শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
২৩। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্ৰ থেকে প্রচারিত বাংলা অনুষ্ঠানমালার আরও কয়েকটি কথিকা। |
‘বেতার বাংলা’। মার্চ ও এপ্রিল, |
—— ১৯৭১ ১৯৭২ |
তথাকথিত পাকিস্তান বেতার ঢাকা
ঢাকা বেতার কেন্দ্র এখন কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প। না, গ্যাস চেম্বার কিম্বা সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে বেতার কর্মচারীদের হত্যা করা হচ্ছে না। মিথ্যে প্রচারকে জিইয়ে রাখবার জন্য তাদের যথেষ্ট প্রয়োজন আছে। এবং এই প্রয়োজনটুকু না থাকলে বেতারের সঙ্গে জড়িত সবাইকে মানবতার বর্বরতম শত্রু ইয়াহিয়া সরকার এতদিনে নিশ্চয়ই হত্যা করতো। তবু বলছি ঢাকর বেতার কেন্দ্র এখন কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প। সেখানে বিবেককে, সত্যকে, সাড়ে সাত কোটি বাংলার মানুষের বক্তব্যকে বেয়নেটের পাশবিক আক্রমণে প্রতিদিন হত্যা করা হচ্ছে। এর চেয়ে জঘন্যতম কনসেন্ট্রেশন আর কি হতে পারে?
১৯৭১-এর ২৫শে মার্চ-এর পর যদি কারো কারো বেতার কেন্দ্রে যাওয়ার দুর্ভাগ্য হ’ত তা হলে দেখতে পেতেন সহকারী আঞ্চলিক পরিচালক সামী কোরায়শীর সেক্রেটারীয়েট টেবিলের উপর দ্বিতীয় আর একটি টেলিফোন শোভা পাচ্ছে। সাধারণ টেলিফোনের থেকে এর গড়ন সম্পূর্ণ অন্য ধরনের। এই টেলিফোন থেকে একটি মাত্র জায়গায় যোগাযোগ করা যায় এবং সে জায়গাটা হচ্ছে কসাইদের সুরক্ষিত ক্যান্টনমেন্ট। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কেন? কেন এই ইলেকট্রো ম্যাগনেটিক টেলিফোন লিঙ্ক-এর এই আলাদা ব্যবস্থা? ঢাকার বেতারে আরও ৬ জন সিনিয়র সহকারী আঞ্চলিক পরিচালক আছেন। কিন্তু কেনই বা বেছে সামী কোরায়শীর কক্ষে এই টেলিফোনের ব্যবস্থা করা হল? যদিও তিনি অনেক জুনিয়র- এর একমাত্র উত্তর সামী কোরায়শী পশ্চিম পাকিস্তানী। অতএব, তিনি কসাই সরকারের একনিষ্ঠ পদলেহী। অবশ্য সামী কোরায়শী ছাড়াও ঢাকা বেতারে আরও এমন কয়েকজন দালাল রয়েছে যারা সামরিক স্বার্থের লালসায় বর্বরতার গ্যাংরিনে আক্রান্ত শত্রুদের পদলেহন করছে। বাংলার মানুষের ন্যায়দণ্ড তাদেরকে কোনদিনই ক্ষমা করবে না। ক্ষমা করতে পারে না।
এ থেকে আর একটি সত্য আগুনের মতো জ্বল জ্বল করে ওঠে। আর সেটা হচ্ছে কসাই সরকার বাঙালীদের কোনক্রমেই বিশ্বাস করতে পারছে না, বাংলার মুক্তিকামী মানুষদের নিয়ে তারা সর্বদাই সন্ত্রস্ত। অবশ্য এটা অত্যন্ত পুরোনো সত্য। কিন্তু আমার বক্তব্য হচ্ছে- এত অবিশ্বাস, এত সন্ত্রস্ততা, এত আতঙ্ক সত্ত্বেও বর্বর সরকার মিথ্যে প্রচারের প্রলেপ বুলিয়ে তাদের কুৎসিৎ মানসিকতাকে চাপা দেয়ার অপপ্রয়াস চালাচ্ছে। তাই রেডিও পাকিস্তানের খবরে ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে, অমুক জায়গায় জনসাধারণ কসাইদের ভাষায় দুষ্কৃতকারীদের ধরিয়ে দিয়েছে। একদিকে তারা প্রচার করছে শান্তি কমিটির কথা, অন্যদিকে প্রচার করছে দেশের অবস্থা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। তাই যদি হবে তাহলে শান্তি কমিটির প্রয়োজন পড়ল কেন? কেন নানা ধরনের মিথ্যে প্রচারণার বেসাতি? কেনই বা বার বার প্রচার করা হচ্ছে আপনারা সবাই কাজে যোগ দিন? এর উত্তর বাংলার মানুষ জানে। নতুন করে বলবার প্রয়োজন নেই।
[১৯৭১-এর মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকা বেতারের কয়েকজন কর্মীসহ আশরাফুল আলম শত্রুকবলিত ঢাকা বেতার কেন্দ্র ছেড়ে মুজিবনগরের স্বাধীন বাংলা বেতারে যোগ দেন। এই কথিকাটি ১৯৭১-এর ৯ই জুন স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে প্রচারিত হয়েছিল- বেতার বাংলা, ১৯৭২]
<005.023.504>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
বলছিলাম ঢাকা বেতারের কথা। কিভাবে সেখানে ন্যায়কে, সত্যকে হত্যা করা হচ্ছে সেই প্রসঙ্গে আসছি। দৈনিক পত্রিকার সম্পাদকীয় মতামত- শক্র কবলিত ঢাকা বেতারের একটি নিত্যকার অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানে কি সত্যি কথা প্রচার করা হয়? এর উত্তর জানতে হলে পত্রিকা অফিসের কথা জানা প্রয়োজন। বর্বর জঙ্গীশাহী বিভিন্ন পত্রিকার সম্পাদকীয় বিষয় টেলিফোনে জানিয়ে দেন। এবং সেইসব বিষয়ের উপর সম্পাদকীয় লেখা হয়ে থাকে। এরপর লিখিত বক্তব্য ছাপাবার আগে সামরিক কর্তৃপক্ষ পুনরায় সেটা অনুমোদন করেন।
পত্রিকার সমস্ত সংবাদ ঠিক একই নিয়মে ছাপা হয়-শুধুমাত্র তারিখ, পত্রিকার নাম এবং সম্পাদকের নাম ছাড়া। বিবেকহীন নির্মম বেয়নেট সত্যকে লংঘন করে যে পত্রিকার জন্ম দেয় তাদের আর যা-ই থাক বিন্দুমাত্র সত্যের প্রয়াস থাকে না। তাই দৈনিক পত্রিকার মতামত একটি জাল অনুষ্ঠান। ঢাকা বেতারে এ ধরনের অনেক জালিয়াতি চলছে। ২৫শে মার্চের পরও আমি ঢাকা বেতারে কিছুদিন কাজ করতে বাধ্য হয়েছিলাম। অনুষ্ঠান ঘোষক হিসেবে ছিলাম পরে ও-বি সেকশনে লোক না থাকায় সেই সেকশনে আমাকে দেয়া হ’ল। ও-বি অর্থাৎ আউটসাইড ব্রডকাষ্ট সম্পর্কে বলার আগে পত্রবিতান’ অনুষ্ঠানটির কথা না বলে পারছি না। ২৫শে মার্চের পর প্রথম যেদিন পত্রবিতান প্রচার করা হ’ল তার দুদিন আগে এই অনুষ্ঠানটির স্ক্রীপ্ট লেখা এবং পড়বার জন্য একটা নির্দেশ পেলাম। সেই সঙ্গে আমাকে কয়েকটা চিঠি দেয়া হ’ল। পত্রবিতান অনুষ্ঠানে শ্রোতাদের চিঠিপত্রের জবাব দেয়া হয়। সেই চিঠিগুলোর তারিখ দেখে অবাক হয়ে গেলাম, চিঠিগুলো ১৯৭০ সালের। আরও অবাক হলাম চিঠিগুলোর উপরে লেখা রিপ্লাই’ অর্থাৎ ৭০-এর কোন এক সন্ধ্যায় এই চিঠিগুলোর জবাব দেয়া হয়েছে। এর পরের ঘটনা আরও মারাত্মক। দ্বিতীয় সপ্তাহে আবার পত্রবিতান অনুষ্ঠান-এর পালা এলো। কিন্তু কর্তৃপক্ষও একটু চিন্তায় পড়লেন, শেষ চেষ্টা হিসেবে আমাকে পুরোনো কিছু চিঠি খোঁজ করতে বললেন। দোতলার একটা অফিসরুমে গিয়ে দেখলাম আলমারির পাশে মেঝেতে অসংখ্য চিঠি পড়ে আছে। এত চিঠি? একটু অবাক হবারই কথা। চিঠিগুলো ১৯৭১ সালেরই, কিন্তু ২৫শে মার্চের আগের কথা। একটার পর একটা চিঠি পড়তে লাগলাম। প্রত্যেকটা চিঠির বক্তব্য প্রায় একই ধরনের। এক সময় ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামকে পূর্ণভাবে সমর্থন করে যেসব অনুষ্ঠান, সংবাদ প্রচার করা হয়েছিল তারই প্রশংসায় ভরপুর। একটা চিঠির এক জায়গায় পড়লাম বাংলার মানুষের বক্তব্যকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রচার করার জন্য ধন্যবাদ- অনুষ্ঠানগুলি শুনিলে এত আনন্দ লাগে যে, আমার মায়ের মৃত্যুশোকও আমি ভুলিয়া যাইতে পারিব।”
প্রতিটি চিঠিই অনুষ্ঠান সম্পর্কিত বক্তব্য ছাড়াও কুটিল ভুট্টো ও প্রধান কসাই ইয়াহিয়ার কঠোর সমালোচনায় ভরা ছিল।
দোতলার সেই কক্ষে যখন চিঠিগুলো পড়ছিলাম পাশের কোন রুম-এর স্পীকার থেকে পাকিস্তানী খবরএর বিচ্ছিন্নতাবাদী দুষ্কৃতকারী, দেশের প্রধান শত্রু শেখ মুজিব এইসব শব্দ ভেসে আসছিল, আমি তখন যে চিঠিখানা পড়ছিলাম তাতে অল্প বয়সের একটি ছেলে ভাঙ্গা ভাঙ্গা অক্ষরে লিখছে-
“এয়ারপোর্ট-এ ইয়াহিয়া খান আসলে তাকে তো বাচ্চা ছেলের দ্বারা মালা দিয়ে স্বাগত জানান হয়, তাই না? জানেন আমাকে যদি তাকে মালা দেয়ার জন্য নেয়া হত তাহলে লুকিয়ে একটা পিস্তল নিয়ে যেতাম আর মালার বদলে তাকে গুলি করে মারতাম।”
এইসব চিঠি নিয়ে কর্তৃপক্ষকে দেখালাম। কিন্তু এ দিয়ে তো আর পত্রবিতান’ অনুষ্ঠান চলে না। জনৈক কর্তব্যক্তি নির্দেশ দিলেন কিছু মিথ্যে ঠিকানা দিয়ে সমস্ত স্ক্রীপ্ট লিখতে। ক্ষমা করবেন, আমি লজ্জিত। সেই নির্দেশ মত স্ক্রীপ্ট লিখতে বাধ্য হয়েছিলাম এবং তা যথারীতি সন্ধ্যে সাড়ে সাতটায় প্রচার করেছিলাম। তারিখটা আমার স্মরণ নাই। ২৫শে মার্চের পর মে মাসে দ্বিতীয় যেদিন পত্রবিতান অনুষ্ঠান প্রচার করা হয় সেই দিনের কথা বলছি। ঐ দিনের চিঠির সত্যতা সম্পর্কে যে কোন শ্রোতা শত্রুকবলিত ঢাকা বেতার কেন্দ্রকে চ্যালেঞ্জ করতে পারেন। সেই দিনের পত্রবিতান অনুষ্ঠানে যেসব শ্রোতার চিঠির উত্তর দেয়া হয়েছে তাদের সেই ঠিকানায়
<005.023.505>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
বেতার কর্তৃপক্ষ কোনদিনই তাদেরকে খুঁজে বের করতে পারবে না। কারণ, নাম-ঠিকানা সবই কাল্পনিক ছিল। সেই দিনের পত্রবিতানে এমন অনেক কাপ্পনিক শ্রোতার চিঠির উত্তর দেয়া হয়েছিল যারা নাকি কষ্টিপাথর, প্লেইন ট্রথ, ঢাকা শহর ও তার আশেপাশে প্রভৃতি অনুষ্ঠানের প্রশংসা করেছেন। কি ভয়ঙ্কর জালিয়াতি।
ঢাকার আউট ব্রডকাষ্ট সেকশনকে ‘ঢাকা শহর ও তার আশেপাশে’ এই শীর্ষক অনুষ্ঠানটি প্রযোজনা করতে হ’ত। ঢাকা এবং তার আশেপাশে যে স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে তারই উপর শত্রু দের ভাষায় প্রামাণ্য অনুষ্ঠান প্রচার করা হত। যেমন ট্রেন কেমন চলছে কিংবা ফ্যাক্টরী কেমন চলছে সে সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার। আর ওই সাক্ষাৎকারগুলো নিতে আমাকেই যেতে হত। গেল মাসের প্রথম দিকের কথা। পোরটেবল রেকর্ডিং মেশিন নিয়ে কমলাপুর ষ্টেশনে গেলাম। সমস্ত ষ্টেশন খাঁ খাঁ করছে। ডিকেড অব রিফর্মস-এর ভাষায় এশিয়ার বৃহত্তম ষ্টেশনের এ কি পরিণতি! জনহীন নিস্তব্ধতায় চারদিক থম থম করছিল। মনে হচ্ছিল নির্জনতার দ্বারা সমস্ত ষ্টেশনটা লাঞ্ছিত। টিকেট কাউন্টারের পাশের বিরাট চত্বরটার উপর দিয়ে একমাত্র আমিই প্ল্যাটফর্মের ভেতর প্রবেশ করলাম। দু’একজন উর্দুভাষী টিকেট কালেক্টর ও দু’একজন অন্যান্য কর্মচারী প্ল্যাটফর্মে অকারণ ঘুরে বেড়াচ্ছিল। দূরে দেখতে পেলাম লাইনে দাঁড়ানো নিস্তব্ধ কতগুলো কম্পার্টমেন্ট। জানালাগুলো বন্ধ। দেখলেই বোঝা যায়, বহুদিন চাক্কা ঘোরেনি। প্রথমে স্টেশনের জনৈক পদস্থ কর্মচারীর সাক্ষাৎকার নিলাম। বুঝতে পারলাম তিনি নিরূপায় হয়েই ইন্টারভিউ দিলেন। প্যাসেঞ্জারদেরও সাক্ষাৎকার নিতে হবে। কিন্তু প্যাসেঞ্জার পাব কোথায়? ষ্টেশনের কয়েকজন কর্মচারীকে প্যাসেঞ্জারের ভূমিকায় অভিনয় করালাম। তারা সবাই উর্দুভাষী। বাংলাও মোটামুটি বলতে পারেন। ষ্টেশনের সেই পদস্থ কর্মচারীই ব্যবস্থা করে দিলেন। সাইডিং-এ একটা ইঞ্জিন দাঁড় করানো ছিল। সেখান থেকে সাউণ্ড এফেক্ট সংগ্রহ করলাম। যথারীতি ট্রেন চলাচলের উপর প্রামাণ্য অনুষ্ঠান প্রচার করা হল। অথচ যবনিকার দুয়ারে যে অভিনয়টুকু করান হ’ল, যে সাজান মিথ্যে কথাগুলো বলান হ’ল তার হিসেব কে রাখে? এরি নাম প্রামাণ্য অনুষ্ঠান! বেয়নেটের আগায় অনেকেই বাধ্য হয়ে সাজানো সাজানো কথা তোতাপাখির মত আউড়ে গেছে। এবং সেই সব সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠান ফলাও করে “ঢাকা শহর ও তার আশেপাশে” শীর্ষক অনুষ্ঠানে প্রামাণ্য অনুষ্ঠান হিসেবে প্রচার করা হচ্ছে। বর্বর ইয়াহিয়া সরকার এর মাধ্যমে প্রমাণ করতে চাইছেন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। প্রসঙ্গতঃ একটা কথা বলে রাখি, ঢাকা শহরে একটা মাত্র কারখানা পুরোদমে চলেছে। আর তা হচ্ছে ঢাকা বেতার। যেখান থেকে প্রতিদিন প্রতি মুহুর্তে মিথ্যে” ম্যানুফ্যাকচার করা হয়।
মে মাসের ৮ তারিখে স্কুলগুলো খোলার জন্য বর্বর সরকার নির্দেশ দিয়েছিল। তিন-চারটে স্কুলে সাক্ষাৎকার নেয়ার জন্য গিয়েছিলাম। কিন্তু কোন স্কুলে ছাত্র দেখতে পাইনি। ঢাকার কোন এক নামকরা স্কুলের গেটে দেখলাম জনা ৫/৬ ছেলে জটলা করছে। জিজ্ঞেস করে জানতে পেলাম তারা ক্লাশ করতে আসেনি। এবং তারা ক্লাশ করবেও না। এমন কি স্কুলবাড়ির ভিতরে ঢুকতেও তারা ভয় পাচ্ছিল। কারণ যে কোন মুহুর্তে দু’পেয়ে পশুরা এসে তাদেরকে হত্যা করতে পারে। তবুও স্কুলের উপর প্রামাণ্য অনুষ্ঠান করা হয়েছিল। দু’একজন শিক্ষক যাদেরকে বেয়নেটের ডগায় স্কুল খুলতে বাধ্য করান হয়েছিল তারাই সেই বেয়নেটের ভয়ে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। ক্লাশে কোন ছাত্রী নেই অথচ একজন শিক্ষয়িত্রী ক্লাশে পড়াচ্ছেন। এমনি একজন শিক্ষয়িত্রীর কণ্ঠস্বরও সেদিনের সেই প্রামাণ্য অনুষ্ঠানে প্রচারিত হয়েছিল অথচ ছাত্ৰীবিহীন একটি ক্লাশকক্ষে সেই শিক্ষয়িত্রী শুধু পড়ানোর অভিনয় করে যাচ্ছিলেন। সামরিক কর্তৃপক্ষ তাঁকে এ ধরনের অভিনয় করতে বাধ্য করেছিল।
এরই নাম স্বাভাবিকতা, এরই নাম প্রামাণ্য অনুষ্ঠান। এবং এরই নামই জালিয়াতি৷ ডকুমেন্টারী’ নামে তারা জাল অনুষ্ঠান প্রচার করছেন। পত্রবিতান অনুষ্ঠানে তারা কাল্পনিক শ্রোতাদের চিঠিত উত্তর দিচ্ছেন, সংবাদ সেখনে ‘ম্যানুফ্যাকচার’ করা হয়, যে কোন স্ক্রীপ্ট প্রচারের পূর্বে ইংরেজীতে অনুবাদ করে সামরিক কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমোদন করিয়ে নিতে হয়; কোরানের কোন কোন আয়াত এমন কি ছুরা, হাদিসের কোন কোন অংশ বা পুরো হাদিস তারা প্রচার করতে দিচ্ছেন না। বেতারের ‘প্রোগ্রাম ফাইল ঘাঁটলে এমন
<005.023.506>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
অসংখ্য স্ত্রীপ্ট পাওয়া যাবে না থেকে কোরানের উদ্ধৃতি কেটে দেয়া হয়েছে। বেতার কেন্দ্রের ডিউটি রুমের আলমারিতে রাখা হাদিসের নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে, এমন কি কোন কোন হাদিস সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ করা যেতে পারে-“আল্লাহতালা সে জাতির অবস্থা কখনই পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ পর্যন্ত সে নিজের অবস্থা নিজে পরিবর্তন না করে।” আল-কোরানের এই বিখ্যাত বাণীটি শত্রুর দ্বারা পরিচালিত ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে আর শোনা যায় না। মোটের উপর মিথ্যার বারুদ পুড়িয়ে ঢাকা বেতার আতসবাজির খেলায় মেতে উঠেছে। সেখান থেকে এক ধরনের বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করা হচ্ছে- যাকে সহজ কথায় ছ্যাবলামো ছাড়া আর কিছুই বলা চলে না। ঢাকা বেতার একটা অনুষ্ঠানের নাম সোহাগ করে রেখেছে ’প্লেইন ট্রথ’। অনুষ্ঠানের বক্তব্যগুলো অনুধাবন করলে দেখা যাবে তারা কতগুলো জটিল মিথ্যের জাল বুনছেন অনুষ্ঠানটির নাম কমপ্লেক্স লাই দিলেই ভাল হত। তাই বলছিলাম- ঢাকা বেতার কেন্দ্র এখন কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প। সেখানে বিবেককে, সত্যকে, বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের বক্তব্যকে বেয়নেটের পাশবিক আক্রমণে প্রতিদিন হত্যা করা হচ্ছে। এর চেয়ে জঘন্যতম কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প আর কি হতে পারে।
(আশরাফুল আলম রচিত)
মৃত্যুহীণ প্রাণ
মাকে গল্প বলতে বললে মা গড়িমসি করতেন।
পরে আমাদের আগ্রহ দেখে শুরু করতেন। এক দেশে ছিল এক রাজা। আর রাণী। তাঁর হাতীশালে হাতী, ঘোড়াশালে ঘোড়া। সেপাই লস্করে জনে মানুষে মম করে রাজপুরী, আমলায় পইলায়, উজিরে নাজিরে রাজদরবারের কী রবরবা! কিন্তু আজ গল্পের ধরন পাল্টে গেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিখিয়ে দিয়েছেন রাজা একটি নয়, সাড়ে সাত কোটি মানুষ প্রত্যেকেই এক একটি রাজা। আমরা সবাই রাজা। শুধু স্বাধীনতা বন্দী নয়, জালেমের কারাগারে ন্যায়বিচার মানবাধিকার, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ২৪ বছর ধরে মাথা কুটে মরছে। বন্দী আমার বাংলা। আমার রূপসী বাংলা আমরা ধর্ষিতা বাংলা। আমার জননী বাংলা।
রাজপুত্র একটি নয়। হাজার হাজার, লাখ লাখ রাজপুত্ৰ-মাতৃ অপমানের তীব্র প্রতিশোধ কামনায় ছায়াহীন, বৃক্ষহীন ধুধু তেপান্তরে ধূসর পথ অতিক্রম করে চলছে বন্দিনী মাকে উদ্ধার করতে।
আমার মা রাজপুত্রের যে বর্ণনা দিতেন তার সঙ্গে এর কত তফাৎ সেই রাজপুত্রের পোশাকে জরীর কারুকাজ, সূর্য এসে চুমু দিলেই সাত রং খেলা করে তার দেহে রূপোর খাপে কারুকাজ করা তলোয়ার। মাথায় মণিমুক্তা খচিত উষ্ণীষ। গলায় গজমতি হার কানে কানপাশা। চন্দন চর্চিত কপালে জয়-তিলক। চরণে চটকদার বাহারী জুতো। ঘোড়াটাই বা কম কী দুধের মতো সাদা ধবধবে চোখ জুড়ানো ঘোড়া। তার উপর মখমলের জীন। আর আমার রাজপুত্র! পায়ে তার জুতো নেই। না বর্ষায়, না শীতে। পরনে একটি মাত্র লুঙ্গি। ভাগ্য প্রসন্ন হলে একটা গেঞ্জি, নইলে গামছাই সার। চন্দন চর্চিত অঙ্গ নয়, ক্রলিং করে করে সারা গায়ে মেখেছে বাংলার মাটি। তলোয়ার তো নেই। হাতে লাঠি, নয় বর্শা। রাজাকার বা হানাদারদের কাছ থেকে ছিনিয়ে আনা থ্রি-নট-খ্রি। আমার রাজপুত্র বলে, না না ছিনিয়ে আনা নয়, ওটা তো রোজগার। রোজগারটা যদি এল-এম-জি হয়। ব্যাস আহার-নিদ্রা মাথায় উঠল, তেল দাও, সাফ কর, শোবার সময় বুকে জড়িয়ে ধরে শোও- স্বপ্নও ঐ এল-এম-জি নিয়ে না, রাজকন্যা-টন্যা নয়, এমন কি পরীটর কাছে ঘেষতে পারে না তার, সে স্বপ্ন দেখে বিশাল এক প্রান্তরে সে দাঁড়িয়ে আছে, এল-এম-জি একটানা গর্জন করে চলেছে, আর শত্রু সেনারা, তাগড়া ছোট চাচা প্রবল ঝাঁকুনী দিলে কুলগাছের কুলগুলো যেমন ঝুপ ঝুপ করে শিশিরের উপর ঝরে পড়ত, তেমনি
<005.023.507>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
রাক্ষসগুলো ঝুপ ঝুপ করে পড়ছে তো পড়ছেই। এক সময় একটা বুলেট এসে তাকে থামিয়ে দেয়। সে দ্যাখে, তার প্রিয় পতাকা দিয়ে গোটা শরীর জড়িয়ে রাখা হয়েছে। আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হচ্ছে-আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি।
গান শুনতে শুনতেই তার ঘুম ভাঙে। আহা স্বপ্নটা যদি সত্য হয়! ধীরে ধীরে নতুন রাখা দীর্ঘ দাড়িতে হাত বুলায় সে।
আচ্ছা, আমার এই রাজপুত্রের কাছে আমার মায়ের রাজপুত্ত্বরটাকে একটু পানসে পানসে মনে হয় না! ঐ রাজপুত্রটা যেন যাত্রা-থিয়েটারের। কেমন যেন ন্যাকা ন্যাকা। না? নিজের কোন বুদ্ধিসুদ্ধি নেই, কোন কাজ নিজের করার মুরোদ নেই, হয় ব্যঙ্গমা-ব্যঙ্গমী নয় পরটরী এসে করে দেয়। না হলেই চিত্তির।
আমার মায়ের কিসসা শেষ হতো এভাবে-তারপর? তারপর আর কি, রাজপুত্র রাজকন্যাকে নিয়ে সুখেশান্তিতে বাস করতে লাগল। আর আমার রাজপুত্র?
না। না, না এমন রাজপুত্র পৃথিবী কোনদিন দেখেনি, কোন কবি কল্পনা করতে পারে না এর রূপের পৃথিবীতে এর কথা কেউ কোনদিন বলে নি। বীর প্রসবিনী বাংলাদেশের গর্ভেই এমন রত্ন জন্মগ্রহণ করে। খালি হাতে যারা বীরের মতো লড়াই করতে পারে। যারা হাসতে হাসতে মারতে পারে, হাসতে হাসতে বীরের মতো মরতে জানে। আমার রাজপুত্র জানে মৃত্যু কত তুচ্ছ জানে, মানুষ মরে। মানুষের মৃত্যু অনিবার্য। কেউ রোগে মরে, কেউ হাসপাতালে মরে, কিন্তু প্রাণ দিতে জানে না। আমার রাজপুত্র শুধু মারতেই নয়, প্রাণ দিতেও জানে। যে প্রাণ মানুষের কল্যাণের জন্য, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়কে প্রতিষ্ঠা করার জন্য সবাইকে মর্যাদা দেয়ার জন্য, দেশের জন্য নিবেদিত, তার জন্য মৃত্যুবরণ করার মতো সৌভাগ্য আর কিছুতেই নয়। সকল জীবনের গৌরবোজ্জ্বল দেশের জন্য প্রাণ দিতে জানা। এ প্রাণ মরে না, চিরকাল বেঁচে থাকে। মেয়েরা ঘাটে চাল ধুতে ধুতে তারই গল্প করে, পাল তুলে দিয়ে বৈঠায় ক্লান্ত হাত রেখে মাঝি তারই গান গায়, কবিরা আসরে।
সাধ্য আছে কোন নুরুল আমীনের কোন নতুন অস্ত্র দিয়ে, বুলেট দিয়ে, স্যাবরজেট দিয়ে বা শ্যাকে ট্যাঙ্ক দিয়ে বাংলার বুক থেকে রফিক, জব্বার, বরকত, সালামকে হত্যা করতে পারে? না । কেন? আমার রাজপুত্র মৃত্যুহীন প্রাণ দিয়ে জন্মগ্রহণ করেছে। কিসসার রাজপুত্র রাজা হয়, তারপর এক সময় মারাও যায়। এই রাজপুত্রের মৃত্যু নেই। এরা মৃত্যুহীন প্রাণ।
(আসাদ চৌধুরী রচিত)
ইবলিশের মুখোশ
যখন ছোট ছিলাম, বয়স যখন পাঁচ কিংবা ছয়ের কোঠায় ছিল তখন দাদীমা গল্প শোনাতেন। ঝোলা বোঝাই গল্প ছিল দাদীমার। আজগুবি সব ভূতের গল্প। গল্প শুনতে শুনতে কখনো উত্তেজিত হয়ে উঠতাম, কখনো আবার প্রত্যক্ষ ভূত দেখার মতোই আৎকে উঠতাম। বুকের ভেতরটা দূর দূর কেপে উঠতো। কোন কোন দিন এত ভয় পেতাম যে ভয়ের প্রচণ্ডতায় দাদীমাকেই নিজের অজান্তে জড়িয়ে ধরতাম। এতো ভয় পেতাম তবু কিন্তু গল্প শোনার নেশা কাটত না। ভয় খেয়ে গেছি বলে দাদীমা একটু থেমে গেলেই ওকে তাড়া দিয়েছি আবার শুরু করবার জন্য।
<005.023.508>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
দাদীমার ভূতের গল্পে কেমন একটা যাদু ছিল। গল্পের সব নায়ক-নায়িকারা ছিল জন্তু-জানোয়ার ও পশুপাখি। মজার ব্যাপার হল জন্তু-জানোয়ারগুলো কথা বলতে পারত। দাদীমা সেই জন্তু-জানোয়ারের হাঁকডাকের স্বর ও গোঙানী অবিকল নকল করে শোনাতে পারত। জন্তুরা কেমন আচমকা তাদের রূপ পাল্টাতে পারত এবং দেহের রূপ পাল্টাবার সাথে সাথে বাঁচনভঙ্গীও কেমন পাল্টে যেত, দাদীমা সবকিছু পরিবর্তন করে শোনাতে পারতো। দাদীমার গল্পের সব জন্তু-জানোয়াররাই ছিল ভূত-প্রেত। সন্ধ্যার অন্ধকারে গুটি শুটি মেরে গল্প শুনতাম। অন্ধকারে ভূতেরা কেমন করে হাঁটে, কেমন করে চাঁপা গোঙাতে গোঙাতে পাহাড় পর্বত নদী খাল বিল অতিক্রম করে তা দিব্যি দেখতে পেতাম। দু’মিনিট আগেই যে ভূতটির আকৃতি একটি হিংস্ৰ বাঘের ন্যায় ছিল হঠাৎ কেমন করে তা একটি পোষা ময়না পাখি বনে গিয়ে মিহি সুরে গান শুরু করত তা তখন ভেবেই পেতাম না। তখন ওই সব বিশ্বাস করতাম। কেন না, বয়েসটা ছিল পাঁচের কোটায়। দু’দশক পর আজ হলে দাদীমার সেই আজগুবি ভূতের গল্প হয়ত আমল দিতাম না। দাদীমার ভূতের গল্পে তখন শুধু এক জন্তু অন্য জন্তু বা পশু-পাখিতে রূপান্তরিত হত। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর একাত্তরের প্রান্তসীমানায় মানুষও যে ভূত হতে পারে এবং রাতের অন্ধকারে তারা নরঘাতক পশু হতে পারে তা হয়ত দাদীমা জানতো না। জানা থাকলে এ মনুষ্যবশীে ভূতদের গল্পও পারতো। বাংলাদেশের পথে-প্রান্তরে এই মনুষ্যবেশী ভূত তথা হিংস্ৰ জানোয়ারদের আজকাল বিচরণ করতে দেখা যায়। সত্যি সত্যি যা ভূত, তার অস্তিত্ব বুঝে পাওয়া কঠিন-কিন্তু এরা যে মনুষ্যবেশী ভূত এদের মূর্তিমান অস্তিত্ব আবিষ্কার করাটা তেমন দুরূহ কাজ নয়।
বাংলার মুক্তিসেনারা দেশের প্রতিটি অঞ্চলে তাদের শৌর্যবীর্য ও পূর্ণ জীবন প্রতিষ্ঠা করার জন্য এই হানাদার জন্তুদের আবিষ্কার করে চলেছেন। মনুষ্যবেশী এই জন্তুদের মুণ্ড আবিষ্কারই এখন এই বীর সেনাদের জীবনের পরম কামনা।
গত কয়েক দিনে ঢাকা, কুমিল্লা, সিলেট, রাজশাহী ও যশোরে মুক্তিবাহিনীর বীর গেরলাদের হাতে হানাদার পাকিস্তনী সৈন্যরা প্রচণ্ড মার খাওয়ার পর বাংলাদেশে জন্তুরাজ জেনারেল নিয়াজী এই সমস্ত অঞ্চল পরিভ্রমণে বেরিয়েছে। নিয়াজী বলেছে, আমার জওয়ানরা ভারতীয় অনুচরদের আক্রমন প্রতিহত করেছে এবং পাল্টা আক্রমণের মুখে ভরতীয় অনুচররা পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে। ওদিকে ইয়াহিয়া খানই বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের একটি বিকৃত রূপ বিশ্বের দরবারে তুলে ধরার জন্য মনুষ্যবেশী ভূতের মতো গোঙাতে শুরু করেছে। ভারত নাকি পাকিস্তানের পবিত্র ভূমি আক্রমণ করছে। বেমালুম চেপে যাচ্ছে মুক্তিযোদ্ধাদের কথা। ইতিমধ্যে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব সুলতান মোহাম্মাদ খাঁ তার আব্বা হুজুর ইয়াহিয়ার চেয়েও কয়েকহাত বেড়ে গলাবাজি করছে। ভরত-পাকিস্তানের সীমান্তে নাকি একটি যুদ্ধাবস্থার মতো পরিবেশ বিরাজ করছে।
‘বাবু যত বলে পারিষদ দলে বলে তার শতগুণ’ এ কথা যথার্থতই প্রমাণ করেছে ইয়াহিয়ার তাবেদার সুলতান খাঁ। মনুষ্যবেশী পশুসম্রাট ইয়াহিয়া আরেক কাণ্ড করে বসেছে। ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছে সৌহার্দ্য স্থাপনের প্রস্তাব করেছেন। ভূতের মুখে রাম নাম আর কি। ভারত কিন্তু এর যথোচিৎ জবাব দিয়েছে। গত তেইশ বছর ধরেই ভারত সৌহার্দ্য স্থাপনের প্রস্তাব দিয়ে এসেছে। আজ হঠাৎ জঙ্গী শাসকদের প্রবক্তা ইয়াহিয়া খান ভারতের সঙ্গে সৌহার্দ্য স্থাপনের জন্য এত উদ্বেল হয়ে উঠলো কেন? মতলবটা কি? আসল মতলব আমরা টের পেয়েছি। উদ্দেশ্য সৌহার্দ্য স্থাপন নয়, বাংলাদেশের মুক্তির সংগ্রাকে বিভ্রান্তির অতলে ডুবিয়ে দেয়া। কিন্তু ইয়াহিয়া জানেন, বিভ্রান্তির অতলে বাংলাদেশের মানুষকে আর ডুবানো যাবে না। বাংলাদেশই নয় বিশ্ববিবেকও আজ জাগ্রত।
ভূতের মুখে রাম নামই হোক আর সৌহার্দ্যর প্রস্তাবই হোক, সে আমাদের ব্যাপার নয়। তার জবাব ভারতই দিয়েছে এবং দেবে। কিন্তু আমাদের জবাব সম্পূর্ণ ভিন্ন। যে বুলেট বেয়নেটে মনুষ্যবেশী জন্তুরা আমাদের সর্বহারা করেছে সেই বুলেট বেয়েনেটের আমরা জবাব দেব। কেননা, আমরা তাদের স্বরূপ উদঘাটন
<005.023.509>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
করেছি। এরা দাদীমার সেই আজগুবি জন্তুবেশী ভূত নয়। এরা মানুষ্যবেশী হিংস্র জন্তু নরঘাতক, ইবলিশ। বাংলার পবিত্র মাটি থেকে উৎখাত করে বিশ্বের দরবারে এই ইবলিশের মুখোশ আমরা ফাঁস করে দেবেই দিবো।
(মেসবাহ আহমেদ রচিত)
রণাঙ্গনের চিঠি
যশোহরের রণাঙ্গনে ক্ষণিক বিরতির সময়ে জানতে পেলাম, গণতন্ত্রের পীঠস্থান মহান ভারত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। উল্লাসে ফেটে পড়েছে আমাদের সমস্ত শিবির। আনন্দে কোলাকুলি করছে সবাই, কেউ মাটিতে গড়াগড়ি দিচ্ছে আর চিৎকার করে বলছে, আমার দেশের মাটি আমার মায়াঘেরা দেশের সোনার মাটি, কত ঝড় বয়ে গেলো তোর উপর দিয়ে, শত্রুর আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেছে তোর সোনার অঙ্গ। ভাবিস আমরা তোর শৃঙ্খল ঘোচাবো, তোকে মুক্ত করবো, আবার তোকে সাজাবো আমাদের প্রীতি মমতা দিয়ে, সবটুকু শক্তি দিয়ে।
জানো বন্ধু, কী তৃষ্ণা কী আকুলতা নিয়ে কেটেছে গত আট মাস বারো দিন এই একটি সংবাদের জন্য! কেটে গেছে কতো বিনিদ্র রজনী। যখন রণক্ষেত্র থেকে আহত স্বামীকে কোলে করে নিয়ে ফিরেছি, তখন ভেবেছি আর কতদিন? স্বামী মৃতদেহের পাশে বসে ভেবেছি আর কতো দিন বাকী আমাদের স্বীকৃতির। মনে পড়ে কয়েক দিন আগে শেষ নিঃশ্বাস ফেলবার আগের মুহুর্তে আশরাফ ফিস ফিস করে জিজ্ঞাসা করেছিলো “স্বীকৃতি মিলেছে? উত্তর দেবার আগেই আশরাফ শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছে। আমার বুকে আমার হাতে তখনও আশরাফের ছোপ ছোপ রক্ত। রক্ত কথা বলে উঠলো, “আমি আশরাফের রক্ত স্বীকৃতির দাবী নিয়ে বাংলার মাটিতে জমাট বেঁধে থাকবো, তোমরা আমাকে স্বীকৃতি দাও। তোমরা আমাকে স্বীকৃতি দাও।”
আজ স্বীকৃতি মিলেছে। আমার বুকপকেটে রয়েছে আশরাফের রক্তমাখা আমার রুমালটি। বার বার রুমালটি দু’চোখে চেপে ধরছি। আমাদের বন্ধু আশরাফের রক্ত-শোন, তুমি শোন, স্বীকৃতি মিলেছে তোমার। স্বীকৃতি মিলেছে আশরাফের, স্বীকৃতি মিলেছে কুদ্দুস, টিটু, আজাদ, তারিক, মাসুদ আরো শত শত শহীদের রক্তের। স্বীকৃতি মিলেছে দশ লক্ষ লোকের রক্তের, যারা বর্বর খুনী ইয়াহিয়ার বাহিনীর গুলির আঘাতে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছে, স্বীকৃতি মিলেছে বাংলার সাতে সাত কোটি মানুষের।
বন্ধু, আনন্দে আমার চোখের জল ঝরছে। আশরাফের পবিত্র রক্তের সংগে আমার চোখের জল মিলে একাকার হয়ে গেছে। তুমিও কী কাঁদছো বন্ধু? কেঁদো না। দোহাই তোমার, কেঁদোনা, চোখের জল মুছে ফেলো।
বাংলাদেশে পাকিস্তানী সরকারের বিমান বাহিনী বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। ৪৭টি পাকিস্তানী জংগী বিমান ভূপাতিত তাদের দুটি যুদ্ধজাহাজ, একটি ডেষ্ট্রয়ার, ১টি সাবমেরিন নিমজ্জিত। তাদের একটির পর একটি ঘাটিঁতে পতন ঘটেছে। আখাউড়া, লাকসাম, কুলাউড়া, লাতু, বিয়ানীবাজার, মিয়ার বাজার, ফেনী থেকে শত্রুসেনা সম্পূর্ণ বিতাড়িত। সমগ্র টাঙ্গাইল, ফরিদপুর, বরিশাল, পটুয়াখালী জেলা সম্পূর্ণরূপে শত্রুমুক্ত হয়েছে। অন্যান্য জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে উড্ডীয়মান বাংলাদেশের জয় পতাকা।
সুতরাং, বন্ধু কেঁদো না। চোখের কোণে তোমার আনন্দের, বেদনার যে জলটুকু জমে উঠেছে তা মুছে ফেলো। আমরা এগিয়ে চলেছি, তোমরাও এগিয়ে চলো দুর্বার গতিতে। শত্রুর দুর্গে আঘাতের পর আঘাত।
<005.023.510>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
হানবো আমরা। চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেবো ওদের সামরিক শক্তি। ধুলোয় মিলিয়ে দেবো ওদের শক্তির দম্ভকে। তারপর আর মাত্র কয়েকদিন পর যখন বাংলাদেশের মাটি থেকে শেষ শত্রুটি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, যখন আমাদের সোনার বাংলার মাটি শত্ৰস্পর্শের কলঙ্কমুক্ত হবে তখন আমরা কাঁদবো গলা জড়িয়ে আমাদের হারানো সাখীদের জন্যে। আমরা সেদিন চোখের জলে আমাদের বন্ধুদের শুভ্র, পবিত্র অম্লান স্মৃতিকে স্মরণ করবো। আর সবাই মিলে গড়ে তুলবো আমাদের সোনার বাংলাকে।
(গাজীউল হক রচিত)
বিচার চাই
সারা বাংলাদেশ যখন নবলব্ধ স্বাধীনতার নবীন আভায় অবগাহন করছে ঠিক সেই সময় এক দুঃসংবাদ আমাদের সবাইকে বিস্মিত, মর্মাহত ও বেদনার্ত করে তুলেছে। পরাজয়ের পূর্ব মুহুর্তে পশুর চেয়েও নির্মম খান-সেনারা ও তাদের দালালদরা ঢাকার বুক থেকে শত শত বুদ্ধিজীবীকে গোপনে ধরে নিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। এই নরঘাতকদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল বাংলার প্রতিভাকে ধ্বংস করে দেওয়া। এরা বেছে বেছে হত্যা করেছে প্রখ্যাত অধ্যাপকদের, ডাক্তারদের, ইঞ্জিনিয়ারদের, সাংবাদিকদের। ঢাকা সেক্রেটারিয়েটের অফিসারদেরকেও এরা হত্যা করার জন্য ডেকে পাঠিয়েছিল, কিন্তু পশুদের সে উদ্দেশ্য সফল হয়নি।
প্রথম থেকে এই নরপশুরা যে একটি ঘৃণ্য পরিকল্পনা হাতে নিয়ে ষড়যন্ত্র করে বাংলাদেশের মানুষকে, তার ইতিহাসকে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল, একথা বহুবার প্রমাণিত হয়েছে। আমরা প্রথম থেকেই বলে আসছি, এরা বর্ণগত ভিত্তিতে, ভাষাগত ভিত্তিতে, ধর্মগত ভিত্তিতে, সংস্কৃতিগত ভিত্তিতে ও রাজনৈতিক মতামতের ভিত্তিতে বাঙালী জাতির অস্তিত্ব পৃথিবীর বুক থেকে মুছে ফেলতে চায়। আমরা প্রমাণ উপস্থিত করেছি। আমরা বলেছি উপযুক্ত অনুসন্ধান করে আমাদের এই অভিযোগ যাচাই করা হোক। আমরা বার বার জাতিসংঘের সদস্যদের বলেছি যে, যে আইন আপনারা পাশ করেছিলেন সেই আইন অনুসারে বাংলাদেশে যা ঘটেছে তা গণহত্যা। বর্ণগত ভিত্তিতে গণহত্যা। চলেছে। গণহত্যা চলেছে ধর্মের নামে ভাষার নামে, সংস্কৃতির নামে। আমরা চিৎকার করে বলেছি, লক্ষ লক্ষ মানুষকে ষড়যন্ত্র করে বাংলাদেশে মেরে ফেলা হচ্ছে। নারীর উপর নির্যাতন চলছে, বৃদ্ধ ও শিশু পর্যন্ত রেহাই পাচ্ছে না। আপনারা গণহত্যা হচ্ছে কিনা অন্তত একবার তদন্ত করুন, একবার দেখুন আমাদের ক্ৰন্দন যথার্থ কিনা। আমরা আরও বলেছি, একই বিষয়ের জন্য দু’ধনের মানদণ্ড হতে পারে না- একথা আপনারাই একদিন বলেছিলেন। ন্যুরেমবার্গে হিটলারের সাঙ্গপাঙ্গদের আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে আপনারা বিচার করেছিলেন। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিলেন যুদ্ধাপরাধের, শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধের ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের। তাদের বিরুদ্ধে আপনারা গণহত্যার অভিযোগ এনেছিলেন এবং সেই অপরাধে তাদের শাস্তিও দিয়েছিলেন। আর তখনই সেই আন্তর্জাতিক আদালতের মার্কিনী বিচারপতি কি মন্তব্য করেননি যে, একই অপরাধের জন্য বিচারের মানদণ্ড দু’রকম হতে পারে না? তিনি কি আরও বলেন নি যে, উর্ধ্বতন অফিসারের আদেশেই অপরাধ করেছি, সুতরাং আমার কোন দোষ নেই, সব দোষ অফিসারের, এ যুক্তি গ্রাহ্য নয়? তিনি কি বলেন নি যে, যে যার কাজের জন্য দায়ী হবে? সেই মহান বিচারপতি কি আরও ঘোষণা করেন নি যে আমরা এমন কোন আইন তৈরী করবো না যা আমাদের বেলায় ব্যবহার করা যাবে না? গণহত্যা সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক আইন পাশ করার সময় এ কথা কি ঘোষণা করা হয়নি যে গণহত্যার বিচার করার জন্য জাতিসংঘ যে-কোন ব্যবস্থা নিতে পারে এবং তার অর্থ কোন রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ বোঝাবে না? সেখানে কি বলা হয়নি যে বর্ণগত, ধর্মগত, সংস্কৃতিগত কারণে কাউকে হত্যা বা অত্যাচারিত করা যাবে না? জাতিসংঘের সনদের ৯৯ সংখ্যক ধারায় জাতিসংঘের সেক্রেটারী জেনারেলকে কি ব্যক্তিগতভাবে এসব ক্ষেত্রে
<005.023.511>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
এসব হস্তক্ষেপের অধিকার দেয়া হয়নি? দুঃখের বিষয়,বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে পুরাপুরি গণহত্যা অনুষ্ঠিত হোল, লক্ষ লক্ষ মানুষের রক্তে বাংলার মাটি রঞ্জিত হোল, লক্ষ লক্ষ নারীর আর্তনাদে বাংলার আকাশ-বাতাস কেঁপে উঠলো, লক্ষ শিশুর আর্তনাদে কেঁদে উঠলো বাংলার গাছপালা, কিন্তু তাতে জাতিসংঘের গলাবাজ সদস্যদের হৃদয় সামান্যতমও কাঁপলো না। মানুষের মরণ আর্তনাদ তাদের কানে পৌছালো না। তারা নির্বিকার চিত্তে সম্মতি জানালো পাকিস্তানী জঙ্গীশাহীর কার্যাবলীর প্রতি। তারা গণহত্যা হতে দিলো, তারা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হতে দিলো, তারা লক্ষ লক্ষ নিরীহ নিরস্ত্র মানুষকে মরতে দিলো, তারা অত্যাচারিতকে পায়ে দলে দিলো, অত্যাচারীকে সাদরে কোলে টেনে নিলো। তারা আইন ভঙ্গ হতে দিলো, তারা অত্যাচারীরর পক্ষ অবলম্বন করলো।
বিশ্বশান্তির এই সব ধ্বজাধারীদের ধারণা যে, চোখ বুজে থাকলেই কঠিন কঠোর সত্যকে এড়িয়ে যাওয়া যাবে। এদের ধারণা, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র বলেই ন্যায়বিচার করার দরকার নেই। এরা মনে করে, দু’একবার আইন ভঙ্গ হতে দিলে এমন দোষ ঘটে না। এরা ভাবে, যত আইন ভঙ্গ হোক না কেন গোলমালে না জড়িয়ে পড়লেই বাঁচা যাবে। এরা ঠিক করেছে যে, কেবল নিজের স্বার্থ ছাড়া আর কিছুই দেখবো না।
দুঃখের বিষয় মহাকালের শিক্ষা এরা ভুলে গেছে। এরা ভুলে গেছে যে, আইন ভঙ্গ হতে দেওয়া কোন উদারতার ব্যাপার নয়, আইন ভঙ্গ হতে দেওয়া দুপক্ষেরই বিপজ্জনক। হিটলার যখন বারবার অন্যায় করছিল তখন বৃহৎ শক্তিগুলো সব মেনে নিচ্ছিল, হিটলার ছোট ছোট দেশগুলো যখন দখল করছিল তখন চেম্বারলিন ছাতা দিয়ে তাকে বাতাস করছিলেন। কিন্তু সেই আইন ভঙ্গকারী হিটলারই কোটি কোটি মানুষের মৃত্যু ডেকে আনলো, বৃটেন ফ্রান্সসহ বহু দেশে প্রচণ্ড ধ্বংসলীলা চালালো। যদি প্রথম থেকেই বাধা দেয়া হোত তাহলে এই ধ্বংসের সম্মুখীন হতো না পৃথিবী।
পৃথিবীর সর্বত্র অন্যায় হচ্ছে। অথচ স্বার্থপরতার জন্য তার প্রতিকার করা হচ্ছে না। বাংলাদেশের মানুষ প্রাণ দিলো, কিন্তু অপরাধীর শাস্তি হলো না। পৃথিবীর রাষ্ট্রগুলো চেয়ে চেয়ে তাই দেখলো। আমরা ক্ষুদ্র বলেই এই অবহেলা। কিন্তু ইতিহাসের শিক্ষা যদি মিথ্যা না হয় তাহলে একদিন অন্যায়ের প্রশ্রয়দানকারীরা উপযুক্ত শিক্ষাই পাবে। অত্যাচারীর পক্ষ অবলম্বন করার জন্য রক্ত দিয়েই শাস্তি পেতে হবে। এবং অত্যাচারীর হাতেই সেই শাস্তি পেতে হবে তাদের।
আমার সোনার বাংলার শত শত প্রতিভাকে বিনষ্ট করা হয়েছে। কি আর কোন ভাষায় যে আমরা হাহাকার করবো বুঝতে পারছি না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে পড়েছি। শত স্মৃতি আজ মনে পড়ছে। আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষকরাও অনেকে প্রাণ হারিয়েছেন। কোন কিছুই দিয়েই তাদের শূন্য স্থান পূর্ণ হবে না। যেসব সাংবাদিক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার চিরকালের জন্য হারিয়ে গেলেন তাঁদের অভাবে সারা দেশ আজ কাঁদছে।। আমরা সবাই আজ হাহাকার করছি। সেইসব বিদেহী আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করার সময় চীৎকার করে আমরা বলতে চাই- হত্যঅকারী যেন শাস্তি পায়, হত্যাকারী যেন শিক্ষা পায়, হত্যাকারীদের সাগরেদ যেন শাস্তি পায়, হত্যাকারীদের সাগরেদ যেন শিক্ষা পায়।
তবে এ কথা ঠিক, অপরাধীর বিচারের ভার আমরা নিজের হাতে তুলে নেবো না। বিচার করবেন আমাদের সরকার। বিচারের ভার বহন করবেন সরকারের আইন বিভাগ।
(মোহাম্মদ আবু জাফর রচিত)
<005.024.512>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
২৪। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গীত সূচী | স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের দলিলপত্র | …… ১৯৭১ |
২৫ আগষ্ট, ১৯৭১ ২। সোনার বাংলা বলো (কোরাস)
১। সোনা সোনা সোনা লোকে বলে সোনা (কোরাস) ৩। আয়রে চাষী মজুর কুলি (ঐ)
২। পথে যেতে যেতে জন্ম হলো একটি কাহিনী ৪। অনেক রক্ত দিয়েছি (আঃ জব্বার)
(আপেল মাহমুদ) ৫। দুর্জয় বাংলা- (কোরাস
৩। দুনিয়ার যত গরীবকে আজ
৪। সেলাম সেলাম হাজার সেলাম ১৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
২য় অধিবেশনঃ ১ম অধিবেশনঃ
১। মুজিব বাইয়া যাওরে (আঃ জব্বার) ১। সোনায় মোড়ানো বাংলা মোদের (কোরাস)
২। জাগো অনশন বন্দী উঠোরে যত (কোরাস) ২। সেলাম সেলাম হাজার সেলাম (ঐ)
৩। আমার দেশের মাটির গন্ধে (ফেরদৌসী রহমান) ৩। আমার বাংলা দেশের মাটি (ঐ)
৪। ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য ৪। জাগো জাগো ও বাঙ্গালী (ঐ)
৫। জাগো জাগো ও বাঙ্গালী ২য় অধিবেশনঃ
৩য় অধিবেশনঃ ১। ভেবো না গো মা তোমার ছেলেরা (কোরাস)
১। চল বীর সৈনিক (আপেল মাহমুদ) ২। ভায়ের মায়ের (ঐ)
২। কারার ঐ লৌহ কপাট (কোরাস) ৩। আমি মরিব তাতে ক্ষতি নাই (ঐ)
৩। জনতার সংগ্রাম চলবেই (ঐ) ৪। হাজার বছর পরে (আঃ জব্বার)
৪। আমার প্রতিবাদের ভাষা ৫। জয়ধ্বনি কর বীর মুজিবর (মোঃ শাহবাঙালী)
৫। আমি শুনেছি শুনেছি বাংলার মায়ের কান্না ৬। হায়রে পাষাণ তোদের শীর্ণ দেহ (স্বপ্না রায়)
(মান্না হক) ৭। দুনিয়ার যত গরীবকে আজ (কোরাস)
৮। কারার ঐ লৌহ কপাট (ঐ)
২৮ আগষ্ট, ১৯৭১
২য় অধিবেশনঃ ৩য় অধিবেশনঃ
১। শেখ মুজিব সত্যযুগের (তোরাব আলী শাহ) ১। রক্তে যদি ফোটে (কোরাস)
২। মুজিব বাইয়া যাওরে (আঃ জব্বার) ২। জনতার সংগ্রাম চলবেই (ঐ)
৩। ওরা কোথায় গো (শাহ আলী সরকার) ৩। আমি ভয় করবো না (জরিন আহমদ)
৪। আমি ভয় করবো না (জরিন আহমদ) ৪। যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক (তপন ভট্টাচার্য)
৫। আজি বাংলাদেশের (অজিত রায়) ৫। বীর বাঙ্গালী অস্ত্র ধর (মনোরঞ্জন সরকার)
৬। অনেক রক্ত দিয়েছি (আঃ জব্বার)
৭। সোনা সোনা সোনা লোকে (কোরাস)
৩য় অধিবেশনঃ
১। বীর বাঙ্গালী অস্ত্র ধর (মনোরঞ্জন সরকার)
<005.024.513>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
২৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
২য় অধিবেশনঃ
১। পথে যেতে জন্ম হলো
(আপেল মাহমুদ ও স্বপ্না রায়)
২।আয়রে চাষী মজুর কুলি (কোরাস)
৩। তোমার নেতা আমার নেতা (ঐ)
৪। সোনার বাংলা বলে (ঐ)
৫। জয়ধ্বনি করে শেখ মুজিবর (মোঃ শাহ বাঙালী)
৬। কার বা বিচার কে বা করেরে (হরলাল রায়)
৭। শিকল পরা ছল (নজরুল গীতি)
৮। জাগো অনশন বন্দী (ঐ)
৩য় অধিবেশনঃ
১। নওজোয়ান সব এগিয়ে চল (কোরাস)
২। বাধ ভেঙ্গে দাও (রবীন্দ্র সঙ্গীত)
৩। বাংলার মাটি বাংলার জল (ঐ)
৪। যুদ্ধ কর অসি ধর (অনিল চন্দ্ৰ দে)
৫।আয়রে চাষী মজুর কুলি (কোরাস)
৬। জাগো জাগো ও বাঙালী (ঐ)
২১ অক্টোবর, ১৯৭১
১ম অধিবেশনঃ
১। ও আমার দেশের মাটি (অজিত রায়)
২। জয় জয় বাংলার জয় (কোরাস)
৩। পথে যেতে যেতে জন্ম হলো (আপেল মাহমুদ)
৪। সোনা সোনা সোনা লোকে (কোরাস)
২য় অধিবেশনঃ
১। জ্বলছে জ্বলছে জ্বলছে (নাসরিন ও অরূপ)
২। আয়রে চাষী মজুর কুলি (কোরাস)
৩। জাগো জাগো ও বাঙ্গালী (ঐ)
৪। বিচারপতি তোমার বিচার (ঐ)
৫। সোনার স্বদেশ ভূমি (মনজুর আহমদ )
৬। জাগো অনশন বন্দি (নজরুল গীতি)
৭। কারার ঐ লৌহ কপাট (কোরাস)
৩য় অধিবেশনঃ
১। ওরে জাগো জাগো ও বাঙ্গালী (কোরাস)
২। নওজোয়ান সব এগিয়ে চল (ঐ)
৩। রক্ত রঙীন উজ্জ্বল দিন (ঐ)
৪। জনতার সংগ্রাম চলবেই (ঐ)
৫। সোনার স্বদেশ ভূমি (মনজুর আহমদ)
৬। আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে (অজিত রায়)
৭। আমি মরিব তাতে ক্ষতি নেই (কোরাস)
১ নভেম্বর, ১৯৭১
২য় অধিবেশনঃ
১। জন্ম আমার ধন্য হলো মাগো (কোরাস)
২। জয় জয় বাংলার জয় (ঐ)
৩। পূবের ঐ আকাশে সূর্য উঠেছে (ঐ)
৪। বাংলার মাটি বাংলার জল (রবীন্দ্রসঙ্গীত)
৫। ও খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি (রবীন্দ্রনাথ)
৬। আরে ও মাঝি ভাই (মনিরা জামান)
৭। দুর্গম গিরি কান্তার মরু (নজরুল গীতি)
৮। চল ছুটে চল (পল্লীগিতি) (আঙ্গুর)
৩য় অধিবেশনঃ
১। আমার প্রতিবাদের ভাষা (কোরাস)
২। যে তোমার ছাড়ে ছাড়ুক (ঐ)
৩। আয়রে চাষী মজুর কুলি (ঐ)
৪। আমি একজন মুক্তিসেনা (মান্না হক)
৫। একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে (আপেল)
৬। দুনিয়ার যত গরীবকে আজ (ঐ)
<005.024.514>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
১৫ নভেম্বর, ১৯৭১
১ম অধিবেশনঃ
১। এবার উঠেছে মহাঝড় আলোড়ন (কোরাস)
২। দিনের শোভা সূর্য রাতের শোভা চাঁদ (আঃ গনি বোখারী)
৩। “এঘর দুর্গ ওঘর দুর্গ’- একটি গীতিনকশা
সংযোজনা-শাজাহান ফারুক বর্ণনায়- আশরাফুল আলম
১। সুজেয় শ্যাম
২। আপেল মাহমুদ
৩। রফিকুল আলম।
৩য় অধিবেশলনঃ
১। কারার ঐ লৌহ কপাট (কোরাস)
২। মোরা ঝঞ্জার মত (ঐ)
৩। জনতার সংগ্রাম চলবে (ঐ)
৪। সোনার বাংলা (জারী গান) (হযরত আলী)
৫। চল ছুটে চল (মফিজ আঙ্গুর)
৬ একি অপরূপ (কোরাস)
৭। বাংলাদেশ বাংলাদেশ (ঐ)
৮। সংগ্রাম সংগ্রাম (অনুপ)
২৮ নভেম্বর, ১৯৭১
১। গীতিনকশা (রক্ত চাই)
সঙ্গীত পরিচালনাঃ সুজেয় শ্যাম (কোরাস)
২। জয় বাংলার জয় (কোরাস)
৩। জনতার সংগ্রাম চলবেই (ঐ)
৪। ওদের বাঁধন যতই শক্ত হবে (রবীন্দ্রসঙ্গীত)
৫। বাঁধ ভেঙ্গে দাও (কোরাস)
৫ ডিসেম্বর, ১৯৭১
১। এঘর দুর্গ ওঘর দুর্গ (কোরাস)
২। জয় ধ্বনি কর বীর মুজিবর (মোঃ শাহ বাঙালী)
৩। বাংলা থেকে দুশমনদের (সর্দার আলাউদ্দিন)
৪। সাগর পাড়িতে ঝড় জাগেই যদি
৫। বাংলাদেশ বাংলাদেশ (রবীন্দ্র সঙ্গীত)
৬। এই কথাটি ধরেই (লায়লা জামান) (ঐ)
৭। এবার তোর মরা গাঙ্গে (তপন ভট্টাচার্য) (ঐ)
৯ ডিসেম্বর, ১৯৭১
প্রথম অধিবেশনঃ
১। ধন্য আমার জন্মভূমি (কোরাস)
২। রক্ত চাই রক্ত চাই (ঐ)
৩। আগুন আগুন আমরা আগুন (ঐ)
৪। জনপদ প্রান্তরে সাগরে বন্দরে (ঐ)
৫। ঝড় ঝঞ্জার মুখোমুখি (ঐ)
৬। আহা ইয়াহিয়া কান্দেরে (হরলান রায় )
৭। কার বা বিচার কে বা করে রে (ঐ)
৮। বাঁধ ভেঙ্গে দাও (রবীন্দ্র সঙ্গীত)
১০ ডিসেম্বর, ১৯৭১
প্রথম অধিবেশনঃ
১। পথের আঁধার আর নাই (কোরাস)
২। এবার উঠেছে মহাঝড় (ঐ)
৩। মোরা জঞ্জার মতো উদ্দাম (ঐ)
৪। কারার ঐ লৌহ কপাট (ঐ)
৫। ও বাঙালী ভাই কে কে যাবি
(ইন্দ্রমোহন বোখারী)
৬। ঐ ঐ ঐ চল চল নওজোয়ান
(আঃ গনি রাজবংশী)
৭। জয় বাংলা জয় (কোরাস)
৮। রক্ত রঙ্গীন উজ্জল দিন (ঐ)
দ্বিতীয় অধিবেশনঃ
১। ও বগিলারে কেন বা আইলো (নর্থীন্দ্রনাথ রায়)
<005.024.515>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
২।সাত কোটি আজ প্রহরী প্রদীপ (কোরাস) ১৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১
৩। ওরা কলিজা ছিড়ে তৃতীয় অধিবেশনঃ
৪। বারুদে বারুদে সারা বাংলা ১। জয় জয় জয় হবে বাংলার (কোরাস)
৫। সম্মুখপানে চলবো মোরা ২। ওরা কলিজা ছিড়ে (ঐ)
৬। বীর মুক্তিযোদ্ধা তোদের (আঃ গনি বোখারী) ৩। ঝড়ঝঞ্চার মুখোমুখি (ঐ)
৭। তোরা জোরছে চল (শাহ আলী সরকার) ৪। ব্যারিকেড বেয়নেট বেড়াজাল (ঐ)
৮। ঐ ঝঞ্জার ঝংকারে ঝংকারে ৫। পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে (ঐ)
৬। আমি শুনেছি শুনেছি (মান্না হক)
১২ ডিসেম্বর, ১৯৭১ ৭। রুখে দাঁড়াও রুখে দাঁড়াও (সরদার লাউদ্দিন)
দ্বিতীয় অধিবেশনঃ ৮। বীর বাঙ্গালী অস্ত্র ধর (মনোরণজন সরকার)
১। দেয়ালে দেয়ালে লিখা (কোরাস) ৯। একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে (আপেল মাহামুদ)
২। ওরা যতই বলুক (ঐ) ১০। অনেকে রক্ত দিয়েছি (আঃজব্বার)
৩। সোনার বাংলা করবো সোনা ১১। ঐ ঝঞ্চার ঝংকারে ঝংকারে (রবীন্দ্র সঙ্গীত)
(মোঃ নৌশেদ আলী) ১২। ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা (ঐ)
৪। বারুদে বারুদে সারা বাংলা
৫। পথের আধাঁর আর নেই (লাকি আখন্দ) ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১
প্রথম অধিবেশনঃ
তৃতীয় অধিবেশনঃ ১। পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে (কোরাস)
১। সংগ্রাম সংগ্রাম (কোরাস) ২। মোরা ঝঞ্জার মত উদাম (নজরুল)
২। আমার প্রতিবাদের ভাষা (ঐ) ৩। শিকল পরা ছল (ঐ)
৩।মুক্তির একই পথ সংগ্রাম (ঐ) ৪। চলরে সবাই বাঁধ ভাঙ্গাবার (কোরাস)
৪। দুর্জয় মোরা সাত কোটি (ঐ) ৫। সংগ্রাম আজ সংগ্রাম (ঐ)
৫। এবার উঠেছে মহাঝড় আলোড়ন (ঐ) ৬। রক্ত রঙীন উজ্জ্বল দিন (ঐ)
৬।এঘর দুর্গ ওঘর দুর্গ (ঐ) তৃতীয় অধিবেশনঃ
৭।সাগর পাড়িতে ঝড় জাগেই যদি (ঐ) ১। আমরা গেরিলা আমরা (কোরাস)
৮।ঐ ঝঞ্জার ঝংকারে (রবীন্দ্রসঙ্গীত) ২। আমি এক বাংলার মুক্তিসেনা (ঐ)
৯। বাংলা থেকে দুশমনদের (সর্দার আলাউদ্দিন) ৩। দুর্জয় বাংলা (ঐ)
১০। ও আমার দেশবাসী ভাই (মোঃ মুন্নাফ) ৪। দুর্গম দূর পথ বন্ধুর (ঐ)
১১। জনতার সংগ্রাম চলবেই (কোরাস) ৫। নোঙ্গর তোল নোঙ্গর তোল (ঐ)
১২। আয়রে চাষী মজুর কুলি (ঐ) ৬। তোরা জোরছে চল (শাহ আলী সরকার)
১৩। এবার তোর মরা গাঙে (রবীন্দ্রসঙ্গীত) ৭। দস্যু মারিতে চল ধাইয়া (ঐ)
১৪। এই কথাটি বলেই (ঐ) ৮। পরানের বন্ধুরে বলবো কি তোরে (দ্বৈত সঙ্গীত)
<005.024.516>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
৯। হুশিয়ার হুশিয়ার হুশিয়ার (আপেল মাহমুদ)
১০। বাঁধ ভেঙ্গে দাও (রবীন্দ্রসঙ্গীত)
১১। চল যাই চল যাই (ঐ)
১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১
প্রথম অধিবেশনঃ
১। আজ রণ সাজে বাজিয়ে বিষাণ (সমবেত কণ্ঠ)
২। ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য (ঐ)
৩। পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে (ঐ)
৪। রক্ত রঙ্গীন উজ্জ্বল দিন (ঐ)
৫। আমি মস্ত সাগর
৬। মোরা ঝঞ্জার মত উদাম (নজরুল গীতি)
৭। রক্ত দিয়ে নাম লিখেছি
দ্বিতীয় অধিবেশনঃ
১। আমি শুনেছি শুনেছি (মান্না হক)
২। থের আধার আর নাই (কোরাস)
৩। চল বাঙ্গালী চল (পল্লীগীতি)(কোরাস)
৪। মুক্তি ভাই ঝম বাম করে (তোরাব শাহ আলী)
তৃতীয় অধিবেশনঃ
১। সাত কোটি মোরা করেছি অঙ্গীকার (কোরাস)
২। সম্মুখপানে চলবো মোরা (ঐ)
৩। চলরে সবাই বাঁধ ভাঙ্গাবার (ঐ)
৪। মুজিবর মুজিবর (ঐ)
৫। ওরে শোনরে তোরা শোন (ঐ)
৬। আমি মরবো তাতে ক্ষতি নাই (ঐ)
৭। আমার মুক্তিবাহিনী ভাইরা (তোরাব শাহ আলী)
৮। আকাশের তারার মত (ঐ)
৯। ও আলোর পথ যাত্রী (কোরাস)
১০। চল চল চল (নজরুলগীতি)
১১। আমার মুক্তি আলোয় আলোয় (রবীন্দ্রসঙ্গীত)
১২। নাই নাই ভয় (ঐ)
১৩। এবার তোর মরা গাঙ্গে বান এসেছে (ঐ)
<005.025.517>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
পরিশিষ্ট-১
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
২৫। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা সম্পর্কিত কয়েকটি প্রতিবেদন | —————— | …… ১৯৭১ |
১.
মুক্তিকামী বাঙালীর প্রেরণার উৎস
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র
আতিকুর রহমান
ইথারে ভেসে আসা শব্দ যে বুলেটের চেয়েও প্রচণ্ডতম শক্তি নিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে আঘাত হানতে পারে তার প্রমাণ হচ্ছে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্ৰ। ইয়াহিয়া খানের নেতৃত্বে টিক্কা-নিয়াজী-ফরমান আলীর বীর পশুরা সেদিন বুলেট-বেয়োনেট দিয়ে বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতা সংগ্রামকে স্তব্ধ করতে চেয়েছিল। আর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হাতিয়ারের চেয়ে শক্তিশালী আঘাত হেনেছে নরপশুদের বিরুদ্ধে।
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের কালো রাতে পাকিস্তানী বাহিনী মরণ ছোবল হেনেছিল। শহর-বন্দরগ্রামকে রক্তে রঞ্জিত করেছিল। সেই আঘাতে হকচকিত বাংলার মানুষ পরদিন ২৬শে মার্চ বেতারে শ্রুত একটি বাণীতে খুঁজে পেয়েছিলেন আশার বাণী। সে বাণী ছিল স্বাধীনতার, হানাদারদের কবল থেকে মুক্তির। দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধে এই বেতার বাঙ্গালীদের যুগিয়েছে উৎসাহ-উদ্দীপনা, দেশকে মুক্ত করার প্রেরণা।
বিপ্লবী বীর সূর্যসেনের স্মৃতিতে উজ্জ্বল চট্টলার বুক থেকেই সেদিন বেতারে হয়েছিল বাংলার স্বাধীনতা। আর কালুরঘাটস্থ পাকিস্তানী বেতারের ট্রান্সমিশন কেন্দ্র থেকেই বাংলার ঘরে ঘরে পৌছানো হয়েছিল স্বাধীনতার সে বাণী। ২৬শে মার্চ জন্ম নিয়েছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম হাতিয়ার স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র।
২৫শে মার্চ রাতে হানাদার হায়েনার দল হত্যাযজ্ঞ শুরু করার পর ২৬শে মার্চ সকাল থেকে চট্টগ্রাম বেতারের সকল কর্মচারী কাজ বন্ধ করে নিয়েছিলেন। ব্রডকাষ্টিং যন্ত্রপাতি সরিয়ে রেখেছিলেন যাতে হানাদার বাহিনী প্রয়োজনবশত অবিলম্বে বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচার শুরু করতে না পারে। ঢাকা বেতারও সেদিন নীরব ছিল।
চট্টগ্রামের কিছু সংখ্যক দেশপ্রেমিক সেদিন এগিয়ে এসেছিলেন। ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র চালু চালু করেছিলেন তাঁরা সকল প্রকার ঝুকিঁ নিয়ে।
২৬শে মার্চ দুপুরে কিছুক্ষণের জন্য একবার চট্টগ্রাম বেতার থেকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ বলে নিজেদের পরিচয় দিয়ে হানাদার বাহিনীকে রুখে দাঁড়াবার আহ্বান প্রচারিত হয়েছিল।
<005.025.518>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
সংগঠিতভাবে না হলেও সেদিনই সন্ধ্যায় আরেকদল কর্মী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ বলে পরিচয় দিয়ে প্রচার শুরু করেছিলেন। ২৭শে মার্চ এই কেন্দ্র থেকে মেজর (বর্তমান লেঃ কর্নেল) জিয়াউর রহমান জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর পক্ষে বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন।
এই কেন্দ্র থেকেই ২৮শে মার্চ মুক্তিযোদ্ধারা অতর্কিত হামলা চালিয়ে ঢাকায় টিক্কা খানকে হত্যা করেছে বলে প্রচার করা হয়। সত্য না হলেও জনগণের হৃদয়ে আশা ও উদ্দীপনা সঞ্চারের জন্য বেতার কর্মীরা সুপরিকল্পিতভাবে এ কাজ সেদিন করেছিলেন।
দুই ভাগে বিচ্ছিন্নভাবে এজন্য প্রচেষ্টা চলেছিল। প্রথম দিনে দুপুরে সামান্যক্ষণ অনুষ্ঠান প্রচারকালে গণপরিষদ সদস্য জনাব এম, এ, হান্নান হানাদারদের রুখে দাঁড়াবার আহবান জানিয়ে ভাষণ দিয়েছিলেন। আর এই অনুষ্ঠান প্রচারে সহযোগিতা করেছে চট্টগ্রাম বেতারের ইঞ্জিনিয়ার মীর্জা নাসির, জনাব আবদুস সোবহান, চট্টগ্রাম কাষ্টম বিভাগের জনাব আবদুল হালিম, একটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা জনাব এম, এ, মাসেম প্রমুখ।
সেদিন সন্ধ্যায় দ্বিতীয় অনুষ্ঠান প্রচারের সাথে জড়িত বেতার কর্মিগণ ৩০শে মার্চ পর্যন্ত চট্টগ্রাম থেকে এই প্রচার চালু রেখেছিলেন। সেসব বেতার কর্মীর অনেকেই শেষ পর্যন্ত মুজিবনগর থেকে প্রচারিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে কাজ করেছেন।
আগ্রাবাদ আবাসিক এলাকার ডাঃ সৈয়দ আনোয়ার আলীর বাসভবনে জমায়েত হয়েছিলেন দেশপ্রেমিক কয়েকজন ব্যক্তি। নেপথ্যে শুরু হয়েছিল অপর প্রচেষ্টা। ওয়াপদার ইঞ্জিনিয়ার জনাব আসিকুল ইসলামের গাড়ীতে (চট্টগ্রাম ট-৯৬১৫) সেদিন ডাঃ আনোয়ার আলী, জনাব ইসলাম, ইঞ্জিনিয়ার দিলীপ চন্দ্র দাস, চট্টগ্রাম বেতারের ঘোষিকা কাজী হোসনে আরা সবাই ছুটে গিয়েছিলেন আগ্রাবাদস্থ ব্রডকাষ্টিং হাউসে। আরেকদিক থেকে চট্টগ্রাম বেতারের কমী জনাব বেলাল মোহাম্মদ, জনাব আবুল কাসেম সন্দ্বীপ, জনাব মাহবুব হাসান একই প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ব্রডকাস্টিং হাউসে পৌছেন। সমবেত প্রচেষ্টার ফল ফলে সেদিন সন্ধ্যায়।
সেই কর্মীদের দল আবার একত্রে কালুরঘাট পৌঁছেন। খবর পেয়ে কাজে যোগ দিয়েছিলেন টেকনিশিয়ান ও প্রোগ্রাম প্রডিউসার কয়েকজন।
রাত সাড়ে সাতটার দিকে ট্রান্সমিশন কেন্দ্রের একটি কক্ষকে ষ্টুডিও হিসাবে ব্যবহার করে জনাব আবুল কাসেম সন্দ্বীপের কণ্ঠে ঘোষণার মাধ্যমে শুরু হয় মুক্তির নবতম হাতিয়ারের ব্যবহার।
প্রথমেই বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা করে টেলিগ্রামের বাংলা ও ইংরেজী তর্জমা প্রচার করা হয়েছিল। ইংরেজী থেকে তর্জমা করেছিলেন ডঃ মঞ্জলা আনোয়ার। ইংরেজীতে ঘোষণাটি পড়েছিলেন ইঞ্জিনিয়ার জনাব আশিকুল ইসলাম। এই ঘোষণায় বাঙালী জাতি উদ্বুদ্ধ হয়নি শুধু- বাঙ্গালী জাতি যে স্বাধীন হবেই সে আশায় উদ্দীপ্ত হয়েছিল।
আধ ঘণ্টার মত প্রচারকালে আওয়ামী লীগ নেতা জনাব হান্নান ও বয়োবৃদ্ধ কবি আবদুস সালাম কথিকা পাঠ করেছেন। সেদিনের ঘোষণায় কণ্ঠ দিয়েছেন কাজী হোসনে আরা।
৩০শে মার্চ পর্যন্ত বেতার কর্মীরা অনিয়মিত হলেও অনুষ্ঠান প্রচার করেছেন। ৩০শে মার্চ হানাদার বাহিনী বাংলাদেশে প্রথম বিমান হামলা চালায়। আর তা ছিল কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে। স্যাবর বিমান থেকে রকেট নিক্ষেপ করে স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল ইথারের ভাষা।
<005.025.519>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
পরে বেতার কর্মীরা স্থান ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন। ধীরে ধীরে তখন মুজিবনগরে গড়ে উঠেছিল ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র চট্টগ্রামের বীর সন্তানদের পথ ধরেই। সেদিনের অনেক কর্মী পরে সেখানে যোগ দেন।
চট্টগ্রামের বিদ্রোহী বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রায় পঞ্চাশজন যোদ্ধা বেতার কেন্দ্র রক্ষার দায়িত্বে থেকে সেই কয়দিন অক্নান্ত প্রচেষ্টা চালিয়েছেন অনুষ্ঠান চালু রাখার।
‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে তখনকার অনুষ্ঠান প্রচারে জড়িত ছিলেন এ ছাড়াও প্রোগ্রাম শাকের, টেকনিক্যাল এসিসট্যান্ট জনাব রশিদুল হাসান ও জনাব আমিনুর রহমান, টেকনিক্যাল অপারেটর জনাব রেজাউল করিম চৌধুরী, জনাব শরফুজ্জামান ও কাজী হাবিবউদ্দিন আহমদ।
সক্রিয়ভাবে সাহায্য করেছেন জনাব এ, কে খানের দুই ভাইপো সেকান্দর ও হারুন।
অন্যান্য ভূমিকা পালন করেছেন। মেকানিক শফুর। প্রথমে ড্রাইভার হিসেবে চাকুরী নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু পরে অভিজ্ঞতার জন্য মেকানিক হিসেবে নিয়োজিত হয়েছিলেন। শত অনভিজ্ঞতা সত্ত্বেও তার অদম্য প্রেরণা ও প্রচেষ্টায় একদিন অনুষ্ঠান প্রচার সম্ভব হয়েছিল।
-দৈনিক ‘পূর্বদেশ, ১৫ ডিসেম্বর, ১৯৭২
২,
বেতার-মুক্তি সংগ্রামে
বেলাল মোহাম্মদ
এই তথ্য-নিবন্ধ নির্মাণোদ্যত হয়ে প্রথমেই যে বিবেচনা বোধ করছি, তা হচ্ছে, ইতিহাস দুই কারণে বিকৃত হতে পারে। এক, প্রণেতার স্মৃতি বিপত্তি, যার কারণ কালবিলম্ব না করে লিপিবদ্ধকরণের পরিবেশের অপ্রতুলতা। দুই, অবস্থা গতিকে না ব্যক্তিগত দলগত স্বার্থে কোনো কোনো তথ্য গোপন বা অব্যক্ত আবশ্যকতা। এই শেষোক্ত কারণে অনেক সময় কোন বক্তব্য বিষয়কে বিকৃত না করলেও সীমাবদ্ধতা দিয়ে ক্ষুন্ন করতে পারে বেশ খানিকটা, অনেক কথাই স্মৃতিতে অম্লান হওয়া সত্ত্বেও সর্বমুহুর্তে প্রকাশ করা যায় না।
গোড়াতেই সবিনয়ে একটি কতা বলে রাখতে চাই, যে বিষয়ের আমি প্রত্যক্ষ কর্মবিবরণ লিপিবদ্ধ করতে বসেছি, আমার সহকর্মীরা অনেকেই বর্তমান আছেন যারা এটি পাঠ করবেন এবং আমার ভ্রমের জন্য বা দৃষ্টি বৈচিত্র্য ও উপলব্ধির বিভ্রমের জন্য তাদের কারো কাছে এখানে বর্ণিত কোনো তথ্যকে অস্বস্তিকর আপত্তিকর বিবেচিত হলে তা যেন ব্যক্তিগত ভুল বোঝাবুঝির বা অসন্তুষ্টির কারণ না হয়ে দাঁড়ায়। বস্তুত সবচেয়ে বড়ো সমস্যা হচ্ছে একজন সাংবাদিক যখন কোন সংবাদ সরঞ্জাম প্রত্যক্ষদশী হিসেবে সংগ্রহ করেন, তখন তিনি ঘটনা পরম্পরার সঙ্গে স্বয়ং জড়িত না হয়ে তৃতীয় ব্যক্তিত্বের ভূমিকা গ্রহণ করেন। কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের পটভূমিকা লিখতে গিয়ে আমরা স্বকীয় নগণ্য প্রয়াসকে ও সামগ্রিক সংগ্রামসূচী ও সংগ্রামী কার্যক্রমের সংগে সংযুক্ত করতে বিশেষভাবে প্রলুব্ধ হই। এটি একটি সংগ্রামী জাতির অস্তিত্বের সংগে একটি ব্যক্তিজীবনের কর্মময়।
*একই শিরোনামে ১৯৭৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর তারিখে বেতার বাংলা’র বিজয় দিবস সংখ্যায় প্রকাশিত বেলাল মোহাম্মদ-এর প্রতিবেদন দ্রষ্টব্য।
<005.025.520>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
সময়ে সঙ্গত কারণেই আমরা সবাই অসম্ভব রকম জাতীয় সঙ্কীর্ণতায় আক্রান্ত বলেই নিবন্ধের গৌরচন্দ্রিকা আকারে এতো কথা বলতে হলো।
এবার আরম্ভেরও প্রারম্ভিক হিসেবে বলতে হচ্ছে, একটা বিষয় রহস্যাবৃত থাকা পর্যন্ত তাই নিয়ে বিচিত্র বিক্ষিপ্ত জল্পনা-কল্পনারও যেমন অবকাশ আছে, তেমন অবকাশ আছে নানা রকম রটনার এবং নানা জনের ব্যক্তিগত কৃতিত্ব প্রকাশের সুযোগ-সুবিধার।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার বিষয়টি ইতিমধ্যেই একটি বহুবিতর্কিত জটিল প্রসঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ বিষয়ে একজন নগণ্য বেতার কর্মী হিসেবে আমার সর্বসময়ের বক্তব্য হচ্ছে, স্বধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার একক কৃতিত্ব কারুরই নেই। অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের সূচনাকালে এ ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করতে পারেন। তবে একথা নিদ্বিধায় বলা যায় বেতার বিভাগীয় কর্মীরাই আলোচ্য কেন্দ্রটি চালু করেছেন-সেটা স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়েই হোক কিংবা হোক রাজনৈতিক কর্মীদের প্রভাবে বা সহযোগিতায়। কেননা, বেতার মাইকের সামনে শব্দনিক্ষেপণ এবং শব্দকে ইথারে উৎক্ষেপন এই দুই কর্মই বেতারের অনুষ্ঠান ও প্রকৌশল বিভাগীয় কর্মীগণ ছাড়া আর কারো পক্ষে সম্ভব নয়। এছাড়া ২৫শে মার্চ, ৭১- এর পূর্বহ্নে বঙ্গবন্ধু আহুত অসহযোগ আন্দোলনের প্রভাবে আমাদের বেতার কেন্দ্রগুলো দখলদার সরকারের সঙ্গে সত্যিকার অসহযোগিতা প্রদর্শনে উদাহরণ সৃষ্টি করেছিল- তারই নিদর্শন হচ্ছে ‘রেডিও পাকিস্তান’ – নাম ঘোষণাটি সম্পূর্ণ বর্জন করে প্রত্যেক আঞ্চলিক কেন্দ্র নিজ নিজ আঞ্চলিক নাম ঘোষণা শুরু করেছিল, যেমন, ঢাকা বেতার কেন্দ্র, চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র ইত্যাদি। প্রত্যেক বেতার কেন্দ্রেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে ছিল বাঙালী কর্মীদের সমন্বয় সংগ্রাম কমিটি। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানের ভাষণটি চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকেই প্রথম ৭ই মার্চ সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় প্রচার করা হয়েছিল। অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে ১৫ই মার্চ, ৭১ স্থানীয় লালদীঘির ময়দানে অভিনীত গণনাটক মমতাজউদ্দীনের রচিত ‘এবারের সংগ্রাম”- এর রেকর্ড ১৭ই মার্চ চট্টগ্রাম বেতার থেকে বাজানো হয়েছিল। বেতার তথা সরকারী কর্মচারীদের কানে নিত্যই বাজাতো একটি বজ্ৰকণ্ঠের বাণীঃ বাঙালীর স্বার্থবিরোধী কোনো কাজ তোমাদের করতে বলা হলে তোমরা অফিস বন্ধ করে দেবে।
ঠিক তা-ই করেছিলাম ২৬শে মার্চ, ৭১ সকালবেলা চট্টগ্রাম বেতারের কর্মীরা। প্রথম অধিবেশনের শেষাংশে যে মুহুর্তে বেতারের তখনকার প্রাদেশিক অনুষ্ঠানের সামরিক প্রশাসক প্রবর্তিত বিধানের প্রারম্ভিক ঘোষণা প্রচার করা হয়েছিল সেই মুহুর্তে উপস্থিত সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়েছিল। আমাদের কর্মীরা বেতার ভবন ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন।
তার পরের ঘটনাগুলো অসম্ভব রকম স্বতঃস্ফূর্ত, অসম্ভব রকম বিচিত্র-বিক্ষিপ্ত। বিচিত্র কি, তখন আমাদের অনুষ্ঠানের শ্রোতারাও এরকম কিছু একটা ভাবতে পারেন, এখন যদি বেতারের বাঙালিদের সংগ্রামের সপক্ষে কিছু প্রচার করা যেতো।
বস্তুতঃ অনুরূপ চিন্তা-ভাবনা থেকেই চট্টগ্রাম বেতারের ট্রান্সমিটারে বিভিন্ন পর্যায়ে একই দিনে ২৬শে মার্চ, ৭১ তিনবার স্বল্পকাল স্থায়ী তিনটি অধিবেশন প্রচারিত হয়। একবার বেলা ২ টা বেজে ৭ মিনিট আর একবার সন্ধ্যা ৭ টা বেজে ৩৫ মিনিটে এবং আর একবার রাত ১০ টায়। বস্তুতঃ এই তিনটি ঘটনাই অসম্ভব রকম বিক্ষিপ্ত এবং এগুলোর উদ্যোগ-আয়োজনও ছিল প্রকৃতপক্ষে স্বতঃস্ফূর্ত- দেশে দখলদার সামরিক বাহিনীর আকস্মিক আক্রমণাত্মক তৎপরতার বিরুদ্ধে যেমন সেদিন সর্বত্র গড়ে উঠেছিল জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ, এগুলোও ঠিক তেমনি।
<005.025.521>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
দ্বিপ্রহরের অধিবেশনটির আমি প্রত্যক্ষদশী বা শ্রোতা নই। কিন্তু পরবর্তীকালে জেনেছিলাম, সেটির উদ্যোক্তা ছিলেন চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক জনাব এম এ হান্নান। তিনি ও তার দলের সহকর্মীরা আমাদের কয়েকজন প্রকৌশলীকে নিজেদের প্রভাব খাটিয়ে ট্রান্সমিটার ভবনে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং ট্রান্সমিটার চালু করিয়েছিলেন। অধিবেশনটিতে ঘোষণা হিসেবে জনাব হান্নানের নাম ও বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে জাতির উদ্দেশে ভাষণদানের কথা উল্লেখ করা হয়েছিল এবং জনাব হান্নান বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা প্রসঙ্গে পাঁচ মিনিট ভাষণ প্রচার করেছিলেন। অধিবেশনের স্থিতিকালও ছিল ছয় থেকে সাত মিনিট।
জনাব হান্নানের প্রভাবে যেসব বেতারকর্মী/প্রকৌশলী ট্রান্সমিটার চালু করেছিলেন, তাঁর পরে আর এমুখো হননি-অধিকন্তু পরবর্তীকালে পাকিস্তান বেতারে কাজ করেছিলাম।
সন্ধ্যা৭টা বেজে ৩৫ মিনিটে যে অধিবেশন প্রচার করা হয় সেটার উদ্যোক্তা পরিচালক ছিলাম আমি। স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র নামটি আমিই অন্যতম সহকারী আবুল কাসেম সন্দ্বীপের সঙ্গে আলোচনাক্রমে স্থির এবং অনুমোদন করেছিলাম।
২৬ শে মার্চ, ৭১ সকালবেলা সহসা যখন চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র নীরব হয়ে গিয়েছিল, তখন আমি ছিলাম এনায়েত বাজারে দন্তচিকিৎসক মোহাম্মদ শফীর বাড়িতে। তখনই আমার মনে এসেছিল, এখন যদি কিছু একটা করা যেতো! যেটা একজন অসহযোগকারী বাঙালীর জন্যে অত্যান্ত স্বাভাবিক, আগেই বলেছি। মনের কথাটা সে মুহুর্তে আমি শুধু বেগম মুশতার শফীকে বলেছিলাম- তিনি উৎসাহ দিয়েছিলেন।
প্রথমেই আমি গিয়েছিলাম ষ্টেশন রোডের রেষ্ট হাউসে আওয়ামী লীগ অফিসে- নেতৃবৃন্দের অনুমোদন নিয়ে যদি পরিকল্পনাটি বাস্তবায়িত করা যায়। পরিচিত কারো সঙ্গেই সেখানে আমার দেখা হয়নি। আমি শুধু নিজের নাম-পরিচয় দিয়ে সেখানে অন্যভাবে অসম্ভব রকম কর্মব্যস্ত দু’একজন কর্মীর দৃষ্টি আকর্ষণ করার প্রয়াস করেছিলাম। তখন সেখানে অস্ত্র বিতরণ করা হচ্ছিল। সেখানেই দেখা হয়েছিল অধ্যাপক মমতাজউদ্দীনের সঙ্গে। মমতাজ আমার প্রস্তাব/ পরিকল্পনা শুনেই নিদ্বিধায় সহযোগী হয়েছিলেন এবং নিজের প্রভাবে আওয়ামী লীগ কর্মী এডভোকেট রফিকের কাছ থেকে একখানা জীপ চেয়ে নিয়েছিলেন। আমাদের প্রাথমিক প্রস্তুতি প্রসঙ্গটি ছিল আগ্রাবাদ বেতার ভবন এবং কালুরঘাট ট্রান্সমিটার ভবন এ দুটি এলাকাকে পর্যপ্ত সংখ্যক সশস্ত্র স্বেচ্ছাসেবক বা বাঙালী সৈন্য সমাবেশে সংরক্ষিত করা। আমরা দুজন জীপে করে রেলওয়ে বিল্ডিং- এর পাহাড়ে ইপিআর হেড কোয়ার্টার্সে কমাণ্ডার রফিকের কাছে গিয়েছিলাম। তখন বেলা ২ টা কমাণ্ডার আধ ঘণ্টার মধ্যে বেতার ভবনে ২০ জন এবং ট্রান্সমিটারে ১৫ জন ইপিআর পাঠিয়ে দেয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন। আশ্বস্ত হয়ে আমরা রাবেয়া খাতুন লেনে মাহবুব হাসানের বাড়ীতে গিয়েছিলাম। মাহবুব হাসান বেতার নাটকের শিল্পী- প্রযোজক হিসেবে চট্টগ্রাম বেতারের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে সংশ্লিষ্ট, আমাদের প্রকৌশলীদের অনেকের সঙ্গেই তার বন্ধুত্ব। তার সহায়তায় প্রকৌশলিক প্রস্তুতি সম্পাদন আমার উদ্দেশ্য ছিল।
এবার আমরা তিনজন জীপে করে চকবাজার এলাকার বাসিন্দা আমাদের বেতারের দুজন প্রকৌশলীর কাছে গিয়েছিলাম। তারা শর্ত আরোপ করেছিলেনঃ তারা কাজ করবেন, তবে এক, আঞ্চলিক প্রকৌশলীর লিখিত অনুমতি নিতে হবে অথবা দুই, এমন একটা পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে যেন তারা বাধ্য হয়ে প্রস্তাবিত কাজটি করেছিলেন- অনিশ্চিত ভবিষ্যতে যেন তাদের বিপদ না হয়। বেশ তো! দ্বিতীয় শর্তে আমরা মেনে নিয়েছিলাম। কেননা তখন যে কোন মুহুর্তে কমাণ্ডার রফিকের বাহিনী এসে পড়বে বলে আমরা আশা করেছিলাম। করেছিলাম।
প্রকৌশলী দুজনকে ট্রান্সমিটার ভবনে নামিয়ে দিয়ে আমরা তিনজন বেতার ভবনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলাম। পথে কলেজ রোডে পৌঁছে মমতাজউদ্দীন বললেনঃ আচ্ছা, ভালো কথা, আমরা কিন্তু কি প্রচার
<005.025.522>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
করবো সেটা একটুও চিন্তাভাবনা করছি না। এক কাজ করা যাক আমি এখানেই নেমে পড়ি এক্সটেম্পোর (তাৎক্ষণিক) কিছু বলতে পারবেন এরকম দু-একজনকে সঙ্গে নিয়ে শিগগিরিই আগ্রাবাদ গিয়ে আপনাদের সঙ্গে মিলিত হচ্ছি।
সেদিন মমতাজউদ্দীন আর আমাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে পারেননি। এখন আমি আর মাহবুব হাসান- আমরা আগ্রাবাদ রোডে জেকস এর সামনে এসে জীপ ছেড়ে দিয়েছিলাম- গাড়ী আর যাবে না, এখানে ছিল ব্যারিকেড। হেঁটে জনশূন্য বেতার ভবনে পৌঁছেই মাহবুব হাসান কন্ট্রোল রুমের সূইচ অন করেছিলেন। এমন সময় টেলিফোন ট্রান্সমিটার থেকে প্রকৌশলী বন্ধুরা মাহবুব হাসানকে জানিয়েছিলেন তারা অনুষ্ঠান এয়ার’-এ দিতে পারবেন না। কেননা ইতিমধ্যেই তারা আঞ্চলিক প্রকৌশলির সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। তিনি সম্মতি দেননি- কাজেই তারা ট্রান্সমিটার ভবন ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। আমি টেলিফোন ধরলাম। বলেছিলাম আপনারা একটু অপেক্ষা করুন, আপনাদের দুই শর্তের একটি কর্যকারী হবে।
মাহাবুব হাসান আঞ্চলিক প্রকৌশলীর বাসার নম্বরে ডায়াল করে রিসিভার আমাকে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। আঞ্চলিক প্রকৌশলী ঠিক এ কথাটি বলেছিলেন। বেলাল সাহেব আমাকে কেন জড়াচ্ছেন। বেতার কেন্দ্রে আমি তো দু’নম্বর। আপনি বরং নাজমুল আলম সাহেবের পারমিশন নিন। দুপুর বেলা হান্নান সাহেব জোর করে নিয়ে গিয়ে আমাদের হাতে কাজ করালেন, তার জন্য কি যে বিপদ আসে, আমি সত্যি ভয় পাচ্ছি।
আমি বলছিলাম- আর ডি সাহেবের বাসায় তো টেলিফোন নেই, ওর সঙ্গে কি করে যোগাযোগ করবো। তিনি বললেনঃ আলম সাহেব এখন আর ডি কাহহার সাহেবের বাসায়। ওখানে টেলিফোন করুন।
ঠিক সে সময় আমার খোঁজে এনায়েতবাজার থেকে আবুল কাসেম সন্দ্বীপ ও আবদুল্লাহ আল ফারুক বেতার ভবনে এসে পৌছেছিলেন। জনাব কাহহারের বাসায় টেলিফোন করে আমি কাসেমকে কথা বলতে দিয়েছিলাম। নাজমুল আলম সাহেব ওখানে আছেন কিনা এটাই জেনে নিতে বলেছিলাম। ওদিক থেকে এই অনুসন্ধানের কারণ জানতে চাওয়া হলে কাসেম আমার কথা বলেছিলেন। স্বাভিকভাবেই রিসিভার আমার হাতে এসে গিয়েছিল।
নাজমুল আলমের সঙ্গে আলোচনা করে আবদুল কাহহার আমাকে যা বলেছিলেন, তা সংক্ষেপে, বেতার ভবন বন্দরে নোঙ্গর করা পাকিস্তনী যুদ্ধজাহাজ বাবর’ সোয়াত-এর শেলিং এর আওতায় যে কোন মুহুর্তে শত্রুকবলিত হতে পারে। উত্তম হবে কালুরঘাট ট্রান্সমিটারের ক্ষুদে ষ্টুডিওটি ব্যবহার করা- সেটি শহর থেকে বেশ দূরে- সে এলাকার পতন শীঘ্র হবার কারণ নেই। এ ছাড়া একযোগে দুটি ঘর রক্ষা করার জন্যে বাড়তি প্রস্তুতি অবশ্যক। ট্রন্সমিটার ভবনটি ব্রডকাষ্টিং পারপাস-এ স্বয়ংসম্পূর্ণ।
এবারে মাহবুব হাসান, আবুল কাসেম স্বন্দ্বীপ, আবদুল্লাহ আল ফারুক আর আমি কন্ট্রোল রুম থেকে বেড়িয়ে এসেছিলাম। গাড়ি বারান্দায় আমাদের একজন মহিলা ঘোষিকা- তিনি একজন ভদ্রলোককে দেখিযে বলেছিলেনঃ বেলাল ভাই, ইনি আমার চাচা ডাক্তার আনোয়ার- আওয়ামী লীগের একজন কর্মী।
ডাক্তার আনোয়ার বলেছিলেনঃ আচ্ছা আপনারা বেতার চালু কার কি প্রচার করবেন, ঠিক করেছেন?
আমি বলেছিলামঃ আগে চালু করার ব্যবস্থা করি, তারপর যা মুখে আসে বলবো। কথা তো সেই একটা, আমরা স্বধীন।
তিনি সাইক্লোষ্টাইল করা একটি ক্ষুদ্রকার ঘোষণাপত্র আমার হাতে দিয়ে বলেছিলেনঃ এটা দেখুন তো দুই বা তিন বাক্যবিশিষ্ট বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র। পড়েই আমি উল্লসিত হয়েছিলাম। বলেছিলামঃ ভালোই হলো এটা দিয়েই অধিবেশন শুরু করা হবে, আর এরই ভিত্তিতে প্রচার করা হবে সকল বক্তব্য।
<005.025.523>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
আমি টুকরো কাগজখানা পকেটে নিয়েছিলাম। তারপরই বেরিয়ে এসেছিলাম ডাক্তার আনোয়ারকে বিন্দুমাত্র সৌজন্য প্রদর্শন না করে।
জেকস-এর সামনে এসেই খেয়াল হয়েছিল আমাদের গাড়ী নেই। এখন উপায়! উদ্ধার করেছিলেন ডাক্তার আনোয়ার- তিনিও আমাদের সঙ্গে সঙ্গে এসে গিয়েছিলেন, সঙ্গে ঘোষিকা হোসনে আরা। ডাক্তার আনোয়ার বলেছিলেনঃ কালুরঘাট যাবেন তো আসুন আমার গাড়ীতে।
মাহবুব হাসানের মাথায় তখন অন্য চিন্তা।
ট্রান্সমিটার ভবনে অবস্থানরত প্রকৌশলী বন্ধুরা তো তাদের শর্ত পূরণ ছাড়া সহযোগিতা দেবেন না। দেখা যাক আঞ্চলিক প্রকৌশলীকে বাধ্য করে এখান থেকে একটা টেলিফোন করিয়ে দেয়া যায় কিনা। আমরা আগ্রাবাদ কলোনীতে আঞ্চলিক প্রকৌশলীর বাসায় গিয়েছিলাম- তিনি প্রথমে ক্ষমা চেয়ে পরে চাপে পড়ে বলেছিলেনঃ আচ্ছা, আমি টেলিফোনে বলে দিচ্ছি, আপনারা যান।
রাস্তায় ইতিমধ্যে কবি আবদুস সালাম আমাদের গাড়ীতে এসে উঠেছিলেন। বললেনঃ নাতী বেলাল, আমাকে তোদের সঙ্গে নিয়ে যা। আমি-এই-দেখ-একটা কথিকা লিখছি-দু’পাতা লেখা হয়ে গেছে, এটা প্রচার করবো। তুই দেখে দিস।
মাহবুব হাসান বলেছিলেনঃ দেখুন, আর-ই সাহেব আসলে, ট্রান্সমিটারে আদৌ ফোন করবেন না। এদিকে বিনা পারমিশনে ওঁরা দুজন কাজ করবেন না। আমি বরং এক কাজ করি- আমি স্টেশন রোডে আওয়ামী লীগ অফিসে যাই। কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবক নিয়েই এসে পড়বো। আপনারা এ গাড়ীতে যান।
মাহবুব হাসান আর আমাদের সংগে যোগদান করতে পারেননি- শুধু দু’দিন পরে একবার টেলিফোনে যোগাযোগ করেছিলেন।
কালুরঘাটগামী মোটর গাড়ীতে আমরা তখন ছ’জন- হোসনে আরা, ডাক্তার আনোয়ার, কবি আবদুস সালাম, কাসেম, ফারুক ও আমি ট্রান্সমিটার ভবনের গেটের কাছেই আমি একরকম লাফ দিয়ে গাড়ী থেকে নেমে পরেছিলাম। কেননা, দেখতে পেয়েছিলাম, প্রকৌশলী বন্ধু দু’জন ততোক্ষণে বেরিয়ে এসে রিকশায় উঠেছেন। রিকশা আগলে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলাম-বলেছিলামঃ আর-ই সাহেব পারমিশন দিয়েছেন (?) এবং স্বেচ্ছাসেবকরাও এসে পড়বেন মাহবুব হাসানের সংগে। আপনারা দয়া করে চলে যাবেন না।
ওরা বলেছিলেনঃ আর-ই সাহেবের সংগে আমাদের টেলিফোনে আলাপ হয়েছে, তিনি বলেছেন কিছু করলে নিজের দায়িত্বে করবেন। দেখুন, আমাদের চাকরি থাকবে না।
ডাক্তার আনোয়ার সমস্যাটি উপলব্ধি করেছিলেন এবং দ্বিতীয় ও শেষবাবের মতো পরম আনুকূল্য দিয়েছিলেন। তিনি কাছাকাছি কোনো গ্রামীণ অস্থায়ী ছাউনী থেকে কয়েকজন সশস্ত্র জোয়ানকে নিয়ে এসে সাময়িকভাবে ট্রান্সমিটারে মোতায়েন করার উপস্থিত ব্যবস্থা করেছিলেন- বাধ্যবাধকতার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। প্রকৌশলী বন্ধুদের দেয়া একটি শর্ত পূরণ করা গিয়েছিল।
কেন্দ্রের নাম ও প্রথম ঘোষণাপত্রটি আমি লিখেছিলাম ট্রান্সমিটার ভবনের অফিসকক্ষে বসে। এমন সময় টেলিফোন বেজে উঠেছিল। আমি ‘হ্যালো’ বলতেই ওদিক থেকে দ্রুত এবং চাপা কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিলঃ বেলাল সাহেব, দেরী করছেন কেন? এখন তো প্রায় সাড়ে সাতটা-যা পারেন প্রচার শুরু করুন। লোক এখন
<005.025.524>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
রেডিওর কাটা ঘোরাচ্ছে- আটটা বাজলেই কিন্তু আকাশবাণীর খবর শুনবে সবাই। আপনাদেরটা আর কেউ শুনবে না।
আমাদের বার্তা সম্পাদক সুলতানা আলী। করেছিলাম তিনি হয়তো ইতিমধ্যে আবদুল কাহহারের কাছ থেকে আমরা কথা জেনেছিলেন। সুলতানা আলী আমাকে প্রচারযোগ্য দুএকটি খবরও বলে দিয়েছিলেন।
হোসেন আরাকে আমি কণ্ঠ দিতে দিইনি- কেননা একটি গুপ্ত বেতার কেন্দ্রে আমাদের শ্রোতা সাধারণের জন্যে একটি মহিলাকষ্ঠের ঘোষণা বেমানান ঠেকাতে পারে বলে আমাদের ধারণা হয়েছিল। সেদিন অন্য একজন ঘোষক সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন এবং কণ্ঠ দিয়েছিলেন- সুলতানুল আলম। তবে ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র নাম ঘোষণটি সর্বপ্রথম আমার নির্বাচনক্রমে আবুল কাসেম সন্দ্বীপের কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল। আবদুল্লাহ-আল-ফারুক বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি পাঠ করেছিলেন। কবি আবদুস সালাম কথিকা প্রচার করেছিলেন।
অধিবেশন চলাকালেই এসে উপস্থিত হয়েছিলেন জনাব এম, এ হান্নান। তিনি তাঁর ভাষণের পূর্বাহ্নে নাম ঘোষণা করতে বলেছিলাম। আমি বলেছিলামঃ নাম ঘোষণা না করলেই ভালো হতো, কেননা আমরা শত্রু শ্রোতাদের কাছে যতটা সম্ভব নিজেদের অবস্থানকে দুর্জ্ঞেয় রাখতে চাই- সহজে যেন ওদের বোমাবর্ষণের টার্গেট নির্ণয় করতে না পারে। রাডারের সাহায্যে ওরা ঠিকই ধরে নেবে- তবে এক-দু’দিন অন্ততঃ তা বিলম্বিত হবে।
জনাব হান্নান দ্বিপ্রহরে স্বনামে ব্রডকাস্ট করার কথা বললে আমি বলেছিলামঃ তখন কেন্দ্রের নামকরণ হয়নি এবং অনুষ্ঠান প্রচারের ধারবাহিকতা পরিকল্পনা ছিল না।
আমার উদ্দেশ্য তিনি অনুধাবন করেছিলেন এবং নাম ঘোষণা ছাড়াই তার মূল্যবান ও সময়োপযোগী ভাষণ প্রচার করেছিলেন।
বেতার ভবন থেকে আমার একটি টেপ হাতে করে নিয়ে এসেছিলাম। তাতে অসহযোগ আন্দোলনের সময়ে রেকর্ডকৃত ও প্রচলিত গণসঙ্গীত এবং রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুরে গীটার বাদ্য ছিল- সেই টেপটিও এই অধিবেশনে বাজানো হয়েছিল।
আনুমানিক আধঘণ্টা স্থায়ী অধিবেশন শেষে বাইরে এসে আমরা ডাক্তার আনোয়ার ও তাঁর সৌজন্যে মোতায়েনকৃত জোয়ানদের কাউকে আর দেখতে পাইনি। জনাব হান্নানও তার ভাষণ প্রচারের পর চলে গিয়েছিলেন। প্রসঙ্গতঃ ডাক্তার আনোয়ারকে এরপর আর কোন দিনই বেতারকেন্দ্রে দেখতে পাইনি এবং হোসনে আরা পরবর্তীকালে পাকিস্তান বেতারে কাজ করেছিলেন।
আমি, কাসেম ও ফারুক পায়ে হেঁটে রাত সাড়ে দশটায় এনায়েতবাজারে ফিরে এসেছিলাম পথটি ছিল ৭/৮ মাইল। (অংশ)
-দৈনিক আজাদী, ২৬ মার্চ, বিশেষ সংখ্যা, ১৯৭
<005.025.525>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
৩.
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জন্মকথা
মেসবাহ আহমেদ
——- বাংলাদেশে ২৬শে মার্চের সূর্যোদয় হল রক্তস্নানের মধ্য দিয়ে। ইথারে ক্ষীণ কণ্ঠস্বর ভেসে এল “স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র”। ঐ সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শুনে মনে হয়েছিল এ একটি অল্প বিদ্যুৎ শক্তি সম্পন্ন কেন্দ্র। তখনো জানা যায়নি কে বা কারা এই অসমসাহসী যোদ্ধা যাদের উদ্যোগে বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের আশা-আকাংক্ষা ও সুখ-দুঃখ-কান্নার কথা প্রথম বাতাসে ধ্বনিত হল। অবশ্য পরে আমরা এদের সন্ধান পেয়েছি।
শত্রুসৈন্য চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র দখল করাবার পর এই বেতার কেন্দ্রের অন্যতম বেলাল মোহাম্মদের পরিচালনায় দশজনের একটি দল চট্টগ্রাম থেকে সরে গিয়ে কালুরঘাট এক কিলোওয়াট শক্তিসম্পন্ন ট্রান্সমিটার প্রথম স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান প্রচার করে। এই দলে ছিলেন রেডিও ইঞ্জিনিয়ার আবদুস সাকের, রাশেদুল হাসান, আমিনুর রহমান, রেজাউল করিম, শরফুজ্জামান, আবুল কাশেম সন্দ্বীপ, আবদুল্লা-আল-ফারুক, সুব্রত বড়ুয়া ও কাজী হাবিবউদ্দীন। কালুরঘাট পাকিস্তানী সৈন্যদের কবলে এলে পরে তাঁরা বাংলাদেশকে অন্য এক মুক্তাঞ্চল থেকে কিছুদিন অনুষ্ঠান প্রচার করেন।
২৫শে মার্চ রাজশাহী বেতার কেন্দ্রেও কয়েকজন বাঙালী কর্মী আটকা পড়েছিলেন। ২৮শে মার্চ রাজশাহী পুলিশ লাইনে পুলিশ বাহিনী ও ই-পি-আর বাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণে পাক ফৌজ রাজশাহী বেতার কেন্দ্রে পিছু হটতে বাধ্য হয়। একদিন একরাত পর্যন্ত কয়েকজন বেতারকর্মীকে একটি ষ্টুডিও মধ্যে আটকে রাখা হয়।
মুক্তাঞ্চল থেকে স্বাধীনতার অনুষ্ঠান প্রচারের উদ্দেশ্যে রাজশাহী বেতার কেন্দ্রের কয়েকজন নির্ভীক কর্মী জীবন বিপন্ন করে বেরিয়ে পড়েন বেতার ভবন থেকে। এই দলে ছিলেন অনুষ্ঠান সংগঠক মেসবাহ আহমেদ, অনুষ্ঠান সংগঠক আতাউর রহমান, অনুষ্ঠান প্রযোজক অনু ইসলাম, অনুষ্ঠান প্রযোজক শাহজালাল ফারুক এবং বার্তা সম্পাদক মোহাম্মদ মামুন।
রাজশাহী বেতারের এই কর্মীদল ২রা মে মুজিবনগরে পৌছান। দু’চারদিন পরের কথা। তখন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়েছে। ইতিমধ্যে রাজশাহী বেতারের অনুষ্ঠান সংগঠক শামছুল হুদা চৌধুরী এসে গেছেন। তাঁকে আমাদের মধ্যে পেয়ে আমরা আরো উৎসাহ পেলাম।
ঢাকা টেলিভিশনের মোস্তফা মনোয়ার এবং জামিল চৌধুরী, প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী কামরুল হাসান, বিশিষ্ট সাংবাদিক এম, আর, আখতার এবং চিত্রাভিনেতা হাসান ইমাম ও তখন মুজিবনগনে। বিশিষ্ট ছাত্রনেতা এবং শেখ সাহেবের প্রেস সেক্রেটারী আমিনুল হক বাদশার সংগেও দেখা হল।
আমরা সকলে মান্নান সাহবের সংগে দেখা করলাম
পর পর কয়েকদিন আলোচনা হল। মান্নান সাহেবের পরিচালনায় উচ্চ বিদ্যুৎ শক্তি সম্পন্ন ট্রান্সমিটারযোগে স্বাধীন বাংলা বেতারের অনুষ্ঠান প্রচারের কয়েকটি খসড়া পরিকল্পনা প্রণীত হয়।
ইতিমধ্যে ট্রান্সমিটার সংগ্রহের কাজও শুরু হয়ে গেছে। অনুষ্ঠান প্রচারের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র কেনার জন্য ১৪ই মে মান্নান সাহেব আমাদের শ দুই টাকা দিয়েছিলেন।
আমি, শামসুল হুদা চৌধুরী এবং ঢাকার পাইওনিয়ার প্রেসের মালিক এম, এ মোহাইমেন এম-পি-এ ঐদিনই প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র ক্রয় করি।
<005.025.526>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
দু-তিনদিন ধরে আমরা প্রপোজল রেজিষ্টার, কন্ট্রাক্ট রেজিষ্টার, কন্ট্রাক্ট ফরম, আর্টিষ্ট রেজিষ্টার ইত্যাদি তৈরি করি। এবস কাজে অনু ইসলাম আমাদের যথেষ্ট সহযোগিতা করেণ, যদিও তিনি তখন ‘জয়বাংলা’ পত্রিকায় কাজ করতেন।
এগিয়ে এল চরম মুহুর্ত। মান্নান সাহেবের প্রচেষ্টায় পঞ্চাশ কিলোয়াট শক্তিসম্পন্ন ট্রান্সমিটার পাওয়া গেল। ঠিক ঐ মুহুর্তে ঢাকা বেতারের সেই নির্ভীক তিন কর্মী আশফাকুর রহমান, তাহের সুলতান এবং টি, এইচ শিকদার মুজিবনগরে এসে পৌছেন। তারা এসেই এম-এন-এ তাহের উদ্দীন ঠাকুর এবং আমিনুল হক বাদশার সংগে দেখা করেন। তাদের সংগে ঢাকা থেকে আনীত কিছু মূল্যবান গানের টেপও ছিল।
২৫শে মে, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের জীবনে বিশেষ করে বাংলাদেশের বেতারকর্মীদের জবিনে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। ঐদিনই বাংলাদেশের মানুষের আশা-আকাংক্ষা ও দুঃখ-কান্নার শব্দ ধ্বনিত হয় বাতাসে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র নামে বাংলাদেশের প্রথম আনুষ্ঠানিক বেতার প্রচারে শুরু হল।
কয়েকদিন আবাসিক বাড়ীর সীমাবদ্ধ পরিবেশে ছোট একটি ঘরকে ষ্টুডিও করে প্রথম অনুষ্ঠান প্রচার শুরু হয়। প্রথম কিছুদিন প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার নিদারুণ অসুবিধার মধ্যেও অনুষ্ঠান প্রচার করতে হয়েছে। পরবর্তীকালে আমরা সে সমস্ত অসুবিধা অনেকটা কাটিয়ে উঠেছিলাম। ষ্টুডিও অভাব, পর্যাপ্ত রেকর্ডিং সুবিধার অভাব এবং শিল্পী-সাহিত্যেকের ও কথকের অভাবের মধ্যে প্রথম দু’তিন মাস যে কি কষ্টে আমরা অনুষ্ঠান চালিয়েছি তা আজ লিখে শেষ করা যাবে না। ইতিমধ্যে চট্টগ্রাম বেতারের সেই দশজনের দলটিও এসে কাজে যোগ দিয়েছেন।
প্রথম দিকের ঝক্কি খানিকটা কাটিয়ে ওঠার পর অনুষ্ঠান সম্পর্কে সংহত পরিকল্পনা গ্রহণ করা হল। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সমগ্র দায়িত্ব ছিল তথ্য ও বেতার দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত এম-এন-এ আবদুল মান্নানের উপর ন্যস্ত।
কিছুদিনের জন্য সেক্রেটারী পর্যায়ে প্রতিরক্ষা দপ্তরের সচিব আবদুস সামাদও অনুষ্ঠান সম্পর্কে আমাদেরকে পরামর্শ দিতেন।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ভেতর অনুষ্ঠান সংগঠন এবং কেন্দ্রের প্রশাসনিক পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন আমাদের সিনিয়র পোগ্রাম অর্গানাইজার শামসুল হুদা চৌধুরী।
সমগ্র অনুষ্ঠানের সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করেছেন আশফাকুর রহমান।
পরবর্তীকালে তথ্য ও বেতার সচিব হিসেবে আনোয়ারুল হক খান আমাদের বিভিন্ন কার্যক্রম তত্ত্বাবধান করেছেন।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান বিভাগে নিয়মিত কর্মী হিসাবে যাঁরা কাজ করেছেন তাঁরা হলেনঃ শামসুল হুদা চৌধুরী, আশফাকুর রহমান, মেসবাহ আহমেদ, বেলাল মোহাম্মদ, তাহের সুলতানা, টি এইচ শামসুদ্দিন আহমেদ, মঞ্জুর কাদের (বাবুল আখতার), আবু ইউনুস প্রমুখ কর্মী।
<005.025.527>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে কাজ করেছেন আবদুস সাকের, রাশেদুল হাসান, আমিনুর রহমান, রেজাউল করিম, মইনুল হক, প্রণব রায়, মোহাম্মদ মহসিন ও শরফুজ্জামান।
যাদের নিরলস প্রচেষ্টায় সংবাদ বিভাগ সমৃদ্ধ হয়েছে তারা হচ্ছেন কামাল লোহানী, মোহাম্মদ মামুন, সুব্রত বড়ুয়া, মৃণালকৃষ্ণ রায়, আবুল কাশেম সন্দ্বীপ, নূরুল ইসলাম সরকার, আলী রেজা চৌধুরী, পারভীন হোসেন, জাহেদ সিদ্দিকী, শহীদুল হক ও জারিন আহমেদ।
ড্রামা প্রডিউসার ছিলেন রণেন কুশারী ও হাসান ইমাম। ইংরেজী অনুষ্ঠান প্রচারে ছিলেন আলমগীর কবীর ও আলী যাকের।
যেসব শিল্পী, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবী অনুষ্ঠান সমৃদ্ধির জন্য সহযোগিতার হস্ত প্রসারিত করেছেন, তাদের মধ্যে ডক্টর এ, আর, মল্লিক, সৈয়দ আলী আহসান, ডক্টর মাযহারুল ইসলাম, ডক্টর আনিসুজ্জামান, শওকত ওসমান, গাজীউল হক, আবদুল গাফফার চৌধুরী, রণেশ দাশগুপ্ত, সিকান্দার আবু জাফর, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, কল্যাণ মিত্র, নারায়ণ ঘোষ, সুভাষ দত্ত, জহির রায়হান, সুমিতা দেবী, মাধুরী চট্টোপাধ্যায়, বুলবন ওসমান, আসাদ চৌধুরী, আনু ইসলাম, প্রণব চৌধুরী, রাজু আহমেদ, নুরন্নাহার মযহার, আইভি ঘোষ, আপেল মাহমুদ, স্বপ্না রায়, অনুপ কুমার ভট্টাচার্য, রফিকুল আলম প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
স্বাধীন বাংলা বেতারের কর্মী বলে নয়, একজন সাধারণ শ্রোতা হিসেবে বলতে পারি, এই কেন্দ্র থেকে গত নয় মাসে প্রচারিত প্রায় সব অনুষ্ঠানই উন্নতমানের হয়েছে। বিশেষ করে চরমপত্র’, ‘অগ্নিশিখা, “জল্লাদের দরবার’, ‘পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে’, ‘পুতুলনাচের খেল অনুষ্ঠানসমূহ সবচেয়ে বেশী জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে বলে আমার বিশ্বাস। বিশিষ্ট সাংবাদিক এম আর আখাতার চরমপত্র অনুষ্ঠানের লেখক ও প্রচারক। “জল্লাদের দরবার লিখতেন প্রখ্যাত নাট্যকার কল্যাণ মিত্র। জল্লাদ, দুর্মুখ, নবাবজাদা, টিটিয়া খান, পিয়জী খান, গর্ভণর এবং বেগমের ভূমিকায় অভিনয় করতেন যথাক্রমে চিত্রাভিনেতা রাজু আহমেদ, চিত্র পরিচালক নারায়ণ ঘোষ, প্রসেনজিৎ আজমল হুদা মিঠু, ফিরোজ ইফতিখার, জহিরুল হক ও বুলবুল মহলানবীশ। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিশেষ অনুষ্ঠানের পরিচালক ছিলেন আশরাফুল আলম। ইসলামের দৃষ্টিতে অনুষ্ঠান প্রচার করে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যক সৈয়দ আলী আহসান আমাদের অনুষ্ঠানে শ্রীবৃদ্ধি করেছেন।
পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে এবং ‘পুতুলনাচের খেল’ লিখতেন যথাক্রমে ফয়েজ আহমদ ও আবদুল গাফফার চৌধুরী।
গণসঙ্গীত ও দেশাত্মবোধক গানের সুর সংযোজনা এবং কণ্ঠদানে কয়েকজনের নাম বিশেষভাবে স্মরণ করেত হয়। তাঁরা হচ্ছেন- তাহের সুলতান, সমর দাশ, মোহাম্মদ আবদুল জব্বার, আপেল মাহমুদ, মান্না হক, কল্যাণী ঘোষ, সুজেয় শ্যাম, অজিত রায়, রফিকুল আলম, অনুপ ভূট্টাচার্য, হরলাল রায়, রথীন রায়, প্রমুখ শিল্পী।
(অংশ)
-‘জয়বাংলা/বিশেষ সংখ্যা, ১৯৭২
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র সম্পর্কে আরও তথ্য পাওয়া যাবে শামসুল হুদা চৌধুরীর একাত্তরের রণাঙ্গন গ্রন্থে।
.
.
<005.026.528>
শিরোনা্ম | সূত্র | তারিখ |
২৬। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান প্রচার সম্পর্কিত একটি সভার কার্যবিবরনী |
‘বেতার বাংলা’ ডিসেম্বর,১৯৭৮ |
১০ অক্টবর, ১৯৭১ |
যুদ্ধের কার্যকলাপের সপক্ষে প্রচারনা এবং প্রজ্ঞাপনের সমন্বয়ের ওপর সভার কার্যবিবরনীর সারাংশ।
১০-১০-১৯৭১ তারিখে অনুষ্ঠিত
উপস্থিত সদস্যগণঃ
১. এ. সামাদ, সেক্রেটারী, প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয়
২. ড. বি. হোসেন
৩. জনাব আলমগীর কবির
৪. জনাব শামসুল হুদা চৌধুরী
৫. জনাব কামাল লোহানী
৬. জনাব এ. রাহমান
৭. জনাব বি. মাহমুদ
গত সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তের কার্য অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা করা হয়। বাংলাদেশ রেডিওর সদস্যগণ নিশ্চিত করেছেন যে, তারা ইতোমধ্যে আলোচিত ধারা অনুযায়ী কাজ করছেন এবং ১৫-১০-৭১ তারিখের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি লক্ষ্য করা যাবে।
সেখানে রেডিও প্রোগ্রামের উন্নতিতে অবদান রাখবে এমন বিষয় নিয়েও আলোচনা করা হয়।
সিদ্ধান্ত সমুহঃ
১. অবিলম্বে রেডিও বিল্ডিংয়ে একটি অফিস স্থাপন করা হবে এবং সকল প্রাতিষ্ঠানিক কার্যাবলি সেখানে হবে।
২. সংবাদের গঠন পদ্ধতি পরিবর্তন করা হবে এবং ইংরেজি, বাংলা ও উর্দু বুলেটিনের পাঠ্যাংশও একই থাকবে।কাজের চাপ বিবেচনায় জনাব এ. কাবু রাতের বুলেটিন তৈরী করবেন এবং জনাব ক. লোহানী সকাল ও বিকালের বুলেটিন তৈরী করবেন।
৩.রেডিওতে অবিলম্বে একটি টাইপ রাইটিং মেশিন, দুইটি বহনযোগ্য টেপ রেকর্ডার এবং একটি ক্যাসেট টেপ রেকর্ডার সরবরাহ করা হবে।
৪. যেহেতু বর্তমানে কোন যাতায়াতের ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না, বহির সম্প্রচার বিভাগের কর্মচারীরা প্রায়শই নিজ খরচে প্রদত্ত কর্মক্ষেত্রে যাবেন।
৫। দেশাত্ববোধক গানের উপর নির্ভরতা কমিয়ে আনা উচিত এবং এর জায়গায় সমর সঙ্গীত ও বাদ্যের প্রবর্তন করতে হবে।
৬। অবিলম্বে আগরতলা থেকে মাইক্রোফোন আনার ব্যাবস্থা করা উচিত
৭। ১৫.১০.১৯৭১ থেকে নিরপত্তা ব্যাবস্থা আরো জোরদার করা হবে, এর মধ্যে যেখানে প্রয়োজন সেসব জায়গায় আইডি কার্ড ইস্যু করতে হবে।
৮। চিত্রনাট্য রচয়িতা এবং বক্তাদের পারিশ্রমিক অবশ্যই নিয়মিত ভাবে প্রদান করতে হবে।
৯। এম এন এ- এর ইনচার্জ এম এ মান্নানের সাথে আলোচনা করে অবিলম্বে ট্যালেন্ট নিয়ে একটি প্যানেল চূড়ান্ত করতে হবে।
১০। পর্যাপ্ত অগ্রীম সময় ( কমপক্ষে ৪দিন) নিয়ে ৭ দিনের জন্য অনুষ্ঠানমালা একবারে করতে হবে, অনুষ্ঠান সাজানোর দায়িত্ব নিজ নিজ অনুষ্ঠান সংগঠক/ বিভাগীয় প্রধানের উপর থাকবে।
১১। পাকি-পত্রিকা থেকে তথ্য নিয়ে পালটা প্রচারণা বিভাগের ব্যাবস্থাপনায় থাকবেন সচিব মহোদয়।
এসডি /এ সামাদ
সেক্রেটারী
প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয়
মেমো নং D-003/76(8)
১। এম এন এ ইনচার্জ, অথ্য ও তথ্য সম্প্রচারক এম এম মান্নান কে প্রতিলিপি পাঠানো
২। জনাব সামসুল হুদা চৌধুরী, স্বাধীন বাংলার বেতার তথ্য সচিব ।