You dont have javascript enabled! Please enable it! স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান ০৩ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র - সংগ্রামের নোটবুক

 

শিরোনাম সূত্র তারিখ

১৩। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত

সাহিত্যানুষ্ঠান থেকে

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের

দলিলপত্র

….. ১৯৭১

বিপন্ন যখন

…অক্টোবর, ১৯৭১

এই অন্ধকার, নিটোল নিশছিদ্র অন্ধকার, অন্তহীন হোক- সে প্রার্থনা করল মনে মনে। আর সেই সুতীব্র অন্ধকারের কামনার সাথে অসাড় হয়ে যাওয়া চেতনা ফিরে আসে নিঃশব্দে, এবং যখন নিজেকে সে আবিষ্কার করল কচুরিপানার ভরা জলাশয়টির এক প্রান্তে। এক গলা জলের মধ্যে মাথায় কচুরিপানা চাপিয়ে কতক্ষণ লুকিয়ে রয়েছে তার নিজেরই মনে নেই। আমার মা, বউ, চার বছর বয়সের ফুটফুটে ছেলেটি- কেউ বেঁচে নেই, নৈঃশব্দের হু-হু ধূসর পটভূমিতে এই সব মনে এল এখন। ছোট ছোট মাছ অথবা জলের পোকা ক্রমাগত তার শরীরের অনাবৃত অংশ ছুয়ে ছুয়ে যাচ্ছে একটি তীব্র অনুভূতি, সে ঠিক জানে না তা কি, তার সমস্ত শরীরে ওঠানামা করছে। আস্তে করে কচুরিপানা সরিয়ে সে মাথা তুলল এবং একটি আহত জন্তুর মত ভীত দৃষ্টিতে তাকাল চারপাশে কিছুই চোখে পড়ছে না। অন্ধকার, তার চারপাশে এখন মৃত্যুর মত শীতল অন্ধকার।

এবার উঠি, সে ভাবল এবং অশক্ত পায়ে দাঁড়াতে চেষ্টা করল। যেহেতু ক্লান্তিতে এখন শরীর ভেঙ্গে পড়ছে, তার পদক্ষেপ সংক্ষিপ্ত এবং এলোমেলো।

জলাশয় পেরিয়ে মাঠ, তার পর আম-জাম-কাঁঠালের বাগান। তারপর, কি আশ্চর্য, তেঁতুল গাছের পেছনে উকি মারে মৃত্যুশয্যার বিবর্ণ স্নান চাঁদ। দু’এক পা এগোতে এই প্রথম স্পষ্ট বুঝতে পারল ক্ষিধে পেয়েছে তার, এক্ষুনি কিছু খেতে না পেলে সে বোধ হয় মরে যাবে। সতর্ক চোখে তাকায় চারিদিক, কোন বাসগৃহ চোখে পড়ে না- কোন নিকানো আঙিনা বা অস্পষ্ট কোন আলো রেখা। এ গাঁয়ে বোধ হয় কেউ বেঁচে নেই। আখের ক্ষেতের আশেপাশে লুকিয়ে নেই কোন সতর্ক প্রহরা। সে ভাবলো এবং হুমড়ি খেয়ে পড়ল ফলন্ত ক্ষেতের কিনারে। আশ্চর্য ক্ষিপ্রতায় কয়েকটি আখ ভেঙ্গে নিয়ে একটিতে কামড় বসাল।

এখন সে একটার পর একটা আখ চিবিয়ে চলছে। শক্ত খোসায় লেগে একপাশ কেটে গিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে, সেদিকে খেয়াল নেই। আখের খোসা ছাড়ান খণ্ডগুলো দাঁতে পিষতে অল্প মিষ্টি অথচ নোনতা তরল পদার্থে মুখের ভেতটা ভরে উঠছে। এখনো পাকেনি, পাক ধরতে সেই আশ্বিন মাস, পুজোর সময়। আর বোধ হয় আমার ক্ষিধে নেই, সে ভাবল এবং আখ চিবানো বন্ধ করল। মাথা ঝিম ঝিম করছে, সমস্ত শরীরে অসহ্য ক্লান্তি এবং ক্রমশ ভারী হয়ে আসা চোখের পাতার সামনে মূর্ত হয়ে ওঠে অজস্র দৃশ্যাবলী। না, ঘুম আসবে না এখন- কারণ সেই বীভৎস দৃশ্যটি এখনো তার চেতনায় অনির্বাণ। ঘাসের উপর শরীরটা ছেড়ে দিতেই স্মৃতিরা ফিরে এল দ্রুত লয়ে, প্রপাতের মত- তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় অতীতের সেই নির্দয় মুহুর্তটির নৈকট্যে।

আমার নাম জীবন, জীবন দাস- তার মনে পড়ল। মনে পড়ল বিধবা মাকে, জোয়ান বউ সরমাকে, আর চার বছরের ফুটফুটে বাবুকে। গত পরশু সকালে ওরা বেঁচে ছিল, সুস্থ ছিল, প্রাণবন্ত ছিল। অথচ, কি আশ্চর্য, ওরা এখন নেই। হিংসার জানোয়ারগুলো নিরস্ত্র নিষ্পাপদের গুলি করে মেরেছে। আর আমি, উনত্রিশ

<005.013.298>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

বছরের ক্লীব, অক্ষম যুবক আমি, মা ছেলে- বৌকে ঘাতকের হাতে ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে এসেছি নিজের মহামূল্য প্রাণটি বাঁচাতে- একথা ভাবতে চোখের জলে ঝপসা হয়ে এল তার সামনের দৃশ্যাবলী।

এখন, এই বিষগ্ন রাতে, তার মনে পড়ল কয়েকদিন আগের একটি অনিশ্চয় রাত্রিকে।

        : আমার বড় ভাবনা হচ্ছে। অন্তরঙ্গ শয্যায় সরমা বলেছিল তাকে।

তা ভাবনা হবারই কথা। যদিও শহর থেকে যাত্রী বোঝাই লঞ্চের আসা যাওয়া হঠাৎ করেই বন্ধ হয়েছে বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই। বাতাসে ভেসে ভেসে অনেক মন-কেমন-করা গুজব ছড়িয়ে পড়ছিল দক্ষিণ খুলনার সুদূর নিস্তরঙ্গ এই গ্রামটিতেও। একটা প্রচণ্ড লড়াই শুরু হয়েছে নাকি পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসা মিলিটারি আর বাংলাদেশের শহর গঞ্জে বাস করা মানুষগুলোর মধ্যে। কারণটা কি, ওরা সঠিক জানে না কেউ- কেবল গ্রামের একমাত্র কলেজে পড়া ছেলে রফিকের কথাবার্তা থেকে একটা ধোঁয়াটে উপলব্ধির প্রান্তসীমায় পৌঁছেছে ওরা। হাতে টাকা নেই, মাঠে ফসল ফলে না, অনাবৃষ্টি বন্যা অনাহার, দুঃস্বপ্নের অনাবাদী বছরে নিষ্ঠুর দারিদ্র্য দাওয়ায় উঠে বসে পাওনাদারের মত- এ সবকিছুই নাকি পশ্চিম পাকিস্তানের কর্তাদের ষড়যন্ত্রের ফল। যে বিপুল ষড়যন্ত্রে বিরান হয়ে যায় উর্বর, বর্ধিষ্ণু জনপদ- ফলবতী হয়ে ওঠে আজন্মের অনুর্বর মরুভূমিও। বছরের পর বছর অত্যাচার, অনাচার আর শোষণের অবসান ঘটাতে এই জীবনান্ত যুদ্ধ। আর এ যুদ্ধে আমরা বাংলাদেশের সংগ্রামী মানুষ জিতবই- রফিকের কণ্ঠে বলিষ্ঠ প্রত্যয় ঝলমল করে।

: আমার বড্ড ভাবনা হচ্ছে। সরমা আবার পুনরাবৃত্তি করে।

ভাবনা আবার কিসের? সরমাকে নয়, যেন নিজেকেই সান্তনা দিতে চেয়েছে জীবন শহরে নাকি তুমুল কাণ্ড হচ্ছে। ক্ষ্যাপা কুকুরীর মত হয়ে গেছে মিলিটারী। মানুষ পেলেই গুলি। কোন বাছবিচার নেই। সরমার গলায় উদ্বেগ স্পষ্টতর হয়ে ওঠে।

: তা শহরে যাই হোক গাঁয়ে তার কি? আমাদের এখানে ত আর যুদ্ধ হচ্ছে না। জীবন সান্তনা দিতে চেয়েছে।

: কিন্তু যদি হয়?

: পাগল! এই অজপাড়াগাঁয়ে মিলিটারী আসপে মরতি? আর কার সঙ্গে যুদ্ধ করবে এখেনে?

সব আশঙ্কাকে জোর করে সরিয়ে পাল্টা এক প্রত্যয়ের প্রশ্নকে বউয়ের দিকে ছুড়ে দিয়েছে জীবন। চুপ করে গেছে সরমা।

গত পরশুর ভয়ঙ্কর সকালের কথা মনে পড়ল এখন। যথারীতি সূর্য উঠেছিল, নদী থেকে এলোমেলো হাওয়া উঠে এসে গ্রামের গাছপালা, বাড়িঘর, মানুষগুলোকে ছুয়ে যাচ্ছিল। সেই প্রশান্ত সকালে আকাশে অনেক সঞ্চারণশীল মেঘ চোখে পাড়েছিল এবং স্পষ্ট মনে আছে জীবনের, বাড়ির পাশের গাছপালা থেকে যথারীতি পাখিদের ডাকাডাকি শুনেছিল ঘুম থেকে উঠেই।

মুখ-হাত ধুয়ে, দু’মুঠো পান্তা খেয়ে, রোজকারের মত রফিকদের বাড়িতে হাজির হয়েছিল। এই আসাটা প্রায় একটি অভ্যেসে পরিণত হয়ে পড়েছিল বেশ কিছুদিন থেকেই- কর্যত শহরে গণ্ডগোল শুরু হবার পর থেকেই। কেবল জীবন নয়, গ্রামের অনেকেই রফিকদের বাড়িতে ভিড় করত রেডিওর খবর শুনতে।

রফিকদের বাড়িতে পৌছে জীবন শুনতে পেল রেডিওতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের খবর হচ্ছে এবং তার চারপাশে ছোটখাটো একটি উৎসুক জনতা। খান সেনারা মার খাচ্ছে। ক্রমাগত জিতে চলছে মুক্তিবাহিনী,

<005.013.299>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

এক রণাঙ্গন থেকে অন্য রণাঙ্গনে। শিগগির বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হবে, রফিকের দৃপ্ত ঘোষণা ভোর বেলাকার এক মিষ্টি স্বপ্লের আমেজ বয়ে আনে যেনবা।

বেলা একটু বাড়তে দূর থেকে অবিরত এক যান্ত্রিক আওয়াজ স্পষ্টতর হয়ে ওঠে। লঞ্চের শব্দ অথবা কোন ষ্টীমারের প্রত্যাশায় ব্যগ্র গ্রামবাসীরা ভাবে। অনেকগুলো জিজ্ঞাসা পাক খায়ঃ যুদ্ধ কি শেষ হয়ে গেল তবে? হেরে গেছে খান সেনাদের দল? সেই শুভ ঘোষণা করতে আসছে বিজয়ী মুক্তিসেনারা?

দুপুরের দিকে তারা এল এবং ঝাঁপিয়ে পড়ল ঘুমিয়ে থাকা পাখির মত অসহায় গ্রামটির ওপর। গানবোট থেকে দূরপাল্লার কামানের শব্দ জেগে উঠতেই আগন্তকের পরিচয় গোপন থাকেনি। গ্রামবাসী প্রথমে হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছে। এ রকম একটি ভয়াবহ সম্ভাবনার কথা ওদের কল্পনাতেও অনুপস্থিত ছিল। এখন, এই নির্দয় দুপুরে, অকস্মাৎ তাকে শরীরী হয়ে উঠতে দেখে বৃষ্টির মত আতঙ্ক নামে এবং তা গড়িয়ে গড়িয়ে যায় গ্রামের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে।

গানবোটের কামানের শব্দ শুনেই দৌড়ে বাড়ি ফিরেছে জীবন। ওদের বাঁচাতে হবে- আমার বৃদ্ধা মা, স্ত্রী আর সন্তানকে। এই একটিমাত্র চিন্তায় সে একাগ্র এখন।

দাওয়ায় বসে মা চীৎকার করে কাঁদছে, সরমার মুখ মৃতের মত ফ্যাকাসে, ছোট্ট বাবু অবাক হয়ে চেয়ে আছে- বাড়িতে পা দিতে তার সামনের দৃশ্যপটটি ছিল এই রকম।

-চল, পালাতি হবে। মিলিটারী।

কথা নয়, যেন কাঁদছে জীবন।

-না মা, কিছছু নিতে হবে না। খালি হাতে চল। শিগগির।

মা-বউ-ছেলেকে নিয়ে দ্রুত ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিল জীবন। এখন, এই অভাবনীয় সংকটকালে, মৃত্যু যখন একটু ওপাশে ছা করে দাঁড়িয়ে, একটি নিশ্চিন্ত নির্ভাবনার আশ্রয়ের বড় প্রয়োজন।

অথচ সেই নিশ্চিন্ততার আশ্রয় ওদের জোটেনি। রাস্তার মোড়ে সৈন্যের পোশাক পরে মৃত্যু ওদের অপেক্ষায় ওঁৎ পেতে বসে ছিল। যমদূতগুলোর মুখোমুখি হতে আর্ত চিৎকার করে উঠেছে মা, গলা ছেড়ে কেদে উঠেছে সরমা, আর সেই সাথে ওদের হাতের মেশিনগানগুলো সক্রিয় হয়ে উঠেছে। চোখের সামনে লুটিয়ে পড়েছে মা, সরমা আর বাবু অথচ, কি আশ্চর্য, জীবনের চুল ছুয়ে বেরিয়ে যায় এক ঝাঁক গুলি এবং সেই সাথে রাস্তার পাশের আগাছা ভর্তি খানার মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল সে অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতায়। দ্রুত ঘন ঝোপের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে ফেলে শুনতে পেল বাবুর গোঙানি, ভারী ভারী বুটের আওয়াজ, বিজাতীয় ভাষার বীভৎস উল্লাসধ্বনি, সহসা কোন নারীকণ্ঠের আর্তনাদ উচ্চগ্রামে উঠে হারিয়ে যায় নিঃশব্দে। গুলির শব্দ থেমে যেতে এবং বুটের আওয়াজ ক্রমশ অপসৃয়মান মনে হতে, হামাগুড়ি দিয়ে বাইরে এসেছে জীবন রাস্তায় তার চোখের সামনে পাশাপাশি এলোমেলো শুয়ে তার জননী, তার জায়া, তার একমাত্র সন্তান, ওরা মরে গেছেএই নির্মম সত্যটি উপলব্ধির পরও চোখে জল এল না তার।

অনেকক্ষণ বিরতির পর আবার খুব কাছাকাছি শোনা গেল গুলির আওয়াজ এবং আর্তচীৎকার। জীবন আর দেরী করেনি। ঝোপের মধ্যে গা-ঢাকা দিয়ে আবার মড়ার মত পড়ে রয়েছে। এই মৃত্যুপুরী থেকে, এই নরককুণ্ড থেকে আমি পালিয়ে যেতে চাই, তার লুপ্তপ্রায় চেতনায় তখন একটিমাত্র সিদ্ধান্ত।

<005.013.300>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

দূর গাঁয়ের এই পরিত্যক্ত জলাশয়ে সে লুকিয়ে থেকেছে সারাটা দিন এবং সমস্ত সন্ধ্যে। কারণ, গানবোটের আওয়াজ মনে হয়েছে কখনো দূরে, আবার কখনও খুব কাছে। রাইফেল, মেশিনগানের আওয়াজ ভেসে এসেছে অনেক বার।

এখন, এই বিবর্ণ শেষরাতে ঘাসের ওপর শুয়ে আছে মানুষটি, যার নাম জীবন, আর যার জীবন এক অন্তহীন অর্থহীন যন্ত্রণার উপাখ্যানে পরিণত। সব হারিয়েও আমি এক অন্ধকারের জন্তুর মত পালিয়ে বেড়াচ্ছি, আমার বিষে নীল হয়ে যাওয়া পদ্মপাতার জীবনকে বাঁচাতে এ কি এক হাস্যকর প্রহসন,এলোমেলো ভাবনারা ঘুরেফিরে আসে।

এই মুহুর্তে, নিজের ওপর প্রচণ্ড ঘৃণাবোধ হতে লোকটি আবিস্কার করে- আজন্মের অন্তরঙ্গ মৃত্যুভয় অকস্মাৎ অপসারিত। তার এখন মরতে কোন ভয় নেই, ভয় নেই সেই সব হিংস্র ঘাতকদের মুখোমুখি দাঁড়াতে। আমি প্রতিশোধ নিতে চাই, সারা শরীরে মাখতে চাই আমার সন্তান-হত্যার রক্ত, একটি অমোঘ প্রতিজ্ঞা ক্রমশ ওকে জড়িয়ে ধরছে নিবিড় করে। অতএব, আমি ফিরে যাব। একটি আশ্চর্য সিদ্ধান্তে নিজেই অবাক হল জীবন।

এখন, ভোররাতের আবছা অন্ধকার গায়ে মেখে, একটি মাত্ৰ কামনা করে হঠাৎ ঋজু হয়ে বসা মানুষটিঅস্ত্র চাই, একটি অমোঘ শাণিত অস্ত্র, যা দিয়ে নিষ্ঠুর আঘাত হানতে পারি আমার সর্বস্ব কেড়ে নেওয়া হার্মাদদের ওপর।

হঠাৎ জীবনের স্মৃতিতে তার ফেলে আসা বাড়িটি একটি ছায়াছবির দৃশ্য হয়ে ভেসে ওঠে। শোবার ঘর, রান্নাঘর, উঠোন। তারপর ধানের গোলার নীচে এসে থমকে দাঁড়ায় যেন ক্যামেরার চোখ। ওই তো স্পষ্ট চোখে পড়ছে- তীক্ষ্ণধার অস্ত্রটিকে, বিকেলের সূর্যালোক তার অবয়বে প্রতিফলিত।

ফেলে আসা বাড়িটি এক দুর্বার আকর্ষণে ডাকছে জীবনকে। চুম্বকের মত আকর্ষণ করছে গোলার নীচে কাটপাতার তলে লুকিয়ে রাখা হঠাৎ বিপদের অবলম্বন সেই চকচকে ফলার বর্শাটি।

আমি এখন বাড়ি যাব। শেষরাতের হালকা অন্ধকারের মধ্য দিয়ে হেঁটে হেঁটে বাড়ি যাব- বিড় বিড় করে নিজেকে শোনায় জীবন। আর তখন সে স্পষ্ট শুনতে পেল- একটি চার বছরের কচি ছেলে তার কানের কাছে ফিস ফিস করে বলছে, শোধ নেবে না বাবা?

উঠে দাঁড়ায় জীবন। শোধ নেবে সে।

সব মৃত্যুর প্রতিশোধ।

(অসিত রায় চৌধুরী রচিত)

আজকের বাংলায়

১৬ অক্টোবর, ১৯৭১

ঘাট থেকে ফিরে এলো গোলাপজান। তার কোলের বাচ্চাটার নোংরা কাপড়-চোপড় ধুয়ে নিয়ে উঠোনে সেগুলো একটা বাঁশের ওপর মেলে দিতে দিতে সে লক্ষ্য করলো- কলিমুদ্দিন তার ফেরীতে যাবার সরঞ্জামগুলো

<005.013.301>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

সাজিয়ে নিচ্ছে। গোলাপজান ত্রস্তে একবার ঘরের ভেতরটা দেখে নিল। মেঝেতে তখনও অঘোরে ঘুমুচ্ছে তার বছর পাঁচেকের ছেলেটা। ওকে নিয়ে ঠিক এই মুহুর্তে গোলাপজানের এতো ভীতি। গতকাল রাতে যখন ওর সামনে একটা আধপোড়া শুকনো রুটি ও খেতে দিয়েছিল, তখন ছেলেটা কিছুতেই তা গিলতে চায়নি। ওর একমাত্র জেদ ভাতই খাবে আর কিছু নয়। শেষ পর্যন্ত গোলাপজান সকালেই ভাত রেধে দেবে বলে বহু সাধ্যসাধনা করে রুটিটা খাইয়েছিল। এখন, যদি ও উঠেই জেদ ধরে এই আশংকায় যতোক্ষণ কলিমুদ্দিন ঘরের ভেতর ছিল, গোলাপজান ওর সাথে কথা বলেনি। বারান্দায় আসতেই ও স্বামীর উদ্দেশে বলে উঠল-

আইজ তুমার ফেরীতে জাওনের কাম নাইক্যা।’

‘ক্যান, কি অইছে, ঘরেত চাউল নাই, খাওনের কিছু নাই, এডডা পয়সাও নাই, হে খেয়াল আছে? এমতেই আইজ দশদিন বাইর অই নাই, প্যাটেত খাওন লাগবো না?”

থাউকগা অবাবর, তুমারে বাড়িত থাকন লাগবো, আমারে ডর করতাছে।’

‘ডর! কি তামাসা করতাছস, ডর কিয়ের লাইগ্যা?

‘হেই কতাই তো কইতাছি, ঘাটেত ত্যানাবানি ধ্যুইয়া, গোসল কইর‍্যা উঠতাছিলাম, দেহী নাকি, দুইডা মেলেটারি, আমারে দেইখ্যা খাড়াই গ্যালো, আর চিকখোর পাইড়া, এশারা কইরা কি যান কইব্যার লাইগলো, তারপর আমারে ছটপটাইয়া বাড়িত যাওন দেইক্যা তাগোর কি হাসি। হাচা কইতাছিগো, ডর লাগতাছে, তুমি যাইও না।’

‘তোক তাগোর মনে লাগছেরে সোন্দরী, আর আমগো বাবনা কিরে, তোর কপালটা ফির্যাই গ্যাল। আচ্ছা থাউক, আমি যাইগ্যা।’

গোলাপজানের উদ্দেশ্যে রসিকতার কথাটি বলে কলিমুদ্দিন তার অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়িপাতিলগুলো বিক্রির উদ্দেশ্যে রাস্তায় নামলো।

 শহরে এমনিই মানুষজন কম। মিলিটারীদের সাথে শেখ সাহেবের দলের কি একটা গোলমালে সমস্ত সম্পত্তি। ভালো ভালো ঘরের মেয়েদের ইজ্জত নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে। রাস্তাঘাটে অনেক ধর্ষিতা মৃতদেহে একটা ভ্যাপসা পচা কটুগন্ধে ওর মাথাটা ঝিম ঝিম করতে থাকে। শহর জনশূন্য। কৃচিৎ-কদাচিৎ কোন বাড়িতে দেখা যায় বুড়ো অথবা আধৰুড়ো দাড়িটুপিওলা এক-আধজন মুরুববী চেহারার লোক। শহরের সব লোক পালিয়ে গেছে গ্রামে। পথচলিত দু’একটা লোকের মুখে কলিমুদিন এ খবরও পেয়েছে, শহরের লোক গ্রামে চলে যাওয়ায় এখন মিলিটারীদের লক্ষ্য গিয়ে পড়েছে গ্রামে। তারা শহরে যে সমস্ত অত্যাচার চালিয়েছে, এখন ব্যাপক হারে তা চালাচ্ছে গ্রামে। হঠাৎ এসব কথা ভাবতে ভাবতে কলিমুদিনের ভীষণ হাসি পেলো। বোধ হয় একটু জোরেই হেসে উঠলো ও আরে কি বোকা সে। যেখানে শহরে মানুষ নাই বললেই চলে, যা এক-আধজন আছে, তারাও আতঙ্কে খাওয়াদাওয়া ছেড়েই দিয়েছে প্রায়, দোকানপাট-হাটবাজার সব ভস্মীভূত-ধ্বংস-প্রায়, আর এরমধ্যে সে কিনা বের হয়েছে হাঁড়িপাতিল বেচতে।

আবার মাইল চারেক হেঁটে শহরতলীর বস্তিবাড়িতে ফিরে যাওয়ার কথা চিন্তা করতেই তার যেন ক্লান্তিতে সারা দেহ অবসন্ন হয়ে পড়লো। কি করবে সে এখন? একটু জিড়িয়ে নিয় বাড়ির দিকে হাঁটবে? কিন্তু, অন্ততঃ কিছু চাল না নিয়ে সে বাড়ির দিকেই বা যাবে কি করে? হঠাৎ এই মুহুর্তে তার ভীষণ রাগ হলো

<005.013.302>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

উপর। সত্যিই, কি অন্যায় গোটা দেশটাকে ওরা একেবারে ছারখার করে দিল। এতো সুন্দর সাজানো শহর, মানুষজন, বাড়িগাড়ি, সব যেন কোথায় হারিয়ে গেল। কলকাকলিতে ভরা এতো বড়ো শহরটা, এখন যেন মৃতের শহর। কোথাও প্রাণের কোন কিছু নাই। পথেঘাটে কুকুরেরা লুটোপুটি করে খাচ্ছে মানুষের গলিত অর্ধগলিত শবদেহগুলি।

এসব কথা ভাবতে ভাবতে আচম্বিতে তার মনে পড়লো গোলাপজানের কথা, তার মুখে শোনা আজ সকালের ঘটনাটা। আৎকে উঠলো সে। অজান্তেই ক্ষিপ্ৰ পদক্ষেপে সে হাঁটতে শুরু করলো বাড়ির দিকে। তার সাজানো সংসার আজো যেখানে অন্ধ স্যাঁতসেঁতে বস্তিবাড়িতে মোটামুটি সন্ত্রমের সাথেই টিকে আছে- গতকাল পর্যন্ত যেখানে শকুনীর দৃষ্টি পড়েনি- এতোক্ষণ সেখানে যে কি তাণ্ডবলীলা চলেছে কে জানে! আচ্ছা, মিলিটারীরা কি গোলাপজানকে ধরে নিয়ে গেছে? তাই যদি হয়- সলিম, তার বড়ো ছেলেটা, সে কি করছে? নাকি সংগীনের এক খোঁচায় তাকে….না, আর সে ভাবতে পারে না তা তিন মাসের কোলের বাচ্চাটার কথা। ভয়ে-উত্তেজনায় সে হাঁটতে থাকে, তার পা যেন আর উঠছে না মাটি থেকে। ক্লান্তিতে ভেঙ্গে সে বসে পড়লো রাস্তার পাশের বাবলা গাছটার নীচে, ঘাড় হতে তার ফেরীর বোঝাটা নামিয়ে। এক সময় তার মনে হলো আর বাড়ি গিয়ে কোন লাভ নাই, এতোক্ষণে সব শেষ। এখন বাড়ি গিয়ে যে দৃশ্য সে দেখবে, তা সে দেখতে চায় না। তা সে সহ্য করতে পারবে না।

নাঃ, সে সে যাবেই না আর ওদিকে। বরং বরং সে কামালের সাথে দেখা করবে। উকিলপাড়ার চৌধুরীদের বড়ো ছেলে কামাল, তাদের কামাল ভাই। কামালদের বাড়িটা যেখানে ছিল, সেখানে তখন ইটসুরকির একটা বিরাট ধ্বংসস্তুপ পাকসেনাবাহিনীর বাহাদুরীর সাক্ষ্য হয়ে জমে আছে। যখন এ ঘটনা ঘটে তখন কামাল বাড়িতে ছিল না। যাঁরা ছিলেন তাঁদের মধ্য হতে কামালের ছোটবোন আই-এ ক্লাশে পড়া কুমকুমকে ওরা শুধু জ্যান্ত ধরে নিয়ে গেছে। আর সবাইকে……যাকগে, এখন সেকথা ভেবে তার কি লাভ। কামাল কোথায় আছে তা সে জানে। বোঝাটা ঘাড়ে নিয়ে সেদিকে পা চালালো কলিম।

এরপর-বিকেলের কিছু আগে কলিমুদিকে দেখা গেল, দুই ফুট চওড়া গ্রেটার রোডে। কোর্ট হতে মাইল দু’য়েক যে রাস্তার দিকে এগিয়ে গেলে হাতের ডাকদিকে চোখে পড়ে তীর চিহ্ন দেওয়া একটা কালো কাষ্ঠফলক, ইংরেজিতে যার গায়ে লেখা  Gratt Sector Headquarter-B Prohibited Area – সেদিকে । এ  লেখা অবশ্য সে পড়তে পারে না, তবে একথা সে জানে ওখানে অনেক মিলিটারী থাকে। এই ভরভেলায় ওই রাস্তায় কলিম কেন যে বোঝাটা নিয়ে চলছে, তা অবশ্য বোঝা যাচ্ছে না। রাস্তার দু’পাশে যে সমস্ত বড়িঘর, সেগুলো জনশূন্যই, তবু দেখা গেল, দু’পাশের বাড়িগুলোর দিকে চাইতে চাইতে আর হাকতে হকতে কলিমুদ্দিন সে রাস্তা বেয়ে এগিয়ে আসছে। ধীরে ধীরে এসে পৌঁছল সে কাষ্ঠফলকের সামনে। ওখান হতে সোজা ভিতর দিকে চলে গেছে মিলিটারীর ছাউনিটায় যাবার রাস্তা, জঙ্গল ঘেরা। একটা গেটের মতো তৈরি করা আছে । আর তার কাছে গোটা পাঁচেক মিলিটারি প্রহরী- কেউ দাঁড়িয়ে, কেউ বসে। সিগারেট ফুঁকছে আর হাসাহাসি করছে।

ওদের দেখেই কলিমুদ্দিন একটা লম্বা-চওড়া সালাম ঠুকে দিল, কোন জবাব এলো না। তাজ্জব বনে গেল। মিলিটারীগুলো। যেখানে ওদের দেখলেই সবাই পালায়, সেখানে এ ব্যাটা নিঃসংশয়মুখে ওদের সামনে দিয়ে শুধু যাচ্ছেই না, সালাম ও দিচ্ছে। একজন মিলিটারী ওকে ধমক দিয়ে উঠল- ‘আবে ভাগ, ইহা তেরা হাণ্ডি কোন খরিদেগা?- ‘অহনই যাইত্যাছি সাব, খুব পেরেসান অইছি, পসীনা মুছ্যা লই।’ বলে কলিমুদ্দিন মাথার গামছাটা খুলে ঘাম মুছল। মিলিটারীগুলো অবাক বিস্ময়ে ওর ভীতিহীনতা লক্ষ্য করছে। ঘামটাম মোছা শেষ হলে কলিমুদ্দিন ওর টুকরি হতে বের করলো এক প্যাকেট সস্তা সিগারেট। ম্যাচ দিয়ে ফস করে সিগারেটটা জেলে প্যাকেটটা আর ম্যাচটা রেখে দিল টুকরির মধ্যে। এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে সে টুকরীর মধ্য হতে কি যেন একটা বের করল। তারপর-ক্ষিপ্রগতিতে সে জিনিসটা ছুড়ে দিল মিলিটারীদের দিকে।

<005.013.303>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

ততোধিক ক্ষিপ্রতায় একটা মিলিটারীও তার দিকে হাল্কা মেশিনগান হতে গুলি ছড়িলো- অব্যর্থ লক্ষ্যদুটো বুলটেই কলিমুদিনের হৃৎপিণ্ড ভেদ করে বেরিয়ে গেছে। লুটিয়ে পড়েছে সে রাস্তায় ছটফট করছে সে, আর দমকে দমকে তার বুকের রক্ত রাস্তায় লাল লাল ছোপ এঁকে যাচ্ছে।

আর ওদিকে গ্রেনেডের বিকট শব্দে যখন ছাটনী হতে সৈনরা উদ্যত অস্ত্র হাতে বেরিয়ে এলো, তারা দেখলো, তাদের প্রহরী পাঁচজন শত টুকরোই বিছিন্ন হয়ে এদিকে-সেদিক ছড়িয়ে আছে। গেটের মাঝখানে একটা বিরাট গর্ত, তখনও চারপাশে ধুয়ো উড়ছে, কাপড় আর পোড়া মাংসের কটু গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে।

মিলিটারীগুলো তার দিকে এগিয়ে গেল- দেখলো, তার দেহটা আকাশের দিকে মুখ করে পরে আছে। একটা প্রশান্তির তৃপ্তির হাসিতে উদ্ভাসিত সে মুখে যন্ত্রণার চিহ্নও নাই।

(আনোয়ারুল আবেদীন রচিত)

সূর্য ওঠার স্বপ্ন নিয়ে

২ নভেম্বর, ১৯৭১

প্রেরণার আলোয় যে হৃদয় দীপ্ত, সে হৃদয় প্রকাশের উন্মাদনায় উন্মুখ। এই প্রেরণা জীবনের প্রেরণা এই আলো মেঘের পরে মেঘ জমা আঁধারের ফাঁকে ফাঁকে টুকরো আলো নয়। অনেক অনেক আলো।

জীবনকে সুখের ঐশ্বর্যে শান্তির পরশ বুলিয়ে আপন ভৌগোলিক অবস্থানের মধ্যে পেতে চাই। ঐশ্বর্য বা শান্তিই প্রেরণার উৎস।

প্রেরণার দীপশিখা যে হৃদয়কে স্পর্শ করেছে, সে হৃদয় অনির্বাণ- কেননা এই দীপশিখা দেহকে একদিনে উত্তপ্ত করেনি। সময়, হ্যাঁ প্রচুর কালহননের পর বিবেকতাড়িত মন একটি বিশেষ মুহুর্তে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। হৃদয় তখন প্রকাশের প্রতীক্ষায় মাতোয়ারা হয়ে ওঠে। আমরা প্রেরণা পাই। আলো জ্বলে, আলো নেভে না। তথাপি ঝড় ওঠে। বাতাস ছোটে। দীপশিখায় কাপন জাগে। কখনো মৃদু, কখনো ভয়ঙ্কর। তাই বলে কি নিভিয়ে দেবে প্রেরণার আলো। নীরব অন্ধকার ঠেলে দেবে স্বর্ণোজ্জ্বল ভবিষ্যৎ? না, দিতে পারে না কস্মিনকালেও না।

প্রেরণার আলো অন্তরে জ্বলেছে। জেনেছি প্রেরণার উৎস কোথায়। শুধু পাইনি ফসলটুকু। কিন্তু শুনেছি তো কবির কষ্ঠে, “সেদিনও এমনি ফসল বিলাসী হাওয়া মেতেছিল তার চিকুরের পাকা ধানে।”

‘পাকা ধান আর রূপসীর শরীরের মিষ্টি ঘাণ। মনে হলে কেমন যেন আবেশ জাগে। উত্তাপও। অথচ না পাওয়ার একটা জলার্ত বেদনা।

না না না, এ হতে পারে না। পেতেই হবে। আলোর রশ্মিটা দিব্যদর্শন করেছি। আর বেশী দূরে নয়। তিমির রাত্রির অবসান হবে। ভোর হবে। পাখি ডাকবে। আবার জানালায় দাঁড়িয়ে প্রভাতসূর্যোদয় প্রাণভরে উপভোগ করবো। হঠাৎ চমকে উঠবো, একি সন্ধ্যা তুমি, এমনি অকালে!

<005.013.304>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

– হ্যাঁ, আমি, চমকে উঠলে যে বড়। এই নাও, মালাটা রাখ।

সন্ধ্যার চোখে-মুখে দুষ্টুমি হাসি। হাতে বকুলমালা শয্যা থেকে ওঠা সন্ধ্যার মিথিল বৈশিষ্ট্য দৃকপাত করতে অজান্তেই কেমন যেন শৈথিল্য আসে। অন্যমনস্ক হতে চায়। কিন্তু শুধুই কয়েকটি মুহুর্ত। অন্যমনস্ক চিত্ত আবার চঞ্চল হয়ে ওঠে একটি কথায়- এমন করে আমাকে দেখছ কি? আকাশের দিকে চোখ মেলে দেখ।

ও তাই তো! আমাকে আকাশের দিকে চোখ মেলে তাকাতে হবে। আমার দৃষ্টি হবে প্রসারিত। আকাশ। মাটি স্বদেশ। ভালবাসা।

সন্ধ্যা আমাকে ভালোবাসে। ভালোবাসে বলেই আমার দৃষ্টিপথ সৃষ্টি করে দিলো একটি সরল সংলাপে। আমি হাত বাড়িয়ে মালাটি নিলাম নিমেষে দৃষ্টির আড়ালে মিলিয়ে গেল সন্ধ্যা।

বকুল ও সন্ধ্যা’। এই দুটোর মধ্যে কেমন যেন দূর অস্তিত্বের সম্পর্ক বিদ্যমান। বকুল-সন্ধ্যা না হয়ে ‘মালতী’-সন্ধ্যা হতে পারত। কিন্তু সন্ধ্যা মালতী নিয়ে এল না। এল বকুল নিয়ে। প্রভাতসূর্যোদয় মুহুর্তে। একটি বকুলমালাও জীবনের মহৎ প্রেরণা।

এমনি মহৎ প্রেরণার উৎস খুঁজে বেড়াবো। স্বদেশের লাখো লাখো সন্ধ্যা প্রভাতসঙ্গীতের সুর নিয়ে জীবনের নতুন অধ্যায় রচনা করবে। আবার চিনতে পারবো নিজেকে। উপলব্ধি করতে পারবো।

সন্ধ্যা, এই মুহুর্তে আমি তোমার স্মৃতিচারণ করছি। তোমার সরল সংলাপ আমার মনে পড়ছে। পঁচিশে মার্চের কয়েকদিন আগে বলেছিলে, তুমি ভয়ানক ঘরকুনো একদিন মিছিলেও যোগ দিলে না। এত ঘরকুনো আমার ভাল লাগে না- তোমার কথায় সেদিন লজ্জা পেয়েছিলাম। এ লজ্জা যে আমার দীনতা তাও বুঝতে পেরেছিলাম, কিন্তু তোমার কাছে ঠিক সেই মুহুর্তে পরাজয়টা স্বীকার করে নিতে পারিনি। কঠিন জবাব দিয়েছিলাম- যা বোঝ না তা নিয়ে কথা বলো না সন্ধ্যা। হাউকাউ করে, মিছিলে ঘুরে স্বাধিকার পাওয়া যায় না।

রূঢ় জবাবে তোমাকে সাময়িক স্তব্ধ করতে পেরেছিলাম হয়তো কিন্তু বিবেককে আমি ফাঁকি দিতে পারিনি। পরক্ষণেই ভীরু হৃদয় আমার সংকুচিত হয়েছিল। সন্ধ্যা, তুমি জানতে না এসব শ্লোগান মিছিল সভা শোভাযাত্রা আমার বডড ভয় করতো! কিন্তু আজ? তুমি জান না কেমন করে আমি জনতার মিছিলে লিখেছি আমার নাম। আমি এখন মিছিলের ভিড়ে। ছিন্নমূল মানুষের মাঝে। তুমি দেখতে পাচ্ছ না কেমন করে লাখো লাখো ছিন্নমূল প্ৰাণ জীবনের জয়গান করে। কেমন করে মরিয়া হয়ে ঈপ্সিত লক্ষ্যে পৌছুবার সংগ্রামে ওরা ঝাঁপিয়ে পড়ে। হয়তো তুমিও এতক্ষণে তস্করদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছ।

জান, বুকের ভেতরটা মাঝে মাঝে কেমন যেনো করে। তোমার মুখখানি মনে পড়লে একতা অজনিত আশংকায় কেপে উঠি। না জানি তুমি কোথায় কেমন করে আছো! অবশ্যি আমি একটি শক্তিও অর্জন করে ফেলেছি। আত্মসান্তনার বিপুল শক্তি। আগে তো সপ্তাহখানেক না দেখলে কেমন ভেঙ্গে পড়তাম। কই, এখন তো আর তেমন হয় না। বলতে পার কোথায় পেয়েছি এই সান্তনা। এই সংযমশক্তি। আমার মনে হয় কি জানো, এর পেছনে প্রেরণা আছে। তোমার ভালোবাসাই এই প্রেরণার উৎস।

সন্ধ্যা, আমার অনেক আশা। হয়তো তুমি এক মারাত্মক অস্ত্রে সজ্জিতা। ঘরের বাইরে। ঝড় কেটে গেলে তুমিও একদিন সুন্দর একটি ঘরের মানুষ হবে। বাংলার লাখো লাখো সন্ধ্যা তোমার মতো সংলাপী হবে। তারা আমার সহোদরা একদিন বধূ হবে। মা হবে। বীর সন্তানের জননী। তোমার মধ্যে আমি কোথায় আমার মায়ের আদল খুঁজে পাই। আমার মাও যে এমনি কথা বলে। বাংলার বিস্তীর্ণ প্রান্তরে প্রান্তরে আমি তোমার অস্তিত্ব খুজি। দিনমণি বিদায় নিলে আমরা অন্ধকারে জলে জলে স্থলে, কখনোবা কালো পাহাড়ের গায়ে মিলে যাই, অতন্দ্র

<005.013.305>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

রাত জাগি, হানাদার শত্রুশিবির নিশ্চিহ্ন করে অন্যমনে পরিপূর্ণ ভিন্নজগতে- তখন সত্যি ভুলে যাই তোমার কথা। ভুলে যেতে হয়। সূর্য ওঠার স্বপ্ন নিয়ে যখন ক্যাম্পে ফিরি, তখন নিশুতি রাতে অসহায় ছিন্নমূল মানুষের কান্নার শব্দ ভেসে আসে। রাতজাগা দু’একটি পাখি পাখা ঝাপটায়। আমি বাতাসে তোমার ঘন ঘন নিঃশ্বাস শুনতে পাই। অনুভব করি। তুমিও বুঝি এতক্ষণেও কোনও ক্যাম্পে ফিরছ।

সূর্য ওঠার এখনও দেরী। বাকি রাতটুকু আমাদের পাড়ি দিতে হবে। জমাটবাঁধা অন্ধকার ব্যারিকেড সবল বাহুতে উপড়ে ফেলে আবার প্রভাতসঙ্গীতের সুর শুনব জানালায় দাঁড়িয়ে প্রভাতসূর্যোদয়কে অভ্যর্থনা জানাবো। তুমি আমার বকুলমালা হাতে নিয়ে স্নিগ্ধ হাসবে।

(মেসবাহ আহমেদ রচিত)

রণশিবিরের একটি প্রত্যক্ষচিত্র

১৬ নভেম্বর, ১৯৭১

ছেলেটার কর্মক্ষিপ্রতা এবং কর্মপটুতা আমার প্রথম নজরে পড়ে। অথচ ও আমাকে দেখেনি- এতখানি একান্তচিত্তে সে হাতের যুদ্ধাস্ত্রগুলো নাড়ছিলো। রবিনবাবুর কাছে তার এলাকার কথা শুনতে শুনতে পারি যে বার-তের বছরের ছেলেটার দিকে বেশ মনোযোগী হয়ে পড়েছি তা তিনি লক্ষ্য করে বললেনঃ হ্যাঁ, ও ছেলেটার নাম আলো। ওর বাবা হালিম মাস্টার আমার ছোটবেলার বন্ধু। এই গ্রামের প্রাইমারী স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন তিনি। ওর আর এক ভাই ছিল। এখন তারা কেউ নেই। ও একা।

আমি আগেই শুনেছিলাম, খুলনার দক্ষিণাঞ্চলের এই গ্রামটার ওপর হানাদার পাকবাহিনী জওয়ানরা দুবার হামলা করে। এবং শেষে এসে গ্রামের কাঁচাবাড়িগুলো পেট্রল ছিটিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। অবশ্য মুক্তিসেনা ভায়েরা তার মাশুলও আদায় করেছে এদের কাছ থেকে। তবু হানাদারদের অত্যাচারের পরিচয়টা সরেজমিনে জানতে আমি দীর্ঘ এগার-বার মাইল কাঁচা রাস্তা পায়ে হেঁটে সন্ধ্যার সময়ে সেখানে পৌঁছে যাই। গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা ভায়েরা আমার পরিচয় জানার পর দলপতি রবিনবাবুর কাছে নিয়ে যায়। রবিনবাবু আমাকে জানালেনঃ আপনার কোন সিকিউরিটির অভাব হবে না। থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। তবে রাতে গ্রামের ধ্বংসচিত্র দেখানো যাবে না- প্রধানতঃ আমাদের গ্রামের সবাইকে কড়া ডিফেন্স দিতে হচ্ছে। রাতের আঁধারে দেখলাম গ্রামের খানা, ডোবা, নালা, আমাদের মুক্তিযোদ্ধা ভাইদের এক-একটা মজবুত বাঙ্কার- সবাই অস্ত্র হাতে অতন্দ্র প্রহরী।

সকালে রবিনবাবুর সাথে বিধ্বস্ত গ্রামের পোড়া বাড়ি, ভাঙ্গা ঘর, শূন্য উঠোন দেখে মনটা খা খা করে উঠলো। অথচ বাংলার এই গ্রাম একদিন নবান্নের ধানে গানে, ছেলেমেয়েদের কলকাকলীতে মুখর ছিল। তাদের অনেকে আজ হানাদারদের হাতে বলী হয়েছে। অনেকে চলে গেছে অন্যত্র নিরাপত্তার সন্ধানে। একটা আশ্চর্য নির্জনতার কালো গ্রামটাকে বিষাদে যেন ঘিরে রেখেছে। তবু, তবু দেখলাম- যারা আছে, যারা এখনো বাপদাদার ভিটে না ছেড়ে সাহসে নির্ভর করে আছে- তারা সেই নির্জনতার বুকে জীবন জাগিয়ে তোলার সাধনায় রত। ধীরে ধীরে তারা সকল প্রতিকূলতার মুখেও তাদের অধিকার রক্ষার সাহসে প্রত্যয় গড়ে তুলেছে মনের ভিতরে, বাইরে।

<005.013.306>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

গ্রামের সবদিকে ঘুরে দেখে বেলা প্রায় সাড়ে বারটা নাগাদ রবিনবাবুর সাথে মুক্তিসেনা বন্ধুদের গ্রামের অফিসে ফিরলাম। টিনের ছাউনি দেয়া একটু ছোট ঘর, দুটো তক্তপোষ, একটা টেবিল, একটা চেয়ার- এই ওদের অফিস। ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে রবিনবাবুর কথা শুনছিলাম। কর্মরত ধবধবে ফরসা ছেলেটার দিক থেকে চোখ তুলে রবিনবাবুর দিকে তাকিয়ে বললামঃ কিন্তু ও একা কেন? রবিনবাবুর মুখের ওপর একটা কষ্টের ছাপ দেখলাম। রবিনবাবু একবার ছেলেটার দিকে এক নজর দেখলেন তারপর স্নান কণ্ঠে বললেনঃ হ্যাঁ, ও একা। ওর ভাই মনি ক্লাস নাইনে পড়তো। সে আমাদের মুক্তিবাহিনীর প্রথম গ্রুপের সাথে যোগ দেয়। মনির ছিল আশ্চর্য সাহস। পাকসেনারা প্রথমবার এসে গ্রামের মোড়ল হাজীসাহবের বাড়িতে আগুন দেয়। মনি আগুন নেভাতে গিয়ে পুড়ে মারা যায়। মনির মা কয়দিন পাগলের মতো হয়ে ওঠে। আলো মুক্তিসেনাদের সাথে আসতে চাইতো। কিন্তু ওর মা ওকে বুকে জড়িয়ে রাখতো সর্বদা। কিন্তু এমনটা ঐটুকু ছেলের ভাগ্যে আছে, কে বলবে বলুন? শেষবার যখন পাকসেনারা সমস্ত গ্রাম ধরিয়ে দিল, তখন একপ্রান্তে ওদের সাথে আমাদের ফাইট চলছে, অন্যদিকে গ্রামের নিরীহ নারী-পুরুষ উর্ধ্বশ্বাসে প্রাণভয়ে ছুটে পালাতে ব্যস্ত। হালিম মাস্টারের স্ত্রী, হালিম মাস্টার ও আলো ইতস্ততঃ দৌড়ানোর প্রাক্কালে অকস্মাৎ এক মিলিটারী ট্রাকের সামনে পড়ে যায়। বেঈমান পাকবাহিনীর লোকেরা হালিম মাষ্টারের ফরসা সুন্দরী স্ত্রীকে জোর করে ট্রাকে তুলে নেয়। বাধা দেওয়ার সাহস দেখাবার অপরাধে হালিম মাস্টারকে গুলি করে মেরে ফেলে। আলো ভয়ে ত্রাসে মা-মা-মা করে চীৎকার করে কাঁদতে থাকে- দস্যু ট্রাকটি ঘর ঘর শব্দ করে আলোর জলভরা চোখের সামনে দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়। গ্রামের কাঁচা বাড়িগুলো দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে।

রবিনবাবু এখানে থামলেন।

আমি বল্লামঃ তারপর?

রবিন্দ্রবাবু বললেনঃ বহুকষ্টে আগুন আমরা নেভালাম- কিন্তু আপনি তো দেখেছেন এতবড় গ্রামে মাত্র গোটা ছয়-সাত বাড়ি রক্ষা হয়েছে।

আমি আলোর দিকে তাকালাম। রবিনবাবু বললেনঃ আর ঐ আলো- তারপর দিন এলো আমাদের কাছে- বললেঃ আমি মুক্তিসেনা। তোমাদের সাথে যুদ্ধে যাবো।

রবিনবাবু অল্প থেমে বললেনঃ আমার মনে হয়েছিল ওকে ফিরিয়ে দিই। গ্রামের কারো কাছে ও থাক- কেননা ও যে ওর পরিবারের শেষচিহ্ন। কিন্তু ওকে ফিরাতে পারিনি। ওর চোখের জলভরা প্রতিবাদ আমাকে জয় করলো। তারপর থেকে আলো আমাদের সাথে ওই শিবিরের প্রাণ ও ও গুলি ছুড়তে চায় বার বার। কিন্তু ও যে একেবারে বার বছরের শিশু। ওকে আশ্বাস দিয়েছিল আর কিছুদিন পরেই ও গুলি চালাবে। মুক্তিসেনা ভায়েরা সারারাত টহল দিয়ে সকালে প্রত্যেকের অস্ত্র আলোর জিন্মায় জমা দিয়ে যায়। এরপর সারাদিন অস্ত্রের সাথে আলোর খেলা। সে প্রত্যেকটা রাইফেল-ষ্টেনগান খুলবে, পরিষ্কার করবে, তেল দেবে। ওর হাতে অস্ত্রগুলো যেন শাণ পেয়ে চিক চিক করে ওঠে। সন্ধ্যাবেলায় ওই আলোই আবার প্রত্যেকের হাতে জীবন্ত অস্ত্রগুলো তুলে দেয়- এই ওর কাজ। এই কাজেও এত পটু যে বিশ্বাস করাই মুষ্কিল। আলোর দিকে চোখ ফিরে গেল দুজনেরই। আলো আশ্চর্য একাগ্রতায় তখনও কর্মরত। একঝাঁকড়া কালো চুল মাথায়- একটি কচি ফর্সা মুখ, ডগডগে দুটি চোখ- নরম নরম দুটি হাতে কি ভীষণ ব্যস্ততা আলোর। আলো কার মতো দেখতে? হয়ত ওর বাবার মত, নয়তো ওর মায়ের মতো- কিন্তু তারা যে আজ কেউ নেই। এমন অসম্ভব একটি দুঃস্বপ্ন ঐটুকু আলোর জীবনে ঘটেছে ভাবলে বড় পাষণ্ডেরও বোধ করি কষ্ট লাগে।

আলো কাছে গেলাম।

<005.013.307>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

মিষ্টি করে বললামঃ তোমার নাম বুঝি আলো? ষ্টেনগানের খুলে ফেলা অংশগুলি আঙ্গুলের নরম কারসাজিতে এক মিনিটে ঠকাঠক শব্দে লাগিয়ে নিয়ে মুখ তুলে ছোট করে বললেঃ হ্যাঁ তারপর ডানহাতে ষ্টেনগানটা রেখে বামহাতে একটা ৩০৩ রাইফেল নিয়ে একান্ত চেনা ভঙ্গিতে পার্টগুলো খুলে কাপড় দিয়ে পরিষ্কার করতে লাগলো।

আমি বল্লামঃ তোমার বাবা-মা কেউ নেই বুঝি?

আলো একটু কাজ থামালো। তারপর বললোঃ ওরা বাবাকে গুলি করে মেরেছে। ডান হাতে একটা বেতের ছড়ি দিয়ে তারপর মাথায় কিছু দেশী তুলো সেঁটে রাইফেলের ব্যারেলটা পরিষ্কার করতে করতে আলো কিছু একটা বলার জন্য মুখ তুললো- কিন্তু কিছু বললো না।

আমি বললামঃ গ্রামে তোমার কোন আত্মীয় নেই? আলো আমার দিকে তাকালে। আমি বললামঃ এই ধরো চাচীমা, খালাম্মা, এমন কেউ? আলোর কচি মুখটা এর পলকের ব্যবধানে অন্য ধাতুর মনে হল। আমার দিকে থেকেও অন্যদিকে তাকালো। বললেঃ আমার মাকে ওরা নিয়ে গেছে- আনতে যেতে হবে। আলোর গলাটা এখন অন্যরকম শোনাল। আমি ওর বাহুর ওপর একটু নাড়া দিয়ে বললাম- ওদের কাছ থেকে আনতে পারবে তুমি? রাইফেলের খোলা ব্যারেলের মধ্য থেকে বেতের ছড়িটা বের করে নেয় আলো, তারপর ব্যারেলের ছিদ্র দিয়ে দূর আকাশের গায়ে চোখ রেখে আলো মাথা নাড়ে। তার সামর্থ্যের ইঙ্গিত দেয়। আলোর দূরে, নীল নীল চোখ মেলে শত্রুহননের সাহসগুলো ঝালিয়ে নিচ্ছে, শত্রুর পরাজয়ের পথগুলি চিহ্নিত করছেমনে মনে প্রস্তুতি নিচ্ছে। প্রস্তুতি নিচ্ছে তার বাবা হালিম মাস্টার, ভাই মনির মৃত্যুর বদলা নিতে। প্রস্তুতি নিচ্ছে দস্যুদের নাগাল থেকে তার মাকে ছিনিয়ে আরার প্রতিজ্ঞা রক্ষার।

(লেখকের নাম জানা যায়নি)

স্বীকারোক্তি

৭ ডিসেম্বর ১৯৭১

ছাপাখানাটা শহরের মাঝখানে এবং আবাসিক এলাকায়। এ অঞ্চলে আর কোন ছাপাখানা ছিল না। পরে যখন আরো দুটো ছাপাখানা বসে শহীদ সাহেব চিন্তিত হয়, অবশ্য সেটা সাময়িক। ছাপাখানার কাজে কোন ভাটা পড়েনি, যেমন আজ আসত তেমনি আসতে লাগল।

একতলা বাড়ীর উঠোনের একপাশে বাঁশের চালায় দুটি যন্ত্র নিয়ে ছাপাখানা। একটা ট্রেডল, একটা ফ্ল্যাটবেড। একপাশে শহীদ সাহেবের বসার ঘর, যেটা অফিস বলে বিবেচিত। শহীদ সাহেব প্রায় পঁয়ত্রিশ বয়স, মাথার একপাশের চুল অর্ধেক সাদা-কালো। ইংরেজী সাহিত্যে এমএ, কিন্তু বরাবর ছিল ব্যবসার দিকে ঝোঁক, তাই চাকরি না নিয়ে অল্প মূলধন জোগাড় করে ধরেছে এই ব্যবসা।

ব্যবসায় প্রথম দিকে তেমন সুবিধা হচ্ছিল না। তাই কমার্সের সব বই নিয়ে বসে যায়, বিশেষ করে ছোট ব্যবসা কেমন করে চালাতে হয় এ ব্যাপারে পড়াশোনা করে একেবারে বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠে এবং এখন তার কাছে

<005.013.308>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

এম-কম পাস করা লোকেও অনেক কিছু শিখতে পারে। লেখাপড়ার ফল হিসেবে ছাপাখানার এখন বাড়বাড়ন্ত অবস্থা। পাঁচজন লোক নিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল, এখন পয়ত্রিশজন খাটছে।

পত্রিকা বের করার ইচ্ছা ছিল, তাই মাসিক বেরিয়েছে- এবার বাসনা দৈনিকের। বন্ধুবান্ধবের ধারণা শহীদ তা পারবে।

শহীদ সাহেব ভীষণ নিয়ম মেনে চলার পক্ষপাতী। সময়মত পাওনা দিয়ে দেওয়া এবং সময়মত কাজ আদায় করতেও ছাড়ে না। তার সঙ্গে ব্যবসা করতে এসে সবাই খুশী। শ্রমিকরাও। বড় ঝড় বড় গাছের উপর দিয়েই যায় প্রবলভাবে, কিন্তু মাঝে মাঝে এমন এক-একটা ঝড় আসে যা ঘাসকেও রেহাই দেয় না। মার্চ মাসে বাংলাদেশে সে ঝড় এসে গেল। দোসরা মার্চ থেকে সব কিছু বন্ধের সাথে শহীদ সাহেবের ছাপাখানাও গেল আচল হয়ে। সাত তারিখ থেকে শেখ সাহেবের ডাকে আন্দোলন শুরু হয়ে গেল কর্মীরা মাঝে মাঝে এসে ঘুরে যেতে লাগল, বেশীর ভাগই বাড়ি চলে যাবে ঠিক করে।

দশ তারিখে শহীদ সাহেব সব কর্মীদের নিয়ে মিটিং-এ বসে যায়।

বলে, আমরা এখানে কেন জমায়েত হয়েছি আপনারা জানেন।

জানে, সবাই জানে, তাই সবাই চুপ৷

শহীদ সাহেব বলে চলে, দেখুন আমরা রাজনীতি করতে চাই বা না চাই, রাজনীতি আমাদের ছেড়ে কথা কইবে না। আজ দেশ যে পর্যায়ে গেছে সেখান থেকে আমাদের আর ফেরার উপায় নেই। এ ব্যাপারে আমাদেরও ত্যাগ স্বীকার করেত হবে। দেখুন, কাজ হোক আর না হোক মাইনে আমাকে গুণতেই হবে। তবে আপনারা আমাকে একটু সাহায্য করুন, এ মাসের পনের দিনের টাকা নিয়ে দেশে চলে যান, পরে আমি চিঠি দিয়ে ডেকে আনব, আর বাকী টাকা দু’মাসের মধ্যে কিস্তিতে শোধ করে দেব। প্রেসের আয় কত তাতো আপনারা সবাই জানেন।

শ্রমিকরা প্রতিবাদ না করে এই ব্যবস্থা মেনে নেয়।

ভরা বসন্ত তখন বাংলাদেশে। চৈত্র পবনে বাতাস উতলা। ঝুমকো লতার চাওয়ায় মনের বেদনা উদাস হয়ে দেখা দেয়। মুকুলগুলি ঝরে ঝরে পড়ে। এমন এক বসন্ত-রাতে অকস্মাৎ সেই ঝড়টা চূড়ান্ত রূপে এসে গেল। পঁচিশে মার্চের রাতে।

ঘুমন্ত দশ লক্ষ লোক খুন করে বিশ্বের দরবারে সাহসিকতার চরম দেখানোর ইয়াহিয়ার নেকড়েগুলো ছাড়েনি।

এক মাস কেটে গেছে ছাপাখানার কোন কর্মীর দেখা নেই। শহীদ সাহেব আর তালা খোলেন না। কি হবে খুলে? ব্যবসা, টাকা-পয়সার কথা চিন্তা হলেই বুকের কাছটা কেমন করে ওঠে তার, মাথা ঘুরে যায়।

কয়েকদিন পর শহীদ সাহেব ছাপাখানা খোলেন, সরকারী চিঠি এসেছে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সব খুলে রাখার হুকুম।

 ধুলো ঝেড়ে চেয়ারে বসে কি যেন ভাবছেন এমন সময় প্রতিবেশী রসুল সাহেব উঁকি দেন।

বলেন, কি ভাই, অফিস খুলেছেন, বহুত আচ্ছা।

ভদ্রলোক অবাঙালী।

<005.013.309>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

খাতির করে ডেকে বসান শহীদ সাহেব।

দু’চারটে কথা বলে রসুল সাহেব বেশ হৃষ্ট মনে চলে যান। আর শহীদ সাহেব গালে হাত দিয়ে ভাবেন এক মাস আগেও এই রসুল সাহেব যেতে-আসতে সালাম দিয়ে যেতেন, গায়ে পড়ে করতেন আলাপ, আর আজ? এই রসুল সাহেবের দয়ার উপরেই নির্ভর করছে এ পাড়ার লোকগুলোর জীবন-মরণ।

প্রায় তিন মাস কেটে গেছে। ছাপাখানা তেমনি অচল। তবে প্রতিরোধের কাজ দিন দিন জোরদার হচ্ছে। শুধু বোমা নয়, ঢাকা শহরে রীতিমত সামনাসামনিও লড়াই হচ্ছে। চোরাগুপ্তি সংগঠনের সাথে সাইক্লোস্টাইলে ছাপা দুটো পত্রিকা চলছে, গোপনে একজনের হাত থেকে আর একজনের হাতে চলে যায়- লিফলেট- হ্যাণ্ডবিলও বিলি চলছে।

দু’দিন গভীর রাতে রসুল সাহেব লক্ষ্য করেন শহীদ সাহেবের ছাপাখানায় আলো- আর ট্রেডল মেশিনটাও চলছে। ভাবেন, এত রাতে কি কাজ। বলেন ত কোন কাজও নেই।

রোজকার মত শহীদ সাহেব অফিস খুলে বসেন, ঝিরঝিরিয়ে নেমেছে বৃষ্টি, ভিজে বাতাসে ঘুম ঘুম ভাব। চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে থাকতে থাকতে কখন চোখের পাতা তার জড়িয়ে গেছে। এক সময় দেখতে পান তার অফিসটা কখন তিনতলা বাড়ি হয়ে গেছে, নীচতলায় চলতে অফসেট মেশিন, লাইনোটাইপে কম্পোজ হচ্ছে। তার দৈনিক পত্রিকা ‘দৈনিক বাংলাদেশ’, কাগজের শেষ পাতায় নীচের দিকে কোণায় তার নাম লেখা, সম্পাদকঃ শহীদ আহমদ।

এই সময় ভীষণ ঘরঘর শব্দে তার তন্দ্রা ভেঙ্গে যায়। দেখে একটা মিলিটারী জিপ সাঁ করে বেরিয়ে গেল। ঘাড় কাৎ করে শহীদ সাহেব দেখেন জিপটা রসুল সাহেবের বাসার সামনে থেমে গেল। জিপ থেকে নামেন রসুল সাহেব, কি যেন বলেন, তারপর আঙ্গুল বাড়িয়ে এদিকেই কি দেখান।

জিপটা মুখ না ফিরিয়ে ব্যাক করে ছাপাখানার সামনে এসে দাঁড়িয়ে যায়। লাফ দিয়ে নামে সশস্ত্র দু’জন পশ্চিমা সেনা।

একজন সেনা পরিষ্কার বাংলায় বলে, শহীদ আহমদ কার নাম?

আমার নাম। কি দরকার বলুন। ভাবেন রসুল সাহেব হয়ত কোন সরকারী কাজ জোগাড় করে দিয়েছেন।

কোন জবাব না দিয়ে সৈনিক বুক পকেট থেকে একটা ভাঁজ করা কাগজ বের করে শহীদ সাহেবের মুখের সামনে তুলে ধরে।

একটা হ্যান্ডবিল বড় বড় হরফে লেখা- মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করুন। কিন্তু অত বড় অক্ষরগুলো কেমন চিনে উঠতে পারেন না শহীদ সাহেব, সব কেমন গুলিয়ে যেতে থাকে। তা অবশ্য মুহুর্তের জন্যে।

পর মুহুর্তের শহীদ সাহেব সহজ গলায় বলেনঃ ও হ্যান্ডবিলটা তো, ওটা আমার প্রেসেই ছাপা হয়েছে।

(বুলবন ওসমান রচিত গল্প)

<005.014.310>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৪। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত কয়েকটি কবিতা …………. জুন-ডিসেম্বর, ১৯৭১

৮ জুন, ১৯৭১

                        শব্দের তারতম্যে

                        শিকদার ইবনে নূর

                        শব্দকে আমার বড় ভয় ছিল

                        পৃথিবীর নানা রকম শব্দকে,

                        বিশেষ বয়সে এসে অতর্কিত

                        বাবার পায়ের শব্দ, সেকেলে

                        খড়ম পড়া মায়ের চলার শব্দ

                        প্রিয়তমার কাঁকন নিক্কন; ট্রেনের

                        চাকার শব্দ, মোটরের বিস্ফোরণ,

                        প্রাচীন ইটের স্তুপে টায়ারে

                        আর্তনাদ- অকারণ ট্রাফিক হুইসিল,

                        এবং বিদগ্ধ দিনে রাজ পথে

                        রোদ্রের বিলাপ- ইত্যাদি অনেক শব্দে

                        শব্দময় পৃথিবীকে আমার ভীষণ ভয় ছিল।

                        অথচ অবাক হই, ইদানীং

                        আমি এক অত্যাশ্চর্য শব্দের মিছিল।

                        আমার আত্মায় শব্দ, শব্দ নাচে

                        প্রতি লোমকূপে, ধমনীতে, ফেনায়িত

                        রক্তের কণায়, জাগরণে, বিলম্বিত

                        ঘুমের সত্তায়।

                        শব্দ বাজে-সোনামুখি ধানের

                        শীষের মত, চতুর্দশী কৃষাণী

                        মেয়ের চুলে রক্ত লাল

                        শাপলার খোপার মত;

                        আমার সমস্ত দেহে, হৃৎপিণ্ডের

                        রক্তের ধারায়-শব্দ বাজে।

<005.014.311>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

বাংলার শ্যামল মাঠে, আঙ্গিনায়

পৈশাচিক পদশব্দ, নিসর্গের

বুক চিরে কামান গোলার শব্দ

বিধ্বস্ত মায়ের চোখে দুগ্ধপোষ্য

শিশুদের কচিকণ্ঠে শব্দের আগুন,

আমার পৃথিবী জুড়ে শব্দ শব্দ শব্দ শুধু;

কাজেই, এখন আর শব্দকে, ভয় নেই,

আমিও নিজেই এক অত্যাশ্চর্য

শব্দের মিছিল।

(শব্দ সৈনিক’-ফেব্রুয়ারী ১৯৭২ থেকে সংকলিত)

<005.014.312>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

৯ জুন ১৯৭১

আবার দেখবো *

আবার দেখবো বাংলার পথে-ঘাটে

কৃষাণের লাঙ্গল জোয়াল-

সোনালী ধানের ক্ষেতে শালিকের আনাগোনা –

পদ্মার উত্তাল ঢেউয়ের ঝড় তোলা পানসী-নৌকা দেখবো।

ভিজে দেহ, হিজল-বট-আমের বনে

দোয়েল-শালিকের মেলা। দেখবো ডানপিঠে ছেলের

দুরন্তপনা। বাড়াভাত নিয়ে বসে থাকা মায়ের

উদ্বিগ্ন মুখ আবার দেখবো।

আবার দেখবো রমনার কৃষ্ণচূড়ায়

থোকা থোকা লাল ফুল।

পল্টনের বাতাসে অনেক শপথী কণ্ঠ।

দেয়ালে দেয়ালে চোখ মেলে চেয়ে থাকা

সবুজ ইচ্ছে দেখবো। দেখবো-

ভার্সিটির চতুরে অনেক উন্মুখ স্বপ্নের

চঞ্চলতা শহীদ মিনারে নতুন শপথের

বজ্ৰমুষ্ঠি আবার দেখবো-

রেসকোর্সে মুজিবের দৃপ্ত কণ্ঠ। ক্লান্ত দুপুরে

বৈরাগীর সুরেলা কন্ঠ- সন্ধ্যায় ঘরফেরা

মানুষের তালহীন কণ্ঠস্বর অবিশ্রান্ত শুনে যাবো-

আবার। আবার দেখবো- আমার চিরপরিচিতা ।

রূপসী বাংলাকে।

* স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের দলিলপত্র থেকে সংকলিত। লেখকের নাম জানা যায়নি।

<005.014.313>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

——–জুলাই, ১৯৭১

আমার প্রতিদিনের শব্দ

সৈয়দ আলী আহসান

(১)

আমার সমস্ত চেতনা যদি

শব্দে তুলে ধরতে পারতাম

জোবনের নৈমিত্তিক আচার

অকুণ্ঠ অভিবাদন,

কখনও রহস্যের অস্পষ্টতা

আবার কখনও সূর্যের তাপ

এবং রাত্রিকালে সমস্ত সুন্দর

গাছের পাতার নিদ্রা

তমসার অবগাহন যখন

সময়কে গ্রাশ করেছে

যখন নিঃশ্বাসের ছায়া

স্বচ্ছ কাচে কুয়াশা ফেলেছে

তখন আমার ভাষার শরীরে

প্রকাশের যে যন্ত্রণা

তা আমি প্রতিবার কবিতা লিখতে যেয়ে

অনুভব করেছি-

তার কেশে সমস্ত আকাশের মেঘ

তার নয়নে চিরকালের নদীর উদবেলতা

এবং বাহুতে প্রান্তরের বিস্তীর্ণ আশ্রয়।

সে আমার প্রতিদিনের শব্দ।

(২)

বিষণ্ণ  নির্জনতা যেখানে চিরদিন রাজত্ব করে

এবং লম্বা ঘাস বসে থাকে সিড়ির ফাটলে

চাঁদ, সূর্য, শীত, গ্রীষ্ম এবং তুষার

যেখানে দেয়ালের রং মুছে দেয়

<005.014.314>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

কয়েকটি ইঁদুর যখন ছুটোছুটি করে

তখন প্রশ্ন করতে ইচ্ছা হয় –

এ-পরিত্যক্ত অট্রালিকায় কে বাস করতো?

একটি সাপ তখন কোনো উত্তর না দিয়ে

সিঁড়ি বেয়ে অন্ধকারে হারিয়ে যায়-

আমার ভাষার শব্দ

সময়ের অন্ধকারকে প্রকাশ করার জন্য

আহত শরীর নিয়ে উদ্ভ্রান্ত

রবীন্দ্রনাথের প্রাচুর্য, সৌভাগ্য এবং আনন্দ থেকে সে বঞ্চিত

হৃতশ্রী আমার শব্দ আজ সমস্ত ক্ষুব্ধ ইচ্ছার

উপমা হতে চাচ্ছে-

আমার প্রতিদিনের শব্দ।

(৩)

দ্বিখণ্ডিত শিশুর মৃতদেহ নিয়ে

অট্টহাস্যে যারা রাত্রির নীরবতাকে ভয়াল করলো,

যারা আমার কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করবে ভেবে

সকাল বেলার শিশিরকে রক্তিম করলো

(মাতৃদুগ্ধের মতো স্রোতস্বিনী

অজস্র শবের আর্ত দৃষ্টি নিয়ে প্রবাহিত)

 মধ্যযুগের অন্ধকারকে লজ্জিত করে

যে-সব সারমেয় তাদের করাল

দ্রষ্টাংশরেখায় আমাকে

আতুর করতে চাচ্ছে

আমার প্রতিদিনের শব্দে তাদের

ধ্বংস উচ্চারিত হোক,

মাতৃভূমি আমার, আমার সপ্রেম

অনুরাগকে যারা কলঙ্কিত করতে চাচ্ছে

আমার অজেয় শব্দে-

তাদের সর্বনাশ চিহ্নিত হোক-

আমার প্রতিদিনের শব্দ।

<005.014.315>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

(8)

ভয় থেকে উন্মাদ উদ্দেশ্যহীন পলায়ন

যখন আর সম্ভবপর হচ্ছে না

যখন রুদ্ধশ্বাস জীবনে বেঁচে থাকার যন্ত্রণা নিয়ে

আমরা হতভাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছি

আর রাত্রির অন্ধকার দেখেছি

আকাশ থেকে এক একটি তারা খসে পড়ছে

এবং অসহ্য একটি স্তব্ধতায়

আবেগের সমস্ত তরঙ্গগুলো

অশ্রুতে হারিয়ে যাচ্ছে,

তখন আমার শব্দে নতুন বিস্ময়ের উন্মোচন ঘটুক-

আমার প্রতিদিনের শব্দ।

লেখকের নিকট থেকে প্রাপ্ত)

<005.014.316>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

১৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

অশুভ শক্তির চ্যালেঞ্জ আমি

নেওয়াজিস হোসেন

রক্তে আখরে লেখা

পঁচিশের মর্মন্তুদ রাত্রির

ভয়াল পরিধি- নীল-স্বপ্নের

সাত কোটি রজনী জলের

সমুদ্রে কান্না শব্দে তরঙ্গ শিহরিত।

বাংলাদেশ-

কুচক্রী শক্তিসমুহের লালসার

পাদপীঠ কখনো নয়;

 এ নির্ভুল শাশ্বত সত্য যোজনার জবাব

প্রস্তুত রণাঙ্গণে –

সাড়ে সাত কোটি সুদৃঢ় বজ্ৰমুষ্ঠি।

ক্ষমার অযোগ্য পশুশক্তির

নির্মম শাস্তি দিচ্ছিঃ

নিঃস্নেহে জীবনের শত্রুকে আহবান করে

মৃত্যুর খোলা দরজা।

শব্দ দেয় উৎফুল্ল উপহার আমায়

বিপুল বিপ্লবী সাড়া।

স্বজন হারানোর বেদন বিক্ষোভের সবটুকু বহ্নি

আজ প্রাণ মনে উত্থিত।

নির্মেঘ আকাশে অযথা মেঘাবির্ভাবকারীর

তাহলে চ্যালেঞ্জের জন্যে প্রস্তুতঃ

অগ্নিমূর্তি এক আমি সত্তা।

(শব্দসৈনিক- ফেব্রুয়ারী, ১৯৭২ থেকে সংকলিত)

<005.014.317>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

৩০ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

কমাণ্ডার

নাসিম চৌধুরী

কমাণ্ডার

আমরা প্রস্তুত কামান,মর্টার,রকেটে, গোলায়,

যুদ্ধের কড়া সাজে, বেল্টে-বুটে

আমরা সেজেছি যথারীতি।

এবার তোমার অর্ডার দেবার, পালা-

দাও অর্ডার

কমাণ্ডার।

দেখ, চারদিকে প্রস্তুতির আয়োজন শেষ,

কী ভয়াল সুন্দর অন্ধকার ঘনিয়েছে চারদিকে

এতক্ষণ যে মুমূর্য আলো ছড়াচ্ছিল

কৃষ্ণপক্ষের অসুস্থ চাঁদ,

সেটাও টুপ করে খসে গ্যাছে কোন রহস্যলোকে

এখন শুধু অন্ধকার-

কি বিশ্বাসী বন্ধুর মত ঘিরে আছে চারিদিক

আর দেখ কী লোমহর্ষক নীরবতা!

কুলায় ফিরে গ্যাছে সর্বশেষ পাখী

শুধু একটানা ঝিল্লীর ঝংকার।

এটাইতো শক্রনিশ্চিহ্নের মাহেন্দ্রক্ষণ

কমাণ্ডার

আর দেরী নয়, শুধু অর্ডার।

কমাণ্ডার

শুধু তোমার একটি অর্ডার

দেখবে কী দুর্জয় করে তোলে আমাদের।

কী প্রচণ্ড সাড়া জেগে ওঠে রক্তের ধারায়

<005.014.318>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

কী প্রখর জ্বলে ওঠে চোখের তারা

কী অট্টশব্দে গর্জন করে ওঠে প্রতিটি অস্ত্র

শত্রুর আর্তরব।

কমাণ্ডার, এবার শুধু অর্ডার করো, অর্ডার

তোমার অর্ডারের সঙ্গে সঙ্গে

ছুটে যাব আমরা

ঐ দূরে যেখানে শত্রুরা ফেলেছে ক্যাম্প

যেখানে প্রতিটি বাঙ্কারে শুয়ে আছে

হিংস ঘাতকের দল

আর পেন্টাগনের জেনারেলদের মত

কুটিল বক্র ট্রেঞ্চগুলি লুকিয়ে রেখেছে যে

হিংস্র হায়েনাদের

সেখানে ছুটে যাব কী তুমুল প্রাণের আবেগে

গর্জে উঠবে আমাদের মুষ্টিচ্যুত গ্রেনেড

সেই ধ্বংস উৎসবের আশায় বসে আছি

কমাণ্ডার

শুধু আদেশ দাও এবার।

কমাণ্ডার

আমরা প্রস্তুত

কামান মর্টার গানে, রকেটে গোলায়

যুদ্ধের কড়া সাজে, বেল্টে-বুটে

আমরা সেজেছি যথারীতি

এবার তোমার অর্ডার দেবার পালা

দাও অর্ডার

কমাণ্ডার।

কমাণ্ডার

এখনো কী সময় হয়নি তোমার?

এখনো কী দৃষ্টি রাখবে ঘড়ির কাঁটায়?

<005.014.319>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

উৎকর্ণ হবে ঘাসের প্রতিটি শিহরে?

দায়িত্ব কী পালন করবে তুমি

সংসারী কৃষাণীর মত

ভেবে-দেখে, কম্পনে-ত্রাসে?

দায়িত্ব গ্রহণ কী তবে বৃদ্ধত্ব গ্রহণেরই নামান্তর শুধু।

নইলে হিসাবের প্রয়োজন কী

ঘড়ি আর আঁধারের গাঢ়তা নিয়ে?

জানি তা আনবে আরো সুচারু সফলতা

কিন্তু আমাদের কাম্য তা নয়।

আমরা চাই বিশৃঙ্খল বেঠিকের মাঝে

ভয়াল বিজয়।

আমাদের যাত্রা হবে হঠাৎ আচম্বিতে

মনের তাড়ায়।

নিমেষে উগড়াবো যতগুলি জ্বালা আছে মনে

চকিতে ছুড়ে দেবো যতগুলি গোলা পাবো চোখে

আনবো না বিজ্ঞান অংকের মাপ

শুধু যাবার আবেগে চলে যাব।

কমাণ্ডার

যদি ঐ বিদেশী পদবীটার সাথে জড়তা ওতপ্রোত থাকে

তবে তা ছুড়ে ফেলো বিষাক্ত ঘৃণায়

ভুলে যাও সময়ের নির্দিষ্টতা

 চলো এক সাথে ঝাঁপিয়ে পড়ি

শত্রুগুলোর ওপর

তাদের নিশ্চিহ্ন করে দি

আমাদের বেহিসাবী উচ্ছঙ্খলতায়।

তারপর ক্ষতি হয়ে পড়ে থাকি

বে-নিয়ম পৃথিবীর পরে।

<005.014.320>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

____________(স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের দলিলপত্র থেকে সংকলিত)

৫ অক্টোবর, ১৯৭১

রিপোর্ট ১৯৭১

আসাদ চৌধুরী

প্রাচ্যের গানের মতো শোকাহত, কম্পিত চঞ্চল

বেগবতী তটিনীর মত স্নিগ্ধ, মনোরম

আমাদের নারীদের কথা বলি, শোনো।

এ-সব রহস্যময়ী রমণীরা পুরুষের কণ্ঠস্বর শুনে

বৃক্ষের আড়ালে স’রে যায় –

তৃপ্ত অতিথির প্রসন্ন ভোজন

দেখে শুধু মুখ টিপে হাসে।

প্রথম পোয়াতী লজ্জায় অনন্ত হ’য়ে

কোচরে ভরেন অনুজের সংগৃহীত কাঁচা আম, পেয়ারা, চালিতা-

সূর্যকেও পর্দা করে এ-সব রমণী ।

অথচ যোহরা ছিল নির্মম শিকার

সকৃতজ্ঞ লম্পটেরা।

সঙ্গীনের সুতীব্র চুম্বন গেঁথে গ্যাছে-

আমি তার সরকার- তার রক্তে স্বরলিপি লিখি।

মরিয়ম, যীশুর জননী নয় অবুঝ কিশোরী

গরীরেব চৌমুহনী বেথেলহেম নয়

মগরেবের নামাজের শেষে মায়ে-ঝিয়ে

খোদার কালেমে শান্তি খুঁজেছিল,

অস্ফুট গোলাপ-কলি লহুতে রঞ্জিত হ’লে

কার কী বা আসে যায়।

বিপন্ন বিস্ময়ে কোরানের বাঁকে-বাঁকে পবিত্র হরফ

বোবা হয়ে চেয়ে দ্যাখে লম্পটের ক্ষুধা,

মায়ের স্নেহার্ত দেহ ঢেকে রাখে পশুদের পাপ।

পোষা বেড়ালের বাচ্চা চেয়ে-চেয়ে নিবিড় আদর

সারারাত কেদেছিলো তাহাদের লাশের ওপর।

এদেশে যে ঈশ্বর আছেন তিনি নাকি

<005.014.321>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

অন্ধ আর বোবা

এই ব’লে তিন কোটি মহিলারা বেচারাকে গালাগালি করে।

জনাব ফ্রয়েড,

এমন কি খোয়াবেও প্রেমিকারা আসে না সহজ পায়ে চপল চরণে।

জনাব ফ্রয়েড, মহিলারা

কামুকের, প্রেমিকের, শৃঙ্গালের সংজ্ঞা ভুলে গ্যাছে।

রকেটের প্রেমে পড়ে ঝরে গ্যাছে

ভিক্টোরিয়া পার্কের গীর্জার ঘড়ি,

মুসল্লীর সেজদায় আনত মাথা

নিরপেক্ষ বুলেটের অন্তিম আজানে স্থবির হয়েছে।

বুদ্ধের ক্ষমার মূর্তি ভাঁড়েত মতন

ভ্যাবাচেকা খেয়ে পড়ে আছে, তাঁর

মাথার ওপরে

এক ডজন শুকুন মৈত্রী মৈতী ক’রে

হয়তো বা উঠেছিলো কেঁদে।

পা-টিপে পা-টিপে জ্যোতির্ময়

স্যারের কেলাস থেকে চ’লে গ্যালো।

কাচের গ্লাসের মতো ভেঙ্গে গ্যালো ছাত্রাবাস।

পৃথিবীর সব চিন্তা কাগজের চেয়েও দ্রুত পুড়ে গ্যালো,

বারুদের গন্ধে ধন্য গ্রন্থাগার ব্যাণ্ডেজে সুন্দর।

জনাব উ থান্ট,

জাতিসংঘ ভবনের মেরামত অনিবার্য আজ।

আমাকে দেবেন, গুরু, দয়া ক’রে তার ঠিকাদারী?

বিশ্বাস করুন রক্তমাখা ইটের যোগান

পৃথিবীর সর্বনিন্মহারে আমি দিত পারি

যদি চান শিশুর গলিত খুলি, দেওয়ালে দেওয়ালে শিশুদের রক্তের আল্পনা

প্লিজ, আমাকে কন্ট্রাক্ট দিন।

দশ লক্ষ মৃতদেহ থেকে

দুর্গন্ধের দুর্বোধ্য জবান শিখে রিপোর্ট লিখেছি- পড়, পাঠ কর।

কুড়ি লক্ষ আহতের আর্তনাদ থেকে

ঘৃণাকে জেনেছি-পড়, পাঠ কর।

<005.014.322>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

চল্লিশ হাজার ধর্ষিতা নারীর কাছে

জুলুমের সবক নিয়েছি – পড়

দুঃখের স্মৃতিতে ডোবা আশি লক্ষ শরণার্থী

শিখিয়েছে দীর্ঘশ্বাসে কতোটুকু ক্রোধ লেখা থাকে।

কোলকাতার কবির মতো কে পারে শোনাতে

‘আমি তোর জন্ম সহোদর?’

অনাহুত বিবেকের ভ্রাম্যমাণ স্থায়ী প্রতিনিধি হয়ে

ক্লান্তিহীন, বিশ্রামবিহীন আমি ছুটে যাই শান্তির সভায়

কখনো দিল্লীতে, মস্কো, লন্ডন প্যারীর

জনাকীর্ণ সমাবেশে আমি খুঁজি একজন রাসেলের মুখ,

প্রেমের লিপিকা পড়ি জেনেভার জুরীদের কাছে-

পৃথিবীর ইতিহাস থেকে কলঙ্কিত পৃষ্ঠাগুলো রেখে

চ’লে আমি ক্যানাডার বিশাল মিছিলে শ্লোগান শোনাতে।

মানুষের জয় হোক, নিপীড়িত জনগণ জয়ী হোক অন্তিম সমরে।

পলাতক শান্তি যেন ফিরে আসে আহত বাংলার ঘরে ঘরে।

(শব্দসৈনিক’-ফেব্রুয়ারী ১৯৭১ থেকে সংকলিত)

<005.014.323>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

কোন এক নিবেদিতাকে

টি, এইচ, শিকদার

নিবেদিতা,

তোমাকে দেখেছি আমি আগেও অনেক

দেখেছি পথের ভিড়ে, একুশের

সুকান্ত মিছিলে।

এবং কখনো কোন-জলসায়

ভার্সিটির তর্কের আসরে, পাঠাগারে

মেটেরিয়া মেডিকার স্তুপীকৃত

জ্ঞানের সমুদ্রে।

নিবেদিতা,

তোমাকে দেখেছি আমি আগেও অনেক

বঙ্গোপসাগর তীরে, কিংবা কোন সবুজাভ

হিলট্র্যাক্ট জুড়ে সাঁওতালী ছেলের হাতে,

মুক্তোময়ী ঝিনুকের খোলের ভেতরে।

তখনো তোমার চুল ভার্জিনিয়া

তামাকের দেশে, মূৰ্ছিত নেশার মত

তীব্রতর সুবাস ছড়ায়;

তোমার ভুরুতে আঁকা সমুদ্র-কাজল

বৃষ্টির নূপুর হয়ে সঙ্গীত শোনায়।

সুরচিতা,

আজকে তোমাকে আমি দেখেছি আবার –

রক্তাক্ত বাংলাদেশে, খুলনা, কুমিল্লা, ঢাকা,

রংপুর, সিলেট আর কুষ্টিয়ার বিষগ্ন সেক্টরে:-

<005.014.324>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

আহত আত্মার পাশে, টাংকের

ভয়াল-চোখ গর্জনের মুখে,

প্রসন্ন ফুলের মত উৎসর্গের তরে।

কি আশ্চর্য! এখন তোমার মন

অন্যভাবে অনন্য ইচ্ছায়

নিবেদিত, সাত কোটি রক্তের সত্তায়ঃ

সহস্র ধ্বংসের বাজ, মেশিনগান, মর্টারের স্তুপে

অক্টোপাশ-ডানা দেখি অনির্বাণ ভিসুভিয়েসের;

এবং তোমাকে দেখে, সমৰ্পিতা,

যদি আমি হতে পারি অন্য এক নিবেদিত প্ৰাণ।।

(বেতার বাংলা’-মার্চ ১৯৭২ থেকে সংকলিত। কবিতাটি প্রচারের তারিখ জানা যায়নি

<005.014.325>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

নামফলক

অনু ইসলাম

মহান শহীদানের স্মরণে লেখা

প্রস্তর ফলকে বন্ধু তোমাদের নাম ।

আমি হাঁটছি ২৫শে মার্চ থেকে

আমি হাঁটছি কালো-লাল এবং

সবুজ থেকে ঝলসানো স্বাধীনতা

পর্যন্ত।

এখন বন্ধুরা

স্থির হয়ে তাকিয়ে দেখ্যো

কেমন করে ঢেকে রেখেছি

তোমাদের স্মৃতিগাঁথা আমার বুকের মর্মরে।

জানো এখন আমার চোখ থেকে

সব আলো ফুরিয়ে গ্যাছে ।

দ্যাখো আমার চোখ দুটি কেমন করে

ঢেকে রেখেছি

রাশ রাশ জানা অজানা নামে।

আমি তবুও পড়তে পারি

(শিশু শিক্ষায় যেমন পড়তাম)

মানুষের হৃদয়ের পটে পটে

লক্ষ লক্ষ মানুষের নাম।

(ওরা মানুষ নয় বীর)

সালাম,

বরকত,

মুক্তিযোদ্ধা

এবং শেখ

যে একটি মানচিত্র।

আমার বুকের নীচে

রক্তের ঝরণা-

ঝরণার গানে গানে

শুধু শুনি লক্ষ নাম-

<005.014.326>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

সালাম

রফিক

মুক্তিযোদ্ধা।

(শব্দসৈনিক’-ফেব্রুয়ারী ১৯৭২ থেকে সংকলিত। কবিতাটি প্রচারের তারিখ জানা যায়নি)

৫ নভেম্বর, ১৯৭১

হে স্বদেশ হে আমার বাংলাদেশ

মোহাম্মদ রফিক

তোমার দেহের মতো খর-কৃপাণের মতো

দীর্ঘ ও উদ্যত ঋজু

সারি সারি

শাল-তরু-শ্রেণী

দাঁড়িয়ে রয়েছে দুই পাশে;

দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর চুমু খেলে

ভয়ে ও বিহবলতায়

যেমন কম্পন জাগে

তোমার দু’গালে ঠোঁটে, আজকে রাত্রেও তেমনি

উদগ্রীব অপেক্ষার

রুদ্ধ শিহরন সাড়া

শাখে শাখে, শকুনের ডানার ঝাপটে যেন

ঢেউ ওঠে ভয়াল সাগরে;

তোমার ত্বকের রং যেন

তপ্ত কাঞ্চনের মতো

লেগে আচে সড়কের প্রতি ধূলিকণা সাথে,

চোখের মণির মতো সজল নিবিড় কালো

জমছে খণ্ড খণ্ড মেঘ

সারাটা আকাশময়

হয়তো নামবে বৃষ্টি একটু পরে,

যেমন শোনিত চুঁয়ে চুঁয়ে

পড়ছে তোমার পথে পথে

তাল ও তমাল শাখে

শত্রুর বেয়নেটে

<005.014.327>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

তোমার প্রাণের মতো

উষ্ণ লাল রক্ত

যেমন ঝরছে

মাঠে মাঠে গঞ্জে বাটে;

ক’জন চলেছি আমরা

সড়কের, পর দিয়ে এই

একটি ট্রাকে ঠাসাঠাসি

উচিয়ে সঙীন দৃপ্ত

আমরা চলেছি এই

নিরন্ধ রাতের মাঝামাঝি

তোমার প্রেমের ঋণ

রক্ত ঋণ

রক্ত দিয়ে শোধ করে দিতে;

শুধু আলো হাওয়া চাঁদ

বা সূর্যাকরণ নয়

তোমার শরীরে মাগো

বিকট দুর্গন্ধ আছে,

ক্লান্ত শ্রান্ত অবসন্ন সব

কচি কচি যোদ্ধাদের

ঘামে ভেজা ছেড়া গেঞ্জি

ময়লা বিছানা হতে

বিবমিষা ছুটে আসে;

তোমার দেহের সাথে

এ দুর্গন্ধে মাগো

আমাদের ভবিষ্যৎ যেন

নবজাতকের মত

হাত পা বাতাসে ছুড়ে খেলা করছে;

শুধু খালে বিলে মাঠে

নদীতে নালায় জলে

বা সীতাকুণ্ডর

পর্বতমালায় নয়,

<005.014.328>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

এইসব বৃষ্টিভেজা

কাদামাখা তাঁবুতে তাঁবুতে যেন

তোমার মানচিত্ৰখানি

কতগুলি

ছোট ছোট জারুলের চারার মতো

উষ্ণ তাজা

হৃদয়ের সাথে লেপ্টে আছে।

বিভিণ্ণ টিলায় ট্রেঞ্চে

রাইফেলে ট্রিগারে হাত চেপে

দেখছি প্রতিদিন

হাজার হাজার জীর্ণ অবসন্ন ধর্ষিতা নারীও

পুরুষের সাথে

শত্রুর সন্ত্রস্ত গুলি বেয়নেট বেড়াজাল

কি করে এড়িয়ে মা আমার

হেঁটে চলেছে দল থেকে দলে

দৃপ্ত পায়ে

কুয়াশার আস্তরণ ছিড়ে

ভেঙে পড়া

প্রথম সূর্যের ক্ষীণ

আলোর রেখার মত

কম্পমান সম্ভবার দিকে !

বহু পরে

অনেক রাতের শেষে

আধারের আস্তরণ ভেঙে

নির্দয় নিশ্চিত সূর্য

জরাজীর্ণ

দেয়াল ফাটলে বট

বৃক্ষের চারার মতো

যখন বেরিয়ে আসবে

ফেটে পড়বে

বহু প্রতীক্ষিত

সেই আনন্দিত ক্ষণে

<005.014.329>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

হয়তো দেখবে

তোমার ঘরের পাশে

উজ্জ্বল পৈঠার, পর

দু’একটি ফোঁটা

মলিন রক্ত

লেগে আছে,

তখন কি

মনে পড়বে

প্রিয়তমা

আমরা ক’জন মিলে

অবিচল প্রত্যাশায়

তোমার প্রেমের ঋণ

রক্ত-ঋণ

সহস্ৰ সহস্ৰ কোটি

হায়েনার চীৎকারের মতো

সেই এক

পৈশাচিক অন্ধকার রাতে

চলে গেছি

রক্ত দিয়ে

শোধ করে।

(স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের দলিলপত্র থেকে সংকলিত)

<005.014.330>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

১৫ নভেম্বর, ১৯৭১

আমার স্বর্গের নামে

মযহারুল ইসলাম

(এক)

সব কথা সব অনুভূতি যেন কোন এক বিষন্ন উদ্বেগে

হতবাক হয়ে আসে, ক্ষোভাচ্ছন্ন চেতনার উদ্দাম আবেগে

বাংলার মাঠে ঘাটে শহরে বন্দরে গ্রামে গ্রামে

রক্তঝরা মুহুর্তের তিমিরাঞ্চল-ছায়া নামে

শ্মশানের ভস্মে আর দুর্দীনের ক্লান্ত দীর্ঘশ্বাসে

আমাদের কাল শুধু বেদনায় স্নান হয়ে আসে।

(দুই)

বাংলা দেখেছে তার সন্তানের মৃতদেহে

কেমন ভরেছে মাঠ নদী

বাংলা দেখেছে তার সন্তানের রক্তে রক্তে

হিমসিক্ত স্রোতের প্রবাহ

বাংলা জেনেছে তার অপমানে লাঞ্ছনায়

অন্ধকার নামে নিরবধি

বাংলা বুঝেছে তার নির্যাতন নিপীড়নে

কি দুঃসহ যাতনা-প্রদাহ।

ইতিহাস তবু কথা বলে

মুক্তির সোনাসূর্য প্রভাতের প্রতীক্ষায় জাগে পূর্বাচলে।

(তিন)

চারিদিকে শুধু সংগ্রাম আর যুদ্ধ

হাতিয়ার হাতে চলে মহা জয় যাত্রী

বাংলার গ্রাম প্রান্তরে ঘাট প্রতিরোধ বিক্ষুব্ধ

পূর্বগগনে কাটে অভিশাপ-রাত্রি।

অযুত মৃত্যু, অনেক রক্ত সীমাহীন নিগ্ৰহ

পেরিয়ে এসেছে আজকের দিন অগ্নিশপথে স্নাত

<005.014.331>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

দিকে দিকে জাগে মহা অভিযান বিপ্লব বিদ্রোহ

বিজয়ের দিন মুক্তির দিন সম্মুখে প্রতিভাত।

(চার)

বাংলা আমার, স্বদেশ আমার, আমার বাংলাদেশ

রূপে রূপময়ী, চিরমধুময়ী স্বৰ্গ আমার বিশ্বে

সুজলা তটিনী আকাশ চেয়ে দেখি অনিমেষ

সবুজে শ্যামলে নৃত্যে ও গানে নবীনা দৃশ্যে দৃশ্যে।

বিশ্বে আমার স্বর্গ বাংলাদেশ

জাগ্রত আমি সেই স্বর্গের নামে

তার প্রেমে নব-চেতনার উন্মেষ

তারই অনুরাগে নামি মহাসংগ্রামে ।।

(স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের দলিলপত্র থেকে সংকলিত)

<005.014.332>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

১৫ নভেম্বর, ১৯৭১

বাংলাদেশ

মিজানুর রহমান চৌধুরী

গুরুদেব,

তোমার সোনার বাংলা আজ

শ্মশান হয়ে গেছে।

ফাগুনের আমের বনে

মুকুলের গন্ধ আজ আর নেই

বারুদের গন্ধে ভরেছে ফাগুনের বাতাস।

অবারিত মাঠ গগন ললাট আজ উত্তপ্ত।

বাংলার শ্যামল রূপ বিপর্যস্ত ।

মেশিন গান, মর্টার আর বোমার আঘাতে

বাংলার আকাশ বাতাস ভরে গেছে ।

হে রবীন্দ্রনাথ

তোমার সোনার বাংলা

আজ শ্মশান হয়ে গেছে।

হে বিদ্রোহী

ওরা সাত কোটির মুখের গ্রাস

কেড়ে নিতে চায়।

ওরা বুলেটের আঘাতে বাঙালীকে

নিশ্চিহ্ন করতে চায়।

ওই শোনো আকাশে বাতাসে

নিপীড়িত মানুষের ক্ৰন্দন রোল

ওই দেখ অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ

রক্তের হোলি খেলায় মেতে গেছে।

এস বন্ধু সেই শমসের নিয়ে

আর একবার পদ্মর জলে মোরা

<005.014.333>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

লালে লাল হয়ে মরি।

বাংলার পথ-প্রান্তর রক্তলেখায় পূর্ণ

এস বন্ধু আজ মোদের রক্তলেখায়

ওদের নিশ্চিহ্ন করে দিই।

জীবনানন্দ

তুমি দেখেছিলে রূপসী বাংলার

রূপ মনোহর।

পাখীর নীড়ের মত চোখ দেখেছিলে-

নাটোরে বনলতা সেনের।

বাংলার ভাটফুল কদম্বের ডালে

ধানসিঁড়ি  নদীটির পারে

ফিরে আসতে চেয়েছিলে

এই বাংলায়।

কিন্তু বন্ধু রূপসী বাংলার রূপ আজ বিবর্ণ

পশ্চিমা হানাদারের নির্মমতায়

বাংলার মাঠে ঘাটে হাহাকার ধ্বনি

প্রিয়া আজ দানবের হাতে বন্দিনী

ধর্ষিতা তরুণীর দিগন্ত বিদারী কান্না

আজ বাতাসে কেদে মরছে।

আশীৰ্বাদ করো বন্ধু

প্রিয়ার দৃষ্টির অগ্নিশিখায় যেন

শত্রুর মুখ জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যায়।

সুকান্ত

নবজাতকের কাছে অঙ্গীকার করে বলেছিলে

এ বিশ্বকে শিশুর বাসযোগ্য করে যাবে

কিন্তু নরদানবের পৈশাচিকতায়

অসংখ্য শিশু আজ অধিকার হারা।

বুভুক্ষু জনতার অসহায় ক্ৰন্দন

লাঞ্ছিত বঞ্চিত মানুষের ম্লান মুখ

<005.014.334>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

গভীর জিজ্ঞাসা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ।

এসো আজ সিগারেটের মত জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ড হয়ে,

এসো আজ দিয়াশলাইয়ের কাঠির মত মুখে বারুদ নিয়ে

এসো এই সংগ্রাম মাঝে

নতুন আলোর মন্ত্র নিয়ে।

ঠিকানা তোমার পেয়েছি বন্ধু

ইন্দোনেশিয়া, যুগোশ্লাভ, কম্বোডিয়া নয়

আলজিরিয়া, কেনিয়া, ভিয়েতনাম নয়

স্নেহ মায়া মাখা, মমতা ঘেরা এই বাংলায়।

(স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের দলিলপত্র থেকে সংকলিত)

<005.014.335>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

২৪ নভেম্বর, ১৯৭১

অবৈধ ন্যুরেমবার্গ ট্রায়াল

মুসা সাদেক

মহামান্য বিচারকমণ্ডলীঃ

এখন থেকে দুই দশক পূর্বে

পবিত্র ধর্ম এবং আইনের দোহাই সাজিয়ে

বিশ্ববিবেক, বিশ্বমানবতার ধ্বজা উঁচিয়ে

আপনাদের আদালতে যাঁদের বিচার করেছিলেন

আদালতে শেষতম শাস্তির বিধান দিয়েছিলেন

ঈশ্বর-দণ্ড-প্রাণ রক্ষার অধিকার কেড়েছিলেন

তারা প্রত্যেকেই নিরপরাধী এবং প্রত্যেকেই পুণ্যবান

এবং পবিত্র আইনের শ্লীলতাহানির অভিযোগে

মাত্র দুই দশকের ব্যবধানে আপনারা অভিযুক্ত।

ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না- দুই দশক বিলম্বে

আসামীর কাঠগড়ায় আপনারা দাঁড়িয়ে

তার খাসা একখানা প্রমাণ নির্মাণ করলেন অন্তত।

বিশ্ববিবেকের যেসব মহানতম ব্যক্তিত্বকে

আপনারা সেদিন মানব সত্তা এবং সভ্যতা হন্তা হিসেবে

চিহ্নিত করেছেন, তার জন্য আমাদের দারুণ বিলাপ

এবং বিশ্বব্যাপী শোক সভার ঘটা অচিরেই শুরু হবে।

মহামান্য আদালতঃ

আমি অবশ্য কোটি কোটি মানুষের দুর্দশা এবং দুর্ভাগ্যের জনক

ফুয়েরারের প্রসঙ্গ উপস্থাপন করছি

আমি অবশ্যই ফুয়েরার দোসর বেনিটো মুসোলিনীর কথা ভাবছি

ষাট লক্ষ ইহুদী নিধনের পুরোহিত মহাত্মা আইখম্যানের নামও উল্লেখ করছি।

আমি অবশ্যই কূটনীতিক হের হেস, প্রচারবিদ গোয়েবলস, সমরবিদ তেজো

প্রভৃতি পুণ্যাত্মাদের নামও উপস্থাপন করছিঃ

যাঁদেরকে আপনারা অবৈধ আইনের সত্তা অনুসরণ করে

ধর্মের দোহাই পেড়ে পাপাত্মা বলে চরম দণ্ড দিয়েছেন।

<005.014.336>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

এই সব মহাপ্রাণদের ন্যুরেমবার্গ-ট্রায়াল-প্রহসনের মাধ্যমে দণ্ড দিয়ে

সমগ্র বিশ্ব সভ্যতার যে অপূরণীয় ক্ষতি আপনারা করেছেন

আজ তার হিসাব হবে, আজ তার বিচার হবে

না হলে মানব সভ্যতার বুকে মহা অভিশাপ ধার্য হবে।

হে ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালের বিচারমণ্ডলীঃ

ঈশ্বরের অসীম করুণা যে সত্য, ন্যায়, ধর্ম এবং বিচার

অবশেষে প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে- তোমরা কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছ

অবৈধ ন্যুরেমবার্গ ট্রায়েলের তোমরা আসামী

ন্যুরেমবার্গ ট্রায়েলের আসামীদের উত্তরসূরিরা আজ বিচারপতিদের আসনে।

ভিয়েৎনামের লক্ষ লক্ষ হত্যাযজ্ঞের পুরোহিত মহাত্মা রিচার্ড নিক্সন

বাংলাদেশের পঞ্চাশ লক্ষাধিক মানুষ হত্যার যোগ্য জনক পুণ্যাত্মা এহিয়া

এবং অসংখ্য মাইলাই- ঐতিহ্যধারী পুণ্যাত্মারা।

আজকের মহামান্য আদালতের মহিমান্বিত বিচারকমণ্ডলী ।

আজকে বিচার হবে অবৈধ ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালের বিচারকদের

আজকে বিচার হবে ভিয়েৎনাম যুদ্ধ অপরাধে হোচিমিনের

আজকের বিচার হবে বাংলাদেশ অপরাধে শেখ মুজিবের।

(শব্দসৈনিক -ফেব্রুয়ারী ১৯৭২ থেকে সংকলিত)

<005.014.337>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

১ ডিসেম্বর, ১৯৭১

লাল গৌরবে আসে স্বাধীনতা

রফিক নওশাদ

বন্ধু তোমার শব্দীহ মিনার রক্তে আমার রাঙিয়ে দেবো

স্বাধীনতার জয় পতাকা এই মিনারেই উড়িয়ে যাবো।

বাংলার বুকে বেদনার ছায়া- হাসে না বাংলা সহজ গানে

হিংস্র শ্বাপদ তীক্ষ্ণ নখরে সবুজ কুঁড়িয়ে মৃত্যু আনে।

ঘন কালো রাত কালো শৃঙ্খল দুর্গম আজ পথের রেখা

তবুও রক্তে বান ডাকে জানি মুক্তি পথের মিলবে দেখা।

যুদ্ধক্লান্ত বন্ধু আমার, ঘুমাও শহীদ- মুক্তি সেনা-

তোমার রক্তে শপথ নিলাম শত্রুকে আজ হয়েছে চেনা।

গণ-শত্রুর কলজে ছিড়ে পিষবো পায়ে কসম ভাই-

 আমার ভায়ের রক্তের ঋণ শুধতে হবে আপোষ নাই।

সব শোষণের হিম কারাগার পদাঘাতে জানি পড়বে ধসে

গণ-যুদ্ধের রক্ত-ফসল তুলবো এবার যুদ্ধশেষে।

এদেশ আমার, কোটি জনতার- পরাধীনতার লগ্নশেষ

কৃষ্ণচূড়ার লাল গৌরবে আসে স্বাধীনতা- হাসে স্বদেশ।

(স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের দলিলপত্র থেকে সংকলিত)

<005.014.338>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১

অন্বিষ্ট রাজ্যঃ আমার বাংলা

প্রণব চৌধুরী

আমি পেয়েছি খুঁজে এক বাস্তবিক মানোরম রাজ্য।

এ রাজ্যের কোথাও নির্ধারিত কোন সামরিক শাসনের নেই

কড়া বিধি, খাঁচাবন্ধের ভয়।

এখানে সবার নির্বিকার বাধাহীন চলাফেরা,

মা’র কোলে দোল খাওয়া নিগৃঢ় নিশ্চিন্ত ঘুম,

নিরপরাধ আঁচলে মাথা ঝুঁকানো স্বামীর সোহাগ

পুত্তলি … …

এ রজ্যের সবচেয়ে বড়ো কথা, মুলত,

এখানে চিরায়ীত নিয়মে সব পথঘাট, প্রান্তর, জলাশয় নদী

ছায়ান্ধ অন্ধকারে কতোকাল ঢেকেছিল ভয়াবহ জঙ্গল।

অতঃপর একদিন এ রাজ্যের আবালবৃদ্ধ হাত বুলিয়ে গভীর প্রেম,

একে একে সব আধারের পাষাণ পাহাড়, সারি সারি

সভয় জঙল কেটে ভয়াল বাঘের চামড়ায়

শুতে দিল আজীবন ভীরু হরিণী;

মায়ের অনিঃশেষ স্নেহের মতো বাড়ালো সূর্য মুখ

এ সূর্য আর ভুবলো না কোনদিন

ডুবে আবার প্রাত্যহিক বিশাল কালো নদীতে

মাথা বাসানোর বুক ফুলালো না,

এ রাজ্যে সেই থেকে অন্ধকার নেই, প্রতি মুহূর্ত সূর্য

সূর্য আর ডোবে না প্রত্যহ

শুধু ‘আলোয় ভুবন ভরা আলোর স্রোতে পাল তুলেছে

হাজার প্রজাপতি ।। *

(স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের দলিলপত্র থেকে সংকলিত)

<005.014.339>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

১৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১

দিন এলো

আবুল কাসেম সন্দ্বীপ

রাত্রির শেষ-তমসার শেষ- পূর্ব দিগন্ত লাল

বন্দরে শুনি গর্জন আর সমুদ্রে উত্তাল

দুঃস্বপ্নের ঘোর কেটে গেছে- শংকার রাত শেষ

ধ্বংসের স্তুপে শিহরণ জাগে- জীবন্ত উদ্দাম।

গর্জন-ভীতি শংকিত বুকে দুর্জয় সংগ্রাম।

নবতর আজ চেতনার ধ্বনি- জীবনের ধ্বনি

কাল শেষ হয়ে গেলো- রাত্রির শেষ- দিগন্ত আজ লাল।

বেদনার দিন, শোষণের দিন, জালিমের কাল শেষ

শাদ্দাদ কাঁপে ভীত-শংকিত। সব নমরুদ মুহ্যমান।

দুর্গের দ্বার ভেঙেছি ওদের কঠিন কঠোর প্রতিজ্ঞায়-

আমাদের আজ দুবার গতি- দুর্জয় হলো বাংলাদেশ

দুঃস্বপ্নের ঘোর কেটে গেলো- শংকার রাত হয়েছে শেষ।

দিন এলো আজ বিজয়ের দিন- উল্লাস-ধ্বনি দেশে।

বেদনার কথা মিলনের বাণী বিরহবিধুর মন

সচেতন সব বঞ্চিতগণ- বিবেকের জাগরণ

নব উত্থান- নতুন জাতির হৃদয়ে সূর্যোদয়।

চঞ্চল চোখে উদাম আশা মৃত্যুর পরাজয়।

[‘শব্দসৈনিক’- ফেব্রুয়ারী ১৯৭২ থেকে সংকলিত ]

<005.015.340>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

শিরোনাম সূত্র তারিখ

১৫। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে

মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে প্রচারিত অনুষ্ঠান

‘অগ্নিশিখা’ থেকে সংকলিত

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের

দলিলপত্র

…ডিসেম্বর ১৯৭১

এহিয়া বধ কাব্য

৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১

নারীঃ

কহ বীর তুরা করি কীবা সমাচার?

কিভাবে দলিছে, মিত্রসেনা রণাঙ্গনে

এহিয়া চমুরে? ভূপাতিত ইয়াহিয়া

গিরিশৃঙ্গ কিম্বা তরু যথা বজ্রাঘাতে?

পুরুষঃ

গহন কাননে যথা বিধি মৃগবরে

কিরাত অব্যর্থ-শরে, ধায় দ্রুতগতি

তার পানে; শত শত মিত্রসেনা বলী

তেমতি ধায় যশোর শত্রুদুর্গ পানে

চূর্ণিয়া বিচূর্ণ হত করিতে তাহারে।

যথা প্রভঞ্জন বলে উড়ে তুলারাশি

হেরি যমাকৃতি মুক্তিসেনা রখীদলে।

পলাইলা, পলাইয়া সত্ৰাসে চৌদিকে।

মহারোষে যমসম মুক্তি মিত্র সেনা

বেড়াজাল মাঝে যথা ক্ষীণপ্রাণ মীন।

সমৰ্পিল অস্ত্র যত দীন করজোড়ে

মাগিল জীবন ভিক্ষা নরাধম কুল।

যশোহর দুর্গশিরে বিজয় কেতন

বাঙ্গালার মুক্তিসেনা উড়ায় গৌরবে।

<005.015.341>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

নারীঃ

যশোহর দুর্গ তবে হয়েছে পতন?

কহ বীর ত্বরা আর আর রণাঙ্গনে

কিভাবে যুঝিছে মিত্র অক্ষৌহিনী সেনা?

পুরুষঃ

সিলেট কুমিল্লা টাংগাইল নোয়াখালী

জিনি হেলাভরে, আন্দোলিয়া নীলাকাশে,

ঘোর রবে গরজিয়া ভীষন সরবে

চালিয়েছে মিত্রসেনা ঢাকা অভিমুখে

প্রলয়ের মেঘ কিম্বা করযুথ যথা।

অগ্নীময় আকাশ পুড়িছে কোলাহলে

যথা যাবে ভূকম্পন, ঘোর বজ্রনাদে

উগড়ে আগ্নেয়গিরি অগ্নিস্রোতরাশি

নিশীথে! আতঙ্কে শত্রু উঠিছে কাঁপিয়া

কাঁপিছে মালিক বিভীষন প্রাণভয়ে

থরথরি পিণ্ডিনাথ কাঁপে সিংহাসনে।

অলংঘ্য সাগর সম মিত্র অক্ষৌহিনী

বেড়িছে তাহারে। রক্ষা নাহি এবে তার।

বনের মাঝারে যথা শাখাদলে আগে

একে একে কাঠুরিয়া কাটি, সবশেষে

নাশে বৃক্ষ; মহারথী মিত্র অক্ষৌহিণী

তেমতি দুর্বল করে এহিয়া পামরে

নিরন্তর। অবিলম্বে সমূলে নির্মুল

হইবে কুমতি। রক্ষিবে না কভু তারে

চীন আমেরিকা; রক্ষিবে না খান সেনা

আপনার জন। তুরঙ্গে কুরঙ্গে যেবা

মৃগেন্দ্র কেশরী নখে ছিন্নভিন্ন করি

নাশে প্রাণ, শৃগালের পদতলে চাপি

পিষ্ট করি সংহারে ক্রোধান্ধ ঐরাবত

তেমতি নাশিবে প্রভঞ্জন-সেনা সম

মিত্রসেনা ঘোর রণে এহিয়া পামরে।

<005.015.342>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

নারীঃ

ধর্ম-নাম লয়ে যেবা ধর্ম নাশিয়াছে,

ধর্ম তারে করিবে না ক্ষমা। ধর্ম কভু

ক্ষমিবে না ঘোর অধৰ্মীরে। নরহন্তা

পাশব শ্বাপদ লভিবে না প্রাণভিক্ষা।

পুরুষঃ

পৃথিবীর রাষ্ট্রপুঞ্জ যদি ছত্র ধরি

তারে রক্ষিবারে চাহে, বজ্রঘাত হতে

রক্ষা নাতি হার । লুকালে জলধিতলে

মিত্রসেনা জল সেচি অতল সলিল

আনিবে ধরিয়া তারে মৃত্যুদণ্ড লাগি।

অধর্মের পরাজয় জানো সুনিশ্চয়।

নারীঃ

জয় সত্যের জয়, জয় ধর্মের জয়

উভয় কষ্ঠেঃ

জয় মুক্তিবাহিনীর জয় জয় জয়

জী জীবনের জয়, জয় বাংলার জয়।

…ডিসেম্বর, ১৯৭১

পুরুষঃ

দুরাত্মা দানব দল মদমত্ত হয়ে

হানিয়াছে বঙ্গবক্ষে নিষ্ঠুর আঘাত

কাপুরুষ সম। সদা রুধিরাক্ত দেহে

কাঁদিছে জননী। হিংস্র হায়েনারা সবে

প্রমত্ত উল্লাশে ফেরে রাতের আঁধারে

প্রসারিত লোলজিহবা প্রেতের মতো।

দুগ্ধপোষ্য শিশুদের স্তুপ মৃতদেহ,

বিধাতার জয়গান গাহিছে দানব।

পাকিস্তানের গলিত শব কাঁধে বহি

<005.015.343>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

ইসলাম বাচাইতে কতিছ বাসনা

পামর এহিয়া।

নারীঃ

ইসলাম কি বাঁচিবে তাহে?

মানবতা হত্যাকারী জল্লাদের

হাতে ধর্ম কভু লভিবে কি প্রাণসুধা?

পুরুষঃ

ধর্ম কহে না কভু নিষ্পাপ শিশুদেহে

করিতে আঘাত। ধর্ম কভু কহে নাই

নারীদেহ পশুসম করিতে দলন৷

ধর্ম কভু কহে নাই সুতীক্ষ্ম শাণিত

অস্ত্রে নারীদেহ খণ্ডবিখণ্ডিত করি

রক্তমাখা মুখে গাহিতে ধর্মের গান।

যদি কেহ অস্ত্রাঘাতে শিশুহত্যা করে

যদি কেহ মদমত্ত পাশব ক্ষুধায়

নারীদেহে করিবে দলন তার লাগি

রহিয়াছে অনির্বা অনন্ত নরকণ।

নারীঃ

ইয়াহিয়া পাক্সেনা মুখে ভাই বলি

ভ্রাতৃবক্ষে হানিয়াছে পাশব আঘাত

নারীরক্তে করিয়াছে ক্ষমাহীন পাপ

বাংলার বুকে।

পুরুষঃ

তারি লাগি দৃড়পদে

চলিয়াছে মুক্তিসেনা ক্ষমাহীন ক্রোধে

বিধাতার বজ্ৰসম করিতে সংহার

পাক পশু সেনা । ক্ষিপ্ত কেশরী যেমতি

বনভূমি প্রকম্পিয়া প্রচণ্ড গর্জনে পশুদেহ

ছিন্নভিন্ন করি তপ্তরক্তে করে

<005.015.344>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

তৃষ্ণা নিবারণ, মদমত্ত করি

যথা শঠ শৃগালের পদতলে দলি

প্রতিহিংসার আগুন যত করে প্রশমন

তেমতি দুরন্ত ক্রোধে বীর মুক্তিসেনা

সুতীক্ষ্ণ অস্ত্র প্রহরে জর্জিরিত করি

পাক সেনা যত, প্রতিশোধ বহ্নি করে

নির্বাপণ। শত্রুরক্তে করি স্নান সদা

নিভাইছে প্রতিহিংসার প্রজ্বলিত চিতা।

ক্রদ্ধ সিংহসম মুক্তিসেনা আগমনে

দানবের দল ভীত শ্বাপদের মতো

পুচ্ছ নামাইয়া প্রাণভয়ে ছুটিয়াছে

আত্মরক্ষা লাগি দিকে দিকে ধ্বনিতেছে

গগন বিদারী কণ্ঠে বাংলার জয়,

নারীঃ

জয় সত্যের জয়, জয় ধর্মের জয়-

উভয় কষ্ঠেঃ

        জয় মুক্তিবাহিনীর জয়, জয় জয়

জয় জীবনের জয়, জয় মানবতার জয়।

 ১০ ডিসেম্বর, ১৯৭১

নারীঃ

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ মাঝে

কিবা খেলা চলিয়াছে কহ সমাচার

পুরুষঃ

নিরাপত্তা পরিষদে চীন আমেরিকা

স্বীয় স্বার্থে অন্ধ হয়ে কুকীতি স্থাপিল

ধরা মাজে। স্বর্ণ বঙ্গে দুরাত্মা এহিয়া

কনক কমল বনে ঐরাবত যথা

লণ্ডভণ্ড করে সব বিস্মারিল তাহা।

বিস্মরিল দানবের প্রচণ্ড ক্ষুধায়

জ্বলিতেছে এবে বাংলার জনপদ।

<005.015.345>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

স্বীয় ক্ষুদ্র স্বার্থ লাগি তোষণ করিছে

দুরাত্মা দানবে। ভারত আগ্রাসী কহি

মুক্তিযুদ্ধ দংশিবার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে

উঠিয়াছে মাতি, আনিয়াছে পরিষদে

প্ৰগলভ প্রস্তাব ক্ষান্ত হও, ক্ষান্ত হও

মহান ভারত। অস্ত্র করো সংবরণ।

নারীঃ

অতঃপর কি করিল মহান রাশিয়া?

পুরুষঃ

গর্জিয়া উঠিল রাশিয়ার প্রতিনিধি

ধূর্ত শৃগালেরে দেখি সঘনে গর্জিয়া

যেমতি কেশরী ধায় বিদ্যুৎ গতিতে

ধরিতে তাহারে, পাপিষ্ঠ ভ্ৰমিছে দেখি

যেমতি গর্জিয়া ওঠে সুর, সুরপতি

হানে বজ্র পাপিষ্ঠের শির লক্ষ্য করি

রাশিয়ার প্রতিনিধি তেমনি গর্জিয়া

হানিল বজ্রের প্রচণ্ড আঘাত। ভেটো দিয়া

কহিল অশনি স্বরে, পাপী পাকিস্তান

মহাপাপ করিয়াছে পামর এহিয়া।

শৃগাল হইয়া সিংহে করিছে আঘাত

ভারত সীমান্ত দেশ করি আক্রমণ।

জল্লাদ বাহিনী যবে হিংস্র হয়ে

ছিন্নভিন্ন করেছিল বাংলার দেহ?

কোথা ছিলে তুমি বীর চীন আমেরিকা

জল্লাদ বাহিনী যবে ক্রুর লালসায়

আহুতি দিছিল ভোগে লক্ষ লক্ষ নারী?

মানবতা বিসর্জিয়া আসিয়াছ এবে

পশু লাগি করিতে ক্ৰন্দন, দানবের

<005.015.346>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

রক্ষা করিবারে? কিন্তু হীন ইচ্ছা তব

হবে না সাধিত। যতদিন পাক সেনা

না ছাড়িবে বাংলার মাটি যতদিন

গলবস্ত্রে পামর এহিয়া চাহিবে না

ক্ষমা ভারতের পায়ে, অস্ত্র ততদিন

কোষবদ্ধ করিবে না ভারত কেশরী।

নারীঃ

ভেটো লভি দিশেহারা হইয়াছে তারা

কলংক জর্জর মুখে কথা নাহি আর।

হীনতার পরিচয় সর্ব অঙ্গে মাখি

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে যাচে

দস্যুর জীবন ভিক্ষা লজ্জা নাহি পায়

নিক্সন সরকার। নির্লজ্জ হয়েছে

চীন প্ৰগলভ কুমতি। এতদিন ধরি

গণতন্ত্র গণতন্ত্র বলি ভিয়েৎনামে

লক্ষ লক্ষ লোক হত্যা করি আমেরিকা

বাংলার গণতন্ত্র হত্যা অনুষ্ঠান

করিবার ষড়যন্ত্রে রত। বিসর্জিয়া

মানবতা, সাম্যবাদ বুলি প্রকাশিছে

চীন আপনার ক্রর গৃঢ় অভিলাষ

ভারত বিদ্বেষ। মানবতা নিয়াছে সে

বলি আপনার হীন স্বার্থ বেদিমূলে

রক্ষা কি পাইবে তাহে পামর এহিয়া?

পুরুষঃ

পৃতিবীর শক্তি যদি ছত্র ধরি থাকে

এহিয়া শিরের উপর রক্ষা নাহি

রক্ষা নাহি তার। লুকাইয়া থাকে যাদি

সমুদ্রে পর্বতে কিম্বা মরুভূমি মাঝে

কভু এহিয়া চমুর। যশোহর জিনিয়াছে,

চলিয়াছে বীর সেনা বীর পদভারে

<005.015.347>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

করিতে হেলায় জয় ঢাকার অংগন,

ব্যুহ ভাঙ্গি পলায়িত এহিয়া চমুর

এস্তভীত শ্বাপদ যথা মহা শংকায়

সন্দর্শিয়া বীরেন্দ্র কেশরী প্রাণভয়ে

উর্ধ্বশ্বাসে করে পলায়ন। সূর্যকর

মুক্ত হবে রাহুগ্রস হতে, ধ্বনিতেছে

গগন বিদারী কণ্ঠ, বাংলার জয়-

নারীঃ

জয় ন্যায়ের জয়, জয় ধর্মের জয়

উভয় কণ্ঠেঃ

জয় মিত্রবাহিনীর জয়, জয় জয়

জয় বাঙালীর জয়, জয় সত্যের জয়।

(রচনাঃ গাজিউল হক। আবৃত্তিঃ উম্মে কুলসুম ও আশফাকুর রহমান।)

<005.016.348>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৬। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত একটি রূপক অনুষ্ঠান- জল্লাদের দরবার (অংশ) স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের দলিলপত্র …১৯৭১

জল্লাদের দরবার

১১ জুলাই, ১৯৭১

নকীবঃ         (চিৎকার করে হকিছে) জনাব সদরে-মূলুক, খানা-এ-তালুক, প্যায়ারে মোহাম্মদ কেল্লা ফতে খান বাহাদুর-

ফতেঃ সিপাহসালার টিটিয়া খান, যুদ্ধের খবর কি?

সিপাহঃ         যুদ্ধ শেষ। আমাদের সেনারা এখন ক্যাম্পে বসে তুন্দুরী রুটি খাচ্ছে। আর ঘুমুচ্ছে।

দুর্মুখ খানঃ     জনাব সদরে মুলুক, গোস্তাকি মাপ। আমি দুর্মুখ খান। মাঝে মাঝে অতিব সত্য কথা না বললে কেমন যেন অম্বলের মতো বুক জ্বলে যায়।

ফতেঃ তোমার কি বক্তব্য, বলে ফেল দুর্মুখ খান।

দুর্মুখঃ আমাদের সিপাহসালার বুড়ো হলেও মনটা জোয়ানই আছে। উনি এই মাত্র বললেন আমাদের সেনারা নাকি যুদ্ধ শেষ করে এখন ক্যান্টনমেন্টে বসে তুন্দুরী রুটি খাচ্ছে আর ঘুমুচ্ছে।

ফতেঃ   তুমি কি বলতে চাও?

দুর্মুখঃ হুজুরে আলা, আপনি তো তিন মাস হ’ল হার্ট আর মাথা ঘুরানি ব্যামোতে আপনার ‘মসরকী বাঙ্গালে’ পা রাখতে পারেননি। যদি মেহেরবানী করে একবার “বাংলাদেশে” যান তাহলে দেখতে পাবেন, ওইসব দুষ্টু বিচ্ছিন্নতাবাদী মানে মুক্তিবাহিনী প্রতিদিন আপনার প্যায়ারে সেনাদলকে এ্যায়সান ধোপা পাটকান পাটকাচ্ছে যে, সেইসব আমাদের সেনারা তুন্দুর রুটি খাবার বদলে হাসপাতালের বেড়ে খাবি খাচ্ছে। ওরা ঘুমুচ্ছে ঠিকই- তবে সে ঘুম সহজে ভাঙবার নয়। উঃ কি মার হুজুর- একেবারে বদন বিগড়ে দিয়েছে।

ফতেঃ খামোশ নালায়েক! মুক্তিবাহিনী-মুক্তিবাহিনী-মুক্তিবাহিনী আমাকে পাগল না বানিয়ে ছাড়বে না দেখছি।

দুর্মুখঃ গোস্তাফি মাফ জনাব। ভুলে গিয়েছিলাম, ওদের মুক্তিবাহিনী বলা চলবে না। মানে ঐসব দুষ্ট্র বিচ্ছিন্নতাবাদীরা।

ফতেঃ দুমুখ খানের একথা কি সত্য টিটিয়া খান?

সিপাহঃ         জনাব, মারতে গেলে মার খেতে হয়- এইটাই আমাদের যুদ্ধকৌশল।

<005.016.349>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

ফতেঃ তাহলে ওইসব দেশদ্রোহীদের হাতে আমার সাধের সেনাদল এখনও মার খাচ্ছে।

দুমুর্খঃ খাচ্ছে মানে? এ মার এমন মার যে হজম করা মুস্কিল। মেরে একে বারে তক্তা করে দিচ্ছে। আহা!

ফতেঃ দুর্মুখ খান, তোমার এই কথা শুনে আমার মাথাটা আবার ঘুরে উঠল। পানি।

সিপাহঃ         জনাব, আপনি বিচলিত হবেন না। আমাদের বীর সেনাবাহিনী জান দিয়েও দেশ রক্ষা করবে।

দুমুর্খঃ          দেশ রক্ষা নয়- বলুন তারা এখন পেট রক্ষায় ব্যস্ত।

ফতেঃ তার মানে? বেশ খোলাসা করে বলো দুর্মুখ খান।

দুমুর্খঃ তার মানে বুঝলেন না জনাব? আপনার সেনাদল বাংলাদেশের বুকে অভিযান চালাবার নামে নিরীহ মানুষ গুলোকে হত্যা করেছে, তাদের যথাসর্বস্ব লুটতরাজ করেছে, ব্যাঙ্ক লুটেছে। এইসব লুটের টাকায় আপনার এক-একজন গরীব সেনা রাতারাতি ক্রোড়পতি বন গিয়া।

ফতেঃ  এ তো আনন্দের বিষয়। খোশ খবর।

দুমুর্খঃ   কিন্তু নিরানন্দে আপনি তাদের ভাসালেন জনাব। আচমকা একশো আর পাঁচশো টাকার নোটগুলোকে কাগজ করে দিয়ে আপনার ওইসব ক্রোড়পতি সেনাদের আপনি একেবারে পথে বসালেন। তারা বলছে, কেল্লা ফতে খান আমাদের পথে বসালেন।

ফতেঃ   সিপাহসালার, এ কথা কি সত্য? এই দেখো মাথাটা আবার-

সিপাহঃ আংশিক সত্য জনাব। লুটের টাকা নিয়ে সৈন্যদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে কিনা জানি না। তবে তারা পুরো মাইনে না পাওয়াতে মানে ডিফেন্স সারটিফিকেটে মাইনে দেওয়াতে দিলে বড়ই দুঃখ পেয়েছে।

ফতেঃ কি আর করা যাবে সিপাহসালার। যুদ্ধের ব্যয়, খয়রাতি সাহায্য বন্ধ, ব্যবসা অচল। এই সব মিলে কোষাগার প্রায় শূন্য। উঃ মাথাটা কেমন যেন-

সিপাহঃ ভাববেন না জনাব। আমাদের সেনারা মাইনে না পেলেও বীরবিক্রমে যুদ্ধ চালিয়ে যাবে।

দুর্মুখঃ   হ্যাঁ-হ্যাঁ, কুছ পরওয়া নাহি হ্যায়। পয়ষট্টি সালের যুদ্ধের সময় আমাদের স্বনামধন্য লালকানার নবাব নন্দন বলেছিলেন, যদি আমাদের ঘাস  খেয়ে বাচতে হয় তবু হাজার বছর যুদ্ধ চালিয়ে যাবো। ভাগ্যিস সতেরো দিনে যুদ্ধ থেমেছিলো।

সিপাহঃ         তুমি পরিহাস করছো দুর্মুখ খান!

দুর্মুখঃ এ পরিহাস নয় সিপাহসালার। বাস্তব আর মুখের বজঠাণ্ডা। বুলি এক নয়। এর মধ্যেই শোনা যাচ্ছে, আমাদের কিছু সেনা নাকি আর বাংলাদেশের নিরীহ মানুষ খুন করতে রাজী নয়।

ফতেঃ ওফ! মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল!

সিপাহঃ         বিচলিত হবেন না জনাব। এ নিতান্ত কিছু সেনার মুখের কথা- মনের কথা নয়।

<005.016.350>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

দুর্মুখঃ আমাদের বৃধ সিপাহসালার আজকাল কি তাঁর প্রতিটি অন্তরের গভীরতর তদেশ অন্বশ্ন করে এ খথা বলছেন? আপনার বীর বেলুচ সেনারা যে ধীরে ধীরে বিদ্রোহী হয়ে উঠছে। তারা নাকি এখন বলছে, কাফের হত্যার নির্দেশ আমাদের দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এখন দেখছি,  আমরা যাদের খুন করছি তারা নিরিহ মানুষ, তারা মুসলমান, তারা আমার ভাই।

ফতেঃ ওফ-মাথাটা আবার

সিপাহঃ         জনাব, আপনার মাথাটাকে অতো ঘোরাবেন না। আপনার প্রেসার আবার বেড়ে যাবে। আমার ওপর বিশ্বাস আর আস্থা রাখুন। সব ঠিক করে দেবো।

ফতেঃ কি করে আস্থা রাখি টিটিয়া খান! ইতিপূর্বে আপনি আমাকে বলেছিলেন সব স্বাভাবিক হয়ে গেছে। আমিও বিশ্বকে বুক ঠুকে বলেছিলাম, দেখে যান বিশ্ববাসী, আমরা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে সব স্বাভাবিক করে ফেলেছি। কিন্তু কতোকগুলো বিদেশী মানুষ এদেশে এসে আপনার জারিজুরি সব ফাঁস করে দিল। আমার মুখ হাসালেন।

দুর্মুখঃ শুধু মুখ হাসালেন না, চোখের জলে লোমশ বুক ভাসালেন। আচ্ছা জনাব, যুদ্ধটা বন্ধ করে দিলে হয় না?

ফতেঃ   কি বললে?

দুর্মুখঃ   একটু ভেবে দেখুন, আপনার জন্মদাতাও অবশেষে যুদ্ধে ক্ষ্যান্ত দিয়ে নিরালায় বসে আত্মজীবনী লিখছেন আর দিলখুশবাগে পায়চারী করছেন। আপনিও না হয় সব কিছুতে ইস্তফা দিয়ে সাকী আর সুরা নিয়ে খোশমহলায় বাকি জীবনটা আরাম-আয়েশে কাটিয়ে দেবেন। কি দরকার এসব বুট ঝামেলা!

ফতেঃ দুর্মুখ খান, তোমার এই ঔদ্ধত্য স্পর্ধা দেখে আমি বিস্মিত হচ্ছি। রসনা সংযত করো। এই মুহুর্তে আমি তোমাকে বহিষ্কার করতে পারি।

দুর্মুখঃ পারেন না জনাব। কারণ আমি আপনার হৃদয়ের গভীরে বাস করি। সেখান থেকে আমাকে বিতাড়িত করবেন কি করে।

সিপাহঃ         জনাব আমি তাহলে এখন চলি।

ফতেঃ আসুন। তবে হ্যাঁ, স্মরণ রাখবেন সাড়ে সাত কোটি মানুষকে চরমভাবে শায়েস্তা না করা পর্যন্ত বিশ্রাম আমাদের হারাম।

সিপাহঃ         আমি আবার বলছি। আপনি নিশ্চিত থাকুন। আর ক’দিন পর ওদের আমরা ফুয়ে উড়িয়ে দেবো

দুর্মুখঃ (হেসে) দেখবেন, সাড়ে সাত কোটি মানুষের মিলিত নিঃশ্বাসে আপনারা শেষে উড়ে না যান! জনাব। নিজেদের গোড়া শক্ত করে রাখবেন।

সিপাহঃ         এ ব্যাপারে তোমার মাথা না ঘামালেও চলবে। আমি চললাম জনাব। খোদা হাফেজ।

ফতেঃ খোদা হাফেজ।

<005.016.351>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

দুর্মুখঃ জনাব, আমাদের সিপাহসালারের ভীমরতি ধরেছে। ওকে অবসর দিন।

ফতেঃ   আমিও তাই ভাবছি।

নকিবঃ জনাবে আলা, লারকানার নবাবজাদা আপনার দর্শনপ্রার্থী।

ফতেঃ   উঃ লোকটা আবার ঝামেলা করতে আসছে।

দুর্মুখঃ   সে কি জনাব, বাদশাজাদা আপনার প্যায়ারের দোস্ত। সেই দোস্তকে এখন বরদাস্ত না করার কারণ?

ফতেঃ   যখন প্রয়োজন ছিল দোস্তি করেছি।

দুর্মুখঃ   আর এখন প্রয়োজন শেষে ছোববার মতো রাস্তায় ছুড়ে ফেলে দিচ্ছেন এইতো!

ফতেঃ   এইটাই আমাদের নীতি। যাও, নবাবজাদাকে পাঠিয়ে দাও।

নকীবঃ জো হুকুম জনাব।

দুর্মুখঃ   আমি কি চলে যাবো জনাব?

ফতেঃ   না-না-থাক বুঝলে দুর্মুখ খাঁ, এক এক সময় তোমাকে সহ্য করতে পারি না সত্য, আবার তোমার অস্তিত্বকে অস্বীকারও করতে পারি না। আসুন, নবাবজাদা, আসন গ্রহণ করুন। তারপর কি সংবাদ?

নবাবঃ আমাদের পক্ষে আর প্রকাশ্যে চলাফেরা দুঃসাধ্য খাঁ সাহেব। কোন রকেম ছাতা দিয়ে মাথা বাঁচিয়ে চলছি।

ফতেঃ   কেন?

নবাবঃ আমার দলের সদস্যরা আজকাল কাবলে তাগাদা শুরু করেছে। তারা বলছে, আমরা এতো তকলীফ করে সদস্য হলাম, আর এখন পর্যন্ত ক্ষুদে উজির হওয়া তো দূরের কথা, মাইনেটা পর্যন্ত পেলাম না।

ফতেঃ   (হেসে) নবাবজাদা বর্তমান পরিস্থিতি বড়ই ঘোলাটে।

দুর্মুখঃ   নবাবজাদা সেটা জানেন হুজুর, কারণ ওঁর হাত দিয়েই তো ঘোল ঢালিয়েছেন।

ফতেঃ   দুর্মুখ খান!

দুর্মুখঃ   গোস্তাফি মাফ করবেন।

নবাবঃ খাঁ সাহেব, আপনি আমার কাছে ওয়াদা করেছিলেন বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ঠাণ্ডা করেই ক্ষমতা আমার হাতে অর্পণ করবেন।

দুর্মুখঃ   লাগ ভেল্কি লাগ, চোখে মুখে লাগ।

ফতেঃ   নবাবজাদা, আমার ওয়াদার পূর্বে আপনি আপনার দেশবাসীর কাছে ওয়াদা করেছিলেন যে, আপনার কতো একর জমি যেন গরীবদের মধ্যে দান করবেন। আপনি ওয়াদা রক্ষা করেছেন?

<005.016.352>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

নবাবঃ সেটা নিতান্ত আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার।

ফতেঃ   আর এটাও আমার কিছুটা ব্যক্তিগত ব্যাপার বৈ কি! কারণ

দুর্মুখঃ   কারণ, এই দেশ হুজুরের বাপ-দাদার খাশ তালুক না হলেও গোটা মালুকের একছত্ৰ মালিক উনি।

ফতেঃ   স্তব্ধ হও দুর্মুখ খান।

নবাবঃ আমি এসেছি এই জন্যে যে, আর আপনার কাছ থেকে নতুন প্রতিশ্রুতি নিয়ে যাবো খাঁ সাহেব।

ফতেঃ   প্রতীক্ষায় থাকু-ব্যবস্থা হবে।

নবাবঃ তাতো বুঝলাম। কিন্তু কবে!

দুর্মুখঃ   ঠিকই তো। এ কথা তো ছিল না!

ফতেঃ   দুর্মুখ খান

দুর্মুখঃ   গোস্তাফি মাপ করা হোক জনাব।

ফতেঃ   আর চার মাস অপেক্ষা করুন নবাবজাদা। যদি দুর্যোগ কাটিয়ে উঠতে পারি, যদি পৃথিবীর মানচিত্রে এ রাজ্যের অস্তিত্ব থাকে- তাহলে আমি অবশ্যই আপনাদের সম্পূর্ণ বিমুখ করবো না।

দুর্মুখঃ   হুজুর পাঠানের বাচ্চা- এক কথার লোক। পাঠান জীবন থাকতে ওয়াদা খেলাপ করে না।

ফতেঃ   নিশ্চয়ই।

দুমুখঃ   অবশ্য নেহাৎ বেকায়দায় পড়ে দু’চারবার বাধ্য হয়ে জনাবকে কথার বরখেলাপ করতে হয়েছে তবে পৃথিবীর গ্রেটম্যানরা ওসব করেই থাকেন।

ফতেঃ   দুর্মুখ, তোমাকে আমি কোতল করবো। তুমি গাধার বাচ্চা

দুর্মুখঃ   হুজুর আমার মা-বাপ। যা বলবেন তাই সত্যি।

নবাবঃ আমি চলি। আবার আসবো। খোদাহাফেজ।

দুর্মুখঃ   লারকানার নবাব নন্দন একটু চটে গেছেন।

ফতেঃ   কুছ পরওয়া নাহি। এই দেখো, আবার মাথাটা ঘুরে উঠল। বাতাস দাও-পানি খাওয়াও।

১৬ জুলাই, ১৯৭১

সিপাহঃ কি ব্যাপার দুর্মুখ খান? তুমি একাকী দরবারে বসে যে?

দুর্মুখঃ   এসেছি একা, যাইবো একা। দোসর নাহিকো আর

সিপাহঃ কাব্য করতেও জানো নাকি?

দুর্মুখঃ   বাংলায় কিছুদিন ছিলাম। তাই শ্যামল মাঠভরা ধানের বাতাসে হৃদয়ে একটু কাব্য সঞ্চার হয়েছিল সিপাহসালার ।

<005.016.353>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

সিপাহঃ বাংলাকে তুমি ভালোবাসো?

দুর্মুখঃ   অমন সোনার বাংলাকে কে না ভালোবাসে জনাব। বাংলার মাটি, বাংলার আকাশ, সোনাঝরা রোদুর প্রাণে নতুন স্পন্দন জাগায়।

সিপাহঃ কই আমার মনে তো কোন স্পন্দন জাগে না!

দুর্মুখঃ          সিপাহসালার, জীবনে আপনি কোনদিন হেসেছেন?

সিপাহঃ না।

দুর্মুখঃ   কোনদিন কেদেছেন?

সিপাহঃ না।

দুর্মুখঃ   তবে কি করে আপনার হৃদয়ে স্পন্দন জাগবে? আপনি যে মৃত নক্ষত্রের মতো। হৃদয়টাকে হত্যা করেছেন আপনি।

সিপাহঃ না। আমি উল্কার মতো আকাশের বুকে অশুভের বার্তা নিয়ে দেখা দিই। তাইতো আমার ছায়া দেখলে লোকে শিউরে ওঠে।

দুর্মুখঃ   আমার মনে হয় সিপাহসালার, শৈশবে, কৈশোরে আপনি কারও স্নেহ-ভালোবাসা পাননি। তাই আপনার হৃদয় থেকে স্নেহ, ভালোবাসা শুকিয়ে গেছে। অন্তর বিদ্রোহ করেছে। আচ্ছা সিপাহসালার, আপনার সন্তানদের প্রতি আপনার এতোটুকু স্নেহ-ভালোবাসা নেই?

সিপাহঃ প্রয়োজন মনে করি না।

দুর্মুখঃ   নিজের স্ত্রীকেও কি কোনদিন একটু ভালোবেসে

সিপাহঃ দুর্মুখ খান! বেয়াদপি আমি পছন্দ করি না। ভালোবাসা স্নেহ! মমতা ওসব হচ্ছে ন্যাকামি, ভাঁড়ামি। আমি ঘৃণা করি ওসবকে। ওই মোহে যারা আচ্ছন্ন তারা বেয়াকুব।

দুর্মুখঃ   আচ্ছা আপনি তাহলে কি ভালোবাসেন, সিপাহসালা?

সিপাহঃ মানুষ খুন করতে আমি ভালোবাসি। রক্ত মুঠো-মুঠো রক্ত হাতে নিলে আমি আনন্দ পাই আমার বুকজোড়া তৃষ্ণা নিবারণ হয়- হৃদয়ে রোমাঞ্চ জাগে- স্পন্দন, শিহরণ জাগে।

দুর্মুখঃ   (হেসে) ইতিহাসের এক নতুন চরিত্র। বিশ্বের বিস্ময়!

সিপাহঃ জানো দুর্মুখ, যুদ্ধে মানুষ খুন করলে কোন গুণাহ হয় না। তবে জানি না আমার কিসমৎ আমাকে কোথায় নয়ে চলেছে।

দুর্মুখঃ   জাহান্নামে জনাব।

সিপাহঃ কি বললে দুর্মুখ খান?

দুর্মুখঃ   না, মানে ইয়ে বলছিলাম কি, জনাবের বয়স অনেক হয়েছে, তাই জাহান্নামে যাবার পাসপোর্ট পেতে দেরী নয়। তবে হুজুর, বেহেস্তে যাবেন না। ওখানে আপনি শান্তি পাবেন না। কারণ সেখানে যতসব মহাত্ম ব্যক্তিরা খোদার ধ্যানে মগ্ন। ওসব ন্যাকামিপনা দেখলে আপনার গা খিসমিস করবে- হাত চুলকাবে। তার চাইতে আপনি দোজখবাসী হবেন। সেখানে আপনার

<005.016.354>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

অনেক বাপ, দাদা, চাচা, মামুর সাক্ষাৎ পাবেন। আপনি সেখানে গেলে একেবারে দোজখ গুলজার হবে। কবে যাবেন জাহাপনা? আগে থেকে জনাবের যাতে ঢাকেশ্বরী মিলের ফাইন কাফনের কাপড় আপনার হাতে দিতে পারি। আমাদেরও তো একটু কর্তব্য আছে।

সিপাহঃ খামোশ কমবকত!

দুমুখঃ এইতো আবার চটে যাচ্ছেন। যতো বুড়ো হচ্ছেন ততই মেজাজ খিটখিটে হচ্ছে। শিশুহত্যা নারী হত্যা করে আপনি যেরকম না করেছেন- তাতে মেজাজের মুখে লাগাম না দিলে বুড়ো বয়সে অপঘাতে মরবেন।

সিপাহঃ         আমাকে মারবার সাধ্য কারও নেই।

দুমুখঃ আছে জনাব-আছে- ওই মাথার ওপর যিনি বসে আছেন তার মার আপনি রকেট-বোমা দিয়েও ঠেকাতে পারবেন না। সেই মার দুনিয়ার বার।

সিপাহঃ         আমি কাউকে পরোয়া করি না দুর্মুখ।

দুর্মুখঃ আপনি খোদাকে মানেন?

সিপাহঃ যাকে দেখি না তাকে মানি না।

দুমুখঃ তাহলে ইসলাম রক্ষার জন্য বাংলার বুকে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিলেন কেন?

সিপাহঃ মসনদ ক্ষমতা রক্ষাই আমাদের একমাত্র উদ্দেশ্য ।

দুমুখঃ ও! “ইসলাম বিপন্ন- ইসলাম রক্ষা সাচ্চা মুসলমানের ফরজ” ইত্যাদি বজ্ৰ বুলি তাহলে বাষ্প? আসলে-চাচা আপন প্রাণ বাঁচা।

সিপাহঃ বাঁচতে পারছি কই?

দুমুখঃ কি বললেন!

সিপাহঃ        না-কই কিছু না! যাক, ওসব রাজনীতি নিয়ে তুমি মাথা ঘামিও না। ওসব তুমি বুঝবে না।

দুমুখঃ ২৩ বছর পর এবার বুঝেছি। চোখ খুলে গেছে। সূর্যের আলোর মতো সব ঘোর কেটে গেছে।

সিপাহঃ তুমি বড় চালাক দুর্মুখ খান। তোমার বুদ্ধির প্রখরতায় এক এক সময়- যাক, চলো জাঁহাপনার মন্ত্রণা কক্ষে যাওয়া যাক।

দুমুখঃ          সে কি জনাব, আমাকে আপনি সহ্য করতে পারেন না অথচ আমাকে ল্যাজে বেঁধে নিয়ে জাহাপনার সামনে হাজির হতে চান? ব্যাপারটা ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না তো সিপাহসালার!

সিপাহঃ         না মানে, তুমি দরবারে না থাকলে দরবার কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগে।

দুর্মুখঃ          যাক, তাহলে এতদিন পরে আমার অস্তিত্বটুকুকে স্বীকার করলেন। সত্যিই আমি যে কি আনন্দিত সিপাহসালার যে, এই মুহুর্তে আপনার মৃত্যু হলে এতো আনন্দিত হয়তো হতে পারতাম না।

সিপাহঃ দুর্মুখ খান! বেয়াদপ- বেতমিজ-

<005.016.355>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

দুর্মুখঃ   ক্ষ্যাপা কুকুরটা বিদায় হলো তাহলে। খোদা, তোমার দুনিয়া থেকে এই আবর্জনাগুলোকে সরিয়ে নাও। নইলে লাঞ্ছিত, নিপীড়িত মানুষ তোমাকে অভিশাপ দেবে। তোমার আরশ কেঁপে উঠবে। এ্যায় পরওয়ারদিগার, তুমি রহমানুর রাহিম। রহম করো-নিরীহ, নিষ্পাপ বঙ্গসন্তানদের প্রতি তুমি রহম করো। ওরা সত্য, ন্যায়ের পূজারী। ওরাই তোমার সৃষ্টির গর্ব। সাড়ে সাত কোটি মানুষের অন্তরাত্মা যেখানে অত্যাচারিত নির্যাতিত, সেখানে কেন তুমি নিশ্চুপ!

নবাবঃ         দুর্মুখ খান-

দুমুখঃ এই যে আসুন নবাবজাদা।

নবাবঃ         জাহাপনা কোথায়?

দুর্মুখঃ মন্ত্রণা কক্ষে।

নবাবঃ         কেউ কি মন্ত্রণা কক্ষে গেছে?

দুর্মুখঃ   জী হ্যাঁ। ত্রিরত্বের এক রতু এইমাত্র অন্দরে গেলেন, এবার আপনি গেলেই ত্র্যহস্পর্শ।

নবাবঃ কোন গোপন সলাপরামর্শ হচ্ছে নাকি?

দুর্মুখঃ   (হেসে) আজ তেইশ বছর ধরেই তো এই দরবারের মন্ত্রণা কক্ষে কতো চক্রান্তের জাল জন্ম নিল- আবার ভাঙলো- আবার গড়লো। মাকড়শার মতো এই দরবার জালে ছেয়ে গেছে। তাইতো নিজেদের জালে নিজেরা ফেসে গিয়ে এখন আর পালাবার পথ পাচ্ছে না।

নবাবঃ তুমি বড় বাজে বলো।

দুর্মুখঃ   মাঝে মাঝে একটু চরম সত্যি কথা না বললে মুখটা কেমন যেন তেতো তেতো লাগে।

নবাবঃ আমার হাতে ক্ষমতা আসলে আমি তোমাকে একটা মন্ত্রিতু দেবো। দু পয়সা পাবার লাইন ধরিয়ে দেবো।

দুর্মুখঃ          সাবাস নবাবজাদা- সাবাস! গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল। আগে নিজের পেট বাঁচান নবাজাদা।

নবাবঃ আমি অন্য ধাতু দিয়ে তৈরী দুর্মুখ খান।

দুর্মুখঃ          ওসব ধাতু ছাতু হয়ে যাবে নবাজাদা। সত্যিই, আপনার অবস্থার কথা চিন্তা করলে আমার মরা কান্না কাঁদতে ইচ্ছে করে।

নবাবঃ কেন? কেন? কাঁদার কি আছে!

দুর্মুখঃ   কাঁদবো না! জাঁহাপনা আপনার গলার দড়ি ধরে ডুগডুগি বাজালেন। দর্শকের সামনে আপনি দর্শকের পায়ে হাত দিয়ে পয়সা নিয়ে জাহাপনাকে দিলেন। জাহাপনা মুচকি হেসে পকেটে সব পয়সা পুরলেন- আর আপনি বসে বসে এখন উকুন বাছছেন- আর এক টুকরো কলার জন্যে জাহাপনার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাচ্ছেন। এদিকে লোকে আপনার পেছনে কাঠির খোঁচা দিয়ে মজা লুটছে- আর আপনি দাঁত খিচুচ্ছেন। এইতো পরিণাম!

নবাবঃ খামোশ বেয়াদপ। তোমাকে- তোমাকে আমি –

<005.016.356>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

দুর্মুখঃ         আহা- আপনার এ্যালকোহলী চেহারা লাল হয়ে গেল। রাগ করবেন না নবাবজাদা। একটু ঠাট্টা করলাম মাত্র।

নবাবঃ তুমিই কি এই মন্ত্রণা কক্ষের দ্বাররক্ষী?

দুর্মুখঃ   না জনাব, হৃদয়ের দ্বাররক্ষী ! হৃদয়ের

নবাবঃ উন্মাদ। যতোসব উন্মাদ

দুর্মুখঃ নবাবজাদাও মন্ত্রণা কক্ষে চলে গেলেন। আমি উন্মাদ! কিন্তু তোরা- তোরা কি? তোরা জল্লাদ। তাই এই জল্লাদের দরবার ইতিহাসের এক কলঙ্কিত অধ্যায়। (Change over)

।। মন্ত্রণা কক্ষ।।

ফতেঃ   শুনুন সিপাহসালার টিটিয়া খান, শুনুন লারকানার নবাবজাদা, পিণ্ডির মসনদ আজ ধীরে ধীরে অন্ধকারাচ্ছন্ন হতে চলেছে। বাংলাদেশের বিদ্রোহীরা আমাদের লক্ষ্য করে একের পর এক তীর ছড়ছে। বাংলাদেশের বিদ্রোহের ফলে দারুণ অর্থসংকট দেখা দিয়েছে আমার রাজ্যে। শুধু অস্ত্র কোষাগারে। আপনারাই বলুন, এ ক্ষেত্রে করণীয় কি?

দুর্মুখঃ   (স্বাগত) আহত মৃতপ্রায় ব্যাঘ্ৰ শেয়াল আর বেড়ালের কাছে মুক্তি চাইছে। হাসি পায়।

সিপাহঃ আমাদের আহাম্মুখ খান, চিটজাদা কি উপদেশ দিচ্ছেন?

ফতেঃ   ও ব্যাটাদের মাথায় কিছু আছে নাকি! বাঁদরের বাচ্চারা আমার মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে খেয়ে এখন জিব চাটছে।

দুর্মুখঃ   না জনাব। ওদের গোঁফ-দাড়িতে এখন কাঁঠালের আঠা জড়িয়ে গেছে। তাই এখন ঘরের কোণে বসে কাঁঠালের আঠা ছাড়াচ্ছে।

নবাবঃ অনেকটা সত্য। ওদেরই জন্যে রাজ্যের অর্থনীতি দীর্ঘদিন ধরে ভেঙ্গে পড়েছে।

ফতেঃ   সিপাহসালার, বাংলাদেশে খাজনা-কর আদায় কেমন হচ্ছে?

সিপাহঃ         আমি যথাসাধ্য চেষ্টা চালাচ্ছি জনাব।

দুর্মুখঃ   কিন্তু কোনই ফয়দা হচ্ছে না। কারণ বাংলার দামাল ছেলেরা সব তহসীল-অফিস বোমা মেরে উড়িয়ে দিচ্ছে।কার বাপের সাধ্য যে বোমা খাবার জন্যে খাজনা আদায় করতে যাবে!

সিপাহঃ দুর্মুখ খান, অবান্তর কথা বলে জাঁহাপনাকে অসুস্থ করে তুলো না।

দুর্মুখঃ   কবে কখন জাঁহাপনা সুস্থ, প্রকৃতিস্থ থাকেন সিপাহসালার।

ফতেঃ   খামোশ দুর্মুখ খান।

দুর্মুখঃ এটা মন্ত্রণা কক্ষ। এই মন্ত্রণা নিয়েই তো আপনার যতো যন্ত্রণা। সিপাহসালার,

ফতেঃ   মসরের্কী বাঙ্গাল থেকে পাট বিক্রয়ের কি ব্যবস্থা করলেন?

<005.016.357>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

দুর্মুখঃ   পাট সব লোপাট জনাব।

ফতেঃ   তার মানে?

দুর্মুখঃ জনাব, বাংলার ওই বিদ্রোহী নেকড়েগুলো আপনার পাটের গুদামগুলি পুড়িয়ে ছাই করে দিচ্ছেকারণ, আপনারা যাতে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে অস্ত্র কিনতে না পারেন। তা ছাড়া বাংলার মুক্ত অঞ্চলের যাবতীয় পাট বাংলাদেশ সরকার ক্রয় করে বিদেশে রপ্তানী করছেন। ওই পাট দিয়েই আপনাদের সাট করার ব্যবস্থা হচ্ছে।

ফতেঃ   দুর্মুখ খান! উঃ মাথাটা আবার ঘুরে উঠল।

সিপাহঃ দুর্মুখের কথায় অসুস্থ হয়ে পড়বেন না-জনাব। এবার মাশরেকী বাঙ্গালে পাট খুব কম পয়দা হয়েছে।

ফতেঃ   নসীব- সবই বদনসীব সিপাহসালার। বিপদ যখন আসে তখন চারিদিক দিয়ে আসে।

দুর্মুখঃ   আলবৎ খোদা যখন দেন তখন একেবারে ছাপ্পর ফারকে দেন। আর যখন মারেন, তখন পানি খাবারও সময় দেন না।

ফতেঃ   উঃ পাঁচ ডিভিশন সৈন্য দিয়েও আপনি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নিশ্চিহ্ন করতে পারলেন না। সিপাহসালার! অথচ বোমাবাজ টিটিয়া খানের ওপর আমার যথেষ্ট আস্থা ছিল।

দুর্মুখঃ   বোমাবাজ, ধরিবাজ যাকেই পাঠান- বাংলা মুলুকে গিয়ে সবাই ডিগবাজী খাবেন। কারণ আল্লাহ খোদ মদত করছেন বাঙালীদের। তাইতো বীর প্রসবিনী বাংলা আজ ধন্যা।

ফতেঃ   ওফ- বাংলা-বাংলা-বাংলা। সিপাহসালার বাংলাকে আপনি পোড়ামাটি করে দিন। মৃতদেহের ভাগাড়ে পরিণত করুন মাশরেকী বাংলাকে। কুকুর-শেয়ালের সামনে বাঙালীদের লাশগুলো ছুড়ে ফেলে দিন।

দুর্মুখঃ   চমৎকার।

সিপাহঃ অবশেষে তাই করবো আলমপনা। আমি টিটিয়া খান- আমার রোষানলে সব ভস্মীভূত হবে।পুড়িয়ে দেবো বাংলার মাটি, জ্বালিয়ে দেবো ক্ষেত খামার। বাংলার মাটিকে আমি বন্ধ্যা করে দেবো।

দুর্মুখঃ   আপনার মাথার ওপর শকুন উড়ছে সিপাহসালার

সিপাহঃ দুর্মুখ খান!

নবাবঃ দুর্মুখ ঠিকই বলেছে সিপাহসালার। বিদ্রোহ শুধু বাংলার মানুষের মধ্যে নয়- বিদ্রোহ দেখা দিয়েছে আমাদের সৈন্যদের মধ্যে।

ফতেঃ   আপনি আমার সৈন্যদের ভেতরের খবরও রাখেন নাকি নবাবজাদা।

নবাবঃ নিশ্চয়ই। চোখ-কান আমার সদা সজাগ। খাঁ সাহেব হয়তো জানেন না যে, ইতিমধ্যে আমাদের ম্যাসাকার বাহিনী বিশ্বাসঘাতকতা করছে। ওরা মুক্তিযোদ্ধাদের ভয়ে পালাচ্ছে- আত্মসমর্পণ করছে- আমাদের গোপন তথ্য ফাঁস করে দিচ্ছে।

<005.016.358>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

ফতেঃ   তারপর- তারপর নবাবজাদা?

নবাবঃ শুধু তাই নয়, আমাদের বেলুচ সৈন্যদের মধ্যে বিদ্রোহ দেখা দিয়েছে। এমন কি আমাদের সৈন্যদলের কিছু অধিনায়ক তলে তলে আমাদের বিরুদ্ধে হীন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়তো কিছুদিনের মধ্যেই তারা সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে আমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। তখন কি অবস্থা দাঁড়াবে একবার ভেবে দেখেছেন খাঁ সাহেব।

দুর্মুখঃ   তখন আমরা নিজেদের মধ্যে কিত কিত খেলা শুরু করবো। আগেই বলেছি কাকের মাংস কাকে খায়। তাইতো বলছি আলমপনা, আপনাদের মাথার ওপর শকুন উড়ে বেড়াচ্ছে। মাথা সাবধান!

ফতেঃ   এদিকে ভারত আমাদের সামনে বিরাট মহীরুহ। যুদ্ধের হুমকি দিয়েও ফয়দা হ’ল না। এই জাতশত্রুকে খতম করতে না পারলে-

দুর্মুখঃ ভারত অস্ত্র শাণিয়ে আপনাদের স্বাগত জানাবার জন্যে বসে আছে। মার আমরা খাবো ঠিকই তবে তারা মলম লাগিয়ে দেবে বলেছে।

ফতেঃ অসহ্য- অসহ্য! সিপাহসালার, অবিলম্বে ভারত সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করুন। যুদ্ধের দামামা বাজান। যুদ্ধ-যুদ্ধ চাই। হয় উত্থান- না হয় পতন হয় ইতিহাসের মানচিত্রে আমরা টিকে থাকবো- না হয় মুছে যাবো। এ ছাড়া অন্য উপায় নেই।

সিপাহঃ কিন্তু জাঁহাপনা –

ফতেঃ   এর মধ্যে কোন কিন্তু নেই। বাঁচা কিম্বা মরা, দুটোর একটা বেছে নিন। মাশরেকী বাঙ্গালকে কবজায় আনতে হলে, ভারত আক্রমণ ছাড়া অন্য উপায় আর নেই সিপাহসালার। এ কি আপনার মুখটা অমন ছাইয়ের মতো, আমন শুকনো-শুকনো দেখাচ্ছে কেন! যান, মুখে পানির ছিটে দিয়ে বিছমিল্লাহ বলে অগ্রসর হোন। আর নবাবজাদা, আপনিও বিদায় গ্রহণ করুন।

সিপাহঃ খোদা হাফেজ।

ফতেঃ   খোদা হাফেজ।

 দুর্মুখঃ উফ! দুই রাহু বিদায় হল। আলমপনা, আপনি একটা অষ্টধাতুর মাদুলী গলায় বাঁধুন। যেভাবে শনির দল আপনাকে ঘিরে ধেরেছে-

ফতেঃ দুর্মুখ! তোমার ওসব ন্যাকামি আমার ভালো লাগছে না। যক্ষ্মার বীজাণুর মতো কে যেন সর্বদা আমার বুকেরভেতরটা কুরে কুরে খাচ্ছে। সাড়া শরীরে যেন শক্তি পাচ্ছি না। একটা দাহ, বুঝলে দুর্মুখ, কিসের যেন একটা দাহ সর্বদা পুড়িয়ে মারছে। জ্বলে যায়- আমার সর্বশরীর জ্বলে যায়।

দুর্মুখঃ   কিসের দাহ জানেন না? শিশুহত্যা, নারীহত্যার গুণাহ। ওদের অভিশাপের দাহ আপনাকে দগ্ধ করছে। এর কোন দাওয়াই নেই জনাব। এর হাত থেকে রেহাই নেই।

ফতেঃ   শিশুহত্যা-নারীহত্যা হ্যাঁ- মানুষের বাচ্চাগুলোকে আমি খুন করেছি- নারীর ইজ্জত লুটেছি- হত্যা করেছি। আমি খুনি-আমি জল্লাদ- আমি বেঈমান। দেখেও নাও- দেখে যাও বিশ্বাবাসী। আমি নিরীহ বাঙ্গালীর লহুতে রক্তস্নান করেছি- বাঙালীদের লাখো লাশের ওপর বসে আমি মসনদী করছি। আমি বিশ্বের বিস্মরণ- আমি মহাত্রাস- আমি জল্লাদ। হ্যাঁ হ্যাঁ আমি জল্লাদ

<005.016.359>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

আমি খুনী- আমি কশাই। হা-হা-হা-আরও রক্ত চাই- আরও রক্ত চাই- আমি রক্তবীজ- আমি রাক্ষস-হা-হা হা-

দুর্মুখঃ …. নাটক জমে উঠেছে। যবনিকার আর দেরী নেই। তারপর নতুন পালা শুরু।

১ আগষ্ট, ১৯৭১

বাদশা কেল্লা ফতে খান হাসছেন।

দুমুখঃ   আলমপনা, সকাল থেকে আপনি শুধু হাসছেন। এ এক আশ্চর্য পরিবর্তন

ফতেঃ কেন হাসছি বল তো দুর্মুখ খান?

দুর্মুখঃ   অনেক রকম হাসি আছে জনাব। আনন্দের হাসি, দুঃখের হাসি, শয়তানের হাসিআমার হাসি শুনে কি মনে হচ্ছে তোমার? ইথারের বুকে কান পাতলে এমনি অনেক অট্টহাস্য শুনতে পাই। সুলতান মামুদ, নাদির শা, চেঙ্গিস, হিটলার সকলে বোধ করি এভাবেই হাসতেন।

ফতেঃ   রাজা-বাদশারা এভাবেই হাসে মূখ।

দুর্মুখঃ   কিন্তু জাঁহাপনা, কোনদিন কি মায়ের হাসি দেখেছেন? যখন মায়ের কোলে শিশুর মধুর হাসি মুখ দেখে বুক ভরিয়ে যায়? কোনদিন কি রাস্তার ওই উলঙ্গ ছেলেটার মুখের স্নিগ্ধ হাসি দেখেছেন? দেখেছেন কি গ্রাম-বাংলার কৃষকের প্রাণের খোলা হাসি? না, দেখেননি। কারণ সেইসব হাসি আপনি কেড়ে নিয়েছেন।

ফতেঃ   বাংলা-মাশরেকী বাঙ্গালা। শোন দুর্মুখ খান, বাংলার মানুষের মুখের হাসির চাইতে সেখানকারজমিন আমার কাছে-

দুর্মুখঃ   জানি জনাব, বাংলাদেশটা আপনাদের কাছে সোনার থালা, আর বাঙালীদের কাছে বাংলা ওদের মা। সেই মাকে কোনদিন কি আপনি ওদের কাছে থেকে কেড়ে নিতে পারবেন?

ফতেঃ   দুর্মুখ, বাদশা কেল্লা ফতে খান যেখানে থাবা চালায় সেখান থেকে খালি মুঠি কোনদিন ফিরিয়ে আনেন না।আর খোদা না খাস্তা যদি বাংলাদেশ আমার হাত থেকে বেরিয়ে যায়, তাহলে গোটা বাংলাদেশটাকে আমি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ভস্মস্তুপে পরিণত করবো । এই আমার কসম ।

দুর্মুখঃ   জনাব, শুনি নাকি ধ্বংসস্তুপের মধ্যেই নতুনের ভিত্তি রচিত হয়। আশ্চর্য সাহস ওই বাংলার দামাল ছেলেগুলোর-এখনও হিংসের নাকে সুড়সুড়ি দিচ্ছে।

ফতেঃ   ওই বিদ্রোহীরা আমাকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। আমার নীদ হারাম করেছে। কিন্তু কমবকতরা বরঞ্চ দু’পায়ে দলে গেছে। দুর্মুখঃ জনাব, শুনি নাকি বাংলাদেশের পথে কাঁটার চাইতে কাদা বেশী। সেই হাতী এবার কাদায় পড়েছে জাঁহাপনা।

<005.016.360>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

ফতেঃ তার অর্থ?

দুর্মুখঃ   আলমপনা, দীর্ঘ চাত মাস অতিবাহিত হতে চললো, আপনার জবরদস্ত বীর জোয়ানরা স্বাধীনতাকামী ছেলেগুলোঠাণ্ডা করতে পারল না। এদিকে ওই বিচ্ছিন্নতাবাদীরা আরও শক্তিশালী, দুর্ধর্ষ হচ্ছে। আমাদের সৈনিকরা বুকে থাবা মেলে এগিয়ে যাচ্ছেথ- কিন্তু পরক্ষণে মাজা ভেঙ্গে ছাউনীতে ফিরছে। কেউ আর নাড়িভুড়ি এলিয়ে চিতোচ্ছে। আহা রে, আমাদের সোনার চাঁদ সেপাহীদের রক্তাক্ত দেহ দেখে- (কান্নার সুর কণ্ঠে)

ফতেঃ   কেদো না-কেদো না দুর্মুখ খান। আমার মাথা ঘুরছে। এ্যাই- দাওয়াই কা বেতল লে আও।

দুর্মুখঃ   অতো দাওয়াই খাবেন না জনাব। এমনিতেই ভুল বকছেন- আবার ঘন ঘন দাওয়াই পেটে পড়লে, একেবারে ক্ষেপে যাবেন জনাব।

ফতেঃ   খামোশ কমবকত। তমিজ-সে বাত করো!

দুর্মুখঃ   বড় দুঃখে বলি জনাব। আমার বুকটা দুঃখে জার জার।

ফতেঃ   বেচেখান হয়ো না দুর্মুখ খান। যুদ্ধের সাফল্যের ওপর আমি নির্ভরশীল নই। আমার ক্রুর রাজনীতি আমার হাতিয়ার।

দুর্মুখঃ   মেহেরবানী করে বান্দাকে যদি একটু খুলে বলতেন

ফতেঃ শোন দুর্মুখ- গোলা, বারুদ, সুরা, নারী আমার জীবনের সবচে’ পেয়ারা চীজ। মাগার পিণ্ডির এই তক্তে তাউস আমাকে ছাড়ল না। উনোসত্তরের বাংলা আগ্নেয়গিরির মতো ফেটে পড়ল। সেই বাংলার জনতার জ্বলন্ত লাভা আছড়ে পড়ল পিণ্ডির মসনদে। কারাগার ভেঙ্গে বেরিয়ে এলেন বাঙ্গালীদের বঙ্গবন্ধু।

দুর্মুখঃ   জানি জনাব। এবং সঙ্গে সঙ্গে মসনদচ্যুত হলেন আপনার ধর্ম-আব্বা হুজুর জনাব খানে খান বেকুব খান।

ফতেঃ   উত্তাল তরঙ্গে তখন হাবুডুবু খাচ্ছে এই তক্তে তাউস। আমি হাল ধরলাম। ছলনা আর মিষ্টি কথার অস্ত্র প্রয়োগকরে অগ্ন্যুৎপাত বন্ধ করলাম। কিন্তু আমি ভাবতে পারিনি যে, ওই বঙ্গবন্ধু মানুষটার মধ্যে এতো আগুন আছে। আগে যদি জানতাম, তাহলে নির্বাচনের প্রহসন করতে গিয়ে-

দুর্মুখঃ সং সেজে বুক চাপড়াতে হতো না।

ফতেঃ   তবু আমি বঙ্গবন্ধুকে প্রলোভন দেখালাম- ছলে বলে বশ করার চেষ্টা করলাম; কিন্তু ব্যর্থ হলাম। চালালাম কিন্তু

দুর্মুখঃ কিন্তু সেই জুতো যে ফিরে এসে আপনার মুখে পড়বে তা কি আর ভেবেছিলাম জনাব।

ফতেঃ   দুর্মুখ খান।

দুর্মুখঃ   গোস্তাফি মাফ করবেন জনাব !  আচ্ছা আলমপনা, এখন আপনার এই খাশ তালুক রক্ষার কি ব্যবস্থা করছেন?

<005.016.361>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

ফতেঃ   শোন, আমি নিজেই একটা আইন তৈরী করছি। আর সেই আইন মোতাবেক আমিই হবো এই তক্তে তাউসের একচ্ছত্র অধিপতি।

দুর্মুখঃ   একেই বলে রাজরাজড়ার মাথা!

ফতেঃ   আরও শোন, আমার ওইসব পোষা কুকুর যারা এইটুকরো মাংসের জন্য জগতের শ্রেষ্ঠ সর্দার, গণপ্রতিনিধিরাই রাজ্যভার গ্রহণ করেছে।

দুর্মুখঃ   মারহাব্বা- মারহাব্বা, জনাব! আপনাকে যে মা গর্ভে ধারণ করেছিলেন, তিনি সত্যিই বিশ্বের বিস্ময়!

ফতেঃ   কেমন লাগলো পরিকলপনা?

দুর্মুখঃ   অদ্ভুত। জনাব- অদ্ভুত। আমি শুধু ভাবছি, এতো বুদ্ধি নিয়ে আজও আপনি বেঁচে আছেন কি করে।

ফতেঃ   (হেসে) সত্যিই তুমি রসিক পুরুষ দুর্মুখ খান।

দুর্মুখঃ   একটা ছোট্ট গল্প বলি জনাব। বিয়ে-পাগল এক মূখ ব্যক্তি স্থির করল সে এক ধনীর একমাত্র কন্যাকে বিয়ে করে, শ্বশুর-শাশুড়িকে হত্যা করে তাড়াতাড়ি বড়লোক হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, এই মুর্খকে কোন মেয়েই পছন্দ করল না। অবশেষে এই মূর্খ রাগে-দুঃখে তার বুড়ি মাকে বললো মাগো, আমার বিয়া আমি আর দেইখ্যা যাইতে পারুম না।

ফতেঃ   (উচ্চৈঃস্বরে হাসলেন) হাঃ-হাঃ-হাঃ-হাঃ-হাঃ- [ আচমকা হাসি বন্ধ করে ক্রোধে এ্যাঁ। কি বললে, দুর্মুখ খান! বেহুদা বততামিজ, কমিনে- নিকাল যাও-[ গর্জে উঠলেন? উঃ মাথাটা আবার-

।। দরবার কক্ষ।।

নবাবঃ বন্দেগী খাঁ সাহেব।

ফতেঃ   আসুন লারকানা নবাবজাদা। কি সংবাদ?

নবাবঃ আমার কিছু বক্তব্য আছে খাঁ সাহেব।

ফতেঃ   আমিও কিছু বলতে চাই নবাবজাদা। শুনছি, ইদানীং আপনি নাকি আমার কার্যের সমালোচনা করছেন?

নবাবঃ  আমার দলের স্বার্থে

ফতেঃ   উফ – স্বার্থ-স্বার্থ ! শুনুন নবাবজাদা, আমি এসব পছন্দ করি না।

নবাবঃ খাঁ সাহেব কি আমার প্রতি ক্ষুব্ধ হয়েছেন?

ফতেঃ   না নবাবজাদা। কার ওপর ক্ষুব্ধ হবো? আপনারা যে আমার ভাই- অতি আপনার জন। আমার সততা সারল্যকে-

<005.016.362>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

দুর্মুখঃ   নবাবজাদা জনাবকে ভালোভাবেই চেনেন। আমাদের আলমপনা সারল্যে শিশু, মহসীনের ন্যায় দয়ার সাগর-সততায় ইয়ের মতো আর      কি।

ফতেঃ   নবাবজাদা- এই মসনদ, এই গুরুভার আমি বইতে পারছি না। আপনাদের বৃহত্তর স্বার্থে এই রাজদণ্ড আমি হাতে তুলে নিয়েছিলাম। সময় আসলে এই মসনদের সব আপনাদের হাতে অর্পণ করে-

দুর্মুখঃ   জনাব আবার রংমহলায় ফিরে যাবেন।

ফতেঃ   না, আমি মক্কা শরীফে যাবো।

দুর্মুখঃ   (স্বগত) এই বারেই কানা মরেছে।

নবাবঃ কিন্তু আমার দলের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আর ধৈর্য রাখতে পারছে না খাঁ সাহেব।

ফতেঃ   তাঁদের ইচ্ছার ওপর আমার রাজকার্য নির্ভর করে না।

নবাবঃ যদি তাঁরা বিদ্রোহ করে?

ফতেঃ   তাহলে বাংলার মানুষের মতো তাদের কলিজাগুলো ছিড়ে আনা হবে।

দুর্মুখঃ   (স্বগত) একেই বলে কাকের মাংস কাকেই খায়।

নবাবঃ জাহাপনা, শক্তির আতিশয্যে আপনি ভুল পথে চলছেন।

ফতেঃ         (হেসে) জীবনের পাশাখেলায় আমি কোনদিন হারিনি নবাবনন্দন। পশ্চিম খণ্ডে যদি বিদ্রোহ হয় তাহলে আপনি- না-না- আমি আপনাকে বিশ্বাস করি। আপনার প্রতি আমার পূর্ণ আস্থা, ভরসা আছে নবাবজাদা। কারণ-

দুর্মুখঃ কারণ কাকের বাসাতেই কোকিলের বাচ্চা মানুষ হয়ে কু-কু করে ডাকে।

নবাবঃ জাঁহাপনা, আমি একা কি করবো? বাংলার মাটিতে আগুনের লেলিহান শিখা, সিন্ধুর আকাশে দুর্যোগের ঘনঘটা, পাঞ্জাবের বাতাসে পুঞ্জীভূত অস্ফুট প্রতিবাদ ধ্বনি- দারুণ অর্থসংকট, ব্যবসা, বাণিজ্য, কল-কারখানা সব বন্ধ। এতগুলো সমস্যা

ফতেঃ উঃ সমস্যা- সমস্যা-সমস্যা। এতোগুলো সমস্যা সমাধান আমার এক চরম সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

দুর্মুখঃ   ভাববেন না জনাব। মাথার ওপর আমাদের মামারা আছেন, দুর্যোগে কেটে যাবে। নাকের বদলে নড়ন পাবো- সেই ভাল । নবাবজাদা তো এখন থেকেই “চীন-মার্কিন” ভাই ভাই বলে চেচাচ্ছেন।

ফতেঃ   কি লাভ। আমি এতো করে আমার মার্কিন বন্ধুকে দিয়ে পূর্ব বাংলার সীমান্তে রাষ্ট্রসংঘের সৈন্য মোতায়েন করার প্রস্তাব করলাম, কিন্তু আমাদের শত্রু ভারত-সম্রাজ্ঞী আমনি কঠোরভাবে তার বিরোধিতা করল।

দুর্মুখঃ   জনাব, আমি বলি কি, এতোসব ফন্দিফিকির না করে একেবারে চোখ-কান বুজে বিসমিল্লাহ বলে ভারতআক্রমণ করে ফেলুন।

<005.016.363>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

নবাবঃ         আমি তোমার সঙ্গে একমত দুর্মুখ খান।

সিপাহঃ বন্দেগী জাহাপনা। আমিও একমত এদের সঙ্গে।

ফতেঃ   কিন্তু সিপাহসালার কোথায় দাঁড়িয়ে, কিসের ভরসায়, কি নিয়ে যুদ্ধ করবেন ? বাংলার জমিন, বাংলার মানুষ ওই হাজার হাজার বিচ্ছিন্নতাবাদীরা আমাদের শত্রু। এদিকে কোষাগার শূন্য, চার মাসের যুদ্ধে প্রচুর অস্ত্র, সৈন্য আমরা হারিয়েছে। তাই ভেবে দেখুন, ঘরের শত্রুর পাশে দাঁড়িয়ে, ভুখা শরীরে, খালি হাতে ভারতের ন্যায় শক্তিশালী দেশের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া বাতুলতা ।

দুর্মুখঃ   যথার্থ বলেছেন জনাব। দীর্ঘ চার মাস ধরে আমাদের বীর সেনানীরা কতকগুলো ডানপিটে ছেলের সঙ্গে যুদ্ধ করে বাংলার রাজধানী ঠেকাতে পারছে না। আর-

সিপাহঃ         তাহলে জাঁহাপনা, আপনি আপাতত ভারতকে একটা কড়া হুমকি দিন। তাতে দুটো সুফল হবে। এক. যদি বিদ্রোহীরা ভবিষ্যতে বাংলার কিছু জমি দখল করে, তাহলে আমরা বিশ্বকে জানাবো ভারত আমাদের ভূখণ্ড জোর করে দখল করেছে। আর দ্বিতীয়তঃ ভারত-সম্রাজী নারী। আপনার ন্যায় সিংহপুরুষের হুঙ্কারে অবশ্যই ভীত হবে।

দুর্মুখঃ   (হেসে) ভারত-সম্রাজী জানেন যে, ফাঁকা কলসীর আওয়াজ বেশী।

ফতেঃ   খামোশ বেয়াদপ। ঠিক আছে টিটিয়া খান, আপনার যুক্তি মতোই ভারতকে একটা হুমকি দিন। সেই সঙ্গে এটা নিয়ে দিন, এবারের যুদ্ধে আমরা একা নই। হুশিয়ার।

দুর্মুখঃ   আপনার হুংকারে ভারত-সম্রাজ্ঞী একটু মুচকি হাসবে জনাব। বিশ্ব জানে আপনার ভীমরতি ধরেছে।

ফতেঃ   দুর্মুখ খান! সিপাহসালার যুদ্ধের খবর বলুন।

সিপাহঃ         আমাদের বীর সৈন্যরা বিদ্রোহীদের ভেঙ্গে দিয়েছে জনাবে আলা।

দুর্মুখঃ তা-ঠিক। তবে মাঝে মাঝে কমবকত বাঙালী ছেলে-ছোকরারা ঢাকার বুকে বিদ্যুৎ সরবরাহ কেন্দ্র, গ্যাসঘাঁটি উড়িয়ে দিচ্ছে। শহর-গ্রামে রেললাইন সেতু, রাস্তাঘাট, সামরিক ছাউনী গুডুম-ফটাস হয়ে যাচ্ছে। জনাবের ভূড়িয়াল সৈন্যরা, পোষ্যপুত্রেরা মাঝে মাঝে জিব বার করছে। সে এমন কিছুই নয়। সব স্বাভাবিক হয়ে গেছে।

ফতেঃ   উফ। মাথাটা আবার ঘুরছে।

দুর্মুখঃ   ঘাবড়াবেন না জাঁহাপনা। আপনার নতুন চালানের সামান্য কিছু সৈনিক বিদ্রোহ করলেও- সব ঠাণ্ডা, সব স্বাভাবিক হয়ে গেছে জনাব।

ফতেঃ          সত্যই কি সব স্বাভাবিক টিটিয়া খান?

সিপাহঃ আমার প্রতি বিশ্বাস রাখুন আলমপনা। ব্যবসা বানিজ্য চালু করতে পারলেই- ফতেঃ কেন? ওদেশের ব্যবসাদাররা দোকান খুলছে না?

দুর্মুখঃ   সব ভাগল-বা জনাব।

<005.016.364>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

সিপাহঃ তবে আমি নয়া এলান জারি করেছি জনাব। এক সপ্তাহের মধ্যে কেউ যদি তার দোকান না খোলে তাহলে সেই দোকানে আমরা নিজেদের লোক বসাবো।

নবাবঃ নিজেদের লোক মানে?

দুর্মুখঃ   মানে জনাবের ওইসব জারজ সন্তানদের- মানে আর কি জনাবের খাস তালুকের খাস আদমীদের বসানো হবে।

নবাবঃ সে কি ভালো হবে টিটিয়া খান সাহেব?

সিপাহঃ ভালো-মন্দের বিচার এখন রাখুন। বাঁচার কথা ভাবুন নবাব সাহেব। ওই বিদ্রোহীদের শায়েস্তা না করা পর্যন্ত

ফতেঃ   হ্যাঁ, বিদ্রোহীদের নিশ্চিহ্ন করতেই হবে। ভেবেছিলাম বঙ্গবন্ধুকে বন্দী করলে বিদ্রোহের আগুন নিভে যায়। কিন্তু আগুন আরও জ্বললো। এবাব বাঙ্গালীর দরদী বন্দুকে খতম করতে হবে। জীবন দিতে হবে।

দুর্মুখঃ          জনাব, গোস্তাফি মাফ করবেন। বঙ্গবন্ধুকে খতম করলে বীর প্রসবিনী বাংলা বীরশন্য হবে না। আজ বাংলার ঘরে ঘরে প্রতিটি মুক্তিকামী মানুষ বঙ্গবন্ধু- প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধা এক- একজন সিপাহসালার। কটা বঙ্গবন্ধুরে খতম করবেন জনাব? একটি মশাল থেকে আর একটি মশাল জ্বলে উঠেছে। হাজারো হাতের উদ্যত শাণিত তরবারী পিণ্ডির মসনদ লক্ষ্য করে ছুটে আসছে। কি দিয়ে তাদের রুদ্ধ করবেন?

ফতেঃ   স্তব্ধ হও- স্তব্ধ হও দুর্মুখ খান। এ কি! দরবার এতো অন্ধকার কেন? কিসের যেন আর্তনাদ শুনতে পাচ্ছি। কারা যেন এদিকে এগিয়ে আসছে। ঐ, ঐ- জনতার স্রোত, গলিত লাভা এদিকে ছুটে আসছে। আগুন, আগুন বন্ধ করো- সিংহদ্বার বন্ধ করো। আলো, আলো- আরও আরো জ্বেলে দাও। উঃ-

নবাবঃ জাহাপনা মূৰ্ছা গেছেন। পিণ্ডির মসনদ, তুমিও একদিন মুক্তিকামী জনতার পায়ের তলায় গুড়া হয়ে যাবে। মহাকাল, ইতিহাস- শুধু তোমরা সাক্ষী থেকো ।

১৪ নভেম্বর, ১৯৭১

নবাবঃ পিণ্ডির মসনদ, অপেক্ষা করো- আমি আসছি। তোমার কলঙ্কিত জীবনের হবে অবসান। আমার এতোদিন প্রতীক্ষার সেই শুভদিন সমাগত। অনাগত দিনে তুমি আমাকে পেয়ে প্রাণ পাবে- ধন্য হবে। যে করে যেমনভাবে হোক তোমাকে হোক তোমাকে আমার চাই।

ঈমানঃ (ইকো) হা-হা-হা- হা-হা-হা

নবাবঃ কে? কে?

ঈমানঃ সিন্ধুর কুলাঙ্গার-পাকজাঁহার বেঈমান লারকানার নবাবজাদা, সিংহাসনের পানে একদৃষ্টে চেয়ে কিসের সুখস্বপ্ন দেখছো?

<005.016.365>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

নবাবঃ কে! কে তুমি অদৃশ্য পুরুষ?

ঈমানঃ (ইকো) আমি ঈমান। তুমি আমাকে চেনো না। কারণ বেঈমান, শয়তান তোমার দোস্ত। আমি ন্যায়, আমি সত্য, সুন্দর। আমি নিয়ম – আমি বিবেক- আমি মানবতা ! কোনদিন আমাকে চিনবার চেষ্টা করেছো কি?

নবাবঃ         না। ওসব নিয়ে নির্লিপ্ত থাকার সময় আমার নেই। আমি আমার দেশের কথা ছাড়া-

ঈমানঃ         (ইকো) দেশ! হা-হা-হা- সুন্দর শয়তান, মানুষ তোমাকে কতো রূপেই না দেখলো। দেশ! দেশের জন্য কি করেছো আর করছে তা একবার ভেবে দেখেছো কি! স্বার্থের নামী জুয়াড়ী তুমি। দেশকে জুয়ার বাজিতে এনেছো। দেশের মানুষকে ধোঁকা দিয়েছো। আসলে তুমি, পাকিস্তান সামরিক  জুন্তার এর উগ্রদলের হাতের পুতুল। মিলিটারী ব্যুরোক্র্যাটদের রাজনৈতিক ভাড়াটে কণ্ঠ তুমি।

নবাবঃ না। আমি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী- আমি গণতন্ত্র চাই।

ঈমানঃ (ইকো) মিথ্যা কথা। তুমি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী নও। ওটা তোমার পোশাকী কথা। তুমিই বলেছো, পাকিস্তানের হৃদপিণ্ড হচ্ছে পাঞ্জাব ও সিন্ধু। মানে পাঞ্জাবের সামরিক গোষ্ঠী। তুমি যদি সত্যই গণতন্ত্রে বিশ্বাসী হতে- তাহলে বলতে পাকিস্তানের প্রাণ তার জনগণ। আর সেই জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের বাস বাংলায়। অতএব বাংলাদেশেই হচ্ছে পাকিস্তানের হৃদপিণ্ড।

নবাবঃ আমি স্বীকার করি না।

ঈমানঃ         (ইকো) তা জানি। স্বীকার করার সৎসাহস তোমার নেই। কার এক অশুভ লগ্নে, রাজনীতিতে তোমার হাতেখড়ি। আর সে থেকেই তোমার পিপলস পার্টি জন্ম থেকেই সামরিক জুন্তার শক্তিশালী অংশের তাঁবেদার। আর আজ যে পিণ্ডির বাদশার মুখের পানে চেয়ে আছো- সেই বাদশাও সামরিক জুন্তার ভৃত্য মাত্র। আমি জানি, এই সামরিক গোষ্ঠীর অস্ত্র হিসাবে তুমি বাংলাদেশের রাজনৈতিক আকাশে ঝড় ডেকে আনলে- বাঙ্গালীর রক্ত নেবার জন্য পিণ্ডির বাদশাকে সহযোগিতা করলে।

নবাবঃ         না-না- এসব মিথ্যা! আমি কারো খেলার পুতুল নই। আমি যা কিছু করছি- আমার দেশের স্বার্থের জন্য। বাংলার মানুষের ঔদ্ধতা আমি বরদাস্ত করিনি কোনদিন- করবোও না।

ঈমানঃ          (ইকো) ক্ষমতালিঙ্গসু, অন্ধ তুমি। দীর্ঘদিন অতিবাহিত হল, ক্ষমতার স্বাদ কেমন তা বুঝতে পারলে না। কতো রঙ্গই না দেখাচ্ছো। তুমি কি ভেবেছো, পিণ্ডির এই মসনদ কেল্লা ফতে খান সাগ্রহে তোমার হাতে তুলে দেবেন?

নবাবঃ শাহানশা ওয়াদা করেছেন।

ঈমানঃ (ইকো) ওয়াদা। বিশ্বের সেরা নরঘাতী দানবের ওয়াদা! চমৎকার। তাই বুঝি পিণ্ডির বাদশার পেয়াদা হয়ে পিকিং দৌড়েছিলেন ?

নবাবঃ অনেকটা তাই। কারণ বিশ্বের কোন বৃহৎশক্তির সমর্থন না পেলে মসনদ বিপদমুক্ত হবে না।

<005.016.366>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

ঈমানঃ কিন্তু কি পেলে? চীনের নীতির পটপরিবর্তন দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেছো নিশ্চয়ই? দেখলে তা চীন সরকার শুধুমাত্র তোমাদের দু’চারটি উপদেশ দিয়ে বিদায় সম্ভাষণ জানালেন। তুমি ব্যর্থ হলে। এবার কি পিণ্ডির বাদশা তোমার প্রতি খুশী হয়ে মসনদের ভাগ দেবেন? তুমি ইনাম পাবে না।

নবাবঃ তোমরা সবাই অনাগত দিনের দিকে চেয়ে থাকো। এই মসনদ আমার হাতে আসবে। আমিই হবো এদেশের ভাবী প্রধান উজির।

ঈমানঃ অন্ধকারের মাঝে দাঁড়িয়ে আছো লারকানার নবাবজাদা। সত্যিই তুমি যদি জননায়ক বলে দাবী করো, তাহলে কি ভেবেছো সৈরাচারী সামরিক গোষ্ঠী জননায়ককে পেয়ার করে? অসম্ভব। তুমি কি ভেবেছো, যে কেল্লা ফতে খান সামরিক গোষ্ঠীর প্রতীত সে মুখের কথায় মসনদ ত্যাগ করবে?

নবাবঃ যদি স্ব-ইচ্ছায় ওয়াদামতো কেল্লা ফতে খান মসনদ ত্যাগ না করে তাহলে আমি প্রতিহিংসার আগুনে গোটা পাক জাহান পুড়িয়ে দেবো।

ঈমানঃ জ্বলাময়ী ভাষা প্রয়োগ করতে ওস্তাদ লোক তুমি। কিছুদিন আগেই তো বাদশার সঙ্গে তোমার তীব্র মতপার্থক্য শুরু হল। তুমি প্রকাশ্যে অভিযোগ করলে- ‘জনগণের পরিষদ’ আহবান করবে বলে বাদশাকে হুশিয়ার করে দিলে- আবার সেই তুমি পোষা কুত্তার মতো পিকিং দৌড়ালে।

নবাবঃ এর পশ্চাতে রহস্য আছে।

ঈমানঃ বিচিত্র- বিশ্বের বিস্ময়। তোমাদের ২৩ বছরের রাজনীতির ইতিহাসের পৃষ্ঠগুলি রক্তে ভেজা। বিষাক্ত নিঃশ্বাসে ভরপুর তোমাদের অন্তর। তাই পাকিস্তানের রাজনীতির মঞ্চে তোমার প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে, এদেশের রাজনীতি চরম সঙ্কটের সম্মুখীন- এদেশের রাজনীতি পথভ্রষ্ট। তাই কোন বাদশা, কোন প্রজা তোমাকে সহ্য করতে পারে না। তুমি যেন ধূমকেতু। তুমি এক অশুভ ব্যক্তি।

নবাবঃ          খামোশ! আমাকে তোমরা সবাই মিলে অন্ধকারে নিক্ষেপ করতে চাইছো। কিন্তু না- পারবে না। আমার এতোদিনের আশা-পরিকল্পনাকে তোমরা ভেঙ্গে দিতে পারবে না।’

ঈমানঃ (ইকো) পঙ্গু-পরাজিত নায়ক, তুমি এখন মাঝ-দরিয়ার পাঁকে পড়েছো। তুমি তলিয়ে যাবে। যদি বাঁচতে চাও- তাহলে সাচ্চাইয়ের হাত ধরো।

নবাবঃ আমাকে প্রলোভন দেখিও না।

ঈমানঃ (ইকো) বেয়কুব, প্রলোভনের জন্যেই তো বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের স্বাধিকার, গণতন্ত্রকে কামানের মুখে উড়িয়ে দিয়েছো- বাংলার রক্তগঙ্গা বইয়েছো- তোমার দেশের মানুষের জীবনকে নিয়ে স্বার্থের জুয়াখেলা শুরু করেছো। গণতন্ত্রের নামে স্বৈরাচার, ধোঁকাবাজি তোমার দেশের জনগণও আর সহ্য করবে না। সেখানেও বিপ্লবের আগুন জ্বলে উঠবে। সব স্বার্থ ভস্মীভূত হবে।

নবাবঃ আমাকে সুনির্দিষ্ট পথের সন্ধান তুমি দিতে পারো?

ঈমানঃ (ইকো) একটিই পথ। সেটা হচ্ছে সত্য-সুন্দরের পথ। শান্তি-সংহতি-সৌভ্রাতৃত্বের পথে অগ্রসর — হয়ে মানুষের অন্তরের গভীরে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করো। গোটা বিশ্বের মানবকল্যাণে নিজেকে-

<005.016.367>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

উৎসর্গ করো। নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের হাত ধরে অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে এসো। সাচ্চা দেশপ্রেমিক বলে নিজেকে চিহ্নিত করতে পারবে। গন্ডিমুক্ত হও- একলা চলো।

নবাবঃ         কিন্তু কি করে সর্ব বাঁধনমুক্ত হবো আমি! আমি যে আমার গোটা সত্তাটাকে বন্ধক দিয়েছি। আমি মুক্ত হতে চাইলেও- সামরিক জুন্তা আমাকে মুক্তি দেবে না।

দুর্মুখঃ   আরে নবাবজাদা, মসনদের সামনে বসে কি ভাবছেন? ও– নবাবজাদা

নবাবঃ         কে! ও দুর্মুখ খান!

দুর্মুখঃ   হা- খোদা! আজকাল থেকে থেকে অন্য জগতে চলে যাচ্ছেন নাকি!

নবাবঃ আচ্ছা দুর্মুখ খান, তুমি তো বিচক্ষণ ব্যক্তি। আচ্ছা বল তো দুর্মুখ খান, আমি যা কিছু করেছি ও করছি সবই কি স্বীয় স্বার্থের জন্যে?

দুর্মুখঃ   দুষ্ট লোকে অবশ্য তাই বলে। ওরা বলে আপনিই নাকি স্বচ্ছ পানি ঘোলা করেছেন। আবার অনেকে বলে- আপনি নাকি মুশকিল আসান। ভেবে দেখুন, ভেঙ্গে-পড়া গদীহারা পিণ্ডির বাদশা বেকুব খান আপনাকে মুশকিল আসান হিসেবে কাছে টেনে নিয়েছিলেন। পিকিং-এর সঙ্গে পাকিস্তানের দোস্তীয় বন্ধনে আপনি বেঁধে দিয়েছেন। আবার বাংলাকে কোতল করবার পরামর্শ দিয়ে মিলিটারী জুন্তার মুশকিল পথ বাতলে দিলেন। কিন্তু আমি ভাবছি নবাবজাদা, আপনি তো সকলের মুশকিল আসান- কিন্তু আপনার মুশকিল আসান কে করবে?

নবাবঃ তুমিও কি আমাকে বিদ্রুপ করছো দুর্মুখ খান?

দুর্মুখঃ   তোবা-তোবা! আপনাকে নিয়ে বিদ্রুপ-এও কি সম্ভব! নবাবঃ ধিক্কার-বিদ্রুপ আমাকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। যে পথটিকেও বেছে নিচ্ছি সে পথই আমাকে ধিক্কার দিয়ে ফিরিয়ে দিচ্ছে। জানি না, অনাগত দিন আমাকে প্রতিষ্ঠিত করবে, না আমাকে

দুর্মুখঃ   ইতিহাসের আবর্জনার স্তুপে নিক্ষেপ করবে। গোস্তাফি মাপ করবেন, শেষের টুকু আমিই বলে দিলাম। এ কি, কোথায় চললেন নবাবজাদা?

নবাবঃ এখানে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। একটু বাইরে থেকে আসি।

(Change over-Music)

।।দরবার।।

ফতেঃ   একে একে সবাই আমাকে পরিত্যাগ করছে। সবাই আমাকে হুশিয়ার করে দিচ্ছে। সর্বশক্তিমান যে আগুন আমি জেলেছি মাশরেকী বাঙ্গালে, সেই আগুনের তাপ যেন পিণ্ডির দরবারে বসে পাচ্ছি। কিন্তু কি করবো আমি? অদৃশ্য হস্তের ইংগিতে আমাকে পৃথিবীর মানচিত্রের এক অংশে সুপরিকল্পিত উপায়ে আগুন জ্বালাতে হয়েছে। আমি ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ছি। উঃ ভাবতে পারছি না আর এই-কোই হ্যায়?

দুর্মুখঃ   বান্দা হাজির জনাবে আলা। ফরমাইয়ে-

<005.016.368>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

ফতেঃ   দুর্মুখ খান! তুমি!

দুর্মুখঃ   আমিই হাজির হলাম জনাব। আপনার হুকুম তামিল করার জন্যে কাউকে দেখলাম না।

ফতেঃ   কমবকতদের আমি বিতাড়িত করবো।

দুর্মুখঃ   এখন কে কার হুকুম তামিল করে জনাব। দরবার, হারেমের সকলের চোখেমুখে কেমন যেন হতাশা-কেমন যেন একটা প্রচ্ছন্ন আতঙ্ক-

ফতেঃ আতঙ্ক হতাশা! এই সব আতঙ্ক-হতাশাকে আমি গলা টিপে হত্যা করবো। যার কণ্ঠে শুনবো আমি হতাশার বাণী, তার জিবটা আমি ছিঁড়ে নেবো।

দুর্মুখঃ   আপনার অন্তরের গোপনেও কি হতাশা নেই জনাব? ফতেঃ না নেই। আমি পাঠান কা বাচ্চা।

দুর্মুখঃ   এই হুঙ্কার আপনার মুখের-মনের নয়। পাশ্চাত্য দেশগুলির সমর্থন হারানোর জ্বালা আপনার হৃদয়কে দগ্ধ করছে। আমেরিকা কর্তৃক অস্ত্র সাহায্য বন্ধ, চীনের পাল্টা সুর, মশরেকী বাঙ্গালের সেনাবাহিনীর হত মনোবল, মুক্তিবাহিনীর বিক্রম আপনাকে, ধীরে ধীরে হতাশা-নৈরাশ্যের অন্ধকারে নিক্ষেপ করছে।

ফতেঃ   বন্ধুহীনতায় আমি কিছুটা দুর্বল হয়েছি সত্যি-নানারকম চাপ, হুমকির সম্মুখীন হয়ে আমি বিচলিত হয়েছি সত্য- আমার অগণিত সৈন্যদের মৃত্যু আমাকে ব্যথিত করেছে সত্য-কিন্তু তাই বলে মাথা নীচু করে বিশ্বের দরবারে বিচারাধীন হতে আমি রাজী নই। এ পরাজয় আমার আত্মহত্যার শামিল।

দুর্মুখঃ   কিন্তু জনাব, এখনও কি ভেবেছেন বাংলা মুলুকে আপনার রাজ কায়েম রাখতে পারবেন?

ফতেঃ   হ্যাঁ পারবো। প্রয়োজন হলে বাংলার প্রতিটি ঘরকে আমি ভস্মস্তুপে পরিণত করবো- বাংলার মানুষের লাশে ওদের নদীর বুক ভরে যাবে। তবু —তবু বাংলার জমিন আমি ছাড়বো না।

দুর্মুখঃ          হাসালেন-নিতান্তই হাসালেন। আপনি কি আর ছাড়বেন- ওরা ছাড়িয়ে নেবে।

ফতেঃ   দুর্মুখ খান।

দুর্মুখঃ   হ্যাঁ জনাব। পিণ্ডিতে বসে বাংলার খবর কতোটুকু একবার যান না বাংলায়! আপনার সৈন্যদের মাঝে গিয়ে একবার দাঁড়ান। তাদের আশা দিন, ভরসা দিন।

ফতেঃ          বাংলায় যাবার আমি প্রয়োজন মনে করি না।

দুর্মুখঃ বলুন বাংলায় যাবার সৌভাগ্য আর হবে না। ২৫শে মার্চে নিশ্চয় “হে বাংলা বিদায়-চিরবিদায়” বলে সেলাম জানিয়ে চলে এসেছেন?

ফতেঃ   দুর্মুখ খান! তমিজ-সে বাত করো। বাংলায় যাবার সময় হলেই যাবো।

দুর্মুখঃ   সেই ভালো। কারণ খতরনাক স্থানে বুঝে-সুঝে সাবধানে যাওয়াই মঙ্গল। কোথায় মাইন পাতা আছে, ঘুপ-ঘাপ কোথায় বোমা পড়ছে বলা যায় না। এই দেখুন- খবরে প্রকাশ, আপনার ভাবী পুতুল সরকারের একটা পুতুলকে মুক্তিবাহিনী বোমের ঘায়ে খতম করেছে। অশান্তি কমিটির

<005.016.369>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

কয়েকজন চামুণ্ডাও আচমকা মারে পটল তুলেছে। ত্রিপুরা- নোয়াখালীতে আপনার জেট বিমান দিয়েও বিদ্রোহীদের কাত

করা যাচ্ছে না।

ফতেঃ   মরুক-মরতে দাও ওদের। ওদের স্থানে আর একটি পুতুল খরিদ করতে আমার বেশী কষ্ট হবে না।

দুর্মুখঃ   আরও খবর আছে। চাঁদপুরে অস্ত্র বোঝাই একটা মার্কিন জাহাজ বাংলার নৌ-কমাণ্ডোরা ডুবিয়ে দিয়েছে। গোদের উপর বিষফোঁড়া।

ফতেঃ তোমার এই কথাগুলো যেন মনে হচ্ছে আমার কানে গলিত সীসা ঢেলে দিচ্ছে। কতোগুলো অপদার্থের ওপর বাঙ্গাল মুলুকের দায়িত্ব দিয়েছি।

দুর্মুখঃ   সৈন্যদের আর অপরাধ কি? তারা লড়ছে-মরছে। আর আহত সৈনিকরা চিকিৎসার অভাবে প্রাণ দিচ্ছে। এই ধরুন না, মেহেরপুরে আমাদের সৈন্যদের উপর বিদ্রোহীরা তিন দিক থেকে গিয়ে প্রাণ রক্ষা করল। আরও চমকপ্রদ খবর আছে জনাব। আপনার পোষ্যপুত্র নবাবজাদা একটুর জন্যে রক্ষা পেয়েছেন।

নবাবঃ বন্দেগী খাঁ সাহেব।

দুর্মুখঃ   আসুন নবাবজাদা, জাঁহাপনাকে একটু সান্তুনা দিন।

নবাবঃ আমি আর কি সান্তনা দেবো- কি ভরসা দেবো দুর্মুখ? একটা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের অন্ধকারে আমরা নিমজ্জিত। মার্কিনীরা অস্ত্র সাহায্য বন্ধ করল। ফ্রান্স, যুগোশ্লাভিয়া, কানাডা সকলেই বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান দাবী করছে।

ফতেঃ   দাবী! কিসের দাবী! কারও কোন দাবী-কোন আব্দার আমি বরদাস্ত করবো না। আমি জানি আমি বন্ধুহীন-আমি নিঃসঙ্গ। কিন্তু এর শেষ আমি দেখতে চাই। নবাবঃ তবে খাঁ সাহেব, আমাদের চীনা বন্ধুরা-

ফতেঃ          থামুন থামুন। চীনা বন্ধু! কি আশ্বাস নিয়ে এলেন আপনি চীনা দোস্তদের কাছ থেকে? নৈরাজ্য কিছু উপদেশ আর কিছু সান্তনা ছাড়া চীনা দোস্তরা কি দিয়েছে আপনাকে?

দুর্মুখঃ   চীন বলেছে বাংলাদেশের সমস্যার একটা শান্তিপূর্ণ সমাধান করে নিতে। আরে বাবা, নবাবজাদা কতো কাঠখড়ি, পুড়িয়ে, পাক-জাহার ভাবী পেরধান মন্ত্রী হবার আশ্বাস নিয়ে চীনে গেলেন অস্ত্র আর মদত আনতে। চীনা সাহেবদের হৃদয়ে কি নবাবজাদার জন্য এতটুকু করুণা-

ফতেঃ স্তব্ধ হও দুর্মুখ খান। খাঁ-সাহেব, চীন যে এভাবে আমাদের নিরাশ করবে তা ভাবতে পারিনি।

দুর্মুখঃ   কপালে যখন আগুন লাগে-তখন তুষের আগুনের মতোই জ্বলতে থাকে।

ফতেঃ   হ্যাঁ ঠিকই বলেছো দুর্মুখ খান! অথচ ক্ষমতা নেবার জন্য সকলের লোলুপ জিহবা মসনদটাকে গ্রাস করার জন্য ব্যস্ত।

নবাবঃ আপনার এই উক্তি কার প্রতি খাঁ-সাহেব?

<005.016.370>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

ফতেঃ   আপনাদের প্রতি নবাবজাদা। মসনদের ভাগ নেবার জন্য একদিকে শক্তিশালী সামরিক জুন্তা, অন্যদিকে আপনি, আপনি, নুরুল আমিন, দৌলতানা, কায়ুম প্রভৃতি।

নবাবঃ চীন সফরের পূর্বে আপনি আমার নিকট কি ওয়াদা করেছেন আশা করি ভুলে যান নি।

ফতেঃ   না-না-ভুলে যাইনি-যাবো না। আমি বিদায় নেবার পূর্বে মসনদটাকে টুকরো করে আপনাদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে দিয়ে যাবো। আমি ষোল আনা বুঝে দিয়ে যাবো।

দুর্মুখঃ   কবে সেই দুদিন আসবে জনাব?

ফতেঃ   জানি না। বুঝলেন নবাবজাদা, বড় আশা করেছিলাম আপনাদের নিয়ে-তাই আজ আমার এই পরিণতি। বড় আশা করেছিলাম টিটিয়া, পিয়াজী, দান্দাল গভর্নরকে নিয়ে-বড় আশা করেছিলাম আমাদের দুদিনে একমাত্র দোস্ত চীন অন্তত নিঃসন্দেহে আমাদের সক্রিয় সমর্থন জানাবে। ব্যর্থআপনি ব্যর্থ নবাবজাদা!

নবাবঃ এখন থেকে আমাদের অন্য কারও ওপর ভরসা না করা বাঞ্ছনীয়!

ফতেঃ   চীনের প্রতি আমার দৃড়বিশ্বাস ছিল বলেই আমি বড় মুখ করে বলেছিলাম –

দুর্মুখঃ   সে মুখ এভাবে ভোঁতা হবে তা কি জানতেন? চীনে নবাবজাদার প্রতি চীনা ছাত্রদের বিক্ষোভ রীতিমত অপমানকর। যে দেশে বিক্ষোভ, প্রদর্শনী, মিছিলের জন্য সরকারী অনুমতি লাগে, সে দেশে এই বিক্ষোভ প্রদর্শন সরকারের সমর্থন ও অনুমতিতেই হয়েছে।

ফতেঃ চীনও শেষে কি দোস্তের প্রতি অবিচার করবে?

নবাবঃ খাঁ সাহেব, এখন থেকে বিদেশী রাষ্ট্রগুলো সম্বন্ধে সংযত উক্তি করাই বাঞ্ছনীয়। মনে রাখবেন আমরা ধীরে ধীরে বন্ধুহীন হয়ে পড়ছি-নিন্দিত হচ্ছি ।

ফতেঃ   তবু আমি মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে চাই। বন্ধুহীন, অসহায়, রিক্ত আমি। তবু আমি মরণ ছোবল দেবো। এ ছাড়া কোন উপায়, কোন পথ নেই নবাবজাদা। চরম অবস্থার সম্মুখীন আমি।

দুর্মুখঃ   সামনে অন্ধকার-পেছনে অতল গহবর। ইতিহাস তুমি লিখে যাও-মহাকাল তুমি দেখে যাও-বন্য পশু কিভাবে মরণ গহবরে তলিয়ে যায়। বিশ্ববাসী তোমরা প্রত্যক্ষ করো, কেমনভাবে সত্যের অগ্নিতে মিথ্যার মৃত্যু ঘটে।

।।জয় বাংলা।।

(রচনাঃ কল্যাণ মিত্র। অংশগ্রহণেঃ রাজু আহমেদ, নারায়ণ ঘোষ (মিতা), নাজমুল হুদা মিঠু, প্রসেনজিং বোস, অমিতাভ বোস, জহুরুল হক, ইফতেখারুল আলম, বুলবুল মহলানবীশ, করুণা রায় প্রমুখ।)

<005.017.371>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৭। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রচারিত জীবন্তিকা অনুষ্ঠান স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের দলিলপত্র ……১৯৭১

মিরজাফরের রোজনামচা

১ নভেম্বর, ১৯৭১

ভাগ্নেঃ   (ক্ৰন্দন মিশ্রিত কণ্ঠে) মামা- মামাগো-

মামাঃ          কেরে ? কে?

ভাগ্নেঃ   দরজা খোল মামা শীগগীর। আমি তোমার ভাগ্নে হাদু।

মামাঃ   চিৎকার করিসনে- আসছি দাঁড়া। (দরজা খোলার শব্দ)

ভাগ্নেঃ   মামা মামাগো- (ক্ৰন্দন)

মামাঃ   ওকি কাদছিস কেন? এই মলো, বলি কাঁদছিস কেন গবেট?

ভাগ্নেঃ   মামাগো চোখের সামনে খুন করল।

মামাঃ   খুন! মিলিটারী কাকে মারল?

ভাগ্নেঃ   না।

মামাঃ   তবে মুক্তিবাহিনী কি রাজাকারকে মারলো?

ভাগ্নেঃ   বলছি না।

মামাঃ   (রেগে) তবে কি তোর সাতগুষ্ঠির পিণ্ডি চটকালো?

ভাগ্নেঃ   না।

মামাঃ   তবে কে কাকে খুন করল?

ভাগ্নেঃ   একজন বাঙালী রাজাকার আর একজন খান রাজাকারকে আমার চোখের সামনে ধরাম করে গুলি করে পেড়ে ফেলে দিল।

মামাঃ   এই হতভাগা, শীগগীর আমার টেবিল থেকে মিরজাফরের রোজনামচাটা আর পেনটা নিয়ে আয়।

ভাগ্নেঃ   এই নাও।

মামাঃ   এবার বল।

ভাগ্নেঃ   আমি ওই মোড়ের ওপর দোকানে বসে চা খাচ্ছি। আমার পাশের টেবিলে একজন বাঙালী আর একজন খান রাজাকারের মধ্যে বেশ গরম কথাবার্তা চলছিল।

<005.017.372>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

মামাঃ   কি কথাবার্তা হচ্ছিল তোর কানে গিয়েছে।

ভাগ্নেঃ   যাবে না মানে? থিয়েটারের অভিনেতাদের যেমন কান প্রমটের দিকে থাকে, এদিকে অভিনয়ও করে যায়,- আমিও তেমনি চা খেতে খেতে ওদের দিকে কান খাড়া করে রেখেছিলাম।

মামাঃ   ওরে বাবা হাঁদু, তোকে কতদিন বলেছি বাপ-ইনট্রোডাকশন বাদ দিয়ে কথা বলবি। ইয়াহিয়া খানের মতো যতো আজেবাজে কথার ঝুড়ি উপুড় করে দেবে। আসলে কি ঘটল তাই বল?

ভাগ্নেঃ   তারপর? মুখ ছেড়ে হাতাহাতি। খানটা বাঙালীকে কয়েক ঘা বসিয়ে দিল। তারপর বাঙালীটা মুখের রক্ত মুছে নিজের রাইফেলটা হাতে নিয়েই খানের বুকে গুরুম করে গুলি চালালো। খান রাজাকার আল্লা বলে বুক ধরে পড়ে গেল- । তারপর-

মামাঃ   তারপর খান পটল তুললো এইতো? একটা আপদ গেছে।

ভাগ্নেঃ   কিন্তু মামা, যদি গুলিটা আমার বুকে লাগতো?

মামাঃ   লাগেনি তো-তবে আর ভয় কি? এরকম ঘটনা তো রাজাকারদের মধ্যে আকছার ঘটছে। লুটের মাল নিয়ে খুনখুনি, বন্দী রমণী নিয়ে রক্তারক্তি। ইয়াহিয়ার এ এক জ্বালা। ওদিকে দলে-দলে কাতারেকাতারে বহু বাঙালী রাজাকার মুক্তিবাহিনীর কাছে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পা চেপে ধরে আত্মসমর্পণ

ভাগ্নেঃ   তাই নাকি মামা?

মামাঃ   দুনিয়ার কোন খবরই রাখিসনে? শুধু মামার ভাত রেধেই মলি?

ভাগ্নেঃ   তোমার মতো ঘোড়েল সাংবাদিক যার মামা তার চিন্তা কি? আচ্ছা মামা তুমি এসব সংবাদ সংগ্ৰহ করে সরবরাহ কর কোথায়?

মামাঃ   কোথায় এ্যাঁ? হা-হা-হা- শোন, গোপনে এইসব সংবাদ সরবরাহ করে বাংলাদেশ সরকারের তথ্য, বেতার আর প্রচার দপ্তরের কাছে লোক মারফৎ পাঠিয়ে দেই। বাংলার মুক্ত অঞ্চল থেকে এসব খবর প্রচার করা হয় বিশ্বে।

ভাগ্নেঃ   এ্যাঁ, বলো কি মামা।

মামাঃ   গোপন কথা ফাঁস করে ভুল করলাম নাতো?

ভাগ্নেঃ   জান যাবে- তবু কথা বেরুবে না। -হ্যাঁ।

মামাঃ   সাবাস ভাগ্নে।

ভাগ্নেঃ   তাহলে বাংলাদেশ সরকার সব দপ্তরই একরকম খুলে ফেলেছেন।

মামাঃ   আছিস কোথায় রে বেটা হাদু। বাংলাদেশ সরকার এমন কি কাষ্টম ডিপার্টমেন্টও খুলে ফেলেছেন ইতিমধ্যে। বাংলাদেশ কাস্টমকে স     কলে নিয়মমতো শুল্ক দিচ্ছে।

<005.017.373>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

ভাগ্নেঃ   এসব কথা শুনলে, সত্যি বলছি মামা বুকটা খুশীতে ডগোমগো করে। আচ্ছা মামা শুনলাম, বাংলাদেশ সরকার নাকি বিমান আর নৌবহর গড়েছেন?

মামাঃ   গড়েছেন মানে? এইতো সেদিন বাংলাদেশ নৌবাহিনী চাটগাঁর কাছে পাক-সৈন্যের জন্য অস্ত্রশস্ত্র বহনকারী দুটি জাহাজ ডুবিয়ে দিয়েছে। একটা পাকিস্তানী জাহাজ নাসিম’ আর একটা গ্রীসের। নাম ‘এলভোস’।

ভাগ্নেঃ   আনন্দে আমার নাচতে ইচ্ছে করছে মামা।

মামাঃ এই খেয়েছে।

ভাগ্নেঃ          আচ্ছা মামা শুনলাম, ইয়াহিয়া মামু নাকি ভারত আক্রমণ করার জন্যে লুঙ্গি ঝেড়ে ভাল করে গিট মেরে মালকোচা দিয়ে ভারতের সঙ্গে লড়বার জন্যে “ইয়া আলী বলে ডনবৈঠক মারছে আর বুক চাপড়াচ্ছে?

মামাঃ   হ্যাঁ। শেষে লুঙ্গি হারিয়ে ল্যাঙ্গট পরে “মাইয়ারে মাইয়া” বলে পিঠে হাত দিয়ে ব্যাক গিয়ারে দৌড়ুতে হবে। বুঝলি হাঁদু, পিপীলিকার পাখা ওঠে মরিবার তরে। গুণ্ডাধিপতি ইয়াহিয়ার পাখনা গজিয়েছে।

ভাগ্নেঃ   হা-হা-হা-যথার্থ বলেছো মামা। আচ্ছা লড়াই করে কি জিততে পারবে ইয়াহিয়া মামা?

মামাঃ   অসম্ভব। ইয়াহিয়া এখন “কলকে ছোট-তামুক বড়” পান করছেন।

ভাগ্নেঃ   সে আবার কি?

মামাঃ   বুঝলিনে? মানে গেজা গুলগাট্টি মেরে হামবড়াই ভাব দেখাচ্ছে। ওর ছয় জেনারেল দিনরাত পাম্প দিচ্ছে ইয়াহিয়াকে। কারণ বাংলাদেশ আজ বাস্তব-জ্বলন্ত সত্য। বাংলাদেশে খান দস্যুসেনারা বাঙালীদের হাতে প্যাদানী খেয়ে মরছে-হাড়গোড় ভেঙ্গে বদন বিগড়ে পড়ে আছে।

ভাগ্নেঃ   ইয়াহিয়া মামু জান জানে বাংলাদেশ হাত থেকে বেরিয়ে গিয়েছে। মামাঃ শুধু কি তাই, খান সাহেবের ট্যাক শূন্য। ব্যবসা, বাণিজ্য, আমদানী, রপ্তানী নেই। বিদেশী রাষ্ট্রগুলো একে একে মৌলভী সাহেবের পেছন থেকে কেটে পড়ছে। কেউ আর খান সাহেবকে টাকা, অস্ত্র দিয়ে চোট খেতে রাজী নয়।

ভাগ্নেঃ   তাছাড়া তো বাংলাদেশে জাহাজ, রেল, সেতু পোঁ-পো করে চোকের নিমিষে উড়ে যাচ্ছে। পাট লোপাট হয়ে যাচ্ছে। চা বাগানগুলো

মামাঃ   চা রপ্তানী করা ছেড়ে এখন আমদানী করতে হচ্ছে। ইয়াহিয়াকে ভরাডুবির হাত থেকে বাঁচাবার জন্য বোমাবাজ ট্যাটোন খান, বাংলার মামদো ভূত মামুদ আলী, বোতল ট্রেড মার্কা ভুট্টো, কুপুত্তর মালকে বেটা, গুণ্ডা নিয়াজী, টেকো নুরুল চাচা কতো কেমেকারী-কতো কসরৎই না করলেন। কিন্তু কোন ফয়দা হ’ল?

ভাগ্নেঃ   মোটেই না। বরঞ্চ আরও পানি ঘোলা হ’ল।

মামাঃ   তাই ইয়াহিয়া এখন বাঁচার জন্যে শেষ চেষ্টা করছে। ইয়াহিয়া দেখছে, আমি যদি যাই তাহলে ভোগ করার জন্যে আমিও কাউকে রেখে যাবো না। মরি যদি সবাইকে নিয়েই মরবো। তাইতো ভাগ্যের জুয়াখেলা শুরু করেছেন। তাইতো বাঁচেগা ইয়া মরেগা বলে ভারত আক্রমণ করতে চাইছে।

<005.017.374>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

ভাগ্নেঃ   আচ্ছা মামা, ইয়াহিয়া ভারত আক্রমণ করে কিভাবে বাঁচবার পথ পাবে?

মামাঃ   এই পরিষ্কার ব্যাপারটা বুঝতে পারলিনি হাদু। ইয়াহিয়া এখন ছাতা দিয়ে মাথা বাঁচাতে চায়। ইয়াহিয়া বেটা ভাবছে ভারতের সঙ্গে চুলকিয়ে ঘা করে যুদ্ধ বাধাতে পারলেই, রাষ্ট্রসঙ্ঘ সাদা পতাকা বাঁধা বাঁশ কাঁধে করে উভয়ের মাঝে এসে দাঁড়িয়ে বলবে- “থাম বাপ-সকল মারামারি করিসনে।” তারপর সিজ ফায়ার। রাষ্ট্রসঙ্ঘের তখন পাক-ভারত মীমাংসার জন্যে মাথা ব্যথা শুরু হবে। আর মুখ্য বাংলাদেশ সমস্যা তখন ধামাচাপা পড়বে। ব্যাস-খেল খতম!

ভাগ্নেঃ   ইরি বাপ! খানের মাথায় এতো বুদ্ধি।

মামাঃ   শয়তানি বুদ্ধিতে খান সাহেবরা চিরদিনই ওস্তাদ ব্যক্তি। কিন্তু এসব বুদ্ধি লাসটিং করে না বেশীদিন।

ভাগ্নেঃ   হা-হা-হা- মামা একেবারে রসে টুইটুম্বুর। বাংলার মানুষ আজ খান সেনার ভয়ে আতঙ্কগ্রস্ত। কিন্তু মামা ঠিক আছে।

মামাঃ   ঠিক থাকবো না কেন রে ছোঁড়া? আমিও বিয়ে করিনি-তুইও বিয়ে করলিনে? আমাদের কিসের চিন্তা? প্রয়োজনে অস্ত্র ধরবো। দেশের জন্য যদি মরি তাহলে জানবি-আমাদের বাপ-চোঁদ্দপুরুষের পুণ্যের ফল।

(কল্যাণ মিত্র রচিত)

এ সত্য রুধিবে কে?

২৫ নভেম্বর, ১৯৭১

(একটি ঝোপের আড়ালে গভীর আঁধারে নারায়ণ পজিশন নিয়ে বসে আছে। দূরে মর্টার ও মেশিনগানের ক্রমাগত শব্দ শোনা যাচ্ছে। একটু কাছে সামান্য একটি শব্দ হোল-সঙ্গে সঙ্গে সে চ্যালেঞ্জ করে উঠলো)

নারায়ণঃ  হল্ট। হু কামস দেয়ার?

মাইকেলঃ        ফ্রেণ্ড।

নারায়ণঃ        পাস ওয়ার্ড।

মাইকেলঃ        বুলেট পিলেট মর্টার, পিলেট পিলেট মর্টার।

নারায়ণঃ        ও. কে.

মাইকেলঃ        তারপর এদিককার খবর কি নারায়ণ?

নারায়ণঃ        খুব চলছে অর্থাৎ খুব চালাচ্ছে জানোই তো, খান-সেনারা এখন হাওয়ায় গুলি ছোড়ে, আমরা ছুড়ি হয়তো একটা, আর ওরা ছুড়বে এক ধামা।

<005.017.375>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

মাইকেলঃ        উদ্দেশ্য?

নারায়ণঃ        উদ্দেশ্য অতি, পরিষ্কার, যেন আমরা আর কাছেই না যাই। তা না হলে কখনো শুনেছ কোন সেনাবাহিনী হাঁটু কাঁপায় আর এলোপাতাড়ি আকাশের দিকে গুলি ছেড়ে?

মাইকেলঃ        না, তবে অপূর্ব চীজ এই খান বাবাজীদের কল্যাণে তাও এ জীবনে দেখে যেতে হোল। যাক সে কথা, শ্রীমতী বড়ুয়া কি ফিরেছে?

নারায়নঃ        কে, শান্তি? না এখনও তো ফিরলো না। কথা ছিল ডক্টর সিদ্ধার্থ বডুয়ার কাছ থেকে কিছু ঔষধ কথা। এদিকে তো রীতিমতো সুবিধে একেবারে তৈরী হয়েই আছে, খালি একবার ঘোড়া টানার অপেক্ষা।

মাইকেলঃ        এতো ব্যস্ত হয়ো না। রহমান ভাই এখনই এসে পড়বেন। আসলে কি একটা জরুরী ব্যাপারেই নাকি তাকে ডেকে পাঠানো হয়েছে।

নারায়ণঃ        আমিও তাই শুনেছি। আমার মনে হয় চরম আঘাত হানার সময়-হল্ট, হু কান্স দেয়ার? রহমান ও

শান্তিঃ   ফ্রেণ্ড।

নারায়ণঃ        পাস ওয়ার্ড। রহমান ও

শান্তিঃ   বুলেট পিলেট মটার, পিলেট পিলেট মর্টার।

নারায়ণঃ        ও. কে.

মাইকেলঃ        কে, রহমান ভাই? তোমার দেরী দেখে আমরা ব্যস্ত হচ্ছিলাম। নাও চলো, যা দেখে এসেছি তাতে এখনই হানাদারদের আঘাত হানতে হবে। গোটা পচিশেক যা ফট ফট করছে তা একবারেই সাবার হয়ে যাবে।

রহমানঃ না মাইকেল, এখন আর পচিশ-পঞ্চাশের ব্যাপার নয়, এখন হাজারের ব্যাপার শুরু হয়েছে।

নারায়ণঃ        অর্থাৎ?

রহমানঃ         অর্থাৎ চরম মুহুর্ত এসে গেছে।

মাইকেলঃ        হ্যাঁ, চরম মুহুর্ত। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার কাজ আমরা শেষ করে এনেছি। এবারে শুক্রর ওপর হানবো আমরা চরম আঘাত। (নেপথ্যে ক্ষীণ ক্রমাগত গুলির শব্দঃ সেই সঙ্গে দ্বিতীয় বাক্যের সঙ্গে সঙ্গে মুজিবের কণ্ঠস্বরঃ প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল, তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে ……ইত্যাদি)

নারায়ণ ও মাইকেলঃ     চালাও কিস্তি ডাঙ্গা দিয়ে! এই তো চাই।

রহমানঃ         হ্যাঁ এবার কিস্তি ডাঙ্গা দিয়েই চলবে। এবার মানুষের শত্রু  সভ্যতার শত্রু জানবে কটা ধানে কটা চাল। এবার তারা জানবে অন্যায়ের দ্বারা, অত্যাচারের দ্বারা ন্যায়কে, সত্যকে, মানবতাকে হত্যা করা যায় না। শান্তি!

শান্তিঃ   রহমান ভাই।

<005.017.376>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

রহমান         ঃ     তোমার ওপরে যে আদেশ এসেছে তা বুঝতে পেরেছ?

শান্তি    ঃ     হ্যাঁ, রহমান ভাই।

রহমান         ঃ     তুমি প্রস্তুত?

শান্তি    ঃ     সম্পূর্ণ প্রস্তুত রহমান ভাই…হল্ট ও কামস দেয়ার?

জনৈক ঃ     (কাঁপা গলায়) ফ্রেণ্ড।

শান্তি    ঃ     পাস ওয়ার্ড।

জনৈক ঃ     পিলেট বুলেট মর্টার, বুলেট বুলেট মর্ডার (সঙ্গে সঙ্গে শান্তির হাতের ষ্টেনগান গর্জে ওঠে, একটি আর্ত চিৎকার। সবাই ছুটে

এগিয়ে যায়।)

মাইকেল         ঃ     কে লোকটি রহমান ভাই?

রহমান ঃ     রাজাকার দেখছি। পকেটে পাওয়া কাগজই তার সাক্ষী। গোয়েন্দাবাজি করতে এসেছিল।

শান্তি    ঃ     আহা, বেচারা গতকালকার পাসওয়ার্ড সম্বল করে এসেছিল দালালী করতে, ও হয়তো জানতো না সত্যের প্রহরীরা সদা

জাগ্রত।

রহমান         ঃ     তোমায় ধন্যবাদ শান্তি, তুমি সময়মতো ধরে ফেলেছিলে। যাক যা বলছিলাম। চরম মুহুর্ত এসে গেছে। এতদিন

আমরা কেবল গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ করেছি। সারা বাংলাদেশের রাস্তাঘাট অকেজো করে দিয়েছি, ব্রিজ উড়িয়েছি, রেললাইন ধ্বংস করেছি। এবং সুযোগ পেলেই শত্রু কে আঘাত করেছি। আমাদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল এটা দেখিয়ে দেওয়া যে খালি হাতে শুরু করলেও আমরা তাদের কাপুরুষোচিত অতর্কিত আক্রমণে নিশ্চিহ্ন হবার পদার্থ নই, আমরা এক মরে বহু হই। আমরা শত্রুর সমস্ত পথ বন্ধ করে দিয়েছি, সে ইচ্ছা করলেই সামনে-পিছনেডাইনে-বাঁয়ে তাড়াতাড়ি পালাতে পারবে না। সর্বত্র আমাদের ঘাঁটি, সবখানে আমাদের দুর্গ। হানাদাররা এখন যশোরে, রংপুরে, সিলেটে, কুমিল্লায়, ঢাকায়, চট্টগ্রামে আলাদা হয়ে আছে, বন্দী হয়ে আছে। কথায় কথায় এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় তাদের আর যেতে হবে না; একখানে দাঁড়িয়েই তাদের দেখে যেতে হবে সত্য কিভাবে অসত্যের ওপর জয়লাভ করে।

নারায়ন         ঃ     তাহলে এখন আমাদের কর্তব্য কি?

রহমান ঃ     এখানেই বসে থাকা। আর আধঘণ্টার মধ্যেই আমাদের মুক্তিবাহিনী এখান দিয়েই যাবে, এগিয়ে যাবে সামনে। সবুজ গ্রাম,

অর্থাৎ হেডকোয়ার্টার থেকে আমাদেরকে বলা হয়েছে এখান থেকেই সরাসরি মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে মিলিত হতে। এইবার

আমরা চারদিক থেকে হানাদারদের আক্রমণ করবো। আমরা দেখিয়ে দেবো বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি।

নারায়ন         ঃ     রহমান ভাই, আজ আমার বারবার মনে পড়ছে ঢাকার সেই ভয়াবহ পঁচিশে মার্চ, সেই হাহাকার, সেই আর্তনাদ। আমি এখনও

যেন শুনতে পাই খান-সেনাদের বুলেটে ঢলে পড়া আমার মায়ের সেই শেষ আদেশঃ খোকা তুই প্রতিশোধ নিবি, প্রতিশোধ

নিবি তোর মায়ের, তোর দেশের

(নেপথ্যে ঢাকার হাহাকার, মায়ের আর্তনাদ ও শেষ আদেশ দূর থেকে ভেসে আসবে)

<005.017.377>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

মাইকেল         ঃ     আমিও ভুলিনি নারায়ণদা আমার বোনের হাহাকার। আমি এখনও শুনতে পাই আমার বোন মেরীর- তার বান্ধবী রাবেয়া,

মরিয়ম, লক্ষ্মীর চীৎকার। তারা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বার বার বলেছেঃ প্রতিশোধ চাই, প্রতিশোধ চাই। আমরা মরে যাচ্ছি-তোমরা বেঁচে থাকবে, প্রতিশোধ নেবে। প্রতিশোধ (নেপথ্যে মহিলাদের চীৎকার ও সংলাপ ক্ষীণভাবে ভেসে আসবে)

শান্তি    ঃ     সত্যিই কি আমরা বেঁচে আছি মাইকেল? সত্যিই কি আমরা তাদের শেষ ইচ্ছা পূরণ করতে পেরেছি? সত্যিই কি আমরা

বৃদ্ধ বাবার আদেশ আমি পালন করতে সক্ষম হয়েছি? আমাদের আমার বাবা বাধা দিতে চাইলেন, বেয়োনেট দিয়ে তারা

হত্যা করলো তাঁকে। আমরা ঝোপের আড়াল থেকে লুকিয়ে দেখলাম বাবার বুক দিয়ে গল গল করে রক্তের নদী নামছে।

বাবা বলতেন কাউকে ঘৃণা করতে নেই, কারুর প্রতি হিংসা করতে নেই। কিন্তু, কিন্তু যে মানুষ নয়, যে পশুরও অধম, যে

মানুষেরই শত্রু তাকেও কি ঘৃণা করবো না? (নেপথে-মার ঢালো বাঙালীকা)

রহমান  ঃ    তুমি আমি ঘৃণা না করার কে? যারা গুলি খেয়ে মরেছে, যে নারী লাঞ্ছিতা হয়েছে, যে শিশু আগুনে পুড়ে মরেছে তাকে

জিজ্ঞেস করো ঘৃণা করা উচিত কিনা। যে মানুষ, তার বিরুদ্ধে তো আমাদের কোন যুদ্ধ নেই-কিন্তু যে অমানুষ, যে মানুষের

শক্রতাকে আমরা ধ্বংস করবোই।

শান্তি    ঃ     ঠিকই বলেছ রহমান ভাই। আচ্ছা রহমান ভাই, চট্টগ্রামে আমরা যে দুভাগ্যের মুখে পড়েছিলাম তাতো বললাম, কিন্তু তুমি

তো কিছুই বললে না তোমার কথা।

রহমান ঃ     আজ আমাদের ব্যক্তিগত কোন সংবাদ তো নেই শান্তি। আমাদের জিজ্ঞাস্য একটিঃ বাংলাদেশ কেমন আছে। আমাদের

ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত জীবনের একমাত্র নাম হচ্ছে বাংলাদেশ। আর সে জন্যেই তোমরা সবাই নিজেদের কথা বলোনি,

বলোনি কি দুঃখের পাহাড় বুকের মধ্যে প্রতিদিন বহন করছো।

নারায়ণ         ঃ     বলিনি এই জন্যে যে, বলার সময় নেই আমাদের। চূড়ান্ত জয় না হওয়া পর্যন্ত সময় নেই আমাদের। তবু আজ এই মুহুর্তে

সেইসব বেদনার কথা আমাদের মনে পড়ে গেল যা স্মরণে এলে হৃদয় চূর্ণ হয়ে যায়। তাই জানতে বড় ইচ্ছা আমাদের

তোমার কথা, তোমার ব্যক্তিগত কথা।

রহমান ঃ     (করুণ কষ্ঠে) কমরেড, তোমরা আমার জীবনের মরণের বন্ধু। তোমাদের বলতে আমার বাধা নেই। কুষ্টিয়ায় ছিলাম আমরা।

এই হতভাগ্য আমি বাদে আমাদের আর সবাই হারিয়ে গেছে অনন্তে। তাদের হাত-পা বেঁধে আমাদেরই ঘরে পুড়ে আগুন

লাগিয়ে দেয় নরপশুরা। (নেপথ্যে ক্ষীণ শব্দঃ বাঁচাও-বাঁচাও)

সবাই   ঃ     আহা! (দূর থেকে ক্ষীণ মার্চের শব্দ ভেসে আসবে)

রহমান ঃ     ঐ শোন, মুক্তিবাহিনী এগিয়ে আসছে। বন্ধুগণ, প্রত্যেক জাতির জীবনে একটি রচম সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় আসে। তখন তাকে

স্বাধীনতা ও পরাধীনতা, মুক্ত আকাশ ও বদ্ধঘর- এর যে

<005.017.378>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

কোন একটি বেছে নিতে হয়। তাকে বলতে হয় সে সম্মান চায়, না অসম্মান চায়? জীবন ও মৃত্যুর মাঝখানে দাঁড়িয়েই তাকে

সিদ্ধান্ত নিতে হয়। আমরা সেই চরম অবস্থায় এসে পৌছেছি। আমরা ছাব্বিশে মার্চেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি- প্রাণ দেবো, কিন্তু

স্বাধীনতা চাই। সেই সিদ্ধান্ত আজ আমরা চূড়ান্তভাবে কার্যকরী করার কাজে লিপ্ত কাজ যখন শেষ হবে তখন আমি নিজে

আর আমরা অনেকেই বেঁচে থাকবো না। কিন্তু আমাদের আত্মত্যাগ বৃথা যাবে না, আমাদের দেশ স্বাধীন হয়ে বেঁচে থাকবে,

বেঁচে থাকবে আমাদের দেশের শান্তিপ্রিয় মানুষ। আমরা সেই উদ্দেশ্যেই যুদ্ধ করছি, প্রাণ দিচ্ছি।

শান্তিঃ          আমরা যুদ্ধ করছি শোষণের বিরুদ্ধে। একজন মানুষ যাতে আরেকজন মানুষকে শোষণ করতে না পারে, সেজন্যেই আমরা প্রাণ দিচ্ছি। (মার্চের শব্দ আরো কাছে চলে আসবে)

মাইকেলঃ        বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবও তাই বলেছেন। তিনি বলেছেন সবাই সমান অধিকার পাবে, কেউ কাউকে শোষণ করতে পারবে না, মানবিক অধিকারের উপর প্রতিষ্ঠিত একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থাই কায়েম করতে হবে।

নারায়ণঃ        আমাদের দেশের সাধারণ মানুষও তাই চায়। তারা চায় কেউ যেন আর তাদের ঠকাতে না পারে, চব্বিশ বছর ধরে যে শোষণ তা যেন আর না হয়। কেউ যেন বলতে না পারে আমি শোষিত, বঞ্চিত।

রহমানঃ         বন্ধুগণ বঙ্গবন্ধুর সেই মহান ঘোষণার কথা পুনরায় বলেছেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ। তিনি ও অন্যান্য নেতৃবর্গ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেনঃ এদেশের সম্পদ সবাই সমানভাবে ভাগ করে নিতে হবে। দেশের মানুষকে করার কথাই তাঁরা বারবার বলেছেন। আমাদের বীর মুক্তিবাহিনীর সেই মহান লক্ষ অর্জনের পথে চলেছে। তাদেরকে কোন অন্যায় অত্যাচারী শক্তি বাধা দিতে পারবে না।

(মার্চ আরো কাছে চলে এসেছে)

শান্তিঃ   আমরা সত্যের সৈনিক , আমরা অজেও । দেশের মাটি আমাদের বন্ধু, দেশের মানুষ আমাদের সহায়। আমরা যতুই সাফল্যের দিকে

এগিয়ে যাব, দেশের মানুষ ততই আমাদের সাহায্য করবে; তারপর এক সময় সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়বো শত্রু র উপর। এভাবে চারপাশ

থেকে শত্রুকে আমরা ঘিরে ধরবো-পিষে মারবো তাকে।

(মার্চের শব্দ কাছে)

রহমানঃ         বন্ধুগণ, আমরা জনতার প্রতিনিধি, জনতার অংশ, জনতার বন্ধু। আমরা ন্যায়ের পথিক,আলোর পথিক, মানবতার প্রতীক। ন্যায়ের প্রতিষ্ঠায়, মানুষের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় আমরা প্রান দেবো, জয়ী আমরা হবোই। পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ মানুষ জন্মায়, মরে যায়, আবার জন্মায়, আবার মরে যায়- জীবনের প্রবাহ এভাবেই চলে আসছে, চলে আসছে আদিকাল থেকে। সাধারণভাবে একজনের জীবন আর একজনের জীবনের চেয়ে কি বেশী মূল্যবান?

<005.017.379>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

না, তা নয়। কিন্তু যে জীবন মানুষের মঙ্গলের জন্য বিসর্জিত হয়, যে জীবন ন্যায়ের জন্য বিসর্জিত হয়, সে জীবনের ক্ষয় নেই।

সে জীবন অব্যয় অক্ষয় অমর। আজ আমরা মানুষের দাঁড়াবো অন্ধকারের সঙ্গে। কে আমাদের জয়কে ঠেকাবে? কে আমাদের

পথ রোধ করবে? কে বাধা দেবে ইতিহাসকে? সত্যকে? ন্যায়কে?

(মোহাম্মদ আবু জাফর রচিত)

———————–

কে আমাদের রুখবে ?

৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১

(মুক্তিবাহিনীর শিবির। গেরিলাদল হানাদারদের আক্রমণ করার পূর্বমুহুর্তে প্রস্তুত। গেরিলা অধিনায়ক নিয়াজ তাঁর বক্তব্য পেশ করছেন)।

নিয়াজ ঃ     তবু বন্ধুগণ লড়াই আমাদের করতেই হবে। সমস্ত প্রতিকূলতা এবং প্রতিবন্ধকতা দূর করে এগিয়ে যেতে হবে। আজ আমাদের

সমস্ত দুঃখ-কষ্ট বিপদ-আপদকে বরণ করে নিয়ে শত্রুধ্বংসের জন্য নিজেকের নিয়োজিত করতে হবে। আমাদের এক

উদ্দেশ্য, এক লক্ষ্য-বাংলার মাটিতে যারা রক্ত ঝরিয়েছে, বাংলার বুকে যারা আগুন জ্বালিয়েছে, বাংলাকে যারা শ্মশান

করেছে, তাদের ক্ষমা নেই। তাদের আমরা সম্পূর্ণভাবে পর্যুদস্ত করব, বাংলার মাটি মুক্ত করব শয়তানদের কবল থেকে।

আর এমনই শিক্ষা আমরা দেবো যেন ভবিষ্যতে কেউ আবার বাংলার মাটিতে পা রাখতে জায়গা না পায়। বন্ধুগণ প্রস্তুত !

সমস্বরে         ঃ     প্রস্তুত কমরেড।

নিয়াজ ঃ     তবে এগিয়ে যাও-নির্ভয়, নির্ভীক। ভয়ংকর ঈগলের মতো ঝাঁপিয়ে পড়বে কাপুরুষ হানাদারদের উপর। ওদের নিঃশেষ করে

দেবে। প্রভাত আলোর মতো তোমাদের গতি হবে সম্মুখে। এগিয়ে যাও।…মানিক, তুমি স্বপনাকে ডেকে নিয়ে এসো।

মানিক ঃ     নিয়াজ ভাই আসতে পারি?

নিয়াজ ঃ     এসো মানিক, স্বপন কোথায়? ও এসেছ, শোন তোমাদের উপর একটা কাজের ভার দেবো, এর সফলতার ওপর নির্ভর

করছে আমাদের পরবর্তী আক্রমণ। যেমনই করেই হোক এ কাজ তোমাদের করতেই হবে।

স্বপন   ঃ     প্রাণ থাকতে পিছিয়ে আসবো না নিয়াজ ভাই। হয় সাফল্য, না হয় মৃত্যু।

নিয়াজ ঃ     সাবাস। এই হচ্ছে বাংলার সন্তানের, বাংলার মুক্তিযোদ্ধার কথা। এই তো চাই।

মানিক ঃ     আমরা নিয়েছি এগিয়ে চলার শপথ-চলাই আমাদের গতি, চলাই আমাদের জীবন।

<005.017.380>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

নিয়াজ ঃ     হ্যাঁ, চলাই আমাদের জীবন।

(জনান্তিকেঃ হল্ট, হু কামস দেয়ার) (মহিলা কণ্ঠঃ ফ্রেণ্ড)

রেখা এসে গেছে ও তোমাদের সংগে যাবে। দিনের বেলায় যেতে হবে। বিপদসংকুল যদিও, তোমাদের উপর আমার বিশ্বাস

আছে।

রেখা    ঃ     জীবনমৃত্যু পায়ের ভূত্য চিত্ত ভাবনাহীন। বিপদের কথা শুনলে মন আমার আনন্দে নেচে ওঠে। বিপদহীন, শংকাহীন জীবন

বড্ড সুনকো লাগে কমরেড। আমি চাই মৃত্যুর মাঝে জীবনের গান গাইতে।

স্বপন   ঃ     আর সে গান রক্তরাঙ্গা নির্ভীক জীবনের গান।

মানিক         ঃ     রোদ্রোজ্জ্বল সংগ্রামী জীবনের গান।

নিয়াজ         ঃ     নির্ভয় নিঃশঙ্ক চলার শপথ যে নিয়েছে তার কাছে কোন বাধাই বাধা নয়। দুস্তর সমুদ্র বা দুর্লঙ্ঘ্য পাহাড় কিছুই তার পথ রোধ

করতে পারে না।

(বিস্ফোরণের শব্দ দূর থেকে)

শুনলেন তো, ফরহাদপুরের ব্রিজ উড়ে গেলো। হানাদারদের পথ আজ থেকে রুদ্ধ হয়ে গেল।

রেখা    ঃ     এবার আমরা বাকী পথটুকুও বন্ধ করে দেবো। আজ ওরা গ্রামে-গ্রামে দলবদ্ধ পাগলা জানোয়ারের মতো হামলা চালাচ্ছে।

ঘর-বাড়ি আগুন লাগিয়ে পোড়াচ্ছে। মানুষকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে মেশিনগানের গুলি চালিয়ে হত্যা করছে।

নিয়াজ ঃ     আর মা-বোনদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। সমগ্র বাংলাদেশে শয়তানরা ১০০টা বন্দীশিবির করেছে। আর সেখানে হাজার হাজার

মানুষকে বন্দী করে অকথ্য নির্যাতন করছে। মা-বোনদের ইজ্জত নিয়ে ছেলেখেলা করছে। এ নির্যাতন বন্ধ করব,

নির্যাতনকারীর মৃতদেহের স্তুপে লেখা হবে হানাদারের গ্লানিকর পরাজয়।

মানিক ঃ     নিয়াজ ভাই, আমাদের কি কাজের ভার দেবেন বলেছিলেন না?

নিয়াজ ঃ     ও হ্যাঁ, শোন, নগরপুরে দুশমনদের একটা শক্ত ঘাঁটি আছে। এ ঘাঁটিটা আমাদের নষ্ট করতে হবে। এ ঘাঁটিটা নষ্ট হলে আমরা

নদীপথ এবং সড়ক উভয়ই নিয়ন্ত্রণ করতে পারবো। শহরে আঘাত হানার পক্ষেও সুবিধা হবে।

স্বপন   ঃ     এ আক্রমণে আমি নেতৃত্ব দেবো নিয়াজ ভাই, আমাকে শুধু পাঁচটা ছেলে দেন। আমি শয়তানদের ঘাঁটি উড়িয়ে দিয়ে আসবো

রেখা    ঃ     নেতৃত্ব তুমি দাও ক্ষতি নেই, কিন্তু এভাবে এতো অল্প ছেলে নিয়ে গেলে কতখানি সফল হবে ভেবে দেখেছ?

স্বপন   ঃ     এখন এতো ভেবে দেখার সময় নেই। এখন জানি শুধু শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ো ।

নিয়াজ ঃ     না, স্বপন বিশেষ প্রস্তুতি নিয়েই তোমরা এগিয়ে যাবে। আমরা ত্রিমুখী আক্রমণ চালাবো। তিনটে দল থাকবে, তার একটার

নেতৃত্ব নেবে তুমি।

মানিক         ঃ     আমার কাজ কি নিয়াজ ভাই?

<005.017.381>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

 নিয়াজ        ঃ     তোমারও কাজ আছে। তুমি থাকবে রক্ষণভাগে। আক্রমণ শুরু হলে, শহর থেকে শয়তানদের সাহায্য আসতে পারে। তুমি

এই সাহায্য আসার পথে বাধা সৃষ্টি করবে। কোনভাবেই যেন তারা সাহায্য নিয়ে আসতে না পারে।

রেখা    ঃ     আর আমি? আমি কি করব?

নিয়াজ ঃ     তুমি আমার সংগে ওষুধের ব্যাণ্ডেজ সব নিয়ে থাকবে। প্রয়োজন হতে পারে। একটা ষ্ট্রেচার নিয়ে নিয়ো। মানিক নায়েক

কাসেম, বাবলা, রশিদ, কালু, স্বপন তোমার সংগে থাকবে। নায়েক মোহর আলী রফিক, বিজন, মনি এবং আমি নায়ক

নিযামুদ্দিনকে নিয়ে নেবো। নাও প্রস্তুত হয়ে নাও, অস্ত্রশস্ত্র সব নিয়ে নাও। শয়তানদের গুলির জবাব দিবে-বেশী গুলি অহেতুক

খরচ করো না।

(ক্ষণ বিরতি)

প্রস্তুত, এগিয়ে যাও, কিন্তু সাবধান কেউ অহেতুক উত্তেজিত হয়ে উঠবে না। বিপদের মুখে যে ধীরমস্তিষ্কে, শান্ত মাথায়

কাজ করতে পারে সে-ই কামিয়াব হয়। যাও, এগিয়ে যাও।

(মেশিনগান ও রাইফেলের গুলি)

মানিক ঃ     কাসেম ভাই, ডাইনে চেপে যান, বাঁদিকের মেশিনগানটা বন্ধ করতে হবে। (গুলি চলতেই থাকবে)

স্বপন   ঃ     রফিক-বিজন বায়ের খাঁড়ি দিয়ে উঠে যাও, পাশের বাংকারের মেশিনগানটা স্তব্ধ করে দাও।

মানিক         ঃ     বাবলা, কাসেম ভাই কোথায়?

(মটারের শব্দ ও মেশিনগানের গুলি)

নিয়াজ ঃ     মিনিটে ৫টা করে সেল করো, ডাইনে, আর একটু ডাইনে। ঠিক হয়েছে, বাছাধনদের ট্রাকটা একেবারে গেছে। মর্টার থামাও।

স্বপন   ঃ     রফিক চার্জ।

(গ্রেনেডের বিস্ফোরণ)

মানিক ঃ     বাবলা চার্জ (গ্রেনেডের বিস্ফোরণ) এবার জয় বাংলা বলে ঝাঁপিয়ে পড়ো।

(সমস্বরে-জয় বাংলা)

হ্যাণ্ডস আপ ঐ দেখ একটা শয়তান পালাচ্ছে, (গুলির শব্দ) যাক মরেছে। স্বপন ভালই হয়েছে, নাও ভাই অস্ত্রশস্ত্র

গোলাবারুদগুলো নিয়ে নাও।

(কাতরানোর শব্দ)

স্বপন   ঃ     কে কাতরাচ্ছে!…বিজন দেখ তো ভাই। …আরে এ কি কাসেম ভাই…কাসেম ভাই (আর্তনাদ করে ওঠে)

কাশেম ঃ     আমাকে নিয়াজ ভাইয়ের কাছে নিয়ে চলো।

মানিক ঃ     নে, ধরাধরি করে ওঠা। চল চল।

<005.017.382>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

স্বপন   ঃ     তার আগে ক্ষতস্থানটা বেঁধে নে।

নিয়াজ ঃ     কি, কি হয়েছে স্বপন?

স্বপন   ঃ     কাসেম ভাইয়ের গুলি লেগেছে।

নিয়াজ ঃ     কাসেম।

মানিক ঃ     কাসেম ভাই!

কাসেম ঃ     কেদো না ভাই। কেউই বেঁচে থাকার জন্য আসে না। একদিন তাকে যেতেই হয়। আমার দুঃখ নেই, আমি আমার

জন্মভূমির জন্য প্রাণ দিয়েছি। এ মৃত্যু আমার অনেক গৌরবের। দুঃখ করো না।

(মুস্তাফিজুর রহমান রচিত)

<005.018.383>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

শিরোনাম সূত্র তারিখ

১৮। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের

গ্রামীণ শ্রোতাদের জন্য প্রচারিত

অনুষ্ঠান

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের দলিলপত্র অক্টোবর-ডিসেম্বর, ১৯৭১

সোনার বাংলা

২৯ অক্টোবর, ১৯৭১

সবাই   ঃ     আসসালামু আলায়কুম।

ছোটমিয়া       ঃ     ওয়ালায়কুম আসসালাম।

রুস্তম   ঃ     কি জমির ভাই ভাবছ কি? আমাদের ছোটমিয়া গো, ছোটমিয়া। আশফাক ভাই কাল যাবার সময় আমাকে বলল, “চলো

বেড়িয়ে আসি।”

জমির   ঃ     কাল তাহলে তুমি ছোটমিয়ার ওখানে গেছিলে? তা ভালই হয়েছে। কি জমির ভাই, আশফাক ভাই আজ আসবে না?

ছোটমিয়া       ঃ     আশরাফ ভাই আজ আর আসবেন না। উনি রক্ষীবাহিনী গঠনের ব্যাপারে ব্যস্ত আছেন, তাই কাল আমাকে বললেন, “তুমি

ভাই আসরে যেয়ো’।

কাজলীর মা ঃ         ভালই হয়েছে। জমির ভাই, এবার তোমাদের খবর-টবর বলো। এখন সারা বাংলাদেশ জুড়ে তো যুদ্ধের দামামা বাজছে।

একদিকে সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ সাড়ে সাত কোটি মানুষ, আর অন্যদিকে ইয়াহিয়ার জল্লাদ বাহিনী।

রুস্তম   ঃ     ওদিকে আবার জুটেছে চোরের সাক্ষী গাঁটকাটা’।

কাজলীর মা ঃ         তার মানে, কি বলছ রুস্তম!

জমির ভাই ঃ রুস্তম আজকে আবার ভালো কথা বলছে মনে হচ্ছে। কার কথা বলছ রুস্তম!

রুস্তম   ঃ    ও, দেখেছো তো শুধু শুধু আমাকে বোকা ভাবো, এখন দেখো বুদ্ধি হয়েছে কিনা।

জমির ভাই ঃ বুদ্ধি তো হয়েছে দেখতে পাচ্ছি। কার কথা বলছ আগে সেটা বলো।

ছোটমিয়া ঃ    বলো, রুস্তম। কথা বলতে বলতে থেমে যাওয়া ভাল না। কথা পরিষ্কার করে বলা উচিত।

রুস্তম   ঃ     বলব? ওই রাজাকারদের কথা বলছি। খান সৈন্যেরা যত না চেচায়, তার চেয়ে বেশী লাফায় রাজাকাররা।

জমির ভাই ঃ তার মানে তুমি বলতে চাচ্ছো, রাজা যতো বলে পারিষদ দলে বলে তার শতগুণ।

<005.018.384>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

কাজলীর মা ঃ         ঠিকই বলেছ জমির ভাই, রুস্তম কিন্তু ঠিকই ধরেছে।

ছোটমিয়া         ঃ   রুস্তমেরও ধ্যান-ধারণা আছে। আজ বাংলার প্রতিটি মানুষ সচেতন, তারা প্রত্যেকে নিজের দেশকে শত্রুর কবল মুক্ত করার

জন্য বদ্ধ পরিকর । প্রান যায় তবু স্বীকার, স্বাধীনতা চাই-ই ।

জমির ভাই  ঃ       আমরা দখলদার বাহিনীকে তাড়াবোই ।প্রতিটি গ্রামে-গঞ্জে ছেলেরা ট্রেনিং নিচ্ছে, মুক্তি বাহিনীতে ভর্তি হচ্ছে ।

রুস্তম   ঃ   ট্রেনিং আমি নিচ্ছি, দুশমনের বিষদাঁত ভাঙ্গতেই হবে ।এমন শিক্ষা দিবো জীবনে যেন আর কোনদিন –

কাজলীর মা  ঃ      থেমে গেলে কেন, বলো।

ছোটমিয়া          ঃ রুস্তম বলতে চাচ্ছে, দুশমন যেন আর কোনদিন বাংলার মুখে না হয়, বা বাংলার নামও মুখে না আনে। তাই না রুস্তম? রুস্তম      ঃ ঠিক বলেছ ছোটমিয়া। শক্ত কথা তো একটু আটকে যায়। তবে শিখে নিয়েছি। তাই না ছোটমিয়া?

ছোটমিয়া           ঃ ঠিকই, মানুষ ঠেকতে ঠেকতেই শেখে।

জামির ভাই   ঃ      এই রাজাকাররা শিখছে। মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদের হাতে এমনই মার খাচ্ছে যে বদবুদ্ধি সব কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে। কাজলীর মা  ঃ       যাবে না, অন্যায় কদিন থাকবে বলো। দুদিন হয়তো মানুষকে কষ্ট দেবে, তারপর যেতেই হবে।

ছোটমিয়া         ঃ   ঠিকই, অন্যায় বেশীদিন থাকতে পারে না। একদিন তাকে দূর হতেই হবে। ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা হবেই।

জমির ভাই  ঃ        এই দেখ না, আমতলীর বসিরউদ্দিন খবর দিয়ে গেল , বিশজন রাজাকার পালিয়ে এসেছে, মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ

করেছে।

রুস্তম ঃ     কেন, তিড়িং বিড়িং ফুরালো? হাতে তো রাইফেল নিয়ে গা-গেরামের হাসটা মুরগীটা ছাগলটা খুব জুত করে খাওয়া

হচ্ছিল, কেন সে শখ মিটে গেল?

কাজলীর মা ঃ         শখ মিটবে না? মুক্তিবাহিনীর মার জানা আছে না-এমনই মার দেয়, ল্যাজ তুলে চৌ-চোঁ দৌড়।

রুস্তম     ঃ   মুক্তিবাহিনীর ভয়ে খানসেনাদের রাতের ঘুম দিনের আরাম হারাম হয়ে গেছে।

জামির ভাই ঃ         কথাটা একেবারে সত্য বলেছ রুস্তম। আর তার জন্যেই তো ওরা নিজেরো কোথাও যাওয়ার আগে রাজাকারদের পাঠিয়ে

দেয়। হালচাল দেখে তারপর এগোয়।

রুস্তম      ঃ কথায় আছে না, সাবধানের মার নেই।

ছোটমিয়া     ঃ        কথাটা ঠিকই, কিন্তু এক করেও দখলদার পাকবাহিনীর কুল রক্ষা হচ্ছে না। ওরা ভেবেছিল ভয় দেখিয়ে সন্ত্রাস সৃষ্টি করে

মানুষের ইচ্ছাকে, সমগ্র আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দেবে। কিন্তু

<005.018.385>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

বাংলার মানুষের ইচ্ছাই বাংলার মানুষকে জাগিয়েছে। আজ বাংলার মানুষ ঘরে-বাইরে সংগ্রামী। একদিকে লড়াই করছে দুঃসাহসী বীর মুক্তিবাহিনী, অন্যদিকে সহায়তা করছে বাংলার সাধারণ মানুষ।

জমির ভাই ঃ আর ভাই রাজাকারদের অবস্থা হয়েছে “বিনা জলে মাছের মতো খাবি খাচ্ছে।

কাজলীর মা ঃ         তার জন্যেই উপায় না দেখে মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা দিচ্ছে। বুঝলে ছোটমিয়া, ওদের নাক কানগুলো কেটে দিতে হয়। কি

কষ্টই না মানুষকে দিচ্ছে।

রুস্তম   ঃ     ওরা যেমন যেমন করে মানুষকে কষ্ট দিয়েছে, তেমন তেমন করে শোধ তুলে নেওয়া উচিত।

ছোটমিয়া ঃ    ওটা ভুল ধারণা। যারা নিজে এসে ধরা দেয়, তাদের উপর অত্যাচার করাটা ভুল। ওতে মনুষ্যত্বের অপমান হয়। আর তাছাড়া

রাজাকার মানেই যে খারাপ একটা কিছু তা নয়। তুমি কি বলো জমির ভাই।

রুস্তম   ঃ     জমির ভাইয়ের মনে লাগেনি কথাটা, তুমিই একটু বুঝিয়ে বলো

কাজলীর মা ঃ         সেই ভালো ছোটমিয়া।

ছোটমিয়া ঃ    আচ্ছা জমির ভাই, ভাল-মন্দ মিলিয়েই মানুষ- কিন্তু সব মানুষই কি খারাপ? তা নয়। আজ বাংলাদেশের রাজাকার যারা

তাদের মধ্যে অনেকেই প্রাণের দায়ে রাজাকারে নাম লিখিয়েছে। অনেকে হয়তো সামরিক লোভে পড়ে রাজাকার হয়েছে।

কিন্তু তারা যখন বুঝতে পারছে তখনই দলে দলে সরে আসছে। তখন তাদের আর শাস্তি দিলে ভুল হবে। মানুষেই ভুল

করে, তাই না? কি বলো জমির ভাই?

জমির ভাই ঃ ঠিকই বলেছ ছোটমিয়া। তবে দুর্বলের উপর আমাদের রাগ নাই, কিন্তু দখলদার সৈন্যের অত্যাচারের জবাব আমরা দেবো।

ছোটমিয়া ঃ    ঠিকই, দুশমনদের যোগ্য জবাবই আমরা দেবো। তাদের সমস্ত শক্তি আর দম্ভ আমরা নিঃশেষে চূর্ণ করব।

কাজলীর মা ঃ         এ জন্যেই তো ঘরে ঘরে ছেলেরা আজ ট্রেনিং নিচ্ছে। মা-বোনেরা তৈরী হচ্ছে।

ছোটমিয়া       ঃ     নিশ্চয়ই কেননা এ সংগ্রাম আমাদেরই স্বাধীনতার সংগ্রাম।

রুস্তম   ঃ     ছোটমিয়া, বলছিলাম এতো সুন্দর সুন্দর কথা হলো এরপর একটা গান হলে হতো না?

জমির ভাই ঃ ঠিকই ছোটমিয়া, একটা গান শোনাও।

ছোটমিয়া ঃ    বেশ, তাহলে শোন, একটা দেশাত্মবোধক গান শোন। (দেশাত্মবোধক গান)

ছোটমিয়া ঃ    গান তো শুনলে, বেশ ভালই লাগলো, না কি বলো?

রুস্তম   ঃ     এরকম গান শুনলে রক্তটা একেবারে টগবগ করে ফুটতে থাকে।

জমির ভাই ঃ ঠিকই

কাজলীর মা ঃ         সবই তো হতো । ছোটমিয়া, হাতে তো সময়ও নাই।

<005.018.386>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

ছোটমিয়া       ঃ     হ্যাঁ, হাতে আজকে আমাদের আর সময় নেই, চলো আজকের মতো উঠি।

রুস্তম   ঃ     চলো।

 ১ নভেম্বর, ১৯৭১

জমির ভাই ঃ আসসালামু আলায়কুম।

সবাই   ঃ     ওয়ালায়কুম আসসালাম।

ছোটমিয়া       ঃ     এসো জমির ভাই। খবর সব ভাল তো?

রুস্তম   ঃ     জমির ভাই নিশ্চয় খবর নিয়ে এসেছে। আজ আসরে আবার ‘নেট’-এ এলো দেখছ না?

জমির ভাই ঃ রোজদিন নিজে দেরী করে আসো। আজ তাই খুব ঠাট্টা হচ্ছে, না?

কাজলীর মা ঃ         ঠাট্টা করেনি জমির ভাই। রুস্তম সত্যি বলছে। একটু আগে ছোটমিয়াকে বলছিল জমির ভাই খুব খাটছে।

ছোটমিয়া       ঃ     খুব ভালো কথা। জমির ভাই শুধু কেন, তুমিও তো খুব খাটো।

কাজলীর মা ঃ         নিজের কথা কি নিজে বলা যায় ছোটমিয়া? অন্যের উপর দিয়ে যদি যায় ভালো কথা।

রুস্তম   ঃ     কি যে বলো। একটু কাজ করি, তা আবার বলে বেড়াতে হবে নাকি? কাজ তো করতে হবেই। সব মানুষ কাজ করছে আর

আমি একলা বসে থাকবো নাকি?

জমির ভাই ঃ         কি বলছে রুস্তম। তুমি কাজ করো না একথা বলছে কে বলেছে?

ছোটমিয়া       ঃ     কেউই বলেনি, তবে রুস্তম মনে মনে সন্দেহ করছে, হয়তো সবাই ভাবছে রুস্তম কাজ করে না। তাই না রুস্তম ?

রুস্তম ঃ     ঠিকই ছোটমিয়া।

ছোটমিয়া       ঃ     তা কেউ ভাবে না রুস্তম। যে কাজ করবে সে তার মূল্য অবশ্যই পাবে। আজকে খেতখামারে ফসল নষ্ট করেছে, আমাদের

সম্পদ লুট করে নিয়ে গেছে। এমন অবস্থায় চুপচাপ বসে থাকার সময় তো কারোরই নেই। এর জন্যেই তো। দিন-রাত

গ্রামে-গঞ্জে ঘুরছি। এই সংগ্রামে আমাদের মা-বোনদেরও দায়িত্ব আছে-কর্তব্য আছে, সেটা তাদের বুঝাচ্ছি। নিজের নিজের সংসার গুছিয়ে নেওয়ার জন্য সাহায্য করছি।

জামির ভাই ঃ        এক হিসেবে এটা তোমার বিরাট দায়িত্ব। আমাদের সবার সবারই প্রতি দায়িত্ব আছে। তুমি ঠিকই করছ।

ছোটমিয়া       ঃ     আজকের এই দিনে আমাদের মা-বোনরা কেউই বসে নেই। যার যা কাজ করে যাচ্ছেন। এতদিন তোমরা ছিলে অন্দরের

কাজ নিয়ে ব্যস্ত, আজ সংগ্রামে তোমাদেরও ডাক পড়েছে।

<005.018.387>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

আজ তোমরাও বেরিয়ে এসেছো বাইরে। আজ তো কোন প্রশ্নই ওঠে না কি করব, কেন করব।

রুস্তম   ঃ     দেখো ছোটমিয়া। এই লড়াই শুরু হয়ে কতো মানুষ ঘরবাড়ি আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে এসেছে। কতো ভাই ভাইকে হারিয়েছে।

জমির ভাই ঃ ও কথা তুলে মন খারাপ না করাই ভালো, তাই না ছোটমিয়া?

কাজলীর মা ঃ আগে বাপু শোনই কথাটা কি বলতে চাইছে। কথার মাঝে বাগড়া দেওয়া –

ছোটমিয়া       ঃ     থামো, হয়েছে। রাগ করে জমির ভাইকে এমন করে না ধমকালে হতো না? যাক রুস্তম কি বলতে চাইছো বল তো?

রুস্তম   ঃ     কি আর বলব, মনটাই খারাপ হয়ে গেল।

কাজলীর মা ঃ        ও মা, এতটুকু কথা শুনেই মনটা খারাপ হয়ে গেলে চলবে কি করে রুস্তম। তুমি না সৈনিক, তুমি না লড়াই করো?

জামির ভাই ঃ আমি ওভাবে কথাটা বলিনি ছোটমিয়া। আমি ভাবছিলাম, রুস্তম হয়তো কথার তোড়ে আসল কথাই চাপা দিয়ে দেবে,

তাই বলেছিলাম। যাক রুস্তম বল।

ছোটমিয়া ঃ আচ্ছা এবার বলো রুস্তম। এখন আর অভিমান করার সময় নেই রুস্তম। আর ওটা তোমার সাজেও না। আজ আমরা বাংলার

সাড়ে সাত কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ সংগ্রামে লিপ্ত। কোথাও কোনদিকে চাইবার সময় নেই আমাদের। এখন সোজা কথা বলো,

সোজা কাজ করো। অযথা দুঃখ করে সময় কাটিয়ে লাভ আছে? মনে বল রাখো, বুকে সাহস রাখো, চোখকান খুলে রেখে

লড়াই চালিয়ে যায়।

রুস্তম   ঃ     হক কথার এক কথা। ঠিকই বলেছ ছোটমিয়া। তাই তো বলছিলাম আমি। আজ ভোরে গাবতলীর মাঠ দিয়ে

কাসিমপুরে

যাচ্ছিলাম। হঠাৎ রাস্তায় দেখা মানকের সাথে। ওই যে মানকে গো-মজিরুদিন লাতিটা।

কাজলীর মা ঃ         মজিরুদ্দিন লাতির  আবার কি হলো! খুব ভালো লোক-কিছু হয়েছে নাকি?

জমির ভাই ঃ         কৈ, আমি তো শুনিনি কিছু হয়েছে নাকি?

রুস্তম   ঃ     না কিছু হয়নি। আগে কথাটা শুনোই না বাপু, তারপর পিড়িং পিড়িং করো। বাঁধা সারিন্দার তার হাত লাগলেই পিড়িং।

ছোটমিয়া       ঃ     থামো রুস্তম। কথাটা খুব বেশী হয়ে যাচ্ছে। বলো।

রুস্তম   ঃ     হ্যাঁ, তারপরে মানকে তো মুষড়ে, মুখটা এতটুকু হয়ে গেছে। জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে তোর। মুখ এমন শুকনো কেন?

বলে কি জানোয়ারগুলো যেখানেই যাচ্ছে সাধারণ পাড়াগাঁয়ের মানুষগুলোকে মেরে খতম করে দিচ্ছে।

ছোটমিয়া ঃ    কাপুরুষ শক্তি প্রয়োগ করে নিরহের উপরে। এ জন্যেই আমরা আজ রুখে দাঁড়িয়েছি, মরণপণ করে লড়াই করে যাচ্ছি।

<005.018.388>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

রুস্তমঃ                 আমিও তাই বললাম। যুদ্ধ করছি, করব, কিন্তু শেখ মুজিব বলেছেন, দেশকে স্বাধীন করবো। তাই স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত

যুদ্ধ আমরা করবই।

জমির ভাইঃ    ঠিক বলেছ রুস্তম। গ্রামে গ্রামে আজ এ জন্যেই আমরা প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছি। যেখানেই দুশমনকে পাও, মারো-

ইদুরের মতো মেরে মেরে খতম করো।

কাজলীর মাঃ    এর জন্যই তো খানসেনারা শিবির থেকে বের হতে ভয় পাচ্ছে। কখন কোনদিকে মারা পড়ে ঠিক আছে।

ছোটমিয়াঃ      মৃত্যুর ফাঁদ পেতে রেখেছে গেরিলাদল। আর সঙ্গে সহযোগিতা করছে বাংলার সংগ্রামী মানুষ। প্রতিটি বাড়ি হয়ে উঠেছে দুর্গ।

প্রতিটি মানুষ হয়ে উঠেছে সৈনিক।

রুস্তমঃ                 ইয়াহিয়া বুঝতে পারেনি, না বুঝেই ভীমরুলের চাকে ঢিল দিয়েছে। এখন ভীমরুলের কামড়ের চোটে চোখ-মুখ অন্ধকার।

কাজলীর মাঃ    এখন তো খান সেনাদের অবস্থা ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি

ছোটমিয়াঃ      ভীরু কাপুরুষরা যতো অত্যাচার করছে, আমাদের মানুষের মনে সাহস এবং শক্তি ততোই বেড়ে যাচ্ছে। মানিককে বুঝিয়ে

দিয়েছো তো শয়তান জ্বালাতে পারে, মারতে পারে না। সাড়ে সাত কোটি মানুষ যখন একযোগে লেগেছে-আমরা কামিয়াব

হবোই। বর্বরদের তাড়াবোই আমরা।

জমির ভাইঃ     মনে বল ধরতে হবে, আল্লার উপর বিশ্বাস রাখতে হবে, এবং লড়াই করে যেতে হবে। তাই না?

কাজলীর মাঃ    আমারও কথা তাই জমির ভাই।

ছোটমিয়াঃ      আজকের সংগ্রামে জনসাধারণের সাহায্য-সহযোগিতা এবং শক্তি সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন এবং সংগে সংগে দরকার অটুট

                মনোবল, আমাদের সব সময় মনে রাখতে হবে-আমরা জিতব, জিতব, জিতবই। আমাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা পরিপূরণ হবেই।

রুস্তমঃ                 মানকেকে খুব বুঝালাম-ছোটমিয়া। তারপরে মানকের সে কি তড়পানি। বলে কিনা, ঠিক বলেছিস রুস্তম লড়াই যখন করছি,

তখন আর ভাবব না, দুশমনকে তাড়িয়ে তবে আরাম করবো। মানকে আবার আশফাক ভাইয়ের কাছে গেলো।

জমির ভাইঃ    রক্ষীবাহিনীতে নাম লেখাতে, না?

কাজলীর মাঃ    ঠিকই করেছে। পঙ্গুও মনের জোরে পাহাড় ডিঙায়। আর আমাদের তো সবই আছে।

রুস্তমঃ                 কি ব্যাপার জমির ভাই, কথায় কথায় তোমাদের খেয়ালই নাই।

জমির ভাইঃ    কি হলো আবার ?

রুস্তমঃ          গান শুনবে না? ছোটমিয়া একটা গান শোনাও।

ছোটমিয়াঃ      ওহো, আমারও খেয়াল নেই। আচ্ছা এবার তাহলে একটা গান শোন, দেশাত্মবোধক গান। (দেশাত্মবোধক গান)

<005.018.389>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

ছোটমিয়াঃ      গান তো শোনা হলো, হাতে সময়ও নাই আর-চলো আজকের মতো উঠি।

কাজলীর মাঃ   চলো, জমির ভাই, রুস্তম চলো যাই। চলো,

সবাইঃ          চলো।

(মুস্তাফিজুর রহমান রচিত)

জনতার আদালত

১৩ নভেম্বর, ১৯৭১

কুঁকড়্যাঃ        শুন রাসুবু আমি খুব ভালো করা বুঝ্যা লিয়্যাছি, আমাধের দুষমুন আমাধেরই শায়েস্তা কইরতে হবে। তুমি যে একটু আগে বুলল্যা, দানেশ

মিয়ার ব্যাটা রাজাকারে ভর্তি হয়া ধরাখে সরা জ্ঞান করছে-তা ঠিক। আইজক্যাল ওই খালি লুটপাটই কইরছে না, আরো ম্যালা কিছু

আছে।

রাসুঃ   আরে খুলে না বললে কি আর আমি জানিনে। দানেশ মিয়ার ছেলে রহিম তো পাণ্ডা, ওর সাথে যোগ দিয়েছে মোমিন বেপারীর শালা

আর কালু মিস্তিরীর ভাই। সেদিন দেখো না বলা নাই কওয়া নাই, একদল মিলে এসে আমার গাছের ডাবগুলো পেড়ে নিয়ে গেল, কি

না ওদের কে অফিসার এসেছে, সে খাবে। শোন কথা, বেটারা যেন সব বাপের সম্পত্তি পেয়েছে। তা কে বলতে যাবে বল আমার

বোনের ছেলেটা গিয়ে জিজ্ঞেসে করেছে, তাতেই রাগ কতো, এই মারে কি সেই মারে।

কুঁকড়্যাঃ        তুমার ডাব খায়্যাছে। আমার একদিন জাল দিয়া মাছ মার‍্যা লিয়্যা গিয়্যাছে। আমি ছিল্যাম না, না হোলে সেদিন আর জান লিয়্যা যাত্যে

দিতাম না। আমিও তক্কে তক্কে আছি, আর একদিন পাল্যে হয়।

রাসুঃ   আরে শুধু ফল পাকুড় গেলে তো কথাই ছিল না। ওদের জ্বালাতে আজকাল বো- বিটারই কি ঘাট-ঘাটালীতে যাওয়ার জো আছে। সেদিন

আমেনা বুবুর বড়ো মেয়েটাকে পানি নিয়ে আসার সময় ধরে, সে যা-তা, আমেনা বুবু যখোন গিয়ে বলল- হ্যাঁরে রহিম, এক পাড়ার

ছেলেমেয়ে, আমার বাশেরা কি তোর বোন নারে। তো সে হারামজাদা কথায় তো কান দিলই না, যা-তা বলতে শুরু করলো মনে হয়

নোড়া দিয়ে ওর মুখ ভেঙ্গে দিই।

কুঁকড়্যাঃ        আমিও শুন্যাছি আবার হইচই হ্যয়াছিল বুল্যা নাকি রহিম আমেনা বুবুকে শাসিয়্যা গেছে বাশেরাকে চুরি করা লিয়্যা যাবে বুল্যা। শুন কথা,

দিন দিন হচ্ছে কি? আমাধের সহ্যের বাহেরে চল্যা গেলছে, মোড়ল ভাই আসুক, তুমরাও সবাই আছ, আজই ওদেরকে ডাকা আন্যা

আমরাই ওদের বিচার করব। তুমরা সবাই মোড়ল ভাইকে বুলব্যা। আইজই য্যানে একটা ব্যবস্থা করে।

মোড়লঃ কি ব্যাপার, কুঁকড়্যাকে একটু উত্তেজিত মনে হচ্ছে যেন। নোতুন কিছু ঘটেছে নাকি?

<005.018.390>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

রাসুঃ   এইতো মোড়ল ভাই এসেছে। বল কুকড়্যা ভাই, একটু গুছিয়ে বলো তো।

কুঁকড়্যাঃ        আমি খুব রাগ্যা গেছলি, আমি সাজিয়্যা বুলতে পারবো না, তুমি বুল।

মোড়লঃ        কি হয়েছে রাসু বুবু?

রাসুঃ   কি হয়েছে তা আমি বলব আর তুমি জানবে? তোমার কি নিজে থেকেই খবর রাখা উচিত ছিল না মোড়ল ভাই। থাকগে যা বলি শোন।

এই যে দানেশ মিয়ার ছেলে রহিম, গুণ্ডাপাণ্ডার দল নিয়ে রাজাকারে নাম লিখিয়ে গোটা গ্রামটাকে একেবারে তছনছ করে দিচ্ছে, এর

তোমরা কোন বিহিত ব্যবস্থা করবে, না আমাদেরকে দেশ-গাঁ ছেড়ে চলে যেতে হবে।

মোড়লঃ         তোমরা কি বলতে চাও, আমি এসব কোন খবর রাখি না, না কোন চেষ্টা করছি না। নিজে কদিন রাস্তায়-হাটে ডেকে সাবধান করে

দিয়েছি এরপরও যদি তাদের অত্যাচার বন্ধ না হয় বা রাজাকারের দল থেকে নাম না কাটায় তখোন বাধ্য হয়েই মুক্তিবাহিনীর লিষ্টে

ওদের নাম তুলে দিতে হবে।

কুঁকড়্যাঃ        যদ্দিন সে ব্যবস্থা না হয়, তদ্দিন কি আমরা সহ্য করবো ভাবাছো মোড়ল ভাই। এতো বাঢ়া বাঢ়্যাচ্ছে ওরা যে আইজকাল কান্ঠা ঘটাতে

বৌ-বিটীর হাঁটাচলা বন্ধ হবার যো হয়্যাছে। কেউ কিছু বুললেই ভয় দেখায়। আইজকাল ত পকেটে ছুটু বন্ধুক লিয়্যাই ব্যাড়াই।

রাসুঃ   হ্যাঁ, বাপেদের কাছ থেকে বন্ধুক পেয়েছে ত, গুলি-বারুদের হিসেব নাই। আরে মানুষ না হয় দুর্বল, খোদা কি দেখছে না, তোদের বংশ

নির্বংশ হয়ে যাবে, ধ্বংস হয়ে যাবি তোরা।

কুঁকড়্যাঃ        বাদ দ্যাও বুবু ওসব কথা, মোড়ল ভাই। আমি এখুনই যায়্যা ডাকা আনছি ওদেরকে। হয় তুমি এখুন ওদের বিচার কইরব্যা না হলে কিন্তু

খুন খারাবী হয়্যা গেলে আমার দোষ দিতে পাইরব্যা না, হ্যাঁ।

মোড়োলঃ আরে, কুকড়্যা ভাই, মাথা গরম করো না, শোন শোন…

কুঁকড়্যাঃ        শুনাশুনির কিছু নাই। মাথা আমার ঠাণ্ডাই আছে। আমি কিছু বুইলবো না, যা বোলার তুমিই বুলো, আমি খালি ডাকা আনছি, বুইঝল্যা-

আমি চননু । (একটু বিরতি)

মোড়লঃ         রাসু বুবু তুমি একটু বসো, আমি আর দু’চারটে মুরুীকে ডেকে আনি, হাজার হলেও গ্রাম্য পঞ্চায়েতের ব্যাপার, সবারই থাকা উচিত।

আর, এইত নিয়ামত চাচা এসে গেছে, বসো চাচা বসো, পেছনে ওই অন্ধকারের দিকে কে বসে আছে। আবেদ ভাই নাকি-আঃ হা,

পেছনে কেন, সামনে এসে বসোনা, এসো হ্যাঁ-হ্যাঁ, বসো ওখানেই বসো, আরে ডাক্তার সাহেবকে আড়াল করে দিয়ো না, একটু গুছিয়ে বসো।

রাসুঃ   আচ্ছা মোড়ল ভাই দানেশ মিয়াকে একটু ডেকে নিলে হতো না, ছেলের কীর্তিকলাপ সম্পর্কে দানেশ ভাইয়েরও কিছু জেনে রাখা

ভাল। পরে আবার না বলে যে, আমরাই অন্যাই করেছি।

মোড়লঃ         এতো রাগা তোমরা রেগেছ রাসু বুবু, যে, মানুষ পর্যন্ত চিনতে পারছ না, সামনের সারির ওই বামদিকে ওটা কে বসে আছে দানেশ ভাই

না, লজ্জায় এতোক্ষণ কথা বলেনি বুঝলে। দেশ ও দশের এই দুদিনে কারো ছেলে যদি শত্রুর সাথে পাঞ্জা মিলিয়ে এমন সব জঘন্য কাজে লিপ্ত হয়, তবে স্বভাবতই সে বাপের মুখ লজ্জায় বন্ধ হয়ে যায়।

<005.018.391>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

রাসুঃ   আচ্ছা মোড়ল ভাই, এই যে পাকিস্তানের মিলিটারিদের অমানুষিক অত্যচার, লুট, গ্রাম পোড়ানো, খুন আর ইজ্জত নিয়ে ছিনিমিনি করা-

আর দেশেরই কিছু লোকের ওদের দিকে হয়ে ওদেরকে সহযোগিতা করা, এর কি কোন ব্যবস্থা নাই? কিছু একটু বলো না- এরকম সময়ে আমাদের কি করা উচিত?

মোড়লঃ         হ্যাঁ, আমি তোমাদের সবাইকে এ সম্পর্কে কিছু বলতে চাই, দেখ-পশ্চিম পাকিস্তানীরা আমাদের শক্র তারা শুধু শোষণ করার জন্য

আমাদেরকে জুলুম করে ওদের গোলাম করে রাখতে চায়। ওদের মেরে নিঃশেষ করে দেশকে স্বাধীন করার দায়িত্ব নিয়েছে আমাদের

মুক্তিবাহিনী। রীতিমত যুদ্ধ হচ্ছে এবং শুনলে অবাক হবে, খোদা সহায় আছেন বলেই, সব জায়গাতেই পাকিস্তানী সৈন্যরা মার খাচ্ছে

আর পিছু হটছে। আমাদের কাজ হলো- সব রকমে পশ্চিম পাকিস্তানীদের সাথে অসহযোগিতা করা এবং এমন কিছু না করা, যাতে

আমাদের  দেশের পয়শা পশ্চিম-পাকিস্তানে চলে যায় ।

রাসুঃ   তা কি করে সম্ভব? ওরা আমাদের ধার ধরছে থোরাই? যা ইচ্ছে হচ্ছে তাই ত করছে।

মোড়লঃ         খুব সম্ভব। ওদের মনোবল এতো ভেঙ্গে গেছে, যে, আজকাল কোন জায়গায় আর নিজেরা এগোচ্ছে না। আমাদেরই ভাই-ছেলে দিয়ে

তৈরী করা রাজাকার আল-বদর বাহিনীকে ঠেলে দিচ্ছে। আমাদের ছেলেরা যাতে ওদের কাজ না করে, সেদিকে তীক্ষ দৃষ্টি রাখতে

হবে। তারপর-ওদের যোগাযোগ ব্যবস্থা, যতো ক্ষতিই হোক, একেবারে বিচ্ছিন্ন করে দিতে হবে। কোন অবস্থাতেই আমাদের পশ্চিম

পাকিস্তানী পণ্য ক্রয় করা চলবে না। আমরা যারা দেশে যুদ্ধরত আমাদের ভাইদের কাজ এগিয়ে যাবে।

কুঁকড়্যাঃ        এই যে মোড়ল ভাই। তোমার আসামীরা। সবাইকে নিয়্যা আস্যাছি। যা বোলার তুমি বোলো।

মোড়লঃ         এই যে রহিম, বাদশা মিয়া, শাকের ভাই, বসো, সব বসো।

রাসুঃ   এঃ আদর করে আবার বসতে বলা হচ্ছে। ওরা ভদ্রলোকের মধ্যে বসার যোগ্য?

মোড়লঃ         থাম রাসু বুবু আমন করে কাউকে বলতে নেই। দোষ থাক গুণ থাক, ওরা আমাদেরই গাঁয়ের ছেলে। আমাদেরই ভাই-ভাইপো। আমরা

মানুষের কাজের সমালোচনা করতে পারি, কাজকে ঘৃণা করতি পারি- মানুষকে নয়।

কুঁকড়্যাঃ        তুমার ওই ব্যবহারেই ত ওরা অতো আস্কারা পায়্যাছে। হুঁঃ কথায় আছে-ছেল্যাক থাবা, বুঢ়াক বাবা, তা না ভাই-সোনা কর‍্যা কর‍্যা… মোড়লঃ     তুমি থাম কুঁকড়্যা ভাই। শোন রহিম, তোমরাও শোন বাদশা ভাই। তোমরা রাজাকার হয়েছ ভাল কথা, যদিও আমাদের সেটুকুই বরদাস্ত

করা উচিত নয়। অন্যান্য স্থানের রাজাকাররা শুধু নামেই রাজাকার, তারা কাজ করছে। আমাদের তোমরা তাতো করছই না, উল্টে

তোমাদের এমন কোন নোংরা কাজ নাই যা তোমরা করেনি। আর এই সভা যে শাস্তি তোমাদের দেবে তা তোমাদের মাথা পেতে নিতে

হবে। কারণ, গ্রামবাসীরা তোমাদের অত্যাচারে জর্জরিত। তোমাদের বিচার করার পূর্ণ অধিকার তাদের আছে। (সমস্বরে কয়েকজনে)

<005.018.392>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

সমস্বরেঃ                আমরা ওদের মুখ দেখতে চাই না। ওদের গ্রাম থেকে বের করা হোক। ওদের যোগ্য শাস্তি দেয়া হোক।

কুঁকড়্যাঃ                মাইরের বদল মাইর। ওরা আমাদের অনেক জ্বালিয়েছে, আমরা তার বদলা মার‍্যা লিবো।

মোড়লঃ                 দেখছ তা রহিম, তোমাদের বিষয়ে মানুষ কতো উত্তেজিত। যাহোক, ভুলভ্রান্তি মানুষেরই হয়। এবার যদি তোমরা কথা

দাও যে আর কখনও অন্যায় করবে না আর উপস্থিত সবার কাছে ক্ষমা চাও…..

কুঁকড়্যাঃ                ওসব বুঝিন্যা। এই বুটারা- পাঞ্জাবীরা তোধের বাপ। দেশের লোক ভাল লাগে না। এই দেখ শাস্তি কি দিই। (লাঠির শব্দ) (উঃ

হু-হু-রে, আঃ ওরে বাবারে)

মোড়লঃ                 থাম কুঁকড়া ভাই। এবারের মতো ওদেরকে ক্ষমা করা হলো । তবে জানিয়ে রাখি, মুক্তিবাহিনীর তালিকায় তোমাদের নাম

দেয়া আছে, ওরা তোমাদের গতিবিধির ওপর পূর্ণ দৃষ্টি রেখেছে। সাবধান না হলে ভবিষ্যতে মারা পড়বে বলে দিলাম।

কুঁকড়্যাঃ                হ্যাঁ- তেড়িবেড়ি কইরব্যা তো মইরব্যা।

(আনোয়ারুল আবেদীন রচিত)

গ্রামবাংলা

 ১৬ নভেম্বর, ১৯৭১

মাষ্টার ভাই ঃ  সবাই এসে গেছে? ময়না বুতো এখনো এলো না? রাত হয়ে যাচ্ছে, তাছাড়া শীতের মধ্যে লোকজনকে বেশীক্ষণ আটকে

রাখাও যাবে না। তুমি ওদের খবর দিয়েছিলে তো?

বনি     ঃ    হ্যা, ভাল করে বলে দিয়েছি, কাজের কথা আছে, লোকজন আসবে, সাঁঝ লাগতেই ইদলপুরের স্কুলে চলে এসো।

মাষ্টার ভাই ঃ          তাহলে ওরা আসবে। যাক এবার আমরা কথাবার্তা শুরু করি। দেখ তো বাইরে কার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে।

বনি      ঃ   ভালই হয়েছে, ময়না বু এসে গেছে। এসো বুবু এসো।

ময়না বু         ঃ    আঁধার রাত, আসতে একটু কষ্ট হলো বাপু হারিকেন জ্বলিয়ে আসতে পারিনি।

মাস্টার ভাই ঃ         ভয়ের কি আছে? ভয়কে জয় করে চলতে হবে।

ময়না      ঃ ভয় নয়, তবে, সাবধানের মার নাই। শয়তান জল্লাদ বাহিনীর চেলাগুলো কোথায় কখন কিভাবে আসে কেউ জানে?

<005.018.393>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

মাস্টার ভাই ঃ        ময়না বু’র কথাটা ঠিকই “সাবধানের মার নাই।’ শয়তানগুলো তো নিয়ম-কানুনের ধার ধারে  না, মারলেই হলো। তাছাড়া

মনুষ্যত্ব বলতে ওদের নাই কিছুই। ওদের একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে বাঙালী মারো, বাংলার শক্তিকে নিঃশেষ করে দাও।

বনি    ঃ     আমরাও কিন্তু কসম করেছি, ওই জানোয়ারগুলোকে না তাড়াতে পারলে, আমরাও আরাম করব না। দেখ না, দিনে মাঠে

                কাজ করি, রাতের বেলায় মুক্তিবাহিনীর সাথে দুশমনকে মারতে যাই।

ময়না বু        ঃ     এটা আমাদের করতেই হবে। দেশ যখন শত্রুমুক্ত হবে, তখন বসে বসে গল্পগুজব হৈ-হল্লা ঠাট্টা-তামাসা করা যাবে, কি

                বলো?

বনি    ঃ     আমার কথাটাও তাই। যারা আমাদের জানের দুশমন তাদের আমরা শেষ করবই।

মাষ্টার ভাই     ঃ     আজকে এই শপথ নিয়েছে বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ, প্রতিটি স্তরের মানুষ আজ ঝাঁপিয়ে পড়েছে সংগ্রামে।

বনি    ঃ     কিন্তু একটা কাজ খুব ভাল হয়েছে মাস্টার ভাই, কথায় আছে না, সাপের লেজ আর শত্রুর এই দালালগুলোকে মেরে শেষ

                করছে।

ময়না বু        ঃ     পাকিস্তানের দালালগুলোই তো পথ চিনিয়ে নিয়ে আসছে ঐ জল্লাদ বাহিনীকে, ওরা কাকে চেনে বলো তো? ওরা এদেশের

                মানুষ, না, কাউকে চেনে? দালালারাই তো লোকজনকে চিনিয়ে দিচ্ছে, ধরিয়ে দিচ্ছে।

বনি    ঃ     এ জন্যেই তো আমরাও একটা একটা করে দালাল শেষ করছি। আমাদের সংগ্রামের বিরুদ্ধে যে এতটুকু কাজ করবে, তাকে

                আমরা কিছুতেই রেহাই দিব না। আমরাও দালালদের চিনে চিনে মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরিয়ে দিব।

মাস্টার ভাই ঃ         হ্যাঁ, দেশের এই মারাত্মক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে সুবিধাবাদী এবং সুযোগসন্ধানী সেইসব জ্বালাতন করছে, তাদেরকে

                আমাদের খতম করতে হবে। তাছাড়া আরও একটা কারণ আছেএইসব দালালদের শেষ না করলে গেরিলা বাহিনীর গোপন

                আস্তানাও গোপন থাকবে না। অতএব আমাদের সংগ্রামের নিরাপত্তার জন্য, সাফল্যের জন্য আমাদের ঘরের দুশমনের চিহ্ন

                রাখব না। এরাই হচ্ছে জাতির কলংক, এদের ঠাঁই নেই বাংলার মাটিতে।

ময়না বু        ঃ     ওদিকে আবার মুক্তিবাহিনীর লড়াইয়ের খবর ভাল। চট্টগ্রাম, চালনা-দুটো বন্দরেই বিদেশী জাহাজ আসতে চাচ্ছে না।

বনি    ঃ     কেন ময়না বু?

ময়না বু        ঃ     আমাদের গেরিলারা কড়া পাহারার মধ্যেও হরদম জাহাজ ডুবাতেই আছে। অস্ত্রশস্ত্র বোঝাই জাহাজ এরই মধ্যে অনেকটা

                ডুবেছে। তাছাড়া দিন কয়েক আগে একটা তেলবাহী জাহাজও ডুবিয়ে দিয়েছে। এত কড়া পাহারার মধ্যেও এ দুর্ঘটনা ঘটাতে

                শয়তান পাকবাহিনী তো, হকচকিয়ে গেছে।

<005.018.394>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

বনি    ঃ  শুধু জাহাজই না ময়না বু, লঞ্চ, নৌকা কিছুই নিরাপদ না। নৌকা করে শয়তানগুলো যাচ্ছে, মুক্তিবাহিনী গুলি করে ডুবিয়ে দিচ্ছে।

ওদের এখন তরাস ধরে গেছে, ডাঙাতেও ভয়, পানিতেও ভয়।

ময়না বু        ঃ জুলুম করার আগেই একথা ভাবা উচিত ছিল। অন্যায় করলে তার প্রতিফল পেতেই হবে। আমাদেরই টাকায় গুলি কিনে আমাদেরই

খুন করবে, এতো হতে পারে না। এ জন্যেই দিন কয়েক আগে দুটো জাহাজ বাংলাদেশ থেকে পাট নেবে বলে এসেছিল, গেরিলারা ও-দুটোও ডুবিয়েছে।

মাষ্টার ভাই ঃ বঙ্গবন্ধু পল্টন ময়দানে বলেছিলেন ‘আমরা ভাতে মারবো, আমরা পানিতে মারবো’।সে কথাটা কতখানি সত্য। শয়তানদের

অর্থনৈতিক বুনিয়াদ ভেঙে পড়েছে। এখন পাগলা কুকুরের মতো দিশেহারা হয়ে ছুটছে। বিদেশ থেকে সাহায্যও বন্ধ হয়ে গেছে। বাংলার

সম্পদ নিয়ে যে শক্তিমত্ততা দেখাতো আজ তার সেসব জারিজুরি ভেঙে গেছে।

বনি    ঃ এবারে তো বাংলাদেশের মানুষ পাট ভেঙে ফেলে ধান বুনে দিয়েছিল, যার জন্য পাটের উৎপাদনও কমে গেছে অনেক।

মাস্টার ভাই ঃ শুধু পাটই না-চা তামাক এগুলোরও কোন উৎপাদন নাই। চায়ের বাগানগুলো এখন মুক্তিবাহিনীর কব্জায়, যার জন্য জল্লাদ সৈন্যদের

ভাগ্যে আর চা জুটছে না, এখন নিষিদ্ধ পদার্থের মতো চা খাওয়াও নিষিদ্ধ হয়ে গেছে জল্লাদবাহিনীর। যে অন্যায় তারা করেছে তার তিল

তিল করে শোধ তুলে দিবো আমরা।

বনি    ঃ একটা কথা জিজ্ঞেস করছিলাম মাস্টার ভাই, সেদিন তুমি বললে না, কতগুলো খানসেনা খতম হয়েছে?

মাষ্টার ভাই ঃ গত এক মাসের হিসেব ২৪৭০ জন জল্লাদ সেনা, আর তাদের অফিসার খতম হয়েছে এবং রাজাকার পুলিশ মিলিয়ে খতম হয়েছে

২২০০ জন। ২৪টা সামরিক গাড়ী বিধ্বস্ত হয়েছে, ৫টা মিলিটারী স্পেশাল ট্রেন নষ্ট হয়েছে।

ময়না বু        ঃ  খুব ভাল হয়েছে-‘যেমন কর্ম তেমন ফল। বাংলাকে দেখেছে, বাংলার মানুষকে দেখেছি। বাংলার মানুষও যে প্রয়োজনে অস্ত্র হতে লড়াই করতে পারে, জুলুমের প্রতিকার করতে পারে, এবার বুঝেছে।

মাষ্টার ভাই ঃ আমাদের মুক্তিবাহিনী একটা গুরুত্বপূর্ণ সড়কের অধিকাংশ স্থানই দখল করে নিয়েছে, সড়কটা হচ্ছে দিনাজপুর-ফুলবাড়ির মধ্যে।

এই সড়কের পার্শ্বে দুশমনদের যেসব রাজাকার ছিল, এখন সেগুলো মুক্তিবাহিনীর দখলে, মুক্তিবাহিনীর কাজে লেগেছে। এখানের

লড়াইয়ে ৪৫ জন পাকসেনা খতম এবং তিনজন আহত হয়েছে। তাছাড়া প্রতিটি সেক্টরেই তুমুল লড়াই চলছে।

বনি    ঃ লড়াই আরো জোরদার হয়েছে। দুশমনরা পিছু হপতে শুরু করেছে। টাঙ্গাইল তো মুক্তই হয়ে গেছে মাষ্টার ভাই।

ময়না বু       ঃ আস্তে আস্তে সবই মুক্ত হবে বনি। ধৈর্য ধরতে হবে, মনের বল রাখতে হবে। তাই না মাস্টার ভাই?

<005.018.395>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

মাষ্টার ভাই ঃ ঠিকই। লড়াই তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠছে। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের চোটে জল্লাদবাহিনীর পিছু হটতে বাধ্য হচ্ছে। আমরা লড়াই

করছি স্বতঃস্ফৰ্তভাবে, নিজের দেশকে উদ্ধার করার জন্য, আর ওদের সৈন্যরা বেতনভোগী পেশাদার সৈন্য-দুটোর মধ্যে তফাৎ

অনেক। দেশের জন্য যার দরদ আছে তার শক্তি ওই ভাড়াটিয়া সৈন্যদের চেয়ে দশগুণ বেশী।

বনি    ঃ এটা একেবারে খাঁটি সত্য কথা। দেশকে ভালবেসে দেশের জন্য জন্য জান দিতে যাওয়া কি কম কথা মাস্টার ভাই? এর থেকে বড়

গৌরব আর কি আছে? কিন্তু এই দালালগুলো বুঝতে পারেনি সে কথা। তাই মরছেও দমাদম।

ময়না বু        ঃ লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু’।

বনি    ঃ ঠিক বলেছ-ময়না বু, লোভের খেসারত দিচ্ছে। ইসাহাকের ঠ্যাং খোঁড়া হলো, সুলতানউদ্দিন মরলো, মোনেম খাঁ, একে একে সব

মরবে।

মাস্টার ভাই ঃ ফসলের জমিতে যেমন আগাছা রাখতে নাই, ঠিক তেমন একটা সমাজে বা জাতির মধ্যে বেঈমান, বিশ্বাসঘাতক রাখতে নাই।

যাক শোন, তোমাদের একটা কথা বলি, সবাই খেয়াল রাখবে কে আমাদের মধ্যে মোনাফেকী করার সুযোগ নিচ্ছে-তার নাম চাই, নাম দিতে হবে মুক্তিবাহিনীকে। গ্রামে গ্রামে লোক লাগাও, ময়না বু তোমার পক্ষে এ কাজটা করা অনেক সহজ, তুমি অন্দরমহলের মারফত খবর পাবে। খবরগুলো পৌছে দিও।

ময়না বু        ঃ আচ্ছা মাষ্টার ভাই। তা মাস্টার ভাই বলছিলাম কি, রাত তো অনেক হলো, আমি উঠি।

বনি    ঃ তুমি একলাই যাবে না, আমরাও যাবো।

মাষ্টার ভাই ঃ হ্যাঁ চলো, কথায় কথায় অনেক রাত হয়ে গেছে, চলো আমরাও যাই।

বনি    ঃ কাল সকালে তুমি একবার আমার সাথে দেখা করো, কথা আছে।

মাস্টার ভাই ঃ চলো, যাই।

সবাই      ঃ চলো।

৩০ নভেম্বর, ১৯৭১

মাষ্টার ভাই ঃ যুদ্ধ পরিস্থিতি এখন মারাত্মক। মুক্তিবাহিনী যুদ্ধ করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছে আর পাকিস্তানী শয়তানগুলো প্রাণের ভয়ে

পিছে হটে যাচ্ছে বনি, আমাদের আরো সজাগ আরো সতর্ক হতে হবে।

বনি    ঃ     আমরা সতর্ক আছি মাষ্টার ভাই। মানুষের মনের শক্তি কেমন বেড়ে গেছে শুনেছ। মুক্তিবাহিনী যতোই এগিয়ে যাচ্ছে মানুষ

ততই যেন নতুন শক্তি অর্জন করেছে।

মাস্টার ভাই ঃ         এটা তো খুবই স্বাভাবিক বনি। বাংলার মানুষ যেমন আমাদের গেরিলাদের আশ্রয়স্থল, আমাদের গেরিলারা এবং মুক্তিবাহিনী

ঠিক তেমনি বাংলার মানুষের ভরসাস্থল।

<005.018.396>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

 বনি ঃ     পরশু কালিগঞ্জ গেছিলাম। মুক্তিবাহিনীর গানবোটে চড়ে। গায়ের লোক আমাদের বোট দেখে ‘জয় বাংলা ধ্বনি দিতে দিতে

নদীর পাড়ে এসে হাজির, আর আমাদের দেখে কতো খুশী!…কে যায়? কে?

বসির ভাই ঃ আমি বসির। কে, বনি নাকি? …আরে মাস্টার ভাই দেখছি। আসসালামু আলায়কুম।

মাষ্টার ভাই ঃ        ওয়ালায়কুম আসসালাম। এসো বসির ভাই। কোথায় যাচ্ছিলে?

বসির ভাই ঃ         ময়নাবুবুর কাছে যাচ্ছিলাম। কাল কিছু কাপড়-চোপড় ময়নাবুবু জোগাড় করেছে, মুক্তাঞ্চলের গরীব-দুঃখীকে দেওয়ার

জন্য, ওগুলো নিয়ে আসি।

বনি    ঃ     আমিও কিছু জোগাড় করেছি, তাহলে তুমি সেগুলোও নিয়ে যেয়ো, আমি আবার অন্য কাজে আটকা পড়ে গেছি, সময়

পাচ্ছি না।

বসির ভাই ঃ ঠিক আছে নিয়ে যাবো। তারপর কি গল্প করছিলে তোমরা।

বনি    ঃ     গল্প না, বসির ভাই। সত্যি ঘটনা।

মাষ্টার ভাই ঃ বনি পরশুদিন কালিগঞ্জে গেছিল তারি গল্প করছে।

বসির ভাই ঃ কও শুনি। আমিও যাবো একদিন!

বনি    ঃ     যা বলছিলাম, মাস্টার ভাই, ঘাটে যখন বোট ভিড়ল, লোকে কি খুশী। এর মধ্যে এক বুড়ো মানুষ হঠাৎ বলে উঠল “বাপুরে,

আজ তোমাদের গানবোট দেখে আমরা ছুটে আসছি তোমাদের দেখার জন্য। আর দুদিন আগে ওই শয়তানের বাচ্চারা যখন

আসত, নদীর দুই পাড়ে গাঁয়ের লোক কে যে কোথা পালাবে, তার হিসাব পেতো না। মেশিনগান ফিট করে রাখতো। সমানে

গুলি চালাতো পাড়ে, কে মরবে, কে বাঁচবে, বলা মুস্কিল ছিলো।

মাষ্টার ভাই ঃ        মানুষের মনে ভয় এবং সন্ত্রাস সৃষ্টির জন্য এবং মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ থেকে নিজেদের বাঁচানোর জন্য এলাপাতাড়ি গুলি

চালাতো, সাধারণ মানুষের মৃত্যুতে কিছু যেতো আসতো না- কিন্তু আজ শয়তানরা বুঝতে পেরেছে, বাংলার মানুষ তাদের চরম ঘৃণা করে। মুক্তিবাহিনীকে পরম আদরে তারা ডেকে নেয়, কিন্তু জল্লাদদের দেখলে ঘৃণায় মরে যায়।

বসির ভাই ঃ         কথাটা কিন্তু ঠিক। অত্যাচার করে যে মানুষের মুক্তির ইচ্ছাকে দমানো যায় না সেটা শয়তানগুলো বুঝেছে।

মাস্টার ভাই ঃ         আর আজ বেঈমানের জাতগুলো তাই পোড়া মাটি নীতি’ অবলম্বন করেছে। তারা যে অঞ্চল ছেড়ে পিছু হটে যাচ্ছে সে

অঞ্চলটা সম্পূর্ণ জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে শেষ করে দিচ্ছে। ধান-চাল লুটপাট করে দিয়ে যাচ্ছে, বাড়িঘর সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিচ্ছে।

বনি    ঃ     তাতেই কি মানুষকে কোনদিন দাবিয়ে রাখতে পারবে?

মাস্টার ভাই ঃ        না, মোটেই না। এ জন্যই তো আমাদের প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু বলেছেন, “আমাদের আ দাবিয়ে রাখা যাবে না।

মাষ্টার ভাই ঃ চলো না হাঁটতে হাঁটতে গল্প করতে করতে যাই, ময়না বুবুর ওখানে।

<005.018.397>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

বনি    ঃ     কথাটা ঠিকই বলেছ বসির ভাই। চলো মাস্টার ভাই ময়না বুবুর ওখানেই যাই, কাজের কথাও হবে, একটু গল্প করাও যাবে ।

বনি    ঃ     ময়না বু….ও ময়না বু।

ময়না বু        ঃ     কে? বনি নাকিরে- আরে ভাই, কাজ করছি।

বসির ভাই ঃ        আমরাও এসে গেছি ময়না বু,

ময়না বু        ঃ     এসো এসো, মাস্টার ভাইও দেখছি, বসো।

মাষ্টার ভাই ঃ        কাপড়-চোপড় তো অনেক জোগাড় হয়েছে দেখছি ময়নাবুবু ভালই করেছ। অধিকৃত অঞ্চলে মানুষের জীবন তো ভীষণ

কষ্টের মধ্য দিয়ে কাটছে, মুক্ত হওয়ার পর মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে। অধিকৃত অঞ্চলে মানুষের জীবন কাটছে একটা

বিভীষিকাময় ঘোরের মধ্যে। স্বস্তি নাই, শান্তি নাই, ঘুম নাই, আরাম নাই। এদিকে শয়তানগুলো আর রাজাকার- বদর বাহিনীর

জানোয়ারগুলো মানুষের ঘর থেকে তাদের শেষ সম্বলটুকু হবে। ময়না বু আমি কিছু জিনিস, ঔষধপত্র আর কাপড়-চোপড়

জোগাড় করে দেবো।

ময়না বু        ঃ     আমরা তো মানুষের সেবা করতে পারি। তাই এই সেবার ভারটা আমি হাতে তুলে নিয়েছি।

মাষ্টার ভাই ঃ আজ বাংলা মা-বোনেরা এভাবেই তো দেশের সেবা করছে, সেবা করার জন্য এগিয়ে এসেছে ময়নাবুবু আজ স্বতঃস্ফৰ্তভাবে

মানুষ যে যা কাজ করতে পারে, সে তাই করবে। যেকোন কাজ দ্বারাই মুক্তিসংগ্রামকে সাহায্য করা যায়। যে মুক্তিবাহিনীর

জন্য মরচা খোঁড়ে, তাদের শত্রুর অবস্থানের খবর এনে দেয় অথবা মুক্তিবাহিনীর গুলির বাক্স বয়ে নিয়ে যায়, সেও

মুক্তিসংগ্রামের সামিল, সেও মুক্তসংগ্রামকে সাহায্য করছে।

ময়না বু        ঃ     যুদ্ধের খবর-টবর কিছু বলো মাষ্টার ভাই ।

বনি    ঃ     তাহলে আমিই বলি- যশোর ক্যান্টনমেন্টের কাছে তুমুল লড়াই চলছে। ক্যান্টনমেন্টের উপর চরম আঘাত হানছে। এদিকে

আবার জল্লাদবাহিনী মসজিদে মসজিদে ওদের জন্য দোওয়া করতে বলেছে। বেটারা মরে মরে ভূত হচ্ছে আর আতংক

বাড়ছে।

বসির ভাই ঃ         নোয়াখালীর কথা শুনেছ? মুক্তিবাহিনী বিলোনিয়া দখল করে এখন ফেনীর দিকে এগিয়ে চলেছে। পথে ছাগলনাইয়া দখল

করে নিয়েছে। ছাগলনাইয়া ফেনী থেকে মাত্র চার মাইল দূরে।

ময়না বু        ঃ     এদিকে তো আমি শুনলাম, পচাগড়া মুক্তিবাহিনীর দখলে আর সেটা দখল করার জন্য পাক ফৌজ খুবই চেষ্টা চালাচ্ছে। বসির ভাই ঃ   চেষ্টা তো করবেই, কিন্তু পারলে হয়। মুক্তিবাহিনী যেখানে মুক্ত করছে, তাদের ঘাঁটি শক্ত করছে।

ময়না বু        ঃ     ঢাকা শহরে তো হরদম বোমা বিস্ফোরণ হচ্ছে। কয়েকটি পেট্রোল বোমার আগুনে রেলসেতুগুলোর চরম ক্ষতি হয়েছে। মাস্টার ভাই ঃ মুক্তিবাহিনী এখন প্রতিটি সেক্টরে তৎপর। রাস্তা-রেল-নদীপথে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম-

অধিকৃত অঞ্চলে পঞ্চাশ থেকে একশ ভাগ পর্যন্ত বেড়ে গেছে।

<005.018.398>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

সমস্ত শহরের চারিদিকে পরিখা খোঁড়া হয়েছে। দোকানপাট সন্ধ্যার আগেই বন্ধ হয়ে যায়। ঢাকায় তো জোর গুজব

দু’হাজার মুক্তিসেনা প্রস্তুত, যেকোন মুহুর্তে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। তুলেছে।

বসির ভাই ঃ         মুক্তিবাহিনী এদিকে ঝিনাইদহ পাঁচমাথার মোড় দখল করে নিয়ে শক্ত ঘাটি গড়ে তুলেছে ।

বনি    ঃ     এদিকে তো আর দু’চারদিনের মধ্যেই রাজশাহী-নবাবগঞ্জ দখল হওয়ার উপক্রম। মুক্তিবাহিনী ১৭ জন রাজাকার, তিনজন

পাকসেনা বন্দী করে এনেছে। আর বহু রাইফেল আর গুলি উদ্ধার করে নিয়ে এসেছে।

ময়না বু        ঃ     এর জন্যই তো শয়তানগুলো এখন পালাবার পথ খুঁজছে।

মাষ্টার ভাই ঃ        পালাবে আর কোথায়? এখন ওরা সবাই আশ্রয় নিতে চাচ্ছে ক্যান্টনমেন্টগুলোয়। আর মুক্তিবাহিনী তাদের সে পথ রুদ্ধ করে দিচ্ছে। এখন শয়তানগুলো ছড়ানো-ছিটানো অবস্থায় বাংলাদেশের পথে-ঘাটে মুক্তিবাহিনীর হাতে কুকুরের মতো গুলি খেয়ে মরছে। পাকিস্তানী ৬০টা ট্যাংকের মধ্যে ১৭টাই তো মারা পড়েছে। বিমান বহরের ১৮টা বিমানের মধ্যে পাঁচটা নেই। নদী-আকাশপথ আর সড়কে কোথাও নিস্তার নেই শয়তানদের।

ময়না বু        ঃ     সংঘবদ্ধ মুক্তিকামী মানুষের শক্তি যে কি প্রচণ্ড তার প্রমাণ পাচ্ছে শয়তানরা এখন।

বনি    ঃ     আরো পাবে বুবু, কিন্তু সেদিন আর বেশী দূরে নয়।

বসির ভাই      ঃ     যাক ময়না বুবু, কথাবার্তা তো হলো, এবার কাপড়-চোপড়গুলো দাও, আমাদের আবার দেরী হয়ে যাচ্ছে, চলে যাবো।

ময়না বু        ঃ     এই যে দিচ্ছি ভাই।-নাও, কাল আরো কিছু পাবো, পরশু এসে নিয়ে যেয়ো।

বসির ভাই      ঃ     আচ্ছা।

মাষ্টার ভাই    ঃ     চলো, আমরা তাহলে যাই। বুবু চলি।

৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১

মাস্টার ভাই ঃ         এখন আমাদের দুর্যোগময় রাতের অন্ধকার শেষ হয়ে আসছে। এখন আমাদের মুক্তিবাহিনী দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে।

শত্রুশিবির একের পর এক মুক্তিবাহিনীর পদদলিত হচ্ছে মুক্তাঞ্চলের বিস্তৃতি ঘটছে দিনের পর দিন। অত্যাচারে জর্জরিত

মানুষ এখন ফেলছে স্বস্তির নিঃশ্বাস। মুক্তাঞ্চল দিয়েছে তাদের নতুন জীবনের আশ্বাস। আজ আমরা জমায়েত হয়েছি দুটো

কারণে। একটা হলো- আমরা মুক্তিবাহিনীকে কিভাবে আরো সাহায্য করতে পারি তারই পরিকল্পনা নিতে হবে এবং দ্বিতীয়টা

হলো- সদ্য মুক্তাঞ্চলের বিপর্যস্ত জীবনধারা আমরা আবার স্বাভাবিক এবং সুন্দর করে গড়ে তুলতে পারি। এ কাজ নিঃসন্দেহে

খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অবশ্য তার জন্য চিন্তা আমরা করি না, কেননা মুক্তিসংগ্রামে নিয়োজিত প্রতিটি ব্যক্তি আপন আপন দায়িত্ব

এবং কর্তব্য পালনে নিষ্ঠাবান, সচেষ্ট এবং উন্মুখ। আমরা গভীরভাবে আমাদের কর্মদক্ষতায় বিশ্বাসী।…কি ব্যাপার বসির ভাই

কিছু বলবে নাকি?

বসির ভাই ঃ পাকিস্তানী জল্লাদগুলো নিজের ঘাঁটি ছেড়ে পালাবার সময় আশেপাশের গ্রাম-বাড়িঘর জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে শেষ করে দিচ্ছে।

এর জন্য আমরা কি করব? আমরা কিভাবে সাহায্য করতে পারি, আমাদের বলো।

<005.018.399>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

বনি    ঃ     হ্যাঁ মাস্টার ভাই, বসির ভাই ঠিকই বলেছে। প্রত্যেকটা জায়গায় একই রকম অন্যায় করছে ওরা। আমাদের বুদ্ধি দাও

কিভাবে সাহায্য করব আমরা।

মাষ্টার ভাই ঃ        নানাভাবে সাহায্য করতে পারি আমরা। প্রথমতঃ যেসব অঞ্চলে ওরা এমন অত্যাচার করছে, বা করেছে সেখানের খুঁটিনাটি

খবরাখবর আর ক্ষতির পরিমাণ জানতে হবে। তারপর স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর অত্যাচারিত মানুষকে আশু সাহায্য করতে হবে।

অসুস্থআহত লোকদের চিকিৎসার জন্য ওষুধপত্র নিয়ে যেতে হবে।

ময়না বু        ঃ     আমি কিন্তু আরো কিছু ওষুধপত্র , কাপড়-চোপড় জোগাড় করে রেখেছি। আমাকে খবর দিলেই আমি লোকজন নিয়ে সংগে

সংগে চলে যাবো।

মাষ্টার ভাই ঃ        তাহলে সবাই প্রস্তুত। প্রতিটি মানুষকে খবর দিয়ে রাখো যে ছোট ছোট দল ভাগ করে কাজের ভার দেয়া হয়েছে, তাদের

সংশ্লিষ্ট নেতৃবৃন্দ প্রতিমুহুর্তে প্রস্তুত থাকবে।

বসির ভাই ঃ সে কথা বলে দিয়েছি মাস্টার ভাই। ইতিমধ্যেই কয়েকটা সাহায্যকারীদল চলে গেছে। ওষুধপত্র, কাপোড়-চোপড়ও পাঠিয়ে

দেওয়া হয়েছে। আরো কিছু জোগার করে রেখেছি।

মাস্টার ভাই ঃ         খুব ভালো করেছ। লড়াই যে ভাবে তীব্রতর হচ্ছে, তাতে বিজয়ের দিন আমাদের সুদূর নয়। জল্লাদবাহিনীর বিষদাঁতগুলো

একের পর এক ভেঙে আমরা মুক্ত করব বাংলাদেশ।

বনি    ঃ     এদিকে তো মুক্তিবাহিনী যশোর, কুষ্টিয়া, দিনাজপুর জেলার আরো কয়েকটি থানা দখল করে নিয়েছে।

বসির ভাই ঃ         শুধু তাই নাকি? গেরিলা আক্রমণে হেরে গিয়ে পাকফৌজ যশোর শহর থেকে পাকবাহিনীর সদর দফতর সরিয়ে নিয়ে মাগুরা

শহরে নিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে।

ময়না বু        ঃ     মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে পাকফৌজ এখন চেচাচ্ছে ‘পালাও, পালাও এখন ওরা যাযাবরের মতো আজ এ শহরে কাল ও শহরে

পালাবে, শেষে পালাবার যখন আর পথ থাকবে না তখন কি করবে?

বনি    ঃ     তখন বঙ্গোপসাগরে-পদ্মা-মেঘনা-যমুনা ধলেশ্বরী-মহানন্দা-আত্রাই আর পুনর্ভবায় ইদুরের মতো ডুবে মরবে। আর তা না হলে

এখন যেমন মাঝে মাঝেই ধরা দিচ্ছে, তখন মুক্তিবাহিনীর কাছে দলে দলে ধরা দেবে।

ময়না বু        ঃ     সাহায্যের সব রাস্তাগুলোই তো বন্ধ হয়ে গেছে। নদীপথ, সড়ক আর রেলপথে যোগাযোগ তো বন্ধ, এদিকে আবার

বিমানপথও বন্ধ হবার উপক্রম। গেরিলারা লালমনিরহাট বিমানবন্দর বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে।

মাষ্টার ভাই ঃ         যোগাযোগের সমস্ত ব্যবস্থাগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে শয়তানগুলোর এখন আর অন্য কোন পথ খোলা থাকবে না, তখন হবে

হয় মৃত্যু, নয় আত্মসমর্পণ। এ ঘটতেই হবে, হতে বাধ্য। ইতিহাসের লিখন মর্মান্তিকভাবে ওদের যে পরাজয় লিখে রেখেছে,

তাতে হানাদারদের নিঃশেষ হওয়া ছাড়া উপায় নেই।

বনি    ঃ     এদিকে শুনেছ গেরিলা বাহিনী নাগেশ্বরী থানাটা দখল করে নিয়ে লালমনিরহাট বিমানবন্দরটা ঘিরে ফেলেছেন, এখান থেকে

হানাদারদের জন্য বিমান চলাচল বা বিমানের সাহায্যে কোন সাহায্যদ্রব্য পাঠানো একেবারে বন্ধ-

<005.018.400>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

বসির ভাই ঃ         গত বুধবার মুক্তিবাহিনী সিলেটের শমসেরনগর বিমানঘাঁটিটি দখল করে নিয়েছেন। রংপুরের ধরলা নদীর উপরে তারা

শক্তি সঞ্চার করে হানাদারদের আঘাত হানার জন্য দক্ষিণে এগিয়ে যাচ্ছে।

মাষ্টার ভাই ঃ        মুক্তিবাহিনী খুলনার সাতক্ষীরা শহর সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ করে ফেলেছে এবং ফেনীর কমলপুরে প্রচণ্ড আক্রমণ চালিয়ে

মুক্তিবাহিনীর বীর যোদ্ধারা যশোর জেলার সাদিপুর, ঝিনাইকুণ্ড এবং জামিরা এলাকা থেকে দখলদার সৈন্যদের বিতাড়িত

করেছে।

ময়না বু        ঃ     মুক্তিবাহিনী দিনাজপুর জেলার বোদা থানা সদর দখল করে নিয়েছে। পচাগড় থেকে মাত্র কয়েক মাইল দূরে এই বোদা থানা।

এখন মুক্তিবাহিনী তীব্রগতিতে ঠাকুরগাঁয়ের দিকে এগিয়ে গিয়ে দখল করে নিয়েছে। এদিকে আবার ময়দানদীঘি এলাকাটা

হানাদার বাহিনীর হাতে থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে গেছে।

বনি    ঃ     মুক্তিবাহিনী এখন যেখানে আঘাত হানছে সেখান থেকেই শয়তানরা পিছু হটছে। সময় হয়ে গেছে, বাছাধনরা খাওয়া-দাওয়া

ভুলে এখন ইয়া নফসী, ইয়া নফসী শুরু করেছে।

বসির ভাই ঃ বনি, একটা সুন্দর আলোচনা হচ্ছে। তার মধ্যে শুরু করেছ ফাজলামি, তোমাকে কতবার বলা হয়েছে, এখন ঐসব হালকা

কথাবার্তা বলবে না।

মাস্টার ভাই ঃ         যাক তোমরা দুজনেই থামো, মুক্তিবাহিনী কুমিল্লা জেলার তিনটে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা দখল করে নিয়েছে। শয়তানদের বাইরের

সংগে যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। এই এলাকাগুলো হলো গংগাসাগর এবং রাজারকোট।

বসির ভাই ঃ যশোর সেক্টরে মুক্তিবাহিনী প্রচণ্ড আক্রমণ করে নাভারন-সাতক্ষীরা রোডটি থেকে পাক সাতক্ষীরা রোডে হানাদারদের সংগে

মুক্তিবাহিনীর জোর লড়াই চলছে।

বনি    ঃ     কুষ্টিয়া জেলার কথাও শোন তাহলে। জীবননগর তো মুক্তিবাহিনীর দখলে; এদিকে আবার জীবননগর থানার উত্তর-পূর্বে

আন্দুবাড়িয়া এখন মুক্তিবাহিনীর দখলে। চুয়াডাঙ্গা দখলের ব্যাপার নিয়ে মুক্তিবাহিনীর সংগে-প্রচণ্ড লড়াই চলছে।

মাষ্টার ভাই ঃ        মারো আর তাড়ো। কথাটা ঠিকই। বগুড়া জেলায় মুক্তিবাহিনী আরিয়াকান্দি থানায় ২২ জন পাক দস্যকে খতম করেছে। আর

বেঁচেছিল দুজন, তারা আবার পালাতে না পেরে মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে।

ময়না বু       ঃ    পাক জানোয়ারগুলো যেখানে না পারছে, সেখানেই বিমান আক্রমণ চালিয়ে সাধারণ নিরীহ মানুষদের মারছে, তাদের বাড়িঘর

নষ্ট করে ফেলছে ।

মাস্টার ভাই ঃ         কিন্তু তাতেই কি বাংলাদেশের মানুষের মনোবল ভাঙতে পারবে? পারবে না। কোনদিন ওরা সক্ষম হবে না। বাংলার মানুষের

মন আরো সবল, আরো কঠিন হয়ে উঠেছে। শত দুঃখ কষ্টেও বাংলার মানুষ ভেঙে পড়বে না।

<005.018.401>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

বনি    ঃ     বাংলার মানুষ এবং মুক্তাঞ্চলে নতুন উৎসাহে কাজ শুরু করেছে; চাষবাস করছে, ফসল কাটছে, ফসল তুলছে ঘরে।

মাস্টার ভাই ঃ        এদিকে আরেক খবর শুনেছ? ঢাকার বেতার কেন্দ্র, পাকিস্তানের প্রলাপের ভাণ্ডার একদম বন্ধ হয়ে গেছে। গেরিলাবাহিনীর

আক্রমণে শেষ পর্যন্ত ওদের দালালী কণ্ঠস্বরও স্তব্ধ হয়ে গেছে।

বসির ভাই ঃ ওদের হাত ভাঙবে, পা ভাঙবে, গলার স্বরও বন্ধ হয়ে আসবে। হতেই হবে।

মাস্টার ভাই ঃ        যাক, যুদ্ধের আলোচনা হলো, আমরা খবরাখবর তো শুনলাম, এবার আমরা আমাদের অন্য আলোচনায় আসি।

ময়না বু        ঃ     বলো মাষ্টার ভাই। আমরাও কাজের কথা শুনি।

মাষ্টার ভাই ঃ ময়না বু শোন, মেয়েদের কাজ প্রচুর আছে। তোমরা দুঃখ-কষ্টে জর্জরিত মানুষকে সান্তনা দেবে। নতুন করে গেরস্থালী

যারা গুছিয়ে নিচ্ছে, তাদের সাহায্য করবে। মানুষকে সান্তুনা দেওয়া বা তার ভাঙা সংসার গড়ে তোলার কাজে তোমরা

সাহায্য করতে পারবে সবচেয়ে বেশী। এ কাজের ভারটা তোমাদেরই নিতে হবে। তা ছাড়া শয়তানদের বোমায় আহত বা

যুদ্ধে আহত মানুষের সেবা করার দায়িত্বও তোমাদের নিতে হবে। আশা করি এ কাজটা ভালই পারবে তোমরা, তাই না?

ময়না বু        ঃ     হ্যাঁ, মাষ্টার ভাই। খুব ভালভাবে পারব। আমি আমার দলবল নিয়ে এই কাজই করছি, দরকার হলে আরো কয়েকজনকে

নিয়ে নিবো।

মাস্টার ভাই ঃ        বসির ভাই, বনি- তোমাদের কাজ হবে আহত অসুস্থ মানুষদের নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে আসা, মানুষের ঘরবাড়ি তোলার

ব্যাপারে সাহায্য করা এবং খাদ্য এবং আশ্রয়হীন মানুষের জন্য খাদ্য এবং আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা।

বসির ভাই ঃ বনি, তাহলে আমি উত্তর পাড়ায় যাচ্ছি, ওখানেই কাজ করব, আর তুমি তোমার ছেলেদের নিয়ে পূর্বপাড়ায় চলে যাও।

বনি    ঃ     হ্যাঁ, আমি পূর্বপাড়ায় থাকবো, মাষ্টার ভাই তুমি আসবে তো? আমাদের মাঝে মাঝে বুদ্ধি-সুদ্ধি দিবে, কিভাবে কাজ করলে

সুবিধা হবে একটু দেখিয়ে শুনিয়ে দিবে।

মাষ্টার ভাই ঃ নিশ্চয় আমি সব জায়গায় যাবো, আমি সবসময় তোমাদের সংগে সংগে থাকবো, আর শোন, কাল আবার এ সময় এসো,

কতগুলো নির্দেশ আছে, সেগুলো জানিয়ে দেবো। আর একটা কাজ করো, মানুষের মনোবল অটুট রাখার জন্য তাদের

সংগে গল্পগুজব করবে, যুদ্ধের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ-আলোচনা করবে। আর হ্যাঁ, শয়তানদের ঘাঁটির খবরাখবর,

ওদের চলাফেরার খবরগুলো কিন্তু অবশ্যই জোগাড় করবে।

বনি     ঃ    ঠিক আছে, তাহলে আমরা যাই। ময়না বু চলো যাই, তোমাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আমি যাবো।

ময়না বু         ঃ    চলো উঠি, মাস্টার ভাই তাহলে গেলাম।

মাষ্টার ভাই ঃ        আচ্ছা।

বসির ভাই  ঃ তাহলে মাস্টার ভাই, চলো আমরাও যাই।

মাস্টার ভাই ঃ        চলো।

(রচনা ও পরিচালনাঃ মুস্তাফিজুর রহমান)

<005.019.402>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

শিরোনাম সুত্র তারিখ

১৯। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র

প্রচারিত গান

…১৯৭১

 

 (এক)

জয় বাংলা বাংলার জয়।।

হবে হবে হবে, হবে নিশ্চয়

কোটি প্রাণ একসাথে জেগেছে অন্ধরাতে

নতুন সূর্য উঠার এই তো সময় ।।

বাংলার প্রতিঘর ভরে দিতে

চাই মোরা অন্নে।

আমাদের রক্ত টকবক দুলছে

মুক্তির রিক্ত তারুণ্যে ।।

নেই—ভয়

হয় হউক রক্তের প্রখ্যাত ক্ষয়

আমি করি না করি না করি না ভয়।

অশোকের ছায়া যেন রাখালের বাঁশরী

হয়ে গেছে একেবারে স্তব্ধ।

চারিদিকে শুনি আজ নিদারুণ হাহাকার

আর ঐ কান্নার শব্দ ।।

শাসনের নামে চলে শোষণের

সুকঠিন যন্ত্র।

বজ্রের হুংকারে শৃংখল ভাংতে

সংগ্রামী জনতা অতন্দ্র।

আর—নয়

তিলে তিলে মানুষের এই পরাজয়

আমি করি না করি না করি না ভয়।

                                                জয় বাংলা বাংলার জয় ।।

(কথা-গাজী মজহারুল আনোয়ার)

<005.019.403>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

(দুই)

মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি

মোরা একটি সুখের হাসির জন্য অস্ত্র ধরি ।।

যে মাটির চির মমতা আমার অঙ্গে মাখা

যার নদী জলে ফুলে ফলে মোর স্বপ্ন আকা

যে নদীর নীল অম্বরে মোর মেলেছে পাখা

সারাটি জীবন সে মাটির গানে অস্ত্র ধরি ।।

নতুন একটি কবিতা লিখতে যুদ্ধ করি-

মোরা নতুন একটি গানের জন্য যুদ্ধ করি

মোরা একখানা ভালো ছবির জন্য যুদ্ধ করি

মোরা সারা বিশ্বের শান্তি বাঁচাতে আজকে লড়ি ।।

যে নারীর মধু প্রেমেতে আমার রক্ত দোলে

যে শিশুর মায়া হাসিতে আমার বিশ্ব ভুলে

যে গৃহকপোত সুখ স্বর্গের দুয়ার খুলে

সেই শান্তির শিবির বাঁচাতে শপথ করি ।।

মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি

মোরা একটি সুখের হাসির জন্য আজি অস্ত্র ধরি।

(কথা-গোবিন্দ হালদার)

(তিন)

আমি এক বাংলার মুক্তি সেনা

মৃত্যুর পথ চলিতে

কভু করি না ভয় করি না।

মৃত্যুরে পায়ে দলে চলি হাসিতে।

দুঃসহ জীবনের রাহু মুক্তি

প্রাণে মেখে সূর্যের নবশক্তি

বজ্রশপথে নেমেছি যুদ্ধে

বাঙ্গালীর জয় হবে নিশ্চয়

চলেছে এ দুর্জয় মুক্তির পথে।

<005.019.404>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

বাংলার তরে আমি সঁপেছি এ মন

নেই জালা হাহাকার নেই হুতাশন৷

রক্তে রাঙা আজ বিপ্লবী মন

ক্ষমা নেই বাংলার গণদুশমন

বজ্রের তূর্যের মন্ত্রে

মারবো এবার মরবো না আর

চলেছি যে শত্রুকে পায়ে দলিতে।

(কথা-নেওয়াজিস হোসেন)

(চার)

বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা

আজ জেগেছে এই জনতা, এই জনতা ।।

তোমার গুলির, তোমা ফাঁসির,

তোমার কারাগারের পেষণ শোধবে তারা

ও জনতা এই জনতা এই জনতা ।।

তোমার সভায় আমীর যারা,

ফাঁসির কাঠে ঝুলবে তারা ।।

করজোড়ে মাগবে বিচার।

ঠিক যেন তা এই জনতা ।।

তারা নতুন প্রাতে প্রাণ পেয়েছে, প্রাণ পেয়েছে।

তারা ক্ষুদিরামের রক্তে ভিজে প্রাণ পেয়েছে ।।

তারা জালিয়ানের রক্তমানে প্রাণ পেয়েছে।

তারা ফাঁসির কাঠে জীবন দিয়ে

প্রাণ পেয়েছে প্রাণ পেয়েছে।

তারা গুলির ঘায়ে কলজে ছিড়ে প্রাঁণ পেয়েছে,

প্রাণ পেয়েছে এই জনতা।

নিঃস্ব যারা সর্বহারা তোমার বিচারে।

সেই নিপীড়িত জনগণের পায়ের ধারে ।।

ক্ষমা তোমায় চাইতে হবে

নামিয়ে মাথা হে বিধাতা ।

<005.019.405>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

রক্ত দিয়ে শোধতে হবে

নামিয়ে মাথা হে বিধাতা।

ঠিক যেন তা এই জনতা।

বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা

আজ জেগেছে এই জনতা, এই জনতা ।।

(কথা- সলিল চৌধুরী)

(পাঁচ)

সোনা সোনা সোনা

লোকে বলে সোনা

সোনা নয় ততো খাঁটি

বলো যতো খাঁটি

তার চেয়ে খাঁটি বাংলাদেশের মাটিরে

আমার জন্মভূমির মাটি।

ধন জন মন যত ধন দুনিয়াতে

হয় কি তুলনা বাংলার কারো সাথে।

কত মার ধন মানিক রতন

কত জ্ঞানীগুণী কত মহাজন।

এনেছে আলোয় সূর্য এখানে

আঁধারের পথ পাতি রে

আমার বাংলা … … … ।।

এই মাটির তলে ঘুমায়েছে অবিরাম

রফিক, শফিক, বরকত কত নাম

কত তিতুমীর, কত ঈশা খান

দিয়েছে জীবন, দেয়নি তো মান।

রক্ত শয্যা পাতিয়া এখানে

ঘুমায়েছে পরিপাটি রে

আমার বাংলাদেশের মাটি

আমার জন্মভূমির মাটি।

(কথা-আবদুল লতিফ)

<005.019.406>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

(ছয়)

ছোটদের বড়দের সকলের

গরীবের নিঃস্বের ফকিরের

আমার এ দেশ, সব মানুষের, সব মানুষের ।।

নেই ভেদাভেদ হেতা চাষা আর চামারে,

নেই ভেদাভেদ হেথা কুলি আর কামারে।

হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খৃষ্টান দেশ মাতা এক সকলের

লাঙ্গলেরা সাথে আজ চাকা ঘুরে এক তালে

এক হয়ে মিশে গেছি আমরা সে যে কোন প্ৰাণে

বাণী শুনি একই সুরের ।।

চাষাদের মজুরের ফকিরের

ফকিরের নিঃশ্বের গরিবের

আমার এ দেশ , সব মানুষের , সব মানুষের ।

বড়দের ছোট দের সকলের

ছোটদের বড়দের সকলের

আমার এদেশ সব মানুষের … ।।

(কথা ও শিল্পী-রথীন্দ্রনাথ রায়)

(সাত)

জনতার সংগ্রাম চলবেই,

আমাদের সংগ্রাম চলবেই

জনতার সংগ্রাম চলবেই।

হতমানে অপমানে নয়, সুখ সম্মানে

বাঁচবার অধিকার কাড়তে

দাসের নির্মোক কাড়তে

অগণিত মানুষের প্রাণপণ যুদ্ধ

চলবেই চলবেই,

জনতার সংগ্রাম চলবেই

আমাদের সংগ্রাম চলবেই।।

<005.019.407>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

প্রতারণা প্রলোভন প্রলোপ

হোক না আধার নিশিছদ্র

আমরা ত সময়ের সারথী

নিশিদিন কাটাবো বিনিদ্র।

দিয়েছি ত শান্তি আরও দেবো স্বস্তি

দিয়েছি ত সন্ত্রম আরো দেবো অস্থি

প্রয়োজন হলে দেবো এক নদী রক্ত

হোক না পথের বাধা প্রস্তর শক্ত

অবিরাম যাত্রা চির সংঘর্ষে

একদিন সে পাহাড় টলবেই

চলবেই চলবেই

জনতার সংগ্রাম চলবেই

আমাদের সংগ্রাম চলবেই ।।

হতে পারি পথভ্রম আরও বিধ্বস্ত

ধিকৃত নয় তবু চিত্ত

আশায় ত সুস্থির লক্ষ্যের যাত্রী

চলবার আবেগেই তৃপ্ত।

আমাদের পথরেখা দুর্গম দুস্তর

সাথে তবু অগণিত সঙ্গী

বেদনার কোটি কোটি অংশী

আমাদের চোখে চোখে লেলিহান অগ্নি

সকল বিরোধ বিধ্বংসী।

এই কালো রাত্রির সুকঠিন অর্গল

কোনদিন আমরা যে ভাঙবোই

মুক্ত প্রাণের সাড়া আনবোই।

আমাদের শপথের প্রদীপ্ত স্বাক্ষরে

নূতন অগ্নিশিখা জলবেই

চলবেই চলবেই

জনতার সংগ্রাম চলবেই

আমাদের সংগ্রাম চলবেই।

(কথা-সিকান্দার আবু জাফর)

<005.019.408>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

(আট)

মুক্তির একই পথ সংগ্রাম

অনাচার অবিচার শোষণের বিরুদ্ধে

বিদ্রোহ-বিক্ষোভ-ঝংকার-হুংকার

আমরণ সংঘাত, প্রচণ্ড উদ্দাম

সংগ্রাম-সংগ্রাম-সংগ্রাম!

ক্ষমতার দম্ভ লোভ সালসায় যারা

জনতার অধিকার খর্ব

ঘরে ঘরে গড়েছি দুর্জয় প্রতিরোধ দুর্গ

তাদের আজ প্রতিহত করবোই করবো ।

যারা মানুষের রক্ত চোষে,

মানুষের মাঝে আনে ব্যবধান

যারা পৃথিবীর কলঙ্ক কালিমা,

কেড়ে নেয় মা-বোনের সম্মান

এসো রক্তশপথে আজ আঘাতে আঘাতে

তাদের করি খান খান –

বাঁচার জন্য ভয় সংশয় রেখে

প্রতিজ্ঞা করেছি আজ মোরা লড়বো

কাটিয়ে জীবনের দুঃখ ঝরা রাত্রি

নতুন এক পৃথিবী গড়বোই গড়বো।

(কথা-শহীদুল ইসলাম)

(নয়)

তীরহারা এই ঢেউয়ের সাগর

পারি দিবরে

আমরা ক’জন নবীন মাঝি

হাল ধরেছি শক্ত করে রে ।।

জীবন কাটি যুদ্ধ করি প্রাণের মায়া সঙ্গ

করি জীবনের সাধ নাহি পাই।

<005.019.409>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

ঘর-বাড়ির ঠিকানা নাই

দিন রাত্রি জানা নাই

চলার ঠিকানা সঠিক নাই ।।

জানি শুধু চলতে হবে এ

তরী বাইতে হবে

আমি যে সাগর মাঝি রে ।।

জীবনের রঙে মনকে টানে না

ফুলের ঐ গন্ধ কেমন জানি না

জ্যোৎস্নার দৃশ্য চোখে পড়ে না

তারাও তো ভুলে কভু ডাকে না ।।

বৈশাখের ওই রৌদ্র ঝড়ে

আকাশ যখন ভেঙে পড়ে

ছেঁড়া পাল আরও ছিঁড়ে যায় ।।

হাতছানি দেয় বিদ্যুৎ আমায়

হঠাৎ কে যে শান্ত সোনার

দেখি ঐ ভোরের পাখী গায় ।।

তবু তরী বাইতে হবে

খেয়া পারে নিতে হবে

যতই ঝড় উঠুক সাগরে।

তীরহারা এই ঢেউয়ের

সাগর পারি দিব রে ।।

(শিল্পীঃ আপেল মাহমুদ ও সঙ্গীরা)

(দশ)

অবাক পৃথিবী দেখো

রূপসী বাংলা রুদ্র মূর্তি আজ ।।

তোমরা চিনতে মায়াভরা সেই বাংলাকে

তোমরা জানতে শস্য শ্যামলা বাংলাকে

সেই সে বাংলা আজ হয়েছে ক্ষুধার রাজ ।।

<005.019.410>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

যে দেশ ছিল সোনার ফসলে ভরা

যে দেশ ছিল নীল নভঃনীলে ঘেরা

আঘাতে আঘাতে সেই পলিমাটি চৌচির হলো আজ ।।

যে মায়াকুঞ্জ একদিন ছিল পাখীর কুজনে ভরা

যে সহজ মন একদিন ছিল স্নেহ প্রীতি মায়া ঘেরা

সে হৃদয় যন্ত্রে আজ গরজে উঠেছে বাজ।।

(কথাঃ নূরে আলম সিদ্দিকী)

(এগার)

রক্তেই যদি ফোটে

জীবনের ফুল

ফুটুক না, ফুটুক না, ফুটুক না ।।

আঘাতেই যদি বাজে

প্রভাতের সুর

বাজুক না, বাজুক না, বাজুক না ।।

গান গান গান বেজেছে অগ্নি গান

দূর সব ব্যবধান সাত কোটি প্রাণ বিসর্জনে

বাংলার গ্লানি ঘুচুক না, ঘুচুক না ।।

এক এক এক

হয়েছি সবাই এক

আসুক দুর্বিপাক

ক্ষুব্ধ মিছিল চলবেই চলবে

প্ৰলয়-ঝঞ্চা উঠুক না, উঠুক না ।।

(কথাঃ সৈয়দ শামসুল হক)

<005.019.411>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

(বারো)

নোঙর তোল সময় যে হোল হোল

হাওয়ার বুক নৌকা এবার

জোয়ারে ভাসিয়ে দাও

শক্ত মুঠি বাঁধবে বজ্র বাঁধিয়া নাও

সমুখে এবার দৃষ্টি তোমার পেছনের কথা ভোল

দূর দিগন্তে সূর্য রথে

দৃষ্টি রেখেছ স্থির

সবুজ আশার স্বপ্নেরা আজ

আলোর দুয়ার খোল।

(কথাঃ নঈম গওহর)

(তেরো)

অনেক রক্ত দিয়েছি আমরা

দেবো যে আরো, এ জীবন পণ

আকাশে বাতাসে জেগেছে কাঁপন

আয়রে বাঙালী ডাকিছে রণ ।।

ঘরে ঘরে ঔ জ্বলছে অগ্নিশিখা

শহীদের খুনে লিখতে রক্ত লেখা

আঘাতে আঘাতে ভেঙ্গেছে পাহাড়

ভেঙ্গেছে ওরে বন্ধুগণ ।।

দিকা দিকা তোরা আয়রে সার্বহারা,

মুক্তি শপথ ভেঙ্গেছে বন্দী কারা ।

ভেঙ্গেছে ভেঙ্গেছে পথের বাঁধন

ওরে ও বাঙ্গালী শোনরে শোন ।।

অনেক রক্ত দিয়েছি আমরা

দেবো যে আরো এর জীবন পণ।

(কথাঃ টি, এইচ, শিকদার)

<005.019.412>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

(চৌদ্দ)

পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে

রক্ত লা রক্ত লা রক্ত লাল

জোয়ার এসেছে পরশ মনে

রক্ত লাল, রক্ত লাল, রক্ত লাল ।।

বাঁধন ছেড়ার হয়েছে কাল,

হয়েছে কাল, হয়েছে কাল ।।

শোষণের দিন শেষ হয়ে আসে

অত্যাচারীরা কাপে আজ ত্ৰাসে

রক্তে আগুন প্রতিরোধ গড়ে

নয়া বাংলার নয়া শাশান, নয়া শ্মশান ।

আর দেরী নয় উড়াও নিশান

রক্তে বাজুক প্রলয় বিষাণ

বিদ্যুৎ গতি হউক অভিযান।

ছিড়ে ফেলো সব শত্রুজাল, শত্ৰজাল।

(কথা-গোবিন্দ হালদার, সুর-সময় দাস)

(পনেরো)

এক সাগর রক্তে বিনিময়ে

বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা

আমরা তোমাদের ভুলব না ।।

দুঃসহ এ বেদনার কণ্টক পথ বেয়ে

শোষণের নাগপাশ ছিঁড়লে যারা

আমরা তোমাদের ভুলব না।

যুগের নিষ্ঠুর বন্ধন হতে

মুক্তির এবারতা আনলে যারা

আমরা তোমাদের ভুলব না ।।

<005.019.413>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

কিষান কিষাণীর গানে গানে

পদ্মা মেঘনার কলতান

বাউলের একতারাতে

আনন্দ ঝংকারে

তোমাদের নাম ঝংকৃত হবে।

নতুন স্বদেশ গড়ার পথে

তোমরা চিরদিন দিশারী রবে

আমরা তোমাদের ভুলব না ।।

(কথা-গোবিন্দ হালদার, সুর ও শিল্পী-স্বপ্না রায়)

(ষোল)

সালাম সালাম হাজার সালাম

সকল শহীদ স্মরণে,

আমার হৃদয় রেখে যেতে চাই

তাদের স্মৃতির চরণে ।।

মায়ের ভাষায় কথা বলাতে

স্বাধীন আশায় পথচলাতে

হাসি মুখে যারা দিয়ে গেল প্রাণ

সেই স্মৃতি নিয়ে গেয়ে যাই গান

তাদের বিজয় মরণে।।

ভাইয়ের বুকের রক্তে আজিকে

রক্ত মশাল জ্বলে দিকে দিকে

সংগ্রামী আজ মহা জনতা

কণ্ঠে তাদের নব বারতা

শহীদ ভাইয়ের স্মরণে ।।

বাংলাদেশের লাখো বাঙালী

জয়ের নেশায় চলে রক্ত ঢালি

আলোর দেয়ালী ঘরে ঘরে জ্বালী

ঘুচিয়ে মনের আধার কালি-

শহীদ স্মৃতি বরণে ।।

(কথা-ফজল-এ খোদা)

<005.019.414>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

(সতেরো)

সোনায় মোড়ানো বাংলা মোদের

শ্মশান করেছে কে?

পৃথিবী তোমার আসামীর মত

জবাব দিতে হবে ।।

শ্যামল বরণী সোনালী ফসলে

ছিল যে সেদিন ভরা

নদী নিবার সদা ব’য়ে যেত

পূর্ত অমৃত ধারা

অগ্নিদাহনে সে সুখ স্বপ্ন

দগ্ধ করেছে কে?

আমরা চেয়েছি ক্ষুধার অন্ন

একটি স্নেহের নীড়

নগদ পাওনা হিসেব কষিতে

ছিল না লোভের ভীড়।

দেশের মাটিতে আমরা ফলাবো

ফসলের কাঁচা সোনা

চিরদিন তুমি নিয়ে যাবে কেড়ে

হায়রে উন্মাদনা

এই বাঙালীর বুকের রক্তে

বন্যা বহালো কে?

পৃথিবী তোমায় আসামীর মত

জবাব দিতে হবে ।।

(কথা, সুর ও শিল্পী-মকসুদ আলী খান সাই)

(আঠারো)

সাত কোটি আজ প্রহরী প্রদীপ

বাংলার ঘরে জ্বলছে,

বন্ধুগো এসো হয়েছে সময়,

পথ যে তোমায় ডাকছে।

<005.019.415>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

বন্ধুগো আজ চেয়ো না পিছে,

আজকে শঙ্কা করো না, মিছে,

বাংলার মাটি, বাংলার তৃণ,

তোমাদেরই কথা বলছে ।।

বন্ধু অনেক বেদনা সয়েছি,

অনেক হয়েছি কাতর,

বন্ধু ভুলেছি বেদনা এবার

হৃদয় করেছি পাথর ।।

রক্তের দাম চাইনাকো আর

আজকে দেখুক বিশ্ব আবার,

বাংলার প্রাণে, বাংলার গানে

আগুনের শিখা জ্বলছে।

(কথা-সারওয়ার জাহান)

(উনিশ)

ব্যারিকেড বেয়নেট বেড়াজাল

পাকে পাকে তড়পায় সমকাল

মারীভয় সংশয় ত্রাসে

অতিকায় অজগর গ্রাসে

মানুষের কলিজা

ছেঁড়া খোড়ে খাবলায়

খাবলায় নরপাল ।।

ঘুম নয় এই খাঁটি ক্রান্তি

ভাঙো ভাই খোয়ারির ক্লান্তি

হালখাতা বৈশাখে

শিষ দেয় সৈনিক হরিয়াল ।।

দুর্বার বন্যার তোড়জোড়

মুখরিত করে এই রাঙা ভোর

নায়ে ঠেলা মারো হেই এইবার

তোলো পাল তোলো পাল ধরো হাল ।।

<005.019.416>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

কড়া হাতে ধরে আছি কবিতার

হাতিয়ার কলমের তলোয়ার

সংগ্রামী ব্যালাডে

ডাক দেয় কমরেড কবিয়াল ।।

 (আবু বকর সিদ্দিক)

(কুড়ি)

শোনন, একটি মুজিবরের থেকে

লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি, প্রতিধ্বনি

আকাশে বাতাসে উঠে রণি।

বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ।

সেই সবুজের বুক চেরা মেঠো পথে,

আবার এসে ফিরে যাবো আমার

হারানো বাংলাকে আবার তো ফিরে পাবো।

শিলেপ কাব্যে কোথায় আছে হায়রে

এমন সোনার দেশ ।।

বিশ্ব কবির সোনার বাংলা, নজরুলের বাংলাদেশ,

জীবনানন্দের রূপসী বাংলা

রূপের যে তার নেইকো শেষ, বাংলাদেশ।

‘জয় বাংলা’ বলতে মনরে আমার এখনো কেন ভাবো,

আমার হারানো বাংলাকে আবার তো ফিরে পাবো,

অন্ধকারে পুবাকাশে উঠবে আবার দিন মণি।

(কথা-গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, সুর ও শিল্পী-অংশুমান রায়)

(একুশ)

অত্যাচারীর পাষাণ কারা জ্বালিয়ে দাও।

সভ্যতার ওই বধ্যভূমি জ্বালিয়ে দাও।

শত্রুহনন চলছে দিকে দিকে

সকল যুগের নিপীড়িতের পক্ষ থেকে

<005.019.417>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

আপোষহীন সংগ্রামের

শেষ কথাটি জানিয়ে দাও

অসূরের হাড়কাঠে

তোর পায়ের ধূলিঝড়

ওরে লাগুক,

লাগুক ভয়ঙ্কর-

খুনের বদলা খুন নেবো

খুন নেবো আজ

রক্ত লোভীর খুনী পাজর ভেঙ্গে

হানাদারের কলজে ছিঁড়ে

খুনের আগুন জ্বালিয়ে দাও।

(কথা-আল মুজাহিদী)

(বাইশ)

আমার নেতা শেখ মুজিব,

তোমার নেতা শেখ মুজিব,

দেশের নেতা শেখ মুজিব,

দশের নেতা শেখ মুজিব,

আহা বাংলা মা’র কোল কইরাছে উজল।

ওরে মনের আশা আল্লায় তাঁরে কইরা দিক সফল রে

আশার আলো করতাছে ঝলমল ।।

ও দ্যাখো আশার আলো করতাছে ঝলমল

আমার নেতা শেখ মুজিব,

দিশার নেতা সেখ মুজিব,

যুগের নেতা শেখ মুজিব,

সবার নেতা শেখ মুজিব,

ওরে সাবাস ব্যাটার বুকের পাটা, যেমন বিজলী ঠাটা রে

চুকবে যত সমস্যার ল্যাটা,

এবার চুকবে যত সমস্যার ল্যাটা ।।

<005.019.418>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

হাইলার বন্ধু শেখ মুজিব,

জাইলার বন্ধু শেখ মুজিব,

কুলির বন্ধু শেখ মুজিব,

ঢুলির বন্ধু শেখ মুজিব,

আহা এমন বন্ধুর তুলনা আর নাই।

ওরে নিজের প্রাণ বিলাইয়া করে দ্যাশেরি ভালাই রে,

আইসো ভাই তাঁর কাতারে দাঁড়াই ।।

ও এবার আইসো ভাই তাঁর কাতারে দাঁড়াই ।।

 (কথা ও সুর-হাফিজুর রহমান)

(তেইশ)

ও বগিলারে,

কেন বা আলু বাংলাদেশের মাছের আশা নিয়া।।

ও বগিলারে, …………।

শিয়াল কান্দে, কুত্তা কান্দে, কান্দে ইয়াহিয়া হায়রে ।।

দুপুর রাইতে ডুপরি কান্দে, ভুট্টো বড় মিয়া, কান্দে।

ও বগিলারে,………।

আপন ফাঁদে আপনি বন্দী টিক্কার চৌখত পানি, ঐ দেখ।

আন্ধার দেখে মাইরের চোটে মিছাই বন্দুক তানি।

বগিলারে,…………. |

বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ বাংলার মাটি ঠুকরি ভাংলু কার।

আষাঢ় মাসোত কাদোয় পরি

হলু নাজেহাল, ও তুই হলু নাজেহাল।

শাওন মাসোত ফালগুন ছাড়ি

নেংটি করলো ছাড়ি

বৈঠার গুঁতায় বাপরে মরে

জান বাঁচে না আর

ও তোর জান বাঁচে না আর।

<005.019.419>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

মরদ মরদ কাওয়ার শালি

কেমন তোর মরদানি ঐ।।

বন্দুক ছাড়ি ঘর উদাসী, ও তুই ।।

গাইলের চোটে কোমড় ভাংগী ভাত বাড়িৰু গিয়া

হাত বাড়াইয়া কান্দে এখন ভুট্টো-ইয়াহিয়া, টিক্কা-ইয়াহিয়া

ও বগিলারে,

কেন বা আলু বাংলাদেশে মাছের আশা নিয়া।

(কথা-হরলাল রায়, শিল্পী-রথীন্দ্রনাথ রায়)

(চব্বিশ)

ওরে আমার দেশের মানিক সোনা।।

তোরা হাসিয়া জীবন দিতেছিস

শেখ মুজিবের সব জানা।

তোমাদের মত কে আর আছে,

তোদের মারতে বসেছেরে।

তোরা দুরাচারী ধ্বংস কর

সহায় আছে রাব্বানা।।

কত দিন করবে শয়তানী

উড়িয়ে দেবে তার জীবন খান।

তোরা শেষ কর তাদের দুশমনি

গুলিকে ভয় কইর না।

যত শয়তান আছেরে দেশে,

বেশীদিন রবে না,

একটিও পাবি না।

তোদের কাছে সবাই নত,

শেষ করে দাও শত শত।।

এখন হইছে বাঘে হত হত

প্রাণ ভয়ে আর বাঁচে না।

(কথা, সুর ও শিল্পী-শাহ আলী সরকার)

<005.019.420>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

(পচিশ)

মোদের ফসল কেরে নিলরে,

যারা মারলো জাতি-কুলরে,

তোরা ভাই শেষ কর তাদের।

তাদের পাঠাইয়া দেরে তোরা,

ঐ না যমের ঘরে।।

তোদের খাইয়া মানুষ হইলো,

তাই বাঘেরা বেঁচে রইলরে।।

এবার বুঝিয়ে দে ভাই সকল

        কেমনে সে যাবে সে পার ।।

 হানাদারীর পাঞ্জেগানা

ভিতরে শয়তানী

এবার বুঝক বাঙ্গালীদের

সিংহ বিক্রমণি।।

তোরা সব জয়ধ্বনি কর… বাঙ্গালী

জোরছে কষে গুলি মাররে।

 এই ভব সংসারে।

(কথা, সুর ও শিল্পী-শাহ আলী সরকার)

(ছাব্বিশ)

ওরে ও বাঙ্গালীরে,

দুশমনদেরে, দেশে রাইখ না।

                                যারা তোদের খাইয়া তোদের মারে

তারে ক্ষমা কইর না।

                                খানের ঘরের ইয়াহিয়া-

মানব পশু গেছেরে হইয়া।।

কি আজব এ ঘটনা।

<005.019.421>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

কতদিন আর ঘুমাও ঘরে:

চাইয়া দেখ আজ বাহিরে,

ওরে অবোধ নয়ন মেললি না ।।

ও বাঙ্গালী-

মরুভুমির বাঘে ঘুরে

এবার মার ধইরে ধইরে ।।

চালাও গুলি বুদ্ধির জোরে

একটিরও প্রাণ রাইখ না ।।

(কথা, সুর ও শিল্পী-শাহ আলী সরকার)

১-৪ গান শামসুল হুদা চৌধুরী সম্পাদিত সাময়িকী অনেক রক্ত একটি জাতি’, ৫-১৬ গান বেতার বাংলা ডিসেম্বর ১৯৭৯, ১৭-২৩ গান শামসুল হুদা চৌধুরী রচিত গ্রন্থ ‘একাত্তরের রণাঙ্গন এবং ২৪-২৬ গান স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের দলিলপত্র থেকে সংকলিত।”