শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
২০। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত ইংরেজী অনুষ্ঠানঃ নিউজ কমেন্টারি |
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের দলিল পত্র |
জুন-সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ |
সংবাদ ভাষ্য
বিশ্বব্যাংকের পাকিস্থানের সাহায্যার্থে আসন্ন বৈঠক স্থগিত করার মধ্য দিয়ে তৎকালীন সংখ্যাগরিষ্ঠ পাকিস্তানের প্রদেশ তথা বাংলাদেশে সংগঠিত গণহত্যার প্রতি আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়ায় নতুন রূপে শুরু হয়েছে। এই স্থগিতকরণ বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ কারণ প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের জনতার সাথে পাকিস্থানের সামরিক জান্তার মধ্যকার ৮৬ দিনের পুরনো যুদ্ধ নিয়ে সর্ববৃহত সহায়ক রাষ্ট্রগুলো যেমন ইউএসএ এবং বৃটেন পূর্বাঞ্চলে যা চলছে তা নিয়ে তারা তাঁদের নীরব কিন্তু পরিষ্কারভাবে তাদের অপছন্দ প্রকাশ করেছে। সর্বোপরি, এই সমিতি কোন দাতব্য প্রতিষ্ঠান নয়। এটা শুধুমাত্র তখনই ঋণ মঞ্জুরে আগ্রহ প্রকাশ করে যখন তারা বুঝতে পারে যে ঋণ গ্রহীতা আসল এবং মুনাফার নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে পারে। গণহত্যার জন্য পাকিস্থান যে পুরো দেউলিয়া হয়ে পড়েছে তা বুঝতে কোন বিশেষজ্ঞের দরকার পড়ে না। যদিও নিউজউইক আন্তর্জাতিক মুদ্রা বাজারে পাকিস্তানি রুপির অত্যন্ত কম দাম উদ্ধৃত করেছে, বাস্তবতা হচ্ছে পাকিস্তানি রুপি কিছুতেই বিক্রয়যোগ্য নয়। বৈরুত, হংকং এবং ব্যাংককের মতো খোলা অর্থবাজার হতে প্রত্যক্ষদর্শীর প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে ক্রেতারা পাকিস্তানি রুপি স্পর্শ করছেই না, দর করা তো দূরের কথা। পাকিস্তান এই অবস্থার অস্থায়ী পরিত্রাণ হিসেবে সমৃদ্ধ শেখরাজত্ব হতে ধার করার চেষ্টা করছে। কিন্তু তারাও ব্যবসায়ী এবং তারা এটা প্রমাণ করতে চায় না যে পাকিস্থানের একমুখী ক্ষয়িষ্ণু দোদুল্যমান অর্থনীতিতে বিশাল রকমের সোনা ছুঁড়ে দেওয়ার জন্য তারা উৎসুক হয়ে আছে।
গত সপ্তাহে বিশ্বব্যাংকের যে দলটি বাংলাদেশ সফর করেছেন তাঁরা তাঁদের জন্য তৈরী করা ইয়াহিয়ার পোষা গুন্ডাদের দ্বারা সাবধানতার সাথে আরোপিত অবগুন্ঠনের আড়ালের ছলচাতুরি দ্রুততার সাথেই দেখে এসেছেন। তাঁদের প্রতিবেদনানুযায়ী, বাংলাদেশের কোণায় কোণায় দুর্ভিক্ষের ব্যাপকহারে মাত্রই ছড়িয়ে পড়া শুরু হয়েছে। করাচি ত্যাগের পূর্বে বিশ্বব্যাংকের পাকিস্তান-সহায়তা তহবিলের চেয়ারম্যান পিটার কার্গিল শুধুমাত্র সম্ভাব্য বর্ধিত খাদ্য সহায়তা সম্পর্কে বলেছেন। তাঁর এই মন্তব্যের কূটনৈতিক শিষ্টাচারের মাধ্যমে এটাই পরিষ্কার যে বিশ্বব্যাংক চাইছে পাকিস্থান পূর্বাঞ্চলের সমস্যার জন্য রাজনৈতিক সমাধানের পথ খুঁজে নিলে অধিকতর অর্থনৈতিক সহায়তাকে আরো গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা যেতে পারে। মার্কিং পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম রজার এর কাছ থেকেও প্রায় একই রকমের বিবৃতি এসেছে। তিনিও বাংলাদেশে যুদ্ধের একটি রাজনৈতিক নিষ্পত্তির উপর জোর দিয়ে আসছেন যা উপমহাদেশের জন্য দীর্ঘস্থায়ী শান্তি হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। পাকিস্থান সহায়তা সমিতির অন্যান্য তিন সদস্য- ফ্রান্স, কানাডা ও জাপানও সম্ভবত একই রকম চিন্তা করছে। ইংরেজী সংবাদ ভাষ্যগুলি আহমেদ চৌধুরী’ ছদ্মনামে আলমগীর কবীর রচিত।
<005.020.423>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
সুতরাং দুইটি সুস্পষ্ট বৈশ্বয়িকমতবাদ বাংলাদেশের বিষয়ে নতুন দুইটি মেরু যুক্ত করছে। ব্যাপকভাবে বিস্তৃত সংবাদ প্রতিবেদনের দ্বারা বিশ্বজুড়ে জনমত বাংলাদেশের মানুষের জন্য একমাত্র আইনগত ও নৈতিক মুখপাত্র হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর দলকে চিহ্নিত করার পক্ষেই যাচ্ছে। তাঁরা বিশ্বাস করছেন যে, বাংলাদেশের জনগণের উপর সামরিক জান্তা দ্বারা গণহত্যাজনিত যুদ্ধের পর পাকিস্থানের মূল উদ্দেশ্য বিলুপ্ত হয়েছে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা অবিলম্বে প্রদান করা আবশ্যক হয়ে উঠেছে। তাঁরা সত্যিকার অর্থেই উক্ত এলাকায় আন্তর্জাতিক শান্তির উপর মারাত্মক হুমকির জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন।
দ্বিতীয় মতটি পশ্চিমা সরকারগুলোর। এটা যদিও দৃঢ় হতে সময় নিচ্ছে, কিন্তু পরিষ্কারভাবেই এই সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান চাওয়ার জন্য ইয়াহিয়া সরকার এর উপর চাপ তৈরী করা হচ্ছে। যদি সেই উন্মাদ জেনারেলরা শোনার মতো স্থিতিশীল অবস্থায় থাকে তবে কোন প্রকার ত্যাগ করা ছাড়াই রাজনৈতিক কূটকৌশল প্রয়োগের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ জায়গা থাকার প্রস্তাবে তারা প্রলুব্ধ হতে পারে। দ্রুততার সাথে প্রস্তাব ও পাল্টা প্রস্তাব অন্তত আরো কয়েক দশকের জন্য বাংলাদেশে উপনিবেশ স্থাপনের মতো দুঃসাহসিক পাগলাটে অভিযানের লক্ষ্যে ক্ষিপ্ত প্রয়াস চালনার পদক্ষেপের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ যোগানের সময় এনে দিতে পারে। একটি ফ্যাসিবাদী সেনাদল যারা অযাচিতভাবে অধিগ্রহণ করছে এবং কোন প্রকার সশস্ত্র প্ররোচনা ছাড়াই বৃহৎ হত্যাযজ্ঞের আয়োজন করেছে তারা স্বেচ্ছায় রাজনৈতিক সমাধানের জন্য সহমত পোষণ করবে এই আশা করাটা বোকামী হবে।
যদি প্রতিক্রিয়া হিসেবে ভারতের সাম্প্রদায়িকতাপ্রবণ এলাকায় হাজার হাজার মুসলমান মারা যায় তবে পাকিস্থানের সামরিক জান্তা এটাকে অগ্রাহ্য করে থাকতে পারবে না। তারা যা চায় তা হচ্ছে ভারতের উপর রাজনৈতিক সুবিধা অর্জন। ভারতের যে সকল মুসলমান পাকিস্তানের সামরিক জান্তার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করছে এবং বুঝতে পারছে বাংলাদেশের জনগণের উপর সামরিক জান্তা দ্বারা সংগঠিত মহান দুর্বিপাকে সহানুভূতি প্রকাশ করাটাই এই সময় অত্যন্ত কঠিন যা মনে রাখা উচিত। তাঁদের আরো মনে রাখা উচিত যে পাকিস্থানের বিভিন্ন প্রদেশে, বিশেষ করে পশ্চিম পাঞ্জাবে ভারত হতে উদ্বাস্তুদের সাথে কি রকম আচরণ করা হচ্ছে। যাই হোক, ভারতের প্রধানমন্ত্রী পাকিস্তানের এই হীন চক্রান্ত মোকাবেলায় একাধিকবার তার সংকল্প প্রকাশ করেছেন এবং ভারতে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে ফেলা হয়েছে।
বিশ্বকে এখনই কাজ শুরু করতে হবে- শুধুমাত্র বন্দী ও বাস্তুহারা বাংলাদেশীদের জন্যই নয় বরং নিজের স্বার্থেই। একে অবশ্যই বাংলাদেশের জনগণের ভোটে নির্বাচিত ও বৈধ সরকারকে স্বীকার করে নিতে হবে এবং ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনীর আক্রমণ সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। শুধুমাত্র এইভাবেই এই অঞ্চলের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা যেতে পারে।
…জুন, ১৯৭১
পশ্চিমা সরকারগুলো, যদিও এখনও অপ্রতুলতার সাথে, পাকিস্থানের সামরিক জান্তা দ্বারা ইচ্ছাকৃতভাবে বিপুলায়তনের উদ্বাস্তু ভারতের উপর চাপিয়ে দেওয়া সমস্যা নিয়ে তাঁদের জেগে ওঠার সাড়া দিচ্ছেন। প্রতিবেদনানুযায়ী, ত্রাণ সামগ্রী নিয়মিতভাবে প্রতিদিনই কলকাতায় আসছে। এর সবই দ্রুততার সাথেই ক্যাম্পের লক্ষ লক্ষ্য ক্লিষ্টদের মাঝে বিতরণ করা হচ্ছে। সাহায্যের পরিমাণ আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যেই বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। কিন্তু তা বাংলাদেশের ভেতর এবং বাহিরের ক্লিষ্টদের মাঝে অত্যাধিক আশা জাগানোতে উৎসাহিত করা উচিত নয়। উদ্বাস্তুদের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহানুভুতি সম্ভবত অনির্দিষ্টকালের জন্য, কিন্তু সাহায্যের হাত খুব সম্ভবত
<005.020.424-426>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
বছর শেষ হওয়ার আগেই ধীরে ধীরে কমে আসতে পারে। স্বাভাবিকভাবেই কেউ এটা আশা করতে পারে না যে দাতা দেশ অনিদির্ষ্ট কালের জন্য এই রকম ভারী বোঝা বহন করে যাবে। তাহলে শেষ পর্যন্ত কী হতে পারে? পুরো ভারটিই আবার ভারতের বিষম বিপন্ন অর্থনীতির উপর বর্তাবে। কিন্তু ভারত কী এই ধাক্কা সামলাতে পারবে? না।
সুতরাং বিশ্বের কাছে এই উপমহাদেশ আরো একটি রক্তক্ষয়ী জায়গা হিসেবে পরিচিত পাওয়ার আগেই এর একটা স্থায়ী সমাধান খুঁজে বের করা আবশ্যক। বিশ্বের মনোযোগ অপরাধী হতে অপরাধমূলক কর্মকান্ডের দিকে সরিয়ে নেওয়ার মতো প্রচারণার ক্ষেত্রে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা দারুণভাবে সফল। পুরো বিশ্ব শরণার্থীদের যারা সীমান্ত পার করে এসেছে তাঁদের ত্রাণের অস্থায়ী সমাধানের ব্যবস্থা করেছেন যেখানে ইয়াহিয়ার দল যারা শুধু এই সঙ্কটের জন্যই দায়ী নয় বরং অনিবার্য সমাধানে যথা, রাজনৈতিক আবহ, শরণার্থীদের সম্মানজনক ও সামঞ্জস্যমূলকভাবে সাগ্রহের সাথে তাঁদের ঘরে ফিরে যেতে বিলম্ব করছে। তারা ততদিন ফিরে যেতে পারবে না যতদিন হানাদার বাহিনীর কান্ডজ্ঞানহীন নিষ্ঠুরতা সেই মাটিতে আছে, যারা তাঁদের প্রিয়জনদের খুন করেছে এবং তাঁদের ভিটে হতে উচ্ছেদ করেছে । পুরো বিশ্বকে একইভাবে সেই সব লক্ষ লক্ষ লোকের ভাগ্যের জন্য সাড়া দিতে হবে যারা বিবিধ কারণে তাঁদের দেশ ছাড়তে ব্যর্থ হয়েছে এবং বর্তমানে নিদারুণভাবে সময়কে ভয়ংকরতম হিসেবে দুষছে। দখলকৃত এলাকায় ইচ্ছাকৃতভাবে খাদ্য শস্য ও ফসল ক্ষেতের বিনষ্ট করায় অভূতপূর্ব দুর্ভিক্ষের নিশ্চিত সম্ভাবনা তৈরী হয়েছে। ইতোমধ্যেই বরিশাল, পটুয়াখালী ও ফরিদপুর জেলায় দুর্ভিক্ষের বিস্তার ঘটেছে। পাক হানাদার বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের শুরু থেকেই গ্রীষ্মকালীন ফল পাকার আগেই জনগণ সেইসবের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। মে মাস শেষ হওয়ার আগেই সকল কাঁচা আম, কাঁঠাল, কলা এবং আর যা কিছুই মানুষের ভক্ষণযোগ্য আছে সবই নিঃশেষিত হয়ে যাবে। চালের দাম মণ প্রতি ৪০ রুপির উর্ধ্বে অর্থাৎ, ৮০ হতে ৯০ রুপি প্রতি মণ। একটি বক্সের দাম পড়ছে ৫০ পয়সা। সেখানে কোন লবণ নেই, নেই কোন চিনি অথবা চা পাতা। গরীব কিংবা দুঃখীকারোরই কিছু কেনার মতো টাকা নেই। পাক হানাদার বাহিনীর সৈন্য ও অফিসাররা শুধু বাজার এবং গুদামের শস্যই নষ্ট করেনি বরং সেই সাথে প্রতিটি বাড়িঘর হতে টাকা ও সোনা লুট করে নিয়েছে।এক রাতের মধ্যেই হাজারো পরিবার ভিক্ষুকে পরিণত হয়েছে। কিন্তু সেখানে এমন কি কোন ধনীও রইলো না যে তাঁদের পর্যাপ্ত সহায়তা দিতে পারে।
রাষ্ট্রে ব্যাপারটা এমনই ছিলো যে পাকিস্থানের এইসব উন্মাদ জেনারেলরা তাঁদের লুন্ঠনরাজ অব্যাহত রাখছিল যতক্ষণ না তাঁদের উর্ধ্বতন ক্ষমতার কেউ তাঁদের হয় বহিষ্কার করছে অথবা এই দুঃসাহসিক অভিযান স্থগিত করতে বাধ্য করছে। প্রবল ক্ষয়ক্ষতি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর তরুণ অফিসারদের মাঝে কিছুটা মতভেদ বৃদ্ধি করেছে। একটি অভ্যুত্থানে শাসিত করা যায় না। কিন্তু বিশ্ব তা হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে যেতে পারে না, কারণ কবে ঘটবে তা কেউই জানে না…
২০ জুলাই, ১৯৭১
একজন ভীতু ইয়াহিয়া যুদ্ধের হুমকি দিয়েছে। এই মরিয়া মানুষটি এই খেলায় তার আন্তর্জাতিক ছলচাতুরী ও প্রতারণার শেষ ট্রাম কার্ড নিয়ে এসেছে যখন থেকে সে বাংলাদেশে নিরপরাধ মানুষদের উপর তার আদিম দলটিকে গণহত্যার জন্য ছেড়ে দিয়েছে। ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস অব লন্ডনের সংবাদদাতাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি এভাবেই বলতে চেয়েছেন যে, যদি ভারত পূর্ব পাকিস্থানের কোন অংশ দখল করে তবে তিনি ভারতের সাথের যুদ্ধ শুরু করার হুমকি দিচ্ছেন। তিনি এমনকি এই ইঙ্গিতও দিয়েছেন যে যদি তিনি ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে তবে তিনি শুধু যে একা তা নয়, প্রকৃতপক্ষে,এটি অন্যান্য রাজনৈতিক সংকটেরই শাখাভুক্ত যা তিনি এবং তার সঙ্গীরা মার্চের এক তারিখ থেকেই করে আসছেন যেদিন তিনি পাকিস্তানে গণতন্ত্র পুনঃনির্গমন এর চুক্তি করে প্রাণঘাতী আঘাত করেছিলেন এবং ২৫ দিন পরের পূর্ণ বিঘটন এর পথ নিশ্চিত করেছিলেন।ইয়াহিয়ার ভয়প্রদর্শন চূড়ান্ত নৈরাশ্য প্রকাশ করছিলো যা সাধারণত স্নায়বিক স্বাস্থ্যভঙ্গ এর আবির্ভাব ঘটাকে অধিকতর প্রয়োজনীয় করে তোলে। এটি এখন আসলে জনসাধারণের অনিশ্চিত যুদ্ধ অবস্থানে প্রবেশ মাত্র। তিনি এখন স্বীকার করেছেন যে পাক সেনাবাহিনী বাংলাদেশের প্রকান্ড এলাকাজুড়ে নিজেদের কর্তৃত্ব হারিয়ে ফেলেছে।
বিভিন্ন সম্মুখভাগ এর প্রতিবেদন অনুসারে,পাকিস্তানী সেনাবাহিনী মুক্তিফৌজসমূহের বিশাল হামলার জন্য সকল সেক্টরে পিছু হটেছে। বিশেষ করে পশ্চিমা ভাগে পাক সেনাবাহিনীর অনেক বেশী সৈন্য নিহত বা আহত হয়েছেন এবং প্রায় পুরো কুষ্টিয়া জেলাই মুক্তিবাহিনী কর্তৃক পুনঃদখল করা হয়েছে। পর্যবেক্ষকরা বিশ্বাস করেন যে,এই ভাগে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী যেসব তাৎপর্যপূর্ণ হামলার ভেতর দিয়ে দিয়েছে তা মূলত ভারতে যুদ্ধের প্রতি ইয়াহিয়ার হুমকির কারণে হয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই তিনি যেসব স্থানে তার সামরিক বাহিনী মুক্তিবাহিনীর কাছে পরাজিত হয়েছে,তার কারণ হিসেবে ভারতেকে দোষী করছেন। তিনি কীভাবে মানবেন যে তার “অজেয়” সেনাবাহিনী বাংলাদেশী মুক্তিবাহিনীর পর্যাপ্ত অস্ত্রাদি বিহীন কিন্তু চমৎকারভাবে অনুপ্রাণিত যুবকদের সাথে করুণভাবে পরাজিত হচ্ছে? তার সেনাবাহিনী শক্তিশালী ভারতের কাছে পরাজিত হচ্ছে,এরূপ অভিনয় অন্তত তার নিজের বিবেক এর কাছে একটি কপট ছলনা ছাড়া কিছুই নয়। কিন্তু,পৃথিবীই ভালো জানে। অগণিত বিদেশী সাংবাদিক বাংলাদেশের মুক্তিপ্রাপ্ত এলাকাগুলো ঘুরে গিয়েছেন। তারা মাইলের পর মাইল বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পও পরিদর্শন করেছেন এবং সেনাপতি এবং সৈন্যদের সাথে কথা বলেছেন। বিদেশী টেলিভিশন নেটওয়ার্ক সমূহ যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর কর্মকান্ড ক্যামেরায় ধারণ করেছেন। তাদের প্রতিবেদনে খুব সহজেই প্রমাণ হয়ে যাবে যে মুক্তিযুদ্ধের সাথে ভারতের কোন সম্পর্ক নেই। যুদ্ধের আদর্শ সম্পূর্ণ ভাবে মেনে নিয়ে এই যুদ্ধ করছে শুধুমাত্র দেশপ্রেমিক বাংলাদেশীরা। তাদের অসাধারণ সাফল্যের কারণ গোলাবর্ষণ এর ক্ষমতা নয়,বরং এর পেছনে রয়েছে তাদের দেশপ্রেম। তারা তাদের মাতৃভূমিকে মুক্ত করার জন্য যুদ্ধ করছে।যদিও পাকিস্তানী আক্রমণকারীদের অস্ত্রসমৃদ্ধ অস্ত্রাগার আছে,তা কখনোই তাদের আত্মা এবং নীতির সাথে মিলবে নাহ।
কিন্তু ইয়াহিয়া এবং তার সঙ্গীরা নিজেদের মধ্যেই ডুবে ছিলেন বলে তাদের পক্ষে এটি বুঝে ওঠা সম্ভব হয়নি। যুদ্ধ তো আর কোন গোষ্ঠী বা তার পরিবারকে হুমকির মুখে ফেলেনি। একদিকে হাজার হাজার সৈন্য হাজার মাইল দূরে বাংলাদেশের জঙ্গলের কাদামাটির ভেতর তাদের প্রাণ বিসর্জন দিচ্ছে,আর অপরদিকে এসব কর্মকর্তারা অফিসারস মেস এর আরাম এবং আন্তর্জাতিক পতিতাদের সঙ্গ ভোগ করছেন। সুইস ব্যাংক তাদের নিজেদের সৌভাগ্যের নিরাপত্তার দিকে-সৌভাগ্য যা তারা আসন্ন বৃষ্টির দিনে বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানকে লুট করে সঞ্চয় করবে। যখন সৈন্যশ্রেনী তাদের ভয়ংকর উদ্দেশ্য আবিষ্কার করবে এবং পরিস্থিতি উত্তপ্ত হবে তখন তারা তাদের পরিবার নিয়ে সুইস ভিলার নিরাপত্তার উদ্দেশ্যে আকাশপথে গমন করবেন। অজ্ঞাত তথ্য হচ্ছে, ভারতের বিরুদ্ধে আক্রমণের সময় ইয়াহিয়া একা থাকবেন না, যা প্রমাণ করে তিনি এখনো স্কুলপড়ুয়া বালকটিই রয়ে গেছেন যার উপর কর্তৃত্ব খাটানো যায়। অবশ্যই তিনি ভুলে গেছেন যে,চীন কখনোই কোরিয়ার পর তার সীমান্তের বাইরে আসার সাহস করেনি। এমনকি লাওসের যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য পাওয়া আক্রমণ ও তাকে নাড়াতে পারেনি। সে ভারতের সাথে সরাসরি মিলিটারী আক্রমণে শুধুমাত্র ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তাকে তুষ্ট করতে আসবে কীনা,এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া খুব বেশী কষ্টকর নয়।
অপরদিকে,ভারত এই উশৃঙ্খল বলশালী সৈন্যবাহিনী এবং ইয়াহিয়ার মত ভয়ানক ভয়ার্ত দলপতিকে ভয় পাচ্ছে নাহ।যাই হোক,ইয়াহিয়ার নিজেকে ফাঁকি দেওয়া ধারণা যে,ভারতের কোন বন্ধু নেই;আবারো তার রাজনৈতিক ধারণা কীরূপ তার দিকে সম্পূর্ণভাবে ইঙ্গিত করে।
৮ আগস্ট,১৯৭১
নয়া দিল্লীতে সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রেই গ্রোমিকোর গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাৎকারের সঙ্গে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লড়াই এর চূড়ান্ত দশা শুরু হয়। সোভিয়েত সরকারের জনশ্রুতি ভারত-এর জন্য তার সমর্থন সম্পর্কে স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছে যদি ইসলামাবাদ সামরিক জান্তা এবং চীনা অনুমোদন এইটি উন্মত্তবৎ ভারতের বিরুদ্ধে আত্মঘাতী প্রচেষ্টায় যুদ্ধ ঘোষণা করতে বেছে নেয় এবং বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর উপর নির্ভর করে বাংলাদেশে সামরিক পরাজয় এড়াতে পারে। সোভিয়েত সরকারের এই বদ্ধপরিকর অবস্থানে নিক্সন এবং লিন পিয়াও উভয়ই ইয়াহিয়া ও তার সহযোগীর কুশ্রী মুখ রক্ষা করার জন্য ভয়াবহ ফলাফল এর সঙ্গে একটি বিশ্বযুদ্ধ ঝুঁকি নিতে রাজি হন না। অন্য কথায়, ইন্দো-ইসলামাবাদ সামরিক সংঘাতের সম্ভাবনা এখন একটি মহান চুক্তি প্রবর্তিত হয়েছে, এমনকি মনে হয় এটি কয়েক দিন আগে করেছেন।এবং এর মানে স্বাধীনতা সংগ্রামে বিপর্যয়কর একটি দৃশ্য সঙ্গে বাংলাদেশ বিষয়টি আন্তর্জাতিকীকরণ করতে ইয়াহিয়া জান্তার ব্যর্থতা।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন যে, চীনা, এমনকি এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের জেদ ধরে থাকা নতুন সপ্তাহে বাংলাদেশ, পশ্চিম পাকিস্তান ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভবিষ্যতের জন্য গুণগত পরিবর্তনের সম্মুখীন হতে পারে যা বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ইসলামাবাদ জান্তার প্রতি আমেরিকান সামরিক এবং অর্থনৈতিক সাহায্যের বিরুদ্ধে ভারতীয় প্রতিবাদ এর নিশ্চিত প্রভাব নিক্সন সরকার এর উপর রয়েছে। ভারত ওয়াশিংটনকে জানিয়েছে যে আমেরিকাকে সমর্থনের কারণে ইয়াহিয়ার যুদ্ধ হুমকি ছিলো সরাসরি পরিণতি। ভারতের এরূপ প্রকাশ্যে নিন্দা জ্ঞাপন নিশ্চিতভাবেই আমেরিকার ঘরোয়া রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য প্রাভেব ফেলবে। ভারত যখন স্পষ্টভাবে আমেরিকান প্রভাবক্ষেত্রের বাইরে চলছে, চীন তখনো যুদ্ধ থেকে পিছু হটছে না যতক্ষণ পর্যন্ত আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদ এখানে সম্পৃক্ত। সর্বশেষে আসছে, বাংলাদেশের মানুষদের প্রতি প্রেসিডেন্ট নিক্সন এর নিষ্ঠুর আচরণের কথা। যুক্তরাষ্ট্রে ইয়াহিয়া জান্তার গণহত্যার অপরাধে তুলনামূলকভাবে কম প্রচার সত্ত্বেও রাজনৈতিকভাবে সচেতন সাধারণ মানুষ নিক্সন আর হত্যাকারীদের একতা দেখে মর্মাহত হয়। ভিয়েতনাম যুদ্ধের থেঁতলে যাওয়া বিবেক এর উপরে এটি আরো একটি বোঝা হিসেবেই প্রমাণিত হয়। নিক্সনের চীন দখলের বেপরোয়া চেষ্টার সময় পাকিস্তানী ফ্যাসিবাদীদের প্রতি বিশ্বাস আনার জন্য মিডিয়াতে প্রচারণা চালানোর টুকু সময় ছিলো না। এখন যদি ইয়াহিয়া শাসন এর হুমকী মোতাবেক শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়, যেখানে নিক্সন সহজেই তাঁর মুক্তি এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারতেন, তাহলে তার মানে দাঁড়াবে নিক্সন এর আর ফিরে আসার কোন পথ থাকল না। এমন একটি খারাপ রেকর্ড সঙ্গে নিয়ে নিক্সন নিশ্চয় ১৯৭২ রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে একজন খুব খারাপ প্রার্থী প্রমাণিত হবেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
<005.020.427>
এটা এমন নয় যে নিক্সন গত কয়েক সপ্তাহে যে বিশৃঙ্খলায় নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছেন তা তিনি বুঝেন নি। রিপাবলিকানদের হয়ে তার রাজনৈতিক দুর্যোগ ঠেকাতে যা তার কৌশল হতে পারত। স্বাধীনতার পরপরই বাংলাদেশের জন্য রাজনৈতিক সমাধান খোঁজা এবং এতে শেখ মুজিবের সম্মতি আদায় করা সম্ভবত তার প্রথম পদক্ষেপ হত। ইয়াহিয়া জান্তা দৃশ্যপট এতই বিশৃঙ্খল করেছিল যে তা কনফারেন্স টেবিলে উপস্থাপন যোগ্য ছিল না। সিআইএ কে তাদের প্রিয় খেলায় ফিরতে দেখে এবং তথাকথিত মধ্যপন্থী জেনারেলদের দ্বারা রাষ্ট্রদ্রোহ ঘটিয়ে সরকার উৎখাত করতে দেখে কারো অবাক হওয়া উচিত নয়।
তখনো বাংলাদেশে অবস্থানরত আমেরিকান কর্মকর্তাদের মাঠ প্রতিবেদন নিশ্চয় তাকে তা উপলব্ধি করিয়েছিল যে বাংলাদেশে ধরা খাওয়া পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জয় দূরের কথা সামরিক পরাজয় আসন্ন। যদি নিক্সন সেখানে অবস্থানরত বেচে থাকা সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের রক্ষা করতে পারেন তবে পাকিস্তান বিশুদ্ধ কৃতজ্ঞতা স্বরুপ যুক্তরাষ্ট্রের বহিঃরজ্জুতে আবদ্ধ থাকবে।
অন্যদিকে ইস্যুটিতে চীনাদের অবস্থান অনমনীয় নেই। পিকিং রেডিও অস্বাভাবিক দীর্ঘ সময়ের জন্য বিষয়টির ব্যাপারে নীরব থাকে। পাকিস্তানী জান্তাদের জন্য সর্বশেষ আমেরিকান পূর্ণ সমর্থন তাদেরকে অবশ্যই বাস্তবতায় ফিরিয়ে আনে, তারা বুঝতে পারে সিনো-পাক বন্ধুত্ব শুধুমাত্র ভারতের প্রতি তাদের উভয়ের সাধারণ ঘৃণার উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে। সব অস্ত্র ও সুদ বিহিন অর্থ সাহায্য দেওয়া স্বত্বেও পাকিস্তান হোয়াইট হাউজের কাছে সবসময় শিশুই রয়ে গেছে। এই বাস্তবতা পিকিংয়ের বৈদেশিক বিশেষজ্ঞদের কাছে বরং অবশ্যই বিরক্তিকর ঠেকছে। সম্প্রতি, স্পষ্ট প্রতীয়মান ব্যাপারগুলো ভারতের প্রতি চীনাদের মনোভাবকে অভিযুক্ত করে। আমেরিকার সাথে বন্ধুত্বের ব্যাপারে ভারতের মোহ মুক্তির পর ইন্দো-চীনা সম্পর্ক নতুন পর্যায়ে উন্নীত হতে পারে, কেননা এখন পর্যন্ত চীনাদের কাছে সবচেয়ে বড় ব্যাপার হল ইন্দো-আমেরিকান বোঝাপড়ার। এদিকে, ক্ষমতাসীন কংগ্রেস সহ প্রায় সব রাজনৈতিক দলই ইন্দো-চীনা নীরব সংঘর্ষ পূণর্মূল্যায়নের পক্ষে মত প্রকাশ করছে। এইসব নতুন ঘটনা আন্তর্জাতিক আবহ বাংলাদেশের পক্ষে থাকবে এরূপ ভবিষ্যদ্বাণী প্রদানে নিশ্চিত ভাবেই উৎসাহ দেয়। যুদ্ধ ক্ষেত্রে মুক্তি বাহিনীর দর্শনীয় সাফল্য এবং বাংলাদেশে জায়গা দখল ও স্বাধীনকরণ এবং তা ধরে রাখার অবস্থানগত যুদ্ধে তাদের ক্রমাগত শক্তি ও সক্ষমতা বৃদ্ধি একাধিক দেশ কর্তৃক বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি প্রধানের সম্ভাবনা সৃষ্টি করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আগস্ট মাসটি অবশ্যই খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
১২ই আগস্ট, ১৯৭১
আমি আমার ভয় পুনরায় প্রকাশ না করে পারছি না। এই মুহূর্তে একমাত্র প্রশ্ন হল শেখ কি এখনো জীবিত? ইয়াহিয়ার হঠাৎ করে দেওয়া সবচেয়ে কমসময়ে সম্ভবপর- সঠিক ভাবে বললে ৪৮ ঘন্টার নোটিশে বিচারের তারিখ ঘোষণার পূর্বেই কি উন্মাদনাগ্রস্ত ব্যক্তিরা তাকে শেষ করেনি? কেন তারা তাড়াহুড়া করছে? শেখ পালিয়ে যাচ্ছে না! সে তাদের হাতে আছে এবং যুদ্ধক্ষেত্র থেকে অনেক দূরে আছে যেখানে পরাজয় পাক সেনাবাহিনীকে খুব ধীরে নয় কিন্তু অটলভাবে পূর্ণ করে দিচ্ছে। বিচারের সময় নির্ধারণে তাদের বিচার ব্যবস্থার উজ্জ্বলতা দেখানোর চেয়ে বড় কোন কারণ অবশ্যই লুকিয়ে আছে।
শেখ কে গ্রেফতার করার পর থেকেই নির্জন কারাগারে রাখা হচ্ছে। তাকে গ্রেফতার করা জঘন্য ব্যক্তিরা বাদে তাকে আর কেউ দেখেনি। অবশই, শহীদ সোহরাওয়ার্দীর কন্যা বেগম সুলাইমান, এবং বর্তমানে যে সামরিক জান্তাদের পক্ষ হয়ে দেশদ্রোহী, মে মাসের শেষের দিকে ঢাকায় দাবি করে যে খুনী জেনারেলগণ কর্তৃক উদ্ভাবিত আপস রফা পরিচালনা করার আমন্ত্রণ করার জন্য আটকের সামরিক জেলে সে শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে দেখা করেছে।
<005.020.428>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান যে, শেখ তাকে নিজের কাজে মন দিতে বলেছিলেন।এমনকি এই গল্প যদি সত্যি হয় তবে সাত সপ্তাহ ধরে এমন কারো সাথে শেখের যোগাযোগ হয়নি যে পৃথিবীকে তার শারীরিক ও মানসিক অবস্থার বর্ণনা দিতে পারবে। শুধু মাত্র ইয়াহিয়া নিজে এক বিদেশি সাংবাদিকের সাথে স্বীকার করেছে যে সেনাবাহিনীর সরবরাহকৃত খাদ্য অনুপভোগ্য হওয়ায় শেখের স্বাস্থ্য ভালো না।
গুজব ছিল্ যে বঙ্গবন্ধু অমানবিক অত্যাচারের শিকার হয়েছেন। এই গুজব সত্যি হলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এটা সর্বসাধারণে বিদিত ছিল যে ইয়াহিয়া তার সাহস কে ঘৃণা করত।সভ্যতার চেতনা শূন্যব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ঔদ্ধত্যে প্রশিক্ষিত একজন ব্যক্তির জন্য নিরস্ত্র শেখকে হুমকি ধামকিতে বাগে আনার ও সামরিক হুমকিতে আত্মসমর্পণ করানোর ব্যর্থতা ইয়াহিয়ার ভঙ্গুর ধৈর্যকে শেষ করে দিয়েছে।
সংখ্যা গরিষ্ঠ দলের নেতাকে পুরোপুরি অবহেলা করে ভুট্টুর পরামর্শে জাতীয় সংসদ স্থগিতাদেশের পর তার বক্তব্য গুলোকে এই বিষয়ে উল্লেখ করা যায়। সে ভুট্টুর সাথে তথাকথিত ‘ঐক্য’ তৈরির ব্যর্থতার জন্য শেখকে অভিযুক্ত করে কিন্তু রাগের কারণে ভদ্রতা ভুলে গেছে। যখন সে খলনায়ক হিসেবে ভুট্টুকে মি. ভুট্টু হিসেবে উল্লেখ করেছিল সেখানে সে শেখকে মুজিব হিসেবে উল্লেখ করেছে। ব্রিটিশ রীতির সেনা মেসে বেড়ে উঠা ব্যক্তির জন্য এটি অসতর্কতাজনিত ভুল নয়। এটি সহজেই বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্বের প্রতি তার বিরাগকে ফাঁস করে দেয়। ৬ মার্চ তার পরবর্তী বক্তব্যে যেখানে সে ২৫শে মার্চ জাতীয় সংসদের অধিবেশন ডাকার বিষয়ে অনিচ্ছায় অনুমোদন করে সেখানেও সে পুনরায় একইভাবে শেখকে অপমান করে, প্রকৃতপক্ষে তখন সে বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণের সময় ক্রুদ্ধতা প্রকাশ করে। ২৬শে মার্চের ভাষণে তার বাজে আচরণের পুনরাবৃতি লক্ষ্য করি। এটা স্পষ্ট ছিল শেখের মৃত্যুই তাকে সবচেয়ে বেশি খুশি করতে পারত।
ইচ্ছাকৃতভাবে ফাঁসকৃত তথ্যে জানা যায় যে শেখ তার পক্ষে কৌঁসুলি গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান যা তাদের অসাধুতার ব্যাপারে সন্দেহ বাড়িয়ে দেয়। শেখের সাথে বহির্বিশ্বের কোন যোগাযোগ ছিলনা। ইয়াহিয়ার সহায়তা ছাড়া কিভাবে আত্মপক্ষ সমর্থনের অস্বীকৃতির গল্প বিশ্ব সংবাদ হয়ে যায়? যদি ইতিমধ্যে ঘটে যাওয়া অপরাধ লুকানোর জন্য এই তথাকথিত বিচার আয়োজন করা হয় তবে এই ‘অস্বীকৃতির গল্প’ কি খুবই কাজের হয়না? বিশেষ করে সবাই যখন জানে যে বৈদেশিক সামরিক আদালতে বিচার করতে শেখ কখনো একমত হবেন না। এই রহস্য আরো জোড়াল হয় যখন জানা যায় যে এপ্রিল থেকে সন্তানসহ গৃহবন্দী থাকা বেগম মুজিবুর রহমানকে ঢাকা থেকে করাচি নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তার পরিবারকেও কি শেষ করে দেয়া হয়েছে? মধ্যযুগীয় ভয়ঙ্কর গল্পের মত কোন অপরাধ ঘটানো তাদের পক্ষে অসম্ভব নয়।
বিশ্ব জুড়ে নিন্দা ও তাদের পরামর্শদাতা যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক ভয়ের উপর জোর দিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ সত্ত্বেও জান্তা এই অবৈধ বিচার চালিয়ে যায়। যদি এটি সত্য হয় তবে এটা প্রমাণিত হয় যে ইয়াহিয়া বিদেশি সংবাদকে ধোঁয়াশায় রাখছে যখন তার জল্লাদরা শেখ মুজিবের গলায় দড়ি পড়াচ্ছে। এই অপরাধের ব্যাপারে নিক্সনের প্রতিক্রিয়া কৌতূহলোদ্দীপক হবে। জান্তাকে সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা অব্যাহত রাখার জন্য সে অজুহাত দেখাচ্ছিল যে যুক্তরাষ্ট্র সরকার এই পথে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমঝোতার উপর আকাঙ্ক্ষিত উদ্দেশ্য সাধন করতে পারবে। যতদিন পর্যন্ত শেখ বেচে থাকবে ও বন্দী থাকবে ততদিন পর্যন্ত এই অজুহাত কভার আপ নকশা হিসেবে সুবিধা জনক। কিন্তু তাকে ছাড়া সে সঙ্কটে পড়ে যাবে।
<005.020.429>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
আন্তর্জাতিক ক্ষমতার খেলায় তিনি করুণ ভাবে হেরেছেন যেহেতু তার ভোটারদেরকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্রের বিপরীতে দেখানোর জন্য তার কাছে শুধুমাত্র একটি পিংপং বল আছে। নিক্সন এবং ইসলামাবাদে তার আশ্রিতদের জন্য শেখের মৃত্যু দুর্যোগ নিয়ে আসবে।
কেননা বাংলাদেশের জনগণ তার মৃত্যুর সন্তোষজনক প্রতিশোধ না নেওয়া পর্যন্ত বিশ্রাম নেবে না।
হাজারে একবারও যদি বঙ্গবন্ধুর বেচে থাকার সুযোগ থাকে তবে বিশ্ব ক্ষমতার উচিত দেরি হওয়ার পূর্বেই এই প্রহসনের বিচার বন্ধ করা।
১৭ আগস্ট, ১৯৭১
ইসলামবাদের খবর সমূহ ধারণা দেয় যে ইয়াহিয়া টিক্কা খানের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছেন। ইসলামাবাদ যেটাকে তার পূর্ব উপনিবেশ হিসেবে মনে করত এই উন্মাদ খুনি নিজেকে জন সম্মুখে সেটার অদ্বিতীয় শাসক ঘোষণা করাই বাকি রেখেছিল। এখন ইয়াহিয়া ঢাকায় আসতে ভয় পায়। অন্যদিকে টিক্কাও হঠাত গ্রেফতারের ভয়ে ইসলামাবাদ ভ্রমন করতে ভয় পাচ্ছে। ইয়াহিয়া বাংলাদেশে দখল কৃত জায়গা ভ্রমনে তার বহুল প্রচারিত সফর দ্বিতীয়বারের মত বাদ দেয়, শেখ মুজিবুর রহমান ও বাংলাদেশের জনগনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতার পর যেখানে ভ্রমন করার সাহস সে পায় না এবং রাতের আধারে চোরের মত সে ঢাকা থেকে পালিয়ে গিয়েছে। দুই সপ্তাহ আগে সে কিছু সংখ্যক বিদেশি সাংবাদিককে বলেছিলেন তার পাশে থাকতে যদি তারা তার ঢাকা সফরে সঙ্গী হতে চায়। তাদের অনেকে এখনো মুখে কুলুপ এঁটে তার পাশে আছে। এইদিকে কিছুদিন আগে ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিত জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের সভায় টিক্কা খান লক্ষণীয়ভাবে অনুপস্থিত ছিল।
এটাও লক্ষনীয় যে ১৪ই আগস্ট ইয়াহিয়া রুটিন মাফিক টিক্কাকে হিলাল-ই-কায়েদ-ই-আজম উপাধিতে ভূষিত করে। যদি তাদের সম্পর্ক ভালো থাকত তবে পাকিস্তান ধ্বংসের মত ঐতিহাসিক কার্য সমাধার জন্য তাকে নিশ্চিতভাবেই হিলাল-ই-পাকিস্তান উপাধি দিত। এটা অবশ্যই সম্ভব যে ইয়াহিয়া পদকটি নিজের জন্য রেখে দিয়েছে।
টিক্কা তার অপরাধের বিপরীতে বিশ্ব প্রতিক্রিয়া কি হবে তা সম্পূর্ণভাবে বুঝতে পারার অভাবেই এই দুর্বৃত্তদের মাঝে ফাটল ধরেছে। সে ইয়াহিয়াকে বিশ্বাস করিয়েছে যে পূর্বের পরিস্থিতি স্বাভাবিক এবং পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য সে যেকোন সংখ্যক সাংবাদিক পাঠাতে পারে। সম্ভবত সে ভেবেছিল যে, পশ্চিম পাকিস্তানি ভাড়াটেদের মত সেনা মেসে মদ ও নৈশাহারের বিনিময়ে এই সাংবাদিকদেরও কেনা যাবে। সম্ভবত তারাও তোতাপাখির (চমকপ্রদভাবে এন্থনি মাস্কারেনহাস ব্যতিক্রম ছিল) মত তার বানানো গল্প বলত। সত্যবাদী বোকার মত ইয়াহিয়া তাকে বিশ্বাস করে সাংবাদিকদের পাঠিয়ে ছিল যারা যথা সময়ে টিক্কার মিথ্যাগুলো ফাঁস করে দেয়। দৃশ্যতই এটি ইয়াহিয়াকে বিরক্ত করে যে সাংবাদিকদের বাইরে রাখতে চেয়েছিল বিশেষ করে যখন শুধু মাত্র ঢাকায় কতগুলো স্থাপনা মেরামত করার মাধ্যমে বাংলাদেশীদের মাঝে চালানো নগ্ন হামলা লুকান যাবে না। সে আশা করেছিল টিক্কা ইসলামাবাদে আসলে তার ব্যয়বহুল ভুলের জন্য শাস্তি দিতে পারবেন। কিন্তু তখন টিক্কা রাষ্ট্র পরিষদে তার বন্ধুদের মাধ্যমে এটার গন্ধ পায় এবং ইসলামাবাদের বাইরে থাকে।
<005.020.430>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
এখন সে এই ভেবে চিন্তা না করে পারছিল না যদি ঢাকা সফরের সূচী ঠিক রাখতে বারবার ব্যর্থ হবার ফলে ইয়াহিয়া’র আন্তর্জাতিক অবস্থান দ্বিগুণ হাস্যকর হয়ে যায়।
একটা ব্যাপার নিশ্চিৎ যে এই জুটি আর টিকতে পারবে না। হয় টিক্কা যাবে, নাহয় ইয়াহিয়া যাবে। বাহ্যত, প্রেসিডেন্ট নিক্সন চায় যে তারা উভয়েই ক্ষমতা ছেড়ে যাক এবং এমন আমেরিকাপন্থী জেনারেল ক্ষমতায় আসুক যারা শেখ মুজিবের সাথে সমঝোতায় পৌঁছাতে দ্বিধা করবে না। প্রেসিডেন্ট স্পষ্ট ভাবেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে কিন্তু পাকিস্তানের কাঠামোর ভিতরে একটা রাজনৈতিক সমঝোতা দেখে খুশিই হবেন যা এখন বাংলাদেশের মানুষের নিকট সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য।
১৮ই আগস্ট, ১৯৭১
সর্বশেষ খবর অনুসারে যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাকিস্তানি দুতগণকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। এটা জানা যায়নি যে তাদেরকে বহিস্কার করা হয়েছে অথবা ইসলামাবাদে সচিবদের গুদামে বিদেশ বিষয়ক তুচ্ছ কোন প্রকল্পে নিয়োগ করা হয়েছে কিনা। তাদের কপালে যাই ঘটুক এটা পরিষ্কার যে কোন প্রতিফল ছাড়াই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যে বিশৃংখলা তৈরি করেছে তার ফলে এই দুর্বৃত্তের দল পাগল হয়ে গেছে।
ওয়াশিংটন ও ব্রিটেনে ইয়াহিয়ার লোক আগা হিলালি ও সালমান আলি ও তার সমর্থকদের ব্যর্থতা হচ্ছে তারা যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের কোন পত্রিকায় বাংলাদেশে ইয়াহিয়ার অপরাধের পক্ষে কোন লেখা প্রকাশ করতে পারেনি, তাই তারা পেটে গুঁতো খেয়েছে। ঈশ্বরের কসম তারা কি চেষ্টা করেনি? আমেরিকানরা বাদে সালমান আলি ও তার মত কূটনীতিকদের জন্য ব্রিটিশ সংবাদ পত্রে এমন কিচ্ছু প্রকাশ করা খুবই কঠিন যাতে সম্পাদকরা একমত হয় না। দুর্বল সালমান তা জানত তাই সে প্রাথমিক ব্যর্থতার পরেই সেই নিস্ফল প্রচেষ্টা বাদ দেয়। কিন্তু হিলালি প্রকৃতিতে ভিন্ন ধরণের লোক। সে এমন ধরণের প্রাণী যে সাধারণ এক শব্দের না তার উদ্যম কমানোর জন্য যথেষ্ট না। তার উপর, সে ঘটনাক্রমে পুর্ব পাকিস্তানের অধিবাসি। যদিও সে বাংলায় একটি শব্দও বলতে পারে না তবুও সে রাষ্ট্রদূতের পদ দখল করেছে বাঙ্গালি কোটায়। সে মূলত মাদ্রাজ হতে উদ্বাস্তু হলেও বিদেশী অফিসে পাঞ্জাবি গোষ্ঠীর একজন হতে পারেনি। সে যদি বাঙালি কোটা বাণিজ্যের না হত তবে অনেক আগেই তাকে সরিয়ে দেওয়া হত। যখন ইয়াহিয়া গণহত্যা চালাচ্ছিল তখন সে নিজের টিকে থাকার জন্য একে প্রশ্রয় দিয়েছে এবং ঘন ঘন ও জোরে জোরে এই অপরাধের পক্ষে হ্যাঁ হ্যাঁ বলেছে যেন প্রমাণ করা যায় সে যাই হোক বাঙালি নয়। সে টিভিতে আমেরিকান দর্শকদের সামনে স্কুল ছাত্রের মত ঘ্যানঘ্যান করে অভিযোগ করে যে আমেরিকান সংবাদ পত্র তার কথা শুনে না এবং তার সংবাদ বিজ্ঞপ্তিগুলো প্রকাশ করে না। এগুলো এমন করুণ ঘটনা ছিল যে ইসলামাবাদের গ্রাম্য স্বৈরাচারও লজ্জিত বোধ করেছে। এবং পাঞ্জাবি গোষ্ঠীও তার থেকে মুক্তি পাওয়ার অপেক্ষা করছিল।
কিন্তু তাদের উত্তরসুরিরাও কি এর চেয়ে ভাল করতে পারবে? কিভাবে একজন এমন জঘন্য বিষয়ের পক্ষ সমর্থন করবে? সর্বোপরি, পাকিস্তানের সীমানা ও লিনপিয়াও এর চীনের বাইরে একটা আদর্শ সভ্যতার অস্তিত্ব রয়েছে। কমপক্ষে এক মিলিয়ন জীবনের রক্তে সিক্ত পাটবস্ত্র স্নো হোয়াইট বলে উপস্থাপন করা অসম্ভব।
<005.020.431>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
২০ আগস্ট, ১৯৭১
২৫ মার্চে স্বেচ্ছায় গ্রেফতার হওয়া শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্য ও প্রকৃত হদিস এখনো রহস্যের বেড়াজালে আবৃত। যদিও বিতর্কিত চরিত্র যেমন বেগম আখতার সুলেমান দাবি করেছেন যে তিনি জেলখানায় তাকে দেখতে গিয়েছিলেন তবুও গ্রেফতারের রাত থেকে মনোবিকারগ্রস্ত খুনি টিক্কা খানের ক্রোধ থেকে এখনো তিনি বেচে আছেন কিনা তার অকাট্য প্রমাণ একটিও নেই।
বন্দুকবাজ জান্তার কাছের সুত্রদের দ্বারা ইচ্ছাকৃতভাবে ফাঁস হওয়া খবর সমূহ বিশ্বকে আজ পর্যন্ত অনিশ্চিত ধারণায় নিমজ্জিত রাখছে। জান্তার দপ্তর থেকে আসা একান্ত ও অন্তর্নিহিত নেতিবাচক প্রতিক্রিয়াটি ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের নিরাপত্তা নিয়ে জাতিসংঘের মহাসচিব কর্তৃক জনসম্মুখে উদ্বেগ প্রকাশকে নগ্ন সমালোচনা করার প্রচেষ্টা। উ থান্ট এবং অন্যান্য বিশ্ব ব্যক্তিগণ এই বিচার প্রক্রিয়া যার রায় কৌঁসুলি তথা বিচারক তথা ঘাতক ইয়াহিয়া তার অনেক সাক্ষাতে বিদেশি সাংবাদিকদের কাছে প্রকাশ করেছেন তা সভ্যতার আদর্শ ও চেতনার উপর আরো একটি আঘাত বলে বিবেচনা করেছেন। আমেরিকান ও চীনাদের চাপ সত্ত্বেও উ থান্ট এই ক্ষেত্রে তার জঘন্য নীরবতা বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন (বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের চালানো গণহত্যার প্রথম সপ্তাহে তিনি নীরব ছিলেন- যে নীরবতা রক্তপিপাসু জেনারেলদেরকে ভয়ঙ্করভাবে শেখের জীবন নিতে উৎসাহ দেয়)। পাকিস্তানের বিদেশ বিষয়ক দপ্তর ধৃষ্টতার সাথে মহাসচিবকে দেখিয়ে দেয় যে উত্তর আয়ারল্যান্ডে ব্রিটিশ গণহত্যার সময় তিনি নীরব ছিলেন। এর দ্বারা পাকিস্তানিরা বুঝাতে চেয়েছিল যে বাংলাদেশে তাদের অপরাধের ব্যাপারে জাতি সংঘের নিষ্ক্রিয় থাকা তাদেরও অধিকার। এটা এমন যে এক খুনি আরেক খুনির বেচে যাওয়াকে উদাহরণ দিয়ে নিজেকে নির্দোষ দাবি করে। এই মনোভাব তাদের লজ্জাহীনতার স্তর প্রকাশ করে এবং দেখায় যে তারা কতটা নীচ হতে পারে।
এমনকি সবচেয়ে বড় অবমাননা হল এই হিটলার ও মার্কো দে সেইদ এর সন্তানেরা তাদের অপরাধী মনোবিকারকে অনেক দূর নিয়ে গেছে। বিশ্ব কি এতই ক্ষমতাহীন যে তারা এই ধরা থেকে এসব কুৎসিত বস্তুকে সরিয়ে দিতে পারছে না এবং একে মানুষের জন্য আরো বাসযোগ্য করতে পারছে না? যুক্তরাষ্ট্র ও চীনসহ বিশ্ব ক্ষমতা কি এতই বিবেকহীন ও অন্ধ যে তারা তুচ্ছ জাতীয় স্বার্থের জন্য এই অপরাধেসাহযোগী হওয়া অথবা নীরব দর্শক হওয়ার খেলা খেলবে?এই সংঘর্ষের প্রথম দলকে ভুলে তৃতীয়, চতুর্থ এবং পঞ্চম দলেরসাথে চুক্তি করা বাদে কি বাংলাদেশের জনগণ ও তার অবিসংবাদিত নেতার প্রতি সোভিয়েত ইউনিয়নের আরো বড় দায়িত্ব নেই?
ধারণা করে নেই যে খুনিরা শেখ মুজিবকে এখনো জীবিত রেখেছে। আমি একথা বলছি এই জন্যে যে, অন্য একটা খবরে জানা গেছে শেখ মুজিবঅত্যাচারিত হয়েছেন যা তথাকথিত বিচারের আদালতে কক্ষে তার ভেঙ্গে পড়ার কারণ। এখন, বিশ্ব নিন্দাকে কলা দেখিয়ে ইয়াহিয়া যদি নেতাকে শেষ করার পথে এগিয়ে যায় তখন বিশ্ব ক্ষমতাধারীরা কী করবে? শুধু কথার বাহিরে অর্থবহ কোনকিছু কী তারা করবে? এই ঘৃণ্য দুঃখজনক ঘটনার পর্যবেক্ষকদের মনে এই প্রশ্নটিই প্রাধান্য বিস্তার করছে।
যদি বিশ্ব ইসলামাবাদের খুনিদের মত ভাবে, শেখ মুজিবের খুন বাঙালি জাতিকে দমিয়ে দিবে এবং সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে তাহলে তারা বোকার স্বর্গে বাস করছে। মহা ক্ষমতাধরদের আবার মনে করিয়ে দেই বাংলাদেশ বায়াফ্রা কিংবা কঙ্গো নয়। পুরো জাতি ভয়ঙ্কর উন্মাদ, সামন্তবাদী এবং ফ্যাসিবাদী সামরিক রাষ্ট্রযন্ত্র এর অন্যায্য ও অপ্রয়োজনীয় যুদ্ধের দ্বারা আঘাত পেয়েছে।
<005.020.432-433>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
২০/ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত ইংরেজি অনুষ্ঠান : নিউজ কমেন্টারি | স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের দলিল পত্র | জুন-সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ |
নিউজ কমেন্টারি
[ অনুবাদকের ভাষ্য: পূর্ব পৃষ্ঠা থেকে]
হিংস্র, ধর্মান্ধ, ফ্যাসিবাদী ও সামন্তবাদী সামরিকজান্তার অঘোষিত অনৈতিক যুদ্ধ আঘাত করেছে সমগ্র জাতিকে। আমাদের স্বাধীনতার জন্য আমরা সর্বাধিক মূল্য দিয়েছি। এখন আমরা উপলব্ধি করেছি, আমাদের টিকে থাকার একমাত্র শর্ত সম্পূর্ণ স্বাধীনতা, এর চেয়ে কম কিছু নয়। এবং আমরা স্বাধীনতা অর্জন করবই – নিজ শক্তিতেই অর্জন করব। আমরা বৃহৎ শক্তির কাছে সাহায্যও চাই না, অস্ত্রও চাই না। এই নরঘাতকরা যাতে অর্থ এবং অস্ত্র সাহায্য না পায়, আমরা শুধু এটুকু চাই। ইতিহাস এদের ক্ষমা করবে না।
২১ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
প্রায় দশ দিন চুপ করে থাকার পর পাকিস্তানি বেতার শেখ মুজিবুর রহমানের প্রহসনমূলক বিচার বিষয়ে আরও একটি নির্লজ্জ্ব মিথ্যা বক্তব্য প্রদান করেছে। গতকাল প্রচারিত সংবাদে দাবি করা হয়েছে যে, শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁর বিচার করার এখতিয়ারবিহীন আদালতে যিনি এর আগে আত্মপক্ষ সমর্থনে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন বলে এক সূত্রে প্রকাশ করা হয়েছিল, সেই একই সূত্রে প্রকাশ পেয়েছে যে তিনি তাঁর মামলায় লড়ার জন্য তিনজন আইনজীবীর একটি প্যানেল দাবি করেছেন। রেডিওতে আরও দাবি করা হয়েছে যে, শেখ সাহেবের কথিত পছন্দের তিনজন আইনজীবীর একজন এ কে ব্রহী তাঁর (রেডিওতে দাবিকৃত) পূর্বের অঙ্গীকারবদ্ধ মামলাগুলোর ব্রিফিং নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। রেডিও অসচেতনভাবে অন্য দু’জন আইনজীবীর নাম উল্লেখ করতে ভুলে গেছে। নাকি সেটা সচেতনভাবেই করা হয়েছে?
এ সংবাদটি, পাকিস্তানি সামরিকজান্তার পক্ষ থেকে যেটি বাংলাদেশে গণহত্যার অপরাধের বিষয়ে প্রদত্ত লিখিত বিবৃতির পরের জঘন্যতম মিথ্যাচার, এ প্রহসনমূলক বিচারে বিক্ষুব্ধ বিশ্ববাসীর মতামতকে ধোঁকা দেয়ার ষড়যন্ত্রের প্রয়োজনেই তৈরি করা হয়েছে। পূর্বে প্রকাশিত ‘মিথ্যা’, অর্থাৎ শেখ সাহেব আত্মপক্ষ সমর্থন করবেন না, এটিকে সামাল দেয়ার জন্য সর্বশেষ মিথ্যাচারটি তৈরি করা হয়েছে। আমাদের নেতা এ ধরণের বিচারের প্রস্তাবনার মুখোমুখি হলে কীরকম আচরণ করবেন সে সম্পর্কে আমরা যথেষ্ট অবগত। সামরিকজান্তার কেউ এটা জেনেশুনেই সারা বিশ্বকে এভাবে বোঝাতে চাচ্ছে যে শেখ সাহেব আসলে জীবিত আছেন, তিনি সচরাচর যেভাবে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতেন তেমনটি করানোর জন্য তাঁকে বন্দি করে রাখা অমানুষদেরকে অত্যাচারের আশ্রয় নিতে হয় নি।
কিন্তু জান্তারা একটা ভুল করে ফেলে। বার্তাটি প্রচারিত হবার পর সারা বিশ্বের সন্দেহের সম্মুখীন হয়েছে এটি। এমনটিও সন্দেহ করা হয়েছে যে শেখ সাহেবকে সম্ভবত মেরে ফেলা হয়েছে, এখন তাঁর এ অস্বীকৃতি জানানোর খবরটি রটানো হয়েছে পুরো ব্যাপারটিকে সামরিক আবহ দেয়ার জন্য। এরকম সন্দেহ খুব সম্ভবত সেনাবাহিনীতে কর্মরত পেশাদার মিথ্যাবাদীদেরকে গতিপথ পাল্টাতে বাধ্য করেছে। তারা খুব শীঘ্রই শেখ মুজিবের মামলায় লড়ার সিদ্ধান্তের গল্প ফেঁদে বসে।
ব্রোহীর শেখ মুজিবের পক্ষে লড়তে অস্বীকৃতি জানানোর খবরটিও বেশ বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়। ব্রোহী, অথবা এ ক্ষেত্রে যে কারও জন্য দশ হাতের প্রয়োজন পড়বে শেখ মুজিবের মামলার ব্রিফ নেয়ার জন্য। কারণ তিনি আসামী পক্ষে উপদেষ্টার দায়িত্ব পালনে পেশাগত সততা দেখাতে গিয়ে প্রায় নিশ্চিতভাবেই বিশাল বিপদে পড়বেন। এমনকি রহস্যজনক মৃত্যুর শিকারও হতে পারেন তিনি। ব্রোহী এ মূহুর্তে শেখ মুজিবের সাহায্যে এগিয়ে আসবেন না। এমনকি, যখন আইয়ুবশাহী শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে, তখনও তিনি বিবাদী পক্ষের কৌসুলী হিসেবে দাঁড়াতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। এ থেকে বোঝাই যায়, ইয়াহিয়ার খোঁড়া ঘোড়ায় সওয়ার হবেন এমন বোকা তিনি নন। যদি ধরে নেয়া যায় যে শেখ মুজিব জীবিত রয়েছেন এবং হোয়াইট হাউজ থেকে ক্রেমলিনে, মহাসচিব উ থান্ট থেকে খান আবদুল গাফফার খান, পৃথিবীর যেখানেই এ বিচার করা হোক না কেন, ইয়াহিয়ার সেনা জান্তাকে সবদিক সামাল দেয়ার জন্য বিবাদী পক্ষে একজন কৌসুলী নিয়োগ দিতেই হবে। আইনানুসারে, যে মামলায় আসামীপক্ষের মৃত্যুদণ্ড হতে পারে, সেক্ষেত্রে আসামীপক্ষকে দরকার হলে রাষ্ট্রপক্ষের খরচে একজন কৌসুলী দিতে হবে। আসামীপক্ষের পছন্দ হোক না হোক, বিবাদী পক্ষের কৌসুলী থাকবেই।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা এখনও এমন কোন বাস্তব প্রমাণ পান নি যা থেকে আশা করা যায় যে শেখ মুজিবকে এখনও মেরে ফেলা হয় নি। এমনকি শেখ মুজিবের বিবাদী প্যানেল বাছাই করা সংক্রান্ত সর্বশেষ মিথ্যাচার থেকেও এমনটা প্রমাণিত হয় না যে তিনি বেঁচে আছেন। পাকিস্তান রেডিও আরও দু’জন আইনজীবীর নাম উল্লেখ করেছে, যারা হয়তো এ প্রহসনমূলক বিচারে জান্তার সাথে সহযোগিতা করবেন। শেখ মুজিবুর রহমানের প্রাণদণ্ড কার্যকর করার আগে ন্যায়বিচার দাবি করে এমন দলিলপত্রে স্বাক্ষর করতে সেনাবাহিনী তাঁদেরকে ব্যবহার করবে। এটা খুবই সম্ভব যে, এ ব্যক্তিরা বেঁচে থাকলে এ ঘটনার বেশি এক্সপোজার ঘটবে, এমন ঝুঁকি সেনাবাহিনী নেবে না। এটাই হচ্ছে খুনের রাজনীতির অসঙ্গতি, খুন না করে পার পাওয়া অসম্ভব।
সারা বিশ্বকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে চাপ দিয়ে সত্য প্রকাশে বাধ্য করতে হবে। যদি শেখ মুজিব বেঁচে থাকেন, তাহলে বিশ্বকে চাপ প্রয়োগ করতে হবে যাতে করে তাঁকে সেনাবাহিনী ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।
<005.021.434-436>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
২১। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রচারিত ইংরেজী অনুষ্ঠানঃ ওয়ার্ড প্রেস রিভিউ অন বাংলাদেশ |
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের দলিলপত্র | জুলাই-ডিসেম্বর, ১৯৭১ |
২৫ জুলাই, ১৯৭১
২৫ জুলাই, ১৯৭১
পূর্ব বাংলার জনগণকে দমন করে রাখার জন্য সহিংসতা ও হত্যার যে নীতি ইসলামাবাদভিত্তিক সামরিক শাসকরা বেছে গ্রহণ করেছিল, সেটি উল্টো তাদের পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শান্তিপূর্ণ সমঝোতার পথ পরিহার করে, বন্দুকধারী পশ্চিম পাকিস্তানি জেনারেলরা নিরীহস্বভাবের, পরিশীলিত এবং শান্তিপ্রিয় পূর্ব বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। কেন? কারণ, দশকব্যাপী পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাতান্ত্রিক এবং আমলাতান্ত্রিক শাসকদের হাতে চলতে থাকা ঔপনিবেশিক শোষণের সমাপ্তি ঘটিয়ে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করে জনগণ নিজেদের প্রদেশ তাদের ইচ্ছানুযায়ী চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পূর্ব বাংলার মিলিটারি গভর্নর, জেনারেল টিক্কা খান বুক ফুলিয়ে বলেছিলেন, তিনি ছয় দিনে বাংলাদেশের জনগণকে দমন করবেন। সে ছয়টি দিন শেষ হয়ে আরও ৩ মাস পেরিয়ে গিয়েছে, জনগণকে দাবিয়ে রাখা যায় নি। ইসলামাবাদের ‘সাহসী’ জেনারেলরা যে যুদ্ধ শুরু করেছিলেন, সেটি শুধুমাত্র সশস্ত্র বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধেই ছিল না, তা ছিল সমগ্র পূর্ব বাংলার জনগণের বিরুদ্ধে। নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিশেষে নিরস্ত্র বেসামরিক জনতার ওপর চালানো বর্বরতা সারা বিশ্বের কাছে প্রকাশিত হয়েছে, সামরিক জান্তার তৈরি করা ধূম্রজাল পুরোপুরি উবে গেছে। এখন সবাই জানে কীভাবে লক্ষাধিক শরণার্থী বাস্তুহারা হয়েছে। তারপরেও, বাংলাদেশে স্বাভাবিক অবস্থা রয়েছে বলে পাকিস্তানি প্রচারমাধ্যমের বারবার উল্লেখ করা এটাই দেখায় যে ইসলামাবাদ এখনও সারা বিশ্বকে এবং বিশেষ করে পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণকে মুক্তি ফৌজের তীব্র আক্রমণ সম্পর্কে জানাতে চাচ্ছে না। পশ্চিম জার্মানির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড: আর্নেস্ট হাইনসেন এবং ব্রিটিশ লেবার পার্টির সংসদসদস্য জনাব জন স্টোরহাউজ মুক্তাঞ্চলের বেশ কিছু অংশ ঘুরে এসেছেন। তাঁরা জানাচ্ছেন, সেখানে মুক্তিবাহিনীর কার্যক্রমে তাঁরা মুগ্ধ। ইতোমধ্যে মুক্তিবাহিনী তাদের কৌশল পুরোপুরি পালটে ফেলেছে, তাদের সাম্প্রতিক যুদ্ধগুলো থেকে বোঝা যায় যে তারা গেরিলাযুদ্ধের উন্নততর কলাকৌশলে দক্ষতা অর্জন করেছে। তারা তাদের পছন্দমত জায়গায় শত্রুদের অ্যামবুশ করে এবং হামলা করে। ব্রিজ, কালভার্ট, রেলওয়ে লাইন এবং অন্যান্য কৌশলগত স্থাপনাসমূহ ব্যাপকহারে উড়িয়ে দেয়া হয়েছে। কমান্ডাররা আর্টিলারি এবং মর্টারের ব্যবহার করছেন। মুক্তিবাহিনীর কার্যক্রম শুধুমাত্র গ্রামাঞ্চলেই সীমাবদ্ধ নয়। সম্প্রতি ঢাকা নগরের ভেতরে বেশ কয়েকটি গ্রেনেড হামলা হয়েছে। নগরে এবং এর উপকণ্ঠে সেনা ক্যাম্পে এবং সৈন্যদের অন্যান্য অবস্থানে দৈনিক অন্তত বিশটি হামলা হচ্ছে। গেরিলা আক্রমণে উদ্ভুত ক্ষয়ক্ষতির ফলে ঢাকার নিকটে গাজীপুর অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিতে উৎপাদন আবারও বন্ধ হয়ে গেছে। দু’দিন ধরে ঢাকায় পানি সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। কয়েকদিন আগে ঢাকার প্রধান পাওয়ার প্ল্যান্ট বিদ্রোহীদের আক্রমণে ধ্বংস হয়ে গেছে। নগরে আবার কারফিউ জারি হয়েছে মর্মে খবর পাওয়া গেছে।
চট্টগ্রাম নগর এবং শহরের অন্যান্য এলাকায়, বাড়ির ছাদে ছাদে বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে। আরও অনেকগুলো শহরে আক্রমণ হয়েছে।
নিউ ইয়র্ক টাইমসের বহিস্কৃত প্রতিনিধি সিডনি শনবার্গ প্রতিবেদন করেছেন যে গেরিলা প্রতিরোধ আরও বিস্তৃত ও কার্যকরী হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। বিবিসির মার্ক টালি সম্প্রতি প্রতিবেদন করেছেন, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্রিজগুলোতে এবং যেসব এলাকা মুক্তিবাহিনীর শক্ত ঘাঁটি হতে পারে সেসব স্থানে লোকবল নিয়োগ করার মত অবস্থানে নেই।
সংক্ষেপে, সেনাবাহিনী বড়সড় আঘাতের মুখোমুখি হয়েছে, এবং আঘাতের প্রচণ্ডতা তারা অনুভব করছে। সাম্প্রতিক ইতিহাস এটাই দেখায় যে, যত শক্তিশালীই হোক না কেন, সেনাবাহিনী কখনও জনগণকে দাবিয়ে রাখতে পারে না। বাংলাদেশে স্বাধীনতার মশাল জ্বলে উঠেছে। পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বরতা পূর্ব বাংলার জনগণের হৃদয়কে তিক্ত করেছে। মুক্তিবাহিনী অভিজ্ঞতায়, শক্তিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে, সময় তাদের পক্ষে রয়েছে। সত্যি বলতে, এ সহিংসতার পথ ইসলামাবাদেরই সিদ্ধান্ত ধরেই এসেছে।
২৮ জুলাই, ১৯৭১
পূর্ব বাংলায় পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের চালানো গণহত্যার ব্যাপারে অনেকটাই জানা গেছে। তাদের কার্যক্রম এতোই নিখুঁত ছিল যে, হিটলার বেঁচে থাকলে তাঁর আধুনিক শিষ্যদের পদ্ধতিতে কোন কিছুর কমতি খুঁজে পেতেন না। সবচেয়ে রক্ষণশীল হিসেব অনুযায়ী নিহতের সংখ্যা পৌনে এক লক্ষের মত। জীবন-সম্ভ্রম বাঁচাতে সত্তর লক্ষ পূর্ব বাঙ্গালিকে ভারতে পালিয়ে যেতে হয়েছে। সারা বিশ্বের সামনে ইসলামাবাদের সামরিকজান্তা এক কলংকের নাম। এর পরেও, জনগণকে ধোঁকা দিতে, পূর্ব বাংলায় সব কিছু স্বাভাবিক আছে, এমন দাবি করছে পাকিস্তানি সামরিক শাসকরা, তারা উদ্বাস্তুদের ফিরে আসার আহ্বান জানাচ্ছে। এমনকি, ফিরে আসা শরণার্থীদের জন্য অভ্যর্থনাকেন্দ্রও খোলা হয়েছে।
ব্রিটিশ সংবাদপত্র সানডে টাইমস এর একজন প্রতিনিধি সম্প্রতি এরকম একটি কেন্দ্র থেকে ঘুরে এসে জানাচ্ছেন, পাঁচটি বেওয়ারিশ কুকুর ছাড়া কেন্দ্রটিতে আর কেউ নেই। গত কয়েক সপ্তাহে, ব্রিটেন, কানাডা, আয়ারল্যান্ড থেকে সংসদীয় প্রতিনিধিদল পূর্ব বাংলা সফর করেন। সেখানে আতংকের পরিস্থিতি বিরাজ করছে বলেই তাঁদের সবার মনে হয়েছে। নাৎসীদের কাছ থেকে ইসলামাবাদের শাসকরা গণহত্যার পদ্ধতি ছাড়া আরও অনেক কিছুই শিখেছে বলে দেখা যাচ্ছে। সেন্সরশিপ থাকা সত্ত্বেও যতটুকু তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, তাতে বোঝা যায়, পূর্ব বাংলায় পুলিশী রাজ কায়েম হয়েছে। পূর্ব বাংলা এখন এক আতংকের উপত্যকা, যেখানে জার্মান গেস্টাপো কায়দায় তল্লাশি চালানো হচ্ছে। সরকারী অফিসে এখনও যেসব কর্মকর্তা আসছেন তাঁদের উদ্দেশ্যে সামরিক আইন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রশ্নমালা জারি করা হয়েছে। যেসব প্রশ্নের উত্তর বাধ্যতামূলকভাবে দিতে হবে, সেগুলোর মধ্যে একটি : আপনি কি আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছেন? আরেকটি : আপনি কি বাঙালি? এ কী ধরণের অন্যায়!
লস অ্যাঞ্জেলস টাইমসের প্রতিনিধি জ্যাক ফয়সির (Jack Foisie) কাছ থেকে পূর্ব বাংলায় পরিস্থিতির একটা স্পষ্ট চিত্র পাওয়া যায়। তিনি জানাচ্ছেন, ঢাকা এখন এক ভয়ের নগরী। রাতের বেলায় রাস্তায় রাস্তায় ভূতুড়ে শূন্যতা বিরাজ করছে। সন্ধ্যা নামলেই লোকজন বাড়িতে ঢুকে যাচ্ছে; যদি আত্মীয়স্বজনের বাড়ির দরজা-জানালা-দেয়াল শক্তপোক্ত হয়ে থাকে, তাহলে তারা সেখানে আশ্রয় নিচ্ছে। ফয়সি জানাচ্ছেন, “কোনমতে শাকসবজি, অথবা একটু মাছের তরকারি দিয়ে ভাত খেয়েই তাড়াতাড়ি তেলের বাতি নিভিয়ে দেয়া হয়, দরজা আটকে দেয়া হয়। এরকম একটা ধারণা বিরাজ করছে যে, অন্ধকার বাড়িঘরে কর্তৃপক্ষ আসার সম্ভাবনা কম।” গোপন আলোচনায় এ আতংকের কারণ হিসেবে বেশ কয়েকজনই “তল্লাশি”কে চিহ্নিত করেছেন। প্রতিনিধি আরও বলেন, “রাতের বেলায় ঘরে ঘরে দরজায় কড়া নেড়ে একই কাজ করা হয়। কোথায় বিদ্রোহীরা রয়েছে সে তথ্য জানা, পিঠ বাঁচাতে ইচ্ছুক লোকদেরকে চর হিসেবে দলে নেয়া, অথবা বাড়ির নারীদের শ্লীলতাহানি করা; অথবা ভয় দেখানোর জন্যই আসা; অথবা মুচলেকা আদায় করা”। তিনি একজন বাঙালি ব্যাঙ্কারের ঘটনা বলেন, যাঁকে বিপুল পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে সামরিক কর্মকর্তাদের থেকে নিজের ও তাঁর পরিবারের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হয়েছিল। ফয়সি লিখেছেন, “কখনও কখনও পুরুষদের অস্ত্রের মুখে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়, আর নারীরা আহাজারি করতে থাকে। কেউ কেউ আহত অবস্থায় ফেরে, কেউ কেউ ফেরে না।”
সেনা কর্তৃপক্ষ ও তাদের পোষ্য স্থানীয় মিলিশিয়াদের সহায়তায় গঠিত তথাকথিত শান্তি কমিটিও জনগণকে আতংকিত করার আরেকটি উপায়। বিবিসি লন্ডন টাইমসের মার্ক টালি বলেন, স্থানীয় মিলিশিয়ারা মূলত মাস্তান, যারা এ সুযোগে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করে বেড়াচ্ছে।
৩০ জুলাই, ১৯৭১
পূর্ব বাংলায় সেনা নিপীড়ন, যার ফলে পাকিস্তানে গণতন্ত্রের প্রত্যাবর্তন স্থগিত হয়েছে, সেটির প্রভাব শেষ পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানেও প্রতিধ্বনিত হতে শুরু করেছে, এবং যাঁর কারণে এ সব কিছু শুরু হয়েছে, তিনি আর কেউ নন, জনাব ভুট্টো, যাঁকে সেনাবাহিনীর সহযোগী হিসেবেই মনে করা হয়। ভুলে যাওয়া উচিৎ হবে না যে, সেনাবাহিনী আর জনাব ভুট্টো মিলিতভাবে এ বছরের শুরুতে ১৯৭০ এর নির্বাচন-পরবর্তী গণতান্ত্রিক কাঠামোতে পাকিস্তানের ফিরে আসা ব্যর্থ করে দিয়েছিলেন। সে সময় এটা বোঝাই যাচ্ছিল, জনাব ভুট্টো যাদের প্রতিনিধিত্ব করেন, তাদের ইচ্ছা সেনাবাহিনীর ইচ্ছার অনুরূপ ছিল। তাদের যৌথ লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানের জাতীয় সংসদে নিয়মতান্ত্রিকভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতার কার্যকরী হস্তান্তর অগ্রাহ্য করা। এ পদক্ষেপের পেছনে অনেকগুলো মূল কারণ ছিল; এর মধ্যে ছিল এ ভয় যে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ক্ষমতার সমীকরণে ব্যাপক রদবদল ঘটবে, সেনাবাহিনী তার অর্থনৈতিক স্বায়ত্তশাসন হারাবে, পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী এতোদিন টিকে ছিল যে ভারতবিদ্বেষী প্রচারণার ওপর, সেটি তাসের ঘরের মত ভেঙ্গে পড়বে। তদুপরি, পাকিস্তানের ক্ষমতার গঠনের বড় কোন অংশ থেকে ব্যক্তিগতভাবে বঞ্চিত হবার সম্ভাবনা থাকে এমন কোন পরিস্থিতি ক্ষমতালোভী ভুট্টো মেনে নেবেন না। আওয়ামী লীগকে সমীকরণের বাইরে রাখলে দু’টো ঘটনার মধ্যে একটি হবে, হয় জাতীয় সংসদের দ্বিতীয় বৃহত্তম দল, তারই পিপলস পার্টির হাতে ক্ষমতা আসবে, অথবা পূর্ব বাংলা সামরিক শাসনে চলবে আর পশ্চিম পাকিস্তানের অন্তত চারটি প্রদেশে প্রতিনিধি সরকার পুনর্বহাল হবে, ভুট্টো খুব সম্ভবত এই ভরসায় ছিলেন। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে তাঁর পার্টি পশ্চিম পাকিস্তানের সবচেয়ে জনবহুল দুটো প্রদেশ, পাঞ্জাব ও সিন্ধুর ক্ষমতা পেত। কিন্তু কার্যত হিসাবে ভুল হল। যতদিন জেনারেল ইয়াহিয়ার হিসেব অনুযায়ী পূর্ব বাংলায় “স্বাভাবিক অবস্থা” ফেরত না আসবে ততদিন পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে তিনি অস্বীকৃতি জানালেন। এরকম কোন “স্বাভাবিক” অবস্থার আশু সম্ভাবনা না থাকায় জনাব ভুট্টোর হতাশা বাড়লো। তাছাড়াও, ক্ষমতার হস্তান্তরে দেরির ফলে তাঁর দলের ভেতরে অস্থিরতার লক্ষণ দেখা যেতে লাগলো। সব কিছু মিলিয়ে, জনাব ভুট্টো ক্ষমতা হস্তান্তরের পক্ষে আরও উচ্চকণ্ঠ হলেন, যা সামরিক শাসকগোষ্ঠীর জন্য বিব্রতকর হয়ে উঠতে লাগল। সম্ভবত এ দু’পক্ষের মধ্যে মতানৈক্য আরও তীব্র হয়ে উঠবে, এ আশংকায়ই সম্ভবত বাংলাদেশ প্রসঙ্গে পাকিস্তানের বক্তব্য উপস্থাপন করার জন্য শাসকগোষ্ঠী জনাব ভুট্টোকে বিদেশে প্রেরণ করেছে।
প্রতিবেদনে প্রকাশ, তেহরানে এক ইরানি পত্রিকার সাথে সাক্ষাৎকারে, জনাব ভুট্টো বলেছেন যে, পাকিস্তানের সমস্যার অবশ্যই রাজনৈতিক সুরাহা হতে হবে, এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে নির্বাচিত দল আওয়ামী লীগকে এতে অংশ নিতে হবে। তিনি বেসামরিক শাসনের আশু প্রত্যাবর্তনও দাবি করেছেন। জনাব ভুট্টোর সফর সামরিক জান্তার আয়োজিত ছিল। তাঁকে তৎক্ষণাৎ পশ্চিম পাকিস্তানে ডেকে পাঠানো হয়। ইয়াহিয়ার সাথে তার পরবর্তী সাক্ষাৎ থেকে আঁচ করা যাচ্ছে, তাদের মধ্যে বনিবনার অভাব দেখা দিয়েছে।
<005.021.437-441>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
সংখ্যাগরিষ্ঠ দল, এই বিষয়ে স্থিতিশীলতা আনার জন্য শুধুমাত্র তার দায়িত্ব পালন করবে। তিনি দ্রুত বেসামরিক শাসনে ফিরে যাওয়ার দাবি জানিয়েছেন। জনাব ভুট্টোর এই সফরটির সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলো পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং এর পরে তাঁকে তাৎক্ষণিকভাবে পশ্চিম পাকিস্তানে ডাকা হয়। ইয়াহিয়া খানের সাথে তাঁর পরবর্তী বৈঠক নির্দেশ করছে যে, তাঁরা একে অন্যের চোখের উপর উপর চোখ রাখতে পারছে না।
৬ নভেম্বর ১৯৭১
হংকং থেকে প্রকাশিত “দি এশিয়ান” নামক এক আন্তর্জাতিক সাপ্তাহিক পত্রিকা, বাংলাদেশের দখলকৃত এলাকাসমূহতে মুক্তিবাহিনীর ক্রমবর্ধমান তৎপরতার কথা প্রচার করেছে।
রিপোর্টটির শিরোনাম ছিলো-“বাংলাদেশি যোদ্ধারা পাকিস্তানী বাহিনীকে নতুন নতুন উপায়ে পর্যুদস্ত করছে।” রিপোর্টটির শুরুতেই, পাকিস্তানিদের দ্বারা গঠিত “রাজাকার” নামক এক ভাড়াটে বাহিনীর বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। এর বর্ণনামতে- বাংলাদেশের এখনকার দখলীকৃত অপরিচিত জায়গাগুলোতে, রাজাকাররাই মূল ভূমিকা পালন করছে। তাদের এই নামের পেছনে ঐতিহাসিক বিষয় জড়িয়ে আছে। সাধারণত, এই শব্দটার অর্থটা হল- “রাজার অনুগত সেবক। ” প্রকৃতপক্ষে, রাজাকার হল- পাকিস্তানি বাহিনীর ভাড়াটে সৈনিক। তাদের প্রধান কর্মকাণ্ড হল- যথেচ্ছভাবে মানুষের উপর অত্যাচার করা।
বিপক্ষ শক্তির উপর নির্যাতন চালানোর জন্য- পাকিস্তানি নিরাপত্তাবাহিনী তাঁদের এই সাহায্যকারী বাহিনীর জন্য একটা নির্দিষ্ট ফি বরাদ্দ করেছে। বাঙালিদের নিজেদের দলে আনার জন্য- তারা জনপ্রতি তিন রূপী ( যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রায় ৪০ সেন্ট) পুরষ্কার ঘোষণা করেছে।
এমন ধোঁয়াশাময় ক্ষেত্রে, যেখানে সুরক্ষাই একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ, এই অবস্থায় সেখানে কার স্বার্থসিদ্ধি হচ্ছে, তা এখনো পরিষ্কার নয়। যেমন, উদাহরণস্বরূপ, পাকিস্তানি আর্মি রাজাকারদের হাতে উদ্বাস্তুদের হস্তান্তর করার সর্পিল পথ থেকে সরে আসতে পারে এই বিবেচনায় যে এটি কেবলই অতিরিক্ত আতঙ্ক ও গোলমালের সৃষ্টি করছে।
এই ভাড়াটে সৈনিকদের বিষয়ে দুটি ব্যাপার নিশ্চিতভাবে বলা যায়। প্রথমত, টাকা তাদের পক্ষে অনবরত কথা বলছে। দ্বিতীয়ত, তারা খুবই হঠকারী ও পাশবিক হতে পারে।
যেহেতু, আমাদের সাহসী সামরিক যোদ্ধারা, সুগঠিত দখলদার বাহিনী ও রাজাকার বাহিনীর বিরুদ্ধে যে আক্রমণ চালিয়েছে, সেটা সফল হয়েছে, যখন কোন দখলদার বাহিনীর সেনা স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছাবশত আমাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসছে,তাদেরকে আমাদের যোদ্ধারা ক্ষমা প্রদর্শন করছে। দি এশিয়ান আরো বলেছে- বাংলাদেশের বিহারী অভিবাসী, যারা ভারত ভাগের পর থেকে এখানে অবস্থান করছে, তাদের মধ্য থেকে রাজাকার গঠন করা হচ্ছে। যেহেতু গেরিলা আক্রমণ বৃদ্ধি পেয়েছে, তাই তাদের কর্মকাণ্ড ও বৃদ্ধি পেয়েছে। শরণার্থীদের সাহায্য করার পাশাপাশি, তাদের মধ্যে কেউ কেউ – বিচ্ছিন্ন সামরিক শিবিরে আকস্মিক আক্রমণ করার সময় পথনির্দেশক হিসেবে কাজ করার কথাও শোনা গেছে।
পাকিস্তানি বাহিনী খুব সম্ভবত রাজাকারদের দক্ষতা বিষয়ে আস্থা হারিয়ে ফেলেছে, যারা এখন তাদের অস্বীকৃত উপাধি “গৃহরক্ষক” হিসেবে বাস করছে না- এই ধরনের কিছু চিহ্ন পরিলক্ষিত হচ্ছে। তাদের মধ্যে কিছু বাঙ্গালী, অস্ত্রসহ বাংলাদেশি গেরিলাদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। এটাও সবাই জানে যে, রাজাকারে যোগ দেওয়া মানুষদের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে যে প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হয়েছিলো, সেটা এখন বন্ধ রয়েছে।
রাজাকারদের প্রতিবাদের চিত্র বাংলাদেশের সর্বত্র একই এবং সেটা বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে বিস্তৃত হয়ে গেছে। কিছু বিষয় এখন প্রায় সমাপ্তির পথে, বাংলাদেশি যোদ্ধারা এখন আরো বেশি যুদ্ধংদেহী এবং এযাবতকালে সংঘটিত যেকোন আক্রমনের চেয়ে আরো বড় মাত্রায় আক্রমণ চালাতে তারা সদা প্রস্তুত আছে।
দি এশিয়ান পাকিস্তানি বাহিনীর হতাহত, মুক্তিবাহিনীর দক্ষতা ও আমাদের সামরিক বাহিনীর দ্রুত সংঘটিত হওয়ার ব্যাপারে মন্তব্য করেছে, তারা বলেছে- ” জানা হতাহতের সংখ্যা বিবেচনা করে বলা যায়- মুক্তিযোদ্ধারা এখন আক্রমণ ও পালিয়ে যাওয়া এই নীতিতে কাজ করছে। প্রতিদিন প্রায় ২০ থেকে ৩০ জন আহত পাকিস্তানী সৈন্য কে প্রতিদিন ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট হাসপাতালে আনা হচ্ছে।
সে তুলনায় গেরিলাদের হতাহত হওয়ার সংখ্যা অনেক কম, এটা সম্ভব কারণ তারা খুব আকস্মিকভাবে আক্রমণ করে।
গেরিলারা বিভিন্ন গ্রামের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময়, গ্রামবাসীদদের কাছ থেকে অনেক সুবিধা লাভ করে। যেখানে আগে, গ্রামবাসীরা নির্যাতিত হতে পারে এই ভয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের দূরে পালিয়ে থাকতে বলতো, সেখানে এখন তারা নির্ভয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার ও আশ্রয় প্রদান করছে।
এছাড়া , অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ পাচ্ছে বলে যে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে, সেটা এটা প্রকাশ করছে, বাংলাদেশী বাহিনী, ছড়িয়ে পড়া বাহিনীর উপর আরো ব্যপক মাত্রায় আক্রমণ চালানোর দ্বারপ্রান্তে!!
৮ নভেম্বর, ১৯৭১
সারাবিশ্বের সংবাদপত্রসমূহ বাংলাদেশে ইয়াহিয়া খানের সেনাদলের নৃশংসতার কথা প্রচার অব্যাহত রেখেছে। এই নৃশংসতা, অনেক নিরীহ মানুষকে সীমান্ত পারি দিতে এবং সেখানে আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য করছে। জাতিসংঘের ত্রাণ কমিশনার ৯.৫ মিলিয়ন মানুষ শরনার্থী হওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। কিন্তু ইয়াহিয়া খান গত চার মাস ধরে, এই সংখ্যা ২ মিলিয়ন বলে দাবি করে আসছেন। যাইহোক, জেনারেল সাহেব আবার দাবি করেছেন, প্রতিদিন বিপুক সংখ্যক শরণার্থী দেশে ফেরত আসছে। যদি ব্যাপারটা এরকম হয়ে থাকে, তাহলে কিভাবে চার মাস ধরে এই সংখ্যাটি একই থাকছে?
যুক্তরাষ্ট্রের “টাইম ম্যাগাজিন” ২৫ অক্টোবর তারিখে লিখেছে যে- ” যদিও ইসলামাবাদ তার সেনাবাহিনীকে দমনপীড়নমূলক নীতি পরিবর্তনের দিয়েছে, তখন থেকে আর ঘরবাড়ি পোড়ানো, সাধারণ মানুষের উপর গুলি করা, গণ্যমান্য ব্যক্তিকে তুলে নেওয়ার কথা শোনা না গেলেও, এখনো প্রতিদিন ৩০,০০০ জন শরণার্থী ভারতে পারি জমাচ্ছে।” এটার মানে দাঁড়ায়- প্রতিমাসে প্রায় ১ মিলিয়ন মানুষ, সীমান্ত পাড়ি দিচ্ছে – সেখানে ইয়াহিয়া খান হয়তো সামনের চার মাসেও দুই মিলিয়ন শরণার্থীর কথা বলে যাবেন। কিন্তু বাস্তবতা হল- ফেব্রুয়ারি মাস শেষ হওয়ার পূর্বেই আরো ৪ মিলিয়ন শরণার্থী সীমান্ত পাড়ি দিতে পারে।
সেনাবাহিনীর নৃশংসতার কথা উল্লেখ করে, ২৬ অক্টোবর “ফিনান্সিয়াল টাইমস” লিখেছে- সামরিক শাসক রাষ্ট্রপতির নির্দেশ উপেক্ষা করে, বাঙ্গালি বিদ্রোহীদের অপারেশনের স্থানগুলোতে পাকিস্তানি পুলিশ ও সেনাবাহিনী নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের উপর তাদের দমনপীড়ন অব্যাহত রেখেছে, এমনকি ঢাকাস্থ নতুন বেসামরিক গভর্নরের বাসভবনের আশেপাশেও তাদের অভিযান চালিয়েছে। মার্টিন উয়ালাকর্ট, ১ নভেম্বর এর “গার্ডিয়ান” পত্রিকায় লিখেছেন- অবস্থা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে ইসলামাবাদ কিছু অনৈতিক ও অপবিত্র পন্থা অবলম্বন করলেও, পূর্ব বাংলার পাকিস্তানি সরকার এখন দমন-পীড়ন অব্যাহত রেখেছে।
মুক্তিবাহিনীর সাফল্যের খবরও বিশ্বের নানা সংবাদপত্র ও সাময়িকীতে প্রকাশিত হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের “নিউজউইক” সাময়িকী ১ নভেম্বর তারিখে লিখেছে-” যদিও ইয়াহিয়া খান মার্চের শেষ থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ভয়ানক অভিযান চালানো শুরু করেছে এবং ৯ মিলিয়নের ও বেশি শরণার্থীকে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য করে আসছে তবুও প্রায় ৫০ হাজার বাঙালি মিলে গেরিলা বাহিনী গঠন করেছে। স্বভাবসুলভভাবে ” নিউজউইক” সংবাদদাতা গেরিলার সংখ্যা কম দেখিয়েছে। পত্রিকাটি আরো বলেছে- “গেরিলারা সফলতার সাথে সরকারী বাহিনীকে হেনস্থা করতে সক্ষম হয়েছে এবং অনেক পশ্চিমা বিশ্লেষক মনে করছেন, বিদ্রোহীদের সফলতা অব্যাহত থাকবে। গেরিলাদের দমনে, ইয়াহিয়া খানের যে পরিমাণ সৈন্য দরকার, সে পরিমাণ সৈন্য এখন সেখানে নেই।
লন্ডনের “গার্ডিয়ান” পত্রিকা লিখেছে- “সম্প্রতি, মুক্তিবাহিনী বেশ ক’বার ঢাকার কেন্দ্রস্থলে আক্রমণ চালিয়েছে, সাধারণত বোমা মেরে অথবা মাঝে মাঝে সাধারণ নিয়মে আক্রমণ চালিয়েছে। ” পত্রিকাটি আরো লিখেছে – “ফরিদপুরের দক্ষিণে অবস্থিত, গোপালগঞ্জ এলাকাতে, যেখানে মুক্তিযোদ্ধারা অত্যন্ত সুসংঘটিত, সেখানে তাঁরা এমন কিছু রাজনৈতিক কর্মচারী নিযুক্ত করেছে- যারা সামরিক সশস্ত্র হলেও তাঁরা তাঁদের বেশিরভাগ সময়, ঢাকায় কি কি ঘটছে তা সাধারণ মানুষকে জানানোর কাজে ব্যস্ত থাকে।”
১৫ নভেম্বর, ১৯৭১
“বাংলাদেশি গেরিলারা বোমা নিক্ষেপ ও হত্যার সংখ্যা বাড়িয়েছে” এটাই ছিলো ৯ নভেম্বরের লন্ডন টাইমস পত্রিকার শিরোনাম।” পূর্ব বাংলায় অবস্থিত, পাকিস্তান বাহিনী কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত উচ্চ শিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলো, গেরিলারা বন্ধ করে দিতে চাইছে। ” এটি আরো লিখেছে- “গত কয়েকদিনে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের পরিমাণ ও অনেক বেড়েছে। পাকিস্তান সরকার কর্তৃক নিযুক্ত,ভবিষ্যতে প্রাদেশিক আইনসভায় প্রতিনিধিত্ব করার মতো এক ডানপন্থী নেতাকে গতোকাল সাব- মেশিনগান এর হামলায় হত্যা করে হয়েছে।” মুক্তিবাহিনী যে, দখলদার বাহিনীকে সহযোগিতাকারী মানুষদের পক্ষ পরিবর্তন ও শোধরানোর পর্যাপ্ত সময় দিয়ে – যে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে, সেই খবরও পত্রিকাটির রিপোর্টে গুরুত্ব পেয়েছে। পত্রিকাটি লিখেছে, “গেরিলারা শান্তি কমিটির সদস্য, সামরিক জান্তা কর্তৃক নিযুক্ত কর্মকর্তা এবং বিপক্ষ শক্তিকে প্রত্যক্ষভাবে সাহায্যকারী ব্যক্তিদের মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছে। ” এটি আরো লিখেছে, “যেসব বাঙালি সরকারী চাকুরে এখনো কর্মস্থলে আছেন, তাঁরাও গেরিলাদের নজরদারীতে আছেন জানিয়ে , গেরিলারা তাঁদের সতর্ক করেছেন; সরকারের সাথে কাগুজে সম্পর্ক ছাড়া অন্য কোন ধরণের সম্পর্ক থাকলে তাঁদেরকেও হত্যা করার হুমকি দেওয়া হয়েছে।” ১১ জন দখলদার বাহিনী যে মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে, সেই সংবাদ ও পত্রিকাটিতে স্থান পেয়েছে। এটি লিখেছে- ” সামরিক নীতি ভেঙে পড়েছে, সেটা ঠিকভাবে মানা যাচ্ছে না এবং পূর্বে নিহত পাকিস্তানী সৈন্যদের, পাকিস্তানে নিয়ে সমাহিত করার যে প্রথা ছিলো, বর্তমানে ক্রমবর্ধমান হতাহত সৈনিক সংখ্যার কারণে পূর্বের নিয়ম বজায় রাখা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। “
…. এ সপ্তাহের যুক্তরাষ্ট্রের “নিউজউইক” সাময়িকী টি মনে করছে যে, পাকিস্তানীরা একটি পরাজিত হওয়ার যুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। ইয়াহিয়া খান এক অজেয় যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছেন। এটি আরো লিখেছে- “পাকিস্তানী বাহিনীর শুধুমাত্র গেরিলাদের যুদ্ধাবস্থা নিয়ে গভীর জ্ঞান রয়েছে। সীমান্তে যেখানে সৈন্যরা অবরুদ্ধ অবস্থায় আছে, সেখানে গেরিলারা পূর্ব পাকিস্তানের দিকে দৌঁড় শুরু করতে উদগ্রীব। পাকিস্তান সরকার রাজাকারদের সাথে নিয়ে বিদ্রোহীদের সাথে যুদ্ধ করতে চেয়েছে কিন্তু রাজাকাররা সরকারকে সাহায্য করতে গিয়ে, আরো ক্ষতি করেছে।” রাজাকার নিযুক্ত করার প্রক্রিয়া এখন প্রায় নেই বললেই চলে এবং এর ফলে অনেক মানুষ মুক্তি বাহিনীর পক্ষাবলম্বন করেছে। নিউজউইক পত্রিকাটি লিখেছে- ” রাজাকারদের এসব দমনপীড়নমূলক নীতি সাধারণ মানুষের উপর প্রয়োগ করার ফলে, সাধারণ বাঙালিদের মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে যেতে বাধ্য করেছে। ” নিউজউইক পত্রিকার সিনিয়র সম্পাদক আর্নউড ডি বর্ছগ্রেভ সাধারণ মানুষকে একটি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছিলেন, তারা কি পাকিস্তান রাষ্ট্র হিসেবে থাকতে চায়, নাকি বাংলাদেশ নামের নতুন রাষ্ট্র চায়, তিনি লিখেছেন, সেসব লোকদের প্রত্যেকেই বাংলাদেশের কথা বলেছেন। সাময়িকীটি আবারো নিশ্চিত করেছে যে, বাংলাদেশের সকল মানুষ এখন একটি স্বাধীন দেশের ব্যাপারে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। নিউজউইকের সিনিয়র সাংবাদিক লিখেছেন- ” কিছু মানুষ আমাকে ফিসফিসিয়ে বলেছে যে, “বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়া উচিত, আমরা সকলেই এটা ভাবছি।”
সাময়িকীটি আরো উল্লেখ করেছে যে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অবস্থার নিয়ন্ত্রণ হারাতে চলেছে। পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর প্রশাসক, জেনারেল নিয়াজী, দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যবস্থার অবনতি ও মুক্তিবাহিনীর সংঘটিত হওয়ার মাত্রা দেখে সন্তুষ্ট হতে পারছেন না। গত সপ্তাহেই সরকার পূর্ব পাকিস্তানের ২৫ শতাংশ পুলিশ স্টেশনের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে।
ইয়াহিয়া খানের কয়েকজন প্রতিনিধি যে মুক্তিবাহিনীর সাথে সমঝোতার চেষ্টা করেছে, সেটা ১৫ তারিখের নিউজউইক সাময়িকী থেকে জানা যায়, সাময়িকীটি লিখেছে, কয়েকজন কমিশনার গেরিলাদের সাথে কৌশলে সমঝোতা করতে চাচ্ছে এবং শুধুমাত্র ঢাকার উত্তরভাগের বেশিরভাগ অংশ এখনো মুক্তিবাহিনীর আওতামুক্ত আছে। মুক্তিযোদ্ধাদের সংঘটিত হওয়া ও দক্ষতার বিষয়ে সিনিয়র সম্পাদক শ্রদ্ধার সাথে লিখেছেন, ” কড়া পুলিশি পাহাড়ার মধ্যে, ঢাকায় হোটেলে পৌঁছানোর ৩০ মিনিটের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের একজন প্রতিনিধির সাথে আমার যোগাযোগ হয়েছিলো। ” তিনি আরো লিখেন- বিদ্রোহীরা অত্যন্ত সতর্কতার সাথে ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে সংঘটিত হয়েছে এবং তাঁরা কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়েছে- তাঁদের কেউ চাঁদা সংগ্রহের ও ব্যাংকে লুট করার কাজ সুসংহত করার কাজে নিযুক্ত হয়েছে, কেউবা অন্তর্ঘাতক আর কেউবা হামলাকারী হিসেবে নিয়োগ পেয়েছে।
১৬ নভেম্বর ১৯৭১
যুক্তরাষ্ট্রের নিউজউইক সাময়িকী ১৫ নভেম্বর তারিখে প্রকাশ করে যে, ইয়াহিয়া খান বা অন্যান্য জেনারেল রা বাংলাদেশের আসল অবস্থা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়। তার বেসামরিক রাজ্যপাল ও জানে না, সাধারণ মানুষের মনে কি বিরাজমান। সাময়িকীটি লিখেছে, “বাঙালির কঠোর প্রতিরোধের মতো, কঠিন সত্য কথা- শুধুমাত্র রাজ্যপাল এ. এম. মল্লিকের র কাছ থেকে গোপণ করা হয়নি, এমনকি রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খানের কাছ থেকেও গোপন করা হয়েছে।”
অতি সম্প্রতি, সাময়িকীটি পাকিস্তান আর্মি কর্তৃক সংঘটিত নৃশংসতা এমনকি আজও যে নৃশংসতা ঘটিয়েছে, সেটা নিশ্চিত করেছে। এটি লিখেছে, ” একজন প্রবাসী অতি জ্ঞানী ব্যক্তি নৃশংসতার জন্য সেনাবাহিনীকে দায়ী করেছেন। ” সাম্প্রতিককালে পাকিস্থানী বাহিনী ডেমরার একটি গ্রামে অভিযান চালিয়েছে, যেখানে কখনই মুক্তিযোদ্ধারা ছিলো না, এবং সেখানে ১২ থেকে ৩৫ বছর বয়সী সকল মহিলাকে ধর্ষণ করা হয়েছে এবং ১২ বছরের অধিক সকল মানুষের উপর গুলি চালানো হয়েছে। “
এটি আরো লিখেছে- “এর একদিন পড়েই পাকিস্তানি গানবোট “চালনা” নদীতে মাছ ধরার নৌকাগুলোর উপর হামলা চালায় এবং নিরাপত্তার সন্ধানে সাঁতারাতে থাকা জেলেদের উপর গুলিবর্ষণ করেছে। ” কিন্তু, সাময়িকীটির সিনিয়র সম্পাদক একটি বিষয়ে ইঙ্গিত করেছেন যে, পাকিস্তানি বাহিনী যত বেশি অত্যাচারী হবে ও যত বেশি নৃশংসতা চালাবে, সাধারণ মানুষের প্রতিরোধ তত বেশি হবে। এটা সাধারণ মানুষকে বশে আনার পরিবর্তে, তাঁদের প্রতিরোধের মাত্রা আরো বাড়াবে । সাময়িকীটি লিখেছে, ” এই সকল কর্মকাণ্ড পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিবাদকে আগের যেকোন সময়ের চেয়ে আরো বেশি শক্তিশালী ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ করে তুলবে। বেশিরভাগ মানুষ পাকিস্তানের কাছ থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ার চিন্তা এখন থেকে শুরু করে দিয়েছে এবং অনেক পাকিস্তানি সেনাপতিও ভাবতে শুরু করেছেন, তারা একটি অনিবার্য গেরিলাযুদ্ধের ফাঁদে আটকা পড়েছেন।”
“ইয়াহিয়ার সাহায্যের হাত ছোট হয়ে আসছে” – এটিই ছিলো ৯ নভেম্বরের লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকার শিরোনাম। এটি উল্লেখ করেছে কিভাবে পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে এবং ইয়াহিয়া খানের সবচেয়ে বড় মিত্র চীন ও ধীরে ধীরে তার সাহায্য প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। সম্পাদকীয় তে লেখা হয়েছে, ” বর্তমানের ঘটনাপ্রবাহ ইয়াহিয়া খানের বিরুদ্ধে যাচ্ছে, অনবরতভাবে আসতে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য গতকাল হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে গেছে এবং চীন হালকা বন্ধুত্ত্বের ভাব বজায় রেখে পেকিং থেকে ইয়াহিয়া খানের গোয়েন্দাদের বাড়িতে কিছু সাহায্য পাঠিয়েছে।” পাকিস্তানের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে, সম্পাদকীয় তে লিখেছে ” এটি ইয়াহিয়া খানকে পশ্চিমা-মিত্র শূণ্য করেছে।পশ্চিম পাকিস্তানের জেনারেলরা অতি দ্রুত অনৈতিক ভাবে অত্যাচার চালানোর ইচ্ছে থেকে সরে এসেছে। ” পেকিং এ ইয়াহিয়া খানের প্রতিনিধিদের সাথে চীনাদের শীতল ব্যবহারের কথাও সম্পাদকীয় তে প্রতিফলিত হয়েছে, সেখানে তারা লিখেছে, “এই আলোচনার মাধ্যমে একটি অস্পষ্ট বিষয় স্পষ্ট হয়েছে। যদি ভারতের সাথে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে, সেক্ষেত্রে চীনের কোন সাহায্য পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। যদি সত্যিকারেই এই যুদ্ধ হয় ; পাকিস্তানকে এককভাবে আক্রমণ চালাতে হবে এবং এককভাবে এর ফল ভোগ করতে হবে। “
” রিফিউজিরা বলেছে – পাকিস্তানি সেনারা এখনো হত্যা ও লুণ্ঠণ চালিয়ে যাচ্ছে।” এটিই ছিলো লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকার শিরোনাম। পত্রিকাটি রিপোর্ট করেছে, ” প্রথমে মনে করা হতো শুধুমাত্র মুসলিম সদস্য নিয়ে গঠিত পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর মূল উদ্দেশ্য ছিলো হিন্দু গ্রামগুলোতে হামলা চালানো কিন্তু আমাদের সংবাদকর্মীরা বিগত কিছু ঘটনা থেকে প্রমাণ পেয়েছে যে বর্তমানে অভিযানটি তাঁদের বিরুদ্ধে চালানো হচ্ছে যারা স্বাধীন বাংলাদেশ জাতির চিন্তাচেতনা ধারণ করছে। “
১৭ ই নভেম্বর, ১৯৭১
যতই দিন যাচ্ছে, মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ ততই তীব্র হচ্ছে। “সীমান্তে চাপ বাড়ার সাথে সাথে পূর্ব বাংলায় অন্তর্ঘাত এর ঢেউ লেগেছে।” এটিই ছিলো এ সপ্তাহের লন্ডন টাইমস পত্রিকার শিরোনাম। এটি লিখেছে -“গেরিলাদের দ্বারা সংঘটিত সবচেয়ে সেরা হামলার ঘটনা ছিলো- চট্টগ্রামে, একটি বড় একটি তেলবাহী ট্যাংকার ডুবিয়ে দেওয়া, যেটি ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করার অপেক্ষায় ছিলো। ৭ জনের মতো জাহাজের কর্মী নিখোঁজ ছিলো।” নিউজপেপার পত্রিকার ঢাকা প্রতিনিধি ম্যালকম ব্রাউন আরো বলেছেন, গেরিলারা অতি সম্প্রতি পাকিস্তানী বাহিনীর কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করার জন্য জ্বালানী পেট্রোলের সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে এবং এখনো পর্যন্ত কমপক্ষে ১ ডজন জাহাজ ডুবিয়ে দিয়েছে অথবা ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। তিনি আরো লিখেছেন, গত ২৪ ঘণ্টায় গেরিলারা ঢাকার একজন প্রখ্যাত আইনজীবীর কক্ষে হামলা চালিয়েছে এবং একটি পাওয়ার স্টেশনে ৩ টি বড় বোমা হামলা চালিয়ে, ঢাকা ও তার পার্শ্ববর্তী ২ শহরকে দিনের বেশিরভাগ সময় বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন করে রেখে গেছে। বিদ্যুতের অভাবে গতকাল ঢাকা শহরে পানির অভাব দেখা দিয়েছে। তিনি আরো লিখেছেন- ঢাকা ও পূর্ব পাকিস্তানের কোথাও কোথাও নাশকতার কারণে বিদ্যুৎবিভ্রাট দিন দিন বাড়ছে, এই বিষয়ে বলা যায়, দিনে প্রায় অর্ধ ডজনবার বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়।
১২ নভেম্বর এর লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকার শিরোনাম ছিল-“বোমা হামলার কারণে, ঢাকার ব্যবসার প্রাণকেন্দ্র কেঁপে উঠেছে।” এটি লিখেছে – গতকাল যখন মূল ডাকঘরের প্রবেশমুখের কয়েকগজ দূরে গাড়ি থাকা বোমা বিস্ফোরিত হয়, ঢাকার বাণিজ্য কেন্দ্র তখন কেঁপে উঠে। একজন বিশ্বাসযোগ্য ব্রিটিশ প্রত্যক্ষদর্শী একজন মানুষকে মারা যেতে দেখেছেন এবং পরবর্তীতে জানা গেছে ৩ জন মানুষ নিহত হয়েছে।” এই পত্রিকাটি লিখেছে – মার্চে প্রায় ৬,০০০ এর মতো পুলিশকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানে আনা হয়েছিল,যেটাকে এখন খুব কম মনে হচ্ছে।
<005.021.442-449>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
এটি বলে, “তারা তীব্র উত্তেজনা প্রদর্শন করছে। গত সপ্তাহ থেকে কিছু ইউনিটকে ব্যরাকে রাখা হচ্ছে।” এই পত্রিকার প্রতিবেদক আরও লিখেন, “আমি বুঝতে পারছি যে সকল পুলিশ পূর্ব পাকিস্তানী বাহিনীর স্থলাভিষিক্ত হতে ঢাকা এসেছে তাদের বলা হয়েছে যে তারা সেপ্টেম্বরে দেশে ফিরে যাবে। যেহেতু বাহিনীকে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে না, তাই তারা তাদের চাওয়া পূরণ করে পশ্চিমে ফিরে যাওয়ার জন্য একটি তারিখ পেতে ধীরে ধীরে নিষ্ঠুর হচ্ছে।”
সৈন্য বাহিনী তাদের মরিয়া অবস্থান থেকে সরে এসে জাহাজ রক্ষণাবেক্ষকদের পণ্যের জন্য বল প্রয়োগ করতে শুরু করেছে বলে প্রতিবেদক লিখেন, “পশ্চিম পাকিস্তানী যোদ্ধাদের দলগুলোকে পণ্যের জন্য জাহাজ রক্ষকদের উপর বল প্রয়োগ করতেও আমি দেখেছি। দুই মাস আগের চেয়ে তাদের আচরণ কিছুটা ভীতিজনক ছিল।”
ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস-এর ১২ নভেম্বরের শিরোনাম ছিল, “পাকিস্তানের কাঁচা পাট গেরিলারা বিনষ্ট করছে।” এটি বলে, “পূর্ব পাকিস্তানে গেরিলা কার্যক্রম ওয়ার্ল্ড স্পিনিং ইন্ডাস্ট্রিগুলোতে কাঁচা পাট রপ্তানিতে প্রভাব ফেলছে। কিছু ক্রেতা কোম্পানির মতে রপ্তানির জন্য পাটের পরিমাণ ক্রমাগত কমছে।” ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস-এর প্রতিবেদক গটফ্রে ব্রাউন, লন্ডন-এর একটি রিপোর্ট থেকে লিখেন, “অনিয়মিত এবং বিলম্বিত স্থানান্তর ইউরোপিয়ান ক্রেতাদের পাট কেনা থেকে বিরত রাখছে। ফলশ্রুতিতে পাটের দাম বাড়ছে এবং রাতারাতি টন প্রতি ৭ থেকে ১০ পাউন্ড বৃদ্ধি পেয়েছে।”
১৮ নভেম্বর, ১৯৭১
লন্ডনের দ্যা টেলিগ্রাফের আরও একটি শিরোনাম ছিল, “গেরিলারা পূর্ব পাকিস্তানের বিশাল এলাকা দখল করেছে।” এটি বলে, “বাংলাদেশী গেরিলারা পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান ৭ টি এলাকা স্বাধীন ঘোষণা করেছে। দুই সপ্তাহ আগে থেকে এমন একটি যুদ্ধংদেহী অবস্থা বিরাজ করছে যে গেরিলা কমান্ডাররা আরও সাফল্য প্রত্যাশা করছেন।”
সংবাদপত্রের প্রতিবেদক মুক্তি বাহিনী কর্তৃক মুক্তাঞ্চল সম্পর্কে বিস্তারিত দেয়। প্রতিবেদক ভারতীয় সীমান্ত থেকে ৭০ মাইল ভেতরে বাংলাদেশের স্বাধীন এলাকাগুলো পর্যবেক্ষণ করেন। মধুপুর বন ও সুন্দরবন বাংলাদেশ মুক্তি বাহিনীর প্রধান গেরিলা ঘাঁটি বলে এটি উল্লেখ্য করে। পত্রিকাটি বলে, “বিচ্ছিন্ন প্রধান শহরগুলো এবং সেগুলোর মধ্যবর্তী ভূমির রাস্তাগুলো উত্তর-পশ্চিম ব্যতিত সম্পূর্ণ বাংলাদেশে গেরিলারা সন্ত্রাস ঘটিয়েছে।” রাজাকারেরা নিরাপত্তা দেয়ার কারণে ফেরি পারাপার ব্রীজ, প্রশাসনিক ভবন এবং সেনা ক্যাম্পগুলোতে বেশি সাফল্য পাওয়া যায় নি।
আরেকটি প্রতিবেদনে লন্ডনের দৈনিক টেলিগ্রাফে ক্লার্ক হলিংওর্থ লিখেন, “শহরের প্রধান ৪টি পাওয়ার স্টেশনের ৩টি বাংলাদেশের গেরিলারা ধ্বংস করে দেয়ার পর ঢাকার ৩০ মাইলের ভেতরকার ইন্ডাস্ট্রি সম্পূর্ণরূপে স্থবির হয়ে পড়েছে।”
“গেরিলারা ঢাকার পাওয়ার স্টেশন ধ্বংস করেছে” প্রতিবেদনে ক্লেয়ার হলিংওর্থ আবার লিখেন, “সিদ্ধিরগঞ্জের কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টিত পাওয়ার স্টেশনের কম্পাউন্ডের ভেতর ৩টি বিস্ফোরণ সঙ্ঘটিত হয়। তারা সহসা বিদ্যুৎ পরিবহন বিচ্ছিন্ন করে এমনকি জরুরী গ্রাহক যেমন শ্রমিকদের কর্মস্থল, পুলিশ এবং সেনা ব্যারাকে।” তিনি আরও লিখেন, “সবচেয়ে সঙ্গিন ফলাফল হল এই যে ঢাকা অঞ্চলের পাট কল এবং লাইট ইন্ডাস্ট্রিগুলোর অন্তত পক্ষে এক হাজার শ্রমিক তাদের কাজ বন্ধ করে দিয়েছে, যেখানে ৬০% এর মত কর্মজীবী ইতিমধ্যে বেকার।”
লন্ডনের দ্যা টাইমস এই পরিস্থিতি সম্পর্কে লিখে, তারা এখন বাংলাদেশের ভেতর নিয়ন্ত্রণ করছে এবং দখলকৃত অঞ্চল শাসন করার চেষ্টায় পাকিস্তানী সরকার পরম ব্যর্থ। আইন এবং আদেশের অবস্থা সম্পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রনের বাইরে। পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা এবং বাংলাদেশের অধিবাসীরা অনিরাপদবোধ করছে এবং ব্যবসায়ীরা তাদের সকল সম্পদ পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। লন্ডনের দ্যা টাইমস লিখে, “পূর্ব পাকিস্তানে বেশীর ভাগ পশ্চিম পাকিস্তানী অধিবাসীরা নিজেদের অনিরাপদ বোধ করছেন এবং অনেকেই আগে দেশান্তরী হত্তয়ার সুযোগ পেয়েছে কিন্তু এখন অনেক দেরী হয়ে গিয়েছে।” মুক্তি বাহিনী সম্পর্কে এটি লিখে, “আর্মি কর্তৃক সন্দেহপূর্ণ গেরিলা অবস্থানে হামলা করা সত্ত্বেও গেরিলারা কম বেশি তাদের আক্রমণ অব্যাহত রেখেছে।” এটি আবার লিখে, “সামরিক বাহিনীর মনোবল ভেঙ্গে পড়েছে। পুলিশের মনোবলও ভুগছে।” পত্রিকাটি আবারও নিশ্চিত করে যে পুলিশ ও রাজাকারেরা যৌথভাবে মুক্তি বাহিনীর সাথে লড়াই করছে। এটি বলে, “সরকার জুনে পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশ অফিসারদের একটি বাহিনী প্রেরণ করে আহতদের প্রতিস্থাপন করতে।” বাহিনীকে বলা হয় যে তাদের কাজ কেবল স্বল্প পরিসরের জরুরী অবস্থায় কিন্তু তারা এখনও অবস্থান করছে এবং জরুরী অবস্থা যেকোনো সময়ের চেয়ে গুরুতর আকার ধারণ করছে।
২৪ নভেম্বর ১৯৭১
ইয়াহিয়া খানের নিয়োজিত আর্মিরা ধ্বংস হতে শুরু করেছে। প্রতিদিনকার বিপুল পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতিতে ভুগে তারা পতনের একদম শেষ প্রান্তে। তারা যতই তাদের নিপীড়ন ও নৃশংসতার মাত্রা বাড়াচ্ছে, ততই সাধারণ মানুষও মুক্তি বাহিনীকে সমর্থন বাড়াচ্ছে। বোকা, গর্দভ এবং সাধারণ মানের যোদ্ধা, ইয়াহিয়া খান, বদ্ধ ব্যাংকারে চলে গেছে। লন্ডনের দ্যা ডেইলি এক্সপ্রেস ১৭ নভেম্বর তাকে বর্ণনা করে, “সে খর্ব-স্থূলকায় কিছুটা বোঝাসম লোক। তার সবচেয়ে গাফিলতি সে ২৫ মার্চের কঠিন অবস্থার পর থেকে বাংলাদেশ যায় নি।” এটি আবার বলতে যায়, “সে তার তথ্যরে জন্য তার কমান্ডারদের প্রতিবেদনের উপর নির্ভরশীল এবং যে কেউ ধরে নিবে, এই কারণেই, উদ্বাস্তু এবং গেরিলা যোদ্ধারা দুর্বৃত্ত এবং ভারতের অনুপ্রবেশকারী হিসেবে তার হাতে প্রাণ হারাচ্ছে।”
ইয়ান ব্রডি, দ্যা ডেইলি এক্সপ্রেসের বিদেশী প্রতিবেদক আবারও ইয়াহিয়া খানকে অভিযুক্ত করে বলেন, “তিনি সংকট ত্বরান্বিত করেন যখন পাকিস্তান নির্বাচনের ফলাফল শেখ মুজিবের জন্য একটি বড় বিজয় এনে দেয়, যা তার অনুসারে হয় নি।” ইয়াহিয়া খান সম্পর্কে তিনি আবার লিখেন, “ইয়াহিয়া খান, মাথামোটা লোক এমন কাজ করেন যেন জঘন্য কিছু দিয়েই গড়া।” তিনি আবার বলতে যান, “যখন জেনারেল ইয়াহিয়া বলেন সে কেবল একজন সামান্য সৈনিক, তার উচিৎ তার কথা ফিরিয়ে নেয়া। তার অযাচিত প্রদক্ষেপ তাকে জেনারেলের চেয়ে সার্জেন্ট-মেজরেই বেশি মানায়।”
১৬ নভেম্বরের ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস রিপোর্ট করে মিসেস ইন্দিরা গান্ধী কংগ্রেস পার্টি কার্যনির্বাহীকে বলেছেন, “বাংলাদেশ থাকতে এসেছে। পৃথিবীর এমন কোন শক্তি নেই যে এই বাস্তব অবস্থান পরিবর্তন করতে পারে।”
“মিসেস গান্ধী বাংলাদেশের ব্যপারে চূড়ান্ত অবস্থান দিয়েছেন” ছিল ১৭ নভেম্বরে লন্ডনের দ্যা টাইমসের শিরোনাম। এর প্রতিবেদক পিটার হ্যাজেলহার্স্ট লিখেন, “প্রধানমন্ত্রী মিসেস গান্ধী আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বাংলাদেশের সংকট নিরসনে দুই সপ্তাহের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছেন।”
“মিসেস গান্ধী স্রোতের পরিবর্তন দেখছেন” ছিল ১৬ নভেম্বরে লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফের শিরোনাম। পত্রিকাটির নয়া দিল্লীর প্রতিবেদক ডেভিড লোসাক লিখেন, “ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস গান্ধী সংসদে গতকাল বলেন যে আন্তর্জাতিক প্রবাহ পাকিস্তানের প্রতিকূলে যাচ্ছে।”
১৭ নভেম্বরে লন্ডনের দ্যা টেলিগ্রাফের রিপোর্ট থেকে মাত্রই নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, পাকিস্তানী সেনাবাহিনী বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকায় প্রতিদিন ধীরে ধীরে আরও মরিয়া হয়ে উঠছে। শিরোনাম ছিল, “পাকিস্তানীরা যাজক হত্যা করেছে।” প্রতিবেদক লিখেন, “আমেরিকান রোমান ক্যাথলিক ফাদার উইলিয়াম পি ইভান্সকে গেল সপ্তাহে ঢাকা থেকে ১৭ মাইল উত্তর-পশ্চিমে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। তিনি ২৩ বছর ধরে পাকিস্তানে বসবাস ও কাজ করছিলেন।” ক্লেয়ার হলিংওর্থ আবার লিখেন, “আমি তার বক্সনগর মিশন চার্চের যাওয়ার পথেই ছিলাম যখন তিনি খুন হয়েছেন একটি সুনসান এলাকায়, যেখানে নেই কোন রাস্তা কিংবা টেলিফোন।” মিশনে অবস্থান করা ঢাকার আর্চবিশপের কি হয়েছিল তা গলা থেকে মিশনে নিয়ে যাওয়া মাঝি তাকে বর্ণনা করেন। মাঝি ক্লেয়ার হলিংওর্থকে বলেছিল, “আমরা নদীর নিম্নাংশ দিয়ে নৌকায় যাচ্ছিলাম যখন সৈন্য প্রহরীরা স্থানীয় কমান্ডিং অফিসারকে নৌকা তল্লাশি করে জানানোর জন্য আদেশ করে। ফাদার ইভান্সকে কিছু জিজ্ঞাসা করা হয় এবং নৌকায় ফেরত যাওয়ার অনুমতি দেয়। কিন্তু কিছু অজানা কারণে তারা ফাদার এবং আমাকে নৌকা থেকে বের করে এবং আমাদের একটি পরিখায় বসতে জোর করে।”
দ্যা ডেইলি টেলিগ্রাফের প্রতিবেদক ক্লেয়ার হলিংওর্থ আবার বর্ণনা করেন, বাংলাদেশে প্রসিদ্ধ আমেরিকান রোমান ক্যাথলিক যাজক ফাদার ইভান্স হত্যাকাণ্ড পাকিস্তানী আর্মির অন্যতম অপরাধমূলক এবং বিশ্বাসঘাতক কাজ। তিনি লিখেন, “যদিও কমান্ডিং অফিসার সুনির্দিষ্টভাবে ফাদার ইভান্সের ব্যপারে নিশ্চিত হতে পেরেছিল, আর্মি খুব কাছ থেকে গুলি করেছিল।” মাঝি প্রতিবেদককে বলেছিল, “আমি আমার প্রাণ হারানোর ভয়ে বিমূঢ় হয়েছিলাম এবং তারা আমাকেও দুইবার গুলি করেছিল কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছিল। পরবর্তীতে আমি প্রতিবেশী আরেক মাঝির থেকে জানতে পারি যে ফাদারকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল এবং তার দেহ নদীতে ফেলে দিয়েছিল।”
২৫ নভেম্বর ১৯৭১
দখলদার আর্মির উপর প্রতিদিনকার মুক্তিবাহিনীর বিশাল আক্রমণের সংবাদ প্রতিনিয়ত বড় বড় সাফল্য বহন করছিল। এখন তারা যেখানে ইয়াহিয়া খানের বাহিনী রয়েছে সকল দিক দিয়ে এবং সকল ক্ষেত্রে জোরালোভাবে তাদের আক্রমণগুলো চালাচ্ছে। বিশ্ব গণমাধ্যমের প্রায় সকল প্রধান প্রধান অঞ্চলগুলো মুক্তিবাহিনীর সাফল্যের প্রতিবেদন করে।
যুক্তরাষ্ট্রে নিউ ইয়র্ক টাইমসের শিরোনাম ছিল, “বাঙালি গেরিলাদের আশা উঁচু।” বাংলাদেশী মুখপাত্র ম্যালকম ব্রাউন লিখেন, “এশিয়ান রণ কৌশলী মাও-সে-তুং এর সমর নীতি অনুসরণ করে, বাংলাদেশের বেশীর ভাগ অংশ মুক্তি বাহিনীর যোদ্ধা গেরিলাদের স্বর্গ।” তিনি মুক্তিবাহিনীর নেতা বলেছেন বলে উল্লেখ্য করে আবার লিখেন, “যদি আপনারা বিদেশীরা আমাদেরকে অস্ত্র এবং গুলি সরবরাহ করেন, যা আমাদের প্রয়োজন, আমরা পাকিস্তানী আর্মিকে ৭ দিনের মধ্যে বের করে দিতে পারব।” প্রতিবেদক আবার লিখেন, “মোটর লঞ্চ ও সাম্পান দিয়ে যাওয়ার সময় আমি ঢাকার দক্ষিণে এক ছোট গ্রামকে গেরিলারা পাহারা দিতে দেখেছি। গেরিলাদের এই গ্রামটিতে বন্যা প্রবণ বাংলাদেশের অনেক গুলি গ্রামীণ সম্প্রদায়ের অবস্থান, যা কাছের রাস্তা বা পায়ে হাঁটা পথের থেকে ২০ মাইল দূরে। বিভিন্ন দিক হতে অনুপ্রবেশ করে এম্বুশ করতে এতে কেবল পানি ভরা গভীর খাল দিয়ে যেতে হয়।” “এর মত মুক্তাঞ্চলগুলোর গেরিলারা আর্মি আক্রমণ থেকে সম্পূর্ণরূপে নিরাপদ বোধ করছেন এবং বাড়ি গুলোতে বাংলাদেশী পোস্টার ও দেশপ্রেমী বন্দী বাঙালি নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি শোভা পাচ্ছে।” প্রতিবেদক মুক্তিবাহিনী সংঘটনকে আবারও সাধুবাদ জানিয়ে বলেন, “গেরিলারা যখন ঢাকা কিংবা অন্য জায়গায় যান, তখন একটি সম্প্রসারিত সংকেত এবং গোপনীয় ব্যবস্থার মাঝে যেকোনো শক্তিশালী মিলিটারি বাঁধা অতিক্রম করেন।” তিনি আবার লিখেন “কোথায় জয় করা স্বাধীন অঞ্চল শেষ এবং অন্যগুলো শুরু এর একটি সম্পূর্ণ ধারণা রাখা বাংলাদেশে অবস্থান করা প্রত্যেকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বাহ্যিকভাবে, বিদেশী কূটনৈতিকগণ এবং সামরিক পর্যবেক্ষকদের মতে চার ভাগের এক ভাগ অঞ্চল গেরিলারা নিয়ন্ত্রণ করছে যারা কমপক্ষে ১০০০০০ জনের একটি বাহিনী বলে দাবী করে। কিন্তু পাকিস্তানী আর্মি কর্তৃক দখলকৃত অঞ্চলেও তাদের কর্তৃত্ব খুবই কম।”
ম্যালকম ব্রাউন আবারও লিখেন যে গেরিলা কমান্ডার আমাকে বলেছে, “সকল গেরিলা আক্রমণের মূল যেটা থাকে যে, আমরা শত্রুর থেকে আমাদের অস্ত্র চিনিয়ে নেই।” তিনি আবার উল্লেখ করেন, “গেরিলাদের দুটি আলাদা অঞ্চলের সাথের যোগাযোগ দ্রুত ও বিশ্বাসযোগ্য বলা যায়।” আমার অবস্থানের সময় দূরবর্তী এলাকা থেকে একটি প্লাস্টিকের বাক্স এবং নির্দেশনামূলক প্রচারনা পোস্টার ও হাতে লেখা মুক্তিবাহিনী পত্রিকার কপি বহন করে একজন গেরিলা আসে।
“বাংলাদেশী বাহিনীরা অত্যাবশ্যক যোগাযোগগুলোর উপর কর্তৃত্ব স্থাপন করছে।” ছিল ১৮ নভেম্বর টাইমস অব লন্ডনের শিরোনাম। এটি বলে, বাংলাদেশের গেরিলারা দর্শনা শহর আয়ত্তে নিয়েছে। চালনা বন্দরের সাথে দক্ষিণ ও পূর্বের জেলা গুলোর মধ্যবর্তী প্রধান সংযোগ সড়কগুলোর উপর কর্তৃত্ব নেয়ার জন্য মুক্তি বাহিনীর উদ্দেশ্য এই সেক্টরকে আরও পূর্বে বিস্তৃত করা। কুষ্টিয়া, যশোর এবং খুলনার মত গুরুত্বপূর্ণ শহরের কর্তৃত্ব নেয়ার জন্যও এই সড়কের কর্তৃত্ব নেয়া অত্যাবশ্যক।
১৮ নভেম্বরে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের এক বিতর্কে জন স্টনহাউজ আবারও ব্রিটিশ সরকারকে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে বলে। হাউজ অফ কমেন্সের এই বিতর্কে লেবার সরকারের সাবেক ক্যাবিনেট মন্ত্রী বলেন বাংলাদেশে সংঘটিত ধর্ষণ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রর নিস্ক্রিয়তা কোন কিছু করতে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে এবং কিছু উদ্যোগ নেয়া জরুরী যেমন, পূর্ব বাংলা থেকে ইয়াহিয়া খানকে তার সৈন্য বাহিনীকে এসব বন্ধ করতে বলা, শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে বলা এবং পূর্ব বাংলার মানুষকে তাদের নিজেদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের ক্ষমতা দেয়া।
তিনি বলেন, “আওয়ামীলীগ নেতারা যারা হত্যাকাণ্ড থেকে বেঁচে যাচ্ছে ও পালাচ্ছে, তারা স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র ঘোষণা করেছে এবং অস্তিত্বে আসা এই রাষ্ট্রকে আমাদের জানা উচিৎ।”
২৯ নভেম্বর, ১৯৭১
মুক্তি বাহিনীরা এখন সপ্তাহ বাংলাদেশের সকল সেক্টর জুড়ে দখলদার বাহিনীর সাথে হিংস্র যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার শপথ নেয়। “বাংলাদেশের গেরিলাদের দ্বারা শহর মুক্তি” ছিল ২৩ নভেম্বরে মর্নিং স্টার অব লন্ডনের শিরোনাম। এটি বলে, “ইয়াহিয়া খানের বাহিনীর সাথে তুমুল যুদ্ধ শেষে বাংলাদেশের যশোর জেলার চৌগাছা শহর বাংলাদেশী বাহিনী স্বাধীন করেছে।” এটি আবারও উল্লেখ করে, “চৌগাছা আয়ত্তে আনার পর, যশোর শহরের ১৪ মাইল উত্তর-পূর্বে, ইয়াহিয়া খানের বাহিনী নাভারণ শহরে স্থগিত করে যেখান থেকে তারা বাংলাদেশী মুক্তি বাহিনীর উপর পাল্টা আক্রমণ চালাচ্ছিল।” এটি আবারও বলে, “মুক্তি বাহিনী সপ্তাহান্তে পূর্ব বাংলার সীমান্তে কুষ্টিয়া, খুলনা এবং যশোর জেলায় আক্রমণ করে এবং চৌগাছা দখলের আগে যশোর জেলার ২৩ মাইল উত্তর-পশ্চিমের মহেশপুর অধিকৃত করে।” পত্রিকাটি আবারও লিখে, “পাকিস্তানী সেনা বাহিনী যশোর ও কুষ্টিয়া সেক্টরে ক্রাক কমান্ডোর সাথে সংঘর্ষের পর বিপুল পরিমানে ট্যাঙ্ক প্লেন ও লোকবল হারানোর ফলে সংকটে ভুগছে। কমান্ডোরা এই দুই সেক্টরে অনেক অঞ্চল স্বাধীন করছে।”
এটি আবারও নিশ্চিত করে, “মুক্তিবাহিনী একটি ভয়ানক এবং দুর্দান্ত যুদ্ধের পর খুলনা জেলার সীমান্তবর্তী দেভালা স্বাধীন করে।” বাহিনীটি কালীগঞ্জও দখল করে এবং সেখানে থেকে সামনে অগ্রসর হয়। পত্রিকাটি আবারও বলে, “বাহিনীটি কুষ্টিয়া থেকে ভারতীয় সীমান্ত শহর বানপুর ও গিদি এর কাছের কামান বেষ্টিত শহর জীবননগর ও দামুরহুদা স্বাধীন করতে অগ্রসর হয়। ইয়াহিয়ার বাহিনীর অনেক হতাহত হয় এবং মুক্তিবাহিনীর ২৫ পাউন্ড ওজন কামানের সেলের বিস্ফোরণের শব্দ কৃষ্ণনগরের ২০ মাইলেরও দূর থেকে শুনতে পাওয়া যায়।”
“গেরিলারা বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ অর্জন করেছে” ছিল ২৩ নভেম্বরের দ্যা টেলিগ্রাফের শিরোনাম। দিল্লি থেকে পত্রিকাটির প্রতিবেদক ডেভিড লোসাকের রিপোর্টে বলেন, “বাংলাদেশে বাংলাদেশ সরকারী গেরিলারা পাকিস্তানী আর্মিদের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অর্জন করেছে। গেরিলারা কুষ্টিয়া, খুলনা এবং যশোর জেলায় পুনরায় দেখা করার কথা বলেছিল এবং চৌগাছা শহর দখল করেছে।”
লন্ডনের দ্যা ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস ২৩ নভেম্বরে প্রতিবেদন করে, “মুক্তি বাহিনী বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা যেমন দক্ষিণ থেকে রংপুর এবং উত্তরে সিলেটে পাকিস্তানী ১০টি অবস্থান একযোগে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। শেষ শুক্রবার থেকে চলা যুদ্ধে গেরিলারা পাকিস্তানী বাহিনীর বহু হতাহত করে।” এটি আবারও বলে, “মুক্তিযোদ্ধারা একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর কুষ্টিয়া এবং যশোর জেলার ১৪টি গ্রাম স্বাধীন করে।”
“ফিনান্সিয়াল টাইমের মুল শিরোনাম ছিল “বাঙালি গেরিলারা চাপ প্রয়োগ করছে।“। করাচি থেকে এদের প্রতিনিধিদের পাঠানো কাগজপত্রের ভিত্তিতে এই সংবাদপত্র লিখেছে, “ মুক্তিবাহিনী গেরিলারা সামরিক প্রশাসনের উপর চাপ বৃদ্ধি অব্যাহত রাখছে…… সামরিক শাসনতন্ত্রের গেরিলাদের তাদের কার্যাবলির বৃদ্ধি রোধ করার জন্য বিগত কয়েক সপ্তাহে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া সত্ত্বেও প্রতিনিয়ত অন্তর্ঘাতী কার্যাবলির তীব্রতা বৃদ্ধির মাধ্যমে পরিস্থিতিকে ঘোলাটে এবং কঠিন করা হচ্ছে। এখানে আরও বলা হয়েছে যে, “ গেরিলাদের বেছে নেয়া লক্ষ্যের মধ্যে শিল্প স্থাপনা, যোগাযোগ ব্যহত করা এবং সরকারের সাথে সহায়তা করা শান্তি কমিটির সদস্যদের গুলি করে হত্যা করা এই উদ্দেশ্যে যে, চারিদিকে আতঙ্ক সৃষ্টি করা এবং এই মাত্রা পর্যন্ত নাগরিক জীবন ও প্রশাসনকে অচল করে দেয়া যাতে তারা স্বাভাবিক পরিস্থিতে ফেরার আশা পরিত্যাগ করে।
নভেম্বর ২২ এ ব্রিটেন এর স্কটসম্যান পত্রিকার শিরোনাম ছিল, “ রাজাকারেরা বাংলাদেশী শক্তিকে সহায়তা করছে”। এখানে বলা হয়, বাংলাদেশে রাজাকারেরা পুর্বের মত বর্তমানে সেই গোষ্ঠী নয়। তারা অন্ততপক্ষে গেরিলাদের কিছু অংশের কাছে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর জন্য নতুন পন্থা অবলম্বন করেছে। সূত্রমতে, সম্প্রতি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিয়োগ দেয়া রাজাকারেরা গেরিলাদের সেনাবাহিনীর ব্যাপারে গুরুত্ত্বপূর্ণ তথ্য দিয়ে সহায়তা করছে। রাজাকারেরা মুক্তিবাহিনীর কমান্ডোদের পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমনের পরিকল্পনার পুর্বেই স্থান ত্যাগ অথবা প্রতিরক্ষামুলক অবস্থান নেয়ার জন্য খবর প্রদান করছে। এখানে আরও উল্লেখ করা হয় যে, মুক্তিবাহিনীর সাম্প্রতিক অনেক সাফল্যের পেছনে রাজাকারদের প্রাথমিকভাবে দেয়া তথ্যের ভুমিকা রয়েছে। রাজাকারেরা মুক্তিবাহিনীকে প্রতিরক্ষামুলক সুরক্ষাও প্রদান করছে।
১০ ডিসেম্বর, ১৯৭১
ব্রিটেনের সমস্ত অংশে এবং অন্যান্য জায়গায় বাঙালিরা বাংলাদেশ সরকারকে ভারত কর্তৃক স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার খবরে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছে। ইয়ান রোডী, ডেইলি এক্সপ্রেসের বিশেষ সংবাদদাতা, প্রথম পৃষ্ঠার বিশেষ সংবাদে বলেন যে, সুদিঘের বিষণ্ণ ও নিশ্চুপ গ্রামবাসীরা আনন্দে অত্যন্ত উচ্ছ্বসিত।
জন পিলগার, ডেইলি মিরর যার এক দিনে প্রায় পনের কোটি কপি প্রকাশিত হয় তার প্রধান আন্তর্জাতিক প্রতিবেদক ছিলেন প্রথম একজন আগন্তুক যিনি প্রত্যক্ষ করেছেন ১৯৬৭ এর ইসরায়েল এর ছয় দিন ব্যাপী যুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় এবং কর্মক্ষম একটি সফল ঘটনা। একজন বাংলাদেশী বৃদ্ধ পিলগারকে বলেন যে, “ আমার বন্ধু, তুমি দেরি করে ফেলেছ। তারা আমাদের অনেক নারী এবং মেয়েদের এবং অনেক তরুণকেও মেরে ফেলেছে। কিন্তু তবুও আমরা আনন্দিত যে আমরা জয় বাংলা পেয়েছি”।
এখানে এবং পশ্চিমের বিভিন্ন অংশে যে প্রতিক্রিয়া পুর্ব বাংলার বিভিন্ন অংশে ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর কার্যক্রম পরিচালনার কারণে সৃষ্টি হয়েছে, আপাতদৃষ্টিতে প্রতীয়মান হয় যে, এটিকে যুদ্ধের কার্যক্রমের প্রচেষ্টার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হচ্ছে। দ্য টাইমস অফ লন্ডনের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, বাস্তবসম্মত নীতিমালা অনুসরণ করার জন্য এবং এই পরিক্ষায় শক্তি প্রদর্শনের জন্য ভারতকে দোষারোপ করা ভুল হবে। দীর্ঘ ৮ মাস যাবত পাকিস্তানী সরকার পুর্ব অংশের রাজনৈতিক বাস্তবতা থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এখানে আরও বলা হয়েছে যে, তারা এখন নিজেদেরকে বিনা উস্কানিমূলক আক্রমনের মাধ্যমে রাজনৈতিক ভুক্তভোগী হিসেবে উপস্থাপন করে আন্তর্জাতিক সাহায্য নিজেদের দিকে আনতে পারার আশা করতে পারে না। এবং ইন্ডিয়া যদি হিসেব করে দেখে যে তাদের নেয়া সত্ত্বর পদক্ষেপের কারণে মানব দুর্দশা কমে আসবে, তবে তাদেরকে কেউ ঢালাওভাবে ভুল বিবেচনার দোষ সহজে দিতে পারবে না। টাইমস অফ লন্ডন একই অনুচ্ছেদে বলেছে যে, যাইহোক, সেই মুহুর্তের জন্য পাকিস্তান সরকার তীব্রভাবে তার আরোপের প্রাপ্তি স্বীকারের ইচ্ছা প্রকাশ করেছে এবং বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা ফিরিয়ে দেয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে।
অপরপক্ষে, পশ্চিম জার্মানি এবং ফ্রান্সের পত্রিকাগুলোতে প্রকাশিত মন্তব্য সাধারনত একই সংবাদের প্রতি ইঙ্গিত করে। লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়ার সম্ভাব্য লক্ষ্য ছিল ইন্ডিয়াকে রণকৌশলে হারানোর জন্য বাঙালিদের সাথে নিয়ে একটি বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠা করা কিন্তু তা ব্যর্থ হয়েছে।
ডিসেম্বর ৬ এর টাইমস অফ লন্ডনে বলা হয়েছে, “যেহেতু পাকিস্তান বিশ্ব নেতাদের করা সকল আবেদনের সতর্কবানীকে প্রত্যাখান করেছে, ইন্ডিয়া বিশ্বাস করে যে বাংলাদেশের জন্য সমাধান জারি করার জন্য তার আওয়াজ তোলা ব্যতীত ভিন্ন রাস্তা নেই। এখানে আরও বলা হয়েছে যে, পূর্বে ২৫ মার্চ থেকে পাকিস্তানী ব্যবহারের নির্মমতা বিবেচনা করে, শত কোটি শরনার্থীর উপর চাপিয়ে দেয়া দুর্দশা বিবেচনা করে এবং বাংলাদেশের প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের পেছনে শক্ত যুক্তির কথা চিন্তা করে পাকিস্তান দুর্বল এবং কলঙ্কিত দলিলের মাধ্যমে এই দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করেছে। ডিসেম্বর ৬ এ টাইমস অফ লন্ডনের পরামর্শ অনুযায়ী, “ এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে উত্তম পন্থা হতে পারে বাংলাদেশে ইন্ডিয়ার একটি আশু বিজয় যাতে ইন্ডিয়া পশ্চিম পাকিস্তানী আক্রমনকে প্রতিহত করতে পারে।
স্যার এলেক ডগলাস হিউম, ব্রিটিশ পররাষ্ট্র সচিব, হাউস অফ কমন্সে দেয়া বক্তব্যে ভারতীয় উপমহাদেশের উপর কোন প্রকার মূল্যবিচার থেকে নিজেকে বিরত রেখেছেন। বিরোধীদলীয় নেতা মি হ্যারল্ড স্যার এলেকের মনোভাবের মত নিজেকে যুদ্ধের উপর উত্থিত কোন সমস্যার চটজলদি বিচারে না পৌঁছনয় নিজেকে যুক্ত করেছেন।
মি জন স্টোরহাউস, পার্লামেন্টের নেতৃ সদস্য এবং সাবেক মন্ত্রীপরিষদ সদস্য স্যার আলেককে ইউ এন প্রস্তাবনে সমর্থন না করার জন্য অভিনন্দন জানিয়েছেন এবং ঘোষণা করেছেন যে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অধিকারকে স্বীকৃতি না দেয়ার জন্য বিশ্ব নেতৃবৃন্দ দোষারোপের যোগ্য।
১১ ডিসেম্বর, ১৯৭১
পূর্ব জার্মানির সংবাদ সংস্থা এডিএনের মাধ্যমে প্রচার হওয়া একটি বক্তব্যে পুর্ব জার্মানির সরকার সোভিয়েতের স্থানকে সমর্থন দিয়ে বলে যে ভারতীয় উপমহাদেশে এই রক্তপাত অবিলম্বে বন্ধ হওয়া উচিত। এই বক্তব্য বলা হয় যে, “ পূর্ব জার্মানি ভারতীয় উপমহাদেশের পরিস্থিতির উপর উদাসীন ছিলনা এবং এখনও নয়”। এখানে বলা হয়, “ বিশ্ব শান্তি রক্ষার্থে নিয়োজিত দায়িত্ববান সরকার প্রধানেরা বাংলাদেশে একটি শান্তিপূর্ন সমঝোতা নিশ্চিত করার জন্য পাকিস্তানের কাছে অনেকবার আবেদন করেছেন কিন্তু জেনারেল ইয়াহিয়া খান এটির পক্ষে সাড়া দেননি।
প্যারিসে ফ্রেঞ্চ কমিউনিস্ট পার্টি একটি বক্তব্যে বলেছে “ ইন্ডিয়ার সাথে পাকিস্তানের যুদ্ধাবস্থায় যাওয়ার ঘোষণা এশিয়ায় একটি অত্যন্ত ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে”। এই বক্তব্যে আরও বলা হয় যে, “ এই দ্বন্দ্ব গত বছর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ব্যাপক সাফল্যকে ইয়াহিয়া খানের সরকার স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করায় আরও ত্বরান্বিত হয়েছে” ।
কমিউনিস্ট পার্টির সংবাদপত্র লা হিউমানিতে তে একজন ভাষ্যকার বলেন যে, “ এটি একটি অত্যন্ত তাৎপর্যপুর্ন ব্যাপার যে এখনও তারা তাদের মুল লক্ষ্যকে হারিয়ে যেতে দেয়নি। এবং এই ৮ মাসব্যাপী এই কার্যপরম্পরা এখন শুধুমাত্র একটি ইন্দো-পাকিস্তান দ্বন্দ্ব নয়, একটি যুদ্ধ যা বাংলাদেশের উপর পাকিস্তানী সামরিক সরকার ছেড়ে দিয়েছে।
ডিসেম্বর ৭ এর টাইমস অফ লন্ডন লেখে, “ ইন্ডিয়া এখন বাংলাদেশে যুদ্ধের রাজনৈতিক সমাপ্তি নিশ্চিত করতে চাইছে এই আশায় যে এটি করলে সামরিক শক্তির পতন শীঘ্রই ঘটবে। সমঝোতার কোন স্থান নেই, কোন অংশ থেকে কোন প্রতিবাদের জায়গা নেই, জাতিসংঘে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবনা হবে না এবং পর্যবেক্ষকদের যুদ্ধরত দেশগুলোর মধ্যে অবস্থান ইন্ডিয়ার সংকল্পকে পরিবর্তন করবে না।লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফ বলেছে, “ ইন্ডিয়ার নীতি এবং পরিস্থিতি যা বাংলাদেশ সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে পৌঁছানর কথা বিবেচনায় আনলে এই সিদ্ধান্ত বাস্তবিকপক্ষে যুক্তিযুক্ত হয়েছে।
দ্য গার্ডিয়ান লিখেছে, “ বাংলাদেশ যা সংকল্প ও রক্তের মাধ্যমে জন্মেছে এখন হার স্বীকার করবে না। এমনকি যদি শান্তির জন্য আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা মিসেস গান্ধীর আওয়ামী লীগ সরকারের স্বীকৃতি সফল হয় তবে এই সরকার বাস্তবিক আঞ্চলিক নিয়ন্ত্রন দ্বারা সমর্থিত হবে। রয়টার্স প্রতিবেদন দিয়েছে যে, “ রেডিও মস্কো আজ বর্তমান পরিস্থিতে জাতিসংঘে ইন্দো-পাকিস্তান দ্বন্দ্বে শান্তিপুর্ন সমাধান খুজে বের করার জন্য চীনের আন্তরিকতার অভাবকে দায়ী করেছে”। এখানে আরও বলা হয় যে, “ চীন পুজিবাদীদের সাথে মিলিত হয়ে জাতীয় মুক্তির আন্দোলনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে”।
ডিসেম্বর ৭ এর দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস রাষ্ট্রপতি নিক্সনকে ইন্দো- পাকিস্তান দ্বন্দ্বে নিরপেক্ষতার আড়ালে পাকিস্তানকে সমর্থন দেয়ার জন্য দায়ী করেছে। সকল সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, “বাংলাদেশে নিপীড়ন বন্ধ করার জন্য অথবা আসল রাজনৈতিক সমঝোতার ক্ষেত্রে চাপ প্রয়োগে সবকিছু ব্যর্থ হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে স্পষ্টভাবে ইন্ডিয়াকে এই চলমান আন্তর্জাতিক দ্বন্দ্ব এর পেছনে প্রধান দায়ী বলে অভিহিত করেছে যা কয়েক মাস অপেক্ষা করেছে পাকিস্তানে অস্ত্র সাহায্য পাঠানো বন্ধের পেছনে। প্রশাসন এখন তাৎক্ষণিকভাবে ইন্ডিয়ায় অস্ত্র সাহায্য বন্ধ করে দিয়েছে। এটিকে কোনভাবেই পুরোদস্তর নিরপেক্ষতা বলা যায় না। এই সম্পাদকীয়তে আরও বলা হয় যে, “ জাতিসংঘে প্রথমে নিরাপত্তা পরিষদ এবং এখন সাধারণ পরিষদে যুক্তরাষ্ট্র লক্ষ্য প্রচেষ্টা হল একটি সাধারণ অস্ত্রবিরতি চুক্তি তৈরি এবং সৈন্য প্রত্যাহার”।এই ধরনের কার্যক্রম নিশ্চিতভাবেই জরুরি এবং প্রয়োজনীয়, কিন্তু কার্যগতভাবে এটি সফল হতে পারবে না যতক্ষণ না জাতিসংঘ এবং এর প্রধান সদস্য দেশগুলো বিশেষভাবে যুক্তরাষ্ট্র একই সময়ে স্বীকৃতি দেয়া এবং পাকিস্তানের সাথে এই সমস্যার মূল কারণ নিয়ে কাজ করার প্রচেষ্টার জন্য তৈরি হচ্ছে।
রাষ্ট্রপতি নিক্সনের সম্মান বাচানোর জন্য শেষ মরিয়া চেষ্টা হিসেবে তিনি বলেন যে দক্ষিণ এশিয়া দ্বন্দ্বের ক্ষেত্রে আমেরিকা একদম নিরপেক্ষ থাকবে। সম্পাদকীয়তে আরও বলা হয় যে, “ ইন্দো-পাকিস্তান দ্বন্দ্বে রাষ্ট্রপতি নিক্সনের পুর্ন নিরপেক্ষতার ঘোষণা প্রশাসনিক রাজনিতিকে লুকোতে ব্যর্থ হয়েছে, যেটি আসলে ইসলামাবাদে ইয়াহিয়া খানের সরকারের পক্ষে নিশ্চিতভাবেই পক্ষপাতদুষ্ট”।
<005.022.450-451>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
শিরোনম | সূত্র | তারিখ |
২২। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত ইংরেজী প্রতিবেদনমালা | স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের দলিলপত্র | জুন-নভেম্বর ১৯৭১ |
১৫ জুন, ১৯৭১
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত ইংরেজী প্রতিবেদনমালা।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের দলিলপত্র, জুন-নভেম্বর’ ১৯৭১
(প্রতিবেদনগুলী আলমগীর কবির রচিত)
পশ্চিমাদের উদাসীনতা দুঃখজনকঃ বাংলাদেশ বায়াফ্রা বা ইন্দোনেশিয়া না।
বাংলাদেশ বিয়োগাত্মক ঘটনার ব্যাপারে পশ্চিমা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত হয়েছে খুবই মন্থর গতিতে। এই বিষয়টা লন্ডন, নিউইয়র্ক ও ওয়াশিংটন ভিত্তিক পত্রিকাগুলোর বরাতে তথ্য উপাত্তসহ একাধিকবার গুরুত্বসহকারে প্রকাশিত হয়েছে। তবে শীতল অভ্যর্থনার প্রতি বাংলাদেশের জনগণের প্রতিক্রিয়া খুবই প্রবল। কারণ আমরা জানি হাজার হাজার নিরপরাধ জীবন রক্ষা করা যেতো যদি পশ্চিমা জনগণ ও সরকার বাংলাদেশের জনগণের উপর অযৌক্তিক গণহত্যা বন্ধ করতে অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া ইয়াহিয়া শাসনের উপর চাপ প্রয়োগ করতো। এটাই হতো বাস্তবতা। আমরা বিশ্বাস করতে পারি না বিংশ শতাব্দির সভ্যতা একটি নারকীয় তান্ডবলীলার নীরব দর্শক হতে পারে যা অকার্যকর ও চূর্ণ করেছে সকল লালিত আদর্শকে। তারা আশায় এবং প্রতিক্ষায় ছিলো। আশা না থাকলেও তারা আশায় ছিল, প্রতিক্ষায় ছিল। দীর্ঘ দিনগুলো একে একে সপ্তাহ হয়েছে, সপ্তাহ মিলে মাস হয়ে গেছে কিন্তু ফাঁকা বুলি ছাড়া আর কিছুই মেলেনি।
এমন কিংকর্তব্যবিমূঢ় বিরাগের কারণ কী? ইতোমধ্যে বিশ্ব সংবাদ মাধ্যম বলছে, বাংলাদেশ ট্র্যাজেডি ভিয়েতনামের চেয়েও মর্মান্তিক। এখন কোথায় সেই হাজার হাজার শ্বেতাঙ্গ চরমপন্থিরা, ছাত্ররা আর শান্তিকামীরা যারা দঃ আফ্রিকা ও ভিয়েতনামের যেকোন ঘটনায় উন্মত্ত হয়ে যেতে পারে? মিলিট্যান্ট ব্ল্যাক পাওয়ার মুভমেন্ট এবং নারীমুক্তি আন্দোলন নিশ্চুপ কেনো?
বাংলাদেশের বিরূদ্ধে ইয়াহিয়ার গণহত্যা বর্ণবাদীও, সাম্প্রদায়িকও। তর্জন গর্জন করা সেই বর্ণবাদবিরোধী ক্রুসেডারগণ এখন কোথায়? পশ্চিমাদের এই সামগ্রিক বেদনাবোধহীনতা দেখে মানুষ সহজেই বিশ্বাস করে নিবে যে প্রযুক্তিগত সভ্যতার অগ্রগতি স্বত্বেও বিশ্ব আত্মিকভাবে উপনিবেশবাদ বা দাসপ্রথার যুগেই রয়ে গেছে। এটা জাতীয়তার বিভক্তি নয় বরং দুটি স্বতন্ত্র অঞ্চলের সংখ্যাগুরুদের সাথে শ্বেতাঙ্গ ও অশ্বেতাঙ্গদের মধ্যে সহজাতভাবে বিভক্তি হিসেবে বিশ্বাস করতে চাই। শ্বেতাঙ্গ চরমপন্থিরা কেবল তখনি বিবেকের তাড়নায় ভোগে যখন তাঁরা অশেতাঙ্গদের কাছাকাছি আসে। কিন্তু অশ্বেতাঙ্গরা যখন নিজেরা নিজেদের মধ্যে গণহত্যা চালায় তখন তাঁরা (শ্বেতাঙ্গরা) নিজেরা একত্রিত থাকার প্রয়াস চালায় এবং গোপন আনন্দ উপভোগ করে। আমি আশা করি আমার বিশদ ব্যাখ্যা ভুল নয়।
পশ্চিমা বিরাগের দ্বিতীয় কারণ হতে পারে এই যে, ইয়াহিয়া সরকার কিছু দ্বায়িত্বহীন পশ্চিমা সাংবাদিকদের দ্বারা বিদ্বেষপরায়ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ট্র্যাজেডির সংবাদ প্রচারের মাধ্যমে কিছু শ্বেতাঙ্গদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে বাংলাদেশর স্বাধীনতা আন্দোলন আসোলে বায়াফ্রার মতো বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন যা শেষ পর্যন্ত পরাজয় ছাড়া আর কিছুর দেখা মিলবে না। একটি পশ্চিমা রেডিও এখনো আমাদের যোদ্ধাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী গেরিলা বলে অভিহিত করে যাচ্ছে। ইয়াহিয়ার কৈফিয়ত দাতারা উদাহরণ হিসেবে ইন্দোনেশিয়ার সুহার্তোকে তুলে ধরে এবং বলে যে তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয় জাতিয়তাবাদী নেতা সুকর্নকে সফলতার সাথে অপসারন করেছে সাবলীলভাবে অর্ধ মিলিয়ন পিকেআই মেম্বারদের হত্যা করে। জোর দিয়ে বলা যায় যে, ইয়াহিয়াও শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে এবং পাকিস্তানকে একত্রিত রাখতে আওয়ামী লীগ ও বাঙ্গালি বুদ্ধিজীবি সম্প্রদায়কে ধ্বংস করতে চাইছে। গণহত্যা শুরুর আগে জুলফিকার আলী ভুট্টোর করাচি সাপ্তাহিক কম্ব্যাটে এই পরিনতির ইঙ্গিত দিয়েছে এবং সতর্ক ছয় দফার মাধ্যমে অতিমাত্রায় স্বায়ত্বশাসনের দাবি না করতে বাংলাদেশের জনগণকে সাবধান করে দিয়েছে।
বলাই বাহুল্য যে, টেরা ফ্যাসিস্টরা রাজনৈতিক দূরবীক্ষণের ভুল দিক দিয়ে পরিস্থিতি অবলোকন করছে। তারা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন নয় এবং সংকটাপন্ন বিষয়গুলো মূলতঃ ঐসব বায়াফ্রা অথবা ইন্দোনেশিয়ার ইস্যূগুলো থেকে ভিন্ন। ইন্দোনেশিয়ার সুহার্তো সফল হয়েছিলো কারণ সে গণহত্যা চালায়নি এবং লক্ষ্য ছিলো শুধুমাত্র কমিউনিস্ট পার্টির বিলোপ ঘটানো যে দলটা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সিকিভাগ জনপ্রিয়তার আস্বাদও পায়নি। আর বায়াফ্রার ইস্যূটি ছিলো মূলতঃ উপজাতীয় প্রকৃতির এবং এটা ছিলো অপ্রতিরোধ্য একটি বৃহৎ অংশের সাথে একটি ছোট সংখ্যালঘু বিদ্রোহ। যা ছিলো আগা গোড়া সশস্ত্র ভুমিকার এবং যার ফলে শুরুতেই অবধারিত ভাগ্য নিরূপিত হয়ে গিয়েছিল। অন্যদিকে এটা একেবারে পরিষ্কার যে বাংলাদেশের বিষয়টা সম্পূর্ণ স্বাধীনতা স্বাধীনতা আন্দোলন কেন্দ্রিক। দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে একটি ফ্যাসিস্ট আর্মির সহায়তায় পশ্চিম পাকিস্তানের কায়েমি স্বার্থের দ্বারা অন্যায্য অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শোষনের বিরুদ্ধে এই ভূখন্ডের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগন আজ জেগে ওঠার সিদ্বান্ত নিয়েছে। একত্রিত থাকা তাদের জন্য অসম্ভব ছিলো যেখানে পারস্পরিক আস্থা বিশ্বাস ব্যতিরেকে শুধুমাত্র একটি ধর্ম ঐক্যের ভিত্তি হতে পারে। আরো যোগ হয়েছে অনন্য ভৌগলিক ও জাতিগত বাস্তবতার অস্তিত্ব।
যুদ্ধটা বস্তুতঃ সামরিক জান্তার একটি উন্মত্ত দুঃসাহসিক অভিযান অথচ এই মাথামোটা জান্তা এখনো তাঁদের বোকামির মাত্রা উপলব্দি করতে পারেনি। ইহা অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে পশ্চিমা বিশ্বও এই অদূরদৃষ্টির শিকার হতে পারে।
(১৬ জুন ১৯৭১)
জাতিসংঘ ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছেঃ
পাকিস্তানী সামরিক জান্তাদের দ্বারা সংঘটিত বাংলাদেশের জনগণের উপর চালানো গণহত্যা থামাতে জাতিসংঘের ব্যর্থতা বিশ্ব বিবেককে অন্যসব কিছুর চেয়ে বেশি মর্মাহত করেছে। লক্ষ লক্ষ নিপীড়ত মানুষ নিরর্থক অাশায় ছিলো জেনারেল সেক্রেটারী উ থান্ট অন্ততপক্ষে সদলবলে লুটপাটরত ফ্যাসিস্ট জান্তাদের নিবৃত করবে কারণ ইয়াহিয়ার আওতার নির্বাচনে শেখ মুজিবকে ভোট দেওয়া ছাড়া রাজনীতিতে নূন্যতম সম্পর্ক ছিলো না নির্যাতিত নির্দোষ নারী পুরুষ ও শিশুদের। শুধুমাত্র উপ-মহাদেশে না, বরং সমস্ত এশিয়ার শান্তির জন্য হুমকি মোকাবেলায় নিরাপত্তা পরিষদকে সক্রিয় করতে জাতিসংঘের ভারতীয় প্রতিনিধিদল উ থান্টকে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করানোর জন্য যথাসাধ্য প্রচেষ্টা চালিয়েছে। আর্ত পীড়িত মানুষের জন্য উ থান্টের মানবিক সাহায্যের প্রস্তাব ব্যতিত আর কোনো পদক্ষেপ গৃহিত হয়নি তাও ঐ সাহায্য আসত কেবল যদি ইয়াহিয়া খান সেটা চাইতেন। কিন্তু সাহায্য আনয়নের কোনো উদ্দেশ্য ইয়াহিয়ার ছিলো না।
*প্রতিবেদনগুলি আলমগীর কবির রচিত
<005.022.452-455>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
সেক্রেটারি জেনারেল ইউ এন অফিসিয়াল দের কাছ থেকে গনহত্যার সব খোজ খবর পেয়েছিলেন যাদের মার্চ মাসে তাদের পদ থেকে অব্যহতি দেয়া হয়নি। তিনি একে ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্য তম হত্যাকান্ড হিসাবে চিহ্নিত করেন। ইউ এন এর উপর সারা বিশ্বের এক রকম চাপ ছিল বাংলাদেশে দখল দারিত্তের ব্যাপারে , ব্রিটিশ ও আমেরিকান সংবাদ মাধ্যম গুলো ও এই ব্যাপার টিকে অনেক গুরুত্ব দিয়েছিল।
যদিও সেক্রেটারি জেনারেল কাউন্সিল এর সব মেম্বার দের একত্রিত করতে পারছিলেন না মিটীং এ বসার জন্য, কিন্তু আমেরিকা ও ব্রিটেন এর পাশাপাশি সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মনে করছিলেন বিষয়টি এত সহজ না। ইউ এন হাল ছেড়ে দিক বা না দিক , বাংলাদেশের সাধারন মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধারা স্বাধীনতার সংগ্রামে শুধু নিজেদের উপর ই ভরসা করেছিল। ইউ এন তাদের তেমন কোনো ভরসা যোগাতে পারেনি।
আফ্রিকার ব্যাপারে অনেকবার হস্তক্ষেপ করলেও তা তেমন ফলপ্রসূ হয়নি। আমরা কঙ্গো ও আফ্রিকার দিকে তাকালে বুঝতে পারব, বাংলাদেশে তাদের হস্তক্ষেপ বরং পরিস্থিতি কে আরো ঘোলাটে করে তুলতে পারে। তখন বহিরাগত শক্তি আমাদের উপর আরো বেশি নাক গলানোর সুযোগ পাবে। বাংলাদেশের একমাত্র মুখপাত্র ও নেতা শেখ মুজিবর রাহমান মার্চ মাসে বাংলাদেশের কথা বলেছিলেন যখন U thant তার লোক দের বাংলাদেশ থেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন। ইউ এন এর জন্য এটি আরেকটি বড় সুযোগ সৃষ্টি করেছিল।
কিন্তু এগুলো এখন সব ইতিহাস । বাঙ্গালীরা তাদের গভীর ক্ষত থেকে বের হয়ে এসে একতা বধ হয়েছে পাকিস্তানী হানাদার বাহীনীর বর্বরতার বিরুদ্ধে। জয় আমাদের হাতের কাছেই চলে এসেছে। এখন শধু দরকার একতা ও সাহস ও ধৈর্যের ।
ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বিতর্ক
বাংলাদেশ
লেবার পার্টির এম পি দের কল্যাণে বাংলাদেশ আবার ব্রিটিশ পারলামেন্ট এর সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হয়ে উঠেছিল। ১২০ জন সংসদ সদস্য বাংলাদেশ এর সরকার গঠনের পক্ষে ছিল ও পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বর্বরতার বিরোধিতা করেছিল। পাকিস্তানীদের এই জঘন্য গনহত্যা প্রতিরোধ করতে তারা হাউজ অফ কমন্সে মিটিং ও ডেকেছিল।
এটা ছিল তখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় খুবি সাহসি পদক্ষেপ , রাজনৈতিক বোদ্ধারা মনে করতেন, ব্রিটিশ পার্লামেন্ট এর পাকিস্থানীদের গনহত্যার ব্যাপারে যে মতামত তাতে টিকে থাকা উচিত। কিন্তু এই আলোচনার মাধ্যমে স্যার এলেক ইয়াহিয়া খানের ব্যাপারে আরো সতর্ক হতে পারবেন।
সারা বিশ্বের রাজনৈতিক বোদ্ধারা ইতোমধ্যেই বুঝতে পারছিলেন যে ইয়াহিয়া খান কত বড় বিশ্বাসঘাতক ছিলেন এবং তার দল ও সেনাবাহিনী কতটা জঘন্য ও বর্বর ছিল। ১৯৬৯ সালে আইয়ুব খানের হাত থেকে ক্ষমতা নেয়ার পর থেকে ইয়াহিয়া খান নানা রকম তালবাহানা শুরু করেছিল। পাকিস্তানী মানুষের সাথে নানা রকম শুরু থেকেই সে নানা রকম প্রতারনা করে আসছিল। তিনি আসলেই ছিলেন একজন পাকা অভিনেতা ও ধূর্ত নেতা, যেকোনো সম্মেলনেই তিনি বলতে ভুলতেন না যে তিনি একজন আর্মি ছিলেন। তিনি তার অসুস্থ মানসিকতার লোক বল নিয়ে নীল নকশা আকছিলেন যে পূর্ব বাংলায় কিভাবে স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করা যায়। তিনি ৮ কোটি টাকা ব্যয় করে সাজানো একটি নির্বাচন করেন যার প্রতিটি অর্থ ছিল জনগনের কষ্টের ট্যাক্স এর টাকা। বিদেশীরা মনে করেছিলেন জিনিষটা গুজব কারন একটি গরীব দেশের পক্ষে এত্ত টাকা ব্যয় করা সম্ভব না। কিন্তু তারা আসলে পাকিস্তানী মিলিটারিদের অস্বাভাবিক মানসিকতার সাথে পরিচিত ছিলেন না। শুধু তারা নয় কেউ ই এই ব্যাপারে ধারনা করতে পারেনি। তানা হলে ২৫ মার্চ ইতিহাসের সব চেয়ে নিকৃষ্ট ও জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডটি ঘটত না। প্রতারক ইয়াহিয়া ও তার দল এত্ত বড় মিথ্যাবাদী ছিল যে এই গনহত্যার পক্ষেও তারা নানা রকম খোঁড়া যুক্তি উপস্থাপন করছিল। তিনি ২৬ মার্চ এক সাক্ষাতকারে বলেন, এই ছাড়া তার আর কোনো উপায় ছিলনা, কারন আওয়ামীলীগ এর লোকেরা পাকিস্তানের পতাকা ও জিন্নাহর ছবি ছিড়ে ফেলেছিল। আর্মিদের কেও তারা নানা ভাবে অপমান করেছিল। এভাবে প্রতারক ইয়াহিয়া নানা রকম গল্প ফেদে বিদেশি সরকার কে বোঝানোর চেষ্টা করছিল।
কিন্তু সব ঘটনা এখন দিনের আলোর মতই পরিষ্কার ছিল। ইয়াহিয়া যে কত্ত বড় ঘৃণ্য কুচক্রী তা সবার কাছে প্রকাশ পেয়েছিল। সে যদিও পূর্বে সেনাবাহীনিতে ছিল, কিন্তু এমন জঘন্য লোক ও তার দল ছিল আর্মি দের জন্য , তাদের পোশাকের জন্য একরকম কলংক । পশিচম পাকিস্তান এর লোকদের কাছেও এই আর্মিরা বিশ্বাসঘাতক হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। ইয়াহিয়া খান এর মধেই বাংলার লোকদের বিরুধে ক্ষমতালোভী , কুচক্রি ভুট্টোকে ব্যাবহার করে ফেলেছিল। এই ঘটনা কে তারা আরো খারাপের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল।
প্রতারক ইয়াহিয়ার আসল রূপ দেখে পশ্চিমারাও তার বিপক্ষে চলে গিয়েছিল, তারা ও একটি সাধীন বাংলাদেশ দেখার অপেক্ষা করছিল। রাজনৈতিক পরিস্থিতি কে স্থিরতায় আনা সম্ভব ছিল যদি তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী নজরুল ইসলাম এর কিছু শর্ত এর উপর আলোকপাত করা হত-
১- শেখ মুজিবর রহমান সহ সব রাজনৈতিক নেতার মুক্তি।
২- বাংলাদেশ থেকে হানাদার বাহিনী সরিয়ে নেয়া।
৩- বাংলাদেশের সরকার কে স্বীকৃতি প্রদান ।
৪- ১৯৪৭ থেকে এখন পর্যন্ত যাযা ক্ষতি হয়েছে বিশেষ করে ২৫ মার্চ কাল রাতের ভয়াবহতা এর ক্ষতিপূরণ দেয়া ।
২৫ জুন ১৯৭১
বাঙালি হত্যার জন্য আরও আমেরিকান অস্ত্র
আপসো বাংলাদেশকে বুঝতে অপারগ
এই সময়ে ইউ এস সরকারের ভূমিকা আমাদের জন্য আরো পরিস্থিতিকে আরো ভয়াবহ করে তুলেছিল। যেখানে ১০ লাখ লোক ইতোমধ্যেই প্রান দিয়েছিল, সেখানে ইউ এস পাঠানো আর্মি দের জন্য অস্ত্র পরিস্থিতি কে আরো খারাপ করে তুলেছিল। যদিও ২৫ মার্চের ভয়াবহতার পর আরমি দের কোন কিছুর সাপ্লাই দেয়া কংরেস থেকে নিষিদ্ধ ঘোষনা করা হয়েছিল, এরপরে ও নিউইয়র্ক থেকে তাদের জন্য বিশাল পরিমান অস্ত্র এসেছিল। স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে এই অস্ত্রের লাইসেন্স দেয়া হয়েছিল, ৩১ মার্চ ও ৬ এপ্রিল এই অনুস্মতি দেয়া হয় এবং এতে বলা হয় যে , ২৬ মার্চ এর দেয়া নিষেধাজ্ঞার এখন আর কোনো কার্যকরীতা নেই।
এই ঘটনা জানার পর সিনেটর স্টুয়ারট সিমিংটন বলেন, স্টেট ডিপার্টমেন্ট যেহেতু এর অনুমতি দিয়েছে তার মানে তারা জানেনা যে আসলে সেখানে কি হচ্ছে। এরপর সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি তাদের সরকারকে ঘটনার সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন করেন। এর মধ্যেই খবর পাওয়া যায় যুদ্ধের অনেক সরঞ্জাম নিয়ে ৩য় শীপমেন্ট পাকিস্তানে রওয়ানা দিয়েছে। এ ঘটনা শুধু আমেরিকা না সারা বিশ্বকেই হতবুদ্ধি করে দেয়।
বাংলাদেশে বসে আমরা চিন্তা করি যে স্টেট ডিপার্টমেন্ট এ আসলে প্রো পাকিস্তান সেইল বলে কিছু আছে কিনা, কোনো এমন পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী আছে কিনা যারা মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে এসব শীপমেন্টের ব্যাবস্থা করছে। যদি এমন কিছু থেকে থাকে তাহলে তাৎক্ষনিক ব্যাবস্থা গ্রহন করা উচিত আরো বড় ক্ষয়ক্ষতি হবার পূর্বেই ।
পাকিস্তানী আর্মিরা ছিল অতি ধূর্ত । তারা সরকারের কোনো পদক্ষেপ আগে থকেই অনুমান করে ফেলতে পারলে এমন স্মভাবনা চাহে যে কার্গো থেকে এসব মারণাস্ত্র অন্য কোনো জাহাজে করে নিয়ে যাবে। তাই আর দেরি করার মত সময় নাই, আমেরিকার সরকার কে অতি দ্রুত ই কোনো পদক্ষেপ নিতে হবে।
এমন সময় মিড ইস্টার্ন ফন্ট থেকে আরেকটি খারাপ খবর আসে। আফ্রো এশিয়ান সমন্বয়কারী সংস্থা দামাস্কাস এ তাদের ১০ম সম্মেলন করে কিন্তু সেখানে পাকিস্তান বাহিনীর এই নারকিয়তা তাদের সহানুভূতি অর্জনে ব্যারথ হয়। ভারতীয় ডেলিগেটদের চাপে পরে তারা এই ইস্যুতে নাম মাত্র লোক দেখানো সহানূভুতি প্রকাশ করে। কবির আহমেদ নামের এক বাংলাদেশি এই সেশন এ নেতৃত্ব দিলেও তাকে আসলে কিছু বলার সুযোগ দেয়া হয়নি। আরব দেশ গুলো কেন ইতিহাসের এত বড় নারকীয় হত্যা যজ্ঞের বিরোধিতা করার মত কিছু খুজে পেলনা জিনিসটা আসলেই ছিল অবাক হবার মত। একটি ব্যাপার অত্যন্ত দুঃখের ছিল যে সিরিয়া , লিবিয়া , নাইজেরিয়া এমন কিছু মুস্লিম দেশ শুধু মাত্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ধর্ম ইসলাম হওয়ায় তাদের সাপোর্ট করছিল। যদিও নাইজেরিয়া বাংলাদেশকে সাপোর্ট করবে এমন আশা করাও ভুল ছিল কেননা তারা নিজেরাই তাদের সংখ্যা লঘু ব্লাফরা জাতির উপর ঠিক একই ভাবে নির্যাতন চালিয়েছিল। লিবিয়ায় রাজতন্ত্র চলছিল, তাই গণতন্ত্র এর ব্যাপারে তাদের কোনো আগ্রহ ছিলনা,। পেলেস্তাইন গেরিলাদের আল ফাত্তাহ এর নেতা ইয়াসির আরাফাত, বাংলাদেশি দের প্রতি তার পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছিলেন, যারা নিজেদের অস্তিত্তের জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল। এটি আসলেই অত্যন্ত দুঃখজনক ছিল যে আফ্রো এশিয়ান সমন্বয়কারী সংস্থা র মত এমন একটি প্রতিষ্ঠান সেই ৭৫ লক্ষ দুর্দশাগ্রস্ত , ভয়াবহতার শিকার বাঙ্গালীদের সমর্থন না করে কুচক্রি পাকিস্তানী দের সমর্থন করছিল, এর মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠানটির নৈতিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
<005.022.456>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
ধর্মনিরপেক্ষতার উত্থান
অসুস্থ সাম্প্রদায়িকতায় ভরা এক সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের চলমান স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল হল ধর্মনিরপেক্ষতার উত্থান। ইতিহাসে প্রথমবারের মত মুসলমান এবং হিন্দুরা নিজেদের মধ্যে বিভেদ বাদ দিয়ে এক অভিন্ন শত্রুর মুখোমুখি।. দুপক্ষই সমানভাবে ভুক্তভোগী এবং উভয়েই এই শত্রুকে চিরতরে ধ্বংস করে মুক্তভাবে বেঁচে থাকতে চায় এমন এক সমাজে যেখানে বিশেষত দুই ধর্মের মানুষের মাঝে সামাজিক সম্পর্ক গড়ে উঠবে একটি সম্পূর্ণ নতুন অর্থনৈতিক ভিত্তির উপর যা নিশ্চিত করবে আন্ত-সম্প্রদায়িক শান্তি।
ধর্মনিরপেক্ষতার এই আবির্ভাব যা এখন অপরিবর্তনীয়ভাবে সুসংহত হয়েছে তা আসলে জনসমর্থন পেয়েছে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে। সম্ভবত এটাই একমাত্র আন্দোলন যা প্রায় একচেটিয়াভাবে ছাত্রদের আগ্রহে সুচিত এবং পরে বুদ্ধিজীবিদের দ্বারা পুষ্ট হয়েছে।
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার যেসব ঘটনা পূর্ববঙ্গে ঘটেছে তা প্রায় সবসময় শাসক চক্রের প্ররোচনায় অবাঙালি শরণার্থীদের একটি অংশের দ্বারা শুরু হয়। এই উদ্বাস্তু সম্প্রদায়,
যারা দেশভাগের তিক্ত পরিনতির শিকার, তারা সবসময়ই দাঙ্গাকারীদের উৎসাহী সহযোগী হিসেবে আবির্ভুত হত এই আশায় যে সংখ্যালঘুদের ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য করে তাদের সম্পত্তি দখলের আশায়। ১৯৫০ সালের সাম্প্রদায়িক উন্মত্ততায় মুসলিম লীগ বাঙালি মুসলমানদের একাংশকে এ ধরনের লাভের আশায় প্রলুব্ধ করেছিল। পাকিস্তান গঠনের পক্ষে বাংলার মুসলিম সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান অভিযোগ ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের অর্থনৈতিক আধিপত্য। দেশভাগের পর পূর্ববাংলায় অবস্থা দ্রুত উলটে গেল কিন্তু কায়েমী স্বার্থবাদীরা পুরনো জুজুর ভয় দেখানো অব্যাহত রাখে। কাশ্মীর ইস্যুও এক্ষেত্রে কিছুদিন বেশ কাজে লাগে।
তারপর দ্রুতই সমাজের চোখ খুলতে শুরু করল, বাঙ্গালি মুসলিমরা বুঝতে শুরু করলেন বাংলার মাটিতে কারা অর্থনৈতিক শোষণ জোরদার করছে। পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই পশ্চিম পাকিস্তান-ভিত্তিক সামরিক-পুঁজিবাদী-আমলাতান্ত্রিক গোষ্ঠী পূর্ববাংলাকে একটি ভার্চুয়াল কলোনিতে পরিনত করার নীল-নকশা তৈরি করা শুর করে। তাদের প্রথম আক্রমণ আসে বাংলা ভাষার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের মাধ্যমে। লক্ষ্য ছিল যে শুধুমাত্র উর্দুকে জাতীয় ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারলে জনগণের ওপর আরোপিত, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্য এমনিতেই উর্দুভাষী জনগোষ্ঠীর হাতে চলে যাবে যারা ছিল জনসংখ্যার ৩ শতাংশ মাত্র। বাঙ্গালীরা সফলভাবে এ চক্রান্ত প্রতিহত করে কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা শাসকগোষ্ঠীর হাতিয়ার হিসেবেই থেকে যায়। ১৯৫২ সালের পরে পুর্ব বাঙ্গালিরা প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে একটি সুস্থ, স্বাভাবিক সম্পর্কের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন. এটা শাসকগোষ্ঠীকে ভীত করে তোলে কারন ভারতবিরোধী উগ্র দেশপ্রেম তাদের রাজনৈতিক ছলচাতুরি এবং জনগণের অর্থনৈতিক শোষণ চালিয়ে যেতে সাহায্য করছিল। তারা শেষ পর্যন্ত পূর্ববাংলায় সাম্প্রদায়িকতা পুনরুজ্জীবিত করার মরিয়া চেষ্টা চালায় কাশ্মিরের উপসনালয় থেকে নবীর চুল হারানো নিয়ে ভারতে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকে পুজি করে। এসময় বিভাজন ছিল স্পষ্ট। একপক্ষে ছিল, আইয়ুব খানের সামরিক সরকারে মদদপুষ্ট সেইসব অবাঙালি যারা রক্তগঙ্গা সৃষ্টি করতে নেমেছিল আর তাদের বিরুদ্ধে ছিল সমগ্র বাংলার মুসলিম সম্প্রদায়, যার নেতৃত্বে ছিল বুদ্ধিজীবি সমাজ। আট কলামের শিরোনামে সংবাদপত্রগুলো মানুষকে আহ্বান করে এই ভয়াবহ চক্রান্ত রুখে দিতে । ইতিহাসে প্রথমবারের মতো মধ্যে হিন্দুদের রক্ষা করার চেষ্টায় প্রান দেয় মুসলমানরা। ফলাফল ছিল অসাধারন. দাঙ্গা স্তিমিত হয়ে আসে।
<005.022.457-459>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
“ফিনান্সিয়াল টাইমের মুল শিরোনাম ছিল “বাঙালি গেরিলারা চাপ প্রয়োগ করছে।“। করাচি থেকে এদের প্রতিনিধিদের পাঠানো কাগজপত্রের ভিত্তিতে এই সংবাদপত্র লিখেছে, “ মুক্তিবাহিনী গেরিলারা সামরিক প্রশাসনের উপর চাপ বৃদ্ধি অব্যাহত রাখছে…… সামরিক শাসনতন্ত্রের গেরিলাদের তাদের কার্যাবলির বৃদ্ধি রোধ করার জন্য বিগত কয়েক সপ্তাহে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া সত্ত্বেও প্রতিনিয়ত অন্তর্ঘাতী কার্যাবলির তীব্রতা বৃদ্ধির মাধ্যমে পরিস্থিতিকে ঘোলাটে এবং কঠিন করা হচ্ছে। এখানে আরও বলা হয়েছে যে, “ গেরিলাদের বেছে নেয়া লক্ষ্যের মধ্যে শিল্প স্থাপনা, যোগাযোগ ব্যহত করা এবং সরকারের সাথে সহায়তা করা শান্তি কমিটির সদস্যদের গুলি করে হত্যা করা এই উদ্দেশ্যে যে, চারিদিকে আতঙ্ক সৃষ্টি করা এবং এই মাত্রা পর্যন্ত নাগরিক জীবন ও প্রশাসনকে অচল করে দেয়া যাতে তারা স্বাভাবিক পরিস্থিতে ফেরার আশা পরিত্যাগ করে।
নভেম্বর ২২ এ ব্রিটেন এর স্কটসম্যান পত্রিকার শিরোনাম ছিল, “ রাজাকারেরা বাংলাদেশী শক্তিকে সহায়তা করছে”। এখানে বলা হয়, বাংলাদেশে রাজাকারেরা পুর্বের মত বর্তমানে সেই গোষ্ঠী নয়। তারা অন্ততপক্ষে গেরিলাদের কিছু অংশের কাছে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর জন্য নতুন পন্থা অবলম্বন করেছে। সুত্রমতে, সম্প্রতি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিয়োগ দেয়া রাজাকারেরা গেরিলাদের সেনাবাহিনীর ব্যাপারে গুরুত্ত্বপুর্ণ তথ্য দিয়ে সহায়তা করছে। রাজাকারেরা মুক্তিবাহিনীর কমান্ডোদের পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমনের পরিকল্পনার পুর্বেই স্থান ত্যাগ অথবা প্রতিরক্ষামুলক অবস্থান নেয়ার জন্য খবর প্রদান করছে। এখানে আরও উল্লেখ করা হয় যে, মুক্তিবাহিনীর সাম্প্রতিক অনেক সাফল্যের পেছনে রাজাকারদের প্রাথমিকভাবে দেয়া তথ্যের ভুমিকা রয়েছে। রাযাকারেরা মুক্তিবাহিনীকে প্রতিরক্ষামুলক সুরক্ষাও প্রদান করছে।
১০ ডিসেম্বর, ১৯৭১
ব্রিটেনের সমস্ত অংশে এবং অন্যান্য জায়গায় বাঙালিরা বাংলাদেশ সরকারকে ভারত কর্তৃক স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার খবরে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছে। ইয়ান রোডী, ডেইলি এক্সপ্রেসের বিশেষ সংবাদদাতা, প্রথম পৃষ্ঠার বিশেষ সংবাদে বলেন যে, সুদিঘের বিষণ্ণ ও নিশ্চুপ গ্রামবাসীরা আনন্দে অত্যন্ত উচ্ছ্বসিত।
জন পিলগার, ডেইলি মিরর যার এক দিনে প্রায় পনের কোটি কপি প্রকাশিত হয় তার প্রধান আন্তর্জাতিক প্রতিবেদক ছিলেন প্রথম একজন আগন্তুক যিনি প্রত্যক্ষ করেছেন ১৯৬৭ এর ইসরায়েল এর ছয় দিন ব্যাপী যুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় এবং কর্মক্ষম একটি সফল ঘটনা। একজন বাংলাদেশী বৃদ্ধ পিলগারকে বলেন যে, “ আমার বন্ধু, তুমি দেরি করে ফেলেছ। তারা আমাদের অনেক নারী এবং মেয়েদের এবং অনেক তরুনকেও মেরে ফেলেছে। কিন্তু তবুও আমরা আনন্দিত যে আমরা জয় বাংলা পেয়েছি”।
এখানে এবং পশ্চিমের বিভিন্ন অংশে যে প্রতিক্রিয়া পুর্ব বাংলার বিভিন্ন অংশে ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর কার্যক্রম পরিচালনার কারণে সৃষ্টি হয়েছে, আপাতদৃষ্টিতে প্রতীয়মান হয় যে, এটিকে যুদ্ধের কার্যক্রমের প্রচেষ্টার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হচ্ছে। দ্য টাইমস অফ লন্ডনের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, বাস্তবসম্মত নীতিমালা অনুসরণ করার জন্য এবং এই পরিক্ষায় শক্তি প্রদর্শনের জন্য ভারতকে দোষারোপ করা ভুল হবে। দীর্ঘ ৮ মাস যাবত পাকিস্তানী সরকার পুর্ব অংশের রাজনৈতিক বাস্তবতা থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এখানে আরও বলা হয়েছে যে, তারা এখন নিজেদেরকে বিনা উস্কানিমূলক আক্রমনের মাধ্যমে রাজনৈতিক ভুক্তভোগী হিসেবে উপস্থাপন করে আন্তর্জাতিক সাহায্য নিজেদের দিকে আনতে পারার আশা করতে পারে না। এবং ইন্ডিয়া যদি হিসেব করে দেখে যে তাদের নেয়া সত্ত্বর পদক্ষেপের কারণে মানব দুর্দশা কমে আসবে, তবে তাদেরকে কেউ ঢালাওভাবে ভুল বিবেচনার দোষ সহজে দিতে পারবে না। টাইমস অফ লন্ডন একই অনুচ্ছেদে বলেছে যে, যাইহোক, সেই মুহুর্তের জন্য পাকিস্তান সরকার তীব্রভাবে তার আরোপের প্রাপ্তি স্বীকারের ইচ্ছা প্রকাশ করেছে এবং বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা ফিরিয়ে দেয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে।
অপরপক্ষে, পশ্চিম জার্মান এবং ফ্রান্সের পত্রিকাগুলোতে প্রকাশিত মন্তব্য সাধারনত একই সংবাদের প্রতি ইঙ্গিত করে। লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়ার সম্ভাব্য লক্ষ্য ছিল ইন্ডিয়াকে রণকৌশলে হারানোর জন্য বাঙালিদের সাথে নিয়ে একটি বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠা করা কিন্তু টা ব্যর্থ হয়েছে।
ডিসেম্বর ৬ এর টাইমস অফ লন্ডনে বলা হয়েছে, “যেহেতু পাকিস্তান বিশ্ব নেতাদের করা সকল আবেদনের সতর্কবানীকে প্রত্যাখান করেছে, ইন্ডিয়া বিশ্বাস করে যে বাংলাদেশের জন্য সমাধান জারি করার জন্য তার আওয়াজ তলা ব্যতীত ভিন্ন রাস্তা নেই। এখানে আরও বলা হয়েছে যে, পুর্বে ২৫ মার্চ থেকে পাকিস্তানী ব্যবহারের নির্মমতা বিবেচনা করে, শত কোটি শরনার্থীর উপর চাপিয়ে দেয়া দুর্দশা বিবেচনা করে এবং বাংলাদেশের প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের পেছনে শক্ত যুক্তির কথা চিন্তা করে পাকিস্তান দুর্বল এবং কলঙ্কিত দলিলের মাধ্যমে এই দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করেছে। ডিসেম্বর ৬ এ টাইমস অফ লন্ডনের পরামর্শ অনুযায়ী, “ এই পরিস্থিতে সবচেয়ে উত্তম পন্থা হতে পারে বাংলাদেশে ইন্ডিয়ার একটি আশু বিজয় যাতে ইন্ডিয়া পশ্চিমে পাকিস্তানী আক্রমনকে প্রতিহত করতে পারে।
স্যার আলেক ডগলাস হিউম, ব্রিটিশ পররাষ্ট্র সচিব, হাউস অফ কমন্সে দেয়া বক্তব্যে ভারতীয় উপমহাদেশের উপর কোন প্রকার মুল্যবিচার থেকে নিজেকে বিরত রেখেছেন। বিরোধীদলীয় নেতা মি হ্যারল্ড স্যার আলেকের মনোভাবের মত নিজেকে যুদ্ধের উপর উত্থিত কোন সমস্যার চটজলদি বিচারে না পৌঁছনয় নিজেকে যুক্ত করেছেন।
মি জন স্টোরহাউস, পার্লামেন্টের নেতৃ সদস্য এবং সাবেক মন্ত্রীপরিষদ সদস্য স্যার আলেককে ইউ এন প্রস্তাবনে সমর্থন না করার জন্য অভিনন্দন জানিয়েছেন এবং ঘোষণা করেছেন যে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অধিকারকে স্বীকৃতি না দেয়ার জন্য বিশ্ব নেতৃবৃন্দ দোষারোপের যোগ্য।
১১ ডিসেম্বর, ১৯৭১
পুর্ব জার্মানির সংবাদ সংস্থা এডিএনের মাধ্যমে প্রচার হওয়া একটি বক্তব্যে পুর্ব জার্মানির সরকার সোভিয়েতের স্থানকে সমর্থন দিয়ে বলে যে ভারতীয় উপমহাদেশে এই রক্তপাত অবিলম্বে বন্ধ হওয়া উচিত। এই বক্তব্য বলা হয় যে, “ পুর্ব জার্মানি ভারতীয় উপমহাদেশের পরিস্থিতির উপর উদাসীন ছিলনা এবং এখনও নয়”। এখানে বলা হয়, “ বিশ্ব শান্তি রক্ষার্থে নিয়োজিত দায়িত্ববান সরকার প্রধানেরা বাংলাদেশে একটি শান্তিপুর্ন সমঝোতা নিশ্চিত করার জন্য পাকিস্তানের কাছে অনেকবার আবেদন করেছেন কিন্তু জেনারেল ইয়াহিয়া খান এটির পক্ষে সাড়া দেননি।
প্যারিসে ফ্রেঞ্চ কমিউনিস্ট পার্টি একটি বক্তব্যে বলেছে “ ইন্ডিয়ার সাথে পাকিস্তানের যুদ্ধাবস্থায় যাওয়ার ঘোষণা এশিয়ায় একটি অত্যন্ত ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে”। এই বক্তব্যে আরও বলা হয় যে, “ এই দ্বন্দ্ব গত বছর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ব্যাপক সাফল্যকে ইয়াহিয়া খানের সরকার স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করায় আরও ত্বরান্বিত হয়েছে” ।
কমিউনিস্ট পার্টির সংবাদপত্র লা হিউমানিতে তে একজন ভাষ্যকার বলেন যে, “ এটি একটি অত্যন্ত তাৎপর্যপুর্ন ব্যাপার যে এখনও তারা তাদের মুল লক্ষ্যকে হারিয়ে যেতে দেয়নি। এবং এই ৮ মাসব্যাপী এই কার্যপরম্পরা এখন শুধুমাত্র একটি ইন্দো-পাকিস্তান দ্বন্দ্ব নয়, একটি যুদ্ধ যা বাংলাদেশের উপর পাকিস্তানী সামরিক সরকার ছেড়ে দিয়েছে।
ডিসেম্বর ৭ এর টাইমস অফ লন্ডন লেখে, “ ইন্ডিয়া এখন বাংলাদেশে যুদ্ধের রাজনৈতিক সমাপ্তি নিশ্চিত করতে চাইছে এই আশায় যে এটি করলে সামরিক শক্তির পতন শীঘ্রই ঘটবে। সমঝোতার কোন স্থান নেই, কোন অংশ থেকে কোন প্রতিবাদের জায়গা নেই, জাতিসংঘে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবনা হবে না এবং পর্যবেক্ষকদের যুদ্ধরত দেশগুলোর মধ্যে অবস্থান ইন্ডিয়ার সংকল্পকে পরিবর্তন করবে না।লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফ বলেছে, “ ইন্ডিয়ার নীতি এবং পরিস্থিতি যা বাংলাদেশ সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে পৌঁছানর কথা বিবেচনায় আনলে এই সিদ্ধান্ত বাস্তবিকপক্ষে যুক্তিযুক্ত হয়েছে।
দ্য গার্ডিয়ান লিখেছে, “ বাংলাদেশ যা সংকল্প ও রক্তের মাধ্যমে জন্মেছে এখন হার স্বীকার করবে না। এমনকি যদি শান্তির জন্য আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা মিসেস গান্ধীর আওয়ামী লীগ সরকারের স্বীকৃতি সফল হয় তবে এই সরকার বাস্তবিক আঞ্চলিক নিয়ন্ত্রন দ্বারা সমর্থিত হবে। রয়টার্স প্রতিবেদন দিয়েছে যে, “ রেডিও মস্কো আজ বর্তমান পরিস্থিতে জাতিসংঘে ইন্দো-পাকিস্তান দ্বন্দ্বে শান্তিপুর্ন সমাধান খুজে বের করার জন্য চীনের আন্তরিকতার অভাবকে দায়ী করেছে”। এখানে আরও বলা হয় যে, “ চীন পুজিবাদীদের সাথে মিলিত হয়ে জাতীয় মুক্তির আন্দোলনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে”।
ডিসেম্বর ৭ এর দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস রাষ্ট্রপতি নিক্সনকে ইন্দো- পাকিস্তান দ্বন্দ্বে নিরপেক্ষতার আড়ালে পাকিস্তানকে সমর্থন দেয়ার জন্য দায়ী করেছে। সকল সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, “বাংলাদেশে নিপীড়ন বন্ধ করার জন্য অথবা আসল রাজনৈতিক সমঝোতার ক্ষেত্রে চাপ প্রয়োগে সবকিছু ব্যর্থ হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে স্পষ্টভাবে ইন্ডিয়াকে এই চলমান আন্তর্জাতিক দ্বন্দ্ব এর পেছনে প্রধান দায়ী বলে অভিহিত করেছে যা কয়েক মাস অপেক্ষা করেছে পাকিস্তানে অস্ত্র সাহায্য পাঠানো বন্ধের পেছনে। প্রশাসন এখন তাৎক্ষণিকভাবে ইন্ডিয়ায় অস্ত্র সাহায্য বন্ধ করে দিয়েছে। এটিকে কোনভাবেই পুরোদস্তর নিরপেক্ষতা বলা যায় না। এই সম্পাদকীয়তে আরও বলা হয় যে, “ জাতিসংঘে প্রথমে নিরাপত্তা পরিষদ এবং এখন সাধারণ পরিষদে যুক্তরাষ্ট্র লক্ষ্য প্রচেষ্টা হল একটি সাধারণ অস্ত্রবিরতি চুক্তি তৈরি এবং সৈন্য প্রত্যাহার”।এই ধরনের কার্যক্রম নিশ্চিতভাবেই জরুরি এবং প্রয়োজনীয়, কিন্তু কার্যগতভাবে এটি সফল হতে পারবে না যতক্ষন না জাতিসংঘ এবং এর প্রধান সদস্য দেশগুলো বিশেষভাবে যুক্তরাষ্ট্র একই সময়ে স্বীকৃতি দেয়া এবং পাকিস্তানের সাথে এই সমস্যার মুল কারন নিয়ে কাজ করার প্রচেষ্টার জন্য তৈরি হচ্ছে।
রাষ্ট্রপতি নিক্সনের সম্মান বাচানোর জন্য শেষ মরিয়া চেষ্টা হিসেবে তিনি বলেন যে দক্ষিণ এশিয়া দ্বন্দ্বের ক্ষেত্রে আমেরিকা একদম নিরপেক্ষ থাকবে। সম্পাদকীয়তে আরও বলা হয় যে, “ ইন্দো-পাকিস্তান দ্বন্দ্বে রাষ্ট্রপতি নিক্সনের পুর্ন নিরপেক্ষতার ঘোষণা প্রশাসনিক রাজনিতিকে লুকোতে ব্যর্থ হয়েছে, যেটি আসলে ইসলামাবাদে ইয়াহিয়া খানের সরকারের পক্ষে নিশ্চিতভাবেই পক্ষপাতদুষ্ট”।
<005.022.460-461>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
১২ ও ২২ জুলাই, ১৯৭১
“বিচ্ছিন্নতাবাদ” নয়ঃ স্বাধীনতার যুদ্ধ
বাংলাদেশের জনগনের স্বাধীনতার সংগ্রামকে বিশ্বের একটি অংশ “বিচ্ছিন্নতাবাদ” বা “বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন” বলে উল্লেখ করছে। এটা নিঃসন্দেহে কানাডার ফরাসী ভাষী মানুষের বা বেলজিয়ামের ফ্লেমিশ ভাষী মানুষের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের মত প্রভাব ফেলবে। এটা ভবিষ্যৎ সম্পর্কেও একটা প্রতিচ্ছবি তৈরি করবে- কঙ্গোর কাতাঙ্গা বা ইদানিং কালের বায়াফ্রার মতন একটি ভবিষ্যৎ। সাধারণ মানুষের বাংলাদেশের আন্দোলনের খুঁটিনাটি বঝার সময় খুব কম, তাই তারা বুঝতে পারছে না যে এই আন্দোলনটি একেবারেই আলাদা।যদিও পাকিস্তানের শুরু করা গণহত্যার যুদ্ধের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী সহানুভূতি ছিল তবুও খুব কম পত্রিকাই, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রেরগুলো পার্থক্যগুলো তুলে ধরেছিল এবং বুঝিয়েছিল যে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে জয়ই অবশ্যাম্ভাবী, কাটাঙ্গা বা বিয়াফ্রার পরিনতি নয়।এই বিশাল অমিলের একটা অংশ আন্দোলনের প্রকৃতি সম্পর্কে সংবাদদাতাদের নিজেদের অজ্ঞতার কারনে তৈরি। কিন্তু এটা বড় পরিমানে ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামকে হেয় করার প্রচেষ্টা- সেই সব শক্তির অপচেষ্টা যারা উপমহাদেশে একটা স্থির রাজনৈতিক অবস্থা সংরক্ষণ করতে চেয়েছিল।
সম্ভবত এখন আবার বিশ্বের কাছে সম্ভাব্য সব দিক থেকে ব্যাখ্যা করার সময় এসেছে যে, একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন এবং জাতীয় স্বাধীনতার সংগ্রাম যেটার জন্য বাংলাদেশের মানুষ একটা বিদেশী সামরিক বাহিনীর হাতে প্রান দিচ্ছে, দুটির মধ্যে আমূল পার্থক্য রয়েছে। পাকিস্তানের জন্ম হয়েছিল কারন উপমহাদেশের বিভিন্ন জাতীয়তার মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা হিন্দুদের অপ্রতিরোধ্য অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আধিপত্য এড়াতে চেয়েছিল। ১৯৪০ সালে মুসলিম লীগের লাহোর সম্মেলনে তারা পাকিস্তানের জন্য এই শর্তে রাজি হয় যে, নতুন সৃষ্ট প্রত্যেক প্রদেশে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসন ও সার্বভৌমত্ব প্রদান করা হবে। ঐতিহাসিক লাহোর সমাধান একটা শিথিল যুক্তরাষ্ট্র গঠনের প্রতিশ্রুতি দেয়। এ থেকে বোঝা যায় তৎকালীন মুসলিম লীগ এই বিশাল উপমহাদেশে একই ধর্মানুসারী দেড় মধ্যে নৃতাত্ত্বিক, ভাষাগত এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে মেনে নিয়েছিল। মুসলিম লীগ যে কারনে সংগ্রাম করছিল তা হল একটা নতুন রাষ্ট্র সৃষ্টি করা, যেখানে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার যুক্তিসঙ্গত বণ্টনের মাধ্যমে বিভিন্ন জাতীয়তার মধ্যে একটা দীর্ঘস্থায়ী ঐক্য অর্জিত হবে। বস্তত, নতুন রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ পুরোপুরি নিরভর করছিল মৌলিক প্রতিজ্ঞা অনুধাবনের উপর- যে প্রতিজ্ঞার ভিত্তি ছিল পারস্পারিক বিশ্বাস ও সম্মান- যে প্রতিজ্ঞা ১৯৪৭ সালে যখন পাকিস্তান হয় তখন ছিল না।
দুশো বছরের কঠোর ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তির উচ্ছ্বাসের মধ্যে বিভক্ত বাংলার মুসলিমরা ক্ষমতা হস্তান্তরের আসল স্বরূপ বুঝে উঠতে পারে নি। ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সরকার তাদের হাতেই ক্ষমতা ছেড়েছিল যাদের মাধ্যমে তাদের স্বার্থ উদ্ধার হয়েছিল। আমরা ক্ষমতার মসনদে পেয়েছি পুঁজিবাদী, আমলা আর সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের এক দলকে যারা স্বাধীনতার আন্দোলনের সময় স্বাধীনতা ও গণমানুষের বিপক্ষে ভূমিকা রাখছিল। ব্রিটিশ রাজদের তৈরি এই গনবিরোধীরা যারা ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের সেবা করে এসেছে তারা হঠাৎ করে নতুন রাষ্ট্রের, ধর্মের রাষ্ট্রর ও ধর্মের অখণ্ডতার রক্ষক হিসেবে আবির্ভূত হয়। বলাই বাহুল্য ধর্ম সম্পর্কে তাদের মনমতো ব্যাখ্যা নতুন রাষ্ট্রের অর্থনীতি ও রাজনীতিতে তাদের দখল ধরে রাখতে সাহায্য করছিল। তাদের কোন ইচ্ছাই ছিলোনা এই ক্রিত্তিম ইউনিয়নের জন্য পরিশ্রম করার। আমি এই ইউনিয়নকে কৃত্তিম বলছি কারন শুধুমাত্র ধর্মের মিল আন্তর্জাতিক ঐক্যের ভিত্তি হতে পারে না। কারন তাহলে এতগুলো আরব রাষ্ট্রের কিংবা একই ধর্মের পাকিস্তান আর আফগানিস্তানের মাঝে এত বড় দেয়ালের দরকার হত না। অর্থনোইতিক সম্পদ এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার সুষ্ঠু বন্টনের মাধ্যমেই পাকিস্তান একটি সত্যিকারের গনতান্ত্রিক রাষ্ট্র হয়ে উঠতে পারে যাকে আম্লা,পুজিবাদী,সেনাশাসকের দল সবচেয়ে বেশি ভয় পায়।
আর এভাবেই শুরু হয় ইতিহাসে পাশবিক ঔপনিবেশিক শোষনের এক হীন অধ্যায়। দুই এলাকার বিশাল দুরত্ব এই দলের বেশ কাজেই লাগে। তার উপর রাজনিতির প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষের নিঃস্পৃহতাও তাদের একটা বাড়তি সুবিধা হওয়া দেখা দেয়। বাঙ্গালীরা থামানোর জন্য আর্তচিতকার করে ওঠার আগ পর্যন্ত নির্লজ্জ শোষনকে টিকিয়ে রেখেছিল ফ্যাসিস্ট দমন-পীড়ন। ফ্যাসিস্ট সামরিক জান্তার নেতৃত্বাধীন এই গোষ্ঠী জানত তাদের এই শোষন চিরকাল চলতে পারে না। একথা মাথায় রেখে সশস্ত্র বাহিনীতে তারা সবসময় খেয়াল রাখছিল যেন শতকরা দশ ভাগের বেশি যেন বাঙ্গালী না হয়। তারা ভেবেছিল এভাবেই তারা সশস্ত্র বিদ্রোহের সম্ভাবনাকে বিলুপ্ত করে দিয়েছে। কিন্তু ইতিহাস তাদের হতবাক করে দিয়েছিল। বাকি কাহিনী আমাদের অনেক পরিচিত। মানব ইতিহাসে সবচে কালো অধ্যায়ের অংশ এই কাহিনী। পাকিস্তান জন্ম থেকেই বিভক্ত এবং ক্ষমতা দখল করে বসে থাকা গোষ্ঠী কখনো চেষ্টাও করেনি বাঙ্গালির সাথে ঐক্যের ভিত্তি স্থাপন করার। বাঙ্গালির স্বাভাবিক ধৈর্যের জন্যেই এই অভিশপ্ত ইউনিয়ন ২৩ বছর টিকে ছিল। বাংলার মানুষ যে সাংস্কৃতিক,জাতিগত এবং ভাষার দিক দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের অন্য জাতিগুলার থেকে আলাদা এটা পাকিস্তানি জান্তার শুরু করা গণহত্যার এই যুদ্ধে পরিষ্কারভাবে প্রমাণ হয়ে গেছে।
নিষ্পাপ নারী,পুরুষ এবং শিশুদের তারা নির্বিচারে হত্যা করেছিল। করেছিল বাঙ্গালী নারীদের ওপর ধর্ষনসহ এত অমানবিক এবং বর্বর নির্যাতন তারা চালিয়েছিল যে হিটলারের বর্নবাদী উন্মত্ততার সাথেই শুধু তার তুলনা করা যায়। উন্মত্ততা বা আত্মঅহমিকা যত বড়ই হোক না কেন নিজের জাতি বা বর্নের ওপর এধরনের বর্বরতা কখনোই দেখা যায়নি। বিচ্ছিন্নতাবাদ বা আলাদা হতে চাওয়া আসলে অন্তঃজাতিক প্রকৃতির। জাতির একাংশ অন্য অংশ থেকে আলাদা হতা চায় আঞ্চলিক স্বার্থের জন্য।কিন্তু যখনি কোন জাতি এরকমের কৃত্তিম ইউনিয়ন যে ইউনিয়ন আদতে ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের মত তা ভেঙ্গে বের হতে চায় তখন তা জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম হয়ে ওঠে। উপনিবেশবাদ থেকে মুক্তির লড়াই হয়ে ওঠে। মানুষের ইতিহাস এরকম অসংখ্য ঘটনায় পরিপুর্ন। যুক্তরাষ্ট্র,চীন বা সোভিয়েত ইউনিয়ন সবাইকেই বিদেশী পরাশক্তির শাসন থেকে জাতীয় মুক্তির এমন অনিবর্তনীয় অবশ্যাম্ভাবী লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। আজ যদি সেই একি রাষ্ট্রগুলো বিরোধিতা করে বা নিরব দর্শকে পরিণত হয় তবে তা হবে তাদের একসময়ের লালিত লক্ষের সাথে বিশ্বাসঘতকতা যে লক্ষ্যের জন্য তারা লাখে লাখে জীবন বিসর্জন দিয়েছে।
<005.022.462>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
কিন্তু যখনি কোন জাতি এরকমের কৃত্তিম ইউনিয়ন যে ইউনিয়ন আদতে ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের মত তা ভেঙ্গে বের হতে চায় তখন তা জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম হয়ে ওঠে। উপনিবেশবাদ থেকে মুক্তির লড়াই হয়ে ওঠে। মানুষের ইতিহাস এরকম অসংখ্য ঘটনায় পরিপুর্ন। যুক্তরাষ্ট্র,চীন বা সোভিয়েত ইউনিয়ন সবাইকেই বিদেশী পরাশক্তির শাসন থেকে জাতীয় মুক্তির এমন অনিবর্তনীয় অবশ্যাম্ভাবী লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। আজ যদি সেই একি রাষ্ট্রগুলো বিরোধিতা করে বা নিরব দর্শকে পরিণত হয় তবে তা হবে তাদের একসময়ের লালিত লক্ষের সাথে বিশ্বাসঘতকতা যে লক্ষ্যের জন্য তারা লাখে লাখে জীবন বিসর্জন দিয়েছে।
১৩ জুলাই, ১৯৭১
বাংলাদেশের প্রতি আরব বিশ্বের নিঃস্পৃহতার কারনসমুহ
দুর্ভাগ্য যখন আসে সদলবলেই আসে- শেক্সপিয়ারের প্রবাদ, কিন্তু কেউ ভাবতেও পারেনি প্রকৃতি বাংলাদেশের মানুষকেই বেছে নেবে প্রবাদের সত্যতা প্রমানে, শতাব্দীতে মাত্র একবার হলেও। নুন্যতম হৃদয় আছে এমন কেউ কখনো চাইবে না মাত্র দুইমাস আগে নেমে আসা প্রায় বিশলক্ষ প্রাণ হরণকারী শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়ংকর সাইক্লোনে টালমাটাল জাতির ওপর এমন বীভৎস ধ্বংসযজ্ঞ নেমে আসুক। কিন্তু তাই হয়েছিল এবং সমস্যা আরো বাড়িয়েছিল আন্তর্জাতিক নিঃস্পৃহতা বিশেষত পরাশক্তিদের যাদের ক্ষমতা ছিল সভ্যতার বিরুদ্ধে পাকিস্তানি জান্তার এই উন্মত্ত, ঘৃণ্য অপরাধ থামানোর। এবং তাও যেন যথেষ্ট ছিলনা, শীঘ্রই বাঙ্গালিরা শুনতে পেল কিছু আরব সরকারের কাছে খুনি জান্তার পাশবিক অপরাধের নিন্দা করা দূরে থাক বিপন্ন মানবতার প্রতি সহানুভূতি জানানোও কঠিন মনে হচ্ছে। এরকম বীভৎস বিরোধীতা খুনি জান্তার সাথে নিক্সন প্রশাসনের প্রকাশ্য আঁতাতের চেয়েও মনোবেদনা জাগায় কারন শেই সুয়েজ সংকট থেকে শুরু করে বাঙ্গালীরা কখনোই আরবদের পাশে দাড়ানোর সুযোগ হাতছাড়া করেনি যদিও পাকিস্তানি শাসকের সবসময়ই সন্দেহজনক নীতি অবলম্বন করে চলত যা আসলে আরব স্বাধীনতার বিপক্ষের ষড়যন্ত্রকেই সাহায্য করে। প্রেসিডেন্ট নাসের যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন এটা ভোলেননি। যখনই পাকিস্তান থেকে কেউ তার কাছে আসত তিনি সেই সোফাটা দেখাতেন যেখানে পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী বসেছিলেন সুয়েজ খালকে মিসরের রাষ্ট্রীয়করনের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ আগ্রাসনের প্রতি তার সরকারের সমর্থন জানানোর জন্য লন্ডন যাত্রার প্রাক্কালে। কিন্তু নাসেরের বিদায়ের পরেই পরিস্থিতি আমুল বদলে যায়। যাহোক সেপ্রসঙ্গে আমরা পরে আসব।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম নিয়ে আরব প্রতিক্রিয়ার ঘটনাগুলোকে আমার তুলে ধরতে হবে। আমাদের জন্য সবই অন্ধরাচ্ছন্ন নয়। আমাদের চিনতে হবে কারা পাকিস্তানের প্রতি মৌন সমর্থন জানাচ্ছে আর কারা জানাচ্ছে না। সৌদি আরবের সরকার প্রথম পাকিস্তানের পাশে দাঁড়ায়।তাকে অনুসরন করে মরুর কিছু মধ্যযুগীয় রাজতন্ত্র। এসব সরকারকে সরাসরি দোষ দিতে আমরা তাড়াহুড়ো করতে পারিনা কারন আমাদের ভাবতে হবে কেন এবং কি স্বার্থে তারা এমন জনগোষ্টীর উপর হামলাকে সমর্থন করে যাদের সংখ্যাগরিষ্ঠই ধর্মভীরু মুসলিম। পাকিস্তানের সমর্থনের আবেদনে তাদের প্রতিক্রিয়া মোটামুটি স্বাভাবিকই ছিল।
<005.022.463>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
সম্পুর্ন সামন্ততান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির এইসব রাজতন্ত্রের সাধারন জনগণের গনতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার প্রতি কোন চিন্তা বা সহানুভূতি ছিলনা। এসব দেশের সধারন জনগণ ভুমিদাসত্বে বাস করত এবং সম্ভবত দুনিয়ার সবচেয়ে শোচনীয় অবস্থায় ছিল। এসব সরকারকে পাকিস্তানি জান্তার ধর্মীয় ছদ্মবেশই নাড়া দিয়েছিল। আর যেহেতু সত্যগুলো দেখিয়ে দেয়ার মত বাঙ্গালী কমই ছিল সেহেতু পাকিস্তানি সরকার খালি ময়দান পেয়েছিল এবং এসব রাজতন্ত্রকে বিশ্বাস করিয়েছিল যে বাংলায় ইসলাম বিপদে আছে এবং এখাঙ্কার মুসলিম জনগোষ্ঠী দ্রুত অমুসলিম হয়ে যাচ্ছে এবং হিন্দুনিয়ন্ত্রিত ভারতের সাথে যুক্ত হতে চেষ্টা করছে। পাকিস্তান তাদের বিশ্বাস করিয়েছিল যে তাই তার পুর্ববাংলায় জেহাদ শুরু করে ইসলামকে রক্ষা করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিলোনা। এটা ছিল খুব সহজেই তৈরি এক টোটকা এবং পুর্ব বাংলা সম্পর্কে অজ্ঞ রাজা-বাদশারা আরো সহজে তা হজম করে নেয়। এমন কেউ ছিল না যে এই স্বঘোষিত ইসরমের রক্ষকদের কোরআন ও সুন্নাহ বিরোধী জীবন যাপন ও ক্ষমতার দখলদারী তুলে ধরে। এমনকি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীরা যে আসলে হাজারে হাজারে ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের মেরে তাদের উপাসনার স্থান ধ্বংস করে ফেলছে শুধু পাকিস্তানি সামরিক-পুজিবাদী-আমলা গোষ্ঠীর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শোষণের ইতি টানতে বাঙ্গালির প্রতিজ্ঞাকে ধ্বংস করার জন্য এটা বলারও কেউ ছিলোনা। সৌদি পত্রিকাগুলো বাংলাদেশের ধারেকাছে যায়নি এমন লোকদের মাধ্যমে ইয়াহিয়ার প্রেস রিলিজ দিয়ে পাকিস্তানপন্থী প্রবন্ধ ছাপাচ্ছিল যা থেকে রাজতন্ত্রীদের মনোভাব বোঝা যাচ্ছিল। কিন্তু কেন আরব সোশ্যালিজম এর পতাকাবাহীরা বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে গেল যার কিনা সবসময় তাদের পাশে ছিল? পাকিস্তানের হত্যাযজ্ঞ অনুমোদন দিয়ে তো তাদেরও কিছু পাওয়ার নেই। বিশ্বের জাতীয় মুক্তিকামী সাধারন মানুষের প্রতি তাদের ঘোষিত সংহতির তাহলে কি হল? আসলে আগে যেমনটা বলছিলাম নাসেরর বিদায়ের পরে আরব সমাজতন্ত্রে মৌলিক সমস্যা দেখা দিয়েছে। ইউএআর স্পস্টতই ডানপন্থী প্রতিক্রিয়ার দিকে ঝুঁকে পড়ছে।এই অবস্থার পক্ষে যুক্তি হিসেবে দেখান যায় সাদাত সরকারের মধ্যপন্থী সমাজত্নত্রীদের ওপর দমন-পীড়ন এবং মুসলিম ব্রাদারহূড, পাকিস্তানি জামাত-ই-ইস্লামির মিসরীয় রুপ,এক ভয়ংকর গোষ্ঠী যাদেরকে নাসের স্বয়ং শক্ত হাতে দমন করেছিলেন তাদের প্রতি তোষনের নীতিকে। মিসর প্রভাবিত রাষ্ট্র যেমন সিরিয়া এবং লেবাননেও একইরকম ধারা ছিল। তাই রাজতন্ত্র নেই এমন সরকারগুলোর মনোভাবও রাজতন্ত্রী সরকারগুলোর মত ছিল কারন তারাও ইসলামের নামে পাকিস্তানি ধোকায় অন্ধ হয়েছিল।
কিন্তু অজ্ঞতা ও গোঁড়ামির এই অন্ধকার পরিবেশেও আলোর ঝলকানি এসেছিল আরব বিশ্বের মুক্তিযোদ্ধাদের থেকে যারা একইসাথে দুই শত্রু বাইরের ইসরায়েল ও ভিতরের রাজতন্ত্রের সাথে লড়াই করছিল। আল ফাত্তাহ এবং ইপিএলপির মত প্যলেস্টাইনি কমান্ডো সংস্থাগুলো যারা জর্দানে পকিস্তানি সৈন্যসমৃদ্ধ হুসেইনের বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করছিল তারা বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সংহতি জানিয়েছিল।আমি নিশ্চিত বাংলাদেশ এবং ফিলিস্তিনি জনতার দুর্ভোগের সাদৃশ্য যদি আরব জনতার কাছে তুলে ধরা যেত তাহলে সমগ্র আরব বিশ্ব পাকিস্তানের অপরাধের কথা জানত এবং দ্ব্যর্থহীনভাবে বাংলাদেশের প্রতি তাদের সংহতি জানাত।
<005.022.464>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
১৭ জুলাই, ১৯৭১
বাংলাদেশের রক্তক্ষরণের মাঝে নিক্সনের পিকিংযাত্রা
থলির বিড়াল বেরিয়েই এল। চীনই চরম প্রাচ্য আর যুক্তরাষ্ট্র চরম পাশ্চাত্য নয় এরা মিলতেও পারে। এ মুহুর্তে পিকিঙের আমন্ত্রনে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সফরের সিদ্ধান্ত আমাদের অনেকের উপলব্ধির চেয়ে বেশী তাতপর্যপুর্ন। বাংলাদেশের জনগণের উপর গণহত্যার এই যুদ্ধের আগে কে ভাবতে পেরেছিল এরকম মোলাকাত এ শতাব্দীত শেষের আগেই সম্ভব?
ইয়াঙ্কি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে পিকিং রেডিওর তীব্র প্রচারনা এখনো কানে বেজে অবিশ্বাসে চোখ কচলাতে বাধ্য করে। পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ ধাপ যাকে লেনিন সাম্রাজ্যবাদ বলে অভিহিত করেছেন তার সাথে বিপ্লবী সমাজতন্ত্রের বোঝাপড়া অসম্ভব বলে পিকিঙের নিজেদেরই প্রচার করা তত্বকে তারা এভাবে ভুল প্রমাণিত করে। এখন প্রেসিডেন্ট নিক্সন, সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ডানপন্থী প্রেসিডেন্টকে পিকিং কর্তৃপক্কের আমন্ত্রন জানান থেকে বোঝা যায় পিকিঙ্গের নিও-সোস্যালিজম এবং যুক্তরাষ্ট্রে নির্দয় সাম্রাজ্যবাদের মাঝে শুধু সহাবস্থানই নয় বরং বেশ ঘনিষ্টতাও সম্ভব। এ বিষয়ে তেমন কোন সন্দেহই নেই যে চৌ এন লাইয়ের চীন সুযোগ পাওয়া মাত্রই জাতিসংঘের অন্তর্ভুক্ত হবে। এই ঐক্যে তাৎক্ষনিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে চিয়াঙ্গের ফরমোসা। আর দীর্ঘমেয়াদে ভুক্তভোগী হবে সোভিয়েত ইউনিয়ন।
ফরমোসার পরেই এই চীন-মার্কিন দাম্পত্য নিয়ে সবচেয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কথা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের। যতই তথ্য-উপাত্ত আলোয় আসছিল ততই বোঝা যাচ্ছিল এযাবৎ অচিন্তীয় এই দাম্পত্য সংঘটনে পাকিস্তান একটি গুরুত্বপুর্ণ ভুমিকা রেখেছে। দুপক্ষই শয্যাসঙ্গী হতে বেশ কয়েকমাস ধরে তৈরি ছিল কিন্তু তাদের মাঝে ২৩ বছরের বরফ গলাতে উভয় পক্ষের বিশ্বস্ত একটি তৃতীয় পক্ষ দরকার ছিল এবং পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এক্ষেত্রে উপযুক্ত ছিল। ভারত সম্পর্কে অসুস্থ বিরক্তিকর ঘোর চীনকে পাকিস্তানের কাছাকাছি এনেছিল এবং বিশ্বাস করিয়েছিল যে পাকিস্তান তার বন্ধু এবং তাদের মধ্যে অনেক মিল আছে। অন্য দিকে গোড়া থেকেই পাকিস্তান আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতিতে অনুচরের ভুমিকা পালন করে আসছিল এবং বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের সক্রিয় সহযোগী ছিল। সুয়েজ সংকটের সময় পাকিস্তানের বিশ্বাসঘাতকতার কথা কারোরই ভোলা উচিত না। পাকিস্তান দুই পক্ষের ঘটকালি করতে রাজি হয়েছিল বাংলাদেশের বিরুদ্ধে হত্যযজ্ঞের পরিকল্পনায় সমর্থনের বিনিময়ে। পাকিস্তানকে কথা দিয়েছিল যে তার অপরাধে কেউ হস্তক্ষেপ কর হবে না। বাংলাদেশের নিরীহ জনগণের উপর হত্যাযজ্ঞে ব্যাবহার হবে জেনেও চীন হাল্কা ও মাঝারি ধরনের অস্ত্রশস্ত্র এবং গোলাবারুদ সরবরাহ করেছিল। এমনকি বাংলাদেশের গ্রীষ্মপ্রধান ছোট শহরগুলোর উপযুক্ত করে ৩জনের ছোট ট্যাঙ্কও বানিয়েছিল । ঢাকা নারায়ণগঞ্জ, চট্রগ্রাম,খুলনা যশোর আর কুমিল্লাতে গণহত্যা আর ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে এই ট্যাঙ্কগুলোই ব্যাবহার করা হয়েছিল। অন্যদিকে নিক্সন প্রশাসন বিশেষত সিআইএ পাকিস্তানের গণহত্যার পরিকল্পনা আগে থেকেই জানত এরকমটাও বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারন রয়েছে।
<005.022.465>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
শুধুমাত্র পাকিস্তানি গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রবল জনমতের জন্যেই হোয়াইট হাউস স্বীকার করতে দেরি করছিল যে তারা পাকিস্তানকে অস্ত্র সাহায্য করে যাচ্ছে স্টেট ডিপার্ট্মেন্টের বিপরীত সুপারিশ সত্ত্বেও। পাকিস্তান সারা যুক্তরাষ্ট্রে একটাও সংবাদপত্র, টিভি চ্যানেল বা রেডিও নেটওয়ার্ক খুঁজে পায়নি যেখানে সে বাংলাদেশের সাথে করা তার ঘৃণ্য অপরাধের সাফাই গাইবে। এটা লক্ষণীয় যে নিক্সন প্রশাসন পাকিস্তানে অর্থ ও অস্ত্রসাহায্য অব্যাহত রাখার ঘোষনার পরেই শুধু নিক্সনের উপদেষ্টা কিসিঞ্জারকে পাকিস্তানে চীনা নেতাদের সাথে সাক্ষাতের গোপন সফরে আসতে দেয়া হয়েছিল। এটা একধরনের ব্ল্যাকমেইল ছিল যা সম্ভবত অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিক্সনকে মেনে নিতে হয়েছিল। তিনি এমনিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রচলিত পদ্ধতি, মানে সবই করেও কিছুই স্বীকার না করার পথে হাটতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এই নিরবতা সেনাবাহিনীর আভ্যন্তরীন ক্ষমতার লড়াইয়ে ইয়াহিয়া এবং তার খুনি সঙ্গীদের জন্য সঙ্কটপুর্ণ হয়ে ঊঠেছিল। কিন্তু জনসমক্ষে এই অপরাধের স্বীকারোক্তিতে নিক্সনের প্রতিপক্ষ ডেমোক্রেটরা রাজনৈতিক সুবিধা পেয়ে যায়।কিন্তু তিনি লাভের হিসাবও করে রেখেছিলেন। নিক্সন আশা করছিলেন চীনের সাথে স্থায়ী বন্ধুত্ব করা গেলে কোনরকম রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রন না হারিয়েই ইন্দোচীন থেকে সৈন্য সরিয়ে নেয়া যাবে এবং তাতে ডেমোক্রেটদের ব্যার্থ করে দেয়ার ভাল সুযোগ থাকবে।
আর এভাবেই চীন আর আমেরিকা নিজেদের মধ্যে অভিসার শুরু করল দশ লক্ষ বাঙ্গালীর জীবন এবং ষাট লক্ষ বাঙ্গালীর ভারতে উদ্বাস্তু হওয়ার বিনিময়ে। সুবিধাবাদের রাজনীতিতে এমন আত্মকেন্দ্রিক পদক্ষেপ মানব ইতিহাসের কিছু কালো অধ্যায় রচনা করে যাবে। নিপীড়িত জনতার অধিকারের স্বঘোষিত রক্ষক চীন বৈশ্বিক রাজনীতিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে সুবিধা আদায়ের জন্য এই অপরাধগুলো মেনে নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ংকর সাম্রাজ্যবাদের প্রতিনিধি সোভিয়েত ইউনিয়নকে আটকানোর এই যৌথ প্রচেষ্টার মাধ্যমে আরো বড় রাজনৈতিক আধিপত্য কায়েম করতে চায়। চীন এখনো পরাশক্তি হয়ে উঠতে পারেনি কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন এখনই পরাশক্তি । ের প্রভাবকে ক্ষুন্ন করতে এটা খুব চতুর একটা চাল। এখন পর্যন্ত যে অবস্থা তাতে চীনের রাশিয়ার মত রাজনৈতিক শক্তি হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
কিন্তু আমাদের কি হবে? আমরা, বাংলাদেশের জনগণ কি এই চীন-মার্কিন বন্ধুত্বে বলি হয়ে যাব? রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকের ধারনা করছেন চীন-মার্কিন মধুচন্দ্রিমা দিনশেষে আমাদের জন্য ভালোই হবে। নতুন এই বোঝাপড়া ভারত সম্পর্কে চীনকে নমনীয় করে তুলবে। এছাড়াও দুই পক্ষের মধ্যে বোঝাপড়া শেষেও তারা পাকিস্তানকে খুশি করার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাবে এমনটা ভাবার কোন কারন নেই। বাংলাদেশের সমস্যার সমাধান অর্থাৎ সম্পুর্ন স্বাধীনতা তরান্বিত হতে পারে শুধু যদি সোভিয়েত ইউনিয়ন আরো সক্রিয়ভাবে আগ্রহী হয়ে ওঠে।
আরো একটা প্রশ্ন বাকি থেকে যায়, ওয়াশিংটন কি সাম্যবাদের দিকে ঝুকছে নাকি পিকিং পুঁজিবাদের দিকে?
২৩শে জুলাই, ১৯৭১
শেখকে হত্যা করতে ইয়াহিয়ার প্রস্তুতি
আমরা বাংলাদেশের মানুষের সর্বংসহা হয়ে গেছি।
<005.022.466>
সামরিক আদালতের নুন্যতম আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমানকে ইয়াহিয়ার খুন করতে চাওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই তাই আমরা আর অবাক হই না। এই অসুস্থ ফ্যাসিস্টদের কাছ থেকে এরচেয়ে সভ্য ব্যাবহার কেউ আশাও করে নয়া। এতদিনে এটা বোঝা হয়ে গেছে যে এরা মানুষ আর পশুকে আলাদা করা মানবিকগুনাবলিশূন্য শুধু তাই নয় বরং অহমিকার নেশায় এতই অন্ধ যে নিজেদের আসন্ন পতনও তারা দেখতে পাচ্ছে না । মানবতার বিরুদ্ধে বাংলাদেশে সংগঠিত তাদের অপরাধগুলো বিশ্বের কাছ থেকে ঢাকতে ব্যার্থ হয়ে তারা এখন ভান করাও ছেড়ে দিয়েছে। তাই তাদের সভ্যাসমাজের কাছে ঘৃণ্য তাদের পরিকল্পনাগুলোও এখন তারা প্রচারমাধ্যমে প্রচার করে বেড়াচ্ছে। সভ্য সমাজ যে ঘৃণায় শিউরে উঠছে তাতে তাদের আর কিছুই যায় আসে না।
ন্যায়বিচার এবং উদারতা বলে কোনকিছু এই কাপুরুষদের অভিধানে নেই। ইয়াহিয়া এবং তার সহযোগী জেনারেলদের কাছ থেকে শেখ মুজিবের প্রতি কোন সভ্য ব্যাবহার আশা করাও বোকামি। শেখ সাহেব, যদি চাইতেন তবে তিনি পালিয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু একজন সাহসী গণতন্ত্রী এবং সভ্য ব্যাবহারের প্রতি চুড়ান্ত আস্থাশীল হওয়ায় তার কাছে এটা অসম্মানজনক মনে হয়েছিল। তবে তিনি বুদ্ধিমান ছিলেন একদিকেই সব ঝুকি না নেয়ার মত। তাই তিনি তার পার্টির লোকদের পাকিস্তানি সৈন্যদের রণোন্মাদ হয়ে গেলে তাদের নাগালের বাইরে আশ্রয় নিতে বলেছিলেন।২৫শে মার্চ রাতে সেনাবাহিনী এসে তার বাড়ি ঘিরে ফেলে গুলি চালানো শুরু করেছিল। বিপুল নৈতিক শক্তির মানুষ শেখ মুজিব ব্যাল্কনিতে বেরিয়ে এসেছিলেন এবং আর্মি অফিসারকে বলেছিলেন তাকে গ্রেফতার করে এই অর্থহীন গুলিবর্ষন থামাতে। কাপুরুষ টিক্কা খানের কাছে এটা ছিল একটা বিশাল বিজয়। সবরকম মানবিকতাশুন্য টিক্কা খান তার বন্দিকে মেরে ফেলতে পারলেই খুশি হত কিন্তু ইয়াহিয়া চেয়েছিলেন সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালির সাহসী নেতাকে নিয়ে আরেকটু খেলতে। তিনি রক্তপিপাসু টিক্কা খানকে বিশ্বাস করতে পারেননি। শেখ মুজিবকে শীঘ্রই পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। বাংলাদেশে গনহত্যা যতই চলছিল শেখ মুজিবকে ততই রাজনৈতিক আপোষের দিকে, যা বাংলার জনগণকে রাজনৈতিকভাবে বিক্রি করেদিবে তার দিকে ঠেলে দেয়ার চেষ্টা চলছিল। কিন্তু মদ ও ক্ষমতার মোহে মত্ত ইয়াহিয়া জানতেন না শেখ মুজিব কি ধাতুতে তৈরি। শারীরিক নির্যাতনের সাথে হুমকির মুখোমুখি হওয়া সত্ত্বেও শেখ মুজিব সাড়ে সাত কোটি মুক্তি পিপাসু বাঙ্গালির বিশ্বাসের অমর্যাদা করেননি। ফলাফল হিসেবে কোর্ট মার্শালের হুমকিও একসময় চলে আসল। যেভাবে বিশ্বের কিছু বড় পরাশক্তি পাকিস্তানের পাশে ছিল টাটা এটা অস্মভব কিছু ছিল না যে শেখ মুজিবুর রহমানকেও হত্যা করা হবে বিশ্ববিবেককে পাট্র্যিস লুমুম্বার মত আরেক দেশপ্রেমিকের স্মৃতিভার বয়ে বেড়াতে হবে। এবং খুনিরা এখানেই থামবে না। ঢাকার ধানমন্ডি আবাসিক এলাকায় গৃহবন্দি হয়ে থাকা শেখ মুজিবের পরিবারকেও বাচিয়ে নাও রাখা হতে পারে।
কারো মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে জাতিসংঘ এ সময় কি করছিল? জাতিসংঘের নাকের ডগাতেই মৈসে সোম্বের নেতৃত্বাধীন কাটাঙ্গা ফ্যাসিস্টদের হাতে লুমুম্বা মারা যান কিন্তু জাতিসংঘ সেখানে কিছু করার চেষ্টা অন্তত করেছিল। জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব ড্যাগ হ্যামারস্কোল্ড প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন সমধান খোজার জন্য। শেখ মুজিবের সম্ভ্যাব্য হত্যায় লুকিয়া থাকা আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা কতটা হুমকির সম্মুখীন হতে পারে সে বিষয়ে উ থান্ট অন্তত নিরাপত্তা পরিষদকে সাবধান করতে পারতেন। লক্ষন অবশ্য দেখা যাচ্ছে জাতিসংঘ বাংলাদেশের ব্যাপারে নড়েচড়ে বসেছে ভারতের বিরুউধে ইয়াহিয়ার যুদ্ধ হুমকির পরে।
<005.022.467>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
কিন্তু জাতিসংঘের মধ্যে একটি প্রভাবশালী গোষ্ঠী ভারত ও পাকিস্তানে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়লে একটি সমঝোতার পন্থা উদ্ভাবন করেই তাদের প্রকৃত দায়িত্ব এড়াতে চায়।কিন্তু প্রকৃত ইস্যু, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইস্যুকে এখন পর্যন্ত জাতিসংঘ এড়িয়েই গেছে। কিন্তু এটাও স্পষ্ট যে তারা বাংলাদেশকে নিয়ে যেকোনরকম ইন্দো-পাক শোডাউন এড়াতে চায়। কিন্তু তাদের বোঝার সময় এসে গেছে যে ভারত নয় বরং পাকিস্তানই এখানে একটি ধ্বংসযজ্ঞ চালাবে যখন তারা বুঝতে পারবে যে তারা আর বাংলাদেশকে আয়ত্তে রাখতে পারবে না। প্রচুর অর্থ-সৈন্য খরচ করে তারা কোনমতে বাংলাদেশের শহরগুলোতে নিয়ন্ত্রন রেখেছে। কিন্তু উত্তরোত্তর আগ্রাসী হয়ে উঠে মুক্তিবাহিনী সেটাকেও দুঃসহ করে তুলছে। মরিয়া হয়ে ইয়াহিয়া চীনের সাহায্য কামনা করেন এবং চীনকে রাজি করান বাংলাদেশে হস্তক্ষেপ করতে ২০০ বিশেষজ্ঞ দিয়ে যারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নড়বড়ে সামরিক কৌশল ও পরিকল্পনাকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করবে। বাংলাদেশের মাটিতে চীনা বাহিনীর উপস্থিতি এ এলাকাকে সেই রক্তস্নানের দিকে আরেকধাপ ঠেলে দেবে যার আশংকা রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা করে আসছিলেন। নিঃসন্দেহে সময় এসে গেছে জাতিসংঘের কিছু একটা করার, শুধু বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে তথাকথিত পর্যবেক্ষক পাঠানো নয়। আরও বড় বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষার একমাত্র উপায় অনৈতিক এবং অবৈধ পাকিস্তানি সরকারকে বাংলাদেশের মাটি ছাড়তে বাধ্য করা।
এবং আমরা, আমরা প্রতিহত করব যুদ্ধক্ষেত্রে। ইয়াহিয়াকে আমরা মনে করিয়ে দেব লুমুম্বার হত্যাকারীর নিজের পরিণাম কি হয়েছিল। সোম্বেকে শুধু তার কাটাঙ্গাই হারাতে হয়নি, বরং তাকে অমর্যাদাকর মৃত্যুও বরন করতে হয়েছিল। ইয়াহিয়ার নিজের পরিনতিও এরচেয়ে সম্মানজনক হবে না।
২৪ ও ২৮ জুলাই,১৯৭১
ভারতীয় মুসলামানরা বিভ্রান্ত(?)
নির্ভুলভাবেই বোঝা যাচ্ছে যে ভারতীয় মুসলমানদের একটা অংশ লক্ষাধিক দুর্দশাগ্রস্ত বাংলাদেশীদের প্রতি কোন সহানুভুতিবোধ করছে না। তারা বরং তাদের মাঝে লুকিয়ে থাকা পাকিস্তানি সামরিক জান্তার চর এবং চক্রান্তকারীদের মিথ্যাকেই বেশি বিশ্বাস করছে। আমাদের কলকাতা প্রতিনিধি জানান, পাকিস্তানিরা এজেন্টরা গোপনে প্রকাশিত কিছু উর্দু লিফলেট ছড়াচ্ছে যেখানে বাংলাদেশিদের বিরুদ্ধে জঘন্য মিথ্যাচার করা হয়েছে। এবং সবচেয়ে আশংকাজনক ব্যাপার হচ্ছে ভারতীয় উর্দু গনমাধ্যমগুলোর এক অংশে শুধু এসব লিফলেটই প্রকাশ করা হচ্ছিল না বরং কিছু দায়িত্বজ্ঞানহীন সম্পাদক অত্যুৎসাহী হয়ে ইয়াহিয়ার গনহত্যার যুদ্ধ শুরুর আগে দিয়ে মার্চ মাসে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদীদের হাতে উর্দুভাষী শরনার্থীদের নির্বিচারে হত্যার কাল্পনিক গালগল্পও ছাপা হচ্ছিল। এগুলোতে দাবি করা হচ্ছিল ১লা মার্চ থেকে শেখ মুজিবর রহমানের শুরু করা অহিংস আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ঢাকা চট্রগ্রাম খুলনাসহ বিভিন্ন এলাকায় লাখ লাখ বিহারি শরনার্থীদের হত্যা করা হয়েছে। তারা আরো দাবি করছিল ইয়াহিয়া বাঙ্গালিদের উপর পালটা গনহত্যা শুরু না করলে সম্পুর্ণ উর্দুভাষী জনগোষ্ঠীকেই নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হত।
বাংলাদেশে গণহত্যার পক্ষে ইয়াহিয়ার কি চমৎকার কৈফিয়ত আর এটা সামরিক জান্তার দাবির সাথে অক্ষরে অক্ষরে মিলে যায় যেখানে তাদের আগের একই ধরনের দাবিগুলো দুনিয়াকে ধোঁকা দিতে ব্যার্থ হয়েছে। এই রিপোর্টগুলোতে এত নিখুঁতভাবে সত্যকে বিকৃত করা হয়েছে যে তার পালটা জবাব দেয়াটাও বিব্রতকর। কিন্তু জবাব দিতেই হবে।
<005.022.468>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
বঙ্গবন্ধুর ডাকা শান্তিপুর্ণ অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের ২৫ দিনেও বাংলাদেশের কোথাও কোন অবাঙ্গালী হত্যার খবর পাওয়া যায়নি। শুধু কিছু পশ্চিম পাকিস্তানি, যারা ঢাকা থেকে বিপুল পরিমানে অর্থসম্পদ এবং সোনাদানা নিয়ে পালাচ্ছিল তাদেরকে কিছু স্বেচ্ছাসেবী ছাত্ররা আটকে দিয়েছিল। যদিও সেনাবাহিনী গুলি চালিয়ে হত্যা জখম করে প্ররোচিত করার চেষ্টা করছিল তবু পশ্চিম পাকিস্তানি হত্যার কোন ঘটনাই ঘটেনি। থমথমে পরিস্তিতি দেখে স্বয়ং বঙ্গবন্ধু ছাত্রদেরকে পিছিয়ে আসতে বলেছিলেন।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে, অবাঙ্গালী শরনার্থীদের একটি অংশ পশ্চিম পাকিস্তানি গোষ্ঠীর সাথে হাত মিলিয়েছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থের বিরুদ্ধে যেয়ে। এই অংশটিই ২৫ মার্চে লেলিয়ে দেয়া ইয়াহিয়ার খুনী বাহিনীর সহযোগী হিসেবে আবির্ভুত হয়েছিল। সেনাবাহিনী প্রথমে এদের অস্ত্র এবং প্রশিক্ষন দেয়। তারপর তাদের পূর্ণ সামরিক নিরাপত্তা দেয় ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চিটাগং, খুলনা, রংপুর, সৈয়দপুর, ঈশ্বরদীসহ বিভিন্ন যায়গায় বাঙ্গালী বিরোধী দাঙ্গা বাধানোর জন্য। শতশত নিরীহ বাঙ্গালিদের হত্যা করে তাদের ঘরবাড়ি সহায় সম্পত্তি লুটপাট করা হয়েছিল। এমনকি নারী ও শিশুরাও রেহাই পায়নি। এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞ স্মরন করিয়ে দেয় ২০-২৫ বছর আগে ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক উন্মত্ততাকে। তবুও বাঙ্গালীরা সর্বোচ্চ সহনশীলতা দেখিয়েছিল। প্রচন্ড আবেগতাড়িত হয়েও মুক্তিবাহিনীর কমান্ডারেরা মুক্তাঞ্চলগুলোর উর্দুভাষী জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত মুক্তিবাহিনী কৌশল্গত পশ্চাদপসরণ করলে সেই একই জনগোষ্ঠীর অংশবিশেষ পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সাথে হাত মিলিয়েছিল।
এখন পর্যন্ত আমি বলে আসছি অবাঙ্গালীদের একটি অংশ। এটা আমি বলে আসছি শুধু বোঝানোর জন্য যে অবাঙ্গালীদের আরেকটি অংশ ছিল যারা শেখ মুজিবের আশ্বাসে বিশ্বাস করত যে তারা বাঙ্গালিদের সাথেই সমান অধিকার পাবে। এটা সাহায্য করেছিল তাদেরকে যেখানে তারা স্থায়ীভাবে থাকতে চায় সেখানকার মানুষের মাঝে পরিচয় লাভ করতে। সাম্রাজ্যবাদী পাকসেনাবাহিনী যারা তাদের সাবেক প্রভুদের কাছ থেকে জনগণের এক অংশকে অন্য অংশের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়ার কৌশল শিখেছে , তাদের প্রলোভন সত্ত্বেও।
ভারতীয় মুসলমানদের এক অংশের স্মৃতিকাতর অনুরাগ ছিল পাকিস্তানের প্রতি যে রাষ্ট্রের জন্য চল্লিশের দশকে আমরা সবাই অনেক কষ্ট করেছি ভারতীয় মুসলমানদের জন্য উন্নততর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পটভূমি হয়ে উঠবে এই আশায়। কিন্তু এই আশা মিলিয়ে যেতে কোন সময়ই লাগেনি। এক অশুভ গোষ্ঠী ক্ষমতা দখল করে বসে এবং নিজেদের স্বার্থে জনগনকে নির্মমভাবে শোষন করা শুরু করে। সহসাই বাংলাদেশের মানুষ বুঝতে পারল শোষকদের সাথে শুধু ধর্মের মিল থাকলেই কোন লাভ হয়না বরং তা বাঁধা হয়েই দাঁড়ায়। কারন শোষনের যেকোন রকম বিরোধীতাকে এই গোষ্ঠী ইসলাম ও একতার নামে আক্রমন করছে। আর যখন মানুষ এইসব ছলনায় প্রতারিত ও নিগৃহীত হচ্ছে না তখনই এরা ঠান্ডা মাথায় হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠছে।
কিভাবে কোন সুস্থ বুদ্ধির মানুষ এদের পক্ষ নিতে পারে?এমনকি যারা এদের সহযোগী হিসেবে কাজ করছে তারাও বুঝতে পারছে না তাদেরকে কেবল মাত্র ব্যাবহার করা হচ্ছে । পাকিস্তানি জান্তা তাদের প্রকৃত রুপ গোপন করতে বর্তমান সমস্যাকে হিন্দু মুসলিম সংঘর্ষ হিসেবে তুলে ধরছে।
<005.022.469>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে. হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে একটি দ্বন্দ্ব বিরাজমান ছিল। কিন্তু বাস্তবতা হল যে, তাহলে এই মুসলমানরা কিভাবে লক্ষ লক্ষ নিরস্ত্র নারী, পুরুষ ও শিশু হত্যা করেছিল? তাহলে কেমন করে এই ভারতীয় মুসলিমরা সহকর্মী ধর্মবাদীদের এই হত্যাযজ্ঞের “জিহাদের” এমনকি একটি পাকিস্তান-কল্পনানুসারে ইসলামী রাষ্ট্র রক্ষা করতে পদক্ষেপ নিতে পারে।
ভারতীয় মুসলিমরা ঐ চিনি-লেপা রক্ত জমাট বেঁধে পাকিস্তানি উপ-মানুষের দ্বারা বন্টিত হচ্ছে। তাদের একবার হলেও উপলব্ধি করতে হবে যে,তাদের স্বপ্নের পাকিস্তান রাষ্ট্র একবার নিরস্ত হয়েছিল।
তারা ভাগ্যবান একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বাস করে যেখানে তারা অবাধে শত্রু রাষ্ট্রের জন্য তাদের সমর্থন প্রদর্শন করতে পারেন মনে হবে. তারা যথার্থই পাকিস্তানের পঞ্চম স্তম্ভ এবং সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যেতে পারে। তারা নিশ্চয়ই এই সুযোগের অপ বা খারাপ ব্যবহার যেটি প্রতিটা পাকিস্তানি করেছিল ১৯৪৭ সালে।
২৬ জুলাই, ১৯৭১
বাংলাদেশে একটি সাঁড়াশি আাক্রমন
সুচনালগ্ন থেকেই পাকিস্তান রাষ্ট্রের স্বভাবই ছিল অর্থনৈতিক শোষণ যা অন্তত বর্তমান গণহত্যার বিভীষিকাময় ভয়াবহতার চেয়ে কম বেদনাদায়ক নয়। বস্তুত এই বিয়োগান্তক ঘটনা এই বছর এপ্রিল থেকে অবিশ্বাস্য অনুপাতে পৌঁছেছে।
এখন এটা সর্বজনবিদিত যে বাংলাদেশ, সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের এই ২৩ বছরে পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রার সিংহভাগ অর্জন করেছে কিন্তু লাভ, বিনিময়ে, জাতীয় সম্পদ যে প্রতীকী চিনাবাদাম সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। দণ্ডপ্রাপ্ত ফেডারেশনের এই অংশ ইচ্ছাকৃতভাবে একটি উপনিবেশিক বাজারে পরিনত হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তান ভিত্তিক শিল্পকে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রায় স্থিরতা দিতে জা আমাদের অর্থকরী ফসল-পাট এবং চা আয় বিনিময় দ্বারা নির্মিত। শিল্প উন্নয়নের একটি ভগ্নাংশ পূর্ব পাকিস্তানে এসেছিল কিন্তু বেশিরভাগই মালিকানাধীন এবং পশ্চিম পাকিস্তানের রাজধানী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। সেখানে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের জন্য সামান্যই রয়েছে। ফলস্বরূপ, বাংলাদেশে শিল্প ইউনিট যেগুলো পশ্চিম পাকিস্তানীদের মালিকানাধীন নয় সেগুলোকে পাবলিক সেক্টরে দিয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু কর্ণফুলি পেপার এর জ্বলজ্বলে উদাহরণ এবং কৃত্রিম তন্তু কমপ্লেক্স দেখাত যেমন, এইগুলোও পশ্চিম পাকিস্তানী পুঁজিবাদীদের থেকে হচ্ছে। এই ভয়ানক অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে সহিংস গণবিক্ষোভ এর মধ্যে চূড়ান্ত পরিণতি পায়। জনঅসন্তোষ থাকা সত্ত্বেও কিছুই সত্যি পরিবর্তিত হয়নি। বস্তুত অর্থনৈতিক উপনিবেশ স্থাপন করে পুঁজিবাদীরা যারা স্পষ্টত পশ্চিম পাকিস্তানী জেনারেলদের দ্বারা পাকিস্তান প্রথম ক্ষমতাসীন হয়েছে, পরোক্ষভাবে গত ১২ বছর ধরে সরাসরি একটি জান্তা সামরিক সুরক্ষা নিশ্চিত করেছে।
গত কয়েক বছরে শোষণ প্রকৃতির খুব অসহনীয় হয়ে ওঠে. পশ্চিম পাকিস্তানীদের ব্যবসা যেগুলো পূর্ববাংলায় ছিল তারা উদ্বেগ না শুধুমাত্র এমনকি একটি পয়সাও স্থানীয়ভাবে বিনিয়োগ করতে অস্বীকার করেছিল এমনকি তারা পূর্বাঞ্চলের অফিসের সব আয় দৈনিক সূর্যাস্তের পূর্বে পশ্চিম পাকিস্তানে স্থানান্তর করতে কড়া আদেশ ছিল। পাট শিল্পই কেবল একমাত্র শিল্প যেটি…
<005.022.470-471>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
শুরু থেকেই এটি ছিল পার্টিশন পূর্বের বোম্বের একটি অবারিত দেওলিয়ত্ব সম্পন্ন আদমজীর অধীনে যে আক্ষরিক অর্থেই চোখের পলকেই পাকিস্তানের ধনকুবেরে পরিনত হয়েছিল। এই লোভী চক্রান্তকারী বাজারে মনোপলি খেলে উচ্চমূল্যে পণ্য বিক্রি করে টাকা হাতিয়েছে আর পাট চাষীদের ভার্চুয়াল ভিক্ষাবৃত্তিতে পতিত করেছে। পরবর্তিতে সে অন্যান্য অবাঙ্গালী পুজিবাদীদের সাথে যোগদান করে আরো পেষনে যুক্ত হয়। এইরুপ বিরামহীন, বহুমুখী , নির্মম শোষণের ফলাফল রুপে খুব শীঘ্রই প্রকাশ পেতে শুরু করে এমনকি সরকারী পরিসংখ্যানে এর অঙ্কগুলো ছিলো প্রশ্নবিদ্ধ। বর্তমানে পূর্ব পাকিস্তানের মাথা পিছু আয় ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের প্রায় অর্ধেক যদিও তারা প্রায় একই অবস্থান থেকেই শুরু করে। বরং ১৯৪৭ সালে বাঙ্গালীদের আয় কিছুটা বেশিই ছিলো।
রাজনৈতিকভাবে , সামরিক-পুঁজিবাদী-আমলাতান্ত্রিক মৈত্রী/ সম্পর্ক হিসেবে বিবেচিত। পূর্ব-বাঙালিদের ধীর গলায় হত্যা করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার কোন অধিকার ছিল না। “ইসলাম বিপদাপন্ন” “ইন্ডিয়ার দালাল” “রাষ্ট্রদ্রোহী ষড়যন্ত্র” “বিপদগ্রস্ত জাতীয় ঐক্য” ইত্যাদি ইত্যাদি ছিলো তাদের দমানোর জন্য একধরনের অশনি সংকেত। বাঙ্গালীদের উপর এ রাজনৈতিক নিপীড়ন একটি ভয়াবহ ব্যাধীতে রুপান্তর নেয়, হাজার হাজার মানুষ বিনা বিচারে জেলখানায় অবহেলিত হতে থাকে। বিশেষ রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব সম্পন্ন আইয়ূব খান অসাধারন সমন্বয়ে ক্ষমতা দখল করার পর, ভীতিপ্রদর্শন এবং ১৯৫৮ সালের ব্ল্যাকমেইল, কুট কৌশলে পূর্ব বাংলার উঠতি অসন্তোষ মোকাবেলা করতে চাওয়া। আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি স্বীকৃতি দেন যে, এত গুলো বছর ধরে পূর্ব বাংলা নিগৃহিত হয়ে আসছে এবং এসব ঠিক করার প্রতিশ্রুতি দেন। অবশ্য তিনি এসব মোটেও বোঝান নি। শোষন অব্যাহত থাকে। কিন্তু এসব লোক চক্ষুর আড়ালে রাখতে সব কিছু থেকে বাইরে গিয়ে তিনি অসন্তোষ বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় কে কিনে নিতে চাইলেন চাকরী, বৃত্তি এবং অন্যান্য বৈধ ও অবৈধ ঘুষ প্রদানের মাধ্যমে। এটা কাজ করছিলো কিন্তু রাজনৈতিক নেতৃত্বে ধাক্কা আসছিলো মধ্যবিত্ত থেকে জনসাধারনের মধ্যে যাদের পেটে লাথি মারা হয়েছিল। আয়ূবের তাদের সবাইকে কেনার ইচ্ছা যদিও ছিলো না। বাকি গল্প গুলি ছিলো ২৫শে মার্চ ১৯৭১ পর্যন্ত গ্রেপ্তারী পরোয়ানা যা এখন সবার জানা।
জান্তা ইয়াহিয়ার নেতৃত্বে “আয়ুব চাতুরীর” অভাব আছে। এর ফলে, আমরা সাক্ষী ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্য দুই দাড়ওয়ালার আক্রমন বাংলাদেশের মানুষের উপর। সামরিক কসাইখানা ইতোমধ্যে নিয়েছে লাখ সাধরন মানুষের প্রান। ইয়াহিয়া এবং তার দল এখন ধীরে ধীরে প্রস্তুতি নিচ্ছে বছর শেষের আগেই ইতিহাসের সবচাইতে নিকৃষ্টতম দূর্ভিক্ষ সৃষ্টির। দৃড় পদক্ষেপে শিল্পে ডাকাতি শুরু হয়েছে। সকল গুরুত্বপূর্ন মেশিনারিজ এবং মেশিন মিল কারখানাগুলো থেকে যন্ত্রাংশ পশ্চিম পাকিস্তানের পুজিবাদীদের মালিকানাধীন জাহাজে করে করাচি চলে যায়। এখন সর্বশেষ রিপোর্ট অনুযায়ী, খুনে সামরিক প্রশাষনের টিক্কা অর্থনৈতিক ডাকাতির দায়িত্ব গ্রহন করেছে। শিল্প উদ্বেগ এর সাথে সরকারী খাতে বাংলাদেশের মানুষদের মেশিনারি গুলো ডাকাতি হচ্ছে। উদাহরন স্বরুপ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন ঢাকা স্টুডিওর ২৫ শে মার্চের আগ পর্যন্ত যেসব মূল্যবান যন্ত্রপাতির ডাকাতি হয়েছিলো তার কেন্দ্রবিন্দু। মুভি ক্যামেরা, শুটিং মেঝের সরঞ্জাম, সাউন্ড রেকর্ডিং ইউনিট এবং রঙীন এবং সাদা কালো ছবির ল্যাবটরির যন্ত্রপাতি লাহোরে স্থানান্তর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়। স্টুডিওর আছে বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ উৎপাদন হার, ১৯৫৬ সালে তৎকালীন শিল্প মন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান প্রাদেশিক পরিষদের একটি আইনে সরানোর মাধ্যমে এর অস্তিত্ব এসেছিলো। এই ধরনের ডাকাতি গুলো সম্প্রসারিত হচ্ছে অন্যান্য পাবলিক মালিকানাধীন শিল্প গুলোতেও। আমরা জানতাম ব্রিটেন আমাদের ঐতিহ্যবাহী তাঁত শিল্পকে ধ্বংস করতে চায় ম্যানচেস্টারের টেক্সটাইল শিল্পের বাজার টিকিয়ে রাখতে। আমরা আরো শুনেছি ব্রিটিশ নীলকরদের অত্যাচারের কথা। দেখে মনে হয় ইতিহাস যেনো এখনো একই রকম রয়ে গেছে। আমি শুধু কেউ ই জানতো না এ সম্পর্কে যতক্ষন না পাকিস্তানি উপ-মানুষেরা বাংলাদেশে কাজ পায়।
২৭শে জুলাই ১৯৭১
পাকিস্তান রক্ষায় জাতিসংঘ
জাতিসংঘের কাঁচ ঘর থেকে একটি অত্যন্ত অশুভ পদক্ষেপের খবর পাওয়া গেল। বলা বাহুল্য যে এর মুল পরিকল্পনাকারী আর কেউ নন, জাতিসঙ্ঘের শরনার্থী কমিশনার প্রিন্স সদরউদ্দিন আগা খান। প্রিন্স আগা খানের ক্ষতবিক্ষত বাংলাদেশ আর পাকিস্তানিদের অত্যাচারে ভারতে আশ্রয় নেওয়া ৬০ লক্ষ শরনার্থীর রিফ্যুজি ক্যাম্প গুলো পরিদর্শনের পরও পাকিস্তানি সাম্রাজ্যবাদীদের প্রতি তার সমবেদনা লুকাতেই এই প্রচেষ্টা। গণমাধ্যমে দেয়া তার সতর্ক ও গতানুগতিক কুটনৈতিক বক্তব্যে বাংলাদেশের মানুষের ভয়ানক দুর্দশার প্রতি তার নির্মম উদাসীনতাই প্রকাশ পেল।বলার অপেক্ষা রাখেনা যে ৫০ জন ইউ.এন. সদস্যকে পরিদর্শক হিসেবে বাংলাদেশে পাঠানোর তার নতুন পরিকল্পনা মুল উদ্দেশ্য ছিল নিক্সন প্রশাসন কে সম্পুর্ন সমর্থন দেওয়া। এটা শুধুমাত্র তিনি এবং তার পরামর্শদাতারা জানতেন। নিক্সন প্রশাসন, যারা পরিষ্কার ভাবেই এই ইস্যুর পক্ষে অবস্থান নিয়েছে এবং বাংলাদেশে ঘৃণ্য পাকিস্তানি কলোনীস্টদের একটি পুতুল শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে।এই পরিকল্পনাটি আমেরিকার দক্ষিন ভিয়েতনামে Ngo Din Diem শাসন প্রতিষ্ঠার চেষ্টার থেকেও জঘন্য।নিশঃন্দেহে হত্যাকারী জান্তাকে উপর্যপুরি অশ্র সরবরাহের পর এটি ছিল নিক্সন সরকারের বাংলাদেশি জনগনের বিরুদ্ধে প্রথম কুটনৈতিক আক্রমন।
এরকম ভয়াবহ পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে এই প্রস্তাবিত ইউ.এন. পরিদর্শক দল নিয়ে আমাদের মাঝে বিভ্রান্তির কোন অবকাশই ছিল না। এর উদ্দেশ্য পরিষ্কার ভাবেই বাংলাদেশি জনগণের বর্তমান স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধি ছিল।গত চার মাসে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর লক্ষাধিক নিরপরাধ মানুষের পৈচাশিক হত্যা আর সমগ্র বাঙ্গালী জাতির ওপর তাদের নারকীয় ও অন্ধ হিংস্র আক্রমন জাতিসঙ্ঘকে খুব সামান্যই বিচলিত করেছিল।এর সাধারন সচিব এমন একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান সম্পাদক হিসেবে সম্পুর্ন ব্যার্থ যা এক সময় বিশ্ব মানবতার রক্ষক হিসেবে বিবেচিত হত।যদিও তিনি জনসম্মুখে এই দুঃখজনক ঘটনায় তার ব্যক্তিগতভাবে মর্মাহত হওয়া কথা জানিয়েছেন।সপ্তাহের পর সপ্তাহ বাংলাদেশের বিধস্ত মানবতা বৃথাই অপেক্ষা করেছে এই আশায় যে, জাতিসংঘ তাদের ওপর কৌশলে চাপিয়ে দেওয়া এই ধংসাত্মক যুদ্ধের দুর্ভোগ লাঘবের জন্য কিছু করবে।কিন্তু কিছুই হয়নি।জাতিসংঘ অত্যন্ত আপত্তিকর ভাবে একটি হৃদয়হীন নিরব দর্শকের ভুমিকা পালন করেছে।যখন এরকম একটি প্রতিষ্ঠান হঠাৎ করে এত সক্রিয় হয়ে ওঠে তখন সেটা সাভাবিক ভাবেই উদ্যেগের সৃষ্টি করে।এরকম একটি তথাকথিত পরিদর্শক পাঠানোর প্রস্তাব শুধুমাত্র অসৎ
উদ্দেশ্য প্রনিতই নয় বরং এটি বাংলাদেশের জনগণের জন্য একটি অশনি সংকেতের পুর্বাভাস।দলটির উপস্থিতি নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশ অধিকৃত এলাকায় পাকিস্তানি জান্তার অবস্থান সুসংহত করার উদ্দেশ্যে ছিল।মুক্তিযদ্ধাদের আক্রমনে মারাত্মকভাবে হয়রানির শিকার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সাময়িক বিশ্রামের খুব প্রয়োজন ছিল।জাতিসংঘ শুধুমাত্র তাদের সে সুযোগ দেয়ার চেষ্টা করছিল।তাদের সামগ্রিক পরিকল্পনা ছিল স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে দৃষ্টি অন্য দিকে ঘোরানো।
<005.022.472-476>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
পাকিস্তানিরা বাংলাদেশের জনগনের সাথে গণহত্যামূলক যুদ্ধ শুরু করেছিলো ,যে যুদ্ধ জন্ম দিয়েছে স্বাধীনতার জন্য এক আপোষহীন যুদ্ধের। এটাই প্রধান কারন এবং পাকিস্তান তার অশুভ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ভারতকে টেনে আনছে যাতে বাংলাদেশের মানুষের উপর চালানো অমানবিক নির্যাতন থেকে বিশ্বের মনযোগ অন্যদিকে ঘোরানো যায়। একদা মহান সংগঠন জাতিসংঘ এখন নিক্সনের আন্তর্জাতিক কৌশলের স্বার্থে সরাসরি বাংলাদেশের জনগনের বিরুদ্ধে আপত্তিকর ভূমিকা পালন করেছে । মনে হচ্ছে যেন সভ্য পৃথিবী শেষ ,সমস্ত মানবিক মুল্যবোধ ডিগবাজি খেয়ে গেছে ।
পাকিস্তানি ফ্যাসিস্ট রেডিও জাতিসংঘের স্বার্থে এর সন্দেহজনক বিজয়ে উল্লাস না করে পারছিলো না । সর্বশেষ সংবাদে এটি প্রিন্স সদরুদ্দীনের গোপন উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানায় । এটা দাবী করে পর্যবেক্ষকরা ইন্দো-বাংলাদেশ সীমান্তে তদন্ত করে পাকিস্তানের দাবীমতো এটাই প্রতিষ্ঠা করবে যে ,ভারত মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করে আসছে এবং বাংলাদেশের কোন স্বাধীন কোন অঞ্চল নেই । বিখ্যাত পশ্চিমা সাংবাদিক যারা স্বাধীন অঞ্চল গুলো ঘুরে রিপোর্ট করেছে তাদেরকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে জাতিসংঘ পাকিস্তানের মিথ্যার কাছে আত্মসমর্পণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে । আর ভারত সবসময়ই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য সহানুভূতি প্রকাশ করে । তবুও ভারত তার সীমান্তে জাতিসংঘের তদন্তকারী দলের উপস্থিতিকে অনুমোদন দিবে ,যা বোঝা খুব একটা কঠিন নয় ।
জাতিসংঘ বাংলাদেশের একটি সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারতো যদি বৃহত্তর শক্তিগুলোর সন্দেহজনক রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের চেয়ে বিবেচনা দিয়ে সক্রিয় হতো ।এটা গভীর পরিতাপের বিষয় যে , উ সান্টের অদূরদর্শী উপদেষ্টারা পাকিস্তানি ফ্যাসিস্ট জান্তার অশুভ উদ্দেশ্যকে সাহায্য করছে এটা অনুধাবন করতে ব্যর্থ । এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে একটি পুতুল সরকার বসিয়ে পাকিস্তানি উপনিবেশ ধরে রাখতে সাহায্য করছে ।
বাংলাদেশের জনগন এবং সরকার জাতিসংঘের এই সর্বশেষ পদক্ষেপকে শুধুমাত্র বেআইনী হিসেবেই নয়, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের উপর ক্ষমার অযোগ্য হস্তক্ষেপ এবং স্থুল অবমাননা হিসাবে বিবেচনা করছে ।এই দল তাই গুরুত্বপুর্ন পরিনিতির ব্যাপারে সতর্ক ছিলো ।এই তথাকথিত পর্যবেক্ষকরা আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের শত্রুদের ই বেশি আমলে নিবে ।বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীরা তাদের অবিশ্বাসী সহযোগির সাথে যে আচরণ করতে হয় ঠিক তাই করবে ।কিন্তু জাতিসংঘকে যে ভূমিকা পালন করতে বলা হয়েছে তা করার খুব একটা প্রয়োজনীয়তা নেই ।
১৩ ই জুলা ,১৯৭১
“ দুর্ভিক্ষ হলো অস্ত্র ,সৈনিকদের জন্য খাদ্য পরিত্রান !
বাংলা বায়াফ্রা নয় “
বাংলাদেশে ইয়াহিয়ার খুনী জান্তার দুটি গুরুত্বপুর্ন উদ্দেশ্য ছিলো ।এক , সম্পূর্ণ সামরিক বিজয় এবং দুই , একটি ব্যাপক দুর্ভিক্ষ ।প্রথমে সে তাচ্ছিলের সাথে আশা করেছিলো নিশ্চিতভাবেই কয়েকদিনের ভিতরে বিজয় অর্জিত হবে ,যা কোনভাবেই এক সপ্তাহের অধিক সময় নেবেনা এটি এখন ছয়মাস ধরে জয়ের আশায় টেনে হিঁচড়ে নেওয়া একটি যুদ্ধ ।প্রতিটি সূর্যোদয়ের সাথে সাথে তাদের পরাজিত হয়ে পশ্চাদপসারন করার আমধ্যমেই তা প্রতীয়মান হয় ।একজন ডুবন্ত মানুষের মত ইয়াহিয়া এখন তার পথে যেই আসছে তাকেই খড়কুটোর মতো আকড়ে ধরতে চাইছে ।
তার সর্ব শেষ কৌশল হলো বাংলাদেশের দখলকৃত অঞ্চলে একটি দুর্ভিক্ষ তৈরি করা ,যতোটা ব্যাপকভাবে সম্ভব ।তার আশা ছিলো এই দুর্ভিক্ষে যখন বাংলাদেশে লক্ষাধিক লোক মারা যাবে ,প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙ্গে তার ঔপনিবেশিক সৈনিকেরা স্থায়ী বিজয় অর্জন করবে । সাম্প্রতিক নানাবিধ ঘটনায় তার নারকীয় ,ধর্ষকামী ,পাগলামিপুর্ন দমননীতি তিনগুন বেড়ে যাওয়া এটাই প্রমান করে ।মুক্তিবাহিনি যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙ্গে দিছে এই অভিযোগে খাদ্য সরবরাহের সুবিধার কথা বলে সে ইউএসএ এবং চীনের কাছ থেকে বোট এবং উপকুলগামী জাহাজ পেয়ে গেছে । যথাসময়ের এইগুলো গানবোট এবং আর্মিদের সরবরাহ যানে রূপান্তর করা হবে ।এই সপ্তাহে মুক্তিবাহিনী পাক আর্মির একটি সরবরাহ বহর দখল করে ।এটা রেশন নিয়ে যাচ্ছিলো ,যার মধ্যে ছিলো বন্যায় আক্রান্তদের জন্য রেডক্রস এবং CARA এর দেওয়া ত্রাণসামগ্রী । শুধুমাত্র কম্বল ই নয় , নভেম্বরের সাইক্লোন আক্রান্তদের জন্য বিভিন্ন বৈশ্বিক সংগঠন তাবুসহ অন্যান্য ত্রাণসামগ্রী পাঠিয়েছিলো তা খুনী আর্মিদের কাছে সরবরাহ করা হচ্ছিলো ।এভাবে ভেবেচিন্তেই লক্ষ লক্ষ ক্ষুধার্ত মানুষকে জোর করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে । আক্রান্ত অঞ্চলে না দেওয়া হচ্ছে প্রয়োজনীয় খাদ্য না বাইরের বিভিন্ন সংস্থা থেকে পাঠানো খাদ্যদ্রব্যসহ অন্যান্য দ্রব্যসামগ্রী । বাংলাদেশের মানুষের সাথে এই অদ্ভুত প্রতিহিংসা নিক্সন সরকারের সম্পুর্ন জ্ঞানসারেই ঘটছিলো ।এবং খুনীর প্রতি গ্রহনযোগ্য অবস্থানের প্রেক্ষিতে তাদের একটা পক্ষপাতিত্ব সবসময় ছিলো । সামনে আসছে কঠিন মাস অক্টোবর ।নজিরবিহীন দুর্ভিক্ষ হয়তো আসন্ন । আমরা শ্রীগ্রই জানতে পারবো জাতিসংঘ এই পূর্বানুমিত ব্যাপক খুনকে নিজেদের মতো করে বিচার বিবেচনা করতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে যেভাবে তারা পাকিস্তানি গনহত্যাকে ক্ষমা করেছে ।কিন্তু খুনী জান্তার এই ধ্বংসাত্মক পরিকল্পনা কি স্বাধীনতা সংগ্রামকে ধ্বংস করতে সফল হবে ? অবশ্যই ইয়াহিয়া এবং তার সহযোগিরা বায়াফ্রার দিকে দৃষ্টি রাখছিলো । বায়াফ্রাতে প্রচণ্ড দুর্ভিক্ষই পরাজয়ের কারন ছিলো ।এইখানে ও কি একই ব্যাপার ঘটবে ?
বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থানের জন্য দুর্ভিক্ষের মাধ্যমে বিজয় লাভের খুনে যুক্তি একটি ভ্রান্ত ধারণা ।বায়াফ্রাতে সশস্ত্র বিদ্রোহিরা ফেডারেল আর্মির হাতে এমন এক জায়গায় ধরা পড়েছিলো যেটি ছিলো নাইজেরিয়ার নিকটস্থ ।অন্য কোন বন্ধু রাষ্ট্রে তারা এমনকি কোন উপসানালয় ও খুজে পায়নি । তাই দুর্ভিক্ষে তাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছিলো । বাংলাদেশের অবস্থা ঠিক এর বিপরীত । এখানে ঔপনিবেশিক সৈন্যরা ধরা পড়েছে এবং মুক্তিযোদ্ধারা তাদের সম্পুর্নভাবে ঘিরে ধরেছে ,সারাদেশ আক্রান্ত অঞ্চলের অর্থনীতির উপর নির্ভরশীল নয় ।প্রকৃতপক্ষে দুর্ভিখ থাক না না থাক গনপ্রজাতন্রী বাংলাদেশের জনগন ৮৫-৯০ শতাংশ অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করছে ।ইতিমধ্যে অক্টোবরে বিভিন্ন খাদ্য গুদামে কি পরিমাণ খাদ্য মজুদ আছে তা পরিমাণ কর আহয়েছে ।এখানে দখলকৃত অঞ্চলে একটি দুর্ভিক্ষ আমাদের বিজয়ের পথে কোন প্রভাব ফেলতে পারবে না ।
ধ্বংসাত্মক দুর্ভিক্ষ তৈরির অপকৌশল এটা আবারো প্রমান করেছে যে ,ইয়াহিয়া শুধু অদ্ভুত খুনীই নয় ,সে একজন নিকৃষ্ট মিলিটারি কৌশলপ্রনেতা । এবং যেভাবে সে ২৫শে মার্চ ঢাকা থেকে পালিয়ে গেছে ,এটা ইতিমধ্যে প্রমান করেছে সে একজন নির্লজ্জ কাপুরুষ । আইলোক গুটিয়ে আনা জালের ভিতর ক্রমশই আটকে যাচ্ছে ।দেয়াল লিখনগুলো বড়ো হচ্ছে প্রতিদিন ।
১৫ জুলাই ,১৯৭১
শেখ মুজিব কে নিয়ে বিশ্ব মিডিয়ায় উদ্বেগ, টিক্কাকে সম্মান!
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাস্ট্রপ্রতি শেখ মুজিবুর রহমানের অবস্থান এবং নিয়তির ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করতে এখন লন্ডনের পত্রিকা “ডেইলি টেলিগ্রাফ” বাংলাদেশ বেতারের সাথে যোগ দিয়েছে । ১৪ আগস্ট এটি একটি সংখ্যা প্রকাশ করে ,যেখানে প্রশ্ন করা হয় “শেখ মুজিবুর রহমান কি মৃত” গত কিছুদিন বিভিন্ন ঘটনায় আমাদের মতৈ এই পত্রিকার প্রধান লেখক লক্ষ্য করেছেন ২৫শে মার্চের রাতে মুজিবের স্বেচ্ছা বন্দিত্ব গ্রহণের পর থেকে তাঁর কোন বক্তব্য শোনা যায়নি শুধু ইয়াহিয়ার কিছু স্টেটমেন্ট ছাড়া ।ইয়াহিয়ার বক্তব্য ছিলো শেখ মুজিব শাস্তি পাবে এবং মুজিবের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তাঁর শাস্তি মৃত্যুদণ্ড ।গত সোমবার পাকিস্তানি আর্মি বলছিলো যে , আগামি পরশু থেকেই তাঁর বিচারকাজ শুরু হবে ।সম্পাদকীয়তে আর ও প্রশ্ন তোলা হয় ,মুজিবের শাস্তি ইতিমধ্যে কার্যকর করা হয়েছে কিনা । এটি আর ও জানতে চায় , অবশ্যম্ভাবী সন্দেহ যে ভিত্তিহীন,ইয়াহিয়া তা দেখাতে সক্ষম হবে কিনা । পত্রিকাটি প্রস্তাব করে বিশ্বের সবার সন্দেহ দূর করতে ইয়াহির শেখের জন্য পাকিস্তানের বাইরের একজন আইনজীবীকে নিয়োগ দিতে পারে । কিন্তু এমন একটি প্রচেষ্টা ইতিমধ্যে ব্যর্থ । আন্তর্জাতিকভাবে যে সকল সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে তা হলো , শেখ মুজিব হঠাত করে একদিনের নোটিশে বিচারের মুখোমুখি হতে পারেন । আর্মির সোর্স থেকে পাওয়া অন্য একটি রিপোর্ট থেকে জানা যায় ,শেখ মুজিব কোর্টের বৈধতা মেনে নিতে অস্বীকার করেছেন ।তাই কোন পরামর্শক নিয়োগে স্বীকৃত হননি ।
সম্পুর্ন
বাংলাদশের ট্রাজেডীতে এটাই হতে পারে একমাত্র চতুর প্রচারণা ।শেখ মুজিবকে চেনে এমন যে কেউই মুজিবের যুকিতে মেনে নেবে ।কিন্তু এটি মিলিটারি জান্তার উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ও কাজ করবে ।যদি ইতিমধ্যে মুজিবকে খন করা হয়ে থাকে ,বিশ্বকে প্রতারিত করার জন্য এই কল্পকাহিনী খুব সুবিধাজনক হবে ।সেক্ষেত্রে খুনী জান্তার পরবর্তী পদক্ষেপ হবে ,শেখ মুজিবকে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ডে দন্ডিত করা হয়েছে ।এই বিকৃতকামী প্রহসনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে একটু সময় লেগে যেতে পারে । তা সত্ত্বে ও কিছু সময় পরে নেতার বিচারকাজ স্থগিত রাখার প্রস্তাব অনুমোদিত না হওয়া বা বিচারের ফলাফল ঠিক সময়ে ঠিকভাবে জন সম্মুখে প্রকাশীত হবে ।
এর আগে ইয়াহিয়া ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যমের এক প্রতিনিধির সাথে সাক্ষাৎকারে বলেছে যে ,শেখকে ফায়ারিং স্কোয়াডের মুখোমুখি নাও করা হতে পারে ,সে মারাও যেতে পারে যাকে সে “জেলের ভিতর স্বাভাবিক মৃত্যু” বলে অভিহিত করেছিলো । অবশ্যই সে এটা বলেনাই “ স্বাভাবিক মৃত্যু” বলতে সে কী বোঝাচ্ছে ।
যাইহোক, এই সংবাদ শেখ মুজিবের অবস্থান সম্পর্কে যেসব জল্পনাকল্পনা ছিলো তা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করবে ।
সেখানে ,জনগণের ধারণা ,বিচারকাজের জন্য সম্ভাব্য জায়গা হবে একটি নির্মানাধীন জেলখানা । একজন বিদেশি প্রতিনিধি রিপোর্ট করেছেন তিনি আর্মি দ্বারা সুরক্ষিত জেলখানাটি দেখেছেন । এইসব অনুমান ,বাস্তবতা ,গুজব এবং খাপছাড়া ঘটনাগুলো থেকে বোঝা যায় ,শেখ মুজিব বেঁচে আছেন এবং তাঁর বিচারের নামে এক হাস্যকর এবং প্রহসনের আইন পাশ করা হয়েছে ।
আর ও গুজন আছে যে ,বিচার প্রক্রিয়া স্থগিত ও হতে পারে ।
আসব কিছুই ক্ষুদ্র মনে হয় যখন কেউ স্মরণ করে এই খেলায় আইনজীবি ,বিচারক ,জল্লাদ সবই একই ব্যক্তি যে জনগনকে একজন বন্দির হত্যাকে “ মৃত্যু” হিসাবে দেখাতে চায় । এখন সে বিশ্বকে বোঝানোর সড়যন্ত্রে ব্যর্থ হয়েছে যে বাংলাদেশ পাকিস্তান যুদ্ধাবস্থা হলো একটি ইন্ডিয়া পাকিস্তান সংঘর্ষ ।এক ঢিলে দুই পাখি মারার উদ্দেশ্য নিয়ে সে শেখ মুজিবকে খুন করতে চায়। তাই চতুরতার সাথে এক মুখে দুরকম কথা বলে সবাইকে প্রলুব্ধ করার অপচেষ্টায় লিপ্ত ।এটি আলাপ আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তির সম্ভাবনাকে আক্ষরিক অর্থেই ধ্বংস করবে । এবং বাংলাদেশের জনগন সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ইন্ডিয়ার কাছে যা ছিলো এই প্রসংগে একমাত্র গ্রহনযোগ্য রাজনৈতিক সমাধান ।অন্যদিকে ইয়াহিয়া শেখ মুজিবের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে আওয়ামীলীগের ভিতর নেতৃত্ব নিয়ে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব আশা করে ছিলো ।রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা সতর্ক্তার সাথে মিলিটারি জান্তার দেওয়া আসন বাতিল করা আওয়ামীলীগের অব্যাহতি প্রাপ্ত নেতাদের তালিকার উপর নজর রাখছিলেন ।এই তালিকায় গনপ্রজানন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীসভার গুরুত্বপুর্ন সদস্যরা ও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন ।এই অন্তর্ভুক্তি দলের ভিতর অবিশ্বাসের জন্ম দিবে ,যার পরিণতিতে বাংলাদেশের জনগনের অটল ঐক্যমতে ফাটল ধরিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানি উপনিবেশ থেকে নিজেদের স্বাধীন করার দৃঢ়তা ধ্বংস করবে বলে পরিকল্পিত আশাবাদ ব্যক্ত করা হয় ।
যা ছিলো শিশুসুলভ । যেখানে উটপাখি পাখিও একটু চালাক হতে চেষ্টা করে যা আমরা বিশ্বাস করি তাঁর চেয়েও ।
তা সত্ত্বে ও তারা উটপাখির মতো আসন্ন বিক্ষোভ ঠেকাতে হাস্যকর ভাবে ক্ষমতাহীন ,এখনো পর্যন্ত ।
ইয়াহিয়ার জন্য সবকিছুই দেরি হয়ে গিয়েছিলো । তাঁর আত্মবিশ্বাস নোড়ে যাচ্ছিলো দ্রুত । মুজিবের মৃত্যু মানে যদি হয় বাংলাদেশের আলোচনা সাপেক্ষ স্বাধীনতা প্রাপ্তিতে বাঁধা সেটা আমাদের শান্তিকাম্যি বন্ধু রাষ্ট্র সোভিয়াত ইউনিয়ন আর ইন্ডিয়া চায় ,তাহলে এইটা হবে সামরিক সমাধান । একটি সামরিক বিজয় শুধুমাত্র একটি বিশাল সম্ভাবনা ই নয় , আমাদের বীর মুক্তিযোদ্দারা এর মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে আমাদের কিছু শুভাকাংখী যেমনভাবে তাঁর চেয়ে ও দ্রত গতিতে।আমাদের এখন যা প্রয়োজন তা হলো কার্যকর সহানুভতি এবং সহযোগিতা ।আমরা কখনোই চাইনা আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশের জনগন ছাড়া অন্য কেউ যুদ্ধ করুক ।আমরা খুব ভালোভাবেই বহিরাগত শত্রুকে পরাজিত করে আমাদের স্বাধীনতা অর্জন করতে পারি ।
ইসলামাবাদের এক রিপোর্টে জানা যায় , দুই মিলিয়ন নিরস্ত্র নারী ,পুরুষ এবং শিশুকে হত্যাকারী অননুতপ্ত টিক্কা খান “হিলাল ই কায়েদে আজম “ নামের বেসামরিক পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছে যা ইয়াহিয়া কর্তৃক প্রদত্ত ।এটা প্রমান করে ,অদ্ভুতভাবেই বারবার ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয় ।এক মিনিটের ভিতর জালিয়ানওয়ালাবাগে একটি শান্তিপুর্ন সমাবেশে গনহত্যা চালানো জেনারেল দায়ুর লন্ডনের “ডেইলি এক্সপ্রেস “ এর “সিলভার সোর্ড অফ ভেলোর “ এ ভূষিত হয়েছিল যখন সে ইন্ডিয়া থেকে আসে ।অবশ্যই মানবতার বিরুদ্ধে টিক্কা খানের যে অপরাধ এবং বালুচের লোকের উপর ঈদের নামাজের মাঝে যে হত্যাযজ্ঞ দায়ুরের চেয়ে ও এটি আজ পর্যন্ত ঘটা সবচেয়ে ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ ।মারকুইসের এই অজ্ঞ শিষ্য সত্যিই এইখম্যান ডঃ মিয়োগিলি এবং হিটলারের নির্যাতন ক্যাম্পের কমান্ডোদের শ্রেনীতে পড়ে হিটলার তাদেরকে কিছু সর্বোচ্চ সম্মানে ভূষিত করেছিলো ,বলা নিষ্প্রয়োজন জার্মানির জনগণ এবং রাষ্ট্রের দমনই তাদের এই পুরষ্কার দেওয়া হয়েছিলো ।
৪ জুলাই ১৯৭১ ,
“ ইয়াহিয়া তাঁর দেশদ্রোহী খুজে পেয়েছে “
বাংলাদেশের দখলকৃত অঞ্চলে বেসামরিক গভর্নর হিসাবে ভাড়াটে কর্মি মোতালেব মালিককে নিয়োগ দান বাস্তবে পাকিস্তান জান্তার আত্তমসমর্পনের শুরু । এই তথাকথিত ডক্টর যে কখনোই জীবন ধারনের জন্য তাঁর দন্ত চিকিৎসক পেহস্যা নিয়োজিত হয়নি ,সে একজন ভাড়াটে মৌসুমি রাজনীতিক , জনপ্রিয় আন্দোলনের সময় যে পুরোপুরি বিস্থিত থাকে কিন্তু তখুনি মঞ্চে হাজির যখন জনবিরোধী শক্তি জোরপুর্বক রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে । একজন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকের মতে , রাজনৈতিকভাবে সে একজন পরিচয়হীন ব্যক্তি ।এই রাজনৈতিকভাবে অক্ষম লোকের নাম সকল বেআইনী , অগণতান্ত্রিক ,অনৈতিক মন্ত্রীসভা যারা গত বিষ বছর ধরে পাকিস্তানের জনগনের উপর নিজেদের তুলে রেখেছে , তাদের মধ্যে পাওয়া যায়। এই তথাকথিত ডাক্তারের আর ও একটি অদ্ভুত রেকর্ড আছে যে ইয়াহিয়া এবং তার দলবলের জন্য এই লোকের এক আজব আকর্ষণ কাজ করে ।ঠিক তার ডাক্তারি পেশার মতো সে কখনোই জনপ্রিয় হতে পারে নি , কেউ জানে না কবে হবে । ইহাহিয়া রাজনৈতিকভাবে অস্তিত্বহীন ,দাসত্বের মনোভাব নিয়ে বেঁচে থাকা এই লোক ছাড়া আর কাকেই বা ইয়াহিয়া বিশ্বাস করতে পারে ?
বাংলাদেশের দখলকৃত এলাকার ভিতরে এবং বাইরে সামান্য সন্দেহ ছিলো যে তথাকথিত গভর্নর তার ব্যক্তিগত ওয়াশরুমের দরজার চেয়ে বড়ো জায়গা তৈরি করতে পারবেনা । এমনকি “পাপেট” শব্দটা ও তার রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক কর্তৃত্বের অপ্রাসঙ্গিকতা পরমাপ করতে ব্যর্থ ।তবু ইয়াহিয়া পরিকল্পনা করেছে , বিশ্বকে বিশেষ করে বিষম হোয়াইট হাউজ এবং রাগান্বিত বিশ্বব্যাংককে এটা বলবে যে , এই ব্যক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের দখলকৃত অঞ্চলের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় সে বেসামরিকরন শুরু করেছে । যদিও সত্যিটা হলো , চুড়ান্ত আত্তমসমর্পনের আগে মালিককে বাইরের বিশ্বের কাছে সামনে রেখে তাদের গনহত্যা ,ধর্ষণ ,লুট এবং অগ্নিসংযোগ চলবেই ।এসবই চলছে মার্শাল ল প্রশাসনের সরাসরি পরিকল্পনায় ,সে যে ই হোক । যদি মালিকের একার কোন কর্তৃক থাকতো তাহলে প্রকৃতপক্ষে আর্মি এবং আর্মি ইন্টোলিজেন্স সার্ভিসের জন্য সে একটা স্থায়ী মাথা ব্যাথার কারন হয়ে দাড়াত ।এটা কোন আনন্দদায়ক দুশ্চিন্তা নয় যে তাদের দুস্কর্মের ভারবাহী ব্যক্তিকে মুক্তিবাহিনীর বুলেটের হাত থেকে তাকে বাঁচানো ।তাকে মুলত গভর্নর হাউজে আনা হয়েছে মাঝে মাঝে জনগণের মাঝে দেখানোর জন্য ।অন্য একজন বাঙ্গালির মৃত্যুর জন্য ইয়াহিয়া চিন্তিত ব্যাপারটা তা নয় , হোক সে সহযোগি বা অন্য কেউ । কিন্তু তার অপরাধের উত্তরাধিকার নেবার মতো খুব কম লোক পাওয়া যাবে । তা সত্ত্বেও এটাই বিশ্বাস ঘাতকতার শেষ কাজ যে ,ডঃ মালিক বাংলাদেশের জনগনের বিরুদ্ধে কাজ করবে।
এরমধ্যে প্যারিস থেকে খবর এসেছে ,ইয়াহিয়া বাংলাদেশের ৭৫ মিলিয়ন লোকের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত নেতার উপর অব্যাহতভাবে আক্রমণ বাড়িয়ে যাচ্ছে ।প্যারিসের দৈনিক “ লা ফিগারো” কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ইয়াহিয়া শেখ মুজিবকে একজন “অপরাধী” এবং “তুচ্ছ ফ্যাসিস্ট” বলে উল্লেখ করে ।
<005.022.477>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
ডানপন্থী প্যারিস দৈনিক “লে ফিগারো” কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি শেখ মুজিবকে একজন অপরাধী এবং একটি’ নাবালক ফ্যাসিবাদী “বলেছেন। কিন্তু এই অর্ধেক-বুদ্ধি বাংলাদেশের মানুষের তার নাৎসি-শৈলী গণহত্যার সম্পর্কে বড়াই করেছে শুধুমাত্র একটি বাক্য পরে। তিনি নির্লজ্জভাবে গর্ব করে তার সেনাবাহিনীকে পেশাদারী বলে এবং বলে যে যখন তারা হত্যা করে তখন তারা এটা পরিপূর্ণ ভাবে করে। তিনি দৃশ্যত নিজেকে বিশ্বাস করিয়েছেন যে তার সেনাবাহিনী একটি সমানভাবে সজ্জিত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ২৫ মার্চ রাতে একটি পূর্ণ যুদ্ধ করেছে। সাধারণত সেনাবাহিনীর মেসে শ্রেণীর বা সম্প্রদায়ের ভাষা ব্যবহার করে তিনি দম্ভ করে বলেছিলেন যে “এটা কোন ফুটবল ম্যাচ ছিল না।” দুর্ভাগ্যবশত “লে ফিগারো” সংবাদদাতা তাকে মনে করিয়ে দিতে ব্যর্থ হয় যে তার বর্বর সেনাবাহিনী নিরস্ত্র এবং নিরীহ বেসামরিকদের উপর লেলিয়ে দেওয়া হয় এবং শুধুমাত্র একটি কাপুরুষোচিত সেনাবাহিনীই নারী ও শিশুদের উপর যুদ্ধ ঘোষণা করে। সংবাদদাতার এই বড় ফ্যাসিস্টকে স্মরণ করিয়ে উচিত ছিল যে সেনাবাহিনীর ইউনিফর্ম তার পশুরা শুধুমাত্র পেশাদারী দক্ষতায় হত্যা করেনি বরং ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের মধ্যে মহান প্রতিভা প্রদর্শিত করেছে। .একটি মহান উদ্দেশ্যর সঙ্গে নিষ্ঠুরতাকে দক্ষতা বলা যেতে পারে ‘কিন্তু অন্যথায়, এটি শুধুই ধর্ষকাম হয়। তিনি বড় ফ্যাসিস্টকে স্মরণ করিয়ে দিতে পারতেন যে যদি শেখ মুজিব গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় বিশ্বাস না করে তিনি পাকিস্তানি ফ্যাসিস্টদের মাংসের কিমা এবানাতে পারতেন যদি তিনি চাইতেন। এটা তার সভ্য আচরণ যে বড় ফ্যাসিস্টকে সুযোগ দেওয়া হয়েছে ডেইসি আপ ঠেলাঠেলি করার পরিবর্তে ইসলামাবাদে বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে পারছেন।
প্রকৃতপক্ষে এটি হবে ইতিহাসের নির্মমতম পরিহাস যে সবচেয়ে কাপুরুষোচিত খুনী ও ঘৃণ্য মিথ্যাবাদি বিশ্বের এখন গণতন্ত্রের ডিফেন্ডার। এখন পর্যন্ত অপরাধের মূল্য পরিশোধ না করার জন্যই তাদের এই স্পর্ধা। কিন্তু ইতিহাস থেকে একথাও জানা যায় যে কিছু দীর্ঘতার অবশেষে ভাল পরিবর্তন আসে। অন্যথায় আজ আমরা হিটলার, মুসোলিনি এবং তজো কে দেখতে পেতাম।
৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
অ্যামনেস্টি ধোঁকা দেয়ায় বিফল: বিবিসি সংবাদঃ
অর্থলোভী মালিক
এটা সম্ভবত দুর্ঘটনা না যে ইয়াহিয়া মুক্তিবাহিনীর ডেডিকেটেড সদস্যদের যারা এখন যুদ্ধ করছে তথাকথিত ক্ষমার সদ্য প্রস্তাব দিয়ে মোতালেব মালিক নামক তার বাংলাভাষী স্বদেশদ্রোহী একটি নন-প্র্যাকটিসিং ডাক্তার এর নিয়োগ দিয়েছেন।
স্বাভাবিকভাবেই, তথাকথিত অফারটি গত চার মাসের মধ্যে তৃতীয়বারের মতো তৈরি করা হয়েছে ইয়াহিয়া ও টিক্কার খুনীর দলের নিপীড়নের ফাঁকি সফল করার একটি দৃশ্য হিসেবে। ঘোষণাটি এরকম বলে মনে হয়- “, এখন ছেলেরা এখন ফিরে আসো” । তোমাদের এখন ভয় পাওয়ার কারণ নাই, একজন বাংলাভাষী গভর্নর তোমাদের দেখাশোনা করার জন্য আছে।”
ইয়াহিয়া অবশ্যই মরিয়া ছিল, তাই এরকম দুর্বল পদক্ষেপ নিয়েছে। এই চালটি শরনার্থী অভ্যর্থনা কেন্দ্রের থেকেও বেশি হাস্যকর ছিল, যেখানে বিদেশী সাংবাদিকরা শুধু কুকুরদেরই পেয়েছিল যারা পাকিস্তানি আপ্যায়ন গ্রহন করছিল, কুকুরের সংহতি জ্ঞাপনের মাধ্যমে কুকুরীয় কৌতুকের বৃহৎ নির্মম প্রদর্শন। কিন্তু এইবার ইয়াহিয়া এমনকি কুকুরদেরও খুজে পায় নি। কিছু সহজ সরল মানুষ প্রথম বারের মিথ্যা ক্ষমা প্রার্থনাকে বিশ্বাস করেছিল। সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য যারা গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিল এবং মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে দ্বিধা করছিল তারা ইয়াহিয়া ডাকে সাড়া দিয়েছিল এবং ইয়াহিয়ার ক্ষমার বিষাক্ত মধুর স্বাদ গ্রহন করেছে।
<005.022.478>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
এই হতভাগাদের ঢাকার বুড়িগংগায় ১৫/২০ বান্ডলে ভাসতে থাকা লাশদের সাথে পাওয়া গেছে। তখনো তাদের পরনে আর্মি শর্টস ও ভেস্ট ছিল। কারো শরীরের বেয়নেটের আঘাত ছিল। কিন্তু অধিকাংশই মারা গেছে যখন নরকের খুনিরা তাদের শরীরের শেষ ফোটা রক্ত বের করে দিয়েছে তখন।
সৌভাগ্যবশত খুব অল্পই ইয়াহিয়ার মৃত্যু সংগীতে আটকে পড়েছিল। গণহত্যার সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার পর একজনও সামরিক সদস্য দ্বিতীয় ডাকে সাড়া দেয় নি। আসলে প্রথম গণহত্যার পরই দ্বিধায় ভোগারা মনস্থির করে ফেলে এবং রাতের অন্ধকারে মুক্তিবাহিনী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এলাকায় যেতে শুরু করে। তারা এখন নিবেদিতপ্রাণ বিশাল মুক্তিবাহিনীর সদস্য, যারা পাকি ভীরুদের দৌড়ের উপরে রেখেছে। প্রথমবারের বিবিসি, একটি অত্যন্ত রক্ষণশীল এবং পুরাতন সন্দেহজনক গ্রুপ, পরিস্থিতির বাস্তবতা স্বীকার করেছে। কয়েক মাসের জন্য মুক্তিযুদ্ধের উপর নিরবতার পর বিবিসির অবশেষে প্রকাশ্যে স্বীকৃত দিয়েছে যে স্বাধীন বাংলাদেশ একটা বাস্তবতা এবং পাকিস্তানি বন্দুক পরিসীমার বাইরে বসবাসকারী মিলিয়ন মানুষের এর কল্পনায় একে বানানো হয় নি। তার বিশেষ সংবাদদাতা মার্টিন বেল একটি তথ্যকাহিনী শুট করেছে এটি প্রতিষ্ঠার জন্য যে মুক্তিবাহিনীতে নিজেই একটি সুগঠিত বলবত্ গ্রুপ এবং মুক্ত বাংলাদেশ একটা বাস্তবতা যদিও সমগ্র অঞ্চলের ওপর আনুষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণ ঘোষণা করা হবে । তিনি মুক্তিবাহিনী সদস্যদের মুক্তির দাবির পর্যাপ্ত স্থান দিয়েছেন। তিনি প্রকাশ করেছেন: পাকিস্তানি সৈন্যরা কাপুরুষ। যখন মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা একশনে যায় তারা তাদের জীবন বাচানোর জন্য পালিয়া যায়। তারা এত দ্রুত পালায় যে মুক্তিবাহিনীতে দ্বারা ব্যবহারের জন্য অস্ত্র ও গোলাবারুদ ফেলে যায়।
ইয়াহিয়া হয় বোকা অথবা পুরাপুরি পাগল যে এরকম বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌছে যাওয়া বাহিনী কলোনিয়াল বাহিনীর ক্ষমার ফাদে পা দিবে যারা তাদের মা, বোন, স্ত্রীদের ধর্ষন করেছে। মোতালেব মালেক নামক এই বাংলাভাষী রাজনৈতিক নপুংসকের নাম ব্যবহার করে তার কৌতুক তার ইসলামাবাদ প্রাসাদের বাইরে কাজ করতে পারবে না।
উপমহাদেশের ভেংগে যাওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত তিনি লাইমলাইট থেকে দূরে ছিলেন। এতগুলো বছর-যেহেতু উপমহাদেশের-মোতালেব মালেক বিভক্তির আগে প্রচারের ছটা থেকে দূরে থাকার জন্য পরিচালিত. কিন্তু সেখানে অনেক সাক্ষী তার সাথে যারা বড় হয়েছি হয়. তিনি নিজেকে ড্রেসিং আপ কলকাতার একটি তথাকথিত শ্রমিক নেতা হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন. ধর্মের নামে শোষণ সে মোসলেম শ্রমিক নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু সেখানে অনেক সাক্ষী আছে তার সাথে যারা বড় হয়েছিল। তিনি নিজেকে ড্রেসিং আপ কলকাতার একটি তথাকথিত শ্রমিক নেতা হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। ধর্মের নামে শোষণ করে সে মোসলেম শ্রমিক নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিল।
শীঘ্রই তিনি শ্রমিকদের ধর্মঘট দ্বারা ব্যক্তিগত মুনাফার কৌশলের উদ্ভাবক হয়ে ওঠেন। কর্মীদের সামান্য লাভ অথবা কিছুই ছাড়াই ধর্মঘট করাতে বাধ্য করতেন। এদিকে, তার অ্যাংলো-স্যাক্সন কর্ত্তাদের ধন্যবাদ, তিনি তাঁর পারিবারিক নাম ‘মল্লিক’ থেকে বদলে ‘মালিক’ হয়ে গেছে, যাতে তার সাদা বসদের কম প্রচেষ্টার সঙ্গে তার নাম উচ্চারণ করতে পারত। যখন সাদা চলে যায়, তখন তিনি দ্রুত মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বিরোধী বাংলায় যে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে সংহত দল ছিল তা ধ্বংস করতে সচেষ্ট হন। জিন্নাহ তার আংগুল কলার মত নাড়াত এবং মালিক তাতে কুকুরের মত ঝাপিয়ে পড়ত। তিনি জিন্নার মন্ত্রীসভায় মন্ত্রীত্ব পান বাংলা কোটায় যেখানে একে ফজলুল হক, শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মত বাংলার মহান সন্তানদের বঞ্চিত করা হয়।
<005.022.479>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
এখানেই মন্ত্রী জাহাজ মল্লিক ওরফে মালিক এর চেইন শুরু। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানী আমলাদের একটি পরোপকারী কামলা হিসেবে প্রমাণিত, আমি বলতে চাচ্ছি, তিনি নিজেকে যেমন একটি পুতুল প্রমাণিত করেন যে তৎকালীন সচিবরা পূর্ব পাকিস্তানকে বঞ্চিত করার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা উপভোগ করে। এ জন্যই সামরিক-পুজিবাদী-আমলাতান্ত্রিক চতুর গোষ্ঠী যারা পাকিস্তান শাসন করেছে তারা তাকে সুবিধা দিয়েছে ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ পর্যন্ত যেদিন রাষ্ট্র বিস্ফোরিত হয়েছিল। মল্লিকের এই গুণাবলীর জন্যই মল্লিক ওরফে মালিক ইয়াহিয়ার প্রিয় ছিল যদিও ইয়াহিয়া প্যাথোলোজিকালি বাঙ্গালীদের বর্ণবাদী ঘৃণার চোখে দেখত।
যা আমি আগেই বলেছি, এই বিভীষণকে নিয়ে ইয়াহিয়া বোকামী করতে পারে, বাংলাদেশের মানুষ নয়। এমনকি মনে হয় যুদ্ধ ঘোড়া জুলফি ভুট্টোও এই বোকামি পুরষ্কারের বাতাস বুঝতে পেরেছিল। মল্লিক ওরফে মালিক তার কাছেও খারাপ মানুষ ছিল। তিনি অনবরত মল্লিক ওরফে মালিককে নিয়োগ দেয়াকে সমর্থন না করার কথা বলেন।
ফুটনোটে বলছিঃ বাংলাদেশের দখলকৃত এলাকার শ্রোতাদের আমাদের বাজিকরদের সর্বশেষ সংবাদ জানাচ্ছি। ইতিমধ্যে বাজি ইসলামাবাদ পরবর্তী প্রেসিডেন্ট উপর শুরু হয়েছে। এটা ভুট্টো না ইয়াহিয়া হবে? সর্বশেষ শ্রেষ্ঠতা ১০-২ বিজয়ী হিসেবে ভুট্টোর পক্ষপাতী।
ইয়াহিয়া পাকিস্তান ধ্বংস করেছে। ভুট্টো অবশিষ্টাংশের সমাপ্তি ঘটাতে বিশেষ সুযোগ পাবে।
১০ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
একটি ঐতিহাসিক পাঁচ দলীয় সম্মতিঃ প্রফেসর গাল্ব্রেইথ বাঙ্গালি সত্ত্বাকে বুঝতে ভুল করেছেন। গতকাল মুজিবনগরে একটি ঐতিহাসিক পাঁচ দলীয় সম্মতি সম্পাদিত হয়েছে। ২ দিনের দীর্ঘ আলোচনা শেষে আওয়ামি লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামি পার্টি (ভাসানী গ্রুপ), ন্যাশনাল আওয়ামি পার্টি (মোজাফফর গ্রুপ), বাংলাদেশ কম্যুনিস্ট পার্টি এবং বাংলাদেশ ন্যাশনাল কংগ্রেস ৮ সদস্য বিশিষ্ট জাতীয় কনসাল্টেটিভ কমিটি গঠন করতে সম্মত হয়েছে। কমিটিকে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের ব্যাপারে আলোচনার জন্য পাওয়া যাবে। ২৫শে মার্চের পর এই প্রথম মাওলানা ভাসানী এই বড় পর্যায়ের রাজনৈতিক আলোচনায় অংশ নিলেন।
জাতীয় কনসাল্টেটিভ কমিটি গঠিত হয়েছে নিম্নোক্ত সদস্যদের নিয়েঃ মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ, বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ, ন্যাশনাল আওয়ামি পার্টির প্রফেসর মোজাফফর আহমেদ। বাংলাদেশ কম্যুনিস্ট পার্টির মনি সিং এবং বাংলাদেশ ন্যাশনাল কংগ্রেসের মনোরঞ্জন ধর। দুজন আরো সদস্য যোগ অন্যান্য দল থেকে যোগ দিতে পারে যাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি শর্তাধীন আনুগত্য রয়েছে।
কমিটি পুনরায় বিজয় পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া নিশ্চিত করেছে। বাংলাদেশের পূর্ণাংগ স্বাধীনতা ব্যাতীত যে কোন রাজনৈতিক বক্তব্য বাংলাদেশের মানুষ গ্রহণ করবে না, এটা যতটা সম্ভব পরিষ্কার করে বলা হয়েছে.
<005.022.480>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
কমিটির বিশ্বের সভ্য দেশের কাছে আবেদন বাংলাদেশের সংগ্রামী মানুষের সঙ্গে সংহতি ঘোষণা করতে এবং তাদেরকে ডেকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে চিনতে। কমিটি অস্ত্র এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য গোলাবারুদ সহ পূর্ণ সমর্থনের জন্য সব দেশের কাছে আবেদন করে।
এশীয় ইতিহাসের এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে জাতীয় পরামর্শমূলক কমিটি গঠনের পর শীঘ্রই মুজিবনগর থেকে তার ঘোষণার পর বিভিন্ন মহল এ মর্যাদা দেওয়া হয়।
কমিটির সামনা-সামনি জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘোষণা স্বীকৃতি এবং অস্ত্র ও গোলাবারুদ জন্য তার আবেদন । এই প্রথমবারের মতো এমন একটি সর্বজনীন আবেদন যা আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ গণপ্রজাতন্ত্রী সরকারসহ যেকোন রাজনৈতিক দল দ্বারা স্বীকৃতি জন্য তৈরি করা হয়েছে জন্য। এটা বিশ্বাস করা হয় যে এই আবেদন বাংলাদেশের মানুষের জন্য প্রশ্নাতীত সহানুভূতি থাকা অনেক দেশের উপর গভীর প্রভাব বিস্তার করতে পারে। বস্তুত, নির্ভরযোগ্য সূত্র ইঙ্গিত দেয় যে, রাষ্ট্রের একটি সংখ্যা দ্বারা প্রজাতন্ত্রের স্বীকৃতি ঘনায়মান সম্ভবত হয়। এখন কিছু সমাজতান্ত্রিক দল ‘আনুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী লীগের সাথে যোগদান করতে পারে , এই যুদ্ধের ব্যাপারে পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোর সাথে কথা বলতে পারে যা স্বীকৃতি ও বস্তুগত সাহায্য নিয়ে এগিয়ে আসতে দেশগুলোকে উৎসাহিত করতে পারে। নির্ভরযোগ্য উৎস সম্পর্কে অবগত যে জার্মান ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অর্থাত ইস্ট জার্মানি, প্রসঙ্গক্রমে, এছাড়াও ইউরোপ চতুর্থ বৃহত্তম শিল্প শক্তি, প্রথম দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে পারে। জিডিআর এর উদাহরণ অবশ্যই অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশ গ্রহণ করবে। পাকিস্তানি গণহত্যার প্রাদুর্ভাব থেকে যুগোস্লাভ সরকারের ধারাবাহিকভাবে অনুকূল মনোভাব ভুলে গেলে চলবে না। আসলে, আশ্চর্যজনক হবে না যদি যুগোস্লাভিয়া জিডিআর এর আগে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে সার্বভৌমত্ব স্বীকৃতিদানকারী প্রথম দেশে পরিণত হয়। আরেকটি ভালো সম্ভাবনা হল হাংগেরি। চেকোস্লোভাকিয়া এবং পোল্যান্ড আসছে, তবে ধীর হতে পারে কারণ তারা পাকিস্তানের সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্ক হিসাবে রাখছে। এছাড়াও কিছু এশীয় দেশসমূহের শীঘ্রই প্রজাতন্ত্রকে স্বীকৃতি দিবে বলে আশা করা হচ্ছে। কিউবা সহ লাতিন আমেরিকার দেশগুলো কম সহযোগিতা করে না। পরবর্তী কয়েক দিন অনেক ঘটনাবহুল হবে যা পাকিস্তানের সমাপ্তি সম্পর্কিত।
এরকম গুরুত্বপূর্ণ উন্নতি এবং বাংলাদেশের মানুষের অনমনীয়তা যা যুদ্ধকে বিজয়ের দিকে নিয়ে যাবে, এরকম অবস্থায় ভারতের প্রাক্তন মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্রফেসর জন গালব্রেইথের পূর্ব বাংলায় সার্বিক সায়ত্বশাসনের আহ্বান অবিবেচনাপ্রসূত। প্রফেসর জন গালব্রেইথ রেডিও বাংলাদেশের কলকাতা প্রতিনিধির কাছে গতকাল পৌছে বলেন যে বাংলাদেশ সমস্যার একটিই সমাধান হল পূর্ব বাংলায় তাদের নিজেদের শাসন যেন পাঞ্জাবীদের মত তারা নিজেরা তাসের ভাগ্যের মালিক মনে করে। তিনি আরও বলেন, যে যেমন একটি সমাধান বিশ্বের সভ্য জাতির কাছে গ্রহণযোগ্য হবে।
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে এই ধরনের একটি শিক্ষিত অর্থনীতিবিদ ও পাকা কূটনীতিক অধ্যাপক গালব্রেইথ গেমে এত দেরিতে একটি অবাস্তব এবং অসম্ভব সমাধান পরামর্শ করছেন। এটা খুবই দুঃখজনক যে তিনি ইতিহাসের রায় বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে।
<005.022.481>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
তিনি দেখতে ব্যর্থ হয়েছেন যে পাকিস্তান এমনই একটি অদ্ভুত ইউনিয়ন যেখানে পারস্পারিক বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা ছাড়া টিকে থাকা যায় না। তারপরও শেষ ২৩ বছর কিছু প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি যারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে পূর্ব-পশ্চিম সম্পর্ককে কলোনিয়াল চরিত্রে পরিণত করে যার সবথেকে খারাপ রূপায়ন হল, গত মার্চের বর্বোরোচিত গণহত্যা। প্রফেসর কিভাবে ভাবতে পারলেন অর্থপূর্ণ অংশীদারিত্বের প্রাথমিক শর্তগুলো আবার গড়ে উঠবে যেখানে কলোনিস্টরা অবহেলিত অঞ্চলের নিরপরাধ পুরুষ, নারী, শিশুদের নির্বিচারে হত্যা করেছে? শুধু তাই নয়, এই অবর্ননীয় হত্যাযজ্ঞ এখনো চলছে, কলোনিস্টরা কৌশলে বাঙ্গালিদের সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক মেরুদন্ড ভেংগে দিচ্ছে। এখন তারা একটি দুর্বল ও বিদেশী স্ক্রিপ্ট চাপিয়ে দিয়ে বাঙ্গালিদের মাতৃভাষা ধ্বংসের দিকে আগাচ্ছে, যার জন্য ইতিমধ্যেই অগণিত বাঙ্গালি প্রাণ দিয়েছে। কিভাবে যে কোন সভ্য মানুষ, প্রফেসর জন গালব্রেইথের মত একজন প্রখ্যাত স্কলার, কোন ভিত্তিতে এই ইউনিয়ন চালু রাখার পরামর্শ দিতে পারে? এটা হতে পারে যে সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ব্যাক্তিগতভাবে তথাকথিত রাজনৈতিক বক্তব্যের নামে হোয়াইট হাউজের ফর্মূলাকে প্রচার করছেন। যদি বাংলাদেশের সার্বিক সায়ত্বশাসন এতই যৌক্তিক ফর্মুলা হয় তাহলে ইসলামাবাদের আমেরিকান প্রভুরা ২৫শে মার্চের আগে বাংলাদেশের মানুষকে পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম ভয়ংকর গণহত্যার শিকার হওয়ার আগে, কেন খুনি জেনারেলদের দিয়ে এটা করালো না? বাস্তবিকভাবে, শেখ মুজিবের ছয় দফার লক্ষ্য সায়ত্বশাসন থেকে বেশি কিছু ছিল না। তারপরও মার্কিন প্রশাসন এই গণহত্যা হতে দিয়েছে। প্রফেসর গালব্রেইথ- দয়া করে বোঝার চেষ্টা করুন, ২৫শে মার্চের পর থেকে ইতিহাস আর উল্টো দিকে না যাওয়ার জন্য আগাচ্ছে। বুঝতে চেষ্টা করুন যে একমাত্র সভ্য, বিবেচনাপ্রসূত ও শান্তিপূর্ণ সমাধান হল বাংলাদেশের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা।
১৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
মার্কিন সিনেটরদের সাহায্য বন্ধে ভোটঃ পাকিরা দৌড়ের উপরে
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তার শেষ স্ট্রেজে পৌছেছে। আমাদের দিক হতে, মুক্তিবাহিনী শত্রু নিধনের জন্য প্রস্তুত কারণ শুকনার সময় ডেরায় ফিরে আসতে হয় এবং মৌসুমি বায়ুতে গেরিলা যুদ্ধ কৌশলে বিশেষ সুবিধা পাওয়া যায়। শত্রুপক্ষের দিক থেকে, বাংলাদেশে দখলকৃত এলাকায় শেষ কার্ড হল প্রশাসনের বেসামরিকিকরণ। বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে ইয়াহিয়া সামরিক জান্তার এমন নৃশংস যুদ্ধের পঞ্চম মাসের শেষ, কিন্তু এরই মধ্যে তারা পরাজিত।পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর অবশিষ্টাংশ সেনানিবাসে অবরুদ্ধ। ৩৫ হাজারেরও বেশি লোক ও কর্মকর্তাদের মারা গেছে। মিলিটিয়া রাজাকাররা শুধুমাত্র প্রতিটি সুযোগেই লাশ ফেলছে না, পরাজিত আর্মির মুমুর্ষু শ্বাসকে ইতিবাচক বোঝা প্রমাণ করতে চাচ্ছে।
নিক্সন প্রশাসন, চীন এবং আরব রাজতন্ত্রগুলো হতে গোপনে অর্থ ও বস্ত্ুগত সাহায্য আসার পরও পাকিস্তানের অর্থনীতি খাদের কিনারে পৌছে গেছে। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের পরামর্শ মত ইয়াহিয়া তার বেসামরিকিকরণ কার্যক্রমের উপর জোর দিতে থাকে, যা জনগণের আস্থা পায় নি, শুধু জান্তার সমর্থন পেয়েছিল।
<005.022.482>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
মার্কিন বৈদেশিক সাহায্য বিল সিনেটে গিয়েছে যেখানে সিনেটর কেনেডি একজন প্রভাবশালী ব্যাপার । পাকিস্তান এবং গ্রীসকে অর্থনৈতিক ও ত্রাণ সাহায্য দেয়ার রীলের প্রস্তাব ইতিমধ্যেই হাউজ রিপ্রেজেন্টিটিভেরা নাকচ করে দিয়েছে। এটা বলা হয়েছে যে যতক্ষণ পর্যন্ত বাংলাদেশে বেসামরিক সরকার শাসন না করছে এবং রিফিউজিরা পাকিস্তানে না ফিরছে, পাকিস্তানে কোন সাহায্য দেয়া হবে না। সিনেট সদস্যরাও একই ভাবে ভোট দিতে যাচ্ছে তাই মোতালেব মল্লিক আলিয়াস মালিককে গভর্নর প্রধান হিসেবে দেখিয়ে সামরিক থেকে বেসামরিক ছদ্মবেশ ধারন, মার্কিন সিনেটরদের আগামী সপ্তাহে চূড়ান্ত হিল ভোটিং এর আগে তাদের পক্ষে আনতে এটি পরিষ্কারভাবে একটি হাস্যকর চেষ্টা। মালিক এখন ২য় শর্তের উপর কাজ করছে, রিফিউজিদের ফিরিয়া আনা। তিনি ভারতীয় অথরিটিকে আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছেন এবং রিফিউজিদের অবাস্তব সব সুযোগ সুবিধা প্রতিজ্ঞা করেছেন যারা জীবন বাচাতে পালিয়েছিল। জান্তা এবং তার পালিত কুকুর মোতালেব মল্লিকের কাছে রিফিউজিদের প্রতিক্রিয়াও কম গুরুত্বপূর্ণ নয় কারণ তিনি একই খুনিদের এজেন্ট যারা তাদের পালাতে বাধ্য করেছিল। এই উদ্যোগ কম জানা কিছু সিনেটরকে বিভ্রান্ত করার জন্য খুবই বিপদজনক ছিল। বলার অপেক্ষা রাখে না, যতক্ষণ রিফিউজিরা সচেতন ততক্ষণ প্রভুর কুকুরের নিশ্চয়তা তাদের কাছে খুনী প্রভুর থেকে কম অথবা বেশি প্রতারণামূলক নয়। যদি মার্কিন সিনেটররা পাকিস্তান সাহায্য বিষয়ে হাউজ রিপ্রেজেন্টিটিভদের পদ অনুসরণ করে তাহলে ইসলামাবাদ জান্তা কি প্রতিক্রিয়া জানাবে? এই মুহুর্তে এটি সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। মার্কিন সাহায্য বন্ধ মানে হল অর্থনীতির হঠাৎ ভেঙ্গে পড়া যার মেরুদন্ড বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে আগ্রাসন চালানোর মেরামত অযোগ্যভাবে ক্রাশ করেছে। এটি নিশ্চিতভাবেই পাকিস্তানকে অস্থিতিশীল করবে। এমনকি জান্তা-জুলফি ভুট্টোর পুরান বন্ধুরা অস্থির হয়ে উঠছিল এবং এরই মধ্যে তারা ইয়াহিয়াকে হুমকি দেয় মুজিবকে ক্ষমতা হস্তান্তর না করলে তারা মুজিবের পথ অনুসরণ করবে।
জান্তার সদস্যরা (দুরভিসন্ধির সদস্যরা সহ) বাংলাদেশ-ধরনের জনগণের বিপরীতে সামরিক পদক্ষেপ নিয়ে তর্জন গর্জন করার আগে দুইবার ভাববে। অন্য কোন কিছুর জন্য নয়, আর্মি আরেকটি যুদ্ধের জন্য নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ পায় নি। বলার অপেক্ষা রাখে না, ভারতের বিপক্ষে যুদ্ধের হুমকি খুনীদের জন্য শুধুই জাতিসংঘের হস্তক্ষেপের সামান্য আশার শান্তি।
তাহলে কিভাবে তারা প্রতিক্রিয়া দেখাবে? জান্তা সবচেয়ে ভাল যে প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে তা হল প্রবল ধ্বংসাত্নক পলিসির পর বাংলাদেশ থেকে পিছু হটা। এটিই হবে যদি কোন গণ অভ্যুত্থান না হয়, এটি মেনে নেয়া বাস্তব সম্মত যে পাকিস্তানের ২৫শে মার্চের ইতিহাস এটি রুদ্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু এরকম অভ্যুত্থানই এই অবস্থা উত্তরনের একমাত্র সম্ভাবনা।
দখলকৃত এলাকার মানুষজনের আরো খারাপ কিছুর জন্য নিজেদের প্রস্তুত করা উচিত। পরাজিত আর্মি যখন আরো ভয়ংকর হওয়ার চেষ্টা করবে তখন তাদের আঘাত করতে হবে এবং আরেকটি গণহত্যার মধ্য দিয়ে যাত্রা করতে হবে। তাদের মনে রাখতে হবে যে পাকিস্তানি আর্মি সকল প্রকার শক্তি প্রদর্শনের পরও তারা বাংলাদেশে অসহায়ভাবে বন্দি হয়ে আছে। পাকিস্তানে পলায়ন লজিস্টিকালি অসম্ভব। যখন পরিস্থিতি গরম হয়ে উঠবে অফিসাররা তাদের যুদ্ধ সাজে সজ্জিত সেনাদের প্রতিকূলতার মুখোমুখি করে বিমানপথে পালাতে চাইবে। এইবারে আর্মি ২৫শে মার্চের আকস্মাত আক্রমণ রিপিট করবে না।
<005.022.483>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
আপনি অবশ্যই যে কোন অস্ত্রকে (আধুনিক অথবা প্রচলিত)কার্যকরী প্রমান করেবন, যখন আর্মি মুভ করবে অথবা অস্ত্রের সংকটে থাকবে। প্রকৃতপক্ষে, প্রচলিত অস্ত্র চূড়ান্ত ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। যদি পাকিস্তানিরা আত্নসমর্পন করে তাহলে তাদের বন্দী হিসেবে নিতে হবে এবং ভাল ব্যবহার করতে হবে।
একটি সতর্কতামূলক নোট। দখলকৃত এলাকায় কেন্দ্রীয় কমান্ডের অধীনে মুক্তিবাহিনীর যে সকল গেরিলাগ্রুপ গড়ে উঠেছে, সকল রাজনৈতিক মতাদর্শের উর্ধে উঠে সকলকে একসাথে কাজ করতে হবে। এটি জাতীয় স্বাধীনতার যুদ্ধ। দেশ এবং দেশের স্বাধীনতা সবার আগে। যেকোন সংকীর্ণতা অথবা দলান্ধতা যা পারস্পারিক দ্বন্ধ তৈরি করতে পারে, দেশের জনগণের জন্য তা দেশদ্রোহীতা বলে বিবেচিত হবে। এত ভোগান্তির পর এদেশের জনগণ উপযুক্ত দেশপ্রেমের দাবীদার তাদের কাছে যারা নিজে থেকে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিকতা থেকে দেশের মানুষকে মুক্ত করতে এগিয়ে এসেছে।
স্লোগান হোক- বিজয়ের জন্য ঐক্য। বাংলাদেশের জন্য বিজয়।
১৬ সেপ্টেম্বার, ১৯৭১
ইরানের সাথে গোপন আঁতাত
ইয়াহিয়ার তড়িঘড়ি করে তেহরান সফর কোন বিস্ময় ছিল না। বাংলাদেশে দ্রুত এগিয়ে আসা সামরিক পরাজয়ের জন্য, তিনি অন্য পথ খুজছেন। তিনি এখনই জয়ের আশা ছেড়ে দিতে চান না। তার সামরিক অবস্থান যতই হাস্যকর হোক না কেন, তিনি অনিষ্টকর ধারণা উপস্থাপন শুরু করলেন।
শাহ্ র ভবন হতে আসা যৌথ বিবৃতিতে বাংলাদেশে গণহত্যা শুরু হওয়ার পর থেকে প্রথমবার ইরানী সম্রাট পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান জানান। এটি গুরুত্বপূর্ণ যে ইয়াহিয়ার এজেন্টরা (ভুট্টো সহ) তাদের অপরাধের পক্ষে আনতে ব্যর্থ হওয়ার পর ইয়াহিয়াকে House of Pahalvis এ যেতে হয়েছে। কিন্ত এর পরও ইয়াহিয়া যা চেয়েছিল তা পায় নি। শাহ্ বাংলাদেশের ব্যাপারে তার আগের অবস্থানে অনড় থাকে, কোন যোগাযোগ করেননি। যৌথ বিবৃতিতে এটা বলা হই নি যে, ইরানের বিবেচনায়, বাংলাদেশ ইস্যু পাকিস্তানের অভ্যন্তরীন ব্যাপার ।
কিন্তু অন্য দিক থেকে ইয়াহিয়ার অর্জন উল্লেখ করার মত। জাতিসংঘের শরনার্থী হাই কমিশনার প্রিন্স সাদ্রুদ্দিন আগা খানের সময় থেকে প্রথমবারের মত ইয়াহিয়া এই যুদ্ধ নিয়ে তার নিজের আইডিয়া বেচতে পারল। কোন কারণ ছাড়াই তিনি জোর দিয়ে বলছিলেন বাংলাদেশের মানুষ ও তার জান্তার মধ্যে এই যুদ্ধ আসলে ইন্দো-পাকিস্তান দ্বন্ধ। আমরা বিস্মিত যে শাহ তার এই বড়ি গিলেছেন এবং তার সরকারের ভাল দপ্তরগুলোকে ভারত এবং পাকিস্তানের সংঘাত নিরসনের জন্য প্রস্তাব করেছেন।
নতুন দিল্লী এই সন্দেহজনক কাজেও ঠান্ডা থাকল। এমনকি ভারত পাকিস্তানি খেলায় এই ইরানি চালে বিস্মিত হয় নি।
<005.022.484>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
১৯৬৫ সালে ভারতের বিরুদ্ধে ইয়াহিয়ার যুদ্ধের সময় যুদ্ধে অংশ না নেয়া দেশ হিসেবে ইরান সব ধরনের আন্তর্জাতিক নিয়ম লংঘন করে। তারা পাকিস্তানি বিমান বাহিনীকে প্লেন, প্লেনের জ্বালানী এবং প্রচুর অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করে। ভারতের বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনার সময় তারা পাকিস্তানের বোয়িংকে আশ্রয় দেয়। অতি তড়িঘড়ি করতে যেয়ে ইয়াহিয়া ভুলে গিয়েছিল ভারতের বিরুদ্ধে এরুপ রেকর্ডধারীকে মধ্যস্তাকারী হিসেবে ভারতের কাছে গ্রহনযোগ্যতা খুবই সামান্য।
ইয়াহিয়ার তেহরান সফর এবং ইন্দো-পাকিস্তান সম্পর্ককে “স্বাভাবিক” করতে চাওয়া ছিল ইয়াহিয়ার একটি পাবলিসিটি চমক, তাহলে তার আসল পদক্ষেপ কি ছিল? ইয়াহিয়া কি বিশ্বকে দেখাতে চাচ্ছে যে তিনি ভারতের শান্তি স্থাপনে উদগ্রীব, কিন্তু দরজার পেছন দিয়ে ভারতকে আকস্মিক হামলা করে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আসন্ন পরাজয় এড়াতে চায়? এগুলোই ইয়াহিয়ার সাথে মানায়। শুধুমাত্র ভারতের সাথে যুদ্ধ বাধিয়েই বাংলাদেশের সাথে দ্বন্ধে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপের আশা করা যায়। জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ তার পক্ষেই যাবে এবং এভাবেই আসন্ন ভয়ংকর পরাজয় তিনি এড়াতে পারেন। এটাই যদি তার প্রকৃত উদ্দেশ্য হয় তাহলে ইরানের শাহ পাকিস্তানি কোলাবোরেটরের ভুমিকায় নেমে ভয়ংকর খেলা খেলছেন যা দক্ষিণ পশ্চিম এশিয়ায় আন্তর্জাতিক উত্তাপের সৃষ্টি করতে পারে। আন্তর্জাতিক শক্তিরা, বিশেষ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন অবশ্যই পাকিস্তান ইরানের এই ভয়ংকর পদক্ষেপ সম্পর্কে সচেতন। গতকাল মস্কোয় সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট পডগর্নির বাংলাদেশ সমস্যার আশু সমাধান চাওয়া সম্ভবত পাক-ইরানিয়ান পরিকল্পনার প্রতি হুশিয়ারি।
প্রেসিডেন্ট পডগর্নির ভাষণ নিশ্চিতভাবেই ইয়াহিয়া ও তার মিত্রদের সমস্যায় ফেলে দিয়েছে। পর্দার আড়ালের বড় ভিলেন যিনি সেই পঞ্চাশের দশক থেকে সতর্কতার সাথে পাকিস্তান ধ্বংসের কাজ করে যাচ্ছেন তিনি হলেন এম এম আহমদ। তিনি ইয়াহিয়া ও তার খুনি মিত্রদের বড় বন্ধুও। দৃশ্যপট থেকে তার সরে যাওয়া, ধারালো অস্ত্রের আঘাতের জন্য সাময়িক ভাবে হলেও, ইয়াহিয়াকে গাইডেন্স ক্রাইসিসে ফেলবে। মনে হয় ইয়াহিয়া শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়ার পরবর্তী হুমকির ব্যাপারে ভুট্টোকে শান্ত করেছে। ইয়াহিয়ার এই ক্রাইসিসে ভুট্টো সুযোগ নিতে পারে। ভীতিকর শহর ইসলামাবাদের এলিটদের এলাকাগুলো সামনের কয়েকদিন ঘটনাবহুল হতে যাচ্ছে।
৩০ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
ভারত-USSR চুক্তি
ইন্দিরা-Kosygin যৌথ বিবৃতির অংশটি বিশেষ করে যেটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ভবিষ্যতকে সুরক্ষিত করার কথা বলা হয়েছে। এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ যে “বাংলাদেশ” শব্দটি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। যদিও ইন্দো-সোভিয়েত জোটের সমালোচকরা এর মধ্যেই এই এড়িয়ে যাওয়ায় হিসাব নিকাশ শুরু করে দিয়েছে, গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল এই বিবৃতি একটি সুদূর প্রসারী ফলাফলের দলিল হয়ে থাকবে। দিল্লীর শক্তিবৃদ্ধি নিয়ে প্রেসিডেন্ট পদগর্নির পরবর্তী বক্তব্য এই আশাকে আরো জোরদার করে। বিবৃতি উদ্ধৃতির মাধ্যমে আমি বিশ্লেষণ করছিঃ
<005.022.485>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
“২৫ মার্চ ১৯৭১ থেকে পূর্ব বাংলার অবস্থার উন্নতির বিষয়ে উভয়পক্ষের শান্তি রক্ষার দাবি বিবেচনা করে সমস্যাগুলোর দ্রুত রাজনৈতিক সমাধানে যেগুলো উঠে এসেছে, ইচ্ছার মর্যাদা দেওয়া, পূর্ব বাংলার মানুষের প্রাপ্য অধিকার ও আইনগত সুবিধার পাশাপাশি রিফিউজিদের তাদের মাতৃভূমিতে সম্মান ও মর্যাদা সহকারে দ্রুততম ও সুরক্ষিত ফেরা নিশ্চিত করা।”
অন্যভাষায়, যেকোন সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের উল্লেখ হয়েছে এখানে। জনগণের আকাঙ্ক্ষা ও আইনগত অধিকার বলতে এখানে ডিসেম্বর ৭০ এর নির্বাচনের ফলাফলকে বোঝানো হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার এক বিবৃতিতে জানিয়েছে স্বাধীনতার কম কিছু গ্রহনযোগ্য নয়। অন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হল যা খুবই ইউনিক যে বিবৃতিটিতে স্বাক্ষর করেছেন সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষে চেয়ারম্যান, প্রধানমন্ত্রী এবং সোভিয়েত কম্যুনিষ্ট পার্টির জেনারেল সেক্রেটারি।
আমার মতে সোভিয়েত প্রিমিয়ারের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য হল “অভ্যন্তরীণ বিষয়” অংশটি। এটিকে যদি পৃথকভাবে দেখা হয় তাহলে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু যেহেতু বিবৃতিটিকে সার্বিকভাবে বিবেচনা করতে হবে, সোভিয়েত ইউনিয়ন সমস্যাটিকে আন্তর্জাতিক ইস্যু হিসেবে বিবেচনা করে। এরকম একটি অবস্থায় সোভিয়েত নেতা “অভ্যন্তরীণ বিষয়” বলতে কি বুঝিয়েছেন? আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে বিচ্যুত করার একমাত্র উপায় হল আন্তর্জাতিকভাবে ভ্রান্তি ছড়ানো। এই অর্থে ধরা যাক ভিয়েতনামের কথা। এটিকে অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে ধরা হয়েছে কারণ যুদ্ধ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যোদ্ধা ও ইসলামাবাদ জেনারেলদের মধ্যে হচ্ছে। এটি আমাদের যুদ্ধ। এটি বাঙ্গালী জাতির একার- এবং অন্য কোন জাতি অবশ্যই চলমান যুদ্ধে যুক্ত হবে না। আমরা কিছু বন্ধুপ্রতীম দেশ যেমন ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর নির্ভর করতে পারি যেন আন্তর্জাতিক ভাবে এখানে নাক না গলানো হয়। অন্য বন্ধু ও শুভাকাংখীদের মনে করিয়ে দিতে চাই যে “হস্তক্ষেপ না করা” ছিল ভিয়েতনামীদের অবস্থান এবং সোভিয়েত ও ভিয়েতিনামের মধ্যেও। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিদেশী শক্তির সংযুক্তি ঠেকাতে না পারাই এই সমস্যার দীর্ঘসূত্রতার সরাসরি কারণ ছিল।
এই ক্ষেত্রে, আমরা কিছু গুরুত্বপূর্ণ অনুপস্থিতি নোট করব। বিশেষভাবে অনুপস্থিত ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সহানুভূতি যা দুই দেশই অনুভব করে। এরকম কিছুর উপস্থিতি ফ্যাসিস্ট ইসলামাবাদের সাম্রাজ্যবাদী রক্ষকদের বাংলাদেশে সরাসরি যুক্ত হওয়ার সুযোগ দিত। এটা ভাবার কোন কারণ নেই যে ইন্দিরা অথবা Kosygin এর কেউই বিজয়ী স্বাধীনতাকামী সেনা দেখতে চান না। যে কারো মনে থাকবে যে ভিয়েতনামে যখন শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধান দাবি করা হচ্ছিল সে সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের অস্ত্রশস্ত্র ভিয়েতনামীদের জোগান দিয়েছিল।
বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধিদের ভোটে নির্বাচিত বৈধ জনপ্রতিনিধিদের সমর্থিত যৌথ বিবৃতিতে দেয়া রাজনৈতিক সমাধানের তীব্র বিরোধিতা কেউই করেনি।
<005.022.486>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
কিন্তু এই জনপ্রতিনিধিরা ইসলামাবাদের সাথে সম্মতির জন্য কিছু নূন্যতম শর্ত ঘোষনা করেছে এবং এগুলো হল – বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বকে মেনে নিতে হবে এবং শেখ মুজিবুর রহমান এবং দখলকৃত এলাকায় যে সকল রাজনৈতিক বন্দীদের নির্যাতন করা হচ্ছে ও আতংক ছড়ানো হচ্ছে তাদের নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে। এই নূন্যতম শর্তগুলোই আমাদের শর্ত, কোন আদর্শের জন্য নয়, শুধুই বেচে থাকার জন্য। এই নূন্যতম শর্তগুলো যতক্ষণ না পূরণ হচ্ছে আমাদের যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া ছাড়া কোন উপায় নাই যেমনটা ফরাসী মুক্তিযোদ্ধা, লেখক এবং সাবেক সংস্কৃতি মন্ত্রী Andre Malraux বলেছেন, এবং আমরা যুদ্ধ চালিয়ে যাব। আমাদের ভারত এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন সহ অন্যান্য বন্ধুপ্রতিম দেশের মহান নেতৃত্বের উপর পূর্ণ আস্থা রয়েছে যে তারা তথাকথিত রাজনৈতিক সমাধানের নামে কিছু ক্ষমতাশালীদের জন্য জাতীয় স্বার্থের নামে কোন প্রকার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হবে না। পাকিস্তানের ২৫ মার্চের পূর্ববর্তী আমাদের অধিকাংশই প্রকাশ্যে বলেছিল যে পাকিস্তানের কৃত্রিম মিলনের পথ সেই বিশেষ দিনটি থেকে বন্ধ হয়ে গেল যেদিন কিছু উন্মাদ, দুঃখবাদী এবং ক্ষমতালোভী জেনারেলরা এবং তাদের পুঁজিবাদী ও আমলাতান্ত্রিক কোলাবোরেটররা অধিকাংশ জনগণকে অপরিসীম ভয়াবহতা ও পৈশাচিকতার দিকে ঠেলে দেয়। কোনকিছুই এই দ্যর্থ ঘোষনার থেকে অধিক নৈতিক ও সঠিক হতে পারে না। যদি এখনো কিছু পরাশক্তি মনে করে যে তারা নিজেদের স্বার্থে পাকিস্তান ফ্রেমওয়ার্ককে বাচিয়ে রাখতে পারবে তাহলে তারা খুব বড় ভুল করছে। তাদের কাছে আমাদের একটাই চাওয়া- আমাদের ব্যাপারে নাক গলাবেন না, আমাদেরকে আমাদের মত থাকতে দিন। কোন দলেই অস্ত্র ও অর্থ সরবরাহ করে বিঘ্ন ঘটাবেন না। আপনারা যদি এগুলো করতে পারেন তাহলে আমরা প্রতিজ্ঞা করছি কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই আমরা সমাধানে পৌছাবো- যদি সত্যিই আপনারা এটা চেয়ে থাকেন।
সোভিয়েত ইউনিয়নের অতি বুদ্ধিদীপ্ত পদক্ষেপ আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের অগ্রগতিকে কোনরূপ বাধা না দিয়ে পাকিস্তানকে লেভারেজে রাখছে। তারা তাদের প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে ইসলামাবাদকে বাংলাদেশ ছাড়ার ব্যাপারে একটি সম্মতিতে আসতে বাধ্য করতে পারে। এটা ভাবার কোন কারণ নেই যে ছয় মাসের আত্নহত্যাসম যুদ্ধের পর ইসলামাবাদ অর্থনৈতিকভাবে খোড়াচ্ছে না। বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ রিপোর্ট অনুযায়ী তারা আর কোন লোন দিবেনা। মিলিটারিরও দৃশ্যগত অবস্থা একই রকম।
সবশেষে, দখলকৃত এলাকায় এবং বিদেশে আমাদের জনগণের প্রতি সতর্কবার্তা। পরাশক্তিদের দ্বারা সাহস পাওয়া এবং অর্থনৈতিক সাহায্য পাওয়া শক্তিগুলো যারা বাংলাদেশের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন নয় তারা যোদ্ধা এবং তাদের প্রতি সহানুভুতিশীলদের প্রতি ধোয়াশা তৈরি করতে পারে। কেউ কেউ আরো আগ বাড়িয়ে বলছে যে আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি আর্মির বিরুদ্ধে আমরা খুবই অপ্রতুল, এবং এভাবে আমরা তথাকথিত রাজনৈতিক সমাধানে সম্মত হচ্ছি। এখন পর্যন্ত গত ছয় মাসের অনবরত যুদ্ধ দেখিয়েছে যে আমাদের শত্রু আধুনিক ট্রেনিংপ্রাপ্ত এবং অস্ত্র সজ্জিত হলেও তারা আমাদের থেকে ৪০ গুণ বেশি সৈনিক হারিয়েছে। এটা কি অলৌকিক? অবশ্যই না। এরূপ বিস্ময়কর জয়ের কারণ কি? মানুষের সমর্থন, আমাদের যুদ্ধকৌশলে আমাদের ১ম শ্রেণীর স্বতঃস্ফুর্ততা এবং বাধা বিপত্তি সত্ত্বেও দেশপ্রেমের জোরে এগিয়ে যাওয়া আমাদের সিংহরা। বিজয় আমাদেরই- কারণ শুধু এটি ই নয় যে আমরা চাই বরং এটি ইতিহাসের বিচার।
<005.022.487>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
৫ অক্টোবর, ১৯৭১
বৃটিশ লেবার পার্টির জাগরণ: জাতিসংঘের মধ্যস্থতা এখনই আমন্ত্রিত নয়
অবশেষে বৃটিশ লেবার পার্টি বাংলাদেশ বিষয়ক সমস্যাকেন্দ্রিক অঙ্গীকারের খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। পার্টির জাতীয় কার্যনির্বাহী সম্পাদক কর্তৃক প্রস্তুতকৃত এক বক্তব্যে বাংলাদেশে চলমান সামরিক অবরোধের অবিলম্বে অবসান এবং বাঙালী রাজনৈতিক নেতা বিশেষ করে শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির আহ্বান জানানো হয়। বাংলাদেশের জনগণের বিষয়ে কোন গ্রহণযোগ্য সমাধান খুঁজে পাওয়া না পর্যন্ত সাহায্য সংস্থা “এইড-পাকিস্তান” এবং অন্যান্য সকল দেশকে এই নিন্দিত সামরিক সরকারকে সকল প্রকার সহায়তা প্রদান স্থগিত করার আহ্বানও এই বক্তব্যে জানানো হয়। জাতিসংঘকে এ বিষয়ের সমাধান অনুসন্ধানে আরো সক্রিয় হবার দাবীও এতে জানানো হয়।
চলতি সপ্তাহে ব্রাইটনে অনুষ্ঠিত লেবার পার্টির বাৎসরিক সম্মেলনে এই বক্তব্য উপস্থাপন করা হবে। পরবর্তী বৃহস্পতিবার এ নিয়ে বিতর্ক হবে এবং নেতৃত্বের মতামত সাধারণ পরিষদে সমর্থিত হবে বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা ধারণা করছেন।
এটা অবশ্যই একটা তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতি। কারণ জন স্টোনহাউস, পিটার শোর এবং পার্টির অন্যান্য নেতৃস্থানীয় সদস্যদের অটল তদবির এবং কূটনৈতিক চাল সত্ত্বেও পার্টি প্রধান হ্যারল্ড উইলসন বাংলাদেশের উপর পাকিস্তানি অপরাধমূলক কর্মকান্ডের ব্যাপারে মুখে কুলূপ এঁটে ছিলেন। আপাতদৃষ্টিতে এই আকস্মিক প্রতিশ্রুতির পিছনে নানাবিধ কারণ থাকতে পারে। একটি বিষয় এখানে নিশ্চিত যে, বাংলাদেশ এখন তার অস্তিত্ব সারাবিশ্বে অনূভব করাতে শুরু করেছে। বাংলাদেশ অন্যান্য কিছু দেশ যেমন গ্রীস, স্পেন আর নাইজেরিয়ার মত শুধুমাত্র “আভ্যন্তরীন বিদ্রোহ” -এর কোন ঘটনা নয়। এই উপলব্ধি বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় রাজধানীসমূহের সর্বশেষ প্রতিক্রিয়ায় লক্ষণীয় যারা এতদূর পর্যন্ত নিরপেক্ষ অবস্থানে ছিল। দৃঢ় বাস্তবতায় লেবার পার্টির জাগরণ নিশ্চিতভাবেই পরিবর্তনের ক্রমবর্ধমান হাওয়াকে নির্দেশ করে, যদিও এটির গঠনে সময় লেগেছিল দীর্ঘ ছয়টি মাস। বেশ কিছুসংখ্যক ব্রিটিশ এমপির অভিমত ছিল যে উপমহাদেশের প্রতি আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর মধ্যে বৃটেনের অনন্য দায়িত্ব রয়েছে। যেহেতু বৃটেন ১৯৪৭ সালে ভারতীয় সাম্রাজ্য বিভাজনে তত্ত্বাবধায়কের ভুমিকায় ছিল, সেহেতু তারা যেকোন বিশৃঙ্খল অপ্রাকৃত বিভাজন অথবা অনুবর্তী কৃত্রিম ঐক্যের ব্যাপারে সরাসরি দায়ী। বাংলাদেশের মানুষের উপর ইসলামাবাদ-জান্তার ঔপনিবেশিক, বর্ণবাদী এবং ফ্যাসিবাদী আক্রমণ পরিস্কারভাবে সূচিত করে যে, উপমহাদেশের ব্রিটিশ মদদপুষ্ট বিভাজন মোটেই কাজ করছে না। স্পষ্টতই, উপমহাদেশের দীর্ঘস্থায়ী এবং শান্তিপুর্ণ রাজনৈতিক সাম্যাবস্থা নিশ্চিত করার জন্য সীমানারেখা নতুন করে আঁকতে ও সাজাতে হবে। নতুন প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে উপমহাদেশের মানচিত্রে সম্মানজনক অবস্থানে থাকতে হবে।
লন্ডন এই সংঘর্ষ একটি গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ ভুমিকা পালন করতে পারত। যথাসময়ে সক্রিয় থেকে এডওয়ার্ড হেলথ এর রক্ষণশীল মন্ত্রণালয় পাকিস্তানি বুলেটের শিকার হাজার হাজার নিরীহ মানুষের জীবন বাঁচাতে পারত এবং দেশান্তরের কারণে ভারতের উপর যে বিপুল চাপ পড়েছিল তা ব্যাপকভাবে হ্রাস করতে পারত। কিন্তু ব্রিটিশ পররাষ্ট্রসচিব স্যার অ্যালেক্স ডগলাস হোম ইতিবাচক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হন।
<005.022.488>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
সম্ভবত এই ব্যর্থতাই লেবার পার্টিকে উদ্যোগটি আয়ত্ব করতে উৎসাহী করে। যেহেতু বাংলাদেশ ক্রমবর্ধমানভাবে একটি তাৎপর্যপূর্ণ আন্তর্জাতিক বিষয় হিসেবে প্রমাণিত হচ্ছে, সেহেতু এটি বৃটিশ এবং আমেরিকান নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করবে। অন্ততপক্ষে, শ্রম নেতৃত্বের আমাদের পক্ষে চলে আসার কারণ যেটাই হোক না কেন, বাংলাদেশের জনগণ হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে জন স্টোনহাউস এবং পার্লামেন্টের সেইসকল লেবার সদস্যকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করবে, যারা বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করেছেন। বাংলাদেশের ব্যাপারে লেবার পার্টির দ্বিধা তাদের কূটনীতির কারণেই সমাপ্ত হয়েছিল।
বাংলাদেশে জাতিসংঘের সম্পৃক্ততার ব্যাপারেও আমরা অকপটে সন্দেহবাদী ছিলাম। এমনকি বিশ্বের চতুর্দিক থেকে উত্থিত গণহত্যার অভিযোগ জাতিসংঘ বিভীষিকাময় হত্যাযজ্ঞের ছয়মাস পরেও তদন্তে ব্যর্থ হয়। যখন ইয়াহিয়া খান গর্বের সাথে পূর্ব পাকিস্তানে রক্তের বন্যা বইয়ে দেয়ার মাধ্যমে তার পূর্বপুরুষ নাদির শাহকে ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টায় ছিল, তখন এটি সম্পুর্ণ নিশ্চুপ দর্শক হয়ে ছিল। কার্যত, এর পূর্ণ পৃষ্ঠপোষকতার কারণে ইয়াহিয়ার বাংলাদেশের স্বতঃস্ফূর্ত স্বাধীনতা যুদ্ধকে দমন করার যে নির্মম আশাহীন চেষ্টা ছিল, সেটিতেও হস্তক্ষেপের বিভিন্ন উপায় উদ্ভাবন করে। বাংলাদেশের জনগণ এবং তাদের আন্তর্জাতিক বন্ধুমহল অটলভাবে এবং সাফল্যের সাথে এটিকে প্রতিহত করে। এমনকি আজকেও জাতিসংঘ বাংলাদেশ এবং ইসলামাবাদের মধ্যকার দ্বন্দ্বকে ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যকার বিরোধিতা হিসেবে দেখছে। এই অবস্থান বাংলাদেশের জনগণের জন্য সুনিশ্চিতভাবে ক্ষতিকর এবং জনবিরোধী, কারণ ২৬ মার্চ ইয়াহিয়ার স্বীকারোক্তির সময় থেকে এটি ছিল পাকিস্তানি রটনারই বীর্য।
বিশ্বশান্তি ও দক্ষিণ এশিয়ার শান্তির স্বার্থে এবং বাংলাদেশের জনগণ যারা নিজেদের মাতৃভূমিতে শান্তিতে এবং স্বাধীনভাবে বসবাস করতে চায়, তাদের স্বার্থে এই দ্বন্দ্বের একটামাত্র সমাধান হতে পারে। আর তা হল সরাসরি এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বাংলাদেশের স্বাধীনতা। এখানে পুনরায় উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের জনগণ এবং পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস এবং সুবিধাই ঐক্যের একমাত্র ভিত্তি হতে পারত, যেহেতু তাদের ভাষাগত, জাতিগত, সংস্কৃতিগত এবং ইতিহাসগত কোন মিলই নেই। সাধারণ ধর্মের যুক্তিটি দ্বিতীয় ইঙ্গিতেই খুব অর্থহীন এবং সেকেলে।
ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র এবং তেমন অন্যান্য কিছু দেশ যারা পাকিস্তানকে বিপুল পরিমাণে সাহায্য দিয়েছিল, ঋণদাতা হিসেবে তারা ব্যাপক শঙ্কিত ছিল। যদি পাট এবং চা উৎপাদনে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যায়, পাকিস্তান কি ঋণ পরিশোধ করতে পারবে? এটাই ছিল তাদের প্রধান শংকা এবং ইয়াহিয়ার অপরাধের ব্যাপারে দ্বিধান্বিত নীরবতার কারণ। যখনই বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী বাংলাদেশ স্বাধীনতা ঘোষণা করে, পশ্চিম পাকিস্তান তীব্র অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখি হয়। সৌহার্দ্য প্রতিষ্ঠার আর কোন ভিত্তি নেই- এরুপ নিছক দাম্ভিকতার মধ্য দিয়েই ইয়াহিয়া এবং তার নির্বোধ উপদেষ্টারা বিষয়টি উপলব্ধি করে। ফলে, দায়িত্বভারটা এসে পড়ে ঋণদাতাদের কিছু অংশের উপর, যারা একইসঙ্গে ইসলামাবাদের রাজনৈতিক উপদেষ্টাও ছিল। স্বাধীন বাংলাদেশ স্থায়ী এবং ব্যাপকভাবে স্বীকৃত। যত দ্রুত তারা এটা উপলব্ধি করবে ততই মঙ্গল। নতুবা বাস্তব গ্রহণযোগ্যতায় তারা ঋণ এবং অন্যান্য পরিসেবায় আরো বেশি লোকসানের সম্মুখীন হতে পারে।
এখন একমাত্র যেটা করার রয়েছে তা হল ইয়াহিয়া এবং তার দলকে আলোকদর্শন করানো এবং ইতিহাসের রায় মানতে বাধ্য করা। হয়ত, বৃটেনের মত দেশ জাতিসংঘের চেয়ে এই কাজটির জন্য অধিক পারদর্শী ছিল, যেখানে ইতোমধ্যে অন্য কিছু দেশ সাড়ে সাতকোটি মানুষের জীবন-মৃত্যু বিষয়ক ফুটবল খেলার বিষয়ে অনুরক্তি দেখিয়েছে।
<005.022.489>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
জাতিসংঘে খেলাটা ইয়াহিয়ার সাথে বেশ মানানসই ছিল। উপরন্তু, এই সহানুভূতিহীন নীরবতার দরূন জাতিসংঘ বস্তুত তার মধ্যস্থতা করবার ন্যায়সংগত অধিকারটুকুও হারিয়ে ফেলেছে।
১৪ অক্টোবর, ১৯৭১
ইয়াহিয়া এবং তার উপনির্বাচন
গজদন্তের তৈরি দুর্গে বসবাস করার সুবিধা হল তার অধিবাসীরা অবাধ স্বাধীনতা পেয়ে থাকে- লজ্জা কিংবা বিবেক অথবা ন্যায়ের কোন ভূমিকাই তাদের কর্মকান্ডে থাকে না। বাংলাদেশের অধিকৃত অঞ্চলে ইয়াহিয়ার তথাকথিত পুনঃনির্বাচনের ঘোষণা এটাই নিশ্চিত করে, যেখানে সে মাত্র দশ মাস আগেই সফল নির্বাচন অনুষ্ঠিত করেছিল। সবসময় জনগণ থেকে দূরত্ব বজায় রেখে এবং সর্বশেষ সাড়ে ছয় মাস শুধুমাত্র তার অপরাধসমূহের নিকটতম সহযোগীদের মাঝে থেকে অন্যান্য মানুষ বা অন্যান্য দেশসমূহ তার ক্রমান্বয়ে সংঘটিত অপকর্ম এবং অপরাধের ব্যাপারে কি বলবে এসকল বিষয়ে সম্ভবত সে তার হুঁশজ্ঞানের পাতলা আবরণটিও হারিয়ে ফেলেছিল।
অন্যথায় কিভাবে একজন আত্মমর্যাদাসম্পন্ন মানুষ জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের কথা বলতে পারে যখন সে তার কলমের এক খোঁচাতেই (অবশ্যই মানুষের গণহত্যার অনুষঙ্গী) নির্বাচনে জেতা দলকে অবৈধ ঘোষণা করে, ৭৯জন বৈধভাবে নির্বাচিত সদস্যকে বাতিল বলে মনে করে এবং এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করে যাতে বাকি ৮৮ জন আওয়ামীলিগের সদস্যদের মধ্যে মাত্র ১৫-১৬ জন বিশ্বাসঘাতক সদস্য আসন্ন ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত প্রহসনের জাতীয় মহাপরিষদের সভায় অংশগ্রহণ করে, যেখানে একটি নতুন সংবিধানের রূপরেখা তৈরি করা হবে-যেটি হবে তার সংবিধান। একজন মানুষ যে কিনা বাকি দুনিয়াকে যথেষ্ট বোকা বলে মনে করে, সে নিজের এ সমস্ত শিশুসুলভ তামাশা নিজের চোখে দেখতে পায় না যা কিনা “দেশের সেরা গাধা” খেতাব পাওয়ার জন্য সুনিশ্চিত যোগ্যতা। এটা বুঝতে কোন রাজনৈতিক বোদ্ধা হতে হয়না যে সে আসলে আগে থেকেই কি চায়- জনপ্রতিনিধি নয় বরং একদল খুনি যারা তাদের প্রভুকে সন্তুষ্ট করতে বাঙালি জাতির বিরুদ্ধে চক্রান্ত করতে এবং তাদের রক্ত ঝরাতে কোনরূপ দ্বিধাবোধ করবে না।
কিন্তু বাস্তবে এই তথাকথিত উপনির্বাচনে তার মনোনীত সন্ত্রাসীদের নির্বাচিত করার জন্য ইয়াহিয়ার কাছে শুধু তার রাজাকারেরাই ছিল, যেটা ছিল একটা আন্তর্জাতিক ঐক্য সৃষ্টি করার জন্য তার সর্বশেষ আপ্রাণ চেষ্টা। বেচারা! সার্বক্ষণিক তার পেশাদার মিথ্যাবাদীদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে, যারা তার উর্দিপরা খুনীদের কীর্তিকলাপ সম্পর্কে ক্রমাগত নানাবিধ রুপকথা এবং বিশ্বের সরকারসমূহের গোপন সহানুভূতির কথা শোনাত, সে আসল দুর্ভাগ্যজনক অবস্থা অনুধাবন করতে পারেনি। বাংলাদেশে যুদ্ধটি পরাজয়েরই ছিল। ভারতের বিরুদ্ধে তার যুদ্ধের তর্জন-গর্জন কেউই শুনছিল না। এমনকি তার সাম্রাজ্যবাদী বন্ধুরাও এটা অনুধাবন করছিল যে দিন দিনই এই লোক একটু একটু করে নুয়ে পড়ছে।
কিন্তু সর্বশেষ মুহূর্ত না আসা পর্যন্ত সে ভাঙবে না। তার সামগ্রিক খারাপ জন্মবৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে এটিই ছিল একমাত্র ইতিবাচক দিক। এমনকি ছয় মাস ধরে ক্রমাগত মুক্তিবাহিনীর হাতে মার খেয়ে এবং তার সেরা সৈন্য এবং অফিসারদের প্রায় ৪০,০০০ জন হারিয়েও সে অবিচলিত থাকার অভিনয় করতে চাইত। সামনের কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই সে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে এক অবিস্মরণীয় আঘাত পেতে যাচ্ছে। কিন্তু সে যদি তখনো সেখানে থেকে থাকে, তার এই অসুস্থ দাম্ভিকতা প্রত্যাশিতই থাকবে।
<005.022.490>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
বাংলাদেশের এই আত্মঘাতী যুদ্ধ পাকিস্তানের গত চব্বিশ বছরের অন্যায়লব্ধ অর্থনীতিকে ধবংস করে ফেলেছে। কিন্তু এই টিনের সেপাই নড়বে না। সে এখনো তার চুপসে যাওয়া অস্তিত্বহীন প্রতিপত্তির বেলুনে ফুঁ দিয়েই যাচ্ছে। সে দেখাতে চায় যে বিশ্ব তার আস্পর্ধাকে যে নজরেই দেখুক না কেন, সে তাতে বিন্দুমাত্র পরোয়া করে না। শেখ মুজিবুর রহমানের অবৈধ ও বিবেকবর্জিত বিচারের বিষয়ে বিশ্বব্যাপী নিন্দার ঝড় বয়ে গেলেও নির্লজ্জের মত গণমানুষের নেতাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করার ধৃষ্টতা তার ছিল। শেখের চরম সাহসের বিপরীতে কী কাপুরুষের মত প্রতিক্রিয়া! শেখ যদি চাইতেন, নিরাপদে ই তিনি পালাতে পারতেন। কিন্তু মনেপ্রাণে একজন গণতন্ত্রবাদী হয়ে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং স্বেচ্ছায় গ্রেফতার হন। এখন এই অপরাধী তার স্পর্ধায় মনের কথা জানান দেয় যে, সে মুজিবকে মৃত্যুদন্ড না-ও দিতে পারে বরং তাঁকে সারাজীবনের জন্য পাকিস্তানের জেলে পচানোর জন্য রেখে দিতে পারে। সে ভেবেছে, এটা করার মাধ্যমে সে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল ভেঙ্গে দিতে পারবে। কিন্তু তার অন্যান্য চিন্তার মত সে এখানেও অনেক বড় একটা ভুল করে ফেলে। শেখ এক ঝুড়িতে সবগুলো ডিম রেখে যাননি। তিনি বাইরে ছিলেন কিন্তু তার সকল সেনানায়কদের বিজয় লাভ না করা পর্যন্ত যুদ্ধ করতে তিনি নির্দেশ দিয়ে যান। তার জীবনের সবচেয়ে বড় লক্ষ্য ছিল মুক্ত এবং স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা করা। এবং সেটা অর্জিত হয়েছে। এখন যেটা বাকি সেটা হল একটা দেশের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য একটি ঝাড়া অপারেশনের, সেটিও ক্রমবর্ধমান গতি এবং দক্ষতার সাথে পরিচালিত হচ্ছে। যেখানে প্রতিটি অস্ত্রধারী কিংবা অস্ত্রবিহীন মুক্তিযোদ্ধা তার আদর্শ দ্বারা অনুপ্রাণিত, সেখানে আমাদের মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহহমানের শারীরিক উপস্থিতি অপরিহার্য ছিল না।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লক্ষ মুজিবকে পেছনে রেখে গিয়েছিলেন। এমন নেতৃত্বের স্বাদ আস্বাদনের জন্য ইয়াহিয়াকে সবসময় স্বাগতম।
মোনেম খান মৃতঃ ভীতসন্ত্রস্ত্র অন্যান্য সহযোগীরা
অবশেষে বিশ্বাসঘাতক মোনেম তার প্রাপ্য পেল। অপকর্ম যে সবসময় লাভের মুখ দেখায় না, বাংলাদেশে প্রথমবারের মত এটি প্রতিষ্ঠিত হল। প্রত্যাশিতভাবেই আইয়ুব খান জনসমক্ষে সেই লোকটির জন্যই অশ্রুবর্ষণ করল, যে একটা অ্যালসেশিয়ানের মতই ভক্তি এবং হিংস্রতার সাথে তার সেবাদানে রত ছিল। মোনেমের একটাই ভাল গুণ ছিল- সে কখনোই তার অন্তরের অনুভূতি নিয়ে সতর্ক হতে পারত না। একটা ছোটখাট বিভাগীয় উকিল থেকে তাকে গভর্নর বানানোর জন্য তার প্রতি তার প্রুভুর দয়াশীলতার কথা সে মাঝে মাঝেই নির্লজ্জের মত আউড়ে যেত। সে যে শুধু তার প্রভুর জন্য ক্রীতদাসের মত কাজই করে যেত না বরং সে একজন আদর্শ ক্রীতদাসের প্রতিমূর্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। যখন আইয়ুব এবং তার অদ্ভূত একনায়কতন্ত্র জনগণের তীব্র ঘৃণার সম্মুখীন হচ্ছিল তখন “আইয়ুব আমার বাপ, আমার নেতা” এই কথা জনসমক্ষে উচ্চারণ করার মতন ঘৃণীত সাহস একমাত্র এই লোকেরই ছিল। তার সক্রিয় সাহায্যের ফলেই আইয়ুব খান পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্পের জন্য একটা ঔপনিবেশিক বাজারে পরিণত করেছিল। বাংলাদেশের মানুষ তাকে যতই ঘৃণা করত, ঠিক সেই পরিমাণ কারণই তাকে রেখে দেয়ার জন্য আইয়ুবের কাছে ছিল। সে তাকে দীর্ঘ সাত বছর ধরে বাঙালি জনগণের উপর নির্যাতন করার জন্য বসিয়ে রেখেছিল।
বাঙালি জনগণের স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন এবং বিশেষ করে শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের নীল নকশা প্রণয়নের ক্ষেত্রে মোনেম ছিল আইয়ুব খানের সবচেয়ে বিশ্বস্ত সহযোগী.
<005.022.491>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
হাজার হাজার দেশপ্রেমিকে বাংলাদেশের কারাগার পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। শেখ মুজিব ও তার দলকে পিষে ফেলবার চেষ্টায় মোনেম তার সকল অসৎ ক্ষমতাই প্রয়োগ করেছিল যেটি আইয়ুব খানই তাকে দিয়েছিল। ১৯৬৬ সালের মে মাসে সে মুজিবকে গ্রেফতার করায়। একই বছরের ৬ জুন যখন ৬ দফা স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় তখন সে এতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণকারীদের বিরুদ্ধে তার পুলিশবাহিনীকে লেলিয়ে দেয়, ফলে কিছুকাল পরেই কারাগারগুলোতে অধিক বন্দীধারণের তিল পরিমাণ জায়গাও অবশিষ্ট থাকে না।
আতঙ্কের রাজত্বের পাশাপাশি সে দুর্নীতি এবং স্বজনপ্রীতির নজিরবিহীন উদাহরণ গড়ে তুলেছিল। ঘুষ ছাড়া অফিসে কিছুই নড়ত না। মোনেমের প্রত্যেক আত্মীয়ই আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গিয়েছিল। শেষ বছরগুলোতে তার সাইরেন বাজিয়ে পাহারায় চলা আমেরিকান গাড়ির যাতায়াতের জন্য রাস্তায় সাধারণ গণপরিবহন থেমে থাকত। প্রতিটি ক্ষেত্রেই মোনেম বাঙালি জাতির প্রতি আইয়ুবের জঘন্যতম কলঙ্কের প্রতীক হয়ে ছিল। আইয়ুব খান যে তার শেষকৃত্যে তাকে একজন মহান দেশপ্রেমিক হিসেবে উল্লেখ করেছে, এতে আশ্চর্যান্বিত হবার কিছুই নেই।
এই লোকটা এখন মৃত। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ নিরাপত্তার মধ্যে থাকা সত্ত্বেও মুক্তিবাহিনী তাদের শুদ্ধিকরণ অভিযানের মাধ্যমে তাকে সরিয়ে দেয়। একটু দেরিতে হলেও বিজয় হয়েছে ন্যায়ের। বাংলাদেশ সম্পর্কিত কোন বিষয়েই তার আর কোন উল্লেখ থাকবে না। তার সমাধিফলক লেখারও কেউ নেই।
মোনেম খানের হত্যাকান্ডের সংবাদে বিশ্বাসঘাতক ও হানাদার বাহিনীর দেশীয় সহযোগীদের মনে আতঙ্ক বিরাজ করতে থাকে। মোতালেব মল্লিকের পুতুল সরকারের তথাকথিত মন্ত্রীরা আতঙ্কিত। সেনাবাহিনীর পাহারা ব্যাতিত সাধারণত তারা বাইরে আসে না। প্রতিবাদন অনুযায়ী তথাকথিত রাজনীতিবিদ ফজলুল কাদের চৌধুরী পশ্চিম পাকিস্তানে পালিয়েছে। ফরিদ আহমেদও লুকিয়ে পড়েছে। অধিকন্তু, গুপ্তচর মাহমুদ আলী এখনো জানে না যে সে কি আদৌ বাংলাদেশে ফিরবে কিনা, ইয়াহিয়ার তাবেদার হয়ে যে দেশের মানুষের সাথে জাতিসংঘে সে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রেডিও পাকিস্তান এবং ঢাকা টেলিভিশনে থাকা বেঈমানদের দিনও ঘনিয়ে আসছে। তবে প্রায়শ্চিত্তের সময় এখনো আছে। শুধুমাত্র একটা অসৎ বিদেশী শত্রুকে সাহায্য করার জন্য নিজের জ্ঞাতি গোষ্ঠীর সাথে প্রতারণা বন্ধ করতে হবে। মুক্তাঞ্চলে এসে আত্মসমর্পণ কর। ক্ষমা পেলেও পেতে পার।
ইয়াহিয়ার আসন্ন সর্বনাশ
যে ব্যাক্তি এক কানে শোনে না সে রাস্তার এক পাশ দিয়ে হাঁটে, কিন্তু যখন সে কোন কানেই শোনে না তখন সে হাঁটে রাস্তার মাঝখান দিয়ে। নির্লজ্জতার ব্যাপারে এটা একটা বাঙালি প্রবাদ। ব্রিটেনের সাম্রাজ্যবাদসমর্থক পত্রিকা ডেইলি মেইলে প্রকাশিত ইয়াহিয়ার সর্বশেষ সাক্ষাতকারে তার গতিপ্রকৃতি এই প্রবাদটির সাথেই খাপে খাপ খায়। যখন সমগ্র বিশ্ব জানত যে মুজিবের সাথে সংলাপের মিথ্যা নাটকের মাধ্যমে ইয়াহিয়া ও তার সঙ্গীসাথীরা বাংলাদেশের ওপর গণহত্যার দুই বছরের পুরনো পরিকল্পনা সাজাচ্ছে, এই জানোয়ারটা এখনো বলে যাচ্ছে যে, শেখ মুজিবের শুধুমাত্র আভ্যন্তরীণ স্বায়ত্তশাসন বিষয়ক যে প্রতিশ্রুতি ছিল, তিনি তা ভঙ্গ করেছেন এবং সশস্ত্র বিদ্রোহ সংগঠিত করে তার নেতৃত্ব দিচ্ছেন। অজ্ঞতা এরকম অশোধনীয় জড়বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিত্বের জন্য শুধুই স্বর্গবাস। এই ব্যাক্তি মনে হয় না নিজের ভ্রান্ত ধারণা আর দাবিগুলোকেও আদৌ স্বীকার করবে।
<005.022.492-493>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অবাঙালির মৃত্যুর খবরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ২৫দিন ব্যাপী শান্তিময়, অসহিংস, অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয়ার একমাত্র ঘটনা ছিলোনা। শুধুমাত্র যে সংখ্যকক পশ্চিম পাকিস্তানী ঢাকা থেকে প্রচুর পরিমাণে নগদ অর্থ ও সোনাদানা নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিলো, ছাত্র সেচ্ছাসেবীরা মাঝপথে তাদেরকে পাকড়াও করে। যদিও সেনাবাহিনী অগ্নিকান্ড, হত্যা এবং আঘাতের মাধ্যমে তাদেরকে খেপিয়ে তুলছিলো উপরন্তু পশ্চিম পাকিস্তানিদের মৃত্যুর আর কোন ঘটনা ছিলো না। বরং পরিস্থিতির চাপা উত্তেজনা দেখে স্বয়ং বঙ্গবন্ধু ছাত্রদের সরে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। . দুর্ভাগ্যবশত বাংলাদেশে স্বল্পদেখা শরণার্থীর একটি শাখা এদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থের বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানিদের সাথে সবসময় আবদ্ধ ছিলো। এই শাখাই ইয়াহিয়ার খুনিদের সম্পূর্ণভাবে সহায়তা করেছিলো ইতোমধ্যে ২৫শে মার্চ তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হয়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী প্রথমে তাদের প্রশিক্ষিত করে এবং অস্ত্র সরবরাহ করে। তারপর সামরিক বাহিনীর পূর্ণ তত্ত্বাবধানে তারা ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম , খুলনা, রংপুর, সৈয়দপুর, ঈশ্বরদী এবং আরো বহু স্থানে বাঙালী বিরোধী দাঙ্গা শুরু করে। শতাধিক নিরস্ত্র, নিরপরাধ বাঙালীকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় এবং তাদের ঘরবাড়ি বিষয়সম্পত্তি লুন্ঠিত হয়। এমনকি নারী ও শিশুদেরকেও ছেড়ে দেয়া হয়নি। এই ভয়ংকর হত্যাকাণ্ড মনে করিয়ে দেয় সাম্প্রদায়িক উন্মত্ততার কথা যা ২০/২৫ বছর আগে আমাদের প্রত্যক্ষ করার দুর্ভাগ্য হয়েছিলো। তৎসত্ত্বেও বাঙালী সর্বোচ্চ সহিষ্ণুতা প্রদর্শন করেছে। মুক্তিবাহিনী কর্তৃক উদ্ধারকৃত অঞ্চলে ববসবাসকারী উর্দুভাষী জনসমষ্টির নিরাপত্তা বিধান করেন আবেগপ্রবণ মুক্তিবাহিনীর কমাণ্ডার। তা সত্ত্বেও মুক্তিবাহিনী সরিয়ে নেয়ার পর দুর্ভাগ্যক্রমে এই মানুষগুলোর একটা দল পরবর্তীতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগী রূপে কাজ করে এবং বাঙালী হত্যাকাণ্ড এ অংশগ্রহণ করে। . আমি যতদূর সম্ভব একটি অবাঙালি শাখার কথাই উল্লেখ করেছি। কারণ বাংলাদেশে উর্দুভাষী আরো একটি দলের অস্তিত্ব ছিলো যারা শেখ মুজিবের প্রতিশ্রুতির উপপর বিশ্বাসী ছিলো যে তাদের সাথে বাঙালীর মতই আচরণ করা হবে। এই প্রতিশ্রুতি তাদেরকে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য একটি ভূমি খুঁজে পেতে সাহায্য করেছিলো। তা সত্ত্বেও তাদের পাকবাহিনীর প্রলোভন সইতে হয়েছিলো। ঔপনিবেশিক পাকবাহিনীর প্রধান লক্ষ্য ছিলো জনসংখ্যার একাংশকে অন্য অংশের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা ; কৌশলটি তারা তাদের পূর্ববর্তী নিয়ন্ত্রণকারীদের কাছ থেকে আয়ত্ত করেছিলো।
ভারতীয় মুসলমানের একটি দল তখনো পাকিস্তানিদের জন্য স্মৃতিবিধুর মমত্ত্ব বোধ করতো – অথচ এই রাষ্ট্রের জন্য চল্লিশের দশকে আমাদের অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছিলো একটিমাত্র আশায়; এটি হয়তো ভারতীয় মুসলমানদের জন্য রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উৎকর্ষতা সাধন করবে।কিন্তু সেই প্রত্যাশা অচিরেই নষ্ট হয়ে গেল। একদল অসদুদ্দেশ্য প্রণোদিত স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী ক্ষমতা দখল করে নেয় এবং নিজেদের স্বার্থে অত্যন্ত সুশৃঙ্খল উপায়ে নির্মমভাবে জনগণকে শোষণ করতে থাকে।. অকস্মাৎ বাংলার মানুষ উপলব্ধি করতে পারলো যে শোষকদের সমধর্মাবলবী হয়েও তারা আদৌ কোন সাহায্য পায়না বরং এটিই ছিলো প্রধান প্রতিবন্ধকতা। কারণ কেউ যদি শোষণের বিরোধিতা করতো তবে স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী ইসলাম এবং তথাকথিত অখণ্ডতার দোহাই দিয়ে তাদের উপর আক্রমণ চালাতো। মানুষ তাদের প্রতারণা, বিভ্রান্তি অথবা ছলনা দমন করতে চাইলে তারা পূর্ণ শক্তি নিয়ে নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড চালাতো ।কিভাবে মানুষ সজ্ঞানে এমন একটি কলুষিত চক্রের পক্ষ নিতো! এমনকি যারা তাদের সাহায্য করতো তারা বুঝতেই পারতোনা যে তারা কেবলমাত্র ব্যবহৃত হচ্ছে। পাকিস্তানি জান্তা নিজেদের আসল চেহারা লুকিয়ে রেখে সর্বাত্মক ভাবে চেষ্টা করেছিলো বিষয়টাকে হিন্দু-মুসলিম তথা ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার একটি সংঘর্ষ হিসেবে উপস্থাপন করতে। কিন্তু বাস্তবে যে লক্ষ লক্ষ নিরস্ত্র নারী,পুরুষ ও শিশুকে তারা হত্যা করেছিলো তাদের একটি বড় অংশ ছিলো ধর্মপ্রাণ মুসলমান। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডকে ভারতীয় মুসলমান কি করে ‘জিহাদ’ আখ্যা দিয়ে পারে! এমনকি একে ইসলাম রক্ষার কবচ হিসেবে সফল পদক্ষেপ কিংবা পাকিস্তানকে সম্ভাব্য ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে আখ্যায়িত করে কিভাবে!
<005.022.494>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
তা সত্ত্বেও সিদ্ধান্তটি নেওয়া হয়েছিলো ১৯৭২ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখার লক্ষ্যে । রাষ্ট্রপতি নিক্সনের পররাষ্ট্রনীতি ইন্দো- সোভিয়েত চুক্তিসই এবং জাতিসংঘে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের অন্তর্ভুক্তি এবং যুক্তরাষ্ট্রের মদদপুষ্ট চিয়াং কাই শেকের তাইওয়ান হতে বিতাড়ন প্রভৃতির ফলে একটি বড়সড় ধাক্কা খায় । রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে , পাকিস্তানকে সহায়তা করতে অস্ত্র পাঠানোর উপর এই ইচ্ছাকৃতভাবে বিলম্বিত নিষেধাজ্ঞাটি মূলত রাষ্ট্রপতি নিক্সনের ডেমোক্রেটদের কাছে হারানো অঞ্চলের অন্তত কিছু অংশ হলেও ফিরে পাবার একটি প্রচেষ্টা মাত্র ।
এই ঘোষণাটি অবশ্য বাংলাদেশের জনগণ এবং তাদের সমগ্র বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা বন্ধুদের কাছে সতর্ক বিবেচনা গ্রহণ করবে। কেউই এটা লক্ষ্য করতে ব্যর্থ হবে না যে ভবিষ্যৎ অস্ত্র সরবরাহের উপরকার এই নিষেধাজ্ঞা ইয়াহিয়া জান্তার সম্মতিতেই আরোপিত হয়েছে । উপরন্ত ,এরকম ভাবার কোন কারণ নেই যে বাংলাদেশের এই শোকাবহ ঘটনাটির প্রতি যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের দৃষ্টিভঙ্গির কোনোরূপ পরিবর্তন হয়েছে । ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, রাষ্ট্রপতি নিক্সন ইসলামাবাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়াটা বেঁছে নিলেন এবং ইয়াহাইয়া ও তার ঘাতক দলকে বাংলাদেশে এই নিষ্ঠুর হত্যালীলা বন্ধের জন্য কোন প্রকার চাপ প্রয়োগের চিন্তা বাতিল করে দিলেন । এই বিষয়টি আবারও ওই ধারণাটিকেই জোরালো করে যে হয়তোবা এই সরবরাহ বন্ধের সিদ্ধান্ত হয়তোবা বাংলাদেশের জনগণের যে প্রত্যাশা ছিল তার সাথে একদমই সম্পর্কিত না – বরঞ্চ এই পদক্ষেপটি যুক্তরাষ্ট্রের নিজেদের ঘরোয়া রাজনীতির উদ্দেশ্যে নেওয়া ।
সত্যি এটাই যে বিশেষ একটা সময়ে ইয়াহিয়া স্বেচ্ছায় বিরতি দিতে সম্মত হয়, যখন সে বাংলাদেশে তার নিশ্চিত পরাজয়ের সম্মুখীন হবার সন্দেহর ও জন্ম দেয়। হতেও পারে যে একই সাহায্য পরোক্ষ আরেকটি চ্যানেল থেকে আসবে এই প্রতি শ্রুতির বিনিময়ে, তিনি সরাসরি সাহায্য বন্ধ করার জন্য সম্মত হয়েছিলেন? পাকিস্তানের সাথে সৌদি আরবের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। অবাধে ইউ এস এর অস্ত্র সরবরাহের জন্য জর্ডান, তুর্কি, ইরান বিকল্প রাস্তা খুলে দিয়ে দিয়ে সাহায্য করতে পারে যাতে নিক্সন প্রশাষনের নিকট বাধ্য গত ভাবমুর্তি অক্ষুন্ন থাকে। পরবর্তিতে এই সব দেশ গুলো ইয়াহিয়ার ঘনিষ্ঠ দালাল হিসেবে বাংলাদেশের লোকদের বিরুদ্ধে গনহত্যার যুদ্ধে অবস্থান নেয়। রিপোর্টে নিশ্চিত করা হয় যে, গত ছয় মাসে প্রচুর পরিমানে সামরিক হার্ডওয়্যার ও জ্বালানী এসেছে তেহরান ও আংকারার হতে ইয়াহিয়ার কাছে। কোন উপায় আছে কি এই সব দেশের মাধ্যমে ইউ এস এর বাক্সভর্তি অস্ত্র পরিবহন বন্ধ করার উপায় আছে কি ? ইউ এস কংগ্রেস বেশ সতর্কতা প্রদর্শন করেছে তাদের উপর,বাংলাদেশের প্রতি প্রশাষনের এই নিষ্ঠুর নীতি। সম্ভবত তারা এখন থেকে যেকোন ছলচাতুরির জন্য সতর্ক পর্যবেক্ষনে থাকবেন।
ইসলামাবাদে সরাসরি অস্ত্র সরবরাহ বন্ধের কৃতিত্বের একটি বড় অংশের দাবিদার নিউ ইয়র্ক টাইমস। যদি এটা রাষ্ট্রী বিভাগের পাকিস্তানে সরাসরি অস্ত্র সরবরাহ নিয়ে সামনা-সামনি বলা মিথ্যা গুলোর চমৎকার ব্যাখ্যা না দিত তাহলে জনসম্মুখে ঘোষনা দেওয়া সত্বেও পাকিস্তানে অনবরত অস্ত্র সরবরাহ করার পেছনের বাস্তব চিত্র কখন প্রকাশ পেত না। এর মাধ্যমে এই পত্রিকাটি মানবতার সেবায় একটি বড় কাজ করেছে কারন এর ফলে সমগ্র বাংলাদেশের মানব সভ্যতা একই সরলরেখায় এসেছে।আমরা প্রায় নিশ্চিত যে, মানবতার এমন সাহসী পর্যবেক্ষক সক্রিয় থাকলে অলক্ষিত ভাবে কাল পন্যসম্ভার হত্যাকারীদের নিকট পৌছানো সহজ হবে না।সন্দেহ ও ভয় থাকা সত্ত্বেও, রাষ্ট্রীয় বিভাগের ঘোষনা নিঃসন্দেহে উন্নত পৃথিবীর লক্ষ্যে মানবতার যাত্রার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নির্দেশ করে।আমরা সেই সকল সভা সদস্যদের অভিবাদন জানাই যারা এই চাপ সৃষ্টির জন্য উদ্যোগ নিয়েছেন।
<005.022.495>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
১৩ ও ১৫ নভেম্বর, ১৯৭১
বেকায়দায় পাকিস্তানঃ চূড়ান্ত সময় সন্নিকটেঃ জাতিসংঘের জন্য সতর্কবার্তা
নিউজউইকের একজন সিনিয়র সম্পাদক ঢাকা জেলার দখলকৃত ও মুক্ত এলাকায় কিছুদিন অবস্থান করে মুজিবনগর হয়ে ব্যাংককের পথে রয়েছে। ভারত- ইসলামাবাদ আসন্ন ভয়াবহ যুদ্ধ সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী নানা জল্পনা শর্তেও তিনি ব্যক্তিগত ভাবে মনে করেন ভারতের সাথে একটি সর্বাত্মক যুদ্ধে জড়ানোর মত অবস্থানে পাকিস্তান নেই। বাংলাদেশে দখলদার বাহিনী আশাহত অবস্থায় দিন পার করছে। ঢাকা ভিতরে এবং আশেপাশে মুক্তি বাহিনীর কিছু শক্তিশালী অবস্থান ভ্রমণ শেষে তিনি উপসংহারে পৌঁছান যে মুক্তিবাহিনী শুধু মাত্র একটি সক্ষম বাহিনীয় নয় বরং তারা ইতোমধ্যেই দখলদার বাহিনীকে বেকায়দায় ফেলতে সক্ষম হয়েছে। পাকিস্তানী বাহিনীর গোলাবারুদ সরবরাহ এতই কম যে অধিকাংশ সময় তারা মুক্তিবাহিনীর শেলিং এর প্রতিউত্তর দিতে ব্যর্থ হয়। ৫০ ভাগেরও বেশি অপারেশনে মুক্তিবাহিনী শত্রুপক্ষের অস্ত্র ও গোলাবারুদ দখলে নিতে সক্ষম হয়। তিনি আরো বলেন মুক্তি বাহিনী তাদের এইসব সফলতায় এখন এতই আত্মবিশ্বাসী যে তারা আকস্মিক আক্রমণের পর এখন আর পিছুহটে না। তারা একটি এলাকা দখল করার পর সেখানেই অবস্থান করে। সাম্প্রতিক এই কৌশল ইতোমধ্যেই তাদের কে নানা ভাবে উপকৃত করেছে। এই কৌশল শুধুমাত্র শত্রুবাহিনীর মনোবলই ধংস করছে না বরং একই সাথে দিন দিন জনগণের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে তুলছে। পাকিস্তানীদের সাধারন অভ্যাস হচ্ছে মুক্তি বাহিনীর হাতে কোথাও পরাজিত হওয়ার পর প্রতিশোধ নিতে নিরস্ত্র সাধারন জনগনের উপর আকস্মিক আক্রমন করা। এখন মুক্তিবাহিনীর এই ‘আঘাত এবং ধংস’ কৌশল সাধারন নাগরিকদের হতাহত হওয়ার হার উল্লেখযোগ্য পরিমানে কমিয়ে এনেছে। নিউজইউকের রিপোর্টার যিনি ভিয়েতনাম, আলজেরিয়া, দক্ষিন আফ্রিকা এবং বায়াফ্রা যুদ্ধ সহ আরো অনেক যুদ্ধের ব্যাপারে অভিজ্ঞ অভিমত দেন যে ইসলামাবাদ সামরিক ভাবে প্রায় নিঃশেষিত। তারমতে ইন্দো-পাক যুদ্ধ ছাড়াই, পশ্চিমা পর্যবেক্ষকরা যা ভাবেন তার থেকে অনেক দ্রুতই এই যুদ্ধ জেতার সক্ষমতা মুক্তিবাহিনীর আছে। তিনি আত্মবিশ্বাসের সাথে তার এক বন্ধুকে বলেন, পাকিস্তান নিশ্চিত যে তারা এক বরজোর দুই মাসের মধ্যে পরাজয়ের স্বাদ গ্রহন করবে।
এই ধরনের মুল্যায়ন যা এসেছে ইয়াহিয়ার ঘনিষ্ঠ কারো কাছ থেকে তা অবশ্যই বিবেচনার দাবী রাখে। সম্ভবত ইয়াহিয়া তাকে ব্যক্তিগত ভাবে অনুরোধ করেছিল বাংলাদেশে তার সেনাবাহিনী সম্পর্কে একটি গোপন বস্তুনিষ্ঠ প্রতিবেদন তৈরি করার জন্য।
এই ঘটনা অবশ্যই মুক্তি বাহিনীর ছেলেদের জন্য বরং ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে যারা এই সংবাদ দাতাকে তাদের গোপন ক্যাম্প ও কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান সমুহ দেখিয়েছে।
তিনি ইয়াহিয়ার হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করছিলেন না এমন বলা যায় না। সম্ভবত মুক্তিবাহিনীর জন্য এখনই সময় বিদেশি সাংবাদ দাতাদের বিরুদ্ধে একটি নিরাপত্তা বলয় তৈরি করা। গত এক সপ্তাহে বা তার বেশি সময়ে শত শত এমন সংবাদ দাতা হন্যে হয়ে মুক্তি বাহিনীর খোজ করেছে।
সম্মুখ যুদ্ধ প্রচেষ্টা বাদ দেয়ার পর এবং দীর্ঘ ৬ মাস সফলতার সাথে পাকিস্তানী বাহিনীকে আঘাত করার পর হটাত করে তারা তাদের কৃত ভুলের ব্যপ্তি উপলব্ধি করতে পেরেছে। তারা অবশ্য কিউবান উপায়ে তাদের গল্প প্রকাশে আগ্রহী। মুক্তিবাহিনী যদি তাদের বিজয়ের ব্যাপারে নিশ্চিত হতে চায় তাহলে তাদেরকে অবশ্যই তাদের সংগ্রামের রাজনৈতিক চরিত্র নির্ধারণ করতে হবে। তারা কি সবাই জাতীয়তাবাদী নাকি ছদ্মবেশী কম্যুনিস্ট? অতীত অভিজ্ঞতা বলে এই সমস্ত উপসংহারের সাথে বাস্তবের সম্পর্ক খুব ক্ষীণ। তাই যে কোন সম্ভব্য উপায়ে তাদের কাছ থেকে দূরে থাকা সব সময়ই মঙ্গলজনক। এমনকি মুক্তি যোদ্ধাদের সাথে যদি এই সব লোকের দেখাও হয়ে যায় কোন ভাবে তাহলে তাদের সাথে কোন ভাবেই রাজনীতি বা যুদ্ধ কৌশল নিয়ে আলাপ করা উচিৎ নয়। তাদেরকে অবশ্যই সবাইকে অবিশ্বাস করতে হবে।
<005.022.496-497>
রাজনীতি অথবা রণকৌশল এদের অবশ্যই অবিশ্বাস করতে হবে যদি না তারা প্রমানসহ একে অপরের বিপরীত হয়। এখন এইটা ঢাকাবাসীদের জন্য বড় সংকেত। এই অবস্থায় শত্রুরা যদি ক্রমাগত আশাহত হয় তবে সম্ভবত তারা চাইবে শহরকে আক্রমণ ও ধ্বংস করতে। জনগণের এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে সেই দিনের জন্য। তিনি এইটা নিশ্চিত করেছে এইবার এটা এক পক্ষীয় ঘটনা হবে না।নাগরিকদের শুধু মুক্তিবাহিনীদের সহায়তা করলেই হবে না সাথে সাথে তাদের যা আছে তাই নিয়ে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হওয়া শত্রুবাহিনীদের হত্যার জন্য ঝাপিয়ে পড়তে হবে এবং রাস্তা রাস্তা লড়াইয়ের মাধ্যমে তাদের প্রতিরোধ করতে হবে। তোমাদের ভয়ের কিছু নেই । আমরা সংখ্যায় অনেক বেশী এবং এখন তাদের কাছে অনেক শক্তিশালী।এর মধ্য অনেক গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে যে জাতিসংঘ চিহ্ন সংবলিত আমেরিকান সাজানো জাহাজ চীনের বন্দরে অবস্থান করছে। জাতিসংঘ ও আমেরিকান সূত্রমতে এই জাহাজে অন্য কিছু নয় বরং শুধুমাত্র খাদ্য বহণ করছে। এই প্রচারের লক্ষ্য হল প্রতিষ্ঠা করা যে মুক্তিযোদ্ধারা চায় দূর্ভিক্ষপীড়িত বাংলাদেশের মানুষ খাদ্যের অভাবে মারা যাক। আক্রান্ত লক্ষাধিক বাংলাদেশী এই গল্পটা বিশ্বাস করুক আর নাই করুক এই অপপ্রচার হবে তা অনুমান করা কঠিন কিছু না। তারা জানে কারা তাদের ও জাতিসংঘের বন্ধু যারা বাংলাদেশে চালানো ইয়াহিয়ার গণহত্যাকে নীরব সমর্থন করে যাচ্ছে। জাতিসংঘের পরিহাসমূলক পরিসংখ্যানে এমন কিছু নাই যাতে আমাদের বাচা মরার ব্যাপারে তারা চিন্তিত। তদুপরি আমরা এটাও নিশ্চিত না যে জাহাজটিতে খাদ্যশষ্য আছে এবং এতে লুকানো কোন অস্ত্র নাই। যদি এখানে খাদ্য থেকেও থাকে তবে এই খাদ্য কি পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর জন্য আনা হয়েছে কিনা তাও আমরা জানি না। এর আগেও অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের জন্য রেড ক্রসের দেয়া দুধ পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীকে খাওয়ানো হয়েছে।সতর্কতামূলক ভাবে মনে রাখা হোক এই মূহুর্তে শত্রু দ্বারা নিয়ন্ত্রিত চট্টগ্রাম ও চালনা বন্দরে যদি কোন জাহাজ নোঙ্গর করে তবে তা হবে পাকিস্তানীদের সহযোগী। ওইসব জাহাজ ধ্বংস করা আমাদের পবিত্র দায়িত্ব। যে কোন রাষ্ট্র যদি জনগণের মঙ্গল কামনা করে বাংলাদেশে খাদ্য পাঠায় তবে তা বাংলাদেশের সরকারের মাধ্যমে পাঠানোই হবে আইনগতভাবে স্বিদ্ধ। এই চেষ্টাকে অন্য দিকে ধাবন করলে তা শত্রুতামূলক কাজ বলে গণ্যহবে।নিউজউইকের এক মুখপাত্রের প্রশ্নের উত্তরে ইয়াহিয়ার অধীনস্থ মূল ঘাতক জেনারেল নিয়াজী হুমকী দিয়ে বলেন, যদি মুক্তিবাহিনী ঢাকার মধ্যে আসার চেষ্টা করে তাহলে তিনি আবার ঢাকাবাসীর বিরুদ্ধে পুণরায় ট্যাংক মোতায়েন করবেন। তিনি তার শার্ট ছুড়ে ফেলেন এবং বলেন বাঙালীদের জানা উচিৎ দখলদার বাহিনী নিরস্ত্র ঢাকার মানুষদের সাথে কি কি করতে পারে। এটাই ছিল মূলত নিরস্ত্র ও অসহায় ঢাকার নাগরিকদের উপর ২৫শে মার্চ তারা যে হামলা চালায় তার প্রথম জনসম্মুখে স্বীকারোক্তি।বোকা জেনারেল অনুধাবন করতে পারেনি বিদেশীদের সামনে দেখানো তার এই দাম্ভিকতা মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিল অথবা সেটা পাকিস্তানি বাহিনীর কাপুরুষত্ব ফুটিয়ে তুলেছে। যাই হোক মুক্তিবাহিনী এখন খুব ভালভাবে প্রস্তুত যে কোনো ধরণের পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য বাংলাদেশ তৈরি হও সে সময়ে যে সমস্ত সাংবাদিক বাংলাদেশের অব্রুদ্ধ এবং মুক্তাঞ্চলে প্রবেশ করতেন, তাদের প্রায় সবাই মুজিবনগরে আসতেন আগ্রহী লোকেদের তাদের রিপোর্ট শোনাতে। এই বিশেষায়িত জনগোষ্ঠী গত ২-৩ সপ্তাহে প্রচুর পরিমাণে আসতে শুরু করেছেন, এদের মধ্যে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ভাবে প্রচারিত সংবাদ্মাধ্যমের সাংবাদিক ও রয়েছেন, যারা সারা বিশ্বকে তাদের নিজস্ব ভঙ্গীতে জানিয়ে দিচ্ছেন যে, ২৫ মার্চ রাতেই পাকিস্তানের মৃত্যু হয়েছে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ এখন কেবল একটি বাস্তবতাই নয়, বরং আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই তারা ক্রমক্ষয়িষ্ণু দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে পূর্ণ সামরিক বিজয় লাভে সক্ষম হবে বলে ধারণা করা যাচ্ছে। এখানে উল্লেখ্য যে, এই সাংবাদিক বা ফটোগ্রাফারদের অনেকেই কেবল নিজের পেশাগত খ্যাতির তাড়নায় একটি অনবদ্য গল্পের লোভে এই ঝুকিপূর্ণ এলাকায় প্রবেশ করেছিলেন, কোন শুভ উদ্যোগের সঙ্গী হতে নয়, যে কারনে, অনেক ক্ষেত্রেই তাদের রিপোর্ট যদিও জনগণের দুর্ভোগের সঠিক প্রতিফলন হয়ে উঠতে পারেনি, কিন্তু কি ঘটেছে তার একটি দিক নির্দেশক হিসেবে এগুলো চমৎকার কাজ করেছে।গত প্রায় ২ সপ্তাহ ধরে আমি ব্যক্তিগত ভাবে এরকম অনেক সাংবাদিকদের সাথে দেখা করেছি, তারা সবাই আমাকে পাকিস্তানী বাহীনির অসহায়তার কথা বলেছে। এক মাস আগেও তারা এভাবে বলতে সংকোচ বোধ করত। দখলকৃত এলাকায় অবর্ণনীয় অত্যচার আর হত্যযজ্ঞের বিবরণেও পাকবাহিনির নার্ভাস্নেসের বিষয়টি বোঝা যায়। আসলে, মুজিব বাহিনির এক একটি বিজয়ের সাথে সাথে পাক বাহিনির অরাজকতা আরো বাড়বে, এটাই স্বাভাবিক। অবরুদ্ধ এলাকায় থাকা জনগণ, বিশেষ করে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও কুমিল্লার জনগণকে যেকোন পরিস্থিতির জন্য তৈরি থাকতে হবে। ধীরে ধিড়ে জাল গুটিয়ে আসছে, সব দিক থেকে মুক্তি বাহিনির ছেলেরা এগিয়ে যাচ্ছে ঢাকার দিকে। হানাদার বাহিনীর রসদ সরবরাহ বিঘ্নিত হচ্ছে। পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে থাকলে আমরা ধারণে করছি যে তাদের কর্মকর্তারা তাদের নির্বোধ গোয়ার সৈন্যদের তাদের অস্ত্র আর গোলাবারুদ শেষ হবার আগ পর্যন্ত নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ চালাবার নির্দেশ দিয়ে বিমানে করে বাংলাদেশ ত্যাগ করবে, আর সেই সৈন্যদল নিরবিচার হত্যাযজ্ঞের পর নিজেরাও মারা যাবে। এর খুব বেশি দেরি নেই, অতএব, সাধারণ জনগনের এখনি প্রস্তুতি নিতে হবে, ঠিক যেভাবে প্রস্তুতি নেওয়াকে তাদের কাছে সবচেয়ে কার্যকর মনে হয়। তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য হতে হবে বেচে থাকা এবং মুক্তিবাহিনি যখন সেনানিবাস অবরোধ করবে তখন তাদের যেভাবে সম্ভব সাহায্য করা। খুব সম্ভবত সেনানিবাসের ভিতর থেকে শেল আর মরটারের সাহায্যে তারা পুরো শহর গুড়িয়ে দেবার চেষ্টা করবে, এমনকি মিনি চীনা ট্যাংক দিয়ে শহরে আক্রমণ চালাতে পারে, তবে ট্যাংক নিয়ে ভয়ের কিছু নেই কেননা এই ট্যাংক ধ্বংস করার জন্য প্রয়োজনীয় এন্টি ট্যাংক অস্ত্র মুক্তি বাহিনীর কাছে যথেষ্ট পরিমাণে আছে।ইতোমধ্যে পশ্চিমাঞ্চলে পাক বাহিনি এরকম ১৩ টি ট্যাংক হারিয়েছে। খুব সম্ভবত পাক বাহিনিসেনানিবাস থেকে বেরিয়ে এসে মুক্তি বাহিনির মোকাবিলা করবে না কেননা তারা রাস্তায় নেমে মুক্তি বাহিনির মোকাবিলে করতে ভয় পাচ্ছে। যুদ্ধ কতক্ষন স্থায়ী হবে তা নির্ভর করবে পাক বাহিনী কতক্ষণ সেনানিবাস ধরে রাখতে পারবে তার উপর। মুক্তিবাহিনির উদ্দেশ্য হলে তাদের এদেশের মাটি থেকে ঝেটিয়ে বিদায় করা, এটা মাথায় রেখে জনগণকে তৈরি হতে হবে। সময় নষ্ট করার অবকাশ নেই। সেনানিবাস থেকে দূরে থাকুন। অন্যদিকে, গত সপ্তাহের শেষ দিকে ঢাকায় ঘটে যাওয়া গণহত্যার ব্যাপারে এখনো সারা বিশ্ব অন্ধকারে আছে। হঠাত করে কার্ফিউ জারি করে ১৫ ঘন্টা ধরে বেসামরিক নাগরিকের উপর যে হত্যাযজ্ঞ তারা চালিয়েছে বলে আমরা শুনতে পারছি, তা বিশ্বের কোন সংবাদ মাধ্যম বা রেডিও তো আসেনি। এর দ্বারা প্রমাণিত হয় এই খুনী কর্তৃপক্ষ কিভাবে সংবাদ প্রতিনিধিদের হত্যাযজ্ঞের খবর প্রকাশে বাধা দিচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই, তারা সকল হত্যাযজ্ঞের খবর চিরন্তনের জন্য চাপা দিতে পারবেনা। অচিরেই কিছু বিদেশী সাংবাদিক ঢাকায় আসবে কি ঘটেছে সে খবর সংগ্রহ করতে। আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদন অনুযায়ী সেদিন কার্ফিউ জারির অনেক আগেই মুক্তিবাহিনির সাথে পাক হানাদার বাহিনির সংঘর্ষ হয়। সেখানে পরাজয় মেনে নিতে না পেরে দখলদার বাহিনি পরে কার্ফিউ জারি করে বেসামরিক জনগনের উপর তাদের মনের ক্ষোভ মেটায়, যা কাপুরুষ এক সেনাবাহিনির আদর্শ রূপ।এই যুদ্ধ প্রমাণ করেছে পাকিস্তানের প্রভুরা সরাসরি মধ্যযুগীয় বর্বর সমাজের প্রতিনিধি এবং আধুনিক সমাজের কোন মূল্যবোধই তাদের মনে কোন দাগ কাটতে পারেনি। অন্যদিকে সৈনিক হিসেবে, তারা চুড়ান্ত রকমের ভীতু। তারা কেবল নিরস্ত্র নর নারি আর শিশুদের বিরুদ্ধেই প্রবল পরাক্রমে যুদ্ধ করতে পারে
<005.022.498>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
খন্ড অবশ্যই হত্যাকারীরা পুরো ঘটনা সবসময় চাপা রাখতে পারবে না। শীঘ্রই হয়তো কিছু বিদেশি সাংবাদিক ঢাকা থেকে বের হয়ে পুরো পৃথিবীকে জানাবে সতিকার অর্থে সেখানে কি হয়েছে। আমাদের তথ্য অনুসারে, কারফিউ জারি হওয়ার অনেক আগেই মুক্তিবাহিনী এবং হত্যাকারীদের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছে। যুদ্ধে হেরে অনুপ্রবেশকারীরা সাধারণ জনগণকে হত্যায় লিপ্ত হয় যা কি না তাদের কাপুরুষতার লক্ষন। এই যুদ্ধ প্রমাণ করে যে পাকিস্তানী শাষক গোষ্ঠী ইতিহাসে বর্ণিত মধ্যযুগীয়দের মতো বর্বর এবং আধুনিক সভ্যতা ও তার মূল্যবোধ তাদের উপর কোন প্রভাব ফেলতে পারেনি। যোদ্ধা হিসেবেও তারাও অতিমাত্রায় ভীতু। তারা শুধু নিরস্ত্র নারী-পুরুষ এবং শিশুদের সাথেই যুদ্ধ করতে পারে। ২৪ নভেম্বর, ১৯৭১ শেষ যুদ্ধ শুরুঃ মুক্তি বাহিনী শীর্ষে বর্ষা মৌসুম শেষ হওয়ার আগে দিয়ে আশ্চর্যজনক হারে অনেক পন্ডিত বিভিন্ন যায়গায় তাদের মতামত জ্ঞাপন করেছিলেন এই বলে যে আসন্ন শুকনা মৌসুমে বর্বর পাকিস্তানীরা হারকিউলিসের আর্মিতে পরিণত হবে এবং দূর্বল বাঙ্গালী মুক্তিযোদ্ধাদের নিশ্চিহ্ন করে দেবে। স্বাভাবিকভাবেই এই আশা সেসকল পন্ডিতেরাই করেছিলেন যারা কল্পনায় পাকিস্তানকে ধারণ করে। অর্ধেক ভবিষ্যতবাণী সত্যিও হয়েছিল আর সেটা হচ্ছে কিছু মানুষকে কুচি কুচি করে কাটা হয়েছিলো। এটা এতোটায় প্রকাশ্য ছিল যে অনিচ্ছুক বিদেশী সাংবাদিকরাও তা জানতেন। প্রায় চার সপ্তাহ আগে যখন থেকে মুক্তিবাহিনী তাদের হিট এবং রান কৌশল ছেড়ে হিট-স্টে-ক্রাশ কৌশল নেয়, সেসময় থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে সম্মুখ যুদ্ধ সহ অন্যান্য যুদ্ধে অনুপ্রবেশকারীদের অনেক প্রাণহানি ঘটে এবং এতে করে বাংলার সাহসী তরুণ সিংহরা তাদের মনে স্থায়ী এক ভীতির সঞ্চার করে। নিজেকে সম্পূর্ণ ক্ষমতাহীন বুঝে ইয়াহিয়া সেই ক্ষোভ মেটান প্রতিবেশী ইন্ডিয়ার নিরাপত্তাহীন শহর এবং গ্রামগুলোতে শেল ফেলে এবং নিরাপরাধ সাধারণ জনগণকে হত্যা করে যাতে লুটেরা নাদির শাহ’র এই বংশধর বেশ অভিজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছে। জবাবে ভারত অসীম ধর্য্যের পরিচয় দেয় যা দেখে ইয়াহিয়া-ক্লিকে তাদের মাংসল শরীর এলিয়ে দেয়। যেদিন থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা হাতে অস্ত্র তুলে নেয়, সেদিন থেকেই ইসলামাবাদের ভীতুগুলো বাংলাদেশ-ইসলামাবাদ দ্বন্দ্বকে আন্তর্জাতিকবভাবে প্রতিষ্ঠিত করার আপ্রাণ চেষ্টা চালায়। যদিও এই জানোয়ারদের অনেক বিদেশী সহযোগী ছিল (তারপরও তারা তা প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যর্থ হয়ে বিভিন্ন কারণে) আন্তর্জাতিকভাবে ব্যর্থ হয়ে তারা পাকিস্তানের সাড়ে ৪ কোটি মূর্খ, সন্দেহহীন জনগণকে বোঝানোর চেষ্টা করে। শেষ সপ্তাহের শুরুর দিকে, মুক্তিবাহিনী যখন স্বাধীনতার এই যুদ্ধের শেষ পর্যায়ের শুরু করে, পাকিস্তানী অনুপ্রেবেশকারীরা অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হয় এবং সকল ক্ষেত্রে তারা পিছু হঠতে বাধ্য হয়। প্রতিটি পরাজয়ের পেছনে ইসলামাবাদ নিয়ন্ত্রিত রেডিও ভারতীয় সৈন্যের সম্পৃক্ততার মায়াকান্না শুরু করে।
<005.022.499>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
radios cry hoarse over imaginary involvement of Indian troops অবশ্যই এই অফিসিয়াল লাইন টি শুরু থেকেই তাদের দাবি ছিল।তারা সবসময় মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী বলে আত্মতৃপ্তিতে ভোগে।এই মূর্খ ভুমিকা তাদেরকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হাসির খোড়াকে পরিনত করেছে।কিন্তু তারপরেও ধিক্কার কিংবা আন্তর্জাতিক অপমান প্রায় চিনাবাদাম এর আকৃতির মস্তিস্কের উদ্ধত মহিষের কাছে একটু কমই।
এমনকি নিরপেক্ষ সাংবাদিক ইসলামাবাদের এই কাল্পনিক গল্প বিশ্বাস করবে না যে ভারতীয় ট্যাংক যশোরে দিকে এগুচ্ছে,এটি একজন ভয়ার্ত জেনারেল এর কাছে খুব সামান্য বিষয়।তারা ইতিমধ্যেই জরুরী অবস্থা ঘোষণা করেছে এবং ক্ষিপ্ততার সাথে একটি থিতান যুদ্ধকে ভারতের আশার বিপরীতে এই আশা ছুড়ে দিয়েছে যে কেউ একজন বাংলাদেশে তাদের উদ্ধারের জন্য এগিয়ে আসবে।যদিও এখন একটি শিশু জানে ইসলামাদ ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ডাক দিতে চায় কারন এটি শুধু বুঝাবে পাকিস্তানের মাটিতে পাকিস্তানি রক্ত ঝরছে।এখন পর্যন্ত হত্যাকারী জান্তা সফলভাবে পাকিস্তানের সমগ্র জনতাকে ভয়ানক মিথ্যার সহিত বাংলাদেশের ধ্বংস সম্পর্কে মারাত্মক ধোঁকা দিচ্ছে এবং the crisis that was precipitated by nobody else but the junta members almost out of the blue পাকিস্তানী সৈনিকদের হাজার হাজার দেহ বাংলাদেশে হয় কবর দেয়া হচ্ছে অথবা পেট্রোল পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত এই খুনী জন্তা, বড় পরিসরে এবং সফলতার সাথে জঘন্য মিথ্যা দিয়ে পুরো পাকিস্তানী জনগণকে বাংলাদেশে হত্যাকান্ড এবং সঙ্কট সম্পর্কে অন্ধকারে রেখেছে, যা কোন সংকেত ছাড়াই এই জন্তার সদস্যা সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশে হাজার হাজার পাকিস্তানী সৈন্যের মৃতদেহ পুতে ফেলা হয়েছে অথবা পেট্রোল দিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। এবং এসব মৃত সৈন্যদের লজ্জাজনক মৃত্যু সম্পর্কে কিছুই প্রকাশ করা হবে না। কিন্তু যখন ভারতীয় ট্যাঙ্ক এবং বিমান সত্যিকার অর্থে লাহোর, করাচি এবং রাওয়ালপিন্ডিতে আক্রমন করতে শুরু করেছে, আমাদের রক্তের বদলা হিসেবে পাকিস্তানী রক্তের বন্যা বয়ে যাবে, এবং জন্তার এই পুরো খেলাই শেষ হয়ে আসবে।
<005.022.500>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
২৫ নভেম্বর, ১৯৭১
নিষ্পত্তিমূলক অধ্যায় . এখন বাংলাদেশের জাতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধ একটি সন্তোষজনক চূড়ান্ত নিষ্পত্তিমূলক পর্যায়ে রয়েছে। পশ্চিম সেক্টর থেকে রিপোর্ট ইঙ্গিত দেয় যে, যশোর শহরের স্বাধীনতা এখন অপরিহার্য। যশোরের দখলের বাস্তব পরিভাষার মানে করলে হবে চূড়ান্ত বিজয়ের অন্তত অর্ধেক পথ পাড়ি দেয়া হয়েছে আর যার সত্যিকার অর্থ করলে দাঁড়ায় যশোর এর উপর দিয়ে পণ্য সরবরাহে নির্ভরশীল সমস্ত সেক্টরের পাকিস্তানি সৈন্যদলের পরাজয়, অন্যকথায়, ঢাকা আর চট্টগ্রাম অংশ বাদ দিলে পুরো এলাকাটাই পাকিস্তানি মুক্ত করতে পারা যাচ্ছে। গত কয়েকদিন ধরে যশোর থেকে ক্ষিপ্রগতিতে পাকিস্তানি সেনা ও সহযোগীদের প্রত্যাহারের এই ইঙ্গিত দেয় যে, হত্যাকারী দখলদারেরা ইতিমধ্যেই পলায়নমুখি হয়েছে। দৈনিক যতো বেশী সম্ভব ততবার করে প্রায় ৪০বার আসা-যাওয়ায় নিযুক্ত রয়েছে পি.আই.এ.-র বিমান গুলো। ইতিমধ্যে, এদিকে, সম্পুর্ণ যশোর রোড বরাবর যুদ্ধে, মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা নিষ্পত্তিমূলক বিজয় লাভ করেছে। তারা ১৫টি ট্যাংক এবং বিপুল সংখ্যক শত্রু সৈন্যকে ছিন্নভিন্ন করেছে। একটা আশাহীন অবস্থানে আটকা পরে হানাদারেরা তাদের বিমানবাহিনী কে আহ্বান করে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের উপর গুলী আর বোমা বর্ষন করে মোকাবিলা করতে।
চারটি স্যাবর জেট একটিকে গ্রাউন্ড ফায়ার-১ দ্বারা ভূপাতিত করা হয়। বাকি ৩টি, বীরত্ব দেখানোর চেষ্টা করে, ভারতীয় সীমান্ত অতিক্রম করে এবং ভারতীয় বিমানবাহিনী দ্বারা নিখুঁত ভাবে ধ্বংস প্রাপ্ত হয়। এদিকে, চট্টগ্রামে, অস্ট্রেলিয়ান ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশনের রিপোর্টে, বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর প্রথমবারের মতো অপারেশন করতে গিয়ে এবং বিস্মিত পাকিস্তানীদের বোমা হামলা চালিয়ে দোযখ পাঠায়। কিন্তু, এই সব পরাজয়ের সত্ত্বেও ইসলামাবাদ এর পশুদের লাজ-লজ্জাহীন মুখপত্র, রেডিও পাকিস্তানে, কাল্পনিক পাকিস্তানের বিজয় সম্পর্কে ঘেউঘেউ করে যায়। এটা উল্লেখ করে যে সমস্ত সেক্টরে, যেখানে খুনীরা মানসিক গ্লানিতে পীড়িত হচ্ছে বলে দাবী করছে, একই মুখে বলছে, পলায়নরত পাকিস্তানিরা শতশত ভারতীয় সৈন্যদের হত্যা করেছে।
একথাও ঠিক যে, ভারতীয় সৈন্য দ্বারা-বিশ্বস্ত কুকুর মানে মুক্তিবাহিনীর ছেলেদের বোঝাচ্ছে। রেডিও শোনার পর মনে হবে যে বাহিনীর ছেলেদের তাদের বুড়োঅঙ্গুল চুষছিল যখন পাকিস্তানিরা তাদেরকে হত্যা করেছিল এবং দৌড়ে পালিয়েছিল।
নিয়াজীর ব্যবহারে পর্যাপ্তভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে পাকিস্তানিরা জগাখিচুড়ীর ভেতর আছে। তিনি প্রতি ছয় বা দশ ঘন্টা বা তারও বেশী কারফিউ জারী দ্বারা ঢাকায় দৈনিক হত্যা উন্মাদনায় মেতে চলেছে। রিপোর্ট বলে, যে পাকিস্তানী খুনীরা ক্রমাগত তাণ্ডব করেই যাচ্ছে। নিরস্ত্র এবং নিরপরাধ বেসামরিক নাগরিকরা হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের শিকার হচ্ছে। স্বাভাবিক পরিস্থিতির অনেক দাবির পর এই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে যেটা অবশ্যই প্রমাণ করে যে, নিয়াজি ভীত এবং হতাশাগ্রস্ত হয়ে প্রচন্ড ক্রোধে উন্মাদে পরিণত হয়েছে। একজন পাকিস্তানী মুখপাত্র প্রকাশ্যে স্বীকার করেছে যে তারা সংখ্যায় একেবারে আশাহত ভাবে নগণ্য, আর অস্ত্রে বলীয়ান। তিনি ব্যতিক্রম হলেও সঠিক। কিন্তু খুনী নিয়াজী এটা বিশ্বাস হবেনা। বোকারদল মুক্তিবাহিনীর মাথার জন্য নগদ পুরষ্কার ঘোষণা করেছে। সে এতোটাই নির্বোধ ক্যাবলা তাই বুঝতে পারছে না যে, এই রঙ্গভঙ্গের জন্য খেলায় খুব দেরি হয়ে গেছে। সে এটাও প্রমাণ করেছে যে, তার হিসেব-নিকেশ ও বরং যাচ্ছেতাই রকমের। সে এটা উপলব্ধি করছে না যে ইসলামাবাদের পুরো টাকশাল ফুরিয়ে যাবে যদি মুক্তিবাহিনীর এক তৃতীয়াংশের মাথা কিনতেও পুরষ্কারের টাকা পরিশোধ করতে হয়।
সম্ভবত, সে জানে যে, তাকে প্রকৃত অর্থে একটি পয়সাও পরিশোধ করতে হবে না। একটি মানুষও বিদেশী হানাদার কাছে বিক্রি হবেনা।
এটা নিয়াজীর একটা পণ্ডশ্রম। আমাদের পরামর্শ নিন: আগে বাংলাদেশ থেকে বের হও। এখন খুবই দেরি হয়ে গেছে।
<005.022.501>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
২৮ নভেম্বর, ১৯৭১
লন্ডনের দা ডেইলি এক্সপ্রেস ইয়াহিয়াকে অবিহিত করেছে একজন ধর্ষকামী জেনারেল হিসেবে, যার বুদ্ধিমত্তা সার্জেন্ট-মেজরের পর্যায়ের। এটাই যদি তার বসের ‘আই কিউ’ হয়, তাহলে বাংলাদেশের দখলকৃত এলাকায় ইয়াহিয়ার খুনি-সহযোগী লে. জে. নিয়াজির বুদ্ধিমত্তা কোন পর্যায়ের হতে পারে? এটির একটি ইঙ্গিত পাওয়া যায় দখলকৃত এলাকায় নিউজউইকের সিনিয়র সম্পাদক আর্নড বোর্চগ্রেভের ঘটনাস্থল থেকে করা প্রতিবেদনে। সেখানে বলা হয়েছে, এই নির্বোধ জেনারেলের বুদ্ধিমত্তা একটি অতিভোজী মহিষের পর্যায়ের। কাজেই মানুষের বেশির ভাগ সংবেদনশীলতা ও বাস্তবতা নিয়ে সে পুরোপুরিই নি:সাড়। গেরিলাদের সে যেভাবে হত্যা করছে, সেটা নিয়ে ফালতু দম্ভের একমাত্র ব্যখ্যা সম্ভবত এটিই। শোনা যাচ্ছে সে নাকি গর্জন করেছে, “ওহ..গেরিলাদের নিয়ে আমার ভয় নেই। ওদের তো আমি মাছির মত মারছি!” তার আত্মতৃষ্টির মজার দিক হলো, মাছি মারা যে আসলে কতটা কঠিন, সেটা বোঝার মত অভিজ্ঞতা বা বুদ্ধিমত্তা, কোনোটাই তার নেই। তাছাড়াও যারা বুঝবে, তাদের কাছে তুলনাটা একদমই মিলিয়ে যাবে। কারণ মুক্তি বাহিনী যেভাবে বিষাক্ত মাকড়ষার মতো হানাদার বাহিনীর জীবনী রক্ত শুষে নিচ্ছে, মাছি সেভাবে কখনোই কামড়ায় না। আরও ব্যাপার হলো, নিয়াজির ভান্ডারে যত ধরণের কীট আছে, তাদের কেউই এই বিষাক্ত মাকড়শার হাত থেকে নিরাপদ নয়। নির্বোদেল মত আত্মতৃপ্ত বলেই এমনকি লড়াইয়ের এই পর্যায়েও সে সশব্দে ঘেউ ঘেউ করছে। শিগগিরই এই হাসি রূপ নেবে শোকে। নিয়াজি-তোমার কাছে এটা আমাদের পরম প্রতিজ্ঞা। চেষ্টা করো শেষ বাজনা শোনার জন্য-আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে, লজ্জাজনক পতন দেখার জন্য বেঁচে থাকতে!
ইয়াহিয়া ও তার নির্বোধ জেনারেলরা হয়ত বুঝতে পারছে না কি হয়ে যাচ্ছে-তবে বুড়োটা (the good old lago, ল্যাগো বলে কোনো শব্দ বা কাছাকাছি কিছু পেলাম না) মনে হয় মৃত্যুর গন্ধ ইতিমধ্যেই পেয়েছে। লারকানার স্বঘোষিত শাসক জুলফি ভুট্টো নাকি করাচিতে বলেছে যে ‘আগের পাকিস্তান এখন মৃত এবং বিপর্যয় এড়াতে নতুন পাকিস্তান গঠন করা জরুরী।” অন্যদিকে, এই ধূর্ত প্রতারক ও চূড়ান্ত মিথ্যাবাদি লোকটি ইতিমধ্যেই বাংলাদেশকে খরচের খাতায় ফেলে দিয়েছে এবং পাকিস্তানী জাতীয়তাবাদের কৃত্রিম জোটের বিভাজন রক্ষার জন্য ইতিমধ্যেই অনুনয় শুরু করেছে। যদিও, সাত মাস আগে, সুনির্দিষ্ট করে বললে গত ২৬ মার্চ, বাংলাদেশের মানুষকে গণহত্যার পর ইয়াহিয়ার প্রচারণাকে পূর্ণ সমর্থন দিয়ে এই লোকটিই বড়াই করে বলেছিল, “আমি পাকিস্তানকে রক্ষা করেছি।” সত্যিকার অর্থে একজন বেহায়াই কেবল এভাবে ডিগবাজি খেতে পারে, সেটাও আবার প্রকাশ্যে। অবশ্য এটা করে সে অন্তত বোঝাতে পেরেছে যে, জেনারেলের উর্দি পড়া ওই পশুগুলোর চেয়ে তার রাজনৈতিক বোধ খানিকটা উচ্চস্তরের। সে জানে পরিসিাথতি এখন কতটা খারাপ এবং কত দ্রুত পাকিস্তান ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। পাকিস্তান যে শেষ, সেটা সে জানে। মুখ রক্ষার জন্য এখন সে চতুরতার আশ্রয় নিচ্ছে। এখন আর সে ক্ষমতার পরিবর্তন দাবী করছে না। কৃত্রিম ভাবে সে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধাঙ্ক সৃষ্টি করেছে যা তাকে অনেক সহায়তা করেছে। জরুরী অবস্থা ঘোষণা করায় ধীরে ধীরে ক্ষমতার পালাবদলের সম্ভাবনা শেষ হয়ে গেছে। তারপরও ধূর্ত ভুট্টো চুপচাপ। পাকিস্তানকে যখন সঙ্কট ঘিরে ধরছে, সে সন্দেহজনক ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশের ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা না নিয়ে ইয়াহিয়া একই ছড়ি ঘোড়াচ্ছে সিন্ধি, বেলচিজ ও পাঠানদের ওপর। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যে অজুহাত দেখানো হয়েছে, সেই একই অজুহাতে নিষিদ্ধ করা হয়েছে ওয়াল খান ও মৌলানা ভাসানির ন্যাশলনাল আওয়ামী পার্টি উভয়কেই। এবং অনুমিতভাবে, প্রতিক্রিয়াও একই।
<005.022.502>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
পৃথিবী থেকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভাঙ্গন ছিলো অবশ্যম্ভাবী। ভুট্টো ধূর্ততার সাথে দৃশ্যপট থেকে সরে যাচ্ছেন যেনো তার উপর দোষারোপ করা না হয়। যদিও বাস্তবতা হলো এই জঘন্য ঘটনায় ইয়াহিয়া এবং তার সহযোগীদের তুলনায় ভুট্টো অনেক সক্রিয় ছিলেন। যুদ্ধ খুব দ্রুত শেষ হয়ে আসছিলো। হয়তো আর কয়েক সপ্তাহ বাকি রয়েছে। বাংলাদেশে যুদ্ধের শেষ দৃশ্য মাঝপথের ও বেশি অতিক্রম করেছে যেখানে পর্দা নামানো হচ্ছে স্থিরতা এবং দ্রুততার সাথে। এরমধ্যেই পরবর্তী দৃশ্য শুরু হয়ে গিয়েছে- শুধুমাত্র ভারত-পাকিস্তান বর্ডারে নয়, স্বয়ং পাকিস্তানেও। সর্বশক্তি প্রয়োগ করা সত্ত্বেও ইয়াহিয়া ভারতের সাথে যুদ্ধ চালাতে পারেন না। যার অর্থ হবে তিনি তার দেশবাসীর মধ্যে উগ্র দেশপ্রেম জাগাতে সফল হবেন না । তিনি অবশ্যই ব্যর্থ হবেন অভ্যন্তরীণ সমস্যা হতে অন্য দিকে দৃষ্টি সরাতে যা কিনা টাইম বম্বের মতো অপেক্ষা করছে তার জন্য। এটি অবশ্যই বিস্ফোরিত হবে, এবং ফ্যাসিস্ট জেনারেল, রাজনীতিবিদগণ এবং কূটনীতিকগণ- যারা দায়ী ছিলেন তাদের মাঝেই বিস্ফোরিত হবে।