You dont have javascript enabled! Please enable it! স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান ০১ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
শিরোনাম সূত্র তারিখ
১। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র
প্রচারিত অনুষ্ঠান (অংশ) টেপ থেকে উদ্ধৃত ২৬-৩০ মার্চ, ১৯৭১

“এবার তোমাদের বিদায় নিতে হবে, তবে অক্ষত অবস্থায় নয়। যে রক্ত এতদিন তোমরা নিয়েছো, সে রক্ত এবার আমরাও নেব।” বলেছেন বাংলার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব।
“বাঙালী রেজিমেন্ট, ই-পি-আর, পুলিশ বাহিনী, মুক্তিসেনা- এগিয়ে যাও। তোমাদের সাথে রয়েছে বাংলার বিপ্লবী বীর জনতা। এরা সবাই রক্ত দিতে প্রস্তুত, আজ এরা রক্ত দেবেই এই প্রতিজ্ঞা নিয়ে পাকিস্তানী হানাদারদের ওপর এরা আক্রমণ চালাবে।” বলেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব।
“পাক সৈন্যদের খতম করুন, বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে অক্ষুণ্ণ রাখুন। যে পতাকা একবার বাংলার– মানুষ উড়িয়েছে,শেষ রক্তবিন্দু থাকতেও সেই পতাকা কোনোদিন তারা ভুলে যাবে না।” বলেছেন স্বাধীন বাংলার ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের চারজন নেতা।
মনে রাখবেন, শত্রুসৈন্য ধ্বংস হওয়া না পর্যন্ত এই যুদ্ধাবস্থা চলবেই। তাই আরাম-আয়েশ বিসর্জন দিয়ে, রাতের ঘুম হারাম করে আপনারা আপনাদের বিজয়ের পথে এগিয়ে যান।
পশ্চিমা হানাদারেরা এখনো চিনতে পারেনি বাঙালী রেজিমেন্ট, ই-পি-আর, পুলিশ বাহিনী আর মুক্তিসেনা কি জিনিস। তারা ভুলে গেছে, এই বাহিনী বিভিন্ন যুদ্ধে যে শৌর্য ও বীর্য দেখিয়েছে তা তারা এখনো আন্দাজ করতে পারেনি। আমরা দৃঢ় বিশ্বাস রাখি, যে সমস্ত হানাদার পাকিস্তানী সৈন্য এখনো রয়েছে তাদের বাঙালীরা নিশ্চিহ্ন করে দেবে। জয় বাংলা।
সংগীতঃ জয়, জয়, বাংলার জয়… …।
স্বাধীনতা অর্জনের জন্য মরণপণ সংগ্রাম চলেছে। বাংলার বীর সৈনিক, ইষ্ট বেঙ্গল রাইফেলস, ইষ্ট পাকিস্তান রাইফেলস, পুলিশ বাহিনী এবং এদেশের প্রতিটি ছাত্র, কৃষক, জনতা, হানাদার পশ্চিমা গুণ্ডা বাহিনীর আক্রমণ সাফল্যের সাথে প্রতিহত করে চলেছে। এবং বাংলার বীর সৈনিকদের আক্রমণে দিশেহারা পশ্চিমা বাহিনী পিছু হটে চলেছে এবং মর্টার, কামান এবং ট্যাঙ্কের সাহায্যে বিভিন্ন স্থানে নির্বিচারে গণহত্যা করে চলেছে। পশ্চিমা হানাদার বাহিনী যখন প্রতিটি আন্তর্জাতিক নিয়ম-কানুন উপেক্ষা করে গতকাল রাত্রে হাসপাতালে পর্যন্ত বোমাবর্ষণ করেছে- বাংলার সাত কোটি মুক্তিপাগল মানুষের উপর যেভাবে পশ্চিমা হানাদার বাহিনী আক্রমণ করে চলেছে, তার প্রতিরোধে বাংলার মানুষকে সর্বাত্মক সহায়তা করা প্রত্যেক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নৈতিক কর্তব্য বলে আমরা মনে করি। তাই বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ আজ বিশ্বের কাছে আহবান জানাচ্ছে তারা যেন বাংলার মুক্তিপাগল জনগণের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসেন। আপনাদের অবগতির জন্য আমরা আরও জানাচ্ছি যে, পশ্চিমা হানাদার বাহিনীর মেজর জেনারেল টিক্কা খান- যাকে বাংলার বীর জনতা গর্ভনর হিসাবে মেনে নিতে ………. (অস্পষ্ট) অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন, সেই কুখ্যাত টিক্কা খানকে বাংলার বীর

স্বাধীন বাংলা বেতারের প্রথম সম্প্রচার কেন্দ্র ছিল চট্টগ্রাম বেতারের কালুরঘাট ট্রান্সমিটার ভবন। ২৬ মার্চ থেকে ৩০ মার্চ পর্যন্ত অনুষ্ঠান প্রচারের পর হানাদার বাহিনীর বিমান আক্রমণে কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে যায় এবং চট্টগ্রাম সীমান্তবর্তী মুক্তাঞ্চল থেকে দ্বিতীয় পর্যায়ে অনুষ্ঠান পুনঃপ্রচার শুরু হয়। পরবর্তীতে ২৫ মে থেকে মুজিব নগরে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সরাসরি তত্ত্বাবধানে বেতার সম্প্রচার পূর্ণাঙ্গভাবে চালু হয়।

* বন্ধনীযুক্ত অংশের টেপ অস্পষ্ট ও বাংলা ভাষণের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ।

<005.001.002>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

সৈনিকেরা হত্যা করেছে। বাংলার বীর জনতা প্রতিটি অলিতে-গলিতে অস্ত্র হাতে শত্রু দের মোকাবিলা করে চলেছে। বিশ্ববাসী, আপনারা আসুন, বাংলার মানুষকে সর্বাত্মক সহায়তা করুন। আমরা জানি, ইনশাল্লাহ জয় আমাদেরই হবেই। জয় বাংলা।
আপনারা বাংলার প্রতিটি জনসাধারণকে জানিয়ে দিন যেন শত্রুর মোকাবিলায় তারা সর্বাত্মক সাহায্য করেন। বাংলার বীর সৈনিকেরা যেভাবে শত্রুর মোকাবিলা করে চলেছে, তা সত্যই প্রশংসার যোগ্য। আপনারা এগিয়ে আসুন। আপনারা কেউ শহর থেকে যাবেন না। যে যেরূপ ভাবেই পারেন বাংলার মুক্তিপাগল মানুষকে সাহায্য করুন। …… আমাদের বিভিন্ন কেন্দ্রে খাদ্য ও যেসব সামগ্রী সংগ্রহ করা আছে, আপনারা যদি পারেন, সেখানে খাদ্য ও সামগ্রী জমা দিন।
সঙ্গীতঃ … … …
ঘুম পাড়ানো তোতা পাখী লও বিদায়, লও বিদায়।

… … … … … …
. আমি বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর মেজর জিয়া। বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীরদলনেতা মেজর জিয়া বংবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনুতার আন্দোলনের পক্ষে কথা বলছি।

মূলত পাঞ্জাবী অধ্যুষিত পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী সর্বস্তরের বেসামরিক বাঙ্গালীদের নির্মমভাবে হত্যা করেছে। তারা মূলত সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী এবং বিমানবাহিনীর নিরস্ত্র কর্মকর্তা ও অন্যান্যদের যাদের পরিবারকে হত্যা করা হয়নি মূলত তাদের কাউকেই রেহাই দেওয়া হয়নি। গত বৃহস্পতিবার রাত হতেই এই হত্যাকান্ড শুরু করেছে এবং যখন তারা আক্রমণ করা শুরু করে পুরো স্বাধীন বাংলার নিরস্ত্র সৈন্য, নৌ সদস্য, বিমানবাহিনীর সদস্য ও সাধারণজনগণকে হত্যা করা শুরু করে দেয়। তারা আর্টিলারী কামান, আমেরিকান, রাশিয়ান ও চীনা অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করে। এছাড়াও বর্তমানে তাদের কাছে রয়েছে রাশিয়ান ট্যাঙ্ক যা ১৯৬৫ সালের তথাকথিত যুদ্ধে ইন্দোনেশিয়া আমাদেরকে দিয়েছিলো। তাদের এ সমস্ত কাজ যেমন বর্বরোচিত তেমনই জঘন্য। বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, বেসামরিক কর্মচারী, সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদেরকে হত্যা করার ব্যাপারে তাদের পূর্ব পরিকল্পনা ছিল। এই চরম মুহূর্তে সবচাইতে প্রয়োজনীয় হচ্ছে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের অন্তরালে চলে যাওয়া বা গোপনে সেখান হতে কাজ চালানো। কিছুক্ষণ আগে ভয়েস অব আমেরিকা বেতারে বলা হয়েছে যে, স্বাধীন বাংলাদেশের ন্যায় আন্দোলনকে পূর্ণরূপে সমর্থন করে বেলুচিস্তান এবং সীমান্ত প্রদেশের পাখতুনিস্তান তথাকথিত পাকিস্তান হতে বিচ্ছিন্ন হয়েছে। এই সময়ে আমাদের একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে সংঘবদ্ধভাবে মহান সংগ্রাম গড়ে তোলা। সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহে আমরা এই সমস্ত দেশদ্রোহী পাঞ্জাবী সেনাদের দু’একদিনের ব্যবধানেই সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত করবো এবং শত্রুদের কবল থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করবোই। জয় বাংলা।

আপনারা এতোক্ষন শুনছিলেন বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর নেতা মেজর জিয়ার ধারণকৃত বক্তব্য। এই সম্প্রচার মুক্ত বাংলা বেতার হতে সম্প্রচারিত হচ্ছে।

আপনারা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শুনছেন। এবার আপনাদের মুক্তি-বাঙালী মুক্তিসেনা বাহিনীর নায়ক মেজর জিয়া আপনাদেরকে বাংলায় ভাষণ দিচ্ছেন।

আমি শেখ মুজিবুর রহমানের ঘোষিত স্বাধীন বাংলা প্রসংগে বলছি।

<005.001.003>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রধানত ……….. * পাঞ্জাবী সৈন্যরা বাংলার বেসামরিক মানুষদের নির্মমভাবে হত্যা করেছে। তারা অফিসার এবং নিরস্ত্র সৈন্যদের হত্যা করেছে। এমন কি তাদের পরিবারদেরকেও রেহাই দেয়নি। তাদের এরকম হত্যাকাণ্ড শুরু হয়েছে গত বৃহস্পতিবার থেকে। সেদিন থেকে তারা বাঙালী সৈন্যদের নিরস্ত্র করে এবং সমস্ত স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণের উপর জুলুম চালাতে থাকে। তারা আর্টিলারী কামান, আমেরিকান, রাশিয়ান ও চীনা অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করে। এছাড়াও তাদের জুলুমের ভয়াবহ সামগ্রীগুলির মধ্যে ইন্দোনেশিয়া আমাদেরকে দিয়েছিলো। দুশমনদের এ সমস্ত কাজ যেমন বর্বরোচিত তেমনি জঘন্য। এই সমস্ত বর্বর হানাদারদের এখন সুপরিকল্পিত মতলব হচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশের মহান রাজনীতিক নেতাদের, বেসামরিক উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের এবং বাংলাদেশের মুক্তিসেনাদের হত্যা করা। এই চরম মুহুর্তে সবচেয়ে প্রয়োজন হচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদিগকে আণ্ডারগ্রাউন্ড বা গোপন কাজে চলে যেতে হবে এবং সেখান থেকে দুর্বার আক্রমণ গড়ে তুলতে হবে। কিছুক্ষণ আগে ভয়েস অব আমেরিকা বেতারে বলা হয়েছে যে, স্বাধীন বাংলাদেশের ন্যায় আন্দোলনকে পূর্ণরূপে সমর্থন করে বেলুচিস্তান এবং সীমান্ত প্রদেশের পাখতুনিস্তান তথাকথিত পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে। এই সময় আমাদের একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে সংঘবদ্ধভাবে মহান সংগ্রাম গড়ে তোলা। আল্লাহর অনুগ্রহে আমরা পাঞ্জাবী দেশদ্রোহীদের সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত করবো। এই পাঞ্জাবী দেশদ্রোহীদের বিধবস্ত করতে আমাদের সময় লাগবে মাত্র একদিন কিংবা দুইদিন। এবং এভাবে স্বাধীন বাংলাদেশকে আমরা শত্রুর কবল থেকে মুক্ত করবো। জয় বাংলা।

আমি বাঙালি মুক্তি বাহিনীর লেফটেন্যান্ট শমসের বলছি, এতদ্বারা বাঙালি মুক্তিবাহিনীর মেজর জিয়াউর রহমানের তরফ থেকে এই ঘোষণা পাঠ করছি। তিনি বলেন, এমন খবর পাওয়া গেছে যে জল ও আকাশ পথে চিটাগং এবং ঢাকায় আরো অধিক সংখ্যক পাঞ্জাবি সেনা এবং অস্ত্র আনয়ন করা হচ্ছে। অতএব বাঙালি জনগণের পক্ষ থেকে বিশ্বের সকল শান্তিকামী দেশের প্রতি আমার অনুরোধ, স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিন এবং গণতান্ত্রিক মানসিকতার বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে সব ধরনের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। এই পরিস্থিতিতে আমি নিজেকে শেখ মুজিবের অধীনে পরিচালিত স্বাধীন বাংলা মুক্তি সরকারের প্রাদেশিক প্রধান হিসেবে ঘোষণা করছি। আমি বাংলাদেশের মানুষকে আরো তীব্রতা, তেজ এবং আত্মত্যাগের সাথে স্বাধীনতা সংগ্রাম চালিয়ে নেয়ার আহবান জানাচ্ছি। আল্লাহর রহমতে জয় আমাদেরই- জয় বাংলা। ঘোষণাটি এরকমঃ চট্টগ্রামের সকল বেসামরিক জনগণকে যার যা অস্ত্র আছে তাই নিয়ে লালদিঘী ময়দানে জমায়েত হওয়ার জন্য এবং বাঙালি মুক্তিবাহিনীর ক্যাপ্টেন ভূঁইয়া এবং ক্যাপ্টেন নাসেরের কাছে রিপোর্ট করার জন্য অনুরোধ করা গেল।

চট্টগ্রামে অবস্থানরত সমস্ত নাগরিকদেরকে আহবান করা হচ্ছে যে, তারা দুপুর বারোটার মধ্যে লালদিঘীর ময়দানে তাদের সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ক্যাপটেন ভূইয়া এবং ক্যাপটেন নাসের … (অস্পষ্ট) হাজির হন। তিনারা দুপুর বারোটা পর্যন্ত আপনাদের জন্য ওখানে অপেক্ষা করবেন। দুপুর বারোটার মধ্যে আপনারা সবাই নিজ নিজ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে লালদিঘীর ময়দানে হাজির হয়ে যান। সেখানে ক্যাপটেন ভূইয়া ও ক্যাপটেন নাসের আপনাদেরকে আদেশ ও নির্দেশ দেবেন। অস্ত্রশস্ত্র পারতপক্ষে লুকিয়ে আনবেন-সাধারণ নাগরিক যাতে তা না দেখেন। আপনারা অস্ত্রশস্ত্র লুকিয়ে আনবেন। অস্ত্রশস্ত্র ছাড়া লালদিঘীর ময়দানে যাবেন না। যাদের হাতে অস্ত্রশস্ত্র আছে শুধু তারাই লালদিঘীর ময়দানে যেয়ে হাজির হবেন। অস্ত্রশস্ত্র ছাড়া কেউ ওখানে যাবেন না।

*এই অংশে টেপ অস্পষ্ট

<005.001.004>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

আর একটি বিশেষ ঘোষণাঃ কুমিরায় অবস্থানরত স্বাধীন বাংলা মুক্তিবাহিনীর সংগে ক্যাপটেন ভূইয়া- ক্যাপটেন ভূইয়া দ্বারা পরিচালিত স্বাধীন বাংলা মুক্তিবাহিনীর সংগে পাঞ্জাব রেজিমেন্টের যে সংঘর্ষ হয়েছিল, তাতে পাঞ্জাব রেজিমেন্টের তিনশত সিপাই নিহত হয়েছে। তারা এখন ছত্রভঙ্গ হয়ে এদিক-সেদিক ছড়িয়ে পড়েছে। কোন বেসামরিক নাগরিক তাদেরকে সাহায্য করবে না। পাঞ্জাবী কোন সৈনিককে বেসামরিক নাগরিক সাহায্য করবেন না। এখানেও স্বাধীন বাংলা মুক্তিবাহিনীর জয় হয়েছে। জয় বাংলা।

……স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বলছি। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বলছি। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বলছি। স্বাধীন বাংলার বাসিন্দাদের উদ্দেশে আমাদের আবেদন, আপনারা কোন অবস্থাতেই বিভ্রান্ত হবেন না। আপনাদের উৎসাহ ও মনোবল অক্ষুণ্ণ রাখুন। শান্তি ও শৃংখলার সাথে প্রত্যেকটি স্বাধীন দেশের নাগরিক বাংলার মুক্তিবাহিনীর কাজে সহায়তা করুন। আমাদের মুক্তিবাহিনীর কর্মতৎপরতায় সমগ্র এলাকা মুখর। আমাদের ব্যবসায়ীরা তাদের দোকানপাট চালু করেছেন যাতে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সুলভে পাওয়া যায়। ঔষধপত্রের দোকানগুলো খোলা হচ্ছে। আপনারা যদি পরাজিত শক্রবাহিনীর তাদের সাথে কথা বলে তাদের ভাষা পরীক্ষা করবেন। তারা আমাদের বাঙালী সামরিক বিভাগের জোয়ানদের ওপর জুলুম করেছে। তাদের ক্ষমা নেই। ক্ষমা নেই। প্রতিশোধ! প্রতিশোধ নেবো! নেবো! আমাদের মুক্তিবাহিনী, কুমিরায় তিনশত বেঈমান পাঞ্জাবী জোয়ান যখন পালাচ্ছিল, ক্যাপটেন ভূইয়ার নেতৃত্বে সম্পূর্ণভাবে তাদের ধ্বংস করে দিয়েছে। জয় বাংলা। জয় বাংলা। জয় বাংলা।
দুশমনরা আমাদের মুক্তিবাহিনীর পোশাক পরে চোরের মত স্বাধীন বাংলাদেশ ছেড়ে বনে-জঙ্গলে পালিয়ে যাচ্ছে। সমস্ত বাংলাদেশের নাগরিকরা সজাগ দৃষ্টি রাখুন এই হানাদারদের ওপর। এদের যেখানেই পান, সাথে সাথে এদের ধরে উপযুক্ত শাস্তি দিন। এদের চেনার প্রথম উপায় হচ্ছে- যেখানে দেখেন বেশ দূরত্বে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে এদের সাথে কথা বলবেন, সামনে যাবেন না প্রথমে। সন্দেহজনক লোক দেখলে বেশ দূরত্ব থেকে কথা বলে এদের পরিচয় জেনে তারপরে যদি সন্তুষ্ট হন, ছেড়ে দেবেন। নয়তো হাতের আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করুন।

স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে প্রচারিত খবর শুনুন

স্বাধীন বাংলার মুক্তিবাহিনী প্রধান ঘোষণা করেছেন, স্বাধীন বাংলার গ্রাম ও শহরের কোন ব্যক্তি যেন কোন প্রকার গুজবে কান না দেন বা কোন গুজবে বিভ্রান্ত না হন। কেননা, শত্রুসৈন্যরা ছদ্মবেশে শহরে ছড়িয়ে পড়ে এসব গুজব ছড়াতে পারে বলে তিনি জানিয়েছেন। আন্তর্জাতিক মানবতাবাদী সংস্থা স্বাধীন বাংলাদেশের নিরস্ত্র জনগণের ওপর হানাদার পাঞ্জাবীদের অমানুষিক অত্যাচারের তীব্র নিন্দা করেছেন। গত পাঁচদিন ধরে শত্রুসৈন্যরা পানি, খাদ্য, বিদ্যুৎবঞ্চিত হয়ে অবরুদ্ধ হয়ে আছে। তাদেরকে ভাতে পানিতে মারাই হচ্ছে উপযুক্ত প্রতিশোধ। এই উচিত সাজাই হবে তাদের প্রাপ্য। আসাম বেতার কেন্দ্রের খবরে প্রকাশ, কুখ্যাত এহিয়া সরকার বঙ্গবন্দু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে খবর প্রচারের বহু পরে বেতারে শেখ মুজিবুর রহমানের কণ্ঠ শোনা গেছে। আমি আবার বলছি, আসাম বেতার কেন্দ্রের খবরে প্রকাশ, কুখ্যাত এহিয়া সরকার বঙ্গবন্দু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে খবর প্রচারের বহু পরে বেতারে শেখ মুজিবুর রহমানের কণ্ঠ শোনা গেছে । শেখ মুজিবুর রহমান সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থায় বিপ্লবী পরিকল্পনা কেন্দ্রে অবস্থান করছেন। মুক্তিবাহিনী প্রধান

<005.001.005>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

নির্দেশ দিয়েছেন- বেসামরিক লোক, যাঁরা অস্ত্রশস্ত্রের ব্যবহার জানেন না, তাঁদের হাতে যেসব অস্ত্রশস্ত্র আছে, তা প্রত্যেক জেলার ই-পি-আর বাহিনীর হাতে অবিলম্বে জমা দিতে হবে। পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান, পাখতুনিস্তানে অবস্থানকারী সমস্ত সামরিক ও বেসামরিক বাঙালী লোকজন সম্প্রতি আশংকার কোন কারণ নেই বলে আসাম বেতার থেকে ঘোষণা করা হয়েছে।
মুক্তিবাহিনী প্রধানের খবরে প্রকাশ,নিহত টিক্কা খানের চারজন সহকারীও নিহত হয়েছে। এ খবর আপনারা শুনছেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী বলেছেন, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিষ্টার শরন সিং পূর্ববাংলার উপর পশ্চিমাদের সামরিক হামলার পরিপ্রেক্ষিতে যে বিবৃতি দিয়েছেন তাতে কোন আবেগ প্রকাশ না করার অর্থ এই নয় যে, ভারতবাসীদের মনে বাঙালীদের প্রতি সহানুভূতি ও আবেগের অভাব রয়েছে এবং এ বিষয়কে গুরুত্ব দেয়ার অর্থই হচ্ছে তারা আমাদের প্রতি বিশেষ সহানুভূতিশীল। মিসেস গান্ধী স্বাধীন বাংলার মুক্তিকামী জনতার ওপর পাঞ্জাবী দস্যুদের ট্যাঙ্ক আক্রমণের তীব্র নিন্দা করেছেন।
ভয়েস অব আমেরিকার খবরে প্রকাশ, সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তান পাখতুনিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে।
বাংলাদেশের সমস্ত সরকারী-বেসরকারী অফিস, আদালত সম্পূর্ণরূপে বন্ধ রয়েছে। এই সম্পর্কিত তথাকথিত পাকিস্তান রেডিওর খবর সর্বৈর মিথ্যা।
খবর শুনলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে। আমাদের পরবর্তী ঘোষণার জন্য একটু অপেক্ষা করুন।
বাংলাদেশের সমস্ত পেট্রোল পাম্পের মালিকদের প্রতি এক নির্দেশে স্বাধীন বাংলার মুক্তিবাহিনী প্রধান ঘোষণা করেছেন, সামরিক বাহিনীর অনুমোদিত পরিচয়পত্র ছাড়া কেউ যেন কোন প্রাইভেট গাড়ীর জন্য পেট্রোল বিক্রি না করেন।
আমি আবার বলছি, বাংলাদেশের সমস্ত পেট্রোল পাম্পের মালিকদের প্রতি এক নির্দেশে স্বাধীন বাংলার মুক্তিবাহিনী প্রধান ঘোষণা করেছেন, সামরিক বাহিনীর অনুমোদিত পরিচয়পত্র ছাড়া কেউ যেন কোন প্রাইভেট গাড়ীর জন্য পেট্রোল বিক্রি না করেন। এই সংগে অন্যান্য নির্দেশ হচ্ছে, রাত্রে কেউ বাতি জ্বালাবেন না। কোন ঘরের আলো যেন আকাশ থেকে দেখা না যায়। সারা বাংলাদেশে সম্পূর্ণরূপে নিম্প্রদীপ থাকবে। স্বেচ্ছাসেবকরা প্রত্যেকটি গাড়ী চেক করবেন। বাংলাদেশের প্রত্যেকটি বিমানবন্দরের রানওয়ে যে-কোন ত্যাগের বিনিময়ে বিমান নামার পক্ষে অনুপযোগী করে তুলুন। রাত্রে কোন বেসামরিক স্বেচ্ছাসেবক কোন গোলাগুলির আওয়াজ করবেন না। কোন অবস্থাতেই কোন সক্ষম ব্যক্তি শহর ছেড়ে গ্রামে যাবেন না। ঘোষণাটি আবার পড়ছি … …
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান সম্পর্কে বিশেষ ঘোষণা। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রর অনুষ্ঠান সম্পর্কে একটি বিশেষ ঘোষণাঃ
এখন থেকে আমরা প্রতিদিন নিয়মিত তিনটি অধিবেশন আমাদের সংগ্রামী জনতার উদ্দেশে প্রচারের ব্যবস্থা করেছি। প্রতিটি অধিবেশন আধঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা পর্যন্ত স্থায়ী হবে। প্রতিদিন সকাল ন’টায় আমাদের প্রথম অধিবেশন শুরু করা হবে, বেলা একটায় দ্বিতীয় অধিবেশন ও সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় তৃতীয় অধিবেশন শুরু করা হবে। আবার বলছি … … … …

<005.001.006>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

প্রত্যেক অধিবেশনে আপনারা খবর, দেশ-বিদেশের প্রতিক্রিয়া, সংগীত ইত্যাদি শুনতে পাবেন। মাঝে মাঝে বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীন বাংলা মুক্তিবাহিনীর মেজর জিয়ার নির্দেশ শুনতে পাবেন। এছাড়া মুক্তিবাহিনীর বীর জোয়ান এবং বেসামরিক ব্যক্তিবিশেষের সংগে সাক্ষাৎকারও প্রচারিত হবে।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বিশেষ ঘোষণা ও খবর প্রচার শেষ হলো। জয় বাংলা।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা বাহিনী- আমি এখন বাংলাদেশ স্বাধীনতা বাহিনীর মেজর জিয়ার পক্ষ থেকে একটি বাণী প্রচার করবো। এতে বলা- এ কথা প্রচারিত হচ্ছে যে আরও পাকিস্তানি পাঞ্জাবী সেনাবহর ও অস্ত্রশস্ত্র চট্টগ্রাম ও ঢাকায় নিয়ে আসা হচ্ছে সাগর ও আকাশপথে। তাই-আমি, বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে বিশ্বের সকল শান্তিপ্রিয় দেশগুলোকে অনুরোধ জানাচ্ছি “স্বাধীন বাংলাদেশ” এর স্বীকৃতি প্রদানের জন্য এবং গণতান্ত্রিক মানসিকতালব্ধ বাংলাদেশের মানুষকে স্বাধীনতা প্রদানের জন্য সকল প্রকার বাস্তবিক সহায়তা বৃদ্ধি করতে। এমতাবস্থায় আমি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছত্রচ্ছায়ায় নিজেকে স্বাধীন বাংলা মুক্তি সরকারের ভারপ্রাপ্ত প্রধান বলে ঘোষণা করছি। আমি বাংলাদেশের জনগণকে এই স্বাধীনতা যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি। আমি আবারও বলছি…
সমস্ত পেট্রল পাম্পের মালিকদের প্রতি-যারা গাড়ী চালানো জানেন, তারা অবি লম্বে রেষ্ট হাউজে আওয়ামী লীগ অফিসে গিয়ে উপস্থিত হোন।

… … (নারীকণ্ঠ)- বাংলাদেশকে মুক্ত করার জন্য বাংলার সব পুরুষেরা ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। এদের সাহস ও উৎসাহ যোগাতে হবে আমাদের নিজ নিজ ঘরে শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখুন, এ সংগ্রাম চালিয়ে যেতে বাড়িতে পুরুষদের উজ্জীবিত করে প্রমাণ করুন- এ সংগ্রাম শুধু বাংলার পুরুষদের নয়, মা-বোনেরাও ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। আপনারা প্রমাণ করুন প্রতিটি বাঙালী ললনা বীর নওজোয়ানদের মা-বোন,বীরাঙ্গনা। আপনারা বগীর হাংগামার সময় যেভাবে হানাদার বর্গীদের বিরুদ্ধে তেজের সংগে রুখে দাঁড়িয়েছেন, রাস্তায় রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে প্রতিবাদের ঝড় তুলেছেন, তা এখন বৃথা যেতে দেবেন না। আপনারা সবক্ষেত্রে প্রাণপণ সাহায্য করুন। প্রতিটি ঘরে দুর্গ তৈরী হরেছেন, আজ দেশদ্রোহী পাঞ্জাবীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। আপনাদের সন্তানদের প্রেরণা দিন, সাহস দিন, তাদেরকে অস্ত্র হাতে বেরিয়ে পড়তে দিন। আপনাদের কোন ভয় নেই। আমাদের স্বাধীন বাংলা মুক্তিবাহিনীর তৎপরতায় সারা বাংলাদেশ এখন আমাদের হাতে আমাদেরই আছে, আমাদের কাছে। আপনারা এদেশ রক্ষা করুন, আপনারাও রক্ষার কাজে পার্টিসিপেট করুন, অংশগ্রহণ করুনঅংশ নিন। আপনারা মুক্তিবাহিনীর জোয়ানদের সব রকমের সহায়তা করুন। আল্লাহর অনুগ্রহে আমাদের জয় সুনিশ্চিত। জয় ন্যায়ের ও বিনাশ অন্যায়ের হবেই হবে, এ আমাদের মনে রাখতেই হবে। জয় বাংলা। … …

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে অনুষ্ঠান প্রচার এখনকার মত এখানেই শেষ হচ্ছে। আবার আমরা আপনাদের সম্মুখে উপস্থিত হবো সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায়।

<005.001.007>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে প্রচারিত অনুষ্ঠান শুনছেন।
স্বাধীন বাংলার ভাই-বোনেরা, আসসালামু আলায়কুম

মহান জননায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন । সারা বাংলাদেশে আজ যুদ্ধাবস্থা বিরাজমান। চিরাচরিত প্রথায় বাংলার জনসম্পদ লুণ্ঠন করার ঘৃণ্য মানসিকতা বর্জন করতে না পেরে এখনও শোষণ অব্যাহত রাখতে চায় ওরা। তাই তার সকল ন্যায়নীতি বিসর্জন দিয়ে পৈশাচিকভাবে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে সাড়ে সাত কোটি বাঙালীকে সর্বপ্রকার অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখতে বদ্ধপরিকর এবং বাংলাদেশসহ সমগ্র পৃথিবী আজ স্তম্ভিত সামরিক শক্তির এহেন জঘন্যভাবে প্রয়োগ পৃথিবীর ইতিহাসের আর দ্বিতীয় নজীর নেই। আজ সারাদেশ সামরিক শক্তির দাপটে এবং নারকীয় হত্যাকাণ্ডে ক্ষতবিক্ষত। স্বাধীন বিপ্লবী জনসাধারণ*…….. হেনে তাদের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছে। ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় স্বাধীন বাংলার মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড আক্রমণে হানাদার তস্করের দল প্রায় দিশেহারা হয়ে পড়েছে। এই অবস্থায় এ শত্রুবাহিনী তাদের শক্তি বাড়াবার উদ্দেশ্যে অনবরত হেলিকপ্টার ব্যবহার করছে। কুমিল্লা থেকে সৈন্য এনে তারা তাদের শক্তিকে মজবুত করতে চাইছে। ই-পি-আর ও অন্যান্য শক্তি তাদের মোকাবিলায় প্রচণ্ডভাবে যুদ্ধ চালিয়ে তুমুল যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ুন। হানাদারদের যাতয়াতের পথ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দিন। শত্রুসেনা শহরে প্রবেশ করতে চাইলে সুবিধা মত স্থানে অবস্থান করে মরিচের গুড়া, সোডা ও অন্যান্য জিনিসপত্র ছড়িয়ে দিন, হাতবোমা নিক্ষেপ করুন। গ্রামের ভাইদের কাছে আমাদের আবেদন, দলে দলে শহর অভিমুখে অগ্রসর হোন এবং ক্যান্টনমেন্ট দখল করার কাজে লিপ্ত মুক্তিসেনাদের সর্বতোভাবে সাহায্য করুন। শহরের ভাইদের কাছে আবেদন, আপনারা দলে দলে আন্দোলনকে সফলকাম করে তুলুন। বন্ধুগণ!……….

আজকে আমরা দেখতে পাই, নিরপরাধ নিরীহ নিরস্ত্র জনগণের ওপর যেভাবে অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে, দেখামাত্র গুলি করছে, হাজার হাজার মানুষ আজকে মৃত্যুবরণ করছে তার নজির এ বিশ্বের ইতিহাসে নেই। জানাবো, আপনারা এই নারকীয় হত্যাকাণ্ড দেখেও চুপ করে থাকবেন না। আসুন বিশ্ববাসী, সাড়ে সাত কোটি এই পূর্ব পাকিস্তানী ভাইদের বাঁচানোর জন্য আপনারা আমাদের সাহায্য করতে অগ্রসর হোন। বিশ্ববাসীর কাছে আবেদন জানাই- আপনারা মানবতার খাতিরে, মানুষকে বাঁচাবার তাগিদে, বাংলার জনগণের মুক্তির জন্য অগ্রসর হোন। হে বিশ্বের অধিবাসী তোমরা দেখ, কিভাবে পশ্চিমা এই গণবিরোধী শক্তি,এই শোষক শ্রেণীর প্রতিভূ পশ্চিম- এই সাম্রাজ্যবাদীদের দালালেরা পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করবার উদ্দেশ্যে কিভাবে তাদের নারকীয় হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। তাই প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের কাছে আহবান জানাই, আপনারা চুপ করে থাকবেন না, আসুন আমাদের সর্বপ্রকার সাহায্য করুন। বন্ধুগণ, আমি সারা বাংলার স্বাধীন বাংলার জনগণের কাছে আহবান জানাবো, বাঙালী ভাইয়েরা, আপনারা তুমুল সংগ্রামে নিজেদেরকে শরিক করুন এবং হানাদার দুশমনদের খতম করুন। যেখানে যে যে অবস্থায় আছেন, যার হাতে যে অস্ত্র আছে, সেই অস্ত্র তুলে নিন। মা-বোন বাপ-ভায়েরা বসে থাকবেন না। রাস্তায় বার হন এবং সুবিধামত স্থানে অবস্থান করে শত্রুসেনাদের ঘায়েল করুন। মারাত্মকভাবে আঘাত হানুন। আঘাতের পর আঘাত হেনে বাংলাকে মুক্ত করুন। স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়বে- এদিন আর সুদূরপরাহত নয়। পরিশেষে আমি জনগণকে আহবান জানাবো, এই দেশ এই দেশের মহামান্য জননেতা, বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রাণের দেবতা, বাংলার নয়নের করবে না এবং কোন মার্শাল ল’ বাঙালীরা মানে না। আমি আহবান জানাবো- বাংলার প্রতিটি নরনারী সকলের কাছে-আপনারা মার্শাল ল’ মানবেন

টেপ অস্পষ্ট

<005.001.008>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

না, মার্শাল ল’র আইনই আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা স্বাধীন বাংলার নাগরিক। স্বাধীন বাংলার মহান জননায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নির্দেশ আমাদের শিরোধার্য। জয় বাংলা স্বাধীন বাংলা-জয়। …

……অনুষ্ঠান শুনছেন স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে। আমাদের পরবর্তী অনুষ্ঠান বাংলা খবর।

স্বাধীন বাংলাদেশের বিপ্লবী বেতার থেকে খবর বলছি। আমাদের বিপ্লবী গণবাহিনী শত্রুর দুর্ধর্ষ আক্রমণকে প্রতিহত করে সম্মুখের দিকে এগিয়ে চলছে। বাংলাদেশের অধিকাংশ সামরিক ঘাঁটিতে এখন বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে। সামরিক বিধি-বিধান, ভয়-ভীতি সবকিছুকে তুচ্ছ করে আমাদের বিপ্লবী বাঙালী সৈন্যবাহিনী শত্রুদের হটিয়ে চলছে। বাংলাদেশের মানুষের সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টার ফলে বাংলার মাটি আজ দুর্জয় ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে। ঢাকা, কুমিল্লা, দিনাজপুর, রংপুর, পাবনা, চট্টগ্রাম এবং আরও কয়েকটি জেলায় সামরিক ঘাঁটি আমাদের বেঙ্গল রেজিমেন্টের হাতে এসে গেছে। দুনিয়ার সমস্ত মানবতার সহায়তা আমরা পাচ্ছি। খবর শুনছেন স্বাধীন বাংলাদেশের বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে। আমাদের বীর সেনানীরা বিপুল বিক্রমে দুশমন সৈন্যকে প্রতিহত করে চলছে। বাংলাদেশের ঘরে ঘরে মুক্তির আগুন জ্বলছে দাউ দাউ করে। বাংলাদেশের প্রত্যেকটি থানার পুলিশ বাহিনী আমাদের সাথে লড়ছেন। ই-পি-আর বাহিনী, বেঙ্গল রেজিমেন্ট, বাংলার বীর স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী, বাংলার মা-বোনেরা, বাংলার যুবক সম্প্রদায় প্রত্যেকে ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করে আছেন। স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে আজকের মত খবর এখানে শেষ করছি। জয় বাংলা।
স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে আমাদের বিশেষ অনুষ্ঠান আজকের মত এখানেই শেষ হলো। আল্লাহ আমাদের সহায় হউন। জয় বাংলা।

শত্রুবাহিনী উপায়ন্তর না দেখে ট্যাঙ্ক ও মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়েছে, আঘাত হানার চেষ্টা করছে। চট্টগ্রামের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বাঙালীদের আয়ত্তে (একজনের হাততালি ও বাহবা) কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট দখল করে ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সৈন্যবাহিনী ইতিমধ্যেই চট্টগ্রামে পৌঁছে গেছে। এদেশের অন্যান্য সকল স্থান বাঙালীদের সম্পূর্ণ আয়ত্তাধীনে এসে গেছে। বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে বলছি। স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র। এখন খবর পড়ছি-

বাংলাদেশের পথে পথে মুক্তিবাহিনীর সাথে পাকিস্তানী হানাদার সৈন্যদের প্রচণ্ড লড়াই চলছে। স্বাধীন বাংলার বিপ্লবী সৈন্যবাহিনী ও পুলিশ জনতার সাহায্য নিয়ে আক্রমণের পর আক্রমণ করে চলেছে। ঢাকার সর্বশেষ প্রাপ্ত খবরে প্রকাশ, পাকিস্তান হানাদার সেনাবাহিনীর কর্মাধ্যক্ষ টিক্কা খান দলবলসহ নিহত হয়েছেন। কিছুক্ষণ পূর্বে হানাদার সৈন্যদের মুখপত্র পানিস্তান রেডিও থেকে যে খবর পৌঁছেছে যে শেখ মুজিব ধৃত হয়েছেন, সেটা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও উদ্দেশ্যমূলক। টিক্কা খান তার দলবলসহ নিহত হয়েছেন। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট সম্পূর্ণভাবে বাঙালীদের আয়ত্তাধীন। কুমিল্লা থেকে একদল সৈন্য চট্টগ্রামের পথে পালাবার সময় বাংলার বিপ্লবী ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ই-পি-আর ও পুলিশ বাহিনী তাদের সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়েছে ও তারা এখন তাদের আক্রমণের মুখে টিকে থাকতে না পেরে বিভিন্ন অবস্থায় পালিয়ে রয়েছে। তাই বঙ্গবন্ধু এক নির্দেশ জারি করেছেন যে পলায়িত সৈন্যরা যাতে কোনক্রমেই রেহাই না পেতে পারে। চট্টগ্রামের অবস্থা সম্পূর্ণভাবে বাঙালী সৈন্যদের আয়ত্তাধীন। চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টের হানাদার পাকিস্তানী সৈন্য বিভিন্ন অবস্থানে লুকিয়ে রয়েছে। চট্টগ্রামের বীর জনতা, বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ই-পি-আর, পুলিশ তাদের ধ্বংস করে দেয়ার কাজে লিপ্ত রয়েছে। গতকাল চট্টগ্রামের বিভিন্ন অবস্থান থেকে হানাদার বাহিনীর উপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালানো হয় এবং এতে করে

<005.001.009>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

হানাদার বাহিনীর বেশ কয়েকটা ঘাঁটি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। যশোর, রংপুর সিলেট এসব শহরেও এখন পর্যন্ত প্রচণ্ড গোলাগুলি চলছে এবং হানাদার সৈন্যদের এখন মূল লক্ষ্যস্থল হলো বেতার কেন্দ্রগুলো। তারা বেতার কেন্দ্রগুলো দখল করে সেখান থেকে ভুয়া প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছে। কিন্তু বাংলার বীর জনতা তাতে মোটেই বিভ্রান্ত না হয়ে তাদের যুদ্ধ অব্যাহত রেখেছেন। ঢাকার পথে পথে এখন মুক্তিসেনা এবং বেংগল রেজিমেন্ট, ই-পি-আর ও পুলিশদের সাথে হানাদার সৈন্যদের প্রচণ্ড লড়াই চলছে এবং সর্বশেষ প্রাপ্ত খবরে প্রকাশ, টিক্কা খান তার দলবল সহ নিহত হয়েছেন। সারা বাংলাদেশে পাকিস্তানী হানাদার সৈন্যের নির্দেশ অমান্য করে জনসাধারণ স্বাধীন বাংলার পাহারাদার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নির্দেশক্রমে চলছেন এবং তারা বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত প্রত্যেকটি নির্দেশকে হুবহু মেনে চলছেন। স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব জাতিসংঘের কাছে এক আহবানে বলেছেন, যেহেতু পাকিস্তানী হানাদার সৈন্যরা বাংলাদেশ আক্রমণ করেছে তাই জাতিসংঘের এখন উচিত বিদেশী সৈন্যদের বাংলাদেশ থেকে হটানোর ব্যাপারে বাংলার মুক্তিকামী মানুষকে সহযোগিতা করা। আপনারা এ খবর শুনছেন স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে।
টিক্কা খান সদলবলে নিহত হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে তার নির্দেশ জারি করে চলেছেন। তার সর্বশেষ নির্দেশ হলো যে, আপনারা জনসাধারণ যে যেখানে আছেন সেখান থেকেই পশ্চিমা সেনাবাহিনীর অবস্থান নির্দেশ করুন। এবং পশ্চিমা সেনাবাহিনী কোথায় আছে সেটা জেনে তাদের ধ্বংসকাজে লিপ্ত থাকুন। ই-পি-আর, বেংগল রেজিমেন্ট ও পুলিশ বাহিনীকে খাদ্য-পানীয় দিয়ে সর্বাত্মক সহযোগিতা করুন। যার ঘরে যা আছে, বন্দুক, পিস্তল, রিভলভার, প্রয়োজনবোধে সেটা ই-পি-আর অথবা বেংগল রেজিমেন্টের হাতে তুলে দিন আর আপনারা যারা চালানো জানেন তারাও তৈরী হয়ে থাকুন এবং যেখানে পশ্চিমা সেনাবাহিনী দেখবেন তাদের উপর আক্রমণ করুন। তবে একটি জিনিস মনে রাখবেন যে, কোথাও বাংগালী বা অন্য কেথাও কোন সৈন্য দেখা গেলে তার প্রতি গুলি করবেন না এবং এসব করার আগে ই-পি-আর, বেংগল রেজিমেন্ট অথবা পুলিশ বাহিনীর সাথে যোগাযোগ করুন। গত রাত্রেও সারা বাংলাদেশের উপর নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চলেছে কিন্তু বাংলার বিপ্লবী বীর জনতা পশ্চিমা হানাদার সৈন্যদের উপর আঘাতের পর আঘাত হেনে চলেছে। স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিদেশের কাছে এক আবেদনে জানিয়েছেন যে, পাকিস্তানী হানাদার সৈন্যরা বাংলাদেশ আক্রমণ করে এটাকে দখল করে নিতে চাইছে। তাই প্রত্যেকটি দেশের উচিত এ অবস্থায় বাংলাদেশকে সহযোগিতা ও সাহায্য করা এবং পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীর উপর চাপ সৃষ্টি করা যাতে করে তারা অবিলম্বে এখান থেকে চলে যেতে বাধ্য হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আর এক নির্দেশে এ কথাও জানিয়েছেন যে … পাকিস্তানী সৈন্য যারা যেখানে আছেন তারা যদি আত্মসমর্পণ করেন তাহলে তাদেরকে ক্ষমা প্রদর্শন করা যেতে পারে। অন্যথায় বাংলার মাটি থেকে তাদের সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হবে এবং যাতে করে তারা বাংলাদেশ থেকে পালাতে না পারে তারও সম্পূর্ণ নির্দেশ তিনি জারি করেছেন। জয় বাংলা। বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে খবর প্রচার আপাতত এখানে শেষ হলো।

স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে প্রচারিত একটি ঘোষণা। আমাদের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। এখন বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। স্বাধীনতা ঘোষণার পরপরই পাকিস্তানী বিপক্ষ শক্তি পাগলা কুকুরের মতো আচরণ করছে এবং গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে, এভাবে বাংলাদেশে ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের সাহসী মানুষেরা শেখ মুজিবের নেতৃত্বে পাকিস্তানিদের দেশছাড়া করার জন্য লড়ে যাচ্ছে। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইস্ট বেঙ্গল রাইফেলস ও পুলিশ বাহিনীর সাথে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ মিলে তাদের প্রতিহত ও প্রতিআঘাত করছে সারা বাংলাদেশজুড়ে। চট্টগ্রাম পুরোপুরি বাংলা রেজিমেন্টের দখলে চলে এসেছে পাশাপাশি কুমিল্লা, রাজশাহী, সিলেট, যশোর ও রংপুরও । ঢাকায় তীব্র যুদ্ধ হচ্ছে এবং আমাদের সাহসী যোদ্ধারা বিজয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

<005.001.010>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
আমরা শহরে ও সদরে অবস্থানরত সবাইকে অনুরোধ করবো শহর ছেড়ে না যেতে এবং তাদের যা কিছু আছে তা দিয়েই শত্রুপক্ষের আসার সম্ভাবনা আছে এমন রাস্তার প্রতিটি মোড়ে মোড়ে ব্যারিকেড দিয়ে রাখার প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে। তাদের এক ইঞ্চিও আগাতে দেয়া যাবে না বাঁধা ছাড়া। গ্রামের সকল মানুষ যাদের কাছে যেকোনোপ্রকার আগ্নেয়াস্ত্র আছে তাদের শহরের দিকে আসার জন্য অনুরোধ করা যাচ্ছে। সর্বসাধারণকেই অনুরোধ করা যাচ্ছে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়ার জন্য, বিশেষ করে খাবার দিয়ে আমাদের সাহসী যোদ্ধাদের সহায়তা করার জন্য।

এখন, স্বাধীন বাংলাদেশের তরফ থেকে বিশ্বের সকল শান্তিপ্রিয় দেশ, বিশেষ করে আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোর কাছে যতটুকু সম্ভব সাহায্য প্রার্থনা করছি যেন আমরা আমাদের দেশকে আমাদের করে নিতে পারি। আমরা বিশ্বের ক্ষমতাবান শক্তিদের হস্তক্ষেপ আশা করছি এবং সাড়ে সাত কোটি মানুষ যেন অবিচার, কষ্ট, আইনি অধিকার থেকে বঞ্চনা ও শোষণ এবং পাকিস্তানী শক্তির অত্যাচার থেকে মুক্ত হতে পারে সেটি দেখতে বলছি। আমরা আরও অনুরোধ জানাই জাতিসঙ্ঘকে তড়িৎ…

<005.002.011>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
শিরোনাম সূত্র তারিখ
২। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র
প্রচারিত আরও অনুষ্ঠান ১। বেতার বাংলা’
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭৯
২ ও ৩। শব্দসৈনিক’ ফেব্রুয়ারী, ১৯৭২ ২৬ ও ২৮ মার্চ এবং
২১ এপ্রিল, ১৯৭১

১.
২৬ শে মার্চের অনুষ্ঠান থেকে
আবদুস সালাম
“নাহমাদুহু ওয়ানুসাল্লীয়ালা রাসুলিহীল কারিম”

আসসালামু আলায়কুম,
প্রিয় বাংলার বীর জননীর বিপ্লবী সন্তানেরা। স্বাধীনতাহীন জীবনকে ইসলাম ধিক্কার দিয়েছে। আমরা আজ শোষক প্রভুতুলোভীদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছি। এ গৌরবোজ্জ্বল স্বাধিকার আদায়ের যুদ্ধে, স্বাধীনতার যুদ্ধে, আমাদের ভবিষ্যৎ জাতির মুক্তিযুদ্ধে মরণকে বরণ করে যে জানমাল কোরবানী দিচ্ছি, কোরআনে করিমের ঘোষণা-তারা মৃত নহে, অমর।

দেশবাসী ভাইবোনেরা, আজ আমরা বাংলার স্বাধীনতার সংগ্রাম করছি।

আল্লার ফজল করমে বাংলার আপামর নরনারী আমাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সংগ্রাম করে চলেছেন। আর সবখানে আমাদের কর্তৃত্ব চলছে। আমরা যারা সংগ্রামে লিপ্ত রয়েছি- তাঁদের আপনারা সকল প্রকার সহযোগিতা দিন। এমন কি খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারেও সহাযতা দিন। স্মরণ রাখবেন দুশমনরা মরণকামড় দিয়েছে। তাদের এ সোনার বাংলাকে সহজে তাদের শোষণ থেকে মুক্তি দিতে চাইছে না। কোন অবাঙালী সৈনিকের কাজেই সাহায্য করবেন না।

মরণ তো মানুষের একবার। বীর বাংলার বীর সন্তানেরা শৃগাল-কুকুরের মতো মরতে জানে না। মরলে শহীদ, বাঁচলে গাজী।

কোন গুজবে কান দেবেন না। খালি হাতে কয়েকজন মিলে কোন পশ্চিমা মিলিটারীর মোকাবেলা করবেন না। ওরা আমাদের দেশে এসে আমাদের খেয়েই শক্তি যুগিয়ে আমাদের নির্বিচারে হত্যা করবে- তা হতে পারে না। দশজনে হলেও একজনকে খতম করুন। সমস্ত প্রকার অস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত থাকুন। যারা নিরস্ত্র তারা অন্তত সোডার বোতল, বাজি প্রস্তুতকারীরা মরিচের গুড়ার ঠোঙ্গা বানায়ে ওদের প্রতি নিক্ষেপ করলে টিয়ার গ্যাসের কাজ করবে। বিজলী বাতির বাল্বে এসিড ভরে তাও নিক্ষেপ করুন। একেবারে খালি হাতে থাকবেন না। মরবেন তো মেরেই ইতিহাস সৃষ্টি করুন।

“নাছরুম মিনাল্লাহে ওয়া ফাতহুন কারিব” । আল্লাহর সাহায্য ও জয় নিকটবর্তী।।

<005.002.012>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
২.

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রথম কথিকা
বেলাল মোহাম্মদ
কবির ভাষায়ঃ

‘স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় রে
কে বাঁচিতে চায়
দাসত্ব শৃংখল বলো কে পরিবে পায় রে
কে পরিবে পায়।’
দাসত্বের শৃংখল ভেঙ্গেছে সাড়ে সাত কোটি বাঙালী। স্বাধীনতাবঞ্চিত জীবন থেকে তারা স্বাধীন জীবনের জয়যাত্রার পথে এগিয়ে চলেছে। এই এগিয়ে চলার পথ দুর্গম, দুর্বার। এই যাত্রাপথে কোনো শাসক-শোষকের দমননীতি, কোনো অশুভ শক্তির বিধিনিষেধ সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত জীবনজয়ের অভিযাত্রীদের কে বাধা দেবে? কে এই অভিযাত্রীদের পথ রোধ করে দাঁড়াবে? সেই সাধ্য কারুর নেই, সেই দুঃসাহস দেখাবার সকল ‘পশ্চিম পাকিস্তানী দাপট আজ ছিন্ন-ভিন্ন, পর্যুদস্ত।

ভাবতে অবাক লাগে, তেইশ-তেইশটি বছর কিভাবে সেই তথাকথিত পাকিস্তান সরকার বাংলার মাবোন, বাংলার শিশুবৃদ্ধ, বাংলার কৃষক-শ্রমিক, জেলে-তাঁতী কামার-কুমার-মেহনতি মানুষের ওপর অত্যাচারের ষ্টীম রোলার চালিয়েছে। আমার সন্তানের দুধ ওরা কেড়ে খেয়েছে, আমাদের ক্ষেতের ফসল ওরা লুটে নিয়েছে, ওরা আমাদের মা-বোনের ইজ্জত নষ্ট করেছে, তথাকথিত সংহতির ধুয়া তুলে ওরা আমাদের নিরীহ জনপদের ওপর শাসনের নামে চালিয়ে গেছে শোষণ।

বাংলার মানুষকে ওরা লাঞ্ছনা-গঞ্জনা আর অবহেলা দিয়ে দিয়ে নিজেদের জাতিগত দুশ্চরিত্রেরই পরিচয় দিয়েছে।

আজকের স্বাধীন বাংলার পথে-ঘাটে দেখতে পাওয়া যায় বীর জনতার গড়া স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ ব্যবস্থা। পশ্চিম পাকিস্তানী গুপ্তচর, বর্বর সৈন্যদের প্রত্যেক প্রবেশপথ আজ রুদ্ধ। ওদেরকে যেখানেই দেখা যাচ্ছে, স্বাধীন বাংলা মুক্তিবাহিনীর রাইফেল গর্জে উঠছে, এফোঁড়-ওফোঁড় করে চলে যাচ্ছে বুলেট- আজ ধরাশায়ী হচ্ছে এক-একটি হানাদার দুশমন। ওদের ক্ষমা নেই- ক্ষমা নেই। স্বাধীন বাংলার প্রতিটি গৃহ এক-একটি দুর্ভেদ্য দুর্গ। আমাদের মা-বোনেরাও আর নিক্রিয় হয়ে নেই। প্রত্যেকেই সশস্ত্র। দুশমনকে উচিত সাজা দেবার জন্যে নারী-পুরুষ শিশু-বৃদ্ধ সবাই সদা প্রস্তুত।

বাঙালী আজ জেগেছে। দাসত্বের শৃংখল ভেঙ্গে বেরিয়ে এসেছে তারা –

‘এবার বন্দী বুঝেছে,
মধুর প্রাণের চাইতে ত্রাণ
মুক্তকণ্ঠে স্বাধীন বিশ্বে
উঠিতেছে এক তান;

<005.002.013>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

জয় নিপীড়িত জনগণ জয়
জয় নব অভিযান
জয় নব উত্থান।’
জয় স্বাধীন বাংলা।
প্রচারঃ ২৮-৩-৭১
৩.

সাম্প্রদায়িকতাঃ সামন্তবাদ প্রসঙ্গ *
মোস্তফা আনোয়ার
সামন্তবাদ সভ্যতার ইতিহাসে একটি মৃত অধ্যায়। বাংলাদেশেও একদিন ছিলো সামন্ততন্ত্র ছিলো জমিদারের শাসন ও শোষণ। এই জমিদারদের ছিল দুর্দান্ত প্ৰতাপ। পরগাছার মত এই জমিদার-শ্রেণী বেঁচে ছিল লাঞ্ছিত-নিপীড়িত মানুষের রক্ত শোষণ করে। এই জমিদাররা নিজেরাই এক জাতি-নিজেরাই একটা শ্রেণী। এরা হিন্দুও নয়, মুসলমানও নয়। এরা রক্তপায়ী এক জীব। এরা দরিদ্র মুসলমান কৃষককে শোষণ করেছে-নিরন্ন হিন্দু কৃষককেও ক্ষমা করেনি। এদের রক্তলোলুপ থাবা থেকে কেউ-ই রেহাই পায়নি। সম্পর্কটি ছিলো জমিদার ও কৃষকের মধ্যে শোষক ও শোষিতের সম্পর্ক- হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্ক নয়। হিন্দু জমিদারের মধ্যে যেটা কাজ করেছে সেটা শ্রেণীস্বর্থ-জমিদাররূপে অত্যাচারিত কৃষকের রক্ত-পানের উদগ্র নেশা।

হিন্দু বা মুসলমান জমিদারদের অত্যাচারের এটাই বাস্তব চিত্র। শুধু বাংলাদেশে কেন সমগ্র বিশ্বে সামন্ততন্ত্রের এটাই আসল চেহারা। রাশিয়ায় বা আমেরিকায় এই সামন্ত প্ৰভুদের অত্যাচারের কাহিনী রক্তলেখায় লেখা আছে ইতহাসে ও সাহিত্যে।

(বিশ্বের প্রতিটি দেশে সাধারণ মানুষ অত্যাচারিত, লাঞ্ছিত, নিপীড়িত হয়েছে এই জমিদার শোষকগোষ্ঠী দ্বারা। কিন্তু এই অমানিশারও শেষ আছে। মানুষের মুক্তির সূর্যোদয় অবশ্যম্ভাবী। অত্যাচারিত মানুষ জেগেছে। ঘুম ভেঙ্গেছে দৈত্যপুরীর রাজকন্যার। অবশেষে কবর রচিত হয়েছে সামন্ততন্ত্রের। অত্যাচার আর নিপীড়নের হয়েছে অবসান। শোষণহীণ গণতান্ত্রিক সমাজ গঠন করেছে সংগ্রামী মানুষ।)

আমরা আগেই বলেছি, সামন্তবাদ বা জমিদারতন্ত্র সভ্যতার ইতিহাসে একটি মৃত অধ্যায়-যাদুঘরের সামগ্ৰী। যে জমিদার অত্যাচার করেছিলো, সে জমিদার শেষ হয়েছে। নিশ্চিহ্ন হয়েছে এই রক্তাপায়ী জোঁক শ্রেণী। ব্যাপারটি হচ্ছে শ্রেণী-সংঘর্ষের- হিন্দ-মুসলমানের নয়। বরং সর্বহারা কৃষকের জয় ঘোষিত হয়েছে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পত্তনের মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশের দরিদ্র কৃষকের দুঃখের অবসান হয়েছিল। বাংলার কৃষকের চোখে নেমেছিলো নতুন ফসলের আশা। বাংলার কৃষক দুর্ভিক্ষ দেখেছে। দেখেছে জলোচ্ছাসের ভীষণ তাণ্ডবলীলা, দেখেছে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণির বিধ্বংসকে। তবু সে বুক বেঁধে দাঁড়িয়েছে প্রতিবার। পদ্মাপারের মানুষ ধ্বংসকে ভয় করে না, তার হাতে আছে দুর্জয় সৃষ্টির মন্ত্র।

কিন্তু এতবড় দুর্যোগ কি কেউ কোনোদিনও দেখেছে? নিজের দেশে, নিজের ঘামঝরানো পয়সায় কেনা গুলি এসে বিধে নিজেরই বুকে। কারা চালালো গুলি? হিন্দু জমিদার-নাকি সেই দস্যু বর্বর পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদার?

চট্টগ্রাম সীমান্তবর্তী মুক্তাঞ্চলে দ্বিতীয় পর্যায়ে স্থাপিত বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত

<005.002.014>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

কারা পুড়িয়ে দিলো কৃষকের সাজানো সবুজ ক্ষেতকে- কারা কামান ও গোলায় গুড়িয়ে দিলো কৃষকের কুটির- কারা কেড়ে নিলো নবান্নের উৎসব- কারা, কারা, তারা কারা?
ইতিহাসের কবর থেকে উঠিয়ে আনা হচ্ছে জমিদারকে । জমিদার তো অত্যাচার করাই ছিল আর তার শাস্তিও পেয়েছে গণ-মানুষের হাতে। কিন্তু তোমাদের শাস্তির দিনও যে দ্রুত ঘনিয়ে আসছে- তা কি জানো?
তোমরা কি ভেবেছ জমিদার ও কৃষকের শ্রেণী-সংঘাতের ইতিহাসটি মুছে দিয়ে আজকের জাগ্রত শ্রেণীসচেতন মানুষকে সাম্প্রদায়িতার ভাঁওতায় ভোলাতে পারবে? ইতিহাসের ভুল ব্যাখ্যা করে দাঙ্গাবাজ রাজনীতি এদেশের মাটিতে আজ অচল।
আজ প্রতিটি বাঙালী জানে, এ যুদ্ধ তার বাঁচার জন্য। এ যুদ্ধ তার চিরদাসত্বের নিগড় থেকে মুক্তির জন্য। বাঙালীর মুক্তিযুদ্ধকে তাই ইতিহাসের কবরে পচে যাওয়া সাম্প্রদায়িকতার বিষে ঘুলিয়ে দেওয়া যাবে না।
তথাকথিত পাকিস্তান আর নেই। পাকিস্তানের নিশান আমরা পুড়িয়ে ভস্মীভূত করেছি। আমরা উড়িয়েছি আমাদের বুকের রক্তে রাঙানো স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। রক্তে আমাদের স্বাধীনতার আগুন গদগদ করছে। চোখে আমাদের প্রতিশোধের দাবাগ্নি দাউ দাউ করে জ্বলছে। মুখে আমাদের স্বাধীনতার বাণী চৌচির করে ফেটে পড়েছে শত-কোটি কণ্ঠে ।
এই মহান বিপ্লবকে বিভ্রান্ত করার জন্য ওরা তাই উঠে-পড়ে লেগেছে। কিন্তু ওদের রসদ কই? হ্যাঁ, আছে বস্তাপচা রাজনীতি- হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা-বাধানোর অপচেষ্টা। বুকে বেপরোয়া গুলি চালিয়ে সমস্ত বাঙালী জাতিটাকে পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার হীন-ষড়যন্ত্রে মেতে, অখণ্ডতার প্রলেপ মাখানো আর ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী ভূত দেখানোতে ।
এক কথায়, দাঙ্গাবাজি, লুটতরাজ, নারী-হরণ প্রভৃতি অসামাজিক পৈশাচিক নারকীয় পশুত্বের রাজত্ব সৃষ্টি করতে চায় ওরা লক্ষ শহীদের রক্তভেজা বাংলার মাটিতে। যে জাতি সূৰ্যতেজে জেগে উঠেছে সে কি অন্য কোন রাষ্ট্রের কাছে দাসত্বের জন্য হার মানে? অদ্ভুত ওদের রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ। অদ্ভুত ওদের ইতিহাসের ব্যাখ্যা। অদ্ভুত ওদের বেপরোয়া গণ-হত্যার নজির।
দাঙ্গাবাজি কলা-কৌশল আর চলচে না। লাঞ্ছিত নিপীড়িত দরিদ্র বাঙালী গণ-মানুষ ওদের কলঙ্কিত রাজনীতির মুখোশ উন্মোচিত করেছে। ওদের নগ্ন আসল রূপটি অতি দুর্ভাগ্যের রাত্রে আমরা দেখে ফেলেছি। পশুও বুঝি এত নগ্ন নয়- এত বিশ্রী, এত কুৎসিৎ এত বীভৎস নয়।
ওরা মানুষ হত্যা করেছে- আসুন আমরা পশু হত্যা করি।
জয় বাংলা।

প্রচারঃ ২১-8-৭১

<005.003.015>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩৷ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র
(মুজিব নগর) এর অনুষ্ঠানপত্র গুচ্ছ
(অংশ) স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র-এর
দলিলপত্র
২৫ মে-১৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১

আজ মঙ্গলবার, ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩৭৮
২৫ মে ১৯৭১ সাল

(Signature Tune)

7-00Α.Μ আসসালামো আলায়কুম। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি জনগণকে শুভেচ্ছা জানিয়ে আমাদের প্রথম অধিবেশন শুরু করছি। মিটারে… কিঃ সাঃ এ। অধিবেশনের প্রথমে
7-10 ” শুনুন তেলাওয়াতে কালামে পাক ও তার বাংলা তরজমা। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। আমাদের অনুষ্ঠান সম্পর্কে একটি ঘোষণা। আজ থেকে সকাল ৭টা ও সন্ধ্যে ৭টায় দুটি অধিবেশনেস্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান প্রচারিত হবে। আজকের প্রথম অধিবেশনের অনুষ্ঠানঃ
* বাঙলা খবর প্রচারিত হবে সকাল সোয়া সাতটায়।
* ইংরেজী খবর শুনতে পাবেন মিনিটে।
* “চরমপত্র’ শুনতে পাবেন সকাল ৭টা বেজে …..মিনিটে।
* বঙ্গবন্ধুর বাণী থেকে পাঠ শুনতে পাবেন সকাল সাতটা বেজে চল্লিশ মিনিটে।
* জাগরণীঃ দেশাত্মবোধক গান শুনবেন সকাল পৌনে আটটায়।

আজকের প্রথম অধীবেশনের অনুষ্ঠান সূচি শুনলেন। স্বাধীন বাঙলা বেতার কেন্দ্র থেকে…মিটারে। কিছুক্ষণের মধ্যেই খবর শুনতে পাবেন-প্রথমে বাংলা পরে ইংরেজীতে।
7–15A.M (News in Bengali)
7-25 “ (News in English)
7–30 “ সকাল সাড়ে সাতটা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। আজ এগারই জ্যৈষ্ঠ। বিদ্রোহী কবি নিপীড়িত জনগণের কবি কাজী নজরুল
7–40 “ ইসলামের জন্মদিন। এ উপলক্ষে এখন কবি রচিত কবিতা থেকে আবৃতি ও গান শুনুন অগ্নিশিখা অনুষ্ঠানে।
Slogans & Sayings of SK. Mujib.
SWADHIN BANGLA BETAR KENDRA
(Cue Sheet)
Trans-I
Date: 26-5-71
6–57 P.M.
Signature Tune Opening of the station &
7–00 ” Programme Summary.
AGNISHIKHA : A
Composite Programme for the freedom fighters. (a)Message from

<005.003.016>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
খ) “দুর্গম গিরি কান্তার মরু”- নজরুল সঙ্গীত রাত ৭:৫০ চরমপত্রঃ শ্রব্য অনুষ্ঠান

গ) এগিয়ে চলো- অনুপ্রেরণার বাণী রাত ৭ টা ৫৫- ৮ টা পর্যন্ত বিশ্ব জনমত- বাঙালি কথন

ঘ) বিশেষ সংবাদ বুলেটিন সমাপ্তি ঘোষণা

ঙ) দেশাত্মবোধক গান ৩০ মে, ১৯৭১

সন্ধ্যা ৭টা ২০ চরমপত্র- সন্ধ্যা ৬টা ৫৮ সুরসংকেত

সন্ধ্যা ৭টা ৩০ বিরুদ্ধানুস্ঠান সন্ধ্যা ৬টা ৫৯ স্টেশনের কার্যক্রম শুরু

সন্ধ্যা ৭টা ৪০ বাংলা সংবাদ সন্ধ্যা ৭টা অগ্নিশিখা- মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সংযুক্ত অনুষ্ঠান

সন্ধ্যা ৭টা ৪৫ ইংরেজি সংবাদ ক) দর্পণ- বাংলায় কথন

রাত ৮টা ১৫ অগ্নিবীণা- কবি নজরুল ইসলামের খ) ঐকতান- দেশাত্মবোধক গান
জন্মদিবস উপলক্ষে গ) আবৃত্তি
বিশেষ অনুষ্ঠান। ঘ) রণভেরি- বিভিন্ন সেক্টর থেকে প্রতিবেদন
রাত ৮টা ২০ জাতীয় নেতাদের সন্ধ্যা ৭টা ২০ ঙ) দেশাত্মবোধক গান
স্লোগান ও বক্তব্য
রাত ৮টা ৩০ আলোর দিগন্ত- বাংলা কথন

২৭ শে মে, ১৯৭১

সন্ধ্যা ৬টা ৫৯ সঙ্গিতাংশ, সমাপ্তি ঘোষণা সন্ধ্যা ৭টা ৩০ ইংরেজি সংবাদ

সন্ধ্যা ৭টা স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধীনতা

সুরসংকেত স্টেশনের কার্যক্রম বাংলা কথন
শুরু এবং অনুষ্ঠানসূচি সন্ধ্যা ৭টা ৪০ জনাব এ মন্নান, এমএনএ
রক্তস্বাক্ষর-
অগ্নিশিখা- মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সংযুক্ত অনুষ্ঠান সন্ধ্যা ৭টা ৪৫ স্বরচিত কবিতা,
ক) বেলাল মোহাম্মদ
ক) দর্পণ- বাংলায় কথন সন্ধ্যা ৭টা ৫৫ খ) এস আই নূর
বাংলা সংবাদ, সাময়িকী- সংবাদ
খ) ঐকতান- দেশাত্মবোধক গান রাত ৮টা বাংলায় ভাষ্য
রাত ৮টা ৫ লোকসঙ্গীত- শাহ্‌ আলী সরকার
গ) কবিকন্ঠ-
স্বরচিত কবিতা রাত ৮টা ১৫ বাঙালি জবাব দাও- বাংলা কথন
ঘ) রণভেরি- বিভিন্ন সেক্টর থেকে প্রতিবেদন রাত ৮টা ২৫ দেশাত্মবোধক গান
সন্ধ্যা ৭টা ২০ ঙ) দেশাত্মবোধক গান বিশ্ব জনমত
সন্ধ্যা ৭টা ৩০ বাংলা কথন রাত ৮টা ৩৫ চরমপত্র-
সন্ধ্যা ৭টা ৪০ বাংলা সংবাদ রাত ৮টা ৪০ বিরুদ্ধানুস্ঠান
সন্ধ্যা ৭টা ৪৫ ইংরেজি সংবাদ স্লোগান ও দেশাত্মবোধক গান
রক্তস্বাক্ষর সমাপ্তি ঘোষণা
.
.
স্বরচিত কবিতা ও
দেশাত্মবোধক গান

<005.003.017>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

৩১ মে, ১৯৭১ (চ) সঙ্গীত
দ্বিতীয় অধিবেশন : ৭-৩০ মিঃ বাংলা সংবাদ
৬-৫৯ মিঃ সূচকধ্বনি ও উদ্বোধনী ঘোষণা ৭-৪৫ ’’ সাময়িকী/কথিকা
৭-০০ ” অগ্নিশিখাঃ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ৭-৫০ ’’ ইংরেজী খবর
বিশেষ অনুষ্ঠান ৭-৫৭ ’’ বজ্রকণ্ঠ
(ক) দৰ্পণঃ বাংলা কথিকা ৮-০০ ’’ সঙ্গীত
(খ)জাগৃতিঃদেশাত্মবোধক গান ৮-১৫ ’’ … …
(গ)আবৃত্তি ৮-৩০ ’’ জাগ্রত বাংলা
(ঘ) রণভেরীঃ যুদ্ধের খবর ৮-৪০ ’’ চরমপত্র
(ঙ)বজ্রকণ্ঠঃ শেখ মুজিবেরবাণী ৮-৪৭ ’’ বিশ্বজনমত
(চ) দেশাত্মাবোধক গান ৮-৫১ ” রক্তস্বাক্ষরঃ ৭ই জুন (ক) কথিকা-
৭-২০ ’’ ইংরেজী সংবাদ শহিদুল ইসলাম
৭-৩০ ’’ বিশ্বজনমত (খ) কবিতা
৭-৩৫ ’’ পল্লীগীতিঃ শাহ আলী সরকার ৮-৫৫’’ সমাপ্তি
৭-৪০ ’’ রক্তস্বাক্ষরঃস্বরচিত কবিতা পাঠ ১৯ জুন, ১৯৭১
(ক) বেলাল মুহম্মদ সন্ধ্যাঃ
(খ) শিকদার ইবনে নূর ৭-০০ মিঃ উদ্বোধনী ঘোষণা ও অনুষ্ঠান

৭-৪৫ ’’ বাংলা সংবাদ পরিচিতি।
৭-৫৫ ” দেশাত্মবোধক গান ও বিশেষ ৭-০৫ ’’ অগ্নিশিখাঃ
ঘোষণা (ক) দর্পণঃ ইসলাম ও
৮-০৫ ” যন্ত্রসঙ্গীত পকিস্তানের রাজনীতিঃ কথিকা
৮-১৫ ” বজ্রকণ্ঠ ও দেশাত্মবোধক গান -কামাল মাহবুব
৮-২০ ” চরমপত্র (খ) সঙ্গীত
৮-৩০ ’’ সমাপ্তি। (গ) সংবাদ
৭ জুন, ১৯৭১ (ঘ) আবৃত্তি
দ্বিতীয় অধিবেশন (ঙ) বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশ
৬-৫৯ মিঃ পরিচিত সুর ৭-২৫ ’’ বিশ্বজনমত
৭-০০ ’’ উদ্বোধনী ঘোষণা ৭-৩১ ’’ সঙ্গীত
৭-০৫ ’’ অনুষ্ঠান পরিচিতি। ৭-৪০ ’’ দৃষ্টিপাতঃ কথিকা-ডঃ মজহারুল
৭-১০ ’’ অগ্নিশিখা। ইসলাম
(ক) দর্পণঃ বাদশা ৭-৪৫ ’’ বাংলা সংবাদঃ পড়বেন
(খ) সংগীত কামাল লোহানী।
(গ) আবৃত্তিঃ নূরে আলম ৭-৫৫ ’’ বজ্রকণ্ঠ
(ঘ) সংবাদ বুলেটিনঃ ৮-০০ ’’ ইংরেজী অনুষ্ঠান।
কামাল লোহানী ৮-২৫ ’’ স্লোগান ও সঙ্গীত
(ঙ) নির্দেশাবলী

<005.003.018>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

৮-৩০ মিঃ চরমপত্র ৭-৪০ মিঃ ত্রিপিটক/কথিকা অথবা আবৃত্তি
৮-৪০ ’’ সঙ্গীত ৭-৪৫ ” বিশ্বজন্মত
৮-৪৫ ’’ রক্তস্বাক্ষর ৭-৫০ ” বজ্রকণ্ঠ ও স্লোগান
(ক) শহীদ মিনারঃ ৭-৫৩ ” চরমপত্র
আলেখ্য-মোস্তফা আনোয়ার ৮-০০ ” জয় বাংলা।
৯-০০ ’’ জয় বাংলা ।
২৭ জুন, ১৯৭১
সন্ধ্যাঃ সন্ধ্যাঃ
৭-০০ মিঃ উদ্বোধনী ও অনুষ্ঠান পরিচিতি ৭-০০ মিঃ উদ্বোধনী অনুষ্ঠান পরিচিতি।
৭-০৫ ” অগ্নিশিখাঃ ৭-০৫ ” অগ্নিশিখাঃ
(ক) দর্পণ (ক) দর্পণ
(খ) সঙ্গীত (খ) সঙ্গীত
(গ) আবৃত্তি (গ) আবৃত্তি
(ঘ) রণভেরীঃ সংবাদ বুলেটিন (ঘ) রণভেরীঃ সংবাদ বুলেটিন
(ঙ) বাংলাদেশ সরকারের (ঙ) বাংলাদেশ সরকারের
নির্দেশ নির্দেশাবলী
৭-২৫ ” বিশ্বজনমতঃ পর্যালোচনা ৭-২৫ ” বিশ্ব জনমতঃ পর্যালোচনা
৭-৩০ ” সঙ্গীত আমিনুল হক বাদশা
৭-৩৫ ” দৃষ্টিপাতঃ ৭-৩০ ” সঙ্গীত
অধ্যাপক আবদুল হাফিজ ৭-৩৫ ” দৃষ্টিপাতঃ কথিকা
৭-৪০ ” সঙ্গীত অধ্যাপক আবদুল হাফিজ
৭-৪৫ ” বাংলা সংবাদ, সঙ্গীত ও ৭-৪০ ” সঙ্গীত
স্লোগান ৭-৪৫ ” বাংলা সংবাদ
৮-০০ ” ইংরেজী অনুষ্ঠান ৮-০০ ” ইংরেজী অনুষ্ঠান
৮-২৫ ” বজ্রকণ্ঠ ও স্লোগান ৮-২৫ ” বজ্রকণ্ঠ ও স্লোগান
৮-৩০ ” চরমপত্র ৮-৩০ ” চরমপত্র
৮-৪০ ” ইসলামের দৃষ্টিতেঃ ৮-৩৫ ” সঙ্গীত
সৈয়দ আলী আহসান। ৮-৪০ ’’ রক্তস্বাক্ষরঃ ষড়যন্ত্রের অন্তরালেঃ
৯-০০ ” জয় বাংলা পাকিস্তানের কবর রচনার জন্য
৩০ জুন, ১৯৭১ দায়ী কে?- অধ্যাপক অসিত রায়
সকালঃ চৌধুরী।
৭-০০ মিঃ (ক) উদ্বোধনী ৮-৪০ ” স্লোগান ও সঙ্গীত
(খ) কোরান তেলাওয়াত ৯-০০ ” জয় বাংলা।
৭-১০ ” (ক) অনুষ্ঠান সূচী
(খ) বাংলা সংবাদ ৫ জুলাই,১৯৭১
(গ) ইংরেজী সংবাদ সকালঃ
৭-৩০ ” জাগরণীঃ সঙ্গীতানুষ্ঠান ৭-০০ মিঃ (ক) উদ্বোধনী
” (খ) কোরান তেলাওয়াত

<005.003.019>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
৭-১০ মিঃ (ক) অনুষ্ঠান সূচী ৮-৩০ মিঃ চরমপত্রঃ কথিকা-এম, আর,
(খ) বাংলা সংবাদ আখতার।
(গ) ইংরেজী সংবাদ ৮-৩৫ ” সঙ্গীত
৭-৩০” জাগরণীঃ সঙ্গীতানুষ্ঠান ৮-৪০ ” রক্তস্বাক্ষর
৭-৪০” আবৃত্তি ৮-৪৫ ” সঙ্গীত
৭-৪৫” বিশ্বজনমত ৮-৫০ ” ইসলামের দৃষ্টিতে
৭-৫০” বজ্ৰকণ্ঠ ও স্লোগান সৈয়দ আলী আহসান
৭-৫৩” চরমপত্র ৮-৫৫ ” স্লোগান ও দেশাত্মবোধক গান
৮-০০” জয় বাংলা ৯-০০” জয় বাংলা।
১০জুলাই, ১৯৭১
সন্ধ্যাঃ সকালঃ
৭-০০ মিঃ উদ্বোধনী ও অনুষ্ঠান পরিচিতি
৭-০৫ ” অগ্নিশিখাঃ ৭-০০ মিঃ (ক) উদ্বোধনী
(ক) দৰ্পণঃ আজকের মুক্তিযুদ্ধঃ (খ) কোরান তেলাওয়াত
সূর্যসেনের স্মৃতি-কথিকাঃ ৭-১০ ” (ক) অনুষ্ঠান
রণেশ দাশগুপ্ত পরিচিতি (খ) বাংলা সংবাদঃ
(খ) সঙ্গীত আলী রেজা চৌধুরী
(গ) আবৃত্তি (গ) ইংরেজী সংবাদঃ
(ঘ) সংবাদ বুলেটিন পারভীন হোসেন
(ঙ) বাংলাদেশ সরকারের ৭-৩০ ” জাগরণীঃ সঙ্গীতানুষ্ঠান
নির্দেশাবলী ৭-৪৫ ” বিশ্ব জনমতঃ আমিনুল হক
৭-২৫ ” বিশ্ব জনমতঃ আমিনুল হক বাদশা
বাদশা ৭-৫০ ” বজ্রকণ্ঠ
৭-৩০ ” সঙ্গীত ৭-৫৩ ” চরমপত্রঃ এম আর আখতার
৭-৩৫” দৃষ্টিপাতঃ কথিকা (পুনঃপ্রচার)
অধ্যাপক আবদুল হাফিজ ৮-০০ ” জয় বাংলা।
৭-৪০ ” সঙ্গীত
৭-৪৫” বাংলা সংবাদঃ সালেহ আহমদ
৮-০০” ইংরেজী অনুষ্ঠানঃ সন্ধ্যাঃ
পরিচালনা-আলমগীর কবীর ৭-০০ মিঃ উদ্বোধনী ও অনুষ্ঠান পরিচিতি
৭-০৫ ” অগ্নিশিখা
(ক) …… (ক) দর্পণ
(খ) বিভিন্ন বিদেশী সংবাদপত্রের (খ) সঙ্গীত
উদ্ধৃতিঃ আলী জাকের (গ) আবৃত্তি
(গ) গান (ঘ) সংবাদ বুলেটিনঃ মনজুর
ইংরেজী সংবাদঃ পারভীন কাদের
হোসেন ৭-২৫ ” বিশ্ব জনমতঃ আমিনুল হক
৮-২৫” বজ্ৰকণ্ঠ বাদশা
৭-৩০ ” সঙ্গীত

<005.003.020>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

৭-৩৫ মিঃ দৃষ্টিপাতঃ জামিল শরাফী ৭-৪০ সঙ্গীত
৭-৪০” মিঃ সঙ্গীত ৭-৪৫” বাংলা সংবাদঃ সালেহ আহমদ
৭-৪৫” বাংলা সংবাদঃ সালেহ আহমদ ৮-০০ ” ইংরেজী অনুষ্ঠানঃ
৮-০০” ইংরেজী অনুষ্ঠানঃ পরিচালনা- পরিচালনা- আলমগীর কবীর
আলমগীর কবীর (ক) বিদেশী সংবাদপত্রের
(ক) বিদেশী সংবাদপত্রের মন্তব্য
উদ্ধৃতি (খ) পর্যালোচনা
(খ) পর্যালোচনা (গ) সঙ্গীত
(গ) ইংরেজী সংবাদঃ (ঘ) ইংরেজী সংবাদঃ পারভীন
পারভীন হোসেন হোসেন
(ঘ) সঙ্গীত ৮-২৫ ” উর্দু সংবাদঃ শহীদুল হক
৮-২৫” সাম্প্রদায়িকতার উপর উর্দু ৮-৩০ ” চরমপত্রঃ এম আর, আখতার
কথিকা-শহীদুর রহমান ৮-৩৫” সঙ্গীত
৮-৩০” দেশবাসীর উদ্দেশে অর্থমন্ত্রী ৮-৪০ ” মানবতার নামেঃ কথিকাঃ
এম মনসুর আলীর ভাষণ আবু মাসুদ
৮-৪০” দেশাত্মবোধক গান ৮-৪৫” বজ্রকণ্ঠ, স্লোগান ও সঙ্গীত
৮-৪৫” চরমপত্রঃ এম আর আখতার ৯-০০” জয় বাংলা
৮-৫০” বজ্রকণ্ঠ
৮-৫২” স্লোগান ও সঙ্গীত
৯-০০” জয় বাংলা। ২৭ জুলাই, ১৯১৭
সকালঃ
২৩ জুলাই, ১৯১৭
সন্ধ্যাঃ উদ্বোধনী ও অনুষ্ঠান পরিচিতি
৭-০০ মিঃ অগ্নিশিখাঃ
৭-০০ মিঃ উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ও পরিচিতি ৭-০৫ ” (ক) দর্পণ
৭-০৫” অগ্নিশিখাঃ (খ) সঙ্গীত
(ক) দর্পণ (গ) আবৃত্তি
(খ) সঙ্গীত (ঘ) সংবাদ বুলেটিনঃ
(গ) আবৃত্তি শহীদুল ইসলাম
(ঘ) সংবাদ বুলেটিন (ক) আমাদের সংগ্রামঃ
শহীদুল ইসলাম ৭-২০” আবু শহিদ
৭-২০ মিঃ সংবাদ পর্যালোচনাঃ (খ) স্লোগান ও সঙ্গীত
আমীর হোসেন দৃষ্টিপাতঃ
৭-২৫” আলাপনঃ শ্রোতাদের চিঠির ৭-৩৫” অধ্যাপক আবদুল হাফিজ
জবাব সঙ্গীত
৭-৩০” সঙ্গীত ৭-৪০” বাংলা সংবাদঃ সালেহ আহমদ
৭-৩৫” দৃষ্টিপাতঃ ৭-৪৫” ইংরেজী অনুষ্ঠানঃ
অধ্যাপক আবদুল হাফিজ ৮-০০” (ক) বিদেশী সংবাদপত্রের
মন্তব্য

<005.003.021>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
(খ) পর্যালোচনা লিখিত-সলিমুল্লা, পড়বেন-
(গ) সঙ্গীত মোস্তফা আনোয়ার
(ঘ) ইংরেজী সংবাদঃ ৮-৪৫” বজ্রকণ্ঠ ও স্লোগান
পারভীন হোসেন ৮-৪৭” জল্লাদের দরবার
৮-২৫” উর্দু সংবাদঃ শহীদুল হক ৯-০০ জয় বাংলা।
৮-৩০” স্লোগান ও সঙ্গীত
৮-৩৫” শেখ মুজিবের বিচার প্রহসনঃ ২৮আগষ্ট, ১৯৭১
আহমদ রফিক দ্বিতীয়
৮-৪৪” বজ্রকণ্ঠ, স্লোগান ও সঙ্গীত অধিবেশনঃ (ক) উদ্বোধনী ঘোষণা ও
৮-৫৩” চরমপত্র ; এম, আর, আখতার ১-০০” অনুষ্ঠানসূচী
৯-০০” জয় বাংলা । (খ) বাংলা খবর
(গ) ইংরেজী খবর
১৮ আগস্ট ১-১৫” সঙ্গীতানুষ্ঠান/পল্লীঃ
১৯৭১ ১। শেখ মুজিব সত্যযুগের….
সন্ধ্যাঃ ২। মুজিব বাইয়া …
৩। ওরা কোথায় ….
৭-০০ মিঃ উদ্বোধনী ও অনুষ্ঠান পরিচিতি ১-৩০” বিশ্ব জনমত
অগ্নিশিখা ১–৩৫ ” রবীন্দ্র সঙ্গীতঃ
৭-০৫” (ক) দর্পণঃ আশরাফুল আলম ১-৪৫ ” রক্তস্বাক্ষরঃ আশরাফুল আলম।
ও মোস্তফা আনোয়ার ১-৫০” পুঁথিপাঠঃ মোহাম্মদ শাহ বাঙালী
(খ) সঙ্গীত ২-০০” জয় বাংলা।
(গ) আবৃত্তি
(ঘ) সংবাদ বুলেটিন
সংবাদ পর্যালোচনাঃ তৃতীয় অধিবেশনঃ
৭-২৫” আমির হোসেন সন্ধ্যা
৭-৩০” সঙ্গীত ৭-০০ মিঃ
৭-৩৫” পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতেঃ ৭-০০ ” উদ্বোধনী ঘোষণা ও অনুষ্ঠানসূচী
কামাল লোহানী অগ্নিশিখাঃ পরিচালকঃ
৭-৪৫” বাংলা সংবাদ আশরাফুল আলম
৮-০০” ইংরেজি অনুষ্ঠান (ক) সংবাদ বুলেটিনঃ
পরিচালনা আলমগীর কবির মঞ্জুর কাদের
(ক) বিদেশী সংবাদপত্রের (খ) সঙ্গীতঃ সঙ্গীতঃ বীর বাঙালী অস্ত্র
পর্যালোচনা ধর
(খ) সঙ্গীতঃ (গ) দর্পণঃ আশরাফুল
৮-২৫” (গ) ইংরেজি সংবাদ (ঘ) আবৃত্তিঃ কামাল লোহানী
৮-৩০” উর্দু সংবাদ (ঙ) পুথিপাঠঃ
৮-৩৫” সঙ্গীতঃ মোহাম্মদ শাহ বাঙালী
(চ) মুক্তিযোদ্ধার ডায়েরী থেকেঃ
মোস্তফা আনোয়ার
(ছ) আমার সোনার বাংলা

<005.003.022>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

৭-৪৫ মিঃ বাংলা খবরঃ আলী রেজা ৮-৩০” উর্দু কথিকা
চৌধুরী ৮-৩৫” রবীন্দ্র সঙ্গীত
৭-৫৫” সংবাদবাদ পর্যালোচনাঃ শহীদুল ৮-৪০” সোনার বাংলা/পল্লীগীতি
ইসলাম ৯-০০” আমাদের মুক্তি সংগ্রাম ও
৮-০০” ইংরেজী অনুষ্ঠান মহিলাঃ মেহের খোন্দকার
(ক) পর্যালোচনা ৯-০৭” সঙ্গীত
(খ) উদ্ধৃতি ৯-১৭” বজ্ৰকণ্ঠ ও স্লোগান
(গ) সঙ্গীতঃ দুর্জয় বাংলা’ ৯-২০” চরমপত্র
(ঘ) খবর ৯-৩০” সমাপ্তি।
৮-২৫ ” উর্দু খবর ২০সেপ্টেম্বর,১৯৭১
৮-৩০” ‘সোনার বাংলা: গ্রামীণ শ্রোতাদের জন্যে অনুষ্ঠান প্রথম অধিবেশনঃ
৮-৪৫” পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে ৭-০০ মিঃ (ক) উদ্বোধনী ঘোষনা
৮-৫২” বজ্ৰকণ্ঠ ও স্লোগান (খ) তেলাওয়াত
৮-৫৫ ” চরম পত্র (গ) অনুষ্ঠান পরিচি
৯-০০ ” জয় বাংলা। (ক) খবরঃ বাংলা
(খ) খবরঃ ইংরেজী
১৬ সেপ্টেম্বর, ৭-৩০” জাগরনী সঙ্গীতানুষ্ঠান
১৯৭১ ৭-৪৫” ‘রুস্তমের মা আমার মা”:
তৃতীয় অধিবেশনঃ কথিকাঃ কামাল লোহানী
সন্ধ্যা (পুনঃপ্রচার)
৭-০০ মিঃ উদ্বোধনী ঘোষণা ও অনুষ্ঠান ৭-৫৫” বজ্রকণ্ঠ ও স্লোগান
পরিচিতি ৮-০০” সমাপ্তি।
৭-০৫” অগ্নিশিখা
(ক) সংবাদ বুলেটিন
(খ) সঙ্গীত
(গ) দর্পণঃ রণজিৎ তৃতীয় অধিবেশনঃ
(ঘ) আবৃত্তি সন্ধ্যাঃ উদ্বোধনী ঘোষণা ও অনুষ্ঠান
(ঙ) সঙ্গীত পরিচিতি
(চ)মুক্তিযোদ্ধার ডায়েরী ৭-০০” অগ্নিশিখা
থেকেঃ (ক) সংবাদ বুলেটিনঃ
মোস্তফা আনোয়ার ৭-০৫” (খ) সঙ্গীত
(ছ) আমার সোনার বাংলা (গ) দর্পণঃ মোস্তফা আনোয়ার
৭-৪৫” খবরঃ বাংলা (ঘ) সঙ্গীত
৭-৫৫” সংবাদ পর্যালোচনা (ঙ) বাংলার মুখঃ জীবন্তিকা
৮-০০” ইংরেজী অনুষ্ঠান (চ) আমার সোনার বাংলা
সঙ্গীত… … ৭-৪৫” খবরঃ বাংলা
খবরঃ ইংরেজী
৮-২৫ ” খবরঃ উর্দু

<005.003.023>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

৭-৫৫ মিঃ সংবাদ পর্যালোচনা ৮-২৫ মিঃ খবরঃ উর্দু
৮-০০” ইংরেজী অনুষ্ঠান ৮-৩০” (ক) আমাদের মুক্তি সংগ্রাম ও
(ক) পর্যালোচনা মহিলাঃ বেগম উম্মে কুলসুম
(খ) ডাইরি (খ) রবীন্দ্র সঙ্গীত
(গ) সঙ্গীত ৮-৫০” সোনার বাংলা
(ঘ) খবর (ক) কথোপকথন
৮-২৫ ” খবরঃ উর্দু (খ) পল্লীগীতি
৮-৩০” রবীন্দ্র সঙ্গীত ৯-০০” পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে
৮-৪০” সোনার বাংলা ৯-০৭ ” সঙ্গীত
৯-০০” কথিকা ৯-১৭” বজ্রকণ্ঠ ও স্লোগান
৯-০৭” সঙ্গীত ৯-২০” চরমপত্র
৯-১৭ ” বজ্রকণ্ঠ ও স্লোগান ৯-৩০ ” সমাপ্তি।
৯-২০” চরম পত্র ২৪সেপ্টেম্বর,১৯৭১
৯-৩০” সমাপ্তি। তৃতীয় অধিবেশনঃ
সন্ধ্যা
২১ সেপ্টেম্বর,১৯১৭ ৭-০০ মিঃ উদ্বোধনী ঘোষণা ও অনুষ্ঠান
তৃতীয় অধিবেশনঃ পরিচিতি
সন্ধ্যা ৭-০৫” অগ্নিশিখা
(ক) সংবাদ বুলেটিন
৭-০০” উদ্বোধনী ঘোষণা ও অনুষ্ঠান (খ) সঙ্গীত
পরিচিতি (গ) দর্পণ
৭-০৫” অগ্নিশিখা (ঘ) আবৃত্তি
(ক) সংবাদ বুলেটিন (ঙ) সঙ্গীত (২টি)
(খ) সঙ্গীত (চ) আমরা গেরিলা (৩)
(গ) দর্পণ (ছ) আমার সোনার বাংলা
(ঘ) আবৃত্তি ৭-৪৫” খবরঃ বাংলা
(ঙ) সঙ্গীত (২টি) ৭-৫৫” সংবাদ পর্যালোচনা
(চ) আমরা গেরিলা (২) ৮-০০” ইংরেজী অনুষ্ঠান
(ছ) আমার সোনার বাংলা (ক) পর্যালোচনা
৭-৪৫” খবরঃ বাংলা (খ) উদ্ধৃতি
৭-৫৫” সংবাদ পর্যালোচনা (গ) সঙ্গীত
৮-০০” ইংরেজী অনুষ্ঠান (ঘ) খবর
(ক) পর্যালোচনা ৮-২৫ ” খবরঃ উর্দু
(খ) উদ্ধৃতি ৮-৩০” (ক) ইয়াহিয়া জবাব দাও
(গ) সঙ্গীত (১): শওকত ওসমান
(ঘ) খবর (খ) সঙ্গীত

<005.003.024>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

৮-৪০ মিঃ সোনার বাংলা
(ক) কথোপকথন
(খ) পল্লীগীতি
৯-০০ ” পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে
৯-০৭ ” সঙ্গীত
৯-১৫ ” বজ্রগকণ্ঠ ও স্লোগান
৯-২০ ” সমাপ্তি

আজ ২৫ শে সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ সাল। বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি মানুষের মুক্তি, অধিকার ও স্বাধীনতা সংগ্রামের আজ ছ’মাস পূর্ণ হলো ।

ছ’মাস আগে ২৫ শে মার্চের কাল রাতে জঙ্গী বাংলার নিরীহ নিরস্ত্র জনসাধারণের উপর। লক্ষ লক্ষ নারী-পুরুষ আর শিশু হত্যার এক কলঙ্কিত ইতিহাস রচনা করে জঙ্গীশাহী সমগ্র বিশ্ববাসীকেও স্তম্ভিত করে দিয়েছে। কিন্তু বর্বর বাহিনীর নৃশংসতার জবাব দিতে বাংলার ছাত্র, যুবক, ই পি আর, আসনার আর এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী মুক্তিবাহিনী। প্রতি রণাঙ্গণে তারা প্রচণ্ড আঘাত হেনে চলেছেন শত্রুবাহিনীর উপর। চূড়ান্ত বিজয় এখন সন্নিকটে।

সোনার বাংলার সোনালী আকাশ, রূপালী নদী বীর মুক্তিযোদ্ধা শক্রহননের দৃঢ়প্রত্যয়ে আত্মোৎসর্গ জানিয়ে এবং চূড়ান্ত বিজয়ের দুর্বার শপথে যাঁরা অবিরাম যুদ্ধ করে চলেছেন তাদেরকে সংগ্রামী অধিবেশন শুরু করছি।

বাংলাদেশের মাটি থেকে হানাদারদের চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার এ মরণজয়ী সংগ্রামে যারা শহীদ হয়েছেন এবং যারা অপ্রতিরোধ্য শক্তি নিয়ে অবিরাম যুদ্ধ করে চলেছেন তাদেরকে সংগ্রামী সালাম জানিয়ে আজকের অনুষ্ঠান অগ্নিশিখা অনুষ্ঠান শুরু করছি। ২৫ শে মার্চ ১৯৭১ সালে বাঙালী জাতির উপর সেদিন নেমে এসেছিল শতাব্দীর ভয়াবহতম বিভীষিকা। হানাদার পশ্চিম পাকিস্তানী পশুশক্তি বনমানুষের মতো ঝাপিয়ে

পড়েছিল বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের উপর। কিন্তু সংগ্রামী বাঙালী জাতি সে আক্রমণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল দেশমাতৃকার মুক্তিমন্ত্রে। সংগ্রাম চলেছে অবিরাম-১ দিন- ২দিন- ১ মাস- ২ মাস। আজ ২৫ শে সেপ্টেম্বর। মুক্তিসংগ্রাম আজ সাফল্যজনকভাবে অতিক্রম করলো দীর্ঘ ৬টি মাস। সংগ্রাম চলছে, চলবে- যতদিন না দেশ থেকে শেষ শত্রুসৈন্যটি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।

এই গৌরবমণ্ডিত দিনে আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এখন পরিবেশিত হচ্ছে নাট্যানুষ্ঠান ‘রক্তশপথ’।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র –

বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে শহীদানের প্রতিটি রক্তবিন্দু আজ উদ্দীপ্ত করেছে স্বাধীনতার সূর্যকে। এই স্বাধীনতা সংগ্রামের লক্ষ লক্ষ মুক্তিসেনা আর কোটি কোটি বীর বাঙালীকে সংগ্রামী অভিনন্দন জানিয়ে আমাদের আজকের এ অধিবেশন এখানে শেষ করছি।

আবার আমরা আপনাদের সামনে উপস্থিত হবো আজ বেলা ১টায়। জয় বাংলা।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র –

ঘূর্ণিঝড় সম্পর্কিত একটি বিশেষ ঘোষণাঃ

বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়টি এখন হারিকেনের আকার ধারণ করেছে এবং তা আজ সন্ধ্যায় সুন্দরবনের উপর দিয়ে বয়ে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে।
• চালনার সমুদ্র-বন্দর থেকে ৮ নম্বর মহাবিপদ থেকে
দেখাতে হবে।
• চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের সমুদ্রবন্দরগুলো থেকে ৩
নম্বর স্থানীয় সতর্ক সঙ্কেত দেখাতে হবে।
• খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালী এবং উপকূলবর্তী
দ্বীপসমূহ থেকে ৪ নম্বর নৌ-মহাবিপদ সঙ্কেত
দেখাতে হবে।
• চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নোয়াখালী, ঢাকা,ফরিদপুর, পাবনা, যশোর, কুষ্ঠিয়া রাজশাহী জেলার নদী –

<005.003.025>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

বন্দরগুলো থেকে ২ নম্বর নেী সর্তক-সঙ্কেত দেখাতে হবে। খুলনা জেলার সমুদ্রবর্তী এলাকায় যারা অবস্থান করছেন তাদেরকে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে অনুরোধ করছি।

সমুদ্রে অবস্থানরত জেলে-নৌকা ও ট্রলারসমূহের আরোহীদের প্রতি অনুরোধ, তাঁরা যেন নৌযানগুলোকে বন্দরে নিরাপদ আশ্রয়ে ভিড়িয়ে রাখেন।

ঘোষণাটি শেষ হলো।
২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
প্রথম অধিবেশনঃ
সকাল
৭-০০ মিঃ (ক) উদ্বোধনী ঘোষণা
(খ) তেলওয়াত
(গ) অনুষ্ঠান পরিচিতি
৭-১০ ” (ক) খবরঃ বাংলা
(খ) খবরঃ ইংরেজী
৭-৩০ ” মুক্তিযুদ্ধের সফল অর্ধবর্ষ পূর্তি
উপলক্ষে গত রাতে গণপ্রজাতন্ত্রী
বাংলাদেশের অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট
জাতির উদ্দেশে যে বেতার ভাষণ
দেন, তার ইংরেজী অনুবাদ।
৮-১৫ ” বজ্রকণ্ঠ ও স্লোগান
৮-২০ ” সমাপ্তি।

দ্বিতীয় অধিবেশনঃ
বেলা
১-০০ মিঃ (ক) উদ্বোধনী ঘোষণা ও অনুষ্ঠান
(খ) খবরঃ বাংলা
(গ) খবরঃ ইংরেজী
১-১৫ ” (ক) ঐকতানঃ কোরাস
১-৩০ ” (ক) এবার মায়ের পুজোয় আমরা:
বিশেষ কথিকা-
রণজিৎ পাল চৌধুরী।
(খ) রবীন্দ্র সঙ্গীত

১-৪৫” রক্তস্বাক্ষরঃ স্বরচিত কবিতা
আবৃত্তি-শামীম চৌধুরী
১-৫০ ” পুঁথিপাঠ
২-০০ ” সমাপ্তি

তৃতীয় অধিবেশনঃ
সন্ধ্যা
৭-০০মিঃ উদ্বোধনী ঘোষণা ও অনুষ্ঠান
পরিচিতি
৭-০৫” অগ্নিশিখা
(ক) সংবাদ বুলেটিন
(খ) সঙ্গীত
(গ) দর্পণঃ মাহমুদ ফারুক
(ঘ) আবৃত্তি
(ঙ) সঙ্গীত
(চ) স্বাধীন বাংলা বেতার পরিক্রমা
(ছ) আমার সোনার বাংলা
৭-৪৫” খবরঃ বাংলা
৭-৫৫” প্রতিধ্বনিঃ শহীদুল ইসলাম
৮-০০” ইংরেজী অনুষ্ঠান
(ক) পর্যালোচনা
(খ) উদ্ধৃতি
(গ) সঙ্গীত
(ঘ) খবর
৮-২৫” খবরঃ উর্দু
৮-৩০” কথিকাঃ উর্দু
৮-৪০’’ সোনার বাংলা
৯-০০’’ পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে
৯-০৭” সঙ্গীত
৯-১৫” জল্লাদের দরবার
৯-৩০” সমাপ্তি
১ অক্টোবর, ১৯৭১
তৃতীয় অধিবেশনঃ
সন্ধ্যা
৭-০০ মিঃ উদ্বোধনী ঘোষণা ও অনুষ্ঠানসূচী
৭-০৫ ” অগ্নিশিখা

<005.003.026>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

(ক) বুলেটিন
(খ) সঙ্গীত
(গ) দর্পণ
(ঘ) সঙ্গীত
(ঙ) আবৃত্তি
৭-৩৫ ” পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে
৭-৪৫ ” বাংলা খবর
৭-৫৫ ” সংবাদ পর্যালোচনা
৮-০০” ইংরেজী অনুষ্ঠান
৮-২৫ ” উর্দু সংবাদ
৮-৩০ ” কথিকাঃ এ,বি,এম, শাহাবুদ্দিন
৮–৪০ ” সোনার বাংলা
৯-০০ ” জয় বাংলা
৯-৩০ ” সমাপ্তি।

২ অক্টোবর ১৯৭১
প্রথম অধিবেশনঃ
সকাল
৭-০০ মিঃ উদ্বোধনী ঘোষণা
৭-০৩ ” তেলাওয়াতে কালামে পাক ও তার বাংলা তরজমা
৭-০৮ ” অনুষ্ঠান পরিচিতি
৭-১০ ’ বাংলা সংবাদ
৭-২০ ” ইংরেজী সংবাদ
৭-৩০ ’’ জাগরণী
৭-৪৫ ” কথিকা (পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে)
৭-৫৫ ” বজ্রকণ্ঠ, সঙ্গীত
৮-০০ ” সমাপ্তি আজ শনিবার,

আজ ১৬ই আশ্বিন ১৩৭৮ সন, ২রা অক্টোবর, ১৯৭১ সাল। অধিবেশনের শুরুতে কালামে পাক থেকে তেলাওয়াত করে শোনাচ্ছেন মোঃ মুজিবুর রহমান জেহাদী ও তার বাংলা তরজমা পড়ছেন মোঃ খায়রুল ইসলাম যশোরী।

তৃতীয় অধিবেশনঃ
৭-০০ মিঃ উদ্বোধনী ও অনুষ্ঠান পরিচিতি
৭-০৫ ” অগ্নিশিখা (মুক্তিবাহিনীর জন্য বিশেষ অনুষ্ঠান)
(ক) বুলেটিন
(খ) সঙ্গীত (দুর্জয় বাংলা)
(গ) দর্পণ
(ঘ) সঙ্গীত
(ঙ) সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠানঃ মেজর মঈনের সাথে
(চ) সোনার বাংলা (গান)
৭-৪৫ ” খবরঃ বাংলা
৭-৫৫ ” সংবাদ পর্যালোচনা আমির হোসেন
৮-০০” ইংরেজী অনুষ্ঠান
৮-২৫ ” উর্দু সংবাদ
৮-৩০” সঙ্গীত
৮-৪০” সোনার বাংলা (পল্লীর শ্রোতাদের জন্য বিশেষ অনুষ্ঠান)
৯-০০” সঙ্গীত
৯-০০” কথিকাঃ আবদুর রাজ্জাক চৌধুরী
৯-১৩’’ বজ্রকণ্ঠ
৯-১৩” চরমপত্র
৯-২৫ ” জয় বাংলা
৯-৩০” সমাপ্তি

৩ অক্টোবর, ১৯৭১
তৃতীয় অধিবেশনঃ
৭-০০ মিঃ উদ্বোধনী ও অনুষ্ঠানসূচী
৭-০৫” অগ্নিশিখা
(ক) বুলেটিন
(খ) দর্পণ
(গ) সঙ্গীত
(ঘ) সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠান
(ঙ) সোনার বাংলা (গান)

<005.003.027>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

৭-৪৫ মিঃ খবরঃ বাংলা ১-১৫ মিঃ ঐকতান
৭-৫৫” প্রতিধ্বনি ১-৩০” কথিকাঃ ইলিয়াস আহমেদ
৮-০০” ইংরেজী অনুষ্ঠান ১-৩৮” রবীন্দ্র সঙ্গীত
৮-২৫” খবরঃ উর্দু ১-৪৫” সাহিত্যানুষ্ঠানঃ
৮-৩০” উর্দু কথিকা রক্তস্বাক্ষর-শামিম চৌধুরী
৮-৪০” সোনার বাংলা ১-৪৮” পুঁথিপাঠ/পল্লীগীতি
৯-০০” সঙ্গীত ১-৫৫” জয় বাংলা
৯-০৫” পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে ২-০০” সমাপ্তি।
৯-১৩” সঙ্গীত
৯-১৮” দখলকৃত এলাকা ঘুরে এলামঃ তৃতীয় অধিবেশনঃ
৯-৩০” কথিকা সন্ধ্যা
৯-২৫ ” বজ্রকণ্ঠ ও সঙ্গীত ৭-০০ মিঃ উদ্বোধনী ঘোষণা ও অনুষ্ঠান
৯-৩০” জল্লাদের দরবার পরিচিতি
৯-৫০” জয় বাংলা ৭-০৫” অগ্নিশিখা
৯-৫৫ ” সমাপ্তি। (ক) সংবাদ বুলেটিন
(খ) সঙ্গীত
৪ অক্টোবর, ১৯১৭ (গ) দর্পণ প্রথম অধিবেশনঃ
প্রথম অধিবেশন (ঘ) আবৃত্তি
(ঙ) আমরা গেরিলা (৪)
৭-০০” উদ্বোধনী (চ) আমার সোনার বাং
৭-০৫ ” কোরান তেলাওয়াত ও ৭-৪৫” খবরঃ বাংলা তরজমা
তরজমা ৭-৫৫” সংবাদ পর্যালোচনা
৭-১০” অনুষ্ঠান পরিচিতি ৮-০০” ইংরেজী অনুষ্ঠান
৭-১১” খবরঃ (ক) বাংলা (ক) পর্যালোচনা
(খ) ইংরেজী (খ) উদ্ধৃতি
৭-৩০” জাগরণী (গ) সঙ্গীত
৭-৪০” নিমজ্জমান ব্যক্তিদের তৃণ (ঘ) খবর
অকড়ে বাঁচার চেষ্টাঃ কথিকা ৮-২৫ ” খবরঃ উর্দু
(পুনঃপ্রচার) ৮-৩০” সঙ্গীত
৭-৪৯” বজ্রকণ্ঠ ৮-৪০” সোনার বাংলা
৭-৫০” নজরুলগীতি ৯-০০” কথিকা
৭-৫৫” জয় বাংলা ৯-০৭ ” সঙ্গীতঃ পল্লী
৮-০০” সমাপ্তি। ৯-১৭” বজ্রকণ্ঠ
৯-২০” চরমপত্র
দ্বিতীয় অধিবেশনঃ উদ্বোধনী ও অনুষ্ঠান পরিচিতি ৯-৩০ ” সমাপ্তি।
১-০০ মিঃ খবরঃ
(ক) বাংলা
১-০৫” (খ) ইংরেজী

<005.003.028>
পৃষ্ঠা-২৮
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র থেকে বলছি
১৬ অক্টোবর,১৯৭১
তৃতীয় অধিবেশনঃ
৭-০০ পি,এম উদ্ভোধনী ঘোষনা ও অনুষ্ঠান পরিচিত
৭-০৫ ‘’ অগ্নিশিখাঃ মুক্তি বাহিনীর জন্য
১)সংবাদ বুলেটিন
২)সংগীত
৩)দর্পন
৪)কবিতা আবৃতি
৫) সংগীত
৬)কথিকা/ সাক্ষাৎকার
৭) আমার সোনার বাংলা
৭-৪৫ পি,এম খবরঃবাংলা
৭-৫৫ ‘’ সংবাদ পর্যালোচনা/ প্রতিধ্বনি
৮-০০ ‘’ ইংরেজি অনুষ্ঠান
১)ধারাভাষ্য
২) বিশ্ব সংবাদ মাধ্যম পর্যালোচনা
৩) সংগীত
৪) খবর
৮-২৫ “ খবর ঃ উর্দু
৮৩০ “ ক) কথিকা
৮-৪০ “ খ) সংগীত
সোনার বাংলা
ক) কথোপকথন
খ) পল্লীগীতি
৯-০০ “ কথিকা/পিন্ডির প্রলাপ
৯-০৭ “ পল্লীগীতি/পুথি/জারি
৯-১২ “ বজ্রকন্ঠ ও স্লোগান
৯-১৫ “ নাটক/জল্লাদের দরবার
৯-২০ “ চরমপত্র
৯-৩০ “ সমাপ্তি

১ নভেম্বর,১৯৭১
প্রথম অধিবেশনঃ
৭-০০ এ,এম ১)উদ্ভোধনী
২) কোরআন তেলওয়াত ও অনুবাদ
৩) অনুষ্ঠান পরিচিত
৭-১০ “ খবরঃ বাংলা
৭-২০ “ খবরঃ ইংরেজি
৭-৩০ “ সঙ্গীত
৭-৩৫ “ কথিকাঃ রনাঙ্গনে বাংলার নারী বেগম উম্মে কুলসুম
৭-৪২ “ রবীন্দ্র সংগীত
৭-৪৭ “ কথিকাঃ মুস্তাফিজুর রহমান
পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতেঃ শত্রুর রক্তে
অবগাহন করতে দাও ( পুনঃপ্রচার)
৭-৫০ “ বজ্রকন্ঠ ও স্লোগান
৮-০০ “ সমাপ্তি

পৃষ্ঠা ২৯
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপরত্র থেকে বলছি পঞ্চম খন্ড
২য় অধিবেশন
১-০০ পি,এম উদ্ভোধনী ও অনুষ্ঠান পরিচিতি আলমগীর কবির কতৃক পরিচালিত
১-০৫ “ ক)খবরঃ বাংলা ক) আহমেদ চৌধুরীর ধারাভাষ্য
খ) খবরঃ ইংরেজি খ) স্বদেশপ্রেমী গান
১-১৫ “ সঙ্গীত গ) বিশ্ব সংবাদমাধ্যমের সারমর্ম
১-২৩ “ বিশ্ব জনমতঃ সাদেকীন এর লেখনী ঘ) সংবাদ
১-৩০ “ পল্লীগীতি/পুথি/জারি ৮-৫৫ “ খবরঃজাহেদ সিদ্দীকের উর্দু সংবাদ
১-৪০ “ কয়েকটা বিক্ষিপ্ত ঘটনাঃ এসপ্তাহের ৯-০০ “ কথিকাঃ উর্দু/ স্বদেশপ্রেম গান
জয় বাংলা পত্রিকা থেকে ৯-১৫ “ স্লোগান এবং অর্কেস্ট্রা
১-৪৭ “ সংগীত ৯-২০ “ চরমপত্রঃ এম আর আক্তার
১-৫০ “ পুঃপ্রচারঃ জল্লাদের দরবার ৯-৩০ “ সমাপ্তি
তৃতীয় অধিবেশন ২ নভেম্বর,১৯৭১
৭-০০ পি,এম উদ্ভোধনী ও অনুষ্ঠান পরিচিতি প্রথম অধিবেশন
৭-০৫ “ অগ্নিশিখা ৭-০০ এ,এম ক)উদ্ভোধনী
১)সংবাদ বুলেটিন খ) কোরআন তেলওয়াত ও অনুবাদ,মাওলানা
২)সঙ্গীত এম আর জাহেদী
৩) দর্পনঃ আশরাফুল আলম গ) অনুষ্ঠান পরিচিত
৪) সঙ্গীত ও স্লোগান ৭-১০ “ খবরঃ বাংলা
৫)আবৃতিঃ মোস্তফা আনোয়ার ৭-২০ “ খবরঃ ইংরেজি
৬) বাংলার মুখঃজীবনটিকা ৭-৩০ “ সঙ্গীত
রচনায় কল্যান মিত্র ৭-৩৫ “ কথিকা/বিশ্বাস বিবেক ও বাংলাদেশঃ মহাদেব
অংশগ্রহনে পুর্নেন্দু সাহা এবং বুলবুল ৭-৪২ “ সাহা
৭) আমার সোনার বাংলা ৭-৪৭ “ নজরুল গীতি
৭-৪৫ “ ৭-৫০ “ বজ্রকন্ঠ ও স্লোগান কথিকা
৭-৫৫ “ খবরঃ বাংলা,সংবাদ পর্যালোচনা ৮-০০ “ সমাপ্তি
লেখাঃ আমীর হোসেইন তৃতীয় অধিবেশনঃ
৮-০০ “ পথঃ আশফাক রহমান ৭-০০ পি,এম উদ্ভোধনী ও অনুষ্ঠান পরিচিতি
৮-০৫ “ সঙ্গীত,জীবনটিকাঃ মিরজাফরের রোজনামচা ৭-০৫ “ অগ্নীশিখা
রচনায় কয়ান মিত্র
৮-১৫ “ নজরুল সঙ্গীত ১)সংবাদ বুলেটিনঃ কামাল লোহানী
৮-২০ “ কথিকা বিশ্বাস বিবেক ২) সঙ্গীত
ও বাংলাদেশঃ মহাদেব সাহা ৩) কথিকঃ মোস্তফা কামাল
৮-২৭ “ বজ্রকন্ঠ ও স্লোগান ৪) সঙ্গীত ও স্লোগান
৮-৩০ “ ইংরেজি অনুষ্ঠান ৫) আবৃতিঃ বি,হাসান
৬) আমার সোনার বাংলা
৭-৪৫ “ খবর বাংলা-বাবুল আক্তার
৭-৫৫ “ সংবাদ পর্যালোচনা

<005.003.030>

লেখাঃ আমির হোসেন
পাঠঃ আশফাক রাহমান
দুপুর ১.০০ উদ্বোধনী অনুষ্ঠান
রাতঃ ৮.০০ সঙ্গীত দুপুর ২.০০ পরিচিত
রাতঃ ৮.০৫ কথিকা/ সংগ্রাম ঘরে ঘরে দুপুর ১.০৫ ক) খবরঃ বাংলা
মোস্তাফিজুর রহমান দ্বারা রেকর্ড কৃত খ) খবরঃ বাংলা

দুপুর ১.১৫- সঙ্গীত দুপুর ১.২৩- বিশ্ব জনমত
লেখাঃ সাদেইন
পাঠঃ শাহজাহান ফারুক
রাত ৮.১৫ নজরুল সঙ্গীত দুপুর ১.৩০- পল্লীগীতি
রাত ৮.২০ কথিপকাঃ পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে দুপুর ১.৪০- সাহিত্য অনুষ্ঠান
লেখাঃ ফায়াজ আহমেদ রক্ত স্বাক্ষর/ নির্মলেন্দু গুনের স্বরচিত দুপুর ১.৪০- সাহিত্য অনুষ্ঠান কবিতা
পাঠঃ কালাম লোহানী
রাত ৮.২৭ বজ্র কন্ঠ ও স্লোগান দুপুর ১.৪৭- সঙ্গীত
রাত ৮.৩০ ইংরেজী অনুষ্ঠান দুপুর ১.৫০- কথিকা( পুনঃপ্রচার)
পরিচালনায় আলমগীর কবির পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে
ক) ধারা ভাষ্যেঃ আহমেদ চৌধুরী দুপুর ২.০০- সমাপ্তি
খ) দেশাত্ববোধক গান
গ) বহির্বিশ্বের খবর তৃতীয় অধিবেশন
কথায়ঃ আলী যাকের
ঘ) সংবাদঃ পারভীন হোসেন

রাত ৮.৫৫ খবরঃ উর্দু পরিবেশনায় জাহিদ সিদ্দিকি সকাল ৭.০০ টা উদবোধনী অনুষ্ঠান
সকাল ৭.০৫ পরিচিতি
অগ্নিশিক্ষাঃ পরিচালনায়- এ আলম
রাত ৯.০০ কথিকা, (উর্দু) জাহিদের পরিবেশনায় ক) সংবাদ বুলেটিনঃ বুলবুল আখতার
রাৎ ৯.১৫ সিদ্দিকী; দেশাত্নবোধক গান খ) সঙ্গীতঃ ১) আমি অস্ত সাগর
রাত ৯.২০ শ্লোগান ও অর্কেস্ট্রা গ) দর্পনঃ এ আলম
রাত ৯.৩০ চরম পত্র ও এম আর আখতার সম্পতি ঘ) সঙ্গীত ও শ্লোগান-
মোরা ঝংঝার মত উদ্দাম
৩রা নভেম্বর ১৯৭১ ঙ) আবৃত্তিঃ এ রহমান
চ) কথিকাঃ মুস্তফা আনোয়ার
প্রথম অধিবেশন
সকাল ৭.৪৫ ছ) আমার সোনার বাংলা
সকাল ৭.০০ খবরঃ বাংলা
ক) উদ্বোধনী সকাল ৭.৫৫ আবদুল্লাহ আল ইসলাম
খ) কোরআন তেলওয়াত সংবাদ পর্যালোচনা
মওলানা এম. আর জাহেদী লেখাঃ আমির হোসেন
অনুবাদঃ এ এ ফারুকী সকাল ৮.০০ পাঠ আশফাকুর রহমান
সকাল ৭.১০ সঙ্গীত ১) আধারে বাধ ভেঙ্গে
সকাল ৭.২০ ক) খবরঃ বাংলা সকাল ৮.০৫ ২) মরবো তাতে নেই ক্ষতি
খ) খবরঃ ইংরেজী কথিকা/জীবন্তিকাঃ জাফর সিদ্দিকের দৃষ্টিপাত
সকাল ৭.৩৫ সঙ্গীত এগিয়ে চলোঃ দেশাতবোধক গান আর সাথে কথিকা/ কাঠগড়ার আসামী শ্লোগান নিয়ে অনুষ্ঠান
সকাল ৭.৪২ জনাব রহমান এর পরিবেশনায় ১) আয়রে চাষী
সকাল ৭.৪৭ রবীন্দ্র সঙ্গীত ২) এবার উঠেছে মহা আলোড়ন
সকাল ৭.৫০ বজ্র কন্ঠ ও শ্লোগান
কথিকাঃ পোন্দীর প্রলাপ অথবা
সকাল ৮.০০ চরম পত্র
সমাপ্তি

Page: 31

রাত ৮-২৭ বজ্রকন্ঠে-ও-স্লোগান। বেলা ১-১৫ সংগীত
রাত ৮-৩০ ইংরেজি অনুষ্ঠান ক) রক্ত রঙ্গীন উজ্জল দিন
পরিচালনায় আলমগীর কবির খ) দূর্গম দূর পথ বন্ধুর
ক)পরিবেশনায় আহমেদ চৌধুরী, এ কবির বেলা ১-২৩ বিশ্ব জনমত
খ)দেশাত্ববোধক গান ব্যারিকেড বেয়নেট বেলা ১-৩০ পল্লী গীতি
গ)বিশ্ব পত্রিকার সারসংক্ষেপ ইন্দ্রমোহন রাজ বংশী
ঘ)খবরঃ জারীদ আহমেদ বেলা ১-৪০ সাহিত্যঃ অনুষ্ঠান
রাত ৮-৫৫ খবরঃ উর্দু-জাহেদ সিদ্দিকি বেলা ১-৪৭ রক্ত সাক্ষর, মহাম্মদ
রাত ৯-০০ কথিকাঃ উর্দু এবং সংগীত রফিকের সরচিত কবিতা
রাত ৯-১৫ জল্লাদের দরবারঃ লিখেছেন সংগীতঃ রবীন্দ্র গীতি
কল্যান মিত্র বেলা ১-৫০ জীবনটিকাঃ পুনপ্রচার-
অংশগ্রহনেঃ রাজু আহমেদ, মীর জাফরের রোজনামচা
…বোস, বাবুল চৌধুরী, নারায়ন ঘোষ বেলা ২-০০ সমাপ্তি
রাত ৯-২০ চরম পত্র ৩য় অধিবেশন
রাত ৯-৩০ সমাপ্তি সন্ধ্যা ৭-০০ উদ্বোধনি ও অনুষ্ঠান
৫ নভেম্বর, ১৯৭১ পরিচিতি
প্রথম অধিবেশন সন্ধ্যা ৭-০৫ অগ্নি শিখাঃ পরিচালনা
সকাল ৭-০০ ক)উদ্বোধনি আশরাফুল আলম
খ)কুরআন তিলাওয়াত ও অনুবাদ ক)সংবাদ বুলেটিন
গ) অনুষ্ঠান পরিচিতি বাবুল আখতার
সকাল ৭-১০ খবরঃ বাংলাঃ আব্দুল্লাহ আল ইসলাম খ)সংগীতঃ
সকাল ৭-২০ খবরঃ ইংরেজিঃ পারভীন হোসাইন গ)কথিকাঃ
সকাল ৭-৩০ সংগীতঃ জন্ম আমার ধন্য হল… আমরা গরিলাঃ বেলাল
সকাল ৭-৩৫ কথিকা মোহাম্মদ
সকাল ৭-৪২ নজরুল সংগীতঃ ও ভাই খাটি সোনার চেয়ে খাটি ঘ)সংগীত ও স্লোগান
সকাল ৭-৪৭ বজ্রকন্ঠ-ও-স্লোগান ঙ)আবৃতিঃ মোস্তফা
সকাল ৭-৫০ কথিকাঃ পিন্ডির প্রলাপ, রচনা আবু তোয়াব খান আনোয়ার
সকাল ৮-০০ সমাপ্তি চ)দুর্জয় বাংলাঃ কথা
২য় অধিবেশন বলবেন বদরুল হাসান
বেলা ১-০০ উদ্বোধনি ও অনুষ্ঠান পরিচিতি সন্ধ্যা ৭-৪৫ খবরঃ বাংলা-কামাল লহানি
বেলা ১-০৫ ক)খবরঃ বাংলাঃ আলী রেজা চৌধুরী সন্ধ্যা ৭-৫৫ সংবাদ পর্যালোচনা
খ)খবরঃ ইংরেজিঃ পারভীন হোসাইন লেখা-আমির হোসেন
পাঠ-এ রহমান
রাত ৮-০০ সংগীত
রাত ৮-০৫ কথিকাঃ বলবেন, নুরুল হক এম.এন.এ.
রাত ৮-১৫ নজরুল সংগীত
রাত ৮-২০ কথিকাঃ পুতুল নাচের খেল,
বলবেন আব্দুল গাফফার
চৌধুরী
রাত ৮-২৭ বজ্রকন্ঠ-ও-স্লোগান
Page: 32

রাত ৮.৩০ ইংরেজি অনুষ্ঠানঃ রাত ৮.৫৫ খবরঃ উর্দু
(ক)ধারা বিবরণী রাত ৯.০০ কথিকাঃ সৈয়দ আল আহসানের
পরিবেশনায় রমজানের আদর্শ
(খ) দেশাত্ববোধক গান রাত ৯.১০ অর্ক্রেস্ট্রা ও শ্লোগান (গ) বহির্বিশ্বের খবর রাত ৯.২৫ জল্লাদের দরবার কল্যান মিত্রের (ঘ) খবরঃ পারভিন হোসেইন লেখা
রাত ৮.৫৫ খবরঃ উর্দু রাত ৯.৩০ সমাপ্তি
রাত ৯.০০ আলোচনা
রাত ৯.১৫ উর্দু আলোচনা এবং গানঃ জাহিদ সিদ্দিকি ১৬ নভেম্বর ১৯৭১
রাত ৯.২০ পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে লেখা – ফায়াজ আহমেদ প্রথম অধিবেশনঃ
পাঠ – কামাল লোহানি সকাল ৭.০০
রাত ৯.৩০ সমাপ্তি । ক) উদবোধনী খ) কোরআন তেলওয়াত ও অনুবাদ
গ) অনুষ্ঠান পরিচিতি
১০ নভেম্বর, ১৯৭১ সকাল ৭.১০ খবরঃ বাংলা
তৃতীয় অধিবেশন সকাল ৭.২০ খবরঃ ইংরেজি
সকাল৭.৩০ সঙ্গীত
সন্ধ্যা ৭.০০ উদ্বোধনী ও অনুষ্ঠান পরিচিতি সকাল৭.৩৫ কথিকা / পুতুল নাচের খেলা পুনঃ প্রচার
সন্ধ্যা ৭.০৫ অগ্নিশিখাঃ সকাল৭.৪২ রবীন্দ্র সঙ্গীত
ক) সংবাদ শিরোনাম সকাল ৭.৫০ কথিকা- অভিযোগ
খ) সঙ্গীত সকাল৮.০০ গন সঙ্গীত ও শ্লোগান
গ) কথিকাঃ বদরুল হাসানের জনতার সংগ্রাম সকাল ৮.১৫ বজ্র কন্ঠ ও শ্লোগান
ঘ) সঙ্গীত ও শ্লোগান সকাল৮.২০ কথিকা-পিন্দির প্রলাপ, এ
ঙ) আবৃত্তিঃ মোস্তফা আনোয়ার তোয়াব খান
চ) সাক্ষাতকারঃ রনাঙ্গনে ডকুমেন্টরী
ঙ) আমার সোনার বাংলা সকাল ৮.৩০ সমাপ্তি
সন্ধ্যা ৭.৪৫ খবরঃ বাংলা দ্বিতীয় অধিবেশন
সন্ধ্যা ৭.৫৫ সংবাদ পর্যালোচনা দুপুর ১.০০ উদ্বোধনী ও অনুষ্ঠান পরিচিতি
লেখাঃ আমির হোসেন দুপুর ১.০৫ ক) খবরঃ বাংলা
পাঠঃ এ। রহমান খ) খবরঃ ইংরেজি
রাত ৮.০০ সঙ্গীত দুপুর ১.১৫ সঙ্গীত
রাত ৮.০৮ দৃষ্টিপাতঃ জাফর সাদেক দুপুর ১.২৩ ধর্মীয় অনুষ্ঠান /ইসলামের দৃষ্টিতে- পুনঃ প্রচার
রাত ৮.১২ সঙ্গীত ( লোক সঙ্গীত ) দুপুর ১,৩০ পুথি মোহাম্মদ শাহ বাঙালী
রাত ৮.১৭ বজ্রকন্ঠ ও শ্লোগান দুপুর ১.৪০ সাহিত্য অনুসন্ধ্যান
ছোট গল্প মুসা সাদেক
রাত ৮.৩০ ইংরেজি অনুষ্ঠান দুপুর ১.৪৭ যন্ত্র সঙ্গীত
আই জাকের পরিচালিত দুপুর ১.৫০ কথিকা পুনঃপ্রচার করবে
ক) ধারা ভাষ্যে আই জাকের দুপুর ২.০০ সমাপ্তি ।
খ) দেশাত্ববোধক সঙ্গীত
গ) বহির্বিশ্বের খবর
কথাঃ জামিল আখতার
ঞ) সংবাদঃ

.
.

<005.003.033>
তৃতীয় অধিবেশন ক) বজ্রকন্ঠ
সন্ধ্যা ৭ টা উদ্বোধনি ও অনুষ্ঠান পরিচিতি খ) সঙ্গীত
সন্ধ্যা ৭টা ৫ খবরঃ বাংলা গ) প্রতিনিধির কণ্ঠ- আবদুল মালেক উকিল এমএনএ
সন্ধ্যা ৭টা ১৫ গণসংগীত ও স্লোগান ঘ) …
সন্ধ্যা ৭টা ৩০ অগ্নিশিখা- পরিচালনাঃ আশফাকুর রহমান ঙ) কথিকা- কাঠগড়ার আসামী- মুস্তাফিজুর রহমান
ক) বজ্রকন্ঠ চ) স্লোগান ও সঙ্গীত
খ) বিশ্ববিবেক ও বাংলাদেশ- মহাদেব সাহা ছ) জনতার সংগ্রাম- বদরুল হাসান
গ) সঙ্গীত
ঘ) আবৃত্তি জ) যুদ্ধের খবর
ঙ) ইবলিশের মুখোশ- মেসবাহ আহমেদ রাত ৮টা ২৫ আমার সোনার বাংলা
রাত ৮টা ৩০ ইংরেজি অনুষ্ঠানঃ
চ) সঙ্গীত আলমগীর কবিরের সম্পাদনায়
ছ) পিণ্ডির প্রলাপঃ পুনঃপ্রচার রাত ৮টা ৫০ ইংরেজি খবর
জ) যুদ্ধের খবর রাত ৯টা পল্লিগীতি/পুঁথিপাঠ
রাত ৮টা ২৫ আমার সোনার বাংলা রাত ৯টা ১০ কথিকাঃ
রাত ৮টা ৩০ ইংরেজি অনুষ্ঠান আবদুর রাজ্জাক চৌধুরী
রাত ৮টা ৫০ ইংরেজি খবর রাত ৯টা ২০ উর্দু অনুষ্ঠানঃ
রাত ৯টা পুঁথিপাঠ ক) কথিকা
রাত ৯টা ১০ কথিকা- পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে
রাত ৯টা ৩৫ খ) খবর
সংঘর পর্যালোচনাঃ
রাত ৯টা ২০ উর্দু অনুষ্ঠান পান্ডুলিপি- আমির হুসেইন
ক) কথিকা পড়েছেন- আশফাকুর রহমান
খ) খবর রাত ৯টা ৪০ সঙ্গীত
রাত ৯টা ৩৫ সংঘর পর্যালোচনা রাত ৯টা ৪৫ কথিকা- ইসলামের দৃষ্টিতে
রাত ৯টা ৪০ সঙ্গীত শবে কদর- সৈয়দ আলী আহসান
রাত ৯টা ৪৫ কথিকা- ইসলামের দৃষ্টিতে রাত ৯টা ৫৫ সঙ্গীত
রচনায়- সৈয়দ আলী আহসান রাত ১০ টা কথিকা- দৃষ্টিপাত
রাত ৯টা ৫৫ সঙ্গীত ডঃ মাজহারুল ইসলাম
রাত ১০টা চরমপত্রঃএম আর আখতার রাত ১০টা ১০ জীবন্তিকা- যাইদের দরবার
রাত ১০টা ১০ গ্রাম বাংলা- জীবন্তিকা রাত ১০টা ১৫ কথিকা
রাত ১০টা ২৫ খবর শিরোনাম রাত ১০টা ২৫ খবর শিরোনাম
রাত ১০টা ৩০ সমাপ্তি রাত ১০টা ৩০ সমাপ্তি
১৭ নভেম্বর,১৯৭১ ২০ নভেম্বর, ১৯৭১ ঈদের দিন
তৃতীয় অধিবেশন প্রথম অধিবেশন
সন্ধ্যা ৭টা উদ্বোধনি সকাল ৭টা ক) উদ্বোধনি
অনুষ্ঠান পরিচিতি খ) কোরআন তেলাওয়াত ও অনুবাদ
সন্ধ্যা ৭টা ৫ খবর- বাংলা গ)অনুষ্ঠান পরিচিতি
সন্ধ্যা ৭টা ১৫ গণসংগীত ও স্লোগান সকাল ৭টা ১০ খবর- বাংলা
সন্ধ্যা ৭টা ৩০ অগ্নিশিখাঃ সকাল ৭টা ২০ খবর- ইংরেজি

<005.003.034>
সকাল ৭টা ৩০ সঙ্গীত আয়োজন গ) আবৃত্তি- কৃষকের ঈদ
ঈদের দিনের জন্য সুর করেছেন কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা
শহিদুল ইসলাম ও অজিত রায় আবৃত্তি করবেন- মুস্তাফা আনোয়ার
সকাল ৭টা ৪৫ রমজানের ওই রোজার শেষে ঘ) কথিকাঃ বিশ্ববিবেক
রচনা- আবদুল গাফফার চৌধুরী ও বাংলাদেশ
সকাল ৮টা ২০ সঙ্গীত বজ্রকন্ঠ ও স্লোগান ঙ) সঙ্গীত
সকাল ৮টা ২৫ সমাপ্তি চ) পিণ্ডির প্রলাপঃ আবু তোয়াব খান
দ্বিতীয় অধিবেশন ছ) যুদ্ধের খবর
দুপুর ১ টা উদ্বোধনি ও অনুষ্ঠান পরিচিতি রাত ৮টা ২৫ আমার সোনার বাংলা
দুপুর ১টা ৫ ক) খবর- বাংলা রাত ৮টা ৩০ ইংরেজি অনুষ্ঠান
খ) খবর- ইংরেজি আয়োজনে- আলমগির কবির
দুপুর ১টা ১৫ সঙ্গীত রাত ৮টা ৫০ খবর- ইংরেজি
দুপুর ১টা ২৩ রক্ত রাঙা ঈদ- জীবন্তিকা রাত ৯টা পল্লিগীতি
বাংলা-লিখেছেন- বদরুল হাসান রাত ৯টা ১০ সূর্যশপথ- কথন- আবদুর রাজ্জাক চৌধুরী
দুপুর ১টা ৩০ ঈদের পুঁথিঃ মোঃ শাহ্‌ রাত ৯টা ২০ উর্দু অনুষ্ঠান
বাংলা ক) কথিকা
দুপুর ১টা ৪০ সাহিত্য- অনুষ্ঠান- খ) খবর
ছোটোগল্প রাত ৯টা ৩৫ সঙ্ঘদ পর্যালোচনা
বুলবন ওসমান লেখক- আমির হোসেন
দুপুর ১টা ৪৭ গণসংগীত ও স্লোগান
দুপুর ১টা ৫০ কথিকা- ঈদুল ফিতর রাত ৯টা ৪০ সঙ্গীত
দুপুর ২টা আলী আহসান- কথন রাত ৯টা ৪৫ কথিকা- পত্রপত্রিকার
দুপুর ২টা ৫ সঙ্গীত মন্তব্য- রচনা-সাদেকিন
রমজানের ওই রোজার শেষে
(পুনঃপ্রচার) রচনা- আবদুল গাফফার চৌধুরী রাত ৯টা ৫৫ চন্দর, রচনা- মামুনুর
রশিদ, প্রযোজনা- হাসান ইমাম
দুপুর ২টা ৩০ সমাপ্তি রাত ১০টা ২৫ খবর শিরোনাম

তৃতীয় অধিবেশন রাত ১০ টা ৩০ সমাপ্তি
সন্ধ্যা ৭টা উদ্বোধনি ও অনুষ্ঠান পরিচিতি ২৫ নভেম্বর,১৯৭১ ঈদের দিন
সন্ধ্যা ৭টা ৫ খবর- বাংলা প্রথম অধিবেশন
সন্ধ্যা ৭টা ১৫ সঙ্গিতায়োজন- ঈদের বিশেষ আয়োজন- মুস্তাফিজুর রহমান, প্রযোজনায়- আশরাফুল আলম সকাল ৭টা ক)উদ্বোধনি
খ) কোরআন তেলাওয়াত
গ) অনুষ্ঠান পরিচিতি
সকাল ৭টা ১০ খবর- বাংলা
সন্ধ্যা ৭টা ৩০ অগ্নিশিখা- আশফাকুর রহমান সকাল ৭টা ২০ খবর- ইংরেজি
ক) বজ্রকণ্ঠ সকাল ৭টা ৩০ সঙ্গীত
সকাল ৭টা ৩৫ কথিকা- মুক্তিসংগ্রামে মায়ের প্রেরণা
খ) সঙ্গীত- ঈদুল ফিতর এই দিনে
বাংলা কথন- হাফেজ আলী, পড়েছেন- মোঃ ফারুক সকাল ৭টা ৪২ রবীন্দ্র সঙ্গীত/ নজরুল গীতি

<005.003.035>
পৃষ্ঠা ৩৫
সন্ধ্যা ৭.৫০ কথিকাঃ দৃষ্টিপাত রচনায় ডঃ এম ইসলাম সকাল ৮.০০ বর্ণনার সাথে গন সঙ্গীত
সন্ধ্যা ৮.১৫ বর্ণোনার সাথে গনসঙ্গীত সকাল ৮.১৫ বজ্রকন্ঠ শ্লোগান
সন্ধ্যা ৮.২০ বজ্রকন্ঠ ও শ্লোগান সকাল ৮.২০ কথিকাঃ পিন্ডির প্রলাপ, রচনায় ও পাঠে
কথিকাঃ পিন্ডির প্রলাপ , রচনায় ও পাঠে সকাল ৮.৩০ সমাপ্তি
আবু তোয়াব খান দ্বিতীয় অধিবেশন
সন্ধ্যা ৮.৩০ সমাপ্তি দুপুর ১.০০ উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ও পরিচিতি
দ্বিতীয় অধিবেশন দুপুর ১.০৫ (ক) বাংলা খবর পাঠে কামাল লোহানী
দুপুর ১.০০ উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ও পরিচিতি (খ) ইংরেজী খবর পাঠে পারভীন হোসেন
দুপুর ১.০৫ ক) খবরঃ বাংলা দুপুর ১.১৫ সঙ্গীত
খ) খবরঃ বাংলা দুপুর ১.২৩ জীবন টিকাঃ জনতার আলাপ
দুপুর ১.১৫ সঙ্গীত দুপুর ১.৩০ পল্লীগীতি, পুথি , জারী
দুপুর ১.২৩ ধর্মীয় অনুষ্ঠান/ গীতা পাঠ দুপুর ১.৪০ সাহিত্য অনুষ্ঠানঃ
দুপুর ১.৪০ সাহিত্য অনুষ্ঠানঃ রক্ত স্বাক্ষরঃ ছোট গল্প
জাফর সাদেক রচিত রক্তের আখর লিখি দুপুর ১.৪৭ যন্ত্রসংগীত
পাঠে আশরাফুল আলম দুপুর ১.৫০ কথিকা অগ্নিশিক্ষা to be re-b cast
দুপুর ১.৪৭ যন্ত্রসংগীত
দুপুর ১.৫০ কথিকা অগ্নিশিক্ষা to be re-b cast দুপুর ২.০০ সমাপ্তি
থেকে সময়োপযোগী আলোচনা
কাঠগড়ার আসামীঃ এম রহমান
দুপুর ২.০০ সমাপ্তি ১০ই ডিসেম্বর ১৯৭১ ঈদের দিন
৪ই ডিসেম্বর ১৯৭১ প্রথম অধিবেশন
প্রথম অধিবেশন সকাল ৭.০০ (ক) উদ্বোধনী
সকাল ৭.০০ (ক) উদ্বোধনী (খ) কোরআন তেলওয়াত ও তর্জমা
(খ) কোরআন তেলওয়াত ও তর্জমা (গ) অনুষ্ঠান পরিচিতি
(গ) অনুষ্ঠান পরিচিতি
সকাল ৭.১০ বাংলা খবর পাঠে বাবুল আখতার সকাল ৭.১০ খবরঃ বাংলা
সকাল ৭.২০ ইংরেজী খবর পাঠে পারভীন হোসেন সকাল ৭.২০ খবর ইংরেজী
সকাল ৭.৩০ সঙ্গীত সকাল ৭.৩০ সংগীত শ্লোগান
কথিকাঃ পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে রচনায় ফায়েজ সকাল ৭.৪৭ যন্ত্র সঙ্গীত ও শ্লোগান
আহমেদ সকাল ৭.৫০ কথিকা স্বীকৃতির খবর পেয়ে শওকত
সকাল ৭.৪২ রবীন্দ্র সংগীত /নজরুল গীতি ওসমান
সকাল ৭.৫০ কথিকা জনতার সংগ্রাম- গাজীউল হক সকাল ৭.৫৮ সংবাদ শিরোনাম
সকাল ৮.০০ কথিকা/পিন্দির প্রলাপঃ আবু তোয়াব খান
সকাল ৮.১০ সঙ্গীত

পৃষ্ঠা ৩৬
সকাল ৮.১৫ কথিকাঃ বাংলাদেশ ও বুদ্ধিজীবি সম্প্রদায় সকাল ৭.২৫ সঙ্গীত
ডঃ অজয় রয় সকাল ৭.৩০ অগ্নিশিখা
সকাল ৮.২২ নজরুল গীতি (ক) বজ্রকন্ঠ ও শ্লোগান
সকাল ৮.২৮ সংবাদ শিরোনাম (খ) সঙ্গীত
সকাল ৮.৩০ পল্লীগীতি (গ) প্রতিনিধির কন্ঠঃ জীল্লুর রহমান এম এন এ
সকাল ৮.৪২ বজ্র কন্ঠ ও শ্লোগান (ঘ) আবৃত্তিঃ অমিত্রাক্ষর ছন্দ, আশফাক রহমান
সকাল ৮.৪২ বজ্রকন্ঠ ও শ্লোগান উম্মে কুলসুম
সকাল ৮.৪৫ খবরঃ উর্দু (ঙ) যন্ত্রসংগীত ও শ্লোগান
সকাল ৮.৫০ খবরঃ বাংলা (চ) কথিকাঃ জনতার সংগ্রামঃ গাজীউল হক
সকাল ৯.০০ সমাপ্তি (ছ) সঙ্গীত
দ্বিতীয় অধিবেশন (জ) কথিকা/ রনাঙ্গন ঘুরে
দুপুর ১.০০ উদ্বোধনী ও অনুষ্ঠান পরিচিত এলমঃ মুসা সাদেক
দুপুর ১.০৫ খবরঃ বাংলা (ঝ) যুদ্ধের খবর
দুপুর ১.১৫ খবরঃ ইংরেজী সকাল ৮.১০ আমার সোনার বাংলা
দুপুর ১.২৫ সঙ্গীত সকাল ৮.১৫ উর্দু অনুষ্ঠান
দুপুর ১.৩০ সংগ্রামী বাংলা (ক) কথিকা
দুপুর ১.৩৭ যন্ত্র সঙ্গীত ও শ্লোগান (খ) খবর
দুপুর ১.৪০ সাহিত্য অনুষ্ঠানঃ রক্ত স্বাক্ষর/ সকাল ৮.২৮ সংবাদ শিরোনাম
অসিত রয় চৌধুরী ও সবুজ চক্রবর্তী রচিত সকাল ৮.৩০ ইংরেজী অনুষ্ঠান
কবিতা সকাল ৮.৫০ ফায়েজ আহমেদ এর রচনায় পর্যবেক্ষকের
দুপুর ১.৫০ সঙ্গীত দৃষ্টিতে, পাঠে কামাল লোহানী
দুপুর ১.৫৮ সংবাদ শিরোনাম সকাল ৮.৫৮ সংবাদ শিরোনাম
দুপুর ২.০০ কথিকা সকাল ৯.০০ কথিকাঃ জংগীশাহীর পদলেহীর উদ্দেশ্যে
দুপুর ২.০৭ যন্ত্রসংগীত ও শ্লোগান সকাল ৯.১০ জীবন টিকাঃ গ্রাম বাংলা
দুপুর ২.১০ কথিকা, ফায়েহ আলীর লেখায় একটি সমীক্ষা সকাল ৯.২৮ সংবাদ শিরোনাম
দুপুর ২.২০ সঙ্গীত সকাল ৯.৩০ সংঘাত পর্যালোচনা লেখায় আমির হোসেন
দুপুর ২.২৮ সংবাদ শিরোনাম
দুপুর ২.৩০ পুথিপাঠঃ মোহাম্মদ শাহ সকাল৯.৪০ সঙ্গীত ও শ্লোগান
দুপুর ২.৪০ কথিকাঃ দৃষ্টিপাত ডঃ মাজহারুল ইসলাম সকাল ৯.৫০ খবরঃ বাংলা
দুপুর ২.৫০ খবর বাংলা সকাল ১০.০০ সমাপ্তি
দুপুর ৩.০০ সমাপ্তি ১২ ডিসেম্বর ১৯৭১ ঈদের দিন

সকাল ৭.০০ (ক) উদ্বোধনী
সন্ধ্যা ৭.০০ (ক) উদ্বোধনী ও অনুষ্ঠান পরিচিতি (খ) কোরআন তেলওয়াত ও তর্জমা
সন্ধ্যা ৭.০৫ বাংলা খবর (গ) অনুষ্ঠান পরিচিতি
সন্ধ্যা ৭.১০ ইংরেজী খবর সকাল ৭.১০ খবর বাংলা
সকাল ৭.২০ খবর ইংরেজী
সকাল ৭.৩০ সংগীত শ্লোগান

পৃষ্ঠা ৩৭
সন্ধ্যা ৭.৪০ কথিকা; একটি আলেখ্য-জলি জাহানুর দুপুর ২.৪০ কথিকা; রনাঙ্গন ঘুরে
এলম; মুসা সাদেক
সন্ধ্যা ৭.৪৭ যন্ত্র সংগীত ও শ্লোগান দুপুর ২.৫০ খবর বাঙলা
সন্ধ্যা ৭.৫০ কথিকা এই যুদ্ধ শেষ যুদ্ধঃ সাধন কুমার ধর দুপুর ৩.০০ সমাপ্তি
১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১
সন্ধ্যা ৭.৫৮ খবর শিরোনাম সকাল ৭.০০ (ক) উদ্বোধনী
সন্ধ্যা ৮.০০ কথিকা (খ) কোরআন তেলওয়াত ও তর্জমা
সন্ধ্যা ৮.১০ সঙ্গীত (গ) অনুষ্ঠান পরিচিতি
সন্ধ্যা ৮.১৫ কথিকাঃ বিশ্ব বিবেক ও বাংলাদেশ সকাল ৭.১০ খবর বাঙলা
মহাদেব সাহা, পাঠকঃ শহীদুল ইসলাম সকাল ৭.২০ খবর ইংরেজী
সন্ধ্যা ৮.২২ নজরুল গীতি খবর সকাল ৭.৩০ সংগীত শ্লোগান
সন্ধ্যা ৮.২৮ খবর শিরোনাম সকাল ৭.৪০ কথিকাঃ দেশ গঠনে নারীর
সন্ধ্যা ৮.৩০ দৃষ্টিপাত ডঃ মাজহারুল ইসলাম ভুমিকাঃ পারভিন আখতার
সন্ধ্যা ৮.৪০ বজ্রকন্ঠ ও শ্লোগান সকাল ৭.৪৭ যন্ত্র সঙ্গীত ও স্লোগান
সন্ধ্যা ৮.৪২ যন্ত্র সঙ্গীত ও শ্লোগান সকাল ৭.৫০ কথিকাঃ মদের গরব মোদের আশা; আসাদ
চৌধুরী
সন্ধ্যা৮.৪৫ খবরঃ উর্দু সকাল ৭.৫৮ সংবাদ শিরোনাম
সন্ধ্যা ৮.৫০ খবরঃ বাঙলা সকাল ৮.০০ কথিকাঃ দৃষ্টিকোনঃ আবু তোয়াব খান
১৩ই ডিসেম্বর ১৯৭১
দ্বিতীয় অধিবেশন
দুপুর ১.০০ উদ্বোধনী ও অনুষ্ঠান পরিচিতি সকাল ৮.১০ সঙ্গীত
দুপুর ১.০৫ বাংলা খবর সকাল ৮.১৫ কথিকাঃ সত্যের ঝংকারঃ প্রনব চৌধুরী
দুপুর ১.০৫ ইংরেজী খবর সকাল ৮.২২ নজরুল গীতি
দুপুর ১.২৫ সঙ্গীত সকাল ৮.২৮ সংবাদ শিরোনাম
দুপুর ১.৩০ সাদেকীন এর সম্পাদনায় বিশ্ব জনমত সকাল ৮.৩০ কথিকাঃ সুর্য শপথঃ রেজাউল হক চৌধুরী
দুপুর ১.৩৭ যন্ত্র সঙ্গীত ও শ্লোগান সকাল ৮.৩৫ যন্ত্র সঙ্গীতএবং শামসুর রহমান ও সুকান্তের
কবিতা মোস্তফা মনোয়ারের আবৃত্তি
দুপুর ১.৪০ সাহিত্য অনুষ্ঠানঃ রক্ত স্বাক্ষর/নির্মলেন্দু গুনের কবিতা
দুপুর ১.৫০ সঙ্গীত সকাল ৮.৪০ বজ্রকন্ঠ ও শ্লোগান
দুপুর ১.৫৮ সংবাদ শিরোনাম সকাল ৮.৪২ যন্ত্র সঙ্গীত ও শ্লোগান
দুপুর ২.০০ কথিকা সকাল ৮.৪৫ খবর উর্দু
দুপুর ২.০৭ যন্ত্র সংগীত ও শ্লোগান সকাল ৮.৫০ খবর বাংলা
দুপুর ২,১০ কথিকাঃ পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে( পুনঃপ্রচার) সকাল ৯.০০ সমাপ্তি
তৃতীয় অধিবেশন
দুপুর ২.২০ সঙ্গীত সন্ধ্যা ৭.০০ (ক) উদ্বোধনী ও অনুষ্ঠান পরিচিতি
দুপুর ২.২৮ সংবাদ শিরোনাম সন্ধ্যা ৭.০৫ বাংলা খবর
দুপুর ২.৩০ পল্লীগীতি পুথিপাঠঃ সন্ধ্যা ৭.১৫ ইংরেজী খবর
মোহাম্মদ শাহ বাঙালী সন্ধ্যা ৭.২৫ সঙ্গীত
(ক) ব্জ্রকন্ঠ ও শ্লোগান সন্ধ্যা ৭.৩০ অগ্নিশিক্ষা
(খ) কথিকাঃ ঢাকায় স্বাধীনতার সূর্য দীপ্তি লোহানী সন্ধ্যা ৭.৩০ তোরা সব জয়ধ্বনি করঃ বিশেষ
(গ) সঙ্গীত সঙ্গীতানুষ্ঠান
সন্ধ্যা ৭.৪২ এই ঢাকা এই রাজধানীঃ বিশেষ জীবন্তিকা
পৃষ্ঠা ৩৮ রচনাঃ টি, এইচ সিকদার।
ঘ)আবৃত্তিঃ শহিদুল ম্যাম সকাল ৭.৫২ (ক) অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর
ঘ)আবৃত্তিঃ শহিদুল ম্যাম ভাষণ
ঙ)জারিত্র সঙ্গীত ও শ্লোগান (খ) বিজয় নিশান উড়ছে ওইঃ বিশেষ সঙ্গীত
চ)কথিকাঃ বাংলাদেশ সরকারের সাফল্যঃ সকাল ৮.০০ শ্লোগান ও গান (স্বাধীন স্বাধীন)
শামীম চৌধুরী সকাল ৮-০৫ প্রধানমন্ত্রীর সাথে ‘দি পিপল’ পত্রিকার
ছ)চোরা সব জয়ধ্বনি করঃ কোরাস গান প্রতিনিধির সাক্ষাৎকার
জ)যুদ্ধের কাহাঁর সকাল ৮.১০ বাংলার মাটি বাংলার জলঃ রবীন্দ্র সঙ্গীত
রাত ০৮-১০ অর্কেস্ট্রা সকাল ৮.১৫ চরমপত্রঃ এম, আর আখতার
রাত ০৮-১৫উর্দু অনুষ্ঠানঃ জাহিদ সিদ্দিকি সকাল ৮.২৫ দেশাত্মবোধক গান
পরিচালিত সকাল ৮.৩০ যন্ত্রসঙ্গীত ও শ্লোগান
ক)কথিকা, শহিদুর রাহমান সকাল ৮.৩৫ বাংলাদেশ সরকারের ডেপুটি কমিশনার
খ) খবর ও পুলিশ সুপারিটেন্ডেন্টের নিয়োগ সম্পর্কিত
রাত ০৮-২৮খবর শিরোনাম ঘোষণা
রাত ০৮-৩০ইংরেজি প্রোগ্রাম সকাল ৮.৪০ দেশাত্মবোধক গান
রাত ০৮-৫০পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতেঃ সকাল ৮-৪৫ খবরঃ উর্দু
ফাইজ আহরমেদ সকাল ৮-৫০ খবরঃ বাংলা

রাত ০৮-৫৮খবর শিরোনাম সকাল ৯-০০ সমাপ্তি

রাত ০৯-০০ কথিকাঃ চরমপত্রঃ দ্বিতীয় অধিবেশনঃ
এম. আর. আখতার দুপুর ১-০০ উদ্বোধনী ও অনুষ্ঠান পরিচিতি
রাত ০৯-১০ জীবন্তিকাঃ কল্যাণ মিত্রের লেখা দুপুর ১-০৫ খবর বাংলা
রাত ০৯-২৮খবর শিরোনাম দুপুর ১-১৫ খবর ইংরেজী
রাত ০৯-৩০সংসদ পর্যালোচনাঃ দুপুর ১-২৫ সঙ্গীত
আমির হোসেন দুপুর ১-৩০ বাংলার মুখঃ কথিকা-সাদেকীন
রাত ০৯-৪০সঙ্গীত ও শ্লোগান দুপুর ১-৩৭ বাংলাদেশের বিভিন্নস্থানে প্রশাশনিক
রাত ০৯-৫০খবরঃ বাংলা পুলিশ অফিসার নিয়োগ সম্পর্কিত ঘোষণা।
রাত ১০-০০ সমাপ্তি দুপুর ১-৪২ সাহিত্যনুষ্ঠানঃ স্বরচিত কবিতা আবৃত্তিঃ দুপুর ১-৪২ সাহিত্যনুষ্ঠানঃ স্বরচিত কবিতা আবৃত্তিঃ
১৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১ মোহাম্মদ রফিক ও আবুল কাশেম সন্দ্বীপ
প্রথম অধিবেশনঃ
৭-০০ মিঃ (ক) উদ্বোধনী
(খ) কোরান তেলাওয়াত ও অনুষ্ঠান
পরিচিতি
সকাল ৭-১০ খবরঃ বাংলা
সকাল ৭-২০ খবরঃ ইংরেজি

দুপুর ১-৫০ সঙ্গীত কথিকাঃ বদরুল হাসান
দুপুর খবর শিরোনাম গ)সঙ্গীতঃ ও আমার দেশের মাটি
দুপুর ২-০০ ……….. ঘ) আবৃত্তি
দুপুর ২-০৭ যন্ত্রসঙ্গীত ও স্লোগান ঙ) যন্ত্রসঙ্গীত ও শ্লোগান

পৃষ্ঠা ৩৯
দুপুর ২-১০ বহু ইতিহাসের নগরী ঢাকাঃ কথিকা- কথিকাঃ মহাদেব সানা
জয় বাংলা পত্রিকার কাটিং…… ছ) কথিকা
দুপুর ২-২০ সঙ্গীত জ) সঙ্গীত
দুপুর ২-২৮ খবর শিরোনাম ঝ) যুদ্ধের খবর
দুপুর ২-৩০ পল্লিগীতি/পুঁথিপাঠ রাত ৮-১০ অর্কেস্ট্রা
দুপুর ২-৪৫ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে প্রশাসনিক রাত ৮-১৫ উর্দু অনুষ্ঠানঃ
পুলিশ অফিসার নিয়োগ সম্পর্কিত ঘোষণা ক)কথিকা/জীবন্তিকা
দুপুর ২-৪৬ সঙ্গীত খ)খবর
দুপুর ২-৫৩ খবরঃ বাংলা রাত ৮-২৮ খবর শিরোনাম
রাত ৮-৩০ ইংলিশ প্রোগ্রাম
রাত ৮-৫০ পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতেঃ
চিত্রনাট্য ফাইয়াজ আহমেদ,
তৃতীয় অধিবেশনঃ পঠিত কামাল লোহানী
সন্ধ্যা ৭-০০ উদ্বোধনী ও অনুষ্ঠান পরিচিতি পঠিত কামাল লোহানী
সন্ধ্যা ৭-০৫ খবরঃ বাংলা রাত ৯-০০ কথিকা/দৃষ্টিকথন আবু তোয়াব খান
সন্ধ্যা ৭-১৫ খবরঃ ইংরেজী রাত ৯-১০ দেশাত্মবোধক গান
সন্ধ্যা ৭-২৫ সঙ্গীত রাত ৯-২৮ খবর শিরোনাম
সন্ধ্যা ৭-৩০ অগ্নিশিখাঃ আশরাফুল আলম পরিচালিত রাত ৯-৩০ সংসদ পর্যালোচনাঃ মুস্তাফিজুর রহমান
(ক)বজ্রকন্ঠ ও শ্লোগান রাত ৯-৪০ সঙ্গীত ও শ্লোগান
(খ) দর্পনঃ আশরাফুল আলম রাত ৯-৪০ সঙ্গীত ও শ্লোগান
রাত ১০-০০ সমাপ্তি।

.

<005.004.040>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
শিরোনাম সুত্র তারিখ
৪। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত বাংলা ও ইংরেজী সংবাদ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র-
এর দলিলপত্র ২৬ মে-৫ জুন, ১৯৭১

বাংলা সংবাদ
২৬-৫-৭১
(১) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেছেন,স্বাধীনতা ও
সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতির মধ্যেই রয়েছে বাংলাদেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার চাবিকাঠি।
(২) ওয়ার অন ওয়ান্ট প্রতিষ্ঠান প্রধান ও বৃটিশ এম-পি আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করেছেন।
(৩) বুদাপেষ্টের শান্তি সম্মেলন বাংলাদেশে পাকিস্তানী হামলার নিন্দা করেছে।
(৪) মুক্তিফৌজ গানবোট দখল করেছে, কালভার্ট উড়িয়ে দিয়েছে, পাক ফাঁড়ি উড়িয়ে দিয়েছে।
(৫) আজ বাংলাদেশের সর্বত্র বিদ্রোহী কবি নজরুলের জন্মজয়ন্তী পালিত হচ্ছে।
(৬) বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি বিচারপতি জনাব আবু সাঈদ চৌধুরী নিউইয়র্ক পৌছেছেন।
(৭) পাকিস্তান বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘের প্রধান উ থান্টের কাছে বাংলাদেশের বৌদ্ধহত্যার কাহিনী
জানিয়েছেন।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেছেন যে, বাংলাদেশের স্বাধীন ও সার্বভৌম সত্তা স্বীকার করে নেওয়ায় মধ্যে নিহিত রয়েছে বাংলাদেশে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরে আসার নিশ্চয়তা। তিনি আশা প্রকাশ করেছেন যে, জাতিসংঘ বাংলাদেশ থেকে পাক সৈন্য সরিয়ে নিতে পাকিস্তান সরকারের উপর প্রভাব বিস্তার করবে।
ইউনাইটেড প্রেস ইন্টারন্যাশনালের জনৈক বিশেষ প্রতিনিধির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে আমাদের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান বাংলাদেশ মনোভাব ব্যক্ত করেছেন।
ভারতে আশ্রয়প্রার্থী বাংলাদেশ শরণার্থীদের সাহায্য দানের জন্য বিশ্ব সরকারসমূহের প্রতি জাতিসংঘের সেক্রেটারী জেনারেল যে আবেদন জানিয়েছেন সে সম্পর্কে মন্তব্য প্রসঙ্গে সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন,বিরাট সংখ্যক নির্যাতিত ও নিগৃহীত মানুষ যে পাক-দস্যুদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে গিয়েছে উ থান্টের আবেদনে তার স্বীকৃতি রয়েছে। সেক্রেটারী জেনারেলের বিবৃতি থেকে এও প্রতীয়মান হয়, কি নিদারুন পরিস্থিতিতে মানুষ জন্ম-জন্মান্তরের বাড়িঘর ছেড়ে বিদেশে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে।
সৈয়দ নজরুল ইসলাম আশা প্রকাশ করে বলেন যে উ থান্ট বাংলাদেশে এমন একটা পরিবেশ সৃষ্টি করার দায়িত্ব নেবেন যে পরিবেশে দেশত্যাগী শরণার্থীরা পূর্ণ মর্যাদায় ও নিরাপত্তায় আবার দেশে ফিরে আসতে পারবেন। উক্ত সাংবাদিকের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার এ বক্তব্যের দ্বারা আমি এ কথাই বোঝাতে চাচ্ছি যে জাতিসংঘ পাকিস্তান সরকারের উপর এমন একটা চাপ সৃষ্টি করবে যে চাপের মুখে বাংলাদেশ থেকে

পাক হানাদার বাহিনী প্রত্যাহার করা হবে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব স্বীকৃত হবে। তিনি বলেন যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব স্বীকৃত হওয়ার মধ্যেই বাংলাদেশে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা

<005.004.041>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

ফিরে আসার সম্ভাবনা নিহিত রয়েছে। তিনি বলেন, শুধু সে অবস্থাতেই দেশত্যাগী লক্ষ লক্ষ নারী-পুরুষ-শিশু স্বদেশে ফিরে আসতে পারবে।
বুদাপেষ্ট শান্তি সম্মেলনে যোগদানকারী ৫৫টি দেশের ১২৫ জন প্রতিনিধি একটি বিশেষ আবেদন প্রচার করেছেন। প্রতিনিধিদের মধ্যে মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, আইনজীবী, চিকিৎসক, সাংবাদিক, আফ্রো-এশীয় দেশসমূহের মুক্তি আন্দোলনের এবং গোষ্ঠী-নিরপেক্ষ দেশসমূহের নেতৃবৃন্দ রয়েছেন।
আবেদনে বাংলাদেশের শরণার্থীদের সাহায্যদানের জন্য এবং তারা যাতে মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে পারেন সেই অবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য বিশ্বের সরকারসমূহের ও জনগণের প্রতি অনুরোধ জানান হয়েছে। তারা বাংলাদেশে গণহত্যার জন্য পাকিস্তান সামরিক শাসক-চক্রের কার্যকলাপের তীব্র নিন্দা করেছেন। বাংলাদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক আশা-আকাঙ্খার প্রতি মর্যাদা প্রদর্শনের জন্য তারা পাক সামরিক শাসকচক্রের প্রতি আহবান জানান। তারা সিয়াটো-সেন্টো জোটের মার্কিন এবং অন্যান্য সদস্যরা যাতে পাকিস্তানের সামরিক চক্রকে সাহায্য দেয়া বন্ধ করেন তার জন্যও দাবী জানিয়েছেন। বুদাপেস্ট শান্তি সম্মেলনে জাতীয় পরিষদ সদস্য জনাব এম. এ. সামাদ বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন। তিনি বর্তমানে লণ্ডনের পথে রয়েছেন বলে অনুমান করা হচ্ছে।
বিলেতের War on Want প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান মিঃ ডোনাল্ড চেসওয়ার্থ এবং শ্রমিক দলের পার্লামেন্ট সদস্য মিঃ মাইকেল বার্নস গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে এক বৈঠকে মিলিত হন। এই বৈঠক প্রায় তিন ঘণ্টা কাল স্থায়ী হয়। এই বৈঠকে বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতির প্রশ্নে বৃটিশ সরকারের মনোভাব সম্পর্কে আলাপ-আলোচনা হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমাধান বলতে বৃটিশ পার্লামেন্ট কি বোঝাতে চাইছেন সে সম্পর্কে আমাদের প্রধানমন্ত্রী বৃটিশ এম, পি-র কাছ থেকে বিশদ ব্যাখ্য দাবী করে বলে জানা গেছে। বৃটিশ নেতা আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছেন যে, বাংলাদেশের মানুষের আশা-আকাঙ্খার বাস্তবায়নকেই তাঁরা সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান বলে মনে করেন। বাংলাদেশ থেকে বাঙালীদের তাড়িয়ে দিয়ে সেখানে একটা শাসন চাপিয়ে দেওয়ার নাম রাজনৈতিক সমাধান নয় বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
মুক্তিবাহিনীর দক্ষিণাঞ্চলীয় সদর দফতর থেকে পাওয়া এক খবরে জানা গেছে যে, মুক্তিফৌজ এক প্রচণ্ড সংঘর্ষের পর পাকিস্তানী সেনাদের একখানা গানবোট দখল করে নিয়েছে। গানবোটযোগে খানসেনারা টহল দিয়ে বেড়াচ্ছিল। গানবোটের আরোহী সব ক’জন খানসেনাই পানিতে ডুবে মারা গেছে।
মুক্তিবাহিনী জোয়ানেরা বরিশালে একটি থানা আক্রমণ করেন এবং বাঙ্গালীর দুশমন খানসেনাদের কয়েকজন স্থানীয় দোসরকেও হত্যা করেন।
রংপুর সেক্টরে পাকিস্তানী সৈন্যদের একটি দল ধরলা অতিক্রমের চেষ্টা করলে মুক্তিফৌজ তাদেরকে বাধা দেয়। সংঘর্ষকালে বেশ কয়েকজন খানসেনা নদীতে ডুবে মারা যায়।
রাজশাহীর কাছে একটি কালভার্টে মুচক্তিফৌজের স্থাপিত মাইন বিস্ফোরিত হয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি জীপ ধ্বংস হয়েছে। জীপের আরোহীরা গুরুতর আহত হয়েছে বলে জানা গেছে।
সিলেট সেক্টরে বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনী পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের একটি কনভয়ের উপর চোরা-গোপ্তা আক্রমণ চালায়। এতে শত্রুপক্ষের ৭ খানা যানবাহন ধ্বংস হয়। বিয়ানীবাজার এবং বরলেখায় মুক্তিফৌজ খানসেনাদের ১৭ জন স্থানীয় দালালকে হত্যা করেছে বলে সংবাদ পাওয়া গেছে।

<005.004.042>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

সম্প্রতি কুমিল্লার কসবা অঞ্চলে বাংলাদেশ মুক্তিফৌজ একটি পাক-হানাদার বাহিনীর উপর হামলা চালায় এবং তাদের হটিয়ে দেয়।
এই অঞ্চলে মোন্দেভাগ নামক এক জায়গায় পাক-হানাদারদের একটি ট্রলি বোঝাই অস্ত্র আর খাদ্যদ্রব্য যাচ্ছিল। মুক্তিফৌজ সেটি আক্রমণ করে পুড়িয়ে দিয়েছেন। বল্লবপুরে পাক-ঘাঁটির উপর হঠাৎ আক্রমণ করে মুক্তিফৌজ দু’জন প্রহরীকে হত্যা করেছেন। কাঁঠালবাড়িয়াতে মুক্তিফৌজের হামলায় পাক-বাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন ও কয়েকজন পাক-হানাদার খতম হয়েছে। ময়মনসিংহ এলাকার শ্রীবর্দীতে মুক্তিফৌজ একটি পাকা সেতু উড়িয়ে দিয়েছেন।
সিলেট সেক্টরে দুটি পাক-ঘাঁটি মুক্তিফৌজ জ্বালিয়ে দিয়েছেন। এই ঘাঁটি দুটির নাম জামকান্দি ও লালাপুঞ্জি। কুমিল্লায় বিবিরবাজারে মুক্তিফৌজ মাইন ফেলে পাক-হানাদারদের একটি ট্রাক বিধ্বস্ত করেন। হতাহতের সংখ্যা জানা যায়নি। হিলি আর পাচবিবির মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা আমাদের মুক্তিফৌজ বিপর্যস্ত করে দিয়েছেন।
চট্টগ্রাম শহর ও বন্দর এলাকায় যুক্তিসংগ্রামরত বাঙালী ছাত্ররা পাকিস্তানী বর্বর সৈন্যদের হুশিয়ার করে দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার লাগিয়েছে। পোস্টারের ভাষা হচ্ছে, ইয়াহিয়ার সেনাদের খতম কর- ওদের খতম কর- খতম কর। অবিলম্বে বাংলাদেশ ছেড়ে না গেলে হানাদার সৈনিকদের সবাইকে খতম করা হবে বলে হুঁশিয়ারি করে দেওয়া হয়েছে ।
আজ বাংলাদেশের সর্বত্র বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৭২তম জন্মজয়ন্তী পালিত হচ্ছে। এ উপলক্ষে বাংলাদেশের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান আয়োজন করেছে আলোচনা সভা আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। আজকের সান্ধ্য অধিবেশনে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকেও নজরুলের উপর একটি বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করা হবে।
পাকিস্তান বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘ এবং বিশ্ব বৌদ্ধ ফেলোশিপের পাকিস্তান আঞ্চলিক শাখার সভাপতি মিঃ জ্যোতিপাল মহাথেরো জাতিসংঘের সেক্রেটারী জেনারেল উ থান্টের কাছে বাংলাদেশে পাক সৈন্য কর্তৃক বৌদ্ধ নিধনযজ্ঞের সংবাদ জানিয়ে একটা তারবার্তা পাঠিয়েছেন। তারবার্তায় তিনি জাতিসংঘের সেক্রেটারী জেনারেলকে জানিয়েছেন যে, বাংলাদেশে পাক সৈন্যরা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী জনগণকে নির্বিচারে হত্যা করছে। এই হত্যাকাণ্ড থেকে বৌদ্ধ ভিক্ষুরাও বাদ যাচ্ছে না। মহাথেরো জানিয়েছেন, বৌদ্ধদের গ্রামগুলো একের পর এক জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে, মন্দিরগুলো ধ্বংস করা হয়েছে। মহাথেরো বাংলাদেশের বৌদ্ধদের রক্ষা করার জন্য উ থান্টকে অনুরোধ জানিয়েছেন।

ইংরেজী সংবাদ

26-5-71
১। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি বলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বীকৃতি ও স্বার্বভৌমত্ত নির্ভর করছে বিশ্ব মানচিত্রে অত্র অঞ্চলের স্বাভাবিকতা পুনরুদ্ধারের উপর।
২। War on Want (লন্ডন ভিত্তিক একটি দারিদ্র বিমোচন সংক্রান্ত চ্যারিটি সংস্থা) এর চেয়ারম্যান ও লেবার পার্টির একজন এম পি প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ কে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।

<005.004.043>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিল পত্রঃ পঞ্চম খন্ড

৩. বুদাপেষ্ট পীস কনফারেন্স বাংলাদেশে পাকিস্তানী নৃশংসতার নিন্দা জানায়
৪. আজ বাংলাদেশ জুড়ে কবি নজরুলের ইসলামের ৭২তম জন্মদিন উদযাপন করা হয়।
৫. মুক্তিসেনারা একটা গানবোট দখল করে নেয়। একটা কালভার্ট ধ্বংস এবং একটি পাকিস্তানী চেকপোষ্ট পুড়িয়ে দেয়।
৬. “পাকিস্তান বৌদ্ধ কৃষ্টি সংঘের” প্রধান এক তার বার্তায় উ থান্টকে বাংলাদেশের বৌদ্ধদের দুর্দশাপূর্ণ অবস্থার কথা জানান।
৭. জাতিসংঘে বাংলাদেশের বিশেষ দূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী নিউইয়র্কের উদ্দেশ্যে রওনা দেন।
৮। “লন্ডন টাইমস” সংবাদ ছাপায়- পূর্ব বাংলায় সর্বত্র সন্ত্রাস ছড়িয়ে পড়েছে।
৯. সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট মিস্টার পোডগোর্নি গতকাল কায়রো পৌঁছান।

বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ব স্বীকার করার মাধ্যমেই কেবলমাত্র এখান স্বাভাবিকতা পুনঃস্থাপন সম্ভব। তিনি আশা প্রকাশ করেন বাংলাদেশে থেকে পাকিস্তানী শক্তি সরিয়ে নিতে পাকিস্তানকে চাপ দিতে সমর্থ হবে জাতিসংঘ।
ইউনাইডেট প্রেস ইন্টারন্যাশনাল এর এক বিশেষ প্রতিনিধিকে তিনি সব কথা বলেন।
ভারতে বাংলাদেশী শরনার্থীদের জন্য সেক্রেটারী জেনারেল উ থান্টের ত্রাণ সংগ্রহের আহ্বানের সময় তিনি বলেন উ থান্টের এই আহ্বান প্রমাণ করে, বিপুল সংখ্যক বাঙালী তাদের ঘর গৃহস্থালী ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। পাকিস্তান মিলিটারী জান্তার সংগঠিত ভয়াবহতায় তারা তাদের সর্বস্ব ছেড়ে যায়। সেক্রেটারী জেনারেলের আহ্বানে এটাও স্পষ্টত প্রমাণিত হয় কী অসহনীয় পরিস্থিতিতে লোকজন তাদের দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে।
ইউ.পি.আই প্রতিনিধিকে নজরুল ইসলাম বলেন যে, তিনি আশা করেন জাতি সংঘের মহাসচিব বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এমন পরিস্থিতি তৈরি করবেন যেন উদ্বাস্তুরা দেশে ফিরে আসতে পারে। এর মাধ্যমে তিনি বোঝান জাতিসংঘ পাকিস্তান সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করবে যেন তারা পাকিস্তানী দখলদার আর্মিকে বাংলাদেশ থেকে তুলে নিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং সার্বভৈৗমত্ব স্বীকার করে নেয়। তাহলেই কেবলমাত্র শান্তি পুনঃ স্থাপিত হতে পারে।
ইংল্যান্ডের সংগঠন “ওয়ার অন ওয়ান্ট” এর চেয়ারম্যান মিঃ ডোনাল্ড চেশওয়ার্থ এবং একজন লেবার পার্টির সংসদ সদস্য মিঃ মিশেল বার্নস গতকাল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদকে ডেকে নেন। ব্রিটিশ নেতৃদ্বয় আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সাথে অন্তত তিন ঘন্টা সময় কাটান এবং পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। আলোচনায় বাংলাদেশের স্বীকৃতির প্রশ্ন বিশেষভাবে গুরুত্ব পায়।

<005.004.044>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
আমাদের প্রধানমন্ত্রী দুই ব্রিটিশ নেতার কাছে জানতে চান তারা বাংলাদেশে রাজনৈতিক সমাধান বলতে তারা কি বোঝাতে চান। জবাবে তারা বলেন এক্ষেত্রে বাংলাদেশের সংখ্যাগুরু জনসংখ্যার আশা আকাঙ্খার বাস্তবায়নের বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হবে। যে বিপুল সংখ্যক বাঙালী দেশের বাইরে রয়েছেন তাদের উপর কোন রাজনৈতিক সমাধান চাপিয়ে দেওয়া হবে না কোন অবস্থাতেই।
বুদাপেষ্টে অনুষ্ঠিত “বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে” ৫৫টি অংশগ্রহণকারী দেশের ১২৫ জন প্রতিনিধি বিশ্বের সকল সরকারকে ইন্ডিয়ায় বাংলাদেশী উদ্বাস্তুদের জন্য আরো বেশি ত্রাণ এবং সাহায্য পাঠানোর জন্য সম্মিলিতভাবে আহ্বান জানান। সম্মেলনে উদ্বাস্তুদের দেশে ফিরে যাওয়ার মত পরিস্থিতি সৃষ্টি করিতে বিশেষভাবে সাহায্যের কথা বলা হয়। এই আহ্বানে স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে ছিলেন মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, আইনজীবী ডাক্তার এবং আফ্রো-এশিয়ান স্বাধীনতা কামী যোদ্ধা এবং নিরপেক্ষ শক্তি।
তারা পাকিস্তান সরকারকে বাংলাদেশে নজিরবিহীন খুন এবং গণহত্যার জন্য দায়ী করে এবং তাদের নির্দেশনায় সংগঠিত সকল কর্মকান্ডের নিন্দা জানানো হয়। তারা পাকিস্তানী মিলিটারী জান্তাকে বাংলাদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক আশা আকাঙ্খার প্রতি সশ্রদ্ধ হবার আহ্বান জানায়। জাতিসংঘের অন্তর্ভূক্ত SEATO এবং CENTO এর মত সংগঠনগুলোকে শাসক পাকিস্তান সামরিক জান্তাকে সাহায্য বন্ধের আহ্বান জানায়। জনাব এম.এ সামাদ এম.এন.এ বুদাপেষ্টে এই শান্তি সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। তিনি এখন ইংল্যান্ডে যাবার পথে রয়েছেন।
একজন আওয়ামীলীগ কার্যনির্বাহী সদস্য জনাব মোল্লা জালাল উদ্দিন এম.এন.এ এখন পাটনা সফর রয়েছেন। তিনি প্রাদেশিক সরকারের নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনা করেছেন এবং সেখানে অবস্থান কালে এই আলোচনা অব্যাহত রাখবেন
আপনারা শুনছেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংবাদঃ
দক্ষিণ অঞ্চলের মুক্তিসেনারা জানান, উত্তেজনা পূর্ণ এক সংঘর্ষের পর মুক্তিসেনারা বরিশালের উপকূলীয় এলাকায় টহলরত শত্রুদের একটি গানবোট দখল করেছে। গানবোটে অবস্থানরত পাকিস্তানী সেনারা পানিতে ডুবে ইহলীলা …… করে। বরিশালে স্বাধীনতা কামী জওয়ানরা এক পুলিশ ষ্টেশনে তীব্র আক্রমণ করে দখল করে নেয় এবং স্থানীয় পাকিস্তান সহযোগীদের পরাজিত করে।
রংপুরে পাকিস্তানী বাহিনী যখন ধরলা নদী অতিক্রম করে, রাজশাহী কাছে তখন মাইন বিস্ফোরণ করে একটি কালভার্ট উড়িয়ে দেওয়া হয় এবং শত্রুদের একটি জিপ ধ্বংস করা হয়েছে। সিলেটে শত্রুদের এক কনভয়ে গেরিলা আক্রমণ করে সাতটি ট্রাক ধ্বংস করা হয়।
মুক্তিফৌজ কসবায় যুদ্ধসরঞ্জাম এবং খাদ্যভর্তি এক লরিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। বল্লবপুরের পাকিস্তান ফাঁড়িতে অতর্কিত আক্রমণ করে মুক্তিফৌজ দুই পাহারাদারকে হত্যা করে। কাঁঠালাবাড়িয়াতে এক পাস্তিান আর্মি ক্যাপ্টেন এবং তার কিছু সহযোগীকে খুন করা হয়। শ্রীবর্দিতে মুক্তিফৌজ সফলভাবে একটি কংক্রিটের ব্রিজ উড়িয়ে দিতে সমর্থ হয়। জামকান্দি এবং লালাপুঞ্জিতে দুইটি পাকিস্তান ফাঁড়ি পুড়িয়ে দেয় মুক্তিফৌজের সদস্যরা এবং কুমিল্লার বিবির বাজারে মাইন অপারেশনে শত্রুর লরি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।

<005.004.045>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
পাকিস্তান বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘ এবং পাকিস্তান সেন্টার ফর দ্য ওয়ার্ল্ড ফেলোশিপ অফ বুড্ডিষ্ট এর সভাপতি মিস্টার জ্যোতিপাল মহাথেরো জাতিসংঘ মহা সচিবের কাছে এক বার্তায় বাংলাদেশে বৌদ্ধদের দুরবস্থার কথা জানিয়ে বিশ্ব সংস্থার কাছে তিনি বৌদ্ধদের রক্ষায় জরুরী নিরাপত্তার ব্যবস্থা করার আহ্বান জানান। তার বার্তায় তিনি আরো বলেন, ভিক্ষুসহ অনেক বৌদ্ধকে নৃশংসভাবে পাকিস্তানী বাহিনী হত্যা করে, নন্দির ধ্বংস করে দিয়ে বৌদ্ধ গ্রাম পুড়িয়ে ছাই বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। পাকিস্তানী সেনাদের সহযোগী দুর্বৃত্তরা সম্পত্তি লুট করে। দয়া করে তাদের নিরাপত্তা দিন।
জাতিসংঘে বাংলাদেশের বিশেষ দূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর লন্ডন থেকে নিউইয়র্ক যান তার দায়িত্ব গ্রহণ করতে। জাতিসংঘে তিনি বাংলাদেশের ঘটনাবলী উপস্থাপন করবেন। বিচারপতি চৌধুরী আমেরিকার জনগণ এবং সংবাদ মাধ্যমেও বাংলাদেশে দখলদার পাকিস্থানী বাহিনীর পূর্ব পরিকল্পিত গণহত্যা, তারুন এবং বুদ্ধিজীবীদের হত্যার কথা উপস্থাপন করবেন।
আজ বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৭২তম জন্মদিন পালিত হয় সারা বাংলাদেশে। এই উপলক্ষে বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন সেমিনার এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মতো নানাবিধ কর্মসূচীর আয়োজন করে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে সন্ধ্যাকালীন প্রচারের নজরুল জয়ন্তী উপলক্ষ্যে এক বিশেষ আয়োজন প্রচার করবে।
দি টাইমস অফ লন্ডন “বাংলাদেশ সার্বিক ভয়ানক সামাজিক অবস্থা তুলে ধরে। টাইমস প্রতিনিধি পিটার হ্যাজেল হার্স্ট বলেন, “পূর্ব বাংলার আনাচে-কানাচে সন্ত্রাস ছড়িয়ে পড়েছে। হাজার হাজার লোক বাস্তুচ্যুত, সর্বত্র দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পড়েছে। মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়া রোগের সাথে লড়াই করার মতো পর্যাপ্ত ডাক্তারও নেই।”
সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট পোডগোর্নি দু’দিনের সফরে গতকাল কায়রো এসেছন সর্বশেষ মধ্যপ্রাচ্য সংকট নিয়ে রাষ্ট্রপতি আনোয়ার সাদাতের সাথে কথা বলতে।
বাংলাদেশে গত নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় আক্রান্তদের জন্য ব্রিটিশ জনগণের দেওয়া এক মিলিয়নের বেশি ইউরো লন্ডন ব্যাংকে অলস পড়ে আছে বিপর্যয়ের ছয় মাস পরেও। বৃটেনের অন্যতম বৃহৎ ত্রাণ সংস্থা অক্সফামের মতে, টাকাটা অলস পড়ে আছে কারণ, পাকিস্তান সরকার ত্রাণকর্মীদের ঐ অঞ্চলে ঢোকার অনুমতি দেয়নি।
২৭-৫-৭১
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেন “আমরা পাকিস্তানের জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলাম এবং সেজন্য আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি।

.

<005.004.046>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

যখন আমাদের সকল শান্তিপূর্ণ প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে এবং ২৫ মার্চের কালরাতে ইয়াহিয়ার আর্মি নিলর্জ্জভাবে অস্ত্রহীন বাঙালীর উপর আকস্মিকভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা ছাড়া আমাদের কোন বিকল্প ছিল না। ১৫ মিলিয়ন বাঙালীর অস্তিত্ব রক্ষার জন্য এটি ছিল রক্ষাকবচ।
টাইমস অফ লন্ডনের এক প্রতিনিধির সাথে আমাদের প্রধানমন্ত্রী কথা বলেন। তিনি বলেন “আমি বুঝতে পারিনা বিশ্বের গণতান্ত্রিক সরকার সমূহ সামরিক জান্তা পরিচালিত একটি স্বৈরতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থাকে কি করে সমর্থন করে। যেখানে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার জন্য একটি জাতির আশা আকাঙ্খা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।
পাকিস্তানের প্রধান অর্থনীতিবিদের মতে, “পশ্চিম পাকিস্তান গ্রীষ্মের শেষে দেউলিয়া হয়ে যাবে এবং বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে পুরোপুরি ব্যর্থ হবে।” হার্ভার্ডের অর্থনীতিবিদ বরার্ট ডফম্যান গতকাল বলেন “বাইরের সাহায্য ছাড়া পশ্চিম পাকিস্তান বাংলাদেশে পরিচালিত মিলিটারী কার্যক্রম চলমান রাখতে পারবেনা। তিনি আরো বলেন “মনে হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তান এ মাসে বাকি থাকা কিস্তি সমূহ স্থগিতের পথ খুঁজছে। তাছাড়া আমেরিকার চলমান অনুদান এবং ঋণ কোন সামরিক অভিযানের চেয়ে পশ্চিম পাকিস্তানী কৌশলের জরুরী পরবর্তী লক্ষ্য। তিনি বলেন আমেরিকার উচিত কোন সেনা অভিযানের জন্য টাকা না দেওয়া।
বাংলাদেশে ত্রাণ কার্যক্রম সমন্বয়ের জন্য সেক্রেটারি জেনারেল উ-থান্টের প্রতিনিধিকে এদেশে আসতে দিয়ে পাকিস্তানীরা নিজেদের ঔদ্ধত্য নিজেরাই গলধঃকরণ করতে বাধ্য হয়। জাতিসংঘে পাকিস্তানের প্রতিনিধি মি. আগা সাদীর চিঠিতেই বিষয়টি পরিস্কার হয়ে যায়। গতকাল জাতিসংঘের সদরদপ্তর থেকে চিঠিটি প্রকাশিত হয়। এর আগে জাতিসংঘ পাকিস্তানের প্রতিনিধি হিসেবে বিলুপ্ত পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ছাড়া কেউই তাকে স্বীকার করেননি।
সোভিয়েট কমুনিস্ট পার্টির পত্রিকা “প্রাভদা” সোমবারে আসামে পাকিস্তানী বাহিনীর অগ্নি সংযোগের খবর প্রকাশ করে। এতে এই অঞ্চলে বেড়ে যাওয়া উত্তেজনা সোভিয়েত রাশিয়ার চিন্তার কারণ বলে প্রতীয়মান হয়। এই রিপোর্টে পূর্ববাংলায় দখলদার পাকিস্তানী বাহিনীর কার্যক্রম পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বর্ণনা করে।
জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট জানিয়ে দেন পরবর্তী মেয়াদের জন্য তিনি আর প্রতিদ্বন্দ্বীতা করবেন না।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশে শান্তি এবং গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় মধ্যস্ততা করার জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়কে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানান। গতকাল তিনি ভারতীয় লোকসভায় আট ঘন্টা ব্যাপী এক বিতর্কে উত্তর দিচ্ছিলেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন বাংলাদেশে পাকিস্তানের পরিকল্পিত গণহত্যা এবং উদ্বাস্তু প্রবেশ ভারতের এমনকি দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার শান্তি এবং নিরাপত্তার জন্য হুমকি
সেনা, অর্থ এবং রাজনৈতিক উপদেষ্টাদের নিয়ে সোভিয়েত রাষ্ট্রপতি পোডগোর্নি তার মিশরীয় সহযোগী প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতের সাথে আলোচনা শুরু করেন। পোডগোর্নি গত সোমবার কায়রো পৌঁছে রাতে মিশরের রাষ্ট্রপতির সাথে দেখা করেন। গতকাল পর্যন্ত আলাপ আলোচনা চলছিলো।

<005.004.047>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
ইয়াহিয়ার দখলদার সরকার সরকারী চাকুরীজীবীদের মে মাসের বেতন ভাতার বিষয়টি আজকে পর্যন্ত পরিস্কার করেনি। নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় সরকারী ভাতা থেকে বরাদ্দ হিসেবে থাকলেও তা এখনো পৌঁছায়নি।
আওয়ামী লীগ বাংলাদেশ নিয়ে যে কোন সমঝোতার সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়ে বলেছে যে, এই চেষ্টা যেই করুক, বাংলাদেশের জনগণ শেষ পর্যন্ত তা নাকচ করে দেবে। আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্টের এক মুখপাত্র দাবী করেন, ইয়াহিয়ার এক গুপ্তচর আপোষমূলক সমাধানের জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ জোর দিয়ে বলেছে বাংলাদেশ একটি যুক্ত এবং সার্বভৌম দেশ এবং আলাপ আলোচনার জন্য নতুন কোন সুযোগ নেই।
কলকাতার বাংলাদেশ মিশনের প্রধান মিঃ হোসেন আলী কবি নজরুল ইসলামের ৭২ তম জন্মদিনে বাংলাদেশের ৭৫ মিলিয়ন লোকের পক্ষে সম্মান জানান। গতকাল সস্ত্রীক কবিকে দেখতে গিয়ে তিনি তাঁকে ফুলের মালা পড়িয়ে দেন।
কবির বাড়িতে এক বিশেষ আলোচনায় হোসেন আলী বলেন “নজরুল ইসলামের ভালোবাসার দেশ বাংলাদেশে এখন এক ভয়াবহ হত্যাকান্ড চলছে। বাংলাদেশের জনগন দখলদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করছে। ইনশাআল্লাহ আমরা জয়ী হবো।”

২.৬.৭১
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে খবর পড়ছি পারভীন হোসেন।
১. পাকিস্তানে বিদেশী ব্যাংকগুলো পাকিস্তানের ব্যাংকগুলোর এল.সি. গ্রহন করছে না।
২. তিন সদস্য বিশিষ্ট বাংলাদেশের সংসদীয় প্রতিনিধি দল ভারতের রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর সাথে নতুন দিল্লীতে সাক্ষাৎ করেছেন।
৩. খান আব্দুল গাফফার খান বাংলাদেশের সংকটের জন্য ক্ষমতালোভী পশ্চিম পাকিস্তানী দের দায়ী করেন।
৪. গত সোমবার চার তরুণ মুক্তিযোদ্ধা শিকড়গাছায় তিন পাকিস্তানী এজেন্টকে হত্যা করে।
৫. মাওলানা ভাসানী বলেন “স্বাধীনতাই বাংলাদেশের মানুষের একমাত্র লক্ষ্য।“

বিশ্বের আর্থিক সংস্থাগুলো পাকিস্তানের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সতর্কতা জারি করে এবং পাকিস্তানে কোন ঋণ দিতে অস্বীকৃতি জানায়।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
<005.004.048>
ব্যাংক কর্মকর্তারা পাকিস্তানের ব্যবসায়ীদের জানান, পাকিস্তান অর্থনীতির ভয়াবহ সংকটের কারণেই তারা এই পদক্ষেপ নিয়েছেন।

একজন প্রধান এক্সপোর্ট ইম্পোর্ট ব্যবসায়ী পাকিস্তানী এক সংবাদকর্মীকে গতকাল বলেন আমদানির জন্য একটি আমেরিকান ব্যাংক ১০০% ডিপোজিটের শর্তারোপ করেছ।

সুইস এবং জাপানী ব্যাংগুলোও এল.সি. গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছে।

জনাব ফনী মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্য বিশিষ্ট বাংলাদেশের সংসদীয় প্রতিনিধি দল নতুন দিল্লীতে ভারতের রাষ্ট্রপতির সাথে সাক্ষাত করেছেন। বেগম নূর জাহান মোর্শেদ এবং শাহ্ মোয়াজ্জেম হোসেন সহ বাংলাদেশী আইন প্রণেতারা গতকাল পার্লামেন্ট ভারতীয় ভবনে সংসদ সদস্যদের সাথে দেখা করেন। বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র দপ্তরের এক মুখপাত্র আমাদের জানান ৪৫ মিনিট ধরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মুখপাত্র আমাদের জানান ৪৫ মিনিট ধর ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর সাথে আলোচনায় প্রধানত পশ্চিম পাকিস্তানী বর্বরতায় ভারতে যে সকল বাংলাদেশী উদ্বাস্তু অবস্থান করছে, এই সম্পর্কিত সমস্যা প্রাধান্য পায়।

তারা বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতির প্রশ্ন নিয়েও আলোচনা করেন।
ইন্ডিয়ার রাষ্ট্রপতি ভি.ভি গিরি প্রায় বিশ মিনিট ধরে তাদের কথা শোনেন এবং বাংলাদেশ সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন।

বাংলাদেশের তিন আইন প্রণেতা ভারতীয় সংসদে কথা বলার সময় ভারত সরকারের কাছে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে আবেকঘন আবেদন জানায় তারা বাংলাদেশের পটভূমি, পশ্চিম পাকিস্তানের দ্বারা প্রতারিত এবং শোষিত হবার কথা এবং সবশেষে পশ্চিম পাকিস্তানী আর্মিদের নিরীহ বাংলাদেশীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার বর্ণনা দেন।

ইন্ডিয়ার সংসদ সদস্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে জনাব ফনী মজুমদার বলেন বাংলাদেশ গণতন্ত্র ধর্ম নিরপেক্ষতা এবং সমাজতন্ত্রের পক্ষে। তিনি ভার সরকারকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেবার আহ্বান জানান। জনাব ফনী মজুমদার প্রতিটি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ফোরামে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির কথা বলতেও আহ্বান জানান।

<005.004.049>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
রাজনৈতিক স্থিরতা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে মিসেস নূর জাহান মোর্শেদ বলেন, রাজনৈতিক স্থিরতা হতে হবে আমাদের শর্ত মেনে। এবং তা হলো, পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের পুরোপুরি প্রত্যাহার করা এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা।
এর আগে ভারতের সংসদ সদস্যদের বাংলাদেশের জনগণের বৈষম্যের কথা তুলে ধরেন। পাকিস্তান সৃষ্টির শুরু থেকেই যারা দুর্দশার স্বীকার হচ্ছে অথচ আমরাই পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু অংশ। তিনি বলেন পাকিস্তানী শাসকরাই পাকিস্তানকে বিভক্ত করেছে। তারা পাকিস্তানকে হত্যা করেছে আমরা শুধু সমাহিত করছি। পাকিস্তান এর দুই অংশ নিয়ে বিভক্ত এবং দুই অংশের জনগনের মধ্যে একমাত্র ধর্ম ছাড়া অন্য কোন বিষয়ে কোন মিল নেই। জনগণের ইচ্ছে পাকিস্তান এক থাকতে পারেনা। এবং সে ইচ্ছে তৈরি হতে পারতো চাকরের মতো নয় বরং সবাইকে সমান দৃষ্টিতে দেখলে।
জনাব মোয়াজ্জেম হোসেন ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনীল হত্যাযজ্ঞ বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, প্রায় পাঁচ লাখ লোক খুন হয়েছে বাংলাদেশে। তাঁর বক্তৃতায় মোয়াজ্জেম হোসেন বাংলাদেশ সরকারকে কুটনৈতিক স্বীকৃতি দিয়ে সনির্বদ্ধ আহ্বান জানান।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে খবর প্রচারিত হচ্ছে:
পাখতুন নেতা খান আব্দুল গাফফার খান, বাংলাদেশের বর্তমান সঙ্কটের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানী আগ্রাসী, ক্ষমতালোভী, ধনী বা শ্রেণীকে দায়ী করেন।
কাবুলের দৈনিক “কারাভান” রিপোর্ট করে “খান আব্দুল গাফফার খান আওয়ামী লীগ এবং পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের সাথে মধ্যস্থতা বাংলাদেশে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত।
এই পাখতুন নেতা আরও বলেন, জালালাবাদের পাকিস্তান পরিষদ তাকে পাকিস্তান সফর করে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সাথে সাক্ষাত করার আমন্ত্রন জানায়। কিন্তু তিনি পাকিস্তানের এক মিলিটারী স্বৈরশাসকের সাথে দেখা করতে অস্বীকৃতি জানান।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী এম মনসুর আলী দেশের পূর্বাঞ্চলে যাত্রা করছেন। সেখানে অবস্থান কালে তিনি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সাথে সাক্ষাৎ করবেন।
রংপুর, কুমিল্লা এবং ঢাকা সেক্টরে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা তীব্র গেরিলা যুদ্ধ করছে। লালমনিরহাট এবং কেকনিয়া রেললাইনের মাঝে অনেক ব্রিজ উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। পাকিস্তানী সেনাদের জন্য রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। লালমনিরহাট ও কুঁড়িগ্রামে উপর্যুপরি কমান্ডো আক্রমণ করে পাকিস্তানি বাহিনীকে নাস্তানাবুদ করা চলছেই। রিপোর্টে বলা হয়, সম্প্রতি এক আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা লালমনিরহাটে একটি শত্রু জীপ ধ্বংস করে এবং ৬ পাকিস্তানী সৈন্যকে হত্যা করা হয়।
ময়মনসিংহের উত্ত-পূর্বে, ঢাকা সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধারা সম্প্রতি একটা পাকিস্তানী আর্মি টহলদারীতে আগুন ধরিয়ে দেয়। মুক্তিসেনারা সফলতার সাথে পাক বাহিনীর ধরলা নদী অতিক্রম ঠেকিয়ে দেয়। শত্রু সেনারা প্রতিশোধ স্বরূপ গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয় এবং বেসামরিক লোকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।

<005.004.050>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
কুমিল্লা সেক্টরে পাকিস্তানী আর্মির চলাচল বিঘ্নিত করতে মুক্তিবাহিনী আখাউড়ার কাছে দুইটা রেলওয়ে ব্রিজ ধ্বসিয়ে দেয়। কুমিল্লায় পাকিস্তানী সেনারা অসংখ্য লোকজন হত্যা করে মেয়েদের অপহরণ করে নিয়ে যায়। চাঁদপুরের দক্ষিণে পাকিস্তানী সেনারা ৩০০ লোককে গুলি করে হত্যা করে। সম্প্রতি যশোরে স্থানীয় লোকজন দুই পাকিস্তানী সৈন্যকে মেরে ফেলে।
ঢাকা এবং চট্টগ্রামের মধ্যে রাস্তা এবং রেল যোগাযোগ এখনো পুনরায় শুরু হয়নি। আমাদের ময়মনসিংহ প্রতিনিধি জানায়, মুক্তিযোদ্ধারা ময়মনসিংহের তাওয়াকুচা বর্ডারে ফাঁড়ি থেকে পাকিস্তানী সৈন্যদের বিতাড়িত করে।
গত সোমবার ঝিকরগাছা থানার গঙ্গারামপুরে চার তরুন মুক্তিযোদ্ধা তিনজন পাকিস্তানী এজেন্ট কে খুন করে। এর মধ্যে ছিলো স্থানীয় আঞ্জুমান-এ-মুহাজারিন সভাপতি এ সামাদ এবং ঝিকরগাছা থানার দুই সাব ইন্সপেক্টর।
এই পাকিস্তানী এজেন্টরা স্থানীয় দুর্বৃত্তদের সহায়তায় বেসামরিক লোকজনের লুট করা দ্রব্য সামগ্রী জীপে তুলছিলো, তখন চার তরুণ মুক্তিযোদ্ধা হঠাৎ আক্রমণ করে তাদের তিনজনকে হত্যা করে। মুক্তিযোদ্ধারা কিছু রাইফেল এবং একটি হালকা মেশিন গান কেড়ে নেয়। শত্রুদের জীপটা দখল করা হয় এবং মুক্তিযোদ্ধারা মৃত এজেন্টদের একজনের মৃতদেহ নিয়ে আসে।
আপনারা শুনছেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংবাদঃ
ন্যাশনাল আওয়ামী পাটি নেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী বাংলাদেশ বিষয়ে যেকোন রাজনৈতিক সমঝোতার সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছেন। মৌলানা পরিস্কার ভাবে ঘোষণা করেছেন: পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আপনাদের যুদ্ধ শেষ পর্যন্ত চলবে। আমরা জিতবো অথবা মরবো।
তিনি বলেন, দেশ অথবা দেশের বাইরে যদি কোন রাজনৈতিক সমঝোতার চেষ্টা করা হয়, বাংলাদেশের ৭৫ মিলিয়ন লোক তা সাথে সাথে প্রত্যাখ্যান করবে। কারণ লোকজন পাকিস্তানী সরকারের উপর থেকে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে। তাছাড়াও সম্প্রতি বাংলাদেশে তারা বর্বরতা চালায় তা মানব জাতির ইতিহাসে আগে কখনো শোনা যায়নি।
মৌলানা বলেন, জাতিসংঘের পৃষ্ঠপোষকতায় যদি কোন গণভোট অনুষ্ঠিত হয় তাহলে তিনি আপত্তি করবেন না। তিনি নিশ্চিত যে, এক ভাগ লোক ও স্বাধীনতার বিপক্ষে ভোট দিবেনা।
মৌলানা আমেরিকা, রাশিয়া, বৃটেন চীনের মতো দেশগুলোকে বাংলাদেশে পাকিস্তান আর্মির বর্বরতার চিত্র তুলে ধরতে এখানে তাদের সাংবাদিকদের পাঠানোর আহ্বান জানান আওয়ামীলীগ নেতৃত্বের প্রতি সমর্থন জানিয়ে তিনি বলেন বাংলাদেশের জনগনকে আলাদা করে শাসন করার কোন সুযোগ পাকিস্তান সরকারকে দেওয়া হবে না।

<005.004.051-052>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

আপনারা শুনছেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংবাদঃ
বাংলাদেশের দূত জনাব আব্দুল সামাদ এখন মস্কো সফরের পথে। তিনি বলেন ইয়াহিয়ার বাংলাদেশ শরনার্থীদের ভারত থেকে দেশে ফিরে যাওয়ার আহ্বান শুধুমাত্র বিশ্ববাসীকে ধোঁকা দেবার জন্য। যখন পাকিস্তানী সেনারা বাংলাদেশে তাদের গণহত্যা এবং বর্বরোচিত নৃশংসতা করে চলেছে সেখানে ইয়াহিয়ার এই আহ্বান একটি নিষ্ঠুরতার ইংগিত মাত্র।
মিঃ সামাদ গত তিন সপ্তাহ ধরে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ঘুরে ইউরোপের নেতাদেরকে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থার একটি পরিস্কার ধারণা দিতে চেষ্টা করছেন।
খবর এখানে শেষ হলোঃ
৫-৬-৭১
আপনারা শুনছেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রঃ
খরব পড়ছি পারভীন হোসাইন।
১. বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বাংলাদেশের নিরীহ জনগনের উপর পাকিস্তানী বাহিনীর অমানবিক বর্বরতার ব্যাপক নিন্দা জানানো হচ্ছে।
২. পাকিস্তান সরকার অনেক দেরিতে হলেও অবশেষে বিভিন্ন দাতা দেশের কাছে স্বীকার করেছে বাংলাদেশীরা শোষন বঞ্চনার শিকার হয়েছে।
৩. ‘ডেইলী টেলিগ্রাফের’ প্রতিনিধি রিপোর্ট কার যে, পাকিস্তানী আর্মি বাংলাদেশে ভিয়েতনাম ধরনের গেরিলা যুদ্ধের আশংকা করছে
৪. সকল সেক্টরে পাকিস্তানী আগ্রাসনকারীদের উপর মুক্তিযোদ্ধারা ব্যাপক আক্রমণ শুরু করেছে।
৫. রেডিও অস্ট্রেলিয়ার রিপোর্টে বলা হয়, কলকাতার এক রোমান ক্যাথলিক আর্চবিশপ নিশ্চিত করেছেন বাংলাদেশে গত দুই মাসে অন্তত তিনজন যাজক খুন হয়েছে।
পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বাংলাদেশের নিরীহ জনগনের উপর পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর অমানবিক বর্বরতার খবর প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশের জনগনের জন্য বিশ্বের আরও অনেক দেশের জনগন সহানুভুতি প্রকাশ করে এবং সমর্থন জানায়।
জাতি সংঘর বিভিন্ন সহায়ক সংস্থা পশ্চিম পাকিস্তানের সৈনিকদের নৃশংস গণহত্যায় গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে লুক্সেমবার্গে অনুষ্ঠিত ফেডারেশন অফ দ্য ইউনাইটেড নেশনস্ অ্যাসোসিয়েশনের ২৩ম সাধারণ সভায় বাংলাদেশ গণহত্যার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করে নিন্দা প্রস্তাব গৃহীত হয়। বেলজিয়ামের পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতকে এই সভায় প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়নি।
এই সভায় আমেরিকা, রাশিয়া, ব্রিটেন, পোল্যান্ড, ইটালী অস্ট্রেলিয়াসহ ৫২টি দেশের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহন করে। ফেডারেশনের একজন মুখপাত্র বলেন, বাংলাদেশে দুর্ভাগ্য জনক হাজার হাজার হত্যাকান্ডে নিন্দা জানানোর সময় সকল প্রতিনিধিরা সরব ছিলেন।
ভেনেজুয়েলার আইন সভার সদস্যরা জাতিসংঘ সহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাকে বাংলাদেশের জনগনের মানবাধিকারের দিকে দৃষ্টি দিতে পাকিস্তান সরকারের প্রতি আহ্বান জানাতে বলেন। পাকিস্তানী আর্মির যে ভয়াবহ দমনের কারণে বাংলাদেশের উদ্বাস্তুরা দেশ ছেড়েছে, পাকিস্তান যেন তাদের দেশে ফিরিয়ে নেবার যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে এই চাপ সৃষ্টির অনুরোধও তারা জানায়।
যে সীমাহীন অন্যায় অত্যাচার বাংলাদেশে সংগঠিত হয়েছ বিশেষ করে গণহত্যার মতো ঘৃণ্য কর্মকান্ডের জন্য ভেনেজুয়েলার আইন সভার ২১৪ জন সদস্যে একমত হয়ে দুঃখ প্রকাশ করেন।
পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনী বাংলাদেশে যে গণহত্যা চালায় তার প্রতিবাদ স্বরূপ থাইল্যান্ড পাকিস্তান বিমানের জ্বালানীর যোগান বন্ধ করে দেয়। থাইল্যান্ডের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘোষণা করে ৭৫ মিলিয়ন নিরীহ লোকের উপর মিলিটারী অপারেশন চালানোর জন্য কোন বিমানের জ্বালানী তাঁদের কাছে নেই। তাই নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে তাদের অবহিত করানোর কথা বলেন।
ভ্যাটিকানের দৈনিক “অবজারভেটরি রোমানো” প্রকাশ করে যে পাকিস্তানী সামরিক জান্তা বাংলাদেশকে যে যুদ্ধের ভিতর টেনে এনেছে তা একটি অসম যুদ্ধ। প্রথম পাতার মন্তব্যে পত্রিকাটি বলে, এই সংকট সমাধানের জন্য পাকিস্তানের উচিত এই মুহূর্তে যুদ্ধ বন্ধ করা। এবং বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতাকে মেনে নেওয়া। অন্যথায় গেরিলা যুদ্ধের কারণে পূর্ব বাংলা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে যেটা পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনীতিতে আঘাত হানবে।
পাকিস্তান সরকার অনেক পরে অবশেষে দাতা দেশগুলোর কাছে স্বীকার করেছে বাংলাদেশের জনগন বঞ্চনার স্বীকার হয়েছে যার ফলেই এই যুদ্ধ। লজ্জাহীনভাবে পাকিস্তানী মিলিটারী শাসকরা এর প্রতিনিধিদের ঋণ এবং সহায়তা চাইবার কথা বলে দেয়।
বিশ্বস্ত সূত্র মতে পাকিস্তান বর্তমানে প্রতি মাসে ১২০ থেকে ১৫০ মিলিয়ন ক্ষতির মধ্যে রয়েছে। প্রত্যেকটা দেশে পাকিস্তানী মিশনে ঋণ এবং ত্রাণ সংগ্রহের নির্দেশনা দেওয়া
“ডেইলী টেলিগ্রাফের” প্রতিনিধি মে মাসের ২০ তারিখ রিপোর্ট করে, বাংলাদেশে পাকিস্তানী আর্মি দাবী করে সবকিছুই তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে কিন্তু তারা এখন আশংকা প্রকাশ করছে বাংলাদেশে ভিয়েতনামের মতো গেরিলা যুদ্ধ শুরু হতে যাচ্ছে। সাংবাদিক বলেন, প্রতি রাতেই মুক্তি যোদ্ধারা শত্রুদের চলাচলে বাধা সৃষ্টি করতে অন্তত ৩০ রকম ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ড পরিচালনা করছে। পাকিস্তানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অনুমান করছে আরও নিবিড় রকম গেরিলা যুদ্ধ সামনের বর্ষাকালে উপস্থিত হবে।

<005.004.053>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
পৃষ্ঠা- ৫৩
মুক্তিযোদ্ধারা সকল সেক্টরে পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদারদের বিরুদ্ধে ব্যাপক আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। শত্রুদের ধ্বংস করার সংকল্প নিয়ে তারা অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম করছে, মুক্তিযোদ্ধারা রেললাইন উপড়ে ফেলে এবং পথঘাট বন্ধ করে দিয়ে পাকিস্তানীদের কৌশলগত ভাবে ভোগান্তি দিয়ে যাচ্ছে। সকল সেক্টরেই পাকিস্তানী বাহিনী চলাচলের ক্ষেত্রে বাঁধার সম্মুখীন হচ্ছে।

পাকিস্তানী বাহিনীর চলাচল বন্ধ করতে মুক্তিসেনারা বিরল এবং কাঞ্চনকে সংযোগকারী ব্রিজ উড়িয়ে দিয়েছে।

আমাদের রংপুর প্রতিনিধি জানায়, লালমনিরহাট এবং বড়বাড়ির মাঝামাঝিতে টহলরত অবস্থায় পাকিস্তানী বাহিনীর উপর মুক্তিযোদ্ধারা আকস্মিক আক্রমণ চালায় এই অপারেশনে ১৬ জন শত্রু নিহত হয়।

মুক্তিযোদ্ধারা স্বরমাটি রেলওয়ে ব্রিজ উড়িয়ে দিয়েছে। পাকিস্তানী সেনাদের বহনকারী একটা ট্রেন মুক্তিবাহিনী আক্রমণ করে এবং তাদের দশ জনকে হত্যা করে।

তিস্তার ভটমারি ঘাটে মুক্তিযোদ্ধারা দুইটা ফেরী বোট ডুবিয়ে দেয়। এই ফেরি দুইটা পাকিস্তানীরা তাদের সৈন্যদের চলাচলের কাজে ব্যবহার করতো। রেল এবং রাস্তার যোগাযোগ বাঁধাগ্রস্থ হওয়ায় পাকিস্তানীরা চলাচলের ক্ষেত্রে এক ভয়াবহ সমস্যার সম্মুখীন হয়।

উত্তরের সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধা এবং পাকিস্তানী হানাদার সৈনিকদের সাথে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়।

গত শুক্রবার ভুরুঙ্গামারিতে পাকিস্তানী সেনাদের ভারী গোলাগুলি বিনিময় করে এবং শত্রুদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কারণ ঘটায়। এখানে অনেক পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয়। দিনাজপুরে বিভিন্ন জায়গায় মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানী সৈনিকদের উপর ব্যাপক আক্রমণ শুরু করে।

রেডিও অস্ট্রেলিয়া রিপোর্ট করে, কলকাতার এরা রোমান ক্যাথলিক আর্চবিশপ নিশ্চিত করেছে বাংলাদেশে গত দুই মাসে পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে তিনজন যাজক নিহত হয়েছেন। আর্চবিশপ বলেছেন শেষ হত্যাকান্ডটি সংগঠিত হয় ৮ মে, চার্চ বন্ধ করে যাজক বের হলেই তার গায়ে পাকিস্তানীরা আগুন ধরি

<005.005.054>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
শিরোনাম সূত্র তারিখ
৫। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র-
এর নিয়মিত কথিকামালা (অংশ) স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র-এর
দালিলপত্র ৩০মে-২৬ নভেম্বর, ১৯৭১

বিশ্ব জনমত
৩০ মে, ১৯৭১
বিশ্বাসঘাতক ইয়াহিয়া সরকার ২৫শে মার্চ রাতের অন্ধকারে নিরস্ত্র জনতার উপর যে নৃশংস আক্রমণ চালিয়েছে- ইতিহাসে তার তুলনা নেই। আর সে রতের পর থেকেই শুরু হয়েছে বিশ শতকের ইয়াজিদ ইয়াহিয়ার ঘাতক বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের উপর ঔপনিবেশিক শোষণ অব্যাহত রাখার যে চক্রান্ত সাবেক পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে শুরু হয়েছিলো একাত্তরের মার্চ মাসে ঘটলো তারই নগ্ন প্রকাশ। পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকেরা তাই আর কোনকিছু রেখেঢেকে রাখতে চায় না। এজন্য তারা কামান-বন্দুক-মেশিনগান-বোমারু বিমান মায় যুদ্ধ জাহাজ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় বাংগালীদের সামনে একটি মাত্র পথ-সে পথ স্বাধীনতা রক্ষার সশস্ত্র লড়াই। বাংলার বীর জনতা সে দায়িত্ব পালন করেছে। আজ তাই স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ একটি বাস্তব সত্য। এ সত্য বাংলার সাড়ে সাত কোটি জনতার প্রাণের মন্ত্র- বাংলাদেশের বাঁচার শপথ।
বিগত ২৪ বছর বাংলাদেশ শোষিত হয়েছে ধর্ম আর সংহতির নামে। পশ্চিম পাকিস্তানী শোষক গোষ্ঠী লুণ্ঠন করেছে বাংলার সম্পদ-ধ্বংস করেছে বাংলাদেশের আর্থিক মেরুদণ্ড পাট প্রধান অর্থকরী ফসল। আর এ পাট রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করেছে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকেরা। কিন্তু পাটচাষীরা তাতে কোনো উপকৃত হয়নি। বাংলার গরীব চাষী-শ্রমিকেরা আরো গরীব হয়েছে- তাদের উপর নেমে এসেছে নির্যাতনের চরম দণ্ড।
বাংলাদেশ এবং বাংলার জনগণকে বাঁচাবার জন্যই আজ তাই শুরু হয়েছে মরণপথ স্বাধীনতা সংগ্রাম। এ সংগ্রামে শরীক বাংলার বুদ্ধিজীবি, বাংলার কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র-জনতা সবাই।
বাঙালীরা এ সংগ্রামকে আজ নৈতিক সমর্থন জানাচ্ছে সারা দুনিয়ার মানুষের বিবেক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের অধিকাংশ সদস্য দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন বাংলার জনগণের প্রতি তাঁদের সমর্থন। সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি, সিনেটর ফুলব্রাইট এবং আরো কয়েকজন প্রভাবশালী সিনেটর দৃঢ়কণ্ঠে জানিয়ে দিয়েছেন- পাকিস্তানের জংগী সরকার বাংলাদেশে যে গণহত্যা চালাচ্ছে তাকে সমর্থন করার কোন প্রশ্নই ওঠে না। সিনেটের বৈদেশিক সাহায্য সম্পর্কিত কমিটি পাকিস্তানকে আর্থিক সাহায্য দেবার প্রস্তাব সরাসরি নাকচ করে দিয়েছে। ইসলামাবাদের খুনী সরকারের বিশেষ দূত এম, এম, আহমদ হয়েছেন প্রত্যাখ্যাত। সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি তাঁর সাথে দেখা করার সকল আবেদন-নিবেদন নাকচ করে দিয়েছেন।
বাংলাদেশে যুদ্ধ চালাতে গিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানী ঘাতকেরা অধুনালুপ্ত পাকিস্তানের অর্থনৈতিক দেউলিয়াতৃ তুরান্বিত করেছে। যুদ্ধের খরচ দৈনিক দেড় কোটি টাকা। অতএব-চাই-চাই-সাহায্য চাই। সাহায্যের জন্য ভিক্ষাপাত্র নিয়ে দেশ পরিক্রমায় বেরিয়েছিলেন ইয়াহিয়ার দোসর এম,এম, আহমদ কিন্তু সবখানেই ব্যর্থ হয়েছেন- তিনি শূন্য হাতেই ফিরেছেন।

<005.005.055>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

অন্যদিকে যতই দিন যাচ্ছে বাংলা মুক্তিবাহিনীর আঘাত দুর্বার হয়ে উঠেছে। হানাদার শত্রুরা গেরিলা আক্রমণে হয়ে উঠেছে দিশাহারা। সারা বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ এগিয়ে আসছে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সাহায্যে কয়েকদিন আগে বুদাপেষ্টে অনুষ্ঠিত হয় বিশ্বশান্তি কংগ্রেসের অধিবেশন। পৃথিবীর বহু দেশের প্রতিনিধিরা সেখানে সর্বসম্মতভাবে প্রস্তাব নিয়েছেন- বিশ্বশান্তি কংগ্রেস সর্বাত্মক সাহায্য করবে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে।
সুইডেনের সকল রাজনৈতিক দল যুক্তভাবে ঘোষণা করেছেন- বাংলাদেশে ইসলামাবাদের লেলিয়ে দেয়া জল্লাদদের নির্বিচার হত্যালীলা বন্ধ করতেই হবে বাংলার নির্যাতিত জনগণকে। তাদের সকল গণতান্ত্রিক অধিকার অর্জনে তাঁরা জানিয়েছেন অকুণ্ঠ সমর্থন। সুইডেনের ইতিহাসে এই প্রথমবার দল-মত নির্বিশেষে সবাই এমন একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বাংলাদেশের জনগণ বিশ্বের শুভ বিবেকের এই কণ্ঠস্বরকে জানাচ্ছে অকুণ্ঠ অভিনন্দন। লক্ষ লক্ষ স্বাধীনতাকামী জনতা উদ্দীপিত হয়ে উঠেছে- স্বাধীনতার চূড়ান্ত লক্ষ্যে আমাদের লড়াই আজ তাই সুনিশ্চিত বিজয়ের পথে।
ইন্দোনেশিয়ার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ও ইন্দোনেশীয় পার্লামেন্টের স্পীকার মিঃ জাইচেক বিশ্ব মুসলিম সমাজের কাছে বাংলাদেশের সপক্ষে আবেদন জানিয়েছেন। বাংলাদেশে ইয়াহিয়ার হানাদার সেনারা বর্বরতা ও নৃশংসতার যে বীভৎস ইতিহাস রচনা করছে- তার তিনি তীব্র ভাষায় নিন্দা করেছেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালীর উপর অকারণে ইয়াহিয়ার সেনারা যে নির্যাতন চালাচ্ছে তার প্রতিবাদে আওয়াজ তোলার জন্যে তিনি আহবান জানিয়েছেন বিশ্বের সকল মুসলিম রাষ্ট্রের প্রতি। তিনি বলেছেন, বিশ্বের অন্যতম প্রধান মুসলিম রাষ্ট্রের কর্ণধারগণ সে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ অধিবাসীদের বিরুদ্ধে অঘোষিত যুদ্ধ শুরু করেছে- শাসকগোষ্ঠীর এই অমানুষিক হত্যাকাণ্ডের সমর্থন কোন বিবেকসম্পন্ন মানুষই করতে পারে না।
দেশে দেশে পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে জনমত সংগঠিত হচ্ছে। বিবেকের কণ্ঠস্বর আজ বহু দেশে উচ্চকিত। বৃটেনের শ্রমিক দলীয় পার্লামেন্ট সদস্য মাইকেল বার্ণসও বিশ্ববিবেকের সাথে ঘোষণা করেছেন একাত্মতা। বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের কাছে আবেদন জানিয়ে তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশের নিরস্ত্র অসহায় জনগণের উপর পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বর্বরতা বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত পাকিস্তানকে যে কোন রকম সাহায্য দান বন্ধ রাখুন।”
বাংলাদেশের যে সমস্ত লোক পশ্চিম পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন তিনি স্বচক্ষে তাদের অবস্থা প্রত্যক্ষ করেছেন। মিঃ মাইকেল বার্নস বলেছেন, বৃটেনের জনগণ বাংলাদেশের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার সম্পূর্ণ সমর্থন করে।

১০ জুন, ১৯৭১
হংকং-এর ফার ইস্টার্ন ইকনমিক রিভিউ পত্রিকার এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়েছেঃ
দৈনিক ডন এবং দৈনিক পাকিস্তান টাইমসসহ পশ্চিম পাকিস্তানের পত্রপত্রিকা স্বীকার করেছিলেন যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া, শেখ মুজিবুর রহমান ও মিঃ জুলফিকার আলী ভুট্টো ঢাকায় আলোচনা চলাকালে একটা সমঝোতায় এসেছিলেন। ইসলামাবাদ কর্তৃপক্ষ একথা প্রচারও করেছিলেন যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আওয়ামী

<005.005.056>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের চারটি যুক্তিসঙ্গত দাবী মেনে নিয়েছেন। শেখ মুজিবুর রহমানের এই চারটি দাবী হলোঃ

এক – সামরিক শাসন তুলে নেয়া
দুই – সৈন্যদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়া
তিন – নির্বাচিত জন-প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা দেয়া
চার – সশস্ত্র বাহিনী কর্তৃক নিরস্ত্র জনসাধারণ হত্যার তদন্ত করা।

এই দাবীগুলো মেনে নেয়ার কথা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করার আগেই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া নিতান্ত গোপনে ২৫শে মার্চ মধ্যরাতে বিমানযোগে করাচী ফিরে গেলেন। এবং আওয়ামী লীগকে বে-আইনী ঘোষণা করে ও পূর্ব বাংলার নিরস্ত্র মানুষের ওপর সশস্ত্র সৈন্য লেলিয়ে দিয়ে ইয়াহিয়া খান বিশ্বাসঘাতকতা করলেন। এর কোনো যুক্তসঙ্গত ব্যাখ্যাও প্রেসিডেন্ট দিতে পারলেন না। এতে পরিষ্কারভাবে বোঝা গেলো যে, আলোচনার নামে সময় নিয়ে ইয়াহিয়া খান পূর্ববাংলায় সৈন্য আমদানী করলেন- যাতে বাংলাদেশের অধিকার-সচেতন মানুষ ইয়াহিয়া খানের সশস্ত্র বাহিনীর সামনে আর মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। এ সকল কারণে ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর প্রতি সকলে সন্দেহ পোষণ করলো।
কানাডার দৈনিক মন্ট্রিল স্ট্রিট পত্রিকায় বলা হয়েছেঃ

ঢাকার ব্যাপক গণহত্যা পরিকল্পনায় স্বয়ং ইয়াহিয়া খানসহ পাক-সেনাবাহিনীর সব জেনারেল জড়িত ছিলো। মূলত গৃহযুদ্ধ দমনের পরিকল্পনা, তত্ত্বাবধান ও পরিচালনায় এই জেনারেলরা পুরোপুরি সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। এই হত্যাযজ্ঞ কেবলমাত্র টিক্কা খানের নিজস্ব ও একক উদ্যোগ নয়- এটা আসলে খুব সতর্কতা ও সাবধানতার সঙ্গে সংঘটিত একটি মিলিটারী অভিযান। বাঙালী হত্যার সামরিক আদেশ সেনাবাহিনীর সকল ইউনিট কমাণ্ডারের কাছে যাতে প্রত্যক্ষভাবে এবং লিখিতভাবে পৌছে সেজন্য প্রেসিডেন্ট ২৫শে মার্চ বিকেল দুটো পর্যন্ত নিজেই খোঁজখবর নিয়েছেন। সন্ধ্যে সাতটায় প্রেসিডেন্ট বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে বাসভবন ত্যাগ করেন। রাত ১১টায় ট্যাঙ্ক, কামান, মর্টার গানসহ ভারী ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আক্রমণ শুরু হয়।
জাপানের ডেলী জাপান টাইমস এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে লিখেছেনঃ পূর্ববাংলায় পাক-সেনাবাহিনীর সশস্ত্র আক্রমণেই এই রক্তক্ষয়ী অভিযান চলছে। জাপানের আসাহি শিমবুন পত্রিকা বলেছেন, বাংলাদেশে নিহতের সঠিক সংখ্যা জানা না গেলেও সেখানে যে নির্বিচারে গণহত্যা চলছে, তা নজীরবিহীন।
পূর্ববাংলায় যে নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে এবং গণজীবনকে দুৰ্বিসহ করে তুলেছে তাতে বাংলাদেশের নিরস্ত্র ও অসহায় মানুষের প্রতি বিশ্ববাসী সহানুভূতি দেখিয়েছেন। মুক্তিকামী জনতাকে এভাবে হত্যার ফলে পূর্ববাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তানের সম্পর্ক চিরতরে তিক্ত হয়ে গেল। বাংলাদেশে ইয়াহিয়া খানের সেনাবাহিনীর কাণ্ডকারখানার দ্বারা এটাও প্রমাণিত হয়ে গেছে যে, পূর্ববাংলার মানুষ স্বাধীনতার জন্য অকাতরে প্রাণ দিতে পারে এবং তারা প্রাণ দিচ্ছেও।
তুরস্কের ডি ডেলী জুনাইদিন পত্রিকা মন্তব্য করেছেন যে, একদিকে প্রায় এক লক্ষ সুসংগঠিত, সর্বাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য, অপরদিকে সাত কোটি নিরস্ত্র বাঙালী পাকিস্তানী সেনাবাহিনী সকল বাঙ্গালীকে কখনো কতল করতে পারবে না। বাঙালীর মুক্তি অবধারিত।

<005.005.057>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

১৭ জুন, ১৯৭১
বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের বর্বরতা ও ব্যাপক গণহত্যা অপরাধকে ধামাচাপা দেয়ার জন্য ইয়াহিয়ার সামরিক চক্র এক ঘৃণ্য কৌশল অবলম্বন করেছে। বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদারদের গণহত্যার ঘৃণ্য অপরাধ ঢাকা দিতে তারা “ইসলাম বিপন্ন, ইসলামী দেশ বিপন্ন” বলে ধুয়ো তুলেছে। এই ধুয়ো তুলে তারা মধ্যপ্রাচ্য ও আরব দেশসমূহের জনগণকে বিভ্রান্ত করতে চেষ্টা করছে। “ইসলাম বিপন্ন, ইসলামী দেশ বিপন্ন’ বলে তারা ওইসব দেশের সাহায্য নিয়ে পাকিস্তানের কবরে শোয়া অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করতে চাইছে। কিন্তু সবরকমের সাবধানতা সত্ত্বেও ইয়াহিয়ার সামরিক চক্রের এই হীন দুরভিসন্ধি ঢাকা পড়েনি। বাংলাদেশে গণহত্যার রক্তাক্ত হাত তারা লুকোতে পারেনি। গোপন করতে পারেনি তাদের জঘন্যতম অপরাধ।
বিভিন্ন আরব দেশের পাঁচটি প্রভাবশালী যুব সংস্থা এক যুক্ত বিবৃতিতে জানিয়েছে যে ইয়াহিয়ার সামরিক চক্র ধর্মের দোহাই দিয়ে আরব জনগণকে প্রতারিত করার যে চেষ্টা করেছিলো তা ব্যর্থ হয়েছে।
বাংলাদেশের জনগণের উপর পশ্চিম পাকিস্তানী বর্বর বাহিনীর আক্রমণ ও গণহত্যার প্রতিবাদে আরব দুনিয়া থেকে এটাই হলো সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য বিবৃতি ও প্রতিবাদ। ধর্মের দোহাই দিয়ে বিভ্রান্ত করার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলো আবার।
পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের তথা বাঙালীদের বিপুল বিজয়ের বর্ণনা করে বিবৃত্তিতে বলা হয়েছে যে, গণনির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে শাসন ক্ষমতা তুলে দেবার এবং জনগণের রায়ের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের পরিবর্তে পশ্চিম পাকিস্তানের একচেটিয়া পুঁজিপতিদের স্বার্থে ইয়াহিয়া বাংলাদেশে গণহত্যা শুরু করেছে। বাংলাদেশের জনগণের উপর গণহত্যা ও পাকবাহিনীর বর্বরতা ঐক্যের ওপর প্রচণ্ডতম আঘাত হেনেছে।
আরব দুনিয়ার এই পাঁচটি প্রভাবশালী যুব সংস্থা বাংলাদেশের সাত কোটি মানুষের মুক্তি সংগ্রামের প্রতি দৃঢ় সমর্থন ঘোষণা করেছে। বাঙালী মুক্তিসেনাদের বীরোচিত লড়াইয়ের প্রতি দৃঢ় সমর্থন ঘোষণা করেছে। বাঙালী মুক্তিসেনাদের বীরোচিত লড়াইয়ের প্রতি দৃঢ় সমর্থন ও সাহায্যদানের জন্যে সংহতিমূলক প্রচার সংগঠিত করার এবং ইয়াহিয়ার জঙ্গী বাহিনীর গণহত্যার মুখোশ খুলে ধরার জন্য আরব জনগণের প্রতি আহবান জানিয়েছে।
বিবৃতিতে আরব যুব সংস্থাগুলি দাবী করেছেন যে, বাংলাদেশে গণনির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে ইয়াহিয়া ও তার জঙ্গীচক্রকে বাধ্য করে হবে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে।
বিবৃতিতে সিরিয়ার ডেমোক্রাটিক ইউনিয়ন অব ইউথ, ইরাকের ডেমোক্রাটিক ইউথ ইউনিয়ন, ইয়েমেন গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের আসসালাফি যুব আন্দোলন, সুদানের ইউথ ইউনিয়ন,ও লেবানন ডেমোক্রাটিক ইউথ ইউনিয়ন ও লেবানন ডেমোক্রেটিক ইউথ ইউনিয়নে নেতৃবৃন্দ স্বাক্ষর করেছেন। বৃটিশ পার্লামেন্টের শ্রমিক দলের ১২০ জনের বেশী সদস্য বাংলাদেশে গণহত্যার জন্যে ইয়াহিয়ার জঙ্গী সরকারকে এককভাবে দায়ী করে এক প্রস্তাবে স্বাক্ষর করেছেন।
বৃটেনের ক্যাবিনেট মন্ত্রী জন ষ্টোনহাউজ এই প্রস্তাব রচনা করেন। এই প্রস্তাবে পশ্চিম পাকিস্তানী বাহিনীর বাংলাদেশে আক্রমণের ফলে উদ্ভূত পরিস্তিতিকে আন্তর্জাতিক শান্তির পথে মারাত্মক হুমকি ও জেনেভা কনভেনশনের পরিপন্থি বলে বর্ণনা করা হয়েছে। প্রস্তাবে এ ব্যাপারে রাষ্ট্রসংঘকে হস্তক্ষেপ করার আহবান

<005.005.058>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

জানানো হয়েছে। প্রস্তাবে দাবী করা হয় যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকেই প্রকৃত সরকার বলে মর্যাদা দিতে হবে।
মার্কিন প্রতিনিধি সভার এশিয়া বিষয়ক সাবকমিটির চেয়াম্যান মিঃ কর্নেলিয়াস গ্যালাঘার পাকিস্তানকে সবরকম সাহায্য বন্ধ করে দেয়ার জন্যে গতকাল একটি সংশোধনী প্রস্তাব এনেছেন। মার্কিন সিনেটের এ ধরনের একটি প্রস্তাব আনা হয়েছে।
এদিকে ইউরোপের বহু দেশ সুস্পষ্টভাবে একথা জানিয়ে দিয়েছে যে, পাকিস্তান বাংলাদেশে এক তরফা সামাধান চাপিয়ে দিতে পারে না।
সুইডেন, হল্যান্ড, ইতালি, অস্ট্রিয়া ও হাঙ্গেরী সমেত ইউরোপীয় দেশগুলি এ ব্যাপারে একমত হয়েছে যে, পাকিস্তান বাংলাদেশের ওপর একতরফাভাবে কোন সমাধান চাপিয়া দিতে পারে না। ইউরোপের এইসব দেশগুলি তাদের মিত্রদেশসমূহের সঙ্গে একত্রে মিলে ইয়াহিয়া সরকারকে তাদের এই মনোভাব জানিয়ে দেবে।
১৯ জুন, ১৯৭১
…. বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ দূত জনাব আবদুস সামাদ আজাদ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দীর্ঘ এক মাস ধরে সফরের পর মাত্র কয়েক দিন আগে বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চলে ফিরে এসেছেন। জনাব আবদুস সামাদ আজাদ গিয়েছিলেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শান্তিকামী মানুষ ও সরকারের কাছে বাংলাদেশে পাকিস্তানী হানাদারদের ব্যাপক গণহত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ ও বর্বরতার করুণ চিত্রটি তুলে ধরতে এবং দেশ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদারদের উৎখাতের জন্যে বাংলাদেশের মানুষ আজ যে মরণপণ যুদ্ধে নেমেছে তার প্রতি সক্রিয় সহানুভূতি ও সমর্থন আদায় করতে।
জনাব আবদুস সামাদ আজাদ বিশ্বশান্তি সম্মেলনের বুদাপেস্ট অধিবেশনে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে যোগদান করেন। জনাব আবদুস সামাদ আজাদ বলেন, বাংলাদেশের ব্যাপারে এই সম্মেলন সার্থক হয়েছে। তিনি বলেন, জাতীয় স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য সংগ্রামরত বাংলাদেশের জনগণের ন্যায্য সমর্থনে এই সম্মেলনে একটি সর্বসম্মত প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। পরিশেষে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আইনসঙ্গত ও ন্যায্য সংগ্রাম ও তাঁদের বীরত্বের স্বীকৃতি হিসেবে এই সম্মেলনের পক্ষ থেকে ‘ল্যামব্রাকীস’ পদক উপহার দেয়া হয়েছে।
জনাব আবদুস সামাদ আজাদ বলেন, বিশ্ব এটাও বুঝতে পেরেছে যে বাংলাদেশে এই বিস্ফোরক পরিস্থিতির সমাধান না হলে সমগ্র বিশ্বে এর বিস্ফোরণ ছড়িয়ে যেতে পারে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে ইয়াহিয়াশাহীর অবসান ঘটবে। বাংলাদেশ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানীরা নির্মুল হবে এবং তাদের ধবংসস্তুপের ওপর একটি নতুন জাতির অভ্যুত্থান ঘটবে- এই মূল সত্যটি বিশ্ববাসী আজ উপলব্ধি করেছেন।

২০ জুন, ১৯১৭
…পাক সেনারা বাংলাদেশে যে অবর্ণনীয় ধ্বংসযজ্ঞ, লুঠতরাজ ও নারী নির্যাতন চালিয়েছে তাকে কতিপয় দুষ্কৃতকারীরা কার্যকলাপ বলে বিভ্রান্তকর খবর রটিয়েছিলো। কিন্তু বিশ্বের মানুষ তাদের এই অপপ্রচারে বিভ্রান্ত

<005.005.059>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

হয়নি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে শত শত সাংবাদিক, কূটনীতিক, শান্তি ও সমাজসেবী সংস্থাসমূহ এবং পর্যটক প্রকৃত ঘটনাবলী স্বচক্ষে দেখেছেন। তারা দেখেছেন বাংলাদেশে ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনীর লোমহর্ষক নৃশংসতার চিহ্ন। ভারতের সীমান্তে যে লক্ষ লক্ষ শরণার্থীকে ইয়াহিয়া সরকার ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী বলে বর্ণনা করেছিলো তারা সকলেই যে প্রকৃতই বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত এবং ইয়াহিয়ার বর্বর বাহিনীর অত্যাচারেই যে তারা বাধ্য হয়ে দেশ ছেড়েছে এটা তারা প্রত্যক্ষ করেছে। পৃথিবীর সকল দেশের পত্র-পত্রিকা, বেতার ও টেলিভিশনে এর প্রামাণ্য তথ্যাদি প্রকাশিত হয়েছে। বিশ্বের কোন মানুষই ইয়াহিয়া সরকারের জঘন্য প্রচারে ভ্রান্ত হয়নি।
জাতিসংঘের সেক্রেটারী জেনারেল উথান্ট বললেন, বাংলাদেশে যা ঘটছে তা মানব ইতিহাসের এক মর্মান্তিক অধ্যায়- মানব ইতিহাসের এই কলঙ্ক মুছে দেয়া সম্ভব নয়।
বাংলাদেশের ঘটনাবলী সম্পর্কে সেক্রেটারী জেনারেল উথান্টের এই মন্তব্যের কয়েক দিন পরেই জাতিসংঘ ত্রাণ ও সাহায্য দফতরের হাইকমিশনার প্রিন্স সদরুদ্দীন আগা খাঁ ভারত সীমান্তে বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর শিবিরগুলি পরিদর্শন করতে গিয়েছিলেন।
ভারত সীমান্তে শরণার্থী শিবির সফর করার পর সদরুদ্দীন আগা খাঁ নিজেই বললেনঃ বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থীরা নিজেদের জীবন সম্পর্ক কোনোরকম নিশ্চয়তা না পাওয়া পর্যন্ত স্বদেশে ফিরতে পারে না। বাংলাদেশের শরণার্থীরা তাঁর কাছে একটি স্মারকলিপি দিয়েছেন। এই স্মারকলিপিটিতে বাংলাদেশের শরণার্থীরা বলেছেন যে, যতদিন পাক হানাদার বাহিনী বাংলাদেশের মাটিতে থাকবে ততদিন স্বদেশে ফেরা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডী বলেন, পাকিস্তানী হানাদারদের আক্রমণে বাংলাদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ আজও সর্বস্ব হারিয়ে দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে। পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী আজও সেখানে গণহত্যা চালাচ্ছে, আজও তারা সেখানকার সাধারণ মানুষের বাড়ি-ঘর সহায়-সম্পদ ধ্বংস করছে- নারীর ওপর পৈশাচিক নির্যাতন চালাচ্ছে। সারা বাংলাদেশে পাকিস্তানী হানাদারদের এই বর্বরতায় উদ্বেগ প্রকাশ করা ও এর অবসান ঘটানোর ব্যাপারে সচেষ্ট হবার জন্য সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডী মার্কিন প্রেসিডেন্ট মিঃ রিচার্ড নিক্সন ও মার্কিন পরারট্র সচিব মিঃ রজার্সের প্রতি আহবান জানিয়েছেন। সিনেটর কেনেডী বলেন, বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদারদের সৃষ্ট এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে মার্কিন সরকারের নীরবতা মানব ইতিহাসের এক করুন ট্রাজেডি ছাড়া আর কিছুই নয়। তিনি বলেন, আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে যেসব অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করেছে ইয়াহিয়া সরকার তা সবই বাংলার নিরস্ত্র জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছে। সিনেটর কেনেডী বলেন, আর কালবিলম্ব না করে ইয়াহিয়ার জঙ্গী সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে সক্রিয় হতে হবে। বর্তমান জরুরী অবস্থাই ইয়াহিয়া সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির প্রকৃত সময় বলে তিনি উল্লেখ করেন। ২১ জুন, ১৯৭১ … সম্প্রতি হেলসিঙ্কিতে বিশ্বশান্তি সংসদের সম্পাদকমণ্ডলীর এক বৈঠকে বাংলাদেশে পাক হানাদার বাহিনীর সভ্যতা ও মানবতাবিরোধী সামরিক তৎপরতার জন্যে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। বাংলাদেশে পাক

<005.005.060>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

হানাদার বাহিনীর হত্যা, ধ্বংস ও লুণ্ঠন বন্ধ করার ব্যাপারে পাকিস্তান সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতি বৈঠকে আহবান জানান হয়। বিশ্বশান্তি সংসদের সম্পাদকমণ্ডলী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন ও অন্যান্য রাষ্ট্রবর্গের প্রতি এই মর্মে দাবী জানান যে তারা যেন পাকিস্তানকে সর্বপ্রকার সাহায্য দান একেবারে বন্ধ করে দেন।
বাংলাদেশের শরণার্থী প্রসঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারের কাছে এক আবেদনে বিশ্বশান্তি সংসদের সম্পাদকমণ্ডলী বলেন, যারা মানবিকতার নীতিকে অস্বীকার করে, যারা মানবতাকে হত্যা করে- বাংলাদেশে যারা গণতন্ত্র, সভ্যতা ও মানবতাকে একসঙ্গে খুন করেছে তাদের ক্ষমা নেই।
বিশ্বশান্তি সংসদের সম্পাদকমণ্ডলী বিশ্বের বিভিন্ন সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, “শান্তি ও মানবতার প্রতি আজও যারা শ্রদ্ধাশীল তাদের প্রক্যেকেরই উচিত পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের কাছে এমন অনুকূল অবস্থা সৃষ্টির দাবী করা, যাতে বাংলাদেশের শরণার্থীরা তাদের স্বদেশে ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ও শান্তিপূর্ণ জীবন বিশ্বশান্তি সংসদের সম্পাদকমণ্ডলী পাকিস্তান সরকারকে বাংলাদেশ থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে জনগণ কর্তৃক গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবী করেছেন। বিশ্বশান্তি সংসদের সম্পাদকমণ্ডলীর বৈঠকে বাংলাদেশের সংগ্রামকে সাহায্য করার ব্যাপারে সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণের জন্যে বিশ্বের সকল শান্তি সংস্থার প্রতি আহবান জানানো হয়।
বাংলাদেশে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর নির্বিচার গণহত্যা ও ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্যে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক আহবানের উদ্দেশ্যে পৃথিবীর বহু দেশ থেকে বহু মানবদরদী ও শান্তি সংস্থা সেক্রেটারী জেনারেল উত্থান্টের কাছে তারবার্তা পাঠিয়েছেন। এইসব তারবার্তায় বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশের বর্তমান ঘটনাবলী যেহেতু ‘মানব ইতিহাসের সবচেয়ে মর্মান্তিক অধ্যায় সেই কারণেই বাংলাদেশের ঘটনাবলী নিয়ে আলোচনার জন্যে নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত। অথচ কয়েকদিন আগে পর্যন্ত ইয়াহিয়া সরকার তার বেতার, টেলিভিশন ও কূটনৈতিক মিশনসমূহের মাধ্যমে এই ঘটনাকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে প্রচার করছিলো। বাংলাদেশে তাদের সেনাবাহিনীর নির্বিচার গণহত্যাতে তারা বাঙ্গালী-অবাঙ্গালীর মধ্যে সংঘর্ষ ও কমিপয় দুস্তৃকারীর কার্যকলাপ বলে চালিয়ে দিতে চেয়েছিলো। কিন্তু তাদের সে অপকীর্তি বিশ্ববিবেকের চোখে এখন পরিষ্কারভাবে ধরা পড়েছে। জানি না ইয়াহিয়ার সামরিক সরকার এই কেলেঙ্কারির পর আবার কোন ছেদো কাহিনীর আশ্রয় নেবেন- তবে সত্য ঢাকতে গিয়ে, অপরাধ গোপণ করতে গিয়ে তারা যে কৌশলই অবলম্বন করুন না কেন পরিণতি তাদের একই হবে। কারণ, খোঁড়ার পা গর্তেই পড়ে।
২৭ জুন, ১৯৭১
সম্প্রতি বার্লিন থেকে প্রকাশিত জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র সরকারের এক ইশতেহারে ঘোষণা করা হয়েছে যে, পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের ব্যাপক গণহত্যা, লুঠতরাজ, অগ্নিসংযোগ ও নারী নির্যাতনের ফলে বাংলাদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ নরনারী আর যাতে দেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য না হয় এবং ইতিমধ্যেই যে ৬০ লক্ষ বাঙালী দেশ ছেড়ে ভারতে শরণার্থী হতে বাধ্য হয়েছে তারা যাতে অবিলম্বে স্বদেশে ফিরে যেতে পারে এবং বাংলাদেশে যাতে তাদের জানমালের পূর্ণ নিরাপত্তা বিধান করা হয় তার জন্য কালবিলম্ব না করে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ যাতে ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারেন তার জন্যে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এইসব কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের মধ্যেই বাস্তবসম্মত, উপযুক্ত এবং স্বায়ী সমাধানের পথ নিহিত আছে।

<005.005.061>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

জার্মান গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্রের এই ইশতেহারে আরও বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছা এবং সেখানকার গণনির্বাচিত নেতৃবর্গের পরামর্শ ও পরিকল্পনার ভিত্তিতেই মৌলিক রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের এক সঠিক ও সহজ পথ খুঁজে পাওয়া যাবে।
জার্মান গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্রের এই ইশতেহারকে বিশ্বের সকল দেশের রাজনৈতিক মহল দারুণ তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন। তাঁরা বলেন, এই ইশতেহারে বাংলাদেশ থেকে যেসব শরণার্থী ভারতে চলে গেছে তাদের সমস্যাকে শুধু যে কেবল আন্তর্জাতিক সমস্যা বলে বর্ণনা করা হয়েছে তা নয়। এই ইশতেহারে দাবী করা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর প্রত্যাহার, শেখ মুজিবুর রহমানসহ সব রাজনৈতিক নেতার মুক্তি, আওয়ামী লীগের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার, গণনির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রভৃতি।
ইউরোপ ও আমেরিকার পত্রপত্রিকা ও রেডিও-টেলিভিশনসমূহের প্রকাশিত ও প্রচারিত বিভিন্ন সংবাদ ও মন্তব্যে বলা হয়ঃ গত ২৫ শে মার্চ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা বাংলাদেশে যে বর্বরতা চালিয়েছে তাতে বাংলাদেশ থেকে আরও লক্ষ লক্ষ নরনারী দেশছাড়া হতে বাধ্য হবে।
গত ১৯৭০ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশে যে ঘূর্ণিঝড় হয়েছিলো তাতে অনুমানিক ১৮ থেকে ২০ লাখ লোক প্রাণ হারিয়েছে এবং এই ব্যাপক প্রাণহানির মূল্যেও পশ্চিম পাকিস্তানীদের প্রচ্ছন্ন কারসাজি ছিলো। যেসব ব্যবস্থা অবলম্বন করলে ঘূর্ণিঝড়ে ও জলোচ্ছাসে মৃত্যুর হাত থেকে শতকরা ৯৫ জন অব্যাহতি পেতে পারতো, পশ্চিম পাকিস্তানীরা তথা ইয়াহিয়া সরকার ইচ্ছা করেই সেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। এমন কি ব্যাপক প্রাণহানির খবরটুকু পর্যন্ত চেপে গেছে। বাইরের জগত যেটুকু জেনেছে তা বাংলাদেশের বেসরকারী কতগুলো পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে এবং বিদেশী সাংবাদিকদের খবর থেকে। গত ২৫শে মার্চ থেকে ইয়াহিয়া সরকার বাংলাদেশে যে গণহত্যা চাললো, এর খবরও তারা চেপে গেছে। ইয়াহিয়ার জঙ্গী বাহিনী ১০ লাখ নরনারীকে গুলি করে ও আগুনে পুড়িয়ে মেরেছে।
লণ্ডনে কমনওয়েলথ প্রেস সম্মেলনে বিভিন্ন দেশের পত্রপত্রিকা থেকে এই তথ্য উদ্ধৃত করা হয়। অনেকগুলো পত্র-পত্রিকায় একরম মন্তব্য করা হয়েছে যে, পবিত্র বাইবেল গ্রন্থে বর্ণিত মুসার (আঃ) যুগে মিশরের উপর পর পর যে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বিপর্যয় এসেছিলো তাতেও এত প্রাণহানি ঘটেনি। পশ্চিম পাকিস্তানীরা এ পর্যন্ত যত বাঙালী খুন করেছে তার দ্বিতীয় কোন দৃষ্টান্ত নেই। এত নরহত্যা প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে এ পর্যন্ত কখনও ঘটেনি।

২৮ জুন, ১৯৭১

বিশ্বব্যাঙ্ক পাকিস্তানকে আর কোন আর্থিক সাহায্য দেবে না বলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। মার্কিন প্রভাবশালী দৈনিক “ওয়াশিংটন পোষ্ট’-এ প্রকাশিত এক খবরে উল্লেখ করা হয় যে, সম্প্রতি প্যারিস পাকিস্তানকে সাহায্য দানকারী কনসর্টিয়ামভুক্ত ১১টি দেশের প্রতিনিধিদের এক বৈঠকে সর্বসম্মতিক্রমে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। কনসর্টিয়ামভুক্ত দেশসমূহের প্রতিনিধিগণ স্থির করেছেন যে, বাংলাদেশে সবদিক থেকে পূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে না আসা পর্যন্ত পাকিস্তানকে নতুন করে কোন রকম আর্থিক সাহায্যদানের প্রশ্নই উঠতে পারে না। বরং পাকিস্তান এ পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে যেসব ঋণ নিয়েছে সেগুলোই সুদে-আসলে আদায় করা হবে। বৈঠকে আরও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়ে যে, আর্থিক সাহায্য লাভের বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্যে পাকিস্তান যত কান্নাকাটিই করুক না কেন, এ ব্যাপারে কনসর্টিয়ামের আর কোন বৈঠক বসবে না।

<005.005.062>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

‘ওয়াশিংটন পোষ্ট’-এর প্যারিসস্থ সংবাদদাতা জানিয়েছেন যে উক্ত বৈঠকে বেলজিয়াম, কানাডা ও বৃটেন একথা খোলাখুলিভাবে জানিয়ে দিয়েছে যে, পাকিস্তানীরা বাংলাদেশে যে ব্যাপক গণহত্যা, লুটতরাজ ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে তার বিরুদ্ধে তাদের জনমত প্রবল আকার ধারণ করেছে এবং পাকিস্তানকে কোন রকম সাহায্য দানের তারা ঘোরবিরোধী। অতএব নিজেদের দেশের জনমতকে উপেক্ষা করে পাকিস্তানকে সাহায্য দিয়ে বাংলাদেশে সামরিক বর্বরতা চালানোর সহযোগিতা করা তাদের পক্ষে আদৌ সম্ভব নয়। -অর্থাৎ পাকিস্তানকে সাহায্যদানকারী কনসর্টিয়ামভুক্ত দেশসমূহের অভিমত হলোঃ ইয়াহিয়া ও তার জঙ্গী সরকার যতদিন পর্যন্ত বাংলাদেশে গণহত্যা, লুঠতরাজ, অগ্নিসংযোগ ও নারী নির্যাতন বন্ধ না করবে, বাংলাদেশ থেকে যতদিন পর্যন্ত তাদের রক্তভেজা লোমশ হাতগুলো গুটিয়ে না ফেলবে এবং যতদিন পর্যন্ত বাংলাদেশে পূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে না আসবে ততদিন আমরা কেউই পাকিস্তানকে একটি কানাকড়ি পর্যন্ত দিচ্ছি না।
হল্যাণ্ড সরকারও এই একই অভিমত প্রকাশ করেছেন। হল্যাণ্ডের উন্নয়ন সাহায্য সংক্রান্ত মন্ত্রী মিঃ জে, বি, উডনিক হেগস্থ পাকিস্তানী রাষ্ট্রদূতকে তাঁর সরকারের এই সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, যেহেতু পাকিস্তানের সরকার তার নিজের দেশের মানুষের বিরুদ্ধে বর্বর বাহিনীকে লেলিয়ে দিয়ে লক্ষ লক্ষ চালিয়ে ও শহর গ্রাম পুড়িয়ে দিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষকে দেশছাড়া করেছে এবং যেহেতু পাক সরকার নিজেই নিজের দেশের অর্থনীতির মূল বুনিয়াদটিকেই বুলেট-বেয়োনেটের আঘাতে শেষ করে দিয়েছে, সেই কারণেই পাকিস্তানকে নতুন কোন সাহায্য দানের কথা বিবেচনা করা যায় না।
মিঃ উডনিক বলেন, পাকিস্তানকে সাহায্যদানকারী কনসর্টিয়ামভুক্ত দেশসমূহের সিদ্ধান্তের সাথে অমত হয়েই তার সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি বলেন, যেসব সাহায্য দেওয়ার কথা ইতিপূর্বেই হয়েছিলো তা এখন পুনর্বিবেচনা করে দেখা হচ্ছে।…

৪ জুলাই, ১৯৭১ …
ভাটিকানের মহামান্য পোপ পল থেতে শুরু করে জাতিসংঘের সেক্রেটারী জেনারেলে উথান্ট এবং পৃথিবীর শান্তিকামী মানুষ বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদারদের বিরুদ্ধে বর্বরতার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ, ধিক্কার আর ঘৃণা প্রকাশ করেছেন। ইয়াহিয়ার সামরিক সরকার একদিকে যেমন বাংলাদেশে ব্যাপক গণহত্যা ও অবর্ণনীয় বর্বরতায় লিপ্ত হয়েছে অন্যদিকে তারা বাংলাদেশ থেকে বাইরে সংবাদ যাওয়ার সকল পথ রুদ্ধ করে চরম অপপ্রচার ও ভুয়ো কল্পকাহিনী ছড়িয়েছে। এইসব পরস্পরবিরোধী চিত্র ও প্রচারণার জন্যেই সম্প্রতি বৃটিশ পার্লামেন্টের একটি প্রতিনিধিদল পাক-অধিকৃত এলাকাসমূহ এবং বাংলাদেশের মুক্ত এলাকা সফরের এসেছিলেন। এই বৃটিশ পার্লামেন্টার প্রতিনিধিদলে ক্ষমতাসীন রক্ষণশীল ও শ্রমিক উভয় দলের সদস্যই ছিলেন। প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব করেছিলেন দলের প্রভাবশালী সদস্য মিঃ আর্থার বটমলি।
মিঃ আৰ্থার বটমলি ছিলেন বৃটিশ কমনওয়েলথ সচিব। এখন তিনি পার্লামেন্টে শ্রমিকদলের একজন প্রভাবশালী সদস্য।
বাংলাদেশ সফর করে গিয়ে মিঃ বটমলি সাংবাদিকদের বলেছেনঃ ইয়াহিয়া তার সাম্প্রতিক বেতার বক্তৃতায় যে রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলেছেন তা স্রেফ ধাপ্পা মাত্ৰ। ইয়াহিয়ার ওই বেতার বক্তৃতায় রাজনৈতিক সমাধানের প্রস্তাব করা হয়েছে। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ তা ছুড়ে ফেলে দেবেন। ও ধরনের প্রস্তাব বাংলাদেশে মানুষ গ্রহণ করতে পারেন না।

<005.005.063>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

মিঃ বটমলি বলেনঃ আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবুর রহমানকে বাদ দিয়ে সমাধানের দ্বিতীয় কোন পথ নেই। বৃটিশ পার্লামেন্টার দলের অন্যতম সদস্য মিঃ টোবি জেসেল ও বিশিষ্ট সদস্য মিঃ আর্নেষ্ট প্রিন্টিসও এ ব্যাপারে মিঃ বটমলির সঙ্গে একমত।
মিঃ টোবি জেসেল বলেনঃ রাজনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থা বিপজ্জনক। অবিলম্বে এ সমস্যার সমাধান যদি না করা হয়, তাহলে ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষ হতে বাধ্য। তিনি বলেন, পাকিস্তান এখন এ শতাব্দীর সবচে বড়ো দুর্যোগের মধ্যে রয়েছে।
বাংলাদেশে ব্যাপক ধ্বংসের পিছনে ভারতীয় দুষ্কৃতকারীরা রয়েছে বলে পাকিস্তান যে ডাহা মিথ্যা কাহিনী ফেঁদেছিল বৃটিশ পার্লামেন্ট সদস্যগণ সকলেই তার সত্যতা অস্বীকার করেছেন। তাঁরা বলেন, রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে সারা বাংলাদেশে ধ্বংসের যে বীভৎস চিত্র আমরা দেখে এসেছি তা কোনক্রমেই ভারতীয়দের দ্বারা সংঘটিত হয়নি। হওয়া সম্ভবও নয়।…
বৃটিশ পার্লামেন্টারী দলের অপর সদস্য প্রাক্তন বৃটিশ সমর সচিব মিঃ জেমস র্যা মসডেন বলেনঃ বাংলাদেশে পাক সামরিক বাহিনী যা করছে তা বীভৎস। তিনি বলেন, বাংলাদেশে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠার কোন সম্ভবনা নেই। বাংলাদেশের পরিস্থিতি এতই বিপজ্জনক ও দুর্বিষহ যে সেখান থেকে আরও অধিক সংখ্যায় শরণার্থী ভারতে বা প্রতিবেশী দেশে চলে যেতে পারে। এর ফলে শরণার্থী সমস্যা আরও গুরুতর আকারে দেখা দিতে পারে। আর তা দেখা দিলে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। পাকিস্তানের পক্ষে আসবে এক দারুণ মরণ আঘাত। সে আঘাত সহ্য করার ক্ষমতা পাকিস্তানের নেই।
যে পাকিস্তান বর্তমানে এ শতাব্দীর সবচে বড়ো দুর্যোগের মাঝ দিয়ে চলেছে। তাঁরা বলেন, বাংলাদেশের ওপর জঙ্গী শাসন চাপিয়ে রেখে এর সুরাহা হবে না, হতে পারে না। মিঃ আর্থার বটমলি বলেনঃ পাক বাহিনী কেন, পৃথিবীর কোন শক্তির পক্ষেই সাড়ে সাত কোটি মুক্তি-সচেতন মানুষকে দাবিয়ে রাখা সম্ভব নয়। …

৯ জুলাই, ১৯৭১
গতকাল বিশ্বজনমত অনুষ্ঠানে মার্কিন সাময়িকী নিউজউইক’-এ প্রকাশিত বাংলাদেশের ঘটনাবলী সম্পর্কিত একটি মর্মস্পশী রিপোর্টের অংশবিশেষ আমরা উল্লেখ করেছিলাম। দ্য টেরিবল ব্লাড বাথ অব টিক্কা খান” বা “টিক্কা খানের বীভৎস রক্তস্নান’ শিরোনামের এই রিপোটে নিউজউইক’ সংবাদদাতা টনি ক্লিফটন বাংলাদেশে পাক বর্বরতার একটি আংশিক চিত্র তুলে ধরেছেন। রিপোর্টে তিনি বাংলাদেশে যে মর্মান্তিক ঘটনাবলীর কথা বলেছেন সে সম্পর্কে কোন রকম মন্তব্য না করে আমরা শুধু তার বাকী অংশটুকু তুলে ধরছি।
টনি ক্লিফটন তাঁর রিপোর্টে লিখেছেনঃ পাক বর্বরতার যেসব বীভৎস স্বাক্ষর আমি প্রত্যক্ষ করেছি ও পাক-হানাদারদের পৈশাচিকতার যেসব লোমহর্ষক কাহিনী আমি শুনেছি তাতে আমার শুধু একথাই মনে হয়েছে যে বাংলাদেশে কয়েক হাজার মাইলাই ও কয়েক হাজার লিডিসেস সংঘটিত হয়ে গেছে। আমার আজ আর কোন সন্দেহ নেই যে প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে এ পর্যন্ত এমন বর্বরতা কখনও সংঘটিত হয়নি। কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগে এবং এমন কি গত দুটো বিশ্বযুদ্ধেও একখানি বিপর্যয় কখনও ঘটেনি। আমার মনে হয়, পাক বর্বর বাহিনী বাংলাদেশে যে হাজার হাজার মাইলাই আর লিডিসেস করেছে তার শেষ এখানে নয়-বাংলাদেশে আরও অনেক মাইলাই, আরও অনেক লিডিসেস অচিরেই সংঘটিত হতে যাচ্ছে।
টনি ক্লিফটন বলেনঃ এইসব দেখে-শুনে আমার ব্যক্তিগত প্রতিক্রিয়া যা হয়েছে তা যদি বলতে হয় তাহলে আমি বলবো- আমি হতবাক, স্তব্ধ হয়ে গেছি। আমি যা দেখেছি যা শুনেছি তাতে ভয়ঙ্কর এক আতঙ্কে স্তব্ধ হয়ে

<005.005.064>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই। আমি হতবাক হয়ে গেছি- বার বার বিস্ময়ে অবাক হয়ে যাচ্ছি- এই নারকীয় হত্যাকাণ্ড আর এই প্রাগৈতিহাসিক বর্বরতায় একজন মানুষের কোন চেতনা থাকা কি সম্ভব?
টনি ক্লিফটন তাঁর রিপোর্টে বাংলাদেশে পাক-হানাদারদের হত্যা, নির্যাতন ও ব্যাভিচারের বর্ণনা দিতে গিয়ে বাংলাদেশের একটি সর্বহারা বালিকার এক মর্মান্তিক কাহিনী তুলে ধরেছেন।
তিনি বলেনঃ লালফুল ও সবুজ লতাপাতা আকা গোলাপী রঙের একটা ছেড়া ফ্রকের আট-ন বছরের বালিকা ইসমত আরার মুখে আমি এক ভয়ঙ্কর আতঙ্কের প্রতিচ্ছবি লক্ষ্য করেছি। আমি তাকে দেখলাম শরণার্থী শিবিরের অনতিদূরে একটি হাসপাতালে। শত শত আহতদের ভিড়ের একপ্রান্তে সে দাঁড়িয়ে ছিলো। দিশেহারা দুটি ভিরু চোখ দিয়ে চারিদিকে সে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলো। সে যে আহত আমি তা দূর থেকেই লক্ষ্য করলাম। মনে হলো শীর্ণ আলোর একটি রেখার মতো এই মেয়েটি তো কারও বিপদের কারণ হতে পারে না? এই ছোট্ট মেয়েটি ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনীর কাছে কি এমন বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো যার জন্য তারা এভাবে আঘাত করেছে? একজন পাকিস্তানী সৈন্য বেয়োনেট দিয়ে তার ঘাড়ে আঘাত করেছে। তার শ্বাসনালি কেটে দিয়েছে। সে তার গলার ব্যাণ্ডেজের ওপর একটা হাত রেখে দাঁড়িয়ে ছিলো। আমি এগিয়ে গেলাম। মেয়েটি বললোঃ আমার নাম ইসমত আরা আমার বাবার নাম মরহুম ইশাক আলী। কুষ্টিয়ায় আমার বাবার দোকান ছিলো। দু’মাস আগে বাবা কুষ্টিয়ায় রওয়ানা হয়েছিলেন সেই রাতে আমি ঘুমোবার আগে বাইরে কোলাহল আর ভারী ভারী পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম। কি হচ্ছে না হচ্ছে দেখতে যাওয়ার আগেই দেখতে পেলাম অনেকগুলো পাক সৈন্য আমাদের ঘরে ঢুকে পড়েছে। তারা আমাদের ঘরে ঢুকেই আমার দাদাকে গুলি করে। আমার দাদা বি-এসসি পাস করেছিলো। তারপর তারা আমার মা ও বোনদের ওপর অত্যাচার চালায় এবং তাদের শেষ পর্যন্ত বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে মেরে ফেলে। একজন সৈন্য লাফ দিয়ে এসে আমাকে আঘাত করে। তারা বেয়োনেট দিয়ে আমার গলায় আঘাত করার সঙ্গে সঙ্গে আমি পড়ে যাইে এবং মৃতের ভান করি। তারপর সৈন্যরা চলে গেলে পরের দিন একজন লোক দিয়ে আমাকে অচেতন অবস্থায় তুলে নিয়ে আসে। এই কথাগুলো বলার সঙ্গে সঙ্গে সে যেন কেমন হয়ে পড়েছিলো। সেই বীভৎস দৃশ্য যেন তার চোখের সামনে ভেসে উঠছিলো। সে তা সহ্য করতে না পেরে হঠাৎ সরে গেল আমার কাছ থেকে। আর তাকে দেখতে পেলাম না। আমি তার ওয়ার্ডের ডাক্তারের সংগে আলাপ করলাম। ডাক্তার আমায় জানালেন, একদিন এক ভদ্রলোক তাকে রক্তাক্ত অবস্থায় এখানে নিয়ে আসে। এরপর হাসপাতালে আহত শরণার্থীদের ভিড় ঠেলে আমি যখন বাইরে বের হচ্ছিলাম ঠিক সেই সময় ইসমত আরা দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়। তার দুচোখের কোণায় জল টলমল করছিলো। কাঁপা কাঁপা ঠোঁট নিয়ে সে আমায় জিজ্ঞেস করলোঃ বলুন না এখন আমি কি করবো? জানেন আমরা পাঁচ বোন ছিলাম, আমার ভাই ছিলো, মা-বাবা ছিলো। কতো সুন্দর আমাদের ঘরবাড়ি ছিলো। আজ আমার কেউ নেই, কিছু নেই। আজ আমি এতিম। বলুন না, আমি কোথায় যাবো? আমার কি হবে? আমি তাকে বললাম, আর তো কোন ভয় নেই। তুমি এখানে চলে এসেছ, এখন তোমার ভয়ের কিছু নেই। কপট এক নির্বোধের মতো আমি তাকে সান্তনার কথাগুলো বললাম- কিন্তু ইসমত আরার কি হবে? কি হবে আরও হাজার হাজার ইসমত আরার?
টনি ক্লিফটন তাঁর রিপোর্টে উল্লেখ করেন যে, আমেরিকার নিউজার্সির কংগ্রেস সদস্য মিঃ কর্নেলিয়াস গ্যালাঘার আমায় বলেছেন যে, পাক বাহিনীর বর্বরতার খবর অতিরিক্ত বলে আমি প্রথমে মনে করেছিলাম এবং প্রকৃত সত্য যাচাইয়ের জন্যেই আমি শরণার্থী শিবিরগুলো পরিদর্শন করতে গিয়েছিলাম কিন্তু আমি যা দেখেছি তা অবর্ণনীয়। মিঃ গ্যালাঘার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মার্কিন বাহিনীর একজন বিখ্যাত সামরিক অফিসার ছিলেন। তিনি বলেছেনঃ দ্বিতীয় বিশ্ব মহাসমরের সময় ফ্রান্সের বিধ্বস্ত এলাকাগুলো আমি দেখিছি- মর্মান্তিক বধ্যভূমিগুলোও আমি দেখেছি, কিন্তু আমি এমনটি কখনও দেখিনি। এ বীভৎসতা, এ বর্বরতার কোন তুলনা হয় না।

<005.005.065>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

টনি ক্লিফটন বলেন, গত তিন মাসে পশ্চিম হানাদাররা বাংলাদেশে যে নারকীয় বর্বরতায় লিপ্ত হয়েছে তাতে এটা আজ অত্যন্ত সুস্পষ্ট হয়ে গেছে যে পাকিস্তান ভেঙ্গে দুটি স্বতন্ত্র দেশ হয়ে যাচ্ছে। সেটা ঠিক কবে হচ্ছে সেটাই শুধু প্রশ্ন, হচ্ছে কিনা সেটা আজ আর কোন প্রশ্ন নয়। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ আজ একটি বাস্তব ঘটনা।
১০ জুলাই, ১৯৭১

বেশী দিনের কথা নয়। মাত্র কয়েক দিন আগে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ পশ্চিম পাকিস্তানের সংগে বাংলাদেশের সম্পর্কের প্রসঙ্গে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন“বাংলাদেশের লাখো শহীদের লাশের তলায় পাকিস্তানের কবর হয়ে গেছে।” প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীনের এই উক্তির কদিন পরেই লণ্ডনের প্রভাবশালী দৈনিক ডেলী মিরর-এ প্রকাশিত A DEATH OF A NATION শিরোনামের একটি মর্মস্পর্শী রিপোটে বাংলাদেশে পাক বর্বরতার লোমহর্ষক বিবরণ দিয়ে এই একই মন্তব্য করা হয়। এর আগে লেবানিজ দৈনিক “আল সাব’ পত্রিকায় প্রকাশিত ARTIFICIALLLY CREATED PAKISTAN IS UNFIT TO CONTINUE শিরোনামের রিপোর্টটিতেও এই একই মন্তব্য করা হয়। তারপর গত সপ্তায় প্রকাশিত প্রভাবশালী মার্কিন সাময়িকী NEWSWEEK- এ প্রকাশিত THE TERRIBLE BLOOD BATH OF TIKKA KHAN শিরোনামের রিপোর্টে পাকিস্তানীদের বীভৎস হত্যাযজ্ঞ, ব্যাভিচার, নির্যাতন ও ধ্বংসলীলার বিবরণ দিয়ে মন্তব্য করা হয় যে, বাংলাদেশে পাকিস্তানের কবর হয়ে গেছে। পাকিস্তান ভেঙে দু টুকরো হয়ে যাচ্ছে। এ ভাঙ্গন জোড়া দেয়ার নয়। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ আজ একটি বাস্তব ঘটনা। চলতি সপ্তাহে নিউজউইক লিখেছেন, পশ্চিম পাকিস্তান যেদিন বাংলাদেশে সৈন্য পাঠিয়েছে সেই দিনই পাকিস্তানের মৃত্যু হয়েছে।
সম্প্রতি কানাডীয় পার্লামেন্টের তিনজন প্রভাবশালী সদস্য বাংলাদেশ থেকে ভিটেমাটি ছেড়ে যাওয়া সর্বহারা শরণার্থীদের অবস্থা এবং বাংলাদেশে পাক বর্বরতার নমুনা দেখার জন্যে শরণার্থী শিবিরগুলি পরিদর্শনে গিয়েছিলেন।
শরণার্থী শিবিরগুলি পরিদর্শন করে গিয়ে এক সাংবাদিক সম্মেলনে তাঁরা বলেছেনঃ “পূর্ব পাকিস্তান’- এই নামে কোন রাষ্ট্র-রাষ্ট্রাংশের অস্তিত্ব আর নেই। বাংলাদেশ আজ একটি বাস্তব সত্য।
সাংবাদিক সম্মেলনে জাতীয় পরিষদ সদস্যগণ এ কথা জোর দিয়ে বলেন, আমরা একটি গণতান্তিক দেশের নির্বাচিত প্রতিনিধি। নির্বাচন ও গণতন্ত্রের উপর আমাদের পূর্ণ আস্থা আছে। আর এই আস্থা বলেই আমরা মনে করি বাংলাদেশের গণনির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করাই বাংলাদেশ সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ। কানাডীয় পার্লামেন্টারী প্রতিনিধিদলের নেতা, কানাডার ক্ষমতাসীন লিবারেল পার্টির মিঃ জর্জের লাচসি সাংবাদিকদের বলেনঃ শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার দাবী জানিয়ে অন্যায় কিছু করেননি। তিনি বলেন, কানাডার অনেক পরিষদ সদস্যই তো কুইবেক-এর বিছিন্ন হওয়ার দাবী তুলেছেন। এটা গণতান্ত্রিক অধিকার। অতএব এই গণতান্ত্রিক অধিকার তোলার জন্যে কাউকে অপরাধী বলে গণ্য করা উচিত নয়।
শরণার্থী শিবিরগুলি পরিদর্শনের পর কানাডীয় প্রতিনিধিগণ বলেনঃ এটা এখন পরিষ্কার যে পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ পরিকল্পিতভাবে একটি জাতিকে ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন। তাঁরা বলেন, এটা এই শতাব্দীর সবচে কলঙ্কজনক অধ্যায়। শুধু কানাডার জনসাধারণের নয়, বিশ্ববাসী বিশেষ করে কমনওয়েলথ দেশসমূহের মানুষের যা কিছু করণীয় আছে আমরা তা অবশ্যই তুলে ধরবো।

<005.005.066>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

তাঁরা বলেন, পাকিস্তান, ভারত ও কানাডা সকলেই কমনওয়েলথের সদস্য। কমনওয়েলথের একটি সদস্যরাষ্ট্রের সমরনায়করা বাংলাদেশকে ও বাঙালী জাতিকে নিশ্চিহ্ন করবে তা কোনমতেই সহ্য করা যায় না।
কানাডীয় পরিষদের এই তিনজন সদস্য হলেন ক্ষমতাসীন লিবারেল পার্টির মিঃ জর্জেস লাচসি, মিঃ এ বিউইন ও মিঃ হিথ নেলসন। সম্প্রতি ভেনেজুয়েলার কারাকাস থেকে প্রকাশিত খৃষ্টীয় বিশ্বের প্রভাবশালী দৈনিক ‘দ্য রিলিজিয়ন’ পত্রিকায় বলা হয়ঃ পাকিস্তানী হানাদাররা বাংলাদেশে যে নারকীয় বর্বরতায় লিপ্ত হয়েছে তা দেখলে যীশুখৃষ্ট নিজেও ভয়ে শিউরে উঠতেন।
পাক হানাদারদের এই পৈশাচিকতার কঠোর সমালোচনা করে ‘দ্য রিলিজিয়ন’ পত্রিকায় সম্পাদকীয় কলামে বলা হয়ঃ পাক সামরিক সরকার বাংলাদেশের ঘটনাবলীকে ঘরোয়া ব্যাপার বলে চালাতে চেষ্টা করে বিশ্বের বুদ্ধিজীবীদেরই চূড়ান্ত অপমান করেছে। বস্তুতঃ এই সমস্যা একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা এবং মানববিবেকের প্রতি এটা একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ।
১৪ জুলাই, ১৯৭১
… গত ১২ই জুলাইয়ে প্রকাশিত মার্কিন সাময়িকী নিউজইউক-এ বলা হয়ঃ পাকিস্তান যেদিন বাংলাদেশে সামরিক অভিযান চালানোর জন্যে সৈন্য পাঠায় সেই দিনই পাকিস্তানের মৃত্যু হয়েছে।
নিউজউইক’ পত্রিকায় বলা হয়ঃ ইয়াহিয়া খান সামরিক অভিযান চালানোর জন্যে বাংলাদেশে যখন সৈন্য ও সমরসম্ভার পাঠানোর কাজে ব্যস্ত ছিলো ঠিক সেই সময় পাকিস্তানের ঘরে-বাইরে সবদিক থেকেই রাজনৈতিক সমাধানের দাবী উঠছিলো। ইয়াহিয়ার সামরিক প্রস্তুতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ উঠছিলো। দাবী উঠছিলো- পাকিস্তানের যে সঙ্কট তার সমাধান সমরসজ্জা বা সামরিক অভিযানে সম্ভব নয়। সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান করতে হবে। কোন রকম শর্ত আরোপ না করে গণনির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের মধ্যেই সমাধান নিহিত রয়েছে। বুলেট-বেয়োনেটে পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকটের সমাধান সম্ভব নয়। কিন্তু ইয়াহিয়া ও তার সামরিক চক্র ঘরে-বাইরের এই দাবী উপেক্ষা করে পাকিস্তানের গণনির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রস্তাবিত বৈঠক বাতিল করে বাংলাদেশের ওপর সামরিক অভিযান চালালো৷….
নিউজউইক উল্লেখ করেঃ গত সপ্তাহে ঢাকায় কয়েকজন বিদেশী কূটনীতিক মন্তব্য করেছেন, আপোষ আলোচনার আর কোন পথই খোলা রইলো না। ইয়াহিয়ার গোঁয়াতুমির জন্যে আলোচনার সব পথ রুদ্ধ হয়ে গেল। আলোচনা এখন আর সম্ভব নয়। পাকিস্তান মরে গেছে এবং ইয়াহিয়া ও তার সামরিক চক্রই পাকিস্তানকে ধ্বংস করেছে।

১৫ জুলাই, ১৯৭১
… পাকিস্তানকে উন্নয়ন সাহায্য দেওয়ার মত আদৌ কোন অবস্থা রয়েছে কিনা তা সরেজমিনে তদন্ত করার জন্যে বিশ্ব ব্যাঙ্কের একটি বিশেষ প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। বাংলাদেশ ও পশ্চিম পাকিস্তান সফলকরে ফিরে গিয়ে তাঁরা একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছেন।
এই রিপোর্টে বলা হয়েছেঃ বাংলাদেশ ও পশ্চিম পাকিস্তান সফর করে এসে বিশ্ব ব্যাঙ্ক প্রতিনিধিদল তাঁদের রিপোর্টে এই একমাত্র সিদ্ধান্ত করেছেন যে, পাকিস্তানকে সর্বপ্রকার আন্তর্জাতিক সাহায্য দেয়া বন্ধ করা

<005.005.067>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

হোক। কারণ, এখন পাকিস্তানে যে কোন আন্তর্জাতিক সাহায্যই দেয়া হোক না কেন তা সম্পূর্ণ অর্থহীন হয়ে দাঁড়াবে।
রিপোর্টে তারা বলেছেনঃ বর্তমানে পাকিস্তানকে কোন রকম আন্তর্জাতিক সাহায্য দেয়া যাবে না। এমন কি পাকবাহিনী বিধ্বস্ত বাংলাদেশের জন্যে যদি কোন আন্তর্জাতিক সাহায্য পাঠানো হয় তাহলে ইয়াহিয়ার সামরিক সরকার সেই সাহায্যকে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাবে। বাংলাদেশের মানুষের কাছে কোন সাহায্যই গিয়ে পৌঁছুবে না। বাংলাদেশে যুদ্ধ চালাতে গিয়ে পাকিস্তানের অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনীতি দারুণভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে। পাকিস্তানের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙ্গে যাচ্ছে। এ অবস্থায় পাকিস্তানকে কোন রকমের আন্তর্জাতিক সাহায্য দিলে ইয়াহিয়া সরকার তা পশ্চিম পাকিস্তানেই পাচার করবে। অতএব পাকিস্তানকে কোন রকম আন্তর্জাতিক সাহায্য দেয়া যেতে পারে না। বাংলাদেশ ও পাকিস্তান সফরকারী বিশ্ব ব্যাঙ্ক প্রতিনিধিদলের GREİ Mr. I. P. M. CARGILL এই রিপোর্ট প্রস্তুত করেছেন Mr. I. P. M. CARGILL বিশ্ব ব্যাঙ্কের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বিভাগের ডিরেক্টর।
Mr. CARGILL তাঁর রিপোর্টে লিখেছেন, বাংলাদেশে পাকিস্তানী সামরিক অভিযানের ব্যাপকতা এত বেশি হয়েছে যে সেখানে ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক জীবনধারা একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে। বাংলাদেশের মানুষের জীবনে এখন এক ভয়াবহ আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তা ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।
Mr. CARGILL তাঁর রিপোটে লিখেছেনঃ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী বাংলাদেশের সহজ সরল মানুষের বিরুদ্ধে যে এখনও সামরিক অভিযান অব্যাহত রেখেছে, সেখানের সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে তাঁরা যে এখনও চরম শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে, হত্যা, লুণ্ঠন ও ব্যাভিচারে তারা যে এখনও সমান তৎপর রয়েছে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ থাকতে পারে না। সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধেই হোক অথবা বিশেষ ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধেই হোক, সামরিক গভীর আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তা। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ চলছে। মুক্তিসেনাদের হাতে প্রচণ্ড মার খাচ্ছে পাক সেনারা, আর তারই প্রতিশোধ তারা গ্রহণ করছে সাধারণ মানুষের ওপর।
সংক্ষেপে, বাংলাদেশের প্ররিস্থিতি এখন দারুণ উদ্বেগজনক। স্বাভাবিকতার নাম-গন্ধ নেই। বাংলাদেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক বলে পাকিস্তানী সামরিক সরকার যে দাবী করছে Mr. CARGILL তাঁর রিপোর্টে তার কঠোর সমালোচনা করে বলেনঃ সামরিক তৎপরতা বন্ধ করা, সৈন্য প্রত্যাহার করা ও বেসামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসতে পারে না।

১৮ জুলাই, ১৯৭১
কিছুটা বিলম্বে হলেও বাংলাদেশ সম্পর্কে বিশ্বজনমত আজ এক নতুন ধারায় প্রবাহিত হতে শুরু করেছে। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের বিরুদ্ধে বর্বর সেনাবাহিনীকে লেলিয়ে দিয়ে ব্যাপক হত্যা, লুণ্ঠন ও পৈশাচিক নির্যাতন চালিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানী পুঁজিপতি স্বার্থান্বেষী মহল ও ইয়াহিয়া চক্র সর্বাত্মক মিথ্যা ও অপপ্রচার ছড়িয়ে যে বিভ্রান্তির কালো ধোঁয়া ছড়িয়েছিলো বিশ্বমানবতা ও বিশ্ববিবেকের নবতর অভু্যদয়ের আলোকচ্ছটায় তা দ্রুত কেটে যাচ্ছে। বিশ্বের দেশে দেশে আজ ইয়াহিয়ার বর্বর বাহিনীর গণহত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ ও অমানুষিক নির্যাতনের খবর পৌছে গেছে। বাংলাদেশে পাক বাহিনীর গণহত্যা ও বর্বরতার পেছনে কোন দুরভিসন্ধি ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কাজ করেছে বিশ্বের মানুষের কাছে তা আজ অনেকখানি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। পাশে এসে দাঁড়াচ্ছে। বিশ্বের বহু দেশ আজ আমাদের প্রকাশ্যভাবে সমর্থন জানাচ্ছে। কানাডা, পশ্চিম জার্মানী, সুইডেন, স্ক্যাণ্ডিনেভীয় দেশসমূহ এবং আরও কয়েকটি দেশ বাংলাদেশ সংক্রান্ত প্রশ্নটি জাতিসংঘে তোলার জন্যে

<005.005.068>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

উদ্যোগী হয়েছে। বাংলাদেশে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর গণহত্যা ও নির্যাতনের প্রশ্নটি জাতিসংঘে উত্থাপনের প্রস্তুতি প্রায় সম্পূর্ণ হয়ে গেছে। বাংলাদেশে পাক হানাদার বাহিনীর বর্বরতা ও গণহত্যার অপরাধ সম্পর্কে পাকিস্তানের কোন বক্তব্য যে থাকতে পারে না তা ধরে নেয়া হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাংবাদিক, সমাজসেবী, কূটনীতিক, পর্যটক ও বিশ্বসংস্থাসমূহের যেসব প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করে গেছেন তাদের রিপোর্ট ও প্রামাণ্য তথ্যাদি থেকে এটা আজ অত্যন্ত সুস্পষ্ট যে, পাক বাহিনী বাংলাদেশে গণহত্যা ও বর্বরতার অপরাধে অপরাধী। জাতিসংঘে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ উঠলে পাকিস্তান বাংলাদেশে গণহত্যার অপরাধে অপরাধী হানাদার বলে চিহ্নিত হবে এবং সেই সঙ্গে বাংলাদেশও বিশ্ব সংস্থার সমর্থন এবং স্বীকৃতি লাভ করবে।
সোভিয়েট ইউনিয়ন ও ফ্রান্স এ কথা দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেছে যে, সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য দিয়ে কোন অবস্থাতেই তারা পাকিস্তানের সামরিক সরকারকে সহযোগিতা করবে না। অর্থাৎ, ফ্রান্স ও ব্যাঙ্কের যে প্রতিনিধিদলটি গত ৩রা জুন থেকে ২১ শে জুন পর্যন্ত উনিশ দিন ধরে বাংলাদেশ সফর করে গেছেন তারা বাংলাদেশের প্রকৃত ঘটনাবলী ফাঁস করে দিয়েছেন। তারা বলেছেন পরিস্থিতি আদৌ স্বাভাবিক নয়। সেখানে সর্বত্রই ধ্বংসের চিহ্ন ছড়িয়ে আছে, পাক হানাদার সৈন্যরা এখনও বাংলাদেশের ওপর হত্যা, ধ্বংস ও নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। একমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার ছাড়া এইড কনসর্টিয়ামভুক্ত সব দেশই পাকিস্তানকে সাহায্য বন্ধের পক্ষে মত প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশ সফর করে গিয়ে বিশ্বব্যাঙ্ক প্রতনিধিদলের নেতা তাঁর দলের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে একমত হয়ে একথা তো স্পষ্টই ঘোষণা করেছেন যে, পাকিস্তানকে সাহায্য দেয়া অর্থহীন হবে এবং পাকিস্তানকে এখন যে কোন সাহায্যই দেয়া হোক, ইয়াহিয়ার জঙ্গী সরকার তা সামরিক প্রয়োজনে ব্যবহার করবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার বিশ্বজনমত উপেক্ষা করে, ইয়াহিয়ার জল্লাদ বাহিনীকে সমর সম্ভার ও অর্থ সাহায্য দিয়ে বাংলাদেশে গণহত্যার প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করলেও আমেরিকান জনগণ, সংবাদপত্র, বেতার-টেলিভিশ ও বহু জননায়ক বাংলাদেশের প্রকৃত ঘটনাবলী প্রকাশ করে বাংলার জনগণের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছে। মার্কিন সংবাদপত্রসমূহ খোলাখুলিভাবেই বাংলাদেশ প্রশ্নে মার্কিন সরকারী নীতির কঠোর সমালোচনা করেছে। নিউইয়র্ক টাইমস’, ‘ওয়াশিংটন পোষ্ট’, ‘ইভিনিং ষ্টার প্রভৃতি প্রভাবশালী দৈনিক পত্রিকাগুলিতে মার্কিন সরকারী নীতির কঠোর সমালোচনা করে বলা হয়েছে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য ঋণদানকারী রাষ্ট্রগুলির উচিত পাকিস্তানকে সর্বপ্রকার সাহায্য বন্ধ করে দেয়া। ভারতে নিযুক্ত প্রাক্তন মার্কিন রাষ্ট্রদূত Mr. Chester Bowles পাকিস্তানে মার্কিন সাহায্য প্রেরণের কঠোর সমালোচনা করে বলেছেন, মার্কিন সরকারের এ ভুলের কোন তুলনা হয় না। মার্কিন সরকারের এটা শুধু ভুল নয়, এটা একটি ক্ষমাহীন অপরাধ- ইতিহাস এ অপরাধ কোন দিনই ক্ষমা করবে না।

২০ জুলাই, ১৯৭১
… ডাবলিন থেকে প্রকাশিত “আইরিশ টাইমস’ পত্রিকার এক সম্পাদকীয়তে বলা হয়ঃ ইয়াহিয়া তার বেতার ভাষণে যে রাজনৈতিক পরিবর্তনের বা যে রাজনৈতিক রদবদলের প্রস্তাব করেছে তা জঘন্য। ইয়াহিয়া তার বেয়োনেট-উদ্যত সেনাবাহিনী দিয়ে আটক দেশবাসীর উদ্দেশে যে বক্তৃতা করেছে তাতে তার দেশ গোল্লায় যাবে। বাংলাদেশ থেকে যে সকল নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ সেনাবাহিনীর অত্যাচারে দেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছে তারা কেউই এ প্রস্তাবে দেশে ফিরে আসতে পারে না। ক্ষমতা হস্তান্তরের যে পদ্ধতির কথা ইয়াহিয়া ঘোষণা করেছে তা দুরভিসন্ধিমূলক। দশ লক্ষ বাঙালীকে নির্বিচারে হত্যা করে গোটা বাংলাদেশটাকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ধ্বংস করে দিয়ে ইয়াহিয়া বাংলাদেশের কিছু অংশের ওপর তথাকথিত দখল রেখেছে সত্যি, কিন্তু এই দখল

<005.005.069>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

রাখতে গিয়ে তাদের যে কী পরিমাণ দিতে হচ্ছে তা একমাত্র তারাই জানে। কারণ, বাংলাদেশের মানুষ ইতিমধ্যে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে এবং বাংলাদেশে সরকারের অধীনে নিয়মিত সেনাবাহিনী গড়ে উঠছে। সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালাচ্ছেন। বাংলাদেশের সর্বত্রই এখন গেরিলা যুদ্ধ চলছে- শুধুমাত্র তাই নয়, ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনীতেও গণ্ডগোল শুরু হয়েছে।
‘আইরিশ টাইমস’ পত্রিকায় আরও বলা হয় যে, বাংলাদেশ সরকার বর্তমানে সামরিক সমাধানের পথ বেছে নিয়ে যুদ্ধ চালাচ্ছে। বর্তমানের এই দারুণ সঙ্কটপূর্ণ পরিস্থিতিতে শরণার্থীরা দেশে ফিরে যেতে পারে না। ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনী ও সরকার যেখানে আজও হত্যা, লুণ্ঠন ও নির্যাতন সমানে চালিয়ে যাচ্ছে সেখানে শরণার্থীদের ফিরে যাওয়ার প্রশ্নই উঠতে পারে না। এখনও প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে চলে যাচ্ছে। ভারতে এভাবে লাখ লাখ শরণার্থ ঠেলে দিয়ে ইয়াহিয়া সরকার প্রকৃতপক্ষে ভারতের অর্থনীতিকে দুর্বল করতে চাইছে। পত্রিকায় বলা হয়ঃ বাংলাদেশ সমস্যার প্রকৃত সমাধান না হওয়া পর্যন্ত ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক ক্রমশ অবনতির দিকেই যাবে এবং তার পরিণতি হবে ভয়াবহ।
স্টকহোম থেকে প্রকাশিত সুইডিশ দৈনিক, DOGENS NYHETER-এর এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে পাকিস্তানকে বাংলাদেশে সামরিক তৎপরতা বন্ধ করে বাংলাদেশের জনগণের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বলা হয়।
‘ডগেনস নিহিতের পত্রিকার এই সম্পাদকীয় নিবন্ধটিতে ইয়াহিয়ার সামরিক অভিযানের কঠোর সমালোচনা করে বলা হয়ঃ বাংলাদেশে পাক হানাদার বাহিনীর বর্বরতা বর্তমানে চরমে পৌছেছে। এখনও বাংলাদেশ থেকে লাখ লাখ শরণার্থী সৈন্যদের তাড়া খেয়ে দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে।
পত্রিকায় বলা হয়ঃ বাংলাদেশে সামকি বর্বরতা সবকিছুর সীমা ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশ ও ভারত সীমান্তে গিয়ে কিছু সময় দাঁড়ালেই ইয়াহিয়ার স্বাভাবিক পরিস্থিতির দাবীর অসারতা সহজেই ধরা পড়েবোঝা যায় ইয়াহিয়া সরকারের মিথ্যা প্রচারণার বহর।
২৩ জুলাই, ১৯৭১
… সিয়েরা লিওনের ফ্রিটাউন থেকে প্রকাশিত ‘মেইল পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠা জুড়ে এক দীর্ঘ রিপোর্ট বেরিয়েছে। বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ শরণার্থী সম্পর্কে লিখতে গিয়ে ফ্রিটাউন দৈনিকের সংবদদাতা Mr. SOM SHORT প্রশ্ন করেছেনঃ বাংলাদেশে যা ঘটেছে তার চেয়ে বেশি কিছু কি ঘটতে পারতো?
তিনি লিখেছেনঃ বাংলাদেশে যে ভয়ঙ্কর একটা কিছু ঘটেছে এবং এখনও ঘটছে, তা বোঝার জন্যে বা তা বিশ্বাস করার জন্য এর চেয়ে বেশী প্রমাণের প্রয়োজন আছে বলে আমার মনে হয় না। বাংলাদেশের ঘটনাবলী স্বচক্ষে দেখে ফ্রিটাউন দৈনিক মেইল-এর সংবাদদাতা Mr. SOM SHORT বলেন, পাকিস্তান সরকারের নীতি ও কার্যকলাপের পশ্চাতে যে একটা ভীষণ ষড়যন্ত্র বা ভয়াবহ একটা কিছু আছে তা আমি বুঝতে পেরেছি। তিনি লিখেছেন, পশ্চিম পাকিস্তানীদের বর্বরতা ক্রমে বেড়েই চলেছে, যুদ্ধ যতো দীর্ঘস্থায়ী হবে বাংলাদেশে ধ্বংস ও মৃত্যু ততো বেড়ে যাবে। পৃথিবীর সকল দেশের মানুষই তো এখন এখানকার ঘটনাবলীর অল্পবিস্তর জানতে পেরেছে কিন্তু তবু আমরা আমাদের নিজ নিজ দেশের সরকারকে পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টিতে বাধ্য করতে পারছি না কেন?- এই রক্তমানের কি কোন শেষ নেই?

<005.005.070>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

২৯ জুলাই, ১৯৭১
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অবস্থা সম্পর্কে বিশ্বের দৃষ্টিকে বিভ্রান্ত করার যতো অপচেষ্টাই পাকিস্তানী সামরিক চক্র করুক, কিন্তু যা সত্য তাকে ধামাচাপা দিয়ে রাখা সম্ভব নয়। বিশ্বের পত্র-পত্রিকায় নিয়মিতই বাংলাদেশের ঘটনাবলীর খবরাখবর প্রকাশিত হচ্ছে।
আমেরিকান বহুল প্রচারিত সাপ্তাহিক নিউজউইক’ ও লণ্ডনের প্রভাবশালী দৈনিক দি টাইমস’-এ বাংলাদেশে পাকিস্তানী বর্বর সৈন্যদের মোকাবিলায় মুক্তি বাহিনীর সাফল্যজনক অভিযান পরিচালনার খবর প্রকাশিত হয়েছে। পাকিস্তানের সামরিক প্রেসিডেন্ট সম্প্রতি বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পূর্ণরূপে সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন এবং তথাকথিত দুষ্কৃতকারী ও অনুপ্রবেশকারীদের নির্মুল করা হয়েছে বলে যে দাবী করেছেন, সে প্রসঙ্গে ‘The Bengalis Strike Back’ শীর্ষক একটি নিবন্ধে নিউজউইক’ পত্রিকা বলেঃ ইয়াহিয়ার জন্যে দুঃখ হয়, কেননা তিনি যা দাবী করেছেন প্রকৃত ঘটনা তার সম্পূর্ণ বিপরীত। পত্রিকায় বলা হয় যে, সমগ্র বাংলাদেশে মুক্তি বাহিনীর প্রতিরোধ অভিযান ক্রমেই জোরদার হচ্ছে। এ অভিযান গোড়া থেকেই পরিচালিত হচ্ছে এবং উন্নত সমরসজ্জায় সজ্জিত পাকিস্তান সামরিক বাহিনী চরমভাবে ঘায়েল হচ্ছে।
‘নিউজউইক’ বলেঃ বাংলাদেশের বহু কলকারখানা ধ্বংস করা হয়েছে, ডিনামাইট দিয়ে প্রধান প্রধান ব্রীজসমুহ উড়িয়ে দেয়া হয়েছে, মাইন বসিয়ে বহু রেল সড়কের ক্ষতিসাধন করা হয়েছে
পত্রিকায় বলা হয়, সামরিক বাহিনী অধিকৃত ঢাকা শহরেও নিয়মিত গোলাগুলি চলছে। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর বর্বরোচিত কার্যকলাপের বিরুদ্ধে জাগ্রত মুক্তি সংগ্রামীদের অভিযান বাংলাদেশের সর্বত্রই অব্যাহত রয়েছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চল সফরকারী নিউজউইকের সংবাদদাতা মিঃ লোরেন জেনকিনস এখানে মুক্তিবাহিনীর হাতে খুলনার দু’জন দালালের ‘লালরঙা চিঠি’ প্রাপ্তি এবং কড়া সামরিক পাহারাধীন থেকেও শোচনীয় মৃত্যুর খবর জানান।
লণ্ডন টাইমসের রিপোর্টার মাইকেল হর্নসবী জানান যে, বাংলাদেশে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী অহরহ মুক্তি বাহিনীর গেরিলাদের দ্বারা আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মুক্তি বাহিনীর গেরিলারা রাস্তা, রেলওয়ে ব্রীজ, রেললাইন এবং বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থার ক্ষতিসাধন করে পাকিস্তানী সামরিক প্রশাসনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে।
লণ্ডন টাইমসের সংবাদদাতা জানান, বাংলাদেশের সকল শহর বিশেষ করে ঢাকা শহরে গেরিলাদের পাক বাহিনীর ওপর বোমা নিক্ষেপ করছে।
হর্নসবী জানান যে, গেরিলা বাহিনীর আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে প্রতিহিংসাপরায়ণ পাক বাহিনী আশপাশের এলাকার বেসামরিক বাসিন্দাদের ওপর উৎপীড়ন করে থাকে।
বস্তুতঃ বাংলাদেশের পাক বাহিনী অধিকৃত এলাকায় এমনি প্রশাসনিক অচলাবস্থাই বিরাজ করছে। মুক্তি বাহিনীর গেরিলাদের আক্রমণে পাক সেনারা এখানে-ওখানে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। দিন দিনই হানাদার বাহিনীর মনোবল ভেঙ্গে পড়ছে।
এই বাস্তব সত্যকে গোপন করার মতো অপচেষ্টাই পাকিস্তানী জঙ্গী সরকার করুক, বিশ্বের চোখে ধরা পড়বেই। আর এভাবে বাংলার সার্বিক মুক্তিকামী মানুষের সপক্ষে গড়ে উঠবে বিশ্বজনমত।

<005.005.071>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

১ আগষ্ট, ১৯৭১
… বর্তমানে ক্ষমতার লোভে উন্মত্ত ইয়াহিয়ার সৈন্যদের অমানুষিক পাশবিক অত্যাচার ও দাপট যতই বাড়ছে এবং আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতা যতই জোরদার হচ্ছে ততই বিশ্ববাসী আমাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে উঠছেন। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের নির্যাতিত জনগণের সপক্ষে ততই গড়ে উঠছে বিশ্বজনমত।
ইতিমধ্যে জঙ্গীশাহীর অনেক বাধাবিপত্তি সত্বেও বহু বিদেশী সাংবাদিক, সেবাপ্রতিষ্ঠান প্রতিনিধি ও রাজনীতিবিদ যুদ্ধক্ষত বাংলাদেশ সফর করেছেন।
আন্তর্জাতিক রেডক্রস সোসাইটির প্রতিনিধি কর্নেল আ্যালা সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করে তাঁর সফর অভিজ্ঞতা বর্ণনা প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের বলেছেন, বাংলাদেশে দখলদার পাকিস্তানী সৈন্যদের নির্যাতন বায়াফ্রার মর্মান্তিক ঘটনাকেও ছাড়িয়ে গেছে। দখলকৃত এলাকায় হানাদার সৈন্যরা যে বীভৎস হত্যাকাণ্ড ও পাশবিক অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে তার কোন নজির নেই। নরওয়ে রেডক্রসের একজন প্রতিনিধি ভারতের শরণার্থী শিবিরগুলো পরিদর্শন করে বলেছেন, বর্তমান শরণার্থী সমস্যার সাথে বিশ্ব ইতিহাসের অন্য কোন ঘটনার তুলনা করা যায় না।
একটি স্বাধীন দেশে দখলদার সৈন্যরা কতো বেশি নির্যাতন চালিয়ে গেলে ৮০ লাখ মানুষকে ঘর-বাড়ি ও ধন-সম্পত্তি ফেলে দেশত্যাগ করতে হয় তা সকলেই বোধগম্য।
এহেন অবস্থায় বাংলাদেশে যখন মানুষের জীবনের কোনো নিরাপত্তা নেই- মানবতা, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সভ্যতা যখন বিপর্যস্ত, সে ক্ষেত্রে চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দুটি বৃহৎ শক্তি একনাগাড়ে পাকিস্তানের সামরিকশাহীকে অস্ত্র ও আর্থিক সাহায্য করে গণহত্যার উস্কানি দিচ্ছে।
মার্কিন জনগণ ও সেখানকার পত্র-পত্রিকা বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তাঁদের অকুণ্ঠ সমর্থন জানালেও প্রেসিডেন্ট নিক্সন জঙ্গীশাহীকে অস্ত্র সাহায্যের নীতিতে অবিচল রয়েছেন। তাঁরা সকলেই এ বিষয়ে একমত যে, বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত জঙ্গী সরকারকে সাহায্য দেয়ার মানেই হচ্ছে গণহত্যায় অংশ গ্রহণ করা। তা ছাড়া যুদ্ধের ফলে যেক্ষেত্রে বাংলাদেশে তিন কোটিরও রীতিমত যুদ্ধাপরাধ।
এদিকে ওয়াশিংটনের ষ্টেট ডিপার্টমেন্টের আণ্ডার সেক্রেটারী জন আরউইন সিনেটের এক সাব-কমিটির বৈঠকে বলেছেন যে, বাংলাদেশে দারুণ দুর্ভিক্ষের খবর তাঁরা পেয়েছেন। অথচ পাকিস্তানের দখলদার সমরকর্তারা দুর্ভিক্ষ রোধের কোনো চেষ্টা চালাচ্ছে না। এতে এ কথা পরিষ্কার বোঝা যায় যে, দেশ থেকে ৮০ লাখ মানুষকে তাড়িয়ে এবং ১০-১২ লাখ মানুষকে হত্যা করেও এদের কসাই বনোবৃক্তির এখনো খায়েশ মেটেনি।
এমনি মর্মান্তিক অবস্থায় জাতিসংঘ আবার বাংলাদেশ ও ভারত সীমান্তে পর্যবেক্ষক নিয়োগের পাঁয়তারা করছে। অথচ গত চারমাস যাবৎ জাতিসংঘ বাংলাদেশে ইয়াহিয়ার গণহত্যার নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে। পাকিস্তানের জঙ্গী সরকারও বাংলাদেশ-সমস্যাটিকে ভারত-পাকিস্তান বিরোধ হিসাবে দেখাবার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

<005.005.072>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

মুজিবনগরে প্রদত্ত বিবৃতিতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খোন্দকার মোশতাক আহমদ জঙ্গশাহীর এ ধরনের নির্লজ্জ অপকৌশলকে পাকিস্তানের ভ্রান্ত পদক্ষেপ” বলে আখ্যায়িত করেছেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী খোন্দকার মোশতাক আহমদ বলে সহানুভূতিশীল বিশবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন যে, মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে চরম মার খেয়ে পাকিস্তানের অপরিণামদশী জঙ্গী কর্মকর্তারা আজকাল জাতিসংঘের ভিতরে ও বাইরে ব্যাপক তৎপরতা চালিয়ে বাংলাদেশে তাদের কৃতকর্মের কালিমা মোচনের ব্যর্থ চেষ্টা করছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। কাজেই বাংলাদেশ সমস্যাটি হচ্ছে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ বিরোধ। এ বিরোধ যত শ্ৰীঘ্ৰ মিটমাট হবে ততই সাড়ে সাত কোটি মানুষের কল্যাণ তুরান্বিত হবেবাংলাদেশের নিপীড়িত মানুষের মনে ফিরে আসবে শান্তি ও আস্থার মনোভাব।
বিশ্বের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, বেতার ও টেলিভিশন সংস্থাও সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর জীবনের নিরাপত্তার জন্যে বাংলাদেশ সমস্যার আশু সমাধানের উপর জোর দিয়েছেন। এ ব্যাপারে সকলেই একমত যে, বাংলাদেশের প্রকৃত গণপ্রতিনিধিরাই দেশে শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারবে এবং লাখ লাখ শরণার্থীকে
১৫ আগস্ট, ১৯৭১
… গত ২৫শে মার্চ থেকে ইয়াহিয়ার বর্বর সামরিক চক্র বাংলাদেশে যা করেছে সমস্ত বিশ্ব তাতেই হতবাক হয়েছে। জাতিসংঘের সেক্রেটারী জেনারেল উথান্ট বর্ণিত মানব ইতিহাসের সেই সর্বাধিক কলঙ্কজনক অধ্যায় রচনার পর এবং মার্কিন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডী বর্ণিত মানব ইতিহাসের বৃহত্তম বিপর্যয় সৃষ্টির এনে সামরিক আদালতে বিচার প্রহসন শুরু করেছে। এই বিচার প্রহসনের পিছনে পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক চক্রের যে ঘৃণ্য উদ্দেশ্য ও দুরভিসন্ধি রয়েছে তাতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। বাংলাদেশে পাক সামরিক চক্রের বর্বরতা ও বীভৎসতার দৃষ্টান্তে এটাই মনে হয় যে, ইয়াহিয়া ও তার নয়া নাৎসী বাহিনী করতে পারে না এহেন কিছু নেই।
কানাডার প্রধানমন্ত্রী মিঃ ট্রুডো পাকিস্তানের জঙ্গী প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়ার কাছে এক তারবার্তায় শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার প্রহসনে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, এর পরিণতি অত্যন্ত গুরুতর হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন ও অন্যান্য দেশের পত্র-পত্রিকা, বেতার ও টেলিভিশনেও পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক আদালতে শেখ মুজিবুর রহমানের গোপন বিচারে দারুণ আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।
লণ্ডনের প্রভাবশালী সংবাদপত্রগুলিতে মন্তব্য করা হয়েছে যে, যেভাবে শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার প্রহসন শুরু হয়েছে তাতে পাক সামরিক চক্রের ওপর আদৌ ভরসা করা যায় না। লণ্ডনের টাইমস’ ইয়র্কশায়ার পোষ্ট ও অন্যান্য সংবাদপত্রে এই তথাকথিত বিচারের কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে। বৃটেনের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবীগণ এবং কয়েকটি আন্তর্জাতিক আইনজীবী সংস্থাও শেখ মুজিবুরের বিচার প্রহসনের জন্যে ইয়াহিয়ার বর্বর সামরিক চক্রের কঠোর সমালোচোনা করেছেন।
টাইমস’ পত্রিকায় প্রখ্যাত বৃটিশ আইনজীবী মিঃ ডব্ৰু টি, উইলিয়ামের একটি চিঠি প্রকাশিত হয়েছে। এই চিঠিতে মিঃ উইলিয়াম বলেছেনঃ যেভাবে সামরিক আদালতে শেখ মুজিবের গোপন বিচার প্রহসন শুরু হয়েছে তাতে তিনি ও বিশ্বের বিবেকসম্পন্ন সকল মানুষ গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। তিনি বলেন, যেভাবে এই তথাকথিত বিচার চলছে তাতে কোনক্রমেই শেখ মুজিবুর রহমানের ন্যায় বিচার আশা করা যেতে পারে না। তিনি বলেন, একমাত্র প্রাণের ঝুঁকি ও বহু ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি ছাড়া কোন বাঙালী কৌশুলিই শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ সমর্থনে যাবেন না। মিঃ উইলিয়াম বলেন, আইয়ুবের আমলে সুপ্রিম কোর্টের রায় লঙ্ঘন করে সামরিক সরকার শেখ মুজিবুর

<005.005.073>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

রহমানের বিচার শুরু করেছিলো। ভয়ঙ্কর ইয়াহিয়ার সামরিক চক্র সেই একই ধারাবাহিকতায় বর্তমান বিচারে প্রহসন শুরু করেছে। তিনি বলেন, পাক সামরিক চক্ৰ মূঢ়তার বশে মিথ্যা অভিযোগ শেখ মুজিবুর রহমানকে যদি কোনরকম দণ্ড দেয় তাহলে তার পরিণতি হবে অত্যন্ত ভয়াবহ।
গত শুক্রবারে ‘ওয়াশিংটন পোষ্ট’ পত্রিকার এক সম্পাদকীয়তে বলা হয়ঃ মিথ্যা অভিযোগ তুলে শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার প্রহসন শুরু করে পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন সামরিক জান্তা এক মারাত্মক ভুল করেছে। পাকিস্তানী সামরিক জান্তা যদি এই তথাকথিত বিচারে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রাণদণ্ড দেয় তাহলে সেটাই হবে সবচে মারাত্মক ভুল আর সেই ভুলের কোন সংশোধনের পথ থাকবে না।
১৬ আগষ্ট, ১৯৭১
… পৃথিবীর দেশে দেশে শানিকামী মানুষ দেশবরেন্য জননেতা, বুদ্ধিজীবী সমাজ, বেতার টেলিভিশন ও সংবাদপত্র পাকিস্তানী নরঘাতী তস্করদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে।…
জাতিসংঘের জনৈক মুখপাত্র গত শুক্রবারে বলেছেন যে, পাকিস্তানী সামরিক আদালতে শেখ মুজিবুর রহমানের গোপন বিচার প্রহসনের ব্যাপারে সেক্রেটারী জেনারেল উথান্ট কূটনৈতিক যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছেন এবং এ ব্যাপারে তিনি আলোচনা চালাচ্ছেন।
গত শুক্রবারে ‘ওয়াশিংটন ষ্টার’ পত্রিকার এক সম্পাদকীয়তে বলা হয়ঃ শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার প্রহসন শুরু করে পাকিস্তানের মূঢ় সামরিক চক্র এক প্রচণ্ড ভুল করে বসেছে। ইয়াহিয়া আর তার সাঙ্গপাঙ্গদের একথা বোঝা উচিত যে নেতা হিসাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মর্যাদা প্রশ্নাতীত।
ক্রীশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটর’ পত্রিকার এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়ঃ শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রাণপ্রিয় নেতা। আজও তিনি বাংলার নয়নমণি। সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর হৃদয়ে আজও তিনি সদ্য প্রস্ফুটিত রক্তপদ্ম। পাকিস্তানের জঙ্গী সামরিক চক্র বিচার প্রহসনের দ্বারা যদি তার কিছু করে, তাহলে পাকিস্তান বাংলাদেশ থেকে যে চিরতরে বিদায় হবে তা নয় বরং মূল পাকিস্তানটাই চূর্ণ হয়ে যাবে।
যুগোশ্লাভ বৈনিক “বলগ্রেড বোরবা” পত্রিকার সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়, শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার প্রহসন করতে গিয়ে ইয়াহিয়া তার নিজের সমস্যার সমাধানের সকল পথই রুদ্ধ করেছে। এখন অন্ধকারে মাথা কুটে মরা ছাড়া তার আর দ্বিতীয় কোন পথ নেই।
জেনেভার ওয়ার্ল্ড কাউন্সিল অব চার্চেস’-এর সদর দফতর থেকে ইসলামাবাদে একটি তারবার্তা পাঠানো হয়েছে। এই তারবার্তায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গোপন বিচারের তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়েছে।
‘জাকার্তা টাইমস’-এ বলা হয়ঃ শেখ মুজিবুর রহমান হলেন বাংলাদেশের জনপ্রিয় নেতা। তার বিচার ভুল ঘোড়ায় বাজি ধরেছে।
১৮ আগষ্ট, ১৯৭১
বিশ্ব জোড়া প্রতিবাদ, ঘৃণা ও কোটি ধিক্কার উপেক্ষা করে পাক সামরিক চক্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার প্রহসন অব্যাহত রেখেছে …..

<005.005.074>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন ঝানু আণ্ডার সেক্রেটারী ও প্রাক্তন রাষ্টদূত মিঃ চেষ্টার বোলস শেখ মুজিবুর আদালতে শেখ মুজিবুর রহমানের যে গোপন বিচার চালাচ্ছে তা আগাগোড়া একটি প্রহসন মাত্র। পাকিস্তানী সামরিক জান্তার এটা একটা চরম ধৃষ্টতা। এ বিচার সকল রীতিনীতি ও আইন-কানুনের সম্পূর্ণ পরিপন্থী।
মিঃ চেষ্টার বোলস পাকিস্তান ও বাংলাদেশ সম্পর্কিত যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বর্তমান নীতির কঠোরতম সমালোচনা করেন। মার্কিন সরকার পাকিস্তান সরকারকে যে সামরিক সাহায্য অব্যাহতভাবে দিয়ে চলেছে, মিঃ চেষ্টার বোলস তাকে “চরম দায়িত্বজ্ঞানহীনতা ও নীতিবিগর্হিত” বলে বর্ণনা করেছেন।
সম্প্রতি ওয়াশিংটন পোষ্ট’-এ তাঁর একটি তথ্যপূর্ণ প্রবন্ধে মিঃ চেষ্টার বোলস বলেনঃ পাকিস্তানের ফ্যাসিবাদী সরকারকে সাহায্য করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এক চরম ভুল করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে অতীতের সব ভুলত্রটি সংশোধন করে পাকিস্তানের কাছে সামরিক অস্ত্র ও সমরসম্ভার বিক্রয় সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করা এবং পাকিস্তানকে সর্বপ্রকার অর্থনৈতিক সাহায্য দান একেবারে বন্ধ করে দেবার আহবান জানান।
পরলোকগত মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডীর সহোদর সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডী বাংলাদেশে পাক হানাদার বাহিনী সৃষ্ট মানব ইতিহাসের চরম বিপর্যয় ও মানব ইতিহাসের সবচে কলঙ্কজনক অধ্যায় নিজের চোখে দেখে যাবার জন্যে বাংলাদেশের শরণার্থীদের শিবিরগুলো পরিদর্শন করে গেছেন। তিনি পাক অধিকৃত বাংলাদেশেও যেতে চেয়েছিলেন কিন্তু পাক বাহিনীর বর্বরতা পাছে পুরোপুরি ফাঁস হয়ে যায় সেজন্যে পাকিস্তানী সামরিক সরকার তাঁকে পাকিস্তানী বর্বর বাহিনী অধিকৃত বাংলাদেশে যাবার অনুমতি দেয়নি। শুধুমাত্র সীমান্তে দাঁড়িয়ে ও শরণার্থীদের শিবিরগুলো পরিদর্শন করে তিনি যা দেখেছেন এবং যে মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা হয়েছে তা থেকেই তিনি বলেছেনঃ পাকিস্তানী সৈন্যরা যে বাংলাদেশে গণহত্যা চালিয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
মার্কিন সিনেটের উদ্বাস্তু বিষয়ক কমিটির সভাপতি সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডী বলেনঃ পাকিস্তানী সামরিক জান্তার কাছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একমাত্র অপরাধ হলো তিনি নির্বাচনে জয়লাভ করেছেন। তাঁর বিচার আন্তর্জাতিক আইনের দিক থেকে বিচারের ব্যাভিচার এবং ন্যায়বিচারের প্রহসন মাত্র।
আদ্দিস আবাবা বেতার থেকে প্রচারিত এক খবরে বলা হয়ঃ রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির ব্যাপারে সাহায্য করার জন্যে গঠিত আন্তর্জাতিক সংস্থা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্যে সারাবিশ্বে এক প্রচার অভিযান শুরু করবে।
বিশ্ব জোড়া এই বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সত্ত্বেও পাকিস্তানী সামরিক জান্তা শেখ মুজিবুর রহমানের গোপন বিচার প্রহসন অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ এই প্রহসন মেনে নেয়নি। আজ বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকার সর্বত্রই চলছে পাক হানাদার নিধনের দুর্বার অভিযান। মুক্তি বাহিনীর বীর যোদ্ধারা বাংলাদেশের পুণ্যভূমি থেকে হানাদারদের সমানে উৎখাত করে চলেছে। বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ আজ হানাদার উৎখাতে বদ্ধপরিকর।
১৯ আগষ্ট, ১৯৭১
… পাকিস্তানের সাবেক এয়ার মার্শাল আসগর খান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার প্রহসনের তীব্র নিন্দে করেছেন। এই বিচার প্রহসনের কঠোর সমালোচনা করে তিনি পাকিস্তানী সামরিক চক্রকে এই বলে হুশিয়ার করেছেন যে, পাকিস্তানী সামরিক জান্তা বাংলাদেশে যা করছে এবং বঙ্গবন্ধুর বিচার প্রহসনে মেতে যা করতে যাচ্ছে তার পরিণতি হবে অত্যন্ত ভয়াবহ এবং এর ফলে পাকিস্তানটাই তাসের ঘরের মতো এক মুহুর্তে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে।

<005.005.075>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

এয়ার মার্শাল আসগর খান এ নিয়ে পাকিস্তানী সামরিক জান্তাকে পরপর দুবার হুশিয়ার করে দিলেন। এয়ার মার্শাল আসগর খানের মতো পশ্চিম পাকিস্তানের আরও কয়েকজন নেতার চৈতন্যোদয় ঘটেছে। সিন্ধু, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তানের কয়েকটি পত্র-পত্রিকাতেও পাকিস্তানী সামরিক জান্তার সর্বনাশা তৎপরতার কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে।
পাকিস্তানী জঙ্গীশাহীর খোদ মুখপত্র ‘পাকিস্তান টাইমস’-এও শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার প্রহসনের সমালোচনা করা হয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব জনমতকে উপেক্ষা করে, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি শান্তিকামী মানুষের প্রতি চরম বিশ্বাসঘাতকতা করে পাকিস্তানী সামরিক চক্রকে সমরাস্ত্র, সমরসম্ভার ও আর্থিক সাহায্য দিয়ে এলেও মার্কিন বুদ্ধিজীবী মহল, রাজনীতিক ও শান্তিকামী মার্কিন জনগণ পাক জঙ্গীশাহীর বিরুদ্ধে বিরুদ্ধে আজ প্রতিবাদমুখর। গত সপ্তাহে পাকিস্তানী জাহাজ আল-আহমদী মার্কিন সমরাস্ত্র বহনের জন্যে ফিলাডেলফিয়া বন্দরে ভেড়ার চেষ্টা করছিলো কিন্তু সেখানে পাকিস্তানী জঙ্গীশাহীর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শিত হয় এবং বিক্ষোভকারীরা ছোট ছোট নৌযান দিয়ে পাকিস্তানী জাহাজের সম্মুখে অবরোধ সৃষ্টি করে। ফলে পাকিস্তানী জাহাজটিকে ফিলাডেলফিয়া বন্দরে ভেড়ার সংকল্প পরিত্যাগ করে বাল্টিমোরের দিকে এগুতে হয়।
শুধু ফিলাডেলফিয়া বন্দর নয়, পৃথিবীর সর্বত্রই পাকিস্তানী সামরিক চক্রের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও ধিক্কার উঠেছে। পাকিস্তানী জঙ্গীশাহী সর্বত্র লাঞ্ছিত। যুদ্ধবাজ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের মদদ পেয়ে পাকিস্তানের গোঁয়ার সামরিক চক্র এখনও আস্ফালন করছে সত্যি কিন্তু এর শোচনীয় পরিসমাপ্তি অত্যাসন্ন।
২০ আগষ্ট, ১৯৭১
… পশ্চিম পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি প্রধান খান আবদুল ওয়ালী খান পাকিস্তান থেকে আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে এসে তাঁর বাবা খান আবদুল গফফার খানের সঙ্গে মিলিত হয়েছেন। কাবুলে পৌছে তিনি সেখানকার একটি ইংরেজী পত্রিকা ‘নিউ ওয়েভ’-এর সাংবাদিকের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেনঃ পাকিস্তানের রাজনীতি এখন এমন এক অবস্থায় পৌঁছেছে যেখান থেকে আর ফেরা সম্ভব নয়পাকিস্তান ছিন্নভিন্ন টুকরো টুকরো হয়ে যাবেই। পাকিস্তানের রাজনীতি এখন যেভাবে চলছে তাতে সমূলে ধ্বংস হয়ে যাওয়া থেকে পাকিস্তানকে রক্ষা করার আর কোন উপায় নেই।
তিনি বলেনঃ বাংলাদেশে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী যা করছে তা প্রাগৈতিহাসিক বর্বরতাকেও হার মানায়। তবে পাকিস্তানী সৈন্যদের পক্ষে বাংলাদেশকে দখলে রাখা আদৌ সম্ভব নয়। পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী যদি মনে করে থাকে যে, চরম অত্যাচার চালিয়ে, গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ অব্যাহত রেখে বাংলাদেশের বীর জনগণকে দাবিয়ে রাখতে পারবে তাহলে তারা চরম ভুল করবে। খান আবদুল ওয়ালী খান বলেনঃ তুচ্ছাতিতুচ্ছ পুঁচকে পাকিস্তানের পক্ষে বিক্ষুব্ধ বাংলাদেশকে কব্জায় রাখা কি করে সম্ভব? পাকিস্তানের আর্থিক ও সামরিক বাজেট এখনও যেখানে বাংলাদেশের ওপর বিশেষভাবে নির্ভরশীল, সেখানে জয়লাভের কথা চিন্তাও করা যায় না।
পশ্চিম পাকিস্তানী ন্যাপ নেতা খান আবদুল ওয়ালী খান বলেনঃ ধৰ্ম যে ভিন্ন সংস্কৃতির দুটি জাতির রাষ্ট্ৰীয় বন্ধন হতে পারে না, তা চিরকালের মত প্রমাণিত হয়ে গেল। ধর্মকে রাষ্ট্রীয় বন্ধন বলে যারা ভাবতো এবার তাদের মোহমুক্তি চিরদিনের মতো ঘটে গেল। তিনি বলেনঃ আমার কাছে বাঙালীদের প্রতিরোধ আন্দোলনের গুরুত্ব এখানেই।

<005.005.076>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

বাংলাদেশে ইয়াহিয়া আর তার বর্বর সেনাবাহিনীর সামরিক অভিযান শুরু হবার দুদিন আগে পর্যন্ত খান আবদুল ওয়ালী খান ঢাকায় ছিলেন। তিনি বলেন, নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা এবং পাকিস্তানের নতুন সরকার গঠনের একমাত্র অধিকারী তিনিই ছিলেন। কিন্তু ইয়াহিয়া ও তার সামরিক চক্র তাঁর আইনসঙ্গত অধিকার থেকে তাঁকে বঞ্চিত করেছে। তিনি বলেন, পাকিস্তান নামক কৃত্রিম রাষ্ট্রটিকে টিকিয়ে রাখার যে ক্ষীণতম সম্ভবনা ছিলো, পাকিস্তানী সামরিক চক্র তাকেও বেয়োনেট বিদ্ধ করেছে। পাকিস্তান টুকরো টুকরো হবেই- তাকে কেউ রোধ করতে পারবে না। অথচ এমনটি হয়তো এতো তাড়াতাড়ি ঘটতো না। পাকিস্তানী সামরিক চক্রের মাথায় গোবর বোঝাই না হলে খুব সহজে এমনটি ঘটতো না। তারা যদি জনগণের রায়কে মনে নিত এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যদি দেশের প্রধানমন্ত্রী বলে স্বীকার করে নেয়া হতো তাহলে পাকিস্তানকে আরও কয়েকটা দিন টিকিয়ে রাখা যেতো। কিন্তু তা এখন আর কিছুতেই সম্ভব নয়। গত ২৫শে মার্চের রাতেই ইয়াহিয়ার বর্বর সেনাবাহিনী সেই সম্ভাবনাকে খুন করেছে।
পিণ্ডির বর্তমান পরিস্থিতির উল্লেখ করতে গিয়ে খান আবদুল ওয়ালী খান একটি উপমা দিয়ে বলেনঃ ‘দুধের কলসী ভেঙ্গে গেছে। দুধ চারদিকে গড়িয়ে পড়ছে। আর তার চারপাশে বসে তারা কাঁদছে।”
পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তিনি বলেনঃ পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ যে কেবল অন্ধকারাচ্ছন্ন তা নয়, বিপজ্জনক।
২১ আগষ্ট, ১৯৭১
… বাংলাদেশের শহরে নগরে বাজারে বন্দরে প্রতিটি পল্লীতে আজ শত্রু হননের দুর্বার লড়াই চলছে। আর এই লড়াইয়ে কুলিয়ে উঠতে না পেরে আমাদের মৃত্যুঞ্জয়ী বীর মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে প্রচণ্ড মার খেয়ে পাকিস্তানী সামরিক চক্র নতুন এক ফন্দি আটলো। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে তারা ভারত-পাকিস্তান সমস্যা বলে চিহ্নিত করে কাজ হাসিল করতে চেয়েছিলো। তারা ভেবেছিলো আমাদের দেশের এই মুক্তিযুদ্ধকে তারা যদি ভারত-পাকিস্তান বিরোধ বলে চিহ্নিত করতে পারে তাহলে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের মুক্তিসংগ্রামের প্রতি আজ যে বিশ্ব জনমত গঠিত হয়েছে তাকে বিভ্রান্ত এবং বাংলাদেশে আজ যে দুর্বার লড়াই চলছে, তাকে কিছুটা প্রশমিত করা যাবে। পাকিস্তানী সামরিক চক্র এই উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকার সীমান্তে এবং ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে উস্কানিমূলক তৎপরতা শুরু করলো। কিন্তু বিশ্বের সচতেন মানুষ পাকিস্তানী সামরিক চক্রের এই দুরভিসন্ধিটা বুঝে নিয়েছে। ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধের হুমকি দিয়ে এমন কি প্রয়োজন হলে সংঘর্ষ একটা বাধিয়ে দিয়ে কাজ হাসিল করার যে দুরভিসন্ধি তারা করেছিলো তা ভন্ডুল হয়ে গেছে।
সোভিয়েত প্রধানমন্ত্ৰী মিঃ আলেক্সী কোসিগিন পাকিস্তানী ফ্যাসীবাদী সামরিক চক্রের এই ঘৃণ্য দুরভিসন্ধির কথা জানতে পেরে বাংলাদেশে গণহত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ ও নারী নির্যাতনের নায়ক পাকিস্তানের স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়াকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় হুশিয়ার করে দিয়ে বলেছেনঃ সাবধান ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ বাধানো পাকিস্তানের পক্ষে আত্মহত্যার সামিল হবে।
গত ১৭ই আগষ্ট ইসলামাবাদস্থ সোভিয়েট রাষ্ট্রদূত মিঃ এ, এ, রদিনভ জেনারেল ইয়াহিয়ার হাতে সোভিয়েট প্রধানমন্ত্রী মিঃ কোসিগিনের একটি চিঠি পৌঁছে দেন। ওই চিঠিতেই সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী পাকিস্তানী সামরিক চক্রের গোপন দুরভিসন্ধি ঔদ্ধত্যের বিষয়ে জেনারেল ইয়াহিয়াকে হুশিয়ারী প্রধান করেন। চিঠিতে তিনি ইয়াহিয়া ও তার বর্বর সামরিক চক্রকে অত্যন্ত সুস্পষ্ট ভাষায় এই বলে হুশিয়ার করেছেন যে, তারা যেন গোঁয়ারের মতো ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধের আস্ফালন বা দায়িত্বজ্ঞানহীন উক্তি না করে। চিঠিতে প্রধানমন্ত্রী আলেক্সী কোসিগিন ইয়াহিয়া আর তার জঙ্গী সামরিক চক্রকে বাংলাদেশে গণহত্যা ও উৎপীড়ন অবিলম্বে বন্ধ করতে এবং শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার প্রহসনে আর একপা অগ্রসর না হওয়ার জন্যে উপদেশ দিয়েছেন।

<005.005.077>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

২৭ আগষ্ট, ১৯৭১
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রাণরক্ষার জন্য অবিলম্বে সক্রিয় ও কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বিশ্বের সকল সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছেন। বিশ্বের সকল সরকারের কাছে পাঠানো এক বার্তায় তাঁরা বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি ও সামরিক আদালতে বঙ্গবন্ধুর বিচার প্রহসনে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেনঃ বাংলাদেশে আজ যা ঘটেছে এবং যা ঘটতে যাচ্ছে, তাকে বিশ্বশান্তি আজ দারুণ এক হুমকির সম্মুখীন। পাকিস্তানের জঙ্গশাহীকে কোনরকম সামরিক অথবা অর্থনৈতিক সাহায্যদান সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করার জন্যেও তাঁরা বিশ্বের সরকারবর্গের প্রতি আহবান জানিয়েছেন। হংকং-এর একটি প্রভাবশালী দৈনিক হংকং স্ট্যাণ্ডার্ড-এ শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার প্রহসনের জন্যে পাকিস্তানের জঙ্গী সরকারের কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে। এই পত্রিকার এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়ঃ সামরিক আদালতে শেখ মুজিবুর রহমানের বিচারের নামে পাকিস্তানী সামরিক জান্তা যা করতে যাচ্ছে তা একটা প্রহসন ছাড়া আর কিছুই নয়। এই বিচার প্রহসনের পেছনে পাকিস্তানী সামরিক জান্তার যে গোপন দুরভিসন্ধি রয়েছে তা বীভৎস। পত্রিকায় বলা হয়ঃ সম্প্রতি পাকিস্তানী জঙ্গীশাহী ঘোষণা করেছে যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে একজন কৌঁসুলি নিযুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে কো কোঁসুলি থাক আর না-ই থাক এটা স্রেফ একটা ধাপ্পা ও প্রসহন ছাড়া আর কিছুই নয়। কারণ ইয়াহিয়া আর জঙ্গ সরকার ইতিপূর্বেই শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাকতার অভিযোগ এনেছে। তারা যে ক্ষেত্রে শেখ মুজিবুর রহমানকে আগেভাবেই দোষী বলে ঘোষণা করছে সেখানে এই বিচার স্রেফ একটি প্রহসন ছাড়া আর কি হতে পারে? আইরিশ আইনজীবী সমিতির অত্যন্ত প্রভাবশালী সদস্য ও রাজনৈতিক বন্দী মার্জনা সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সংস্থার চেয়াম্যান মিঃ সিয়ান ম্যাকব্রাইড জেনারেল ইয়াহিয়ার কাছে লেখা এক চিঠিতে বঙ্গবন্ধু তিনি সেখানে গিয়ে তখন কিছুই করতে পারেননি। বঙ্গবন্ধু মুজিবের বিচার গোপনে সামরিক আদালতে না করে প্রকাশ্যে বেসামরিক আদালতে করার দাবী জানিয়ে মিঃ ম্যাকব্রাইড বলেনঃ কোন বিদেশী আইনজীবীকে পাকিস্তানের আদালতে শেখের পক্ষ সমর্থনের অনুমতি যদি না দেয়া হয় তাহলে শেখ মুজিবুর রহমান যাতে তাঁর ইচ্ছেমতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবীদের সাথে পরামর্শ করতে পারেন তার ব্যবস্থা যেন করা হয়। মিঃ ম্যাকব্রাইড গত মাসে তাঁর পশ্চিম পাকিস্তান সফরের উল্লেখ করে বলেনঃ শেখ মুজিবুর রহমানের লণ্ডন সলিসিটরদের অনুরোধে তিনি বাংলাদেশের নেতার পক্ষ সমর্থনের উদ্দেশ্য নিয়েই পশ্চিম পাকিস্তানে দেখা করে শেখের বিচার যেভাবে চলছে সে সম্পর্কে দারুণ উদ্বেগ ও সংশয় প্রকাশ করেছিলেন। তিনি বলেনঃ রাজনৈতিক বন্দীদের মার্জনা সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রধান হিসাবে তিনি বিচারের কতগুলো উদ্বেগপূর্ণ দিক সম্পর্ক উল্লেখ করেছেন। তিনি অভিযোগ করেনঃ সামরিক আদালতে গোপনে শেখ মুজিবুর রহমানের যে বিচার চলছে তাতে শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রকাশ করা হয়নি। এর মধ্যে শুধু একটাই বলা হয়েছে যে, অপরাধে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে। তিনি বলেন, বিচারে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে যদি তার ইচ্ছামতো আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দেয়া হয় তাহলে সে বিচার বলে গণ্য হতে পারে না।

<005.005.078>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

২১ আগষ্ট, ১৯৭১
… আজ বাংলাদেশ সমস্যা একটি গুরুতর আন্তর্জাতিক সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। পাকিস্তানী শাসক চক্র শত প্রচেষ্টাতেও বাংলাদেশের ঘটনাবলীকে মৃত পাকিস্তানের পচা গলিত লাশের তলায় ঢাকা দিয়ে রাখতে পারেনি। বিশ্বের সকল চিন্তাশীল, বুদ্ধিজীবী, কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক নেতৃবর্গের কাছেও এই তথ্যটি আজ অজানা নয়। আর ঠিক এই কারণেই মার্কিন সিনেটের আরও একজন প্রভাবশালী সদস্য রিপাবলিকান দলের মিঃ চার্লস পার্সি মন্তব্য করলেনঃ পাকিস্তানের মৃত্যু হয়েছে। আর কোন অবস্থাতেই দ্বিখণ্ডিত পাকিস্তানে জোড়া লাগানো সম্ভব নয়। রিপাবলিকান সিনেটর পার্সি সম্প্রতি ভারত ও পাকিস্তান সফরে এসেছিলেন। তিনি বাংলাদেশের প্রকৃত অবস্থা নিজের চোখে দেখে গেছেন। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী পশ্চিম বঙ্গের উদ্বাস্তু শিবিরগুলোর তিনি বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর অবস্থা প্রত্যক্ষ করেছেন। তিনি ভারতীয় নেতৃবর্গের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। তিনি পাকিস্তানের জঙ্গী সরকারের হোমড়া-চোমড়াদের সঙ্গেও কথা বলে দেখেছেন এবং দেখেশুনেই তিনি বলেছেনঃ এখন আর যাই হোক, একথা কল্পনাও করা যায় না যে পাকিস্তান আবার বেঁচে উঠবে। আগের অবস্থা ফিরে আসবে এ কথা চিন্তা করাও অসম্ভব। পাকিস্তানী হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রত্যেক বাঙালীর মনোভাব একই রকম। বাঙালীদের কাছে পাকিস্তানীরা বিদেশী হানাদার ছাড়া আর কিছুই নয়। সিনেটর চার্লস পার্সি বলেনঃ বাঙালী জাতি আজ যে ইস্পাতকঠিন সংকল্প নিয়ে লড়াই করবে তা একটি বিরাট ও মহৎ সংকল্প। আমি আশা করি পাকিস্তানী জঙ্গীশাহীর নায়করা এটা উপলব্ধি করবে এবং ই উপলব্ধির উপরেই তাদের বাঁচা-মরা নির্ভর করছে। সিনেটর চার্লস পার্সি বলেনঃ আমি পাকিস্তানী সামরিক সরকারের নেতাদের এ কথা সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছি যে, বঙ্গবন্ধুর বিচার প্রহসনে তারা যদি আর এক পা অগ্রসর হয় তাহলে তার পরিণতি হবে অত্যন্ত ভয়াবহ। তারা যদি তথাকথিত বিচারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রাণদণ্ড দেয় তাহলে পৃথিবীর কেউ-ই তাদের ক্ষমা করবে না।
২২ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
… বাংলাদেশ পরিস্থিতির এই ক্রমাবনতিতে পৃথিবীর শান্তিপ্রিয় মানুষ আজ দারুণ উদ্বিগ্ন। বিশ্বজনতার এই উদ্বেগ প্রকাশ পেয়েছে জাতিসংঘের সেক্রেটারী জেনারেল উথান্টের সাম্প্রতিক একটি বিবৃতিতে। গত ১৯শে সেপ্টেম্বরে এক বিবৃতিতে তিনি বিশ্বের রাষ্ট্রবর্গের প্রতি এক দারুণ হুশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেছেনঃ বাংলাদেশের ঘটনাবলী বর্তমানে যেভাবে জটিল হয়ে পড়ছে সেখানকার পরিস্থিতি বর্তমানে যেভাবে দ্রুত অবনতির দিকে গড়িয়ে চলেছে এবং এর ফলে প্রতিনিয়ত যেভাবে জটিল থেকে জটিলতর সমস্যাদির উদ্ভব ঘটছে তাতে আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর পক্ষে দারুণ উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ আছে।… তিনি বলেনঃ বাংলাদেশ পরিস্থিতি এখন এত দ্রুত অবনতির দিকে এগিয়ে চলেছে যে, এ ব্যাপারে বিলম্ব হলে যে কোন রকমের মারাত্মক বিপর্যয় দেখা দেবে এবং তা বাংলাদেশ বা পাকিস্তানের সীমার মধ্যে সীমিত থাকবে না। তিনি বলেনঃ আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর পক্ষে এটা দারুণ এক উদ্বেগের ব্যাপার। বাংলাদেশের মূল সমস্যার সমাধান আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীকে অবিলম্বে এগিয়ে আসবে হবে। সেক্রেটারী জেনারেল উথান্ট বলেনঃ গত ১৯৭০ সালের নভেম্বরের সর্বনাশা ঘূর্ণিঝড়ে বাংলাদেশে লক্ষ লক্ষ প্রাণহানি ঘটেছে। তারপর সেখানে শুরু হয়েছে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সামরিক অভিযান এবং তাতেও লক্ষ

<005.005.079>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

লক্ষ মানুষের জীবনহানি ও ব্যাপক ধ্বংসলীলা সংঘটিত হয়েছে। তিনি বলেন, আজও বাংলাদেশ থেকে প্রতিনিয়ত লক্ষ লক্ষ শরণার্থী সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে চলে যাচ্ছে। পাকিস্তানের সামরিক চক্র বাংলাদেশের তাঁবেদার সরকার খাড়া করেছে এবং জেনারেল ইয়াহিয়া শরণার্থীদের দেশে ফেরার আহবান জানিয়েছে- কিন্তু এসব সত্ত্বেও সেখানে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসছে না, বরং প্রতিদিনই জঙ্গী সরকার যতই গলাবাজী করুক না কেন তারা সেখানে তাদের গণবিরোধী নীতি এখনও সামনে চালিয়ে যাচ্ছে।
সেক্রেটারী জেনারেল উথান্ট বলেনঃ বাংলাদেশ বর্তমানে দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হয়েছে। বাংলাদেশে পাকিস্তানী সামরিক অভিযানের ফলেই এই দুর্ভিক্ষাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকসমূহের মানুষ আজ দারুণ এক শোচনীয় অবস্থার মুখে পড়েছে। অবিলম্বে সেখানে বড় রকমের ত্রান ব্যাবস্থা চালু করা ছাড়া দ্বিতীয় কোন পথ নেই।
৩০ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
গত ২৮শে সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়। বাংলাদেশে পাকিস্তানী হানাদাররা যা করেছে যা করেছে এবং আজও যা করে চলেছে তার এক মর্মান্তিক বিবরণ দিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিগণ পাকিস্তানের জঙ্গশাহীর কঠোর সমালোচনা করেন।
অধিবেশনের শুরুতে সোভিয়েট উইনিয়ন, সুইডেন ও ফ্রান্সের প্রতিনিধিগণ কঠোরতম ভাষায় বাংলাদেশে পাকিস্তানী সামরিক অভিযানের সমালোচনা করে বলেনঃ পাকিস্তানী হানাদাররা বাংলাদেশে যা করছে এবং আজও যা করে চলেছে তা কল্পনাও করা যায় না। তাঁরা দাবী করেন, অবিলম্বে বাংলাদেশে পাকিস্তানী বর্বরতার অবসান ঘটাতে হবে। তাঁরা বলেছেনঃ বাংলাদেশের ঘটনাবলী সম্পর্কে পাকিস্তানী সরকারী প্রচারযন্ত্র যতই বিভ্রান্তির জাল বুনুক সেখানকার প্রকৃত ঘটনাবলী আজ আর কারও অজানা নয়। পাকিস্তানী সামরিক সরকার বা সেখানকার জান্তা যা-ই বলুক না কেন সেখানে যা ঘটেছিলো তা কোনো বিশেষ রাজনৈতিক মতাদর্শ বা বিশেষ কোনো দাবীভিত্তিক আন্দোলন নয়। তা ছিলো বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের জীবন-মরণের আন্দোলন। আর অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই বাংলাদেশের মানুষ তাদের লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো। তারা পশ্চিম পাকিস্তানের কায়েমী স্বার্থবাদী নিও-ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলনই শুরু করেছিলো। গত ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষ যে অভূতপূর্ব বিজয় লাভ করেছিলো পাকিস্তানী হানাদাররা তা মেনে নিতে পারেনি। তাদের কাছে বাংলাদেশের মানুষের একমাত্র অপরাধ হলো নির্বাচনে তাদের বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানী কায়েমী স্বার্থবাদীদের ঔপনিবেশিক স্বার্থে আঘাত লাগার জন্যেই তারা বাংলাদেশে সামরিক অভিযান চালিয়েছে।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে সুইডেন, ফ্রান্স ও সোভিয়েট প্রতিনিধিগণ গভীর আশংকা প্রকাশ করে বলেন যে, অবিলম্বে বাংলাদেশ সংকটের সমাধান না করা হলে তা এক মহাপ্লাবী দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়বে এবং তার পরিণতি হবে অত্যন্ত ভয়াবহ।
সুইডেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিঃ ক্রিসটার ভিকম্যান বলেন, বাংলাদেশে পাকিস্তানী দখলদার বাহিনী যা চালাচ্ছে তা কোনোমতেই সমর্থন করা যায় না। দেশমাতৃকার বুক থেকে পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীকে হটিয়ে দেবার জন্যে বাংলাদেশের মানুষ আজ পাল্টা আঘাত হেনেছে। বাংলাদেশের পাক অধিকৃত এলাকার সর্বত্রই দুর্বার লড়াই চলছে এবং এ লড়াইয়ের পরিণতি বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তার পক্ষে দারুণ বিপজ্জনক। মিঃ ক্রিসটার ভিকম্যান এই আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে, বাংলাদেশে মান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে এবং বাংলাদশের মানুষের পূর্ব নিরাপত্তার ব্যাপারে অবিলম্বে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ সচেষ্ট না হলে এ সংকট বহু দূর গড়াবে।

<005.005.080>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

ফরাসী পররাষ্ট্রমন্ত্রী মরিস সু্যম্যান বলেন, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের ইচ্ছানুযায়ী বাংলাদেশ সংকটের সমাধান করতে হবে, তা না হলে বাংলাদেশের সংকট আরও বিস্তার লাভ করবে।
২ অক্টোবর, ১৯৭১
বাংলাদেশে সাধারন মানুষের উপর পাকিস্তানী হানাদারদের অমানুষিক অত্যাচার ও বর্বরতার মর্মান্তিক দৃশ্য সহ্য করতে না পেরে ঢাকায় বিশ্বব্যাঙ্কের প্রতিনিধি মিঃ টাইগারম্যান পদত্যাগ করেছেন।
মিঃ টাইগারম্যান গত ছ’বছর ধরে বাংলাদেশে বিশ্বব্যাঙ্কের একজন বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছেন। বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর তিনি গত ডিসেম্বর মাসে শিকাগো গিয়েছিলেন। মিঃ টাইগারম্যান একজন মার্কিন নাগরিক। তিনি শিকাগো থেকে গত ১৮ই সেপ্টেম্বর ঢাকায় ফিরে এসেছিলেন।
মিঃ টাইগারম্যান বলেনঃ বাংলাদেশ অত্যন্ত পরিচিত দেশ। এদেশে বিশ্বব্যাঙ্কের প্রতিনিধি হিসাবে যোগদানের পর এখানকার প্রতিটি জিলা প্রতিটি শহর-বন্দরে গ্রামে-গঞ্জে আমি ঘুরেছি। ঘুরেছি একবার নয়, বার বার। বাংলাদেশের জেলাগুলোয় তিনি এ পর্যন্ত ঘুরেছেন ১৮ বার।
গত ৮ই সেপ্টেম্বরে আবার তিনি ঢাকায় ফিরে এলেন তখন তিনি বিস্ময়ে অবাক হয়ে গেলেন। তিনি বলেনঃ বিমান থেকে নেমেই আমি অবাক হয়ে গেলাম। আমার সেই পরিচিত ঢাকা বিমানবন্দর এ যেন নয়। এ যেন বিশ্বযুদ্ধের সময়কার কোন বিমান ঘাঁটি। বিমান বন্দরে পাকিস্তান বিমান বাহিনীর জঙ্গী বিমানগুলোকে প্রস্তুত হয়ে থাকতে দেখলাম। দেখলাম বিমানবন্দরের চারিদিকে অসংখ্য বিমানবিধ্বংসী কামান। টার্মিনাল ভবনের ছাদে, জানালায় আর চিলতে ছাদ বা বারান্দাগুলোয় দেখলাম বালির বস্তা দিয়ে বাঙ্কার করা হয়েছে এবং সেখানে সশস্ত্র পাকিস্তানী সৈন্যরা বিমানবিধ্বংসী কামান, মেশিনগান ও স্বয়ংক্রিয় রাইফেল তাক করে আছে যেন এখুনি কিছু ঘটবে বা ঘটতে যাচ্ছে। আগে যেখানে বিমানবন্দরের পূর্বপাশে রাস্তায় প্রাচীরের ধারে এবং ডমেষ্টিক ও ইন্টারন্যাশনাল উইংসের টার্মিনাল ভবনে হাজার হাজার দর্শনার্থীকে দেখতাম লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে এখন সেক্ষেত্রে একজন অসামরিক ব্যক্তিকেও দেখলাম না। আগে বিমানবন্দরে যেসব অসামরিক কাষ্টম ও ইমিগ্রেশন বিভাগের কর্মচারীদের দেখতাম, তাদের কাউকেই দেখলাম না। হয় তাদের সবাইকে গুলি করে মারা হয়েছে, অথবা তারা প্রাণভয়ে এ শহর ছেড়ে পালিয়েছে। বিমানবন্দরে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরাই সবকিছু করছে। বিমানবন্দরে যেসব বিদেশী নাগরিক যাওয়া-আসা করছে পাকিস্তানী সৈন্যরা তাদের নানাভাবে নাজেহাল করছে। পিআইএ বা পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের যে সাজ-সরঞ্জাম, গোলাবারুদ ও সৈন্যদের পরিবহণের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। মিঃ টাইগারম্যান বলেন, ঢাকা বিমানবন্দরে নেমে একজন বাঙালীকেও আমি খুঁজে পেলাম না। অথচ দেশটা একান্তভাবে সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর দেশ।
বিশ্বব্যাঙ্ক প্রতিনিধি মিঃ টাইগারম্যান বলেনঃ বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে আমি দেখলাম এয়ারপোর্ট রোডের দু’পাশে বহু ট্রেঞ্চ খোঁড়া হয়েছে এবং রাস্তার দুধারের বাড়িগুলি জনশূন্য। আর এইসব জনশূন্য বাড়িগুলির ছাদে, বারান্দায় ও জানালায় বালির বস্তা দিয়ে বাঙ্কার বানানো হয়েছে। রাস্তায় দু’হাত ছাড়া চেকপোষ্ট বসানো হয়েছে। এইসব চেকপোষ্টে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা পাহারা দিচ্ছে। এই রাস্তা দিয়ে কথিত যে দু-একটা অসামরিক গাড়ী চলাচল করছে সৈন্যরা সেগুলো তন্নতন্ন করে তল্লাশী করছে। পথচারীদেরও তল্লাশী করা হচ্ছে। পথচারীদের বেশভূষা ও চেহারায় বাঙালীত্বের স্পষ্ট ছাপ পাওয়া গেলে সৈন্যরা তাদের ধরে নিয়ে ক্যান্টনমেন্টর দিকে যাচ্ছে। বাঙালী বুদ্ধিজীবী তরুণ হলে তো আর কথাই নেই। গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোয় যুদ্ধক্ষেত্র সৃষ্টি করে রাখা হয়েছে। সারি সারি বাঙ্কার ও ট্রেঞ্চে সশস্ত্র পাকিস্তানী সৈন্য মোতায়েন রয়েছে। জায়গায় জায়গায় রাস্তার দুপাশে দেয়াল তুলে দিয়ে চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। শহরের প্রধান প্রধান সরকারী ভবনগুলোর চারপাশে ১৫

<005.005.081>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

থেকে ২৫ ফুট উচু দেয়াল তোলা হয়েছে। ঢাকা রেডিওকে বর্তমানে একটি দুর্ভেদ্য দুর্গে পরিণত করা হয়েছে। সন্ধ্যার পর ঢাকার রাস্তায় কেউ হাঁটে না। সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত শহরের রাস্তায় কেবল পাকিস্তানী সৈন্য, পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশ ও কুকুর ছাড়া আর কেউ চলাচল করে না। মানুষ সেখানে পাকিস্তানী সৈন্যদের অত্যাচার এতই ভীবসন্ত্রস্ত যে কেউ কারও সঙ্গে কথা বলে না। বিদেশীদের সঙ্গে কথা বলতে তারা ভীষণ ভয় পায়। কারণ আজও প্রতিদিন শহরে ধরপাকড় চলছে। কখন কোন মুহুর্তে সেখানে কার জীবনে মৃত্যু নেমে আসবে না কেউ জানে না। প্রায় প্রতিরাতেই বোমা বিস্ফোরণ ও খণ্ড লড়াইয়ের শব্দ শোনা যায়। গোটা শহরটা এখন বদ্ধভূমিতে পরিণত।
বিশ্বব্যাঙ্ক প্রতিনিধি বলেনঃ এই ভয়ংকর পরিস্থিতিতে সেখানে থেকে কাজ করা আমার পক্ষে যুক্তিগতভাবে, নীতিগতভাবে কিংবা নৈতিকতার দিক থেকে কোনভাবেই সম্ভব নয়। তিনি বলেন , পাকিস্তানে আমি আর কোনদিন ফিরে যাবো না। বাংলাদেশ থেকে হানাদার পাকিস্তানীরা বিতাড়িত হলে আমি বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করতে যাবো। আমি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে কাজ করবো। দীর্ঘ ছ’বছর থাকার পর আমি বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষকে ভালোবেসেছি। তাদের সঙ্গে আমার হৃদয়ের বন্ধন অনেক গভীর।
৫ অক্টোবর, ১৯৭১
…বৃটিশ কমন্সসভার অত্যন্ত প্রভাবশালী সদস্য মিঃ ফ্রেভ ইভান্স বলেছেনঃ বাংলাদেশ আজ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। জাতিগতভাবে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং ভাষা ও সামাজিকতার দিক থেকে বাংলাদেশ সম্পূর্ণ স্বাধীন, সার্বভৌম একটি রাষ্ট্র- সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি জাতি। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের এই স্বতন্ত্র অস্তিত্ব ও বাঁচার অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্যেই বাঙালীরা আজ হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিয়েছে। তারা আজ যে লড়াই করছে তা হলো এ দেশকে মুক্ত করার লড়াই- শত্রু মুক্তির লড়াই। দেশকে শত্রুমুক্ত করার জন্য সাড়ে সাত কোটি বাঙালী যে যুদ্ধ করছে তা তাদের বাঁচার অধিকার প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ। আর এই অধিকার প্রকৃতপক্ষে মানুষের জন্মগত অধিকার।
বাংলাদেশে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর নির্বিচার হত্যা, লুণ্ঠন ও নারী-নির্যাতনের ফলে যে দুই লক্ষাধিক শরণার্থী সীমান্তের ওপারে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে তাদের অবস্থা নিজের চোখে দেখে যাবার জন্যে এবং কি নারকীয় নির্যাতনের ফলে তারা তাদের সাতপুরুষের ভিটেমাটি ফেলে উদ্বাস্তু শিবিরে দিন কাটাচ্ছে তা জানার জন্যে বৃটিশ কমন্সসভার বিশিষ্ট সদস্য মিঃ ফ্রেড ইভান্স লণ্ডন থেকে পশ্চিম বাংলায় গিয়েছিলেন। একাধিক শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করে পশ্চিম বাংলার রাজধানী কলকাতায় ফিরে গিয়ে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বাংলাদেশ সম্পর্কে তিনি এই মন্তব্য করেন। বাংলাদেশের ব্যাপারে বিশ্বের বৃহৎ শক্তিবর্গের অসহনীয় নিস্ক্রিয়তার সমালোচনা করে তিনি বলেনঃ বাংলাদেশ সমস্যার সমাধানে বিশ্বের প্রত্যেকটি দেশেরই এগিয়ে আসা উচিত।
মিঃ ফ্রেড ইভান্স বাংলাদেশ সম্পর্কে বক্তৃতায় বৃটিশ সরকারের সমালোচনা করেন। তিনি বলেনঃ অবিলম্বে বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান না হলে এশিয়ার এই অঞ্চলের শান্তি বিঘ্নিত হবে। অবিলম্বে এর সমাধান করতেই হবে। মিঃ ফ্রেড ইভান্স বলেনঃ বাংলাদেশের মূল সমস্যা মানবিক চেতনা ও মানবাধিকারের সমস্যা। তিনি বলেনঃ একজন গণতন্ত্রী হিসাবে বুলেটের বদলে ব্যালটের মাধ্যমেই যে কোন সমস্যার সমাধানে আমি পক্ষপাতী। বাংলাদেশ সঙ্কটের শুরুতে বিশ্বের গণতন্ত্রকামী সকল মানুষের এবং সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর মতো আমিও এটাই আশা করেছিলাম কিন্তু পাকিস্তানী সামরিক শক্তি সে সম্ভাবনাকে গোঁয়ারের মতো গুড়িয়ে দিয়েছে।
মিঃ ফ্রেড ইভান্স বলেনঃ আমরা বৃটেনবাসী ১৯৩৯ সালে ফ্যাসিষ্ট জার্মানীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে নেমেচিলাম, প্রয়োজন নয়া ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ করতে আমরা প্রস্তুত।…

<005.005.082>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

২৯ অক্টোবর, ১৯৭১
…গত বাইশে অক্টোবর থেকে পচিশে অক্টোবরে মধ্যে নয়াদিল্লীতে ভারত ও সোভিয়েট ইউনিয়নের মধ্যে আলোচনা হয় তাতে এই উপমহাদেশের পরিস্থিতি এবং পাকিস্তান ভারতের সীমান্তে যে গুণ্ডামি ও তস্করবৃত্তির দেশের মধ্যে চারদিনব্যাপী আলোচনার পর প্রকাশিত এক বিবৃতিতে বলা হয়ঃ পাকিস্তান ভারত সীমান্তে ব্যাপক সৈন্য সমাবেশ করে এবং যুদ্ধপ্রস্তুতি ও সামরিক তৎপরতায় লিপ্ত হয়ে এই উপমহাদেশে যে উত্তেজনার সৃষ্টি করেছে তাতে এ অঞ্চলের শান্তি বিঘ্নিত হবার দারুণ আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ ব্যাপারে ভারত যে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে সোভিয়েট ইউনিয়নের তাতে পূর্ণ সমর্থন রয়েছে বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়। সুতরাং ভারত আক্রমণ করে বাংলাদেশ প্রশ্নকে ভারত-পাকিস্তান প্রশ্নে রূপান্তরিত করার সপক্ষে এবং পরে জাতিসংঘের সাহায্য নিয়ে ত্রাণ পাওয়ার যে স্বপ্ন দেখেছে তাও সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়ে গেছে। আজ ভারত আক্রমণের অর্থ হবে পাকিস্তানের আত্মহত্যা, ভারত আক্রমণ করতে গেলে গোটা পাকিস্তানটাই কবর হয়ে যাবে।
গত ছাব্বিশে অক্টোবর মস্কো ও অটোয়ায় যুগপৎভাবে প্রকাশিত সোভিয়েট-কানাডা যুক্ত ইশতাহারে বাংলাদেশ সমস্যার প্রকৃত রাজনৈতিক সমাধানের দাবী জানানো হয়।
সোভিয়েট ইউনিয়ন এবং কানাডার এই যুক্ত ইশতাহারে বলা হয়ঃ বাংলাদেশ পরিস্থিতির এমন একটি রাজনৈতিক সমাধান আনতে হবে যাতে বাংলাদেশের জনগণের আইনসম্মত অধিকার ও স্বার্থ সম্পূর্ণ রক্ষিত এবং ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী শরণার্থীরা পূর্ণ আস্থায় ও মর্যাদায় দেশে ফিরে আসতে পারবেন। কানাডায় সোভিয়েট প্রধানমন্ত্রী মিঃ আলেক্সী কোসিগিনের আটদিনব্যাপী সরকারী সফরশেষে এই ইশতাহার প্রচারিত হয়।
১ নভেম্বর ১৯৭১
…যুগোশ্লাভিয়া সর্বোতোভাবেই গোষ্ঠীনিরপেক্ষ একটি শান্তিকামী দেশ বলে বিশ্ববাসির কাছে পরিচিত। পুঁজিবাদী ও সমাজতন্ত্রীবাদী উভয় ব্লকেই এই সম্পর্কে কোনো দ্বিমত নেই। বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের কাছেই জোটনিরপেক্ষ যুগোশ্লাভিয়া সমানভাবে সমাদৃত।
গোষ্ঠীনিরপেক্ষ যুগোশ্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট টিটোও আজ বাংলাদেশের পাকিস্তানী বর্বরতার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে বাধ্য হয়েছেন।
প্রেসিডেন্ট টিটো বলেছেনঃ বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনী যা করেছে এবং আজও তারা সেখানে যা করে চলেছে পৃথিবীর ইতিহাসে তার কোন দৃষ্টান্ত নেই। পাকিস্তানী সৈন্যরা বাংলাদেশে যে ব্যাপক গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে এবং নারী-শিশু-বৃদ্ধ নির্বিশেষে সেখানকার নিরপরাধ সাধারণ মানুষের ওপর যে অবর্ণনীয় অত্যাচার ও বর্বরতা চালিয়েছে তার ফলেই বাংলাদেশ থেকে নব্বই লক্ষাধিক শরণার্থী তাদের ঘরবাড়ি সহায়-সম্বল ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে।
অথচ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াসহ গোটা সরকারী প্রচারযন্ত্র এতদিন প্রচার করে এসেছিলেন যে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি বাঙালী মুষ্টিমেয় অবাঙালীদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছিলো, আর তাকেই থামাতে গিয়ে সেনাবাহিনীকে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়েছে। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ ঘোষণা করে জনগণতান্ত্রিক স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠন করে বাংলাদেশের মানুষ আজ দেশ থেকে হানাদার নিশ্চিহ্ন করার যে দুর্বার অভিযান চালিয়েছে তাকে দুষ্কৃতকারী ও ভারতীয় অনুচরদের কার্যকলাপ বলে ইয়াহিয়া সরকার কতদিন যাবৎ প্রচার করে এসেছে।

<005.005.083>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

পাকিস্তানের মাথামোটা গোঁয়ার প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া আর তার জঙ্গী সরকারের অপপ্রচামুখর মুখে বিরাট একটা চপেটাঘাত মারার মতো জওয়াব শোনা গেল গোষ্ঠীনিরপেক্ষ যুগোশ্লাভীয় প্রেসিডেন্টের দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে। তিনি বলেনঃ বাংলাদেশ প্রশ্নটি ভারত-পাকিস্তান প্রশ্ন নয়। এটি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার কোন বিষয় নয়। তিনি বলেনঃ এটি পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারও নয়।
সপ্তাহব্যাপী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরের আগে গত সপ্তাহে মার্কিন টেলিভিশন সংস্থা সি, বি, এস-এর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে প্রেসিডেন্ট টিটো অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় বিশ্বাবাসীকে এই সত্যটি জানিয়ে দিয়েছেন।…

৬ নভেম্বর, ১৯৭১
সম্প্রতি নিউইয়র্ক টাইমস’ পত্রিকায় বাংলাদেশ পরিস্থিতি তথা বাংলাদেশের বর্তমান ঘটনাবলী ও প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে এক রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। এই রিপোর্টে পাক হানাদার বাহিনী অধিকৃত ঢাকা নগরীসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন অধিকৃত এলাকার একটি চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
নিউইয়র্ক টাইমস-এর রিপোর্টার ঢাকা থেকে পাঠানো এর রিপোটে বলেছেনঃ বাংলাদেশে পাকিস্তানী সামরিক অভিযান শুরুর পর সাত মাস কেটে গেছে কিন্তু এখনও কোথাও স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসেনি। বাংলাদেশের প্রত্যেক শহর-বন্দরের জনসংখ্যা বিগত ২৫ শে মার্চের আগে যা ছিলো এখন তার শতকরা ৩০ থেকে ৪০ ভাগ হাস পেয়েছে। এই ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ মানুষের কিছু অংশ সেনাবাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারিয়েছে, কিছু লোক নিখোঁজ হয়েছে এবং বাকী সকলে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়ে লড়াই করছে।
নিউইয়র্ক টাইমস-এর রিপোর্টে বলা হয়ঃ পাকিস্তানী সৈন্যরা মুক্তি বাহিনীকে খতম করবে বলে যে দুরাশা পোষণ করেছিলো তা চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়েছে। বরং ফল উল্টো ফলতে শুরু করেছে- বাংলাদেশের বিভিন্ন রণাঙ্গনে পাকিস্তানী সৈন্যরা মুক্তিবাহিনীর হাতে দারুণ মার খাচ্ছে। মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে তাদের আক্রমণাত্মক পরিকল্পনাগুলো ব্যর্থ হচ্ছে। লড়াইয়ে তারা তারা কোনোক্রমেই সুবিধে করে উঠতে পারছে না। জলে-স্থলে সর্বত্রই তারা মুক্তিবাহিনীর হাতে মার খাচ্ছে। পাকিস্তানী সৈন্যদের এখন একমাত্র নিরাপদ আশ্রয়স্থল হলো কয়েকটি ক্যান্টমেন্ট।
নিউইয়র্ক টাইমস-এর রিপোর্টার লিখেছেনঃ বাংলাদশের বহু বিস্তীর্ণ অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর অধিকার ও প্রশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ফরিদপর, রংপুর, ময়মনসিংহ, সিলেট ও দিনাজপুরের বিস্তীর্ণ এলাকায় স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
ওই রিপোর্টার লিখেছেনঃ বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকাগুলোয় ব্যাপক হত্যা, লুটতরাজ, নারী নির্যাতন ও ধ্বংসের দ্বারা পাকিস্তানী সৈন্যরা যে বিভীষিকা ও ত্রাসের সঞ্চার করেছিলো তা এখন হ্রাস পেয়েছে। মুক্তিসেনারা এখন দেশের শহরে বন্দরে গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে স্থানীয় প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। বর্তমানে বাঙালীদের মনে পশ্চিম পাকিস্তানের ওপর ঘৃণা দারুণভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশে সামরিক অভিযানের পর প্রথমদিকেও এতখানি ঘৃণা ছিল না। পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী অসামরিক প্রশাসনে নিযুক্ত বাঙালী এবং সাধারণ বাঙালীদের ওপর এখনও চরম নির্যাতন অব্যাহত রেখেছে। একজন বাঙালী একজন বিদেশী সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলেছিলো-শুধু এই অপরাধেই পাকিস্তানী সৈন্যরা ওই বাঙালী ভদ্রলোকের পরিবারের সকলকে নির্মমভাবে প্রহার করেছে। কিন্তু এত করেও তারা মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পেরে উঠছে না।
নিউইয়র্ক টাইমস-এর সংবাদদাতা লিখেছেনঃ মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পেরে উঠতে না পেরে পাকিস্তান এখন বাংলাদেশ প্রশ্নটিকে অন্যদিকে ঘোরানোর উদ্দেশ্যে ভারত সীমান্তে ব্যাপক সৈন্য সমাবেশ করেছে। ভারতীয়

<005.005.084>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

বাহিনীর সঙ্গে একটা সংঘর্ষের মাধ্যমে তারা বিষয়টিকে ভারত-পাকিস্তান বিরোধ বলে চালাবার চেষ্টায় আছে। এই উদ্দেশ্যে পাকিস্তান বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে ব্যাপক সৈন্য সমাবেশ করেছে। ফলে বাংলাদেশের শহরে-বন্দরে পাকিস্তানী সৈন্যদের বর্বরতা, সন্ত্রাস ও দৌরাত্ম্য কমে গেছে।…

১২ নভেম্বর, ১৯৭১
… সম্প্রতি সোভিয়েট ইউনিয়নের সুপ্রীম সোভিয়েটের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক মিঃ ভি, কুদরিয়াভেৎসেভ বাংলাদেশের এই যুদ্ধকে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন-বাংলাদেশে আজ যে লড়াই চলেছে তা খাঁটি জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ। পাকিস্তানের জঙ্গী সরকার তথা বর্বর সমর নায়করা বাংলাদেশে গণহত্যা, ধ্বংস আর চরমসন্ত্রাসের নীতির দ্বারা বাঙালীদের জাতীয় মুক্তিযুদ্ধকে তুরান্বিত করেছে। তিনি বলেনঃ আমি আশা করি এই বাস্তব ঘটনা যত তিক্ত ও যতো কঠোরই হোক না কেন পাকিস্তান এটা উপলব্ধি করে সুবুদ্ধির পরিচয় দেবে। সম্প্রতি সোভিয়েট পার্লামেন্টারী প্রতিনিধিদলের নেতা হিসেবে ভারত সফরে গিয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে মিঃ কুদরিয়াভেৎসেভ বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম সম্পর্কে এই মন্তব্য করেন।
বিশিষ্ট সোভিয়েট নেতার এই উক্তিরই আরও স্পষ্ট প্রতিধ্বনি উঠেছে ফরাসী দেশে। ফ্রান্সের লোকবরেণ্য নেতৃবর্গ আজ মনে করেন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ আজ এক অবশ্যম্ভাবী সত্য। এ সত্যকে অস্বীকার করা বা এড়িয়ে যাবার কোনো পথ নেই, পন্থাও নেই। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট জর্জেস পপিদু নিজেই বলেছেনঃ বাংলাদেশ সংকটের মূল হচ্ছে রাজনৈতিক, অতএব বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছানুযায়ী এ সঙ্কটের সমাধান করতে হবে। তা না হলে সমগ্র উপমহাদেশে বিপর্যয়ের ঝড় নেমে আসবে এবং যার পরিণতি ভাবা দারুণ কঠিন ব্যাপার। বর্বর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর ব্যাপক গণহত্যা, লুটতরাজ ও পৈশাচিকতার ফলেই বাংলাদেশ থেকে ৯৬ লক্ষ অসহায় নরনারী-শিশু বৃদ্ধ তাদের বাড়িঘর-সহায় সম্পদ হারিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী বাংলাদেশকে একটি বধ্যভূমিতে পরিণত করেছিলো। বাংলাদেশে এই ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টির জন্যে পাকিস্তানের জঙ্গীশাহী তথা জঙ্গী সমরনায়করাই দায়ী। আর ঠিক এই কারণেই সোভিয়েট কমিউনিষ্ট পার্টির মুখপত্র প্রাভদা’য় পাকিস্তানী জঙ্গী সরকার ও সামরিকজান্তাকে হুশিয়ার করে বলা হয়েছেঃ বাংলাদেশের যে নব্বই লক্ষাধিক শরণার্থী তাদের সহায়-সম্পদ ঘরবাড়ি এবং স্বদেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে, তারা যাতে পূর্ণ মর্যাদা ও নিরাপত্তার সঙ্গে স্বদেশে ফিরে আসতে পারে তার উপযুক্ত অবস্থার সৃষ্টি করতে হবে। পূর্ণ স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার সঙ্গে তারা যাতে স্বদেশে ফিরে আসতে পারে তেমন অবস্থার সৃষ্টি করতে হবে। প্রাভদায় বলা হয়, ইয়াহিয়ার জঙ্গীশাহীই শরণার্থী সমস্যার সৃষ্টি করেছে এবং এ সমস্যা আজ এক জটিল আন্তর্জাতিক সমস্যায় পরিনত হয়েছে। পাকিস্তানের মাথাগরম জঙ্গীচক্র যুক্তিতর্ক বিসর্জন দিয়ে তাদেরই সৃষ্ট সমস্যার জন্যে গোঁয়ারের মতো ভারতের ঘাড়ে দোষ চাপাবার চেষ্টা করছে।

২৪ নভেম্বর, ১৯৭১
… গত রাতে বিবিস’র এক বিশেষ সংবাদ বুলেটিনে বিভিন্ন সংবাদ সংস্থা ও সাংবাদিকদের পাঠানো রিপোর্টের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়ঃ মুক্তি বাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণে গত ৪৮ ঘন্টায় পাকিস্তান তার দশটি সামরিক ঘাঁটি হারিয়েছে। মুক্তিবাহিনীর বীর যোদ্ধারা পশ্চিম খণ্ডে মোট বাইশটি সীমান্ত চৌকির মধ্যে একুশটি দখল করেছে।
গত রাতে ঢাকা থেকে বিবিসি’র বিশেষ সংবাদদাতা মিঃ রোনাল্ড রোবসন জানাচ্ছেনঃ মুক্তিবাহিনীর বীর যোদ্ধারা এখন যশোরের চৌগাছা থেকে যশোর বিমান বন্দরের ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালিয়েছে। মুক্তিবাহিনীর

<005.005.085>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

আক্রমণে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী অধিকৃত যশোর বিমানবন্দরে রানওয়ে ও কন্ট্রোল টাওয়ারটি সম্পূর্ণরূপে নষ্ট হয়ে গেছে। মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে প্রভূত ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করতে করতে পাকিস্তানী বাহিনী এখন দ্রুত পিছু হটে যেতে শুরু করেছে।
বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা ও অস্ট্রেলীয় বেতার থেকে প্রচারিত সংবাদে উল্লেখ করা হয়ঃ বাংলাদেশের সর্বত্রই বীর মুক্তিসেনারা সর্বাত্মক অভিযান চালিয়ে শত্রু সেনাদের একের পর এক ঘাঁটি থেকে বিতাড়িত করে দুর্বার বেগে এগিয়ে চলেছে। পাকিস্তানী হানাদারদের শিবিরে শিবিরে এখন ত্ৰাহি ত্ৰাহি হাঁক উঠেছে।
ঢাকা থেকে AFP সংবাদদাতা এক তারবার্তায় জানাচ্ছেনঃ শত্রু বাহিনী অধিকৃত ঢাকার সঙ্গে গত সোমবার থেকে বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকার যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। ঢাকা-যশোর, ঢাকাইশ্বরদী, ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-কুমিল্লা এক কথায় বাংলাদেশের সকল আভ্যন্তরীণ রুটে পি-আই এ’র সকল সার্ভিস বন্ধ হয়ে গেছে। গত মার্চের পর ঢাকার সঙ্গে বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকার একমাত্র যোগাযোগ ছিলো পাকিস্তানী বাহিনী নিয়ন্ত্রিত পি-আই-এ সার্ভিস। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর দুর্বার আক্রমণের মুখে তাও বিনষ্ট হয়ে গেল। প্রকৃতপক্ষে মুক্তিসেনারা বর্তমানে চারদিক থেকে শক্রবাহিনীকে ঘিরে ফেলেছে এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে তার শত্রু বাহিনীকে সমূলে নিধন করে চলেছে। সর্বত্রই চলেছে মুক্তিবাহিনীর অপ্রতিরোধ্য জয়যাত্রা। ঢাকার মাত্র আঠারো মাইল দূরে মুক্তিবাহিনীর বীর যোদ্ধারা মুন্সীগঞ্জ শহর আক্রমণ করে। মুন্সীগঞ্জ থানার পুলিশের ওপর আক্রমণ করলে থানার একজন পুলিশ অফিসার ও বহু পুলিশ নিহত হয়। মুক্তিসেনারা বিজয় দৰ্পে সারা শহরে কুচকাওয়াজ করেন। মুক্তিসেনারা মুন্সিগঞ্জ মহকুমার লৌহজং ও টঙ্গীবাড়ী থানা দুটিও পুড়িয়ে দিয়ে ঢাকার এক বিশাল এলাকাকে শত্রুমুক্ত করে।
এদিকে মুক্তিসেনারা বর্তমানে উত্তরে সামরিক গুরুত্বপূর্ণ সিলেট শহরের ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ করে বলে বিবিসির বিশেষ সংবাদদাতা মিঃ ডোনাল্ড রোবসন উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, সিলেটের বিভিন্ন ঘাঁটি থেকে পাকিস্তানী সৈন্যরা হটে যাচ্ছে। তিনি তার বার্তায় জানিয়েছেন মুক্তিসেনারা কুমিল্লার ওপরেও এক ব্যাপক অভিযান চালিয়েছে।
গত রাতে অষ্ট্রেলীয় বেতারের এক সংবাদদাতা বুলেটিনে বলা হয়ঃ বাংলাদেশে মুক্তিবাহিনী যে দুর্বার আক্রমণ চালিয়েছে তার সঙ্গে একমাত্র বাংলাদেশের গত ঘূর্ণিঝড়েরই তুলনা করা যেতে পারে।
এ প্রসঙ্গে আমরা উল্লেখ করবোঃ গত সপ্তাহে NEWSWEEK-এর সিনিয়র এডিটর মিঃ বোচগ্রেভ তাঁর An unwinnable Guerilla war শীর্ষক রিপোটে বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে বলতে গিয়ে মন্তব্য করেছিলেনঃ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এখন এমন এক দুর্জয় গেরিলা যুদ্ধের ফাঁদে পড়েছে যেখান থেকে তাদের মুক্তির কোন সম্ভাবনা নেই।

২৬ নভেম্বর, ১৯৭১
… গত ২২ শে নভেম্বর নিউইয়র্ক টাইমস’ পত্রিকায় প্রকাশিত এক দীর্ঘ রিপোর্টে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের এক রূপরেখা প্রকাশিত হয়েছে।
নিউইয়র্ক টাইমস-এর করাচীস্থ সংবাদদাতা গত সপ্তাহে বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ এলাকা সফর করে God is not with the big battalions শিরোনামের এক দীর্ঘ রিপোর্টে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেনঃ গেরিলা যুদ্ধের কৌশল সম্পর্কিত মাও সেতুঙ এর একটি বিখ্যাত উক্তি ভিয়েৎনাম তথা সমগ্র ইন্দোচীন, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার মুক্তিসেনাদের দারুণ প্রেরণা দিয়ে চলেছে। উক্তিটি হলোঃ মাছ

<005.005.086>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

যেমন করে সমুদ্রের অগাধ জলের মধ্যে অত্যন্ত স্বচ্ছন্দে বিচরণ করে, মুক্তিসেনাকেও সেভাবে জনসমুদ্রে স্বচ্ছন্দে বিচরণ করতে হবে।
Mr. Malcom Browne তাঁর এই রিপোটে বলেনঃ বাংলাদেশের বীর মুক্তিসেনারাও আজ বাংলাদেশের বিশাল জনসমুদ্রে মাছের মতোই সাঁতার দিয়ে বেড়াচ্ছে।
নিউইয়র্ক টাইমস সংবাদদাতা বলেনঃ গত সপ্তাহে বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ এলাকা সফর করে আমার এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়েছে। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী অধিকৃত বিভিন্ন এলাকা এবং মুক্তিবাহিনী নিয়ন্ত্রিত বিশাল এলাকা সফল করে আমার যে অভিজ্ঞতা হয়েছে আমি কোনদিন তা কল্পনাও করিনি। এত স্বল্প সময়ের মধ্যে একটা দেশের সমগ্র জনগণ মুক্তিসেনানী হয়ে উঠবে একথা ভাবাও যায় না। কিন্তু ভাবনা-চিন্তা নয় বাংলাদেশে গিয়ে আমাকে তো স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে। আজ বাংলাদেশের যে কোন পর্যটক যেকোন সাংবাদিক যান না কেন তিনিও আমার মতোই বিস্ময়ে মুগ্ধ হবেন।
পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে বাংলাদেশের সর্বত্র শোচনীয়ভাবে পর্যুদস্ত হতে দেখে আমার শুধু বার বার একটা কথাই মনে হয়েছে যে ভিয়েৎনাম যুদ্ধ থেকে এইসব হতভাগ্য পাকিস্তানী সৈন্য ও সমর নায়করা কিছুই শেখেনি। বাংলাদেশের বিভিন্ন অধিকৃত এলাকায় আমি যেসব পাকিস্তানী সামরিক অফিসারদের সঙ্গে কথা বলেছি, জিজ্ঞাসাবাদ করেছি তাদের সবাইকেও মনে হয়েছে এক একটি আস্তো উজবুক।
পাকিস্তানের মাথামোটা সমরনায়করা বাংলাদেশে বড়ো বড়ো রেজিমেন্ট ও ব্যাটেলিয়ন নিযুক্ত করেছে বাঙালীদের মুক্তি সংগ্রামকে ঠেকিয়ে রাখার জন্য কিন্তু God is not with the big battalions –অর্থাৎ আল্লাহ তাদের সহায় নন। বাংলাদেশের গণগেরিলাদের হাতে তারা চূড়ান্তভাবে মার খাচ্ছে। পাকিস্তানের ব্যাটেলিয়নগুলো এখন কেবল প্রাণরক্ষার জন্যেই লড়াই করছে। বাংলাদেশের নদী-মাঠ-প্রান্তরে আর জলাভূমিগুলোয় পাকিস্তানী যুদ্ধজয়ের স্বপ্নের কবর দিয়েছে বাঙালী গেরিলারা। যে কোন বিদেশীর পক্ষে বাংলাদেশের এই বাস্তব পরিস্থিতিটুকু উপলব্ধি করা আদৌ কঠিন ব্যাপার নয়। কারণ শুধু গ্রাম বা প্রত্যন্ত অঞ্চল বলে নয়- বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকাসমূহের প্রতিটি শহর-বন্দরের সর্বত্রই মুক্তিবাহিনীর দেখা পাওয়া আদৌ কষ্টসাধ্য নয়। হোটেল, রেস্তোরাঁ, ব্যাংক, দোকান, বিদেশী ফার্ম, কনসুলেট অফিস থেকে শুরু করে সরকারী অফিস আদালতের প্রত্যেকটি দফতরে তারা সক্রিয়। বাংলাদেশের আমি যেখানে গেছি, যার সঙ্গে কথা বলেছি সবখানে সবার মুখে একই কথা শুনেছি পাকিস্তানী হানাদারগুলোকে আমরা নিশ্চিহ্ন করবোই। আমাদের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে পাকিস্তানী হানাদারমুক্ত না করা পর্যন্ত লড়াই চলবেই।
পাকিস্তানী বাহিনীর সৈন্যসংখ্যা এখন এমন অবিশ্বাস্যরূপে কমতে শুরু করেছে যা বিশ্বাস করাও কঠিন। কিন্তু বাংলাদেশের ঘটনাবলী সম্পর্কে আজ এটাই কঠোর বাস্তব।

দৃষ্টিপাত

১৪ জুন, ১৯৭১
আমাদের চোখের সামনেই যেন একটি মর্মান্তিক ইতিহাস তার পৃষ্ঠাগুলো দিনের পর দিন উন্মোচন করে দিল। আর আমরা সবাই হয়ে থাকলাম ইতিহাসের এক-একজন উজ্জ্বল সাক্ষী। সর্বযুগের, সর্বকালের এবং সর্বদেশের একটি নিষ্ঠুরতম ঘটনা, একটি অমানুষিক পৈশাচিকতা, একটি হৃদয়বিদারক, বিশ্বাসঘাতকতা

<005.005.087>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

আমাদের চোখের সামনেই ঘটে গেল। আমরা চোখ দিয়ে দেখলাম, আমাদের সমগ্র অনুভূতি দিয়ে অনুভব করলাম এবং আমরা সবাই বহু ত্যাগের মধ্যে দিয়ে দিনযাপন করে আবার নতুন সূর্যের অভিমুখে যাত্রা শুরু করলাম। নতুন দিনের আশায় আমরা সাড়ে সাত কোটি বাঙালী আজ উজ্জীবিত নতুন সংগ্রামে আমরা সমগ্র বাঙালী আজ শপথ গ্রহণ করেছি। এ সংগ্রাম আমাদের সুনিশ্চিত মুক্তি নিয়ে আসবে, এ সংগ্রাম আমাদের বিজয়ের তোরণদ্বারে উপস্থাপন করবেই।…
বন্ধু, আমরা তো কোন অন্যায় করি নাই। বৃটিশ বেনিয়াদের উৎখাত করে এদেশে স্বাধীনতা গোখলে তাই একদিন বাঙালীকে লক্ষ্য করে এ যুগের একটি পরম সত্যবানী উচ্চারণ করেছিলেন What Bengal thinks today, Indian thinks tomorrow -অর্থাৎ বাঙালী আজ যা ভাবে, সারা ভারত তা চিন্তা করে আগামীকাল। রামমোহন, চিত্তরঞ্জন, রবীন্দ্রনাথ, ইসমাইল হোসেন সিরাজী, নেতাজী সুভাষ বসু, নজরুল ইসলাম এবং এই জাতীয় আরো বহু নাম উচ্চারণ করা যায় যাঁরা সারা ভারতীয় উপমহাদেশকে মানবতার শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন এবং স্বাধীনতার দীক্ষায় দীক্ষিত করেছেন। পাকিস্তান আন্দোলনের ভিত্তিও ছিল বাংলাদেশ। ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগের জন্ম হয়েছিল বাংলাদেশের ঢাকায়। ১৯৪০ সালে পাকিস্তান প্রস্তাব যিনি সারা বিশ্বের কাছে পেশ করেছিলেন তিনিও ছিলেন একজন বাঙালী-বাংলার নয়নমণি, বাংলার বাঘ ফজলুল হক। পাকিস্তান অর্জনের প্রাক্কালে পাঞ্জাবে এবং সিন্ধুতে মুসলিম লীগের বিরোধী মন্ত্রিসভা ছিলসীমান্ত প্রদেশ পাকিস্তান চায় কিনা তা নির্ধারণ করতে হয় গণভোট নিয়ে। সারা পাকিস্তানে একমাত্র বাংলাদেশেই মুসলিম লীগ সরকার কায়েম ছিল। সুতরাং পাঞ্জাব ও সিন্ধু এবং সীমান্ত প্রদেশ পাকিস্তান আন্দোলনের প্রতি বহুলাংশে নিস্পৃহ ছিল-এ আন্দোলনে বলিষ্ঠ এবং অগ্রণী নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিল বাংলাদেশ। বাঙালীর আন্দোলনেই পাকিস্তান এসেছে পাঞ্জাবীম সিন্ধী, বেলুচি বা পাঠানদের আন্দোলনে নয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই যে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হবার সাথে সাথেই মাতব্বর হয়ে এলো পাঞ্জাবী, কি চাই? না লুটের মাল চাইএলো সিন্ধী, এলো পাঠান। কোথায় লুট করা যায়। আর কোথায়! সোনার বাংলায় সোনা ফলে। সুতরাং সবাই মিলে লুটের জন্য হাত বাড়ালো। কিন্তু লুট করতে গিয়ে দেখা গেল বাঙালীর সাধনা, বাঙালীর ঐতিহ্য, বাঙালীর সংস্কৃতি সব কিছু অত্যন্ত প্রদীপ্ত। সুতরাং শুরু হলো ষড়যন্ত্র। ধ্বংস, করতে হবে বাঙালীর আসল চেহারাকে। ইসলামকে সামনে রেখে পাকিস্তানের অখণ্ডতাকে সামনে রেখে তাদের এই লুণ্ঠনের কাজ সম্পন্ন করতে হবে। এরপর দিনের পর দিন ষড়যন্ত্রেও জাল বিস্তারিত হতে থাকলো। প্রথম আঘাত এলো ভাষার ওপর তারপর অর্থনীতির ক্ষেত্রে, রাজনীতি ক্ষেত্রে, সংস্কৃতির ক্ষেত্রে। শুরু হলো শোষণের এক সুপরিকল্পিত আয়োজন, আরম্ভ হোল শাসনের এক নিদারুণ প্রয়াস। আমরা পাকিস্তান অর্জন করেছিলাম এবং প্রত্যেকটি বাঙালী পাকিস্তানের নিষ্ঠাবান নাগরিক হিসেবে পাকিস্তানের আদর্শকে বিশ্বস্তভাবে অনুসরণ করতে একান্ত নাগরিরে পরিণত করলো। কথায় কথায় আমরা যে পাকিস্তানের সত্যিকার নাগরিক সে ব্যাপারে তারা সন্দেহ পোষণ করতে শুরু করলো-আমাদের আন্তরিকতা, আমাদের বিশ্বস্ত চেতনা সবকিছু পদদলিত করে আমাদের সবাইকে পর্দার সামনে থেকে পর্দার অন্তরালে নিয়ে যাবার সুপরিকল্পিত কাজ শুরু হোল। আর এই হোল পাকিস্তানের বিগত তেইশ বছরের ইতিহাস। বর্তমান শতাব্দীর নিমর্ম একটি ইতিকথা।

(‘চেনাকণ্ঠ” ছদ্মনামে ডঃ মযহারুল ইসলাম রচিত)

১৬ জুন ১৯৭১
বাংলার প্রাণের নেতা শেরে বাংলা ফজলুল হককে পশ্চিম পাকিস্তানের স্বার্থবাদীচক্রের মুখপাত্ররা of an foot of ST-T fossil of Mr. Fazlul Hoq is self-confessed traitor ১৯৫৪ সালের

<005.005.088>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

নির্বাচনে কুচক্রী মুসলিম সরকারের অনুসারীগণ বাংলার মাটিতে সাংঘাতিক পরাজয়বরণ করে আবার পর্দার অন্তরালে ষড়যন্ত্রের আশ্রয় গ্রহণ করে। এই নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের একুশ দফার সপক্ষে সমগ্র বাঙালী অকুণ্ঠ রায় দিয়েছিলেন। বাঙালীর এই একতা ও নবজাগ্রত চেতনা পশ্চিমাদের ভয়ের ও আশঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়ায় বাংলাকে যেমন নির্বিচারে শোষণ করা চলছিল এবার সে পথে এক বিরাট বিঘ্ন সৃষ্টি হয়ে পড়ে। এই জাগ্রত জনতার পুরোভাগে দাঁড়িয়ে যখন শেরে বাংলা ফজলুল হক ব্ৰজকণ্ঠে ঘোষণা করতে থাকেন যে বাংলাকে আর শোষণ করতে দেয়া হবে না তখন পশ্চিমা আমলাগণ এবং স্বার্থবাদী রাজনীতিবিদরা বিপদ গুনতে শুরু করে। তাই ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার হতে থাকে-আর বাংলার অবিসংবাদিত নেতা ফজলুল হককে বলা হয় বিশ্বাসঘাতক। এই ষড়যন্ত্রের নেতা সেদিন ছিল ইস্কান্দার মির্জা, গোলাম মোহাম্মদ প্রমুখ। এদের সাথে হাত মিলিয়েছিল চুয়ান্নোর নির্বাচনে পরাজিত মুসলিম লীগের কতিপয় বাঙালী মীরজাফর। ১৯৫৫ সালের ২৯ শে মে বাংলার দরদী নেতা শেরে বাংলা ফজলুল হক যখন করাচী থেকে ঢাকা বিমানবন্দরে ফিরে এলেন তখন বিপুল জনতা তাঁকে সংবর্ধনা জানাতে সেখানে সমবেত হয়েছিলেন। কিন্তু ভাগ্যের কি পরিহাসনিজের দেশে ফিরে এসে, যে বাংলার মাটিকে ফজলুল হক প্রাণের মত ভালবাসতেন সেই মাটিতে দাঁড়িয়ে একটি কথা পর্যন্ত বলবার অধিকার তাঁর রইল না। সামরিক বাহিনীর কড়া পাহারায় তাঁকে বিমানবন্দর থেকে গৃহে নিয়ে যাওয়া হোল এবং নিজের ঘরে তাঁকে অন্তরীণাবদ্ধ করে রাখা হোল ছয় মাস তাঁকে বাইরের কোন লোকের সাথে মিশতে দেয়া হোত না। এমনকি পবিত্র ঈদের দিনে মুসলিম জামাতের সাথে একত্রে বসে নামাজ পড়তে পর্যন্ত তাঁকে দেয়া হোত না। বাংলাকে ভালবাসার এই হোল শাস্তি-বাংলার দুঃস্থ, নিঃস্ব, নিপীড়িত এবং বঞ্চিত মানুষের জন্য কথা বলার এই হোল সত্যিকার পুরস্কার। ঋণ সালিসী বোর্ড স্থাপন করে একদিন যে ফজলুল হক বাঙালীর অস্তিত্ব রক্ষা করতেন, বাংলার গ্রামে, বন্দরে, শহরে অসংখ্য স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা করে শিক্ষার পথ যিনি সুগম করেন এবং সর্বোপরি লাহোর বৈঠকে যিনি সারা বিশ্বের সামনে পাকিস্তান প্রস্তাব তুলে ধরেন সেই ফজলুল হক, সেই শেরে বাংলা ফজলুল হক সেদিন প্রবীণ ও বৃদ্ধ বয়সে নিজের ঘরে বন্দী হয়ে রইলেন। যেদিন জীবনের সমস্ত বিশ্বাস ও আরাম-আয়েশ পরিত্যাগ করে দেশের স্বাধীনতার জন্য ফজলুল হক ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন সেদিন কোথায় ছিল ইস্কান্দার মির্জা, গোলাম মোহাম্মদ? বৃটিশের তাঁবেদার ও গোলাম সেজে তারা তখন চাকরি করতো ও নিজেদের সমস্ত বিপদ থেকে নিরাপদ দূরত্বে বাঁচিয়ে রেখে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ওপর রক্তচক্ষু নিক্ষেপ করতো এই দুই পরাশ্রিত বশংবদ জানোয়ার। আর পাকিস্তান বলতে এদের এতটুকু বাধলো না।…

উনিশ শ’ সত্তরের নির্বাচনের পর এসেছে অভিশপ্ত একাত্তর সাল। এবারেও সেই একই খেলার ভয়াবহ পরিণাম আমাদের চোখের সামনে প্রত্যক্ষ হয়ে উঠেছে। চুয়ান্নোর নির্বাচনের পর শিকার ছিলেন শেরেবাংলা ফজলুল হক, প্রবীণ গণনেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ও অসংখ্য দেশপ্রেমিক। শিকার ছিলেন শহীদ সোহরাওয়াদী এবং সেদিনের তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। আর আজকের নির্বাচনের পর শিকার হয়েছেন বাংলার অবিসংবাদিত প্রাণের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁর অনুসারীবৃন্দ এবং বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা। যে ইয়াহিয়া, টিক্কা এবং এম, এম, আহমেদ একদিন ছিল বৃটিশের পদলেহী চাকর, যারা স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় ছিল এক-একটি অখ্যাত-কুখ্যাত সাধারণ গোলাম, আজ তারাই হয়েছে দেশের হর্তাকর্তা-বিধাতা। আর ফজুলল হকের ভাগ্যে যেমন জুটেছিল বিশ্বাসঘাতকতার গ্রানি, তেমনি বাংলার প্রাণের নেতার সমগ্র পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের একমাত্র গণনেতা আজ হলেন দেশদ্রোহী। ভাগ্যের এ এক নির্মম পরিহাস বটে-রবীন্দ্রনাথের উপেনের ভাষায় “তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ আর আমি চোর বটে।”

কিন্তু দিন আর বেশী দূরে নয় যখন এই ষড়যন্ত্রের জাল আমরা ছিন্নবিচ্ছিন্ন করবোই এবং বাং এই দানবদের নির্যাতন থেকে উদ্ধার করবোই। আসুন আপনি কৃষক-মজুর, আসুন আপনি চাকরিজীবী-বুদ্ধিজীবী, সবার ওপর এসো তোমরা ছাত্র-ছাত্রী, যুবক-তরুণের দল এবার আমরা দানব হত্যায় ও দানব বিতাড়নের

<005.005.089>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ি। আল্লাহ আমাদের সহায় হবেন। জয় বাংলা। (চেনাকণ্ঠ” ছদ্মনামে ডঃ মযহারুল ইসলাম রচিত)

২৩ জুলাই, ১৯৭১
পাকিস্তানের জঙ্গী শাসকবর্গ তাদের বেতার ও অন্যান্য প্রচারকেন্দ্রের মাধ্যমে বিশ্বের নিকট দিন-রাত প্রচার করে চলেছে যে তাদের দখলীকৃত বাংলাদেশের অঞ্চলসমূহ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছে। বিগত তিন মাসে জঙ্গী শাসকদের অমানুষিক কার্যকলাপ এবং সমগ্র প্রচারণা যে কিভাবে বিশ্বাসঘাতকতা ও মিথ্যাকে অবলম্বন করে অগ্রসর হয়েছে আমরা তা জানি এবং বিশ্বের নিকটও তা বিশেষভাবে প্রমাণিত হয়েছে। স্বাভাবিক অবস্থা সম্পর্কে পাকিস্তান সরকারের চীৎকার এবং ক্ৰন্দন এই বিশ্বাসঘাতকতা এবং মিথ্যা প্রচারণাই জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত।
মাসক্যারেনহাস নামক সানডে টাইমস’-এর একজন বিখ্যাত সাংবাদিক এই মাসের ১৩ তারিখে করাচী থেকে সপরিবারে লণ্ডনে চলে যান এবং সেখানে গিয়ে বাঙালী জাতিকে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করবার সুপরিকল্পিত কার্যকলাপের একটি লোমহর্ষক এবং প্রামাণ্য বর্ণনা দিয়েছেন। সানডে টাইমস-এর জেনোসাইড বা একটি জাতিকে নির্মুল করা সম্পর্কে এই প্রামাণ্য তথ্য আজ ইউরোপ, আমেরিকা এবং প্রাচ্যজগতে একটি আলোড়নের সৃষ্টি করেছে। তিনি স্বচক্ষে দেখেছেন কিভাবে শক্তসমর্থ যুবকদের ধরে নিয়ে গিয়ে শরীর থেকে ধরছে এবং খেয়ালখুশিমত গুলি করে মারছে। তিনি দেখেছেন এই বর্বর পশুগুলো কিভাবে যুবতী মেয়েদের ধরে নিয়ে গিয়ে পাশবিক অত্যাচার করছে। এবং এই জাতীয় আরো বহু চোখে দেখা ঘটনার বর্ণনা তিনি দিয়েছেন। আর এই ঘটনাগুলো সবই বেশী দিন আগের নয়। মে মাসের দ্বিতীয় ও তৃতীয় সপ্তাহের দিকে ঘটেছে। সুতরাং একদিকে মৃত্যুর নিষ্ঠুর লীলা চালিয়ে যাচ্ছে পাকিস্তানের বর্বর হানাদার সেনাবাহিনী, অন্যদিকে জঙ্গী সরকার প্রচারণা অব্যাহত রেখেছে যে অবস্থা স্বাভাবিক হয়েছে।
এই প্রসঙ্গে পি-টি-আই পরিবেশিত আর একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনার উল্লেখ করবো। কোন একটি শহরে শতাধিক নিরীহ লোককে বলা হয় যে, রেশনের দোকানে এলে তাদেরকে সাপ্তাহিক রেশন দেয়া হবে। লোকজন সরল বিশ্বাসে রেশনের দোকানে উপস্থিত হয়। তখন সেনাবাহিনী রেশনের দোকান খুলে দিয়ে সেই শতাধিক লোককে দ্রব্য নিয়ে দোকান থেকে ঘরে ফিরে যাচ্ছিল তখন সৈন্যরা পেছন থেকে গুলি করে এবং শতাধিক লোককে সেখানেই হত্যা করে।
এগুলো সবই বর্বরতা এবং বিশ্বাসঘাতকতার এক-একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আর এই দৃষ্টান্তগুলো এখন সবই ইউরোপ, আমেরিকা ও অন্যান্য বিদেশী পত্রিকাগুলোতে ব্যাপকভাবে প্রকাশ পেয়েছে। অন্যদিকে মিথ্যা প্রচারণার তো অন্ত নেই। দেশবাসী সবাই জানেন যে এখনো ট্রেন পুরো চালু করা সম্ভব হয়নি- যে সব জায়গায় দিনে একটি কি দুটো মাত্র ট্রেন চালু হয়েছে সেখানেও বাঙালীদের উঠবার বিশেষ সুযোগ নেই। সড়কপথেও অনুরূপ অবস্থা। মফস্বল শহরগুলোতে লোকজন ফিরে আসতে ভরসা পাচ্ছে না, কেননা বহু ঘটনায় দেখা গেছে যে লোকজন ফিরে এলেই তাদের ব্যাপকভাবে হত্যা করা হয়েছে। সুতরাং সড়কপথে গাড়ি দু’এক স্থানে চালু হলেও লোকজন নেই। জলপথের অবস্থাও একই রকম। স্কুল, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় খোলা হয়েছে কিন্তু দু’একজন শিক্ষক কাজে যোগ দিলেও ছাত্র নেই- এবং এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে হানাদার সৈন্যদের বিতাড়িত না করা পর্যন্ত কোন ছাত্র পড়াশুনা করতে যাবে না।
অফিস-আদালতের অবস্থাও অন্যরূপ নয়। ঢাকার বেশকিছু পরিমাণ অফিস খোলা হয়েছে। কিন্তু ঢাকার অফিসগুলো মফস্বল শহরগুলোর অফিসের ওপর নির্ভরশীল। যেহেতু মফস্বল শহরে শতকরা আট-দশটির বেশী

<005.005.090>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

অফিস চালু হয়নি, সেহেতু ঢাকায় লোকজন অফিসে গিয়ে বসে বসে স্ময় কাটানো ছাড়া করবার কিছু পাচ্ছেন না।

সুতরাং পাকিস্তানের জঙ্গী শাসক চীৎকার করে যতই বলুক যে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এসেছে কিন্তু আসলে যে তা সত্য নয় একথা আমরা সবাই জানি। আর আমরা বাঙালী একথা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে বাংলাদেশকে যতদিন পর্যন্ত না হানাদার পশ্চিম পাকবাহিনীর হাত থেকে মুক্ত করা যাচ্ছে, ততদিন দেশে স্বাভাবিক অভস্থা ফিরে আসতে পারে না। সত্যিকারভাবে বাংলায় বিগত তিনমাসে যা ঘটেছে তারপর আর কোন অবস্থায়ই এই হানাদার পশুশক্তির সাথে সহযোগিতা করতে একটি বাঙালীও অগ্রসর হতে পারেন না। জোর করে কিছুসংখ্যক লোককে অফিসে, আদালতে, ট্রেনে, বাসে বা শহরে-নগরে নিয়ে এলেও বাংলার মানুষের মন জয় করবার সাধ্য এই পশুশক্তি চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেলেছে। আর তাদের বর্বরতা, তাদের ইতিহাসে নজীরবিহীন হত্যালীলা, পাশবিকতা ইত্যাদি কার্যকলাপের মাধ্যমে পাকিস্তান নামক দেশটি মৃত্যুবরণ করেছে-আর সেখানে জন্ম নিয়েছে স্বাধীন সার্বভৌম জনগণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। আমাদের প্রিয় জন্মভূতি বাংলাদেশ। জয় বাংলা।

(চেনাকণ্ঠ” ছদ্মনামে ডঃ মযহারুল ইসলাম রচিত)

২৬ জুন, ১৯৭১
বাংলাদেশ ও নাম কানের ভিতর দিয়া মরমে পশে এ নামের লাবণী অবনি বহিয়া যায়। আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি। শেখ মুজিবের বড় প্রিয় গান। সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর প্রাণের গান। এ গানে বাংলাদেশের মর্মকথাটি আছে। আমার কাছে এ গানের কিন্তু একটা ভিন্ন অর্থ আছে। মনে পড়ছে গাঁ থেকে ফিরছি। অদূরে রাজশাহী শহর দেখতে পাচ্ছি। তেসরা এপ্রিল। সকাল দশটা। মাথার ওপরে উড়ে এলো ইয়াহিয়া খানের জল্লাদ বিমান স্যাবর জেট। তারপর শুরু হলো নির্মম বোমা বর্ষণ। আমি তাড়াতাড়ি একটা খালে শুয়ে পড়লাম। কিন্তু খালটার দশহাত দূরেই একটি ছেলে হাল চাষ করছে। তাকেও শুয়ে পড়তে দেখলাম। কিন্তু সে নির্বিকার হাল চাষ করতে লাগলো। কোন কিছুই হয়নি। বিমানগুলি চলে গেলে আমি উঠে দাঁড়িয়ে কাপড়-চোপড় ঝাড়তে লাগলাম। কিন্তু ছেলেটি তখন গাইছে, আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি। আমাকে দেখে ও বলদ দুটি থামালো-বললো, আপনি বুঝি খুব ভয় পেয়েছিলেন? তার কথায় একটু বিদ্রুপের সুরও ছিল। বললাম, হ্যাঁ ভয় একটু পেয়েছিলাম বৈকি। বললাম, তোমার বুঝি ভয় করেনি। বললো, না। বললো, মরতে তো হবেই স্যার। জিজ্ঞেস করেছিলাম, তোমার নামটি কি ভাই? উত্তর এলো, অমল। ঘটনাটা ছোট্ট কিন্তু অসামান্য। অমল, বিমল, রহিম, করিম হাল-চাষ করছে আর গান গাইছে, আমার সোনার বাঙলা আমি তোমায় ভালবাসি।
হাঁটতে হাঁটতে আবার গাঁয়ের দিকে যাচ্ছি। আম বাগানের নীচে ইষ্ট পাকিস্তান রাইফেলসের বীর সেনানী ভাইরা বন্দুক নিয়ে শত্রুর মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত হয়ে বসে আছি। রাজশাহী শহরের চারিদিকে অতন্দ্র প্রহরী এই ই-পি-আর বাহিনীর জোয়ানেরা। ওদের কাছে বসলাম। পাশেই বাজছে রেডিও। আবার গানঃ আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি। ই-পি-আর এর কয়েকজন জোয়ান গানের সঙ্গে পায়ের তাল ঠুকছে। ওরই মধ্যে একজন, নাম রশিদ। ঢাকায় বাড়ি, বললো, কি জানেন সাহেব, এ গানটা শুনলেই পরানটা এক্কেবারে ফাইট্যা যাবার চায়। বললো ঐ যে ছেলেটাকে দেখছেন, ঐ যে হাল চাষ করছে। ওর নাম অমল। কাল সারা রাত ট্রেঞ্চ কেটেছে আমাদের জন্য। আর এই যে দেখছেন বুড়ো মিয়াকে, ইনি মসজিদের ইমাম। সারাদিন আমাদের জন্য খাবার দিয়ে যাচ্ছে। পানি আনছেন। বিড়ি-সিগারেট জোগাড় করছেন। বুকটা আমার গর্বে ফুলে উঠলো। বাংলাদেশের মানুষ জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে শেখ মুজিবের আহবানে সাড়া দিয়েছেন। হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের এমন প্রমাণ আর কখনও দেখিনি…

(অধ্যাপক আব্দুল হাফিজ রচিত)

<005.005.091>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

২৭ জুন, ১৯৭১
২৭ জুন, ১৯৭১
একজন মায়ের কথা বলছি। হ্যাঁ, একজন বাঙালী মায়ের কথাই বলতে চাইছি। মার্চ মাসে ইয়াহিয়ার সরকার বন্দুক-রাইফেল জমা দেবার নির্দেশ দিয়েছেন। কেউ কেউ জমাও দিয়েছিল। কিন্তু যে মায়ের কথা হাতে বন্দুক দেয়ার অর্থ মৃত্যুকে ডেকে আনা। মা-বোনের ইজ্জত রক্ষা করবি না তোরা? বললেন তিনি। আমার মনে আছে, তিনি তাঁর তিন ছেলেকেই বললেন, মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করো। হয় ইয়াহিয়ার সেনাদেরকে খতম করবে আর না হয় মরবে। ছেলেরা কথা রেখেছে। তাঁর এক ছেলে শহীদ হয়েছে। আর বাকী দুজন এখনও লড়ছে। গেরিলা আক্রমণে তারা দুজনেই সকলের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা পেয়েছে। এই কিছুদিন আগে এদের দু’ভাইয়ের সঙ্গে আমার আলাপ হলো। বললাম- তোমার মায়ের কথা বলো। বললে মা আছেন গাঁয়ে। তিনি তাঁর কাজ করছেন। সবাইকে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেবার জন্য উদ্বুদ্ধ করছেন, প্রেরণা যোগাচ্ছেন। বললে- মা কি বলেন জানেন আপনি? বলেন, মাকে আর দেশকে এক করে দেখবি। তোমরা আমার ছেলে নও, তোমরা বাংলাদেশের সন্তান- এই কথাটা মনে রেখো, ইয়াহিয়ার রক্তপিপাসু সেনারা আমার মতো বহু রত্নপ্ৰসবিনী মাতাকে হত্যা করেছে। আর এখন রতুগর্ভা বাংলাদেশকে হত্যা করছে। কিন্তু ওরা জানে না, একজন মাকে হত্যা করা যায় কিন্তু দেশকে হত্যা করা যায় না। বাংলাদেশকে হত্যা করা যায় না। যাবেও না। মাতা আর পুত্রের রক্ত থেকে জন্মনেবে রক্তবীজের ঝাড় ।

এমনি মা আমরা পেয়েছি লক্ষ লক্ষ, আর এমনি পুত্ৰও পেয়েছি লক্ষ লক্ষ। শেখ মুজিবের বাংলাদেশ আজ মরণ-পণ লড়াইয়ে ব্যস্ত। সমস্ত শোষিত নিপীড়িত জনগণ আজ জেগে উঠেছে, হাতে তুলে নিয়েছে তারা ওপর। আর ভয় নেই। মুক্তিফৌজের বীর ভাইয়েরা প্রতিনিয়ত কঠিন আঘাত হানছে ইয়াহিয়ার সেনাদলের ওপর। আর ভয় নেই। মুক্তিফৌজির সামনে তিনটি প্রধান কর্তব্যঃ
(এক) শত্রু কে চূড়ান্ত আক্রমণ করতে হবে
(দুই) শত্রুর দালালদের খতম করতে হবে
(তিন) কে শত্রু আর কে মিত্র তা চিনতে হবে।
…আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধে লড়াই করছি, আমরা জানি পৃথিবীর যে সমস্ত স্থানে মুক্তিযুদ্ধ চললছে, তার মধ্যে বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তি আন্দোলন সর্বাপেক্ষা গৌরবময়। কারণগুলো কি? প্রথম কারণঃ পৃথিবীর কোনও মুক্তিযুদ্ধ এমন অভূতপূর্ব গণঐক্য দেখে নি। দ্বিতীয় কারণঃ পৃথিবীর কোনও মুক্তিযুদ্ধই যুদ্ধের শুরুতেই সশস্ত্র বাহিনীর এমন সমর্থন লাভ করেনি। স্মরণ করুন কিভাবে আমরা ই-পি-আর, ই-বি-আর পুলিশ, আনসার এবং মুজাহিদ ভাইদের সহযোগিতা পেয়েছি এবং এ মুহুর্তেও তারা কিভাবে জনগণের পাশে দাঁড়িয়ে লড়াই করে যাচ্ছেন। এমন কি ভিয়েতনামের যুদ্ধেও প্রথম দিকে এ ধরনের সশস্ত্র সমর্থন পাওয়া যায়নি, কাজেই সবদিক থেকে বিচার বিবেচনা করে বলা যায় আমরা সবাই একটি গৌরবময় মহান যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করছি। মনে রাখতে হবে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কারণসমূহ যথার্থ। আমরা লড়াই করছি ন্যায়ের জন্য এবং আমাদের লড়াইও যথার্থ পথ ধরে অগ্রসর হচ্ছে। কাজেই বিশ্বের সকল দেশ থেকে আমরা সমর্থন, সাহায্য ও সহানুভূতি পাবোই এবং পাচ্ছিও….

(অধ্যাপক আবদুল হাফিজ রচিত)

৯ জুলাই, ১৯৭১
মাঠে মারা গিয়েছে ইয়াহিয়া খানের লম্বা-চওড়া রেডিও গলাবাজি। শাহী কায়দায় ফরমান জারির ভঙ্গিতে কাকাতুয়া ইংরেজীতে আওড়ানো প্রায় একঘন্টার নরম গরম চরম বিলাপ আর প্রলাপ কি করে দাগ রাখবে

<005.005.092>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

দুনিয়ার মানুষের মনে? তবু, যাদের মাথায় দুবুদ্ধি ভর করেছে, যাদের মাধ্যমণি হিসেবে ইয়াহিয়া খান ধরাকে সরা জ্ঞান করেছে, তারা এই রেডিও গলাবাজির আগে একটা অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির জন্যে বাজনা তো কম দেশদেশান্তরে মিষ্টি কথা তো কম পরিবেশন করেনি। পাকিস্তানী শাসকচক্রের ঝানু ঝানু উপদেষ্টারা ইতিমধ্যে তদ্বির-তদারকের বাকি কিছু রাখেনি। কিন্তু কোন ফল হলো না। ইয়াহিয়া খানের ২৮ শে জুনের রেডিও ভাষণ একটা জঘন্য অপভাষণ হিসেবেই বরং চিহ্নিত হয়ে গেল। উলঙ্গ হয়ে ধরা পড়ে গেলে রাওয়ালপিণ্ডি সামরিকচক্রের সেই মুনাফালোভী দুবুদ্ধিতা, যা এই চক্রকে বাংলাদেশ দমনে প্রবৃত্ত করেছে। ইয়াহিয়া খান তার প্রলাপে বলেছে যে, রাওয়ালপিণ্ডির সামরিক চক্র নিজেরাই শাসনতন্ত্র রচনা করবে। তারা পশ্চিম পাকিস্তানের নির্বাচিত প্রতিনিধিদেরও শাসনতন্ত্র রচনার এখতিয়ার নাকচ করে দিয়েছে। বাংলাদেশকে তো তারা ধ্বংস করতেই চেয়েছে। এটা ইয়াহিয়ার কারণে দুনিয়ার কাছে জাহির হয়ে গিয়েছে।
২৮শে জুনের আগে দুনিয়ার যেসব রাষ্ট্রের কর্মকর্তারা চিন্তা করছিলেন যে, দাবনীয় অপকর্ম করে ফেলে হাতেনাতে ধরা পরে ইয়াহিয়া খানেরা হয়তো তওবা করে পশ্চিম পাকিস্তানে বহাল থাকার জন্যেও দুনিয়ার কাছে একটা সম্মানজনক মীমাংসাসূত্র রাখতে পারবে, তারাও খুঁজে পেতে কিছু পায়নি ইয়াহিয়া খানের বাচনে।
বস্তুতপক্ষে ২৮শে জুনের পরে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মুখপাত্র এবং প্রতিনিধিবৃন্দ বাংলাদেশের ঘটনা সম্পর্কে যেসব বক্তব্য বলেছেন, তাদের প্রত্যেকটি থেকেই একথা বুঝতে পারা যায় যে, এইসব মুখপাত্র এবং প্রতিনিধি ইয়াহিয়া খানের বাচনকে আমলেই আনেননি। নিউজিল্যাণ্ডের প্রধানমন্ত্রী এবং পশ্চিম জার্মানীর পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রী বাংলাদেশ সম্বন্ধে বলতে গিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক মীমাংসাসূত্রের জন্যেই তাগিদ দিয়েছেন। এটা ধরে নেওয়া যায়, তাঁরা কূটনৈতিক সূত্রে ইয়াহিয়া খানের রাজনৈতিক সমাধান সূত্রগুলিকে প্রত্যাখান করেছেন।
কানাডা আর আয়ারল্যান্ডের আইন পরিষদের যেসব সদস্য বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ সফরে এসেছেন, তাদেরও একই কথা। তাঁরা স্বচক্ষে দেখে যাচ্ছেন, বাংলাদেশে ইয়াহিয়া খানের রাওয়ালপিণ্ডি চক্রের জল্লাদেরা একটা গোটা জাতিকে সাড়ে সাত কোটি নরনারী শিশুকে ধ্বংস করে দেওয়ার উদ্দেশ্য কি ধরনের হত্যাকাণ্ড করেছে। বাংলাদেশের প্রশ্নে রাজনৈতিক সমাধানের যে তাগিদ তাঁরা দিয়েছেন তাতে বুঝতে পারা যায়, ইয়াহিয়ার বাচনকে তাঁরা ঝাড়া অগ্রাহ্য করেছে। গোটা বাঙালী জাতিকে নিধন করার জন্য পাকিস্তানী শাসকচক্র যে ষড়যন্ত্র চালিয়ে এসেছে এতদিন, ইয়াহিয়ার বক্তব্য তারই একটা বেতালা পদক্ষেপের মহড়া ছাড়া যে আর কিছু নয় সে কথা আজ বিশ্বের মানুষ বুঝে নিয়েছে। পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন সমাজতন্ত্রী দেশ বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে তাঁদের সমর্থন জানিয়ে আসছে। সর্বশেষ সংবাদে দেখা গেল, চেকোশ্লোভাকিয়ার কর্মকর্তারা সরকারীভাবে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে সমর্থন জানিয়েছেন। তাঁরা বাংলাদেশের ব্যাপারে রাজনৈতিক মীমাংসার জন্যে তাগিদ দিয়েছেন। এর সোজা অর্থ এই যে, ইয়াহিয়া খানের রেডিও বাচনকে তাঁরা ধর্তব্যের মধ্যেই আনেননি। বাংলাদেশ আজ স্বাধীন। এটাই সত্য, এটাই বাস্তব, এটাই বর্তমান, এটাই ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ নিজের শাসনতন্ত্র নিজেরাই তৈরী করবে। দুনিয়ার দেশ-দেশান্তরের কাছে এই ঘটনা অনিবার্য অপ্রতিরোধ্য ঘটনা হিসেবে উন্মোচিত হয়ে চলেছে। ইয়াহিয়া খানেরা মিথ্যা। স্বাধীন বাংলাদেশ সত্য। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি নরনারী-শিশু বুকের রক্ত ঢেলে এই সত্যের ভিত্তিতেই বাংলাদেশের মুক্তির দিনকে এগিয়ে নিয়ে আসছেন।

(“জামিল শারাফি’ ছদ্মনামে রণেশ দাশগুপ্ত রচিত)

<005.005.093>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

১০ জুলাই, ১৯৭১
রাওয়ালপিণ্ডি থেকে দুটো পত্র পৌঁছেছে লণ্ডনে। সরকারীভাবে সরকারী চিঠি। এগুলো নাকি প্রতিবাদলিপি। কিন্তু কিসের প্রতিবাদ? দুনিয়া তাজব হয়ে গিয়েছে খবরটা শুনে। পাকিস্তানী জল্লাদ সরকার বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর কাছে লিখে জানিয়েছে, বাংলাদেশের ঘটনা নিয়ে বৃটেনের সংবাদপত্রে পাকিস্তানবিরোধী প্রচার চলছে- এ প্রচার বন্ধ করার ব্যবস্থা হোক।
বিশ্ববাসীর মনে স্বভাবতই দুটো প্রশ্ন জেগেছে। বাংলাদেশ নিজেকে স্বাধীন বলে ঘোষণা করার পরেও যে পাকিস্তানী স্বৈরাচারী শাসকচক্র অতীতের রেশ ধরে বাংলাদেশের ঘটনাকে এখনও আভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে বোঝাতে চেষ্টা করছে। আর শুধুমাত্র অস্ত্রপাতির জোরে বলে বেড়াচ্ছে যে বাংলাদেশ তাদের দখলে রয়েছে- তারা বৃটেনের খবরের কাগজগুলি কি লিখছে না লিখছে তার ওপর খবরদারি করতে চাইছে কোন লজ্জায়? এটা হতে পারে প্রথম প্রশ্ন।
দ্বিতীয় প্রশ্নটা ভিন্ন ব্যাপার থেকে এসেছে। পাকিস্তানী জল্লাদেরা নিজেদের হাতে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ধ্বংস করা ঢাকা কিংবা চট্টগ্রাম নগরীতে রাজমিস্ত্রী দিয়ে দুটো-চারটে দালানকোঠা মেরামত করিয়ে আর রং ফিরিয়ে, নিজেদের হাতে খুন করা হাজার হাজার নরনারী-শিশুর গলিত লাশ গুম করে সাফাই-সাক্ষীর মারফত প্রমাণ করার চেষ্টায় ছিল যে, পাকিস্তানী ফৌজের লোকেরা বেকসুর, মাসুম; তারা দুষ্টের দমন আর ক্যান্টনমেন্টে বসে আছে জনসংযোগ দফতর হাট করে খুলে। ফল এতে উল্টোই হয়েছে। সাংবাদিকরা অবরুদ্ধ নগরীগুলিতে ঢুকবার সুযোগ কাজে লাগিয়েছেন এবং ফাঁস করে দিয়েছেন পাকিস্তানী জল্লাদদের সমস্ত গোমর। শেষ রক্ষা করার জন্যে, সত্যের বিশ্বপরিব্যাপ্ত অগ্নিশিখাগুলিকে ঢাকা দেবার জন্যে পাকিস্তানী জল্লাদেরা এখন চেষ্টা করছে বিভিন্ন দেশের সরকারকে দিয়ে কিছু একটা করাতে। কিন্তু এদের মাথায় কি এ কথাটা ঢুকছে না যে, যে হাত দিয়ে এরা সত্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদপত্র লিখছে, তা বাংলাদেশের নিরস্ত্র নিরীহ নরনারী-শিশুর রক্তে রঞ্জিত সে রক্তের দাগ লেগে যাচ্ছে এদের চিঠিপত্রেও? তবে দুনিয়ার সামনে উপরোক্ত দুটো প্রশ্নের একটাই জবাব রয়েছে। দু’কান কাটা রাস্তার মাঝ দিয়েই চলে। আসামীর কাঠগড়ায় উঠে আবোল-তাবোল বকে পাগলের ভান করে। সত্যকে চাপা দেবার জন্যে পাকিস্তানী জল্লাদেরা কম চেষ্টা করেনি এরা ২৫শে মার্চে নৈশ হামলা শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা নগরীতে সমাগত সমস্ত বিদিশী সাংবাদিকদের হোটেলের কামরায় আটকে রেখেছিল। তা সত্ত্বেও সেই অবরোধ ভেদ করে সাংবাদিকরা পাকিস্তানী জল্লাদদের নারকীয় কাণ্ডের যে তথ্য আর ছবি নিয়েছিল, সেই সব তথ্য আর ছবি কেড়ে নেয়া হয়েছিল করাচী বিমানবন্দরে। আন্তর্জাতিক রেডক্রসের স্বেচ্ছাসেবী বাহিনীকে এরা ঢুকতে দেয়নি, পাছে পাপ প্রকাশ পেয়ে যায় এই চিন্তায়। এরা বাংলাদেশের যেসব খবরের কাগজের অফিসকে দালান সমেত পুড়িয়ে ছাই করেনি, তাদের ওপর জঙ্গী আইনের নিষেধাজ্ঞা জারি করে। কোন ফাঁকে যাতে বাংলাদেশ থেকে খবর বাইরে না যেতে পারে সে জন্যে এরা বিদেশীদের জন্যে নির্ধারিত কূটনৈতিক শিষ্টাচারকে বুটের তলায় মাড়াতেও দ্বিধা করেনি। কিন্তু সত্যকে চাপা দেওয়া যায়নি। পাকিস্তানী জল্লাদেরা ভেবেছিল, দিন চলে যাবে একরকম করে এবং দুনিয়ার মানুষ আস্তে আস্তে ভুলে যাবে।

(“জামিল শারাফী’ ছদ্মনামে রণেশ দাশগুপ্ত রচিত)

১৬ জুলাই, ১৯৭১
বাংলাদেশের মত এমন শান্তির দেশ, এমন সুখের দেশ আর কোথায় আছে। এমন জন্মভূমি ক’জনে ভাগ্যে পায়। সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা বঙ্গজননী। বাংলাদেশের ছেলে-মেয়েরা চিরকাল ঘরকুনো। বুঝিবা একটু আডডাবাজ। কিন্তু বাংলার ছেলেমেয়েরা কোনোদিন গোলমালে নিজেদেরকে জড়াতে চায়নি। মায়ের স্নেহ, দাদা-

<005.005.094>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

দাদী আর নানা-নানীর আদর কেড়ে বাংলার ছেলেমেয়েরা মানুষ হয়। অথচ আজ! ভাবলে অবাক লাগে। এই তো সেদিন ঘুরছি আর ঘুরছি। হঠাৎ গিয়ে হাজির হলাম মুক্তিবাহিনীর শিবিরে। শান্ত নিরীহ বাঙালীর ছেলেরা দীপ্ত অগ্নিশিখার মত জ্বলছে। এক একটি ছেলে যেন জীবন-মৃত্যুকে পায়ের ভূত্য করে নিয়েছে। মায়ের আচল ছেড়ে, ঘরের নিশ্চিন্ত কোণ ছেড়ে, সামান্য সুখ আর আনন্দের পথ ত্যাগ করে বাংলাদেশের ছেলেরা এই প্রথম অস্ত্রের ভাষায় কথা বলছে। পার্থক্যটা অনুভব না করে উপায় নেই। আমিও না করে পারিনি। বাংলাদেশে স্কুল-কলেজ বন্ধ। কিন্তু বন্ধ নেই মুক্তিবাহিনীর স্কুল-কলেজ। তা সব সময়ই খোলা।
এমনি একটি মুক্তিবাহিনীর শিবিরে গেলাম সেদিন। সোনার টুকরো হীরের টুকরো সব ছেলেরা লড়াইয়ে যাবে তাই তৈরী হচ্ছে। বললাম, কেমন আছো ভাইরা আমার? কেমন আছো? সবাই বললে ভালো আছি। বললেঃ আমাদের বিপ্লবী সেলাম নিন। ওদের সঙ্গে কথা বললাম। পেয়ালা পেয়ালা চা খেলাম। একজন বললেঃ আমরা এখন লড়াই করতে যাচ্ছি। বললাম- সে কি? এক্ষুনি? হ্যাঁ এক্ষুনি। প্রথমে অবশ্য বুঝতে পারিনি। পরে বুঝেছিলাম। অস্ত্রে ওরা দীক্ষিত হচ্ছে- অস্ত্রে ওরা শাণ দিচ্ছে। ওদের সমস্ত মাংসপেশীগুলো ক্রমাগত শক্তিশালী হচ্ছে, ওরা পায়ের তালে তালে মার্চ করছে- ওরা তৈরি হচ্ছে, লড়াই করতে যাচ্ছে। বাংলার সন্তান মুক্তিযুদ্ধে লড়ছে, শক্র নিকেশ করছে। পার্থক্যটা সত্যিই ভুলবার মত নয়। মায়ের আদূরে বেগ। ওদের একজন বললে-দেখবেন লড়াইটা। বলার অপেক্ষা মাত্র। সঙ্গে সঙ্গে ওরা দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেল। একদল মুক্তিবাহিনী আর একদল পাক-সেনা শুরু হল লড়াই। ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনী হেরে গেল। আমি হাততালি দিয়ে ওদের অভ্যর্থনা জানালাম। এরপর ওরা গেরিলাযুদ্ধের কলাকৌশল দেখালো। আর একবার হাততালি দিয়ে ওদেরকে অভিনন্দন জানালাম। ওদের অবসর ওরা এমনি করে কাটায়। আনন্দের মধ্যে শিক্ষা আর শিক্ষার মধ্যে আনন্দ। মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা এভাবে তৈরী হচ্ছে। ইয়াহিয়ার খুনী সেনাবাহিনীর কবর রচিত হবে অচিরে।

(অধ্যাপক আবদুল হাফিজ রচিত)

১৯ জুলাই, ১৯৭১
কবি শহীদ সাবের আজ আর নেই- কিন্তু তার কবিতা আছে। সেই কবিতাটিই পড়ছিলাম। গত মহাযুদ্ধের সময় ফ্যাসিস্ট জার্মান বাহিনী যেভাবে গেরিলাদের ওপর অত্যাচার চালিয়েছিল- সেসব কথা মনে পড়েছিলো শহীদ সাবেরের। সাবেরের মনে তৈরি হচ্ছিল বিদ্যুতের-জন্ম হচ্ছিল একটি কবিতার- আর সে কবিতা মুহুর্তে মনকে আক্রান্ত করে।
কবিতাটি পড়ছিলাম। শহীদ সাবের আজ আর নেই। বাংলাদেশে ইয়াহিয়ার বর্বর সেনাবাহিনী হত্যা করেছে শহীদ সাবেরকে হত্যা বলবো, না অন্য কিছু? শহীদ থাকতেন ঢাকার দৈনিক পত্রিকা ‘সংবাদ’-এর কার্যালয়ে আগুনে-বোমা ফেলে পুড়িয়ে দেওয়া হল সংবাদ কার্যালয়। তাঁরই সঙ্গে পুড়ে গেলেন শহীদ সাবেরযে শহীদ সাবের ছিলেন ফ্যাসি-বিরোধী, যে শহীদ ছিলেন মুক্ত মানবতার প্রতীক। ইয়াহিয়ার খুনী সেনাবাহিনী শুধু অধ্যাপক হত্যাই করেনি। কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী কেউ বাদ যায়নি।
শহীদ সাবের নেই- কিন্তু আছে তাঁর কবিতা। কবিতাটির একটি ভূমিকা লিখেছিলেন সরদার ফজলুল করিম। লিখেছিলেনঃ

‘কিশোর শহীদ সাবের আমারই ন্যায় জেল থেকে জেলান্তরিত হতে হতে রাজশাহী সেন্ট্রাল জেলে এসে আমার সঙ্গে দৈবক্রমে মিলিত হয়েছিলেন। রাজশাহীর সাঁওতাল কৃষকদের আত্মপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন পূর্ববাংলার

<005.005.095>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

আন্দোলনের মধ্যমণি ছিল। আর সে আন্দোলনের সঙ্গে ইলা মিত্রের নামও ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল।”… সরদার ফজলুল করিম আরও লিখেছেনঃ “ইলা মিত্রের গ্রেফতার এবং তার উপর অনুষ্ঠিত নির্যাতন তখনকার সংগ্রামের উপকথায় পরিণত হয়েছিল। সে কাহিনীর ভিত্তিতে শহীদ সাবের তাঁর ‘শোকার্ত মায়ের প্রতি কবিতাটি রচনা করেন।” সংক্ষেপে এই হল শহীদ সাবেরের সেই বিখ্যাত কবিতার পটভূমি। তাঁর মনে পড়েছিল হিটলারের ফ্যাসিস্ট বাহিনীর অত্যাচারের কথা। কিন্তু যে কারণে আমি বিস্ময় বোধকরি, তা হল শহীদ সাবেরের সেই কবিতায় ইয়াহিয়ার খুনী জল্লাদ সেনাবাহিনীর অত্যাচার, নারী নির্যাতন ধর্ষণ, অপহরণ, খুন সবই প্রতিফলিত হয়েছে বিস্ময়কর ভাষায়। কবিরা নাকি ভবিষ্যৎ দেখতে পান। দেখতে পেয়েছিলেন শহীদ সাবেরও। সবচাইতে বড় কথা সেই ফ্যাসিস্ট নির্যাতনের শিকার হলেন কবি নিজেই। এমন করে নিজের ভবিষ্যৎ আর কোনও কবি দেখেছেন কি? আছে কি বিশ্বে কোনও উদাহরণ? না নেই- শুধু আছে এই বাংলাদেশে। শহীদের সেই কবিতার ভাষা তাই কান্নায় সিক্ত, ঘৃণায় ঘৃণায় উচ্চকিত, ছন্দে ছন্দে উচ্ছসিত, পাশব শক্তির ঘৃণ্যতম অত্যাচারের কথা এমন কোরে কেউ কখনও প্রকাশ করেনি।…

কবিতাটির প্রথম অংশে দেখা যাচ্ছে একজন জার্মান ফ্যাসিস্ট ক্যাপ্টেন ভের্নের গর্ভবতী একজন রুশ মহিলাকে উলঙ্গ করছে। কারণ, সেই রুশ মা ছিলেন গেরিলা দলের সদস্যা। তাই এই নির্মম অত্যাচার। শহীদ সাবের লিখেছেনঃ

মাগো, মা আমার কাঁদছো তুমি?
আমাকে একবার দেখো,
দেখো, আমি স্থির, আটল, চোখের পাতাটি নড়ছে না।
চেয়ে দেখো, আমার হাতে লাল মলাটের বই,
কারা-প্রাচীরের অন্তরালে, লুকিয়ে আনা বইটি।
এখন আমার চোখে ভেসে উঠেছে
সেতো তোমারি ছবি মাগো।

কি সেই ছবি? ছবিটা দেখুন।

চারদিকে রক্ত-জমানো হিমেল মৃত্যু
আর তুমি দাঁড়িয়ে আছ জার্মান কমান্ডারের সামনে
মাগো ক্যাপ্টেন ভের্নের কি বুঝবে বলো?
কেন তুমি যোগ দিয়েছ গেরিলা দলে?
স্বদেশ প্রেমের আগুন কত জ্বলে
পররাষ্ট্র লোভী নাৎসীরা কি বুঝবে তা।

না, শুধু হিটলারের ফ্যাসিষ্ট বাহিনী নয়। বোঝেনি ইয়াহিয়ার ফ্যাসিস্ট জল্লাদ সেনারাও। শহীদ সাবের তারপর লিখেছেন দ্বিতীয় দৃশ্য। ফ্যাসিস্টরা ধরে নিয়ে গেছে গর্ভবতী মাতাকে। পথেই তার সন্তান হল। মায়ের কোল থেকে দস্যরা কেড়ে নিলে নবজাতককে।

তারপর আমি দেখছি পরিষ্কার
সেই হাড় কাঁপানো শীতের রাতে, সেই দুঃসহ শীতে
তুমি উলঙ্গ, মাগো তুমি উলঙ্গ

<005.005.096>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

সেই বরফের আস্তরণের উপর দিয়ে ধীর পদক্ষেপে তুমি
হেঁটে চলেছ মাগো, পেছনে বেয়োনেটের ডগা
ছুঁয়ে আছে পিঠেতে তোমার,
দস্যুরা হাসছে মাগো, মাতৃমূর্তির নগ্নতায়,
তোমার সন্তান ভরা পেট ঝুলে পড়েছে মাগো

* * * * *

তুমি এখন জন্ম দিচ্ছ একটি সন্তানের
কি দারণ যন্ত্রণা বলোঃ
একটি ক্ষুদ্র লাল মাংসপিণ্ডঃ আগামী দিনের
এক সর্বহারা সেনা বেরিয়ে আসে ধীরে।
শিশুটি ছিনিয়ে নিলে তোমার কোল থেকে

* * * * *

শয়তান তোমার ছেলের জাম কবজের দিক হুমকি
মাগো, তুমি, মা- তোমার একটি কথার পরে
করছে নির্ভর অসংখ্য তরুণ গেরিলার প্রাণ
তুমি তো জননী, বলবে না একটি কথাও।

না জননী একটি কথাও বলেননি। তাঁর চোখের সামনে তার সাদ্যোজাত শিশুকে হত্যা করা হলো। পরে তিনি নিজেও প্রাণ দিলেন। বাংলাদেশের মা-বোনদের ওপরে এমনি নির্যাতন চালিয়েছে ইয়াহিয়ার বর্বর সেনারা।…

শহীদ সাবের লিখেছিলেনঃ
আর দেখ আমি কারাগারে
মাগো তুমি কেঁদো না, কেঁদো না
আমার জন্যে কেঁদো না, দেখ দেখ
আমি স্থির, আটল…

না, শহীদ সাবেরের জন্য আমরা কাঁদবো না। বাংলাদেশের তিনিই প্রথম কবি যিনি ইয়াহিয়ার বর্বর ফ্যাসিষ্ট সেনাদের হাতে প্রাণ দিলেন।…

(অধ্যাপক আবদুল হাফিজ রচিত)

<005.005.097>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

২০ জুলাই, ১৯৭১

…পাকিস্তান সরকার শিক্ষিত সেনাবাহিনীর নিয়মিত মৃত্যু রোধ করতে আরও কিছু ব্যবস্থা নিয়েছে? যেমন- রাজাকার বাহিনী তৈরী করেছে বিভিন্ন অঞ্চলে। আকাশ থেকে নিক্ষেপ করেছে রাশি রাশি প্রচারপত্র। তাতে বলা হয়েছেঃ হে দেশপ্রেমিক জনগণ দুষ্কৃতকারী ও অনুপ্রবেশকারীরা বড্ড খারাপ কাজ করছে। আপনারা তাদেরকে ধরিয়ে দিয়ে দেশপ্রেমের পরাকাষ্ঠা দেখান। বাংলাদেশে ইয়াহিয়া খাঁ সাহেবদের জন্য এখনও দেশপ্রেমিক আছে, এ কথা ভাবলে হাসি পায়। তবে একটা কথা বলতেই হয়, বাংলাদেশের মানুষ দেশপ্রেমের বাস্তব পরাকাষ্ঠার প্রমাণ দিয়েছেন হাতে হাতে।
একজন কৃষক ভাইয়ের সাথে আলাপ করছি। তিনি জমিতে রোয়া লাগাচ্ছিলেন। বললাম- কেমন আছেন? বললে-ভাল আছি, খুব ভাল আছি। বলেই মাথার টোপরের ভেতর থেকে একখানা কাগজ বের করে দিলে। বললে, এই এক্ষুণি ফেলেছে বিমান থেকে। ওখানেই বসে বসে পড়লাম। সেই প্রচারপত্র যাতে দেশপ্রেমিক জনগণের প্রতি আবেদন জানানো হয়েছে। কৃষক ভাইটি জানালেন, মুক্তিবাহিনীকে বলবেনতাদের জন্য আমরা ধান-চাল আটা-গম সব মজুদ করে রেখেছি। এমন জায়গায় রেখেছি, খান সেনাদের চোঁদ্দপুরুষও খুঁজে পাবে না।
অবাক লাগলো। একজন সাধারণ চাষী মুক্তিবাহিনীর জন্য সর্বস্ব পণ করেছেন। অবশ্য এটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশে ইয়াহিয়ার দস্যু সেনাবাহিনী যা করছে, তা সমস্ত অত্যাচারের ইতিহাসকে স্নান করে দিয়েছে। প্রতিটি কৃষক, শ্রমিক, মধ্যবিত্ত, বুদ্ধিজীবী প্রতিদিন অনুভব করছেন, পশ্চিম পাকিস্তানের পুঁজিবাদী ধনিকদের দালাল পাকিস্তানী হানাদার সেনার হাত থেকে মুক্ত করতেই হবে স্বদেশকে তাই দেশের সমস্ত অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করছেন। দেশের সাধারণ মানুষ। মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে জনগণের আন্তরিক সহযোগিতাই মুক্তিবাহিনীর সাফল্যের কারণ। রাজাকার বাহিনী কিংবা শান্তি কমিটি করেও কূল পাওয়া যাচ্ছে না। জনগণের ব্যাপক অংশে বিরাজ করছে অসন্তোষের তীব্র দাবদাহ।…
আজ পাকিস্তান বলতে যা বোঝায়- তা হল পশ্চিম পাকিস্তান। পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কোনো অভিযোগ নেই। পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ আমাদের মতই শোষিত, বঞ্চিত, নির্যাতিত। কিন্তু পাকিস্তানী শাসকচক্র পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষকে মিথ্যে ভাঁওতায় ভুলিয়ে, কাশ্মীরে নিয়ে যাওয়ার নাম করে বাঙালীকে হত্যা করবার কাজে লাগাতে চেয়েছে। সিন্ধু থেকে কৌশলে এভাবে স্বল্পমেয়াদী ট্রেনিংপ্রাপ্ত লোক আনা হয়েছে সীমান্ত অঞ্চল রক্ষার জন্যে মুক্তিবাহিনীর হাতে এরাও প্রচণ্ড মার খাচ্ছে।
গোড়াতে সেই যে চাষী ভাইয়ের কথা বলেছিলাম। তিনিই বলছিলেন- একটা মজার ব্যাপার দেখেছেন? মজার ব্যাপার? আমি অবাক হলাম- চারিদিকে হত্যাকাণ্ড, লুটতরাজ এবং অত্যাচারের মধ্যে মজার ব্যাপারটা কি? তিনি বলছিলেন, সিন্ধু থেকে আনা একদল সেনা রাস্তার ধারে বসে নিজেদের ভাগ্য নিয়ে আলোচনা করছে। তারা এ হত্যাকাণ্ডে নিজেদের হাত রক্তাক্ত করতে চায় না। তাদের মধ্যে কেউ কেউ দেশে ফিরে যেতে চায়। আর কেউ বা বসে বসে কাঁদে। এরা যুদ্ধ করতে চায় না, মরতে চায় না। পাকিস্তানী শাসকচক্র সিন্ধুর শোষিত জনগণকে লেলিয়ে দিয়েছে শোষিত বাঙালীদের বিরুদ্ধে। মানুষ যুদ্ধ নয়- মানুষ ভাবে, মানুষ চিন্তা করে, মানুষেরই শুধু বিবেক রয়েছে। তাই সিন্ধী, বেলুচী এবং সীমান্ত প্রদেশের লোকেরা লড়তে চায় না। একজন কম্যাণ্ডিং অফিসার তার অধীনস্থ সেনাদেরকে বাঙালীদের বাড়ি ঘর লুট করতে বললে তারা রাজী হয়নি। উল্টো তারা কম্যাণ্ডিং অফিসারকেই হত্যা করে।…

(অধ্যাপক আবদুল হফিজ রচিত)

<005.005.098>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

২ নভেম্বর, ১৯৭১

বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ এলাকা আজ শত্রুমুক্ত। এইসব জায়গায় মুক্তিবাহিনীর সহায়তায় গ্রামবাসী প্রতিটি গ্রমকে দুর্ভেদ্য দুর্গের মতো করে গড়ে তুলেছে। যে হাত কেবল লাঙল ধরতো, কিংবা কলম ধরতো, কিংবা যে হাতে একতারা শোভা পেতো-সেই হাত, সেই একই হাত আজ তুলে নিয়েছে রাইফেল।
এই সব এলাকা কয়েকদিন আগে ঘোরার সময় খান সেনাদের অত্যাচারের চিহ্ন দেখেছি, শুনেছি তাদের বর্বরতার কথা, জেনেছি মুক্তিবাহিনী ও গ্রামবাসীর সম্মিলিত ক্রমাগত যুদ্ধের কথা, জয়ের কথা। তরুণ যোদ্ধাদের সঙ্গে ভাব-বিনিময় করেছি এবং বার বার অনুভব করেছি কি গভীর আমাদের দেশের মানুষের দেশপ্রেম; কি প্রচণ্ড সংগ্রামের, যুদ্ধের ইচ্ছা তাদের। এবং কি কঠিন পণ নিয়েছে তারা সবকিছু উৎসর্গ করে স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার।
এসব জায়গায় যে কদিন খান সেনারা ছিল, সে কদিন তারা গ্রামগুলোর ওপর দিয়ে অত্যাচারের ঝড় বইয়ে দিয়েছে। বহু মানুষের ঘর-বাড়ি জ্বালিয়েছে, ফসলের ক্ষতি করেছে, বাজার-দোকানপাট জ্বালিয়েছে, মানুষকে, অত্যাচার করেছে মেয়েদের উপর। এইসব অন্যায়-অত্যাচারের মধ্য দিয়ে মানুষ-পদদলিত, শোষিত মানুষ জেগে উঠেছে। তাদের চোখে এখন শত্রু হননের আকাঙ্খা। জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত প্রতিটি মানুষ এখন যুদ্ধ করে যেতে চায়। একজন গ্রামবাসী আমায় বললেনঃ যুদ্ধ তো সবে শুরু, এখনই কি জয়ের কথা বলেন। খান সেনাদের বিষদাঁত ভেঙে না দেয়া পর্যন্ত জয় কিসের। আমাদের হাতে অস্ত্র ছিলো না তাই খান সেনারা ফাঁকা মাঠে কারদানি দেখিয়েছে, এখন তো আমরা সবে অস্ত্র ধরেছি, তারা শোধ তুলবো না?
গ্রামের একজন যুবক বললেন, ‘অস্ত্র যখন ধরেছি তখন বেঁচে থাকতে খান সেনারা এই গ্রামে আর ঢুকতে পারবে না। চেষ্টাও তারা কম করেনি, ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়েও চেষ্টা করেছে, কিন্তু এখন মজাটা টের পেয়েছে তারা। এখন তারা মাইল সাতেক দূরে থানা গেড়েছে।’
সবখানেই এক মানসিকতা। খরচাপাতি কমিয়ে দিয়েছে সবাই। খাদ্যসামগ্রী জমিয়ে রাখছে ভবিষ্যতের জন্য। গ্রামের এখানে-ওখানে জঙ্গল হয়ে গেছে- আমাদের যোদ্ধাদের জন্য খুবই অনুকূল। গ্রামবাংলা যুদ্ধ ও জীবন সব এখন একাকার হয়ে গেছে।

মুক্তিযোদ্ধারা এমন চতুরতার সঙ্গে খানসেনাদের ঘায়েল করে চলেছে যে আমাদের কোন প্রাণহানি হয় না বল্লেই চলে। তার কারণ নিজেদের পরিচিত দেশে যুদ্ধ করে চলেছে মুক্তিসেনারা সহজে তারা দেশের মাটির সঙ্গে, মানুষের সঙ্গে মিশে যেতে পারে। মানুষের শত্রুখান সেনারা তা পারে না। কাউকেই তারা বিশ্বাস করতে পারে না, দেশের মাটি ও পরিবেশ তাদের অনুকূল নয়। কারণ এদেশ তাদের নয়, এদেশকে তারা জানে না, এ দেশের মানুষকে চেনে না, জানে না। তারা কেউ এদেশের নয়। তারা যে জোর করে এদেশে থাকতে চাইছে সেটি নিতান্তই অস্বাভাবিক ব্যাপার তাই তারা এদেশে থাকতে পারবে না, এদেশ থেকে তাদের চলে যেতে হবে, এদেশের মানুষই তাদের তাড়িয়ে দেবে। মাটির সঙ্গে ও মানুষের সঙ্গে যারা শত্রুতার করে তাদের এরকমই পরিণত হয়ে থাকে।
যুদ্ধ কিভাবে জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে তা দু-পাঁচজন মুক্তিসেনার সঙ্গে আলাপ করলেই জানা যায়। যারা আহত হয় তাদের কারুর হাতে বা পায়ে, কিংবা কাঁদে বা শরীরের অন্য কোথাও হয়তো গুলি লাগে। এগুলো যেন কাউকে বলার মতো কোন ব্যাপার নয়। নিতান্ত জিজ্ঞেস করলে উত্তর পাওয়া যায়ঃ গুলি তা লেগেছিল

<005.005.099>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

গোটা দুই-হাত কিংবা পায়ে বা অন্য কোথাও বেশ কিছু ছেলে বিকলাঙ্গ হয়ে গেছে, কিন্তু তাদের কাছে তা বিশেষ কোন ব্যাপার নয়, জীবনে আর পাঁচটা ঘটনা প্রত্যেকদিন ঘটে, ঘটেছে; এও তেমনি। সে জন্যে এসব ব্যাপারে কোন মুক্তিসেনার ভ্রক্ষেপও নেই। তাদের সবার সামনে একটি মাত্র লক্ষ্য-শত্রু ধ্বংস করা।
দুটি তরুণের কথা শুনলাম। কয়েকবার যুদ্ধ করেছে এমন একটি ছেলের নাম খোকন। স্কুলের ছাত্র। হালকা গড়ন। লাজুক লাজুক ভাব। সবার সঙ্গে বিনয়ের সঙ্গে কথা বলতো। যুদ্ধ করতে করতে এমন অবস্থা হয়েছিল যে, কোন সুযোগ এলেই সে লাফিয়ে উঠতো। তার সঙ্গে শেষবারের মতো যখন আমার দেখা হয় তখন সে বারবার আমাকে বলেছিল, “আমাদের একমাত্র উদ্দেশ্য শুক্র খতম করে এদেশের শোষিত মানুষকে সত্যিকার স্বাধীনতা দেয়া। কেউ যেন আর কোন দিন আমাদের বঞ্চিত পদদলিত করতে না পারে সে জন্যই আমরা জীবন দিচ্ছি। পাক-সেনাদের দ্বিমুখী আক্রমণের সম্মুখীন হয়েছিল খোকন। একটি সজিনা গাছের আড়ালে লুকিয়ে গুলি চালাচ্ছিল সে। তার শেষ চেষ্টা ছিল সঙ্গীদের বাঁচানো। কয়েকজন খানসেনাকে খতম করার পর একটি গুলি সজিনা গাছ ভেদে করে তার শরীর বিদ্ধ করে। মৃত্যুর শেষ মুহুর্তে তার উত্তর ছিল একজন খান সেনার উদ্দেশে একটি হ্যান্ড গ্রেনেড ছুড়ে দেয়া। তাতেই খানরা তাদের বহু সঙ্গীকে হারিয়ে পালিয়ে যায়।
কাছাকাছি এক শিবিরে দেখা হয় হাবলুর সঙ্গে। তার বুকে পাশ থেকে এক ঝাঁক গুলি এসে লাগে। বাঁ হাতেও লাগে কয়েকটি গুলি, বা পা-ও রেহাই পায়নি। ডান হাত ছাড়া হাবলুর কোন অঙ্গই আর চালু ছিল না। বুক পেটের সামনের মাংস সমেত উড়ে চলে যায়, হাত-পা আচল তবু হাবলু যুদ্ধ চালিয়ে গেছে এক হাতে, ছুড়েছে গ্রেনেড। যে খানসেনাটি তাকে গুলি করেছিল তাকে হাবলু শেষ করেছে এক গ্রেনেডেই। সামনে যে কয়টি পড়েছিল তাদের কাউকেই ছাড়েনি সে। তারপর বুকে হেঁটে জীবন ও মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে সে নিরাপদ জায়গায় চলে। হাবলুর বাঁ হাতের আঙ্গুলগুলো অচল হয়ে গেছে।
হাবলু বললো, “আমরা এখন খানদের একেবারে কাছে না পেলে আর গুলি ছুড়ি না। ওরা এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ে, আমরা হিসেব করে গুলি খরচ করি। ওরা বেহিসাবীর মতো মরে, মরে অন্যায়ের ধ্বজাধারী হয়ে। আমরা মরি স্বাধীনতা রক্ষার জন্য, প্রতিটি প্রাণ আমাদের অমূল্য, একটি একটি মৃত্যু একটি অবদান।”
এরকম বহু খোকন ও হাবলুর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। তারা সবাই প্রাণ দিচ্ছে, দেবে। তারা বারবার বলেছে, এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা শোষণের শেষ ঘাঁটিটি পর্যন্ত ধ্বংস করতে চাই। কড়াই থেকে আগুনে পড়তে চাই না আমরা। দশ লক্ষ নিরীহ মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। মরছে প্রতিদিন হাজার হাজার। রক্ত দিচ্ছে মুক্তিসেনারা, দেশ সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত এর বিরাম নেই। কিন্তু তার মাধ্যমে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ যেন মুছে যায়, শোষক যেন ধ্বংস হয়। শোষক যেন না গজায়, গরম কড়াই থেকে আমরা যেন আগুনে না পড়ি। তাহলেই, কেবল তাহলেই আমাদের জীবন বিসর্জন, আমাদের সংগ্রাম, আমাদের যুদ্ধ, আমাদের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ সার্থক হবে।

(“জাফর সাদেক’ ছদ্মনামে মোহাম্মদ আবু জাফর রচিত)

৩ নভেম্বর, ১৯৭১

‘মাথার ঘায়ে কুকুর পাগল প্রবাদটি বিশেষভাবে প্রযোজ্য পিণ্ডি অধিকর্তাদের বেলায়। কয়েক লক্ষ মানুষকে হত্যা করে, ৯০ লক্ষ লোককে দেশত্যাগী, আরো অসংখ্য গৃহ ভস্মীভূত এবং লুণ্ঠন করে হঠাৎ টনক নড়েছে। আজ ইয়াহিয়ার বাদশাহী সিংহাসন টলোমলো, জল্লাদবাহিনীর আর্তনাদে মুখর সমস্ত পাকিস্তানের আকাশ বাতাস। যারা এসেছিল এদেশকে পদানত করতে, শৃংখল পরাতে, ধনসম্পদ লুট করতে আজ মুক্তি বাহিনীর প্রতিরোধের মুখে হত্যাকারী হয়ে উঠেছে হতোদম, গতপ্রাণ। জল্লাদ বাহিনীর মনেও আজ ভয়, সন্ত্রাস দানা বেদে উঠেছে। মুক্তিবাহিনীর নাম শুনলে তিনবার ইষ্টদেবতার নাম স্মরণ করে।

<005.005.100>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

এখন উপায়? উপায় খুঁজে বের করেছে বিশ্ব ইতিহাসের ঘৃণিত নায়ক, বুদ্ধিবিবেক বর্জিত সেনাপতি ইয়াহিয়া খান। খবরের কাগজে প্রকাশিত হলো বিবৃতি, সর্ব অসত্যের ভাণ্ডার রেডিও পাকিস্তান থেকে ক্ষণে গৃহহীন আশ্রয়হীন সংসারকে টিকিয়ে রাখার জন্য, একটু আশ্রয়, একটু নিরাপত্তার অভিপ্ৰায়ে। দরদবিগলিত কণ্ঠে পরম বন্ধুর মতো আহবান এলো- ‘আয়, ওরে আয় ঘর ছেড়ে যারা গেছিস তারা আয়। তোদের সব আছে, তোদের সব দেবো। কিন্তু বাংলার মানুষ দুর্জনের আশ্বাসে ভুলল না। কেননা তারা জানে, ‘খলের ছলের অভাব হয় না। একবার তারা আঘাত পেয়েছে, বহু কষ্টে বুকের পাথর চাপা দিয়ে ভুলে আছে মা বোন ভাই আত্মীয়স্বজনের হত্যার কাহিনী। তারা চায় নায় আবার সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হোক।
ইয়াহিয়ার তাঁবেদাররা বলল, ‘সংবর্ধনা শিবিরগুলি ফেরত-উদ্বাস্তুদের দ্বারা ভেঙ্গে গেছে।” সংগে সংগে ইংল্যাণ্ডের একটি পত্রিকায় প্রকাশিত হলো, ‘সংবর্ধনা সভায় একটি লোকও দেখলাম না। দুর্জনদের মিথ্যা উক্তির প্রমাণটি লক্ষ্য করুন।
যারা মানুষকে ঘরছাড়া করার জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ করেছে, বাঙালীকে হত্যা করে সংখ্যাসমতা আনতে চাইছে- তাদের কোন আশ্বাস কি সংগ্রামী মানুষ সুস্থ মানুষের উক্তি বলে গ্রহণ করতে পারে?…
শুধু এই নয়, আরো আছে। ইয়াহিয়া নির্বাচনের দিন ও তারিখ ঘোষণা করেছে। ভাবখানা এই, নিজের মুরগী যেদিকে ইচ্ছা সেদিকে কাটব’। কিন্তু সাড়ে সাত কোটি মানুষের অধিকার, ভাগ্য, ধ্যান-ধারণা তো সস্তা বা মূল্যহীন নয়। ইয়াহিয়া খান অনুভব করেছে এতদিনে।
আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো, জনপ্রিয় অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, নির্বাচিত সদস্যবৃন্দ, আওয়ামী লীগের সদস্যদের দেশদ্রোহী বলে ফরমান জারি করা হলো। আবার সেই ব্যক্তি যে দলটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলো, সে দলেরই নির্বাচিত কতিপয় সদস্যদের আবার বৈধ বলে মেনে নিলো। প্রবঞ্চক প্রবঞ্চনার পথ বেছে নিলো। বাতিলকৃত সদস্যপদ আবার নির্বাচন হবে। এ যেন ছেলের হাতের মোয়া। সামরিক শক্তির বলে গণমানুষের মৌলিক অধিকার হরণ করা যেন ছেলেখেলা ব্যাপার।
শুধু তাই না, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রতিনিধি নির্বাচিতও হয়ে যাচ্ছে। আর আশ্চর্য, আওয়ামী লীগের সংগে প্রতিদ্বন্দ্বিতায়, খেলা আর বলে কাকে? মনগড়া হিসেবে বিশ্বকে ভাঁওতা দেয়ার যে পথ বেছে নিয়েছিল ইয়াহিয়া খান, আজ তা নিদারুণভাবে ব্যর্থতায় পর্যবসিত। বাংলার মানুষ আজ তার জবাব দিচ্ছে প্রতিটি ক্ষেত্রে এবং বারবার।…

(মুস্তাফিজুর রহমান রচিত)

৭ নভেম্বর, ১৯৭১
জল্লাদ বাহিনীর মৃত অফিসারদের জন্য কাটের বাক্স তৈরী করা হচ্ছে এবং সেটা হচ্ছে ব্যাপকহারে। বেচারা কাঠমিস্ত্রীর শান্তি বা স্বস্তি নেই। দিন-রাত তার কাজ-বাক্স বানাও। মরা লাশগুলোকে জলদি পাঠাও নিজের দেশের মাটিতে। কারণ? কারণ অনেকগুলো। প্রথমত, বাংলার মানুষ যেন বুঝতে না পারে যে বর্বরবাহিনীর অফিসাগুলোর একে একে লোপাট হয়ে যাচ্ছে। দ্বিতীয়, বাংলার মাটিতে ওদের ঠাঁই নাই। কেননা ওরা বাংলার নয়। বাংলার মাটির এতোটুকু দরদ নেই ওদের জন্য। বাংলা শুধু বাংলাদেশের জনগনের। এখানের সাহিত্য-সংস্কৃতি, ঐতিহ্য কৃষ্টি সব এদেশেরই। এসবই বেড়ে উঠেছে সবুজ কোমল লতার মতো বাংলার মাটি থেকে। তাই এ মাটিতে কি ঠাই পেতে পারে যারা বাঙালী বিদ্বেষী, যারা বাংলার পয়লা নম্বরের দুশমন? কখনোই না।

<005.005.101>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

হিংস্র পশুদের খাঁচা থেকে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল বাংলার শ্যামল প্রান্তর আর জনপদে। লোভী, বিবেকহীন পশুর দল দিকদিশাহীনভাবে চালিয়েছে অত্যাচার, হনন আর সন্ত্রাসের রাজত্ব।
কিন্তু তারপর? কুল আর রক্ষা হয় না। চারিদিক থেকে আঘাত হানছে বাংলার মানুষ। পথে-ঘাটে, হাটে-বাজারে, শহরে-বন্দরে, জলে-স্থলে, যেখানেই সুযোগ পাচ্ছে, অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে তাদের খতম করছে। এখন শয়তানদের পথ চলতে ভয়, ঘরের মধ্যেও নেই স্বস্তির আশ্রয়।
এজন্যেই নিজের প্রাণ বাঁচানোর জন্যে এবং মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য রাইফেল দেখিয়ে টেনে নিয়ে আসছে খেটেখাওয়া সাধারণ মানুষকে। তাদের আড়ালে এগিয়ে আসছে মুক্তিবাহিনীর সম্মুখে। কিন্তু এতেও কুল রক্ষা হচ্ছে না। তীক্ষ্ণধী, সদজাগ্রত বাংলার প্রহরী মুক্তিবাহিনী তাদের কৌশল ধরে ফেলেছে। পাল্টা এমন আঘাত হানছে যে দস্যুর দল পরি কি মরি করে পালাতে দিশা পাচ্ছে না।
ভীত সন্ত্রস্ত জল্লাদবাহিনী শহরের চারপাশে নদীর ধারে গড়েছে বাঙ্কার, বসিয়েছে মেশিনগান। কিন্তু রাতের অন্ধকারে গা মিশিয়ে এসে মুক্তিবাহিনী আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়ে ওদের উপর, তাই কোন কিছুতেই বিশ্বাস নেই। নদী দিয়ে পানা ভেসে যাবে ওদের সামনে দিয়ে? যাদি মুক্তিবাহিনী হয়? মেশিনগানের গুলি চলে পানার ওপর।
রাতের অন্ধকারে শিয়াল-কুকুরেরও ওদের সীমানা দিয়ে যাওয়ার উপায় নাই। হত্যাকারীদের ধারণা, মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা যেকোন রূপ ধারণ করতে পারে-অতএব দৃশ্যগোচর কোন কিছুকেই ক্ষমা নেই।
রাতের বেলায় মুক্তিবাহিনীর গুলির শব্দ পেলে সে পথে তারা হাঁটে না। প্রথমে তাদের পরম ভৃত্য রাজাকারদের পাঠিয়ে খোজ খবর নেয়, পরে বিশ্বাসযোগ্য হলে সেখানে যায়।
একবার রাতের বেলায় গেরিলারা একজন পাক দালালের বাড়ি ঘেরাও করে তাকে হত্যা করে। দালালের এক শুভানুধ্যায়ী উর্ধ্বশ্বাসে ছুটে যায় পার্শ্ববর্তী জল্লাদবাহিনীর ক্যান্টনমেন্টে। খবর দেয়, ‘হুজুর, অমুককে মুক্তিবাহিনী এসে মেরে ফেলল। এখনো ওরা আছে, রাজাকারদের খুঁজে বেড়াচ্ছে। কাপুরুষ পশুপ্রবর, খেকিয়ে উঠে বলল, ‘হাম কিয়া করেগা। মুক্তিফৌজ আয়া হ্যায়, তুম লোগ যা কর হঠা দো। আভি হাম নেহি যায়েগা, সুবাহ মে যায়েগা। নিরাশ হয়ে ফিরে এলো দালালের সাগরেদ।
এখন ফল হয়েছে অন্যরকম। এখন বরং পশুগুলো এলে এইসব ঘা খাওয়া মানুষগুলোই এসে খবর দেয়, ‘ওরা এসেছে। তাদের সংখ্যা এবং শক্তি সমস্তই পুংখানুপুংখরূপে জানিয়ে দেয় মুক্তিবাহিনীকে।
যারা নেহাৎই প্রাণের দায়ে শান্তি কমিটির সদস্য হয়েছিল বা রাজাকারে নাম লিখিয়েছিল, আজ তারা সর্বতোভাবে সাহায্য করতে প্রস্তুত। শুধু তাই নয়, মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড মারের সামনে টিকতে না পেরে দলে দলে রাজাকার আত্মসমর্পণ করছে। জংগীশাহীর জঘন্যতার রূপটাও ফাঁস করে দিচ্ছে।
আজ স্পষ্টভাবে প্রমাণ হয়ে গেছে ভাড়াটে সৈন্যের চেয়ে হাজার গুণ শক্তিশালী দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ সৈনিক। আমাদের গেরিলারা আজ তাই হয়ে উঠেছে অজেয়, দুর্বার।
আর পক্ষান্তরে এবং মুক্তিবাহিনীর সাম্রাজ্য বাসনা ঘরের মতো ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে।
দুঃসাহসী গেরিলাদের এবং মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে খতমকৃত জালেম বাহিনীর অফিসারের জন্য আর কতো কতো কাটের বাক্স লাগবে, তার খতিয়ান কি করছে ইয়াহিয়া খান?
(মুস্তাফিজুর রহমান রচিত)

<005.005.102>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

১ ডিসেম্বর, ১৯৭১
যাদের চক্ষু আছে এবং চক্ষু থেকেও যাঁরা অন্ধ নন, আজ তাঁদেরকে একবার বাংলাদেশের রণাঙ্গনে দিকে দৃষ্টিপাত করতে অনুরোধ করবো। একবার চোখ খুলে দেখুন আমাদের সংগ্রামী বীর যোদ্ধা বাঙালী যুবকগণ কিভাবে পশ্চিম পাকের হানাদার পশুদের খতম করে ক্রমাগত জয়যাত্রার পথে এগিয়ে চলেছেন। বাংলাদেশের চূড়ান্ত দুর্দিনে পশু পাকসেনাদের হাত থেকে দেশকে সম্পূর্ণ মুক্ত করবার জন্য মুক্তিবাহিনীর বীর সৈনিকগণ আত্মত্যাগ, সাহসিকতা, বিক্রম, ধৈর্য এবং দেশপ্রেমিকতার যে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, বিশ্বের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে তার নিদর্শন একান্ত বিরল। একবার চেয়ে দেখুন যশোর রণাঙ্গনের দিকে-আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের আঘাত সামালাতে অপারগ হয়ে কিভাবে খানসেনারা পশ্চাদপসারণ করছে। খুলনায় একটি জাহাজ ডুবিয়ে আমাদের সেনারা জাহাজ চলাচলের পথ রুদ্ধ করে দিয়েছেন। সিলেট, চাটগাঁ, কুমিল্লা, নোয়াখালী, ময়মনসিংহ, রংপুর, দিনাজপুর, রাজশাহী, বগুড়া, পাবনা, কুষ্টিয়া সর্বত্রই আমাদের বীর যোদ্ধাদের অগ্রগতি এবং পাকসেনাদের পরাজয় অব্যাহত রয়েছে। ঢাকায় বেসামাল হয়ে সামরিকচক্র বারবার সান্ধ্য আইন জারি করে নিরীহ নিরস্ত্র নাগরিকদের হত্যা ও নির্যাতন করছে। কিন্তু তাই বলে বাঙালীর মনোবল হ্রাস পায়নি। আমাদের বীর সেনাদের অগ্রগতি দেখুন এবং জেনে রাখুন, ইনশাল্লাহ সময় আর খুব দূরে নাই যখন ঢাকায় স্বাধীন বাংলার পতাকা গৌরবের সঙ্গেই উত্তোলিত হবে।
সে কারণেই বলছিলাম যাঁদের চক্ষু থেকেও যাঁরা অন্ধ নন আজ তাঁরা চোখ খুলে একবার দেখুনশ্রবণশক্তি যদি বধির না হয়ে থাকে তবে স্বাধীন বাংলার বেতার কেন্দ্রের এই বিজয় বার্তাগুলো শুনুন। কথাগুলো এইজন্য বলছি যে বাংলাদেশ এখনো কিছুসংখ্যক বাঙালী আছেন যারা চোখ থেকেও অন্ধ এবং শ্রবণশক্তি থেকেও বধির। ঢাকা, রাজশাহী প্রভৃতি বেতার কেন্দ্রে এই জাতীয় কিছু অন্ধও বধির বাঙালী এখনো পশ্চিম পাকিস্তানের প্রভুদের মনোরঞ্জনের জন্য দেদার চীৎকার করে যাচ্ছেন। এইসব বাতুলদের তখনই জ্ঞানোদয় হবে যখন মুক্তিবাহিনীর সঙ্গীন তাদের গর্দানকে স্পর্শ করবে। যে প্রভুদের মনোরঞ্জনের জন্য এখনো কিছুসংখ্যক জন্মদালাল বাঙালী গলদঘর্ম হচ্ছেন তাদের বোঝা উচিত যে আজ ঐসব প্রভুদের কি অবস্থা। পশ্চিম পাকিস্তানেও বিদ্রোহের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠছে। বেলুচিস্তানে বেলুচরা এবং সীমান্ত প্রদেশে পাঠানরা এবার অস্ত্ৰধারণ করেছে। এমান কী রাজনীতির ক্ষেত্রে বালকোচিতে চাপল্যই যাঁর বৈশিষ্ট্য সেই জুলফিকার আলী ভূট্টোর খোদ জন্মভূমি সিন্ধু ও আজ বিক্ষুদ্ধ। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ভূট্টো এবং ইয়াহিয়া চক্রের পালাবার স্থানটি পর্যন্ত থাকবে না। এই দুই জানোয়ারের শেষের সেই ভয়ঙ্কর দিনটির কথাই আমরা এখন ভাবছি।
জানি, বহু দুঃখ এবং বেদনা, এবং নিপীড়ন বহু রক্তক্ষয় এবং মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষের দিন কেটেছে এবং এখনো অনেক ক্ষেত্রে সেভাবেই তাঁদের দিন কাটাতে হচ্ছে। জানি, আমরা যারা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে দুদিন পর বিজয়ীর বেশে নতুন করে যাত্রা শুরু করবো, তাদের অনেকেই প্রিয়জন হারানোর গভীর বেদনাকে কোনদিন ভুলতে পারবো না। যে জীবন আমরা হারিয়েছি, যে সম্মান এবং ইজ্জত আমরা পশুদের হাতে বিসর্জন দিয়েছি, যে সম্পদ আমাদের লুষ্ঠিত হয়েছে, জানি, সেসব আর ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু এই অবক্ষয়, এই অপরিসীম ত্যাগের মধ্য দিয়ে আমরা একটি জাতিকে, একটি দেশকে বিশ্বের ইতিহাসে নবজন্ম দান করতে চলেছি- এই মহান গৌরব একান্তভাবেই আমাদের বাংলাদেশের বর্তমান বংশধরদের। আমাদের পূর্বপুরুষদের এই গৌরব অর্জনের সৌভাগ্য হয়নি। সেদিকে থেকে আমরা অনেক ভাগ্যবান। দুঃখ আমাদের অনেক হয়েছে, রক্ত এবং জীবন আমাদের প্রচুর দিতে হয়েছে সত্য কিন্তু স্বাধীনতার জন্য এই মৃত্যু এই রক্তদান, এই আত্মত্যাগ সবকিছুর মধ্যেই একটি বিরাট মাহাত্ম্য আছে। সেই মাহাত্ম্যই আমাদের মহীয়ান করে তুলেছে। তার জোরেই ভবিষ্যৎ বংশধরগণ আমাদের ললাটে গৌরবের টিকা দিয়ে বলতে পারবে যে আমরা আজ দেশের কারণে মরতে শিখেছিলাম বলেই তারা মানুষের মত বাঁচতে পারবে। আমাদের

<005.005.103>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

আত্মত্যাগ ও মৃত্যুর মাধ্যমে ভবিষ্যত বংশধরদের সত্যিকার মানুষের মত বাঁচবার একটি স্থান, একটি পথ আমরা আজ তৈরি করে যাচ্ছি। যে মহৎ কারণের জন্য জীবনের মায়াকে তুচ্ছ করে, অনেক অভাব ও দীনতাকে হাসিমুখে বরণ করে এবং দুঃখ-কষ্ট ও দুর্ভোগের সকল ছোবলকে দু’পায়ে দলিতমথিত করে আজ বাংলাদেশের মানুষ সংগ্রামে লিপ্ত রয়েছেন, তার মূল্য মানুষের ভাষায় নির্ণয় করা দুঃসাধ্য। এই মহান কারণ ও সংগ্রামের উজ্জ্বলতম আদর্শ শুধু বাংলাদেশের নয়, ভবিষ্যতে সমস্ত বিশ্বের সমাজ গঠনে ব্যাপকভাবে সাহায্য করবে। বাঙালী জাতি হিসাবে আমরা যে সমগ্র বিশ্বের সম্মুখে এই একট অত্যুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপনে সমর্থ হয়েছি, তা কম গৌরবের কথা নয়।…
এটা অত্যন্ত আশার কথা যে বিশ্ববিবেকের ক্ষেত্রে আজ আশানুরূপ পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। বিশ্বের বিবেকসম্পন্ন সকল মানুষ আজ উপলব্ধি করেছেন যে, আমাদের সংগ্রাম ন্যায়ের পথে, সত্যের পথে। অবশ্য বাংলাদেশের মানবতার যে অপমান সংঘটিত হয়েছে, মানবতার ইতিহাসে তুলনা হয় না। আর এই লাঞ্ছিত মানবতাকে রক্ষার জন্য সভ্যতাগর্বী উন্নত দেশগুলো সক্রিয়ভাবে এগিয়ে আসবেন, আমরা গোড়া থেকেই এমন আশা করেছিলাম। সে আশা আমাদের সম্পূর্ণভাবে সফল হয়েছে একথা আমরা বলতে পারবো না। গণতন্ত্রের আদর্শকে সমগ্র বিশ্বে যাঁরা সমুন্নত রেখেছেন বলে গর্ব করেন, সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারী ভূমিকা আমাদের সম্পূর্ণ নিরাশ করেছে।
বিশ্বের জনগণ আমদের সাথে আছেন। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণও আমদের সংগ্রামকে সমর্থন করেন। এ ছাড়া বিশ্বের সর্বত্রই বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম মোটামুটি একটি সহানুভূতি লাভে সমর্থ হয়েছে। আমরা আশা করব, আমাদের চুড়ান্ত বিজয়ের দিন ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে বিশ্ব বিবেক আমাদের সপক্ষে আরো জাগ্রত হবে। আমরা একথা জানি,স্বাধীনতা কোনদিন শুধুমাত্র অপরের সাহায্যে আসে না সংগ্রাম ও ত্যাগের মাধ্যমে সেই স্বাধীনতা অর্জন ও রক্ষা করতে হবে। আমরা তাই আজ দিকে দিকে সংগ্রামের এমন দুষ্কর যাত্রাপথকে বেছে নিয়েছি। আর এই সংগ্রামই আমাদেরকে বিজয়ের পথে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে চলেছে। মুক্তিবাহিনীর জয়পতাকার ছায়া আজ বাংলা সমস্ত অঞ্চলে অঞ্চলে সবুজ ঘাসের ওপর বিপুল এক শুভাবহ মায়ার প্রলেপের মত বিস্তারিত হচ্ছে। সেদিন আর অধিক দূরে নয় যখন এই বিজয়-কেতনের ছায়ায় দাঁড়িয়ে আমরা জাগ্রত সাড়ে সাত কোটি বাঙালী কবি নজরুলের কণ্ঠে কণ্ঠে মিলিয়ে গভীর প্রত্যয় জননী জন্মভূমি বাংলাদেশকেও প্ৰণতি জানাবোঃ
নমঃ ননঃ বাংলাদেশ মম
চির মনোরম চির মধুর
বুকে নিরবধি বহে শত নদী
চরণে জলধির বাজে নূপুর।
(ডঃ মযহারুল ইসলাম রচিত)

<005.005.104>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

সংবাদ পর্যালোচনা *
২১ জুলাই, ১৯৭১
একটি ছোট্ট খবর। পাকিস্তানী জঙ্গীশাহী শীগগীরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের বিচার করবে। কখন, কোথায়, কিভাবে এ বিচার প্রহসন জমে উঠবে, খবরে তার বিস্তারিত বিবরণের উল্লেখ নেই। তবে প্রকাশিত খবরে এটুকু স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে যে, ইয়াহিয়া খানের জঙ্গী সরকার স্বাধীন বাংলার জনক শেখ মুজিবের বিচারের আয়োজন করছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ-রাষ্ট্রদ্রোহিতা।
ভ্রান্তি বিলাসের কি বিচিত্র পুনরাবৃত্তি! সত্যকে, ন্যায়কে, বিবেককে, টুটি টিপে হত্যা করে ক্ষমতার গদি আঁকড়ে থাকবার কি দুঃসাহসিক প্রয়াস! কি সীমাহীন স্পর্ধা! এ তো নতুন কিছু নয়। বিচার নামে প্রহসনের জালিয়াতি মঞ্চ সাজিয়ে শেখ মুজিবের কণ্ঠকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেবার এমনি এক স্পর্ধিত অপচেষ্টা ছিল আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। উনিষ শ ছিষট্টি সালে বীরপ্রসবিনী বাংলার অগ্নিসন্তান শেখ মুজিব যেদিন ছয়দফা দাবী পেশ করেন, সেদিনই ত্রাসে আতঙ্কে থরথর করে কেপে উঠেছিলো পশ্চিমা শাসককুলের তখতে তাউস। আর তাই সেদিনের গণবিরোধী শাসক সামরিক জান্তার মুখপাত্র প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল গৃহযুদ্ধ ও অস্ত্রের ভাষা প্রয়োগের হুমকি। উদ্ধত রাজরোষ জেল-জুলুম আর বক্ষভেদী বুলেট হয়ে নেমে এসেছিল আওয়ামী লীগের নেতা ও কর্মীদের উপর-স্বাধীনচেতা বাঙালী জাতির উপর। কিন্তু তাতেও যখন ফল হয়নি, যখন বাংলার গণশক্তির ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের মুখে আয়ুবের রণহুঙ্কার বিধবার অসহায় আর্তনাদের মত বাতাসে মিলিয়ে গেছে, আইয়ুবশাহী শেষরক্ষার জন্য সাজিয়েছিল মিথ্যা আগরতলা ষড়যন্ত্রের মামলা। উদ্দেশ্য ছিল, ভাড়াটিয়া জজ, উকিল আর সাক্ষীসাবুদের সযত্নসৃষ্ট ষড়যন্ত্রের জালে বেঁধে শেখ মুজিবকে চিরতরে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়া। কুর্মিটোলা সেনানিবাসে দিনের পর দিন সেই সাজানো-গুছানো মামলার বিচার প্রহসন চলেছে। ভাড়াটিয়া সাক্ষীদের মিথ্যা জবানীর রেকর্ডপত্র স্তুপীকৃত হয়ে উঠেছে-গোটা সরকার তার সর্বশক্তি দিয়ে শেখ সাহেবকে আটকাবার চেষ্টা করেছে। কিন্তু সকলি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। বাংলার মানুষ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাকে মনে করেছে তাদের নিজেদেরেই বিরুদ্ধে, সমগ্র বাংলার বিরুদ্ধে এক সুগভীর ষড়যন্ত্র। আর তাই সর্বশক্তি নিয়ে তারা রুখে দাঁড়িয়েছে এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে, আইয়ুবশাহীর বিরুদ্ধে। শেখ মুজিবের পিছনে কাতারবন্দী বাংলার মানুষের সেই প্রতিরোধ আন্দোলনের স্রোতের মুখে খুলে গেছে জেলের তালা, খড়কুটোর মত ভেসে গেছে ক্ষমতাদর্পী শাসকের মসনদ আর আইয়ুব-মোনেম নিক্ষিপ্ত হয়েছে ইতিহাসের আস্তাকুড়ে।
তারপর বহুদিন গত হয়েছে। বাঙালীর আশা-আকাঙ্খার বিশ্বস্ততম প্রতিনিধি, বঞ্চিত বাংলার বিবেকের কণ্ঠস্বর শেখ মুজিবর রহমান জেল-জুলুম আর ত্যাগ-তিতিক্ষার দুঃসহ আগুনে পুড়ে হয়েছেন আরও খাঁটি সোনা। হয়েছেন বঙ্গবন্ধু-বাংলার মুকুটহীন সম্রাট। বিগত সাধারণ নির্বাচনে নিঃশব্দ ব্যালটের বিপ্লবে বাংলার মানুষ সমগ্র পৃথিবীকে দেখিয়ে দিয়েছে-শেখ মুজিব বাংলার, বাংলা শেখ মুজিবের। তারা আরও দেখিয়ে দিয়েছে-শেখ মুজিব শুধু বাংলার নন, সারা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু দলের নেতা। শুধু তাই নয়, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সমগ্র বাংলাদেশের মানুষ বিশ্ববাসীকে বিস্মিত হতবাক করে দিয়ে অসহযোগ আন্দোলনের ইতিহাসে এক নয়া রের্কড সৃষ্টি করেছে। সবচাইতে বড় কথা, শেখ মুজিবেরই মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে বাঙালী জাতি প্রতিষ্ঠা করেছে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। তারই নির্দেশে বাংলার মানুষ হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছে। ইয়াহিয়ার জল্লাদ বাহিনী গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে দিয়েছে, লক্ষ লক্ষ মানুষকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করেছে। এই নরপশুর দল ছারখার করে দিয়েছে অগণিত সোনার সংসার-চিরতরে নিভিয়ে দিয়েছে লক্ষ লক্ষ ঘরের প্রদীপ। কিন্তু বুলেট শুধু রক্তই ঝরাতে পারে-মানুষের হৃদয়ের অমোঘ বাণীকে, তার আত্মার আন্তরিক আকাংক্ষাকে পিষে মারতে পারে না। ওরাও পারেনি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠনে যে অনিবার্য প্রদীপশেখা শেখ মুজিব জেলেছেন সাড়ে সাত কোটি

‘সংবাদ পর্যালোচনা’ শীর্ষক ধারাবাহিক কথিকাগুলি আমির হোসেন রচিত।

<005.005.105>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

বাঙালীর অন্তরে, হানাদার সেনা-দস্যুদের হিংস্র থাবা তা নিবিয়ে দিতে পারেনি। আর পারেনি বলেই তা আজ বাংলার দশদিগন্তে চলেছে শত্রুহননের মহোৎসব। দিন যায়, রাত যায়, আর স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে ওঠে জল্লাদবাহিনীর মৃত্যুঘন্টার শব্দ। ওরা দেখতে পাচ্ছে ওদের পরাজয় আসন্ন। ওরা বুঝতে পারছে সোনার বাংলার বুকটিকে চিরে চিরে খাবার দিন শেষ-এবার বিদায়ের পালা। তাই মুমূর্ষু শয়তানের মরণার্তির মতই ইয়াহিয়ার মুখে অশ্রাব্য প্ৰলাপধ্বনি। তাই আইয়ুবের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার শোচনীয় পরিণতির স্মৃতি মিলিয়ে যাবার আগেই তার জারজ সন্তান আজ ব্যতিব্যস্ত শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে নতুন মামলা সাজাবার আয়োজনে।
কিন্তু কিসের মামলা? কিসের বিচার? কে করবে কার বিচার? নরঘাতক ইয়াহিয়া শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনেছে। কিন্তু ক্ষমতাদর্পী সেই উন্মাদ জেনারেল রঙীন পানীয়ের নেশায় বুদ হয়ে আজ এই সত্যটুকু উপলব্ধি করবার মানসিকতা হারিয়ে ফেলেছে যে, ইয়াহিয়ার শক্তির উৎস বন্দুকের নল। আর সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর স্বাধীন আবাসভূমি বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবের শক্তির উৎস তার দেশবাসীর শুভেচ্ছা, সমর্থন ও সংগ্রামী চেতনা। …
২৮ জুলাই, ১৯৭১
একটি বিদেশী বার্তা প্রতিষ্ঠানের খবরে বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকায় অফিস আদালতে ও দোকান-পাটের নামফলক বাংলার পরিবর্তে ইংরেজী ও উর্দুতে লেখার নির্দেশ জারি করা হয়েছে। খবরে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, যেসব স্থান বা প্রতিষ্ঠানের নামের সংগে অমুসলিম গন্ধ রয়েছে সেগুলো পাল্টিয়ে নয়া নামকরণের অভিযান শুরু হয়েছে।
খবরটিতে নতুনত্ব না থাকলেও কৌতুকের খোরাক আছে। কারণ, ইতিহাসের চাকা আর ঘড়ির কাঁটা পেছনদিকে ঘোরে না জেনেও কসাই ইয়াহিয়া ইতিহাসের চাকা আর ঘড়ির কাটাকে পশ্চাদমুখী করার হাস্যকর প্রচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে। বাংলার পরিবর্তে উর্দু এবং ইংরেজীতে নামফলক লেখা আর বিশেষ বিশেষ স্থাপনা ও প্রতিষ্ঠানের নয়া মুসলমানী নামকরণের নির্দেশে ওদের দুরভিসন্ধিটাই নগ্নভাবে আত্মপ্রকাশ করেছে। আমরা এতে বিস্মিত হইনি। বিক্ষুব্ধ হলেও আমরা এতে মোটেই বিচলিত হইনি। কারণ, ওদের এই অপচেষ্টা নতুন কিছু নয়। চব্বিশ বছর আগে যেদিন বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা এদেশ ছেড়ে যায় সেদিনই পশ্চিম পাকিস্তানী উপনিবেশবাদীচক্র মেতে ওঠে বাংলার বিরুদ্ধে সুগভীর ষড়যন্ত্রে। এই ষড়যন্ত্রের লক্ষ্য ছিল বাঙালী জাতিকে চিরদিন পায়ের নীচে দাবিয়ে রাখা। আর এই ঔপনিবেশিক লক্ষ্য হাছিলের স্বার্থে পশ্চিমা শাসককুল বাঙালীর রাজনৈতিক অধিকার, অর্থনৈতিক হিস্যা, তাদের সাহিত্য, সংস্কৃতি আর স্বকীয় সত্তার ওপর হামলা করেছে বার বার। বাঙ্গালীদের নিজস্ব পরিচয়, তাদের স্বতন্ত্র সত্তাকে চিরতরে মুছে ফেলবার জন্য চক্রান্ত চলেছে সুপরিকল্পিতভাবে। চেষ্টা চলেছে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাহিত্য ও সংস্কৃতিক দিক দিয়ে তাদের পঙ্গু করে রাখবার। …
বাংলার মানুষের সাহিত্য সংস্কৃতিকে পঙ্গু করার যে নির্লজ্জ প্রচেষ্টা চলে এসেছে চব্বিশ বছর ধরে, পরাধীন বাংলার শেষ সুবেদার মোনেম খানের আমলের একটি ঘটনায় তার একটি সুন্দর চিত্র পাওয়া যাবে। দুরন্ত প্রতাপশালী গভর্নর মোনেম খান একদিন লাটভবনের দরবার কক্ষে ডেকে পাঠালেন ঢাকার কবি, সাহিত্যক, লেখক ও বুদ্ধিজীবীদের। এ এত্তেলা পেয়ে হাজির হলেন সকলে। তাদের মধ্যে ছিলেন ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লা, অধ্যক্ষ মুহম্মদ আবদুল হাই, আবুল হাশিম, কবি জসীমুদ্দীন এবং অন্যান্য। হুকুম করলেন গভর্নরঃ কি লেখাপড়া করেছেন আপনারা? রবীন্দ্রসঙ্গীত লিখতে পারেন না? জবাব দিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের তৎকালীন অধ্যক্ষ মুহম্মদ আবদুল হাই। বললেনঃ ‘না, পারি না। আমরা কি করে রবীন্দ্রসঙ্গীত

<005.005.106>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

লিখবো? আমরা লিখলে তো তা হবে হাই সঙ্গীত, জসীম সঙ্গীত… লজ্জায় অপমানে অগ্নিশৰ্মা হয়ে উঠলেন গভর্নর। জারি করলেন দ্বিতীয় নির্দেশ- বাংলা ভাষাকে ইসলামী রূপ দিতে হবে। এবার জবাব দিলেন অবিভক্ত বাংলার খ্যাতনামা রাজনীতিক- মুখের উপর চীৎকার করে বলেছিলো বাংলার ছাত্র-তরুণের দল- ‘না। তোমার কথা মানি না। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। বিদ্রোহী বাঙালীর সেই কণ্ঠস্বর নূরুল আমিনের বুলেটও স্তব্দ করে দিতে পারেনি। বরকত, সালাম, রফিক, জাব্বারের দল বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে মাতৃভাষা বাংলার রাষ্ট্ৰীয় মর্যাদার স্বীকৃতি আদায় করে এনেছেন। রক্তের অক্ষরে লিখিত হয়েছে বাংলাভাষা আর বাঙালীর বিজয়গাথা।
কিন্তু পশ্চিমা শাসকের দল কোনদিন এই সত্যকে সহজভাবে স্বীকার করে নিতে পারেনি। বাংলা আর বাঙালী কথা দুটি ওদের অনুভূতিতে প্রতিনিয়ত ছড়িয়েছে বৃশ্চিক দংশনের জ্বালা। তাই অবিরাম হামলা চলেছে বাঙালী জাতির উপর-বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্য, বাঙালী, সংস্কৃতির ওপর। ওরা আরবী হরফে বাংলা ভাষা লিখতে চেয়েছে, হাওয়াই হামলা করেছে, ভাষাটাকে মুসলমানী চেহারা দেবার জন্য তার মাথায় টুপি পরিয়ে দিয়েছে। ‘কৃষ্টি-সংস্কৃতিকে’ করা হয়েছে ‘তাহজিব-তমদ্দুন’। নজরুলের কবিতায় ‘শ্মশান’ কেটে করা হয়েছে ‘গোরস্থান’। কায়কোবাদের লেখা ‘মহাশ্মশান’ বইখানির নাম পাল্টিয়ে রাখা হয়েছে ‘মহা-গোরস্থান’।
কিন্তু কি লাভ? মিঃ জিন্নাহ থেকে মোনেম খাঁ যা পারেনি-ইয়াহিয়া-টিক্কাও তা পারবে না। ইতিহাসের গতি পশ্চাদমুখী নয়, ঘড়ির কাটা পেছনের দিকে ঘোরে না। সাড়ে সাত কোটি মানুষের মুখের ভাষা আর তাদের অসাম্প্রদায়িক জাতীয়বাদী চেতনাকেও কেউ জোর করে হত্যা করতে পারবে না।
৩০ জুলাই, ১৯৭১
একটি বিদেশী বার্তা প্রতিষ্ঠানের খবরে জানা যায় যে, এবারে পাকিস্তানী সামরিক কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকায় রেডিও বাজেয়াফত করতে শুরু করেছে। অপরাধ? সেখানকার মানুষ শত্রুকবলিত ঢাকা বেতারের কোন অনুষ্ঠান শোনে না-তারা শোনে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, বিবিসি, আকাশবাণী ও ভয়েস অব আমেরিকার অনুষ্ঠান।
খবরটি ছোট্ট হলেও তাৎপর্যপূর্ণ। বুঝতে কষ্ট হবার কথা নয় যে, অধিকৃত এলাকার জনগণকে যুদ্ধ পরিস্থিতি এবং বিশ্বজনমত সম্পর্কে অন্ধকারে রাখবার জন্যই জঙ্গীশাহী রেডিও বাজেয়াফত করতে শুরু করেছে। আর এই প্রচেষ্টা থেকে বাংলাদেশে হানাদারদের নাজেহাল অবস্থারই স্বীকৃতি পাওয়া যায়।
যুদ্ধের সবচাইতে বড় বলি হচ্ছে সত্য। মারণাস্ত্র মানুষের জানমালের মত সত্যকেও নির্দয়ভাবে হত্যা করে। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর জঙ্গীশাহীও তাই করেছে। প্রকৃত ঘটনা যাতে কেউ জানতে না পারে সেজন্য সংবাদপত্রের উপর কড়া সেন্সরশীপ আরোপ করা হয়েছে। অধিকৃত এলাকায় বর্তমানে যেসব সংবাদপত্র প্রকাশিত হয় তাতে প্রকৃত ঘটনার কোন বিবরণ থাকে না, নিরপেক্ষ সত্যনিষ্ঠ মতামত প্রকাশের কোন সুযোগ সেখানে নেই। প্রতিটি শব্দ ছাপা হবার আগে সামরিক কর্তৃপক্ষের অনুমতি লাগে। সব কাগজে একই খবর ও মন্তব্যের কার্বন কপি ছাপা হয়। ফলে সংবাদপত্র নামে যে কাগজগুলি অধিকৃত এলাকায় প্রকাশিত হয়, তা বস্তুত সংবাদপত্র নয়- জঙ্গীশাহীর প্রচার বুলেটিন মাত্র। তাই সেগুলো কেউ কেনে না, পড়ে না। জালেমশাহীর প্রচার দফতর ওগুলো বিনামূল্যে বিলি করে।
এইতো গেল সংবাদপত্রের কথা। এরপর থাকে রেডিও। এবং সেটাই আজকের দিনের সবচাইতে শক্তিশালী প্রচার মাধ্যম। ঢাকা বেতারকেন্দ্র এখন শত্রুবাহিনীর দখলে। শত্রুকবলিত এই বেতারযন্ত্রটি থেকে যা প্রচারিত হয়, তা জঘন্য জালিয়াতি আর মিথ্যার বেসাতি ছাড়া কিছুই নয়। জল্লাদ বাহিনীর বর্বর অত্যাচারের রক্তের গঙ্গা

<005.005.107>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

বয়ে চলেছে বাংলার দিকে দিকে। ভস্মীভূত ঘরবাড়ি, বিধ্বস্ত জনপদের ধ্বংসস্তুপ সাক্ষী হয়ে আছে ওদের পাশবিক নির্যাতনের। হানাদার দস্যুরা নারীর স্মভ্রম কেড়ে নিচ্ছে, দুধের শিশুকে খুন করেছে, দলে দলে মানুষকে করছে ঘরছাড়া, দেশছাড়া। অধিকৃত এলাকার মানুষ নিজের চোখে দেখেছে, দেখছে এ দৃশ্য। কিন্তু ঢাকা বেতারে শুনছে ঠিক এর উল্টো কথা। ঢাকা বেতার সুকৌশলে প্রচারণার মারপ্যাচে সত্যটাকে হত্যা করে মিথ্যার পুতুল সাজিয়ে খাড়া করছে মানুষের কাছে। তাই তারা আস্থা হারিয়েছে- বীতশ্রদ্ধ, অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে ঢাকা বেতারের উপর। আর সেই কারণেই কেউ আজ ঢাকা বেতারের অনুষ্ঠান শুনছে না। তারা সত্যি খবরের জন্য, নির্ভুল তথ্যের জন্য, বাংলাদেশ সম্পর্কে বিশ্বজনমতের ধারা সম্পর্কে অবহিত হওয়ার জন্য শুনছে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, বিবিসি, আকাশবাণী, ভয়েস অব আমেরিকার অনুষ্ঠান। জঙ্গীশাহী এ খবর জানে। তারা জানে যে, এসব বেতার কেন্দ্রের মারফত জনগণ হানাদারদের নির্যাতন-নিপীড়ন-গণহত্যার লোমহর্ষক কাহিনী জেনে নিচ্ছে। জেনে নিচ্ছে বাংলাদেশের যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের গৌরবময় সাফল্য এবং হানাদারদের ক্রমাগত বিপর্যয়ের বৃত্তান্ত। ফলে ওদের জারিজুরি ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। ধরা পড়ে যাচ্ছে ওদের মিথ্যাবাজি আর জালিয়াতির বেসাতি। তাই শংকিত, বিব্রত হয়ে উঠেছে জঙ্গীশাহী। ওরা জানে, লোকের হাতে যদি রেডিও থাকে, ঢাকা বেতারের জাল-জুয়াচুরি অনুষ্ঠান তারা শুনবে না- শুনবে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ও বিদেশী বেতারের অনুষ্ঠান। তাই আক্রোশের ক্রোধে দিশেহারা হয়ে জল্লাদেরা এখন কেড়ে নিতে শুরু করেছে সকল রেডিও উদ্দেশ্য-মিথ্যে যদি না শুনতে চাও, সত্য কথাও শুনতে দেবো না…।
১আগষ্ট, ১৯৭১
পাকিস্তানের জঙ্গশাহী বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকায় উৎপাদিত ফসলের তিন-চতুর্থাংশ সামরিক কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দোবর জন্য চাষীদের প্রতি নির্দেশ জারি করেছে। নির্দেশে বলা হয়েছে যে, ফসলের এক-চতুর্থাংশ নেওয়া হবে জরিমানা হিসাবে এবং বাকী দুই-চতুর্থাংশ নেওয়া হবে ট্যাক্স ও খাজনা বাবদ।
বুঝতে এতটুকু কষ্ট হবার কথা নয় যে, বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকায় চাষীদের শায়েস্তা করা ছাড়াও আরেকটা উদ্দেশ্যে এই নির্দেশ জারি করেছে। বাংলাদেশের যুদ্ধ পশ্চিমা শাসকদের রাজকোষ শূন্য করে দিয়েছে। আর সেই শূন্য রাজভাণ্ডার পূর্ণ করে তোলার জন্যই জল্লাদ ইয়াহিয়া করেছে এই তোগলকি নির্দেশ।
একথা আজ সকলেরই জানা যে, বাংলাদেশে যুদ্ধের বিপুল ব্যয়ভারের চাপে পাকিস্তানী অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে। বাংলাদেশ থেকে পাট, চা, চামড়া সহ সমস্ত রকম রফতানী বাণিজ্য বন্ধ। কলকারখানায় উৎপাদন নেই। যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে থাকার দরুন ব্যবসা-বাণিজ্যে নেমে এসেছে চূড়ান্ত অচলাবস্থা। সাড়ে সাত কোটি মানুষের সংরক্ষিত বাজারে পশ্চিম পাকিস্তানী পণ্য বিক্রয়ের নামে হরিলুটের বাতাসের মত দুহাতে অর্থ লুটে নেবার দিন শেষ। রাজস্ব আদায় বন্ধ-বাংলার মানুষ খাজনা দিচ্ছে না, ট্যাক্স দিচ্ছে না। আয়ের কোটা শূন্য কিন্তু খরচ বেড়েছে বহুগুণ। প্রশাসনিক ব্যয় ছাড়াও জঙ্গশাহী বাংলাদেশে গণহত্যা খাতে প্রতিদিন খরচ করছে দেড় কোটি টাকা। এত টাকা আসবে কোথা থেকে? বৈদিশক সাহায্য বন্ধ। পৃথিবীর দেশে দেশে ভিক্ষার ঝুলি হাতে ঘুরেছে ইয়াহিয়ার অনুচরেরা, কিন্তু উদ্দেশ্য সিদ্ধি হয়নি। তাই রাজকোষ শূন্য-নিদারুণ অর্থসংকট, পরের ধনে পোদ্দারিতে ঘটেছে মারাত্মক বিঘ্ন। বেসামরিক কর্মচারীদের তো বেতন দেয়ার প্রশ্নই নেই, কসাই বাহিনীর জোয়ানদেরও বেতন বাকী পড়েছে দীর্ঘদিনের। ফলে দিকে দিকে উঠেছে অসন্তোষের ঝড়। বেগার খাটতে রাজী নয় তারা- কাজ করেছি পয়সা চাই। বেতন বাকী রেখে যুদ্ধ করা যায় না। আর এই পরিস্থিতির মোকাবেলা করার জন্যই টাকা চাই-প্রচুর টাকার দরকার ইয়াহিয়া খানের। টাকার দরকার বাঙালী হত্যার হাতিয়ার কিনতে, জল্লাদ ভাড়া করতে। আর সে টাকা ওরা আদায় করতে চায় বাংলাদেশেরই চাষীদের কাছ থেকে। এই লক্ষ্য হাসিলের জন্যই জারি হয়েছে নরঘাতক ইয়াহিয়ার নয়া নির্দেশ। …

<005.005.108>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

১৭ আগষ্ট,১৯৭১
তিনটি খবর। তিনটি খবরের উৎসস্থল দূর-দূরান্তরে তিনটি জায়গা-করাচী, নয়াদিল্লী, ওয়াশিংটন। অথচ খবর তিনটি একই সূত্রে গাঁথা-একই লোককে কেন্দ্র করে। আর তিনি হচ্ছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
করাচী থেকে ফরাসী বার্তা প্রতিষ্ঠান এ-এফ-পি জানিয়েছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান আত্মপক্ষ সমর্থনে অস্বীকৃত জ্ঞাপন করায় পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক আদালতে তার বিচার স্থগিত হয়ে গেছে। লায়ালপুরের কাছে শেখ সাহেবের বিচার প্রহসনের আয়োজন করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি বলেছেন, আমি কোন অপরাধই করিনি। তাই বিচার বা আত্মপক্ষ সমর্থনের প্রশ্নই ওঠে না।
নয়াদিল্লীতে মার্কিন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডী বলেছেন, তিনি সর্বপ্রথম শেখ মুজিবের মুক্তিদানের শর্তে বাংলাদেশের সমস্যার একটি রজনৈতিক সমাধানের পক্ষপাতী। বঙ্গবন্ধুর গোপন বিচারের তীব্র নিন্দা করে সিনেটর কেনেডী বলেন, শেখ মুজিব যদি কোন অপরাধ করে থাকেন তা হচ্ছে এই যে, তিনি একটি নির্বাচনে জয়লাভ করেছে। যেভাবে গোপনে তাঁর বিচার হচ্ছে তা আন্তর্জাতিক আইন ও রীতি-নীতির চূড়ান্ত বরখেলাপ ছাড়া আর কিছুই নয়।
অপরদিকে জাতিসংঘে জঙ্গশাহীর রাষ্ট্রদূত আগা হিলালী বলেছে যে, শেখ মুজিবের গোপন বিচার প্রত্যক্ষ করার জন্য আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের অনুমতি দেয়া হবে না।
আগা হিলালী আরও বলেছে যে, বঙ্গবন্ধুর বিচারকারী মিলিটারী কোর্টের রায় যাই হোক না কেন, তাকে সঙ্গে সঙ্গে হত্যা করা হবে না। রায়ের পর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বঙ্গবন্ধুর দণ্ডাদেশ বাতিল বা হ্রাস করতে পারবে।
খবরগুলো পাশাপাশি রেখে এগুলোর তাৎপর্য লক্ষ্য করলেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, শেখ মুজিবকে জল্লাদ বাহিনী এখনও হত্যা করেনি- করতে পারবেও না। কারণ সে শক্তি ওদের নেই। তাই বঙ্গবন্ধুর বিচারের প্রহসন মঞ্চ সাজিয়ে সমগ্র বিশ্বকে ভীতসন্ত্রস্ত করে নরঘাতক ইয়াহিয়া চেষ্টা করছে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করতে। বঙ্গবন্ধুর অমূল্য জীবনকে বাজি রেখে সে নেমেছে বাংলার স্বাধীনতার যুদ্ধ বানচালের জুয়াখেলায়। কিন্তু ইয়াহিয়া খান আবার ভুল করেছে- আবার ভ্রান্তির বালুচরে পা আটকে গেছে তার। ইয়াহিয়া স্বীকার না করলেও বিশ্ববাসী জানেন, প্রায় সাড়ে চারমাস ধরে ভয়ভীতি- প্রলোভন দেখিয়ে চেষ্টা চলছে শেখ মুজিবকে বশে আনার। কিন্তু কোন লাভ হয়নি। বঙ্গবন্ধুর মাথা সে কিনতে পারেনি। আর পারেনি বলেই শেষ অস্ত্র নিক্ষেপের মত হুঙ্কার ছেড়েছে-আমি শেখ মুজিবের বিচার করবো, তাকে ফাঁসিতে ঝুলাবো। এর পিছনে এক সুচতুর লক্ষ্য ছিল ইয়াহিয়া খাঁর। সে ভেবেছিল, শেখ মুজিবকে হত্যার হুমকি দিয়ে তাকে বশে আনা যাবে, মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল ভেঙ্গে দেয়া যাবে, আর যাবে বিশ্বজনমতকে বিভ্রান্ত করা। কিন্তু এবারও ব্যর্থ হয়েছে জল্লাদী প্রচেষ্টা। ভয় পাবার পরিবর্তে আরও বলিষ্ঠকণ্ঠে বঙ্গবন্ধু বলেছেন: আমি কোন অপরাধ করিনি। সুতরাং বিচার বা আত্মপক্ষ সমর্থনের কোন প্রশ্নই ওঠে না।
তাই বাধ্য হয়ে তাকে বঙ্গবন্ধুর বিচার প্রহসন মুলতবি রাখতে হয়েছে। এই বিচার আর হত্যার হুমকি মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল এতটুকু দমাতে পারেনি। বরং শেখ মুজিবের নির্দেশিত পথে দ্বিগুণতর শক্তি নিয়ে তারা ঝাঁপিয়ে পড়েছে দুশমনের ওপর-আরও ত্রিশঙ্কু অবস্থায় নিক্ষিপ্ত হয়েছে হানাদার বাহিনী। আর বিশ্বজনমত বিভ্রান্ত করার প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হয়েছে ইয়াহিয়া খানের। এইতো গতকাল সিনেটর কেনেডী বলেছেন শেখ মুজিবের একটিমাত্র অপরাধ যে তিনি নির্বাচনে জয়লাভ করেছেন। তার গোপন বিচার আন্তর্জাতিক আইন ও রীতি-নীতির চূড়ান্ত বরখেলাপ মাত্র। বস্তুতঃ এ কথা কেনেডীর একার কথা নয়। কেনেডীর কণ্ঠে বিশ্ববিবেকের দ্ব্যর্থহীন রায়ই ধ্বনিত হয়েছে। আর সে ক্ষমাহীন নিয়তির মত জানিয়ে দিয়েছে যে, অপরাধী শেখ মুজিব নয়- ইয়াহিয়া

<005.005.109>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

খান। যুদ্ধ শেখ মুজিব শুরু করেননি-ইয়াহিয়া খানের গণহত্যা অভিযানের জবাবেই সৃষ্টি হয়েছে রক্তাক্ত সংঘর্ষের। আর তাই সমস্যার সমাধানের শর্ত হচ্ছে শেখ মুজিবের মুক্তি। কেনেডীর এই বক্তব্যের আরেকটি তাৎপর্য আছে। কেনেডীদের বলা হয়ে থাকে মার্কিন বিবেকের কণ্ঠস্বর। আর সে কারণেই বলা যায়, কেনেডীর বক্তব্য পৃথিবীর আর দশটি দেশের মত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোটি কোটি শান্তি, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রকামী মানুষেরই বক্তব্য। সুতরাং দেখা যায়, যে দেশের অস্ত্র দিয়ে ইয়াহিয়া বাঙালীদের হত্যা করেছে, শেখ মুজিবকে হত্যার হুমকি দিচ্ছে সেই আমেরিকার জনগণের দৃষ্টিতেও ইয়াহিয়া দোষী, শেখ মুজিব নির্দোষ। জল্লাদ ইয়াহিয়ার রাষ্ট্রদূত আগা হিলালী বলেছে, বিচারের রায় যাই হোক সঙ্গে সঙ্গে শেখ মুজিবকে হত্যা করা হবে না। তার দণ্ডাদেশ বাতিল বা হ্রাসের ক্ষমতা থাকবে ইয়াহিয়ার। চমৎকার ব্যবস্থা। কিন্তু এর গোপন তাৎপর্যটুকু বুঝতে কষ্ট হবার কথা নয়। ইয়াহিয়া চেয়েছিল ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ বাধিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধকে ধামাচাপা দিতে। কিন্তু ভারত-রাশিয়া শান্তি ও সহযোগিতার চুক্তি জল্লাদের সে খায়েশ চিরতরে গুড়িয়ে দিয়েছে। এখন একটিমাত্র তুরুপের তাস আছে ইয়াহিয়ার হাতে। আর সে হচ্ছে শেখ মুজিবের জীবন। তাই সে চাইছে বিচার প্রহসনে বঙ্গবন্ধুর চরম দণ্ডের ব্যবস্থা করে তার জীবনরক্ষার ক্ষমতাটুকু নিজের হাতে নিয়ে তাই দিয়ে রাজনীতি করতে। আর ইয়াহিয়ার এই গোপন উদ্দেশ্যটি সম্পর্কে টাইম ম্যাগাজিন লিখেছে : “এ ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই যে শেখ মুজিবকে দণ্ড দেওয়া হবে। তবু মনে হয় ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করবে না। কারণ, সে জানে বাংলাদেশের যুদ্ধে এক পাকিস্তানের আসা চিরতরে সমাধিস্থ হয়েছে। শেখ মুজিবকে বাচিয়ে রাখলে অন্তত একটা শেষ সুযোগ পাওয়া যাবে। সে হচ্ছে দীর্ঘস্থায়ী রক্তাক্ত যুদ্ধের বদলে শান্তিপূর্ণভাবে বাংলাদেশ ও পশ্চিম পাকিস্তানের ভাগাভাগিটা সম্পন্ন করা।” অতঃপর মন্তব্য নিম্প্রয়োজন।
২২ শে আগষ্ট, ১৯৭১
লণ্ডনের ‘ডেলী টেলিগ্রাফ’ পত্রিকার এক খবরে বলা হয়েছে যে, পাকিস্তানী জঙ্গীশাহীর সঙ্গে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের মধ্যে আলোচনার পন্থা স্থির করার উদ্দেশ্যে ইসলামাবাদ ও তেহরানে গোপনে গোপনে জোর কূটনৈতিক তৎপরতা চলেছে। এই তৎপরতার নায়ক ইরান। আর এর পেছনে নাকি সমর্থন রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও রাশিয়ার। খবরটিতে আরও বলা হয়েছে যে, পশ্চিম পাকিস্তানের পররাষ্ট্র দফতরের সেক্রেটারী ইতিমধ্যেই তেহরান পৌছেছেন। সেখানে ইরানের উদ্যোগে তার সঙ্গে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের গোপন সাক্ষাৎকারের আয়োজন হবে।
সুদূর ইরানে বাংলাদেশ প্রশ্ন নিয়ে পর্দার অন্তরালে কি ঘটেছে স্পষ্ট জানবার উপায় নেই। আর সে নেপথ্য নাটকে তেহরান-চীন-রাশিয়ার ভূমিকাটাও সহজবোধ্য নয়। ডেলী টেলিগ্রাফের এই খবরটি ছাড়া এ ব্যাপারে আর কোন সূত্র থেকে কোন তথ্যও আমাদের হাতে আসেনি। তাই এক কথায় খবরটি উড়েয়ে দেয়া বা একে সত্য বলে মেনে নেয়া কোনটাই সহজ নয়। তবু কথা আছে। বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচন্ড আক্রমণের মুখে জল্লাদ ইয়াহিয়ার ভাড়াটিয়া বাহিনী আজ দিশেহারা। প্রতিদিন ওরা মরছে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে। আর সেই শূন্যস্থান পূর্ণ করতে মাত্র কদিন আগে নতুন করে এক ডিভিশন সৈন্য আমদানী করা হয়েছে বাংলাদেশে। আমেরিকা থেকে প্রচুর অস্ত্র আসছে, চীন থেকে সামরিক সরঞ্জাম আসছে, মার্কিন বিশেষজ্ঞ এসেছে। এমনকি জর্দান থেকে লোক ভাড়া করে আনা হয়েছে বাংলাদেশের বীর যোদ্ধাদের মোকাবিলা করার জন্য। কিন্তু তবু অবস্থার উন্নতি হয়নি-পায়ের তলা থেকে দ্রুত মাটি সরে যাচ্ছে ইয়াহিয়ার। প্রতিদিন নয়া নয়া এলাকা মুক্ত হচ্ছে। অবস্থা বেগতিক দেখে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য ইয়াহিয়া খান প্রাণপণ চেষ্টা করেছে পাক-ভারত যুদ্ধ বাধাতে। ভারত-সোভিয়েত শান্তি, মৈত্রী ও সহযোগিতার চুক্তি তার সে দুরভিসন্ধি বানচাল করে দিয়েছে-ভারতের সঙ্গে যুদ্ধের খায়েস মিটে গেছে ইয়াহিয়ার। ক্ষমতার মদমত্ত সেই নরঘাতক চেষ্টা করেছে জাতিসংঘকে টেনে এনে নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক ডেকে বাংলাদেশ প্রশ্নকে পাক-ভারত বিরোধ বলে চিহ্নিত করতে। কিন্তু সে চেষ্টাও তার নিদারুন ব্যর্থতা বরণ করেছে। আরেকটা চাল খেলেছে খুনী ইয়াহিয়া। সে

<005.005.110>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

ভেবেছিল বিচারের নামে প্রহসনের মঞ্চ সাজিয়ে মিলিটারী জজ-ব্যারিস্টারের পুতুল নৃত্যের ব্যবসা করে শেখ মুজিবকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়া যাবে-আর তার ফলে মনোবল ভেঙ্গে যাবে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের। তার ভাড়াটিয়া ডালকুত্তা বাহিনীর দুরু দুরু বক্ষে আসবে নতুন শক্তি-দাবিয়ে দেওয়া যাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ। কিন্তু এখানেও হতাশ হয়েছে জোনারেল ইয়াহিয়া। এ খবরে আরও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে মুক্তিবাহিনী-তীব্রতর হয়েছে তাদের আক্রমণধারা। তারই পাশাপাশি বিশ্বজনমতের প্রচণ্ড চাপে শাণিত ছুরিকা খসে পড়েছে জল্লাদের হাত থেকে। তার প্রমাণ- বিচারের সঙ্গে সঙ্গেই শেখ মুজিবকে গুলি করা হবে না বলে জাতিসংঘে পশ্চিম পাকিস্তানী রাষ্ট্রদূত আগা হিলালীর ঘোষণা। ইয়াহিয়ার সামনে এখন পাকিস্তান নামক মৃত ঘোড়াটিকে জীবিত করে তোলার আর কোন পথই খোলা নেই। তবু শেষ চেষ্টা করছে সে। শেখ মুজিবকে ফিরিয়ে দিয়ে হলেও যদি বাংলাদেশকে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে রাখা যায়, সেটাই তার শেষ চেষ্টা। হতে পারে, এই উদ্দেশ্যেই চলেছে তেহরানের গোপন কূটনৈতিক তৎপরতা। আবার এমনও হতে পারে যে, এই তৎপরতা নতুন কোন জালিয়াতি, কোন দুরভিসন্ধি হাসিলের জঘন্য ষড়যন্ত্রেরই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।…

২৬ আগষ্ট, ১৯৭১

একটা খবরের মত খবর। করাচী থেকে এ-এফ-পি জানিয়েছে যে, পাকিস্তানী জঙ্গীশাহী বাংলাদেশের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের প্রতি জনগণের প্রতিনিধি হিসাবে দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসার আবেদন জানিয়েছেন। যেসব সদস্য জল্লাদশাহীর দৃষ্টিতে নিরপরাধ সুবোধ বালক, তাদের প্রতিই এই আবেদন জানানো হয়েছে। রেডিও পাকিস্তানের মারফত সরকারী মহল গণপ্রতিনিধিদের সর্বপ্রকার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
খবর শুনে হাসবো না কাঁদবো ভেবে পাই না। মনে হয়, পৃথিবীর সবকিছুরই সীমা আছে- সীমা নাই শুধু বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে ওদের নির্মম পেশাদারী রসিকতার। সম্ভবতঃ সে কারণেই, এতদিন পরে জঙ্গীশাহী গণপ্রতিনিধিদের প্রতি স্বীয় দায়িত্ব পালনের আবেদন জানাতে এতটুকু লজ্জাবোধ করেনি। কে না জানে, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে এই দেশবাসীর প্রতি দায়িত্ব পালনের জন্যই তারা বাংলাদেশের গণপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছিলেন। আর এজন্যই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে বাংলার মানুষ নিঃশব্দ ব্যালটের বিপ্লবের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের শিরদেশে পরিয়ে দিয়েছিল ইতিহাসের নজিরবিহীন নির্বাচনী বিজয়ের গৌরবময় শিরোপা। বাংলার মানুষ বিগত নির্বাচনে শেখ মুজিব এবং তার অনুসারীদের শুধু ভোট দেয় নাই- দিয়েছিল হৃদয়ের অন্তহীন ঐশ্বর্যমণ্ডিত অবিচল বিশ্বাস, ভালোবাসা আর আস্থা। এ বিশ্বাস ও আস্থার যাতে এতটুকু অমর্যাদা না হয়, স্বীয় দায়িত্ব পালনে যাতে বিন্দুমাত্র অবহেলা না হয়, সেই সচেতন সতর্কতাই গণপ্রতিনিধিদের সমাবেশ ঘটিয়েছিল ঢাকার ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে। দিনটা ছিল ৩রা জানুয়ারী ১৯৭১ সাল। বাংলার উদার আকাশের নীচে শীতার্ত দিনের শেষ প্রহরে স্নিগ্ধ সূর্যালোক-স্নাত সুবিশাল রেসকোর্সের জনারণ্য আর উপরে জাগ্রত বিধতাকে সাক্ষী রেখে সেদিন বাংলাদেশের গণপ্রতিনিধিরা শপথ নিয়েছিলেন। এক হাত বুকের উপর রেখে আরেক হাত উর্ধ্বে তুলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে গণপ্রতিনিধিরা বিবেকের নামেই ওয়াদা করেছিলেন : ‘জীবনের বিনিময়ে হলেও আমরা আমাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে যাব।’ এই শপথ যে ধোঁকাবাজির ভড়ং ছিল না, ছিল তাদের ঈমানেরই অঙ্গ-সেই সমাবেশে বঙ্গবন্ধুর ভাষণেও তার সুস্পষ্ট আভাস ছিল। শেখ মুজিব সেদিন বাংলার মানুষকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় নির্দেষ দিয়েছিলেন ; যদি কেউ এই শপথ ভঙ্গ করে, যদি কোন গণপ্রতিনিধি তোমাদের বিশ্বাস ও আস্থার অমর্যাদা করে, দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়-তাকে জ্যান্ত কবর দিও। এমনকি এই যদি আমি করি-আমাকেও তোমরা রেহাই দিও না।

<005.005.111>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

গণপ্রতিনিধির দায়িত্ব পালনের এমন দুর্বার আগ্রহ ছিল বলেই নির্বাচনী-বিজয়ী সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বারবার জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহবানের জন্য ইয়াহিয়ার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। এজন্য তিনি ১৫ই ফেব্রুয়ারী তারিখটিও নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন। কিন্তু ইয়াহিয়াই টালবাহানা করেছে। শেষ পর্যন্ত তারই খুশিমত ১লা মার্চ হয়েছিল জাতীয় পরিষদের উদ্ভোদনী অধিবেশনের তারিখ। কিন্তু সেদিনও পরিষদের অধিবেশন বসতে দেয়নি ইয়াহিয়া খানই-গণপ্রতিনিধিরা নয়। আর এভাবেই শাসনতন্ত্র রচনা ও রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পালনের পথ গণপ্রতিনিধিদের সামনে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে অথচ আজ হঠাৎ করে সেই জঙ্গীশাহীর মুখেই শোনা যাচ্ছে গণপ্রতিনিধিদের প্রতি দায়িত্ব পালনের আবেদন। শুনে চমকে উঠতে হয় ভূতের মুখে রাম নাম শোনার মত।
কিন্তু আর যাই হোক হঠাৎ করে জঙ্গীশাহীর এই সুমতির পেছনে যে কোন সাধু উদ্দেশ্য নেই তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সেদিন ও আজকের অবস্থাটার দিকে তাকালেই জল্লাদী আবেদনের গোমরাটা ফাঁস হয়ে যাবে।
৩১০ সদস্যের জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগের সদস্যসংখ্যা ১৬৭। ৩০০ সদস্যের বাংলাদেশ পরিষদেও আওয়ামী লীগারের সংখ্যা ২৮৮। যদি মার্চের এক তারিখে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসতো, একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে আওয়ামী লীগ জনগণের আশা-আকাঙ্খা অনুযায়ী একটি শাসনতন্ত্র রচনা করতে পারতো, ক্ষমতাসীন হতে পারতো। ফলে সমাধি রচিত হতো জঙ্গীশাহীর। কিন্তু তা হতে দিতে চায়নি জল্লাদ ইয়াহিয়া। আর চায়নি বলেই ষড়যন্ত্র আর শঠতার আশ্রয় নিয়ে সে বাহিনীকে লেলিয়ে দিয়েছে বাংলার মানুষের ওপর। লক্ষ লক্ষ মানুষকে খুন করে, বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে, অসংখ্য ঘর-বড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে, প্রায় এক কোটি মানুষকে দেশান্তরী করেও ইয়াহিয়া বাংলাদেশের গণপ্রতিনিধিদের বিবেককে কিনে নিতে পারেনি। তাই সেই বিবেকহীন জল্লাদ কলমের এক খোঁচায় জবাই করেছে আওয়ামী লীগের ৭৯ জন জাতীয় পরিষদ এবং ১৯০ জন প্রাদেশীক পরিষদ সদস্যকে। ইয়াহিয়ার দৃষ্টিতে তার পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ পরিষদে আওয়ামী লীগের টিকিটে নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিরা এখন সংখ্যলঘু। শেখ মুজিব কারাগারে। পাকিস্তানের সাবেক জঙ্গীশাসক আইয়ুবের জারজ সন্তান এবং বর্তমান শাসক ইয়াহিয়ার লেজুড় ভূট্টোর দল জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগুরু। সুতরাং আর ভয় নেই। তাইতো আজ জল্লাদ ইয়াহিয়া মেহেরবানি করে পরিষদ সদস্যদের প্রতি দায়িত্ব পালনের আবেদন জানিয়েছেন। কিন্তু বড় দেরী হয়ে গেছে। এ আবেদনে আজ শুধু মানুষের মনে বিদ্রুপ, ঘৃণা আর ধিক্কার সৃষ্টি করবে। …

২৭ শে আগষ্ট, ১৯৭১
বিদেশী পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে যে, পাকিস্তানী জঙ্গশাহী বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকার তথাকথিত দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত গণপ্রতিনিধিদের শূন্য আসনগুলির উপনির্বাচন অনুষ্ঠান স্থগিত রাখতে চায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের যে ৭৯ জন অনুসারীকে দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়ে তাদের সদস্যপদ খারিজ করা হয়েছে, তাদের জায়গায় আগামী নভেম্বর মাসে উপনির্বাচন হবে বলে ইয়াহিয়া খানই ঘোষণা প্রচার করেছিল। লণ্ডনের ‘ডেলী টেলিগ্রাফ’ পত্রিকা জানিয়েছে যে, নির্বাচনে দাঁড়াবার মত দালাল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বলেই ইয়াহিয়া খান উপনির্বাচন স্থগিত রাখতে বাধ্য হচ্ছে। এর আরেকটা কারণ হচ্ছে গেরিলাদের অপ্রতিহত তৎপরতা। তারা যে কোনভাবে হোক উপনির্বাচনের প্রহসন ঠেকিয়ে রাখবে। ‘ডেলী টেলিগ্রাফ’ বলেছে, ইয়াহিয়া খান খুব শিগগিরই উপনির্বাচন স্থগিতের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করবে। বলা নিম্প্রয়োজন, যা ঘটতে যাচ্ছে তা অপ্রত্যাশিত বা আকস্মিক কিছু নয়।
গত ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচন ছিল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরবর্তী তেইশ বছরের প্রথম নির্বাচন। এই নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষ ভোট দিয়েছে শোষক-ষড়যন্ত্রী শাসকের কব্জা থেকে নিজেদের ভাগ্য ছিনিয়ে আনার দূর্বার আকাঙ্ক্ষায়। বিজয়ী করেছে তাদের প্রিয় নেতা শেখ মুজিব এবং তার দল আওয়ামী লীগকে। দেশ ও

<005.005.112>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

দেশবাসীর প্রতি বঙ্গবন্ধুর অপরিসীম ভালোবাসা এবং তার প্রতি জনগণের অকুণ্ঠ বিশ্বাস ও আস্থাই নেতা ও জনতাকে পরস্পরের কাছাকাছি টেনে এনেছে। এই নৈকট্যবোধ এবং ঘনিষ্ঠ সম্পর্কই প্রতিফলিত হয়েছে নির্বাচনী রায়ে। এই নির্বাচনের লক্ষ্য ছিল একটি গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র প্রণয়ন ও গণপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর। কিন্তু এই নির্বাচনের রায় যখন শেখ মুজিবের পক্ষে গেল, যখন শোষক-ষড়যন্ত্রকারী গণদুশমন শাসকরা বুঝতে পারলো যে শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা দেওয়ার মানে হলো নিজেদের কবরের উপর জনতার বিজয়-কেতন উড্ডীন করা, ওরা প্রমোদ গুনলো। লিপ্ত হলো নির্বাচনী রায় বানচালের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে। ন্যায়নীতি বিবেকের মাথা খেয়ে জঙ্গীশাহী জনতা, গণ-প্রতিনিধিবর্গ আর তাদের নেতা শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে শুরু করলো নতুন চক্রান্ত। উদ্দেশ্য-যে কোনভাবে হউক পরিষদের অধিবেশন বাতিল এবং শেখ মুজিবকে রাষ্ট্র পরিচালনার সুযোগ লাভ থেকে বঞ্চিত রাখতেই হবে। আর এই দুরভিসন্ধি হাসিলের জন্য কি না করেছে জঙ্গীশাহী। রক্তগঙ্গা সৃষ্টি করেছে ওরা বাংলাদেশে-খুন, জখম, লুট, নারী ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ এমন কোনও খারাপ কাজ নেই যা ওরা করেনি। এমনকি শেখ মুজিবকে বন্দী করে, বিচারের প্রহসন মঞ্চ সাজিয়ে তাকে হত্যা করার চক্রান্ত করতেও ওরা পিছপা হয়নি। তাতেও যখন কাজ হয়নি-মাথা নত করেনি বাংলার নেতা ও জনতা-জল্লাদ ইয়াহিয়া কলমের এক খোঁচায় খারিজ করেছে পৌনে তিনশত গণপ্রতিনিধির সদস্যপদ। কারণ, ইয়াহিয়া ভেবেছিল আওয়ামী লীগ দলীয় সদস্যদের এসব শূন্যপদে উপনির্বাচন করে দালালদের পার করিয়ে নেওয়া যাবে, গঠন করা যাবে একটি পুতুল সরকার- যে সরকারের একমাত্র দায়িত্ব হবে জল্লাদের পা চাটা।
কিন্তু বিধি বাম, বাংলার মাইর দুনিয়ার বাইর। বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা আর বীর জনতার মিলিত প্রতিরোধের সামনে ধূলিসাৎ হয়ে গেছে ইয়াহিয়ার তোগলকি খোয়াব। …

…সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

রয়টার পরিবেশিত এক খবরে জানা যায়, পাকিস্তানী জঙ্গীশাহীর নায়ক ইয়াহিয়া খান গত মঙ্গলবার ইরানের রাজধানী তেহরান গিয়ে পৌঁছেছে। ওয়াকেবহাল মহল জানিয়েছেন, ইয়াহিয়া খান ইরানের শাহের সঙ্গে পাক-ভারত সম্পর্কে যে সংকট সৃষ্টি হয়েছে সে সম্পর্কে আলাপ-আলোচনা করবে।
তেহরানের ইংরেজী দৈনিক ‘তেহরান জার্নাল’ -এর উদ্ধৃতি দিয়ে রয়টার আরও জানিয়েছে, পাকিস্তান ও ভারতের বর্তমান সংঘাত ইরানের মধ্যস্থতা করার সম্ভাবনা রয়েছে। পত্রিকায় আরও বলা হয়েছে, পাকিস্তান ও ভারত উভয় দেশের সঙ্গে ইরানের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিরাজমান থাকায় ইরান দুই দেশের সম্পর্কোন্নয়নের ব্যাপারে তৃতীয় যে কোন দেশের চাইতে অধিকতর ফলপ্রসূ ভূমিকা পালন করতে পারবে। পত্রিকাটিতে এমনও বলা হয়েছে , অক্টোবরে পারস্য সম্রাজ্যের আড়াই হাজারতম বার্ষিকী অনুষ্ঠান ইয়াহিয়া খান ও ভারতীয় নেতাদের বৈঠকের একটা চমৎকার সুযোগ করে দেয়।
ঠিক একই দিন ঢাকা থেকে এক বেতার ভাষণে বাংলদেশের অধিকৃত এলাকার লাটবাহাদুর গাদ্দার মালিক বলেছে যে, সে ভারতীয় মন্ত্রীদের সঙ্গে দেখা করে শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ও অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয়ে আলোচনা করতে প্রস্তুত রয়েছে।
দুটি খবরের উৎসস্থল তেহরান ও ঢাকার মধ্যে দূরত্ব অনেক-হাজার হাজার মাইল। কিন্তু আশ্চর্যজনক মিল রয়েছে খবর দুইটির সারসংক্ষেপে। ব্যাপারটা অদ্ভুত ঠেকছে অনেকের কাছেই। তবু একথা সত্য যে, সমস্যার কেন্দ্রভূমি বাংলাদেশ হওয়া সত্ত্বেও ইয়াহিয়া ধর্না দিয়েছে ইরানের দরবারে, উদ্যোগ-আয়োজন চলছে ইয়াহিয়ার সঙ্গে ভারতীয় নেতাদের বৈঠকের। আর এদিকে ইয়াহিয়ার ভাড়াটিয়া গভর্নর মালিক বাস্তচ্যুত বাঙ্গালী শরণার্থীদের স্বদেশে ফিরিয়ে আনবার জন্য আলোচনা করতে চাইছে ভারতীয় মন্ত্রীবর্গের সঙ্গে।

<005.005.113>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

কিন্তু কেন? পশ্চিম পাকিস্তানী জঙ্গীশাহীর এই আচরণের, ভারতের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার এত খায়েশ কেন?
বিশ্ববাসী জানেন ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের প্রত্যক্ষ কোন বিরোধ নেই। আসলে সংঘাত চলেছে, যুদ্ধ চলেছে শেখ মুজিবের স্বাধীন বাংলাদেশ এবং উপনিবেশবাদী পশ্চিম পাকিস্তানী জঙ্গীশাহীর মধ্যে। রক্তপাত, বর্বরতা, লুটতরাজ, নির্যাতন চলছে বাংলার মাটিতে-এসব করেছে ইয়াহিয়ার লেলিয়ে দেওয়া ডালকুত্তার দল। সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর মাতৃভূমি বাংলাদেশ স্বাধীনতা ঘোষণা করে অমিতবিক্রমে লড়ে চলেছে হানাদার পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাদস্যুদের বিরুদ্ধে। হানাদার বাহিনী নাপাম বোমা ফেলে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দিচ্ছে বাংলাদেশের জনপদ। স্বাধীন বাংলার জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কারারুদ্ধ করে রেখেছে জল্লাদ ইয়াহিয়া খান। লিপ্ত হয়েছে তার বিচার প্রহসনে। তাই সমগ্র বিরোধটা, মূল সংঘর্ষটা চলেছে বাংলাদেশের জনগণ আর পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সঙ্গে। এর মধ্যে ভারতের স্থান কোথায়? ভারতের কথা আসে কিসে?
কিন্তু তবু গোড়া থেকেই জঙ্গীশাহী চেষ্টা করে এসেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রসঙ্গটি বেমালুম চাপা দিয়ে বিশ্ববাসীকে এই মর্মে বিভ্রান্ত করতে যে সংঘর্ষটা আসলে পাকিস্তন ও ভারতের মধ্যে। এর উদ্দেশ্যেও পরিষ্কার। জঙ্গীশাহী চাইছে পাক-ভারত সংঘর্ষের ডামাডোলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে স্তব্ধ করতে ইয়াহিয়া চাইছে বাংলাদেশ ইস্যু থেকে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি কল্পিত পাক-ভারত বিরোধের দিকে সরিয়ে নিতে। আর সে কারণেই তেহরানের দুয়ারে ধর্না।

২২শে সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
খবরের পর খবর। নয়াদিল্লীতে বাংলাদেশ সম্পর্কে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদানকারী ২৫টি দেশ একবাক্যে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি সংগ্রামী মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিনাশর্তে মুক্তি দাবী করেছে। গত সোমবার সম্মেলনের সমাপ্তি অধিবেশনে স্বাধীন বাংলাদেশেকে স্বীকৃতি দিয়ে সর্বপ্রকার রাজনৈতিক ও অর্থিক সাহায্য দানের জন্য বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। ভারতের সর্বোদয় নেতা শ্রী জয়প্রকাশ নারায়ণের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে পাকিস্তানকে সর্বপ্রকার আর্থিক ও সামরিক সাহায্য দান বন্ধ করা এবং বাংলাদেশের জনগণের জন্য বরাদ্দকৃত সমুদয় সাহায্য সামগ্ৰী স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের মাধ্যমে বিলি-বন্টনের ব্যবস্থা করারও দাবী জানানো হয়।
এদিকে কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ সংসদীয় সম্মেলনে বাংলাদেশে হানাদার পশ্চিম পাকিস্তানী বাহিনীর বর্বর গণহত্যাযজ্ঞের তীব্র নিন্দা করে বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের দাবী জানানো হয়েছে। সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মুক্তি দাবী করে বলা হয়েছে, তাঁর মত কালজয়ী নেতাকে আটক রাখা গৰ্হিত অন্যায়। আফগানের বাদশাহ জহির শাহের মস্কো সফরশেষে প্রকাশিত সোভিয়েত – আফগান যুক্ত ইশতেহারেও বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের সুপারিশ করা হয়েছে। এমনকি, বাংলাদেশে হানাদার পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাদস্যুদের বর্বর গণহত্যাযজ্ঞের নীরব দর্শক জাতিসংঘের সেক্রেটারী জেনারেল উ থান্ট শেষ পর্যন্ত বিবেকের তাড়নায় বলতে বাধ্য হয়েছেন যে, মানবিক মূল্যবোধের মর্যাদাপূর্ন স্বীকৃতির ভিত্তিতে রাজনৈতিক সমাধানের মাধ্যমেই বাংলাদেশের মূল সমস্যার সমাধান সম্ভবপর। তিনি একথাও বলেছেন যে, বাঙালী জাতিকে সর্বপ্রকার সাহায্য করা বিশ্ববাসীর নৈতিক দায়িত্ব।
এদিকে, ফ্রান্সের বিশিষ্ট লেখক, রাজনীতিক ও প্রাক্তন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী মঁসিয়ে আঁদ্রে মালরো বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করবার সদিচ্ছা প্রকাশ করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, বাংলাদেশের পক্ষ হয়ে হানাদার দস্যুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবার ইচ্ছা প্রকাশ করে দেশ-

<005.005.114>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

বিদেশের বহু তরুণ তার কাছে চিঠি লিখেছে। এই খবর পরিবেশনাকারী একটি পত্রিকার ভাষায় “আজ বাংলার মুক্তিসংগ্রামে কার আগে প্রাণ, কে করিবে দান, তারি লাগি কাড়াকড়ি” পড়ে গেছে।
বলা বাহুল্য, উল্লেখিত সবকটি খবরই বাঙালী জাতির জন্য শুভ সংবাদ। কারণ, এতে একদিকে যেমন বাঙালী জাতির মুক্তিযুদ্ধের যৌক্তিকতা ব্যাপকভাবে স্বীকৃত হয়েছে, অন্যদিকে তেমনি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়ে গেছে যে দুনিয়ার মানুষ জল্লাদ ইয়াহিয়ার কথা বিশ্বাস করেনি। বরং পৃথিবীর বিবেকবান মানুষের কাছে অস্ত হীন ঘৃণা আর ধিক্কার ছাড়া তার আশা করবার আর কিছুই নেই।….

২৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

একটি বিদেশী পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যায়, লণ্ডনে এই মর্মে জোর জল্পনা-কল্পনা চলেছে যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি আসন্ন। কোন কোন পর্যবেক্ষকের মতে, বাংলাদেশ সম্পর্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে আলোচনার আগেই শেখ সাহেবকে মুক্তি দেওয়া হতে পারে। লণ্ডনে পাকিস্তানী অনুচররা এই মর্মে প্রচরণা চালিয়ে যাচ্ছে যে, শেখ মুজিবের কোন দোষ নেই। শুধুমাত্র চরমপন্থীরা দেশদ্রোহী কার্যকলাপের জন্য দায়ী। আর এরই দরুন ২৫শে মার্চ পাক ফৌজকে অস্ত্র হাতে রাস্তায় নামতে হয়েছিল।
এদিকে করাচী থেকে ফরাসী বার্তা সংস্থা এ-এফ-পি জানিয়েছে, জেনারেল ইয়াহিয়া খান বেগম মুজিবকে লয়ালপুরের কারাগারে আটক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করতে দিতে পারে। রাওয়ালপিণ্ডির বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার খবর অনুযায়ী ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুকে ঢাকায় চিকিৎসাধীন তার বৃদ্ধ পিতা এবং বৃদ্ধা মায়ের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ দিতে পারে। বলা হয়েছে যে, গত সপ্তাহে বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকার গভর্নর ডাঃ মালিকের সঙ্গে দেখা করে বেগম মুজিব বঙ্গবন্ধু যাতে তার অসুস্থ পিতা-মাতাকে দেখতে পারেন সে ব্যবস্থা করার অনুরোধ জানান। পিণ্ডির পত্র-পত্রিকার খবরে আরও বলা হয়েছে যে, শেখ মুজিবের বিচারের রায় আগামী সপ্তাহেই দেওয়া হবে বলে মনে হয়।
জল্লাদ ইয়াহিয়া খেলাটা ভালো জমিয়ে তুলেছে। উপরের খবরগুলো একটু তলিয়ে দেখলেই পরিষ্কারভাগে বুঝতে পারা যায় যে এর পেছনে রয়েছে ইয়াহিয়ার এক সুচতুর চাল। এই ক’দিন আগেও জেনারেল ইয়াহিয়া খান “লা ফিগারো’ পত্রিকার প্রতিনিধির কাছে সদম্ভে বলেছে যে, শেখ মুজিব কোথায় আছে তা তার জানা নেই। কারণ, কারারুদ্ধ ক্রিমিনালদের কে কোথায় আছে তা-একটা দেশের প্রেসিডেন্টের জানা থাকবার কথা নয়। আজ সেই ইয়াহিয়া খানের সরকারই দয়ায় বিগলিত শেখ মুজিবের পত্নীকে তার সঙ্গে দেখা করার সুযোগ দেবে, বঙ্গবন্ধুকে তার রোগশয্যায়শায়ী পিতামাতাকে দেখতে ঢাকায় নিয়ে আসবে, এমনকি জাতিসংঘে বাংলাদেশ প্রশ্নে বির্তক শুরু হবার আগেই বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেবে-এতসব খবরে এখন বাজার মাত। শুধু কি তাই, একদিকে ইয়াহিয়া খান নিজেই বলেছে শেখ মুজিব রাষ্ট্রদ্রোহী ক্রিমিনাল, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার দায়ে তার হচ্ছে বিচারের নামে প্রহসন- আবার অপরদিকে জেনারেল ইয়াহিয়াই বঙ্গবন্ধুর জাতীয় পরিষদ সদস্য পদটি খারিজ করে। তার অনুচরেরা সার্টিফিকেট দিচ্ছে ‘শেখ মুজিব আসলে ভালো মানুষ’। তার কোন দোষ নেই। ইয়াহিয়া খান ‘লা-ফিগারোকে’ বলেছে, ‘শেখ মুজিবকে দিয়ে ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতা দাবী করিয়েছে। ইয়াহিয়ার অনুচরেরা বলছে, ‘চরমপন্থীরাই দেশদ্রোহী কর্মকাণ্ডের গুরুঠাকুর।’
কিন্তু ঘটনাটা কি? আমরা বরাবরই বলেছি, শেখ মুজিবের জীবন এবং তার নিরাপত্তাকে ইয়াহিয়া খান ব্যবহার করতে চাইছে শেষ রক্ষার তুরুপের তাস হিসাবে। তাই সে একদিকে শেখ মুজিবের প্রাণনাশের হুমকি দিচ্ছে, অপরদিকে গোপনে দূত পাঠিয়ে তারই কাছে দিচ্ছে আপসের ধর্না। … তারই অনুসারীদের ঘাড়ে সব দোষ চাপিয়ে জঙ্গশাহী আর তার চেলা-চামুণ্ডারা জনমনে বিভ্রান্তি এবং বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা করেছে। ইয়াহিয়া

<005.005.115>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

খান জানে যে, বাংলাদেশ সরকার এবং বাংলাদেশের জনগণ শেখ মুজিবের নির্দেশিত পথেরই অভিযাত্রিক মাত্র। তবু এই বিভেদ-প্রচার নীতি অনুসরণ করছে তারা নিজেদের দুরভিসন্ধি হাসিলের জন্যই।

১লা অক্টোবর, ১৯৭১

জাতিসংঘ সদর দফতর প্রাঙ্গণে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দেবার জন্য পাকিস্তান জাতিসংঘের সেক্রেটারী জেনারেল মিঃ উথান্টের কাছে আবেদন জানিয়েছে।
রেডিও পাকিস্তানের খবরে বলা হয়, জাতিসংঘে নিযুক্ত পাকিস্তানী প্রতিনিধি আগা শাহী উথান্টের কাছে লেখা এক চিঠিতে এ আবেদন জানিয়েছে। চিঠিতে অভিযোগ করা হয় যে, বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের অন্যতম সদস্য জনাব এম, আর, সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে গুরুতর ক্রিমিনাল’ অভিযোগ রয়েছে। চিঠিতে জনাব সিদ্দিকী এবং প্রতিনিধিদলের অন্য সদস্যদের নিউইয়র্কে প্রবেশ করতে না দেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কাছেও আবেদন করা হয়েছে।
ব্যাপারটাকে কি বলা যায়! পাকিস্তান যে ফরিয়াদ জানিয়েছে তাকে মামা বাড়ির আবদার বললেও খাটো করে বলা হয়। একটি স্বাধীন দেশের জনগণের আস্থাভাজন প্রতিনিধিদের বিশ্বসংস্থায় মাতৃভূমির বক্তব্য পেশে বাধা সৃষ্টিকল্পে উপনিবেশবাদী জঙ্গীশাহীর এই নির্লজ্জ অপচেষ্টাকে কলঙ্কজনক তস্করবৃত্তি আখ্যা দিলেও যথেষ্ট বলা হয় না, কিন্তু তবু ঘটনা সত্য যে পাকিস্তানী জঙ্গীশাহী জাতিসংঘে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের বক্তব্য পেশে বাধা সৃষ্টির ঘৃণ্য প্রচেষ্টায় মেতে উঠেছে। এমনকি জাতিসংঘ লবিতে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের কাছে বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা যাতে স্বীয় বক্তব্য পেশ করতে না পারেন, সেজন্য বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের ভিসা মঞ্জুর বন্ধ করার চেষ্টাও পাকিস্তান করেছে। পাকিস্তানের এই অপচেষ্টার দরুনই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা লাভে বিলম্ব হয়েছে এবং তার ফলে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নিউইয়র্ক পৌঁছুতে বিলম্ব হয়েছে পুরো চারটি দিন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জঙ্গীশাহীর প্রথম অপচেষ্টাটি ব্যার্থ হওয়ায় প্রতিনিধিদল নিউইয়র্কে পৌঁছেছেন এবং ইতিমধ্যেই তাদের নির্দিষ্ট দায়িত্ব পালনে আত্মনিয়োগ করেছে।
সকলেই জানেন, ঢাকা হাইকোর্টের বিচারপতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর এবং লণ্ডনে বাংলাদেশ মিশনের প্রধান জনাব আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল নিউইয়র্ক গিয়েছেন বিশ্ব সংস্থার সদস্যদের কাছে জননী বাংলার বুকে জল্লাদ ইয়াহিয়ার ভাড়াটিয়া সেনাবাহিনীর বর্বর অত্যাচার ও নজিরবিহীন গণহত্যাযজ্ঞের লোমহর্ষক কাহিনী বর্ণনা করতে। তাঁরা গিয়েছেন স্বাধীন বাংলাদেশের স্বীকৃতিদান এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কারামুক্তির জন্য উদ্যোগ গ্রহণে বিশ্ব রাষ্ট্রবর্গকে আগ্রহী করতে। সাড়ে ৭ কোটি বাঙালীর প্রতিনিধি হিসাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবং বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে যারা জাতিসংঘে গিয়েছেন তারা জনগনের আস্থভাজন-সর্বজনশ্রদ্ধেয় রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী এবং কূটনীতিক। সততা ও দেশপ্রেমের অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ খাঁটি সোনা তারা। তাদের কণ্ঠস্বর বাঙালী জাতির কণ্ঠস্বর বলেই বিবেচিত হবে। তাঁরা প্রতিনিধিত্ব করছেন হানাদার বর্বর উপনিবেশবাদী শক্তির বিরুদ্ধে জীবনপণ মুক্তিযুদ্ধে নিয়োজিত একটি দুর্বিনীত জাগ্রত জাতির।
অপরদিকে পাকিস্তানী প্রতিনিধিদলটি গঠিত হয়েছে গণধিকৃত রাজনৈতিক মৃত সৈনিকদের নিয়ে। সকলের পরিচয় দিয়ে কাজ নেই। শুধুমাত্র দুই নেতা-বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতা বিচারপতি জনাব আবু সাঈদ চৌধুরী এবং পাকিস্তানী প্রতিনিধিদলের নেতা পেশাদার দালাল মাহমুদ আলির দিকে তাকালেই দুটি প্রতিনিধিদলের মধ্যকার পার্থক্যটা পরিষ্কার হয়ে ওঠে। বলা বাহুল্য, বিশ্বাবাসী জানেন, বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের হয়ে কথা বলার অধিকার রয়েছে একমাত্র বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের-পাঞ্জাবী কুচক্রের জারজ সন্তান মাহমুদ আলিদের নয়। তাই একথাও পরিষ্কার যে, বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের বক্তব্যকেই বিশ্ববাসী চূড়ান্ত

<005.005.116>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

বলে মেনে নেবে। ফলে বাংলাদেশ সম্পর্কে বিশ্বজনমত বিভ্রান্ত করার জল্লাদী খায়েশ নির্ঘাত মাঠে মারা যাবে। আর সেই ভয়েই জঙ্গীশাহী প্রাণপণ চেষ্টা করছে যাতে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল বিশ্বসংস্থার আঙ্গিনায় ঢুকতে না পারেন – তাদের কাছে বক্তব্য পেশ করতে না পারেন।…

৮ নভেম্বর, ১৯৭১
বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকায় জঙ্গীশাহীর উপনির্বাচনের প্রহসন সম্পকে আরও জবর খবর এসেছে। শত্রুকবলিত ঢাকা বেতার মারফত জানা গেছে যে, অধিকৃত এলাকার যে ৭৮টি জাতীয় পরিষদের আসনে আওয়ামী লীগ দলীয় সদস্যদের খারিজ করে উপনির্বাচন হচ্ছে তার ৫৫ টিতেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পাকিস্তান দরদী ইসলামী-দরদীরা নির্বাচিত হয়ে গেছে। এ ছাড়া প্রাদেশিক পরিষদের ১৯৩টি আসনের ৮৫টিতে জনাবরা নির্বাচিত বলে ঘোষিত হয়েছে-ভোটাভুটির দরকার হয়নি। এদিকে রেডিও পকিস্তান জানিয়েছে লাহোরে ইয়াহিয়া খাঁ’র সঙ্গে তার বৃদ্ধ ঘেটু নুরুল আমিন সুদীর্ঘ আলোচনা-বৈঠক চালিয়েছে। বিদেশী বার্তা প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, ইয়াহিয়া খান নূরুল আমিনকে প্রধানমন্ত্রী এবং ভুট্টোকে ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের পরিকল্পনা করেছে বলে পর্যবেক্ষকদের ধারণা। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উপায় নিয়েই নাকি জল্লাদ আর দালালের সলাপরামর্শ চলেছে।
অপরদিকে ভুট্টোর ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী-গিরির চাকরিটা পাকা হবার সম্ভাবনাই বেশী বলে মনে করা হচ্ছে তার চীন সফরের দরুন। কিছুদিন আগেও ভুট্টো ইয়াহিয়ার বিরুদ্ধে অনেক গরম গরম কথা বলেছে। আর শেষ পর্যন্ত সেই ইয়াহিয়ারই ট্যাণ্ডেল হিসাবে সে পিকিং সফর করছে সমরাস্ত্রের ভিক্ষাপাত্র হাতে। বুঝতে কষ্ট হবার কথা নয় যে ক্ষমতার কাঁচকলার গন্ধ পেয়েই ভুট্টো এতটা তকলিফ স্বীকার এবং নীচে নামতে রাজী হয়েছে।…
এবার আসা যাক উপনির্বাচনের তেলেসমাতি খেলার কথায়। আমরা আগেও বলেছি, এখনও বলি ,’৭০-এর ডিসেম্বরের নির্বাচনে যারা নির্বাচিত হয়েছেন তারাই বাংলাদেশের জনগণের বিশ্বস্ততম প্রতিনিধি। তাদের নিয়েই গঠিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার। তাই বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকায় এই তথাকথিত জল্লাদী উপনির্বাচন শুধু অপর একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপই নয়-ইয়াহিয়ার এক হাস্যকর পাগলামিও বটে। আর এই উপনির্বাচন সম্পর্কে ইয়াহিয়ার খাস তালুক পশ্চিম পাকিস্তানের পত্রপত্রিকার মতামতই কি তার প্রতি খুব অনুকূল? মোটেই নয়। সেকথাই এখন বলছি।
করাচীর ‘ডন’ পত্রিকা বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকার উপনির্বাচনে ভুট্টোর পিপলস পার্টির ৬ জন সদস্যের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়াকে ‘রহস্যজনক’ বলে মন্তব্য করেছে। পত্রিকা বলেছে, এটা সত্যিই রহস্যাবৃত-কেন এই ৬টি আসনের সবক’টিতে পিপলস পার্টির বিরোধী নুরুল আমিন নেতৃত্বাধীন ৬ দলের ঐক্যজোটের প্রার্থিরা মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নিয়েছে। আর কেন নিয়েছে, তার জবাব নুরুল আমিনও দিতে পারেনি-সে জানে না। লাহোরের উর্দু দৈনিক ‘কোহিস্তান’ জানিয়েছেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এই ৬টি আসন দখল করার জন্য পিপলস পার্টি বিরোধী প্রার্থীদের ২২ লক্ষ টাকা ঘুষ দিয়েছে। আরেকটি লাহোরী উর্দু দৈনিক ‘আজাদ’ এ ব্যাপারে তদন্ত দাবী করেছে। পত্রিকাটির এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়েছে, এই উপনির্বাচনের ফলাফল জনগণকে এবং বিশ্ববাসীকে নির্বাচনের বৈধতা, নিরপেক্ষতা ও সত্যতা সম্পর্কে সন্তুষ্ট করতে পারবে না। পত্রিকাটি বলেছে, এই ৫৫টি আসনে তারাই নির্বাচিত বলে ঘোষিত হয়েছে, যাদের ডিসেম্বরের নির্বাচনে জামানত পর্যন্ত বাজেয়াপ্ত হয়ে গিয়েছিল। তারপর আমাদের আর কি বলার আছে?

<005.005.117>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

১৬ই নভেম্বর, ১৯৭১

… নিউজউইকের সিনিয়র এডিটর আর্নড বোর্চগ্রেভ গত সপ্তাহে ঢাকা থেকে প্রেরিত এক তারবার্তায় অন্যান্য কথার মধ্যে লিখেছেন : ইষ্টার্ন সেক্টরের কমাণ্ডার নিয়াজীকে মুক্তিযুদ্ধের গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে সে বললো, ‘বিদ্রোহীরা কোন সমস্যা নয়। তাদের শায়েস্তা করার জন্য আমাদের রাজাকাররাই যথেষ্ট।’ অথচ বোর্চগ্রেভের মতে রাজাকাররাই সামরিক জান্তার উপকারের তুলনায় ক্ষতিই করেছে বেশী। যেহেতু তাদের হাতে বন্দুক আছে, তাই তারা মনে করে তাদের এক-একজন বিধাতাপুরুষ। খাদ্য বা মেয়েমানুষ সরবরাহে অস্বীকৃতি জানালে এই রাজাকাররা যে কোন লোকের জীবন বিপন্ন করে তুলতে পারে।
বোর্চগ্রেভ আরও লিখেছেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কঠিন সত্যটিকে সযত্নে ডাঃ মালিক থেকে শুরু করে জেনারেল ইয়াহিয়া পর্যন্ত সবার কাছে থেকে গোপন রাখা হচ্ছে। তাদের ধারণা, সেনাবাহিনী সঠিকভাবেই মুক্তিবাহিনীর মোকাবেলা করছে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী যে এখনও কত ভয়াবহ হিংস্র বর্বরতা চালিয়ে যাচ্ছে, তারই দুটি নজির পাওয়া গেছে সম্প্রতি। নিউজউইকের প্রতিনিধি বলেছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দলের পশ্চাদ্ধাবনের নামে কয়েকদিন আগে পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ডেমরা গ্রামে ঢুকে পড়ে। হানাদার নরপশুরা সেখানে ১২ থেকে ৩৫ বছর বয়স্ক মহিলার উপর পাশবিক অত্যাচার চালায় এবং ১২ বছরের বেশী বয়স্ক সকল পুরুষকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এরই দু-একদিন পরে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা চালনার কাছে নদীতে দ্রুত গানবোট চালিয়ে ঢেউ তুলে কতকগুলি জেলে নৌকা ডুবিয়ে দেয়। জেলেরা সাঁতরে তীরে উঠবার চেষ্টা করলে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা তাদের উপর গুলি চালায়।
আমাদের কথা নয়-বিদেশী সাংবাদিক আর্নড বোর্চগ্রেভের এই বিবরণীই নিরপেক্ষ নিয়তির কঠিন রায়ের মত বিশ্ববাসীকে আরেকবার জানিয়ে দিল বাঙালী জাতিকে পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেবার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানী উপনিবেশবাদী জঙ্গীচক্র মার্চ মাসে যে নারকীয় গণহত্যাযজ্ঞ, যে হিংস্র বর্বরতা শুরু করেছিল আজো তা অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু কেন? কেন এই বর্বরতা? কেন এই নৃশংসতা? কেন মানব ইতিহাসে নজিরবিহীন এই পাশবিক গণহত্যাযজ্ঞ? কি অপরাধ করেছিল বাংলার মানুষ?..
১৯৭০ সালের নির্বাচনে ঐক্যবদ্ধ বাঙালী জাতি দ্ব্যর্থহীন রায় দিয়েছেন উপনিবেশবাদী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে-আওয়ামী লীগকে একচেটিয়া ভোট দিয়ে বাঙালী জাতি শেখ মুজিবকে প্রদান করেছে তাদের ভাগ্য নির্ধারণের দায়িত্বভার। আর বিধাতার ছায়া সন্দর্শনে ভীতসন্ত্রস্ত শয়তানের মতই থর থর করে কেপে উঠেছে গণবিরোধী শাসন-শোষককুলের অন্তরাত্মা। কারণ, তারা জানতো, শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষমতাসীন হওয়ার অর্থই হবে দুঃখী জনগণের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি-আর চক্রান্তকারী শাসক-শোষক ও জঙ্গীবাজদের চূড়ান্ত সর্বনাশ। আর তাই তাদের স্বার্থের জিম্মাদার, ভাড়াটিয়া এজেন্ট ইয়াহিয়াকে তারা প্ররোচিত করেছে হিংস্র বর্বর পন্থায় বাঙালী জাতিকে নির্মুল করে দেবার অভিযান চালাতে। …

২৩শে নভেম্বর, ১৯৭১

‘নিউইয়র্ক টাইমস’ পত্রিকার প্রতিনিধি ম্যাককম ডব্লু ব্রাউন বাংলাদেশের দখলকৃত এলাকা সফরশেষে ঢাকা থেকে প্রেরিত এক রিপোর্টে বলেছেন, ‘বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই। বাংলাদেশের মানুষ পূর্ন স্বাধীনতা চায়। ইয়াহিয়া খান শক্তি প্রয়োগের দ্বারা তাদের এ ইচ্ছাকে দাবিয়ে দিতে পারবে না। অর্থাৎ তার বর্বরতা এবং শক্তি প্রয়োগের মাত্রা যত বাড়বে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ততই ত্বরান্বিত হবে।’ নিউইয়র্ক টাইমসের এই রিপোর্টে এতটুকু অতিশয়োক্তি নেই। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে বিদ্রোহী তার সব রকমের মাধ্যমের সাহায্যে যে বিভ্রান্তিকর প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে, নিউইয়র্ক টাইমসসহ

<005.005.118>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

বিভিন্ন নিরপেক্ষ বিদেশী সংবাদপত্রের রিপোর্টে এবং মন্তব্যই বিশ্ববাসীর সামনে তার অসারতাকে নগ্নভাবে তুলে ধরেছে। সমগ্র দুনিয়ার দৃষ্টি আজ বাংলাদেশের দিকে। তাই বাংলাদেশ সম্পর্কে বিশ্বের মানুষ যাতে ঠিক তথ্য জানতে না পারে জল্লাদ ইয়াহিয়ার প্রচারবিশারদরা সেজন্য চেষ্টার এতটুকু কসুর করেনি।
পশ্চিম পাঞ্জাবী শিল্পপতি, কায়েমী স্বার্থবাদী এবং শোষককুল পৃষ্ঠপোষিত উপনিবেশবাদী জঙ্গী শাসককুলের গণবিরোধী শাসন ও শোষণের চাকা বন্ধ হয়ে যাবার আশংকায় তাদেরই ভাড়াটিয়া গোলাম জল্লাদ ইয়াহিয়া ২৫শে মার্চ বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর বর্বর সেনাবাহিনীকে লেলিয়ে দেয়। ইতিহাসে নজিরবিহীন গণহত্যাযজ্ঞ চালিয়ে, হিংস্র বর্বরতার সঙ্গে নারী ধর্ষণ, লুটতরাজ ও অগ্নিসংযোগের আশ্রয় নিয়ে, লক্ষ লক্ষ মানুষকে গৃহহারা দেশান্তরী করে ইয়াহিয়া খান চেয়েছিল পৃথিবীর বুক থেকে বাঙালী জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে, তাদের স্বাধীনতার দাবীকে নির্মুল করে দিতে। আর এ বর্বরতার লোমহর্ষক কাহিনী চাপা দিয়ে রাখবার জন্য কুচক্ৰী ইয়াহিয়া বাংলাদেশ থেকে বিদেশী সাংবাদিকদের বহিষ্কার করেছিল বর্বর গণহত্যাযজ্ঞ শুরুর প্রথম মুহুর্তেই। কিন্তু তার অসদুদ্দেশ্য সফল হয়নি। ইয়াহিয়া একদিকে যেমন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বানচাল করতে পারেনি, তেমনি পারেনি বাংলাদেশে তার ভাড়াটিয়া সেনাবাহিনীর পৈশাচিকতা সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে অন্ধকারে রাখতে।
বহুদিন কড়া সেন্সরশীপ আরোপ রেখে, কিছু অসৎ সাংবাদিক ভাড়া করে অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখিয়ে জল্লাদশাহী নিজেদের পাপকীর্তি চাপা রাখার, বিশ্ববাসীকে ধোঁকা দেবার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছে। কিন্তু সমগ্র দুনিয়াব্যাপী সংবাদপত্র জগৎ এর জনমতের প্রচণ্ড চাপে বাধ্য হয়ে ইয়াহিয়া খান বিদেশী সাংবাদিকদের বাংলাদেশে ঢুকতে দিয়েছে। প্রথম সুযোগেই দুনিয়ার দশদিগন্ত থেকে খ্যাতনামা পত্রিকা, রেডিও এবং টেলিভিশন সাংবাদিক ও ক্যামেরাম্যানরা ছুটে এসেছেন যুদ্ধবিক্ষত বাংলাদেশে। তারা দেখেশুনে বিস্মিত হতবাক হয়ে গেছেন। ভিয়েৎনাম, আলজেরিয়া, কিউবার বিপ্লব আর জনযুদ্ধ সারা পৃথিবীর মানুষের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। কিন্তু বাংলাদেশও মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্রে নয়া রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আট মাস সময়ও অতিক্রান্ত হয়নি কিন্তু এর মধ্যে বীর প্রসবিনী বাংলার মুক্তিযোদ্ধারা যে অভূতপূর্ব বীরত্ব সাফল্যের পরিচয় দিয়েছেন ইতিহাসে তার আর কোন নজির নেই। ইয়াহিয়া খান ৭২ ঘণ্টার ‘ক্রাশ বেঙ্গলী পোগ্রামের হিংস্র নখরাঘাতে শুরুতেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ দাবিয়ে দেওয়ার স্বপ্ন দেখেছিল। কিন্তু শেখ মুজিবের বাংলাদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড পাল্টা আক্রমণের তীব্রতায় জল্লাদী খোয়াব ভেঙ্গে খান খান হয়ে গেছে। আজ জল্লাদী সম্রাজ্যের মোহই চূড়ান্তভাবে ক্রাশ হবার দ্বারপ্রান্তে। বিদেশী সাংবাদিকরাই নিজের চোখে দেখছেন প্রতিদিন প্রতিটি রণাঙ্গনে হানাদার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড আক্রমনের মুখে টিকতে না পেরে পিছু হটছে। প্রতিদিন মুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা-নতুন নতুন অঞ্চলে উড়ছে স্বাধীন বাংলার পতাকা। আর তাই হানাদার জঙ্গীবাহিনীর চূড়ান্ত বিপর্যয়ের পূর্বাভাস দিয়ে বিদেশী সাংবাদিকেরা সত্যভাষণের স্বার্থেই বলেছেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই-কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না।

২৬শে নভেম্বর, ১৯৭১
জল্লাদ ইয়াহিয়া খান গতকাল বৃহস্পতিবার বলেছে যে, বর্তমান পরিস্থিতি ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্ক এখন এমন একটি জায়গায় টেনে নিয়ে গেছে যেখান থেকে আর ফিরবার উপায় নেই। রেডিও পাকিস্তানের কাজ অনুসারে জেনারেল ইয়াহিয়া বলেছে, পাকিস্তানের সম্মান ও অখণ্ডতাকে সে সর্বশক্তি দিয়ে রক্ষা করবে। ইয়াহিয়া খান আবার অভিযোগ করেছে যে, ভারত বাংলাদেশের ওপর আক্রমণ পরিচালনার ফলেই উপমহাদেশের শান্তি বিঘ্নিত হয়েছে।

<005.005.119>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

একই দিনের আরেকটি খবরে জানা যায়, যে সমস্ত বৃটিশ, মার্কিন ও জার্মান নাগরিক বাংলাদেশে আছেন অবিলম্বে তাদের নিজ নিজ দেশে ফিরে যাবার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যারা এই মুহুর্তেই স্বদেশে ফিরতে পারছেন না তাদেরকে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় গ্রহণ এবং পর্যাপ্ত খাদ্যশস্য মজুদ রাখতে বলা হয়েছে। গতকালের খবরে বলা হয়েছে, মুক্তিবাহিনী ঝিকরগাছা থেকে হানাদার বাহিনীকে তাড়িয়ে দিয়ে যশোর সেক্টরে একটি নতুন ফ্রন্ট খুলেছে। সাতক্ষীরা মহকুমাও গতকাল শত্রুমুক্ত হয়েছে। মুক্তিবাহিনীর একটি দল খুলনা শহর অভিমুখে এগিয়ে চলেছে। আর যশোর ক্যান্টনমেন্টের চারপাশে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণাত্মক তৎপরতা প্রচণ্ডভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
অপরদিকে আকাশবাণীর খবরে জানা যায়, পকিস্তানী সৈন্যরা বুধবার মধ্যরাত্রি থেকে পশ্চিম দিনাজপুরের জেলা সদর বালুরঘাটের ওপর একটানা ১২ ঘণ্টা ধরে গোলাবর্ষণ করায় ১২ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন। আগরতলা সীমান্তেও পাকিস্তানী বাহিনীর অশুভ তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। সমগ্র পাকিস্তানে ইতিপূর্বেই জরুরী অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে।
সবকিছু মিলিয়ে আশংকা করবার সঙ্গত কারণ রয়েছে যে, পাকিস্তানী কাণ্ডজ্ঞানহীন জঙ্গীচক্রের ভারত আক্রমণের সম্ভবত বেশী দেরী নেই। ভারতও প্রস্তুত হয়ে আছে হামলার পাল্টা জবাব দেবার জন্য। আত্মরক্ষার প্রয়োজনে ভারতীয় বাহিনীকে সীমান্ত অতিক্রমের অনুমতি দেয়া হয়েছে। ফলে একথা নিশ্চিত যে, পাকিস্তান যদি আক্রমণ চালায় ভারত তার দাঁতভাঙ্গা জবাবই দেবে। আর সে জবাব যে পাকিস্তানী জঙ্গীচক্রের জন্য কত ভয়াবহ হবে, তার জলজ্যান্ত উদাহরণ হচ্ছে সম্প্রতি ভারতের আকাশসীমা লংঘনকারী ৪টি পাকিস্তানী বিমানের তিনখানির ভূ-পতন।
কিন্তু, কেন এই রণপাঁয়তারা? কেন এই যুদ্ধের আগুন? ভারত যুদ্ধ চায় নাই। ভারত চেয়েছে প্রতিবেশী বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীন জাতি হিসাবে বাঁচুক, সেখান থেকে জঙ্গী বর্বরতায় অতিষ্ঠ হয়ে প্রাণভয়ে যারা ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে, তারা সসম্মানে দেশে ফিরে যাক। তবু, শুধুমাত্র এই মৌলিক মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির দায়েই পাকিস্তান ভারতের ওপর সমস্ত দোষ চাপিয়ে দিতে চাইছে। আগাগোড়াই ইয়াহিয়া খান চেষ্টা করে এসেছে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে ভারতের কারসাজি বলে চালিয়ে দিয়ে বিশ্বজনমতকে বিভ্রান্ত করতে। আজ যখন ইয়াহিয়ার লেলিয়ে দেয়া ভাড়াটিয়া বাহিনী শেখ মুজিবের বাংলাদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে চারদিকে থেকে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে তখনও ইয়াহিয়া খান সেই পুরাতন সুরেই কথা বলছে। মুক্তিবাহিনীর হাতে নিজের ভাড়াটিয়া সৈন্যদের পরাজয়ের কথা স্বীকার করতে লজ্জাবোধ হওয়াতেই হয়তো সে বলে চলছে ভারতীয় সৈন্যরা পূর্ববঙ্গ আক্রমণ করেছে। আর এই কল্পিত অভিযোগ তুলেই জল্লাদ ইয়াহিয়া ভারত আক্রমণের পাঁয়তারা করছে।…

২৯ নভেম্বর, ১৯৭১

ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিারা গান্ধী অবিলম্বে শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তিদান এবং বাংলাদেশ প্রশ্নে একটি রাজনৈতিক সমাধানে পৌছার জন্য পাকিস্তানী জঙ্গীশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খানের প্রতি আহবান জানিয়েছেন। ইয়াহিয়া খানের শুভেচ্ছা বাণীর জবাবে শ্রীমতী গান্ধী পাকিস্তানে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনারের মাধ্যমে তার এই আহবান জানিয়ে দেন।
ভারত সরকারের একজন মুখপাত্র স্বীকার করেন যে, ইয়াহিয়া খান শ্রীমতী গান্ধীর সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হবার প্রস্তাব দিয়েছে। এ ব্যাপারে মুখপাত্রটি বলেন, শ্রীমতী গান্ধী বলেছেন, ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে তিনি বৈঠকে বসতে পারেন। কিন্তু বাংলাদেশ কোন আলোচনার বিষয়বস্তু হতে পারবে না। শ্রীমতী গান্ধীর মতে, তিনি বাংলাদেশের জনগণকে কোন সমাধান মেনে নিতে বলতে পারেন না। কারণ সে অধিকার তার নেই।

<005.005.120>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

এই উপমহাদেশের বর্তমান উত্তেজনাকর পরিবেশের পটভূমিতে বঙ্গবন্ধুর মুক্তিদান এবং বাংলাদেশ ইস্যুর রাজনৈতিক সমাধানের জন্য জেনারেল ইয়াহিয়ার প্রতি শ্রীমতী গান্ধীর এই আহবানের তাৎপর্য অপরিসীম। ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের মধ্যে একটা ভয়াল রক্তক্ষয়ী এ্যাডভেঞ্চার পরিহার করে বাস্তবতার আলোকে বিরাজমান গুরুতর সমস্যা থেকে শান্তিপূর্ণ পরিত্রানের এটাই সম্ভবত বিশেষ মানবিক আহবান। ইয়াহিয়া খান যদি শ্রীমতী গান্ধীর এই ডাকে সাড়া দিতে ব্যর্থ হয়, অনুমান করা অন্যায় হবে না যে, এই উপমহাদেশে উত্তেজনার বারুদস্তুপে জল্লাদী হামলার অগ্নিস্ফুলিঙ্গের সংযোগে, সর্বাত্মক যুদ্ধের দাবানল দাউ দাউ করে জ্বলে উঠবে। আর তার পরিণতি হবে ভয়াবহ।
ইয়াহিয়া খান শুধু মানবেতিহাসের ঘৃণ্যতম জল্লাদই-নয় কুটচক্রান্তের এক ঘৃণিত নায়ক। সে পশ্চিম পাঞ্জাবী শোষক-পুঁজিপতি উপনিবেশবাদী চক্রের ভাড়াটিয়া গোলাম, তাদের স্বার্থরক্ষার জন্য ইয়াহিয়া না করতে পারে এমন কোন কাজ নেই। বাঙালীদের বুকের ওপর দিয়ে ঔপনিবেশিক দুঃশাসনের রথচক্র চালিয়ে যাওয়া অব্যাহত রাখার জন্যই জল্লাদ ইয়াহিয়া বাংলাদেশের বর্বর গণহত্যাযজ্ঞ, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ আর নারী-ধর্ষণের পাশবিক উন্মত্ততায় লিপ্ত হয়েছে। এই জঘন্য উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্যই সে দশ লক্ষ বাঙালীর নরকঙ্কালের ওপর বিচার প্রহসনের মঞ্চ সাজিয়ে মেতে উঠেছে বঙ্গবন্ধুর জীবন নিয়ে রাজনৈতিক জুয়াখেলায়। কাহিনীর এখানেই শেষ নয়। ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে বাংলাদেশে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার পর থেকেই ইয়াহিয়া খান চেষ্টা করে এসেছে বাংলাদেশ ইস্যুকে ভারত-পাকিস্তান বিরোধের চেহারা দিতে। এই উদ্দেশ্যেই সে বারবার ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বৈঠকের প্রস্তাব দিয়েছে। প্রত্যাখাত হয়েও আবার প্রস্তাব দিয়েছে। এই একই উদ্দেশ্যেই জল্লাদ ইয়াহিয়া ইরান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন এবং সর্বশেষ সুইজারল্যাণ্ডের কাছে তথাকথিত ভারত-পাকিস্তান বিরোধ মীমাংসার মধ্যস্থতা করার জন্য ধর্না দিয়েছে। ঈদবানীতে শ্রীমতী গান্ধীর সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হবার জল্লাদী খায়েশেরও আসল উদ্দেশ্য ভারত- পাকিস্তান বিরোধের জগদ্দল পাথরের তলায় চাপা দিয়ে জননী বাংলার স্বাধীনতার স্বপ্ন আর সংগ্রামকে পিষে মারা। পাকিস্তান যদি ভারত আক্রমণ করে তারও পিছনে সক্রিয় এই একই দুরভিসন্ধি। …

১১ ডিসেম্বর, ১৯৭১
ইয়াহিয়ার অপকর্মের দোসর স্বঘোষিত ডেনমার্কের যুবরাজ জুলফিকার আলী ভুট্টো ৮-সদস্যের এক প্রতিনিধিদলের নেতা হিসাবে জাতিসংঘে গিয়েছে। ডেপুটি প্রধানমন্ত্রীর চাকরি পাওয়ার পরপরই ইয়াহিয়া তাকে জাতিসংঘে পাঠিয়েছে তার পক্ষ হয়ে বক্তব্য পেশের জন্য।
ভুট্টো ভাগ্যবান লোক। ইয়াহিয়া জল্লাদ হলেও বেঈমান নয়। সম্ববত সেকারণেই অনেক ঝগড়া-ফ্যাসাদ, মান-অভিমানের পর আবার জল্লাদে-যুবরাজে মিলন ঘটেছে। শেষ পর্যন্ত বঞ্চিত হয়নি ভুট্টো। দীর্ঘদিন পরে ক্ষমতার কাঁচকলাটার টুকরা একটা অংশ হলেও ইয়াহিয়া ভুট্টোর হাতে তুলে দিয়েছে। তাকে পাঠিয়েছে জাতিসংঘে। …
বিগত সাড়ে আট মাসে জল্লাদ ইয়াহিয়া বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্নকে বানচাল করার জন্য যে হিংস্র বর্বরতা, যে পাশবিক গণহত্যা, শাঠ্য-ষড়যন্ত্র আর ছল-চাতুরির তস্করসুলভ অভিযান চালিয়েছে, মানব জাতির ইতিহাসে তার কোন নজির নেই। কিন্তু তবু তার উদ্দেশ্য সফল হয়নি। দশ লক্ষ বাঙালীকে হত্যা করে, এক কোটিকে দেশান্তরী করে, অগণিত জনপদ নিশ্চিহ্ন করে, কারারুদ্ধ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার হুমকি দিয়েও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে বানচাল করতে পারেনি ইয়াহিয়া খান। বরং যতই দিন গেছে, ততই তীব্রতর দুর্জয় দুর্বার হয়ে উঠেছে দুর্ধর্ষ বাঙালী জাতির আক্রমণধারা। মিত্রবাহিনীর সহায়তায় বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা মাতৃভূমিকে সম্পূর্ণভাবে শত্রুমুক্ত করতে চলেছেন। দুশমন বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে তারা দুরন্ত বেগে এগিয়ে চলেছেন শত্রুকবলিত ঢাকার দিকে। বাঙালী জাতি আজ শত্রুমুক্ত বাংলাদেশের দ্বারপ্রান্তে।

<005.005.121>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

কিন্তু এই নিষ্ঠুর বাস্তবকে স্বীকার করে নিতে কষ্ট হচ্ছে ইয়াহিয়া খানের। তাই সে মরিয়া হয়ে উঠেছে শেষরক্ষার জন্য -ধর্না দিয়েছে আমেরিকার দুয়ারে। আমেরিকা এগিয়ে এসেছে খুনী নিক্সনের দোসর জল্লাদ ইয়াহিয়ার পরিত্রাণে। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধবিরতির প্রচেষ্টা চালিয়ে আমেরিকা চাইছে ইয়াহিয়াকে সর্বনাশের চিতাগ্নি থেকে রক্ষা করতে। ইয়াহিয়ার সরকার মানবেতিহাসের ঘৃণ্যতম নরমেধযজ্ঞের নায়ক-এক কলঙ্কিত সরকার। এই সরকারের চেহারাটা বিশ্ববাসীর কাছে এত বেশী ঘৃণাদায়ক যে খোলস বদল ছাড়া ওকালতির ও সাহস পাচ্ছে না নিক্সন। সম্ভবত সে কারণে -ওয়াশিংটনের অদৃশ্য সুতার টানে ইয়াহিয়া নুরুল আমিনকে প্রধানমন্ত্রী আর ভূট্টোকে ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেছে। উদ্দেশ্য : বাঙালী নুরুল আমিন আর সিন্ধী ভূট্টোকে মঞ্চে খাড়া করে বিশ্ববাসীকে ধোঁকা দেয়া যে, পাকিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে-গণপ্রতিনিধিদের নিয়ে সরকার গঠিত হয়েছে। জনগণ পাকিস্তানই চায়-ভারতই পাকিস্তানকে খণ্ডবিখণ্ড করার জন্য পূর্ব বাংলা দখল করার চেষ্টা করছে। কিছুদিন আগে ভূট্টোকে অস্ত্র ভিক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছিল চীনে। এবার তাকেই মৃত পাকিস্তানের সঞ্জীবনী সঙ্গীত গাইবার জন্য পাঠানো হয়েছে জাতিসংঘে। ইয়াহিয়ার বড় আশা, ভূট্টো ব্যারিস্টার, তুখোড় বক্তা-নিশ্চয় সে সবকিছু গুছিয়ে বলে সারা দুনিয়ার মানুষকে ধোঁকা দিতে পারবে।
হায়রে দুরাশা! ইয়াহিয়া হয়তো জানেই না যে, কথার মারপ্যাচে ধোঁকাবাজির দিন বাসি হয়ে গেছে। আসল সত্য, উপমহাদেশের প্রকৃত অবস্থা বিশ্ববাসীর অজানা নয়। তার প্রমাণ বিদেশী পত্র-পত্রিকার রিপোর্টে ও নিবন্ধে।
লণ্ডনের ‘গার্ডিয়ান’ পত্রিকা লিখেছে, চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভিপ্রেত হোক আর না হোক, ধ্বংস আর রক্তপাতের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ আজ এক বাস্তব সত্য হয়ে দেখা দিয়েছে। যদি এরপর আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অতি নাটকীয় কিছু ঘটে তবু বাংলাদেশের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা কোনমতেই সম্ভব হবে না। গার্ডিয়ান আরও বলেছে, ইয়াহিয়া যদি এখন আলোচনায় বসতে চায়, সে আলোচনার মূল বিষয় হবে কি উপায়ে বাংলাদেশ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য ফিরিয়ে নেয়া যায়। আমেরিকার যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব অনেক দেরীতে এসেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের গতিরোধের সময় পার হয়ে গেছে। ‘নিউজউইক’ লিখেছে, পাকিস্তানের মৃত্যুচিৎকারের মধ্যেই ধ্বনিত হয়ে উঠেছে নবজাত বাংলাদেশের প্রথম জন্মধ্বনি। আমাদের আর কিছু বলবার দরকার আছে কি?

১৫ ডিসেম্বর, ১৯৭১
অনিবার্য পতনের মুখে জঙ্গীশাহীর সাম্রাজ্য। বড্ডো প্ৰাণ লাগছে, সাধের উপনিবেশ হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে গালে চড় খেয়ে চোখে সর্ষের ফুল দেখছে। বীরবর জওয়ানরা লড়াই করা তো দূরের কথা, প্রাণের ভয়ে আত্মসমর্পণ করছে মিত্রবাহিনীর কাছে। তবু অবশ্য আশানুরূপ সাড়া এখনো মেলেনি। আজ পর্যন্ত অফিসার এবং জওয়ান মিলিয়ে ৮ হাজার অস্ত্র ফেলে আশ্রয় ভিক্ষা করেছে।
বাংলাদেশকে শ্মশানে পরিণত করার স্বপ্ন যারা দেখেছিল, বাংলাদেশে জুলুমের এবং ত্রাসের রাজত্ব চালিয়ে যারা বাংলাকে শায়েস্তা করতে চেয়েছিল, তারা প্রত্যক্ষভাবে কেউই বাংলার অকুতোভয় মুক্তিবাহিনীর শক্তির সম্যক উপলব্ধি পারেনি, অথবা ঘটনা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয়েও মনকে চোখ ঠেরে সবকিছু ধামচাপা দিতে চাইছিল। পিণ্ডির সদর দফতরে যুদ্ধের ঢেউয়ের আঘাত লেগেছে কিন্তু বাংলার মাটিতে মৃত্যভয়ে ভীতি খানসেনাদের আর্তহাহাকারের কোন শব্দ হয়তো পৌঁছায়নি।
কিন্তু সত্যকে গোপন করে বাস্তবকে অস্বীকার করা যায় না। সেটা বোধগম্য হয়েছে জল্লাদশাহীর অনেক দেরীতে। যুদ্ধরত সৈনিকের আকুল আবেদন পৌঁছেছে রাষ্ট্রসংঘের দরবারে, কিন্তু সে আবেদনের সাড়া দেবার এখতিয়ার নেই রাষ্ট্রসংঘের। বাংলাদেশে জল্লাদবাহিনীর প্রধান লেঃ জেঃ নিয়াজী সমস্ত অনুরোধ-উপরোধ নাকচ

*সংবাদ পর্যালোচনা’র এই কথিকাটি মুস্তাফিজুর রহমান রচিত।

<005.005.122>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

করে মৃত্যুর দিনটি গোনার জন্য তাদের লড়াই চালিয়ে যেতে বলেছেন। মেজর জেঃ রাও ফরমান আলীর সব আবেদন ব্যর্থ হয়ে গেছে।
ভারতের সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল শ্যাম মানেকশ’ বারবার পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে অস্ত্রসংবরণ করে মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন। আর তা না হলে চরম বিপর্যয়ের জন্য তাদের প্রস্তুত থাকতে বলেছেনে। ঢাকা নগরীর ওপর গত রাত থেকে চরম আঘাত হানা শুরু হয়েছে।
জেনারেল নিয়াজী সত্যকে গোপন করার জন্য পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ বা উদ্ধারের পক্ষে সমর্থন জানায়নি। কারণ, উদ্ধারপ্রাপ্ত জীবিত এই সেনাবাহিনী দেশের মাটিতে অর্থাৎ পাকস্তানে ফিরে গেলে সেটা হবে জঙ্গীশাহীর পক্ষে আত্মহত্যার শামিল। বাংলাদেশের সংগ্রামের সামগ্রিক রূপটি উদঘাটিত হয়ে যাবে। আপামর জনসাধারণের কাছে এবং পাকিস্তানের জনসাধারণ এটি স্পষ্টভাবে বুঝতে পারবে যে, তাদেরই বাপ-ভাই-ছেলে বাংলদেশে জঙ্গশাহীর পরিচালিত অন্যায় যুদ্ধের জন্যই মারা গেছে। তাদের মৃত্যু হয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের কাছে গ্লানিকর মৃত্যু। তার ফল হবে মারাত্মক। এবং এরই পরিপ্রেক্ষিতে আজ পাকিস্তানে বিদেশী সংবাদপত্রের প্রবেশ নিষেধ, আকাশবাণী এবং বি-বি-সি শোনা নিষিদ্ধ।
আর এদিকে যাদের ভরসা দিয়ে শক্তির অহমিকা দেখিয়ে একটি অবাস্তব পুতুল সরকার গড়ে তুলল, তাদেরও স্বস্তি নেই। চিরকালের মিথ্যাবাদী, উগ্ৰমস্তিষ্ক ভুট্টোকে তথাকথিত পররাষ্ট্রমন্ত্রী করে পাঠানো হলো জাতিসংঘে। কিন্তু ভাগ্যের কি পরিহাস! সেই উগ্ৰমস্তিষ্কের মাথা এখন ঠাণ্ডা হয়ে গেছে, মিথ্যাবাদীর মুখ দিয়ে সত্য প্রকাশ হয়ে পড়েছে। এতদিনে ভূট্টো স্বীকার করেছে তারা ভুল করেছে এবং ভুট্টোর স্বভাবসিদ্ধ নীতিমাফিক সামরিক জান্তাকে দোষরোপ শুরু করেছে-অন্যায়ের সমস্ত ঝক্কি এখন ঠেলে দিচ্ছে সামরিক জান্তার উপর।
পুতুল সরকারের লোভী, ক্ষমতালিপ্সু পালের গোদাটির যখন এই অবস্থা তখন বাংলাদেশের অবস্থায় পরিবর্তন হয়ে গেছে অনেক। জঙ্গীশাহীর ক্ষমতার ওপর বিশ্বাস করে একটি বালির প্রাসাদ গড়ে তুলেছিল চিরদিনের বাংলার জাতশত্রু পাক দালাল ডাঃ মালিক। পাকিস্তানী সুবেদারের দায়িত্বভার গ্রহণ করে তাঁতের মাকুর মত নিয়াজী এবং ফরমান আলী যাতায়াত করেছিলেন, ঠিক তখনই কলজের ওপর প্রচণ্ড আঘাত হানলো মুক্তিবাহিনী এবং মিত্রবাহিনী। চৈত্যন্যোদয় হলো বাংলার কলংক, জঙ্গীশাহীর পদলেহী তথাকথিত পাকিস্তানী সুবেদার ডাঃ মালিকের। চোখ থেকে এতদিনে গ্যালন গ্যালন জল ঝরতে শুরু করেছে।
ঢাকার গভর্নর হাউসের উপর বোমা এবং কামানোর গোলা নিক্ষেপের সংগে সংগে সন্দেহাতীভাবে পাক প্রতিরোধের পতন অনুধাবন করেছেন ডাঃ মালিক।
আন্তর্জাতিক রেডক্রস সোসাইটির একটি খবরে প্রকাশ, ডাঃ মালিক কাঁপা কাঁপা হাতে তাঁর এবং মন্ত্রী পরিষদের পদত্যাগের কথা ঘোষণা করেছেন। আজ জীবনের শেষপ্রান্তে ডাঃ মালিক নিজের জীবনের চুলচেরা হিসেব করে দেখছেন।
গভর্নর হাউসের বাংকারও আজ নিরাপদ নয়। তাই অতি মূল্যবান নিজের প্রাণটি বাঁচানোর জন্য স্ত্রী-কন্যার হাত ধরে ঢাকা নগরীর নিরপেক্ষ এলাকা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আন্তর্জাতিক রেডক্রস সোসাইটির কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন। গতকাল অর্ধমৃত অবস্থায় পুলিশের প্রধান এম, এম, চৌধুরী উচ্চপদস্থ আরো ১৬ জন সরকারী কর্মচারীকে নিয়ে এখানে আশ্রয় নিয়েছেন। ডাঃ মালিক সপরিবারে আশ্রয় পেয়েছেন অবশ্য। আসামরিক প্রশাসন ব্যবস্থা একেবারে বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত।

<005.005.123>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

ঢাকা নগরী মিত্রবাহিনীর এবং মুক্তিবাহিনীর পদানত না হওয়া পর্যন্ত ডাঃ মালিক সপরিষদ আইউব খানের আমল থেকে আজ পর্যন্ত তাঁর কাজের পর্যালোচনা করুন, হিসেবের খতিয়ান কষে দেখুন।
পাকিস্তানী বাহিনীর সর্বশেষ এবং সূদৃঢ় প্রতিরোধ যে বিপর্যস্ত এবং পতনের মুখে, এটা আজ দিনের আলোর মতোই সুস্পষ্ট। এখন পাকিস্তানী বাহিনীর সম্মুখে দুটি পথ-একটি জেনারেল মানেকশ’র আহবান আহবানে সাড়া দিয়ে আত্মসমর্পণ করা, আর তা না হলে মৃত্যুকে শ্রেয় জেনে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা।

মানুষের মুখ *
১৬ জুন, ১৯৭১
এক টুকরো রুটি
সময় ; উনিশ শ একাত্তের সনের ২৭শে মার্চ স্থানঃ চট্টগ্রামের কোন উপকণ্ঠ। পাকিস্তানী জল্লাদ বাহিনীর নির্বিচার গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে উঠেছে শহরে, বন্দরে, গ্রামে। দানবের সাথে সংগ্রামের তরে প্রস্তুত হয়েছে ঘরে ঘরে আমাদের মুক্তিবাহিনী। সীমান্ত থেকে ছুটে এসেছে ই-পি -আর এবং বেঙ্গল রেজিমেন্টের জওয়ানরা। দলে দলে ওরা এসেছে রামগড়া রাঙামাটি আসলং কিংবা হরিণা থেকে। শ্রান্ত, ক্লান্ত অথচ উদ্দীপ্ত ঐ জওয়ানদের অন্তত একরাত্রির আহার ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। তারপর কাল ভোর থেকে ওরা অবরোধ শুরু করবে ক্যান্টনমেন্টে। সুতরাং যত শীঘ্র সম্ভব ঐ দেড়শ জওয়ানের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা প্রয়োজন।
না, অসুবিধা মোটেই হল না। থাকার ব্যবস্থার জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তালা খুলে দেয়া হল। খাবারের কথা গ্রামে পৌঁছতেই বাড়ি বাড়ি থেকে গরম ভাত-তরকারি চলে এল। মাত্র একঘণ্টার মধ্যেই নবাগত মেহমানদের জন্যে স্বতঃস্ফূর্ত খাবার এল অঢেল পরিমাণে।
যুদ্ধের সময়ে খাদ্য সরবরাহ একটি গুরত্বপূর্ণ ব্যাপার। স্থানীয় যুবকবৃন্দ এ বিষয়ের সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিয়ে একটি কমিটি করে ফেললেন। খবর এল, রাতেই আরও নতুন জওয়ান পৌছে যাবে ওখানে। মোট আড়াই শ’ লোকের ব্যবস্থা করে ফেলতে হবে। জনগণের মধ্যে উদ্দীপনা থাকলেও নিয়মিত কার্যসূচী চালিয়ে যাওয়া নিতান্ত সাধারণ কথা নয়।
ভোর বেলাতেই বস্তা বস্তা চাল এসে পৌঁছলো মুক্তিযুদ্ধের স্থানীয় দফতরে। গ্রামের একজন অবস্থাপন্ন ভদ্রলোক দু’টো দশাসই ছাগল নিয়ে এলেন। ওগুলো যুদ্ধকর্মীর হাতে তুলে দিয়ে বললেন, আগমী ঈদে কোরবানী দেব ভেবেছিলাম। সে সুযোগ আর জীবনে আসবে কিনা জানি না। ছাগল দুটো দিয়েই খালাস পেলাম ভাববেন না। প্রয়োজন হলে নিজেকেও কোরবানী দিতে কসুর করব না।
শুধু চাল আর ছাগল নয়। আরও এল তরিতরকারি, লাউ-কুমড়ো, গুড়ো মশলা ইত্যাদি। অনেকে পাক করে আনলেন ভাজা কিংবা সেদ্ধ ডিম। সেসব যথাযথভাবে রাখতে হিমশিম খেয়ে উঠলেন তিরিশজন কর্মী।

* ‘মানুষের মুখ’ শীর্ষক ধারাবাহিক কথিকাগুলি কামাল মাহবুব’ ছদ্মনামে মাহবুব তালুকদার রচিত।

<005.005.124>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

একাশি বছরের বৃদ্ধ সাদেক আলী লাঠীতে ভর দিয়ে যখন এসে পৌঁছালেন তখন সকাল আটটা। গভীর মমত্ববোধে তাকিয়ে রইলেন জওয়ানদের মুখের দিকে। শীর্ণ হাতে ধরে থাকা একটা কলাপাতার ঠোঙা। ওটার মোড়ক খুলে বেরুল এক টুকরো রুটি।
বৃদ্ধ একজন জওয়ানের দিকে এগিয়ে দিতে যাচ্ছিলেন ঠোঙাটি। দেখতে পেয়ে জনৈক কর্মী ছুটে এলেন। বললেন কিছু দিতে হলে আমাকে দিন। ভদ্রলোক রুটির টুকরোটি এগিয়ে দিলেন কর্মীটির দিকে। বললেন, আমি গরীব মানুষ। এক টুকরো রুটি দেয়া ছাড়া আমার আর সাধ্য নেই বাবা। বয়স কম হলে যুদ্ধে যেতাম। কিন্তু আল্লাহ সে সৌভাগ্যও কপালে রাখেননি।
আপনি কোথেকে এসেছেন? কর্মীটি সহনুভূতির স্বরে জিজ্ঞেস করলেন। গ্রামের নাম বললেন বৃদ্ধ। আত্মপরিচয়ও দিলেন, ‘আমি গ্রামের প্রাইমারী স্কুলে শিক্ষকতাও করেছি। এখন আর কিছু করে খাবার সাধ্য আমার নেই’। ‘কিন্তু আপনি দেড় মাইল পথ হেঁটে রুটি বয়ে আনলেন, কষ্ট তো আর – বাধা দিয়ে বৃদ্ধ বললেন, ‘আমার এতগুলো ছেলে দেশের জন্য প্রাণ দেবে, আর আমার হবে কষ্ট?’ একটু যেন উষ্ণতা তাঁর কণ্ঠে। ভদ্রলোক বিশেষ অপেক্ষা না করে চলে গেলেন।
এক টুকরো রুটি নিয়ে যুদ্ধ কর্মীটিকে যথেষ্ট অসুবিধেয় পড়তে হল। সকালের টিফিন-সবারই খাওয়া হয়ে গেছে। রুটিটা তাহলে কি করা যায়? এমনিতর রুটি তখন পর্যন্ত আর আসেনি, সুতরাং ওটাকে আলাদা রাখতে হবে এবং এক টুকরো রুটির জন্যে আলাদা ব্যবস্থার প্রয়োজন। কর্মীটি মনে মনে বিড়ম্বনা বোধ করলেন।
বেঙ্গল রেজিমেন্টের এক সুবেদার সাহেব তাঁর প্লাটুন নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন অপারেশনের জন্যে। কর্মীটি তাঁর দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল, এটা খেয়ে নিন তো?
আমার নাস্তা সারা হয়েছে। সুবেদার বললেন, এখন এটা দিয়ে কি করব?
কর্মীটি ম্লান মুখে বললেন, আমার রাখার অসুবিধা হচ্ছে। একজন অনেক কষ্ট করে রুটিটা নিয়ে এসেছেন। সুতরাং কোনদিকে ফেলে রাখতেও মন চাইছে না।
দিন তাহলে আমাকে, সুবেদার সাহেব হাত বাড়িয়ে রুটির টুকরোটি নিলেন। তারপর ওটা কাগজে মুড়িয়ে প্যান্টের পেছন-পকেটে ভরে রেখে দিলেন।
ঘটনাটা এখানেই শেষ হতে পারতো। কিন্তু তা হল না। দুদিন পর্যন্ত কোন খোঁজ পাওয়া গেল না সুবেদার সাহেবের। শোনা গেল, যুদ্ধ করতে করতে সুবেদার সাহেব ক্যান্টনমেন্টের কাছাকাছি চলে গিয়েছেন, বিস্তর পাক সৈন্যকে খতম করেছে ওঁদের দলটি। গড়পড়তায় এক-একজন মুক্তিযোদ্ধা তিনজন পাকিস্তানীর প্রাণ নিয়েছে। কিন্তু সুবেদার সাহেব বেঁচে আছেন কিনা কে জানে!
হ্যাঁ, বেঁচেছিলেন সুবেদার সাহেব। তিনদিন পরে যখন ফিরলেন তখন তাঁকে দেখে মনে হল, কয়লার খনি থেকে এইমাত্র বেরিয়ে এসেছেন যেন, দুচোখ ভরে কালি পড়েছে। শ্রান্তি আর ক্লান্তির প্রলেপ পড়েছে মুখে।
কিন্তু সুবেদার সাহেব কাকে যেন খুঁজছেন। পেয়েও গেলেন এক সময়। সেই যুদ্ধ কর্মীটিকে সামনে দেখে হাত চেপে ধরলেন তার বললেন, আপনি আমার খুব উপকার করেছেন।
আ-আমি! অপ্রস্তুত হলেন কর্মীটি।

<005.005.125>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
আপনি সেদিন রুটিখানা না দিলে কি যে হত? উপোস করার অভ্যেস অবশ্য আছে। কিন্তু যুদ্ধের জন্যে যে তাকদ দরকার ঐ রুটিখানাই তা আমাকে দিয়েছিল। আপনি ওটা না দিলে-
কর্মীটি বাধা দিয়ে বললেন-সেই বৃদ্ধ ভদ্রলোককে স্মরণ করুন ঐ এক টুকরো রুটি যে সময় বিশেষে এত মূল্যবান হয়ে উঠবে, তাতো আমি জানতাম না। বৃদ্ধ ভদ্রলোক বোধকরি জানতেন।
দুজনেই মাটির দিকে তাকালেন। দুজনের অভিভূত মনে একজন বৃদ্ধের মুখচ্ছবি। একজনের মনে বাস্তব, আর একজনা তাঁকে দেখেননি বলে ছবিটি কাল্পনিক। কিন্তু আর একটা ছবি ওদের সামনে স্পষ্ট। দুজনের চোখের সামনেই অতি সাধারণ এক টুকরো রুটি।
২৭ জুন, ১৯৭১
স্বাতীর যুদ্ধ
স্বাতী। বয়েস সাড়ে পাঁচ। পেশা-ঘরকান্নার কাজে মাকে টুকিটাকি সাহায্য করা, আব্বু বাড়ী ফিরলে দরজা খুলে দেয়া, ছোট বোনটিকে যাবতীয় পার্থিব বিষয়ে উপদেশ দান। ইস্কুলের পড়াশুনা এখনও ওর শুরু হয়নি, বাসায় প্রথম পাঠের অনেক দূর এগিয়ে গেছে। বাংলাদেশের হাজার মেয়ের মত সাড়ে পাঁচ বছরের ছোট্ট স্বাতী এখন যুদ্ধ করছে।
ওর বাবা ছিলেন অধ্যাপক। আর অধ্যাপক মানেই জল্লাদ ইয়াহিয়া বাহিনীর পয়লা নম্বরের শক্র। ওদের চোখে শিক্ষা ও শিক্ষকতা মারাত্মক অপরাধ। মানুষের বুদ্ধি, মেধা প্রভৃতি আণবিক বিস্ফোরকের চাইতেও মারাত্মক; ফলে কুচক্রী পাশব শক্তির ষড়যন্ত্রে ওদের ছোট্ট সংসারেও নাড়া পড়ল। সংসারের সাজানো বাগান পেছনে ফেলে ওদের এগিয়ে যেতে হলো অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে।
প্রথম বাড়ি থেকে বেরিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল একটি স্কুলের ছাত্রাবাসে। দিন দশেকের মধ্যে ওখান থেকে সরে যেতে হলো গ্রামের আরো অভ্যন্তরে, তারপর আরও ভেতরে যেখানে আদি অকৃত্রিম পা ছাড়া বিংশ শতাব্দীর কোন যানবাহন চলে না। চিরকালের পরিবেশ ত্যাগ করে সম্পূর্ণ নতুন করে নতুন এক পরিবেশে এসে দাঁড়াল ক্ষুদে পরিবারটি। হাতের সম্বল বলতে সামান্য কিছু টাকা- স্বাভাবিক অবস্থায় যাতে পনের থেকে বিশ দিন অব্দি চলে। এখন ঐ টাকায় অনির্দিষ্টকাল চালাতে হবে। প্রথম দিকে আলুভর্তা, ডাল আর দুবেলা ভাত বরাদ্দ রইল, কিন্তু ওতে মুখ ঘুরিয়ে রইল স্বাতী। বল্লো, আমি নাশতা খাবো। আমার বড়ো খিদে লাগে।
ওর মা এসে মাথায় হাত বুলালেন, নাশতা এখন কোথায় পাব মামণি? এখন তো যুদ্ধ চলছে। সাবাইকে তাই কষ্ট করতে হচ্ছে। আমরা যুদ্ধ করছি? স্বাতীর মুখের রেখা পালটে গেলো সহসা। ওর চোখে-মুখে ঔজ্জ্বলতার ছোঁয়া লাগল। কণ্ঠ নামিয়ে বল্লো, ভূট্টো খুব পাঁজী, খুব শয়তান। আর শেখ মুজিব কতো ভাল, না আম্মু?
আম্মু মাথা নাড়লেন।
এরপর স্বাতীই সংসারের সব সমস্যার সমাধান করে ফেলল। ওর আব্বুর পরনের একমাত্র লুঙ্গিটা ছিড়ে এসেছিল কিন্তু কেনা হচ্ছিল না। স্বাতীর মাও কবার বলেছেন আর একটা কিনে ফেলতে। কিন্তু পয়সার অভাব তখনকার জন্যে নিদারুণ সত্য। স্বাতী বল্লো, যুদ্ধ থামলে তোমাকে একটা ভালো লুঙ্গি কিনে দেব আব্বু।
এ কথার পর যথাশীঘ্ৰ লুঙ্গি কেনার ব্যাপারে ওর মায়ের চাপ কার্যকরী হলো না। ওর বাবা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।

<005.005.126>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

স্বাতীর ছোট বোনটির অনেকগুলো হবি। তার মধ্যে অন্যতম কান্না। কিছু একটা হাতের মুঠোয় পায়নি বলে হঠাৎ সেদিন কান্নায় প্লাবন বইয়ে দিল। বোনের রকম-সকম দেখে স্বাতী ভারি খাপ্পা। বোনকে রীতিমতো শাসাল সে, কতবার বলছি এখন যুদ্ধ হচ্ছে। খবরদার তুমি কান্নাকাটি করবে না। কাঁদলে মিলিটারি বুঝে ফেলবে আমরা এখানে আছি। আব্বুকে তখন ধরে নিয়ে যাবে।
তারপর আব্বুর কানের কাছে মুখ লাগিয়ে বল্লো! আব্বু তুমি যে প্রফেসর তা কিন্তু কাউকে বলো না। তুমি যদি কিছু না বল, তাহলে তোমাকে কেউ চিনতেই পারবে না, আবার যুদ্ধ করে আমাদের জয় হলে তখন তুমি প্রফেসর বলবে।
ওদের বাসস্থানের তিন-চার মাইলের মধ্যেই গোলাগুলির শব্দ শোনা যেত। ততদিনে স্বাতী চিনে ফেলেছে কোনটি মেশিনগানের শব্দ আর কোনটা শেল। বেশী আর অনেকক্ষণ ধরে শব্দ হলে বুঝত পাকিস্তানীদের আওয়াজ, অন্যদিকে পাশাপাশি কম শব্দ হলেই বুঝতে পারতো বাঙালীদের গোলাগুলির শব্দ। সাড়ে পাঁচ বছরের স্বাতী যুদ্ধের অনেক কথাই শিখে ফেলেছিল।
এইটা মেশিনগানের শব্দ, না আব্বু? দূরের শব্দ শুনে স্বাতী বলতো। কখনো ছোট বোনকে ধমকে দিয়ে বলতো, তুমি কিছু বোঝ না। খালি বিস্কুট খেতে চাও। যুদ্ধের সময় কি বিস্কুট পাওয়া যায়।
কান্নাকাটি থামিয়ে ছোট বোনটি তখন ফ্যালফ্যাল করে তাকাত ওর দিকে। আম্মু ও আব্বু দুজনেই তাকাতেন। তখন ভবিষ্যতের অনেক পরিকল্পনায় মুখর হতো স্বাতী ; আমাকে আর ছোট বোনকে দুটো শাড়ি কিনে দিয়ো যুদ্ধ থামলে। আমরা না একদিন পোলাও খাব তখন! তখন তো তুমি আবার মাইনে পাবে। আমাদের সাইকেলে চড়ে আবার বিকেলে বেড়াতে যাব। আচ্ছা আব্বু আমাদের অত সুন্দর বাড়ীটা মিলিটারীরা নিয়ে গ্যাছে? তোমার বইগুলো ওরা নষ্ট করেছে? এসব কথা শুনে ওর আব্বুকে মুখ ফিরিয়ে থাকতে হতো, ছল ছল করতো ওর মায়ের চোখ। আশ্চর্য, এসব মোটেই বিষাদ-বেদনা জড়াতো না ওর কণ্ঠে। স্বাভাবিক সহজভাবে বলতো সব কথা। যুদ্ধক্ষেত্রের একজন সৈনিক যেমন জীবনের সকল অস্বাভাবিকতা দূর করে পৃথিবীর নির্মমতম সত্যটিকে হাতের মুঠোয় রাইফেল তুলে দাঁড়ায়, তেমনি ওদের ছোট্ট সংসারে বাস্তবের কঠিন সত্যতার মুখোমুখি দাঁড়াবার জন্য প্রেরণা যোগাত সে।
একদিন বিকেলে দিঘীর পাড়ে আব্বুর সাথে বসে ছিল স্বাতী। চুপচাপ বসে মেশিনগানের শব্দ শুনছিল। হঠাৎ প্রশ্ন করল সে , আব্বু যুদ্ধ কেন হয়?
এ প্রশ্নের উত্তর ওর আব্বুর অজানা-কি উত্তর হতে পারে এই অবোধ সরল শিশুর ক্ষুদ্র প্রশ্নটির? মানুষ মারার কারিগর ইয়াহিয়া খান! আপনি কি পারবেন এ প্রশ্নের জবাব দিতে? বাংলাদেশের মানুষের উপর কেন যুদ্ধ চাপিয়ে দিলেন আপনি? কি স্বার্থ রক্ষা করলেন নিরীহ লক্ষ লক্ষ আবাল-বৃদ্ধ-বনিতাকে নির্বিচারে হত্যা করে? আপনি তো পাকিস্তানের অখণ্ডতা চেয়েছিলেন; সেনাবাহিনীর পশুত্ব লেলিয়ে রাষ্ট্রীয় সংহতিকে নিহত করল কে? ইতিহাসের পাতায় একদিন পাকিস্তানের প্রথম শত্রু ইয়াহিয়ার কলঙ্কিত নামে সিন্ধু-বেলুচিস্তানের মানুষও থুতু ছিটাবে। আর বাংলাদেশের মানুষের কাছে প্রবাদে রূপ লাভ করবে এই কথাটির : বিশ্বাসঘাতকতার অন্য নাম ইয়াহিয়া খান।
কিন্তু স্বাতীর কথায় আসি। দিঘীর কালো জলের দর্পণে মুখ রেখে স্বাতী বলেছিল ; আমাদের পেলেন থাকলে বেশ হতো।
পেলেন দিয়ে কি হবে? অন্যমনস্ক আৰু প্রশ্ন করেছিলেন।

<005.005.127>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

শান্ত ধীর কণ্ঠে স্বাতী বলেছিল, তাহলে পেলেনে বসে আমরা মেশিনগান দিয়ে ওদের মারতাম। আমাদের অনেক বন্দুক থাকলে মিলিটারীরা আমাদের সাথে পারত না।
হ্যাঁ মা-ওর আব্বু বলেছিলেন, আমদের হীরের টুকরো ছেলেরা সব অশ্বমেধের বলী হয়ে গ্যালো। অস্ত্র হাতে থাকলে তা হতো না।
স্বাতী কি বুঝেছিলে কে জানে! আব্বুর হাত ধরে ঘরের দিকে পা বাড়িয়ে বলেছিল, ওরা আমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে পারবে না।
ওর আব্বুকে উত্তর দিতে হয়নি। বাংলাদেশের মানুষ বুকের রক্ত ঢেলে এর উত্তর লিখেছে রাঙ্গামাটির প্রান্তরে। সত্যি, ওরা আমাদের সাথে যুদ্ধ করে পারবে না। জল্লাদ বাহিনীর কয়েক লক্ষ নিয়মিত সৈন্য ছাড়া আর কি আছে? হৃদয়হীন পাশব শক্তির উল্লাস ছাড়া ওদের অস্ত্রের আর কোন ভাষা নেই।
আর বাংলার মাটির দুর্বার ঘাঁটিতে প্রত্যেকে সৈনিক আজ, প্রত্যেকে সৈনিক’। ওরা কি করে এ যুদ্ধে জিতবে? আমাদের মুক্তিফৌজের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে সাড়ে পাঁচ বছরের স্বাতী সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর মুক্তির জন্য যুদ্ধ করে। ওরা কি করে এ যুদ্ধে জিতবে?
স্বাতী কেবল একটি মেয়ের নাম নয়, এদেশের অগণিত শিশু মেয়েদের নাম- সে স্বাতী জাতির অন্ধকার আকাশে ধ্রুবতারার মতো সংগ্রামী জনতাকে পথ দেখায়, যে স্বাতী রাতের অন্তিমে আসন্ন সূর্যোদয়ের আহবান জানাতে ঘন অন্ধকারেও প্রাণের আলো জেলে রাখে।
“কলিজার রক্তে ভেজা মুহুর্তেই সে মুক্তি মহিমা
আকাশ, তোমারে ভাঙ্গে সীমা!”
৩ জুলাই, ১৯৭১
দেশের শক্ৰ
ছেলেটির বয়স ষোল কিংবা সতেরো। মুখের আদলটি কিন্তু আরও কচি। দেখতে চৌকস। এস-এস-সি পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছিল দুটো লেটার নিয়ে। কলেজের ছাত্র ছিল ঢাকায়। মুক্তিফৌজের দফতরে এসে বলল, আমি গেরিলা যুদ্ধে নাম লেখাব।
তুমি এত দেরী করে এলে কেন? প্রাথমিক তদন্তকারী অফিসার জিজ্ঞেস করলেন।
কি করব? আব্বা দিচ্ছিলেন না কিছুটা উষ্মা ও ক্ষোভ ছেলেটির কণ্ঠে।
তোমার বয়সী ছেলেরা অনেকেই বাবার মতামতের অপেক্ষা করেনি। তদন্তকারী অফিসার বল্লেন।
জানি, একটু বিরক্তির স্বর ছেলেটির কণ্ঠে। বলল, কিন্তু ঘরের দরজা বন্ধ করে আটকে রাখলে আপনি কি করবেন?
তাহলে কি করে এলে? এবারে কৌতুহলের স্বর অফিসারের কণ্ঠে।
অনশন করে। তিনদিন যখন না খেয়ে রইলাম, তখন মা-কে দরজার তালা খুলে দিতে হলো।
মা অবিশ্য আব্বার ভয়ে কিছু বলতে পারেননি, নইলে আটকে রাখার মত মহিলা নন।
তোমার বাবাই বা আটকালেন কেন?

<005.005.128>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

বাবার কথা বলবেন না, সে পরে বলব, আমি আবার একটু ভদ্র ছেলে ছিলাম কিনা, মুক্তিফৌজে যোগদান করব ভেবে বিদায় চাইতে গিয়েছিলাম। অফিসার ভদ্রলোক অন্য প্রসঙ্গ তুল্লেন, বল্লেন-ঢাকার কি খবর বলো।
সবাই স্বাধীন বাংলা বেতার শুনছে, ঐ যে “পরমপত্র’ বলে অনুষ্ঠানটা-দারুণ পপুলার। আচ্ছা বলুন না ভদ্রলোক কি এই ক্যাম্পে থাকনে? আমি দেখব।
পাকিস্তানী বেতার লোকে শোনে না তাহলে?
শোনে মাঝে-মধ্যে, তবে স্বাধীন বাংলা না থাকলে ভারতীয় বেতারই শোনে বেশী। বিশেষ করে রাত সাড়ে দশটার সংবাদ পরিক্রমা।
ব্যাস! এবার বলো ঢাকার মুক্তিসেনার গেরিলারা কেমন কাজ করছে?
করছে বেশ ভাল, কয়েকটি তো ঘুঘু লোককে সাবাড় করে দিয়েছে। তবে টপ লীগার ফিগারগুলোর মাথায় মিলিটারী ছাতা ধরা কিনা, ঝড়-বৃষ্টি এখনও এদের গায়ে লাগেনি, দুচারটে বাজ ফেলতে পারলে কাজ হবে।
এরপর ছেলেটাকে তার ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ জিজ্ঞেস করা হলো। ওর নাম মোরশেদ। ঢাকার এক অভিজাত এলাকায় ওদের বাড়ি। ওদের এলাকায় একটি লিষ্ট তৈরি করে মিলিটারিরা লোকজন ধরছে। বিশেষ করে কম বয়সী ছেলেদের। ওর জন্য অবশ্য বিশেষ ভয় ছিল না। ও বরাবরই একজন গুড বয়। বাংলাদেশের আন্দোলন সম্পর্কে ওর সচেতনতা নিজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। ২৫শে মার্চের পরের ঘটনা ওকে দারুণভাবে প্রভাবন্বিত করে। তারপরই মুক্তিযুদ্ধে নাম লেখাবে বলে ঠিক করেছে।
তদন্ত ও অন্যান্য কাজ শেষ হলে মোরশেদকে মুক্তিযুদ্ধে ভর্তি করে ট্রেনিং সেন্টারে পাঠান হল। এতদিনে ওর সকল স্বপ্ন যেন সার্থক হয়েছে। সেই সফলতার ছাপ লাগল ওর চোখে -মুখে।
ওদের ট্রেনিং ক্যাম্পের এক অফিসারের উপর ভার পড়েছিল একটি লিষ্ট তৈরি করবার, তাতে পাকিস্তানী সৈন্য বাহিনীর সাহায্যকারী দালালদের নাম সংকলিত করে ওদের খতম করার জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের নির্দেশ দান ছিল অফিসারটির কাজ। দুজন বন্ধুকে নিয়ে মোরশেদ ঢাকা থেকে নবাগত বলে উনি ওর সাথে আলাপ করছিলেন।
আপনি কি শত্রুদের লিষ্ট করেন? মোরশেদ এক সময় তাঁকে প্রশ্ন করল।
কেন? অফিসারটি এহেন প্রশ্নের জন্য বোধ করি প্রস্তুত ছিলেন না।
আমি আপনাকে একটা নাম দেব। মোরশেদ বলল।
সবার কাছে সব সময়ে অবশ্য নাম নেওয়া হয় না। নির্দিষ্ট কোন ব্যক্তি সম্পর্কে যদি শত্রুতার উপযুক্ত প্রমাণাদি পাওয়া যায়, তবেই তার নাম তালিকায় রাখা হয়।
আমি কিন্তু সত্যি সত্যি একজন শত্রুর নাম আপনাকে বলতে পারি, মোরশেদ জানালো।
কিন্তু, সে তো সত্যিকার শত্রু না-ও হতে পারে। আসলে একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি না বল্লে ঠিক বোঝা যায় না কে কোন ধরনের শক্র । অনেকে ব্যক্তিগত শত্রুতার জন্যও আমাদের কাছে একজনের নাম দিয়ে বসতে পারে। এই বিষয়ে আমাদের খুব সতর্ক থাকতে হয়।

<005.005.129>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

ব্যক্তিগত শত্রু হলেই দেশের শত্রু হবে এমন কি কথা আছে? দেশের শত্রু মানে দেশের শত্রুই।
কিন্তু সেটা তুমি কিভাবে বিচার করবে। এমন তো হতে পারে যে, তুমি যাকে শত্রুভাবছ, চরম মূল্য দেবার মতো শত্রু সে নয়।
আমি তাকে ভাল করেই চিনি। তিনি যে দেশের জন্য ক্ষতিকর কাজ করেছেন, সে সম্পর্কেও কোনরকম সন্দেহ নেই। মোরশেদ বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে বল্লো কথাগুলো। সব অভিযোগ খুলে বল্লো।
কি নাম তার বলো। অফিসারটি কাগজ-কলম নিলেন। বল্লেন, যাচাই করে অভিযোগ যদি সত্য প্রমাণিত হয়, তাহলে উপযুক্ত ব্যবস্থাই নিতে হবে। এবারে অকস্মাৎ স্নান হয়ে উঠল মোরশেদের মুখ। চোখের সমস্ত উজ্জ্বল্য যেন নিভে গেলো, শীতল কণ্ঠস্বরে বল্লো-আমি একটা কথা বলতে চাই এ সম্পর্কে।
কি কথা? ধরুন তাকে না মেরে বন্দী করে নিয়ে আসা যায় না?
সেসব আমরা দেখব। তোমার ভাবনার কারণ নেই।
তাকে যদি বন্দী করে রাখা যায় তো সবচেয়ে ভাল।
বল্লাম তো! সে আমরা দেখব, অফিসারটি ওর চোখ-মুখের ওপর দৃষ্টি ফেলেই হঠাৎ থমকে গেলেন, বল্লেন, লোকটির প্রতি তোমার দুর্বলতা আছে মনে হয়; কিন্তু ওর কাজের বর্ণনা শুনে কিন্তু তার প্রতি কোন দুর্বলতা থাকার কথা নয়।
মোরশেদ চুপ করে রইল, কিছু বল্লো না।
কথা বলছো না কেন? অফিসার ভদ্রলোক সহানুভূতির সাথে জিজ্ঞেস করলেন।
উনি আমার আববা, মোরশেদ বল্লো। ওর দুচোখের পাতা ভিজে উঠছে।
না! মোরশেদের আববার নামটি শেষ পর্যন্ত শত্রুর তালিকায় উঠাতে পারেন নি অফিসার। ঐ তালিকায় নাম থাকার একটিমাত্র অর্থ, তা হচ্ছে মৃত্যু। গেরিলা যুদ্ধের প্রথম সারিতে দাঁড়িয়ে মোরশেদ এখন দিগ্বিজয়ের মতো একটির পর একটি দেশের শত্রুকে খতম করছে। ওর মতো একটি ছেলের শুধুমাত্র জনক হয়ে মোরশেদের বাবা তার জীবনের মূল্য পরিশোধ করেছেন। জনাব আফতাব আলী সাহব-ঐ হীরের টুকরো সন্তানের ত্যাগ ও দেশপ্রেমের কথা স্মরণ করে নিজেকে আপনি সংশোধন করবেন না কি?

<005.005.130>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

প্রতিনিধি কণ্ঠ*
১৯শে জুলাই, ১৯৭১
… টিক্কা-হামিদ, ভূট্টু-মওদুদী চক্র পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী সেনাপতি ইয়াহিয়াকে বলিলেন, “আলোচনার প্রয়োজন নাই, আলোচনা দ্বারা বাঙালীকে ঠাণ্ড করা যাইবে না। সেনাবাহিনী প্রস্তুত, হুকুম পাইলেই ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বাঙালী জাতিটাকে চিরদিনের জন্য হুকুমের গোলাম বানাইয়া দিতে পারি।” হুকুম মিলিয়া গেল। রাতের অন্ধকারে পরিকল্পনা মোতাবেক আধুনিক অস্ত্র সজ্জিত হইয়া ইয়াহিয়ার জল্লাদ বাহিনী নারী শিশু জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে ১০ লক্ষ বাঙালীকে খুন করিল। নগর, বন্দর, গ্রাম, জনপদ, স্কুল, মাদ্রাসা, মসজিদ, মন্দির, কারখানা, পত্রিকা অফিস সবই এই কসাইরা অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠনের মাধ্যমে ধ্বংস করিতে লাগিল। ইহারা বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করিল। বাঙালী জাতি এই দানবীয় হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে জল্লাদদের হাত হইতে অস্ত্র কাড়িয়া লইয়া রুখিয়া দাড়াইল। বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করিল। কসাইদের অত্যাচার ও লুণ্ঠনের কারণে ৬০ লক্ষ বাঙালী হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খৃষ্টান প্রতিবেশী ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করিতে বাধ্য হইল। মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করিয়া ইয়াহিয়ার নিয়মিত জল্লাদ বাহিনীতে যখন টান পড়িল, তখন পশ্চিম পাকিস্তান হইতে অনিয়মিত বাহিনী আমদানী করা হইল। বঙ্গ শার্দুলদের সঙ্গে যুদ্ধ করিয়া যদি বলা হয় ইয়াহিয়া-টিক্কার হানাদার বাহিনী খতম হইয়াছে, তাহা হইলে অত্যুক্তি হইবে না। আমরা যাহারা অসীম সাহসী মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত আছি তাহারা দেখিয়াছি বাংলার সংগ্রামী জনতা ও মুক্তিবাহিনীর নাম শুনলে কিভাবে এই হানাদার বাহিনী প্রাণ লইয়া দৌড়ায়। মার খাইতে খাইতে ইহারা এখন মুক্তিযোদ্ধাদের সামনে আসিতে নারাজ। অপরপক্ষে এই পশুবাহিনী নিরীহ গ্রামবাসীর উপর অত্যাচার চালাইয়া প্রতিশোধ লইতে চাহিতেছে। এই প্রসঙ্গে দুই-একটি জেলার যুদ্ধ প্রসঙ্গ উল্লেখ করিতে চাই। তাহা হইতে বিশ্ববাসী বুঝিতে পারবেন প্রকৃত অবস্থা কি। একমাত্র নোয়াখালী জেলার শুভপুর, ছাগলনাইয়া, বান্ধুয়া, মুন্সিরহাট, পরশুরাম, রথি ইত্যাদি স্থানের সম্মুখযুদ্ধে হানাদার বাহিনীর তিন হাজারের উপর সৈন্য নিহত হইয়াছে। গেরিলাদের আক্রমণে এই জিলার পেনাঘাটা, চন্দ্রগঞ্জ, লক্ষ্মীপুর, মাদাসা ব্রীজের নিকট, বগাদিয়া , আলোরপাড়া, কাঠালিয়া, পারপাড়া, পাঠাননগড় ইত্যাদি স্থানে কর্নেল, মেজর, ক্যাপ্টেন, জে-সি-ও ইত্যাদি অফিসার সহ এক হাজারের উপর হানাদার বাহিনী নিহত হইয়াছে। আহতের সংখ্যা নিহতের সংখ্যার দ্বিগুণ হইবে। পার্শ্ববর্তী কুমিল্লা জিলার শত্রুর অবস্থা আরও শোচনীয়। কুমিল্লা হইতে ফেনী পর্যন্ত হাইওয়ে রাস্তার দুই পার্শ্বে মিয়ার বাজার, চৌদ্দগ্রাম, জগন্নাথ দিঘী এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া, শালদা নদী, কসবা, আখাউড়া, গঙ্গাসাগর ইত্যাদি রণাঙ্গন হানাদার বাহিনীর গোরস্থানে পরিণত হইয়াছে। মুক্তিবাহিনীর সাথে গ্রামবাসী একত্র হইয়া যোগাযোগ ব্যবস্থা বানচাল করিয়া দিয়াছে। গেরিলা যুদ্ধ সম্বন্ধে নোয়াখালীর এক গ্রামবাসীর মন্তব্য এখানে উল্লেখ করিতে চাই। তাহারা পিতা-পুত্র দুইজনে শক্র যাতায়াতের রাস্তার পার্শ্বের জমিতে ইরি ধান কাটিতেছিল। এমন সময় মাইন বিস্ফোরণ ঘটিয়া শত্রু সৈন্যসহ দুইখানা ট্রাক ধ্বংস হইয়া যায়। পরের দিন গ্রামবাসীরা তাদের নিকট ঘটনার বিষয় জানিতে জড়ো হয়। তখন বৃদ্ধ বলিতে থাকেন, “যুদ্ধের কথা শুনিয়াছি, এইবার আল্লাহ তাহা দেখাইয়াছে। কামান-বন্দুকের কথা শুনিয়াছি কিন্তু গতকল্য যাহা দেখিয়াছি তাহা আল্লার গজব ছাড়া আর কিছু নহে। এই পাঞ্জাবী পশুরা নিরীহ গ্রামবাসী মা-বোনের উপর অকথ্য অত্যাচার করিয়াছে, শরিয়ত বিরোধী কার্যে লিপ্ত হইয়াছে। তাই আল্লাহ তায়ালা এই গজবিয়াগো উরফে এক্কারে নারাজ অই গ্যাছে। নইলে কওচেন, হিগুন যাওন লাগছিল রাস্তার হরদি গাড়ী চালাইয়া, আচমবিৎ মাটির তলেতুন আওয়াজ করে কি একটা বারঅই হিগুনরে কিল্লাই ধ্বংস কল্লো! ইয়াতুন আর মনে অইচে ইগুনের উরফে আল্লার গজব নাজিল অইচে। আল্লা মজিবের উরফে রাজী অই গ্যাছে। মজিব এই যুদ্ধে জিতবো। নইলে আল্লার কিতাব মিইছা।”……
(নূরুল হক, এম-এন-এ)

*জাতীয় সংসদ সদশ্যের বক্তৃতামালা থেকে সংগৃহীত

<005.005.131>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

৫ আগষ্ট, ১৯৭১
প্রিয় ভাই বোনেরা

পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে আমাদের সর্বাত্মক যুদ্ধ বর্তমানে পঞ্চম মাসে পদার্পণ করল। প্রতিকূলতার মধ্যেই আওয়ামী লীগের জন্ম এবং প্রতিকূলতার মধ্যেই আওয়ামী লীগ ২২ বৎসর যাবৎ টিকে আছে। যুদ্ধ আমরা চাইনি, যুদ্ধ আমাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। যুদ্ধ চাইনি বলেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আমরা নির্বাচনে অংশ্রগ্রহণ করেছিলাম। প্রতিপক্ষ অর্থাৎ পশ্চিম পাক সামরিক জান্তা ভেবেছিল আওয়ামী লীগ পূর্ব বাংলায় সংখাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারে কিন্তু অধুনালুপ্ত পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে সামগ্রিক সংখাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারবে না। ওরা ভেবেছিল বাংলদেশের যে সমস্ত প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দল আছে তাদের কিছু কিছু বাঘা বাঘা নেতা নির্বাচনে জয়লাভ করবেই এবং সেই সমস্ত ‘কুইস্লিং’ দেরকে নিয়ে যে পরিষদ গঠিত হবে তাতে আওয়ামী লীগ খুব জোর হলে প্রধান বিরোধী দল হিসাবে পরিষদে আসন গ্রহণ করবেন কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে বিগত নির্বাচনে সাড়া বাংলার সংগ্রামী মানুষ যেন এক হয়ে গেল এবং শতকরা ৯৮.৫ টি আসনে জয়লাভ করে অধুনালুপ্ত পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে আওয়ামী লীগ। তার পরেই শুরু হলো নতুন খেল। সেনাপতি ইয়াহিয়া খাঁ ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলাপ করে ফেরার পথে মন্তব্য করল যে “আমি পাকিস্তানের ভাবী প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলাপ করে এসেছি।” এদিকে পূর্বেই আয়োজিত লারকানায় শিকারের বাহানায় ভুট্টোর সঙ্গে মিলিত হয়ে সেনাপতি ইয়াহিয়া ভুট্টোকে বলল যে, চিরাচরিত প্রথায় অর্থাৎ মন্ত্রিত্বের টোপ আমি দিয়ে এসেছি। ভুট্টো তুমি শক্ত হয়ে যাও। ভুট্টো তার চিরাচরিত প্রথায় আবোল-তাবোল বকা আরম্ভ করে দিল এবং তার ঔদ্ধত্য এতখানি বেড়ে গেলে যে, সে বলল- “পাঞ্জাব এবং সিন্ধু পাকিস্তানের রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎস।” অথচ সবাই জানেন যে, সিন্ধু প্রদেশ ’৪৭ সালের পরে কোন সময়ই শাসনযন্ত্রের চাবিকাঠি হাতে পায় নি। পশ্চিম পাঞ্জাবের সামন্তপ্রভু এবং আমলাতন্ত্রের হাতের ক্রীড়নক হিসাবে সিন্ধু প্রদেশ অন্যান্য প্রদেশের ন্যায় কিছু সংখ্যক রাজনৈতিক নেতার যোগান দিত। আমাদের তরফ থেকে আমরা জবাব দিলাম যে, স্মরণকালের ইতিহাসে ১৯৪৭ সালের পূর্বে পশ্চিম পাঞ্জাব কোন সময়ই রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎস ছিল না, বরং বৈদেশিক আক্রমণে বিদেশীদের ভাড়াটিয়া লাঠিয়ালের কাজ করেছে। শুধু তাই নয়, আলেকজাণ্ডার হতে আরম্ভ করে যত বিদেশী আক্রমণকারী ভারত বর্ষে স্বল্পকাল অবস্থান করেছেন তাঁদের অনেকেই পরিবার-পরিজন নিয়ে আসেননি।
যাই হোক ভুট্টোর সাথে বঙ্গবন্ধুর যে আলোচনা হয়েছিল তাতে পরিষ্কারভাবে বলে দিয়েছিলেন যে, আমি জনগণের কাছে আমার দলের ৬-দফা এবং ছাত্রদের ১১-দফা কর্মসূচী দিয়ে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করেছি। এ থেকে একচুল নড়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ভুট্টো বলেছিল সে তার দলের নেতাদের সঙ্গে আলেচনা করে পরে বঙ্গবন্ধুর সাথে আলোচনা করবে। কিন্তু পরবর্তীকালে ভুট্টোর ধৃষ্টতাপূর্ণ আচরণ আপনাদের সকলেরই জানা আছে। যাই হোক সংখ্যাগরিষ্ঠদলের নেতা হিসাবে বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের নয়নমণি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেনাপতি ইয়াহিয়াকে তারযোগে জানিয়ে দিলেন যে, যদি ফেব্রুয়ারির ১৫ তারিখের মধ্যে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকা না হয় তবে ১৪ই ফেব্রুয়ারী প্রাদেশিক আওয়ামী লীগ কার্যকরী পরিষদের সভায় যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তাহার পরে ১৩ই ফেব্রুয়ারী তারিখে সেনাপতি ইয়াহিয়া ৩রা মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহবান করে। এদিকে ভুট্টোর একগুয়েমির কারণে পহেলা মার্চ বেআইনী এবং অগণতান্ত্রিকভাবে সেনাপতি ইয়াহিয়া খাঁ পরিষদের অধিবেশন বসার আগেই মুলতবি ঘোষণা করে দিল। সারা বাংলাদেশ আন্দোলনে ফেটে পড়লো। শত শত ছাত্র-জনতা ইয়াহিয়ার সামরিক বাহিনীর গুলিতে শহীদ হলেন। সংগ্রামী ছাত্রলীগ ২রা মার্চ প্রদেশের সর্বত্র প্রতিবাদ দিবস ঘোষণা করল এবং আওয়ামী লীগ

<005.005.132>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

৫ই মার্চ প্রতিবাদ দিবস ঘোষণা করে। বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চ রমনার ঘোড়দৌড় মায়দানে আয়োজিত লক্ষ লক্ষ মানুষের ঐতিহাসিক সমাবেশে ঘোষণা করলেন, “শহীদের রক্তে রঞ্জিত রাজপথ দিয়ে আওয়ামী লীগ পরিষদের অধিবেশনে যোগদান করতে পারে না।” তিনি ঘোষণা করলেন যে, অবিলম্বে নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে, সামরিক আইন প্রত্যাহার করতে হবে, সৈন্যদেরকে ছাউনিতে ফিরিয়ে নিতে হবে এবং ২রা মার্চ হতে ৬ই মার্চ পর্যন্ত যে সমস্ত ছাত্র-জনতাকে হত্যা করা হয়েছে তাদের হত্যার নিরপেক্ষ তদন্ত করতে হবে – অন্যথায় আওয়ামী লীগ পরিষদের অধিবেশনে যোগদান করতে পারে না।
পরবর্তীকালে ১৫ই মার্চ থেকে সেনাপতি ইয়াহিয়া খাঁ তার উপদেষ্টাদের নিয়ে ঢাকায় বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর উপদেষ্টাদের সাথে সুদীর্ঘ আলোচনায় বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের সকল শর্ত মেনে নিল এবং ২৪ কি ২৫শে মার্চের মধ্যে উহা ঘোষণা করার প্রতিশ্রুতি দিল। কিন্তু আসলে এই দীর্ঘসূত্রতা অতি সংগোপনে সামরিক প্রস্তুতির বাহানা ছাড়া আর কিছুই নয়। রেডিওর ঘোষণা দূরে থাকুক আসলে ২৫ই মার্চ রাতে ট্যাঙ্ক, কামান, মেশিনগান নিয়ে হানাদার বাহিনী বাংলার জনগণের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল প্রথমে ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালী সৈন্যদের নিরস্ত্র করে হত্যা এবং বিভিন্ন রেজিমেন্টে যে সমস্ত বাঙালী অফিসার ও নিয়মিত বাঙালী আছে তাদেরকে নিরস্ত্র করে হত্যা করা এবং ই-পি-আর ও পুলিশ বাহিনীকে সম্পূর্ণভাবে শেষ করে দেয়া। তাই তারা যেখানে সম্ভব হয়েছে সেখানে নিয়মিত বাহিনীর বাঙালীদেরকে হত্যা করেছে এবং ই-পি-আর সদর দপ্তর, রাজারবাগ পুলিশ লাইন এবং প্রদেশের অন্যান্য স্থানের ই-পি-আর পুলিশ বাহিনীর উপর সামরিক বাহিনীকে লেলিয়ে দেয়া হয়েছে। আজকে এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ আমাদের বাঙালী ছেলেরা হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বন্দুক ঘুরিয়ে ধরেছে এবং দেশমাতৃকাকে হানাদারের কবলমুক্ত করার অগ্নিশপথে সারা বাংলার ছাত্র-যুবক-কৃষক-শ্রমিক-জনতা বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের নির্দেশে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। আজকে বাংলার প্রতিটি ঘর এক-একটি দুর্ভেদ্য দুর্গে পরিণত হয়েছে। সেই জন্য মরিয়া হয়ে হানাদার বাহিনী নারী ও শিশু সমেত হাজার হাজার নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালীকে হত্যা করে চলেছে। ইয়াহিয়া বাহিনীর এই নৃশংস হত্যাযজ্ঞে যাঁরা আত্মাহুতি দিয়েছেন তাঁদের জন্য আমাদের মন ও প্রাণ শোকাপুত এবং অভিভূত।…
প্রিয় ভাই-বোনেরা
আজকে আপনারা সকলেই বিক্ষুব্ধ। বাংলার ঘরে এমন কোন পরিবার নেই যাদের কেউ না কেউ কোন না কোন ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন নাই। বঙ্গবন্ধুর নামে আজকে আপনাদেরকে ডাক দিয়ে যাই-বাংলাদেশ আজ স্বাধীন। এই স্বাধীনতা সংরক্ষণের দায়িত্ব আমার আপনার সকলের। মুক্তি বাহিনী আজ যথেষ্ট শক্তিশালী এবং দিন দিন এর শক্তি বেড়েই যাবে, কমবে না। আপনারা ধৈর্য ধরুন। বঙ্গবন্ধুর সুমহান নেতৃত্বে আমরা উদ্বুদ্ধ। একটি বাঙালী বেঁচে থাকা পর্যন্ত হানাদারদের রেহাই নাই। বাঙলা মায়ের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ব কায়েম আমরা করবোই। বাঙালী হিসাবে জন্মেছি, বাঙালী হিসাবে বাঁচবো, বাঙালী হিসাবে আমাদের জীবনতরী বেয়ে যাবো আর বাঙালী হিসাবেই মরবো- এই মন্ত্রই হোক আমাদের যাত্রাপথের পাথেয়।
পরিশেষে আমি বলতে চাই

“আমাদের যাত্রা হলো শুরু
এখন ওগো কর্ণধার,
তোমারে করি নমস্কার।
এবার বাতাস ছুটুক, তুফান উঠুক
ফিরবো নাকো আর
ওগো কর্ণধার।”
আল্লাহ আপনাদের সহায় হোন। জয় বাংলা।

(মিজানুর রহমান, এম-এন-এ)

<005.005.133>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

২১ আগষ্ট, ১৯৭১
শেখ মুজিব আজ কোন ব্যক্তিবিশেষের নাম নয়- শেখ মুজিব আজ বাংলার ইতিহাস। বাংলার ২৩ বছরের রাজনীতি তথা সামাজিক উত্থান-পতনের সঙ্গে তিনি এক হয়ে মিশে গিয়েছেন। শোষণ ও পীড়নের রাজনীতিতে শেখ মুজিব এক আশ্চর্য প্রতিবাদ। প্রতিবাদ তিনি করেছেন সমস্ত জীবন ধরে, সমস্ত সত্তা দিয়ে। তিনি তাঁর পর্বতপ্রমাণ অটল সাহস ও মনোবল নিয়ে সবকিছু বাধা বিঘ্নকে অতিক্রম করে একক ভাবে বাংলার ইতিহাসে প্রতিবাদের মূর্ত প্রতিক হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।
আজ সেই শেখ মুজিব, যাঁকে বাংলার সাড়ে সাত কোটি বাঙালী বঙ্গবন্ধু নামে আখ্যায়িত করেছিল এবং যিনি শুধু মুজিব ভাই বলে সবারই কাছে পরিচিত হতে চেয়েছিলেন তাঁকে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে গিয়ে বন্দী করে রাখা হয়েছে এবং বিচারের নামে প্রহসন চলছে।
শেখ মুজিবুর রহমান বাংলার সন্তান। বাংলাদেশে জন্মেছেন, বাংলাদেশে লালিত-পালিত, বাংলাদেশকে ভালবেসেছেন এবং সাড়ে সাত কোটি বাঙালী আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার অকুণ্ঠ ভালবাসা পেয়েছেন। শুধু তাই নয় বাঙালীর স্বার্থে বাঙালীর মুক্তি কামনায় নিজের জীবনের সুখ-শান্তি চিরদিনের মত বিসর্জন দিয়েছিলেন। সেই শেখ মুজিবকে বাংলাদেশে না রেখে সুদূর পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। শোষক গোষ্ঠী সমস্ত রকমের আধুনিক মারণাস্ত্রে সজ্জিত হয়েও নিরীহ বাঙালীর ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে তাঁকে ১২০০ মাইল দূরে বন্দী করে রেখেছে। শুধু তাতেই তারা নিজেদের নিরাপদ মনে করেনি। বাঙালীর কণ্ঠকে ও দাবীকে চিরকালের জন্য স্তব্ধ করার জন্য তাঁকে মেরে ফেলার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।…
এবারের এই বন্দীদশা তিনি অনায়াসে এড়াতে পারতেন, কিন্তু তিনি তা করেননি। তিনি বিশ্বাস করতেন গণতন্ত্রে, বিশ্বাস করতেন অহিংস আন্দোলনে। তিনি কোনদিন মনে-প্ৰাণে গ্রহণ করতে পারেননি যে, বন্দুকের নল ক্ষমতার উৎস। তিনি কোনদিন চাননি নিরস্ত্র, নীরহ জনসাধারণের রক্তে বাংলাদেশ রাঙা হোক। আগরতলা কেস থেকে মুক্তি পেয়েই রমনার রেসকোর্স ময়দানে এক ঐতিহাসিক জনসভায় ঘোষণা করেছিলেন, “আমি জনগণের রক্তের সঙ্গে বেঈমানী করব না, দেশের স্বাধীনতার জন্য দরকার হলে সবার আগে আমি রক্ত দেব”। তিনি নিজের ঘোষণার সম্মান দিয়েছেন। আজ তিনি ধৃত। আমাদের এই মুক্তিযুদ্ধে তিনি সবার আগে তাদের হাতে ধরা পড়েছেন।
আর আজ জল্লাদ ইয়াহিয়া বিচারের আসনে বসেছেন। কিন্তু কার বিচার কে করে? তাঁকে বিচারের অধিকার খুনী ইয়াহিয়ার নাই। শেখ মুজিব সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর আশা-ভরসার স্থল, তাদের একচ্ছত্র নেতা। স্বৈরাচারী ইয়াহিয়া তাঁকে ভাবী প্রধানমন্ত্রী বলে অভিনন্দিত করতেও কসুর করেনি। আজ শেখ মুজিবুর রহমান যদি অখণ্ড পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতেন তাহলে ইয়াহিয়াকে তাঁরই হুকুমের তাঁবেদার হতে হতো। ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাসে শেখ মুজিবের বিচার তিনি করতে বসেছেন। যদি বিচার করতেই হয় তাহলে এত গোপনীয়তা কেন? কেন আজ স্থানের নাম পর্যন্ত গোপন রাখা হয়েছে? কেন বিচারকদের নাম জনগণকে জানান হচ্ছে না? কেন বাইরের কৌসুলী আসবার অনুমতি দেয়া হয়নি? শেখ মুজিব যদি দেশদ্রোহী বা দেশের শক্র হন তাহলে সাধারণ কোর্টে এবং সবার সামনে বিচার করার মত সৎসাহস থাকা উচিত ছিল।…
আজ পৃথিবীর শান্তিকামী, গণতন্ত্রে বিশ্বাসী প্রতিটি মানুষের কাছে আমাদের দাবী ও আবেদন তাঁরা যেন শেখ মুজিবের বিচার প্রহসন বন্ধ করতে জল্লাদ ইয়াহিয়াকে বাধ্য করেন। শেখ মুজিবুর রহমান কোন একটি বিশেষ দেশের মানুষ নন। তিনি গণতন্ত্রের প্রতীক, তিনি নিপীড়ত জনগণের ত্রাণের প্রতীক। তাঁর জীবন রক্ষা

<005.005.134>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

করার দায়িত্ব শুধু বাংলাদেশের লোকের নয়, তাঁকে রক্ষা করার দায়িত্ব শান্তিকামী প্রতিটি মানুষের। শেখ মুজিবকে হত্যা মানেই গণতন্ত্রকে হত্যা করা- সত্য ও ন্যায়কে আবর্জনার আস্তাকুড়ে ছুড়ে ফেলে দেয়া। বাংলাদেশের মা-বোনের তরফ থেকে আমি শুধু এইটুকু বলতে চাই, তাঁর মত মহান নেতার কোন ক্ষতি আমরা সহ্য করবো না। এবং তাদের এই বলেই সাবধান করে দিতে চাই, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি বাঙালী পশ্চিম পাকিস্তানের কোন লোককেই ক্ষমা করবে না।…
(বদরুন্নেসা আহমেদ, এম-এন-এ কর্তৃক
শেখ মুজিবের বিচার প্রসঙ্গে’ শিরোনামে লিখিত ভাষণ)

১৫ নভেম্বর, ১৯৭১
বাংলাদেশের মানুষের উপর যখন ইয়াহিয়া খানের সৈন্যবাহিনী হিংস্র হায়েনার মত ঝাঁপিয়ে পড়লো, যখন বাংলার শ্যামল প্রান্তরে রক্তের প্লাবন বয়ে চললো, যখন বাংলার আকাশ নির্যাতিত মানুষ ও ধর্ষিতা মা-বোনদের আর্তণাদে বেদনাকরুণ, তখন পৃথিবীর মানুষের চোখে এক নিদারুণ বিস্ময় ঘনীভূত হয়ে উঠেছিলো। পরম বিস্ময়ে মানুষ দেখছিলো বিশ্ববিবেক যেন স্তব্দ হয়ে গেছে। ব্যবসায়ী বৃহৎ রাষ্ট্রগুলির সরকার, যারা গণতন্ত্র এবং মানবতার নামে চীৎকারের প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ, তাদের কণ্ঠ রুদ্ধ। শুধু তাই নয়, পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের এই রক্তপ্লাবী ঘটনাকে পাকিস্তানের ঘরোয়া ব্যাপার বলে একটা ধামাচাপা দেয়ার প্রচেষ্টারও অন্ত ছিল না। এদের মনোভাব দেখে এই সময়ে মনে হয়েছিলো ব্যবসার মুনাফার বেদীমূলে তারা মানবতাকেও বলি দিতে কুন্ঠিত নন। বাংলাদেশের ঘটনা যে পাকিস্তানের ঘরোয়া ব্যাপার নয় সেই সম্পর্কে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বলিষ্ঠ কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিলো “লাখো লাখো আদম সন্তানের লাশের তলায় পাকিস্তানের কবর রচিত হয়েছে। পাকিস্তান আজ মৃত। রক্ত স্নানের মধ্য দিয়ে একটা নতুন জাতির জন্ম হয়েছে।” কিন্তু তার এই পরিষ্কার ঘোষণাটিও যেন তখন পৃথিবীর বৃহৎ রাষ্ট্রবর্গের মনে কোন সাড়া জাগাতে পারেনি। কিন্তু দেখা গেল মানবতাকে রক্ষার জন্য শেষ পর্যন্ত পৃথিবীর মুক্ত মানুষের মন সোচ্চার হয়ে উঠলো বাংলার মানুষের স্বপক্ষে। ধিক্কার দিল তারা ইয়াহিয়ার জঙ্গী শাসক ও পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক চক্রকে। ব্যবসার মুনাফার গোলকধাঁধায় বাধা সরকার ছাড়া প্রতিটি দেশের গণতন্ত্রকামী মানুষ বাংলার মানুষের পাশে এসে দাঁড়ালো।
ইংল্যাণ্ডের লিবারেল দলের M.P মিঃ রাসেল জনষ্টোন ৩১ মার্চে প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বল্লেনঃ
“আমি বিশ্বাস করি না ইহাকে পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলিয়া বৃটেন নীরব দর্শকের ভূমিকায় অভিনয় করিতে পারে। আমাদের চোখের সম্মুখে যে ঘটনা সংঘটিত হইতেছে তাহা চূড়ান্ত বর্বরতার নামান্তর মাত্র। শান্তি ফিরাইয়া আনা এবং মীমাংসার জন্য কমনওয়েলথের প্রধান সদস্য হিসাবে বৃটেনকে তাহার সমস্ত কিছুই করিতে হইবে।”
“Conflict in East Pakistan : Background & Prospect” শিরোনামে হার্বাট বিশ্ব বিদ্যালয়ের ৩ জন অধ্যাপক- মি: এডওয়ার্ড মেসন, রবার্ট ডফম্যান এবং স্টীফেন এ, মার্গলিন ১লা এপ্রিল তারিখে লিখলেনঃ
“স্বাধীন বাংলাদেশ অবশ্যম্ভাবী। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় রাখতে সক্ষম, বাংলাদেশ হবে একটি সত্যিকারের স্বাধীন রাষ্ট্র। কিন্তু প্রশ্ন হল এই স্বাধীনতার জন্য তাকে কত রক্ত ঢালতে হবে।”
History of Economics & Political Domination of East Pakistan পত্রিকায় Herbert বিশ্ববিদ্যালয়ের রিপন সোসাইটি লিখলেন, “বাংগালীরা স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে এবং তাঁরা মুক্তিযুদ্ধ লড়ছে।

<005.005.135>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

এই যুদ্ধে তাদের জয় সুনিশ্চিত। কিন্তু প্রশ্ন হল, এই স্বাধীনতা অর্জনের জন্য তাদের কত প্রাণ দিতে হবে এবং তাদের কত সম্পদ ধ্বংস হবে।”
৯ই এপ্রিল নেপালের ‘অৰ্পন’ পত্রিকা বলিষ্ঠ কণ্ঠে ঘোষণা করলো,“ইহা পাকিস্তানের ঘরোয়া ব্যাপার নয়। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় আজ শুধুমাত্র কল্পনা নয়, একটি বাস্তব সত্য।”
১৩ই এপ্রিল তুরস্কের পত্রিকা আকসাস লিখলো, “পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানীরা স্বাধীনতার যুদ্ধ লড়ছে।” ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তা পত্রিকা ১৫ই এপ্রিল লিখলো, “পূর্ব পাকিস্তানীরা আর পাকিস্তানী নামে পরিচিত হইতে ইচ্ছুক নয়। তারা বাঙালী- এই পরিচয়ই গ্রহণ করেছে। কারণ আজ পাকিস্তানী’ শব্দ দ্বারা তারা মনে করে একদল সৈন্য, যারা তাদের লোকজনকে নির্দয়ভাবে হত্যা করে।”
৩০শে মার্চ চিকাগো ট্রিবিউন লিখলো, “পৃথিবীর যে অংশটি একদিন ভিয়েতনামের হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে মুখর ছিল, সেই অংশে আজ শত-সহস্ৰ লোককে মেশিনগানের গুলিতে নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে। ভিয়েতনামে গত ৪ বছরে যত লোককে হত্যা করা হয়নি তার চেয়েও অধিক লোককে মাত্র ৪ দিনে হত্যা করা হয়েছে।”
৭ই এপ্রিল নিউইয়র্ক টাইমস’ পত্রিকা লিখলো, “পাকিস্তানী সেনাবাহিনী নির্বিচারে গণহত্যা করছে, চাক্ষুষ দর্শীর এই বিবরণ সত্ত্বেও ওয়াশিংটনের এই নিস্ক্রিয়তা এবং নিরবতা মানুষের কাছে নিশ্চয় পীড়াদায়ক। বাংলাদশের এই হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধ প্রতিবাদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নিশ্চয় একটি মানবিক দায়িত্ব রয়েছে।
শুধুমাত্র এই কয়েকটি পত্রপত্রিকাই নয়, লণ্ডনের ডেইলি মেইল, ডেইলি টেলিগ্রাফ, New Statesman. Sunday Times. London- এর Time পত্রিকা, গার্ডিয়ান, Sunday Telegraph. Newsweek. Christian Monitor. Washington Post. Ockland Tribune. Bultimore Sun. Otowa Citizen. চিলির আলমারকিউরিও, ব্রসেলসের লা লিব্রা, জাপানের Time পত্রিকা, আরব রাষ্ট্র কুয়েতের আকবর- আল- কুয়েত, সিরিয়ার আল তাউরা, রাশিয়ার প্রাভধা ইত্যাদি সমস্ত পত্রিকায় পৃথীবির মানবতাকামী মানুষ ইয়াহিয়ার জল্লাদ বাহিনীর গণহত্যার বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ জানালেন, স্বাধীনতাকামী বাংলার মানুষকে জানালেন আন্তরিক সমর্থন।
হিমালয়ের ঘুম ভাঙলো। পাকিস্তানকে অস্ত্র সাহায্য দেবার বিরুদ্ধে আমেরিকার সিনেটে প্রতিবাদের ঝড় তুললেন সিনেটর কেনিডি। শ্রমিকরা পাকিস্তানী জাহাজে অস্ত্র বোঝাই করতে অস্বীকার করলেন। আমেরিকার বৈদেশিক সাহায্য কমিটি পাকিস্তানকে সর্বপ্রকার সাহায্য বন্ধ করার জন্য সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করলেন।
বৃটেন, ফ্রান্স, পাকিস্তানকে অস্ত্র সাহায্য প্রদান বন্ধ করার কথা ঘোষণা করলো। রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী কোসিগিন গণহত্যার নিন্দা করে গণহত্যা বন্ধ করার দাবী জানালেন।
এবার বাংলাদেশর সপক্ষে এগিয়ে এলো উত্তর কোরিয়া ও উত্তর ভিয়েতনাম। সংগ্রামী উত্তর ভিয়েতনাম ঘোষণা করলোঃ “বাংলাদেশের যুদ্ধ জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ।” বাংলার মুক্তিযুদ্ধকে তারা পূর্ণ সমর্থন জানালেন- কিন্তু দৃষ্টি নিবদ্ধ রইল চীনের প্রতি। ইয়াহিয়া বার বার হ্রেষা ধ্বনি করছিল,”চীন আমাদের সাথে”। চীনের কণ্ঠ নীরব। অবশেষে চীন মুখ খুললো ভুট্টোর চীন গমন উপলক্ষ ভোজসভায়। বিভ্রান্ত ইয়াহিয়ার বিশেষ দূত হিসাবে মানবতার ইতিহাসে অন্যতম জঘন্য অপরাধী ভুট্টো গিয়েছিলো চীনের সমর্থন আদায়ের জন্য।
ইয়াহিয়া এবং ভুট্টো চক্ৰ মনে করেছিলো চীন তাদের কুকর্মকে সমর্থন জানাবে, কিন্তু চীনের অস্থায়ী পররাষ্ট্রমন্ত্রী সেদিন প্রকৃতপক্ষ ইয়াহিয়া-ভুট্টোর মুখে চপেটাঘাত করলেন। ভোজসভায় চীনের অস্থায়ী

<005.005.136>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভুট্টোকে পরামর্শ দিলেন পূর্ব বাংলা সম্বন্ধে একটি যুক্তিসম্পন্ন মীমাংসা করতে। শুধু তাই নয়, চীন ইয়াহিয়া-ভুট্টো চক্রের সমস্ত প্রচারণার মুখে পদাঘাত করলেন।
১১ই নভেম্বর
B.B.C.-র খবরে প্রকাশ, চীন পাকিস্তানকে সংযত হওয়ার জন্য উপদেশ দিয়েছে। চীন বলেছে, “কোন অবস্থাতেই ভারত আক্রমণ করা পাকিস্তানের উচিত হবে না। শুধু তাই নয়, পাকিস্তান বাংলাদেশ সমস্যাকে ভারত-পাকিস্তান সমস্যার আকারে নিরাপত্তা পরিষদে তোলার আবেদন জানিয়েছিলো। চীন তার সেই আবেদনও প্রত্যাখ্যান করেছে। চীনের এই কথার অর্থ এই দাঁড়ায়, চীন পাকিস্তান সরকারের কার্যাবলী সমর্থন করতে প্রস্তুত নয় এবং ইয়াহিয়ার রণহুঙ্কারকেও চীন অসার ও অযৌক্তিক মনে করে। সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ সমস্যাকে চীন পাকভারত সমস্যা হিসাবে দেখতে রাজী নয়। এইদিকে মার্কিন সরকারও পাকিস্তানে অস্ত্র বিক্রয়ের লাইসেন্স বাতিল করে দিয়েছে। এর ফলে আজ ইয়াহিয়ার জঙ্গী সরকার সারা বিশ্ব অসহায় এতিমের পর্যায়ে নেমে এসেছে। অন্যদিকে বিশ্ববিবেক সোচ্চার হয়ে উঠেছে স্বাধীন বাংলার মানুষের সপক্ষে। বাংলার দুর্ধর্ষ মুক্তিবাহিনী আঘাতের পর আঘাত হেনে চলেছেন। তাদের ক্ষীপ্রতায় এবং প্রচণ্ডতায় হানাদার বর্বর পাক বাহিনী দিশেহারা। সেদিনের স্বল্প অস্ত্রে সজ্জিত মুক্তিবাহিনী আজ বিশ্বের সমর্থনপুষ্ট হয়ে আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত এবং দুর্ধর্ষ শত্রু টিকেও নিশ্চিহ্ন করার জন্য। জয় আমাদের সুনিশ্চিত। জয় বাংলা।
(জিলুর রহমান, এম-এন-এ)
১৭ নভেম্বর, ১৯৭১
প্রিয় ভাইবোনেরা, আমার সংগ্রামী অভিনন্দন গ্রহণ করুন। বিগত প্রায় আট মাসাধিককাল যাবৎ আমরা সবাই মুক্তিসংগ্রামে লিপ্ত আছি। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এ মুক্তিসংগ্রামে শরীক হয়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, কোরবানী দিয়েছে কোন না কোন ভাবে। মুক্তিযুদ্ধ ও সাধারণ সাম্রাজ্যবাদী বা সম্প্রসারণবাদী যুদ্ধের পার্থক্য এই যে, সাম্রাজ্যবাদী বা সম্প্রসারণবাদী যুদ্ধে দেশের জনসাধারণকে জোর করে যুদ্ধের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়; বেতনভোগী (Mercenary) সৈন্যরা দায়ে পড়ে অথবা পদের লোভে বা প্রয়োজনে যুদ্ধ করতে বাধ্য হয়। আর মুক্তিযুদ্ধে দেশের আপামর জনসাধারণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে শরীক হয়- সুশিক্ষিত, অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত সৈন্যরা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে শত্রুসেনাকে খতম করার জন্য মাতৃভূমিকে শত্রুকবল হতে উদ্ধারের জন্য যুদ্ধ করে। আমাদের বাংলাদেশের বাহাদুর বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ই-পি-আর, পুলিশ, আনসার ও মোজাহেদ বাহিনী, আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এবং বিভিন্ন শ্রমিক সংস্থার সংগ্রাম পরিষদের বাহাদুরেরা প্রথমে এরূপ দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমরনায়ক ইয়াহিয়া-টিক্কা খানের হানাদার দস্য্যুবাহিনীর বর্বর আক্রমণ রুখে দাঁড়িয়েছে। দেশের সর্বস্তরের নরনারী, ছাত্র-শ্রমিক-কৃষক-মজদুর তথা আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা নির্বিশেষে পরবর্তীকালে এই চরম সংগ্রামে শরীক হয়েছে- কেহ সক্রিয়ভাবে, কেহ পরোক্ষভাবে, সক্ষম যুবকেরা অস্ত্রের মাধ্যমে এবং শিল্পী-সাহিত্যিক-কবি-সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবী, বিভিন্ন স্তরের কর্মচারী ও কূটনীতিবিদ সাধ্যমত তাদের নিজ নিজ ক্ষমতা ও প্রতিভার মাধ্যমে। কাজেই একথা বলা ঠিক নয় যে, মুক্তিযুদ্ধ কারও একার কর্তব্য। অবশ্য যুগে যুগে মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে বেঈমান, সুবিধাবাদী, বা ‘কুইসলিং মীরজাফরদের যেমন ভূমিকা ছিল, আমাদের এই সংগ্রামেও

<005.005.137>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

মীরজাফরেরা তেমন নিক্রিয় নয়। দেশবন্ধু তাই একসময়ে আক্ষেপ করে বলেছিলেন, “পরাধীন দেশের সবচেয়ে বড় অভিশাপ এই যে, মুক্তিসংগ্রামে বিদেশীদের অপেক্ষা দেশের লোকদের সঙ্গেই মানুষকে যুদ্ধ করতে হয় বেশী।” সোনার বাংলার লক্ষ লক্ষ নীরিহ ‘মাসুম নরনারী, শিশু, যুবক-যুবতীকে নির্বিচারে হত্যার অপরাধে, লক্ষ লক্ষ নারীর শ্লীলতাহানি ও সতীত্ব নষ্ট করার অপরাধে, বাংলার কোটি কোটি টাকার ধন-সম্পদ বিনষ্ট করা, লুটপাট ও চুরি-ডাকাতির অপরাধে, প্রায় ৯৫ লক্ষ নরনারী-আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা নির্বিশেষে বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত করার অপরাধে এবং অপর প্রায় ২ কোটি লোককে গৃহহারা-বাস্তুহারা এবং ছিন্নমূল করার অপরাধে, লক্ষ লক্ষ কর্মক্ষম ব্যক্তিকে জীবিকা নির্বাহের সুযোগ হতে বঞ্চিত করা তথা চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য ধ্বংস করার অপরাধে ইয়াহিয়া-টিক্কা-ভুট্টো-হামিদ যেমন অপরাধী- তেমনি এই জলল্লাদচক্রের ক্রীড়নক সহযোগী মাহমুদ আলী, ডাঃ মালিক, নুরুল আমীন গং এবং তাদের প্রত্যেকটি সক্রিয় সমর্থক ও তাঁবেদারগণও সমভাবে অপরাধী এবং সমভাবে শাস্তির যোগ্য। ফৌজদারী দণ্ডবিধি আইনের বিধানানুসারে হত্যাকরী এবং তার সহযোগীকে একই আইনে ফাঁসি দেয়ার বিধান চালু আছে। সহযোগী বা নর হত্যাকারীর সম্পর্কে আইনে বলা আছে, As if he himself Committed murder- অর্থাৎ, সহযোগী যেন নিজেই খুন করেছে। কাজেই ইয়াহিয়া চক্রের দালালদের সম্পর্কে এই চালু ফৌজদারী দন্ডবিধি আইন সম্পূর্ন প্রযোজ্য। বন্ধুগন, “Truth shall prevail” -এটা universal truth বা সার্বজনীন সত্য- অর্থাৎ সত্যের জয় হবেই, আমাদের পবিত্র কোরানেও আছে-
قل جاء الحق وزهق الباطل ان الباطل كان زهوقام
অর্থাৎ “সত্য সমাগত- মিথ্যা অপসৃয়মাণ, এবং মিথ্যা অবশ্যই ধ্বংসপ্রাপ্ত হইবে।”
আমাদের এই আজাদীর সংগ্রাম মিথ্যার বিরুদ্ধে সত্যের সংগ্রাম, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের সংগ্রাম, জালেমের বিরুদ্ধে সাড়ে সাত কোটি বঞ্চিত মজলুমের সংগ্রাম। আমাদের প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধুর ভাষা‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম- এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। ” এই যুদ্ধে ইনশাল্লাহ আমরা কামিয়াব হবই। আমাদের মনজিলে মকসুদে আমরা পৌছবই।
দুনিয়ার সমস্ত আজাদীর ইতিহাসে দেখা যায় স্বাধীনতা “অর্জন করা হয়েছে”। স্বাধীনতার জন্য লক্ষ লক্ষ দেশপ্রেমিক কোরবান হয়েছে, নানাভাবে আজাদী পাগল মানুষ নির্যাতন ভোগ করেছে- কিন্তু শির দিয়েছে তবু আমামা দেয়নি। ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে হেসে হেসে ফাঁসির রজ্জ্ব বরমাল্যের মত কণ্ঠে বরণ করে আজাদীর জয়গান গেয়েছে, তবুও জাতির স্বাধীন সত্তাকে বিলিয়ে দেয়নি- স্বাধীন পতাকাকে অপমানিত হতে দেয়নি। ইতহাসে মহাচীন, আমেরিকা, ইন্দোনেশিয়া, আলজেরিয়া যুগ যুগ ধরে যুদ্ধ করে স্বীয় স্বাধীনতা অর্জন করেছে। কেহই স্বাধীনতা দান হিসাবে বিনা রক্তপাতে পায়নি। অবশ্য ওদের মুক্তিসংগ্রামে সহায়তা পেয়েছে সভ্য জাতির নিকট হতে, সক্রিয় বা পরোক্ষ সমর্থন পেয়েছে। আমরাও আশা রাখি, দুনিয়ার সমস্ত সভ্য দেশ হতে সাহায্য সমর্থন পাবো। পাক-ভারত উপমহাদেশের স্বাধীনতা অর্জন সম্পর্কে অনেকের হয়ত ভ্রান্ত ধারণা যে, মেহেরবানী করে বৃটিশ সরকার আমাদিগকে স্বাধীনতা দান করে গিয়েছেন। বাস্তবপক্ষে কি তাই? ১৮৫৭ ইং সনের সিপাহী বিদ্রোহ, ক্ষুদিরাম, ভগৎসিং এবং হাজার হাজার সিপাহীর ফাঁসির কি কোন দাম নেই? নেতাজী সুভাষ বসুর পরিচালনায় বার্লিন, সিঙ্গাপুর, মালয়, বৰ্মা ও বিভিন্ন স্থানে যে প্রায় পঞ্চাশ হাজার আজাদ হিন্দু ফৌজ গঠন করা হয়েছিল, তা কি কম চাঞ্চল্যকর? মনিপুর ও ইম্পল অপরেশনে যে প্রায় ছয় হাজার আজাদ হিন্দু ফৌজ (INDIAN NATIONAL ARMY) অনাহারে-অর্ধাহারে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে, এবং ১৯৪২ থেকে ১৯৪৬ সন পর্যন্ত বিভিন্ন রণাঙ্গনে মিত্র পক্ষ তথা ব্রিটিশ আর্মির হাতে যে বিভিন্নভাবে প্রায় ২০ হাজার আজাদ হিন্দু ফৌজ বন্দী হয়েছিল, নির্যাতন ভোগ করেছিল বা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিল, তা কি এদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যায়নি? বৰ্মা, রেঙ্গুন, সুমাত্রা, সিঙ্গাপুর, জার্মানী, জাপান ও অন্যান্য স্থানের লক্ষ লক্ষ ভারতীয় (তদানীন্তন) নাগরিকগণ কেহ কেহ তাদের সমস্ত ধন-সম্পত্তি ও কোটি কোটি টাকা এবং কেহ কেহ

<005.005.138>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

মোট সম্পদের একটা অংশ INA ফৌজকে দান করেছিল। ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মির Kin’s Commission, প্রাপ্ত Major G.S. Dillon, শাহনাওয়াজের মত শত শত কমিশন্ড অফিসার এবং হাজার হাজার জোয়ান ব্রিটিশ সরকারের চাকরি ও নিশ্চিত ভবিষ্যৎ ছেড়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের স্রোতে নিজদেরকে নিক্ষেপ করে আজাদ হিন্দু ফৌজে যোগ দিয়েছিল। ICS পরীক্ষায় প্রথম স্থান দখল করেও নেতাজী সুভাষ বসু যে চাকরি ত্যাগ করেছিলেন, তা কি বৃথা গিয়েছে? বস্তুতঃ এই সব বীরত্ব ও আত্মত্যাগ উপমহাদেশের আজাদী লাভকে ত্বরান্বিত করেছিল।
আমার প্রিয় ধর্মভীরু দেশবাসীকে বলা প্রয়োজন যে, মিঃ জিন্নার পাকিস্তানের স্বাভাবিক মৃত্যুই হয়েছে। এবং এটাকে অপমৃত্যু বলা চলেনা। অবশ্য পাকিস্তানের জন্মটাকে কিছুটা অস্বাভাবিক বলা চলে। কাজেই এর প্রতি আর কারও কোন মোহ থাকা উচিত নহে? পাকিস্তানরূপী যে শিশুকে তিওয়ানা-নসরুলা কোম্পানীর আকবার-আহরার পার্টি তথা পশ্চিম সামন্ত বাদ চক্র জন্ম দিতেই চায়নি, তারাই পরবর্তীকালে স্বীয় বুর্জোয়া স্বার্থে সে শিশুর দাবীদার সেজে প্রকৃত জন্মদাতা তথা নিরীহ ধৰ্মভীরু বাঙালীকে বিগত ২৪ বৎসর ধরে নানাভাবে শোষণ ও নির্যাতন করেছে। ইসলাম, সংহতি ও মুসলমানের নামে বহু অনৈসলামিক কারবার বেঈমানী ও ধোঁকাবাজি করেছে। ব্যবসায়ী স্বার্থে, সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থে তারা ভাই বলে মুখে প্রচার করেছে কিন্তু পূর্ববঙ্গের মানুষকে কোনদিন তারা হৃদয়ে স্থান দেয়নি। লক্ষ লক্ষ বাঙালী বন্যায়-জলোচ্ছাসে-ঘূর্ণিঝড়ে শিয়ালকুকুরের মত প্রাণ দিয়েছে, কিন্তু পশ্চিমা শোষকচক্র, কখনও শোষণের যাতাকল বন্ধ করেনি। ১৯৬৪ সনে যখন পূর্ববাংলার এক মহকুমায়ই ১৮ হাজার লোক একরাত্রে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছাসে প্রাণ হারিয়েছিল তখন তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট আয়ুব খান সফর করতে পূর্ববঙ্গে না এসে লণ্ডনে বেড়াতে গিয়েছিলেন। লণ্ডনের পত্রপত্রিকা ব্যঙ্গ করে লিখেছিলঃ 18 thousand people died, who cares? অর্থাৎ বিগত নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছাস নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, বরিশাল, খুলনা ও পটুয়াখালীতেই যখন প্রায় ১০ লক্ষ নরনারীর মৃত্যু হয়েছিল, লক্ষ লক্ষ গৃহহারা সর্বহারা নরনারীর অগণিত মৃতদেহ পদ্মা-মেঘনা-যমুনাতে এমনকি বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরে পর্যন্ত ভেসে যাচ্ছিল- তখন আমাদের গরীবের ট্যাক্সের টাকায় কেনা Gunboat, Helicopter কোথায় ছিল? তদানীন্তন গভর্নর এডমিরাল আহসান বলেছিলেন, “আমি Islamabad-এর কাছে Helicopter চেয়েছিলাম- কিন্তু পাইনি।” সেই নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড়ের ধ্বংসলীলা পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে প্রলয়ঙ্কারী দুর্যোগ। লক্ষ লক্ষ দুর্দশাগ্রস্ত আদম সন্তানের করুণ আর্তনাদে আল্লাহর আরশ কেঁপে উঠেছিল। ভারতসহ দুনিয়ার প্রায় সব রাষ্ট্র হতে সাহায্য-সম্ভার এসেছিল, হেলিকপ্টার এসেছিল। তখনও পিণ্ডি-ইসলামাবাদশাহীর হৃদয় বিগলিত হয়নি। শত শত নর-নারীকে, স্ত্রী ও পুরষকে একসাথে কবরস্থ করা হয়েছিল। এমনকি হিন্দু-মুসলমানকে একসাথে এক গোরে দাফন করা হয়েছিল-কারণ দাফনের কাপড়েরও অনটন হয়েছিল। Gunboat ছিল না, অর্থ ছিল না। এক ফোঁটা পানি, এক মুঠো অন্ন ও লজ্জা নিবারণে এক টুকরো কাপড়ের জন্য লক্ষ লক্ষ আদম সন্তানের করুণ আর্তনাদে সারা দুনিয়া বিগলিত হয়েছিল, সাহায্য-সম্ভার নিয়ে এগিয়ে এসেছিল কিন্তু বিগলিত হয়নি আদমজী, ভালিকা, আমীর আলী, ফেন্সী, দাউদ ও গান্ধারা গোষ্ঠীর তথা পশ্চিমা ২২-পরিবারের হৃদয়। এর পরও আপনারা এদের ইসলামী দরদের ধোঁকামিতে বিশ্বাস করেন? এদের ইসলাম শোষণের যন্ত্রবিশেষ। আসলে এরা ইসলাম মানে না। ১৪ শত বৎসর পর্যন্ত প্রতি জুম্মাতে, ঈদে আপনারা খোতবায় শোনেন
والإحسان بالعدل يأمر الله ان (ইন্নালাহা ইয়া’মুরু বিয়াদাল ওয়া ইহছান)
-আল্লাহ ‘আদাল’ ও এহছানের কথা তথা ন্যায়বিচার ও ইনছাফের কথা, মঙ্গলের কথা বলেছেন; আর এই লুটেরা দস্যুরা পাক কোরানের এই নির্দেশ অমান্য করে যুগ যুগ ধরে বেইনসাফ ও বেঈমানী করেছে। ভাইসব, দুনিয়ার কোন রাষ্ট্রই শুধু ধর্মীয় বন্ধনের নামে বা দ্বিজাতিতত্ত্বের উপরে ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। জোর করে অবাস্তব ও অসম্ভবকে বেশীদিন টিকিয়ে রাখা যায় না। তাই বহুদিন জোড়াতালি দেওয়ার পর নকল পাকিস্তানের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। আর যদি কেহ মনে করেন পাকিস্তানের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে, তজ্জন্যও বঙ্গবন্ধু, আওয়ামী লীগ বা পূর্ববঙ্গবাসী দায়ী নহে।

<005.005.139>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

বঙ্গবন্ধু শেষ পর্যন্ত Artificial Heart Transplantation করে কোন রকমে জোড়াতালি দিয়ে পকিস্তানকে জিইয়ে রাখতে চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু অকস্মাৎ ২৫শে মার্চের গভীর রাতে জেনারেল ইয়াহিয়া টিক্কাখান-ভুট্টো চক্ৰ বেয়নেটের খোঁচায় পাকিস্তানের অপমৃত্যু ঘটিয়েছে। এর জন্য এককভাবে তারাই দায়ী। তারপর ১০ লক্ষাধিক বাঙালী নরনারী-শিশু-যুবক-যুবতী-মা-ভাই-ভগ্নির তাজা রক্তস্রোতের অতল তলে পাকিস্তান নিমজ্জিত হয়েছে-ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। এর প্রাণরক্ষা আর সম্ভব নহে। ইসলাম Universal -আল্লাহ সবার। আমরা ‘আলহামদুলিল্লাহ রাবিবল আলামীন’- অর্থাৎ সব প্রশংসা তাহার জন্য যিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করেছেন’….
মোট কথা, ইসলাম Co-existence, Co-havitation ও Compromise-এর ধর্ম। এক কথায় ইসলামের মর্মকথা Secularism-এর মর্মকথা। কাজেই আমরা স্বাধীন বাংলদেশ গড়ে তুলবো এমন এক সমাজব্যবস্থা যা হবে সার্বজনীন- Universal and Secular-যাতে থাকবে হিন্দু-মুসলমান-ধৃষ্টান-বৌদ্ধ, জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সমান অধিকার। থাকবে না মানুষে মানুষে কোন বিবাদ-বিচ্ছেদ, কোন ভেদাভেদ। আর আমাদের এই মহান মূলমন্ত্রের হোতা সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালী তথা দুনিয়ার সমস্ত মজলুম বঞ্চিত মানবতার অগ্রনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
ভাগ্যের পরিহাস, তিনি আজ জোনরেল ইয়াহিয়ার কারাগারে আটক, আমরা সাড়ে সাত কোটি বাঙালী সাবধান করে দিতে চাই- বঙ্গবন্ধুর কোন ক্ষতি সাধিত হলে সমগ্র বিশ্ব দাবানলের অগ্নির মত দাঊ দাঊ করে জ্বলে উঠবে। এখনও সময় আছে জেনারেল ইয়াহিয়া, তাকে এখনই মুক্তি দাও-নচেৎ শুধু তোমার পাকিস্তান নয় অচিরেই তুমিও ধ্বংস হয়ে যাবে। জয় বাংলা।
(আবদুল মালেক উকিল,এম-এন-এ)

অভিজ্ঞতার আলোকে
২৪ জুলাই, ১৯৭১
বাংলার মুক্তি আন্দোলনে যারা রক্ত দিয়েছেন, যারা বিভিন্ন রণাঙ্গনে শত্রুসেনার সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন তাদের উদ্দ্যেশে সশ্রদ্ধ অভিবাদন জানিয়ে শুরু করছি। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের রায়কে উপেক্ষা করে, গণতন্ত্রের সমস্ত নীতি পদদলিত করে এবং মানবতার সমস্ত শিক্ষাকে মথিত করে স্বৈরাচারী বিশ্বাসঘাতক পাকিস্তানী বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়েছিল নিরপরাধ নিরস্ত্র বাঙালী জনতার উপর ২৫শে মার্চের রাতে। বাংলার গ্রাম-গ্রামান্তরে সূর্যরশ্মি পৃথিবীর আবহাওয়ায় প্রবেশ করার পূর্বেই প্রচারিত হয়ে গেল এ খবর, পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর নৃশংস কার্যকলাপের ঘটনা। কিন্তু বাংলার মানুষ এবার মরণজয়ী। সামরিক বাহিনীর কামান, ট্যাংক, মর্টার, বিমান ও আরও হাজার ধরনের উন্নত মরণাস্ত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হল তারা। বিপুল বিক্রমে বিশ্বাসঘাতক বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ আরম্ভ হল EPR, পুলিশ বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর। এ খবরও প্রচারিত হল গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে নিশাবসানের পূর্বেই। সচেতন জনতা বুঝতে পারলো মুক্তি তাঁদের সোজা পথে আসবে না। স্বাধীনতা তো ভিক্ষে করে পাওয়া যায় না। স্বাধীনতা আদায় করে নিতে হয়। এবং তার জন্য প্রয়োজন হয় রক্তের। জনতার কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হতে থাকলো বঙ্গবন্ধুর বাণী “রক্ত যখন দিতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের ঠেঁকিয়ে রাখতে পারবে না।” বাংলার বীর জনগণ রুদ্ররোষে বেরিয়ে এল রাস্তায়। কৃষক, মজুর, শিক্ষক, ছাত্র, কর্মচারী ও জনতা অস্ত্র হাতে তুলে নিল। কোটি কণ্ঠ থেকে উচ্চারিত হল রক্তের বিনিময়ে বাংলার মুক্তি আদায় করার দুর্জয় প্রতিজ্ঞা, পরাধীনতার গ্লানির অবসান করার দীপ্ত প্রতিজ্ঞা।

<005.005.140>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

এ ধ্বনি আকাশে বাতাসে প্রতিধ্বনিত হয়ে আঘাত করলো বাংলার গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। আর সে ঢেউ এসে সাড়া জাগালো হজরত শাহ মখদুম শাহদ্দৌলার পদস্পর্শে পবিত্র শাহজাদপুরসহ পাবনা জেলার বেড়া, সাঁথিয়া, উল্লাপাড়া, ফরিদপুরসহ আরও অসংখ্য গ্রামে। প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকলো সবাই। মুক্তিবাহিনী গঠিত হল মহল্লায় মহল্লায়। মা-বোনেরা এবং অশীতিপর বৃদ্ধও এসে দাঁড়ালো মুক্তিবাহিনীর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। সবার মুখেই একই মন্ত্র “জয় স্বাধীন বাংলা”। সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকলে শত্রু বাহিনীর আগমনের- মোকাবেলা করার দৃঢ়প্রতিজ্ঞা নিয়ে। কারও হাতে বর্শা, কারও হাতে দা এবং কারও হাতে মজবুত লাঠি। বাইরে থেকেও মুক্তিবাহিনীর জোয়ানরা এলো। বিভিন্ন জায়াগয় ছাউনি ফেলা হল। শেরপুর থেকে নগরবাড়িঘাট পর্যন্ত ঐ রকম ছাউনি পড়লো পাঁচ-ছয়টা। এ পর্যন্ত ছাউনিতে বাংলার মুক্তিসেনাদের হাতে সাধারণত বন্দুক, রাইফেল এবং কোন কোন ক্ষেত্রে পাকিস্তানী বাহিনীর কাছ থেকে নেওয়া কিছু উন্নত ধরনের অস্ত্র থাকতো। সোনার বাংলার সোনা মুক্তিযোদ্ধাদের জনতা আপন করে নিল। নিষ্পেষিত, অধিকারবঞ্চিত জনগণ মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে দেখতে পেল স্বাধীন বাংলার প্রতিচ্ছবি। একটি ঘটনা বলি। একদিন দুপুরের দিকে খেয়া নৌকায় পার হচ্ছি। সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা কয়েকজন যুবক। নৌকারোহীরা মুক্তিসংগ্রামে মোমেনের ত্যাগের কথা শ্রদ্ধাবনত চিত্তে স্মরণ করছে। একজন অশীতিপর বৃদ্ধ উঠে এলেন আমাদের কাছে। একজন মুক্তিযোদ্ধার মাথায় হাত রেখে বললেন, “তোমরাই তো বাবা অবহেলিত, লাঞ্ছিত বাংলার চোখের মণি। তোমাদের রক্তের বিনিময়ে আমার মাতৃভূমি শত্রুমুক্ত হবে। আমি মুক্ত বাংলায় মরতে পারবো। আমাদের পরবর্তী পুরুষকে আর পরাধীনতার গ্লানি সহ্য করতে হবে না। কি গৌরব এ ত্যাগের! জয় তোমাদের হবেই বাবা, ইনশাআল্লাহ জয় আমাদের হবেই। এ যুদ্ধ তো অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের যুদ্ধ। দুর্ভাগ্য, অনেক বয়েস হয়েছে আমার। অস্ত্র ধরবার ক্ষমতা এখন আর নেই। কিন্তু তবুও যদি আমাদের মত নিরস্ত্র হয়ে সামনে আসতো শত্রু তবে এ বয়সেও একবার দেখিয়ে দিতাম বিশ্বাসঘাতকের কি শাস্তি।” ভাবছিলাম সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর এই আশীর্বাদের উপর শ্রদ্ধা রেখে, মাতৃভূমিকে মুক্ত করবার প্রতিজ্ঞা নিয়েই তো অসংখ্য রণাঙ্গনে বাংলার রত্নরা সদাসচেতন প্রহরী হয়ে রয়েছে হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীর মোকাবেলা করার জন্য। চিন্তা করার আর সময় হয়নি। বৃদ্ধকে মৌখিক শ্রদ্ধা নিবেদনও করা হয়নি। হঠাৎ শুনতে পেয়েছিলাম মারণাস্ত্রের বিকট আওয়াজ। খুব কাছে। কয়েক সেকেণ্ড পরে খেয়াল হল অদূরে পাইকারহাটির ডাববাগানে মুক্তিবাহিনীর ছাউনির কথা-আমাদের বাহিনীর ৬০ জন মুক্তিসেনার কথা। তখন বেলা প্রায় দুটো। পাকিস্তানী বাহিনীর সৈন্যরা ১৪ খানা ট্রাকে সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়ে কাশিনাথপুর থেকে আসছিল বাঘাবাড়িঘাট অভিমুখে। মাঝপথে ডাববাগানে। ট্রীগারে হাত রেখে মুক্তি বাহিনীর জোয়নরা প্রস্তুত। শত্রুসেনাদের ট্রাকগুলো ওদের আওতায় এসে পড়বার সঙ্গে সঙ্গে গর্জে উঠলো মুক্তিসেনাদের রাইফেল আর ব্রেনগানগুলি। শত্রুবাহিনীর পাঁচখানা সৈন্যবাহী ট্রাক অকেজো হয়ে গেল গুলির আঘাতে। প্রাণ দিল ৫০/৬০ জন পাকিস্তানী সৈন্য। এ যুদ্ধে আমাদের বাহিনীর একজন গুরুতররূপে আহত হয়েছিল- EPR- এর লোক। অদ্ভূত শরীর। তার গায়ে বিদ্ধ হয়েছিল ৫/৬টা বুলেট অচেতন অবস্থায় তাকে নিয়ে আসা হল ফ্রন্ট থেকে। ডাক্তারগণ তাকে ঔষধ দিচ্ছেন অপারেশন করে তার শরীর থেকে শত্রুবাহিনীর বুলেট বের করছেন। বাঁচার আশা খুবই কম। আমরা সেবা করছি কায়মনোবাক্যে। ও চোখ মেলে চাইলো। জিজ্ঞেস করলো মুক্তিসেনাদের কুশল, অগ্রগামী অবস্থানের পরিস্থিতি। মুমূর্ষ অবস্থায়ও ওর চোখে-মুখে প্রকাশ পাচ্ছিল মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করার দুর্জয় প্রতিজ্ঞা। করুণাময় আল্লাহতায়ালার অসীম কৃপায় ও বেঁচে আছে। মনে হয় বাংলার কোন প্রান্তে আবার সে অস্ত্র তুলে নিয়েছে শত্রুসেনাকে সমুচিত শিক্ষা দিতে। খোদার অসীম রহমত আছে ওর উপর, কারণ ও তো সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করছে। পরে পাকিস্তানী বাহিনীর কামান আর মটারের আঘাতে ডাববাগান নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। ধ্বংস হয়েছিল পাশ্ববর্তী গ্রামগুলো। মুক্তিযোদ্ধারা তবুও নির্ভয়। তারা আবার ঘাঁটি গড়ালো ঘ্যাটনা ব্রীজের তলায়। পণ করলো, পাকস্তানী বাহিনীকে কিছুতেই সিরাজগঞ্জের দিকে অগ্রসর হতে দেওয়া হবে না। কয়েকদিন পর শত্রুসেনারা ট্রেনে সৈন্য বোঝাই করে সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়ে অগ্রসর হচ্ছে সিরাজগঞ্জের দিকে। কিন্তু মুক্তিসেনারা ঘ্যাটনা ব্রীজের কাছে রেলের ফিস-প্লেট তুলে রেখেছে। ট্রেন থেমে গিয়েছে। পাকিস্তানী সৈন্যরা ট্রেন

<005.005.141>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

থেকে নেমেছে মেরামত করার জন্য। এ সময়ের জন্যই ওৎ পেতে বসে ছিল মুক্তিসেনারা-সংখ্যায় মাত্র ১০ জন। সঙ্গে সঙ্গে গর্জে উঠলো তাদের রাইফেল। ভূলুষ্ঠিত হল আক্রমণকারী পাকিস্তানী সৈন্য বাহিনীর ১৫/১৬ জন সৈন্য। শত্রুসেনারা মেশিনগান, মর্টার আর রকেট ব্যবহার করেও মাত্র ১০ জন মুক্তিকামী বাঙালীর সামনে দিয়ে সেদিন ঘ্যাটনা ব্রীজ অতিক্রম করতে পারেনি। নরপিচাশ পাকিস্তানী সৈন্যরা তখন ফিরে উল্লাপাড়া গ্রামে চলে যায়। নিরপরাধ জনগণের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়, হত্যা করে নিরস্ত্র লোকজনকে। আশ্চর্য পৌরুষ পাকিস্তানী সৈন্যদের। মুক্তিবাহিনীর হাতে মার খেয়ে নিরস্ত্র মানুষ মারার অদ্ভুত মনোবল! আরও আশ্চর্য ইসলামপ্রীতি এহিয়া খানের! ইসলাম কি কোথায়ও নিরস্ত্র, নিরপরাধ লোককে হত্যা করার অনুমতি দিয়েছে? অনুমতি দিয়েছে কি অসংখ্য নিরপরাধ লোকের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়ার, খাদ্যশস্য নষ্ট করার? মেয়েদের উপর পাশবিক অত্যাচার করার?
জানি, এহিয়া খান এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে-পারবে না। কিন্তু যত অত্যাচারই করুক না কেন বাংলার জনগণ এবার এদের উৎখাত করবেই। একজন বাঙালী জীবিত থাকলেও সে পাকিস্তানী বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করবে। বাংলাকে মুক্ত করবে। আমরা পশুর-মত বাঁচতে পারি না। আমাদের মা-বোনের ইজ্জত নিয়ে যারা ছিনিমিনি খেলেছে তাদের আমরা ক্ষমা করতে পারি না। তাইতো সেদিন বাংলার সোনা ফলানো মাঠের মধ্য দিয়ে আসবার সময় কয়েকজন কৃষক আমার কাছে এসেছিল। ওরা বলছিলো, “তিন গাঁয়ের লোক সভা করে ঠিক করেছে-যদি গায়ে মিলিটারী আসে তবে লাঠি, দা আর বর্শা নিয়েই তাদের খতম করব। গায়ের একটা পুরুষ লোক বেঁচে থাকতে একটা মিলিটারী ঢুকতে পারবে না। পুরুষ লোক বেঁচে থাকতে গাঁয়ের মেয়েদের উপর মিলিটারী এত অত্যাচার করবে তা হতে দেওয়া হবে না।” ওরা জানে ওদের লাঠি আর বর্শা মিলিটারীর মারণাস্ত্রের তুলনায় কত নগণ্য। কিন্তু কি অদ্ভুত প্রত্যয়! এহিয়া খান, তুমি এদের পরাভূত করতে পারবে কি?
(এই কথিকাটির লেখকের নাম জানা যায়নি)

২৭ জুলাই, ১৯৭১
অসম সাহসের অধিকারী মুক্তিবাহিনীর হাতে নরপশুরা মার খেয়ে চিরতরে বিদায় নিয়েছে, আর অনেকে হাসপাতালে পা-হাত হারিয়ে কাতরাচ্ছে। তাদের বন্ধুরা সেসব দেখেশুনে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা হতে যেসব সংবাদ পাওয়া গেছে তাতে মনে হয় ‘ছেড়ে দে মা পালিয়ে বাঁচি’ এই পুরাতন কথাটি ওরা জেনে ফেলেছে। কারণ, পশ্চিম পাঞ্জাবী কুকুরদের সঙ্গে বালুচ ও পাঠান সৈন্যদের তীব্র মতদ্বন্দ্ব দেখা দেয়। পশ্চিম পাঞ্জাবী অধিনায়ক অনেক জায়গায় বালুচ ও পাঠান সৈন্যাদের নিরীহ নিষ্পাপ গ্রামবাসীদের উপর গুলি করে হত্যার নির্দেশ দিলে এই মতবিরোধের সৃষ্টি হয়। যার ফলে সৈন্যদের মধ্য হতে একটা বিরাটসংখ্যক অংশ বাঙালীদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে রাজী নয়, এ দৃষ্টান্ত কয়েকটা ঘটনায় সোচ্চার হয়ে উঠেছে। কিছুসংখ্যক পাঠান সৈন্য মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে মুক্তিফৌজে যোগদানেরও ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। অনেকে নিজের পায়ে নিজেরা গুলি করে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। তারা জানে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে

<005.005.142>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

লড়াই করে এ পৃথিবী হতে চিরবিদায় না নিয়ে আহত হয়ে হাসপাতালে থাকা অনেক ভাল। তবুও আশা থাকবে ভাল হয়ে মা, ভাই, বোন, স্ত্রী, পুত্র পরিজনের সঙ্গে দেখা করার।
স্পষ্টতই পাক বাহিনী ভীষণভাবে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। এমনকি সেদিন পাক পশুদের একটা চলন্ত গাড়ীর সামনে একটি বোমা ফুটলে গাড়ী থামিয়ে ড্রাইভার সমেত অস্ত্র শস্ত্র ছেড়ে সকলেই নেমে পালাতে আরম্ভ করে। তখনই মুক্তিবাহিনীর কয়েকজন ও জনগণ গিয়ে গুলি না করে ছুরি দিয়ে পাক পশুদের কতল করে ফেলে। এই চার মাসের যুদ্ধে পাক পশুরা সেখানে যেভাবে নতুন নতুন কলাকৌশল করে প্রস্তুতি নিয়েছে, পরক্ষণেই মুক্তিবাহিনী চারদিকে থেকে আক্রমণ করলে আস্তানাতেই চিরতরে মৃত্যুর কালো অন্ধকারে লুটিয়ে পড়েছে। এসব দেখেশুনে পাক পশুরা বাঙালীদের সঙ্গে আর যুদ্ধ করতে রাজী নয়। তাছাড়া বেশ কিছুদিন হতে পশ্চিম পাকিস্তানের যে সমস্ত লোক বাংলাদেশে এসে ব্যবসা-বাণিজ্য ও এক নম্বর লাইসেন্স নিয়ে কন্ট্রাকটরি করত এবং বড় বড় চাকরিজীবী হয়ে বাংলার মাটিতে আধিপত্য বিস্তার লাভ করে ঘরবাড়ি, আসবাবপত্র তৈরি করে ছেলেমেয়ে নিয়ে বসবাস করত, তাদের অনেকেই এদেশ থেকে চলে গেছে। খুলনা পোর্ট হতে জাহাজ ভর্তি হয়েছে তাদের মালপত্র-জীপ, ট্যাক্সি, খাট, আলমিরা, আসবাবপত্র ও এমন কি যাত্রীবাহী বড় বড় বাস পর্যন্ত। এইসব মালপত্র নিয়ে সাগর পাড়ি দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে গেছে। বাংলাদেশে কার্যরত সব লোকই খুব ভালভাবেই উপলব্ধি করতে পেরেছে এদেশে তাদের থাকা চলবে না। একটা ঘটনার উল্লেখ করি। বেশ কিছুদিন আগে পশ্চিম পাকিস্তানী পশুদের মেজর খান আলতাফ হোসেনের ভাই, যিনি একজন সি এ্যাণ্ড বি’র প্রথম শ্রেণীর কন্ট্রাকটর, তিনি বক্তব্যগুলি তার আর এক বাঙালী প্রথম শ্রেণীর কন্ট্রাকটর ঘনিষ্ঠ বন্ধুর কাছে পেশ করে বলেন, “রহমান সাহেব, এদেশে আমরা থাকতে পারব না। ভাইয়ের কাছে অনেক কিছু শুনলাম। যে কটা টাকা-পয়সা আছে তা নিয়ে আমি পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যাচ্ছি। আর আমার যে সমস্ত জিনিসপত্র রয়েছে, তা আপনাকে দিয়ে চলে যাব। আপনাদের দেশ মুক্ত হবার পর বেঁচে থাকলে পরে দেখা হবে।” এমন কি খুব গোপনভাবে তিনি বলে গেলেন, তার ভাই যশোর ক্যান্টনমেন্টে রয়েছেন কিন্তু খুলনায় থাকা বেশী নিরাপদ নয় মনে করে চলে আসতে চান- কখন কোন সময় কি হয় তার ভয়ে।’ এখন বুঝতেই পারা যাচ্ছে তাদের মনোবলের মিটার কত নীচুতে নেমে গেছে। অথচ টিক্কা এত ধাক্কা খাওয়ার পরও চিন্তা করতে পারে না কি গতি হবে তার। আর জঙ্গী এহিয়া ইসলাবাদের স্বপ্নপুরীতে থেকে মুক্তিবাহিনীর মার কি রকম কি করে বুঝিতে পারবে? যে স্বপ্নপুরী একদিন ওর বাপ বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের রক্ত চুষে অর্থ নিয়ে গড়ে তুলেছিল, সেখানে শুধু লালপানির শ্রাদ্ধ করা হয়। আর এদিকে তার দালাল ভাইস অ্যাডমিরাল মোজাফফর হাসান ঐ বর্বর কুকুরদের আস্তানায় আস্তনায় সাহস যোগাতে বেরিয়ে পড়েছে। হলে কি হবে, ফল যে হচ্ছে তার উল্টো। মুক্তিবাহিনীর হাতে ওরা দিনের পর দিন মার খেয়ে হয়েছে দিশেহারা।
ছিঃ ছিঃ লজ্জা করে একটা কথা বলতে; মুক্তিবাহিনীর হাতে এত মার খাওয়ার পরেও ইয়াহিয়া আজও ভারতকে দোষারোপ করছে। লজ্জাহীনকে শিক্ষা দিতে হলে কিছুটা নির্লজ্জ না হয়ে পারা যায় না। এখন পর্যন্ত তো বাংলার মুক্তিবাহিনীকে স্বীকার করা হল না, অথচ মুক্তিবাহিনী বাংলার মাটিতে থেকে আজ হতে প্রায় চার মাস ধরে অবিরাম লড়াই করে যাচ্ছে, তবুও তারা ভারতের দুষ্কৃতকারী। যদি তাই-ই হয় তাহলে ইয়াহিয়ার প্রিয় দালাল ও পাক সেনাদের জিজ্ঞাসা করলেই তো সঠিক খবরটা পাওয়া যাবে। কারা তারা, যাদের ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পিছনে সরে যাচ্ছে? দালালেরা কিছুদিনের জন্য পরিত্রাণ পাবার আশায় তো রাজাকার বাহিনী করেছে। আর এই রাজকার বাহিনীতে যতসব চোর, বাটপার, বদমাইশ ও ডাকাতদের নেয়া হয়েছে- যারা সমাজের কাছে ঘৃণার পাত্র এবং যাদের সমাজে কোন ঠাঁই নেই। এদের মধ্যে অবশ্য অনেকে জেল-হাজতে ছিল। এই সমস্ত লোকেরাই পাক পশুদের লুটতরাজ ও ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিতে সাহায্য করেছিল। তাদের নাম ইতিমধ্যে মুক্তিবাহিনীর কাছে ধরা পড়েছে। আসলে মুক্তিবাহিনীর হাত থেকে জীবন রক্ষার্থে রাজকারের খাতায় নাম লিখেছে। অথচ দেখা গেছে, পাক বাহিনী এদেরকে ভালোভাবে বিশ্বাসও করে না। ঐ রাজাকারেরা

<005.005.143>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

এখন শুধুমাত্র মুসলিম লীগ ও জামাতে ইসলামের কতগুলি দালালের দেহরক্ষী হিসাবে রাইফেল ঘাড়ে করে চলে, কোন সময় মুক্তিবাহিনীর সম্মুখীন হলেই অস্ত্রশস্ত্র ছেড়ে পালিয়ে যায়।
এদিকে আবার ইয়াহিয়া ডিফেন্স সার্টিফিকেট, সেভিংস সার্টিফিকেট ও প্রাইজবণ্ড কেনার কতই না আহবান জানাচ্ছে; কিন্তু বিশ্বাসঘাতক এহিয়া জানে যে অন্ধ তার লাঠি একবারই হারায়। যে ভুল বাঙালী একবার করেছে, তার পুনরাবৃত্তি আর করতে পায় না। কারণ তারা জানে এসব টাকা-পয়সা কোন দিনই আর ফিরে পাওয়া যাবে না। বাঙালীদের জানতে বাকি নাই যে, এগুলোর হেড অফিস ঐ দালালদের দেশে। সে জন্যই ব্যাঙ্ক-বীমার টাকা জমা দেয়া ও প্রিমিয়াম বন্ধ হয়ে গেছে। আজকে ইন্সুরেন্সের প্রিমিয়ার দিতে গেলে কোন দিনও আর সে টাকা ফিরে পাওয়া যাবে না। বরং ওদের অর্থনৈতিক অবস্থাকে আরও শক্তিশালী করা হবে। অবশ্য বাংলাদেশ মুক্ত হবার পর বাংলাদেশ সরকার এর একটা ব্যবস্থা করবে। আমরা পশ্চিম পকিস্তানী দালালদের কোন মালপত্র খরিদ করবো না। কোন কাপড়-চোপড় আমরা না কিনলে ওদের গুদামে সব জমা হয়ে হয়ে পচবে। এ জন্যই ওদের কল-কারখানা বন্ধ হতে বাধ্য। ইতিমধ্যে অনেক মিল ও কারখানা হতে শ্রমিক ছাঁটাই আরম্ভ হয়েছে। আমরা ওদের অর্থনৈতিক অবস্থাকে চিরতরে ভেঙ্গে চুরমার করে দেবো। বাংলার মানুষকে ফাঁকি দিয়ে অর্থ সঞ্চয় করবার দিন ঐ ২৫শে মার্চের রাত ১০টায় ফুরিয়ে গেছে। যারা আজ পশ্চিম পাকিস্তানী দ্রব্য দেখেশুনে খরিদ করছে, তারা নরঘাতক এহিয়ার হাতকে শক্তিশালী করতে সহায়তা ছাড়াও বাংলার সম্পদ ভোগ করে বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছে। বাংলার মাটিতে জন্ম নিয়ে, বাংলার সম্পদ ভোগ করে বাংলার মানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা যে কত বড় অপরাধ তার কৈফিয়ৎ ওদের দিতে হবে জীবন দিয়ে। বাঙালীরা তাদের অধিকার ও স্বাধীনতা রক্ষা করবেই করবে- যার জন্য দিনের পর দিন গ্রাম বাংলার প্রতিটি ছাত্র, শ্রমিক ও যুবকেরা এসে মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করছে। এরা সকলেই স্বাধীনতা রক্ষার বজ্রকঠিন শপথ নিয়ে বাংলার পথে-প্রান্তরে ঐ কুকুরদের চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দেবার জন্যই বেরিয়ে পড়েছে। তারা জানে, অমাবস্যার কালো অন্ধকার ভেদ করে অচিরেই লাল সূর্য আলোয় ভরা আভা নিয়ে পূর্বদিগন্তে উদিত হবে।
(অধ্যাপক এম, এ, সুফিয়ান রচিত)

শেখ মুজিবের বিচার প্রহসন
২৭শে জুলাই, ১৯৭১
(দ্বিতীয় পর্যায়)
বাংলদেশ রত্নগর্ভা। বাংলাদেশে শুধু সম্পদ নয়, আছে মানুষের মত মানুষ। বাংলাদেশের জননেতারা যুগের পর যুগ, বছরের পর বছর নিজ দেশের জনগণকে ভালোবেসে যে নির্যাতন ভোগ করেছেন, তার তুলনা সমকালীন ইতিহাসে নেই। বঙ্গজননী তার কোলে শুধু তীতুমীর, ক্ষুদিরাম, সূর্যসেন, বাঘা যতীনদের মত বিপ্লবীদের ধারণ করেনি, করেছে চিত্তরঞ্জন, এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মত বিখ্যাত নিয়মতান্ত্রিক নেতাদেরও। নিয়মতান্ত্রিক নেতা হয়েও এরা দেশের জন্য কম নির্যাতন ভোগ করেননি। শেরে বাংলা ফজলুল হককে পাকিস্তানের তৃতীয় বড়লাট গোলাম মোহাম্মদ ‘দেশদ্রোহী’ আখ্যা দিয়ে নজরবন্দী করেছিলেন। এই বৃদ্ধ সর্বজনমান্য নেতাকে পশ্চিম পাকিস্তানের শয়তান শাসকচক্র ঈদের নামাজের জামাতেও যোগ দিতে দেয়নি। এর চাইতেও নির্মম ও নিষ্ঠুর আচরণ করা হয়েছে হোসেন শহীদ সোহরাওয়াদীর সঙ্গে। হৃদরোগে আক্রান্ত এই নেতাকে বৃদ্ধ বয়সে ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক ষড়যন্ত্রের’ কাল্পনিক অভিযোগে দীর্ঘ ছয় মাস

<005.005.144>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

জেলে আটকে রাখা হয়েছে। জেলেই তার স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়ে। মুক্তিলাভের পর দেশের বাইরে সুদূর বৈরুতে প্রিয় পরিজনের সান্নিধ্য থেকে বহুদূরে নিঃসঙ্গ অবস্থায় তার মৃত্যু ঘটে। বাংলাদেশের আরেক জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। তিনি এখনো আমাদের মধ্যে আছেন। ১৯৫৪ সালে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক সাধারণ নির্বাচনের পর গিয়েছিলেন লণ্ডনে। তিনি দেশে ফেরার আগেই হয়ে গেল সব ওলট-পালট। যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভাকে কলমের এক খোঁচায় বরখাস্ত করে দিলেন বড়লাট গোলাম মোহাম্মদ। ফজলুল হক হলেন নজরবন্দি। গোলাম মোহাম্মদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ইসকান্দার মীর্জা হুঙ্কার ছেড়ে বললেন, ‘মওলানা ভাসানী যদি দেশে ফেরেন, তাকে আমি গুলি করার নির্দেশ দেব।’
বিবরণ দিতে গেলে এক মস্তবড় পুঁথি তৈরি করা যায়। বাংলাদেশের এমন একজন নেতা, এমন একজন রাজনৈতিক কর্মী ও বুদ্ধিজীবী নেই যাকে পাকিস্তানের ফ্যাসিস্ট শাসকচক্র হয়রানি করেনি, নির্যাতন করেনি, অমর্যাদা করেনি। তাই এবারেও বৃটিশ পার্লামেন্টারী প্রতিনিধিদলের কাছে পাকিস্তানের বর্তমান ফ্যাসিষ্ট জঙ্গীচক্রের নায়ক ইয়হিয়া খাঁ যখন বলেন ‘শেখ মুজিব একজন ক্রিমিনাল, তখন আমরা বিস্মিত হই না। ইয়াহিয়ার মত একজন অর্ধশিক্ষিত বর্বরের কাছ থেকে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রাণপ্রিয় নেতা সম্পর্কে এর চাইতে শোভন ও ভদ্র ভাষা আমরা আশা করি না। যে ব্যক্তি নিজে ক্রিমিনাল,যার হাতে এখনো নিরীহ-নিরপরাধ বাঙালীর বুকের তাজা রক্ত লেগে রয়েছে, ইতিহাসের সেই জঘন্যতম খুনী দস্যু বাংলার ইতিহাস সৃষ্টিকারী এক মহান জননায়ক সম্পর্কে শ্রদ্ধাভরে কথা বলবেন, এটা কেমন করে সম্ভব হয়?
আমি আগেই বলেছি, বাংলাদেশে অনেক মহান নেতা জন্মেছেন। দেশের জন্য তারা যথেষ্ট কষ্ট ভোগ করেছেন, নির্যাতন সহ্য করেছেন। তারা সকলেই আমাদের শ্রদ্ধেয়। তবু এ কথা স্বীকার করতেই হবে, নির্যাতন বরণ ও নেতৃত্বাদানের ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যুগ সৃষ্টিকারী নেতা। তার ত্যাগ, সাহস ও ব্যক্তিত্ব অতুলনীয়। তিনি এখন শুধু বাঙালীর নয়নমণি নন, কিংবদন্তীর রাজা। জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রায় বারটি বছর তিনি কাটিয়েছেন জেলে। ইয়াহিয়ার আগে আইয়ুব একবার তার গলায় ফাসির রজ্জ্ব পরাতে চেয়েছিলো। পারেনি। এখন আবার সেই ফাঁসির রজ্জ্ব হাতে নিয়ে খুনী ইয়াহিয়া নতুন খুনের নেশায় মত্ত হয়ে উঠেছে। শেখ মুজিবের অপরাধ তিনি বাংলাদেশকে ভালোবাসতেন। বাংলাদেশের মানুষ তাকে ভালোবাসে। শেখ মুজিব বাংলাদেশের ইতিহাসে যে অধ্যায় যোজনা করেছেন, তার কোন দ্বিতীয় নজির নেই। একটি নিয়মতান্ত্রিক গণআন্দোলনকে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও নেতৃত্বের প্রভাবে তিনি রূপান্তরিত করেছেন বিপ্লবে। বিপ্লবকে রূপান্তরিত করেছেন মুক্তিযুদ্ধে। বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ আজ মুক্তিযোদ্ধা। বাংলাদেশের নিরীহ নিরস্ত্র মানুষ ইতিহাসের সবচাইতে জঘন্য ও বর্বর হত্যাকাণ্ড রুখে দাঁড়িয়েছে। আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত একটি সুদক্ষ ও শক্তিশালী সেনাবাহিনীর সঙ্গে বলতে গিয়ে প্রায় খালি হাতে লড়ছে। এ কি ইতিহাসের কম বড় বিস্ময়? এই অসম্ভব সম্ভব হয়েছে একটিমাত্র মানুষের সবল ও প্রেরণাদানকারী নেতৃত্বের জন্য। একটি নামই আজ বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের মুক্তি সংগ্রাম। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশের সংগ্রামী ইতিহাস বঙ্গবন্ধুকে সৃষ্টি করেছে। আর বঙ্গবন্ধু সৃষ্টি করেছেন বাংলাদেশের নতুন সংগ্রামী ইতিহাস। তাই বাংলাদেশের ঘৃণ্য শত্রু ইয়াহিয়া, হামিদ ও টিক্কা খাঁর দল এই ইতিহাস এবং এই ইতিহাসের নায়ক শেখ মুজিবকে ধ্বংস করার জন্য পাগলা কুকুরের মত হয়ে উঠেছে। শেখ মুজিবকে জেলে বন্দী রেখে কাপুরুষ ইয়াহিয়া সাহস ও স্বস্তি পাচ্ছে না। সুতরাং বিচারের নামে তাকে হত্যা করার এই শয়তানি চক্রান্ত।…
(আবদুল গাফফার চৌধুরী রচিত)
২০শে আগষ্ট, ১৯৭১
(এই পর্যায়ের শেষ আলোচনা)
সত্তরের নির্বাচনবিজয়ী বাংলাদেশের একচ্ছত্র জাতীয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করার গোপন চক্রান্ত চলছে পকিস্তানী নাৎসীদের জেলে। এটা যেবিচার নয়, বিচার প্রহসন এবং হত্যা করার নারকীয় চক্রান্ত,

<005.005.145>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

সে সম্পর্কে বিশ্বের কোন দেশের কোন মানুষের মনে এতটুকু সন্দেহ নেই। শেখ মুজিবের বিচার প্রহসন সম্পর্কে ইউরোপের প্রভাবশালী দৈনিক ‘ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটর’ পত্রিকা গত ১২ই আগষ্ট তারিখে এক সম্পাদকীয় প্রবন্ধে বলেছেনঃ “এই বিচারে বিদেশী সাংবাদিকদের পর্যন্ত উপস্থিত থাকতে দেয়া হচ্ছে না। বিদেশের সংবদাপত্রগুলোর প্রতি ইসলাবাদের এই অবিশ্বাস, পাকিস্তানের কল্যাণ সাধন করবে না।”
‘ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটর’ পত্রিকা ঠিকই বলেছেন। তবে তিনি বলছেন বিদেশী সাংবাদিকদের প্রতি ইসলামাবাদের জঙ্গীচক্রের অবিশ্বাস, আসলে সেটা ভয়। ইয়াহিয়া জানে, গত ২৫শে মার্চ রাতে ঢাকায় বিদেশী সাংবাদিকেরা ছিলেন বলেই, তার পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের কথা বিশ্ববাসী জানতে পেরেছে। আজো শেখ মুজিবের তথাকথিত প্রহসন মূলুক বিচারে যদি বিদেশী সাংবাদিকরা উপস্থিত থাকেন, তাহলে আসল কথা ফাঁস হয়ে যাবে। ধরা পড়বে আসল অপরাধী ইয়াহিয়া এবং তার বেঈমান খুনী চক্র। তাই বিচারের নামে খুনী ইয়াহিয়ার এই কঠোর গোপনীয়তা। প্রতি যুগে বিচারের নামে ইয়াহিয়ার মত খুনীচক্রের যে হত্যালীলা, তারই প্রতি ধিক্কার জানিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখে গেছেন
‘আমি যে দেখেছি প্রতিকারহীন শক্তের অপরাধে
বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে।’
পশ্চিম পাকিস্তানে ইয়াহিয়ার খুনীচক্রের ষড়যন্ত্রে আজ এই বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদছে। তবে কবিগুরু, তোমাকে আজ সাড়ে সাত কোটি বাঙালী দৃঢ় আস্থার সঙ্গে এই আশ্বাস দিতে পারে, বাংলাদেশে প্রতিকারহীন শক্তির যুগ শেষ হয়ে গেছে। শয়তান ইয়াহিয়া চক্র আজ বাংলাদেশে প্রতিকারহীন শক্তি নয়। এই জানোয়ারদের, এই বর্বর পশুশক্তির পৈশাচিক অত্যাচারের প্রতিকার করার জন্য বাংলাদেশের তরুণরা আজ অস্ত্ৰধারণ করেছে। বাঙালী মুক্তিবাহিনী আজ অজেয়, অপরাজেয়, অপ্রতিরোধ্য। এই অপরাজেয় মুক্তিবাহিনীর ভয়ে কাপুরুষ ইয়াহিয়া ঢাকা আগমনের সাহস পাচ্ছে না। টিক্কা এবং সৈন্যরা আশ্রয় নিয়েছে ছাউনিতে।
এখন প্রশ্ন, এত শীঘ্ৰ শেখ মুজিবকে বিচারের নামে হত্যা করার জন্য পাগলা কুকুরের মত কেন হন্যে হয়ে উঠেছে ইয়াহিয়া? এই প্রশ্নের জবাব অত্যন্ত সোজা। মূর্খ ইয়াহিয়া ভেবেছে- এক, শেখ মুজিবকে হত্যা করা হলে বাংলাদেশে মুক্তিবাহিনীর উৎসাহ নষ্ট হবে এবং মুক্তিযুদ্ধ ব্যর্থ হবে; দুই, বাংলাদেশ নেতাহীন হবে এবং তার প্রতিরোধ শক্তি ধ্বংস হবে; তিন. শেখ মুজিব বেঁচে না থাকলে বাংলাদেশের সারা এলাকা স্বাধীন হলেও তাকে সংগঠিত ও স্থিতিশীল করার মত কোন নেতা ও সংগঠন থাকবে না।
আগেই বলেছি, অতীতের ইতিহাস থেকে কোন শিক্ষা গ্রহণ করেনি এই মূৰ্খ ইয়াহিয়া। নইলে সে জানতো, আইয়ুবের আমলে এই পরীক্ষা একবার নয়, বহুবার হয়ে গেছে। ১৯৬৬ সালে যখন বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ছয় দফার আন্দোলন শুরু করেন, তখন আইয়ুব বঙ্গবন্ধুকে দীর্ঘকালের জন্য কারাগারে রেখে ভেবেছিল আন্দোলন ব্যর্থ হবে। শেখ মুজিবকে ছাড়া তার হাতে গড়া আওয়ামী লীগ এই আন্দোলনকে টিকিয়ে রখতে পারবে না। আইয়ুবের এই দুরাশা ব্যর্থ হয়। ১৯৬৭ সালে কুচক্রী নওয়াবজাদা নসুরুল্লাকে হাত করে পশ্চিম পাঞ্জাবের চৌধুরী মোহম্মদ আলী চক্র ভেবেছিল, শেখ মুজিব জেলে রয়েছেন এই সুযোগে আওয়ামী লীগকে ভেঙে তাদের পকেট প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা যাবে। কিছু লোককে হাত করে এজন্য তারা চেষ্টাও চালিয়েছিলেন, কিন্তু নসুরুল্লার এই চক্রান্তও সফল হয়নি। ১৯৬৮ সালে যখন তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা শুরু করা হয়, তখনও আইয়ুব চক্র ভেবেছিল শেখ মুজিবকে জেলে রেখে এই মামলার বিচার চালানো হলে দেশে নেতৃত্বের অভাবে কোন আন্দোলন হবে না। আইয়ুবকে এই ভুলের খেসারত দিতে হয়েছে অত্যন্ত কঠোরভাবে। ১৯৬৯ সালে বাংলাদেশে শেখ মুজিবের মুক্তি এবং গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসনের দাবীতে যে গণবিপ্লব হয়, তখনো শেখ

<005.005.146>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

মুজিব কারাগারে। তার অনুপস্থিতিতে আওয়ামী লীগের নবীন অথচ সংগ্রামী নেতারা এবং আওয়ামী লীগের প্রতি সহানুভূতিশীল ছাত্রনেতারা এই বিপ্লবকে সাফল্যের দিকে নির্ভুলভাবে পরিচালনা করেন।
ইয়াহিয়া বাংলাদেশের এই বিপ্লবী ইতিহাস জানে না তা নয়। কিন্তু মানবতাবোধ ও ইতিহাসজ্ঞান বর্জিত এক মূৰ্খ সেনাপতির কাছ থেকে রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি ও প্রজ্ঞা আশা করা বাতুলতা। ইয়াহিয়া এবং তার চারপাশে জমায়েত জঙ্গী নায়কেরা জানে না, একজন ব্যক্তিকে হত্যা করা যায়; কিন্তু একটি আইডিয়া বা আদর্শকে হত্যা করা যায় না। শেখ মুজিব আজ শুধু একজন ব্যক্তি নন, একটি সংগ্রামী আইডিয়া বা আদর্শ। বাংলাদেশের বর্তমান সংগ্রামী জাতীয়তা এবং তার সংগ্রামী সংগঠন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক ভিত্তি শেখ মুজিবরূপী এক আদর্শ। এই আদর্শেই আওয়ামী লীগ এবং বাংলাদেশের মুক্তিসেনারা আজ বলীয়ান। শেখ মুজিব যদি সশরীরে এই আদর্শ রূপায়ণে নেতৃত্বের ভূমিকায় থাকতে পারেন, তাহলে সারা বাংলাদেশের ও বাঙালী জাতির পরম গৌরব। আর তিনি যদি কোন চক্রান্তের শিকার হয়ে নাও থাকেন, তাহলেও তার প্রদর্শিত পথেই আওয়ামী লীগ ও বাঙালী জাতির জয়যাত্রা অব্যাহত থাকবে। শেখ মুজিব আজ দেশের বাইরে বহুদূরে কারান্তরালে রয়েছেন; তবু তার প্রদর্শিত পথে অবিচল থেকে আওয়ামী লীগ বর্তমানে একটি সুসংগঠিত সংগ্রামী প্রতিষ্ঠান। স্বাধীন গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশ সরকারে শক্তি ও স্থিতিশীলতা দিন দিন বেড়ে চলেছে। মুক্তিযোদ্ধারা দিন দিন সংগিঠত ও শক্তিশালী হচ্ছেন। সুতরাং বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ষড়যন্ত্র দ্বারা বাঙালী জাতির এই নবঅভ্যুত্থান ব্যর্থ করার আশা মূর্খ ইয়াহিয়ার দূরাশা মাত্র।
তবে বাঙালীর নয়নমণি, জাতির প্রাণপ্রিয় মুজিব ভাইকে যদি হত্যা করা হয়, তাহলে ইয়াহিয়া চক্র নিস্তার পাবে তারা এমন আশা যেন স্বপ্নেও না করে। এই কথা স্পষ্টভাবে ঘোষণা করার সময় এসেছে। বাংলাদেশের উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেছেন, এই হত্যাকাণ্ডের একমাত্র পরিণতি হবে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের শতবর্ষব্যাপী যুদ্ধ। আমরা বলি, একজন বাঙালীর দেহে শেষ রক্তবিন্দু থাকতে এই পৈশাচিক হত্যার পরিশোধ না নিয়ে তারা ছাড়বে না। ইয়াহিয়া চক্র পালিয়েও প্রাণে বাঁচবে না। তোজো ও হিটলারের পরিণতি বরণই তাদের ভাগ্যে অবধারিত হয়ে রয়েছে। অন্যদিকে আমরা বিশ্বাস করি, কোটি কোটি বিশ্ববাসী এবং সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর ভালোবাসা ও শুভেচ্ছার জোরে শেখ মুজিব ইয়াহিয়ার সমস্ত শয়তানি চক্র ব্যর্থ করে বেঁচে থাকবেন এবং তার প্রিয় জনগণের মধ্যে ফিরে আসবেন। আজ এই সংকট সন্ধিক্ষণে সেই শুভদিনের প্রতীক্ষায় আমরা দিন গুনছি।
শেখ মুজিব দীর্ঘজীবী হোন। জয় বাংলা। ..
(আবদুল গাফফার চৌধুরী রচিত)

পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে
২৫শে আগষ্ট, ১৯৭১
রোগাগ্রস্ত ভদ্রলোকের অপচেষ্টা
বিদ্রোহের অগ্নিতে ভষ্মীভূত ইয়াহিয়ার পাকিস্তানে বিশ্বের বৃহত্তম উপ-নির্বাচন অনুষ্ঠানের অয়োজন চলছে। পৃথিবীতে এতো ব্যাপক উপ-নির্বাচন বোধ হয় আর কোন দেশে হয়নি। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের দখলীকৃত

<005.005.147>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

এলাকায় মূক ও শঙ্কিত নাগরিকগন অস্ত্রের হুঙ্কারে একটি তথাকথিত সাধারণ নির্বাচনের স্বাদ পেতে হয়তো চলছেন। বন্দী নাগরিকদের অন্ধকূপের মধ্যে নিক্ষেপ করে ইয়াহিয়া যে উপ-নির্বাচনের ফাঁদ পেতেছেন, গণহত্যার মতোই সেটা হবে তার আর একটি ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রমূলক রেকর্ড-প্রবঞ্চকের ডাইরীতে নতুন অধ্যায়ের সংযোজন।
ভদ্রলোক রোগগ্রস্ত। মনস্তত্ত্ববিদগণ যেমন কোন কোন রোগীর মধ্যে বিশেষ জৈবিক প্রবণতা সন্ধান পান, মনোবিজ্ঞানের চেম্বারে উপস্থিত করলে ইয়াহিয়ার মধ্যেও রক্তপাতের প্রবল উন্মাদনা পরীক্ষাযন্ত্রে ধরা পড়বে।
জীবনে অন্ততঃ একটা বিজয় তার আছে- তা হচ্ছে অস্ত্রের ঝঙ্কারে বলপূর্বক পাকিস্তান দখল, রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতা কুক্ষিগত। অঙ্গুলি হেলনে তিনি নির্বাচন করেছেন, অঙ্গুলি আস্ফালনে তিনি গণহত্যার পৈশাচিক তাণ্ডবে সেনাদের লেলিয়ে দিয়েছেন। আবার খেয়াল-খুশী মতো নির্বাচিত প্রতিনিধিদের আসনচ্যুত করার নির্দেশ দিয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়েছেন। এই তোঘলকী হঠকারিতার উত্তরাধিকারী শৈলনিবাসী ভদ্রলোক ইয়াহিয়া জানেন না যে, নির্বাচন অনুষ্ঠানের নির্দেশ তিনি দিয়ে থাকতে পারেন; কিন্তু প্রতিনিধিদের সদস্যপদ খারিজের অধিকার তার নেই। কারণ, পরিষদ সদস্যগণ নির্বাচিত হয়েছেন জনগণের ভোটে, তার ভোটে নয়। এক্ষেত্রে ধনুক থেকে তীর তার নাগালের বাইরে চলে গেছে। তার এই উচ্ছৃঙ্খল চরিত্রটি একটি মাত্র অভিপ্রায় বা মনোবাসনা দ্বারা পরিচালিত, তা হচ্ছে অস্ত্রবলে বেআইনীভাবে ক্ষমতার মসনদ আইনানুগ ও চিরস্থায়ী করার অভিপ্রায়। পাগলাগারদের চিকিৎসকগণ এ রোগের একটা নাম দিয়েছেন। আপাতঃদৃষ্টিতে সুস্থ-সবল দেখতে, এমন কি মাত্রাধিক অমৃত রসধারা পান করেও লোকটি স্বাভাবিক মাতালের মতো ব্যবহার করে। কিন্তু বিশেষ বিশেষ আকাঙ্খা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে সে অকস্মাৎ অস্বাভাবিক হয়ে পড়ে- তখন যেকোন ব্যক্তিকে সে হত্যা করতে পারে। বিশষজ্ঞগণ এ রোগকে “প্যারানাইয়া” বলেন। উন্মাদদের শ্রেণীবিন্যাস।
নরহত্যার জেনারেল এই ইয়াহিয়া কলমের এক খোঁচায় আওয়ামী লীগের ৭৯ জন জাতীয় পরিষদ সদস্যের নির্বাচন বাতিল করেছেন। তিনি প্রাদেশিক পরিষদের ১৯৫ জন আওয়ামী লীগ সদস্যের পদ খারিজ করে আত্মতুষ্টি লাভ করেছেন। শুধু তাই নয়, তিনি নিজেই আবার আওয়ামী লীগ প্রধানরূপে অবশিষ্ট পরিষদ সদস্যদের উক্ত প্রতিষ্ঠান থেকে বহিষ্কার করে স্বপ্নরাজের ভবিষ্যৎ পরিষদে স্বতন্ত্র সদস্য হিসেবে আসন গ্রহণ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। অর্থাৎ “প্যারানাইয়া রোগে আক্রান্ত এই ভদ্রলোকের এক অস্বাভাবিক খেয়ালে দু’টি পরিষদে আওয়ামী লীগের মোট ৪৫৫ জন সদস্যপদ হারিয়েছেন এবং মোট যে ১৮১ জন সদস্যপদ হারাননি, তাদের ইয়াহিয়া খান নিজেই শেখ মুজিবের পক্ষে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার করেছেন! এ যেন টোগোল্যাণ্ডের কোন এক ক্লাউন অধিনায়ক কর্তৃক ইংল্যাণ্ডের প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতাচ্যুত করার নির্দেশের মতো। ইয়াহিয়ার এই স্বেচ্ছাচারমূলক অধিকারটা রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের কাছে উন্মাদের কার্যকলাপ বলেই পরিগণিত হচ্ছে, একথা আজ সত্যের মতো উজ্জ্বল।
যে ২৭৪ জনকে অপরাধী বলে উল্লেখ করে সদস্যপদ খারিজ করেছেন, তাদেরই আবার বিচারের জন্যে কোর্টে উপস্থিত হতে বলেছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি শাস্তি আগে দিয়েছেন, বিচার পরে হতে চলছে। শরীরের রক্তপ্রবাহ মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে; কিন্তু মানুষ যদি রক্ত পান করে, তবে তার কার্যক্রমে অস্বাভাবিক ব্যতিক্রম ও অসঙ্গতি দেখা যায়- এ তারই দৃষ্টান্ত।
এতো সামঞ্জস্যহীন কার্যপদ্ধতির মধ্যেও ইয়াহিয়া একটি বিশেষ উদ্দেশ্য সফল করতে চাচ্ছেন- এক ঢিলে দুই পাখী। অন্ততঃ কাল্পনিক পরিষদে আওয়ামী লীগকে এভাবে সদস্যপদ থেকে বঞ্চিত করা যাবে এবং গণহত্যার সহচরও ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী চক্রান্তকারী ভূট্টোকে সংখ্যালঘু দলের নেতার নেতারূপে পঙ্গু করা সম্ভব হবে।

<005.005.148>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

জাতীয় পরিষদে মাত্র ৮৮ জন এবং প্রাদেশিক পরিষদে ৯৩ জন আওয়ামী লীগ নেতার সদস্যপদ বাতিল হয়নি বলে পিণ্ডি সরকার ঘোষণা করে স্বাধীনতা সংগ্রামে লিপ্ত বাংলাদেশের নাগরিকদের বোঝাতে চেষ্টা করেছেন যে, উক্ত মোট ১৮১ জন আওয়ামী লীগ পরিষদ সদস্য ইয়াহিয়া ও তার উন্মাদ জেনারেলদের পাশে রয়েছেন। এমন কি বাংলাদেশে গণহত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিকাণ্ড, ও নারী নির্যাতন তারা সমর্থন করেন। পরিষদ সদস্যদের একটা বিরাট অংশ স্বাধীনতা সংগ্রামে বিশ্বাস করেন না। অপরদিকে এমন একটা ভ্রান্ত ধারণা দিতে চেষ্টা করা হয়েছে যে, উক্ত ১৮১ জন সদস্য ইয়াহিয়ার কোটের পকেটে রয়েছেন। বিশ্ববাসীর কাছে তিনি এই বিভ্রান্তিকর চিত্র সাময়িককালের জন্যে তুলে ধরেছেন। কারণ মিথ্যাশ্রয়ী এই জেনারেল জানেন যে, ১৮১ জন সদস্য তার মুঠোর মধ্যে নেই। এদের প্রায় সব ক’জনই বিশ্বাসঘাতকের ভূমিকা পালন করতে যাননি। তিনি সদস্যপদ বাতিল না করে শুধুমাত্র প্রলোভন দেখিয়েছেন।
এতো ব্যাপকসংখ্যক আওয়ামী লীগ সদস্যকে ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তা বিশ্বাস করতে পারে না। অবস্থার প্রেক্ষিতে পরিষদের মধ্যেও তারা বিদ্রোহীর ভূমিকা নিতে পারেন। যারা বিশ্বাসঘাতক, ‘বিশ্বাস’ শব্দটি তাদের অভিধানে থাকে না। চক্রান্তের প্রথম পর্বেই হচ্ছে সন্দেহ। রক্তপিপাসুদের হাতে নিহত হবার জন্যে মুষ্টিমেয় দু’চারজন ছাড়া কেহই যখন ইয়াহিয়ার বন্দীশালায় পা বাড়াবেন না, তখন তিনি পর্যায়ক্রমে বাতিলকৃত সদস্যদের তালিকার কলেবর বৃদ্ধি করবেন এবং সে সংখ্যা চার শতাধিক হয়ে দাঁড়ালে আশ্চর্য হবার কিছু থাকবে না। আর সে ক্ষেত্রে যুদ্ধবিধ্বস্ত দক্ষিণ ভিয়েতনামের নির্বাচনের রূপ নেবে ইয়াহিয়ার সর্বব্যাপী উপ-নির্বাচন।
এই সামগ্রিক পরিস্থিতি সম্পর্কে “কম্পিউটারকে” ও জিজ্ঞেস করলে একই উত্তর পাওয়া যাবে। বাংলাদেশে হত্যাভিযানে যিনি প্রধান সেনাপতির দায়িত্বভার নিয়েছেন, সেই ইয়াহিয়া জানেন যে, যতো প্রলোভনই থাকুক না কেন লক্ষ লক্ষ দেশপ্রেমিকের মৃতদেহ মাড়িয়ে ইতিপূর্বে নির্বাচিত কোন সদস্য পরিষদকক্ষে প্রবেশ করবেন না। তিনি জানেন যে, মা-বাপ, ভাই-বোন, স্ত্রী-পুত্র-কন্যাকে যারা হত্যা করেছে নির্বিচারে, তাদের সাথে সহযোগিতা করে দেশবাসীর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করার জন্যে কেউ এগিয়ে যাবেন না। তিনি জানেন যে, দেশপ্রেমিকদের রক্তে কলম চুবিয়ে কেউ ইয়াহিয়ার পরিষদের হাজিরা খাতায় দস্তখত করবেন না। সেই দানব শক্তিটি জানেন যে, দস্যু-হানাদারদের কবল থেকে সমগ্র বাংলাদেশকে উদ্ধার করার জন্য এরা সবাই স্বাধীনতার অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত।
এই রোগগ্রস্ত ভদ্রলোক এ-ও জানেন যে, বিশ্ববাসীকে বিভ্রান্ত করার তার এই অপচেষ্টা নিদারুণভাবে ব্যর্থ হবে।
(ফয়েজ আহমদ রচিত)
২১ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
ছদ্মবেশীর ময়ূরপুচ্ছ খসে পড়েছে
সামরিক ডিক্টেটর আয়ুব খানকে তাড়িয়ে নাঙ্গা তলোয়ার হাতে তারই প্রধান সেনাপতি ইয়াহিয়া ১৯৬৯ সালের ২৫শে মার্চের রাত্রে যখন পিণ্ডির সিংহাসনে বসলেন, সে সময় এই মিথ্যাশ্রয়ী জেনারেল বিক্ষুব্ধ জনসাধারণকে শান্ত করার জন্যে সভ্য জগতের শাসকদের অনুকরণে কোমল ভাষায় দর্শনসম্মত বাণী উচ্চারণ করতে শুরু করেন। গণতান্ত্রিক নির্বাচন, জনগণের আশা-আকাঙ্খা প্রতিফলিত শাসনতন্ত্র ও ন্যায়নীতির শাসন প্রতিষ্ঠার কথা তিনি অহরহ প্রচার করতেন। এমন কি, “আমি জনগণের প্রতিনিধি নই- সৈনিক; জনগণের হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়ে ব্যারাকে ফিরে যাবো এবং সামরিক সরকার হচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন”- এ সমস্ত বক্তব্য ফলাও প্রচার করে জনগণের চিন্তাকে আচ্ছন্ন করে রাখতেন।

<005.005.149>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

দেশী-বিদেশী নেতৃবর্গ, অফিসার ও সাংবাদিকদের কাছে সবচাইতে প্রিয় আলোচ্য বিষয় ছিল নির্বাচন ও শাসনতন্ত্র। অর্থাৎ বন্দুকধারী মানুষটির মধ্যে গণতন্ত্রের এক সুকুমার মূর্তি বিরাজ করছে, এটাই ছিল সমগ্র কিছুর প্রতিপাদ্য বিষয়। এক কথায় তিনি দানবের কাছ থেকে মানবীয় গুণাগুণ লাভের আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু তবুও ঈশপের গল্পের সত্য তার মধ্য প্রকাশ পেতে থাকে। বিশেষ বিশেষ পশু বা পক্ষী ছদ্মবেশ ধারণ করে দীর্ঘ সময় যেমন নিজেকে লুকিয়ে রাখতে সক্ষম হয় না, কণ্ঠস্বরই তার জন্যে অভিশাপ হয়ে ওঠে, তার পরিচয়কে ঘোষণা করে-ইয়াহিয়ার ব্যাপারেও তাই ঘটল। ক্রমবিকাশমান পাশবিক রূপটি সকলের কাছে স্পষ্ট হতে থাকে। তবে তিনি সুচতুরের ন্যায় বাক্যব্যয়ে শিক্ষিত।
তখন পিণ্ডিতে ট্যাঙ্কগুলো ক্যান্টনমেন্টে ফিরে গিয়েছিল, রাস্তার মোড়ের কামানগুলোর নল মাথা নত করে স্তব্ধ। অসামরিক ও সামরিক স্টারধারী আমলদের রাজনৈতিক শাসনগত কাঠামো তখন অনেকটা সুপ্রতিষ্ঠিত। সে সময় ইয়াহিয়া সিভিলিয়ান পোশাকে ঢাকা সফরে আসলেন। হাতের ব্যাটন আর মূখনিঃসৃত সৌরভ বাদ দিলে তাকে সেদিন অন্ততঃ একজন মোনাফেক রাজনীতিকের মতো মনে হয়েছিল। সাংবাদিকরা বিমানবন্দরে তাকে প্রশ্ন করেছিলেন, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট দ্য গলের পদত্যাগের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে- দেশব্যাপী এক রেফারোণ্ডামে দ্য গল পরাজিত হয়ে সেদিনকার পত্রিকাতেই পদত্যাগের কথা ঘোষণা করেছিলেন।
প্রশ্ন ছিলঃ দ্য গলের এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কি?
জেনারেল ইয়াহিয়া খান হাতের ব্যাটন বাঁ হাতের তালুতে দু’বার ঠুকে বিজ্ঞের ন্যায় মন্তব্য করেনঃ যে কোন সম্মানীয় নেতার পক্ষে এটাই হচ্ছে গৌরবজনক পথ।
আবার প্রশ্নঃ পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও কি এ কথা প্রযোজ্য?
এ প্রশ্ন যে তির্যকভাবে তাকেই আঘাত করছে, তা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। ক্রোধ সংবরণ করে প্রশ্নকারী রিপোটারের কাঁধে হাত রেখে দ্রুত উত্তর দেন ‘ইয়েস’ -মানে ‘হ্যাঁ’।
এটা যে তার দিক থেকে প্রতিশ্রুতি ছিল, সে কথা এই সিপাহীর মস্তিষ্কে আসেনি। কিন্তু রিপোর্টারগণ বুঝতে পেরেছিলেন কোথায় তার আঘাত লাগে।
ক্রমান্বয়ে ক্ষণিকের এই ছদ্মবেশীর ময়ূরপুচ্ছ খসে পড়তে থাকে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রবঞ্চনাপূর্ণ বাক্যসম্ভারের ছিদ্রপথে তিনি জনগণের বিরুদ্ধে অস্ত্র চালানোর তথ্য প্রকাশ করতে থাকেন- রিপোর্টারের কাঁধে তিনি হাত রেখে “গৌরবজনক পথ অবলম্বনের’’ প্রতিশ্রুতি তখন থেকেই তার কানে ব্যঙ্গ’র মতো শোনাতে ।
পিণ্ডির এক সংবর্ধনা সভায় ঘনিষ্ঠ মহলের আলোচনায় ইয়াহিয়া অস্ত্রে শান দেওয়ার তথ্য সগৌরবে ফাঁস করেন। তিনি বা হাতের অমৃত্যাধার উর্ধ্বে তুলে ডান হাতের অঙ্গুলি নির্দেশে বলেনঃ আইয়ুব খান ক্ষমতায় এসেছিলেন মুষ্টিবদ্ধ হাতে- বিদায়ের সময় মুষ্টি খুলে তাকে চলে যেতে হয়েছে। আর আমি এসেছি মুষ্টি খুলে, কালক্রমে আমার হাত মুষ্টিবদ্ধ হবে। কথাটা শুনে জী-হুজুর পরিষদ নিম্প্রয়োজনে হেসে উঠেছিলেন, সুযোগসন্ধানী রাজনৈতিক নেতারা বিচলিত হয়ে পড়বেন- কিন্তু জনসাধারণ তার এই বক্তব্যে মোটেই বিস্মিত হননি। তারা জানতেন ডিক্টেটর সেনাপতি কোন পথ নেবেন, তার শাসনের পথ কোনটি, ক্ষমতায় স্থির থাকার জন্যে তার হাতের অস্ত্রের নাম কি। আর এক দস্যু জেনারেলের ‘‘অস্ত্রের ভাষা” সম্পর্কে তারা সচেতন।
নির্বচনের আয়োজন ও বিলম্বিত ব্যবস্থার পরও জনগণ ও দেশপ্রেমিক রাজনীতিকগণ ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রশ্নে ইয়াহিয়াকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করতেন না। তবুও সামরিক আইনের মধ্যেই জনগণ ইয়াহিয়ার স্বপ্নকে চুরমার করে এক ঐতিহাসিক রায় ঘোষণা করেন। সামরিক শাসকগোষ্ঠীর গুপ্ত বাহিনীর রিপোর্ট ছিল আওয়ামী লীগ

<005.005.150>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

শতকরা ৬০ বা ৬৫টির অধিক আসন লাভ করতে পারবে না। কিন্তু নির্বাচনের ফলাফল শত্রুর শানিত অস্ত্রের ন্যায় ইয়হিয়ারে বক্ষে প্রোথিত হল। এই পরিস্থিতিটা ছিল সামরিক শাসকদের বিদায়ের ইঙ্গিতবাহী। কিন্তু সামরিক শাসক কোনদিন সম্মানের সাথে বিদায় নেন না- বিতাড়িত পশুদের ন্যায় পরাজয় হয়ে পলায়নই তার চরিত্র। ডিক্টেটরের চরিত্রের নির্দেশে ইয়াহিয়া প্রচণ্ড রূপ নিয়ে হত্যার অভিযানে বের হলেন বাংলাদেশের নগরে-বন্দরে-গ্রামে-গঞ্জে। বিদ্রোহের অগ্নিতে প্রজ্বলিত হয়ে উঠলো সাড়ে সাত কোটি মানুষের মুখমণ্ডল। বিপ্লবী প্রত্যেকটি মানুষের লৌহ-পেশী বাহু দৃঢ়তর হয়ে উঠলো ঘৃণ্য আক্রমণকারী ভাড়াটিয়া সৈন্যবাহিনীর ধ্বংসের তাড়নায়। এতো হত্যা, এতো ধ্বংস আর নির্যাতনের বিভীষিকার মধ্যে তারা আজ দৃঢ়তর ক্ৰন্দনরত নয়, নয় স্থবির। তারা আজ স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ, নবচেতনায় উদ্ভাসিত মুক্তির দিশারী।
তাই আজ পরিস্থিতিটা হত্যাকারীর বিরুদ্ধে চলছে। বিশ্বের সচেতন রাষ্ট্র ও নাগরিকগণ সোচ্চার কন্ঠে বর্বর শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর। কিন্তু এর পরও স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রবঞ্চিত করার উদ্দেশ্যে ইয়াহিয়া নানান অপকৌশল অবলম্বনে পথ বেছে নিয়েছেন। চক্ষু চিকিৎসককে করেছেন ক্রীড়নক গভর্নর, আর মন্ত্রী করেছেন দশজন ধিকৃত ও জনগণের আঘাত থেকে পলাতক পশুকে। তদুপরি নির্বাচিত ১৮৪ জন সদস্যের পদ খারিজ করে উপ-নির্বাচনের নির্দেশে দিয়েছেন। ২৫শে নভেম্বর থেকে ৯ই ডিসেম্বর পর্যন্ত এই উপ-নির্বাচনে হবে। আর এরই মধ্যে তিনি সামরিক নির্দেশে রচিত শাসনতন্ত্রের খসড়া প্রকাশ করবেন। তার মতের বাইরে উক্ত খসড়ার কোন ধারাই প্রস্তাবিত তথাকথিত পার্লামেন্টে বাতিল সংশোধন করার ক্ষমতা থাকবে না। সম্ভবত ১৯৭২ সালের জানুয়ারীর পূর্বে তিনি পার্লামেন্ট আহবান করতে সাহসী হবেন বলে মনে হয় না। কিন্তু তার এই স্বেচ্ছাচারমূলক শাসনতন্ত্র রচনা ও অধিবেশন সবকিছুই একটা বিরাট ”যদি”র উপর ঝুলছে।
কার রাজত্ব তিনি শাসন-নির্যাতন-হত্যা অব্যাহত রাখার উদ্দেশ্যে এইসব বিভ্রান্তির আয়োজন করার ঘোষণা করছেন, সে কথা পিণ্ডির “ব্রাসহ্যাট” গোষ্ঠী হয়তো জানেন। কিন্তু তার চাইতে ও সুস্পষ্টভাবে এই শ্রেণীর চক্রান্তের ফলাফল সম্পর্কে অবহিত রয়েছেন বাংলাদেশের সংগ্রামরত নাগরিকগণ। ইয়াহিয়ার প্রতিশ্রুতি আর দেশদ্রোহীদের সমাবেশ দ্বারা অস্ত্রধারী সংগ্রামীদের স্তব্ধ করা যাবে না-সমগ্র নব-চক্রান্ত আজ সূর্যের মতো প্রখর।
যার জীবনেতিহাস প্রবঞ্চনার বিষধারায় আচ্ছন্ন, মুক্তিকামী মানুষের ক্রুদ্ধ অস্ত্রের বর্ষণেই কেবল তার চক্রান্তের ফলপ্রসূ উত্তর।
(ফয়েজ আহমদ রচিত)

দর্পণ
১৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
সম্প্রতি প্রখ্যাত ফরাসী সাহিত্যক ও কূটনীতিকে মঁসিয়ে আঁদ্রে মালর বাংলাদেশের সংগ্রামী জনগণকে সংগ্রামী ভিয়েৎনামী জনগণের মত জবাব দিতে বলেছেন। বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীকে তিনি আমরণ যুদ্ধ চালিয়ে যাবার আবেদন করেছেন।
তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের জনগণ কোন রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে রক্ষা করার জন্যে যুদ্ধ করছেন না- তাঁরা আত্মরক্ষার জন্য যুদ্ধ করছেন।
মঁসিয়ে মালর দৃঢ়তার সাথে বলেছেন, বাংলাদেশের জনগণ পাকিস্তানী জঙ্গী বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে যে পদ্ধতি অবলম্বন করেছে তাতে জয় তাদের অনিবার্য।

<005.005.151>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

দ্য গল মন্ত্রীপরিষদের সংস্কৃতি দফতরের বিদগ্ধ মন্ত্রী এই প্রখ্যাত সাহিত্যিক দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় নাৎসী বর্বরতা নিজের চোখে দেখেছেন। তিনি জানেন যুদ্ধ কি। তিনি জানেন, অন্যায় যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধে কিভাবে গড়ে ওঠে এবং তিনি জানেন মুক্তিযুদ্ধ কি। এই কুটনীতিক ও সংবেদনশীল মানুষটির অভিজ্ঞতা ও রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ নেই। ফ্রান্সকে নাৎসী জার্মানীর কবল থেকে মুক্ত করার জন্যে একদিন জেনারেল দ্য গলকেও ইংলিশ চ্যনেল পার হয়ে ইংল্যাণ্ডে আশ্রয় নিতে হয়েছিল। জেনারেল দ্য গল তখন মুক্তিযোদ্ধা-স্বদেশকে মুক্ত করার জন্যে তিনি সংগ্রাম করছেন।
আলজেরিয়ায় মুক্তিযুদ্ধের সময় ফরাসী বুদ্ধিজীবী ও সাহিত্যিকের ভূমিকাও এ প্রসঙ্গে স্মরণীয়। এই মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে সাহায্যের জন্যে অনেক প্রখ্যাত শিল্পী-সাহিত্যিক কারাগার বরণ করেন। এ সম্পর্কে এ কালের বিবেকের অন্যতম মুখপাত্র জাঁ পল সাত্রের নাম উল্লেখযোগ্য। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় সার্ত্র নাৎসী বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলনের একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন। শুধু সার্ত্র নন, ফরাসী দেশের অন্যতম প্রখ্যাত সাহিত্যিক আলবেয়র কামুও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন। এ ছাড়াও বহু প্রখ্যাত কবি-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী যুদ্ধে সৈনিক হিসাবে যুদ্ধ করেছেন কিংবা পরোক্ষভাবে সাহায্য করেছেন। ইংরেজ কবি লর্ড বায়রন Anglo-Spanish যুদ্ধে নিহত হন। স্পেনের কবি গার্সিয়া লোরকাও স্পেনের গৃহযুদ্ধে শহীদ হন। প্রখ্যাত মার্কিন ঔপন্যাসিক আর্নেষ্ট হেমিংওয়ে স্পেনের গৃহযুদ্ধে সক্রিয় ছিলেন এবং প্রথম মহাযুদ্ধেরও তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হয়েছিল। ক্রিমিয়ার যুদ্ধে সৈনিক ছিলেন মহান সোভিয়েট ঔপন্যাসিক ঋষি টলষ্টয়।
এ যুগের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে আর একটি উজ্জ্বল তারকা গ্রীসের মিকিস থিওডোরাকিস। পাশ্চাত্য সঙ্গীতে তার বিশেষ অবদান রয়েছে। কিন্তু এই বিপ্লবী শিল্পী ও সঙ্গীতজ্ঞ মিকিস থিওডোরাকিস গ্রীক সামরিক জান্তার উৎপীড়নকে না মেনে নিয়ে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠলেন। গ্রীক সামরিক জান্তা তাকে বন্দী করে রেখেছে কারাগারে।…
মুক্তিযুদ্ধে শত্রুকবলিত দেশের প্রত্যেকটি নাগরিক এক-একজন মুক্তিযোদ্ধা। সকলেই হয়তো রণাঙ্গনে শত্রুর সাথে প্রত্যক্ষ মোকাবেলা করেন না- কিন্তু সকলেই যুদ্ধ করছেন। কেউ নিস্ক্রিয় নয়, সকলেই সক্রিয়। চাষী, শ্রমিক, মজুর, চাকুরে, ব্যবসায়ী সকলেই যুদ্ধ করেছেন।
এই মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবী, কবি, শিল্পীদের একটা বিশেষ ভূমিকা থাকে- তারা সংগ্রামীদের মনোবল অক্ষুন্ন রাখেন, তাঁদের গান, কবিতা ও রচনার মাধ্যমে।
রণাঙ্গনে গিয়ে যুদ্ধ করার দরকার নেই কবির। কবি তখন যুদ্ধক্লান্ত যোদ্ধাদের গেয়ে শোনান দেশপ্রেমের উদাত্ত সঙ্গীত, বিজয়গাথা। রণক্লান্ত সৈন্যরা আবার নতুন বলে বলীয়ান হয়ে মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষায় এগিয়ে যান। কবি তখন চারণের ভূমিকা গ্রহণ করেন।
মসি ও অসির প্রাধান্য নিয়ে পুরোনো বিতর্ক সৃষ্টি করার সময় নয় এটা। মসি এখন ঝলসে উঠুক অসির মত প্রতিশোধের প্রতিশ্রুতিতে।
বাংলাদেশের বেশীরভাগ কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী ও বুদ্ধিজীবী আজ গৃহহারা। ঘাতক ইয়াহিয়া ২৫শে মার্চ রাতেই তাদেরকে খতম করতে চেয়েছিল। শিক্ষা-সংস্কৃতি বাংলাদেশ থেকে উচ্ছেদ করার জন্যে নরপশু ইয়াহিয়ার জল্লাদবাহিনী বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপকের কোয়ার্টারগুলোতে আক্রমণ চালায়। বেশীরভাগই নিহত হয়েছেন। কেউ কেউ হয়তো পালিয়ে বেঁচেছেন।
কিন্তু এখনও যাদের কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি কিংবা অসুবিধার জন্য যারা দেশের শত্ৰু-অধিকৃত অঞ্চলে রয়ে গেছেন, তারা কি করছেন- এটাই জানতে ইচ্ছে হয়। বলাবাহুল্য তারাও চুপ করে নেই। কি করে চুপ করে

<005.005.152>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

থাকা যায়? চোখের সামনে মা, বোন, ভাই, বাপ, বন্ধু-বান্ধব সকলকে ঘাতকেরা হত্যা করছে। এই জল্লাদদের অকথ্য অত্যাচারে সোনার বাংলা আজ শ্মশান।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় বন্ধন হচ্ছে ভাষার বন্ধন। বাংলা-বাংলা ভাষাভাষীর দেশ। কি করে সহ্য করা যায় বাংলাদেশের পবিত্র মাটিতে হানাদারদের আনাগোনা? তবু সহ্য করতে হয়। সারাদিন রাত-কাটে এক ত্রাসের মধ্যে, এক দুঃস্বপ্নের জগতে। বেয়নেটের মুখে বিপন্ন অস্তিত্ব!
শামসুর রাহমান এখন পত্রিকা অফিসের তেতলায় বসে কবিতা লিখছেন কি? তাঁর বিষগ্ন চোখ দুটোতে নিশ্চয় দশ লাখ মৃত মানুষের পুঞ্জীভূত নিম্পলক দৃষ্টি লেগে রয়েছে। দুঃখ, মহা দুঃখ! আর এই দুঃখ অহরহই নাম লিখেছে- বাংলার প্রতিটি পর্ণ কুটিরে-ভাবনার আদিগন্ত জুড়ে। …
শিল্পচার্য জয়নুল আবেদীন নিশ্চয় বেয়নেটের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে সৃষ্টির উন্মাদনায় একের পর এক একে চলেছেন ধর্ষিতা বাংলার ছবি। আরব গেরিলা শিবিরে থাকাকালে তার তুলিতে জ্বলে উঠেছিল আগুন- আর সেই অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষা পেয়েছিল আরব মুক্তিযোদ্ধারা। আমরাও সে মন্ত্রে দীক্ষা নেবার জন্যে প্রতীক্ষায় রয়েছি।
জিন্না এভেন্যুর রেস্তোরাঁতে নববিবাহিত শহীদ কাদরী কি এখনও সন্ধ্যা কাটান? রক্ত, রক্ত চায়ের কাপে, ফ্রিজের জলে। মধ্যরাতে ঘুম ভেঙ্গে বৃষ্টির শব্দকেও কি তার দশ লাখ মানুষের আত্মার হাহাকার মনে হয়?..
আবুল হাসান কি এখনও হাসপাতালে পড়ে আছে? অসুখে নয়, জল্লাদের গুলীতে আহত হয়ে। নাকি সে পড়ে পড়ে ধুঁকছে কোন মেসের আলোহীন কক্ষে-আলোর প্রতীক্ষায়। … সে কি এক মিলিয়ন শবের দুঃস্বপ্নে ঘুমের মধ্যে ঘেমে ওঠে?
রফিক আজাদের অন্তরঙ্গ দীর্ঘশ্বাস নিশ্চয়ই এখন বারুদের আগুন হয়ে শত্রুকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছে? ….
তোমাদের মৃত্যু নেই। তোমাদের স্থান সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর মনের মণিকোঠায়। বিশ্ববিবেক তোমাদের দিকে। তোমাদের ভয় কি?
জয় আমাদের হবেই। তোমাদের মসিকে করে তোল জিঘাংসু ধারালো হাতিয়ার। পড়ে পড়ে মার খাবার দিন চলে গেছে। তোমার প্রাণের ভাষা তোমার পবিত্র জন্মভূমি জননী বাংলাকে ওরা ধর্ষণ করছে। তোমরা দেখিয়ে দাও রবীন্দ্রনাথের সোনার বাংলা, জীবনানন্দের রূপসী বাংলা, নজরুলের বাংলাদেশ কত ভয়ঙ্কর হতে পারে।
আমরা তোমাদের পাশেই রয়েছি। পশ্চিম বাংলার কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ভাষায় বলতে চাই –
‘মরো কিন্তু মেরে মরো এবং উদ্ধার করো ঘর
নিশ্চিত রয়েছি পাশে আমি তোর জন্ম সহোদর।”…
(রণজিৎ পাল চৌধুরী রচিত)

<005.005.153>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

কাঠগড়ার আসামী
১৪ নভেম্বর, ১৯৭১
পৃথিবীর ইতিহাসে নৃশংস হত্যাকারীর তালিকায় সংযোজিত হয়েছে দুটি নাম। একটি ইয়াহিয়া খান, অপরটি টিক্কা খান। জঘন্য জালেম হিসেবে সারা বিশ্ব তাদের ধিক্কার দিচ্ছে। টিক্কা খান শুনেছ সেসব কথা? তোমার বক্তব্য আছে কিছু? বিচারের কাঠগড়ায় হলফ করে বলো, কেন এই গণহত্যা অনুষ্ঠিত করলে? বাংলার মাটি মানুষের রক্তে কেন লালে লাল হয়ে গেলো? এ গণহত্যার অন্যতম আসামী টিক্কা খান জবাব দাও।
অদ্ভুত এবং মস্তিষ্কবিকৃত নাদির শাহের যোগ্য প্রতিনিধি, হত্যার নেশায় ভুলে গেছিলে, মরিয়া মানুষের কি প্রচণ্ড শক্তি! বিশাল অতল সমুদ্রও সে শক্তির কাছে হার মানে। তুমি তো আজাজিলের পাণ্ডা, তুমি তো কোন ছার! ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, কুমিল্লায় তথা সারা বাংলাদেশে তোমারই নির্দেশে নিতান্ত বর্বরের মতো গুলি করে মারা হয়েছে অগণিত মানুষ। বিভীষিকার রাজত্ব কয়েম করতে চেয়েছ সারা বাংলাদেশে। বলো কুখ্যাত গণহত্যাকারী-কি অধিকার তোমার ছিল এ গণহত্যায়?
জল্লাদ প্রভুর আর জনগণের দুশমন দালালদের মনোরঞ্জনের জন্য, অমিতশালী তুমি- ৭২ ঘণ্টায় স্তিমিত করে দিতে চেয়েছিলে সারা বাংলার সংগ্রামের আগুন। কত শক্তি ধরে তোমার ওই শূকরছানার দল? সাম্রাজ্যবাদী, গণতন্ত্রের শত্রু এ যুগের কলংক টিক্কা খান, তোমারই সেই বীর পুংগবের দল নেড়াকুত্তার মত আজ লেজ গুটিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে গর্তে। দেখেছ? প্রত্যক্ষ করছে বাংলার মানুষের শক্তি? তোমার শক্তির দম্ভ এক নিমিষেই মাটির হাঁড়ির মতো ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। অবশ্যই এ কথা তোমার জানা। তবু, তবু হত্যাকারী, তোমার হত্যার নেশা মেটেনি। গ্রামে-জনপদে-শহরে-নগরে জাতি ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে অত্যাচারের বান ডাকিয়েছ। বাংলার মাটি নিরীহ মানুষের রক্তে হয়ে গেছে লালে লাল। রক্তের সমুদ্রে আজ কার সর্বনাশ দেখছো শয়তান? তোমার? না তোমার মহাপ্রভুর? বলো কুৎসিৎ হত্যাকারী, এ বীভৎস হত্যার জবাব কি? জবাব দাও।
গ্রামে-গ্রামান্তরে-শহরে নগরে কুকুরের মতো লেলিয়ে দিয়েছ তোমার সেনাবাহিনী। ধর্ষণে, লুণ্ঠনে, হত্যায় তারা সারা বাংলাকে করে তুলেছিল মৃত্যুর পুরী এ অত্যাচারে কতটুকু পেলে শয়তান? এক-একটি রক্তবিন্দুতে জন্ম নিয়েছে লাখো লাখো মুক্তিযোদ্ধা। তোমার সেই কুকুরের দল মুক্তিবাহিনীর হাতে মার খেয়ে দিকভ্রান্ত, বিপর্যস্ত, ভীত এবং সন্ত্রস্ত। তবু আজো সাধ মেটেনি, হত্যার নেশায় এখনো খুঁজে ফিরছে অস্ত্রহীন সাধারণ মানুষদের। কিন্তু তারই বদলে কুকুরগুলো নিঃশেষ হচ্ছে একের পর এক। বলো নরকের কীট, গ্রামবাংলাকে তুমি পুড়িয়েছ, লুট করেছ, শ্রীহীন করেছ কেন? জবাব দাও।
বাংলাদেশে সন্ত্রাস সৃষ্টি করে যে পদলাভে উন্মুখ হয়েছিলে, যে সাম্রাজ্যের বুনিয়াদ পাকাপোক্ত করতে চেয়েছিলে- চেয়ে দেখা আজ সেই সাম্রাজ্য তাসের ঘরের মতো ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। মৃত মানুষের লাশের তলায় চাপা পড়ে গেছে তোমার সাধের পাকিস্তান। হাত-পা কামড়াচ্ছ কেন? সঙ্গীদের মতোই লাঙ্গুল দিয়ে গায়ের মাছি তাড়াও বিভ্রান্তির অতল গহবরে নিহিত আত্মাকে খুঁজে পাচ্ছে না? নির্লজ্জ বিবেকহীন, জবাব দাও, কোন বিভীষিকা তোমার চোখে ভাসছে?
কতো মজার শাসন ব্যবস্থা তোমার দেশের! বেহায়ার পৃষ্ঠপোষক বেহায়াই হয়। তার প্রমাণ তুমি আর তোমার বন্ধু-বিশ্বের ইতিহাসে কলঙ্কিত নায়ক ইয়াহিয়া খান। এত অত্যাচার, এত লুণ্ঠন, এতো হত্যা করার পরেও তোমার পদোন্নতি হলো- পশ্চিম পাকিস্তান সীমান্তে ‘কোর-কমাণ্ডার’। কিন্তু অর্বাচীন টিক্কা খান, যে আগুন তুমি জ্বালিয়েছে তার জের চলছে, চলবে। বাংলাদেশের মানুষে কোনদিন তোমাদের ক্ষমা করবে না।
তোমাদের

<005.005.154>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

শয়তানের মতো কালো মুখে নিক্ষেপ করবে রাশি রাশি কলঙ্কের কালি। তুমি যেখানেই যাও, যতো পদোন্নতিই তোমার হোক না কেন, শান্তিহীন, স্বস্তিহীন হবে তোমার দিবারাত্রি। বলো হত্যাকারী শয়তান, তোমার জবাব কি?
কালো কলংকের বোঝা মাথায় দিয়ে, নৃশংস জালেম প্রস্তুত হও বলো, তোমার জবাব কি? জবাব দাও শয়তান ইয়াহিয়ার চেলা টিক্কা খান।
(মুস্তাফিজুর রহমান রচিত)
জনতার সংগ্রাম
৫ নভেম্বর, ১৯৭১
আমাদের বাংলাদেশের সংগ্রামী জনতা রচনা করেছে নয়া ইতিহাস। হরতাল, মিছিল আর বিক্ষোভের স্তর পার হয়ে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম যে মুহুর্তে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের রূপ নিয়েছে, সে মুহুর্তে জনতার মধ্য থেকে বেরিয়ে এসেছে সশস্ত্র মুক্তিবাহিনী, অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে আপনাআপনি। ফুল ফুটলে যেমন সুগন্ধ বেরিয়ে আসে, ঠিক তেমনিভাবে।
দুনিয়ার ইতিাহসে দেশের এমন ঘটনা অবশ্য ঘটেছে এর আগেও। ফ্রান্সে ঘটেছে ফরাসী বিপ্লবের সময়। রাশিয়াতে ঘটেছে সোভিয়েট বিপ্লবে। চীনে গণচীনের প্রতিষ্ঠায়। কিউবাতে ঘটেছে চে গুয়েভারার গেরিলা সংগ্রামের ধারায়। আর ঘটেছে হো চি মিনের ভিয়েতনামে- সারা দুনিয়াকে আজও যা করছে বিস্মিত।
কিন্তু বাংলাদেশে হরতাল, বিক্ষোভ আর মিছিলের স্তর পার হয়ে জনতার মুক্তিসংগ্রাম যত তাড়াতাড়ি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের পর্যায়ে প্রবেশ করেছে, এমনটি আর কোথাও হয়নি।
চলতি ’৭১ সালের মার্চ মাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে সারা বাংলাদেশ জুড়ে যে অহিংস গণঅসহযোগের কর্মসূচী অক্ষরে অক্ষরে পালিত হয়, তা যে দেখতে দেখতে অস্ত্ৰধারণের কর্মসূচীতে পরিণত হবে, মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে বিশাল পাকিস্তানী হানাদার সাঁজোয়া বাহিনীকে বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত করার দুর্দম অভিযানে পৌছতে পারবে, এ ধারণা হয়তো আগে করা যায়নি।
কিন্তু এ ঘটনাই ঘটিয়ছে আমাদের বাংলাদেশ- আমাদের বাংলাদেশের জনতা- বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি বাসিন্দা। পাকিস্তানী শাসকচক্রের শোষণে জর্জরিত বাংলাদেশের নিরন্ন বুভূক্ষু সর্বস্তরের মানুষ, নরনারী-শিশু অবতীর্ণ হয়েছে আপোষহীন মুক্তিযুদ্ধে। মাত্র সাত মাসের মধ্যে বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষ আধুনিক অস্ত্র নিয়ে হানাদার পাকিস্তানী সৈন্যদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে শিখেছে। পাকিস্তানী সামরিক শাসকদের সমস্ত রকমের যোগাড়যন্ত্র করা আধুনিকতম মারণাস্ত্রে সজ্জিত সাঁজোয়া বাহিনী ‘ব্লিৎসক্রিগ’ বা বজ্রগতির যুদ্ধপদ্ধতিতে বাংলাদেশের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেও বাংলাদেশের বিপ্লবী সংগ্রামী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে দিতে পারেনি। ফিউজ হয়ে গিয়েছে পাকিস্তানী ‘ব্লিৎসক্রিগ’। বাংলাদেশের সংগ্রামী মানুষের একটিমাত্র অংশের কাছে মামুলি ধরনের অস্ত্র ছিল ২৫শে মার্চ। ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, বাঙালী ইপিআর আর বাঙালী পুলিশ বাহিনী এবং আনসার বাহিনীকে সামনে নিয়ে ভবিষ্যতে আধুনিক অস্ত্র পাবার আশায় বাংলাদেশের জনতা মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েই হানাদার পাকিস্তানী জল্লাদ বাহিনীর সামরিক সময়সূচীকে পণ্ড করে দিয়েছে, কেড়ে নিয়েছে উদ্যোগ।

<005.005.155>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

নরঘাতক ইয়াহিয়া খান, টিক্কা খান, হামিদ খান, গং এর নির্দেশে হানাদার পাকিস্তানী সেনাবাহিনী বাংলাদেশের সংগ্রামী জনতাকে ঠাণ্ডা করার মতলবে যে বীভৎস হত্যাকাণ্ড আর পাশবিক অত্যাচার চালিয়ে আসছে গত সাত মাস ধরে, পৃথিবীর ইতিহাসে তার নজীর নেই। কিন্তু বাংলাদেশের সংগ্রামী জনতা এতে ঠাণ্ডা না হয়ে বরং আরও বেশি একরোখা হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের প্রায় দু’কোটি মানুষ উৎখাত হলেও দেখা যাচ্ছে জনতা শুধু সামলে নেয়নি নিজেদের, পাল্টা আঘাত শুরু করেছে হানাদার বাহিনীর ওপর- প্রথমত গেরিলা পদ্ধতিতে আক্রমণ পরিচালনা করে, দ্বিতীয়ত নিয়মিত সেনাবাহিনীকে রণক্ষেত্রে নিয়োজিত করে। সময়সূচীর দিক দিয়ে এইভাবে পাল্টা আক্রমণে যাওয়ার তুলনা নেই ইতিহাসে।
সে জন্যই আমরা বলতে পারি, বাংলাদেশের সংগ্রামী জনতা মুক্তিসংগ্রামের নতুন নজীর স্থাপন করলো।
তুলনা করার জন্যে দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে ফরাসী বিপ্লবের আমলের ফরাসী জনতার। ফ্রান্সের জনগণ স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের শাসন-শোষণের যাতাকলে নিষ্পষিত হচ্ছিল। গ্রামাঞ্চলে কৃষকসমাজ আর শহরের মেহনতি মানুষ আর ব্যবসায়ীরা খাজনা-ট্যাক্সের কড়ি গুণতে গুণতে সর্বস্বান্ত হয়ে গিয়েছিল। একদিন ফ্রান্সের শহর আর গ্রামাঞ্চলের কোটি কোটি জনতা তাই গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের পতাকা নিয়ে সশস্ত্র বিদ্রোহে অবতীর্ন হয়েছিল। পূর্ণ গণতন্ত্র, প্রজাতন্ত্র, ফরাসী জাতির নবজীবন আর মুক্তি আর মেহনতি মানুষের মুক্তির জন্যে যে সংগ্রাম চলে আসছিল বিভিন্নভাবে, তা-ই দানা বেঁধেছিল সশস্ত্র বিপ্লবে।
সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার অগ্নিমন্ত্রে উদ্বুদ্ধ প্যারিসের জনতা শুধুমাত্র সড়কি সম্বল করে দুর্ভেদ্য ব্যাষ্টিল কারাগার ভেঙ্গে ফেলেছিল। মুক্ত করে এনেছিল রাজবন্দীদের। তার পরে বিপ্লবী ফরাসী গণসেনাবাহিনী গড়ে তুলতে তাদের চার বছর লেগেছিল। অথবা বলা যেতে পারে, ফরাসী জনতা চার বছর সময় পেয়েছিল গণসেনাবাহিনী গড়ে তোলার। পরে অবশ্য তৎকালীন ইউরোপের সমস্ত দেশের রাজতন্ত্রী বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে নবপ্রতিষ্ঠিত গণপ্রজাতন্ত্রকে রক্ষা করেছিল এই ফরাসী জনতার গণসেনাবাহিনী। রাজকীয় অস্ত্রভাণ্ডারগুলি দখল করে জনতার এই সেনাবাহিনী। রাজতন্ত্রীদের সাঁজোয়া বাহিনী তুলোর মত উড়ে গিয়েছিল ফরাসী গণবাহিনীর ঝটিকা অভিযানে। এই গনসেনাবাহিনীর লোকদের নিয়মিত সামরিক পোশাক-আশাক ছিল না বলে তাঁদের স্যানসবুলেট নাম হয়েছিল। জনতার মুক্তিসংগ্রাম জনতার মুক্তিযুদ্ধে রূপান্তরিত হবার পরে জনতার সুখে-দুঃখে, ভাবনায়-চিন্তায় জড়িত যে সেনাবাহিনীর প্রয়োজন হয়, তার সফল সূত্রপাত হয়েছিল এইভাবে।
এদিক দিয়ে আমাদের বাংলাদেশের সংগ্রামী জনতা আর মুক্তিবাহিনী ফরাসী বিপ্লবকে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। স্মরণ করবে বিপ্লবের নেতা ড্যান্টনের অগ্নিবাণী- আমাদের চাই সাহস, আরও সাহস এবং আরও সাহস।
শ্রদ্ধা জানাবে একথা মনে রেখেই যে, বাংলাদেশেও এমন লড়াই করছে, যা আজ এবং আগামী যুগে- যুগান্তরে মুক্তিপ্রেমিক দেশদেশান্তরের মানুষকে অনুপ্রানীত করবে। …।
(রণেশ দাশগুপ্ত রচিত)
পুতুল নাচের খেল
৫ নভেম্বর, ১৯৭১
বাংলাদেশের মানুষ দখলীকৃত ঢাকা বেতারের অনুষ্ঠান শোনে না। গত পঁচিশে মার্চের পর থেকেই ঢাকা বেতারের অনুষ্ঠান ধীরে ধীরে তারা বর্জন করতে শুরু করে। এখন এই অনুষ্ঠান বাংলাদেশের নারী, পুরুষ, শিশু

<005.005.156>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

কেউ শোনে না। কে শুনবে? যারা নিজেদের চোখে দেখেছে মেঘনা নদীকে কারবালার রক্তরাঙা ফোরাত নদী হয়ে যেতে, যাদের চোখের সামনে হয়েছে নির্মম নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড, তারা কি করে বিশ্বাস করবে দখলীকৃত ঢাকা বেতারের নির্লজ্জ মিথ্যা প্রচার? গল্পের পাগলা মেহের আলীর মতো অবস্থা হয়েছে ঢাকা বেতারের। মেহের আলী থেকে থেকে কেবল বলতো, সব ঝুট হ্যায়- সব ঝুট। ঢাকা বেতারও সেই মার্চ মাসের সাতাশ তারিখ থেকে কেবল চেচাচ্ছে, সব নর্মাল হায়- সব নর্মাল।
এবার রমজান মাসের শুরুতে যশোরের এক মুক্তাঞ্চলে গিয়েছিলাম। দেখি মাগরিবের নামাজ ও ইফতার সেরে গ্রামের মসজিদের এক ইমাম সাহেব তার ট্রানজিষ্টর রেডিও নিয়ে বসেছেন। নিবিষ্ট মনে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শুনছেন। পরিবেশটি বড় চমৎকার। আকাশে চাঁদ নেই। মিটি মিটি জ্বলছে তারার প্ৰদীপ। কার্তিকের হিমেল বাতাসে শরীর জুড়িয়ে যায়। যে পুকুরের পাড়ে ইমাম সাহেব বসেছেন, তার পানিতে ঝিকিমিকি তারার প্রতিভাস। ক’দিন আগেই এই গ্রামটিতে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়েছে- তার চিহ্ন এখন নেই। হানাদারেরা পালাবার সময় কোন কোন বড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। ধানের গোলা পুড়িয়ে দিয়েছে। মুক্তিবাহিনীর উপস্থিতিতে গ্রামের মানুষ আবার নতুন উৎসাহে ঘর বাঁধার কাজে হাত দিয়েছে। তাদের কেউ হারিয়েছে তার প্রিয়তম ভাইকে। কেউ হয়েছে পিতৃহারা। কারো যুবতী বোন লাঞ্ছিত হয়েছে বর্বর হানাদার দস্যুদের হাতে। কিন্তু তাতে কারো চোখে অশ্রুকণা নেই। সব অশ্রুকণা পুড়ে যেন ক্রোধের বারুদ হয়ে গেছে। সকলের মুখে, সকলের বুকে এক প্রতিজ্ঞা- মরতে হয় আরো মরবো, তবু হানাদারদের দেশছাড়া করবো।
ইমাম সাহেবের পাশে বসে আমি দেখছিলাম সোনার বাংলার সংগ্রামী রূপ। এই তো কার্তিকের হিমে ভেজা বাংলার সবুজ ঘাস। মাথার উপরে সাদা মেঘের কারুকাজ করা নীল আকাশ। ইমাম সাহেব নিবিষ্ট মনে শুনছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান। আমি হঠাৎ জিজ্ঞেস করলাম। এই গ্রামে আপনি কি একাই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শোনেন, না সবাই শোনেন? ইমাম সাহেব হেসে বললেন, কি যে বলেন, সবাই শোনে। এই অনুষ্ঠান শোনার জন্য আমরা সারাদিন পাগল হয়ে থাকি।
প্রশ্ন করলাম, এই অনুষ্ঠান শুনে কি লাভ হয় আপনাদের?
ইমাম সাহেব বললেন, আমাদের আশা বাড়ে, সাহস বাড়ে, বুকের হিম্মত বাড়ে।
এরপরই আমার কাছে সরে এসে বললেন, একটা সত্য ঘটনা বলি শুনুন। তখনো আমাদের এই গ্রাম মুক্ত এলাকা হয়নি। পাকিস্তানী সৈন্যরা চারিদিকে ঘোরাঘুরি করছে, দিনে-দুপুরে লুটপাট চালাচ্ছে, ঘরের মেয়েকে বে-আব্রু করে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা বুড়ো মানুষরা তখন কেবল চোখের পানিতে ভাসি, আল্লাহকে ডাকি আর ভাবি, মুক্তিবাহিনীর নওজোয়ানেরা কবে আমাদের গ্রামে আসবে? আমার ছোট নাতিটির বয়স বছর দশ। সে রোজ লুকিয়ে লুকিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শোনে। আমি তাকে একদিন সাবধান করে দিলাম, বললাম- নানু, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শুনিস না। মিলিটারিরা জানতে পারলে আমাদের সবাইকে মেরে ফেলবে। নাতি বলল, কতজনকে মারবে! এই গ্রামের সকলেই তো লুকিয়ে লুকিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শোনে। কেউ ঢাকা বেতারে হুক্কামে মারশাল ল’-র অনুষ্ঠান শোনে না।
এর পরই নাতি আমাকে জিজ্ঞেস করে বসলো- আচ্ছা নানা, হুক্কামে মারশাল ল’র অর্থ কি?
নাতির প্রশ্ন শুনে এই বুড়ো বয়সেও ঠাট্টার লোভ সামলাতে পারলাম না। বললাম, নানু, হুক্কামে মারশাল ল’-র অর্থ- মার শালাদের। এই শালা কারা জানো? ওই বর্বর পাকিস্তানী সৈন্যরা। বৃদ্ধ ইমাম তার নাতির গল্প শেষ করে মৃদু মৃদু হাসতে লাগলেন। আমি তাকে বললাম, আপনার নাতির কথা বুঝতে পারলাম। কিন্তু আপনি এবং আপনার এই মসজিদের অন্যান্য মুসল্লিরাও কি ঢাকা বেতারের অনুষ্ঠান শোনেন না?

<005.005.157>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

ইমাম সাহেব বললেন, মিথ্যা কথা বলা মহাপাপ। মুসলমানদের কাছে তো কবিরা গুনা। এটা পবিত্র রমজান মাস বাবা। আমাদের কাছে বড়ই পবিত্র মাস। এই মাসে মিথ্যা কথা বলার মতো শোনাও মস্তবড় পাপ। ঢাকা বেতার থেকে এই রমজান মাসেও রাত দিন যে মিথ্যা বলা হয়, আল্লাহর বান্দা, নবীর উম্মত হয়ে তা কেমন করে বরদাস্ত করি বাবা?… তবু মনকে চোখ ঠেরে না হয় ঢাকা বেতারের প্রাচারই বিশ্বাস করলাম, কিন্তু এর পরই একদিন শুনলাম নতুন প্রচার। শরণার্থীদের ফিরিয়ে আনার জন্য পাকিস্তানের মিলিটারি সরকার বর্ডারে অভ্যর্থনা শিবির খুলেছেন। শুনে আমরা সবাই বেকুব ঢাকা বেতারই এতদিন বলে এসছে, যারা দেশ ছেড়ে গেছে তারা দৃস্কৃতকারী, তারা ভারতের চর। এখন সেই দৃস্কৃতকারী ও ভারতের চরদেরই আবার ফিরিয়ে আনার জন্য অভ্যর্থনা শিবির খোলা কেন?
এটা গেল জুলাই মাস পর্যন্ত প্রচার। আগষ্ট মাস ও সেপ্টেম্বর মাসে শোনা গেল নতুন কথা। দলে দলে শরণার্থী ভারত থেকে দখলীকৃত বাংলাদেশে ফিরে এসেছে। ঢাকা বেতার থেকে বলা হলো, রোজ হাজারে হাজারে মানুষ ফিরে আসছে। আগে যারা বলেছিলেন মুষ্টিমেয় দুষ্কৃতকারী দেশ ছেড়েছে- তারা পরে কি করে বললেন, হাজারে হাজারে দেশত্যাগী ফিরে আসছে? এটা যে বাবা আমাদের সেই পুঁথির বয়ানের মত-
লাখে লাখে সৈন্য মরে কাতারে কাতারে
শুমার করিয়া দেখি চল্লিশ হাজার।
মাঝখানে ঢাকা বেতারের মুরুবিবরা বোধ হয় বুঝতে পেরেছিলেন, তাদের মিথ্যা প্রচার বিশ্ববাসীর কাছে ধরা পড়ে গেছে। তাই ফাঁক বুঝে এক সময় বলা হলো, ভারতে কিছু শরণার্থী গেছে বটে, কিন্তু তাদের ভয় দেখিয়ে ও লোভ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। শোন বাবা কথা। বিদেশের রেডিওতেও শুনেছি, বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে নব্বুই লাখ শরণার্থী গেছে। কেউ লোভ দেখিয়ে বা ভয় দেখিয়ে এতগুলো লোককে রাতারাতি দেশছাড়া করতে পারে? আর যদি তা পারাই যায়, তাহলে তোরা কেন বাপু ভারতের অন্তত এক হাজার লোককেও ভয় দেখিয়ে, কি লোভ দেখিয়ে তোদের দিকে নিয়ে আসতে পারিস না? দেখা না তোদের কথার সত্যতা!।
ইমাম সাহেব থামলেন, দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন, কত আর বলবো বাবা, বললে কিসসা ফুরায় না। সারা আগস্ট আর সেপ্টেম্বর মাসে শুনেছি, ভারত থেকে হাজার হাজার শরনার্থী ইয়াহিয়া খানেদের অভ্যর্থনা শিবিরে ফিরে যাচ্ছে। যে হারে হিসাব দেয়া হয়েছে, তাতে এতদিনে নব্বুই লাখ লোকেরই দেশে ফিরে যাওয়ার কথা। কিন্তু এখন ওই ঢাকা বেতারেই তাঁবেদার গভর্নর মল্লিক মিয়ার একটা ভাষণ শুনলাম। মল্লিক মিয়া বলেছেন, ভারত রাজি হলে তারা বিমান পাঠিয়ে শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেবেন। শোন বাবা কথা! এতদিন তোরা বল্লি সব শরণার্থী ফিরে গেছে। তাহলে বিমানে কবে কাদের আবার ফিরিয়ে নিতে চাইছিস? এ জন্যই কথায় বলে, মিথ্যাবাদীর স্মরণশক্তি কম। আগে জেনে শুনেও ওরা কত মিথ্যা বলতে পারে, তা যাচাই করার জন্য ঢাকা বেতর ধরতাম। এখন আর ধরি না। এই রমজান মাসে মিথ্যা শোনাও পাপ। বাবা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে এই কথাটা কেন তোমরা ঢাকা বেতারকে জিজ্ঞাসা কর না- প্রত্যেক দিন এত মিথ্যা কথা বলতে ওদের জিহবা আড়ষ্ট হয়ে যায় না? ঈমান কমজোর হয়ে যায় না? আমি বাবা এখন ঢাকা বেতার ধরি না। কেউ ধরে না। খামোখা কেন মিথ্যা কথা শুনে গুণাহগার হই বলো! তার উপর এখন তো আবার রমজান মাস।
ইমাম সাহেবকে বললাম, এ নিয়ে দুঃখ করবেন না। দখলীকৃত ঢাকা বেতারে এখন চলছে পুতুল নাচের খেল। পুতুলকে দিয়ে যা বলানো হচ্ছে, তাই তারা বলছে। যে খেল খেলানো হচ্ছ তা-ই তারা বলছে। মেফিষ্টোফিলিস আর ফাউষ্টের কাহিনী আপনি জানেন না- শয়তানের কাছে আত্মা বন্ধক রেখে এক সাধুর কি পরিণতি হয়েছিল। ঢাকা বেতারেরও এক শ্রেণীর ভাড়াটিয়া বুদ্ধিজীবী তাদের আত্মা, বিবেক, সততা ও মনুষ্যত্ববোধ কয়েকটা টাকায় বন্ধক রেখেছে খুনী দস্যু ইয়াহিয়া চক্রের কাছে।

<005.005.158>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

ইমাম সাহেব কি বুঝলেন জানি না। দুঃখিত স্বরে বললেন, বাবা, এর কি কোন প্রতিকার নেই? তাকে সান্তনা দিয়ে বললাম, আছে এবং সেই প্রতিকারের দিনও খুব দূরে নয়। শিগগিরই বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী ঢাকা বেতার কেন্দ্রসহ সারা দখলীকৃত এলাকা মুক্ত করবে। আবার ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে আপনারা শুনতে পাবেন মুক্ত বাংলার মুক্ত কণ্ঠ, সত্য ও সুন্দরের জয় ঘোষণা ।
ইমাম সাহেব ভাবাবেগে আশ্রম্নপূর্ণ চোখ মুছে বললেন, আমিন, আমিন। ইয়া আল্লা, রব্বুল আলামিন, বাংলাদেশের সেই সুদিন যেন দেখে যেতে পারি।
কার্তিকের সেই স্বপুসন্ধ্যায় ইমাম সাহেবের কাছ থেকে বিদায় নিলাম।

(আবদুল গাফফার চৌধুরী রচিত)

বিশ্ববিবেক ও বাংলাদেশ
১১ নভেম্বর, ১৯৭১

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এখন পৃথিবীর সজাগ দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। বিশ্বের মানুষের কাছে এখন সবচেয়ে আলোড়নকারী ঘটনা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। পৃথিবীর প্রতি অঞ্চলের মানুষের চোখ বাংলাদেশের ওপর- সেখানে কি ঘটছে, কি চলছে সেখানে। কিন্তু জল্লাদ ইয়াহিয়ার মিথ্যা প্রচারণার কুয়াশা ভেদ করে বাংলাদেশের ঘটনাবালী সঠিক চিত্র কি সব সময় তাদের চোখে ধরা পড়ছে? তারা কি দেখতে পাচ্ছেন বাংলাদেশের বর্তমান রূপ, তার ক্ষতবিক্ষত, রক্তাক্ত চেহারা? বাংলাদেশ এখন আক্রান্ত। হানাদার বর্বর দস্যুরা তার বুকের ওপর সন্ত্রাসের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করে চলেছে। সেখানে সত্য নেই, ন্যায় নেই- মানুষের মুল্যবোধ মৃত, সেখানে এখন প্রচলিত মিথ্যা, উন্মাদ লালসা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। সেখানে কেবল-
জীবনের সারকথা পিশাচের উপজীব্য হওয়া
নির্বিচারে নির্ববাদে সওয়া
শবের সংসর্গ আর শিবার সদভাব;
বর্তমান আক্রান্ত বাংলাদেশকে যদি আপনার জানতে চান, যদি তার পূর্ণাঙ্গ ছবি মানসচক্ষে অবলোকন করতে চান, তাহলে পিশাচের উপজীব্য জীবনকেই সেখানে খুঁজতে হবে। কারণ পাশবিকতাই এখন সেখানকার মৌলনীতি। কিন্তু এইসব নয়। এই রক্তাক্ত, নিপীড়িত বাংলাদেশের মাটি থেকেই লক্ষ লক্ষ মৃত মানুষের কংকাল থেকেই বেরিয়ে এসেছে বাংলাদেশের জাগ্রত তারুণ্য। তারা যুদ্ধ করছে মিথ্যার বিরুদ্ধে, পাশবিকতার বিরুদ্ধে অবিরাম যুদ্ধ করছে- আর তার নামই বাংলাদেশ। তাই আমরা হতাশ হইনে, হতাশ হবো না।

বিশ্বের বিবেকমান মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন আছে আমাদের এই সংগ্রামে, অস্তিত্ব রক্ষার এই যুদ্ধে। বিশ্বের এমন কোনো দেশ নেই, যে দেশের একটি মানব হৃদয়ও ব্যথিত হয়নি বাংলাদেশের মর্মান্তিক ঘটনাবলীতে। সব অঞ্চলের সব দেশের বিবেকমান মানুষের মন এই ঘৃণ্য বর্বরতায় বিষায়িত হয়েছে, প্রতিবাদ কল্যাণ ও সত্য প্রতিষ্ঠার যে সংগ্রাম, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধও তারই অন্তর্ভুক্ত। …
<005.005.159>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এখন চূড়ান্ত বিজয়ের পথে। যতই দিন যাচ্ছে, নৈতিকতাহীন, বর্বর হানাদার সেনাবাহিনীর মনোবল ও শক্তি ততই দুর্বল হয়ে পড়ছে। দেশ-বিদেশের সংবাদপত্রে আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের এই বিজয় ও সাফল্যের সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে প্রতিদিন। বিশ্বের সব প্রভাবশালী পত্রপত্রিকা মুক্তিযোদ্ধাদের সাফল্যের কথা স্বীকার করেছেন। নিউজউইক’ ও অন্যান্য পত্রপত্রিকায় মুক্তিবাহিনীর অগ্রগতি ও পাকিস্তানী হানাদার খান সেনাদের চরম নাজেহাল হওয়ার বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে। বিদেশী সাংবাদিক ও সংবাদ ভাষ্যকারদের মতে, হানাদার পাকিস্তানী সেনাবাহিনী আর দীর্ঘদিন এই প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে বাংলাদেশে তাদের প্রভূত্ব বজায় রাখতে পারবে না, তাদের মৃত্যু আসন্ন ও অবশ্যম্ভাবী।

এর পরেও মধ্যযুগীয় বর্বরতার নায়ক জল্লাদ ইয়াহিয়া তার মিথ্যা অপপ্রচারের দ্বারা বিশ্বকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে, কারণ তার খোয়াব ভাঙতে এখনো কিছু বিলম্ব। কিন্তু ইয়াহিয়া, তোমার খোয়াব যেদিন ভাঙবে, সেদিন দেখবে কি নিষ্ঠুর ভয়ঙ্কর বাস্তব তোমার সম্মুখে।

দস্যু ইয়াহিয়া বাংলাদেশে পুতুল সরকার খাড়া করে বিশ্বকে ধোঁকা দেয়ার চেষ্টা করে আসছে। সম্প্রতি একজন বিদেশী সাংবাদিক ঢাকা ঘুরে এসে তার বাংলাদেশ পরিভ্রমণের অভিজ্ঞতা বর্ণনা প্রসঙ্গে জানিয়েছেন, বাংলাদেশের পুতুল মন্ত্রিসভার যে ঠাঁট ইয়াহিয়া দেখিয়ে বেড়াচ্ছেন, বাংলাদেশে প্রকৃতপক্ষে তার কোনো অস্তিত্বই নেই। মন্ত্রী সাহেবরা থাকেন মিলিটারি ক্যান্টনমেন্টে। হাজার চেষ্টা করেও তাদের সাক্ষাৎ মেলেনি। আর বাংলাদেশের মালেক মন্ত্রিসভার কোনো আছে অস্তিত্ব বলেও মনে হয় না। এইসব মন্ত্রীদের জনসাধারণ কেউ চেনে না। বরং সেখানকার প্রকৃত অবস্থা অন্যরূপ। মৃত্যু, নির্যাতন সবকিছু উপেক্ষা করে ঢাকার হওয়ার জোগাড়।

সম্প্রতি মার্কিন কংগ্রেসের প্রবল চাপের মুখে যুক্তরাষ্ট্র সরকার পাকিস্তানে সামরিক সাজসরঞ্জাম রপ্তানির লাইসেন্স বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সরকারী ঘোষণায় এই তথ্য জানা গেছে। এদিকে চীনে গিয়ে মি. ভুট্টো বড়ো বেশি কন্ধে পাননি। বরং চীনা অস্থায়ী পররাষ্ট্রমন্ত্রী চিং পেং ফেই বাংলাদেশ সমস্যার যুক্তসঙ্গত সমাধানের প্রতিই পাকিস্তানকে সচেষ্ট হতে বলেছেন। ফরাসী সরকার বাংলাদেশ সমস্যার প্রতি অধিক মনোযোগী হয়েছেন এবং এর গুরুত্ব স্বীকার করেছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সাম্প্রতিক ফ্রান্স সফরকালে ফরাসী সরকারের পক্ষ থেকে এই মতামত প্রকাশ করা হয়। পশ্চিম জার্মানীর চ্যালেন্সর উইলি ব্রান্ট বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমাধানের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছেন। পশ্চিম সরকারের এক ঘোষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ঘটনাবলীতে পশ্চিম জার্মান সরকার গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।

কিন্তু এখনো বাংলাদেশের মানুষ মরছে, গৃহ অগ্নিদগ্ধ হচ্ছে। এখনো দলে দলে মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য সীমান্ত পাড়ি দিচ্ছে। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের জীবনে এখনো অন্ধকার রাত্রির শেষ হয়নি। তারা সকল চোখে অসহায় দুটি হাতে তুলে তাকিয়ে আছে সত্য ও ন্যায়ের অমোঘ দণ্ড করে নেমে আসবে, কবে, কবে। কবে শেষ হবে এই কালরাত্রির কুটিল অন্ধকার? শেষ এর হবেই। এতো রক্ত, এতো মায়ের চোখের জল, বুকফাটা কান্না, সকরুণ প্রার্থনার বাণী ব্যর্থ হতে পারে না :

বীরের এ রক্তস্রোত
মাতার ও আশ্রমধারা
এর যতো মূল্য সেকি ধরার ধূলায় হবে হারা?
স্বর্গ কি হবে না কেনা
বিশ্বের ভাণ্ডারী শুধিবে না
এত ঋণ?

<005.005.160>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

রাত্রির তপস্যা সেকি আনিবে না দিন
নিদারুণ দুঃখ রাতে
মৃত্যুঘাতে
মানুষ চুর্নিল যাবে নিজ মর্ত্যসীমা
তখনও দেবে না দেখা
দেবতার অমর মহিমা?
(মহাদেব সাহা রচিত)
৩০ নভেম্বর, ১৯৭১

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এখন চরম বিজয়ের লক্ষ্যপথে অগ্রসর হচ্ছে। যতই দিন যাচ্ছে, অমিতবিক্রম মুক্তিযোদ্ধাদের শক্তিও ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ক্রমশই তারা সংগঠিত হচ্ছে, শক্তিশালী হচ্ছেন, দুর্বার দুর্জয় হচ্ছেন। আর অন্যদিকে সেই সঙ্গে যতই দিন যাচ্ছে হানাদার পাকিস্তান বাহিনী ততই দুর্বল হচ্ছে, মনোবল ও নৈতিক সাহস হারাচ্ছে। এর কারণ বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের তারুণ্য ও নৈতিক মনোবল হানাদার দস্যুদের নেই। তারা পাশবশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে একটি নবজাগ্রত জাতির স্বাধীনতার আকাংক্ষাকে পদদলিত করে নিজেদের ঔপনিবেশিক শাসন কায়েম রাখতে। আর সেই শাসন কায়েম রাখতে গিয়ে তারা নির্বিচারে নরহত্যা, লুণ্ঠন ও নারী ধর্ষণের পাশবিকতার পথ অনুসরণ করেছে। নীতিবোধ, মনুষ্যত্ব, মানবিক ন্যায়বিচার সবকিছু জলাঞ্জলী দিয়ে তারা দস্যু ও তস্করের নির্লজ্জ বর্বরতার ভূমিকায় নেমেছে- যেখানে তারা বন্যপশুর মতোই আদিম, হিংস্র ও নৃশংস। তাদের কাছের ন্যায়নীতি, সুবিচার, যুক্তি কিংবা মনুষ্যত্বের কোনো মূল্য নেই। নিষ্ঠুরতায় তারা বন্যজন্তুর মতোই অন্ধ, বর্বরতার তারা মধ্যযুগীয় হার্মাদ দস্যদের মতোই হিংস্র ভয়ংকর।
বিপরীত দিকে বাংলাদেশের তরুণ যারা যুদ্ধ করছেন, তাদের সংগ্রাম নিজেদের মাতৃভূমির শৃঙ্খল মোচনের সংগ্রাম, মায়ের লজ্জা, বোনের অপমান, পিতার অমর্যাদার প্রতিশোধ গ্রহণের সংগ্রাম। তাদের রক্তে মায়ের বোনের ভায়ের রক্তের প্রতিজ্ঞা জড়িত। তাই আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে ঐ হানাদার বর্বর দস্যুরা বন্দী পশুর মতোই অসহায়, দুর্বল। তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিজয়-পতাকা। বাংলাদেশে উড়ছে স্বাধীনতার বিজয়-পতাকা, সেই সঙ্গে বিশ্বমানবতার মনের ভূগোলে অর্জিত হচ্ছে তাদেও জন্যে সমর্থন ও শুভেচ্ছার রক্তকুসুম। পৃথিবীর দিকে দিকে উড়ছে তারই উজ্জ্বল মানবিক পতাকা। তাই ওদেও যেখানে শেষ; আমাদের সেখানে শুরু।
বিখ্যাত মার্কিন সাপ্তাহিক নিউজউইক’ লিখেছেন, সামরিক ও রাজাকার বাহিনীর ক্রমাগত অত্যাচার বাংলাদেশের মানুষের মনে ভীতির সঞ্চার করতে পারিনি। বরং অত্যাচার যতই বাড়ছে, বাংলাদেশের জাগ্রত জনতার মনে প্রতিশোধের স্পৃহা ততই প্রবল হচ্ছে। ঐ সাপ্তাহিকের বিশেষ প্রতিনিধি সিনিয়র সম্পাদক আর নো দ্যা বোরচাগ্রাফ বলেছেন, বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের ওপর এখন মুক্তিবাহিনীর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত। সারা বাংলাদেশের মানুষ আজ প্রতিশোধ চায়। শিকাগো নান টাইমসের সহযোগী সম্পাদক মি. রবার্ট ই, কেনেডি বলেছেন, বাংলাদেশ সম্পর্কে মার্কিন নীতি তার কাছে হতবুদ্ধিকর। মার্কিন প্রেসিডেন্ট সমস্যাটির প্রতি যথেষ্ট মনোযোগী নন বলেও তিনি কঠোর সমালোচনা করেছেন। মি. কেনেডি স্বীকার করেছেন যে মুক্তিবাহিনীর সাফল্য আসন্ন এবং তারা স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মোৎসর্গ করেছেন। বিখ্যাত মার্কিন দৈনিক ‘নিউইয়র্ক টাইমস’-এর এক সম্পাদকীয় নিবন্ধেও বাংলাদেশ সম্পর্কে মার্কিন নীতির কঠোর সমালোচনা করা হয়। মার্কিন সাপ্তাহিক টাইমস এ ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধীর সাম্প্রতিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরের একটি দীর্ঘ বিবরণী প্রকাশ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে- পাকিস্তান একটি ডুবন্ত কুকুর। তার মাথা জলের নিচে ঠেসে ধরার কোনো প্রয়োজন নেই ভারতের।

<005.005.161>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

মস্কোর প্রভাবশালী রাজনৈতিক সাপ্তাহিক নিউ টাইমস’-এ বিশিষ্ট সোভিয়েট লেখক মি. উলানুকী এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, পাকিস্তানের নিষ্ঠুর নিষ্পেষণই স্বাধীন বাংলাদেশের দাবীর জন্ম দিয়েছে। বাংলাদেশ আন্দোলনের ধারাবাহিক ইতিহাস পর্যালোচনা করে মি. উলানুকী বলেছেন, পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর অত্যাচারের প্রেক্ষিতেই বাঙালীরা অস্ত্ৰধারণ করতে বাধ্য হয়েছে। বৃটেনের উদারনৈতিক দৈনিক গার্ডিয়ান বলেছেন, পাকিস্তান এখন নিঃসঙ্গ ও বন্ধুবিহীন। যুদ্ধ বাধলে তাকে একাই তার ফল ভোগ করতে হবে। ডেলি টেলিগ্রাফ পত্রিকাও পাকিস্তানের এই নিঃসঙ্গ অবস্থার কথা বর্ণনা করে বলেছে, যতক্ষণ না ইয়াহিয়া বাংলাদেশ সমস্যার একটি যথার্থ রাজনৈতিক সমাধান না চাচ্ছেন, ততক্ষণ তার বন্ধুহীনতা কেবল বাড়তেই থাকবে।
এদিকে বৃটিশ মন্ত্ৰী মিঃ রিচার্ড উড বাংলাদেশ সমস্যার যথার্থ রাজনৈতিক সমাধানের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে বলেছেন, বাংলাদেশ সমস্যার যুক্তগ্রাহ্য সমধান ছাড়া শরণার্থীরা দেশে ফিরে যেতে পারে না। আর এই যুক্তগ্রাহ্য সমাধানের অর্থই হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা।
মার্কিন সিনেটর উইলিয়ম স্যাকসবি বলেছেন, বাংলাদেশের অবিসংবাদিত জননেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে ছাড়া বাংলাদেশ সমস্যার কোন সমধান হতে পারে না। সুতরাং বাংলাদেম সমস্যার সমাধানে অগ্রসর হতে হলে প্রথমেই শেখ মুজিবের মুক্তি প্রয়োজন। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাকে তিনি ইতিহাসের অন্যতম শোচনীয় ঘটনা বলে আখ্যায়িত করেছেন। বাংলাদেশ সমস্যা সমাধানে মার্কিন সরকারকে সচেষ্ট হওয়ার জন্য তিনি আহবান জানিয়েছেন।
বাংলাদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পতাকা উড়িয়ে দিচ্ছে বাংলাদেশের বিস্তৃত অঞ্চলে- আর সেই সঙ্গে বিশ্বমানুষের সমর্থনপুষ্ট মানবতার পতাকাও উড়ছে বিশ্বের সর্বত্র। কেননা ন্যয়, সত্য ও স্বাধীনতার সংগ্রাম কখনো ব্যর্থ হয় না।

(মহাদেব সাহ রচিত)
পিপ্তির প্রলাপ *
১২ নভেম্বর, ১৯৭১

জঙ্গী শাসক ইয়াহিয়া খাঁ আর তার জল্লাদ বাহিনীর তোতাপাখীগুলা সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত একই শেখানো বুলি আউড়ে চলেছে রেডিও গায়েবি আওয়াজে গ্রামোফোন কোম্পানীর কুকুরের ছবিওয়ালা সেই রেকর্ডের মতো। পিন দিয়ে চড়িয়ে দিলেই হোল কলেরগান বাজতে শুরু করবে। বাঁধা গতে গান হবে। সকালসন্ধ্যা-রাত-যখনই শুনুন না কেন, পড়ানো লবজই বেতারের একমাত্র পুঁজি। সকালবেলা উঠে শুনতে পাবেন, অবস্থা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক, পরিস্থিতি সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। দুপুরে-দেশপ্রেমিক জনসাধারণ দৃস্কৃতকারীদের প্রশ্ৰয় তো দিচ্ছে-ই না বরং সেনাবাহিনীর কাছে ধরিয়ে দিচ্ছে। এরপর রাত গভীর হওয়ার সাথে সাথে পিন পাল্টে দেয়া হবে। আর তোতার কণ্ঠে শোনা যাবে- একদল অনুপ্রবেশকারী আমাদের সীমান্তের কয়েকশ’ গজ ভেতরে ঢুকে পড়েছিল। আমাদের সেনাবাহিনী শুরুতেই তাদের বাধা না দিয়ে পরিকল্পিতভাবে তাদের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। পরে সময়মতো আক্রমণ চালায়। আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে অনুপ্রবেশকারীরা অস্ত্রশস্ত্র ফেলে পালিয়ে যায়। এর পরেই একটি অস্ত্রপাতির লম্বা ফর্দ পেশ

* পিণ্ডির প্রলাপ’ শীর্ষক ধারাবাহিক কথিকাগুলো তোয়াব খান রচিত।

<005.005.162>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

এবং হতহাতের সংখ্যা বহু বলে উল্লেখ করা হবে। সবশেষে বলা হবে, কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।’ দিনের পর দিন তোতার কণ্ঠে রেডিও গায়েবী আওয়াজের এই বাণীই শুনতে পাওয়া যাবে। অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যাও আবার কয়েক হাজার, কিন্তু তোমার প্রভুর ক’জন বরকন্দাজ মারা গেল সে সম্পর্কে গায়েবী আওয়াজ এক্কেবারেই চুপ৷

সমরবিদ্যার সবচেয়ে খারাপ ছাত্রটিরও পেটের পিলে এই জাতীয় কথাবার্তা শুনে ফেটে যেতে পারে হাসতে হাসতে। সীমান্তের কয়েকশ’ গজ ভেতরে, হতাহতের সংখ্যা বহু, কয়েকজন গ্রেফতার’- অর্থাৎ সঠিক সুস্পষ্ট কোন তথ্য তোতার মুখে ভুল করেও শোনা যাবে না। যদি প্রশ্ন করা যায়- মাথা খারাপ হয়েছে, ও কথা মুখে আনবেন না। কোন তথ্য সম্পর্কে প্রশ্ন করা সাফ মানা। তার উপর তোতা কি প্রশ্ন করতে পারে? কিন্তু মুশকিল হোয়েছে গ্রামোফোন কোম্পানীর তোতা আর তার প্রভু ছাড়াও বাইরের যে জগতটি রয়েছে তাকে নিয়ে তারা তো তোতা নয়, তাই প্রশ্ন তারা তুলছে। বলছে, নাদীর শাহের বংশধর আর গোয়েবলসের মন্ত্রশিষ্যারা হাতে কোন সুস্পষ্ট তথ্য থাকলে ছাডুন। কয়েক হাজার অনুপ্রবেশকারী, কয়েকশ’ গজ ভেতরে, কয়েকজন গ্রেফতার, হতাহত বহু- এসব কথা শুনলে তো পাগলেও হাসবে।

বাংলাদেশে কি ঘটেছে বা এখন কি ঘটছে, সে সম্পর্কে তোতার মুখের কাহিনীর ছাড়া অন্য কিছু যাতে দুনিয়ায় প্রচারিত না হয় তার জন্যই ইয়াহিয়া খাঁর আর সাঙ্গপাঙ্গরা প্রথমেই সমস্ত বিদেশী সাংবাদিককে ঢাকা সাংবাদিককে বাংলাদেশে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হলো। সেই সঙ্গে বলে দেয়া হলো- অমুক অমুক জায়গায় যেতে পারবেন না, তমুক তমুক কথা লিখতে পারবেন না। অমান্য করলে হয় ফাটক, না হয় লেখা গুম। এতসব বাধানিষেধ সত্ত্বেও বিদেশী খবরের কাগজগুলো যা লিখছে, তাতে জঙ্গীশাহীর বিচারের বেলুনটি ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে।

‘নিউজউইক’ পত্রিকার কথাই ধরা যাক। এই মার্কিন সাপ্তাহিকীটির সাথে সাক্ষাৎকারে ইয়াহিয়া খাঁ ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ অপরিহার্য বলেছিলেন। সেই কাগজই লিখেছে, ইয়াহিয়ার সরকার যাদেরকে অনুপ্রবেশকারী, ভারতীয় চর বলছে, তারা তো শুরু থেকেই লড়ছে সামরিক চক্রের বিরুদ্ধে। এরা বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর লোকজন ছাড়া আর কিছুই নয়। পত্রিকাটিতে ভারতীয় গোলাবর্ষণের পাকিস্তানী অভিযোগের কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, শেলগুলো পরীক্ষা করলেই যে কোন পর্যবেক্ষক বুঝতে পারবেনএগুলো নিকটপাল্লার কামান বা দুইঞ্চি মর্টার থেকে বর্ষিত হয়েছে। দূরত্ব বিচার করে একথা অনায়াসে বলা বলে, ভারত থেকে বর্ষণ করলে শেলগুলো এত দূরে আসতে পারে না। বিলেতের কাগজগুলো বলছে, বিবিসি বলছে, ফ্রান্সের সবচেয়ে মর্যাদাসম্পন্ন সংবাদপত্র ‘লামদ বলছে একই কথা। কিন্তু তাতে কি আসে যায়! তোতার শেখানো লবজ তা পালেট যাবে না।

এরপর ধরুন না অবস্থা স্বাভাবিক, দেশপ্রেমিকেরা দুষ্কৃতকারীদের ধরিয়ে দিচ্ছে তোতার এ বাণীর কথা। দেশপ্রেমিক নাগরিকরা জঙ্গিশাহীর সাথে এমনই সহযোগিতা করছেন যে, এখন তাদের উপর পিটুনি ট্যাক্স ধার্য করতে হচ্ছে জঙ্গীশাহীকে। এতেও যদি নিজেদের দৈন্য প্রকাশ না পায়, তবে দৈন্য’ শব্দের আধিধানিক অর্থই পাল্টে ফেলতে হবে। বিবিসির ভাষ্যকারের মতে, পিটুনি ট্যাক্স ধার্য থেকে বাংলাদেশের অবস্থা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক, জঙ্গীশাহীর এ দাবির অসারতা দুনিয়ার মানুষ বুঝতে পেরেছে। শুধুই তাই নয়, মুক্তিবাহিনীর লোকজন বাংলার মানুষের যে অকুণ্ঠ সহযোগিতা পাচ্ছে, এ থেকেই তা স্পষ্ট বোঝা যায়। গার্ডিয়ান, ডেলি টেলিগ্রাফ ও বিবিসির মতে, বাংলাদেশের মাইলে পর মাইল এলাকায় ইয়াহিয়ার জল্লাদ বাহিনী বা তার ক্রীড়নক সরকারের কোন অস্তিত্ব নেই। সেখানে মুক্তিবাহিনীর কর্তৃত্ব সূদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত। সর্বোপরি ইয়াহিয়ার চামুর দল রাতের বেলা কোথাও বের হতে সাহস করে না।

<005.005.163>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

মুক্তিবাহিনীর সাথে লড়াইয়ে জঙ্গিশাহীর এই যখন হালহকিকত, সৈন্যদলের মোর্যাল ঠিক রাখার জন্য তখনই খাঁ সাহেবরা গোয়েবলসের প্রেতাত্মার ঘাড়ে ভর করেছেন, তাই প্রতিদিন কুৎসা আর মিথ্যার বোঝা তাদের বেড়েই চলেছে। কিন্তু এমন দিন আর দূরে নয়, যখন মিথ্যার বোঝা চাপা পড়ে জঙ্গশাহীকে পুঁজিপাটাসমেত পৈত্রিক প্রাণটাও হারাতে হবে।

১৬ নভেম্বর, ১৯৭১

একেবারে গোমড় ফাঁক! ইয়াহিয়া খাঁর জবর বাক্যবাগীশ জেনারেল এ, এ, কে নিয়াজীকে একেবারে পথে বসিয়ে দিয়েছে মার্কিন কাগজ ‘নিউজউইক’। এত জাঁক করে তিনি বলেছিলেন, মার্চে যা করেছি, প্রয়োজনবোধে আবার তা করবো ঢাকার রাজপথে। আমাদের ট্যাঙ্কগুলো অপেক্ষা করছে। কিন্তু নিউজউইকের সিনিয়র এডিটর আরনড-দ্য-ব্ৰচগ্রেভ তো আর নিয়াঁজীর ক্যান্টনমেন্টের সিপাই নয়। সাফ বলে দিয়েছেন, জেনারেল তুমি মূখের স্বর্গে বাস করছো। পায়ের তলায় মাটি যে কতটা সরে গেছে তার খবর রাখ না। বাংলাদেশের শতকরা ২৫ ভাগ থানার উপর তোমাদের কোন কর্তৃত্ব নেই। মুক্তিবাহিনীর কর্তৃত্ব সেখানে সুপ্রতিষ্ঠিত। খোদ ঢাকার উত্তরাংশ এখন মুক্ত।

বাংলাদেশের ৭২ ঘন্টার মধ্যে অভিযান শেষ করার লম্বা-চওড়া আশ্বাসদানীকারী নরঘাতক জেনারেল টিক্কা খানের সর্ববৃহৎ বেলুনটি চুপসে যাওয়ার সাথে সাথেই এ, এ, কে নিয়াজীর আবির্ভাব। পাঞ্জাবের সাবেক সামরিক প্রশাসন এই জেনারেলের ভূমিকা সামরিক চক্রের জঘন্য ষড়যন্ত্রগুলিতে কোন অংশেই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। ’৬৯ সালের জানুয়ারী-ফেব্রুয়ারী-মার্চ যখন সারাদেশ গর্জে উঠেছিল আইয়ুবের স্বৈরাচারী কুশাসনের বিরুদ্ধে, হরতাল মিছিল আর ঘেরাওয়ে প্রকম্পিত হয়েছিল সামন্ত প্ৰভু একচেটিয়া পুঁজিপতি আর সামরিক অফিসারদের বাড়িতে বাড়িতে সেই সময়ে এই নিয়াজীকে দেখা যায় ঝিলামের একটি সামরিক ছাউনি এলাকায় অফিসারদের সাথে সলাপরামর্শ করতে-সংগঠিত করতে। ’৬৯ সালের ২৫ মার্চের ইয়াহিয়ার সামরিক অভ্যুত্থানের নেপথ্য কাহিনী সম্পর্কে লিখতে গিয়ে লণ্ডনের ডেলী টেলিগ্রাফ বলেছিল, জেনারেল নিয়াজীর-যাকে সামরিক চক্র টাইগার নিয়াজী বলে অভিহত করে থাকে- নেতৃত্বে একদল অফিসার এই মর্মে আলটিমেটাম দিয়েছিল যে তারা বাংলাদেশের তথাকথিত অরাজকতা কোনমতেই বরদাস্ত করতে রাজি নয়। তাদের মতে, এই সমেয় যা চলেছে তাকে বাড়তে দিলে সব যাবে। শোনা যায়, ঝিলামের সেই কুখ্যাত বৈঠকেই ঠিক করা হয়েছিল, বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থানকে স্তব্ধ করে দেয়ার জন্য যদি দরকার হয় তবে লক্ষ লক্ষ লোককে সাবাড় করে দেওয়া হবে। শহরে-নগরে বিক্ষুব্ধ জনতার মিছিলের উপর প্রয়োজনবোধে চালানো হবে ট্যাঙ্ক। তবে নিয়াজীর বড় আফসোস ছিল ’৬৯ সালেই এগুলো ঘটেনি বলে। অতএব নিয়াজী এ্যান্ড কোম্পানীরা বাংলাদেশের গণহত্যার ব্লপ্রিন্টটা দু’বছরের জন্যে কোল্ড ষ্টোরেজে রেখে দিয়েছিলেন। তাই ’৭১ সালের মার্চের শুরুতেই বাংলাদেশের মানুষের অসহযোগ আন্দোলনের আলোতেই এইসব জেনারেলরা তাদের বিপদের সংকেত দেখতে পেলো। কায়েমী স্বার্থ বিপন্ন। তাই তারা চক্রান্তের জাল ফেলতে শুরু করলো একে একে। অবশেষে এলো ২৫শে মার্চের সেই কালোরাত। টিক্কা খাঁর সাথে সাথে জেনারেল নিয়াজী বাংলাদেশে এলেও প্রেক্ষাপটে তার আগমনবার্তা ঘোষিত হয়নি। কিছুটা নেপথ্যেই রয়ে গেলেন তিনি। দায়িত্ব দেওয়া হলো বাঙালী নিধনের অপারেশনের। তারপর একদিন রণাঙ্গণে তার আবির্ভাব সামরিক প্রশাসন ও ইষ্টার্ন কমান্ডের কমাণ্ডাররূপে।

কিন্তু এবারে জেনারেল সাহেবের এস্টার্ন কমান্ড একোবরেই ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়েছে মুক্তিবাহিনীর গোলা আর বুলেটের আঘাতে আঘাতে অবস্থা বেগতিক দেখে রাজাকার নামক একদল ক্ষুদে ডাকাত সৃষ্টি করা “হাতে অস্ত্র আছে বলে রাজাকারদের দল নিজেদের খোদা বলে মনে করে। যত্রতত্র নিরীহ নিরস্ত্র জনসাধারণের কাছ থেকে

<005.005.164>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

টাকা-পয়সা আদায় করছে। যারা তাদের আশ্রয় দিতে বা মেয়েলোক সরবরাহ করতে অস্বীকার করছে তাদেরকে হত্যা করছে গুলি করে। এরপর মুক্তিবাহিনীর দুর্জয় অভিযানের সামনে সেনাবাহিনী প্রথমেই ঠেলে দিচ্ছে এইসব নিবোধ রাজাকারের দলকে।”

এসব সত্ত্বেও জেনারেল নিয়াজীর লম্বা-চওড়া দাবি কেন? নিউজউইকের মতে, পরাজয়ের গ্রানি কিছুটা লাঘবের জন্য জেনারেলের জল্লাদ বাহিনী নিরীহ-নিরস্ত্র সাধারণ মানুষকে হত্যা করছে, ব্যাপকাকারে চালাচ্ছে লুটতরাজ। সংবাদদাতা ঢাকার ডেমরা এলাকার কথা উল্লেখ করে বলেছেন, ইয়াহিয়ার সৈন্যদল এই গ্রামটি ঘেরাও করে ১২ থেকে ৩৫ বছরের প্রত্যেকটি মহিলার উপর পাশবিক অত্যাচার চালায় এবং ১২ বছরের উপরের সকল পুরুষকে হত্যা করে। এই হত্যা, লুণ্ঠন ও পাশবিকতায়ও শেষরক্ষা যে অসম্ভব, বাংলার দিগন্তবিস্তৃত মাঠ আর পদ্মা-মেঘনা-যমুনার উত্তাল তরঙ্গমালার দিকে একবার তাকালেই তা পরিষ্কার হয়ে যাবে।

২৮ নভেম্বর, ১৯৭১

মিথ্যোবাদী রাখালের কান্নায় ভিজে তার মহাপ্ৰভু শ্বেতপ্রাসাদ থেকে একেবারে দূরপাল্লার টেলিফোন করে বসেছেন ১০ ডাউনিং স্ট্রিটে। অভিপ্রায়- কিভাবে বাঁচানো যায় রাখালটিকে। স্বস্তি পরিষদের বৈঠক-টৈঠক কিছু করা যায় কিনা, তারই শলাপরামর্শ নাকি চলছে। হাজার হলেও এই রাখাল আর তার দেশ দীর্ঘদিন ধরে সাথে সাথে আছে সবকিছুতেই। সেই বাগদাদ চুক্তি, সিটো আর পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি থেকে শুরু করে সব সময়ে দুদিনে-সুদিনে পাশ্চাত্যের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সাথে তাল মিলিয়ে চলেছে পিণ্ডির জঙ্গীচক্র। ৫৮ সালের ইরাকী বিপ্লবের পর বাগদাদ জোট থেকে খোদ বাগদাদ খসে পড়ার পরও পিণ্ডির জঙ্গীচক্র উৎসাহী দোসর হিসাবে পাশ্চাত্যের সাথে থেকেছে সেন্টো চুক্তির বাঁধনে। আর এশিয়ার মাটিতে পরিবর্তনের ঢেউ বয়ে গেলেও পিণ্ডির জল্লাদের দল কোন সময়েই সিটো জোট থেকে সরে দাঁড়ায়নি। অতএব এ ধরনের একটি বিশ্বস্ত দালালকে তো রক্ষা করতেই হবে। কিন্তু মুশকিল হয়েছে জাতিসংঘ নামক সংস্থাটির সনদ নিয়ে। এই সনদ অনুযায়ী একমাত্র আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার মত অবস্থা দেখা দিলেই শুধু স্বস্তি পরিষদ কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। হাজার চেষ্টা সত্ত্বেও পিণ্ডির জঙ্গীচক্র এখনও এমন অবস্থা সৃষ্টি করতে পারেনি, যাকে আন্তর্জাতিক শান্তি বিপন্ন হওয়ার মত পরিস্থিতি বলে অভিহিত করা চলে। অন্যদিকে জঙ্গীচক্রের বরকন্দাজেরা একথা ক্রমান্বয়ে স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছে যে, বৈদেশিক হামলা-টামলা নয়, মুক্তিবাহিনীর দুর্বার আক্রমণেই এখন তারা চোখে সর্ষের ফুল দেখতে শুরু করেছে। বরকন্দাজ দলের পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান জেনারেল নিয়াজী তো খোলাখুলিভাবে বলেই ফেলেছেন যে, একমাত্র ঢাকাতেই দু’হাজার গেরিলা সক্রিয় রয়েছে। আর রেডিও গায়েবী আওয়াজ বলছে, যশোরের চৌগাছার কাছে লড়াই চলছে। তবে কিনা মুক্তিবাহিনী এখনও সরাসরি যুদ্ধ করার পর্যায়ে যায়নি। আতএব জঙ্গীচক্র শীঘ্রই চৌগাছা আবার দখল করতে পারবে-এই তাদের আশা বিভিন্ন সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে রেডিও গায়েবী আওয়াজ এটা প্রচার করলেও একটি সত্য সকলের কাছে সুস্পষ্ট হয়ে যায়- চৌগাছায় মুক্তিবাহিনীর সাথেই জল্লাদ দলের লড়াই চলছে। অতএব বৈদেশিক আক্রমেণর জুজুটা যে একেবারেই নির্জলা মিথ্যা, এটা রেডিও গায়েবী আওয়াজও স্বীকার আইন-কানুনেই তা স্পষ্টই ধোপে টেকে কি করে? বাংলার মানুষের মুক্তিসংগ্রোমের আট মাস অতিক্রান্ত হয়েছে। এই দীর্ঘ আট মাসের তীব্র ও তিক্ত সংগ্রামকালে যাদের মুখ থেকে এমনকি সমবেদনার একটি কথাও শোনা যায়নি। আজ তারা এতই উদ্বিগ্ন যে, স্বস্তি পরিষদে হাজির হওয়ার কথা পর্যন্ত ভাবছেন। অবশ্য মিথ্যেবাদী রাখালটিকে নিয়ে শ্বেতপ্রসাদের মহাপ্রভুরা উদ্বেগে আজ সোচ্চার হলেও নতুন কিছু নয়।কিছুদিন আগে ছ’জন সদস্যকে নিয়ে একটি তদন্তদল গঠনের কথা তারা ঘোষণা করেছিলেন। এটার মাধ্যমে তারা আসর জাঁকাতে চেয়েছিলেন। ওয়াশিংটনের পররাষ্ট্র দফতর থেকে ঐ রাখাল বালকটিকে কিছু কিছু সুপরামর্শও দেয়া হয়েছে। এবং সেই অনুযায়ী বাংলার গভর্নর পদে আবদুল মোতালিব

<005.005.165>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

মালিক নামক জনৈক দালাল দন্তচিকিৎসককে বসানো হয়েছে। বিগত সাধারণ নির্বাচনে জনগণের কাছে পরিত্যাক্ত কতিপয় রাজনীতিককে নিয়ে একটি তথাকথিত বেসামরিক সরকারও খাড়া করা হয়েছে। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার প্রহসকে তথাকথিত ‘সুবিচার’ হিসেবে দেখানোর জন্য একজন অনুমোদিত কৌঁসুলি দেয়া হয়েছে। আরো শোনা যায়, মার্কিনী সুপারিশ অনুযায়ীই গঠন করা হয়েছে রাজাকার বাহিনী, দেখানো হয়েছে সাধারণ ক্ষমার প্রহসন।

বাংলাদেশের মানুষ, সংগ্রামী মুক্তিযোদ্ধারা আর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কেউই এই ধরনের কোন ফাঁদে পা দেননি। সকলের কাছেই এই ধরনের সুকৌশল-চাতুর্যের আসল মতলবটা সব সময়ই ছিল অত্যন্ত পরিষ্কার। এবার তাই মরণোন্মুখ রাখাল বালটিকে বাঁচানোর জন্য শেষ চেষ্টা শুরু হয়েছে শ্বেতপ্রাসাদ আর ডাউনিং স্ট্রিট থেকে। যে সংস্থা বাংলার লাখ লাখ মানুষ হত্যার, গণহত্যার অভিযোগ শুনতে চায়নি, জল্লাদ দলের অত্যাচারে পৈত্রিক ভিটেমাটি থেকে উৎখাত হয়ে বিদেশে আশ্রয়গ্রহণকারী প্রায় এক কোটি মানুষের আকুল আবেদন যাদের কর্ণকুহরে প্রবেশ করেনি, তাদের নতুন যেকোন চক্রান্ত বাংলার মানুষ বানচাল করে দেবে। হানাদার বাহিনীকে চিরতরে খতম করে দিয়ে বাংলার স্বাধীনতার সূর্যকে অম্লান অক্ষয় রেখেই সাড়ে সাত কোটি বাঙালী এই নতুন চক্রান্তের দাঁতভাঙ্গা জবাব দেবে।

১০ ডিসেম্বর, ১৯৭১

স্বস্তি পরিষদ বা সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে চীনের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা মার্কিন চক্রান্ত একের পর এক চলতে থাকলেও গণপ্রজাস্ত্রী বাংলাদেশ এখন একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য। এটা অস্বীকারের অর্থ সকালের নবীন সূর্যের আলোকরশ্মি থেকে নিজেকে বঞ্চিত করা। নিরাপত্তা পরিষদে ব্যর্থ হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সাধারণ পরিষদে কতিপয় পেটুয়া রাষ্ট্রের সাহায্যে এবং চীনের সহযোগিতায় বাংলাদেশ তথা ভারতের বিরুদ্ধে একটি প্রস্তাব পাস করিয়ে নিয়েছে। আর তাদের সাথে এ ব্যাপারে ভিড়ে গেছে ইসলামের বেশধারী কতিপয় ইসলামপন্থী রাষ্ট্র। কিন্তু জাতিসংঘে যত তাড়াহুড়ো করেই তারা প্রস্তাব পাস করুক না কেন বাংলাদেশের পিণ্ডির জল্লাদ দলের বিরুদ্ধে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর দুর্বার অভিযান তাতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাগ্রস্ত হবে না । জাতিসংঘের ফরমান বাংলাদেশে পৌঁছানোর আগেই পাকিস্তানী হানাদারদের প্রতিরোধের সকল প্রাচীর ধসে পড়বে, এটা এখন প্রায় সুনিশ্চিত। সত্যি কথা বলতে কি, জাতিসংঘ নামক ঠুটো জগন্নাথকে রবার স্ট্যাম্প হিসেবে ব্যবহার করার সুযোগ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে আর পাচ্ছে না বা এ সুযোগ তাদেরকে দেয়া হবে না। বাংলাদেশের আকাশে স্বাধীনতার যে সূর্য আজ আপন মহিমায় বিকশিত হয়েছে তাতে কলঙ্কিত করার মওকা পাক-দোস্ত চীন বা পিণ্ডির মহাপ্ৰভু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা তাদের রবার স্ট্যাম্প জাতিসংঘ পাবে না।

বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের যে সংগ্রাম শুরু করেছেন মহান গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের কূটনৈতিক স্বীকৃতির পর তা আজ এক নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করেছে। মুক্তাঞ্চলে নবজীবনের রূপায়নের মহান দায়িত্ব আজ মুক্তিসংগ্রামী সকলের উপর বর্তেছে। তারাই আজ স্বাধীন বাংলাদেশে সুখী শোষণহীন গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার নকিব। এজন্যই প্রথমে মনে রাখা দরকার, আমাদের এই স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমি ও মূলনীতির কথা। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ তাদের সাম্প্রতিক বেতার ভাষণে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় স্বাধীন বাংলার অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের মূলনীতি জানিয়ে দিয়েছেন। এই নীতির ভিত্তি হলো ধর্মনিরেপক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র। তারা বলেছেন, মানুষের উপর মানুষের শোষণের নীতিতে আমরা বিশ্বাসী নই। ধনী ও দরিদ্রের মধ্যকার অর্থনৈতিক ব্যবাধানের অবশ্যই বিলোপ সাধন করতে হবে। আজ তাই এমনভাবে সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থাকে পুনর্গঠিত করতে হবে, যাতে বাংলাদেশের মেহনতি মানুষ উপকৃত হয়। যাতে শ্রমিক-কৃষক পায় সকল সুযোগ-সুবিধা তাদের জীবনযাত্রার পুনর্বাসনের জন্য।

<005.005.166>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

বস্তুতঃপক্ষে স্বাধীন বাংলাদেশের শোষণহীন সমাজব্যবস্থার অর্থনৈতিক কাঠামোটি কি ধরনের দাঁড়াবে তার একটি মোটামুটি রূপরেখা দেয়া হয়েছে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ম্যানিফেষ্টোতে। এতে অর্থনৈতিক রফতানী বাণিজ্য রাষ্ট্রায়তুকরণের কথা বলা হয়েছে। ভূমিব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন সাধন এবং কর কাঠামোর প্রগতিশীল রূপায়নের দিকও নির্দেশিত হয়েছে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ম্যানিফেষ্টেতে। যেহেতু বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান ও কৃষিনির্ভর দেশ সেহেতু গ্রামবাংলার উন্নয়ন তথা কৃষির পক্ষে কল্যাণকর ব্যবস্থা ছাড়া অর্থনৈতিক বৈপ্লবিক রূপায়ণ প্রায় অসম্ভব বলা চলে। দারিদ্র্য তার সর্বগ্রাসী সংহার মূর্তি নিয়ে সর্বত্র সমান ছায়া ফেললেও পাকিস্তানী শাসকদের ঔপনিবেশিক নীতির ফলে বাংলাদেশের গ্রামবাংলার চেহারা আজ ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। পাকিস্তানী শোষকরা দরিদ্র কৃষককুলের কল্যাণের জন্য কোন ব্যবস্থা তো গ্রহণ করেইনি বরং এমন সমস্ত ব্যবস্থা নিয়েছে যাতে ভূমিহীন কৃষকের হাতে এককাঠা জমি না যায়। এক সময়ে ভূমির সর্বোচ্চ সীমা পরিবারপ্রতি ৩৩ একর নির্ধারণ করে যে আইন পাশ করা হয়েছিল, জল্লাদ ইয়াহিয়ার গুরদেব আইয়ুব খাঁ তা রদ করে ১২৪ একরে নির্ধারণ করে। যার ফলে উদ্ধৃত্ত ভূমি বাংলাদেশে বন্টনের সম্ভাবনা চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যায়। তাই আজকে বাংলাদেশের মেহনতি কৃষকসমাজের ৭৬ শতাংশ হয় ভূমিহীন আর না হয় নিতান্তই গরীব। পশ্চিম পাকিস্তানী সামন্ত ভূস্বামী একচেটিয়া পুঁজিপতিদের সীমাহীন শোষণের ফলে বাংলাদেশের কৃষকের ঋণের পরিমাণ শুধু সরকারের কাছে দাঁড়ায় একশো কোটি টাকার উপরে। জোতদার ও মহাজনী ঋণের পরিমাণ তাতে ধরা হয়নি। আর কৃষকদের মধ্যে এই মহাজনী ঋণের পরিমাণ যে কত ব্যাপক তা সকলেরই জানা আছে। বাংলাদেশের অধিকাংশ আবাদী জমিও এদের কবজার মধ্যে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় এই যে, বাংলাদেশের শস্যভাণ্ডার বলে বিবেচিত জেলাগুলো- সিলেট, ময়মনসিংহ, রংপুর, রাজশাহী, দিনাজপুর, বরিশাল, পটুয়াখালী, খুলনার দক্ষিণাঞ্চলে মহাজনী ও জোতদারী শোষণের রূপটা সবচেয়ে প্রকট। এই সমস্ত অন্যায় ও অবিচার অবসানের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ম্যানিফেষ্টেতে। ভূমিব্যবস্থাকে এমনভাবে পুনর্বিন্যাসের কথা বলা হয়েছে যাতে সত্যিকারের কৃষক উপকৃত হয়। বর্তমান ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার বিলোপ সাধনের উদ্দেশ্যে প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমি করমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে এবং এই পরিমাণ জমির জন্য বকেয়া কোন খাজনা দিতে হবে না বলে ঘোষণা করা হয়েছে।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামো সম্পূর্ণ শোষণমুক্ত করে কৃষক-শ্রমিক মধ্যবিত্ত-ব্যবসায়ী তথা আপামর জনসাধারণের জন্য এক সুখী-সমৃদ্ধিশালী সমাজ গঠনের দায়িত্ব আজ সকলের গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যেই মুক্তাঞ্চলে বেসামরিক প্রশাসন ব্যবস্থা চালু করার কাজ হাতে নিয়েছেন। নয়া জামানার নতুন নকীবদের কণ্ঠে ধ্বনিত হোক আজ নবজীবনের শপথ, নতুন সমাজ গঠনের রণতর্য।

রক্তের অক্ষরে লিখি*

১৪ নভেম্বর, ১৯৭১

শান্তির ললিতবাণী যাদের কাছে পরিহাসের সামগ্রী, সেই দানবের সঙ্গে সংগ্রামের তরে সংগ্রামীরা ঘরে ঘরে প্রস্তুত হচ্ছে- এই সংবাদ রবীন্দ্রনাথ আমাদের দিয়েছিলেন বহু বছর আগে। আজ বাংলার মাটিতে দাঁড়িয়ে আমরা অনুভব করছি সংগ্রামীদের পদচারণা, বীরের মতো তারা যুদ্ধ করছে শত্রু র সঙ্গে, প্রাণ দিচ্ছে অকাতরে প্রাণ দেয়া-নেয়ার এই উৎসবের মধ্য দিয়ে তারা আমাদের সোনার বাংলা ও তার শান্তিপ্রিয় মানুষকে সুখের মধ্যে

* ‘রক্তের অক্ষরে লিখি’ শীর্ষক ধারাবাহিক কথিকাগুলি ‘জাফর সাদেক’ ছদ্মনাম

<005.005.167>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

প্রতিষ্ঠিত করার মহান সংকল্প নিয়েছে। জেগেছে মানুষ, জেগেছে প্রাণ, খুলেছে দুয়ার। কার সাধ্য বিজয়ের পথে বাধা সৃষ্টি করে। কার সাথ্য অন্ধকারে রাজত্ব কায়েম করে।

সাধ্য যে নেই তার প্রমাণ বাংলাদেশ, রক্তাক্ত বাংলা, সংগ্রামী বাংলা। সাধ্য যে নেই তার প্রমাণ বাংলার মানুষ, প্রমাণ তাদের সংগ্রামী চেতনা। সেই চেতনার কথা বলছেন বাংলারই এক কবিঃ

আমার চেতনা ঘিরে বিচ্ছুরিত এক কণা
গড়ে তোলে আর এক রক্তিম চেতনা
পৃথিবীর সব কথা স্নান ভেবে অনেক বিস্মৃতি
মুছে ফেলে আজ জেগে থাক রক্তাক্ত স্মৃতি।

এই রক্তাক্ত অনুভূতির কথা বাংলার হৃদয়কে উজ্জীবিত করেছে। বাংলার যে মানুষ চিরকাল শান্তি শত্রু র সঙ্গে যুদ্ধ করতে। আজ শক্র হননের পালা। জীবন আজ উৎসর্গিত হবে জীবন বাঁচাতে- জীবনকে প্রতিষ্ঠিত করতে, প্রতিষ্ঠিত করতে এমনভাবে যেন শত্রু আর শান্তির নীড়ে হানা দিতে না পারে। তাই আজ চারিদিকে লাল সূর্যের অভ্যুদয়।…

২১ নভেম্বর, ১৯৭১

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ জোরদার করার জন্য দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে বহু পত্রপত্রিকা বেরিয়েছে। আওয়ামী লীগের মুখপত্র ‘জয় বাংলা সাপ্তাহিক বাদে বাংলার বাণী, নতুন বাংলা, বিপ্লবী বাংলা, স্বদেশ, দাবানল প্রভৃতি নানা নামের পত্রপত্রিকায় আমাদের বীর যোদ্ধাদের অগ্রগতির সংবাদ, অজেয় মনোবল ও অভূতপূর্ব আত্মত্যাগের কাহিনীসহ দেশী-বিদেশী সংবাদ সব সময় বেরুচ্ছে। দেশের জনসাধারণকে সব ব্যাপারে ওয়াকিফহাল রাখতে এই পত্রপত্রিকাগুলো নিরন্তর চেষ্টা করে চলেছে। হানাদারদের মিথ্যা প্রচারের স্বরূপ উদঘাটনের জন্য দেশপ্রেমিক সাংবাদিকরা মন-প্রাণ দিয়ে পরিশ্রম করছেন। প্রতিটি ক্ষেত্রে দুর্ভেদ্য দুর্গ গড়ার যে প্রচণ্ড প্রচেষ্টা দেশের মানুষ সব সময় করে চলেছে, এটা তারও একটি অংশ। দেশবাসীর মনোবল অক্ষুণ্ণ রাখতে সংবাদপত্র যে মহান ভূমিকা পালন করতে পারে সেই ভূমিকাই আন্তরিকভাবে এইসব পত্রিকাগুলো পালন করে চলেছে।

সংগ্রামীরা যুদ্ধের সংগে সংগে কলম ধরেছেন এবং দেশপ্রেম ও সংগ্রাম এক হয়ে যে আগুন ঝরাচ্ছে তা অনুভব করতে হলে এই পত্রিকাগুলো বার বার পড়া দরকার।

মুক্তিযোদ্ধারা ডায়েরীর আকারে তাদের অভিজ্ঞতার কথা সব সময় লিখছেন এখানে। দাবানল’ পত্রিকায় ‘গেরিলার ডায়েরী’ লিখেছেন মুকুল নায়ক। ৩১শে অক্টোবর সংখ্যায় ইনি লিখেছেন :

“আমি একজন গেরিলা নায়ক। গত মাসে পাবনার বিভিন্ন মুক্ত এলাকা ঘুরেছি। গ্রামবাংলার মানুষ এত দুঃখ, কষ্ট ও নির্যাতনের মাঝেও সুকঠিন মনোবল নিয়ে থাকতে পারে এটা একটা বিস্ময়কর দৃষ্টান্ত ছাড়া কিছুই নয়। তাদের বাড়ি-ঘর দস্যুসেনারা জ্বালিয়েছে, লুট করেছে মা-বোনের ইজ্জত, হত্যা করেছে নিরীহ মানুষকে, তবুও তারা মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে আছেন মুক্তিবাহিনীর আগমনের অপেক্ষায়।… তারা দেশকে শত্রু মুক্ত করার জন্য পাগল হয়ে উঠেছেন।… তাদের সকলের কথা অস্ত্র চাই, মরতে হয় যুদ্ধ করে মরবো, দেশকে স্বাধীন করবোই।” কথা বলার সময় মনে হচ্ছিল তাদের চোখ দিয়ে যেন আগুনের ফুলকি বেরুচ্ছে।

<005.005.168>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

এরপর লেখক দালাল, দস্যু ও পাকসেনাদের খতম করার কাহিনী বলেছেন :

“রাতের অন্ধকারে বিভিন্ন রণাঙ্গন থেকে এলো আমাদের গেরিলা ইউনিটসমূহের দলপতিগণ।… গাজনার বিলে অপারেশন করে এগারোজন দুর্ধর্ষ ডাকাতকে ধরে এনে গণআদালতে বিচার করে তাদের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন। বাকী দুষ্কৃতকারীগণ গ্রাম থেকে পালিয়েছে।… তৃতীয় দল নগরবাড়িগামী পাকসেনা বোঝাই ট্রাকের উপর আক্রমণ চালিয়ে ১২ জন পাকসেনাকে খতম করেছেন।
তাদের বীরত্বপূর্ণ কাজের কথা শুনে সত্যি আনন্দ অনুভব করছিলাম।”

বিপ্লবী বাংলাদেশ’ পত্রিকার নিয়মিত মুক্তিযোদ্ধার ডায়ের প্রকাশিত হচ্ছে। বরিশাল থেকে মিজানুর রহমান লিখেছেন তার উপর পাকসেনাদের নির্যাতনের কথা, কিভাবে তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করলেন তার কথা। তিনি লিখছেনঃ

“মৃত্যুর হাত থেকে আমি বেঁচে এসেছি। বাঁচিয়েছে মুক্তিসংগ্রামী আবদুল জলিলকে। কিন্তু বাঁচাতে পারিনি শহীদুল হাসান, শাহজাহান ও আমির হোসেনকে। ওরা আজ মৃত্যুর দেশে বসে আমাদেরকে আশীৰ্বাদ করছে।” এই স্মৃতিচারণের পর লেখক বর্ণনা করেছেন, কিভাবে তারা পাঁচ বন্ধু খান-সেনাদের হাতে বন্দী হলেন। এরপর তিনি লিখছেনঃ
“পাক হানাদাররা আমাদের পাঁচজনকে পাঞ্জাবী পুলিশের হেফাজতে রেখে চলে গেল যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকে।… এরপর আমাদের নিয়ে যাওয়া হোল থানায়। সেখানে পাঁচজনের উপর চলল নির্যাতন।… শরীর কেটে লবন পর্যন্ত দেয়া হয়েছিল। সমস্ত রাত ধরে চলল এমনি অত্যাচার, পর দিনও কাটল। আবার রাত হলো।…
দেখতে দেখতে এক সময় চরম মুহুর্ত ঘনিয়ে এলো। ফায়ারের অর্ডার হলো। তিনজন পাঞ্জাবী পুলিশের রাইফেল গর্জে উঠল, লুটিয়ে পড়ল শহীদুল হাসান, শাহাজান, আমির হোসেন। আবার ট্রিগার টানা হলো মুহুর্ত পরেই লুটিয়ে পড়ব আমরা বাকী দুজন, কিন্তু এমন মৃত্যুই কি চেয়েছিলাম?

না, না, প্রতিশোধ নিয়ে তবে মরতে হবে। পাশেই স্রোতস্বিনী নদী বয়ে চলেছে- বাঁচতে হবে, প্রতিশোধ নিতে হবে, আবার ফায়ারের অর্ডার হল। কিন্তু তার আগেই জলিলকে বুকে নিয়ে ঝাপিয়ে পড়লাম নদীর বুকে। হে দেশমাতা, তোমার বুকে ঝাঁপ দিয়েছি, তুমিই গ্রহণ করো।

রাতের আধাঁর বিদীর্ণ করে ঝাকে ঝাকে গুলি এসে পড়তে লাগল নদীর বুকে, জলিলকে ধরে ডুব দিতে দিতে ওদের নাগালের বাইরে চলে এলাম, এবার প্রতিশোধ।”…..

২৫ নভেম্বর, ১৯৭১

বাংলাদেশের সংগ্রামী জনতা এক বিচিত্র অবস্থার মধ্যদিয়ে এ বছরের ঈদ উদযাপন করলো। দেশের মাঝে পশুশক্তির প্রতীক ইয়াহিয়া চক্র নিরীহ মানুষের রক্ত ঝরাচ্ছে, নিরস্ত্র বঙ্গবাসী প্রাণ রক্ষার্থে ব্যতিব্যস্ত, আর বীর মুক্তিযোদ্ধারা জীবনপণ করে লড়ছে শত্রু র সঙ্গে। বিভিন্ন সেক্টরে খান সেনারা আজ কাপুরুষের মতো পালিয়ে বেড়াচ্ছে, দিন গুণছে মৃত্যুর। এমনি পরিবেশের ঈদের চাঁদ উঠলো, ঈদও হয়ে গেল- কিন্তু বাঙালী আজ দরদভরা

<005.005.169>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

কণ্ঠে, আব্বাসউদিনের কণ্ঠে শুনতে পেলো না নজরুলের সেই বিখ্যাত গানঃ রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশীর ঈদ।

এতে বাংলাদেশের মানুষ দুঃখিত নয়। কারণ তারা জানে যে, কোনো জাতির জীবনে কোন কোন সময়ে এক-একটি ঐতিহাসিক মুহুর্ত আসে যখন তাকে স্থায়ী একটি সিদ্ধান্ত দিতে হয়, জীবন ও মৃত্যুর শত মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। শত আত্মত্যাগের মধ্যদিয়ে তাকে এ কথা নিশ্চিত প্রমাণ করে যেতে হয় যে, পরবর্তী বংশধররা আর অত্যাচারিত, শোষিত, নিষ্পেষিত হবে না। সেই ঐতিহাসিক ও চরম মুহুর্ত আজ এসে গেছে। আমরা সেই ইতিহাস পরিবর্তনকারী, ইতিহাস সৃষ্টিকারী গৌরবময় মুহুর্তের মধ্যে আছি যখন আমরা বুঝতে পারছি “ফুল খেলবার দিন আজ নয়’- আজকের দিন হচ্ছে চরম সংগ্রামের, চরম আত্মত্যাগের, আত্মোপলব্ধির।

বাংলাদেশে যে অভূতপূর্ব অবস্থা বিরাজ করছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে এবারকার ঈদ সম্পর্কে নানা মন্তব্য প্রকাশিত হয়েছে মুজিবনগর থেকে প্রকাশিত একাধিক পত্রপত্রিকায়।

সাপ্তাহিক ‘জয় বাংলা পত্রিকা ২ অগ্রহায়ণ সংখ্যায় লিখেছেঃ এবার শারদোৎসবে বুড়ীগঙ্গার পারে যেমন বাজন বাজেনি, তেমনি এবার ঈদেও খুশীর চাঁদ বাঙালীর আকাশে ওঠেনি। খুশী হওয়ার উৎসব করার অবকাশ কই এখন বাঙালীর জীবনে? গোটা জাতি যখন তার অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে ব্যস্ত, নরপশু ইয়াহিয়ার দস্যুচক্রের বিরুদ্ধে জাতি যখন জীবন-মরণ সংগ্রামে লিপ্ত তখন উৎসব করার, আনন্দ করার অবকাশ মানুষের জীবনে থাকতে পারে না।

গতবারও বাংলাদেশের মুসলমান রোজার ঈদে উৎসব করতে পারেনি। বারোই নভেম্বরের প্রলংকারী ঝড়ে সেবার বিশ লাখ বাঙালী মৃত্যুবরণ করেছে। দেড় হাজার মাইল দূরে তথাকথিত ইসলামাবাদের শাদাদী বেহেশতে বসে ইয়াহিয়া-চক্র বিশ লাখ বাঙালীর মর্মন্তদ মৃত্যু দেখে উপেক্ষার শয়তানী হাসি হেসেছে এবং আরো দশ লাখ বাঙালীকে হত্যার জন্য ছুরি শাণিয়েছে। গতবার বাংলার মুসলমান বিশ লাখ মানুষের মৃত্যুর শোকে রোজার ঈদে শোকাশ্ৰ চোখে কাতারবন্দী হয়েছে নমাজের ময়দানে,- এবার আরো বিশ লাখ ভাইবোনের লাশের স্তুপের উপর বসে তারা আকাশে দেখছে বাঁকা খঞ্জরের মত ঈদের চাঁদ। এবারও তারা উৎসব পালন করতে পারে না।

আজ নয়, বাংলার আকাশে খুশীর ঈদের চাঁদ একদিন উদিত হবে এবং সেদিন সুদূর নয়- যেদিন ইয়াহিয়ার দস্যুবাহিনী বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত হবে এবং স্বাধীন ও মুক্ত বাংলার নীলাকাশে শওয়ালের চাঁদ সব অশ্রুর কুয়াশামুক্ত হয়ে আবার খুশীর রোশনাই ছাড়বে।

মুজিবনগর থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকার ১লা অগ্রহায়ণ সংখ্যায়ও ঈদ সম্পর্কে একটি রচনা প্রকাশ করা হয়েছে। পাকিস্তানী বিমানবাহিনীর বোমাবর্ষণেও বিধ্বস্ত একটি পাকা মসজিদের ছবিসহ এই রচনার এক জায়গায় বলা হয়েছেঃ

বাংলাদেশের দ্বারপ্রান্তে এসে ঈদ যেন এবার ক্ষণিকের জন্য থমকে দাঁড়াল। তার নামে যে কী একটা উৎকট দুর্গন্ধের দমকা হাওয়া ঢুকে পড়ে মুখটাকে একটু বিকৃত করে ফেললো। কী এক বিকট হাহাকার ও আর্তনাদের ধ্বনি যেন তার কানে তালা লগিয়ে দিলো। চোখ তুলে এক মুহুর্ত এদিক-ওদিক তাকিয়ে একেবারে আৎকে উঠল সে? ধ্যাননেত্ৰে যেন স্পষ্ট দেখতে পায় কোথাকার কোন রক্তপিপাসু রক্তপায়ী দানবের দল কামড়ে আঁচড়ে লাখো লাখো বাঙালীর মুণ্ডু ছিড়ে রক্ত ঝরিয়ে চলেছে। ধর্ষিতা বাংলার মা হতচেতন অবস্থায় মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। আর এখনো যারা বাংলাদেশে প্রাণটুকু নিয়ে বেঁচে আছে তারা প্রায় সকলেই প্রিয়জনের

<005.005.170>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

বিয়োগব্যথায় শোকাতুর, ব্যাথাতুর, স্নানমুখ, জীবন্মত অবস্থায় ধুকছে। আমি কি করে এদের মুখে হাসি ফোটাব?…
মৃত্যুর সঙ্গে, শত্রু র সঙ্গে যে পাঞ্জার লড়াই চলছে- তার সংবাদ দিয়েছেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধামন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ। ঈদের দিনে মুক্তিবাহিনী নিবেদিতপ্রাণ সদস্যদের উদ্দেশ করে দেয়া এক বক্তৃতায় তিনি বলেছেন যে, আমরা শত্রু কে চারদিক থেকে আঘাত হেনে চলেছি, দেশবাসী যেন তৈরি থাকে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যে শোষণহীন সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা কায়েম করার কথা বলেছিলেন, সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য এই মুক্তি আন্দোলন শুরু হয়েছে। শত্রু কে নির্মুল করে এমন এক সুখী বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে যেখানে একজন আর একজনকে শোষণ করতে পারবে না। সবাই সমান সুযোগ-সুবিধে পাবে।
এর পর পরই মুক্তিবাহিনী প্রচণ্ড বিক্রমে শত্রু সেনার উপর আঘাত হেনেছে এবং খুলনা, যশোর, রংপুর, সিলেট ও চট্টগ্রাম খান সেনারা প্রচণ্ড মার খেয়ে ক্রমাগত পিছু হটে চলেছে। মুক্তিবাহিনী এখন বিজয়ের পথে। সে কথা ঘোষণা করে প্রধানমন্ত্রী গত ২৩শে নভেম্বর জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া এক বেতার ভাষণে দেশের প্রতিটি বিজয়ের পথে এগিয়ে চলেছে, শক্র দাঁতভাঙ্গা জবাব পাচ্ছে। সে এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি। তার মনোবল ভেঙে গেছে। সে বুঝতে পারছে অন্যায় টিকতে পারে না। অহঙ্কারের পতন অবশ্যম্ভাবী, অত্যাচারীর ধ্বংস অনিবার্য, পশুশক্তি মানবতার কাছে কিছুই নয়। বাংলার মানুষ আজ ইতিহাসের শুভ্রতম পৃষ্ঠাগুলো অধিকার করেছে, আর ইয়াহিয়াচক্র ইতিহাসের কৃষ্ণতম পৃষ্ঠাগুলোর মধ্যে মুখ থুবড়ে পড়ছে। এরই নাম ইতিহাস, এরই নাম মহাকাল। এরই নাম সত্যের জয়, ন্যায়ের জয়।

২ ডিসেম্বর, ১৯৭১

… ১৯৪৭ সালে যখন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হয় তখনও আমরা জানতাম পশ্চিম পাকিস্তানের জীবনধারন পদ্ধতি, ধ্যান-ধারণা, আচার-সংস্কার প্রভৃতির সঙ্গে বহুক্ষেত্রেই আমাদের মিল নেই, তাদের সঙ্গে আমাদের গভীর পরিচয় নেই, বহুদূরে অবস্থিত সেই দেশের মানুষের সঙ্গে গভীরভাবে সব সময় পরিচায়েরও সুযোগ নেই। তবুও আমরা মিলেমিশে থাকতে চেয়েছিলাম। বহু জাতি, বহু ভাষা, বহু ধর্ম ও বহু সংস্কৃতি নিয়েও একসঙ্গে বাস করা যায়। রাশিয়া, ভারত, চীন তার প্রমাণ। আমরা আশা করেছিলাম, ইতিহাসের দৃষ্টান্ত যেমন আমরা অনুসরণ করছি তেমনি পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারাও অনুসরণ করবেন। দেয়া-নেয়া, মিলনের মধ্যদিয়ে একটি বৃহৎ মৈত্রী প্রতিষ্ঠিত হবে, সে জন্যই আমরা সব সময়ই স্বার্থ ত্যাগ করতে প্রস্তুত ছিলাম, স্বার্থ ত্যাগ করেছিও। সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও জাতীয় পরিষদে সমান সমান প্রতিনিধিত্ব আমরা মেনে নিয়েছিলাম। সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা হওয়া সত্ত্বেও এ কথা আমরা বলিনি যে একমাত্র বাংলাই রাষ্ট্রভাষা হবে। বাংলা ভাষার মর্যাদা আমরা চেয়েছিলাম, মাতৃভাষা বাংলার মাধ্যমে বিদ্যা শিক্ষা আমরা চেয়েছিলাম, কিন্তু এ কথা আমরা বলিনি যে, উর্দু সম্পূর্ণ বাদ দিতে হবে- যে উর্দুকে আমরা জানবো না, উর্দু সাহিত্য সম্পর্কে আমাদের কোন উৎসাহ নেই। বরং উর্দু ছোটগল্প, কবিতা সম্পর্কে আমাদের উৎসাহ-ই ছিল। সমসাময়িক উর্দু সাহিত্যিকদের মধ্যে ফয়েজ আহমদ ফয়েজসহ অনেকেই আমাদের পরিচিত ছিলেন। শুধু উর্দু কেন, পশ্চিম পাকিস্তানের সবকটি ভাষা সম্পর্কেই আমাদের গভীর আগ্রহ ছিল। পশতু বা সিন্ধী সাহিত্য জানবার চেষ্টা করেছি আমরা। করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিক্রিয়াশীলরা যখন পাকিস্তানী ভাষা ও সাহিত্য কেন পৃথিবীতে সমস্ত ভাষা ও সাহিত্য জানবার দরজা আমরা সব সময়ই খোলা রেখেছি। বাঙালী কি ইতোপূর্বে সংস্কৃত, ফারসী, আরবী, উর্দু, ইংরেজি শেখেনি? সেইসব ভাষা ও সাহিত্যে তাদের অধিকার অর্জন করেনি?

<005.005.171>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

প্রকৃত প্রস্তাবে বাংলাদেশের মানুষ শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে কোনরকম বাধনিষেধ বা ঘৃণার জন্ম দিতে কখনও রাজি হয়নি। আমরা জানিয়ে দিয়েছি কোন কিছু জোর করে আমাদের ওপর চাপিয়ে দিলে আমরা মেনে নেবো না- যেমন উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার চেষ্টা আমরা ব্যর্থ করে দিয়েছি; কিন্তু তখন একথা আমরা বলিনি, উর্দু ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি আমরা বিদ্বেষভাবাপন্ন। এমনকি বাংলাদেশে যে সমস্ত উর্দুভাষী বাস করছেন তাদেরকে উর্দু বাদ দিয়ে কেবল বাংলাই শিখতে হবে এমন কথাও আমরা বলিনি। আমরা সব সময়ই উদার নীতি গ্রহণ করেছি। আমরা স্মরণ করেছি যে, হিটলারের সঙ্গে যখন যুদ্ধ চলছে, তখনও জার্মান সাহিত্য গ্রন্থ বা সংগীত বন্ধ করে দেয়নি বৃটেন। এই দৃষ্টান্ত আমাদের লেখকরা বারবার কর্তৃপক্ষের সামনে উপস্থিত করেছিলেন; বিশেষ করে ভারত থেকে বাংলা গ্রন্থাদি আমদানী করার সয় দৃষ্টান্ত উল্লেখ করে আমরা বলেছিলাম যে, যে জাতি জ্ঞানের দরজা বন্ধ করতে উদ্যত হয় সে জাতির মৃত্যু অনিবার্য। কেবল গায়ের জোরে একটি জাতি টিকে থাকতে পারে না। ইতিহাস তার সাক্ষী….
৯ ডিসেম্বর, ১৯৭১
… আমরা, বাংলাদেশের মানুষেরা, সবসময় পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে বাস করতে চেয়েছিলাম। চেয়েছিলাম বলেই দীর্ঘকাল ধরে আমরা পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য প্রচণ্ড স্বার্থ ত্যাগ করেছিলাম। বড় বড় উন্নয়নমূলক কাজ করা হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানে, আর বাংলাদেশে সামান্য কয়েক শ কোটি টাকার অভাবে বন্যা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়নি, সম্ভব হয়নি ঘূর্ণিঝড় থেকে বাঁচার জন্য কোন বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ। লক্ষ লক্ষ বাঙালী প্রাণ দিয়েছে। তবু পশ্চিমী কুচক্রীদের চৈতন্যেদয় হয়নি। শেষ পর্যন্ত বীর বাঙালী হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছে, যুদ্ধ করেছে ও করছে শত্রু র সঙ্গে। এখন চূড়ান্ত বিজয় ঘোষণার সময়, এখন শত্রু র পরাভব শিকারের সময়, এখন শত্রু র অস্ত্র ত্যাগ করে প্রাণ ভিক্ষা চাওয়ার সময়। এখন সত্যের জয়, আলোকের জয়, ন্যায়ের জয় ঘোষণার সময়। এখন নতুন সূর্য ওঠার সময়।…
বাংলাদেশ, বাঙালী জাতি আজ সেই গৌরবের অধিকারী হতে চলেছে। তারা অকাতরে প্রাণ দিচ্ছে দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য। প্রাণ দেয়ার মহান কর্তব্যে বাংলাদেশের লক্ষ তরুণ আত্মনিয়োগ করেছে। তাদেরই একজন আমিন। সেই আমিনের আত্মত্যাগের কথা লিখেছেন বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত ‘বিপ্লবী বাংলাদেশ’। পত্রিকাটি লিখছেনঃ
“তেতুলিয়া নদীর পাড়ে ছোট একটি গ্রাম, নাম তার সোনাহাটি। কবে অনাদি কালে কে এই মিষ্টিমধুর নামটি রেখেছিল জানি না, তবে সোনারহাট না হলেও ঘর আলো করা অফুরন্ত সুখ-সৌন্দর্য এই গ্রামটিকে ঘিরে ছিল-আজও কালের সর্বগ্রাসী ক্ষুধা তার সবটুকু হরণ করে নিতে পারেনি। সোনাহাটির প্রতিটি গাছ, পাতা, লতা আর ধূলোমাটির সাথে তার অন্তরের একান্ত আত্মিক সম্পর্ক। সে বন্ধন কেউ কোনদিন ছিন্ন করতে পারে না- পাক হানাদার বাহিনী তো দূরের কথা মহাকালও সেখানে এসে থমকে দাঁড়ায়।
এরপর হানাদার বাহিনীর সঙ্গে তেতুলিয়াতে যে যুদ্ধ হয় তার প্রসঙ্গে পত্রিকাটি লিখছেনঃ
“তেতুলিয়ার বুকে আজ দস্যুদের গানবোট। গোলাগুলির বজ্ৰগম্ভীর শব্দের অকস্মাৎ সোনাহাটির আকাশবাতাস কেঁপে উঠছে। চোখের পলকে ছোট ছোট কুটিরগুলো দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। বিশ্বাঘাতক বেঈমানেরা হানাদারদের খবর দিয়েছে- খবর দিয়েছে আমিনের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা সুসংঘটিত হয়ে আক্রমণ পরিচালনা করছে। আর যোগ্য সেনানীর ন্যায় পরিচালনা করছে ওর সহযোদ্ধাদের। এ যুদ্ধ হলো বিপ্লবী বাংলাদেশের বীর সন্তানদের মুক্তিযুদ্ধ, যে মুক্তিযুদ্ধ কোনদিন ব্যর্থ হয়নি, হতে পারে না। চারদিক থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে রাইফেল আর হাল্কা মেশিনগানের গুলি হানাদারদের আক্রমণের জবাব দিতে আরম্ভ করল। পাক পশুরা এই আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিল না। সারাদিন ধরে এইভাবে চললো গুলিবিনিময়। একশো’র উপর খান

<005.005.172>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

সেনা মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে- পশুদের উষ্ণ তাজা রক্তে সেনাহাটির মাটি তৰ্পণ করছে। এক সময় পশ্চিম দিকের মুক্তিযোদ্ধাদের গুলি চালনা থেমে যায়। এই সুযোগে অবশিষ্ট হানাদারদের গানবেটে পালিয়ে গেলঃ পেছনে ফেলে গেল ১০-১২ খানা গানবেটি ও অসংখ্য আধুনিক মারণাস্ত্র।”

এই যুদ্ধে আমিন শহীদ হন। আমরা জানি ইতিমধ্যে শত্রু রা তেতুলিয়াসহ বহু জায়গায় পরাস্ত হয়ে পালিয়ে গেছে। আমিনের আত্মত্যাগ সম্পর্কে পত্রিকাটি মন্তব্য করেছেন।
“আমিন মরেনি, আমাদের মাঝে ও বেঁচে আছে-বেঁচে আছে বাংলার মাটির সাথে, মিশে আছে তেতুলিয়ার উদাম তীরভাঙ্গা পাগলা ঢেউগুলোর সাথে, যা কোন দিনই বাংলা মায়ের কাছ ছাড়া হবে না। স্বাধীন বাংলাদেশে আবার সবাই যে যার ঘরে ফিরে যাবে-ফিরে যাবে সেই ছোট গ্রাম সোনাহাটিতে। সেই গ্রামে অজস্র ঝরা বকুল ফুল কবরটাকে ঢেকে রেখেছে। মিষ্টিমধুর গন্ধে মাতোয়ারা মৌমাছি উড়ে বেড়াচ্ছে গাছটাকে ঘিরে, লক্ষ আমিন জন্মেছে বাংলাদেশে। আমিনরা কোনদিন মরবে না, আমিনরা কোনদিন মরে না।

দৃষ্টিকোণ
১৫ডিসেম্বর, ১৯৭১

পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের হবু বেসামরিক সরকারের হবু উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্টমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভূট্টোর জাতিসংঘ প্রাসাদ চত্বরে পদার্পণের সাথে সাথেই হাজার মাইল দূরের ভিয়েৎনামের টনকিন উপসাগরে মার্কিন সপ্তম নৌবহরের পদচারণা শুরু হয়ে গেছে। গন্তব্যস্থল অনিদিষ্টি বলে উল্লেখ করা হলেও আপাতত উদ্দেশ্য নাকি ঢাকার মার্কিন নাগরিকের উদ্ধার করা। ঢাকার মাত্র কয়েক শ’ মার্কিন নাগরিক উদ্ধারের জন্য সপ্তম নৌবহরের পারমাণবিক শক্তিচালিত বিমানবাহী জাহাজ এন্টারপ্রাইজ ন্যায় রণপোতকে ব্যবহার করতে হচ্ছে এই খোঁড়া অজুহাতটি দুগ্ধপোষ্য বালকেও বিশ্বাস করবে না। তা ছাড়া মার্কিন নাগরিকরা হয়তো ইতিমধ্যেই ঢাকা ছেড়ে গেছেন। তাই সপ্তম নৌবহরের এই আকস্মিক আনাগোনা বা শক্তি প্রদর্শনের পেছনে নিশ্চয়ই অন্য কোন অভিসন্ধি রয়েছে, এটা সকলেই স্বাভাবিকভাবে সন্দেহ করবেন। এদিকে দিয়ে মার্কিন সপ্তম নৌবহরের ন্যস্কারজনক কীর্তিকলাপের রেকর্ড কেউ বিস্তৃত হবেন না। মার্কিন সমর দফতর পেন্টাগনের গোপন দলিলপত্র সম্প্রতি প্রকাশিত হওয়ার পর দুনিয়ার মানুষ জেনেছেন কিভাবে বিনা প্ররোচনায় এই সপ্তম নৌবহর টনকিন উপসাগরে থেকে উত্তর ভিয়েতনামের উপর আক্রমণ চালিয়েছিল। এখনও ভুলে যাওয়ার কথা নয়, ১৯৫৬ কোরিয়া যুদ্ধে মার্কিন হানাদার বাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল ম্যাকআরথারের নৌবহর বলে পরিচিত এই সপ্তম নৌবহরকে কোরিয়ার হামলা চালানোর জন্য ব্যবহার করা হয়েছে ! লোক অপসারণের নামে এরা অবতরণ করেছিল ১৯৬২ সালে থাইল্যাণ্ডে। পর্যবেক্ষকরা তাই ১২৫টি জাহাজ, ৬৫০টি বিমান ও ৬৫ হাজার নৌসেনা গঠিত এই সপ্তম নৌ-বহরকে উনবিংশ শতাব্দীর মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের গানবেটের সাথে তুলনা করেছেন। অতএব অবরুদ্ধ মার্কিন নাগরিক উদ্ধারের অজুহাত যে একেবারেই বাজে একথা বলাই বাহুল্য মত্র। ভারত সরকারের জনৈক মুখপাত্র ইতিমধ্যেই তাই বলেছেন” মানসিক চাপ সৃষ্টির জন্যই মার্কিন সপ্তম নৌবহরের এই পদচারণা।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিক্সন প্রশাসনের পিণ্ডি-প্রেম বর্তমানে প্রায় চরম পর্যায়ে উপনীত হলেও একেবারে নতুন কিছু নয়। দুনিয়ার সকল জাতির মুক্তি আন্দোলনের বিরোধিতায় সবার আগে এগিয়ে গেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশে পিণ্ডির জল্লাদ দলের গণহত্যা তথা এক কোটি বাঙালীর পৈত্রিক ভিটেমাটি থেকে উৎখাতের ব্যাপারে

<005.005.173>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

এই মার্কিন প্রশাসন তাই উচ্চবাচ্য করেনি। মার্কিন সংবাদপত্র এবং উদারপন্থী সিনেটেরদের প্রবল চাপের মুখে নিক্সন সরকার শরণার্থীদের জন্য কিঞ্চিৎ খয়রাতি বিতরণ করলেও পিণ্ডির জল্লাদচক্রকে অস্ত্রশস্ত্রসহ সবকিছুর সাহায্যে মদদ দিয়েছে। যার পরিণতি ভারতের উপর পাকিস্তানী সামরিক চক্রের প্রকাশ্য নগ্ন হামলা। আজ নিজের চক্রান্ত জালে আটকে জবরদস্ত সেনাপতি ইয়াহিয়া খাঁর যখন নাভিশ্বাস উঠতে শুরু করেছে তখন পেয়ারের পিণ্ডিকে বাঁচানোর জন্য স্বস্তি পরিষদের দুয়ারে ছুটে গেছে নিক্সনের অগ্রদূত বুশ সাহেব। ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়ায় দিনের পর দিন নির্বিচারে বোমাবর্ষণ করে গ্রামের পর গ্রাম এমনকি বনাঞ্চল সাফ করে দিলেও আজ শ্যামচাচারা এই উপমহদেশের শাস্তির জন্য একেবারে বেচায়েন হয়ে পড়েছে। ভিয়েতনামে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ও সৈন্য অপসারণে যে মার্কিন প্রশাসন অস্বীকৃতি জায়য়েছে সেই একই প্রশাসন আজ বাংলাদেশে যুদ্ধবিরতির আহবান জানাচ্ছে। তবে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এবারের চক্রান্তে মার্কিনী “কাগুজে বাঘ” রা এক নয়। চীনের বিপ্লবী সাত্ত্বিক নায়করা এবার মার্কিন শ্যামচাচার সাথে ভিড়ে গেছেন। স্বস্তি পরিষদে প্রস্তাব পেশ ও ভোটদানের ব্যাপারে এ দুটো দেশ একই সাথে চলেছে হাতে হাত মিলিয়ে।

পিকিং ও ওয়াশিংটন একের পর এক প্রস্তাব স্বস্তি পরিষদে উত্থাপন করেছে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ইউনিয়নের ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগের ফলে তাদের সে চক্রান্ত ভণ্ডুল হয়ে গেছে প্রতিবারেই। সোভিয়েট প্রতিনিধি জ্যাকব মালিক ভারতীয় প্রতিনিধি সমর সেনের বক্তব্য সমর্থন করে বলেছেন, বাংলাদেশ সমস্যার মূল অনুসন্ধান না করে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের ন্যায়সঙ্গত ও আইনানুগ অধিকারের কথা বিবেচনা না করে শুধুমাত্র যুদ্ধবিরতির আহবান জানালে তাতে সমস্যার কোন সমাধান হবে না। তিনি স্বস্তি পরিষদের বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিকে তাঁদের বক্তব্য পেশ করার সুযোগ দেওয়ার আহবান জানিয়েও একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন তাতেও সমর্থন জানানোর প্রয়োজনবোধে করেনি।

জাতিসংঘ স্বস্তি পরিষদের ব্যর্থ হওয়ার পর পিণ্ডির মহাপ্ৰভু ওয়াশিংটন আর জানি-দোস্ত পিকিং একই সাথে জাতিসংঘের বাইরে দাবার ঘুটি চালাতে শুরু করেছে। নিক্সনের নির্দেশে সপ্তম নৌবহর সায়গন দরিয়ার পানি কেটে এগিয়ে চলেছে তথাকথিত মার্কিন নাগরিকদের উদ্ধারের অজুহাতে। অন্যদিকে তিব্বত চীনা সৈন্য নাকি নড়াচড়া করতে আরম্ভ করেছে। মার্কিন বা চৈনিক কার্যক্রমের পেছনে যে গৃঢ় অভিসন্ধিই থাকে না কেন, তাদের লেজের আগুনে আর একটি ভিয়েতনাম এই উপমহাদেশে কখনই করতে দেবে না বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি এবং ভারতের ৫৫ কোটি মানুষ। স্বাধীন দুনিয়ার বড় মোড়ল গণতন্ত্রের মেকি ভজনাকারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রক্তচক্ষু ঘৃণাভরে উপেক্ষা করবে এই দু দেশের সাধারণ মানুষ। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সককারের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদও সাম্প্রতিক এক বেতার ভাষণে বলেছিলেন, এই উপমহাদেশ সম্পর্কে মনগড়া যে ধারণা নিয়ে কতিপয় বৃহৎ শক্তি থাকুন না কেন বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম তাতে দ্বিধাগ্রস্ত হবে না। নিক্সন প্রশাসনের চোখরাঙানি আরো একবার প্রমাণ করলো, গণতন্ত্রের জন্য যতই তারা চীৎকার করুক না কেন আসলে এরা দুনিয়ার সকল জঙ্গীচক্রের শয্যাসঙ্গিনী। ভিয়েতনামের থিউ, কম্বেডিয়ার লন নল, লাওসের ফুমি নোসাভান, থাইল্যাণ্ডের কিট্টিকাচরণ, কঙ্গোর মোবুতু আর পিণ্ডির ইয়াহিয়া সবাই শ্যামচাচার অবৈধ সন্তান।

নিক্সন প্রশাসনের বাসনা থাকলেও বাংলদেশকে আর একটি ভিয়েতনাম বানানোর পথে বড় বাধা হোল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাগ্রত জনমত। ভিয়েতনামের জঙ্গীচক্রের শাসন বজায় রাখতে গিয়ে আমেরিকার শত শত মা হারিয়েছেন তাঁদের সন্তান, স্ত্রী হারিয়েছে স্বামীকে, পিতা হারিয়েছে পুত্রকে। তাই আর একটি ভিয়েতনাম সৃষ্টির ঝুঁকি তাঁরা নিতে চান না। সিনেটের এডওয়ার্ড কেনেভী, সিনেটোর মাস্কি, সিনেটের ম্যাকগর্ভান এবং মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল ডেমোক্রেটিক পাটির নেতা সিনেটর মাইক ম্যান্সফিল্ড ইতিমধ্যেই পাকিস্তান সম্পকে নিক্সন প্রশাসনের ভ্রান্তনীতির সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠছেন। এই সিনেটরদের মধ্যে অন্ততঃ দুজন আগামী বছরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী হতে পারেন। আশা করা যায়, এই অবস্থায়

<005.005.174>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

প্রেক্ষিতে নিক্সন সাহেব যত লম্ফঝফই করুন না কেন আর একটি ভিয়েতনাম সৃষ্টি করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাজনৈতিক সমাধি রচনায় তিনি সাহসী হবেন না। সর্বোপরি, মার্কিন দুঃসাহসের পথে প্রচণ্ডতম অন্তরায় হয়ে আছে সোভিয়েট ইউনিয়ন। সোভিয়েট রাষ্ট্রপ্রধান নিকোলাই পদগণি ইতিমধ্যেই বৃহৎ শক্তিবর্গকে এই উপমহাদেশের সংকট থেকে দূরে থাকতে বলেছেন। তিনি এ ব্যাপারে নাক গলানোর বিরুদ্ধে সকলকে হুশিয়ার করে দিয়েছেন।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ এখন একটি প্রতিষ্ঠিত স্বীকৃত সত্য। জাতিসংঘ বা বিশ্বের অন্যান্য দেশ যত তাড়াতাড়ি এই সত্যকে স্বীকার করে নেবেন, এই উপমহাদেশে সংকট তত তাড়াতাড়িই নিম্পত্তি হবে। এতে বিভ্রান্তি বা দ্বিধাদ্বন্দ্বের কোন অবকাশ নেই।
(লেখকের নাম জানা যায়নি)

১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১

বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায়ে ঢাকার অধিকৃত এলাকা থেকে চমকপ্রদ খবর এসে পৌছছে। দখলদার বাহিনীর তথাকথিত বেসামরিক প্রশাসনের শেষ কাঠামোটুকুও ভেঙ্গে ছারখার হয়ে গেছে। রেডক্রসের নিরপেক্ষ এলাকা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে। চীফ সেক্রেটারী ও পুলিশের আইজিসহ আমলাদের একটি দলও মহাজনী পন্থা অনুসরণ করেছেন। কিন্তু ঢাকার লাখ লাখ বেসামরিক অধিবাসী এখন কি ভাবছেন, কি করছেন? বিগত নয় মাস ধরেই তারা বাস করছেন ইতিহাসের দীর্ঘতম অমাবস্যার রাত্রিতে। ২৫শে মার্চের কালরাতে আমবস্যার যে অন্ধকারে নেমে এসেছিল এখনও তার অবসানের প্রতিক্ষা। স্বজন হারিয়ে, সর্বস্ব যখন বলতে পারবো ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি? সেই দিন যেদিন আসবে পাকিস্তানের রাহুগ্রাস থেকে সোনার বাংলার মুক্তি। বাংলাদেশের মুক্তির দ্বারপ্রান্তে ঢাকায় এখন চলেছে চূড়ান্ত সংগ্রামপিণ্ডির জল্লাদ দলের শাসন-শোষণের অবসানের শেষ সংগ্রাম। মুক্তির এই উষালগ্নে জঙ্গীশাহী যে ব্যবস্থাই গ্রহণ করুক না কেন ঢাকার মানুষ কি ধাতুকে গড়া তা তারা ভালভাবেই জানে। ঢাকায় মুক্তিযুদ্ধের মূল নায়ক হবেন যে ঢাকার মৃত্যুঞ্জয়ী মানুষ, একথা নিঃশঙ্কচিত্তে বলা চলে। গত এক দশকের ইতিহাসে যাঁরা জ্ঞাত আছেন, যাঁরা দেখেছেন কিভাবে ঢাকার মানুষ এই সময়ে জঙ্গী শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্তি হওয়ার জন্য একের পর এক দুর্বার গণঅভ্যুত্থান গড়ে তুলেছে, তাঁরাই একথা স্বীকার করবেন। কামানের গোলা, মর্টারের শেল আর মেশিনগানের গুলি বর্ষিত হয়েছে হাজারো হাজারে। কারফিউ আর ১৪৪ ধারা সেখানে নিত্যসহচর। সমুদ্র সেখানে শয্যা পাতা, জঙ্গীচক্রের আজকের শেষ চোখরাঙানিতে সেখানে ভয়ের কি আছে। ঢাকার সংগ্রামী নাগরিকরা পিণ্ডির জল্লাদ দলের সকল ভ্ৰকুটিকে উপেক্ষা করে এগিয়ে গেছেন চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনের দিকে বার বার। ইয়াহিয়ার গুরুদের আইয়ুব খাঁর সামরিক শাসনের খবরদারীকে ছিন্নভিন্ন করে পথে নেমেছিলেন ঢাকবাসী গণতন্ত্রের দাবী কণ্ঠে নিয়ে ১৯৬২ সালে। মিছিলে মিছিলে রক্ত ঝরেছিল সেদিনে। আইয়ুবের ছবিগুলো হয়েছিল টুকরো টুকরো। আইয়ুবের দেওয়া ঔপনিবেশিক শিক্ষা ব্যবস্থার যুপকাষ্ঠ সংগ্রামের আগুনে ভস্মীভূত হয়েছিল রমনার রাজপথে, পটুয়াটুলির অলিতে-গলিতে। আইয়ুবের মৌলিক ধরনের মৌলিক গণতন্ত্রের অধীনে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও ঢাকার মানুষ সুস্পষ্টভাবে রায় দিয়েছিলেন আইয়ুবের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে। এলো ১৯৬৬ সাল ঐতিহাসিক ছ’দফা আন্দোলনের ক্রান্তিলগ্ন। বাংলার স্বাধিকারের দাবীতে গর্জে উঠলো ঢাকা। ৭ই জুন স্তব্ধ হয়ে গেল নগরীর প্রতিটি ধমনী। মিছিলের ভৈরব গর্জনে প্রকম্পিত হোল একনায়কত্বের পাষাণ কারা। জনসন রোড, জিন্নাহ এভিনু্য, তেজগাঁও শিল্প এলাকায় শত শত শহীদদের রক্ত স্নান করেছিল কৃষ্ণচূড়ার লাল রং এরপর থেকে ঢাকার মানুষের বজ্রকণ্ঠ ধ্বনিত হয়েছে বারবার ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে। ৬৮-৬৯ সালের আইয়ুব-বিরোধী গণুঅভ্যুত্থানের প্রবল জোয়ারে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে পিণ্ডির শাসকচক্রের সকল জঞ্জাল। ঢাকার মুক্তিপাগল মানুষ সেদিন অগ্নিমন্ত্রে
<005.005.175>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

দীক্ষা নিয়ে শাসক। শ্রেণীর মিথ্যার বেসাতির কারখানাগুলোকে সাফ করে দিয়েছিল আগুনের লেলিহান শিখায়। বাংলার মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের মুক্তি দাবীতে ঘেরাও করেছিল ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট। সাজানো আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার মিথ্যা নথিপত্র সমেত পুড়েছিল ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি এস. এ রহমানের বাসভবন। বাঙালী গৃহভূত্যের মহানুভবতায় প্রাণে রক্ষা পেয়েছিলেন তিনি। ১৮ই ফেব্রুয়ারীর রাত। ঢাকার মানুষের সংগ্রামের ইতিহাসে সে এক অনন্য রাত। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীকে মুখোমুখি মোকাবিলা করেছে নিরস্ত্র মানুষ সারা রাত। অবরোধ করে রেখেছে ঢাকা নগরীকে। কারফিউর বিধিনিষেধ দিয়েছে উড়িয়ে। মেশিনগানের গুলির মুখে বুক পেতে দিয়েছিল তারা। শ্লোগানে শ্লোগানে ঝংকৃত ঢাকা নগরীতে সে রাতে হৃদকম্প উপস্থিত হয়েছিল আইয়ুবের বেতনভুক সেনাবাহিনীর রক্তের বিনিময়ে মানুষ তাদের প্রাণপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্ত করে এনেছিল ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ধন্য হয়েছিল তারা। তারপর মার্চের অবিস্মরণীয় অসহযোগ আন্দোলনের দিনগুলিতেও ঢাকা আপন মহিমায় থেকেছে অম্লান বস্তুতঃপক্ষে ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন মূলতবি ঘোষণা করলে ঢাকার মানুষই প্রথমে ছুটে গিয়েছিল তাঁদের নেতার কাছে নির্দেশের জন্য। ঢাকার পূর্বাণী হোটেলে তখন বৈঠক চলছিল বঙ্গবন্ধুর সভাপতিত্বে আওয়ামী লীগ কার্যকরী কমিটির নির্দেশ এলো সর্বাত্মক গণঅসহযোগ আন্দোলনের। কারখানার চিমনিতে ধোঁয়া উড়লো না। ট্রেনের চাকা গেল থেমে। লঞ্চ-স্টীমার স্তব্ধ। বাসট্যাক্সি-রিকশা চললো না। এমন যে সাধের পিআইএর বিমানগুলোও মুখ থুবড়ে পড়ে থাকলো মাটিতে। মিছিলে পতাকায় ব্যানারে ফেস্টুনে শ্লোগানে সে আরেক ঢাকা পিণ্ডির শাসক-চক্রের বাংলাদেশবিরোধী অনড় মনোভাবের মুখে ঢাকার মানুষই প্রথম আওয়াজ তুলেছিলেন একটি নতুন জাতীয় পতাকার, নতুন জাতীয় সঙ্গীতের মিছিলের বজ্ৰমুঠিতে সেদিন উচ্চকিত হয়েছিল একটি নতুন জাতির আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রথম শপথ।

নিষেধাজ্ঞা-বিধিনেষেধের বেরাজাল ফেললেই ঢাকার মানুষ প্রতিবাদে আলোড়িত হয় ঝাপিয়ে পড়ে। কারফিউ দিলে রাস্তায় নামে। কাউকে ডাক দিতে হয় না। পায়ে পায়ে এগিয়ে যায়। আওয়াজ তোলে । গুলিতে বুক পেতে দেয়। আবার শ্লোগানে কাঁপিয়ে তোলে আকাশ-বাতাস।

অবরুদ্ধ ঢাকা নগরীতে এখনও সে মানুষ আছে। পিণ্ডির জল্লাদ দলের পাশবিক হামলাকে বিশেষ এক অবস্থার প্রেক্ষিতে তারা মুখ বুঝে সহ্য করেছে। গত নয় মাস শুধু সেই বিশেষ মাহেন্দ্রক্ষণটি প্রতীক্ষায়, যখন তারা ফেটে পড়তে পাড়বে আগ্নেয়গিরির মত। নাদিরশাহের সুযোগ বংশধর জল্লাদ সরদার ইয়াহিয়া খাঁর পাইকবরন্দাজের দল মৃত্যুর পূর্বমুহুর্তে যে বিভীষিকাই কায়েম করুক না কেন, ঢাকায় তাদের নিস্তার নেই।

(লেখকের নাম জানা যায়নি)

রাজনৈতিক মঞ্চ
৪ অক্টোবর, ১৯৭১

পূর্ব বাংলা-পূর্ব পাকস্তান- বাংলাদেশ। এ রূপান্তর ২৫শে মার্চের সেই কালো রাতে নিরীহ নিরস্ত্র গণতন্ত্রকামী মানুষের উপর ইয়াহিয়ার ঘাতক দলের উন্মুক্ত আক্রমণের ফলে চূড়ান্ত রূপ নিলেও বিগত ২৫ বছরের অনেক বঞ্চনা আর রক্তঝরা ইতিহাস জমাট বেঁধে ছিল এর পিছনে। বাংলাদেশে গণপজাতন্ত্রী সরকার

<005.005.176>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

প্রতিষ্ঠার সাথে ফলগুধারার সেই বাঁধটি খুলে গেছে, যা প্রতিনিয়ত পিষে মারছিলো বাঙালীর সঞ্জীবনী শক্তিকে। অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বাংলাদেশকে পঙ্গু করে রাখার জন্য, সামাজিকভাবে কোণঠাসা করার জন্য একের পর এক চক্রান্তের জালে বুনেছে পশ্চিম পাকিস্তানের সামন্ত সামরিক চক্র। বাংলা ভাষা, বাংলার সংস্কৃতি, সাহিত্য ও ঐতিহ্যকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য আঘাত এসেছে একের পর এক। এসবের প্রতিবিধান দাবী করে বাঙালী পেয়েছে শুধু বুলেট।

১৯৪৭ সালের ১৪ই আগষ্টের অব্যবহিত পরেই পাকিস্তান পরিষদের প্রথম অধিবেশনেই স্বাধীনতা সংগ্রামে পাঞ্জাবী-বেলুচ, পাঠান-সিন্ধী সকলের অবস্থানের কথা সাড়ম্বরে ঘোষণা করা হয়েছিল। স্বীকৃত পায়নি শুধু বাংলার মানুষ। ভাগ্যের এ এক নিদারুণ পরিহাস। দেশে জনসংখ্যার যারা শতকরা ৫৬ ভাগ, যাদের ভোটের জোরে পাকিস্তান নামক একটি রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছিল- রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সকল ধ্যান ধারণা বিসর্জন দিয়ে অতীব কৃত্রিম একটি কাঠামোর উপর ভিত্তি করে তারাই হলো অবহেলিত। অবজ্ঞা আর বঞ্চনার হোল শুরু। সদ্য স্বাধীন বাংলার রাষ্ট্রভাষার প্রশ্ন উঠলো। সদৰ্পে ঘোষণা করা হলো- উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। আর একথা বাঙলা মুলুকে সরবে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। কর্ণধাররা ড্যাকোটা বিমানে চেপে ঢাকা এলেন। প্রতিবাদ জানালো ঢাকার ছাত্রসমাজ। মুসলিম লীগের দোর্দণ্ড প্রতাপের সেই দিনগুলিতেও ছাত্ররা পুলিশ বাহিনী আর গুণ্ডাদলের সম্মিলিত হামলার মাধ্যমে এই প্রতিবাদের কণ্ঠ স্তব্ধ করার চেষ্টা হলেও শাসকগোষ্ঠী সাময়িকভাবে তখন প্রশ্নটিকে ধামাচাপা দিয়েছিল। এলো রক্তস্নাত ১৯৫২ সাল। শাসনতন্ত্রের মুসলিম লীগ সংক্রান্ত বিষয়ে আবার এলো রাষ্ট্রভাষার প্রশ্ন। গোলাম মোহাম্মদ-নাজিমুদ্দীন গোষ্ঠী আবার বাংলার মানুষের উপর চাপিয়ে দিতে চাইলো উর্দুর বোঝা এবার ছাত্র-জনতা পথে নামলে ফেষ্ট্রন-ব্যানারপ্লাকার্ড নিয়ে। রাজপথ হলো প্রকম্পিত। বিধিনিষিধের বেড়াজাল গেল উড়ে। খুনী নুরুল আমিনের পুলিশের গুলিতে বরকত-সালমসহ শাহাদাতবরণ করলেন বহু ছাত্র। জনতা গর্জে উঠলো “আমরা সালামের ভাই! আমরা বরকতের ভাই!” সেই গর্জন ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে থাকলো শহরে-বন্দরে, গ্রাম-গঞ্জে, কলেকারখানায়, হাটে-মাঠে। একের পর এক সর্বদলীয় সমাবেশ ঘটতে থাকলো কুখ্যাত মূলনীতি কমিশন রিপোটের বিরুদ্ধে। জনতার একবাক্যে রায়-মানি না।

এলো নির্বাচন। পূর্ব বাংলার মানুষ আইনসভায় নিজেদের বক্তব্য পেশের সুযোগ পেলেন। গঠিত হোলো যুক্তফ্রন্ট- শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়াদী ও মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে। শাসক মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার বৃহত্তম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগসহ ছোটখাটো অনেকেই শরীক হলেন এ যুক্তফ্রন্টে। নির্বচনী রায়ে দেখা গেল পূর্ব বাংলায় মুসলিম লীগের সমাধি রচিত হয়েছে। যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা গঠিত হলো। কিন্তু শেরে বাংলা ফজলুল হক বাংলাদেশের স্বার্থে যখনই কিছু করতে ও বলতে শুরু করলেন তখন পশ্চিম পাকিস্তানী কায়েমী স্বার্থবাদী মহল ষড়যন্ত্রের জাল বুনে তা নস্যাৎ করে দিল। ৯২ (ক) ধারাবলে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভাকে ভেঙ্গে দেওয়া হোল।

পরবর্তী বছরগুলিতে বুড়ীগঙ্গার অনেক পানি বয়ে গেছে। বাঙালীর রক্তে রমনার কৃষ্ণচূড়া গুচ্ছ আরো লাল হয়েছে। কিন্তু চক্রান্তের রাজনীতি শেষ হয়নি। মরহুম সোহরাওয়াদী চেয়েছিলেন এবং বাস্তব পদক্ষেপের মাধ্যমে চেষ্টা করছিলেন পশ্চিমী সামন্ত সামরিক গোষ্ঠীর একমাত্র উপজীব্য ষড়যন্ত্রের প্রাসাদ রাজনীতিকে সার্বজনীন ভোটধিকারের ভিত্তিতে দেশব্যাপী সাধারণ নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে খতম করার।

এবারে দেশের গণতন্ত্রকামী মানুষের সকল আশা-আকাঙ্খা নস্যাৎ করার জন্য সেনাবাহিনী সরাসরি এগিয়ে এলো। সামরিক শাসক আইয়ুব খাঁর অধিনায়কত্বে এবং তথাকথিত মৌলিক গণতন্ত্রের যাতাকলে নিষ্পেষিত হলো সারাদেশ দীর্ঘ দশ বৎসর যাবৎ আইয়ুবী আমলের এই কালো দশকে বাংলার মানুষের জাতীয় সত্তার প্রতিটি তন্তু ছিড়ে টুকরো টুকরো করার নিস্ফল চেষ্টা হয়েছে বারবার। শত শত ছাত্র যুবককৃষক-শ্রমিককে হত্যা করা হয়েছে গুলি করে। আটক করা হয়েছে হাজার হাজার দেশগ্রেমিক নাগরিককে। বাংলা ভাষা –

<005.005.177>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

সাহিত্য ধ্বংস করার জন্য চালানো হয়েছিল বর্ণমালা-বানান সংস্কারের দানবীয় অভিযান। বেতার-টে লভিশনে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ছিলেন নিষিদ্ধ।

রাজনীতিতে এই যখন অবস্থা বাংলাদেশের অর্থনীতির চিত্র সে সময়ে কি হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। আইয়ুব খান দেশের দু’অঞ্চলের মধ্যেকার অর্থনৈতিক বৈষম্যের অবস্থাটা খতিয়ে দেখার জন্য একটি কমিশন নিয়োগ করেছিলেন। সেই কমিশনের একবাক্য রায় ছিল –আয়ুবের তথাকথিত “উন্নয়ন দশকে” বৈষম্যের পরিমাণ আরো ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে।

এই প্রেক্ষিতে বাংলার জাতিসংঘ বিকাশের সুযোগ-সুবিধার দাবী কণ্ঠে নিয়ে গড়ে উঠলো ঐতিহাসিক ছ’দফায় আন্দোলন। আকাশ-বাতাস মুখরিত হলো ‘জাগো জাগো, বাঙালী জাগো” আওয়াজে। হুঙ্কার ছাড়লেন বন্ধু নয় প্রভু’র ফিল্ড মার্শাল- অস্ত্রের ভাষা প্রয়োগ করা হবে। বাংলার মানুষ অবিলম্বেই বুঝতে পারলো এ কথার তাৎপর্য। সাজানো হলো কুখ্যাত আগরতলা মামলা”। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান থেকে শুরু করে অনেককেই জড়ানো হলো এই সাজানো মামলার জালে। কিন্তু বাঙালী এটাকে মেনে নেয়নি। আর মেনে নেয়নি বলেই ১১ দফা আন্দোলনের সূচনা, ’৬৯-এর আইয়ুব বিরোধী গণবিপ্লবের অভু্যদয়। আইয়ুব ধনকুবের সামরিক চক্রের আরেক প্রতিভূ আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান। পশ্চিমী শাসক গোষ্ঠী বাংলাদেশের প্রতি এবার তাদের নীতিতে কপটতার আশ্রয় নিল। দেশব্যাপী সাধরণ নির্বচনে অনুষ্ঠানের কথা ঘোষিত হলো। তারা মনে করেছিল জাতীয় পরিষদে বিভিন্ন দলের মধ্যে বিভেদ সৃষ্ট করে তাদের শোষণের পাকাপোক্ত একটা রূপ দিতে পারবে। কিন্তু এবারেও বাংলার মানুষ এই চক্রান্ত প্রতিহত করলেন নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে জয়যুক্ত করে। জাতীয় পরিষদে চক্রান্তের পথ রুদ্ধ হওয়াতেই সামরিক শাসকগোষ্ঠী বাংলাদেশের মানুষের উপর সরাসরি সামরিক হামলার পথ বেছে নিল।

পাকিস্তানের বিগত ২৩ বছরের ইতিহাসে এইভাবে বারবার সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে বাঙালীর জাতিসত্তার সামগ্রিক বিকাশের প্রচেষ্টাকে হিংস্র পন্থায় দমন করতে চাওয়া হয়েছে। ৪৮, ৫২, ৬২, ৬৬, ৬৯, ৭০ সালগুলো বাংলার মানুষের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের একএকটি উজ্জ্বল স্বাক্ষর। কিন্তু প্রতিটি ক্ষেত্রেই পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী পাল্টা হামলা চালিয়েছে নব নব কৌশলে। তাই ৭১-এর ২৫শে মার্চের পর পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যে বাঙালীর জাতিসত্তা বিকাশের পথ চিরতরে রুদ্ধ হয়ে গেছে। এবার শুরু হয়েছে স্বাধীন জাতি হিসেবে দুনিয়ার বুকে মাথা তুলে দাঁড়াবার পালা।

(আহমদ নাদিম রচিত)