খন্ড-বিখন্ড করা তাঁর দলের উদ্দেশ্য নয়। এর আগে ১৯৭০ সালের ২১শে জুন রাজশাহীতে এক জনসভায় বক্তৃতাদানকালে তিনি বলেন, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান অচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি খন্দকার মুশতাক আহমদ ১৯৭০ সালের ২০শে মার্চ ফেনীতে এক জনসভায় বলেন, আওয়ামী লীগের লক্ষ্য হচ্ছে একটি শক্তিশালী পাকিস্তান গঠন করা। তিনি বলেন, পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন একটি শক্তিশালী জাতি গঠন সহায়ক হবে।
যাহোক, শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর সহযোগীদের এসব বক্তৃতার মধ্যে এমন সব কথা ছিল বা অত্যন্ত আবেগপ্রসূত এবং তথ্যের দিক দিয়ে ত্রুটিপূর্ণ যার উদ্দেশ্যে ছিল পূর্ব পাকিস্তানীদেরকে তাদের পশ্চিম পাকিস্তান ভাইদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে তোলা। ১৯৭০ সালের ১১ই মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের হাজারিবাগ পার্কে এক জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমান নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান, মওলানা মওদুদী, খান আবদুল কাইয়ুম খান প্রমুখের কাছে জানতে চান যে তাঁরা তাঁদের প্রভুদের মাধ্যমে বাংলার যে সম্পদ লুন্ঠন করেছেন তা ফিরিয়ে দিতে আর কত সময় নিবেন।
তিনি বাঙালীদেরকে এই মাহেন্দ্রক্ষণে তার এবং বাংলার পবিত্র মাটি থেকে রাজনৈতিক মীরজাফর এবং পরগাছাদের নির্মুল করার আহ্বান জানান। ১৯৭০ সালের ১০ই মার্চ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব তাজউদ্দীন আহমদ ঢাকায় এক জনসভায বলেন, “বিগত বৎসরগুলোতে শোষক এবং ডাকাতরা বাঙালীদের রক্ত মাংস চিবিয়ে খেয়েছে। আসন্ন নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক গগন থেকে তাদেরকে বিদায় করতে হবে”।
পরদিন ঢাকা জেলার কাপাসিয়ায় কালালেশ্বর হাই স্কুলে আরেক জনসভায় তিনি বলেন “পশ্চিম পাকিস্তানের এক শ্রেণীর শোষণকারী পূর্ব বাংলাকে গত ২৩ বছর ধরে শোষণ করেছে। পাকিস্তানের ইতিহাস একটি ষড়যন্ত্রের ইতিহাস, অব্যাহত নির্যাতন ও শোষণের ইতিহাস”।
এরপর পূর্ব পাকিস্তানে যে নির্বাচনী অভিযান শুরু হয় তাতে আওয়ামী লীগ এমন অসংযমের পরিচয় দেয় যে তার বিরুদ্ধে অন্য সব দল অভিযোগমুখর হয়ে ওঠে।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অভিযানের বিরুদ্ধে যারা প্রকাশ্যে প্রতিবাদ জানান তাদের মধ্যে রয়েছেন:
(১)জনাব নুরুল আমীন, পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির সভাপতি এবং পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক মূখ্য উজীর।
(২)জনাব আবদুস সালাম, পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির পূর্ব পাকিস্তান শাখার সভাপতি।
(৩)জনাব মাহমুদ আলী, পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির পূর্ব পাকিস্তান শাখার সহ-সভাপতি।
(৪)প্রফেসর গোলাম আযম, পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমীর।
(৫)সৈয়দ আলতাফ হোসেন, পূর্ব পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ওয়ালী গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক।
(৬)পীর মহসিন উদ্দিন, পূর্ব পাকিস্তান জমিয়তে উলেমায়ে ইসলামের সভাপতি। এবং
(৭)মিসেস আমেনা বেগম, পাকিস্তান ন্যাশনাল লীগের উর্ধ্বতন সহ-সভানেত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভানেত্রী।
১৯৭০ সালে এঁরা এবং অন্যান্য নেতারা জনগণের উদ্দেশ্যে তাঁদের বিবৃতিতে আওয়ামী লীগের জবরদস্তিমূলক পদ্ধতি, জনসভা পন্ড করে দেওয়া, রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের উপর দৈহিক আক্রমণ এবং পার্টির দফতর লুট ও বিনষ্ট করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। এই সমালোচনা দিন দিন বাড়তেই থাকে। কিন্তু পাছে নির্বাচন অভিযানে সরকার হস্তক্ষেপ করেছেন বলে মনে করা হয়, এ জন্য সরকার এ ব্যাপারে কিছু বলেননি।
ঢাকার পুরানা পল্টন ময়দানে ১৯৭০ সালের ১৮ই জানুয়ারী পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য একটি দলের প্রথম জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এই জনসভা জনতা কর্তৃক আক্রান্ত হয়। ফলে, একজন লোক নিহত এবং পাঁচ শতাধিক লোক আহত হয়। জামাত-ই-ইসলামী এই সভার আয়োজন করেছিল। জামাত-ই-ইসলামী প্রমাণ করেছিলো যে, “ময়দানে ঢুকে যারা শ্রোতাদের উপর হামলা চালিয়েছিলো, তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগ কর্মীরা ছিলো এবং গুন্ডাদের হাতে অস্ত্রশস্ত্র এবং হাতবোমা ছিলো”।
ঢাকা দৈনিক পত্রিকা পাকিস্তান অবজারভার এ ঘটনাকে নিন্দা করে ১৯৭০ সালের ২০শে জানুয়ারী প্রকাশ করে যে, “সন্ধ্যার পর ঘটনাস্থলে দলে দলে লোকের পুনরাগমন, সভা পন্ড করা, মঞ্চ পুড়িয়ে ফেলা এবং কয়েক হাজার শ্রোতাকে তাড়িয়ে দেওয়ার ঘটনাটা প্রমাণ করে যে, এটা একটা সুপরিকল্পিত এবং সংকল্পবদ্ধ প্রচেষ্টা। তা না হলে এতো অল্প সময়ের মধ্যে সবকিছু বিনষ্ট করা সম্ভব হত না”।
যারা হিংসাত্মক কার্যকলাপের আশ্রয় নেয় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট তাদের নিন্দা করেন এবং সতর্ক করে দিয়ে বলেন:- রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সাধনের জন্য যদি কেউ হিংসাত্মক কার্যকলাপের সাহায্য নেয়, তাহলে মনে করা হবে যে সে জনসাধারণের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে বাঁধার সৃষ্টি করছে। সুতরাং তাকে জনমতের সামনে জবাবদিহি করতে হবে। তিনি আরো বলেন:- যারা হিংসাত্মক কার্যকলাপ দিয়ে তর্কের মীমাংসায় পৌঁছুতে চায়, তারা যে শুধু তাদের দাবীর প্রতি বিশ্বাসের অভাব প্রমাণ করে তাই নয়, গণতন্ত্রের প্রতিও তাদের আস্থার অভাব প্রমাণ করে- একথা তারা যতোই অস্বীকার করুক না কেনো।
এই ঘটনার এক সপ্তাহ পর পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি নামে আর একটি দলের একটা জনসভায় মারপিট হয়। ১৭ জন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ যুক্ত এশতেহারে এর নিন্দা করে বলেন, “কিছু সংখ্যক দুষ্কৃতিকারী এবং গুন্ডারা সুসংবদ্ধভাবে ১৯৭০ সালের ২১শে জানুয়ারী নারায়ণগঞ্জে অনুষ্ঠিত জনসভা পন্ড করে দেবার চেষ্টা করে”। সেই একই দিন (২১শে জানুয়ারি ১৯৭০) পৃথক একটি যুক্ত বিবৃতিতে এই নেতৃবৃন্দ আওয়ামী লীগকে গুন্ডামী এবং সন্ত্রাসনীতি অবলম্বন করার জন্য বিশেষভাবে দোষারোপ করেন।
১৯৭০ সালের ২২শে জানুয়ারী ঢাকায় জামাত-ই-ইসলামীর দফতরে হামলা করা হয়। পার্টির জেনারেল সেক্রেটারী এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, “আমাদের দফতরে হামলা চালানোকালে আওয়ামী লীগ কর্মীদের দ্বারা পরিচালিত গুন্ডারা দরজা ভেঙ্গে ঢুকে আসবাবপত্রাদি ভেঙ্গে তছনছ করেছে, সাইনবোর্ড সরিয়ে ফেলে এবং পার্টির কাগজপত্র, দলিল এবং পতাকায় আগুন ধরিয়ে দেয়”।
১৯৭০ সালের ১লা ফেব্রুয়ারী ঢাকায় পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান ডেমোক্র্যাটিক পার্টির এক জনসভায়ও আওয়ামী লীগ কর্মীরা গোলাযোগ সৃষ্টির চেষ্টা করে। তারা ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান দেয় গোলযোগের মধ্যে নিজাম-ই-ইসলাম পার্টির নেতা, মৌলবী ফরিদ আহমদ প্রমুখসহ কিছু লোক আহত হন। পিডিপি’র প্রেসিডেন্ট মি: নুরুল আমীন এক বিবৃতিতে বলেন: “আওয়ামী লীগের এসব কার্যকলাপের নিন্দা করার মতো ভাষাও আমার নেই। পরিষ্কার মনে হচ্ছে- আওয়ামী লীগ ফ্যাসিবাদী পদ্ধতি অনুসারে তাদের নিজেদের পরিকল্পনা অন্যের উপর চাপানোর সংকল্প করেছে। আওয়ামী লীগ এই প্রথমবার নীতি অনুসরণ করেনি”।
১৯৭০ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারী চট্টগ্রামে দৈনিক “বুনিয়াদ” এবং দৈনিক “সংগ্রাম” পত্রিকার দফতর দুটির উপর হামলা করা হয়। এই দুটি পত্রিকার আওয়ামী লীগ বিরোধী বলে পরিচিত ছিলো। পাকিস্তান ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ভাইস প্রেসিডেন্ট মি: মাহমুদ আলী এই হামলা সম্পর্কে মন্তব্য করে বলেন: “সংবাদপত্রের স্বাধীনতার উপর হীন একটা হামলা”। তিনি আরও বলেন “যদি ‘বুনিয়াদ’ ও ‘সংগ্রামের’ সঙ্গে আওয়ামী লীগের আদর্শের মিল না হয়, তাহলেই কি তাকে ধ্বংস করেতে হবে? এই কি পাকিস্তানের জনগণের কাছে আওয়ামী লীগের প্রদত্ত গণতন্ত্রের নমুনা”।
১৯৭০ সালের ৩১শে জুলাই ঢাকার পাকিস্তান অবজারভারসহ কয়েকটি পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয় যে, “আওয়ামী লীগের পাঁচ শতাধিক সশস্ত্র কর্মীরা হালি শহর হাউসিং এস্টেটের অধিবাসীদের আক্রমণ করে। এর ফলে ২২ জন আহত হয়। তার মধ্যে ৭ জনের অবস্থা গুরুতর। খবরে জানা যায় যে, আওয়ামী কর্মীরা চেয়েছিলেন যে উল্লেখিত লোকেরা ধর্মঘট পালন করুক। কিন্তু সে এলাকার অধিবাসীরা তা করতে অস্বীকার করে”।
১৯৭০ সালের ৭ই আগষ্ট দৈনিক “পূর্বদেশ” এর খবর প্রকাশ “২রা আগষ্ট ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ টাউন ময়দানে পিডিপি’র এক জনসভা হয়। সে সভায় আওয়ামী লীগের একটি দল এবং ছাত্রলীগ কর্মীরা গোলযোগ বাধাবার চেষ্টা করে। খবরে প্রকাশ সন্নিকটে শেখ মুজিবুর রহমানের গোপালগঞ্জের বাসভবন থেকে, সভায় গোলযোগ সৃষ্টিকারী আওয়ামী লীগ কর্মীদের বের হয়ে আসতে দেখা যায়”।
১৯৭০ সালের ২৩শে আগষ্ট দৈনিক “সংগ্রাম” পত্রিকার খবরে জানা যায় যে “চট্টগ্রামের দৈনিক ‘আজান’ পত্রিকার দফতর এর পূর্বদিন ছাত্র বলে পরিচিত একদল যুবক কর্তৃক আক্রান্ত হয়। দৃষ্কৃতিকারীরা ৬ দফার সমর্থনে এবং “জয় বাংলা’র শ্লোগান দিচ্ছিলো। ‘আজান’ কর্তৃপক্ষকে তারা ৬ দফা সমর্থন করে তাদের পত্রিকায় লেখার হুকুম করে। পত্রিকার একজন কর্মচারী হামলার সময় আহত হন”।
ঈশ্বরদীর ইসলামী ছাত্র সংঘের জেনারেল সেক্রেটারীকে ১৯৭০ সারের ১৯শে সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগ কর্মীরা আক্রমণ করে। চাঁদপুর শহরের কাছে বাহুরীবাজারে ১৯৭০ সালের ২৪শে সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগ কর্মীরা নিজাম-ই-ইসলামের অফিসে হামলা করে এবং অফিসের আসবাবাদি বিনষ্ট করে বলে খবর পাওয়া যায়।
ঢাকার দৈনিক পত্রিকা “সংবাদ” এর ১৯৭০ সালের ২০শে অক্টোবর খবরে প্রকাশ যে, “১৯৭০ সালের ১৮ই অক্টোবর ঢাকার হাজারীবাগ এলাকার ১৩ নং রাস্তার বাচ্চু মিয়ার বাসভবন আওয়ামী লীগের একদল দুষ্কৃতিকারী আক্রমণ করে। দুষ্কৃতিকারীরা বাড়ির উপর পাথর নিক্ষেপ করে, বাড়ীর মেয়েদেরকে গালিগালাজ করে এবং দুটি নাবালক ছেলের উপর দৈহিক নির্যাতন চালায়।
১৯৭০ সালের ৫ই নভেম্বর, পাকিস্তান ন্যাশনাল লীগের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং আওয়ামী লীগের এক প্রাক্তন অ্যাকটিং প্রেসিডেন্ট মিসেস আমেনা বেগম, এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের দ্বারা তাঁর মাতুয়াইলস্থ নির্বাচন দফতর আক্রমণের নিন্দা করেন। এক সপ্তাহ পরে (১৯৭০ সালের ১০ই নভেম্বর) “পূর্বদেশ”এর এক খবরে প্রকাশ যে, ঢাকার অন্তর্গত জিঞ্জিরার কাউন্সিল মুসলিম লীগ প্রার্থী খাজা খয়েরউদ্দিনের সমর্থকগণ বিরাট এক মিছিল বের করেন। গত রাতে আরামবাগ গ্রামে আওয়ামী লীগ কর্মীরা মিছিলের উপর হামলা চালায়। ফলে ৫ ব্যক্তি আহত হয়”।
জাতীয় পরিষদের নির্বাচন ১৯৭০ সালের ৫ অক্টোবর হওয়ার কথা ছিলো। সেপ্টেম্বর মাসে প্রবল বন্যায় পূর্ব পাকিস্তান ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। লক্ষ লক্ষ লোক গৃহহীন হয়, যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়। বন্যার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের ভোটারদের যাতে ভোটদানে কোন অসুবিধার সৃষ্টি না হয়, সে জন্য জনসাধারণ নির্বাচন পিছিয়ে দেবার দাবী জানায়। সে দাবীর পরিপ্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট জাতীয় পরিষদের নির্বাচনের তারিখ ঠিক করলেন ১৯৭০ সালের ৭ই ডিসেম্বর। আর প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের তারিখ নির্দিষ্ট হলো ১৭ই ডিসেম্বর। ১৯৭০ সালের ১২ই নভেম্বর ঘুর্ণিঝড়-দুর্যোগের কবলে পড়ে। বর্তমানে যুগের সর্বাপেক্ষা বৃহৎ প্রাকৃতিক বিপর্যয় বলে অভিহিত এই ঘুর্ণিঝড় পূর্ব পাকিস্তানের উপকূলীয় বাঁধকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় সকল নেতাগণ সাহায্য এবং পুনর্বাসনের কাজে মনোযোগ দেয়ার জন্য নির্বাচন আরো পিছিয়ে দেবার জন্য আবেদন জানান। নির্বাচন অভিযান স্থগিত করার নানা অসুবিধা থাকলেও পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধান প্রধান নেতৃবৃন্দ নির্বাচন স্থগিত করায় তাদের সম্মতি প্রকাশ্যভাবে ঘোষণা করেন। শেখ মুজিবুর রহমান কিছুকাল একেবারে নীরব থাকার পর, প্রস্তাবিত স্থগিতের বিরুদ্ধে শুধু যে প্রতিবাদ জানালেন তাই নয়, কেন্দ্রীয় সরকারকে তীব্র আক্রমণ করে বললেন – পূর্ব পাকিস্তান জনগণের আশা-আকাঙ্খা বাস্তব রূপায়ণের জন্য আরো লক্ষ লক্ষ জীবন উৎসর্গ করা হবে।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচন স্থগিত করলেন না। ১৯৭০ সালের ৩রা ডিসেম্বর এক ভাষণে তিনি বলেন – “এই সরকারের উদ্দেশ্য ও আন্তরিকতা নিয়ে অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করাই আমাদের লক্ষ্য আর সে লক্ষ্যে আমরা অটল থাকবো”।
সেই একই ভাষণে তিনি জোর দিয়ে বলেন যে তিনি বরাবরই বলে এসেছেন যে শাসনতন্ত্র একটা সাধারণ আইন নয় বরং “একসঙ্গে বসবাস করা একটা চুক্তি”। আর সেইজন্যই শাসনতন্ত্রের প্রশ্নে মতৈক্য বিশেষ প্রয়োজন। তিনি বলেন, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের এবং বিশেষ করে রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দকে আমি এ কথাই বলতে চাই যে, তারা তাদের নির্বাচন ও জাতীয় পরিষদের প্রথম অধিবেশনের অন্তবর্তী সময় বেশ কাজে লাগাতে পারেন। তারা সকলে একত্রিত হয়ে আমাদের ভবিষ্যত শাসনতন্ত্রের প্রধান বিধানগুলোর ব্যাপারে একমত হতে পারেন। এজন্য কিছুটা আদান-প্রদান দরকার, দরকার পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস। আমাদের জাতীয় ইতিহাসের এই বিশেষ যুগসন্ধিক্ষণের গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয়তার বিষয় উপলদ্ধি করারও দরকার”।
জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনগুলো অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে* জাতীয় পরিষদের ভোটে দুটি রাজনৈতিক দল প্রধান হয়ে দেখা দেয়। তাদের একটি হচ্ছে আওয়ামী লীগ, যে ১৬৭টি আসন লাভ করে। অন্যটি হচ্ছে পাকিস্তান পিপলস পার্টি, যে ৮৫টি আসন লাভ করে। দুটি দলই
*জাতীয় পরিষদের ৯ টি এবং প্রাদেশিক পরিষদের ২১ টি ঘুর্ণি উপদ্রুত নির্বাচনী এলাকার নির্বাচন এক মাস পর অর্থাৎ ১৯৭১ সালের জানুয়ারী মাসে অনুষ্ঠিত হয়
সংগঠনের দিক থেকে আঞ্চলিক। আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিরা সবাই পূর্ব পাকিস্তানী এবং পিপিপি’র সকলেই পশ্চিম পাকিস্তানী।
নির্বাচনের শেষে আশা করা হয়েছিল যে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন শুরু হওয়ার আগেই আইনগত কাঠামো আদেশে একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়নের ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলি নিজেদের মধ্যে একটা সমঝোতায় এসে পৌঁছুবেন। আওয়ামী লীগ জোর দিয়ে একথাটাই বোঝাতে চাইছিলো যে এক পাকিস্তান কাঠামোর বাইরে ৬ দফায় কোন কিছুর পরিকল্পনা করা হয়নি। প্রেসিডেন্টকেও তারা এই ধারণা দিয়েছিলো। ১৯৭১ সালে ২৮শে জুনের বেতার ভাষণে প্রেসিডেন্ট বলেন: “আমাদের আলাপ আলোচনা চলাকালে আমি যখন মুজিবুর রহমানকে আওয়ামী লীগের ৬ দফা সম্বন্ধে প্রশ্ন করেছিলাম তিনি আমার কাছে স্বীকার করেছিলেন যে সেগুলোর রদবদল সম্ভব। তিনি পরিষ্কার বলেছিলেন যে, শাসনতন্ত্রের প্রধান প্রধান বিধানগুলো পরিষদের বাইরে ছোট ছোট বৈঠকে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো মীমাংসা করবেন”। পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দলের নেতা মি: ভুট্টো সমেত, পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে একটা সমঝোতায় পৌঁছুনোর জন্য ঢাকায় যান। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ফলপ্রসু শাসনতন্ত্র সংক্রান্ত আলাপ-আলোচনার জন্যই পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টও বেশ কয়েকবার পূর্ব পাকিস্তান সফরে যান। তিনি শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের ভবিষ্যত প্রধানমন্ত্রী বলে প্রকাশ্যভাবে উল্লেখ করেন। শেখ মুজিবুর রহমানকে পশ্চিম পাকিস্তান সফর করার জন্য কয়েকবার আমন্ত্রণ জানানো হয়। কিন্তু তিনি সে আমন্ত্রণ গ্রহণ করেননি। তিনি ৬ দফা সম্বন্ধেও আলাপ-আলোচনা করতে অস্বীকার করেন। তিনি বলেন যে, ৬ দফা এখন জনসাধারণের সম্পত্তি এবং তার রদবদল করা সম্ভব নয়।
নির্বাচন শেষ হওয়ার পরই আওয়ামী লীগের ভোল সম্পূর্ণরূপে পাল্টে গেলো। ১৯৮১ সালের ৭ই জানুয়ারির প্রকাশিত “অটোয়া, গ্লোব ও মেল” পত্রিকার খবরে প্রকাশ: “মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেছেন যে প্রয়োজন হলে আমি বিপ্লবের আহ্বান জানাবো”। ১৯৭১ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি, “ব্যাঙ্কক পোষ্ট”-এর এক খবরে জানা যায় “আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন যে ৩১৩টি আসনবিশিষ্ট জাতীয় পরিষদের মধ্যে তাঁর দলটির স্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। যদি পশ্চিম পাকিস্তান তার দলের ৬ দফা কার্যসূচী পুরোপুরি মেনে না নেয়, তাহলে তিনি একাই শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করবেন।
১৯৭১ সালের ১৩ই ফেব্রুয়ারি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করা হয়। এতে বলা হয় যে আগামী ৩রা মার্চ ঢাকায় অধিবেশন শুরু হবে। ১৯৭১ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান পিপল্স পার্টির চেয়ারম্যান ঘোষণা করেন যে, “সংখ্যাগরিষ্ট দলের কাছ থেকে কিছুটা পারস্পরিক আদান-প্রদানের” আশ্বাস না পেলে তাঁর দল অধিবেশনে যোগদান করবে না।
তিনি আরো বলেন: “আমার মনে হয় আমরা এমন কিছু করতে পারি যা আমাদের উভয়কেই খুশী করবে। কিন্তু যে শাসনতন্ত্র ইতিমধ্যেই আওয়ামী লীগ প্রণয়ন করে ফেলেছে এবং যে শাসনতন্ত্রের কোথাও এক চুল পরিমাণ কোন অদলবদল করা চলবে না, সেই শাসনতন্ত্রকে শুধু মেনে নেওয়ার জন্যই যদি আমাদের ঢাকায় যেতে বলা হয়, তাহলে আপনারা আমাদের ঢাকায় দেখবেন না”। ১৯৭১ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান বলেন- “আমাদের ভূমিকা অত্যন্ত পরিষ্কার। ৬ দফা ভিত্তি করেই শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করা হবে”।
পাঁচটি ফেডারেটিং ইউনিট সমন্বিত পাকিস্তান ফেডারেশনের জন্য জাতীয় পরিষদ একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করবে। কোন ইউনিটের পক্ষে শাসনতন্ত্রটি গ্রহণযোগ্য করতে হলে শাসনতন্ত্র প্রণয়নের মূল নীতিগুলোর ব্যাপারে সব ইউনিটের মধ্যে মতৈক্যের একটা ব্যাপক ভিত্তি থাকা দরকার।
পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা সৃষ্টি হওয়ার ফলে, এমন এক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে যে, রাজনৈতিক দলগুলো যদি কোন সমঝোতায় না আসেন, তাহলে জাতীয় পরিষদের পক্ষে কোন শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করা সম্ভব হবে না এবং জাতীয় পরিষদ বাতিল হয়ে যাবে। আর তাহলে ভোটদাতাদের আশা-আকাঙ্খা ও ক্ষমতা হস্তান্তরের সুপরিকল্পিত কার্যসূচী উভয়ই নিস্ফল হয়ে যাবে।
১৯৭১ সালের ১লা মার্চ প্রেসিডেন্ট একটি বিবৃতি দেন। সে বিবৃতিতে তিনি বলেন, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দের রাজনৈতিক মোকাবিলা সারাদেশের উপর একটা বিষাদের ছায়া ফেলেছে। তিনি আরো বলেন যে, “সংক্ষেপে পরিস্থিতিটা এই যে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধান দলটি এবং অন্যান্য কয়েকটি রাজনৈতিক দল ১৯৭১ সালের ৩রা মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠিত জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদান করার ইচ্ছে নেই বলে ঘোষণা করেছেন। এর মধ্যে আবার হিন্দুস্থান যে উত্তেজনাপূর্ব পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে তা গোটা ব্যাপারটাকে আরো জটিল করে তুলেছে। সে জন্য আমি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বানের তারিখ পিছিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি”।
“আমি বার বার বলেছি যে, শাসনতন্ত্র একটা সাধারণ আইন নয় বরং এক সঙ্গে বসবাস করার একটা চুক্তি। সুতরাং সুষ্ঠু ও প্রয়োগযোগ্য একটি শাসনতন্ত্রের জন্য যা প্রয়োজন তা হচ্ছে- শাসনতন্ত্র প্রণয়নে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের যথাযথ পরিমাণে অংশগ্রহণের উপলদ্ধি”।
জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার সাথে পরিষ্কারভাবে আশ্বাসও দেওয়া হলো যে, শাসনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য পূর্ব উল্লেখিত পরিস্থিতি অনুকূল হলেই জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকা হবে। ক্ষমতা হস্তান্তরই আমাদের চরম লক্ষ্য- আর তা সবকিছুর উর্ধ্বে।
শেখ মুজিবুর রহমান এর জবাব দিলেন সাধারণ ধর্মঘট আহ্বান করে। ১৯৭১ সালের ২রা মার্চের বিবৃতিতে তিনি বলেন- “এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে সরকারী কর্মচারীসহ, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বাঙালীর পবিত্র কর্তব্য হচ্ছে- গণবিরোধী শক্তির সঙ্গে সহযোগিতা না করা। অধিকন্তু তাদের উচিত সবটুকু শক্তি দিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দেওয়া”।
আওয়ামী লীগের ধর্মঘটের আহ্বান ও ভীতি প্রদর্শনের অভিযান সারা পূর্ব পাকিস্তানের স্বাভাবিক জীবনকে পঙ্গু করে দিলো। আইন ও শৃঙ্খলার দ্রুত অবনতি ঘটতে লাগলো। (এসব ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ এই শ্বেতপত্রের তৃতীয় অধ্যায়ে পাওয়া যাবে)
শাসনতান্ত্রিক সঙ্কটের সমাধান করার উদ্দেশ্যে, ১৯৭১ সালের ৩রা মার্চ- প্রেসিডেন্ট জাতীয় পরিষদের পার্লামেন্টারী গ্রুপের ১২ জন নির্বাচিত সদস্যকে ১৯৭১ সালের ১০ই মার্চ ঢাকায় মিলিত হবার আমন্ত্রণ জানালেন। সে সম্মেলনে যেসব নেতৃবৃন্দকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল তাঁরা হচ্ছেনঃ
১. শেখ মুজিবুর রহমান (আওয়ামী লীগ)।
২. জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো (পাকিস্তান পিপলস পার্টি)।
৩. খান আবদুল কাইয়ুম খান (পাকিস্তান মুসলিম লীগ)।
৪. জনাব নুরুল আমীন (পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি)।
৫. মিয়া মমতাজ দৌলতানা (কাউন্সিল মুসলিম লীগ)।
৬. খান আবদুল ওয়ালী খান (ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি)।
৭. মওলানা মুফতী আহমদ (জমিয়াত-উল-উলামা-ইসলাম)।
৮. মওলানা শাহ আহমদ নূরানী (জামিয়াত-উল-উলামা-ই-পাকিস্তান)।
৯. জনাব আবদুল গফুর আহমদ (জামাত-ই-ইসলামী)।
১০. জনাব মোহাম্মদ জামাল কোরেজা (পাকিস্তান মুসলীম লীগ – কনভেনশন)।
১১. মেজর জেনারেল জামাল দার (সীমান্ত এলাকার)।
১২. মালিক জাহাঙ্গীর খান প্রতিনিধি।
প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে ঘোষণায় আরো বলা হয়- “সম্মেলনের পর সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে বসা কেন যে সম্ভব হবে না প্রেসিডেন্ট তার কারণ দেখছেন না”।
শেখ মুজিবুর রহমান একই দিন সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্টের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যানের কথা ঘোষণা করেন।
সারা পূর্ব পাকিস্তানে অরাজকতা বৃদ্ধি এবং জান-মালের বিপুল ক্ষতি সাধিত হতে থাকে। শেখ মুজিবুর রহমান “সহিংস অসহযোগ আন্দোলন” সাফল্যমন্ডিত করার জন্যে বিভিন্ন নির্দেশ জারী করা শুরু করেন। তিনি খাজনা-বন্ধ অভিযানের কথাও ঘোষণা করেন।
১৯৭১ সালের ৬ই মার্চ তারিখে জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত বেতার ভাষণে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেন যে, জাতীয় পরিষদের উদ্বোধনী অধিবেশন ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চে অনুষ্ঠিত হবে। ব্যাপক ঐকমত্য ছাড়া পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র প্রণীত হলে তার কর্মক্ষমতা সম্পর্কে যারা সন্দেহ পোষণ করেন তাঁদের উদ্দেশ্যে প্রেসিডেন্ট বলেন, “আমি এ কথা পরিষ্কার বলে দিতে চাই যে, পরে কি ঘটবে তাতে কিছু যায় আসেনা কিন্তু পাকিস্তান সশস্ত্রবাহিনী যতদিন আমার কমান্ডে আছে এবং যতদিন আমি রাষ্ট্রপ্রধান আছি ততদিন আমি পাকিস্তানের পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে এ দেশ রক্ষা করার দায়িত্ব আমার রয়েছে। দেশবাসী আমার কাছ থেকে তা আশা করে এবং আমি তাদের নিরাশা করবো না।
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ তারিখে ঢাকায় এক জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর চার দফা দাবী পেশ করেন এবং তা আওয়ামী লীগ কর্তৃক ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে যোগদানের প্রশ্ন বিবেচনার পূর্বশর্ত হিসেবে আরোপ করেন।
বিদেশী পত্র-পত্রিকায় ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মার্চ মাসে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি সম্পর্কে যে সব খবর বেরিয়েছে তাতে তার একটা পরিষ্কার চিত্র পাওয়া যায়। ২৩শে ফেব্রুয়ারিতে “লন্ডন টাইমস” লিখেছেন, শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত বিবৃতিতে “পূর্ব পাকিস্তানে”র পরিবর্তে “বাঙালী” জাতীর কথা উল্লেখ করেন। “লিভারপুল ডেইলি পোষ্ট” ১৯৭১ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় লিখেছেন “হোয়াইট হলে এখন আশঙ্কা করা হচ্ছে যে, পাকিস্তান দ্বিখন্ডিত হয়ে যেতে পারে অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান নিজেকে স্বাধীন বাঙালী মুসলিম প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করবে। আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিব জাতীয় পরিষদে ৩০০টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি লাভ করে এখন আর পূর্ব পাকিস্তানের কথা বলছেন না, বলছেন বাঙলা প্রজাতন্ত্রের কথা। হোয়াইট হলে এটা অনুধাবন করা হচ্ছে যে, ব্রিটিশ সরকার একটি কমনওয়েলথভুক্ত দেশবিভক্তির মারাত্মক সম্ভাবনার মুখোমুখি হচ্ছেন”।
“ওয়াশিংটন পোষ্ট” ১৯৭১ সালের ৩রা মার্চ তারিখে শেখ মুজিবর রহমানের ২রা মার্চের সাংবাদিক সম্মেলনের খবর প্রকাশ করেন। পত্রিকাটি তাতে লিখেছেন “আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকায় তাড়াহুড়ো করে এক সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে বলেন, আওয়ামী লীগ মার্চ মাসের ৭ তারিখে একটি জনসভা অনুষ্ঠান করবে এবং এই সভায় তিনি বাংলার জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার অর্জনের কর্মসূচী প্রদান করবেন। তিনি স্বাধীনতা দাবী করবেন কিনা একথা জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন “অপেক্ষা করুন”। এমন কি এর আগেও ১৯৭০ সারের ২৭ নভেম্বর তারিখে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন “স্বাধীনতা, না এক্ষুণি নয়”।
লন্ডনের “ডেইলি টেলিগ্রাফ” ১৯৭১ সালের ৯ মার্চ সংখ্যায় লিখলেন, “শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা এক রকম ঘোষণাই করেছেন, ২৫শে মার্চ জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে যোগদানের পূর্বশর্ত হিসেবে প্রদত্ত ৪ দফা দাবীর মধ্যেই এ কথা লুক্কায়িত রয়েছে, কাজেই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পারেন না এসব দাবী পূরণ করতে। আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিব তাঁর আন্দোলনকে “স্বাধীনতার আন্দোলন” বলে অভিহিত করে জাতীয় পরিষদে সহযোগিতার জন্য বিভিন্ন শর্ত আরোপ করেন যা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান মেনে নিতে পারেন না”। একইদিনে “ডেইলি টেলিগ্রাফ” এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলেন, “আমরা ইতিমধ্যেই পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানের সম্ভাব্য নামকরণ শুনছি যা “বাংলাদেশ” কিংবা “বঙ্গভূমি” হতে পারে। এর পতাকাও বানানো হয়ে গেছে।
১৯৭১ সালের ১৩ই মার্চে “লন্ডন ইকোনোমিস্ট” লিখেছেন, প্রেসিডেন্ট কর্তৃক ২৫শে মার্চ তারিখে গণপরিষদের অধিবেশন আহ্বানের জবাবে তিনি (শেখ মুজিব) চারটি শর্ত আরোপ করেন যা তাঁর এবং আওয়ামী লীগের অধিবেশনে যোগদানের পূর্বেই পূরণ করতে হবে। এর মধ্যে দুটি শর্ত যেমন, “অবিলম্বে সামরিক আইন প্রত্যাহার” এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর” কার্যত প্রেসিডেন্ট কর্তৃক মেনে নেয়া অসম্ভব। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এর পরিস্থিতির একটা নিষ্পত্তি করার উদ্দেশ্যে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলোচনায় মিলিত হবার জন্যে (যেটা হয়তো তাঁর শেষ বৈঠকও হতে পারে) খুব শিঘঘিরই ঢাকা যাচ্ছেন”।
১৯৭১ সালের ১৫ই মার্চ অর্থাৎ যেদিন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগের সঙ্গে শাসনতান্ত্রিক ব্যাপারে আরো আলাপ-আলোচনার জন্যে ঢাকা গমন করলেন সেদিন “টাইম” সাময়িকী নিউইয়র্ক থেকে লিখলেন, আসন্ন বিভক্তির (পাকিস্তানকে দুটি পৃথক রাষ্ট্রে পরিণতকরণ) পশ্চাতে যে মানবটি রয়েছেন তিনি হচ্ছেন শেখ মুজিবুর রহমান (মুজিব)। গত সপ্তাহে ঢাকায় শেখ মুজিব “টাইম”-এর সংবাদদাতা ডন কগিনকে বলেন, বর্তমানে পাকিস্তানের মৃত্যু হয়েছে, সমঝোতার আর কোন আশা নেই। তিনি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্যে পৃথক পৃথক শাসনতন্ত্র প্রণয়নের কথা বলেন এবং জানান যে তার অনুগামীরা কেন্দ্রীয় সরকারের কর দিতে অস্বীকার করছে যা কিনা পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত। মনে হচ্ছে তিনি তাঁর ভাষায় ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা’ ঘোষণার দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছেন।
এর দুদিন আগে পূর্ব পাকিস্তানের এই নেতা পশ্চিম পাকিস্তানীদের সম্পর্কে বলেন, “আমি তাদেরকে পঙ্গু করে দেব এবং তাদেরকে নতি স্বীকার করতে বাধ্য করবো”। এই ধরণের একটি বিবৃতির পর সোজাসুজি স্বাধীনতা ঘোষণা আর অতি নাটকীয় কিছু নয়।
.
.
দ্বিতীয় অধ্যায়
.
সংকট ঘনীভূত হলো
১৯৭১ সালের ১৫ই মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা ছিলো এইঃ
(১) আওয়ামী লীগের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কার্যকলাপের দরুন আইন-শৃঙ্খলা সম্পূর্নভাবে বিশৃংখল হয়ে পড়েছিলো।
(২) ব্যাপক অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট ছাড়াও, আওয়ামী লীগের হিংসাত্মক কার্যকলাপ আরও বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়ালো। ভিন্নমত পোষণকারীদের তারা আক্রমণ করলো। ৩রা মার্চ চট্রগ্রামে ও ৫ই মার্চ খুলনায় আক্রমণের ফলে শত শত লোক হতাহত হলো।
(৩) শেখ মুজিবুর রহমান কেন্দ্রীয় সরকার ও প্রাদেশিক সরকারকে প্রকাশ্যভাবে চ্যালেঞ্জ করে, একের পর এক এমন কতকগুলো নির্দেশ জারী করলেন, যার ফলে প্রশাসন, যোগাযোগ ও ব্যবসা-বানিজ্য ব্যাহত হলো।
(৪) পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ব ও পশ্চিম উভয় সীমান্তে হিন্দুস্তানী সৈন্য সমাবেশ বৃদ্ধি পেলো।
এই শ্বেতপত্রের পরবর্তী অধ্যায়ে এই ঘটনাবলীর বিশদ বিবরণ দেওয়া হলো। শেখ মুজিবুর রহমান ৭ই মার্চের ৪ দফা দাবী তার বিচ্ছিন্নতার স্পষ্ট অভিপ্রায়কে আরও স্পষ্টতর করলো। তা সত্ত্বেও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আর একদফা শাসনতান্ত্রিক আলোচনা জন্যে ১৫ই মার্চ ঢাকা গেলেন।
শেখ মুজিবের ৭ই মার্চের ৪ দফা দাবী ছিলো এইঃ
(১) অবিলম্বে সামরিক শাসন প্রত্যাহার করা;
(২) অবিলম্বে সব সৈন্যবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়া;
(৩) প্রাণহানি সম্পর্কে তদন্ত, এবং
(৪) জনগনের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তর (জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের পূর্বেই)।
এখানে উল্লেখযোগ্য যে আওয়ামী লীগ নেতা কিন্তু এমন কোন আশ্বাস দেননি যে এই দাবীগুলো মেনে নিলেই তিনি ২৫শে মার্চ তারিখে প্রেসিডেন্ট কর্তৃক আহূত জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে যোগ দেবেন। এক বিবৃতিতে তিনি বলেনঃ এই শর্তগুলো গ্রহণ করা হলে, তখন আমরা বিবেচনা করে দেখবো যে আমরা অধিবেশনে যোগ দেবো কিনা’’।
১৬ই মার্চ ১৯৭১
শেখ মুজিবুর রহমান প্রেসিডেন্টের সংগে সাক্ষাৎ করলেন এবং তার ৪ দফা দাবী পেশ করলেন। এরপর তিনি আওয়ামী লীগ “হাই কমান্ড” – এর সঙ্গে এক বৈঠকে মিলিত হলেন। সেইদিনই তিনি একটি বিবৃতি দিলেন। তাতে “পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিটি গৃহকে এক একটি দুর্গে পরিণত করার জন্য” পুনরায় আহ্বান জানানো হলো।
১৭ই মার্চ ১৯৭১
প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দ্বিতীয় দফা বৈঠকে মিলিত হলেন। প্রেসিডেন্ট বললেন, যথাসম্ভব শীঘ্র জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের মত তিনি সর্বদাই পোষণ করে আসছেন।
সেইদিন সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগের একটি টীম প্রেসিডেন্টের সাহায্যকারীদের সংগে সাক্ষাৎ করলেন। আওয়ামী লীগের এই টীমে ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, জনাব তাজউদ্দীন আহমদ ও ডক্টর কামাল হোসেন। ক্ষমতা হস্তান্তরের পদ্ধতি এই বৈঠকে আলোচিত হলো। এতে একটি সামরিক আইন বিধির খসড়া প্রস্তুত করা হলো। এই আইন বিধিতে ব্যবস্থা করা হলো যে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মধ্য থেকে সদস্য বাছাই করে একটি উজীর-সভা গঠিত হবে। এই উজীর-সভা প্রাদেশিক গভর্নরকে তাঁর কর্তব্যপালনে সাহায্য করবেন এবং পরামর্শ দেবেন। এই সামরিক আইন বিধিতে এমন ব্যবস্থাও রাখা হলো যে সামরিক আইন কার্যকারী থাকবে অন্তরাল থেকে।
এই সময়ে ‘খ’ অঞ্চলের সামরিক আইন প্রশাসক একটি আদেশ জারী করলেন। এই আদেশ বলে একটি তদন্ত কমিশন নিয়োগ করা হলো। ১৯৭১ সালের ১ লা মার্চ তারিখে কোন পরিস্থিতিতে বেসামরিক কর্তৃপক্ষের সাহায্যের জন্য সৈন্যবাহিনী তলব করা হয়েছিল- সে সম্পর্কে তদন্ত করার জন্য এই কমিশন নিয়োগ করা হলো। শেখ মুজিবের ৪ দফা দাবীর অন্তর্গত তৃতীয় দফার পরিপ্রেক্ষিতে এই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলো।
সামরিক আইন বিধিতে ব্যবস্থা করা হলো যে পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি কর্তৃক মনোনীত একজন বিচারপতি এই কমিশনের প্রধান হবেন। এতে ৪ জন সদস্য থাকবেন। এই ৪ জন সদস্য নেওয়া হবে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস, পাকিস্তান পুলিশ সার্ভিস, পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও পূর্ব পাকিস্তান রাইফেল বাহিনী থেকে।
১৮ই মার্চ, ১৯৭১
শেখ মুজিব তদন্ত কমিশন প্রত্যাখ্যান করে একটি বিবৃতি দিলেন। এই তদন্ত কমিশন ছিলো তাঁর ৭ই মার্চের ৪ দফা দাবীর তৃতীয় দফা। শেখ মুজিব বললেনঃ “ আমরা এ ধরনের একটি কমিশনকে গ্রহণ করতে পারি না। বাংলাদেশের লোকেরা এমন একটি কমিশনের সঙ্গে সহযোগিতা করবে না এবং এর সদস্যও হবে না”। তিনি আরও বললেনঃ “ একটি সামরিক আইনবিধির অধীনে এই কমিশনের নিয়োগ, এবং সামরিক কর্তৃপক্ষের নিকট কমিশনের রিপোর্ট পেশ করার বিধান- দুটোই আপত্তিজনক”।
১৯শে মার্চ, ১৯৭১
শেখ মুজিবুর রহমান বেলা ১১টায় প্রেসিডেন্টের সংগে সাক্ষাৎ করলেন। তিনি পীড়াপীড়ি করলেন যে খসড়া সামরিক আইন বিধি চালু থাকাকালীন অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের হাতে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা থাকতে হবে এবং কেন্দ্র ও প্রদেশে থাকবে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিনিধিত্ব মূলক সরকার। তিনি সামরিক আইন সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাহার করারও দাবী জানালেন।
সেইদিন সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট ও শেখ মুজিবুর রহমানের সহকারীদের মধ্যে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হলো। আওয়ামী লীগ টীমকে জানানো হলো যে ১৯৬৯ সালের ২৫শে মার্চের সামরিক আইন ঘোষনা যদি বাতিল করা হয় তাহলে যে দলিলের বলে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তার কোন আইনগত বৈধতা থাকবে না। সুতরাং দেশে সৃষ্টি হবে একটি শাসনতান্ত্রিক শূন্যতা। একথাও ব্যাখ্যা করা হলো যে জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান প্রধান সামরিক শাসনকর্তার অধিকার বলেই প্রেসিডেন্টের পদেও অধিষ্ঠিত রয়েছেন।
জনাব তাজউদ্দিন আহমদ বললেন যে এগুলো রাজনৈতিক বিষয় এবং “রাজনৈতিক পদ্ধতিতেই” এগুলোর সমাধান হওয়া উচিত। ডক্টর কামাল হোসেন প্রস্তাব দিলেন যে জেনারেল এ এম, ইয়াহিয়া খান প্রধান সামরিক শাসনকর্তার ক্ষমতাবলী ত্যাগ করে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের পদবী ও ক্ষমতাবলী গ্রহণ করতে পারেন।
এই বৈঠকের পর, আওয়ামী লীগের দাবী আইনগতভাবে যথাসম্ভব পুরনের উদ্দেশ্যে প্রেসিডেন্টের টীম অন্য একটি সামরিক আইন বিধির খসড়া প্রণয়ন করলেন। এই সামরিক আইন বিধিতে নিন্মলিখিত বিধানগুলো ছিলোঃ
(১) কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক উজীর-সভা গঠন।
(২) জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সমূহকে ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রের অধীনে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা দান।
(৩) সামরিক আইন প্রশাসকের পদ ও সামরিক বিচারালয় ইত্যাদির বিলোপ সাধন।
কিন্তু আইনগত শূন্যতা যাতে ঘটতে না পারে, সে জন্য প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদ বহাল থাকবে। শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা দূরীকরণের প্রচেষ্টায় প্রেসিডেন্ট ও শেখ মুজিবুর রহমানের সংগে সাক্ষাতের জন্য তিনজন পশ্চিম পাকিস্তানী নেতা সেইদিন ঢাকা পৌঁছলেন। এই নেতৃবৃন্দ হচ্ছেন- কাউন্সিল মুসলিম লীগের মিয়া মমতাজ মোহাম্মদ খান দৌলতানা ও সর্দার শওকত হায়াত খান এবং জমিয়তে উলেমায়ে ইসলামের মওলানা মুফতী মাহমুদ।
২০শে মার্চ, ১৯৭১
আওয়ামী লীগ জয়দেবপুর সামরিক সরবরাহ বহনকারী একটি কনভয়কে বাধা দিয়ে এবং চট্রগ্রামে পাকিস্তানী জাহাজ “এম ভি, সোয়াভ’ এর চলাচল ব্যাহত করে যে সাংঘাতিক উস্কানীকে প্রশ্রয় দিলো- তা সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট তাঁদের সংগে রাজনৈতিক আলোচনা অব্যাহত রাখলেন। বেলা ১০ টায় প্রেসিডেন্টের সংগে শেখ মুজিবুর রহমানের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হলো। প্রেসিডেন্টের সংগে ছিলেন তাঁর উপদেষ্টাবৃন্দ। শেখ মুজিবুর রহমানের সংগে ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, খন্দকার মুশতাক আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, জনাব তাজউদ্দিন আহমদ, জনাব এ,এইচ,এম, কামরুজ্জামান ও ডক্টর কামাল হোসেন।
প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানকে স্পষ্টভাবে জানালেন যে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের উদ্দেশ্যে কোন পরিকল্পনা নীতিগতভাবে গৃহীত হওয়ার পূর্বে সে বিষয়ে সকল রাজনৈতিক নেতার দ্ব্যর্থহীন ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়া একান্ত প্রয়োজন। তাহলেই তিনি কোন পরিকল্পনার ব্যাপারে নীতিগতভাবে সম্মত হওয়ার কথা বিবেচনা করতে পারেন।
প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টারা মত প্রকাশ করলেন যে, কোন দলিলের বলে সামরিক আইনের সম্পূর্ন বিলোপ সাধন করে জেনারেল এ,এম, ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের পদবী ও ক্ষমতাবলী গ্রহণ করলে- সে দলিলটির কোন আইনগত বৈধতা থাকবে না। প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিব ও তাঁর সহকারীদের কাছে ব্যাখ্যা করলেন যে, প্রস্তাবিত ঘোষনাটির পেছনে কোন আইনগত বৈধতা থাকবে কিনা তা আইন বিশেষজ্ঞদের দ্বারা পরীক্ষা করিয়ে নিতে হবে। আওয়ামী লীগ তাদের মতের সমর্থনে একজন শাসনতান্ত্রিক বিশেষজ্ঞকে (জনাব এ কে ব্রোহী) পেশ করার ভার নিলেন। প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টাবৃন্দ ও শেখ মুজিবের সহকারীদের মধ্যে পরবর্তী আলোচনার জন্য নিন্মলিখিত নীতিগুলো গৃহীত হলোঃ
১. সামরিক আইন প্রত্যাহার করা হবে।
২. কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক উজীর-সভা গঠনের ব্যবস্থা করতে হবে।
৩. পূর্ব ও প্রাদেশিক পরিষদ সমূহের হাতে আইন প্রণয়নের ক্ষমতাও থাকতে হবে।
৪. পূর্বপাকিস্তানের ভৌগলিক অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে, অন্যান্য প্রদেশের তুলনায় পূর্ব পাকিস্তানকে অধিকতর স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে।
৫. এই সব ব্যবস্থার বাস্তবায়নের পদ্ধতি সম্পর্কে আরও আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে।
একথা উল্লেখ করা হলো যে, যে দলিলটির দ্বারা এইসব ব্যবস্থার বাস্তবায়ন কার্যকরী করা হবে, সে দলিলটি জাতীয় পরিষদ কর্তৃক অনুমোদিত না হওয়া পর্যন্ত সামরিক আইন বলবত রাখতে হবে। এটা আইনগত প্রয়োজন। শেখ মুজিবুর রহমান এতে সম্মত হলেন না।
সেই দিন প্রেসিডেন্টের পক্ষ থেকে জারী করার উদ্দেশ্যে একটি ঘোষনার খসড়া প্রস্তুত করা হলো। প্রস্তাবিত দলিলটি যাতে একটি সামরিক আইনবিধির আকারে জারী না করা হয়, এটা আওয়ামী লীগের দাবী ছিলো। আওয়ামী লীগের এই দাবী পূরনের উদ্দেশ্যে প্রেসিডেন্টের ঘোষনার খসড়া প্রস্তুত করা হলো। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর সম্পর্কিত অন্যান্য গুরুতবপূর্ন বিষয়ের সমাধানের জন্যও খসড়া ঘোষনাটিকে একটি মৌখিক দলিল হিসেবে গণ্য করা হবে বলে সাব্যস্ত করা হলো। এই ধরনের একটি ঘোষনার কোন আইনগত বৈধতা থাকবে কিনা, এই মূল প্রশ্নটি আওয়ামী লীগের শাসনতান্ত্রিক বিশেষজ্ঞের সংগে আলোচনার পর নির্ধারন করা হবে বলে স্থির করা হলো।
সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ন আইনগত বৈধতাসূচক প্রশ্নটির সমাধানসাপেক্ষ, খসড়া ঘোষনার অন্তর্ভূক্ত প্রধান বিষয়গুলো ছিলঃ
(১) প্রাদেশিক উজীর-সভার সদস্য যেদিন শপথ গ্রহণ করবেন, সেইদিন থেকে ১৯৬৯ সালের ২৫শে মার্চের সামরিক আইন ঘোষনা বাতিল বলে গণ্য হবে।
(২) ঘোষনার জন্য প্রয়োজনীয় সংশোধনের পর, ১৯৬৯ সালের ৪ঠা এপ্রিলের অস্থায়ী শাসনতন্ত্র আদেশ অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের জন্য পাকিস্তানের শাসনতন্ত্ররুপে গণ্য হবে।
(৩) ঘোষণা জারী হওয়ার অব্যবহিত পূর্বে যিনি প্রেসিডেন্টের পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন, অন্তর্বর্তীকালীন সময়েও তিনিই প্রেসিডেন্টের পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন।
(৪) প্রেসিডেন্ট হবেন রাষ্ট্রের প্রশাসনিক প্রধান। ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রের সংগে সামঞ্জস্যপূর্ন অস্থায়ী শাসনতন্ত্র আদেশের বিধানসমূহের আওতায় তিনি প্রেসিডেন্টের সমস্ত ক্ষমতা প্রয়োগ করবেন ও কর্তব্য পালন করবেন। ১৯৬২-এর শাসনতন্ত্রকে এরপর ‘প্রাক্তন শাসনতন্ত্র’ রূপে উল্লেখ করা হয়েছে।
(৫) পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলসমূহ থেকে সদস্য বাছাই করে একটি কেন্দ্রীয় উজির-সভা গঠন করা হবে।
(৬) প্রাক্তন শাসনতন্ত্রের অধীনে জাতীয় পরিষদের দায়িত্বসমূহ, আইন কাঠামো আদেশে উল্লিখিত জাতীয় পরিষদ কর্তৃক পালিত হবে।
(৭) প্রাক্তন শাসনতন্ত্রে সন্নিবিষ্ট তৃতীয় তফশীলে উল্লেখিত সমস্ত বিষয়ে আইন প্রণয়নের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা থাকবে কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের হাতে। তবে এ ব্যাপারে পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষেত্রে কিছু ব্যাতিক্রম থাকবে। এ সম্পর্কে সীমারেখা ও পরিবর্তন স্থির করা হবে। তৃতীয় তফশীলে আইন প্রনয়নে কেন্দ্রের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ও কেন্দ্রীয় বিষয় সমূহের তালিকা আছে।
(৮) প্রাক্তন শাসনতন্ত্রের অধীনে প্রাদেশিক পরিষদের দায়িত্বসমূহ, আইন কাঠামো আদেশের অধীনে নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যগণ কর্তৃক পালিত হবে ও পরে পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষেত্রে জাতীয় পরিষদ কর্তৃক আইন প্রণয়নের ব্যাপারে যে ব্যাতিক্রমের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, সেই অনুসারে, যেসব বিষয়ে আইন প্রণয়নে জাতীয় পরিষদের ওপর সীমারেখা আরোপ করা হবে সেই সব বিষয়ে আইন প্রণয়নের অতিরিক্ত ক্ষমতা থাকবে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের হাতে।
(৯) প্রেসিডেন্ট প্রদেশের পার্লামেন্টারী গ্রুপসমূহের নেতাদের সঙ্গে পরামর্শক্রমে প্রাদেশিক গভর্ণর নিযুক্ত করবেন। প্রেসিডেন্ট যতদিন গভর্ণরের প্রতি তুষ্ট থাকবেন, ততোদিন পর্যন্ত গভর্ণর তাঁর পদে বহাল থাকবেন।
(১০) প্রত্যেক প্রদেশে গভর্নরকে তাঁর কর্তব্য পালনে সাহায্য করার জন্য একটি উজীর সভা থাকবে এবং মুখ্য-উজীর এই উজীর সভার প্রধান থাকবেন। অবশ্য প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য কিংবা জাতীয় পরিষদের সদস্য পদে নির্বাচিত কোন ব্যাক্তি ছাড়া কাউকেই উজীর নিযুক্ত করা যাবে না।
(১১) ঘোষনা প্রচারের ৭ দিনের মধ্যে ঢাকা ও ইসলামাবাদে একটি করে দুটি কমিটি গঠন করা হবে। কমিটি দুটো পাকিস্তানের প্রত্যেক প্রদেশের জন্য যেসব বিশেষ ধারার প্রয়োজন রয়েছে তা তৈরী করবেন এবং এসব ধারা পরে জাতীয় পরিষদের তৈরী করা শাসনতন্ত্রের অন্তর্ভূক্ত করা হবে।
(১২) উপরোক্ত কমিটি দুটোর রিপোর্ট পাওয়ার পর প্রেসিডেন্ট পাকিস্তানের জন্য একটি শাসনতন্ত্র তৈরীর উদ্দেশ্য তাঁর বিবেচনামত উপযুক্ত তারিখ সময় ও স্থানে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকবেন।
(১৩) কোন প্রদেশের গভর্ণরের রিপোর্টের মাধ্যমে কিংবা অন্য কোন উপায়ে যখনই প্রেসিডেন্টের মনে হবে যে, এমন একটা পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে যে সেই প্রদেশের সরকারকে দিয়ে কাজ চালানো যাচ্ছে না প্রেসিডেন্ট এক ঘোষনার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট প্রদেশের কার্যনির্বাহী সরকারের সব কিংবা যে কোন ক্ষমতা নিজে গ্রহণ করতে পারবেন।
একই দিন (২০শে মার্চ, ১৯৭১) কাউন্সিল মুসলিম লীগ এবং জমিয়তে উলামার নেতারা শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে পৃথক পৃথক বৈঠকে মিলিত হন।
২১শে মার্চ, ১৯৭১
শেখ মুজিবুর রহমান জনাব তাজউদ্দীনকে সঙ্গে নিয়ে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে এক অনির্ধারিত বৈঠকে মিলিত হন। তিনি উল্লেখ করেন যে, কেন্দ্রীয় উজীর সভা গঠিত হোক এটা তিনি এখন আর চান না। উদ্দেশ্য ও বক্তব্য পেশের এই পরিবর্তন অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। আওয়ামী লীগ তাদের খসড়া ঘোষনার আইনগত বৈধতা প্রতিষ্ঠার জন্য শাসনতান্ত্রিক বিশেষজ্ঞ আনার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তাও কার্যকরী করতে ব্যর্থ হন।
প্রেসিডেন্টের আমন্ত্রণে পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জনাব জুলফিকার আলী ভূট্টো তাঁর সহকারীদের সঙ্গে নিয়ে ঢাকায় এলেন।
২২শে মার্চ, ১৯৭১
যদিও শেখ মুজিবুর রহমান ভুট্টোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনার জন্য মিলিত হতে প্রকাশ্যভাবে অস্বীকৃতি ঘোষনা করেন তবুও প্রেসিডেন্ট তাঁর সঙ্গে একটি যৌথ বৈঠক অনুষ্ঠানের জন্য উভয় নেতার উপর তাঁর প্রভাব খাটান। বৈঠক শেষে শেখ মুজিবুর রহমানের অনুরোধ ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন শুরু করার যে আদেশ প্রেসিডেন্ট দিয়েছিলেন তা বাতিল করা হয়। এটা সাব্যস্ত হয় যে, প্রস্তাবিত ঘোষনাকে আইনগত দিক থেকে বৈধ করার জন্য ১৯৭১ সালের ২ এপ্রিল জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকা যেতে পারে। কিন্তু আওয়ামী লীগ তা গ্রহণ করেননি।
একই দিন সন্ধ্যায় বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ঘোষনা করেন যে, সারা পাকিস্তানে ২৩শে মার্চ তারিখে যে পাকিস্তান দিবস পালন করা হয় তা এবার পূর্ব পাকিস্তানের ‘প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে পালিত হবে।
প্রেসিডেন্ট মিয়া মমতাজ মুহম্মদ খান দৌলতানা, সরদার শওকত হায়াৎ, মাওলানা মুফতি মাহমুদ, খান আবদুল ওয়ালী খান এবং মীর গৌস বক্স বিজেঞ্জোর সঙ্গেও মিলিত হন। তিনি তাঁদেরকে একটা রাজনৈতিক সমঝোতায় উপনীত হওয়ার চেষ্টা করার জন্য শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করতে বলেন।
এদিকে সংশোধিত খসড়া ঘোষনাটির বিভিন্ন বিষয় বিবেচনার কাজকে সহজতর করার উদ্দেশ্য ঘোষনাটি পূর্বাহ্নেই জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং জনাব তাজুদ্দিনের হাতে দেয়া হয়। বিকেল ৬টায় জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো তাঁর সহকারী জনাব মাহমুদ আলী কাসুরী, জনাব জে এ রহিম, ডক্টর মোবাশির হাসান, জনাব হাফিজ পীরজাদা এবং জনাব রফি রাজাকে নিয়ে প্রেসিডেন্টের সাহায্যকারীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পিপিপি প্রতিনিধিরা নিন্মোক্ত যুক্তিসমূহ পেশ করেনঃ
(১) সামরিক আইন প্রত্যাহারের পর জাতীয় পরিষদের অনুমোদন না থাকলে প্রস্তাবিত ঘোষনার পেছনে কোন আইনগত সমর্থন থাকবে না। সুতরাং তাঁরা প্রস্তাব করেন যে, হয় ঘোষনাটিকে জাতীয় পরিষদকে দিয়ে অনুমোদন করিয়ে নেয়া হোক কিংবা ঘোষনাটি প্রকাশ করা হোক কিন্তু জাতীয় পরিষদ কর্তৃক অনুমোদিত হওয়ার পর তা কার্যকরী করা হবে। অথবা বিক্লপ-মূলক ব্যবস্থা হিসেবে, জাতীয় পরিষদ কর্তৃক অনুমোদনের আগ পর্যন্ত ঘোষনাটিকে প্রয়োজনীয় আইনগত বৈধতা দেয়ার জন্য প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা অক্ষুন্ন রাখা হোক।
(২) পিপিপি মত প্রকাশ করেন যে, প্রয়োজনীয় আইনগত বৈধতা ছাড়া এই ঘোষনার কোন মূল্যই থাকবে না। এবং আওয়ামী লীগ একতরফা ভাবে স্বাধীনতা ঘোষনা করতে চাইলে এই ঘোষনা তার পরে একটি আইনগত বাধাও হবে না।
(৩) অবশেষে যখন জাতীয় পরিষদের যুক্ত অধিবেশন হবে তখন আওয়ামী লীগ কর্তৃক বেপরোয়াভাবে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রয়োগের সম্ভাবনা এড়ানোর উদ্দেশ্য পিপিপি প্রতিনিধিরা প্রস্তাব করেন যে, ঘোষনার এই ব্যবস্থা থাকতে হবে যে, আলাদা আলাদাভাবে দেশের দুই অংশের জাতীয় পরিষদ সদস্যদের বেশিরভাগ সদস্যের অনুমোদন ছাড়া কোন আইন কিংবা শাসনতন্ত্র জাতীয় পরিষদে পেশ করা যাবে না।
(৪) তাঁরা মনে করেন যে, ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রের তৃতীয় তালিকা পরিবর্তনের ক্ষমতা কেবল তালিকাটি সংশোধনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকা উচিত এবং তালিকার প্রতিটি বিষয়ই পরিবর্তনের ক্ষমতা থাকা উচিত নয়। দেশ রক্ষার মতো যে সব বিষয় কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রনে থাকবে বলে মতৈক্য হয়েছে সে সব বিষয়ে রদবদল করার ক্ষমতা থাকা উচিত নয়।
(৫) প্রাদেশিক গভর্ণরদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের “সঙ্গে পরামর্শ করে নয়” বরং কেবল তাদের “সুপারিশ অনুসারে” নিযুক্ত করতে হবে। কতিপয় ক্ষেত্রে প্রাদেশিক গভর্ণর নিজ বিবেচনা অনুসারে কাজ করতে পারবেন এই মর্মে যে ধারাটি রয়েছে তা সংশোধন করতে হবে কেননা তা প্রতিনিধিত্বমূলক সরকারের ধারনার পরিপন্থী।
(৬) পিপিপি জানতে চান ঘোষনা জারী করার পর LFO-র মর্যাদা কী হবে? এই জিজ্ঞাসার উদ্দেশ্য ছিল LFO-কে টিকিয়ে রাখা হবে কিনা তা জানা।
(৭) পরিশেষে, পিপিপি মনে করেন যে, প্রথমে একক পরিষদ হিসেবে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত এবং পরে দুটি কমিটি গঠিত হওয়া উচিত।
২৩শে মার্চ, ১৯৭১
২৩শে মার্চ তারিখে বিভিন্ন সশস্ত্র সমাবেশ এবং শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবনে বাংলাদেশ পতাকা উড়ানোসহ এই দিনের ঘটনাবলী অন্যত্র বর্ণনা করা হয়েছে।
বেলা ১১টা ৪৫ মিনিটের সময় প্রেসিডেন্টের সহকারীবৃন্দ এবং আওয়ামী লীগ টিমের মধ্যে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ডক্টর কামাল হোসেন আওয়ামী লীগের পক্ষে তাঁর তৈরী করা একটি খসড়া ঘোষণাপত্র পেশ করেন। আওয়ামী লীগ টিমকে বলা হয় যে, বর্ধিত উত্তেজনা এবং পরিস্থিতির চাপের পরিপ্রেক্ষিতে এবং পিপিপি ও জাতীয় পরিষদের অন্যান্য দলের সঙ্গে পরামর্শ করা প্রয়োজন বিধায় আগের খসড়া ঘোষণাপত্রের ভিত্তিতেই আলোচনার অগ্রগতি হওয়া উচিত। কিন্তু আওয়ামী লীগ টীম এ কথা মানতে অস্বীকার করেন। আওয়ামী লীগ টীমকে বলা হয় যে, তাঁরা ইচ্ছে করলে মুল খসড়াটিতে আরো কিছু যোগ করা কিংবা তাতে রদবদলের প্রস্তাব করতে পারেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ এ কথাও মেনে নেননি।
এই পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের খসড়াটি পরীক্ষা করে দেখা শুরু করা হলো এবং সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত আলোচনা স্থগিত করা হলো। তারপর একটি সান্ধ্য বৈঠক অনুষ্ঠিত হলো এবং আওয়ামী লীগের সঙ্গে নিচে বর্ণিত বিষয়সমূহ আলোচনা করা হলোঃ
(১) আইনগত বাধ্যবাধকতা হচ্ছে যে, এই ধরনের যে কোন ঘোষনা সামরিক আইন প্রত্যাহারের আগে জাতীয় পরিষদ কর্তৃক অনুমোদিত হওয়া উচিত।
(২) আওয়ামী লীগের খসড়ায় বলা হয় যে, একটি প্রদেশে গভর্ণরের শপথ গ্রহণের তারিখেই সেই প্রদেশ থেকে সামরিক আইন উঠে যাবে এবং ঘোষনার তারিখের পর ৭ দিন পার হলে সারা পাকিস্তান থেকে সামরিক আইন উঠে যাবে। স্মরণ রাখতে হবে যে, গভর্ণরকে বরখাস্ত করা যাবে না। আওয়ামী লীগকে বলা হয় যে, এতে প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে এবং সামরিক আইন যদি প্রত্যাহার করতে হয় তাহলে যে তারিখে সব প্রদেশের প্রাদেশিক উজীররা শপথ নেবেন সে তারিখে সামরিক আইন প্রত্যাহার করাটাই সঙ্গত হবে।
(৩) দেশের দুই অংশের জাতীয় পরিষদ সদস্যদের পৃথক পৃথক কমিটি গঠন-সংক্রান্ত যে ধারনাটি আগের ঘোষনার ছিল তা আওয়ামী লীগের নতুন খসড়ায় সংশোধন করে বলা হয়, “বাংলাদেশ রাজ্য এবং পশ্চিম পাকিস্তানের রাজ্যসমূহ থেকে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্যরা শপথ নেবেন এবং “বাংলাদেশ” রাজ্য ও পশ্চিম পাকিস্তানের রাজ্যসমূহের জন্য শাসনতন্ত্র তৈরীর উদ্দেশ্য তাদেরকে নিয়ে পৃথক পৃথক শাসনতান্ত্রিক কনভেনশন গঠন করা হবে।” আওয়ামী লীগ টীমকে বলা হয় যে, এর অর্থ হচ্ছে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদকে পশ্চিম পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ এবং পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ এবং পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ এই দুই জাতীয় পরিষদকে ভাগ করা এবং ফলতঃ তা বিচ্ছিন্নতার এক শাসনতান্ত্রিক ফর্মুলা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
(৪) আওয়ামী লীগের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলা হয় যে, জাতীয় পরিষদ সদস্যদের যে শপথ নেয়ার কথা ছিল তাঁরা তাও বদলেছেন। আইন কাঠামো আদেশ যার অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং যার অধীনে পরিষদের অধিবেশন ডাকার কথা তার ১২ নম্বর অনুচ্ছেদে পরিস্কারভাবে একটি শপথ দেয়া হয়েছে। শপথটি এইঃ
“আমি সর্বান্তকরণে শপথ করছি (বা, ঘোষনা করছি) যে, আমি পাকিস্তানের প্রতি সাত্যিকারভাবে বিশ্বস্ত ও অনুগত থাকবো এবং যেসব কর্তব্য সম্পাদনের ভার আমি নিতে যাচ্ছি তা আইন কাঠামো আদেশ, ১৯৭০-এর ধারা সমূহ ও এই আদেশে বর্নিত পরিষদের আইন-কানুন অনুসারে এবং সব সময়ই পাকিস্তানের অখন্ডতা সংহতি কল্যান ও সমৃদ্ধির প্রতি লক্ষ্য রেখে সততা, আমার সর্বোত্তম যোগ্যতা এবং বিশ্বস্ততার সঙ্গে পালন করবো।”
আওয়ামী লীগের খসড়ার ১৭ (৫) অনুচ্ছেদে যে শপথ দেয়া হয় তা এই ” আমি সর্বান্তকরনে শপথ (ঘোষনা) করছি যে আমি আইন বলে গঠিত পাকিস্তানের শাসনতন্ত্রের প্রতি বিশ্বস্ত ও সত্যিকারভাবে অনুগত থাকবো।”
(১) প্রেসিডেন্টের টীম আওয়ামী লীগের টীমের সঙ্গে তাদের খসড়ার একটি ধারার মারাত্মক তাৎপর্য নিয়ে আলোচনা করেন। এই ধারায় বলা হয় যে, পরিষদ “পাকিস্তান কনফডারেশন”-এর জন্য একটি শাসনতন্ত্র তৈরী করবেন। আওয়ামী লীগ টিমকে স্পষ্ট করে বলা হয় যে, কনফেডারেশনের মানে হচ্ছে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রসমূহের একটি জোট এবং এই কনফেডারেশনের ধারনা ‘আইন কাঠামো আদেশ’ এবং আওয়ামী লীগের “৬দফা”-র বিরোধী কারন, ” আইন কাঠামো আদেশ” এবং ৬ দফা দুটোতেই সুনির্দিষ্ট করে বলা হয়েছে যে, পাকিস্তান একটি ফেডারেল প্রজাতন্ত্র হবে।
(২) আওয়ামী লীগের খসড়ার ১৭ (৭) অনুচ্ছেদে বলা হয়, “প্রেসিডেন্টের কাছে শাসনতন্ত্র বিলটি পেশ করা হলে তিনি তা অনুমোদন করবেন এবং যেকোন অবস্থায় বিলটি পেশের তারিখের পর ৭ দিন অতিক্রান্ত হলেই মনে করা হবে যে প্রেসিডেন্ট তা অনুমোদন করেছেন।” আওয়ামী লীগ টীমের দৃষ্টি আকর্ষন করে বলা হয় যে এই ধারাটি আইন কাঠামো আদেশের পরিপন্থী এবং এতে করে LFO-তে যে ৫টি শাসনতান্ত্রিক মূলনীতির কথা বলা হয়েছে তার পরিপন্থী একটা শাসনতন্ত্র তৈরীর সম্ভাবনা দেখা দেবে।
আওয়ামী লীগের খসড়ার আর্থিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়েও আলোচনা করা হয়। আলোচিত প্রধান বিষয়গুলো হচ্ছেঃ
(০১) আওয়ামী লীগ খসড়ায় ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রের তৃতীয় তালিকার ৪৯টি বিষয়ের পরিবর্তে ১২টি বিষয়ের নাম ছিল। এর অর্থ এই ছিল যে পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষেত্রে এই ১২টি বিষয়ই হবে কেন্দ্রীয় বিষয় এবং বাদবাকী সব বিষয়ই হবে প্রাদেশিক বিষয়।
(০২) এমন কি তৃতীয় তালিকার এই ১২টি বিষয়ের ব্যাপারেও আওয়ামী লীগ গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনের প্রস্তাব করেন যে, আওয়ামী লীগ খসড়ায় তৃতীয় তালিকার প্রথম নম্বরে শুধু লেখা ছিল “পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা”। ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রে এই বিষয়ের অধীনে ৫টি উপ-বিষয় ছিল। আওয়ামী লীগ টীমকে বলা হয় যে এই বিষয়ের অধীনে রয়েছে সামরিক, নৌ ও বিমানবাহিনীর কারখানাসমূহ, প্রতিরক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিল্পসমূহ, অস্ত্র উৎপাদন, ক্যান্টনমেন্ট এলাকাসমূহের কর্তৃক প্রভৃতি।
(০৩) বৈদেশিক বিষয়াদি সম্পর্কে আওয়ামী লীগের ব্যবস্থা ছিল, “বৈদেশিক বাণিজ্য ও বৈদেশিক সাহায্য বাদ দিয়ে বৈদেশেক বিষয়াদি।” এক্ষেত্রেও আওয়ামী লীগ খসড়ায় ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রের ৭টি উপ-বিষয় বাদ দেয়া হয়।
আওয়ামী লীগ টীমকে বলা হয় যে তাঁরা বৈদেশিক বিষয়াদির সঙ্গে বৈদেশিক বাণিজ্য ও সাহায্যের সবরকম সম্পর্ক ছিন্ন করে তাদের প্রকাশ্যে ভাবে ঘোষিত নীতিকে পরিবর্তন করেছেন। আওয়ামী লীগ টীম বিদেশে আলাদা আলাদা বাণিজ্য প্রতিনিধি নিয়োগেরও প্রস্তাব করেন।
আওয়ামী লীগ খসড়ায় ১৪ (১) অনুচ্ছেদে কেন্দ্রীয় বিষয়সমূহের বিবেচনা ছিল। এতে বহু গুরুত্বপূর্ন জিনিস বাদ দেয়া হয়েছিল। বাদ দেয়া জিনিসগুলোর মধ্যে ছিলঃ
(১) এতে কেন্দ্রীয় পাবলিক সার্ভিস কমিশন কিংবা কেন্দ্রের কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট চাকুরি সমূহ বা পদসমূহের কোন উল্লেখ ছিল না।
(২) খসড়ায় জাতীয় আদমশুমারি অনুষ্ঠানের জন্য কোন প্রতিষ্ঠানের উল্লেখ ছিল না। (” একজন লোক একটি ভোট”- এই নীতি চালু হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে এই জিনিসটির বাদ পড়া তাৎপর্যপূর্ণ)।
(৩) দেশের দু’অংশের মধ্যেকার পরিবহন এবং দু’অংশের মধ্যেকার ডাক-সার্ভিস, আন্তর্জাতিক ডাক সার্ভিসের কোন উল্লেখ ছিল না।
এসব বিষয়ে আওয়ামী লীগ টীম তাদের মনোভাব পরিবর্তনের অনিচ্ছা প্রকাশ করেন।
কর ব্যবস্থা সম্পর্কে আওয়ামী লীগ খসড়ায় কেন্দ্র কর্তৃক কর আদায়ের কোন বযবস্থাই ছিল না। এমন কি তাদের নিজের খসড়ায় উল্লেখ করা কেন্দ্রীয় বিষয়সমূহের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দায়িত্ব পালনের জন্যও কেন্দ্র কর্তৃক কর আদায়ের কোন ব্যবস্থা ছিল না। আওয়ামী লীগ আরো দুটি ধারাও যোগ করেছিলেন। ধারা দুটি হচ্ছেঃ
(১) প্রস্তাব করা হয় যে, ১৯৭০-৭১ সালের বার্ষিক উন্নয়ন কার্যক্রমে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি কেন্দ্রের বরাদ্দ এবং প্রদেশের সম্পদের মধ্যে যে ব্যবধান রয়েছে কেন্দ্রকে তা পূরন করতে হবে। যদিও কেন্দ্র পূর্ব পাকিস্তানে কর আদায় করবেন না।
(২) আওয়ামী লীগ টীম আরো বলেন যে, অন্তর্বতীকালীন মেয়াদ যদি ১৯৭১ সালের ৩০শে জুনের বাইরে যায় তাহলে প্রদেশসমূহ কর্তৃক নির্দিষ্ট শতকরা হারে কেন্দ্রকে অর্থ সরবরাহের নীতিও মেনে নেয়া হবে না।
প্রেসিডেন্টের টীম আরো বলেন যে, স্বীকৃত ফেডারেল পদ্ধতি এই যে, কেন্দ্রের শাসনতান্ত্রিক দায়িত্বসমূহ পালনের জন্য যতটা প্রয়োজন ততটা কর বসানোর ক্ষমতা কেন্দ্রের হাতে থাকা উচিত।
আওয়ামী লীগ খসড়ায় আরো বলা হয় যে, পূর্ব পাকিস্তানের জন্য একটি স্বতন্ত্র স্টেট ব্যাংক থাকবে এবং তা প্রদেশিক আইন পরিষদের তৈরী আইনের নিয়ন্ত্রণাধীন হবে। ফেডারেল স্টেট ব্যাংকের হাতে মাত্র কতকগুলো নির্দিষ্ট কর্তব্য রাখার প্রস্তাব করা হয়। এসব কর্তব্য হচ্ছেঃ
(১) টাকার বৈদেশিক বিনিময় হার সুপারিশ করা।
(২) পূর্ব পাকিস্তান স্টেট ব্যাংকের অনুরোধক্রমে নোট ইস্যু করা।
(৩) টাকশাল এবং সিকিউরিটি ছাপাখানা সম্পর্কে ব্যবস্থা করা এবং এগুলো নিয়ন্ত্রন করা।
(৪) আন্তর্জাতিক অর্থ সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানসমূহের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ফেডারেল স্টেট ব্যাংক সেই সব কর্তব্য পালন করবেন যা সচরাচর করা হয়ে থাকে-এই শর্তে যে, পূর্ব পাকিস্তানের স্টেট ব্যাংকের নির্দেশের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই এ সব কর্তব্য পালন করা হবে।
(৫) আওয়ামী লীগ খসড়ার অনুচ্ছেদ ১৬ এবং অনুচ্ছেদ ১৭ (১) একত্রে পাঠ করলে বোঝা যাচ্ছে যে তাঁরা ৯ই এপ্রিল নাগাদ অর্থাৎ মাত্র দু’সপ্তাহের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান স্টেট ব্যাংক স্থাপনের প্রস্তাব করেন।
আওয়ামী লীগ এই প্রস্তাবের কোন রকম সংশোধন বিবেচনা করতে রাজি ছিলেন না।
আওয়ামী লীগের ঘোষনায় ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রের ১৪টি অনুচ্ছেদ বাদ দেয়ার প্রস্তাব ছিল। অনুচ্ছেদগুলো হচ্ছে ৯৯, ১০৩, ১০৪, ১০৫, ১০৭, ১০৮, ১১২, ১১৩, ১১৪, ১১৯, ১২০, ১২১, ১২২ এবং ১৩১-এর ২ নম্বর ধারা। এতে ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রের অনুচ্ছেদ নম্বর ৬৭, ৬৮, ৭০, ৮০, ৮১, ৮২, ৮৪, ৮৬ এবং ২৯২ সংশোধন করা হয় এবং ফেডারেল সরকারের ক্ষমতা আরো দুর্বল উদ্দেশ্যে ৯০-ক থেকে ৯০-চ পর্যন্ত নতুন কতকগুলো অনুচ্ছেদ যোগ করা হয়।
১৩১ নম্বর অনুচ্ছেদের ২ নম্বর ধারাটির বিশেষ গুরুত্ব ছিল। এতে এই ব্যবস্থা ছিল যে কেন্দ্রীয় আইন পরিষদ কতকগুলো বিশেষ ক্ষেত্রে প্রাদেশিক বিষয়েও আইন পাস করতে পারেন। এসব ক্ষেত্র হচ্ছেঃ
(ক) যখন পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ও আর্থিক স্থিতিশীলতাসহ পাকিস্তানের নিরাপত্তা বিপন্ন হয়ে পড়ে।
(খ) পরিকল্পনা ও সমন্বয় সাধনের প্রয়োজন।
(গ) যে কোন ব্যাপারে পাকিস্তানের বিভিন্ন অংশের মধ্যে সমতা অর্জনের প্রয়োজন।
এমন কি উপরোক্ত “ক” ক্ষেত্রের বেলায়ও তাদের মত পরিবর্ত্ন করতে আওয়ামী লীগ সুস্পষ্ট অস্বীকৃতি জানান।
প্রেসিডেন্টের টীম উল্লেখ করেন যে ঘোষনার উদ্দেশ্য ছিল একটি অন্তর্বর্তীকালীন শাসনতন্ত্র হিসেবে কাজ করা। আওয়ামী লীগের সব দাবীই এতে মেনে নেয়া হয়নি। এর উপর জনাব তাজুদ্দীন আহমদ বলেন, সময় চলে যাচ্ছে, তাই ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ঘোষনা প্রকাশ করতে হবে। তিনি আরো বলেন, এই সময়ের শেষে ঘোষনা প্রকাশ করা হলে তা হবে অতি বিলম্বিত। তাঁকে জানানো হয় যে, আওয়ামী লীগের প্রস্তাবসমূহের ব্যাপারে অন্যান্য ফেডারেটিং ইউনিটের বিভিন্ন পার্লামেন্টারী দলের সঙ্গে পরামর্শ হওয়া উচিত। বস্তুতঃ প্রেসিডেন্ট ১৯৭১ সালের ২০শে মার্চ আওয়ামী লীগ নেতাদের বলেন যে, সব রাজনৈতিক নেতার মতৈক্য অত্যাবশ্যক।
একই দিনে খান আবদুল কাইয়ুম খান প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সন্ধ্যায় জনাব মমতাজ মুহম্মদ খান দৌলতানা, জনাব সরদার শওকত হায়াৎ, জনাব মুফতি মাহমুদ, খান আবদুল ওয়ালী খান এবং শাহ আহমদ নূরানীও প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করেন। তাঁরা শেখ মুজিবুর রহমানকে যুক্তিতে আনার ব্যাপারে তাঁদের ব্যর্থতার কথা প্রেসিডেন্টকে অবহিত করেন এবং বলেন যে, তিনি (শেখ মুজিব) আওয়ামী লীগের স্কীমের কোন পরিবর্তন মেনে নিতে পারবেন না।
এর আগে সকালের দিকে শেখ মুজিবুর রহমান সশস্ত্র স্বেচ্ছাসেবকদের মার্চপাস্টে বাংলাদেশের পতাকা উড়ান এবং বলেন, ” আমাদের সংগ্রাম মুক্তি ও স্বাধীনতার সংগ্রাম।”
২৪ শে মার্চ, ১৯৭১
জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো ঘোষনার যথার্থতা এবং বৈধতার ব্যাপারে আলোচনার জন্যে আবার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এই ঘোষনার মাধ্যমে সামরিক আইন প্রত্যাহার এবং জেনারেল ইয়াহিয়া খান কর্তৃক প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা ও কর্তব্য গ্রহন করার কথা ছিল।
আওয়ামী লীগের সহকারীরা সন্ধ্যা ছ’টায় প্রেসিডেন্টের টীমের সঙ্গে আবার বৈঠকে মিলিত হন। এই বৈঠকের পর জনাব তাজুদ্দীন আহমদ সাংবাদিকদের কাছে এক বিবৃতিতে বলেন, “বৈঠকে আমাদের যা বক্তব্য তা আমরা সবই বলেছি।” তিনি আরো বলেন, “আমাদের দিক থেকে আর কোন বৈঠকের প্রয়োজন নেই।” (দি পিপল’ ঢাকা ২৫শে মার্চ।১৯৭১)।
২৫ শে মার্চ, ১৯৭১
আওয়ামী লীগ প্রকাশ্যভাবে জানিয়ে দিলেন যে, তাঁরা আর বৈঠক অনুষ্ঠানের ব্যাপারে আগ্রহী নন। তাঁরা যে খসড়া ঘোষনা পেশ করেন তাতে পরিস্কার বোঝা যায় যে, শেখ মুজিবুর রহমান কেন্দ্র কিংবা পাকিস্তান ফেডারেশন সংক্রান্ত কোন বন্দোবস্তের ব্যাপারে উৎসাহী নন। এর অর্থ হচ্ছে, এই খসড়া ঘোষণাটি ফেডারেশনের পরিবর্তে একটি কনফেডারেশন তৈরী করে কেন্দ্র কর্তৃক বিলোপ করবে, শেখ মুজিব পয়লা মার্চ থেকে যে প্রতিদ্বন্দ্বী সরকার চালাচ্ছিলেন এই ঘোষনা তাকে আইনগত বৈধতা প্রদান করবে এবং আইনসিদ্ধ কোন বৈধতা ছাড়াই ঘোষণাটি জারী করে শাসনতান্ত্রিক শূন্যতা সৃষ্টি করবে।
প্রেসিডেন্ট নিম্নোক্ত কথায় বিষয়টির সংক্ষিপ্তসার প্রকাশ করেনঃ
“এটা অত্যন্ত পরিস্কার হয়ে গেছে যে, শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর উপদেষ্টারা এক পাকিস্তানের ভিত্তিতে কোন সমঝোতায় আসবেন না বরং কোনক্রমে আমার কাছ থেকে এমন একটা ঘোষনা প্রকাশ করিয়ে নিতে চান যা কার্যতঃ জাতীয় পরিষদকে দুইটি পৃথক গণপরিষদে পরিণত করবে, ফেডারেশনের পরিবর্তে একটি কনফেডারেশনের জন্ম দিবে এবং সামরিক আইনের ক্ষমতা বিলোপ করে দেশে একটা অরাজকতার সৃষ্টি করবে। এই পরিকল্পনার মাধ্যমে তারা পৃথক ‘বাংলাদেশ’ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল পরিণত করবে, বলাবাহুল্য, তার অর্থই হচ্ছে জাতির পিতা যে অর্থে পাকিস্তান তৈরী করেছিলেন তার সমাপ্তি টানা।”
এই সময়ে আওয়ামী লীগ কর্তৃক ২৬শে মার্চ ভোরে একটি সশস্ত্র বিদ্রোহ করার পরিকল্পনার কথা জানা গেল।
.
.
তৃতীয় অধ্যায়
.
পূর্ব পাকিস্তান সন্ত্রাস
রাজনৈতিক কথাবার্তা ও আলাপ-আলোচনার সঙ্গে সঙ্গে আওয়ামী লীগ কর্মীরা তাদের প্রস্তুতিও সমাপ্তির পথে নিয়ে যাচ্ছিল। যা তারা শাসনতান্ত্রিক পন্থায় পেতে ব্যর্থ হতে পারে, তাকে জোর করে আদায় করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য।
নির্বাচনে সন্ত্রাসবাদীদের কলাকৌশলের সাফল্য শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর দলের সাহস বাড়িয়ে দিলো। তারা বেসামরিক প্রশাসন ব্যবস্থাকে বানচাল, ছাত্রসমাজকে উত্তেজিত এবং পুলিশ ও সেনাবাহিনীর বাঙালীদের দলভুক্ত করার জন্য আন্দোলন শুরু করলেন। বিভিন্ন শহরে “সংগ্রাম পরিষদ” গড়ে উঠলো এবং কলেজের প্রাঙ্গণসমূহ সন্ত্রাসবাদীদের শিক্ষা শিবিরে পরিণত হলো। কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মচারী এবং সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে ভীতি প্রদর্শন এবং আন্দোলন শুরু করা হলো। বহু পূর্ব থেকেই অর্থাৎ ১৯৭০ সালের ১৪ই ডিসেম্বর ঢাকার আওয়ামী লীগ সমর্থক দৈনিক “দি পিপল” রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্টের কথা উল্লেখ করে বলেছিলেন যে, তিনি প্রকাশ্যভাবেই মুক্তি ও স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পক্ষপাতী।
এইভাবে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের সব প্রস্তুতি নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ১লা মার্চ প্রেসিডেন্ট কর্তৃক জাতীয় পরিষদের বৈঠক সাময়িকভাবে স্থগিত ঘোষোণাকে ছুতা হিসেবে ব্যবহার করে আরম্ভ করলেন এক অরাজকতার আন্দোলন। এরপর অহিংস ও অসহযোগ আন্দোলনের নামে আওয়ামী লীগ শুরু করলো এক সন্ত্রাসের রাজত্ব।
১লা মার্চ, ১৯৭১
এক সাংবাদিক সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার এক ধর্মঘট আহ্বান করলেন। তাঁর ধর্মঘট আহ্বানের পর পরই আওয়ামী লীগের চরমপন্থীরা শহরের বিভিন্ন এলাকা লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ এবং অন্যান্য বর্বরোচিত কার্যকলাপে মেতে উঠলো। তারা নারায়নগঞ্জে রাইফেল ক্লাব আক্রমণ করে সব অস্ত্রশস্ত্র লুট করে নিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল ও জগন্নাথ হলে সশস্ত্র দল গড়ে উঠলো- তাদের কাজ ছিল শহরে ছড়িয়ে পড়ে অস্ত্রশস্ত্র, গাড়ী এবং অর্থ সংগ্রহ করা। ১লা মার্চ তারিখের রাত্রে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের সর্বত্র হিংসাত্মক কার্যকলাপের তীব্রতা ও সংখ্যা বেড়ে গেল।
২রা মার্চ, ১৯৭১
বায়তুল মোকাররমে দুটি এবং নিউ মার্কেটে একটি অস্ত্রের দোকান লুট করা হলো। লুণ্ঠিত অস্ত্রশস্ত্র গুলো তারপর ঢাকা বিশবিদ্যালয় প্রাঙ্গণে নিয়ে যাওয়া হয়। আগেই সেখানে একটি “গুলী চালানোর অনুশীলন কেন্দ্র” খোলা হয়েছিল, সেখান থেকে সারা দিন গুলী ছোড়ার আওয়াজ শোনা যেতো। রাস্তায় জনতা পাকিস্তানবিরোধী শ্লোগান দিয়ে হাতে বন্দুক, লোহার ডাণ্ডা, এবং লাঠি নিয়ে ঘুড়ে বেড়াতো। জিন্নাহ এভিন্যুর ও বায়তুল মোকাররমের কয়েকটি দোকানপাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শালিমার হোটেল এবং গুলিস্তান সিনেমা হল আক্রান্ত হলো। চালু রিক্সার উপর ইটপাটকেল ছোড়া হয়। নারায়ণগঞ্জে একটি পাটকল এবং ঢাকার ফার্মগেট এলাকায় বেসরকারী আবাসিক গৃহে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়।
৩রা মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান আর একটি সাংবাদিক সম্মেলনে সারা প্রদেশব্যপী ধর্মঘট পালনের আহ্বান জানান। তাঁর সাংবাদিক সম্মেলন চলাকালীনই আওয়ামী লীগ সমর্থক ছাত্রদল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাকিস্তানী জাতীয় পতাকার অবমাননা করে এবং পুড়িয়ে দেয়। এ ব্যাপারে শেখ মুজিবুর রহমানের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি জবাব দেন, “আমার কোন মন্তব্য নেই।” তিনি আবার জোর দিয়ে বলেন যে ক্রেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে তিনি এক অসহযোগ আন্দোলন শুরু করবেন। তিনি আরও ঘোষণা করেছিলেন যে, ৭ই মার্চের জনসভায় তিনি তার কার্য পরিকল্পনা প্রকাশ করবেন।
ইতিমধ্যেই হিংসাত্মক কার্যকলাপ বাড়তেই থাকলো। বেসরকারী আইন রক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো শহরের ব্যাপক গোলযোগ আয়ত্তে আনতে ব্যর্থ হলো। তাদের অনুরোধেই ব্যারাকে অবস্থিত সেনাবাহিনীকে ডাকা হলো এবং রাতে কারফিউ জারী করা হয়।
৩রা মার্চ, ১৯৭১
ইসলামপুর, পাটুয়াটুলী এবং নবাবপুরসহ ঢাকার কয়েকটি এলাকায় অরাজকতা ছড়িয়ে পড়ার দরুন বিক্ষুদ্ধ জনতার হাতে ৫ জন লোক নিহত এবং ৬২ জন লোক আহত হয়। বেশকিছুসংখ্যক দোকানপাট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং আবাসিক গৃহে আগুল ধরিয়ে দেওয়া হয়। এছাড়া কিছু শহরবাসীকে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়। জিন্নাহ এভিন্যুয়ের উপর একটা জেনারেল স্টোর ও একটি ঘড়ির দোকান আক্রমণ করা হয়। অস্ত্রের দোকানগুলো থেকে আরও অস্ত্রশস্ত্র লুট করা হয়। গোটা পঞ্চাশেক ঘরে আগুনও ধরিয়ে দেয়া হয়েছিল।
ইতিমধ্যে প্রদেশের অন্যান্য অংশে জনতার আক্রমণাত্মক কার্যকলাপ ছড়িয়ে পড়েছে। যশোরে লাঠিসোঁটা বর্শায় সজ্জিত হয়ে জনতা স্থানীয় টেলিফোন এক্সচেঞ্জ আক্রমণ করে। টেলিফোন এক্সচেঞ্জের রক্ষীরা জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য গুলী ছুড়লে দুজন নিহত এবং ৯ জন আহত হয়।
সকালে ভৈরব থেকে লাকসামগামী একটা স্থানীয় ট্রেন কুমিল্লায় থামিয়ে তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়।
লাকসামের কাছে দৌলতগঞ্জ টেলিফোন এক্সচেঞ্জও হামলাকারীদের হাতে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। কুমিল্লা টেলিফোন এক্সচেঞ্জকে প্রদেশের অন্যান্য অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। আখাউড়া, সিলেট, হবিগঞ্জ এবং বিয়ানীবাজার এক্সচেঞ্জগুলোকেও জোর করে বন্ধ করে দেয়া হয়।
আওয়ামী লীগের নির্দেশ মতো ঢাকার রেডিও এবিং টেলিভিশন নতুন এক বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত প্রচার করতে শুরু করে।
শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের জনগণের অধিকার আদায়ের নামে সারা প্রদেশব্যাপী এক অসহযোগ আন্দোলন চালাবার ঘোষণা করেন।
৪ঠা মার্চ, ১৯৭১
১৯৭১ সালের ৩রা মার্চ ও ৪ঠা মার্চ রাতে চট্টগ্রাম ও খুলনায় গোলযোগ ছড়িয়ে পড়ে। চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের অতর্কিত আক্রমণকারীদের দ্বারা পরিচালিত বিক্ষুদ্ধ জনতা Wireless colony এবং শহরের অন্যান্য এলাকা আক্রমণ করে যথেচ্ছা লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ, হত্যা এবং ধর্ষণ করেছিল। ফিরোজশাহ কলোনীতে ৭০০ ঘরে আগুন ধরিয়ে দিয়ে সেখানকার অধিবাসী পুরুষ, মেয়ে ও শিশুদের পুড়িয়ে মারা হয়। যারা পালিয়ে যাবার চেষ্টা করেছিলো তাদের হত্যা কিংবা গুরুতররূপে আহত করা হয়। ৩রা ও ৪ঠা মার্চে যারা জীবন্ত দগ্ধ হয়েছিল এবং যাদের ভস্মীভূত দেহ পরে পাওয়া যায়, তারা ছাড়াও ৩শ’র বেশি লোক হত্যা ও আহত হয়।
যশোর খুলনা হতে আগত একটি ট্রেনকে লাইনচ্যুত করে যাত্রীদের টেনে বের করে হত্যা করা হয়েছিল। যশোরে ডেপুটি কমিশনারের অসিফে জনতা পাকিস্তানের পতাকা অবমাননা করে এবং পুড়িয়ে দেয় এবং একটা হাতবোমা নিক্ষেপ করে।
খুলনায় টেলিফোন এক্সচেঞ্জ আক্রমণ করে কিছুসংখ্যক কর্মচারীদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
ঢাকার ধানমন্ডি ও নবাবপুর রোড থেকে বেশকিছু লুটতরাজের খবর পাওয়া যায়। একটা অস্ত্রের দোকান আক্রমণ করে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যাওয়া হয়।
৫ই মার্চ, ১৯৭১
চট্টগ্রাম থেকে হত্যা এবং বাড়িঘর পুড়িয়ে দেবার খবর পাওয়া যায়। খুলনায় খালিশপুর ও দৌলতপুর এলাকায় ৭জন লোককে হাতবোমা, দা এবং বর্শা দিয়ে হত্যা করা হয়। তাদের মৃতদেহ খণ্ড-বিখণ্ডিত অবস্থায় পাওয়া যায়। খুলনা শহরে লাটি ও বন্দুক নিয়ে জনতা একটি হোটেলে আগুন ধরিয়ে দেয়।
প্রদেশের অভ্যন্তরের অন্যান্য এলাকা থেকে প্রাপ্ত খবরে জানা যায় যে, ব্যাপক গোলযোগ ছড়িয়ে পড়েছে ও সারা প্রদেশের বেসামরিক প্রশাসন ব্যবস্থা পঙ্গু হয়ে পড়েছে।
পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে টেলিযোগাযোগ বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো, টেলিফোন ও টেলিগ্রাম বিভাগের কর্মচারীরা বার্তা গ্রহণ ও প্রেরণ বন্ধ করে পূর্ব পাকিস্তানকে বহির্জগত থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে।
৬ই মার্চ, ১৯৭১
১৯৭১ সালের ৫ ও ৬ই মার্চের রাতে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ছাত্ররা বৃটিশ কাউন্সিল ভবনে ঢুকে কেরোসিন তেল ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেবার চেষ্টা করে। কিন্তু সময় মতো সেনাবাহিনী পোঁছায় এবং গুলী ছুড়ে অবস্থা আয়ত্তে আনে।
ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগার ভেঙ্গে ৩৪১ জন কয়েদী পালিয়ে যায়। পুলিশ গুলী ছোড়ার ফলে ৭ জন কয়েদী নিহত হয়। ১ জন পুলিশ সার্জেন্ট এবং ৬ জন ওয়ার্ডার আহত হয়। পরে পলায়নকারী কয়েদীরা আওয়ামী লীগ উগ্রপন্থী এবং ছাত্রদলের সহযোগিতায় মারাত্মক শ্লোগান দিতে দিতে ঢাকার রাস্তাগুলো প্রদক্ষিণ করে।
আওয়ামী লীগ এবং পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের কর্মীরা এসিড এবং অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থ সংগ্রহ করার জন্য বিজ্ঞান গবেষণাগারগুলো লুট করা শুরু করে। ঢাকায় সরকারী বিজ্ঞান গবেষণাগার থেকে সব বিস্ফোরক রাসায়নিক লুট করে নেয়া হয়।
এই একই উদ্দেশ্যে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটও আক্রমণ করা হয়। যখন গুলী ছোড়া হয়, তখন গুণ্ডারা পালিয়ে যায়। কুমিল্লা ও যশোরসহ পূর্ব পাকিস্তানের সব প্রধান প্রধান শহর থেকে বোমা বিস্ফোরণের খবর পাওয়া যায়। ফরিদপুরের ‘রাজেন্দ্র কালেজ ট্রেনিং কোর’-এ ১০টা রাইফেল এবং ১৫ টি বেয়নেট চুরি হয়।
চট্টগ্রামে লুটত্রাজ, অগ্নিসংযোগ চলতেই থাকে। দুটো দালান এবং কিছুসংখ্যক কুঁড়েঘর পোড়ানো হয়। আড়াল থেকে অতর্কিতভাবে গুলী ছোড়ার ঘটনাও বেশ কয়েক জায়গায় ঘটে।
রাজশাহীতে সদর ম্যাজিস্ট্রেটের অফিসে আগুন লাগানো হয়। খুলনায় জাতি এবং রাষ্ট্রবিরোধী শ্লোগান দিতে দিতে বিক্ষুদ্ধ মিছিলসমূহ অস্ত্রের দোকানগুলো লুট করার চেষ্টা করে। দোকানের মালিক গুলী ছোড়ার ফলে ১ জন নিয়ত ও ৭ জন আহত হয়।
৭ই মার্চ, ১৯৭১
শেখ মুজিবুর রহমান একটি প্রতিদ্বন্দী সরকার চালাবার কথা ঘোষণা করেন এবং আনুষ্ঠানিকভাবে কয়েকটি নির্দেশ জারী করেন। অহিংস এবং অসহযোগ আন্দোলন চালিয়ে যাবার জন্য তিনি সপ্তাহব্যাপী এক কার্যসূচী প্রকাশ করেন। (যেটা ২রা মার্চ শুরু হয়েছিল।) কার্যসূচীর অন্তর্ভূক্ত ছিলো (১) কর না দেওয়া আন্দোলন (২) সারা “বাংলাদেশের” শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ, সরকারী ও আধা সরকারী অফিসগুলো, হাইকোর্ট এবং অন্যান্য কোর্ট বন্ধ করে দেওয়া হবে। রেডিও, টেলিভিশন এবং সংবাদপত্রসমূহকে আওয়ামী লীগের কর্মপন্থা অনুযায়ী নির্দেশ দেওয়া হলো এবং এও জানানো হলো যে, এ নির্দেশ অমান্য করলে মনে করা হবে যে এই সকল প্রতিষ্ঠানসমূহে কর্মরত বাঙালীরা সহযোগিতা করছে না। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে টেলিযোগাযোগ বন্ধ করা হলো। এক নির্দেশে বলা হলো “স্টেট ব্যাংক বা অন্য কোন কিছুর মাধ্যমে ব্যাংক পশ্চিম পাকিস্তানে টাকা-পয়সা পাঠাতে পারবে না।“ আর এক নির্দেশে বিশেষ করে উল্লেখ করা হলো যে প্রত্যাক ইউনিয়ন, মহল্লা, থানা, মহকুমা এবং জেলায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ ইউনিটের নেতৃত্বে একটা করে সংগ্রাম পরিষদ সংগঠন করা হবে।
ঢাকায় রেডিও পাকিস্তান ভবনের মধ্যে বোমা নিক্ষেপ করা হয়।
শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে খবর পাওয়া যায় যে আওয়ামী লীগ ছাত্রদলরা জোর করে জীপ, পিকআপ এবং মাইক্রোবাস নিয়ে যাচ্ছে।
যশোর জেলায় বারগানায় পাকিস্তান জাতীয় পতাকা পুড়িয়ে ফেলা হয়।
৮ই মার্চ, ১৯৭১
ঢাকায় যাদের লাইসেন্স রয়েছে তাদের কাছ থেকে জোর-জবরদস্তি করে আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবীরা অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাগুলী সংগ্রহ করতে লাগলো। পূর্ব পাকিস্তানের অন্যান্য শহর থেকেও অনুরূপ ঘটনার খবর পাওয়া যায়।
আওয়ামী লীগ সারা প্রদেশ জুড়ে মিটিং এবং উন্মুক্ত মিছিলের ব্যবস্থা করলো। জাতীয়বাদ এবং পাকিস্তানবিরোধী শ্লোগান ছিলো তাদের মুখে।
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারী জনাব তাজুদ্দীন আহমেদ শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশের কতকগুলি ব্যতিক্রম ব্যাখ্যা ও ঘোষণা করলেন। এর মধ্যে ছিল “স্টেট ব্যাংক বা অন্য কোনভাবে বাংলাদেশের বাইরে টাকা পাঠানো যাবে না।“
৯ই মার্চ, ১৯৭১
বাংলাদেশের বাইরে যাতে ধনসম্পদ না যায়, সে জন্য আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবীরা এবং ছাত্রদল ঢাকার বিভিন্ন অংশে তল্লাশী ফাঁড়ি বসালো। তল্লাশী করার অজুহাতে এসব স্বেচ্ছাসেবীরা যাদের তল্লাশী করলো তাদের কাছ থেকে টাকা পয়সা এবং অন্যান্য জিনিসপত্র বাংলাদেশের নামে হস্তগত করলো।
রংপুরের লালমনিরহাটে এক উন্মুক্ত জনতা একটি ট্রেন থামিয়ে তার অনেক ক্ষতি করে। জাতিগত এবং রাজনৈতিক কারণে ট্রেনের কিছু যাত্রীদের হয়রানি এবং মারপিট করে। শহরের বিভিন্ন এলাকায় অধিবাসীদের আওয়ামী লীগ কর্মীরা আক্রমণও করেছিলো।
রাজশাহীতে নিটি টাউন হলে একটি ‘স্বাধীনতা পতাকা’ উত্তোলন করা হয়।
লন্ডন ‘ডেলী টেলিগ্রাফ’ পত্রিকার সাংবাদিক কেলিথ ক্লার্ক-এর পাঠানো একটি বিবরণ ১৯৭১ সালের ৯ই মার্চ উক্ত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তিনি বলেন, ‘খবরে প্রকাশ যে রোববার ৭ই মার্চ রাতে যখন শেখ মুজিবুর রহমান প্রদেশকে বিচ্ছিন্নতাবাদের শেষ প্রান্তে এনে ফেলেছিলেন তখন ঢাকা সম্পূর্বভাবে অরাজকতার কবলে গিয়ে পড়েছিলো।’ উক্ত পত্রিকায় আরও বলা হয়, ‘আওয়ামী লীগ নেতা শেখ তাঁর আন্দোলনকে ‘স্বাধীনতা আন্দোলন’ বলে নাম দিয়েছিল। তিনি জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে সহযোগিতা করার জন্য এমন সব শর্ত আরোপ করেন, যা প্রেসিডেন্ট খানের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিলো না।’ এ পত্রিকায় শেখ মুজিবুর রহমানের আর একটি নির্দেশেরও ব্যাখ্যা উল্লেখ ছিলো। নির্দেশটি ছিলো- “গ্রামে গ্রামে আওয়ামী লীগ নেতাদের নেতৃত্বে মুক্তি কমিটি গঠন করা”
১০ই মার্চ, ১৯৭১
আওয়ামী লীগ ঘোষণা করলো যে “ব্যাংকের লকারগুলোর কাজ বন্ধ থাকবে” এবং শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশের বাইরে বন্দর কর্তৃপক্ষ কোন সহযোগিতা করবেন না। কুমিল্লার চা বাগানে গোলযোগ ও সন্ত্রাসের খবর পাওয়া গেলো।
১২ই মার্চ, ১৯৭১
১১ই-১২ই মার্চ রাতে বরিশালের জেল ভেঙ্গে কিছু কয়েদী পালিয়ে যায়। বগুড়ার জেল ভেঙ্গে ৭ জন কয়েদী পালিয়ে যাবার খবরও পাওয়া যায়। কুমিল্লায় ৩০০ কয়েদী পালিয়ে যাবার চেষ্টা করে। পুলিশ গুলী চালায়। পুলিশের গুলিতে ২ জন কয়েদী নিহত ও ১৮ জন কয়েদী আহত হয়।
‘মুক্তি ফ্রন্ট’ এবং আধা সামারিক সংস্থাগুলি প্রদেশে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। ‘মুক্তি ফ্রন্ট’ এর পক্ষ থেকে ‘সাইক্লোস্টাইলড’ এবং হাতে লেখা প্রচারপত্র গোপনে গোপনে বিলি করা হলো। এ সবেরই উদ্দেশ্য ছিল জাতিগত বিদ্বেষ সৃষ্টি এবং হিংসাত্মক কার্যকলাপ উস্কানিদান।
৫টি সামরিক ট্রাকের একটি দল রেশন নেবার জন্য কুমিল্লা থেকে সিলেট যাওয়ার পথে, ব্রাক্ষণবাড়িয়ার সশস্ত্র জনতা কর্তৃক আক্রান্ত হয়।
১৩ই মার্চ, ১৯৭১
ঢাকার রেল স্টেশনে আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবীরা যাত্রীদের ঘেরাও করে পশ্চিম ‘পাকিস্তানের’ দালাল বলে অভিযুক্ত করে জেরা করতো। কাকরাইলের কাছে এক সরকারী অফিসে দুই বোতল এসিড নিক্ষেপ করা হয়। ফলে সে অফিসে আগুন ধরে যায়।
যশোর ডেপুটি কমিশনারের অফিসে পাকিস্তান জাতীয় পতাকার জায়গায় বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়।
কুমিল্লায় আওয়ামী লীগ নেতারা দুজন কয়েদীর মুক্তির জন্য জেল ভাঙ্গার হুমকি দেয়। উল্লেখিত কয়েদী দুজনকে জাতীয় পতাকা পুড়িয়ে ফেলার জন্য শমসের নগরে গ্রেফতার করা হয়।
১৪ই মার্চ, ১৯৭১
শেখ মুজিবুর রহমান পূর্বের সব নির্দেশগুলো বাতিল করে দেন এবং ১৯৭১ সালের ১৫ই মার্চ থেকে নতুন নির্দেশ সম্বলিত এক কার্যক্রম ঘোষণা করেন। এর একটি নির্দেশে বলা হয় যে, ডেপুটি কমিশনার এবং মহকুমা হাকিমগণ তাদের নিজ নিজ কর্তব্য ও দায়িত্ব পালনে স্ব স্ব পর্যায়ে আওয়ামী লীগ সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখবেন এবং সহযোগিতা করে কাজ করবেন।
আর একটি নির্দেশে বলা হয় যে, “কাস্টম বিভাগ তাঁর দায়িত্ব পালন করে যাবে এবং যে পরিমাণ কর ধার্য করা হয়েছে তা পুরো জমা দেয়া হলে মাল বের করতে অনুমতি দেবে। এই উদ্দেশ্য ইস্টার্ন ব্যাংকিং কর্পোরেশন লিমিটেড এবং ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংক লিমিটেড (বেসরকারী ব্যাংক) এ কাস্টমস কালেক্টর দ্বারা পরিচালিত বিশেষ একাউন্ট খুলতে হবে। কাস্টমস কালেক্টরগণ আওয়ামী লীগের মাঝে মাঝে প্রকাশিত নির্দেশ অনুযায়ী এই একাউন্টগুলো পরিচালনা করবেন। এইভাবে যে কর আদায় হবে সেগুলো কেন্দ্রীয় সরকারের একাউন্টে জমা করা হবে না।
১৫ই মার্চ, ১৯৭১
এক যুক্ত বিবৃতিতে ‘স্বাধীন বাংলাদেশ’ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ৪ জন স্বীকার করেন যা, “গাড়ী নিয়ে কিছু দুষ্কৃতিকারীরা বিভিন্ন বাড়িঘর এখনও লুটপাট করছে এবং সংগ্রাম পরিষদের নামে জোরজবরদস্তি করে টাকা আদায় করছে।” কিছু সংখ্যক এলাকা থেকে খবর আসছিলো যে, ঢাকার বিভিন্ন আওয়ামী লীগ তল্লাশী ফাঁড়ী জাতিগত এবং রাজনৈতিক কারণে যে তল্লাশী চালাচ্ছে তাতে জনসাধারণ বর্বরোচিত ব্যবহারের শিকারে পরিণত হয়েছে।
কুমিল্লার এক সশস্ত্র জনতা ফেনীর একটি আর্মি ফিল্ড ইউনিট ঘেরাও করে আক্রমণ চালায়।
১৯৭১ সালের ১৫ই মার্চ লন্ডন-এর বিবিসির খবরে বলা হয়ঃ আজ কাজে যোগ দেবার জন্য যে সামরিক হুকুম জারী হয়েছে, তা অমান্য করার জন্য বেসামরিক প্রতিরক্ষা কর্মীদের অনুরোধ জানিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান একটি বিবৃতি দেন। শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসন চান। এই নির্দেশগুলোর অন্তর্ভূক্ত একটি আদেশ হচ্ছে যে, কর কেন্দ্রীয় সরকারকে না দিয়ে তাঁর সরকারকেই দিতে হবে।
১৬ই মার্চ, ১৯৭১
রাজশাহীতে নাটোরের মহারাজ হাইস্কুল থেকে রাসায়নিক দ্রব্য এবং এসিড চুরি হয়।
চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবকরা একটি অস্ত্রশস্ত্রের দোকান লুট করে।
১৯৭১ সালের ১৬ই মার্চ লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় সংবাদদাতা মার্টীন এডেনির পাঠানো এক রিপোর্টে আওয়ামী লীগের একটি সংগ্রাম কমিটির বৈঠকের বর্ণনা দেয়া হয়, সারা প্রদেশে গঠিত এ ধরনণের অন্যান্য কমিটির মতো এই কমিটিরও আলোচনার বিষয় ছিলঃ তাদের বিবেচনায় ইতিমধ্যেই স্বাধীন হয়ে যাওয়া পূর্ববঙ্গে অর্থাৎ ‘বাংলাদেশে’ তাদের পরবর্তী পদক্ষেপ কি হবে। ৫৮টি গ্রাম থেকে প্রায় শ তিনেক লোক এই সংগ্রাম কমিটিতে একত্রিত হয়েছে। তারা প্রয়োজনবোধে সেনাবাহিনীর মোকাবেলা করতে প্রস্তুত এবং এ জন্য তারা এমন একজন গ্রামবাসীর কাছে ট্রেনিং নিচ্ছে, যুদ্ধবিদ্যা যার একমাত্র অধিকার, যে রাজকীয় ভারতীয় সেনাবাহিনী সার্ভিস কোরে একজন ল্যান্স কর্পোরাল ছিল।
হিন্দুস্তানের দৈনিক পত্রিকা স্টেটম্যান (১৯৭১ সালের ১৬ই মার্চ সংখ্যা) আওয়ামী লীগের ১৪ই মার্চ তারিখে জারী করা নির্দেশসমূহের খবর দিয়ে বলেন, “মিস্টার মুজিবুর রহমান, এসব নির্দেশ জারী করে বলেছেন যে, তিনি ‘বাংলাদেশ’-এর নিয়ন্ত্রণভার গ্রহণ করেছেন।” পত্রিকা আরো জানায়, “শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন, প্রেসিডেন্ট আমাদের অতিথি হবেন। ঢাকায় পর্যবেক্ষকরা এর এই অর্থ নিয়েছেন যে, পূর্ব পাকিস্তান নিজেকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে স্বতন্ত্র একটি এলাকা বলে মনে করে।”
১৭ই মার্চ, ১৯৭১
১৬ ও ১৭ই মার্চের মধ্যবর্তী রাতে ঢাকার আজিমপুরায় একটি সরকারী অফিসের উপর দুইটি এসিড বোতল নিক্ষেপ করা হয়।
ঢাকায় মতিঝিল কেন্দ্রীয় সরকারী হাইস্কুলের উপর হামলা চালানো হয় এবং এসিড ও রাসায়নিক দ্রব্য লুট করে নিয়ে যাওয়া হয়।
১৮ই মার্চ, ১৯৭১
যশোরে সেনাবাহিনীর একটি শিবিরে দুজন সামরিক করমচারীর উপর এসিডের বোতল নিক্ষেপ করা হয়।
১৯ই মার্চ, ১৯৭১
ঢাকায় একটি লেভেল ক্রসিংয়ের উপর ময়মনসিংহ থেকে প্রত্যাবর্তনকারী একটি সামরিক যানের উপর এক জনতা অতর্কিত আক্রমণ চালায়। আক্রমণকারীরা অস্ত্রশস্ত্রসহ ৬ জন লোককে নিয়ে পালিয়ে যায়।
যশোরে বিজলী কেন্দ্রের ক্ষতিসাধন করে বিজলী সরবরাহ ব্যাহত করে দেয়া হয়। যশোর-খুলনা সড়কের বিভিন্ন স্থানে প্রতিবন্ধকতা আরোপ করা হয়। খুলনায় ৫ই মার্চের হত্যাকাণ্ড থেকে বেঁচে যাওয়া প্রায় ৩শ লোকের উপর নতুন করে হামলা চালানোর হুমকি দেয়া হয়।
রংপুরে ছাত্ররা কালিগঞ্জ থানার লালিবাড়ী গ্রামে ১২টি বাড়ী পুড়িয়ে দেয়। ঢাকা থেকে ২২ মাইল দূরে জয়দেবপুর বাজারে লেভেল করসিংয়ের উপর একটি ট্রেন রেখে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করা হলে জনতা এবং সেনাবাহিনীর লোকদের মধ্যে গোলাগুলি বিনিময় হয়। এরপর সেখানে সন্ধ্যা আইন জারী করা হয়। সৈন্যরা ট্রেনটি একদিকে সরিয়ে দিয়ে তাদের যাওয়ার পথ করার চেষ্টা করলে জনতা তাদের উপর গুলি চালায়। এতে তিনজন সৈন্য মারাত্মকভাবে জখম হয়। সৈন্যরা পাল্টা গুলি চালালে দুজন লোক নিহত এবং অন্য ৫ জন আহত হয়। ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কে আরো আধাডজন প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করা হয়।
২০ ও ২১শে মার্চ, ১৯৭১
যশোরে, হিন্দুস্তান থেকে সাতক্ষীরা হয়ে বিপুল পরিমাণ হিন্দুস্তানী অস্ত্রশস্ত্র চোরাপথে সীমান্তের এপারে আসে বলে খবর পাওয়া যায়। চোরা পথে আনীত অস্ত্রশস্ত্র চট্টগ্রাম থেকে কুমিল্লা পাঠানো হয় বলেও খবর পাওয়া যায়।
হংকং-এর দি ফার ইস্টার্ন রিভিউ ২০শে মার্চ (১৯৭১ সাল) সংখ্যায় লিখেছেন, ‘প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান যখন পাশ্চিম পাকিস্তানে তাঁর পরবর্তী উদ্বেগের কথা ভাবছিলেন, তখন শেখ মুজিবুর রহমান তার ঢাকার বাড়ীতে আমাদের প্রতিনিধিকে বলেন, ‘এটাই শেষ দফা।‘ শেখ মুজিবুরের বাসভবন বাংলাদেশের পতাকা এবং বিভিন্ন প্রতীক দিয়ে সুসজ্জিত ছিল। এ কথার অর্থ কি তা জিজ্ঞাসা করায় তিনি সেই শ্লোগানটি দিয়ে তার জবাব দিলেন, যা তিনি হাজার বার জনতার সামনে উচ্চারণ করেছেন- “জয় স্বাধীন বাংলা, স্বাধীন বাংলা দীর্ঘজীবী হোক।”
২২শে মার্চ, ১৯৭১
দিনাজপুর আওয়ামী লীগের কর্মীরা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার একটি কুশপুত্তলিকাসহ এক উন্মুক্ত মিছিল বের করে। কুশপুত্তলিকাটির বুকে তীর বসানো ছিল। সিলেটের কয়েকটি চা বাগানে অস্ত্রশস্ত্র এনে রাখা হয়েছে বলে খবর পাওয়া যায়।
২৩শে মার্চ, ১৯৭১
‘পাকিস্তান দিবসের’ নাম পরিবর্তন করে ‘প্রতিরোধ দিবস’ করা হয়। ঢাকা এবং পূর্ব পাকিস্তানের অন্যান্য শহরে বিভিন্ন সরকারী ভবনের চূড়ায় পাকিস্তানের জাতীয় পতাকার পরিবর্তে ‘বাংলাদেশের’ নয়া পতাকা উড়তে দেখা যায়। মুক্তিফ্রন্টের আধা সামরিক বাহিনী এবং অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মচারীদের মার্চ পাস্ট এবং কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয়। মিরপুর এবং অন্যান্য কয়েকটি এলাকার অধিবাসীরা নয়া বাংলাদেশ পতাকা উড়াতে অস্বীকার করে। পাকিস্তানী পতাকা উত্তোলনের চেষ্টা করলে এসব জায়গায় তাদের উপর হামলা চালানো হয়।
শেখ মুজিবুর রহমান তার বাসভবনে সশস্ত্র মার্চ পাস্টের সালাম গ্রহণ করেন। এখানেও আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়।
বিভিন্ন ছত্রদল পশ্চিম পাকিস্তানী ব্যবসায়ীদের অপহরণ করে এবং মুক্তিপণ দাবী করে। সশস্ত্র জনতা ঢাকা বিমানবন্দরের কাছে বহির্গামী যাত্রীদের উপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে এবং তাদেরকে হয়রানী করে।
২৪শে মার্চ, ১৯৭১
যুদ্ধংদেহী ছত্র এবং শ্রমিকরা জনগণকে হিংসাত্মক কাজের উস্কানী দিয়ে প্রদেশের বিভিন্ন জায়গায় হাতে লেখা এবং সাইক্লোস্টাইল করা প্রচারপত্র বিলি করা শুরু করে। পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের জেলা কমিটি ঐ ধরণের একটি প্রচারপত্র বিলি করে, যাতে লেখা ছিলঃ
“পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তি আন্দোলন এগিয়ে চলছে। এই দাবানলকে দিকে দিকে ছড়িয়ে দিন। দেশপ্রেমিক বিপ্লবী জনগণ, হাতিয়ার তুলে নিন। শত্রুসৈন্যকে বাধা দিন এবং তাদেরকে নির্মূল করুন। সশস্ত্র প্রতিরোধের মাধ্যমে মুক্ত এলাকাগুলো রক্ষা করুন।”
“দেশবাসী বন্ধুগণ! হাতের কাছে যে অস্ত্র পান তাই হাতে তুল নিন এবং শত্রুদের অগ্রগতি বন্ধ করুন। যে সব জায়গা শত্রুদের নিয়ন্ত্রণে নেই, সেসব জায়গায় সড়ক, সেতু রেলযোগাযোগ প্রভৃতি বিচ্ছিন্ন করে দিন। ঘরে ঘরে হাত বোমা ও মলোটোভ বোমা (Molotov Cocktail) প্রস্তুত রাখুন। যদি আমাদেরকে আত্মসমর্পণ করতে হয় কিংবা আমরা শত্রুকর্তৃক আক্রান্ত হয়ে পড়ি তাহলে আমাদেরকে রক্তক্ষয়ী প্রতিরোধ সংগ্রাম শুরু করতে হবে।”
“মনে রাখবেন, পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তি কেবল সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমেই অর্জিত হতে পারে, যার জন্য দীর্ঘ সময়ও প্রয়োজন হতে পারে। কাজেই গেরিলা যুদ্ধ কৌশল ছাড়া আমরা শত্রুদের প্রতিহত করতে সক্ষম হবো না। যে কোনো মূল্যে মুক্ত এলাকাগুলো রক্ষা করার জন্য প্রস্তুত থাকুন।”
“পূর্ব বাংলার দীর্ঘ সংগ্রাম শেষ পর্যায়ে উপনীত হয়নি, বরং এটাই কেবল শুরু। আমাদেরকে দুর্বল করার জন্য শত্রুরা অর্থনৈতিক অবরোধ সৃষ্টি করতে পারে। পূর্ব বাংলার জন্য অবশ্যম্ভাবী। আমরা পাকিস্তানী উপনিবেশের জিঞ্জির ছিঁড়ে ফেলবো। স্বাধীন পূর্ব বাংলা জিন্দাবাদ।”
রংপুরে উত্তর সৈয়দপুরের গোলাহাট থেকে অগ্নিসংযোগের খবর পাওয়া যায়। লাঠি, সড়কি অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র সজ্জিত ৮ হাজার লোকের এক উন্মুক্ত জনতা সৈয়দপুর অভিমুখে যাত্রা করে সেখানকার অধিবাসীদের উপর আক্রমণ করার জন্য ৫০টি বাড়ীতে আগুন লাগিয়ে দেয়।
২৫শে মার্চ, ১৯৭১
ঢাকার ইঞ্জিয়ারিং কলেজ, ইকবাল হল ও জগন্নাথ হলে ব্যাপকভাবে এসিড বোমা তৈরীর খবর পাওয়া যায়। ঢাকা শহরের সর্বত্র ব্যারিকেড এবং বিভিন্ন রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়।
লন্ডনের টাইমস পত্রিকার ২৫শে মার্চ ১৯৭১ সংখ্যায় প্রকাশিত পাল মার্টিন-এর পাঠানো এক বার্তায় বলা হয়, ঢাকা বিশ্বাবিদ্যালয় মাঠে বিভিন্ন বিপ্লবীবাদী দল ছাত্রদেরকে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের ট্রেনিং দেয়া শুরু করেছে। পূর্ব পাকিস্তানের বহু গ্রামে একটি গণবাহিনীর সূচনা হিসেবে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করা হয়েছে। এই গণবাহিনীর ভবিষ্যৎ কাজ হবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মোকাবেলা করা। ইতিমধ্যেই গত কয়েক সপ্তাহে বিভিন্ন ল্যাবরেটরী থেকে চুরি করা রাসায়নিক দ্রব্য থেকে তৈরী করা পেট্রোল বোমা ও অন্যান্য হাতে তৈরী বোমা পূর্বাঞ্চলীয় রাজধানী ঢাকায় প্রথমবারের মতো দেখতে পাওয়া যাচ্ছে।
সৈয়দপুরে আশেপাশের বিভিন্ন গ্রাম থেকে রাইফেল, গাদাবন্দুক, দা, ছোরা প্রভৃতি অস্ত্রে সজ্জিত জনতার চারটি দল সৈয়দপুর অভিমুখে যাত্রা করে এবং স্থানীয় এলাকা কোলাহাটের উপর আক্রমণ চালায়। এতে তিনজন লোক নিহত ও ১৭ (সতের) জন আহত হয়। আহতদের মধ্যে দুজন বুলেট আঘাতপ্রাপ্ত এবং অন্য ৭ জন বন্দুকের গুলিতে আঘত পায়। বাকী কয়জন আহত হয় লাঠিসোঁটার আঘাতে। ৫০টি বাড়ীও জ্বালিয়ে দেয়া হয়। সৈন্যবাহিনী গুলি ছুড়তে বাধ্য হয়। ফলে তিনজন লোক জখম হয়। পরে আরেক উন্মুক্ত জনতা সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টের উপর আক্রমণ চালায়। তারা সৈন্যদেরকে লক্ষ্য করে বন্দুকের গুলি ছোড়ে। সৈন্যরা পাল্টা গুলি চালালে ৫ জন লোক আহত হয়।
অপরদিকে আরেক জনতা সৈয়দপুর-দিনাজপুর সড়কে ডাক বিভাগের একটি গাড়ীর উপর হামলা চালায় তারা ড্রাইভার এবং কন্ডাক্টরকে গাড়ী থেকে টেনে নামায়। কন্ডাক্টরকে ঘটনাস্থলেই পিটিয়ে হত্যা করা হয়, আর ড্রাইভারটি মারাত্মকভাবে আহত হয়।
চট্টগ্রামে ক্যান্টনমেন্টের সামরিক বাহিনীর লোকদের যাতায়াত এবং অস্ত্রশস্ত্র আনা-নেয়া করার জন্য চট্টগ্রাম বন্দর থেকে আগ্রাবাদগামী রাস্তায় অসংখ্য ব্যারিকেড সৃষ্টি করা হয়। প্রধান সড়কে কয়েকটি ট্রেঞ্চ খনন করা হয় এবং যানবাহন চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টির জন্য রাস্তার উপর ট্রক ও লরি, পিচের ড্রাম, ডাস্টবিন ও ইটপাটকেল ফেলে রাখা হয়।
আওয়ামী লীগের ব্যাপক সশস্ত্র প্রস্তুতি আরেক ধাপ এগিয়ে যায়। শেখ মুজিবুর রহমান সাবেক কর্নেল ওসমানীকে ‘বিপ্লবী বাহিনীর অধিনায়ক’ নিযুক্ত করেন এবং তিনি সরাসরিভাবে শেখ মুজিবের কর্তৃত্বাধীনে থাকবেন। শেখ মুজিবুর রহমান প্রাক্তন সামরিক কর্মচারীদেরকে নিজ পক্ষে তালিকাভূক্ত করার জন্য অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল মজিদ এবং অবসরপ্রাপ্ত লেফটেনেন্ট কমান্ডার ময়াজ্জেমকে নিয়োগ করেন। তালিকা সুষ্ঠুভাবে প্রণয়ন করা হয় এবং তা আওয়ামী লীগের সদর দফতরে রাখা হয়। অন্যদিকে তাদের হাতে অস্ত্র দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। আর এ জন্য ঢাকা, নারায়নগঞ্জ, খুলনা এবং যশোরের অস্ত্র দোকানগুলী লুট করা হয় এবং তা বিদ্রোহীদের ব্যবহারের জন্য সব বড় বড় শহরের মওজুত করা হয়। একমাত্র ঢাকা পুলিশ স্টেশনেই গুলিভর্তি ১৫ হাজার রাইফেল জমা করা হয়।
বিভিন্ন ইপিআর এবং ইবিআর বহিঃফাঁড়ীর মধ্যে অয়্যারলেস ট্রন্সমিটারের সাহায্যে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং এক নিউনিট থেকে দ্রুত অন্য ইউনিটে নির্দেশ পাঠানো হয়। বৃহত্তম পরিচালনা সদর দফতর ছিলো চট্টগ্রামে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সেন্টার।
পরিচালনা কার্যক্রম অত্যন্ত সুষ্ঠভাবে তৈরী করা হয় এবং এমন ব্যবস্থা রাখা হয় যে, ঢাকার আওয়ামী লীগ সদর দফতর থেকে নির্দেশ পাওয়া মাত্রই সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু হয়ে যাবে। যেসব ব্যবস্থা নেয়া হয় সেগুলো হচ্ছেঃ
(ক) আকাশ কিংবা সমুদ্রপথে পাকিস্তানী সৈন্যের আগমন রোধ করার জন্য ইবিআর বাহিনী ঢাকা এবং চট্টগ্রাম দখল করবে।
(খ) ইপিআর, পুলিশ এবং সশস্ত্র রাজাকারদের সাহায্যে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অবশিষ্ট সৈন্যরা বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্ট এবং ফাঁড়ীতে সশস্ত্র সৈন্যদের নির্মূল করবে।
(গ) ইপিআর সীমান্তের সব গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটিগুলো দখল করবে এবং তা বহির্সাহায্যের জন্য খোলা থাকবে।
(ঘ) অবশিষ্ট অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহ করা হবে হিন্দুস্তান থেকে।
(ঙ) আওয়ামী লীগ বিদ্রোহী বাহিনী গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রগুলো দখল এবং পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে পর্যদুস্ত করার প্রথম পর্যায়ে সাফল্য লাভ করা মাত্রই হিন্দুস্তানী সৈন্যরা তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসবে।
শুক্রবার দিন খুব ভোরে এই বিদ্রোহ শুরু হবে বলে সময় ধার্য করা হয়। ২৫শে মার্চ দিনগত রাতে আওয়ামী লীগের পরিকল্পনা অনুযায়ী সশস্ত্র বিদ্রোহ সংগঠন এবং স্বাধীন বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্রের অভ্যুত্থান বাস্তবায়িত করার মাত্র কয়েক ঘন্টা আগে প্রেসিডেন্ট পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীকে তাদের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার এবং সরকারের কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার আহ্বান জানান। সেনাবাহিনী তৎপর হয়ে ওঠে এবং তারা হিন্দুস্তানের সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারী এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস, ইস্ট পাকিস্তান পুলিশ ও আধা সামরিক বাহিনীর বিদ্রোহী লোকদের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের পূর্ব পাকিস্তান দখলের সশস্ত্র পরিকল্পনা বানচাল করে দেয়। পরবর্তী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে বিদ্রোহীদের দমন এবং হিন্দুস্তানী অনুপ্রবেশকারীদেরকে তাড়িয়ে দেয়ার জন্য হিন্দুস্তান সংলগ্ন সীমান্ত বরাবর পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে মোতায়েন করা হয়। এই সময় যেসব এলাকা সাময়িকভাবে বিদ্রোহী এবং হিন্দুস্তানী অনুপ্রবেশকারীদের নিয়ন্ত্রণে আসে সেসব জায়গায় আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসের রাজত্ব যা পহেলা মার্চ থেকে শুরু হয়েছিল তা অব্যাহতভাবে চলতে থাকে। এর ফলে এক লাখেরও বেশী পুরুষ, মহিলা ও শিশুর জীবননাশ হয়। তা ছাড়া বিপুলসংখ্যক সরকারী ও বেসরকারী ভবন, শিল্প প্রতিষ্ঠান প্রভৃতি বিনষ্ট এবং পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষতিসাধিত হয়।
আওয়ামী লীগের যুদ্ধবাজ কর্মী এবং ইপিআর ও ইবিআর- এর বিদ্রোহীরা নরঘাতকের ভূমিকা গ্রহণ করে। আওয়ামী লীগের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অশুভ ইচ্ছার যারা বিরোধীতা করে তারাই তাদের হত্যার শিকারে পরিণত হয়। অবর্ণনীয় বর্বরোচিত কাজ সংঘটিত হয়। বগুড়া জেলার শান্তাহারের একটি এলাকায় ১৫ হাজারেরও বেশী লোককে ঘেরাও করা হয় এবং মাকে তার নিজ সন্তানের রক্ত পান করতে বাধ্য করা হয়। চট্টগ্রামে ১০ হাজারেরও বেশী লোককে হত্যা করা হয়। সিরাজগঞ্জে সাড়ে তিনশ মহিলা ও শিশুকে একটি হলঘরে তালাবদ্ধ করে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। ফলে তারা জীবন্ত দগ্ধ হয়ে মারা যায়। ময়মনসিংহে সানকিপাড়া এলাকায় ২ হাজার পরিবারের একটি কলোনীকে সম্পূর্ণ নির্মূল করা হয়। পুরুষদেরকে ঘর থেকে টেনে বের করে গুলি করে মারা হয় এবং মহিলাদের দিয়ে কবর খোঁড়ানো হয় ও তাদেরকে ধর্ষণ করা হয়। তারপর বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই তাদেরকে হত্যা করা হয়। ঐ ধরণের বর্বরোচিত ও অমানুষিক কয়েকটি ঘটনার কথা বিদেশী পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তার কয়েকটির অংশবিশেষ নিচে উদ্ধৃত কর হলোঃ
‘বর্তমান পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসরত লক্ষ লক্ষ অবাঙ্গালী মুসলমান প্রতি মুহূর্তে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যেকার উত্তেজনার প্রতিক্রিয়ার কথা অনুধাবন করছে এবং আশংকা করা যাচ্ছে যে, বাঙ্গালীরা এই বিরাট সংখ্যক সংখ্যালঘুদের উপর প্রতিশোধ নেবার উদ্দেশ্যে তাদের উপর চড়াও হয়েছে।’
‘স্টেটম্যান’, নয়াদিল্লী ৪ঠা এপ্রিল, ১৯৭১ (পিটার হাজেলহার্ষ্ট)
“দেশ বিভাগের সময় যেসব হাজার হাজার অসহায় মুসলিম উদ্বাস্তু পূর্ব বাংলায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন তাদেরকে গত কয়েক সপ্তাহে পূর্ব পাকিস্তানের ক্রুদ্ধ বাঙালীরা হত্যা করেছে।”
এ সপ্তাহে যেসব বিহারী মুসলমান উদ্বাস্তু সীমান্ত অতিক্রাম হিন্দুস্তানে চলে আসে তারা এই হত্যার কথা জানিয়েছে। আজ একজন তরূণ বৃটিশ টেকনিশিয়ান হিলিতে হিন্দুস্তান পাকিস্তান সীমান্ত অতিক্রম করে। তিনি এই হত্যাকাণ্ডের সত্যতা প্রকাশ করেন।
‘দি টাইমস’ লন্ডন, ৬ই এপ্রিল, ১৯৭১।
‘গতকাল কোলকাতায় যে বৃটিশ জাহাজ নোঙর করা হয় তার যাত্রীরা পূর্ব পাকিস্তানের বন্দরনগরী চট্টগ্রামে ব্যাপক নরহত্যা এবং অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনার কথা জানিয়েছেন’
লেয়ন লামসডেন নামে মার্কিন সাহায্য পরিকল্পনার একজন ইঞ্জিনিয়ার বলেছেন, প্রধানত বাঙালী অধ্যুষিত চট্টগ্রাম শহরে গত সপ্তাহে সেনাবাহিনীর লোক আসার আগে একটানা দুই সপ্তাহ ধরে বাঙলীরা পশ্চিম পাকিস্তানীদের উপর হত্যাযজ্ঞ চালায়।
‘নর্দান ইকো’ ডারলিংটন, ডারহাম, ৬ই এপ্রিল, ১৯৭১।
“যখন ইপিআর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস) বিদ্রোহ করলো তখন তারা প্রথম যে কাজে হাত দিলো তা হচ্ছে বিভিন্ন ব্যাংকে অবাঙালীদের উৎখাত করা।”
“১০ থেকে ১৫ হাজার লোক নিয়ে গঠিত ইপিআর-এর শতকরা ৪০ জন হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানী। তাদের বেশীর ভাগই অফিসার”
“ইপিআর-এর লোকেরা হিন্দুস্তানের সীমান্ত তল্লাশী শহর হরিদাসপুরের কাছে সীমান্ত বরাবর এক গরুর গাড়ী বোঝাই লাশ খালাস করে।”
‘ফার ইস্টার্ন ইকনোমিক রিভিউ’, হংকং, ২৪শে এপ্রিল, ১৯৭১। টি আই এস জর্জ।
“শত শত প্রত্যক্ষদর্শীর কাছ থেকে যে বিবরণ পাওয়া গেছে তাতে ধারণা করা যায় যে, আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, তখন কিছু বাঙালী বিহারীদের ঘরবাড়ী লুট করে এবং তাদেরকে হত্যা করে।”
‘নিউইয়র্ক টাইমস’, ইউইয়র্ক ১০ই মে, ১৯৭১ (ম্যালকম ডব্লিউ ব্রাউন)
“স্থানীয় একটি ব্যাংকের ইউরোপীয় ম্যানেজার বলেন, অত্যন্ত সৈভাগ্যের বিষয় যে সেনাবাহিনীর সময় মতো উপস্থিতির জন্য প্রতিটি ইউরোপীয় জীবিত আছেন, না হলে এ কাহিনী বলার জন্য আমি বেঁচে থাকতাম না।”
‘নিউইয়র্ক টাইমস’, নিউইয়র্ক ১১ই মে, ১৯৭১ (ম্যালকম ব্রাউন)
“এমন প্রমাণ পাওয়া গেছে যে, উন্মুক্ত জনতা অবাঙালীদের উপর আক্রমণ চালিয়ে তাদেরকে হত্যা করে এবং তাদের ঘরবাড়ী জ্বালিয়ে দেয়। এসব অবাঙালীদের অধিকাংশই ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় হিন্দুস্তান থেকে পাকিস্তানে আসে। প্রত্যক্ষদর্শীরা দেড় হাজার বিধবা ও এতিম শিশুর নিদারুণ কাহিনীর কথা উল্লেখ করেন। ময়মনসিংহের উত্তরাঞ্চলের একটি মসজিদে আশ্রয় নিতে যাওয়ার সময় বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে শনাক্তকৃত সশস্ত্র লোকেরা তাদের স্বামী ও পিতাদের হত্যা করে।”
‘সিলোন ডেইলী নিউজ’, কলম্বো ১৫ই মে, ১৯৭১ (মরিস কুয়েনট্যান্স)
“গতকাল এই গুরুত্বপূর্ণ বন্দর নগরীতে সফরকারী সাংবাদিকরা বলেছেন, গোলাগুলির ফলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এবং বিদ্রোহীরা যে বেসামরিক লোককে বিপুল সংখ্যায় হত্যা করেছে তার প্রমাণ পাওয়া গেছে।”
“সাংবাদিকরা ইস্পাহানী পরিবারের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তির মালিকানাধীন পাটকলে একটি বিরাট কবর দেখতে পান, যেখানে ১৫২ জন অবাঙালী মহিলা ও শিশুকে একযোগে সমাহিত করা হয়েছে। বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহীরা তাদেরকে গত মাসে কারখানার চিত্তবিনোদন কেন্দ্রে হত্যা করে।”
“বুলেট ঝাঁঝরা এই ক্লাব কক্ষের মেঝেতে এখনো রক্তমাখা জামা-কাপড় ও বাচ্চাদের খেলনা ছড়িয়ে আছে। দায়িত্বশীল মহল বলেন, চট্টগ্রামে হাজার হাজার পশ্চিম পাকিস্তানী এবং ১৯৪৭ সাল থেকে পূর্ব পাকিস্তানে আগত হিন্দুস্তানী মুসলমানদেরকে ২৫শে মার্চ অর্থাৎ যেদিন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার আন্দোলন শুরু হয় সেদিন থেকে ১১ই এপ্রিল সেনাবাহিনী কর্তৃক শহর পুনর্দখল করার দিন পর্যন্ত পাইকারীভাবে হত্যা করা হয়।”
“স্থানীয় বাসিন্দা সাংবাদিকদের একটি অগ্নিদগ্ধ ভবন দেখায়। তারা জানায়, বাঙালীরা এখানে পশ্চিম পাকিস্তানের সাড়ে তিন শ পাঠানকে পুড়িয়ে মেরেছে।”
‘ওয়াশিংটন পোস্ট’, ওয়াশিংটন, ১২ই মে, ১৯৭১।
(এসোসিয়েটেড প্রেস রিপোর্ট)
“বন্দর শহর চট্টগ্রামে একটি পাটকলের চিত্তবিনোদন ক্লাবে রক্ত মাখানো খেলার পুতুল এবং মলমূত্র দেখতে পাওয়া যায়। বাঙালীরা এখানে ৮০ জন মহিলা ও শিশুকে হত্যা করে। উগ্র স্বদেশিকতার উন্মাদনায় বাঙালীরা কিছুসংখ্যক পশ্চিম পাকিস্তানীকে খুন করে।”
বাঙালী বেসামরিক লোক এবং মুক্তি সৈন্যরা হিন্দুস্তানের বিহার রাজ্য থেকে আগত মোহাজিরদের পাইকারী হারে হত্যা করা শুরু করে এবং বাজার ও অন্যান্য এলাকায় ব্যাপকভাবে ছুরি মারা, গুলি চালনা এবং আগুন লাগানো প্রভৃতি হিংসাত্মক কাজ চালায় আর নারী ধর্ষণ ও লুটতরাজ করে।
.
.
চতুর্থ অধ্যায়
.
হিন্দুস্তানের ভূমিকা
পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রবিরোধী ব্যাক্তিদের সঙ্গে হিন্দুস্তানী যোগসাজশের প্রত্যক্ষ পরিচয় পাওয়া গেলো ১৯৬৭-তে যখন আগরতলা ষড়যন্ত্র উদঘাটিত হলো। কয়েকজন সাক্ষী সাক্ষ্য দিলেন যে শেখ মুজিবুর রহমান এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত ছিলেন ১৯৬৪-র সেপ্টেম্বর থেকেই যখন দেশের অবশিষ্ট অংশ থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে পৃথক করার উদ্দেশ্যে একটি বিপ্লবী সংস্থা গঠিত হয়েছিলো। আগরতলা ষড়যন্ত্রের কর্মপরিকল্পনার প্রধান বিষয় ছিলো সামরিক ইউনিটগুলোর অস্ত্রাগারগুলো দখল করে সেগুলোকে অচল করে দেওয়া। পরিকল্পনা করা হয়েছিল যে এ কাজ করা হবে কমান্ডো কায়দায় এবং দলের লোকসংখ্যা কম বলে আক্রমণ করা হবে অতর্কিতভাবে। এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য ষড়যন্ত্রকারীদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে হিন্দুস্তানের প্রতিনিধিদের এক বৈঠকের ব্যবস্থা করা হয়। হিন্দুস্তানের অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করার কথা ছিলো। ১৯৬৭ সালের ১২ই জুলাই তারিখে হিন্দুস্তানের আগরতলায় এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
১৯৬৭-র ডিসেম্বরে ষড়যন্ত্রকারীদের গ্রেফতার করা হয়। তাদের একজন প্রকাশ করে যে, হিন্দুস্তান পূর্ব পাকিস্তানে সশস্ত্র বিপ্লব গড়ে তোলার জন্য অস্ত্র ও অর্থ সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তা ছাড়াও হিন্দুস্তান বলেছে যে হিন্দুস্তান সরকার ‘চূড়ান্ত দিনে’ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধে যোগাযোগকারী আকাশপথ ও সমুদ্রপথ বন্ধ করে ফেলবে।
হিন্দুস্তান এই পরিকল্পনা কার্যকরী করলো ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে। হিন্দুস্তান বিমান লাইনের একটি ফকার ফ্রেন্ডশিপ বিমানের গতি জোর করে পরিবর্তন করে তাকে লাহোরে নিয়ে যাওয়া হলো। গতি পরিবর্তনকারীরা পরে বিমানটিকে ধ্বংস করে ফেললো। এই ঘটনাকে ছুতো হিসেবে অবলম্বন করে হিন্দুস্তান সরকার তার এলাকার উপর দিয়ে পাকিস্তানী বেসামরিক বিমানের চলাচল বন্ধ করে দিল। এতে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি হলো।
সংশ্লিষ্ট বিমানের যাত্রীদের নিরাপত্তা ও হিন্দুস্তান তাদের আশু প্রত্যাবর্তনের নিশ্চয়তা বিধানের জন্য পাকিস্তান সরকার সম্ভব সব ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন। পুরো ঘটনাটি তদন্ত করে দেখার জন্য একটি তদন্ত কমিশন নিয়োগ করা হলো। তদন্ত কমিশনের রিপোর্টে উদঘাটিত হলো যে, এ ঘটনাটি হিন্দুস্তানী এজেন্টরা ইচ্ছা করেই ঘটিয়েছে। এর পিছনে উদ্দেশ্য ছিল হিন্দুস্তানী সীমানার উপর দিয়ে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বিমান চলাচল বন্ধ করার জন্য একটি ছুতো বের করা এবং পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে অসুবিধা ও উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে তোলা। এ জন্য তারা এক সময়ের অপেক্ষায় ছিলো যা পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক আলোচনার সংকটকাল।
‘গার্ডিয়ান’ পত্রিকার ১৯৭১ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারীর সংখ্যায় পরকাশিত হলোঃ ‘তিনি (মুজিব) প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও তার জেনারেলদের বলেছেনঃ জনসাধারণ আমাকে ভালবাসে, সুতরাং আমাকে স্পর্শ করবেন না। তিনি এ কথা বলেছেন, কারণ তিনি জানেন যে, পূর্ব পাকিস্তানে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সৈন্য এতো কম যে তারা বড় রকমের কিছু করার সাহস পাবে না। আর যেহেতু হিন্দুস্তানের ওপর দিয়ে বিমান চলাচল বন্ধ, কাজেই সৈন্য সংখ্যা বাড়ানোও অসম্ভব।
পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হিন্দুস্তানের হস্তক্ষেপের কারণ বহু। আর এই সমস্যার মূল নিহিত রয়েছে অতীত ইতিহাসে। হিন্দুস্তান পাকিস্তানের সমস্যার মূল কারণ হচ্ছে এই যে হিন্দুস্তান কখনো পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাকে সত্যি সত্যি মেনে নেয়নি। এমনকি বল্লভভাই প্যাটেলের মতো শীর্ষস্থানী দায়িত্বশীল নেতারাও আশা পোষণ করতেন যে, হিন্দু মাতৃভূমিরুপে ভারত পুনরায় যুক্ত হবে। এই আশা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে হিন্দুস্তান পাকিস্তানকে ক্ষতিগ্রস্থ করার জন্য চেষ্টায় কোনো ত্রুটি করেনি। যে হঠাৎ পাকিস্তানের জমিতে পানির প্রবাহ বন্ধ করে দিলো পাকিস্তানের অর্থনীতিকে ব্যাহত করার জন্য লাখ লাখ মুসলমানকে ঘরছাড়া করে পাকিস্তানে ঠেলে দিলো। যে জুনাগড় দখল করে নিলো এই অজুহাত দেখিয়ে যে তার অধিবাসীরা হিন্দু আবার কাশ্মীর দখল করার পেছনে সে অজুহাত দেখালো যে তার শাসনকর্তা হিন্দু। ১৯৬৫ সালে যে পশ্চিম পাকিস্তানের আন্তর্জাতিক সীমানায় সরাসরি আক্রমণ চালিয়ে পাকিস্তানকে আঘাত হানলো। ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের সমাপ্তি ত্বরান্বিত করে সে পূর্ব পাকিস্তানের ২ কোটি ৩০ লাখ লোকের জীবনযাত্রা এবং সারা দেশের অর্থনীতিকে বিপদাপন্ন করে তুললো। এখন পূর্ব পাকিস্তানের ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের মাধ্যমে সে আবার পাকিস্তানের সংহতিকে ক্ষুণ্ন করতে চায়।
১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের শেষের দিকে হিন্দুস্তানী সেনাবাহিনীর একটি উল্লেখযোগ্য অংশকে পশ্চিমবঙ্গে মোতায়েন করা হলো। আপাতদৃষ্টিতে উদ্দেশ্য ছিলো নির্বাচনের সময় অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা রক্ষা করা। নির্বাচন শেষ হয়ে যাওয়ার পর সৈন্য পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার পরিবর্তে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের শেষার্ধে অতিরিক্ত সৈন্য সমাবেশ করা হলো পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তে। এদের সাহায্যের জন্য নিয়োগ করা হলো মাউন্টেন ব্রিগেড, প্যাসুট ব্রিগেড, জঙ্গী বোমারু বিমান এবং বিমান পরিবহন ইউনিট।
সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রবিরোধীদের সাহায্যের জন্য হিন্দুস্তান সেনাবাহিনীর বহু সৈন্যকে বিভিন্ন দিক থেকে পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তের আরও কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া হলো। জেট জঙ্গী বিমান এবং পরিবহন বিমানও সীমান্ত এলাকার বিভিন্ন বিমান ক্ষেত্রে নিয়ে যাওয়া হলো।
পশ্চিম বাংলায় পাঁচ ডিভিশনের ওপর সৈন্য সমাবেশ ছাড়াও সীমান্তরক্ষী বাহিনীর অতিরিক্ত ব্যাটেলিয়ানও মোতায়েন করা হলো। এর আগেই কয়েকটি ব্যাটেলিয়ান পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তে মোতায়েন করা হয়েছিল। এই ভাবে পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তে সমাবিষ্ট হলো প্রায় পচিশটি হিন্দুস্তানী ব্যাটেলিয়ান। এইসব ব্যাটেলিয়ান যাতে বিদ্রোহী ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সাহায্যের জন্য পূর্ব পাকিস্তানে ঢুকতে পারে সে জন্য B.S.F এর (বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স) চিহ্ন সরিয়ে ফেলা হলো। জীপ এবং অন্যান্য যানবাহনের রং বদলে দেওয়া হলো। দিল্লী থেকে বিমানযোগে আরও B.S.F সৈন্য আনানো হলো সব B.S.F কোর্স বাতিল করে দেয়া হলও, পুলিশ বিভাগে ছুটি বন্ধ করে দেওয়া হলো।
হিন্দুস্তানী এলাকার ওপর দিয়ে পাকিস্তানী বিমান চলাচল বন্ধ করেও হিন্দুস্তান ক্ষান্ত হলো না। সে পূর্ব পাকিস্তানের সমুদ্র পথেও বাধা সৃষ্টি করতে চাইলো। ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের দুই তারিখ হিন্দুস্তানী নৌঘাঁটি দেয়ারকার ৭০ মাইল পশ্চিমে যুদ্ধ জাহাজ The ocean Endurance নামক একটি পাকিস্তানী সওদাগরী জাহাজকে হয়রান করলো। হয়রানির থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য জাহাজটিকে করাচী ফিরতে হলো। তিন দিন পর হিন্দুস্তানী যুদ্ধজাহাজ আর একটি পাকিস্তানী জাহাজকে হয়রান করলো। এটি ছিল সফিনায়ে আরব। জাহাজটি হাজীদের নিয়ে চট্টগ্রাম যাচ্ছিল। হিন্দুস্তানের দক্ষিণ সীমান্তে কার্যরত আকাশ ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপকারী একটি নতুন ইউনিট অনুশীলন চালাতে গিয়ে উপকূল থেকে ১২৩ মাইল দূর পর্যন্ত ক্ষেপণাস্ত্র ছড়তে থাকে। এইভাবে তারা পাকিস্তানী বেসামরিক বিমানকে আরও দক্ষিণ দিক দিয়ে যেতে বাধ্য করে।
হিন্দুস্তানী বিমানবাহিনীও এমন সব ব্যবস্থা গ্রহণ করতে থাকে, যা থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠে যে তারা একটি সম্ভাব্য যুদ্ধের প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছে। পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ব সীমান্তে শিকারী জঙ্গীবিমান ও অতিরিক্ত পরিবহন বিমান মোতায়েন করা হলো, পূর্ব পাকিস্তানের পশ্চিম ও উত্তর সীমান্তসংলগ্ল ঘাঁটিগুলোতে প্রস্তুতি আরও জোরদার করা হলো। বঙ্গোপসাগরে পাকিস্তানী জাহাজগুলোর চলাচল পর্যবেক্ষণ করার জন্য কোলকাতার কাছে ব্যারাকপুরে কয়েকটি পর্যবেক্ষণ বিমান মোতায়েন করা হলো। পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত এলাকা জুড়ে ব্যাপকভাবে ফটো গ্রহণের কাজ চালানো হয়।
হিন্দুস্তানী সীমান্ত বাহিনীর লোকেরা স্থলপথে পূর্ব পাকিস্তানের ঢুকতে শুরু করলো এবং এই উদ্দেশ্য যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস করা হলো। হিন্দুস্তান বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কাছে গোপনে অস্ত্রশস্ত্র পাঠাতে লাগলো। এমন বহুসংখ্যক রাইফেল হস্তগত করা হয়, যাতে হিন্দুস্তানী রাইফেল ফ্যাক্টরি ইসাপুরের ছাপ রয়েছে। গোলাবারুদে পাওয়া গেছে হিন্দুস্তানের ফিরকী ফ্যাক্টরীর ছাপ।
এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, হিন্দুস্তানের সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর ৭৬, ৮১, ৮৩, ১০১, ১০৩ ও ১০৪ নম্বর ব্যাটেলিয়ানকে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের শেষের দিক থেকে পূর্ব পাকিস্তানে কাজে লাগানো হয়েছিলো। পরবর্তী তথ্য থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে, এছাড়া আরও দুটি ব্যাটেলিয়ানকে কাজে লাগানো হয়েছিলো। ৭৩ নম্বর B.S.F ব্যাটেলিয়ানকে কুচবিহারের মোখিলগঞ্জ এলাকায়, ৭৭ নম্বর B.S.F ব্যাটেলিয়ানকে দিনাজপুরের পশ্চিমাঞ্চলে এবং ১৮ নম্বর B.S.F ব্যাটেলিয়ানকে যশোরের পশ্চিম বনগাঁও নিযুক্ত করা হয়েছিল। হিন্দুস্তান সেনাবাহিনীর সিনিয়র কমান্ডাররা যুদ্ধাকার্য পরিচালনা করতো। এদের মধ্যে একজন ছিল ৬১ নম্বর মাউন্টেন ব্রিগেডের কমান্ডার। সম্প্রতি এই ব্রিগেডিটিকে পূর্ব পাকিস্তানের রাঙামাটির ২৫ মাইল উত্তর-পূর্বে ডিমগিরিতে মোতায়েন করা হয়েছে।
হিন্দুস্তানী অনুপ্রবেশ শুরু হওয়ার পরবর্তী সপ্তাহগুলোতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বহু পরিমাণ হিন্দুস্তানী অস্ত্রশস্ত্র হস্তগত করেছে। নওয়াবগঞ্জ এলাকায় সেনাবাহিনী এখটি গোপন পত্র পেয়েছে। পত্রটি ‘ভারী অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ’ সম্পর্কে সীমান্তের ওপারে হিন্দুস্তানী এজেন্টের সঙ্গে আলোচনা বৈঠকের বিষয়ে লিখিত। লেখক আওয়ামী লীগের একজন নেতা।
পূর্ব পাকিস্তান সংকটের একেবারে গোড়া থেকেই যে হিন্দুস্তান এর সঙ্গে জড়িত ছিল, তার প্রমাণ এখন হিন্দুস্তান ও অন্যান্য বিদেশী তথ্য মাধ্যমের পরিবেশিত সংবাদ থেকে পাওয়া যাচ্ছে। একজন হিন্দুস্তানী সাংবাদিক ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে ২৯ তারিখে কোলকাতা থেকে প্রেরিত এক রিপোর্টে বলেন যে, বিদ্রোহীরা (তথাকথিত মুক্তিবাহিনী) হিন্দুস্তানের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করেছিলো। বোম্বাই-এর ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস প্রকাশিত খবরে সাংবাদিক কুষ্টিয়ায় শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তিবাহিনী কমান্ডারের উদ্বৃতি দিয়েছেন। কমান্ডার তার নাম প্রকাশ করতে চায়নি। কমান্ডার বলেছে, নদীয়ার সীমান্তবর্তী কুষ্টিয়ায় বিদেশী সৈনুদের দুটি ইউনিট নিহত হওয়ার পর অথবা কুষ্টিয়া থেকে তাদের অপসারণের পর কমান্ডার সঙ্গে সঙ্গে কোলকাতায় টেলিফোন করে। সে প্রথমে বলে মিঃ অজয় মুখার্জীর সঙ্গে সেই সপ্তাহেরই শেষের দিকে যার পশ্চিম বাংলার নতুন মুখ্য উজীর হওয়ার কথা। এরপর কমান্ডার কয়েকজন সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলে।
‘বাংলাদেশ’-এর প্রতি সমর্থন জানিয়ে হিন্দুস্তানের কয়েকটি প্রাদেশিক পরিষদে সরকারীভাবে প্রস্তাব গ্রহণ করা হলো। এই প্রদেশেগুলোর মধ্যে রয়েছে তামিলনাড়ু, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, কেরালা, রাজস্থান, উত্তর প্রদেশ, গুজরাট ও ত্রিপুরা। পশ্চিম বাংলার ডেপুটি মুখ্য উজীর বললেন, যদিও কেন্দ্রীয় সরকার এখনও বাংলাদেশের প্রতি স্বীকৃতি জানায়নি কিন্তু পশ্চিম বাংলায় আমরা বাংলাদেশের প্রতি এখন থেকেই স্বীকৃতি জানাচ্ছি।
এদিকে পূর্ব পাকিস্তান পরিস্থিতি সম্পর্কে হিন্দুস্তানী প্রধান উজীর নিজেই একটি প্রস্তাব উপস্থাপন করলেন। ১৯৭১ সালের ৩০শে মার্চ তারিখে হিন্দুস্তানী পার্লামেন্টের উভয় পরিষদেই প্রস্তাবটি গৃহীত হলো। এই প্রস্তাবে ‘পূর্ব বাংলার জনগণের প্রতি গভীর সহানুভূতি ও সংহতি প্রকাশ করা হয় এবং তাদের (বিচ্ছিন্নতাবাদীদের) আশ্বাস দেওয়া হয় যে, ‘হিন্দুস্তানের জনগণ তাদের সংগ্রাম সর্বান্তঃকরণে সহানুভূতি জানাবে ও সমর্থন যোগাবে।’
হিন্দুস্তানের পার্লামেন্টে গৃহীত ‘বাংলাদেশ’ সম্পর্কিত প্রস্তাবটি বক্তৃতা প্রসঙ্গে অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কর্তৃক ‘সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত’ হয়। এই প্রস্তাব সম্পর্কে বক্তৃতা প্রসঙ্গে কংগ্রেস কমিটির পশ্চিম বাংলা ইউনিটের জেনারেল সেক্রেটারী মিঃ কে, কে, শুকলা বললেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান যে যুদ্ধ করছেন সেটা হিন্দুস্তানেরই যুদ্ধ।’
হিন্দুস্তানী প্রধান উজীর শেখ মুজিবুর রহমানের সাহায্যের জন্য তহবিল সংগ্রহের আবেদন জানালেন। হিন্দুস্তানের সর্বত্র সরকারী সমর্থনপুষ্ট কমিটি গঠিত হলো। পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সাহায্যের জন্য তারা চাঁদা তুলতে শুরু করলো। বিহার প্রদেশের মুখ্য উজীর কর্পুরী ঠাকুর ঘোষণা করলেন যে, তার সরকার এই তহবিলে ২৫ লাখ টাকা দান করবে। মুখ্য উজীর ঠাকুরের উদ্বৃতি দিয়ে বোম্বাই ‘ইন্ডিয়ান নেশন’ পত্রিকার ১৯৭১ সালের ৬ই এপ্রিলের সংখ্যায় একটি খবর প্রকাশিত হয়। এই খবর অনুসারে “বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর প্রতি অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহসহ সম্ভব সর্বপ্রকার সাহায্যদানের দৃঢ় সংকল্পের কথা ঠাকুর মহাশয় পুনরায় দৃঢ়তার সঙ্গে উল্লেখ করেন। তিনি আরো বলেন, পরিণতি যাই হোক না কেন, বাংলাদেশের প্রতি অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহের ব্যাপারে আমি অটল।”
শেখ মুজিবের মুক্তিবাহিনীর জন্য অস্ত্রশস্ত্র ক্রয় এবং পূর্ব পাকিস্তানে সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারী পাঠানোর জন্য এই সব অর্থ সংগ্রহ করা হলো।
এপ্রিল মাসের ৫ তারিখে সাংবাদিকরা হিন্দুস্তানী প্রধান উজীরকে প্রশ্ন করেছিলেন যে এসব অস্ত্রশস্ত্র পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানোর জন্য কোনো ব্যবস্থা করা হয়েছে কি না। এর জবাবে তিনি বলেছিলেন, তিনি এ ব্যাপারে প্রকাশ্যভাবে কিছু বলতে পারেন না। কারণ এটা একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। স্টেটম্যান এবং অন্যান্য কয়েকটি হিন্দুস্তানী সংবাদপত্রে এ খবর প্রকাশিত হয়েছিলো।
পূর্ব পাকিস্তানের গোলযোগ সৃষ্টির জন্য হিন্দুস্তানী এখনো বিদ্রোহীদের নিযুক্ত করে যাচ্ছে এবং তাদের ট্রেনিং দিয়ে চলেছে। লন্ডন টাইমস এর একজন প্রতিনিধি ব্যক্তিগতভাবে এই ধরনের একটি রিক্রুটিং সেন্টার পরিদর্শন করেছেন।
১৯৭১ সালের ১৮ই জুন তারিখে প্রেরিত এক খবরে তিনি বলেন যে, শিক্ষা কেন্দ্রের অফিসার ইন চার্জ দাবী করেন যে তথাকথিত ‘বাংলাদেশ’ বাহিনীর সবগুলো ট্রেনিং কেন্দ্রেই বাংলাদেশের কোথাও অবস্থিত। কিন্তু লন্ডন টাইমস-এর প্রতিনিধি যখন জানতে চান যে, এটা একটা সামরিক গোপনীয় তথ্য। লন্ডন টাইমস এর প্রতিনিধি আরও জানান, হিন্দুস্তানের পশ্চিমবঙ্গের অভ্যন্তরে এরকমের প্রায় শ’খানের কেন্দ্র রয়েছে। তিনি আরও বলেন যে, রিক্রুটিং সেন্টারগুলোর এমন সব জায়গায় অবস্থিত, যেগুলো বাইরে থেকে দেখলে মনে হয় যে এগুলো উদ্বাস্তুদের রেজিস্ট্রেশন অফিস। লন্ডন টাইমস-এর প্রতিনিধি খবর অনুসারে যাদের রিক্রুটিং সেন্টারে নিয়োগের নেই। পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে তাদের গুলি করে মারা হবে। লন্ডন বৃটিশ দৈনিক গার্ডিয়ানে প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়েছে যে পূর্ব পাকিস্তান থেকে যেসব সশস্ত্র বিদ্রোহীরা সম্প্রতি সীমান্তের ঐ পারে চলে গেছে হিন্দুস্তানীরা প্রকাশ্যভাবে তাদের আশ্রয় দিচ্ছে। এইসব বিদ্রোহীদের মধ্যে রয়েছে পূর্ব পাকিস্তান রাইফেল বাহিনীর লোক, সামরিক বাহিনীর লোক এবং অন্যান্য লোক এবং অন্যান্যরা।’ গার্ডিয়ান প্রতিনিধি একটি বর্ডার ক্রসিং পয়েন্টে হিন্দুস্তানী সীমান্তবর্তী বাহিনীর অবস্থানের পাশে তাঁবু খাটানো একটি শিবির রাইফেলধারী সশস্ত্র ব্যক্তিদের স্বচক্ষে দেখেছেন।
লাগোসের নাইজেরিয়ান ট্রিবিউন নামক পত্রিকার মে মাসের ১৪ তারিখের সংখ্যায় বলা হয়েছে, “হিন্দস্তান পূর্ব পাকিস্তান-হিন্দুস্তান সীমান্ত বরাবর ছ’টি রিলিফ কেন্দ্র স্থাপন করেছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য অস্ত্রশস্ত্র ও অনুপ্রবেশকারীদের এই সব কেন্দ্রের মধ দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানো হয়।”
কলম্বিয়া ব্রডকাস্টিং সিস্টেমের প্রতিনিধি আর্নেস্ট ওয়েদাবল ১৯৭১ সালের ৩১ শে মার্চ তারিখে নয়াদিল্লী থেকে প্রেরিত এক রিপোর্টে জানালেনঃ মুজিব ও তার বেআইনী ঘোষিত আওয়ামী লীগ যে আগে থেকে সতর্কতার সঙ্গে সামরিক অভিযানের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল তার সব রকম আভাসই পাওয়া যাচ্ছে। এই মুক্তিবাহিনীর প্রথম লক্ষ্য ছিল চট্টগ্রাম বা পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র গভীর সামুদ্রিক বন্দর। এই বন্দরটি একবার ধ্বংস হয়ে গেলেই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পূর্ব পকিস্তানে সৈন্য সরবরাহের ব্যাপারে মুশকিলে পড়তেন। দ্বিতীয় লক্ষ্য ছিল ঢাকা অধিকার করা। যাতে তা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মূল ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহৃত না হতে পারে।
মুজিব বহু দিন যাবৎ বাইরে থেকে সরবরাহ পেয়ে আসছিলেন বলে বিশ্বাস এবং ১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চ তারিখ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া কর্তৃক ব্যবস্থা গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত এসব লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। নয়াদিল্লীতে অবস্থিত বহু বিদেশী কুটনীতিবিদ মনে করেন যে, এসব অস্ত্রশস্ত্র একমাত্র হিন্দুস্তান থেকেই আসা সম্ভব ছিলো।
লন্ডন টাইমস-এর প্রতিনিধি পশ্চিমবঙ্গের ২৪ পরগনা থেকে প্রেরিত এক রিপোর্টে বলেছেন যে, বোমা ও বন্দুক সীমান্ত দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে সরবরাহ করা হচ্ছে এবং পূর্ব বাংলার বেনাপোল সীমান্ত ফাঁড়ির কাছে পশ্চিম বাংলার গেরিলাদের উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া গেছে।
২৮শে এপ্রিল তারিখে নয়াদিল্লী থেকে প্রেরিত এএফপির খবরে বলা হয়েছে- ‘পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ করার জন্য ১০ হাজার প্রাক্তন সৈনিককে সংঘবদ্ধ করা হচ্ছে।’
লন্ডন টাইমস ১৯৭১ সালের জুন মাসের ২ তারিখের সংখ্যায় বলা হয়েছে, “হিন্দুস্তান সরকারই প্রায় সব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ মতবাদটিকে জিইয়ে রাখছে।” পত্রিকাটির কোলকাতা প্রতিনিধি বলেন যে, “সীমান্তের কাছাকাছি প্রায় ২০টি শিবিরে হিন্দুস্তানী ইনসট্রাকটাররা প্রায় ৩০ হাজার রিক্রুটকে ট্রেনিং দিচ্ছে।” তিনি আরও বলেন যে, “তথাকথিত ‘স্বাধীন বাংলাদেশ বেতার’ হিন্দুস্তানী এলাকায় অবস্থিত। তিনি বলেন, ‘কয়েক সপ্তাহের নীরবতার পর আজ আবার ‘স্বাধীন বাংলাদেশ বেতার’-এর কণ্ঠ শোনা গেলো। বেতার থেকে ঘোষণা করা হলো যে কয়েকটি এলাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পরাজিত করা হয়েছে। আজ সকালে আমি একটি বেতার দিকনির্দেশকযন্ত্রের সাহায্যে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার’ কোন দিকে অবস্থিত তা পরীক্ষা করার চেষ্টা করলাম। আশ্চর্যের বিষয়, দিকনির্দেশযন্ত্রে ধরা পড়লো যে স্বাধীন বাংলা বেতারের শক্তিশালী ও স্পষ্ট ধ্বনি যেদিকে বাংলাদেশ অবস্থিত সেই পূর্ব দিক থেকে আসছে না বরং তা আসছে উত্তর দিক থেকে, যেদিক থেকে অল ইন্ডিয়া রেডিওর ধ্বনি আসে। শহরের অন্য কয়েকটি জায়গা থেকেও আমি অনুরূপ পরীক্ষা চালালাম। প্রতিবারই নির্ভুলভাবে ধরা পড়লো উত্তর দিক। উত্তরে চিনশুরা ও মাগুরার কাছে যেখানে অল ইন্ডিয়া রেডিওর ট্রান্সমিটার অবস্থিত সেই দিক থেকেই আসছে স্বাধীন বাংলা বেতার এর ধ্বনি।”
১৯৭১ সালের ১৪ই এপ্রিল তারিখে লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় কোলকাতা প্রতিনিধি মার্টিন উলাকটের প্রেরিত একটি খবর প্রকাশিত হয়। অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের সদস্যরা বাংলাদেশের কোথাও রয়েছেন বলে হিন্দুস্তানী সংবাদপত্রগুলোতে যে খবর প্রকাশিত হয়, মার্টিন উলাকট তাকে কাল্পনিক বলে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, তাদের সবাই কলকাতাতেই রয়েছেন আর তাদের রাখা হয়েছে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে। প্রতিনিধি আরও বলেন যে, গত শুক্রুবার তথাকথিত স্বাধীনতা ঘোষণার যে অনুষ্ঠান হলো, তাতে চেয়ার ও অন্যান্য আসবাবপত্র দিয়ে হিন্দুস্তানীরা এইসব ব্যক্তিদের সাহায্য করেছে। হিন্দুস্তানী সেনাবাহিনীর লোক সাদা পোশাকে সেখানে পাহারায় নিযুক্ত ছিলো।
প্যারিসে যে মণ্ডি নামক ফরাসী দৈনিক পত্রিকার ২০শে এপ্রিলের সংখ্যায় বলা হয়েছে, “অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা করা হয়েছে হিন্দুস্তানী সীমান্ত থেকে এক মাইল দূরে একটি গাছে নিচে। বিদেশী সাংবাদিকদের দেখানোর জন্য। এই সরকার যে পূর্ব পাকিস্তানী এলাকার মধ্যেই রয়েছে- এ কথা প্রমাণ করাই ছিল এ অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য।”
পূর্ব পাকিস্তানের ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপে সাহায্য করা এবং সেখানে অনুপ্রবেশকারী পাঠানো ছাড়াও হিন্দুস্তান, পাকিস্তানের সীমান্ত বরাবর সর্বত্র উত্তেজনা বৃদ্ধি করেছে। পাকিস্তান এ ব্যাপারে হিন্দুস্তানের কাছে কয়েকটি প্রতিবাদ পত্র পাঠিয়েছে। ১৯৭১ সালের জুন মাসের ২১ ও ২২ তারিখে দুটি প্রতিবাদ পত্র পাঠানো হয়। এগুলোতে নিম্নলিখিত ঘটনাগুলির উল্লেখ করা হয়।
(১) ১৬ই জুন তারিখে সশস্ত্র হিন্দুস্তানীরা কোনরকম উস্কানী ছাড়াই যশোর জেলার বেনাপোলের কাছে পাকিস্তানী এলাকায় (QT 7542) ও (QT 7642) মেশিনগান ও ৩ ইঞ্চি মর্টারের সাহায্যে গোলাবর্ষণ করা।
(২) ১৭ই জুন তারিখে হিন্দুস্তানের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সৈন্যরা বেআইনী ভাবে পাকিস্তানী এলাকায় অনধিকার প্রবেশ করে ময়মনসিংহ জেলার একটি গ্রামের (RF 6898) দুজন লোককে হত্যা করে।
(৩) ১৭ই জুন তারিখে ময়মনসিংহের অন্তর্গত কমলাপুর (QE 8512) সীমান্ত ফাঁড়িতে কোন উস্কানী ছাড়াই একবার সকাল সাড়ে ৫টা থেকে ৬টা পর্যন্ত এবং আবার বেলা ১১টা ৪০ মিনিট থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত ছোটখাটো অস্ত্র ও মর্টারের সাহায্যে গুলি চালানো হয়। এতে ২ জন লোক নিহত ও ৩ জন আহত হন।
(৪) ১৭ই জুন তারিখে যশোর জেলার বেনাপোলের কাছে একটি পাকিস্তানী টহলদার দলের ওপর গুলি চালানো হয়।
(৫) জুন মাসের ১৭ ও ১৮ তারিখের মধ্যবর্তী রাত্রে হিন্দুস্তানী বাহিনী কোন উস্কানী ছাড়াই ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্গত কমলাপুর (QE 8512) সীমান্ত ফাঁড়িতে আবার ভারী মর্টার ও ছোটখাট অস্ত্রের সাহায্যে গুলি বর্ষণ করে।
(৬) ১৮ই জুন তারিখে সশস্ত্র হিন্দুস্তানীরা কুমিল্লা (RR 3499) জেলায় মর্টার ও ছোটখাট অস্ত্রের সাহায্যে গোলাগুলি বর্ষণ করে। এতে ৪ জন লোক গুরুতরভাবে আহত হয়।
(৭) ১৮ই জুন তারিখে হিন্দুস্তান সেনাবাহিনী কোন রকম উস্কানী ছাড়াই পূর্ব পাকিস্তানের কুমিল্লা জেলার সালদানদী এলাকা (RM 2818) যশোর জেলার বেনাপোল ও মসলিয়া এলাকা (QT 8665) এবং সিলেট জেলার চাতালপুর এলাকায় (RH 1703) মর্টার ও ছোটখাট অস্ত্রের সাহায্যে গোলাগুলি বর্ষণ করে।
(৮) ১৮ই জুন হিন্দুস্তানের সশস্ত্র লোকজন দিনাজপুর জেলার কিশোরগঞ্জ সীমান্ত ফাঁড়ির (QD 3158) উপর ১ রাউন্ড ৩ ইঞ্চি মর্টার গোলা বর্ষণ করে।
১৯৭১ সালের ৩রা জুলাই, হিন্দুস্তান বিমান বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের দিনাজপুর জেলার অমরখানার উপর হামলা চালায়, সেই তারিখে বেলা সাড়ে বারোটার সময় হিন্দুস্তান বিমান বাহিনীর চারটি জঙ্গী বিমান এবং একটি সশস্ত্র হেলিকপ্টার বেআইনীভাবে পাকিস্তানী আকাশসীমার ৬ মাইল অভ্যন্তরে চলে আসে এবং মেশিনগান ও অন্যান্য অস্ত্রের সাহায্যে গোলাবর্ষণ করে। পরে বিকেলের দিকে (৩রা জুলাই) হিন্দুস্তানী এলাকা থেকে ১২০ মিলিমিটার মর্টারের সাহায্যে অমরখানার উপর প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ করে।
হিন্দুস্তানের প্রকৃত উদ্দেশ্য পরিষ্কার, ১৯৭১ সালের পয়লা এপ্রিল “Yorkshire Post” পত্রিকা বলেন, “পাকিস্তানে হিন্দুস্তানের উচ্ছেদমূলক তৎপরতা, পূর্ব পাকিস্তানে একটি বাহিনী গড়ে তোলার প্রয়াস এবং গোটা পাকিস্তানকেই ধ্বংস করার তার চক্রান্ত এ সবের পেছনে দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের জন্মতারিখ থেকেই এ সবের সূচনা। সেদিন থেকেই হিন্দুস্তান কখনো পাকিস্তানের সৃষ্টিকে মেনে নেয়নি এবং সেই রাষ্ট্রকে পঙ্গু করার জন্য যে সব রকম কৌশলই খাটিয়েছে।” লন্ডনের “Daily Telegraph” এ David Loshak বলেন, হিন্দুস্তান তার প্রধান প্রতিপক্ষের খণ্ডবিখণ্ড কিংবা দুর্বল হওয়ার মধ্যে তার নিজের মঙ্গল ছাড়া কিছুই দেখতে পায় না।
তিনি আরো বলেন, “নিরীহ জনগণের দুর্ভাগ্যের জন্য কোন উদ্বেগ নয় বরং তার এই চিন্তাধারাই বাংলাদেশ এর পক্ষে হিন্দুস্তানের প্রচারণা যুদ্ধে পেছনে রয়েছে।” সমসাময়িক এশীয় বিষয়াদির উপর আরেকজন প্রখ্যাত বৃটিশ ভাষ্যকার Michael Edwards, ১৯৭১ সালের পয়লা এপ্রিল BBC-র ‘আজকের বিশ্ব’ অনুষ্ঠানে প্রচারিত এক আলোচনায় বলেন, “পূর্ব পাকিস্তানের গোলযোগ সৃষ্টিকারীদের সমর্থনে বিবৃতি দেয়া এবং বিক্ষোভ সংগঠনের ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীর মধ্যে যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে তাকে এই পটভূমিকায়ই বিচার করতে হবে। পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে একত্রীকরণের যে উদ্যোগ পশ্চিমবঙ্গে দেখা গিয়েছে তার পেছনে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে। বাংলা বিভাগকে বানচাল করে দিয়ে পশ্চিম বঙ্গীয় নেতারা পূর্ব পাকিস্তানের উপর তাদের প্রাধান্য চাপানো এবং তাদের কলকারখানার কাঁচামালের উৎস পুনঃপ্রতিষ্ঠার আশা পোষণ করছেন।”
হিন্দুস্তানের নিজের লেখক ও ভাষ্যকাররা পাকিস্তানের ব্যাপারে হিন্দুস্তানের চূড়ান্ত লক্ষ্য সম্পর্কে কোন সন্দেহের অবকাশ রাখনেনি।
১৯৭১ সালের দোসরা এপ্রিল, হিন্দুস্তানী পত্রিকা “Free press Journal” বলেন, “আমাদের হিন্দুস্তানের কার্যকলাপকে সচেতনভাবে এবং বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে পাকিস্তানকে দুর্বল করার লক্ষ্যের দিকে পরিচালিত করতে হবে।”
পত্রিকাটি আরো বলেন, “কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ পূর্ববঙ্গ হয়তো কাশ্মীরের উপর হিন্দুস্তানের সার্বভৌমত্বকে স্থায়ীভাবে স্বীকৃতি দিতে রাজী হবে। এর দুদিন আগে ১৯৭১ সালের ৩০শে মার্চ বোম্বাই এর দৈনিক সংবাদপত্র “The Indian Express” পূর্ব পাকিস্তানের সশস্ত্র হস্তক্ষেপের খোলাখুলিভাবে সমর্থন না করে বলেন, “এটা একটি সত্যিকারের ঐতিহাসিক ক্ষণ এবং ঠিক এই মুহূর্তেই হচ্ছে কাজ করার লগ্ন।” ১৯৭১ সালের ৭ই এপ্রিল হিন্দুস্তানের প্রতিরক্ষা গবেষণা ইনষ্টিটিউটের ডিরেক্টর Mr. Subramaniam পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দুস্তানের সমর্থনপুষ্ট বিদ্রোহের প্রসঙ্গে বলেনঃ
“হিন্দুস্তানকে যে জিনিসটি অবশ্যই হৃদয়ঙ্গম করতে হবে তা এই যে পাকিস্তানের খণ্ডবিখণ্ড হওয়া আমাদের স্বার্থের অনুকূল এবং আজ আমাদের সামনে এমন একটি সুযোগ এসেছে যার মতো সুযোগ আর কখনও আসবে না।”
১৯৭১ সালের ১৫ই জুন হিন্দুস্তানী দৈনিক পত্রিকা “Motherland”-এ প্রকাশিত এক প্রবন্ধে আরেকজন হিন্দুস্তানী ভাষ্যকার Subramaniam Swamy যুক্তি পেশ করেন যে, “পাকিস্তানের আঞ্চলিক অখণ্ডতার দিকে লক্ষ্য রাখা আমাদের কাজ নয়। সেটা পাকিস্তানের মাথাব্যথা। আমাদের শুধু দুটো প্রশ্ন বিবেচনা করতে হবে। পাকিস্তানের খণ্ডবিখণ্ড হওয়া কি আমাদের দীর্ঘমেয়াদী অনুকূলে? আর যদি তা সত্যিও আমাদের স্বার্থের অনুকূল হয় তাহলে আমাদের এ ব্যাপারে কি কিছু করার রয়েছে?” ভাষ্যকার এই সিদ্ধান্তে পৌছান যে, “পাকিস্তানের খণ্ডবিখণ্ড কেবল আমাদের বাইরে নিরাপত্তার জন্যই অনুকূল নয়, তা আমাদের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তারও অনুকূলে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে হিন্দুস্তানের একটি মহাশক্তি রুপে গড়ে উঠা উচিত এবং এই ভূমিকা পালনের জন্য আমাদেরকে জাতীয় পর্যায়ে আমাদের নাগরিকদেরকে সু-সংবদ্ধ করতে হবে। আর এজন্য অপরিহার্য পূর্বশর্ত হচ্ছে পাকিস্তানকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করা।”
সর্বোপরি, ১৯৭১ সালের ১৫ই জুন হিন্দুস্তানের প্রধান উজীর স্বয়ং ঘোষণা করেন, “বাংলাদেশ এর অবসান ঘটিয়ে দেয় এমন একটি রাজনৈতিক মীমাংসা হিন্দুস্তান এক মুহূর্তের জন্যও মেনে নেবে না।”
.
.
[শিরোনাম পড়া যাচ্ছেনা]
পূর্ববর্তী অধ্যায়গুলোর আলোকে আমরা পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রতিক মর্মান্তিক ঘটনাবলীকে তার যথার্থ পটভূমিকায় দেখতে পারি। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চর আগে আওয়ামী লীগ উগ্রপন্থীরা যে সব নৃশংস ও অরাজকতা মূলক কার্যকলাপ চালিয়েছে প্রতিশোধমূলক প্রতিক্রিয়া এড়ানোর উদ্দেশ্যে তা প্রচার করা হয়নি। কিন্তু এর ফলে এই ধারণার সৃষ্টি হয়েছে যে, ফেডারেল সরকারের ব্যাবস্থার লক্ষ্য ছিল একটি গণআন্দোলনকে দাবিয়ে দেয়া। এখন অবশ্য বুঝতে পারা যাচ্ছে যে, সশস্ত্রবাহিনী আইন- শৃংখলা এবং সরকারের কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্যই গিয়েছিলেন। কারণ আওয়ামীলীগের ২৫ দিনব্যাপী অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের সময় আইন- শৃংখলা এবং সরকারের কর্তৃত্ব মারাত্মক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল।
আবেগ্মুক্ত মন নিয়ে এই শ্বেতপত্রে দেয়া তথ্য প্রমাণাদি বিচার করলে পরিষ্কার হয়ে উঠে যে, প্রেসিডেন্ট তার সাধ্যমত চেষ্টা চালিয়েছিলেন নির্বাচনে গণপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবেশ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে বিভিন্ন দলের মধ্যে একটি মতৈক্য প্রতিষ্ঠা করতে। কারণ এ ধরণের মতৈক্য ছাড়া একটা সত্যিকারের ফেডারেল ব্যাবস্থা কায়েম করা সম্ভব নয়। তিনি ধর্যসহকারে আওয়ামীলীগের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যান এবং সরকারের সর্বপরি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠাকে এতটাই বিলম্বিত করেন যে কেউ কেউ এখন মনে করছে যে পরিস্থিতি বিষাদের প্রান্তসীমায় পৌঁছে গিয়েছিল। শেখ মুজিবুর রহমান এবং আওয়ামীলীগের অন্যন্য নেতাদের অবশ্য ক্রমেই তাদের দাবী বাড়িয়ে যেতে থাকেন। তাঁরা সম্পুর্ন ভুলে যান যে, আওয়ামীলীগের ৬ দফা অনুসারেও জনগণ তাদের যে রায় দিয়েছেন তা ছিল একটি ফেডারেশনের অধীনে স্বায়ত্বশাসনের জন্য। আলোচনার শেষের দিকে তাদের খসড়া ঘোষণাপত্রে একটি কনফেডারেশনের কথা বলা হয়। কনফেডারেশন হচ্ছে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রসমূহের একটি জোট। এছাড়াও এই ঘোষণা পত্রে তাদের এই দেশকে ভাগ করার সংকল্পের সুস্পষ্ট আভাস ছিল। এটা একদিকে অন্য ফেডারেটিং ইউনিটগুলোর নেতা ও দলগুলোর কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। অন্য দিকে, পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতি অক্ষুণ্ণ রাখার মৌলিক প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রেসিডেন্ট যে আইঙ্কাঠামো আদেশ জারী করেন এবং যার অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, সেই আইঙ্কাঠামো আদেশের শর্তাবলীরও এটা ছিল সুস্পষ্ট লংঘন।
আওয়ামীলীগের নেতারা তাদের সাফল্যের জন্য কতগুলো জিনিসের উপর নির্ভর করছিল। তাঁরা মনে করেছিল যে, আলোচনার মাধ্যমে তাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী দাবী দাওয়া মেনে নেয়া না হলে একদিকে তাঁরা বেসামরিক প্রশাসনকে অচল করে দেবেন এবং অন্যদিকে সশস্ত্রবাহিনীর অনেকগুলো ইউনিটের আনুগত্য নষ্ট করে হিন্দুস্তানের যোগসাজশে এমন একটা বেকায়দা পরিস্থিতির সৃষ্টি করবেন যে তখন তাদের দাবী মেনে নেয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না।
প্রেসিডেন্ট আপোষ – মিমাংসার জন্য সবরকমের চেষ্টা চালান। কিন্তু তিনি একটি ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের ধারণার সঙ্গে সংগতিপূর্ন একটি রাজনিতিজ্ঞসুলভ কিংবা একটি আপোষমূলক মনোভাবও দেখতে পাননি। কাজেই প্রেসিডেন্ট যে বারবার সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে প্রয়োজন ফলে তিনি দেশের অখন্ডতা রক্ষার জন্য চূড়ান্ত ব্যাবস্থা নেবেন, শেষ পর্যন্ত তার কোন উপায় না দেখে তিনি অতীব দুঃখের সঙ্গে সেই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন।
.
.
পরিশিষ্ট ঙ
আওয়ামীলীগের খসড়া ঘোষণাপত্র
ঢাকা, মার্চ ১৯৭১
যেহেতু ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ সামরিক আইন ঘোষণার মাধ্যমে আমি, জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান, এইচ, পিকে, এইচ, জে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং পাকিস্তানের সশস্ত্রবাহিনীর সুপ্রীম কমান্ডার হিসেবে সব ক্ষমতা আমর হাতে নিয়েছি এবং এর ফলে আমি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছি;
যেহেতু, জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছেঃ
যেহেতু, পাকিস্তানের জন্য অবিলম্বে একটি শাসনতন্ত্র তৈরির সহায়ক যথাযথ পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য এভাবে নির্বাচিত গণ- প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা আবশ্যক;
এবং যেহেতু সামরিক আইন তৎপরতা প্রত্যাহার করা যেতে পারে;
অতএব, আমি জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান, এইচ, পিকে, এইচ, জে, ঘোষণা করছি যে, পাকিস্তানের সামরিক আইন প্রত্যাহার করা হবে এবং ১৯৬৯ সালের ২৫শে মার্চের ঘোষণা একটি প্রদেশে সে দিন থেকে বাতিল করে যেদিন প্রদেশিক গভর্নর তার দায়িত্বভার গ্রহণের শপথ নেবেন, এবং যে কোন অবস্থায় এই ঘোষণার ৭ দিন পর পাকিস্তানের সর্বত্র তা বাতিল হয়ে যাবে।
১. এই ঘোষণা এবং এর অধীনে জারী করা অন্য কোন আদেশ আপাতত বলবৎ অন্য কোন আইনের কোন কিছুর বিপরিতে হওয়া সত্ত্বেও তা কার্যকরী থাকবে।
২. এই ঘোষনার উদ্দেশ্য কিংবা বিষয়বস্তুর পরিপন্থী কোন কিছু না থাকলে-
ক. কেন্দ্রের মানে হচ্ছে প্রজাতন্ত্র;
খ. কেন্দ্রীয় সরজার মানে প্রজাতন্ত্রের কার্যনির্বাহক সরকার;
গ. কেন্দ্র প্রশাসিত এলাকার মানে হচ্ছে ১৯৭০ সালের পশ্চিম পাকিস্তানের প্রদেশ ( ভংগ ) আইন বর্ণিত এলাকাসমূহ;
ঘ. প্রারম্ভিক দিন মানে যেদিন থেকে এই আদেশ কার্যকরী হয়;
ঙ. অন্তবর্তীকালীন সময় শুরু হবে জাতীয় পরিষদে যেদিন শাসনতন্ত্র প্রণয়ন শুরু সেদিন থেকে এবং শেষ হবে যে দিন শাসনতন্ত্র প্রণয়ন শেষ হয়ে যাবে।
………..
[পাকিস্তান সরকারের এই শ্বেতপত্রে আরও কয়েকটি পরিশিষ্ট রয়েছেঃ
পরিশিষ্ট- ক প্রেসিডেন্টের নীতি নির্ধারনী ভাষণ সমূহের অংশবিশেষ
পরিশিষ্ট- খ আইন কাঠামো আদেশ, ১৯৭০
পরিশিষ্ট- গ আওয়ামীলীগের ছয় দফা,
পরিশিষ্ট- ঘ আওয়ামীলীগের নির্দেশাবলী, মার্চ ১৯৭১
পরিশিষ্ট- ঙ পাকিস্তান প্রজাতন্ত্রের শাসনতন্ত্র, ১৯৬২
উল্লেখ্য যে, এই পরিশিষ্টসমূহের বিষয়বিস্তু ‘দলিলপত্রঃ ২য় খন্ড’ এবং এই খন্ডের অন্যত্র অন্তর্ভুক্ত হয়েছে বলে এখানে মুদ্রিত করা হয়নি। ]
.
চ. ইসলামাবাদ রাজধানী এলাকার মানে হচ্ছে ১৯৭০ সালের পশ্চিম পাকিস্তানের প্রদেশ ( ভংগ ) আদেশ বর্নিত এলাকা;
ছ. বিগত শাসনতন্ত্র মানে ১৯৬২ সালের পাকিস্তান ইসলামী প্রজাতন্ত্রের শাসনতন্ত্র।
জ. সামরিক আইন মানে ১৯৬৯ সালের ২রা মার্চের ঘোষণার দ্বারা জারীকৃত সামরিক আইন।
ঝ. সামরিক আইন কর্তৃপক্ষে রয়েছেন- কোন সামরিক আইন বিধি বা সামরিক আইন আদেশের দ্বারা বা অধীনে এ ধরণের বিধি বা আদেশের অধীনে কোন কাজ করার জন্যে বা ক্ষমতা প্রয়গের জন্যে অনুমোদিত কোন ব্যাক্তি বা একাধিক ব্যক্তির সংস্থা কিংবা কোন আদালত;
ঞ. সামরিক আইন মেয়াদের মানে হচ্ছে ১৯৬৯ সালের ২৫শে মার্চ থেকে শুরু করে প্রারম্ভিক দিনের ঠিক আগের দিন পর্যন্ত।
ট. জাতীয় পরিষদের মানে হচ্ছে প্রেসিডেন্টের ১৯৭০ সালের দু নম্বর আদেশের অধীনে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ।
ঠ. প্রেসিডেন্ট মানে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট
ড. প্রজাতন্ত্র মানে পাকিস্তান ইসলামী প্রজাতন্ত্র
ঢ. সময়সূচী মানে এই ঘোষণার সময়সূচী
ণ. বাংলা দেশ রাজ্য মানে প্রারম্ভিক দিনের অব্যবহিত আগে পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশ নামে পরিচিত অঞ্চল;
ত. পশ্চিম পাকিস্তানের রাজ্যসমূহ মানে প্রারম্ভিক দিনের অব্যবহিত আগে পাঞ্জাব, সিন্ধু, উত্তর – – পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তান প্রদেশ নামে পরিচিত এলাকাসমূহ;
থ. রাজ্য পরিষদ মানে কোন রাজ্যের পরিষদ;
দ. রাজ্য সরকার মানে কোন রাজ্যের কার্যনির্বাহক সরকার;
ধ. রাজ্য আইন পরিষদ মানে একটা রাজ্যের আইন পরিষদ।
৩. ১৯৬৯ সালের ২৫শে মার্চের সামরিক আইন ঘোষণা বাতিল হয়ে যাওয়ার ফলে এই ঘোষণা থেকে কিংবা ঘোষণার অধীনে ক্ষমতা প্রাপ্ত সব লোক ও আদালতসহ সামরিক আইন কর্তৃপক্ষ বাতিল হয়ে যায়।
৪. ক. সব সামরিক আইন বিধি ও সামরিক আইন আদেশ এবং অস্থায়ী শাসনতন্ত্র আদেশ এতদ্বারা বাতিল হয়ে যাবে।
খ. এই ঘোষণাপত্র সাপেক্ষে সব চলতি আইন উপযুক্ত আইন পরিষদ কর্তৃক সংশোধন বা বাতিল না করা পর্যন্ত যতটা প্রযোজ্য এবং প্রয়োজনীয় উপযগীকরণসহ বলবৎ থাকবে।
গ. চলতি কোন আইনের ব্যবস্থাকে এই ঘোষণাপত্রের ব্যবস্থার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করার উদ্দেশ্যে কেন্দ্রীয় আইন ক্ষেত্র সংক্রান্ত ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট এবং রাজ্য আইন ক্ষেত্র সংক্রান্ত ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের গভর্নর আদেশেক্রমে তা উপযোগী করে নিতে পারে। এই উপযোগীকরণ সংশোধন, সংযোজন বা বর্জনের আকারে হতে পারে এর মধ্য যেটা তিনি প্রয়োজনীয় বা সুবিধাজনক মনে করেন। এভাবে তৈরি কোন আদেশ অন্য আদেশ অন্য কোন রকমের ব্যবস্থা না থাকলে তা প্রারম্ভিক দিন থেকে কার্যকরী হবে কিংবা কার্যকরী বলে মনে করা হবে।
ঘ. চলিতি কোন আইন বলবত করার জন্য প্রয়োজনীয় বা ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোন আদালত বা ট্রাইবুনাল বা কর্তৃপক্ষ [গ] উপ – অনুচ্ছেদের অধীনে তৈরি কোন আদেশ দ্বারা এধরণের আইনের সত্যিকার কোন উপযোগিকরণ না হওয়া সত্ত্বেও এই ঘোষণাপত্রের ব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যে আনার জন্যে এ ধরণের প্রয়োজনীয় উপযোগিকরনসহ আইনের ব্যাক্যা করবেন।
ঙ. এই নিবন্ধে ‘চলতি আইন’ মানে আইন, অর্ডিনেন্স, আদেশ, নিয়ম, বিধি, উপবিধি, বিজ্ঞপ্তি বা অন্য কোন আইনগত ব্যবস্থা বা প্রারম্ভিক দিনের অব্যবহিত আগে পাকিস্তান বা পাকিস্তানের কোন অংশে আইনের শক্তি ছিল বা অঞ্চল বহির্ভূত বৈধতা ছিল।
৫. ক. প্রারম্ভিক দিনের অব্যবহিত আগে কোন সামরিক আদালত কিংবা সংক্ষিপ্ত সামরিক আদালতে অমীমাংসিত প্রত্যেকটি মামলা প্রারম্ভিক দিনে ফৌজদারী আদালতে স্থানাতরিত হয়ে যাবে এবং এই আদালত সাধারণ আইন অনুযায়ী অপরাধের বিচার করতে পারবেন।
খ. উপ অনুচ্ছেদ ক এর অধীনে কোন ফৌজদারী আদালতে স্তানান্তরিত কোন মামলার বেলায় এধরণের কোন মামলার বিচার প্রযোজ্য পদ্ধতি অনুসারে সাধারণ আইনের ব্যবস্থা অনুযায়ী বিচার করা হবে।
গ. প্রারম্ভিক দিনের অব্যবহিত আগে কোন সামরিক আদালত কর্তৃক মীমাংসা করা হয়েছে ও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে অথচ অনুমোদন বাকী রয়েছে এমন সব মামলা এবং এই দিন পর্যন্ত বাকী রয়েছে পর্যালচনা আবেদন ও দরখাস্ত যদি পশ্চিম পাকিস্তানের রাজ্যগুলোর সংশ্লিষ্ট হয় তবে পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রধান এবং বাংলাদেশ রাজ্যের সংশ্লিষ্ট হলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার জি ও সি প্রারম্ভিক দিনের পরে সেগুলো দেখবেন এবং মীমাংসা করবেন।
ঘ. যদি কোন ব্যক্তি সামরিক আইন কর্তৃপক্ষের কোন রায় বা দন্ডে যদি মনে করেন যে, তার প্রতি অন্যায় করা হয়েছে তবে তিনি এধরনের রায় বা দন্ডের বিরুদ্ধে কোন আবেদন পত্র পেশ না করে থাকলে তা পশ্চিম পাকিস্তানের রাজ্যগুলোর সংশ্লিষ্ট হলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলিয় কমান্ডার জি ও সির কাছে পাঠানো যেতে পারে। এ ধরণের কোন আবেদনের বেলায় উল্লেখিত কর্তৃপক্ষ ইচ্ছা করলে কোন রকম শর্তসহ কিংবা শর্ত ছাড়া কোন দন্ডের ক্ষমা মঞ্জুর কিংবা মার্জনা, হ্রাস, লঘুদন্ডদান কিংবা দন্ড বাতিল করে দিতে পারেন।
ঙ. এই ঘোষণাপত্রের ব্যবস্থা সাপেক্ষে সামরিক আইন মেয়াদের সময় কোন সামরিক আইন কর্তৃপক্ষের দেয়া কোন দন্ড আইনগতভাবে দেয়া হয়েছে বলে মনে করা হয় এবং তাদের দন্ড মেয়াদ অনুযায়ী কার্যকরী হতে থাকবে।
চ. সামরিক আইন চলাকালে কোন সামরিক কর্তৃপক্ষের দেয়া কারাদন্ড যদি সামরিক আইন মেয়াদে কার্যকরী করা না হয়ে থাকে তবে দণ্ডাদেশ প্রাপ্ত ব্যক্তিকে যে জেলায় পাওয়া যাবে সে জেলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের পরওয়ানায় তা কার্যকরী করা যেতে পারে।
ছ. সামরিক আইন চলাকালে কোন সামরিক আইন কর্তৃপক্ষের দেয়া জরিমানা দন্ড যদি কার্যকরী না করা হয়ে থাকে তবে দণ্ডাদেশ প্রাপ্ত ব্যক্তি যে জেলায় থাকে সে জেলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট তা কার্যকরী করতে পারেন, যেন এটা ১৮৯৮ সালের ফৌজদারী বিধি ( ১৮৯৮ সালের ৫ নম্বর আইন ) অধীনে তারই দেয়া জরিমানা দন্ড। তবে উল্লেখিত আইনের ২৯ নম্বর পরিচ্ছেদের ব্যবস্থাবলী এধরণের কোন দন্ডের বেলায় প্রযোজ্য হবে না।
জ. এই ঘোষণা পত্রের ব্যাবস্থা ছাড়া অন্য কোন আদালত বা কর্তৃপক্ষ সামরিক আইন চলাকালে কোন সামরিক আইন কর্তৃপক্ষ কিংবা কোন সামরিক আইন কর্তৃপক্ষের পক্ষে কোন লোক সামরিক আইন প্রশাসনের ব্যাপারে যদি কিছু করে থাকেন কিংবা কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকেন তবে তার বৈধতা বা যথার্থতার ব্যাপারে কোন প্রশ্ন তুলতে পারবেন না।
ঝ. সামরিক আইন চলাকালে কোন সামরিক আইন কর্তৃপক্ষ কিংবা কোন সামরিক আইন কর্তৃপক্ষের পক্ষে কার্য সম্পাদনকারী কোন লোক সামরিক আইন প্রশাসনের ব্যাপারে যদি কিছু করে থাকেন বা করেছেন বলে বুঝানো হয়ে থাকে তবে তার বিরুদ্ধে কোন আদালত বা কর্তৃপক্ষ কোন রকম মামলা গ্রহণ করবে না।
৬. অস্থায়ী শাসনতন্ত্র আদেশ ( অরেসিডেন্টের ১৯৬৯ সালের আদেশ ২ নম্বর আদেশ ) বাতিল হওয়া সত্ত্বেও অন্তর্বর্তীকালীন মেয়াদে ঘোষণা পত্রের ব্যাবস্থাসাপেক্ষে এবং ঘোষণাপত্র ও সময়সূচীর দ্বারা যে সব বর্জন, সংযোজন, উপযোগীকরণ ও সংশোধন করা হবে সেগুলো সাপেক্ষে যতদুর সম্ভব পাকিস্তান বিগত শাসন্তন্ত্রের ব্যবস্থা অনুযায়ী শাসিত হবে।
৭. প্রারম্ভিক দিনের অব্যবহিত আগে যিনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন প্রারম্ভিক দিন থেকেও তিনি প্রেসিডেন্ট, পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রধান এবং পাকিস্তান সশস্ত্রবাহিনী প্রধানের দায়িত্ব হাতে রাখবেন যতদিন পর্যন্ত না পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ দ্বারা প্রণীত একটা শাসনতন্ত্র অনুসারে একজন রাষ্ট্র প্রধান দায়িত্বভার গ্রহণ করেন আর তিনি যে নামেই পরিচিত হন না কেন।
৮. ১. অন্ত্ররবর্তীকালীন সময়েঃ
ক. প্রেসিডেন্ট হবেন রাষ্ট্রের কার্যনির্বাহী প্রধান এবং ঘোষণা পত্রের ব্যাবস্থাসাপেক্ষে তিনি সব ক্ষমতা প্রয়োগ করবেন প্রেসিডেন্ট বিগত শাসন্তন্ত্রের দ্বারা কিংবা অধীনে কিংবা আপাতত বলবৎ কোন আইনের দ্বরা কিংবা অধীনে প্রেসিডেন্টের যে ক্ষমতা রয়েছে তা তিনি কার্যকরী করতে পারবেন। প্রেসিডেন্ট এসব কাজ – কর্ম পরিচালনার ব্যাপারে তাকে সাহায্য করা ও পরামর্শ দেয়ার জন্য যতজন উপদেষ্টা নিয়োগের প্রয়োজন মনে করেন ততজন তিনি নিয়োগ করতে পারবেন।
খ. প্রেসিডেন্ট এই ঘোষণাপত্র সাপেক্ষে কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা প্রয়োগ করবেন।
২. জাতীয় পরিষদ কিংবা কোন রাজ্য পরিষদ বাতিল বা ভেঙে দেয়ার ক্ষমতা অরেসিডেন্টের থাকবে না।
৩. অন্তর্বর্তীকালীন মেয়াদে প্রেসিডেন্ট কেন্দ্রীয় সরকারের আইনগত যোগ্যতার আওতার মধ্যে অর্ডিনেন্স জারী করে কোন বিষয়ে আইন তৈরি করতে পারেন।
৯. ১. প্রারম্ভিক দিন থেকে প্রেসিডেন্টের ১৯৭০ সালের ২ নম্বর আদেশের অধীনে নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদগুলো রাজ্যপরিষদ হিসেবে কাজ করবে।
২. অন্তর্বর্তীকালীন মেয়াদে এই ঘোষণা পত্র অনুসারে একটি রাজ্য সরকার ও একটি রাজ্য আইন পরিষদ কাজ করবে।
১০. ১. কেন্দ্রীয় আইন পরিষদ তফসীল উল্লিখিত কোন কিছুর ব্যাপারে সমগ্র পাকিস্তান কিংবা পাকিস্তানের যে কোন অংশের জন্যে আইন ( অঞ্চলে বহির্ভূত বিষয়ের আইনসহ ) তৈরি করার একচেটিয়া ক্ষমতা থাকবে, এবং ঘোষণা পত্রের ১৩ নম্বর অনুচ্ছেদে উল্লেখিত কোন বিষয়ে পশ্চিম রাজ্যের কোন রাজ্যের সর্বত্র কিংবা রাজ্যের যে কোন অংশের জন্যে আইন তৈরি করার ক্ষমতাও থাকবে।
২. কেন্দ্রীয় আইন পরিষদ বিগত শাসনতন্ত্রের তৃতীয় তফসীল কিংবা এই ঘোষণা পত্রের ১৩ নম্বর অনুচ্ছেদ উল্লেখিত নেই এমন কোন বিষয়ে ইসলামাবাদ ও ঢাকার রাজধানী এলাকার জন্যে আইন ( তবে একচেটিয়া নয় ) তৈরি করতে পারবেন।
১১. বাংলাদেশ রাজ্য আইন পরিষদ এই ঘোষণাপত্রের ১৩ নম্বর অনুচ্ছেদে উল্লিখিত বিষয় ছাড়া অন্য কোন বিষয়ে সমগ্র রাজ্যের বা রাজ্যের যে কোন অংশের জন্য আইন তৈরি করতে পারবেন, পশ্চিম পাকিস্তানের কোন রাজ্যের রাজ্য আইন পরিষদ বিগত শাসনতন্ত্রের ৩য় তফসীলে উল্লেখিত কোন বিষয় ছাড়া অন্য যে কোন বিষয়ে সমগ্র রাজ্যের যে কোন অংশের জন্য আইন তৈরি করতে পারবেন।
১২. রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ পার্লামেন্টারী দলের নেতার পরামর্শে প্রেসিডেন্ট একজন রাজ্য গভর্নর নিযুক্ত করবেন এবং অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে তিনি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকবেন।
১৩. ১. বাংলাদেশ রাজ্যের বেলায় কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের কেবলমাত্র নিম্ন লিখিত বিষয়গুলোর ব্যাপারে আইন তৈরি করার একচেটিয়া ক্ষমতা থাকবেঃ
ক. পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা
খ. বৈদেশিক বাণিজ্য ও সাহায্য ছাড়া বৈদেশিক বিষয়
গ. পাকিস্তান থেকে কোন লোকের গমন এবং কোন লোকের পাকিস্তানে প্রবেশসহ নাগরিকত্ব দেশীয়করন ও বিদেশীদের অন্যান্য বিষয়;
ঘ. ঘোষণাপত্রের ১৬ নম্বর অনুচ্ছেদ সাপেক্ষে মুদ্রা, বৈধ নোট ও ষ্টেট ব্যাংক;
ঙ. কেন্দ্রের সরকারী ঋণ
চ. মান এবং ওজন ও পরিমাপ
ছ. কেন্দ্রের সম্পত্তির রাজস্ব তা যেখানেই অবস্থিত হোক না কেন
জ. আন্তঃপ্রাদেশিক ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ সমন্বয়;
ঝ. প্রেসিডেন্ট, জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনার, নির্বাচন কমিশনার, স্পিকার, ডেপুটি স্পীকার ও জাতীয় পরিষদের অন্যান্য ভাতা; জাতীয় পরিষদের ক্ষমতা, অধিকার বাধ্যবাধকতা;
ঞ. সুপ্রিম কোর্ট হব পাকিস্তান
ট. মোকদ্দমা ও বিচার ইত্যাদি যে প্রদেশের বা রাজ্যের হবে তার বাইরে সার্ভিস ও দন্ড বিধান,
ঠ. উপরে উল্লেখিত যে কোন বিষয়ের ব্যাপারে আইন বিরোধী আপরাধ।
২. পশ্চিম পাকিস্তানের রাজ্যগুলোর বেলায় বিগত শাসন্তন্ত্রের তিন নম্বর তফসিলে উল্লেখিত নির্দিষ্ট বিষয়গুলোর ব্যাপারে আইন তৈরি করা ও একচেটিয়া ক্ষমতা কেন্দ্রীয় আইন সভায় থাকবে। পশ্চিম পাকিস্তান আইন সম্মেলনের সদস্যদের মধ্য সম্পাদিত এ ধরণের চুক্তি অনুযায়ী এই ব্যাবস্থা পরিবর্তন সাপেক্ষ। ঘোষণাপত্রের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এই আইন সম্মেলন গঠন করা হবে।
১৪. ১. প্রারম্ভিক দিনের আগে কেন্দ্রীয় আইন সভার দ্বারা কিংবা এর অধীনে বাংলাদেশ রাজ্যের মধ্যে যে সব শুল্ক ও কর ধার্য ও আদায় করা হত তা বাংলাদেশ সরকার আদায় করবেন এবং কেন্দ্রীয় সরকার ১৯৭০-৭১ সালের কেন্দ্রীয় বাজেটে যেমন ব্যাবস্থা রেখেছেন তেমনি বাংলাদেশে কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থনৈতিক বরাদ্দ ও খরচের হিসাবপত্রের পর যে অর্থ অবশিষ্ট থাকবে বাংলাদেশ সরকার তা কেন্দ্রীয় সরকারকে ফেরৎ দেবেন। এধরণের হিসাবে বাংলাদেশ সরকার যদি কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে অর্থ পাওনা হয় তবে কেন্দ্রীয় সরকার সে পরিমাণ অর্থ বাংলাদেশ সরকার কে ফেরৎ দেবেন।
২. বাংলাদেশ রাজ্যের সব বৈদেশিক মুদ্রা আর বাংলাদেশ রিজার্ভ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে একটি পৃথক একাউন্ট থাকবে এবং রিজার্ভ ব্যাংক তা বিতরণ করবে।
৩. প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আলাপ আলোচনার পর ব্যাবস্থা তৈরি করবেন যার ভিত্তিতে বাংলাদেশ সরকার ১৯৭০- ৭১ অর্থ বছরের অবশিষ্ট সময়ের জন্য কেন্দ্রীয় বাজেটের বৈদেশিক মুদ্রে চাহিদায় অর্থ দেবেন।
১৫. ১. ঢাকার ষ্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের নাম পরিবর্তন করে রিজার্ভ ব্যাংক অব বাংলাদেশ রাখা হবে এবং বাংলাদেশ ষ্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের সব শাখা হবে রিজার্ভ ব্যাংক অব বাংলাদেশের শাখা।
২. রিজার্ভ ব্যাংক অব বাংলাদেশ এবং এর শাখাসমূহ বাংলাদেশের আইন পরিষদের আইনগত নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
৩. বাংলাদেশ রিজার্ভ ব্যাংক ধারা ৪. এ বর্ণিত ক্ষমতাসাপেক্ষে বাংলাদেশ রাজ্যের ব্যাপারে এমন সব ক্ষমতা, কাজ ও কর্তব্য প্রয়োগ করবেন যেগুলো প্রারম্ভিক দিনের অব্যবহিত আগে ষ্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান সমগ্র পাকিস্তানের বেলায় প্রয়োগ করতেন। ষ্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান ধারা ৪. এ বর্নিত ক্ষমতা প্রয়োগ করতে থাকবেন।
৪. বাংলাদেশ রাজ্যের বেলায় ষ্টেট ব্যাংক নিম্নলিখিত ক্ষমতাগুলো প্রয়োগ করবেন
ক. কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে টাকার বৈদেশিক বিনিময় হার সুপারিশ করবেন।
খ. বাংলাদেশের অবভ্যান্তরে চালু করার জন্য রিজার্ভ ব্যাংক অব বাংলাদেশের অনুরোধে রিজার্ভ ব্যাংকের দেয়া সম্পদের বিনিময়ে নোট ও মুদ্রা ইস্যু করা;
গ. টাকশাল ও সিকিউরিটি প্রেসের রক্ষণাবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রনঃ
ঘ. আন্তর্জাতিক অর্থ সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান গুলোর সম্পর্কে এমন সব কাজ করা যা স্বাভাবিকভাবে ষ্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান করে থাকেন। তবে এ ধরণের কাজ বাংলাদেশের রিজার্ভ ব্যাংকের নির্দেশ অনুযায়ী হতে হবে।
১৬. ১. ১৯৭১ সালের ৯ই এপ্রিল
ক. বাংলাদেশ রাজ্য থেকে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্যরা বিকাল ৪টায় ঢাকায় পরিষদ ভবনে এক আইন সম্মেলনে বসবেন এবং সম্মেলনে বসার দিন থেকে ৪৫ দিনের মধ্যে বাংলাদেশ রাজ্যের জন্য একটা শাসনতন্ত্র তৈরির জন্য কাজ চালিয়ে যাবেন;
খ. পশ্চিম পাকিস্তানের রাজ্যগুলো থেকে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদের সদস্যরা ১৯৭১ সালের ৯ই এপ্রিল বিকাল ৪টায় ইসলামাবাদে ষ্টেট ব্যাংক ভবনে একটি আইন সম্মেলনে বসবেন এবং বসার দিন থেকে ৪৫ দিনের মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানের রাজ্যগুলোর জন্যে একটি শাসনতন্ত্র তৈরির কাজ চালিয়ে যাবেন।
২. প্রত্যেক আইন সম্মেলন একজন চেয়ারম্যান নির্বাচিত করবেন। তিনি বৈঠকের তারিখ ও সময় এবং সম্মেলনের অধিবেশন পরিচালনার পদ্ধতি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেবেন। তবে চেয়ারম্যানের নির্বাচনসহ অন্য সব সিদ্ধান্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ ভটের দ্বারা নেয়া হবে।
.
.
.
(৩) উপ-অনুচ্ছেদ (১) এর অধীনে বাংলাদেশ রাজ্য এবং পশ্চিম পাকিস্তানের রাজ্যগুলোর শাসনতন্ত্র তৈরী হয়ে যাওয়ার পর এবং নিজ চেয়ারম্যান যখন প্রেসিডেন্ট লিখিতভাবে জানান যে উপ-অনুচ্ছেদ (১) এর শাসনতন্ত্র তৈরী করা হয়েছে তখন প্রেসিডেন্ট জাতীয় পরিষদের এক অধিবেশন ডাকবেন যাতে সব সদস্য পাকিস্তান কনফেডারেশনের জন্য একটি শাসনতন্ত্র তৈরীর উদ্দেশ্যে একটি সার্বভৌম সংস্থা হিসেবে অধিবেশনে মিলিত হবে।
(৪) এই ঘোষনাপত্রের দ্বারা প্রেসিডেন্টের ১৯৭০ সালের ২ নম্বর আদেশ সংশোধনসাপেক্ষে এই আদেশে যে পদ্ধতির ব্যবস্থা রয়েছে উপ-অনুচ্ছেদ (৩) এর অধীনে সমগ্র পাকিস্থানের জন্যে একটি শাসনতন্ত্র তৈরী করার কাজে সে পদ্ধতি অনুসরন করা হবে।
(৫) প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা তাঁর দ্বারা নিয়োজিত কোন ব্যক্তির সামনে উপযুক্ত আইন সম্মেলনের প্রথম বৈঠকে নিম্নোক্ত ধরনের শপথ নিয়ে বা প্রতিজ্ঞা করে জাতীউ পরিষদের সদস্যরা প্রেসিডেন্টের ১৯৭০ সালের ২ নম্বর আদেশে ১২ নম্বর অনুচ্ছেদের ব্যবস্থাগুলো মেনে নিয়েছেন বলে মনে করা হবে। শপথ নিম্নরুপ ‘আমি ‘ক,খ’ শপথ নিচ্ছি/প্রতিজ্ঞা করছি যে, আমি আইনগতভাবে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্থানের শাসনতন্ত্রের প্রতি বিশ্বাসী হব এবনহ সত্যিকারের আনুগত্য পোষন করব।
(৬) এই অনুচ্ছেদের ‘উপ-অনুচ্ছেদ (৫) এ বর্ণিত শপথ গ্রহন বা প্রতিজ্ঞা করার পর জাতীয় পরিষদের কোন সদস্য সব অধিকার, সুযোগ-সুবিধে, ভাতা ইত্যাদি পাওয়ার যোগ্য হবেন যা আইন অনুসারে জাতীয় পরিষদের একজন সদস্য পেতে পারে।
(৭) প্রেসিডেন্টের ১৯৭০ সালের ২ নম্বর আদেশের ’২৫ নম্বর অনুচ্ছেদের’ পরিবর্তে হবে-
“২৫, জাতীয় পরিষদে পাশ করা শাসনতন্ত্র বিল স্বাক্ষরের জন্য প্রেসিডেন্তের কাছে পেশ করা হবে। এই বিল পেশ করার পর প্রেসিডেন্ট তাতে স্বাক্ষর করবেন এবং কোনক্রমে শাসনতন্ত্র তাঁর কাছে পেশ করার দিন থেকে ৭ দেন শেষ হয়ে গেলে তা স্বাক্ষরিত হয়েছে বলে মনে করা হবে।“
১৭। (১) ঘোষনাপত্রের ব্যবস্থাবলী কার্যকরীভাবে চালু করার জন্যে প্রেসিডেন্ট আদেশক্রমে এমন সব ব্যবস্থা তৈরী করতে পারবেন যা তার কাছে প্রয়োজনী বা উপযোগী বলে মনে হয়।
(২) পূর্বে উল্লেখিত ক্ষমতার সাধারণত্বের প্রতি পূর্ব ধারণা না করে বিশেষ করে নিম্নলিখিত বিষয়সমূহের জন্য ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে-
(ক) এই ঘোষনাপত্রের দ্বারা অস্তিত্বে আনা নতুন শাসন্তান্ত্রিক ব্যবস্থাবলী কার্যকরী করার জন্য কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারগুলোর মধ্যে আবশ্যকীয় ক্ষমতা, অধিকার, সম্পদ, কর্তব্য ও দায়িত্ব, ন্যয্যভাবে বন্টন।
(গ) কেন্দ্রিয় সরকারের দায়িত্ব, সম্পদ, অধিকারের অনুগমন ও হস্তান্তর এবং রাজ্যগুলোর মধ্যে এ ধরনের অধিকার ন্যয্যভাবে বন্টন।
(ঘ) কোন রাজ্য এবং তার ক্ষমতা ও কাজের উদ্দেশ্যে অফিসার ও অন্যান্য কর্তৃপক্ষ নিয়োগ ও বদলী এবং রাজ্যগুলোর কাজকর্মের ব্যাপারে কোন সার্ভিসের লোক বরাদ্দ এবং রাজ্যসমূহ ও কেন্দ্রের জন্যে সার্ভিসের গঠনতন্ত্র।
(ঙ) শাসনতান্ত্রিক অবস্থা থেকে এইয় ঘোষনাপত্রের ব্যবস্থাবলীতে স্থানান্তর সম্পর্কিত কোন অসুবিধা দূর করা-যেগুলো এই ঘোষণার প্রারম্ভের আগে পরিলক্ষিত হয়েছিল।
(৩) প্রেসিডেন্ট ‘উপ-অনুচ্ছেদ (২) এ উল্লেখিত বিষয়গুলো বাস্তবায়নের ব্যাপারে কার্যকরী ব্যাবস্থা গ্রহণ এবং এই ঘোষণাপত্র কার্যকরী চালু করার জন্যে প্রয়োজনীয় অন্য সবকিছু করার জন্যে ১১ সদস্যের একটি ‘বাস্তবায়ন পরিষদ’ গঠন অরবেন। এই পরিষদের ৬ জন সদস্য বাংলাদেশ সরকার, ২ জন পাঞ্জাব সরকার এবং সিন্ধু, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্থান সরকার একজন করে সদস্য মনোনয়ন করবেন।
তফসীল
.
১। বিগত শাসনতন্ত্রের ৬৭ নম্বর অনুচ্ছেদ পরিবর্তিত হয়ে নিম্ন্রুপ হবে- “৬৭। কোন ব্যক্তি কোন রাজ্যের গভর্নর হিসেবে নিযুক্ত হবেন না যদি তিনি জাতীয় পরিষদের একজন সদস্য হওয়ার যোগ্য না হন।“
২। বিগত শাসনতন্ত্রের ৬৮ নম্বর পরিবর্তিত হয়ে নিম্ন্রুপ হবে-
“৬৭। ক্ষমতায় অদিষ্টিত হওয়ার আগে বাংলাদেশ সরকারের গভর্নর বাংলাদেশের হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির সামনে এবং পশ্চিম পাকিস্থানের প্রত্যেকটি রাজ্যের গভর্ণর সংশ্লিষ্ট রাজ্যের হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির সামনে প্রথম তফশীলে উল্লেখিত এমন ধরনের শপথ গ্রহন করবেন যা তাঁর পদের জন্য প্রযোজ্য হয়।“
৩। বিগত শাসনতন্ত্রের ৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ পরিবর্তিত হত্যে নিম্নরুপ হবে-
“৭০। বাংলাদেশ রাজ্যের জন্যে একটি আইনসভা থাকবে এবং তা বাংলাদেশ রাজ্য আইন পরিষদ নামে পরিচিত হবে। অনুরুপভাবে পাঞ্জাব, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু ও বেলুচিস্তান রাজ্যের প্রত্যেকটির জন্যে একটি করে আইন পরিষদ থাকবে এবং তা নিজ নিজ রাজ্যের রাজ্য পরিষদ নামে পরিচিত হবে।
৪। বিগত শাসনতন্ত্রের ৮০ নম্বর অনুচ্ছেদ পরিবর্তিত হয়ে নিম্নরুপ হবে-
“৮০। (১) রাজ্য সরকার একটি উজির সভা নিয়ে গঠিত হবে এবং উজিরসভার প্রধান হিসেবে থাকবেন মুখ্য উজির; এ ছাড়া থাকবেন ডেপুটি উজিররা। এই অনুচ্ছেদে বর্ণিত পদ্ধতিতে তাদের সবাইকে নিযুক্ত করা হবে।
(২) শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থা সাপেক্ষে কোন রাজ্যের কার্যনির্বাহী ক্ষমতাকে রাজ্য সরকারের কর্তৃপক্ষের দ্বারা কিংবা অধীনে প্রয়োগ করা হবে।
(৩) একটি রাজ্য উজিরসভা রাজ্য আইন পরিষদের কাছে সমবেতভাবে জবাবদিহি থাকবে।
(৪) (ক) গভর্নর রাজ্য আইনসভার একজন সদস্যকে মুখ্য উজির হিসেবে নিয়োগ করবেন যার প্রতি রাজ্য পরিষদের আস্থা রয়েছে।
(খ) মুখ্য উজির নিয়োগের সময় রাজ্য আইন পরিষদের অধিবেশন না বসলে এবং বাতিল থাকলে তখন থেকে দু’মাসের মধ্যে অধিবেশনে মিলিত হওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হবে।
(৫) গভর্নর মুখ্য উজিরের পরামর্শ অনুযায়ী অন্যান্য উজির ও সহকারী উজির নিয়োগ করবেন।
(৬) যদি কোন উজির পর পর ছ’মাসের কোন মেয়াদের জন্যে রাজ্য পরিষদের সদস্য না থাকেন তবে এই মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর উজির বা সহকারী উজির থাকতে পারবেন না এবং রাজ্য আইনসভা ভেঙ্গে দেয়ার আগে তিনি উজির নিযুক্ত হতে পারবেন না যদি তিনি উপযুক্ত রাজ্য আইন সভার একজন সদস্য নির্বাচিত না হন।
(৭) এই অনুচ্ছেদে এমন কোন ব্যবস্থা থাকবে না যা রাজ্য পরিষদ ভঙ্গ থাকা কালে উজিরসভার সদস্য ও সহকারী উজিরদেরকে দায়িত্বভার চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে অযো’গ্য ঘোষণা করতে পাবে অথবা এ ধরনের কোন মেয়াদে কোন লোককে মুখ্য উজির বা উজির বা সহ্বমরী উজির হিসেবে নিয়োগ রোধ করতে পারে।
(৮) সন্দেহ মুক্ত হওয়ার জন্যে একথা সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করা হয়েছে যে, গভর্নর তাঁর কজে-কর্ম পরিচালনা করার সময় রাজ্য মুখ্য উজ্যিরর পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করবেন ৷
(৯) মুখ্য উজির গভর্নরের কাছে তাঁর পদত্যাগ পত্র পেশ করে যে কোন সময় পদত্যাগ করতে পারেন ৷
(১০) অন্য কোন উজির কিংবা সহকারী উজির পদত্যাগ করতে চাইলে তাঁকে গভর্নরের কাছে পেশ করার উদ্দেশ্যে মুখ্য উজিরের হাতে পদত্যাগপত্র দিতে হবে ৷
(১১) মুখ্য উজির পরামর্শ দিলে গভর্নর মুখ্য উজির ছাড়া অন্য যে-কোন উজিরের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করবেন।
(১২) মুখ্য উজির তাঁর কাছে যথেষ্ট বলে মনে হওয়ার কারণে কোন উজির বা সহকারী উজিরকে পদত্যাগের জন্যে অনুরোধ জানাতে পারেন; সংশ্লিষ্ট উজির এই অনুরোধ মেনে নিতে ব্যর্থ হলে গভর্নর তাঁর নিয়োগ বাতিল করে দেবেন যদি মুখ্য উজির এরকম পরামর্শ দেন।
(১৩) মুখ্য উজির যদি একবার উপযুক্ত রাজ্য আইন পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন না পান এবং গভর্নর যদি তার পরামর্শ অনুযায়ী এ ধরনের আইন পরিষদ ভেঙ্গে না দেন তবে মুখ্য উজির পদত্যাগ করবেন।
(১8 ) মুখ্য উজির কোন সময় পদত্যাগ করলে অন্য উজির এবং সহকারী উজিররাও পদত্যাগ করেছে বলে মনে করা হবে; তবে তাঁদের স্থলাভিষিক্ত হওয়ার জন্যে নতুন উজির নিয়োগ না করা পর্যন্ত তাঁরা কাজ চালিয়ে যাবেন।
(১৫) আইন সভা ভেঙ্গে দেয়ার দিন ক্ষমতাসীন মুখ্য উজির, অন্য উজির ও ডেপুটি উজিররা তাঁদের স্থলাভিষিক্ত হওয়ার জন্যে নতুন লোক নিয়োগ না করা পর্যন্ত তাঁরা কাজ চালিয়ে যাবেন।“
৫। বিগত শাসনতস্তের ৮১ নম্বর অনুচ্ছেদ পরিবর্তিত করে নিম্নরুপ হবে-৮১। (১) রাজ্য সরকারের সব কার্যনির্বাহী তৎপরতা গভর্নরের নামে নেয়া হয়েছে বলে প্রকাশ করা হবে৷
(২) রাজ্য সরকার আইনের দ্বারা এমন পদ্ধতি নির্দিষ্ট করবেন যাতে গভর্নরের নামে তৈরী ও কার্যকর করা আদেশ ও অন্যান্য ব্যবস্থা স্বাক্ষর করা হবে এবং গভর্নর তা তৈরী বা কার্যকরী করেছেন বলে কোন আদালতে এই স্বাক্ষরিত আদেশ বা ব্যবহার বৈধতা সম্পর্কে কোন প্রশ্ন তোলা যাবে না।
(৩) রাজ্য সরকার তার বরাদ্দ এবং ব্যবসায়িক লেনদেনের জন্যেও আইন তৈরী করবেন।
৬। বিগত শাসনতন্ত্রের ৮২ ও ৮8 নম্বর অনুচ্ছেদ বাদ দেয়া হবে।
৭। বিগত শাসনতন্ত্রের ৮৬ থেকে ৯০ নম্বর পর্যন্ত অনুচ্ছেদ পরিবর্তিত হয়ে নিম্নরুপ হবে-
“৮৬ ৷ এই অংশে “অর্থ বিল” মানে এমন একটি বিল যাতে নীচের বিষয়গুলোর সব কিৎবা যে-কোন একটির কেবলমাত্র ব্যবস্থা সংক্রান্ত ব্যাপার রয়েছে, অর্থাৎ
(ক) কোন কর ধার্য, বিলোপ, লাঘব, পরিবর্তন বা নিয়মিতকরণ;
(খ) রাজ্য সরকার কর্তৃক অর্থ ধার বা কোন গ্যারান্টি দেয়া ৷ কিৎবা সরকারের আর্থিক দায়িত্ব সংক্রান্ত আইনের সংশোধন;
(গ) রাজ্য ‘কনসলিডেটেড’ তহবিলের তত্ত্বাবধান, এই তহবিলে অর্থদান বা এই তহবিল থেকে অর্থ ইস্যু তোলা;
(ঘ) রাজ্য কনসলিডেটেড তহবিলের উপর কোন ভার অর্পণ বা আরোপ কিৎবা এ ধরনের ভার বিলোপ বা পরিবর্তন।
(ঙ) রাজ্যের ‘কনসলিডেটেড’ তহবিলের জ্যন্য অর্থগ্রহণ, কিংবা রাজ্যের ‘পাবলিক একাউন্ট’ বা তত্ত্বাবধান বা এ ধরনের অর্থ ইস্যু; এবং
(চ) উপরের উপধারাগুলোর উল্লিখিত কোন বিষয়ের সঙ্গে কোন বিষয় প্রাসঙ্গিক।
২। কোন বিলকে অর্থবিল হিসেবে মনে করা হবে না কেবল এই কারণেই যে,
(ক) এতে কোন জরিমানা বা অন্য কোন আর্থিক দণ্ড আরোপ বা পরিবর্তন বা লাইসেন্স ফি দাবী কিংবা পরিশোধ বা কোন কাজের জন্যে ফি বা খরচের ব্যবস্থা থাকে; অথবা,
(খ) এতে স্থানীয় উদ্দেশ্যে কোন স্থানীয় কর্তৃপক্ষ বা সংস্থা কর্তৃক কোন কর আরোপ, বিলো’প, মওকুফ বা পরিবর্তনের ব্যবস্থা রয়েছে।
(৩) প্রত্যেকটি অর্থবিল যখন গভর্নরের মতের জ্যন্য পেশ করা হবে তখন তার সঙ্গে স্পীকারের হাতের একটি সার্টিফিকেট থাকবে যে, এটা একটা অর্থ বিল এবং এই সার্টিফিকেট সব উদ্দেশ্যে চূড়ান্ত ও এ ব্যাপারে কোন আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না।
“৮৭ ৷ এমন কোন বিল বা সংশোধনী ( কেবলমাত্র রাজ্য সরকারের সুপারিশ ছাড়া ) রাজ্য আইন পরিষদে উত্থাপন করা যাবে না বা ৮৬ নম্বর অনুচ্ছেদের (১) নম্বর ধারায় উল্লেখিত কোন বিষয়ের ব্যবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিংবা যা আইন সম্মত করে কার্যকরী করা হলে রাজ্যের রাজস্ব, ব্যয় সৃষ্টি করতে পারে।“
“৮৮। রাজ্য আইন পরিষদের কোন আইনের ক্ষমতার দ্বারা বা ক্ষমতার অধীনে ছাড়া কোন রাজ্যের জন্যে কোন কর ধার্য করা যাবে না ৷
“৮৯ ৷ (১) কোন রাজ্য সরকার কর্তৃক সংগৃহীত রাজস্ব, কোন ঋণের পবিশোধের তার দ্বারা সংগৃহীত অর্থ একটা কনসলিডেটেড তহবিলের অংশ বিশেষ হয়ে যাবে এবং এই তহবিল রাজ্য কনসলিডেটেড তহবিল নামে পরিচিত হবে ৷
“৯০। (১) রজ্যে কনসলিডেটেড তহবিলের তত্ত্বাবধান, এই তহবিলে অর্থ দেয়া, এই তহবিল থেকে অর্থ তোলা, রাজ্য সরকারের দ্বারা যা পক্ষে সংগৃহীত জমা দেয়া অর্থ ছাড়া সরকারী অর্থের তত্ত্বাবধান, রাজ্যের ‘পাবলিক একাউন্টে’ অর্থ দেয়া, এ ধরনের একাউন্ট থেকে অর্থ তোলা এব উল্লিখিত বিষয়গুলোর সঙ্গে জড়িত সব বিষয় রাজ্য আইন পরিষদের আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে ৷ গভর্নর দ্বারা তৈরী আইনের মাধ্যমে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা তৈরী না করা পর্যন্ত চলতে থাকবে ৷
(২) নিম্নোক্ত উপায়ে সংগৃহীত বা জমাকৃত সব অর্থ-
(ক) রাজ্য সরকার কর্তৃক আদায়কৃত বা গৃহীত রাজস্ব ও সরকারী অর্থ ছাড়া রাজ্যের কাজকর্ম পরিচালনার জন্যে নিযুক্ত কোন অফিসার তার ক্ষমতার আওতায় যে অর্থ সংগ্রহ করবেন;
(খ) রাজ্যের কাজ-কর্ম সংক্রান্ত ব্যাপারে কোন বিষয়, লোক বা কারণের জন্যে দেয় কোন কোর্ট ফি রাজ্যের ‘পাবলিক একড়াউন্টে’ দেয়া হবে ৷
৪১। বিগত শাসনতন্ত্রের ৯০ নম্বর অনুচ্ছেদের পর পরই নিম্নোক্ত নূতন অনুচ্ছেদগুলো যোগ করতে হবে এবং সেগুলোর নম্বর হবে ৯০-ক থেকে ৯০-চ পর্যন্ত।
“৯০-ক। (১) রাজ্য সরকার প্রত্যেক অর্থ বছরের ব্যাপারে রাজ্য সরকারের ব্যাপারে ঐ বছরের জন্যে রাজ্য সরকারের আনুমানিক আয় ও ব্যয়ের একটা বিবৃতি রাজ্য আইন পরিষদে পেশ করবেন। এই অংশে তা ‘বার্ষিক আর্থিক বিবৃতি’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
(২) বাৎসরিক আর্থিক বিবৃতি পৃথকভাবে দেখানো হবে-
(ক) শাসনতন্ত্রের ‘ব্যয়’ হিসেবে বর্ণিত ব্যয় মেটানোর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ রাজ্য কনসলিডেটেড তহবিল দেবেন;
(খ) অন্যান্য যে-সব প্রয়োজন মেটানোর জন্যে রাজ্য কনসলিডেটেড তহবিল থেকে অর্থ দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে; এবং
রাজস্ব হিসেবের ব্যয় অন্যান্য ব্যয় থেকে পৃথকভাবে দেখানো হবে।
“৯০-খ। রাজ্য কনসলিডেটেড তহবিলকে নিম্নোক্ত ব্যয় তার বহন করতে হবে-
(ক) গভর্নরের বেতন ও ভাতা এবং তাঁর দফতর সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ব্যয়, এবং
(১) হাইকোর্টের বিচারক;
(২) রাজ্য পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্য; এবং
(৩) রাজ্য পরিষদের স্পীকার ও ডেপুটি স্পীকারের বেতন ও ভাতা ৷
(খ) রাজ্য আইন পরিষদ সেক্রেটারীয়েট, রাজ্য পাবলিক সার্ভিস কমিশন এবং হাইকোর্টের কর্মচারী ও অফিসারদের দেয় বেতনসহ অন্যান্য প্রশাসনিক ব্যয়;
(গ) সুদ, ‘সিংকিং-ফান্ড’ খরচ, মূলধন পরিশোধ বা ‘সিংকিং তহবিলের’ মাধ্যমে ঋণ হ্রাস ও ঋণ তোলার ব্যাপারে অন্যান্য খরচসহ ঋণ খরচ-যার জন্যে রাজ্য সরকার দায়ী এবং রাজ্য কনসলিডেটেড তহবিলের সিকিউরিটির ওপর ঋণ সার্ভিস ও পুনঃ ক্রয়;
(ঘ) কোন আদালত বা ট্রাইবুনাল কর্তৃক রাজ্যের বিরূদ্ধে কোন বিচার, ডিক্রি বা রায়কে নিঃসন্দেহ করার জন্যে প্রয়োজনীয় অর্থ;
(ঙ) শাসনতন্ত্র বা রাজ্য আইন পরিষদের আইন দ্বারা ঘোষিত অর্থ যে পরিমাণ অর্থ দেয় ৷
.
.
“৯০-গ। (১) বার্ষিক আর্থিক বিবৃতির ততটা নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে যা রাজ্য কনসলিডেটেড তহবিলের ওপর ধার্য করা খরচ সংক্রান্ত, তবে তা রাজ্য আইন পরিষদের ভোটের জন্য পেশ করা হবে না।
(২) বার্ষিক আর্থিক বিবৃতির ততটা পর্যন্ত মঞ্জুরী দাবীর আকারে রাজ্য আইন পরিষদে পেশ করা যেতে পারে যা অন্যান্য ব্যয় সংশ্লিষ্ট এবং আইন পরিষদ তাতে উল্লেখিত অর্থের পরিমাণ হ্রাস সাপেক্ষে কোন দাবীর ব্যাপারে মত দিবে পারবেন।
(৩) রাজ্য সরকারের সুপারিশ ছাড়া কোন মঞ্জুরীর দাবী করা যাবে না।
“ ৯০-ঘ। (১) আগের অনুচ্ছেদের ব্যবস্থার অধীনে আইন পরিষদ কর্তিক মঞ্জুরী দেয়ার পর নিন্মোক্ত বিষয়গুলির সব অর্থ মেটানোর উদ্দেশ্যে রাজ্য কনসলিডেটেড তহবিল থেকে অর্থ তোলার ব্যবস্থা সম্বলিত একটি বিল আইন পরিষোদে উত্থাপন করা হবে-
(ক) রাজ্য আইন পরিষদ কর্তৃক এভাবে মঞ্জুরী; এবং (খ) রাজ্য কনসলিডেটেড তহবিলের ওপর ধার্য করা ব্যয়।
তবে এই অর্থের পরিমাণ কোনক্রমেই রাজ্য আইন পরিষদে আগে পেশ করা বিবৃতিতে দেখানো অর্থের পরিমাণের চেয়ে বেশী হবে না।
(২) এ ধরনের কোন বিলের ওপর সংশোধন প্রস্তাব করা যাবে না যার ফলে এভাবে দেয়া কোন মঞ্জুরীর পরিমাণ বা লক্ষ্য পরিবর্তিত হয়ে যেতে পারে।
(৩) শাসনতন্ত্রের ব্যবস্থা সাপেক্ষে এই অনুচ্ছেদের ব্যবস্থা অনুযায়ী আইন দ্বারা পাশ করা অর্থ তোলার ব্যবস্থা ছাড়া রাজ্য কনসলিডেটেড তহবিল থেকে কোন অর্থ তোলা যাবে না।
৯০- ঙ। কোন অর্থ বছরের বেলায় যদি দেখা যায় যে;
(ক) চলতি অর্থ বছরে কোন একটা কাজের জন্যে ব্যয় করার অনুমোদিত অর্থ যদি অপর্যাপ্ত হয়, বা নতুন কোন কাজের জন্যে ব্যয় করা প্রয়োজন হয়ে পড়ে যা ঐ বছরের বার্ষিক বিবৃতিতে নেই অথবা
(খ) কোন অর্থ বছরে কোন কাজের জন্য মঞ্জুর করা অর্থের চেয়ে যদি বেশী খরচ হয়ে যায়, তবে-
রাজ্য সরকার রাজ্য কনসলিডেটেড তহবিল থেকে খরচ অনুমোদন করতে পারবেন যদি এই খরচ শাসনতন্ত্র অনুযায়ী তহবিলের ওপর ধার্য করা হয় কিংবা ঐ পরিমাণ খরচ সংক্রান্ত একটা অতিরিক্ত আর্থিক বিবৃতি রাজ্য আইন পরিষদে পেশ করতে হবে না। এবং ৯০-ক থেকে ৯০-ঘ অনুচ্ছেদের ব্যবস্থাবলী উল্লিখিত বিবৃতির বেলায় প্রয়োগ করা হবে, যেমন বার্ষিক আর্থিক বিবৃতির বেলায় প্রয়োগ করা হয়।
৯০-চ। (১) এই পরিচ্ছেদের পূর্বে উল্লিখিত ব্যবস্থা গুলোতে কোন কিছু সত্ত্বেও কোন রাজ্য আইন পরিষদের নিন্মোক্ত ক্ষমতা থাকবে,
(ক) কোন অর্থ বছরের কোন অংশের জন্য আনুমানিক ব্যয়ের ব্যাপারে অগ্রিম কোন মঞ্জুরী দেয়া; এই ব্যয়ের ব্যাপারে ৯০-ঘ অনুচ্ছেদের ব্যবস্থা অনুযায়ী আইন পাশ ও এ ধরনের মঞ্জুরের ব্যাপারে ভোট গ্রহণের জন্য ৯০-গ অনুচ্ছেদ বর্ণিত পদ্ধতির সম্পাতি বাকি রেখে এই মঞ্জুরী দেয়া;
(খ) রাজ্যের সম্পদের ওপর একটা অপ্রত্যাশিত দাবি মেটানোর জন্য কোন মঞ্জুরী দেয়া, যখন কাজের গুরুত্ব ও অনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের দরুন বার্ষিক আর্থিক বিবৃতিতে সাধারণভাবে দেয়া বিস্তারিত বিবরণে এই দাবী উল্লেখ করা যায় না।
(গ) কোন অতিরিক্ত মঞ্জুরী দেয়া যা কোন অর্থ বছরের চলতি কোন কাজের অংশ নয়, এবং যে উদ্দেশ্যে এই মঞ্জুরী দেয়া হয়েছে সে উদ্দেশ্যে রাজ্য কনসলিডেটেড তহবিল থেকে অর্থ তোলার ব্যাপারে আইনের অধীনে অনুমোদন দেয়ার ক্ষমতা আইন পরিষদের থাকবে।
(২) ৯০-গ ও ৯০-ঘ অনুচ্ছেদের ব্যবস্থাবলী (১) নম্বর ধারা এবং এই ধারার বলে তৈরী অন্য কোন আইনের অধীনে কোন মঞ্জুরী দেয়ার ব্যাপারে কার্যকরী হবে, কারণ সেগুলোকে বার্ষিক আর্থিক বিবৃতিতে উল্লিখিত কোন ব্যয় এবং রাজ্যের অর্থ থেকে তোলার অনুমোদনের জন্য তৈরী কোন আইনের বেলায় কার্যকরী কনসলিডেটেড তহবিল এ ধরনের ব্যয় মেটাবে।“
৮। ৯১ নম্বর অনুচ্ছেদের ১ নম্বর ধারার পরিবর্তে নিন্মরূপ হবে-
“৯১। বাংলাদেশ রাজ্যের একটি এবং পশ্চিম পাকিস্তানের রাজ্যগুলোর জন্য একটি করা হাইকোর্ট থাকবে।“
৯। (১) বিগত শাসনতন্ত্রের ৯২নম্বর অনুচ্ছেদের ২ নম্বর ধারার উপধারা (খ) বাদ যাবে।
(২) ২ নম্বর ধারার উপধারা (গ) উপধারা (খ) হিসেবে ধরা হবে।
১০। বিগত শাসনতন্ত্রের ৯৯,১০৩,১০৪,১০৫,১০৭,১০৮,১১২,১১৩,১১৪ নম্বর অনুচ্ছেদ এবং ১৩১ নম্বর অনুচ্ছেদের পরিবর্তে নিন্মরূপ হবে।
“১৩৪। কোন আইন পরিষদ কর্তৃক কোন বিষয়ে তৈরী কোন আইন আইন- তৈরীর ক্ষমতার আওতার মধ্যে না হলে তা বাতিল হয়ে যাবে।
১২। বিগত শাসনতন্ত্রের ১৩৭ নম্বর অনুচ্ছেদ বাদ যাবে।
১৩। এই শাসনতন্ত্রের ১৩৮ নম্বর অনুচ্ছেদ পরিবর্তিত হয়ে নিন্মরূপ হবে-
“১৪০। কোন রাজ্যের শাসন ক্ষমতা রাজ্য কনসলিডেটেড তহবিলের সিকিউরিটির বিনিময়ে এমন একটা সীমার মধ্যে অর্থ ধার করতে পারবেন, যদি রাজ্য আইন সভার আইনে এমন কোন সীমার ব্যবস্থা থাকে, এবং এই সীমার মধ্যে গ্যারান্টি দিতে পারবেন, যদি এমন কোন ব্যবস্থা থাকে।“
.
.
পরিশিষ্ট- “ছ”
প্রধান প্রধান নৃশংসতার তালিকা
( ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের আগে সন্ত্রাস ও অরাজকতার তালিকা তৃতীয় পরিচ্ছেদে “পূর্ব পাকিস্তানে সন্ত্রাস” শীর্ষে বর্ণিত হয়েছে। )
জেলা তারিখ ও এলাকা
ঘটনা
চট্টগ্রাম
১৬-৩০শে মার্চ,
১৯৭১
চট্টগ্রাম শহর
শহরটি, ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট (ইবিআর) ইষ্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর) এবং আওয়ামী লীগ (এএল) স্বেচ্ছাসেবকদের মতো বিদ্রোহীদের কবলে ছিলো। এই বিদ্রোহীরা শহরে প্রধান অংশের মধ্যে অবস্থিত এবং পার্শবর্তী এলাকার পুরো কলোনীতে লুটতরাজ, হত্যাকাণ্ড ও অগ্নিসংযোগ করে। মানুষ হত্যার “কসাইখানা” স্থাপন করা হয়। এরকম একটা কসাইখানা চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগের দফতরেও ছিল। এই কসাইখানায় পুরুষ, নারী ও শিশুকে নির্বিশেষে হত্যা করা হয়। অনেক ক্ষেত্রেই দেহ থেকে অঙ্গ কেটে ফেলার আগে সিরিঞ্জ দিয়ে রক্ত বের করে নেওয়া হয়েছিল। ( ১০ হাজার লোক নিহত হয়)।
২৭শে মার্চ, ১৯৭১ ওসমানিয়া গ্লাস ওয়ার্কস। ১৫ই মার্চ ১৯৭১, আমিন জুট মিলস, বিবির হাট পশ্চিম পাকিস্তানী কর্মচারীদের নির্যাতন ও হত্যা করা হয় (১৭ জনের মৃত্যু হয়)। ম্যানেজিং পার্টনার এবং ম্যানেজারকে অপহরণ করা হয়। তাদের হত্যা করা হয়েছে বলে বিশ্বাস। অন্যান্য কিছু সংখ্যক কর্মীদের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। অনুমান করা হয় যে তাদের “জামিন” স্বরূপ আটক রাখা হয়েছে। (হতাহতের সংখ্যা জানা যায় নি)।
১৯শে এপ্রিল, ১৯৭১, ইস্পাহানী জুট মিলস এবং তার পার্শবর্তী এলাকা। নারী ও শিশুদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। পশ্চিম পাকিস্তানী অনেক অফিসার এবং শ্রমিকদের খোঁজ পাওয়া যায় না। অনেকেকে অপরহরণ করা হয়েছে। (হতাহতের সংখ্যা প্রায় এক হাজার)।
২৯-২৮শে এপ্রিল, ১৯৭১ হাফিজ জুট মিলস। মিল-ভবন আক্রমণ করে কিছু সংখ্যক কর্মচারীকে হত্যা করা হয়।মালিকের গৃহে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। কয়েকজন অপ্রাপ্ত বয়স্ক শিশু যারা প্রাণ ভয়ে পালিয়ে গিয়েছিল, তাছাড়া গৃহের অধীবাসীদের সবাইকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছিল।(হতাহতের সংখ্যা ছিল প্রায় ১৫০ জন)।
২৬-৩০শে এপ্রিল,১৯৭১।
কর্ণফুলী পেপার এবং রেয়ন মিলস চন্দ্রঘোনা ও তার পার্শববর্তী এলাকা।
ব্যাপক লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ ও হত্যাকাণ্ড অনুষ্ঠিত হয়। মেয়েদের ঘরে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছিল। উদ্ধার করার পর, তারা বর্ণনীয় ধর্ষণ ও বর্বরতার কাহিনী বর্ণনা করে। (হতাহতের সংখ্যা প্রায় ২ হাজার)।
২৭-৩০ এপ্রিল,১৯৭১ রাঙ্গামাটি। রাঙ্গামাটিতে অবস্থিত পশ্চিম পাকিস্তানীদের একত্রিত করে নির্যাতন ও হত্যা করা হয়।(৫০০ লোক প্রাণ হারায়)
যশোর
২৯-৩০ মার্চ, ১৯৭১ ঝুমঝুমপুর কলোনী। ইষ্ট পাকিস্তান রাইফেলস-এর বিদ্রোহীরা সমগ্র বিহারী জনগণকে সাধারণভাবে হত্যা করে। মেয়ে ও শিশুদের টেনে-হিচড়ে নড়াইলের দিকে নিয়ে যায়। ৪’শ থেকে ৫শ’র মতো মেয়েকে অপরহরণ করে নদীপথে হিন্দুস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। মানুষের কংকাল ও দেহের অন্যান্য অংশ সমস্ত এলাকায় ছড়ানো রয়েছে দেখতে পাওয়া যায়। (প্রায় ৩ হাজার লোক নিহত হয়। ২ হাজার লোকের কোন খোঁজ পাওয়া যায় নি)।
২৯-৩০শে মার্চ, ১৯৭১ রামনগর কলোনী। ঝুমঝুমপুর কলোনীর লোকেরা এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছিলো, এই কলোনীতেও আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। ( ১৫০ জনের ও বেশী লোক নিহত হয়। দুস্থ শিবিরে আশ্রয় নেয় ৪৪৮ জন।)
৩০ শে মার্চ, ১৯৭১ তারাগঞ্জ কলোনী আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছসেবকরা ও ইষ্ট পাকিস্তান রাইফেলস-এর বিদ্রোহীরা সমগ্র কলোনীতে বেপরোয়া হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যায়। খুব কম লোকই বেঁচেছিল। সমস্ত বারী ঘর ধবংস্প্রাপ্ত হয়। (৫শ’র মতো লক নিহত হয়। নিখোঁজ লোকের সংখ্যা ৪শ’)।
৩০শে মার্চ- ৫ই এপ্রিল, ১৯৭১ হামিদপুর, আমবাগান, বাকাচর এবং যশোর শহরের পুরাতন কসবা এই এলাকার অধিকাংশ জনগণকে হত্যা করে নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হয়। ঘর বাড়ী প্রথমে লুট এবং পরে ধবংস করা হয়। ( প্রায় ১ হাজার লোক নিহত ও নিখোঁজ হয়। ১৭৫ জন হাসপাতালে যায় এবং ১৭২ জন দুস্থ শিবিরে আশ্রয় নেয়।)
৩০শে মার্চ- ৫ই এপ্রিল, ১৯৭১, মোবারাকগঞ্জ। পুরুষ, নারী ও শিশুদের নির্যাতন ও হত্যা করা হয়। তাদের বারী ঘরে লুটপাট করে আগুনে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। (২শ রও অধিক লোক নিহত হয়। ১০ জন হাসপাতালে ও ২৭ জন দুঃস্থ শিবিরে যায়।)
৩০শে মার্চ- ৫ই এপ্রিল, ১৯৭১, কালিগঞ্জ বেশ কিছু সংখ্যক এলাকার উপর হামলা চালানো হয়। মেয়েদের ধর্ষণ করা হয়। পুরুষ ও শিশুদের হত্যা করা হয়, ব্যাপক লুটতরাজ ও অগ্নিসংযোগ চলে। ( প্রায় ৩’শ লোক নিহত হয়। ১৩২ জন সাহায্য শিবিরে আশ্রয় নেয়।)
৩০শে মার্চ-১০ই এপ্রিল, ১৯৭১ কোঁটচাঁদপুর। বেপরোয়া হত্যাকাণ্ড ও অগ্নিসংযোগ চলতে থাকে। ( প্রায় ৪শ লোক নিহত ও ৫শ জন আহত হয়। সাহায্য শিবিরে অবস্থানরত লোকের সংখ্যা হচ্ছে ৫৫।)
৩০শে মার্চ-১৯৭১ তাফসিডাঙ্গা। আগে থেকেই চিহ্নিত করা কিছুসংখ্যক বাড়ীঘর সংগ্রাম পরিষদের স্বেচ্ছাসেবকরা আক্রমণ করে। তারা পুরুষ ও বৃদ্ধা নারীদের হত্যা করে এবং যুবতী মেয়েদের ধরে নিয়ে যায়। (প্রায় ২শ লোক নিহত হয়। সাহায্য শিবিরে যায় ৭২ জন।)
৩০শে মার্চ- ১০ই এপ্রিল, ১৯৭১ নড়াইল। এখানে প্রধানতঃ পাঠানদের উপরে নির্যাতন করা হয়। নড়াইলের সমস্ত পাঠানদের একত্রিত করে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। মেয়ে ও শিশুসহ ৬০ থেকে ৭০ জন পাঠানকে হত্যা করা হয়েছিল
২৫শে মার্চ-৪ঠা এপ্রিল,১৯৭১, ঝিনাইদহ, মহকুমা। আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবকগণ কিছুসংখ্যক বাড়ীঘর লুট করে আগুন ধরিয়ে দেয়। জানও মালের প্রচুর ক্ষতি হয়। ২৫০ জনেরও বেশী লোক নিহত ও ৫০ জন নিখোঁজ হয়। ১০ জন হাসপাতালে যায়।
খুলনা
২৮-২৯শে মার্চ, ১৯৭১ খুলনা শহর। ক্রিসেন্ট জুট মিলস খালিশপুর ও স্টার জুট মিলস, চান্দনিমহল খুলনায় আওয়ামী লিগের আধা-সামরিক শিক্ষা শিবির গঠন করা হয়। তথাকথিত পশ্চিম পাকিস্তানী দালালদের বিরুদ্ধে সুসংবদ্ধ হত্যা ও অগ্নিকাণ্ড চলতে থাকে। ঘরবাড়ী ধবংস করা হয় এবং ব্যাপকভাবে হত্যাকাণ্ড চলতে থাকে। গলা কেটে ফেলার আগে হতভাগ্য ব্যক্তিদের উৎপীড়ন করা হতো। নিরপরাধ নারী ও শিশুদের রাস্তায় টেনে এনে হত্যা করা হয়। যারা প্রাণের ভয়ে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ও বেঁচে ছিলো তাদের নদী থেকে উঠিয়ে আনা হয়। তারপর তাদের পেট চিরে আবার নদীতে ফেলে দেয়া হয়। তাদের রক্তে নদীর পানি লাল হয়েছিল। মিল সম্পত্তির ব্যাপক ক্ষতি সাধন হয়েছিলো। কিছু সংখ্যক অফিসার “মুক্তিপণ” দিয়ে বেঁচে যান । ( হতাহতের সংখ্যা প্রায় ৫ হাজার)।
২৮-২৯ মার্চ, ১৯৭১ পিপলস জুট মিলস, খালিশপুর, খুলনা। ইষ্ট পাকিস্তান রাইফেলস, আনসার এবং আওয়ামী লীগ কর্মীরা বয়সের প্রতি কোন লক্ষ্য না রেখে উচ্ছৃঙ্খল হত্যাকাণ্ডে লিপ্ত হয়। (৪শ ৬৭ জন নিহত হয়)।
২৮-২৯ শে মার্চ ১৯৭১ নিউ কলোনী, খালিশপুর, খুলনা। প্রায় ১০ হাজার আওয়ামী লীগ কর্মী কলোনী ঘেরাও করে ফেলে। বিদ্রোহী পুলিশরাও তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। সমানে ৬ ঘন্টারও বেশী গোলাগুলি চলে। (প্রায় ৩শ লোক নিহত হয়)।
.
.
জেলা তারিখ ও এলাকা
৩০ শে এপ্রিল, ১৯৭১
সাতক্ষীরা, মহকুমা, খুলনা
ঘটনা
পশ্চিম অয়াকিস্তানী মহকুমা হাকিমকে আটক করে বন্দী অবস্থায় রাখা হয়। শহরের এলাকা জুড়ে গণহত্যা, নৃশংসতা ও ব্যাপক লুটতরাজ চলতে থাকে। (প্রায়) ১
হাজার লোক নিহত হয়)
কুষ্টিয়া
২৯ শে মার্চ-১লা এপ্রিল ১৯৭১,
চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া
বিহারী ও পশ্চিম পাকিস্তানীদের একত্রিত কত্র হত্যা করা হয়। মেয়েদের সঙ্গে অমানষিল ব্যবহার করা হয়। পশ্চিম পাকিস্তানী মহকুমাআ হাকমের উপর নির্মম অত্যাচার করা হয়। তাঁর সন্তান সম্ভবা স্ত্রীকেও মারধর করা হয়েছিল। (৫শ লোক নিহত এবং ১ শ লোক নিহত হয়)
৩০শে মার্চ-১৩ই এপ্রিল, ১৯৭১
মেহেরপুর, কুষ্টিয়া
প্রায় দ’সপ্তাহ যাবৎ মেহেরপুরে বেপরোয়া হত্যা, অগ্নিসংযোগ এবং ধর্ষণের কব্লে ছিল। ৪শ থেকে ৬শ লোক নিহত ও ২ শ লোক নিখোঁজ হয়। হাসপাতেলে যায়
১০ জন।
বগুড়া
২৬শে মার্চ-২৩শে এপ্রিল ১৯৭১,
বগুড়া শহর।
আওয়ামী লীগ সেচ্ছাসেবকরা জেল ভেঙ্গে কয়েদীদের হিংসাত্নক কার্যকলাপ ও লুটতরাজ করার জন্য ছেড়ে দেয়। ৭ হাজার পুরুষ, নারীও শিশুদের জেল ভবনের মধ্যে ঠাসাঠাসি করে ঢোকানো হয়। জেল ভবন্টি ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেবার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু সেনাবাহিনী সময়মত এসে পৌঁছে তাদের উদ্ধার করে। প্রত্যক্ষদর্শীরা গণহত্যা, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের কাহিনী বর্ণনা করে। প্রকাশ যে প্রায় ২ হজার লোন নিহত হয়।
২৬ শে মার্চ-২২ শে এপ্রিল, ১৯৭১
নওগাঁ, সান্তাহার
বিহারীদের চলাফেরা বন্ধ করার জন্য আওয়ামী লীগ দুষ্কৃতিকারীরা রাস্তা বন্ধ করে দিলো। ব্যাংকগুলো লুন্ঠিত হল মেয়েরা ধর্ষিত হলো। তাদের গুলী করে হত্যা করার আগে নগ্ন অবস্থায় রাস্তা দিয়ে হাটানো হয়েছিল। সারা শহরের মৃতদেহের ছড়াছড়ি দেখা যায়। অনেককে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়। কাউকে বা পেরেকে গেঁথে গুলি করা হত্যা করা হয় আহত অবস্থায় যারা বেঁচেছিলো তাদের কাছে থেকে জানা যায় যে, মেয়েদের নিজের সন্তানের রক্ত পান করতে বাধ্য করা হয়েছিলো। বিহারীরা একেবাএ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় (প্রায় ১৫ হাজার লন নিহত হয়)
পাবনা
২৩ মার্চ-১০ই এপ্রিল, ১৯৭১
পাবনা শহর
দু’সপ্তাহব্যাপী আওয়ামীলীগের সন্ত্রাসের রাজত্ব থেকে শহরকে রক্ষা করলো সেনাহাবিনী এসে। (প্রায় ২য় লোক নিহত হয়)
২৩শে মার্চ-১০ এপ্রিল ১৯৭১
সিরাজগঞ্জ
দুষ্কৃতকারীরা ৩৫০ জন পুরুষ। নারী ও শিশুলে দালানে ঢুলিয়ে তাতে আগুন ধরিয়ে দিলো। (ভেতরে যারা ছিল তাদের সকলকেই এভাবে ফাঁদে ফেলে হত্যা করা হয়)
১০ই এপ্রিল, ১৯৭১ পাকশী।
রেলওয়ে কলোনীর অধিবাসীদের শান্তি কমিটি গঠন করার অজুহাত দেখিয়ে প্রতারিত করা হয়। তাদের একটা হাইস্কুল ভবনে আটকে রেখে জীবিত অবস্থায় পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। (প্রায় ২ হাজার ৭ শত লোক নিহত হয়।)
দিনাজপুর ২৮শে মার্চ-১লা এপ্রিল, ১৯৭১
দিনাজপুর শহর
ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট বিদ্রোহ করার সঙ্গে সঙ্গেই নির্যযাতন শুরু হয়ে যায়। আর তার পরেই বেপরোয়া হত্যাকান্ড চলতে থাকে। পুরুষ, মেহ্যে ও শিশুদের হত্যা করা হয় যে দু-চারজন এখানে সেখানে জীবিত ছিলো তারা প্রধানতঃ ছিলো বৃদ্ধা, স্ত্রীলোক ও শিশু। নিহতদের মাতা কেটে নিয়ে হগাছের আগায় ঝোলানো হয়। প্রায় ৪শ মেয়েকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয় হিন্দুস্তানে। (প্রায় ৫ হাজার লোক নিহত হয়)
২৮ শে মার্চ -১৩ এপ্রিল ১৯৭১
ঠাকুরগাঁও
ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট বিদ্রোহ করে। অধিকাংশ বিহারীকে হত্যা করে নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হয়। যুবতী মেয়েদের অপহরণ করা হয় মেয়েদের ধর্ষণ করা এবং গর্ভবতী মেয়েদের পেটে সঙ্গীনের খোঁচা মারা হয়। আর তারপর সদ্যজাত মৃত শিশুদের ছিড়ে টুকরো টুকরো করা হয়। উলঙ্গ অবস্থায় মৃতদেহগুলিকে রাস্তায় টেনে নিয়ে বেড়ানোও হয়েছিলো। (প্রায় ৩ হাজার লোক নিহত হয়)
পার্বতীপুর, পঞ্চগড়, কাউরকাই, ফুলবাড়ি ও হিলি
বিদ্রোহী ইষ্ট বেঙ্গল রাইফেলস এবং আওয়ামীলীগ স্বেচ্ছাসেবকদের প্রধান লক্ষ্যই ছিলো রেক কলোনীগুলো। কলোনীর বাসিন্দাদের ভীতি প্রদর্শনের জন্য বোমা, হালকা মেশিন গান এবং ছোট অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করা হয়। আর তারপরেই শুরু হয়ে যায় ধর্ষণ ও হত্যাকান্ডের তান্ডবলীলা। (যারা রক্ষা পেয়েছিলো তাদের হিসাবে ৫ হাজারের বেশি লোক নিহত হয়েছিলো)
রাজশাহী
২৮শে মার্চ -১৬ই এপ্রিল ১৯৭১
রাজশাহী শহর
পুলিশ এবং ইষ্ট পাকিস্তান রাইফেলস বিদ্রোহ করে। এদের সঙ্গে এসে যোগ দেয় হিন্দুস্তানী অনুপ্রবেশকারী। শুরু হয়ে যায় বেপরোয়া হত্যাকান্ড। ১৯৭১ সালের ১৬ই এপ্রিল সেনাবাহিনী এসে শহরকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করলো। নাটোর এবং সারদা থেকেও নৃশংস হত্যাকান্ডের খবর পাওয়া যায়। (প্রায় ২ হাজার লোক নিহত হয়েছিলো)
২৭শে মার্চ-১৮ ই এপ্রিল ১৯৭১
নবাবগঞ্জ
হিন্দুস্তানী অনুপ্রবেশকারীদের শযোগীতায় বিদ্রোহী ইষ্ট পাকিস্তান রাইফেলসের লোকেরা নবাবগঞ্জ থেকে জেল কয়েদীদের মুক্ত করে দেয়। তারা কয়েদীদের বর্বরোচিত কার্যকলাপ এবং অগ্নীসংযগ করায় উতসাহিত করতে থাকে। একজন একাউন্টস এর কেরানী বাংলাদেশকে স্বীকার করতে অস্বীকার করেছিলো বলে তাকে কোমর পর্যন্ত মাটির নিচে পুঁতে, লাঠি দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। (নিহতদের সংখ্যা প্রায় ১ হাজার বলে অনুমান করা হয়)।
কুমিল্লা
মার্চ-এপ্রিল১৮, ১৯৭১
ব্রাম্মণবাড়িয়া
ব্রাম্মণবাড়িয়া বিহারী পুরুষ, মেয়ে ও শিশুদের একত্রিত করে জেল খানায় রাখা হয়। পরে ১৯৭১ সালের ১৩ ই এপ্রিল ইষ্ট বেঙ্গল রাইফেলস এর বিদ্রোহী দলের প্রধানের আদেশে স্বয়ংক্রিয় বন্দুকের সাহায্যে তাদেরকে হত্যা করা হয়। (প্রায় ৫শ লোককে নিহত করা হয়)
ময়মনসিংহ
২৭শে মার্চ ১৯৭১
ময়মনসিংহ সেনানিবাস
ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইষ্ট পাকিস্তান রাইফেলস বিদ্রোহ করে। তারা তাদের পশ্চিম পাকিস্তানী সহকর্মীদের হত্যা করে। নিহতদের মধ্যে অফিসারও ছিলেন তা ছাড়া ছিলো আরও বহু লোক, যারা রাতে তাদের বাস্থান ও ব্যারাকে ঘুমিয়েছিলো।
১৬ই-১৭ই এপ্রিল ১৯৭১
ময়মনসিংহ শহর
প্রাক্তন ইষ্ট পাকিস্তান রাইফেলসের লোকজন মেশিন গান নিয়ে ময়মনসিংহ সদর জেলা চড়াও করে এবং নিরাপত্তার কারণে স্থানান্ত্রিত বহিরাগত লোকদের গুলি করে হত্যা করে।
১৭ই-২০শে এপ্রিল ১৯৭১
সানকীপাড়া ও অন্যান্য কলোনী
উন্মত্ত জনতার হারে রাইফেল, তলোয়ার, বর্শা ছোরা এবং রাম-দা ছিলো। তারা ময়মনসিংহ শহর ও তার আশপাশের সানকীপাড়া ও অন্যান্য ৯টি কলোনী আক্রমণ করে অধিকাংশ পুরুষ অধিবাসিকে হত্যা করে। খবরে প্রকাশ যে, প্রায় ৫ হাজার লোক নিহত হয়। মেয়েরা একটি মসজিত এবং একটি স্কুল ভবনে, জড়ো হয়েছিলো। ২১ শে এপ্রিল ১৯৭১ সাল, সেনাবাহিনী যখন শহর হস্তগত করে তখন তারা মেয়েদের উদ্ধার করে।
.
.
দুই
প্রাদেশিক
সামরিক বিধি ও কার্যক্রম
.
.