শিরোনাম | সংবাদ পত্র | তারিখ |
সম্পাদকীয় জনযুদ্ধের জনশিক্ষা |
বাংলার মুক ১ম বর্ষ ঃ ৪র্থ সংখ্যা |
০৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ |
[বিপ্লবি বাংলাদেশঃ বরিশাল হতে প্রকাশিত একটি সাপ্তাহিক। রফিক হায়দার কর্তৃক চাঁপা প্রেশ হতে মুদ্রিত ও সম্পাদক নুরুল আলম কর্তৃক প্রকাশিত।]
সম্পাদকীয়
জনযুদ্ধের জনশিক্ষা
জনযুদ্ধের দুটি দিক আছে। একটি হলো যারা সরাসরি লড়াই করবে, অর্থাৎ ’কম্ব্যাট ফোর্স বা কমান্ডো’। সংখ্যায় তারা জনগনের সামান্য অংশ।আর জনগনের বৃহদাংশ হলো ‘মেটিভেশনাল আর্মি’। তারা জনগণকে বিপ্লব সম্পর্কে সচেতন রাখে, জনগেণের মনোভাব অবিচল রাখতে সাহায্য করে, শত্রুপক্ষকে ভুল বোঝায়, শত্রুপক্ষ সম্পর্কে তথ্য জোগাড় করে, এবং সর্বোপরি কমান্ডোরা যাতে সবরকম সাহায্য পায় তার চেষ্টা করে। এইসব কাজকর্মের মধ্য দিয়ে ‘মেটিভেশনাল আর্মি’ জনগণের বিপ্লবি মনোভাব গড়ে তোলে। ফলে বিপ্লবের কাজ আরো দ্রুততর হয়। আর মেটিভেশনাল আর্মির কার্যকলাপের উপর নির্ভর করে এগোতে থাকে কমান্ডোদের যুদ্ধ ও অন্তর্ঘাতমুলক ব্যবস্থা।
বালাদেশের জনযুদ্ধ তথা মুক্তিযুদ্ধেরও এই দুটি দিক রয়েছে। একটি হচ্ছে কমান্ডো তথা মুক্তিযেদ্ধারা, অপরটি হচ্ছে জনগণের বাকি অংশ অর্থ্যাৎ মোটিভেশনাল আর্মি। মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য হাসিমুখে প্রাণ দিচ্ছে। কিন্তু এসবই বিপল হবে, যদি জনগণ প্রস্তুত না হয়।আর এই প্রস্তুতির জন্য চাই মোটিভেশনাল আর্মি।
মোটিভেশনাল আর্মি কারা এবং তাদের ঠিক কি কি করতে হবে। মোটিভেশনাল আর্মিকে বলা যায় প্রস্তুতি বাহিনী। তাদের মোটামুটি কাজ হলো জনগণকে প্রস্তুত করা। এই প্রস্তুতি বাহিনী গঠন করতে হবে আমাদের মধ্য থেকেই। এতে আপনিও আছেন, আমিও আছি, সমগ্র বাংলাদেশ আছে।মোটিভেশনাল আর্মি তৈরি করা ও তাদের কার্যপদ্ধতির কিছু কিছু অংশ এখানে দেওয়া হলো। এগুলির মধ্যে আপনি যা যা করতে পারেন সেগুলি করতে আরম্ভ করুন।
মোটিভেশনাল আর্মি বা প্রস্তুতি বাহিনীর গোড়াপত্তন হবে তাদের দ্বারাই যারা ব্যক্তিগত জীবনে সৎ ও আদর্শবাদী হবে এবং হাজার বিপদে ভেঙ্গে পড়বেনা। প্রস্তুতি বাহিনীর মনোবল খবই বেশি হওয়া আবশ্যক, কারন তারাই সাধারন লোকদের সাহস যোগাবে। প্রস্তুতি বাহিনীর প্রশাসন সম্বন্ধেও জ্ঞান থাকা প্রয়োজন, যেহেতু অনেক সময়েই তাদের উপর প্রশাসনের দ্বায়িত্ব পড়বে। তাদের হতে হবে কষ্ট সহিষ্ঞু এবং জনগণের সথে মিলে যাবার গুণ থাকা দরকার। সর্বোপরি তাদের থাকবে চারিত্রিক দৃড়তা, সেবাপরায়ণতা এবং সাবধানতা ও গোপনীয়তা অবলম্বন করার ক্ষমতা।
এই প্রস্তুতি বাহিনীর সামনে তিনটি দ্বায়িত্ব রয়েছে। প্রথমতঃ প্রস্তুতি, দ্বিতীয়তঃ মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করা এবং তৃতীয়ত সংবাদ সরবরাহ করা। প্রথমে জনপ্রস্তুতি সম্পর্কে আলোচনা করা যাক।
জনপ্রস্তুতি বলতে আর কিছুই নয়, মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্ত্ব ও দ্বায়িত্ব সম্পর্কে জনগণকে ওয়াকিপহাল করে তোলা। তাদের বোঝানো যে এ লড়াই তাদের মুক্তির লড়াই। মুক্তিযোদ্ধাদের সাফল্য হবে জনগণেরই সাফল্য। তাই বাংলাদেশের একমাত্র উপায় হলো মুক্তিসংগ্রামীদের সর্বপ্রকারের সহায়তা করা। তাছাড়া জনগণের দেশপ্রেম জাগিয়ে তুলতে হবে। তাদের জানাতে হবে যে তারা শুধু স্বাধীন বাংয়লাদেশের আশা করবে তাই নয়, তারা সোনার বাংলা তৈরি করবে। বিগত ২৪ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করে তাদের বোঝাতে হবে কিভাবে পশ্চিম পাকিস্তানী প্রভুরা বাংরাদেশে একটানা অত্যাচার চালিয়েছে। এবং বিশ্বের অন্যান্য মুক্তিযুদ্ধের ফলে কিভাবে অত্যাচারী শাসকদের পতন হয়েছে তা জনসাধারনকে জানাতে হবে, বোঝাতে হবে যে বাংলাদেশে সেইভাবে অত্যাচারী শাসকদের পতন ঘটতে চলেছে।
এসব কাজ করার জন্য গ্রামে ও শহরে প্রস্তুতি বাহিনী তৈরী করা আবশ্যক। এ দ্বায়িত্ব প্রতিটি বাড্গালীর। আপনিও এগিয়ে আসুন। প্রথমে আপনার প্রতিবেশিকে মুক্তিযুদ্ধে জয়লাভ সম্পর্কে বোঝান। পরে আস্তে আস্তে অঞ্চলবাসীকেই বুঝিয়ে দলে আনুন। দেসাত্ববোধক সঙ্গিত, বিগত শোষণের ইতিহাস, পাক সৈন্যের সাম্প্রতিক বর্বরতার কাহিনী এবং তার বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের জয়যাত্রা ইত্যাদি বলে জনগণের দেশপ্রেম জাগ্রত করুন, পাক জঙ্গীশাহীর উৎখাত আরো দ্রুততর করুন। আর লক্ষ্য রাখুন যে আপনার অঞ্চলের প্রতিটি লোক যেন মুক্তিযোদ্ধাদের যথাসাধ্য সাহায্য করে।
প্রস্তুতি বাহিনীর দ্বিতীয় কাজ হলো মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করা। তার জন্য প্রস্তুতি বাহিনীকে জানতে হবে কোথায় মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেওয়া যেতে পারে, রসদই বা কোথায় পাওয়া যাবে এবং কোন পথে নিরাপদে চলাফেরা করা যায়, ইত্যাদি।
এ প্রসঙ্গে অনিবার্যভাবেই এসে পড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের তৃতীয় দ্বায়িত্ব, অর্থাৎ সংযোগ ও সংবাদ সরবরাহের কথা। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ এবং এর উপরেই মুক্তিফৌজের জয় নির্ভর করবে। এই কাজটি হলো নানা জায়গায় যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করা, শত্রুসৈন্য সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে মুক্তিযোদ্ধাদের তা দেওয়া, এবং মুক্তিফৌজের গুরুত্বপূর্ণ বিজয় বার্তাগুলো জনগণের কাছে পৌছে দেওয়া।
এসব ছাড়াও প্রশাসন চালানো, আহতদের সেবা শুশ্রুষা, অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপ ইত্যাদি সম্বন্ধে প্রস্তুতি বাহিনীর সুস্পষ্ট ধারনা থাকা আবশ্যক, এবং প্রয়োজন হলেই প্রস্তুতি বাহিনীকে এসব করতে হবে।
আবার জানাচ্ছি, প্রস্তুতি বাহিনীর মনোবল হওয়া উচিত অত্যন্ত দৃড়। যুদ্ধে ক্ষয়-ক্ষতি থাকেই। কাজেই তাৎক্ষণিক জয়-পরাজয়ে প্রস্তুতি বাহিনী বিচলিত হবেনা। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত,তারা জনগণকে বোঝাবে যে, সথ্যের জয়, ণ্যায়ের জয়, মুক্তিযুদেধর জয় অবশ্যম্ভাবী ।
মনে রাখবেন, আপনার স্বাধীনতা আনবার জন্য মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করছে, হাশিমুখে জীবন দান করছে। তাদের সাহায্যের জন্য আপনার কর্ত্যব্য হলো প্রস্তুতি বাহিনী তৈরি করা। সোনার বাংলার সোনার বাঙ্গালী হতে গেলে আপনার এই কর্ত্যব্যের কথা বুলবেন না।
————-
.
.
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
<৬,১২২,২০২>
শিরোনাম | সংবাদ পত্র | তারিখ |
সম্পাদকীয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ |
বিপ্লবী বাংলাদেশ ১ম বর্ষঃ ৫ম সংখ্যা |
১২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ |
সম্পাদকীয়
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রস্তুতি বাহিণীর কর্তব্য ও ভূমিকা সম্বন্ধে আগেই বলা হয়েছে।েএবার তাদের কর্তব্যগুলি কিভাবে পালন করবে তা জানা দরকার। কিন্তু এটা জানবার আগে বুঝতে হবে যে বাংলাদেশে গেরিলা পদ্ধতির গুরুত্ব ও প্রয়োজনন কতখানি।
গেরিলা যুদ্ধের সবচেয়ে দরকারী তিনটি বিষয় হলো সমগ্র জনগণের যুদ্ধে সাহায্য করা, লড়াইয়ের সঠিক স্থান ও কৌশল নির্বাচন করা এবং দীর্ঘদিন ধরে সর্বদাই একটু একটু করে শত্রু নিধন করা। এই তিনটি বিষয় একটু আলোচনা করে দেখা যাক।
প্রথমে দেখা যাক সমগ্র জনগণকে যুদ্ধে সাহায্য করানোর ব্যাপারটা। এটা জানা দনকার যে গেরিলা লড়াইয়ের মত জনসমর্থনের প্রয়োজন আর কোন যুদ্ধে হয়না। সাধারনতঃ যুদ্ধে সৈন্যবাহিনী লড়াই করে চলে, এবং জনসাধারন তাদের জীবনযাত্রা প্রায় স্বাভাবিকভাবে চালাতে থাকে। কিন্তু গেরিলা যুদ্ধে প্রায় প্রত্যেককেই অংশগ্রন করতে হয়। ভিয়েতনামে দেখাগেছে যে হয়তো কখনো মা বাচ্ছাকে খাওয়াচ্ছে, কখনো বা সে ক্ষেতে চাষ করছে, আবার কখনোবা শত্রুপক্ষের গতিবিধি ক্ষমতা মনোভাব ইত্যাদি সম্বন্ধে তথ্য সংগ্রহ করছে, এমনকি প্রয়োজনে বন্দুকও ঘাড়ে নিচ্ছে।বাংলাদেশের গেরিলা যুদ্ধে এই অবস্থানই ঘটেছে। বর্বর পাক সৈন্য ভেবেছিল যে পাশবিক অত্যাচারের দ্বারা বাঙ্গালীর মুখ বন্ধ করে রাখবে। কিন্তু বিগত ২৪ বছর একটানা পশ্চিমী শোষণের মুখোশ আজ খসে পড়েছে। তাই প্রত্যহ দলে দরে জনসাধারণ মুক্তিফৌজে যোগদান করছে। এই রকম অসাধারণ জনসমর্থনই গেরিলা যুদ্ধে প্রয়োজন।
দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে লড়াইয়ের স্থান এবং কৌশল স্থির করা আবশ্যক। গেরিলা লড়াইয়ে যে ধরনের স্থানের প্রয়োজন তা বাংলাদেশে যথেষ্ট রয়েছে। এইসব স্থান হলো জঙ্গল, পাহাড়, খাল-বিলওয়ালা অঞ্চল ইত্যাদি। এগুলোর সঠিক ব্যবহারের ফলে মুক্তিফৌজ ক্রমাগত জয়ের পথে এগিয়ে চলছে। সেই সঙ্গে যখন যেরকম কৌশল কাজে লাগানো যায়, সেরকম কৌশল নেওয়া হচ্ছে।
আর তৃতীয় বিষয় হলো দীর্ঘদিন ধ েসর্বদাই একটু একটু করে শত্রুর ক্ষতি ঘটিয়ে যাওয়া। এ ব্যাপারটা অত্যন্ত জটিল। কারণ, সাধারণত যুদ্ধে দেখা যায়যে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যুদ্ধের মিমাংশা করার চেষ্টা করা হয়। যেহেতু দিনের পর দিন সৈন্যবাহিনীর রসদ অস্ত্র-শস্ত্র যোগান দিয়ে ওঠা অত্যন্ত কষ্টকর। কিন্তু গেরিলারা জনগণেরই অংশ তাই তাদের রসদের অভাব হয়না। সমস্ত জনহণ মুক্তিফৌজের প্রয়োজনীয় রসদ জোগাড় করে দেয়। বাংলাদেশের জনগণও আজ তাই দৃড় প্র্রতিজ্ঞ হয়ে মুক্তিফৌজের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। সবারই একমাত্র প্রতিজ্ঞা – ‘বাংলা মা’ কে পাক হানাদার বাহিনীর হাত থেকে মুক্ত করবো।
.
.
মোঃ আহসান উল্লাহ
<৬,১২৩,২০৩-২০৪>
সংবাদপত্রঃ বিপ্লবী বাংলাদেশ ১ম বর্ষঃ ৫ম সংখ্যা
তারিখঃ ১২ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১।
.
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কি এবং কেন
মোহাম্মদ আলী খান
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর হতে বাংলাদেশের মানুষ চরম অত্যাচার, শোষণ, উৎপীড়নের বিরুদ্ধে প্রকৃত স্বায়ত্ত্বসাশনের লক্ষ্য অর্জনের মানসে গণতান্ত্রিক অধিকার,অর্থনৈতিক এবং সামাজিক অগ্রগতি সাধনের জন্য অবিচল প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। দীর্ঘদিন এই স্বাধিকার আন্দোলন পরিচালনা করতে কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, জনতা অত্যাচার, নিপীড়ন, লাঞ্ছনা, নিষেধাজ্ঞা, গ্রেপ্তার এবং সামরিক আইনের বহু বাধাকে উপেক্ষা করেছে। বাংলার জনগণের ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তাকে ধ্বংস করার জন্য প্রতিক্রিয়াশীল জালেমরা বারবার ট্যাঙ্ক, কামান ও বোমারো বিমান ব্যবহার করে ব্যাপক নরহত্যা ও ধ্বংসের প্লাবন বইয়ে দিয়েছে। অত্যাচারী নরখাদক বর্বর পশুর দল নির্মমভাবে হত্যা করেছে লক্ষ লক্ষ নিরীহ নারী পুরুষ শিশুকে, লক্ষ লক্ষ বাড়ি ঘর ছাই করে দিয়েছে। ওরা লুট করে নিয়েছে আমাদের সুখের সংসার। শ্মশান করেছে সোনার বাংলা , ধ্বংস করেছে আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য , ভেঙ্গে দিয়েছে অর্থনৈতিক কাঠামো।
.
গনপ্রতিনিধিগন কখনো পাকিস্তান হতে বাংলাদেশেকে বিচ্ছিন্ন করতে চাননি। কিন্তু গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে স্বায়ত্ত্বশাসনের দাবীকে অস্বীকার এবং নির্মমভাবে প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে বর্বর সামরিক আক্রমণ শুরু করার পরেই তাঁরা গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করেন।
.
তাই বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি বাঙালি আজ পাকিস্তানী হানাদারদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার দুর্জয় বিপ্লবী সংগ্রামে লিপ্ত। এই বিপ্লবী যুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালিরা তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার চূড়ান্ত রূপ দেবে।
.
যুগে যুগে বিভিন্ন দেশের আপামর জনসাধারণ অত্যাচার, অন্যায়, জালেম, শোষকের বিরুদ্ধে নিরুপায় হয়ে মুক্তিযুদ্ধ ঘোষণা করেছে । আজও কয়েকটি দেশে সাম্রাজ্যবাদী, শোষণের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড মুক্তিযুদ্ধ ঘোষণা চলছে। আমরা বাঙ্গালীরাও বিশ্বের ইতিহাসে এই চরম শিক্ষাকে গ্রহণ ক্করতে বাধ্য হয়েছি, ভবিষ্যতেও অত্যাচারী শোষিত মুক্তিকামী মানুষ তার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য এই চরম ও পরম পথকে বেছে নিতে বাধ্য হবে।
.
মুক্তিযুদ্ধ কি ? মুক্তিযুদ্ধ কেন ? কীভাবে মুক্তিযুদ্ধে জয়যুক্ত হতে হয় একথা বুঝতে পারলে, শিখতে পারলে যতদিনই মুক্তি চলুক না কেন, যত বাধাই আসুক না কেন, তা দেখে হতাশ হয়ে পরার কারণ নেই। মানুষ তখনই হতাশ হইয়ে পড়ে যখন সে এমন কিছুর সম্মুখীন হয় যা তার কাছে অপ্রত্যাশিত। যদি মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে মুক্তিযোদ্ধার মনে একটা সুস্পষ্ট ধারনা থাকে তবে মুক্তির পথে চলতে কোনদিনই তাঁরা নিরাশ হয়ে পড়বে না। যতই তাদের ধারনা সুস্পষ্ট হবে ততই তাদের প্রেরনা বাড়বে । ভাবাবেগের দ্বারা মুক্তিযুদ্ধ হয় না। রাইফেল চালাতে জানলেই মুক্তিযোদ্ধা হওয়া যায় না। মুক্তিযোদ্ধাকে মনে প্রানে অবশ্যই বিপ্লবী হতে হবে। কেন আজ তাকে এই চরম পরম পথকে বেছে নিতে হয়েছে তা ভালভাবে হৃদয়ংগম করতে হবে। বিপ্লবী যোদ্ধার বড় অস্র হচ্ছে তার বিপ্লবী প্রেরনা, বৈপ্লবিক কর্মতৎপরতা। বিপ্লবী যোদ্ধাকে অস্ত্র হাতে তুলে দিতে হয় না। শত্রুর কাছ থেকে বিপ্লবী অস্ত্র কেড়ে নেয়।
.
ইংরেজি ভাষায় revolution মানে পরিবর্তন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে যেকোনো পরিবর্তনকেই কি বিপ্লব বলা চলে? একটি গভর্নমেন্টের পরিবর্তন বা মন্ত্রিদলের পরিবর্তনকে কি বিপ্লব বলবো ? না এসব বিপ্লব নয়, কারণ এতে জাতীয় জীবনধারার পরিবর্তন ঘটে না। জাতীয়, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক জীবনের গণমুখী পরিবর্তন ঘটে না। আইয়ুব খা জনগণের দেওয়া চাকুরী, অস্ত্রশস্ত্র, জনগণের কষ্টার্জিত অর্থে গড়া সৈন্যবাহিনীকে অপব্যবহার করেছে নিজের এবং শোষক দুর্নীতিপরায়ণ ব্যবসায়ী ও সরকারী কর্মচারীদের স্বার্থে। জাতীয় জীবনে গণমুখী মূলগত পরিবর্তন ঘটেনি।
.
বিপ্লবের ফলে যে পরিবর্তন আসে তা মূলগত পরিবর্তন। জনগণের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, চারিত্রিক জীবনের মূলগত পরিবর্তনে নিয়মতান্ত্রিক, স্বাভাবিক পথ যখন বন্ধ হয়ে যায়, তখন নির্যাতিত, বঞ্চিত মানুষকে অস্ত্র ধারন করে বিপ্লবের পথে সমস্ত বাধাকে ধ্বংস করে এগিয়ে যেতে হবে। শোষণের সমস্ত উৎস মুখ ধ্বংস করতে হবে। জাতীয় শ্ত্রুদের নির্মূল করতে হবে। সেই জন্যই রক্তপাত বিপ্লবের একটা অঙ্গ হয়ে দাঁড়ায়। সামান্য ২/৪ টি নগণ্য পরিবর্তনকে বিপ্লব বলা চলে না।
.
বাংলার মানুষ স্বাভাবিক পথে বাঁচতে চেয়েছিল। চেয়েছিল নিয়মতান্ত্রিক সংগ্রামের মাধ্যমে শোষণ, অত্যাচার, অবিচার, জুলুমের হাত থেকে রেহাই পেতে। কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীল পাকিস্তান সরকার এবং তাদের তল্পিবাহক দালালেরা বারবার সে নিয়মতান্ত্রিক সংগ্রামের পথে বিভিন্ন কায়দায় বাধার সৃষ্টি করেছে এবং নির্মম অত্যাচারের মাধ্যমে সংগ্রাম বন্ধ করার চেষ্টা করেছে। তাই বাংলার জনগণের রাজনৈতিক মুক্তি এবং শোষণহীন সমাজব্যবস্থা গঠনের জন্য অস্ত্র হাতে গর্জে উঠতে বাঙালিরা বাধ্য হয়েছে। দেশীয় শাসকবর্গের বিরুদ্ধে বিপ্লব সৃষ্টি করে নতুন সমাজ ব্যবস্থার জন্য বিপ্লব করা অপেক্ষাকৃত সহজ কাজ। কিন্তু প্রথমে বিদেশী শক্তিকে অপসারিত করা এবং তারপর নতুনতর সমাজ ব্যবস্থা সৃষ্টি করা সত্যিই আরও কঠিন কাজ। বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখে তাই আজ কঠিন অগ্নিপরীক্ষা। প্রথমতঃ বিদেশী পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে বিতাড়িত করা, দ্বিতীয়তঃ বাংলাদেশের বঞ্চিত অবহেলিত মানুষের জন্য শোষণহীন সমাজব্যবস্থার সৃষ্টি করা।
.
মোঃ আহসান উল্লাহ
<৬,১২৪,২০৫-২০৬>
সংবাদপত্রঃ বিপ্লবী বাংলাদেশ ১ম বর্ষঃ ৮ম সংখ্যা
তারিখঃ ১০ অক্টোবর,১৯৭১।
সম্পাদকীয়ঃঅবরোধ
.
মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি যেমন বিশাল হওয়া দরকার, তেমনি দরকার জনগণকে বিপ্লবের মূল তথ্যটা বোঝানো। সব দেশের মুক্তিযুদ্ধ একইভাবে পরিচালিত হয় না। স্থান কাল পাত্র ভেদে মুক্তিযুদ্ধের চেহারা পাল্টায়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধও তার নিজস্ব কায়দায় চলছে।
.
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। এটার গোড়াপত্তন হয়েছিল গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে। সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে যারা নির্বাচনে জয়ী হলেন, তাঁদের সরকার তৈরির সুযোগ দেওয়া হল না। উপরন্তু, সামরিক শাসনকর্তারা সৈন্য দিয়ে গণতান্ত্রিক বিপ্লবকে দমাতে গেলেন। ফলে রাতারাতি গণতান্ত্রিক বিপ্লব পরিবর্তিত হয়ে গেল মুক্তিযুদ্ধে। কাজেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে অন্যান্য দেশের মুক্তিযুদ্ধের সাথে তুলনা করা যায় না।
.
যখন গণতান্ত্রিক বিপ্লব রূপান্তরিত হয়ে গেল সশস্ত্র বিপ্লবে, তখন প্রয়োজন ছিল আত্মরক্ষা করার। কারণ মুক্তিবাহিনী গড়ে তুলবার জন্য লোক, অস্ত্র, রসদ, আশ্রয় ইত্যাদি প্রয়োজন। এখন মুক্তিবাহিনী এক সুসংগঠিত বাহিনী হয়ে উঠেছে । তাই এবার চলছে প্রত্যাঘাতের পালা।
.
এই প্রত্যাঘাত করবার দুটি পথ আছে। প্রথমতঃ সরাসরি যুদ্ধ ও অন্তর্ঘাত, দ্বিতীয়তঃ অবরোধ ও অসহযোগ। যুদ্ধ, অন্তর্ঘাত ও অসহযোগ সম্পর্কে প্রায় সবারই কিছু ধারণা আছে। কিন্তু অবরোধই হবে বাংলাদেশের বিপ্লবের প্রধানতম অস্ত্র এবং অবরোধের পর্ব ও বিভিন্ন কৌশল সবাইকে জানতে হবে। শেখ মুজিব একবার বলেছিলেন, আমরা ওদের ভাতে মারবো, আমরা ওদের পানিতে মারবো। সম্ভবতঃ কেউ ধারনাই করতে পারেনি যে কয়েক মাস পরেই এই কথাটি এক চরম সত্য হয়ে দাঁড়াবে।
.
সাধারণ যুদ্ধে যে অবরোধ সৃষ্টি করা হয় তার সাথে মুক্তিযুদ্ধের অবরোধ সৃষ্টির এক মূলগত অভ্যাস আছে। তা হলো সাধারণ যুদ্ধে একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবরোধ সৃষ্টি করা হয়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ যেহেতু দখলকারী সৈন্যের বিরুদ্ধে চালানো হয়, সেহেতু মুক্তিযোদ্ধারা সমগ্র দেশ জুড়ে অবরোধ সৃষ্টি করে। এ অবরোধের মূল লক্ষ্য হল শত্রুকে রসদ যোগাড়ের পথ সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়া।
.
এই অবরোধে শত্রুকে শুধু ঘিরে রাখাই যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন হয় রাস্তা উড়ানোর, ব্রিজ ভাঙ্গার, বন্দর আক্রমণ করার এবং সর্বোপরি বিমান চলাচল ব্যাহত করার। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে এই সব পদ্ধতি সফলভাবে অনুসৃত হচ্ছে।
.
তাছাড়া অবরোধের সাথে অসহযোগ চালানো দরকার। বাংলাদেশের ধান, পাট, ইত্যাদি কৃষিজ দ্রব্য যার উপর পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে উঠেছে। সেগুলো যাতে পাক হানাদারদের হাতে কিছুতেই না পড়ে তার জন্য সতর্ক থাকা দরকার। চাষী ভাইদের চেষ্টা করতে হবে যাতে তাঁরা ধান পাট ইত্যাদি কৃষিজ দ্রব্য মুক্তাঞ্চলে মুক্তি ফৌজের কাছে পৌঁছে দিতে পারেন। এ কাজে তাঁরা মুক্তিফৌজের সহায়তা পাবেন।
.
একইসঙ্গে অসহযোগ ও অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপ চালাতে পারলে অবরোধ সম্পূর্ণতর হবে। তখন দখলকারী সৈন্যরা বাইরের থেকেও কোন সাহায্য পাবে না, ভেতর থেকেও কিছু সংগ্রহ করতে পারবে না।
.
অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপ যথা ট্রেন ওড়ানো, রাস্তা ভাঙ্গা, ব্রিজ ওড়ানো ইত্যাদি করতে গেলে প্রথমে প্রয়োজন বিভিন্নধরনের বিস্ফোরক ও তাদের ব্যবহার সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা। পরে সে সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
.
মুক্তিযুদ্ধের অবরোধের প্রকৃতি বিচার করলে দেখা যায় যে, তা অত্যন্ত দীর্ঘস্থায়ী। পৃথিবীতে এমন দেশও আছে যারা বিগত বিশ বছর ধরে মুক্তিযুদ্ধ চালাচ্ছে। প্রয়োজন হলে বাংলাদেশেও সেরকম করা হবে। এ এক সুদীর্ঘ সুকঠিন সংগ্রাম। এ সংগ্রামে আমাদের জিততেই হবে।
.
মোঃ আহসান উল্লাহ
<৬,১২৫,২০৭-২০৮>
সংবাদপত্রঃ বিপ্লবী বাংলাদেশ ১ম বর্ষঃ ৮ম সংখ্যা
তারিখঃ১০ অক্টোবর,১৯৭১।
.
রাজনৈতিক সমাধান
মেহেরুন আমিন
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অক্ষশক্তি হিটলারের নেতৃত্বে রুশ-জার্মান অনাক্রমন চুক্তি লঙ্ঘন করে সোভিয়েত রাশিয়া আক্রমণ করে। ইয়াহিয়ার পূর্বসূরি হিটলারের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে মাত্র দুসপ্তাহের মধ্যে মস্কোর ক্রেমলিন প্রাসাদে বিজয়োৎসব পালন করবে। রাশিয়া অভিযানই ত্বরান্বিত করল নরপশু হিটলারের বিপর্যয়। ঘটনা প্রবাহ তাকে ও তার মিস্ট্রেস এফা ব্রাউনকে বার্লিন শহরের আন্ডারগ্রাউন্ডেই আত্মহত্যা করতে বাধ্য করে। ইতিহাসের এক নির্মম ধ্বংসলীলা ও হত্যাকাণ্ডের নাটকের যবনিকাপাত দ্রুততর হল।
.
১৯৭০ সালের নির্বাচনে পাকিস্তান নামক এক রাষ্ট্রের অবিসম্বাদিত নেতা নির্বাচিত হলেন বাংলার প্রানপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সারা পৃথিবী শ্রদ্ধাবনত হৃদয়ে মেনে নিল নির্বাচনের রায়। ক্ষমতা লোলুপ পিণ্ডির জঙ্গিশাহী, মুষ্টিমেয় পুঁজিপতি ও কতিপয় পা চাঁটা রাজনৈতিক দালাল সহ্য করতে রাজি হল না জনতার নির্বাচনী রায়। শুরু হল আদি ও অকৃত্রিম পাকিস্তানী মার্কা ষড়যন্ত্র। নেতৃত্বে নেমে এল সেনাপতি ইয়াহিয়া ও তার জঙ্গি দোসর হামিদ, টিক্কা, নিয়াজি, ওমর, পিরজাদা। এদের সঙ্গে দালালির হাত বাড়াল ভুট্টো, কাইয়ুম ও অন্যান্য। ইয়াহিয়া রেডিও মারফত ১ মার্চ জাতীয় পরিষদের প্রথম অধিবেশনের তারিখ অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করল। উত্তরে জাতির পিতা শেখ মুজিব বাংলাদেশব্যাপী অহিংস অসহযোগ আন্দোলন শুরু করলেন। আন্দলনের স্বতঃস্ফূর্ত গতি ও ব্যাপকতা ঘাবড়ে দিল জংগিশাহিকে এবং তাই “মুজিব-ইয়াহিয়া” দীর্ঘ আলোচনার ভণ্ডামির মাধ্যমে সমর প্রস্তুতি সম্পূর্ণ করে ২৫শে মার্চ রাতে নরঘাতক টিক্কা কে লেলিয়ে দেয়া হল তেইশ বৎসরাধিক নির্যাতিত, নিপীড়িত, শোষিত সাড়ে সাত কোটির এক মানবগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে। লাখো লাখো নিরীহ, নিরস্ত্র মানুষ পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিল। ভস্মীভূত হয়ে গেল বাংলার জনপদ ও গ্রামগুলো। নব্বই লক্ষ লোক নিজ দেশের ভিটে মাটি ছেড়ে প্রতিবেশি রাষ্ট্র ভারতে আশ্রয় নিল। হাজারো হাজারো মা-বোনের ইজ্জত লুটে নিল ইয়াহিয়ার পশ্চিমা সেনাবাহিনী। ইয়াহিয়া গ্যাং ঠিক হিটলারের মতই ভেবেছিল যে আটচল্লিশ ঘণ্টায় সোনার বাংলাকে চিরদাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করবে। ছ’মাস চলে গেছে, বাংলার শহরে গ্রামে প্রতিরোধ সংগ্রাম আজ ব্যাপকতায় ভীষণতর হয়ে প্রতিশোধের শেষ পর্যায়ের দ্বারে উপস্থিত। বাংলার স্থল, নৌ ও বিমান বাহিনী প্রস্তুতি নিচ্ছে হানাদার বাহিনীকে চরম আঘাত হানতে। অবাক বিস্ময়ে বিশ্ব চেয়ে দেখছে অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত পশ্চিম পাকিস্তানী ডালকুত্তা বাহিনীর নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার নাটকীয় ঘটনাবলী। রুখতে পারছেনা ডালকুত্তার দল মুক্তিবাহিনীর স্থল ও নৌ আক্রমণের দুর্বার গতি। ইয়াহিয়া দিকে দিকে দালাল পাঠাচ্ছে। নিজেও দোস্ত ইরানের শাহের দরজায় মাথা কুটছে একটি রাজনৈতিক মীমাংসার জন্য।
.
রাজনৈতিক সমাধান কি সম্ভব? রাজনৈতিক দাবার গুটি যে আজ ইয়াহিয়ার হাতের বাইরে। ইয়াহিয়া ও তার গ্যাং ধ্বংস করে দিয়েছে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে তৈরি জিন্নার সাধের পাকিস্তান। ঐ ধ্বংসস্তূপের মধ্যে জন্ম নিয়েছে এক নতুন জাতি এবং তাঁদের প্রানপ্রিয় স্বাধীন, সার্বভৌম গনপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশ। পশ্চিম পাকিস্তানের পুঁজিপতি দলের এক বিরাট অংশ আজ ইয়াহিয়ার ঘোর বিরোধী। কলকারখানার হাজার হাজার শ্রমিক আজ চাকুরী থেকে বরখাস্ত। মুষ্টিমেয় কয়েকজন জেনারেল ভিন্ন অন্য সেনানীমণ্ডলী ইয়াহিয়ার অবিমৃষ্যকারিতায় তার প্রতি বিরুপ। ইয়াহিয়ার বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র বলে স্বীকৃতি দেওয়ার অর্থ দাঁড়াবে পশ্চিম পাকিস্তানের এতদিনকার জৌলুসে গড়া শিল্প, বাণিজ্য, চাকরি-বাকরি ও সেনাবাহিনীর চরম বিপর্যয়। তারা হারাবে বাংলাদেশে সাজান ঔপনিবেশিক বাজার। ইয়াহিয়ার সাধ্য নেই যে সে বাংলাদেশেকে স্বাধীন বলে স্বীকার করে নেয়। তাই বাংলাদেশ আজ ইয়াহিয়ার গলার কাটা এক গেলাও যাচ্ছে না বা ফেলতেও পারা যাচ্ছে না। সাধু সজ্জন ব্যাক্তিরা বলেন যে ইংল্যান্ড যেভাবে পাক-ভারত সমস্যার সমাধান করেছে সেভাবেই বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সমস্যার সমাধান হতে পারে। তারা ভুলে যান যে ব্রিটিশ জাতির পাক-ভারত নীতি নির্ধারিত হয়েছিল ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টে এবং তার সম্পূর্ণ দায়িত্ব বর্তেছিল ইংল্যান্ডের আপামর জনসাধারনের উপর। পাকিস্তানের বর্তমান চণ্ড নীতি নির্ধারণ করেছে ইয়াহিয়া গ্যাং। বারো কোটি অধ্যুষিত অধুনালুপ্ত পাকিস্তানের জনগণের কোন সম্পর্ক ছিল না এই বর্বর জংগিনিতির সঙ্গে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্ণ দায়িত্ব বর্তাবে বলদর্পী জংগিশাহি ও তার মুষ্টিমেয় অনুচরদের উপর। সেই ভীষণ দিনে রুদ্ধ আক্রশে ফেটে পড়বে পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্যবাহিনী, পুঁজিপতি গোষ্ঠী ও জনসাধারণ। তা থেকে ইয়াহিয়া ও তার মন্ত্রদাতাদের বাঁচবার কোন উপায় থাকবে না। তাই আজ ইয়াহিয়াকে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এই আত্মঘাতী যুদ্ধ চালিয়ে যেতেই হবে। ইয়াহিয়া অবশ্যই বুঝতে পেরেছে যে অনির্দিষ্টকাল এ যুদ্ধ চালাবার ক্ষমতা তার নেই। চীন মার্কিন সাহায্যও তাকে টিকিয়ে রাখতে পারবে না পিণ্ডির সিংহাসন। অথচ ইয়াহিয়া এও জানে যে বাঙ্গালি জাতিকেও এই যুদ্ধ চালাতেই হবে জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে। কোন মীমাংসা পাকিস্তানী কাঠামোর মধ্যে হবে না ও হতে পারে না। ইয়াহিয়ার এখন একমাত্র উপায় পাক-ভারত যুদ্ধ বাধিয়ে নিরাপত্তা পরিষদের হস্তক্ষেপে বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান বের করার চেষ্টা করা। সেক্ষেত্রে হয়তো সে ও তার বশম্বদরা পশ্চিম পাকিস্তানী জনসাধারনের আক্রোশ থেকে জীবনে বেঁচে যেতে পারে। অন্যথায় হার্মাদ ইয়াহিয়া ও তার স্তাবকদের হিটলারের মতই আত্মঘাতী হয়ে নরকের বংশ বৃদ্ধি করতে হবে।
.
কিন্তু এতসবের পরেও একটা মোদ্দাকথা এই যে রণক্ষেত্রে আমাদের জাতীয় সম্মিলিত সেনাবাহিনীর ক্রমাগত দাঁতভাঙ্গা জবাবই শুধু লম্পট ইয়াহিয়া হানাদার বাহিনীকে বাধ্য করবে বাংলার পবিত্র মাটি ছেড়ে যেতে এবং সেখানেই নিহিত রয়েছে বাংলাদেশ সমস্যার একমাত্র সমাধান।
.
মোঃ আহসান উল্লাহ
<৬,১২৬,২০৯>
সংবাদপত্রঃ বিপ্লবী বাংলাদেশ ১ম বর্ষঃ ৮ম সংখ্যা
তারিখঃ ১০ অক্টোবর,১৯৭১।
বিশ্বের মুক্তিকামী সরকার বাংলার মুক্তিবাহিনীকে অস্ত্র দিন। (রাজনৈতিক ভাষ্যকার)
বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা আজ দুর্বার দুর্জয়। প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধা আজ একটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। পাক জঙ্গিশাহীর লেলিয়ে দেওয়া হানাদার বর্বর নরপশুগুলোকে তাড়িয়ে দেওয়ার প্রতিজ্ঞায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ বাংলার অসম সাহসী মুক্তিযোদ্ধারা। তাঁদের জীবনের একমাত্র পণ হয় মুক্তি নয় মৃত্যু। মৃত্যুকে আজ আর ভয় পায় না বাংলার তরুণ শক্তি। মৃত্যুকে জয় করেছে বাংলার মানুষ এক করুণ বাস্তবতার মধ্য দিয়ে। বাংলার মানুষ আজ মুক্তিপাগল। বাংলার মানুষ দেখেছে ইয়াহিয়ার নাৎসিবাহিনীর পৈশাচিক উল্লাস। তাইতো বাংলাদেশ আজ নাপাম বোমার মত জ্বলছে। জ্বলছে তাদের পুড়িয়ে মারবার জন্য যারা সোনার বাংলাকে শ্মশান করেছে, যারা বাংলার ছায়াসুনিবিড় নীড় ভেঙ্গেছে, যারা বাংলার বুকে হিংস্র হায়েনার মত থাবা বিস্তার করেছে। বাংলাদেশের প্রতিটি ঘর এক একটি দুর্জয় ঘাটি। প্রতিটি ঘাটিতে আজ এক দারুন উৎকণ্ঠা। প্রতিটি ঘাঁটির প্রতিটি মানুষ প্রতীক্ষায় উন্মুখ। বিশ্ব এগিয়ে আসবে তাদের পাশে, তাদের হাতে তুলে দেবে মারণাস্ত্র। আর তা নিয়ে ঝাপিয়ে পরবে অসুর শক্তির করবে বাংলার শক্তি। বাংলার মানুষ অন্ন চায় না, বস্ত্র চায় না, চায় শুধু অস্ত্র। অস্ত্র পেলে বাংলার মানুষ দেখিয়ে দেবে কেমন করে স্বীকৃতি পাওয়া যায়। তাই বাংলার প্রতিটি মানুষের একমাত্র আবেদন বিশ্বের মুক্তিকামী জনতা ও সরকারের কাছে, যেন সর্বরকমের অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করে বাংলার মুক্তিকামী মানুষকে।
.
.
দীপংকর ঘোষ দ্বীপ
<৬,১২৭,২১০-২১১>
শিরোনামঃ তথ্য সংগ্রহ ও অন্য কাজ
সংবাদপত্রঃ বিপ্লবী বাংলাদেশ ১ম বর্ষঃ ৯ সংখ্যা
তারিখঃ ১৭ অক্টোবর, ১৯৭১
তথ্য সংগ্রহ ও অন্য কাজ
গেরিলা যুদ্ধের মূল নীতিই হলো ‘হিট এন্ড রান’ অর্থাৎ আঘাত করো এবং করেই সরে পড়ো । কিন্তু সাধারণ বুদ্ধিতেই বোঝা যায় যে, শত্রু জোরালো হোলে তাকে আঘাত করা সহজ নয় । তখন শত্রুকে প্রথমে দুর্বল করে নিতে হয়, অথবা তার দুর্বলতম স্থান খুঁজে বার করতে হয় । শত্রুকে দুর্বল করে তুলতে হলে তার সংযোগগুলো ছিন্ন করা প্রয়োজন । এ কাজটা অবরোধের পর্যায়ে পড়ে, যা আগেই আলোচনা করা হয়েছে । আর শত্রুর দুর্বলতম স্থান খুঁজে বের করতে হলে চাই শত্রু সম্বন্ধে তথ্য সংগ্রহ করা, অর্থাৎ জনসংযোগ । এ সম্বন্ধেও আগে লেখা হয়েছে । এবার আলোচ্য বিষয় হলো ঠিক কোন উপায়ে বাংলাদেশে মুক্তিবাহিনী এই ধরনের কার্যকলাপ চালাতে পারে ।
প্রথমে তথ্য সংগ্রহের কথাই আলোচনা করা যাক । গ্রামাঞ্চলে তথ্য সংগ্রহ করবে গ্রামবাসীরাই । তাদের সামান্য শিক্ষা দিলেই তারা হানাদার পাক সৈন্যদের সম্বন্ধে খবর জোগাড় করতে পারে । যথাঃ-
১। ছাউনীর আয়তন ও তার পাহারার ব্যবস্থা, যা থেকে অনুমান করা যেতে পারে যে মোটামুটি কতজন সৈন্য সেখানে আছে ।
২। গাড়ীর সংখ্যা ও সেগুলির সৈন্য বহন ক্ষমতা ।
৩। সাধারণতঃ কি ধরনের ও কতো অস্ত্র নিয়ে সৈন্যরা চলাফেরা করে ।
৪। পেট্রলের প্রাপ্তিস্থান ও পরিমাণ, যার থেকে আন্দাজ করা যেতে পারে গাড়ী নিয়ে পাক সৈন্য কতদুর অবধি হানা দিতে পারে ।
৫। গাড়ীগুলোতে কি কি অস্ত্র বহন/চালনার ব্যবস্থা আছে ।
৬। গাড়ী চলবার মত রাস্তা কোথায় কোথায় আছে ।
৭। জলযান আছে কি না, এবং থাকলে গাড়ীর মতোই সেগুলো সম্বন্ধেও তথ্য সংগ্রহ ।
৮। রসদ আসে কোন পথ দিয়ে, কবে কবে, কখন কখন, এবং তার সাথে কি ধরনের/পরিমানের প্রহরা থাকে ।
৯। ছাউনীর কাছে ধারে আড়াল রেখে মুক্তিবাহিনীর লড়াই চালাবার মতো কোন ঝোপ-জঙ্গল, টিলা-পাহাড়, নদ-নদী আছে কিনা, এবং থাকলে কতো আছো ।
১০। মুক্তিবাহিনী কোন পথে যাতায়াত করতে পারে, কিভাবে এবং কখন ।
১১। পাক সৈন্য কখন বিশ্রাম করে বা অসতর্ক থাকে ।
এসব তথ্য সংগ্রহ করা একটা অসম্ভব কিছু ব্যাপার নয় । সামান্য নজর রাখলেই দুয়েকজন গ্রামবাসী দশ পনেরো দিনে এইসব খবর যোগাড় করে দিতে পারে ।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে এসব খবর তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয় । কিন্তু একটু ভেবে দেখলেই বোঝা যাবে যে এই “সামান্য” খবরগুলো পেলেই মুক্তিবাহিনী পাকসৈন্যর একটা ছাউনী আক্রমণ করতে পারে ।
শহরের বাসিন্দাদের পক্ষে তথ্য সংগ্রহের কাজটা এতো সহজ নয় । তাদের জানতে হবে প্রতিটি অস্ত্রের পরিচয় ও ক্ষমতা । এর কারণটা খুবই সহজ । গেরিলাদের বারবার আক্রমণে পাকসৈন্য উত্ত্যক্ত হয়ে উঠলে হয়তো তারা ভারী অস্ত্র এনে গেরিলাদের গোপন-ঘাঁটিসহ একটা বসতি অঞ্চল ধ্বংস করে দিতে পারে । কাজেই শহর অঞ্চলের তথ্য সংগ্রহকারীকে জানতে হবে, ঠিক কোন অস্ত্রের সাহায্যে বাড়িগুলো ধ্বংস করে দেয়া যায় । এবং তাদের লক্ষ্য রাখতে হবে হানাদার সৈন্যরা ঐ ধরণের কোন অস্ত্র সমবেশ করছে কিনা । আর যদি তা না করে, তাহলে শুধু পাকসৈন্যর গতিবিধির ও ক্ষমতা সম্বন্ধে খবর সংগ্রহই যথেষ্ট ।
এ পর্যন্ত যা বলা হলো তা হচ্ছে শত্রুর দুর্বলতম স্থান খুঁজে বের করা অর্থাৎ তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে শত্রুর কোথায় জোর কম তা জানা, এবং সেই জায়গাতে শত্রুকে আঘাত করা । প্রথম দিকে আঘাত মানে আত্মরক্ষা, কৌশলশিক্ষা ও অবরোধ । পরে অবরোধের ফলে শত্রুর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে, শত্রুর রসদ কমে গেলে, এক কথায় শত্রুদুর্বল হয়ে পড়লে, শত্রুকে আঘাত করা সহজ হয় ।
“ বাংলাদেশে পাক দখলদার সৈন্যদের আরোধ কিভাবে হবে ?- এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কঠিন নয় । পাকসৈন্য পুরোপুরি বাইরে থেকে, অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আনা রসদ এবং শত্রুসম্ভারের সাহায্যে লড়াই চালাচ্ছে । সুতরাং তাদের রসদ আনার পথ বন্ধ করতে পারলেই লড়াই জেতার অর্ধেকটাই হয়ে যাবে । মুক্তিবাহিনীও সঠিক পথেই চলেছে । তারা ইতিমধ্যেই বন্দরগুলো প্রায় অকেজো করে দিয়েছে । ফলে পাকসৈন্য জলপথের সুযোগ আর বিশেষ নিতে পারছে না । বাকি আছে বিমান যোগাযোগ, এবার সেটা নষ্ট করার ব্যবস্থা দেখতে হবে ।
এই ধরণের অবরোধের সাথে সাথে নানা জায়গা জুড়ে ছোটখাটো আক্রমণ করে পাকসৈন্যকে পর্যুদস্ত করে তুলতে হবে তাতে গ্রামবাসীগণও নিজস্ব ক্ষমতা অনুসারে অংশগ্রহণ করতে পারেন । কিভাবে তা সম্ভব হতে পারে, সে সম্বন্ধে পরে আলোচনা করা হবে ।
মোদ্দা কথা এই, লড়াই যে পর্যায়ে এগিয়ে এসেছে তাতে প্রতিটি সাধারণ মানুষকে হয় তথ্য সংগ্রহ, নয় অন্য পথে মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করতে হবে । কারণ সেটাই সাধীনতা লাভের একমাত্র পথ ।
.
.
দীপংকর ঘোষ দ্বীপ
<৬,১২৮,২১২-২১৩>
শিরোনামঃ আমাদের সাধীনতা সংগ্রাম
সংবাদপত্রঃ বিপ্লবী বাংলাদেশ ১ম বর্ষঃ ১০ম সংখ্যা
তারিখঃ ২৪ অক্টোবর, ১৯৭১
আমাদের সাধীনতা সংগ্রাম
রক্তের একটা নদী পেরিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে- এ সত্য আজ বিশ্বের প্রতিটি মানুষের কাছে দিবালোকের মত সুস্পষ্ট হয়ে গেছে । কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করলেও হানাদারমুক্ত হতে পারেনি আজও । সাম্রাজ্যবাদপুষ্ট পশ্চিম পাকিস্তানের বর্বর সৈন্যরা রাহুগ্রাসের মত বাংলাদেশ আঁকড়ে আছে ।
এই পশ্চিমা নাগপাশ থেকে জননী জন্মভূমিকে মুক্ত করতে হবে সর্বাগ্রে চাই একতা । মুক্তিযোদ্ধারা যেমন আজ বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামে একতাবদ্ধ হতে পেরেছে তেমনি জনগণকেও একতাবদ্ধ হতে হবে । প্রতি মুহূর্তে স্মরণ রাখতে হবে একটা দেশের মুক্ত আন্দোলন তখনই সার্থক হয় যখন সে দেশের জনগণ সমস্ত সংকীর্ণতার উর্ধ্বে উঠতে পারে । তার চেয়েও বড় কথা, আমরা একটা দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছি । যে দেশের সৈন্যরা আমাদের ঘর পুড়িয়েছে, মা-বোনের ইজ্জত ছিনিয়েছে, বাবা-ভাইকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে । এক কথায় বলতে গেলে সোনার বাংলাকে ওরা শ্মশান করেছে । কাজেই সে কথা মনে রেখেই স্বাধীনতা আন্দোলনে সবাইকে অংশগ্রহণ করতে হবে । স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করা বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের জাতীয় কর্তব্য ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে আজ যে সমস্যা বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হল রাজনৈতিক মতানৈক্য । অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে রাজনৈতিক কোন্দল মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে । এতে আন্দোলন বিঘ্নিতই হবে । আজকে জাতির যুগসন্ধিক্ষণে দেশমাতৃকার মুক্তিই প্রতিটি দলের সমর্থকদের মুখ্য লক্ষ্য হওয়া উচিত । রাজনৈতিক মতামতের সময় অনেক পাওয়া যাবে কিন্তু আজকের এই পরম মুহূর্তকে যদি কোন্দলের দ্বারা অবহেলা করা হয় তাহলে আগামী দিনের বংশদররা কিছুতেই আমাদের ক্ষমা করবে না ।
কে কতটুকু ক্ষমতা আকড়ে আছে এই সংকীর্ণতার বেড়াজাল ভেঙ্গে জাতির দুর্দিনে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে এক কাতারে । মানুষের চেয়ে মানুষের কর্ম বড় । তাই ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয় । ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করলে তাকে ছুঁড়ে ফেলা হয় জাতির অঙ্গন থেকে ডাস্টবিনে, তা এই পৃথিবীর শুরু থেকে হয়ে আসছে ।
জনতাই দেশের মালিক । দেশ স্বাধীন হলে কোন দল কিংবা কোন ব্যক্তি দেশের প্রকৃত বন্ধু তার বিচার করবে দেশের জনতা, তাই আমাদের উচিত জনতার সামনে সেই দিনটি উপস্থিত করা । সেই শুভদিনটির জন্য দলমত নির্বিশেষে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যার্থে কিংবা মুক্তিযোদ্ধা হতে প্রতিটি দলের প্রতিটি সমর্থককে এগিয়ে আসতে হবে । এ সংগ্রামে যদি আমরা উত্তীর্ণ হতে পারি তবে বিশ্বে বাংলাদেশেকে নিয়ে সমস্ত ষড়যন্ত্র ছিন্ন করে অচিরেই বাংলাদেশকে হানাদারমুক্ত করা যাবে ।
বাংলাদেশের অনেক হিন্দু যুবকের মুখে শোনা যায়, “আমাদের হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর অত্যাচার হয়েছে সবচেয়ে বেশী অতএব আমরা স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দেব কেন?” অত্যাচার হয়েছে একথা সত্য । কিন্তু এমন ধারণা পোষণ করে এখানে যারা মুক্তিসংগ্রাম থেকে দূরে সরে আছে তাদের উদ্দেশ্যে আমরা একথাই বলব যে তারা ভুল ধারণা পোষণ করে এখনো তুচ্ছ সংকীর্ণতার আবর্তে হাবুডুবু খাচ্ছে । পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভের পর স্বার্থবাদী শাসক চক্র হিন্দুদেরকে সংখালঘু বলে চিরদিন দাবিয়ে রেখেছে । ক্ষমতার রাজনীতিতে পাক স্বার্থবাদী গোষ্ঠী বার বার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে । অথচ তাঁর প্রথম থেকেই যদি শাসক চক্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেন তাহলে হয়তো স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর চক্রান্ত তাসের ঘরের মত ভেঙ্গে গুড়িয়ে যেত । আজো তেমনি ভুলের বশবর্তী হয়ে কিছু সংখ্যক যুবক নিরপেক্ষকের ভূমিকা অবলম্বন করেছে, এ সত্যি দুঃখজনক ঘটনা ।
বাংলাদেশে যখনি ন্যায়ের দাবিতে জনতার কন্ঠে সোচ্চার হয়ে উঠেছে তখনি স্বার্থবাদী শাসক সম্প্রদায় ভারতের সঙ্গে বিরোধ নয় তো ধর্মের নামে ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি করে জনতার কন্ঠকে স্তব্ধ করেছে । এর জন্য বার বার বলি হয়েছে নিরীহ মানুষ । বার বার রক্তে রঞ্জিত হয়েছে বাংলার মাটি । কিন্তু স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর মুখোশ খুলে গেছে এবার । তাই বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ লক্ষ লক্ষ শহীদের বেদীমূলে দাঁড়িয়ে ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িকতা বিসর্জন দিতে সক্ষম হয়েছে । পাক সাম্প্রদায়িক সরকারের সর্ব প্রকারের উস্কানি ব্যর্থ করে দিয়েছে বাংলার সংগ্রামী জনতা ।
বাংলার মানুষ আজ বাঙ্গালী । হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খৃষ্টান নয়, তারা বাংলার মানুষ । জাতি ধর্মের উপরে যে মানব ধর্ম সেই মহান ধর্মে উদ্ধুদ্ধ আজ বাঙ্গালী জাতি । লক্ষ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে যে বাংলাদেশ আজ পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান করে নিয়েছে সে দেশ শুধু মুসলমানের নয় । হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খৃষ্টান সবার দেশ বাংলাদেশ ।
তাই আসুন আমাদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দেশমাতৃকার শৃঙ্খল ছিন্ন করে হানাদার শেষ করে পূত পবিত্র করে গড়ে তুলি জননী জন্মভূমী বাংলাদেশকে ।
.
.
শাহজালাল
<৬,১২৯,২১৪-২১৫>
সংবাদপত্রঃ বিপ্লবী বাংলাদেশ ১ম বর্ষঃ ১২শ সংখ্যা
তারিখঃ ৭ নভেম্বর, ১৯৭১
সম্পাদকীয়
বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী কে?
দুস্কৃতকারী কে?
চল্লিশ বৎসর পূর্বে হিটলারের রাক্ষস চিৎকারে ইউরোপের আকাশে মুহুর্মুহু বিদীর্ণ হত। চিৎকার আর্তনাদের। তার বিলাপের বিষয়বস্তু ছিলঃ অন্যান্য দেশের আক্রমণাত্মক কার্যে জার্মানী ও জার্মান জাতি বিপন্ন।
অথচ বিশ্বের লোকের চোখে এর বিপরীতটাই সত্য বলে মনে হত। কারণ তারা দেখত যে জার্মানীই আজ অস্ট্রিয়াকে কাল চেকোস্লোভাকিয়াকে পদাতিক, ট্যাঙ্ক এবং বিমান বাহিনিযোগে আক্রমণ করছে। কারণ প্রকৃতই ঐ বিপরীতটাই সত্য।
আজ চল্লিশ বৎসর বাদে হিটলারের পদাঙ্ক অনুসরণ করে ইয়াহিয়াও রাক্ষস চিৎকারে পাক-ভারত-বাংলাদেশের আকাশ আচ্ছন্ন করছে। বুলি, পাকিস্তান বিপন্ন। ভারতের প্ররোচনায় ভারতের অনুচরবর্গ পাকিস্তানের পুণ্যভূমি আক্রমণ করেছে। তাদের দুষ্কৃত কার্যে ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তান ছিন্ন- বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বার উপক্রম হয়েছে। এই বিপদ থেকে পরিত্রাণ পাবার একমাত্র উপায় ভারত আক্রমণ।
কিন্তু আজও বিশ্বের লোকের চোখে প্রতিপন্ন হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে যে ইয়াহিয়ার অভিযোগের বিপরীতটাই সত্য। বিশ্বের লোকের সমক্ষে বাংলাদেশের শতকরা ৯৯ জন লোক প্রকাশ্যে নির্বাচনে বাংলাদেশের স্বাতন্ত্রের দাবী ঘোষণা করেছে। তার কারণ বাংলাদেশের বুকের উপর বসে গত চব্বিশ বছর যাবৎ পশ্চিম পাকিস্তানের মুষ্টিমেয় ধনপতি এবং ভূস্বামী বাঙালীর রক্ত শোষণ করেছে।
বাংলাদেশের শতকরা ৯৯ জন লোক-যাদের বাংলার মাটিতে জন্ম, যারা বাংলার মাটিতে বসে পুষ্ট- তারা কি ‘অনুপ্রবেশকারী’? সেই শতকরা ৯৯জন বাঙালির আকাঙ্ক্ষা, শোষ্ণাবসানের কামনা যারা রক্ত দিয়ে পূর্ণ করতে যাচ্ছে, সেই বাঙালী মুক্তিযোদ্ধারাই কি ‘অনুপ্রবেশকারী’?
না কি, সেই সব পশ্চিম পাকিস্তানী ধনিক-ভূস্বামী-রক্তপিপাসু যুদ্ধলিপ্সু সেনাধ্যক্ষরাই অনুপ্রবেশকারী? অবশ্যই তারা অনুপ্রবেশকারী। প্রথমতঃ তারা পাকিস্তানের শাসনযন্ত্রে অনুপ্রবেশ করেছে। কোন নির্বাচনে কে সিকান্দার মির্জা-আইয়ুব-ইয়াহিয়া খানকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করেছে? কেউ নয়। পশ্চিম ধনীক ভূস্বামী বর্গ এবং তাদেরই বেরাদর সেনাধ্যক্ষরা পদাতিক, ট্যাঙ্ক এবং বিমানবাহিনীর শক্তির বলে পাকিস্তানের ভাগ্যনিয়ন্তা সেজে বসেছে।
হাজার মাইল দূরের পশ্চিম পাকিস্তানী পদাতিক, ট্যাঙ্ক, বিমানবাহিনীর প্রয়োগ দ্বারা বাংলাদেশের শতকরা ৯৯ জনের রায় পদদলিত করে, তাদের প্রাণাধিক প্রিয় নেতা মুজিবকে বন্দী করে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। এবং তাদের দুষ্কৃতী চরমে উঠেছে বাংলার গ্রাম জ্বালিয়ে, লক্ষ লক্ষ বাঙালীকে হত্যা করে, লক্ষ লক্ষ বাঙালীকে মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত করে, বাঙালী নারীকে ধর্ষণ ও লাঞ্ছনা করে, বহু বাঙালী বীর সন্তানকে নিরস্ত্র করে নৃশংসভাবে হত্যা করে। দুষ্কৃতকারী পশ্চিম পাকিস্তানী পশুশক্তিই- আর কেউ নয়।
এবং এর হাত থেকে পরিত্রাণ পাবার একমাত্র উপায় মুক্তিবাহিনীর অবিরাম, নিরবচ্ছিন্ন প্রতি- আক্রমণ। তার অবসান পূর্ণ স্বাধীনতায়।
.
.
নোবেল
<৬,১৩০,১১৬>
সংবাদপত্রঃ বিপ্লবী বাংলাদেশ ১ম বর্ষঃ ১২শ সংখ্যা
তারিখঃ ৭ নভেম্বর, ১৯৭১
.
বিশ্বের চোখে বাংলাদেশ
(বিশেষ প্রতিনিধি)
পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা উন্মাদ হয়ে উঠেছে। বাংলার মানুষের স্বাধিকারের দাবী সমস্ত অত্যাচারেও একবিন্দু টলেনি বরং দিন দিন জোরদার হয়ে উঠেছে। এদিকে বিশ্বের সমস্ত দেশ একযোগে পশ্চিমের নেতাদের বিকৃত মস্তিষ্কের চিকিৎসা করতে পরামর্শ দিচ্ছে। পাগলকে পাগল বললে সে আরও ক্ষেপে যায়। সেই রকম ক্ষেপে অক্টোবর মাসে পাঞ্জাবী খানসেনারা তিনবার ভারত আক্রমণের চেষ্টা করে। এর মধ্যে একবার আগরতলায় তারা কিছু কামান প্লেনসহ বোমা ও গোলা বর্ষণ করে। আর দুবার শিয়ালকোটের কাছে ট্যাংক বাহীনিসহ তারা ভারতের মাটিতে ঢুকে পড়ে। পাকিস্তানের আশা ছিল ভারত এরপর যুদ্ধ ঘোষণা করবে। কিন্তু ভারত তিনবারই আক্রমণ প্রতিরোধ করে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরে এই কূপ্রচেষ্টা। পাকিস্তান হয়তো ভেবেছিল ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী তাঁর বেলজিয়াম-ইংল্যান্ড-অস্ট্রিয়া ও আমেরিকা সফর স্থগিত রাখবেন। সে আশাও পূর্ণ হয়নি। শ্রীমতী গান্ধী যাবার পূর্বে জাতির উদ্ধেশ্যে ভাষণে বলেন যে ভারত যে কোন আক্রমণের মোকাবিলা করতে প্রস্তুত কিন্তু যুদ্ধ ভারত চায় না। যে ক’টি দেশে তিনি গেছেন একই কথা তিনি জানিয়েছেন এবং ইংল্যান্ডের জনমত তাঁকে স্বাগত জানিয়েছে নিপুন ভাবে। ইংল্যান্ড সরকার পাকিস্তানের জঙ্গীশাহীর ওপর শীঘ্রই চাপ দেবেন আরো নমনীয় হবার জন্য। ইতিমধ্যে ভারতের প্রতিটি মানুষ আশা রাখে মুক্তিবাহিনীর ওপর। মুক্তিবাহিনী একাই শত্রুর মোকাবিলা করে বাংলাকে মুক্ত করবে।
.
পাকিস্তানী জঙ্গীশাহী উন্মাদ হয়ে উঠেছে। তার দ্বীতিয় প্রমাণ দেখা গেল সোভিয়েত এয়ার মার্শালকে পাক আকাশে চলার অনুমতি বা দেবার মধ্যে। যদিবা সোভিয়েত এয়ার মার্শালের মনে পাকিস্তানের দুরভিসন্ধি সম্বন্ধে কোন সন্দেহ থেকেও থাকে, তাদের এই ব্যাবহারে সেটুকু সম্পূর্ণ কেটে যাবে।
.
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আজ বড় দুর্দিন। চীনকে রাষ্ট্রসংঘে নেওয়ায় আজ বাংলাদেশের নেতারাও উল্লসিত। ভারত ও অন্যান্য দেশে তো বহু বৎসর এই দাবী জানিয়েছে যে মহাচীনের রাষ্ট্রসংঘে বসার অধিকার আছে। মার্কিন প্রস্তাবঃ ‘দুই চীনেই রাষ্ট্রসংঘে থাক,’-ভোটে টেকেনি। আমেরিকা সব দেশকেই সাহায্য বন্ধ করে দিচ্ছে। তারা পাকিস্তানের অখন্ডতা চায় বলে দাবী করেছে। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী আমেরিকা যাচ্ছেন স্পষ্টকন্ঠে জানাতে- ধ্বংসস্তূপ পাকিস্তানকে ছেড়ে আমেরিকা বরং চলে আসুক বাংলাদেশ ও ভারতের মিত্রতার আহ্বানে। কারণ ইতিহাসের বাণী অমোঘ। ভিয়েতনামের মুক্তির মতো, চীনের রাষ্ট্রসঙ্ঘে প্রবেশের মত ধ্রুব আগামী দিন বাংলাদেশের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা।
.
পাকিস্তানের নেতাদের মস্তিস্ক বিকৃতির এক দুঃখজনক উদাহরণ দেখা গেছে দিল্লীতে ২রা নভেম্বর। পাক দুতাবাস থেকে ১১জন বাঙালী অফিসার বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করে বেরিয়ে আসার সময় এই উন্মাদ জঙ্গীশাহীর চররা তাদের প্রচণ্ড প্রহার করে। শ্রী হুসেন আলী, জঙ্গীশাহীর সংবাদ সংগ্রহের ফার্ষ্ট সেক্রেটারীকে মেরে অজ্ঞান করে ফেলা হয়। এই খবর বেরনও অবধি তাঁর স্ত্রী পুত্র কন্যা তাঁর পরীর দূতাবাস থেকে বার করে আনতে পারেনি। বাংলাদেশ দূতাবাদ (দিল্লী) থেকে তাঁর অধ্যক্ষ আমজাদুল চৌধুরী পাক দূতাবাদের শ্রী মাসুদ হাইদারকে সময় দিয়েছেন শ্রী আলী ও তাঁর পরিবারকে সসম্মানে ছেড়ে দিতে।
.
.
নোবেল
<৬,১৩১,২১৭>
সংবাদপত্রঃ বিপ্লবী বাংলাদেশ
তারিখঃ ২১ নভেম্বর, ১৯৭১
.
রক্তমত্ত বাংলাদেশ- ঈদের চাঁদ রক্তের সমুদ্রে
এবারের ঈদ রক্ততিলক শপথের দিন
অনেক স্মৃতির স্বাক্ষর নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে হারিয়ে গেল একটা বছর। এল আবার ঈদ। এল খুশীর ঈদ। আনন্দের ঈদ। মিলনের ঈদ। একটা মাসের সংযমের অগ্নিপরীক্ষার পর আসে আমাদের জীবনে এই পবিত্র দিনটি; তাই পবিত্র দিনোটিকে আমরা স্বাগত জানাই পবিত্র মনে।
.
প্রতি বছরের মত এবারও বাংলাদেশে ঈদ এসেছে। কিন্তু আসেনি আনন্দ! ওঠেনি খুশীর ঢেউ। বাজেনি মিলনের বাঁশি। বাংলাদেশে যে বিদ্রোহের আগুন জ্বলছে শতশিখা বিস্তার করে। বাংলার তরুণ শক্তি যে আজ দুর্বার দুর্জয় স্বৈরাচার আর শোষণের বিরুদ্ধে।
.
বাংলার দামাল ছেলেগুলো আজ ঘরছাড়া। আত্মীয়-স্বজন থেকে দূরে বন থেকে বনান্তরে অস্ত্র হাতে ঘুরছে শত্রু হননের প্রতিজ্ঞা নিয়ে। তাইতো বাংলাদেশে এবার খুশীর বান ডাকেনি। এবার বাংলার তরুণ শক্তির প্রতিজ্ঞা, যে চাঁদ রক্তের সমুদ্রে হারিয়ে গেছে সে চাঁদকে মুক্ত করে তবেই তারা ঈদের উৎসব পালন করবে। তাই আজকের এই দিন শপথের দিন। আজ বংলাদেশের মায়ের চোখে অশ্রু। বোনের চোখে অশ্রু বাবার চোখে অশ্রু। এবারের ঈদে বাংলাদেশে মায়ের পাশে ছেলে নেই। পিতার পাশে সন্তান নেই। বোনের পাশে ভাই নেই। আজকে মা-বাবার আদরের সন্তান, বোনের স্নেহের ভাই প্রতিবাদের রণাঙ্গনে। তাই বাংলার মা-বাবা আর বোনের ঈদের জামাতে খোদার কাছে প্রার্থনা হবে হে খোদা, যারা ১৫ লক্ষ মানুষকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে তাদের বিচার করো। বাংলাকে মুক্ত করো আর যারা বাংলার স্বাধীনতার জন্য লড়াই করে যাচ্ছে তাদের আশীর্বাদ করো। সেই হবে এবারের ঈদের ‘প্রার্থনা’।
.
.
নোবেল
<৬,১৩২,২১৮>
সংবাদপত্রঃ বিপ্লবী বাংলাদেশ ১ম বর্ষঃ ১৪শ সংখ্যা
তারিখঃ ২১ নভেম্বর, ১৯৭১
.
বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে বিরূপ রাজনৈতিক সমাধান মেনে নেয়া হবে না
সম্প্রতি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রশ্নে বিশ্বের সরকার গুলি বড় বেশী সোচ্চার হয়ে উঠছে। এ জন্য বিশ্বের সরকারদের ধন্যবাদ। বাংলাদেশের নির্যাতিত মানুষেরা আশা রাখে বাংলাদেশের প্রকৃত অবস্থা উপলব্ধি করতে বিশ্বের সমস্ত সরকার দ্বিধাবোধ করবে না।
.
কিন্তু বাংলাদেশের প্রশ্নে রাজনৈতিক সমাধানের নামে কোন রকম বিরূপ সমাধান চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে বাংলার মিক্তিযোদ্ধারা তথা জনগণ তা সহ্য করবে না। তাই বাংলার মুক্তিযোদ্ধা এবং জঙ্গণের বিশ্বের সরকারের কাছে প্রশ্ন, কিভাবে রাজনৈতিক সমাধান করা হবে? স্বাধীন বাংলার স্বকৃতির মাধ্যমে না পাকিস্তান কাঠামোর মধ্যে?
.
যারা পাক কাঠামোর মধ্যে মীমাংসার কথা ভাবছেন তাঁদের জেনে রাখা উচিৎ, পাক জঙ্গীশাহী বাংলাদেশের পনের লক্ষ মানুষকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে, নারী নির্যাতন করেছে, ঘরবাড়ী পুড়িয়ে ছারখার করেছে- এরপরও কি পাক কাঠামোর মধ্যে বাংলাদেশ সমস্যা সমাধান হতে পারে? তাদের দেশে যদি এমন অবস্থা হত তাহলে তারা কি এমন সমাধান মেনে নিতে পারতেন?
.
অনেক রক্তের বিনিময়ে পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষের গ্রহণযোগ্য সমাধান করতে পারেন তবেই যেন তারা এগিয়ে আসেন নচেৎ তারা যেন নিরপেক্ষ থাকেন। বাংলাদেশের মানুষেরাই তাদের ভাগ্য নির্ধারণ করতে সক্ষম কেননা বাংলার মানুষ অস্ত্র ধরতে শিখেছে।
.
.
জেসিকা গুলশান তোড়া
<৬,১৩৩,২১৯-২২০>
শিরোনামঃ সম্পাদকীয় শোষণ অবসানের অভিযান
সংবাদপত্রঃ বিপ্লবী বাংলাদেশ ১ম বর্ষঃ ১৫শ সংখ্যা
তারিখঃ ২৮ নভেম্বর, ১৯৭১
সম্পাদকীয়
শোষণ অবসানের অভিযান
একদিকে সারা বাংলাদেশ ভারমুক্ত হবে, বাংলাদেশের সূচাগ্র ভূমিতেও পাকিস্তানী শোষকের অবৈধ অধিকার থাকবে না, সর্বত্র উড়বে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। সর্বত্র প্রতিষ্ঠিত হবে সার্বভৌম, গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ সরকারের শাসন।
কবে আসবে সেদিন?
কয়েক মাস আগেও মনে হয়েছিল, সেদিন বুঝি বহুদূর। কিন্তু আজ শুধু বাংলাদেশের বাঙ্গালী নয়, বিদেশীরাও, শুধু বন্ধুরা নয়, শত্রুও ভাবছে এ ঘটবে অদূর ভবিষ্যতেই।
কী করে ঘটল এই পরিবর্তন? কোন গোপন অস্ত্র এল বাঙ্গালীর হাতে? কে যোগাল সেই অস্ত্র?
বিদেশী কোন মহাশক্তি কি? দুনিয়া জানে পাকিস্তানী জল্লাদেরা কার অস্ত্রের বলে বাংলার রক্ত বইয়ে দিয়েছে। যারা দিয়েছে সেই অস্ত্র তাদের না সবাই জানে। তারা মহাশক্তি, সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যান্ত্রিক উন্নতিতে যারা জগতের শীর্ষস্থানে অধিকার করেছে। তেমন কোন শক্তি মহাপরাক্রমাশালী মারণাস্ত্র বাঙ্গালীর হাতে তুলে দেয়নি, যার বলে আজ পাক পশুশক্তি সন্ত্রস্ত, আতঙ্কগ্রস্ত।
যে শক্তির প্রয়োগে এই সামান্য সময়ে বাঙ্গালী জাতি পাক রক্তপায়ীদের রাক্ষস উল্লাসকে ত্রাসে পরিণত করেছে সে হল সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর শোষণ মুক্তির আকাংখা, মুষ্টিমেয় বাঙ্গালীর ক্ষমতা লোলুপতা নয়। সেই আকাংখা অনুপ্রাণিত করেছে সামান্য অস্ত্রে সজ্জিত, সুশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, বৃদ্ধ, যুবক, শিশু, নারী-পুরুষ মুক্তিসেনাকে। শোষণ মুক্তির উন্মাদনায় মুক্তিযোদ্ধারা রক্তবীজের মত এক থেকে অনেক স্বল্প থেকে বহু হয়ে উঠেছে। সেই উন্মাদনায় ছড়িয়ে পড়েছে দিকে দিকে অঞ্চলে অঞ্চলে, সীমান্তে ও কেন্দ্রে যেখানেই শোষিত বাঙ্গালী সেখানেই মুক্তিসংগ্রামের বীজ অঙ্কুরিত হয়েছে-মুক্তির তীব্র আকুতি তার দ্রুত বৃদ্ধি অব্যাহত রেখেছে।
অপপ্রচারে বাংলাদেশের জনসাধারণ বিভ্রান্ত হয়নি। কেন? কারণ তারা মুক্তিবাহিনীর কার্যকলাপ প্রত্যক্ষ করেছে। তারা দেখেছে, মুক্তিযোদ্ধারা শুধু অস্ত্রবলে বলীয়ান নয়। তাদের মনোবল অটুট আর তাদের মনোবলের উৎস জনসাধারণের প্রতি তাদের সহানুভূতি, সৌহারদ্য, আত্মবোধ। তারা দেখেছে যে তারা জনসাধারণের জন্য, তাদের শোষণ মুক্তির জন্য দিতে পারে সব কিছুই, দিতে পারে প্রাণ- অথচ চায় না কিছুই। তাদের মুক্ত চিত্তে ক্ষমতালোভের কলুষ নেই, বিলাস বসনে আগ্রহ নেই, নেই ক্ষুদ্র স্বার্থবুদ্ধি। একটা মহৎ আদর্শ-সাধারণ মানুষের শোষণের অবসান-তাদের অন্তরকেও মহৎ করেছে। তাদের শৌর্যের মূলে আছে অগ্নিশুদ্ধ, স্বার্থলেশহীন স্বাধীনতা, শোষণমুক্তির যজ্ঞে নিবেদিত নিষ্কলুষ মন।
এ যদি না হতো, তবে সমগ্র দেশে এত শীঘ্র মুক্তিযুদ্ধ এত তীব্ররুপ ধারণ করত না। জনসাধারনের স্বচ্ছ দৃষ্টিতে স্বাধীনতা যুদ্ধের ত্রুটি, তার অন্ধকার রুপ অনাবৃত হয়ে পড়ত। এ যুদ্ধ হয়ে পড়ত শীর্ণ, সংকীর্ণ হত শুধুই অস্ত্র ঝঞ্জনা।
জনসাধারণের শোষণমুক্তি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের হৃৎপিন্ডস্বরুপ। স্বাধীনতার সংকল্পের প্রথম মুহূর্তেই শুধু বাঙ্গালী নয়, দুনিয়ার লোক শুনেছে সেই বজ্রকন্ঠঃ আমাদের সংগ্রাম, শোষিতজনের সংগ্রাম, দুনিয়ার শোষিতজনের মুক্তির সংগ্রাম। শোষণের স্পর্শমাত্র ও যদি এই সংগ্রামে থাকত তবে সারা দুনিয়ার লোক বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে তাদের একান্ত আন্তরিক সহায়তা জ্ঞাপন করত না। তারা ভাবত, এ লড়াই বুঝি ক্ষমতার লড়াই, পশ্চিম পাকিস্তানী ধনিক-ভূস্বামীর সঙ্গে বাঙ্গালী ধনিক-ভূস্বামীর লড়াই।
কিন্তু মুক্তি সংগ্রামের এ কয়েকমাসের সংগ্রামে যুদ্ধক্ষেত্রে কোথাও স্বার্থবৃদ্ধির, লোভের, ক্ষমতার আকাংখার প্রকাশ ঘটেনি। তাই দেশে বাঙ্গালী এবং বিদেশে জনসাধারণ এবং শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবীরা বাংলার স্বাদীনতা সংগ্রামকে প্রকৃতই শোষণমুক্তির সংগ্রাম বলে গ্রহণ করেছে এবং অকুন্ঠ সমর্থন করেছে।
আজ সারাদেশে জোড় এই সংগ্রাম দৃঢ় পদক্ষেপে অগ্রসর হচ্ছে। এই পদক্ষেপ আরও বলিষ্ঠ, আরও দ্রুত হবে- কিন্তু পদে পদেই আমাদের সাধারণ সৈনিক যারা তাঁদেরও, নেতৃস্থানীয় যারা তাঁদেরও প্রমাণ দিতে হবে বাংলাদেশের ও দুনিয়ার জনসাধারণের কাছে যে এ যুদ্ধ শোষণ শেষের, এ যুদ্ধের তরবার শোষণমুক্তির পবিত্র আদর্শ শাণিত এবং তাই দুর্বার। এ সংগ্রাম ক্ষমতার লড়াই নয়, নতুন আরেক শোষণের প্রতিষ্ঠার প্রয়াস নয়। সহস্রের আত্মদানের আহুতি উজ্জ্বল এই আগুনে স্বার্থবুদ্ধি বিসর্জন দিয়ে বাংলাদেশ হবে মুক্ত। তাই লক্ষ মানুষের এই আমৃত্যু পণ, অপূর্ব আত্মদান।
.
.
জেসিকা গুলশান তোড়া
<৬,১৩৪,২২১>
শিরোনামঃ সম্পাদকীয় মালিক সাবধান
সংবাদপত্রঃ জন্মভূমি ১ম বর্ষঃ ৭ম সংখ্যা
তারিখঃ ৬ সেমটেম্বর, ১৯৭১
সম্পাদকীয়
[জন্মভুমিঃ সাপ্তাহিক। বাংলাদেশের সংগ্রামী জনগণের বিপ্লবী মুখপত্র। সম্পাদকঃ মোস্তাফা আল্লামা। জন্মভূমি প্রেস এন্ড পাবলিকেশনের পক্ষে সম্পাদক কর্তৃক রবীন্দ্র এভিনিউ, মজিবনগর, বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত বিদেশস্থ প্রধান যোগাযোগ অফিসঃ ৩৩/২ শশীভূষন দে ষ্ট্রীট, কলিকাতা-১২।]
.
মালিক সাবধান!
.
বঙ্গবন্ধু প্রায়শই একটা কথা বলতেন, “পাকিস্তানের ২৪ বছরের রাজনীতি-ষড়যন্ত্রের রাজনীতি। ” কথাটা এতই সত্য যে, তা আর বিশ্লেষণ করে দেখানোর প্রয়োজন হয় না। বাঙ্গালীদের শাসন আর শোষণ করার জন্য সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদেও পা-চাটা পশ্চিম পাকিস্তানী কুকুরেরা না করেছে হেন কুকর্ম এবং হেন ষড়যন্ত্র নেই।
.
খান সেনাদের মধ্যে অত্যন্ত নরমপন্থী বলে ধিকৃত ভাইস এডমিরাল এম. এস. আহসান পূর্ব পাকিস্তানকে দমন করতে পারছেন না বলে চট করে রাজ্যপালের গদি থেকে তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হলো।
.
অপরদিকে নৃশংস হত্যাকারী নামে পরিচিত কুখ্যাত টেক্কা খাঁকে পূর্বাঞ্চলে পাঠানো হলো প্রধান সামরিক প্রশাসক করে।
.
কিন্তু লক্ষ লক্ষ লোক হত্যা করেও টেক্কা খাঁ যখন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে স্তব্ধ করে দিতে ব্যর্থ হলো, পক্ষান্তরে মুক্তিযোদ্ধাদেরও আক্রমণ প্রচন্ডতর হতে শুরু করল, তখন শুরু হলো আর এক ষড়যন্ত্র।
.
ভোল পাল্টালো জঙ্গীশাহী। বাঙ্গালীদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার, সঙ্গত আচরণ এবং তাদের মঙ্গল বিধানের জন্য টেক্কার পরিবর্তে দেবদূতের মত আবির্ভূত হবেন ডঃ এ, এম, মালিক।
.
ডাক্তার সাহেব, আপনি আর যেখানকার মালিক হোন না কেন, বাংলাদেশের মালিক আপনি নন। নুরুল আমীনের মত ধুরন্ধর রাজনীতিক, মোনেম খাঁর মত পশ্চিমা প্রভুর জুতোবাহী গর্দভ পর্যন্ত এই গদিতে বসার ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে সচেতন। অতএব যদি ভালো চান তো গদির মোহে পড়বেন না। কেন না, মুক্তিবাহিনীর কালো খাতায় আপনার নামটি বহু আগে থেকেই বড় হরফে স্পষ্ট করে লেখা রয়েছে। সুতরাং ডঃ মালিক সাবধান!
.
এহেন অবস্থায়, আপনি যদি অকালে আপনার পৈত্রিক প্রাণটা হারাতে না চান তাহলে কালক্ষেপণ না করে বাংলাদেশ ছাড়ুন। অন্যথায় বাংলাদেশে অবস্থানকারী প্রতিটি পশ্চিম পাকিস্তানীর মত আপনার ভাগ্যেও নিশ্চিত মৃত্যু।
.
.
জেসিকা গুলশান তোড়া
<৬,১৩৫,২২২-২২৩>
শিরোনামঃ (বিদেশী দূতাবাস সমূহে) যাঁরা বাংলাদেশের আনুগত্য স্বীকার করেছেন
সংবাদপত্রঃ জন্মভূমি
তারিখঃ ৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
.
যাঁরা বাংলাদেশের আনুগত্য স্বীকার করেছেন
নয়াদিল্লী- ৬ই এপ্রিল’৭১
১| জনাব কে. এম. শাহবুদ্দিন
সেকেন্ড সেক্রেটারী
২| জনাব আমজাদুল হক
এসিস্টেন্ট প্রেস এটাসি
৩| জনাব আবদুল মজিদ (স্টাফ) ১২ই আগস্ট’৭১
.
কলকাতা-১৮ইং এপ্রিল
১| জনাব এম. হোসেন আলী
ডেপুটি হাইকমিশনার
২| জনাব আর. আই. চৌধুরী
ফাস্ট সেক্রেটারী
৩| জনাব আনোয়ার করিম চৌধুরী
থার্ড সেক্রেটারী
৪| জনাব কাজী নজরুল ইসলাম
থার্ড সেক্রেটারী
৫| জনাব এম. মকসুদ আলী
এসিস্টান্ট প্রেস এটর্নি
৬| জনাব সাইদুর রহমান
নন-ডিপ্লমেট অফিসার
.
নিউইয়র্ক-২৬শে এপ্রিল’৭১
১| জনাব এ. এইচ. মাহমুদ আলি
ভাইস কন্সাল
.
প্যারিস-৫ই জুলাই’৭১
১| জনাব মোশারফ হোসেন
সুপার এসিস্টেন্ট
২| জনাব শওকত আলি
এডিশন্যাল এসিস্টেন্ট
.
লন্ডন-আগস্ট’৭১
১| জনাব মহিউদ্দিন আহমেদ
সেকেন্ড সেক্রেটারী
৮ই আগস্ট’৭১
২| জনাব মোঃ আকবর লুৎফুল মতিন
ডাইরেক্টর-অডিট এন্ড একাউন্টস
১১ইং আগস্ট’৭১
৩| জনাব আবদুর রউফ
এন্ড পাব্লিকেশনস
৪| জনাব ফজলুল হক চৌধুরী
লেবার এটার্নি
.
ইউ. এন-নিউইয়র্ক
৪ আগস্ট’৭১
জনাব এস. এ. করিম
সহযোগী স্থায়ী প্রতিনিধি
.
ওয়াশিংটন
৪ আগস্ট’৭১
১| জনাব এনায়েত করিম
মিনিস্টার
২| জনাব এস. এ. এম. এস. কিবরিয়া
পলিটিক্যাল কাউনসিলার
৩| জনাব এ. এম. এ. মুহিত
ইকনমিক কাউনসিলার
৪| জনাব এ. আর. মতিন উদ্দিন
শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কাউনসিলার
৫| জনাব সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলি
থার্ড সেক্রেটারী
৬| জনাব এ. আর. চৌধুরী
ফাইনেনস ও একাউন্টস অফিসার
৭| শেখ রুস্তম আলি
এসিস্টেন্ট ইনফরমেশন অফিসার
৮| জনাব হাবিবুর রহমান
একাউন্টেন্ট
৯| জনাব সোলেমান
পি এ- পলিটিক্যাল কাউনসিলার
১০| জনাব এম. হক
পি এ-ইকনামিক কাউনসিলার
১১| জনাব নুরুল ইসলাম
এসিস্টেন্ট ডিফেনস উইং
১২| জনাব মোস্তাক আহম্মদ
এসিস্টেন্ট এডমিনিস্ট্রেটিভ উইং
.
বার্ণ
১| গোলাম মোস্তফা
.
হংকং
১৮ আগস্ট’৭১
১| জনাব মহিউদ্দিন আহম্মদ
একটিং ট্রেড কমিশনার
বাগদাদ
২১ আগস্ট’৭১
১| জনাব এ. এফ. এম. আবদুল ফাতেহ
এমবেসেডর
.
স্টকহোম
২৬ আগস্ট’৭১
১| জনাব শফিউল্লা
স্টাফ অফিসার
.
.
জেসিকা গুলশান তোড়া
<৬,১৩৬,২২৪>
.
শিরোনামঃ বাংলাদেশের ডাকটিকিট
সংবাদপত্রঃ জন্মভূমি ১ম বর্ষঃ ৭ম সংখ্যা
তারিখঃ ৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
.
বাংলাদেশের ডাকটিকিট
কলিকাতার কূটনৈতিক মিশন-প্রধান জনাব হোসেন আলী বাংলাদেশের নতুন ডাকটিকিটের প্রদর্শন সম্প্রতি আরম্ভ করেছেন। এই ডাকটিকিটগুলির পরিকল্পনা করেছেন লন্ডন প্রবাসী বিশ্ববিখ্যাত বাঙ্গালী শিল্পী বিমান মল্লিক।
.
মোট আট রকমের ডাকটিকিটের মধ্যে দশ পয়সার টিকিটে আছে বাংলাদেশের মানচিত্র, বিশ পয়সার টিকিটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হত্যাকান্ডের প্রতীক, পঞ্চাশ পয়সার টিকিটে সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর প্রতীক। এক টাকার টিকিটে বাংলাদেশের পতাকা, দুই টাকার টিকিটে আওয়ামী লীগের ৯৮% ভোটে বিজয়ের প্রতীক, তিন টাকার টিকিটে স্বাধীন সরকারের ঘোষণার প্রতীক, পাঁচ টাকার টিকিটে শেখ মুজিবের ছবি, দশ টাকার টিকিট বাংলাদেশের সমর্থনের জন্য আবেদনের প্রতীকবাহী।
.
.
জেসিকা গুলশান তোড়া
<৬,১৩৭,২২৫>
শিরোনামঃ সম্পাদকীয় ১| দূর্ভিক্ষ ও ত্রাণ সংস্থা ২| একটি শুভ পদক্ষেপ
সংবাদপত্রঃ জন্মভূমি ১ম বর্ষঃ ৮ম সংখ্যা
তারিখঃ ১৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
সম্পাদকীয়
.
(১) দূর্ভিক্ষ ও ত্রাণ সংস্থা
অন্নপূর্ণার সোনার বাংলা আজ অন্নরিক্তা। সেখানকার মানুষ আজ একমুঠো অন্নের অভাবে ধুঁকে ধুঁকে মরছে। অথচ কোন দেশ বা কোন আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থা পর্যন্ত এগিয়ে আসছে না বাংলাদেশের দূর্ভিক্ষগ্রস্থ মানুষের সাহায্যের জন্য। কিন্তু কেন? পৃথিবীর অভিধান থেকে কি তবে সেবা, সহানুভূতি, মানবিকতা প্রভৃতি শব্দ নির্বাসিত হয়েছে? অন্ততঃ বাংলাদেশের ব্যাপারে যেন তাই।
.
কিন্তু কেন? তাহলে, বাংলাদেশের অপরাধ সে গণতন্ত্র দাবী করেছে, শোষণের অবসান চেয়েছে, হানাদারদের প্রতিহত করেছে, ন্যায়ের সংগ্রামে, স্বাধীনতা সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে।
.
এই অপরাধে বাঙ্গালী আর তাদের বাংলাদেশ যদি আজ বিশ্বের নিকট থেকে কোনরুপ সাহায্য পাওয়ার অযোগ্য হয়ে দূর্ভিক্ষ আর মহামারীতে প্রাণ হারায় তাহলে ভবিষ্যতে যুগ যুগ ধরে বর্তমান বিশ্ববাসীকে অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।
.
(২) একটি শুভ পদক্ষেপ
বাংলার ভাগ্যাকাশে নতুন আলোর রেখা দেখা দিয়েছে। বাংলার মুক্তিকামী মানুষেরা আবার একত্র হয়েছে। সাড়ে সাত কোটি মানুষের পূণ্যভূমি আজকে আবার নব শয্যায় সজ্জিত। পঞ্চদল বিশিষ্ট উপদেষ্টা কমিটি গঠনের ফলেই বাংলার মানুষের মনে আনন্দ জেগেছে। উপদেষ্টা কমিটি প্রথমেই বাংলাদেশ সরকারকে বাংলাদেশের জনগণের সরকার বলে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং শেখ মুজিবের বিনা বিচারে মুক্তি দাবি করেছে। আমরা উপদেষ্টা দলটিকে জানাই আমাদের আন্তরিক অভিনন্দন। আমরা মনে করি বাংলার স্বাধীনতাপ্রিয় মানুষের সব রকম অসুবিধা এই কমিটি দূর করতে পারবে। যুদ্ধরত বাঙ্গালীদের ঠিক পথে চালিয়ে নিয়ে যাবে। এই আশাই আমরা করি।
.
.
নোবেল
<৬,১৩৮,২২৬>
সংবাদপত্রঃ জন্মভূমি ১ম বর্ষঃ ১৬শ সংখ্যা
তারিখঃ ৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১
সম্পাদকীয়
নিশ্চিহ্ন পাকিস্তানঃ এ লড়াই শেষ লড়াই
পাকিস্তানের জঙ্গী ইয়াহিয়া ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছে। ভারতের স্থলে, জলে ও অন্তরিক্ষে পাকিস্তানী আক্রমণের পাল্টা আঘাতে পশ্চিম পাকিস্তান আর অধিকৃত বাংলাদেশে ইয়াহিয়ার সামরিক বাহিনী কোণঠাসা ও কাবু। ভারতীয় বিমানবাহিনী প্রচন্ড আঘাত করেছে পাকিস্তানের বিভিন্ন নৌ, বিমান ও সামরিক ঘাঁটির উপর। ভারতের সাথে পাকিস্তানের এ যুদ্ধে বাংলাদেশ সরকার ভারতকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন। বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর পাশে এসে এবার দাঁড়িয়েছে ভারতীয় বাহিনী। দুই বাহিনীর মিলিত আক্রমণে পশ্চিম পাকিস্তান ও দখলীকৃত বাংলাদেশের চট্টগ্রাম, করাচী ও কক্সবাজারের নৌবন্দর দাউ দাউ করে জ্বলছে। ঢাকা, শিয়ালকোট, যশোর, সারগেদা, রিসালপুর, পেশোয়ার, নারায়ণগঞ্জ প্রভৃতি শহরগুলি ভারতীয় বিমানের বোমাঘাতে জর্জরিত। মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় বাহিনীর অগ্রগতি অপ্রতিহত। বাংলাদেশের সর্বত্রই মুক্তি আসন্ন। যুদ্ধবাজ উন্মাদ ইয়াহিয়ার কণ্ঠস্বর চিরতরে স্তব্ধ করে দেবে বাংলাদেশ ও ভারতের মিলিত শক্তি।
.
নরঘাতী যুদ্ধবাজ উন্মাদ ইয়াহিয়া ও তার সামরিক জান্তারা বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ নিরীহ নিরস্ত্র নরনারী শিশুসন্তানদের নির্বিচারে হত্যা করেছে। মা-বোনদের ইজ্জত নিয়েছে, সোনার বাংলার গ্রামের পর গ্রাম, শহরের পর শহর জ্বালিয়ে দিয়েছে, ধবংস আর লুট করেছে, ধর্মের নাম নিয়ে এক কোটি অসহায় নরনারীকে ভারতে ঠেলে দিয়েছে, পৃথিবীর শান্তিকামী মানুষের পথ প্রদর্শক, এশিয়া ভূখণ্ডের মহান নেতা, বাংলাদেশের জাতির পিতা বাঙালীর নয়নমণি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বন্দী করে রেখেছে জঙ্গীশাহী অন্ধকার কারাগারে। এই জঙ্গী সরকারকেই অস্ত্র যোগাচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা, মদত যোগাচ্ছে ঔপনিবেশিক বৃটেন। সর্ভারাদের দেশ নামধারী বিপ্লবী চীন স্বৈরাচারী সরকারকে নিয়ে মাতামাতি করছে। আর রাষ্ট্রসংঘ এদের তল্পিবাহক হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশে যে গণহত্যা অনুষ্ঠিত হয়েছে তার পরিপ্রেক্ষিতে এতদিন কি রাষ্ট্রসংঘের কিছু করণীয় ছিল না? রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশের ব্যাপারে কোন কথা তোলার মত ঘটনা কি বাংলাদেশে ঘটেনি? বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দ আর ভারতের নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশের হয়ে পৃথিবীর বৃহৎ রাষ্ট্রগুলির দ্বারে দ্বারে বাংলাদেশের সমস্যা নিয়ে ঘুরেছে, কেহই নির্যাতিত বাঙ্গালীদের আর্তনাদে কর্ণপাত করেনি।
.
আজকে আর কাহারও কথা নয়। সাম্রাজ্যবাদের দালাল পাকিস্তানকে নিষচিহ্ন না করা পর্যন্ত ভারতের দেশপ্রিয় জওয়ান ও জননী বাংলার সংগ্রামী মুক্তিবাহিনী থামবে না। এবার জঙ্গীশাহীর সাম্রাজ্য দখলের উপযুক্ত শাস্তির সময়। পশ্চিম পাকিস্তানের বেলুচিস্তান ও পেশোয়ারে বিদ্রোহ দেখা দিয়েছে। সাবাস বেলুচি পাঠানরা সাম্রাজ্যলোভী পশ্চিম পাকিস্তানের সাম্রাজ্য দখলে রাখার চির সাধ চিরতরে মিটিয়ে দাও। এবার যুদ্ধে পাকিস্তান নিশ্চিহ্ন হবেই। বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী আর ভারতীয় বাহিনী এবার শেষ লড়াই করেছে। বাংলাদেশ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানী ভাড়াটিয়া সৈন্যদের সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন না করা পর্যন্ত এ লড়াই চলবে। দু’দেশের মিলিত শক্তি কারও মধ্যস্ততা এখন আর বরদাশত করবে না।
.
.
নোবেল
<৬,১৩৯,২২৭>
সংবাদপত্রঃ জন্মভূমি ১ম বর্ষঃ ১৬শ সংখ্যা
তারিখঃ ৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১
সম্পাদকীয়
.
মার্কিন ষড়যন্ত্র ব্যর্থ
পাকিস্তানী জঙ্গীশাহীর নির্বিচারে গণহত্যায় যখন বাংলাদেশের মানুষ দিশেহারা, তখন বিশ্বের মানবিকতা বিমথিত আমেরিকা, চীন ও বৃটেন কোথায় ছিল। পাকিস্তানের একতরফা যুদ্ধ ঘোষণার পরে ভারত যখন আত্মরক্ষার্থে, শরনার্থী ও বাংলাদেশের স্বাধীনতাপ্রিয় মুক্তিবাহিনীর স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধবাজ উন্মাদ পাকিস্তানী জঙ্গীশাহীকে নিশ্চিহ্ন করার মত তখন চীন, বৃটেন বিশেষ করে সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বস্তি পরিষদে যুদ্ধ বিরতি ও সইন্যাপসারণের প্রস্তাবের উপর ভেটো দিয়েছে রাশিয়া। বলেছে ভারত-পাক যুদ্ধের উৎস কোথায়? বাংলাদেশে গণহত্যা কে চালিয়েছে, কে শরনার্থী সমস্যার সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশে সত্যিকারের প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। চক্রান্তকারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হৃৎপিণ্ডে আঘাত লেগেছে। যে মার্কিন সরকার পাকিস্তানকে গোপনে স্বাধীনতাপ্রিয় জননী বাংলার বীর সন্তানদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য অস্ত্র দিয়েছে আজকে সেই শান্তির দূত সাজতে চায়।
.
আজকের এই লড়াই বাংলাদেশ ও ভারতের শান্তির লড়াই, মানবতার লড়াই, গণতন্ত্রের লড়াই, বাঁচার লড়াই। এ লড়াই বৃহৎ শক্তিগুলির তল্পিবাহক রাষ্ট্রসংঘের কলমের খোঁচায় বন্ধ হয়ে যাবে না। যে পর্যন্ত না স্বৈরাচারী ঔপনিবেশিক, সাম্রাজ্যবাদী পাকিস্তানের কবর হবে সে পর্যন্ত এ যুদ্ধ চলবে। চালিয়ে যাবে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী ও সহযোগী ভারতীয় জওয়ানরা তাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য।
.
.
নোবেল
<৬,১৪০,২২৮-২২৯>
সংবাদপত্রঃ জন্মভূমি ১ম বর্ষঃ ১৬শ সংখ্যা
তারিখঃ ৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১
ভারতের তুলনায়
জঙ্গীশাহীর সামরিক শক্তি কতটুকু
ভারতের বিরুদ্ধে ইয়াহিয়া খাঁ যুদ্ধ বাধিয়ে দিয়েছে। ভারতের বিরুদ্ধে ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান সরকার যুদ্ধ করে মজা বুঝেছিল। শুধুমাত্র ক্ষেমকারণ ও শিয়ালকোটের অদূরেই অল্পসংখ্যক ট্যাঙ্ক নিয়েই ভারত পাকিস্তান ট্যাঙ্কের গোরস্থান করেছিল।
.
আবার পাকিস্তান সামরিক জান্তারা নতুন ফন্দি করে বাংলাদেশ সমস্যাকে বিনষ্ট করার জন্য পাক-ভারত যুদ্ধ চালিয়েছে। যতই ফন্দি আটকাও না কেন কুখ্যাত ইয়াহিয়া, জননী বাংলার বীর মুক্তিযোদ্ধারা আজকে তোমার সমস্ত ফন্দিই চূর্ণবিচূর্ণ করে দিবে। ভারতের সাথে কিসের জোরে আজকে পাকিস্তান সামরিক গোষ্ঠীরা যুদ্ধ ঘোষণা করছে। ভারতের তুলনায় না আছে তার লোকবল, সৈন্যবল বা অস্ত্রবল, এইতো সম্প্রতি বয়ড়ার কাছে আকাশ যুদ্ধে ভারতীয় জেট দ্বারা তিনটি পাকিস্তানী বোমারু বিমান ও স্থলপথে ১৭টি পাকিস্তানী ট্যাঙ্ক ভারতের মাতৃভূমি প্রিয় সৈন্যরা ঘায়েল করেছে।
পাকিস্তান | ভারত |
মোট সৈন্যবল ৩ লক্ষ ৫০ হাজার | মোট সৈন্যবল ৮লক্ষ ২৮ হাজার |
সাঁজোয়া ডিভিশন ২টি | সাঁজোয়া ডিভিশন ১টি |
স্বয়ংসম্পূর্ণ সাঁজোয়া ব্রিগেড ১টি | মাউন্টেন ডিভিশন ১০টি |
পদাতিক ডিভিশন ১২টি | পদাতিক ডিভিশন ১৩ টি |
এয়ারফোর্স ব্রিগেড ১টি | ছত্রী ব্রিগেড ২টি |
স্বয়ংসম্পূর্ণ সাঁজোয়া এবং পদাতিক ব্রিগেড
ট্যাঙ্ক | ট্যাঙ্ক |
প্যাটন এম-৪৭-৪৮ [৪০০] | বৈজয়ন্ত [৩০০] |
টি-৫৯(চীনা) [২০০] | টি ৫৪, টি ৫৫ [৪৫০] |
টি ৫৪-৫৫ (সোভিয়েত) [২৫০] | সেঞ্চুরিয়ান, এম এক্স-১৩ পিটি [৭৬] |
এম ২৪ শোফে- [২০০] | প্রভৃতি |
এম ৪১ [৭৫] | ১৯৬৫ সালের চেয়ে ভারতীয় ট্যাঙ্কবহর এখন বেশী শক্তিশালী। অনেকের ধারণা বৈজযন্ত্রের মারণ ক্ষমতা প্যাটনকে ছাড়িয়ে যেতে সক্ষম। এটা ভারতেরই তৈরী। |
পিটি-৭৬ [৩০] | |
এইচ ১৩ হেলিকপ্টার [২০] | |
হালকা হেলিকপ্টার [৪০] | |
লোকবল ১৫ হাজার | লোকবল ৯০ হাজার |
বিমান বহর
জঙ্গী বিমান [১৭০] | জঙ্গি বিমান মোট [৬২৫] |
ক্যানবেরা বি১ বোমারু [১১] | ক্যানবেরা বোমারু [৫০] |
বি ৫৭ ক্যানবেরা ২ স্কোয়াড্রন | ক্যানবেরা পি আর ৫৭ [৮] |
আর টি ৩৩ এ, আর বি ৫৭ মিরাজ [১০] | মিগ ২১ [১২০] |
মিগ ১৯ ৫ স্কোয়াড্রন | ন্যাট [১৫০] |
এফ ১০৪এ ১ স্কোয়াড্রন | মারু ৩ [২৫] |
এফ ৮৬ জঙ্গী বোমারু ৭ স্কোয়াড্রন | মিসটের [৬০] |
মিরাজ ৩ই ১ স্কোয়াড্রন | লকহিড এল ১০৪৯ সুপার কন্সতোলেশন [৮] |
পরিবহন বিমান [১৬] | ভ্যাম্পায়ার [৫০] |
হেলিকপ্টার [২০] | হেলিকপ্টার [২২১] |
টি ৬, টি ৩৩,টি ৩৭ বি এবং মিরাজ ৩ডি [৮০] | এস ইউ-বি জঙ্গী বোমারু [১৪০] |
নৌবহর
নৌসেনা ৯ হাজার ৫শ | ৪০ হাজার |
ক্রাইজার ১টি | বিমানবাহী জাহাজ ১টি |
ডেস্ট্রিয়ার ১টি | সাবমেরিন ৪টি |
ডেস্ট্রয়ার এস্কর্ট ৩টি | ক্রাইজার ২টি |
ফ্রিগেট ২টি | ডেস্ট্রিয়ার এবং ডেস্ট্রয়ার এস্কর্ট ১১টি |
মাইন সুইপার ৮টি | ফ্রিগেট ৮টি |
পেট্রোল বোট ৬টি | মাইন সুইপার ১১টি |
সাবমেরিন ৪টি | ল্যান্ডিং সীপ ৮টি |
ল্যান্ডিং ক্রাফট-৩ ৪টি | |
পেট্রোল ক্রাফট-১০ ১টি |
পরিসংখ্যান গুলো ষোল আনা সত্য বললে ভুল করা হবে। এর বাইরে অনেক কিছু থাকতে পারে। সেগুলো অবশ্যই গোপনীয়। তাছাড়া চীন থেকে পাকিস্তান কি পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র পেয়েছে তা সঠিকভাবে জানাবার উপায় নেই। চোরাগোপ্তাভাবে অন্যান্য দেশ থেকে ইয়াহিয়া খান কি সংগ্রহ করেছেন তাও অজ্ঞাত। ১৯৬৫ সালে পাক- ভারত লড়াই এর আগে পাক অস্ত্রাগারে মজুত ট্যাঙ্কের হিসাব ছিল ভুল। বাইরে প্রকাশিত সংখ্যার চেয়ে তা ছিল অনেক বেশী।
.
.
নোবেল
<৬,১৪১,২৩০-২৩১>
সংবাদপত্রঃ বাংলার বাণী মুজিব নগরঃ ৩য় সংখ্যা
তারিখঃ ১৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
সম্পাদকীয়
[বাংলার বাণীঃ সাপ্তাহিক। সম্পাদকঃ আমির হোসেন। মুজিবনগর হতে আমির হোসেন কর্তৃক বাংলার বাণী প্রেসে মুদ্রিত এবং প্রকাশিত।]
দূর্ভিক্ষের করাল গ্রাসে বাংলাদেশ
দুর্ভাগা বাংলার শত্রুকবলিত এলাকাসমূহে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ শুরু হইয়াছে। বাংলাদেশের ১২টি জেলার বিস্তির্ণ এলাকা জুড়িয়া ভয়াল দূর্ভিক্ষের মরণ- ছোবলে ইতিমধ্যেই ১৯১টি মানব জীবন মৃত্যুর অতলান্তে হারাইয়া গিয়াছে। ঘরে ঘরে উঠিয়াছে অন্নহীন উপায়হীন বুভুক্ষ মানুষের মরণার্তি। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা আড়িয়ালখার তীরে তীরে বাতাসে বাতাসে ভাসিয়া বেড়াইতেছে দুঃসহ ক্ষুধার জ্বালায় জর্জরিত অগণিত নরনারী শিশুর সকরুণ আর্তনাদঃ বাঁচাও।
বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত খবর অনুসারে, যে ১২টি জেলায় সর্বনাশা দুর্ভিক্ষ সমস্ত হিংস্রতা লইয়া মারণনৃত্যে মাতিয়া উঠিয়াছে সেই জেলাগুলি হইতেছে ঢাকা, কুমিল্লা, সিলেট, দিনাজপুর, রংপুর, পাবনা, বরিশাল, নোয়াখালী, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, যশোর ও খুলনা। দুর্ভিক্ষ পীড়িত এলাকাসমূহে প্রতিদিন অবস্থার অবনতি ঘটিতেছে। প্রতিদিন অগণিত মানুষ অনাহারে তিলে তিলে ধুঁকিয়া ধুঁকিয়া মরিতেছে। অধিকৃত এলাকা সফর শেষে হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুলের ডাঃ জন রোড বলিয়াছেন, ‘বাংলাদেশে ১৯৪৩ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের পর বর্তমানে যে ধরনের খাদ্যাভাব দেখা দিয়াছে এরূপ সাংঘাতিক অবস্থা আর কখনো দেখা যায় নাই। কম করিয়া ধরিলেও প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষ আসন্ন দুর্ভিক্ষের সময়ে অনাহারে মৃত্যুবরণ করিতে বাধ্য হইবে।
ইহার চাইতে উদ্দেগজনক খবর, ইহার চাইতে ভয়াবহ অবস্থা আর কি হইতে পারে? জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞদের রিপোর্ট অনুসারে পৃথিবীতে যত রকমের দুঃখ আছে তারমধ্যে সব চাইতে মর্মান্তিক, সব চাইতে দুঃসহ হইতেছে অনাহারে থাকার দুঃখ, অফুরন্ত ঐশর্যে ভরা এই পৃথিবীতে ক্ষুধার যন্ত্রণায় পুড়িয়া তিলে তিলে ছাই হওয়ার দুঃখ। আর এই দুঃখ আজ যুদ্ধবিক্ষত বাংলার মানুষকে আষ্টেপৃষ্টে গ্রাস করিয়া লইয়াছে। বাংগালী জঙ্গীশাহীর গুলি খাইয়া মরিতেছে,রোগে ব্যাধিতে মরিতেছে অনাহারে- বুভুক্ষার সুতীব্র দংশনের দুঃসহ যন্ত্রণায়।
কিন্তু কেন? এই বাংলা ছিল সোনার বাংলা। একদিন বাংলাদেশ ছিল অফুরন্ত ঐশ্বর্যের ভাণ্ডার। সেদিন বাংলার মাটি ছিল স্বর্ণপ্রসবিনী। বাংলার সেই স্বর্ণযুগে বাঙ্গালীর ঘরে ঘরে গোলাভরা ধান ছিল, গোয়ালভরা গরু ছিল, পুকুরভরা মাছ ছিল, দিগন্ত বিস্তৃত প্রান্তর ভরিয়া ছিল সোনালী ফসলের সোনার সম্পদ। সেদিন বাংলার দশদিগন্তে ছড়াইয়া ছিল সুখ আর তৃপ্তির মুঠো মুঠো সোনা। বাংলার মানুষ সেদিন নদীর বাঁকে, চাষের ক্ষেত্রে। খালে বিলে গলা ছাড়িয়া গান গাহিত, প্রাণ খুলিয়া হাসিত, জীবনকে অভিনন্দন জানাইতে পারিত আত্মার অন্ত্রঙ্গতম অনুভূতির ঐশ্বর্যে।
কিন্তু সোনার বাংলার সেই সোনার দিনগুলি কবে কোথায় হারাইয়া গিয়াছে। বাংলার সোনার সম্পদই তার কাল হইয়াছে। এই সম্পদের লোভেই বার বার বাংলার শ্যামল উপকূলে হানা দিয়াছে সম্পদলোভী ঠগ, বর্গী, পর্তুগীজ ওলন্দাজ, ইংরেজ দস্যু দল। জননী জন্মভূমির বুক চিরিয়া চিরিয়া কাড়িয়া নিয়াছে সোনালী সম্পদ। সর্ব শেষ আসিয়াছে পাঞ্জাবী লুটেরা দস্যুর দল। তুলনাহীন নিষ্ঠুরতায় তারা কামড়াইয়া ছিড়িয়া খাইয়াছে বাংগালীর হাড় মাংস কলিজা, দুই হাতে লুটিয়া নিয়াছে বাংলার সর্বস্ব। এই সম্পদলোভী দস্যুদানবের দল বাংলাকে ব্যাবহার করেছে কলোনী হিসেবে, পণ্য বিক্রয়ের অবাধ মুনাফা লুটিবার খোলা বাজার হিসেবে। আর এভাবেই তারা একদিনের সোনার বাংলাকে পরিণত করিয়াছে এক অন্তহীন দুঃখের ভাগাড়ে। লুটেরা দস্যুদের সাথে যোগ দিয়েছে ঝড় বন্যা প্লাবন। প্রকৃতি দানব সর্বাত্মক হিংস্রতা লইয়া বার বার ছোবল হানিয়াছে বাংলার বুকে, ছিড়িয়া ফাড়িয়া তছনছ করিয়াছে বাংলার মাটি, মানুষ আর অর্থনীতি। দিনে দিনে বাঙ্গালীদের অবস্থার ক্রমশঃ অবনতি ঘটিয়াছে। ক্ষুধা, দারিদ্র, অনটন আর দুর্ভোগ তাদের ললাটে জাঁকিয়া বসিয়াছে দুরপনেয় কলঙ্ক চিহ্ন হইয়া।
বাংলাদেশকে একদিন বলা হইত প্রাচ্যের শস্য ভাণ্ডার। কিন্তু এই শস্যভান্ডার একদিন পরিণত হইয়াছে ক্রমাবনতিশীল শস্য ঘাটতির দেশে। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে খাদ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল মুটামুটিভাবে বার্ষিক ১২ লক্ষ টন। বিশেষজ্ঞদের মতে, অত্যন্ত জরুরী ভিত্তিতে কমপক্ষে ২৯ লক্ষ টন খাদ্যশস্য আমদানী এবং সঙ্গে সঙ্গে জনগণের মধ্যে বিতরণের ব্যাবস্থা করিতে না পারিলে বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধের কোন আশা নাই। বলা বাহুল্য, ইহা এক অসম্ভব ব্যাপার। কারণ জঙ্গীশাহী বাংলার মানুষকে মারিতে চায়, তাদের বাঁচাইয়া রাখার জন্য কসাইদের কোন গরজ নাই। এই পরিস্থিতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধকল্পে ১৫ টি বা তারও বেশি সি ৩০ পরিবহণ বিমানযোগে সেখানে খাদ্যশস্য নিক্ষেপের জন্য প্রস্তুত রহিয়াছে বলিয়া জানাইয়াছে।
দুর্গত মানবতার সেবাই যদি এই প্রস্তাবের লক্ষ্য হয়, তবে ইয়া একটি মহান প্রস্তাব একথা স্বীকার করিতে আমাদের দ্বিধা নাই। কিন্তু একটা প্রশ্ন আছে। কাহার হাতে এই খাদ্যশস্য দেওয়া হইবে, কাহার মাধ্যমে ইহা বিতরণ করা হইবে? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ সমগ্র পৃথিবীকে আমরা বলিয়া দিতে চাই, ইয়াহিয়ার জঙ্গীশাহীর হাতে খাদ্যশস্য তুলিয়া দেওয়ার অর্থ হইবে বাঙ্গালীদের খুন করার জন্য আর কিছু বুলেট সরবরাহ করা। কারণ, এই খাদ্য সাহায্য সে নিশ্চিতভাবে বাঙ্গালীদের দাবাইয়া রাখার সামরিক উদ্দেশ্যে ব্যাবহার করিবে। অতীত অভিজ্ঞতা নির্ভুল ভাবে এই কথাই প্রমাণ করিয়াছে। তাই বিশ্ববাসীর কাছে আমাদের আবেদন, বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষকে বাঁচাইবার জন্য সাহায্য সামগ্রী লইয়া আগাইয়া আসুন। মানবতার নামেই আমরা আবেদন করিতেছি ক্ষুধার্থ বাঙ্গালীদের মুখে অন্ন তুলিয়া দিন। কিন্তু এ সাহায্য সামগ্রী যেন কোনমতেই ইয়াহিয়ার হাতে না যায়। যে কোন সাহায্য দ্রব্য পৌঁছাইতে হইবে স্বাধীন বাংলা সরকারের হাতে। কারণ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সরকারই বাংলাদেশের একমাত্র বৈধ সরকার। আর এই সরকারই বাংলার এই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের মোকাবিলা করিতে আন্তরিকভাবে সচেষ্ট হইবেন বলিয়া আশা করা যায়। যদি কেহ পাকিস্তান সরকারের হাতে খাদ্যসামগ্রী তুলিয়া দেন, আমরা ধরিয়া নিব বুভুক্ষ মানুষকে খাদ্য সরবরাহের না ভাঙ্গাইয়া তাহারা ধনীদের হাতে বাঙালী নিধনের হাতিয়ারই তুলিয়া দিতেছেন। সংশ্লিষ্ট সকলকে এই স্পষ্টভাবে মনে রাখিতে হইবে।
.
.
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
<৬,১৪২,২৩২>
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্র ঃ ষষ্ঠ খন্ড
শিরোনাম | সংবাদ পত্র | তারিখ |
জাতিসংঘের সাহায্য সামগ্রী নিয়ে ছিনিমিনি খেলা |
বাংলার বাণী মুজিবনগরঃ তৃতীয় সংখ্যা |
১৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ |
জাতিসংঘের সাহায্য সামগ্রী নিয়ে ছিনিমিনি খেলা
(বিশেষ প্রতিনিধি)
বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকায় পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদার সেনাবাহিনী জাতিসংঘের সাহায্য কেন্দ্রের গাড়ীগুলি যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করিতেছে।
লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ, নারী নির্যাতন এবং গণহত্যায় লিপ্ত পাকফৌজের পক্ষে সামরিক বাহিনীর গাড়ীর পরিবর্তে জাতিসংঘের গাড়ী ব্যবহার অধিকতর সুবিধাজনক।
বিশ্বস্ত সুত্রে জানা গিয়াছে, নভেম্বর মাসে বাংলাদেশে যে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিবার্তার ফলে লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারায় ঐসময় ত্রানকার্জে সুবিধার জন্য এইসব গাড়ী বাংলাদেশে আনা হইয়াছিল। জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক জরুরী শিল্প- কল্যাণ তহবিল পরেও সাহায্য কার্যের জন্য কিছু গাড়ী প্রেরণ করিয়াছে।এইসব গাড়ী ছাড়াও তখন নরওয়ে এবং অন্যান্য স্কান্ডিনেভিয়ান দেশ বহু যন্ত্রচালিত ও রাবারের নৌকা ত্রান কার্যের জন্য দান করিয়াছিল।দখলদার পাকিস্তানী জঙ্গীশাহী দুস্থ মানুষের সাহায্যের জন্য প্রদত্ত সেইসমস্ত জলযানসমূহও সামরিক কার্যে ব্যবহার করিতেছে।
সম্প্রতি মুক্তিযোদ্ধারা খুলনায় একটি পাকিস্তানী গানবোট দখল করিয়াছেন। তাঁহারা দেখিয়াছেন, এই গানবোটে জাতিসংঘের প্রদত্ত জলযানসমূহেরই একটি। পাকিস্তানী সৈন্যরা এইগুলির কিঞ্চিত সংস্কার করিয়া সামরিক কাজে ব্যবহার উপযোগী করিয়া লইয়াছে।
পাকিস্তানী সৈন্যরা যে শুধু জাতিসংঘের গাড়ীই ব্যবহার করিতেছে তাহা নহে। তাহারা বাত্যাবিধ্বস্ত মানুষের জন্য প্রদত্ত কাপড়-চোপড়, খাদ্-ঔষধপত্র নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার করিয়াছে।
সর্বশেষ খবরে জানা গিয়াছে, ইউরোপের তিনটি দেশ জাতিসংঘের ত্রাণসামগ্রীর এইরূপ অপব্যবহার সম্পর্কে জাতিসংঘের সেক্রেটারী জেনারেলের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষা করিয়া চলিতেছে।দেশত্রয় মনে করে – অবিলম্ভে পাকিস্তানকে জাতিসংঘের সকল প্রকার সাহায্য প্রদান বন্ধ করা উচিত।
এদিকে বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘকে জানাইয়া দিয়াছে যে, পাকিস্তান জঙ্গীচক্র ইউনিসেফ (Unicef)প্রদত্ত গাড়ীগুলি সামরিক কাজে ব্যবহার করিতেছে।
লন্ডনস্থ বাংলাদেশ মিশন বাংলাদেশ সরকারে পক্ষ হইতে জাতিসংঘের কাছে এই অভিযোগ পেশ করিয়াছে।
—————————
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
<৬,১৪৩,২৩৩>
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্রঃ ষষ্ঠ খন্ড
শিরোনাম | সংবাদ পত্র | তারিখ |
অধিকৃত অঞ্চলে স্বাভাবিক অবস্থার নমুনা |
বাংলার বাণী মুজিবনগরঃ তৃতীয় সংখ্যা |
১৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ |
অধিকৃত অঞ্চলে স্বাভাবিক অবস্থার নমুনা
শিক্ষকদের হয়রানি অব্যাহত
স্কুল কলেজে ছাত্রসংখ্যা হাস্যকরভাবে নগন্য
(বিশেষ প্রতিনিধি)
বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকায় হানাদার বাহিনীর চন্ডণীতি অব্যাহত রহিয়াছে। বাঙ্গালী জাতিকে অজ্ঞানতার অন্ধকারে নিক্ষেপ করিয়া চিরতরে পঙ্গু করিয়া রাখার দূরভিসন্ধি হাসিলের উদ্দেশ্যে হনাদার বাহিনী বাংলাদেশের ছাত্র-শিক্ষকদের বিরুদ্ধে যে বর্বর নিধনযজ্ঞ পরিচালনা করে, উহার বিভীষিকাময় স্মৃতি বাঙ্গালীর মন মানষ হইতে এখনো মুছিয়া যায়নাই। আজও ছাত্র – শিক্ষক বুদ্ধিজীবীদের বুলেটবিদ্ধ মৃতদেহের আতংকময় দৃশ্য আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বিভিন্ন আবাশিক হল ও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ধ্বসস্তুপ বাংলাদেশের ছাত্র-শিক্ষকদের নিরন্তর চাবুক মারিয়া বলিয়া দিতেছে হানাদার পান্জাবী ডালকুত্তার দল বাংলাদেশের শিক্ষাজীবনকে পঙ্গু করিয়া দিতে, ছাত্র শিক্ষকসহ বুদ্ধিজীবীসহ গোটা জাতিকে নিশ্চিহ্ন করিয়া দিতে, চায় বাংলাকে চিরদিন পদানত করিয়া রাখিতে। তাছড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্স ময়দানে ৭ই মার্চের ভাষণে নির্দেশ দিয়াছেন, যতদিন বাংলার মানুষের মুক্তি না আসে, ততদিন স্কুল কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ। তাই আজ আর বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র শিক্ষকদের ভীড় নাই। শিক্ষাঙ্গণ ছাড়িয়া ছাত্র তরুনেরা সমরাস্ত্র হাতে রণাঙ্গনের প্রান্তে খুজিয়া বেড়াইতেছেন শত্রু বাহিনী। আর শিক্ষকরা পালন করিতেছেন স্বাধীনতা সংগ্রামের সুবিস্তৃত প্রাঙ্গনে আপন আপন দ্বায়িত্ব।
সেই কারনেই অধিকৃত এলাকায় স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়া আসিয়াছে বলিয়া জঙ্গীশাহীর অবিরাম প্রচারনা স্বত্তেও স্কুল কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলি এখনো গড়ের মাঠ। আর ইহাতে ক্ষেপিয়া উঠিয়াছে জল্লাদশাহী। প্রতিহিংসা চরিতার্থের জন্য পাকফৌজ এখন ঝাপাইয়া পড়িয়াছে অধিকৃত এলাকায় এখনো যে অল্পসংখ্যক শিক্ষক শিক্ষাবীদ রহিয়াছে তাহাদের উপর।
তথ্যাভিঞ্জ মহলের খবরে প্রকাশ যে, দখলদার জঙ্গীবাহিনী সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্ততঃ ১৫ জন বিশিষ্ট অধ্যাপককে গ্রেফতার করিয়াছে কিংবা সামরিক কর্তৃপক্ষের নিকট হাজির হইবার নির্দেশ দিয়াছে।
হানাদার বাহিনী যাঁহাদের উপর নির্দেশ জারী করিয়াছে তাঁহাদের মধ্যে রহিয়াছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের রীডার ও বিশিষ্ট সাহিত্যিক ডঃ আহমদ শরীফ, ইংরাজী বিভাগের রীডার ডঃ এহসানুল হক এবং বিঞ্জান বিভাগের ৪ বিশিষ্ট অধ্যাপক। এই গ্রেফতারের ব্যাপারে অবশ্য পাকিস্তান সরকার নীরব।
শিক্ষা বিভাগের সহিত সংশ্লিষ্ট মহলের সংবাদে প্রকাশ যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাড়ে সাত হাজার ছাত্র ছাত্রীর মধ্যে গড়ে ৪৭/৪৮ জন ছাত্র ক্লাসে আসে। ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন হাজারের অধিক ছাত্রের মধ্যে উপস্থিতির সংখ্যা মাত্র ১৬ জন এবং ঢাকা কলেজের প্রায় এক হাজার ছাত্রের মধ্যে ৬০ জন, ল’ কলেজ ও নটরডেম কলেজে কেহই ক্লাসে যোগদান করিতেছেনা। চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই হাজার ছাত্র ছাতীর মধ্যে উপস্থিতির সংখ্যা মাত্র ১৬ জন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপস্থিতির সংখ্যাও প্রায় অনুরুপ।
——————–
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
<৬,১৪৪,২৩৪>
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্রঃ ষষ্ঠ খন্ড
শিরোনাম | সংবাদ পত্র | তারিখ |
বাংলাদেশের অধিকৃতিএলাকায় কি দেখিলাম |
বাংলার বাণী মুজিবনগরঃ তৃতীয় সংখ্যা |
১৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ |
বাংলাদেশের অধিকৃতিএলাকায় কি দেখিলাম
(নিজস্ব প্রতিবেদক)
অতিসম্প্রতি ”বাংলার বাণী”র একজন প্রতিনিধি বাংলাদেশের অধিকৃত অঞ্চলের বিস্তীর্ন এলাকা সফর করিয়া ফিরিয়া আসিয়াছেন। সেখানকার পরিস্থিতি সম্পর্কে অঅমাদের প্রতিনিধি যে বিবরন লিপিব্দ্ধ করিয়াছেন তারই অংশবিশেষ এখানে ছাপা হইল।
তরুন গেরিলাদের আক্রমন তীব্রতর হওয়ার সাথে সাথে বাংলাদেশের অধিকৃত অঞ্চলে শত্রু সেনাদের অত্যাচার ও উৎপীড়ন আরো তীব্র হইয়া উঠিয়াছে। ‘বিশ্বের সেরা সৈনিকরা’ মুক্তিযোদ্ধাদের সহিত সম্মুখ সমরে অবতীর্ন হইবার পরিবর্তে সাধারন গ্রামবাসীর উপর চরমতম নিগ্রহ চালাইয়া তাহাদের দুর্বলতা ঢাকিবার চেষ্টা করিতেছে। ভীতসন্ত্রস্ত গ্রামবাসীদের তাহারা নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করিতেছে। বিশেষ করিয়া মুক্তিযোদ্ধারা যে জায়গায় একবার খানসেনাদের উপর হামলা করিয়া গিয়াছে তাহার আশেপাশে সাধারন মানুষের উপর হানাদাররা বর্বর নির্যাতন চালাইতেছে। অতি সম্প্রতি গাইবান্ধার রসুলপুরের সুইসগেটের নিকটবর্তী ফুলছড়ি বাঁধের উপর মানাশ নামক জায়গায় একটি পুল গেরিলা যোদ্ধারা রাত্রিকালে আক্রমন করিয়া রাজাকার ও পাকসেনাদের একটি ছোট পাহারা ঘাঁটি বিদ্ধস্ত করিয়াছেন এবং পুলটির ব্যাপক ক্ষতিসাধন করেন। মানাশের নিকটবর্তী কামারজানী ও গাইবান্ধাতে পাকসেনাদের দুই বিরাট শক্ত ঘাঁটি থাকা সত্ত্বেও যুদ্ধ চলাকালে তাহারা অক্রমনস্থলে আসার সাহস পায়নাই। পরদিন সকালে একজন ক্যাপ্টেনের নেতৃত্বে একদল বর্বর সৈন্য ঘটনাস্থলে আসিয়া ৩/৪ মাইল এলাকা জুড়িয়া ধ্বংশযঞ্জ চালাইয়া প্রায় ১০০ লোক হত্যা করে। রাজাকার ও স্থানীয় অবাঙ্গালীরা পরে তাহাদের সাথে মিলিত হইয়া মানাশ ও রসুলপুর এলাকা তছনছ করিয়া ফেলে।
অনুরুপভাবে গেরিলা রেডিও পাকিস্তান রংপুরের উপর আক্রমন চালাইলে পাহারারত পঞ্চাশজনেরও অধিক পাকসেনা আত্বগোপন করে এবং তাহাদের অনেকে আহত হয়। রেডিও শ্টেশন হইতে মাত্র হাফ কিলোমিটার দুরে পাক সরকারের সিভিল আর্ম ফোর্সের সেক্টর অফিস এবং মাত্র এক কিলোমিটার দুরে রংপুর ক্যান্টনমেন্ট থাকা সত্ত্বেও তাহারা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি পাল্টা আক্রমন করিবার জন্য কেহই বাহির হয়নাই। এখানে অর্ধঘন্টাব্যাপী যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধারা রেডিও শ্টেশনের বেশ ক্ষতিসাধন করে। পরদিন সকালে যথারীতি “বিশ্বের সেরা সৈনিকরা” রেডিও সংলগ্ন এলাকা ছাড়াও প্রায় পাঁচ মাইল দুর পর্যন্ত অভিযান চালাইয়া বহু ঘরবাড়ী জালাইয়া দেয় ও নিরপরাধ গ্রামবাসী ও তরুনীকে ধরিয়া নিয়া যায়। তাহাদের ভাগ্যে কি হইয়াছে তাহা জানা যায় নাই।
একইদিনে তাহারা উক্ত রেডিও শ্টেশনের প্রোগ্রাম অরগানাইজার জনাব মহিউদ্দিন হায়দার, ড্রাইভার তারামিয়া ও কয়েকজন টেকনিশয়ানকে রংপুরের দ্বিতীয় সামরিক শিবির মডেল স্কুলের নিকট দমদম পুলের নিকট অতি নৃশংসভাবে হত্যা করে।
পাকবাহিনীর হিংস্রতা যেভাবে দিনদিন বৃদ্ধি পাইতেছে তাহাতে তাদের দুর্বলতাই প্রকাশ পাইতেছে। দেশবাসীকে আতঙ্ক ও ভীতগ্রস্ত করিয়া তাহারা “স্বাভাবিক অবস্থা” ফিরাইয়া আনিতে চাহিতেছে। কারন তাহারা বুঝিতে পারিয়াছে এইদেশে তাহাদের আয়ু ফুরাইয়াছে।
——————–
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
<৬,১৪৫,২৩৫-২৩৬>
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্র ঃ ষষ্ঠ খন্ড
শিরোনাম | সংবাদ পত্র | তারিখ |
সম্পাদকীয় জাতিসংঘের অগ্নিপরীক্ষা |
বাংলার বাণী মুজিবনগরঃ ৪র্থ সংখ্যা |
২১ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ |
সম্পাদকীয়
জাতিসংঘের অগ্নিপরীক্ষা
আজ ২১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারন পরিষদের অধিবেশন শুরু হইতেছে।
জাতিসংঘ সাধারন পরিষদ আজ বৈঠকে মিলিত হইয়াই সর্ব্রাগ্রে যে জটিল রাজনৈতিক ইস্যুটির জ্বলন্ত সূর্যের মখোমুখি হইবে উহা হইতেছে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রসঙ্গ। মানবাধিকার সংরক্ষনের সুমহান ওয়াদাবদ্ধ জাতিসংঘের আঙ্গিনায় পাশাপাশি উপবিষ্ট হইয়া দলমত নির্বিশেষে সুশভ্য পৃথিবীর সকল জাতি চোখ মেলিলেই দেখিতে পাইবে বিশ্বের একান্তে এই বাংলাদেশে কিভাবে এক পররাজ্যলোভী হানাদার দস্যুর হিংশ্র বর্বরতায় দশ লক্ষ মানুষের রক্তের গঙ্গা প্রবাহিত হইতেছে, কিভাবে সাড়ে সাত কোটি মানুষের আত্মার আমোঘ বাণীকে, মৌলিক মানবিক অধিকারকে, শাশ্বত স্বাধীনতার দুরন্ত স্পৃহাকে শক্তির জোরে পিষিয়া মারার উন্মত্ত প্রচেষ্টা চলিতেছে, কিভাবে কারারুদ্ধ করিয়া রাখা হইয়াছে বাংলার মুকুটহীন সম্রাট স্বাধীন বাংলার জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে, কিভাবে তাকে পৃথিবী হইতে সরাইয়া দেওয়ার ঘৃণ্য প্রয়াশে উদ্যত হইয়া আছে জল্লাদের হাতিয়ার।
গত ছয় মাসে বাংলাদেশে যা ঘটিয়া গিয়াছে, বাংলাদেশে আজও যা ঘটিতেছে হানাদার পশ্চিম পাকিস্তানী কসাই বাহিনী বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে ভন্ডুল করিয়া দেওয়ার জন্য যে হিংশ্র বর্বরতা, যে জঘন্য পোড়া মাটি নীতির আশ্রয় গ্রহন করিয়াছে, যেভাবে বাংলাদেশে বলদর্পী অক্রমনকারীর ঔদদ্ধত্যপূর্ণ পদচারনায় মানবাধিকার ভুলুন্ঠিত হইতেছে, ধর্ষিত নিগৃহিত হইতেছে মৌলিক মানবিক মূল্যবোধ, অসহায় মানবতা, সভ্য মানুষের ইতিহাসে ইহার কোন নজির নাই। তাই জাতিসংঘের ইতিহাসেও বাংলাদেশের ইস্যুটি এক নজিরবিহীন তাৎপর্যপূর্ণ অদ্বিতীয় ইস্যু। বাংলাদেশে মানব ইতিহাসের ঘৃণ্যতম বর্বরতা এবং ভয়াভহতম গণহত্যার রক্তাক্ত পটভূমিতে আজ জাতিসংঘ সাধারন পরিষদের অধিবেশন শুরু হইতেছে। সুতরাং বলিলে এতটুকু অত্যুক্তি হইবেনা যে, জাতিসংঘের চলতি অধিবেশন হইবে বিশ্ব সংস্থার ইতিহাসের সব চাইতে সংকটজনক অধিবেশন। এই অধিবেশনে বাংলাদেশ ইস্যুটি জাতিসংঘের জন্য ডাকিয়া আনিয়াছে এক অগ্নিপরীক্ষা। বাংরাদেশ ইস্যু কেন্দ্রিক এই অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ন হওয়া না হওয়ার উপর নির্ভর করে জাতিসংঘের ভবিষ্যৎ।
.
বলাবাহুল্য, একটি আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক আড্ডাখানা হিসেবে বা সাম্রাজ্যবাদী, উপনিবেশবাদী শক্তির খেয়াল খুশীমত কেতুর নাচ নাচিবার জন্য ও জাতিসংঘের জন্ম হয় নাই। মানব জাতির স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব ও মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ, বিশ্ব শান্তির নিশ্চয়তা এবং মানবিক মূল্যবোধের নিরাপত্তা বিধানের পবিত্র প্রতিশ্রুতিতেই সৃষ্টি হইয়াছে এই বিশ্ব সংস্থার। জাতিসংঘ সনদে সুস্পষ্ট ভাবেই গণহত্যা প্রতিরোধ এবং এক দেশ কর্তৃক অন্য দেশে সশস্ত্র হামলা বন্ধের ব্যাপারে কার্যকরী ব্যাবস্থা গ্রহণের দ্ব্যর্থহীন ওয়াদা লিপিবদ্ধ রহিয়াছে।
কিন্তু গভীর দুঃখের সঙ্গে এ কথাও না বলিয়া পারা যায় না যে বাংলাদেশে হানাদার পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিণীর সশস্ত্র আক্রমন এবং গণহত্যা প্রতিরোধের ব্যাপারে জাতিসংঘ উহার বিঘোষিত দ্বায়িত্ব পালনে চুড়ান্ত ব্যর্থতার পরিচয় দিয়াছে। জাতিসংঘের এই ব্যর্থতা জাতিসংঘের সুমহান ভূমিকা সম্পর্কে আস্থাবান স্বান্তিকামী মানবজাতির প্রতি চরম বিশ্বাসঘাতকতারই শমিল।
বিগত মার্চ মাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে বাংলাদেশে অতুলনীয় অহিংস অসহযোগ আন্দোলন শুরু হইলে জল্লাদ ইহাহিয়া বাংলাদেশে ব্যাপকহারে সৈন্য সমাবেশ করিতে শুরু করে। ২৫শে মার্চ রাত্রে কসাই বাহিনী যে গণহত্যাযজ্ঞ শুরু করে সম্ভবত উহারই অগ্রিম আভাস পাইয়া উথান্ট তৎপূর্বে ঢাকায় কর্মরত জাতিসংঘের কর্মচারীদের ঢাকা ত্যাগের অনুমতি প্রদান করেন। এই সময় বঙ্গবন্ধু উথান্টকে উদ্দ্যেশ্য করিয়া বলিয়াছেন, জাতিসংঘের কর্মচারীদের ঢাকা ত্যাগের অনুমতি দানের মধ্যে জাতিসংঘ সেক্রেটারী জেনারেলের কর্তব্য শেষ হইয়া যায়না। শক্তিমত্ত জঙ্গী শাষকের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের প্রতি জাতিসংঘের যে দায়িত্ব রহিয়াছে উহা বিস্মৃত হইলে চলিবেনা।
কিন্তু ইহাতেও জাতিসংঘের চৈতন্যদয় হয়নাই। যদি হইত বাংলাদেশে মানব সভ্যতার ভয়াভহতম ট্রাজেডির বিভীষিকা সম্ভবতঃ অপেক্ষাকৃত কম হিংশ্রতা লইয়া দেখা দিতে পারিত। তারপর বহু দিন কাটিয়া গিয়াছে। বাংলাদেশে জল্লাদ ইহাহিয়ার নিধনধযঞ্জ চলিয়াছে অব্যাহত গতিতে, বিপন্ন মানবতা অসহায় আর্তনাদে বার বার মুখ থুবড়াইয়া পড়িয়াছে বাংলার রক্তপিচ্ছিল মাটিতে। ইহাহিয়া খান বাঙ্গালী জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার উদ্দ্যেশ্যে ভয়াভহতম গণহত্যা অভিযান চালাইয়াই ক্ষান্ত হয়নাই, মাতিয়া উঠিয়াছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জীবননাশের ঘৃন্যতম ষড়যন্ত্রে। বিশ্ব বিবেক জঙ্গী বর্বরতার বিরুদ্ধে ঘৃনা আর ধিক্কারে প্রমত্ত সাগরের ভয়াল গর্জন হইয়া ফাটিয়া পড়িয়াছে বারবার। কিন্তু তবু জাতিসংঘ নামক কুম্ভকর্ণের নিদ্রাভঙ্গ হয়নাই। স্বাধীনতা সংগ্রামে লীপ্ত বাংলার নেতা ও জনতার প্রতি স্বীয় দ্বায়িত্ব পালনে জাতিসংঘ অগ্রণী হইয়া আসে নাই। বরং উল্টা হানাদার জঙ্গীশাহীর সুবিধাজনক অনুরোধে বিগলিত হইয়া বাঙ্গালী জাতির মুক্তি সংগ্রাম বিঘ্নিত ও বানচাল করার জঘন্য উদ্দ্যেশ্য সাধনের নিমিত্তে ভারত বাংলাদেশ সীমান্তে জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক নিয়োগের অবাঞ্চিত উদ্যেগ গ্রহন করিয়া বিশ্ব সংস্থা হিসেবে নিজের গৌরবমন্ডিত ছবিটাকেই তস্করবৃত্তির কলঙ্কে কালিমালিপ্ত করিয়া তুলিয়াছে। বুঝিতে কষ্ট হইবার কথা নয় যে, কঙ্গোর লুমুম্বা ট্রাজেডির নেপথ্য নায়ক ভিয়েতনামে অন্যায় যুদ্ধের ঘৃনিত দস্যু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ইঙ্গিতেই জাতিসংঘ বাংলাদেশের প্রশ্নে স্বীয় দায়িত্ব পালনে ইচ্ছাকৃত ব্যর্থতার পরিচয় দিয়াছে। অর এই ব্যর্থতা বাংলাদেশের মানুষের সামনে, বিশ্বের শ্বান্তিকামী মানুষের সামনে জাতিসংঘকে লক্ষচ্যুত কার্যকারিতাবিহীন রাজনৈতিক আড্ডাখানা হিসাবেই উপস্থিত করিয়াছে।
.
এই পরিস্থিতির পটভূমিতেই আজ জাতিসংঘ সাধারন পরিষদের অধিবেশন বসিতেছে। জাতিসংঘের সকল ব্যর্থতা, উহার সকল শক্তির সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সম্যক অবহিত থাকিয়াও আমরা শেষবারের মত মানবতার নামে এই বিশ্ব সংস্থার প্রতি আকুল আবেদন জানাইতেছি, মানুষের স্বাধীনতা, স্বার্বভৌমত্ব মানবিক মুল্যবোধ আর মানবজাতির প্রতি যদি উহার বিন্দুমাত্রও আস্থা এবং দ্বায়িত্ব থাকিয়া থাকে তবে এখনো সময় আছে। সমস্ত শক্তি লইয়া জাতিসংঘকে বাংলাদেশের পার্শ্বে আসিয়া দাড়াইতে হইবে সমস্ত শক্তি লইয়া রুখিয়া দাঁড়াইতে হইবে হানাদার পশ্চিম পাকিস্তানী উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে।
পৃথিবীর দিক-দিগন্ত হইতে যেসব দেশ ও জাতি আজ নিউইয়র্কে আসিয়া জাতিসংঘ সদর দপ্তরে বৈঠকে মিলিত হইতেছেন, তাহাদের কাছে মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষার জীবনপণ সংগ্রামে লিপ্ত, সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর পক্ষ হইতে আমাদের একটি মাত্র বক্তব্য আছে। বাংলাদেশে কি ঘটিয়াছে আপনারা জানেন। তাই যদি সভ্য জাতি বলিয়া দাবি করিতে চান, যদি গণতন্ত্র স্বাধীনতা ও মানবতায় বিশ্বাসী বলিয়া নিজেদের পরিচয় অক্ষুন্ন রাখিতে চান, তবে জাতিসংঘের এই অধিবেশনকালে একটিমাত্র পথই আপনাদের সামনে খোলা আছে। আর তাহা হইতেছে সকলের ঐক্যবদ্ধ চাপের দ্বারা ইহাহিয়ার জিন্দানখানা হইতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ছিনাইয়া আনা এবং স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়া জাতিসংঘে বাংলাদেশকে পৃথিবীর নবীনতম রাষ্ট্র হিসাবে আসন প্রদান করা। এইবারও যদি আপনারা বাঙ্গালী জাতির প্রতি দ্বায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হন, ইতিহাস আপনাদের চিহ্নিত করিবে মানবতা ও স্বাধীনতার দুশমন হিসাবে আর জাতিসংঘ পরিণত হইবে ব্যর্থ লীগ অব নেশনসের প্রেতাত্মায়।
.
.
দীপংকর ঘোষ দ্বীপ
<৬,১৪৬,২৩৭-২৩৮>
সংবাদপত্রঃ বাংলার বাণী মুজিব নগর–৪র্থ সংখ্যা
তারিখঃ ২১ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
আজ জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের বৈঠক
মাতৃভূমির বক্তব্য পেশের জন্য বাংলাদেশ
প্রতিনিধিদলের নিউইয়র্ক যাত্রা
( কুটনৈতিক সংবাদদাতা )
বিংশ শতাব্দীর অপরাজেয় জাতীয়তাবাদী গণশক্তির আত্মপ্রতিষ্ঠার দুর্জয় সংগ্রামের নির্ভীক সিপাহশালার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ লিপ্ত বাংলাদেশের দশ দিগন্তে হানাদার পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাদস্যুদের হিংস্র বর্বর গণহত্যাযজ্ঞের কালিমালিপ্ত পটভূমিতে আজ ( মঙ্গলবার ) নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন শুরু হইয়াছে । এই অধিবেশনকালে বঙ্গবন্ধুর পক্ষ হইতে, স্বাধীন বাংলার পক্ষ হইতে ১৬ সদস্যবিশিষ্ট একটি প্রতিনিধিদল বিশ্বের দরবারে জননী বাংলার দুঃখ ও বেদনার বাহিনী, সংগ্রাম ও বিক্রমের কাহিনী পেশ করিবেন ।
এই প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব করিবেন লণ্ডনস্থ বাংলাদেশ মিশনের প্রধান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বজনশ্রদ্ধেয় ভাইস চ্যান্সেলর বিচারপতি জনাব আবু সাঈদ চৌধুরী । ইতিপূর্বে শোনা গিয়াছিল যে, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খোন্দকার মোশতাক আহমদ এই প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব করিবেন । কিন্তু অনিবার্য কারণে তিনি নিউইয়র্ক সফরসূচী বাতিল করিয়াছেন বলিয়া জানা গেছে ।
প্রতিনিধিদলের ১১ জন সদস্য আজ মুজিবনগর হইতে নিউইয়র্ক পথে নয়াদিল্লী রওয়ানা হইয়া গিয়াছেন । ইহারা হইতেছেন আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য সর্বজনশ্রদ্ধেয় জননেতা শ্রী ফণীভূষণ মজুমদার এম,পি,এ, সৈয়দ আবদুস সুলতান এম,এন,এ, জনাব জিরাজুল হক এম,এস,এ, ডাঃ মফিজ এম, এন,এ, ডাঃ আজহারুল হক এম, পি, এ, জনাব সাহাবুদ্দিন আহমদ এম, পি, এ, জনাব এম, এ, সামাদ এম, এন, এ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ডঃ এ, আর, মল্লিক, ন্যাপের সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘোষণাকারী সাবেক পাকিস্তানী কূটনীতিক জনাব এ, এফ, এম, আবুল ফতেহ ও জনাব খুররম খান পন্নী । প্রতিনিধিদলের অপর ৫ জন সদস্য হইতেছেন বর্তমানে বিদেশে অবস্থানরত বিচারপতি জনাব আবু সাঈদ চৌধুরী,জনাব এম, আর, সিদ্দিকী এম, এন, এ, অধ্যাপক রেহমান সোবহান, জনাব এস, এ, করিম ও জনাব এ, এম, এ, মহিত । তাঁহারাও ইতিমধ্যেই নিউইয়র্ক পৌছিয়াছেন বা পথে রহিয়াছেন বলিয়া জানা গিয়াছে ।
বাংলাদেশ সীমান্তে জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক নিযুক্তির প্রস্তাব, জল্লাদ ইয়াহিয়া কর্তৃক সুকৌশলে বাংলাদেশ প্রশ্নে বিশ্বজনমত বিভ্রান্ত করার প্রয়াস এবং আপোষের জন্য বিভিন্ন দেশের দুয়ারে দুয়ারে মধ্যস্থতার ধর্নার জবাবদানের জন্যই বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল নিউইয়র্কে যাইতেছেন । এই প্রতিনিধিদল জাতিসংঘকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় এই কথাই জানাইয়া দিবেন যে বাংলার জনগণ ও সরকারের দৃষ্টিতে বাংলাদেশে জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক বাহিনী প্রেরণের চেষ্টার উদ্দেশ্য হইতেছে হানাদার দুশমনদের সাহায্য করা । তাই এমন অবস্থার উদ্ভব হইলে মুক্তিযোদ্ধারা জাতিসংঘ পর্যবেক্ষকদের বিরুদ্ধেও চরম ব্যবস্থা গ্রহণে বাধ্য হইতে পারেন । প্রতিনিধিদল বিশ্বসংস্থাকে সুস্পষ্টভাবে আরও জানাইয়া দিবেন যে, একমাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বিনাশর্তে মুক্তিদান, বাংলাদেশকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতিদান, হানাদার পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনী প্রত্যাহার এবং জঙ্গী বর্বরতায় ক্ষতিগ্রস্তদের পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দানের পরই বিবেচনা হইতে পারে জঙ্গীশাহীর সঙ্গে কোন আপোষ-মীমাংসার প্রশ্ন আলোচনা করা যায় কিনা ।
.
.
দীপংকর ঘোষ দ্বীপ
<৬,১৪৭,২৩৯-২৪০>
সংবাদপত্রঃ বাংলার বাণী মুজিব নগরঃ ৪র্থ সংখ্যা
তারিখঃ ২১ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
.
বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকায়
কি দেখিলাম-
অতি সম্প্রতি ‘বাংলার বাণী’র একজন প্রতিনিধি বাংলাদেশের অধিকৃত অঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা সফর করিয়া ফিরিয়া আসিয়াছেন । সেখানকার পরিস্থিতি সম্পর্কে আমাদের প্রতিনিধি যে বিবরণ লিপিবদ্ধ করিয়াছেন তাহারই শেষ অংশ এখানে ছাপা হইল ।
অধিকৃত এলাকায় পাক সেনার যথেচ্ছভাবে স্থানীয় অবাঙ্গালী কুলি-কামিন এবং চোর-ডাকাত গুণ্ডা-বদমায়েশদের লইয়া বদর, রাজাকার ও মুজাহিদ বাহিনী গঠন করিয়া চলিয়াছে । তাহাদের সহিত কিছু মুসলিম লীগ ও জামাতের গুণ্ডা-পাণ্ডাও জুটিয়াছে । তাহারা পাক বাহিনীর ছত্রছায়ায় থাকিয়া যে ঘৃণ্য কেলেঙ্কারীর ইতিহাস সৃষ্টি করিয়া চলিয়াছে তাহা বর্ণনার অপেক্ষা রাখে না । পাক বাহিনী নিজেরা যে কোন সম্মুখসমরে গা বাঁচাইয়া চলিয়া প্রাঃয়শই ইহাদিগকে মুক্তিযোদ্ধাদের সামনে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে ঠেলিয়া দেয় । রাত্রিকালে পাক বাহিনী যেখানে শিবিরের বাহিরে আসিবার কল্পনাও করিতে পারে না সেখানে রাজাকার বা মুজাহিদ বাহিনীর লোকদের দিয়া শিবিরসমূহে নৈশকালীন পাহারা দিবার ব্যবস্থা করা হইয়াছে । সামান্য কয়েকদিন অনুশীলনীর পরই তাহাদিগকে ফ্রন্টে পাঠাইয়া দিয়া খান সেনারা নিজেদের নিরাপদ দূরত্বে গা বাঁচাইয়া অবস্থান করে । সে জন্য প্রতি ক্ষেত্রেই স্বল্প ট্রেইংপ্রাপ্ত এইসব বালখিলারা হয় পালাইয়া প্রাণ বাঁচায়, না হয় মুক্তিযোদ্ধাদের নিশ্চিত নিশানায় পরিণত হয় ।
হাট–বাজার
অধিকৃত এলাকার হাট-বাজার প্রায় সবই কোনমতে চলিতেছে । এবং জিনিসপত্রের দাম আগুন হইয়া উঠিয়াছে । অতি সম্প্রতি সেখানে লবণ প্রতি সের দুই টাকা হিসাবে এবং কিছুদিন আগে কেরোসিন তেল প্রতি টিন ৪৫ টাকা হইতে ৫২ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হইয়াছে, ইদানিং তাহা কমিয়া ২৮ টাকা হইতে ৩২ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হইতেছে । চাউল আটা প্রায়ই হঠাৎ করিয়া বাজার হইতে উধাও হইয়া যায় । সাধারণ চাউলের দর এ সময় সাধারনতঃ মণপ্রতি ৪২ টাকা হইতে ৪৮ টাকা পর্যন্ত হইয়া থাকে, বর্তমানে উহা ৬০ টাকার উপরে । গ্রামাঞ্চলে তাহাও পাওয়া দুষ্কর । এইসব নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য এবং খাদ্যশস্যের এরূপ ঊর্ধ্বগতির কারণ কি এই সম্পর্কে জনৈক ব্যবসায়ীকে প্রশ্ন করা হইলে তিনি জানান যে, প্রতিটি নিত্যব্যবহার্য দ্রব্য শহর হইতে খরিদ করিয়া অবাঙ্গালী ব্যবসায়ীদের নিকট বিক্রয় করিয়া দিতেছে । এবং সেইগুলি সৈয়দপুর, পার্বতীপুর, শন্তাহার, ঈশ্বরদী, খালিশপুর ইত্যাদি বিশেষ এলাকায় জমা করা হইয়াছে । তাহাদের উদ্দেশ্য কি জানা ভার । ব্যবসায়ীটি আরো জানান, স্থানীয় হাট-বাজারগুলির আড়তগুলিতে প্রথমদিকে যে লুটের তাণ্ডব চলিয়াছিল সে তাণ্ডবে কোন বাঙ্গালী আড়তই রক্ষা পায় নাই ।
বর্বরা হয় লুটপাট করিয়া মালামাল লইয়া গিয়াছে, না হয় আড়ত অগ্নিদগ্ধ করিয়াছে । কাজেই ব্যবসায়ীরা রাতারাতি পথের ভিখারী হইয়া ব্যবসা গুটাইতে বাধ্য হইয়াছেন ।
জনৈক গ্রামবাসীকে স্থানীয় হাটের ভয়াবহ অবস্থার কথা প্রশ্ন করিলে তিনি জানান, প্রায়ই কিছু না কিছু রাজাকার ও পাকবাহিনী আসিয়া জোরপূর্বক দোকানদারের নিকট হইতে সাধ্যাতিরিক্ত অর্থ চাহিয়া বসে এবং অর্থদানে বিলম্ব ঘটিলে মারধর, খুন-জখম করিতেও দ্বিধাবোধ করে না । তাহারা সবকিছু লুটপাট করিয়া লইয়া যায় । ইহার ফলে কোন ব্যবসায়ীই আর নতুন জিনিস না কিনিয়া দোকান আপাততঃ বন্ধ করিয়া দিতে বাধ্য হইয়াছেন ।
স্কুল–কলেজ
অধিকৃত এলাকায় স্কুল-কলেজগুলির অবস্থা চরম নৈরাশ্যজনক । স্কুলগুলিতে ৫০০-৬০০ ছাত্রের মধ্যে ২-১ জন ছাত্র মাঝেমধ্যে বেড়াইতে আসে । পড়াশোনার প্রশ্নই উঠে না । বোর্ডের ফাইনাল পরীক্ষায় হলগুলিতে ছাত্রদের অনেক ভয়ভীতি প্রদর্শন করাইয়াও মুষ্টিমেয় সংখ্যক ছাড়া কাহাকেও উপস্থিত করাইতে পাকবাহিনী ব্যর্থ হইয়াছে । যাহারা পরীক্ষায় উপস্থিত হয় নাই, তাহাদের পিতামাতার নিকট কারণ দর্শাইবার নোটিশ যাইতেছে বলিয়া প্রকাশ । কলেজগুলিতে কিছু কিছু অবাঙ্গালী ছাত্র হাজিরা দেয় এবং এইসব অবাঙ্গালী ছাত্ররা প্রায়ই ক্লাসের দিকে না যাইয়া ক্যান্টিন ও কমনরুমের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করিয়া কালক্ষেপণ করে ।
শহরের পথ–ঘাট
শহরের পথচারী প্রতিটি মানুষের মুখে আতঙ্কের ভাব পরিস্ফুট । পথচারী সকলেই প্রায় নিরাপত্তার ভয়ে সর্বদা সন্ত্রস্ত ও আতঙ্কিত । শহরবাসীরা একান্ত বাধ্য না হইলে ঘর হইতে বাহির হইবার চেষ্টা করেন না ।
শহরের প্রায় বড় বড় দোকানগুলি তালাবন্ধ হইয়াছে । দোকানগুলির সাইনবোর্ড ও বিজ্ঞাপনে নতুন উর্দু অক্ষর বসিয়াছে । বাঙ্গালী পথচারীকে ব্যঙ্গ করিতেছে । রাতারাতি শহরের সকল সাইনবোর্ড ও মোটর গাড়ি, রিকশার নম্বর-প্লেট বাংলা হইতে উর্দুতে লিখিতে নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে । আওয়ামী লীগ সমর্থকদের বাড়ীঘর, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান ও দোকানগুলি ইতিমধ্যে অবাঙ্গালী ও জামাত মুসলিম লীগ সমর্থকদের মধ্যে নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করা হইয়াছে ।
.
.
দীপংকর ঘোষ দ্বীপ
<৬,১৪৮,২৪১-২৪২>
সংবাদপত্রঃ বাংলার বাণী মুজিব নগরঃ ৪র্থ সংখ্যা
তারিখঃ ২১ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
ইয়াহিয়ার মুখে লাথি মারিয়া
বাঙ্গালী কূটনীতিবিদদের আনুগত্য বদল অব্যাহত
( কূটনৈতিক সংবাদদাতা )
বাংলাদেশে জঙ্গীশাহীর বর্বরতম গণহত্যার প্রতিবাদে ইসলামাবাদের বিদেশস্থ দূতাবাসের আরও একজন বাঙ্গালী কূটনীতিবিদ গত ১৩ই সেপ্টেম্বর জঙ্গীশাহীর চাকুরীতে ইস্তফা দিয়া লন্ডনস্থ বাংলাদেশ মিশনে যোগদান করেন । তিনি হইতেছেন জনাব মহিউদ্দিন জোয়ারদার ।
জনাব মহিউদ্দিন লাগোস এবং নাইজেরিয়াস্থ ইসলামাবাদ মিশনের চেন্সারী প্রধান ছিলেন এবং কখনও কখনও অস্থায়ী হাইকমিশনার হিসাবে কাজ করিতেন ।
একই দিনে ম্যানিলাস্থ ইসলামাবাদ দূতাবাসের প্রধান জনাব খুররম খান পন্নী ইসলামাবাদ জঙ্গীশাহীর সহিত তাঁহার সম্পর্ক ছিন্ন করিয়া বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন ।
গত বৎসর মার্চ মাসে তিনি রাষ্ট্রদূত হিসাবে ম্যানিলা গমন করেন । তাঁহার পদত্যাগের পূর্বে হংকংস্থ ইসলামাবাদ মিশনের প্রধান জনাব মহসীন আলী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন ।
বাংলাদেশের সমর্থনে এ পর্যন্ত বিদেশস্থ ইসলামাবাদ কূটনৈতিক মিশনসমূহের ৪০ জন কূটনীতিবিদ ইসলামাবাদের সহিত তাঁহাদের সম্পর্ক ছিন্ন করিলেন ।
জনাব পন্নীর পদত্যাগের কারণ সম্পর্কে আনু্ষ্ঠানিকভাবে তিনি এখনও কিছু বলেন নাই । অপর একটি সূত্র হইতে জানা যায়, সম্প্রতি ইসলামাবাদ কর্তৃপক্ষ তাঁহাকে ইসলামাবাদে ফিরিয়া যাওয়ার জন্য বার্তা পাঠাইয়াছিল ।
জনাব পন্নীর পদত্যাগের পর এখন কেবল পিকিংযেই ইসলামাবাদ জঙ্গীশাহীর বাঙ্গালী কূটনীতিবিদ অবশিষ্ট রইল । পিকিংস্থ ইসলামাবাদ দূতাবাসের এই বাঙ্গালী কূটনীতিবিদ হইতেছেন জনাব কায়সার । জানা যায়, তিনিও ইসলামাবাদ জঙ্গীশাহীর কোপদৃষ্টিতে আছেন । কারণ, ইয়াহিয়ার বাংলাদেশ নীতির প্রতি পিকিং সরকারের সমর্থনের ফলে বাঙ্গালী কূটনীতিবিদ জনাব কায়সার খুবই অসুবিধায় পড়িয়াছেন । তিনি আর নিজেকে পিকিংয়ের সহিত খাপ খাওয়াইতে পারিতেছেন না ।
প্রকাশ, ইতিমধ্যেই তাঁহার গতিবিধির উপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হইয়াছে । জনাব কায়সারকে হংকং যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হইতেছে না ।
জনাব পন্নীর পদত্যাগের আভাস পূর্বেই পাওয়া যায় । সম্প্রতি ম্যানিলায় প্রেসিডেন্ট ফার্ডিন্যাণ্ড মারকোসের নিকট হইতে একটি পদক গ্রহণ অনুষ্ঠানে ভাষণদানকালে জনাব পন্নী ইচ্ছাকৃতভাবেই পাকিস্তান সরকার কথাটি একবারও উচ্চারণ করেন নাই ।
জনাব পন্নী ম্যানিলায় বাংলাদেশ মিশন স্থাপন করিয়া তথায় বাংলাদেশের স্বীকৃতির জন্য কাজ চালাইয়া যাইবেন ।
১৪ই সেপ্টেম্বর বিবিসি-এর এক খবরে বলা হয়, ওয়াশিংটনস্থ ইসলামাবাদ মিশনের আরও কয়েকজন বাঙ্গালী কূটনীতিবিদ বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াছেন । অবশ্য বিবিসি এইসব বাঙ্গালী কূটনীতিবিদদের নাম বা পদবী ঘোষণা করেন নাই ।
এদিকে বাংলাদেশ সরকার ইসলামাবাদের যে সমস্ত বিদেশী দূতাবাসে এখনও বাঙ্গালী কূটনীতিবিদ রহিয়াছেন, তাহাদের প্রতি আগামী এক পক্ষকালের মধ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের জন্য নির্দেশ দান করিয়াছেন । উক্ত নির্দেশে আরও বলা হইয়াছে যে, যে সকল বাঙ্গালী কূটনীতিবিদ আগামী এক পক্ষকালের মধ্যে বিদেশী হানাদার ইসলামাবাদ সরকারের সহিত সম্পর্ক ছিন্ন করিয়া বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশে ব্যর্থ হইবেন, তাঁহারা দেশদ্রোহী বলিয়া পরিগনিত হইবেন ।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের এই গোপন নির্দেশ ইতিমধ্যেই ইসলামাবাদের বিদেশস্থ কূটনৈতিক মিশনের বাঙ্গালী কূটনীতিবিদদের নিকট পৌঁছিয়াছে । এই নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে লণ্ডন, ওয়াশিংটন এবং ম্যানিলাস্থ ইসলামাবাদ দূতাবাসের বাঙ্গালী কূটনীতিবিদগণ জঙ্গীশাহীর চাকুরী ইস্তফা দিয়া বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন ।
জনাব কায়সার এবং সিরিয়ার ইসলামাবাদের বাঙ্গালী দূত জনাব হুমায়ুন পন্নী ইয়ালামাবাদ চক্রের সহিত সম্পর্ক ছিন্নের সুযোগের অপেক্ষায় রহিয়াছেন ।
এদিকে ইরানে নিযুক্ত ইসলামাবাদের সাবেক বাঙ্গালী রাষ্ট্রদূত জনাব ফতেহ ইসলামাবাদের অর্থ আত্মসাৎ করিয়াছেন বলিয়া যে মিথ্যা অভিযোগ উত্থাপন করা হইয়াছে, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খোন্দকার মুশতাক ইহার তীব্র নিন্দা করিয়াছেন । তিনি ইসলামাবাদ চক্রের এই জঘন্য মিথ্যা অভিযোগে বিস্ময় প্রকাশ করেন ।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, জনাব ফতেহ ইসলামাবাদের অর্থ লইয়া আসিয়া বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশই কেবল পালন করিয়াছেন এবং বাংলাদেশের ন্যায্য প্রাপ্য যথাসময়ে বাংলাদেশের পক্ষ হইতে আদায় করিয়া লইয়াছেন ।
তিনি আরও বলেন, উক্ত অর্থ এখন স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তহবিলে জমা হইয়াছে এবং উহা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ব্যয়িত হইবে ।
.
.
দীপংকর ঘোষ দ্বীপ
<৬,১৪৯,২৪৩-২৪৪>
সংবাদপত্রঃ বাংলার বাণী মুজিব নগরঃ ৫ম সংখ্যা
তারিখঃ ২৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
ইতিহাস আমাদেরই অনুকূলে
স্বাধীন বাংলার জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে পরিচালিত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ছয় মাস অতিক্রম হইয়াছেন । গত ২৫শে সেপ্টেম্বর ছিল বীর প্রসবিনী বাংলার স্বাধীনতা রক্ষার সুমহান সংগ্রামের অর্ধবর্ষ পূর্তির দিন । এই ছয় মাস বাঙ্গালী জাতি অতুলনীয় সাফল্যের সঙ্গে লড়াই করিয়াছে হানাদার পাঞ্জাবী উপনিবেশবাদী সমর শক্তির বিরুদ্ধে । এই ছয় মাসে দুর্ধর্ষ বাঙ্গালী জাতির কামান-বন্দুক-মেশিনগান দুশমনের মৃত্যুঘন্টা বাজাইয়া সঘন গর্জনে বিস্মিত বিশ্ববাসীকে জানাইয়া দিয়াছে চিরদিন কাহারও কলোনী হইয়া, বাজার হইয়া, গোলাম হইয়া থাকার জন্য বাঙ্গালীর জন্ম হয় নাই । দুর্বিনীত বাঙ্গালী জাতি ছয় মাসের বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধে অকল্পনীয় সাফল্যের সগর্ব ঘোষণার সমগ্র পৃথিবীকে বুঝাইয়া দিয়াছে, জননী বাংলার স্বাধীনতার সোনালী স্বপ্নকে নস্যাৎ করিতে পারে এমন শক্তি পৃথিবীতে কাহারও নাই । টিকিয়া থাকার জন্যই স্বাধীন বাংলার জন্ম হইয়াছে ।
বিগত ২৫শে মার্চ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হইলে জল্লাদ ইয়াহিয়া আর কসাই টিক্কা খান ৭২ ঘণ্টার মধ্যে বাঙ্গালী জাতির এই অভ্যুত্থান, এই মুক্তিসংগ্রাম ধূলিসাৎ করিয়া দেওয়ার হাস্যকর খোয়াবে মাতিয়া উঠিয়াছিল । আর এজন্য হানাদার বাহিনী ‘ক্রাস বেঙ্গলী প্রোগ্রাম’ তৈরী করিয়া বাংলার দশদিগন্তে শহর নগর বন্দর জনপদে নিহত মানুষের উপর মারণাস্ত্র লইয়া ঝাঁপাইয়া পড়িয়াছিল নররক্ত লোভী হিংস্র হায়েনার আদিম বর্বরতায় । মানব ইতিহাসের ঘৃণ্যতম জল্লাদ ইয়াহিয়ার লেলাইয়া দেওঘর ভাড়াটিয়া বাহিনীর সেই নজিরবিহীন নরমেধযজ্ঞ চলিয়াছে দিনের পর দিন । মুক্তিপাগল লক্ষ লক্ষ বাঙ্গালীর বুকের তাজা রক্তে বাংলার কাজল মাটি লালে লাল হইয়া গিয়াছে, অসংখ্য জনপদ বিধ্বস্ত হইয়াছে । অগণিত ঘর-বাড়ী সোনার সংসার পুড়িয়া ছাই হইয়াছে । চিরতরে নিভিয়া গিয়াছে অনেক ঘরের প্রদীপ । কিন্তু তবু বঙ্গবন্ধুর মুক্তিমন্ত্রে উজ্জীবিত দুর্ধর্ষ বাঙ্গালী জাতি এই প্রাগৈতিহাসিক বর্বরতার কাছে, এই হিংস্র শক্তি প্রয়োগের কাছে মাথা নত করে নাই । বলদর্পী জালেমের পদতলে বিকাইয়া দেয় নাই আত্মার অন্তরঙ্গতম বাসনাকে, স্বাধীনতার অমোঘ স্পৃহাকে । শুধু তাই নয়, অমিত বিক্রমশালী বাঙ্গালী জাতির প্রচণ্ড পাল্টা আক্রমণে ক্রমাগত নাস্তানাবুদ, পর্যুদস্ত হইতে হইতে হানাদার বাহিনীর এখন মরণদশা সমুপস্থিত । বাংলার অসম সাহসী মুক্তিযোদ্ধাদের গোলার আঘাতে ইয়াহিয়া-টিক্কার ‘ক্রাস বেঙ্গলী প্রোগ্রাম’ নিশ্চিহ্ন হইয়া কোথায় মিলাইয়া গিয়াছে । টিক্কা নিজেই ক্রাশ হইয়াছে । ইয়াহিয়ার অবস্থাও না যায় প্রাণ কাকুতিসার কুপোকাৎ হওয়াটা শুধু সময়ের প্রশ্ন ।
ছয় মাসে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বহুদুর আগাইয়া আসিয়াছে । মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ২৫ হাজার খান সেনা খতম হইয়াছে, অগণিত রাজাকার কচুকাটা হইয়াছে । হানাদার বাহিনীর বহু জাহাজ ধ্বংস হইয়াছে, পথ-ঘাট, রেল-সেতু বোমার আঘাতে উড়িয়া গিয়াছে । শক্তি হাতে কৃষ্ণদণ্ড ধরিয়া যুদ্ধবিক্ষত বাংলাদেশে ‘স্বাভাবিক অবস্থা’ ফিরাইয়া আনার সদম্ভ জল্লাদী ঘোষণাও চূড়ান্তভাবে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হইয়াছে ।
অবস্থা বেগতিক দেখিয়া পররাজ্যলোভী হানাদার জঙ্গীশাহী বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বিনষ্ট এবং মুক্তিযুদ্ধকে বানচাল করার উদ্দেশ্যে বগ্লাহীন অত্যাচার, অবিরাম মিথ্যা প্রচারণা, এমনকি বঙ্গবন্ধুর বিচার প্রহসনের আয়োজন করিয়া তাঁহার জীবন লইয়া ছিনিমিনি খেলার ঘৃণ্য তৎপরতায় লিপ্ত হইয়াছে । কিন্তু কিছুতেই ফল হয় নাই । বাঙ্গালী জাতির স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রাম আগাইয়া চলিয়াছে দ্রুত বেগে । প্রতিদিন নতুন নতুন এলাকা শত্রুমুক্ত হইতেছে । প্রতিদিন অধিকতর বিপর্যয় নামিয়া আসিতেছে হানাদার কসাই বাহিনীর ভাগ্যে । আজ প্রত্যাসন্ন পরাজয়ের মুখে দাঁড়াইয়া একদিনের দাম্ভিক জেনারেল ইয়াহিয়া তাহার নিজের ভাষায় ‘দেশদ্রোহী’ এবং ‘পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার দায়ে অভিযুক্ত’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে মুক্তি দিয়া হইলেও পাকিস্তানকে টিকাইয়া রাখার উদ্দেশ্যে আপোষের আরজি লইয়া দেশ-দেশান্তরের দুয়ারে দুয়ারে ধর্ণা দিয়া বেড়াইতেছে । সুনিশ্চিত পরাজয়ের বিভীষিকা তাকে এমনই বেসামাল-দিশেহারা করিয়া তুলিয়াছে যে, সে এই বাস্তব অবস্থাটাকেও উপলদ্ধি করিতে পারিতেছি না যে, পাকিস্তান আর কোন দিন এক হইবে না । বিনাশর্তে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বীকৃতি, হানাদার সেনাবাহিনী প্রত্যাহার এবং জঙ্গী বর্বরতায় ক্ষতিগ্রস্তদের পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান না করা পর্যন্ত একটি মুহূর্তের জন্যও বাংলার আপোষহীন মুক্তিযোদ্ধাদের সমরাস্ত্রের ধ্বনি স্তব্ধ হইবে না ।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাফল্যজনক অর্থ বর্ষপূর্তির এই শুভলগ্নে আমরা আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অভিনন্দন জানাই । তাদের বীরত্ব, তাদের বিক্রম, তাদের মহান সংগ্রামী চেতনা গর্বে আমাদের বুক ভরিয়া দেয় । আমাদের ইতিপূর্বেকার বক্তব্যেরই পুনরাবৃত্তি করিয়া আমরা নির্দ্বিধায় বলতে চাই, বাংলার মাটি ও মানুষকে ভালোবাসিয়া, স্বাধীন বাংলার রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসিয়া তাঁহারই নির্দেশে যারা শত্রুর সঙ্গে জীবনপণ যুদ্ধে লিপ্ত, যারা জীবনকে বাজি রাখিয়া বাংলার স্বাধীনতা রক্ষা এবং জল্লাদের কারাগার হইতে শেখ সাহেবকে ছিনাইয়া আনার গৌরবময় সংগ্রামের নির্ভীক সেনানী, তাদের জানাই হাজার সালাম । তাদের হাতের রাইফেল, মেশিনগানের মধ্য দিয়াই হানাদার দুশমনের বিরুদ্ধে অস্ত্রের ভাষায় কথা বলিয়া উঠিয়াছেন লক্ষ লক্ষ শেখ মুজিব । মুক্তিযোদ্ধারা তাই বাংলার অগ্নিসন্তান- বাংলার শৌর্য, বাংলার সম্ভ্রম, বাঙ্গালীর স্বাধীনতা স্পৃহার নির্ভুল প্রতীক- শেখ মুজিবের বিশ্বস্ততম প্রতিনিধি । আমরা আবার তাদের অভিবাদন জানাই বীর হিসাবে ।
হানাদার দুশমনের বিরুদ্ধে সফল মুক্তিযুদ্ধের অর্থ বর্ষপূর্তির এই শুভলগ্নে বাঙ্গালীর চিত্তে চিত্তে আজ নতুন করিয়া আবাহনী চলুক সেই শাশ্বত বিশ্বাস ও প্রত্যাশার, সংকল্প আর প্রতিজ্ঞারঃ
হানাদার দস্যুবাহিনী আর তার মুরব্বিদের সমরাস্ত্রনিসৃত গোলাবারুদের ধুম্রজালের আড়াল হইতে বঙ্গবন্ধু আর স্বাধীনতার রক্তসূর্যটাকে বাঙ্গালী জাতি ছিনাইয়া আনিবেই । আমরা- সংগ্রামী গণশক্তির সূর্য সম্ভাবনায় বিশ্বাসী । তাই আমরা বিশ্বাস করি, স্বাধীন বাংলা শত্রুমুক্ত হইবেই- শেখ মুজিব ফিরিয়া আসিবেনই । কারণ, ইতিহাস আমাদের অনুকূলে ।
.
.
এফ এম খান
<৬,১৫০,২৪৫-২৪৬>
সংবাদপত্রঃ বাংলার বাণী
তারিখঃ ২৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
.
বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেওয়া না হইলে ইয়াহিয়ার
সকল উমেদারী ব্যার্থ হইতে বাধ্য
(নিজস্ব ভাষ্যকার)
মুক্তি সংগ্রামের ছয় মাস পূর্ণ হইয়াছে।পঁচিশে মার্চের সেই ঘন-কালো অন্ধকার রাত্রি হইতে বাংলাদেশ আজ উত্তীর্ণ হইয়াছে নতুন উজ্জ্বল ভবিষ্যতের রক্তোজ্জ্বল সুপ্রভাতে।নবপ্রভাতের আর বিলম্ব নাই।আক্রমণকারী উপনিবেশবাদী জঙ্গীশাহীর নৃশংস হীন আক্রমণের বিরুদ্ধে পাল্টা আক্রমণ শুরু করিয়াছেন আমাদের দুর্জয় মুক্তিযোদ্ধারা।মুক্তিসংগ্রামে আত্মহুতি দিয়াছেন লক্ষ লক্ষ বাঙ্গালী,রক্তস্রোতে প্লাবিত হইয়াছে বাংলার পবিত্র মাটি।বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের বজ্রকঠিন শপথে আজ একটি মাত্র আকাঙ্ক্ষাই সোচ্চার।এই আকাঙ্ক্ষা স্বাধীনতার চিরন্তন মন্ত্র,এই আকাঙ্ক্ষা বঙ্গবন্ধুর মুক্তি।জঙ্গীচক্র বাংলাদেশে জঘন্যতম আক্রমণ চালাইয়া ক্ষান্ত হয় নাই,লক্ষ লক্ষ নিরীহ আসহায় নর-নারীকে হত্যা করিয়াও তাহার নিবৃত্ত হয় নাই।জঙ্গী চক্রের সীমাহীন ঔদ্ধত্য সকল সম্ভাবনার সীমারেখা ছাড়াইয়া গিয়াছে। তাহারা বাংলার মানস সন্তান অগ্নিপুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার প্রহসন অনুষ্ঠান করিবার দুঃসাহস প্রদর্শন করিয়াছে।কাণ্ডজ্ঞানহীন বাস্তব নীতিবিবর্জিত বিংশ শতাব্দীর জঘন্যতম নরপশু ইয়াহিয়া বিশ্ব জনমতকে উপেক্ষা করিয়া বঙ্গবন্ধুর গোপন বিচার প্রহসন চালাইয়াছেন।
.
সাম্প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের ‘হিজ মষ্টোরস ভয়েস’ সংবাদপত্র সমূহ একটি খবর প্রকাশ করিয়াছে।এই খবরে বলা হইয়াছে,বঙ্গবন্ধুর তথাকথিত গোপন বিচার শেষ হইয়াছে।ইতিমধ্যে জেনারেল ইয়াহিয়ার পশুসুলভ আচরণের বিরুদ্ধে সারা বিশ্বে ধিক্কার ধ্বনি উচ্চকিত হইয়া উঠিয়াছে।সাম্প্রতি কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ সংসদীয় সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী প্রতিনিধিরা এক বাক্যে পাকিস্তানি জঙ্গীশাহী নৃশংস গনহত্যার তীব্র নিন্দা করিয়াছেন। তাহারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানেকে বিনা শর্তে মুক্তিদানের জন্য ইয়াহিয়ার প্রতি তীব্র নিন্দা জানাইয়াছেন। বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবী করিয়াছেন বিশ্বের বিবেকবান মানুষেরা।সাম্প্রতি নয়াদিল্লীতে বাংলাদেশ সম্পর্কে যে আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হইয়াছে,সে সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী আন্তর্জাতিক প্রতিনিধিরা দ্ব্যার্থহীন কন্ঠে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দাবী করিয়াছেন।
.
রাষ্ট্রসংঘের সেক্রেটারী জেনারেল উথান্ট বাংলাদেশ সমস্যা সম্পর্কে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করিয়া বলিয়াছেন, বাঙালীদের সাহায্য করা বিশ্ববাসীর নৈতিক দায়ীত্ব।
.
মৃত পাকিস্তানের হত্যাকারী ইয়াহিয়া এখন মারাত্মক সংকটের সম্মুখীন হইয়াছে।৭২ ঘন্টার মধ্য বাঙালীদের প্রতিরোধ ভাঙ্গিয়া দিয়া বাংলার প্রাণশক্তিকে ধ্বংস করিয়া দিয়া দম্ভোক্তি ইয়াহিয়ার সেনাধ্যক্ষ টিক্কা খান করিয়াছিলেন সেই টিক্কা খান পরাজয়ের কালিমা মুখে লইয়া চোরের মত পশ্চিম পাকিস্তানে প্রত্যাবর্তন করিয়াছেন।
.
ইয়াহিয়ার বাদশাহী খোয়াব চিরতরে মিলাইয়া গিয়াছে শুন্যে।এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে জেনারেল ইয়াহিয়ার ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা কি হইবে ইতিমধ্যে জল্পনা-কল্পনা শুরু হইয়া গিয়াছে।ইসলামাবাদের সংশ্লিষ্ট কূটনৈতিক মহলের ধারণা,শীঘ্রই বঙ্গবন্ধুর বিচার প্রহসনের রায় ঘোষণা করা হইবে এবং জেনারেল ইয়াহিয়া এই রায় ঘোষণার পর নাটকীয় কোন ঘোষণা করিতেও পারে।ইতিমধ্যে বাংলাদেশের সংগ্রামী মানুষেরা স্পষ্ট ভাষায় জানাইয়া দিয়াছেন,বিনাশর্তে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দেওয়া না হইলে এবং বাংলাদেশের মাটি হইতে হানাদার পাকিস্তানী সেনাদের প্রত্যাহার করা না হইলে বাংলাদেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়া আসার কোন সম্ভাবনা নাই।আর ইয়াহিয়ার সাধের পশ্চিম পাকিস্তানও সর্বনাশের এই লেলিহান অগ্নিশিখা হইতে পরিত্রাণ পাইবে না।
.
দখলকৃত এলাকার পাকিস্তানী সৈন্যদের ঘাঁটির উপর মারাত্মক পাল্টা আক্রমণ শুরু করিয়াছেন বাংলার তরুন যোদ্ধারা।গেরিলা আক্রমণের হাত হইতে রাজধানী ঢাকা শহরও আজ আর নিষ্কৃতি পায় না।প্রতিদিন হানাদার যোদ্ধারা তাহাদের কৃতকর্মের প্রায়শ্চিত্ত করিতেছে।মুক্তিযোদ্ধাদের অব্যর্থ বুলেট স্থির লক্ষ্যে ছুটিয়া যাইয়া নরপশুদের বক্ষভেদ করিয়া চলিয়াছে প্রতি মুহূর্তে।
.
ইয়াহিয়ার সংকট আজ সীমাহীন। এই মারাত্মক সংকট হইতে পরিত্রাণ পাইবার জন্য ইয়াহিয়া ও তাহার সহচরেরা মস্কো, ওয়াশিংটন, তেহরানসহ বহু রাজধানী পরিক্রমা করিয়াছে।কিন্তু আসার আলো কোথাও নাই।
.
এক্ষণে আপোষমূলক আলোচনা চালাইবার জন্য ইয়াহিয়া ধর্না দিয়াছে ইরানের শাহের দরবারে। সাম্প্রতি তেহরানে গিয়া ইয়াহিয়া খান নিজে এই আপোষের অভিমত ব্যক্ত করিয়াছে।কিন্তু ইরানের শাহ ইয়াহিয়াকে কোন আশার বাণী শোনাইতে পারেন নাই।
.
বাংলাদেশের নেতারা সুস্পষ্ট ভাষায় জানাইয়া দিয়াছেন, বঙ্গবন্ধুর মুক্তিদান না করিলে আলোচনার কোন প্রশ্নই উঠে না।
.
কূটনৈতিক মহলের ধারণা,ইয়াহিয়ার সকল উমেদারী ব্যর্থ হইতে বাধ্য,যদি না বঙ্গবন্ধুকে বিনা শর্তে মুক্তি দেওয়া হয়।
.
জানা গিয়াছে,ভারত ইরানের শাহকে জানাইয়া দিয়াছে বাংলাদেশ সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে বাংলাদেশের নির্বাচিত গননেতারাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকারী। ভারত এই ব্যাপারে কিছুই করিতে পারেনা।অতএব, ইয়াহিয়া যদি সত্যই আপোষ চায় তবে তাহাকে বাংলাদেশ সরকারের সহিত আলোচনায় বসিতে হইবে।বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা করিয়াছেন, স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ আজ ইতিহাসের বাস্তব সত্য।এই সত্যকে স্বীকার না করিয়া কোন আলোচনা হইতে পারে না।
.
পাকিস্তানের মারাত্মক আর্থিক সংকট, ধ্বংসোন্মুখ অর্থনীতি, বেলুচিস্তান,উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও সিন্ধুর ব্যাপক গন অসন্তোষ এবং সম্ভাব্য সশস্ত্র গন অভ্যুত্থান আজ অক্টোপাসের মত ঘিরিয়া ধরিয়াছে ইসলামাবাদের সাধের সিংহাসনকে।
.
ইরান অথবা পাকিস্তানের অন্যান্য তথাকথিত বন্ধুরাষ্ট্র এই দুর্দিনে জঙ্গীশাহীকে বাস্তব সাহায্য দিতে সক্ষম নয়।চীনের ভূমিকা আরো অস্পষ্ট।
.
জানা গিয়াছে,ইরান জানাইয়া দিয়াছে ইয়াহিয়ার পক্ষে এখন নতি স্বীকার করা ছাড়া অন্য কোন উপায় নাই।ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধের হুমকি দিয়া কোন ফল হইবে না।
.
জাতিসংঘের চলিত অধিবেশনে বাংলাদেশ সমস্যা প্রধান আলোচ্য বিষয় বলিয়া কূটনৈতিক মহল আশা প্রকাশ করিয়াছেন। এবং বলাবাহুল্য ইসলামাবাদের জঙ্গীচক্র জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে মারাত্মক আক্রমণের সম্মুখীন হইবে।
.
এই অবস্থায় ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ বলিয়া জেনারেল ইয়াহিয়া ছটফট করিয়া মরিতেছেন। কিন্তু ইতিহাসের রায় ইয়াহিয়ার পাঠ করা উচিত। দেওয়ালের লিখন আজ সুস্পষ্ট-স্বাধীন সর্বভৌম বাংলাদেশ এই শতাব্দীর ঘটনাবহুল ইতিহাসের আর একটি বাস্তব সত্য।
——————————–
.
.
এফ এম খান
<৬,১৫১,২৪৭>
সংবাদপত্রঃ বাংলার বাণী
তারিখঃ ২৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
.
অধিকৃত এলাকায় বুদ্ধিজীবীদের উপর
দমননীতি অব্যাহত
(নিজস্ব প্রতিনিধি)
দখলকৃত এলাকার অসামরিক গভর্ণর ডাঃ মালেকের সরকারকে শিখণ্ডী খাড়া করিয়া বর্বর জঙ্গীশাহী সরকার বাঙালী শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীদের উপর অব্যাহতভাবে দমননীতি চালাইয়া যাইতেছে।
.
সাম্প্রতি জল্লাধী বর্বরতার শিকার হইয়াছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও ইসলামের ইতিহাসের অধ্যক্ষ ডঃ হাবিবুল্লা,বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ডঃ মনিরুজ্জামান ও ইমিরিটাস অধ্যাপক ডঃ মুহাম্মদ এনামুল হক।তাহাদিগকে চাকুরী হইতে বরখাস্ত করা হইয়াছে।ডঃ মনিরুজ্জামান আগামী ছয় মাস কোন সরকারী বা বেসরকারি চাকুরী করিতে পারিবেন না বলিয়া হুকুম জারী হইয়াছে।
.
ইহা ছাড়া রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকালাপে লিপ্ত থাকিবার অভিযোগে প্রখ্যাত বৈজ্ঞানিক ডঃ কুদরত-ই-খুদা,ডঃ নীলিমা ইব্রাহিম ও ডঃ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে হুঁশিয়ার করিয়া দেওয়া হইয়াছে।
.
ইতিপূর্বে ডঃ আবুল খায়ের,জনাব রফিকুল ইসলাম, জনাব শহীদুল্লাহ প্রমুখ বিশিষ্ট অধ্যাপক ও কয়েকজন বুদ্ধিজীবীকে গ্রেফতার করা হইয়াছে।
.
অন্য এক সংবাদে প্রকাশ, বেশ কিছুদিন পূর্বে জঙ্গীশাহীর বর্বর সৈন্যরা মর্নিং নিউজের চীফ রিপোর্টার জনাব শহীদুল হক,ঢাকা বেতারের সাইফুল বারী,এ,পি পি’র জানাব মোজাম্মেল হক ও পি,পি,আই-এর নাজমুল হকসহ বেশ কয়েকজন সাংবাদিকে ধরিয়া লইয়া যায়।পরে তাঁহাদের কোন সংবাদ পাওয়া যায় নাই।
.
সামরিক সরকার বাঙালী উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের বিশ্বাস করিতে না পারিয়া পশ্চিম পাকিস্তান হইতে অবাঙ্গালী চীফ সুপারিনটেন্ডেন্ট অব পুলিশ ও চীফ সেক্রেটারি আমদানী করিয়াছে।
————————————–
.
এফ এম খান
<৬,১৫২,২৪৮-২৫০>
সংবাদপত্রঃ বাংলার বাণী মুজিব নগরঃ ৫ম সংখ্যা
তারিখঃ ২৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
.
পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে
বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ও বিশ্বরাজনীতি
বাংলাদেশের দখলীভূত এলাকা থেকে জবর খবর এসেছে। তাঁবেদার লাট মল্লিকের একজন পেয়ারা মন্ত্রীকে মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা ইউনিট হাতবোমা মেরে পঙ্গু করে দিয়েছে।অধিকৃত ঢাকা বেতার কেন্দ্রের খবরে স্বীকার করা হয়েছে,মন্ত্রীবর্গের অবস্থা আশঙ্কাজনক। এই খবর লেখার সময় পর্যন্ত জানা গেছে দালাল মন্ত্রী সংজ্ঞাহীন অবস্থায় হাসপাতালে রয়েছে।
.
ডাঃ মালিক ওরফে মল্লিকের রসজ্ঞান খুব টনটনে। সম্ভবতঃ শৈশবে এই দাতের ডাক্তার হারাধনের দশটি ছেলের ছড়া পাঠ করেছিলেন। তাই বেছে বেছে তার দালাল মন্ত্রীসভার দশটি দালাল গ্রহণ করেছে।এই দশ দালালের অবস্থা যে কার্যক্রমে হারাধনের দশ ছেলের মত হবে,এ বিষয়ে বাংলাদেশের একজন বালকের মনেও আজ কোন সন্দেহ নেই।হারাধনের দশ ছেলের ছড়ায় আছে।
‘হারাধনের দশটি ছেলে
ঘোরে বনময়
একটি গেল বাঘের পেটে
রইলো বাকি নয়’।
মুক্তিযোদ্ধারা এই ছড়াটিকেই একটু ঘুরিয়ে এখন বলতে পারেন,
মালিক মিয়ার দশটি দালাল
ঘোরে ঢাকাময়
একটি গেল গ্রেনেড খেয়ে
রইলো বাকি নয়।
বাকি নয়টি আস্তে আস্তে যাবে।মীরজাফরের নিমক হারামের দেউরির মত তাদের বংশে বাতি দিতে কেউ থাকবেনা। এটা ইতিহাসের আমোঘ বিধান।
.
এবার মুক্তিযুদ্ধের খবর কিছু বলি।একটি বিদেশী সংবাদ সংস্থা খবর দিয়াছেন, যশোরে দত্ত কবি মাইকেলের স্মৃতিপূত সাগরদাঁড়ি এখন মুক্ত এলাকা।সেখানে মুক্তিযোদ্ধারা স্বাধীন বাংলাদেশের প্রশাসন ব্যাবস্থা গড়ে তুলেছেন। খুলনার সুন্দরবন এলাকায় একটি হানাদার ঘাঁটিতে আক্রমণ চালিয়ে মুক্তি সংগ্রামীরা একশোর মত হানাদার দস্যু খতম করেছেন। রংপুরের চাষারহাট ও পাটগ্রামে উড়ছে স্বাধীন বাংলার পাতাকা।বিদেশী সংবাদপত্রের খবর প্রকাশ, বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ ভ্রাতা শেখ আবু নাসের সাংবাদিকদের কাছে বলেছেন,সাম্প্রতি খুলনা বন্দরে ১২ হাজার টনের একটি জাহাজ ডুবিয়ে দেয়া হয়েছে।মুক্তি সংগ্রামীরা চট্রগ্রাম বন্দরে আরো ১৮ টি জাহাজ ডুবিয়েছে।
.
অসামরিক প্রশাসন ও পুনর্বাসন
একদিকে দেশকে হানাদার বাহিনীর কব্জা মুক্ত করার জন্য মরণপণ সংগ্রাম,সেই সঙ্গে অন্যদিকে চলছে মুক্ত এলাকার স্বাধীন বাংলাদেশের অসামরিক প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং ভারত থেকে শরণার্থী দের ফিরিয়ে নিয়ে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা। বঙ্গবন্ধুর ভ্রাতা প্রকাশ করেছেন, মিত্ররাষ্ট্র হিসাবে ভারত সরকার যদি চার মাসের খাদ্যের ব্যবস্থা করেন,তাহলে বাংলাদেশ সরকার এখনিই অন্ততঃ১৫ হাজার শরণার্থীকে মুক্ত এলাকায় ফিরিয়ে নিয়ে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করবেন।সাম্প্রতি জনৈক বিদেশী সাংবাদিক ভারতের মেঘালয় রাজ্যে অবস্থিত একটি শরণার্থী শিবির পরিদর্শনের সময় শরণার্থিদের জিজ্ঞাসা করেন,তারা দেশে ফিরতে প্রস্তুত কি না? শরণার্থিরা একবাক্যে জবাব দেন,একমাত্র বঙ্গবন্ধু আহবান জানালে তারা দেশে ফিরতে পারেন।নইলে ইয়াহিয়া কিম্বা তার কোন তাবেদারকে তারা বিশ্বাস করতে রাজী নন।
.
ঢাকা এখন মুক্ত এলাকা হতে পারে
পূর্ব রণাঙ্গনে যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের জনৈক কমান্ডার এক ঘরোয়া সাংবাদিক সাক্ষাৎকারে প্রকাশ করেছেন,বর্তমান মুক্তি সংগ্রামীদের শক্তি দক্ষতা এতটা বেড়েছে যে,তারা ইচ্ছা করলে আকস্মিক আক্রমণ চালিয়ে কুমিল্লা থেকে শুরু করে ঢাকা পর্যন্ত সাত দিনে মুক্ত করতে পারেন।কিন্তু তারা আশঙ্কা করেন,তাদের এই আকস্মিক হামলায় দখলীকৃত এলাকায় বহু বাঙালী ভাইবোনও ধ্বংস হতে পারেন।তাই তারা ভ্রাতৃরক্তপাত পরিহারের উপায় উদ্ভাবনে ব্যস্ত রয়েছেন। অন্যদিকে হানাদার বাহিনীর শক্তিশালী বিমান বহর থাকায় তাদের পক্ষে কুমিল্লা বা ঢাকা হাতছাড়া হওয়ার পরও সেখানে ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করা সম্ভব হবে।যেমন সম্ভব হয়েছে মার্কিনীদের পক্ষে ভিয়েতকংদের হাতে পরাজিত হওয়ার পরও ভিয়েতনামে বিমান হামলা চালিয়ে বিপুলভাবে জীবন ও সম্পদত্তির ক্ষয়ক্ষতি করা।মুক্তিযোদ্ধারা তাই বিশ্বের অন্ততঃ কয়েকটি বন্ধুরাষ্টের কাছ থেকে স্বাধীন বাংলার স্বীকৃতির অপেক্ষা করছেন।এই স্বীকৃতি লাভের সঙ্গে সঙ্গে বিমানসহ আধুনিক সমরাস্ত্র সংগ্রহ যেমন সহজ হবে, তেমনি বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সাফল্যও অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠবে।
.
আরব বিশ্বের হাওয়া বদল
বিশ্বের ছয়টি মহাদেশের ২৫টি দেশের ৬৫ জন প্রতিনিধি নয়াদিল্লীতে আয়োজিত বাংলাদেশ সম্প্রর্কিত বিশ্ব সম্মেলনে যোগদান করেছিলেন, এ খবর ‘বাংলার বাণী’পাঠকদের আগেই জানানো হয়েছে।এই সম্মেলনে যোগদানকারী কায়রোর ‘আল আহরাম’ পত্রিকার সম্পাদকীয় বোর্ডের একজন বিশিষ্ট সদস্য বলেছেন,বাংলাদেশ সম্পর্কে ইয়াহিয়া সরকার আরব দেশগুলোতে সম্পূর্ণ বিভ্রান্তিকর প্রচারণা চালিয়েছে এবং আরবদের মনে বাঙালীদের বিরুদ্ধে জাতিবিদ্বেষ সৃষ্টির চেষ্টা করেছে।কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে, ততই আরব জনগণ বুঝতে পারছেন, বাংলাদেশ সমস্যার একমাত্র সমাধান ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসের নির্বাচনে বিজয়ী দল আওয়ামীলীগ ও তার অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের মধ্যে নিহিত রয়েছে।
.
সিরিয়ার এক সাংবাদিক স্পষ্ট ভাষাতেই বলেছেন,আমরা সিরিয়বাসীরা আঞ্চলিক দাবী-দাওয়ার ভিত্তিতে এক সময় যুক্ত আরব প্রজাতন্ত্রের অঙ্গদেশ মিশর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছি।সিরিয়া ও মিশরের জনগণ একই ভাষাভাষী এবং একই ধর্মের বন্ধনে আবদ্ধ।এ সত্ত্বেও মিশর থেকে সিরিয়ার বিচ্ছিন্নতায় যদি ইসলাম ধর্ম বিপন্ন না হয়ে থাকে তাহলে পাকিস্তান থেকে দুই হাজার মাইল দূরে অবস্থিত ভিন্ন ভাষাভাষী বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেলে ইসলাম বিপন্ন হয় কি করে?
.
আরব দেশীয় সাংবাদিক ও সংবাদপত্রের এসব মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে কায়রো,বৈরুত, দামাস্কাস প্রভৃতি প্রধান আরব রাজধানীর রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করেছেন,বাংলাদেশের সমস্যা সম্পর্কে আরব জনগণ ক্রমশঃই সজাগ হয়ে উঠেছেন, এবং ইয়াহিয়া চক্রের স্বরূপ তাদের কাছে ধরা পড়ে যাচ্ছে।
.
জাতিসংঘ কি করবে?
.
গত ২১শে সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের যে ২৬ তম অধিবেশন শুরু হয়েছে, তাতে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ উঠবে,অথবা বাংলার বাণীর এ সংখ্যা প্রকাশের আগেই উঠে গেছে এমন সম্ভাবনা রয়েছে।সম্মেলনের সভাপতি ইন্দোনেশিয়ার সামরিক জান্তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডাঃ আদম মালিক-যতই অনীহার ভাব দেখান সোভিয়েত ইউনিয়ন, কানাডা,যুগোশ্লাভিয়া প্রভৃতি দেশ দৃঢ়ভাবে বাংলাদেশে সমস্যার কথা পরিষদের অধিবেশনে বলবেন এমন একটা আস্থার ভাব পরিষদীয় লবীতেও নাকি দেখা যাচ্ছে। জাতিসংঘের সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিষদের বৈঠকেও বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি উঠবে।বিশ্বময় এই ধিক্কার ধ্বনির মধ্যে ইয়াহিয়া চক্র এখন কানকাটা কুকুরের ভূমিকা গ্রহণ করেছে।জাতিসংঘের সমর্থন লাভের আশায় তারা ধর্ণা দিয়েছে রাজতন্ত্রী মরক্কো সরকারের দরবারে।
.
জাতিসংঘ বাংলাদেশ সমস্যায় উল্লেখযোগ্য কিছু করবেন অথবা করতে পারবেন,এমন আশা বাংলাদেশের মানুষ করে না।ভিয়েতনাম, এঙ্গোলা, মোজাম্বিক, বায়াফ্রা সমস্যায় নিষ্ক্রীয় ও নৈরাশ্যজনক ভূমিকা বিশ্বের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে।সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালী নর-নারী তাই মনে করে,তাদের সমস্যার ফলপ্রসূ সমাধান হবে রণাঙ্গনে জাতিসংঘের বিতর্ক সভায় নয়।
.
.
সহুল আহমেদ মুন্না
<৬,১৫৩,২৫১-২৫২>
শিরোনামঃ সশস্ত্র যুদ্ধে বাঙ্গালীদের পাশে আসিয়া দাড়াইতে হইবে – আঁদ্রে মালরো
সংবাদপত্রঃ বাংলার বাণী, মুজিবনগরঃ ৫ম সংখ্যা
তারিখঃ ২৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
.
রাসেলের শূণ্য স্থানে আঁদ্রে মালরো
সশস্ত্র যুদ্ধে বাঙ্গালীদের পাশে আসিয়া দাড়াইতে হইবে
(নিজস্ব নিবন্ধকার)
বিশ্ব বিবেকের কণ্ঠস্বর বার্ট্রান্ড রাসেল আজ আর নাই। কিউবা সঙ্কট, ভিয়েতনাম যুদ্ধ প্রভৃতি ঘটনার সময় এই মহামনীষী বিশ্ববিবেকের পক্ষ হইতে প্রতিবাদ জানাইয়াছিলেন। তিনি সেদিন নামিয়াছিলেন পথে। উচ্চকন্ঠে ঘোষণা করিয়া বলিয়াছিলেন, মানুষের ভবিষৎ বলিয়া যদি কিছু থাকে, তবে বিশ্বের দেশে দেশে মানবতার বিরুদ্ধে যে জঘন্য অপরাধ অনুষ্টিত হইতেছে তাহা বন্ধ করিতে হইবে, অপরাধীকে সমুচিত শাস্তি প্রদান করিতে হইবে।
.
কিন্তু আজিও পৃথিবীতে শান্তি স্থাপিত হয় নাই। অত্যাচারী হানাদার হিংস্র হায়েনারা আজো পৃথিবীর দেশে দেশে মানবতার বিরুদ্ধে নৃশংসতম ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তে লিপ্ত রহিয়াছে। প্রতি মুহুর্তে, প্রতি ঘটনায় মানবতার চরম অপমান ঘটিতেছে। আজিকার দিনে আবার বিশ্ববাসীর সামনে একটি প্রশ্ন সবচেয়ে বড় হইয়া দেখা দিয়াছে। এই প্রশ্ন, মানবজাতির ভবিষ্যৎ কি? পৃথিবীতে কি চিরকাল সাম্রাজ্যবাদী জুলুমবাজরাই রাজত্ব করিয়া যাইবে?
.
ইহার একটি উত্তর হইল, না। বিশ্বের স্বাধীনতাকামী শান্তিকামী জনতা বজ্রকঠোর স্বরে ঘোষনা করিতেছে, না, ইহা হইতে পারে না।
.
আজ তাই বাংলাদেশের সংগ্রামী জনগণের পাশে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করিবার ইচ্ছা প্রকাশ করিয়াছেন ফ্রান্সের বিখ্যাত লেখক মিঃ আঁদ্রে মালরো। ফ্রান্সের পৃথিবী বিখ্যাত ঔপন্যাসিক জাঁ পল সার্ত্রে মানবতার এই দুঃসহ অপমানের দিনে আগাইয়া আসেন নাই, আগাইয়া আসিয়াছেন ফরাসী প্রতিরোধ আন্দোলনের নেতা মঁশিয়ে আঁদ্রে মালরো। আগাইয়া আসিয়াছেন বিশ্বের বহু দেশের অসংখ্য সচেতন মানুষ।
.
বাংলাদেশের জনগনের সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রাম আজ চরম অবস্থায় আসিয়া দাঁড়াইয়াছে, বাংলার মানুষের অপূর্ব আত্নদান আজ সমগ্র পৃথিবীতে তুলিয়াছে অভূতপূর্ব সাড়া। ফ্রান্সের প্রাক্তন সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী মিঃ আঁদ্রে মালরো বাংলাদেশের জনগনের পাশে দাড়াইয়া যুদ্ধ করিবার সংকল্প প্রকাশ করিয়াছেন। আঁদ্রে মালরো এই ঐতিহাসিক ঘোষণা পৃথিবীর মানুষকে অবাক করিয়া দিয়াছে। আঁদ্রে মালরো দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর ফ্রান্সের অবিসংবাদিত গণনায়ক জেনারেল দ্য গলের মন্ত্রী পরিষদের সদস্য ছিলেন।
.
মঁশিয়ে মালরো ফ্রান্সের একজন বিখ্যাত লেখক। আর সম্ভবতঃ ফ্রান্সই একমাত্র দেশ যেখানে এখনো বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক ও কবিরা চিত্রতারকাদের চাইতে অনেক অনেক বেশী জনপ্রিয়। ৬৯ বৎসর বয়স্ক ফরাসী লেখক মালরোর ঘোষনা তাই সমগ্র ফরাসী দেশে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করিয়াছে। কূটনৈতিক মহল এই ঘটনার উপর গুরুত্ব আরোপ করিয়াছেন। আঁদ্রে মালরো জীবনের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশে যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহন করিয়াছেন। স্পেনে স্বৈরাচারী জেনারেল ফ্রাঙ্কোর বিরুদ্ধে তিনি আন্তর্জাতিক বাহিনীতে যোগদান করিয়াছিলেন , চীনের গৃহযুদ্ধেও তিনি যুদ্ধ করিয়াছিলেন। কিন্তু আঁদ্রে মালরোর কৃতিত্ব তিনি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ফ্যাসিস্ট জার্মান বাহিনীর বিরুদ্ধে ফরাসী প্রতিরোধ বাহিনীর অন্যতম সংগঠক। মালরো তাঁহার জীবনের এই সব সংগ্রামী ঘটনার পটভূমিতে রচনা করিয়াছেন অসাধারণ উপন্যাস। তিনি ১৯৬৯ সালে জেনারেল দ্য গলের পরাজয়ের পর সক্রিয় রাজনীতি হইতে অবসর গ্রহণ করিয়াছিলেন। কিন্তু দ্য গল পন্থীদের মাঝে তাঁহার প্রভাব অত্যন্ত বেশী। মাঁশিয়ে মালরো ফ্রান্সের রাজনৈতিক ও সামাজিক জগতের অন্যতম প্রতিভাবান প্রভাবশালী ব্যাক্তিত্ব। সম্প্রতি নয়া দিল্লীতে অনুষ্টিত বাংলাদেশ সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সম্মেলনের প্রধান উদ্যোক্তা সর্বোদয় নেতা শ্রী জয় প্রকাশ নারায়নের কাছে এক চিঠিতে তিনি লিখিয়াছেন- –“ পাকিস্তানী জঙ্গীচক্র যে সময়ে ট্যাঙ্ক ও সৈন্যবাহিনীর সাহায্যে বাংলাদেশের জনগনের উপর পশুসুলভ বর্বর আচরণ অব্যাহত রাখিয়াছে – তখন আবেদন – নিবেদন কিংবা সম্মেলন করিয়া কোন ফল হইবে না”।
.
‘লা ফিগারো’ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের উপর জোর দিয়া মঁশিয়ে মালরো লিখিয়াছেন- আবেদন- নিবেদনের দিন শেষ হইয়াছে। আজ ইসলামাবাদের জঙ্গীশাহীর বর্বরতার একমাত্র জবাব সশস্ত্র সংগ্রাম। বাংলার জনগণকে যদি কেউ সত্যিই সাহায্য করিতে চান – তবে তাঁহাকে সশস্ত্র যুদ্ধে বাঙ্গালীর পাশে আসিয়া দাঁড়াইতে হবে”।
.
আঁদ্রে মালরোর এই প্রত্যয় ঘোষণা ফ্রান্সের রাজনৈতিক মহল বিশেষ গুরুত্ব লাভ করিয়াছে। আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় একই সাথে ইহা দারুণ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করিয়াছেন।
.
আঁদ্রে মালরো ইতিমধ্যে জানাইয়াছেন – তিনি তাঁহার ঘোষণা সম্পর্কে একটি বিবৃতি প্রদান করিবেন। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামী জনগণের সাহায্যে তাঁহার ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা তিনি এই বিবৃতিতে উল্লেখ করিবেন বলিয়া আশা করা যাইতাছে।
.
সম্প্রতি মঁশিয়ে মালরো সহিত যাঁহার সাক্ষাৎ করিয়াছেন তাঁহারে বলেন, প্যারিসের বাইরে তাঁর নিজের বাড়িতে তিনি এখন অবসর জীবন যাপন করিতেছেন। কিন্তু বাংলাদেশ সম্পর্কে সর্বশেষ সংবাদটিও তাঁহার জানা এবং মঁশিয়ে মালরোর দৃঢ় ধারণা, বিশ শতকের সত্তর দশকে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি নির্যাতিত, নিপীড়িত জনতার এই নব- উত্থান পৃথিবীর ইতিহাসের এক যুগান্তকারী ঘটনা।
.
সত্তর বছরের বৃদ্ধ এই মানুষটি তাই বলিয়াছেন- আমি বাংলাদেশের যুদ্ধ অংশগ্রহণ করিতে চাই। মানবতার সপক্ষে নিপীড়িত জনতার এই সংগ্রাম একটি মহান সংগ্রাম। তিনি বলেন, “আমি বৃদ্ধ, হয়তো পদাতিক হিসাবে যুদ্ধ করার সামর্থ্য আমার হইবে না। তবে ট্যাঙ্ক চড়িয়া আমি পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদার পশুদের মোকাবিলা করিবার শক্তি রাখি”।
.
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের উল্লেখ করিয়া তিনি বলেন, “দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক দুনিয়ার ঘটনাবলীর পটভূমিতে বিচার করিলে বুঝা যায় – তৎকালীন সময়ে অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভ সম্ভব পর হইয়াছিল। কিন্তু আজ সেই সম্ভাবনা সম্পূর্ণরূপে তিরোহিত”। আমাদের চোখের সামনে রহিয়াছে ভিয়েতনামের দৃষ্টান্ত।
.
বাংলাদেশের মানুষকে আজ উপলধ্বি করিতে হইবে- যে জঘন্য পশু শক্তির বিরুদ্ধে বাঙ্গালীরা রুখিয়া দাড়াইয়াছেন, সেই পশু শক্তি ইতিহাসের ঘৃণ্যতম নরপশু। বাঙ্গালীকে আজ সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমেই মুক্তি সংগ্রামকে চূড়ান্ত সফলতার দিকে নিয়া যাইতে হইবে।
.
বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের সামনে আজ আর অন্য কোন পথ নাই।
.
.
সহুল আহমেদ মুন্না
<৬,১৫৪,২৫৩-২৫৪>
শিরোনামঃ সর্বশেষ জল্লাদী ষড়যন্ত্র
সংবাদপত্রঃ বাংলার বাণী, মুজিবনগরঃ ৬ষ্ঠ সংখ্যা
তারিখঃ ৫ অক্টোবর, ১৯৭১
.
সর্বশেষ জল্লাদী ষড়যন্ত্র
সম্পাদকীয়
ইতিহাসের কি বিচিত্র পুনরাবৃত্তি!
দুই শত বছর আগে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা ভারতবর্ষে ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণ অব্যাহত রাখার জন্য ‘ডিভাইড এন্ড রুল পলিসি’ উদ্ভাবন করিয়াছিল। এই পলিসি অনুসারেই তারা সুচতুর কৌশলে হিন্দু – মুসলমানের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করিয়া, ‘বঙ্গভঙ্গ’ করিয়া নিজেদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করিতে বহুলাংশে সক্ষমও হইয়াছিল। তারপর দীর্ঘদিন কাটিয়াছে। ভারতবর্ষ হইতে বৃটিশরা বিদায় নিয়াছে। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশের সেদিনের ঔপনিবেশিক স্বার্থরক্ষার তাগিদে অনুসৃত বিভেদ নীতির বিষাক্ত ছোবলের ক্ষতচিহ্ন এই উপমহাদেশের বুক হইতে আজিও নিঃশেষে মুছিয়া যায় নাই। সেই যে বৃটিশ আমলে বাংলা বিভক্ত হইয়াছে, ঘুরিয়া ফিরিয়া উহা দ্বিখন্ডিতই রহিয়া গিয়াছে – জোড়া লাগে নাই, লাগিবেও না।
.
আর আশ্চর্য! দুই শত বৎসর পরে বাংলাদেশে পাঞ্জাবী উপনিবেশবাদী শাসন অব্যাহত রাখার জন্য জঙ্গীশাহী আজ সেই একই সনাতন বৃটিশ বিভেদ নীতিকেই তুরুপের তাস হিসাবে ব্যবহার করিতে উদ্যত হইয়াছে।
.
পররাজ্যলোভী পশ্চিম পাকিস্তানী শাসককুলের এই জঘন্য দুরভিসন্ধিটির প্রতিফলন ঘটিয়াছে জল্লাদ ইয়াহিয়ার প্রস্তাবিত শাসনতন্ত্রের খসড়ায়। এই খসড়ায় বৃটিশ বিভেদ নীতিরই অনুসরণে বাঙ্গালী জাতির মধ্যে বিভেদ, বিদ্বেষ এবং শত্রুতার মনোভাব সৃষ্টির জন্য একদিকে হিন্দুদের ভোটাধিকার হরণ এবং অপরদিকে বাংলাদেশের অধিকৃত অঞ্চলকে তিনটি প্রদেশে ভাগ করার দূরভিসন্ধিমূলক সুপারিশ সন্নিবেশিত হইয়াছে।
.
পশ্চিম পাকিস্তানী জঙ্গী সরকারের বেসরকারী মুখপাত্র পাকিস্তান টাইমসে ইয়াহিয়া খানের প্রস্তাবিত শাসনতন্ত্রের একটি খসড়া প্রকাশিত হইয়াছে। জঙ্গী শাসনের অধীনস্থ জনগণের উপর চাপাইয়া দিবার উদ্দেশ্যে একটি শাসনতন্ত্র রচনার জন্য ইয়াহিয়া খান কিছুদিন আগে যে কমিটি নিয়োগ করিয়াছিল সেই কমিটি খসড়া শাসনতন্ত্র রচনার অপকর্মটি সম্পন্ন করিয়াছে। পাকিস্তান টাইমসের রিপোর্ট অনুযায়ী, খসড়াটিতে হিন্দুদের ভোটাধিকার হরন করা হইয়াছে। কারণ স্বরূপ বলা হইয়াছ যে, হিন্দুদের ভোটের জোরেই আওয়ামীলীগ নির্বাচনে জিতিয়া পাকিস্তানকে ধ্বংস করিবার চেষ্টা করিয়াছে। সুতরাং হিন্দুদের ভোটাধিকার থাকা উচিত নয়। খসড়া শাসনতন্ত্রে বলা হইয়াছে, আওয়ামী লীগের কোন লোক দলের নামে বা বেনামে কোনদিন পাকিস্তানের কোন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করিতে পারিবে না। সব চাইতে উল্লেখযোগ্য বিষয়, জল্লাদী শাসনতন্ত্রে বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকাকে তিনটি পৃথক প্রদেশে বিভক্ত করার পরিকল্পনা সংযোজিত হইয়াছে। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী প্রদেশে গঠিত হইবে এবং প্রত্যেক প্রদেশের পৃথক আইন পরিষদ থাকিবে।
.
প্রত্যেক প্রদেশে গভর্নর থাকিবে এবং গভর্নরই মন্ত্রীদের নিয়োগ করিবেন।
.
জঙ্গীশাহীর রাজত্বে এখন কড়া প্রেস সেন্সরশীপ। তাছাড়া পাকিস্তান টাইমস সরকার সমর্থক পত্রিকা। আর ইয়াহিয়ার নিজের নিয়োগ করা কমিটি তার হুকুম মতই শাসনতন্ত্রের খসড়া তৈরী করিয়াছে ইহাতে সন্দেহের অবকাশ নাই। সুতরাং ধরিয়া নেওয়া যায়, পাকিস্তান টাইমসে সে খসড়া শাসনতন্ত্রের বিবরণী ছাপা হইয়াছে, উহাই প্রকৃত জল্লাদী শাসনতন্ত্র। বাংলাদেশ এখন ইয়াহিয়া খানদের খাস তালুক নয়। বাংলাদেশ এখন একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। তাই বাংলাদেশের ব্যাপারে জঙ্গীশাহী কোন কথা বলিলে তা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নির্লজ্জ হস্তক্ষেপেরই সামিল হইবে। সে কারণেই ইয়াহিয়ার শাসনতান্ত্রিক ফর্মুলা নিয়া আমাদের কোন মাথাব্যাথা নাই। কিন্তু তবু, এ ব্যাপারে মন্তব্য করিতেছি আমরা শুধু এই কারণে যে, জল্লাদের এই সর্বশেষ তৎপরতার অন্তরালে রহিয়াছে এক সুগভীর চক্রান্ত। এ চক্রান্ত ভয়াবহ মারাত্নক, জঘন্য ইহার লক্ষ্য।
.
আমরা আগেই বলিয়াছি, উপনেশবাদী পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক – শোষকদের উদ্দেশ্য হইতেছে যে কোন প্রকারে হোক বিভেদ বিদ্বেষ তিক্ততা সৃষ্টির মাধ্যমে বাঙ্গালী জাতির মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি করিয়া তাদের দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ রাখিয়া বাংলাদেশকে পন্য সামগ্রী বিক্রয়ের খোলা বাজার হিসাবে ব্যবহার করা এবং বাংলার মাটির সোনার সম্পদ ও বাঙ্গালীর হাড় – মাংস –কলিজা হরিলুটের বাতাসার মত কামড়াইয়া ছিড়িয়া খাওয়া। আর এই বদমতলব হাছিলের জন্য গণবিরোধী পশ্চিমা শাসককুল ছল বল কন কৌশল কম প্রয়োগ করে নাই। ন্যায্য দাবী – দাওয়া প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশে যখনই কোন গণ আন্দোলন দানা বাধিয়া উঠিয়াছে, নির্যাতন, নিপীড়নের স্টীম রোলার চালাইবার পাশাপাশি তখনই পশ্চিমা শাসকরা হিন্দু – মুসলমান, বাঙ্গালী – অবাঙ্গালী, স্থানীয় –অস্থানীয় প্রশ্ন উস্কাইয়া দিয়া বিভিন্ন শ্রেণীর জনগণের মধ্যে বিভেদ – বিদ্বেষ, সংঘাত সৃষ্টির মাধ্যমে উহা বানচাল করিয়া দেওয়ার চেষ্টা করিয়াছে। সাম্প্রতিক অতীতকালেও দেখা গিয়াছে, ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলন বানচালের জন্য ভাড়াটিয়া দুষ্কৃতিকারীদের উস্কাইয়া দিয়া প্রথমে তোলা হয় মোহাজিরস্তান প্রদেশ গঠনের দাবী। তারপর ওঠে পৃথক উত্তরবঙ্গ প্রদেশ গঠনের দাবী। কিন্তু শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সচেতন জনতার ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের মুখে স্বার্থবাদীদের এই অপপ্রয়াস ব্যার্থ হইয়া যায়। তারপর আসে বিগত নির্বাচন। এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করিয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙ্গালী জাতি অতুলনীয় ঐক্যবদ্ধনে আবদ্ধ হয়। পাকিস্তানে বাঙ্গালীরা শতকরা ৫৬ ভাগ। এক লোক এক ভোটের ভিত্তিতে অনুষ্টিত নির্বাচনে জনগণ আওয়ামীলীগের হাতে সমগ্র পাকিস্তানের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের বৈধ অধিকার তুলিয়া দেয়ায় বঙ্গবন্ধু নির্বাচিত হন সমগ্র পাকিস্তানের ভাগ্য বিধাতা হিসাবে। কিন্তু পাশ্চিম পাকিস্তানী শাসক ও শোসককুল জনগণের এই রায়কে সহজভাবে গ্রহণ করিতে পারে নাই। আর তার ফলে পরবর্তীকালে কি ঘটিয়াছে, কিভাবে জঙ্গীশাহী হিংস্র বর্বরতায় বাংলার মানুষের উপর পশুর মত ঝাঁপাইয়া পড়িয়াছে, কিভেব শ্যমল বাংলার বুকে দশ লক্ষ মানুষকে ঘরছাড়া নিঃস্ব কাঙ্গালে পরিণত করিয়াছে এবং সর্বোপরি ইয়াহিয়ার নিজের ভাষায় ‘পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী’ শেখ মুজিবুর রহমান কে কারারুদ্ধ করিয়া তাহার জীবননাশের উদ্দেশ্যে বিচার প্রহসনের ষড়যন্ত্রে মাতিয়া উঠিয়াছে, সে কাহিনী সকলেরই জানা। আর ইহাও সকলেরই জানা যে, বর্বরতার দ্বারা বাঙ্গালী স্বাধীনতার স্বপ্নকে ধূলিসাৎ করিয়া দেওয়া সম্ভব হই নাই – সম্ভব হবেও না।
.
নির্মম বাস্তবের এই প্রতিকূল সূর্যরশ্মির সামনে দাড়াইয়া জল্লাদশাহী তাই নতুন কৌশলের আশ্রয় লইয়াছে। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারাই শাসনতন্ত্র রচনার পূর্বপ্রতিশ্রুতি বিস্মৃত হইয়া ইয়াহিয়া খান এখন মাতিয়া উঠিয়াছে স্বকপোল কল্পিত এক শাহী ফরমানের উপর শাসনতন্ত্রের লেবেল লাগাইয়া উহাই জনগণের উপর চাপাইয়া দেওয়ার তোঘলকি খেয়ালে।
.
জঙ্গীশাহী জানে, স্বাধীনতার যুদ্ধ বাঙ্গালী জাতির ঐক্যকে যেভাবে সুদৃঢ় ও সুসংহত করিয়াছে উহার কোন দ্বিতীয় নজির নাই। তারা জানে যে, এই ঐক্য ফাটল ধরাইতে না পারিলে নিজেদের দূরভিসন্ধি হাসিলের কোন আশা নাই। তাই এই ঐক্য ফাটল ধরাইবার সুচতুর কৌশল সংযোজিত হইয়াছে জল্লাদী শাসনতন্ত্রের খসড়ায়।
.
ইয়াহিয়া চক্রের ধারনা, বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকায় তিনটি প্রদেশ গঠিত হইলে বাঙ্গালীরা আর এক কন্ঠে এক জাতি হিসাবে কথা বলিবার সুযোগ পাইবে না। বরং উল্টো, ক্ষমতা, দাবী – দাওয়া এবং স্বার্থের প্রশ্নে বিভিন্ন প্রদেশের জনগনের মধ্যে বিভেদ – বিদ্বেষ ও শত্রুতার মনোভাব সৃষ্টি হইবে। সেই অবস্থায় সহজেই বাংলাদেশেরই এক অঞ্চলের জনগণকে অরেক অঞ্চলের জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যাইবে। ফলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ দীর্ঘসূত্রতার চোরাবালিতে আটকাইয়া যাইবে এবং অনৈক্যের ফাটল উহাকে দুর্বল করিয়া দিবে। ইহা ছাড়া হিন্দুদের ভোটাধিকার হরণ করা হইলে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি এবং ঐক্যের ক্ষেত্রেই ফাটল ধরিবে। জঙ্গীশাহীর ধারণা, তারা যখন বাংলাদেশ ছাড়িয়া চাইতে বাধ্য হইবে, তারপরেও এই বিভেদনীতির বিষময় প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশের এক অঞ্চলের জনগনকে আরেক অঞ্চলের জনগনের বিরুদ্ধে শত্রুমনোভাবাপন্ন করিয়া রাখিবে। একইরকম অসদ্ভাব বিরাজ করিবে হিন্দু – মুসলিম সম্পর্কের ক্ষেত্রে।
.
কিন্তু এখানেও ভুল করিয়াছে ইয়াহিয়া খান। তার এই দূরভিসন্ধি বাস্তবায়িত হইবার নয়। শেখ মুজিবের মুক্তিমন্ত্রে দীক্ষিত ঐক্যবদ্ধ বাঙ্গালী জাতি এই সর্বশেষ জল্লাদী ষড়যন্ত্রও চূড়ান্তভাবে ব্যার্থ করিয়া দিবে।
.
.
সহুল আহমেদ মুন্না
<৬,১৫৫,২৫৬-২৫৯>
শিরোনামঃ কাহার সঙ্গে আপোষ, কিসের আপোষ?
সংবাদপত্রঃ বাংলার বাণী, মুজিবনগরঃ ৫ম সংখ্যা
তারিখঃ ৫ অক্টোবর, ১৯৭১
.
কাহার সঙ্গে আপোষ, কিসের আপোষ?
রাজনৈতিক ভাষ্যকার
স্বাধীন বাংলার জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে পরিচালিত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের তীব্রতা যতই বৃদ্ধি পাইতেছে, ক্ষয়িষ্ণু পাঞ্জাবী উপনিবেশবাদের শেষ প্রতিভূ জল্লাদ ইয়াহিয়ার লেলাইয়া দেওয়া ভাড়াটিয়া হানাদার বাহিনীর চূড়ান্ত পরাজয় যতই প্রত্যাসন্ন হইয়া উঠিতেছে, বিশ্বের দশ দিগন্তে স্বাধীন বাংলাদেশের সমর্থনে জনমত যতই বলিষ্টতর ভাষায় সোচ্চার হইতেহে, ইহারই পাশাপাশি ততই ঘণীভুত হইয়া উঠিতেছে বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানকে কেন্দ্র করিয়া বিভিন্ন মহলে সৃষ্ট আপোষ নামক বিভ্রান্তির ধূম্রজাল। এই বিভ্রান্তির কালো মেঘের গর্জনের জবাবে প্রলয় রাত্রির বিক্ষুদ্ধ বঙ্গোপসাগরের উত্তাল তরঙ্গমালার সংক্ষুদ্ধ হুঙ্কারের মতই উদ্ধত প্রশ্নের ভাষায় দিকে দিকে গর্জিয়া ফিরিতেছে দশ লক্ষ শহীদের আত্না আর মুক্তি যুদ্ধে নিয়োজিত কোটি কোটি বাঙ্গালীর কন্ঠস্বর, “কিসের আপোষ, কাহার সঙ্গে আপোষ?” আর সেই সঙ্গে যেন বাতাসে বাতাসে উদ্দামবেগে ভাসিয়া বেড়াইতেছে বঙ্গবন্ধুর বজ্রকন্ঠঃ ‘লক্ষ লক্ষ বাঙ্গালীর নরমুন্ড লইয়া গেন্ডুয়া খেলায় লিপ্ত জল্লাদের সঙ্গে আপোষের কোন প্রশ্নই ওঠে না। প্রশ্ন ওঠে না বাংলার মানুষের রক্ত আর স্বাধীনতার সঙ্গে বেইমানী করিয়া আমার কারামুক্তি লাভের”।
.
স্বাধীন বাংলার নেতা ও জনতার এই প্রত্যয়দৃপ্ত দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠস্বরকে দুর্বিনীত নিয়তির কণ্ঠস্বর বলিয়া ধরিয়া নিয়া বিশ্ববাসী জানিয়া রাখুক, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামো, ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ ও সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্টার সুমহান উদ্দেশ্যে পরিচালিত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত থামিবে না। মহান নেতা শেখ মুজিবের মুক্তি, স্বাধীনতার স্বীকৃতি এবং জন্মভূমির বুক হইতে হানাদার শত্রু সৈন্য বাহিনী প্রত্যহারের আগে এক মুহুর্তের জন্যও স্তধ্ব হবেনা বীর বাঙ্গালীর সমরাস্ত্রের ধ্বনি। দুশমনের সঙ্গে আপোষের কোন প্রশ্নই ওঠে না। বাঙ্গালী জাতির এই জীবনপণ সংগ্রামের লক্ষ্যকে সম্পূর্ণভাবে স্বীকার করিয়া নিলেই অধিকতর রক্তপাত এড়াইবার জন্য যুদ্ধ বিরতি ঘটিতে পারে, হইতে পারে রাজনৈতিক সমাধানের মাধ্যমে এক রক্তাক্ত যুদ্ধের অবসান।
.
এখানে উল্লেখযোগ্য যে, ৭২ ঘন্টা ‘ক্র্যাস বেঙ্গলী’ প্রোগ্রাম অনুযায়ী মানবেতিহাসের নজিরবিহীন ভয়াবহ বর্বর গণহত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ দাবাইয়া দিতে চাহিয়াছিল। কিন্তু শক্তি প্রয়োগ আর হিংস্র বর্বরতার কাছে বাঙ্গালী জাতি মাথা নত করে নাই। বরং যতই দিন গিয়াছে, ততই জোরদার হইয়াছে বাংলাদেশের মুক্তি – শত্রুমুক্ত হইয়াছে নয়া নয়া এলাকা। ফলে বেসামাল ইয়াহিয়া দশ লক্ষ বাঙ্গালীর লাশের ওপর বঙ্গবন্ধুর বিচার প্রহসনের মঞ্চ সাজাইয়া লিপ্ত হইয়াছে তাহার জীবনকে বাজি রাখিয়া রাজনৈতিক স্বার্থোদ্ধারের তস্করসুলভ জুয়া খেলায়। কিন্তু তাতেও হতোদ্যম হয় নাই বাংলার বীর মুক্তিযোদ্ধারা।
.
বরং অধিকতর শক্তি ও উদ্যম লইয়া ঝাঁপাইয়া পড়িয়াছে হানাদার দুশমনের উপর। ক্রমাগত পর্যুদস্ত হইতে হইতে নিশ্চিত পরাজয়ের ভয়াল বিভীষিকায় আতঙ্কগ্রস্ত-জল্লাদ ইয়াহিয়া আপোষের চোরাবালিতে পথ হাতড়াইয়া হাতড়াইয়া খুঁজিয়া ফিরিতেছে পরিত্রাণের উপায়। মৃত পাকিস্তানে প্রাণসঞ্চার, পাঞ্জাবী উপনিবেশবাদের বিলীয়মান সৌধটিকে কোন মতে টিকাইয়া রাখা এবং নিজের জঙ্গি মসনদ খাড়া রাখার জন্য সে আপোষের আর্জি লইয়া ইরান তুরানের দুয়ারে দুয়ারে ধর্না দিয়াছে, দূত পাঠাইয়াছে তারই ভাষায় “দেশদ্রোহী এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার দায়ে বিচারাধীন” বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কাছে। কিন্তু পূর্ববর্তী খবরেই বলা হইয়াছে, বাংলার মুকুটহীন সম্রাট বঙ্গবন্ধু এই আপোষ প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করিয়া দিয়া বলিয়াছেন, লক্ষ লক্ষ বাঙ্গালীর নরমুন্ডু লইয়া গেণ্ডুয়া খেলায় লিপ্ত জল্লাদের সঙ্গে আপোষের কোন প্রশ্নই ওঠেনা। এ,কে ব্রোহীর মাধ্যমে ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুর কাছে প্রস্তাব পাঠাইয়াছিলেন যে স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরতি ঘোষনা করিয়া পাকিস্তান এক রাখিতে সম্মত হইলে শেখ সাহেবেকে মুক্তি দেওয়া হইবে। কিন্তু কূটনৈতিক সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়া একটি বিদেশী বার্তা জানাইয়াছে, “বঙ্গবন্ধু জল্লাদী দূতের মাধ্যমে ইয়াহিয়া খানকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানাইয়া দিয়াছেন যে, “বাঙ্গালীর রক্ত আর স্বাধীনতার সঙ্গে বেইমানী করিয়া আমার কারা-মুক্তিলাভের কোন প্রশ্নই ওঠেনা।”
.
এখানে উল্লেখযোগ্য যে, বিগত মার্চ মাসের ১ তারিখ হইতে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষনার প্রতিবাদে আন্দোলন শুরু হইলে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে কিছু সংখ্যক ছাত্র জনতা পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত হন। বঙ্গবন্ধু সেই সময় সর্বাত্নক অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। সমগ্র বাংলাদেশের মানুষ বঙ্গবন্ধুকেই ন্যায়তঃ আইনতঃ বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় সমাসীন বলিয়া মানিয়া নিয়া প্রতিটি ব্যাপারে অক্ষরে অক্ষরে তাঁহার নির্দেশ পালন করিতে থাকে। ৬ ই মার্চ ইয়াহিয়া খান এক বেতার ভাষণে ১০ ই মার্চ ঢাকায় নেতৃত্ব সম্মেলন আহ্বান করেন। ৭ ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ভাষনে উহার জবাবে বঙ্গবন্ধু বলনে, ‘কার সঙ্গে বৈঠক, কিসের বৈঠকে বসিব? যে আমার মানুষের বুকে গুলি চালাইয়াছে তার সাথে?’ সেই ভাষণেই বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘রক্ত যখন দিয়াছি রক্ত আরও দিব, কিন্তু বাংলার মানুষকে এবার মুক্ত করিয়া ছাড়িব ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম – এবারে সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’।
.
তারপর বহুদিন গত হইয়াছে, পরস্থিতি, প্রেক্ষিত সবকিছুই আমূল পাল্টাইয়া গিয়াছে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে বাঙ্গালী জাতি লিপ্ত হইয়াছে মুক্তিযুদ্ধে। বাঙ্গালীর আত্নপ্রতিষ্টার আন্দোলন বানচালের জন্য ইয়াহিয়া খান হিংস্র বর্বরতায় হত্যা করিয়াছে দশ লক্ষ মানুষ, নিরাশ্রয় গৃহহারা দেশান্তরী করিয়াছে লক্ষ লক্ষ নর নারী – শিশুকে। এই হত্যাকান্ড ও রক্তপাতের তুলনায় ৭ ই মার্চের পূর্ব পর্যন্ত পশ্চিমা সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহতের সংখ্যা ছিল অতি নগন্য। তবু সেদিনের সেই বীর শহীদের চাপ চাপ রক্তের উপর দিয়া হাটিয়া গিয়া বঙ্গবন্ধু জল্লাদের সঙ্গে বৈঠকে বসিতে রাজী হন নাই। সামরিক শাসন প্রত্যাহার, ক্ষমতা হস্তান্তর, সেনাবাহিনী প্রত্যাহার এবং ক্ষতিপূরণ দানের আগে জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে সম্মত হন নাই। আজ দশ লক্ষ বাঙ্গালীর রক্তের নদী সাতরাইয়া বঙ্গবন্ধুরই মুক্তিমন্ত্রে দীক্ষিত বাঙ্গালী জাতি এবং তাঁহার অনুসারীরা জল্লাদ ইয়াহিয়ার সঙ্গে আপোষ করিতে যাইবে এমন কথা যারা চিন্তা করেন, বা এমন বিভ্রান্তিকর ধারণাকে যারা ক্ষনিকের তরেও মনে ঠাই দেন, তারা আহম্মকের স্বর্গেই বাস করিতেছেন। ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে যে কোন মতেই আপোষ হইতে পারে না, বাংলাদেশ সরকার দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ইহা জানাইয়া দিয়াছেন। বিগত ৬ই সেপ্টেম্বর সাপ্তাহিক বাংলার বাণীর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে স্বাধীন বাংলার অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম তাঁহার পূর্ব ঘোষনার পুনরাবৃত্তি করিয়া বলেন – ইয়াহিয়া খানকে ‘সর্বপ্রথম শেখ মুজিবের মুক্তি দিতে হইবে, স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে হইবে, হানাদার সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করিয়া নিতে হইবে এবং জঙ্গী বর্বরতায় ক্ষতিগ্রস্তদের পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হইবে’। এই সব দাবী পূরণের পরই বিবেচনা করা হইবে রাজনৈতিক সমাধানের জন্য আমরা আলোচনায় বসিব কি না! গত ২৫ শে সেপ্টেম্বর মুক্তিযুদ্ধের অর্ধ বর্ষপূর্তি উপলক্ষে জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত এক বেতার ভাষনেও অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি উল্লিখিত বক্তব্যেরই পুনরাবৃত্তি করেন। একই দিনে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রী খোন্দকার মোস্তাক আহমদ বলেন, ‘আমাদের কথা অতি সুস্পষ্ট। বৃহৎ শক্তিবর্গের গোষ্টীগত স্বার্থরক্ষা এবং রাজনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখার স্বার্থে বাংলাদেশের মানুষের রক্ত স্রোতকে ব্যবহার করিতে দেওয়া হইবে না। পূর্ণ স্বাধীনতাই আমাদের লক্ষ্য”। বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী মহল বিশেষের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘আমাদিগকে যদি বাঁচিয়া থাকিতে কিছু দিতে না পারেন, তবে স্বাধীনতার জন্য আমাদিগকে মরিতে দিন”।
.
নিউইয়র্কে জাতিসঙ্ঘের চার্চ সেন্টারে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বক্তৃতাকালে গত শুক্রবার জাতিসঙ্ঘে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতা বিচারপতি জনাব আবু সাইদ চৌধুরী বাংলাদেশের পক্ষ হইতে সমগ্র বিশ্বকে জানাইয়া দিয়াছেন বঙ্গবন্ধুর মুক্তি, বাংলাদেশের স্বীকৃতি এবং দখলদার বাহিনীর অপসারণ ছাড়া কোন রাজনৈতিক সমাধানই বাংলাদেশের জনগনের কাছে গ্রহনযোগ্য হইবে না।
.
এ দিকে গত শনিবার সৈয়দ নজরুলের সভাপতিত্বে অনুষ্টিত বাংলাদেশ মন্ত্রী সভার এক বৈঠকের পর ঘোষণা করা হইয়াছে যে, ‘পূর্ণ স্বাধীনতা আমাদের লক্ষ্য। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য আমরা বিশ্ব বাসীর সাহায্য ও সহযোগীতা চাই’।
.
সুতরাং এ ব্যাপারে কোন জল্পনা কল্পনা বা সন্দেহের অবকাশ নাই যে মৃত পাকিস্তানকে জীবিত করিয়া বাঙ্গালী জাতি কোন অবস্থাতেই ইয়াহিয়ার সঙ্গে কোনও আপোষে রাজী হইবে না। ইহার পরে আসে রাজনৈতিক সমাধানের প্রশ্ন। এ ব্যাপারেও বাঙ্গালী জাতির বক্তব্য অতি সুস্পষ্ট।
.
রাজনৈতিক সমাধান বলিতে তারা বোঝে অধিকতর রক্তপাত এড়াইয়া আলোচনার টেবিলে বসিয়ে মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য অর্জন। ইয়াহিয়া যদি রক্তপাত এড়াইতে চাহে, সৈয়দ নজরুল ইসলামের চারটি পূর্ব শর্ত পূরণের মাধ্যমে রাজনৈতিক সমাধানের দারোদঘাটিত হইতে পারে না। ইহা ছাড়া রাজনৈতিক সমাধানের নামে অন্য কোন গোজামিল বাংলার মানুষের কাছে গ্রহনযোগ্য হইবে না।
.
ইহা কিসের আলামত
আর হইবে না জানিয়াই, মৃত পাকিস্তানকে কবর খুড়িয়া উঠাইয়া আনিয়া আবার উহাতে প্রাণসঞ্চারে বাঙ্গালী জাতি রাজী হইবে না বলিয়া স্পষ্টভাবে উপলদ্ধি করিয়াই ইয়াহিয়া খান আবার বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে অস্ত্র শাণাইতে শুরু করিয়াছে। একটি বিদেশী বার্তা প্রতিষ্টান জানাইয়াছেন, বঙ্গবন্ধুকে বিচার প্রহসনের মাধ্যমে যে শাস্তি দেওয়া হইবে উহা যাতে বিশ্বজনমতকে বিক্ষুদ্ধ করিতে না পারে তজ্জন্য প্রবল প্রচারণা চালাইবার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানী জঙ্গীশাহী বিদেশস্থ উহার কূটনৈতিক মিশনগুলিকে নির্দেশ প্রদান করিয়াছে। এক সার্কুলারে জঙ্গীশাহী সংবাদপত্র জগতকে এ ব্যাপারে প্রভাবান্বিত করার জন্য মিশনগুলির প্রতি নির্দেশ দিয়াছে। সামরিক জান্তা বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দানে ঢাকা হইতে ৪ জন সাংবাদিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪ জন শিক্ষক, ২ জন ব্যাংক কর্মকর্তা এবং বিপুল সংখ্যক বাঙ্গালী সামরিক ও বেসামরিক কর্মচারীকে পশ্চিম পাকিস্তানে চালান দিয়াছে। খবরে প্রকাশ, ঢাকা ত্যাগের আগে এই সব “সাক্ষীকে” তালিম দেওয়া হইয়াছে। সাক্ষ্যদানকালে তাদের বলিতে হইবে যে শেখ মুজিব নিজেই অবাঙ্গালীদের হত্যা করার হুকুম দিয়াছিলেন। ‘সাক্ষীদের’ কেহ কেহ ইতিমধ্যেই ঢাকা ফিরিয়া আসিয়াছে, অন্যরা এখনও পশ্চিম পাকিস্তানে সুরক্ষিত বন্দিশালায় আটক রহিয়াছে। ইহারা কোথায় আছে, সে কথা তাদের পরিবার পরিজনকেও জানিতে দেওয়া হয় না।
.
২০ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ
গত মঙ্গলবার জঙ্গীশাহীর এক ঘোষণায় বলা হয় যে, শেখ মুজিবের বিচার প্রহসনে এ পর্যন্ত মোট ২০ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হইয়াছে এই ঘোষনার উদ্ধৃতি দিয়া রাওয়ালপিন্ডি হইতে এ,পি, এ, জানান যে, বঙ্গবন্ধুর বিচার প্রহসন চলিতেছে। ঘোষণায় বলা হয় যে, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনার অভিযোগে বিগত ৭ ই সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু গোপন বিচার পুনরায় শুরু হইয়াছে। জঙ্গীশাহী জানায় যে, জনাব এ, কে, ব্রোহী, তিনজন সহকারী মেসার্স গোলাম আলি, আকবর মির্জা এবং গোলাম হোসেনের সহায়তায় শেখ সাহেবের পক্ষ সমর্থন করিতেছেন। পশ্চিম পাকিস্তানি সংবাদপত্রে শেখ মুজিবের মুক্তির সম্ভাবনা সমপর্কে জল্পনা কল্পনা চলার পরিপ্রেক্ষিতেই এই সরকারী ঘোষণা প্রচারিত হয়। শেখ সাহেবের সঙ্গে দেখা করিয়া জনাব ব্রোহী পিণ্ডি ফিরিয়া ইয়াহিয়ার সঙ্গে দেখা করার সাতদিন পরে ৭ই সেপ্টেম্বর বিচার প্রহসন পুনরাম্ভ হয়। ঘোষণানুসারে দেখা যায় ১১ই আগস্ট হইতে ৭ই সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর বিচার প্রহসন মুলতবী ছিল। কিন্তু উক্ত সময়ে জাতিসঙ্ঘে জঙ্গি শাহীর প্রতিনিধি আগাশাহীসহ সরকারী কর্মকর্তারা বলিয়াছিল যে, “বিচার চলিতেছে”। শেখ সাহেব কোথায় আছেন ঘোষণায় সে সম্পর্কে কিছু বলা হয় নাই। তবে সর্বশেষ খবর অনুযায়ী তিনি লায়লাপুর জেলে আটক আছেন।
.
গুজব
এদিকে লন্ডন হইতে প্রাপ্ত খবরে জানা যায়, সেখানে এই মর্মে জোর গুজব চালু হইয়াছে যে, শেখ সাহেবকে শিগগিরই মুক্তি দেওয়া হইবে। এমন কি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশ প্রশ্নে আলোচনার আগেই তাহাকে মুক্তি দেওয়া হইতে পারে। অপর এক খবরে বলা হয়, ঢাকায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অশীতিপর পিতামাতাকে দেখার জন্য বঙ্গবন্ধুকে প্যারোলে মুক্তি দেওয়া হইতে পারে।
.
বিচার বন্ধ করো
সোভিয়েত সাংবাদিক ইউনিয়ন বঙ্গবন্ধুর বিচার প্রহসন বন্ধ করার জন্য ইয়াহিয়ার প্রতি আহ্বান জানাইয়াছে। সাংবাদিক ইউনিয়ন বাংলাদেশ ইস্যুর রাজনৈতিক সমাধানেরও আহ্বান জানান। সোভিয়েত শান্তি কমিটি এবং কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলির পক্ষ হইতেও অনুরূপ আহ্বান জানানো হইয়াছ।
.
সিংহলী এম,পি,র উদ্যোগ
কলম্বো হইতে ডি,পি,এ জানান, সিংহলের ক্ষমতাসীন বামপন্থী যুক্তফ্রন্টভুক্ত পার্লামেন্ট সদস্য মিঃ ভি, গুনবর্ধন জানাইয়াছেন যে, তিনি শেখ মুজিবের দাবীতে পার্লামেন্ট সদস্যদের স্বাক্ষর সংগ্রহ করিতেছেন।
.
বিচার প্রহসন
“প্রাভদায়” প্রকাশিত সোভিয়েত আফ্রো-এশিয়ান সংহতি কমিটির এক বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রাহমানের বিচারকে বিচারের নামে প্রহসন বলিয়া আখ্যায়িত করা হয়। প্রাভদায় বাংলাদেশ ইস্যুর রাজনৈতিক সমাধানও দাবী করা হয়।
.
.
শফিকুল ইসলাম
<৬,১৫৬,২৬০-২৬২>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
বিশ্ববাসী রুখিয়া দাঁড়াও |
বাংলার বানী মুজিব নগরঃ ৭ম সংখ্যা |
১২ অক্টোবর, ১৯৭১ |
সম্পাদকীয়
বিশ্ববাসী রুখিয়া দাঁড়াও
মস্তিস্ক বিকৃতি রোগীর বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে যেমন পাগ্লামীর তীব্ররতাও বৃদ্ধি পাইতে থাকে তেমনি যতই দিন যাইতেছে মানবেতিহাসের জঘন্যতম নরঘাতক দস্যু উন্মাদ ইহাহিয়ার বণোন্মাদনাও ততই বৃদ্ধি পাইতেছে। অগ্নিকুন্ডে ঝাঁপাইয়া পড়ার পরিণতি আত্মঘাতি অপমৃত্যু জানিয়াও ইহাহিয়া খান নিজের হাতে এই উপমহাদেশের একটা ভয়াল যুদ্ধের দাবানল ছড়াইয়া দিয়া একটা সর্বনাশের সূচনা না করিয়া ছাড়িবে বলিয়া মনে হইতেছে না। অবস্থাদৃষ্টে এক ধারণা পোষন না করিয়া পারা যায় না যা, ইয়াহিয়া খান আজ যুদ্ধই চায়- ‘তোটাল ওয়ার’, সে চায় সর্বাত্মক যুদ্ধ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ক্রমাগত মার খাইতে খাইতে দিশাহারা বেসামাল ইয়াহিয়া খান আজ চাহিতেছে আরও বড় যুদ্ধ- সর্ববিদ্বংসী পাক-ভারত যুদ্ধ।
ইসলামাবাদের জঙ্গীশাসক কুল চুড়ামণি ইয়াহিয়ার এই রণোন্মাদনা নতুন কিছু নয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হইবার পর উহাকে ভারতের কারসাজি বলিয়া আখ্যায়িত করিয়া সে বার বার ভারতের মুন্ডুপাত করিয়াছে, বার বার ভারতের বিরুদ্ধে রণহুঙ্কার ছাড়িয়াছে। পশ্চিম পাকিস্তানী, জঙ্গীশাহীর এই উন্মত্ত রণপাঁইয়তারারই দাঁতভাঙ্গা জবাব হিসাবে মাসাধিক কাল আগে স্বাক্ষরিত হয় ভারত সোভিয়েত শান্তি মৈত্রী ও সহযোগিতার চুক্তি। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা সেদিন সংগত কারণেই প্রত্যাশা করিয়াছিলেন যে এই চুক্তি রণোন্মাদ ইয়াহিয়ার যুদ্ধের খায়েশ চিরতরে মিটাইয়া দিতে সক্ষম হইবে। কিন্তু সাগরে যে ঘর বাঁধিয়াছে শিশিরে আর তার ভয় কি? যে ডুবিতেছে, অতলান্ত সমুদ্রের গভীরে কি ভয়াবহ পরিণতি অপেক্ষা করিতেছে উহা বিবেচনার অবকাশ তাহার কোথায়। তাই প্রত্যাসন্ন ভরাডুবির মুখে হিংস্র হায়েনার শেষ মরণ কামড়ের মতই নরদস্যু ইয়াহিয়া আজ পরিত্রানের সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, ইয়াহিয়ার রণপ্রস্তুতি চরমে উঠিয়াছে। বাংলার বাণীর বিশেষ প্রতিনিধি জানাইয়াছেন, জঙ্গীশাহী ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, যশোহর, রাজশাহী প্রভৃতি অধিকৃত শহরে ব্যপক যুদ্ধ প্রস্তুতি গ্রহন করিয়াছে। বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকার শহরসমূহ এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ইতিমধ্যেই বিমানবিধ্বংসী কামান বসানো হইয়াছে, স্থাপিত হইয়াছে দূরপাল্লার কামান, খনন করা হইয়াছে সুগভীর পরিখা। ইহারাই পাশাপাশি করোগেটেড টিন সহযোগে নির্মিত হইতেছে বাঙ্কার। চট্টগ্রাম হইতে শুরু করিয়া ফেনী, চৌদ্দগ্রাম কুমিল্লা সব খানেই পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা নিজেরদের অবস্থা সুরক্ষিত করিতেছে। সীমান্তবর্তী এলাকায় কারফিউ জারি হইয়াছে। সীমান্তের দশ মেইল অভ্যান্তর পর্যন্ত জনপ্রাণীশুন্য করার কাজ পুরাদমে চলিতেছে। ক্যান্টনমেন্টগুলিতে বিপুল পরিমাণ সামরিক সরঞ্জাম ও অস্ত্রশস্ত্র মজুদ করা হইয়াছে।
এদিকে বিদেশী বার্তা সংস্থার খবরে জানা যায় পশ্চিম পাকিস্তানে পুরাদমে রণপাঁইয়তারা চলিতেছে। শহরে বন্দরে সর্বত্র ব্লাক আউটের মহড়া চলিতেছে। বিপুল সেনা সমাবেশ ঘটানো হইয়াছে ভারত সীমান্তে।
শতদ্রু নদীর তীরে ভারী সামরিক যানের চাকা আর পাক সেনাদের পসঞ্চারে বাতাসে বাতাসে উঠিয়াছে ধুলা বালির ঘুর্ণাবর্ত। চম্ব সীমানে সমস্ত বেসামরিক নাগরিকদের দূরে সরাইয়া নেওয়া হইয়াছে।
কিন্তু কেন? ইহা কিসের আলামত? নিঃসন্দেহে যুদ্ধের। সন্দেহতাতীতভাবেই পাকিস্তানী জঙ্গীশাহীর এই রণ পাঁয়তারার লক্ষ্য হইল ভারত। আর এখানেই আসিতেছে আসল কথা। এখানেই নিহিত জঙ্গীশাহীর জঘন্যতম দূরভিসন্ধি।
সারা দুনিয়ার মানুষ জানে, বাংলাদেশের মানুষ পাঞ্জাবী উপনিবেশবাদের শেষ প্রতিভূ ইহাহিয়ার ভাড়াটিয়া সেনাবাহিনীর সঙ্গে জীবনপণ যুদ্ধে লিপ্ত। এই যুদ্ধে একদিকে মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করার সুমহান সংকল্পে উজ্জীবিত বাঙ্গালী জাতি, অপরদিকে রহিয়াছে হানাদার পশ্চিম পাকিস্তানী বাহিনী। কিন্তু এই বাস্তব সত্যটিকে অস্বীকার করিয়া ইয়াহিয়া খান আগা গোড়াই চেষ্টা চালাইয়াছে ইহার মধ্যে ভারতকে টানিয়া আনিতে। ভারত বার বার সুস্পষ্ট ভাষায় জানাইয়া দিয়াছে বাংলাদেশের যুদ্ধে, বাংলার মানুষেরই মুক্তিযুদ্ধ। পশ্চিম পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যকার এক যুদ্ধে ভারতের কোন ভূমিকা নাই। বাংলাদেশের মানুষের সংগ্রাম ন্যায়ের সংগ্রাম, সত্যের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম বলিয়াই বিশ্বের বৃহত্তর গণতন্ত্রী রাষ্ট্র ভারত সৈরতন্ত্রী উপনিবেশবাদী শক্তির বিরুদ্ধে পরিচালিত এই সংগ্রামে বাঙ্গালী জাতির প্রতি নৈতিক সমর্থন জানাইয়াছে। ইহাতে দোষের কি আছে? চীন যদি সর্বহারা নিপীড়িত মানুষের আত্মপ্রতিষ্ঠার আন্দোলনের প্রতি বিশ্বাঙ্ঘাতকতা করিয়া উপনিবেশবাদী পশ্চিম পাকিস্তানী জঙ্গীশাহীকে অস্ত্র যোগাইতে পারে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি ইয়াহিয়ার হাতে অঢেল মারনাস্ত্র তুলিয়া দিতে পারে, তবে ভারতই বা বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে সমর্থন করিতে পারিবেনা কেন?
কিন্তু বর্বর পশুশক্তির কাছে যুক্তির কোন মূল্য নাই। তার আজ প্রয়োজন যে কোনভাবেই হউক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে বাঞ্চাল করিয়া দিয়া সারে সাত কোটি বাঙালীকে দাসত্বের শৃংখলে আবদ্ধ রাখা। আর এই জঘন্য উদ্দেশ্য হাছিলের জন্যি ইয়াহিয়া আজ ভারতের বিরুদ্ধে রণপাঁয়তারা চালাইতেছে। একথা একটা বালকেরও বুঝিতে কষ্ট হইবার কথা নয় যে যুদ্ধে ভারতের বিরুদ্ধে জয়লাভ করার সাধ্য পাকিস্তানের নাই। কিন্তু তবু ইয়াহিয়া খান লাফাইতেছে কেন? কাহার ইঙ্গিতে, কিসের জোরে সে নর্তন-কুর্দন করিতেছে?
উত্তরঃ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। উদ্দেশ্যঃ বাঙ্গালী জাতির স্বাধীনতার স্বপ্ন নস্যাৎ করিয়া দেওয়া। এই উদ্দেশ্যেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অস্ত্র সরবরাহের উপর নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও মার্চ মাসের পরে ইয়াহিয়ার হাতে পৌনে সাত কোটি টাকার মার্কিন অস্ত্র তুলিয়া দিয়াছে। আর এই চৌর্যবৃত্তির পাপকে ঢাকা দেওয়ার জন্য মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব উইলিয়াম রজার্সের কন্ঠে উচ্চারিত হইতেছে দুরভিসন্ধিমূলক ‘সংযমের’ ললিত বাণী।
ইয়াহিয়া খান জানে, তার ভাড়াটিয়া বাহিনী ভারত আক্রমন করিলে উহার সমুচিত জবাব দিতে এতটুকু দ্বিরুক্তি করিবে না। এক যুদ্ধ হইবে সত্য সত্যি এক সর্বাত্মক যুদ্ধ। দাবানলের মত এই যুদ্ধ দ্রুত ছড়াইয়া পড়িলেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু নাই। আর সে ক্ষেত্রে এই যুদ্ধবন্ধ করার জন্য সম্ভবতঃ সবার আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই জাতিসংঘকে পাঠাইবে শান্তি ও সন্ধির প্রস্তাব লইয়া। হয়তো বা যুদ্ধ বিরতি ঘটিবে। আলোচনা বৈঠকে সামনা-সামনি বসিবে ভারত ও পাকিস্তান। দুর্ভাগা বাংলা তার স্বাধীনতার দুর্বার স্বপ্ন বুকে লইয়া অবহেলায় পড়িয়া থাকিবে একান্তে। বাংলাদেশের উপর হইতে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি সরিয়া থাকিবে পাক-ভারত সংঘর্ষের উপর। আর এই ভাবেই চাপা পড়িবে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম। ইয়াহিয়া খান জানে তার ভাড়াটিয়া সেনাবাহিনী যুদ্ধ করিয়া বাংলাদেশ দখলে রাখিতে পাইবে না। তাই সে আজ উপরোক্ত কৌশলের মাধ্যমে বাংলাদেশকে পদানত রাখিতে চায়। আর সে জন্যই চলিতেছে ভারতে বিরুদ্ধে তার চুরান্ত রণসজ্জা।
কিন্তু শান্তিকামী বিবেকবান বিশ্ববাসী কি রণোন্মাদ ইয়াহিয়ার এই মানবতা-বিরোধী রণপাঁয়তারার নীরব দর্শক হইয়া থাকিবে? পাক ভারত যুদ্ধ প্রতিরোধের জন্য, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের মুক্তির জন্য, বাঙ্গালী জাতির স্বাধীনতার নিশ্চিত করার জন্য তাদের কি কিছু করণীয় নাই?
এখনও সময় আছে। বিশ্বের শান্তিকামী বিবেকবান সমস্ত মানুষকে আজ এক যোহে বর্বর ইয়াহিয়ার বিরুদ্ধে রুখিয়া দাঁড়াইতে হইবে। ভারতের উপর আঘাত হানিবার আগেই সজোরে তার রক্তাক্ত হাত চাপিয়া ধরিতে হইবে- প্রচন্ড চাপে বন্ধ করিয়া দিতে হইবে মার্কিন অস্ত্র সরবরাহ। আর শান্তি, প্রগতি, সমাজতন্ত্র স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক চেতনায় বিশ্বাসী মানবসমষ্টিকে আজ সর্বশক্তি লইয়া মুক্তিযুদ্ধে নিয়োজিত বাঙ্গালী জাতির পার্শ্বে আসিয়া দাঁড়াইতে হইবে। কারণ, ইয়াহিয়ার এই সর্বশেষ দুরভিসন্ধির বিজয়ের একমাত্র অর্থ হইবে সুসভ্য মানব জাতির চূড়ান্ত পরাজয়।
.
.
শফিকুল ইসলাম
<৬,১৫৭,২৬৩-২৬৪>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
স্বাধীন বাংলাই একমাত্র সমাধান |
বাংলার বানী মুজিব নগরঃ ৭ম সংখ্যা |
১২ অক্টোবর, ১৯৭১ |
মৃত পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যে নয়
স্বাধীন বাংলাই একমাত্র সমাধান
(রাজনৈতিক ভাষ্যকার)
পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যেও বাংলাদেশের সমস্যার সমাধানের সূত্র মিলিতে পারে বলিয়া ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রী শ্রী শরণ সিং মন্তব্য করিয়াছেন উহা বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে যুগপৎ বিস্ময় ও ক্ষোভের সঞ্চার করিয়াছে।
তাহাদের মতে শ্রী শরণ সিংহ-এর এই বক্তব্য ভারত সরকারের পূর্ববর্তী বক্তব্যের সঙ্গে সংগতিদিবিহীন। এই প্রসঙ্গে তাহারা ভারতের মহান নেত্রী প্রধান্মন্ত্রী শ্রীমতি গান্ধীর কিছুদিন আগেকার মন্তব্যের কথা উল্লেখ করেন। গত মাসে কলিকাতায় শ্রীমতি গান্ধী সাংবাদিকদের কাছে বলিয়াছেন, “আমাকে বারবার স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতি দানের ব্যাপারে প্রশ্ন করা হয়। আমি ভারতে বাংলাদেশ মিশনকে কাজ করিতে দিতেছি। ইহা কি এক অর্থে স্বীকৃতি দেওয়া নয়? শ্রীমতি গান্ধীর এই বক্তব্যের এই কথাই সন্দেহাতীতভাবে স্পষ্ট করিয়া তুলিয়াছিল যে ভারত সরকার পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যে বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিশ্বাস করেন না বরং তারা স্বীকৃতি দিতে বিলম্ব করিলেও স্বাধীন বাংলাদেশেই বিশ্বাস করেন। প্রতিরক্ষা মন্ত্রী শ্রী জগজীবন রাম বলিয়াছেন, স্বাধীন বাংলাদেশই একমাত্র সমাধান। কিন্তু শ্রী শরণ সিং- এর মন্তব্যকে কোন মতেই শ্রীমতি গান্ধী ও শ্রী জগজীবন রামের বক্তব্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বলিয়া মনে করা হয় না। তাই ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মন্তব্য বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে বিস্ময় ও ক্ষোভের সঞ্চার করিয়াছে। এ ব্যাপারে বাংলার জনগণের বক্তব্য সুস্পষ্ট। ভারত মুক্তিযুদ্ধে নিয়োজিত বাঙ্গালী জাতির জন্য যা করিয়াছে, তার কোন তুলনা নাই, এবং এজন্য বাংলার মানুষ চিরদিন ভারতের জনগণের কাছে গভীর কৃতজ্ঞতার ঋণে আবদ্ধ হইয়া থাকিবে। কিন্তু একমাত্র সত্য যে ভাতের কোন মহল যদি মনে করিয়া থাকেন যে পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যেই বাংলাদেশের সমাধান সম্ভবপর, তবে মস্তবড় ভুল হইবে। দশ লক্ষ বাঙ্গালীর লাশের উপর দিয়া হাঁটিয়া হাঁটিয়া আবার পাকিস্তানের কাঠামো নামক উপনিবেশবাদী শাসনের নারকীয় গর্তের মধ্যে প্রবেশের কোন প্রশ্নই ওঠে না। বাংলার মানুষ চায় পূর্ণ স্বাধীনতা।
এদিকে শ্রী শরণ সিং-এর মন্তব্য প্রসঙ্গে সরাসরি কোন মন্তব্য পেশে বিরত থাকিলেও বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ হইতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নররুল ইসলাম পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যে জঙ্গীশাহীর সঙ্গে যে কোন প্রকার আপোষের সম্ভাবনার উপর চুড়ান্ত যবনিকা টানিয়া দিয়া পুনরায় দ্যার্থহীন কন্ঠে ঘোষনা করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের মুক্তি এবং বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতার স্বীকৃতিসহ চারি দফা পূর্বশর্ত পূরণের আগে কোন আপোষের প্রশ্নই ওঠে না। আমরা স্বাধীনতার জন্য জীবনপণ যুদ্ধে অবতীর্ণ হইয়াছি। পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জিত হইবার আগে আমরা ক্ষান্ত হইব না।
বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র ও পূর্ণবাসন মন্ত্রী জনাব কামরুজ্জামান ঘোষনা করিয়াছেন পাকিস্তান আজ মৃত।
যাহারা পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যে বাংলাদেশের সমস্যার সমাধানের কথা চিন্তা করিতেছে তাহারা প্রকারান্তরে উপনিবেশবাদ এবং শোষনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জাগ্রত জনগণের স্বার্থকেই ক্ষুন্ন করিতেছেন। এই অঞ্চলে যদি স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠীত হয় তবে অবশ্যই বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে স্বীকার করিয়া লইতে হইবে।
আমরা মনে করি স্বাধীনতার কোন বিকল্প ব্যবস্থা থাকিতে পারে না এবং যে কোন মূল্যেই তাহা আমরা অর্জন করিব।
শফিকুল ইসলাম
<৬,১৫৮,২৬৫-২৬৭>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমেই রাজনৈতিক সমাধান হতে পারে |
বাংলার বানী মুজিব নগরঃ ৭ম সংখ্যা |
১২ অক্টোবর, ১৯৭১ |
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমেই রাজনৈতিক সমাধান হতে পারে
বন্ডনে শ্রমিকদলের সম্মেলনে শেখ মুজিবরের মুক্তি দাবী
জল্লাদী বর্বরতার বিরুদ্ধে বিশ্ব বিবেকের সুতীব্র ধিক্কার
(বৈদেশিক বার্তা পরিবেশক)
বৃটেনের শ্রমিক দলীয় জাতীয় কর্ম পরিষদ বাংলাদেশের জনগণের অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করিয়াছে এবং জাতিসংঘকে এই ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করিবার জন্য আহ্বান জানাইয়াছে। বাংলাদেশের নিরস্ত্র জনসাধারণের উপর সামরিক হামলা চালাইবার জন্য পাকিস্তানকে নিন্দা করিবার জন্য শ্রমিক দল আহ্বান জানাইয়াছে।
জাতীয় কর্মপরিষদের নামে প্রচারিত বিবৃতিতে বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছা এবং গ্রহনযোগ্য রাজনৈতিক সমাধানের জন্য জাতিসংঘকে সরাসরি হস্তক্ষেপ করিবার অনুরোধ করা হইয়াছে।
বিবৃতিতে আরও বলা হইয়াছে যে এই রাজনৈতিক সমাধান আসিতে পারে বাংলাদেশের নেতা শেখ মুজিবর রহমানের মুক্তি ও তাঁহার সহিত আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে।
ইংল্যান্ডের ব্রাইটনে অনুষ্ঠিত শ্রমিক দলের বার্ষিক সম্মেলন পাকিস্তানী জঙ্গীশাহীর বিরুদ্ধে তীব্র ধিক্কারে সোচ্চার হইয়া উঠিয়াছে। সম্মেলনের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশের মানুষের মর্মান্তিক বিপর্যয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করিয়াছেন।
এই সম্মেলনে শ্রমিক দলের প্রাক্তন মন্ত্রী মিসেস জুডিথ হার্ট দলের জাতীয় কার্যনির্বাহক কমিটির পক্ষ হইতে যে বিবৃতি পেশ করিয়াছেন তাহাতে বাংলাদেশের জনসাধারণের দ্বারা গণতন্ত্রসম্মত ভাবে নির্বাচিত নেতাদের বিরুদ্ধে সামরিক শক্তি ব্যবহারের তীব্র নিন্দা করা হইয়াছে।
এই বিবৃতিতে বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত বিশ্বের সকল সাহায্যকারী রাষ্ট্রকে মানবিক জরুরী সাহায্য দান ছাড়া অন্য সকল প্রকার সাহায্য পাঠানো বন্ধ করিতে আহ্বান জানানো হইয়াছে।
বিবৃতিতে বাংলাদেশে অবিলম্বে পাক-সামরিক উৎপীড়নের অবসান এবং রাজনৈতিক নেতাদের বিশেষ করিয়া শেখ মুজিবের মুক্তির দাবী জানানো হইয়াছে।
বিবৃতিটি পেশ কালে মিসেস হার্ট বলিয়াছেন যে বাংলাদেশের এই ঘটনায় সারা এশিয়া মহাদেশে ভয়ঙ্কর বিপদের সূচনা করিয়াছে।
এই সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন প্রাক্তন মন্ত্রী মিঃ পিটার শোর। লন্ডনের বাংলাদেশ মিশনের প্রধান বিচারপতি জনাব আবু সাঈদ চৌধুরী সম্মেলনে বক্তৃতা করেন। সম্মেলনে মিঃ জন স্টোনহাউজ, মিঃ ব্রিস ডগলাসম্যান সহ অনেকে উপস্থিত ছিলেন।
জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক স্বাস্থ বিভাগের চেয়ারম্যান ডঃ কার্ল টেলর বলিয়াছেন মার্কিন সরকার পাকিস্তানকে অব্যাহত ভাবে অস্ত্রশস্ত্র দান করিয়া বাংলাদেশ সঙ্কটকে ঘোলাটে করিয়া তুলিয়াছে।
ওয়াশিংটন সিনেটের বৈদেশিক সাবকমিটির বৈঠকে ডঃ টেলর বলিয়াছেন ‘পাকিস্তানে অস্ত্র বোঝাই জাহাজ পাঠানোর উপর নিষেধাজ্ঞা জারী হইবার পর তুরস্কের মাধ্যমে পাকিস্তানে মার্কিন অস্ত্র সাহায্য অব্যাহত রাখিয়া মার্কিন সরকার একটি খুবই গর্হিত অপরাধ করিতেছে।
ডঃ টেলর আশঙ্কা প্রকাশ করিয়াছেন আগামী মাসে বাংলাদেশের প্রায় আড়াই কোটি মানুষ অনাহারের কবলে পড়িবেন। এবং নতুন করিয়া শরণার্থী স্রোত আসিতে থাকিবে। তিনি বলেন শেষ পর্যন্ত শরণার্থীর সংখ্যা হয়তো দেড় কোটিতে পৌঁছাইবে। এই সংখ্যা দক্ষিন ভিয়েত্নামের মোট জনসংখ্যার প্রায় সমান।
গত বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রসংঘে সাধারণ পরিষদের নেপালের স্থায়ী প্রতিনিধি মিঃ পদ্মবাহাদুর ক্ষেত্রী বলিয়াছেন যে নেপাল সরকার ও নেপালের অধিবাসীরা বাংলাদেশের বেদনায়ক ঘটনায় মর্মাহত হইয়াছেন। তিনি এই মর্মান্তিক ঘটনাকে তুলনাহীন বলিয়া আখ্যায়িত করিয়াছেন।
আন্তর্জাতিক ছাত্র ইউনিয়ন বাংলাদেশের ব্যাপারে গণহত্যা ও অবাধ নিপীড়নের তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করিয়াছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সমর্থন ও সৌভ্রাতৃত্ব জ্ঞাপন করিয়া আন্তর্জাতিক ছাত্র ইউনিয়ন ঘোষনা করিয়াছেন যে ‘বাংলাদেশের মানুষের এই সংগ্রাম শান্তি, প্রগতি ও গণতন্ত্রের জন্য বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদী বিরোধী সংগ্রামের অংশ’।
বোম্বাইয়ের রান্দ্রা সেন্ট জোসেফ কনভেন্টের ছাত্রী এবং ক্রিশ্চিয়ান স্টুডেন্টস গ্রুপের সভানেত্রী কুমারী নোয়ালো গত বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের বলেন আগামী ৪ঠা নভেম্বর রান্দ্রা হইতে প্রায় ২ হাজার স্কুল ছাত্রী বাংলাদেশের সমর্থনে এক পদযাত্রা শুরু করিয়া দক্ষিন বোম্বাইয়ের কুপারেজ পর্যন্ত যাইবে।
গত ৫ই অক্টোবর ব্রাইটনের এক সমাবেশে বাংলাদেশের ব্যাপারে উদাসীন থাকায় জাতিসংঘ এবং বিশ্ব সমাজকে ধিক্কার দেওয়া হয়।
গ্রেটবৃটেনের শ্রমিক দলের সম্মেলন উপলক্ষে এ্যাকশন বাংলাদেশ কর্তৃত্ব আয়োজিত এই সমাবেশে যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্ট সদস্য মিঃ ষ্টোন হাউজ বলেন উহা ভাবিতে আশ্চর্য লাগে যে জাতিসংঘ এই বৃহত্তম মানবিক দুর্যোগের প্রতি দৃষ্টি দিতে ব্যর্থ হইয়াছে। লর্ড ব্রকওয়ে, বৃটেনস্থ বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, যুক্তরাজ্য পার্লামেন্টের সদস্য ব্রস ডগ্রাস এবং জুলিয়াস সিলভারম্যান এই সমাবেশে বক্তৃতা দান করেন। সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন বৃটিশ পার্লামেন্টের প্রভাবশালী সদস্য মিঃ পিটার শোর। বিপুল করতালির মধ্যে শ্রমিক দলীয় নেতা মিঃ ফ্রেড ইভান্স ঘোষনা করেন বাংলাদেশকে তাহার স্বাধীনতা সংগ্রামে অস্ত্র এবং অন্যান্য জিনিস দিয়া সাহায্য করা উচিৎ।
তাঞ্জানিয়া এবং জাম্বিয়ার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তাহার সাম্প্রতিক সাক্ষাতের কথা উল্লেখ করিয়া জন ষ্টোন হাউজ বলেন, এই দুই দেশের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশের ব্যাপারে সহানুভূতিশীল। তাহারা জন ষ্টোন হাউজকে বলিয়াছেন যে কোন একটি দেশ বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দান করিতে আগাইয়া আসিলেই তাহারাও বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিবেন। প্রেসিডেন্ট কাউন্ডা বাংলাদেশে নির্যাতন বন্ধ করিবার জন্য ইয়াহিয়া খানের নিকট বেশ কয়েকটি চিঠি লিখিয়াছেন।
জন ষ্টোন হাউজ জাতিসংঘকে ক্লান্ত, জরাজীর্ণ এবং বৃহৎ শক্তিবর্গের প্রমোদশালা বলিয়া অভিহিত করেন। তিনি অভিযোগ করেন বৃহৎ শক্তিবর্গের স্বার্থ যেখানে নাই এমন কোন বিষয় জাতিসংঘে উত্থাপিত হয় না।
.
.
শফিকুল ইসলাম
<৬,১৫৯,২৬৭-২৬৮>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
নিশ্চিত পরাজয়ের সম্মুখীন জঙ্গীশাহীর ব্যররথতা চাপ দেওয়ার নয়া কৌশল |
বাংলার বানী মুজিব নগরঃ ১০ম সংখ্যা |
২ নভেম্বর, ১৯৭১ |
নিশ্চিত পরাজয়ের সম্মুখীন
জঙ্গীশাহীর ব্যর্থতা চাপা দেওয়ার নয়া কৌশল
(রাজনৈতিক ভাষ্যকার)
ইসলামাবাদের হানাদার জঙ্গীশাহী বাংলাদেশের দখলকৃত এলাকা লইয়াই শুধু ফ্যাসাদে পড়ে নাই-ইসলামাবাদ সাম্রাজ্য লইয়াও মহা ফ্যাসাদে পড়িয়াছে বলিয়া নির্ভরযোগ্যসূত্রে খবর পাওয়া গিয়াছে। জঙ্গীচক্র ইসলামাবাদ সাম্রাজ্যের বিক্ষুব্ধ বেলুচিস্তান এবং মুক্তিকামী পাখতুন্দের এখন আর বিশ্বাস করিতেছে না। কিংকর্তব্যবিমূঢ় জল্লাদশাহী এখন “আন্ধার ঘরে সবই সাপ” দেখিতে শুরু করিয়াছে।
বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত খান সেনাদের পরিবার পরিজন এবং আত্মীয় স্বজনগণও এখন জঙ্গীশাহীর উপর তীব্র ক্ষুদ্ধ হইয়া উঠিয়াছে বলিয়া জানা গিয়াছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ হইতে যে এক ডিভিশন সৈন্য প্রত্যাহার করিয়া ইসলামাবাদ সাম্রাজ্যে লইয়া যাওয়া হইয়াছে ইহাদের অধিকাংশই পশ্চিম-পাঞ্জাবী এবং অবশিষ্টদের মধ্যে কিছু সিন্ধি সৈন্য রহিয়াছে। কিন্তু বালুচ এবং পাঠান সৈন্য নাই। ভারতের সহিত সম্ভাব্য যুদ্ধের সুযোগ বিক্ষুদ্ধ বালুচ-পাঠানগন বিদ্রোহ ঘোষনা করিতে পারেন এই ভয়েই ইহাদিগকে বদলী করিয়া ইসলামাবাদ সাম্রাজ্যে নেওয়া হয় নাই। উক্ত এক ডিভিশন সৈন্যের মধ্যে পাঠান বালুচ সৈন্য না থাকায় পাঠান ও বালুচ মুল্লুকে জঙ্গীচক্রের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ধূমায়িত হইয়া উঠিয়াছে।
বাংলাদেশে যাহারা মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে খতম হইতেছে ইসলামাবাদ সাম্রাজ্য নিবাসী তাহাদের আত্মীয়-স্বজনদের নিকট উহাদের মৃত্যুর খবর সম্পূর্ণ গোপন করিয়া রাখা হইতেছে। বাংলাদেশে ইহাদের অবস্থা সম্পর্কে যাহাতে তাহাদের আত্মীয়স্বজন কিছু জানিতে না পারে তজ্জন্য বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকা হইতে হানাদার সৈন্যগণকে অবাধে চিঠিপত্র লিখিতেও অনুমতি দেওয়া হয়না। চিঠিপত্র কড়া সেন্সর করার পর ইসলামাবাদ সাম্রাজ্যে প্রেরণ করা হইয়া থাকে।
প্রসঙ্গক্রমে উলেখযোগ্য যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভে হানাদার নিহত সৈনিকদের লাশ ইসলামাবাদ সাম্রাজ্যে তাহাদের নিকট প্রেরণ করা হইত। তাহাতে বিক্ষুব্ধ হইয়া লাহোর রাওয়ালপিণ্ডির রাজপথে জঙ্গীচক্রের বিরুদ্ধে পুত্রহারা, স্বামীহারা, ভ্রাতৃহারা আর পিতৃহীন নর-নারীর সরোষ বিক্ষোভ মিছিলের পর হইতে জঙ্গীশাহী বাংলাদেশ হইতে ইসলামাবাদ সাম্রাজ্যে আর সৈনিকদের লাশ প্ররণ করে না। বাংলাদেশের নদীতে ভাসাইয়া দেয় কিংবা মাটিতে গাঁথিয়া রাখে। অবশ্য ইসলামাবাদ সাম্রাজ্যে নিহত সৈনিকদের লাশ প্ররণ না করার আরও একটি কারণ আছে। তাহা হইতেছে-জঙ্গীশাহী এত লাশ আর বিমানে পাঠাইয়া কুলাইতে পারে না।
বাংলাদেশে নিহত সৈনিকদের মৃত্যু সংবাদ তাহাদের আত্মীয়-স্বজনদের নিকট গোপন রাখার উদ্দেশ্যে ইদানীং জঙ্গীচক্র নিহত সৈনিকদের আত্মীয়-স্বজনদের সহিত এক নিদারুন প্রতারণা করিয়া চলিয়াছে।
জানা যায় জঙ্গীচক্র বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকা হইতে নিহত সৈনিকদের নামে তাহাদের আত্মীয়-স্বজনদের নিকট চিঠিপত্র লিখাইয়া থাকে। শুধু তাহাই নহে, নিহত সৈনিকদের আত্মীয়-স্বজনের ঠিকানায় নিয়মিত কিছু টাকাও প্রেরণ করা হইয়া থাকে।
টাকা এবং চিঠি প্রেরণের মাধ্যমে জঙ্গীচক্র নিহত সৈনিকদের আত্মীয়-স্বজনকে বুঝাইতে প্রয়াস পাইতেছে যে, তাহারা বাঁচিয়া আছে।
নিহত সৈনিকদের বেনামীতে লিখিত এসব পত্রে লেখা হয় যে, তাহারা (সৈনিকরা) ভাল আছে এবং ‘হিন্দুস্তানের দুশমনদের’ সহিত রীতিমত লড়াই করিয়া ‘আল্লাহর ধর্মকে বাঁচাইতেছে’।
অপরদিকে ইসলামাবাদের হতাশাগ্রস্থ জঙ্গীচক্র বাংলাদেশের হানাদার সৈন্যদের প্রানহানীর আসল সংবাদ ইসলামাবাদ সাম্রাজ্যে চাপা দেওয়ার উদ্দেশ্যে এখন দিন রাত জোর প্রচার করিতেছে যে, ইসলামাবাদের সৈনিকেরা বাংলাদেশের অমুক স্থানে অমুক দিন একজন ভারতীয় ‘অনুপ্রবেশকারী’কে হত্যা কিংবা গ্রেফতার করিয়াছে।
এইসব কাল্পনিক খবর প্রচার করিয়া জঙ্গীচক্র ইসলামাবাদ সাম্রাজ্যের জনসাধারণের মনোবলকে জোরদার এবং বাংলাদেশে নিহত সৈনিকদের আত্মীয়স্বজনকে প্রতারণা প্রয়াস পাইতেছে। তদুপরি ভারতের সহিত যুদ্ধের জিগির তুলিয়া বাংলাদেশে নিহত সৈনিকদের আত্মীয়-স্বজন তথা ইসলামাবাদ সাম্রাজ্যের স্বজনহারা জনসাধারণের মনকে চাঙ্গা করার চেষ্টা চালাইতেছে। প্রচারের গোলক ধাঁ ধাঁ ধুম্রজাল সৃষ্টি করিয়া জঙ্গীচক্র বাংলাদেশে খান সেনাদের কচুকাটা হইয়া যাওয়ার খবরটি চাপা দিয়া চলিতেছে।
ওয়াকেবহাল মহলের মতে ভারতের সহিত যুদ্ধ বাধাঁইবার ফন্দিফিকিরের অন্তরালেও ইসলামাবাদের অসহায় জঙ্গীচক্রের বাংলাদেশে নিহত সৈনিকদের ব্যাপারাটি চাপা দেওয়ার এক সুক্ষ্ম অপচেষ্টা নিহিত রহিয়াছে। বাংলাদেশে সুনিশ্চিত পরাজয়ের মুখে বৈদেশিক সাহায্য ঋণ ব্যবসা বানিজ্য বন্ধের মাধ্যমে ইসলামাবাদ সাম্রাজ্যের কায়েমী স্বার্থ ২৩ পরিবারের তথা গোটা ইসলামাবাদ সাম্রাজ্যের অর্থনীতিতে ঠুটো জগন্নাথ দাড়ঁ করানোর এবং বহু বৎসরের অধ্যবসায় ও মোটা অর্থ ব্যয়ে সুশিক্ষিতি সৈনিকদের ক্ষয়ের কোন কৈফিয়তক্ষমতা উন্মাদ জঙ্গীচক্র ইসলামাবাদ সাম্রাজ্যের জনসাধারণের নিকট দিতে পারিবে না। তাই তাহারা যেনতেন প্রকারে ভারতের সহিত একটি যুদ্ধ বাধাইয়া এক ঢিলে দুই পাখী মারিবার ফন্দী আঁটিয়াছে। একটি হইতেছে তথাকথিত পাক ভারত বিরোধের ডামাডোলের মধ্যে বাংলাদেশ ইসলামাবাদ বিরোধকে চাপা দেওয়া এবং অপরটি হইতেছে ইসলামাবাদ সাম্রাজ্যের জনসাধারণকে বুঝানো যে, ভারতের সহিত যুদ্ধ করিতে গিয়া অর্থাৎ ‘পাকিস্তান জিন্দা’ রাখিতে গিয়া সৈন্য ক্ষয় হইয়াছে এবং অর্থনীতি পঙ্গু হইয়া পড়িয়াছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জঙ্গীচক্রের কোন ভাঁওতাবাজীই চলিবে না। ইসলামাবাদ সাম্রাজ্যের জনসাধারণ গভীর আগ্রহ সহকারে জঙ্গীচক্রের সকল কারসাজী নীরবে পর্যবেক্ষন করিয়া চলিয়াছে। যেদিন আকাশ ভাঙ্গিয়া তাহাদের মাথায় পতিত হইবে সেইদিন ইসলামাবাদ সাম্রাজ্যেও এক চরম হানাহাহি শুরু হইতে বাধ্য এবং তাহা ইরাকে নূরী আস সাইদের ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হইলেও কেহ বিস্মিত হইবে না।
.
.
শফিকুল ইসলাম
<৬,১৬০,২৬৯-২৭০>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
সম্পাদকীয় সাম্রাজ্যবাদী খেলা |
বাংলার বানী মুজিব নগরঃ ১১শ সংখ্যা |
৯ নভেম্বর, ১৯৭১ |
সম্পাদকীয়
সাম্রাজ্যবাদী খেলা
মানবতা ও মানবসভ্যতার চরমতম দুশ্মন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের গদীনশীন কর্ণধার প্রেসিডেন্ট নিক্সন খেলাটা ভালই জমাইয়া তুলিয়াছেন। দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ায় ভারত-পাক উপমহাদেশে নিক্সন যে সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের খেলায় মাতিয়া উঠিয়াছে, উহা আগুন লইয়া খেলার সামিল। আর বলা বাহুল্য, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বাঞ্চালের উদ্দেশ্যে পাক-ভারত বিরোধ সৃষ্টির অনভিপ্রেত প্রচ্ছন্ন কারসাজি চালাইয়া, মানব ইতিহাসের ঘৃণ্যতম জল্লাদ ইয়াহিয়ার হাতে অঢেল মারনাস্ত্র তুলিয়াছেন। অথচ কি আশ্চর্য! সেই নিক্সনের মুখেই আজ সংযমের ললিত বাণী, শান্তির বাণী- সীমান্ত হইতে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের উদ্দেশ্যমূলক প্রস্তাব। জগতের সব কিছুরই সীমা আছে। সীমা নাই সম্ভবতঃ সাম্রাজ্যবাদী দস্যুদের হঠকারিতায়।
প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সাম্রাজ্যবাদী তস্করসুলভ চরিত্রের বীভৎস চেহারাটি আরেকবার নগ্নভাবে আত্মপ্রকাশ করিয়াছে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর আমেরিকা সফরকালে। শ্রীমতি গান্ধীর সঙ্গে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের বিস্তর আলাপ আলোচনা হইয়াছে। নিক্সনের মুখ দিয়া অনেক ভারী ভারী কথাও বাহির হইয়াছে। শুধু একটিবারের জন্য কোনও মন্তব্য তিনি করেন নাই বাংলাদেশ প্রশ্নে। প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি প্রেসিডেন্ট নিক্সনের দৃষ্টি আকর্ষন করিয়াছেন। ইহার গুরুত্ব সম্পর্কে, পাক-ভারত উপমহাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত হিসাবে বাংলাদেশ ইস্যুকে সুরাহার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে নিক্সনকে সচেতন করিতে চেষ্টা করিয়াছেন। কিন্তু নিক্সন ইস্যুকে পাত্তা না দিয়া, এ সম্পর্কে কোন উচ্চবাচ্যও না করিয়া বারবার বলিয়াছেন, তিনি চান যাতে পাকিস্তান ও ভারতে মধ্যে কোন সশস্ত্র সংঘর্ষ না বাধে। এই লক্ষ্য হাসিলের উদ্দেশ্যে নিক্সন ভারন পাকিস্তান সীমান্ত হইতে ভারতী সৈন্য প্রত্যাহারের সুপারিশ করিয়াছেন। সুতরাং বুঝিতে কষ্ট হইবার কথা নয়, নিক্সনের চোখে যা পড়িয়াছে উহা হইতেছে পাক-ভারত যুদ্ধের আশংকা। কারণ, এই যুদ্ধ বাঁধিবার একমাত্র অর্থ হইতেছে তার যেটু নরপিশাচ ইয়াহিয়ার বিনাশ।
আর এই স্বার্থের ঠুলি চোখে লাগানো রহিয়াছে বলিয়াই বাংলাদেশের বীরত্বপূর্ণ মুক্তিযুদ্ধ এবং বাঙালী জাতির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের কারাবাস কোন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হইয়া তাহার চোখে ধরা পড়ে নাই। আর সে কারণেই ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আলোচনায় বা তার পরে নিক্সনের কন্ঠে একটিবারের জন্যও বাংলাদেশ প্রসঙ্গটি উচ্চারিত হয় নাই। এই কারণেই শ্রীমতি ইন্ধিরা গান্ধী যে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ইস্যুর অপরিহার্য সমাধানের গুরুত্ব সম্পর্কে মার্কিন প্রেসিডেন্টকে সম্যক অবহিত করিতে চাহিয়াছেন, নিক্সন তখন দক্ষিন ও দক্ষিনপূর্ব এশিয়ার শান্তি প্রতিষ্ঠার ফাঁকা বুলির আবরণে নিজের সাম্রাজ্যবাদী দুরভিসন্ধি চাপা দিতে চাহিয়াছেন।
আসলে নিক্সনের এই শয়তানী চেহারাটা নতুন কিছু নয়। মার্চ মাসে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর হইতে বিশ্বের বিবেকবান মানুষ মাত্রই জল্লাদ ইয়াহিয়ার নারকীয় বর্বরতার বিরুদ্ধে ধিক্কার ও প্রতিবাদ জানাইয়াছেন, পশ্চিম পাকিস্তানী উপনিবেশবাদী জঙ্গীশাহীকে সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য প্রদান বন্ধ করিয়া দেওয়ার দাবী জানাইয়াছেন।
এখন কি খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শান্তি স্বাধীনতা ও মানবিক মূল্যবোধ বিশ্বাসী নেতা ও জনতাও জল্লাদী বর্বরতার প্রতিবাদে বিশ্ববিবেকের কন্ঠে কন্ঠ মিলাইয়াছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপরই মার্কিন কংগরেস পশ্চিম পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করিয়াছে। কিছুদিন আগে মার্কিন সিনেটও অনুরূপ বিল পাশ করিয়াছে। উহার পাশাপাশি সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডী, সাবেক রাষ্ট্রদূত চেস্টার বোলস, অধ্যাপক গলব্রেথ প্রমুখ বিশিষ্ট মার্কিন নাগরিকের নেতৃত্বে মার্কিন জনমত ইয়াহিয়ার জঙ্গী বর্বরতার বিরুদ্ধে অধিকতর সুসংহত হইয়া উঠিয়াছে। কিন্তু বাংলাদেশ প্রশ্নে ইচ্ছা- অন্ধ নিক্সনের জল্লাদ প্রীতির কোন হেরফের হয় নাই। বাংলাদেশ প্রশ্ন সমগ্র বিশ্ববাসীর সামনে একটি জলন্ত মানবিক ও রাজনৈতিক ইস্যু হিসাবে দেখা দিলেও এই সাত মাসের মধ্যে একটিবারের জন্যও নিক্সনের কন্ঠে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে কোন মন্তব্য উচ্চারিত হয় নাই। বরং বিশ্ব জনমতকে উপেক্ষা করিয়া, নিজ দেশবাসীর মতামতকে পদদলিত করিয়া কংগ্রেস ও সিনেটের সুস্পষ্ট নির্দেশকে অমান্য করিয়া ভিয়েতনামে মার্কিন নরখাদক নিক্সন, বাংলাদেশের মাটিতে পশ্চিম পাকিস্তানী জল্লাদ ইয়াহিয়ার হাতে অঢেল অস্ত্র তুলিয়া দিয়া চলিয়াছেন। আর বলা বাহুল্য সেই অস্ত্রের জোরেই সে ভারতের বিরুদ্ধে উন্মাদসুলভ রণহুঙ্কার ছাড়িতেছে। আর প্রেসিডেন্ট নিক্সন এলাকা হইতে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের প্রস্তাব দিয়া ইয়াহিয়া খানের মতই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে পাক-ভারত বিরোধের খোলস পরাইয়া উহা নস্যাৎ করিয়া দেওয়ার জঘন্য দুরভিসন্ধি চালাইতেছে।
আজ তাই সময় আসিয়াছে। আব্রাহাম লিংকনের আমেরিকার যদি মৃত্যু না হইয়া থাকে, মার্কিন জাতিকে আরও বলিষ্ঠ পদক্ষেপে নিক্সন ষড়যন্ত্রের মোকাবেলায় আগাইয়া আসিতে হইবে, আগাইয়া আসিতে হইবে শান্তি স্বাধীনতা, গণতান্ত্রিক চেতনা, মানবিক মূল্যবোধ এবং সমাজতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী সমগ্র বিশ্ববিবেক। বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্নকে নির্মূল করিয়া দেওয়ার জন্য নিক্সন যে সাম্রাজ্যবাদী খেলায় লিপ্ত হইয়াছে, উহা ব্যর্থ করিয়া দেওয়ার জন্য সমগ্র পৃথিবীর মানুষকে একযোগে আগাইয়া আসিতে হইবে। কারণ, সাম্রাজ্যবাদী আর জল্লাদী ষড়যন্ত্রের চালে বাঙ্গালী জাতির মুক্তিযুদ্ধের পরাজয়ের অর্থ হইবে সমগ্র মানব জাতিরই চূরান্ত পরাজয়।
.
.
শাহজালাল
<৬,১৬১,২৭১-২৭২>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধঃ প্রতিক্রিয়া | বাংলার বাণী মুজিবনগরঃ ১১শ সংখ্যা | ৯ নভেম্বর, ১৯৭১ |
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধঃ প্রতিক্রিয়া
যতই দিন যাইতেছে ইসলামাবাদের জঙ্গীশাহীর বিরুদ্ধে বিশ্ববিবেক ক্রমে ততই সোচ্চার হইয়া উঠিয়াছে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে ইয়াহিয়ার লেলাইয়া দেওয়া পশুদের দিশাহারা হইয়া পড়ার খবর আর গোপন নাই। অর্থনৈতিক অবস্থা অচল হইয়া পড়িয়াছে। বাংলাদেশের সকল বন্দর অকেজো। পশ্চিম পাকিস্তানের চরম বেকার সমস্যা, ছাঁটাই বরখাস্ত ও দেদার লক আউটের খবর শুধু পশ্চিম পাকিস্তানের লৌহ যবনিকার অন্তরালেই আবদ্ধ নাই। বিভিন্ন দেশের দায়িত্বশীল পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হইতেছে মানব সভ্যতার ঘৃণ্যতম শত্রু খুনী ইয়াহিয়ার সকল চক্রান্তের খবর। আমরা এমনি কিছু পত্রপত্রিকার উদ্ধৃতি এখানে বাংলার বাণীর পাঠক পাঠিকাদের সামনে তুলিয়া ধরিতেছি।
ডেইলী টেলিগ্রাফ
বৃটিশ জাহাজ কোম্পানীর জনৈক মুখপাত্র বলিয়াছেন প্রায় তিন মাস যাবত আমরা বাংলাদেশের কোন নৌবন্দরে জাহাজ পাঠাই নাই। গত অক্টোবরে প্রথম সপ্তাহে ডেইলী টেলিগ্রাফের সংবাদদাতার নিকট উক্ত মুখপাত্র এই তথ্য প্রকাশ করেন।
এই জাহাজ কোম্পানী পৃথিবীর প্রায় সকল দেশে মালপত্র পরিবহন করে। বাংলাদেশ হইতে অধিকাংশ পাট এবং পাটজাত দ্রব্য এই জাহাজ কোম্পানীর মারফতই রপ্তানী করা হইত।
মুখপাত্রটি বলেন, আমাদের এই সিদ্ধান্তের ফলে বাংলাদেশের অধিকৃত অঞ্চল তথা ইসলামাবাদের জঙ্গী সরকারের অর্থনীতির উপর ভীষণ চাপ পড়িবে।
আশাহি সিম্বুন
জাপান হইতে প্রকাশিত “আশাহি সিম্বুন” পত্রিকা এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলিয়াছে ভারত উপমহাদেশে উত্তেজনা হ্রাসের প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই অনতিবিলম্বে পাকিস্তানকে সকল সামরিক সাহায্যদান বন্ধ করিতে হইবে।
ইহার কারণ ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে উক্ত পত্রিকা বলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া সামরিক সাহায্য পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক জান্তাদেরই শক্তিশালী করিয়া তুলিতেছে এবং তাহা বাংলাদেশে তাহাদের বর্বর কার্যক্রম চালাইয়া যাওয়ার সহায়তা করিতেছে। ইহার ফলে প্রতিদিন চল্লিশ হাজার শরণার্থী বাংলাদেশ হইতে পালাইয়া ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করিতে বাধ্য হইতেছে।
সম্পাদকীয় প্রবন্ধে এই অভিমত ব্যক্ত করা হয় যে বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানী জঙ্গীচক্রের সামরিক কার্যক্রম সমর্থনে যে সকল সামরিক সাহায্য বিদেশে হইতে প্রদান করা হইতেছে অনতিবিলম্বে তাহা বন্ধ করা উচিত।
ইয়োমিউরি
জাপানের আর একটি পত্রিকা “ইয়োমিউরি” তাহার ২৪ শে অক্টোবরের সম্পাদকীয় নিবন্ধে এই বলিয়া অভিযোগ করিয়াছে যে তিনটি বৃহৎ শক্তি বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধ করিতে ব্যর্থ হওয়ায় আজ ভারত উপমহাদেশে বিপজ্জনক পরিস্থিতির উদ্ভব হইয়াছে।
পত্রিকাটি বলে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক অধিনায়কের অনুধাবন করা উচিৎ ছিল যে শক্তির জোরে বাঙ্গালীদের দমন করিবার চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হইয়াছে। কিন্তু তাহা না করিয়া তাহারা “ভারতের সহযোগিতায় বিদ্রোহীরা তৎপরতা চালাইতেছে”- এই অজুহাতে সীমান্ত বরাবর সৈন্য সমাবেশ করিয়াছেন।
গার্ডিয়ান
গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের নতুন ইউনিটসমূহ গত অক্টোবর মাসে ঢাকা বিমান বন্দরে আক্রমণ পরিচালনা করিবার প্রচেষ্টা চালায়। ঢাকার শহরতলীতে অবস্থিত বন্দরে তাহারা বহু গ্যাস পাইপ উড়াইয়া দেন এবং রপ্তানীর জন্য প্রস্তুত বহু পরিমাণ পাট জ্বালাইয়া দেন।
মুক্তিযোদ্ধা কর্তৃক বিমান বন্দর আক্রমণের প্রচেষ্টা সামরিক বাহিনীর লোকদের উদ্বিগ্ন করিয়া তুলিয়াছে। বস্তুতঃ গেরিলাদের ছুড়িয়া দেওয়া তিন ইঞ্চি বোমা কলেরা ল্যাবরেটরীতে পড়ে। বিমান বন্দরের সঙ্গে ল্যাবরেটরীর সরাসরি যোগাযোগ রহিয়াছে এবং উক্ত বোমাটি বিমানবন্দর হইতে ছয়শত ফুট দূরে নিক্ষিপ্ত হয়।
লন্ডন হইতে প্রকাশিত গার্ডিয়ান পত্রিকায় উপরোক্ত রিপোর্ট ছাপা হইয়াছে। রিপোর্টে আরো বলা হয় পশ্চিম পাকিস্তানে বেকার সমস্যা প্রকট হইয়া উঠিয়াছে। ট্রেড ইউনিয়ন সূত্রে জানা যায় পশ্চিম পাকিস্তানের সর্ববৃহৎ শিল্প এলাকা করাচীতে যেখানে চারি লক্ষ শ্রমিক কাজ রিত বর্তমানে শতকরা পয়ত্রিশ জন শ্রমিককে ছাঁটাই করা হইয়াছে।
শ্রমিক নেতৃবৃন্দের মতে করাচী এবং হায়দ্রাবাদে পঁচাত্তরটি সরকারী ও বেসরকারী শিল্প সংস্থা প্রায় দশ হাজার শ্রমিককে চাকুরী হইতে বরখাস্ত করিয়াছে।
.
শাহজালাল
<৬,১৬২,২৭৩>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
বঙ্গবন্ধুর মুক্তি চাইঃ পশ্চিম পাকিস্তানের ৪২ জন নাগরিকের যুক্ত বিবৃতি |
বাংলার বাণী মুজিবনগর সংখ্যাঃ ১১শ সংখ্যা |
৯ নভেম্বর, ১৯৭১ |
বঙ্গবন্ধুর মুক্তি চাই
পশ্চিম পাকিস্তানের ৪২ জন বিশিষ্ট নাগরিকের যুক্ত বিবৃতি –
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অবিলম্বে মুক্তি দেওয়ার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের ৪২ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি জেনারেল ইয়াহিয়ার কাছে আবেদন জানাইয়াছেন। তাহারা গত ডিসেম্বর পাকিস্তানে প্রথম সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের লইয়া একটি গণতান্ত্রিক সরকার গঠনের অনুরোধ করিয়াছেন।
যাহারা ঐ আবেদনে স্বাক্ষর দান করিয়াছেন, তাহাদের মধ্যে রহিয়াছেন রাজনৈতিক নেতা, আইনজীবী, সাংবাদিক, ট্রেড ইউনিয়ন নেতা, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক , লেখক, ছাত্রনেতা ও সমাজসেবী।
গত ৪ঠা নভেম্বর লাহোরে ঐ যুক্ত বিবৃতি প্রচার করা হয়। জেনারেল ইয়াহিয়া তিনদিনের সফরে ঐ দিনই রাওয়ালপিণ্ডি হইতে লাহোর গিয়াছিলেন।
বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারীরা বলিয়াছেন, পাকিস্তানের রাজনৈতিক স্থায়িত্ব বিপন্ন হইবার মত সঙ্কট দেখা দিয়াছে। গণতান্ত্রিক সরকার গঠনই এই সঙ্কট দূর করিবার সবচাইতে ভাল উপায়।
তাহারা বলেন যে, শেখ মুজিবকে মুক্তি দেওয়া হইলে তাহা ন্যায় বিচারের প্রাথমিক অনুশাসনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হইবে।
যুক্ত আবেদনে স্বাক্ষরকারীদের তালিকায় উল্লেখযোগ্য নামগুলি হইল- ইশেতেকলাল পার্টির প্রধান এবং পাকিস্তান বিমান বাহিনীর প্রাক্তন এয়ার মার্শাল আসগর খাঁ, লেনিন শান্তি পুরস্কার বিজয়ী কবি ফয়েজ আহমদ, পাকিস্তান ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের সভাপতি মির্জা মোহাম্মদ ইব্রাহিম, পাকিস্তান সোসালিষ্ট পার্টির নেতা চৌধুরী আসলাম এবং দৈনিক পাকিস্তান টাইমস এর প্রাক্তন সম্পাদক মাজহার আলী খান।
স্বাক্ষরকারীদের অধিকাংশই বামপন্থী বলিয়া পরিচিত। লাহোরে পাক প্রেসিডেন্টের কাছে এই ধরণের আবেদন এই প্রথম। লাহোরকে পাকিস্তানের মুজিববিরোধী সবচেয়ে বড় কেন্দ্র বলিয়া মনে করা হয়।
রায়টারের খবরে প্রকাশ, সুইডেনে বিপুল সংখ্যক পরিষদ সদস্য বাংলাদেশ সমস্যা সমাধানে নিজেদের প্রভাব কার্যকরী করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিক্ট আবেদন জানাইয়াছেন। ২৮০ জন সদস্যের স্বাক্ষরযুক্ত এই আবেদন পত্রটি গত ৫ই নভেম্বর সুইডেনস্থ মার্কিন দূতাবাসে অর্পণ করা হয়।
.
.
শাহজালাল
<৬,১৬৩,২৭৪-২৭৫>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
জননী বাংলার পূর্ণ স্বাধীনতার প্রশ্নে কোন আপোষ নাইঃ কনসাল্ভেটিভ কমিটির অভিমত |
বাংলার বাণী মুজিবনগরঃ ১১শ সংখ্যা |
১৪ নভেম্বর ১৯৭১ |
অবিলম্বে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি চাই
জননী বাংলার পূর্ব স্বাধীনতার প্রশ্নে কোন আপোষ নাই
বাংলাদেশ কনসালটেটিভ কমিটির সুস্পষ্ট অভিমত
রাজনৈতিক সংবাদদাতা
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিস্থিতি সম্পর্কে সময়ে সময়ে আলোচনা করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের লইয়া গঠিত কনসালটেটিভ কমিটির দ্বিতীয় সভায় ন্যায়নীতির প্রতি নতি স্বীকার করিয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দানের জন্য পাকিস্তান সরকারের প্রতি পুনরায় আহবান জানান হয়। সভায় ইসলামাবাদের জঙ্গীশাহী কর্তিক সভ্যতার মাথায় পদাঘাত তথা সকল ন্যায়নীতির প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলী প্রদর্শন করিয়া এখনও বঙ্গবন্ধুকে আটক রাখার তীব্র নিন্দা করা হয়।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদের সভাপতিত্বে গত শনিবার মুজিবনগরে অনুষ্ঠিত কনসালটেটিভ কমিটির এই সভায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী খোন্দকার মোশতাক আহমদ, অর্থমন্ত্রী জনাব মনসুর আলী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব এ, এইচ, এম কামরুজ্জামান, আওয়ামী লীগের শ্রী ফণিভূষণ মজুমদার ও জনাব আবদুস সামাদ, ন্যাপের অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, বাংলাদেশ কংগ্রেস পার্টির শ্রী মনোরঞ্জন ধর এবং বাংলাদেশ কম্যুনিষ্ট পার্টির শ্রী মণি সিংহ উপস্থিত ছিলেন । ন্যাপের মওলানা ভাসানী অসুস্থতার দরুণ সভায় উপস্থিত থাকিতে পারেন নাই।
সভায় দ্যার্থহীন ভাষায় পূর্ণ স্বাধীনতার লক্ষ্য অর্জনের ব্যাপারে বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি মানুষের অটুত সংকল্পের কথা পুনরায় ঘোষণা করা হয় এবং স্বাধীনতাবিহীন অন্য যে কোন প্রকার আপোষ ফর্মুলার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা হয়।
সভায় গৃহীত এক প্রস্তাবে ইসলামাবাদের জঙ্গীশাহীর সমর প্রস্তুতি এবং ভারতের উপর নগ্ন হামলা চালাইবার সংকল্পের নিন্দা করিয়া বলা হয় যে বাংলাদেশ সমস্যা হইতে বিশ্বের দৃষ্টি অন্যদিক ফিরাইয়া নেওয়ার জন্যই জঙ্গীশাহী পাক ভারত বিরোধের ধুম্রজাল সৃষ্টির চেষ্টা করিতেছে। প্রস্তাবে আরো বলা হয় যে, বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড আক্রমণ এবং সাফল্যের বিশেষ করিয়া সকল স্তরের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি জঙ্গীশাহীর এই দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণ করিয়া এবং ঐক্যবদ্ধভাবে হানাদারদের উপরে চূড়ান্ত আঘাত হানিয়া এই জঘন্য চক্রান্ত প্রতিহত করার আহবান জানান হয়। সভায় গৃহীত অপর এক প্রস্তাবে বলা হয়, ইয়াহিয়া খান তথাকথিত বেসামরিক শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনের নামে অবৈধ নির্বাচনের মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে প্রতারিত করার প্রয়াস পাইতেছে। অবিলম্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দানের জন্য বিশ্বের সরকারের প্রতি আহবান জানাইয়া সভাইয় আরো একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। একটি প্রস্তাবে বাংলাদেশের ব্যাপারে সর্বপ্রকার সাহায্যে সহযোগিতা করার জন্য ভারত সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়।
বিশ্বের যে সকল রাষ্ট্র বাংলাদেশে গণহত্যার ব্যাপারে ইয়াহিয়া খানকে অস্ত্রশস্ত্র দিয়া সাহায্য করিতেছে, সেইসব দেশের জনগণকে তাহাদের সরকারকে বাংলাদেশের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা হইতে নিবৃত্ত করার ব্যাপারে কার্যকর ভূমিকা গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানান হয়।
স্বাধীনতার সংগ্রামে যাহারা জীবন উৎসর্গ করিয়া চলিয়াছেন তাহাঁদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করিয়া গৃহীত এক প্রস্তাবে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের এই চরম আত্মোৎসর্গের মূল উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত করার দৃঢ়সংকল্প প্রকাশ করা হয়।
আলোচন কমিটির সভায় গৃহীত এক প্রস্তাবে দিল্লীর পাকিস্তান হাইকমিশন অফিসে জনাব হোসেন আলী তাহাঁর স্ত্রী ও দুই কন্যাকে বলপূর্বক আটক করিয়া রাখাকে জঙ্গীশাহীর বর্বরতার আরও একটি নিদর্শন বলিয়া অভিহিত করিয়া অবিলম্বে তাহাঁদিগকে মুক্তিদানের দাবী জানানো হয়।
.
শাহজালাল
<৬,১৬৪,২৭৬-২৭৭>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
শেখ মুজিবের বাংলাদেশ ইন্দিরার ভারত একযোগে রুখিয়া দাঁড়াও |
বাংলার বাণী মুজিবনগরঃ ১৫শ সংখ্যা |
৭ ডিসেম্বর , ১৯৭১ |
শেখ মুজিবের বাংলাদেশ
ইন্দিরার ভারত একযোগে রুখিয়া দাঁড়াও
দুশমনকে খতম করো
(রাজনৈতিক সংবাদদাতা)
গান্ধী – নেহেরু – নেতাজী- ইন্দিরার মহান ভারত শেখ মুজিবের স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করিয়াছে। ভারত আর বাংলাদেশ আজ দুইটি স্বাধীন সার্বভৌম প্রতিবেশী বন্ধু রাষ্ট্র একই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা, ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ আর সমাজতান্ত্রিক আদর্শের যুগল পূজারী আদর্শ আর আত্মার নিবিড় ঐক্যসূত্রে গাঁথা শেখ মুজিবের বাংলাদেশ আর ইন্দিরার ভারত আজ একই পররাজ্যলোভী জল্লাদ ইয়াহিয়ার হিংস্র আক্রমণের সম্মুখীন। এই আক্রমণ বাংলাদেশ আর ভারতের ৬২ কোটি মানুষের উপর। তাই বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ আর ইন্দিরার ভারতকে আজ একযোগে রুখিয়া দাড়াইতে হইবে। ঐক্যবদ্ধ আঘাতের নির্মম প্রচণ্ডতায় দুশমনকে চিরতরে নির্মূল করিয়া দিতে হইবে। শত্রুকে এমন শিক্ষা দিতে হইবে যেন কোনদিন আর কোন উন্মাদ জঙ্গীবাজ বাংলাদেশ বা ভারতের মাটিতে হামলা করিতে সাহস না পায়।
এতদিন যুদ্ধ চলিতেছিল বাংলাদেশ ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে। কিন্তু বীর প্রসবিনী বাংলার দুঃসাহসী মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড আক্রমণে পিছু হটিতে হটিতে সুনিশ্চিত পরাজয়ের আতঙ্কগ্রস্ত বেসামাল জঙ্গীশাহী বিশ্ব জনমতকে বিভ্রান্ত করার জন্য ভারতীয় আক্রমণের ধুয়া তুলিয়া ভারতের উপর সশস্ত্র হামলা চালায়। ভারতীয় সেনাবাহিনী পিণ্ডচক্রের এই নগ্ন হামলার জবাবে প্রচণ্ড প্রত্যাঘাত হানিয়াছেন। বাংলাদেশেও মুক্তিযোদ্ধাদের সমর্থনে ভারতীয় বিমান বাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণে বাংলাদেশের শত্রু অধিকৃত অঞ্চলে শত্রুর বিমান বহর বিধবস্ত হইয়া গিয়াছে। মুক্তিযোদ্ধারা মিত্র সেনাবাহিনীর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলাইয়া ঝড়ের মত অগ্রসর হইয়া চলিয়াছেন।
পিণ্ডির জঙ্গীচক্রের যুদ্ধের খায়েশ ইতিমধ্যেই চরিতার্থ হইয়াছে কিনা জানা যায় নাই, কিন্তু দীর্ঘ আট মাস পূর্বে নিহত পাকিস্তানের লাশ বুকে জড়াইয়া জঙ্গীচক্র এখন সাম্রাজ্যবাদী দেশসমূহের দ্বারে দ্বারে পদলেহী কুকুরের মত ঘুরিয়া বেড়াইতেছে।
বিশ্বের হীনতম সাম্রাজ্যবাদ, মানবতার ঘৃণ্য শত্রু মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এইবার তাহার মুখোশ খুলিয়া ধরিয়া আপন মূর্তিতে নামিয়াছে। নিপীড়িত নির্যাতিত মানবতার তথাকথিত বন্ধু গণচীনও সাম্রাজ্যবাদী মার্কিনীদের এই সাপ নাচানো বাঁশীর সুরে মোহিনী সাপিনীর মত নাচিতেছে।
জাতিসংঘে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও চীন একযোগে ভারত উপমহাদেশে যুদ্ধিবিরতি ঘোষণার জন্য প্রস্তাব আনিয়াছিল।
সোভিয়েত ইউনিয়ন সাম্রাজ্যবাদী প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর এই চক্রান্ত ব্যর্থ করিয়া দিয়াছে।
অপর দুই স্থায়ী সদস্য বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়া নিরপেক্ষতা অবলম্বন করিয়াছেন। এই দুটি দেশ অর্থাৎ ফ্রান্স ও বৃটেন বর্তমান মুহূর্তে সম্ভবতঃ অত্যন্ত সাবধানতার সহিত পরিস্থিতি পর্যালোচনা করিয়া চলিয়াছে।
আমরা জানি, বিশ্বের সরকারসমূহ যতই পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করুন না কেন, সমগ্র বিশ্বের শান্তিপ্রিয় ও গণতন্ত্রকামী জনগণ বাংলাদেশের জনগণের এই ন্যায় সংগ্রামকে অকুণ্ঠ সমর্থন জানাইয়াছেন। এই সমর্থন লাভ করিবার অধিকার বাংলার জনগণ অর্জন করিয়াছেন। বাংলাদেশের মরণজয়ী মানুষেরা চরম আত্মত্যাগ ও রক্তাক্ত সংগ্রামের মাধ্যমেই এই সমর্থন লাভ করিয়াছেন। বিশ্বের স্বীকৃতিও বাংলার জনগণ এই উপায়ে অর্জন করিবেন। আর সেই দিনটিও খুব বেশী দূরেও নয়।
কিন্তু আজ শুভদিনেও যে কোন বাঙ্গালীর চিত্ত বেদনায় বিপন্ন। বাংলার প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজও শত্রুর কারাগারে। তার কারামুক্তি আর শত্রু স্বাধীন বাংলার জয়জয়ন্তী ত্বরান্বিত করার জন্যই আজ প্রচণ্ডতম শক্তিতে দুশমনের উপর ঝাঁপাইয়া পড়িতে হইবে- রুদ্ধ করিয়া দিতে হইবে শত্রুর পলায়নের সকল পথ।
.
.
রাশেদুজ্জামান রণ
<৬,১৬৫,২৭৮-২৮০>
সংবাদপত্রঃ বাংলার বাণী
তারিখঃ ৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১
সম্পাদকীয়
১
আমরা কৃতজ্ঞ
আমরা কৃতজ্ঞ। আমরা গভীর কৃতজ্ঞ মহান জনগণ এবং মহান নেত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর কাছে। যেভাবে সামরিক ও বৈষয়িক সাহায্য দিয়ে, স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়া ভারত অকৃত্রিম আন্তরিকতায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কারামুক্তি এবং জননী বাংলার শৃঙ্খল মোচনের এই জীবনপণ যুদ্ধে বাঙ্গালী জাতির পার্শ্বে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে উহার তুলনা নেই। শেখ মুজিবের বাংলাদেশ ইন্দিরার ভারতের কাছে চিরকাল সুগভীর কৃতজ্ঞতার ঋণের বন্ধনে আবদ্ধ থাকিবে। আমরা কৃতজ্ঞ সোভিয়েট ইউনিয়নের জনগণ ও সরকারের কাছে। যেভাবে রাশিয়া নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো প্রয়োগ করিয়া বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পরিচালিত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত বানচাল করিয়া দিয়াছে, আমাদের সমর্থনে আগাইয়া আসিয়াছে উহা চিরদিন স্মরণ থাকিবে।
আমরা কৃতজ্ঞতা জানাই ভারতের সেই সব মহান বন্ধুদের যাঁরা নেপথ্যে থাকিয়া আমাদের এই সংগ্রামে অংশ নিয়াছেন।
স্মরণ থাকিবে পোল্যাণ্ডের প্রশংসনীয় ভূমিকা। আর সেই সঙ্গে আমাদের শত্রু হিসাবে চিহ্নিত হইয়া থাকিবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনসহ বাংলাদেশ বিরোধী রাষ্ট্রসমূহ। তাদের এই মানবতাবিরোধী, স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকার বিচারের ভার আমরা ইতিহাসের উপরই ছাড়িয়া দিতেছি।
২
আর কোন পথ নেই
অবশেষে সেই ভয়াবহ আশঙ্কাই সত্যে পরিণত হইয়াছে। সমগ্র বিশ্বের বিবেকবান মানুষের শান্তির লালিত বাণীকে নিদারুণ হটকারিতায় ব্যর্থ পরিহাসে পর্যবসিত করিয়া ইসলামাবাদের জঙ্গীশাসক চক্রের কূলচূড়ামনি জল্লাদ ইয়াহিয়া ভারতের উপর যুদ্ধ চাপাইয়া দিয়াছে। বাংলার মাটিতে বীর মুক্তি যোদ্ধাদের হাতে নাস্তানাবুদ জল্লাদবাহিনী এবার পরাজয়ের সুতীব্র গ্লানির জ্বালায় দিশেহারা হইয়া হিংস্র ছোবল হানিয়াছে ভারতের মাটিতে। আর স্বাভাবিকভাবেই শত্রুর মোকাবিলায় প্রচণ্ড শক্তিতে রুখিয়া দাঁড়াইয়াছে ভারত- আক্রমণের জবাবে সজোরে পাল্টা আঘাত হানিয়া চলিয়াছে। রণদামামা বাজিয়া উঠিয়াছে- শুরু হইয়াছে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ। যে যুদ্ধ ছিল এতদিন বাংলাদেশ ও পশ্চিম পাকিস্তানের যুদ্ধ আজ সেই যুদ্ধেই ইয়াহিয়া খান জড়াইয়াছে ভারতকে। শনিবার সকালে পশ্চিম পাকিস্তানি জঙ্গীশাহী ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। আর আশ্চর্য! ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে রণদামামা বাজিয়া উঠিতে না উঠিতেই ভিয়েতনামে গণহত্যাযজ্ঞের নায়ক মানবতার জঘণ্যতম দুশমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিক্সন চক্র এই উপমহাদেশে ‘শান্তি ভঙ্গের আশঙ্কায়, বিশ্বশান্তির স্লীলতাহানির দুশ্চিন্তায়’ নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক ডাকিয়া ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে বিরতি এবং সেনা প্রত্যাহারের জন্য মরিয়া হইয়া ওঠে। নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক বসিতেও বিলম্ব হয় নাই। তবে সূখের বিষয় বাংলাদেশ এবং ভারতের মহান বন্ধু রাষ্ট্র সোভিয়েত রাশিয়ার ভেটো প্রয়োগের ফলে বাংলাদেশ, ভারত বনাম পাকিস্তানের এই যুদ্ধকে আন্তর্জাতিকীকরণের মার্কিনী দূরভিসন্ধির প্রথম প্রয়াস ব্যর্থতায় পর্যবসিত হইয়াছে। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে করার সঙ্গত কারণ আছে যে ভারতের উপর জঙ্গীশাহীর হামলা এবং নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক অনুষ্ঠানের মার্কিনী প্রয়াসের মধ্যে একটি নিবিড় ঐক্যসূত্র রহিয়াছে। যোগ সূত্র রহিয়াছে প্রায় একই সঙ্গে পিণ্ডি ও পিকিং হইতে ভারতকে আক্রমণকারী আখ্যাদানের মধ্যে। আজ এই উপমহাদেশে কিছু ঘটিতে না ঘটিতেই একই সঙ্গে পিকিং-ওয়াশিংটনে মরণার্তি ধ্বনিত হয়, বৈঠক বসে নিরাপত্তা পরিষদের। কারণ, বিশ্বশান্তি বিপন্নের ধুয়া। কারণ, বিশ্বশান্তি রক্ষার পবিত্র দায়িত্ব জাতিসংঘের।
কিন্তু কন্ঠ যদি আকাশ স্পর্শ করিতে পারিত, আজ চিৎকার করিয়া জিজ্ঞাসা করিতাম, মানবাধিকার লঙ্ঘন আর গণহত্যা প্রতিরোধও কি জাতিসংঘের সুমহান প্রতিশ্রুতির অন্তর্ভুক্ত নয়? বিশ্বের মানুষ জানে ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের লেজুড়বৃত্তি করার জন্য বা আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক আড্ডাখানা হিসাবে জাতিসংঘের জন্ম হয় নাই। জাতিসংঘের জন্ম হইয়াছিল মানবাধিকার ও বিশ্বশান্তি রক্ষা-গণহত্যা রোধ আর মানবজাতির কল্যাণ প্রচেষ্টার সুমহান প্রতিশ্রুতিতে। কিন্তু যেদিন মানবইতিহাসের ঘৃণ্যতম জল্লাদ ইয়াহিয়ার লেলাইয়া দেওয়া ভাড়াটিয়া ডালকুত্তা বাহিনী- দশ লক্ষ বাঙ্গালীকে হত্যা করিয়াছে, বাংলার শ্যামল মাটিতে রক্তের গঙ্গা বহাইয়াছে, নির্বিচারে মা-বোনের ইজ্জত লুটিয়াছে, ঘর-বাড়ী জনপদ জ্বালাইয়া পোড়াইয়া ছাই করিয়াছে, লক্ষ লক্ষ নর-নারী শিশুকে গৃহহারা সর্বহারা দেশান্তরী করিয়াছে আর- কারান্তরালে নিক্ষেপ করিয়াছে স্বাধীন বাংলার জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সেদিন জাতিসংঘ টুঁ শব্দটি করে নাই কেন? কেন সেদিন আজিকার এই যুদ্ধের উৎস জল্লাদী বর্বরতার বিরুদ্ধে একটি শব্দও উচ্চারিত হয় নাই নিরাপত্তা পরিষদ বা খুনী নিক্সনের কন্ঠে? আজো জল্লাদ ইয়াহিয়া তারই ভাষায় ‘পাকিস্তানের ভবিষ্যত প্রধানমন্ত্রী’ বাংলার মুকুটহীন সম্রাট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার প্রহসনের মঞ্চ সাজাইয়া তাহার জীবন লইয়া তস্কর সুলভ রাজনৈতিক জুয়াখেলায় লিপ্ত, কিন্তু তবু কেন নিক্সন নীরব, কেন নিরব জাতিসংঘ আর নিরাপত্তা পরিষদ? বরং উল্টা আজ যখন বাঙ্গালী জাতির মুক্তিযুদ্ধ সাফল্যের স্বর্ণতোরণের দ্বারপ্রান্তে, যখন মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড আক্রমণে জল্লাদ ইয়াহিয়ার ভাড়াটিয়া বাহিনীর মরণদশা, তখন টনক নড়িয়া উঠিয়াছে সাম্রাজ্যবাদী দস্যুদের। ইসলামাবাদের খুনি দোসরদের পরিত্রাণের জন্য শুরু হইয়াছে প্রাণপণ প্রচেষ্টা। বাংলাদেশে ইয়াহিয়া যা করিয়াছে, তার সেই হিংস্র বর্বরতা কারা ধৃষ্টতাপূর্ণ প্রচেষ্টারই শামিল। কারণ, বাংলাদেশের জনগণের কাছে শেখ মুজিব আর বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের পার্থক্য নাই। তবু কেন আজ বৃহৎ শক্তিবর্গ ‘স্বাধীন দুনিয়ার নায়ক’ আর সুসভ্য গণতন্ত্রী বলিয়া পরিচিত পাশ্চাত্য দেশীয় শাসককুল একটিবারও ইয়াহিয়ার এই উন্মত্ত হিংস্রতার বিরুদ্ধে রুখিয়া দাঁড়াইতে পারিল না? অথচ বলা হইয়া থাকে, হিটলারের বিরুদ্ধে মিত্র পক্ষের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার উদ্দেশ্য গণতন্ত্র রক্ষা।
সুতরাং এত দিন যে কথা বলিয়া আসিয়াছি উহাই আজ দিবালোকের মত সত্য হইয়া উঠিয়াছে। জঙ্গী ইয়াহিয়ার ক্ষয়িষ্ণু উপনিবেশবাদী দুঃশাসনের পতনোন্মুখ সৌধটি খাড়া রাখার উদ্দেশ্যেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ দেশ-দেশান্তরের গণবিরোধী শাসকচক্র চায় উপমহাদেশের এই যুদ্ধকে আন্তর্জাতিকীকরণের মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে বানচাল করিয়া দিতে। জল্লাদ ইয়াহিয়া আর তার মুরুব্বীদের ধারণা জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের আহবান অনুসারে ভারত ও পশ্চিম পাকিস্তানের যুদ্ধ বিরতি ঘটিলে শান্তি আলোচন টেবিলের দুই পার্শে বসিবে ভারত ও পশ্চিম পাকিস্তান। আর শৃংখলিতা দুঃখিনী বাংলা তার স্বাধীনতার স্বপ্ন, মুক্তির দুর্মর আকাঙ্ক্ষা বুকে লইয়া এক পার্শে পড়িয়া থাকিবে অনাদৃত-অবহেলিত, শেখ মুজিব থাকিবেন জল্লাদের জিন্দাখানায়। আর এই ভাবেই নির্মূল হইয়া যাইবে বঙ্গবন্ধুর কারামুক্ত আর জননী বাংলার শৃঙ্খল মোচন করিয়া গণতান্ত্রিক চেতনা সমৃদ্ধ রাষ্ট্র ব্যবস্থা, ধর্মনিরপেক্ষ শোষণবিহীন সমাজ আর সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি কায়েমের উদ্দেশ্যে পরিচালিত বঙ্গবন্ধুর আদর্শের পতাকাধারী বাঙ্গালী জাতির জীবনপণ মুক্তি সংগ্রাম।
কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী দস্যু আর ষড়যন্ত্রকারীর দল জানিয়া রাখুক, এ চক্রান্ত আমরা ব্যর্থ করিয়া দিবই। তারা জানিয়া রাখুক, আমরা একা নই- বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি মানুষ পার্শ্বে আছেন মহান ভারতের ৫৬ কোটি মানুষ- আর বিবেকবান বিশ্ববাসী। শেখ মুজিবের বাংলাদেশ আর গান্ধী-নেহেরু-নেতাজি-ইন্দিরার ভারত একযোগে হানাদার জল্লাদ বাহিনীর মোকাবেলা করিয়া যাইবে, দুশমনের মারণার্তির শেষ রেশটুকু নিঃশেষে বাতাসে মিলাইয়া যাওয়ার আগে আমাদের সমরাষ্ট্রর ধ্বনি এক মুহুর্তের জন্যও স্তব্ধ হইবেনা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কারামুক্তি, স্বাধীন বাংলার স্বীকৃতি আদায় আর সেই সঙ্গে মাতৃভূমির বুক হইতে শত্রুবাহিনীকে চিরতরে উৎখাতের আগে আমরা ক্ষান্ত হইবোনা।
যারা আজ ভারত ও পশ্চিম পাকিস্তানের কাছে যুদ্ধবিরতির আহাজারি করিয়া ছাতি ফাটাইতেছে তারা জানিয়া রাখুক, উপমহাদশে জল্লাদ ইয়াহিয়া যে যুদ্ধের দাবানল ছড়াইয়াছে উহা যদি নির্ধারিত করিতে হয় সর্বাগ্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিতে হইবে, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে হইবে, বাংলাদেশ হইতে সকল পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্য প্রত্যাহার করিতে হইবে এবং তারপর একযোগে বাংলাদেশ-ভারত ও পশ্চিম পাকিস্তানের কাছে যুদ্ধ বিরতির আহবান জানাইয়া প্রয়োজনবোধে শেখ মুজিব-ইন্দিরা গান্ধী-ইয়াহিয়া খানকে আলোচনা বৈঠকে মিলিত করার উদ্যোগ নিতে হইবে। ইহা ছাড়া আর কোন পথ নাই।
………………
.
.
রাশেদুজ্জামান রণ
<৬,১৬৬,২৮১-১৮৩>
সংবাদপত্রঃ বাংলার বাণী
তারিখঃ ৭ ডিসেম্বর,১৯৭১
রাজনৈতিক দিগন্তে
যাত্রিক
আজ মৃত্যুঞ্জয়ী ৭ই ডিসেম্বর। এক বৎসর আগে ঠিক এই দিনটিতেই অনুষ্ঠিত হইয়াছিল সেদিনের পাকিস্তানের ২৩ বছরের প্রথম সাধারণ নির্বাচন। আর রাষ্ট্রীয় ভাগ্য নির্ধারণের প্রশ্নে নিজেদের অবাধ মতামত পেশের সেই প্রথম সুযোগেই শেখ মুজিবের বাংলার মানুষ দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে জানাইয়া দিয়াছিল চিরদিন কাহারো গোলাম হইয়া কলোনী হইয়া থাকার জন্য বাঙ্গালীর জন্ম হয় নাই। সেদিন বিশ্বের পার্লামেন্টারী রাজনীতির ইতিহাসে নজীর বিহীন নিঃশব্দ ব্যালটের বিপ্লবের মাধ্যমে শেখ মুজিবের বাংলাদেশ জানাইয়া দিয়াছিল বিদ্রোহী বঙ্গোপসাগরের প্রমত্ত হুঙ্কারে আমরাই আমাদের শাসন করিতে চাই- বাংলাকেই করিতে চাই বাংলার ভাগ্যবিধাতা। দ্ব্যর্থহীন ভাষায়, নিঃসঙ্কোচ আন্তরিকতায়, আর অন্তহীন ভালবাসা ও বিশ্বাসের সঙ্গে বাংলার মানুষ সেদিন নিজেদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের ভার তুলিয়া দিয়াছিল বাংলার মুকুটহীন সম্রাট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে। এ রায় শুধুমাত্র একটি বিক্ষুব্ধ বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠীর রায় ছিলনা- এ রায় ছিল সাড়ে ৭ কোটি বাঙ্গালীর বলিষ্ঠ রায়- সেদিনের পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের ৩১০টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ১৬৭টি আসনে জয়লাভ করিয়া সমগ্র পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ পার্লামেন্টারী দলের মর্যাদা এবং সমগ্র পাকিস্তান শাসনের অধিকার লাভ করে। এই নির্বাচনের মাধ্যমে সমগ্র বিশ্ববাসীর সামনে দুইটি সত্য দিবালোকের মত স্পষ্ট হইয়া যায়। প্রথমতঃ বাংলার মানুষ স্বাধিকার চায়- পশ্চিম পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক দুঃশাসনের শৃঙ্খল চূর্ণ-বিচূর্ণ করিয়া নিজেরাই নিজেদের ভাগ্য-নিয়ন্ত্রণ করিতে চায়। আর ৭ডিসেম্বর এই সত্যকেই সগৌরব মহিমায় প্রতিষ্ঠিত করিয়া দেয় যে, একমাত্র শেখ মুজিবর রহমানেরই বাংলাদেশের এমনকি সমগ্র পাকিস্তানের পক্ষ হইয়া কথা বলার অধিকার রহিয়াছে।
২৪ বৎসর আগে পাকিস্তান নামক রাজনৈতিক জারজ সন্তানের সৃষ্টি হইবার পর একটি দিনের জন্যও সে দেশের মানুষ স্বাধীনতার আস্বাদ লাভ করিতে পারে নাই। দুই যুগ ধরিয়া পশ্চিম পাঞ্জাবী পুঁজিপতি, শিল্পপতি, কায়েমী স্বার্থবাদী ও শোষক ষড়যন্ত্রকারীদের অদৃশ্য সুতার টানে যারাই ক্ষমতার আসনে সমাসীন হইয়াছে আবার চিৎপটাং হইয়া পড়িয়াছে, তারা সকলেই ছিল এই উপনিবেশবাদী দুঃশাসনেরই নাট-বল্টু মাত্র। জনগণের সঙ্গে তাদের কোন যোগাযোগ ছিলনা- জনগণকে তারা না পারিয়াছে আপন করিতে, না পারিয়াছে জনমতের কাছে মাথা নত করিয়া তাদেরকেই সকল শক্তির উৎস ধরিয়া তাদের ইচ্ছানুসারে রাষ্ট্র শাসন করিতে। দুইযুগের ইতিহাস প্রমাণ করিয়াছে ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট আমরা যা পাইয়াছিলাম তার নাম আর যাই হউক স্বাধীনতা নয়। বরং এই দিন স্বাধীনতার নামে শুধু গোলামীর জিঞ্জির বদল হইয়াছিল- ইংরেজদের বদলে আমরা আবদ্ধ হইয়াছিলাম পাঞ্জাবী উপনিবেশবাদের নির্মম শাসন ও শোষনের নিষ্ঠুর শৃঙ্খলে। এই শৃঙ্খলে বিশেষতঃ বাঙ্গালী জাতির জন্য ছিল বৃটিশ পরাধীনতার চাইতে ভয়াবহ। শেখ মুজিবুর রহমানই একদিন বলিয়াছিলেন, বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা ২০০ বৎসরে বাংলাদেশকে যতটা শোষন করিয়াছে, পশ্চিম পাকিস্তানীরা ২৩ বৎসরে তার চাইতে অনেক বেশি শোষণ করিয়াছে। ২৩ বৎসর ধরিয়া পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক ও শোষকের দল শাসনের নামে, ব্যবসায়ের নামে, বাণিজ্যের নামে বাংলার শ্যামল মাটিকে ক্ষত-বিক্ষত করিয়াছে, কামড়াইয়া ছিঁড়িয়া খাবলাইয়া খাইয়াছে বাঙ্গালীর হাড়, মাংস, কলিজা। ২৩ বৎসরে নির্মম দস্যুর মত বল্গাহীন শোষন ও লুন্ঠনে সোনার বাংলাকে পরিণত করিয়াছে শ্মশানে, অন্তহীন দুঃখের ভাগাড়ে। বাঙ্গালী জাতির দুঃখ, বঞ্চনা ও দুর্ভোগ
যত বাড়িয়াছে ততই তীব্রতর হইয়াছে তার দূর্জয় জাতীয়তাবাদী চেতনা। বাঙ্গালী জাতির এই জাতীয়তাবাদী চেতনা এবং নিজেই নিজের ভাগ্য নিয়ন্তা হওয়ার দূর্জয় বাসনা চরম রুপ লাভ করিয়াছে বিংশ শতাব্দীর অপরাজেয় জাতীয়তাবাদী গণশক্তির আত্মপ্রতিষ্ঠার দুর্বার সংগ্রামের নির্ভীক সিপাহসালার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে। ছয় দফা কর্মসূচীর মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের স্বাধিকার চাহিয়াছিলেন। কিন্তু এই আপাতঃ লক্ষ্য স্বাধিকারের দাবীর অন্তরালে যে চূড়ান্ত লক্ষ্য নিহিত ছিল সে সম্পর্কেও তিনি জনগণের কাছে আভাস দিতে ভুল করেন নাই। ১৯৭০ সালের ৪ঠা জানুয়ারি তারই প্রতিষ্ঠিত ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে বাংলার ছাত্র, যুবক, শ্রমিক জনতার উদ্দেশ্যে তিনি বলিয়াছেন, “ছয় দফা যদি মানিয়া না নেওয়া হয় তবে কয় দফা দিতে হইবে আমার জানা আছে। যখন দরকার হইবে আমিই বিপ্লবের ডাক দিব, তোমরা প্রস্তুত থাকিও।” ষড়যন্ত্রকারী এবং শাসককুল যে সহজে জনগণকেই রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার সকল শক্তির উৎস বলিয়া মানিয়া নিয়া তাদের ইচ্ছার কাছে নতি স্বীকার করিবেনা বঙ্গবন্ধু ইহা জানিতেন। আর জানিতেন বলিয়াই ভোট চাইতে গিয়াও তিনি জনগণের প্রতি সর্বাত্মক সংগ্রামের প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দিয়াছেন। বাংলার মানুষের উদ্দেশ্যে তিনি বলিয়াছেন, “আমি তোমাদের কাছে দুইটি জিনিস চাইঃ একটি তোমাদের ভোট, আর একটি যখন আন্দোলনের ডাক দিব তখন সর্বশক্তি লইয়া দুশমনের মোকাবিলা করিবার ওয়াদা।” প্রলয়-বিধ্বস্ত দুর্ভাগা বাংলার উপকুলীয় এলাকা পরিদর্শন শেষে ঢাকা ফিরিয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৩শে নভেম্বর হোটেল শাহবাগে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বক্তৃতা করেন। এই সম্মেলনে দেশ-বিদেশের দুইশোরও বেশী সাংবাদিক যোগদান করেন। এই সাংবাদিক সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বলেন, “আমরা নিয়মতান্ত্রিক পথেই লক্ষ্যে পৌঁছিতে চাই। নির্বাচন যদি হয় ভাল। আর যদি নির্বাচন না হয় সংগ্রামের মাধ্যমেই আমরা অধিকার আদায় করিব। প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড়ে উপকূলের যে দশ লক্ষ ভাইবোন প্রাণ হারাইয়াছে তাদের কাছে আমরা ঋণী। তাদের কাছে এই আমাদের দৃঢ় অঙ্গীকারঃ প্রয়োজনবোধে আরো দশ লক্ষ বাঙ্গালী শহীদ হইব। তবু আমরাই আমাদের দেশ শাসন করিব-বাংলাকেই করিয়া তুলিব বাংলার ভাগ্যবিধাতা!”
এই পটভূমিতে গত বছর ৭ই ডিসেম্বর বাংলাদেশের মানুষ ভোটকেন্দ্রে গমণ করে। তাদের এই দিনের রায়- নিজেরাই নিজেদের শাসক হইবার রায়- বাংলাকেই বাংলার ভাগ্য নিয়ন্তা করার রায়। আর এই রায় নিঃসন্দেহে দেশের রাজনীতির ইতিহাসে এক নব দিগন্তের সূচনা করিয়াছে। আজিকার মুক্তিযুদ্ধের যৌক্তিকতা এবং বৈধতা সপ্রমাণেও তাই ৭ই ডিসেম্বরের রায়ের ভূমিকা অপরিসীম, অনস্বীকার্য। ৭ই ডিসেম্বরের সেই রায় পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক-শোষকের দল মানিয়া নেয় নাই। কিন্তু বাংলার মানুষও শক্তির দাপটের কাছে মাথা নত করে নাই-নীরবে বরদাস্ত করে নাই বাঙ্গালী জাতির আশা-আকাঙ্খার উপর জল্লাদের হামলা।
স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম ২৬শে মার্চ। মাত্র আট মাস আগে বাঙ্গালী জাতি বঙ্গবন্ধুর ডাকে স্বাধীনতার পতাকা আর সমরাস্ত্র হাতে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকচক্রের বিরুদ্ধে রুখিয়া দাঁড়াইয়াছে। এই আট মাসে ২৫শে মার্চের কালো রাত্রির হিংস্র জল্লাদী ছোবল, মানবেতিহাসের নজিরবিহীন বিভৎস নারকীয় গণহত্যাযজ্ঞ, হানাদার বর্বর ডালকুত্তা বাহিনীর পাশবিক নারী ধর্ষণ, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ আর নির্যাতনের নীল সমুদ্র পাড়ি দিয়া, আকস্মিক আঘাতের প্রাথমিক বিপর্যয় কাটাইয়া, স্বাধীনতার দুর্গম বিসর্পিল পথের প্রান্তে প্রান্তে শাঠ্য ষড়যন্ত্র বাধাবিপত্তির মরণ ফাঁদ এড়াইয়া আপোষহীন সংকল্পে সামনে আগাইয়া পাল্টা আঘাত হানিতে অনেকটা সময় কাতিয়া গিয়াছে বাঙ্গালী জাতির। কিন্তু কর্তব্যে অবহেলা আর এতটুকু কালক্ষেপণও তারা করে নাই। হাজার প্রতিকূলতার মধ্যেও স্বাধীনতার স্বর্গতোরণের নির্দিষ্ট পথে আগাইয়া চলিয়াছে বাংলার মানুষ অপ্রতিহত বেগে। বুকে বুকে হানাদার দুশমনের উপর নির্মম প্রতিশোধ গ্রহণের লেলিহান চিতাগ্নি, অন্তরে অন্তরে স্বাধীনতার দুর্মর স্বপ্নের বন্যা, আর বাংলার মুক্তি সেনাদের চোখের সামনে উজ্জ্বল শিখায় জ্বলিয়াছে মহান নেতা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রদীপ্ত আলোকমালা। সেই আলোতেই পথ দেখিয়া তারা অবিচল দৃঢ়তায় শত্রুবাহিনীকে কচুকাটা করিতে করিতে আজ আসিয়া দাঁড়াইয়াছে সুনিশ্চিত সোনালী সূর্যের আলোর রাজত্বে। এবার চরম আঘাত হানিবার পালা। বাংলাদেশের দিকে দিকে দুঃসাহসী মুক্তিযোদ্ধারা এক যোগে দুশমনের উপর
প্রচণ্ড আঘাত হানিয়া চলিয়াছে- সর্বত্রই তাদের জয় জয় কার। বাংলার দশ-দিগন্তে আজ স্বাধীন বাংলার জয় জয়ন্তীর তূর্যনাদ। এই সাফল্যের তুলনা নাই। পৃথিবীর কোন দেশেই কোন কালে মাত্র আট মাসের মধ্যে একটি জাতির মুক্তিযুদ্ধের এমন উল্লেখযোগ্য সাফল্যের আর কোন নজির নাই।
শুধু তাই নয়, নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করিয়া চলিয়াছে বাঙ্গালী জাতি। গত বছর ডিসেম্বর মাসের নির্বাচনে নিঃশব্দ ব্যালটের বিপ্লবের মাধ্যমে বাঙ্গালী জাতি সৃষ্টি করিয়াছিল বিশ্বের পার্লামেন্টারী রাজনীতির ইতিহাসে এক নজিরবিহীন রেকর্ড। কিন্তু সেদিনের পাকিস্তানের গণবিরোধী স্বৈরাচারী রাজশক্তি বাংলার মানুষের সেই নিরস্ত্র বিপ্লবের রায়কে সহজ ভাবে মানিয়া নেয় নাই। জঙ্গীচক্র যে বাঙ্গালীর আশা-আকাঙ্খার কাছে নতি স্বীকার করিবেনা, একথা অজানা ছিল না বাংলার নেতা ও জনতার কাছে, তাই নীরবে-নিভৃতে চলিয়াছে শক্তি দিয়া শক্তির মোকাবিলা করার প্রস্তুতি। যখন সময় আসিয়াছে সাড়ে ৭ কোটি বাঙ্গালীর বিক্ষুব্ধ কন্ঠস্বরকে নিজের কন্ঠে তুলিয়া নিয়া প্রমত্ত হুঙ্কারে গর্জিয়া উঠিয়াছেন বাংলার মুকুটহীন সম্রাট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানঃ ‘বাংলাদেশ স্বাধীন। শত্রু আমাদের আক্রমণ করিয়াছে। সজোরে পাল্টা আঘাত হানো।’ বঙ্গবন্ধুর বজ্রকন্ঠ নির্দেশ বাতাসে মিলাইয়া যাওয়ার আগেই হাতে অস্ত্র তুলিয়া নিয়াছে বাংলার মানুষ। প্রচণ্ড পাল্টা আক্রমণের প্রবল তরঙ্গাঘাতে ৭২ ঘন্টায় বাঙ্গালী জাতি নির্মূল করার জল্লাদী খোয়াব ভাঙ্গিয়া খান খান করিয়া দিয়া শেখ মুজিবের অনুসারীরা মুগ্ধবিস্মিত বিশ্ববাসীকে দেখাইয়া দিয়াছে শুধু ব্যালটেরই নয়-বাঙ্গালীর বুলেটেরও জোর কত বেশী। গত বছরের সাতই ডিসেম্বর আর এবারের সাতই ডিসেম্বর একই সগর্ব সগর্বে পতাকা উর্ধ্ব তুলিয়া ধরিয়াছে। একটি ঐক্যবদ্ধ জাতির ইচ্ছাকে, আশা-আকাঙ্খাকে দাবাইয়া দেওয়ার শক্তি কাহারও নাই-কেহই পারেনা একটি জাতির স্বাধীনতার স্বপ্ন বানচাল করিয়া দিতে। ৭ই ডিসেম্বর তাই মৃত্যুঞ্জয়ী।
…………………
.
.
রাশেদুজ্জামান রণ
<৬,১৬৭,২৮৪-২৮৬>
সংবাদপত্রঃ বাংলার বাণী মুজিবনগরঃ ১৫শ সংখ্যা
তারিখঃ ৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১
চিঠিপত্রের জবাবে
আজাদ
আনোয়ারা বেগম
বনগাঁ।
প্রঃ- সাত মাস হইল দেশান্তরী হইয়াছি। কবে আবার দেশে ফিরিতে পারিব?
উঃ- উতলা হইবেন না বোন। আপনাদের অগণিত সন্তান, অগণিত ভাই মাতৃভূমিকে শত্রু মুক্ত করিয়া আপনাদের ঘরে ফিরাইয়া আনার জন্য জীবনপণ যুদ্ধে নিয়োজিত। এই যুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয় ত্বরান্বিত করার জন্য চেষ্টা ও সাধনার শেষ নাই। সুদিন যখন আসিবে, নিশ্চয়ই আপনারা ঘরে ফিরিতে পারিবেন- দুইদিন আগেই হউক আর পরেই হউক।
মাসুদ হোসেন
টাঙ্গাইল।
প্রঃ- বলিতে পারেন এই যুদ্ধ কবে থামিবে?
উঃ- যেদিন স্বাধীন বাংলার জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের মধ্যে ফিরিয়া আসিবেন, যেদিন বাংলাদেশ হানাদার দুশমনের কবল মুক্ত হইবে।
অনিরুদ্ধ
বর্ধমান।
প্রঃ- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক মূলমন্ত্র এবং আদর্শ কি?
উঃ- স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষ শোষণবিহীন সমাজ এবং জাতীয়তাবাদী চেতনা।
সাহাদত হোসেন
কালিগঞ্জ।
প্রঃ- বঙ্গবন্ধুর ডাকে আমরা স্বধীনতার যুদ্ধ করিতেছি। স্বাধীনতা অর্জনের পর আমাদের কি কর্তব্য?
উঃ- সে দায়িত্ব আরও কঠিন। মাতৃভূমি শত্রুমুক্ত হইবার পর মুহুর্তেই অধিকতর নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা লইয়া শান্তি শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার, সামাজিক পুনর্গঠন এবং বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আদর্শ বাস্তবায়নের কাজে আত্মনিয়োগ করিতে হইবে।
সালামতউল্লা
ফরিদপুর।
প্রঃ- যে স্বাধীনতার জন্য আমরা যুদ্ধ করিতেছি, এই স্বাধীনতা হইবে কাহার জন্য?
উঃ- সকলের জন্য। স্বাধীনতার সুবর্ণ ফসল সকলের দ্বারে পৌঁছাইয়া দেওয়ার সংগ্রামই অধিকতর কঠিন স্বাধীনতার সংগ্রাম।
আব্দুল করিম
বনগাঁ।
প্রঃ- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করিয়া দিল কেন?
উঃ- নিক্সনের ল্যাঙ্গট জল্লাদ ইয়াহিয়াকে মদদ দেওয়ার উদ্দেশ্যে। যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বাস, ভারতের অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ হইলে ভারত পাকিস্তানের কাছে কাবু হইয়া পড়িবে। আর এইভাবেই ভারতকে নাজেহাল করা যাইবে। ভারতের ‘অপরাধ’ সম্ভবতঃ এই যে, ভারত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করে।
অঞ্জনা রায়
কলিকাতা।
প্রঃ- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মার্চ মাসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়াছেন। কিন্তু এই ব্যাপারে তিনি কি আগে কোন আভাস দিয়াছিলেন?
উঃ- বাঙ্গালী জাতির দাবী আদায়ের জন্য যে সংগ্রাম করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিতে পারে, সে আভাস তিনি জাতিকে সব সময়েই দিয়াছেন। নির্বাচনী প্রচার সভাগুলিতেও তিনি জনগণের কাছে সমস্ত পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করিয়া দুইটি জিনিস চাহিয়াছেন; একটি ভোট আরেকটি আপোষহীন সংগ্রামের ওয়াদা। তিনি বলিয়াছেন নির্বাচনী রায়ের মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে দেখাইতে হইবে আমরা কি চাই। আর আমাদের আশা-আকাঙ্খা এবং আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা যদি বানচাল করিয়া দেওয়ার চেষ্টা চলে একযোগে শত্রুর বিরুদ্ধে রুখিয়া দাঁড়াইতে হইবে। সুতরাং আমাকে শুধু ভোট দিলেই চলিবে না। যখন সংগ্রামের ডাক দিব, তখন সর্বাত্মক সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত থাকিতে হইবে।
১৯৭০ সালের ৪ঠা জানুয়ারি ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণ দান কালে ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বলিয়াছিলেন, ‘ছয়দফা’ যদি মানিয়া লওয়া না হয় তখন কয় দফা দিতে হইবে সে আমি জানি। সময় যখন আসিবে, আমি বিপ্লবের ডাক দিব। প্রস্তুত থাকিও। উপকূলীয় প্রলয় বিধ্বস্ত এলাকা সফর শেষে ২৩শে নভেম্বর ঢাকার হোটেল শাহবাগে ২ শতাধিক দেশী-বিদেশী সাংবাদিকের এক সমাবেশে বঙ্গবন্ধু দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে ঘোষণা করেন নিয়মতান্ত্রিক পথে আমাদের অধিকার আদায়ের প্রয়াস যদি বানচাল করিয়া দেওয়া হয় বিশ্ববাসী আর ষড়যন্ত্রকারী শাসক-শোষকেরা জানিয়া রাখুক সংগ্রামের মাধ্যমেই আমরা উহা আদায় করিব। যে দশ লক্ষ মানুষ দূর্ভাগা বাংলার উপকূলে প্রলয় রাত্রির হিংস্র ছোবলে প্রাণ হারাইয়াছে, তাদের আত্মার প্রতি আমাদের ইহাই দৃঢ় অঙ্গীকার। প্রয়োজনবোধে আরও দশ লক্ষ লোক শহীদ হইব। কিন্তু তবু আমরাই আমাদের শাসন করিব, বাংলাকেই করিয়া তুলিব বাংলার ভাগ্যবিধাতা।
তরিকুল আলম
বসিরহাট।
প্রঃ- বাংলাদেশ সম্পূর্ণভাবে শত্রুমুক্ত হইবার পর কারা স্বাধীন বাংলার শাসনতন্ত্র প্রণয়ণ করিবেন?
উঃ- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাহার যে সব অনুসারী নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিরা মহান মর্যাদা রক্ষা করিয়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চালাইয়া যাইতেছে।
শফিকুল আলম
বসিরহাট।
প্রঃ- যে সামান্য কয়েকজন আওয়ামী লীগ দলীয় পরিষদ সদস্য বিশ্বাসঘাতকতা করিয়া শত্রুর সঙ্গে হাত মিলাইয়াছে স্বাধীন বাংলায় তাদের স্থান হইবে কোথায়?
উঃ- কবরে। ৩রা জানুয়ারী ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই জনগণের প্রতি সুস্পষ্ট নির্দেশ প্রদান করিয়াছেন। নির্বাচিত সদস্যদের যদি কেউ দেশ ও দেশবাসীর সঙ্গে বেঈমানী করে তাকে জ্যান্ত কবর দিয়া দিও।
সেলিনা আখতার
সিলেট।
প্রঃ- বিদেশে শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তিদের মধ্যে বাংলাদেশের জনগণের সব চাইতে বড় বন্ধু এবং সব চাইতে বড় দুশমন কে?
উঃ- সব চাইতে বড় বন্ধু ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী আর সব চাইতে বড় দুশমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিক্সন।
আতাহার আলী
কুষ্টিয়া।
প্রঃ- আমি একজন ছোট দোকানদার। বাংলাদেশ স্বাধীন হইলে কি আমার ভাগ্য পরিবর্তিত হইবে?
উঃ- বাঙ্গালী জাতির ভাগ্য তো সুখে দুঃখে একই সূত্রে গাঁথা। সুতরাং আপনার একার ভাগ্য পরিবর্তনের প্রশ্ন তো অবান্তর। সামগ্রিকভাবে জাতির ভাগ্য পরিবর্তনের জন্যই তো এত রক্তপাত, এত ত্যাগ তিতিক্ষা- এই স্বাধীনতার সংগ্রাম।
জনৈক মুক্তিযোদ্ধা
ফরিদপুর।
প্রঃ- হাজার হাজার বাঙ্গালী যখন অস্ত্র লইয়া শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করিতেছে, তখন আপনারা রণাঙ্গন হইতে দূরে নিরাপদ আশ্রয়ে বসিয়া কাপুরুষের মত কলমবাজি করিতেছেন। লজ্জা করেনা আপনাদের?
উঃ- না। আপনাদের মত আমাদের যে সব বীর ভাই বন্ধু জীবনের ঝুঁকি লইয়া রণাঙ্গনে শত্রুর মোকাবিলা করিতেছেন তাদের অবদানের কোন তুলনা নাই। তবে একটা কথা, কলমবাজি করিতেছি ব্যবসায়ীক স্বার্থে নয়- দেশ ও নেতার আদর্শের বাণী প্রচারের প্রয়োজনে। মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কারামুক্তি এবং জননী বাংলার শৃঙ্খল মোচনের সাধারণ লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যেই আপনারা যেমন সমরাস্ত্রের সাহায্যে যুদ্ধ করিতেছেন, আমরা কলমের সাহায্যে লড়াই করিতেছি। আপনারা এবং আমরা একই যুদ্ধের দুই পৃথক ফ্রন্টের সৈনিক। একই ‘হাইকমান্ডের’ নির্দেশ অনুযায়ী যুদ্ধের প্রয়োজনেই আপনারা রণাঙ্গনে, আমরা পত্রিকা অফিসে। একই সংগঠনের আমরা সদস্য। আমাদের মধ্যে এ ধরণের ভুল বুঝাবুঝির অবকাশ না থাকাই কি সমীচীন নয়?
শ্রীকৃষ্ণ
বাগদা।
প্রঃ- ভুট্টো এখন কি করিতেছে?
উঃ- পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার খায়েশ তার চুরমার হইয়া গিয়াছে। তাই বাংলাদেশের আশা ছাড়িয়া ‘নতুন পাকিস্তান’ গঠনের চেষ্টা-তদ্বিরে ব্যস্ত। আরেকটা ডিউটি আছে তার। ইয়াহিয়ার জুতা পালিশ করা।
.
.
রাশেদুজ্জামান রণ
<৬,১৬৮,২৮৭-২৮৮>
সংবাদপত্রঃ নতুন বাংলা ১ম বর্ষঃ ৫ম সংখ্যা
তারিখঃ ১৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
[* নতুন বাংলা। বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সাপ্তাহিক মুখপাত্র। বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি(সভাপতিঃ অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ) কর্তৃক বাংলাদেশ হতে মুদ্রিত ও প্রকাশিত।]
সম্পাদকীয়
এই যুক্ত কর্মদ্যোগকে
সংগ্রামের সকল স্তরে ছড়াইয়া দিন
যুদ্ধকালীন অবস্থায় বাংলাদেশ সরকারকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দানের জন্য বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ গ্রহণকারী দলগুলির এক বৈঠকে একটি সর্বদলীয় উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হইয়াছে। আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি, মওলানা ভাসানি পরিচালিত ন্যাপ, জাতীয় কংগ্রেসের এই যৌথ উদ্যোগকে বাংলাদেশের সংগ্রামী জনগণ অভিনন্দন জানাইবে। সাধারণ শত্রুর বিরুদ্ধে সংগ্রামের ঐক্যবদ্ধ ফ্রন্ট গঠন ব্যতীত সাফল্য অর্জন দুরূহ। বিশেষতঃ যেখানে আমাদের একটি সুশিক্ষিত ও আধুনিক অস্ত্র-সজ্জিত নিয়মিত সেনাবাহিনীর মোকাবেলা করিতে হইতেছে। যেখানে লক্ষ্য এক সেখানে পৃথক পৃথকভাবে শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই পরিচালনা সময় ও শক্তির অপচয়। শত্রুকে বিভিন্ন ফ্রন্টে পর্যুদস্ত করার জন্য সমস্ত জাতির সহযোগিতা সকল দলের ঐক্যবদ্ধ কর্মদ্যোগের মধ্যে প্রতিফলিত হইবে, স্বাভাবিকভাবেই দেশবাসী ইহা আশা করিয়াছে। বিভিন্ন দলের নেতৃবৃন্দ সমন্বয়ে গঠিত ৮ সদস্য বিশিষ্ট উপদেষ্টা কমিটি তাহাদের সেই আশা পুরা করিতে সক্ষম হইবে বলিয়া আমরা ধরিয়া লইতে পারি।
সংগ্রামী দেশবাসী ও বিভিন্ন দলের সাধারণ কর্মীগণ এইভাবে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামে শামিল হইলেও প্রায় ছয় মাস যাবৎ শত্রুর বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত দলগুলি যার যার নিজস্ব পরিকল্পনা লইয়া শত্রুর বিরুদ্ধে সাধ্যমত লড়াই করিতেছিল। সুনিশ্চিতভাবে বলা চলে সাধারন শত্রুর বিরুদ্ধে চূড়ান্ত সংগ্রামে আপন আপন পথে চলার নজীর দেশবাসী খুব ভাল চোখে দেখিতে পারেনা। কারণ, সংগ্রামে জয়ের পথ ইহাতে অহেতুক জটিল ও দীর্ঘ হয়। পারস্পরিক সহযোগিতার স্থলে দেখা দেয় ভুল বুঝাবুঝি।
শত্রুর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ ফ্রন্ট গঠনের কতিপয় পন্থা রহিয়াছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় দেখা গিয়াছে যে, বৃটেনের রক্ষণশীল মন্ত্রীসভায় শ্রমিকদলীয় সদস্যদের গ্রহণ করা হইয়াছে। এইভাবে সরকার গঠনের ক্ষেত্রে সকল মতের প্রতিনিধিস্থানীয় দলকে গ্রহণ করিয়া সাধারণভাবে নাজীবাদের বিরুদ্ধে তাহারা ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম চালাইয়াছে। মন্ত্রীসভায় বিভিন্ন দলকে গ্রহণ করিয়া মুক্তফ্রন্ট গঠন করা যাইতে পারে। দ্বিতীয় পন্থা হইল ঐক্যবদ্ধ জাতীয় মুক্তফ্রন্ট গঠন। ভিয়েতনাম, প্যালেস্টাইন প্রভৃতি কোন সাম্রাজ্যবাদের সমর্থনপুষ্ট ও সাহায্যপ্রাপ্ত চরম প্রতিক্রিয়াশীল সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত বিভিন্ন দলের নেতৃবৃন্দ সমন্বয়ে এই রকম যুক্তফ্রন্ট গঠন করা হয়। এই ধরণের যুক্তফ্রন্ট শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা হইতে মুক্ত এলাকায় শাসন ব্যবস্থা প্রভৃতি সংগ্রামের সকল স্তরে একটি সর্বোচ্চ পরিষদ হিসাবে কাজ করে। ইহার অধীনে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য থাকে সমর পরিষদ এবং মন্ত্রী পরিষদ।
ইহা ছাড়া তৃতীয় একটি পন্থা রহিয়াছে। বিভিন্ন দলের কর্ম পন্থার মধ্যে সমন্বয় সাধন এবং কিভাবে শত্রুর বিরুদ্ধে অগ্রসর হইতে হইবে সে সম্পর্কে পরামর্শ দানের জন্য উপদেষ্টা কমিটি বা পরিষদ গঠন। উপদেষ্টা কমিটি গঠনের প্রকৃতি ও উদ্দেশ্য হইতে স্থির করা হয় যে উহা মন্ত্রীসভার অধীনে শুধুমাত্র সময়ে সময়ে পরামর্শ দিবে, না ইহা মন্ত্রীসভার সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করিবে। কখনও কখনও এই ধরণের উপদেষ্টা কমিটি মন্ত্রীসভার অধীন হইয়া পড়ে আবার কখনও ইহা মন্ত্রীসভার সমান্তরাল ক্ষমতার অধিকারী হইয়া মন্ত্রীসভার সিদ্ধান্তকে গুরত্বপূর্ণভাবে প্রভাবিত করে। উপরন্ত অনেক ক্ষেত্রে উপদেষ্টা কমিটি গঠন করিয়া সরকার জনসাধারণের দাবী দাওয়া বিবেচনার নামে একটি রক্ষাবর্ম সৃষ্টি করে। অতীতে আমাদের দেশে প্রশাসনের ক্ষেত্রে এ ধরণের বহু অধ্যায় সংযোজিত হইয়াছে। কিন্তু কার্যকালে এই সব কমিটির তৎপরতা কাগজপত্রে সীমাবদ্ধ ছিল।
যুদ্ধকালীন অবস্থায় বাংলাদেশ সরকারকে পরামর্শ দানের জন্য এই সর্বদলীয় উপদেষ্টা কমিটির গুরুত্ব অনেক। প্রথমতঃ শত্রুকে আঘাত হানার ক্ষেত্রে কার্যকরভাবে সকল দলের মধ্যে সহযোগিতার পথ উন্মুক্ত হইয়াছে। দ্বিতীয়তঃ বিভিন্ন দলের কর্মপ্রচেষ্টা ক্ষুদ্র অথবা বৃহৎ যাই হউক না কেন- ভিন্ন ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হইয়াছে। লক্ষ্য এক হওয়া সত্ত্বেও এই প্রবাহগুলিকে তুলনা করা চলে নদীর সাথে। ছোট বড় সকল নদীই সমুদ্রে মিলায়। কিন্তু প্রবাহগুলিকে একটি প্রকাণ্ড খাতে পরিচালিত করিলে উহাতে সর্বপেক্ষা বেশী বেগের সঞ্চার হয়। বিভিন্ন দলের আওতায় মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন সংগ্রামকে একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনামাফিক ঐক্যবদ্ধ পথে পরিচালনা করিলে উহা হইতে সর্বাধিক ফল পাওয়া যায়। তৃতীয়তঃ এই উপদেষ্টা কমিটিতে যে নেতৃবৃন্দ রহিয়াছেন তাহাদের পশ্চাতে রহিয়াছে দীর্ঘদিনের সংগ্রামী ঐতিহ্য। পরাধীন আমলে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদীবিরোধী সংগ্রামে এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর স্বৈরাচারী সরকারের বিরোধী সংগ্রামের অগ্নিপরীক্ষায় ইহারা সকলেই উত্তীর্ণ সৈনিক। সুতরাং অতীতের প্রথম সারির সৈনিকগণ আমাদের এই মুক্তিযুদ্ধকে ঐক্যবদ্ধভাবে পরিচালনা করিলে জনগণের মনে অভূতপূর্ব উৎসাহ উদ্দীপনার সঞ্চার হইবে ইহা বলাই বাহুল্য।
এই উপদেষ্টা কমিটির নিকট হইতে আমরা এমন কর্মপন্থা আশা করিব যে, যুদ্ধ প্রচেষ্টার সমস্ত ক্ষেত্র হইতে রণক্ষেত্র পর্যন্ত এই ঐক্যের বিশাল বলিষ্ঠ কার্যক্রম সক্রিয় থাকে।
রণক্ষেত্রে ও প্রচারণা যুদ্ধে শত্রুর মোকাবেলার জন্য এই শক্তি পদক্ষেপের ফল ইতিমধ্যেই ফলিতেছে। অধিকৃত বাংলাদেশের পুতুল গভর্ণর ডাঃ মালিক কর্তার ইচ্ছায় প্রতিধ্বনি করিয়া আওয়ামী লীগ নেতাদের সহিত আলোচনার ইচ্ছা প্রকাশ করিয়াছেন। শত্রু এই ঐক্যবদ্ধ শক্তির ভয়ে এমনই বেসামাল হইয়া পড়িয়াছে তাহারা এখন প্রলাপ বকিতেছে। শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তিদানের জন্য বিশ্বব্যাপী দাবী সম্পর্কে নিশ্চুপ থাকিয়া আওয়ামী লীগের সহিত আলোচনার ইচ্ছা প্রকাশের মত নির্বোধ পুনরুক্তি করিতেছে।
শত্রুর বিরুদ্ধে আমরা সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালী এক সার্বিক যুদ্ধে রত। এই সার্বিক যুদ্ধে সর্বক্ষেত্রে সমন্বয় সাধনের জন্য সংগ্রামী সকল দল মতকে আরো ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার পথে অগ্রসর হইতে হইবে। এই উপদেষ্টা কমিটি আমাদের সংগ্রামী ঐক্যের প্রতীক। ইহাকে সংগ্রামের সকল স্তরে যুক্ত কর্মদ্যোগের মধ্যে ছড়াইয়া দিতে হইবে। সংগ্রাম পরিচালনার সকল স্তরে কীভাবে সুষ্টু সমন্বয় সাধন করা যায় তাহা ছাড়াও ঐক্যবদ্ধ নেতৃত্বের অধীনে সকল সংগ্রামী এই শরিক দলগুলিকে আরও তৎপর করিতে হইবে, ইহাদের মধ্যেকার সম্পর্ককে আরও ঘনিষ্ঠ করিতে হইবে।
……………………
.
.
রাশেদুজ্জামান রণ
<৬,১৬৯,২৮৯-২৯০>
সংবাদপত্রঃ নতুন বাংলা
তারিখঃ ১৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
আপোষ নয়, পূর্ণ স্বাধীনতা
পাঁচ পার্টির যুক্ত কমিটি গঠন ও যুক্ত ঘোষণা
(বিশেষ প্রতিনিধি)
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনার ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারকে উপদেশ প্রদানের জন্য বাংলাদেশের পাঁচটি রাজনৈতিক দলকে লইয়া একটি উপদেষ্টা (কনসালটেটিভ) পরিষদ গঠিত হইয়াছে। এই রাজনৈতিক দলগুলি হইতেছে আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, ভাসানী পন্থি ন্যাপ, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি ও বাংলাদেশ ন্যাশনাল কংগ্রেস।
গত বুধবার মুজিবনগরে অনুষ্ঠিত ঐ পাঁচটি রাজনৈতিক দলের শীর্ষ স্থানীয় নেতৃবৃন্দের এক যুক্ত বৈঠকে উপরোক্ত উপদেষ্টা পরিষদ গঠিত হয়। বৈঠকে গৃহীত এক প্রস্তাবে ঘোষণা করা হয় যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে কোন আপোষ হইবেনা- পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম অব্যাহত থাকিবে। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব খোন্দকার মোশতাক আহমদ, জনাব মনসুর আলী, জনাব কামরুজ্জামান, জনাব আব্দুস সামাদ, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির পক্ষে অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, ভাসানী পন্থী ন্যাপের পক্ষে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষে শ্রী মণি সিং এবং বাংলাদেশ ন্যাশনাল কংগ্রেসের পক্ষে শ্রী মনোরঞ্জন ধর।
যেই উপদেষ্টা পরিষদটি গঠিত হইয়াছে, উহার সদস্যসংখ্যা ৮জন। এই সদস্যবৃন্দ হইতেছেনঃ মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী(ভাসানী পন্থী ন্যাপ), শ্রী মণি সিং(বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি), শ্রী মনোরঞ্জন ধর(বাংলাদেশ ন্যাশনাল কংগ্রেস), অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ(বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি), বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব খোন্দকার মোশতাক আহমদ। পরিষদে আওয়ামী লীগের পক্ষে দুইজন সদস্য থাকিবেন। তাঁহাদের নাম পরে জানান হইবে।
পরিষদের বৈঠক পরিচালনা করিবেন প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ। পরবর্তী বৈঠক খুব শ্রীঘ্রই অনুষ্ঠিত হইবে বলিয়া জানা যায়।
প্রস্তাবাবলীঃ
গত বুধবারের পাঁচ পার্টির ঐ যুক্ত বৈঠকে মোট ৭টি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। প্রস্তাবাবলীর সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নে প্রদত্ত হইলঃ
সভায় শেখ মুজিবের বিচার প্রহসনের গভীর ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়। এই বিচার প্রহসন বন্ধ করার জন্য জাতিসংঘ ও বিশ্বের সকল শক্তির প্রতি আহবান জানান হয়।
সভায় বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আন্তরিক আস্থা ও পূর্ণ সমর্থন প্রকাশ করা হয়।
এক প্রস্তাবে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি প্রাদান ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বাস্তবতা স্বীকার করিয়া লওয়ার জন্য ভারত ও বিশ্বের দেশগুলির প্রতি আহবান জানান হয়।
সভায় মুক্তি সেনানীদের প্রতি অভিনন্দন জানান হয়
সভায় গৃহীত এক প্রস্তাবে ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী শরণার্থীদের সেবা ও যত্নের জন্য ভারত সয়ারকার ও জনগণের প্রতি আন্তরিক অভিনন্দন জানান হয়।
এক প্রস্তাবে শোষণের শৃঙ্খল হইতে মুক্ত হইবার সংগ্রামে লিপ্ত পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের সংগ্রামের প্রতি সমর্থন জানান হয় এবং তাদেরকে বাংলাদেশের সংগ্রাম সমর্থন করার আহবান জানান হয়।
অপর এক প্রস্তাবে ঘোষণা করা হয় যে, রাজনৈতিক সমাধান বলিতে পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া বাংলাদেশের জনগণের নিকট অন্য কিছু গ্রহণযোগ্য নহে। স্বাধীনতার মূল্য যদি রক্ত দিয়াই দিতে হয়, তাহা হইলে বাংলাদেশের জনগণ প্রতি ঘন্টায় উহা দিয়া যাইতেছে।
বিভিন্ন মহলের অভিনন্দন
বিভিন্ন মহল বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম পরিচালনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারকে পরামর্শ দানের জন্য এই উপদেষ্টা পরিষদ গঠনকে অভিনন্দিত করিয়াছেন। তন্মধ্যে ভারতের সরকারী মহল ও বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বলিয়া বর্ণনা করেন।
………
.
.
রাশেদুজ্জামান রণ
<৬,১৭০,২৯১>
সংবাদপত্রঃ নতুন বাংলা ১ম বর্ষঃ ৫ম সংখ্যা
তারিখঃ ১৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
ঢাকা শহর বন্দী শিবিরে পরিণত
(নিজস্ব বার্তা পরিবেশক)
ইয়াহিয়ার দস্যু বাহিনী ঢাকা শহরকে এখন কার্যতঃ বন্দী শিবিরে পরিণত করিয়াছে। উপর্যুপরি কমান্ডো ও গেরিলা আক্রমণে ভীত হইয়াই এই ব্যবস্থা লওয়া হইয়াছে। কিন্তু এতদসত্ত্বেও মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা বন্ধ হয় নাই।
পাকিস্তানী বাহিনী শহরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও কঠোর করিতেছে। বুড়িগঙ্গা নদীতে সশস্ত্র টহলদার বাহিনী গানবোট ও লঞ্চ যোগে দিবারাত্র ঘোরাফেরা করিতেছে। শহরের সহিত অন্যান্য এলাকার যোগাযোগ একেবারে নাই বলিলেই চলে। শহর হইতে বাহিরগামী সড়কসমূহের প্রবেশ পথে সশস্ত্র বাহিনী ও কড়া চেক পোস্ট ব্যবস্থা মোতায়েন করিয়াছে
সেনাবাহিনীর কঠোর নিয়ন্ত্রণে ঢাকা ও বরিশালের মধ্যে লঞ্চ চলাচল করিতেছে। ইহাও আবার অনিয়মিত। সন্ধ্যা হইলেই স্থল ও জলপথে যানবাহন চলাচল বন্ধ হইয়া যায়। পানির ট্যাঙ্কসমূহ ও বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলিতে সেনাবাহিনীর ২৪ ঘন্টা প্রহরা মোতায়েন রহিয়াছে।
সেনাবাহিনীর লোকেরা জামাতে ইসলামী ও মুসলিম লীগের রাজাকার গুণ্ডাদেরকে লইয়া বিভিন্ন রাত্রে বিভিন্ন মহল্লা ঘেরাও করে ও তল্লাশী চালায়। সাধারণত যেসব এলাকায় বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়া থাকে, সেই সব এলাকাতেই এই ধরণের অভিযান চালান হয়। কিন্তু ইহাতেও শহরবাসীর মন দমিয়া যায় নাই। মুখ ফুটিয়া প্রকাশ্যে হয়ত তাহারা কিছু করিতে পারিতেছে না; কিন্তু শত্রুকে চরম আঘাত হানার সংকল্প তাহাদের দৃঢ়তর হইতেছে।
…………
রাশেদুজ্জামান রণ
<৬,১৭১,২৯২-২৯৩>
সংবাদপত্রঃ নতুন বাংলা ১ম বর্ষঃ ৬ষ্ঠ সংখ্যা
তারিখঃ ১৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
রাজনৈতিক পরিক্রমা
(ভাষ্যকার)
নিক্সন সরকার জঙ্গী-ইয়াহিয়া সরকারকে অস্ত্র দিতেছে ও অর্থ সাহায্য করিতেছে। বাংলাদেশের গণহত্যার নায়ককে মার্কিন সরকারের এই খোলাখুলি সক্রিয় সমর্থনে বিশ্বের শান্তি ও স্বাধীনতাকামী জনগণ ‘স্বাধীন দুনিয়া ও গণতন্ত্রের পূজারী’ ও একচেটিয়া স্বত্বাধিকারী আমেরিকার নিন্দায় মুখর হইয়া উঠিয়াছে। খোদ আমেরিকায় জনসাধারণ নিক্সন সরকারের এই ভূমিকায় ক্ষুব্ধ। বাংলাদেশে যাহারা মুক্তি সংগ্রামের প্রথম দিন গুলিতে মার্কিন সমর্থনের মোহ মনে পোষণ করিয়াছিলেন, তাহাদের মোহভঙ্গ হইয়াছে। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ হত্যা, নির্যাতন, লুন্ঠনের মুখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা হইতে সাম্রাজ্যবাদের আসল চেহারাটা চিনিয়াছে।
কিন্তু মার্কিন মূলুকে গলব্রেথ সাহেবরা নিক্সন সরকারের খোলাখুলি সমর্থনে বিব্রত বোধ করিতেছেন। সুতরাং বাংলাদেশের ব্যাপারে তাহাকে কিছু বলিতে হয়। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গলব্রেথ সাহেব তাই ভারতে ছুটিয়া গিয়াছেন। এক সময় তিনি ভারতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ছিলেন। সেই সুবাদে তিনি কলিকাতায় আসিয়া বাংলাদেশ সমস্যার একটা সমাধান বাতলাইয়াছেন। স্বায়ত্তশাসন নাকি বাংলাদেশ সমস্যার একমাত্র সমাধান। গলব্রেথ সাহেব হয়তো না জানার ভা্ন করিয়াছেন। তাহাকে আমরা সবিনয়ে স্মরণ করাইয়া দিতেছি যে স্বায়ত্তশাসন চাহিবার অপরাধেই ইয়াহিয়া খান বাংলাদেশে নরমেধযজ্ঞ শুরু করিয়াছে। ১০ লক্ষ লোককে হত্যা করার পর, ইজ্জত নষ্ট করার পর, ৮০ লক্ষ শরণার্থীকে নিঃস্ব করিয়া ভারতে ঠেলিয়া দিবার পর পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যে বাংলাদেশের সমস্যার সমাধান আর সম্ভব নয়। লক্ষ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে রক্তের দাম দিয়া বাঙ্গালীরা পরিপূর্ণ মুক্তি কিনিয়া লইবে। সুতরাং গলব্রেথের মতে ‘সকল সভ্য মানুষ ও পাকিস্তানের অধিকাংশ লোক কামনা করিলে কী হইবে।’ জানিনা গলব্রেথ সভ্য মানুষ বলিতে খুনি ইয়াহিয়ার বন্ধুদের কথা বুঝাইয়াছেন কিনা এবং পাকিস্তানের অধিকাংশ লোক বলিতে কি তাহাদের প্রাণের ভুট্টো সাহেবদের কথা বুঝাইতে চাহেন কিনা। কিন্তু ‘ন্যাড়া ক’বার বেলতলায় যায়?’ গত ২৪ বছর বাঙ্গালীরা ঠকিয়া শিখিয়াছে, মুহুর্মুহু রক্ত ঢালিয়া বুঝিয়াছে যে, স্বাধীনতা ছাড়া কোন পথ খোলা নাই। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের অস্তিত্ব অস্বীকার করিয়া পাশ কাটাইয়া সমস্যা সমাধানের প্রস্তাব যে কোন মহল হইতেই আসুক না কেন বাঙ্গালীরা তাহা ঘৃণা ভরিয়া প্রত্যাখ্যান করিবে এবং করিয়াছেও।
আপোষের পথে টানিবার জন্য বন্দী শেখ মুজিবুর রহমানকে নাকি পরোক্ষভাবে মার্কিন সরকার টোপ ফেলিয়াছে। তাহার পাশাপাশি গলব্রেথ সাহেবদের এধরণের উক্তি উদ্দেশ্যমূলক। শেখ মুজিবুরকে একদিকে মুক্তিপণ হিসাবে ব্যবহারের চেষ্টা এবং অপরদিকে মার্কিন সরকারের সমালোচকের ভূমিকায় নামিয়া পাকিস্তানের পক্ষে ক্যানভাস করার কৌশল খাটাইয়া কোন লাভ নাই। মার্কিন ক্ষমতাশীল দল ও বিরোধীদলের এই ধরণের আপাতঃ পরস্পর বিরোধী ভূমিকাটা স্বচ্ছ একটা অভিনয়। বাংলাদেশের লোক আর সাম্রাজ্যবাদের ধোঁকায় ভুলিবে না।
ঠাকুর ঘরে কে- আমি কলা খাই নাই
অধিকৃত বাংলাদেশের পুতুল গভর্ণর ডাঃ মালিক, আওয়ামী লীগ নেতাদের সহিত আলোচনা বৈঠকে বসিবার ইচ্ছা প্রকাশ করিয়া একটা ঘোষণা দিয়াছেন। পাকিস্তান সরকারের বিশ্বাসভাজন এই বনেদী মোসাহেবটি প্রভুর অনুগ্রহলাভে ধন্য মনে করিয়া মাথা ঠিক রাখিতে পারিতেছেন না। পাছে লোকে তাহাকে বলে যে, তিনি ইসলামাবাদের হিজ মাস্টার ভয়েস। তাই সাত তাড়াতাড়ি বলিয়াছেন ‘আসলে তাকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের অথবা অন্য কাহারও হাতের পুতুল বলিয়া মনে করার প্রশ্ন উঠে না। এ যেন ঠাকুর ঘরে কে? ‘আমি কলা খাইনি’ গোছের জবাব। দশ লক্ষ বাঙ্গালীর লাশের উপর দিয়া যিনি গদীতে আরোহন করিয়াছেন, শত সহস্র মা-বোনের ইজ্জত নষ্ট করার পরও যিনি নির্বিকার থাকিতে পারেন ও নরঘাতকদের সহিত সহযোগিতা করিতে পারে তাঁহাকে বাঙ্গালী মাত্রই মীরজাফর বলিয়া মনে করে।
ইহার পরও তিনি বলিয়াছেন, “আমি ইয়াহিয়ার হাতের পুতুল নই।” আমাদের জিজ্ঞাসা- কুকুরে লেজ নাড়ে নাই, তবে কি লেজটি কুকুরটাকে নাড়িতেছে?
.
.
রাশেদুজ্জামান রণ
<৬,১৭২,২৯৪-২৯৫>
সংবাদপত্রঃ নতুন বাংলা ১ম বর্ষঃ ৫ম সংখ্যা
তারিখঃ ১৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
সাম্রাজ্যবাদের ট্রয়ের ঘোড়া পাকিস্তান
আলী ইমাম
পাকিস্তান একটি অস্বাভাবিক রাষ্ট্র। আর এই অবাস্তব রাষ্ট্র টিকাইয়া রাখার জন্য চাই ফ্যাসিস্ট সরকার। গত ২৪ বছরের ইতিহাস ইহার সাক্ষ্য। পাকিস্তান কায়েম হওয়ার পর আজ পর্যন্ত ইহার কোন শাসনতন্ত্র রচনা করা হয় নাই। কারণ পাকিস্তানের শাসকবর্গের নিকট ইহা কাম্য ছিলনা। সীমাহীন অত্যাচার নিপীড়ন, জেল-জুলুম আর গুলি চালাইয়া পাকিস্তানী শাসকবর্গ ইহার দ্বিজাতিতত্ত্বের মিথ(myth) কোন মতে ঠেকা দিয়া দাঁড় করাইয়া রাখিয়াছিল। আজ বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে সেই দ্বিজাতিতত্ত্বকে উপড়াইয়া ফেলিয়াছে।
ফ্যাসিস্ট ইয়াহিয়া চক্রটি গত ২৪ বছর যাবৎ সযত্ন লালিত বিষবৃক্ষের ফল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর কালে সারা পৃথিবীতে উপনিবেশ ও আধা উপনিবেশ দেশগুলিতে জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম শুরু হয়। এই মুক্তি সংগ্রামের মুখে সাম্রাজ্যবাদ পিছু হটিতে থাকে। কিন্তু উপনিবেশ হইতে চলিয়া যাবার সময় বিভিন্নভাবে তাহাদের স্বার্থেরও খুঁটাটা শক্ত করিয়া রাখিয়া যায়।
বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের সুচতুর চালে এবং মুক্তি সংগ্রামের দূর্বলতার জন্য এশীয় ভূখণ্ডে পাকিস্তান রাষ্ট্রকে ট্রয়ের ঘোড়া হিসাবে ব্যবহারের পরিকল্পনা করে। ধর্ম ও ভারতদ্বেষিতাকে মূলধন করিয়াই পাকিস্তান তাহার ঐক্য অর্থাৎ পাকিস্তানী পুঁজিপতি ও ভূ-স্বামীদের শোষণের স্বর্গ অটুট রাখিতে চাহিয়াছে। ইহাই পাকিস্তানীদের অভ্যন্তরীণ নীতি। বৈদেশিক ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদের সৃষ্ট এই ট্রয়ের ঘোড়া সকল দেশের মুক্তি সংগ্রামের ক্ষতি সাধনে তৎপর রহিয়াছে। মিত্রের ছদ্মবেশে এবং ধর্মীয় ভ্রাতৃত্বের ঐক্যের বুলির আড়ালে সাম্রাজ্যবাদের এই বাহনটি ব্যবহার করা হইতেছে।
১৯৫৬ সালে বৃটেন, ফ্রান্স ও ইসরাইল যখন একযোগে মিশর আক্রমন করে তখন পাকিস্তান সরকার বৃটেনের প্রতি সমর্থন জানাইয়াছিল। ক্ষুব্ধ নাসের তৎকালীন পাকিস্তানী জনৈক মন্ত্রীকে মিসরে ঢুকিতে বারণ করিয়াছিলেন। বান্দুং সম্মেলনও পাকিস্তান ব্যর্থ করিতে চাহিয়াছিল। কিন্তু সাধ্যে কুলায় নাই। পঞ্চশীলার স্থলে পাকিস্তানের ‘সপ্ত-স্তম্ভের’ নীতি পাল্টা দাঁড় করাইবার প্রয়াস হইতে ইহা বোঝা যায়। হাভানায় ত্রিমহাদেশীয় সম্মেলনেও কাশ্মীর সমস্যাকে চাল হিসাবে ব্যবহার করিতে চাহিয়াছিল।
কিন্তু সাম্রাজ্যবাদের এই ট্রয়ের ঘোড়াটি মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন মুক্তি সংগ্রামে ও জাতীয় স্বাধিকার সংগ্রামের সর্বাপেক্ষা ক্ষতি করিয়াছে ও ক্ষতি সাধন করিতেছে। মুখে ইসলামী ভ্রাতৃত্বের বুলি আওড়াইয়া সাম্রাজ্যবাদের এই সেবাদাসী ইঙ্গ-মার্কিন প্রভুর মনস্তুষ্টি সাধনে ব্যগ্র।
মধ্যপ্রাচ্যে বাগদাদ প্যাক্ট ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সিয়েটো চুক্তি করিয়া পাকিস্তান সাম্রাজ্যবাদের বিশ্বস্ত সহচরদের মধ্যে স্থান করিয়া লইয়াছে। ইরাকে রাজতন্র বিরোধী সফল অভ্যুত্থান বাগদাদ চুক্তির ভিত্তি কাঁপাইয়া তোলে। ইরাক বাগদাদ চুক্তি হইতে বাহির হইয়া যায়। পরবর্তী সময়ে এই প্যাক্ট সেন্টো নামে অভিহিত হয়।
সেন্টোর সদস্য হিসাবে পাকিস্তান মধ্যপ্রাচ্যে আরব জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পৃষ্ঠে ছুরিকাঘাত করিয়া চলিয়াছে। মধ্য প্রাচ্যের প্রতিক্রিয়াশীল রাষ্ট্রগুলিকে সর্বতোভাবে পাকিস্তান সাহায্য করিতেছে।
গত ১৯৭০ সালে আগস্ট-সেপ্টেম্বরে জর্ডানে প্যালেস্টাইন গেরিলা বাহিনী ও জর্ডানের রাজকীয় বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধে পাকিস্তান সক্রিয় অংশগ্রহণ করিয়াছে। মুখে ইসরাইলের বিরোধীতা করিলেও পাকিস্তান সেন্টোর অংশীদার তুরস্কের মারফৎ ইসরাইলের সহিত যোগাযোগ রাখিয়া চলিয়াছে।
প্যালেস্টাইন গেরিলা বাহিনীর নেতা ইয়াসির আরাফাত অভিযোগ করিয়াছেন যে, জর্ডানের ভক্ত(?) আমার মনে হয় ‘শক্ত’ হবে??? রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের সময় বাদশাহ হোসেনের রাজকীয় বাহিনীর অভিযান পরিকল্পনার রচয়িতা একজন পাকিস্তানী জেনারেল। পাকিস্তানী সামরিক অফিসারগণ উক্ত অভিযানে সরাসরি অংশগ্রহণ করিয়াছিল।
গত আগস্ট মাসের মাঝামাঝি জর্ডানের এশীয় সীমান্তে প্রচণ্ড ট্যাঙ্ক যুদ্ধ হয়। গেরিলা বাহিনীর পশ্চান্ধাবন(?) পশ্চাদগমন করিয়া জর্ডানের রাজকীয় বাহিনী সিরিয়ায় প্রবেশ করে। বিমানের ছত্রছায়ায় জর্ডানী একটি ট্যাঙ্ক বাহিনী সিরিয়া সীমান্তে আক্রমণ চালায়। পাকিস্তানী বিমান বহর জর্ডানকে এই সংঘর্ষে সহায়তা করিয়াছে।
মধ্যপ্রাচ্যে সাম্রাজ্যবাদের ট্র্য়ের ঘোড়া পাকিস্তানের এই কীর্তিকলাপ নতুন কিছু নয়। ইহাই পাকিস্তান মার্কা ‘ইসলামী আদর্শের’ স্বরুপ। যাহারা সময়ে সময়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে কথার তুবড়ি ছুটায় তাহারা মার্কিন সাম্রাজ্যাবাদের এই পদলেহী পাকিস্তান সরকারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়। পাকিস্তানের সংহতি ও অখণ্ডতা রক্ষার জন্য অস্ত্র ও সাহায্য পাঠাইতে কসুর করেনা।
বাংলাদেশই শুধু পাকিস্তানী বর্বর বাহিনীর নারকীয়তার শিকার নহে। ১৯৫৮-৫৯ সালে বেলুচদের স্বাধিকার আন্দোলন ও স্বায়ত্বশাসনের দাবীকে ইহারা রক্তের বন্যায় ডুবাইয়া দিয়াছে। ঈদের নামাজ আদায়রত হাজার হাজার মুসল্লীর উপর বিমান হইতে বোমাবর্ষণ করিয়া “বিপন্ন ইসলাম” কে রক্ষা করিয়াছে। সেদিন ৪ শতেরও অধিক বেলুচ প্রাণ হারায়। সেদিন রক্তগঙ্গা বহাইয়া যে টিক্কা খান হাত পাকাইয়াছে তাহাকে বাংলাদেশে গণহত্যা করিতে পাঠান হইয়াছে। কিন্তু গণহত্যা চালাইয়া পাকিস্তানের ফ্যাসিস্ট সরকার বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলন দমন করিতে পারে নাই। পাকিস্তানের মিত্ররা মদদ দিয়াও শেষ রক্ষা করিতে পারিবে না। সাম্রাজ্যবাদের সাধের ট্রয়ের ঘোড়াটির খেলা শেষ হইয়া আসিয়াছে। বাংলাদেশের মুক্তিফৌজের হাতে মার খাইয়া ইহার সমস্ত জারিজুরি ফাঁস হইয়া গিয়াছে।
………………
.
.
রাশেদুজ্জামান রণ
<৬,১৭৩,২৯৬-২৯৭>
সংবাদপত্রঃ নতুন বাংলা ১ম বর্ষঃ ৫ম সংখ্যা
তারিখঃ ১৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
মুক্তাঞ্চলের চিঠি
(নিজস্ব প্রতিনিধি)
ময়মনসিংহ জেলার অষ্টগ্রাম থানা, রংপুর জেলার ফুলবাড়ী থানা এবং দিনাজপুর জেলার তেঁতুলিয়া থানা সম্পূর্ণরুপে মুক্ত অঞ্চল। আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রলীগ, কৃষক সমিতি প্রভৃতি সংগঠনগুলির সমন্বয়ে গঠিত সংগ্রাম কমিটি, গণবাহিনী ও মুক্তিফৌজের সুদৃঢ় প্রতিরোধের মুখে টিকিতে না পারিয়া ইয়াহিয়ার জোয়ানরা এইসব এলাকা হইতে চিরদিনের জন্য পাততাড়ি গুটাইতে বাধ্য হইয়াছে। এই মুক্ত অঞ্চলে এখন ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হইতেছে নবজীবনের জয়গান।
অষ্টগ্রাম
উত্তর-পূর্ব রণাঙ্গন হইতে ময়মনসিংহ জেলা ন্যাপের জনৈক নেতা জানান যে, উক্ত জেলার অষ্টগ্রাম থানায় পাক হানাদাররা আজ পর্যন্ত প্রবেশ করিতে পারে নাই। ন্যাপ, আওয়ামী লীগ, কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রলীগ প্রভৃতি সংগঠনের ঐক্য দুষ্কৃতিকারীদের সকল ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করিয়া দিয়া অষ্টগ্রাম থানাকে আজ পর্যন্ত মুক্ত রাখিয়াছে। এখানে এইসব সংগঠনের সমন্বয়ে একটি সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হইয়াছে। এই সংগ্রাম কমিটি বিভিন্নভাবে কিছু অস্ত্র সংগ্রহ করিয়াছে। সংগ্রাম পরিষদ থানার দুষ্কৃতিকারীদের ডাণ্ডা মারিয়া ঠাণ্ডা করিয়াছে। পাক হানাদারেরা যাহাতে থানার কোন অংশে প্রবেশ করিতে না পারে সেজন্য সকল যাতায়াত পথ নষ্ট করিয়া দেওয়া হইয়াছে। একদিন পার্শ্ববর্তী জেলা কুমিল্লা হইতে কয়েকজন রাজাকার এই থানা এলাকায় প্রবেশ করিলে তাহাদের গ্রেফতার করা হয়।
মুক্তিবাহিনী
সংগ্রাম কমিটির উদ্যোগে এই থানায় যুবকদের লইয়া একটি মুক্তিবাহিনী গড়িয়া উঠিয়াছে। এই বাহিনীতে যোগদানের জন্য প্রতিদিন বিভিন্ন স্থান হইতে দলে দলে ছাত্র ও যুবকেরা ভীড় জমাইতেছে। এই মুক্তিবাহিনী ঢাকা জেলার সঙ্গেও যোগাযোগ রক্ষা করিয়া পাকিস্তানী সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুক্তভাবে কয়েকটি ‘অপারেশন’ চালাইয়াছে। এই বাহিনীর প্রতি আশে পাশের থানা সমূহের বিভিন্ন গ্রামের আস্থা দিন দিন বৃদ্ধি পাইতেছে এবং ইহার সঙ্গে মুক্তাঞ্চলের পরিধিও বিস্তার লাভ করিতেছে।
গণআদালত
সংগ্রাম কমিটি গত ২৫শে মার্চের পরেই উক্ত থানায় একটি গণআদালত গঠন করে এই গণআদালতের মাধ্যমে মুক্তাঞ্চলের অভ্যন্তরীণ শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখা হইয়াছে। ফলে, যাতায়াত ব্যবস্থা ভাঙ্গিয়া পড়ায় জিনিস পত্রের দাম পূর্বাপেক্ষা বৃদ্ধি পাইলেও জনসাধারণের মনোবল ভাঙ্গিয়া যায় নাই- বরং মুক্তাঞ্চলের পরিধি ও মুক্তিবাহিনীর শক্তিবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মনোবলও বৃদ্ধি পাইয়া চলিয়াছে।
পার্শ্ববর্তী থানাসমূহে নির্যাতন
অষ্টগ্রাম থানা অঞ্চলে প্রবেশ করিতে না পারায় পাক হানাদার বাহিনী ইহার পার্শ্ববর্তী থানার গ্রামসমূহে হত্যা, লুটতরাজ, নারী ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ প্রভৃতি নিপীড়ন চালাইতেছে। কিন্তু অষ্টগ্রামের মুক্তি বাহিনী ও সংগ্রাম কমিটি ঐসব অঞ্চলের সহিত যোগাযোগ রক্ষা এবং সময় বুঝিয়া আকস্মিক হামলা চালাইয়া পাক হানাদের
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ ষষ্ঠ খণ্ড, ২৯৭ পৃষ্ঠা
বিভিন্ন সময়ে নাজেহাল করায় জনগণের মনোবল ঠিক রহিয়াছে। অষ্টগ্রাম হইতে মুক্তিবাহিনী ইতিমধ্যে গৌরিপুর, পূর্বধলা দূর্গাপুর, দল মাকান্দা, বারহাট্টা, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, বাজিতপুর, ভৈরব ভালুকা, ত্রিশাল, ফুলবাড়িয়া প্রভৃতি অঞ্চলে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক হানাদার সৈন্যকে হত্যা করে ও যথেষ্ট অস্ত্রশস্ত্র দখল করে।
ফুলবাড়ী
রংপুর জেলার কুড়িগ্রাম মহকুমার ফুলবাড়ী থানা মুক্তিবাহিনীর দখলে, এই থানায় বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসনিক ব্যবস্থা চালু রহিয়াছে। উল্লেখযোগ্য যে, স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর হইতেই এই থানায় আওয়ামী কমিটির উদ্যোগে গঠিত হয় গণবাহিনী। এই গণবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী বর্তমানে ধরলা নদী বরাবর প্রতিরক্ষা লাইন(ডিফেন্স লাইন) স্থাপন করিয়া লালমনিরহাট হইতে পরিচালিত পাকিস্তানী সৈন্যদের আক্রমণ স্বার্থকভাবে প্রতিহত করিয়া আসিতেছে।
বিভিন্ন সমস্যা
এই এলাকার বাণিজ্যিক সম্পর্ক এখনও অধিকৃত এলাকার সহিত, সংশ্লিষ্ট থানায় জনসাধারণ অর্থনৈতিক সমস্যার সম্মুখীন হইয়াছে। বর্তমানে এখানে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ হইতে দুস্থ জনসাধারণের মধ্যে খাদ্য, বস্ত্র ও চিকিৎসা সাহায্য প্রদানের ব্যবস্থা করা বিশেষ প্রয়োজন। বিশেষতঃ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রণকারী লোকজনের পরিবারবর্গকে সাহায্য দেওয়া প্রয়োজন।
আঞ্চলিক প্রশাসন সমীপে
সম্প্রতি অবিলম্বে সাহায্যাদি প্রদান এবং বেসামরিক প্রশাসন ও মুক্তিবাহিনীর কাজের সুষ্ঠু সমন্বয় সাধনপূর্বক আদর্শ প্রশাসন ব্যবস্থা কায়েমের দাবীতে বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির পক্ষে একটি প্রতিনিধিদল উত্তরাঞ্চলের আঞ্চলিক প্রশাসনিক কর্মকর্তার সহিত সাক্ষাত করেন। তিনি অবিলম্বে মুক্তাঞ্চলে সাহায্য, পুনর্বাসন ও বেসামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠার সর্বপ্রকার ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস প্রাদান করিয়াছেন।
মনোবল অটুট
যাহা হউক, শত সমস্যা ও অসুবিধা সত্ত্বেও জনগণের মনোবল অটুট রহিয়াছে। প্রত্যেক রবিবার হইতে গড়ে ২/১ জন করিয়া সবলদেহী সুস্থ যুবকেরা মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করিয়াছে। মুক্তিবাহিনীর শক্তি দিন দিন বৃদ্ধি পাইতেছে।
তেঁতুলিয়া
দিনাজপুর জেলার তেঁতুলিয়া থানাও আগাগোড়াই মুক্ত। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এই থানার কোন গ্রামে আজ পর্যন্ত প্রবেশ করিতে পারে নাই। প্রত্যেক গ্রামের ঘর হইতেই সুস্থ-সক্ষম যুবকেরা মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করিয়াছে।
এই থানাটি বাংলাদেশ সরকারের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। মুক্তিবাহিনী এখান হইতে বোদা, পঁচাগড়, দেবীগঞ্জ, রুহিয়া, ঠাকুরগাঁও প্রভৃতি অঞ্চলে বহু অভিযান চালাইয়াছে। এই সব অভিযানে বহু পাক সৈন্য নিহত, বহু ব্রীজ ধ্বংস, ঠাকুরগাঁও (মহকুমা শহর) বিজলী সরবরাহ কেন্দ্র বিধ্বস্ত ও বহু রাজাকার খতম হইয়াছে।
…………………
.
রাশেদুজ্জামান রণ
<৬,১৭৪,২৯৮-২৯৯>
সংবাদপত্রঃ নতুন বাংলা ১ম বর্ষঃ ১০ম সংখ্যা
তারিখঃ ২১ অক্টোবর, ১৯৭১
সম্পাদকীয়
জঙ্গীশাহীর চক্রান্ত ব্যর্থ করুন
দস্যুসর্দার ইয়াহিয়া আবার যুদ্ধের হুঙ্কার ছাড়িয়াছে। বাংলাদেশে গণহত্যা শুরু করিবার পরদিনই অর্থাৎ ২৬শে মার্চ ইয়াহিয়া বিশ্ববাসীকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য বলিয়াছে অবস্থা “স্বাভাবিক” হইলেই সে তাহার প্রতিশ্রুতি মত কাজ করিবে। জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করিবে। ইহার পর ২৮শে জুন আর একটি বেতার ভাষণে কীভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হইবে এবং “দুষ্কৃতিকারী” অর্থাৎ আওয়ামী লীগ ও স্বাধীনতাকামী বাঙ্গালীদের দমন করার জন্য কী কী ব্যবস্থা নেওয়া হইয়াছে তাহারও একটি বয়ান দেয়। বলা বাহুল্যা এই দুইটি বেতার ভাষণেই পাকিস্তানের জঙ্গীশাহী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধটা যে ভারতীয় “অনুপ্রবেশকারী” ও কিছু “দুষ্কৃতিকারী”র কারসাজি উহা বলিতে বিস্মৃত হয় নাই। গত ২৩ বছরে পাকিস্তানী পররাষ্ট্রনীতির একটি স্তম্ভ ছিল ভারত বিরোধী প্রচারণা করা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় সেই চিরাচরিত সুরটি ইয়াহিয়া চক্র বর্জন করিবে ইহা আমরা কখনও আশা করি নাই।
কিন্তু গত ১২ই অক্টোবর বেতার ভাষণে ভারতের বিরুদ্ধে আর একবার যুদ্ধের হুমকী বিশেষ তাৎপর্য বহন করে বৈকি। অবশ্য পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র, জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রভৃতি পুরাতন প্রতিশ্রুতির বুলির ভাঙ্গা রেকর্ড ঘাতক ইয়াহিয়া বাজাইতে ভুলে নাই। দেখা গিয়াছে যে, ইয়াহিয়ার ঘাতকবাহিনীর বর্বরতা, নারকীয় অত্যাচার ও গণহত্যার বিরুদ্ধে সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালী এক মন এক প্রাণ হইয়া রুখিয়া দাঁড়াইয়াছে। ইয়াহিয়া টিক্কা চক্র সেদিন ইহা স্বপ্নেও আশা করিতে পারে নাই যে, তাহাদের নজিরবিহীন হত্যাকাণ্ড ও পাশবিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে বাঙ্গালী জাতি প্রতিরোধ গড়িয়া তুলিবে, পাল্টা আঘাত হানিবে। গ্রামেগঞ্জে শহরে বন্দরে শত্রুকে পদে পদে বাধা দিবে তাই পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের ঘটনাবলী সম্পর্কে ইসলামাবাদের জঙ্গী শাসকরা নতুনভাবে প্রচারণা শুরু করিবে। বিশ্ববাসীকে তাহারা বুঝাইবার চেষ্টা করিয়াছে যে, ভারতই বাংলাদেশের সমস্যা জিয়াইয়া রাখিয়াছে। ভারতে অব্যাহত শরণার্থী স্রোতের মুখেও প্রথম দিকে ইয়াহিয়া গলাবাজি করিয়াছে সর্বক্ষণ। তারপর এখন সুর পাল্টাইয়া বলিতেছে যে, ভারত শরনার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে বাধা দিতেছে। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ এখন তীব্র হইতে তীব্রতর হইতেছে দস্যুবাহিনীর অধিকৃত এলাকার উপর মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড আঘাতে আঘাতে তাই বেসামাল ইয়াহিয়া বারবার ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধের হুমকী দিতেছে। যে মিত্রদের উৎসাহে মন্ত্রণায় ইয়াহিয়া বাংলাদেশে গণহত্যা অব্যাহত রাখিয়াছে সেই মুরুব্বীদের পরামর্শেই সে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধের হুঙ্কার দিতেছে। এবারের হুঙ্কারের আগেভাগেই সে ভারতের সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করিয়াছে।
একথা আজ দিবালোকের মত স্পষ্ট যে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ইয়াহিয়ার গদি রক্ষা, ততোধিক একটি অবাস্তব ও চরম প্রতিক্রিয়াশীল রাষ্ট্র-পাকিস্তান রাষ্ট্রকে বিপর্যয়ের হাত হইতে রক্ষা করার জন্য ইসলামাবাদের জঙ্গী চক্রকে ভারত আক্রমণে উৎসাহিত করিতেছে। গত মার্চ মাস হইতে জুন মাস পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইয়াহিয়া সরকারকে জঙ্গী জেট বিমানের খুচরা অংশ এবং অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র তথা ট্যাঙ্ক ইত্যাদির খুচরা অংশ সরবরাহ করিয়াছে। বাংলাদেশে অভিযান চালাইয়া পাকিস্তানী বাহিনীর ক্ষয়ক্ষতি সত্ত্বেও উহার বিমান বহর কিংবা ট্যাঙ্ক বহর ও ভারী অস্ত্রশস্ত্র এমন কিছু ক্ষতিগ্রস্থ হয় নাই যে, তন্মূহুর্তেই এই সব খুচরা অংশ ও অস্ত্রশস্ত্রের প্রয়োজন পড়িয়াছিল। প্রয়োজনবোধে পাকিস্তানকে টিকাইয়া রাখার জন্য ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসাবেই ইহা মার্কিন সাহায্যের আগাম অংশ। এইভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে পাক ভারত সমস্যা হিসাবে মোড় ঘুরাইতে পারিলে
সাম্রাজ্যবাদী শক্তি বিশেষভাবে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এক ঢিলে দুই পাখি মারিতে পারিবে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পাক-ভারত সমস্যার অঙ্গ হিসাবে উহার পৃথক সত্ত্বা হারাইয়া পাক-ভারত সমস্যার লেজুড় হইয়া পড়িবে এবং সাবেক পাকিস্তানকে বহাল তবিয়তে সাম্রাজ্যবাদের আলালের ঘরের দুলাল হিসাবে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের দুষ্ট গ্রহ হিসাবে টিকাইয়া রাখা হইবে। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম ব্যর্থ হওয়ার একটি মাত্র অর্থ এই মহাদেশের গণতান্ত্রিক শক্তি দূর্বল হওয়া। বাংলাদেশের এই জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম প্রথমাবধি সাম্রাজ্যবাদবিরোধী একটি গণতান্ত্রিক আদর্শ ও জাতীয় মুক্তির জন্য বাঙ্গালীরা আজ অস্ত্র ধরিয়াছে। অপরদিকে পাক-ভারত যুদ্ধ বাঁধিলে সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এশিয়ার এই খণ্ডে শান্তি স্থাপনের নামে এবার মুরুব্বী সাজিয়া ভারতের প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির সহায়তায়-নয়াদিল্লীরই বর্তমান নিরপেক্ষ নীতিকে বর্জন করিতে বাধ্য করিতে পারিবে। এভাবে ভিয়েতনামে পরাজয়ের গ্লানি ও ক্ষয়ক্ষতি পোষাইয়া লওয়া যাইবে। প্রথমাবধি বাংলাদেশ সমস্যা “পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার” বলিয়া একদিকে সাম্রাজ্যবাদীদের বকধার্মিক সাজার চেষ্টা এবং অপরদিকে বাংলাদেশ সমস্যা অব্যাহত থাকিলে পাক-ভারত উত্তেজনা বৃদ্ধি পাইবে বলিয়া উহারা দিনরাত চিৎকার করিতেছে। তাহাদের এই সব বাকচাতুর্য ও প্রচারণা তাৎপর্যহীন নহে। এবারের ইয়াহিয়ার বেতার ভাষণ সেই ইঙ্গিতই বহন করে।
মূলতঃ সাম্রাজ্যবাদের এই চক্রান্ত ব্যর্থ করার দায়িত্ব আমাদের। ইয়াহিয়ার দস্যুবাহিনীর উপর আমাদের আক্রমণের প্রচণ্ডতা বৃদ্ধি করিতে হইবে এবং এই সময়ে যে সমস্ত বন্ধু রাষ্ট্র বিশেষ করে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন বিভিন্নভাবে সাহায্য করিতেছে উহা পরিপূর্ণভাবে অনুধাবন করিতে হইবে। আমাদের মধ্যে তথাকথিত বহু দেশপ্রেমিক হঠাৎ গজাইয়া উঠিয়াছেন-তাহারা আমাদের পাঁচ পার্টির এই ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের বিরুদ্ধে কটাক্ষ করিয়া থাকেন এবং ঘটনার বাস্তব বিশ্লেষণের নামে এই কথা বুঝাইতে চাহেন যে, বাংলাদেশ সরকারকে সোভিয়েত বক্ষে ঠেলিয়া দেওয়ার জন্য কারসাজি চলিতেছে। একদিকে সোভিয়েতের ভূমিকা আশানুরূপ নহে বলিয়া তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করা এবং অপরদিকে পাকিস্তানে মার্কিন অস্ত্র সাহায্যের বিরুদ্ধে মামূলী ধরণের নিন্দা করিয়া উহারা চলিয়াছেন। অথচ প্রতিদিনই সোভিয়েত ইউনিয়ন কোথায় বাংলাদেশ সম্পর্কে কী বলিয়াছে অণুবীক্ষণ যন্ত্র চোখে লাগাইয়া উহার মধ্যে ত্রুটি খোঁজেন, উল্লাসিত হইয়া উঠেন। যেন ভাবখানা এই যে, ‘বলি নাই রাশিয়া নিজের স্বার্থ ছাড়িয়া এক পাও বেশী বাড়িবে না। এই দেখো সোভিয়েত আলজেরিয়া যুক্ত ইস্তেহার, এই দেখ পদগর্নি ইরানে কী বলিয়াছেন।’ পাকিস্তানী বেতারের মিথ্যা প্রচারণাও এই ক্ষেত্রে কাজে লাগাইতে ইহারা পিছপা নহেন।
বাংলাদেশে ইয়াহিয়ার দস্যুবাহিনী অভিযান চালাইয়া যেখানে হিমশিম খাইতেছে সেখানে কিসের জোরে ইসলামাবাদের সামরিক জান্তা ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধের হুমকি দেয় ইহা একটি বালকও বলিতে পারে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের চক্রান্ত ছাড়া ইয়াহিয়ার সাধ্য নাই বাংলাদেশ সমস্যা সামনে রাখিয়া ভারতের সহিত যুদ্ধ বাঁধাইতে সে সাহসী হয়।
.
.
আব্দুল্লাহ আল নোমান
<৬,১৭৫,৩০০>
শিরোনামঃ অবিলম্বে সংগ্রামের সকল স্তরে ঐক্য চাই
সংবাদপত্রঃ নতুন বাংলা
তারিখঃ ২১ আগষ্ট, ১৯৭১
শত্রু চরম খেলায় মাতিয়াছে অবিলম্বে সংগ্রামের সকল স্তরে ঐক্য চাই (নিজস্ব ভাষ্যকার)
২০শে অক্টোবর। ৬ মাসেরও অধিককাল অতিবাহিত হইল। সংগ্রামের সকল স্তরে এখনও ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হইল না। মুক্তি সংগ্রামে ঐক্যের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করার বিশেষ প্রয়োজন পড়ে না। বিশেষতঃ বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম আজকের এই মুহূর্তে যে পর্যায়ে আসিয়া উপনীত হইয়াছে, সেখানে সংগ্রামের সকল স্তরে ঐক্য ও সংহতি স্থাপন একেবারে অপরিহার্য হইয়া উঠিয়াছে।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী খুঁটির জোরে পাকিস্তান বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে ভারতের কাজ বলিয়া প্রমাণের চক্রান্ত হিসাবে ভারতের বিরুদ্ধে বাঁধানোর সকল আয়জন প্রায় সম্পন্ন করিয়া ফেলিয়াছে। আমরা পূর্বেই বলিয়াছি মুক্তি সংগ্রামকে তীব্রতর করার মধ্য দিয়া এবং শত্রুকে চরম আঘাত হানিয়াই এই চক্রান্তের জবাব দিতে হইবে। অন্যথায় এই চক্রান্ত সফল হইলে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের ক্ষেত্রে সাময়িকভাবে হইলেও বিঘ্ন হইবে।
বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী লীগ এই ঐক্য ও সংহতির জন্য বারবার প্রচেষ্টা চালাইয়া আসিতেছে। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির এই প্রচেষ্টা চালাইয়া আসিতেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমেদও মুক্তিফৌজের সদ্য ট্রেইনিংপ্রাপ্ত জোয়ানদের এক সমাবেশে ভাষণ দানকালে এই ঐক্যের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করিয়াছেন।
আজ (বুধবার) ২০শে অক্টোবর আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হইতেছে, সময়ের দিক হইতে এই বৈঠক খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল আশা করেন যে, ইতিপূর্বে উপদেষ্টা পরিষদ গঠনের ব্যাপারে যে প্রজ্ঞা প্রদর্শন করা হইয়াছে, আওয়ামী লীগের এই বৈঠকে সংগ্রামের স্তরে ঐক্য স্থাপনের ব্যাপারে ততোধিক প্রজ্ঞা প্রদর্শিত হইবে।
আমাদের মনে রাখিতে হইবে যে, মুক্তিযুদ্ধে নিয়োজিত সংগ্রামী রাজনৈতিক দল ও শক্তিসমূহের সার্বিক ওইক্যই আমাদের শক্তি। অনৈক্যের ফলে শত্রুরই লাভ হইতে পারে। তাহা ছাড়া দেশমাতৃকার প্রশ্নে ভেদ বুদ্ধি সংকীর্ণতার কোন অবকাশ থাকিতে পারে না আর যদি থাকে তাহা হইলে তা শত্রুকেই সাহায্য করে শত্রু এখন চরম খেলায় মাতিয়া উঠিয়াছে। আসা করা হইতেছে, সংগ্রামী শক্তিসমূহের সুদৃঢ় সঙ্ঘতি স্থাপনের করিয়া শত্রুর খেলাকে বানচাল করা হইবে এবং বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে ত্বরান্বিত করা হইবে।
.
.
আব্দুল্লাহ আল নোমান
<৬,১৭৬,৩০১-৩০২>
শিরোনামঃ সম্পাদকীয় (স্বাধীনতার প্রশ্নে আপোষ নাই)
সংবাদপত্রঃ নতুন বাংলা (১ম বর্ষঃ ১৩শ সংখ্যা)
তারিখঃ ১১ নভেম্ভর, ১৯৭১
সম্পাদকীয়ঃ
স্বাধীনতার প্রশ্নে আপোষ নাই
আট মাস যাবৎ আমাদের মুক্তিযুদ্ধ চলিতেছে। একদিকে ইসলামবাদের জঙ্গী সরকারকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ অস্ত্র অস্ত্র সাহায্য করিতেছে, গণচীন তাহাকে অভয়বাণী শুনাইতেছে অন্যদিনে তাহারা বিশ্বশান্তির জিম্মাদার সাজিয়া বাংলাদেশের একটা শান্তিপুর্ণ মীমাংসার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করিতেছে।
ইয়াহিয়ার গনহত্যার মুখে ইহারা নীরব ছিল। আমেরিকা ও বৃটেন ইহাকে এখনও পাকিস্তানের আভ্যন্ত্রীণ ব্যাপার বলিয়া চালাইতেছে। ইন্দোনেশিয়ার ব্যাপক গণহত্যার সময় আমরা গণচীনকে ধিক্কার বাণী উচ্চারণ করিতে শুনিয়াছি। এমন কি কূটনৈতিক সম্পর্ক পর্যন্ত ছিন্ন করিয়াছে। কিন্তু বাংলাদেশের গণহত্যায় আজ মহাচীন নীরব। যুদ্ধের প্রশান্তি তার চোখেমুখে, এপ্রিল মাসে ব্যাপক গণহত্যার মুখে ঢাকায় বাক্স বাক্স গুড়া দুধ পাঠায়াছে সাহায্য বাবদ। কাদের জন্য সে সাহায্য ছিল, কেন দেওয়া হইয়াছিল আমরা জানি না।
ভারত ৯০ লক্ষ শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে। তাহাদের দায়দায়িত্ব কার্যতঃ একাই বহন করিতেছে। পাকিস্তানের উস্কানীর মুখে এখনও সংযমের পরিচয় দিতেছে। বাংলাদেশ সমস্যাকে এখন পাক ভারত সমস্যা রূপে দাঁড় করাইবার জন্য সাম্রাজ্যবাদীদের চোখের ঘুম গিয়াছে। তাহাদের চোখের ঘুম আরও একটি কারণে গিয়াছে। পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষার জন্য তাহাদের আশার গুড়ে বালি। বাংলাদেশ পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য লড়িতেছে। লক্ষ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে, হাজার হাজার মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে তাহারা ঘাতক ইয়াহিয়ার পাকিস্তানের ছত্রছায়ায় নামকাওয়াস্তে থাকিতে নারাজ। সাম্রাজ্যবাদীদের সাধের ঘাঁটি পাকিস্তানের এই হালে বিচলিত হইয়া তাহারা শরণার্থীদের মধ্যে টাকা ঢালিতেছে। মুক্তি সংগ্রামে শরিক অঙ্গদলগুলির মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টির জন্য টাকা ঢালিতেছে। কোন কোন রাজনৈতিক দলের নাম দিয়া সুকৌশলে ছয় দফার পক্ষে গণভোট নেওয়ার জন্য গোপনে শরনার্থীদের মধ্যে প্রশ্নাবলী ছাপাইয়া বিলাইতেছে। ইহাদের উদ্দেশ্য যেন মুক্তিযুদ্ধে শরিক আঙ্গদলগুলি পরস্পরকে সন্দহ করে। তারপর কাদা ছোড়াছুড়ি। নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষ। কিন্তু তাহাদের এইসব চালে দেশপ্রেমিক বাঙ্গালীদের আর ভোলানো যাইবে না।
একথা আজ পরিষ্কার করিয়া বলার সময় আসিয়াছে যে, ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ আমাদের মুক্তি সংগ্রামের চিরশত্রু। ইয়াহিয়ার জঙ্গীচক্রের হত্যাকান্ডে যে সব বড় বড় আদর্শের বুলি সত্ত্বেও নীরব থাকিয়াছে, সামান্য নিন্দা ভাষণে যাহাদের আপত্তি, পাকিস্তানের অখন্ডতার জন্য যাহারা মাথাব্যাথার পরিচয় দেন তাহারাও আমাদের মুক্তি সংগ্রামের পক্ষ নহে। আমাদের মুক্তি সংগ্রামের শত্রু তথাকথিত শরনার্থী বুদ্ধিজীবী যাহারা বাংলাদেশের এই দুঃসময়ের মিত্রদের উপর কটাক্ষ করিয়া টু পাইস কামাইতেছেন আর মুখে বলিতেছেন যে স্বাধীন বাংলাদেশ তাহাদের কাম্য। এই সব ভন্ড দেশপ্রেমিক সাম্রাজ্যবাদীদের দালালরা শ্মশানের প্রান্তচর বাসী জীবদের মতই ঘৃণ্য। দেশবাসীর উচিত ইহাদের চিনিয়া রাখা।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধে যাহারা নৈতিক সমর্থন যোগাইতেছে তাহাদের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালানোর অর্থ মুক্তিসংগ্রামের ক্ষতি করা, ইহা একটি বালকেও বুঝে কিন্তু আমাদের তথাকথিত স্বাধীন বুদ্ধিজীবীরা উহা বুঝেননা এমন নহে। আজ সোভিয়েত ইউনিয়ন, বিশ্ব শান্তি পরিষদ, বিশ্ব ইউনিয়ন ফেডারেশন বিশ্ব জনমত বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের পক্ষে সংগঠন করিতেছে। এইসব বুদ্ধিজীবীদের লেখায় তাহার স্বিকৃতি নাই।
কোথায় বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা বিশ্ব জনমত গঠনের জন্য কলম ধরিবেন তাহা না করিয়া, অন্ধ সোভিয়েত বিদ্বেষের বস্তাপচা খেউড় যত্রতত্র আওড়াইয়া মার্কিন প্রভুর মনোরঞ্জন করেন। আর তাদের মোসাহেবদের বাহবা কুড়াইয়া থাকেন।
বাংলাদেশ শত্রু কবলমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত যোদ্ধারা অস্ত্র সংবরণ করিবে না। পাকিস্তানের মধ্যে বাংলাদেশ সমস্যার সমাধানের কোন প্রস্তাব কখনই কোন অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য নহে। কোন মহলের এই ধরণের প্রচেষ্টার অর্থ মুক্তিযোদ্ধের পৃষ্ঠদেশে ছুরিকাঘাতের সামিল। দেশপ্রেমিক বাঙ্গালীরা এই ধরণের মীরজাফরী চক্রান্ত ঐক্যবদ্ধভাবে ব্যর্থ করিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সুর্যোদয়ের মতই অনিবার্য।
.
.
শফিকুল ইসলাম
<৬,১৭৭,৩০৩-৩০৪>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
ইয়াহিয়ার যুদ্ধ চক্রান্ত ও তাহার দোসররা | নতুন বাংলা ১ম বর্ষঃ ১৩শ সংখ্যা |
১১ নভেম্বর, ১৯৭১ |
ইয়াহিয়ার যুদ্ধ চক্রান্ত ও তাহার দোসররা
(নিজস্ব ভাষ্যকার)
বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম দমনে ব্যর্থ মনোরথ ইয়াহিয়া ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধের হুংকার দিয়াছে। গত আগষ্ট মাসে ইয়াহিয়া সদম্ভে ঘোষনা করিয়াছিল প্রয়োজন হইলে ভাততের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করিব। প্রথম হইতেই ইয়াহিয়া সাহেব বাঙ্গালী মুক্তিযোদ্ধাদের ‘ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী’ বলিয়া বিশ্ববাসীর চোখে ধোঁকা দিতে চাহিয়াছিল। ভারতে তাহার অত্যাচারে মুখে আশ্রয়গ্রহণকারী শরণার্থীদের ভারত কর্তৃক সীমান্তে প্রেরিত ভারতীয় বেকার বলিয়া মিথ্যা অপপ্রচার চালাইয়াছে।
ইয়াহিয়ার উদ্দেশ্য ছিল তথাকথিত ইসলামী রাষ্ট্র হইতে অবাঞ্চিত ব্যক্তিদের ভারতে তাড়াইয়া দেওয়া, বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ ধ্বংস সাধন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে রক্তের বন্যায় ডুবাইয়া দিয়া স্বীয় অপকর্মের বোঝা ভারতের ঘাড়ে চাপানো, সেখানে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ বাধাইয়া ভারতীয় মুসলিমদের জন্য মায়াকান্না এবং বিশ্বের দরবারে নিজেদের ২৪ বছরের সাম্প্রদায়িক শাসন-শোষণের পক্ষে সাফাই গাওয়া। কিন্তু জাগ্রত বাঙ্গালী হিন্দু মুসল্মান বৌদ্ধ খৃষ্টান নির্বিশেষে ইয়াহিয়ার এই শয়তানীর বিরুদ্ধে রুখিয়া দাঁড়াইয়াছে। সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের দুই যুগব্যাপী মুখোশ ছিঁড়িয়া ফেলিয়াছে। ভারত উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কবর রচনা করিতেছে।
স্বাভাবিক ভাবেই সাম্রাজ্যবাদী মহল বিশেষ ভাবে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ইহাতে প্রমাদ গুনিয়াছে, তাহারা ইয়াহিয়ার মুখের বুলি লুফিয়া লইয়াছে। পাক-ভারত উত্তেজনার অজুহাত তুলিয়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে বানচাল করিতে চাহিতেছে।
সাম্রাজ্যবাদীদের প্রত্যক্ষ উৎসাহে ইয়াহিয়া ভারত সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করিয়াছে। অন্ততঃ দুইবার সে স্পষ্টভাবেই ভারত আক্রমণ করিবে বলিয়া বড়াই করিয়াছে। সাম্রাজ্যবাদী সরকার উহার নিন্দা করা দূরে থাকুক একটু বিচলিত ভাব পর্যন্ত দেখায় নাই। এখন ভারত আত্মরক্ষার জন্য যেইমাত্র সীমান্তে সৈন্য মোতায়েন করিয়াছে অমনি তাহারা ভারতকে সংযম ধরিবার উপদেশ খয়রাতি শুরু করিয়াছে।
জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক পাঠাবার তাল মাঠে মারা যাওয়ার পর এবার সাম্রাজ্যবাদী মহল ভারত আক্রমনের জন্য পাকিস্তানকে উস্কানী দিতেছে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী সরকার ইয়াহিয়াকে অস্ত্র সরবরাহ করিতেছে। ফ্রান্স ও পশ্চিম জার্মানীও অস্ত্র দিতেছে বলিয়া খবর পাওয়া গিয়াছে। অন্ততঃ ইয়াহিয়ার উক্তি হইতে এ রকম একটা আভাস পাওয়া যায়। চীনে একটি সামরিক প্রতিনিধি দল পাঠাইয়াছে, উদ্দেশ্য ভারত আক্রমন করিলে চীনের কাছ হইতে কী ধরণের সাহায্য ও সমর্থন পাইবে উহা যাচাই করা। পিকিং কর্তৃপক্ষের সুর হইতে মনে হয় তাহারা সরাসরি এ ব্যাপারে এখনে হয়ত আগাইয়া আসিবে না। তবে মার্কিন সরকারের সহিত একটা অন্ততঃ মিল পাওয়া যায় চীনা অস্থায়ী পররাষ্ট্রমন্ত্রী পেং ফেইর মন্তব্যে। তিনি বাংলাদেশ প্রশ্নে ইহাহিয়ার কথিত সমাধানে বিশ্বাসী। তিনি পাকিস্তান ও ভারতকে বিরোধ মীমাংসার জন্য আহ্বান জানাইয়াছেন। এক কোটি শরণার্থী সম্পর্কে তিনি নীরব। কিন্তু পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষায় তাহার আগ্রহ হইতে বুঝা যায় তিনি বাংলাদেশে কী ধরণের সমাধান কামনা করেন। বলা বাহুল্য তাহার ধ্যান ধারনার সহিত বাস্তবতার কোন যোগ নাই।
সামরিক জোটের গাঁটছড়ায় আবদ্ধ পাকিস্তানের যুদ্ধদেহী মনোভাব চীনের চোখে পড়ে না। বারংবার পাকিস্তানকে আশ্বাস দিতেছে যে, বহিরাক্রমণের বিরুদ্ধে চীন তাহাকে সাহায্য করিবে ও সমর্থন জানাইবে। সাম্রাজ্যবাদীদের পান্ডা আমেরিকা পর্যন্ত এ কথা বিশ্বাস করে না যে, ভারত পাকিস্তান আক্রমন করিবে। অঠচ চীনের মত একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রপাকিস্তানের ফ্যাসিস্ট সরকারের আস্ফালনকে প্রশ্রয় দেয় ইহা দুঃখের বিষয়। চীনের সংগ্রামী ঐতিহ্যের ইহা বিরোধী।
পাক-ভারত সীমান্তে আজ যুদ্ধের ঘনঘটা। পাকিস্তান সমস্ত সীমান্ত রীতি লঙ্ঘন করিয়া সৈন্য সমাবেশ করিয়াছে। ভারতের আকাশসীমা লঙ্ঘন এবং ভারতীয় এলাকায় গোলাবর্ষন করিয়া যুদ্ধের উস্কানী দিতেছে এবং এখনও মুক্তিসংগ্রামীদের “ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী” বলিয়া ভারতকে আক্রমণকারী হিসাবে চিহ্নিত করিয়া যুদ্ধ বাধাইবার ফিকির খুঁজিতেছে।
একথা স্পষ্ট বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে পাক-ভারত যুদ্ধে রূপ দিয়া আমাদের স্বাধীনতার প্রশ্নটি ধামাচাপা দেওয়া ও সংগ্রাম বাঞ্চাল করাই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদদের আশু লক্ষ্য। ইসলামাবাদের জঙ্গীশাহী উহা কার্যকরি করিতে ব্যগ্র।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র সফরে গিয়াছেন। তাঁহার উদ্দেশ্য শরণার্থী সমস্যার মূলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম দমন করার জন্য ইয়াহিয়ার বর্বরতা কাজ করিতেছে তৎসম্পর্কে রাষ্ট্রপ্রধানদের দৃষ্টি আকর্ষণ। ব্রিটিশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাহার কথায় কর্ণপাত করে নাই। তাহার ইতাকে পাকিস্তানে আভ্যন্তরীণ ব্যাপার এবং পাক-ভারন উত্তেজনা হ্রাসের জন্য সীমান্ত হইতে উভয় পক্ষের সৈন্যাপসারণের ‘সদুপদেশ’ দিয়াছে। ইসলামী জাতীয়তাবাদের পক্ষে অবাঞ্চিত বাঙ্গালীদের নিধন ও বিতাড়নে ইয়াহিয়ার কলঙ্কিত হাতের সহিত বাঙ্গালীদের হাত মিলাইবার জন্য ইহারা উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়াছে। আর এই মহৎ কাজের জন্য পাক-ভারত যুদ্ধকে অনিবার্য করিয়া তোলাই ইহাদের লক্ষ্য। নিক্সন সরকার ইন্দিরা গান্ধীকে তাহাদের এই পরিকল্পনায় সামিল করার জন্য চেষ্টা করিয়াছে। কিন্তু ইন্দিরাজীর দৃঢ়তার কাছে নিক্সনের চাল ব্যর্থ হইয়াছে। বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী হীথ সাহেবও সুবিধা করতে পারেন নাই। এই দুই দেশে সাংবাদিক সম্মেলনে ইন্দিরাজীর চোখা চোখা জবাবে ঝানু সাংবাদিকগণও সুবিধা করিতে পারে নাই। এই পর্যায়ে ইন্দিরা তাহাদের প্রশ্নের জবাবে পাল্টা প্রশ্ন করেন উথান্ট অথবা অন্য কেহ কি শরণার্থীদের ভারতের ঘাড়ে চাপাইয়া দিয়া এখন ইয়াহিয়া সাহেব বলিতেছেন ভারত শরণার্থীদের ফিরিতে দিতেছে না, শরণার্থী সমস্যা সৃষ্টির দায়িত্ব স্মরণ করাইয়া দিয়াছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী তাহার সফরের ফলে বাংলাদেশের প্রকৃত সমস্যার চেহারাটা বিশ্বের চোখে আরও স্পষ্ট হইয়াছে।
কিন্তু সাম্রাজ্যবাদীরা হাল ছাড়িবার পাত্র নয়। তাহারা ভারত উপমহাদেশে যুদ্ধ বাধাইবার চক্রান্ত হইতে সরিয়া দাঁড়ায় নাই। বিশেষভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৩৬ লক্ষ ডলার মূল্যের অস্ত্র সরবরাহের লাইসেন্স বাতিল করিয়া সম্প্রতি সাধু সাজার চেষ্টা করিতেছে। কিন্তু সিয়াটো এবং সেন্টোভুক্ত পাকিস্তানের দোস্ত রাষ্ট্রদের মাধ্যমে অস্ত্রশস্ত্র এমনকি বিমান সরবরাহ পুরাদমে চলিয়াছে।
.
.
শফিকুল ইসলাম
<৬,১৭৮,৩০৫>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
সম্পাদকীয়ঃ নিক্সনের হুমকি ও সপ্তম নৌবহর |
নতুন বাংলা ১ম বর্ষঃ ১৮শ সংখ্যা |
১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ |
সম্পাদকীয়
নিক্সনের হুমকি ও সপ্তম নৌবহর
বাংলাদেশ মুক্তির দ্বারপ্রান্তে। ঢাকা শহরকে শত্রুকবলমুক্ত করার জন্য তুমুল যুদ্ধ চলিতেছে। বাংলাদেশের মাটি হইতে হানাদারী শত্রুকে নিশ্চিহ্ন করার এই চূড়ান্ত সংগ্রামের মূহূর্তে নিক্সন হুমকি দিয়াছে। আক্রমণকারী ইসলামাবাদের জঙ্গীচক্রকে যুদ্ধ বন্ধ করিতেবলার পরিবর্তে ভারতের বিরুদ্ধে হুঙ্কার দিতেছে। জঙ্গী ইয়াহিয়ার বুট চুম্বনকারী মাও সেতুঙ-এর চীন তার দোসর।
বাংলাদেশে সরাসরি হস্তক্ষেপের জন্য নিক্সন সরকার বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহর পাঠাইয়া দিয়াছে। এইভাবে ঊনবিংশ শতাব্দীর গানবোট পলিসি আজ নিক্সন সরকার গ্রহন করিয়াছে। ভারতকে ভয় দেখাইয়া ও হুমকি দিয়া বাংলাদেশে শত্রুর বিরুদ্ধে মিত্রশক্তির অভিযানকে বানচাল করাই ইহার লক্ষ্য। ইহা নিক্সন সাহেবদের পুরান খেলা। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর ১৯৪৮ সালে ইতালীর সাধারণ নির্বাচনের সময় আতলান্তিক সাগরে ও ভূমধ্যসাগরে আমেরিকা নৌবহর পাঠাইয়াছিল। লেবানন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় ১৯৫৩ সালে ৬ষ্ঠ নৌবহর হইতে বৈরুতে সৈন্য নামাইয়াছিল। দক্ষিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে গণতান্ত্রিক সরকারের পতন ঘটানোর জন্য সেখানকার সমুদ্রে বার বার নৌবহর পাঠাইয়াছে আজ স্বাধীন বাংলাদেশকে আঁতুরঘরে গলাটিপিয়া মারার জন্য সপ্তম নৌবহর পাঠাইয়াছে। বাংলাদেশের দরিয়া বঙ্গোপসাগরে। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশকে গলা টিপিয়া মারা তাহার অসাধ্য। তবুও সপ্তম নৌবহর পাঠাইবার পিছনে তাহার আরও একটি উদ্দেশ্য রহিয়াছে তাহা হইল স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারকে ভয় দেখানো। এজন্যই বাংলাদেশের মার্কিন নাগরিকদের নিরাপত্তা বিধান ও উদ্ধারের জন্য নৌবহর পাঠান হইয়াছে বলিয়া সাফাই গাহিতেছে। যেখানে পাকিস্তানের করাচী প্রভৃতি শহরের মার্কিন নাগরিকদের বিমান অপসারন করা হইয়াছে সেখানে বাংলাদেশে নৌবহর পাঠানো কেন? বাংলাদেশের ঢাকা শহর হইতে অন্যান্য বিদেশী যাত্রীদের যেভাবে বিমানে অপসারন করা হইয়াছে তাহারা সে পথে কেন গেল না? তাহাদের উদ্দেশ্য দ্বিবিধ, আত্মসমর্পণে ইয়াহিয়া প্রথমে অনুমতি দিয়াছিল কিন্তু পরে মত পাল্টাইয়াছে। সপ্তম নৌবহরের গতিবিধি পাকিস্তান সরকার উল্লাসের সহিত বারবার ঘোষনায় উল্লেখ করিতেছে।
প্রথম উদ্দেশ্যের কথা আগেই বলিয়াছি। অপরদিকে ‘কাগজের বাঘে’র নয়া দোস্ত চীন ইয়াহিয়ার পক্ষ লইয়া জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে আর পিকিং-এর বেতারে ভারতবিরোধী কুৎসা চালাইতেছে। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের পদে পদে বিরুদ্ধচারণ করিতেছে।
কোথায় গেল তাহার বড় বড় সাম্রাজ্যবাদবিরোধী বুলি। সপ্তম নৌবহরের এই গতিবিধিতে চীন নীরব কেন? আমরা চীনকে তার নিজের চরকায় তেল দিতে বলি। দেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ তাইওয়ানে মার্কিন ঘঁটি তাহার চোখে পড়ে না, চোখে পড়ে বাংলাদেশে ভারতীয় সৈন্যের অভিযান। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ তাইওয়ান দখন করিয়া রাখিয়াছে। তাই নিয়া জাতিসংঘ ও নিরাপত্তা পরিষদে তাহার গলাবাজী শুনি না। শুনি ভারত নাকি পাকিস্তানের একটা অংশ দখল করিয়া নিতেছে। মহান চীনকে তাহার বর্তমান নেতারা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের গাটাবোধে পরিনত করিয়াছে।
তাই মার্কিন সপ্তম নৌবহরের গতিবিধির সহিত তাল মিলিইয়া চীন ভারতের উত্তর সীমান্তে তিব্বতে সৈন্য মোতায়েন করার উদ্যোগ নিয়াছে। তিব্বতে চীনা সৈন্য চালাচলের পিছনে ভারতকে ব্লাকমেইল করার দুরভিসন্ধি রহিয়াছে।
.
.
শফিকুল ইসলাম
<৬,১৭৯,৩০৬-৩১১>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
স্বাধীন বাংলাদেশে সরকার সমীপেষু | নতুন বাংলা ১ম বর্ষঃ ১৮শ সংখ্যা |
১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ |
স্বাধীন বাংলাদেশে সরকার সমীপেষু
আজ একথা বলিবার প্রয়োজন রাখে না যে-গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের আদর্শকে সামনে রাখিয়াই এ দেশের কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র ও যুবক স্বাধীনতার লড়াইয়ে জীবন দিয়াছে। জীবন ছাড়া যেমন জীব হয় না তেমনি গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র ছাড়া স্বাধীনতার কোন অর্থ হয় না। কৃষকরা বলাবলি করিতেছে এবারে তারা জমি পাইবে, পাটের ন্যায্য মূল্য পাইবে, প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় জিনিষপত্রের দাম কমিবে, ঘুষ রিশওয়াত ও অন্যান্য দুর্নীতির হাত হইতে মুক্তি পাইবে। শ্রমিক মনে করে সে তার বাঁচার মত ন্যায্য মজুরী পাইবে। ছাত্র ভাবে এবার তার লেখাপড়ার সুযোগ হইবে। যুবক মনে করে এবার তাঁর চাকুরীর সংস্থান হইবে। এক কথায়- আজ এ দেশের কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, শিক্ষক, বৃদ্ধ, নর-নারী, ডাক্তার, কবিরাজ, দোকানদার-ব্যবসায়ী রিক্সাওয়ালা ক্ষেতমজুর আপামর জনসাধারণ ভাবিতেছে-পারিব এবারে মানুষের মত বাঁচিতে কথা বলিবার অধিকার পাইব। মানুষকে মানুষের মত বাঁচিতে দেওয়া ও তাঁকে কথা বলিবার অধিকার দেওয়া এবং তার কথা মত কাজ করা এই-ই হইতেছে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের সারমর্ম। এই লক্ষ্যকে সামনে রাখিয়াই আজ আমাদের আগাইয়া যাইতে হইবে। গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রে বিশেষ করিয়া সমাজতন্ত্রে এক লাফে পৌঁছান যায় না তাই, আমাদের তিন পর্যায়ে কাজ করিয়া যাইতে হইবে।
প্রথম পর্যায়ঃ
১। অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকারের স্বরূপ
ক) বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণকারী দলসমূহের প্রতিনিধিদের লইয়া সরকার গঠন করিতে হইবে।
খ) রাষ্ট্রের প্রশাসন ব্যবস্থা প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী এবং তাহার মন্ত্রীসভার সদস্যগণ পরিচালনা করিবেন। স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী দলগুলি কর্তৃক ইহারা মনোনীত হইবেন।
গ) ক ধারায় সুস্পষ্টভাবে ঘোষিত নীতি সরকারের সকল স্তরে অনুসরন করিতে হইবে।
ঘ) সরকারী পদস্থ কর্মচারী এবং স্বায়াত্তশাসিত, আধা-স্বায়াত্তশাসিত সরকারী সংস্থার পদস্থ কর্মচারী ও সাধারণ কর্মচারী এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মধ্য হইতে দালালদের বহিস্কারের জন্য উপযুক্ত স্ক্রীনিং পদ্ধতি স্থির করিতে হইবে।
ঙ) সকল স্তরে যেমন থানা, মহকুমা, জিলা, বিভাগ এবং জাতীয় স্তরে অন্তবর্তীকালীন সময়ে প্রশাসন পূর্বের মত চলিতে থাকিবে। বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থে পদস্থ কর্মচারী ও সাধারণ কর্মচারীদের কার্যনির্বাহ করিতে হইবে।
চ) পাকিস্তান সরকারের সর্বপ্রকার দমনমূলক ও গণবিরোধী আইন, অর্ডিন্যান্স এবং সার্কুলার (ঘোষনা) প্রত্যাহার করিতে হইবে।
ছ) যুদ্ধাপরাধী এবং দালালদের বিচারের জন্য বিশেষ আদালত স্থাপন করিতে হইবে এবং বিধিবিধান প্রণয়ন করিতে হইবে।
জ) মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ কাজ, সাহস ও ত্যাগের স্বীকৃতিদান এবং তজ্জন্য পুরস্কৃত করার ব্যবস্থা করিতে হইবে।
২। শরণার্থীদের পুর্নবাসন
ক) শরনার্থীদের ফিরাইয়া লইবার জন্য ভারত ও বার্মা সরকারের সহযোগিতায় উপযুক্ত লিয়াজোঁ (যোগাযোগ) ব্যবস্থা সংগঠিত করিতে হইবে।
খ) শরণার্থীদের আশ্বাস প্রদান ও নিরাপদ প্রত্যাবর্তনের নিমিত্ত সকল শরনার্থী শিবির ও শরণার্থীদের আস্তানাগুলিতে সর্বদলীয় কমিটিগুলিকে সফরে যাইতে হইবে।
গ) স্ব স্ব এলাকায় শরনার্থীদের গ্রহনের নিমিত্তে উপযুক্তভাবে সংগঠিত অভ্যর্থনা ব্যবস্থা গড়িয়া তুলিতে হইবে। এইসব অভ্যর্থনা কমিটি সর্বদলীয় ভিত্তিতে হইতে হইবে।
ঘ) শরনার্থীদের স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি ফেরৎ পাওয়ার ব্যবস্থা করা।
ঙ) শরনার্থীদের পুর্নবাসনের জন্য সাহায্য সংগঠিত করা।
চ) সমাজসেবামূলক ত্রানকার্য সংগঠিত করা-অনাথ, বিধবা, বৃদ্ধ, এবং পঙ্গু ব্যক্তিদের রক্ষনাবেক্ষণ।
ছ) জমি বেদখল, জোরপূর্বক বাড়ী দখল এবং এক এলাকার লোক অন্য এলাকায় জোরপূর্বক অপসারণ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা।
৩। খাদ্য সরবরাহ
ক) দেশের অভ্যন্তর ও বাহির হইতে খাদ্য সংগ্রহের নিমিত্তে এবং বিভিন্ন এলাকার প্রয়োজন অনুসারে ইহার সমবন্টনের জন্য সরকারের সরকারী সংস্থা ও সংগঠিত করিতে হইবে।
খ)মজুতকরণ, চোরাকারবারি, মুনাফাবাজীর ক্ষেত্রে কঠোর শাস্তিদানের ব্যবস্থা করিতে হইবে।
গ) খাদ্য ও জীবনধারণের পক্ষে অপরিহার্য দ্রব্যাদির উপযুক্ত মূল্য বাঁধিয়া দিতে হইবে যেন উৎপাদকগণ তাহাদের পণ্যের ন্যায্য মূল্য পাইতে পারে।
ঘ) যথারীতি ফসলকাটা ও বীজ বপনের নিশ্চয়তার সপক্ষে ব্যবস্থা গ্রহন করিতে হইবে।
ঙ) সার, কীটনাশক ঔষধ ও শস্যেরর রোগ নিবারক ঔষধের ব্যবস্থা করিতে হইবে।
৪। যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা
ক) সকল ক্ষতিগ্রস্থ বিমান বন্দর, সড়ক, সেতু, আভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল, টার্মিনাল, খেয়াতরী রেল লাইন, অবিলম্বে মেরামত করিতে হইবে।
খ) যাত্রীসাধারণ বহন ও মালবহনের জন্য সকল বে-সরকারী সরকারী যানবাহন সরকারের কর্তৃত্বে লইতে হইবে। এবং অবিলম্বে মেরামত করিতে হইবে।
গ) টেলিগ্রাফ, টেলিফোন, টেলিকমিউনিকেশন (টেলিযোগাযোগ) এবং ডাক ব্যবস্থা অবিলম্বে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করিতে হইবে।
ঘ) যাত্রীসাধারণ ও মাল বহনের জন্য সরকারী পরিবহনের ভাড়া শতকরা ২৫ ভাগ হ্রাস করিতে হইবে।
ঙ) রেডিও ও টেলিভিশন কেন্দ্র চালু করিতে হইবে। সর্বদলীয় উপদেষ্টা কমিটির নির্দেশ মোতাবেক রেডিও টেলিভিশনে প্রচার কার্য চালাইতে হইবে।
৫।সংবাদপত্র ও সংবাদ প্রচার মাধ্যম
ক) পাক জঙ্গীচক্র সমর্থনকারী ও সহযোগী সংবাদপত্র ও সংবাদ সরবরাহ প্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্য সংবাদ ও মতামত প্রচারমাধ্যম বাজেয়াপ্ত করিতে হইবে। বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী বাংলাদেশে যে সকল সংবাদপত্র বর্তমানে চালু রহিয়াছে সেগুলি নিষিদ্ধকরিতে হইবে। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ সামরিক জান্তার আক্রমনের পর সংবাদপত্রগুলি যে নামে প্রকাশিত হইত সে নামে সেগুলিকে প্রকাশের অনুমতি দেওয়া চলিবে না।
৬।বিদ্যুত সরবরাহ
ক) সকল ক্ষতিগ্রস্থ বিদ্যুৎ কেন্দ্র মেরামত করিতে হইবে। এবং বিদ্যুৎ সরবরাহ পুনরায় স্থাপন করিতে হইবে।
খ) বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু রাখার জন্য ব্যবস্থা অবলম্বন করিতে হইবে।
গ) গ্যাস সরবরাহ পুনরায় করিতে হইবে।
৭। শিক্ষাব্যবস্থা
ক) প্রাথমিক এবং উচ্চ বিদ্যালয়, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অবিলম্বে শিক্ষাদান কার্য শুরু করিতে হইবে।
খ) জাতীয় প্রয়োজনের উপযোগী এবং স্বাধীন বাংলাদেশের আশা-আকাঙ্ক্ষার উপযোগী পাঠ্যসূচীর আশু সংশোধন করিতে হইবে এবং অবিলম্বে উহা চালু করিতে হইবে।
গ) ১৯৬৯ সাল হইতে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে অংশগ্রহনের জন্য যে সকল ছাত্রের শিক্ষাজীবনের ক্ষতিগ্রস্থ হইয়াছে তাহাদের ক্ষেত্রে বিশেষ বিবেচনা করিতে হইবে।
ঘ)মাতৃভূমির মুক্তির সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী যুবকদের ক্ষেত্রে তাহাদের অধ্যয়ন চালাইবার জন্য আর্থিক সাহায্যসহ বিশেষ বিবেচনা বাঞ্চনীয়।
চ) বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে যে সকল শিক্ষক, অধ্যাপক এবং শিক্ষাবিভাগ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অন্যান্য পদস্থ কর্মচারী আয়ুব ও ইয়াহিয়া সরকারকে সহযোগিতা করিয়াছেন বলিয়া প্রমাণ পাওয়া যাইবে তাহাদের কঠোর দন্ড এবং শাস্তিদানের ব্যবস্থা করিতে হইবে।
৮। ধর্মীয় ও ভাষাগত সংখ্যালঘু
ধর্মীয় ও ভাষাগত ইত্যাদি সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে রুখিয়া দাড়াতে হইবে। ধর্মীয় ও ভাষাগত সঙ্খ্যালঘুদের রক্ষার জন্য ব্যবস্থা অবলম্বন করিতে হইবে।
৯। যুদ্ধাপরাধ এবং দালাল
ক) যুদ্ধাপরাধী ও দালালদের স্ক্রীনিং এর জন্য সংস্থা স্থাপন করিতে হইবে।
খ) যুদ্ধাপরাধী ও দালালদের শাস্তিদানের জন্য বিশেষ আদালত স্থাপন করিতে হইবে।
গ) যুদ্ধাপরাধী ও দালালদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করিয়া উহা রাষ্ট্রের নিকট গচ্ছিত রাখিতে হইবে।
এইভাবে দখলকৃত গ্রাম্য কৃষিজমি ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বিলিবন্টন করিতে হইবে।
১০। মুক্তিবাহিনী
ক) জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে অংশগ্রহণকে জাতীয় সম্মান বলিয়া স্বীকৃতি দিতে হইবে এবং মুক্তিবাহিনীর প্রতিটি সদস্য যেন তাহার এই দেশ সেবার উপযুক্ত স্বীকৃতি পান।
খ) শিক্ষালাভের জন্য মুক্তিবাহিনী তরুন্দের বিশেষ সুবিধা দিতে হইবে।
গ) সাহসিকতার জন্য পুরষ্কার দানের রীতি প্রচলন করিতে হইবে।
ঘ) বর্তমানে মুক্তিবাহিনীতে যুদ্ধরত তরুন্দের বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী ও মিলীশিয়াতে যোগদানের ইচ্ছা প্রকাশ করিলে তাহাদের গ্রহন করিতে হইবে।
১১। জনস্বাস্থ্য
ক) সকল হাসপাতাল, মেডিক্যাল কলেজ প্রসুতিসদন, গ্রাম ও শহরের শিশু স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অবিলম্বে দিন রাত কাজ শুরু করিতে হইবে।
খ) ঔষধ সরবরাহের প্রয়োজন মিটাইবার জন্য সকল ঔষধ প্রস্তুত শিল্পকারখানা কর্মক্ষম করিতে হইবে এবং উৎপাদন চালু করিতে হইবে।
গ) জীবন রক্ষাকারী ঔষধ আমদানীর জন্য অবিলম্বে ব্যবস্থা অবলম্বন করিতে হইবে।
১২। শাসন্তান্ত্রিক সমস্যা
ক) একটি অর্ন্তবর্তীকালীন শাসনতন্ত্র গ্রহন করিতে হইবে।
১৩। সর্বদলীয় কমিটি
ক) জেলা হইতে শুরু করিয়া ইউনিয়ন স্তরে সকল পর্যায়ে সর্বদলীয় কমিটি স্থাপন করিতে হইবে। উপরে বর্ণিত লক্ষ্য অর্জনের নিমিত্ত সরকারের প্রশাসনিক সংস্থাকে স্থানীয় সর্বদলীয় কমিটিগুলির সর্বাধিক সহযোগিতা ও পরামর্ষ গ্রহন করা উচিত হইবে।
দ্বিতীয় পর্যায়ে
স্বাধীন বাংলার রূপ্রেখা
(১) যে এক কোটি দেশবাসী পাক সৈন্যের বর্বর অত্যাচারে তাহাদের প্রানপ্রিয় মাতৃভূমি ফেলিয়া প্রতিবেশী বন্ধুরাষ্ট্র ভারত ও বার্মায় আশ্রয় গ্রহন করিতে বাধ্য হইয়াছেন, তাহাদিগকে পূর্ণ মর্যাদার সহিত দেশে ফিরাইয়া আনিতে হইবে।
(২) বাংলাদেশের স্বাধীনতার লড়াইয়ে সকলেই স্পষ্টভাবে দেখিয়াছেন-আমেরিকা, চীন অন্যান্য কয়েকটি রাষ্ট্র আমাদের প্রতি দুষ্মনি করিয়া আসিতেছে। তাহাদের ও তাহাদের এজেন্ট মুস্লীম লীগ, জামাতে ইসলাম, নেজামে ইসলাম, পি-ডি-পি এবং চরম বামপন্থীদের বিরুদ্ধে দেশবাসীকে সর্বদাই হুঁশিয়ার থাকিতে হইবে।
(৩) এই চরম বিপদের দিনে যে সব বন্ধুরাষ্ট্র (ভারত, রাশিয়া, পোলান্ড ও অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র) আমাদের বিভিন্নভাবে সাহায্য করিয়াছেন, তাহাদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকিতে হইবে।
(৪) স্বাধীন বাংলাদেশকে গড়িয়া তুলিতে হইবে স্বাধীন প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে। বলাবাহুল্য ইহা হইবে একটি সত্যিকারের ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র অর্থাৎ সকল ধর্মের সমান অধিকার থাকিবে।
(৫) পার্লামেন্ট হইবে সার্বভৌম-জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই দেশ শাসন করিবেন। প্রাপ্তবয়স্করাই ভোট দিতে পারিবেন। নির্বাচন হইবে মুক্ত।
(৬) বিচার বিভাগ শাসন বিভাগ হইতে পৃথক হইবে।
(৭) নর-নারী জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলের সমান অধিকার থাকিবে।
(৮) নিরপেক্ষ ও স্বাধীন বৈদেশিক নীতি গ্রহন করিবে। ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রভৃতি গণতান্ত্রিক ও সামাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশগুলির সহিত সখ্যের সম্পর্ক গড়িয়া তুলিবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতা সগ্রামীদের স্বপক্ষে দাঁড়াইবে। সিন্ধি, বালুচ, পাঠান প্রভৃতি নিপীড়িত জাতির সহিত মৈত্রি সম্পর্ক গড়িয়া তুলিবে।
(৯) সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহের সহিত কোনরূপ অসম চুক্তি করিবে না।
(১০) দেশের একচেটিয়া বৃহৎ পুঁজিপতিদের অধিকার খর্ব করা হইবে। ভারী ও মূল শিল্প জাতীয়করণ করিবে একচেটিয়া পুজিবাদ গড়িয়া উঠিতে দিবে না। ছোট ও মাঝারী জাতীও অর্থনৈতিক কর্মকান্ড উৎসাহিত করিবে। ব্যাঙ্ক, ইনসিওরেন্স, বৈদেশিক বাণিজ্য রাষ্ট্রায়াত্ত করা হইবে।
(১১) ভূমির সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করিবে। অতিরিক্ত মালিকদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিবে। বাড়তি জমি গরীব ও ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করিবে।
(১২) শ্রমিক কর্মচারীদের ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার ও ন্যায্য মজুরির নিশ্চয়তা বিধান করিবে। ক্ষেত মজুররা যাহাতে কাজ পায় ও ন্যায্য মজুরী পায় মূল্য কৃষককে দিবার সুব্যবস্থা করিবে।
(১৩) পাট শিল্প ও চা শিল্প জাতীয়করণ করা হইবে এবং কৃষক যাহাতে পাটের ন্যায্য মূল্য পায় তাহার বাস্তব ব্যবস্থা করিবে। অন্যান্য কৃষিপণ্যের ন্যায্য মূল্য কৃষককে দিবার সুব্যবস্থা করিবে।
(১৪) দালালদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করিবে।
(১৫) বাক ও ব্যক্তি স্বাধীনতা, সভাসমতি ও সংগঠন করার নিশ্চয়তা থাকিবে।
(১৬) জনগণের মিলিশিয়া থাকিবে।
(১৭) শিক্ষা ব্যবস্থাকে বৈজ্ঞানিক মতে আধুনিকীকরন করিবে। মাতৃভাষাই হইবে শিক্ষার মাধ্যম।
(১৮) সার্বজনীন অবৈতনিক শিক্ষার মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত চালু করিতে হইবে।
(১৯) কারিগরী শিক্ষার প্রসারের উপর গুরুত্ব দিতে হইবে।
(২০) জাতী মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহঙ্কারীদের যথাযোগ্য মর্যাদা ও স্বীকৃতি প্রদান করিবে। ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারবর্গকে সাহায্য দিবে।
(২১) শোষন্মুক্ত স্বাধীন বাংলা গঠনের চেষ্টা করিতে হইবে।
তৃতীয় পর্যায়ে
সমাজতন্ত্র
এ যুগ সমাজ তন্ত্র উত্তরণের যুগ। দুনিয়ার বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন পথে সমাজতন্ত্রের দিকে আগাইয়া চলিতেছে। বাংলাদেশ ও তার নিজস্ব পথেই সমাজতন্ত্রের দিকে আগাইয়া চলিয়াছে। তবে আমাদের কাজ মেকি ও বাচনিক সমাজতন্ত্র সম্পর্কে হুঁশিয়ার থাকিতে হইবে। সোনার যেমন পিতলা কলসী হয় না, কানা ছেলের নাম ‘পদ্মলোচন’ হয় না তেমনি বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র ছাড়া অন্য কোন সমাজতন্ত্র ও সত্যিকারের সমাজতন্ত্র নয়।
এ পর্যায়ে আমাদের সমাজতন্ত্রে উত্তরণ কর্মসূচী নিতে হইবে।
.
.
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
<৬,১৮০,৩১২>
শিরোনাম | সংবাদ পত্র | তারিখ |
সম্পাদকীয়ঃ অভ্যুদ্য় |
মুক্ত বাংলা ১ম বর্ষ ঃ ১ম সংখ্যা |
২০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ |
সম্পাদকীয়
অভ্যুদ্য়
মুক্তবাংলার প্রথম সম্পাদকীয় নিবন্ধনটা লিকতে বসে সহসাই মনে পড়ে গেল একদা একটি কিশোর বালকের জিজ্ঞাশাঃ বাঙ্গালী জাতির কি কোন ইতিহাস নেই? এই যেমন গ্রীকদের রয়েছে, মীশরিয়দের রয়েছে, ফরাশিদের, এমনকি ইংরেজদেরও..
সময়টা ছিল নির্বাচন প্রস্তুতিকাল। জনৈক রাজতিক বন্ধুর বৈঠকখানায় বসেছিলাম। আমাদের আলোচ্য বিষয়ের কেন্দ্রবিন্দু ছিল বাঙ্গালী জাতি। কিন্তু তবুও কিশোরটির জিজ্ঞাশার সঠিকমিমাংশায় নিস্পত্তি করতে পারিনি কেউ। কারণ বাংলার ইতিহাস ও বাঙ্গালী জাতি খুব স্পষ্ট ছিলোনা তখনো।
অথচ ভাবতেও পারিনি বাঙ্গালী জাতির সত্যিকার ইতিহাস রচনার মালমশলা তৈরি হতে যাচ্ছে- শীঘ্রই তার সূচনা হবে। ইহাহিয়া খাঁ তার পান্জাবী দস্যুবাহিনীর দ্বারা বাংলার বুকে নজিরবিহীন গণহত্যা ও পৈশাচিক কার্যক্রম চালিয়ে পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চাইবে বাংলাদেশের স্বত্ত্বাকে। কিন্তু রক্তাক্ত হয়ে জেগে উঠবে বাংলাদেশের জনগণ। দেশপ্রেমের অগ্নিপরীক্ষায় সগৌরবে হবে উত্তীর্ন। অভ্যুদ্যয় হবে এক নতুন জাতির যার একমাত্র পরিচয়ঃ বাঙ্গালী।
আজ সেই জাতির জন্ম হয়েছে। ঐক্য, সাহস ও সংগ্রামী মনোবলে তারা অপরাজেয়। তারা রচনা করে চলেছেন নিজেদের সত্যিকার ইতিহাস।
সাপ্তাহিক মুক্তবাংলা – স্বাধীন বাঙ্গালী জাতিরই এক কন্ঠস্বর। তাই তার চলার পথে দেশপ্রেমে দীক্ষিত বাঙ্গালী জাতিকে সশ্রদ্ধ অভিবাদন জানিয়ে তার যাত্র শুরু করলো
-জয়বাংলা
- মুক্ত বাংলাঃ সাপ্তাহিক। বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রাম সিলেট জেলার স্বাধীন নির্ভীক মুখপাত্র। সম্পাদক পরিষদের সভাপতিঃ আবুল হাসনাত সাআদত খান। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক আকাদ্দস সিরাজুল ইসলাম। আবুল হাসনাত কর্তৃক মুক্তবাংলা প্রেশ থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। ভারতীয় ঠিকানাঃ প্রযত্নে- এ এম চৌধুরী, করিমগন্জ, আসাম।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
<৬,১৮১,৩১৩>
শিরোনাম | সংবাদ পত্র | তারিখ |
দখলীয় এলাকায় পাকিস্তানী শাসন অচল |
মুক্ত বাংলা ১ম বর্ষ ঃ ১ম সংখ্যা |
২০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ |
দখলীয় এলাকায় পাকিস্তানী শাসন অচল
মুজিবনগর হতে বিশ্বস্ত সুত্রে জানা গেল যে- সদ্য আগত শরনার্থীরা বলেন – বেশ কিছুদিন আগে থেকেই পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশে প্রচার করছিলেন যে খুব শীঘ্রই সামরিক শাসনের অবসান ঘটবে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে ঢাকা, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, সিলেট, কুমিল্লা, চট্রগ্রাম, রাজশাহী এবং রংপুর থেকে যে খবর পাওয়া গেছে, তাতে দেখা যায় যে, ঐ সকল জেলার সরকারী অফিস, কাছারী এবং আদালতে শতকরা ২৫ জনের বেশী কর্মচারী কাজে যোগদান করেনি। জনৈক শরনার্থী বলেন যে ফারদপুর শহরে আদালতে একজন বিচারকও নেই – শুধুমাত্র দুইজন সামরিক অফিসার আদালতের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। এদের কাছে বিচারের জন্য এখনো কোন মামলা আসেনি। এ অবস্থায় টিক্কা খাঁনের স্থলে ডাঃ মালিককে গভর্নর করায় কোন পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছেনা। রংপুরের সংবাদে জানা যায় যে, এখানকার জজ ও মুন্সেফ পালিয়ে গেছেন। কয়েকজন অবাঙ্গালী অফিসার নিয়োগ করা হচ্ছে। কিন্তু লোকের আস্থা ফিরে অসছে না।
ঢাকায় প্রত্যক্ষ্যদর্শীর বিবরনে প্রকাশ যে – সেখানকার অবাঙ্গালী ব্যবসায়ীরা ব্যবসা গুটানোর তালে আছেন ।
মেয়ে ছেলেদের তারা পূর্বেই করাচিতে স্থানান্তর করেছেন।বাঙ্গালীরা কোন অবাঙ্গালী দোকানে যান না।
———-
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
<৬,১৮২,৩১৪-৩১৫>
শিরোনাম | সংবাদ পত্র | তারিখ |
রাজাকার ও শান্তি কামটি সমীপে একটি খোলা চিঠি |
মুক্ত বাংলা ১ম বর্ষঃ ১ম সংখ্যা |
২০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ |
(একটি খোলা চিঠি)
রাজাকার ও শান্তি কামটি সমীপেষু
সীরাজ উদ্দিন
জালেম পান্জাবী টিক্কার গড়া রাজাকার ও শান্তি কামটির সদস্যদের বলছি- আপনাদেরকে ভুললে চলবেনা যে অপনারা ও আমরা একই বাংলাদেশের অধিবাসী। বাংলাদেশের মানুষ আজ একটি চরম যুদ্ধে লিপ্ত। পৃথিবীর ইতিহা এমন অসম যুদ্ধের নজির খুব অল্পই আছে। নিরপেক্ষ বিদেশী পর্যক্ষেকদের মতে, হিটলার ইহুদিদের উপর যে অত্যাচার করেছিল বাংলাদেশের জনগনের উপর পান্জাবদের অত্যাচার তাকে ছাড়িয়ে গেছে অনেক আগে। মাত্র কয়েকমাস পূর্বেও যাদেরকে কিছুসংখ্যক মানুষ এক ধর্মের বন্ধনে আবদ্ধ ভাই বলে মনে করতো আজ ওরাও পান্জাবীদের আসল চেহারা দেখে বুঝতে পেরেছেতারা ভাই নয়- চরম শত্রু। ওদেকে ভালবাসা যায়না শুধু ঘৃনাই করা যায়। তবে ওই বেঈমানদের দিন শেষ হয়ে আসছে। কারণ পাঁচ মাস পূর্বে বাংলার মানুষ নিরস্ত্র ও অসহায় ছিল, এবং সেজন্যই মেশিনগান, ট্যান্ক ইত্যাদি মারনাস্ত্র দিয়ে সারা বাংলাদেশটি জুড়ে রক্তের হলিখেলা খেলছে পান্জাবী দস্যুরা। একতরফাভাবে করেছে খুন, ধর্ষন ও লুন্ঠন।
আজকের বাংলাদেশ কিন্তু সেই মার্চের অসহায় বাংলাদেশ নহে। অগনিত বাঙ্গালী যুবক যুদ্ধবিদ্যা শিক্ষা করে যোগ দিচ্ছে মুক্তিফৌজে। মুক্তিফৌজকে করে তুলেছে দুর্জয়। তাদের অগ্রগতি আজ দুর্বার। হানাদার পান্জাবী অমন শক্তিশালী নহে যে আমেরিকার ভিয়েতনাম কিংবা ফরাসীদের আলজিরীয়া যুদ্ধের ন্যায় বাংলাদেশে বছরের পর বছর যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারবে।
.
ভয়ে পান্জাবী আর সামনাসামনি যুদ্ধে আসছে না। কেন আপনারা আমাদের ভাই হয়েও ওদের চালাকী বুঝতে পারছেন না? ওরা মুক্তিফৗজের রাজাকার ও শান্তি কমিটির লোকজনকেই ছুড়ে দিচ্ছে।মুক্তিফৌজ অস্ত্রবলে বলিয়ান বলেই আজ কাপুরুষ পান্জাবীদের বীরত্বের দাপাদাপি কমে গেছে। বিনা যুদ্ধে বিজয়ী খেতাবধারী ফিল্ড মার্শাল আইয়ুবের স্বজাতি যে ওরা।
সিপাহী যুদ্ধের পর থেকে আজকের পান্জাবীদের যুগ পর্যন্ত প্রায় দুইশ বছর – আমাদের কেহ বন্দুক হাতে নেবার সুযোগ পায়নি। তাই ওরা ভেবেছিল আমরা বাঙ্গালীরা ওদের বন্দুকের ভয়েই দ্বাসত্ব স্বীকার করে নেবে। কিন্তু আজ ওরা বুঝতে পেরেছে, স্টেনগান, মর্টার, এল এম জি- ইত্যাদি আগ্নেয়াস্ত্র আমাদের খেলার পুতুল। ওদের বুজ চিনে চিনেই গুলি মারছি।
মওদুদী, মুফতি মাহমুদ প্রভৃতি ধর্ম ব্যবসায়ী ও তাদের সর্দার ইহাহিয়া খাঁ ও টিক্কা খাঁ – এর ফতোয়া অনুযায়ী বাংলার মুসলমান আমরা নাকি হাবশি -গোলামদের মত।যথা ইচ্ছা ওরা আমাদের ধ্বংশ করতে পারে। বাংলার মা বোনদের উপর বলাৎকার করতে পারে। ওদেরকে নাকি সেই পশুবর দান করেছে ওদের আল্লাহ। কিন্তু আমরা দেখেছি আমাদের আল্লাহ এই অত্যাচারীদেরকে খতম করে আমাদের দেশ ন্যায়-নীতি প্রতিষ্ঠার তৌফিক আমাদেরকে দিচ্ছেন। এবং সেইজন্যই হালকা পাতলা বাঙ্গালী যুবকরা তাগড়া মোষের মত পান্জাবীদের যে আগ্নেয়াস্ত্র দিয়েই হত্যা করে চলেছে তা নয়, ওদেরকে জ্যান্ত পাকড়াও করেও নিয়ে আসছে।
পাকিস্তানের সর্বমোট সৈন্যসংখ্যা প্রায় ৩ লক্ষ। এর মধ্যে ওদের শাদ্দাদী বেহেশতখানা ইসলামাবাদ, লাহোর ইত্যাদি শহরগুলো এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্ত এলাকা রক্ষা ও পাঠান বালুচ সিন্ধিদের বিদ্রোহ দমনের জন্য ২ লক্ষ ৫৫ হাজার সৈন্য ওখানে মোতায়েন রাখতে হয়েছে। বাংলাদেশে এনেছিল ৭৫ হাজার। কিন্তু ইতিমধ্যে ২৭ হাজার হয়ে গেছে খতম। অবশিষ্ট ৪৮ হাজার বাছাধনেরা বিগত ৫ মাসের অনবরত যুদ্ধের মধ্যে বারশত মাইল দুরে মা বোনদের বাংলার লুন্ঠিত টাকা, অলঙ্কার ও অন্যাণ্য দ্রব্যাদি সমজায়ে দিয়ে আসাতো দুরের কথা লুন্ঠিত সামগী পেটে ও কোমরে বেঁধে রেখে মুহুর্তের জন্যও একবার বিশ্রামের সুযোগ পাচ্ছেনা।দেশে যাওয়ার রাস্তাটাও বিপদসঙ্কুল। মুক্তিফৌজের চতুর্দিকে আক্রমন তাদেরকে বঙ্গোপসাগরের অতল গহ্বরের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। পালাবার সুযোগের জন্য বড় অফিসারেরা বিমান ঘাঁটিগুলো কড়া পাহারায় রেখেছে। পালিয়ে যাওয়ার সময় ওরা কিন্তু বাংলাদেশের সকল দালাল ও বিহারী গুন্ডাদেরকে মুক্তিফৌজের গুলির নিশানায় তাদের সকল পাপের কাফ্ফারাস্বরুপই ফেলে যাবে।
.
ভারত থেকে মার খাওয়া কালো চামড়ার যে বিহারীগণ পশ্চিম পাকিস্তানে মাথা গুজবার ঠাঁইও পায়নি পৃথিবীর সবচাইতে ঘনবসতি অঞ্চল এই পূর্ব বাংলায় আমরাই ওদেরকে ভাই বলে স্থান দিয়েছিলাম। চাকুরী, ভ্যবসা এমনকি ক্ষেত খামারে পর্যন্ত অংশীদার করেছিলাম। কিন্তু সেই চরম বিশ্বাসঘাতকেরাই বাংলার মাটির সাথে করেছে বেঈমানী, নিমকহারামী এবং বাংলার মানুষের উপর করেছে অকথ্য অত্যাচার।
বাংলাদেশের ব্যাপারে দুনিয়ার জনমত আজ পাকিস্তানের নিন্দায় মুখর। নিরস্ত্র জনসাধারন এবং বিশেষ করে নারী শিশুদের প্রতি পাক সামরিক বাহিনী যে চরম অত্যাচার করেছে দুনিয়ার ইতিহাসে তার কোন নজির নেই। এসব কুকির্তী আজ পৃথিবীর মানুষের অজানা নয়। তাই বিশ্বের সকল জায়গা থেকেই ওদেরকে ধিক্কার দেওয়া হচ্ছে এবং সেইজন্যই জল্লাদ টিক্কা খাঁকে বাংলার মাটি থেকে সরিয়ে নিয়ে পাঠান, বালুচ ও সিন্ধিদেরকে শায়েস্তা করার ভার ওর উপর দিয়েছে ইহাহিয়া খাঁ। কারন ওখানকার জনমতও আজ বিক্ষুদ্ধ। ভুট্টো সাহেব কল্কে পাচ্ছেন্না। আর্থিক দিক দিয়েও পশ্চিম পাকিস্তানের অবস্থা কাহিল পাকিস্তানের আয়ের মোট তিন টাকার দুই টাকা ছিল বাংলাদেশের পাট, চা তামাক ও বিলাত প্রবাসী বাঙ্গালীদের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা। মুক্তিযুদ্ধের ঠেলায় দুই টাকার স্থলে আট অনাও এখন তাদের কপালে জুটছেনা। বাংলোর সাড়ে সাত কোটি মানুসের বাজারে পশ্চিম পাকিস্তানের কাপড়ের মিলগুলো ততের তৈরি কাপড় করতে না পারায় মিলগুলোতে তালা চাবি লাগাতে বাধ্য হচ্ছে। বেতন দিতে না পারায় পান্জাবী মিল শ্রমিকদেরকে পাইকারীভাবে চাকরী হতে বরখাস্ত করা হচ্ছে।করাচীর বাজারের আমদানীকারক ও বড় বড় ব্যবসায়ীদের তেলতেলীভাব আজ আর নেই। মোগলাই মেজাজ ভোতা হয়ে যাচ্ছে। চব্বিশ বছরে গঠিত বাইশ পরিবারের শোশণের ভিত ভেঙ্গে আজ চুরমার হয়ে যাচ্ছে। সিপাহীদের যুদ্ধকালীন অতিরিক্ত ভাতা হয়ে গিয়েছে বন্ধ। বাংলাদেশে নিয়োজিত সিপাইদেরকে আপাতত ঘুষের টাকা, লুন্ঠিত ঘড়ি, অলঙ্কার ইত্যাদি ও বদমায়েশীর অবাধ লাইসেন্স দিয়েই খুশি রাখার চেষ্টা চলছে। বেতন ও ভাতা দেবে কোন টাকশাল?
আল্লাহর মেহেরবানীতে করাচি ও ঢাকার দুরত্ব দিন দিনই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভারতের উপর দিয়ে আগে ছিল ১২০০ মাইল আর এখন ভারত ঘুরে ও হাজার মাইল পাক –ভারত যুদ্ধ বাঁধলে এই দুরত্বের মাত্রা দাঁড়াবে ৭ হাজার মাইলেরওে বেশি। আপনারা তখন যাবেন বঙ্গোপসাগরে- আর ঐ পশ্চিমা দস্যুরা ডুবে মরবে আরব সাগরে।