শিরোনামঃ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও জাতীয় পুনর্গঠন
সংবাদপত্রঃ জয় বাংলা ১ম বর্ষঃ ১৬শ সংখ্যা
তারিখঃ ১২ নভেম্বর, ১৯৭১
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও জাতীয় পুনর্গঠন
!! অর্থনৈতিক ভাষ্যকার !!
পাক হানাদার বাহিনীর কবল থেকে বাংলাদেশের অবশিষ্ঠ দখলীকৃত এলাকার মুক্তির কাল আসন্ন বাংলাদেশের বিভিন্ন রণাঙ্গনের খবর থেকে এমন একটি প্রত্যাশা সকলের মনেই জেগেছে।
*
দেশপ্রেম, আত্নবিশ্বাস, ও উন্নততর রণকৌশল এবং দেশের মাটির সঙ্গে নাড়ীর সংযোগই মুক্তিবাহিনীকে চূড়ান্ত বিজয়ের তোরণদ্বারে পৌছে দিতে পেরেছে।
*
তবে রণাঙ্গনের খবর নয়, বর্তমান নিবন্ধে আমাদের আলোচ্য বিষয় স্বতন্ত্র। মাতৃভুমির আসন্ন মুক্তি সম্ভাবনাকে সামনে রেখে যে প্রশ্নটি ইতিমধ্যেই অনেকের মনে জাগছে তা হচ্ছে হানাদার বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞ ও যুদ্ধ্ববিধ্বস্ত বাংলাদেশকে কত দ্রুত পুনর্গঠন করা যাবে এবং পুনর্গঠনের জন্য আমাদের কোন বস্তুটির প্রয়োজন সবচেয়ে বেশী। একটি মাত্র বাক্যে এই প্রশ্নের উত্তর দেয়া যায়। জনগণের দেশপ্রেম ও সর্বস্তরে পূর্ণ ঐক্যই দ্রুত পুনর্গঠনের প্রাথমিক শর্ত।
*
মুক্তি সংগ্রামকে চূড়ান্ত বিজয়ের পথে নিয়ে যাবার জন্যে উপরোক্ত দুটি উপাদানের যেমন প্রয়োজন হয়েছিল, জাতীয় পুনর্গঠন ও দেশকে দ্রুত সুদৃঢ় অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করার জন্যো ওই দুটি উপাদানের প্রয়োজন তার চেয়ে কিছু কম নয়। ওট মুক্তি সংগ্রামের সফল পরিসমাপ্তিরই যুক্তিসঙ্গত পরবর্তী ধাপ।
*
জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম দেশের মানুষকে যেমন উদ্ধুদ্ধ ও ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছে তেমনি অর্থনৈতিক ন্যায়নীতি ও সম্পদের সুষম বন্টন দেশের মানুষের জাতীয় পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক প্রেরণায় উদ্ধুদ্ধ করতে সমর্থ হবে। আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টো ও খসড়া কর্মসূচীতে তার সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি রয়েছে। কাজেই জাতীয় পূর্ণগঠনের জন্যে যে মানবিক উপাদানগুলোর প্রয়োজন সেই উপাদানের কোন অভাব যে হবেনা সে সম্পর্কে আমরা স্থির নিশ্চিত। কিন্তু মানবিক উপাদান ছাড়াও যে অর্থনৈতিক সম্পদ ও সংঙ্গতির প্রশ্ন এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে স্বাধীনতা পরবর্তী অধ্যায়ে জাতীয় পুণর্গঠনের ব্যাপারে সে সম্পর্কেও বিশদ্ভাবে আলোচনা করার প্রয়োজন রয়েছে।
*
এ প্রসঙ্গটির সার্থক আলোচনার পূর্বে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্ভাব্যতা ও সম্ভাবনা সম্পর্কে প্রথমে আলোচনা করে নেবার প্রয়োজন রয়েছে। এ সম্পর্কে ইতিপূর্বেও বিচ্ছিন্নভাবে কিছু কিছু আলোচনা যে হয়েছে তা নয়, তবু জাতীয় পুণর্গঠনের প্রশ্নকে সামনে রেখে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্ভাব্যতা ও সম্ভাবনা সম্পর্কে আরও কিছু আলোচনার অবকাশ আছে।
*
কিছু কিছু মানুষ এখনও আছেন যারা অনেক সময় প্রশ্ন করেন যে, আমাদের এই রাষ্ট্রের ছোট্ট পরিসরে অগুন্তি মুখের খাদ্যের জোগান দিতে হবে। কাজেই এই দেশের পক্ষে অর্থনৈতিক দিক থেকে টিকে থাকা ও এগিয়ে যাওয়া কি সম্ভব হবে? এ প্রশ্ন যারা করেন তারা হয় অধুনালুপ্ত পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ইতিহাস জানেন না, নয়তো মানসিক দিক থেকে পুরোপুরি সংশয়বাদী। তাঁরা পাকিস্তানের বিলুপ্তির পূর্বেকার অর্থনৈতিক বিন্যাসকে সাধারণ দৃষ্টিতে দেখেছেন কিন্তু তার কার্যকারণ এবং তাৎপর্য অনুধাবন করার চেষ্টা করেননি। তা করলে বুঝতে পারতেন যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের গোড়াতে এই কার্যকারণই প্রচন্ডভাবে কাজ করেছে, নিছক ভাবাবেগ দ্বারা তাঁরা পরিচালিত হয়নি।
*
বিলুপ্তির পূর্বেকার পাকিস্তানের যে পশ্চিম পাকিস্তানী অর্থনৈতিক অক্টোপাসের শুঁড় দেখেয়ামাদের অনেকের মনে উপরোক্ত সংশয় জাগে সেই অক্টোপাসটি আসলে বেড়ে উঠেছে বাংলাদেশের সম্পদ গ্রাস করে। এক কথায় বলতে গেলে পশ্চিম পকিস্তান বাংলাদেশের অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখতে সাহায্য করেনি। বরং বাংলাদেশই নিজেকে রিক্ত করে পশ্চিম পকিস্তানেরে এই বিপুল অর্থ ও শিল্প সম্পদকে গড়ে তুলেছে। বাংলাদেশ দীর্ঘ তেইশ বছর ধরে নিজের রক্ত দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানকে গড়ে তুলতে বাধ্য হয়েছে রাজনৈতিক পরাধীনতার শেকলে আবদ্ধ থাকায়। কাজেই পশ্চিম পাকিস্তানের বোঝা বহনের দায় থেকে মুক্ত, দেশপ্রেম উদ্ধুদ্ধ স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ অনেক সহজে এবং আরও ভালভাবে নিজেকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে।
*
যারা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা কিছুটা দ্বিধাগ্রস্থ আপাতদৃষ্টিতে তাঁরা প্রধানত দুটো লক্ষণ দেখে দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে পড়েছেন। সেই কারণের একটা হল বাংলাদেশের ঘনবসতি। মাত্র ৫৫ হাজার ১২৬ বর্গমাইল এলাকায় সাড়ে সাত কোটি লোকের বাস। সম্ভবতঃ বাংলাদেশই পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতি এলাকা। এই ছোট্ট পরিসরে অগুনতি মানুষ যেন ক্রমে হামাগুড়ি দিয়ে চলছে। তার ওপর প্রাকৃতিক দুর্যোগের পৌনঃপৌনিক আঘাত। দ্বিতীয় কারণ হলো বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পশ্চাদপদতা। এই অর্থনৈতিক পশ্চাদপদতাকেই তাঁরা পশ্চিম পাকিস্তানের ওপর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা বলে ভুল করছেন। কিন্তু এ কথাটা মনে রাখার প্রয়োজন রয়েছে যে গত ২৩ বছরে বাংলাদেশ পশ্চিম পাকিস্তানের সমৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন ভাবে কমপক্ষে ছয় হাজার কোটি টাকার যোগান দিতে বাধ্য হয়েছে।
.
রবিউল হাসান সিফাত
<৬,৪০,৮০-৮০>
শিরোনামঃ মোনেমের ভাগ্য সব দালালকেই বরণ করতে হবে
সংবাদপত্রঃ জয় বাংলা ১ম বর্ষঃ ২৭শ সংখ্যা
তারিখঃ ১২ নভেম্বর, ১৯৭১
মোনেমের ভাগ্য সব দালালকেই বরণ করতে হবে
মসনদের লোভে পড়ে যে মীর জাফর আলী খান পলাশীর আম্রকাননে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার স্বাধীনতা বিকিয়ে দিয়েছিল ইতিহাসে কুখ্যাত হয়ে থাকলেও মৃত্যুর পর সে বাংলারই মাটিতে শায়িত থাকার সুযোগ পেয়েছিল। কিন্তু বাংলার লাটগিরির আশায় যে কুখ্যাত মোনেম খান বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটী মানুশের সাথে বেঈমানী করেছে এমনকি লাথি মেরে গদি হারাবার পরও জীবনের শেষ মুহূর্তে পর্যন্ত সাত কোটি বাঙ্গালীকে পরাধীনতার জিঞ্জিরে আবদ্ধ রাখার প্রয়াস পেয়েছে, আজিকার বাঙ্গালী সমাজ তাকে কোনদিনও পারে না। বাঙ্গালী বীর মুক্তিযোদ্ধারা ইয়াকে স্টেনগানের গুলিতে কুকুরের মত হত্যা করেছে। মোনেমের আত্নীয়রা ভেবেছিল ওখানেই সব কিছুর শেষ। মৃত্যুর পরে অন্তত মোনেম খান বাংলার মাটিতে শান্তিতে ঘুমিয়ে থাকতে পারবে। তাই তারা জায়গা কিনে আজিমপুরায় নয়া গোরস্থানে তার লাশ সমাহিত করেছিল। কিন্তু তারা ভুলে গিয়েছিল যে বাঙ্গালী তরুণরা মৃত্যুর পরও মোনেম খানকে ক্ষমা করতে পারেনা, তাকে বাংলার মাটি অপবিত্র করতে দিতে পারেনা। মোনেমের আত্নীয়রা আরো ভুলে গিয়েছিল যে, এই আজিম্পুরা গোরস্থানেই শায়িত রয়েছেন ভাষা আন্দোলনের অমর শহীদান বরকত, সালাম, ও রফিক। আরো রয়েছেন বংবন্ধুর দক্ষিণ হস্ত সৈনিক ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক জনাব তফাজ্জল হোসেন (মানিক মিয়া) এবং আজীবন সংগ্রামী জনাব আবু হাসেন সরকার প্রমুখ। তাই, আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধ্বারা হাজার হাজার পশ্চিমা সৈন্য ও তাদের দালালদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে রাতের বেলায় মোনেম খানের লাশটি গোরস্থান থেকে তুলে নিয়ে নদীতে ফেলে দিয়েছেন।
*
প্রকাশ, মোনেম খানের অপবিত্র লাশ তুলে নেওয়ার সময় মুক্তিযোদ্ধ্বারা সেখানে একখানা কাগজে কতিপয় কথা লিখে গেছেন। তাতে লেখা হয়েছে, অন্যান্য দালালদেরও মোনেমেরই দশা হবে। তাদেরকে কুকুরের মত হত্যা করা হবে। তারপর তাদের লাশ নদীতে ফেলে দেয়া হবে বা শিয়াল-কুকুরের উদারপূর্তির কাজে লাগান হবে যাতে মৃত্যুর পর তারা বাংলার মাটিকে অপবিত্র করতে না পারে।
.
রবিউল হাসান সিফাত
<৬,৪১,৮১-৮১>
শিরোনামঃ ভেঙ্গেছে দুয়ার এসেছে জ্যোতির্ময়
সংবাদপত্রঃ জয় বাংলা ১ম বর্ষঃ ৩৩শ সংখ্যা
তারিখঃ ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১
সম্পাদকীয়ঃ
ভেঙ্গেছে দুয়ার এসেছে জ্যোতির্ময়
ঢাকা মুক্ত। ঢাকা এখন আমাদের। জয় বাংলা। স্বাধীনতার এই পবিত্র ঊষালগ্নে, সাড়ে সাত কোটি মানুষের পরম প্রত্যাশা পূরণের এই পবিত্র মুহূর্তে আমরা ভাবাবেগে অধীর হয়ে নয়, শান্ত, সমাহিত ও সৌম্য হৃদয়ে স্মরণ করি অসংখ্য বীরের রক্তস্রোত ও মাতার অশ্রুধারাকে। স্মরণ করি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। ‘রাত্রির তমসা শেষে আসিবে না দিন?’ এই প্রশ্নের জবাব এসেছে মহানগরী ঢাকায় স্বাধীনতার রক্তরাঙ্গা পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে। আমরা আজ গভীর কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করছি পঞ্চান্ন কোটি ভারতবাসীর অকুতোভয় মৈত্রী এবং তাদের জগৎবরেণ্য নেত্রী শ্রী মতি ইন্দিরা গান্ধীর ঐতিহাসিক ভূমিকাকে। আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রামে ভারতের বীর সৈনিকরাও রক্ত দিয়েছেন, আত্নদান করেছেন এবং রক্তঋণের অচ্ছেদ্য রাখীতে সারা বাংলাদেশকে বেঁধে ফেলেছেন। বাংলাদেশ ও ভারতের এই মৈত্রী সুদৃঢ় হোক। স্বাধীন বাংলাদেশ চিরস্থায়ী হোক।
.
.
সৌ রভ
<৬,৪২,৮২>
.
শিরোনাম:ঢাকা আমাদের
সংবাদপত্র”: জয় বাংলা(১ম বর্ষঃ ৩৩শ সংখ্যা)
তারিখ:১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১
.
[মহানগরীর সরকারী বেসরকারি ভবনে স্বাধীন বাংলার পতাকা বঙ্গবন্ধু দীর্ঘজীবী হোন ধ্বনিতে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত]
.
আজ (বৃহস্পতিবার) বিকেলে ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে। অগ্রসরমান মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় জোয়ানদের সম্মিলিত অভিযানে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা নগরী মুক্ত হয়েছে এবং সকল সরকারী বেসরকারি ভবনে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড্ডীন হয়েছে। মুজিব নগর থেকে শীঘ্রই স্বাধীন বাংলার প্রশাসনিক সদর দপ্তর স্থানান্তরিত হচ্ছে বলে জানা গেছে। তাবেদার গভর্নর মালেকের পদত্যাগের পর সেনারা নিজেরাই যুদ্ধ বিরতির আর্জি জানায়।
.
আজ বাংলাদেশের বীর মুক্তিবাহিনীর ও ভারতীয় জোয়ানগণ পাকিস্তানী ও হানাদারদের পশ্চাৎধাবন করে মহানগরী ঢাকায় প্রবেশ করলে বিরান ও ধ্বংসস্তূপ নগরী আবার সজীব হয়ে ওঠে এবং জয় বাংলা ও বঙ্গবন্ধু দীর্ঘজীবী হোক, বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী স্থায়ী হোক ধ্বনিতে ঢাকার আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। খান সেনারা এবং তাদের তাবেদারেরা সদলে আত্মসমর্পণ করেছে। আত্মসমর্পণের পর তাঁরা জেনারেল মানেক শ’র কাছে যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব জানালে ভারতের সেনাপতি তাদের আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন।
.
ঢাকা শহর মুক্ত হওয়ার খবরে অশ্রুজল কণ্ঠে আমাদের অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট এক বানীতে বলেছে, আমাদের বিজয় লাভ সম্পূর্ণ হল। এখন আমাদের সামনে আরো কঠিন কাজ বাকী। তা হল ধ্বংসস্তূপের মধ্যে একটা জাতির পুনর্বাসন এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক পূর্ণগঠন।
.
প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ বলেছেন, স্বাধীন বাংলাদেশ বিশ্ব নিপীড়িত ও লাঞ্ছিত মানবতার একটি অকৃত্রিম বন্ধু জাতি হিসেবে গড়ে উঠবে। আমরা দেশ ও জাতিকে মুক্ত করার সংগ্রামে জয়ী হয়েছি। কিন্তু এখন জাতির পিতাকে মুক্ত করার সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হবে।
.
সৌ রভ
<৬,৪৩,৮৩-৮৪>
.
বিচারের বাণী…… কাঁদে
.
বিশ্ববাসীর নিকট আমাদের আকুল প্রার্থনা- তাঁর ইয়াহিয়া চক্রের বিচার করুন। অন্যায়ের যদি বিচার না হয়, তাহলে সত্যতা, মানবতা, ন্যায়বিচার- এসব বলে আর বিভ্রান্তির সৃষ্টি করা যেন না হয়। কারণ এই শব্দগুলি যদি শুধু মুখেই বলা হয়- কিন্তু সেগুলিকে যদি কর্মে ব্যবহার তা বাস্তবে প্রয়োগ না করা হয়, তাহলে সেই বলা কথাগুলি শুধু বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে না- প্রহসনে রূপান্তরিত হয়। তখন সেই ভাল ভাল কথাগুলির উপর মানুষ ক্রমে আস্থা হারিয়ে ফেলে। অপরদিকে এই ভাল কথাগুলির বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াশীল চক্র নির্মম হয়ে উঠে। ফলে তাদের অত্যাচারের মাত্রাও যায় বেড়ে। এ পর্যন্ত পৃথিবীর বৃহৎ শক্তিগুলি মানুষের মঙ্গলের জন্য প্রতিষ্ঠান করেছেন- বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বহু মানবতার বাণী প্রচার করেছেন। মানুষের বেঁচে থাকার অধিকারের কথা বলেছেন। গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের বড় বড় বুলি আওড়িয়েছেন। বিশ্ববাসীকে আশার কথ শুনিয়েছেন।এখন দেখা যাচ্ছে তা শুধু কথায় রয়ে গেছে- বাস্তব রূপায়িত হয়নি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা, এখানকার মানুষের উপর বর্বরোচিত নির্যাতনের জন্য ( একমাত্র ভারত ছাড়া ) কেউ কিছু করলেন না বললেই হয়। যেটুকু ও বা কেউ কেউ করলেন তা বাংলাদেশের শত্রুকে তারিয়ে দেওয়ার পক্ষে উপযুক্ত নয়। বরং এই মৃদু প্রতিবাদে ইয়াহিয়া চক্রের অত্যাচার আরও বেড়ে গেল। নির্বিচারে নির্যাতন ও গণহত্যায় বাংলার আকাশ বাতাস বিষাক্ত করে তুলল।
.
গত দুই মাসের যুদ্ধে বাংলা প্রায় ১০ লক্ষ সাধারণ মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে। প্রায় ৪০/৫০ লক্ষ জনগণ ছিন্নমূল লতার মত ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। আশ্চর্য হতে হয় এ বিষয় নিয়ে বিশ্বের বৃহৎ শক্তি মাথা ঘামাচ্ছে না। লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষকে নির্বিচারে নির্লজ্জ হত্যার নজির এক ইয়াহিয়া ছাড়া অন্য কোন ইতিহাসে পাওয়া যায় না। লক্ষ লক্ষ নারীর সতীত্বকে বিনষ্ট করা, তাদের উলঙ্গ করে মাঠে ছেড়ে দেওয়া ও ঘরে আবদ্ধ করে রাখা, একই মেয়ের উপর পর পর কয়েকজন নরপশুর আত্মীয়ের সামনে অত্যাচার, স্তন কেটে ফেলে পিতাকে উপহার দেওয়া, স্ত্রী-লিঙ্গে বেয়োনেট দিয়ে খোঁচান, শিশুকে ধরে পা চিরে বা গাছে আছাড় দিয়ে নির্মমভাবে হত্যা, হাজার হাজার নিরীহ মানুষকে দাঁড় করিয়ে রেখে গুলি করে হত্যা, শহর ও গ্রামের বাড়িঘর নির্বিচারে ধ্বংস করা ও জ্বালিয়ে দেওয়া, মানুষের ধান-চাল, সোনা অর্থাৎ যা কিছু সম্পদ, সবই লুণ্ঠন করা। এসবেও যদি বিশ্ব বিবেক কাতর হয়ে না ওঠে এবং প্রতিকারের জন্য কার্যকারী ভূমিকা গ্রহণ না করে- তা হলে মানবতা, বিশ্বশান্তি, বিশ্বপ্রেম প্রভৃতি শব্দের মূল্য কোথায় ? আজ মানবতা পৃথিবীর দ্বারে কেঁদে মরছে। এরপরও কেউ যদি action না দিয়ে শুধু শান্তির কথা বলে- তা প্রহসন ছাড়া আর কি হতে পারে?
.
তাই আমি বিশ্বকে আহ্বান করে বলতে চাই- মানবতা ও বিশ্বশান্তিই যদি সকলের নিকট শ্রেয় ও আদর্শ হয়- তাহলে অত্যাচারী ইয়াহিয়া বিচার করুন। মানবতার আহ্বানকে যদি আপনারা মর্যাদা দেন তাহলে শয়তান-রুপী ইয়াহিয়ার অত্যাচারে বাস্তব চেহারা বাংলায় এসে দেখে শুনে যান এবং সেই বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আপনারা ন্যায় বিচার করুন। এবং এই জঘন্য নির্যাতন ও গণহত্যা বন্ধ করুন।তা না হলে পৃথিবীতে মানবতার মৃত্যু ঘটবে এবং ‘বিশ্বশান্তি’ ‘বিশ্বপ্রেম’ শব্দগুলির ভাবার্থের কোন মর্যাদাই থাকবে না। যে ন্যায় বিচার স্বর্গীয়- তা কেঁদে মরবে। বিশ্বের বিবেক সম্পন্ন ব্যক্তির আকুল আবেদনে বৃহৎ শক্তিগুলির কোন মর্যাদা দেবেন না ? আমার সোনার বাংলার এ দশা দেখে শুধু মনে পড়ে- “আমি যে দেখেছি প্রতিকার শক্তি অপরাধে- বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে।
.
সৌ রভ
<৬,৪৪,৮৫>
আড়াই ডিভিশন পাঞ্জাবী ফৌজ বাংলার স্বাধীনতা রুখতে পারবে না
অচিরেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর মানচিত্রে সংযোজিত হচ্ছে নদীমাতৃক বাংলাদেশ, একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে।
.
ইদানীং ইয়াহিয়া জঙ্গী সরকারের বেতার বার্তায় প্রচারিত হয়েছে যে বাংলার বিদ্রোহ দমন করতে আরও আড়াই ডিভিশন (৩৫ হাজার) খান সেনা বাংলায় পাঠান হচ্ছে। এখন স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে তবে আগের ৩ ডিভিশন পাঞ্জাবী গেল কোথায় ? তারা কি বাড়ী যেয়ে ছুটি যাপন করছে ? না, বাঙ্গালী বীরেরা তাদেরকে পাতালপুরীতে নিমন্ত্রণ খাওয়াতে নিয়ে গেছেন ? স্বাধীন বাংলার বেতার কেন্দ্রের ঘোষণা ও বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া খবর হতে স্পষ্টই বুঝা যাচ্ছে যে, বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হওয়া থেকে আজ পর্যন্ত কমপক্ষে ২৫০০০ (পঁচিশ হাজার) পাক সেনা নিহত ও বহু আহত হয়েছে।
.
যুদ্ধবাজ টিক্কা খাঁ যে বাংলাদেশের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আয়ত্তে আনবেন- আজ ৪৮ ঘণ্টার স্থলে ৮০ দিন অর্থাৎ ১৯২০ ঘণ্টা বিলীন হয়ে গেল, এর মদ্যে না পারলেন বাংলাদেশকে দমন করতে না পারলেন ২৫০০০ খান সৈন্যের জীবন রক্ষা করতে। বর্তমান হালে আর পানি পাচ্ছে না পাঞ্জাবীদের। অবস্থা বেগতিক দেখে সামরিক কর্তৃপক্ষ সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শন করেছেন দেশবাসীকে এবং তারাও দেশবাসীর নিকট হতে ক্ষমা চেয়েছেন। কথাটি ঠিক মানানসই হল না কার কাছে। বাংলা বাসীকে প্রশ্ন করি তারা কি কার করুণার পাত্র হতে চান অথবা ক্ষমা করতে চান জালেম, অগ্নিসংযোগকারী, লুণ্ঠনকারী, লক্ষ লক্ষ নিরস্ত্র নরনারী, বৃদ্ধ, শিশু হত্যাকারী মা-ভগিনীর ইজ্জত বিনষ্টকারী ইয়াহিয়ার পশু পাঞ্জাবী সেনাদেরকে? কিন্তু এর উত্তর বাংলা বাসী বহু পূর্বেই দিয়েছেন কোন “আপোষ নেই” নেই কোন রাজনৈতিক সমাধান।
.
এর একমাত্র সমাধান “অস্ত্র” অথবা বাংলার “স্বাধীনতা”। ওয়াদা খেলাপ কারীদের আজ আর কোনও কথায় বিশ্বাস নেই। দেশকে স্বাধীন আমরা করবোই। লক্ষ লক্ষ রক্তস্রোত বৃথায় যেতে দিবো না। আজ পূর্বের আকাশে রাঙা প্রভাতের বিজয় কেতন নিয়ে ধীরে জেগে উঠেছে সোনার সূর্য। ওই শোনা যায় জয়ভেরির নিনাদ “স্বাধীন বাংলা’
.
সৌ রভ
<৬,৪৫,৮৬>
.
আমাদের লক্ষ্য মৃত্যু অথবা জয়লাভ
.
দশ লক্ষ শহীদের তাজা রক্তের বন্যায় ভেসে গেছে “পাকিস্তান”- এর শবদেহ। বীর প্রসবিনী। বাংলার লক্ষ লক্ষ দামাল ছেলেরা এখন সুদূর চট্টল থেকে দিনাজপুরের রোদ্র-ক্ষরা মালভূমি পর্যন্ত পঁয়ষট্টি হাজার গ্রাম গড়ে তুলেছে এক একটি দুর্জয় দুর্গ।
.
পদ্মা-মেঘনা-যমুনা আর তিস্তার কূলে কূলে গড়ে ওঠা জনপদে আজ শুধুমাত্র একটি শপথই প্রতিধ্বনিত হচ্ছে- ‘এবার আর শহীদ নয় গাজী হবো।” পাক জঙ্গী চক্র সোনার বাংলাকে শ্মশানে পরিণত করার পর, বাংলাদেশে আবার পাকিস্তানের পতাকা ওড়াতে চায়। তারা ইসলাম ও সংহতি রক্ষা করতে গিয়ে হত্যা করেছে লক্ষ লক্ষ নিরপরাধ অসহায় নর-নারী আর শিশুদের, ধ্বংস করেছে মসজিদ, মন্দির স্কুল কলেজ, কলকারখানা। ক্ষেত- খামার, জমা-জমি আর গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়ে রচনা করেছে পাকিস্তানের সমাধিস্থল- সে সমাধির পড়ে একমাত্র স্বাধীন বাংলার পতাকাই উড়বে।
.
দশ লক্ষ শহীদের রক্তে সিক্ত পাকিস্তানের পতাকার সাথে আমাদের কোন মিত্রতা নেই- কোন সম্পর্ক নেই- নেই কোন আপোষ। যে কোন মূল্যেই হোক না কেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষা আমরাই করবই। আমাদের লক্ষ্য মৃত্যু অথবা জয়লাভ।
.
.
জেসিকা গুলশান তোড়া
<৬,৪৬,৮৭-৮৮>
.
পাকিস্তানের বিধ্বস্ত অর্থনীতি
স্বদেশ
১ম বর্ষঃ ১ম সংখ্যা
১৬ জুন, ১৯৭১
.
পাকিস্তানের বিধ্বস্ত অর্থনীতি
.
যুদ্ধ শুরু হবার পর থেকেই করাচীর কাগজগুলি বিদ্রোহীদের খবরাখবর পুরো চেপে যায় এবং তার ফল এতো পরিষ্কার হয়েছিল যে রাজনীতির বিশেষজ্ঞরা পর্যন্ত দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে রাওয়ালপিন্ডি সরকার যবনিকার সামান্য অংশ তুলে যখন দেখালেন তখন পশ্চিম পাকিস্তানীরা তার অংশটুকু মাত্র দেখে স্তম্ভিত এবং বিষণ্ণ হয়ে পড়লেন।
.
তাঁরা প্রথম এই খবর জানলেন যখন মুহম্মদ ইয়াহিয়া খানের সামরিক সরকার বিদেশী চারশো কোটি পাউন্ড ঋণ ছ’মাসের জন্যে বিদেশী শক্তিগুলির কাছে আপতকালীন স্থগিতের জন্য আবেদন জানালেন এবং জ্বালানী তেলের দাম শতকরা ৮ থেকে ১০ ভাগের ওপর বাড়িয়ে দিলেন; তাছাড়া ৪৬টি জিনিষের ওপর দুই থেকে তিন গুণ কর স্থাপনও ছিল এর মধ্যে। ফলে জনগণের কাছে এই ঘটনাগুলি এলো এক ভয়াবহ মুদ্রাস্ফীতির পূর্বাভাস হিসাবে। পাকিস্তানী অর্থনীতিবিদরা বললেন, পূর্বদিকে সামরিক সরকারের যুদ্ধক্ষেত্রের জয়লাভ যদিও সম্ভব, জাতীয় উন্নতির ক্ষেত্রে তা ভয়াবহ দুর্গতির সূচনা।
.
এই তত্ত্বের সমর্থনে বলা যায় যে, পশ্চিম পাকিস্তানী ব্যবসায়ীরা তাঁদের ব্যবসাপত্র গোটাতে শুরু করেছেন, কারণ তাদের তৈরী জিনিষপত্রের দুই-তৃতীয়াংশের বাজার ছিল পূর্বাঞ্চল। কিন্তু সে বাজার আপাতত বন্ধ। দ্বিতীয়তঃ পূর্ব পাকিস্তানী বাঙালী ব্যাপকহারে ভারতে শরণ নেওয়ার ফলে চা শিল্পের পক্ষে তা এক চরম বিপদের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে- পাকিস্তানকে তারও বিকল্প রপ্তানির কথা চিন্তা করতে হবে। অবশ্য সবচেয়ে বেশী ক্ষতি হয়েছে পাট রপ্তানির ক্রমবর্ধমান হার কমে যাওয়ায়। পাকিস্তানের কাছে এই পাট ছিল বিদেশী মুদ্রা অর্জনের সবচেয়ে বড় সূত্র। কেবলমাত্র গত সপ্তাহের গোড়ার দিকেই কিছু রপ্তানি করা গেছে। সব মিলে যুদ্ধের দরুন দৈনিক মূল্য দিতে হচ্ছে ২০ লক্ষ পাউন্ড করে যে জাতির যুদ্ধের আগে জমা মোট টাকা ছিল ৮ কোটি২০ লাখ পাউন্ড তার পক্ষে এটা একটা বেশ ভারী ধরণের বোঝাই বলতে হবে।
.
নিকট ভবিষ্যতে এই অবস্থার খুব একটা উন্নতির আশা নেই। অফিসার মহল থেকে বলা হচ্ছে, পূর্বাঞ্চলে দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসছে, কিন্তু অন্যেরা বলছেন যে, অবস্থা এখনও অনেকখানিই বিপ্লবীদের পক্ষে রয়ে গেছে। সেখানে জাতীয় করের ৪০ ভাগ কর দেওয়া বন্ধ রয়েছে। রাজনৈতিক স্থৈর্যও ফিরে আসেনি। গেরিলাদের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শনের প্রতিশ্রুতি এবং সরকারী কর্মচারীদের প্রতি কাজে যোগদানের আদেশ প্রদান- সামরিক জান্তার এই বড়শির টোপে অল্প বাঙালিই ধরা দিয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে, পূর্বাঞ্চলের অবিসংবাদিত রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের ১৬৭ জন নির্বাচিত প্রতিনিধির মধ্যে মাত্র দুইজন তাঁদের স্বাধীনতার আন্দোলন আঞ্চলিকভাবে পরিত্যাগ করেছেন।
.
ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সংকট এবং পূর্বের নিরবিচ্ছিন্ন প্রতিরোধ পশ্চিমেও রাজনৈতিক ধাক্কা বয়ে এনেছে। প্রাদেশিক বিচ্ছিন্নতার আন্দোলনের অপরাধে উত্তর পশ্চিম সিন্ধু প্রদেশের ১২ জন নেতাকে সাম্প্রতিককালে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
.
তাছাড়া পশ্চিমের উচ্চাকাঙ্ক্ষী নেতা জুলফিকার আলি ভুট্টো তাঁর অনুগামীদের কাছে সামরিক শাসন অবসানের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা ব্যর্থ হওয়ায় মর্যাদাহীন হয়ে পড়েছেন। সর্বোপরি মুদ্রাস্ফীতি এবং বাঙালীদের প্রতিরোধ সংগ্রামই ইয়াহিয়ার কাছে ব্যক্তিগতভাবেই পতনের পূর্বাভাস হয়ে দেখা দিয়েছে। করাচীর একজন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ আমায় বলেছেন, ইয়াহিয়া খানকে ছ’মাসের মধ্যে এই সমস্যা মিটিয়ে ফেলতে হবে। অতঃপর সৈন্যবাহিনী বুঝবে যে, রাষ্ট্রপতি যতটুকু না চিবোতে পারেন তার চেয়ে বেশী মুখে পোরেন। ফলে তারা নতুন নেতা খুঁজতে চাইবে। ইয়াহিয়াকে বাতাসের অনুকূলে আসতেই হবে- অবশ্য সময়ও দ্রুতগতিতে বয়ে যাচ্ছে।
.
জেসিকা গুলশান তোড়া
<৬,৪৭,৮৯>
শিরোনামঃ সম্পাদকীয়
জানি রক্তের পিছে ডাকবে সুখের বান
সংবাদপত্রঃ স্বদেশ
১ম বর্ষঃ ২য় সংখ্যা
তারিখঃ ১জুলাই, ১৯৭১
জানি রক্তের পিছে ডাকবে সুখের বান
.
সমগ্র বাংলাদেশ আজ যুদ্ধে লিপ্ত। পাকিস্তানের উপনিবেশবাদী জঙ্গী নাৎসীচক্রের ভাড়াটিয়া সৈন্যদের প্রতিহত ও সম্পূর্ণরুপে উৎখাত করার ইস্পাত কঠিন শপথ নিয়ে বাংলার আপামর কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র-জনতা আজ মরণপণ সংগ্রামে লিপ্ত। যে কোন মূল্যেই হোক না কেন বাংলার পবিত্র মাটি থেকে হানাদার বাহিনীকে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত বাংলাদেশের গণ-মানুষের এই যুদ্ধ অব্যাহত থাকবে।
.
বাংলার মানুষের রক্তদান কখনও বৃথা যায়নি। তাই দশ লক্ষ শহীদের রক্তের সাথে আমরা বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারিনা। শহীদের এ রক্তদান আমরা বৃথা যেতে দিতে পারিনা।
.
বাংলাদেশের মানুষের অসীম ত্যাগ-তিতিক্ষা ও শৌর্য-বীর্য ইতিমধ্যেই বিশ্বের অন্যান্য দেশের মানুষের শ্রদ্ধা অর্জনে সক্ষম হয়েছে। কোন বিদেশী শক্তির উপর নির্ভর না করে নিজেদের শক্তিতে বলীয়ান হয়ে বাংলার মানুষ যে একটি সুশিক্ষিত ও আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত, এটা বিশ্বের মানুষের কাছে একটা চরম বিস্ময় হিসাবে দেখা দিয়েছে।
.
রক্ত আমরা দিয়েছি, আরো রক্ত দিতে আমরা প্রস্তুত। কিন্তু বাংলার স্বাধীনতা আমরা রক্ষা করবই। জয় আমাদের অবশ্যম্ভাবী। আমরা এই মর্মে বিশ্বের সকল স্বাধীনতাপ্রিয় জনগণ এবং গণতান্ত্রিক এবং সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নিকট বাংলাদেশের এই মুক্তিযুদ্ধকে সর্বতোভাবে সাহায্য করার জন্য আবেদন জানাচ্ছি। জনবল আমাদের আছে, অস্ত্র, অর্থ, ঔষধপত্র এবং নৈতিক সমর্থন আমাদের একান্ত প্রয়োজন।
.
জেসিকা গুলশান তোড়া
<৬,৪৮,৯০-৯১>
শিরোনামঃ বিচ্ছিন্নতার পথে বাংলাদেশ
সংবাদপত্রঃ স্বদেশ
১ম বর্ষ, ২য় সংখ্যা
তারিখঃ ১ জুলাই, ১৯৭১
বিচ্ছিন্নতার পথে বাংলাদেশ
[আমেরিকার নিউজউইক সংবাদ সাপ্তাহিকের (১৫ই মার্চ সংখ্যায়) পাকিস্তানের তদানীন্তন রাজনৈতিক সংকট সম্পর্কে পাকিস্তান বিচ্ছিন্নতার পথে শীর্ষক এক রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল। ভাষান্তরিত নিবন্ধনটি প্রকাশ করা হল। ]
চূড়ান্ত হতাশা বাঙালীদের আজ বিচ্ছিন্নতার পথে পরিচালিত করেছে অধিকাংশ লোক তাতে বিচলিত হয়ে পড়েছেন। পশ্চিম পাকিস্তানী অফিসাররা স্বীকার করেন যে, পশ্চিমাঞ্চলে পাঁচ কোটি মানুষের তুলনায় পূর্বাঞ্চলের সাত কোটি জনসাধারণের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিতান্ত সামান্য ই হয়েছে। যেমন বিগত তেইশ বছর ধরে কেন্দ্রীয় বাজেটের পাঁচ ভাগের চার ভাগ পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় করা হয়েছে। পাকিস্তানের উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মচারীদের প্রায় ৮৫ ভাগ এবং সেনাবাহিনীর অফিসারদের প্রায় ৯০ ভাগ পশ্চিম পাকিস্তানী এবং বিগত কয়েক বছরে পশ্চিমাঞ্চলে মাথা পিছু আয় বেড়েছে শতকরা ৪২ ভাগ, আর পূর্বাঞ্চলে মাত্র শতকরা ১৭ ভাগ। পূর্ব পাকিস্তানীরা দীর্ঘ বার বছর সামরিক একনায়কত্বের পর গত বছরের শেষভাগে দেশের প্রথম স্বাধীন সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে (নিউজউইক ডিসেম্বর ২১) তাদের পুঞ্জীভূত রোষের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালী জাতীয়তাবাদী অগ্নিপুরুষ শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত আওয়ামী লীগ দল আশ্চর্যজনকভাবে শতকরা ৯৮ ভাগ ভোট লাভ করেন। শেখ মুজিবুর তাঁর অনুরক্তদের মধ্যে ‘মুজিব’ নামে পরিচিত। মুজিব তাঁর ছয় দফা কর্মসূচীর জোরেই নির্বাচনে জয়লাভ করেন। এই ছয় দফা কর্মসূচী মূলত পাকিস্তান রাষ্ট্রকে একটি শিথিল কনফেডারেশনে পরিণত করবে। এতে প্রদেশগুলোকে সত্যিকারের স্বায়ত্তশাসন দিয়ে কেন্দ্রের জন্যে নিতান্ত সামান্য ক্ষমতাই অবশিষ্ট রাখা হয়েছে। কেন্দ্রের হাতে শুধু বৈদেশিক নীতি এবং জাতীয় প্রতিরক্ষার বিষয় ছাড়া আর কিছুই দেয়া হয়নি। আর নতুন জাতীয় পরিষদে নিশ্চিত সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে মুজিব তথা পূর্ব পাকিস্তান তাদের রাষ্ট্রের ইতিহাসে, সর্বপ্রথম মুক্তির পথ করে নেয়ার মত রাজনৈতিক শক্তি অর্জন করেছে। এই সমস্ত ঘটনা পশ্চিম পাকিস্তানে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এখানে উল্লেখ্য যে, গত ডিসেম্বরের নির্বাচনে প্রভাবশালী বামপন্থী নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর নেতৃত্বে পাকিস্তান পিপলস পার্টি পশ্চিম পাকিস্তানে শীর্ষস্থান অধিকার করেছেন। কিন্তু তিনি আওয়ামী লীগের হাতে সংসদীয় পরাজয় মেনে নিতে রাজি হলেন না। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পেয়েছে ১৬৭টি ও পাকিস্তান পিপলস পার্টি পেয়েছে ৮২টি আসন। জুলফিকার আলী ভুট্টো কেবল যে সংসদীয় পরাজয় পরাজয় মেনে নিতে রাজি হলেন না তা নয় তাঁর দলের পরিষদ সদস্যদের বলে দিলেন কেউ যেন জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদান না করে। এর ফলে বৃটেনে ট্রেনিংপ্রাপ্ত অন্তঃসারশূন্য সৈনিক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পড়লেন দুজন আপোষ বিমুখ রাজনীতিবিদের পাল্লায়। শেখ মুজিবর রহমান ও জুলফিকার আলী ভুট্টো দুজনেই রাজনৈতিক মঞ্চের কুশলী নট।
.
অবশেষে ইয়াহিয়া খান ভাবলেন যে, তাঁকে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে যেতে হবে। এ উদ্দেশ্যে জাতীয় পরিষদের উদ্বোধনী অধিবেশন বাতিল করে তিনি চলতি সপ্তাহের মধ্যে পাকিস্তানের শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিবিদদের একটি সম্মেলন আহবান করেছেন। এই সম্মেলন ই হয়তো অচলাবস্থার নিরসন ঘটানোর একটি শেষ ও দুঃসাহসিক প্রচেষ্টা। কিন্তু ইয়াহিয়ার এই আমন্ত্রণ শেখ মুজিব প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং সপ্তাহ শেষের ঘটনাবলী দেখে মনে হয় তিনি অবিলম্বে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন। এই ঘটনার পর ইয়াহিয়া এক ঘোষণার মারফত এ মাসের শেষের দিকে জাতীয় পরিষদ অধিবেশন উদ্বোধনের ব্যাপারে তাঁর মতামত দেশবাসীকে জানিয়ে দিলেন এবং সেই সাথে এক হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বললেন যে, ‘পাকিস্তানের সংহতি ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধানের জন্যে সেনাবাহিনী এগিয়ে আসতে পারে। দেশকে রাজনৈতিক ভরাডুবির হাত থেকে রক্ষার জন্যে ইয়াহিয়ার চেষ্টা সত্ত্বেও পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন যে, অবস্থা এখন পাকিস্তানী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের আয়ত্তের বাইরে। হয়তো সীমাবদ্ধ অনুভূতিই ভবিষ্যৎ ঘটনাবলী নিয়ন্ত্রিত করবে। নিউজউইকের ঢাকায় অবস্থানরত লোরেন জেন কিনসকে পাশ্চাত্যের জনৈক কূটনীতিক বলেছেন, “পাকিস্তানের দুই অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে কি পড়বে না এটা এমন কোন প্রশ্ন নয়। এখন প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে স্বাধীনতা কবে হবে। কি আগামী সপ্তাহে, না কি আগামী মাসে অথবা এর জন্যে আরো বছর খানেক কি বছর দুয়েক সময় লাগবে। দুর্ভাগ্যবশত মনে হয় পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান খুব তাড়াতাড়িই বিচ্ছিন্ন হবে; খুব বেশী দেরী হবে না।”
.
.
জেসিকা গুলশান তোড়া
<৬,৪৯,৯২-৯৪>
সংবাদপত্রঃ স্বদেশ
তারিখঃ ১ জুলাই, ১৯৭১
আমাদের প্রধান সেনাপতিঃ জেনারেল ওসমানী
বাংলাদেশ বাহিনীর প্রধান সেনাপতি জেনারেল মুহম্মদ আতাউল গণী ওসমানীর নাম আজ বাংলার ঘরে ঘরে গর্বের সঙ্গে উচ্চারিত হচ্ছে। আত্মত্যাগ ও নিষ্ঠা এবং সর্বোপরি দৃপ্ত ও বিচক্ষণ নেতৃত্বের জন্য বাংলার এই চিরকুমার প্রধান সেনাপতি সকলের কাছে সুপরিচিত। আজ তিনি দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পুরোভাগে এসে দাঁড়িয়েছেন। তাঁর সবল নেতৃত্বে হাজার হাজার বাঙ্গালী এগিয়ে চলেছে জয়যাত্রার পথে, নব জনগণ বাংলার নতুন ঊষার পথে।
জাতিগত অধিকার এবং গণস্বার্থ আদায়ের জন্য যে সজাগ দৃষ্টি এবং সংগ্রামী মানসিকতার প্রয়োজন, বাঙ্গালীদের মধ্যে সেই উপলব্ধিকে জোরদার করার জন্য জেনারেল ওসমানী অক্লান্ত পরিশ্রম করে যান তাঁর কর্মজীবনের প্রথম থেকেই।
১৯৫১ সালের শেষের দিকে জেনারেল ওসমানী কর্তৃক ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়কত্ব গ্রহণ করার পর থেকে রেজিমেন্টের ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সূচনা হয়। বাঙ্গালীদের সামরিক বাহিনীতে না নেয়ার জন্য বাঙ্গালীবিদ্বেষ স্বার্থ সংশ্লিষ্ট মহল ‘বাঙ্গালীরা সামরিক জাতি নয়’ এই মর্মে যে মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছিল সেটাকে প্রতিরোধ করার জন্য তিনি প্রাণপন ঢেলে দেন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সর্বাত্মক উন্নতি সাধন ও মান উন্নয়নের জন্য। কতৃপক্ষ কর্তৃক সকল রকমের বিঘ্ন সৃষ্টি করা সত্ত্বেও তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করে এই রেজিমেন্টকে একটি সংগ্রামী যোদ্ধাদল হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন যার ফলে যুদ্ধকৌশল এবং বীরত্বের দিক থেকে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট পাকিস্তানের বেলুচ এবং পাঞ্জাব ইত্যাদি সকল দলের মধ্যে নিজেদেরকে শ্রেষ্ঠ প্রতীয়মান করে। এই ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট পাকিস্তানে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে। তারই প্রতিফল আমরা দেখি ১৯৬৫ সালের ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের লাহোর রণাঙ্গনে। সেই যুদ্ধে বীর বিক্রমে লড়াই করে লাহোরকে রক্ষা করে এই বাঙ্গালীরাই।
বাঙ্গালীদের সম্পর্কে পাঞ্জাবী চক্রের মিথ্যা প্রচারণার অবসান ঘটানো এবং সেনাবাহিনীতে বাঙ্গালীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে জেনারেল ওসমানী থাকতেন সকলের পুরোভাগে। এই জন্য তিনি পাকিস্তান সামরিক চক্রের বিরাগভাজন হন। সামরিক শিক্ষা ও কর্মদক্ষতার দিক থেকে তাঁর সমকক্ষ সেনাপতি কেউ নেই, তবু তাঁর পদোন্নতি বন্ধ করে দেয়া হয়।
এখানে উল্লেখযোগ্য যে তদানীন্তন ভারতীয় সেনাবাহিনীর মধ্যে জেনারেল ওসমানীই সর্বকনিষ্ঠ মেজর হিসাবে নিযুক্ত হন। বাঙ্গালী অফিসারদের সবসময়ই পাকিস্তানে দাবিয়ে রাখা হয়। তিনি নিজের ভবিষ্যৎ এবং কর্তৃপক্ষ থেকে সম্ভাব্য সকল রকম বিপদ উপেক্ষা করে এইসব বাঙ্গালীদের উন্নতির জন্য লড়াই করে গেছেন। আর বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের মানুষের প্রতি ভালবাসা এবং তাদের হয়ে সংগ্রাম করার কারণে তাঁকে সামরিক কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে বিভিন্নভাবে পর্যুদস্ত হতে হয়।
সাধারণ সৈনিকদের প্রতি তাঁর অকৃত্র স্নেহ এবং বাংলার মানুষ তথা বাংলার ভাষার প্রতি তাঁর ভালবাসার প্রমাণ নিম্নোক্ত দুটি ঘটনা থেকেই মেলে। সামরিক বাহিনীতে উর্ধ্বতন অফিসারদের কাছে সুবেদার মেজরদের দৈনন্দিন একটা রিপোর্ট দেয়ার রেওয়াজ আছে। পাকিস্তান বাহিনীর নির্দেশ হচ্ছে, এই রিপোর্ট একমাত্র উর্দুতেই দেয়া চলবে। জেনারেল ওসমানী এই সর্বপ্রথন তাঁর সুবেদার মেজরকে বাংলায় রিপোর্ট দেয়ার অনুমতি দেন। এই জন্য পাকিস্তান সামরিক চক্র তাঁর কাছ থেকে কৈফিয়ৎ দাবী করে এবং তিনিও তার যথাযোগ্য জবাব দেন। আর একটি ঘটনা হয়ত অনেকেরই জানা নেই। জেনারেল ওসমানী এক দানপত্রে তাঁর সকল সম্পত্তি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে দিয়েছেন। বাংলাদেশের প্রতি এবং বাঙ্গালী বাহিনীর প্রতি তাঁর আন্তরিক প্রীতির পরিচয় এখানেই পাওয়া যায়।
জেনারেল ওসমানী ১৯১৮ সালের ১লা সেপ্টেম্বর পূর্ব-বাংলার সিলেট জেলার সুনামগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পূর্বপুরুষ শাহ নিজাম উদ্দিন ওসমানী হজরত শাহজালালসহ গৌরগোবিন্দ সিংহের রাজত্বকালে এদেশে আসেন। তাঁর পিতা মরহুম খান বাহাদুর মফিজুর রহমান, বি. এ. কে. এইচ. এম সততা, মানবপ্রীতি ও নিঃস্বার্থ দেশ প্রেমের জন্য খ্যাত ছিলেন।
জেনারেল ওসমানী কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন সিলেট গভর্নমেন্ট হাইস্কুল থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং ইংরেজীতে বিশেষ দখলের জন্য প্রিটোরিয়া প্রাইজ লাভ করেন। ১৯৩৪ সালে তিনি উচ্চ শিক্ষার্থে আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে গমন করেন। ১৯৩৮ সালে তিনি কলা বিভাগে ডিগ্রী লাভ করেন এবং ১৯৩৯ সালে মাস্টার ডিগ্রীর চূড়ান্ত পরীক্ষার পূর্বেই ভারতীয় সেনাবাহিনীতে ক্যাডেট হিসাবে যোগদান করেন। ১৯৪০ সালের ৫ই অক্টোবর তিনি ইন্ডিয়ান মিলিটারী একাডেমী, দেরাদুন থেকে সামরিক শিক্ষা শেষ করে বৃটিশ ইন্ডিয়ান কমিশন প্রাপ্ত হন। এরপর থেকে তাঁর দ্রুত পদোন্নতি হয়। ১৯৪১ এর ফেব্রুয়ারীতে ক্যাপ্টেন এবং ১৯৪২ এর ফেব্রুয়ারীতে তৎকালীন বৃটিশ সাম্রাজ্যের সর্বকনিষ্ঠ মেজর হন ও মাত্র ২৩ বছর বয়সে একটি যান্ত্রিক পরিবহন ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক হয়ে এক রেকর্ড সৃষ্টি করেন।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে বর্মা রণাঙ্গনে যে অল্প কয়েকজন অশ্বেতাঙ্গ অধিনায়ক যুদ্ধ পরিচালনায় নিযুক্ত হয়েছিলেন তিনি তাঁদের মধ্যে অন্যতম। ১৯৪৬ সালের বৃটিশ সেনাবাহিনীতে ইস্টার্ন কমান্ড সিলেকশন কমিটি কর্তৃক তিনি উচ্চ শিক্ষার জন্য মনোনীত হন এবং ১৯৪৭ সালের ফেব্রুয়ারীতে অনুষ্ঠিত ফাস্ট পোস্টওয়ার স্টাফ কলেজ এন্ট্রেস পরীক্ষায় বৃটিশ ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর অফিসারদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় উচ্চস্থান লাভ করেন এবং স্টাফ কলেজে ১৯৪৮ সনের কোর্সে স্থান অর্জন করেন।
এখানে উল্লেখযোগ্য যে তিনি আই. সি.এস. এ কোয়ালিফাইড হওয়ায় ইন্ডিয়ান পলিটিক্যাল সার্ভিসের জন্যও ১৯৪৬ সালেই মনোনীত হন। কিন্তু সৈনিক জীবন পরিত্যাগ করতে অস্বীকার করেন। পরে ১৯৪৭ সনের শুরুতে তৎকালীন ভারতীয় অন্তবর্তী সরকারের পররাষ্ট্র সচিব জওহরলাল নেহেরু তাঁকে একটি কুটনৈতিক পদ গ্রহণের জন্য আহবান জানান। জেনারেল ওসমানী সে প্রস্তাবও প্রত্যাখান করেন। একই সালে তিনি লেফটেন্যান্ট কর্ণেল পদের জন্য মনোনীত হন এবং বৃটিশ ভারতের সিমলাস্থ জেনারেল হেডকোয়ার্টার্স এ কোয়ার্টার মাষ্টার জেনারেলের শাখায় সেকেন্ড গ্রেড স্টাফ অফিসার পদে নিযুক্ত হন।
ভারত বিভাগের পরপরই তিনি পাকিস্তানের জন্য অংশ নির্ধারণের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই বছর সাতই অক্টোবর পাকিস্তানে তাঁকে লেফটেন্যান্ট কর্ণেল পদে উন্নীত করা হয়। তারপর ১৯৪৮ সালে তিনি কোয়েটা স্টাফ কলেজের কোর্সে যোগদান করেন। ১৯৪৯ সনে স্টাফ কলেজ থেকে ডিগ্রী লাভ করার পর তাঁকে তদানীন্তন চীফ অফ দি জেনারেল স্টাফ মেজর জেনারেল রেজিনাল্ড হাটন এর সহকারী স্টাফ অফিসার পদে নিয়োগ করা হয়।
এরপর বিভিন্ন পদে সৈন্যবাহিনীতে অধিনায়কত্ব এবং বিশেষ খ্যাতি অর্জনের পর ১৯৫২ সনের দিকে তাঁকে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রথম ব্যাটেলিয়নের ভার দেয়া হয়। ১৯৫৫ সনে তাঁকে ই,পি রাইফেলস এর অতিরিক্ত কমান্ডান্ট পদে বহাল করা হয়।
১৯৫৬ সনে তিনি কর্ণেল পদে উন্নতি হন এবং জেনারেল হেড কোয়াটার্স এর জেনারেল স্টাফ এ মিলিটারী অপারেশনের ডেপুটি ডাইরেক্টর পদ গ্রহণ করেন। এই সময় থেকে তিনি বহু আন্তর্জাতিক সামরিক ও পরিকল্পনার বৈঠকে পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করেন এবং বিদেশী রাষ্ট্রের সর্বাধিনায়কদের শ্রদ্ধা ও প্রশংসা অর্জন করেন।
১৯৬৪ সনে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে যান এবং সেখানকার সাঁজোয়া, গোলন্দাজ, পদাতিক এবং বিমানবাহী শত্রু ও অস্ত্রের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পর্কে অবহিত হন।
১৯৬৭ সনে জেনারেল ওসমানী সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
অবশেষে ১৯৭১ সনের এপ্রিল মাসে বাঙ্গালীরা তাঁকে তাঁর উপযুক্ত মর্যাদা দেয় এবং বাঙ্গালী সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক পদে তাঁকে বরণ করে নেয়। একই সঙ্গে গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশ সরকার তাঁকে জেনারেল পদে উন্নীত করেন। আজ তাঁরই অধিনায়কত্বে বাংলার সংগ্রামী সেনারা এগিয়ে চলেছে এক নবতর ভবিষ্যতের পানে।
.
.
জেসিকা গুলশান তোড়া
<৬,৫০,৯৫-৯৬>
সংবাদপত্রঃ স্বদেশ
তারিখঃ ১ জুলাই, ১৯৭১
লন্ডনের চিঠি
বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দিয়ে রাজনৈতিক সমাধান জলের উপর আল্পনা কাটার নামান্তর
(মাহমুদ হোসেন প্রদত্ত)
পাকিস্তান সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় বিশিষ্ট ইংরেজী ‘দৈনিক মর্নিং নিউজের’ করাচী সংস্করণের অন্যতম সহকারী সম্পাদক মিঃ এন্টনী মাসকারেনহাস সম্প্রতি পাকিস্তান থেকে সপরিবারে এখানে চলে এসে সানডে টাইমস পত্রিকায় বাংলাদেশের হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কে যে বিস্তারিত বিবরণী দিয়েছেন তাতে থলের বিড়াল বেরিয়ে পড়েছে। ত্যাগী পাকিস্তানী সাংবাদিক মিঃ মাসকারেনহাস- তোমাকে জানাই অভিনন্দন।
কালজয়ী নির্ভীক সাংবাদিক বন্ধু মিঃ মাসকারেনহাস প্রদত্ত ‘সানডে টাইমসের’ সেই স্টোরি পাকিস্তানী কাগজে ছাপবে না এ জানি। কিন্তু সকল দেশের স্বাধীন পত্র-পত্রিকা তা ছাপিয়েছে; ভারতীয় পত্র-পত্রিকাও তা ছাপাতে কুন্ঠিত হয়নি। এখানে বন্ধু মিঃ মাসকারেনহাসের সাথে আমার আলাপ হয়েছে। তিনি তার দেশের (পাকিস্তান) অন্যান্য প্রত্যক্ষ করেছেন ধ্বংসলীলা। বিরাট জনপদগুলো দেখে কান্না পেয়েছে তাঁর। এই কিছুদিন আগেও বাংলাদেশের যে সব জনপদ ছিল প্রাচুর্যে ভরা, হাসি গানে মুখরিত; সে সব জনপদে এখন কবরের নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। অধিকাংশ ঘরবাড়ীতে মানুষ নেই এমন কি নেই জানালা-দরজা। দোকানপাট খা খা করছে। সরকারী অফিসগুলো দরজা খোলা থাকলেও কোন কর্মচারী দেখেননি তিনি। যে সব উর্দুভাষী মানুষ তাঁর চোখে পড়েছে তাদের দেহ অনশন ক্লিষ্ট বা রোগাজীর্ণ। আর দেখেছেন অগণিত মানুষের ফসিল। কলকারখানার চাকা বন্ধ, মাঠে মাঠে ফসল নেই, আছে ঘাস ও অন্যান্য তৃণের সমাহার। আর দেখেছেন জলে স্থলে অন্তরীক্ষে শুধু সেনাবাহিনীর অশুভ পদচারণা, যাদের চোখ বাজপাখীর মত সর্বত্র শিকার খুঁজছে। সে শিকারটি কি তা আর বলে দিতে হয় না। যদিও পাকিস্তানের সামরিক জান্তা সরকার সফরকারী সাংবাদিককে পশ্চিম পাকিস্তানের নাগরিক এবং বাংলাদেশে বসবাসকারী উর্দুভাষী বাসিন্দাদের দ্বারা সৃষ্ট কৃত্রিম স্বাভাবিক পরিবেশ দেখানোর চেষ্টা করেছিল কিন্তু তা দিয়ে বিভীষিকাকে ঢাকা যায়নি, যায় না। তবে মাসকারেনহাস আপ্রাণ প্রচেষ্টায় খুব গোপনে এবং সতর্কতার সাথে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সাক্ষাৎ লাভে সমর্থ হয়েছিলেন।
তাদের সাথে আলাপ করে তিনি জানতে পেরেছেন কোন আপোষ নয়, বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত না করা পর্যন্ত সংগ্রাম চলবে। মাসকারেনহাসের মন্তব্যঃ এই তো কথার মত কথা। তেতো বলে অপবাদ থাকলেও বাঙ্গালীরা সত্যিই বীরের জাত। অধিকার সচেতন বাঙ্গালীরা নিজেদের মৌলিক দাবী প্রতিষ্ঠার প্রশ্নের এ ব্যাপারে কাউকে তোয়াক্কা রাখে না।
মাসকারেনহাসের রিপোর্ট বিশ্বে যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে, এই বিংশ শতাব্দীর সাংবাদিকতার ইতিহাসে এখানে তা অনুভব করা যায়। এখন আর কিছুই লুক্কায়িত নেই। বাংলাদেশের চলমান ঘটনাবলীর কাছে মাইলাইর হত্যাযজ্ঞ তুচ্ছ বলে এখানে অনেকে অভিমত প্রকাশ করেছেন। অবশ্যি ঘটনার শুরুতে ভারতের বার্তা সরবরাহ প্রতিষ্ঠান পি,টিআই বাংলাদেশের জনৈক হাই পারসোনালিটির বরাত দিয়ে এ ধরনের একটি খবর ক্রিড করেছিলেন। তা আজ সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। প্রমাণিত হয়েছে যে এটা কখনই পাকিস্তানের ঘরোয়া ব্যাপার হতে পারেনা। এমনি বাংলাদেশের প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিঘোষিত স্বাধীনতা মেনে নিয়ে কোন রাজনৈতিক মীমাংসা হওয়াও অসম্ভব ব্যাপার। এটা বিশ্বের জনমত। কারণ পাকিস্তান আর বাংলাদেশ প্রকৃতপক্ষে ভৌগলিকভাবে এবং অনেক দিক থেকে সম্পূর্ণ সামনজ্যহীন। সুতরাং এ দুটোকে এক সুতোয় বেঁধে রাষ্ট্র হিসেবে দাঁড় করান যায় না। আর যেহেতু বাংলাদেশের জনসংখ্যা পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় বেশী সে ক্ষেত্রে নীতিগতভাবে বাংলাদেশের অধিবাসীরা প্রশাসনিক ব্যাপারে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃত্ব মেনে নিতে পারে না। এবং তা চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা হবে জলের উপর আল্পনা কাটার নামান্তর।
.
.
আহসান উল্লাহ
<৬,৫১,৯৭>
শিরোনামঃ বাংলাদেশের স্বীকৃতি এখন কেবল সময়ের প্রশ্ন মাত্র
সংবাদপত্রঃ স্বদেশ ১ম বর্ষঃ ৩য় সংখ্যা
তারিখঃ ১৪ জুলাই, ১৯৭১
.
বিষয়ঃ বাংলাদেশের স্বীকৃতি এখন কেবল সময়ের প্রশ্ন মাত্র
.
প্রখ্যাত মার্কিন সাপ্তাহিক পত্রিকা নিউজউইক এ বাংলাদেশের গণহত্যার করুণ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।বলা হয়েছে এই হত্যাযজ্ঞের সাথে ইতিহাসে অন্য কোন ধ্বংসলীলার তুলনা হতে পারে না। উক্ত পত্রিকায় আরও বলা হয়েছে যে এই হত্যালীলা ও নরমেধযজ্ঞের ফল একটিই হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তান আজ নামমাত্র পাকিস্তানের অংশ। যে পাশবিকতা চালানো হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের উপর তাতে আর কোন দিন পূর্ব ও পশ্চিমের একত্রে জোড়া লাগানো যাবে না। পাকিস্তানের দুই অংশ চিরদিনের মত বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। রক্তস্নাত বাংলাদেশের স্বীকৃতি এখন কেবল মাত্র সময়ের ব্যাপার।
.
অপরদিকে ভিয়েনার পত্রিকার সাংবাদিক বাংলাদেশ সম্পর্কে দীর্ঘ প্রবন্ধ প্রকাশ করেছেন। উক্ত প্রবন্ধটিতে বলা হয়েছে শাসক জাতির গর্বে উন্মত্ত পাঞ্জাবীরা বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে, ফলে বাঙালিরা বাধ্য হয়ে ঘোষণা করেছে তাদের স্বাধীনতা। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করছে। আর এসব অস্ত্র এখন ব্যবহার হচ্ছে নির্বিকার গণহত্যায়। কিন্তু এই হত্যাকাণ্ডের ফলে পাকিস্তানের ঐক্য চিরতরে বিনষ্ট হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশের স্বীকৃতি এখন কেবল সময়ের প্রশ্ন মাত্র।
.
আহসান উল্লাহ
<৬,৫২,৯৮-৯৯>
সংবাদপত্রঃ স্বদেশ ১ম বর্ষঃ ৩য় সংখ্যা
তারিখঃ ১৪ জুলাই,১৯৭১।
.
স্বাধীনতার দাবি করে মুজিব অন্যায় করেনি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার দাবি করে শেখ মুজিবুর রহমান কোন অন্যায় করেননি। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি যদি দেশের স্বাধীনতা চেয়ে থাকেন তাহলে তিনি রাজনৈতিক অপরাধী হতে পারেন না। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে তাই আমাদের একমাত্র দাবী, মুজিবুর রহমানের মুক্তি চাই।
.
কলাসীম, গাইঘাটা, বনগাঁ ও বাগদার শরণার্থী শিবিরগুলো পরিদর্শনের পর কানাডার সরকারী দলের নেতা শ্রী জর্জ ল্যাচেন্স সাংবাদিকদের কাছে তার এ অভিমত ব্যক্ত করেন ।
.
বুধবার নয়াদিল্লী থেকে দমদম বিমানঘাঁটিতে নেমে তাঁরা সোজা সীমান্ত শিবিরগুলি পরিদর্শনে যান। পথের দুপাশে অগণিত জনতার মিছিল তাদের বারবার জিজ্ঞাসার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। দোভাষীকে দিয়ে জিজ্ঞাসা করান , কোথায় তাদের ঘর, কত দূর থেকে তাঁরা এসেছে। সেই একই বেদনাময় কাহিনী। মায়ের বুক থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে সন্তানকে, সদ্য বিবাহিত স্ত্রীর চোখের সামনে স্বামীকে হত্যা করেছে, ইয়াহিয়ার রক্তলোলুপ বাহিনীর রক্তের তৃষ্ণা তাতেও মেটেনি। প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসার পথেও হিংস্র কুকুরের মত তারা ঝাপিয়ে পড়েছে যুবতী কন্যাদের লুণ্ঠন আর কিশোরীদের হত্যা- ওপার বাংলা থেকে পালিয়ে আসা মানুষদের সবারই একই কাহিনী। কানাডিয়ান পার্লামেন্টের প্রতিনিধিরা তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা কি আর দেশে ফিরে যাবে না ? হ্যাঁ, যাবো, যদি মুজিব আমাদের ডাক দেয়। সবার মুখে একই উত্তর।
.
আবেগআপ্লুত কানাডার নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতা মিঃ এন্ড্রু ব্রেউইন, কনজারভেটিভ দলের নেতা মিঃ হিথ ম্যাকোয়ারি ও লিবারেল পার্টির নেতা মিঃ জর্জ ল্যাচেন্স বলে উঠেনঃ পাকিস্তানে গিয়ে আমাদের প্রধান কাজ হবে শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির দাবী তোলা।
.
গণতান্ত্রিক কাঠামোয় কেউ যদি স্বাধীনতার দাবী করে তাহলে সে অন্যায় কিছু করবে না। কানাডায় এমন গণতান্ত্রিক দল আছে যারা কুইবেকের স্বাধীনতার দাবী তুলেছে। তাদের বিচ্ছিন্নতাকামি বলে তো জেলে তোলা হয়নি। কিংবা তাদের দেশদ্রোহী বানিয়ে পৃথিবীর সামনে হেয় করবার কোন চেষ্টা হয়নি। নিউ ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নেতা শ্রী এন্ড্রু ব্রেইউন তাদের সফরের উদ্দেশ্য ঘোষণা করে বলেন, দুটি উদ্দেশ্য নিয়ে তারা ভারতে এসেছেন। একটি মানবিক কর্তব্য সম্পাদনের দায়িত্ব। অপরটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমাধানের সম্ভাবনা পরীক্ষা করা। মানবিকতার দিক থেকে ভারতের কাঁধে সবচেয়ে বেশি বোঝা এসে পড়েছে। কানাডা তার কতটুকু সহজ করে দিতে পারে সেদিকে তাদের প্রধান লক্ষ্য। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমাধান না হলে বিশ্বশান্তি বিঘ্নিত হবে বলে তাদের বিশ্বাস। কারণ আমেরিকা, চীন ও রাশিয়া বাংলাদেশের উপর লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তাই ভয় হয়,রাজনৈতিক সমাধানের সম্ভাবনা সুদূর পরাহত না হয়ে পড়ে।
.
তিনি আরও বলেন, মাত্র ছ’মাস শরণার্থীদের থাকা খাওয়ার জন্য প্রায় চল্লিশ কোটি ডলার খরচ হবে। কানাডা ইতিমধ্যেই কিছু অর্থ ও অন্যান্য সামগ্রী পাঠিয়েছে। শরণার্থীদের দেখে যাবার পর তারাও সরকারের কাছে দাবী তুলবেন, কত বেশি সাহায্য শরণার্থীদের দেওয়া সম্ভব সেদিকে নজর দিতে।
.
লিবারেল পার্টির নেতা শ্রী জর্জ ল্যাচেন্স বলেন, অর্থনৈতিক সাহায্যের জন্য পাকিস্তানকে বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রের উপর নির্ভর করতে হয়। তাই এমন পরিকল্পিত গণহত্যা করার আগে তারা যদি বিশ্বের অন্যান্য দেশের পরামর্শ গ্রহণ করত তবে তা অনেক বেশি বাস্তব ও বুদ্ধিমানের কাজ হত।
.
আহসান উল্লাহ
<৬,৫৩,১০০>
সংবাদপত্রঃ স্বদেশ ১ম বর্ষঃ ৩য় সংখ্যা
তারিখঃ ১৪ জুলাই,১৯৭১
.
রক্তে মোদের জ্বলছে আজ প্রতিশোধের আগুন।
.
বাংলাদেশের মুক্তিপাগল সাড়ে সাত কোটি মানুষ আজ পাকিস্তানের উপনিবেশবাদী জঙ্গি নাৎসী চক্রের ভাড়াটিয়া সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে মরণপণ যুদ্ধে লিপ্ত। পাঞ্জাবী সামরিক আমলাতন্ত্রের পোষ্য ইয়াহিয়া-টিক্কা চক্র ভেবেছিল মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বাংলাদেশের প্রতিরোধ চূর্ণ করে দেওয়া যাবে। কিন্তু বিগত ১১০ দিনের যুদ্ধে বাংলার মুক্তিপাগল স্বাধীনতাকামী মানুষের হাতে ২৩ হাজার ভাড়াটিয়া সৈন্য নিহত হয়েছে। এছাড়া পাকিস্তানের অর্থনীতি সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত। রপ্তানি বাণিজ্য শুন্যের কোঠায় এসে পৌঁছেছে। অপরদিকে পাক সামরিক চক্রের দিবা স্বপ্নকে ধূলিসাৎ করে দিয়ে পৃথিবীর বুকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে।
.
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার দাবি সোচ্চার হয়ে উঠেছে। স্বাধীনতাকামী বাংলার গনমানুষ আজ প্রমাণ করেছে যে , ভিয়েতনাম, লাউস, কম্বোডিয়ার মানুষের রক্তের মতই বাংলার মানুষের রক্ত লাল। পদ্মা মেঘনা যমুনার কুলে কুলে আজ প্রতিশোধের আগুন জ্বলছে। ভাড়াটিয়া সৈন্যের কামান স্তব্ধ না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের মানুষের এ যুদ্ধ চলবে। রূপসী বাংলার দু চোখে জ্বলছে ভয়াল বহ্নিশিখা। সোনার বাংলায় আজ দাবানলের মত প্রতিশোধের আগুন ছড়িয়ে। ভাড়াটিয়া সৈন্যের কামান স্তব্ধ না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের মানুষের এ যুদ্ধ চলবে। সোনার বাংলায় আজ দাবানলের মত প্রতিশোধের আগুন ছড়িয়ে পড়েছে দিকে দিকে।
.
.
সৌ রভ
<৬,৫৪,১০১>
শিরোনাম: আমেরিকা তোমার পতাকার তারাগুলো যেন বুলেটের গর্ত
সংবাদপত্র: স্বদেশ ১ম বর্ষ: ৩য় সংখ্যা
তারিখ: ১৪ই জুলাই, ১৯৭১
.
আমেরিকা তোমার পতাকার তারাগুলো যেন বুলেটের গর্ত
আমেরিকা বার বার বলেছিল, পাকিস্তানকে আর নতুন করে অস্ত্রশস্ত্র দেয়া হচ্ছে না এবং পুরানো শর্তানুযায়ীও অস্ত্রশস্ত্র যাচ্ছেনা। এই কথা দেয়া হয়েছিল ২৫শে মার্চ থেকে ২১শে জুন পর্যন্ত। কিন্তু দেখা গেল সবই নির্ভেজাল মিথ্যা। তারপর যখন নিউইয়র্ক টাইমস অস্ত্র পাঠাবার কথা ফাঁস করে দিল তখন মার্কিন সরকার নাকে কেঁদে বললেন ওটা আমলাতান্ত্রিক ‘মারপ্যাঁচ’। কিন্তু সম্প্রতি ‘থলের বিড়াল’ বেড়িয়ে পড়েছে। আমলাতন্ত্র নন প্রেসিডেন্ট নিক্সন নিজের দায়িত্বে অস্ত্র যোগাচ্ছেন পাকিস্তানকে তিনি নিজেই আমলাতন্ত্রের পরামর্শ খারিজ করেছেন। সেই অতি পুরাতন যুক্তি পাকিস্তানকে অস্ত্র না দিলে দেশটা চলে যাবে চীনের খপ্পরে ইত্যাদি।
.
সমগ্র পৃথিবী বাংলাদেশের ইয়াহিয়ার সামরিক আমলাতন্ত্রের মধ্যযুগীয় বর্বরতা নিন্দায় মুখর ঠিক তখনই পেন্টাগনের কর্তৃপক্ষ ইয়াহিয়ার রক্তাত্ত হাতকে সবল করার জন্য অস্ত্র পাঠাচ্ছে। আমরা জানি মার্কিন সরকার তার শিল্পপতি ব্যবসায়ীদের স্বার্থে কাজ করে। সম্প্রতি মার্কিন পত্রিকা ‘ বিজনেস উইক’ বলেছে যদি ভিয়েতনামের যুদ্ধ বাবদ সরকারী খরচ বন্ধ হয়ে যায় তাহলে আমেরিকার বৃহত্তম কোম্পানির মধ্যে একশ পঁচাত্তরটাই ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হবে অর্থাৎ এতেই বুঝা যায় যে, পেন্টাগন কর্তৃপক্ষ তাদের অস্ত্রের বাজার সৃষ্টির জন্য উদ্বিগ্ন। আমেরিকার সমরনায়কেরা ও সমরশিল্পের সম্রাটেরা নতুন নতুন যুদ্ধের এলাকা খুঁজে বেড়াচ্ছে কারণ তাদের তৈরী সমর সম্ভার বিক্রির ব্যবস্থা করতে হলে যুদ্ধ বাধানো চাই।
.
পাকিস্তানকে আমেরিকা যতই অস্ত্র পাঠাক না কেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে বানচাল করার ক্ষমতা পৃথিবীর কারোর নেই। ভিয়েতনামের মানুষ যেমন মার্কিন ঔদ্ধত্যের জবাব দিয়েছে, বীর প্রসবিনী বাংলার মানুষ আজ সেইভাবে জবাব দিতে প্রস্তুত।
.
সৌ রভ
<৬,৫৫,১০২>
.
শিরোনাম: বিচিত্র নয়- অবাস্তব নয়
সংবাদপত্র: স্বদেশ (১ম বর্ষ: ৪র্থ সংখ্যা)
তারিখ: ২১ অক্টবর,১৯৭১
.
সম্পাদকীয়
.
বিচিত্র নয়- অবাস্তব নয়
ফ্রান্সের দৈনিক লামদ পত্রিকার প্রতিনিধির সাথে এক সাক্ষাৎকারে পাক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বলেছেন যে, “জনগণ চাইলে আমি শেখ মুজিবকে ক্ষমা করতে পারি।” এবং ভারত ও পাকিস্তান বিরোধ আলাপ- আলোচনার মাধ্যমে হওয়া উচিত যুদ্ধের মাধ্যমে নয়। তিনি আরো বলেছেন যে, এই বিরোধ মীমাংসায় তিনি যে কোন লোকের সাথে যে কোন স্থানে বসতে রাজী আছেন। ইয়াহিয়ার ‘জনগণ’ কারা তা আমরা জানি না। তবে আমরা জানি বিগত গণঅভ্যুত্থানের সময় বাংলার গণমানুষ ব্যারিকেড বেয়নেট-বেড়াজাল ভেদ করে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবীতে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে। আজ সারা বিশ্ব জানে যে, বিগত সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে বাংলার সাড়ে সাত কোটি মুক্তিপাগল জনতা ছয় এবং এগারো দফার সপক্ষে রায় দিয়েছে। এবং সে রায় ঐতিহাসিক রায়। পৃথিবীর নির্বাচনের ইতিহাসে সে রায় অনন্য সে রায় ভাস্বর।
.
আজ যখন সুদূর চট্টল থেকে দিনাজপুরের রৌদ্রক্ষরা মালভূমি পর্যন্ত বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর বীর সেনানীরা দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়েছে,আঘাতে আঘাতে যখন পর্যুদস্ত করছে হানাদার পাক-দস্যুদের, তখন পাক সামরিকচক্র বাংলাদেশে তাদের নিশ্চিত পরাজয় জেনে, আজ ভুল করতে শুরু করেছে। এটা বিচিত্র নয়- এটা অবাস্তব নয়, এটাই স্বাভাবিক। এ ছাড়া ইয়াহিয়া ‘ভারত পাকিস্তান বিরোধের মত একটা কল্পিত ভূত আবিষ্কার করেছেন- বিশ্ব জনমতকে ধোঁকা দেয়ার জন্য। তিনি আবদার করেছেন যে, ‘যে কোন লোক’ এর সাথে ‘যে কোন স্থানে’ তিনি বিরোধ মীমাংসায় বসতে রাজী আছেন। কারা সেই যে কোন লোক কোন সে স্থান ? কারা সেই লোক যারা একটি বর্বর পশুর সাথে আলোচনায় বসতে যাবে ? মানব ইতিহাসে দুরপনেয় কলঙ্ক সৃষ্টিকারী নায়কের সাথে কারা আলোচনায় বসবে আমরা জানি না।কি সে বিরোধ আমরা তাও জানি না। তবে আমরা জানি বাংলাদেশের মাটি আজ দুর্জয় ঘাটিতে পরিণত হয়েছে। এক লক্ষ মুক্তিবাহিনী সুন্দরবনের বাঘেরমত ক্ষিপ্রতা নিয়ে যে কোন মুহূর্তে সম্পূর্ণভাবে পরাজিত করবে হানাদার পাক-বাহিনীকে। মুক্ত করবে বাংলার মাটি আর মানুষকে।
.
সৌ রভ
<৬,৫৬,১০৩>
শিরোনামঃ মৃতনগরী ঢাকা
সংবাদপত্রঃ স্বদেশ ১ম বর্ষঃ ৪র্থ সংখ্যা
তারিখঃ ২১ অক্টোবর, ১৯৭১
.
মৃত নগরী ঢাকা ( কলকাতা প্রতিনিধি )
রেডিও সুইডেন প্রতিনিধি মিঃ এরল্যান্ডসন তিনি দিনব্যাপী বাংলাদেশে সফর সমাপ্ত করে সম্প্রতি দিল্লিতে সাংবাদিকদের জানান যে, ঢাকা সন্ত্রাসকবলিত শহরে পরিণত হয়েছে। সূর্যাস্তের পূর্বেই দোকানপাট বন্ধ করে দেয়া হয় এবং সেই সময়ে যুবকদের রাস্তায় দেখা যায় না। এ ছাড়া সর্বত্রই পাক বাহিনী মোতায়েন রয়েছে। সমস্ত সুবিধাজনক স্থানে, এমনকি ডাকঘরেও হোটেল ইন্টারকনটিনেনটালে সামরিক প্রহরা রয়েছে। হোটেল প্রবেশ করার ও বাইরে আসার সময় তল্লাশি চালানো হচ্ছে।
.
মিঃ এরল্যান্ডসন বলেছেন যে, যদিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচ হাজার ছাত্রের তালিকা রয়েছে, কিন্তু তিন থেকে চারশো ছাত্র ক্লাসে যোগ দেয়। সংবাদপত্রগুলির ওপর সেন্সরের কড়াকড়ি ব্যবস্থা রয়েছে। বাংলাদেশ শব্দটির সংবাদপত্রে মধ্যে কোন স্থান নেই এবং বঙ্গবন্ধু সম্পর্কিত যে কোন সংবাদের ঐ একই অবস্থা। তিনি আরো বলেছেন যে, সফররত বিদেশী সাংবাদিকদের পক্ষে পরিস্থিতির সঠিক চিত্র সংগ্রহ করা অসম্ভব। ঢাকার বাইরে সফর সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। মুক্তিবাহিনীর কার্যকলাপের বিভিন্ন সূত্রে শহরে এস পৌঁছায়। গেরীলাদের মাইন আক্রমণে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ ডুবানোর সংবাদ ঢাকায় পৌঁছেছিল।
.
মিঃ এরল্যান্ডসন ক্ষোভের সঙ্গে জানান যে, যেহেতু ত্রাণ সামগ্রী বিলি বণ্টনের দায়িত্ব পাক কর্তৃপক্ষের হাতে সেহেতু বণ্টন মোটেই আশাপ্রদ নয়। তিনি এই মর্মে অভিমত প্রকাশ করেছে যে, ত্রাণ সামগ্রীর সিংহভাগই পাক সেনারা ভোগ করেছে।
.
সৌ রভ
<৬,৫৭,১০৪>
সংবাদপত্রঃ স্বদেশ ১ম বর্ষঃ ৪র্থ সংখ্যা
তারিখঃ ২১ অক্টোবর, ১৯৭১
.
ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র
বাংলাদেশ সরকারের লক্ষ্য সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী ( ভ্রাম্যমান প্রতিনিধি )
“ এ লড়াই বেঁচে থাকার লড়াই, এ লড়াই মৌলিক ও মানবিক অধিকার সুরক্ষিত করার আন্দোলন-এ লড়াই স্বাধীনতার লড়াই। বিজয় আমাদের সুনিশ্চিত।” সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের বিভিন্ন মুক্তাঞ্চলে বক্তৃতা প্রসঙ্গে উপরোক্ত মন্তব্য করেন।
.
আমাদের সরকার এমন এক রাষ্ট্র গঠনে ইচ্ছুক যে রাষ্ট্র হবে সার্বিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক এবং যার বৈদেশিক নীতি হবে গোষ্ঠীনিরপেক্ষ”- মুক্তি বাহিনীর দুর্জয়-ঘাটি রৌদ্রক্ষরা মালভূমি দিনাজপুরে প্রায় তিন হাজার সুশিক্ষিত গেরিলাদের উদ্দেশ্যে ব্যক্ততা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী দৃপ্তকণ্ঠে উপরোক্ত ঘোষণা করেন। প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে সকল প্রকার মতপার্থক্য পরিহার করার জন্য আকুল আহ্বান জানিয়ে বলেন যে, এই সংকটকালে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের মুখ রাজনৈতিক, মতপার্থক্য কোন প্রকার বাধা হয়ে দাড়াতে পারে না।” এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন হাসপাতালে ৫০ জন আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে ব্যক্তিগতভাবে সাক্ষাৎ করেন সাক্ষাৎকারে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে অসীম সাহস ও মনোবল প্রত্যক্ষ করেছে বলে প্রধানমন্ত্রী আমাদের প্রতিনিধিকে জানান। আমাদের ভ্রাম্যমান প্রতিনিধি জানান যে, মুক্তাঞ্চল সফরকালে প্রধানমন্ত্রী মুক্তাঞ্চলের জনসাধারণের মধ্যে অসীম সাহস ও মনোবলের ভূয়সী প্রশংসা করেন।
.
সৌ রভ
<৬,৫৮,১০৫>
সংবাদপত্রঃ স্বদেশ ১ম বর্ষঃ ৪র্থ সংখ্যা
তারিখঃ ২১ অক্টোবর, ১৯৭১
.
রাষ্ট্রসংঘে ‘ পাক অপপ্রচার’ ব্যর্থ হয়েছে ( নিজস্ব প্রতিনিধি )
মুজিব নগরঃ রাষ্ট্রসংঘ সাধারণ বাংলাদেশে সম্পর্কে পাক অপপ্রচার এবং ব্যাপারে ভারতের হস্তক্ষেপের অভিযোগ রাষ্ট্রসংঘের অধিকাংশ প্রতিনিধিকেই প্রভাবিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। নিউইয়র্ক থেকে এখানে প্রত্যাবর্তন করে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের সদস্য অধ্যাপক মুজাফফর আহমেদ এই কথা জানান।
.
অধ্যাপক আহমেদ জাতীয় আওয়ামী দলের (ওয়ালি মুজাফফর গোষ্ঠী) সভাপতি। তিনি বলেন, সাধারণ সভায় যারা কোন পক্ষের সমর্থনে ভাষণ দেননি, এমন কি সে সব প্রতিনিধিদের মধ্যেও বাংলাদেশ প্রশ্নে বিপুল সহানুভূতি লক্ষ্য করা গেছে।
.
তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির বহু সদস্যের সঙ্গে কথা বলার পর তারা আমাদের বাংলাদেশ প্রশ্নে নৈতিক সমর্থন দানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এই সব প্রতিনিধি এবং বহু মার্কিন সিনেটর মনে করেন যে, গত ছয় মাসের ঘটনাবলীর পর বাংলাদেশ আর পাকিস্তানের অংশ হিসাবে থাকতে পারে না। বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই। প্রশ্ন যেটা তা হল সময়ের।
.
বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দান সম্পর্কে আরব দেশগুলির মনোভাবের কথায় অধ্যাপক আহমেদ বলেন, কিছু আরব দেশসহ বিদেশী প্রতিনিধিরা আমাদের জানিয়েছেন যে, ঠিক সময় এলেই তারা আমাদের স্বীকৃতি দেয়ার জন্য তৈরী।
.
প্রত্যাবর্তনের সময় তিনি লন্ডনে দলের নেতা পশ্চিম পাকিস্তানের শ্রী ওয়ালী খান সমেত কয়েকজনের সঙ্গে মিলিত হন তারাও বাংলাদেশের সংগ্রামের প্রতি পূর্ণ সহানুভূতি জ্ঞাপন করেন। অধ্যাপক আহমেদ জেনেছেন যে পশ্চিম, পাকিস্তানিরাও আত্মনিয়ন্ত্রনাধিকার লাভের জন্য সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ।
.
সৌ রভ
<৬,৫৯,১০৬>
সংবাদপত্রঃ স্বদেশ ১ম বর্ষঃ ৫ম সংখ্যা
তারিখঃ ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১
.
আসন্ন যুদ্ধের জন্য ঘরে ঘরে প্রস্তুত হউন
সমগ্র বাঙ্গালী আজ আসন্ন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। এ যুদ্ধ মহান যুদ্ধ- এ যুদ্ধ পবিত্র যুদ্ধ। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র-জনতা এ যুদ্ধের সৈনিক। যে কোন মূল্যেই হোক এ যুদ্ধে আমরা জয়লাভ করবই। পৃথিবীর কোন শক্তিই আমাদের এই জয়লাভকে নস্যাৎ করতে পারবে না। কেননা আমরা আজ সংকল্পবদ্ধ। চট্টল থেকে সাতক্ষীরা পর্যন্ত বিস্তৃত এর রণাঙ্গন। খেত-খামার-স্কুল-কলেজ আর কলে কারখানায় এ যুদ্ধ চলবে আমাদের আজকের যুদ্ধ ধর্মনিরপেক্ষ-গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের সুমহান আদর্শ বাস্তবায়নের যুদ্ধ। আমাদের আজকের যুদ্ধ সাম্রাজ্যবাদ উপনিবেশবাদ পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে। আমাদের আজকের যুদ্ধ সুখী সমৃদ্ধশালী কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র-জনতার বাংলাদেশ গড়ার। বাংলাদেশের মাটিতে কবরস্থ হয়েছে পাকিস্তান। পাকিস্তান আত্মহত্যা করেছে। গড়ে উঠেছে নতুন দেশ নতুন জাতি বাংলাদেশ আর বাঙ্গালী জাতির সুজলা-সুফলা বাংলা, বীর প্রসবিনী বাংলা। লক্ষ লক্ষ শহীদের তাজা রক্তে বিধৌত বাংলা- কোটি কোটি গাজীর বাংলা। যে দেশ যে জাতি মাতৃভাষার জন্যে রক্ত দিয়েছে স্বাধিকারের জন্য রক্ত দিয়েছে রক্তের মূল্যে স্বাধীনতা কিনেছে, সে জাতি পৃথিবীতে অমর,সে জাতির কথা পৃথিবীর মানুষ শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। সে জাতি আজ আসন্ন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। সে জাতি আজ আসন্ন যুদ্ধের জন্য ঘরে ঘরে প্রস্তুত।
.
.
হিমু নিয়েল
<৬,৬০,১০৭>
সংবাদপত্রঃ স্বদেশ ১ম বর্ষঃ ৫ম সংখ্যা
তারিখঃ ২২জুন, ১৯৭১
.
সম্পাদকীয়
বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে লিপ্ত জনগন আজ পশ্চিমা বর্বর জঙ্গীশাহীর পশু-জনোচিত হামলার হাত থেকে স্বীয় মাতৃভুমির ও লাখো লাখো নর-নারীর মান ইজ্জত রক্ষার জন্য মরণপণ করে রুখে দাড়িয়েছে । বাংলাদেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত পাক হানাদার বাহীনীকে নির্মুল করার জন্য চলছে মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড লড়াই । আধুনিক অস্ত্র-শস্ত্রে সুসজ্জিত খান সেনাদের নায়ক নাদির শাহীর উত্তরসুরী টিক্কা খান ভেবেছিল মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যেই ভেঙ্গে দিয়ে যাবে বাঙ্গালীর প্রতিরোধ, তাদের আবদ্ধ করা যাবে চিরদিনের মত গোলামীর শৃঙ্খলে। কিন্তু তাদের সে দুরাশা সম্পূর্নরূপে নস্যাৎ করে দিয়ে বাংলার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শকে সামনে রেখে ঘোষণা হল ‘স্বাধীনতা’ গঠিত হল বাংলাদেশ সরকার ।
.
স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্বে লাখো লাখো মুক্তি সংগ্রামীরা নিচ্ছে হানাদার বাহিনীদেরও খতম করার চুড়ান্ত প্রস্ততি । দিন দিন বাড়ছে মুক্তি বাহিনীর শক্তি । শত্রুর কামান চিরতরে স্তব্দ না করা পর্যন্ত থামবে না এ যুদ্ধ । বিশ্বের ইতিহাসে যখনই কোন বিদেশী শক্তি অস্ত্রের জোরে পরের দেশ দখল করেছে তখনই তারা চেষ্টা করেছে সে দেশে শিখন্ডী সরকার খাড়া করার । ইয়াহিয়া-ভুট্টো-টিক্কা খানও সেই মহাজনী পন্থার আশ্রয় নিয়েছে । এর উদ্দেশ্য হচ্ছে জনগণের মধ্যে বিবেধ সৃষ্টি করা, তাদের মনোবল নষ্ট করা, চুড়ান্ত বিজয় সম্পর্কে তাদের সফলতা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি ইয়াহিয়া ভুট্টো চক্রেরও হবে না, হতে পারে না । শোষক নিপীড়িত বর্বর এই পশ্চিম পাকিস্তানী চক্র হয়ত ভেবেছে যে, আওয়ামী লীগকে অবৈধ ঘোষণা করেও শিখন্ডীদের তারা বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করাবে । তাই তারা আজ দলে ভিড়িয়ে নিয়েছে বাংলার কুলাঙ্গার বিশ্বাস ঘাতক ক্ষমতালিপ্সু মীরজাফরদেরকে ।
.
তাই আমরা স্পষ্ট ভাষায় বলে দিতে চাই যে সেনারা অধিনায়ক ইয়াহিয়া খানের ক্ষমতা হস্তান্তর বা পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র রচনার সাথে বাংলাদেশের মানুষের কোন সম্পর্ক নেই । বাঙ্গালীরা যখনই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর্যায়ে উপনীত হয়েছে তখনই পেয়েছে বুলেট ও বেয়নেট, রক্তে রঞ্জিত হয়েছে বাংলার জনপদ ।
.
১৯৫০ সালে যে প্রবঞ্চনা পেয়েছিলাম তারই পুনরাবৃত্তি দেখতে পাই ১৯৭১ সালে । ব্যবধান মাত্র ১৬ বত্সরেরঃ তারিমধ্যে বাঙ্গালী জাতি আত্মত্যাগের মহিমায় মহান নেতার আদেশে একতাবদ্ধ । ধোকাবাজি আর প্রবঞ্চনা ধরা পড়েছে আমাদের চোখে । তাই আজ আমরা আমাদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে অস্ত্র হাতে নিয়েছি সে প্রবঞ্চনা আর ধোকাবাজির চির অবসান ঘটাতে ।
.
“কাল মৃত্যুঞ্জয়ী কাউকে কোনদিন ক্ষমা করে না, করতে পারে না ।”
-আমরাও ঠিক সে কালকে সামনে রেখে আমাদের রক্তের প্রতিশোধ রক্তের মাধ্যমেই নেব । স্বাধীনতা আমাদের আক্ষুন্ন থাকবেই । পৃথিবীর মানচিত্রে অন্যতম আদর্শ রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হবেই ।
স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ ও আদর্শ বাঙ্গালী জাতির জয় সুনিশ্চিত ।
“জয় বাংলা”
.
[বাংলাদেশঃ সাপ্তাহিক সংবাদপত্র। বাংলাদেশ সম্পাদনা পরিষদের পক্ষে আবুল হাসান চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত এবং আব্দুল মমিন কর্তৃক বাংলাদেশ প্রেস, রমনা, ঢাকা থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত।]
.
.
রিফাত বিন শরীফ
<৬,৬১,১০৮>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ ষষ্ঠ খণ্ড
শিরোনামঃ সম্পাদকীয়
সংবাদপত্রঃ স্বদেশ (১ম বর্ষঃ ৯ম সংখ্যা)
তারিখঃ ১৯ জুলাই, ১৯৭১
.
সম্পাদকীয়
.
বর্তমানে আমরা অসম যুদ্ধে লিপ্ত, আমাদের এই সংগ্রাম অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায় প্রতিষ্ঠার, অত্যাচার অবিচারের বিরুদ্ধে সুবিচার প্রতিষ্ঠার, অসুন্দরের বিরুদ্ধে সুন্দর সুখী জীবন প্রতিষ্ঠার, পরাধীন হতে স্বাধীন হবার যে স্বাধীনতা পেলে নির্বিচার গণহত্যার পুনরাভিনয় হবে না, শোষণের অবসান হবে, প্রতিষ্ঠিত হবে সুন্দর গণতান্ত্রিক সমাজ যেখানে থাকবে মানবের মানবাধিকার, ধর্ষিতা মা বোনের বুক ফাটানো কান্নার পরিসমাপ্তি হবে সেখানে।
.
আমাদের শত্রুরা পাশবিক উত্তেজনায় মত্ত; রক্তের লালসায় এদের কামনা আকাশ প্রমাণ। ধর্মের নাম করে এরা গত ২৪ বৎসর যাবৎ আমাদেরকে করেছে প্রাণান্ত শোষণ। এই ধর্মের দোহাই মুখে উচ্চারণ করে এরা ধ্বংস করেছে মসজিদ, মক্তব, গুলি করেছে ধর্মপ্রাণ মুসলমানকে, হত্যা করেছে নামাজে দণ্ডায়মান মোক্তাদিকে। গ্রামকে গ্রাম উজার করেছে। পরিত্যক্ত মসজিদগুলো আল্লাহুর আহজারি করছে; এরা মুসলমান রমনীদের উপর করেছে বলাৎকার অন্তহীন পাশবিক অন্যাচার কাণ্ড দেখে মনে হয় এরা হাদীস বর্নিত খানে দজ্জাল। এ কথা অজানা নয় যে এরা শুধুমাত্র নিজেদের বাজার এবং শোষণ পাকা পোক্ত রাখতে আমাদের ধর্মপ্রাণ নির্বোধ মানুষকে ধর্মের দোহাই দিয়ে এতসব অপকর্ম ঢাকতে চেষ্টা করছে।
.
এদের আছে আধুনিক যুদ্ধের সরঞ্জাম, উন্নত শিক্ষাপ্রাপ্ত সেনাবাহিনী। আমরা নিরস্ত্র সাধারণ মানুষ। এই দলে রয়েছে ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, জনতা, উকিল, মোক্তার, ডাক্তার, শিক্ষক বুদ্ধিজীবী পুরো সম্প্রদায়। এরা আমাদের শেষ করে দিতে চায়। তাই বাংলাদেশের যারা চিন্তা করতে শিখেছে, তাদেরকেই নির্বিচারে হত্যা করেছে। এই জন্যেই বেঁচে থাকার দুর্জয় ইচ্ছা নিয়ে আমরা গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলছি।
.
আমাদের মুক্তিবাহিনীর সৈনিক ও গেরিলারা মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য অস্ত্র নিয়ে সংগ্রাম করছে। গণপ্রতিনিধিরা পরিকল্পনা দিচ্ছেন। আমরা কলম ধরে দেশবাসী ও বিশ্ববাসীকে আমাদের সংগ্রাম সম্বন্ধে অবহিত করছি। মোট কথা সকলেই আমরা সংগ্রামে লিপ্ত। যারা একান্তভাবে অক্ষম, কর্মশক্তিহীন, তারাও গণমত অক্ষুণ্ণ রাখার ব্যাপারে নিয়োজিত মনে রাখতে হবে কোন কাজকর্ম না করে শুধুমাত্র ধ্বংসাত্মক কথাবার্তায় লিপ্ত থাকা যে কথা, পাক বাহিনীর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সহযোগীতা এক কথা। বিবেক কাওকে রেহাই দেবে না।
.
রিফাত বিন শরীফ
<৬,৬২,১০৯>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ ষষ্ঠ খণ্ড
শিরোনামঃ সম্পাদকীয় (এই প্রহসন নতুন নয়)
সংবাদপত্রঃ স্বদেশ (১ম বর্ষঃ ১১শ সংখ্যা)
তারিখঃ ১৬ আগস্ট, ১৯৭১
.
সম্পাদকীয়
.
এই প্রহসন নতুন নয়
বঙ্গবন্ধুর বিচারের প্রহসন আরম্ভ হয়েছে। অবশ্য এই জাতীয় ষড়যন্ত্র ও বিচারের নামে প্রহসনের অবতারণা এই নতুন নয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এই ষড়যন্ত্রের উপর ভিত্তি করে। তাই তো পাকিস্তান সংগ্রামে যাদের দান সর্বাপেক্ষা অধিক, প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানে তারা পেয়েছে নির্বিচার জেল,জুলুম, লাঞ্ছনা, বঞ্চনা। ইতিহাসের পাতা থেকে তাদের নাম কৌশলে মুছে দেয়া হয়েছে। বাংলার অগ্নিপুরুষ শেরে বাংলাকে পেতে হয়েছে দেশদ্রোহী আখ্যা; সম্মুখীন হতে হয়েছে বিচার প্রহসনের। মহান নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে পেতে হয়েছে ভারতের লেলিয়ে দেয়া কুকুর খেতাব; আমৃত্যু অশেষ লাঞ্ছনা,নিপীড়ন জেল জুলুম। বাংলার মহান নেতা বাঙ্গালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান আজ ইয়াহিয়ার তথাকথিত আদালতে বিচারের নামে প্রহসনের সম্মুখীন। মূলত এই প্রহসন নতুন কিছু নয়। বাঙালীর সামগ্রিক মানবাধিকার সংরক্ষণের জন্য যে কণ্ঠ সর্বদাউচ্চকিত হয়েছে সে কণ্ঠ হয় ইসলাম বা জাতীয় সংহতির শত্রু; ভারতের চর নতুবা দেশদ্রোহী আখ্যায় ভূষিত হয়েছে। জানা কথা বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার লগ্ন থেকে পশ্চিমা প্রভুদের বিরাগভাজন হয়েছিলেন। তাই তো জেল জুলুম হয়রানি তার নিত্যসঙ্গী। ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন আমলে তাকে ৬টি মিথ্যা মামলার জের টানতে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছিল। বিনা বিচারে দীর্ঘ কারাবাসের পর সসম্মানে মুক্তি পেয়ে ১৯৬২ সালে তিনি পুনরায় কারান্তরালে যেতে বাধ্য হলেন। ১৯৬৪ সালেও তিনি আয়ুব খার বিরুদ্ধে বিরোধী দলের সপক্ষে নির্বাচনী অভিযানে নেমে বহু মিথ্যা মামলাজনিত হয়রানীর সম্মুখীন হয়েছিলেন। ১৯৬৬ সালের এপ্রিল মাস হতে আরাম্ভ করে মে মাসের প্রথমার্ধ পর্যন্ত গড়ে দৈনিক তার বিরুদ্ধে একটি করে মামলা আনীত হয়। এই সময় অস্ত্র সংগ্রহ ও গৃহযুদ্ধের প্রস্তুতির অভিযোগও নেতার বিরুদ্ধে আনা হয়। তারপর দীর্ঘ ১১ মাস কারাবাসের পর তার বিরুদ্ধে আনীত হয় কুখ্যাত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। অভিযোগ আনা হয় যে ভারতের যোগসাজশে ও অর্থানুকূল্যে নেতা বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে বিচ্ছিন্ন করে স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত করতে চেয়েছিলেন। আইয়ুব খার আদালতে নয় পূর্বের ন্যায় গণআদালতের রায়ে তিনি মুক্তি পান। দৃশ্যপটের পরিবর্তন ঘটেছে। এবারে মঞ্চে ইয়াহিয়া। এবারেও নেতার বিরুদ্ধে হাজারো অভিযোগ। বহু বিচিত্র সেই সব অভিযোগ। একটা জিনিস লক্ষণীয়, আজকে যিনি মদ্যপ, নরখাদক ও ব্যাভিচারীদের আদালতে বিচার প্রহসনের সম্মুখীন তিনি অতীতেও এই জাতীয় ব্যক্তি বিশেষের কাছে দেশদ্রোহিতার আখ্যা পেয়েছিলেন। আকার আকৃতিতে না হউক চরিত্রগত দিক থেকে গোলাম মহম্মদ মীর্জা বা আয়ুব ইয়াহিয়া সমগোত্রীয়। আজ যারা বিচারক, আমাদের দৃষ্টিতে তো বটেই সারা দুনিয়ার সভ্য মানুষের মানদণ্ডে তারাই প্রকৃত অপরাধী। বঙ্গবন্ধু তার বিচারের বৈধতা এই দৃষ্টিকোণ থেকেই চ্যালেঞ্জ করেছেন। বহু ষড়যন্ত্র ও বহু বিচার প্রহসন থেকে বঙ্গবন্ধু অপার করুণাময়ের কৃপায় নিষ্কৃতি পেয়েছেন। অতীতে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের ফলে আমরা নেতাকে ফিরিয়ে এনেছি। এবারে অনিয়মতান্ত্রিক উপায়ে অস্ত্রের হুংকারে নেতাকে ছিনিয়ে আনতে হবে। আমাদের চোখের জলকে করতে হবে বারুদ, চিত্তকে করতে হবে সুদৃঢ, বাংলার মাটি থেকে দুবৃত্তদের উৎখাত ও বন্দী করে আমরা ছিনিয়ে আনব পরমপ্রিয় নেতাকে।
.
একথা সত্য যে নেতার সামান্যতম ক্ষতি সাধিত হলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধকে ঠেকিয়ে রাখা দুষ্কর হবে।
.
রিফাত বিন শরীফ
<৬,৬৩,১১০>
শিরোনামঃ বঙ্গবন্ধুর জীবন রক্ষায় ২৪টি রাষ্ট্রের প্রধানদের কাছে ইন্দিরা গান্ধীর আবেদন
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ (১ম বর্ষঃ ১১শ সংখ্যা)
তারিখঃ ১৬ আগস্ট, ১৯৭১
.
বঙ্গবন্ধুর জীবন রক্ষায় ২৪টি রাষ্ট্রের প্রধানদের কাছে ইন্দিরা গান্ধীর আবেদন
মুজিবনগর ১১ ই আগস্ট – গতকাল ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বিশ্বের ২৪টি রাষ্ট্রের প্রধানদের কাছে আবেদন জানিয়ে বানী পাঠিয়েছেন, যেন তারা শেখ মুজিবের জীবন রক্ষার জন্য পাক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খার উপর প্রভাব বিস্তার করেন।
.
শেখ মুজিবুর রহমানের গোপনে সামরিক আদালতে বিচার ব্যবস্থা এবং তাকে কোন রকম বিদেশী আইন বিশেষজ্ঞদের সাহায্য নিষিদ্ধ করার যে ঘোষণা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খা করেছেন তাতে ভারত সরকার, ভারতের জনগণ, প্রেস এবং সংসদ গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।
.
“আমাদের আশঙ্কা হচ্ছে যে, এই তথাকথিত বিচার প্রহসনের আড়ালে শেখ মুজিবকে হত্যার চক্রান্ত করা হয়েছে। এই হত্যা সংঘটিত হলে পূর্ব বাংলার পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে দাঁড়াবে এবং ভারতের সমস্ত রাজনৈতিক দল ও জনগণের মনোভাব কঠোর হওয়ার ফলে এদেশেও জটিলতর পরিস্থিতির উদ্ভব হবে। সেই কারণেই আমাদের উদ্বেগ এত গভীর। তাই আপনার কাছে আমরা আবেদন জানাচ্ছি যে, এই অঞ্চলের শান্তি বজায় রাখার স্বার্থে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া যাতে এ ব্যাপারেও বাস্তব দৃষ্টিগোচর পরিচয় দেন, তার জন্য আপনি তার উপর আপনার প্রভাব কাজে লাগান।
.
শেখ মুজিব তার দেশের জনগণের কাছে এক অবিসম্বাদিত নেতা, বিপুলভাবে জনপ্রিয় এবং শ্রদ্ধেয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তার সাফল্য সাম্প্রতিক কালে বিশ্বে বিভিন্ন রাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলির মধ্যে হয়ত সবচেয়ে বেশি চমকপ্রদ। আমাদের দেশে জনমত, প্রেস সংবাদ এবং সরকার সবাই দৃঢ় বিশ্বাস পূর্ব বাংলায় পাকিস্থানী কার্যকলাপের ফলে আমাদের দেশ জটিল সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে; পাক সরকার শেখ মুজিবের প্রাণনাশ করলে বা তার কোন ক্ষতি করলে যে চরম অবস্থার সৃষ্টি হবে, তাতে এই সমস্যা দশগুণ বৃদ্ধি পাবে।
.
আমরা আপনার কাছে আবেদন জানাচ্ছি যে, আপনি পাকিস্তান সরকারকে অনুরোধ জানান, যেন তাঁরা তাদের এবং আমাদের দেশকে বিপদজনক পরিস্থিতিতে ফেলার মত কোন কাজ না করেন। পাক সরকার শেখ মুজিবের কোন ক্ষতি করলে তার ফল মারাত্মক হবে।
.
গতকাল শ্রীমতি গান্ধী এই আবেদনটি পাঠিয়েছেন নিম্নোক্ত দেশগুলোর রাষ্ট্র প্রধানদের কাছেঃ আরব সাধারণতন্ত্র, সিংহল, ইন্দোনেশিয়া, আফগানিস্তান, নেপাল, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, সোভিয়েত ইউনিয়ন, কানাডা, ফ্রান্স, ইতালী, সুইডেন, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন, পশ্চিম জার্মানী, যুগোস্লাভিয়া, হল্যাণ্ড এবং আরো কয়েকটি দেশ।
.
হিমু নিয়েল
<৬,৬৪,১১১-১১২>
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ ১ম বর্ষঃ ১২শ সংখ্যা
তারিখঃ ২৩ আগস্ট, ১৯৭১
.
সম্পাদকিয়ঃ ৬ দফা না মুজিববাদ?
.
বাংলাদেশে বহু বিচিত্র দেয়ালের লিখন দেখেছি । কোথাও দেখেছি পাঞ্জাবী কুকুর বাংলা ছাড়; আবার কোথাও দেখেছি পশ্চিম পাকিস্তানী পশুরা মানুষ হত্যা করেছে, আসুন আমরা পশু হত্যা করি । স্থানে স্থানে প্রত্যক্ষ করেছি, বঙ্গবন্ধু দীর্ঘজীবি হউক । এক জায়গায় দেখেছি লেখা রয়েছে মুজিববাদ দীর্ঘজীবি হউক । এই পোষ্টারটি আমার চিন্তাস্রোতকে বিঘ্নিত করেছে, তাড়িত করেছে নতুন ভাবনার পথে । সত্যি কি মুজিববাদ বলে বিশ্বে কিছু প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ?
.
আজকে শেখ মুজিব কোন ব্যক্তির নাম বা কোন দলীয় প্রধান নয়, শেখ মুজিব এক কালজয়ী আদর্শ, এক জলন্ত শিখা । এই অগ্নিশিখার আলোকে অনাগত ভবিষ্যতের অগনিত নিপীড়িত জনতা পথ দেখে নেবে । বিশ্বের যেখানে অত্যাচার, অনাচার, সাম্রাজ্যবাদী শোষণ-শাসন, ফ্যাসিবাদী নির্যাতন, নির্মম আঞ্চলিক বৈষম্য বিরাজমান, সে সব এলাকার মানুষের জন্য মুজিব এক বলিষ্ট সোচ্চার প্রতিবাদ, স্বৈরতন্ত্র ও সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে অনড় চ্যালেঞ্জ; বাস্তব, প্রাণবন্ত ও নির্ভেজাল গণতন্ত্রের প্রতীক এবং শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার বিমূর্ত প্রকাশ । অন্যান্য বহু প্রসঙ্গকে না টেনেও শুধু মাত্র নেতা প্রণীত ৬ দফা কর্মসুচির আলোকেই উপরিউক্ত সত্যকে নির্দ্ধিধায় প্রতিষ্ঠিত করা যায় । বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা যদিও পাকিস্তানের দুটি বিচ্ছিন্ন অংশের আঞ্চলিক বৈষম্য দুরীকরনের একটা রাজনৈতিক অর্থনৈতিক কর্মসূচী ছিল, আজকের দিনে সেটা বাংলাদেশের জন্য এক দফায় রূপান্তরিত হলেও অদুরভবিষ্যতে এর আবেদন চিরন্তন বলেই আমাদের বিশ্বাস । ৬ দফা কালজয়ী, ৬ দফা এখন মুজিববাদ এ রূপান্তরিত । তদানীন্তন পাকিস্তানের সংশ্লিষ্ট এলাকা বাংলাদেশ এখন স্বাধীন সত্তা নিয়ে বিরাজমান । পশ্চিম পাকিস্তানের অবস্থা ভঙ্গপ্রায়, টলটলায়মান । বিলুচিস্তানের মানুষের বিক্ষোভ ধুমায়িত । ৮ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর কাছে লিখিত একটি পত্রে সেখানকার ছাত্র-শ্রমিক, রাজনীতিবিদ তথা সাধারণ মানুষের পাঞ্জাব বিদ্বেষী মনোভাব স্ফোটিকের ন্যায় স্বচ্ছ । পাকিস্তানে যে জাতিগত বৈশিষ্ট চূড়ান্তভাবে লাঞ্ছিত, আঞ্চলিক শোষণের শিকার হিসাবে অবহেলিত এলাকার চেতনা মুমূর্ষ প্রায়, পাঞ্জাবী শোষক ও শাসকের জগদ্দল পাষাণ বেদী হাতে মুক্তির চিরন্তর আকাঙ্কা আকাশ প্রমাণ, তারই মুর্ত প্রকাশ উক্ত পত্র । অপর দিকে সীমান্তের মানুষেরা আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের দাবীতে সোচ্চার সীমান্ত গান্ধী আব্দুল গাফ্ফার খানের অতীতের বক্তব্য ও সাম্প্রতিক কার্যকলাপ, তদীয় সন্তান ওয়ালী খানের সাম্প্রতিক বিবৃতি একটি সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছে যে জাতিগত সত্তার বিলুপ্তি বা অবলুপ্তি অসম্ভব, সাম্রাজ্যবাদী শোষণ অকল্পণীয় । এই চেতনাবোধের গভীরতা আর ব্যাপ্তির পেছনে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ কর্মপ্রচেষ্টা এবং সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক অর্থনৈতিক প্রোগ্রাম । বাংলাদেশ আজ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিনত হয়েছে । সারা পশ্চিম পাকিস্তান ভগ্নোন্মুখ । বিদ্রোহ ও বিক্ষোভ ঘনায়িত । এমনি পরিস্থিতিতে পশ্চিম পাকিস্তানের অস্তিত্ব প্রায় বিলীয়মান । এমতাবস্থায় কোন যাদুমন্ত্র, রক্তচক্ষু, সামরিক জান্তার নির্বিচার গণহত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ বা নারী ধর্ষণ পশ্চিম পাকিস্তানকে একত্রিত রাখতে অক্ষম । এই মুহুর্তে ভগ্নোম্মুখ পশ্চিম পাকিস্তানের আশু বিচ্ছিন্নতা রোধের জন্য প্রয়োজন বঙ্গবন্ধু প্রণীত ৬ দফা কর্মসূচির অনুরূপ কোন বাস্তব ও বিজ্ঞানভিত্তিক পদক্ষেপ গ্রহণ । এ কথা সত্য যে ৬দফার আক্ষরিক প্রয়োগ হয়ত সেখানে সম্ভব নয় কিন্তু তার গভীরতম প্রদেশে নিহিত চুড়ান্ত বক্তব্যটিকে গ্রহণ করতেই হবে । মার্কসবাদ লেনিনবাদও প্রনেতাদের ধ্যান ধারনাকে অতিক্রম করে অবস্থা ও অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে রূপান্তরিত হয়েছে । বাস্তব প্রয়োগ ক্ষেত্রে লক্ষিত হয়েছে বিভিন্নতা । এটা নিতান্ত স্বাভাবিক এবং স্বাভাবিক বলেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রতিষ্ঠিত সমাজতন্ত্রে কতকগুলো মৌলিক পার্থক্য রয়েছে । এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে ৬ দফা বা মুজিববাদও পরিবেশের প্রভাবহেতু রূপান্তরিত হবে সত্য কিন্তু তার অন্তর্নিহিত মৌলিক সত্যটি কোনক্রমে ম্লান হবে না । বিশ্বের দেশে দেশে আঞ্চলিক বৈষম্য রয়েছে, রয়েছে সাম্রাজ্যবাদী শাসন-শোষণ; অত্যাচার, অনাচার নিপীড়নের অবসান আজও ঘটেনি, আজও স্বৈরাচারী সামরিক জান্তা গণতন্ত্রের টুটি চেপে ধরেছে । অন্যগত বিশ্বে এই জাতীয় বৈষম্য, শোষণ-শাসন বা নিপীড়নের রূপান্তর ঘটবে বটে, তবে একেবারে তিরোহিত হবে না । এই জাতীয় রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ব্যধি নিরসনের জন্য সুনির্দিষ্ট কর্মপন্থা প্রয়োজন এর নাম ৬ দফা না হলেও কিছু একটা হবে কিন্তু এর প্রতিষ্ঠাতার আবেদন চির ভাস্বর । মুজিববাদ তাই স্থান-কাল-জয়ী ।
.
আহসান উল্লাহ
<৬,৬৫,১১৩>
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ ১ম বর্ষঃ ১২শ সংখ্যা
তারিখঃ ২৩ আগস্ট,১৯৭১।
.
শত্রুর বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক প্রতিরোধ গড়ে তুলুন,দেশবাসীর প্রতি বাংলাদেশ সরকারের আবেদন।
মুজিবনগর,২০ আগস্টঃ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আমাদের যে সংগ্রাম তাহা হইল সর্বাত্মক মুক্তির সংগ্রাম। এই সংগ্রামে জয়ী হইতে হইলে বাংলাদেশের সংগ্রামী জনতার নয়নমণি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাহেবের নির্দেশনানুসারে শত্রুর মোকাবেলা করিতে হইবে। তজ্জন্য প্রয়োজন বাংলাদেশের ঘরে ঘরে দুর্গ গড়িয়া তোলা এবং শত্রুর অর্থনৈতিক অবরোধ কায়েম করা। অর্থনৈতিক কাঠামো ধ্বংস করিয়া দিতে পারিলে শত্রু দুর্বল হইবে। বাংলাদেশবাসির উদ্দেশ্যে এই নির্দেশ প্রচার করিয়াছেন বাংলাদেশ সরকার।
.
উক্ত নির্দেশনামায় বলা হইয়াছে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী বিভিন্ন ফসল যথা পাঁট,চা,তামাক প্রভৃতির উৎপাদন বন্ধ রাখুন, আলু, ডাল ও কৃষি দ্রব্য উৎপাদন বৃদ্ধি করুন। খাদ্যশস্য ব্যাপকভাবে উৎপাদনের মাধ্যমে দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ করুন। শ্রমিকদের নির্দেশ দেওয়া হইতেছে তাহারা যেন কলকারখানায় যোগদান হইতে বিরত থাকেন।
.
জনসাধারণকে আহ্বান জানাইয়া বলা হইতেছে, আপনারা সামরিক সরকারকে কোন প্রকার ট্যাক্স দিবেন না। আপনাদের ভোটে নির্বাচিত বাংলাদেশ সরকারই একমাত্র বৈধ সরকার। নির্দেশনামায় বলা হয়েছে, খেলাধুলা, আমোদ প্রমোদ বর্জন করুন। বাস্তুত্যাগীদের সম্পত্তি নিলাম ডাক বা বন্ধক লওয়া পরিহার করুন। কোন সরকারী প্রতিষ্ঠানে অর্থলগ্নি করিবেন না। কোথাও টাকা জমা থাকলে তাহা উঠাইয়া লউন। সরকার পরিচালিত বিমানপথ, রেলওয়ে,স্টিমার বয়কট করুন। সমস্ত পশ্চিম পাকিস্তানী ও অবাঙালি মালিকানাধীন প্রস্তুত দ্রব্য দৃঢ়তার সাথে বর্জন করুন। আপনিও একজন মুক্তিযোদ্ধা , মনে রাখিবেন আপনার সক্রিয় সহযোগিতা আমাদের বিজয়কে আরও নিকটবর্তী করিয়া তুলিবে।
.
আহসান উল্লাহ
<৬,৬৬,১১৪>
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ ১ম বর্ষঃ ১৫শ সংখ্যা
তারিখঃ ৪ অক্টোবর, ১৯৭১।
.
খাদ্যের ব্যবস্থা হলে মুক্তাঞ্চলে উদ্বাস্তুদের ফিরিয়ে নেয়া যায়।
বোম্বাই,২৪ সেপ্টেম্বরঃ ভারত সরকার যদি মাত্র তিন চার মাসের জন্য বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চলে খাদ্য সরবরাহ প্রতিশ্রুতি দেন তাহলে ভারত থেকে উদ্বাস্তু ফিরিয়ে নেওয়ার কাজ শুরু করা যেতে পারে এবং এখনই অন্তত ১৫ হাজার উদ্বাস্তুকে ফিরিয়ে নেয়া যায় বলে ভারতস্থ বাংলাদেশ প্রতিনিধিবৃন্দ ভারত সরকারকে যে প্রস্তাব দিয়েছেন আজ এখানে এক সাংবাদিক সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমানের অনুজ শেখ আবু নাসের তা প্রকাশ করেন।
.
শেখ নাসের বলেন খাদ্যই বাংলাদেশের বর্তমান প্রধান সমস্যা তবে, সমগ্র মুক্তাঞ্চল জুড়ে ব্যাপক চাষাবাদ হচ্ছে এবং তিন চার মাসের মধ্যে নতুন ফসল উঠবে। তখন কোন সমস্যা থাকবে না।
.
শেখ নাসের আরও বলেন মুক্তাঞ্চলে ইতিমধ্যেই কোর্ট কাচারী ও স্কুল কলেজ বসান হয়েছে এবং আশা করা যায় তিন চার মাসের মধ্যেই পরিস্থিতির সামগ্রিক উন্নতি হবে।
.
মাত্র দুদিন আগেও শেখ নাসের বাংলাদেশে ছিলেন এবং স্বল্পকাল সফরের জন্য তিনি বোম্বাইতে এসেছেন। তার সঙ্গে এসেছেন ১৫ সদস্য বিশিষ্ট এক সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি দল।
.
[ সাপ্তাহিক বাংলাদেশ এর ১৫ ও ১৬ শ সংস্করণ ধারাবাহিক সংখ্যা, প্রকাশের তারিখ এবং প্রকাশিত সংবাদের তারিখে গরমিল পরিলক্ষিত হওয়ায় প্রকাশিত সংবাদের তারিখের ভিত্তিতে ধারাবাহিকতা রক্ষার চেষ্টা করা হয়েছে। ]
.
আহসান উল্লাহ
<৬,৬৬,১১৫>
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ ১ম বর্ষঃ ১৫শ সংখ্যা
তারিখঃ ৪ অক্টোবর, ১৯৭১।
.
বাংলাদেশ নারীদের উপর পাক ফৌজের অত্যাচার তদন্ত কমিটি গঠন করার জন্য রাষ্ট্রসংঘের প্রতি আবেদন।
মুজিবনগর, ২৭ সেপ্টেম্বরঃ বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহক সমিতি আজ রাষ্ট্রসংঘের প্রতি আকুল আবেদন জানান যে, বাংলাদেশে নারীদের উপর পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনী যে অত্যাচার করেছে তা তন্ন তন্ন করে তদন্ত করার জন্য একটি বিশেষ তদন্ত কমিটি গঠন করা হোক।
.
পরিষদের সাধারণ সম্পাদিকা মালেকা বেগম এখানে বিবৃতি প্রচার করে বাংলাদেশের নির্যাতিত নারী সমাজের পক্ষ থেকে বিশ্বের সমস্ত গণতান্ত্রিক নারী সংস্থার উদ্দেশ্যে আবেদন করেন যে পাকিস্তানী সৈন্যদের হাতে বাংলাদেশের নারীরা যে করুণ নির্যাতন ভোগ করছে তার প্রতি সহানুভূতিসূচক মনোযোগ দিন ও তা অবিলম্বে বন্ধের জন্য সমস্ত প্রকার ব্যবস্থা নিন।
.
মিসেস বেগম অভিযোগ করেন যে প্রত্যেক জেলা, শহর ও গ্রামে যেখানে পাকিস্তানী ফৌজ তাদের ক্যাম্প পেতেছে সেখানে তারা কিছু দূরে পৃথক পৃথক ক্যাম্পে তাদের লালসা তৃপ্তির জন্য হাজার হাজার বাঙালি নারীকে আটক করে রেখেছে।
.
তিনি বলেন, ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের কাছে একটি হারেমে পনের শতের বেশি নারীকে নির্যাতন করে তিলে তিলে মেরে ফেলা হচ্ছে। তাদের অনেকে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছে। যারা গর্ভবতী হয়েছে তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে যাতে তাদের আত্মীয় স্বজনগণ তাদের হাতে বিয়ের পাত্র তুলে দেয়। তিনি বলেন, ফলে বাংলাদেশের হাজার হাজার নারী হয় আত্মহত্যা করছে অথবা পাগল হয়ে যাচ্ছে।
.
পার্থ সুমিত ভট্টাচার্য্য
<৬,৬৮,১১৬>
শিরোনামঃ পশ্চিম পাকিস্তানে রাজনৈতিক অস্থিরতার ঢেউঃ বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের তীব্রতা বৃদ্ধি
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ, ১ম বর্ষঃ ১৬শ সংখ্যা।
তারিখঃ ১৫ অক্টোবর, ১৯৭১
.
পশ্চিম পাকিস্তানে রাজনৈতিক অস্থিরতার ঢেউঃ
বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধে তীব্রতা বৃদ্ধি
ঢাকা, ১৩ অক্টোবর- বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে যে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দিয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাম্প্রতিক বক্তব্যে সব স্পষ্ট হয়ে পড়েছে।
.
বর্তমানে ঘটনার চাপে জঙ্গী সরকারের বহু তাবেদার স্বীকার করেছেন যে অসন্তোষ ক্রমশ ছড়িয়ে পড়েছে। মাত্র কয়েকদিন পুর্বে পশ্চিম পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির সভাপতি নবাব নসরুল্লাহ খান মন্তব্য করেছেন যে, জাতীয় বিরোধীদের প্রভাবে বুদ্ধিজীবি মহল, ছাত্র মহল ও অনান্য শ্রেণীর মধ্যে চাপা সহানুভূতির লক্ষণ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। পশ্চিম পাকিস্তান এটাই দুঃখজনক বাস্তব অবস্থা। এমন কি পাঞ্জাবের এক শক্তিশালী মহল চাইছেন উদ্ভট একলা চলার নীতি অনুসরন করতে। উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং সিন্ধুতে জাতীয় বিরোধী শক্তি দ্বিজাতি নীতির বিরুদ্ধে জনমত উত্তেজিত করছে এবং আলাপ আলোচনা আরম্ভ করছেন পাকতুনিস্থান জয় সিন্ধু এবং স্বাধীন বালুচিস্থান বলে।
.
পাকিস্তানী সংবাদপত্র নবাবজাদা নসরুল্লা খানের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রকাশ করেছে যে, শেখ মুজিবর রহমানের প্রতি এই ধরণের সহানুভূতি ও সমর্থনই পূর্ব বাংলা অসন্তোষ বজায় রাখতে সাহায্য করছে। আর এক বাঙালী দালাল মউলোভী ফরিদ আহমদ আর এক ধাপ এগিয়ে গেছেন। তিনি অভিযোগ করেছেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানের এক শক্তিশালী মহল পূর্ব বাংলায় আওয়ামী লীগের বিদ্রহকে সাহায্য করছে। পাকিস্তানি জঙ্গী সরকার মউলোভী ফরিদ আহমদকে পাকিস্তান কাউন্সিল ফর পিস এন্ড ওয়েলফেয়ারের সভাপতি পদে নিযুক্ত করেছে। জঙ্গি সরকার সমর্থক লাহোরের ইমরোজ এবং করাচীর জং পত্রিকা ফরিদ আহমদের বক্তন্য উল্লেখ করে লিখেছে যে, পূর্ব পাকিস্তানে যে রকম ঘটেছে তাঁর পুনরাবৃত্তি হবার সমূহ সম্ভবনা আছে পশ্চিম পাকিস্তানে। পূর্ব বাংলার এমন সব গুরুত্বপূর্ণ দলিলপত্র আছে যার দ্বারা প্রমাণ করা যায় যে পশ্চিম পাকিস্তানের এক শক্তিশালী মহল আওয়ামী লীগকে আর্থিক, নৈতিক ও মালপত্র দিয়ে সাহায্য করছে। তিনি আরও বলেছেন যে, সরকার ঐ মহলের বিরুদ্ধে কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি এই আশংকায় যে ব্যবস্থা নিলেই পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে যাবে।
.
বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা সম্বন্ধে বলতে গিয়ে মৌলভী ফরিদ আহমদ মন্তব্য করেছেন যে, অবস্থা কোন মতেই স্বাভাবিক নয়। আওয়ামী লীগ প্রভাবাম্বিত পাক বিরোধী শক্তিদের আক্রমণ বেশ বেড়ে গেছে। সৈন্যবাহিনীর বীরত্ব সূচক কাজকর্ম হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তান সমর্থকদের জীবন ও স্পম্পত্তি প্রতি পদে বিপদের সম্মুখীন। মৌলভী ফরিদ আহমদ আরও বলেছেন যে শত শত পাকিস্তানী প্রাণ হারিয়েছেন আওয়ামী লীগ গেরিলাদের হাতে।
.
ফরিদ আহমদ ভাষণ দু’কারণে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত বেশ স্পষ্ট বুঝতে পারা যায় যে পশ্চিম পাকিস্তানের বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতি সম্পন্ন। এর ফলে জঙ্গী গোষ্ঠীর মিথ্যা অপবাদ যে ভারতবর্ষ থেকে সাহায্য পেয়ে একজন দুর্বৃত্ত বাংলাদেশে গোলযোগ চালাচ্ছে, সম্পুর্ন মিথ্যা প্রমাণিত হল, দ্বিতীয়ত, ফরিদ আহমদ স্পষ্ট স্বীকার করেছেন যে, প্রতিরোধ আন্দোলনে বাংলাদেশ ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠেছে এবং শত শত পাক জঙ্গীশাহী তাবেদার বিনষ্ট করতে সমর্থ হয়েছেন মুক্তিযোদ্ধারা।
.
.
পার্থ সুমিত ভট্টাচার্য্য
<৬,৬৯,১১৭>
শিরোনামঃ মন্ত্রীদের মধ্যে আতংকঃ পদত্যাগের অভিপ্রায় প্রকাশ।
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ, ১ম বর্ষঃ ১৮শ সংখ্যা।
তারিখঃ ২৫ অক্টোবর, ১৯৭১।
.
মন্ত্রীদের মধ্যে আতংকঃ
পদত্যাগের অভিপ্রায় প্রকাশ।
ঢাকা, ১৫ অক্টোবর- গেরিলাদের হাতে পূর্ববঙ্গের প্রাক্তন গভর্নর মুসলিম লীগ নেতা মিঃ আব্দুল মোমেন খানের মৃত্যুতে মুসলিম লীগ ও জামাতে ইসলামী নেতৃবৃন্দের ও ডাঃ এ এম মালিকের পুতুল মন্ত্রিসভার মন্ত্রীদের মধ্যে মনোবল ভেঙে পড়েছে।
.
এইসব সংবাদে বলা হয় যে, মিঃ খানের মৃত্যুর অব্যবহিত পরে ডাঃ মালিক মন্ত্রিসভার মন্ত্রীরা এবং কয়েকজন বিশিষ্ট মুসলিম লীগ ও জামাত-ই-ইসলামী নেতারা পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য একটি গোপন বৈঠক করে। এই বৈঠকে নাকি তারা মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগের অভিপ্রায় প্রকাশ করেছে। তারা পদত্যাগ করলে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা অবলম্বন করতে পারে, এই ভয়ে তারা নাকি ডাঃ মালিককে এ সিদ্ধান্ত জানাতে সাহসী হচ্ছে না।
.
গোপন বৈঠকে উপস্থিত ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন, জামাত-ই-ইসলামের অধ্যাপক গোলাম আযম, মুসলিম লীগের খাজা খয়ের উদ্দিন ও শফিউল ইসলাম পি ডি পি’র নুরুল আমিন ও ফরিদ আহমদ।
.
আরও জানা গিয়াছে যে, এইসব নেতাদের অধিকাংশের পূর্ববঙ্গের প্রাক্তন গভর্নরের শেষকৃত্যে উপস্থিত থাকতে পারেন নি। তাদের ভয় মুক্তিবাহিনীর হাতে তাদেরও অনুরূপ অবস্থা ঘটতে পারে।
.
সংবাদে প্রকাশ যে, এমনকি সরকারের উর্দ্ধতন বেসামরিক অফিসাররা ও মিঃ খানের মৃত্যুর পর তাদের নিজ নিজ অফিসে যেতে সাহস পাচ্ছে না।
.
.
পার্থ সুমিত ভট্টাচার্য্য
<৬,৭০,১১৮>
শিরোনামঃ সেই অতীতে যেন আর ফিরে আনা যাই।
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ, ১ম বর্ষঃ ১৯শ সংখ্যা।
তারিখঃ ১ নভেম্বর, ১৯৭১।
.
সম্পাদকীয়ঃ
৭ই মার্চ থেকে ২৫শে মার্চ আর ২৫ শে মার্চের রাতের আঁধার থেকে ফেলে আসা আজকের ১ লা নভেম্বর। সাড়ে সাত কোটি বাঙালী জাতির অতুলনীয় ত্যাগ, তিতিক্ষা ও সংগ্রামের এক অভূতপূর্ব ইতিহাস। এই ইতিহাস সমগ্র মানবজাতির ইতিহাসের এক নতুনতর সৃষ্টি। এই সৃষ্টি আগামী দিনের পৃথিবীকে দেখাবে নতুন পদ ও মত।
.
২৪ বছরের শাসন-শোষণের জিঞ্জির ভেঙে বাঙালী জাতি চেয়েছিল সম অধিকারের ভিত্তিতে একত্রে বাস করতে এক পাকিস্তানে কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী শক্তির প্ররোচনায় এদেশের শাসক আর শাসকগোষ্ঠীর ভেঙে খান খান করে দিল সেই সদিচ্ছাকে। পদদলিত করে দিল তাদেরই দেওয়া নির্বাচনের রায়কে। বাঙালীর ন্যায্য অধিকার থেকে বাঙ্গালীকে করল বঞ্চিত।
.
ক্ষমতা হস্তান্তর আর আলোচনার সুযোগ নিয়ে বাঙালী নিধনের যে ষড়যন্ত্র ইয়াহিয়া গোষ্ঠী করে চললো বাঙালী ভাবতে পারে নি তাঁর হিংস্রতা হতে এতো পৈশাচিক ও নগ্নতায় ভরপুর। লক্ষ লক্ষ নিরস্ত্র জনতাকে গুলি করে হত্যা করে আর প্রায় এক কোটি বাঙ্গালীকে গৃহত্যাগে বাধ্য করে নয় পিশাচ ইয়াহিয়া ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গরা কি আশা করেছিল সেটা প্রকাশ হয়ে পড়েছে সাংবাদিক মিঃ এন্থনী মাসকারেনহাসের লিখিত গ্রন্থ দি রেপ অব বাংলাদেশ নামের পুস্তিকায়।
.
অপ্রস্তুত বাঙালী জাতি ক্ষণিকের তরে মুষড়ে পড়েছিল এই নারকীয় হত্যালীলা আর হত্যা যজ্ঞের রূপ দেখে কিন্তু দুর্ভাগ্য ইয়াহিয়া খানের তিনি চিনতে পারেননি এই বাঙ্গালী জাতিকে। বাঙালী মচকাবে তবু ভাঙ্গবে না।
.
অচিরেই শুরু হয়ে গেল পাল্টা আঘাত হানার পালা। হাজার হাজার তরুনেরা যোগ দিতে লাগল মুক্তিফৌজের-শিক্ষা নিতে লাগলো আধুনিকতম গেরিলা যুদ্ধের কায়দা। এক একজন মুক্তিফৌজ এগিয়ে এলো হানাদার দস্যুদের নিধনে। মুক্তিফৌজের আক্রমণ ধারা যতই তীব্র হতে তীব্রতর হতে লাগল পশু ইয়াহিয়ার সামরিক শক্তি ততই অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দিল। নিরীহ গ্রামবাসীদের ধন সম্পদ লুট করে বাড়ী ঘরদোর জ্বালিয়ে দিয়ে বাঙালী মা বোনদের মান-ইজ্জত নষ্ট করে তারা প্রতিশোধের তান্ডবলীলায় মেতে উঠলো মেতে উঠলো কিন্তু তবু আজকে কিদেখতে পাচ্ছি। এক একজন মুক্তিযোদ্ধা চার-পাঁচগুন শক্তিশালী হানাদার দস্যুকে খতম করে চলেছে। দুর্জয় সাহস আর মাতৃভূমিকে হানাদার মুক্ত করার বলিষ্ঠ শপথে আমাদের মুক্তিবাহিনী আজ দৃঢ় সংকল্পচিত্ত। দেশ-বিদেশী বন্ধুরা দিচ্ছেন আধুনিকতম সমরাস্ত্র। শত্রুর বুকে শেষ আঘাত হানার জন্য আজ আমরা কৃত সংকল্প।
আমরা জানি অমানিষার অন্ধকার কেটে গিয়ে পূর্বাকাশে নবতর সূর্যোদয় ঘনিয়ে আসছে। বাংলার আকাশে নতুন সূর্য উঠবে এবং সেই আলোকে প্রদীপ্ত হয়ে উঠবে প্রতিটি বাঙালীর মনপ্রাণ, আর সঙ্গে সঙ্গে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে বাঙালী কুলবধুদের উপাসনার সুমধুর কন্ঠস্বর বেজে উঠবে বাংলা মায়ের বুকে। আর সেই দৃঢ়প্রত্যয় নিয়েই বলতে চাই-যে অতীতকে আমরা পদদলিত করে স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছি, সেই অতীতে যেন আর আমরা ফিরে না যাই।
.
.
পার্থ সুমিত ভট্টাচার্য্য
<৬,৭১,১১৯-১২০>
শিরোনামঃ ভন্ড নায়ক ইয়াহিয়া।
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশও ১ম বর্ষঃ ১৯শ সংখ্যা।
তারিখঃ ২৫ অক্টোবর, ১৯৭১।
.
ভন্ড নায়ক ইয়াহিয়া।
ইয়াহিয়া খান যুদ্ধ চান না। আলোচনার মাধ্যমে তিনি পাক-ভারত মীমাংসার পক্ষপাতী। তাঁর মতে যুদ্ধ বাধলে উভয় রাষ্ট্রের জনগণের দুঃখ দুর্দশা বাড়বে শরনার্থী সমস্যার ও হবে না কোন সামাধান। পাক-ভারত বিরোধের কতটা ফয়সালার জন্য যে কোন সময়, যে কোন স্থানে এবং যে কোন নেতার সঙ্গে তিনি শান্তি বৈঠকে বসতে রাজি। পাক প্রেসিডেন্ট এ কথাগুলা বলছেন ফরাসী পত্রিকা লা মদের প্রতিনিধির সঙ্গে। এত সুবোধ বালক ইয়াহিয়া খান তা হয়ত ফরাসীরা আগে জানতেন না। এখন হয়ত তারা হাফ ছেড়ে বাচবেন। পাক-ভারত যুদ্ধটা আর হল না, হবেই বা কি করে ? ইয়াহিয়া নিজেই বলছেন, পাকিস্তানের চেয়ে পাচগুন ভারত। তাঁর সমর শক্তিও পাচগুন বেশি। এ অবস্থায় কি করে ভারতের উপর ধাপিয়ে পড়তে পারে পাকিস্তান? এখন যে উত্তেজনা চলছে তা প্রশমনের জন্য যে কোনো সালিশীতে তিনি সম্মত। ইয়াহিয়ার অভিযোগ-পাক-ভারত উত্তেজনার জন্য দায়ী নয়াদিল্লী। আট ডিভিশন সৈন্য দিয়ে তারা ঘিরে রেখেছেন পূর্ব বাংলা। দলে দলে পাঠাচ্ছেন অনুপ্রবেশকারী। ওরা ধ্বংস করছে যোগাযোগ ব্যবস্থা, অসার করে ফেলছে পাক অর্থনীতি। পাকিস্তানের অভ্যন্তরীন সমস্যায় ভারতীয় হস্তক্ষেপ সহ্য করা চলে না। বর্তমান সংকটের পরিণতি কি হবে তা নির্ভর করছে নয়াদিল্লীর মতি গতির উপর।
.
চমৎকার অভিনেতা ইয়াহিয়া খান। কয়েক সপ্তাহ আগে তিনি দিয়েছিলেন ভারতের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সংগ্রামের হুমকি। সীমান্ত বরাবর তিনি আগে করেছেন সৈন্য সমাবেশ।
.
ইয়াহিয়ার আসল মতলব প্রায় সবারই জানা। তিনি চান বাংলাদেশ সমস্যাকে পাক-ভারত বিরোধে পরিণত করতে। তাই ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাতকারেও তাঁর এত আগ্রহ-সালিশীর জন্য এতো আকুতি। এক সময় তিনি বলতেন ভারতে যাওয়া শরনার্থীরা আসলে পাক-শরনার্থী নয়। ওরা কলকাতা এবং অন্যান্য শহরের ফুটপাতের বাসিন্দা। পাকিস্তানকে জব্দ করার জন্য তাদের ঝেটিয়ে পাঠানো হয়েছে সীমান্তের শিবিরগুলোতে। পরে মতটা একটু পাল্টে বললেন দু’রকমের শরনার্থী আছে। আসল এবং নকল। আসলদের ফিরিয়ে নেবো। নকলরা যথাস্থানে থাকবে। এখন বলছেন সব শরনার্থীকেই তিনি গ্রহণ করবেন তার জন্য দরকার পাক-ভারত আলোচনা। আর মুক্তিবাহিনী ? ওরা পূর্ব বাংলায় ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী। এদের আস্কারা দিচ্ছেন নয়াদিল্লী। তাঁর জন্যই পাক-ভারত সামরিক উত্তেজনা। বাংলাদেশের শতকরা তেরজন নাগরিক এখন দিন কাটাচ্ছেন ভারতের আশ্রয় শিবিরগুলোতে। এরা কেন গেলেন তা খতিয়ে দেখলে ইয়াহিয়া ধরতে পারতেন নিজের নারকীয় কীর্তি। যে বীভৎসতার কাহিনী জানে বিশ্ববাসী তা জানেন না এই স্বৈরাচারী মানবদ্রোহী। মুক্তি বাহিনী বাংলাদেশের জনগণের মুক্তি সাধনার বলিষ্ঠ প্রকাশ। তাদের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। স্বেচ্ছাচারী এবং মানবদ্রোহীর পূর্ণ উচ্ছেদ ছাড়া হবে না এ সংগ্রামের বিরতি। রক্ততিলকে শপথ নিয়েছেন বাংলার সন্তানরা। মারার চোটে একটু একটু করে নির্মম সত্য বুঝতে পারছেন ইয়াহিয়া খান। আগে তিনি বলতেন মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রদ্রোহী। এখন বলছেন জনগণ চাইলেই তাঁকে মুক্তি দেয়া হবে। এত রক্তপাতের পর স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে এসে বাঙালী জনতা মহানুভব পাক সম্রাট ইয়াহিয়ার কাছে দাসখত লিখে মুজিবের মুক্তি চাইবে ?
.
বাংলাদেশের হৃদয়ের কতখানি জায়গা জুড়ে বসে আছেন বঙ্গবন্ধু তা কি তিনি জানেন না? ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফল কি তিনি ভুলে গেছেন ? শুধুমাত্র বাংলাদেশ কেন, গোটা দুনিয়া আজ দাবী করছে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি । ইয়াহিয়া খান বলদর্পিত বধির। তার কানে পৌঁছায় না মানুষের ভাষা। তিনি বুঝেন অস্ত্রের ভাষা। তাই মুক্তিবাহিনী ধরেছে অস্ত্র। খতম করছে পাক সৈন্য। এ ভাষা যত জোরালো হবে ইয়াহিয়া বধিরত্ব তত ঘুচবে। চালাকি দিয়ে ঢাকা যাবে না আহম্মকী। দেয়ালের লিখন পড়তে চেষ্টা করুন ইয়াহিয়া খান।
.
.
পার্থ সুমিত ভট্টাচার্য্য
<৬,৭২,১২১>
শিরোনামঃ রাজাকাররাও আর বিশ্বাসী নয়।
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ, ১ম বর্ষঃ ১৯শ সংখ্যা।
তারিখঃ ১ নভেম্বর, ১৯৭১।
.
রাজকাররাও আর বিশ্বাসী নয়।
ঢাকা ২৮শে অক্টোবর- এক জেলার রাজাকারদেরও অন্য জেলায় ব্যাপকভাবে বদলি করে মুক্তিবাহিনীর মোকাবিলা করবার কাজে নিয়োগ করতে পাক হানাদাররা উঠে পরে লেগেছে। পাকবাহিনী শহর, গ্রাম, গঞ্জ থেকে সক্ষম লোকদের এক বিশেষ আদেশ বলে সামরিক ছাউনীতে নিয়ে গিয়ে মোটামুটি গোছের একটা প্রশিক্ষণ দিয়ে রাজাকার বাহিনীতে শামিল হতে বাধ্য করছে।
.
জানা গেছে, ঢাকা, চট্টগ্রাম, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ প্রভৃতি জেলা থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত রাজাকারদের রংপুর দিনাজপুর প্রভৃতি এলাকায় প্রেরণ করা হচ্ছে। বাংলাদেশের জনৈক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির ধারণা দলে দলে মুক্তিবাহিনীর হাতে রাজাকারদের আত্মসমর্পনের ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বনের জন্যই এক জেলার লোকদের অন্য জেলায় ঠেলে দেওয়া হয়েছে। মুক্তিবাহিনীর হাতে ধৃত বেশ কিছু সংখ্যক রাজাকারদের মধ্যে বিভিন্ন জেলার লোকও দেখা গেছে। ধৃত রাজাকারদের কাছ থেকে জানা গেছে যে, পাকবাহিনী এক ফতোয়া জারী করে তাদের রাজাকার বাহিনীতে প্রবেশ করতে বাধ্য করছে।
.
জনৈক রাজাকার বলেন যে, অনেকে মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধাচরনের ভূমিকা প্রদর্শন করেও রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিচ্ছে কারণ এর ফলে অতি সহজে যদি প্রাণে বেঁচে থাকা যায় তাহলে অস্ত্র শস্ত্রসহ মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পনের নামে মুক্ত জীবনের অধিকারী হওয়া সম্ভব হচ্ছে।
.
.
উল্লেখযোগ্য, এত সাবধানতা স্বত্বেও খানসেনারা রাজাকারদের আত্মসমর্পন আটকাতে পারছে না। কারণ জেলাব্যাপী ব্যাপকভাবে বদলী করেও রাজাকারদের মানসিক গতিকে অর্থাৎ বাঙালীদের বাংলাদেশ প্রীতিকে ঠেকিয়ে রাখতে পারছে না যদিও ব্যতিক্রম কিছু বিশ্বাসঘাতক ক্ষমতালোভী ইয়াহিয়ার তাবেদার।
.
.
পার্থ সুমিত ভট্টাচার্য্য
<৬,৭৩,১২২>
শিরোনামঃ বাঙালী রাজাকররা সাবধান।
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ ১ম বর্ষঃ ২১শ সংখ্যা।
তারিখঃ ১৫ নভেম্বর, ১৯৭১।
.
বাঙালী রাজাকাররা সাবধান।
নরপিশাচ ইয়াহিয়া খান তাঁর বর্বর সামরিক বাহিনীকে সাহায্য করার জন্য বাঙালী যুবকদের জোর করিয়া রাজাকার বাহিনীতে যোগদান করিতে বাধ্য করিয়াছেন। সমাজবিরোধী এক শ্রেণীর গুন্ডা বদমায়েশ লম্পটরাও এই সুযোগে রাজাকার বাহিনীতে ঢুকিয়া পড়িয়াছিল। ইহারা জনসাধারণের জান মালের যথেষ্ট ক্ষতিসাধন ও ধনসম্পত্তি লুন্ঠন করিয়া অরাজকতা সৃষ্টি করিয়াছিল। কিন্ত ইদানিং মুক্তিফৌজের ক্রমাগত সাফল্যের ফলে এক শ্রেণীর রাজাকার যারা নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে রাজাকার বাহিনীতে যোগদান করিতে বাধ্য হইয়াছিল তাহারা মুক্তিফৌজের গেরিলাদের হাতে প্রত্যহ আত্মসমর্পন করিয়া চলিয়াছে। রাজাকারদের মনে আরও ভীতির সঞ্চার করিয়াছে যখন তাহারা দেখিতে পায় পাঞ্জাবী হানাদার বাহিনী মুক্তিফৌজের ভয়ে তাহাদিগকেই প্রথমে সম্মুখে ঠেলিয়া দেয়। রাজাকাররা ইদানিং তাদের ভবিষ্যত সম্বন্ধে অত্যন্ত চিন্তিত হইয়া পড়িতেছে। তাদের মানসিক অবস্থার দিকে লক্ষ্য রাখিয়া এই কথাই বলিব অবিলম্বে যেন তারা তাদের অস্ত্র শস্ত্রসহ মুক্তিফৌজের হাতে আত্মসমর্পন করেন। তাদের অপকীর্তি দেশ দ্রোহিতার শামিল এবং দেশদ্রোহিতার একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদন্ড। এই মৃত্যুদন্ড এড়াইবার পথ হইল নিকটস্থ মুক্তিফৌজ শিবিরে অবিলম্বে আত্মসমর্পন।
.
.
সৌ রভ
<৬,৭৪,১২৩>
শিরোনাম ( ঢাকায় চাপা আনন্দের সঞ্চার )
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ ( ১ম বর্ষঃ ২১শ সংখ্যা)
তারিখঃ ১৫ নভেম্বর, ১৯৭১
.
ঢাকায় চাপা আনন্দের সঞ্চার
ঢাকা ১৫ নভেম্বরঃ গত কয়েকদিন থেকে ঢাকা শহরের সর্বত্র একটা চাপা আনন্দের ভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। আমাদের প্রতিনিধি ঢাকা শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে সফর করে এই সম্বন্ধে তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেন যে, ইদানিং খোদ ঢাকা শহরে মুক্তিবাহিনীর দুঃসাহসিক অভিযান এবং বিভিন্ন স্থানে হানাদার বাহিনীর সাথে প্রকাশ্য সংঘর্ষে মুক্তিবাহিনী যে বীরত্ব প্রদর্শন করেছেন তাতে ঢাকার বাসিন্দারা ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে অত্যন্ত আশান্বিত হয়ে উঠেছেন। সম্প্রতি বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চলে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম ক্যাডেটদের কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে ভাষণ দান কালে বলেন সেই দিন আর দূরে নয় যেদিন ঢাকায় স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুকে গার্ড অব অনার দেয়া হবে। ঢাকা ও বাংলাদেশের হানাদার অধিকৃত এলাকায় অধিবাসীদের মনে এটা গভীর আনন্দের সঞ্চার করেছে।তদুপরি হানাদার কবলিত এলাকাগুলি ক্রমশই মুক্তিবাহিনী দখল করে নিচ্ছে এসব খবরও আর ঢাকা বাসীদের নিকট গোপন থাকছে না। রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে প্রকাশ্য দিবালোকে বোমা বিস্ফোরনের ফলে হানাদার পাক সেনাদের মনোবল একেবারেই ভেঙ্গে পড়েছে। রাতের বেলায় ঢাকা নগরীতে হানাদারের কোন অস্তিত্ব খুজে পাওয়া যায় না।তাই বিবিসি থেকে এই বলে মন্তব্য করা হয়েছে যে রাতের বেলা ঢাকা নগরী মুক্তিবাহিনীর দখলে থাকে। এমনকি দিনের বেলায়ও হানাদার বাহিনী দলবদ্ধ না হয়ে আজকাল শহর ঘুরাফেরা করতে সাহস পাচ্ছে না। তাছাড়া পশ্চিম পাকিস্তান থেকে, যে সকল পুলিশ আমদানী করা হয়েছিল তারা দেশে ফিরে যাবার জন্য একদিনের ধর্মঘট করেছে। এই সকল অবস্থা আজ ঢাকাবাসীর মনে বন্ধমূল ধারনার সৃষ্টি করেছে যে, সে দিন আর বেশী দূরে নয় যেদিন ঢাকা নগরী তথা সারা বাংলাদেশ ইয়াহিয়ার দানবদের কবল মুক্ত হবে।
.
সৌ রভ
<৬,৭৫,১২৪-১২৫>
শিরোনাম সম্পাদকীয়ঃ শান্তি কমিটি?
সংবাদপত্র বাংলাদেশ ১ম বর্ষঃ ২২শ সংখ্যা
তারিখঃ ২২ নভেম্বর, ১৯৭১
.
শান্তি কমিটি ?
বঙ্গবন্ধু প্রায়ই বলতেন বাংলার সজীব মাটিতে সোনার যেমন ফসল ফলে, তেমনি উর্বরতার সুযোগে আগাছাও গজিয়ে উঠে। বাংলার মাটি সিরাজ, মোহন লালকে জন্ম দিয়েছে, আবার মীরজাফর, ঊর্মিচাদ জগৎশেঠকেও জন্ম দিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর এ কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্য। শান্তি কমিটি নামে বাংলার বুকে যা গড়ে উঠেছে তা কি মীরজাফর আর ঊর্মিচাদের প্রেতাত্মার বৃথা আস্ফালন নয় ?
.
বাঙ্গালী হয়ে বাঙ্গালীর ক্ষতি, পাক হানাদার দুস্যদের তাবেদারী করে স্বদেশদ্রোহিতার নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন আমাদের শান্তি কমিটির (?) বন্ধুরা। ২৫শে মার্চের হোলিখেলায় গ্রামবাংলায় এমনিতেই মৃত্যুর হিমশিতলতায় ঢলে পড়েছিল।
.
সামরিক চক্রের নিধনযজ্ঞের পর আবার নতুন করে অশান্তির আগুন জ্বালায় এই শান্তি কমিটির অশান্তি ওয়ালারা। এদের আচরনে ও কার্যকলাপে লক্ষ লক্ষ বাঙ্গালী দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে। বহু পরিবারকে এরা সর্বহারা করে ছেড়েছে, হানাদার দুস্যদের হাতে ধরিয়ে দিয়েছে,মা বোনদের সতীত্ব নষ্ট করার সুযোগ করে দিয়েছে আর নিজেরা সুযোগ সুবিধামত দলবলসহ বাড়ী বাড়ী হানা দিয়ে সর্বস্ব লুট করে নিয়েছে। এরাই আবার পাক জল্লাদদের সাহায্যের জন্য পাড়ায় পাড়ায় গ্রামে গ্রামে রাজাকার বাহিনী সৃষ্টি করতে সাহায্য করেছে।
.
সেদিনের ছবি আমাদের মন থেকে এখনও মুছে যায়নি। আমরা দেখেছি কত অগনিত পরিবার একান্ত নিরুপায় হয়ে চোখের জলে বুক ভাসিয়ে দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে। আমরা আরও দেখেছি পাক দুস্যদের সাথে সহযোগিতা করে এরা কত শত ব্যাক্তিকে নিজেদের পারিবারিক বা আর্থিক কলহের শিকারে পরিণত করে ছেড়েছে। লক্ষ লক্ষ নিরপরাধ মানুষ পুত্র, কন্যা, মা, বাপ, ভাই বোনকে ফেলে রেখে প্রাণের ভয়ে রিক্তহস্তে ভারতের মাটির দিকে ছুটে চলে গেছে।
.
মুক্তিযোদ্ধাদের ক্রমাগত সাফল্যে হাওয়া বিপরীত বইতে শুরু করেছে, এদের কার্যকলাপও স্তিমিত হয়ে আসছে। সুর অনেকের পাল্টাতে শুরু করছে। এখন অনেকেই ভবিষ্যৎ চিন্তা করে হানাদার কবলিত দেশে এবং মুক্তাঞ্চলে নিজ নিজ পথে প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে দূত পাঠিয়ে যোগাযোগ করবার চেষ্টায় আছেন। আবার অনেকে নাকি এখন মুক্তিবাহিনীর সহযোগিতায় এগিয়ে আসতে অসম্ভব আগ্রহের ভাবও দেখাচ্ছেন।
.
ইতিহাস বলে, যুগে যুগে সুবিধাবাদীরা এবং দেশদ্রোহী লম্পটেরা এমন করেই তাদের অস্তিত্বকে বজায় রাখতে চেষ্টা হয়। তাই এবার আমরা জাতির অতি ঘৃণিত এই শত্রুদের দিকে সজাগ ও তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখার জন্য আমাদের একান্ত প্রিয়, সংগ্রামী চেতনায় উদ্ধুদ্ধ, বাঙ্গালী জাতীয়বোধে অনুপ্রাণিত বাংলার ঐতিহ্যবাহী, ত্যাগ তিতিক্ষার মূর্ত প্রতীক আমাদের যুবসমাজের প্রতি আবেদন জানাই। আমরা জানি শান্তি কমিটির দালাদের নিকট আত্মীয়স্বজনদের অনেকেই এবারের মুক্তিসংগ্রামে আমাদের সাথে অংশগ্রহণ করেছেন। তাই প্রতি পদে মুক্তি সংগ্রামীর মানসিক দুর্বলতা দেখা দেওয়া স্বাভাবিক কিন্ত বহু ত্যাগ, বহু প্রাণ ও বহু রক্তের বিনিময়ে আমরা যে স্বাধীনতা প্রায় আমাদের হাতে কব্জায় নিয়ে এসেছি তা যেন বিন্দুমাত্র দুর্বলতার সুযোগে ফসকে না যায়।
.
শান্তি কমিটির অশান্তি সৃষ্টিকারীরা যেন আমাদের ব্যক্তিগত বা পারিবারিক সম্পর্কের সুযোগ নিয়ে আত্মত্যাগী মুক্তিযোদ্ধাদের কিছু মাত্র দুর্বল বা বিপথগামী করতে না পেরে, সেটাই হবে আজকের দিনে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি একান্ত আবেদন।
.
.
দীপংকর ঘোষ দ্বীপ
<৬,৭৬,১২৬>
শিরোনামঃ বাংলাদেশ সরকার রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক বিষয়ে কর্মসূচী নিচ্ছেন
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ ১ম বর্ষঃ ২২শ সংখ্যা
তারিখঃ ২২ নভেম্বর, ১৯৭১
বাংলাদেশ সরকার রাষ্ট্রীয় ও
সাংবিধানিক বিষয়ে কর্মসূচী নিচ্ছেন
ঢাকা, ২২শে নভেম্বরঃ মুজিবনগর থেকে আমাদের বাংলাদেশ প্রতিনিধি জানিয়েছেন যে, মুক্তিবাহিনীর ক্রমবর্ধমান আক্রমণ ও সাফল্যের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ সরকার রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক কাঠামো সম্পর্কে এখন থেকেই সুনির্দিষ্টভাবে চিন্তা করছেন এবং এই বিষয়ে তারা ইতিমধ্যে বেশ কিছু আলোচনাও সেরে ফেলেছেন । মুক্ত বাংলাদেশে যাতে যথাশীঘ্র আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা যায় তার জন্য পার্লামেন্টারি, আইন ও পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রী জনাব খোন্দকার মোশতাক আহম্মদ সাহেব তার সহকর্মীদের সহযোগিতায় যথাযোগ্য ব্যবস্থা গ্রহণ করে চলেছেন ।
.
.
দীপংকর ঘোষ দ্বীপ
<৬,৭৭,১২৭>
শিরোনামঃ বাস্তুত্যাগীদের নিয়ে ঢাকা বেতারের অপপ্রচার
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ ১ম বর্ষঃ ২২শ সংখ্যা
তারিখঃ ২২ নভেম্বর, ১৯৭১
বাস্তুত্যাগীদের নিয়ে ঢাকা বেতারের অপপ্রচার
(রাজনৈতিক ভাষ্যকার)
হানাদার শত্রু কবলিত ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের বাস্তুত্যাগীদের স্বদেশে আশা নিয়ে প্রতিদিনই বিভিন্ন ধরনের মিথ্যা প্রচার চালানো হচ্ছে । এর মধ্যে প্রথম দিকে বিশেষ একটি প্রচারনা ছিল ভারতে চলে যাওয়া লক্ষ লক্ষ বাস্তুত্যাগীদের স্বদেশ প্রত্যাগমনের জন্য আবেদন নিবেদন, অনেক দিন যাবৎ একটানা প্রচার করা হয়েছিল পাকিস্তানী সামরিক কর্তারা বাস্তুত্যাগীদের জন্য বিভিন্ন স্থানে অভ্যর্থনা শিবির (Reception Camp) খুলছেন এবং সেই সাথে প্রচার-মহাত্মা দিয়ে প্রতিদিনই যে হাজারে হাজারে বাস্তুত্যাগী স্বদেশ ফেরার পথে ঐ সকল অভ্যর্থনা শিবিরে আগমন করছেন, সেই খবরও জৌলুস সহকারে প্রচার করা হয়েছিল কিন্তু বিদেশী সাংবাদিকরা এবং পরবর্তী পর্যায়ে রাষ্ট্রসংঘের ত্রান কমিটির কর্ণধার প্রিন্স সদরুদ্দীন আগাখানের সফরের পর পাক বেতারের মিথ্যা প্রচারনার খোলস খুলে পড়েছে । বিদেশী সাংবাদিকদের জবানীতেই জানা যায় বাংলাদেশের যেখানে প্রতিদিন অব্যাহতভাবে মানব ধিনযজ্ঞ ও বাড়ী ঘর, গ্রামকে গ্রাম পাইকারী হারে লুটপাট ও পোড়ানো চলছিল এবং সর্বত্র তল্লাশী চালিয়ে ধরপাকড় আর বিভীষিকার রাজত্ব কায়েম করা হয়েছিল এবং সর্বোপরি হাজারে হাজারে বাঙালীরা প্রাণভয়ে ভারতে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল, সেখানে হানাদারকবলিত অভ্যর্থনা শিবির তথা নিশ্চিত মৃত্যুর শিবিরে ফিরে যাবার কোন প্রশ্নই আসে না ফলে শেষ পর্যন্ত ঐ ধরনের অভ্যর্থনা শিবিরগুলি স্বাভাবিকভাবে বন্ধ হয়ে যায় ।
এবার ঢাকা বেতারের কর্তা ব্যক্তিরা প্রচারের ঢং বদলিয়ে অন্য সুর ধরেছেন । এখন বলা হচ্ছে বাস্তুত্যাগীরা দেশে ফেরার জন্য খুবই উদগ্রীব শুধু ভারত সরকার তাদের স্বদেশে ফিরতে দিতেছেন না । সঙ্গে সঙ্গে এই খবরও ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে ভারতে অবস্থিত শরণার্থী শিবিরগুলিতে মহামারী লেগেছে এবং প্রতিদিন সেখানে হাজার হাজার শরণার্থী প্রাণ হারাচ্ছেন ।
কিন্তু আমরা শুধু ঢাকা বেতার কর্তৃপক্ষের নিকট একটি মাত্র প্রশ্নের জবাব চাইব যে, বাস্তুত্যাগীদের জন্য যেমন মার চেয়ে মাসীর দরদের মত দেখানো হচ্ছে, স্বগৃহে প্রত্যাবর্তনের জন্য বিভিন্ন লাভজনক টোপ ফেলা হচ্ছে- তার আগে কি ঢাকা বেতার কর্তৃপক্ষ জবাব দেবেন- বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি অধিবাসীকে কোন অপরাধে আত্মীয়হারা, স্বজনহারা আর সহায় সম্বলহীন অবস্থায় বাড়ীঘর ছেড়ে শুধুমাত্র প্রাণভয়ে ভারতের মাটির দিকে ছুটে চলে যেতে হয়েছিল? ২৫শে মার্চের রাতের আধারে যে হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়েছিল এবং এখনও কেন সেটা বন্ধ হয়নি ? বেতার কর্তৃপক্ষ অথবা তাদের পরিচালক সামরিক চক্র কি এতই অবোধ শিশু যে, তারা বুঝতে পারছে না যত রং ঢং দিয়েই প্রচার চালানো হউক না কেন সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর প্রাণপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি না দিয়ে এবং বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পূর্বে ভারতে চলে যাওয়া বাস্তুত্যাগীরা আর দেশে ফিরে আসবেন না । আমরা এটাও জেনেছি বাস্তুত্যাগীদের একমাত্র বক্তব্যই হলো আমাদের নেতা বঙ্গবন্ধু যে দিন আমাদেরকে স্বদেশ ফেরার আহবান জানাবেন ঠিক তখনই আমরা স্বদেশ পানে ছুটে যাব এবং আমরাত বঙ্গবন্ধু ও সেই স্বকণ্ঠ আহবানের প্রত্যাশাতেই আছি এবং থাকবো ।
.
.
দীপংকর ঘোষ দ্বীপ
<৬,৭৮,১২৮>
শিরোনামঃ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মুক্তাঞ্চল পরিদর্শন
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ ১ম বর্ষঃ ২২শ সংখ্যা
তারিখঃ ২২ নভেম্বর, ১৯৭১
নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মুক্তাঞ্চল পরিদর্শন
ঢাকা, ২২শে নভেম্বরঃ- হানাদার মুক্ত এলাকা সফর শেষে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের একদল সদস্য তাদের সফর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে আমাদের বাংলাদেশ প্রতিনিধিকে বলেন যে, গত এক সপ্তাহ যাবৎ আমরা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে শত্রু বিতাড়িত এলাকাগুলি সফর করে চলেছি । গ্রামবাসীদের সাথে আমরা ঘরোয়া পরিবেশে আলাপ-আলোচনা করেছি এবং স্থানে স্থানে জনসভাতেও বক্তৃতা দিয়েছি । আমরা সর্বত্রই দেখতে পেয়েছি এত দুঃখ কষ্ট ও অত্যাচার সহ্য করার পরও গ্রামবাসীদের মনোবল একটুও নষ্ট হয়নি বরং এখন গ্রামবাসীরা নিজেরাই সক্রিয় হয়ে উঠেছেন । মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতায় দলবদ্ধভাবে হানাদার দস্যুদের বিরুদ্ধে সাক্ষাৎ সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে চলেছেন ।
প্রতিনিধিবৃন্দ আরও জানান, পাক দস্যুরা অতর্কিত হামলা দিয়ে গ্রামবাসীদের হত্যা বাড়ীঘর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দিয়েছে । আশ্রয়হীন অবস্থায় আর শীতে তাদের দুরবস্থা অবর্ণনীয় । তবুও তাদের একমাত্র কথা আপনারা মুক্তি ফৌজ নিয়ে শত্রুর উপর প্রবলভাবে ঝাপিয়ে পড়ুন এবং অনতিবিলম্বে সমগ্র দেশকে হানাদার শত্রুমুক্ত করে রাজধানী ঢাকার বুকে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড্ডীন করুন ।
আমরা এটাও লক্ষ্য করেছি গ্রামবাসীরা অধীর আগ্রহে স্বাধীন বাংলা রেডিওর সংবাদ শোনার জন্য রেডিও নিয়ে বসে থাকেন । তারা আমাদের একথাও জানান আমরা ঢাকা বেতার কেন্দ্রের কোন অনুষ্ঠান শুনিনা । প্রত্যেক গ্রামেই দেখলাম যুবক শ্রেণীর সংখ্যা খুবই কম খোজ নিয়ে জানতে পারলাম যুবসম্প্রদায় মুক্তিফৌজে ট্রেনিং নেবার জন্য বিভিন্ন যুবশিবিরে চলে গেছেন। অনেক অভিভাবক সে কথা গর্বভরে আমাদের জানাতে এগিয়ে এলেন । পিছু হটে যাওয়া হানাদার শত্রুদের ব্যাঙ্কারগুলিও আমরা পরিদর্শন করালাম ভিন্ন স্থানে আমাদের জওয়ানদের সাথে মিলে তাদের কর্মপদ্ধতিও লক্ষ্য করলাম । তাদের মুখে চোখে দেখতে পেলাম এক অভূতপূর্ব বীরত্বব্যঞ্জক চিহ্ন, যা থেকে সহজে অনুমান করা যায় শত্রুকে আমরা নির্মুল করেই ছাড়বো প্রতিদিনই তারা শত্রুনিধন করে এগিয়ে যাচ্ছে আর হানাদার বাহিনী পিছু হটে চলছে । বিদায়ের প্রাক্কালে তাদের প্রত্যেকের সাথেই হলো আমাদের গভীর মমতাভরা আলিঙ্গন আর তাদের হাতে তুলে দিলাম আমাদের সাথে নিয়ে যাওয়া তাদেরই সংগ্রামের ইতিহাসের জ্বলন্ত প্রতিচ্ছবি সাপ্তাহিক বাংলাদেশ পত্রিকার কয়েকটি সংখ্যা ।
.
.
সৌ রভ
<৬,৭৯,১২৯>
.
শিরোনামঃ রাজাকারদের জন্য শেষ সুযোগ
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ ১ম বর্ষঃ ২২শ সংখ্যা
তারিখঃ ২২ নভেম্বর, ১৯৭১
.
রাজাকারদের জন্য শেষ সুযোগ ( নিজস্ব ভাষ্যকার )
বাংলার মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপকতা ও প্রচণ্ডতা সাথে সাথে পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদার পশুদের মনে এক বিভীষিকাময় আতঙ্কের কালো ছায়া রেখাপাত করেছে। স্বাধীনতা মন্ত্রে দীক্ষিত মুক্তিযোদ্ধা ও গেরিলাদের অতর্কিত আক্রমণে পাক বাহিনী দিশেহারা, সদা শঙ্কিত। নিতান্ত প্রাণের দায়ে বা মুখ রক্ষার খাতিরে এরা আজ ভগ্নমনে লড়ে যাচ্ছে। এরা এতই শঙ্কিত যে, যে কোন অভিযানে তাবেদার রাজাকার ছাড়া এক পাও এগোতে সাহস পাচ্ছে না। রাজাকার নামক এইসব বকরীগুলো এতদিন খুঁটির জোরে বহু কুদেছে। আজ খুঁটি ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম দেখে বহু রাজাকার দলে দলে মুক্তিবাহিনীর কাছে অস্ত্রশস্ত্র সমেত আত্মসমর্পণ করে চলছে।
.
পায়ের তলা থেকে যখন মাটি সরে যাচ্ছে, পালে যখন উল্টো হাওয়া বাইতে শুরু করেছে তখন এদিন যারা ধর্মীয় বিভ্রান্তি, প্রলোভন বা সামরিক মোহের বশবর্তী হয়ে অথবা লুটপাটের দরাজ সুযোগ লাভের জন্য সেনাবাহিনীর তল্পীবাহক হয়ে স্বাতি নিধনযজ্ঞে, অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠনে লিপ্ত ছিল তারা আজ স্বনিত ফিরে পাচ্ছে ক্রম। তাই দলে দলে এরা আত্মসমর্পণ করে চলেছে। রাজাকারদের কাছে শেষ সুযোগ এসেছে। এদের ভেবে দেখা উচিত কার জন্য কিসের জন্য এত আত্মবলিদান করে চলেছে। একবারও কি এরা ভাবছে না যে স্বাধীন বাংলায় এদের কি অবস্থা হবে। বাঙ্গালী হয়ে বাঙ্গালীর প্রতি এই ক্ষমাহীন আচরনের জন্য তাদের শাস্তি পেতেই হবে। আর স্বদেশ দ্রোহিতার বা স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধীদের একমাত্র শাস্তিই হলে মৃত্যুদণ্ড।
.
এখনও কিছু সময় বাকী আছে। আজও যদি এরা মুক্তাঞ্চলে চলে আসে, কৃতকর্মের অনুশোচনা করে, তবে আমরা তাদেরকে পথভোলা মানুষ বলে পরিপূর্ণ নাগরিকের মর্যাদা দেব। যার যা অস্ত্রশস্ত্র আছে তাই সমেত আত্মসমর্পণ করে আত্মপক্ষ সমর্থনের শেষ সুযোগ এসেছে রাজাকারদের কাছে।
.
সৌ রভ
<৬,৮০,১৩০>
শিরোনামঃ সম্পাদকীয়
সংবাদপত্রঃ রণাঙ্গন ১ম সংখ্যা
তারিখঃ ১১ জুলাই, ১৯৭১
.
সম্পাদকীয়
আমরা শান্তি চেয়েছিলাম, গনতন্ত্র চেয়েছিলাম আমরা, তাই অংশ নিয়েছিলাম নির্বাচনে। কিন্ত বর্বর ইয়াহিয়ার বিশ্বাসঘাতকায় আমরা শান্তি হারিয়েছি, গণতন্ত্রের হয়েছে মৃত্যু। লক্ষ লক্ষ নারী, পুরুষ, শিশু জালিম হানাদারদের বেয়োনেট, গুলির আঘাতে প্রাণ দিয়েছে ইজ্জত দিয়েছে কিন্ত স্বাধীনতা ছাড়ে নাই। বাংলাদেশ আর বাঙ্গালী জাতি আজ স্বাধীন। মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় আমরা যে স্বাধীনতা হারিয়েছিলাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সেই স্বাধীনতা আমরা আবার ফিরে পেয়েছি। মুক্তিফৌজের বীর জোয়ানরা আমাদের স্বাধীনতা রক্ষায়, দীর্ঘ সাড়ে তিন মাস ধরে জীবনপন লড়াই করে চলেছেন। ইতিহাসের শিক্ষা, বঙ্গবন্ধুর দীক্ষা আমাদের স্বাধীনতার লড়াই ব্যর্থ হবে না ব্যর্থ হতে পারে না।
.
আমরা শান্তি চাই। কিন্ত কবরের শান্তি চাই না। এবার আমরা শান্তি প্রতিষ্ঠা করব-আঘাতের পর আঘাত হেনে, দস্যূ হানাদারদের খতম করে। জয় বাংলা।
.
[* রণাঙ্গনঃ মুক্তিফৌজের সাপ্তাহিক মুখপত্র। সম্পাদক রণদূত। টাঙ্গাইল জেলা মুক্তিফৌজের বেসামরিক দফতর থেকে প্রকাশিত। রণদূত সম্পাদকের ছদ্মনাম। পত্রিকাটি শত্রুসেনা পরিবেষ্টিত বাংলাদেশ হতে সাইক্লোস্টাইলে প্রকাশিত।]
.
সৌ রভ
<৬,৮০,১৩১>
শিরোনাম সম্পাদকীয়ঃ (শেখ মুজিবের বিচার প্রসঙ্গে)
সংবাদপত্রঃ রণাঙ্গন ২য় সংখ্যা
তারিখঃ ১৫ জুলাই, ১৯৭১
.
সম্পাদকীয়
বর্বর ইয়াহিয়ার সাম্প্রতিকতম ষ্টান্ট হল মুজিববের বিচার প্রসঙ্গে। গত চার মাস ধরে বঙ্গবন্ধু এক হিংস্র বর্বর পশুর শিকার। বাংলাদেশের সাধারণ জনগন এক নারকীয় পরিস্থিতিতে দিন কাটাচ্ছেন, প্রাণ দিয়েছেন দশ লাখ লোক। গত চার মাস ধরে বিশ্বের কাছে এই বর্বরতা এবং দস্যুতার কাহিনী উদঘাটিত হয়েছে, ধীরে ধীরে পাকিস্তান সরকারের নামে দস্যু সরকার বিশ্বে তার বন্ধু হারিয়েছে। ব্রিটেন, কানাডা, রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, পশ্চিম জার্মানী, জাপান, ফ্রান্স, বন্ধ করেছে সকল প্রকার সাহায্য।
.
অর্থনীতিক দিক দিয়ে পাকিস্তান এখন পুরোপুরি দেউলিয়া। বাংলাদেশের কলখারখানা পুরোপুরি বন্ধ, প্রধান অর্থকরি ফসল পাচ্ছে না সে। পাকিস্তানের উৎপাদনের সমস্তই তাদের সমকালীন কলোনী বাংলাদেশে রফতানী করত। সেটাও বন্ধ। সুতরাং ইয়াহিয়া সরকারের অর্থনৈতিক অবস্থা দেউলিয়া। তাছাড়া ২১ মার্চের পরে যুদ্ধে প্রথম দিকে যে আবেগ আশ্রিত আন্দোলন বাংলাদেশে জন্ম নিয়েছিল, আজ আর তা নেই আবেগ আর অস্ত্র হীন আন্দোলন দিয়ে যে এখন দেশ স্বাধীন করা সম্ভব নয়, মুক্তিফৌজ তা তার বাস্তব অভিজ্ঞতা দিয়ে অচিরেই বুঝতে পেরেছিল। সুতরাং অস্ত্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরা শিখতে হয়েছে তাকে। এভাবেই শক্তিশালী হয়েছে মুক্তিফৌজ। এই শক্তি সম্পর্কে ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তা যেমন তেমনি সমস্ত বিশ্বও সচেতন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বিশ্বের কারো সঙ্গে আজ পর্যন্ত দেখা করতে দেয়নি। পশ্চিম পাকিস্তানের গণমনে ধুইয়ে উঠছে রক্তস্রোত। বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের মনে জ্বলছে রুদ্র বহ্নি শিখা। আর এসবেরই বিরুদ্ধে ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তা এক ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে মেতে উঠছে। বঙ্গবন্ধুর বিচার করে মুক্তিফৌজের শক্তিকে আবেগ আপ্লুত করে দিয়ে সমস্ত বিশ্বের দৃষ্টিতে বিভ্রান্ত করতে চাইছে সে। আমেরিকান প্রেসিডেন্টের সঙ্গে গণচীনের বৈঠক প্রস্তাব এবং পাকিস্তানের ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধের হুমকিও এই ষড়যন্ত্রের অংশ। কিন্ত ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তাকে আমরা সুস্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিতে চাই মুক্তিফৌজের শক্তিকে বিভ্রান্ত করা সমস্ত বিশ্বের পক্ষেও সম্ভব নয়। ইয়াহিয়ার ঔধত্যের জবাব আমরা বুলেটেই দিব। বিশ্ব জনমতকেও আমরা জানিয়ে দিচ্ছি যদি ইয়াহিয়া বঙ্গবন্ধুর বিচার করতে চায় তাহলে বাংলা মুক্তিফৌজ এমন জবাব দেবে যাতে বিশ্ব শান্তি বিঘ্নিত হতে পারে।
.
.
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
সম্পাদকীয়ঃ | রণাঙ্গন
৩য় সংখ্যা |
৮ আগস্ট, ১৯৭১ |
তাসমিয়া তাসিন
<৬,৮২,১৩২>
সম্পাদকীয়
আমাদের মুক্তি সংগ্রামের বয়স মাত্র সাড়ে চার মাস । বিশ্বের বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ব অর্জনের ইতিহাসে খুব একটা বেশী সময় নয়। তবে আমাদের শ্যামল আর পলি মাটির দেশ সোনার বাংলার চূড়ান্ত মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়েই যে অসম সাহস এবং অপূর্ব রণ-কৌশল প্রদর্শন করেছেন বিশ্বের সর্বকালের সর্ব দেশের সর্বযুগের স্বাধীনতার ইতিহাসে তা সত্যই বিরল। সামান্যতম ক্ষতি স্বীকার না করেই আমাদের পরম গৌরব ও আশার তরী মুক্তিযোদ্ধা ভাইয়েরা নাৎসী ইয়াহিয়ার বর্বর হানাদার বাহিনীর রসদ চলাচল বাধাগ্রস্ত করার জন্য শত শত সড়ক, রেল লাইন, কালভার্ট মুক্তিবাহিনীর বীর যোদ্ধারা বিধ্বস্ত করে ফেলেছেন । শত্রুর বিমান ভূ-পাতিত করেছেন, বহু গানবোট ও স্পীডবোট পানিতে ডুবিয়ে দিয়েছেন । প্রচুর রসদ গোলাবারুদ , অস্ত্রশস্ত্র ও দলিলপত্র মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়েছে । অফিসারসহ হাজার হাজার বর্বরতার পাকসেনা বন্দী হয়েছে, আত্মসমর্পণ করেছে অনেকে । হাজার হাজার দস্যুসেনা গুরুতররূপে আহত অবস্থায় হাসপাতালে মৃত্যুর প্রতীক্ষা করছে । প্রতি দিন প্রতি মুহুর্তেই মুক্তিবাহিনীর কাছে নতুন সাফল্যের দ্বার উদঘাটিত হচ্ছে । সংগ্রামী বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মুক্তিপাগল মানুষ বীর মুক্তিসংগ্রামীদের সাথে একাত্ম হয়ে লড়ে চলেছেন । মুক্তিবাহিনীর এই অভূতপূর্ব সাফল্যে তাদের প্রতি আমরা জানাই হৃদয় নিংড়ানো শ্রদ্ধা এবং সংগ্রামী অভিনন্দন । জয় বাংলা ।
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
সম্পাদকীয়ঃ | রণাঙ্গন
৩য় সংখ্যা |
৮ আগস্ট, ১৯৭১ |
তাসমিয়া তাসিন
<৬,৮৩,১৩৩>
সম্পাদকীয়
বাংলাদেশে আজ যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা চলছে । এ খেলা মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে শত্রুহননের খেলা । এ খেলা পাকিস্তানী বর্বর হানাদার সেনাদের খতম করে বাংলাদেশকে মুক্ত করার খেলা । এ খেলায় জয় আমাদের অনিবার্য, কেননা আমরা সত্য ন্যায় এবং স্বাধীনতার পক্ষে রয়েছি বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ এবং বিশ্বের বিবেকশালী অগণিত জনতা আমাদের পক্ষে রয়েছেন বিশ্ব মানবের প্রতিপালক মহাশক্তিশালী আল্লাহ । অপরপক্ষে আছে পাকিস্তানী বর্বর দস্যু বাহিনী এবং সম্রাজ্যবাদী পশুশক্তি । ওদের জয় হতে পারে না। ওদের যদি জয় হয় তাহলে সাম্রাজ্যবাদ উপনিবেশবাদের করাল গ্রাসে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে, বিশ্ব ইতিহাস মিথ্যা হয়ে যাবে । সভ্যতার হবে চরম অপমান ।
না তা হচ্ছে না জয় ওদের হচ্ছে না । জয় আমাদের । প্রতিটি আগামীকাল আমাদের রণক্ষেত্রের বিজয়ের সংবাদ নিয়ে আসছে। আমাদের আগে উদ্দীপনা নিয়ে যুদ্ধ করে যেতে হবে, বিজয়কে আরো তরান্বিত করতে হবে। আঘাতের পর আঘাত হেনে দস্যু পশু শক্তির বিষদাত ভেঙ্গে দিতে হবে, চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিতে হবে । বাংলার বীর যোদ্ধারা, বাংলা মুক্তিকামী সৈনিকেরা তোমরা আরও শক্তি নিয়ে এগিয়ে চলো । দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলো । নিঃশেষ করে দাও তোমাদের শেষ শত্রুকে । বাংলার মানুষ তোমাদের সাথে, বিশ্ববিবেক তোমাদের সাথে , পরম শক্তিশালী আল্লাহ তোমাদের সাথে । গুলির আওয়াজ , আঘাতের প্রচন্ডতায় ছিনিয়ে নাও তোমাদের স্বাধীনতা । জয় বাংলা ।
————————–
[** ঢাকা, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ ও পাবনা জেলা মুক্তি বাহিনীর বেসামরিক দপ্তর থেকে প্রকাশিত, পত্রিকাটির মূল সংখ্যায় এই উল্লেখ্য রয়েছে।]
তাসমিয়া তাসিন
<৬,৮৪,১৩৪>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করেই হাতিয়ার
ছাড়বো |
রণাঙ্গন
৬ষষ্ঠ সংখ্যা |
২৪ অক্টোবর, ১৯৭১ |
বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করেই হাতিয়ার ছাড়বো
টাঙ্গাইলের মুক্ত এলাকার জনসভায় বীর কাদেরের ভাষণ
মুজিবনগর থেকে ফেরার পর মুক্ত এলাকার কোন এক অঞ্চলে প্রথম জনসভায় জনাব কাদেরের ভাষণ দিচ্ছিলেন । ২২ অক্টোবার মাহে রমজানের প্রথম দিনে বেলা ৩-১০ মিনিটে মাওলানা জয়নুল আবেদীন হাদীর কোরআন তেলয়াতের মাধ্যমে এই জনসভার শুভ সূচনা হয় ।
যুদ্ধ এখনও শুরু হয়নিঃ
জনাব সিদ্দিকী তার ভাষণে বলেন – বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামের প্রায় সাত মাস অতিবাহিত হতে চলছে । এ যুদ্ধ নয়-প্রস্তুতি মাত্র। ২৩ বৎসর প্রস্তুতি নিয়ে ২৫ মার্চের রাত্রে ওরা আমাদের উপর ঝাপিয়ে পড়েছে । আমরা ৭ মাসের প্রস্তুতিতে এখন যুদ্ধ করবো।
জনসাধারন করিয়ে দেয়ঃ
মুজিব নগরে বিভিন্ন সময় আমাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে – যোগাযোগ এবং খাদ্য কে দেয়? আমি বলেছি যখন দুরালপনী ছিল না, তখন জনসাধারন যেভাবে যোগাযোগ করিয়ে দিত, আমাদের বেলায় তাই-ই হইতেছে । সাধারন মানুষের খাবার আমার খাবার।
আপোষ হতে পারে নাঃ
বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ যাকে নেতা বলে স্বীকার করেছেন, তাকে কারাগারে রেখে জালিমের হাতে কামান রেখে কোন আপোষ হতে পারে না ।
বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করেই হাতিয়ার ছাড়বোঃ
জনাব সিদ্দিকী বলেন- ৫২র ভাষা আন্দোলন, ৬২র শিক্ষা কমিশন আন্দোলনের ৬৯র গণজোয়ারে ‘ ৭০-র নির্বাচনে আমরা জয়ী হয়েছি। ৭১-র এ যুদ্ধেও আমরা জয়ী হব । বঙ্গবন্ধু কে যে কোন কারাগারেই রাখা হোক না কেন , তাকে মুক্ত করেই ছাড়বো ।
এখনো সময় আছেঃ
সাধারন ক্ষমা ঘোষণা করে তিনি বলেন- আত্মসমর্পণ করা হলে দালাল এবং রাজাকারদের এখনও ক্ষমা করা হবে ।
ধৈর্যশীল হতে হবেঃ
জনগণকে আশ্বাস দিয়ে তিনি বলেন – আপনারা ধৈর্য ধরেন । দেশ স্বাধীন হতে আর বেশী বিলম্ব নেই । আপনারা পাট বিক্রি করতে পারবেন । তবে পাট ক্রেতাকে মণপ্রতি এক টাকা করে মুক্তিবাহিনীকে চাঁদা দিতে হবে ।
ঢাকা টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ ও পাবনার বেসামরিক প্রধান তার জ্ঞান গম্ভীর ভাষণে বলেন- বাংলাদেশের বুক থেকে হানাদারদের খতম করা পর্যন্ত এ যুদ্ধ চলবে । ত্যাগ-তিতিক্ষা স্বীকার করেই আমরা যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছি । কারো ধার করা স্বাধীনতা আমরা চাই না । আমরা গাজী হয়ে যুদ্ধ শুরু করেছি গাজী হয়েই যুদ্ধ শেষ করবো । বঙ্গবন্ধুকে হানাদার গোষ্ঠীর কারাগার থেকে ছিনিয়ে আনবই আনব ।
.
.
জেসিকা গুলশান তোড়া
<৬,৮৫,১৩৫>
.
শিরোনামঃ সম্পাদকীয়
সংবাদপত্রঃ স্বাধীন বাংলা ১ম বর্ষঃ ৭ম সংখ্যা
তারিখঃ ১২ জুলাই, ১৯৭১
সম্পাদকীয়
.
[স্বাধীন বাংলা (সোনারদেশ): স্বাধীন বাংলার সাপ্তাহিক মুখপত্র। প্রতিষ্ঠাত্রী সম্পাদিকাঃ মিসেস জাহানারা কামারুজ্জামান। সম্পাদকঃ এস, এম এ, আলমাহমুদ চৌধুরী কতৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত এবং বলাকা প্রেস জামানগঞ্জ, রাজশাহী, বাংলাদেশ হতে এম, এ, মজিদ কর্তৃক মুদ্রিত।]
বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ আজ ১০০টি দিন অতিবাহিত হয়ে গেল। বীর মুক্তিবাহিনীর ব্যাপক আক্রমনে হানাদার পাক সেনারা ভূত দেখার মত আঁতকে উঠছে। এদের অবস্থা এখন ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি। ভীত সন্ত্রস্ত পাক জঙ্গীরা ক্যান্টনমেন্ট এর বাইরে বেরুতে সাহস পাচ্ছে না। শুধু কি তাই? নিজেদের মধ্যে শুরু হয়েছে কোন্দল। সাধারন একজন সৈনিক, একজন মেজরের আদেশ ঘৃনাচ্ছলে অমান্য করেছে। এক মাস যুদ্ধ করার নামে জঙ্গী শাসক ইয়াহিয়া যে তান্ডবলীলা শুরু করেছেন, তাতে অনেক সৈনিকই বিরক্ত বোধ করছে। তারা চঞ্চল হয়ে পড়েছে দীর্ঘদিন ছেড়ে আসা মা-ভাই-স্ত্রী-পুত্রদের অদর্শনে। ওদিকে বেলুচ সৈন্যরা নরহত্যা করতে অস্বীকার করায় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে প্রায় ৫ পাঁচ হাজার বেলুচ ও পাঞ্জাবী সেনাদের মধ্যে মাঝে মাঝেই যে যাকে পারছে সুযোগ অনুযায়ী হত্যা করছে।
.
নদীমাতৃক বাংলাদেশ বর্ষার আগমনে ঝলমল করছে। চারিদিকে জলে জলাকার। রাস্তাঘাট কর্দমাক্ত, গাড়ী-ঘোড়া আর চলছে না। প্রকৃতি দেবী বর্বর পাক-জঙ্গীর অমানুষিক অত্যাচারিত সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর দুরবস্থায় ম্রিয়মান বাংলার পশু-পাখিও ভুলে গেছে তাদের কুজন। বনে জঙ্গলে আর শোনা যায়না কোকিলের কুহুতান। বাংলার পূর্বাবস্থা ফিরিয়ে আনতে বাংলার যুবক আজ বদ্ধপরিকর, তাই দিকে দিকে তাদের আক্রমণে পাক সেনারা যথেষ্ট নাজেহাল হচ্ছে। বিভিন্ন এলাকায় সেতু ধ্বংস করে দিয়ে তাদের চলাচলে যে ব্যাঘাত ঘটিয়েছে তাতে পাক সৈন্যরা কোন কূল কিনারা পাচ্ছে না। বিভিন্ন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে দেখা যায় যে, পাক সেনারা আজ এমনই এক অবস্থার সম্মুখীন হয়েছে যে তারা আজ ‘চাচা আপন পরান বাঁচা’ মানে কোন প্রকারে পৈতৃক প্রাণটা বাঁচানোর তাগিদেই অস্থির হয়ে পড়েছে।
.
এদিকে বর্ষার অপেক্ষায় অপেক্ষমাণ মুক্তিবাহিনী এই সুযোগের অপেক্ষাই করেছিল। তারা আজ দেশমাতৃকাকে শত্রুকবল থেকে মুক্ত করবার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ এবং ইতিমধ্যে প্রায় ৩০ হাজার পাক সেনাকে খতমও করেছে। চট্টগ্রাম, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, যশোর, রাজশাহী, বগুড়া, দিনাজপুরসহ বহু অঞ্চল আজ মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রনে। হিসাব মোতাবেক দেখা যায় বাংলাদেশের প্রায় তিন অংশ আজ মুক্তিবাহিনীর দখলে। অল্পদিনের মধ্যে হয়তো বাকী অংশ দখল হয়ে যাবে।
.
তাই পরিশেষে সেই সব পাকিস্তানের শক্ত কেন্দ্রের দাবীদারদের বলতে হয়- হে বাংলার দরদী বন্ধুরা তোমরা তোমাদের শক্ত কেন্দ্র নিয়ে থাক। তোমাদের সৃষ্ট ঐ সখের পাকিস্তানকে বাংলার জনগণ অনেক আগেই কবর দিয়ে তার মৃত আত্মার সদগতির জন্য তামদারী ও দোয়া দরুদ পড়ে সবই শেষ করে দিয়েছে। চিন্তা কর না, যেটুকু বাকী আছে তাও অতি শীঘ্রই শেষ করে দেবে।
.
.
জেসিকা গুলশান তোড়া
<৬,৮৬,১৩৬>
সংবাদপত্রঃ স্বাধীন বাংলা ১ম বর্ষঃ ৭ম সংখ্যা
তারিখঃ ১২ জুলাই, ১৯৭১
.
[ছবি। ক্যাপশনে লিখা রয়েছে- ৯ জন পাক পশু সেনার ধর্ষনে মৃত রমণী। তার হাতের চুড়িগুলো এখনো বলছে ‘আমি ঘরের বৌ ছিলাম’। ]
বিশ্বের নারী সমাজের প্রতি অন্তিম আবেদন
বাংলার নারীদের বাঁচান
[এম.এ জলিল (বার্তা সম্পাদক) পরিবেশিত]
.
যশোহর ১০ই জুলাইঃ-
বাংলাদেশে পাক সেনার অধিকৃত অঞ্চলসমূহে প্রতিদিন কামান্ধ তথাকথিত ইসলামভক্ত পাকিস্তানী হানাদাররা অবলা নিস্কলঙ্কিনী মা-বোনদের উপর সীমাহীন পাশবিক আচরণ ও অকথ্য নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। তারই একটি উজ্জ্বল স্বাক্ষর বহন করছে এই বধুটি। একমাত্র সন্তানের জননী এই বধু। (নগ্নাবস্থার জন্য তার পরিচয় দেয়া হল না। ) ঘর-বাড়ী তাদের বহু পূর্বেই পাক সদস্যরা ধ্বংস করে দেয়ায় গ্রামের অন্যান্যদের সাথে তার পরিবারও আশ্রয় নিয়েছিলেন একটি স্কুলগৃহে। খাবার সংস্থানও নেই। সারাদিন অনাহারে থেকে বহু কষ্টে ৬ মাসের শিশুর জন্য একটু দুধ সংগ্রহ করে খড়কুটো দিয়ে গরম করেছিলেন তিনি। ক্ষিধেয় কাতর তার একমাত্র নয়নমনি আকাশফাটা চিৎকার করছিল। তাড়াতাড়ি দুধটুকু গরম করতে তিনি ব্যস্ত। হঠাৎ কান্না-কাটির শোরগোলে তার সংগৃহীত দুধটুকু ছলকে পড়ে যায়। দু’গাড়ী পাক পশু ঢুকে পড়ে ঘরে। যুবতী মেয়েদের রেখে বাকীগুলোকে ঘর থেকে বের করে দেয় তারা। তারপর শুরু করে অকথ্য অত্যাচার। বর্বরেরা বলপূর্বক টেনে হিচড়ে তার দুগ্ধপোষ্য শিশুকে ছুড়ে ফেলে দেয় ঘরের বাইরে। চীৎকার করে কেঁদে উঠতেই বেয়নেটের এক খোচায় চির নিদ্রায় ঘুম পাড়িয়ে দিল অবোধ শিশুকে। উন্মাদিনী মাতা সন্তানের কাছে ছুটে যেতে বাধা পেলেন। তিনি তখন এক পশুর বাহুবন্ধনে আবদ্ধ। ইজ্জত বাঁচানোর তাগিদে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করলেন তিনি তার সুতীক্ষন দন্তরাশি। কামড়ে ধরলেন পশুটির একটি হাত। যন্ত্রণায় কাতর হয়ে হাত সরিয়ে নিল বর্বরটি। এই সুযোগে দৌড়ে বেড়িয়ে গেলেন তিনি। শিকার পালিয়ে যাওয়ায় যন্ত্রণার কথা ভুলে গিয়ে কামোন্মাদ পশু ঝাপিয়ে পড়ল শিকার ধরতে। সহকর্মীর শিকার ধরতে এগিয়ে এল আরও ৮ জন পাক দস্যু। ব্যর্থ হল নিষ্পাপ রমনীর ইজ্জত বাঁচানো। পশু শক্তির কাছে হেরে গেলেন তিনি। শুরু হল অকথ্য অত্যাচার ও ধর্ষণ। ৯ জন পশুর অত্যাচারে শোণিত ধারা বয়ে চললো-জ্ঞান হারালেন তিনি।
.
ঘন্টা দুয়েক পর বর্বরেরা চলে গেলে লুক্কায়িত দুজন ব্যক্তি ছুটে এল সেখানে। একজন ডাক্তারের আপ্রাণ চেষ্টাতে তার জ্ঞান ফিরে এলো ক্ষণিকের জন্য। নির্দোষ খোকনের কথা স্মরণ করে হত্যাকারীদের বিচার প্রার্থনা করে আই. এ. পাশ এই বধু তথা নারীকল্যান সমিতির সম্পাদিকা বিশ্বের নারী সমাজের কাছে রেখে গেলেন তার জীবনের শেষ আকুল আবেদন- ‘হে বাংলার নারী তোমরা বিশ্ব বিবেক জাগ্রত কর, বর্বর পাক-দস্যুদের হাত থেকে লক্ষ লক্ষ মা-বোনদের প্রাণ ও ইজ্জত রক্ষা কর আমার-তোমার দেশমাতৃকাকে। চোখ মুদে এল তার। নিমিষে সব কিছু শেষ হয়ে গেল। সমস্ত গ্রাম জুড়ে নেমে এল শোকের ছায়া। বর্বরদের ভয়ে জনশূন্য হয়ে গেল গ্রামটি। সৎকারের অভাবে তার দেহ হয়তো এখন শৃগাল কুকুরের উদর পূর্তিতে পরিণত হয়েছে।
.
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
<৬,৮৭,১৩৭>
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্র ঃ ষষ্ঠ খন্ড
শিরোনাম | সংবাদ পত্র | তারিখ |
সম্পাদকীয়
ইহাহিয়া চক্রান্তের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করুন |
মুক্তিযুদ্ধ
১ম বর্ষ ঃ ২য় সংখ্যা |
১৮ জুলাই ১৯৭১ |
সম্পাদকীয়
ইয়াহিয়া চক্রের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করুন
.
বাংলাদেশের জনগণ যখনই কোন অধিকারের জন্য সংগ্রাম করিয়াছেন, তখনিই পাকিস্তানের গণদুশমন শাসকবৃন্দ জনগণের উপর তীব্র দমননীতির সঙ্গে সঙ্গে কতকগুলি সাম্প্রদায়িক জিগির তুলিয়া গনমনে নানা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করিতে চেষ্টা কনিয়াছে।১৯৫২ সালে গৌরবময় গণ সংগ্রামের সময়ে গণ-বিরোধী সরকার একদিকে যেমন ঢাকার রাজপথ বরকত সালাম প্রমুখদের রক্তে রঞ্জিত করিয়াছিল তেমনি অন্যদিকে ঐ সংগ্রাম পাকিস্তান ভাঙ্গার জন্য হিন্দুদের কারসাজি, সীমানার অপর পার হতে উসকানির ফল প্রভৃতির জিগির তুলিয় গণমনে নানা সংশয় ও সন্দেহ সৃষ্টি করিতেও প্রয়াশ পাইয়াছিল।
.
১৯৫৪ সালে যখন বাংলাদেশের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের হাতে শাসক মুসলিম লীগের শোচনীয় পরাজয় ঘটিয়াছিল, ১৯৬২ সনে যখন ছাত্র সমাজের মৃত্যু-ভয়হীন সংগ্রামে শৈরাচারী আয়ুবশাহীর ভিত কাঁপিয়া উঠিয়াছিল, ১৯৬৬ সনে যখন আওআমিলীগের ৬ দফা সংগ্রামে ঢাকা নারায়নগঞ্জের হাজার হাজার শ্রমিক ও শহরের গরীব বুক ফুলাইয়া সশস্ত্র পুলিশের বিরুদ্ধে রুখিয়া দাড়াইয়াছিল, ১৯৬৮-১৯৬৯ সনে যখন বাংলাদেশ ও পশ্চিম পাকিস্তানে সম্মিলিত গণ-অভ্যুথানে লৌহমানব আয়ুবখান ধরাশায়ী হইয়াছিল এবং শ্রমিক কৃষকদের অনেক সংগ্রামের সময়েও গণবিরোধী শাসকগোষ্ঠী জনগণের উপর বিভেদ সৃষ্টির জন্য শাসকগোষ্ঠী সময়ে সময়ে হিন্দু মুসলমান সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাও বাধাইয়াছিল।
.
বস্তুতঃ বাংলাদেশের জনগণকে পায়ের তলায় রাখার জন্য শাসকগোষ্ঠী গত ২ বছর ধরিয়াই জনগণের বিরুদ্ধে প্রচন্ড দমননীতি ও ভারত বিরোধী জিগির তথা সাম্প্রদায়িক বিভেদনীতি- এই দুটি মোক্ষম অস্ত্র প্রয়োগ করিয়া আসিয়াছে।
.
মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য আমাদের বর্তমান মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধেও শয়তানের দোসর ইয়াহিয়া চক্র ঐ অস্ত্রগুলি প্রয়োগ করিতেছে। ২৫ মার্চ মধ্যরাত হতে ঐ হিংস্র পশুর দল বাংলাদেশে নজিরবিহীন গণহত্যা, ব্যাপক নারী ধর্ষন প্রভৃতি নারকীয় কার্যক্রম অনুষ্ঠানের সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করিতে শুরু করিয়াছে যে, ভারত হইতে অনুপ্রবেশকারী দুস্কৃতিকারীরাই নাকি বাংলাদেশে গোলমাল বাধাইয়াছে।
.
বাংলাদেশের জনগণ প্রত্যক্ষভাবে দখিতেছেন ও বুঝিতেঝছন যে, বিদ্রোহী ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ই,পি,আর প্রভৃতির লোকজন এবং এইদেশের বহু তরুনদের নিয়াই গঠিত হইয়াছে আজিকার মুক্তিফৌজ। বাংলাদেশের মাটি হইতেই জন্ম নিয়াছে মুক্তিফৌজ।এই মুক্তিফৌজই আজ গণ-সমর্থন নিয়া ইহাহিয়া-চক্রের দস্যু বাহিনীর বিরুদ্ধে দেশের স্বাধীনতার অসম সাহসিক সংগ্রাম চালাইতেছেন।বাংলাদেশের স্বাধীনতার এই সংগ্রাম হইল এই দেশের জনগণের সংগ্রাম।
[মুক্তিযুদ্ধঃ সাপ্তাহিক। পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশের) কমিউনিষ্ট পার্টির মুখপাত্র পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশের) কমিউনিষ্ট পার্টি কর্তৃক প্রকাশিত ও মুক্তিযুদ্ধ প্রেশ বাংলাদেশ হইতে মুদ্রিত।]
.
কিন্তু দুনিয়ার চোখে আমাদের এই মহান ও ন্যায্য সংগ্রামকে কলঙ্কিত করার জন্য ইহাহিয়া-চক্র আজ মুক্তিফৌজকে ভারত হইতে অনুপ্রবেশকারী এবং স্বাধীনতার গণ-সংগ্রামকে ‘ভারতের হস্তক্ষেপ’ বলে চিত্রিত করার চেষ্টা করিতেছে।
.
ইহা ছাড়াও ঐ পশুর দল, যাহারা হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে জনগণকে হত্যা করিয়াছে, ধর্ম নির্বিশেষে অগনিত নারীর ইজ্জত হানি করিয়াছে, তাহারা জনগণের মুক্তির সংগ্রামের ভিতর সাম্প্রদায়িক বিষ সৃষ্টির জন্য গুন্ডা বদমায়েশদের জমায়েত করিয়া উহাদের দ্বারা কতকগুলি স্থান বাছিয়া বাছিয়া নিরীহ হিন্দুদের ঘরবাড়ি লুট করাইতেছে ও তাহাদের দেশ ছাড়া করিতেছে।ঐ দস্যুর দল তাহাদের পোষা গুন্ডাশ্রেনীর অবাঙ্গালীদের-বাঙ্গালীদের বিরুদ্ধেও লেলাইয়া দিতেছ, যাহাতে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ অবাঙ্গালী সংঘর্ষের খাতে চলিয়া যায়।
.
আগামী দিনে মুক্তিযুদ্ধ যখন আরো দুর্বার হইয়া উঠিবে, মুক্তিফৌজের মারের চোটে হানাদার বাহিনী যখন পরাজয়ের পর পরাজয় বরণ করিবে তখন ইহাহিয়া-চক্রের ঐসব ষড়যন্ত্র আরো বৃদ্ধি পাইবে।তাহারা আরো তারস্বরে ভারতের হস্তক্ষেপ বলিয়া চিৎকার করিতে থাকিবে এবং সাম্প্রদায়িক ও জাতিগত উত্তেজনা সৃষ্টিতে আরো বেশি করিয়া তৎপর হইবে। এমনও হতে পারে যে, মুক্তিফৌজের ও জনগণের হাতে ভরাডুবি আসন্ন দেখিয়া দস্যু ইহাহিয়া-চক্র ভারতের সশস্ত্র আক্রমনের এক মিথ্যা কাহিনী বানাইয়া পাক ভারত সংঘর্ষ বাধাইয়া গণ-মনে প্রবল বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার প্রয়াসী হইতে পারে।
.
বাংলাদেশের জনগণকে আজ বিদেশী ও দেশি প্রতিক্রিয়াশীলদের এসব চক্রান্ত সম্পর্কে হুশিয়ার হইতে হইবে।অতীতে গণবিরোধী শাসকগোষ্ঠী সাম্প্রদায়িক ও জাতিগত বিরোধে এবং পাক ভারত উত্তেজনা সৃষ্টি ও উসকানি সত্তেও বাংলাদেশের জনগণ ঐক্যবদ্ধভাবে নিজেদের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম চালাইয়া গিয়াছেন। মুক্তিযুদ্ধের জনগণ অপূর্ব একতার পরিচয় দিয়াছেন।তাই আমরা দৃড়ভাবে বিশ্বাস করি যে, ইহাহিয়া-চক্র মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধ বিনষ্ট করার জন্য যে সাম্প্রদায়িক ও জাতিগত হানাহানি এবং পাক ভারত সংঘর্ষ বাধাইবার জুয়াখেলায় মাতিয়াছে বাংলাদেশের জনগণ তাহাতে বিভ্রান্ত হইবেনা। আমরা বিশ্বাস করি যে, সাম্রাজ্যবাদীদের সহযোগী ইয়াহিয়া চক্র যত শয়তানীই করুক, জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে বাংলাদেশের শ্রমিক কৃষক ছাত্র জনতা মুক্তিযুদ্ধে তাহাদের অটুট একতা রক্ষা করিবেন এবং দস্যুদলের সমস্ত চক্রান্ত ব্যর্থ করিয়া মুক্তিযুদ্ধকে জয়ী করিবেন।
—————-
.
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
<৬,৮৮,১৩৯>
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্র ঃ ষষ্ঠ খন্ড
শিরোনাম | সংবাদ পত্র | তারিখ |
সম্পাদকীয়
মুক্তিসংগ্রামের বিজয়ের স্বার্থে |
স্বাধীনবাংলা
১ম বর্ষ: ৩য় সংখ্যা |
২৫ জুলাই ১৯৭১ |
সম্পাদকীয়
মুক্তিসংগ্রামের বিজয়ের স্বার্থে
বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের চার মাস পূর্ণ হইল।চব্বিশ ঘন্টা, আটচল্লিশ ঘন্টা বা এক সপ্তাহের মধ্যে বাংলাদেশকে পদানত করা সম্ভব হইবে, এই হিসাব নিয়া যাহারা বাংলাদেশের সামরিক অভিযান শুরু করিয়াছিল ইসলামাবাদের সেই জঙ্গী শাসকদের মুখে ছাই দিয়া গণপ্রজাতন্ত্রী বালাদেশ দৃঢপণ লড়াই চালাইয়া যাইতেছে এবং শত্রুর বিরুদ্ধে একের পর এক গৌরবময় বিজয় অর্জন করিয়া চলিয়াছে।বাংলাদেশের জনগণ স্বাধীনতার দাবীতে ঐক্যবদ্ধ ও আপোষহীন এবং লক্ষ্য অর্জনের জন্য যে কোন ত্যাগ স্বীকার করার জন্য প্রস্তুত।ইহাহিয়ার দস্যুবাহিনীর অবর্নণীয় অত্যাচার ও নৃশংস গণহত্যা স্বত্বেও দেশবাসীর মনোবল অটুট রহিয়াছে- অত্যাচার উৎপীড়ন শত্রুর বিরুদ্ধে ঘৃনা ও প্রতিরোধের সংকল্পকে আরো সুদৃঢ় করিতেছে মাত্র। পক্ষান্তরে ইহাহিয়া দস্যুদলের সামনে খুন ও লুন্ঠন ছাড়া কোন উদ্দেশ্য নাই- ইহাদের শৃঙ্খলা ও মনোবল একেবারে ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে এবং শোচনীয় পরাজয় অবধারিত হইয়া উঠিয়াছে।প্রতিটি রণাঙ্গনে মুক্তিফৌজের হাতে মার খাইয়া ইহারা দিশাহারা হইয়া পালাইবার পথ পাইতেছেনা।আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রবর্গ, বিশ্ব কমিউনিষ্ট আন্দোলন এবং দুনিয়ার অন্যান্য গনতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল শক্তি বাংলাদেশের সমর্থনে ক্রমেই অধিক হইতে অধিকতর সোচ্চার ও সক্রিয় হিইয়া উঠিতেছে।
.
কিন্তু ইহা সত্তেও বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সামনে কোন সমস্যা নাই একথা বলা আত্মসন্তুষ্টি ও আত্মপ্রবঞ্চনার নামান্তর হইবে।এই সমস্যাগুলিকে গভীরভাবে উপলব্ধি করা এবং উহাদের সমাধানের জন্য বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়া একান্ত জরুরী। সমস্যাগুলিকে উপেক্ষা করিয়া নয়, উহাদের যথাযধ সমাধানের মাধ্যমেই মুক্তিসংগ্রামকে দ্রুত চুড়ান্ত ও নিশ্চিত সাফল্যের পথে অগ্রসর করিয়া লওয়া সম্ভব।
.
বাংলাদেশের সংগ্রামী শক্তিগুলির সমবায়ে জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গঠিত না হওয়ার দরুন যুদ্ধপ্রয়াসে যেসব বিঘ্ন সৃষ্টি হইতেছে, সে সম্পর্কে ইতিপূর্বে মুক্তিযুদ্ধে সংক্ষিপ্তভাবে আলোচনা করা হইয়াছে।
.
মুক্তিফ্রন্ট গঠিত না হওয়া পর্যন্ত সাময়িক ব্যবস্থা হিসেবে আওআমিলীগ দলীয় পরিষদ সদস্যবর্গ ছাড়াও যাহাতে অন্যান্য সংগ্রামী দলের দায়িত্যশীল কর্মকর্তাদের সুপারিশ পত্র লইয়া মুক্তিফৌজে যোগ দেওয়া যায় উহার ব্যবস্থা অবিলম্বে করা দরকার। দ্বিতীয়তঃ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গোপন সংগ্রাম কমিটিগুলো যাহাতে সকল সংগ্রামীদলের প্রতিনিধিদের লইয়া ঐক্যবদ্ধ সংগঠন হিসেবে গড়িয়া উঠিতে পারে সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা অবলম্বন করা দরকার।
.
বাংলাদেশের যে হাজার হাজার ছাত্র যুবক মুক্তিবাহিণীতে যোগদানের উদ্দেশ্যে আগাইয়া আসিতেছে তাহাদের ট্রেনিংয়ের সুযোগ সুবিধা আরও উন্নত ও সম্প্রসারিত করিতে হইবে এবং রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত কারণে কাহারো বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক আচরন করা চলিবেনা।
.
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা ইহাহিয়া চক্রকে অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে সাহায্য করার যে নির্লজ্জ নীতি অনুসরন করিয়া চলিয়াছে উহার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকারের বৈদেশিক নীতির পূর্ণমূল্যায়ন আবশ্যক। মানবতার নামে আবেদন জানাইয়া মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের হৃদয় পরিবর্তন করা যাইবে এইরুপ চিন্তা বাংলাদেশ সরকার কিংবা গণতান্ত্রিক শিবিরের কোন অংশে এখনও থাকিয়া থাকিলে অভিলম্বে উহা দুর করা দরকার।মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শুধু অস্ত্র সরবরাহই নয়, প্রযয়াজন হইলে ভিয়েতনামের এই খুনি যে বাংলাদেশে গণহত্যাকারীদের স্বপক্ষে অস্ত্র ধারন করিতেও দ্বিধা করিবেনা উহার ইঙ্গিত ইহাহিয়া খানের সাম্প্রতিক হুমকিতেও স্পষ্ট।পক্ষান্তরে বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী শক্তিবর্গ বাংলাদেশের সমর্থনে উত্তর উত্তর আগাইয়া আসিতেছেন এই পটভূমিকায় বাংলাদেশ সরকারের বৈদেশিক ণীতিকেও ঢালিয়া সাজাইতে হইবে এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের হৃদয় পরিবর্তনের চেষ্টার পরিবর্তে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী শক্তিগুলিকে বাংলাদেশের স্বপক্ষে আরো সক্রিয়ভাবে টানিয়া আনার জন্য সচেষ্ট হইতে হইবে।
————
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
<৬,৮৯,১৪১>
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্র ঃ ষষ্ঠ খন্ড
শিরোনাম | সংবাদ পত্র | তারিখ |
সামরিক আদালতে মুজিবের বিচার | স্বাধীন বাংলা
১ম বর্ষঃ ৩য় সংখ্যা |
২৫ জুলাই ১৯৭১ |
সামরিক আদালতে মুজিবের ’বিচার’
অভিযোগ প্রমাণিত হইলে মৃত্যুদন্ড পর্যন্ত দেওয়া যাইতে পারে- ইহাহিয়া (বিশেষ প্রতিনিধি)
.
ইসলামাবাদের সামরিক চক্র কর্তৃক গণপ্রজাতনন্ত্রী সরকারের প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের সামরিক আদালতে বিচারের চক্রান্ত দেশবাসি ও রাজনৈতিক মহলে তীব্র ক্ষোভ ও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করিয়াছে। সকল মহল ইহাকে বে-আইনি ইসলামাবাদ গোষ্ঠীর অধিকার বহির্ভুত এবং বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আরেকটি ষড়যন্ত্রমূলক কার্য বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন।উল্লেখযোগ্য যে, শেখ মুজিব বর্তমানে ইহাহিয়ার হাতে বন্দী।
.
বিবিসি প্রচারিত এক খবরে ফাইনান্সিয়াল টাইম পত্রিকার সংবাদের বরাত দিয়া বলা হয় যে, ইহাহিয়া উক্ত পত্রিকার প্রতিনিধিদের জানাইয়াছে যে, শীঘ্রই শেখ মুজিবুর রহমানকে বিচারের জন্য সোপর্দ করা হইবে। এই বিচার সামরিক আদালতে গোপনে অনুষ্ঠিত হবে।ইহাহিয়া নাকি আরো বলে যে, শেখ সাহেবের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনয়ন করা হইয়াছে উহা প্রমাণিত হইলে মৃত্যুদন্ড পর্যন্ত দেওয়া যাইতে পারে।
.
সৈয়দ নজরুল ইসলাম
বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান এবং ভারত, চীন, বৃটেন, কানাডা, অষ্ট্রেলিয়া প্রভৃতি প্রধানমন্ত্রীদের কাছে শেখ মুজিবের নিরাপত্তা ও মুক্তির ব্যাপারে হস্তক্ষেপের জন্য আবেদন জানাইয়া তারবার্তা প্রেরণ করিয়াছেন।
.
কমিউনিষ্ট পার্টি ও ন্যাপের নেতৃবৃন্দ ইহাহিয়া গোষ্ঠীর এই সিদ্ধান্তের নিন্দা করিয়া বলেন যে, ইহা তো বিচার নয়, বিচারের প্রহসন করিয়া শেখ মুজিবকে হত্যার ষড়যন্ত্র মাত্র।তাহারা বলেন ইয়াহিয়ার এই চক্রান্তও তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ন্যায় একই পরিনতি লাভ করিবে।
.
কমিউনিষ্ট পার্টির জনৈক মুখপাত্র বলেন শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার করার কোন অধিকার ইহাহিয়ার চক্রের নাই।
.
উল্লেখ্য যে, কমিউনিষ্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির এক সভায় শেখ মুজিবুর রহমানের বিনাশর্তে মুক্তি দাবি করা হয়।
.
আমাদের নিজস্ব বার্তা প্রতিবেদক জানানঃ
শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যদানের জন্য সামরিক বাহিনীর গোয়েন্দারা ঢাকার সাংবাদিকদিগকে পীড়ন করিতেছেন। বিভিন্ন পত্রিকার বার্তা সম্পাদক, বার্তা পরিবেশক, আলোকচিত্র শিল্পী প্রভৃতিকে ক্যান্টনমেন্টে নিয়া গিয়া শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগের বিবৃতিতে স্বাক্ষর আদায় করা হইতেছে। কতকগুলি দালাল সংবাদপত্র এ ব্যাপারে সোৎসাহে সহযোগিতাও করিতেছে।
—————–
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
<৬,৯০,১৪২>
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্র ঃ ষষ্ঠ খন্ড
শিরোনাম | সংবাদ পত্র | তারিখ |
সম্পাদকীয়
সংগ্রামী দেশবাসির প্রতি |
স্বাধীন বাংলা
১ম বর্ষ ঃ ৪র্থ সংখ্যা |
০১ আগষ্ট ১৯৭১ |
.
সম্পাদকীয়
.
সংগ্রামী দেশবাসির প্রতি
.
বালাদেশের বীর জনগণকে মুক্তিসংগ্রামের একনিষ্ট হিসেবে কমিউনিষ্ট পার্টি জানায় বিপ্লবী অভিনন্দন। দেশপ্রেমের অগ্নিপরিক্ষায় সগৌরবে উত্তির্ণ জনগণের ঐক্য, সাহস ও সংগ্রামী মনোবল বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগামের সবচেয়ে বড় শক্তি।জনগনের বিজয় অবসস্ভাবী, জনগনের ঐক্যবদ্ধ শক্তি অপরাজেয়- এই দৃঢ় প্রত্যয় লইয়াই কমিউনিষ্ট পার্টি অন্যান্য গনতান্ত্রিক শক্তির সহিত কাধে কাধ মিলাইয়া বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে অংশগ্রহন করিতেছে।
.
দস্যু সর্দার ইয়াহিয়া খানের জল্লাদ বাহিনী গত চারমাস ধরিয়া বাংলাদেশে যে গণহত্যা ও পৈশাচিক বর্বরতা চালাইয়া আসিতেছে ইতিহাসে উহার নজির সত্যিই বিরল।ইতিহাসে আমরা বহু অত্যাচার উৎপীড়নের কাহিণী পড়িয়াছি কিন্তু একটা নিরস্ত্র জাতিকে পৃথিবীর বুক হইতে নিশ্চিহ্ন করিয়া দেবার এই দানবীয় প্রচেষ্টার দৃষ্টান্ত কদাচিৎ দেখা যায়। কিন্তু ইহাহিয়া বাহিনীর অত্যাচারের যেমন তুলনা নাই, তেমনি বাংলাদেশের গণ-জাগরণও অতুলনীয়।স্বাধীনতার দাবিতে এরূপ একতার দৃষ্টান্ত ইতিহাসে বিরল।মুক্তিসংগ্রামের শুরু হইতেই শতকরা একশজনই স্বাধিনতা সংগ্রামের সপক্ষে- প্রতিটি দেশবাসিই স্বাধীনতার সৈনিক। ১৯৪৭ সালে বৃটিশ সরকার এদেশের জনগণের মধ্য হইতে যতটা বিচ্ছিন্ন ছিল, ইহাহিয়া শাহী আজ বাংলাদেশের সকল শ্রেণী, সকল স্তর হইতে ততোধিক বিচ্ছিন্ন।
.
স্বাধীনতার দাবীতে জনগনের সুদৃঢ় ঐক্যর দরুনই ইহাহিয়া শাহী বিপুল নৈ-সামন্ত ও আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র সত্ত্বেও বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে দমন করিতে পারিতেছেনা।ইহাহিয়া বাহিনীর শত অত্যাচারও জনগণের মনোবলকে ভাঙ্গিতে পারেনাই।বরং দস্যুবাহিনীর অত্যাচার ও উৎপীড়ন ইসলামাবাদের জঙ্গী শাসকগোষ্ঠীর প্রতি বাংলাদেশের জনগণের ঘৃনাকে তীব্রতর করিতেছে, তাহাদের সংকল্পকে আরো দৃঢ় করিতেছে। জাতীয় মুক্তির এই সংগামের বিজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ উন্মুক্ত হইবে এই আশা নিয়াই দেশবাসী এই মরণপণ যুদ্ধে ঝাপাইয়া পড়িয়াছেন। ইয়াহিয়া চক্র নৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে আগেই পরাজিত হইয়াছে, সামরিক ক্ষেত্রেও উহাদের পরাজয় অবধারিত হইয়া উঠিয়াছে।
.
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অবস্যম্ভাবী বিজয়ের দৃঢ় আস্থা লইয়া সেই বিজয়কে ত্বরান্বিত করার উদ্দেশ্যে কমিউনিষ্ট পার্টি দেশবাসীর কাছে কয়েকটি আবেদন রাখিতেছেঃ
১।বাংলাদেশের প্রতিটি শহর-বন্দর, গ্রাম-গঞ্জ, প্রতিটি গৃহকে শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধের দুর্ভেদ্য দূর্গ হিসেবে গড়িয়া তুলুন।
২।জনগনের শক্তিকে সংগঠিত করুন। মনে রাখিবেন পূর্বে আমাদের আন্দোলন ছিল নিয়মতান্ত্রিক ধরনের- উহাতে স্বতঃস্ফুর্ততার উপাদান ছিল অধিক। বর্তমান সশস্ত্র শত্রুর বিরুদ্ধে সংগামে জয়লাভের জন্য স্বতঃস্ফুর্ততাকে পরিহার করিয়া জনশক্তিকে সংঘবদ্ধরূপে গড়িয়া তুলিতে হইবে।
৩।ছাত্র যুবক ও শ্রমিকদের পাশাপাশি কৃষক ভাইয়েরাও আরো বেশি সংখ্যায় স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহন করুন।মনে রাখিবেন আমাদের দেশের শতকরা ৮০ জন কৃষিজীবি, কাজে কৃষক সমাজ কত অধিক সংখ্যায় ও কতটা সংগঠিতভাবে অংসগ্রহন করেন উহার উপর অনেকাংশে নির্ভর করে কত শীঘ্র স্বাধীনতার সংগ্রাম সাফল্যজনক পরিসমাপ্তিতে পৌছিবে।
৪।বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীতে হাজারে হাজারে, লাখে লাখে যোগ দিন। নানা অসুবিধা ও কষ্ট সত্ত্বেও মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়ে শত্রুর নৃশংস অত্যাচারের প্রতিশোধ দিন, আমাদের সকলের প্রানের চেয়ে প্রিয় মাতৃভূমিকে শত্রুর কবল হইতে মুক্ত করুন।
৫। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে বানচাল করার জন্য ইহাহিয়া চক্র ও উহার অনুচরেরা হিন্দু –মুসলিম, বাঙ্গালী- অবাঙ্গালী প্রভৃতির মধ্যে বিরোধ ও বিভেদ উসকাইয়া সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা বাধাইতেছে। ইহার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়িয়া তুলুন ও সাম্প্রদায়িক শান্তি বজায় রাখুন।
৬।স্থানীয়ভাবে মুক্তি দংগ্রাম পরিচালনা ও মুক্তিযোদ্ধাদের সহিত সহযোগিতার উদ্দেশ্য দলমত নির্বিশেষে সংগ্রামী কর্মীদের নিয়া গোপন মুক্তি সংগ্রাম কমিটি গড়িয়া তুলুন।দুস্কৃতিকারী ও সমাজবিরোধীদের দমন করুন ও মুক্তিসংগ্রাম কমিটির নেতৃত্বে গ্রামরক্ষা বাহিনী গড়িয়া তুলুন। চোরাকারবার ও মুনাফাখোরী দমন করুন।
৭। শত্রুবাহিনীর সহিত সর্বপ্রকার অসহযোগিতা করুন এবং উহাদের অবস্থান ও চলাচলের খবর মুক্তিবাহিনীর নিকট পৌছাইয়া দিন। মুক্তিবাহিনীর খবর গোপন রাখুন।মুক্তিযোদ্ধাদিগকে আশ্রয়, রশদ প্রভৃতি দিয়া সহায়তা করুন। মনে রাখিবেন মুক্তিযোদ্ধারা আপনাদেরই সন্তান, দেশমাতৃকাকে শত্রুর কবল হইতে মুক্ত করার জন্য তাহারা প্রাণের মায়া তুচ্ছ করি লড়াই করিতেছে।
.
বিজয় আমদের অবশ্যম্ভাবী। স্বাধীনতার অগ্নিমন্ত্রে উদ্ধুদ্ধ বাংলাদেশের বীর জনগণের সংগ্রামকে চূর্ন করিয়া দিতে পারে পৃথিবীতে এমন কোন শক্তি নাই।
.
স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।
.
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
<৬,৯১,১৪৪-১৪৫>
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্র ঃ ষষ্ঠ খন্ড
শিরোনাম | সংবাদ পত্র | তারিখ |
ইহাহিয়াচক্রকে মদত দেয়ার জন্য জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক দল ও মার্কিন ”বিশেষজ্ঞ” | স্বাধীন বাংলা
১ম বর্ষঃ ৪র্থ সংখ্যা |
০১ আগষ্ট ১৯৭১ |
ইয়াহিয়া চক্রকে মদত দেয়ার জন্য জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক দল ও মার্কিন ”বিশেষঞ্জ”
(বিশেষ প্রতিনিধি)
.
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা কি বাংলাদেশকে ভিয়েতনামে রূপান্তরিত করার ষড়যন্ত্র আঁটিয়াছেন? এই অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক প্রশ্নটি আজ সকলের মনকে আলোড়িত করিতেছে। নির্ভরযোগ্য সুত্রে জানা গিয়াছে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা “জননিরাপত্তামূলক” কর্মসূচির নামে ঢাকায় পুলিশ বিশেষজ্ঞ পাঠাইবার সিদ্ধান্ত নিয়াছে। জননিরাপত্তার নামে এই বিশেষজ্ঞ ও তার শিকারী কুকুরের দলের কাজ হইবে, মুক্তিযুদ্ধ দমনের কাজে ইহাহিয়ার জল্লাদ বাহিনীকে মদত দেওয়া। এই দায়িত্ব দিয়া যে কুটনীতিকে ঢাকায় পাঠানো হইতেছে, এই ধরনের কাজে তাহার নাকি বিশেষ পারদর্শিতা ও পূর্ব অভিজ্ঞতা রহিয়াছে। খবরে প্রকাশ, ইতিপূর্বে এই ব্যাক্তি ভিয়েতনামে নিযুক্ত ছিল এবং সেখানেই সে হাত পাকায়।পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড একজন কুখ্যাত সিআইএ এজেন্ট। একসময় তিনিও কূটনৈতিক কাজে ভিয়েতনামে ছিলেন। কাজেই পুলিশ বিশেষজ্ঞ হিসাবে রবার্ট জ্যাকসন রাষ্ট্রদুত ফারল্যান্ড এর সহিত যোগদান করিলে একেবারে সোনায় সোহাগা হইবে, তবে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের খেলার এইখানেই শেষ নয়, মাত্র শুরু। ভিয়েতনামেও তারা এইভাবে সৈন্যদল পাঠানোর আগে নগো-দিন-দিয়েম চক্রকে মদত দেবার জন্য পুলিশ বিশেষজ্ঞ পাঠাইয়াছিল। বাংলাদেশে ভিয়েতনামের সেই খেলার পুনরাবৃত্তি হইতে চলিয়াছে মাত্র।
.
বাংলাদেশ সিমান্তে জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞ বসাইবার যে পরিকল্পনা কার্যকর হইতে যাইতেছে উহার পিছনেও রহিয়াছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের নোংরা হাত।বাংলাদেশে ইহাহিয়ার জল্লাদ বাহিনীর হাতে দশ লক্ষ নারী প্রাণ দিল, মানবাধীকারের পবিত্র সনদ রক্তের বন্যায় ভাসিয়া গেল, জাতিসংঘ টু শব্ধটি পর্যন্ত করিল না।হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে পৈানে এক কোটি শরণার্থী ভারতে আশ্রয় গ্রহন করিয়াছে- জাতিসংঘ তাহাদের রিলিফের দায়িত্ব গ্রহন না করিয়া বিশ্ববাসীর উদ্দেশ্যে একটি আবেদন জানাইয়া বিবেক পরিষ্কার করিয়াছে, অবশেষে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের “গুড বয়” সদরুদ্দিন আগা খান দাওয়াই আবিষ্কার করিয়াছে, ভারত বাংলাদেশ সিমান্তে জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক বসাইতে রাজি না হওয়ায় এখন বাংলাদেশের এলাকায় পর্যবেক্ষক বসাইবার পায়তারা চলিতেছে। কিন্তু বাংলাদেশের সরকারও দ্ব্যার্থহীন ভাষায় এই উদ্দ্যোগের বিরোধীতা করিয়াছে।
.
জাতিসংঘ কর্মকর্তাদের জানিয়া রাখা দরকার যে, বাংলাদেশ সরকারের বিনা অনুমতিতে বাংলাদেশের এলাকায় পর্যবেক্ষক নিয়োগের কোন অধীকার তাহাদের নাই এবং ইহা দ্বারা জটিলতা বৃদ্ধি ছাড়া সমস্যা সমাধানের কোনই সম্ভাবনা নাই। এই মূহুর্তে জাতিসংঘের যা করনীয় তাহা হইল, বাংলাদেশ হইতে দখলকারী বাহিনী সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাহার করার জন্য ইয়াহিয়া সরকারকে চাপ দেওয়া। উহা না করিয়া জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক বসাইলে বাংলাদেশে স্বাভাবিক অবস্থা বা আস্থা ফিরিয়া আসিবে, করিয়া জাতিসংঘ জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক বসাইলেই বাংলাদেশে স্বাভাবিক অবস্থা বা জনমনে আস্থা ফিরিয়া আসিবে, বাস্তুত্যাগ বন্ধ হইবে এবং ভারতে আশ্রয়-প্রার্থীরা প্রত্যাবর্তন করিবে ইহা আশা করা মূর্খতা ছাড়া কিছুই নয়। দুঃখের বিষয়, জাতিসংঘ জানিয়া শুনিয়া বোকা সাজিতেছে এবং বাংলাদেশের গণমানুষের স্বাধীনতার আকাঙ্খা ও ইয়াহিয়া বাহিনীর গণহত্যা ও নৃশংস অত্যাচারকে পাশ কাটাইয়া গিয়া বাংলাদেশ প্রশ্নকে পাক- ভারত বিরোধ হিসাবে চিহ্নিত করার প্রয়াস পাইতেছে।
.
বাংলাদেশের সংগ্রামী মানুষ বাংলাদেশকে দ্বিতীয় ভিয়েতনামে পরিণত করা কিংবা বাংলাদেশের মুক্তি-সংগ্রামকে পাক- ভারত বিরোধ হিসাবে চিহ্নিত করার ন্যাক্কার জনক ষড়যন্ত্রকে দৃঢ়ভাবে প্রতিহত করিবেন। একথা সকলের পরিষ্কারভাবে জানিয়া রাখা দরকার যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কিছুতেই পাক- ভারত বিরোধের পর্যায়ে ফেলা চলেনা এবং যেকোন মহলের যেকোন অযুহাতেই ইয়াহিয়া চক্রকে মদত দেওয়া বাংলাদেশের জনগণ বরদাস্ত করিবেনা। এই প্রসঙ্গে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের উদ্দ্যেশ্যে আমরা হুশিয়ারী উচ্চারন করিতে চাই যে, বাংলাদেশের জননিরাপত্তার নামে শিকারী কুকুরের দল পাঠানো হইলে উহাদিগকে কুকুরের মতই বিতাড়িত করা হইবে। বাংলাদেশে দ্বিতীয় ভিয়েতনাম সৃষ্টির ষড়যন্ত্র ভিয়েতনামের মত বাংলার মাটিতেও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কবর রচনা করিব- ইতিহাসের ইহাই আমোঘ বিধান।
————————
.
.
দীপংকর ঘোষ দ্বীপ
<৬,৯২,১৪৬-১৪৭>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
সম্পাদকীয় সামরিক দিক হইতেও ঐক্যজোটের
অনিবার্য তাগিদ |
স্বাধীন বাংলা
১ম বর্ষঃ ৯ম সংখ্যা |
৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ |
সম্পাদকীয়
সামরিক দিক হইতেও
ঐক্যজোটের অনিবার্য তাগিদ
আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঠিক পরিচালনা ও সাফল্যের জন্য জাতীয় মুক্তিফ্রণ্ট গঠনের জরুরী আবশ্যিকতার কথা আমরা ইতিপূর্বে একাধিকবার আলোচনা করিয়াছি । আমরা বার বার এ কথাটাই বলিয়াছি যে, বিগত নির্বাচনে কোন দল কত ভোট পাইয়াছিল, কোন দল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করিয়াছিল প্রভৃতি কথা দুর্ধর্ষ শত্রুর বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের পরিস্থিতে অবাস্তব । আজিকার পরিস্থিতিতেই সবচেয়ে বড় কথা হইল হানাদার পাক সেনাদলকে পরাজিত করা, অধিকৃত বাংলাদেশকে মুক্ত করা, বাস্তুত্যাগীদের পুনবার্সন করা এবং ধর্ম-জাতি-ভাষা নির্বিশেষে বাংলাদেশের জনগণের সামনে নতুন জীবনের পথ খুলিয়া দেওয়া এই মহান কর্তব্য সাধনের জন্যই শত্রুর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রামে অংশগ্রহণকারী ছোট বড় সমস্ত দলও গ্রুপের একতা জরুরী প্রয়োজন । এই সোজা, সরল কথাটা আমরা ইতিপূর্বে বাংলাদেশের সমস্ত জনগণ ও আওয়ামীলীগসহ সমস্ত গণতন্তিক শক্তির নিকট একাধিকবার পেশ করিয়াছি এবং একতার জন্য আবেদনও জানাইয়াছি । এই প্রসঙ্গে আমরা ভিয়েতনামের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তুলিয়া ধরিয়া দেখাইয়াছি যে, সেখানে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী কোন দলই “আমরা বড় দল” বা আমরা “বেশী বিপ্লবী” বলিয়া বড়াই করিয়া জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গঠনে অস্বীকার করে নাই । বরং সমস্ত দেশপ্রেমিক দল ও সংস্থা অহমিকা, সংকীর্তনা, প্রভৃতি পরিহার করিয়া শত্রুর বিরুদ্ধে এক ব্যাপক একতা গড়িয়া তুলিয়াছেন । ইহাই হইল মূল রাজনৈতিক কারণ যার জন্য ভিয়েতনামের মুক্তিযুদ্ধ এত দুর্বার, এত সাফল্যমণ্ডিত ।
.
ভিয়েতনামের এই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত দেখাইয়া আমরা বলিয়াছি যে, বাংলাদেশে সমস্ত গণতান্তিক ও সংগ্রামী শক্তির সমবায়ে জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গঠন দেশের জনগণের মনে সৃষ্টি করিবে নতুন প্রেরনা, সংগ্রাম হইবে অধিকতর সংঘটিত, দুনিয়ার প্রগতিশীল শক্তির সাহায্য ও সমর্থন পাইতে অধিকতর সুবিধা হইবে এবং এগুলির ফলে আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রাম এমন দুর্বার শক্তি সমর্থন করিবে যে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত হইয়া চক্রের পশু সেনাদলের পরাজয় নিশ্চিত ও ত্বরান্বিত হইবে ।
.
দুঃখের বিষয়, কোন কোন দলের নেতৃত্বের অহমিকা ও বুর্জোয়াসুলভ সংকীর্নতার জন্য জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গঠিত হয় নাই । কিন্তু ফ্রন্ট আজও গঠিত হয় নাই বলিয়া উহার প্রয়োজনীয়তা ফুরাইয়া যায় নাই ।
.
বরং আজ আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রাম এমন একটি পর্যায়ে আসিয়া পৌঁছিয়াছে যে, জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গঠন আরও অপরিহার্য হইয়া উঠিয়াছে । গত পাঁচ মাসে আমাদের মুক্তিবাহিনী সংখ্যায় বাড়িয়াছে, তাহারা অধিকতর সংগটিত হইয়াছেন এবং সামরিক দিক হইতে তাহারা আজ অধিকতর দক্ষ । এসবের বাস্তব প্রমাণ আমরা প্রতিদিন পাইতেছি রণক্ষেত্রে- যেখানে শত্রুসৈন্য ক্রমাগত মার খাইতেছে ।
.
ইহা ছাড়া, বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে আজ গড়িয়া উঠিয়াছে বহু গেরিলা দল । তাহারাও শত্রুপক্ষকে অবিরত নাজেহাল করিতেছেন ।
.
কিন্তু এই ক্ষেত্রে একটা সমস্যাও দেখা যাইতেছে । অধিকাংশ গেরিলা দলই স্বাধীনতার আদর্শে উদ্ধুদ্ধ এবং অনেক অসম সাহসিক কাজ তাহারা দক্ষতার সহিত করিতেছেন । কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে এই গেরিলা দলগুলির ভিতর পারস্পরিক কোনও যোগাযোগ, কোন সমন্বয় প্রভৃতি নাই । অনেক ক্ষেত্রে মুক্তিবাহিনীর সহিতও গেরিলা দলের কাজের সমন্বয়ের অভাব আছে । তাছাড়া, গেরিলা দলগুলি শুধু কোন একটি রাজনৈতিক পার্টির অনুগামী নহে । আওয়ামীলীগ, কমিউনিষ্ট পার্টি, ন্যাপ ও অন্যান্য গণতান্ত্রিক দলের স্থানীয় নেতৃত্বে পরিচালিত গেরিলা দলসমূহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে রহিয়াছে ।
.
কিন্তু যেহেতু ঐ সব দল ও গ্রুপ নিয়া কেন্দ্রীয়ভাবে কোন জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গড়িয়া উঠে নাই এবং বহু স্থানে গেরিলা দলগুলির ভিতর এলাকা ভিত্তিতেও যোগাযোগ, সমন্বয় প্রভৃতি নাই, সেই হেতু এরূপ বিপদের আশঙ্কা আছে যে, রাজনৈতিক মতভেদ হেতু কোন কোন স্থানে বিভিন্ন গেরিলা দলের ভিতর পারস্পরিক গোলমাল বাধিতে পারে । ইহা ছাড়া, উপরোক্ত কারণগুলির জন্যই বিভিন্ন স্থানে গেরিলা দলগুলির কাজের ক্ষেত্রে বিভিন্নতা ঘটিয়া শক্তির অপচয়ও ঘটিতে পারে ।
.
এইসব অবাঞ্জিত ঘটনা ঘটিলে, উহার ফলশ্রুতিতে জনগণের মনে সমস্ত গেরিলা দল তথা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতি বিরূপ মনোভাব দেখা যাবে, ক্ষতিগ্রস্ত হইবে আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রাম এবং লাভ হইবে নরঘাতক ইয়াহিয়া চক্রের ।
.
বাংলাদেশ সরকার ও আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব এই বিপদের আশঙ্কা সম্পর্কে অবহিত কিনা এবং অবহিত হইলে সেগুলি দূর করার জন্য কোনও ব্যবস্থা অবলম্বন করিতেছেন কিনা, তা আমরা জানি না । কিন্তু ঐ বিপদের আশঙ্কা আজ বাস্তব ।
.
আমরা মনে করি যে, স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামের বর্তমান পর্যায়ে উপরে উল্লেখিত যে সমস্যা দেখা দিয়াছে, তার সমাধানের প্রশস্ত পথ হইল সমস্ত গণতান্ত্রিক ও সংগ্রামী শক্তির সমবায়ে কেন্দ্রীয়ভাবে একটি জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গঠন করা এবং সমস্ত পর্যায়ে সেরূপ ফ্রন্ট গঠনের নির্দেশ দেওয়া এই কাজ করা হইলে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন গেরিলা দলের ভিতর গড়িয়া উঠিবে সমন্বয়, ঐক্যবোধ প্রভৃতি এবং রণদক্ষতা বৃদ্ধি পাইয়া তাহারা শত্রুকে আরও বেশী আঘাত করিতে পারিবেন ।
.
তাই, শুধু রাজনৈতিক প্রয়োজনেই নয়, বাস্তব সামরিক প্রয়োজনে ও জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গঠন আজ অপরিহার্য । ইহা গঠনের বিলম্বে সমূহ ক্ষতি হইবে ।
.
দীপংকর ঘোষ দ্বীপ
<৬,৯৩,১৪৮-১৪৯>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
সম্পাদকীয়
শুভ সূচনা |
স্বাধীন বাংলা
১ম বর্ষঃ ১১শ সংখ্যা |
১৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ |
সম্পাদকীয়
শুভ সূচনা
গত সপ্তাহে পাঁচটি সংগ্রামী রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি সমবায়ে মন্ত্রিসভার পরামর্শদাতা কমিটি গঠন বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে নব অধ্যায়ের সূচনা করিয়াছে । পরামর্শদাতা কমিটিতে বাংলাদেশ সরকার ও আওয়ামীলীগের দুই জন করিয়া এবং কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ( সভাপতি অধ্যাপক মোজফফর আহমদ) জাতীয় কংগ্রেস ও ভাসানী ন্যাপের একজন করিয়া প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত হইয়াছেন । এই কমিটি গঠনের ফলে বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তির সংগ্রামে নিয়োজিত সকল সংগ্রামী দল ও শক্তির সমান অংশীদারিত্বেও মনোভাব নিশ্চিত হইবে এবং বিভিন্ন দল ও শক্তির কার্যকলাপের মধ্যে সমন্বয় বিধানের মাধ্যমে মুক্তিসংগ্রামের আরও সুষ্ঠু পরিচালনা সম্ভব হইবে । সর্বোপরি, সংযুক্ত কমিটি হইল জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে বাংলাদেশের সমগ্র জনগণের জঙ্গী একতার প্রতীক । আমরা এই কমিটি গঠনকে মুক্তি সংগ্রামের দ্রুত ও নিশ্চিত বিজয়ের পথে একটি সঠিক পদক্ষেপ বলিয়া মনে করি এবং ইহাকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাইতেছি ।
.
বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে সকল সংগ্রামী দল ও শক্তির মধ্যে একতা গড়িয়া তোলার প্রয়োজনীয়তা অধিক বলার অপেক্ষা রাখে না । কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি প্রথমাবধি সকল সংগ্রামী দল ও শক্তির সমবায় ঐক্যবদ্ধ জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গঠনের আহবান জানাইয়া আসিয়াছে । কমিউনিস্ট পার্টি বর্তমান অবস্থার পরিপেক্ষিতে প্রস্তাবিত মুক্তিফ্রন্টের উপযোগী একটি খসড়া নিম্নতম কর্মসূচীও হাজির করিয়াছে । কিন্তু কোন কোন দলের সঙ্কীর্ণতাবাদী মনোভাবে ও বৃহৎ দলসুলভ অহমিকার দরুন মুক্তিসংগ্রামের বিজয়ের অত্যাবশ্যকীয় শর্তস্বরূপ এই একতা গড়িয়া তোলার কাজ এতদিন অগ্রসর হইতে পারে নাই । এখন জনমতের চাপ ও মুক্তি সংগ্রামের বাস্তব অভিজ্ঞতা হইতে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলি ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করিয়াছেন । আলোচ্য পরামর্শদাতা কমিটি জাতীয় মুক্তিফ্রন্টের সমর্থক বা সমপর্যায়ের না হইলেও ইহা নিঃসন্দেহে সঠিক পথে এক ধাপ অগ্রগতি এই কমিটি গঠনের ফলে একতার প্রয়োজনীয়তা স্বীকৃত হওয়ার সাথে সাথে উহার একটা প্রাথমিক ভিত্তিও স্থাপিত হইয়াছে । ইহাকে দিন দিন আরও প্রসারিত ও আরও উন্নত করিয়া নিতে হইবে এবং উহার সম্ভাবনাও রহিয়াছে ।
.
সর্বদলীয় ভিত্তিতে মন্ত্রিসভার পরামর্শদাতা কমিটি গঠিত হওয়ার ফলে দেশবাসীর সংগ্রামী উদ্দীপনা আরও বৃদ্ধি পাইবে এবং মুক্তিবাহিনী ও অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল ও বাহুবল বহুগুণে বাড়িয়া যাইবে । বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকার বেসামরিক গভর্নর নিয়োগ সাধারণ “ক্ষমা” ঘোষণা প্রভৃতি দ্বারা দেশের ও বিদেশের জনগণকে দুর্বল ও বিভ্রান্ত করার যে সুচতুর কৌশল জল্লাদ ইয়াহিয়া- চক্র অবলম্বন করিয়াছে, উহাকে নস্যাৎ করার ব্যাপারে সংযুক্ত কমিটি বিশেষ কার্যকর হইব । আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মিত্রবর্গ বিশেষ সমাজতান্ত্রিক শিবির এবং সম্রাজ্যবাদ বিরোধী প্রগতিশীল রাষ্ট্রবর্গ ও গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহের অধিকতর সাহায্য সমর্থন লাভেও ইহা খুবই সহায়ক হইবে । এ সব দিক দিয়া এই সংযুক্ত কমিটি গঠনে তাৎপর্য সুদুর প্রসারী বলিয়া আমরা মনে করি ।
.
দেশবাসী একান্তভাবে আশা করেন যে, এই কমিটি নিছক কাগজে-পত্রে সীমাবদ্ধ না থাকিয়া সংগ্রামী শক্তিগুলির ঐক্য ও সমন্বয়ের কার্যকর হাতিয়ারে পরিণত হউক । এতদিন সংগ্রামের ক্ষেত্রে যে সকল অসুবিধা বিরাজ করিতেছিল ( যা মুক্তিবাহিনীকে লোক সংগ্রহের ব্যাপারে দলীয় বাছবিচার, সামরিক অপারেশনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন শক্তির কার্যক্রমের ব্যাপারে সমন্বয়ের অভাব প্রভৃতি ) সংযুক্ত কমিটি গঠনের ফলে এখন সেগুলি দূরীভুত হইবে বলিয়া দেশবাসী প্রত্যাশা করেন । উচ্চ পর্যায়ের মত স্থানীয় কার্যকলাপের সমন্বয় সাধনের উদ্দেশ্যে নিচের স্তরের সর্বদলীয় কমিটি গঠন করা দরকার । এবং সর্বোপরী যাহা দরকার তাহা হইল, প্রত্যেকেরই দলীয় সঙ্কীর্ণতা ত্যাগ করিয়া স্বাধীনতা সংগ্রামের সার্থকে সর্বাগ্রে স্থান দেওয়া এবং সংগ্রামী শক্তিগুলির পরস্পরের মধ্যে সমঝোতা ও সহযোগিতার মনোভাব গড়িয়া তোলা এখানে আমরা দেশবাসী সংগ্রামী শক্তিগুলির উদ্দেশ্য একটি সতর্কবাণী উচ্চারিত করিতে চাই । সংযুক্ত কমিটি গঠনের ফলেই সংগ্রামী ঐক্যের সমস্যা দূরীভুত হইয়া গিয়াছে কিম্বা দলীয় সঙ্কীর্ণতা বা বিভেদ পন্থার শক্তি সম্পূর্ণরূপে পরাস্ত হইয়াছে একথা মনে করা ভুল হইবে । বিভেদে ও শক্তি সম্পর্কে দেশবাসী ও সকল সংগ্রামী শক্তিকে সজাগ থাকিতে হইবে এবং ইহার বিরুদ্ধে লড়াই করিয়া ঐক্যের ভিত্তিকে মজবুত করিতে হইবে ।
.
গত ৮ই সেপ্টেম্বর সরবদলীয় বৈঠকে যেসব প্রস্তাব গ্রহণ করা হইয়াছে সেগুলি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং উহাদের তাৎপর্যও সুদরপ্রসারী । এই বৈঠকে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি দলমত নির্বিশেষে সমগ্র জনগণের পূর্ণ আস্থার কথা পুনরায় ঘোষনা করা হইয়াছে । ইহাহিয়া-চক্রের রুট চক্রান্ত ও বিভেদমূলক নীতির পরিপেক্ষিতে বাংলাদেশের সকল দলের এই সম্মিলিত ঘোষণা দেশে ও বিদেশে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করিবে । অন্যদিকে বাংলাদেশের প্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে জিম্মি রাখিয়া মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা যেভাবে স্বাধীনতার দাবি ছাড়িয়া দিয়া আপোষ মীমাংসার জন্য চাপ সৃষ্টি করিতেছে উহার পটভূমিতে সর্বদলীয় বৈঠকের স্বাধীনতার স্বীকৃতি ব্যতীত অন্য কোন ভিত্তিতে রাজনৈতিক মীমাংসা গ্রহণযোগ্য নয়” বলিয়া সুস্পষ্ট প্রস্তাবও তাৎপর্যপূর্ণ । শেখ মুজিবকে আটক রাখিয়া ব্লাকমেলিং এর কোন প্রচেষ্টা বাংলাদেশের জনগণ বরদাস্ত করিবেন না, এই প্রস্তাবের উহাই দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রকাশ পাইয়াছে শেখ মুজিবের গ্রেফতার ও বিচার প্রহসনের বিরুদ্ধে তীব্র ধিক্কার ধ্বনিত হইয়াছে সর্বদলীয় বৈঠকে । বাংলাদেশের সংগ্রাম যে “পশ্চিম পাকিস্তানীদের” বিরুদ্ধে নয়, সেখানকার একচেটিয়া ধনিক ও বৃহৎ সামন্ত ভূস্বামী-শ্রেণী এবং ইহাদের স্বার্থরক্ষক ইয়াহিয়ার নেতৃত্বাধীন সামরিক চক্রের বিরুদ্ধে এই সঠিক উপলব্ধির অভিব্যক্তিও দেখা গিয়াছে সর্বদলীয় বৈঠকের প্রস্তাবে ।
.
দীপংকর ঘোষ দ্বীপ
<৬,৯৪,১৫০-১৫১>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
স্বাধীনতার প্রশ্নে আপোষ নাই | মুক্তিযুদ্ধ ১ম বর্ষঃ ১৩শ
সংখ্যা |
৩ অক্টোবর, ১৯৭১ |
সাম্রাজ্যবাদীদের ষড়যন্ত্র রুখিয়া দাঁড়ান
স্বাধীনতার প্রশ্নে আপোষ নাই
(বিশেষ প্রতিনিধি)
বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিভ্রান্তি সৃষ্টির উদ্দেশ্য সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী ও উহাদের তাবেদার কোন মহল সম্প্রতি অতি তৎপর হইয়া উঠিয়াছে । বীর মুক্তিবাহিনী ও গেরিলাবাহিনীর অকুতোভয় তরুন যোদ্ধারা স্বাধীনতার লাল সূর্যকে ছিনাইয়া আনার জন্য যখন অকাতরে বুকের রক্ত ঢালিতেছেন, তখন ইহাদের কণ্ঠে আপোষের সুর । যে স্বাধীনতার স্বপ্নকে সামনে রাখিয়া দেশবাসী গত ছয় মাস যাবৎ কঠোরতর দুঃখ কষ্ট ও চরম লাঞ্চনা সহ্য করিয়াছেন কিন্তু কখনও হতাশ হন নাই বা ভাঙ্গিয়া পড়েন নাই সেই স্বাধীনতার স্বপ্নকে নস্যাৎ করিয়া দিতে উদ্যত হইয়াছে ইহারা । ইহাদের সম্পর্কে সজাগ থাকা এবং অবিলম্বে উহাদের অশুভ তৎপরতা বন্ধ করা দরকার ।
.
গলব্রেথের মিশন
ভারতে প্রাক্তন মার্কিন রাষ্ট্রদুত গলব্রেথ খোলাখুলিই বলিয়াছেন স্বায়ত্বশাসন দেওয়া হইলেই পূর্ব বাংলা সমস্যার সমাধান হইয়া যাইবে । অর্থ্যাৎ তাহার মতে স্বায়ত্বশাসনের অধিক কোন কিছুর জন্য জেদ ধরা বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দের পক্ষে ঠিক হইবে না । তিনি নাকি সর্বদলীয় উপদেষ্টা কমিটি গঠনের ব্যাপারে উদ্বেগ গোপন না করিয়া বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিগণকে শাসাইয়াছেন যে, এভাবে চলিলে বাংলাদেশ ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের লেজুড়ে পরিণত হইবে । তাহার মত স্বাধীনতার দাবী ছাড়িয়া দিয়া বাংলাদেশের উচিত মার্কিনের মধ্যস্থতায় ইয়াহিয়া-চক্রের সহিত আপোষ মীমাংসার পথে আসা ।
.
হাফটনের ‘ফর্মুলা’
অন্যদিকে বৃটেনের সংসদীয় শ্রমিক দলের চেয়ারম্যান ডগলাস হাপফটন সম্প্রতি বলেন, ইয়াহিয়া খান ও আওয়ামীলীগ প্রতিনিধিগণকে আলোচনা বৈঠকে মিলিত করার ব্যাপারে বৃটেন মধ্যস্থের ভূমিকা গ্রহণ করিতে পারে । তাহার মতে পাকিস্তানের জন্য একটি নয় শাসনতন্ত্র প্রণয়ন কিংবা ইয়াহিয়া খানের শাসনতন্ত্রে সংশোধনের ব্যবস্থা সন্নিবেশিত করিয়াই সমস্যার সমাধান হওয়া সম্ভব । এ সম্পর্কে মন্তব্য নিস্প্রয়োজন ।
.
কিছু দিন আগে ইরানের মারফত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা আর এক দফা আপোষের টোপ ফেলিয়াছিল কিন্তু বাংলাদেশ উহাকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করিয়াছে ।
.
হিজ মাষ্টারস ভয়েস
জল্লাদ ইয়াহিয়াচক্র ও দোসর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বৃটেনের কোন মুখপাত্র কি বলিল উহা সমস্যা নয় । কারণ বাংলাদেশের জনগণ রক্তমূল্যে সাম্রাজ্যবাদীদের স্বরূপ চিনিয়াছে কিন্তু সমস্যা হইতেছে বাংলাদেশের কিছু কিছু মার্কিন-প্রেমীর কার্যকলাপ । ইহারা ইহাদের মার্কিন প্রভুদের সুরে সুর মিলাইয়া আপোষের ধুয়া তুলিয়াছে, প্রকাশ্যে আপোষের কথা বলার সাহস না থাকায় গুজবের আশ্রয় লইয়াছ । গুজবে গুজবে দেশ ছাইয়া ফেলিতেছে। সর্বদলীয় উপদেষ্টা কমিটি সম্পর্কেও ইহাদের বিরুপতা সুবিদিত ইয়াহিয়াচক্র ছয় ডিভিশন সৈন্য আমদানী করিয়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে দমন করিতে পারে নাই, ইহারা ভিতর হইতে এই সংগ্রামকে দুর্বল করিয়া ফেলিতে উদ্যত হইয়াছে ।
.
বেতারযোগে প্রাপ্ত এক খবরে প্রকাশ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ডঃ মজহারুল ইসলাম ভারতের কোন এক স্থানে এক বক্তৃতায় নাকি বলিয়াছেন যে, শেখ মুজিবর রহমান কে মুক্তিদান ও পূর্ববাংলা হইতে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য বাহিনী প্রত্যাহার করা হইলে বাংলাদেশের জনগণ পশ্চিম পাকিস্তানের সহিত একটা শিথিল ধরনের ফেডারেশন গঠন করিতে রাজী হইতে পারে । এই সংবাদ সঠিক হইলে ইহাকে বাংলাদেশের জনগণ ও তাহাদের প্রতিনিধিরা যখন দ্যর্থহীন ভাষায় ও সর্বসম্মতিক্রমে ঘোষণা করিয়াছেন যে, স্বাধীনতা ছাড়া অন্য কোন কিছুই দেশবাসীর কাছে গ্রহণযোগ্য নয় তখন এই মার্কিনপ্রেমী পণ্ডিত ব্যক্তিটি জনগণের পক্ষ হইতে ভিন্নরূপ কথা বলার অধিকার পাইলেন কোথায় ? প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযোগ্য, ভারতে বাংলাদেশের হাই কমিশনার জনাব হোসেন আলীর একটি সাম্প্রতিক বিবৃতির জনমনে নানা প্রশ্ন জাগাইয়াছে ।
.
স্বাধীনতার প্রশ্নে আপোষ নাই
আমরা দ্যর্থহীন কন্ঠে সকল মহলকে একথা জানাইয়া দিতে চাই যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বীকৃতি ব্যতীত অন্য কোন প্রকার সমাধান দেশবাসীর কাছে গ্রহণযোগ্য নয় । গত ৮ই সেপ্টেম্বর ও সর্বদলীয় উপদেষ্টা কমিটি এ ব্যাপারেও সর্বসম্মতিক্রমে যে প্রস্তাব গ্রহণ করিয়াছেন দেশবাসী দৃঢ়ভাবে উহার পিছনে রহিয়াছেন উহা হইতে কোন প্রকার পশ্চাদাপসরণ দেশবাসী বরদাস্ত করিবেন না ।
.
.
এফ.এম. খান
<৬,৯৫,১৫২-১৫৩>
সংবাদপত্রঃ স্বাধীন বাংলা
তারিখঃ ১০ অক্টোবর, ১৯৭১
সোভিয়েত-ভারত যুক্ত বিবৃতি
ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সাম্প্রতিক মস্কো সফর শেষে প্রকাশিত সোভিয়েত -ভারত যুক্ত বিবৃতিটি বাংলাদেশের সংগ্রামী জনগণের প্রতি সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের গভীর ভ্রাতৃত্ববোধ ও দৃঢ় সমর্থনের পরিচায়ক। দলমত নির্বিশেষে বাংলাদেশের জনগন ইহাকে সঠিকভাবেই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্বপক্ষে একটি মস্তবড় ঘটনা হিসাবে গন্য করিয়াছেন এবং যুক্ত বিবৃতির প্রতি দ্ব্যার্থহীন অভিনন্দন জানাইয়াছেন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় মন্ত্রী পরিষদ ও সোভিয়েত ভারত যুক্ত বিবৃতিতে সন্তোষ প্রকাশ করিয়া বলিয়াছেন যে,ইহার মধ্য দিয়া বাংলাদেশের সমস্যা সম্পর্কে সোভিয়েত সরকারের গভীর উপলদ্বির পরিচয় ফুটিয়া উঠিয়াছে।বাংলাদেশ সরকারের ঘনিষ্ঠ মহলের বরাত দিয়ে কোন কোন স্বার্থসন্ধানী মহল সোভিয়েত – ভারত বিবৃতিতে বাংলাদেশ সরকার হতাশ হইয়াছেন-এই মর্মে ইতিপূর্বে যে প্রচারণা চালাইয়াছিল বাংলাদেশ সরকারের মুখপাত্র প্রকাশ্য বিবৃতি দ্বারা উহাকে দ্ব্যার্থহীন ভাষায় খণ্ডন করিয়াছেন।
অবশ্য এই কথা ঠিক যে,সোভিয়েত -ভারত যুক্ত বিবৃতিতে প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেওয়ার কথা এবং স্বাধীনতা ছাড়া বাংলাদেশ সমস্যার আর কোন গ্রহণযোগ্য সমাধান যে নাই তাহা স্পষ্ট করে বলা হয় নাই। কিন্তু ইহা হইতে একথা প্রমাণিত হয় না যে সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবির বিপক্ষে কিম্বা বাংলাদেশের উপর সোভিয়েত সরকার যেমন-তেমন ধরনের একটা রাজনৈতিক সমাধান চাপাইয়া দিতে চায়।
বাস্তব অবস্থা তাহা নয়।প্রথমত, সোভিয়েত -ভারত যুক্ত বিবৃতিতে প্রস্তাবিত রাজনৈতিক সমাধানের চরিত্র সুনির্দিষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা হইয়াছে।এই রাজনৈতিক সমাধানকে অবস্যই বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছা অনপহরনীয় অধিকার ও আইনসঙ্গত স্বার্থের সহীত সামঞ্জস্যপূর্ণ হইতে হইবে।ভাষ্যকারদের মতে অনপহরনীয় অধিকার বলতে জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণ এর অধিকারও বুঝায়। বিশেষত বাংলাদেশের জনগণ তথা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিগণ এবং বাংলাদেশ সরকার ও সর্বদলীয় উপদেষ্টা পরিষদ যখন অপরিবর্তনীয়রূপে ঘোষণা করিয়াছেন যে,পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া অন্য কোন ভিত্তিতে রাজনৈতিক সমাধান তাহাদের নিকট গ্রহণযোগ্য নয় সেক্ষেত্রে জনগণের ইচ্ছার ভিত্তিতে মিমাংসা করিতে হইলে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দিয়াই উহা পদক্ষেপ নিয়াছে সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ পরিষ্কারভাবে সেগুলিকে উপেক্ষা করিয়াছেন।
দ্বিতীয়, বাংলাদেশ সমস্যা ও ভারতে প্রায় এক কোটি উদ্বাস্তর আশ্রয়গ্রহণ ও প্রভৃতির জন্য সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ইসলামাবাদের জঙ্গীশাহীকে দায়ী করিয়াছেন এবং শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সম্মানার্থে আয়োজিত ভোজসভায় সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী কমরেড কোসিগিন ইয়াহিয়া-চক্রকেই এই অবস্থার প্রতিকারের উদেশ্যে অবলিম্বে প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা গ্রহণ করিতে বলিয়াছেন।ইয়াহিয়া-চক্র বিশ্ববাসীকে ধোকা উদেশ্যে বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকায় বেসামরিক ” গভর্নর ” নিয়োগ, “সাধারণ ক্ষমা” ঘোষণা প্রভৃতি যেসব পদক্ষেপ নিয়াছে সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ পরিষ্কারভাবে সেগুলিকে উপেক্ষা করিয়াছেন।
তৃতীয়ত,সোভিয়েত ইউনিয়নের বাংলাদেশ সংক্রান্ত বক্তব্য বা দৃষ্টিভঙ্গী যে অনড়-অচল নয়,গত কয়েক মাসে উহার পরিচয় পাওয়া গিয়াছে।এপ্রিল মাসে সোভিয়েত রাষ্ট্রপ্রধান কমরেড পদগর্নি ইয়াহিয়া সরকারকে শক্তি প্রয়োগের পরিবর্তে রাজনৈতিক সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান করার জন্য আবেদন জানাইয়া ছিলেন।উহার মধ্যদিয়া বাংলাদেশের জনগণের জন্য গভীর সহানুভূতি প্রকাশ পাইলেও তখনকার তুলনায় সোভিয়েত ইউনিয়নের সাম্প্রতিক বক্তব্য অনেক বেশী সুনির্দিষ্ট ও বাংলাদেশের পক্ষে আরো অনুকূল।এমনকি সোভিয়েত-ভারত মৈত্রী চুক্তি সম্পাদনের পর নয়া দিল্লীতে স্বাক্ষরিত গ্রোমিকোশরন সিং যুক্ত ইশতেহারের সহিত যুক্ত বিবৃতিকে মিলাইয়া দেখিলেও সোভিয়েত দৃষ্টিভঙ্গীর গতিশীলতার পরিচয় পাওয়া যাইবে।গ্রোমিকো-শরন সিং যুক্ত ইশতিহারেও বাংলাদেশে “পূর্ব পাকিস্তান ” বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছিলো।আলোচ্য যুক্ত বিবৃতিতে তদস্থলে পূর্ব বাঙলা “ব্যাবহৃত হইয়াছে।যুক্ত ইশতেহারে” সারা পাকিস্তানের জনগণের স্বার্থে রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলা হইয়াছে।সেখানে যুক্ত বিবৃতিতে পূর্ব বাংলার জনগণের ইচ্ছা,অনপহরনীয় অধিকার ও আইনসঙ্গত স্বার্থের” ভিত্তিতে সমাধানের কথা বলা হইয়াছে।কাজেই সোভিয়েত-ভারত যুক্ত বিবৃতির রাজনৈতিক সমাধানের প্রস্তাবকে যাহারা বাংলাদেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দেওয়া বলিয়া প্রচারণা চালাইয়া সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারত বিরোধী জিগির তুলিতেছেন তাহার হয় অন্ধ না হয় মতলববাজ।
সোভিয়েত ভারত যুক্ত বিবৃতি নিছক কথার কথা কিম্বা বাংলাদেশের প্রতি লোক দেখানো সহানুভূতি নয়।জাতিসংঘে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন ইয়াহিয়া-চক্রের প্রতি ধিক্কার জানাইয়া বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্বজনমতকে সংগঠিত করিতেছে।সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী মস্কোতে সাংবাদিকদের নিকট খোলাখুলিভাবে যাহা বলিয়াছেন (” আমাদের সহানুভূতি পূর্ব বাংলার নিপীড়িত জনগণের প্রতি,উৎপীড়কের প্রতি নয়”) জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক মঞ্চে উহার সহিত সঙ্গতিপূর্ণ বাস্তব কার্যক্রম দেখা যাইতেছে।বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান শেখ মুজিবর রহমান ও অন্যান্য নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মুক্তির যে দাবী যুক্ত বিবৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ স্থান লাভ করিয়াছে,সোভিয়েত ইউনিয়ন সে দাবীতে বিশ্বজনমত গড়িয়া তুলিতেছে।সোভিয়েতের বিভিন্ন সংগঠন যথা শান্তি পরিষদ, ট্রেড ইউনিয়ন, আফ্রো-এশিয় সংহতি পরিষদ, সাংবাদিক ইউনিয়ন, মহিলা সংস্থা প্রভৃতি গত কয়েক দিনে বাংলাদেশের প্রতি সংহতি জানাইয়া যে সব বিবৃতি প্রকাশ করিয়াছে উহা তাৎপর্যহীন নয়।সোভিয়েত ইউনিয়ন আজ নয়,একেবারে প্রথম হইতে দৃঢ়চিত্তভাবে বাংলাদেশের জনগণের প্রতি সহানুভূতি ও সৌভ্রাতৃত্ব প্রকাশ করিয়া আসিয়াছে।এপ্রিল মাসের প্রথম সাপ্তাহে যখন একমাত্র ভারত ছাড়া অন্য কোন দেশ বাংলাদেশ সম্পর্কে মাথা ঘামাইবার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে নাই- তখনি সোভিয়েত ইউনিয়ন রাষ্টপ্রধানের আবেদন জ্ঞাপনের ন্যায় সর্বোচ্চ কূটনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করিয়াছে।কাজেই সোভিয়েত ইউনিয়ন এর ভূমিকাকে যাহারা জল্লাদ ইয়াহিয়া চক্রের দোসর মার্কিন সম্রাজ্যবাদীদের সহিত এক করিয়া প্রচার করে তাহাদের উদেশ্য সম্পর্কে প্রশ্ন না তুলিয়া পারা যায় না।
পাক-ভারত যুদ্ধের আশঙ্কা প্রতিহত করিয়া বিশ্বের এই এলাকায় শান্তি অব্যাহত রাখার প্রশ্নটি বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের পক্ষে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। শান্তি অক্ষুন রাখার ব্যাপারে শুধু যে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারত আগ্রহী তা নয়,বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্বার্থের প্রয়োজন। পাক-ভারত যুদ্ধ বাধাইয়া জাতিসংঘ মারফত মার্কিন সম্রাজ্যবাদীদিগকে হস্তক্ষেপের সুযোগ দেওয়া এবং বাংলাদেশের প্রশ্ন হইতে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি পাক-ভারত বিরোধের প্রতি সরাইয়া নেওয়ার উদেশ্যে ইয়াহিয়া চক্রই কেবল পাক-ভারত যুদ্ধ বাধাইতে আগ্রহী হইতে পারে।বস্তুত পাকিস্তানী শাসকচক্র মুক্তিবাহিনীর হাতে ক্রমাগত মার খাইয়া পাক-ভারত যুদ্ধ বাধাইবার ফিকিরই খুঁজিতেছে। কাজেই যুক্ত বিবৃতিতে যুদ্ধ প্রতিহত করিয়া শান্তি রক্ষার যে কথা বলা হইয়াছে উহা বাংলাদেশের স্বার্থের সহিত সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ।
বাংলাদেশের দুই অকৃত্রিম সুহৃদ ভারত সোভিয়েত ইউনিয়ন এর মধ্যে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগীতে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের অনুকূলে গুরুত্বপূর্ণ অবদান সৃষ্টি করিতেছে।ভারত-সোভিয়েত যুক্ত বিবৃতি এই ফলপ্রসু সহযোগীতারই একটি অমূল্য দলিল। আমরা ইহাকে মুক্তকণ্ঠে অভিনন্দন জানাইতেছি।
.
.
সাহুল আহমেদ মুন্না
<৬,৯৬,১৫৪-১৫৫>
বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ ষষ্ঠ খন্ড
শিরোনামঃ বাংলাদেশের সংগ্রামী জনগনের সহিত আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের দৃঢ় সংহতি জ্ঞাপন।
সংবাদপত্রঃ “মুক্তিযুদ্ধ”, ১ম বর্ষ, ১৪শ সংখ্যা।
তারিখঃ ১০ অক্টোবর ১৯৭১
[বাংলাদেশের সংগ্রামী জনগনের সহিত আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের দৃঢ় সংহতি জ্ঞাপন।]
বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের প্রতি আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের দৃঢ় সমর্থন ও সংহতি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির নবম কংগ্রেসের মধ্যে দিয়া পরিষ্কাররূপে ফুটিয়া উঠিয়াছে। কংগ্রেসে গৃহীতব্য সি পি আই জাতীয় কাউন্সিলের রাজনৈতিক রিপোর্ট ও খসড়া প্রস্তাবে বাংলাদেশের সংগ্রামের প্রতি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সর্বাত্নক সমর্থন পুনরায় ঘোষনা করা হয়। ইহা ছাড়া কংগ্রেসে যোগদানকারী সোভিয়েতে ইউনিয়ন, গ্রেট ব্রিটেন, ফ্রান্স, বুলগেরিয়া, গনতান্ত্রিক জার্মানী, হাঙ্গেরী প্রভৃতি বহু দেশের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধিদল তাহাদের ভাষনে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ও সংগ্রামী জনগনের সহিত সংহতি জ্ঞাপন করেন। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধিদলকে যেরূপ বীরোচিত সম্মান দেয়া হয় উহার মধ্যে দিয়া বাংলাদেশের সংগ্রামের উচ্চ মূল্যায়নের আন্তরিক অভিব্যাক্তিই প্রকাশ পাইয়াছে।
.
ভারতের কেরালা রাজ্যের ঘাটে নগরে (কোচিন) গত ৩রা অক্টোবর ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির এই গুরুত্বপূর্ণ কংগ্রেস শুরু হয়। ১০ ই অক্টোবর কংগ্রেস সমাপ্ত হইবে। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক কমরেড আব্দুস সালামের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল এই কংগ্রেসে যোগ দিয়াছেন। ইহা ছাড়াও আরও বিশটি বিদেশী ভ্রাতৃসুলভ পার্টির প্রতিনিধিবর্গ এই কংগ্রেসে অংশগ্রহণ করিতেছেন।
.
কমরেড সালাম
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধিদলের নেতা কমরেড আব্দুস সালাম কংগ্রেসের প্রতিনিধি, দর্শক ও অতিথিদের তুমুল হর্ষধ্বনির মধ্যে বাংলাদেশের মু আন্দোলনের পটভূমি ও প্রগতিশীল চিত্র ব্যাখ্যা করেন। তিনি এই সংগ্রামকে জাতীয় আত্ননিয়ন্ত্রনাধিকার আদায়ের ন্যায্য লড়াই বলিয়া অভিহিত করেন এবং আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট ও শ্রমিক আন্দোলন এবং পৃথিবীর সকল প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক শক্তিকে ইহার সমর্থনে দৃঢ়ভাবে দাড়াইবার জন্য উদাত্ত আহ্বান জানান।
কমরেড সালাম বাংলাদেশের শ্রমিক কৃষক মেহনতি মানুষের আন্দোলনে কমিউনিস্ট পার্টির অগ্রণী ভূমিকার কথা উল্লেখ করিয়া বলেন, সাম্প্রদায়িকতা, স্বৈরাচারী শাসন ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র ও জাতীয় অধিকারের সংগ্রামে কমিউনিস্ট পার্টি সর্বদা সর্ব-অবস্থায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করিয়াছে। বর্তমান স্বাধীনতার লাড়াইয়েও কমিউনিস্ট পার্টি অন্যান্য সংগ্রামী শক্তির সহিত কাঁধে কাধ মিলাইয়া অস্ত্র হাতে লড়াই করিতেছে।
.
কমরেড সালাম বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির একটি অভিনন্দন বানী ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির হাতে সমর্পণ করেন। অভিনন্দন বানীতে বাংলাদেশের পার্শ্বে সর্বশক্তি লইয়া দাড়াইবার জন্য ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি, সকল গণতান্ত্রিক শক্তি ও ভারতের জনগনের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা জানানো হয়।
.
উহাতে বলা হয় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি সর্বহারার আন্তর্জাতিকতাবাদের প্রতি অনুগত্যের উজ্জ্বল ও অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করিয়াছে। (অভিনন্দন বানীর পূর্ণ বিবরণ আগামী সংখ্যায় প্রকাশিত হইবে)
.
কমরেড সালাম তাহার ভাষণের উপসংহারে বলেন, আমরা জানি বাংলাদেশের সংগ্রাম কঠিন ও কঠোর। বাংলাদেশের জনগন এই কঠোর সংগ্রামের মধ্য দিয়াই জাতীয় আত্ননিয়ন্ত্রনের অধিকার ও স্বাধীনতা কায়েম করিবেন। বিজয় আমাদের অনিবার্য।
.
সোভিয়েত প্রতিনিধি
সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধিদলের নেতা কমরেড দীন মোহাম্মদ কুনায়েত বাংলাদেশের নিপীড়িত জনগনের প্রতি সহানুভূতি জ্ঞাপন করিয়া বলেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রথমাবধি ইয়াহিয়ার সামরিক সরকারের নির্যাতন ও দমননীতির বিরুদ্ধে দৃঢ়তার সহিত প্রতিবাদ জানাইয়াছে এবং পূর্ব বাংলার জনগনের ইচ্ছা ও অলঙ্ঘনীয় অধিকারের ভিত্তিতে সমস্যাটির রাজনৈতিক সমাধান দাবি করিয়াছে।
.
ফরাসি পার্টির সমর্থন
ফ্রান্সের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধি দলের নেতা কমরেড গাই বেসসি তুমুল হর্ষধ্বনির মধ্যে ঘোষণা করেন যে, বাংলাদেশের ‘জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের’ বিজয় সম্পর্কে তাহাদের পার্টির বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই। তিনি বলেন, ফ্রান্সের কমিউনিস্ট পার্টি পুরাপুরিভাবে বাংলাদেশের সংগ্রামের পক্ষে। ফরাসী পার্টি ফ্রান্সের এক – চতুর্থাংশ ভোটদাতাদের আস্থাভাজন বিধায় তাহাদের পার্টির মাধ্যমে ফ্রান্সের অন্ততঃ এক – চতুর্থাংশ জনসংখ্যা বাংলাদেশের সংগ্রামের সমর্থনে ঐক্যবদ্ধ। তিনি দৃঢ়তার সহিত ঘোষণা করেন যেন, জনগনের আত্ননিয়ন্ত্রনের অধিকারের স্বীকৃতির ভিত্তিতেই এই সমস্যার সমাধান করিতে হইবে।
.
হাঙ্গেরী
হাঙ্গেরী প্রতিনিধিদলের নেতা কমরেড আন্দ্রে গাইনেস ইসলামাবাদের জঙ্গী শাসকদের বর্বর নির্যাতনের নিন্দা করিয়া বলেন যে, কেবল মাত্র জাতীয় গণতান্ত্রিক বিধি ও মানবিক অধিকার মানিয়া নেওয়ার মধ্য দিয়া বাংলাদেশের সমস্যার সমাধান সম্ভব।
.
গণতান্ত্রিক জার্মানী
গণতান্ত্রিক জার্মানীর প্রতিনিধি দলের নেতা কমরেড অ্যালবার্ট নর্ডস বাংলাদেশের জনগনের “গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক অধিকার” প্রতিষ্টা ও শেখ মুজিবের মুক্তি দাবি করেন।
.
ভ্রাতৃত্বমূলক সংহতি
পশ্চিম জার্মানীর কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধি দলের নেতা কমরেড কুর্ট অর্লরেকন বাংলাদেশের সংগ্রামী জনগনের সহিত “ভ্রাতৃত্বমূলক সংহতি” জ্ঞাপন করেন।
.
ন্যায্য সংগ্রাম
ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধি দলের নেতা কমরেড উইলিয়াম ওয়েনরাইট বাংলাদেশের আন্দোলনকে ‘ন্যায় সংগ্রাম’ বলিয়া অভিহিত করেন।
.
এই রিপোর্ট লেখার সময় পর্যন্ত দেশের ভ্রাতৃপ্রতিম পার্টিগুলির প্রতিনিধিদলের বক্তব্য জানা যায় নাই।
.
.
সাহুল আহমেদ মুন্না
<৬,৯৭,১৫৬-১৫৭>
শিরোনামঃ সম্পাদকীয় উপদেষ্টা পরিষদকে সংগ্রামী ঐক্যের প্রাণবন্ত প্রতীকে পরিনত করা হউক।
সংবাদপত্রঃ স্বাধীন বাংলা, ১ম বর্ষঃ ১৮শ সংখ্যা
তারিখঃ ৭ নভেম্বর, ১৯৭১
সম্পাদকীয়
[উপদেষ্টা পরিষদকে সংগ্রামী ঐক্যের প্রাণবন্ত প্রতীকে পরিনত করা হউক]
৬ নভেম্বর সর্বদলীয় উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক আহ্বান করা হইয়াছে। উপদেষ্টা পরিষদকে আতুড়েই গলা টিপিয়া মারার জন্য ঐক্যবিরোধী কোন কোন মহল ও দেশী-বিদেশী প্রতিক্রিয়াশীলরা বিশেষতঃ মার্কিন লবী যেভাবে আদা-জল খাইয়া লাগিয়াছিল উহার পরিপ্রেক্ষিতে এই বৈঠকের তাৎপর্য রহিয়াছে।
.
প্রায় দুই মাস পূর্বে সর্বদলীয় বৈঠকে মন্ত্রিসভার উপদেষ্টা পরিষদ গঠিত হইলে দেশব্যাপীপ্রবল উৎসাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি হইয়াছিল। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে সংগ্রামী শক্তিগুলির মধ্যে ঐক্য ও সমন্বয় বিধানের যে সমস্যাটি প্রথমাবধি রহিয়া গিয়াছে, দেশবাসী আশা করিয়া ছিলেন উপদেষ্টা পরিষদ গঠনের ফলে উহার বহুলাংশে সমাধান হইবে এবং উপদেষ্টা পরিষদ ধীরে ধীরে পূর্ণাঙ্গ জাতীয় মুক্তিফ্রন্টের স্তরে উন্নত হইবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় জনগনের এই আশা পূরণ হয় নাই। ঐক্যের ভিত্তি আরো প্রসারিত কিম্বা গভীরতর হওয়া দূরের কথা উপদেষ্টা পরিষদ গঠনের মধ্য দিয়া যে সূচনাটি হইয়াছে এহাকেই অঙ্কুরে নির্দিষ্ট করার জন্য পূর্বোক্ত মহলগুলি উঠিয়া পড়িয়া লাগে। ইহার ফলে গত দুই মাসের মধ্যে উপদেষ্টা পরিষদের একটিও বৈঠক অনুষ্টিত হইতে পারেনাই।
.
ঐক্যের পথে এই সকল বাধা থাকা সত্ত্বেও ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা ফুরাইয়া যায় নাই। বরং বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সাথে সাথে ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা আরও তীক্ষ্ণভাবে অনুভুত হইতেছে শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ঐক্য প্রয়োজন- ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা প্রয়োজন মুক্তাঞ্চলগুলো পুনর্গঠনের ক্ষেত্রেও। কাজেই উপদেষ্টা পরিষদকে একেবারে ঘুম পাড়াইয়া রাখার পরিবর্তে মাঝে মাঝে উহার বৈঠক ডাকিয়া নিয়মরক্ষা করিলেও সমস্যার সমাধান হইবে না। উপদেষ্টা পরিষদকে বাংলাদেশের সংগ্রামী শক্তিগুলির প্রাণবন্ত ঐক্যের প্রতীক হিসাবে দেশবাসীর সম্মুখে তুলিয়া ধরিতে হইবে, মুক্তিসংগ্রামকে সুসংগঠিত ও বিভিন্ন সংগ্রামী শক্তির তৎপরতার মধ্যে সমন্বয় সাধনের ক্ষেত্রে ইহাকে যোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করিতে দিতে হইবে। তাছাড়া উপদেষ্টা পরিষদকে শুধু উপরের তলায় সীমাবদ্ধ না রাখিয়া নীচের স্তরগুলিতেও ঐক্যবদ্ধ কমিটি গঠন করিতে হইবে।
.
দেশবাসীর জঙ্গি উদ্দিপনা বৃদ্ধির জন্য সরকারের তরফ হইতে স্বাধীন বাংলাদেশের ভবিষ্যতের একটি রূপরেখা তুলিয়া ধরা এবং বক্তৃতায় বিবৃতিতে, বেতারে, সংবাদপত্রে উহা ব্যাপকভাবে প্রচার করা দরকার। বিভিন্ন সময়ে প্রধানমন্ত্রীসহ বিভিন্ন সরকারি মুখপাত্র বলিয়াছেন, সরকারের লক্ষ্য বাংলাদেশে একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক,ধর্মনিরপেক্ষ ও সামজতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম করা। কখনও বা বলা হয়, আওয়ামীলীগ উহার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত করিবে। সম্প্রতি একজন সরকার মুখপাত্র বলিয়াছেন, বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চলে আওয়ামীলীগের নির্বাচনী ওয়াদা অনুযায়ী ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির মালিকদিগকে খাজনা হইতে অব্যাহতি দেওয়া হইয়াছে। এই সমস্ত কথাবার্তার মধ্যে দিয়া স্বাধীন বাংলাদেশের রূপরেখা টুকরা টুকরা ভাবে তুলিয়া ধরার চেষ্টা দেখা গেলেও ইহা যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন যা তাহা হইল, স্বাধীন বাংলাদেশে যে আবার সাম্রাজ্যবাদ বিশেষতঃ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও দেশীয় পুজিপতি শ্রেণীর অবাধ শোষণের মৃগয়া ক্ষেত্র হইয়া উঠিবেনা, স্বাধীন বাংলাদেশে যে সত্যিই সুখী সমৃদ্ধিশালী সমাজ গড়িয়া তোলা হইবে- এই আশ্বাস ও নিশ্চয়তা দেশবাসীকে দিতে হইবে। আওয়ামীলীগের কর্মসূচিতে পাকিস্তানের তৎকালীন পঠভুমিতে অনেক ইতিবাচক বিষয় সন্নিবেশিত হইলেও বাংলাদেশের স্বাধীনতার পঠভূমিতে ইহার রদবদল অত্যাবশ্যক। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, আওয়ামী লীগের কর্মসূচীতে সাম্রাজ্যবাদী শোষণ বন্ধ করা ও কৃষকের স্বার্থে ভূমি ব্যবস্থার সংস্কার সম্পর্কে কোন উল্লেখ নাই। অথচ স্বাধীন বাংলাদেশের পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে এই দুই বিষয়ই হইবে মুখ্য। কাজেই পরিবর্তিত অবস্থার চাহিদার সহিত সঙ্গতি রাখিয়া সর্বদলীয়ভাবে স্বীকৃত একটি গণমুখী কর্মসূচী বাংলাদেশ সরকারের তরফ হইতে ঘোষণা করা একান্ত আবশ্যক হইয়া পড়িয়াছে।
.
ইয়াহিয়া চক্রের পাক-ভারত যুদ্ধের হুমকির দরুন বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের ক্ষেত্রে নয়া পরিস্থিতির উদ্ভব হইয়াছে এই পরিস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধকে অগ্রসর করিয়া নেওয়ার জন্য উপদেষ্টা পরিষদের সামগ্রিক ও ঐক্যবদ্ধ পরিকল্পনা গ্রহণ করা দরকার। ইয়াহিয়া-চক্র যদি মরিয়া হইয়া যুদ্ধ বাধায় তাহা হইলেও শত্রু যেন পাক-ভারত যুদ্ধের মধ্য দিয়া বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নটিকে চাপা দেওয়ার কুমতলব হাসিল করতে না পারে বরং বাংলাদেশে উহার পরাজয় ত্বরান্তিত হয় সে জন্য বাংলাদেশের সকল সংগ্রামী শক্তিকে প্রস্তুত থাকিতে হইবে। বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী এবং সাড়ে সাত কোটি নর-নারী যেন একটি মানুষের ন্যায় ঐক্যবদ্ধ ও ক্ষিপ্রতার সহিত শ্ত্রুর উপর ঝাপিয়া পড়িতে পারে সে জন্য একটি সামগ্রিক অভ্যূত্থানের পরিকল্পনা তৈরী করা দরকার। উপদেষ্টা পরিষদের সামনে ইহাও আজ একটি মুখ্য করণীয় হিসাবে হাজির হইয়াছে। এ ব্যাপারে কাল বিলম্ব করা চলেনা ।
.
.
শফিকুল ইসলাম
<৬,৯৮,১৫৮-১৫৯>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
ঐক্যবদ্ধভাবে চূড়ান্ত আঘাত হানিয়া শত্রুকে পর্যুদস্ত কর | স্বাধীন বাংলা
১ম বর্যঃ ১৯শ সংখ্যা |
১৪ নভেম্বর, ১৯৭১ |
ঐক্যবদ্ধভাবে চূড়ান্ত আঘাত হানিয়া শত্রুকে পর্যুদস্ত কর
যে-স্বাধীনতার বেদীমূলে অগনিত দেশবাসী অকাতরে আত্মবলি দিয়াছেন
উহার প্রতি বেইমানী বরদাশত করা হইবে না।
(নিজস্ব বার্তা পরিবেশক)
বাংলাদেশ সরকারের সর্বদলীয় উপদেষ্টা পরিষদ ঐক্যবদ্ধভাবে চরম আঘাত হানিয়া পাক জঙ্গীশাহীর ধ্বংসকে ত্বরান্বিত করার জন্য সমগ্র জনগণ ও সকল মুক্তি সংগ্রামীর প্রতি আহ্বান জানাইয়াছেন। উপদেষ্টা পরিষদ বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য আপোষহীন লড়াইয়ের সঙ্কল্প পুনরায় ঘোষনা করেন এবং যে স্বাধীনতার জন্য অগনিত দেশবাসী অকাতরে আত্মদান করিয়াছেন উহার সহিত কোন অবস্থাতেই বেঈমানী হইবে না বলিয়া ওয়াদা করেন।
.
উপদেষ্টা পরিষদ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সহায়তার জন্য ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের ভুমিকায় প্রশংসা করেন।
.
গত ৬-৭ নভেম্বর মুজিব নগরে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সভায় উপরোক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহন ও অভিমত প্রকাশ করা হয়। এই সভায় সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমেদ এবং অংশ গ্রহন করেন বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির শ্রী মনি সিং, আওয়ামী লীগের জনাব আবদুস সামাদ আজাদ ও শ্রী ফণী ভূষণ মজুমদার, ন্যাশনাল আওয়ামী লীগ পার্টির অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ ও কংগ্রেস নেতা শ্রী মনোরঞ্জন ধর। ইহা ছাড়া মন্ত্রিসভার সদস্যবর্গও সভায় যোগদান করেন।
.
বৈঠকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি এবং মুক্তি সংগ্রামের অগ্রগতি পর্যালোচনা করিয়া সর্বসম্মতিক্রমে নিম্নলিখিত প্রস্তাবসমূহ গ্রহণ করা হয়ঃ
(১) কমিটি মনে করে যে, ইহাহিয়ার যুদ্ধবৎ প্রস্তুতি ভারত-পাকিস্থান যুদ্ধ বাধানোর প্রকাশ্যে পায়তারা বাংলাদেশ স্বাধীনতার প্রশ্নও দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধের বাহিনীর বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধের ক্রমবর্তমান সাফল্য হইতে বিশ্বের দৃষ্টি অন্যত্র সরানোরই একটি কুমতলব। কমিটি শত্রুর স্পষ্টতঃ দৃশ্যমান দূর্বলতাসমূহের পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ এবং শত্রুর পতন দ্রুততর করার উদ্দেশ্য তাহার উপর ঐক্যবদ্ধ ও চরম আঘাত হানার জন্য সকল শ্রেনীর সম্প্রদায়ের মানুষ এবং সকল স্তরের মুক্তি সেনানীদের প্রতি আহ্বান জানাইতেছে।
(২) কমিটি সভ্যতার সকল নিয়ম কানুন ভঙ্গ করিয়া শেখ মুজিবর রহমাঙ্কে আব্যাহতভাবে আটক রাখার বিরুদ্ধে নিন্দা প্রকাশ করিতেছে এবং বাস্তবকে স্বীকার করিয়া লইয়া অবিলম্বে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তিদানের জন্য পাকিস্তান সরকারের প্রতি আহ্বান জানাইতেছে।
(৩) কমিটি জালিয়াতিমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে ইয়াহিয়ার প্রস্তাবিত বে-সামরিক শাসনে প্রত্যাবর্তনকে শঠতা বলিয়া মনে করে। ইহা শুধু তাহাদেরকেই মুগ্ধ করিবে যাহারা ইহাকে বিশ্বাস করার ভাব বা বিশ্বাস করিতে ইচ্ছুক।
(৪) কমিটি ভারতের জনগণ ও সরকারকে বাংলাদেশের প্রশ্নে তাহাদের ঐক্যবদ্ধ সমর্থনের জন্য কৃতজ্ঞতা জানাইতেছে এবং বাংলাদেশ প্রশ্নে সোভিয়েত ইউনিয়নের নীতির প্রশংসা করিতেছে।
(৫) কমিটি সাড়ে ৭ কোটি মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষার ন্যাষ্যতার প্রতিনিধিত্বকারী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের জন্য বিশ্বের সরকারসমুহের প্রতি আবেদন জানাইতেছে।
(৬) কমিটি লক্ষ করিতেছে যে, কতিপয় দেশ বাংলাদেশের ব্যাপারে সহানুভূতিশীল হইলেও তাহাদের মনোভাব প্রকাশ্যে দ্বিধাগ্রস্ত। কমিটি ন্যায়, গণতন্ত্র ও মুক্তির পক্ষে তাহাদেরকে আরও সোচ্চার হইহা আগাইয়া আসার আহ্বান জানাইতেছে।
(৭) যে সব দেশের সরকার ইয়াহিয়া খানকে অস্ত্রশস্ত্র ও অন্যান্য উপকরন দিয়া বাংলাদেশে গণহত্যার সাহায্য করিতেছে, কমিটি সে সব দেশের জনগণের প্রতি আবেদন জানাইতেছে, তাহারা যেন বাংলাদেশের ব্যাপারে তাহাদের সরকারের এই নিষ্ঠুর হস্তক্ষেপ বন্ধ করেন।
(৮) কমিটি পূর্ণ স্বাধীনতার লক্ষ্যকে দ্রুত বাস্তবায়িত করার সঙ্কল্প পুনরায় ব্যক্ত করিতেছে এবং স্বাধীনতার কমে সমাধানের নিমিত্ত প্রদত্ত সকল বক্তব্য ও ফর্মূলা প্রত্যাখান করিতেছে।
(৯) স্বাধীনতার জন্য যাহারা জীবন দিয়াছেন, তাহাদের ত্যাগ স্মরণ করার সঙ্গে সঙ্গে কমিটি ঐসব নিহত বীরদের সহিত সংহতি ঘোষনা করিতেছে এবং শপথ গ্রহণ করিতেছে যে, যে কারনে তাহারা সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করিয়াছেন, উহার সহিত কখনও বিশ্বাস ভঙ্গ করা হইবে না।
.
শেষ দুইটি প্রস্তাবে কমিটি নয়াদিল্লীস্থ পাকিস্তানী হাইকমিশনে আটক জনাব হোসেন আলী ও তাহার স্ত্রী-কন্যাদের মুক্তি দাবী করে উরিষ্যার প্রলয়ঙ্কারী ঘুর্নিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্থদের প্রতি গভীর সহানুভূতি জ্ঞাপন করে।
.
শফিকুল ইসলাম
<৬,৯৯,১৬০-১৬১>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
গ্রাম বাংলায় জঙ্গীশাহীর কর্তৃত্ব অচল | স্বাধীন বাংলা
১ম বর্যঃ ১৯শ সংখ্যা |
১৪ নভেম্বর, ১৯৭১ |
আয় নাই, ঘরে খাদ্য নাই, ভয়াবহ সঙ্কট
গ্রাম বাংলায় জঙ্গীশাহীর কর্তৃত্ব অচল
(নিজস্ব বার্তা পরিবেশক)
.
বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে পাক জঙ্গী শাহীর কর্তৃত্ব সম্পূর্ণ ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে। অধিকৃত এলাকার বিভিন্ন অঞ্চল হইতে আমাদের নিজস্ব সংবাদদাতাগণ যে প্রত্যক্ষদর্শীর রিপোর্ট পাঠাইয়াছেন তাহাতে বলা হয়, সৈন্যহাহিনী শহরগুলি হইতে সচারচর বাহির হয় না। তদুপরি পাক জঙ্গীশাহী ভারতের সহিত যুদ্ধ প্রস্তুতির অঙ্গ হিহাবে সেনাবাহিনীর প্রধান অংশকে সীমান্ত অঞ্চলে মোতায়েন করায় অধিকৃত বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে জঙ্গীশাহীর শাসন কার্যত রাজাকার ও অবাঙ্গালী পুলিশ বাহিনীর লুটপাট ও জবরদস্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ কিন্তু অধিকৃত এলাকায় পাক সরকারের প্রশাশন সম্পূর্ণ অচল এবং মুক্তিবাহিনী ও স্থানীয় ভিত্তিতে গড়িয়া ওঠা ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামে পরিষদগুলির কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হইহাছে। এইসব এলাকায় বাংলাদেশ সরকারের বেসামরিক প্রশাসন চালু করা সম্ভব এবং অত্যান্ত দরকার।
.
পাক হানাদার বাহিনী কর্তৃক অধিকৃত শহরগুলিতে স্কুল-কলেজ কিছু কিছু খোলা হইলেও গ্রামাঞ্চলে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ বন্ধ।
.
পাক দস্যু বাহিনী সামরিক অভিযান চালাইবার পর স্থানীয় সমাজ বিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি তথা পাক দালালেরা জনসাধারনের উপর নির্যাতন, লুটতরাজ প্রভৃতি দুষ্কর্ম করে। কিন্তু পরবর্তীকালে মুক্তিহাহিনী ও স্থানীয় গেরিলা বাহিনীগুলি সংঘবদ্ধ হইয়া ইহাদিগকে শায়েস্তা করে। বর্তমানে এই মহলটি একেবারে কোনঠাসা এবং মুখচেনা পাক দালালেরা সকলেই গিয়া শহরে আশ্রয় লইয়াছে। গ্রামে যারা আছে তাহারা মৌখিকভাবে হইলেও মুক্তিসংগ্রামের প্রতি সহানুভূতি জানাইয়াছে। কিছু কিছু ভুয়া মুক্তিফৌজ জনসাধারনের উপর অত্যাচার করিত। মুক্তিবাহিনী ও গেরিরা বাহিনীগুলো ইহাদিগকে ঠাণ্ডা করিয়াছে।
.
অর্থনৈতিক সংকট
হানাদার বাহিনীর লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের ফলে জনজীবনে দারুন অর্থনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি হইয়াছে। গত আউশের মওশুমে ধান হয় নাই-পাক সেনাদের অত্যাচারে কৃষকরা ধান বুনিতে ও কাটিতে পারে নাই। আমন ধানের আবাদ হইয়াছে কম শ্রমিক, ব্যবসায়ী, দোকানদার, কর্মচারী, ক্ষেতমজুর প্রভৃতির আয়ের কোন পথ নাই। ধান- চাউলের দর কোন কোন জায়গায় খুবই বেশী- বরিশালের একটি এলাকা হইতে আমাদের প্রতিনিধি জানাইতাছেন, সেখানে নতুন আউশের চাল প্রতিমন ৬০ টাকা দরে ক্রয়-বিক্রয় হইতেছে। আবার যোগাযোগের ব্যাবস্থার ওভাবে পার্শ্ববর্তী উদ্ধৃত্ত এলাকা হইতে ধান চাউল আমদানী করা যাইতেছে না।
.
বরিশাল প্রতিনিধি জানান, কোন কোন এলাকায় শতকরা ৯০ জন অধিবাসী উপবাসে দিন কাটাইতেছে। পাক জঙ্গীশাহী খাদ্যশস্য সরবরাহের ব্যবস্থা করিবে না ইহা জানা কথাই। তাই বাংলাদেশ সরকারের উচিত এই সব গ্রামাঞ্চলে খাদ্যশস্য সরবরাহের উদ্যোগ নেওয়া। বস্তুত খাদ্যসঙ্কট এরূপ তীব্র যে, আমাদের সংবাদদাতা লিখিয়াছেন, এই সমস্যা সমাধানের উপর মুক্তি সংগ্রামের ভবিষ্যত বহুল পরিমাণে নির্ভরশীল।
.
.
শফিকুল ইসলাম
<৬,১০০,১৬২-১৬৩>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকার অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়েছে | স্বাধীন বাংলা
১ম বর্ষঃ ১৯শ সংখ্যা |
১৪ নভেম্বর, ১৯৭১ |
বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকার অর্থনীতি
একেবারেই ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে
(নিজস্ব বার্তা পরিবেশক)
বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকার অর্থনীতিতে চরম অচলাবস্থা বিরাজমান। গত পহেলা মার্চ অসহযোগ আন্দোলনের সূচনা হইতেই অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কর্মচাঞ্চল্য ভাটা পড়ে, গত কয়েক মাসের লড়াই উহাকে একেবারে অচল করিয়া দিয়াছে।
কলকারখানা আজো পুরোপরি চালু করা সম্ভব হয় নাই। ব্যবসা-বানিজ্য বন্ধ বললেই চলে। কৃষিক্ষেত্রে কিছুটা তৎপরতা থাকিলেও ব্যবসাকেন্দ্রগুলি ধ্বংস হওয়ায় কৃষি পন্যের বাজারজাতকরণের সুবিধা খুবই সীমাবদ্ধ।বাংলাদেশের দুটি সামুদ্রিক বন্দর চট্টগ্রাম ও চালনা শ্রমিকদের অসহযোগিতা ও মুক্তিফৌজের আঘাতে আঘাতে প্রায় অচল আমদানী রপ্তানী প্রায় সম্পূর্ণ বন্ধ। যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থা ভাঙ্গিয়া পড়ায় অধিকৃত এলাকার অভ্যান্তরেও পন্য চলাচল খুবই সামন্য। ফলে স্থানীয় চাহিদা ও সরবরাহের ভিত্তিতেই জিনিসপত্রের দাম নির্ধারিত হইতেছে।
আমাদের সংবাদদাতাদের প্রেরিত রিপোর্ট হইতে জানা জায়, কৃষকরা যাহা উৎপাদন করে উহা পানির দরে বিক্রি হইতেছে আর শিল্পজাত পন্য বা যাহার সরবরাহ বাহির হইতে আসে সেগুলি রীতিমত অগ্নিমূল্য। ধান-চাউলের দর বেশী না হওয়া সত্তেও লোকের ক্রয়ক্ষমতা একেবারেই লোপ পাওয়ার ফলে দুর্ভিক্ষাবস্থা বিরাজ করিতেছে।
ময়মনসিংহ জিলার একটি এলাকা হইতে আমাদের একজন সংবাদদাতা জানাইয়াছেনঃ
ভৈরববাজার, নরসিংদী ও নারায়ণগঞ্জ এই তিনটি মূল ব্যবসা কেন্দ্রের সহিত প্রত্যক্ষ যোগাযোগের অভাবে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের আমদানী ব্যহত হওয়ায় দ্রব্যমূল্য ভীষনভাবে বৃদ্ধি পাইয়াছে। কাপড়-চোপড়, ঔষধ, লবন, কেরোসিন তৈল, সরিষার তৈল, চা, সিগারেট, চিনি প্রভৃতি মূল্য দ্বিগুন হইতে তিনগুন বৃদ্ধি পাইয়াছে। চাউলের দর প্রতিমণ ৫০ টাকা, আটা ৪২ টাকা।
পাট
কৃষকের প্রধান অর্থকরী ফসল পাটের উৎপাদন এবার খুবই কম। স্থানীয়ভাবে অনুমিত হয়, অন্যান্য বৎসরের তুলনায় অর্ধেক পাট উৎপাদন হইয়াছে।
পাট বোনার মওশুমে পাক বাহিনীর নির্মম অত্যাচার শুরু হওয়ায় কৃষকের পাট বুনিতে পারে নাই। অনেক কৃষক জঙ্গীশাহীর সহিত অসহযোগিতার উদ্দেশ্যে পাটক্ষেত ভাঙ্গিয়া ধান বুনিয়াছিল তাছাড়া পাক সৈন্য ও রাজাকার বাহিনীর অত্যাচারে বহু কৃষক বাড়ীঘর ছাড়িয়া চলিয়া যাওয়ায় ক্ষেতের পাট ক্ষেতে শুকাইয়াছে। ফলে পাট উৎপাদন বিরাজ গুরুতররূপে হ্রাস পাইয়াছে।
নারায়নগঞ্জে পাটের দর চড়া থাকা সত্ত্বেও কৃষকেরা উহার সুবিধা পাইতেছেনা অনেক ভাল ভাল পাটের বাজার পাক হানাদার সৈন্যরা পুড়াইয়া দেওয়ায় পাট বিক্রয়ের দারুন অসুবিধা সৃষ্টি হইয়াছে। আবার আর্থিক সঙ্কট এবং পাক বাহিনী বা রাজাকারদের লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ প্রভৃতির আশঙ্কায় কৃষক ঘরে ঘরে পাট মজুত রাখা নিরাপদ মনে করিতে পারে নাই। কৃষকের এই অসহায় অবস্থার সুযোগ ফড়িয়া ব্যাপারীরা গ্রাম হইতে পানির দরে পাট কিনিয়া নিয়াছে। পাটের দর সূতী মনপ্রতি ২০ হইতে ৩০ এবং বগী ৩৫ হইতে ৪০ টাকা। নিরপত্তার অভাব হেতু ব্যবসায়ীরা সরাসরি নারায়নগঞ্জে পাট চালান না দিয়া নরসিংদীতে বিক্রি করিয়া দেয়। লুটেরা রাজাকার বাহিনী পাটের নৌকা আটক করিয়া হয়রানির একশেষ করে। ফলে নারায়নগঞ্জ বন্দরে পাটের দর ও গ্রামের বাজারে কৃষক যে দাম পায়, উহার মধ্যে বিস্তর ব্যবধান সৃষ্টি হইয়াছে।
অন্যান্য অর্থকরী ফসল
এই মওশুমে কলা, লিচু, মূলা, হলুদ, মরিচ, পেয়াজ, রসুন, আদা, তরিতরকারী প্রভৃতি বিক্রি করিয়া কৃষকের হাতে কিছু পয়সা আসিত। কিন্তু বাজারজাতকরণের অসুবিধা এবং ক্রয়ক্ষমতা লোপ পাওয়ার দরুন স্থানীয় চাহিদা হ্রাসের ফলে এই সবের মূল্য শতকরা ৪০ হইতে ৫০ ভাগ কমিয়া গিয়াছে।
খাদ্য-শস্য
এই এলাকায় চাউলের দর বর্তমান মণপ্রতি ৪৫ টাকা হইতে ৫০ টাকা নিরাপত্তার অভাবে ধান চাউলের মজুত ব্যবসা নাই। পার্শ্ববর্তী ভাটি অঞ্চলের বিচ্ছিন্নতার দরুন সেখানে ধান প্রতিমণ ৮ হইতে ১০ টাকা এবং চাউল ১৫ হইতে ২০ টাকা দরে বিক্রি হইতেছ। যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থার অভাবে মাল চলাচল নাই।
ভাটি অঞ্চলের ধানই সাম্বৎসরের একমাত্র ফসল। কৃষক উহা পানির দরে বিক্রি করিয়া দিতে বাধ্য হইতেছে কারন লুটেরা রাজাকার বাহিনীর দৌরাত্ম্যে কৃষক ঘরে ধান চাউল মজুত রাখিতে ভরসা পাইতেছে না। অবিশ্বাস্য হইলেও সত্যি যে, একদিকে ধান চাউলের নিম্ন মূল্য ও অন্যদিকে দূর্ভিক্ষের করাল ছায়া পাশাপাশি বিরাজ করিতেছে। রুটি রোজগারের অভাবে গ্রামের গরীব মানুষ ক্ষেতমজুর ভূমিহীন প্রভৃতি উপবাসে দিন কাটাইতেছে। তাছাড়া আমন ফসলের ফলন বিক্রি ভাল হয় নাই। সার ও কীটনাশকের অভাবে অধিক উৎপাদনশীল ইরি ধানের চাষ ক্ষতিগ্রস্থ হইয়াছে। যুদ্ধাবস্থার দরুন আউশ ধান সময় মত বোনা ও কাটা সম্ভব হয় নাই ফলে কৃষকের সামনে অন্ধকার ভবিষ্যত।
তাঁত শিল্প
সুতার অভাবে গ্রামীন তাত শিল্প ধ্বংসের মুখে। পশ্চিম পাকিস্তানী মিলের কাপড় চালু করার উদ্দেশ্য হানাদার পাক সৈন্যরা অনেক গ্রামে তাত পুড়াইয়া দিয়াছে। যথাঃ বাজিতপুর, বসন্তপুর, নিতাইকান্দি, কাপাসটিয়া পার্শ্ববর্তী ঢাকা জেলার নরসিংদী এলাকার তাঁত শিল্পও পাক বাহিনী ধ্বংস করিয়া দিয়াছে।
বেকার সমস্যা
এই অর্থনৈতিক অবস্থার পটভুমিতে গ্রামাঞ্চলে বেকার সমস্যার তীব্রতা বৃদ্ধি পাইয়াছে। শিক্ষক সরকারী কর্মচারী বেসরকারী চাকুরীজিবী বেকার হইয়া গ্রামে আশ্রয় লইয়াছে। এবং ভরনপোষনের জন্য নিজেদের যৎসামান্য জমির উপর নির্ভর করিতেছে। অধিকাংশ কলকারখানা বন্ধ থাকায় শ্রমিকেরা দলে দলে গ্রামে আসিয়া ভিড় জমাইয়াছে। সরকারী ও বেসরকারী অফিসের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীরাও বেকার হইয়া ক্ষেতমজুরের কর্মপ্রার্থী হইয়া একদিকে বেকার সমস্যা বৃদ্ধি করিয়াছে অন্যদিকে ক্ষেত মজুরের চাহিদা ও মজুরী হ্রাস পাওয়ার কারন ঘটাইয়াছে।
.
.
শফিকুল ইসলাম
<৬,১০১,১৬৪>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
দিনাজপুরের মুক্তাঞ্চলে সর্বদলীয় কমিটি গঠিত | স্বাধীন বাংলা
১ম বর্ষঃ ২০শ সংখ্যা |
১ নভেম্বর, ১৯৭১ |
জনজীবনের বহুমুখী সমস্যা সমাধানের তাগিদে
দিনাজপুরের মুক্তাঞ্চলে সর্বদলীয় কমিটি গঠিত
(নিজস্ব প্রতিনিধি)
বাংলাদেশের উত্তরতম প্রান্তে দিনাজপুরের মুক্ত এলাকা তেতুলিয়ার বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসন, আইন, শৃংখলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও গণজীবনের সুষ্ঠু পুনর্বাসন সঙ্ক্রান্ত সকল বিষয়াদি দেখা শোনার জন্য উক্ত এলাকা হইতে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্য জনাব মোশারফ হোসেনের আহবানে কমিউনিস্ট পার্টি, আওয়ামীলীগ ন্যাপসহ একটি সর্বদলীয় উপদেষ্টা কমিটি গঠিত হইয়াছে। কমিটিতে জনাব হোসেন ছাড়া অন্যান্যরা হইতেছেন জনাব তফিল হোসেন, জনাব খোরশেদ আলী, জনাব নজির হোসেন, জনাব জমীর আলী, জনাব আব্দুস সাত্তার মোল্লা, জনাব নুরুল হক, জনাব ওয়াহেদ হোসেন, জনাব মোহাম্মদ আলী, জনাব নিজামুদ্দিন আহমদ, জনাব খাদেম আলী, জনাব নাফিসউদ্দিন, জনাব করিমউদ্দিন, জনাব গফুর উদ্দিন আহমদ প্রধান, জনাব লুৎফর রহমান, জনাব তবিবুর রহমান ও জনাব মঈনুল হক। উপদেষ্টা কমিটি গঠনের ফলে স্থানীয় জনসাধারনের মধ্যে বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার সৃষ্টি হইয়াছে।
গত ৯ই নভেম্বর কালান্দিগঞ্জে জনাব মোশাররফ হোসেন চৌধুরীর আহ্বানে অনুষ্ঠিত এক সর্বদলীয় সভায় এই উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হয়। এই সভায় তেতুলিয়া থানার আওয়ামীলীগ, কমিউনিষ্ট পার্টি, ন্যাপ, ছাত্র ইউনিওন, ছাত্রলীগ, কৃষক সমিতি, শিক্ষক সমিতি প্রভৃতি রাজনৈতিক ও গণসংগঠনের প্রতিনিধি ছাড়াও সকল স্তরের জনগণের প্রতিনিধি স্থানীয় ব্যাক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। সভায় সভাপতিত্ব করেন জনাব জমির আলী।
সভায় জনাব নুরুল হক উপদেষ্টা কমিটি গঠনের প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন এবং উহা সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।
সভায় সংশ্লিষ্ট মুক্তাঞ্চলে সমস্যাদি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা হয় এবং সর্বসম্মতিক্রমে তিনটি প্রস্তাব গৃহীত হয়।
প্রথম প্রস্তাবে মুক্তাঞ্চলে আসন্ন মরসুমে মালিকবিহীন পরিত্যাক্ত জমির ফসলাদি কাটা এবং বিলি ব্যবস্থা সম্পর্কে সরকারের নীতি কি তাহা অবগত হওয়ার জন্য কমিটি জনাব মোশাররফ হোসেন এম. এন এ কে অনুরোধ করে।
দ্বিতীয় প্রস্তাবে উক্ত এলাকার যে সব সরকারী ও পরিত্যাক্ত মালিকবিহীন সম্পত্তি বা উহার আয় যাহাতে বাংলাদেশ সরকারের হাতে আসে তাহার জন্য জনাব মোশাররফ হোসেন এম এন একে উপদেষ্টা কমিটির পক্ষ হইতে অবিলম্বে সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পত্তির একটি হিসাব গ্রহন করিতে অনুরোধ জানানো হয়।
অপর প্রস্তাবে উক্ত এলাকায় সরকার অনুমোদিত যে ইয়ুথ ক্যাম্পটি কার্যতঃ নিস্ক্রীয় রহিয়াছে, উহাকে সক্রিয় করা ও যুবকদের ট্রেনিং দানের ব্যবস্থা করার জন্য জনাব মোশাররফ হোসেন এম. এন. এ-কে সরকারের সহিত আলাপ আলোচনা করার অনুরোধ জানানো হয়।
.
.
শফিকুল ইসলাম
<৬,১০২,১৬৫-১৬৮>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
রাজনৈতিক হালচাল | স্বাধীন বাংলা
১ম বর্ষঃ ২০শ সংখ্যা |
২১ নভেম্বর, ১৯৭১ |
রাজনৈতিক হালচাল
(ভাষ্যকার)
বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে। ছোট ছোট মুক্তাঞ্চল গড়িয়া উঠিয়াছে বিভিন্ন এলাকায়। এছাড়া গ্রাম এলাকায় পাক হানাদার বাহিনীর তৎপরতা খুবই সীমাবদ্ধ রাজাকার ও পশ্চিম পাকিস্তান হইতে আমদানী করা পুলিশও মুক্তি বাহিনী ও গেরিলাদের অতর্কিত আক্রমনের ভায়ে থানার সদর কার্যালয় ছড়িয়া দূরে যাইতে সাহস পায় না। ফলে বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকার বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চল কার্যত মুক্ত। সেখানে ইয়াহিয়া খান কিনবা তাহার পা-চাটা মালেকের তথাকথিত সরকার শাসন নাই বলিলেও চলে। বাংলাদেশ সরকারের মুক্তিবাহিনী, স্থানীয়ভাবে সংগঠিত আওয়ামীলীগ, ন্যাপ বা কমিউনিস্ট সমর্থক গেরিলা বাহিনী এবং স্থানীয় মুক্তিসংগ্রাম কমিটি (যা বহুক্ষেত্রে উপদেষ্টা কমিটির ধরনে সর্বদলীয় গড়িয়া উঠিয়াছে) প্রভৃতির হাতেই এই সব এলাকার কর্তৃত্ব কার্যত ন্যাস্ত। এই সব মুক্তাঞ্চলে অসামরিক প্রশাসন ব্যবস্থা চালু ও অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের প্রশ্নকে কেন্দ্র করিয়া একটি বড় ও মৌলিক প্রশ্ন সামনে চলিয়া আসিয়াছে। প্রশ্নটি হইল বাংলাদেশ সরকার অর্থনৈতিক ও সামাজিক পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে কোন নীতি, কোন পথ অনুসরন করিবে? মুক্ত এলাকার সমস্যা সমাধান আলাদাভাবে হইতে পারে না। গোটা বাংলাদেশের পুনর্গঠনের প্রশ্নের সহিত ইহা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আজিকার ছোট ছোট মুক্তাঞ্চলগুলিকে গড়িয়া তুলিতে হইবে আগামী দিনের বাংলাদেশের মডেল হিসাবে তাই মুক্তাঞ্চলের পূর্ণগঠনের প্রশ্নকে সামনে রাখিয়া আজ বাংলাদেশ সরকার ও অন্যান্য সকল সংগ্রামী শক্তিকে দেশের ভবিষ্যত সামাজিক অর্থনৈতিক রূপরেখা সম্বন্ধে চিন্তা করিতে হইবে। ইহা এখন আর নিছক তত্ত্বগত বিষয় নয়, ভবিষ্যতের জন্য ইহাকে ফেলিয়া রাখাও চলে না।
স্বাধীন বাংলাদেশের সম্পর্কে অস্পষ্টভাবে হইলেও একটা ধারণা বা ছবি সকলের মনেই আছে ইহার প্রকাশও নানাভাবেই দেখা যাইতেছে। স্বাধীনতার দাবিতে বাংলাদেশের সব মানুষ এক। পশ্চিম পাকিস্তানের কুখ্যাত বাইশটি একচেটিয়া পুজিপতি পরিবার, বড় জমিদার গোষ্ঠী ও উহাদের মুরব্বী সাম্রাজ্যবাদীরা বাংলাদেশের উপর যা এক ধরনের ঐপনিবেশিক শাসন শোষনের জোয়াল চাপাইয়া দিয়াছিল, উহা হইতে মুক্তি চায় প্রতিটি নরনারী এই একচেটিয়া শোষন বজায় রাখার উদ্দেশ্যে উহার যে নিষ্ঠুর সামরিক স্বৈরতন্ত্র কায়েম করিয়াছিল উহাকে ধ্বংস করিয়া জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রন ও গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে বাংলাদেশের সকল শ্রেনীর সকল স্তরের মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করিতেছে।
কিন্তু ইহার অর্থ অবশ্য এই নয় যে, বাংলাদেশে সকল শ্রেণি ভেদাভেদ লুপ্ত হইয়া গিয়াছে কিম্বা শ্রেণী স্বার্থের বৈপরীত্য লোপ পাইয়াছে। স্বাধীন বাংলাদেশের ছবিও সকল শ্রেনীর মানুষের মনে এক রকম নয় কৃষক ভাবিতেছে স্বাধীন বাংলাদেশে সে জমি পাইবে, সামন্তবাদী শোষনের নাগপাশ হইতে পাইবে মুক্তি। শ্রমিক ভাবিতেছে সে পাইবে বাঁচার মত মজুরী, কাজের নিরাপত্তা রাজনৈতিক ও ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার। যুগ যুগ ধরিয়া সে সভ্যতার পিলসুজ হইয়া কাটাইয়াছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার মধ্য দিয়া এমন এক উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের দুয়ার খুলিয়া যাইবে যেখানে সে সভ্যতার নির্মাতা হিসাবে উহার ফল ভোগেরও অধিকারী হইবে।
এখন প্রশ্ন হইল, স্বাধীন বাংলাদেশে কোন শ্রেণীর মানুষের স্বপ্ন সফল হইবে? শোষক শ্রেণীর না শোষিত শ্রেণীর? যে শ্রমিক কৃষক-ছাত্র জনতা স্বাধীনতার জন্য বুকের রক্ত ঢালিতেছে তাহাদের শোষন মুক্তির পথ উম্মোচিত করা হইবে, না মুষ্টিমেয় ধনিকের শোষনের অধিকার কায়েম করা হইবে। বাঙালী উদীয়মান ধনিকশ্রেনীর স্বাধীনতা সংগ্রামের স্বপক্ষে-পশ্চিম পাকিস্তানের একচেটিয়া পুজির বিরুদ্ধে ইহারা অতীতেও লড়াই করিয়াছে। স্বাধীনতা সংগ্রামে ইহারা মিত্র শ্রেণীভুক্ত। তাহা সত্ত্বেও একথা মনে রাখিতে হইবে যে, ইহাদের শ্রেনী চরিত্র শোষকের। কাজেই স্বাধীন বাংলাদেশে ইহাদিগকে যদি অবাধ বিকাশের সুযোগ দেওয়া হয় শ্রেণীগুলি অর্থাৎ শ্রমিক কৃষক বুদ্ধিজিবী তথা সকল মেহনতী মানুষ শোষনের জোয়ালে আবদ্ধই থাকিয়া যাইবে। শোষকের পরিবর্তন হইলেও শোষনের অবসান ঘটিবেনা। তাছাড়া পুজিবাদী ব্যবস্থা কায়েম করা হইলে যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ আজ ইহাহিয়া চক্রকে অস্ত্র অর্থ উপদেষ্টা দিয়া বাংলার নরমেধাযজ্ঞে সহায়তা করিতেছে, সাহায্য ঋণ ও বিশেষজ্ঞের জন্য উহাদিগকেই স্বাধীন বাংলাদেশে ডাকিয়া আনিতে হইবে। সাম্রাজ্যবাদী শোষনের শৃংখলে বাঁধা পড়িবে বাংলাদেশ। সোনার বাংলা আরও রিক্ত, আরও কঙ্কালসার হইয়া পড়িবে।
ইহার বিকল্প কি? ইহার বিকল্প রাস্তা হইল পুঁজিবাদী পথ পরিহার করা শুধু শোষক পরিবর্তন নয়, শোষনমূলক ব্যবস্থারই চির অবসানের দিকে পদক্ষেপ নেওয়া। শোষিত নিপীড়িতের রাজ কায়েম করা। ইহার অর্থ এই নয় যে, পুঁজিপতিদের গলা কাটিয়া ফেলা হউক কিম্বা যে লোক আন্ডা বেচিয়া খায় তাহার মুরগীটিকে জাতীয়করন করিয়া লওয়া হউক। বাংলাদেশের সামাজিক বিকাশের বর্তমান স্তরে বেসরকারী উদ্যোগের ইতিবাচক ভূমিকা শেষ হইয়া যায় নাই। কাজেই বেসরকারী পুঁজি বা উদ্যোগকে সম্পূর্নরূপে নাকচ করার প্রশ্ন আসে না। কিন্তু এই পুঁজিকে জনসাধারনের উপর অবাধ শোষন চালাইয়া একচেটিয়া পুঁজিতে পরিনত হইতে দেয়া চলিবে না। রাষ্ট্রায়ত্ব খাতকে জাতীয় অর্থনীতির নিয়ামক শক্তিরূপে গড়িয়া তুলিতে হবে। ব্যাংক, বীমা বৃহৎ শিল্প, পাট শিল্প ও পাট ব্যবসা, আমদানী রপ্তানী ব্যবসা প্রভৃতি জাতীয়করন করিয়া রাষ্ট্রায়ত্ত বা সরকারী খাতকে শক্তিশালী করিতে হইবে। সরকারী খাতের পরিচালনা ব্যবস্থার গণতান্ত্রিকরন, পরিচালনার ক্ষেত্রে শ্রমিকদের অংশ গ্রহনের নিশ্চয়তা বিধান এবং সরকারী খাতের দক্ষতা বৃদ্ধির ও ব্যবস্থা নিতে হইবে। জাতীয় অর্থনীতির বিকাশকে পরিচালিত করিতে হইবে অপুঁজিবাদী পথ-যাহা পরিনতি লাভ করিবে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি ও সমাজ ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠায়।
অর্থনৈতিক র্পুনগঠনেও একটি প্রধান কাজ হইল, ভুমি ব্যবস্থার সংস্কার তথা কৃষির পুর্নগঠন বাংলাদেশে ভুমি সংস্কারের প্রশ্নটিকে দীর্ঘদিন যাবৎ ফেলিয়া রাখা হইয়াছে। ১৯৫০ সালে জমিদারী প্রথার উচ্ছেদ হইলেও জমিদারী উচ্ছেদ হয় নাই।
আইয়ুব খানের আমলে ভূমি ব্যবস্থার ‘সংস্কার’ করা হয় উলটা দিকে। এর আগে বাংলাদেশে মাথাপিছু জমির মালিকানার সর্বোচ্চ সীমা বা সিলিং ছিল ৩৩ একর বা ১০০ বিঘা। আইয়ুবী শাসনে তথাকথিত ‘ভূমি সংস্কার’ আইনে বাড়াইয়া ৩৭৫ বিঘায় নির্ধারিত করা হয়। অথচ বাংলাদেশে জমির উপর জনসংখ্যার অতিরিক্ত চাপের পরিপ্রেক্ষিতে সিলিং নামাইয়া ৫০ বিঘা নির্ধারিত করা ছিল খুবই জরুরী।
১৯৫০ সালের জমিদারী দখল আইন এবং সিলিং সংক্রান্ত বিধি কিংবা পরবর্তীকালের আইয়ুব আমলের তথাকথিত ‘ভুমি সংস্কার’ আইন যে কোন গরীব বা অর্থহীন কৃষক এক বিঘা জমিও পায় নাই। বাংলাদেশের শতকরা ৩৫ জন কৃষক ভূমিহীন এবং যাহাদের জমি আছে তাহাদের মধ্যেও শতকরা ৭৮ জনের জমির পরিমাণ পাঁচ এর বা ১৫ বিঘার নিচে (বাংলাদেশে অন্যুন ১৫ বিঘা পরিমাণ জমিকে ইকনমিক হোল্ডিং ধরা হয়)। কাজেই ভুমি সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা জরুরী তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
কিন্তু এই জরুরী কাজটিই হয় নাই এবং না হওয়ার ফলে কৃষিতে সৃষ্টি হইয়াছে বন্ধ্যাত্ব। অধিকাংশ জমির মালিক জমি চাষ করেন না আর যারা জমি চাষ করেন তাহারা জমির মালিক নন। ফলে কৃষির অগ্রগতির পথে এক দুরন্ত বাধা সৃষ্টি হইয়াছে। আবার কৃষি ব্যবস্থার আধুনিকীকরন তথা কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির মারফত কৃষকের হাতে পয়সা না আসার ফলে শিল্পজাত পণ্যের বাজারও রহিয়া গিয়াছে সঙ্কুচিত অবস্থায় এবং শিল্প বিকাশের সম্ভাবনা হইয়াছে খর্ব। এই অবস্থায় অর্থনৈতিক উন্নতির আশা ছিল সুদূর পরাহত।
আজ যখন বাংলাদেশের সংগ্রাম সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে তখন দেশের অর্থনৈতিক রূপরেখায় ভূমি সংস্কার তথা কৃষি পুর্ণগঠনের কর্মসূচীকে আর ফেলিয়া রাখা যায় না। ইহার স্থান হওয়া উচিত অর্থনৈতিক পুনর্গঠন কর্মসূচীর একেবারে পয়লা নম্বরে। পারিবারিক মালিকানাধীন জমির সিলিং কমাইয়া উর্ধ্বপক্ষে ১০০ বিঘা নির্ধারিত করা, উদ্বৃত্ত জমি গরীব কৃষক ও ভূমিহীন্দের মধ্যে বিনামূল্যে বিলি করা, ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির মালিকদিগকে খাজনা হইতে অব্যাহতি দেওয়া, খাজনা প্রথা ধীরে ধীরে উঠাইয়া দিয়া কৃষি আয়কর চালু করা, সমবায় কৃষি খামার গড়িয়া তোলা প্রভৃতি কৃষি পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে আশু করণীয়।
শুধু অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের তাগিদে নয়, স্বাধীনতার লড়াইয়ে কৃষকদিগকে অধিকতর সংখ্যায় উদ্বুদ্ধ করার জন্যো মুক্তি সংগ্রামের একটি প্রধান রণধ্বনি হওয়া উচিতঃ কৃষকের হাতে জমি দাও। বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা হইতেও আমরা এই শিক্ষাই পাইতে পারি। কৃষকের হাতে জমি দেওয়ার ভিত্তিতে মুক্তাঞ্চল গুলিতে ভূমি সংস্কারের কাজে এখনই হাত দেওয়া উচিত। মুক্তাঞ্চলে এই দৃষ্টান্ত স্থাপন করিতে পারিলে অধিকৃত এলাকার কৃষকগণও মুক্তি সংগ্রামে অনুপ্রানিত হইবেন।
সাম্রাজ্যবাদী শোষনের অবসান ঘটান রাজনৈতিক পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে আর একটি জরুরী কাজ। সোনার বাংলা যে শ্মশান, তার পিছনে করাচী-লাহোরের একচেটিয়া পুঁজিপতিদের সাথে সাথে সাম্রাজ্যবাদী বিশেষতঃ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শোষনের অবসান কম নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঋণের সুদ বাবদই প্রতি বৎসর ৭০-৮০ কোটি টাকা পাকিস্থান হইতে লুটিয়া নিত, উহার সিংহভাগ যাইত পূর্ব বাংলা হইতে। অতীতে দেশবাসীর দৃষ্টি এদিকে যথেষ্ট পরিমাণে সজাগ ছিল না। পূর্ব বাংলারূপী চৌবাচ্চাতে দুইটি ছিদ্র ছিল একটি করাচী-লাহোরের একচেটিয়া পুঁজির শোষনের আর অন্যটি সাম্রাজ্যবাদী তথা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শোষনের। বাংলাদেশের সম্পদ পাঁচার বন্ধ করিতে হইলে এই দুইটি ফূটোই বন্ধ করা দরকার। এ ব্যাপারে সরকারের কর্মসূচী হওয়া উচিতঃ (১) অতীতে পাকিস্তানকে দেওয়া ঋণের সমুদয় দায়িত্ব অস্বীকার করা; (২) বাংলাদেশে সাম্রাজ্যবাদী পুঁজি বিনা ক্ষতি পূরণের জাতীয়করণ করা (চা-শিল্প ব্যাংক, বীমা ও রপ্তানী বাণিজ্যে সাম্রাজ্যবাদী পুঁজি রহিয়াছে); এবং (৩) ভবিষ্যতে সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির অনুপ্রবেশের পথ বন্ধ করা।
কোন কোন মহল মনে করেন এবং অনেক সময় প্রকাশ্যে বলিয়াও থাকেন, আগে তো দেশ স্বাধীন হউক, তারপর কর্মসূচীর কথা ভাবিয়া দেখা যাইবে। আবার কোন কোন মহল মনে করেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আসুক, তা হইলেই সব সমস্যার সমাধান হইয়া যাইবে। কিন্তু এগুলি হইল শোষকশ্রেণীর যুক্তি। ১৯৪৬ সালে বলা হইয়াছিল, পাকিস্তান হাসিল হইলেই সব শোষনের অবসান হইবে। কারণ সব মুসলমান ভাই ভাই। আবার কেহ কেহ বলিতেন, মুসলমানদের মধ্যে জমিদার বা বড় পুঁজিপতি বিশেষ কেন নাই, কাজেই পাকিস্তান কায়েম হইলে উহা ‘গরীবের পাকিস্তান’। এইসব ‘যুক্তি’ যে ধোঁকাবাজি ছাড়া কিছু নয়, তা আজ আর কাহাকেও বলিয়া বুঝাইতে হয় না। কাজেই ‘সব বাঙালী ভাই ভাই’ শ্লোগানও কোন কাজের কথা নয়। স্বাধীনতার দাবিতে সকল বাঙালী এক হইলেও বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে স্বার্থের দ্বন্দ্ব রহিয়াই গিয়াছে। কাজেই বাংলাদেশে যাহাতে প্রকৃতই শ্রমিক কৃষক বুদ্ধিজীবি তথা মেহনতি জনতার ন্যায্য স্বার্থ রক্ষা পায় উহার নিশ্চয়তা সংবলিত একটি সামাজিক অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের কর্মসূচী অবিলম্বে ঘোষনা করা দরকার। এবং এই কর্মসূচীর রূপরেখার ভিত্তিতেই আদর্শ হিসাবে গড়িয়া তুলিতে হইবে মুক্তাঞ্চলগুলিকে। শুধু সামাজিক ন্যায়নীতির খাতিরেই নয়, শ্রমিক কৃষক জনতাকে অধিকতর অনুপ্রানিত করিয়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে আরও দুর্বার করিয়া তোলার জন্য ইহা অত্যাবশক।
.
.
শাহজালাল
<৬,১০৩,১৬৯-১৭১>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
মুক্তাঞ্চলে নতুন জীবন গড়িতে হইবে | মুক্তিযুদ্ধ
১ম বর্ষঃ ২২শ সংখ্যা |
৫ ডিসেম্বর, ১৯৭১ |
মুক্তাঞ্চলে নতুন জীবন গড়িতে হইবে
(নিজস্ব বার্তা পরিবেশক)
আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির অনেক অঞ্চল মুক্ত হইয়াছে। নতুন নতুন এলাকা মুক্ত হইতেছে। মুক্তাঞ্চলের মানুষ দখলদার শত্রুসেনাদের কবলমুক্ত হইয়া নিঃশ্বাস ফেলিতেছেন এবং মাতৃভূমির বাকি অংশ মুক্ত করার জন্য মুক্তিবাহিনীর সহিত পূর্ণ সহযোগিতা করিতেছেন। কিন্তু এই সঙ্গে মুক্তাঞ্চলে দেখা দিয়াছে অনেক জটিল সমস্যা। যুদ্ধ বিধবস্ত এলাকাগুলির পুনর্গঠন, জনজীবনে শান্তি ও নিরাপত্তা এবং সুষ্ঠু প্রশাসন গড়িয়া তোলার জন্য বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণের তাগিদ জরুরী হইয়া দেখা দিয়াছে।
.
আমাদের প্রতিনিধি সম্প্রতি রংপুর জেলার ভূরুঙ্গামারী, নাগেশ্বরী, পাটগ্রাম ইত্যাদি মুক্তাঞ্চল পরিভ্রমণ করিয়া এই সকল ( এখানে লিখা সলক) সমস্যার কথা জানাইয়াছেন।
.
পাক বাহিনীর পোড়ামাটি নীতি
সর্বত্রই পিছু হটার সময় পাক বাহিনী পোড়ামাটি নীতি গ্রহণ করিয়া সব কিছু জ্বালাইয়া পোড়াইয়া ধবংস করিয়া দিতেছে। মুক্তি বাহিনীর অগ্রগতির মুখে ভূরুঙ্গামারী ও নাগেশ্বরী থানা ত্যাগ করার সময় হানাদার শয়তানরা গ্রামবাসীদের উপর এলোপাতাড়ি গুলি চালাইয়া তিন শতাধিক লোককে হত্যা করে, বহু বাড়িঘর জ্বালাইয়া দেয়, এমন কি পেট্রোল দিয়া জমির পাকা ধানে আগুন ধরাইয়া দেয়। কয়েকটি সড়ক সেতুও পাক সেনারা যাইবার সময় ধবংস করিয়া দিয়াছে। নিজদলীয় রাজাকারদেরও পাক সেনারা গুলি করিয়া হত্যা করিয়াছে।
.
এইভাবে শত্রুসেনারা পূর্ব দখলকৃত গ্রামগুলিকে যাইবার সময় শ্মশানে পরিণত করিয়াছে। মুক্তাঞ্চলে নিজ বাড়িঘরে যাহারা ফিরিয়া আসিতেছেন, তাহাদের আশ্রয় নাই, বস্ত্র নাই, ক্ষেতের ধান বিনষ্ট হওয়ায় খাদ্যও নাই।
.
মুক্তাঞ্চলের জনগণকে বাঁচাইবার জন্য এখনই জরুরী ভিত্তিতে রিলিফের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। যাহাদের ঘরবাড়ি নাই তাহাদের পুনর্বাসনের জন্য ঘর তুলিয়া দেওয়ার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। খাদ্য, ঔষধপত্র ও চিকিৎসকের তীব্র অভাব রহিয়াছে।
.
অর্থনীতি
মুক্তাঞ্চলগুলি অর্থনৈতিক দিক (দিকে) হইতে কার্যত বন্ধ এলাকাতে পরিণত হইয়াছে। স্বাভাবিক ব্যবসা-বানিজ্য নাই। এই সকল অঞ্চলের ব্যবসা বানিজ্য পূর্বে দখলকৃত এলাকার সহিত মুক্ত থাকায় এখন সরবরাহের ক্ষেত্রে দারুণ উচ্চমূল্য। লবণ, কেরোসিন, দেশলাই, আটা, চিনি ইত্যাদি প্রায় পাওয়াই যায় না। লবণ প্রতি সের কোথাও কোথাও ৫ টাকা ও কেরোসিন ৮ টাকায় বিক্রয় হইতেছে। গরীব, ক্ষেত মজুর দিনমজুর ও সাধারণ কৃষকের এইগুলি ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। এই শ্রেণীর জনগণের হাতে এখন কোন কাজও নাই। এই সকল এলাকায় প্রধান অর্থকরী ফসল পাট ও তামাক যাহাদের কিছু আছে তাহারাও দাম পাইতেছে না।
অভিজ্ঞ মহলের মতে, মুক্তাঞ্চলে সরবরাহ ও কিছুটা স্বাভাবিক ব্যবসা বাণিজ্য চালু করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের উচিত প্রতিবেশী ও মিত্র ভারতের সহিত আলাপ আলোচনা করিয়া ভারত ও মুক্তাঞ্চলের মধ্যে ব্যবসা- বাণিজ্য চালুর করা। তবে, সেরূপ ক্ষেত্রে যাহাতে বিশৃঙ্খলা ও অবাধ মুনাফার প্রবণতা দেখা না দেয় তাহার জন্য বর্তমান পরিস্থিতিতে জনগণের প্রয়োজনের প্রতি লক্ষ্য রাখিয়া ব্যবসা বানিজ্য সরকারী নিয়ন্ত্রণে ও কো-অপারেটিভ ভিত্তিতে পরিচালিত হওয়া উচিত তাহারা মনে করেন।
.
প্রশাসন
মুক্ত অঞ্চলসমূহে বাংলাদেশ সরকারের বেসামরিক প্রশাসন চালু হইতেছে। আমাদের প্রতিনিধি জানাইতেছেন, রংপুরের মুক্তাঞ্চলগুলিতে থানা প্রশাসন চালু হইয়াছে, অসামরিক প্রশাসনের জন্য অনেক এলাকার আঞ্চলিক কাউন্সিল গঠন করা হইতেছে। বাংলাদেশ সরকারের রাজস্ব আদায় শুরু হইয়াছে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও কিছু কিছু খোলা হইতেছে।
.
ভূরুঙ্গামারী ও নাগেশ্বরী এলাকায় সরকারী হাট-বাজার হইতে তোলা আদায় করিতেছেন। প্রতিরক্ষা ও প্রশাসনের নাম করিয়া কোন কোন স্থানে উচ্চহারে তোলা হইতেছে বলিয়া কৃষকরা অভিযোগ করিতেছেন। এই বিষয়ে সরকারের সতর্ক দৃষ্টি ( এখানে সৃষ্টি) দেওয়া প্রয়োজন। বর্তমান অবস্থায় শুধু সচ্ছল ব্যবসায়ীর নিকট হইতেই তোলা আদায় করা উচিত বলিয়া মুক্তাঞ্চলের মানুষ মনে করেন।
.
প্রয়োজন ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা
মুক্তাঞ্চলের বহুমুখী জটিল সমস্যা সমাধানের জন্য প্রয়োজন দক্ষ দুর্নীতিমুক্ত ও সুষ্ঠু প্রশাসন গড়িয়া তোলা। ইহার জন্য বাংলাদেশ সরকার ও মুক্তিযুদ্ধ শরিক সকল দলের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা প্রয়োজন। হানাদার পাকিস্তানীরা বিতাড়িত ( এখানে বিতারিত) হওয়ার পর কোন এলাকায় যাহাতে প্রশাসনিক শূন্যতা দেখা না দেয় তাহার জন্য প্রশাসনকে জনগণ ও সকল গণতান্ত্রিক দলের সক্রিয় অংশগ্রহণ সমভব করিয়া তুলিতে হইবে।
.
পুনর্গঠনের কঠিন কাজকে সমভব করিয়া তোলার জন্য সর্বদলীয় ভিত্তিতে প্রশাসনিক কাঠামো দাঁড় করান প্রয়োজন।
.
কিন্তু এ যাবৎ যে সকল জোনাল, সাব- জোনাল, থানা ও ইউনিয়ন কাউন্সিল গঠন করা হইয়াছে, সেগুলি কোনটি সর্বদলীয় ভিত্তিতে গঠিত হয় নাই। শুধু অফিসারদের বড়জোর অফিসার ও আওয়ামী লীগের লোকজন লইয়া গঠিত হইয়াছে। অথচ সব জায়গাতেই স্থানীয় জনসাধারণ দলমত নির্বিশেষে তাহাদের বিশ্বাসভাজন নেতৃবৃন্দকে এই প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত দেখিতে চান।
.
মুক্তাঞ্চলের থানাগুলিতে পুলিশ ও কর্মচারীর সংখ্যা প্রায়শই নগণ্য। এ ক্ষেত্রে সকল সংগ্রামী দল ও গণসংগঠন হইতে যুবকদের নিয়া স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়িয়া তোলার প্রয়োজনীয়তা মুক্তাঞ্চলের মানুষ অনুভব করিতেছেন। পুনর্বাসন, খাদ্য ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে যে তীব্র অভাব রহিয়াছে, সর্বদলীয় রিলিফ কমিটি গঠন করিয়া উহার কাজের সহিত সরকারী প্রশাসনের সমন্বয় সাধন করিয়া তাহা মোকাবিলা করিতে হইবে। ইতিপূর্বে ফুলবাড়ীর মুক্তাঞ্চল সর্বদলীয় রিলিফ কমিটি গঠনের সংবাদ “মুক্তিযুদ্ধে” প্রকাশিত হইয়াছে। এইরূপ রিলিফ কমিটি সকল মুক্তাঞ্চলে গড়িয়া তোলা দরকার।
.
জনগণের মনোবল অটুট আছে
আমাদের প্রতিনিধি জানাইতেছেন, মুক্তাঞ্চলের সর্বত্রই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জনগণ বিপুলভাবে অভিনন্দিত করিতেছেন। মুক্তাঞ্চলের যুবকরাও মাত্রিভূমিকে সম্পূর্ণ শত্রুকবল করার সংকল্প লইয়া ট্রেনিং গ্রহণ করিতেছেন এবং জনগণ মুক্তিবাহিনীর সহিত পূর্ণ সহযোগিতা করিতেছেন।
.
রংপুর রয়াঙ্গনে পলায়নপর জনৈক পাকিস্তানী অফিসার তাহাকে নদী পার করিয়া দেওয়ার বিনিময়ে কয়েকজন গ্রামবাসীকে ১৩শত টাকা দিতে চায়। গ্রামবাসীরা পাক অফিসারকে সাহায্য করার ভান করে এবং তাহাকে পোশাক বদলাইয়া লুঙ্গি পরিতে বলে। অফিসারটি হাতের অস্ত্র মাটিতে রাখিয়া গ্রামবাসীদের দেওয়া লুঙ্গি পরিতে শুরু করিলে এই সুযোগে তাহারা অফিসারটিকে পাকড়াও করিয়া মুক্তি বাহিনীর হাতে সমর্পণ করে।
.
অপরিসীম দুঃখ, কষ্ট ও চূড়ান্ত ত্যাগের মধ্য দিয়া সাড়ে সাত কোটি মানুষ বাংলাদেশে নবজীবনের স্বপ্ন দেখিতেছেন। তাহাদের স্বপ্ন কতটা বাস্তবায়িত হইবে তাহা বোঝা যাইবে মুক্তাঞ্চলগুলি দেখিয়া। তাই সকলের সমবেত প্রচেষ্টায় মুক্তাঞ্চলগুলিকে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের আদর্শ হিসাবে গড়িয়া তুলিতে হইবে। ইহা হইতে শত্রুকবলিত অঞ্চলসমূহের জনগণও মুক্তিযুদ্ধকে তীব্রতর করিতে অনুপ্রাণিত হইবেন। মুক্তাঞ্চলের জনগণের আশা কি জন প্রশাসন কি অর্থনৈতিক কি সামাজিক কাঠামো কোন ক্ষেত্রেই যেন পূর্বতন পাকিস্তান দুর্ণীতি অসাম্য আর শোষণের পুনরাবৃত্তি না ঘটে।
.
শাহজালাল
<৬,১০৪,১৭২-১৭৩>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
সম্পাদকীয়ঃ জাতীয় জীবনের এই প্রম লগ্নে | মুক্তিযুদ্ধ
১ম বর্ষঃ ২৩শ সংখ্যা |
১২ ডিসেম্বর,১৯৭১ |
সম্পাদকীয়
জাতীয় জীবনের এই পরম লগ্নে
আট মাসের এবং বলিতে গেলে ২৪ বৎসরের অমনিশার পরে বাংলাদেশের আকাশে আজ নব-অরুণোদয় ঘটিতেছে।
.
পাকিস্তানের মুষ্টিমেয় একচেটিয়া পুঁজিপতি ও বৃহৎ সামন্তবাদী ভূস্বামীদের জাতিগত নিপীড়ন ও শোষণ এবং তাঁর সাথে মার্কিনী পুঁজির নয়া ঔপনিবেশিক জাঁতাকলে নিষ্পেষিত বাংলাদেশের শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র, মধ্যবিত্ত তথা গোটা বাঙালী জাতি নিজেদের ন্যায্য জাতীয় ও গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য গত ২৪ বৎসর বহু গৌরবময় সংগ্রাম করিয়াছেন। গত ২৫শে মার্চের পর জনগণের এই ন্যায্য সংগ্রামই ইয়াহিয়া চক্রের বর্বর বাহিনীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের রূপ পরিগ্রহণ করিয়াছে। মাতৃভূমির স্বাধীনতা এবং জাতীয় মুক্তির জন্য জনগণের এই বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম আজ সাফল্যের দ্বারে আসিয়া উপনীত হইয়াছে। ঘৃণ্য দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে কৃত্রিমভাবে রচিত প্রতিক্রিয়াশীল পাকিস্তান রাষ্ট্র আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের আঘাতে আজ ভাঙ্গিয়া পড়িতেছে। দুনিয়ার বুকে জন্ম নিয়াছে এক নবীন রাষ্ট্র- গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পাকিস্তানের অভিশাপ হইতে বাঙালী জাতি আজ মুক্ত হইতেছে।
.
আমাদের এই স্বাধীনতা সংগ্রামকে স্তব্ধ করার জন্য নরঘাতক ইয়াহিয়া চক্র গণহত্যা, পাইকারী নারী ধর্ষণ, গৃহদাহ, লুণ্ঠন প্রভৃতি কোন অপরাধমূলক কাজই বাকি রাখে নাই। কিন্তু, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ তাহাতে দমিত হওয়ার বদলে আরো দুর্বার হইয়াছে। দুর্ধর্ষ মুক্তিবাহিনী ও গেরিলা বাহিনীর প্রচণ্ড- মারের চোটে দিশাহারা হইয়া ইয়াহিয়া চক্র অবশেষে আমাদের দেশে মার্কিনী হস্তক্ষেপ ডাকিয়া আনার জন্য পাক-ভারত যুদ্ধ বাধাইয়াছে। ইয়াহিয়া চক্রকে বাঁচাইবার জন্য মার্কিনী সাম্রাজ্যবাদীরাও এই যুদ্ধের সুযোগে নিরাপত্তা পরিষদের মাধ্যমে আমাদের দেশে হস্তক্ষেপের চেষ্টা করিয়াছিল। সমাজতন্ত্রের দাবীদার চীনও সমাজতন্ত্রের নীতি হইতে বিচ্যুত হইয়া নরঘাতক ইয়াহিয়া চক্রের পক্ষ নিয়া মার্কিনী সাম্রাজ্যবাদের ঐ চক্রান্ত সমর্থন করিয়াছিল। কিন্তু, দুনিয়ার নিপীড়িত জাতিসমূহ ও জনগণের অকৃত্রিম বন্ধু মহান সোভিয়েত ইউনিয়ন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও চীনের সে চক্রান্ত জাল ছিন্নভিন্ন করিয়া দিয়া আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সাফল্যে এক বিরাট অবদান রাখিয়াছে।
.
পক্ষান্তরে ইয়াহিয়া চক্রের আগ্রাসী আক্রমণের বিরুদ্ধ ভারত সরকার প্রতিরক্ষার জন্য যে পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণ করিয়াছেন , তাতে বাংলাদেশে ঐ খুনীর দলের অন্তিম দশা উপস্থিত হইয়াছে। ভারত সরকার বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিয়া নিজের সেনাবাহিনীকে আমাদের মুক্তিবাহিনীর সহিত একযোগে কাজ করার নির্দেশ দিয়াছেন। আমাদের মুক্তিবাহিনী ও মিত্র ভারতীয় বাহিনীর যৌথ আক্রমণে বাংলাদেশে শত্রুর ঘাটিগুলির একটার পর একটা দ্রুত পতন ঘটিতেছে। নিরস্ত্র মানুষকে পাইকারী হত্যা, অসহায়া নারীকে ধর্ষণ ও এক কোটি নরনারীকে দেশছাড়া করিয়া যে নরপিশাচরা একদা বীরত্ব দেখাইয়াছিল, আজ মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনীর দুর্বার অগ্রগতির সামনে তারা প্রাণভয়ে পলায়ন করিতেছে। বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ এলাকা ইতিমধ্যেই শত্রুর কবল হইতে মুক্ত হইয়াছে। সে শুভদিনও আজ আর বেশী দূরে নয়, যেদিন ঢাকার সরকারী দপ্তরেও স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড্ডীন হইবে। বাঙালী জাতির জীবনে আজ নতুন দিন আগত।
.
জাতীয় জীবনের এই শুভলগ্নে নুতন দায়িত্বের কথাও আমরা সমস্ত মুক্তিযোদ্ধা ও দেশবাসীকে স্মরণ করাইয়া দিতে চাই। মার্কিনী সাম্রাজ্যবাদীদের চক্রান্ত এখনো থামে নাই। কাজেই আত্মসন্তুষ্টিরও অবকাশ নাই।
.
তাই, দেশবাসীর কাছে আমাদের আবেদনঃ (১) মুক্তি সংগ্রামের ত্বরিত ও চূড়ান্ত বিজয়ের জন্য সকলে মিলিয়া আরও প্রবল বেগে শত্রুর বিরুদ্ধে আঘাত হানুন, শত্রুর পলায়নের পথ রুদ্ধ করুন। (২) বাংলাদেশ সরকারের প্রতি অটুট আনুগত্য রাখুন ও নির্দেশ মানিয়া চলুন। (৩) মুক্তিবাহিনী ও মিত্র ভারতীয় বাহিনীর সহিত সকল প্রকারের সহযোগিতা করুন (৪) সর্বত্র মুক্ত এলাকা গড়িয়া তুলুন। মুক্ত এলাকার স্বাধীনতা সংগ্রামী সকল দলমতের লোক নিয়া গণ- কমিটি গঠন করিয়া তার উপর অসামরিক প্রশাসনের দায়িত্ব ন্যস্ত করুন। (৫) মুক্ত এলাকায় শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষা করুন। জাতি ধর্ম ভাষা নির্বেশেষে সকলের নিরাপত্তা বিধান করুন। আইনশৃঙ্খলা নিজের হাতে নিবেন না। অবাঙালী বিরোধী বা অন্য কোন প্রকার দাঙ্গা না ঘটিতে পারে সে দিকে লক্ষ্য রাখুন। (৬) খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের সুষ্ঠু বিতরণের ব্যবস্থা করুন। স্কুল কলেজ খোলার ব্যবস্থা করুন। স্বাভাবিক জীবন গড়িয়া তুলিতে উদ্যোগী হউন। (৭) শ্রমিক কৃষক মেহনতি জনতার দুঃখ দুর্দশা লাঘব করার চেষ্টা করুন।
.
সকল দলমতের সংগ্রামী দেশবাসীর প্রতি আমাদের আহবানঃ আসুন, সকল প্রকার দলীয় সঙ্কীর্ণতা ভুলিয়া সকলে মিলিয়া রক্তমূল্যে অর্জিত স্বাধীনতার নবীন সূর্যোদয়কে স্বাগত জানাই। বাংলাদেশে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম করি এবং সত্যকারের সুখী সুন্দর প্রগতিশীল নুতন বাংলা গড়িয়া তুলি।
.
.
রাশেদুজ্জামান রণ
<৬,১০৫,১৭৪-১৭৫>
শিরোনামঃ সম্পাদকীয়ঃ মুক্তির শুভ দিনে
সংবাদপত্রঃ মুক্তিযুদ্ধ ১ম বর্ষঃ ২৪শ সংখ্যা
তারিখঃ ১৯ ডিসেম্বর, ১৯৭১
.
সম্পাদকীয়
মুক্তির শুভ দিনে
বাঙালী জাতির জীবনে আজ মহা উৎসবের দিন। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পরে গত ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশে দখলদার বর্বর পাক বাহিনী আত্মসমর্পণ করিয়াছে। ২৪ বৎসর জাতীয় নিপীড়ন ও সীমাহীন দুঃখভোগের পরে বাংলাদেশের জনগণ প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক পাকিস্তান রাষ্ট্রের নিগড়=(নিগূঢ় হবে।) হইতে মুক্ত হইয়া বহু আকাঙ্খিত স্বাধীনতা লাভ করিয়াছেন। বহু সংগ্রাম, বহু ত্যাগের পর বাঙালী জাতি আজ স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসাবে বাস করার অধিকার লাভ করিয়াছেন। দুনিয়ার বুকে সগৌরবে উদয় হইয়াছে হাজার হাজার শহীদের রক্তোত স্বাধীন, সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ।
.
বাঙালী জাতীয় জীবনের এই শুভ দিনে আমরা অন্তরের শ্রদ্ধাঞ্জলী অর্পণ করি সেই বীর শহীদদের স্মৃতির প্রতি যাঁরা গত ২৩ বৎসরে জাতীয় অধিকার ও গণতন্ত্রের সংগ্রামে এবং মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। আমরা সালাম জানাই সেই অগণিত প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক কর্মীদের জাতীয় অধিকার, গণতন্ত্র এবং শ্রমিক কৃষক ও মেহনতি জনগণের মুক্তির জন্য যাঁরা দিনের পর দিন পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল শাসকবর্গের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করিয়াছেন এবং সেজন্য বহু অত্যাচার ও নির্যাতন সহ্য করিয়াছেন। সঙ্গে সঙ্গে আজ এই শুভ দিনে আমরা বাংলাদেশের জনগণের প্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের অবিলম্বে নিঃশর্ত মুক্তির দাবি আবার ধ্বনিত করিতেছি।
.
মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত সাফল্যে বাংলাদেশের শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র, জনতা যে অবদান রাখিয়াছেন, পাক সামরিক জান্তার বহু পাশবিক অত্যাচার সত্ত্বেও জনগণ যে ভাবে দৃঢ়তার সহিত স্বাধীনতা সংগ্রামকে অকুন্ঠ সমর্থন জানিয়া গিয়াছেন, সেজন্য আমরা বাংলাদেশের জনগণকে আজ আন্তরিক অভিনন্দন জানাইতেছি। আমরা অভিনন্দন জানাইতেছি আমাদের দুর্ধর্ষ মুক্তিবাহিনী ও গেরিলা যোদ্ধাদের যারা(যাঁরা হবে।) মুক্তিসংগ্রামে এক বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করিয়াছেন এবং মাতৃভূমির স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মত্যাগের এক গৌরবোজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করিয়াছেন।
.
প্রতিবেশী ভারতের জনগণ, গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহ, সরকার এবং সেনাবাহিনী আমাদের মুক্তি সংগ্রামে যে অকুন্ঠ সমর্থন ও সাহায্য দিয়াছেন, তা বাঙালী জাতি কোনোদিন ভুলিবেনা। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সেই সাহায্য ও সমর্থনের জন্য আমরা তাদের নিকট জানাই আমাদের আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও অভিনন্দন।
.
সর্বোপরি, আমরা অভিনন্দন ও কৃতজ্ঞতা জানাই সোভিয়েত ইউনিয়ন ও সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহের নিকট, যাঁদের সাহায্য ও সমর্থন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ে অবিস্মরণীয় অবদান রাখিয়াছে।
.
বস্তুত, স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলাদেশের জনগণের ঐক্যবদ্ধ ও দৃঢ় সমর্থন, শত্রুর বিরুদ্ধে আমাদের মুক্তিবাহিনী ও গেরিলা যোদ্ধাদের অসম সাহসিক সংগ্রাম এবং ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহের সাহায্য এবং সমর্থন আমাদের মুক্তিসংগ্রামের এই ঐতিহাসিক বিজয় সম্ভব করিয়াছে।
.
কিন্তু বিজয়ের আনন্দে আত্মহারা হইয়া স্বাধীনতা লাভের পরবর্তী অধ্যায়ের দায়িত্বের কথা আমরা যেন বিস্মৃত না হই। পাক সেনাদল কর্তৃক ধ্বংস্কৃত বাংলাদেশের পুনর্গঠন, প্রায় এক কোটি দেশত্যাগী নর-নারীকে দেশে ফিরাইয়া আনিয়া তাঁদের পুনর্বাসন, দেশের শান্তি ও শৃংখলা রক্ষা এবং অত্যাচার ও শোষণহীন,(এখানে কমা ছিলনা!) সুখী ও শান্তিময় সমাজ ব্যবস্থা গড়িয়া তোলার কঠিন কর্তব্য আজ আমাদের সম্মুখে উপস্থিত হইয়াছে। মুক্তিযুদ্ধে জয়ের চেয়ে এক(এখানে এ হবে।) কাজ কম কঠিন নহে। কোন একটি দল, সে দল যত বড়ই হোকনা কেন, তার একার পক্ষে এই কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। তাই, আজ জরুরী প্রয়োজন হইল উচু হইতে নিচু পর্যন্ত সমস্ত স্তরে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সমস্ত দেশপ্রেমিক ও গণতান্ত্রিক শক্তির একতা। এই একতার আবেদন আমরা আজ আবার সকলের নিকট জানাইতেছি।
.
তাছাড়া, দেশীয় ও বিদেশী প্রতিক্রিয়াশীলদের চক্রান্ত সম্পর্কে সমস্ত জনগণ ও গণতান্ত্রিক শক্তিকে আমরা হুঁশিয়ার করিয়া দিতেছি। মার্কিনী সাম্রাজ্যবাদ আমাদের দেশে তার নয়া ঔপনিবেশিক শোষণ রক্ষা করার জন্য সব সময়ই আমাদের সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বিরোধিতা করিয়াছে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাক সামরিক জান্তাকে অশেষ সাহায্য দিয়াছে। মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের মুখে তারা জাতিসংঘের মারফত আমাদের দেশে হস্তক্ষেপ করিতে চেষ্টা করিয়াছে। পরিশেষে সপ্তম নৌবহর পাঠাইয়া ভীতিপ্রদর্শনপূর্বক মুক্তিযুদ্ধের বিজয়কে পর্যুদস্ত করিতে সচেষ্ট হইয়াছিল।
.
চীনের মাওবাদী নেতৃত্বও মার্কসবাদী লেলিনবাদী(এখানে হবে লেনিনবাদী।) নীতি বিসর্জন দিয়া আমাদের ন্যায়সঙ্গত মুক্তি সংগ্রামের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াশীল ইয়াহিয়া চক্রকে সমর্থন দিয়া চলিয়াছে।
.
যদিও আমাদের বিরুদ্ধবাদী ঐ সকল শক্তির চক্রান্ত এ পর্যন্ত ব্যর্থ হইয়াছে, কিন্তু তাদের সে চক্রান্ত থামে নাই। এখনও তারা আমাদের দেশ পুনর্গঠনের কাজে নানাবিধ বিগ্ন(এখানে বিঘ্ন হবে) সৃষ্টি করিতে এবং বহু রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতাকে বিপর্যস্ত করিতে সচেষ্ট থাকিবে। তাই, জাতির মুক্তির এই শুভদিনে সকল গণতান্ত্রিক ও দেশপ্রেমিক শক্তিকে আমরা আহবান করি যে, ঐক্যবদ্ধভাবে এই চক্রান্তের মোকাবিলা করিয়া উহাকে পরাস্ত করুন। স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জয়যাত্রা অব্যাহত রাখুন।
……………………..
.
রাশেদুজ্জামান রণ
<৬,১০৬,১৭৬-১৭৭>
শিরোনামঃ টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া মুক্তিবাহিনী জয়মাল্য নিয়ে এগিয়ে চলেছে
সংবাদপত্রঃ সোনার বাংলা ১ম বর্ষঃ ৪র্থ সংখ্যা
তারিখঃ জুলাই(?), ১৯৭১
.
[*সোনার বাংলাঃ সাপ্তাহিক। মুক্তিবাহিনীর মুখপত্র। সরকার কবীর খান কর্তৃক সম্পাদিত এবং কে জি মুস্তফা কর্তৃক সোনার বাংলা প্রেস হতে মুদ্রিত ও প্রাচারিত।]
.
[বাংলার সবুজ-শ্যামল প্রান্তর
টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া মুক্তিবাহিনী জয়মাল্য নিয়ে এগিয়ে চলেছে (ভ্রাম্যমান প্রতিনিধি)]
.
স্বধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশের অদম্য মনোবলের অধিকারী ও দুর্জয় শপথে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড আক্রমণে হানাদার খান সেনারা যতই পর্যুদস্ত হয়ে পালিয়ে যাচ্ছে, ততই দিনের পর দিন মুক্ত অঞ্চলের সীমানা বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্বাধীনতার যুদ্ধ প্রায় চারমাস অতিক্রম করতে চলেছে আর সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর শক্তি দিনের পর দিন বৃদ্ধি পেয়ে খান সেনাদের ভীত ও সন্ত্রস্ত করে তুলেছে।
.
আমাদের ভ্রাম্যমান প্রতিনিধি বিভিন্ন রণাঙ্গন পরিদর্শন করে খবর পাঠিয়েছেন মুক্তিবাহিনী বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকা টেকনাফ থেকে শুরু করে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকা খান সেনাদের কবল মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে। চট্রগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় এখন বাংলাদেশের সবুজ-লাল রঙ্গে রঞ্জিত, সোনালী বংলাদেশের মানচিত্র অঙ্কিত পতাকা শস্য শ্যামল মাটির বুকে দাঁড়িয়ে আছে। ঠাকুরগাঁও মহকুমা, মেহেরপুর মহকুমাও একই গর্বে গর্বিত। এমনকি বাংলাদেশের প্রাণকেন্দ্র ঢাকা নগরীর রেল স্টেশনেও মুক্তিবাহিনী আক্রমণ চালিয়ে একটি সামরিক অস্ত্র বোঝাই ট্রেন ধ্বংস করে দিয়েছে এবং তিনটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে ঢাকা শহর গত কয়েক দিন অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল। আমাদের কমাণ্ডো(এখানে কমান্ডো হবে) বাহিনী ঢাকা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল সুইমিং পুলের নিকটে, হাবিব ব্যাংক, নবাবপুর রোড,(এখানে কমা হবেনা।) এবং গভর্ণর ভবনে হ্যাণ্ড(এখানে হ্যান্ড হবে।) গ্রেনেড দিয়ে আক্রমণ করে। ফলে ঢাকা শহরে প্রবেশর সকল পথ সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পাক সেনারা কমাণ্ডো(এখানে কমান্ডো হবে)দের ভয়ে ঢাকার প্রধান সামরিক দপ্তরটি গভর্ণর ভবন থেকে অধিকতর সুরক্ষিত তেজগাঁও এলাকায় প্রাদেশিক পরিষদ ভবনে স্থানান্তরিত করেছেন।
.
রংপুর জেলার বিভিন্ন রণাঙ্গনে আক্রমন চালিয়ে মুক্তিবাহিনীর কমাণ্ডো(এখানে কমান্ডো হবে)রা হাতীবান্দা(এখানে হাতিবান্ধা হবে।) সেক্টর দখল করে খান সেনাদের তাড়িয়ে দিয়েছে। দিনাজপুরের রণাঙ্গন মুক্ত হয়েছে তিন দিনের প্রতিরোধের পর। যশোর অঞ্চলের পঁয়ত্রিশজন খান(এখানে মনে হয় খানসেনা শব্দটি হবে) মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত হয়েছে। বিদ্যুৎ সরবরাহের প্রাণকেন্দ্র জলঢাকা বিদ্যুৎ কেন্দ্র সাত দিন অবরোধের পর মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে এসেছে। উত্তরবঙ্গের বৃহত্তম চিনির কল দর্শনাও এখন মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। পূর্ব রণাঙ্গনে কুমিল্লা জেলার মুরাদনগরে একটি সামরিক দল কয়েকটি নৌকা করে যখন তাদের মনের কুপ্রবৃত্তিকে চরিতার্থ করার জন্য নদী পাড়ি দিচ্ছিল, ঠিক সেই সময় মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে একজন মেজর সহ ১৭জন খান সেনা নদীর জল পেট পুরে খেয়ে মৃত্যু বরণ করেছে। আখাউড়া ও ফেনী মহকুমার বিভিন্ন স্থানে আক্রমণ চালিয়ে ১ জন উর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তাসহ বেশকিছু সংখ্যক খান সেনাদের খতম করে মুক্তিবাহিনীর বিজয় অভিযান অব্যাহত রাখছে।
.
কুষ্টিয়ার নয়নপুরে আক্রমণ চালিয়ে মুক্তিবাহিনীর কমাণ্ডো(এখানে কমান্ডো হবে)রা ২০ জন খান সেনার প্রাণনাশ করেছে। পরে সামরিক হেলিকপ্টারযোগে মৃত খান সেনাদের অন্যত্র সরিয়ে নিতে দেখা গেছে। আক্রমণের ফলে বাজিতপুরে ৫ জন দালাল, ফকিরহাটে ৭ জন ও কুষ্টিয়ায় বেশ কয়েক জন দালাল নিহত হয়েছে।
.
কুষ্টিয়ায় প্রচণ্ড লড়াইয়ের পর মুক্তিবাহিনীর কমাণ্ডো(এখানে কমান্ডো হবে)রা পাকিস্তানি খান সেনাদের একটি অস্থায়ী সামরিক ব্যারাক দখল করে নিয়েছে এবং বেশ কিছুসংখ্যক অস্ত্রশস্ত্রও দখল করেছে।
……………….
রাশেদুজ্জামান রণ
<৬,১০৭,১৭৮>
শিরোনামঃ হানাদার বাহিনীর শাস্তিদানের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন করুন
সংবাদপত্রঃ সোনার বাংলা ১ম বর্ষঃ ৪র্থ সংখ্যা
তারিখঃ জুলাই(?), ১৯৭১
.
হানাদার বাহিনীর শাস্তিদানের জন্য
ট্রাইব্যুনাল গঠন করুন
কে, জি মুস্তফা প্রদত্ত
সাড়ে সাত কোটি মানুষের আবাসভূমি “স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশ” বিশ্বের মানচিত্রে একটা নতুন রাষ্ট্র হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে। বিশ্বের বিবেকসম্পন্ন জাতিসমূহের নিকট বাংলাদেশ স্বীকৃতি লাভ করেছে। শুধুমাত্র সাম্যবাদ, সমাজবাদের ধারক, চীনের মানুষের নিকটই বাংলাদেশের ঘটনাসমূহ কোনো আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারে নাই।
.
গণপ্রজাতন্ত্রের ধ্বজা ধরে বিশ্ব মানবতার চিরশত্রু সাম্রাজ্যবাদের এক নম্বর পাণ্ডা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এবং তিব্বত গ্রাসকারী পররাজ্যলোভী গণতন্ত্রের দুশমন চীন একাধারে বাঙালী নিধন যজ্ঞে সাহায্য সহযোগিতা করে সাধ্যমত নিজের দেশের ধনসম্পদ ও অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে কুখ্যাত পাকিস্তান সরকারকে শক্তিশালী করে তুলেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চারমাস অতিক্রম করে সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে এসে হাজির হয়েছে। আর সঙ্গে সঙ্গে এই সাফল্যের সংবাদে টনক নড়েছে আমেরিকা, চীন ও রাশিয়ার। বন্ধ করে দিয়েছে পাকিস্তান সরকারকে সর্বপ্রকার সাহায্য ও সহানুভূতি, জিকির তুলেছে বাংলাদেশের একটি রাজনৈতিক সমাধান চাই। কিন্তু এই জিকিরে কি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ স্তিমিত হবে? হতে পারেনা। যাদের অদৃশ্য হাতের কারসাজিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা পাগল ১০ লক্ষ নিরীহ, নিরস্ত্র মানুষ পশ্চিমা বেনিয়া গোষ্ঠীর প্রতিভূ খান সেনাদের হাতে প্রাণ দিয়ে বাংলার শস্য-শ্যামল প্রান্তরকে রক্তে রঞ্জিত করে তুলেছে এবং তাদেরই প্রাণপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বাংলা জাতীয় লীগ প্রধান জনাব আতাউর রহমান খান এখনও খান সেনাদের অন্ধকার কারাগারে নিক্ষিপ্ত। আর ষাট লক্ষাধিক মানুষ প্রাণের ভয়ে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছে বন্ধুরাষ্ট্র ভারতে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষের অনুপস্থিতিতেই তাদের নামে ট্রাইব্যুনাল গঠন করে চরম শাস্তিদানের ব্যবস্থা করে বিশ্বের কলঙ্কজনক ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে খান প্রতিভূ গোষ্ঠী। এমনকি বাঙালীদের নয়নমনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জনাব আতাউর রহমান খানের জন্যও বিচারের ট্রাইব্যুনাল গঠন করার খবর আমরা পেয়েছি। তাই প্রতিটি বাঙালী মানুষই আতঙ্কে শিউরে উঠেন এই ট্রাইব্যুনাল গঠনের সংবাদ শুনে। বিশ্বের বিবেকসম্পন্ন রাষ্ট্রসমূহ নির্বাক দৃষ্টিতে ইয়াহিয়া খানের এই নাটকীয় ঘটনার দিকে তাকিয়ে আছে। কখন কি ঘটবে, তা বলা মুশকিল।
.
তাই এই সমস্ত হানাদার বাহিনীর কুখ্যাত সামরিক কর্মকর্তাদের শাস্তি বিধানের জন্য বাংলাদেশ সরকারকে একটি বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ একান্ত প্রয়োজন। স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চলে একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে হানাদার বাহিনীর কর্মকর্তাদের বিচার করে, উপযুক্ত প্রতিশোধ গ্রহণ করার জন্য আমরা স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আবেদন জানাই।
…………………….
.
.
আল নোমান
<৬,১০৮,১৭৯>
শিরোনামঃ সম্পাদকীয় (মুক্তিযোদ্ধা লহ সালাম)
সংবাদপত্রঃ সোনার বাংলা (১ম বর্ষঃ ৬ষ্ট সংখ্যা)
তারিখঃ আগষ্ট, ১৯৭১
সম্পাদকীয়
.
মুক্তিযোদ্ধা লহ সালাম
ক্ষুধিরাম, তিতুমীর, সূর্যসেনের জন্মভূমি পদ্মা, মেঘনা, তিস্তা, যমুনা প্রন্তরে এগিয়ে চলছে দুর্বার গতিতে ওরা কারা? পশু হানাদার বাহিনীকে সমুচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য কেন ওরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ? মুক্তির নেশায় কেন ওরা পাগল? রক্ত পিচ্ছিল পথে কেন ওরা চলছে। স্বাধীনতা না হয় মৃত্যু কেন ওদের কাম্য?
.
২৫শে মার্চ ১৯৭১ সাল। অবহেলিত বাংলা তথা সমগ্র পৃথিবীর ইতিহাসে সংযোজিত হলো একটি চরম বিশ্বাসঘাতকতার নির্মম ইতিহাস। বিশ্বাসঘাতক ইয়াহিয়ার হানাদার পশুরা স্তব্ধ করতে চাইলো সাড়ে সাত কোটি মেহনতি, কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, জনতার কন্ঠস্বর। শহর বন্দর গ্রাম গঞ্জে ওরা চালালো রাইফেল, স্টেনগান, ব্রেনগান, মর্টার, কামান, ট্যাংক লুটিয়ে পড়ল লক্ষ লক্ষ নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষের শব। রক্ত আর রক্ত। রক্তের বন্যায় ভেসে গেল সোনার বাংলা। ওরা আগুন জ্বালালো গ্রাম হতে গ্রামান্তরে বাংলার আকাশে বাতাসে গুমরিয়ে উঠলো নারীর আর্তনাদ, সন্তানহারা জননীর বুক ফাটা আকুল ক্রন্দন। অত্যাচার ব্যাভিচার নির্যাতনে নিষ্পেষিত জনতার সঞ্চিত ব্যাথা পুঞ্জীভূত হয়ে আগ্নেয়গিরির মতো ফেটে পড়ল তারই ফলশ্রুতিতে।
.
বাংলার বুকে ২৫শে মার্চের ভয়াবহ কালো রাত্রিতে জন্ম নিল বাংলা মুক্তিবাহিনী। ওরা দূর্বার, বিক্ষুব্ধ বাংলার সংক্ষুব্ধ কৃষক, শ্রমিক ছাত্রজনতা। যেকোন তিতিক্ষার মাধ্যমে গ্রহণ করবে মা বোন ভাইয়ের রক্তের প্রতিশোধ। বাংলার শ্যমল প্রান্তরে তাইতো আজ জেগে উঠেছে বীর বাংলার সংগ্রামী মুক্তিযোদ্ধা। লক্ষ লক্ষ শহীদের রক্তে সিক্ত পাকিস্তান আজ মৃত। জন্ম নিয়েছে সেই শহীদী রক্তে পৃথিবীর মানচিত্রে একটি নতুন দেশ বাংলা। সৃষ্টি হয়েছে নতুন ইতিহাস। সেই রক্তাত পিচ্ছিল পথে এগিয়ে চলছে বীর বাংলার সংগ্রামী মুক্তি বাহিনী। লক্ষ কোটি মায়ের অশ্রু আজ আশীর্বাদ ওদের, শহীদী রক্তে লাল পতাকা হাতে নিয়ে বিজয়ের জয়মাল্যে ওরা চলছে ওরা চলবে।
.
আল নোমান
<৬,১০৯,১৮০>
শিরোনামঃ মুজিবের প্রাণনাশের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি
সংবাদপত্রঃ সোনার বাংলা (১ম বর্ষ ৬ষ্ঠ সংখ্যা)
তারিখঃ আগষ্ট, ১৯৭১
মুজিবের প্রাণনাশের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি
.
রাশিয়া
সোভিয়েত সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্ট করে পাকিস্তানের জঙ্গী শাসক ইয়াহিয়া খাঁকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রাণপ্রিয় নেতা শেখ মুজিবকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করলে তার পরিণাম মারাত্নক হবে। তাই অবিলম্বে শেখ মুজিবকে মুক্তি দিয়ে আলাপ আলোচনার মধ্যমে বাংলাদেশ সমস্যার একটি রাজনৈতিক সমাধান করার জন্য সোভিয়েত সরকারের পক্ষে থেকে আহবান জানান হয়েছে।
.
অষ্ট্রেলিয়া
পাকিস্তানের জঙ্গী শাসকগোষ্ঠী রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের যে বিচার প্রহসনের ব্যবস্থা করেছেন তার প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করে অষ্ট্রেলিয়ার সরকার পাকিস্তানকে একটি নোট দিয়েছেন। অষ্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী মিঃ উইলিয়াম ম্যাকমোহন প্রেসিডেন্টে ইয়াহিয়ার নিকট একটি ব্যক্তিগত বার্তা পাঠিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
.
মার্কিন
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রগতিশীল রাজনীতির অন্যতম প্রবক্তা সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডী ও সিনেটর চার্লস পার্সি বলেন- শেখ মুজিবের বিচারের ব্যাপারে মার্কিন সরকার পাকিস্তান সরকারের উপর প্রবল প্রভাব বিস্তার করবে। বঙ্গবন্ধুর প্রাণনাশ হলে পরিস্থিতির বিষ্ফোরণ ঘটবে বলেও তারা মন্তব্য করেন।
.
বৃটিশ সংবাদপত্র
বৃটিশ সংবাদপত্র ইয়র্কশায়ার পোষ্ট মন্তব্য করেছে, শেখ মুজিবের গোপন বিচার সম্পর্কে সারা বিশ্বে যে আলোড়ন সৃষ্টি করে পাকিস্তান সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে যে ধিক্কার তুলেছে তার প্রতি জঙ্গীশাহী কর্ণপাত করলে সুবিবেচনারই পরিচয় দিতেন। পত্রিকাটিতে তীব্র প্রশ্ন তুলে বলা হয়েছে শেখ যদি মানুষ হিসেবে এতই ভয়ংকর ও খারাপ হয় তবে প্রকাশ্য আদালতে বিচার করতে সামরিক কর্তৃপক্ষ কুণ্ঠিত কেন?
.
ভারত
ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী পাকিস্তান সামরিক জান্তার প্রতি এই মর্মে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন যে, পাকিস্তান সামরিক কর্তৃপক্ষ যদি শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে তবে ‘শুধু বাংলাদেশ নয়, তার প্রতিক্রিয়া সারা বিশ্বে গিয়ে পড়বে।‘
.
আল নোমান
<৬,১১০,১৮১>
শিরোনামঃ সম্পাদকীয় বিশ্ব বিবেক নীরবতা প্রেক্ষিতে
সংবাদপত্রঃ সোনার বাংলা (১ম বর্ষঃ ৬ষ্ঠ সংখ্যা)
তারিখঃ আগষ্ট, ১৯৭১
সম্পাদকীয়ঃ
.
বিশ্ববিবেক নীরবতার প্রেক্ষিতে
বিশ্বপলিটব্যুরোর বুড়োদের কি ভিমরতী ধরেছে? বাংলার মুক্তিযুদ্ধ সাত মাস অতিক্রান্ত। শরণার্থীদের সংখ্যা ভারতে দিন দিন বাড়ছেই, তেমনি বাড়ছে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা তৎপরতা।
.
অনেকেই বাংলার লাল রঙ দেখে গেলেন। শরণার্থীদের বুক ফাটা কান্না শুনে গেলেন। ভালো ভালো কান্নাজড়ানো, জ্ঞানিকথা কপচানো বিবৃতিও দিয়ে গেলেন। কিন্তু তাদেরকে প্রশ্নঃ এগুলো রসগোল্লা ফিরিস্তি কি সেই জলে পড়া, সাঁতার না জানা সেই হতভাগ্য বালকের প্রতি সেই বুড়োর “জলে নেমেছো ক্যানো বাবা” বলে উপদেশ ঝাড়া নয়? যখন জল থেকে বালককে উদ্ধার করাটা সবচেয়ে প্রথম কর্তব্য তখন এহেন উপদেশ প্রহসন নিশ্চয় নিষ্প্রয়োজন।
.
কিন্তু তাদের কাছে, না কোন আবেদন বা আজ্ঞে হুজুরের নিবেদন নয়।
.
বাঙ্গালী জেগেছে-এ কথাটা এখন পুরনো। বাঙ্গালী কোনদিন ঘুমিয়েছিল এবং নির্যাতিত, শোষিত, লাঞ্চিত বন্দি কি কখনো ঘুমায়- তা তাদের অবশ্যই জানা উচিত। আর যদি ঘুমায় কখনো, তাদের জানা উচিত এ তাদের চির জাগ্রত নিদ্রা। বাঙ্গালী জাতির ইতিহাস চিরকালই ঘুম ভাঙ্গানোর ইতিহাস একটা বিশেষ লাল ঐতিহ্য।
.
অতএব তাদেরকে অনুরোধ, তারা আর মিছিমিছি বড় বড় আলোচনা বৈঠক না করে, আশা দিয়েও আর হতাশ করবেন না। এত রক্ত, এত শহীদানের পর পাকিস্তানের ক্রমেই বাংলাকে বেঁধে রাখার অপচেষ্টা করে আমাদের স্বাধীনতা অর্জনকে বিলম্বিত করবেন না।
.
আমাদের এ যুদ্ধ আমাদের প্রিয়তম নেতার সুরে সুর মিলিয়ে বলি- এ সংগ্রাম মুক্তি রসংগ্রাম, এ সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। চলছে, চলবে।
.
তবে হ্যাঁ বিশ্ববিবেকের ধুয়া তুলে, শুধু কথা এবং আশা দিয়ে নয় আসুন আমরা সবাই মিলে, কি হিন্দু কি মুসলিম, কি খৃস্টান সব সাম্প্রদায়িকতার উর্ধ্বে উঠে নির্বিশেষ আমাদের এই মহৎ সংগ্রাম যাতে আরো এগিয়ে যায় তার পথকে সুগম করার চেষ্টা করি।
.
আল নোমান
<৬,১১১,১৮২>
শিরোনামঃ বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান প্রসঙ্গে (রাজনৈতিক ভাষ্যকার)
সংবাদপত্রঃ সোনারবাংলা (১ম বর্ষঃ ৮ম ও ৯ম সংখ্যা)
তারিখঃ৩১ অক্টোবর, ১৯৭১
.
বাংলাদেশে আজ রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা সংগ্রাম চলছে। হানাদার পশ্চিম পাকিস্তানী বাহিনীকে বাংলাদেশের মাটি থেকে চিরতরে উৎখাত করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ কায়েম করার জন্য স্বর্ণ প্রসবিনী বাংলার বীর সন্তানগণ শত্রুর বিরুদ্ধে লড়ছে। গত ৬ মাসের যুদ্ধে আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ এলাকা মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন এবং দখলীকৃত এলাকা উদ্ধারের জন্য পালটা আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছেন। এবং সেদিন হয়তো আর বেশি দূরে নয়, যেদিন আমরা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ ফিরে পাব। ঠিক এই মুহুর্তে বিশ্বের বিভিন্ন মহল বিশেষ করে বৃহৎ শক্তিবর্গসহ কয়েকটি প্রভাবশালী রাষ্ট্র বাংলাদেশ সমস্যার একটি রাজনৈতিক সমাধানের জন্য আহবান জানিয়েছেন। কিন্তু এই রাজনোইতিক সমাধানের কাঠামোটা কি তা কেউ স্পষ্ট ভাষায় বলেননি। বাংলার মানুষের বক্তব্যের প্রতিধ্বনি করে নবগঠিত বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ উপদেষ্টা কাউন্সিল ঘোষণা করেছেন, বাংলাদেশ সমস্যার একমাত্র সমাধান পূর্ণ স্বাধীনতা। আমরা সেই রাজনৈতিক সমাধান মেনে নিতে পারি, যাতে বাংলাদেশকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বলে স্বীকার করে নেওয়া হয়।
.
কারন যারা রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলেন, তাদের একটা উপলব্ধি করতে হবে যে কি অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের ৮০ লক্ষ মানুষ দেশ ত্যাগ করে ভারতে আশ্রয়গ্রহণ করেছে এবং কেন স্বাধীনতা ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছে। বাঙ্গালীরা চিরদিন শান্তিপ্রিয় জাতি এবং আওয়ামী লীগও একটি গনতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। তাই তারা ২৫শে মার্চের পূর্বে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান করতে চেয়েছিল; কিন্তু খুনি ইয়াহিয়া তা হতে না দিয়ে বাংলার মানুষের উপর শোষণ আর শাসন অব্যাহত রাখার জন্য কুত্তা বাহিনীকে লেলিয়ে দিয়ে পাকিস্তানকে খুন করেছে। তাই নিরীহ নিরস্ত্র নিরাপরাধ ১০ লাখ বাঙ্গালীকে হত্যা করে, দেশত্যাগ করতে বাধ্য কর, লাখো মা বোনের ইজ্জত লোটার পর আর পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের সংগে বাঙ্গালীদের বসবাস সম্ভব নয়। ন্যায্য অধিকারের পরিবর্তে শোষণ অপমান আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে বাঙ্গালীরা ন্যায়ের জন্য সংগ্রাম করেছে। অহিংস রাজনীতির অনুসারী দল আওয়ামী লীগ বাধ্য হয়েছে সশস্ত্র সংগ্রামের পথে নামতে। তাই স্বাধীনতা ঘোষণা করতে হয়েছে। স্বাধীনতার অগ্নিমন্ত্রের শপথ নিয়ে মা বোনের ইজ্জত লুণ্ঠনকারী মানুষের নামধারী বর্বর জানোয়ারদের খতম করার জন্য বাঙ্গালীরা প্রস্তুত। মৃত পাকিস্তানের উপর উঠবে বাঙ্গালীর বাংলাদেশ যেখানে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খৃষ্টান, ধনী-দরিদ্রের মধ্যে কোন ভেদাভেদ থাকবে না। গড়ে উঠবে এক শোষণমুক্ত সোনার বাংলা।
.
এত রক্ত, জীবনহানি, সম্পত্তি লুট, ইজ্জতহানির পরও যদি কেউ ভাবেন যে, বাঙ্গালীরা ঐ বেঈমানদের সংগে বসবাস করবে-তারা মস্ত বড় ভুল করবেন। ইয়াহিয়ার রক্ত কলঙ্কিত হাতে খন্ডিত পাকিস্তান বাঙ্গালীরা জোড়া লাগাবে না। আমরা শহীদদের সহিত বেঈমানী করতে পারি না। তাই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমেদ যথার্থই বলেছেন “লাখো” শহীদের লাশের তলায় পাকিস্তানের কবর হয়েছে। তাই যারা রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলেন, তাদের আমরা একথা স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিতে চায় যে, বাংলার মানুষ পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া কোন সমাধান মেনে নিতে রাজি নয়।
.
আল নোমান
<৬,১১২,১৮৩-১৮৪>
শিরোনামঃ বাংলাদেশ ও জাতিসংঘ
সংবাদপত্রঃ বাংলার মুখ (১ম বর্ষঃ ৩য় সংখ্যা)
তারিখঃ ২৭ আগষ্ট, ১৯৭১
.
জাতিসংঘ নামে বিশ্বের বুকে একটা আন্তর্জাতিক বিশ্ব সংগঠনের অস্তিত্ব আছে-একথা সংগ্রামী বাংলার মানুষ আজ আর বিশ্বাস করতে চায় না। একদিন তারা জানতো বিশ্ব মানবতার জন্য এ নামে একটা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। লীগ অব ন্যাশনস এর পরিবর্তে, সংশোধিত রূপ এই জাতিসংঘ মানব কল্যাণের জন্য অত্যচার নির্যাতন ও মানবীয় শোষণের অবসাণের জন্য কিছু করা অন্তত করার দায়িত্ব নিয়ে প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব হয়েছে এ বিশ্বাস বাংলাদেশের জনগণের ছিল। কিন্তু আজ আর তারা এ কথা বিশ্বাস করতে চায় না আর চাইবে কিনা তাতেও যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
.
কেননা জাতিসংঘের সফলতার দিকটার চাইতে দূর্বলতার দিকটা, ব্যর্থতার দিকটা অত্যাচারিত, শোষিত, বঞ্চিত, সংগ্রামী বিশ্বের জনতার কাছে বেশি প্রকট হয়েছে। যে আশা নিয়ে , আকাংখা নিয়ে, সাহায্যের তীব্র ইচ্ছা নিয়ে সর্বোপরি মানবতার সেবা পাবার আগ্রহ নিয়ে যখনই তারা হাত বাড়িয়েছে, তখনি জাতিসংঘের সদর মহলের প্রবেশপথে কারো পর্দা ঝুলে পড়েছে। তাহা রিক্তহস্তে করুণভাবে ফিরে এসেছে। বিশ্বের এই সংগ্রামী মানুষেগুলোর সাথে বাংলার সংগ্রামী নরনারীও আজ পর্যন্ত জাতিসংঘের সদর দরজার কাছ থেকে তেমনি ফিরে এসেছে আসছে। হয়তো এমনি আঘাত পেয়ে আরও বহুবার ফিরে আসতে হবে।
.
মূলতঃ কার্যদৃষ্টে এ কথা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, জাতিসংঘ নামে আন্তর্জাতিক এই প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বের গুটিকয়েক বড় শক্তির বৈঠিকখানা বিশেষ। চা খাওয়, আড্ডা দেয়া, প্রোয়জনবোধে তাস পাশা খেলার সুন্দর ব্যবস্থা বিশেষ এই জাতিসংঘের সদর দফতরটি। তার কর্মকর্তারা বৃহৎ শক্তিগুলোর হর্তা-কর্তা আড্ডাবাজদের হুকুমের কর্মচারী বিশেষ।
.
এই পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘের কাছ থেকে সংগ্রামী বাংলাদেশ কি আশা করতে পারে। পক্ষান্তরে বিশ্বের দুটি ক্ষমতার রাজনীতির নেশায় এমনভাবে মজেছে যে, মানবদরদি, শোষণ-নির্যাতনের বিরোধী বলে পরিচিত এ দুই রাষ্ট্রের বিবেকের সকল অনুভুতির যেন বিলুপ্তি ঘটেছে। অন্যরা আজ মেরুদন্ডহীন প্রাণীবিশেষ। আত্নবিশ্বাস, আত্নশক্তি, ন্যায়বোধ বলতে যে তাদের কিছুই নাই।
.
এদিকে আজকের বিশ্বের বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, যার শক্তি নাই, সম্পদ নাই, আত্নবিশ্বাস নাই, সম্মান ও মর্যাদাবোধ নাই তার কদর নিজের কাছে তো নাই, পরের কাছে তো মোটেও নাই। সম্পদ ও ক্ষমতা এ দুটোই আমোঘ অস্ত্র। এ দুটোর নির্দেশেই সবাই উঠানামা-বসা-শোয়া করছে। জাতিংঘও তাই বৃহৎ শক্তিগুলোর ক্রীড়নক হয়ে কাজ করুক, তাতে তাদের মেরুদন্ড বিবেকহীন অস্থিমজ্জায় বাধে না। বাধবে না।
.
জাতিসংঘ ও বৃহৎ শক্তিগুলোর বাংলাদেশ নিয়ে খেলার অবস্থাদৃষ্টে এ কথা স্পষ্টভাবে বলা যায় যে, নিজেদের ক্ষমতা ছাড়া তাদের মুক্তি সম্ভব নয়-স্বাধীনতা কখনো আসবে না। স্বাধীনতা সার্বভৌম বাংলাদেশ সরকারের নেতৃবৃন্দের অভিমতও তাই। ইতিপূর্বেই তারা এ কথা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন।
.
অবশ্য এই ঘৃণ্য, মানবতাবিরোধী মানসিকতার বিরুদ্ধে যে শক্তিশালী রাষ্ট্র ও বিবেকবান মানুষ নাই, তা নয়। তারাও কাজ করছেন। করবেন। তারাই একমাত্র বাংলাদেশের জনগণের বাইরের সম্পদ।
.
মুক্তিযোদ্ধারা মাতৃভূমি থেকে পাক হানাদারদের একে একে খতম করেছে। করবে। তাদের শেষ অপচেষ্টা শীঘ্রই তাদের মৃত্যুমুখী আঘাতে সম্পূর্ণ নির্মূল হবে-এ দৃঢ় বিশ্বাস ও আত্মনিষ্ঠা তাদের রয়েছে।
.
সাড়ে সাত কোটি মানুষ বিশ্বের বুকে কণিষ্ঠতম জাতি হবে, শোষক গোষ্ঠীকে সাম্রজবাদ ক্রীড়নক শক্তিগুলো উৎখাত করবে বিশ্বের বুক থেকে এ কামনা বাঙংলার প্রতিটি মানুষই করেছে। আর এই জন্য সার্বিক সাফল্য তাদের জন্য সুনিশ্চিত।
.
.
সৌ রভ
<৬,১১৩,১৮৫-১৮৬>
শিরোনামঃ সম্পাদকীয় ( সংগ্রামী নেতৃবৃন্দের প্রতি)
সংবাদপত্রঃ বাংলার মুখ (১ম বর্ষঃ ৬ষ্ঠ সংখ্যা)
তারিখঃ ১৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
.
সংগ্রামী নেতৃবৃন্দের প্রতি
বাংলার সংগ্রামী সাড়ে সাত কোটি মানুষ আজ এক গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে উপনীত হয়েছে। সাম্প্রতিক সর্বদলীয় ঐক্যফ্রন্ট স্বাধীনতার সংগ্রামে এক নতুন মোড় দিয়েছে। নতুন রূপ পেয়েছে সংগ্রামী আন্দোলন। এর সাথে সাথে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্বেও বাংলাদেশ এক নতুনতর, উজ্জ্বলতর রূপ পেল। বিশ্বের বুকে একটি বলিষ্ঠতম জাতি হিসাবে, ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের প্রতীক হিসাবে বাংলাদেশ শীর্ষ সম্মানের, উপযুক্ত মর্যাদার দাবীদার। সাম্রাজ্যবাদ, মানবতাবিরোধী চক্রকে নস্যাৎ করার ব্যাপারে, উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের প্রস্তুতি নেয়ার জন্য এ সূচনা নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করলো।
.
পক্ষান্তরে বাংলার সংগ্রামী জনগন অতি গভীর আগ্রহভরে লক্ষ্য করেছে যে, তাদের নিয়ে তাদের জীবন নিয়ে, মান-ইজ্জত নিয়ে লোলুপ সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী, মানবতা বিধ্বংসী চক্র নতুনভাবে ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। তাদের এই ষড়যন্ত্র দিনের পর দিন অতি সূক্ষ্মতর পদ্ধতিতে জাল বিস্তার করে চলেছে। আগামী দিনের বাঙ্গালী জাতিকে পঙ্গু করার জন্য, বিধ্বস্ত করার জন্য, পদানত করে রাখার জন্য এই ষড়যন্ত্র সক্রিয়ভাবে কাজ শুরু করেছে। অতি দুঃখের সাথে সাড়ে সাত কোটি মানুষ এও লক্ষ্য করেছে যে, এই ষড়যন্ত্রকারী গোষ্ঠীর সাথে বাংলার মীরজাফরের দল তলে তলে কাজ করে যাচ্ছে। নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্যে ও একটি জাতিকে সমূলে নষ্ট করার জন্য তাদের এই হীনতম কাজ অতি জঘন্য ও ঘৃণ্য।
.
এদিকে জাতীয় নেতৃবৃন্দ এই চক্রান্তকারী গোষ্ঠী সম্পর্কে সচেতন থাকলেও এই হীন, জঘন্যতম প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করার ব্যাপারে কোন বিশেষ কর্মসূচির মাধ্যমে এগিয়ে আসছেন কিনা তা বাংলার জনগণের জানা নেই।
কুখ্যাত জামাতে ইসলামী, মুসলিম লীগ এবং তাদের লেজুড় রাজাকার বাহিনীকে বাংলার সোনার মাটি থেকে আগাছার মত উপড়ে ফেলার কর্মসূচী বাস্তবায়িত হচ্ছে, এ বড় আনন্দের কথা। কিন্ত স্বাধীনতা সংগ্রামের নামে তলে তলে একশ্রেণীর ছদ্মবেশী কাজ করে যাচ্ছে এবং সমাজের শীর্ষস্থান থেকে তাদের কাজের গতিধারা প্রতিটি সচেতন ও স্বাধীন বিবেকসম্পন্ন নাগরিককেই ব্যথিত করে তুলেছে।
.
স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রাথমিক পর্যায় থেকে আজ পর্যন্ত কিছুসংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ শিক্ষক বাংলাদেশ থেকে বাইরের বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। অতি সাম্প্রতিক কালের একটি খবরে জানা যায় যে, আমেরিকার একটি বিশেষ ফাউণ্ডেশন তাদের “ সাময়িক আর্থিক” সাহায্যদানে সাড়ে সাত লক্ষ টাকা দান করেছে। এই দানের কারণ হিসাবে জেনারেল ইয়াহিয়ার অত্যাচার, নির্যাতনের কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। অতিসাধারণ সচেতন নাগরিকও জানেন যে, আমেরিকা এই প্রশাসনে তথাকার কুখ্যাত গোয়েন্দা বিভাগের পরেই প্রভাব বিস্তার করেছে। যে আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদী প্রশাসন বাংলার বুকে হত্যালীলার, বাংলাকে বিধ্বস্ত করার কাজে জেনারেল ইয়াহিয়াকে সরাসরি সমর্থন এবং প্রয়োজনীয় আর্থিক ও অস্ত্র সাহায্য দিয়ে আসছে তারই অঙ্গ হিসাবে এই ফাউণ্ডেশন বাংলার শিক্ষাবিদ, পণ্ডিতদের গবেষণায় আর্থিক সাহায্য দিচ্ছে। আর এইসব হতভাগ্য গবেষণাবিশারদরা, পণ্ডিতরা ইতিপূর্বেই সাম্রাজ্যবাদ গোষ্ঠীর দালালী করেছে, ক্রীড়নক হিসাবে কাজ করছে, এ কথা সর্বজনবিদিত। আজ তারা বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ দূরে থাকুক, যারা স্বাধীনতাকে নস্যাতকরার জন্য, হত্যাযজ্ঞকে ব্যাপকতর করার জন্য সক্রিয়ভাবে কাজ করেছে তাদেরই অর্থানুকূল্যে বিলাসপূর্ণ জীবনযাপন করার কাজে উঠেপড়ে লেগেছে। তাদের এই জীবন- ঐতিহ্য, বহু পুরনো। বাংলার সংগ্রামী জনতা, জননেতা তাদেরকে ভালো করেই জনেন। কিন্ত আজ পর্যন্তও এইসব জাতি বিধ্বংসীদের ব্যাপারে কোন ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হয়নি। আজো যদি করা না হয় তা হলে বাংলার আগামী দিনের স্বাধীনতা কোন পথে মোড় নেবে তা প্রত্যেকের জানা আছে।
.
সৌ রভ
<৬,১১৪,১৮৭-১৮৮>
শিরোনাম ( মুক্তি সংগ্রামের নতুন দিক )
সংবাদপত্রঃ বাংলার মুখ ১ম বর্ষঃ ৬ষ্ঠ সংখ্যা
তারিখঃ ১৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
.
মুক্তি সংগ্রামের নতুন দিক
অধিকৃত বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানী ইসলামবাহিনী বিতাড়নের জন্য মুক্তিবাহিনী যেমন তৎপর হয়ে উঠেছে,তেমনি তৎপর হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট কূটনীতিবিদরা। বিভিন্ন রাষ্ট্রে নিযুক্ত কূটনীতিবিদরা পাকিস্তানীদের সাথে সম্পর্কছেদ করে বাংলাদেশ সরকার ও জনগণের সংগ্রামের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন এবং একই সাথে তারা কূটনৈতিক সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছেন।
.
আধুনিক সশস্ত্র সংগ্রামের কূটনৈতিক চালের যে মূল্য নেই এ কথা বলা মুশকিল। বিশেষতঃ বিরোধী শক্তি যদি কোন বিশেষ রাষ্ট্রগোষ্ঠীর কূটনৈতিক আশ্রয়ে থাকে সেক্ষেত্রে সংগ্রামী পক্ষও গ্রহণ করতে হয় অনুরুপ কূটনৈতিক পদ্ধতি। সংগ্রামে প্রচারের ভূমিকার পাশেই কূটনৈতিক মারপ্যাঁচের স্থান নির্ধারিত করা যেতে পারে।
.
অনস্বীকার্য যে বিশ্বের প্রতিটি সংগ্রামী জনসাধারণ আত্মপক্ষ সমর্থন জন্য খুঁজেছে কোন না কোন কূটনৈতিক দিকে ক্ষমতাবান দেশকে। এর অন্যমত কারণ, যে দেশগুলোর স্বাধিকার অর্জনের জন্য সংগ্রাম শুরু করেছে এমন কতকগুলি শক্তির বিরুদ্ধে যে শক্তিগুলোর পেছনে ছিল উপনিবেশবাদী সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিবাদী ক্ষমতা। তাই তাদের সংগ্রামে প্রয়োজন হয়েছে অনুরুপ ক্ষমতাবান শক্তির সমর্থন।
.
আমাদের মুক্তি সংগ্রামের প্রথম দিকে আমরা শুধু শত্রুর মোকাবিলা করেছি অস্ত্রে, অন্যদিকে শত্রু শুধু অস্ত্রেই নয়, তার প্রচার মাধ্যমে ও কূটনৈতিক মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে প্রকৃত ঘটনা থেকে সম্পূর্ণ দূরে সরিয়ে রাখতে সমর্থ হয়েছে। সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব এবং জোটবহির্ভূত তৃতীয় বিশ্ব নামে কথিত শান্তিকামী দেশগুলো শুধু অবাক বিস্ময়ে চেয়ে থেকেছে। কারণ বাংলাদেশের সামগ্রিক ঘটনা তাদের কাছে পৌঁছায়নি। যেটুকু পৌঁছেছিল তা হল জবরদখলকারীর বিকৃতি। আমরা যে গনতন্ত্রে বিশ্বাসী একটি জনগোষ্ঠী ছিলাম এবং আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করে স্বৈরাচারী সরকার যে শোষণকে কায়েম রাখতে চেয়েছে এবং আমাদের ওপর সশস্ত্র সংগ্রাম চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে এ কথা জানতে পারেনি বিশ্বের কেউই বরঞ্চ বিশ্ব জনমতের এই ভ্রান্তির সুযোগে সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী আমাদের দেশটাকে ও সংগ্রামটাকে তাদের স্বার্থে স্ট্রাটেজিক প্রয়োজনে ব্যবহার করতে চেয়েছে। কূটনৈতিক চালে ফেলে আমাদের বিভ্রান্ত করতে চেয়েছে।
.
কমনওয়েলথে বাংলাদেশের যোগদান করার কথা ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি জনাব কে, এম, সাহাবুদ্দিন এবং এ জন্যেই জনাব হোসেন আলীকে ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশ হাইকমিশনার হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছে। নয়াদিল্লীতে হাইকমিশনারের অফিসও স্থাপিত হচ্ছে।
.
আবার অন্যদিকে বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ আসন্ন অধিবেশন তাদের প্রতিনিধি পাঠাবার কথাও ঘোষণা করেছেন। সাধারণ অধিবেশনে যোগদানের অন্যতম উদ্দেশ্য জাতিসংঘের সমর্থন অর্জন।
.
অন্যদিকে এও জানা গেছে যে আসন্ন সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ভারত সরকার বাংলাদেশ প্রশ্ন উত্থাপন করবে। এ ব্যাপারে ভারত সরকার হয়ত সোভিয়েত রাশিয়ার সাহায্য অথবা অনুমোদনও নিতে পারে। রাজনৈতিক মহল এ নিয়ে বেশ সরগম হয়ে উঠেছে।
.
সম্প্রতি কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত সপ্তদশ কমনওয়েলথ শারদীয় অধিবেশনে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর বর্বর অত্যাচারের তীব্র সমালোচনা করা হয় তাছাড়াও সিংহল, ফিলিপিন, নেপাল, ইংল্যান্ড প্রভৃতি দেশে বাংলাদেশের মিশন স্থাপিত হতে যাচ্ছে।
.
সমগ্র পরিস্থিতি দৃষ্টে এটুকু আশা করা যায় যে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম তার সর্বাঙ্গিন রুপ পরিগ্রহ করেছে এবং তার আপন অধিকার শুধু দেশের মাঝেই সীমিত রাখবে না বিশ্বের মাঝেই সে তার স্থান করে নেবে। বিশ্বের গণতন্ত্রে বিশ্বাসী শান্তিকামী মানুষের যেমন সমর্থন সে কামনা করছে তেমনি বিশ্বের শোষণ মুক্তির প্রতিটি সংগ্রাম সে করবে সমর্থন।
.
সংগ্রামের যথার্থ মুহূর্তেই সূচিত হয়েছে আমাদের এই কূটনৈতিক তৎপরতা। বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ এলাকা আজ হানাদারমুক্ত। বাংলাদেশ সরকার সেখানে তাদের কর্তৃত্ব সম্পূর্ণ বজায় রেখে চালিয়ে যাচ্ছেন প্রশাসন ব্যবস্থা। ঠিক এই পরিস্তিতিতে তার স্বীকৃতির প্রয়োজনে কূটনৈতিক কার্যপদ্ধতি অত্যন্ত প্রয়োজন।
.
তবে এটা ঠিক যে আমাদের এই কূটনৈতিক তৎপরতায় চিনে নিতে হবে আমাদের হিতাকাঙ্ক্ষীদের। কারণ ইতিহাস আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে যে মিত্ররুপী শত্রু একটা দেশকে ধ্বংস করে দেয়ার জন্য কিনা করেছে। কূটনৈতিক ফাঁদে পড়ে বাংলাদেশ সমস্যার যে অপঘাত হতে যাচ্ছিল ওই তৎপরতায় প্রমানিত হল যে বাংলাদেশের সংগ্রাম একমুখী নয়। শত্রুর প্রতিটি আস্তানায় হানা দেবে বাঙ্গালার বীর সন্তানরা এবং তারা হবে জয়ী।
.
শুধু দু’চারটি দেশে নয় এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকার যে দেশগুলো আমাদের সংগ্রামের প্রতি সহানুভূতিশীল সে সব দেশেও আমাদের মিশন স্থাপন করতে হবে এবং কূটনৈতিক বোঝাপড়ার মাধ্যমেই গড়ে তুলতে হবে আমাদের পররাষ্ট্র নীতি।
.
বেসামাল জঙ্গীশাহী আপ্রান চেষ্টা করেছে বাংলাদেশে দালালশাহী প্রবর্তনের। প্রতিক্রিয়াশীল ও ধর্মান্ধ রাজনৈতিক দলগুলোকে এক করে চেষ্টা করেছে দালাল গনতন্ত্র সৃষ্টির। এর পেছনে যুক্তি একটি সেটা হল বিশ্ব জনমতকে বিভ্রান্ত করা। অতএব আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপ হবে সংগ্রামী পদক্ষেপ। আমাদের ধরে নিতে হবে যে আমরা প্রতিটি পদক্ষেপ সংগ্রামের সম্মুখীন হচ্ছি এবং যে সংগ্রাম আমাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে। শত্রুর প্রতিটি গতিবিধি লক্ষ্য রেখে পরিচালিত করতে হবে আমাদের সংগ্রাম কৌশল।
.
সৌ রভ
<৬,১১৫,১৮৯-১৯০>
শিরোনামঃ বাংলাদেশ ও বিশ্ব বিবেক
সংবাদপত্রঃ বাংলার মুখ ( ১ম বর্ষঃ ৬ষ্ঠ সংখ্যা )
তারিখঃ ১৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
.
আজকের সংগ্রামী বাংলাদেশ ও বিশ্ব বিবেক
দি ইকনমিষ্ট পত্রিকার চলতি সংখ্যায় বলা হয়েছে যে, অবশেষে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া কিছু একটা করলেন। গত সপ্তাহে পূর্ব পাকিস্তানে ফেরত পাঠিয়েছেন এবং তার দায়িত্ব বাঙ্গালী বেসামরিক ব্যক্তি ডাঃ আব্দুল মালিক গভর্নর হিসাবে ও জেনারেল আমীর নিয়াজী সামরিক প্রশাসক হিসাবে ভাগ করে নেবে। একজন সরকারী মুখপাত্র বলেছেন যে, “সেনাবাহিনী এখন বেসামরিক প্রশাসন ব্যবস্থাকে কেবল সাহায্য করেছে।” এবং রোববার ১লা মার্চ হতে ৫ই সেপ্টেম্বরের মধ্যে যারা অপরাধ করেছিল তাদের ব্যাপক ক্ষমা প্রদর্শন করেছেন। অপ্রকাশিত সংখ্যক আটক বাঙ্গালী পুলিশ ও সেনাবাহিনীসহ বহু ব্যক্তিকে মুক্তিও দেওয়া হয়েছে।
.
পশ্চিম পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা মিঃ ভূট্টো যিনি সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আপন সজাতিতে আক্রমণ রচনা করেছে, বলেছেন যে, একজন অসামরিক গভর্নর নিয়োগ লোক দেখানো মাত্র। অবশ্য এ মন্তব্য কতখানী সত্য এখন বলা কঠিন। ডাঃ মালিকের মন্ত্রিপরিষদে মুজিবের আওয়ামী লীগের সদস্য গ্রহণ এবং সামরিক কর্তৃপক্ষ তাকে কতখানি ক্ষমতা ব্যবহারের সুযোগ দেবে তার ওপরই নির্ভর করবে অনেকখানি। ডাঃ মালিক মনেপ্রানে বাঙ্গালী নন, ১৯৬৯ সালে ইয়াহিয়ার মন্ত্রিপরিষদে কাজ করার ফলে অধিকাংশ বাঙ্গালী তাকে সন্দেহের চোখে দেখতো।
.
পত্রিকাটিতে আরও বলা হয় যে, নতুন বেসামরিক শাসনকর্তা যদি সাচ্চা হন তাহলে তার এ ভয় দূর করা উচিত যে সাহায্য সামগ্রী মুক্তিফৌজের প্রতি বাঙ্গালীদের সমর্থন নষ্ট করা জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। কোন কোন প্রতিষ্ঠান অবশ্য ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছেন। কিন্ত একটা দাতব্য প্রতিষ্ঠান, অপারেশন ওমেগা, সরকারকে তাদের সামগ্রী দিতে সাহস পাচ্ছে না। এবং তাই তারা পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তে নিজেরাই গিয়ে কাজ করতে সচেষ্ট হয়েছে। গত মাসে এদের ফেরত পাঠানো হয়েছিল। এবং রোববার চারজন সদস্য প্রোটিনযুক্ত খাদ্যাদি নিয়ে আবার পূর্ব পাকিস্তানে ঢোকার চেষ্টা করতে তাদের গ্রেফতার করা হয়।
.
পত্রিকাটি মন্তব্য করে যে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এই পন্থা গ্রহণ করেছেন বিভিন্ন কারণে। মার্কিন অস্ত্র সরবরাহে দ্বিধা দূর করতে হবে তবে পাশ্চাত্য সাহায্য কোনসর্টিয়ামের সাহায্য পাওয়ার জন্য তাকে তাদের অনুরোধ করতে হবে এবং শেখ মুজিবুর রহমানের বিচারের থেকেও সবার দৃষ্টি অন্যদিকে সরানোর চেষ্টা করছেন। কিন্ত আসল ব্যাপার রয়ে যাবে ভারতে আগত ৮৫ লক্ষ শরণার্থীর প্রত্যাবর্তন ও মুক্তিফৌজের সংগ্রাম থামার পর।
.
বৃটিশ গিয়ানার বিরোধীদল পিপলস প্রোগ্রেসিভ পার্টির নেতা ডঃ চেণ্ডি জগলের স্ত্রী ও উক্ত দলের আন্তর্জাতিক সংক্রান্ত বিষয়ের সেক্রেটারী মিসেস জালে জগল বলেন যে, ভারত উপমহাদেশে মানবিক দুর্দশার যে কাহিনী প্রকাশিত হচ্ছে তার গুরুত্ব পশ্চিম দেশগুলো উপলব্ধি করতে পারেনি।
.
তিনি ফোরবেস বানটাহম সরকারকে এ ব্যাপারে ব্যর্থতার জন্য তীব্র সমালোচনা করেন।
.
এক সাংবাদিক সাক্ষাতকারে তিনি বলেন যে, এ মুহূর্তে গিয়ানার উচিত ভারতে আগত ৮০ লক্ষ শরণার্থী প্রত্যাবর্তনের জন্য পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা স্বাভাবিক করার নিমিত্তে পাকিস্তান সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করা ও বিশ্বজনমত সৃষ্টিতে সাহায্য করা।
.
মিসেস জগল বলেন যে অনুষ্ঠিতব্য জতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন গিয়ানার উচিত শান্তিকামী দেশগুলোর সাথে এক হয়ে রাজনৈতিক সমাধান ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত পাকিস্তানী নেতাদের হাতে শাসনক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করা।
.
বিশ্ব শান্তি পরিষদ রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ সম্পাদক উ থানটের কাছে এক স্মারকলিপিতে এই অভিমত প্রকাশ করেছেন যে, বাংলাদেশ সমস্যার একটা রাজনৈতিক সমাধান সম্ভব, যদি তা নিয়ে জনগণের সত্তিকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে এবং বাংলাদেশের জনগণের ভাগ্য নির্ধারণে তাদের অবিচ্ছেদ্য অধিকারের ভিত্তিতে আলোচনা করা হয়।
.
৯ই সেপ্টেম্বর নিউয়র্ক পরিষদের মহাসচিব শ্রী রমেশচন্দ্রের নেতৃত্বাধীন পরিষদের এক প্রতিনিধি দল এবং সমস্ত মহাদেশের অন্যান্য প্রতিনিধিরা উ থানটের হাতে স্মারকলিপিটি অর্পণ করেন।
.
স্মারকলিপিতে বাংলাদেশের নিরস্ত্র অসামরিক নাগরিকদের ব্যাপক হারে হত্যা করার তীব্র নিন্দা করা হয়েছে। স্মারকলিপিতে বাংলাদেশের জনগণের ক্রমবর্ধমান প্রতিরোধ এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রতি পরিষদের সমর্থন জ্ঞাপন করা হয়েছে।
.
নেপালস্থ পূর্ববঙ্গ শরণার্থী সহায়ক কমিটি এক প্রস্তাবে অবিলম্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মুক্তি এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে বাংলাদেশের শাসনভার তুলে দেবার দাবী জানিয়েছে। কারণ এই ব্যবস্থার দ্বারাই শরণার্থীদের আবার স্বদেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে।
.
আর এক প্রস্তাবে বাংলাদেশে পাকিস্তানের জঙ্গীশাহীর বর্বরতা তীব্র নিন্দা করা হয়েছে। নেপালের খ্যাতনামা নেতারা এই সভায় যোগ দেন এবং বাংলাদেশের জনগণের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানান।
.
প্রাত্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রী ঋষিকেশ সাহা এই সভায় সভাপতিত্ব করেন। বাংলাদেশ সহায়ক তহবিলে ডাঃ কামার্জি একশত টাকা দিয়ে অর্থ সংগ্রহ শুরু করান।
.
যে ঘটনায় কোন দেশের ৮০ লক্ষ মানুষকে পররাষ্ট্রে আশ্রয়ের জন্য চলে যেতে হয় আর সে দেশের আভ্যন্তরীণ সমস্যা বলা যায় না। ভারতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাত্তন রাষ্ট্রদূত অধ্যাপক জন কেনেথ গলব্রেথ এক সংবাদিক বৈঠকে বলেন, পূর্ববঙ্গের বর্তমান পরিস্তিতি আর ভারতে শরণার্থী আসার ঘটনাকে ভিন্ন করে দেখা যায় না।
.
অধ্যাপক গলব্রেথ বলেন, তাঁর ভারত সফর পুরোপুরি বেসরকারী। এর সঙ্গে কূটনৈতিক গুরুত্ব আরোপ করা ঠিক নয়। নিজের সফর সম্পর্কে তিনি বলেছেন, একজন প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত এসেছেন ভালোভাবে শরণার্থী সমস্যা অনুধাবন করতে। বাংলাদেশে পাকিস্তানের ভূমিকা সম্পর্কে পর পর কয়েকটি প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছেন, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নতুন কোন ‘ফ্রন্ট’ খোলার উদ্দেশ্যে তিনি ভারতে আসেন নি তবে তিনি বলেছেন, জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে পূর্ববঙ্গে শাসন চালাবার চেষ্টা করলে পাকিস্তানের অর্থনীতির শোচনীয় পরিস্তিতি হবে। শেখ মুজিব সম্পর্কে এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, শেখ মুজিব গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত হয়েছেন তাঁর বিচারকে গণতান্ত্রিক বলে চালানো হলে গণতন্ত্রের ওপর মানুষের আস্থা হারিয়ে যাবে।
.
অধ্যাপক গলব্রেথ বলেন, তাঁর ধারণা, নিরাপত্তা বোধ করলে শরণার্থীরা দেশে ফিরে যাবেন। তাঁর মতে নিরাপত্তার ভাব তখনই ফিরে আসবে যখন তাঁরা নিজেদের শাসনের অধিকার হাতে পাবে এবং নিজেদের ভাগ্য নিজেরাই নিয়ন্ত্রন করতে পারবে। তিনি জানান, তিনি এ ব্যাপারে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী, হাইকমিশনার ও সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করে এ সিদ্ধান্তে এসেছেন।
.
.
তাসমিয়া তাসিন
<৬,১১৬,১৯১-১৯২>
সংবাদপত্রঃ বাংলার মুখ ১ম বর্ষঃ ৭ম ও ৮ম সংখ্যা
তারিখঃ ১ অক্টোবর, ১৯৭১
সম্পাদকীয়
.
স্বাধীন বাংলাদেশের বাস্তব সত্য
বিশ্বের বুকে আজ স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশ বাস্তব সত্য। বাংলাদেশের যুদ্ধরত সিংহশাবকরা একথা চরমভাবে প্রমাণিত করছেন । বাংলার সশস্ত্র মুক্তিবাহিনী বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদ গোষ্ঠীকে হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করাতে পেরেছেন যে, বাংলার বুকে তাদের পাঁয়তারার দিন শেষ হয়ে গেছে । বর্বর পশু সেনাবাহিনীর নেতা জেনারেল ইয়াহিয়াও বুঝতে পেরেছে তার ঘৃণ্য মানসিকতাও বিধ্বস্ত । মানবীয় ও সচেতন বিশ্ব তার সমালোচনায় মুখর । বিশ্ব-ব্রিগেড গড়ে তোলার প্রস্তাব নেওয়া হয়েছে । দিল্লীতে বিশ্ব-সম্মেলনে । বাংলাদেশ সম্পর্কে অন্ধকারে রাখা পশ্চিম পাকিস্তান ও আর অন্ধকারে নয় । বিশ্ব- সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী ২৫ টি রাষ্ট্রের নেতৃবৃন্দের পশ্চিম পাকিস্তান প্রতিবাদ পরিক্রম তাদের নতুন চোখ খুলে দিবে ।
.
রাষ্ট্রসংঘের সেক্রেটারী উ থান্টের মুখ খুলেছে । অবশ্য তার মুখ সাম্রাজ্যবাদ গোষ্ঠীরই মুখ একথা স্পষ্ট । চীনেরও মনোভাবের পরিবর্তন (?) ঘটেছে ।
.
এসবের সাথে বাংলাদেশ সম্পর্কে বিশ্বের রাজনৈতিক চিন্তাধারাও পরিবর্তন হচ্ছে অভূতপূর্বভাবে। এই পরিস্থিতির মধ্যে বসেছে রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাধারণ অধিবেশন । বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে সেখানে যোগদান করছেন স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ সরকারের একটি প্রতিনিধি দল। উদ্দেশ্য বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানবাত্মার আত্মবিশ্বাস, দৃঢ়তা ও সঙ্কল্পকে জানিয়ে দেয়া । বিশ্ব বিবেককে বুঝানো বাংলাদেশ কি চায় , সেখানে কি ঘটছে । কি ঘটবে । বাংলাদেশের স্বাধীন সার্বভৌম সরকারের স্বীকৃতি বিনাশর্তে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি, পশু পাক-সৈন্যদের বাংলার মাটি থেকে সরিয়ে নেয়ার দাবী জানাবেন তারা । পাকিস্তানের বর্বর আক্রমণের বিরুদ্ধে যুগোশ্লাভিয়া, চেকোশ্লাভিয়া, ইরাক, রাশিয়া ও আরো ক’টি দেশ ধিক্কার জানাবেন। বাংলাদেশকে রাষ্ট্রপুঞ্জে গ্রহনের দাবীও তোলা হবে । প্রতিনিধিদল বিশ্বের ক’টি দেশও ঘুরে আসবেন । স্বীকৃতি সাপেক্ষে অস্ত্রের কথাও তুলবেন তারা ।
.
বাংলাদেশ সম্পর্কে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারত যে মানবীয় দায়িত্বের তাগিদে কাজ করেছেন একথা স্পষ্ট । প্রতিনিধিদল একথাও বুঝবেন । ভারত শরণার্থীদের জন্যে যা করেছেন তা মানবীয় , রাজনৈতিক নয় । এ ব্যাপারে জঙ্গী পশু পাক সরকার যা বলেছেন যা করেছেন তা ভিত্তিহীন, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত , সঙ্কীর্ণ মানসিকতা সম্পন্ন বই আর কিছু নয় । একথা বিবেকবান বিশ্ব আজ ভালো করেই জানেন ।
.
একদিকে এই হলো আন্তর্জাতিক বিশ্ব । পক্ষান্তরে বাংলার সিংহশাবকরা অবিরাম সংগ্রাম করে চলেছেন । মুক্ত করছেন মাতৃভুমিকে পাক হানাদারদের কাছ থেকে । দিন দিন তাদের হামলা দুর্বার হচ্ছে ।
.
আজ সংগ্রামী বাংলার যে কন্ঠস্বর তা হচ্ছে পূর্ণ স্বাধীনতা রাজনৈতিক সমাধান নয় । স্বাধীনতা অর্জনের জন্য , বিশ্বের বুকে সাম্রাজ্যবাদ গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে দুর্বার গণ-রাষ্ট্রীয় প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্যে চাই অস্ত্র । এ হলো তাদের প্রথম ও সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ দাবী । সাম্রাজ্যবাদ গোষ্ঠী ইয়াহিয়াকে নিয়ে বাংলাদেশের উপর যেভাবে দাবা খেলতে বসেছেন তা নিপাত করতে অস্ত্রের প্রয়োজন। অস্ত্র ব্যাতীত তাদের মরণ কামড়কে প্রতিরোধ করার মতো ক্ষমতা অন্যকিছু আছে কিনা তাদের জানা নেই । মনেপ্রাণে তারা প্রয়োজন বোধে বাংলার সংগ্রামী জনগণের অধিক দান করতেও সম্পূর্ণ প্রস্তুত রয়েছে ।
.
এর বাইরে যদি কেউ কিছু চিন্তা করে থাকেন তা হলে তারা বাংলার সংগ্রামী স্বাধীনতাপ্রিয় জনগণের বাইরের বলেই বিবেচিত হবেন । জনগণের পরম শত্রু বলে বিবেচিত হবেন তারা । এ ব্যাপারে বাংলার সংগ্রামী নেতৃবৃন্দের বলিষ্ঠ ভূমিকারও বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে । আজ তাদের নেতৃত্বে বাংলার বুকে যা জাতি গড়ে উঠছে তা শুধু বাংলার নয়, বিশ্বের নিপীড়িত , নির্যাতিত, মানব গোষ্ঠীরও আশা ভরসা । তারা আজ সংগ্রামী বাংলার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন ।
.
জাতিসংঘে প্রতিনিধিদল সংগ্রামী বাংলার সত্যিকার রূপ, মানসিকতা বলিষ্ঠতার সাথে স্পষ্টভাবে তুলে ধরতে পারবেন এ দৃঢ় বিশ্বাস জনগণ পোষণ করছেন ।
.
.
তাসমিয়া তাসিন
<৬,১১৭,১৯৩-১৯৪>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ ষষ্ঠ খন্ড
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
সম্পাদকীয়
এবারের ঈদ |
বাংলার মুখ
১ম বর্ষঃ ১০ম সংখ্যা |
২৬ নভেম্বর, ১৯৭১ |
এবারের ঈদ
বাংলার আকাশে এবারেও শাওয়ালের চাঁদ দেখা দিয়েছে । আত্মবিশ্বাসের বলিষ্ঠতা, সংগ্রামের দৃঢ়তায় সাড়ে সাত কোটি নাগরিক অধ্যুষিত বাঙ্গালী জাতি তাদের ভাগ্যের ইতিহাসের এক করুণ ও সঙ্কটময় মূহুর্তে সেই শাওয়ালের চাঁদকে স্বাগতম জানিয়েছেন।রমজানেরপূর্ণ কৃচ্ছ সাধনার পর গত শনিবার বাংলাদেশে পবিত্র ঈদ-উল-ফিতর উদযাপন করলেন। বাংলার ঘরে ঘরে এবারের শারদোৎসব যেভাবে পালিত হয়েছে, ঈদ-উল-ফিতরও সেইভাবেই পালিত হয়েছে।ঈদ আনন্দের হলেও, বছরের একটি পুন্যোৎসব হলেও, এবার হয়েছে ত্যাগের, উৎসবের নয়। শারদোৎসবে যেমন এবার বুড়িগঙ্গা-পদ্মা-মেঘনা-যমুনার বুকে বাজনা বাজেনি, বিচিত্র বেশে নারী-পুরুষ, আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা নামেনি মিছিল করে তেমনি এই ঈদে ঘরে ঘরে আনন্দের ঢেউ খেলেনি, নতুন পোশাকে নামেনি রাস্তায়, আত্মীয়-স্বাজনের বাড়ীতে যায়নি উন্মুক্ত খুশির মন নিয়ে।বাংলার বুকে বর্বর ইয়াহিয়ার ফ্যাসিবাদী চক্র যে অত্যাচার, যে নির্যাতন, যে করুণ মর্মবিদারক পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছে তা সব আনন্দকে সব আশা আকাঙ্খাকে ধূলিসাৎ করে দিয়েছে। বাংলার বুকে আজ এমন কোন ঘর নাই যার স্বজন হারানোর শোক নাই। কি পরোক্ষ, কি প্রত্যক্ষ শোকে শোকে আজ তারা এমন হয়েছেন যে, অত্যাচার, নির্মম নগ্ন পাশবিকতার শিকার পরিণত হয়ে বাংলার প্রতিটি নারী-পুরুষ দুর্জয় শপথে স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্নিমন্ত্রে উজ্জীবিত। প্রতিটি মুহুর্ত, প্রতিটি ক্ষণ, প্রতিটি রক্তের ফোঁটা, মাতৃভূমির মান রক্ষায়, সার্বিক অস্তিত্ব রক্ষায় উৎসর্গীকৃত। অতএব ঈদের উৎসবের জন্যে তাদের স্বাভাবিক অনুভুতিও এর সাথে বিলীন। তারা ইতিহাসের এমন চরম মূহুর্তে বিশ্বের বুকে নিজেদের প্রতিষ্ঠার প্রয়াসে আত্মবলিদানরত।
.
শুধু এবারের ঈদ নয়। বিগত সালের ১২ ই নভেম্বর বাংলার বুকে যে ভয়ঙ্করী দুর্যোগ নেমে এসেছিল যার ফলে ২০ লাখেরও বেশী নর-নারী বাংলার বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়েছেন, এক বিস্তীর্ণ জনপদ ধূলিসাৎ হয়েছে তার ফলে সেবারও বাংলার মানুষ রমজানের ঈদের পবিত্র সুখ আনন্দ উপভোগ করতে পারেনি। স্বজন হারানোর শোকে তখনো তারা ছিলেন মুহ্যমান।
.
বাংলার মানুষ আজ যে ত্যাগ ব্রতে উদ্ধুদ্ধ, দেশকে হানাদার জল্লাদ বাহিনীর কবলমুক্ত করার কাজে হাসিমুখে কোরবান দিচ্ছেন তারই মধ্যে তারা এবারের ঈদের স্বরূপ খোঁজার চেষ্টা করেছেন।
.
আকাশে অশ্রুর কুয়াশামুক্ত খুশীর রোশনাই ছড়িয়ে শাওয়ালের চাঁদের অপেক্ষায় বাংলার বীর সিংহ শাবকরা কাজ করছেন, দেশকে মুক্ত করে সে চাঁদের অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন আর এক আনন্দ পুলকে দোলায়িত হচ্ছেন এই ভেবে যে, লৌহ শপথ বাস্তবায়িত হলেই তাঁরা ঈদ করবেন। নিজেদের মধ্যে নয়, দুনিয়ার স্বাধীনতাপ্রিয় সংগ্রামী প্রতিটি মানুষের সাথেই তারা ঈদের সত্যিকার আনন্দ আর শুভেচ্ছা বিনিময় করবেন।নিঃস্বার্থভাবে সেই কাজে নিজেদের নিয়োগ করার শক্তি দেয়ার জন্যে বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ পরম করুনাময়ের কাছে, সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে হাত উঠিয়ে প্রার্থনা জানিয়েছেন। এই প্রার্থনা, এই মোনাজাত হয়েছে ভাঙ্গা মসজিদে, উন্মুক্ত ময়দানে, শরণার্থী ক্যাম্পে, হাসপাতালে, গীর্জায়, মন্দিরে সর্বত্র। ছিন্ন বস্ত্রে, কঙ্কালসার দেহে উন্মুক্ত হৃদয়ের এই মোনাজাত বিশ্ববিধাতার কাছে, মানবতার কাছে, স্বাধীনতাপ্রিয় প্রতিটি বিশ্ববাসীর কাছে।
.
তাই ঈদের সাথে সাথে লক্ষণীয় বিষয় এই যে, স্বাধীনতার অগ্নিমন্ত্রে উজ্জীবিত বঙ্গশার্দুলরা হানাদার পাকদস্যুদের অধ্যুষিত এলাকায় দ্রুতগতিতে নিধন করে চলেছেন একের পর এক।
.
বিভিন্ন রণাঙ্গন হানাদার বাহিনী মুক্ত হচ্ছে। বাংলার এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত আত্মবিশ্বাসে ভরপুর মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা খুব শীঘ্রই জলে, স্থলে , আকাশে হানাদার দস্যুদের নিশ্চিহ্ন করে দিবেন। এই হলো বাংলাদেশ সরকারের দুর্জয় বলিষ্ঠ শপথ। ঢাকার পতন আসন্ন। চূড়ান্ত বিজয় একান্ত নিকটতর । বাংলার প্রতিটি নারী-পুরুষ জল্লাদমুক্ত, অবাঞ্ছিত অবস্থা থেকে মুক্ত এক স্বাধীন, সার্বভৌম দেশে সুখে শান্তিতে বসবাস করবেন এই হোক তাদের চরমতম ও দুর্জয় বলিষ্ঠ শপথ।
.
.
হিমু নিয়েল
<৬,১১৮,১৯৫-১৯৬>
সংবাদপত্রঃ বাংলার মুখ ১ম বর্ষঃ ১০ম সংখ্যা
তারিখঃ ২৬ নভেম্বর, ১৯৭১
.
বাংলার স্বাধীনতা
অশ্রু আর রক্তে
তাজউদ্দীন
.
অশ্রু আর রক্ত । এরই বিনিময়ে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে বাংলার সাড়ে সাত কোটি নর-নারী স্বাধীনতা সংগ্রামে । কালের গতির সাথে সাথে স্বাধীনতার সোনালী সূর্যের ক্ষণটি নিকটতর হচ্ছে। কিন্তু এর জন্য চাই আরো রক্ত, আরো অশ্রু, আরো আত্মত্যাগ, আরো জীবন ও কষ্ট ।
.
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ গত বুধবার জাতির উদ্দেশ্যে এক বেতার ভাষণে এই অভিমত ব্যক্ত করেন । আত্মত্যাগের মহিমায় উজ্জ্বল সংগ্রামী প্রতিটি নারী-পুরুষের কথা উল্লেখ করেছেন তিনি । এই পর্যায়ে শত্রুসংহারের প্রতিজ্ঞা গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে চাই শহীদদের রক্তের উপযুক্ত মর্যাদার বিনিময়ে সমাজ গঠনের দৃঢ় প্রতিজ্ঞা, আত্মপণ। তিনি বলেন, বাংলাদেশের শহরে ও গ্রামে তরুণেরা যে যুদ্ধে লিপ্ত, তা বিদেশী দখলদারদের উত্খাত এবং অসাম্য ও সুবিধা ভোগের অবসান ঘটানোর সংগ্রাম । আমাদের আজকের সংগ্রাম সেদিনই সার্থক হবে যেদিন আমরা বঙ্গবন্ধু প্রতিশ্রুত ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবো । সমাজের যে ভবিষ্যত্ রূপ আজ বাংলাদেশের জনসাধারণ প্রত্যক্ষ করছেন সেখানে সকলে সমাধিকারের ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয়, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবন গঠিত হবে এবং উন্নয়ন ও পরিপূর্ণতার সাধারণ লক্ষে উপনীত হবার প্রয়াসে সকলে অংশগ্রহণ করবে ।
.
প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের সামরিক চক্রের হাত থেকে উদ্ধার করার একমাত্র উপায় হিসাবে বাংলাদেশ থেকে হানাদার সৈন্যদের নিষ্ক্রমণের সকল পথ রুদ্ধ করে দেয়ার কথা বলেন । জলে স্থলে অন্তরীক্ষে শত্রুকে আমরা চরম আঘাত হানবো আর তখনই জেনারেল ইয়াহিয়া খান ক্রুর সত্যের মুখোমুখি হবেন ।
.
জনাব তাজউদ্দীন বক্তৃতায় এশিয়ায় গণতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে কোন কোন পাশ্চাত্য দেশের নিরাসক্তির কথা উল্লেখ করেন । তিনি বলেন, মনে হয় মানুষ হিসাবে মানুষের মর্যাদার চাইতে এখনো তাঁরা সরকারের স্থিতিশীলতার গুরুত্ব দেন বেশী, এটা শোচনীয় । কিন্তু ভারতকে অর্থ সাহায্যের বিনিময়ে বাংলাদেশের শরণার্থীদের সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাসের প্রস্তাব যখন কোন রাষ্ট্র উথ্থাপন করেন তখন আমরা শিউরে না উঠে পারি না । এই প্রস্তাবে গণহত্যা ও তার ফলাফলকে নীরবে মেনে নেয়া হয়েছে । পর্বত প্রমাণ অবিচার ও অন্যায়কে বিনাবাক্যে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে এবং ভবিষ্যতে গণহত্যা ও তার ব্যপক বাস্ত্তুত্যাগের পথ প্রশস্ত করা হয়েছে । পাকিস্তানী সন্ত্রাসের ফলে যারা ছিন্নমূল হয়েছেন, তারা অস্থাবর সম্পত্তি নন যে, অর্থের বিনিময়ে তাঁদেরকে হাতবদল করা হবে । সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে নিজ বাসভূমে ফেরার জন্মগত অধিকার তাদের আছে এবং তারা সেখানে সেভাবেই ফিরে আসবেন । আর আমি বলছি যে, তার খুব বেশী দেরী নাই ।
.
প্রসঙ্গত জনাব তাজউদ্দীন আমেরিকার কথা উল্লেখ করেন । বাংলাদেশের এই চরমতম ক্ষণে প্রেসিডেন্ট নিক্সন উপমহাদেশের তথ্য সংগ্রহের জন্যে একটি বিশেষ দল পাঠিয়ে কি উদ্দেশ্য সাধন করতে চান, এই হলো তাঁর জিজ্ঞাসা । তিনি বলেন, তাঁর দেশের কূটনীতিবিদ ও আইনসভার সদস্যরা অবগত নন এমনকি নতুন তথ্য তিনি জানতে ইচ্ছুক ? লক্ষ লক্ষ বাঙ্গালীকে সুপরিকল্পিতভাবে হত্যা এবং প্রায় এক কোটি মানুষকে বাস্তুত্যাগে বাধ্য করা সত্ত্বেও পাকিস্তান সরকারকে তাঁর প্রশাসন নিন্দা করেনি । এমন তথ্য সংগ্রাহক পাঠিয়ে কি ফল তাঁরা লাভ করতে চান, জানি না । তবে এতে আমাদের সঙ্কল্পের কোন ব্যত্যয় হবে না । সে সঙ্কল্প হল দেশকে শত্রুমুক্ত করে নিজেদের অভিপ্রেত সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা ।
.
জনাব তাজউদ্দীন মুক্তিসংগ্রামের সাফল্যের কথা উল্লেখ করেন এবং বলেন, দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ যে সর্বক্ষেত্রে তীব্রতর হয়েছে, সেকথা শত্রু মিত্র নির্বিশেষে সকলেই স্বীকার করেছেন । মুক্তিবাহিনী এখন যে কোন সময়ে যে কোন জায়গায় শত্রুকে আঘাত করতে পারে, এমনকি শত্রুর নিরাপদ অবস্থানের কেন্দ্রে অতর্কিতে আক্রমণ চালিয়ে তাকে বিমূঢ় করে দিতে পারে । জলে স্থলে চমকপ্রদ অগ্রগতি ঘটেছে মুক্তিবাহিনীর । নদী পথে হানাদাররা বিপর্যস্ত, মংলা ও চট্টগ্রাম বন্দর প্রায় অকেজো, বাংলাদেশের বিস্তৃত অঞ্চল শত্রুমুক্ত । ক্রমেই অধিকতর এলাকায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কার্যকর প্রশাসন চালু হচ্ছে । আর সৈন্য, সামগ্রী ও মনোবল হারিয়ে শত্রুপক্ষ হতাশায় উন্মাদ হয়ে উঠেছে ।
.
তিনি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পাক সামরিক হুঙ্কার দিশাহারা ও কোণঠাসা হয়ে পড়ার কথা উল্লেখ করেন । তিনি বলেন ইসলামাবাদের দুষ্কৃতিকারীরা নিজেদের ভবিষ্যত্ সম্পর্কেই সংশয় ও ভীতিগ্রস্ত । বাংলাদেশের জনগণের অপরিমেয় দুর্দশা ঘটাবার সঙ্গে সঙ্গে তারা পশ্চিম পাকিস্তানকেও টেনে নিয়ে গেছেন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ভাঙ্গনের দিকে । এখন তারা চায় ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ বাধিয়ে একটা আন্তর্জাতিক সঙ্কট সৃষ্টি করতে । তারা আশা করে যে, এমন একটি যুদ্ধ হলে বাংলাদেশের রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে পৃথিবীর দৃষ্টি অন্যদিকে নিবন্ধ হবে । মুক্তিবাহিনীর হাতে তাদের পরাজয়ের গ্লানি গোপন করা যাবে এবং এমন একটা পরিস্থিতির উদ্ভব হবে যাতে তাদের পৃষ্ঠপোষকেরা হস্তক্ষেপ করার সুযোগ পাবে । কিন্তু আমি প্রত্যয়ের সঙ্গে বলছি যে, এর একটি উদ্দেশ্যও সিদ্ধ হবে না । এবং এতে তাদের ভ্রান্তি, অপরাধ ও আত্মঘাতের মাত্রা বৃদ্ধি পাবে মাত্র এবং পাকিস্তানের আত্মবিনাশ সুনিশ্চিত হবে ।
.
সর্বশেষে জনাব তাজউদ্দীন জনগণকে মুক্তি সংগ্রামের বর্তমান পর্যায়কে চুড়ান্ত স্তরে নিয়ে চলার আহবান জানান । যেসব সরকারী কর্মচারী, রাজাকার, পুলিশ বা অন্যান্য ব্যক্তি বিবেকের নির্দেশের বিরুদ্ধে হানাদারদের কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন তাদেরকে সামরিক চক্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার সুযোগ নেয়ার আহবান জানান । শত্রুপক্ষের সঙ্গে যারা স্বেচ্ছায় হাত মিলিয়েছে তাদের শেষবারের মত তিনি জানিয়ে দেন যে, বিশ্বাসঘাতকতার পথ পরিহার করুন । অনুতাপহীন বিশ্বাসঘাতকদের আর তাদের বিদেশী প্রভুদের পরিণতি এক হবে আর তা হল গ্লানিকর মৃত্যু ।
.
.
হিমু নিয়েল
<৬,১১৯,১৯৭-১৯৮>
সংবাদপত্রঃ বাংলার মুখ ১ম বর্ষঃ ১০ম সংখ্যা
তারিখঃ ২৬ নভেম্বর, ১৯৭১
.
বাংলাদেশ সরকার ও তার ব্যপক সাফল্য
.
আমাদের স্বাধীন সরকার গঠন করার পর মাত্র কয়েকটি মাস অতিক্রান্ত হয়েছে । দেশের মাটি থেকে একটি বিদেশী শোষকগোষ্ঠির পোষা পেশাদারী সৈন্যদের নিশ্চিহ্ন করার কর্তব্যই আমাদের প্রাথমিক এবং মৌলিক কর্তব্য । এই কর্তব্য সম্পাদনের প্রাথমিক পর্বে আমাদের শক্তি ছিল সীমিত এবং শত্রুপক্ষের তুলনায় একেবারে নগণ্য । বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্য, ইষ্ট পাকিস্তান রাইফেলস্ সহ পুলিশ এবং আনসারের সামান্য শক্তিই ছিল আমাদের মুলধন । এই সামান্য শক্তি নিয়ে যে যুদ্ধের সূচনা হয়েছিলো তাকে আজকের বিশ্লেষনে এক অভাবনীয় সাফল্যের সূচনার দারপ্রান্তে পৌছেছে বলে বলতে হয় । কারণ আমাদের সমস্যা ছিলো অস্ত্রের এবং অস্ত্র বিদ্যায় পারদর্শী সুসংহত বাহিনীর । বাহিনী বলতে যে তাৎপর্যময় একটি সামরিক শক্তিকে বোঝায় তা যেমনি ছিলো না, তেমনি ছিলো না প্রয়োজনীয় অস্ত্র ছাড়াও সামরিক যানবাহন এবং সামরিক প্রয়োজনে যোগাযোগের ব্যবস্থা । অপর পক্ষে শত্রু সেনাদের ছিল আধুনিক যুদ্ধোপযোগী সবকিছুই এবং কয়েকটি রাষ্ট্রের অস্ত্র সরবরাহ ও তাদের নিশ্চিত রেখেছে ভবিষ্যত্ সম্পর্কে ।
.
বস্তুতঃ এই যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে আমাদের অতি সামান্য সামরিক শক্তি ছাড়া ছিলো সাড়ে সাত কোটি মুক্তিকামী মানুষের নৈতিকসহ সার্বিক সমর্থন ।
.
এই কয়েকটি মাসের ব্যবধানে বহুমুখী সমস্যার মধ্য দিয়ে এগুতে হয়েছে বাংলাদেশ সরকার তথা বাংলাদেশের জনগণকে । একদিকে যেমন সক্ষম যুবকদের এক বিরাট অংশকে যুদ্ধবিদ্যায় ট্রেনিং দিতে হয়েছে অন্যদিকে তেমনি অর্থনৈতিক সমস্যার মোকাবেলা করতে হয়েছে । এছাড়া দ্রুত প্রশাসন ব্যবস্থার প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অস্ত্র সমস্যার সমাধানও করতে হয়েছে । সর্বোপরি বিপর্যস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থার মধ্যেও সাড়ে সাত কোটি মানুষের মনে জেগে ওঠা স্বাধীনতার দুর্বার বাসনাকে রক্ষা করতে হয়েছে অতি সন্তর্পণে । সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা দেখা দিয়েছিলো আন্তর্জাতিক বিশ্বের কাছে আমাদের সংগ্রামের সত্যিকার রূপ তুলে ধরা এবং সমর্থন লাভ ।
.
এই সমস্ত বহুমুখী সমস্যা সত্ত্বেও আমাদের যুদ্ধ সাফল্য আজ বিশ্বের কাছে এক দৃষ্টান্ত হয়ে দাড়িয়েছে ।
.
আন্তর্জাতিক বিশ্ব আমাদের সংগ্রামের সত্যিকার রূপটি যেমন চিনতে পেরেছে তেমনি সর্বক্ষেত্রে নৈতিক সমর্থন লাভ করতে শুরু করেছি আমরা, অন্যদিকে ইয়াহিয়া সামরিক চক্রের সমর্থনকারী দেশগুলো আমাদের বক্তব্যের মৌলিকত্ব অনুধাবনের সঙ্গে ইয়াহিয়া সামরিক চক্রের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করে আমাদের স্বার্থের অনুকূলে মনোভাবও প্রকাশ করেছে । আমাদের সংগ্রামের এই দিকটিতে বিশেষ সাফল্য ইয়াহিয়া চক্রকে এক বিপর্যস্ত অবস্থায় ফেলে দিয়েছে । প্রশাসন ব্যবস্থায় প্রচলনের সঙ্গে সঙ্গে বহু দেশই আমাদের দূতাবাসের কার্যোপযোগী অফিসগুলো স্থাপিত হয়েছে । এগুলোর মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরীণ অবস্থার সাথে বিশ্বকে পরিচিত করে তোলা সহজ হয়েছে । সামরিক ক্ষেত্রে আমাদের দ্রুত সাফল্যের তথ্য এবং ইয়াহিয়ার বর্বরোচিত অত্যাচারের রূপটি বিশ্বের জনগণের কাছে তুলে ধরা সম্ভব হচ্ছে । এক কথায় আন্তর্জাতিক জনমত গঠনে সর্বতোভাবেই আমাদেরই সাফল্য লাভ সম্ভব হয়েছে ।
.
বর্তমান অবস্থায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ই হচ্ছে আমাদের শত্রুনিধন অভিযান । একটি সামরিক বিষয় এবং সামরিক ক্ষেত্রে আমাদের সাফল্য আজ তর্কাতীতভাবে পাকিস্তানী সামরিক চক্রের ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে । পাকিস্তানী সেনাদের নিহতের সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়ে গত এক মাসেই তা হয়ে দাঁড়িয়েছে পাঁচ হাজারেরও বেশী । চলতি মাসের হিসাবে এখন দৈনিক গড়ে দু’শোর মত পাকিস্তানী সেনা মুক্তিবাহিনীর হাতে নিহত হচ্ছে । সার্থক ভাবে গেরিলা যুদ্ধ কায়দা রপ্তের পর আমাদের গেরিলাদের ব্যাপক তত্পরতা শুরু হয়েছে এবং তা এখন তীব্রতর হয়ে শত্রুবাহিনীকে একেবারে কোণঠাসা করে ফেলেছে । শত্রুবাহিনী নিজেদের নিয়মিত সৈন্যদের জীবনের ওপর ঝুঁকি না নেয়ার জন্যে যে রাজাকার বাহিনীর সৃষ্টি করেছিলো তাও ভেঙ্গে পড়ছে । দলে দলে রাজাকাররা অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করছে । অগত্যা পাক সেনাদের রাজাকারদের ওপর নির্ভরশীলতা ছেড়ে দলে নিজেদের পত্যক্ষ সংঘর্ষে এসে লড়তে হচ্ছে এটাই পাক সেনাদের বেশী হারে নিহত হবার কারণ । আমাদের সংগ্রামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশটিতেই আমাদের সাফল্য সবচেয়ে বেশী । গেরিলা তৎপরতার এতো বড় রকমের সাফল্য এর আগে অন্য কোথাও দেখা যায়নি । আমাদের বাহিনীতে সদ্য সামরিক শিক্ষা সমাপ্তকারী অফিসাররা যোগদান করেছেন এরই পত্যক্ষ ফল হিসাবে মুক্তিবাহিনী এই সাফল্য লাভ করছে ।
.
.
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
<৬,১২০,১৯৯>
শিরোনাম | সংবাদ পত্র | তারিখ |
সম্পাদকীয়
তোমার স্বপ্ন সফর তোমার বাংলা স্বাধীন |
বাংলার মুক
১ম বর্ষঃ ১২ তম সংখ্যা |
১০ ডিসেম্বর ১৯৭১ |
সম্পাদকীয়
তোমার স্বপ্ন সফর
তোমার বাংলা স্বাধীন
জয় নব অভ্যুত্থান
জয় বাংলাদেশ, জয়বাংলার সাড়ে সাতকোটি সংগ্রামী নরনারীর ত্যাগ, তিতিক্ষা, অশ্রু আর রক্তের। জয় বিম্বের স্বাধীনতা সংগ্রামী জনগণের। বঙ্গবন্ধু বাংলার যে স্বপ্ন দেখেছেন, যে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য আত্মত্যাগ করেছেন তা আজ সফল
ভারত আর ভুটানকে বাংলাদেশের স্বীকৃতির জন্যে, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং সর্বোপরি মানবতার জন্যে আত্মত্যাগ এবং চরম বলিস্টতার জন্যে বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ জানাচ্ছেন অন্তরের গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা। সাম্রাজ্যবাদ গোষ্ঠী, মানবতা বিরোধীদের শেষ গোরস্তান আজ বাংলাদেশ।
সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর আশা আকাঙ্খার স্বাধীন দেশ পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিবাহিণীর হানাদার সেনা নিধনের অভিযান সাফল্যের দারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে।মুক্তিবাহিণীর সাথে ভারতীয় বাহিনীর যোগদানে যুদ্ধ পরিস্থিতির বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেছে। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর যুক্ত আক্রমনে হানাদার পাকসেনাদের ঘাঁটিগুলোর পতন ঘটেছে এবং হানাদার সেনারা পিছু হটে যাচ্ছে।
মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর মিলিত আক্রমনের মুখে বহু হানাদার পাকসেনা আহত ও নিহত হয়েছে এবং বিভিন্ন অংশে অনেক হানাদার পাকসেনা আত্মসমর্পণ করেছে।
পাকিস্তান বিশ্ব সভ্যতার সব রকম ণীতিমালাকে অস্বীকার করে ভাতের বিভিন্ন অংমে বিমান আক্রমন চালিয়ে উপমহাদেশের শ্বান্তিপূর্ণ অবস্থার মধ্যে সংকটের সৃষ্টি করেছে।
পাকিস্তানের সামরিকচক্র আমাদের স্বাধীনতার স্বপ্নকে ধুলিস্যাত করবার জন্যে ভারত আক্রমন করেছে। আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ তথা ঈঙ্গ – মিার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হস্তক্ষেপের মাধ্যমে অামাদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে বানচাল করবার জন্যে এক আন্তর্জাতিক সমস্যা সৃষ্টিতে লিপ্ত হয়েছে পাকিস্তান। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ যে স্বাধীনতার মন্ত্রে উদ্দিপ্ত তা আন্তর্জাতিক চক্রান্তের জাল ছিন্ন করে বিশ্বের দরবারে যে মর্যাদা অর্জন করেছে তা রক্ষা করতে বদ্ধ পরিকর। জনগণ মুক্তিবাহিনী ও ভবারতীয় বাহিনীকে সর্বাত্মক সাহায্য দিয়ে চলেছে।
মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর আক্রমনে পূর্ব রণাঙ্গনে ফেনি, লাকসাম, সিলেট শত্রুকবলমুকাত হয়েছে। উত্তর এবং উত্তর পশ্চিম রণাঙ্গনেও ব্যাপক সাফল্য লাভের খবর পাওয়া গিয়েছে। যশোর ক্যানটনমেন্ট এবং বিমানবন্দরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পতন ঘটেছে।
এছাড়া চট্টগ্রাম জেলার রামগড়, কক্সবাজার, বান্দরবনও শত্রুকবলমুক্ত হয়েছে।