You dont have javascript enabled! Please enable it!

শিরোনাম – সম্পাদকীয়

সংবাদপত্র – জয় বাংলা ২য় সংখ্যা।

তারিখ – ৩১শে মার্চ, ১৯৭১।

সম্পাদকীয়

ইংরেজীতে একটা কথা আছে “Man does not live by bread alone” অর্থাৎ মানুষ শুধুমাত্র আহার করিয়াই বাঁচিয়া থাকে না। কথাটি অক্ষরে অক্ষরে সত্য। আমাদের বর্তমান স্বাধীনতা সংগ্রাম উহার প্রমাণ। স্বৈরাচারী সরকারের আমলে জনসাধারণ ভুট্টা, গম, চাইল ইত্যাদি মোটামুটি খাইতে পাইত। স্বাধীনতা স্বাধীনতা বলিয়া চিৎকার না করিলে “বাসমতী” চাউলও কিছু খাইতে পাইত! ভাতের সঙ্গে আমরা স্বাধীনতাও চাহিয়াছি- এবং আমরা পরম করুণাময়ের অনুগ্রহে সফলতা অর্জন করিয়াছি। আম মনে করি ভাতের সঙ্গে মানুষের মনের খোরাকেরও প্রয়োজন আছে। “জয় বাংলা” সেই চাহিদার কিঞ্চিৎ মিটাইবার চেষ্টা করিতেছে।

*

গতকল্যকার সংখ্যায় আমরা জনসাধারণের প্রতি আবেদন করিয়াছিলাম- প্রয়োজনের অতিরিক্ত ক্রয় করিবেন না। জানিতে পারিলাম কিছুসংখ্যক লোকও বেহুঁশের মতো লবণ কিনিতে শুরু করিয়াছে। এই জাতীয় কর্ম হইতে বিরত থাকুন। ইহাতে বাজারে সংকট সৃষ্টি হইতে পারে। আমরা মনে করি দোকানদারদের উচিৎ লবণের মত একটি অত্যাবশ্যকীয় জিনিস কাহারও নিকট এক সঙ্গে অর্ধসেরের বেশি বিক্রয় না করা। এই সমস্ত ছোটখাট ব্যাপারেও সংগ্রাম পরিষদের নির্দেশের অপেক্ষায় থাকিবেন- ইহা কোনো কাজের কথা নহে। সংগ্রাম পরিষদের অনুমোদন সাপেক্ষে আপনারাও সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে প্রত্যেকটি নাগরিকের জাতীয় স্বার্থের কথা চিন্তা করা কর্তব্য।

*

“জয় বাংলা” জনসাধারণ, সংগ্রাম পরিষদ ও সেনাবাহিনীর সমর্থন ও উৎসাহ পাইয়াছে। সেজন্য আমরা সকলের কাছেই কৃতজ্ঞ।

*

উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে নওগাঁর বাহিরেও বেশ কিছুসংখ্যক পত্রিকা প্রেরণ করা হইয়াছে।

*

নিরস্ত্র যুদ্ধবন্দীদের হত্যা করা ন্যায়নীতি ও যুদ্ধনীতির পরিপন্থী। ভাবাবেগে চালিত না হইয়া সংশ্লিষ্ট সকলের বিচার বিবেচনা করিয়া কার্য করিবেন। ইহা আমাদের কথা বহে- পবিত্র কোরানে এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট নির্দেশ রহিয়াছে। জয় বাংলাঃ স্বাধীন বাংলার আদি পর্যায়ে নওগা থেকে প্রকাশিত একটি মুদ্রাকার দৈনিক পত্রিকা। সম্পাদকঃ রহমতউল্লাহ এম,এ,। সম্পাদক দাবী করেছেন, “জয় বাংলা”-ই সে সময়ে স্বাধীন বাংলার একমাত্র দৈনিক পত্রিকা এবং স্বাধীন বাংলার সাড়ে সাত কোটি জনগণের একমাত্র মুখপাত্র।

*

বাংলা মুক্তিবাহিনী, পুলিশ আনসার এবং স্বেচ্ছাসেবকদের সহিত সর্বপ্রকার সহযোগিতা করিবেন। মনে রাখিবেন হয় আমরা জয়ী হইব, নতুবা ধ্বংস হইব। মাঝামাঝি কোন পথ আর নাই। সংগ্রাম পরিষদের সদস্যদের নানা প্রকার গুরুত্বপূর্ণ কাজে এখানে-ওখানে ছুটাছুটি করিতে হইতেছে বলিয়া অনেক সময় জনসাধারণের তাহাদের সহিত যোগাযোগ করিতে অল্প-স্বল্প অসুবিধা হইতেছে। আমরা মনে করি জনসাধারণের সহিত সর্বক্ষণ যোগাযোগ রক্ষার সুবিধার্থে মহকুমা প্রশাসকের দপ্তরে সরকারী কর্মচারীদের রোষ্টার ডিউটি দিয়া একটি নয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা প্রয়োজন। সংগ্রাম পরিষদের নির্দেশে আওতার মধ্যে উক্ত নিয়ন্ত্রণ কক্ষ হইতে বিশেষ বিশেষ কাজ-যেমন পেট্রোল, কেরোসিন ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণের কাজ সুষ্ঠুভাবে চলিতে পারে। ইহাকে উপ-নিয়ন্ত্রণ কক্ষ নাম দেয়া যাইতে পারে।

কোরানের বানী

“… যদি কেহ তোমাকে আক্রমণ করে তবে ঠিক সেইভাবেই তুমি তাহাকেও আক্রমণ করে…” ( সুরা বাকারা-১৯৪ আয়াত)

“… অত্যাচার বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত লড়াই কর-ধর্ম আল্লাহরই। যদি তাহারা বিরত হয় তবে শুধুমাত্র অত্যাচারীদের ছাড়া অপর কাহারও উপর বিদ্বেষ না রাখাই শ্রেয়…” ( সুরা বাকারা-১৯৩ আয়াত)

“এবারে সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম এবারে সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। “ ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল”। ( ঘোড়দৈড় মাঠ, ঢাকা, ৭ই মার্চ) “তোমরা ঐক্যবদ্ধভাবে স্বাধীনতা সংগ্রাম চালাইয়া যাও”।– মাওলানা ভাসানী (পোলোগ্রাউন্ড, চট্টগ্রাম-২১শে মার্চ)

পার্থ সুমিত ভট্টাচার্য্য

<৬,২,৪-৫>

শিরোনামঃ সম্পাদকীয়

সংবাদপত্রঃ জয়বাংলা৩য় সংখ্যা

তারিখঃ ১ এপ্রিল ১৯৭১

সম্পাদকীয়

সর্বশক্তিমান আল্লাহতায়ালার কৃপায় “জয় বাংলা”র ৩য় সংখ্যা বাহির হইল। নওগাঁর মতো ছোট শহর হইতে বর্তমান পরিস্থিতিতে একটি দৈনিক পত্রিকা (যত ছোট কলেবরেই হোক) বাহির করা যথেষ্ট কষ্টসাধ্য ব্যাপার। মুদ্রণালয়ের কর্মচারীদের অকুন্ঠ এবং আন্তরিক সহযোগীতা না পাইলে “জয় বাংলা” হয়ত বা আপনাদের কাছে পৌঁছিত না।

*

ইংরেজ কবি শেক্সপীয়ার সিজারের মুখ দিয়া বলাইয়াছেনঃ “Cowardds die many times before their death, the valiant never tastes of death but once.” কাপুরুষেরা মৃত্যুর আগেও বার বার মরে, বীরেরা কখনও একবারের বেশি মৃত্যুবরণ করে না। (আমাদের অন্যবাদ) টিপ্পনী নিষ্প্রয়োজন।

*

“জয় বাংলা”র প্রথম সংখ্যায় আমরা লিখিয়াছিলাম সংগ্রাম পরিষদের নির্দেশ কেহ অমান্য করিবেন না। আমরা পুনর্বার সংগ্রাম পরিষদের নির্দেশবলী মানিয়া চলিবার জন্য জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানাইতেছি।

আমাদের চূড়ান্ত বিজয় সমাসন্ন। ইতিহাস পাঠে জানা যায় যুদ্ধে যত ক্ষতি হয় বিজয় পূর্বে বিশৃংখলার দরুন অনেক সময় তার চেয়ে বেশি ক্ষতি সাধিত হয়। একটা উদাহরণ দেওয়া অপ্রাসঙ্গিক হইবে না। ইতিহাসে আছে ফরাসি বিপবের পরে আত্মকলহ, হিংসা এবং বিশৃংখলা এত চরমে উঠিয়াছিল যে বিপ্লবের অনেক লক্ষ্যই অর্জিত হয় নাই। এমনকি বিপ্লবের পরিষদের অধিকাংশ নেতৃবর্গকেই “গিলোটিনে” প্রাণ হারাইতে হইয়াছিল। পরিণামে ফ্রান্সে পুনর্বার রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। কাজেই আমাদের অনুরোধ জনসাধারণ, নেতৃবৃন্দ এবং মুক্তিবাহিনীর বিভিন্ন শাখা হুঁশিয়ার থাকিবেন।

*

সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ ফেরেশতা নহেন-তাহারাও মানুষ। কাজেই ছোটখাট ভুল-ভ্রান্তি ত হইবেই। আমাদিগকে দুঃখের সহিত লিখিতে হইতেছে এই চরম সত্যটি অনেকেই স্বীকার করিতে চাহেন না। লক্ষ্য করা গিয়াছে কিছুসংখ্যক শিক্ষিত লোকও এসব ব্যাপার নিয়া জনমনে কিছুটা বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করিতেছেন। আমদের অনুরোধ, জনসাধারণের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি না করিয়া সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে যোগাযোগ করতঃ আপনাদের গঠনমূলক মতামত পেশ করিয়া সামান্য ভূল-ত্রুটি দূর করার ব্যাপারে সহায়তা করুন। আমরা মনে করি “Voice of reason must prevail”. স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, আকাশবাণী ও অন্যান্য সূত্র হইতে আপনারা যথেষ্ট খবর পাইতেছেন। সে কারণে এবং ছোট কলেবরের দরুন “জয় বাংলা” কোন খবর ছাপান হইতে বিরত রহিয়াছে। সব খবরের সারমর্ম নজরুলের ভাষায় বলা যায়-“মাভৈ মাভৈ আর ভয় নাই-নবযুগ ঐ আসে ঐ”।

*

 বাংলা মুক্তিবাহিনী, পুলিশ, আনসার এবং স্বেচ্ছাসেবকদের সহিত সর্বপ্রকার সহযোগীতা করিবেন। নওগাঁর আভ্যন্তরীণ শান্তিরক্ষা এবং লুটতরাজ বন্ধের ব্যাপারে বিভিন্ন মহল্লার স্বেচ্ছাসেবকরা যে রকম সুষ্ঠুভাবে কাজ করিয়া যাইতেছেন সেজন্য নওগাঁবাসীর পক্ষ হইতে “জয় বাংলা” তাহাদিগকে অভিনন্দন জানাইতেছে। সাবাস! নওগাঁ হাসপাতালে বেশ কিছুসংখ্যক জখমী চিকিতসাধীন রহিয়াছে। জনসাধারণ এবং ঔষধ বিক্রেতাদের প্রতি আমাদের আবেদন-হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়া চাহিদা মতো কিছু ঔষধপত্র বিনামুল্যে দান করিবেন। মনে রাখিবেন পীড়িতদের সেবা করা মহান কাজ। বেশি দামের সম্ভব বা হয় কম দামের ঔষধপত্রই দান করিবেন।

*

বঙ্গবন্ধু বলিয়াছেন “বাংলাদেশে প্রতিটি নাগরিকের জানমাল রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব। সে বাঙালী হউক, বিহারী হউক, হিন্দু হউক, মুসলমান হউক”।

পার্থ সুমিত ভট্টাচার্য্য

<৬,৩,৬>

শিরোনাম – সম্পাদকীয়

সংবাদপত্র – জয়বাংলা

তারিখ- ৩ এপ্রিল, ১৯৭১

সম্পাদকীয়

বাংলার বীর সৈনিকেরা-বাংলা রাইফেল বাহিনী, বাংলা রেজিমেন্ট, পুলিশ, আনসার, স্বেচ্ছাসেবক-যেভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য লড়াই করিতেছেন, তাহার তুলনা বিশ্বের ইতিহাসে মিলিবে না। সারা বিশ্ব তাহাদিগকে সালাম জানাইতেছেন। বাংলার সাড়ে সাত কোটি বীর জনতার পক্ষ হইতে “জয় বাংলা” ও তাহাদিগকে জানাইতেছে হাজারো সালাম।

.

একের পর এক শত্রুর ঘাঁটি আমাদের বীর সৈনিকেরা প্রাণপণ লড়াই করিয়া দখল করিয়া লইতেছে। বাংলার মাটি হইতে শত্রুদের নিশ্চিহ্ন না করা পর্যন্ত আমাদের আরাম হারাম।

.

বাংলার সমগ্র উত্তরাঞ্চল (দুই একটি জায়গা ছাড়া) মুক্তিবাহিনীর দখলে। পূর্বাঞ্চলেরও অধিকাংশ অংশ মুক্তিবাহিনীর করায়ত্ত। স্বাধীন বাংলার সৈন্যবাহিনীর অন্যান্য অংশ হইতে ইনশাআল্লাহ অচিরেই শত্রুদেরকে উৎখাত করিবে। বাংলার অন্যান্য বীর সন্তানদের প্রতি আহ্বান-আপনারা বাংলা-সেনাবাহিনীর সহিত কাঁধে কাঁধ মিলাইয়া লড়াই এবং তাহাদের সহিত সর্ব প্রকার সহযোগিতা করুন। জনসাধারণের প্রতি আহ্বানঃ সৈনিক ভাইদের যখন যা প্রয়োজন আপনাদের সাধ্যমত যোগাইবার চেষ্টা করিবেন। নিজেদের হাজার অসুবিধা হইলেও লক্ষ্য রাখিবেন সৈনিক ভাইদের যেন কোন কষ্ট না হয়, কেননা বাংলাদেশের পতাকাকে সমুন্নত রাখিবার জন্য তাহারা প্রাণপণ লড়াই করিতেছেন। আমরা সকলেই লড়াই করিতেছি সন্দেহ নাই, কিন্তু সৈনিক ভাইরাই সকলের আগে রহিয়াছেন। ঝড়- ঝাপটা তাহাদের উপর বেশি যাইতেছে।

.

বাংলাদেশের শুধুমাত্র ঢাকা এবং চট্টগ্রাম হইতেই দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হইত। উক্ত দুইটি শহয় প্রচন্ড লড়াই চলিতেছে বিধায় কোন দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হইবার কোন সম্ভাবনা নাই। বাংলাদেশে অন্য কোন শহর হইতে কোন দৈনিক পত্রিকা আজ পর্যন্ত প্রকাশিত হয় নাই। মাসিক, পাক্ষিক, সাপ্তাহিক ও সাময়িকী বহু প্রকাশিত হয়, কিন্তু দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হয় না। দেখা যাইতেছে এই ক্ষুদ্র আকারে “জয় বাংলা”-ই বর্তমানে বাংলাদেশের একমাত্র দৈনিক পত্রিকা। কাজেই “জয় বাংলা”-ই স্বাধীন বাংলার সাড়ে সাত কোটি জনগণের একমাত্র মুখপত্র। ইহা অযৌক্তিক দাবী নহে, এই দাবী অখণ্ডনীয় যুক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। সেহেতু “জয় বাংলা”র মতামতকে সবিশেষ গুরুত্ব দেওয়া সকলের কর্তব্য বলিয়ায় আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। …

.

.

সৌ রভ

<৬,৪,৭-৮>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : ষষ্ঠ খণ্ড

শিরোনামঃ সম্পাদকীয়

সংবাদপত্রঃ জয় বাংলা

তারিখঃ ৪ এপ্রিল, ১৯৭১

সম্পাদকীয়

আমরা বীরের জাতি। পৃথিবীর বীর জাতিগুলির তালিকায় সর্বাগ্রে বাঙ্গালিদের নাম অবশ্যই থাকিবে। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা যেভাবে ট্যাঙ্ক, কামানের বিরুদ্ধে লাঠি, সাধারণ বন্দুক ইত্যাদি দ্বারা লড়াই করিয়া শত্রুকে ধ্বংস করিয়া দিতেছে তাহার তুলনা বিশ্বের ইতিহাসে খুঁজিয়া পাওয়া দুষ্কর। পৃথিবীর অন্যান্য দুই এক জায়গায় এই ধরনের প্রতিরোধের কথা শোনা গিয়াছে। কিন্তু এমন ব্যাপকভাবে আর কোথায়ও প্রতিরোধ করা হয় নাই। বীর মুক্তিযোদ্ধারা-আল্লাহর উপর ভরসা রাখিবেন। জয় আমাদের হইবেই।

.

এতদিন বাঙ্গালিরা ঘুমন্ত সিংহের ন্যায় ছিল। আজ তাহারা জাগ্রত হইয়াছে। আজ তাহাদের গতি রোধ করিবার শক্তি কাহারও নাই।

.

গত কয়েক শতাব্দী তাহাদিগকে জাগাইবার চেষ্টা করা হইয়াছে, অনেক জাগরণী গানও শোনান হইয়াছে। কিন্তু তাহাদিগকে সম্পূর্ণভাবে জাগাইতে একমাত্র বঙ্গবন্ধু সক্ষম হইয়াছেন। জয় বঙ্গবন্ধু !

.

অতীতে কে কি করিয়াছেন ভুলিয়া যান।

.

যে যা হাতিয়ার-লাঠি, বৈঠা, বন্দুক,রামদাও, বল্লম, বরশা, সড়কি, কাস্তে, হাতুড়ী, তীর-ধনুক ইত্যাদি যোগাড় করিতে পারেন উহা লইয়াই মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপাইয়া পড়ুন। বাংলার কামারেরা অস্ত্র তৈরি করিতে থাকুন। শুধু বন্ধুদের মুখাপেক্ষী না থাকিয়া নিজেদের যা আছে তাহার উপরও নির্ভর করিতে শিখুন।

.

সাঁওতাল, গারো, হাজং, চাকমা, মগ ও অন্যান্য ভাইয়েরা আপনাদের বিষমাখা তীর-ধনুক লইয়া ঝাঁপাইয়া পড়ুন। সৈন্যদলে বিভিন্ন উপশাখা থাকে। আপনারা বাংলার ধনুক-বাহিনী হইবেন।….

.

প্রতিবেশী বন্ধু রাষ্ট্রবর্গের কাছে স্বাধীন বাংলার সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর পক্ষ হইতে আমাদের আবেদন-প্রয়োজনমত আমাদিগকে সর্বপ্রকার সাহায্য দিবেন। বাঙ্গালিরা অকৃতজ্ঞ নহে। আপনাদের বিপদের দিনেও আমরা আপনাদের পাশে দাঁড়াইব। কে জানে কার উপর কখন বিপদ নামিয়া আসিবে।

.

প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের জনগণ স্বাধীন বাংলার জনগণের প্রতি সমর্থন দান এবং তাহাদের সহিত একাত্মতা প্রকাশ করিয়াছেন। সেজন্য বাঙ্গালিরা তাহাদের নিকট কৃতজ্ঞ। আমরা সকল সময়েই প্রতিবেশীদের সাথে ভাল সম্পর্ক রাখিতে চাহিয়াছি। আমাদের শত্রুরাই তাহাতে বাধা দিয়াছে। এবার শত্রুদের উৎখাত করা হইয়াছে এবং হইতেছে।…..

.

বন্ধ করুন

কিছু কিছু বর্বর ব্যক্তি আইন নিজেদের হাতে নিয়া বহু নিরস্ত্র লোকের উপর জুলুম চালাইতেছেন। উহা অবিলম্বে বন্ধ করুন। এইরূপ বর্বরদের উপর খোদার গজব আসিবে। জনসাধারণ ও অনন্যাদের প্রতি আবেদন আপনারা বাধা দিন।

.

কিছুসংখ্যক লোক শহর ত্যাগ করিয়া গ্রামে চলিয়া গিয়াছেন। অসমর্থ ব্যক্তিরা শহর ছাড়িয়া যান আপত্তি নাই। কিছু কিছু সমর্থ ব্যক্তিরাও শহর ছাড়িয়া পালাইয়াছেন। বহু চেনা মুখকেই নওগাঁ শহরে দেখা যাইতেছে না। এই সমস্ত লোকগুলিই সময়ে শহরে ফিরিয়া লম্বা লম্বা কথা বলিবে, উজির নাজির মারিবে, নওজোয়ান মাঠ চেঁচাইয়া ফাটাইবে। এ সমস্ত লোককে জানান যাইতেছে ” জয় বাংলা”র কলমরে খোঁচা খাইতে না চাহিলে অবিলম্বে শহরে প্রত্যাবর্তন করুন। জানেনই ত “pen is mightier than the sword” কলম তরবারির চাইতে শক্তিশালী।……

.

হিংসা সংক্রামক রোগের ন্যায়। কোন কোন বিশেষ পরিস্থিতি হিংসাকে চাড়া দেওয়া অসম্ভব হইয়া পড়ে। যদি সম্পূর্ণ চাপা দেওয়া সম্ভব না হয় ( চাপা দিতে পারিলেই মঙ্গল) তবে উহাকে অবশ্যই নিয়ন্ত্রণে রাখা কর্তব্য। আজ যে হিংসার স্রোতে কোন একটি বিশেষ শ্রেণীর লোকদের দিকে প্রবাহিত হইতেছে পড়ে উহা যে অন্য কোন দিকে পরিবর্তন করিবে না তাহা কি কেহ নিশ্চয় করিয়া বলিতে পারেন? সব কিছুকেই নিয়ন্ত্রণে রাখা ভাল। সময় অতিক্রান্ত হইলে কোন কিছুকেই হাজার চেষ্টা করিলেও নিয়ন্ত্রণে আনিতে পারিবেন না। অত্যাচারীদের অবশ্যই শাস্তি দিতে হইবে, তবে নিরপরাধ ব্যক্তিদের লঘু পাপে গুরু দণ্ড দেওয়া কোনমতেই সমর্থনযোগ্য নহে। উহা নীতিবিরুদ্ধ এমনকি পবিত্র কোরানের নির্দেশেরও পরিপন্থী। অত্যাচারীর সঙ্গে লড়াই করা ধর্মীয় এবং নৈতিক কর্তব্য। হিংসার সঙ্গে উহার কোন সম্পর্ক নাই। বঙ্গবন্ধু নিজেও একাধিকার হিংসা পরিহার করিবার নির্দেশ দিয়াছেন।

…………….

সৌ রভ

<৬,৫,৯-১০>

শিরোনামঃ সম্পাদকীয়

সংবাদপত্রঃ জয়বাংলা (৭ম সংখ্যা)

তারিখঃ ৫ এপ্রিল, ১৯৭১

.

ইনশাআল্লাহ জয় আমাদের হইবেই। উহাতে কোনই সন্দেহ নাই।

.

মুক্তিযোদ্ধাদের সহিত সর্বপ্রকার সহযোগিতা করিবেন। তাহাদিগকে আশার বাণী শুনাইবেন, সাহস দিবেন। মনে রাখিবেন তাহারাও মানুষ। আপনাদের আশার বাণী তাহাদের মনে নব-বলের সঞ্চার করিবে।নব উদ্যমে তাহারা শত্রুর উপর ঝাঁপাইয়া পড়িবে এবং কামিয়াব হইবে।

.

রাজশাহী বহুসংখ্যক শত্রুকে ধ্বংস করার সময় আমাদের কয়েকজন সৈনিক জখম হইয়াছেন। তাহারা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রহিয়াছেন। “জয় বাংলা”র পক্ষ হইতে তাহাদের জন্য ৬টি গ্লুকোজ ও এক ডজন বিস্কুট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে দেওয়া হইয়াছে।

.

মুক্ত এলাকার আভ্যন্তরীণ শান্তি রক্ষার দায়িত্ব আঞ্চলিক সংগ্রাম পরিষদ, আনসার, মুজাহিদ ও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর উপরে।তাহারা নিজ নিজ দায়িত্ব যথাযথ পালন করিবেন। কেহ কোন অপকর্মকে প্রশ্রয় দিবেনই না বরং কঠোর হস্তে দমন করিবেন। মনে রাখিবেন, যে যাহা করিবেন তাহার ফল পাইবেন। অন্যায় অত্যাচার চোখের সামনে ও জানামতে সংঘটিত হইতে দেখিয়াও যদি কেহ উহাকে কঠোর হস্তে দমন না করেন তবে তাহাদিগকে আল্লাহ যথোপযুক্ত শাস্তি দিবেন। অন্যায় অন্যায়ই। আল্লাহ্‌র বিচার এতো সূক্ষ্ম, কেহই তাঁহার বিচারের আওতার বাহিরে নহে। দুই একদিন আগে পরে প্রতিটি অত্যাচারীকেই কৃতকর্মের শাস্তি ভোগ করিতে হইবে। কবিগুরু বলিয়াছেন : “অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে, তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে” – অর্থাৎ অন্যায় করাও পাপ, অন্যায় চোখের সামনে সংঘটিত হইতে দেখিয়া বাধা না দেওয়াও পাপ। কেহ কোন প্রকার পাপ কর্ম নিজেরাও করিবেন না বা অন্যকেও করিতে দিবেন না।

.

‘ক’ আপনার ভাইকে মারিয়াছে- উহার প্রতিশোধ নিবার জন্য আপনি নিরস্ত্র নিরপরাধ ‘খ’ কে মারিবেন- তাহা হইতে পারে না। ‘ক’ অত্যাচারী, উহাকে সমুচিত শাস্তি দিতেই হবে। যদি আপনি ‘ক’ এর নাগাল না পাইয়া নিরপরাধ ‘খ’ কে মারেন তবে আপনিও ‘ক’ এর সমান অত্যাচারী হইলেন। ‘খ’ এর উপরে আপনার সন্দেহ থাকে অথবা উহার পক্ষ হইতে বিপদের আশঙ্কা থাকে তবে ‘খ’-কে নিরস্ত্র করিয়া বন্দি করিতে পারেন-কিন্তু কোন অবস্থাতেই হত্যা করিতে পারিবেন না।

.

“জয় বাংলা”র কণ্ঠ স্তব্ধ না হওয়া পর্যন্ত সত্য কথাই বলিবে।”জয় বাংলা” বিশ্বাস করে “সত্যম শিবম সুন্দরম” অর্থাৎ যাহা সত্য তাহাই মঙ্গলময় এবং সুন্দর। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস সর্বশক্তিমান আল্লাহতায়ালা “জয় বাংলা”র কণ্ঠকে স্থব্ধ হইতে দিবেন না। আপনাদের সকলের দোয়া চাই।

.

কোথায় কি চক্রান্ত হইতেছে না হইতেছে, কে কোথায় কি দুষ্কর্ম করার চেষ্টা চালাইতেছে আল্লাহ্‌র মেহেরবানীতে “জয় বাংলা”র কানে তাহা যথাসময়ে পৌঁছে। শয়তানদিগকে সাবধান করিয়া দেওয়া হইল। “জয় বাংলা”কে কেহ দুর্বল মনে করিবেন না।

.

আল্লাহ্‌র মেহেরবানীতে ত আছেই তদুপরি সংশ্লিষ্ট সকল মহলেরই সমর্থন এবং সহযোগিতা “জয় বাংলা” পাইতেছে।কাজেই হুঁশিয়ার। জানা গিয়াছে সান্তাহারে বেশ কিছুসংখ্যক নিরস্ত্র নিরপরাধ নারী, শিশু এবং পুরুষ কতিপয় হিংস্র দানব এবং লুটেরাদের ভয়ে সর্বক্ষণ আল্লাহ্‌কে ডাকিতেছে এবং সকলের সাহায্য ভিক্ষা করিতেছে। সংশ্লিষ্ট সকল মহলের প্রতি আবেদন অবিলম্বে তাহাদের সকলের নিরাপত্তার উপযুক্ত ব্যবস্থা করিবেন। প্রয়োজনবোধে তাহাদিগকে অতিসত্বর নিরাপদ জায়গায় অপসারণ করুন। বঙ্গবন্ধু একাধিকবার বলিয়াছেন “বাংলাদেশে স্থায়ী বসবাসকারী প্রতিটি নাগরিকই বাঙালী- সে যে ভাষায়ই কথা বলুক না কেন-।” বঙ্গবন্ধুকে যদি আন্তরিকভাবে শ্রদ্ধা করেন এবং তাহার নির্দেশ মানেন তবে আর কাল বিলম্ব না করিয়া উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করুন।

.

দেশে এখন যুদ্ধাবস্থা বিরাজমান বলিয়া জনস্বার্থের খাতিরে “জয় বাংলা” সব-আরোপিত সেন্সর নীতি ( self censorship ) অবলম্বন করিয়াছে। কেহ ইহাকে অন্য অর্থে নিবেন না। “জয় বাংলা” প্রথমত :আল্লাহ্‌ এবং দ্বিতীয়ত জনস্বার্থ ও দেশের মঙ্গল ছাড়া আর কিছুরই তোয়াক্কা করে না।

“জয় বাংলা” পশ্চিমা বর্বরদের বিরুদ্ধে আরও ব্যাপকভাবে বিশ্বজনমত গড়িয়া তুলবার কথা চিন্তা করিতেছে।…

………………………………..

নিয়াজ মেহেদী

<৬,৬,১১-১৩>

     শিরোনাম      সংবাদপত্র      তারিখ
     সম্পাদকীয়

     জন্যবাংলা

৮ম সংখ্যা

     ৮ এপ্রিল, ১৯৭১

                          সম্পাদকীয়

    বগুড়ার তরুণ মুক্তিফৌজের বীর সদস্যদের সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গলীর পর হইতে “জয় বাংলা” লাখো ছালাম জানাইতেছে। যে রকম বীরত্ব তাহারা প্রদর্শন করিয়াছেন এবং হানাদারদের যেভাবে উৎখাত করিয়াছেন তাহার তুলনা বিশ্বের ইতিহাসে খুব বেশী একটা পাওয়া যাইবে না। একদিকে কয়েকশত মারাত্মক অস্ত্রে সজ্জিত শত্রুসেনা অপরদিকে মামুলি বন্দুক-রাইফেলে সজ্জিত বগুড়ার বীর তরুনেরা। চার পাঁচ দিন বাহিরের কোনরূপ সাহায্য ছাড়াই অবিরাম লড়াইয়ের পর তাহারা বহিরাগত হানাদারদেরকে পশ্চাৎপসরণ করিতে বাধ্য করিয়াছিলেন। কে জানে ঐ একটি ঘটনাই সমস্ত যুদ্ধের মোড় ফিরাইয়া দিয়াছে কিনা। সেইদিন বগুড়ার তরুনেরা যদি মৃত্যুর ভয় করিয়া শত্রুদের বাঁধা না দিত তবে যুদ্ধের গতি কোন দিকে মোড় নিত তাহা বলা কঠিন। আল্লাহর মেহেরবানীতে তাহারা সফলকাম হইয়াছেন। জয় বগুড়ার বীর তরুণ মুক্তিফৌজ!

    মূল শহরে প্রবেশের মুখে(যাহাকে ১ নং ফ্রন্ট বলিব) মাত্র ২৩ জন তরুণ মুক্তিফৌজ কয়েকটি রাইফেল ও বন্দুকসহ বিভিন্ন দালানের ছাদে উঠিয়া হানাদারদের গতি রোধ করিবার প্রথম প্রচেষ্টা চালাইয়াছিল। এই দলেরই অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক জনাব আসাদুজ্জামানের পুত্র বগুড়া জিলা স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্র বিংশ শতাব্দীর তীতুমীর বীর তীতু অন্যান্যদের সাথে ঘন্টাখানের লড়াই করিবার পর শাহাদাৎ বরণ করে। তাহার সাথে একটি রাইফেল ছিল। তাহার সাথে আর যে ৪ জন ঐ দালানের ছাদ হইতে রাইফেল বন্দুক হইতে শত্রুদের উপর অবিরাম গুলিবর্ষন করিয়া বেশ কিছুসংখ্যক সৈন্যকে ঘায়েল করিয়াছিল, তাহাদের আর কোন খোঁজ আজ পর্যন্ত পাওয়া যায় নাই। দালানটি আমরা দেখিয়াছি। উহা রাস্তার অন্য মুখে অবস্থিত। এদেশে শান্তি ফিরিলে বাংলার মানুষ যে শহীদদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলিতে শ্রদ্ধাঘ্র্য নিবেদন করিবেন, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই।

    শহরের অন্য অঞ্চলে(২ নং ফ্রন্ট) বগুড়া মটর শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি তরুণ মুক্তিযোদ্ধা আকবর হোসেন ওরফে বকুলের নেতৃত্বে বেশ কিছুসংখ্যক তরুণ ও জনতা হানাদারদের বাঁধা দিবার জন্য প্রস্তুতি গ্রহন করে। এক নং ফ্রন্ট অপেক্ষা এই দলে মুক্তি যোদ্ধাদের বেশী ছিল। কিন্তু বন্দুক ও রাইফেলের সংখ্যা ছিল কম। এই ফ্রন্টেও হানাদারদের সঙ্গে প্রচণ্ড লড়াই চলে। এই ফ্রন্টে বীর বকুল একাই একটি ২-২ বোর রাইফেলের সাহায্যে বেপরোয়া এবং অবিরাম গুলিবর্ষণ করিয়া হানাদারদেরকে দেড় ঘন্টা ঠেকাইয়া রাখিয়াছিলেন। তৎপরে অন্যান্যরা হানাদারদের ঘিরিয়া ফেলিবার প্রচেষ্টা চালাইলে উহারা কাপুরুষের মত পশ্চাৎপসরণ করে। এই ফ্রন্টে সকলেই কিছু কিছুর আড়ালে কভার নিতে সক্ষম হইয়াছিলেন বলিয়া হতাহতের সংখ্যা বেশী নহে।

                 বিশেষ ঘোষণা

    আল্লাহর মেহেরবানীতে এবং সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বিশেষ করিয়া বাংলা রাইফেল বাহিনীর প্রানপন চেষ্টার ফলস্বরূপ গতকল্য দুপুরের আগে রাজশাহী আমরা পুনরুদ্ধার করিয়াছি। শত্রুদের ধংস করিয়া ফেলা হইয়াছে। দুই একটি ক্যান্টনমেন্ট ছাড়া সমস্ত উত্তরাঞ্চল আমাদের দখলে। এগুলিও ইনশাল্লাহ অনিতিবিলম্বে আমাদের করায়ত্ব হইবে। পূর্বাঞ্চলের বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য। ঐ অঞ্চলেও মাত্র দুই একটি ক্যান্টনমেন্ট শত্রুদের দখলে রহিয়াছে। শত্রুদেরকে স্বাধীন বাংলার মাটি হইতে সম্পূর্ণরূপে উৎখাত না করা পর্যন্ত আমাদের সকল প্রকার আরাম হারাম করা কর্তব্য। স্বাধীন বাংলার উত্তরাঞ্চলের বীর যোদ্ধাদের এবং তাহাদের তরুণ সর্বাধিনায়ককে স্বাধীন বাংলার সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর পক্ষ হইতে “জয় বাংলা” সংগ্রামী অভিনন্দন জানাইতেসে…..

    প্রথম হামলায়ই হানাদারেরা যে প্রস্তর-দৃঢ় প্রতিরোধের সম্মুখীন হয় তাহাতে তাহাদের প্রায় বিলুপ্ত মনোবল আরও ভাঙ্গিয়া পড়ে। ইহার পরে আরও তিন চারদিন ধরিয়া বিভিন্ন অঞ্চলে মুক্তিফৌজের সন্দগে হানাদারদের খণ্ড লড়াই চলে এবং পরিশেষে তাহারা বেশ কিছুসংখ্যক হতাহতকে পিছনে ফেলিয়া রাত্রির অন্ধকারে চোরের মত পলায়ন করে। শত্রুদের আগমনের খবর ২৫শে মার্চ সন্ধ্যায় পাওয়া যায়। সঙ্গে সঙ্গেই মুক্তি সেনারা তাহাদেরকে বাধা দিবার জন্য সকল প্রকার ব্যাবস্থা গ্রহন করে। প্রথম লড়াই শুরু হয় ২৬শে মার্চ শুক্রবার।

    এদিকে শহরের ওপর প্রান্তে শহর হইতে ৭ মাইল দূরে অবস্থিত আড়িয়ার বাজার ক্যাম্পে অবস্থানরত বাঙ্গালী এবং পশ্চিমা সৈন্যদের মধ্যে কনফ্রন্টেশন চলিতেছিল। পশ্চিমারা অবস্থা বেগতিক দেখিয়া বিমান সাহায্য চাওয়ায় ক্যাম্পকে টার্গেট করিয়া দুইদিনে বেশকিছু বোমা ফেলা হয়। শোনা যায় উহাদের অন্য বিশেষ মতলব ছিল। আল্লাহর মেহেরবানীতে শত্রুদের কোন কুমতলবই হাসিল হয়নাই। শহরেও কয়েকটি বোমা ফেলা হয়। উহাদে ৪-৫ টি ঘর বাড়ী মাত্র আংশিক পুড়িয়াছে। কেহ হতাহত হত নাই। অবশেষে মুক্তিসেনারা শহরের অপর অংশ হইতে হানাদারদের বিতারন করিয়া আড়িয়ার বাজার ক্যাম্পের বাঙ্গালী সৈন্যদের সাহায্যার্থে অগ্রসর হয়। এই সময়ে কিছু পুলিশ ও পার্শ্ববর্তী এলাকা হইতে প্রেরিত কিছু নিয়মিত সৈন্যও তাদের সাথে যোগ দেয়। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় অনধিক এক ঘন্টার মধ্যে শত্রুদেরকে ধ্বংস করিয়া দেওয়া হয়। এই ফ্রন্টে বগুড়া শহর আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান তরুণ মুক্তিযোদ্ধা বীর মাসুদ শহীদ হন।

    প্রথম দিনেই হানাদারদের বাধা দিতে রওয়ানা হইবার পূর্বে বগুড়ার মহকুমা প্রশাসক জনাব আবদুল হাই সাহেব তাহাদের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত এক উদ্দীপনাময়ী ভাষণ দিয়া তরুণ মুক্তি সেনাদিগকে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিলেন। শ্রদ্ধেয় হাই সাহেব বয়োবৃদ্ধ হইলে কি হইবে-বগুরার বীর তরুণেরা তাহাকেও তরুণ বলিয়া স্বীকার করিয়া নিয়াছে। জেলা প্রশাসকসহ অন্যান্য সরকারী কর্মচারীবৃন্দও তাহাদের সহিত সর্বপ্রকার সহযোগিতা করিয়াছেন। অপর একজনের নাম উল্লেখ না করিয়া পারিতেছি না- তিনি হইলেই মুক্তি সেনাদের “কমন মামা”(সম্পাদকও তাহাকে “মামা” বলিয়া ডাকে) ক্যাপ্টেন(অবসরপ্রাপ্ত) এম, আর, চৌধুরী। মুক্তি সেনাদের ঠিক পথে পরিচালিত করাই তাহার অন্যতম প্রধান কাজ। পুলিশ বাহিনীর বর্তমান অধ্যক্ষও মুক্তি সেনাদের সঙ্গে সর্বপ্রকার সহযোগিতা করিয়াছিলেন এবং করিতেছেন। ইহা ছাড়া দু’একজন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের পরামর্শও তাহারা পাইয়াছিলেন।

    গত ৫ তারিখ রাত্রি হইতে ৭ তারিখ সকাল পর্যন্ত বগুড়ায় অবস্থানকালে দেখিতে পাইয়াছি বেশকিছুসংখ্যক গর্ত্তে পলায়নকারী তথাকথিত রাজনৈতিক নেতারা মাঠে নামিয়া তাহাদের নানা প্রকার কুমতলব হাসিলের চেষ্টায় রত রহিয়াছেন। ইহাদের কার্যকলাপ এতই জঘন্য যে উহারা মুক্তি সেনাদের মাঝেও বিভেদ সৃষ্টি করিবার চেষ্টার ত্রুটি করেন নাই। আল্লাহর মেহেরবানীতে তাহাদের প্রচেষ্টা সফল হয়নাই। সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি বিশেষ করিয়া বেসামরিক, সামরিক, এবং মুক্তি সেনাদের প্রতি আমাদের আবেদন অবিলম্বে চোর-ছ্যাচড়াদেরে যে সব গর্ত্তে উহারা পলাইয়াছিল সে সব গর্ত্তে উহাদিগকে ফেরত পাঠান। এখন যুদ্ধাবস্থা। এ ব্যাপারে কোন রকম শৈথিল্য দেখান কাহারও পক্ষে উচিত হবেনা। সকলেই স্মরণ রাখিবেন একতা ছাড়া আমাদের কোন প্রচেষ্টাই সফলতা লাভ করিতে পারিবে না। আর একটি কথা স্মরণ রাখিবেন আমরা বাঙ্গলী। যুদ্ধের সময় প্রধান প্রধান নেতৃবৃন্দের আত্মগোপনের প্রয়োজন অবশ্যই রহিয়াছে। কিন্তু সকলেরই পলায়নের অধিকার বা প্রয়োজন রহিয়াছে, তাহা আমরা মানিয়া নিতে প্রস্তুত নহি।

    আমরা একটি প্রস্তাব সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট পেশ করিতেছি অবিলম্বে মুক্ত অঞ্চল সমুহে বেসামরিক কর্তৃপক্ষকে স্ব স্ব অঞ্চলে বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সহযোগিতায় আভ্যন্তরীণ শান্তিরক্ষা এবং বিশৃঙ্খলা

    সৃষ্টিকারীদের সমুলে ধ্বংস করিবার পূর্ণ দায়িত্ব দেয়া কর্তব্য। এ ব্যাবস্থা অবিলম্বে গ্রহন করিতে হইবে। নতুবা দেশে অরাজকতা দেখা দিতে পারে। হিংসাও মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি পাইতে পারে। যে কোন প্রকার হিংসা এবং অনৈক্যকে প্রশ্রয় দিলে আমাদের ধ্বংস অনিবার্য। কে কি করিয়াছে শুধু তাহাই আমরা দেখিব না বা অনুসরণ করিব ন- আমরা কি করিব তাহাই চিন্তা করিতে হইবে। অরাজকতা এবং হিংসার বৃদ্ধি কোন অবস্থাতেই চলিতে দেওয়া যাইতে পারে না। আমরা মনে করি সময় নষ্ট না করিয়া অবিলম্বে ব্যাবস্থা গ্রহন করিতে হইবে।

    টেলিফোন বিভাগের কর্মীরা আমাকে জানাইয়াছেন যে মুক্ত অঞ্চলসমূহে অনতিবিলম্বে টেলিযোগাযোগ ব্যাবস্থা চালু করার জন্য তাহারা আপ্রাণ চেষ্টা চালাইবেন। সংশ্লিষ্ট সকলে তাহাদের সহিত পূর্ণ সহযোগিতা করিবেন।

    “জয় বাংলা”র সংখ্যাগুলি শুধুমাত্র বগুড়ায় দশ পয়সা মূল্যে বিক্রয় করিবার অনুমুতি দেওয়া হইল। একমাত্র শর্ত কাহারও নিকট হইতে কোন অবস্থাতেই ঐ বাবদ দশ পয়সার বেশী লওয়া চলিবেনা। তরুণ মুক্তিফৌজের তরুণতম সদস্য বগুড়া জিল স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র বাবলুর অনুরোধে এই অনুমতি দেওয়া হইল। সে নিজেই উদ্যোগী হইয়া বগুড়ার মুক্তি ফৌজের বড় ভাইদের বিভিন্ন টূকিটাকি জিনিস যোগান দিবার উদ্দেশ্যে বিক্রয়লব্ধ অর্থ দ্বারা “জয় বাংলা” ফান্ড খুলিয়াছে। ‘মামা’ সহ মুক্তিফৌজের অন্যান্য সকলেই উহা অনুমোদন করিয়াছেন বিধায় আমাদিগকে নতি স্বীকার করিতে হইল।

    সংশ্লিষ্ট সকলের অবগতির জন্য জানাইতেছি এই ফান্ড হইতে “জয় বাংলা” কর্তৃপক্ষ (কর্তৃপক্ষ বলিতে এ ক্ষেত্রে আমাকেই বোঝাইতেছে) এক পয়সাও গ্রহন করিবে না।

    বগুড়ার মুক্তিফৌজের তরুণ ভাইয়েরা “হাইজ্যাক” বাদ দিন। সিগারেট না পান দাদার আমলের হুক্কা ধরুন!!

.

.

লাল কমল

<৬,৭,১৪-১৫>

শিরোনাম সংবাদপত্র তারিখ
সম্পাদকীয়

জয় বাংলা

৯ম সংখ্যা

৯ এপ্রিল, ১৯৭১

সম্পাদকীয়

আমরা সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করিতেছি। অত্যাচার, অনাচার, অবিচার দূর করিয়া স্বাধীনভাবে শির ও স্বদেশের পতাকাকে সমুন্নত রাখিয়া বিশ্বের বুকে বিচরণ করিবার জন্যই লড়াই করিতেছি। আল্লহার মেহেরবাণীতে জয় আমাদের হইবেই। আমাদিগকে ঠেকাইবার শক্তি(এক আল্লাহ ছাড়া) আর কাহারও নাই।

যে সমস্ত মুক্তিযোদ্ধা এবং অন্যান্য নিরস্ত্র লোক বর্বরদের হাতে নিহত হইয়াছেন তাহাদের সকলের আত্মার শান্তির জন্য আমরা পরম করুণাময়ের কাছে প্রার্থনা জানাইতেছি।

গতকল্যকার বিশেষ সংখ্যায় বগুড়ার মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে বিস্তারিত লেখা হইয়াছে। প্রতি খবরই বিভিন্ন মহল হইতে সংগ্রহ করিয়া নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে যাচাইয়ের পরেই পত্রিকায় প্রকাশ করা হইয়াছে। যতগুলি ‘ফ্রন্টের’ উল্লেখ রহিয়াছে প্রতিটি অঞ্চলই ব্যাপকভাবে পরিদর্শন করা হইয়াছে। উহা ছাড়াও সমস্ত শহরও একাধিকবার চষিয়া বেড়ান হইয়াছে। একাজে দ্বিচক্রযানের পিছনে বসাইয়া ঘোরানোর এবং গাইডের কাজ করিবার জন্য জনাব আলমগীর হোসেন সাহেবকে এবং দ্বিচক্রযানের খোরাক এক গ্যালন পেট্রোল যোগাড় করিয়া দিবার জন্য মুক্তিযোদ্ধা দোস্ত পেস্তাকে ধন্যবাদ জানাইতেছি।

চুড়ান্ত বিজয় সমাসন্ন। এখন সকলকেই আরও বেশী হুশিয়ার থাকিতে হইবে। অনৈক্য, অরাজকতা, হিংসা, বিশৃঙ্খলা ইত্যাদি কোন মতেই বৃদ্ধি পাইতে দেওয়া চলে না। পশ্চিমা বর্বরেরা যতখানি ক্ষতি করা সম্ভব করিয়াছে। কিন্তু আমরা যদি উপরি-উল্লিখিত পাপগুলিকে (আমরা ঐগুলিকে পাপ বলিয়া মনে করি) প্রশ্রয় দেই বা নির্মূল না করি তাহা হইলে যাহা অবশিষ্ট রহিয়াছে তাহা হয়ত আমাদের নিজেদের হাতেই ধ্বংস হইবে। ঐক্য, শৃঙ্খলা ও শান্তির গুরুত্ব যুদ্ধবিশারদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ, জনপ্রশাসনবিদ যাহাকেই জিজ্ঞাসা করুন না কেন একবাক্যে স্বীকার করিয়া নিবে। বিজয়ের মুহূর্তে এবং বিজয় পরবর্তী সময়ে ঐগুলির গুরুত্ব অপরিসীম।

পশ্চিমা বর্বরদের অত্যাচারে সারা বাংলাদেশে এমন লোক পাওয়া দুষ্কর যে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় নাই। চুড়ান্ত বিজয়ের পরে পশ্চিমা বর্বরদের চিহ্ন একরকম থাকিবে না। এদিকে যাহারা উহাদের অত্যাচারে ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছে বা হইতেছে তাহাদের একটি অংশ ধীরে ধীরে হিংস্র হইয়া উঠিতেছে। এখনই ইহাকে বাধা না দিলে জয়ের শেষে হিংসাকে বাধা দেওয়া কাহারও পক্ষে সম্ভব হইবে না।

একটু গভীরভাবে চিন্তা করুন- যুদ্ধের শেষে একরকম নিশ্চিহ্ন হইয়া যাইবে। কিন্তু হিংসা শুধু থাকিবেই না-নিত্যনতুন বর্বরতার খবর কানে আসিবার (সমস্ত বর্বরতার খবর এখনও পাওয়া যায় নাই) সঙ্গে সঙ্গে উহা আরও বৃদ্ধি পাইবে। এই পুঞ্জীভূত হিংসা কোন দিকে ধাবিত হইবে? দুষ্ট প্রকৃতির লোকেরা তো ওঁৎ পাতিয়া রহিয়াছে-যেদিকে ইচ্ছা হিংসাকে দিক পরিবর্তন করাইবার ত্রুটি করিবে না। আমাদের তৃতীয় সংখ্যায় (১৮ই চৈত্র,১৩৭৭) আমরা ফরাসী বিপ্লবের উদাহরণ দিয়াছিলাম। ইতিহাস একেবারে অস্বীকার করা চলে না-যদি তাহাই চলিত তবে আর উহা নিয়া মাথা ঘামাইত না-আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রে স্বাধীনতা আন্দোলন ফরাসী বিপ্লব বা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের কাহিনী পড়িত না।

কাজেই আমরা আশা করি সংশ্লিষ্ট সকলেই দেশের মঙ্গল ও জনস্বার্থের দিকে লক্ষ্য রাখিয়া নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করিবেন।

আমরা একাধিকবার বলিয়াছি অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে লড়াই করা এবং উহাদিগকে ধ্বংস করা ধর্মীয় এবং নৈতিক কর্তব্য। হিংসার সঙ্গে উহার কোনই সম্পর্ক নাই।

মুক্ত অঞ্চলসমূহে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতিকল্পে যাহা করা প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট সকলেই সেদিকে নজর দিবেন।

পশ্চিমা বর্বরদের বেতার কেন্দ্র কেহ ধরিবেন না। আমরাও তাহা শোনা অনেক পূর্বেই বাদ দিয়াছি। নিজস্ব একটি বেতার কেন্দ্র যতদিন আমাদের চালু না হইতেছে ততদিন বন্ধু রাষ্ট্রসমূহের বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠানাদি শুনিতে পারেন। পূর্বের একটি সংখ্যায় আমরা উত্ত্রাঞ্চলে একটি বেতার কেন্দ্রের আবশ্যকীয়তার কথা উল্লেখ করিয়াছিলাম।

.

.

সৌ রভ

<৬,৮,১৬>

শিরোনামঃ সম্পাদকীয়

সংবাদপত্রঃ জয়বাংলা

তারিখঃ ১১ এপ্রিল, ১৯৭১

সম্পাদকীয়

পশ্চিমা বর্বরদের সীমানা মাত্রা ছাড়াইয়া গিয়াছে। বিভিন্ন দেশী- বিদেশী সূত্র হইতে প্রাপ্ত খবর গুলি যেমনই পৈশাচিক তেমনি হৃদয় বিদারক। খবরগুলি যতই হৃদয়বিদারক হউক না কেন এখন  আর শোক প্রকাশের সময় নাই। বর্বরদের অবিলম্বে পালাইতে হইবে। বাংলার প্রতিটি সবল দেহ লোক বিশেষ করিয়া যুবকদের প্রতি আমাদের আহ্বান, হাতিয়ার তুলিয়া নিন, হানাদারদের বর্বরোচিত হামলার উপযুক্ত জবাব দিন।

.

বাংলার মা- বোনেরা ছেলে, ভাই, স্বামীদের উৎসাহ দিন, প্রেরণা যোগান। তাহাদিগকে লড়াই করিতে উদ্ধুদ্ধ করুন। কোন প্রকার স্নেহের ডোরে এখন আর বাঁধিয়া রাখিবার চেষ্টা করিবেন না। দেশের স্বার্থে,জনগণের স্বার্থে, এমনকি নিজেদের স্বার্থে তাহাদিগকে অবিলম্বে যুদ্ধে পাঠান। মনে রাখিবেন শত্রুকে নির্মূল না করিতে পারিলে কাহারও কোন প্রকার নিরাপত্তা থাকিবে না।

.

 গতকল্যকার সংখ্যা আমরা সবল দেহ লোকদিগকে যুদ্ধ- ট্রেনিং দানের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করিয়াছি। এ ব্যাপারে স্বেচ্ছাসেবকদেরকেই অগ্রণী হইতে হইবে। আমাদের দৃঢ বিশ্বাস সংশ্লিষ্ট সকল মহলেরই সহযোগীটা আপনারা পাইবেন। উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও এ ব্যাপারে যোগাযোগ করিতে পারেন।

.

এই সংখ্যা হইতে কিছু কিছু খবর ছাপিবার ব্যবস্থা করা হইয়াছে। কিছু বিদেশী সুত্রে প্রাপ্ত, কিছু আমাদের নিজস্ব সংস্থা ‘জবাসসের’- ‘জয় বাংলা’ সংবাদ সংস্থা-মাধ্যমে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ এবং জনসাধারণের সক্রিয় সহযোগিতায় প্রাপ্ত।

.

খবর ছাপিবার প্রস্তাবটি যিনি দিয়াছেন তাহাকে ‘জয় বাংলার’ পক্ষ হইতে ধন্যবাদ জানাইতেছি।

.

কলিকাতার ইংরেজি দৈনিক অমৃত বাজার পত্রিকার ৯ই এপ্রিল সংখায় প্রকাশিত এক সংবাদে প্রকাশ ঢাকা The Pakistan Observer, Morning News, দৈনিক পাকিস্তান, পূর্বদেশ এবং আজাদ- এই দৈনিক পত্রিকাগুলি পশ্চিমা সামরিক বাহিনীর তত্তাবধানে প্রকাশিত হইতেছে। পত্রিকাগুলির অধিকাংশ সাংবাদিক ও কর্মচারীদের নির্মমভাবে হত্যা করা হইয়াছে। পশ্চিমা বর্বরেরা বিশ্বকে ধোঁকা দিবার জন্য উক্ত বিখ্যাত পত্রিকাগুলির নাম বা Goodwill ব্যবহার করিতেছে। উক্ত খবরে আরও বলা হইয়াছে দৈনিক ইত্তোফাক, সংবাদ ও The people- এর কার্যালয়গুলি ২৫শে মার্চ দিবাগত রাত্রে অর্থাৎ ২৬শে মার্চ ভোরে ধ্বংস করিয়া ফেলা হইয়াছে।

.

‘জয় বাংলা’ বাংলার সাংবাদিক, সংবাদপত্র কর্মচারী, তথা সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালির পক্ষ হইতে ইহাতে তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করিতেছি এবং বর্বরদের হাতে নিহত সকলের আত্মার শান্তির জন্য বিশ্ব- নিয়ন্তার দরবারে প্রার্থনা জানাইতেছে। ইহার উপযুক্ত বদলা অবশ্যই লওয়া হইবে।

.

হে বিশ্বপ্রভু, আমাদের উপরে তোমার রহমত অবিলম্বে আরও অধিক মাত্রায় বর্ষিত হউক।

.

জয় আমাদের সুনিশ্চিত। জয় বাংলা!

সৌ রভ

<৬,৯,১৭>

শিরোনামঃ সম্পাদকীয়

সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ* ( ১ম বর্ষঃ ১ম সংখ্যা)

তারিখঃ ১৭ এপ্রিল, ১৯৭১

.

সম্পাদকীয়

.

বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের নির্মম নিষ্ঠুর আঘাত আর অত্যাচারে আজও বাংলার মানুষ নিপীড়িত,আজও বাংলার মানুষ দস্যুর সহিত রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে লিপ্ত। বর্তমান শতাব্দীর সভ্যতার চরম বিকাশের যুগেও এই সম্পাদকীয় লিখতে হচ্ছে বাংলার লক্ষ লক্ষ মানুষের জমাট বাঁধা রক্তের উপর দাঁড়িয়ে। তাই বিশ্বের মানবতাকামী সকল রাষ্ট্র ও জনসাধারণের মানবতাবোধের কাছে আমরা আবেদন জানাই এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে রক্ত শপথে রুখে দাঁড়াবার জন্য।

[ বাংলাদেশঃ বরিশাল হতে প্রকাশিত একটি অনিয়মিত অর্ধসাপ্তাহিক। সম্পাদনাঃ এস, এম, ইকবাল, মিন্টু বসু, হেলাল উদ্দিন। প্রকাশনায়ঃ হারেচ এ, খান, এনায়েত হোসেন, মুকুল দাস। ]

.

সৌ রভ

<৬,১০,১৮-২০>

শিরোনামঃ সম্পাদকীয়

সংবাদপত্রঃ জয়বাংলা* ১ম বর্ষঃ ১ম সংখ্যা

তারিখঃ ১১ মে, ১৯৭১

সম্পাদকীয়

.

বাংলাদেশের মুক্তিপাগল মানুষ আজ ইয়াহিয়া ও তার জঙ্গিচক্রের দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মরণপণ করে রুখে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত পাক ফৌজের বিরুদ্ধে চলছে মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড লড়াই। অস্ত্র বলে বলীয়ান খান-সেনাদের নায়ক টিক্কা খান ভেবেছিল মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ভেঙ্গে দেয়া যাবে বাঙ্গালির প্রতিরোধ, তাদের পরিণত করা যাবে গোলামের জাতে। কিন্তু তাদের সে আশা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে। প্রতিদিন বাড়ছে মুক্তিবাহিনীর শক্তি। বাংলাদেশের হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন যোগ দিচ্ছে মুক্তিবাহিনিতে। স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী নিচ্ছে খান সেনাদের খতম করার চূড়ান্ত প্রস্তুতি। শত্রুর কামান চিরতরে স্তব্ধ না করা পর্যন্ত থামবে না এ যুদ্ধ। কিন্তু এছাড়া কি অন্য কোন পথ খোলা ছিল সাড়ে সাত কোটি বাঙালী ও নেতাদের জন্যে ?

.

এ প্রশ্নের জবাব দিতে গেলে পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকে নানা বিষয়ের উপর আলোকপাত করতে হয়। গনতন্ত্রের পথেই হয়েছিল পাকিস্তানের জন্ম, এবং তা অর্জনের উদ্দেশ্যই ছিল আপামর দেশবাসীর সার্বিক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি। কিন্তু বাঙালী জাতি কি কোনদিন পেয়েছে মুক্তির স্বাদ ? বারবার বাঙ্গালীর রাজনৈতিক, অর্থনীতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের উপর হানা হল একটানা হামলা।

.

গোড়াতেই চলল বাঙ্গালীর মাতৃভাষার উপর গোড়াতেই চলল বাঙ্গালীর মাতৃভাষার উপর আক্রমণ-যদিও পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার মধ্যে বেশিরভাগ ছিল বাঙালী। বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য প্রাণ দিতে হল আমাদের সন্তানদের, কিশোর তরুণের তাজা রক্তে লাল করতে হল ঢাকার রাজপথ। অনেক খুন, অনেক রক্তে ও অনেক সংগ্রামের বিনিময়ে বাংলা রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি পেলেও কোনদিন তার ন্যায্য মর্যাদা পেল না।

.

বাংলাভাষার বিরুদ্ধে ওদের কত ঘৃণা কত বিদ্ধেষ, বাংলাদেশব্যাপী শহীদ মিনারগুলো কামান দাগিয়ে ধ্বংস করা থেকেই পাওয়া যায় তার প্রমাণ।

.

শুধু ভাষা নয়, বাংলার সংস্কৃতির প্রতিটি ক্ষেত্রে তারা চালাল হামলা। আমাদের সংস্কৃতিকে গলা টিপে মারার প্রচেষ্টা চলল সুপরিকল্পিতভাবে।

.

অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও চললো একটানা শোষণ বঞ্চনা। বাংলাদেশকে শোষণ করে গড়ে তোলা হল পশ্চিম পাকিস্তান। ফলে একদিকে সোনার বাংলা পরিণত হল শ্মশানে অন্যদিকে মরুময় পশ্চিম পাকিস্তান হয়ে উঠলো শস্য শ্যামলা। কেন্দ্রীয় সরকারের চাকুরী বাকুরী সশস্ত্রবাহিনী কোথাও হল না বাঙ্গালিদের স্থান। আজাদীর চব্বিশ বছর পরও সশস্ত্রবাহিনীতে বাঙ্গালীদের সংখ্যা শতকরা দশজনও ছিল না। বিদেশী সাহায্য, ঋণ প্রভৃতি ক্ষেত্রেও পেল না বাংলাদেশ তার ন্যায্য হিস্যা। সাড়ে বার কোটি পাকিস্তানীর নামে এসব বিদেশী সাহায্য ঋণ ও মুঞ্জুরী এনে তা ভোগ করলো দেশের মাত্র একটি অংশের মানুষ। বাংলাদেশের পাট বেচা টাকা থেকে আয় হত পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রার মোট শতকরা ষাট ভাগ। কিন্তু কোনদিন বাঙালী এর অর্ধেকও নিজের ব্যবহারের জন্য পায়নি। বাংলাদেশের উদ্ধৃত্ত বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে পূরণ করা হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানের ঘাটতি । কেনা হয়েছে দেশের সেই অঞ্চলের জন্য কলকারখানা ও শিল্পের যন্ত্রপাতি, আর আনা হয়েছে সামরিক অস্ত্রশস্ত্র। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস বাঙ্গালীর অর্থে কেনা অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে আজ নির্বিচারে খুন করা হচ্ছে বাঙ্গালীদের।

.

আওয়ামী লীগ যখনই এসব অন্যায়, অবিচার ও শোষণ বঞ্ছনার প্রতিকার দাবী করেছে তখনই তাদেরকে আখ্যায়িত করা হয়েছে ভারতের দালালরূপে, ইসলাম ও সংহতির দুশমনরূপে। তবু নির্ভেজাল গণতন্ত্রে বিশ্বাসী আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব চেয়েছিলেন গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে জাতীয় সমস্যাবলী সমাধান করতে, কেন্দ্র ও প্রদেশের মধ্যকার তথা দেশের দুই অংশের মধ্যকার সম্পর্ক নির্ধারণ করতে।ভাই ভাই হিসেবে একসাথে বাস করতে। কিন্তু বেইমান ইয়াহিয়া ও তার সামরিক চক্র রুদ্ধ করে দেয় গণতন্ত্রের পথ। গণতন্ত্রের সব পথ বন্ধ হয়ে যাবার পরই শুরু হয়েছে আজকের এই যুদ্ধ। এ যুদ্ধের জন্য বাঙ্গালিরা দায়ী হয়। এ যুদ্ধ ইয়াহিয়া ও তার জঙ্গী চক্রের চক্রান্তেরই ফলশ্রুতি।

.

বাংলাদেশের মানুষ সব সময়ই শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সমস্যার সমাধান চেয়েছে। তাই যখনই দেশে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সমস্যা সমাধানের সামান্যতম সুযোগ এসেছে তাকে তারা গ্রহণ করেছে সযত্নে। ১৯৫৪ সালে বাংলাদেশের মানুষ গণতান্ত্রিক উপায়ে তাদের আশা আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবরূপ দানের জন্যে ঐক্যবদ্ধ হয়। যুক্তফ্রন্ট গঠন করে। যুক্তফ্রন্ট বাংলাদেশে বিপুল ভোটাধিক্যে জয়লাভ করে। পরাজিত হয় পশ্চিম পাকিস্তানের দালাল নূরুল আমিন ও তার মুসলিম লীগ। কিন্তু যুক্তফ্রন্ট সরকারকে ৯২ক ধারা প্রয়োগ করে ১৪ দিনের বেশী মন্ত্রিত্ব করতে দেয়া হয় না। এরপরে চলে নানা চক্রান্ত। শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে সাজান হল ডাকাতির মামলাসহ অনেকগুলো মামলা। কথা ছিল ১৯৫৯ সালে সারা পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন হবে। আওয়ামী লীগ নির্বাচন অনুষ্ঠানের শর্তে সেদিন কেন্দ্রে মন্ত্রী সভায় যোগ না দিয়েও ফিরোজ খান নুন মন্ত্রী সভাকে সমর্থন করছিল। কারণ সেদিন বাঙ্গালীরা ভেবেছিল এই নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের আশা- আকাঙ্ক্ষা পূরণের কথা। পশ্চিমা স্বার্থ যখন বুঝতে পারল যে নির্বাচন হলেই হলেই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসীন হবে তথা বাঙ্গালীদের হাতে কেন্দ্রের ক্ষমতা চলে যাবে তখন আইয়ুব খান করলেন ক্ষমতা দখল। পাকিস্তানে চালু হল সামরিক রাজ। সামরিক রাজ মানেই পাঞ্জাবী রাজ। বাংলাদেশের গনতন্ত্রকামী সব নেতাদের জেলে পাঠান হল। আওয়ামী লীগের অসংখ্য নেতাকে করা হল বছরের পর বছর কারাবরণ। তাদের অপরাধ ছিল, তারা পাকিস্তানে চাচ্ছিলেন সত্যিকার গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা। আর চাচ্ছিলেন বাঙ্গালীদের ন্যায্য অধিকার। ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিব ঘোষণা করেন তার বিখ্যাত ছয় দফা কর্যসূচী।আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আইয়ুব শাহীর বিরুদ্ধে দানা বাধতে থাকে গণ-আন্দোলন। ঢাকার রাস্তায় নিরস্ত্র মিছিলের উপরে চলে গুলি।  অবশেষে শেখ সাহেবকে গ্রেপ্তার করা হয় ও কুখ্যাত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা সাজান হায়। এই মামলা চালাকালীন সারা দেশে সৃষ্টি হয় বিরাট গণ-আভ্যুত্থান। আইয়ুব শাহী বাধ্য হয় তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা তুলে নিতে।

.

আইয়ুবের জাইগায় আসেন ইয়াহিয়া খান তার নির্বাচন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বুলি নিয়ে। ইয়াহিয়া নির্বাচন দেন জনসাধারণের চাপে পড়ে। কিন্তু নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল জয় দেখে শংকিত হয়ে উঠেন ইয়াহিয়া সামরিক চক্র, পশ্চিম পাকিস্তানি আমলাতন্ত্র ও কায়েমি স্বার্থবাদীর দল। নতুন করে ষড়যন্ত্র শুরু হয় আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে। আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে শতকরা ৭৯টি পপুলার ভোট পেয়ে ৩১৩ সদস্যবিশিষ্ট জাতীয় পরিষদে বাংলাদেশের জন্য নির্ধারিত ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি দখল করে। আওয়ামী লীগ নিজেকে প্রমাণ করে পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলরূপে এবং বাংলাদেশের একমাত্র মুখপাত্ররূপে। গণতন্ত্রের সার্বজনীন নিয়মরীতি আনুসারে আওয়ামী লীগেরই ছিল মন্ত্রী সভা গঠন করার, গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করার অধিকার। কিন্তু সে পথে না গিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক চক্র, আমলাতন্ত্র ও কায়েমী স্বার্থবাদীর দল নতুন করে চক্রান্ত শুরু করে বাংলার বিরুদ্ধে। অনেক টালবাহানার পর ৩রা মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করা হয়। আওয়ামী লীগ এগিয়ে চলল তার শাসনতান্ত্রিক বিল নিয়ে।কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানী পুঁজিপতিদের দালাল ভুট্টো সামরিক বাহিনীর ইঙ্গিতে দাবী তুললেন জাতীয় পরিষদের বাইরেই শাসনতান্ত্রিক সমস্যার সমাধান করতে হবে। এটাকে ছুতো হিসেবে ব্যবহার করে ইয়াহিয়া জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বন্ধ করে দিলেন অনিদির্ষ্টকালের জন্য। সারা বাংলাদেশ ফেটে পড়ল গণ-বিক্ষোভে । সামরিক চক্র চাইল  ছুড়ে এই বিক্ষোভ দমন করতে। কিন্তু পারল না। শত শত শহীদের রক্তে রাঙা হল বাংলার রাজপথ। শেখ সাহেব ঘোষণা করলেন তার অসহযোগ আন্দোলনের কথা। সারা বাংলাদেশ সাড়া দিল তাতে। ইয়াহিয়া সরকার প্রমোদ গুণলেন। ইয়াহিয়া এলেন ঢাকায়। আলাপ-আলোচনা আরম্ভ করলেন শেখ সাহেবের সাথে। কিন্তু এই আলোচনা ছিল আসলে এক বিরাট ষড়যন্ত্রের অংশ মাত্র।

.

আলোচনার উদ্দেশ্য ছিল কেবল সময় নেওয়া। আলোচনার উছিলায় সেনাবাহিনীকে প্রস্তত করা। ইয়াহিয়া যখন ঢাকার আলোচনায় বসেন তখন বাংলাদেশে যা সৈন্য ছিল তাকেই যথেষ্ট ভাবতে পারেনি ইয়াহিয়া চক্র। আরো বিপুল রণসম্ভার আনা হতে থাকে এই সময়। আনা হল কমপক্ষে আরো বিশ হাজার সৈন্য। বাঙ্গালীরা যা সামান্য কিছুসংখ্যক সেনাবাহিনীতে ছিল তাদের কাছ থেকে নিয়ে নেওয়া হতে থাকল অস্ত্রপাতি। ই, পি, আরকে নিরস্ত্র করার চেষ্টা চলল। এমনকি পুলিশ বাহিনীর কাছ থেকেও অস্ত্র-শস্ত্র সব নিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হল।

.

যাতে লোকের সন্দেহ না হয় তাই ইয়াহিয়া বলতে থাকে বিভিন্ন মন ভোলান কথা। কিন্তু আলোচনা শেষ হবার আগেই ২৫শে মার্চ রাত্রিতে ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে ঢাকার নিরস্ত্র ঘুমন্ত বাঙ্গালীদের উপর। সাড়া দেশে আরম্ভ হয়ে যায় ফৌজি বিভীষিকা। পৃথিবীর রাজনৈতিক ইতিহাসে এমনি ভয়াবহ জঘন্য বেইমানির নজির আর নেই। হিটলারের নিষ্ঠুরতাও হার মেনেছে এদের কাছে।

.

আওয়ামী লীগ ছয় দফার ভিত্তিতে নির্বাচনে জয়ী হয়। ছয় দফার গোড়ার কথা ছিলঃ পাকিস্তানকে হতে হবে একটি গণতান্ত্রিক ফেডারেল প্রজাতন্ত্র। এই প্রজাতন্ত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে থাকবে  পররাষ্ট্র ( বৈদেশিক বাণিজ্য বাদে ) ও দেশ রক্ষার ভার। অন্যান্য সমস্ত ক্ষমতা থাকবে প্রাদেশিক সরকারের হাতে। ছয় দফার মধ্যে পাকিস্তানকে ধ্বংস করার কোন পরিকল্পনা ছিল না। ইয়াহিয়া শেখ মুজিবের সাথে আলোচনায় এর সব কিছুই বাহ্যতঃ স্বীকার করেছিলেন। কিন্তু পরে দেখা গেল এ সবই ছিল ভাওতা। তার আসল লক্ষ্য ছিল সময় নেওয়া। আলোচনার নামে আক্রমণের প্রস্তুতি চালান।

.

ইয়াহিয়া ও পশ্চিম পাকিস্তানী নেতাদের বিশ্বাসঘাতকতা, সেনাবাহিনীর নরঘাতী আক্রমণ বাঙ্গালিকে বাধ্য করেছে অস্ত্র ধারণ করতে। স্বাধীন সরকার গঠন করতে। বাঙালী এর কোন ষড়যন্ত্রে পতিত হইতে চায় না। ওদের সাথে একসাথে বসবাস করা যাবে না – এটা প্রতিটি বাঙালী আজ বুঝতে পেরেছে। অস্ত্রের ভাষার জবাব বাঙালী আজ দিতে প্রস্তুত অস্ত্রের ভাষায়। বাংলাদেশের লক্ষ কোটি ভাই বোন এগিয়ে আস, অস্ত্রধর, বাংলার মাটি থেকে শোষক, অত্যাচারী, নিপীড়ক ও স্বৈরাচারী খান সেনাদের খতম করতে। খুনের উত্তর খুন। রক্ত দিয়েই আমরা রক্তের বদলা নেব। বাংলাদেশের মাটিতে জন্ম নিয়েছে এক নতুন পতাকা। বাংলাদেশের সবুজ প্রান্তরে পড়েছে লাল রক্তের দাগ। এ রক্তের কথা আমরা ভুলব না। বাঙ্গালীর রক্ত বৃথা যেতে দেব না। পূত পবিত্র এ রক্ত আমাদেরকে যুগ যুগ ধরে দেবে অনুপ্রেরণা।আবার বলি এ যুদ্ধ আমরা চাইনি। বাধ্য হয়েই আমরা স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ ঘোষণা করেছি। নিজেদের সরকার গঠন করেছি আর পশ্চিম পাকিস্তানী জল্লাদদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেছি। কারণ তারা আমাদের সামনে আর কোন পথ খোলা রাখেনি।

জয় বাংলা।

.

[ জয় বাংলাঃ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাপ্তাহিক মুখপত্র। সম্পাদকমন্ডলীর সভাপতিঃ আহমেদ রফিক, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ মতিন আহমেদ চৌধুরী। মুজিবনগর, জয়বাংলা প্রেস থেকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পক্ষে আহমদ রফিক কর্তৃক মুদ্রিত ও প্রকাশিত। ]

.

.

পার্থ সুমিত ভট্টাচার্য্য

<৬,১১,২১>

.

শিরোনামঃ সম্পাদকীয়।

সংবাদপত্রঃ জয়বাংলা; ১ম বর্ষঃ ১ম সংখ্যা।

তারিখঃ ১১ মে, ১৯৭১।

এ যুদ্ধ আপনার আমার সকলের।

রক্তের অক্ষরে লেখা হচ্ছে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস। যেমন লেখা হয়েছে আরো অনেক দেশের। অন্যান্য দেশের মানুষের দেশপ্রেমের কাছে হার মেনেছে বিদেশী হানাদারেরা। আমাদের কাছেও মানবে। ঘাতকের ক্ষমা নেই। শত্রুকে নির্মুল না করে ক্ষান্ত হবো না আমরা।

.

আমরা এ যুদ্ধ চাইনি। কিন্তু যুদ্ধ আমাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। রাতের অন্ধকারে ঝাঁপিয়ে পড়েছে আমাদের উপর জঙ্গীশাহীর সেনাবাহিনী। হাতে তার সর্বাধুনিক মারণাস্ত্র। সমস্ত শক্তি নিয়ে সে আক্রমণ করেছে। কিন্তু লক্ষ্য সিদ্ধ হয়নি। শত্রু আমাদের পরাভূত করতে পারে নি। হিটলারী কায়াদার হঠাত আক্রমণ করে, ভয় পাইয়ে আমাদের নিস্ক্রিয় করে দিতে চেয়েছিল। মৃত্যুর বিভীষিকা দেখিয়ে চেয়েছিল আমাদের স্তব্ধ করে দিতে। কিন্তু তা সে পারে নি। বাংলার একপ্রান্তথেকে অপর প্রান্ত রুখে দাঁড়িয়েছে প্রতিরোধ প্রতিজ্ঞা নিয়ে। জেগে উঠেছে বীর জনতা তার বিপুল উদ্দীপনা নিয়ে।

.

প্রথমে আমাদের দাবী ছিল স্বায়ত্তশাসনের। কিন্তু ইয়াহিয়া আর তার জঙ্গীচক্রের বিশ্বাসঘাতকতা খুলে দেয় আমাদের দৃষ্টি। জন্ম নিয়েছে আজ গণপ্রজাতান্ত্রিক স্বাধীন বাংলাদেশ। আর এই সরকার ও জনতার সহযোগিতায় বাংলাদেশের প্রতি অঞ্চলে গড়ে উঠেছে মুক্তিফৌজ। তারা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হচ্ছে শত্রু নিধনের। আমাদের এই যুদ্ধ একটি জাতির বাঁচা মরার যুদ্ধ। আসুন, আপনিও শরীক হোন এই যুদ্ধে। শত্রু কে ধ্বংস করে রক্ষা করুন আপনার দেশের হাজার হাজার মানুষকে। আমাদের শত্রু নির্মম। আর নির্মম হাতেই রচনা করতে হবে তার কবর।

আমাদের রণনীতিঃ

আমরা যে রণনীতি গ্রহণ করেছি তার মূল লক্ষ্য হল যত কম ক্ষতি স্বীকার করে যত অধিক সংখ্যক শত্রু সৈন্য হত্যা করা যায়। আমাদের লক্ষ্য হল শত্রু সৈন্যকে আক্রমণের পর আক্রমণ করে তাকে সদা ব্যস্ত রাখা। তাকে ক্লান্ত করে তোলা। পাকিস্তান সরকার অস্ত্রপাতি তৈরি করে না। গোলাবারুদের জন্য বিশেষভাবে সে অন্যদেশ নির্ভর। তার অর্থনীতিতে দেখা দিয়েছে তীব্র সংকট। তাই দীর্ঘ প্রলম্বিত যুদ্ধ চালিয়ে যেতে গিয়ে তার সমর কৌশল ব্যর্থ হতে বাধ্য।

.

আমাদের কাছে এ যুদ্ধ হল গণযুদ্ধ বা জনগণের যুদ্ধ। আমরা ভাড়াটে পেশাদার সৈনিক নই। অস্ত্রবল আমাদের কম। কিন্তু আমাদের মনে আছে প্রবল দেশপ্রেম। শুধু অস্ত্র দিয়ে যে যুদ্ধ হয় তার থেকে আমাদের যুদ্ধের চেহারা আলাদা। গণ-সমর্থন আমাদের যুদ্ধের মূল ভিত্তি। সমস্ত বাঙালী আজ জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ। এ যুদ্ধ মুষ্টিমেয় পেশাদার সৈনিকের বিরুদ্ধে একটা সমগ্র জাতির স্বাধীনতা যুদ্ধ। এ যুদ্ধের কোন নির্দিষ্ট অঞ্চল নেই। আমাদের লড়াই কোন নির্দিষ্ট যুদ্ধক্ষেত্রের লড়াই নয়। যে কোন সময়, যে কোন স্থানে, সুযোগ পেলেই আমরা ঝাঁপিয়ে পড়ব শত্রুসেনার ওপর। আমরা তাদের হত্যা করব। আমরা তাদের সরবরাহ ব্যবস্থাকে বানচাল করবো। বিদেশী বিশেষজ্ঞদের মতে বাংলাদেশে যে পাকিস্তানি সৈন্য আছে তা একটি যুদ্ধজয়ের জন্য যথেষ্ট নয়।

.

পার্থ সুমিত ভট্টাচার্য্য

<৬,১২,২২-২৩>

শিরোনামঃ সম্পাদকীয়। “আমাদের বক্তব্য স্পষ্ট”

সংবাদপত্রঃ জয়বাংলা; ১ম বর্ষঃ ২য় সংখ্যা।

তারিখঃ ১৯ মে, ১৯৭১।

সম্পাদকীয়

আমাদের বক্তব্য স্পষ্ট

রাওয়ালপিন্ডি—ইসলামাবাদ পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন সংবাদপত্রে এই মর্মে এক সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে যে, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান গণপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে ইচ্ছুক। তবে দুটি মাত্র শর্তে। তা হলো সামরিক সরকারের হাত থেকে ক্ষমতা নেয়ার আগে সংশ্লিষ্ট সকলকে তারই দেয়া একটি অন্তর্বর্তিকালীন শাসনতন্ত্র মেনে নিতে হবে। তারপর জাতীয় পরিষদ যে শাসনতন্ত্র রচনা করবে তাও হুবহু অন্তর্বর্তীকালীন শাসনতন্ত্রের অনুরূপহতে হবে। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে আমরা পশ্চিম পাকিস্তানি পত্রিকা সমূহে প্রকাশিত সংবাদের উপর আদৌ গুরুত্ব দিতাম না। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা যথার্থ গুরুত্ব না দিয়ে পারছি না। পশ্চিম পাকিস্তানিরা ইয়াহিয়া বা অন্য কারো দেয়া শাসনতন্ত্র গ্রহণ করবে কি করবে না, তা তাদের নিজস্ব ব্যাপার। তারা যদি রোজ কেয়ামত পর্যন্ত সামরিক আইনে শাসিত হতে চায় তাহলেও আমাদের বলার কিছু নেই। কেন না, ওটা তাদের ঘরোয়া ব্যাপার। তারা একটা আলাদা রাষ্ট্র।

.

আমাদের বিশ্বাস, সামরিক সরকারের ইঙ্গিতেই পশ্চিম পাকিস্তানের সংবাদপত্রগুলো আলোচ্য সংবাদটি গুরুত্বসহকারে বাজারে ছেড়েছে। কেননা, পাকিস্তানের সংবাদপত্রসমূহের উপর সামরিক আইনের যে খড়গ উদ্যত হয়ে আছে তার প্রেক্ষিতে কোন সংবাদপত্রের পক্ষেই সরকারের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এ ধরণের কিছু প্রকাশ করা সম্ভব নয়। কার ঘাড়ে ক’টা মাথা আছে যে উল্টাপাল্টা সংবাদ ছাপিয়ে পাকিস্তানের জঙ্গী শাসকদের ক্ষেপিয়ে তুলবে ?

.

বিশ্বের ইতিহাসে যখনই কোন বিদেশী শক্তি অস্ত্রের জোরে পরের দেশ দখল করেছে তখনই তারা চেষ্টা করেছে সেদেশে একটি শিখন্ডি সরকার খাড়া করার। ইয়াহিয়া-ভুট্টো-টিক্কা খানও আজ সেই মহাজনী পন্থার আশ্রয় নিয়েছে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে জনগণের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা, তাদের মনোবল নষ্ট করা, চূড়ান্ত বিজয় সম্পর্কে তাদের মনে সংশয় ও সন্দেহ সৃষ্টি করা। অতীতে কোন দখলদার শক্তি সাময়িকভাবে সফল হলেও তাদের সফলতা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি-ইয়াহিয়া-ভূট্টো চক্রেরও হবে না, হতে পারে না। শোষক, নিপীড়ক, বর্বর এই পশ্চিম পাকিস্তানি চক্র হয়তো ভেবেছে যে, আওয়ামী লীগকে অবৈধ ঘোষণা করে শিখন্ডিদের দ্বারা বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করাবে। তাই তারা আজ সওয়ার হয়েছে নূরুল আমীন, হামিদুল হক, সবুর খান, ফকা চৌধুরী, ফরিদ আহমদ, মাহমুদ আলী, সোলায়মান। খয়ের উদ্দীন প্রমুখ কুখ্যাত, গণধিক্কৃত, সুবিধাবাদী ও জনগণবর্জিত লোকের ঘাড়ে। এদেরকে বাঙ্গালীরা ডাস্টবিনের আবর্জনা ছাড়া কিছুই মনে করে না।

.

আমরা দ্ব্যররথহীন ভাষায় বলে দিতে চাই যে, ইয়াহিয়া খানের ক্ষমতা হস্তান্তর বা পাকিস্তানের শসনতন্ত্র রচনার সাথে বাংলাদেশের মানুষের কোন সম্পর্ক নেই। আমরা যখন ক্ষমতা চেয়েছিলাম তখন দেয়া হয়নি। তার বদলে আমরা পেয়েছি গুলী। এতে প্রাণ দিয়েছে আমাদের লাখ লাখ ভাই-বোন, ইজ্জত হারিয়েছে আমাদের মা-বোনেরা, ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়েছে লাখ লাখ পরিবার, গ্রিহহারা হয়েছে দেড় কোটির মত বাঙালী সন্তান। লাখো শহীদের লাশের তলায় লাখো মায়ের তপ্ত অশ্রুর অতল তলে কবর হয়ে গেছে পাকিস্তানের। আমরা ঘোষণা করেছি স্বাধীনতা। আমাদের সন্তানরা ধরেছে অস্ত্র, বহাচ্ছে খুনের বন্যা। আমরা লিপ্ত হয়েছি এক মরণপণ সংগ্রামে- হয় স্বাধীন জাতি হিসেবে বাঁচবো না হয় মরবো। আজ আমাদের একটি মাত্র কথা- মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পতন।

.

তাই আজও যারা ইয়াহিয়ার কাছ থেকে ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট গ্রহণের জন্য ঢাকা পিন্ডি- ছুটাছুটি করছে, এক পা কবরে রেখে আরেক পা নিয়ে সংহতির নামে বিবৃতি দানের জন্য রেডিও পাকিস্তানে দৌড়াচ্ছে, তাদেরকে আমরা হুঁশিয়ার করে দিতে চাই- বাঙ্গালীদের স্বার্থ নিয়ে ছিনিমিনি খেলার দিন আর নেই। ১৭ জন সৈন্য নিয়ে বাংলাদেশ দখলের দিন ফুরিয়ে গেছে। এক মীরজাফরকে হাত করে পলাশীর যুদ্ধ জয় করার দিন অতীত হয়ে গেছে। শত মীরজাফরকে মসনদে বসিয়েও বাংলাদেশকে আর পদানত রাখা যাবে না।

.

বাঙালী আজ জেগেছে। শেখ মুজিবের মন্ত্রে দীক্ষিত হয়েছে। পশ্চিমা বর্বর সৈন্যদের ঝরানো রক্তের প্রতি ফোঁটায় জন্ম নিয়েছে হাজার হাজার মুজিব। প্রয়োজনবোধে তারাই দেবে জাতিকে নেতৃত্ব। মীরজাফর বিশ্বাসঘাতকদের বাংলার ব্যাপারে নাক গলানোর প্রয়োজন বা অধিকার নেই। বাঙালী জাতি নিজেকে মুক্ত করবেই করবে। টিক্কা খান ৩০ লাখ বাঙালী কেন তিনশ’ লাখ বাঙালী সন্তানকে হত্যা করেও শান্তিতে ঘুমুতে পারবে না। একটি বাঙালী তরুণ বেঁচে থাকা পর্যন্তও সে অস্ত্র চালিয়ে যাবে বিদশী হানাদারদের বিরুদ্ধে। কেননা, বাঙালী আজ বেঁচে মরতে চায় না, সে মরে বাঁচতে চায়।

.

নূরুল আমীন, হামিদুল হক প্রমুখরা অতীতে বাংলাদেশ ও বাঙ্গালীর অনেক সর্বনাশ করেছে। আর সে সুযোগ তাদেরকে দেয়া হবে না। নূরুল আমীন মাতৃভাষায় কথা বলার দাবী করার অপরাধে আমাদের সন্তানদের গুলি করে মেরেছে। বাংলাদেশ পক্ষে কথা বলার কোন অধিকার বাঙালী তাকে দেয়নি। গত ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত গণভোটে বাঙালী এ অধিকার দিয়েছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও তার দলকে। “অতি বুদ্ধিমান” ও ধনকুবের হামিদুল হক চৌধুরীর পরামর্শেই যে পাক ফৌজ বর্বরের মত ঢাকাসহ বাংলাদেশের সমস্ত বস্তি এলাকা ধ্বংস করে দিয়েছে তাও আমাদের জানা হয়ে গেছে। অতীতেও বহুবার হামিদুল হক বাংলা স্বার্থকে জলাঞ্জলী দিয়েছে। ফরিদ আহমদ, মাহমুদ আলী ও সোলায়মানের মত সামাজিক কীটগুলো তো দালালের দালাল তস্য দালাল। উপসংহারে আমরা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই যে, পাকিস্তান ,মরে গেছে। সেজন্য আমরা দায়ী নই-দায়ী ইয়াহিয়া ভূট্টো চক্র। তার কবরও দিয়েছেন ইয়াহিয়া খান যথারীতি সামরিক কায়দায়। কবর থেকে লাশ তুলে আহাজারি করাতে কারো কোনো লাভ হবে না। যারা বাঙালী হয়েও এ লাশ নাড়াচাড়া চেষ্টা করবে তাদেরকে আমরা জাতীদ্রোহী বলেই গণ্য করবো। সাথে সাথে জাতিদ্রোহিতার যে একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদন্ড তাও আমরা তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেব।

শিরোনামঃ অমানিশার অবসানে পূর্ব দিগন্তে ঊষার আলো দেখতে পাচ্ছি ।

সংবাদপত্রঃ জয়বাংলা; ১ম বর্ষঃ ২য় সংখ্যা।

তারিখঃ ১৯ মে, ১৯৭১।

অমানিষার অবসানে পূর্ব দিগন্তে ঊষার আলো দেখতে পাচ্ছি।

জাতির উদ্দেশ্যে অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধানের বেতার ভাষণ

‘মুক্তির সংগ্রামের অন্ধকার অধ্যায় কাটিয়ে আমরা শুভ প্রভাতের দিকে এগিয়ে চলেছি। ইতিমধ্যে আমি পূর্ব দিগন্তে ঊষার আলো দেখতে পাচ্ছি’।

.

গত ১৮ই মে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত এক ভাষণে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপরোক্ত ঘোষণা করেন।

.

তিনি বলেন, সেদিন বেশি দূরে নয়, যখন স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার বহু বিদেশী রাষ্ট্রের স্বীকৃতি লাভ করবে।

.

সৈয়দ নজরুল ইসলাম তাঁর ভাষণে মুক্তিফৌজের ভূমিকার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন এবং বলেন, মুক্তিফৌজের কঠোর প্রতিরোধ ও তীব্র পাল্টা আক্রমণে পাকিস্তান বাহিনী হিমশিম খাচ্ছে এবং তাদের মনোবল একেবারে শূণ্যের কোঠায় এসে দাঁড়িয়েছে।

.

বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মুক্তি-পাগল মানুষের প্রতি গভীর সহানুভূতি প্রকাশ করে সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশের মানুষ ইতিমধ্যেই অভাবিত-পূর্ব ত্যাগ স্বীকার করেছে। লাখো লোক ইয়াহিয়ার বর্বর বাহিনীর গুলিতে প্রাণ দিয়েছে, কোটি লোক গৃহহারা হয়ে পথের ভিখারী বনেছে। লাখো লাখো মাতা তাদের সন্তান হারিয়েছেন, তাদের অশ্রুতে বাংলার আকাশ-বাতাস আজ সিক্ত। শহীদদের রক্তে বাংলাদেশের পথ-প্রান্তর আজ নদী। তবু তারা আজও সংগ্রামী মনোবল হারায়নি। আজ তাদের এতসব ত্যাগের প্রতিদানে তিনিও শুধু অশ্রু দিতে পারেন।

.

অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি দৃঢ়তার সাথে বলেন যে, সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর ত্যাগ বৃথা যেতে পারে না। এবং তা বৃথা যেতে দেওয়া হবে না। তিনি আশ্বাস দিয়ে বলেন যে, বাঙ্গালীর এ অশ্রু একদিন তাদের মুখে হাসি ফোটাবে।

.

বাংলাদেশ কেন স্বাধীনতা ঘোষণা করতে হয়েছে তার কারণ ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, ইয়াহিয়া ও তার উপদেষ্টাদের সাথে আলাপ আলোচনা শেষে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সহকর্মীরা ২৫ শে মার্চ সামরিক আইন প্রত্যাহার করে গণপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর সম্পর্কে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কাছ থেকে একটি ঘোষণা শোনার জন্য অপেক্ষা করেছিলেন। কিন্তু সে ঘোষণা কোন সময় আর আসল না। তার বদলে ইয়াহিয়ার বর্বর সেনাবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ল নিরীহ, নিরস্ত্র মানুষের ওপর।

.

তথাকথিত দুই শাসনতন্ত্রের প্রশ্নে আওয়ামী লীগের উপর যে দোষ চাপানোর প্রয়াস চলছে অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান ওটাকে একটি মিথ্যার বেসাতি বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, ইয়াহিয়া উপদেষ্টারাই তাদের খসড়ায় এ প্রস্তাব করেছিলেন। তাতে স্পষ্টভাবে লেখা ছিল যে, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ সদস্যগণ পৃথক পৃথক বৈঠকে মিলিত হয়ে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করবেন। তারপর যৌথ অধিবেশনে একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করা হবে, ভূট্টোকে খুশি করার জন্যই ইয়াহিয়ার পক্ষ থেকে এ প্রস্তাব করা হয়েছিল। সৈয়দ নজরুল ইসলাম এ ব্যাপারে উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর অপচেষ্টায় তীব্র নিন্দা করেন।

.

সশস্ত্র আওয়ামী লীগ কর্মী এবং দুষ্কৃতিকারীদের উপরই সামরিক বাহিনী আক্রমণ চালিয়েছে বলে সামরিক জান্তার পক্ষ থেকে যে দাবী করা হয়েছে তার জবাবে সৈয়দ নজরুল জিজ্ঞেস করেনঃ তাহলে ই পি আর ও পুলিশের সদর দফতরের উপর আক্রমণ চালান হল কেন ? তারা তো আওয়ামী লীগ কর্মী বা দুষ্কৃতীকারীর কোনটাই ছিল না।

.

বাংলাদেশের ইতিহাসের বৃহত্তম হণহত্যা দেখেও বিশ্বের মুসলিম রাষ্ট্রবর্গ আজ যে নীরবতা অবলম্বন করেছেন তার জন্য সৈয়দ নজরুল গভীর দুঃখ প্রকাশ করেন। তাদের উদ্দেশ্যে তিনি জিজ্ঞেস করেঃ লাখো লাখো নিরীহ, নিরস্ত্র মানুষকে বিনা কারণে হত্যা কি ইসলাম অনুমোদন করে? মসজিদ, মন্দির বা গীর্জা ধ্বংস করার কি কোন বিধান ইসলামে আছে ?

.

বাংলাদেশের মানুষদের আশ্বাস দিয়ে অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান বলেন, নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ জনগণকে যেসব ওয়াদা দিয়েছিল তার প্রতিটি তারা পালন করবে। তিনি জানান যে, তাঁর সরকার ভূমিহীনকে ভূমি দান, ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ, বড় বড় শিল্প জাতীয়করণ করে দেশকে সমাজতন্ত্রের পথে নিয়ে যেতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

.

যে সমস্ত বিশ্বাসঘাতক পশ্চিমা সামরিক বাহিনীর সাথে সহযোগীতা করছে, তাদের প্রতি কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে সৈয়দ নজরুল ইসলাম তাদেরকে অবিলম্বে বাংলার স্বার্থবিরোধী ও মুক্তি সংগ্রাম বিরোধী ঘৃণ্য কাজ করবার থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দেন। অন্যথায় অদুর ভবিষ্যতেই তাদেরকে এসবের জন্য জবাবদিহি করতে হবে। তখন তাদের প্রতি কোনরূপ কৃপা প্রদর্শন করা হবে না।

.

উপসংহারে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন যে, নিরীহ নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করে সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর মুক্তির সংগ্রামকে স্তব্ধ করা যাবে না। বাঙ্গালীরা তাদের দেশকে শত্রুমুক্ত করবেই করবে।

.

তিনি বাংলাদেশের জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও মতাদর্শ নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষকে আজ স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে লক্ষ্য অর্জনে-মুক্তি সহায়তা করার আবেদন জানান, কেননা, জয় আমাদের সুনিশ্চিত। কোন শক্তিই তা ঠেকাতে পারবে না।

.

.

সৌ রভ

<৬,১৪,২৬>

শিরনামঃ বিদেশী সাংবাদিকের জিজ্ঞাসা

সংবাদপত্রঃ জয়বাংলা ( ১ম বর্ষঃ ২য় সংখ্যা)

তারিখঃ ১৯ মে, ১৯৭১

.

পশ্চিম পাকিস্তানী জল্লাদ বাংলাদেশের কত লাখ লোক খুন করেছে?

.

গত ২৫শে মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী নিরস্ত্র নাগরিককে সুপরিকল্পিতভাবে হত্যা করার জন্য ইয়াহিয়া-টিক্কা এবং তাদের জল্লাদ বাহিনী যে ঘৃণ্য পথ গ্রহণ করে তার কুকীর্তি বিশ্ববাসীর চোখে ঢাকা দেওয়ার জন্য ঢাকায় অবস্থানরত ৩৫ জন বিদেশী সাংবাদিককে ২৬শে মার্চ জোর করে ধরে তাদের ফিল্ম ক্যামেরা কেড়ে নিয়ে বিমানে করে পশ্চিম পাকিস্তানে ছেড়ে দেওয়া হয়। তারপর থেকে সংবাদপত্র, বেতার-টেলিভিশনের উপর কঠোর সামরিক সেন্সরশিপ আরোপ করে পাক হানাদার বাহিনী সাড়া বাংলাদেশে এক লোমহর্ষক গণহত্যা লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ ও ধর্ষণ অভিযান চালিয়ে যায়। পৃথিবীর শান্তিকামী মানুষ বাংলাদেশের সত্যকার ঘটনা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লো। তবু লৌহ যবনিকার অন্তরালে এবং পাকফৌজের কঠোর দৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়ে যে সব সাংবাদিক প্রাণভয়কে তুচ্ছ করে সীমান্ত ডিঙ্গিয়ে যে টুকরো টুকরো খবর সংগ্রহ করলেন তা দিয়ে বিশ্ববাসী জোড়া করলেন  বাংলাদেশের বীভৎস চিত্র। আর তখন সমগ্র বিশ্ব   আজকের বিক্ষুব্ধ ও বিধ্বস্ত বাংলার চিত্র দেখে আতঙ্কিত হয়ে উঠলেন। বিশ্বজনমত মূল তথ্য জানাবার জন্য চাপ শুরু করে দিয়েছে। গুটিকয়েক স্থান ঠিকঠাক করে ইয়াহিয়া খান বাধ্য হয়ে ৬ জন বিদেশী সাংবাদিক যারা এর আগে কোনদিন বাংলাদেশে আসেনি। তাদের আমন্ত্রণ করলেন। এসব নতুন সাংবাদিককে সফরে আনায় ইয়াহিয়া খানের একটি লাভ হলো- এরা রেসকোর্স ময়দানের ঢাকার জনসংখ্যা দেখেনি, দেখেনি সদরঘাটের বাস, নবাবপুরের ভিড় এর দেখেনি ঢাকার পথে সাইকেল, রিকসা, বেবিট্যাক্সি, মোটর গাড়ির প্রচণ্ড ভীড়।

.

সে যাহোক সামরিক গাড়িতে সামরিক নিয়ন্ত্রণে এ সব সাংবাদিকে ৬ দিনের জন্য বাংলাদেশে সফরের অনুমতি দেওয়া হল। এই সফরের আগে ইয়াহিয়া সাহেব বায়না ধরলেন যে সব সাংবাদিক ২৫শে মার্চ পর্যন্ত ঢাকায় অবস্থান করেছিলেন তাদের এই সফরে আসতে দেয়া হবে না। কারণ তাদেরকে এই নিয়ন্ত্রিত সফরে আসতে দিলে আদিম পৈশাচিকতার মূল তথ্যকে ফাঁকি দেয়া যাবে না। তবু এই নিয়ন্ত্রিত সফরের ব্যবস্থা করেও বাংলাদেশ নবাগত সাংবাদিকের চোখে যথার্থভাবে ফাঁকি দিতে পারলেন না বেঈমান ইয়াহিয়া-টিক্কা চক্র।

.

এসোসিয়েট প্রেসের প্রতিনিধি সাংবাদিক মট রোজেন ব্লম বলেন সামরিক কর্তৃপক্ষ এই সফরের নিয়ন্ত্রিত পথে বিভিন্ন স্থানে ভাড়া করা লোক দাঁড় করে রাখে। পথঘাট মেরামত করে মূল তথ্যকে ঢাকতে চেষ্টা করে। কিন্তু তার মধ্য থেকেও বাংলাদেশের এক ভয়ঙ্কর বীভৎস চিত্র ফুটে উঠেছে। তাঁর সফরের অভিজ্ঞতার বর্ণনা করতে গিয়ে একটা মাত্র দৃষ্টান্তের মধ্যে তিনি সাড়া বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর পৈশাচিক নরহত্যার একটি খণ্ডাংশ তুলে ধরতে চেষ্টা করেছেন। তিনি লিখেছেন, গলিত লাশের মাংসে শকুনি, গৃধিনীদের পেট এত পূর্ণ হয়েছে যে পদ্মার তীর ধরে উঠে যেতেও কষ্ট হচ্ছে।তার মতে মাত্র ৫ সপ্তাহে হানাদার বাহিনীর হত্যালীলায় বাংলাদেশের ৫ লক্ষ লোকের লাশ শুকুনীরা মেজবানির জন্য পেয়ে গেছে।

.

রোজেন ব্লম লিখেছেন, বাংলাদেশে পাকফৌজের কত লাখ হত্যা করেছে তা কারও পক্ষে বলা সম্ভব নয়। কিন্তু নির্ভরযোগ্য ও নিরপেক্ষ হিসাবের ভিত্তিতে এ সংখ্যা কমপক্ষে দশ লক্ষ হবে বলে তাঁর ধারণা।

.

কিন্তু আমাদের কাছে আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য সূত্রে যে সমস্ত হিসাব এসেছে তার থেকে বলা যায় যে এ যাবৎ অন্ততঃ ৩০ লক্ষ থেকে ৫০ লক্ষ লোককে তার হত্যা করেছে।

সৌ রভ

<৬,১৫,২৭-২৯>

.

শিরনামঃ বাংলাদেশ প্রশ্নে বিশ্ব-শক্তিবর্গের নিস্ক্রিয়তা

সংবাদপত্রঃ জয়বাংলা ১ম বর্ষ ২য় সংখ্যা

তারিখঃ ১৯ মে, ১৯৭১

.

মানবতার ক্রন্দনরোলে কাঁপছে আল্লাহ্‌র আরশ

কিন্তু কুম্ভকর্ণদের ঘুম ভাঙবে কবে?

.

থোক থোক রক্তের উপর প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। এই শিশু ও নবগঠিত রাষ্ট্রকে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য, নির্মূল করার জন্য নরঘাতক জঙ্গি ইয়াহিয়া লেলিয়ে দিয়েছে তার হয়নাদের সবুজ বাংলার শ্যামল প্রান্তরে। চলছে নির্বিচারে গণহত্যা, শিশু, নারী, বৃদ্ধ, যুবক-যুবতী কোন ভেদাভেদ নেই। অবলীলায় ধ্বংস করেছে সভ্যতার পীঠস্থান শিক্ষাঙ্গনকে, মাড়িয়ে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে মসজিদ-মন্দির জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছে অর্থনৈতিক বুনিয়াদ, শিল্প-কারখানা, বিপণীকেন্দ্র আর এই বর্বর নাৎসি হামলার মর্মান্তিক ঘটনাকে চাপা দেওয়ার জন্য বুদ্ধিজীবী এবং সাংবাদিকদের করেছে নিধন, ভস্ম করে দিয়েছে স্বাধীন সংবাদপত্র অফিসগুলো।

.

সাড়া বাংলাদেশ আজ রণক্ষেত্র। বাংলার মাঠে জ্বলছে আগুন বাতাসে তার রুঢ়তা, আকাশ অন্ধকারাচ্ছন্ন। আর চারদিকে ভীত, বিহ্বল ও আতঙ্কগ্রস্ত অসহায় মানুষের চিৎকারে বাংলাদেশ হয়ে পড়েছে প্রেতপুরী। মানবতার এহেন অবমাননায় আল্লাহর আরশ হয়তো থর-থর করে কাঁপছে কিন্তু বিশ্বমানবতার এবং শান্তির সোল এজেন্ট জাতিসংঘের বৃহৎ রাষ্ট্রবর্গের ঘুম ভাংছে না, বিবেক দংশিত হচ্ছে না।

.

উথানট সাহেব কি জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদের কথা ভুলে গিয়েছেন ? না শুধু বৃহৎ শক্তিবর্গের স্বার্থ জড়িত না থাকলে তাঁর কণ্ঠে শান্তির ললিতবাণী বেরোতে বাধে ? শুধু বিনয়ের সাথে উথানট সাহেবের জানাতে চাই বাংলাদেশে যে মানবনিধন যজ্ঞ চলছে তা পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার নয়। এ যুদ্ধ একটি স্বাধীন জাতির সার্বভৌমত্ব রক্ষার যুদ্ধ- তাই সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করুন, সিদ্ধান্ত নিন। যাতে জাতিসঙ্ঘের প্রতি মানুষ আস্থা হারিয়ে না ফেলে। বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ শক্তি আমেরিকা আজ নীরব। নীরব নিক্সনের কণ্ঠ। কিন্তু কেন? তিনিও কি ভাবেন এটা পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ বিষয়, তাই নাক গলানোর প্রয়োজন নেই? কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় নাক গলাতে তো তারা কোন পাত্রাপাত্র, স্থান, কাল বিচার করে না- তবে এখানে কেন এত চিন্তা এত ভাবনা। ফুলব্রাইট এবং এডওয়ার্ড কেনেডির মত প্রভাবশালী নেতৃবৃন্দ যখন বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দানের দাবী জানিয়েছেন, তখনও নিক্সন কোন কোন ব্যবস্থা করেছে না? আমেরিকা পত্র পত্রিকাও মানবতার এই ক্রন্দন বেদনায় ভারাক্রান্ত, বিহ্বল।

.

কিন্তু নিক্সন সাহেব কি বাংলাদেশে সঙ্ঘটিত গণহত্যার ব্যাপারে নিজের এবং তাঁর সরকারের দায়িত্ব এড়াতে পারেন? তাঁর জানা উচিত বাংলাদেশে আজ যা ঘটছে তাতে তিনি মার্কিন অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি দিতে পারেন না। নিক্সন সরকারের পক্ষ থেকে বলা যেতে পারে যে, ইয়াহিয়া জঙংগচক্র কমিউনিস্ট চীনের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য প্রদত্ত মার্কিন অস্ত্র-শস্ত্র তাদের অনুমতি ব্যতিরেই বাংলাদেশে নরমেধযজ্ঞে ব্যবহার করেছে। কিন্তু সেক্ষেত্রেও কি তাদের কিছু করনীয় ছিল না বা নেই ? তাঁরা কি চুক্তিভঙ্গের অজুহাতে পাকিস্তানের জঙ্গীশাহীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ পারতেন না ? আসল কথা হলো ক্ষমতাসীন মার্কিন সরকারের গণতন্ত্র ফাঁকি। দেশে দেশে একনায়কত্ববাদীদের ফাকি। দেশে দেশে একনায়কত্ববাদীদের পোষণের যে নীতি মার্কিন সরকার অনুসরণ করে আসছে পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। কেন না, মার্কিন সরকারের সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য না পেলে পাকিস্থানের সামরিক চক্র বাংলাদেশে একদিনও যুদ্ধ চালাতে পারে তা আমাদের বিশ্বাস হয় না। মার্কিন সরকারের জেনে রাখা উচিত বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ তাদের অস্তিত্ব বজায় রাখার প্রয়োজনেই আজ মরণপণ যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। এ যুদ্ধে তাদের জয়লাভ করতেই হবে। জয় তাদের অবশ্যম্ভাবী। মাঝখানে মার্কিন সরকার বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের পক্ষ অবলম্বন না করে চিরকালের জন্য তাদের বন্ধুত্ব হারালেন- এই আমাদের দুঃখ।

.

ব্রিটেনও একই পথের পথিক। ব্রিটেন বিশ্ববাসীকে শিক্ষা দিলো মানবিক মূল্যে কথা। আজও কমনওয়েলথের অন্যতম সদস্য। ব্রিটেনের কাছ থেকে সে পাচ্ছে নানারকম সাহায্য ও সহযোগিতা। সুতরাং ব্রিটেন সরকার ইচ্ছে করলে এই গণহত্যার বিরুদ্ধে ইয়াহিয়া সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারতো কিন্তু তারা তা করেনি। কারণ পাকিস্তানের জঙ্গী শাসকচক্রের সাথে রক্ষণশীল ব্রিটিশ সরকারের বাণিজ্যিক ও অন্যবিধ সম্পর্ক জড়িত। ব্রিটিশ শ্রমিক দলের পীড়াপীড়ি স্বত্বেও প্রধানমন্ত্রী হীথ পাকিস্তান সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন এবং ঘোষণা করেছেন যে পাকিস্তানে ব্রিটিশ সাহায্য অব্যাহত থাকবে।

.

পশ্চিমা শক্তিবর্গ ভাবছেন এটা পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার এবং বাংলাদেশ বিছিন্নবাদী। ইয়াহিয়া, ভুট্টো ও টিক্কা চক্রের বক্তব্যও এই। ভাবখানা এই- বায়াফ্রা, নাগা ও মিজোদের মত বাংলাদেশেও একই পর্যায়ে পড়ে। কিন্তু যুক্তির ধোপে তা কি টিকে ? একটু আলোচনা করে দেখা যাক। বায়াফ্রা নাইজেরিয়ার একটি ক্ষুদে অংশ-সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সামাজিক বন্ধনের দিক থেকে নাইজেরিয়ার অন্য এলাকার সাথে কোন পার্থক্য নেই। নাগা ও মিজ্যোল্যান্ড- ভারতের বিরাট অংশের দুইটি ক্ষুদ্র এলাকা। তাদের দাবীর সংগে বাংলাদেশের  বক্তব্যকে এক করে দেখার অর্থ – জেগে ঘুমানোর মত। কারণ, পাকিস্তানের জনসংখ্যার শতকরা ছাপ্পান্ন জনের বাস বাংলাদেশে। ভৌগো্লিক দিক থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের দূরত্ব বারোশত মাইল। মধ্যবর্তী স্থানে ভারত অবস্থিত। ভাষা সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সামাজিক বন্ধন এবং আচার অনুষ্ঠান সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী। এবং তথাকথিত পাকিস্তান সংহতির নামে বিগত তেইশ বছরে পশ্চিম পাকিস্তানীরা বাংলাদেশেকে শোষণ করেছে, গণতন্ত্রের গলা টিপে হত্যা করে রাজনৈতিক অধিকারটুকুও ছিনিয়ে নিয়েছে। ৫৪ হাজার বর্গমাইল ভূমিকে তারা তাদের বাজারে পরিণত করে। অতএব অর্থনৈতিক মুক্তি, রাজনৈতিক স্বাধীনতা, সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ ও মানবিক মূল্যায়নের এই সংগ্রামকে বিছিন্নবাদী আন্দোলন বলে অভিহিত করা যায় না।……

.

বাংলাদেশ যখন ইয়াহিয়ার হয়নাদের ছোবলে ক্ষতবিক্ষত তখন রেডক্রস এগিয়ে এসেছিলো আর্তের সেবায়, কিন্তু সামরিক জান্তা যেহেতু বাংলাদেশে প্রবেশের অনুমতি দেননি সেহেতু তারা মানবতার সেবা করতে নিরস্ত রয়েছেন।তা নিরস্ত রয়েছেন বলে জঙ্গীচক্রের মানব নিধনযজ্ঞ বন্ধ হয়নি, বন্ধ হয়নি মানবতার ক্রন্দন। প্রশ্ন রয়ে যায় রেডক্রসের দায়িত্ব কি শেষ হয়ে গিয়েছে ? বিশ্ব জনমতের কাছে তারা এই নগ্নতার বর্বরতা বীভৎস করুণ চিত্র তুলে ধরে বৃহৎ শক্তিবর্গের উপর আশু চাপ সৃষ্টির দাবী করতে পারেন না ? আমরা আশা করবো, তারা আর মুখ ফিরিয়ে থাকবে না। আমরা এতদিনে শুনে এসেছি চীন এশিয়ার গৌরব, নির্যাতিত নিপীড়িত সংগ্রামী জনতার আশা-আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক। বিশ্ববাসী জানতো, বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষও জানতো বিশ্বের যেখানেই শোষণ, বঞ্চনা আর অত্যাচার সেখানেই আছে  মহাচীনের  শীতল স্পর্শ। সেখানেই মহাচীন নিপীড়িত মানুষের দুঃখ মোচনের চেষ্টায় সচেষ্ট। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের হানাদার দখলদার বাহিনীর বর্বরোচিত আক্রমণে সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর জীবন যখন আজ বিপন্ন, অর্থনৈতিক জীবন যখন বিপর্যস্ত, তখন চীন আক্রমণকারী হানাদারদের পক্ষ অবলম্বন করেছে এটা ভাবলে সত্যিই অবাক হতে হয়।

.

বলা যেতে পারে যে চীনের রাষ্ট্রনায়কগণ বাংলাদেশের গণমানসের সত্যিকার পরিচয় না জেনেই জঙ্গী শাসকের সমর্থন যোগাচ্ছেন। কিন্তু তাও বা আমরা কিভাবে বিশ্বাস করবো ? কারণ চীন বিশ্বের নাড়ী- নক্ষত্রের খবর রাখেন তারা সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর মুক্তি-সংগ্রামের প্রকৃতি ও পরিচয় জানবেন না তা কোনমতেই বিশ্বাস করা যায় না।

.

অবাক বিস্ময়ে তাকাতে হয় আরব জাহানের দিকে। ইসলামের শিক্ষা যেখানে অন্যায়, যেখানে জালিমের জুলুম তাকেই প্রতিহত করতে হবে, যেকোনো মূল্যের বিনিময়ে মজলুমকে দিতে হবে ছায়া কিন্তু তারতো কোন নমুনা বিশ্ববাসী দেখছেন না। আরব জাহানের মানবতা ও বিবেক জাগ্রত হোক, ইসলামের মূলমন্ত্র সাম্য স্বাধীনতা সৌভ্রাতৃত্বের পরশে স্নাত হোক বাঙলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ এই কথাই বিশ্ববাসীর চোখে-মুখে বিচ্ছুরিত হচ্ছে।

.

আরব জাহানের নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে জানা উচিত যে, কেবলমাত্র ধর্মীয় বন্ধনের জোরেই বিভিন্ন মানবগোষ্ঠী এক রাষ্ট্রে বসবাস করতে পারে না। যদি তাই হতো, তাহলে একই ভাষা। একই ভূগোল একই ধর্ম ও একই সংস্কৃতির অধিকারী আরব জনগণ আজ এতগুলো রাষ্ট্রে বিভক্ত কেন ?

.

মানবতার এই অবমাননা ও বৃহৎ শক্তিবর্গের এই ন্যক্কারজনক পলায়নী মনোভাবের মধ্যেও সাড়ে সাত কোটির নিরস্ত্র নিরন্ন মানুষের যন্ত্রণা চিৎকারে সাহায্যের হস্ত প্রসারিত করে যারা নজির স্থাপন করেছে, তাঁরা হলেন বুদ্ধ, গান্ধী, নেহেরু, রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের মানব প্রেমিকতার আশীষে পুষ্ট মহামানবের মিলন ক্ষেত্র ভারতবর্ষ আর মহামতি লেলিনের আদর্শে পরিচালিত সোভিয়েত রাশিয়া। বিশ্ব-মানব-প্রেমিকরা এ দুইটি রাষ্ট্রকে জানাচ্ছে প্রীতিসিক্ত সালাম।

.

.

সৌ রভ

<৬,১৬,৩০-৩২>

শিরোনামঃ সম্পাদকীয়ঃ রাজনৈতিক সমাধান

সংবাদপত্রঃ জয় বাংলা ( ১ম বর্ষঃ ৬ষ্ঠ সংখ্যা)

তারিখঃ ১৮ জুন, ১৯৭১

রাজনৈতিক সমাধান ?

.

বাংলাদেশ সমস্যার এক রাজনৈতিক সমাধানের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বিশ্বের বহু দেশ সোচ্চার হয়ে উঠেছে। কিন্তু এর রূপ পাওয়া যাচ্ছে না বলে ‘রাজনৈতিক সমাধান’ এ অস্পষ্ট কথাটি অনেক কল্পনা-জল্পনার জাল বুনে চলেছে। যে কোন সমাধানের পথে কল্পনা-জল্পনা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, এবং সমস্যাটিকে জটিলতর করে। এ জন্যে সুস্পষ্ট, সুনির্দিষ্ট পথের একান্ত প্রয়োজন।

.

যে কোন সমস্যার মত বাংলাদেশের সমস্যাকে বাস্তবতার নিরিখে বিশ্লেষণ না করে কেবল বাহ্যিক দৃষ্টিতে বিচার করা হলে, আমরা মনে করি এর সমাধান পাওয়া যাবে না। কেন আজ বাঙালী মরণপণ করে মুক্তিযুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়েছে- এ কথাটির জবাব পেতে হবে।

.

পৃথিবীর কাছে অজানা নয় যে আওয়ামী লীগ গণতান্ত্রিক এক রাজনৈতিক দল। আওয়ামী লীগ নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাসী। তাই, আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল, নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসাবে জয়ী হয়েও শান্তিপূর্ণ, সহ-অবস্থানের জন্য আলোচনা বৈঠক মিলিত হয়েছিল। সহিংস বিপ্লবী মত ও পথ আওয়ামী লীগের নয়। তবু কেন আজ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাংলাদেশের মানুষকে মুক্তি সংগ্রাম চালাতে হচ্ছে এর সদুত্তর পেতে হবে। এ সংগ্রামের, এবং ইয়াহিয়া সরকারের পৈশাচিক বর্বরতার বহু কথা বলা হয়েছে। দুনিয়ার সকলের কাছে এ সব কথা জানা।

.

মূল সমস্যার মৌলিক কারণগুলোকে এড়িয়ে কোন সমাধানের চেষ্টা করা হলে, সাময়িকভাবে স্বস্তি পাওয়া গেলেও স্থায়ী শান্তি আসতে পারে না। স্থায়ী সমাধানের জন্যে নিরপেক্ষ, প্রভাবমুক্ত মন, গভীর ও সুদূরপ্রসারী অন্তর্দৃষ্টি এবং বাস্তব উপলব্ধির প্রয়োজন। তাই, যারা রাজনৈতিক সমাধানের ধুয়া তুলছেন তাঁদের কাছে সংগ্রামের সার্বিক রূপটি স্পষ্ট থাকতে হবে।

.

বাংলাদেশের মানুষ নির্বাচন শেষে স্বাভাবিক আশা করেছিল, গণতন্ত্রের সাধারণ নিয়মে, একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে, আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের সংবিধান রচনা করবে, পাকিস্তানের শাসন, ভার, পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত চালিয়ে যাবে। কিন্তু জন্মলগ্ন থেকে পাকিস্তানে যে ষড়যন্ত্রের রাজনীতি চলে আসছে তারই পথ ধরে সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে কায়েমি স্বার্থবাদী, অগণতান্ত্রিক শক্তি আবারও চক্রান্ত শুরু করল। মানুষের সমস্ত আশা-আকাঙ্ক্ষাকে নস্যাৎ করে দিয়ে শাসন ও শোষণকে অব্যাহত রাখার উদ্দেশ্যে তারা আকস্মিকভাবে নিরপরাধ, নিরস্ত্র বাঙ্গালীর উপর পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য লেলিয়ে দিল। তারা বাংলাদেশকে গোরস্থানে পরিণত করেছে, লক্ষ লক্ষ মানুষকে গৃহহারা করেছে, আবাল-বৃদ্ধা-বনিতাকে হত্যা করেছে, লক্ষ লক্ষ মা বোনদের ইজ্জতহানি করেছে, কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি লুট করেছে। পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক চক্রের নজিরবিহীন নির্মমতা ও পাশবিকতা, সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর মনকে রক্তাক্ত করে দিয়েছি। বাঙ্গালীর চোখে আজ তীব্র ঘৃণা ও প্রতিহিংসার আগুন জ্বলেছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলামের কণ্ঠে যেদিন ধ্বনিত হল- ‘লক্ষ লক্ষ শহীদের লাশের উপর আলোচনা চলতে পারে না’- সেদিন ক্ষতবিক্ষত বাঙ্গালীর মনের কথাটিই প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠেছিল।

.

কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ বাস্তব ও যুক্তিবাদী বলে ভাবাবেগকে প্রশ্রয় দেন না। মূলত: তাঁরা নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ রাজনীতিতে বিশ্বাসী বলে অপ্রয়োজনে রক্তপাতে আগ্রহী নন। বিনা রক্তপাতে যদি লক্ষ্যে পৌঁছান সম্ভব নয়, বাঙালীর আশা-আকাঙ্ক্ষা যদি রূপায়িত হওয়া সম্ভব হয়, সেই পথ অনুসরণে যাতে কোন প্রতিবন্ধকতা না আসে, তারই জন্য অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম চারটি পূর্বশর্ত দিয়েছেন। সুস্পষ্ট, দ্ব্যর্থহীন, সুনির্দিষ্ট ইঙ্গিত অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধানের কেবল দেশপ্রেমেরই পরিচায়ক নয়, এতে তাঁর মানবিকতা আন্তরিকতাকেও প্রতিভাত করেছে। তাঁর চারটি শর্ত বাস্তব অবস্থার প্রেক্ষিতে বাঙালীর মনের কথাটিকে প্রতিধ্বনিত করেছে।

.

সৈয়দ নজরুল ইসলামের চারটি শর্ত হলঃ (১) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান এবং অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে বিনাশর্তে মুক্তি (২) বাংলাদেশ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানী সমস্ত সৈন্যদের অপসারণ (৩) স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতি এবং (৪) বিগত ২৩ বছরের বঞ্চিত অর্থসহ বর্তমান যুদ্ধে ক্ষতিসাধিত সম্পত্তির ক্ষতিপূরণ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলার অবিসংবাদিত নেতা। তিনি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান। তাঁকে কারাগারে রেখে কোন আলোচনা চলতে পারে না। আলোচনা চালাবার জন্য তাঁর ও তাঁর সহকর্মীদের বিনা শর্তে মুক্তি দিতেই হবে। বাংলা ও বাঙালীর পক্ষে অভিমত দেবার একমাত্র অধিকারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের বাঙ্গালীরা বিদেশী হানাদার বলে মনে করে। পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের উপর বাঙ্গালীদের কোন আস্থা নেই। তাদের উপস্থিতিতে বাঙ্গালী নিরাপদ মনে করতে পারে না এবং এ কারণেই ক্ষমা প্রদর্শনের কথা বলা সত্ত্বেও কোন উদ্বাস্তু ফিরে যাননি। ভীতি ও অবিশ্বাসের মধ্যে নিরাপত্তার ভাব জাগতে পারে না। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার বাংলার সর্বস্তরের মানুষের আস্থা ভাজন। বাংলার আশা-আকাঙ্ক্ষা স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের মাধ্যমে প্রতিফলিত। বাংলার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত এই সরকার প্রকৃত প্রস্তাবে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করার অধিকারী। আর পশ্চিম পাকিস্তানীরা গত ২৩ বছরে বাংলাকে শোষণ করে, বঞ্চিত করে এবং সর্বশেষে গত মার্চ মাসের ২৫ তারিখ থেকে হত্যা, লুণ্ঠন ইত্যাদিতে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে যেভাবে ধ্বংস করে দিয়েছে তার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। নৈতিক বা আইনগত যে কোন বিচারে বাঙ্গালী ক্ষতিপূরণ দাবী করতে পারে। বিনা অপরাধে তার সম্পদ নষ্ট করা হয়েছে। তাছাড়া বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করলে বলতে হয়, অনাহার-অনটনক্লিষ্ট, দারিদ্র-পীড়িত মানুষ কখনো শান্তিতে থাকিতে পারে না।

.

সৈয়দ নজরুল ইসলামের চার দফার ভিত্তিতে রাজনৈতিক সমাধান হলে স্থায়ী ফল পাওয়া যাবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। একটি জাতি নির্দিষ্ট এক লক্ষ্যে পৌছার জন্যে জীবন মরণ সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক সমাধান সেই লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে ব্যর্থ হলে স্থায়ী ফল বা শান্তি আসতে পারে না। সত্য সে যতই কঠোর হোক, তাঁকে অস্বীকার করা যায় না এবং করাও উচিত নয়। বাস্তব ও সত্যকে উপেক্ষা করার চেষ্টা করা হলেও পরিস্থিতি তার নিজস্ব গতিতে বয়ে যেতে বাধ্য।

.

বাংলাদেশের ব্যাপারেও সত্যকে অস্বীকার করা উচিত হবে না। আজ নগ্নভাবে এ সত্য ভেসে উঠেছে যে বাংলা, পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এক নয়, বাংলা ও বাঙালীর সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের মিলনের কথাই উঠে না, এমনকি সম্প্রীতিও জাগতে পারেনা। বাংলার প্রতি ঘরে যে হাহাকার উঠেছে, প্রতিটি বাঙালীর মন যেভাবে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে, আর কোন মধুর বাণী এ হাহাকার, এ আর্তিতে প্রলেপ দিতে পারবে না। আজ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, বাংলার স্বাধীনতাই একমাত্র সমাধানের পথ। বাঙালীর সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানীদের সাহিত্য, সংস্কৃতি, কৃষ্টির কোন মিল নেই এ সর্ববাদী সম্মত বক্তব্যের সাথে গত ২৩ বছরের বঞ্চনা এবং গত কয়েক মাসের হত্যা, লুণ্ঠন, ব্যভিচার, নির্যাতন মিলে বাঙ্গালী- মন যে ভাবে বিষাক্ত হয়ে গেছে, তাতে কোন বন্ধনের কথা প্রলাপ বলেই মনে হবে। তাই আজ স্বীকার করে নিতে হবে পাকিস্তান যে কোন বাস্তব বিচারে তার অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলেছে। কেবল আবেগ ও অনুভূতিতে সমস্যার বিচার চলে না।

.

এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তানকে গড়ে তোলার চিন্তাও বাতুলতার সমান। পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর পৈশাচিকতায় শত শত কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হয়েছে, বাংলাদেশে এমনকি পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনীতি আজ ধ্বংসের পথে। এ ধ্বংসস্তূপ থেকে অর্থনীতিকে গড়ে তুলতে হলে জনসাধারণের সহযোগিতা অপরিহার্য। ভয়-ভীতি, ত্রাস, ঘৃণা, অবিশ্বাসের মধ্যে সহযোগিতা হতে পারে না। চাপে পড়ে যে কাজ তাতে আন্তরিকতা থাকে না আন্তরিকতা না থাকলে কার্যকরী প্রচেষ্টা চলতে পারে না। তাই রাজনৈতিক সমাধানের নামে যদি বাংলাদেশকে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে দেওয়ার চেষ্টা চলে তাতে সংহতি- সে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা সামাজিক যে কোন ক্ষেত্রেই হোক, আসতে পারে না। বরং এ কথা বলা চলে, বাস্তব সত্যকে স্বীকার করে বাংলার স্বাধীনতাকে মেনে নিলে, কালের গতিতে বর্তমানের পুঞ্জীভূত হিংসা, বিদ্বেষ,অবিশ্বাস কেটে যেতে পারে এবং এক সময়ে হয়ত প্রীতির বন্ধন গড়ে উঠতে পারে।

.

তাই, আমাদের অভিমত ভবিষ্যতের কল্যাণ কামনায়, বর্তমানে বাস্তবতার প্রেক্ষিতে নির্মম সত্য-বাংলার স্বাধীনতার স্বীকৃতিতে সমাধান হওয়া বাঞ্ছনীয় । এবং দীর্ঘস্থায়ী সুফল পাওয়া সম্ভব হবে।

.

.

পার্থ সুমিত ভট্টাচার্য্য

<৬,১৭,৩৩-৩৪>

শিরোনামঃ ঐক্যবদ্ধ বাঙালী আজ সাম্প্রদায়িক মনোভাবের ঊর্ধ্বে।

সংবাদপত্রঃ জয়বাংলা ১ম বর্ষঃ ৬ষ্ঠ সংখ্যা।

তারিখঃ ১৮ জুন, ১৯৭১।

ঐক্যবদ্ধ বাঙালী আজ সাম্প্রদায়িক মনোভাবের ঊর্ধ্বে।

.

পৃথিবীর সভ্য মানুষ মাত্রই রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে বা একই রাষ্ট্রের মধ্যকার ধর্ম সম্প্রদায়ের হানাহানিকে ঘৃণা করে। এই সাম্প্রদায়িকতা ক্ষয়িষ্ণু শাসক-চক্রের আত্মরক্ষার কবচস্বরূপ। বর্তমান পাকিস্তান সরকারও নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যে বাংলাদেশকে শাসনের হাতিয়ার হিসাবে বেছে নিয়েছে। এখন বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার যে বিষ পাকিস্তান সরকার ছড়াচ্ছে তার পশ্চাতে আছে শাসকগোষ্ঠী পাকিস্তান সরকারের অনেক কৌশল, অনেক চক্রান্ত এবং অনেক স্বার্থের দ্বন্দ্ব।

.

একনায়ক শাসন ব্যবস্থায় শাসক শ্রেণী শাসন ও শোষণ যন্ত্রকে অব্যাহত রাখতে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে অবিশ্বাস, দ্বিধা-সন্দেহ সৃষ্টি করে পরিণামে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ বাঁধিয়ে দেয়। পাকিস্তানে যতবার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বেঁধেছে ততবারই তার মূলে পশ্চিম পাকিস্তানে শাসক শ্রেণীর চক্রান্ত ক্রিয়াশীল ছিল। উদ্দেশ্য হচ্ছে মূল সমস্যা থেকে বাঙ্গালীদের দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে দেয়া ও বাঙালী জাতির আত্মপ্রতিষ্ঠা ব্যাহত করা। দলে পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক বাংলা শোষণ সহজতর হবে। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক-চক্র বরাবরই চেয়েছে পূর্ববাংলার জনগণ যেন একতাবদ্ধ হয় তবে তাকে কিছুতেই পশ্চিম পাকিস্তান রুখতে পারবে না। এ জন্যেও সাম্প্রদায়িকতার পক্ষে তার এত উৎসাহ। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই পূর্ববাংলার মানুষ ধীরে ধীরে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে মতামত গড়ে তোলে; এই অভিজ্ঞানের পর থেকে সাধারণ মনোভঙ্গী গড়ে উঠতে থাকে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে ও ১৯৫৪ সালে জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর প্রচেষ্টায় যুক্ত নির্বাচন প্রথা প্রবর্তন ও বাংলাদেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান আওয়ামী লীগের ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির প্রভাবে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে এবং স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার পক্ষে সংগ্রাম শুরু হয়েছিল সেদিনই। আর এই ধর্মনিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক সংগ্রাম চালাতে গিয়ে শেখ মুজিবর রহমানসহ অসংখ্য রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীকে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর বিভিন্ন নির্যাতনমূলক আইনের মাধ্যমে জেল ও নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে। ১৯৬৪ সালে আইয়ুব খানের প্রধান সহচর পূর্ববাংলার তদানীন্তন গভর্নর মোনায়েম খান পুনরায় এই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগানোর চেষ্টা করেন। শেখ মুজিবর রহমানসহ অন্যান্য নেতৃবর্গ বাংলাদেশের সর্বত্র দাঙ্গা-বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানালেন। এই সময় ঢাকার সকল পত্রিকায় ‘পূর্ব বাংলা রুখিয়া দাঁড়াও’ শিরোনামায় বাঙ্গালীর প্রতি এক আকুল আবেদন করা হয়। সেই আহ্বানে এক অপার মানবতাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে সমস্ত চক্রান্তের বিরুদ্ধে বাঙালী জাতি সাড়া দিল। দাঙ্গা রোধ করতে গিয়ে সেদিন আমির হোসেন চৌধুরীর মত বহু মুসলমান অকাতরে মৃত্যুবরণ করে নিলো। কথার ফানুস দিয়ে নয়, বুকের তাজা রক্ত দিয়ে বাঙালী এবারও তাঁর মানবতাপ্রীতি প্রমাণ করলো। তারপর থেকে শাসক শ্রেণী চেষ্টা করতে লাগলো বাঙালী অবাঙালী দাঙ্গা বাঁধিয়ে তাদের উদ্দেশ্য সফল করতে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ সে ঘৃণ্য চেষ্টাও ব্যর্থ করে দিয়ে তাদের নিরাশ করলো। বর্তমান সংগ্রামের এক পর্যায়ে আবার পশ্চিমী শাসক-চক্র সাম্প্রদায়িকতার ধুয়ো তুললো। পাকিস্তানী বেতার যন্ত্র হিন্দুদের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারে তৎপর হয়ে উঠলো। এই পর্যায়ে ইয়াহিয়ার জঙ্গীচক্র সুপরিকল্পিত ভাবে বেশ কিছু হিন্দু অধ্যুষিত গ্রাম উড়িয়ে দিয়ে অসহায় জনগণকে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে বাধ্য করেছে। হিন্দুদের সঙ্গে সঙ্গে মুসলমান গ্রামও পুড়লো, অগুনতি হিন্দু-মুসলমান বাঙালী জঙ্গী মেশিনগানের গুলিতে প্রাণ দিল। তার ফলে সারা বাংলাদেশও আজ শ্মশানভূমি।

.

এই অত্যাচার চালানোর জন্যে বর্বর সৈন্য ভয় দেখিয়ে কিছু লোককে গ্রামে গ্রামে অগ্নিসংযোগ ও লুঠতরাজ কাজে নিয়োগ করে। এবং সেই অগ্নিসংযোগকারীকে দুষ্কৃতিকারী প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে ক্যামেরার সাহায্যে তাদের ছবি তুলে নিয়েছে। আবার পরক্ষনেই গুলি করে তাদেরকে হত্যা করেছে। তবু বাংলাদেশের ঐক্যবদ্ধ স্বাধীনতা প্রিয় মানুষ সাম্প্রদায়িক উস্কানিতে উত্তেজিত হয়নি। ইস্পাতের মত কঠিন একতা নিয়ে অপেক্ষা করছে শত্রুর ধ্বংস দেখার জন্য।

.

আজ সর্বত্র সামরিক বাহিনী সাধারণ মানুষকে হত্যা করে, ভয় দেখিয়ে নিজেদের এই লুটপাট নিয়োজিত করেছে, এই সমস্ত জঘন্য অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে নিরুপায় নিরীহ জনগণ দলে দলে পালিয়ে ভারতবর্ষে যেতে শুরু করে, হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ০খৃষ্টান সকলেই পালাচ্ছে- এতেই প্রমাণিত হয় অত্যাচার এসেছে বাঙালী জাতির ওপর। কোন ব্যক্তি-বিশেষে, কোন গোষ্ঠীবিশেষ বা সম্প্রদায় বিশেষের উপর নয়। বহু বৌদ্ধ অধ্যুষিত এলাকা, খৃষ্টান গির্জা আজ ধ্বংসপ্রাপ্ত, হিন্দুদের মন্দির, মুসলমানদের মসজিদ কিছুই রেহাই পায়নি এই বর্বর অত্যাচারীদের হাত থেকে।

.

বাঙ্গালীদের নিশ্চিহ্ন করতে যেভাবে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছে, সেখানে হিন্দু-মুসলমান সমান হারে মরেছে। এর কারণে বাঙ্গালীকে নেতৃত্বহীন করে দেওয়া। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যক্ষ ডঃ গোবিন্দ দেব- এর পাশাপাশি পরিসংখ্যান বিভাগের প্রধান জনাব মনিরুজ্জামান এবং অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতার পাশে অধ্যাপক মোক্তাদিরও একই হাতের শিকার।

.

তাই দীর্ঘ চব্বিশ বছরের ইতিহাসের দিকে তাকালে বোঝা যায় অত্যাচারী পাকিস্তান সরকারের অতীত ও বর্তমান রাজনীতির প্রধান হাতিয়ার এই সাম্প্রদায়িকতা। আজ বাংলাদেশের মুক্তির প্রচেষ্টায় যে ঐক্যবদ্ধ শক্তির বিকাশ ঘটেছে তা বানচাল করার উদ্দেশ্যে প্রতিক্রিয়াশীল জঙ্গী সরকার বাঙ্গালীদের মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টির জন্যে হন্যে হয়ে উঠেছে। তারা অবাঙ্গালীদের হাতে প্রচুর অস্ত্র দিয়ে গ্রামে গ্রামে পাঠিয়ে দিচ্ছে, সেখানে তারা নতুন করে অত্যাচার শুরু করেছে, রাস্তায় রাস্তায় এই সব অবাঙ্গালীরা টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। এদিকে ইয়াহিয়া সরকারের প্রচার যন্ত্র একথা প্রচার করছে যে, বাংলা ও বাঙ্গালীদের স্বাধিকারের জন্য যারা সংগ্রাম করেছে এবং অসাম্প্রদায়িক স্বাধিকার সংগ্রামের সাথে একাত্মতা করেছে, এ অবস্থায় যদি পাকিস্তানের উস্কানির ফলে কোথাও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধে তাহলে পাকিস্তান সরকারের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়। তাই এই মুহূর্তে সব থেকে যা প্রয়োজন তা হচ্ছে বাংলার শত্রু ঘৃণ্য পশ্চিমী কুচক্রীদের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করা, তাদের কোন প্রকার উস্কানিতে কান না দেওয়া বরং দিনের পর দিন মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্যে নিজেদের তৈরী করা। একথা মনে রাখতে হবে যে কোনো স্বাধীনতা যুদ্ধেই সহজে সাফল্য অর্জন করা যায় না। সুতরাং সংগ্রাম যত কঠিন ও দীর্ঘ হোক না কেন তা চালিয়ে যাওয়ার জন্য তৈরী থাকতে হবে।

.

পার্থ সুমিত ভট্টাচার্য্য

<৬,১৮,৩৫-৩৬>

শিরোনামঃ সম্পাদকীয় – এরই নাম কি স্বাভাবিক অবস্থা ?

সংবাদপত্রঃ জয় বাংলা, ১ম বর্ষঃ ৭ম সংখ্যা।

তারিখঃ ২৫ জুন, ১৯৭১।

সম্পাদকীয়

এরই নাম কি স্বাভাবিক অবস্থা ?

.

মিথ্যার শত জাল বুনেও সত্যকে কোনদিন ঢেকে রাখা যায় না। স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ বিশ্ব মানবতার কাছে আজ একটি মহাসত্য। এই সত্যকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য সাড়ে সাত কোটি মানুষ ত্যাগ, তিতিক্ষা, শৌর্যবীর্যে ও আত্মদানের যে নজীর স্থাপন করেছে তা মানব ইতিহাসে চিরদিন ভাস্বর থাকবে। অথচ এই মহাসত্যটি মুছে ফেলার জন্য সুপরিকল্পিত ভাবে জল্লাদ ইয়াহিয়া খান প্রথম থেকে একের পর একটি করে মিথ্যার জাল বুনে বুনে তার প্রচার যন্ত্র, ব্যক্তিগত দূত ও পৃথিবীর সর্বত্র প্রতিষ্ঠিত ডিপ্লোম্যাটিক মিশনের মাধ্যমে প্রচার চালিয়ে পৃথিবীর মানুষকে ধোঁকা দেওয়ার কত কোশেশই না করে এসেছে। সত্যের কাছে মিথ্যা পরাজিত হবেই। তাই ইয়াহিয়া খানে ধোঁকাবাজিও বিশ্ব-মানবতার কাছে হার মানতে বাধ্য।

.

সাড়ে ৭ কোটি বাঙালী জাতিকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক তথা সর্বতোভাবে নিশ্চিহ্ন করার মানসে নজিরবিহীন নৃশংস গণহত্যা, ব্যভিচার, লুণ্ঠন প্রজ্বলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। যার ফলে প্রায় ১০ লক্ষ নিরস্ত্র মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, প্রায় ৬০ লক্ষ মানুষ সর্বহারা বাস্তুত্যাগী হয়ে ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেছে। শুধু তাই নয়, গুটিকয়েক শহর ও বন্দর এবং মুষ্টিমেয় এলাকায় হানাদার বাহিনীর আধিপত্য সীমাবদ্ধ থাকলেও বাংলার ৬৪ হাজার গ্রামের প্রায় ৪ কোটি পরিবারের প্রায় প্রত্যেকটি গ্রাম ও পরিবার প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে আজ জল্লাদ ইয়াহিয়ার নৃশংস হত্যাযজ্ঞ ও অত্যাচারের শিকারে পরিণত হয়েছে। অথচ সম্পূর্ণ ব্যাপারটিকে ঢেকে রাখার জন্য পৃথিবীর মানুষকে অপপ্রচারের মাধ্যমে এ কথাই বুঝাতে চেয়েছিলেন যে, বিষয়টি একান্ত ভাবেই পাকিস্তানের ‘ঘরোয়া ব্যাপার’। কিন্তু সাড়ে সাত কোটি মানুষের করুণ ফরিয়াদে বিশ্বের দরবারে এই সত্যটি আজ প্রকাশ্য দিবালোকের মত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, ইয়াহিয়া খানের কাছে যা ঘরোয়া ব্যাপার, মানব ইতিহাসে সেটা জঘন্যতম কলঙ্ক। কখনও ইসলামের ব্যবসা করে, কখনও তথাকথিত প্রতিষ্ঠিত রাজ্যে অখণ্ডতার নামে, আবার কখনও সাম্প্রদায়িকতার জঘন্যতম অপপ্রচার করে বাংলার সাড়ে ৭ কোটি মানুষের শাশ্বত সত্য প্রাণের চেয়েও প্রিয় যার জন্য প্রতিটি বাঙালী যে কোন ত্যাগকে হাসিমুখে গ্রহণের জন্য সদা প্রস্তুত সেই স্বাধীনতা সংগ্রামকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য কত কৌশলই না করেছে। কিন্তু সূর্যের আলো থেকে কুয়াশা দূরে সরে যাবেই। যতই দিন যাচ্ছে শত মিথ্যার ধুম্রজালকে ভেদ করে পূর্ব দিগন্তে সূর্যরশ্মি ততই আসন্ন হচ্ছে।

.

আজ সার্বভৌম বাংলাদেশ যেমন মহাসত্য, তথাকথিত পাকিস্তানের অবলুপ্তিও তেমনি তকটি সত্য। ব্যক্তিবিশেষ কিংবা গোষ্ঠী বিশেষের স্বার্থান্ধতা ও হঠকারিতা এবং ভুলের মাশুল হিসাবেই এই অবলুপ্তি ঘটেছে, একথা আমরা পূর্বেই বলেছি এবং পৃথিবী তা স্বীকার করেছে। কারণ, মৃত পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক সাহায্য দিতে পৃথিবী আজ নারাজ। এর কোনো বিশ্লেষণের অপেক্ষা রাখে না। কনসোর্টিয়াম বৈঠক থেকে শুরু করে প্রত্যেকটি সাহায্যকারী দেশ অভিমত প্রকাশ করেছে ইয়াহিয়ার পাকিস্তানের ‘অভ্যন্তরীণ ব্যাপারটি’ আন্তর্জাতিক দৃষ্টিতে এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, বাংলাদেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে না আসা পর্যন্ত সাহায্য দেওয়ার প্রশ্নটি স্থগিত রাখাই বাঞ্ছনীয়। এ রকম অভিমত প্রকাশের পিছনে অবশ্য একটি গূঢ় রহস্য আছে। সাহায্যকারী দেশ ভালভাবেই জানেন যে, বাংলাদেশও আর ইয়াহিয়া খানের মৃত পাকিস্তান এক নয়। আর বাংলার পাট, চা, তামাক এবং চামড়ার টাকা ছাড়া বৈদেশিক ঋণ শোধ করার কোন সম্ভাবনা নেই। সুদের জন্যই যেখানে কিস্তি ভিক্ষে সেখানে আসল পাওয়ার সম্ভাবনা কোথায় ? কাজেই জনাব ইয়াহিয়া খান ঢাকঢোল পিটিয়ে মুক্তিফৌজ থেকে শুরু রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে যারা দু’দিন আগে দুষ্কৃতিকারী ও  অনুপ্রবেশকারী বলে আখ্যায়িত করেছে তাদেরকে সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শনের নামে রিসেপশন ক্যাম্প খুলে, আগে অস্বীকার করে পরে বিপাকে পড়ে মাত্র ৪০ হাজার বাস্তুত্যাগী স্বীকার করে ‘স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এসেছে’ শিরোনামওয়ালা ১২ পৃষ্ঠার জায়গায় ২ পৃষ্ঠায় সংবাদপত্রগুলোকে প্রকাশ করতে বাধ্য করে, আর মুক্তিফৌজের কাছে পাক সেনাবাহিনীর বেধড়ক মার খাওয়া গোপন করে, গুটিকতক ভাড়াটিয়ে পদলেহী তথাকথিত শিল্পীকন্ঠে ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে ইসলামের গান গাইয়ে ইয়াহিয়া খান এ কথাই প্রমাণ করেছেন যে সাহায্য পাওয়ার স্বাভাবিক অবস্থা এখন ফিরে এসেছে।

.

বাংলায় স্বাভাবিক অবস্থা বাঙ্গালীরাই ফিরিয়ে আনবে। প্রতিটি বাঙালী আজ দৃঢ়প্রতিজ্ঞা যে, সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর নয়নমণি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্ত করে, হানাদার ইয়াহিয়া বাহিনীদের বাংলার মাটি থেকে নিশ্চিহ্ন করে, বাংলার স্বাধীনতা স্বীকৃতি আদায় করে, বিগত দিনের অর্থনৈতিক বঞ্চনার প্রতিশোধ ও ক্ষতিপূরণ আদায় করে বাংলার স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনবেই।

.

পার্থ সুমিত ভট্টাচার্য্য

<৬,১৯,৩৭-৩৮>

শিরোনামঃ তোমরা তোমরা আমরা আমরা

সংবাদপত্রঃ জয় বাংলা; ১ম বর্ষঃ ৮ম সংখ্যা।

তারিখঃ ২ জুলাই, ১৯৭১।

.

সম্পাদকীয়

তোমরা তোমরা আমরা আমরা

.

আওয়ামী লীগ ও স্বাধীনতা মন্ত্রে দীক্ষিত তার অসংখ্যা কর্মী ও সদস্য এবং মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশ্য করে তথাকথিত পাকিস্তান সরকারের প্রচার যন্ত্রগুলো কতকগুলো বিশেষ বিশেষণ ব্যবহার করে থাকে। সরাসরি প্রকৃত নাম উচ্চারণ করার বাঁধা কোথায় আমরা তা বুঝি না। বিশেষঙুলো হলো- দুষ্কৃতিকারী, বিচ্ছিন্নতাবাদী, দেশদ্রোহী, ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী ইত্যাদি।

.

এই বিশেষঙুলোর ব্যবহার পাকিস্তান সরকারের পক্ষে যদি নেহাৎ লজ্জাজনিত হয়ে থাকে আমাদের কিছু বলার নেই। কারণ বৃদ্ধা স্ত্রীলোকটিকে যখন স্বামীর নাম জিজ্ঞেস করা হয়েছিল তখন লজ্জাবনতভাবে সে বলেছিলো-

“বিশেষণে সবিশেষ কহিবার পারি

জান হে স্বামীর নাম নাহি ধরে নারী”।

সরাসরিভাবে স্বামীর নাম উচ্চারণ করতে ইয়াহিয়া সরকারের যদি বাঁধে তা হলে আমাদের বলার কিইবা থাকতে পারে। এটা হলো তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু এই বিশেষণগুলোর ব্যবহার যদি ঘৃণাজনিত হয় অথবা আওয়ামী লীগ, মুক্তিযোদ্ধা এবনবগ অগুনতি স্বাধীনতাকামী মানুষের নাম বিস্মৃতির অন্তরালে নিয়ে যাওয়ার অপচেষ্টা হয়ে থাকে তাহলে আমাদের অবশ্যই কিছু বলার আছে।

.

ইয়াহিয়া খানের জানা দরকার শেখ মুজিবর শুধু মুক্তি-পাগল সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর অবিসংবাদিত রাজনৈতিক নেতাই নয়, শেখ মুজিব কৃষক শ্রমিক ছাত্র জনতা ও আবাল বৃদ্ধা বনিতার ‘মুজিব ভাই’। শেখ মুজিব একটি নাম-একটি ইতিহাস এ নামের প্রভাবে একদিকে যেমন সাম্রাজ্যবাদী, সামন্তবাদী আমলাতন্ত্র সামরিক জান্তা ও যাবতীয় কায়েমী স্বার্থবাদীদের প্রাসাদ চক্র খান খান হয়ে ধুলায় লুন্ঠিত হতে চলেছে অন্যদিকে তেমনি বঞ্চিত, লাঞ্ছিত ও নির্যাতিত ও অগ্নিপরীক্ষায় পরীক্ষিত। তার রাজৈনিতক প্রজ্ঞা বহু চড়াই-উতরাই পার হয়ে গিয়ে আজ বিশ্বের দরবারে সুপ্রতিষ্ঠিত। তার অলৌকিক জনপ্রিয়তা আজ কঠিন বাস্তব। তার অপরিসীম সংগঠনী ক্ষমতা আজ সকল সন্দেহের উর্ধ্বে। মুজিবের আরেক নাম সংগ্রাম। আর এই সংগ্রামের জন্ম হয়েছে মানবাধিকার আদায়ের সংগ্রাম ও দুঃস্থ মানবতার সেবায় নিয়োজিত দেশের সর্ববৃহত রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান আওয়ামী লীগের অঙ্গনে। যে প্রতিষ্ঠানের জন্ম, পরিস্ফুটন পরিব্যাপ্তি এবং অসাধারণ বিস্তৃতি ঘটেছে নিরলস নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম ও সাধনা মধ্য দিয়ে। নির্বাচনের শতকরা সাড়ে আটানব্বই আসন ও শতকরা ৮১ জনের সমর্থন লাভ করা একমাত্র ত্যাগ তিতিক্ষা ও নিষ্কলুষ সংগ্রামের বিনিময়ে অর্জিত জনপ্রিয়তার মাধ্যমেই সম্ভব। অহিংস ও অসহযোগ আন্দোলন সশস্ত্র বিপ্লবে রূপান্তরিত হয়ে সুদীর্ঘ ৪৩ বছর লেগেছিল ভারতের স্বাধীনতা লাভ করতে আর ২৫শে মার্চ পর্যন্ত অহিংস অসহযোগ আন্দোলন করে সশস্ত্র সংগ্রামে রূপান্তরিত হয়ে মাত্র তিন মাস মুক্তিফোজের সাথে অসম যুদ্ধের পর আধুনিক সমরাস্ত্রে সুসজ্জিত ইয়াহিয়া বাহিনীর নাভিশ্বাস উঠেছে। এটা সম্ভব হয়েছে আওয়ামী লীগ প্রতিষথানের সংগঠনী শক্তিমত্তা ও দলীয় ঐক্য সংহতি শৃংখলা এবং নেতৃত্বের প্রতি অটুট আস্থার পরিপ্রেক্ষিতে।

.

আর মুক্তিফৌজ ও আওয়ামীলীগ এরা এঁকে অপরের পরিপূরক। প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধা অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত। হানাদার বাহিনীর হাত থেকে দেশমাতৃকাকে মুক্ত করার কঠিন শপথে তারা আবদ্ধ।.

.

স্নেহাশিস পানু

<৬,২০,৩৯-৪০>

শিরোনামঃ মুক্তিযুদ্ধে আপনার করনীয় কি?

সংবাদপত্রঃ জয় বাংলা (১ম বর্ষঃ ৮ম সংখ্যা)

তারিখঃ ২ জুলাই, ১৯৭১

.

মুক্তিযুদ্ধে আপনার করণীয় কি ?

.

পাঞ্জাবী শোষক গোষ্ঠীর তল্পিবাহক ইয়াহিয়ার সরকার স্বাধীন বাংলাদেশে যে নারকীয় হত্যালীলা চালিয়ে যাচ্ছে তার নজীর ইতিহাসে নেই। মুখে ইসলাম, মুসলিম ভ্রাতৃত্ব, এক জাতীয় বুলি আওড়িয়ে সে তার পশু সৈন্যদের হিংস্র কুকুরের মত লেলিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশের সকল মানুষের বিরুদ্ধে। সারা দেশে সৃষ্টি করেছে এক বিভীষিকার  রাজত্ব, ধ্বংসের তাণ্ডবলীলা। স্বাধীন বাংলাদেশ, সোনার বাংলাদেশ, বাঙ্গালী জাতির গৌরব, তাদের পীঠস্থান। বাংলাদেশকে এই দানবীয় পিশাচের হাত থেকে রক্ষা করবার জন্য বাংলাদেশ, বাংলাদেশকে শত্রুসেনা মুক্ত করবার জন্যে আজ বাংলাদেশের মুক্তিকামী সমস্ত জনতা ইস্পাত কঠিন শপথে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আজ রক্তের শপথ নিয়েছে বাংলার মুক্তিযোদ্ধারা, তারা আঁজলা ভরে বুকের রক্ত ঢেলে দেবে, বিনিময়ে স্বাধীন বাংলার বুক থেকে শত্রু সৈন্যকে নিশ্চিহ্ন করবে । সুতরাং লড়ছে আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা, বাংলাদেশের সোনার ছেলেরা। সিংহের মত তারা ওত পেতে বসে থাকে সুযোগ পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়ছে পাক সৈন্যের ওপর, নির্মমভাবে হত্যা করছে হানাদার দস্যু পাক সেনাদের। প্রতিদিন শত শত্রুর রক্তে স্নাত হয়ে বাংলার মাটিকে করছে কলুষমুক্ত। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে অপূর্ব বীরত্বে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে পাকসেনা। প্রতিদিন শতশত পাকসেনার মৃত্যুতে পাক সেনাবাহিনীতে হাহাকার উঠেছে। তারা আজ মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পেরেছে এমনিভাবে আর কিছুদিন যুদ্ধ চললে বাংলাদেশ থেকে আর একটি পাক সৈন্যও জীবিত ফিরে যেতে পারবে না। মুক্তিযোদ্ধাদের অতুলনীয় বীরত্ব সারা বিশ্বের মানুষ আজ বিস্মিত, মুগ্ধ । তাদের অপূর্ব সুন্দর সাফল্যে আজ শত্রুদের অন্তিমদশা উপস্থিত ।

.

বাংলার মুক্তিযোদ্ধারা তাদের কর্তব্য করে যাচ্ছেন, একান্ত নিষ্ঠার সংগে। তাদের অজেয় দেশপ্রেম, তাদের ত্যাগ, তাদের  অপূর্ব নিষ্ঠা সারা বাঙ্গালী জাতিকে এক গৌরবময় মহিমা দান করেছে ।

.

মুক্তিযোদ্ধারা যেমন তাদের কর্তব্য করে যাচ্ছেন অপূর্ব নিষ্ঠার সংগে তেমনি আজ বাংলাদেশের সমস্ত মানুষের একান্ত কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিটি কাজে সর্বতোভাবে সাহায্য করা । কারণ মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত সাফল্য নির্ভর করছে দেশের কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, যুবক, মধ্যবিত্ত সমগ্র জনসাধারণের সক্রিয় সমর্থনের উপর।

.

মুক্তিযোদ্ধারা যেমন এ দেশের কৃষক শ্রমিক জনতার শ্রেষ্ঠ সন্তান, তেমনি বাংলাদেশের মানুষকেও মুক্তিযোদ্ধাদের একান্ত আপনজন হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের জীবনের নিরাপত্তা এবং সাফল্য সম্পূর্ণরূপে গ্রামের কৃষক, শ্রমিক, জনতার উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। বর্তমান যুদ্ধে অবলম্বিত গেরিলা যুদ্ধের নীতি হল শত্রুর সন্ধান নেয়া, শত্রুকে অতর্কিতে আক্রমণ করা, ধ্বংস করা এবং নিজেকে রক্ষা করা। সুতরাং শত্রুর সন্ধান নিতে হলে শত্রুকে অতর্কিতে আক্রমণ করতে হলে, সর্বশেষে গেরিলাদের আত্মরক্ষা করতে হলে সংঘর্ষের এলাকার এবং তার চারপাশের এলাকার কৃষক শ্রমিক জনতার সক্রিয়  সাহায্য একান্ত প্রয়োজন। কারণ মুক্তিযোদ্ধাদের শত্রুর চোখ এড়িয়ে শত্রুকে আক্রমণ করতে সাহায্যও তারাই করতে পারেন। তাছাড়া  শত্রুকে আক্রমণের আগে এবং দ্রুত পশ্চাৎপসারণ সময়েও আশ্রয় দিয়ে সাহায্য তারাই করবেন। এ কথা অনস্বীকার্য যে আজ মুসলিম লীগ ও জামাতে ইসলামির একদল অনুচর শত্রুকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সাহায্য করছে। এরা সব সময়ে চেষ্টা করছে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাটি এবং মুক্তিযোদ্ধাদের শত্রুকে চিনিয়ে দিতে। এদের ঘৃণ্য প্রচেষ্টায় এরা যদি সাফল্য লাভ করতে পারে তাহলে মুক্তিযুদ্ধে এরা চরম ক্ষতিসাধন করবে ।সুতরাং বাংলাদেশের মানুষের প্রথম কর্তব্য হবে এই সমস্ত শত্রুচরদের দৃষ্টি থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের রক্ষা করা। তাহলে বর্তমান মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের প্রথম মানুষের আশু করণীয় হচ্ছে, মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাটির সাথে যোগাযোগ রাখা, শত্রুর গতিবিধির খবর গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাটিতে পৌছিয়ে দেয়া, মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেয়া, পশ্চাৎপসারণ কালে তাদের সাহায্য করা, শত্রুকে এবং শত্রুর চরদের ধ্বংস করতে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করা। এছাড়া তারা নিজেদের প্রচেষ্টা চালিয়ে শত্রুর চরদের খতম করবেন। গ্রামকে শত্রুচর মুক্ত করতে  না পারলে মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সহায়কদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে।

.

উপরে উল্লিখিত উপায়ে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করতে হলে গ্রামগুলোকে সংঘটিত হতে হবে। নিঃসন্দেহে এ কথা বলা চলে যে, মুষ্টিমেয় শত্রুর অনুচর ব্যাতীরেখে সারা বাংলাদেশের মানুষ আজ মুক্তিযোদ্ধাদের অনুকূলে। কিন্তু এই প্রসঙ্গে এ কথাও একান্ত সত্য যে, গ্রামে দু একটি শত্রুচর থাকলেও গেরিলা যোদ্ধা কিংবা মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারীগণ কেউ নিরাপদ নন। সুতরাং সুযোগ পেলেই শত্রুর চরকে খতম করে দিতে হবে।

.

.

দীপংকর ঘোষ দ্বীপ

<৬,২১,৪১-৪৩>

শিরোনামঃ জাতিসংঘের মাধ্যমে নয়া চক্রান্ত

সংবাদপত্রঃ জয় বাংলা ১ম বর্ষঃ ১২শ সংখ্যা

তারিখঃ ৩০ জুলাই, ১৯৭১

                      জাতিসংঘের মাধ্যমে নয়া চক্রান্ত

    বাংলাদেশে এবং ভারতের সীমান্তে জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক দল মোতায়েন করার প্রস্তাব করা হয়েছে । জাতিসংঘের উদ্ধাস্তু পুনর্বাসন দপ্তরের হাইকমিশনার প্রিন্স সদরুদ্দিন বাংলাদেশের জাতিসংঘের চল্লিশজন পরিদর্শক পাঠাবার প্রস্তাবও করেছেন । উদ্দেশ্য হিসাবে বলা হয়েছে, ভারতে চলে এমন লক্ষ লক্ষ শরণার্থী যাতে নিরাপদে স্বদেশে ফিরে আসতে পারেন এবং তারা পুনর্বাসিত হন তার তদারকি করা । দৃশ্যতঃ প্রস্তাবটি খুবই নির্দোষ ও সাধু । কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে দৃশ্যতঃ সাধু ও নির্দোষ প্রস্তাবটির আড়ালে রয়েছে জাতিসংঘ ও তার প্রধান মুরুব্বি যুক্তরাষ্ট্রের নিক্সন এডমিনিষ্ট্রেশনের নতুন চক্রান্ত । কেবল একটি প্রস্তাব এসেছে তাদের পাকিস্তান ঘেঁষা এজেন্ট সদরুদ্দিনের মারফৎ । গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশ সরকার এবং ভারত সরকারও সঙ্গে সঙ্গে জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক মোতায়েনের ‘সাধু’ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন ।

    কিছুদিন আগে, জাতিসংঘের তরফ থেকে বাংলাদেশের উদ্ধাস্তুদের পরিদর্শনের নামে ভারত, পাকিস্তান ও অধিকৃত বাংলাদেশ সফরে এসেও সদরুদ্দিন নানা উল্টাপাল্টা কথা বলে গেছেন । উদ্দেশ্য ছিল সম্ববতঃ তার দোস্ত ইয়াহিয়ার গণহত্যার পাপ যথাসম্ভব কমিয়ে দেখানো ।

    প্রিন্স সদরুদ্দিনের কথা থাক । বাংলাদেশ ও ভারতে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক মোতায়েন করার প্রস্তাব শুনে অতি দুঃখের মধ্যেও আমাদের একটি পুরনো গল্প মনে পড়েছে । একবার এক সার্জন একজন রোগী দেখে বললেন, এমন কিছু বড় অপারেশন নয় । এখনই তিনি রোগীকে রোগমুক্ত করে দেবেন । ঘটা করে সার্জন রোগীর দেহে অস্ত্রোপ্রচার করলেন । প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে কক্ষের বাইরে এসে রোগীর রুদ্ধশ্বাস আত্মীয়দের বললেন, ‘আপনাদের কি বলবো’ অপারেশন অত্যন্ত সাকসেসফুল হয়েছে । তবে দুঃখের কথা এইটুকু যে, রোগী মারা গেছে ।

    বাংলাদেশে ইয়াহিয়ার দস্যুচক্র বেপরোয়া গণহত্যা চালাচ্ছে আজ চার মাস হয়ে গেল । দখলীকৃত বাংলাদেশ এখন ধ্বংসস্তুপে পরিণত । এখনো বাংলার জীবন ও সম্পত্তি ধ্বংসের কোন সঠিক হিসাব হয়নি । বেসরকারী হিসাবে আশঙ্কা করা হয়েছে, মৃতের সংখ্যা দশ লাখ, গুরুতরভাবে আহতের সংখ্যা পঁচিশ হাজার, সাধারণভাবে আহত তিন লাখ, নির্যাতিত নারীর সংখ্যা পনের হাজার থেকে বিশ হাজার । আর বাংলাদেশ থেকে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খৃষ্টান নির্বিশেষে শরণার্থী ভারতে ঠেলে দেয়া হয়েছে ৭০ লাখের উপরে । এই পৈশাচিক ধ্বংসযজ্ঞ ও হত্যাকাণ্ড যখন চলছিল, তখন বাংলাদেশের নেতারা বার বার জাতিসংঘ ও বৃহৎ রাষ্ট্রবর্গের কাছে মানবতা ও বিশ্বশান্তির নামে আকুল আবেদন জানিয়েছেন, এই শিশুঘাতী ও নারীঘাতী বর্বরতা বন্ধে সক্রিয় হোন, বাংলাদেশে মানবতার স্বার্থে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ চাই । জাতিসংঘ কোটি কোটি মানুষের এই বিপন্ন আর্তনাদে কান দেননি । আর বৃহৎ  রাষ্ট্রবর্গের মধ্যে আমেরিকা জাহাজ বোঝাই করে অস্ত্র পাঠিয়েছে এই অস্ত্র নিরীহ ও নিরস্ত্র নর-নারী হত্যার কাজে লাগানো হবে এই তথ্য জেনেও । এই দীর্ঘ চার মাস পরে যখন ইয়াহিয়া চক্রের ধ্বংসযজ্ঞ প্রায় সমাপ্ত হয়ে এসেছে, তখন জাতিসংঘ কর্তৃপক্ষ পর্যবেক্ষক পাঠাতে চান কি প্রয়োজনে ? সেখানে স্তুপিকৃত মৃতদেহের সংখ্যা গুনতে ? ধ্বংসস্তুপে পরিণত দখলীকৃত বাংলাদেশে জাতিসংঘের তথাকথিত ত্রাণকার্যের মহড়া দিতে ? হ্যাঁ, তাতে জাতিসংঘের ত্রাণকার্যের অপারেশন অবশ্যই সাকসেসফুল হবে, কিন্তু রোগী বাঁচবে না, অর্থাৎ বাংলাদেশের ধ্বংস চূড়ান্ত বিপর্যয় ঠেকানো যাবে না । এই ধ্বংসস্তুপ ও মৃতদেহের স্তুপের উপর দাঁড়িয়েই জাতিসংঘের পর্যবেক্ষকরা তখন হয়ত দাবী করবেন, বাংলাদেশ ধ্বংস হয়ে গেছে তাতে আমাদের কি ? আমাদের অপারেশন অভিযান সাকসেসফুল ।

    জাতিসংঘ নামক একটি বিশ্ব প্রতিষ্ঠানের যদি যথার্থই কোন অস্তিত্ব থাকতো, তাহলে তারা ভারতে তো দূরের কথা, বাংলাদেশেও পর্যবেক্ষক পাঠাবার নাম এখন মুখে আনতেন না । জাতিসংঘের কর্তা ব্যক্তিদের স্মরণ আছে কিনা আমরা জানি না, এপ্রিল মে মাসের দিকে দখলীকৃত বাংলাদেশে ইয়াহিয়ার গণহত্যাযজ্ঞ যখন পুরোদমে চলেছে, তখন জাতিসংঘ সেখানে ত্রাণসামগ্রী পেরণ এবং নিজেদের তদারকিতে তা বন্টনের জন্য প্রস্তাব দিয়েছিল । ইয়াহিয়া তখন আন্তর্জাতিক রেডক্রসের একটি টিমকেই শুধু পাকিস্তান থেকে বহিষ্কার করে দেয়নি, উ-থান্টের প্রস্তাবেও সাফ না বলে দিয়েছিল তারপর জাতিসংঘের পক্ষ থেকে আবার নরম ভাষায় প্রস্তাব দেয়া হল, জাতিসংঘের ত্রাণসামগ্রী ইয়াহিয়ার সরকারী সংস্থাগুলোই বন্টন করবে, তবে তদারকি করবে জাতিসংঘের লোকেরা । এই প্রস্তাবটি প্রথমে ইয়াহিয়ার মনঃপূত হয়নি । ইয়াহিয়ার কাছে জাতিসংঘের আমল পায়নি । এমনকি তার পৈশাচিক গণহত্যা বন্ধ করতেও জাতিসংঘ পারেননি । আক্রমণকারী ও অত্যাচারীর বর্বরতা বন্ধ করতে সাহসের সঙ্গে না এগিয়ে দীর্ঘ চার মাস পর সক্রিয় হয়েছেন, পর্যবেক্ষক নিয়োগের নামে আক্রান্তু পক্ষের আত্মরক্ষার প্রস্তুতি ও উদ্যোগ আয়োজন নষ্ট করার জন্য । এ না হলে আর জাতিসংঘ! আসলে জাতিসংঘ নামক বিশ্ব সংস্থাটির বহুদিন আগেই অস্তিত্ব লোপ পেয়েছে । নিউ ইয়ার্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তর নামে যে ভবনটি আছে, তা প্রকৃতপক্ষে একটি বৃহৎ শবাধার । আর এই শবাধারটি বহনের জন্য সর্বাগ্রে এগিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের নিক্সন এডমিনিষ্ট্রেশন । এবং সর্বশেষ ব্যক্তি নিমন্ত্রিত হয়েছেন পাকিস্তান নামক একটি অধুনালুপ্ত রাষ্ট্রের বেআইনী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ।

    সব চাইতে মজার ব্যাপার এই যে, জাতিসংঘ ভারত সীমান্তেও পর্যবেক্ষক মোতায়েন করতে চেয়েছেন । এ যেন মামার বাড়ীর আবদার । ভারত সরকার অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে এ ব্যাপারে না বলে দিয়েছেন । তথাপি প্রশ্ন থেকে যায়, ভারতে পর্যবেক্ষক পাঠিয়ে কি হবে ? গৃহস্থ বাড়ীতে ডাকাত পড়েছে । ডাকাত না বেঁধে, গৃহস্থ বাঁধার এমন চমৎকার প্রস্তাব আর কখনো শোনা যায়নি । অপরাধ করেছে পাকিস্তান । সত্তর লাখ শরণার্থী সে ভারতের ঘাড়ে চাপিয়েছে । ভারত এই শরণার্থীদের সাময়িকভাবে আশ্রয় দিয়ে বিরাট মানবতাবাদী ভারতকে একাসনে বসিয়ে ভারতের ঘাড়েও পর্যবেক্ষক বসিয়ে দেয়ার প্রস্তাব বাতুলতা না নতুন চক্রান্ত পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতাতেই তা বিচার্য । এখানে আরও একটি কথা বলা দরকার শরণার্থীরা ভারতে গিয়ে বিপন্ন হয়নি । এ জন্যেই পাকিস্তান ঘেঁষা জাতিসংঘ প্রতিনিধি প্রিন্স সদরুদ্দিন ইয়াহিয়ার অনেক দুষ্কর্ম চাপা দিতে চাইলেও বলতে বাধ্য হয়েছেন ‘পাকিস্তানে ফিরে গেলে শরণার্থীদের জীবন বিপন্ন হবে না, এমন গ্যারান্টি আমি দিতে পারি না । যে স্বীকারোক্তির একমাত্র অর্থ, পাকিস্তানে এখনো অত্যাচার চলছে এবং দেশত্যাগীদের প্রত্যাবর্তন সেখানে নিরাপদ নয় । এই অবস্থায় জাতিসংঘের যদি সত্যই কোন দায়িত্ব বোধ থাকে, তাহলে তাদের একমাত্র কর্তব্য হচ্ছে, বাংলাদেশ থেকে অবিলম্বে অত্যাচারী হানাদার বাহিনী অপসারণের ব্যবস্থা করা এবং লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন নিরাপদ ও নিশ্চিত করার জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে তাদের বৈধ কর্তৃত্ব সম্প্রসারণে সাহায্য করা । তা না করে শরণার্থীদের জন্য মেকি দরদ দেখিয়ে বাংলাদেশে এবং ভারতে পর্যবেক্ষক প্রেরণের প্রস্তাব আসলে নতুন মোড়কে একটি পুরনো সাম্রাজবাদী চক্রান্ত মাত্র । জাতিসংঘ এই চক্রান্তেরই বহু ব্যবহৃত মাধ্যম ।

    জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক ও জাতিসংঘ বাহিনীর মোতায়েনের চমৎকার ফল বিশ্ববাসী একবার মধ্যপ্রাচ্যে এবং আরেকবার কঙ্গোতে প্রত্যক্ষ করেছে । জাতিসংঘের চমৎকার পর্যবেক্ষণ ও খবরদারি প্যালেষ্টাইনেও দেখেছে । কঙ্গোতে বিপুল ভোটধিক্যে নির্বাচিত প্রথম জাতীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রী লুমুম্বা দেশের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য জাতিসংঘ বাহিনীকে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিজ দেশে নিয়েছিলেন । এ জাতিসংঘ বাহিনীর নাকের ডগায় দাড়িয়ে কঙ্গোর ফ্যাসিষ্ট চক্র মহান দেশনায়ক লুমুম্বাকে পৈশাচিক নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করেছে ।

    জাতিসংঘ এই হত্যাকান্ডের নীরব দর্শক ছিলেন মাত্র । সুতরাং বাংলাদেশের শরণার্থীদের সেবার অছিলায় সুঁচ হয়ে ঢুকে জাতিসংঘ কাদের জন্য ফাল হটে চান, তা বুঝতে ‘বোকা বাঙালীরও’ খুব বেশী দেরী হয়নি ।

    জাতিসংঘের মাধ্যমে এই নয়া চক্রান্তের উদ্দেশ্য অতি স্পষ্ট । দখলীকৃত বাংলাদেশে ইয়াহিয়ার হানাদার বাহিনী এখন ক্রমবর্ধিত গেরিলা তৎপরতায় কাবু হয়ে পড়েছে । মুক্ত অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর উপর চূড়ান্ত আঘাত হানার প্রস্তুতি নিচ্ছে । জাতিসংঘ সংগঠিত ও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে এবং ইয়াহিয়ার হানাদার চক্রের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করে তাদের নেপথ্যের মুরুবিবরা চাচ্ছে হানাদারদের এই চরম মার থেকে বাঁচাতে । পর্যবেক্ষক মোতায়েনের নামে যদি বাংলাদেশেও ভারত সীমান্তে জাতিসংঘ বাহিনী মোতায়েন করা যায়, তাহলে মুক্তিবাহিনী ও গেরিলাদের তৎপরতা রোধ করা যাবে এবং তাদের মার থেকে হানাদার বাহিনীকে বাঁচানোও যাবে, এই তাদের দুরাশা । পাকিস্তানকে এখনো অস্ত্র প্রদানের যুক্তি হিসাবে নিক্সন সরকার যে অভিনব তথ্য আবিষ্কার করেছেন, তাহল বাংলাদেশে উগ্রপন্থীদের দমনের জন্য অস্ত্র প্রেরণ দরকার । ভবিষ্যতে এই  উগ্রপন্থীদের দমনের নামে মুক্তিবাহিনীকে দমনেরও এক চমৎকার যুক্তি নিক্সন সাহেবেরা খাড়া করতে পারবেন, বাংলাদেশে যখন জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ চলছে, তখন সেখানে যারা ‘উগ্রপন্থীদের অস্তিত্ব বা তাদের প্রভাব আবিষ্কার করতে পারেন, তাদের পক্ষে সবই সম্ভব । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বড় ব্যবসায়ীদের এখন প্রধান ব্যবসা অস্ত্র বিক্রয় । ভিয়েতনামের কিছু উদ্ধত্ত মার্কিন সৈন্য জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক বাহিনীতে ঢুকিয়ে যদি বাংলাদেশে পাঠানো যায়, তাহলে এখানেও আরেকটি ভিয়েতনাম সৃষ্টিতে দেরী হবে না এবং মার্কিন অস্ত্র ব্যবসায়ীদের অস্ত্র ব্যবসায়ও ভাটা পড়বে না । যুক্তরাষ্ট্রের শান্তিকামী ও গণতন্ত্রকামী মানুষেরও তাই উচিৎ, তাদের দেশের রক্ত ব্যবসায়ীদের এই নতুন চক্রান্ত সম্পর্কে সজাগ হওয়া ।

    বাংলাদেশ সমস্যায় জাতিসংঘ যদি কোন কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করতে চায়, তার পথ এখনো উন্মুক্ত রয়েছে । গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম তার সাম্প্রতিক এক ভাষণে এই পথের কথাই সুস্পষ্ট ভাষাই বলে দিয়েছেন । এই পথ হল, বাংলাদেশ থেকে পাক হানাদার বাহিনী অবিলম্বে সরিয়ে ফেলার ব্যবস্থা করা, স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকার ও জাতিসংঘে স্থান দেয়া, গত তেইশ বছর ধরে বাংলাদেশে যে শোষণ চালানো হয়েছে বিশেষ করে গত ২৫শে মার্চের পর ধ্বংস সাধন করা হয়েছে, ইসলামাবাদ সরকারের কাছ থেকে তার ক্ষতিপূরণ আদায় করা ও শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসনে সাহায্য করা । একমাত্র এ পথেই বাংলাদেশ সমস্যার শান্তিপূর্ণ ও ন্যায়সঙ্গত সমাধান সম্ভব । জাতিসংঘের তাই উচিৎ কোন নেপথ্য চক্রীদলের চক্রান্তের মাধ্যম না হওয়া এবং ভাওতাবাজির আশ্রয় না নেয়া । বাংলাদেশের মানুষ এখন অপরের কৃপাপ্রার্থী নয় । তারা নিজেরাই নিজেদের সমস্যার সমাধান ও হানাদার উৎপাদনে কৃতসংকল্প ।

.

.

হিমু নিয়েল

<৬,২২,৪৪>

শিরোনামঃ বাংলাদেশের মানুষ বরদাশত করবে না ( শেখ মুজিবের বিচার প্রসঙ্গে)

সংবাদপত্রঃ জয় বাংলা ১ম বর্ষ ১২শ সংখ্যা

তারিখঃ ৩০ জুলাই, ১৯৭১

.

বাংলাদেশের মানুষ বরদাশত করবে না

(নিজস্ব প্রতিনিধি)

.

বঙ্গবন্ধুর বিচার করবে, একথা প্রচার করেছে ইসলামাবাদের খুনী চক্র। কিন্তু এ অধিকার তাকে কে দিয়েছে? ইতিহাসের পথ রোধ করে যারা ক্ষমতার দাপটে উন্মাদ হয়ে উঠে, বাংলার সরলপ্রাণ মানুষ তাদের শায়েস্তা করেছে। আর তাদেরই অবিসম্বাদিত চেতনা বঙ্গবন্ধু আজ বন্দীদশায় কাল কাটাচ্ছেন জঙ্গীশাহীর কারান্তারালে। কিন্তু তাঁকে বিচার করবার অধিকার তাদের নেই । জবরদস্তি করে এ প্রহসন করলে বাংলাদেশের মানুষ তাকে বরদাশত করবে না। এ উদ্ধৃত আচরণের সমুচিত জবাব দেবেই বাংলার মানুষ।

.

স্বাধীন বাংলাদেশ একটি সত্য। পৃথিবীর মানচিত্রে এ এক সার্বভৌম নবরাষ্ট্রের নাম। ইতিহাসে এ নাম সাড়ে সাত কোটি রক্তের অক্ষরে লেখা চিরভাষ্কর। এই দেশেরই প্রতিটি মানুষের প্রাণ প্রিয় সুহৃদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁকে দেশদ্রোহীর অপরাধে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চায়, এমন ধৃষ্টতা কার? ‘পাকিস্তান’ নামের যে দেশটি আজ মৃত, তারই নরপতি ইয়াহিয়া যদি এই দুঃসাহস নিয়ে বিশ্বের মানবগোষ্ঠীকে বোকা বানাতে চায় আর বাংলার সার্বিক মুক্তির অপ্রতিরোধ্য সংগ্রামকে করতে চায় দুর্বল তবে জেনে রাখো ইয়াহিয়া তোমাদের জবাবের দিন সমাগত। এবারেতে প্রতিশোধ কসম নিয়েছি, পালাবার পথ দেবো না তোমাদের।

.

জঙ্গী পাক সরকারের হাতে মাতৃভূমি বাংলাদেশ থেকে দেড় হাজার মাইল দুরে পশ্চিম পাকিস্তানে বন্দী বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের নয়নমণি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জল্লাদ অধিপতি ইয়াহিয়া খান কতৃক সামরিক আদালতে বিচারের হুমকি সম্পর্কে প্রকাশিত খবরে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারবর্গের আশু মুক্তির জন্য জাতিসংঘের সেক্রেটারী জেনারেল উথান্ট, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত রাশিয়া, গ্রেট বৃটেন, গণচীন, ভারত, কানাডা, অষ্ট্রোলিয়া প্রভৃতি দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের নিকট পৃথক পৃথক তারবার্তা প্রেরণ করে তাঁদের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

.

এ ছাড়া গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদ ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী খোন্দকার মোশতাক আহমদ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও অবিসম্বাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য বিশ্বের বিভিন্ন ও জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। বাংলাদেশ ছাত্র লীগের সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী ও সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ যুবশক্তির অদম্য প্রেরণার অফুরন্ত উত্‍স বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির ব্যপারে বিশ্বের যুব সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। নেতৃবৃন্দ তাঁদের বিবৃতিতে বলেন যে, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার করার ন্যায় ও আইনসঙ্কত অধিকার আজ জঙ্গী সরকারের নেই।

.

.

কম্পাইলারঃ হিমু নিয়েল

<৬,২৩, ৪৫-৪৭>

শিরোনামঃ ঐতিহাসিক গণপ্রতিনিধি সমাবেশ

সংবাদপত্রঃ জয় বাংলা (১ম বর্ষঃ ১২শ সংখ্যা)

তারিখঃ ৩০ জুলাই, ১৯৭১

ঐতিহাসিক গণপ্রতিনিধি সমাবেশ

আহমেদ রফিক

.

অসহযোগ আন্দোলন থেকে স্বাধীনতায় উত্তরণ করে স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠন করার পর, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটি এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রথম বৈঠক এ মাসেই ৫ই ও ৬ই তারিখে মুজিবনগরে অনুষ্ঠিত হয়েছে।

.

দেশমাতৃকার স্বাধীনতা রক্ষার জন্যে যখন সাড়ে সাত কোটি মানুষ মৃত্যুঞ্জয়ী সংগ্রামে লিপ্ত হয়ে বুকের তাজা রক্ত বইয়ে দিয়েছে বাংলার শ্যামল প্রান্তরে, জাতীয়তাবাদের নব চেতনায় উদ্বুদ্ধ ও স্বাধীনতা মন্ত্রে দীক্ষিত সংগ্রামী বাংলার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন কারারুদ্ধ, বিশ্বমানবতা যখন বিবেকের দংশনে কিংকর্তব্য বিমূঢ়, সারা বিশ্ব যখন বাংলার নেতৃত্ব বিশেষ করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের দিকে এক বিরাট উৎকণ্ঠা নিয়ে তাকিয়ে আছে, তেমনি এক মুহুর্তে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হল। কার্যকরী সংসদের ৩৯ জন সদস্য এবং উভয় পরিষদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের যুক্ত বৈঠকে মোট ৩৭৪ জন সদস্য উপস্থিত ছিলেন। এর মধ্যে ১৩৫ জন জাতীয় পরিষদ সদস্য ২৩৯ জন প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য। আওয়ামী লীগ দলীয় জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের মধ্যে যাঁরা সম্মেলনে উপস্থিত হতে পারেননি, তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন ইয়াহিয়া খানের সেনাবাহিনীর হাতে নিহত অথবা গ্রেফতার হয়েছেন এবং কয়েকজন আত্মসমর্পণও করেছেন। আর কেউ কেউ নিজ নিজ এলাকায় থেকে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার কাজে ব্যস্ত থাকায় সম্মেলনে হাজির হতে পারেননি। অবশ্য আরও বেশ কয়েকজন সদস্য পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রসমুহে আশ্রয় নিয়েছেন।

.

এই বৈঠক কয়েকটি দিক থেকে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ইয়াহিয়া সরকার আওয়ামী লীগ তথা বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে নস্যাত্‍ করার উদ্দেশ্যে ত্রিমুখী আক্রমণ চালিয়েছিল। ইয়াহিয়া সরকার আওয়ামী লীগকে বেআইনী ঘোষণা করে, আওয়ামী লীগের নেতা, কর্মী ও নির্বাচিত পরিষদ সদস্যদের উপর সকল রকম অত্যাচার চালিয়ে তাদেরকে সর্বস্বান্ত করেছে। আর সর্বশেষে আওয়ামী লীগকে বেআইনী ঘোষণা করা হলেও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নির্বাচন বাতিল হবে না বলে একটি মস্ত বড় প্রলোভনের টোপ ছেড়েছিল। কিন্তু এই বৈঠক প্রমাণ করে দিয়েছে যে, ইয়াহিয়ার প্রলোভনের টোপ ব্যর্থ হয়েছে।

.

সম্মেলনে উপস্থিত প্রতিটি মানুষই যে সংগ্রামী বাংলাদেশের প্রতিনিধি তার চিহ্ন আঁকা রয়েছে তাদের চোখে মুখে। তাঁরা এসেছেন রণক্ষেত্রের মুক্তিযোদ্ধাদের এবং সারা বাংলাদেশের সংগ্রামী মানুষের দুর্জয় সংকল্পের প্রতিনিধি হিসেবে। তাদের চোখ মুখে চূড়ান্ত বিজয়ের অলোয় উদ্ভাসিত।

.

এই বৈঠকের রাজনৈতিক তাৎপর্য, ঐতিহাসিক গুরুত্বও অনেক। ভাবী কালের ঐতিহাসিকেরা যেদিন বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস লিখবেন, সেদিন এই মুজিবনগর বৈঠকের গুরুত্ব তার যথার্থ প্রেক্ষিত নিয়ে ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হবে, এতে কোন সন্দেহ নেই। কেউ কেউ হয়ত বলতে পারেন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যরা একটি যুক্ত বৈঠক করেছেন এবং দেশের রাজনৈতিক ও সামরিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে কয়েকটি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তার রাজনৈতিক গুরুত্ব থাকতে পারে, ঐতিহাসিক তাৎপর্য কি?

.

এই তাৎপর্য বুঝতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে, আজ থেকে দু’মাস আগে জানুয়ারীর এক শীত বিকেলে রমনার সবুজ ঘাসে ঢাকা রেসকোর্সের ময়দানে। তখন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের সদ্য নির্বাচন বিজয়ের মহা উল্লাস। গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক অধিকার ফিরে পাওয়ার আকুল প্রত্যাশায় বাংলার আবাল বৃদ্ধা বনিতা প্রতীক্ষারত। সেই মহা বিজয়ের মহা উল্লাসের দিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব প্রস্তাব দিলেন রমনার মাঠের প্রায় বিশ লাখ মানুষের সামনে দাড়িয়ে অর্থাৎ গণ-আদালতে দাড়িয়ে আওয়ামী লীগের সকল সংসদ সদস্যকে শপথ গ্রহণ করতে হবে, জনগণের রায় বানচাল হতে পারে, জনগণকে দেয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ হতে পারে এমন কাজ কেউ করবেন না। জনগণের সঙ্গে গণস্বার্থের সঙ্গে কেউ যদি বিশ্বাসঘাতকতা করে, তাহলে জনগণের অধিকার রইল তাকে চরম শাস্তি দেয়ার। সেদিনও বাইরের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা প্রশ্ন তোলেননি তা নয়, নতুন করে আবার শপথ গ্রহণের দরকার কি ? বাংলাদেশের জাতীয় নেতা বঙ্গবন্ধু তার ময়দানের ভাষণে এর জবাব দিয়েছেন অল্প কয়েকটি কথায়, “এই নির্বাচনী বিজয়ই চূড়ান্ত বিজয় নয়। আমাদের আবার সংগ্রামে নামতে হতে পারে।”

.

মাত্র তিন মাসের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেল। ইয়াহিয়া চক্র বিশ্বাসঘাতকতা করলো । নিরস্ত্র এবং অহিংস গণ অসহযোগ আন্দোলনের মোকাবিলায় আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত কয়েক ডিভিশন সৈন্য তারা লেলিয়ে দিল বাঙ্গালী নিধনে। মার্চ মাসের সাত তারিখে আবার লাখো লাখো মানুষ জমায়েত হল রমনার মাঠে তাদের মুক্তি সংগ্রামে নেতার নির্দেশ লাভের জন্য। তাদের সকলের মনেই সেদিন একটি নীরব প্রশ্ন এর পর কি হবে ? বঙ্গবন্ধু যদি তাদের মধ্যে না থাকেন, তাকে যদি গ্রেফতার হতে হয় বর্বর জঙ্গীচক্রের হাতে তাহলে কি হবে ? কে নির্দেশ দেবে সংগ্রামী জাতিকে ? এই প্রশ্নেরও জবাব দিলেন বঙ্গবন্ধু নিজেই। আবেগমণ্ডিত বজ্রকন্ঠে বললেন, “আমি যদি নির্দেশ দেয়ার জন্য না থাকি তাহলে আমার এই নির্দেশ রইল, এই সংগ্রাম চলবে। এই সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এই সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”

.

বঙ্গবন্ধু আজ আমাদের মধ্যে হাজির নেই। হানাদার বর্বর ইয়াহিয়া চক্রের হাতে আজ তিনি বন্দী কিন্তু বাংলাদের মুক্তির সংগ্রাম থামে নি, স্বাধীনতার সংগ্রাম পথভ্রষ্ট হয়নি, আওয়ামী লীগের একজন কর্মী অথবা নেতা নীতি ভ্রষ্ট হয়নি, বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে তারা বিশ্বাসঘাতকতা করেননি। বরং তারা আরো ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন। মুক্তি সংগ্রাম আরও জোরদার ও সংগঠিত হয়েছে। সংগ্রামে চূড়ান্ত জয়লাভের দিনও ক্রমশঃ আমাদের নিকটবর্তী হচ্ছে। আর এই সংগ্রাম ও সাফল্যের নিরিখেই এ মাসে অনুষ্ঠিত মুজিবনগর বৈঠকের রাজনৈতিক তাৎপর্য ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিচার করতে হবে।

.

ইয়াহিয়া ভুট্টো টিক্কা চক্র আশা করেছিল, বঙ্গবন্ধুকে আটক করা হলে নেতাহীন মুক্তি আন্দোলন বানচাল হবে, চরম অত্যাচারের মুখে আওয়ামী লীগ দল ভেঙ্গে যাবে, আওয়ামী লীগের পরিষদ সদস্যেরা ইয়াহিয়ার নির্দেশ মেনে নিয়ে সাড়ে সাত কোটি মানুষের নির্বাচনী রায়কে ব্যর্থ করে দেবে। এই দুরাশায় ইয়াহিয়া তথাকথিত রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলে বিশ্ববাসীকে ধোঁকা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাতে ভাবী ভোলানি। আওয়ামী লীগ দলীয় কয়েকজন পরিষদ সদস্যকে বন্দীকরা ছাড়া আর দু একজনের বেশী ইয়াহিয়া খান দলে ভেড়াতে পারেননি। আওয়ামী লীগ গোটা জাতির সমর্থন পেয়ে মুক্ত অঞ্চলে বাংলাদেশের গণপ্রজাতন্ত্রী সরকার গড়ে তুলেছেন, মুক্তি বাহিনীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মুক্তি সংগ্রামে শরিক হয়েছেন। নগরে এই মাসের গোঁড়ার দিকে তারা সকলে একত্র হয়ে ইয়াহিয়ার মিথ্যা প্রচারণা ফাঁস করে দিয়েছেন এবং বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দিয়েছেন, শেখ মুজিব বন্দী হলেও আদর্শ রয়ে গেছে পিছনে, আর রয়ে গেছে তার সুযোগ্য সহকর্মীরা যাদের নেতৃত্বের প্রভাবেই ইয়াহিয়ার তথাকথিত রাজনৈতিক সমাধানের ফাঁদে তাদের কেউ ধরা দেননি। তারা সকলেই মক্তাঞ্চলে রয়েছেন এবং মুক্তি সংগ্রামে শরিক হয়ে তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন রত। বিশ্বের কোন কোন প্রখ্যাত রাজনৈতিক ভাষ্যকার তাই বিস্মিত হয়ে মন্তব্য করেছেন বিশ্ব ইতিহাসে এমনটি আর কখনো ঘটেনি। আওয়ামী লীগের মত একটি নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল রাতারাতি বিপ্লবী চরিত্র গ্রহণ করবে, এটা বিস্ময়কর বিশ্বের ইতিহাসে এটা তুলনাহীন, উপমাহীন ঘটনা।

.

এই বৈঠক প্রমাণ করেছে, ইয়াহিয়া-চক্রের চরম বর্বরতার মুখেও বাংলাদেশের গণঐক্য অটুট গণপ্রতিনিধিরা ঐক্যবদ্ধ এবং স্বাধীনতার চূড়ান্ত লক্ষ অর্জনে দৃঢ়-সংকল্প। এই বৈঠক আমাদের মুক্তিবাহিনীর মনে নতুন প্রেরণা এনেছে, সাড়ে সাত কোটি মানুষের মনে এনেছে নতুন প্রত্যয়, দৃপ্ত সাহস। বহির্বিশ্বের বন্ধু রাষ্ট্রগুলোও উপলব্ধি করেছেন, বাংলাদেশের একমাত্র বৈধ ও প্রতিনিধিত্ত্বশীল সরকার গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।

.

বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে আমরাও বলি, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম। এবং সংগ্রামে জয়লাভ অবশ্যম্ভাবী । উদয়াচলে মুক্তি সূর্যের আলোর রেখা উদ্ভাসিত। রক্ত পিছল সূর্যতোরণে আজ প্রতীক্ষারত বাংলাদেশের সংগ্রামী মানুষ। লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর হাহাকার ব্যর্থ হবে না। বীরের রক্তস্রোত, মায়ের অশ্রুধারা বিফলে যাবে না। জয় আমাদের সন্নিকট এবং সুনিশ্চিত। জয় বাংলা ।

(স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে প্রচারিত)

.

.

কম্পাইলারঃ হিমু নিয়েল

<৬,২৪,৪৮-৪৯>

.

শিরোনামঃ তাঁকে হত্যা করে বাঙালী জাতিকে স্তব্ধ করা যাবে না

সংবাদপত্রঃ জয় বাংলা ১ম বর্ষঃ ১৬শ সংখ্যা

তারিখঃ ২৭ আগস্ট, ১৯৭১

.

তাঁকে হত্যা করে বাঙালী জাতিকে স্তব্ধ করা যাবে না

মুজিব আজ আর কোন ব্যক্তি নয়

সাড়ে সাত কেটি বাঙালীর নাম শেখ মুজিব

(জয় বাংলা প্রতিনিধি)

.

মানব ইতিহাসের নৃশংসতা হত্যাকারী ইয়াহিয়া লাখো লাখো নিরপরাধ বাঙালীর শোণিতে দেহ রঞ্জিত করেও তার রক্ত পিপাসা নিবৃত্ত করতে পারেনি । খেঁকি কুত্তা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলে যেমন দিকবিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে যা তা কিছু করে বসে তেমনি মদ্যপ দুশ্চরিত্র ইয়াহিয়াও ঝাঁকালো ডিম্পল হুইস্কির নেশায় গোলাপি হয়ে গিয়ে তার মনিব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বিচারের প্রহসন চালাবার জন্য উদ্ধত ঔদ্ধত্য ঔদ্ধত্যে খেউ খেউ রব ছাড়তে শুরু করেছে ।

.

মানব সভ্যতা ও মানবিক মূল্যবোধের প্রতি হুমকিস্বরূপ এই ঘৃণ্য নরপশুকে তার বিপদজনক কাজ থেকে নিবৃত্ত করার জন্য বিশ্বের মানবতাবাদী বিবেক তাদের কণ্ঠস্বরকে উচ্চগ্রামে তুলেছেন। কিন্তু তাতেও কোন লাভ হচ্ছে না। উন্মুক্ত খেঁকি কুত্তাকে যেমন মুগুরের আঘাতে মাথার মগজ বের করে দিয়ে মানুষের স্বাভাবিক জীবন যাত্রা পরিচালনার পথকে কন্টকহীন করতে হয় ইয়াহিয়া এবং তার ইতিহাসের শিক্ষা বিস্মৃত জান্তাকেও তেমনি প্রচণ্ডতার সাথে আঘাত করতে না পারলে আগুন নিয়ে খেলা থেকে নিবৃত্ত করা যাবে না। ইতিহাসের আস্তাকুড়ের গলিজ পচা চরিত্র হিটলার, আইখম্যান মুসোলিনীদেরও মিষ্টি কথায় নিবৃত্ত করা যায় নি। যেমন কুকুর তার জন্য তেমন মুগুরের প্রয়োজন। আমাদের মুক্তি বাহিনী স্বয়ংক্রিয় মুগুর হাতে সে কাজ সমাধা করার জন্য আজ বিদ্যুতের গতিতে কাজ শুরু করে দিয়েছেন। তারা পথের কোন বাধা মানবে না বাঙ্গালী জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন রক্ষার জন্য কোন ত্যাগকেই বড় করে দেখবে না। মুজিব ভাই না বাঁচলে তাদের আলো বাতাস নিঃশ্বাস নিয়ে বেচে থাকারও কোন আগ্রহ নেই । প্রতিটি অস্ত্রাঘাতে জল্লাদদের বাচার ক্ষীণ সম্ভাবনাকেও তরুণ মুক্তি সেনারা অসম্ভব করে তুলবে ।

.

ইয়াহিয়া ঘোষণা করেছে, সে ৭৫ মিলিয়ন বাঙালীর আশা আকাঙ্ক্ষা ও আবেগ অনুভূতির প্রতীক শেখ মুজিবের বিচার করবেই। বিচারের কয়েক মাস আগেই সে ২৬শে মার্চের বেতার ভাষণে রায়ও দিয়ে ফেলেছে । মদ্যপ ইয়াহিয়ার মাতাল কণ্ঠ থেকে সেদিন ঝরে পড়েছিলঃ শেখ মুজিবকে রেহাই দেওয়া হবে না । পরবর্তীকালে একই কণ্ঠ ঘোষণা করেছে, বিচারে শেখ মুজিবের প্রাণদণ্ড হতে পারে । তার পাঞ্জাবী সেনাদের বুটের আঘাতে প্রকম্পিত বেতার থেকে প্রতিদিন শেখ সাহেবকে হত্যার হুমকি দেওয়া হচ্ছে । খেঁকি কুকুরের দুগ্ধক্তময় নখ চাটা বাঙালী কণ্ঠ তাকে মীরজাফর বলার ঔদ্ধত্য দেখাচ্ছে ।

.

এই পরিবেশে স্থানের নামহীন, বিচারকের নামহীন, খাকী ইউনিফর্ম ধারীর গ্যাস চেম্বারে বাংলার নয়নমণি শেখ মুজিবের বিচার শুরু হয়েছে বলে ঘোষণা করা হয়েছে ।

.

আরও একটি চমকপ্রদ ঘোষণাও একই সাথে সাথে করা হয়েছে তাতে বলা হয়েছে সিন্ধুর আল্লাবক্স খোদাবক্স দ্রোহী শেখ সাহেবের পরে মামলা পরিচালনা করতে স্বীকৃত হয়েছেন । এবং তাকে শেখ সাহেবের পক্ষ অবলম্বনের জন্য অনেক চেষ্টা তদ্বির করা হয়েছে । চেষ্টা করেছেন স্বয়ং ঘাতক বিচারক ইয়াহিয়া । অনেক চেষ্টা তদ্বিরের পর জনাব ব্রোহী মামলা পরিচালনায় স্বীকৃত হয়েছেন । আহা কি নাটক কি উপাদেয় নাটক !

.

শেখ মুজিব দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, আমার বিচার করার কোন এখতিয়ার ইয়াহিয়ার নেই । কিসের অভিযোগ আমার বিরুদ্ধে ? আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করার কি অধিকার ইয়াহিয়ার আছে, তাকে এ অধিকার কে দিয়েছে ?

.

এর পরও জনাব এ কে দ্রোহীকে নাকি শেখ সাহেবের পক্ষে মামলা পরিচালনায় নিযুক্ত করা হয়েছে এবং তিনি তার মক্কেলের সাথে আলোচনার জন্য এক অঘোষিত স্থানে রওয়ানা হয়ে গেছেন । সে স্থানের নাম তিনি প্রকাশ করবেন না কারণ তিনি গোপনতার শপথ পাঠ করেছেন ইয়াহিয়ার কাছে । ঘাতক যে শেখ সাহেবকে অপরাধী বলে পূর্বেই রায় দিয়ে ফেলেছে । যার প্রচারযন্ত্র অহরহ শেখ বিরোধী বিষ ছড়িয়ে ঝালিয়ে যাচ্ছে সেই আইনের আর ইতিহাসের জ্ঞান বর্জিত ইয়াহিয়া আবার অনেক চেষ্টার পর বিবাদী পক্ষের আইনজীবীও ঠিক করে নিয়েছেন । ইয়াহিয়া তোমাদের হাজারো গ্রামের গুহায় এ জাতীয় বিচারের প্রহসন হতে পারে কিন্তু সভ্যতার আলো বাতাসে উদ্ভাসিত আজকের বিশ্বে এ জাতীয় মধ্যযুগীয় বিচারের প্রহসন অকেজো । ইয়াহিয়া তোমাকে খেয়াল রাখতে হবে পরকীয়া প্রেম করে তোমার সাদ্দামী বেহেস্ত প্রেসিডেন্ট ভবনে প্রত্যাবর্তনের পর তোমার স্ত্রীকে চোখ রাঙ্গিয়ে ঠান্ডা করার ক্ষমতা তোমার আছে কিন্তু দুর্জয় শপথের দীপ্তিতে মাথা উঁচু বাঙালীরা তোমার হুমকির কাছে যে মাথা নোয়াবার শিক্ষা পায়নি তা তুমি এবং তোমার জেনারেলরা ইতিমধ্যেই নিশ্চয়ই টের পেয়ে গেছে ।

.

মিঃ ব্রোহী মামলায় কার পথ অবলম্বন করবেন ? শেখ সাহেবের বিরুদ্ধে কি অভিযোগের জবাব তিনি দেবেন এবং কার কোর্টে ? বিশ্ব জনমতের আদালতে শেখ মুজিব একটি মাত্র অপরাধ করেছেন এবং তা হলো জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষা অনুভূতির সাথে তিনি বিশ্বাস ঘাতকতা করেননি-ছয় দফার সাথে বেঈমানী করে প্রধানমন্ত্রীর পদকে বড় করে দেখেননি । জনতার রক্ত নদী আর অশ্রু গঙ্গার সাথে নিজেকে একাত্ম করে নিতে সূক্ষ্মতর বিলম্ব করেননি । এই অপরাধে যদি শেখ সাহেবের বিচার হয় তাহলে সাড়ে সাত কোটি বাঙালীকেও বিচারের কাঠগড়ায় উঠাতে হবে । কারণ শেখ মুজিব আজ ব্যক্তি নয়, সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর নাম শেখ মুজিব । মুজিব মানে সাড়ে সাত কোটি বাঙালী-কণ্ঠ, বাঙালী-প্রাণ, বাঙালী আবেগ । ইয়াহিয়া তোমার ক্ষমতাদর্পী সেনারা একটি জাতিকে কি নিশ্চিহ্ন করতে পারবে ? পারবে না । হিটলার পারেনি । আইখম্যানদের গ্যাস চেম্বারও একদিন ‘টায়ার্ড’ হয়ে পড়েছিল।

.

.

কম্পাইলারঃ আহসান উল্লাহ

<৬,২৫,৫০-৫১>

.

শিরোনামঃ সম্পাদকীয়, বন্যা ও মুক্তিযুদ্ধ।

সংবাদপত্রঃ জয় বাংলা, ১ম বর্ষঃ ১৬শ সংখ্যা ।

তারিখঃ ২৭ আগস্ট, ১৯৭১।

.

সম্পাদকীয়ঃ বন্যা ও মুক্তিযুদ্ধ

.

বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। হানাদার বাহিনীর দখলীকৃত এক বিস্তীর্ণ এলাকা এখন পানির নিচে। বাংলাদেশের এটা সাম্বৎসরিক বন্যা। ১৯৫৫ সালে প্রথম প্রথম এই সর্বগ্রাসী বন্যার প্লাবন দেখা দেয় বাংলাদেশে। এখন এটা নিয়মিত মৌসুমি ব্যাপার। প্রথম প্রথম এক বছর বা দু বছর অন্তর এই বন্যা দেখা দিত। তারপর প্রতি বছর এমনকি বছরে একাধিকবার এই প্লাবনে বাংলাদেশের মানুষ সর্বস্বান্ত হচ্ছে। বন্যায় প্রতিবছর বাংলাদেশের ফসলের যে ক্ষতি হয় তার পরিমাণ দুশো কোটি টাকা। গবাদিপশু ও ঘরবাড়ির ক্ষয়ক্ষতির হিসাব এর মাঝে ধরা হয়নি। অবশ্য এই দুশো কোটি টাকাও ইসলামাবাদের মিথ্যাবাদী রাখাল বালকদের হিসাব। বন্যায় প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতির হিসাব এখন পর্যন্ত জানা যায়নি বা জানানোর চেষ্টা হয়নি। ইসলামাবাদের উপনিবেশিক শাসকেরা সবসময় এই খতির হিসাব চেপে রাখার চেষ্টা করেছেন।

.

বন্যায় বাংলাদেশের ক্ষয়ক্ষতি শুধু ফসল, গবাদিপশু বা ঘরবাড়ি সম্পত্তি ধ্বংস হওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এই ক্ষতির ধাক্কা যেমন পৌনঃপুনিক তেমন সুদূরপ্রসারী । এক বছরে একাধিকবার সর্বপ্লাবি বন্যা হওয়ার ফলে বাংলাদেশে খাদ্যঘাটতি একটা সংক্রামক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে।দুর্ভিক্ষাবস্থা বাংলাদেশে নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। বন্যার দরুন কৃষি সংস্কার ও অধিক খাদ্য ফলাও আন্দোলন কিছু মাত্র সফল হয়নি। ইসলামাবাদের শোষকচক্র বাংলাদেশকে হরিলুটের বাতাসার মত কেবল চোষণ করেছে, কিন্তু বন্যার প্রতিকার বা খাদ্য ঘাটতি দূর করার জন্য সবুজ বিপ্লব অনুষ্ঠানের কোন ব্যবস্থা করেননি। জাতিসংঘের পিয়ারসন কমিটির রিপোর্টেও অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় এই ব্যাপারে বলা হয়েছে যে বাংলাদেশে ভূমির উপর অত্যধিক চাপ হ্রাসের জন্য শক্তি চালিত পাম্প ও গভীর নলকূপের সাহায্যে সেচ ব্যবস্থা প্রবর্তন দ্বারা বহু আগেই বাংলাদেশে সবুজ বিপ্লব বা কৃষি উন্নয়নের ব্যবস্থা ত্বরান্বিত করা উচিৎ ছিল। কিন্তু বাংলাদেশে যা করা হয়নি তা করা হয়েছে পাকিস্তানের মরুভূমিতে। সেখানে গভীর নলকূপের সাহায্যে সেচ ব্যবস্থা প্রবর্তন করে গত চব্বিশ বছরে একটি খাদ্য ঘাটতি এলাকাকে খাদ্য উদ্বৃত্ত এলাকায় পরিণত করা হয়েছে। অন্যদিকে সেখানকার শিল্পোন্নতি তো রয়েছেই। বাংলাদেশে না হয়েছে শিল্পোন্নতি না হয়েছে সবুজ বিপ্লব। ফলে খাদ্যঘাটতি দুর্ভিক্ষ ও দারিদ্র্যের করালগ্রাসে বাংলাদেশ আজ সর্বনাশের শেষ প্রান্তে উপনীত। তারপর গোদের উপর বিষ ফোঁড়ার মত জুটেছে প্রতি বছরের বন্যা।

.

পিয়ারসন কমিটির এই রিপোর্টের বিবরণ প্রকাশিত হলে বাংলাদেশে রীতিমত চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। আজ ঢাকা শহরের যে দুটি বা তিনটি পত্রিকা হানাদার বাহিনীর পা চাটা দালালের ভূমিকা গ্রহণ করেছে মাত্র এক বছর আগে অর্থাৎ গত বছরের এই সময়ই তারাই পিয়ারসন কমিটির রিপোর্টের উদ্ধৃতি দিয়ে বাংলাদেশকে বঞ্চনা ও বাঙ্গালিদের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের বিশ্বাসঘাতকতার বিবরণ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করেছে এবং ইসলামাবাদ বাংলাদেশে উপনিবেশিক শাসন ও শোষণ চালাচ্ছে বলে অভিমত ও প্রকাশ করেছে।

.

বন্যা বাংলাদেশ ও বাঙ্গালির জীবন মরণ সমস্যা । বন্যা সমস্যার সমাধান না হলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিপর্যয় ও সামাজিক ধ্বংস রোধ করার দ্বিতীয় কোন উপায় নেই। কিন্তু গত ষোল বছর যাবৎ প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার শস্য নষ্ট, জীবন ও সম্পত্তির ক্ষতি হওয়ার পরও এই সমস্যার যে সমাধান হয়নি তার কারণ বাংলাদেশের উপর পশ্চিম পাকিস্তানি জঙ্গি চক্রের উপনিবেশিক শাসন । বাংলাদেশ ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি শকুনি চরিত্রের একদল মানবতাদ্রোহি শাসকের ও শোষণের লীলাক্ষেত্র । পাকিস্তানের পরিকল্পনা কমিশনের প্রাক্তন কর্তা এবং এখন যিনি জেনারেল ইয়াহিয়ার অর্থনৈতিক উপদেষ্টা সেই পাঞ্জাবি আমলা এম এম আহমদ এ যুগের শ্রেষ্ঠ প্রতারক ও জালিয়াত আখ্যালাভের যোগ্য। বাংলাদেশের উপার্জিত বৈদেশিক মুদ্রায় পশ্চিম পাকিস্তানের তারবেলা, মংলা বাধ পরিকল্পনা কার্যকরী হয়েছে পরিকল্পনা বহির্ভূত টাকায় জমির লবনাক্ততার সমস্যা মোচন করা সম্ভব হয়েছে, এমনকি বিনা প্রয়োজনে কয়েক হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে পাঞ্জাবের মরুভূমিতে ইসলামাবাদ নাম দিয়ে একটি নতুন রাজধানী তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। কেবল সম্ভব হয়নি ১৯৫৫ সালের পর বাংলাদেশের বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য পাঁচশো কোটি টাকার একটি প্রাথমিক পরিকল্পনা অর্থসংস্থান করা, বাংলাদেশের প্রস্তাবিত একমাত্র আণবিক চুল্লি রুপপুর কেন্দ্রের জন্য বৈদেশিক সাহায্য সংগ্রহ করা।

.

বছরের পর বছর যে মর্মজ্বালা বাঙ্গালিরা হাড়ে হাড়ে অনুভব করেছে তারই বহিঃপ্রকাশ আজকের মুক্তি সংগ্রাম। এবারেও বাংলাদেশেও দখলীকৃত বিস্তীর্ণ এলাকায় বন্যার ঢল নেমেছে এবং বিভিন্ন নদীতে পানির উচ্চতা বিপদসীমার দিকে দ্রুত এগিয়ে গেছে। কিন্তু এবারের বন্যা বাঙ্গালিদের জন্য যতই দুঃখ কষ্টের হোক, তারমধ্যে আশীর্বাদের অংশও কম নয়। বন্যার ফলে হানাদার বাহিনীর চলাচল এখন রুদ্ধ। তাদের ট্যাঙ্ক ও বিমান অকেজো হয়ে পরেছে । দখলীকৃত এলাকায় বাঙালি মুক্তিবাহিনী এই সুযোগে আগের চাইতেও তৎপর হয়েছেন। এই তৎপরতা আরও বাড়ানো হবে। শত্রুর উপর চূড়ান্ত আঘাত হানার সন্ধিক্ষণ দ্রুত এগিয়ে আসছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের বন্যা সমস্যার সমাধান বাংলাদেশের মানুষের সকল দুঃখকষ্টের অবসানের একমাত্র উপায় হল তার স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতাকে ত্বরান্বিত করাই আমাদের আজিকার একমাত্র কর্তব্য।

.

আহসান উল্লাহ

<৬,২৬,৫২-৫৩>

.

শিরোনাম: ভিয়েতনাম পদ্ধতিতে গণহত্যার জন্য ইয়াহিয়া খান বিশেষ জল্লাদ বাহিনী গড়ে তুলেছে।

সংবাদপত্রঃ জয়বাংলা (১ম বর্ষঃ ১৬শ সংখ্যা)

তারিখঃ ২৭ আগস্ট,১৯৭১।

সভ্য জগত থেকে বিচ্ছিন্ন  বেলুচিস্তানের কাকুনে বাংলাদেশে হত্যার জন্য বিশেষ জল্লাদ বাহিনী ট্রেনিং লাভ করেছে। এক ডজন আমেরিকান বিশেষজ্ঞ ইয়াহিয়ার স্পেশাল ফোর্স তৈরির কাজে ট্রেনিং দিচ্ছেন। দক্ষ হত্যাকারী গড়ে তোলার জন্য এই বিদেশী হত্যা বিশেষজ্ঞদের আমদানি করা হয়েছে উত্তর ক্যারোলিনা থেকে ।

.

যুগে যুগে যেসব জল্লাদ সম্রাট ও রাষ্ট্রনায়ক বিশ্বের বুকে তাণ্ডব সৃষ্টি করেছে, নৃশংস হত্যার স্বীকার সাধারণ মানুষের রক্ত দিয়ে বর্বর শাসনের ইমারত গাঁথুনি দিয়েছে পিণ্ডির ইয়াহিয়া তাদের সমগোত্রীয় ।অতীতের নির্যাতনকারী হত্যার নায়কদের ব্যতিক্রম তিনি নন। ২৫ মার্চের বহু পূর্বে থেকেই এই মানব সভ্যতা বিরোধী হত্যাবাজ জেনারেল অত্যাধুনিক পদ্ধতিতে গণহত্যার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ক্রমে ক্রমে রুদ্ধদ্বার ভেদ করে অবিশ্বাস্য হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনার সংবাদ প্রকাশ পাচ্ছে।

.

সব জানোয়ারকে যেমন পোষ মানানো যায় না,  তেমনি সব মানুষকে দিয়ে নিরীহ মানুষকে হত্যার জন্য ঝুঁকি নেওয়া সম্ভব না। সে জন্যই রক্ত পিপাসু ও পশু প্রকৃতির সেনাদের বাছাই করে হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্যে বাছাই করা হয়। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এদের বিশেষ ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করা হয়েছিল ।

.

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মুক্তিকামী ভিয়েতনামী নাগরিকদের বেছে বেছে হত্যা ও ধ্বংসের উদ্দেশ্যে যেমন করে গুপ্ত ট্রেনিং প্রাপ্ত একটি বাহিনী প্রেরণ করেছিল । যার নাম সরকারী ভাবে “গ্রিন ব্যারেট” । ইয়াহিয়া সরকারও ঠিক তেমনি করে গোপন ট্রেনিং দিয়ে একটি বিশেষ হত্যাকারী বাহিনী গড়ে তুলেছে। ব্যাপক গণহত্যা , বেছে বেছে জীবন নাশ, হিটলারের এস এস অফিসারদের পদ্ধতিতে নির্যাতন, ধ্বংস ও অগ্নিকান্ড সম্পর্কে এদের বিশেষজ্ঞ করে তোলা হয়েছে। জেনারেলদের ফাইলে একে “বিশেষ বাহিনী” বা স্পেশাল ফোর্স বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

.

বেলুচিস্তানের রাজধানী কোয়েটার কাছাকাছি অঞ্চলে যে স্থানটিতে ব্রিটিশ আমল থেকেই সামরিক ছাউনি রয়েছে তার নাম কাকুন। সাধারণ প্রশাসনিক কাজে কাকুন নামটির উল্লেখ থাকে না। এই বিশেষ ছাউনিতে সভ্য জগত থেকে বিচ্ছিন্ন এই নিচ্ছিদ্র কাকুনে বাংলাদেশে হত্যার জন্য বিশেষ জল্লাদ বাহিনী ট্রেনিং লাভ করে।

.

বিদেশী তথ্য অনুযায়ী, কাকুনে প্রায় এক ডজন আমেরিকান বিশেষজ্ঞ ইয়াহিয়ার স্পেশাল ফোর্স তৈরির কাজে ট্রেনিং দিচ্ছেন। দক্ষ হত্যাকারী গড়ে তোলাই এই বিদেশী বিশেষজ্ঞদের কাজ । বেতনভুক্ত এই হত্যা বিশেষজ্ঞদের আমদানি করা হয়েছে উত্তর ক্যারোলিনা থেকে।

.

আইয়ুব খাঁর আমলে ১৯৬৪ সাল থেকেই এই ধরনের একটা বিশেষ বাহিনী গঠনের চেষ্টা চলছিল। আর সে সময় জেনারেল মুসা আর বর্তমানে জেনারেল ইয়াহিয়া উক্ত বাহিনীর উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। প্রধানত পাঞ্জাবী ও আরও কয়েকটি রেজিমেন্ট থেকে বাছাই করা পাঁচ শত অস্বাভাবিক চরিত্রের সেনাকে পাঠানো হয় আমেরিকায় হত্যা বিশেষজ্ঞদের ট্রেনিং লাভ করতে। এই ব্যবস্থাকে এতই গোপন করা হয়েছিল যে , ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট দুরের কথা অধিকাংশ পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাপ্রধানও তা জানতেন না। এই সমস্ত হত্যা ও ধ্বংসের সেনাদের সমন্বয়ে যে হত্যাকারী নরপিশাচের দল গঠন করা হয় তার নাম “স্পেশাল ফোর্স” । দশজনের এক একটি দল করে তাদের পঞ্চাশটি গ্রুপে বিভক্ত করা হয়।

.

আমেরিকার উত্তর ক্যারলিনাস্থ “ফোট ব্র্যাগ” এ মার্কিন স্পেশাল ফোর্স ট্রেনিং ক্যাম্পটিতে এই ধরনের বিশেষ ট্রেনিং প্রাপ্ত হত্যা বাহিনী তৈরি করা হয়ে থেকে। ইয়াহিয়ার স্পেশাল ফোর্স প্রথমে “ফোট ব্র্যাগ” ক্যাম্পেই লালিত হয়েছে। বর্তমানে কোয়েটাস্থ “কাকুন” পশ্চিম পাকিস্তানী উন্মাদ জেনারেলদের “ ফোট ব্র্যাগ” আর কাকুন থেকে বিশেষভাবে শিক্ষা প্রাপ্ত হত্যাকারী বাহিনীই হচ্ছে তাদের “ গ্রিন ব্যারেট”।

.

জনৈক বিদেশী সাংবাদিকের তথ্য অনুযায়ী , অতিতে ও বর্তমানে ট্রেনিং-প্রাপ্ত হত্যা বিশেষজ্ঞগণ বাংলাদেশে নরহত্যা ও ধ্বংসের অবিশ্বাস্য অভিযানে যুক্ত রয়েছে। কাকুন গুপ্ত শিবিরে এদের তিন সপ্তাহ ট্রেনিং দেয়া হয়ে থাকে। ট্রেনিং-প্রাপ্ত জল্লাদদের সংখ্যা দিন দিন এতো বৃদ্ধি পাচ্ছে যে , ভবিষ্যতের দুর্যোগের কথা বিবেচনা করে পশ্চিম পাকিস্তানের কোন বিদ্রোহ স্থানে এদের পোস্ট করার ব্যবস্থা হয়েছে।

.

২৫ শের রাত্র থেকে মেজর জেনারেল মিঠার উপর দায়িত্ব পরেছিল ইয়াহিয়ার গেরিলা বাহিনীর। আর রক্ত পিপাসু স্পেশাল বাহিনী তারই সামগ্রিক নেতৃত্বের আওতায় আসে। এ রাত্র থেকে এবং পরবর্তী কালে এই বাহিনীই ইয়াহিয়ার গণহত্যার পরিকল্পনা কার্যকরী করেছে।

.

কিন্তু সেই স্পেশাল বাহিনীর রক্ত লালসা শেষ হবার পূর্বেই তারা নিজেদের রক্ত প্রবাহ দেখে আঁতকে উঠে । আর নিজের সঙ্গীর মৃত দেহের পাশে দাঁড়িয়ে শিউরে উঠেছে পরবর্তী ভয়াবহ মুহূর্তের কথা ভেবে।

.

ভিয়েতনামে যেমন গ্রিন ব্যারেট দের পালিয়ে যেতে হয়েছে , বাংলাদেশের মাটিতে ঠিক তেমনিভাবে ইয়াহিয়ার স্পেশাল বাহিনীকে বিলীন হয়ে যেতে হচ্ছে। নৃশংস হত্যা আর ধ্বংসের স্বীকার দেশপ্রেমিক সাধারণ নাগরিকদের প্রত্যেকটি রক্ত কণিকা থেকে আজ জন্ম নিচ্ছে মুক্তি সেনা। তাদের দুর্জয় অভিযানের মুখে , তাদের প্রতি আক্রমণের তীব্রতার ঝলকে হত্যাকারী হায়েনাদের জীবনে বিভীষিকার হাতছানি। মৃত্যু , উচ্ছেদ আর পরাজয়ের কালিমা তাদের আজ কলঙ্কিত ইতিহাসের ধিক্কৃত জীব বলে চিহ্নিত করেছে।

.

.

কম্পাইলারঃ জেসিকা গুলশান তোড়া

<৬,২৭,৫৪-৫৭>

শিরোনাম: বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছাই রাজনৈতিক সমাধানের বাস্তব ভিত্তি

সংবাদপত্রঃ জয় বাংলা ১ম বর্ষঃ ১৬শ সংখ্যা

তারিখঃ ২৭ আগস্ট, ১৯৭১

.

বাংলাদেশ ও বিশ্ববিবেক

বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছাই রাজনৈতিক সমাধানের বাস্তব ভিত্তি

হানাদারদের সামরিক সাহায্যদান অব্যাহত রেখে রাজনৈতিক সমাধান সম্ভব নয়

(রাজনৈতিক ভাষ্যকার)

.

পশ্চিম পাকিস্তানী ঘাতক ইয়াহিয়া ও তার জল্লাদ বাহিনীর বিরুদ্ধে বিশ্ববিবেক জাগ্রত ও সোচ্চার হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক আলোচনা চালানোর নামে ইয়াহিয়া খান ষোলই মার্চ থেকে পঁচিশে মার্চ পর্যন্ত টালবাহানা করে নিজের ঘাতক বাহিনীর শক্তিকে সংহত করেছে এবং নিঃসন্ধিগ্ধু ও নিরস্ত্র বাঙালী জনতার উপর আধুনিক মারণাস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার ব্লুপ্রিন্ট প্রস্তুত করেছে। তারপর ২৫শে মার্চের রাতে ভুট্টো আর ইয়াহিয়া খান গোপনে পালিয়ে যাবার পর মধ্য রাতে পূর্ণ সামরিক প্রস্তুতি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে নিরস্ত্র ঘুমন্ত নারী, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধ নির্বিশেষে বাঙালী জনসাধারণের ওপর।

.

বাংলাদেশের জাতীয় নেতৃত্ব গণতন্ত্র সম্মত নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বাঙালীর স্বাধিকার তথা দেশের রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করতে চেয়েছিল। কিন্তু ইয়াহিয়ার ঘাতক বাহিনী সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের পথ পরিত্যাগ করে সামরিক পশু শক্তির আশ্রয় গ্রহণ করেছিল।

.

বিশ্ববিবেক, বিশ্বের গণতন্ত্রীকামী মানুষ ইয়াহিয়ার পশুশক্তির বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রজনৈতিক নেতৃবৃন্দ একথা সুষ্পষ্টরুপে বুঝতে পারছে, ইসলামাবাদের শাসকচক্রের পক্ষে সামরিক পশুশক্তির সাহায্যে বাংলাদেশ সমস্যার কোন সমাধান সম্ভব নয়।

.

আর সেই জন্যেই জনৈক সাংবাদিক ও সাহিত্যিক সক্ষোভে প্রশ্ন করেছেনঃ সাম্রাজ্যবাদকে ‘মানবতাবোধ সম্পন্ন’ করতে সমর্থ হবার পূর্বে আরও কত নিখুঁত মানুষকে ‘শান্তিপূর্ণ’ এবং ‘অহিংসভাবে’ মৃত্যুবরণ করতে হবে? ‘অহিংস’ মৃত্যু কি সম্ভব? এই ক্ষোভ এ ক্ষণে সারা পৃথিবীতেই ধ্বনিত হচ্ছে।

.

রাজনৈতিক সমাধান

সম্প্রতি বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশ ও পাকিস্তান সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের ওপরে  জোর দিচ্ছেন। তাঁরা মনে করছেন যে, অবিলম্বে বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান না হলে পরিস্থিতির গুরুতর অবনতি ঘটবে এবং তার প্রতিক্রিয়া পড়বে সারা বিশ্বের ওপরে।

.

এডওয়ার্ড কেনেডির মন্তব্য

সম্প্রতি মার্কিন সিনেটের উদবাস্তু বিষয়ক সাব-কমিটির প্রেসিডেন্ট সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরার শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করে স্বদেশে ফিরে গিয়েছেন। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পূর্বে নয়াদিল্লীতে তিনি মন্তব্য করেন যে প্রকৃত অবস্থা দেখার পর তাঁর ধারণা হয়েছে যে, একমাত্র রাজনৈতিক পথেই বাংলাদেশ সংকটের সমাধান হতে পারে এবং রাজনৈতিক আলোচনা শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গেই হতে হবে। তিনি পূর্বাহ্নে এমন একটি ধারণাও দিয়েছিলেন যে, বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান সম্পর্কে তাঁর মনে একটি প্রস্তাব রয়েছে। কিন্তু সেই প্রস্তাব সম্পর্কে তিনি সেই মুহূর্তে কিছু জানাতে অস্বীকার করেন।

.

পূর্ব জার্মানীর অভিমত

পূর্ব জার্মানীর তিন সদস্য বিশিষ্ট সংসদীয় প্রতিনিধিদল পশ্চিমবঙ্গের শরণার্থী শিবিরগুলো দেখার পর নয়াদিল্লীতে গত ২১শে আগস্ট এক সাংবাদিক সম্মেলনে মন্তব্য করেছেন, “এশিয়া তথা বিশ্বের শান্তি ও নিরাপত্তা অক্ষুন্ন রাখতে হলে বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান একান্ত প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি। “

.

পশ্চিম জার্মানী

অপরদিকে নয়াদিল্লীর দূতাবাসে পশ্চিম জার্মানীর নবনিযুক্ত মন্ত্রী মিঃ ডবল্যু বেহরেম্ভস পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তে বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থীদের শিবির পরিদর্শন করার পর সাংবাদিকদের কাছে মন্তব্য করেছেন যে, শরণার্থীরা যাতে স্বদেশে ফিরে যেতে পারেন সেজন্যে সেখানে উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হোক, এটাই তাঁর দেশের কাম্য এবং সে জন্যে একটা রাজনৈতিক সমাধান প্রয়োজন।

.

সমাধান কোন পথে?

সকলেই বাংলাদেশ সংকটের রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলেছেন। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পরিবর্তে রাজনৈতিক পথে এই প্রশ্নের যদি মীমাংসা করা সম্ভব হয় তাহলে আপত্তির কি থাকতে পারে। কিন্তু এই রাজনৈতিক সমাধানের রুপ কি হবে এবং কোন পথে এই সমাধানকে ফলপ্রসূ করা সম্ভব হবে তা কেউই খোলাখুলি বলছেন না।

.

হানাদার বাহিনীর প্রত্যাহার চাই

সিনেটর কেনেডি গণতান্ত্রিক ও মানবতাবাদী ভূমিকার জন্য বিশ্বের গণতন্ত্রবাদী ও শান্তিকামী মানুষের অকুন্ঠ শ্রদ্ধা ও অভিনন্দন লাভ করেছেন। তিনি নিজেই একটা কথা স্বীকার করেছেন যে পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী বাংলার মাটিতে থাকা পর্যন্ত একজন শরণার্থীও স্বদেশে ফিরে যাবে না বরং আগামী কয়েক মাসের মধ্যে শরণার্থীর সংখ্যা এক কোটি বিশ লক্ষে দাঁড়াবে। আমাদের ব্যক্তিগত ধারণা সিনেটর কেনেডি সংখ্যাটা অনেক কমিয়ে বলেছেন। তবে তাঁর কথা অনুযায়ী বলা যায় যে, পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী বাংলাদেশে এমন একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে যে, সেখানে মানুষের পক্ষে নিশ্চিন্তে নিরাপদে বাস করা সম্ভব নয়। তারা দেশে সামান্যতম স্বাভাবিক অবস্থাও ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হয়েছে। অর্থাৎ বৈদেশিক হানাদার বাহিনীর চরিত্র তারা কোন ক্রমেই চাপা দিতে পারছে না। সেখানকার অবস্থাটা যে খুবই অবনত তার প্রমাণ পাওয়া যায়, পশ্চিম পাকিস্তানী সরকার কর্তৃক শেষ মুহূর্তে আকস্মিকভাবে বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকায় সিনেটর কেনেডির সফরের অনুমতি বাতিল করার ভেতর দিয়ে।

.

‘অপারেশন ওমেগার’ লাঞ্চনা

বৃটিশ ও মার্কিন নাগরিক সমবায়ে গঠিত ‘অপারেশন ওমেগার’ নামে একটি সেবা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকায় দুস্থ মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় রিলিফ সামগ্রী বিতরণের উদ্দেশ্যে বেনাপোলের পথে বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকায় প্রবেশ করেছিল। কিন্তু পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী তাদের বাধা দেয় এবং ত্রাণ সামগ্রীসহ পুনরায় মুক্ত এলাকায় ফিরে আসতে বাধ্য করে। এই প্রতিষ্ঠানের সদস্য ও সদস্যগণ  মানবতার নামে এবং মানবাধিকারের দাবীতে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ অধিকার দাবী করেছিল। কিন্তু জল্লাদ হানাদার বাহিনীর কাছে মানবতা বা মানবাধিকারের বানী অর্থহীন শব্দ মাত্র। অথচ এই হানাদার সামরিক জান্তাই বিশ্বের কাছে দখলীকৃত এলাকার দুর্গত মানুষের ত্রাণ কার্যের জন্য সাহায্য চেয়ে পাঠাচ্ছে।

.

আসলে তা বাঙালীদের ত্রাণ কার্যের জন্যে নয়, তাদের ভেঙ্গে পড়া অর্থনীতিকে কোন রকমে টিকিয়ে রাখার এবং ঘাতক সৈন্যদের জন্যে রসদের সরবরাহ অব্যাহত রাখার উদ্দেশ্যেই এই সাহায্যের আবেদন জানানো হচ্ছে। তা নইলে ‘অপারেশন ওমেগার’ সদস্যদের সাহায্য সম্ভার দুস্থ মানুষদের মধ্যে বিতরণ করতে না দেয়ার কোন কারণ থাকতে পারেনা।

.

যারা সত্য-সত্যই বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমাধান কামনা করেন, তাঁরা এটাও জানেন যে, একমাত্র বাংলাদেশের জাতীয় নেতৃত্বের সঙ্গেই রাজনৈতিক সমাধান সম্ভব। তাঁরা এও জানেন যে, পঁচিশে মার্চের রাতেই ইয়াহিয়ার সামরিক চক্র সেই সমাধানের সকল পথ রুদ্ধ করে দিয়েছে।

.

শুধু মুখের কথায় একটা সামরিক জান্তাকে রাজনৈতিক সমাধানের পথে আনা সম্ভব নয়, তাদের রাজনৈতিক সমাধানের পথে আনতে বাধ্য করতে হবে। ভাল কথায় তাদের মনে শুভ বুদ্ধির উদয় হবেনা।  সিনেটর কেনেডি নিজেই বলেছেন যে, পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত অবস্থায় প্রতিবেশী বন্ধুরাষ্ট্রে আশ্রয় গ্রহণকারী শরণার্থীরা কিছুতেই স্বদেশে ফিরতে প্রস্তুত নয়, এ কথাটা তিনি উপলব্ধি করতে সমর্থ হয়েছেন। তাহলে এই সমস্যার সমাধান যে কি তাও তিনি নিজে উপলব্ধি করতে পেরেছেন।

.

তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন যে, এই সমাধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর রাজনৈতিক দলের সঙ্গে করতে হবে।

.

পূর্ব জার্মানীর প্রতিনিধি দলও বলেছেন যে, রাজনৈতিক সমাধান সেখানকার জনগণের ইচ্ছা অনুযায়ী হতে হবে। বাংলাদেশের নির্বাচন, আশি লক্ষ শরণার্থীর প্রতিবেশী রাষ্ট্রে আশ্রয় গ্রহণ ও আরও  সমপরিমাণ শরণার্থীর আগমন সম্ভাবনা এবং গণ প্রতিনিধিদের অভিমত থেকে জনগণের ইচ্ছা যে কি তা বুঝতে কারও অসুবিধা হবার কথা নয়। আরও অস্ত্রশস্ত্র ও রসদ দিয়ে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে তাদের ঘাতক বৃত্তিতে উৎসাহ দান করলে কোন ক্রমেই বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছা অনুযায়ী রাজনৈতিক সমাধান করা যাবে না। সত্য সত্যই রাজনৈতিক সমাধান করতে হলে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্যদান বন্ধ করতে হবে। অথচ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই হানাদার বাহিনীকে সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্যদান করে রাজনৈতিক সমাধানের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করছে।

.

দায়িত্বজ্ঞানহীন ও নৈতিকতা বিরোধী

এককালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আন্ডার সেক্রেটারী অব স্টেট ও ভারতে নিযুক্ত প্রাক্তন মার্কিন রাষ্ট্রদূত মিঃ চেস্টার বোনস মন্তব্য করতে বাধ্য হয়েছেন যে, পাকিস্তানে অব্যাহত মার্কিন সাহায্য ‘দাবিত্বজ্ঞানহীন’ ও নীতিবিগর্হিত। ভ্রান্ত মার্কিন নীতি সংশোধন করে তিনি সামরিক সাহায্যদানের পরিবর্তে শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে আলোচনায় প্রবৃত্ত হবার জন্যে ইয়াহিয়ার উপর চাপ সৃষ্টির পরামর্শ দিয়েছেন।

.

সিনেটর কেনেডির রাজনৈতিক সমাধানের রুপরেখা আমাদের জানা নেই। কিন্তু প্রকৃত পরিস্থিতি তিনি নিজেই উপলব্ধি করতে পেরেছেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর রাজনৈতিক সমাধানের ফর্মুলা উদ্ভাবন করতে হবে।

.

পাকিস্তানের রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্যে এই সমাধানের যে সম্ভাবনা ২৫শে মার্চের পূর্বে ছিল, ২৫শে মার্চের মধ্য রাতেই সে সম্ভাবনাকে পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী সম্পূর্ণ নস্যাৎ করে দিয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানের ন্যাপ নেতা ওয়ালী খানও সম্প্রতি কাবুলে এক সাংবাদিক সাক্ষাৎকারে এই সত্য স্বীকার করেছেন।

.

বিশ্বের বৃহৎ শক্তিপুঞ্জে তাদের প্রভাব বলয়ের ক্ষেত্র সম্প্রসারিত করার উদ্দেশ্যে এই সত্যটির প্রতি যদি উদাসীন থাকেন তা হলে বিশ্বের একটা মৌলিক ও শাশ্বত সত্যের প্রতিই মুখ ফিরিয়ে থাকা হবে। সেই সত্যটি হচ্ছেঃ পৃথিবী কোথাও কখনও জাতীয় মুক্তি সংগ্রামকে শেষ পর্যন্ত কেউই ব্যর্থ করতে পারেনি। জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম চিরকাল জয়লাভ করেছে।

.

যারা আজ বাংলাদেশ সংকটের রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলেছেন তাদের এই সত্যটি সম্পর্কে পুরোপুরি অবহিত থাকতে হবে। হানাদার বাহিনীকে অস্ত্র, রসদ ও অর্থনৈতিক সাহায্যদান অব্যাহত রেখে রাজনৈতিক সমাধান সম্ভব নয়। সিনেটর কেনেডির এ ব্যাপারে বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে। মার্কিন জনগণের মধ্যে তাঁর প্রভাব অনস্বীকার্য। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্যদান যে বাংলাদেশের সংকটকে দীর্ঘস্থায়ী করা এবং রাজনৈতিক সমাধানের পথে পর্বত প্রমাণ অন্তরায় সৃষ্টি করা, মার্কিন জনগণের কাছে এই সত্যটাকেই তুলে ধরতে হবে।

.

‘আমরাও একা নই’ বলে ইয়াহিয়া খান যে সামরিক দম্ভোক্তি করেছে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের প্রেক্ষিতে এই দম্ভোক্তি যাদের সমর্থনের কথা ভেবে করা হয়েছে, তাদের জন্যে মোটেও শ্লাঘার বিষয় নয়, মার্কিন জনগণ ও মার্কিন সরকারের কাছে এ কথাও সিনেটর কেনেডিকেই পৌঁছে দিতে হবে। শরণার্থী শিবিরগুলো পরিদর্শনের এবং পাকিস্তানী সামরিক জান্তা কর্তৃক দখলীকৃত বাংলাদেশে তার সফরের অনুমতি বাতিলের পর, এই দায়িত্ব তাঁর ওপর বিশেষভাবে বর্তেছে।

.

চারটি প্রশ্ন

বাংলাদেশ সমস্যা সম্পর্কে সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী চারটি মৌলিক প্রশ্নের প্রতি বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তিনি প্রশ্ন করেছেনঃ সাড়ে সাত কোটি মানুষের বাঁচার অধিকার আছে কি না? সংখ্যাগরিষ্ঠরা কি সংখ্যালঘুদের দ্বারা নিপীড়িত হতে থাকবেন? এই সংখ্যালঘুরাই কি সংখ্যাগরিষ্ঠদের দাবিয়ে রাখার জন্যে অন্যান্য দেশ থেকে অস্ত্র আমদানী করে চলবেন?

.

তিনি চান যে, প্রতিটি রাষ্ট্র উপরোক্ত প্রশ্নগুলো নিয়ে চিন্তা করুন এবং উত্তর দিন।

.

যারা আজ রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলেছেন, তাদের আন্তরিকতা কতটুকু তার বিচার হবে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর উপরোক্ত প্রশ্নের কার্যকরী উত্তরের ওপর।

.

.

জেসিকা গুলশান তোড়া

<৬,২৮,৫৮>

.

সম্পাদকীয়ঃ সর্বদলীয় উপদেষ্টা কমিটি

সংবাদপত্রঃ জয় বাংলা ১ম বর্ষঃ ১৯শ সংখ্যা,

তারিখঃ ১৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

.

সর্বদলীয় উপদেষ্টা কমিটি

.

বর্তমান মুক্তিযুদ্ধকে সফল সমাপ্তির পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজে গণপ্রজাতন্ত্রী সরকারকে উপদেশ দানের জন্য বাংলাদেশের চারটি প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে যে উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হয়েছে, তার খবর দেশ-বিদেশের সংবাদপত্রে ইতিমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে এবং এ সম্পর্কে অনেক উৎসাহী আলোচনাও মুদ্রিত হয়েছে। বস্তুতঃ এই সর্বদলীয় কমিটি গঠিত হওয়ায় জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে জাতির যে নিবিড় ও অটুট ঐক্য আরেকবার প্রমাণিত হল, তাতে বাংলাদেশের ভিতরে মুক্তিসংগ্রামীরা যেমন অনুপ্রাণিত হবেন, তেমনি বাইরে বাংলাদেশের শুভাকাঙ্ক্ষী ও বন্ধু দেশগুলোও উৎসাহী হবেন। বস্তুতঃ এই উপদেষ্টা কমিটি গঠনের গুরুত্ব এইখানেই যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অনৈক্য সৃষ্টির জন্য সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত এবং উগ্র তত্ত্বসর্বস্বদের সুবিধাবাদী ভেদনীতি অঙ্কুরেই বিনষ্ট হল এবং জাতীয় স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের লক্ষে অবিচল চারটি প্রগতিশীল দল বাংলাদেশের জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিত্বশীল সরকারের প্রতি তাদের ঘোষিত সমর্থন আরো কার্যকর ও সক্রিয় করে তুলবেন। এই ব্যাপারে এই দলগুলোর ভূমিকার যেমন প্রশংসা করতে হয়, তেমনি প্রশংসা করতে হয় আওয়ামী লীগেরও। আওয়ামী লীগ সাধারণ নির্বাচনে বাংলাদেশের প্রায় শতকরা নিরানব্বইটি আসনে জয়লাভ করে জাতিকে নেতৃত্ব দানের অবিসম্বাদিত অধিকার লাভ করা সত্ত্বেও মুক্তিসংগ্রাম পরিচালনার অন্যান্য প্রগতিশীল দলের সমর্থন ও উপদেশ গ্রহণের সিদ্ধান্ত দ্বারা দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে জাতীয় স্বার্থের প্রতি তাদের আনুগত্য বলিষ্ঠভাবে প্রমাণ করছেন।

.

সর্বদলীয় উপদেষ্টা কমিটিতে যারা রয়েছেন, তাদের রাজনৈতিক মত ও পথে পার্থক্য থাকলেও সকলেই পরীক্ষিত দেশপ্রেমিক। কমিটিতে ভাসানী ন্যাপের প্রতিনিধিত্ব করছেন মাওলানা ভাসানী, বাংলাদেশ কম্যুনিস্ট পার্টির প্রতিনিধিত্ব করছেন মণি সিং, বাংলাদেশ জাতীয় কংগ্রেসের শ্রী মনোরঞ্জন ধর এবং মোজাফফর ন্যাপের অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ। এ ছাড়া এই কমিটিতে আওয়ামী লীগের দুজন সদস্যকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী এই কমিটিতে রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী কমিটির বৈঠক আহবান ও পরিচালনা করবেন।

.

মুজিব নগরে অনুষ্ঠিত এই উপদেষ্টা কমিটির প্রথম কমিটির প্রথম বৈঠকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারই যে বাংলাদেশের একমাত্র বৈধ সরকার এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাংলাদেশের অবিসম্বাদিত জাতীয় নেতা এ সত্যটির অকুণ্ঠ অভিব্যক্তি দেখা গেছে। জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গি এই সমঝোতা ও অভিন্নতা একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।

.

বাংলাদেশের গণপ্রজাতন্ত্রী সরকার এবং এই সর্বদলীয় উপদেষ্টা কমিটির মধ্যে স্বাভাবিক চরিত্রগত পার্থক্য রয়েছে, কিন্তু রয়েছে উদ্দেশ্য ও লক্ষগত ঐক্য। এই লক্ষ হল বাংলাদেশের পূর্ণ জাতীয় স্বাধীনতা। চরিত্রগত পার্থক্যের ক্ষেত্রে বলা চলে, গণপ্রজাতন্ত্রী সরকার জনগণের ভোটে নির্বাচিত একমাত্র সংস্থা। জনগণের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ও তা কার্যকর করার সম্পূর্ণ এখতিয়ার তার। অন্যদিকে জনগণের পক্ষ থেকে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তা কার্যকর করার ব্যাপারে সাহায্য ও সুপরামর্শ দান হবে উপদেষ্টা কমিটির কাজ। তাই এই উপদেষ্টা কমিটি গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ দ্বারা গণপ্রজাতন্ত্রী সরকার মুক্তিযুদ্ধকে জোরদার করার কাজে একটি বলিষ্ঠ ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিয়েছেন বলা চলে। এই ব্যবস্থার ফলে বাংলাদেশের সকল এলাকার স্বাধীনতা এবং হানাদার দস্যুদের চূড়ান্ত পরাজয়ের দিনটি অবশ্যই ত্বরান্বিত হবে।

.

.

কম্পাইলারঃ রবিউল হাসান সিফাত
<৬,২৯,৫৯-৬০>

শিরোনাম সংবাদপত্র তারিখ
সেই পুরাতন খেলা
(সামরিক জান্তা কতৃক একজন অসামরিক ব্যক্তিকে বাংলাদেশের গভর্নর পদে নিয়োগ প্রসঙ্গে)
জয় বাংলা
১ম বর্ষঃ ১৯শ সংখ্যা
১৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

সেই পুরাতন খেলা

বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকায় একটি নতুন নাটকের অভিনয় চলছে। নাটকটি যদিও নতুন কিন্তু তার বিষয়বস্তু অত্যন্ত পুরনো। এই বিষয়বস্তু হল, একজন অসামরিক তাঁবেদার বাঙ্গালীকে গভর্নরের পদে বসিয়ে বিশ্ববাসীকে বোঝানো, বাংলাদেশে আর সামরিক শাসন নেই। এমন চেষ্টা আইয়ুব খাঁও করেছিলেন। তার দশ বছরের স্বৈরাচারী শাসনে মোনেম খাঁ নামক এক বটতলার উকিলকে গভর্নরের পদে বসিয়ে দুনিয়ার মানুষকে বোঝাতে চেয়েছিলেন, বাংলাদেশ বাঙ্গালীদের দ্বারা শাসিত হচ্ছে। মোনেম খার বদলে এবার ভাড়া পাওয়া গেছে আবদুল মোতালিব নামক এক দাঁতের ডাক্তারকে।

*

ঢাকার লাটভবনে শুধু তাঁবেদার গভর্নর বসিয়ে নয়, পিণ্ডির জঙ্গীচক্র বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকার আসল অবস্থা সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে বিভ্রান্ত করার জন্য আরো ছল চাতুরীর আশ্রয় নিচ্ছে। হঠাৎ খুনি ইয়াহিয়া একেবারে “মহানুভব” ব্যক্তি সেজেছেন এবং তাদের কথিত এক শ্রেণীর “রাষ্ট্রবিরোধী” বাঙ্গালীর প্রতি সাধারণ অনুকম্পা ও ঘোষণা করেছেন। দখলীকৃত ঢাকা বেতার থেকে বলা হয়েছে, কিছুসংখ্যক আটক লোককে নাকি জেল থেকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। কিন্তু এই কিছুসংখ্যক লোক কারা, তাদের নাম ধাম কি, তা কিছু বেতার ঘোষণায় বলা হয়নি। সুতরাং আশঙ্কা হয় শিয়ালের কুমীর ছানা প্রদর্শনের মত এই ‘ক্ষমা প্রদর্শনের’ মহড়াটিও জঙ্গীচক্রের কোন নতুন শয়তানি অভিসন্ধির বহিঃপ্রকাশ কিনা।

*

এইদিকে এইসব লোক দেখানো ভড়ং, অন্যদিকে দখলীকৃত বাংলাদেশে পাকিস্তানী হানাদার সৈন্যদের বর্বরতা অব্যাহত রাখা হয়েছে। এখনো বাঙ্গালী মেয়েদের ইজ্জত নাশ করা হচ্ছে এবং এক একজন অশিক্ষিত সেপাইকে বাঙ্গালী মেয়েদের বলপূর্বক পত্নী (উপপত্নী) হিসাবে গ্রহণে উৎসাহ জোগানো হচ্ছে। দখলীকৃত এলাকায় এখনো চলছে গ্রামের পর গ্রাম লুণ্ঠন, হত্যা ও অগ্ন্যুৎসব। দখলীকৃত এলাকায় বাঙ্গালীদের এই অবস্থা। বিদেশেও তাদের সঙ্গে একই আচরণ করা হচ্ছে। ইয়াহিয়া চক্র বুঝতে পেরেছে, তাদের বিদেশী দূতাবাসে যেসব বাঙ্গালী কর্মচারী রয়েছে, তাদের কেউ আর পিণ্ডির খুনীচক্রের প্রতি অনুগত নয়। তারা স্বাভাবিকভাবেই স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারের প্রতি আনুগত্য পোষণ করেন এবং সুযোগ পেলেই তা ঘোষণা করবেন। গত পাঁচ মাসে বহু বাঙ্গালী কূটনীতিবিদ ও দূতাবাস কর্মচারী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি তাদের আনুগত্য ঘোষণা করে বহির্বিশ্বে ইয়াহিয়া চক্রের মিথ্যা প্রচারণার বেলুন ফুটো করে দিয়েছেন। শঙ্কিত ইয়াহিয়া চক্র তাই অবশিষ্ট বাঙ্গালী কর্মচারীদের আটকানোর জন্য তাদের পাসপোর্ট আটকের আদেশ দিয়েছেন। যদিও নির্দেশে বলা হয়েছে, এই আদেশ সকল দূতাবাস কর্মচারীদের বেলাতেই প্রযোজ্য, কিন্তু কাজের বেলায় বেছে বেছে যে কেবল বাঙ্গালী কর্মচারীদের পাসপোর্টই আটক করা হচ্ছে, বিশ্ববাসীর সে খবর জানতেও আর দেরী হয়নি।

*

দেশ-বিদেশে এই বাঙ্গালী নিধন ও বাঙ্গালী-বিতাড়ন নীতি অব্যাহত রেখেও ইয়াহিয়া চক্র ঢাকায় কেন এক বিশ্বাসঘাতক বাঙ্গালীকে তাঁবেদার হিসাবে লাটের গদিতে বসিয়ে এই অসামরিক শাসনের ভড়ং দেখাচ্ছে? এই প্রশ্নটির জবাব বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমেদ গত ৫ই সেপ্টেম্বর রাত্রে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত তার ভাষণে দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, “জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন আসন্ন হওয়ায় পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শাসকগোষ্ঠী বাংলাদেশে অসামরিক শাসন পুনঃপ্রবর্তনের ভাব সৃষ্টির একটা কৌশল অবলম্বন করেছে। প্রধানমন্ত্রী আরো বলেছেন, ইয়াহিয়া ঘৃণ্য টিক্কা খার স্থলে একজন অসামরিক সাক্ষী গোপালকে বসিয়েছেন এবং জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন মুষ্টিমেয় হতাশ বাঙ্গালীকে পাকিস্তানের প্রতিনিধি করে জাতিসংঘে পাঠাবার চেষ্টা করছেন এ সবই ওই একই কৌশলের অঙ্গ। অর্থাৎ বাংলাদেশে যে সামরিক আইন, গণহত্যা ও দমননীতি অব্যাহত রয়েছে, এই নগ্নসত্য গোপন করার চেষ্টা।

*

কিন্তু পিণ্ডির খুনি চক্রের এই সত্য গোপন করার চেষ্টা সফল হয়নি। তাই বাংলাদেশে একজন তাঁবেদার গভর্নর নিয়োগ সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের ‘নিউইয়র্ক পোষ্ট’ পত্রিকা স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ‘বাংলাদেশে গভর্নর হওয়ার কোন যোগ্যতা এই লোকটির নেই। বাংলাদেশ সম্পর্কে ব্যবস্থা গ্রহণের একমাত্র অধিকার রয়েছে জনগণের নির্বাচিত নেতা শেখ মুজিবের।‘ নেদারল্যান্ডের একজন প্রভাবশালী পার্লামেন্ট সদস্য ডাঃ মালিককে বাংলার দখলীকৃত এলাকার গভর্নর নিয়োগ করা সম্পর্কে বলেছে ‘এটা ঔপনিবেশিক ধরনের নিয়োগ।‘ বস্তুত ইয়াহিয়া চক্র যতই চেষ্টা করুন, বিশ্ববাসীকে বিভ্রান্ত করা তাদের চোখে ধুলা নিক্ষেপের কোন চেষ্টাই সফল হবে না। বাংলাদেশের মানুষ আর ইয়াহিয়া চক্রের দাসত্ব স্বীকার করবে না। বরং মুক্তিবাহিনী অস্ত্রের মুখেই ইয়াহিয়ার এই নব-নাট্যাভিনয়ে সকল ভাঁড়ামির অবসান ঘটাবে।

.

রবিউল হাসান সিফাত

<৬,৩০,৬১-৬১>

শিরোনামঃ জল্লাদরা ত্রাণ সামগ্রী যুদ্ধের কাজে লাগাচ্ছে

সংবাদপত্রঃ জয় বাংলা(১ম বর্ষঃ ১৯শ সংখ্যা )

তারিখঃ ১৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

.

পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক শাসক গোষ্ঠী ইউনিসেফ এবং জাতিসংঘের অপরাপর ত্রাণ প্রতিষ্ঠানসমূহের যাবতীয় গাড়ি ও যানবাহন যুদ্ধের কাজে ব্যাবহার করছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার লন্ডনস্থ মিশনের মাধ্যমে জাতিসংঘকে একথা জানিয়ে দিয়েছে।

*

জাতিসংঘের সাহায্য সংস্থা ইউনিসেফ এর একটি জীপে টিক্কা খানকে দেখা গেছে।

*

১৯৭০ সালের ভয়াবহ বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের সাহায্যের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র বিপন্ন মানবতার সেবায় যেসব ত্রাণ সামগ্রী পাঠিয়েছিল, সেগুলোও সামরিক শাসকেরা যুদ্ধের কাজে ব্যবহার করছে। দ্রুত রিলিফ প্রেরণের জন্য যাতায়াতের সুবিধার্থে নরওয়ে এবং স্ক্যান্ডিনেভিয়ার অন্যান্য রাষ্ট্র যে সব রবারের নৌকা, দ্রুতগামী লঞ্চ পাঠিয়েছিল, সেগুলোও ঐ একই কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে।

*

সম্প্রতি খুলনার নিকটে একটি সংঘর্ষে মুক্তিবাহিনী পাক সেনাবাহিনীর কাছ একটি গানবোট দখল করেন। পরে মুক্তিবাহিনী দেখে আশ্চর্য হন যে ওটা ঘুর্ণিদুর্গতদের সাহায্যে বিতরণের কাজে ব্যবহারের জন্য নরওয়ে প্রেরিত নৌ যানগুলোর অন্যতম। শুধু যানবাহনই নয়, ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত বাঙ্গালীর জন্য প্রেরিত খাদ্যদ্রব্য এবং কাপড়-চোপড় পাক সেনাবাহিনী নিজেরাই ব্যবহার করছে। সম্প্রতি পশ্চিম রণাঙ্গনে নিহত শত্রুসেনাদের কাছে টিনে ভর্তি খাবার পাওয়া গেছে। টিনের উপরের ছাপ এবং লেখা থেকে দেখা যায় যে, এগুলোও বন্যা ও ঘূর্ণিঝড় দুর্গতদের রিলিফের জন্য প্রেরিত জিনিস। এমনকি, শরণার্থীদের জন্য প্রেরিত খাদ্যদ্রব্যও হানাদার বাহিনীর ‘রেশন’ দ্রব্যে পরিণত হয়েছে।

*

জানা গেছে, ভারতসহ ইউরোপের তিনটি রাষ্ট্র জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল উথাল্টকে পাকিস্তানে জাতিসংঘের সাহায্য বন্ধ করে দেয়ার জন্য অনুরোধ করেছে।

.

রবিউল হাসান সিফাত

<৬,৩১,৬২-৬৩>

শিরোনামঃ সম্পাদকীয়: ইয়াহিয়ার ইরান সফর

সংবাদপত্রঃ জয় বাংলা ১ম বর্ষঃ ২০শ সংখ্যা

তারিখঃ ২৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

ইয়াহিয়ার ইরান সফর

একদিনের জন্য ইয়াহিয়া খানের আকস্মিক ইরান সফর সম্পর্কে পর্যবেক্ষক মহলের মধ্যে জল্পনা শুরু হয়েছে। ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক সৌহার্দ্যমূলক। পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তা বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক সংকটের বেড়াজালে আটকা পড়েছে। বাংলাদেশের মানুষ পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে মরণপণ সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে। মুক্তিবাহিনীর হাতে প্রচন্ড মার খাচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানের জল্লাদ বাহিনী অপরদিকে যুদ্ধপরিস্থিতির দরুন এবং ঘাতক বাহিনীর নৃশংস অত্যাচারের ফলে দখলীকৃত বাংলাদেশে অস্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে। মুক্তিবাহিনীর তৎপরতায় বিব্রত সামরিক কলকারখানা, ব্যবসা বাণিজ্য প্রভৃতি অর্থনৈতিক কাজকর্ম চালু করতে ব্যর্থ হয়েছে। এর ফলে পাকিস্তানের অর্থনীতি সম্পূর্ণভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। অপরদিকে জনগণের প্রতিনিধিদের হাতে সত্যিকারের রাজনৈতিক ক্ষমতা ফিরিয়ে দেয়ার সম্ভাবনা সুদূর পরাহত হওয়ায় খাস পশ্চিম পাকিস্তানেও রাজনৈতিক সংকট ঘনীভূত হয়ে উঠেছে। পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর বর্বর অত্যাচারের সাক্ষী ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী বাংলাদেশের ৮৫ লক্ষ শরণার্থী। এই বিপুলসংখ্যক শরণার্থীর জন্যে বিশ্বের কাছে পাকিস্তানের মুখ রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না, তাদের কৈফিয়তও খাটছে না। এইভাবেই তৈরী হয়েছে তাদের সংকটের বেড়াজাল।

*

এই সংকটের জাল এড়াবার জন্য পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে ইরানের হৃদ্যতামূলক সম্পর্কের সুযোগে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে ইরানকে মধ্যস্থতার ভূমিকায় অবতীর্ণ করাতে যায়। বাংলাদেশ সমস্যাকে পাক-ভারতের মধ্যে ইরানকে মধ্যস্থতার ভূমিকায় অবতীর্ণ করাতে চায়। বাংলাদেশ সমস্যাকে এড়িয়ে বর্তমান সমস্যাকে পাক-ভারত বিরোধের রুপ দেয়ার এই পাকিস্তানী আগ্রহ নতুন নয়। বাংলাদেশে সামরিক এডভেঞ্চার শুরু করার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই তারা নিজেদের সৃষ্ট সংকটের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরেছিল। তারপর থেকেই ইয়াহিয়ার সরকার বিশ্বের বিভিন্ন দেশে একজন মধ্যস্থ খুঁজে বেড়াচ্ছে । ইতিপূর্বে আমরা মধ্যস্থ হিসেবে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়ার টেংকু আব্দুর রহমান প্রভৃতির নাম শুনেছি। আবার বাংলাদেশ ও ভারত সীমান্তে পর্যবেক্ষক বাহিনী মোতায়েন করে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের বিরোধকে পাক-ভারত বিরোধ রূপান্তরিত করার প্রয়াসও আমরা লক্ষ করেছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনটাই সফল হয়নি। এক্ষণে পাকিস্তানের হইয়ে এই কাজটি করে দেয়ার জন্যে ইয়াহিয়া খান ইরানের শাহের দ্বারস্থ হয়েছে।

*

কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক জান্তার বর্তমান সংকটটি বাংলাদেশ সমস্যা থেকে উদ্ভূত। এই সমস্যার কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে বাংলাদেশ সমস্যা। একে এড়িয়ে গিয়ে সমস্যার প্রকৃত কারণ হতে পারে না। ইরানের শাহ সত্যিই যদি পাকিস্তানের সামরিক জান্তা কর্তৃক সৃষ্ট সমস্যা সমাধানের আন্তরিক ইচ্ছা পোষণ করেন তাহলে প্রকৃত বিবদমান পক্ষকেই বেছে নিতে হবে। এই বিরোধের বিবদমান পক্ষ পাকিস্তান ও ভারত নয়, আসল বিরোধ বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে । এটাকে এড়িয়ে গিয়ে বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান হওয়া সম্ভব নয়। ভারতের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে যে ৮৫ লক্ষ শরণার্থী আশ্রয় গ্রহণ করেছেন, তাঁরা সরাসরিভাবে বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক জান্তা কর্তৃক সৃষ্ট সংকটের শিকার। কাজেই এই সংকটের সমাধানো নির্ভর করছে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকার করে নেয়ার মধ্যে, পাক-ভারত বিরোধে রূপান্তরিত করার মধ্যে নয়।

*

কিন্তু এই বাস্তব সত্য কি ইরানের শাহ স্বীকার করে নেবেন? ইয়াহিয়া-শাহ আলোচনার পর যে সংক্ষিপ্ত ঘোষণা প্রকাশিত হয়েছে তাতে বাংলাদেশ সমস্যার ক্ষীণতম ইঙ্গিতও নেই। বরং যা আছে তা প্রকারান্তরে পাকিস্তানের জঙ্গীশাহীর প্রতি পরোক্ষ সমর্থন বলা চলে। উক্ত যুক্ত ঘোষণায় পাকিস্তানের প্রতি ইরানের সমর্থনের প্রতি জোর দেয়া হয়েছে। কাজেই এই কথিত মধ্যস্থতার চরিত্র ও পরিণতি সম্পর্কে এর পরে আর কারো মনেই মোহ থাকবার কথা নয়। অবশ্য ইরানের কাছ থেকে সত্যিকারের কোন গণতান্ত্রিক ভূমিকা আশা করা চলেনা। ইরানের পূর্বাপর ভূমিকা আলোচনা করলে দেখা যাবে যে, ইরানের রাজতন্ত্র এ পর্যন্ত কোন গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল ও গণমুখী ভূমিকা গ্রহণ করেনি। মধ্যপ্রাচ্যে আরব জাতীয়তাবাদের প্রতি ইরান কোনদিন সক্রিয় সমর্থন তো দূরের কথা, নৈতিক সমর্থনও জানাইনি। বরং আরব জাতীয়তাবাদের জোয়ারে পাছে ইরানের রাজতন্ত্র বিপন্ন হয় সেই ভয়ে ইরানের রাজতন্ত্র বারবার পরোক্ষভাবে জাতীয়তাবাদী শক্তির বিরোধিতাই করেছেন। এমন কি ইরানের মহান জাতীয়তাবাদী নেতা ডঃ মোসাদ্দেককে পর্যন্ত ইরানী রাজতন্ত্রের পক্ষে সহ্য করা সম্ভব হয়নি। অথচ এই ডঃ মোসাদ্দেকই ইরানের বর্তমান অর্থনৈতিক প্রাচুর্যের দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন। ইরান আধুনিক গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তে এখনও একটি মধ্যযুগীয় রাজতন্ত্র বহাল রাখা হয়েছে।

*

মধ্যপ্রাচ্য তথা পশ্চিম এশিয়ায় নবজাগ্রত জাতীয় চেতনার ফলে আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থ ও শক্তির ভারসাম্য বিপন্ন হতে বসেছিল, ইরানের রাজতন্ত্র পেছন দুয়োর দিয়ে সেই সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের বিশ্বস্ত প্রহরী হিসেবে কাজ করে আসছে।

*

বাংলাদেশের নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তার চরম বিশ্বাসঘাতকতা ও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হবার পরও ইরান গোপনে পশ্চিম পাকিস্তানী জান্তাকে অর্থ ও সমর সম্ভার যুগিয়েছে বলে অভিযোগ শোনা গিয়েছে।

*

বাংলাদেশের জাতীয় প্রতিনিধিদেরকে সাম্রাজ্যবাদের লেজুড়ে পরিণত করার উদ্দেশ্যে ইরানের শাহ নির্বাচনের পূর্বেও একবার চেষ্টা চালিয়েছিলেন। সেসময় ইসলামাবাদ হয়ে ইরানের শাহ আকস্মিকভাবে ঢাকা সফরে এসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সঙ্গে এক সাক্ষাতে মিলিত হন। কিন্তু শেখ সাহেব যে জাতীয় স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে সাম্রাজ্যবাদের লেজুড়ে পরিণত হননি, পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক জান্তা কর্তৃক বাংলাদেশের জনগণ ও জাতীয় নেতৃত্বের বিরুদ্ধে অভিযান ও ঘৃণ্যতম গণহত্যার ইতিহাস থেকেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়। বাংলাদেশের ঘটনা সম্পর্কে বিশ্ববিবেক জাগ্রত হলেও সাম্রাজ্যবাদী সরকারসমূহের নিষ্ক্রিয়তা এবং পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক জান্তাকে পরোক্ষ সমর্থন ও উৎসাহ দানের ঘটনা থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, ইরানের শাহ বা করিম আগা খানের মাধ্যমে বাংলাদেশে সাম্রাজ্যবাদীরা কোন স্বার্থ হাসিল করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছে।

*

আমরা অবশ্য জানি যে, ঠিক তেমনিভাবে বাংলাদেশ সমস্যাকে পাক-ভারত বিরোধে রূপান্তরিত করার প্রয়াসও তাদের ব্যর্থ হবে। বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান নির্ভর করে কেবলমাত্র বঙ্গবন্ধুর মুক্তিদান, বাংলাদেশ সরকারের হাতে শাসন ক্ষমতা অর্পণ এবং হানাদার বাহিনীর অপসারণের ওপরে। অন্যথায় নয়। ইরানের শাহের সত্যই যদি এই সমস্যা সমাধানের কোন সদিচ্ছা থাকে তাহলে ইয়াহিয়া সরকারের ওপরেই তিনি প্রভাব বিস্তার করুন।

  • এই সংখ্যা হতে ‘জয় বাংলা’ সম্পাদকমন্ডলীর সভাপতি আবদুল মান্নান কর্তৃক মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়।

.

.

কম্পাইলারঃ লাল কমল

<৬,৩২,৬৪-৬৫>

শিরোনাম সংবাদপত্র তারিখ
কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারী সম্মেলনে বাংলাদেশ

জয় বাংলা

১ম বর্ষঃ ২০শ সংখ্যা

২৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারী সম্মেলনে বাংলাদেশ

কুয়ালালামপুর, ১৪ই সেপ্টেম্বর-আজ কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারী সম্মেলনের দ্বিতীয় দিবসে একজন বৃটিশ এম,পি, ভারতে বাংলাদেশ শরণার্থীদের ৯৫০টি শিবিরকে ৯৫০টি গাজা ব-দ্বীপ বলে অভিহিত করেন। এবং বলেন ‘এই ৯৫০টি শরণার্থী শিবির পাক-ভারত যুদ্ধের ৯৫০টি সম্ভাব্য কারণ’ হিসাবে বিরাজ করছে।

উক্ত বৃটিশ এম,পি, হচ্ছেন বৃটিশ চাকরী-বিনিয়োগ দফতরের উপমন্ত্রী মিঃ কে বেকার। তিনি বলেন, প্রতিটি শরণার্থী শিবিরে দেড় লাখ লোককে রেশনের জন্য সীমাহীন লাইন দিয়ে দাঁড়াতে দেখার চেয়ে মানুষের চোখের পক্ষে বিরক্তিকর দৃশ্য আর কিছু হতে পারে না।

নিউজিল্যান্ডের প্রতিনিধি মিঃ এইচ, সি, টেম্পেল্টন সতর্কবানী উচ্চারণ করে বলেন যে, কমনওয়েলথভুক্ত রাষ্ট্রগুলো যদি অবিলম্বে প্রত্যক্ষ ব্যবস্থা গ্রহণ না করে তাহলে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়বে, যার ফলে উভয় দেশের অর্থনীতি সম্পূর্ণরূপে ভেঙ্গে পড়বে।

তিনি আরও বলেন যে, নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী মিঃ কিথ হলিওক ইতিমধ্যেই ইয়াহিয়া খানকে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ যা চায় তা মেনে নিতে অনুরোধ জানিয়েছেন।

সম্মেলনে একাধিক বক্তা বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য সাহায‍্য প্রেরণের কাজ ত্বরান্তিত করার আহবান জানান।

কুয়ালালামপুরের বিপন্ন মানবতা ও মরণোন্মুখ গণতন্ত্রের সপক্ষে যে সামান্য কয়েক পঙক্তি বিবেকবাণী উচ্চারিত হয়েছে, পাকিস্তানের জঙ্গী সরকার তা প্রসন্ন চিত্তে গ্রহন করতে পারেনি। কেন না, মালয়েশিয়ায় নিযুক্ত পাকিস্তানী হাইকমিশনার উক্ত সম্মেলনে বাংলাদেশের সমস্যা আলোচিত হয়েছে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

বাংলাদেশে পাকিস্তানী জল্লাদ বাহিনীর নৃশংস অত্যাচারের কঠোর সমালোচনার মধ্যে দিয়ে পূর্বদিন সপ্তদশ কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারী সমতির সপ্তাহব্যাপী সম্মেলন শুরু হয়।

সাবেক কমনওয়েলথ সচিব মিঃ আর্থার বটমলী ইয়াহিয়া খান কে এই সত্যটি উপলব্ধি করতে বলেছেন যে, একমাত্র শেখ মুজিবুর রহমানই পূর্ব বাংলার জনগণের পক্ষে কথা বলতে পারেন। তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি দাবী করে বলেন যে, জন নেতাদের কারাগারে রেখে দুনিয়ার কোন সমস্যার যে সমাধান করা যায় না বৃটিশ সাম্রাজ্যের ইতিহাস থেকে ইয়াহিয়ার শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত। মিঃ বটমলী তার ভাষণে বাংলাদেশ সমস্যা অধিকৃত বাংলাদেশ এবং ভারত সরকারের অভিজ্ঞতার উপর আলোকপাত করেন। ইয়াহিয়া খান সম্পর্কে তিনি মন্তব্য করেন যে, ইয়াহিয়া খান রাজনৈতিক নেতা নন। অথচ তাকে মোকাবেলা করতে হচ্ছে নির্ভেজাল রাজনৈতিক সমস্যার।

উক্ত আধিবেশনে ভারতীয় প্রতিনিধিদলের নেতা শ্রী জি, এস ধীলন বাংলাদেশের প্রশ্নে বলেন যে, বর্তমান সংকট ভারত পাকিস্তানের মধ্যে বিরোধের ফল নয়, সংস্কৃতি ও ভাষার দিক দিয়ে পাকিস্তানের দুইটি ভিন্ন জাতির মধ্যকার বিরোধ।

ঘানার প্রতিনিধি মিঃ সাকিস্তেক কমনওয়েলথের পক্ষ থেকে পূর্ব বাংলার শরণার্থীদের সাহায্য করার জন্য আবেদন জানান।

বৃটেনের স্যার রোনাল্ড রাসেল বলেন যে, পূর্ব বাংলার মানুষের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত ভারত উদ্বাস্তুদের ফেরত পাঠাতে পারবে না। তিনি পূর্ব বাংলার সমস্যার একটি রাজনৈতিক সমাধানের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেন।

গায়ানার প্রতিনিধি মিঃ নেভিল জেমস বলেন যে, পাকিস্তানকে নিন্দা করার অধিকার কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর আছে, কারণ পাকিস্তান পূর্ব বাংলাকে অবদমিত করে এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে আটক রেখে নীতি ও ন্যায় ধর্মের সকল বিধি লঙ্ঘন করেছে।

কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারী সভার এই অধিবেশনে পাকিস্তানের প্রতিনিধি প্রেরণের অধিকার নেই। কেননা পাকিস্তানের কোন পার্লামেন্ট নেই। ঐ একই কারণে নাইজেরিয়া ও উগান্ডা প্রতিনিধি প্রেরণ করতে পারেনি।

.

.

কম্পাইলারঃ স্নেহাশিস পানু

<৬,৩৩,৬৬-৬৭>

শিরোনাম সংবাদপত্র তারিখ
আর আবেদন নয়, এবার সক্রিয় সাহায্য দিতে হবে

জয় বাংলা

১ম বর্ষঃ ২০শ সংখ্যা

২৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

নয়াদিল্লীতে আয়োজিত বাংলাদেশে সম্মেলনে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের আবেদন

আর আবেদন নয়

এবার সক্রিয় সাহায্য দিতে হবে

(বিশেষ প্রতিনিধি প্রেরিত)

নয়াদিল্লীঃ- পৃথিবীর ছয়টি মহাদেশের ২৫টি রাষ্ট্রের ৬৫ জন প্রতিনিধি নয়াদিল্লীতে আয়োজিত বাংলাদেশ সম্পর্কিত এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে (১৮-২০শে সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশে শতাব্দীর নিষ্ঠুরতম ও মর্মন্তদ গণহত্যার বিরুদ্ধে তীব্র ধিক্কার ও ঘৃণা প্রকাশ করেন। সম্মেলনে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জল্লাদ ইয়াহিয়া বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখসমরে অবতীর্ণ হওয়ার ব্যাপারে একটি আন্তর্জাতিক ব্রিগেড গঠনের আহবান জানান হয়।

.

সম্মেলনে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের প্রতি সর্বাত্মক সমর্থন প্রকাশ করে বলা হয় যে, সমসাময়িক মানব ইতিহাসে এর চেয়ে জঘন্যতম হত্যাকান্ড আর সংঘটিত হয়নি।

.

সম্মেলনে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত এক প্রস্তাবে বাংলাদেশের গণজাগৃতির উদ্যোক্তা ও বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবিলম্বে বিনা শর্তে মুক্তি দাবী করা হয়েছে।

.

আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদানকারী বিভিন্ন রাষ্ট্রের বিশিষ্ট প্রতিনিধিরা বলেন যে, বর্তমানে বাংলাদেশ প্রশ্নে সরাসরি সাহায্য দান করতে হবে-শুধুমাত্র সুন্দর প্রস্তাব গ্রহণের মধ্যে সম্মেলনের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখা উচিত হবেনা।

.

নেপালের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মিঃ বি, পি, কৈরালা, সিংহলের স্যার গুনাওয়ারধানা এবং ফ্রান্সের মিঃ ডানিয়েল মায়ার উল্লেখিত অভিমত প্রকাশ করেন।

.

নয়াদিল্লীতে আয়োজিত এই আন্তর্জাতিক সম্মেলনের উদ্ধোধন করেন সবর্বাদয় নেতা শ্রী জয়প্রকাশ নারায়ন। সম্মেলনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে শহীদ লাখো লাখো নারী, পুরুষ ও শিশুর প্রতি সংগ্রামী অভিনন্দন জানিয়ে তাঁদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য দু’মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।

.

জনৈক মার্কিন প্রতিনিধিসহ সম্মেলনে যোগদানকারী বেশ কয়েকজন প্রতিনিধি বাংলাদেশে মানবিক মূল্যবোধ অক্ষুন্ন রাখার ব্যাপারে ইয়াহিয়ার সরকারের ওপর বিশ্ব চাপ সৃষ্টি এবং সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত পাকিস্তান যাতে অস্ত্র সাহায্য না পায় তার নিশ্চয়তা বিধানের দাবী জানান।

.

ইন্দোনেশিয়ার জনৈক সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী জঃ মোহাম্মদ রোয়েম আন্তর্জাতিক আইনের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, বাংলাদেশ সমস্যা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার হতে পারেনা। এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার অধিকার জাতিসংঘের রয়েছে।

.

সম্মেলনের সাফল্য কামনা করে অন্যান্যদের মধ্যে বিশ্ব নন্দিত ব্যক্তিত্ব ইহুদি মেনুহিন, মিঃ আঁদ্রে মালরো, সিনেটর কেনেডি, ফুলব্রাইট, কানাডার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী লেষ্টার পিয়ারসন বাণী পাঠিয়েছেন।

.

ভারতের প্রেসিডেন্ট গিরি এক বাণীতে সম্মেলন বাংলাদেশ প্রশ্নে আন্তর্জাতিক বিবেক জাগ্রত করতে সহায়ক হবে বলে আশা প্রকাশ করেন।

.

শ্রী নারায়ণ সম্মেলনে বক্তৃতা প্রসঙ্গে বলেন যে, বিশ্ব আজ অবহিত যে, লাখো শহীদের লাশের নিচে পাকিস্তান আজ চাপা পড়ে গেছে।

.

তিনি বলেন একমাত্র মুক্তিবাহিনীর সফলতার ওপরই বাংলাদেশের জনগণের নিকট গ্রহনযোগ্য রাজনৈতিক সমাধান সম্ভব। অন্য দিকে মুক্তিবাহিনীর সফলতা বিশ্বের সকল দেশের জনগণ ও সরকারের সার্বিক সহায়তা অ সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল।

.

সম্মেলনে বেসরকারীভাবে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডঃ এ, আর মল্লিক।

.

তুমূল করতালির মধ্যে কায়রোর ‘আল-আহরাম’ পত্রিকার সম্পাদক ডঃ মকসুদ বলেন, বাংলাদেশে পাকিস্তানী সমরিক জান্তার নজিরবিহীন নিষ্ঠুর কার্যক্রমে বিশ্ববিবেক স্তম্ভিত হয়ে পড়েছে।

.

বৃটিশ এম, পি, এবং ওয়েলসে সর্বদলীয় বাংলাদেশ কমিটির চেয়ারম্যান মিঃ ফ্রেড ইভান্স বলেন যে, বাংলাদেশে গণহত্যা বিনা বাধায় চালিয়ে যেতে দেয়া হলে আমরা অচিরেই উপলব্ধি করতে পারবো যে আমাদের নিজেদের স্বাধীনতাও বিপন্ন হয়ে পড়েছে।

.

সিংহলে বাংলাদেশ মানবিক অধিকার কমিটির চেয়ারম্যান স্যার সেনারেট গুনাওয়ার্ধন বলেন যে, বাংলাদেশের গণহত্যার ব্যাপারটি জাতিসংঘে যথার্থভাবে আলোচিত হোয়ার যোগ্যতা রাখে।

.

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিঃ স্টেনলি প্লাষ্ট্রিক বলেন, বাংলাদেশে গনহত্যা এবং অকল্পনীয় নিষ্ঠুরতার নিন্দা জ্ঞাপন নিক্সন সরকারের কাছ থেকে আশা করা ভূল হবে।

.

তিনি বলেন, তবে আশার কথা হচ্ছে আমেরিকার যুব সমাজ, ছাত্র সমাজ, বুদ্ধিজীবী সমাজ বাংলাদেশের জনগণের পক্ষে রয়েছেন। ফ্রান্সের মিঃ ডানিয়েল মেয়র বলেন, বাংলাদেশে সমস্যা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার ব্যাপার নয়। বাংলাদেশ সমস্যা হচ্ছে পাকিস্তানের সাথে বিশ্ববিবেকের। বাংলাদেশে গনহত্যার জন্য দায়ী জল্লাদ ইয়াহিয়া জান্তাকে সকল প্রকার সামরিক সাহায্য প্রদান বন্ধের দাবী জানান।

.

যুগোশ্লাভ শান্তি লীগের মিঃ জোভরেমেভিক বলেন সমসাময়িক ইতিহাসে বাংলাদেশ ট্রাজেডির কোন নজির নেই।

.

বৃটেনের বিশ্ব কলা ও বিজ্ঞান একাডেমির ডিরেক্টর স্যার বলেন, বাংলাদেশে মানবিক মূল্যবোধ এবং গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষার যাতে সমাধি না ঘটে তা দেখার দায়িত্ব বিশ্বের প্রতিটি মানুষের।

.

‘আফগান-মিল্লাত’ – এর সম্পাদক জনাব কিউ, হাদাদ, আফ্রো-এশীয় সংহতি কাউন্সিলের নাইজেরীয় শাখার সদস্য মিঃ গনি ফাওয়াহিনমি, টোকিওর অধ্যাপক নারা, সালভাদর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ফাদার ইসমাইল কুলেইম, অটোয়ার বিশ্ব কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মিঃ নিয়েলমল, অসলোর মিসেস মিগরিড এবং বিশ্ব ধর্মীয় শান্তি সম্মেলনের সেক্রেটারীর জেনারেল ডঃ হোমার জগক সম্মেলনে বক্তৃতা প্রসঙ্গে পাকিস্তানী জল্লাদ বাহিনির নাদিরশাহী বর্বতার নিন্দা করে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিশ্ব জনমত সংগঠিত করার ব্যাপারে গুরুত্ব আরোপ করেন।

.

অন্যান্যদের মধ্যে ভারতের বিশিষ্ট জননেতা মেসার্স সাদিক আলী, আচার্য্য কৃপালনী, সুচেতা কৃপালনী, বিজয় লক্ষী পন্ডিত, অধ্যাপক রাঙ্গা এবং শায় নওয়াজ সম্মেলনে যোগদান করেন।

.

স্নেহাশিস পানু

<৬,৩৪,৬৮-৬৯>

শিরোনাম সংবাদপত্র তারিখ

বিশ্ব মানবতা

জল্লাদ ইয়াহিয়ার বিচার চায়

জয় বাংলা

১ম বর্ষ, ২০শ সংখ্যা

২৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

বিশ্ব মানবতা জল্লাদ ইয়াহিয়ার বিচার চায়

জাতিসংঘ কি করতে পারবে?

(রাজনৈতিক ভাষ্যকার)

গত ২১শে সেপ্টেম্বর থেকে বহু বিঘোষিত জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন শুরু হয়েছে। বিশ্বের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর প্রতিনিধিগণ প্রতিবারের মতই এবারও বিশ্ব সম্মেলনে যোগদান করেছেন। কিন্তু এবারে জাতিসংঘ সম্মেলনে আরো একটি নতুন স্বাধীন দেশের প্রতিনিধিরা যোগ দিতে গিয়েছেন। এ দেশটি হল স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। যদিও জাতিসংঘের সদস্যপদ তার অর্জিত হয়নি পৃথিবীর কোন দেশের কাছ থেকে এখনো রাজনৈতিক স্বীকৃতি পায়নি, তবুও বিশ্বপ্রতিষ্ঠানের কাছে বাংলাদেশ তার নিজস্ব গণতান্ত্রিক অধিকারেই হাজির হয়েছে।

.

জাতিসংঘের অধিবেশনে পৃথিবীর প্রতিটি অঞ্চলের অধিবাসীদের আত্মনিয়ন্ত্রন, ব্যাক্তিস্বাধীনতা ও মানবিক অধিকারগত সমস্যার প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। গনহত্যা, মানবাধিকার লঙ্ঘন, বর্ণ বৈষম্য, ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িকতা, নারী নির্যাতন, কোন অঞ্চলে উত্তেজনা ও যুদ্ধের আশংকা প্রভৃতি বিষয়ে বহু জটিল প্রশ্ন নিয়ে প্রায় বৃহত্তর বিতর্কের সুত্রপাত ঘটে থাকে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ও নিষ্ঠুর সত্য এই যে, এই সব সমস্যা সমাধানে প্রায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জাতিসংঘের ভূমিকা খুব উজ্জল নয়। বরং বিশ্বরাজনীতির দাবা খেলায় বহু মানবিক প্রশ্নই নানাভাবে উপেক্ষিত হতে দেখা গেছে। একদা লীগ অব নেশন্সের ব্যার্থতা মানব জাতির ভাগ্যে যে মর্মান্তিক পরিণতি নিয়ে এসেছিল, আজকের জাতিসংঘের কর্মকর্তাদের সে ব্যর্থতার নজির থেকেই শিক্ষা গ্রহন করতে হবে; সম্ভবত তাহলেই কেবল জাতিসংঘ ইতিহাসের সেই নিষ্ঠুরতম পুনরাবৃত্তিকে ঠেকাতে সক্ষম হবে।

.

বাংলাদেশে গত ছয় মাসে পৃথিবীর বৃহত্তর গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে। এ শতাব্দীর সবচেয়ে নিষ্ঠুরতম হত্যাকান্ড, নারী নির্যাতন, লুন্ঠন ও বর্বরোচিত ধ্বংসলীলায় যে নারকীয় ইতিহাস রচিত হয়েছে, যার কাছে চেঙ্গিস হালাকু কিংবা হিটলারের নৃশংসতাও ম্লান হয়ে যায়, মানব ইতিহাসের এমন নারকীয় এমন বীভৎস দৃশ্য দেখেও জাতিসংঘের মতো বিশ্ব প্রতিষ্ঠানের কন্ঠ তীব্রতর প্রতিরোধের ভাষায় সোচ্চার হয়ে উঠেনি, সক্রিয় হস্তক্ষেপ মানবতার এই অপমান রোধে অগ্রসর হয়নি এবং প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খানের মতো পশ্চিম পাকিস্তান ঘেষা পুঁজিপতিকে মামুলি সফরে পাঠিয়ে জাতিসংঘ মোটামুটিভাবে তার দায়িত্ব শেষ করেছেন এমন বললে বোধ করি বাড়িয়ে বলা হবেনা।

.

বাংলাদেশের এই মর্মান্তিক ঘটনাকে জাতিসংঘের সেক্রেটারী মিঃ উথান্ট কেবল ‘মানব সভ্যতার দূরপনেয় কলঙ্ক’ বলেই খালাস হলে চলবেনা; মানব সভ্যতার এই দূরপনেয় কলঙ্কের যে হোতা, যে স্বনির্বাচিত প্রেসিডেন্টের ষড়যন্ত্র ও ক্রুর ইচ্ছায় এ শতাব্দীর এতো বড় একটা ধ্বংসযজ্ঞ সংঘটিত হচ্ছে, দশ লক্ষ নর-নারী পশুর মত প্রাণ দিয়েছেন, পঁচিশ লক্ষ লোক ঘরবড়ী স্বর্বস্ব হারিয়ে অন্যপদেশে আশ্রয় নিয়েছেন, আরো লক্ষ লক্ষ মানুষ যেখানে প্রতিনিয়ত মৃত্যুর মুখোমুখি বসবাস করছে, যার উম্মাদ খোলায় মানব সভ্যতার এমন দূরপনেয় কলঙ্ক সূচিত হতে পারলো, বিশ্বমানের প্রতিষ্ঠান জাতিসংঘেরই দায়িত্ব সেই একরোখা ক্রুর দানবের শাস্তি বিধান করা।

.

কেননা ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদেই গণহত্যা বন্ধ ও তার শাস্তি বিধানের সনদ গৃহীত হয়েছে।

.

জাতিসংঘের এই সনদ অনুযায়ী গণহত্যা কিংবা অনুরূপ কোন অপরাধের জন্যে দায়ী ব্যক্তি অবশ্যই শাস্তি পাবে, সে শাসনতান্ত্রিকভাবে কোন দেশের শাসনকর্তাই হোক, কোন সরকারী কর্মচারীই হোক কিংবা বেসরকারী লোকই হোক। এ সঙ্গে আরো বলা হয়েছে যে, গণহত্যা কিংবা অনুরূপ কোন অপরাধে দায়ী ব্যক্তির বিচার সে দেশেরই ক্ষমতা সম্পন্ন আদালতে নিস্পন্ন হবে কিংবা আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে তার বিচার করতে হবে।

.

.

প্রতীক খান

<৬,৩৫,৭০-৭১>

সংবাদপত্রঃ জয় বাংলা

তারিখঃ ২৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

.

বহু মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতার আলোকে আদ্রেঁ মালরো বলছেন …
.

যে কজন ফরাসী সাহিত্যিকের নাম আজ বিশ্বজোড়া, আদ্রেঁ মালরো তার অন্যতম।মালরোর জীবন খুবই ঘটনাবহুল।মালরো তাঁর যৌবনে স্পেনের গৃহযুদ্ধে যান।লড়াই করেন সাহসিকতার সঙ্গে ফ্রাঙ্কোর সেনাবাহিনীর সাথে। স্পেনের গৃহযুদ্ধ শেষ হবার পর,মালরো যান চীনে।সেখানে চীনের পক্ষ নিয়ে লড়াই করেন বিদেশী শক্তির বিরুদ্ধে।তারপর চীন থেকে নিজের দেশে ফিরে অংশ নেন নাৎসীবাহিনির বিপক্ষে। তাঁর দেশবাসীর প্রতিরোধ সংগ্রামের সময় তাঁর পরিচয় হয় জেনারেল চার্লস দ্য গল এর কর্মধারার সাথে।মালরো এর আগে ছিলেন বামপন্থী।কিন্তু এখন থেকে হয়ে উঠেন দ্য গল এর মত স্বদেশপন্থী যার গোড়ার কথা হল, দেশের স্বাধীনতা ও ক্ষমতাকে বিলুপ্ত করে আন্তর্জাতিকতা অর্থহীন। জাতীয় রাষ্ট্র আজকের পৃথিবীতে এক বিরাট রাজনৈতিক সত্তা।তাকে বাদ দিয়ে বিশ্বের রাজনীতির কথা, মানুষের মুক্তির কথা ভাবতে যাওয়া অবান্তর। দ্য গল এর আমলে মালরো মন্ত্রী হন।তাঁর উপর ভার পড়ে সাংস্কৃতিক দপ্তরের।মালরোর নেতৃত্ত্বে ফরাসীদের দেশের বিভিন্ন চিত্রশালা ও মিউজিয়ামগুলি নবজীবন লাভ করে।তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন শিল্পকলা সম্পর্কে আধুনিকতম জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে লিখিত হয় বহু খণ্ডের  একাধিক গ্রন্থ।মালরোর মতে, “মানুষের ইতিহাস বুঝবার ক্ষেত্রে শিল্পের ইতিহাস অপরিহার্য। কারণ শিল্পের মধ্যে ধরা পড়ে মানুষের চেতনা।শিল্পের মধ্যে সেই মানুষ গভীরভাবে জানতে পারে,অনুভব করতে পারে নিজেকে।একটা সভ্যতাকে”।
.

মালরো সাহিত্যিক।তাঁর উপন্যাসের খ্যাতি জগৎজোড়া।মালরো শিল্পরসিক।মালরো যোদ্ধা।মালরো আবার রাজনীতির সাথে থেকেছেন ওতপ্রোতভাবে জড়িত।আর সেই রাজনীতি কেবল তাঁর নিজের দেশের নয়- স্পেন থেকে চীন তার ব্যাপ্তি।সাহিত্যিক মালরো তাই ব্যাক্তি হিসেবেও স্থান করে নিতে পেরেছেন পৃথিবীর নানা দেশের মানুষের মনে। মালরো এ যুগের একজন বিশিষ্ট শক্তিমান ব্যাক্তি।
.

বর্তমানে এই প্রবীণ ফরাসী সাহিত্যিক বাংলাদেশের স্বাধীনতা সম্পর্কে কতগুলো মূল্যবান মন্তব্য  করেছেন।মালরো বলেছেন, “বাংলাদেশের ঘটনা বিশ্বের করুণতম ঘটনাবলীর অন্যতম।কিন্তু বাঙ্গালীদের বুঝতে হবে,বর্তমান যুদ্ধ তাদের অস্তিত্বের লড়াই।হয় তারা জাতি হিসেবে জিতবে,নয়ত চিরতরে বিলীন হয়ে যাবে।আবেদন নিবেদনে কোন ফল হবে বলে মনে হয়না।বাঙ্গালীকে তার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে যুদ্ধ করেই।এখন বাঙ্গালীরা কেবল নির্ভর করতে পারে আত্মসাহস ও রণশক্তির উপর।অবশ্য মুক্ত রণাঙ্গনে, সম্মুখসমরে পাক বাহিনির সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া উচিৎ হবেনা বাঙ্গালীদের।বর্তমানে তা সম্ভব নয়।তাদের উচিৎ হবে গেরিলা যুদ্ধই ভালভাবে চালিয়ে যাওয়া।বিদেশের কাছে গনতন্ত্র ও মানবতার নামে দরখাস্ত দাখিলের চাইতে বাঙ্গালীদের আজ বেশী প্রয়োজন,সামরিক সংগঠন।বছর চল্লিশেক আগের অ্যাংগলো-সেক্সন উদারনৈতিক বিবেক এখন আর বাস্তব নয়।আপনভোলা আমেরিকানদের শুভেচ্ছার উপর নির্ভর করতে যাওয়া হবে ভুল…”
.

মালরো উপরের কথাগুলো লিখেছেন একটি চিঠিতে ভারতের বিখ্যাত নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণের কাছে।কিছুদিন আগে মালরো আমেরিকার বিখ্যাত সাপ্তাহিক ‘টাইমস’ এর একজন সাংবাদিককে  বলেন, “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অচিরে এশিয়া ভূখণ্ডে একটি নতুন সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে।সমস্যাটি হল বাংলাদেশ।‘ভিয়েতনামের অনুরূপ’ রূপ নিয়ে দেখা দেবে এই সমস্যা।কিন্তু ভিয়েতনামের সাথে ব্যাতিক্রম বাংলাদেশের।বাংলাদেশের জনসংখ্যা ৭৮ মিলিয়ন।আর এই জনসংখ্যা মাওবাদ দ্বারা নয়,অনুপ্রাণিত জাতীয়তাবাদ দ্বারা।আমেরিকানদের বাংলাদেশ সম্পর্কে বর্তমান শান্ত অঞ্চল ভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে (টাইমস,আগস্ট,২)
.

মালরোর এই উক্তির কোন ফল হয়নি বলেই সম্ভবত জয় প্রকাশের কাছে লিখিত চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেছেন, সভা করে আবেদন নিবেদন করবার নিষ্ফলতার কথা।

.

বাঙ্গালীরা আজ এক জিবন-মরণ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে।দূর বিদেশে বসে সংবেদনশীল সাহিত্যিক মালরোর পক্ষে বুঝতে অসুবিধে হচ্ছেনা সেকথা।যুদ্ধ ও যুদ্ধজয় ছাড়া বাঙ্গালীর সম্মুখে আজ আড় কোন পথ খোলা নেই।
.

.

প্রতীক খান

<৬,৩৬,৭২-৭৪>

সংবাদপত্রঃ জয় বাংলা ১ম বর্ষ, ২৩শ সংখ্যা

তারিখঃ ১৫ অক্টোবর, ১৯৭১

.

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও অর্থনৈতিক প্রতিশ্রুতি (অর্থনৈতিক ভাষ্যকার)
.

    বাংলাদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধারা জীবন বাজি রেখে মরণপণ সংগ্রামে লিপ্ত।তাদের সঙ্গে দেশপ্রেমিক,কৃষক,মজুর ছাত্র,বুদ্ধিজীবী,শিল্পী,সাহিত্যিক-এক কথায় ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষ যার যার নিজের কর্মক্ষেত্রে এই মুক্তি সংগ্রামের অংশভাগী হয়ে দেশ মাতৃকার শৃঙ্খল মোচনের জন্য সর্বস্ব পণ করেছে।অসহ্য দুঃখ-কষ্ট লাঞ্ছনা ও প্রতি মুহূর্তে নিশ্চিত মৃত্যু সম্ভাবনার মুখেও তারা জাতীয় মুক্তির প্রশ্নে আপোষহীন মুক্তির প্রভাতসূর্যের সম্ভাবনা প্রত্যয়শীল।
.

     মাত্র চব্বিশ বছর আগে সাম্প্রদায়িক জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে যে রাষ্ট্রের পত্তন হয়েছিল,সেই রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ সাম্প্রদায়িকতা পরিহার করে ভাষা,সাহিত্যে,সংস্কৃতি ও ভৌগলিক জাতীয়তার ভিত্তিতে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধভাবে স্বাধীনতার জাতীয় মুক্তির লক্ষ্য অর্জনের জন্যে সশস্ত্র সংগ্রামে কাতারবন্দী হয়েছে।শুধু ময়দানে স্লোগান দেয়া নয়,এক সঙ্গে  কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হাতিয়ার হাতে পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীকে হত্যা করছে,প্রাণ দিচ্ছে।বাংলাদেশের সকল ধর্মীয় বিশ্বাসের মানুষ,বাঙালী জাতি হিসেবে প্রাণ নেয়া ও দেয়ার মিলিত রক্তধারায় যে জাতীয় ঐক্য তুলেছে,এদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে তা অনন্য।সাম্প্রদায়িকতাবাদের কবর রচনায় ইতিহাসের এই অনন্য অধ্যায়ের ভূমিকা অপরিসীম এবং সুদূরপ্রসারী।বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের এটি প্রাথমিক সাফল্য।শুধু যারা ঔপনিবেশিক শোষণের হাতিয়ার হিসেবে ধর্মীয় জিগির তুলে সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধিকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়,পশ্চিম পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শক্তির সেইসব দালালরা এই জাতীয়তাবাদের অভ্যুদয়কে ভয় করে।শুধু তারাই এই মুক্তিসংগ্রামের বিরুদ্ধে  সামরিক জান্তার সাথে হাত মিলিয়েছে।এই দুটি বিপরীত ধারার কথা যদি আমরা বিচার করি তা হলে অন্যান্য বিষয় বাদ দিলেও শুধু বাঙালী জাতীয়তাবাদের এই অভ্যুদয়কে নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ মৌলিক অগ্রগতি হিসেবে স্বাগত জানাতে হয় বাংলাদেশের জাতীয় এবং রাজনৈতিক জীবনে এই জাতীয়তাবাদী ধারার দুর্জয় শক্তি পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক জান্তা ভালভাবেই উপলব্ধি করতে পেরেছে বলে ইয়াহিয়া খানের খসড়া শাসনতন্ত্রে দখলীকৃত বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের ভোটাধিকার হরণের ব্যাবস্থা করা হয়েছে।এর একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে সাম্প্রদায়িক বিভেদ জিইয়ে রেখে সাংস্কৃতিক ও ভৌগলিক জাতীয়তাবাদকে প্রতিহত করা।এটাই সাম্প্রদায়িকতাবাদী ঔপনিবেশিক শক্তির লক্ষ্য।জামায়াতে ইসলামী,মুসলিম লীগ প্রভৃতি দালাল দলগুলো পশ্চিম পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শক্তির লক্ষ্য পূরণের কাজে আত্মনিয়োগ করেছে।
.

      কিন্তু এই দালালরা চিহ্নিত ও ধিকৃত।তাদের শক্তি পুরোপুরিভাবে সামরিক জান্তার পশুশক্তির পৃষ্ঠপোষকতার উপর নির্ভরশীল।এরা মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যোদ্ধাদের আক্রমণে এখন নিজেরাই সন্ত্রস্ত।তবে সংখ্যায় একেবারে নগণ্য হলেও স্বদেশে ও বিদেশে প্রগতিবাদী এবং বামপন্থী বলে কিছু লোক আছেন যারা এই মুক্তিসংগ্রামকে পশ্চিম পাকিস্তানী বুর্জোয়াদের জায়গায় বাঙালী বুর্জোয়াদের প্রতিষ্ঠিত করার যুদ্ধ বলে অভিহিত করে এই মুক্তিযুদ্ধের যৌক্তিকতা ও সার্থকতার প্রশ্ন উত্থাপন করে থাকেন।অবশ্য এ কথা ঠিক যে, জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে প্রতিটি মানুষই কাতারবন্দী হবে এমন আশা সবসময় করা যায় না।কিন্তু তা সত্ত্বেও  বলতে হয় যে প্রগতিবাদীদের নাম করে যারা বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের ভূমিকা ও তাৎপর্য সম্পর্কে সংশয়বাদী প্রশ্ন তুলে নিজেদের এই সংগ্রাম থেকে দূরে রাখেন তারা প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের মুক্তি ও সংগ্রামেরই বিরোধিতা করেছেন।সেদিন থেকে পরিণামে জামায়াত বা মুসলিম লীগের ভূমিকা থেকে এদের ভূমিকার আসলে খুব বেশি পার্থক্য নেই।একদল ধর্মের নামে বিরোধিতা করে,অপরদল প্রগতির নামে বিরোধিতা করে।
.

       রাজনৈতিক,অর্থনৈতিক,সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সকল অর্থেই বাংলাদেশকে পশ্চিম পাকিস্তানের কলোনি করে রাখা হয়েছিল।এখন প্রশ্ন হচ্ছে অন্যান্য প্রগতিশীল ও সমাজবাদী অঙ্গীকার যদি অনুপস্থিতও থাকত তা হলে শুধু ঔপনিবেশিক শৃঙ্খল থেকে বেরিয়ে আসার জন্যে যে মুক্তি সংগ্রাম কি ওই একটি কারণেই উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী মহলের সমর্থন লাভের দাবীদার হত না? তা না হলে বলতে হয় যে,তাদের নির্দেশিত রাষ্ট্র কাঠামোর অঙ্গীকার যদি না থাকে তাহলে দেশ পরাধীনই থাক।এই নেতিবাচক ভূমিকা আত্মহননেরই সামিল।
.

         কিন্তু এই ধরণের মনোভাব যদি কেউ পোষণ করেন তা হলে বলতে হবে যে তারা নিঃসন্দেহে ভ্রান্ত।বিশেষ করে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের ব্যাপারে।কারণ তা হলে বুঝতে হবে যে, জিন্না সাহেবের দ্বি-জাতিতত্ত্বের মাথায় পদাঘাত করে বাংলাদেশে যে সাম্প্রদায়িক ক্লেদমুক্ত সাংস্কৃতিক ও ভৌগলিক জাতীয়তার ভিত্তিতে সংগ্রাম চলছে তার সুদূরপ্রসারী গুরুত্ব ও প্রভাব তারা হয় অনুধাবন করতে পারেননি নয়ত হিসেবের মধ্যে আনেননি।তাছাড়া ঔপনিবেশিক শোষণ ও শাসনের বিরুদ্ধে জাতীয় মুক্তির লক্ষ্য অর্জনের জন্যে সশস্ত্র সংগ্রাম যে চরিত্রগতভাবে প্রগতিশীল সংগ্রাম হতে বাধ্য বিশেষ করে বিশ শতকের শেষ পর্যায়ে বিশ্বের সমাজ চেতনার পরিমণ্ডলে অবস্থান করে তাও হয়তো হিসেবের বাইরে রয়ে গিয়েছে।বিশ শতকের শেষ ভাগে বর্তমান যুগের সমাজ চেতনার পরিচিত পরিমণ্ডলের মধ্যে বাংলাদেশের সর্বশ্রেণীর সমর্থনে ও সক্রিয় সহযোগিতায় যে মুক্তি সংগ্রাম চলছে সেই যুদ্ধের সফল পরিণতি কোন দিনই দেশী বাইশ পরিবার গড়ে উঠতে দেবে না।বাংলাদেশের সর্বশ্রেণীর সমন্বয়ে গঠিত মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তক্ষরণের ভেতর দিয়ে যে সমাজ শক্তি ও সমাজ চেতনা দৃঢ়মূল হচ্ছে,সেই শক্তি ও চেতনাই সে ধরণের সম্ভাবনার পথ রুদ্ধ করবে।
.

           এ কথাও বুঝতে হবে যে,মুক্তিযোদ্ধারা ভাড়াটিয়া সৈন্য নয়।দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষও শুধু শুধু জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে উদ্বুদ্ধ হয়নি।এর পেছনে অবশ্যই সামাজিক,সাংস্কৃতিক,  রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির সুনিশ্চিত আশ্বাস রয়েছে।বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দ্যার্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেছেন যে,পশ্চিম পাকিস্তানী ২২ পরিবারের জায়গায় বাঙালী ২২ পরিবার সৃষ্টি করার জন্য তিনি এই মুক্তি সংগ্রাম শুরু করেননি।শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠাই ছিল তার মুক্তির সংগ্রামের লক্ষ্য।
.

             শুধু বঙ্গবন্ধুর মৌখিক ঘোষণাই নয়, আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টোতেও সামাজিক ন্যায়বিচার ও অর্থনৈতিক শোষণের হাত থেকে মুক্তির প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে।এই ঘোষণাপত্রের প্রথম দিকেই সংক্ষিপ্ত কয়েকটি কথায় জীবনের মৌলিক চাহিদা পূরণের নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে।তাতে বলা হয়েছে যে অন্ন,বস্ত্র,আশ্রয়,শিক্ষা,চিকিৎসা এবং উপযুক্ত পারিশ্রমিক কর্মসংস্থানের সুযোগসহ প্রতিটি নাগরিকের প্রাথমিক চাহিদা পূরণের মৌলিক দায়িত্ব রাষ্ট্রের এ কথার স্বীকৃতি শাসনতন্ত্রে থাকবে।
.

       রাষ্ট্রকর্তৃক জনগণের প্রাথমিক চাহিদা পূরণের মৌলিক দায়িত্ব রাষ্ট্রের বলে ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে উক্ত ঘোষণাকে বাস্তবে রূপায়িত করার জন্যে আওয়ামীলীগ ম্যানিফেস্টোতে অর্থনৈতিক কর্মসূচীর ভিত্তিও ব্যাখ্যা করা হয়েছে।তাতে বলা হয়েছে যে, “শোষণমুক্ত একটি ন্যায় ও সাম্যবাদী সমাজ গঠন করাই এই অর্থনৈতিক কর্মসূচীর মূল লক্ষ্য।এটা একটা সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যাবস্থার রূপকল্প-যাতে  অর্থনৈতিক অবিচার দূরীকরণ ও দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নতি সাধন করা হবে এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ও সকল স্তরের মানুষের মধ্যে এই সমৃদ্ধির ফল যথাযথভাবে বণ্টনের বিধান থাকবে।

.

         “শোষণমুক্ত ন্যায় ও সাম্যবাদী সমাজ গঠন ও সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক রূপকল্প” বাস্তবায়িত করার জন্য আওয়ামীলীগের ম্যানিফেস্টোতে ভাবী শাসনতন্ত্রের যে ব্যাবস্থা সংবিধানে সন্নিবদ্ধ করার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে  সেই সংবিধানটি জনগণের হাতে উপরোক্ত শোষণমুক্ত ন্যায় ও সাম্যবাদী সমাজ গঠন নির্ভর করবে প্রশাসনিক ব্যাবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে।আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টোতে উপরোক্ত  প্রশাসনিক পদক্ষেপ সম্পর্কেও সুস্পষ্টভাবে পথ নির্দেশ করা হয়েছে।

.

                  বাক্তিগত মালিকানাধীন শিল্পের জায়গায় সরকারী খাতের সম্প্রসারণ এবং গুরুত্ব অনুযায়ী অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বিভিন্ন শিল্প,ব্যাংক,বীমা,বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ  ব্যাবসা ও আমদানী রফতানী বাণিজ্য জাতীয়করণ,যে পরোক্ষ কর সাধারণ মানুষের কাঁধে চেপে বসে,কর ব্যাবস্থার আমূল পরিবর্তন করে উপরোক্ত পরোক্ষ করের জায়গায় প্রত্যক্ষ কর ব্যাবস্থার মাধ্যমে অধিক পরিমাণ অর্থ আদায়ের ব্যাবস্থা করা প্রভৃতি প্রশাসনিক পদক্ষেপের অঙ্গ।
.

                                  মূলধন ও ব্যাবস্থাপনায় শ্রমিক অংশীদারিত্ব
মূলধনে শ্রমিক শ্রেণীর অংশীদারিত্ব সম্পর্কে ম্যানিফেস্টোতে বলা  হয়েছে যে,সমস্ত শিল্প কারখানা সত্বর জনগণের মালিকানাধীনে আনা হবে না,সরকার ক্রমবর্ধমানহারে তাদের ইকুইটি মূলধন দখল করবে।সরকার  যেটুকু ইকুইটি মূলধন আয়ত্ত করবে,সংশ্লিষ্ট শিল্পে নিযুক্ত শ্রমিকগণ যৌথভাবে সেই পরিমাণ অংশের মালিকানা লাভ করবে এবং সেই পরিমাণ অংশের মুনাফার ভাগ পাবে।শ্রমিকরা কেবল ইকুইটি মূলধনের নয়,শিল্প কারখানার ব্যাবস্থাপনায়ও অংশগ্রহণ করবে।এইভাবে শ্রমিক সমাজ যেমন ক্রমান্বয়ে অধিক হারে শিল্পে মালিকানা লাভ করবে তেমনি শিল্প পরিচালনা ও ব্যাবস্থাপনাতেও দক্ষতা অর্জন করতে পারবে।

.

কৃষি ও গ্রামের জনগণ
বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৯০ শতাংশ পল্লী অঞ্চলের অধিবাসী।এদের মধ্যে ৮০ শতাংশ প্রত্যক্ষভাবে কৃষিকর্মের ওপর নির্ভরশীল।কাজেই শোষণমুক্ত এবং  ন্যায় ও সাম্যবাদী সমাজ গঠন বা সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির সফল রূপায়ণ কৃষি ও ভূমি ব্যাবস্থার আমূল সংস্কার ছাড়া সম্ভব নয়।তাই আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টোতে এ সম্পর্কে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।তাতে বলা হয়েছে যে , “কৃষি ও গ্রামের মানুষের অবস্থার উন্নয়নের উপর সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া না হলে আমাদের জাতীয় অর্থনীতির বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধনের সমস্ত পরিকল্পনাই অর্থহীন হয়ে পড়বে।এটা এক দিকে আমাদের গোটা সমাজের সর্বত্র দারিদ্র্য ছড়িয়ে পড়েছে,অন্যদিকে গ্রামে ও শহরের জীবনযাত্রার মানের মধ্যে গুরুতর বৈষম্য রয়েছে।“

.

  এ প্রসঙ্গে ম্যানিফেস্টোতে আরো বলা হয়েছে যে এর পিছনে ঐতিহাসিক কারণ থাকলেও নিকট অতীতে সরকারের বৈষম্যমূলক নীতির জন্য এই বৈষম্য আরো বেড়ে গিয়েছে,ফলে গরীব চাষীর  হাত থেকে সম্পদ ধনী পুঁজিপতিদের হাতে ব্যাপকভাবে পাচার হয়ে গেছে।আওয়ামী লীগ অবিলম্বে গ্রামাঞ্চলের জনগণকে এইরূপ শোষণের হাত থেকে বাঁচাবার অঙ্গীকার করেছে।আর এটা করতে গেলে কৃষিখাতে সুদূরপ্রসারী বিপ্লবের প্রয়োজন।এই ধরণের বিপ্লবের পূর্বশর্ত হল ভূমি ব্যাবহারের বর্তমান পদ্ধতির আমূল পরিবর্তন এবং বহুমুখী সমবায়ের মত নয়া প্রতিষ্ঠান স্থাপন।
.

    কাজেই ঔপনিবেশিক শোষণের নাগপাশ থেকে নিজেদের মুক্ত  করার ঐকান্তিক কামনার সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক ন্যায় নীতি ও অর্থনৈতিক সাম্যের প্রতিশ্রুতি বাংলাদেশের সর্বশ্রেণীর মানুষকে একটি শোষণহীন সমাজ গঠনের জন্য ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করেছে।বাংলাদেশের সর্বশ্রেণীর মানুষের বর্তমান রক্তমোক্ষণ নিছক ভাববিলাশের ফলশ্রুতি নয়।

.

.

দীপংকর ঘোষ দ্বীপ

<৬,৩৭,৭৫-৭৬>

শিরোনামঃ (১) যুদ্ধক্ষেত্রেই সমাধান নিহিত

     (২) জঙ্গীশাহীর সামরিক পাঁয়তারা

সংবাদপত্রঃ জয় বাংলা ১ম বর্ষ, ২৩শ সংখ্যা

তারিখঃ ১৫ অক্টোবর, ১৯৭১

                     যুদ্ধক্ষেত্রেই সমাধান নিহিত

    বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের কথা বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রনায়কদের মুখে প্রায়ই শোনা যায় । মুক্তি সংগ্রামের আশু লক্ষ্যও হচ্ছে রাষ্ট্রের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব অর্থাৎ জনগণের জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করা । কিন্তু সেই রাজনৈতিক সমাধানের লক্ষ্যে পৌছানো যাবে কোন পথে? সশস্ত্র সংগ্রামের দ্বারা চূড়ান্ত বিজয়ের পথে, না আলাপ আলোচনার পথে ?

    স্বভাবতই যাঁরা রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলেন, তাঁরা শান্তিপূর্ণ উপায়ে অর্থাৎ আলাপ আলোচনার পথে সমাধানের কথাই বোঝাতে চান । কিন্তু বাংলাদেশের জাতীয় নেতৃবৃন্দ ১৯৬৯ সালের গোল টেবিল বৈঠক থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ পর্যন্ত এই শান্তিপূর্ণ উপায়ও আলাপ আলোচনার পথই অনুসরণ করেছিলেন । পাকিস্তানী জঙ্গীশাহীই পথ বন্ধ করে বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে । ফলে অস্ত্রের ভাষায় জবাব দেয়া ছাড়া বাংলাদেশের জনগণ ও নির্বাচিত জাতীয় নেতৃত্বের কাছে আর কোন বিকল্প পথ খোলা থাকেনি । এরই ফলে জন্ম নিয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী ।

    সামরিক জান্তা একটা ভাষাই বোঝে । সে ভাষা অস্ত্রের ভাষা । তাই সেই ভাষাতেই তাদের জবাব দেয়া হচ্ছে । সামরিক জান্তা তখনই রাজনৈতিক সমাধানের জন্যে পথে আসতে বাধ্য হবে, যখন তাদের অস্ত্রের ভাষা ফুরিয়ে যাবে । যদি রাজনৈতিক ও সামরিক উদ্যোগ তাদের আয়ত্তে থাকে তাহলে কেন তারা নিজেদের বাড়া ভাতে ছাই দেবে ? শক্তের ভক্ত নরমের যম বলে এদেশে যে প্রবাদটি চালু আছে, অনেকের বেলায় যদি নাও খাটে, সামরিক জান্তার বেলায় তা অবশ্যই খাটে । কাজেই সামরিক জান্তাকে রাজনৈতিক সমাধানের পথে আসতে বাধ্য করার জন্যেও আমাদেরকে পাক হানাদার বাহিনীর ওপর আঘাতের পর আঘাত হানতেই হবে । এটা আমরা ভাল করেই বুঝি । তাই রাজনৈতিক সমাধানের শিখণ্ডী দাড় করিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষকে নিবৃত্ত বা বিভ্রান্ত করা যাবে না ।

    আমাদের নিজস্ব প্রতিনিধির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদও তাই মন্তব্য করেছেন। “ যুদ্ধক্ষেত্রেই বাংলাদেশ প্রশ্নের সমাধান নিহিত । ” বিশ্বের প্রতিটি গণতন্ত্রকামী ও মানবতাবাদী শক্তি এবং রাজনৈতিক সমাধানে বিশ্বাসী নেতৃবৃন্দ এই সত্যটি যত শীঘ্র উপলব্ধি করেন, সমস্যার সমাধানও তত ত্বরান্বিত হবে ।

                      জঙ্গীশাহীর সামরিক পাঁয়তারা

    পাকিস্তানের জঙ্গীশাহীর বাংলাদেশ-পাকিস্তান বিরোধকে সশস্ত্র পাক-ভারত বিরোধ রূপান্তরিত করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে । অবশ্য তাদের এই প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে বেশ কিছুদিন পূর্বেই । তবে এতদিন তা প্রধানত সীমাবদ্ধ ছিল কূটনৈতিক ব্যর্থতা, জঙ্গীশাহীর বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী তীব্র ধিক্কার, অর্থনৈতিক বিপর্যয় ও মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যোদ্ধাদের তীব্র আক্রমণের মুখে দিশেহারা ও পাগলা কুকুরের মতই ক্ষিপ্ত এবং হিতাহিত জ্ঞানশূন্য পিণ্ডি ইসলামাবাদের জঙ্গীশাহী এখন ভারতের সঙ্গে একটি যুদ্ধ বাধিয়ে তোলার চেষ্টা করছে ।

    বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকা এবং পাকিস্তান থেকে মুক্ত অঞ্চলে পাকিস্তানী জঙ্গীশাহীর ব্যাপক সমর প্রস্তুতির খবর পাওয়া যাচ্ছে । শতদ্রু নদীর দক্ষিণ তীর বরাবর পাকিস্তানের ব্যাপক সামরিক সমাবেশ লক্ষ্য করা গেছে । চাম্ব সীমান্তের কয়েকটি পাকিস্তানী গ্রাম থেকে অসামরিক অধিবাসীরা চলে গিয়েছে । মুক্ত অঞ্চল ও ভারতের সীমান্ত বরাবর দখলীকৃত বাংলাদেশে ব্যাপক সামরিক সমাবেশ, ভারী কামান ও অন্যান্য সমরাস্ত্র স্থাপনের খবর পাওয়া গিয়াছে । তাছাড়া ভারতের নদীয়া জেলার সীমান্তে বিনা প্ররোচনায় পাকিস্তানী সেনারা গোলাগুলীবর্ষণ করেছে । এর একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে, কোন রকমে ভারতের সঙ্গে একটা যুদ্ধ বাধিয়ে পাক-ভারতের বিরোধের আবরণে বাংলাদেশ সমস্যাকে চাপা দেয়া এবং এই উপমহাদেশে শান্তি স্থাপনের অজুহাতে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের তদারকির ছত্রছায়ায় বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা বন্ধ করে পাক জঙ্গীশাহীর আত্মরক্ষার চেষ্টা ।

    বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম যে জয়যুক্ত হবেই এবং বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে পাততাড়ি ঘটি-বাটি গুটোতে হবেই এটা জঙ্গীশাহী হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করতে পেরেছে । অথচ তাদের দেশবাসীকে কিম্বা মুক্তিবাহিনীর হাতে নিহত সৈনিকদের পরিবার পরিজনকে বাংলাদেশে সামরিক এ্যাডভেঞ্চারের ব্যর্থতার কৈফিয়ত দেয়া সহজ হয় । তাই একান্তপক্ষে তাদের নিজ দেশের অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তানী জনগণের কাছে মুখ রক্ষার জন্যে পাক ভারত বিরোধের মতো আর একটি সামরিক এ্যাডভেঞ্চারের ঝুকি নেবার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে ।

    বাংলাদেশের ঘটনায় পাকিস্তানী জঙ্গীশাহী বিশ্বের কাছে মুখ পায়নি । এখন তাকে পাক ভারত বিরোধে রূপান্তরিত করলে বিশ্বে কিম্বা নিজ দেশের জনগণের কাছে মুখ থাকবে কিনা তা আমাদের গবেষণার বিষয় নয় । তবে সূত্র ধরে যদি এদেশের মাটিতে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক দলের আগমন ঘটে এবং তারা যদি জঙ্গীশাহীকে ভরাডুবির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য মুক্তিবাহিনীর জাতীয় কর্তব্যে অন্তরায় হতে চান তাহলে বাংলাদেশের জনগণ, গণপ্রজাতন্ত্রী সরকার ও দেশপ্রেমিক বীর মুক্তিযোদ্ধারা তা সহ্য করবে না । পাকিস্তানের জঙ্গীশাহী যখন বাংলাদেশে নির্মম গণহত্যা চালিয়েছে, মা বোনদের ইজ্জত নষ্ট করেছে, ধন সম্পদ লুন্ঠন করেছে ও ঘরবাড়ী জ্বালিয়ে দিয়েছে, নব্বই লক্ষাধিক মানুষকে দেশছাড়া এবং নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের অধিকার হরণ করেছে তখন জাতিপুঞ্জ কোন মানবিক ও নৈতিক দায়িত্ব পালন করেনি । এখন এই উপমহাদেশে শান্তির নামে বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের আশা আকাঙ্কা ও জাতীয় লক্ষ্য অর্জনের পথে কোন অন্তরায় সৃষ্টির চেষ্টাকেই তারা মানবে না । তবে তারা সত্যই যদি এই উপমহাদেশে স্থায়ী শান্তি চান, তাহলে বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধ করতে এবং বাংলাদেশের মাটি থেকে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে চলে যেতে বাধ্য করুন । বাধ্য করুন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে এবং স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে মেনে নিতে । এই উপমহাদেশে স্থায়ী শান্তির এটাই পথ, পাক জঙ্গীশাহীর সামরিক এ্যাডভেঞ্চারিজম নয় ।

.

.

রবিউল হাসান সিফাত
<৬,৩৮,৭৭-৭৭>

শিরোনামঃ বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতাই সমস্যার একমাত্র সমাধানঃ আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা

সংবাদপত্রঃ জয় বাংলা অতিরিক্ত সংখ্যা

তারিখঃ ২৫ অক্টোবর, ১৯৭১

বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতাই সমস্যার একমাত্র সমাধান

আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির দ্ব্যর্থহীন ঘোষণাঃ

বঙ্গবন্ধুর আশু মুক্তির ব্যবস্থা ও বাংলাদেশ সরকারকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দানের জন্য বিশ্বের রাষ্ট্রবর্গের প্রতি আবেদন

গত বৃহস্পতিবার মূলতবী হয়ে যাওয়ার পূর্বে পূর্বনীতির পুনরুল্লেখ করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দ্ব্যর্থহীন ও স্পষ্টভাবে ঘোষণা করা হয় যে, পূর্ণ স্বাধীনতাই বাংলাদেশ সমস্যার একমাত্র সমাধান। ওয়ার্কিং কমিটি এই সংগ্রাম ত্বরান্বিত করার জন্য বলিষ্ঠ শপথ গ্রহণ করে।

*

ওয়ার্কিং কমিটির অপর এক প্রস্তাবে বাঙ্গালী জাতির অবিসম্বাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আশু মুক্তির জন্য প্রতোক্ষ কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্র ও জাতিসংঘের প্রতি আহবান জানান হয়।

*

ওয়ার্কিং কমিটি জনগনের বিপুল ভোটে নির্বাচিত আওয়ামী কীগ দলীয় সদস্যদের সদস্য পদ খারিজ করে তদস্থলে ইয়াহিয়ার উপ নির্বাচন অনুষ্ঠান প্রচেষ্টাকে ‘ধৃষ্ঠতার পরিচায়ক এবং বিশ্ব জনমতকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা’ বলে অভিহিত করে এবং এ প্রসঙ্গে স্পষ্ঠভাবে ঘোষণা করে যে বাঙ্গালী জাতি ও আওয়ামী লীগ স্বাধীন বাংলার জাতীয় জীবনে তথাকথিত পাকিস্তানীদের কোন হস্তক্ষেপই সহ্য করবে না।

*

ভারতসহ বিশ্বের যে সমস্ত রাষ্ট্র বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের মুক্তি ও স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতি অকুন্ঠ সমর্থন জ্ঞাপন করেছে আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটি তাদের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।

*

আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির প্রস্তাবে বিশ্বের প্রতিটি মানুষ ও যে সমস্ত সংবাদপত্র প্রচার মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন দান করেছেন তাদের প্রতি সংগ্রামী অভিনন্দন জানান হয়। সাথে সাথে ওয়ার্কিং কমিটি বাংলাদেশের ইয়াহিয়া চক্রের নজীরবিহীন গণহত্যা, নারী নির্যাতন ) ধ্বংসযজ্ঞের বিরুদ্ধে মানবতার স্বার্থে সক্রিয় জনমত গঠনের জন্য বিশ্ববাসীর প্রতি আকুল আবেদন জানান।

*

ভারত সরকার ৯০ লক্ষাধিক শরনার্থীকে আশ্রয় দিয়ে ও তাদের ভরণ পোষণের দায়িত্ব নিয়ে মানবতার ইতিহাসে যে নজীর সৃষ্ঠি করেছেন তজ্জন্য আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। সাথে সাথে ওয়ার্কিং কমিটী দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেন যে, জাতিধর্ম নির্বিশেষে ভারতে আশ্রিত প্রতিটি শরণার্থীকে সসম্মানে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার ব্যপারে আওয়ামী লীগ বদ্ধপরিকর।

.

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!