শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৫৫। স্বাধীনতা সংগ্রামের বিভিন্ন দিকের সংবাদসহ প্রকাশিত ‘শিখা’ | নিউইয়র্কের বাংলাদেশ লীগ অফ আমেরিকার মুখপাত্র ‘শিখা’ ভলিউম-১, নং-৫ | ১ আগস্ট, ১৯৭১ |
শিখা
ভলিউম-১, নং-৫
বাংলাদেশ লীগ অফ আমেরিকার মুখপাত্র
সম্পাদনা পরিষদঃ বমনদাস বসু–চেয়ারম্যান, মনোয়ার আলী–সদস্য
ঐক্যবদ্ধ হলেই আমরা শক্তিশালী
প্রথমে বাঙ্গালিদের স্বায়ত্তশাসন ও পরে স্বাধীনতার আন্দোলনকে অবদমিত করতে পাকিস্তানী আর্মি ২৫ মার্চ থেকে রক্তাক্ত অভিযানের সূচনা করে তার পরে বেশ কিছু সময় অতিবাহিত হয়েছে। সাধারণভাবে বাঙালিদের, বিশেষ করে বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকাণ্ড চলেছে; ৭০ লক্ষ ভয়ার্ত মানুষ শরণার্থী হয়েছে। বিশ্বজুড়ে বিবেকবান জনগণ তা দেখে ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠেছেন, পাকিস্তান সরকারের মধ্যযুগীয় এই বর্বরতার নিন্দা জানিয়েছেন তারা। কিন্তু হিটলারের পর থেকে সংঘটিত গণহত্যাগুলোর মাঝে ভয়াবহতম এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞের ব্যাপারেঅল্প কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া তথাকথিত বিশ্বশক্তিগুলো, বড় অথবা ছোট, তাদের নীরবতা বজায় রেখেছে। নিজেদের জনগণের শোরগোল ক্ষমতার রাজনীতির দুরাতিক্রম্য বাধা অতিক্রম করে তাদের কাছে পৌঁছাতে পারে নি। ব্যতিক্রম ছিল ভারত, ইউএসএ এবং চায়না।৭০ লক্ষ শরণারথীর দেখভালের পাহাড়সম দায়িত্ব নেবার পাশাপাশি ভারত বাংলাদেশের জনগণের সংগ্রামে জনসম্মুখেই সমর্থন জানিয়েছে। অন্যদিকে বাঙালিদের জন্য একটি রাজনৈতিক অবস্থান গঠিত হবার আগে পাকিস্তানকে কোনোরূপ সামরিক সাহায্য না দেবার সিদ্ধান্ত নিতে প্রচণ্ড অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক চাপের মুখোমুখি হয়েও আমেরিকা রক্তপিপাসু পাকিস্তানী সামরিক জান্তাকে সামরিক উপকরণ পাঠিয়ে যাচ্ছে। চীন, যারা এখনো পর্যন্ত আগ্রাসণকারী এবং তাদের পালিত কুকুরদের বিপক্ষে সবচেয়ে সচেষ্ট সমালোচক ছিল তারাই পাকিস্তানী আগ্রাসনের পক্ষ নিয়ে সেই একই ক্রীতদাসসুলভ আচরন করছে। আর এসবের মাঝে বাংলাদেশের রক্ত ঝরছে, অঝোরে ঝরেই যাচ্ছে।
এ থেকে পাওয়া শিক্ষা হলঃ আমাদের, অর্থাৎ বাংলাদেশের জনগণকেনিজেদের যা কিছু আছে কেবলমাত্র তা নিয়ে এসব বৈশ্বিক শক্তির এমনকি নৈতিক সমর্থন ছাড়াই “সোনার বাংলা” কে লড়াই করে মুক্ত করতে হবে। এর অর্থ হল মুক্তি বাহিনী এবং অধিকৃত বাংলাদেশের অভ্যন্তরের কর্মীরাই আমাদের একমাত্র রক্ষক।
নিজেদের ইতিহাসের এই গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে দাঁড়িয়ে আমাদের প্রয়োজন এক সার্বজনীন একতা-সকল রাজনৈতিক দল এবং যুদ্ধরত শক্তির মাঝে একতা। এরই সাথে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অবস্থানরত জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে, নির্দেশনা দিতে হবে। আমাদের মতে এ ব্যাপারকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা উচিৎ কারণ গেরিলা যুদ্ধের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ। বাংলাদেশের সর্বস্তরের জনগণ হাতে অস্ত্র তুলে নিলেই কেবলমাত্র সামরিক জান্তার তৈরি প্রাসাদ ভেঙ্গে পড়বে। নিঃসন্দেহে বলা যায় বাংলাদেশের জনগণের নিরঙ্কুশ সমর্থন আওয়ামী লীগের পক্ষে রয়েছে। কিন্তু ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি এবং অন্যান্য যেসব দল স্বাধীনতার সংগামে সমর্থন ব্যক্ত করেছে তারাও কিছু কিছু অঞ্চলে প্রভাবশীল। ৭০,০০০ সদস্যের সুপ্রশিক্ষিত পেশাদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে দলগুলোর তাদের রাজনৈতিক এবং সামাজিক মতবাদের ভিন্নতাসমূহকে দূরে ঠেলে একত্রিতভাবে একটি বিস্তৃত ‘লিবারশন ফ্রন্ট’ গঠন করাটা অত্যাবশ্যকীয়। যত বেশি সময় আমরা অপেক্ষা করব আমাদের উপর পশ্চিম পাকিস্তানী রক্তচোষাদের করাল গ্রাস আরো শক্তিশালী হতে থাকবে এবং তাদের উৎখাত করাও কঠিন থেকে কঠিনতর হতে থাকবে।
আমেরিকার ভেতরে এবং চারিপাশের কর্মকাণ্ড
কানাডায় আলী চৌধুরী
একটি সংবাদ সম্মেলনে জনাব হামিদুল হক চৌধুরী এবং জনাব মাহমুদ আলী বলেন“গৃহযুদ্ধ, গণহত্যা, শরণার্থীদের পলায়ন এবং কলেরা মহামারীর ব্যাপারে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক সংবাদগুলো মিথ্যা; যা শক্তিশালী অর্থনৈতিক গোষ্ঠীদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে”, আর সে সময় ন্যাশনাল প্রেস ভবনের বাইরে জনা পনের নারী-পুরুষ প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করছিলেন। বিক্ষোভকারীরা “বাংলাদেশ দীর্ঘজীবী হোক”, “বিশ্বাসঘাতকেরা নিপাত যাক”, “আলী-চৌধুরী দেশে ফিরে যাও” প্রভৃতি স্লোগান দিচ্ছিলেন।
এই জনবিরল সংবাদ সম্মেলনে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বক্তার ভূমিকা পালন করা জনাব চৌধুরী ভারতে পালিয়ে যাওয়া শরণার্থীদের ব্যাপারে সাধারণভাবে উল্লেখ হয়ে আসা ৬৫,০০,০০০ সংখ্যাটাটিকে চ্যালেঞ্জ জানান। তিনি এও অস্বীকার করেন যে ইয়াহিয়া খানের সৈনিকেরা গণহত্যার নীতি অনুসরণ করছে।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জনাব চৌধুরী সরাসরি প্রশ্নের জবাবে মূল বিষয় থেকে বহু দূরবর্তী ব্যাপারে দীর্ঘ বক্তৃতার অবতারণা করেন। বেশ কয়েকবার হতাশ প্রতিবেদকেরা তাকে মুল বিষয় থেকে সরে না যাবার আহ্বানও জানান।
একজন প্রতিবেদক যিনি ৭ এবং ৮ মার্চ ঢাকায় অবস্থান করছিলেন যখন ঢাকাকে সেসব দিনে শান্ত হিসেবে বর্ণনা করেন তখন জনাব চৌধুরী বলেন “এটা আপনার মতামত। আপনার সংবাদপত্র পড়তে হবে।”
বেশিরভাগ সময় নিশ্চুপ থাকা জনাব আলী, যাকে দেখতে একজন কঠোর প্রকৃতির মানুষ বলে মনে হয় তিনি একসময় ডেস্কের ওপর ভর দিয়ে এগিয়ে আসেন এবং জোর দিয়ে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে বলে উঠেন “ যদি দেশের অখণ্ডতা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়, সেনাবাহিনীর কর্তব্য তা রক্ষা করা……… যখনই দরকার হবে সেনাবাহিনী এবং পুলিশকে ব্যবহার করা হবে” (দ্য গ্লোব অ্যান্ড মেইল, টরেন্টো, জুলাই ২২, ১৯৭১ এ ক্লেয়ার বেলফৌর এর প্রতিবেদন থেকে)।
টরেন্টো থেকে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অফ কানাডার সভাপতি জনাব সারোয়ার আলম খান বলেনঃ
টরেন্টোর তথাকথিত “পাকিস্তান সংহতি পরিষদ” অন্টারিও কলেজের শিক্ষা মিলনায়তনে ১৮ জুলাই, ১৯৭১ এ একটি সভার আয়জন করে যাতে বক্তা হিসেবে ছিলেন বিশ্বাসঘাতক মাহমুদ আলী।
ইয়াহিয়া খানের এই প্রোপাগান্ডা কৌশলের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অফ কানাডা (টরেন্টো) মিলনায়তনটির সামনে একটি শান্তিপূর্ণ সমাবেশের আয়োজন করে। শুধুমাত্র ‘পাকিস্তানী’ দের আমন্ত্রণ জানানোয় আমরা সভাটি সম্পূর্ণরূপে বয়কট করি।
আমাদের পক্ষ থেকে কোনোরূপ প্ররোচনা ছাড়াই বর্বর পশ্চিম পাকিস্তানিরা এই শান্তিপূর্ণ সমাবেশের ওপর লাফিয়ে পড়ে এবং শারীরিক আক্রমণ শুরু করে। এহেন পরিস্থিতিতে আমরাও তাদের বাধা দিই এবং তারা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। সেই মুহূর্তে পুলিশ এসে পৌঁছায় এবং তাদের মিলনায়তনের ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়। সভাটি সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয় বলে জানা যায়।
জাতিসংঘের সামনে সমাবেশ
জুলাই এর ২৪ তারিখে প্রায় ৫০ জন বাঙালি এবং আমেরিকান সমব্যথী জাতিসংঘের সামনে একটি সমাবেশে অংশগ্রহণ করেন। তারা “মুজিবকে অনতিবিলম্বে মুক্তি দাও”, “ইয়াহিয়ার বিচার কর, মুজিবের নয়” এরূপ প্ল্যাকার্ড বহন করছিলেন। বাংলাদেশ লীগ অফ আমেরিকা, নিউ ইয়র্ক;মৃত্যুদণ্ড সম্ভব এমন অভিযোগের প্রেক্ষিতে শেখ মুজিবের বিচার হওয়া সংক্রান্ত রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়ার সাম্প্রতিক এক বিবৃতির প্রতিবাদে এই সমাবেশের আয়োজন করে।
পরে বাংলাদেশ লীগ অফ আমেরিকা শেখ মুজিবের বিচারিক হত্যাকাণ্ড ও গণহত্যা রোধ এবং একটি আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের অধীনে গণহত্যার পরিকল্পনাকারীদের বিচার করতে পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষের সাথে হস্তক্ষেপের আহ্বান জানিয়ে সেক্রেটারি জেনারেল ইউ থান্টের হাতে একটি স্মারকলিপি তুলে দেয়।
বিশ্বশক্তিগুলোর কাছে ইসকো এর আবেদন
ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টস কালচারাল অ্যাসোসিয়েশন (ইসকো), নিউ ইয়র্ক; যাতে জার্মানি, পোল্যান্ড, আমেরিকা, ভারত, ইরান, সুদান এবং আরো অনেক দেশ থেকে আসা সদস্য রয়েছে; একটি অনন্যসাধারণ সভায় অনতিবিলম্বে বাংলাদেশ থেকে সকল হানাদার পাকিস্তানি সৈন্য সরিয়ে নেবার দাবি জানায়। তারা তাদের ভাতৃপ্রতিম সংস্থাগুলোর কাছে বাংলাদেশের জনগণের গণতন্ত্র ও স্বশাসনের দাবীর পক্ষে সমর্থন দেবারও আহ্বান জানায়।
চেয়ারম্যান বাবু সুধাংশু বি. কর্মকার জানান যে সংস্থাটি জাতিসংঘের দূত, প্রধান কর্তাব্যক্তি এবং বিভিন্ন দেশের প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের কাছে, যাদের মাঝে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী চৌ-এন-লাই ও রাষ্ট্রপতি নিক্সন, আবেদন জানিয়েছে যেন অনতিবিলম্বে গণহত্যা বন্ধ করে সকল খুনীকে বাংলাদেশ থেকে সরিয়ে নিতে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার ওপর তারা তাদের প্রভাব ব্যবহার করেন।
জানা যায় এ আহ্বানের উত্তরে ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ ইসরাইলি স্টুডেন্টস বাংলাদেশের জনগণের পক্ষে তাদের পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করে।
জাহাজে করে অস্ত্র চালানের বিরুদ্ধে পিকেটিং
সেভ ইস্ট বেঙ্গল কমিটি, ফ্রেন্ডস অফ বাংলাদেশ, কোয়েকারস এবং অন্যান্য পিস গ্রুপের সদস্যরা সম্মিলিতভাবে ইউনাইটেড স্টেটস থেকে পশ্চিম পাকিস্তানি সরকারের কাহচে জাহাজের মাধ্যমে অস্ত্র চালানের বিরুদ্ধে ২৩ জুলাই নিউ ইয়র্কের ইস্ট রিভারের পিয়ার নং ৩৬ এ পিকেটিং করে।
খবরে প্রকাশ এই পিয়ারটিতে নোঙ্গর করে রাখা পাকিস্থানী লাইন জাহাজ সুতেজ সামরিক সরঞ্জাম বহন করছে।
১৫ জুলাই বাল্টিমোর সিটি পোর্টে পাকিস্তানী ফ্রেইটার পদ্মা-তে অস্ত্র বোঝাই এর বিরুদ্ধে একই রকম ঘটনার অবতারণা হয়েছিল। সাতজন কোয়েকারকে সেদিন গ্রেপ্তার করা হয়।
ফ্রেইটার পদ্মা অস্ত্র বোঝাই শেষে ১৮ জুলাই বাল্টিমোর ত্যাগ করে। বন্দরের কাজে নিয়োজিত দুজন ব্যক্তি জানান তারা জাহাজটিতে কামান দেখেছেন।
গালাঘার বিলকে সমর্থন প্রদান করুন
নিউ ইয়র্কে বা তার আশেপাশে বসবাসরত পূর্ব বাংলায় জন্ম নেয়া আমেরিকান নাগরিকেরা কংগ্রেস সদস্যদের কাছে চিঠি ও টেলিগ্রাম পাঠিয়ে আহ্বান জানান তারা যেন তাদের সবরকম প্রভাবপাকিস্তানের প্রতি সকল প্রকার সাহায্য বন্ধ করাবার পেছনে কাজে লাগান। চেয়ারম্যান জনাব গালাঘারের অধীন এশিয়ান এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় স্থায়ী কমিটির ছাড়পত্র পাওয়া বিলটিকে সমর্থন প্রদানের জন্যেও তাদের আহ্বান জানান হয়। তাদের চিঠিসমূহে তারা আরো আহ্বান জানান যেন যখন স্যাক্সবি-চার্চ অ্যামেন্ডমেন্ট #এস-১৬৫৭ উত্থাপিত হবে তখন সেটার পক্ষেও যেন কংগ্রেস সদস্যরা নিজেদের সমর্থন ব্যক্ত করেন।
বাংলাদেশ তথ্য কেন্দ্র
ওয়াশিংটন ডিসি-তে বাংলাদেশ তথ্যকেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই দপ্তরটি হবে কঠোরভাবে নির্দলীয় এবং সকল বাংলাদেশ গ্রুপ ও সহমর্মীদের জন্যে নিকাশ ঘর। অস্থায়ী ভিত্তিতে যেসকল স্বেচ্ছাসেবক বর্তমানে এখানে কাজ করছেন তারা হলেনঃ এম. সিদ্দিক, এম. ইউনুস, এফ. ফয়সাল, ডব্লিউ. গ্রিনোউ, ডি. নলিন (খণ্ডকালীন), এ. টেইলর (পূর্ণকালীন)।
তথ্যকেন্দ্রটি তার সংবাদনামার প্রথম ইস্যুটি প্রকাশ করেছে। আরো বেশি তথ্যের জন্য লিখুনঃ
বাংলাদেশ তথ্য কেন্দ্র
৪১৮ সিউয়ার্ড স্কয়ার, আপার্টমেন্ট ৪
ওয়াশিংটন ডিসি ২০০০৩
অথবা ফোন করুন (২০২) ৫৪৭-৩১৯৪
ঘোষণা! ঘোষণা!
বাংলাদেশ লীগ অফ আমেরিকা, নিউ ইয়র্কের জেনারেল সেক্রেটারি ঘোষণা দিয়েছেন যে ৮ আগস্ট, রবিবার ১৪৫ ব্লিকার স্ট্রীট, নিউ ইয়র্কের গুলস্তান রেস্তোরাঁয় সকাল ১১টায় সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হবে। লীগের কর্মকাণ্ড সম্বন্ধে সাধারণ আলোচনা ছাড়াও এতেনির্বাচনের দিন উত্থাপিত সংবিধানের সংশোধনীগুলোর ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত হবে। নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর স্ট্যানলি প্লাস্ট্রিক এদিন তার বক্তব্য পেশ করবেন। সকলসদস্য এবং আগ্রহী ব্যক্তিবর্গকে এই সভাটিতে যোগদানের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হল।
* * * * * * * * * * * * * * * *
“…… নিশ্চয়তার সাথে বলা যায় যে যদি আজই এ ব্যাপারে কোনো ভোটাভুটির আয়োজন করা হয় তবে জার্মানির সমস্তজনগণ সভ্য সমাজ থেকে পাকিস্তানকে বিতারণের পক্ষে ভোট দেবে”।
– ডাই যেইত, পশ্চিম জার্মানি
‘শিখা’ বাংলাদেশ লিগ অফ আমেরিকা, ২৬৬৭ ব্রডওয়ে, নিউ ইয়র্ক, এন. ওয়াই. ১০০২৫ থেকে প্রকাশিত
<৪,১৫৬,৩০২-৩০৪>
অনুবাদকঃ সুদীপ্ত কুমার সাহা, মাহিয়া হাসান মীম
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৫৬। শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার প্রসঙ্গে বিভিন্ন পত্রিকার সম্পাদকের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রবাসী বাঙালিদের লিখিত চিঠি
|
বাংলাদেশ লীগ অব আমেরিকার দলিলপত্র | আগস্ট ১৯৭১ |
এএলওবি থেকে বিভিন্ন সংবাদপত্রে পাঠানো চিঠির প্রতিলিপি
সম্পাদকঃ
আমাদের কাছে যথেষ্ঠ প্রমান আছে এটা বিশ্বাস করার জন্য যে শেখ মুজিবুর রহমান,বাংলাদেশের(সাবেক পূর্ব পাকিস্তান) বাঙালি নেতা,যিনি গত ডিসেম্বরে ঘটে যাওয়া সর্বপ্রথম সাধারন নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেন,তিনি মৃত এবং পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী দ্বারা হত্যার শিকার হন ৩১শে মার্চ ১৯৭১ এর আগে যদি না পাকিস্তানি সামরিক সরকার তার জীবিত থাকার যথেষ্ঠ প্রমান প্রদান না করতে পারে।পাকিস্তান সরকার দ্বারা প্রকাশকৃত একমাত্র আলোকচিত্রটিও ছিল নকল যেটি তোলা হয়েছিল শেখ মুজিবের পূর্বের বহু গ্রেপ্তারের যেকোনো একটির সময় এবং যা খুজে বের করা হয় বৃহদাকার নথিপত্র থেকে যা ছিল পূর্বের খাতাপত্রে।
পাকিস্তান সরকার দ্বারা প্রচারিত শেখ মুজিবের “বিদ্রুপাত্মক বিচার” হল খুবই হিসাবকৃত পরিকল্পনা সেই সকল লোকদের বোকা বানানোর জন্য যারা পাকিস্তানের রাজনৈতিক উন্নতির ব্যপারে অবগত নন।বিশেষ সামরিক আদালত দ্বারা কৃত সেই রুদ্ধদ্বার “বিচার” শুরু হবে বুধবার,আগস্ট ১১,তার “বিশ্বাসঘাতকতার অপরাধ” এর প্রত্যাশিত রায় এর পরবর্তী “মৃত্যুদণ্ড” এবং বিশ্বাসঘাতকের চুড়ান্ত ফাঁসি অধিকাংশ বৈধবিশ্বের জনগনের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হবে এবং এইসব ঘটনার বাস্তবতা সম্বন্ধে।
আরেকটি প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে যেখানে পাকিস্তানি সামরিক সরকার ভালভাবেই অবগতঃ
একজন ইচ্ছাপূর্বক নির্বাচিত “শেখ মুজিবুর রহমানকে” খুবই ছোট সামরিক আদালত কক্ষে নিয়ে আসা হবে যাতে কিছু অল্পসংখ্যক “ক্ষমতাশীল” ব্যাক্তি,তাকে দেখা যাবে তার প্রচলিত পোশাকে কিন্তু অত্যন্ত সুরক্ষিত ও পরিবেষ্টিত সামরিক কর্মীবৃন্দ দ্বারা তার নিজের “নিরাপত্তার” জন্য যাতে কোনো পাকিস্তানি বা বাঙালি “জ্যাক রুবি” তাকে আদালত কক্ষের ভিতর তাকে হত্যা না করতে পারে, যাতে তারা আদালত কক্ষে ”শেখ মুজিবের” বাস্তব উপস্থিতি সম্বন্ধে নিশ্চিত হতে পারে কারন তারা মুজিবের শরীরের সামান্য অংশ দেখতে পাবে কিন্তু তারা কখনোই রক্ষীদের অপর পার্শ্বে তার চেহারা দেখতে পারেনি যারা পুরো বিচারজুড়ে তাকে রক্ষা করছে।
বিচার স্থায়ী হয় এক সপ্তাহের কম সময় জুড়ে।শেখ মুজিবের জঘন্য “অপরাধ” প্রমান করার জন্য সকল “প্রমান” সামরিক শাসকদের(যারা পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান দ্বারা নিযুক্ত যিনি ইতিমধ্যে শেখ মুজিবের “বিশ্বাসঘাতকতার” ব্যপারে নিজের অভিমত ঘোষনা করেন ১৯৭১ সালের ২১ মার্চে) প্রদান করা হবে।পরিশেষে সামরিক আদালত তার “অপরাধ” সম্পর্কে নিশ্চিত হবে এবং তাকে বিশ্বাসঘাতকতার অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করবে এবং তাকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করবে।এরপর একটি সামরিক পর্যালোচনা প্যানেল তাৎক্ষনিকভাবে দন্ডাদেশ অনুমোদন করবে এবং পাকিস্তানের প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক,এই ক্ষেত্রে ইয়াহিয়া খান নিজে,এটা নিশ্চিত করবেন কেননা তিনি ইতিমধ্যে শেখ মুজিবকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে ঘোষনা করেছেন।
শেখ মুজিবের “মৃত্যুদণ্ড” সম্পন্ন করা হবে কোনো এক শনিবারে এবং রবিবারে সংবাদ প্রতিবেদনগুলো যথেষ্ট পরিমান আলোড়ন ও উত্তাপ সৃষ্টি করতে পারবেনা কারন সকল দফতর ও ব্যবসা ওইদিন বন্ধ থাকে।
পরবর্তী সংক্ষিপ্ত সামরিক প্রেস রিলিজ হবে অনেকটা এরকমঃ
“শেখ মুজিবুর রহমান”,নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের তথাকথিত নেতা,যাকে পূর্বে বিশ্বাসঘাতকতার অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল বিশেষ সামরিক ট্রাইবুনাল যা গঠিত হয় প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দ্বারা,তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় ফায়ারিং স্কোয়াড দ্বারা শনিবার সকালে রাওয়ালপিন্ডি ক্যান্টনমেন্ট(দুর্গ) এর ভেতর।
“গতকাল তার মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত করেন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান।”
“ইসলামিক অনুশাসন অনুসারে শেখ মুজিবুর রহমানকে তৎক্ষণাৎ সকল ইসলামিক আচার অনুসারে রাওয়ালপিন্ডি ক্যান্টনমেন্টের ভেতর একতি সমাধিতে কবর দেয়া হয় কারন রাওয়ালপিন্ডির সকল খোলা সরকারি ও বেসরকারি কবরস্থানের ব্যবস্থাপনা সমিতি তাকে কবর দিতে অস্বীকৃতি জানায় কারন তারা তাকে পাকিস্তানের প্রতি বিশ্বাসঘাতক হিসেবে বিবেচনা করে।”
“গ্রীষ্মকালের প্রচণ্ড গরম(১১০̊ ফারেনহাইট) এর কারনে মৃতদেহকে কবর প্রদানে কোন বিলম্ব করা সম্ভব ছিল না কারন মৃতদেহ কয়েক ঘন্টার মধ্যেই খারাপভাবে পচে যেত।”
“পূর্ব পাকিস্তানে ঢাকায় মৃতের পরিবারে কোন সদস্যের সাথেই যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি কারন তাদের অধিকাংশই শহর ছেড়ে চলে গেছে সম্ভবত ভারতে চলে গেছে।”
“শেখ মুজিবর রহমানের মৃতদেহ পাকিস্তান আন্তর্জাতিক বিমান পরিবহনব্যবস্থার মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানো সম্ভব হয়নি অতিরিক্ত খরচের কারনে তাই ঢাকা বা ফরিদপুরে তার গ্রামে তাকে সমাহিত করা সম্ভব হয়নি।”
“পাকিস্তান সরকার এ নিয়ে দুঃখিত যে মৃতের দেহ তার স্ত্রী বা নিকট আত্মীয়দের কাছে পাঠানো সম্ভব হয়নি।”
এভাবে ইয়হিয়া খানের সামরিক সরকার পুরো পৃথিবীকেএকটি বৈধ “মৃত্যুদন্ডের” ব্যপারে “সন্তষ্ট” করতে পারত।
এবং এ সমস্ত নাটকে বিশ্বাসী সমগ্র বিশ্বের মানুষ নিশ্চিত হত যা পাকিস্তানের বাইরের মানুষ জানে নাঃ
এই একই শেখ মুজিবুর রহমান পুর্বে বহুবার গ্রেপ্তার হয়েছেন এবং প্রায় ১২ বছরের মত হাজতবাস করেছেন।
পাকিস্তনের সাবেক সামরিক শক্তিমানব মার্শাল আইয়ুবও শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করিয়েছিলেন বিশ্বাসঘাতকতার দায়ে(১৯৬৭ সালের কুখ্যাত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা) এবং প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান দ্বারা নিযুক্ত একটি শক্তিশালী সামরিক ট্রাইবুনাল ১৯৬৮-৬৯ সালে পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে শেখ মুজিবকে হত্যা করার চেষ্টা করছিলো।
এই বিশেষ সামরিক “বিচার” পূর্ব পাকিস্তানে এত আকস্মিক সহিংসতা সৃষ্টি করে যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঢাকায় ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারীর এক রাতে শত শত মানুষ মেশিন গান দিয়ে হত্যা করতে বাধ্য হয়,যখন তারা কারফিউ লঙ্ঘন করে(তখন সিজেএস রাষ্ট্রদূত ছিলেন জনাব বেঞ্জামিন ওলেহার্ট,কোকা-কোলা প্রেসিডেন্ট;ইউ.এস. রাষ্ট্রবিভাগ সকল খুঁটিনাটি জানে কারন তারা জানতে পেরেছিল ভিয়েতনামে ডায়েম এর বিপর্যয় সম্বন্ধে)।
অবশেষে রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খান শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে থাকা সকল রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা ও চার্জ তুলে নেন এবং তাকে ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মুক্তি দেন। এমনকি রাষ্ট্রপতি আইয়ুব তাকে আমন্ত্রণও জানাতে চেয়েছিলেন (যদিও কিছুদিন আগে যে হুমকি বলে বিবেচিত ছিল) রাওয়াল্পিন্ডিতে একটি গোল টেবিল আলোচনায় অংশগ্রহণ করার জন্য।
কিন্তু মৃত্যু অনিবার্য ছিল। শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে থাকা “রাষ্ট্রদ্রোহিতার ষড়যন্ত্র মামলা” আইয়ুব খানের ১৯৬৯ পতন হতে বাধ্য করে।
কে না বলতে পারে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে থাকা “রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা” ১৯৭১ সালে রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া ও তার দেশের দিকে চালিত করেছিল।
<৪,১৫৭,৩০৫>
অনুবাদকঃ মাহিয়া হাসান মীম
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৫৭। বাংলাদেশ লীগ অব আমেরিকা কর্তৃক আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্রচারপত্র | বাংলাদেশ লীগ অব আমেরিকা | ২২ আগস্ট, ১৯৭১ |
বাংলাদেশ লীগ অব আমেরিকা
নিবেদিত
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান
বাংলাদেশ (পূর্ব পাকিস্তান) থেকে ভারতে
থাকা প্রায় ৭ লক্ষ শরণার্থীর সহায়তার লক্ষ্যে।
তারিখঃ ২২ আগস্ট (রবিবার)
স্থানঃ জেফারসন হাই স্কুল অডিটোরিয়াস
২৩০৫, পাইরেস স্ট্রিট
সময়ঃ ০৩.১৫
দয়া করে উদার হস্তে অবদান রাখুন
হতে
বাংলাদেশ লীগ অব আমেরিকা
<৪,১৫৮,৩০৬-৩০৭>
অনুবাদকঃ নওশীন তাসনিম
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৫৮। বাংলাদেশের সংগ্রামে মার্কিন জংগণের ভূমিকা সম্পর্কে বিশেষ প্রতিবেদন | বাংলাদেশ ইনফর্মেশন সেন্টার প্রকাশিত নিবন্ধ |
——- ১৯৭১ |
বাংলাদেশ তথ্যকেন্দ্র
৪২৩ ৫ম রাস্তা, এস.ই., ওয়াশিংটন ডি.সি. ২০০০৩*২০২-৫৪৭-৩৮৭৩
আমেরিকা বাংলাদেশের বন্ধু
লিখেছেন কায়সার জামান
গত নয় মাসের মোহমুক্তিতে বাংলাদেশের মানুষদের ধ্বংসযজ্ঞের অভিজ্ঞতা হয়ে গিয়েছিলো। অধিকাংশ বাঙ্গালী ভাবেনি যে পাকিস্তান সৈন্য সত্যই তাদের নিজেদের লোক হয়ে উঠবে, যেমনটা গত বছরে ২৫শে মার্চের বাঙ্গালী ছিল । কিন্তু তা ছিল এক রকম অনৈতিকতা যা ছিল ইতিহাসের সদৃশ। একবার যখন না ফেরার মুহূর্ত আসে, বাঙ্গালী পাকিস্তানী অর্থনীতি টানাপড়েন কম সময়ে কাটিতে উঠতে পারার পূর্বাভাস পায়। কিন্তু এটা ছিল একরকম চতুর অর্থনীতিবিদের কিংকর্তব্যবিমুড় শোষণ কৌশল । বাঙ্গালীরা আশা করেছিল যে অন্তত কিছু দেশ বাংলাদেশ কে সাথে সাথে চিনতে পারবে। কিন্তু কেউ পারেনি, এমনকি তখন পর্যন্ত ইন্ডিয়াও না। নিশ্চিতভাবে, বাঙ্গালীরা ভেবেছিল, গনতন্ত্রের রক্ষক এবং অভিভাবক দেশ আমেরিকা গণতন্ত্র দমনের জন্য মিলিটারি একনায়ক্তন্ত্রের নির্মম প্রচারণাকে সমর্থন করবে না। কিন্তু তারা পুরো পৃথিবীকে পরিতাপের গোঁ ধরে তা করেছিল । আমার কাছে বাঙালীদের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি ইউ এস এর সংবেদনশুন্য আচরন মেনে নেয়া কষ্টসাধ্য ছিল, কারণ এটা ছিল অদূরদর্শী এবং অনর্থক। বাঙালীদের এবংনিঃসন্দেহে অনেকের মনে যদি ঠিক ভুলের পরিষ্কার ধারনা থাকতো তাহলে তা এটা। একটি মিলিটারি একনায়কতন্ত্র একটি মুক্ত এবং স্বাধীন গণতান্ত্রিক নির্বাচনের ফলাফল মুছে দিয়েছিল এবং নিরীহ মানুষ,শিশু মেরে ফেলা, ধর্ষণ, লুটের তাণ্ডব চালিয়ে অনুভুতিশুন্যভাবে একটি দেশকে ধ্বংস করে দিচ্ছিলো। নিশ্চিতভাবে, একটি সভ্য গণতান্ত্রিক দেশ যেমন আমেরিকা এর নিন্দা জানিয়েছিল অথবা, শেষ পর্যন্ত স্বাভাবিক ছিল। ধীরে ধীরে এটাই স্পষ্ট হচ্ছিল যে নিক্সন প্রশাসন এই শাসনের পাশবিকতার নিন্দা করেনি কিন্তু অনেক সহায়তা করেছিল।
আশানুরূপভাবে সাধারণ গণতন্ত্র এবং আমেরিকায়, সব আমেরিকানরা সরকারের রাজনীতিকে সমর্থন করেনি। পুরুষ এবং নারী, জানা এবং অজানা মানুষেরা নৈতিক এবং রাজনৈতিকভাবে সরকারের এই ভুল মনোভাবের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছিল। সিনেটার এবং ছাত্রসমাজ, শিক্ষাবিদ এবং শ্রমিক, চিকিৎসক এবং চার্চের যোজক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রের মানুষ এই রাজনীতি বদলের জন্য কঠিন উদ্যোগ নেয়া শুরু করে। ফলত প্রেস এটা স্পষ্ট করে যে পুলিশদের অত্যাচারী এবং অত্যাচারীত দের মধ্যে পক্ষপাতিত্ব করছিল। একজন স্বতন্ত্র আমেরিকান নারী, একদা নাজি পাশবিকতার স্বীকার, হোয়াইট হাউজেড় বাইরে অটলভাবে জাগরণ থাকতো। একদল নিজস্ব শহুরে পাকিস্তানী অনুশাসন সৈন্য দিয়ে সফলভাবে পাকিস্তানির একটি বিশাল জাহাজ আতকে দিয়েছিল। ছোট ডেভিড ক্ষমতাশীল দানবকে চ্যালেঞ্জ করেছিল। যতক্ষণ পর্যন্ত ইয়াহিয়া খান অসহায় মানুষের উপর শোষণ বন্ধ করেনি ততক্ষন তারা মিলিটারি এবং পাকিস্তানী অর্থনৈতিক সাহায্যের নিষেধাজ্ঞা জারি করার জন্য সিনেটের করিডরে অনেকদূর এগিয়ে গিয়েছিল।
ফিলাদেলফিয়ার একটি দল হোয়াইট হাউজ জুড়ে থাকা লাফায়েত পার্কের নর্দমার পাইপ ক্যাম্প কে উপহাস করে।শিকাগো এবং বোস্টনের মত দূরেরে এলাকা থেকেও মানুষ এসে পাইপে বসবাস করে এবং লক্ষ্যাধিক উদ্বাস্তুদের সাথে ভাত এবং ডালের মত একই খাবার খায়। আমেরিকানরাদক্ষিন এশিয়ার জনসচেতনতা আর্কের ক্ষতিপূরণমূলক এরকম এবং অন্যান্য অভিব্যাক্তিতেদুঃখ প্রকাশ করে।
এছাড়াও থার্টি-অড ফ্রেন্ডস অফ বাংলাদেশ সংস্থায় কিছুসংখ্যক দল গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। যদিও প্রশাসন নীতি বাংলাদেশের বিপরীতে বাড়াবাড়ি রকম কঠিন হয়ে যাচ্ছিলো, এই ত্যাগী মানুষদের চেষ্টা বৃথা যায়নি। কংগ্রেস অতিরিক্ত সহানুভূতিশীল হয়েছিল। কমপক্ষে ত্রিশ সেনাটর এবং সভাসদস্য প্রশাসনকে সমালোচনামূলক বিবৃতি প্রদান করে। মিডিয়ার প্রতিক্রিয়া ছিল ইতিবাচক। এই আঁচ হোয়াইট হাউজ পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল যেটা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভয়ানক পদক্ষেপ নিতে বাধা সৃষ্টি করেছিল। কে জানে এই চেষ্টাগুলোই কি স্বাধীনতায় সহায়তা করেনি? মিঃ নিক্সন বিভিন্ন অজুহাতে চাইলেই ইয়াহিয়া খান কে মেরিন সাপোর্ট দিতে পারতো।
ইয়াহিয়া খানের প্রতি আমেরিকার তিক্ত প্রতিক্রিয়া প্রকাশ পায় ফরেইন-এইড বিলের কাছে সাক্সবি-চার্চ এমেন্ডমেণ্ট এর মাধ্যমে, যেটা পাকিস্তানের সকল প্রকার সৈনিক এবং আর্থিক সহায়তা বন্ধ করেছিল। এছাড়াও বাংলাদেশের অন্যান্য সহায়করাও অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিল। বাংলাদেশ ইনফরমেশন সেন্টার পর্দার ওপাশের অল্প পরিচিত কিন্তু সম্মানিত দল হিসেবে কাজ করে। প্রাথমিকভাবে এটি তৈরি করা হয় আমেরিকান চিকিৎসক এবং অন্যান্য পেশার মানুষ এবং তাদের স্ত্রী দ্বারা, যারা একসময় বাংলাদেশে ছিল এবং ভালবেসেছিল। তাদের অক্লান্ত পরিশ্রম এবং সীমাহীন ত্যাগ ছিল অনুপ্রেরণার মূল উৎস। অদ্ভুতভাবে, এটি সম্ভবত ইউ.এস. এর শ্রেষ্ঠ অর্থনৈতিক সহায়তা কর্মসূচী।
বাংলাদেশের আমেরিকান শুভাকাঙ্ক্ষীরা উপলব্ধি করতে পেরেছিল যে বাংলাদেশের এই স্বাধীনতা যুদ্ধই শেষ নয়, দীর্ঘ এবং দুঃসহ সংগ্রামের শুরু। তাদের সকল চেষ্টার মাধ্যমে তারা এটাও বুঝতে পেরেছিল যে, আমেরিকার স্বাতন্ত্র্য কাজ ছিল তীব্র ঘৃণার প্রকাশ। বাংলাদেশ সে বছরের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের আলোচ্য রাজনৈতিক ইস্যু ছিল না। সুতরাং, মিঃ নিক্সন তার নীতি পরিবর্তনের ক্ষেত্রে কোন প্রবল চাপে ছিলনা।অতএব, যে চাপ ছিল তা অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে বজায় রেখেছিল। দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিশ্রুতি উদ্দেশ্য ছিল জনগণের আরও প্রতিশ্রুতি উদ্বুদ্ধ করা এবং বাংলাদেশের পুনর্গঠনে সহায়তা করা। আমেরিকা তার নৈতিক দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারেনা, জ্ঞ্যাত অথবা অজ্ঞ্যাতভাবে। আমেরিকা বাংলাদেশ ধ্বংসের পক্ষে কাজ করেছইল। সত্যিকার অর্থে, আমেরিকান বন্দুক যা দেশের লাখো মানুষ হত্যা করেছিল, ট্যাঙ্ক এবং যোদ্ধা যা এ দেশ ধ্বংসে ভুমিকা পালন করেছিল।
<৪,১৫৯,৩০৮>
অনুবাদকঃ নিঝুম চৌধুরী
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৫৯। বাংলাদেশের সংগ্রামে সাহায্যের আবেদন | জর্জিয়াস্থ বাংলাদেশ ডিফেন্স লীগের প্রচারপত্র | ডিসেম্বর, ১৯৭১ |
“তারা যারা অন্যের স্বাধীনতাকে অস্বীকার করে তাদের জন্য এটা না এবং স্বয়ং ঈশ্বরের অধীনেও এটা দীর্ঘক্ষণ ধরে রাখে না।“-লিংকন
বাংলাদেশকে বাঁচানো সম্ভব
প্রিয় বন্ধুরা,
আমরা ইতিহাসের সব থেকে জটিল সময় পার করছি।সমস্ত বাংলাদেশের(পূর্বে পূর্ব পাকিস্তান)নগরজীবন সংকটাপন্ন। প্রায় সারে ৭ কোটি গণতান্ত্রিক মানুষ চিৎকার করছে আপনার নৈতিক সহায়তার জন্য এবং পশ্চিম পাকিস্তানের বর্বর সামরিক আক্রমণের বিরুদ্ধে তাদের সংগ্রামের জন্য। প্রায় ১০ লক্ষের কাছাকাছি মানুষ ইতিমধ্যে মারা গেছে এবং ৮০ লক্ষেরও বেশি শরনার্থী ইন্ডিয়ায় পালিয়ে গেছে।
যখন বাংলাদেশে রক্ত ঝরছে তখন শুধু দাঁড়িয়ে থাকবেন না।
মনে রাখবেন বাংলাদেশের মানুষ আজ যে সংগ্রাম করছে, আমেরিকানরা তা দুই শতাব্দী পূর্বে তাদের দূরবর্তী শাসকদের সাথে সেই একই সংগ্রাম করেছিলো।
সভ্যতা এবং মানবতা আজ আপনার প্রতিক্রিয়া দাবী করছে: এই সমস্ত গণহত্যাকারীদের অপরাধী করো।
ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক সহায়তা করুন।
অনুগ্রহ করে আপনার সহায়তা পাঠাতে:
সি/ও বাংলাদেশ
বক্স ১২৬৩,
অ্যাথেন, জর্জিয়া ৩০৬০১
আপনার প্রতিক্রিয়াই বাঁচাতে পারে সারে ৭ কোটি মানুষের জীবন ও স্বাধীনতা।
বাংলাদেশ ডিফেন্স লীগ,
এথেন্স, জর্জিয়া।
<৪,১৬০,৩০৯-৩২১>
অনুবাদকঃ সৈয়দা ইসরাত জাহান কনক, আল-জাবির মোহাম্মদ,কাজী সাদিকা নূর
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৬০। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমি ও বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন। | ক্যালিফোর্নিয়াস্থ প্যাসিফিক স্টাডিজ সেন্টার প্রকাশিত বুলেটিন |
১৯৭১ |
বাংলাদেশে বিদ্রোহ
মে ৭. ১৯৭১
জুডিথ মিলগ্রম কার্রনো কর্তৃক
প্যাসিফিক স্টাডিজ সেন্টারের সদস্য।
তীব্র লড়াইয়ের শেষ পর্যায়ে এবং মুক্তিফৌজের আপাত ছত্রভঙ্গে, পূর্ব পাকিস্তানের সংবাদ সামনের পাতা থেকে সরে যাচ্ছে। কিন্তু পাকিস্তান কখনোই আগের মতো হবে না। ইতিহাসে দ্বিতীয়বারের মত, মিলিয়ন পাকিস্তানি সহিংস হত্যাকান্ডের স্বীকার হল। তবুও যেখানে ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজনের ফলে যে হত্যাকান্ড হয়েছিল তার একটি ধর্মীয় ভিত্তি ছিল, বর্তমানে যা পশ্চিম পাকিস্তানকে পূর্ব পাকিস্তান থেকে বিভক্ত করে প্রাথমিকভাবে তা হল পশ্চিম পাকিস্তানি অভিজাত দ্বারা পূর্ব বাংলার অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ। (পাকিস্তানের স্বাধীনতার পূর্বে, পূর্ব পাকিস্তান ব্রিটিশ বাংলার অন্তর্ভুক্ত ছিল পূর্ব বাংলা-যা বর্তমানে বাংলাদেশ নামে পরিচিত-হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তান। পশ্চিম বাংলা ভারতের অধীনে অবস্থিত)।
মূলত নিরস্ত্র বাঙালিরা মোকবিলা করেছিল ৭০,০০০ পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সাথে যারা আমেরিকান, রাশিয়ান, ফ্রান্স এবং চাইনিজ অস্ত্র দ্বারা সুসজ্জিত ছিল। মধ্যপন্থী নেতারা মৃত, কারারুদ্ধ এবং নির্বাসিত হওয়ার ফলে, তাদের সংগ্রাম সর্বোৎকৃষ্ট “জনগণের যুদ্ধ”-এ রূপ নেয়— বাঙালী জনগণের সর্বজনসম্মত সমর্থনে প্রতিষ্ঠিত ভিয়েতনামীয় মডেলে গরিলা সংঘর্ষ। যেহেতু ভারত ইতিমধ্যে মাওবাদী গরিলার মুখোমুখি হয়েছে তাদের পশ্চিম বাংলা প্রদেশে এবং চায়না পূর্ব বাংলার নিকট প্রতিবেশি, তাই এ যুদ্ধের ফলাফল বিস্তৃত তাৎপর্য্য রয়েছে। ভিয়েতনামে যেমন এর বিচার হয়তো প্রদেশের আনুষ্ঠানিক সীমানা ভঙ্গ করে।
পাকিস্তানের অধিবাসীদের অর্ধেকেরও বেশি মানুষের বাসস্থান, বাংলাদেশ পৃথিবীর মধ্যে একটি অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চল- এর ৭৫০ মিলিয়ন মানুষ বাস করে লুইসিআনার আকৃতির একটি এলাকায়। ব্রিটিশ শর্তাধীন যুদ্ধ-পরবর্তী স্বাধীনতার ফলে পাকিস্তান সংযুক্ত ছিল হাজার হাজার মাইলের ভারতীয় এলাকার অপর প্রান্তে অবস্থিত পূর্ব বাংলার সাথে, ঐ সকল মানুষের সাথে যাদের সাথে ধর্ম ব্যাতিত তাদের মিল ছিল খুব সামান্য, এমনকি ভাষারও নয়। এখন, পূর্ব ও পশ্চিমের সে উত্তপ্ত শত্রুতার ইতিহাসের পর, উন্মুক্ত যুদ্ধ প্রথম কিছু সপ্তাহেই এক মিলিয়ন বেসামরিক নাগরিকের মৃত্যু ঘটিয়েছে।
বর্তমান অবস্থা
পাকিস্তান সর্বপ্রথম এক-মানুষ, এক-ভোট নির্বাচনের প্রর্বতন করে গত ডিসেম্বরে, যা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া কর্তৃক অনুষ্ঠিত শ্রমজীবী এবং ছাত্র আন্দোলনের মুখে তা অনুমোদন দেয়া হয়, যা তাদের পূর্বসূরি আইয়ুব খানের পতন ঘটায়। এ নির্বাচন অপ্রতিরোধ্য বিজয় আনীত করে পূর্ব ও পশ্চিমের নামমাত্র সমাজতাত্ত্বিক প্রার্থীদের। পশ্চিমে পাকিস্তান পিপল’স পার্টি (পিপিপি)র নেতা জুলফিকার আলি ভুট্টো সহজেই জয়লাভ করে, যেখানে জাতীয় পরিষদ নিয়ন্ত্রণের ভার যায় শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন পূর্ব বাংলার মধ্যপন্থী আওয়ামী লীগের হাতে। (বাংলায় “শেখ” ইংরেজিতে “স্কোয়ার”র সাথে সমতুল্য।)
নির্বাচনসমূহের জাতীয় পরিষদ মনোনীত করার কথা ছিল যা পাকিস্তানের জন্য নতুন সংবিধান রচনা করবে। এবং ২০ পরিবারের ক্ষুদ্র পশ্চিম পাকিস্তানি অভিজাতরা স্বাধীনতার পর থেকে দুটি প্রদেশ শাসন করে আসছিল, মুজিবের বুর্জোয়া আওয়ামী লীগের ব্যালেট-বক্স ক্ষমতা পূর্ব বাংলা স্বায়ত্বশাসনের দাবি বজায় রেখেছিল। জেনারেল ইয়াহিয়া যদি পূর্বনির্ধারিত তারিখ ২৫ মার্চে সভা আহ্বান করতেন, লীগ সদস্যগণ হয়তো ভারতের সাথে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে পুনরধিকার প্রতিষ্ঠা করে (যা নিষিদ্ধ হয় ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পর) এবং নিজেদের আর্থিক ব্যাপার স্বপরিচালনা করে পূর্ব বাংলাকে আধা-স্বায়ত্তশাসন রাষ্ট্র হিসেবে নির্বাচিত করতো। পশ্চিম পাকিস্তানি প্রদেশ পাঠান এবং বেলুচিস্তানের স্বায়ত্বশাসন খুব সম্ভবত জাতীয় প্রতিরক্ষা এবং বৈদেশিক নীতি থেকে কেন্দ্রিক সরকারের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা ত্যাগের অনুসারী হতো।
যদিও এখানে পশ্চিম পাকিস্তানি অভিজাতেরা যুদ্ধব্যতীত তাদের সর্বোচ্চ ধনী প্রদেশ ছেড়ে দেবে তার কোনরকম কারণ ছিল না, মুজিবুর নির্বাচন পরবর্তী বেসামরিক অবাধ্যতা এবং কর্মবিরতিকে তাঁর ব্যক্তিগত অনুমোদন দেয়, যা প্রতিবাদ করেছিল তাঁর ভাষায় “সংখ্যাগরিষ্ঠতা দমনের”। তাঁর আওয়ামি লীগ কোন ধরণের সশস্ত্র যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়নি অন্যদিকে জেনারেল ইয়াহিয়া জাতীয় পরিষদের সভা আহ্বান করতে গড়িমসি করছে, শেষ পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানের বিজেতা ভুট্টোর সাথে একটি মিটিংয়ের জন্য মুজিবকে আমন্ত্রণ জানানো হয়, যার বুর্জোয়া পিপিপি-এর বাঙালিদের স্বায়ত্বশাসনের অধিকার দেবার কোন ইচ্ছাই ছিল না। মিটিং ব্যর্থ হল এবং ২৬ শে মার্চ ইয়াহিয়া বাংলায় আওয়ামী লীগ এবং সকল রাজনৈতিক কর্মকান্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করল। ২৭শে মার্চ, মুজিবুরের নামে বাংলাদেশ গোপন রেডিও থেকে ঘোষণা করা হয় যে, স্বাধীন বাংলাদেশ (বাঙালি জাতি), তার নিরস্ত্র জনগণকে পূর্ব বাংলার রাস্তায় একত্রিত করছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী কঠোর পশ্চিম পাকিস্তানি জেনারেলদের চাপের মুখে, প্রায় সকল অফিসার এবং সৈন্যবাহিনী ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি—ইয়াহিয়া বাংলায় অবস্থানরত ৭০,০০০ কেন্দ্রিয় সরকারের সেনাবাহিনীকে আদেশ দিল বিদ্রোহ চূর্ণ করে দিতে। বাইরে থেকে কোন সুদীর্ঘ অভিযান হস্তক্ষেপ করতে পারে এ ভীতিতে, হয়তো তা ভারত থেকে, তিনি তার প্রদেশের কমান্ডার টিক্কা খানকে বললেন তাকে আটচল্লিশ ঘন্টার সময় দেয়া হল এ কাজ সমাধা করার জন্য। সেনাবাহিনীর ঝটিকা অভিযান শুরু হল ২৫শে মার্চ প্রয়াত সন্ধ্যায়।
এখানে প্রতীয়মান যে পাকিস্তানি জেনারেল অত্যন্ত সূক্ষভাবে কিছু বাঙালি গোষ্ঠী নির্বাচন করেছিল তাঁদের সমগ্রভাবে বিনাশ করার জন্য। তাদের তালিকায় ছিল আওয়ামী লীগের নেতাগণ, পূর্ব বাংলার পেশাদার মানুষগণ এবং বিশ্ববিদ্যালয় সম্প্রদায়। ট্যাংক ব্যাটেলিয়নের মধ্যরাতের আক্রমণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় পাঁচ শতাধিক ছাত্রকে হত্যা করা হয়।
“বিশ্ববিদ্যালয়ের দালানের বাইরে তাজা সমাধি স্তুপ” টাইমস অব লন্ডন ২রা এপ্রিলের প্রতিবেদন করে। “প্রতিটি রুমের ভেতর থেকে রক্ত প্রবাহ।”
পাকিস্তানি বাহিনী রাস্তায় চলমান কোন মানুষের প্রতি অথবা তার স্ত্রী এবং সন্তানদের প্রতি নম্র ছিল না । নগর এবং বড় শহরগুলোতে মর্টার, ট্যাংক এবং মেশিন গান ব্যবহার করা হত। গ্রামাঞ্চলে, শরণার্থীরা তাদের ঘর ছেড়ে পালানোর সময়, পাকিস্তানি বিমান বাহিনী বোম, নাপাম ছুঁড়ে দিয়ে আক্রমণ চালাত। বাঙালী দেশজ পোশাক পরিহিত যেকোনো মানুষের জন্য অবস্থা নিরপেক্ষ মনে হয়।
শহরগুলো সম্ভবত সবচেয়ে বেশি আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। “শহরে একটি ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড হয়েছে” একজন পালিয়ে আসা ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ার বন্দরনগরী চট্রগ্রামের বর্ণনা করেন। “যদি বন্দুকবাহী কোন মানুষ রাস্তায় কাউকে খুঁজে না পেত, তারা মর্টার, বোমা ঘরের জানালা দিয়ে ছুঁড়ে দিত।”
ঢাকাতে সৈন্যবাহিনী শুধুমাত্র রাজনৈতিক নেতা এবং ছাত্রদেরই অন্বেষণ করেনি, পুলিশ এবং অগ্নিনির্বাপক কর্মীদেরও অন্বেষণ করেছে। পায়ে হেঁটে কলকাতা পালিয়ে আসা ছাত্রনেতা সাজাহান সেরাজের মতে,
, সৈন্যবাহিনী একটি বাদে প্রতিটি পুলিশ স্টেশনে অভিযান চালিয়েছিল, দেয়ালের বিপরীতে পুলিশ সদস্যদের সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি করেছিল তারা। অগ্নিনির্বাপক কর্মীদের প্রতিও একই ব্যবহার করা হয়, স্পষ্টত ঢাকার “পুরান শহর” এলাকায় ২৬শে মার্চ সেনাবাহিনী টহলের জন্য রাস্তা ফাঁকা করার উদ্দেশ্যে। সিরাজ কর্তৃক বর্ণিত, প্রধানত হিন্দু কোয়ার্টারগুলোর বাসিন্দারা অগ্নিশিখা থেকে বাঁচতে চেষ্টা করার সময় তারা সেনাবাহিনী কর্তৃক মেশিন-গান দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল। শহরের অন্যদিকে, সৈন্যবাহিনী অগ্নিনিক্ষেপকারীদের ব্যবহার করে ৫০,০০০ মানুষ বসবাসরত আবাসিক কমপ্লেক্সগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেয়, এবং যখন বাসিন্দারা রাস্তায় নেমে আসে, সিরাজ বলেন, “তাদের হত্যা করা হয়েছিল”।
যখন তিনি শহর ছেড়ে পালানোর জন্য শরণার্থী শিবিরে যোগ দিলেন, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দু’দিক থেকে গুলিবর্ষণ শুরু করে, সিরাজ বলেন, “হাজার” মানুষ হত্যা করে। পূর্ব বাংলার শহরগুলো এখন মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে।
অন্যত্র যুদ্ধ হচ্ছিল খুবই নির্মমভাবে, যদিও বাঙালিদের অস্ত্র ছিল আদিকালীন। পশ্চিম পাকিস্তানি ৭০,০০০ অস্ত্রে সুসজ্জিত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ৯,০০০ সদস্য নিয়ে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস সজ্জিত করা হয়, কেবলমাত্র সীমানায় প্রহররত সশস্ত্রবাহিনী এ ক্ষুদ্র বাহিনীকে নিরুৎসাহিত করতে যথেষ্ট ছিল। তারা অবশিষ্ট ৩০০০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মানুষ দ্বারা যোগদান করে, কারণ বাংলাদেশ রেডিও থেকে স্বাধীনতার ঘোষণায় এসেছে ইস্ট বেঙ্গল সেনাবাহিনী এবং তাদের পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসারদের মধ্যকার অগ্নিযুদ্ধের কথা। কিন্তু স্বাধীন বাংলার সমর্থনকারী জনগণ যারা রাজপথে নেমে এসেছে, বাংলার বাতাসে যাদের স্লোগান এবং গ্যারিশন ঘেরাও করে রেখেছে তাদের ছিল শুধুমাত্র শাণিত লাঠি এবং তীর-ধনুক। পশ্চিম বাংলার প্রতিবেশি ভারতের প্রদেশ কলকাতা থেকে বর্ণিত যে-শত শত বাঙালি ভারত সীমান্তে এসে অস্ত্র ভিক্ষা চাইছে।
খুব খারাপ প্রস্তুতি থাকা সত্বেও বাঙালিরা কঠোর যুদ্ধ করছে। ভারতীয় প্রেস এজেন্সি(পিটিআই) থেকে বর্ণিত, যশোর শহরে পাকিস্তান নিয়মিত ১৫০০ বাঙালিদের মেশিন-গান দ্বারা হত্যা করতো-অনেকেই সজ্জিত থাকতো সারেঙ্গ এবং অন্তর্বাসে—বিমানবন্দরটি হস্তাগত করার প্রয়াসে তাদেরকে মাস্তুল, অক্ষ, ছোরা, কুঠার প্রভৃতি দিয়ে অভিযুক্ত করা হত। দক্ষিণ যশোরে কুষ্টিয়া জেলার অপারেশন বর্ণনাকালে জানানো হয়, একজন আওয়ামী লীগ নেতা টাইমস অব লন্ডনকে বলেন, যখন পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর ৩০০ জন সৈন্য স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের ঘিরে রেখেছিল, তারা তখন ৩০,০০০ বাঙালি কর্তৃক আবৃত ছিল যাদের নিকট ছিল লাঠি এবং পাথর। ভিড়কে লক্ষ্য করে পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী কামান এব্য মর্টার ছোঁড়ে, কিন্তু আটাশ ঘন্টা পর যখন তাদের গোলাবারুদ ফুরিয়ে আসে, তাদেরকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।
যদিও পশ্চিম পাকিস্তানিদের তুলনায় বিমান, ট্যাংক, ট্রাকের ঘাটতি ছিল—অনিয়মিত পূর্ব বাংলা( আনুমানিক ৫০,০০০ মানুষ) গ্রামগুলো নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে এবং কেন্দ্রীয় সরকার সৈন্যবাহিনীর নিকট জনহীন নগরী ও বন্দরগুলো ছেড়ে দেয়। এবং যখন তাদের হতাহতের পরিমাণ যখন অত্যন্ত বেশি হয়ে যায়, তারা সেনাবাহিনীর মুখে নিরস্ত্র জনগণ হয়েও ৩,০০০ পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী(পিটিআই) হত্যা করে এবং অগণিত সংখ্যক প্রচণ্ড আহতদের বন্ধী করে। এমন স্তিমিত অবস্থায়, ইয়াহিয়া পূর্ব বাংলায় অবস্থানরত তার সৈন্যবাহিনী চাঙ্গা করার জন্য ১০,০০০ অতিরিক্ত সৈন্য এবং অপ্রকাশিত সংখ্যক যুদ্ধবিমান পাঠায়।
পর্যবেক্ষকগণ আশা করেছিলেন, পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী যুদ্ধের প্রথম পর্যায় জয়লাভ করেছিল, কিন্তু বাঙালিরা সুযোগ নিজেদের দিকে ঘুরিয়ে নিতে অপেক্ষা করছিল মৌসুমী বৃষ্টিপাতের এবং গরিলা কার্যকলাপের । গরিলা কর্মকান্ডের জন্য পূর্ব বাংলার গ্রামাঞ্চল ছিল অত্যন্ত উপযুক্ত। বাঙালিদের গৃহস্থ এলাকা, গঙ্গা-ব্রক্ষ্মপূত্র ব-দ্বীপের হাজার নদী এবং জলস্রোতের বিভ্রান্তিকর মিলন শুষ্ক সমতল এবং পাহাড় হতে আশা পশ্চিমাদের কাছে বিশ্বাসঘাতক এবং সম্বন্ধহীন হয়ে ওঠে। “পশ্চিম শুধু বর্ষার জন্য লিখছে”, এপ্রিল ১৪ কে নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেন এক বাঙালি অফিসার।
“আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না যে তারা পানিতে কি পরিমাণ ভীতসন্ত্রস্ত। আর আমরা সহজেই পানিতে বিচরণ করতে পারি। তারা তাদের কামান এবং ট্যাংকগুলো ব্যবহার করতে পারত না এবং বিমানগুলোও উড়তে পারত না। প্রকৃতি আমাদের দ্বিতীয় সৈন্যবাহিনীতে পরিণত হবে।”
কিন্তু যুদ্ধের ফলে প্রধান শস্য ধান বপন সঙ্কুচিত হয়ে গেল যা কিনা আবহাওয়ার সময়সূচীর উপর নির্ভর করতো যদি বাঙালিরা কিছু মাস যাবৎ দুর্ভিক্ষের মোকাবিলা করতে না হয়। বর্ষা বাঙালিদের সামরিক সুবিধা দিবে, কিন্তু অনাহারের মাধ্যমে সে তার শুল্ক আদায় করে নিবে।
বাংলা গেরিলা যুদ্ধের নেতৃত্ব এসেছে অনেকটা ভিয়েতনাম থেকে- যেমন প্রাথমিক অবস্থায় জাতীয়তাবাদীর সংযুক্তি এবং অপ-সামাজ্ঞ্যবাদী দল গঠন হয়। অধিকাংশ আওয়ামী দলের নেতা হয় মারা গিয়েছেন নতুবা কলকাতায় নির্বাসিত হয়েছেন। ছোট মাওবাদী পার্টি-পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির (মার্ক্সবাদী লেনিনবাদী) বাংলাদেশি ক্যাডাররা, অথবা ইপিসিপি-এমএল ঝটিকা অভিযানের পূর্ব অনুমান করেছিল এবং ব্রিজ, পাওয়ার স্টেশন এবং টেলিফোন লাইন ধ্বংসের মধ্য দিয়ে আঘাত হানার পূর্বে তারা গা ঢাকা দেয়। এ যুদ্ধে ইপিসিপি-এমএল একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে গরিলা যুদ্ধে কৃষকদের প্রশিক্ষণ দান করছে।
ব্রিটিশ সামাজ্ঞ্যবাদ
জাতীয়তাবাদী, অপ-সামাজ্ঞ্যবাদ বাঙালিদের জন্য নতুন নয়। সামাজ্ঞবাদীতার বিরুদ্ধে তাদের সংগ্রাম অনেক দীর্ঘ এবং রক্তাক্ত। আঠরো শতাব্দীর মাঝামাঝিতে ব্রিটিশদের থেকে জয়লাভ করে, ১৯১৮ সালে ব্রিটিশ কমিশন কর্তৃক বর্ণিত বাংলার প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন হচ্ছে, “অধিক অগ্রবর্তী ইউরোপীয় জাতিসমূহের চেয়ে নিকৃষ্ট নয়।” সমগ্র পূর্ব থেকে ইউরোপে এটির কুটির টেক্সটাইল শিল্প রপ্তানি করতো অধিক সংখ্যক উৎকৃষ্ট মানের সুতা এবং সিল্কের কাপড়। স্বনির্ভর কৃষিক্ষেত্রে, বাংলা থেকে রপ্তানি হত চাল, চিনি এবং মাখন। মুঘল শাসনামলে- তাজমহল সভ্যতায়-বাংলা ছিল ইউরোপের সমকক্ষ, হয়তো সবকিছুতে তার চেয়েও উৎকৃষ্ট, অস্ত্র ব্যতীত। ১৯৫৭ সালে বিজয়ী দলের প্রধান, লর্ড রবার্ট ক্লাইভ ঢাকায় প্রবেশ করে বিষ্ময়ের সাথে প্রকাশ করেছেন যে, “এ শহরটি লন্ডন শহরের মতোই ব্যাপক, জনপ্রিয় এবং ধনী।”
কিন্তু এক প্রজন্মের মাঝেই, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী শাসকগোষ্ঠী এদেশ বিদ্ধস্থ করে ফেলল এবং মানুষদের দরিদ্র করে তুলল। পশমী বাণিজ্যের ক্ষেত্রে-যাতে বাঙালির কোন হাত নেই-কোম্পানীর প্রতিনিধি তা চাঁদাবাজিতে পরিণত করল। ১৯৬২ সালে ক্লাইভের হাতের পুতুল রাজবংশীয় নবাব কোম্পানীর এজেন্টের নামে অভিযোগ করেছিল যে তারা “জোরপূর্বক দ্রব্য ও পণ্য কৃষক এবং বণিকদের থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে এক-চতুর্থাংশ দামে এবং সন্ত্রাস ও নিপীড়নের মাধ্যমে এক রুপি সমমূল্যের দ্রব্য পাঁচ রুপি দিয়ে কিনতে বাধ্য করছে। “
কিছু বছরের ব্যবধানে কোম্পানি ব্যাপক জলসেচন পদ্ধতির অনুমোদন দেয় ফসলাদি ধ্বংস করার জন্য এবং কর বাড়িয়ে দেয় কৃষকদের উপর বীজ এবং গৃহপালিত পশু পরিত্যাগ করতে সোজাসুজি বাধ্য করা যায়। পরিণামে ১৭৭০ এর পূর্ববর্তী সময়কার দুর্ভিক্ষ যাতে মৃত্যুর কারণ ছিল অনাহার এবং বাঙালি জাতির এক তৃতীয়াংশ তাতে মৃত্যুবরণ করে। কিন্তু ব্রিটিশ সাম্রাজ্য রাক্ষুসে হারে বাড়ছিল বাংলা লুটতরাজ করার মাধ্যমে, ইংল্যান্ডে শিল্প-সংক্রান্ত বিপ্লবের প্রথম ধাপ পূর্ণ হয়।
মৃত্যুর সঙ্গে মোকাবিলা বাংলার পোশাকশিল্পে আঘাত হানে। প্রথমে শুল্ক ব্যবহার এবং ব্রিটিশ ও ইউরোপীয়ান বাজারে বাঙালি পোষাকের সরাসরি নিষেধাজ্ঞার পর, ব্রিটিশগণ ভারতীয় বাজারে মেশিনে প্রস্তুত দ্রব্যসামগ্রীর পরিচয় ঘটায়। কিছু বছরের মধ্যেই বাংলার কুটির শিল্প মৃত হয়ে পড়ে এবং এর ব্যবসায়ীদের অস্তিত্ব নির্বাহের জন্য তাদেরকে কৃষিক্ষেত্রে প্রেরণ করা হয়।
১৮৫০ সালে এককালের সমৃদ্ধ ঢাকা ক্লাইভের ১৫০,০০০ মানুষের লন্ডন থেকে সংকুচিত হয়ে ২০,০০০ লোকের গ্রামে পরিণত হয়। এবং ভারত আট ভাগের এক ভাগ ইংরেজ শ্রমিক সমাজের কর্মসংস্থান প্রদানের মাধ্যমে ব্রিটেন টেক্সটাইল উৎপাদনের এক চতুর্থাংশ আত্নভূত করে আসছিল।
বাঙালির বিখ্যাত পোশাকশিল্পের দক্ষতা এবং কারিগরি শুধুমাত্র অস্পষ্ট স্মৃতিতে পরিণত হয়, আধুনিক বাঙালিরা রপ্তানিজাত কৃষিজ অর্থনীতিতে অভ্যস্থ হয়ে ওঠে। চার-পঞ্চমাংশের বেশি অঞ্চল ধানি জমিতে পরিণত হয়। গড়ে প্রতিটি পারিবার প্রায় সাড়ে তিন একর জমিতে কাজ করে, সাধারণত বিস্তৃত বিচ্ছিন্ন (অকার্যকর জমি) খণ্ডে। জমিগুলো বছরে দুবার ধান চাষের উপযোগী ছিল, কিন্তু কৃষিকাজ ছিল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ- বর্ষার আবহাওয়ায় জমিগুলো প্রতি গ্রীষ্মে বন্যায় প্লাবিত হতো ও প্রতি শীতে শুকাত। গত কয়েক বছর ধরে ইস্ট পাকিস্তানকে এর প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্যের দশ শতাংশ আমদানি করতে হচ্ছে—যার বেশিরভাগই যুক্তরাষ্ট্র থেকে।
যদিও পূর্ব বাংলায় চা এবং সুপারি উৎপন্ন হতো, অধিকাংশ জমি যেগুলো ধান চাষের জন্য দেয়া হয়নি, সেগুলোতে পাট উৎপন্ন হতো (কৃষকদের প্রধান শস্য)। এ জমি থেকে উৎপন্ন পাট ব্যবহৃত হতো বিশ্বের চল্লিশ শতাংশ দড়ি, ব্যাগ এবং চটের থলে তৈরিতে। প্রধানত ঢাকায় সিভিল সার্ভিস এবং ছোট বাণিজ্য ব্যতীত- পাট ছিল শুধুমাত্র পূর্ব বাংলার শিল্প। পশ্চিম পাকিস্তানি অভিজাতরা, যারা কিনা সরকারের প্রথম এবং দ্বিতীয় পাঁচ বছর মেয়াদী পরিকল্পনাগুলোর জন্য মঞ্জুর হওয়া আন্তর্জাতিক তহবিলগুলোতে একচেটিয়া অধিকার ভোগ করে, এবং পূর্ব বাংলার পাট রপ্তানির দ্বারা অর্জিত আন্তর্জাতিক মূল্য বাজারে পাচার করে-এগুলোই মূলত আংশিকভাবে দায়ী পূর্ব বাংলায় এ শিল্পের অভাব তৈরিতে। স্বাধীনতার পর থেকে, পশ্চিম পাকিস্তানের পুঁজিবাদিরা কলকাতার ধনী হিন্দুদের সরিয়ে দেয় পাট প্রক্রিয়াজাতকরন কারখানা এবং রপ্তানি খামারের মালিক হিসেবে। যদি পূর্ব বাংলা নিজেকে পশ্চিম পাকিস্তানের সাম্রাজ্যবাদ থেকে মুক্ত করতে পারত তবে, তবে বাণিজ্যে ক্ষেত্রে তা অনুকূল হতো। এর পাট, বর্তমান সঙ্কটের পূর্বে, পণ্য রপ্তানিতে পাকিস্তানের মোট আয়ের অর্ধেক আয় করত-বছরে প্রায় পঞ্চাশ মিলিয়ন ডলার।
তাদের ইসলাম ধর্মের মিল ব্যতীত, বাঙালিদের পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাব এবং পাঠানদের সাথে মিল খুব অল্প। এমনকি পূর্ব ও পশ্চিমের ভাষাতেও ছিল অমিল; পশ্চিমের উর্দু ছিল পার্সিয়ান ভিত্তিতে এবং আরবি লেখনী দ্বারা এবং পূর্বের বাংলা ছিল সংস্কৃত ভিত্তি ও লেখনী। যখন ব্রিটিশরা বাঙালিদের সংস্কৃতি ধ্বংস করলো, তারা ভারতীয় ঔপনিবেশে পাঞ্জাবীদের সামরিক, প্রশাসনিক এবং উদ্যোক্তার ভূমিকা পালনের প্রশিক্ষণ দিল। লম্বা এবং গৌরবর্ণের কারণে পাঞ্জাবীরা নিজেদের শ্রেয় মনে করে, অধিকতর খাটো এবং কৃষ্ণবর্ণের বাঙালিদের থেকে এবং পূর্বের মানুষরা তাতে তীব্র বিরক্তিবোধ করে।
অনেক বাঙালিরাই সঙ্গতকারনে বিশ্বাস করতো যে তারা তাদের ব্রিটিশদের নিকট ঔপনিবেশিক অধীনতা পশ্চিম পাকিস্তানিদের, বিশেষত পাঞ্জাবীদের নিকট, অধীনতার কাছে বিক্রি করেছে। অবাক হবার কিছুই নেই, বাঙালিরা প্রথম বিদ্রোহের শিকার হয় ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে, পরবর্তীতে পাকিস্তানি সাম্রাজ্যবাদের। ১৯০৫ সালে বাংলায় ব্রিটিশ পার্টিশন আনয়ন করে কঠোর জাতীয়তাবাদী স্পষ্ট প্রতিবাদ, যদিও ব্রিটিশ পলিসি মেকারগণ তাদের বিভক্তিকরণ ও নিয়মগুলো চাপিয়ে দেয় হিন্দু ও মুসলিম বাঙালিদের রাজপরিবারের উপদেস্টা পরিষদের জন্য পৃথক সদস্য নির্বাচনে ঠেলে দিকে। স্বাধীনতার পর, অনেক পূর্ব বাংলার মানুষ মুসলিম পাকিস্তান গঠনে অস্বীকৃতি জানায় বরং তারা ছিল পশ্চিম বাংলার সাথে ভাতৃত্ব গঠনের পক্ষে। বিভক্তির পর থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি পূর্ব বাংলার জনগণের অসন্তোষ বিভিন্ন সরকারি সঙ্কটের অধঃক্ষেপনের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বাংলার রাজনীতি
কিন্তু বাঙালি রাজনীতি ঐতিহ্যগতভাবে হীনচেতা শিল্পপতি যেমন ধনী বণিক সম্প্রদায়, উচ্চবিত্ত পেশাদার মানুষ এবং বাণিজ্যিক স্বার্থ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে, যার মধ্যে বাঙালি সমাজের উঁচুশ্রেণীর কোন অভিজাত সম্প্রদায় কিংবা পুঁজিবাদী গোষ্ঠী অনুপস্থিত ছিল। আওয়ামী লীগের পক্ষে এই সমাজটি নেতৃত্ব দেয়। যদিও জাতীয় স্বায়ত্ত্বশাসনের পক্ষে দলটির প্রচার আওয়ামীলীগকে পশ্চিম বাংলার মফস্বল এলাকা ও শহরে বিপুল জনপ্রিয়তা এনে দেয়,অনেক বাঙালীই সেনাবাহিনীর ঝটিকা আক্রমণের আগে শেখ মুজিবের মধ্যপন্থী মনোভাবের সমালোচনা করেন।
বাঙালী ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা তাদের চাহিদাসমূহ ন্যাশনাল আওয়ামী লীগ পার্টি (এনএপি) এর মাধ্যমে প্রচার করতে লাগল,যাদের উত্তর বাংলার কৃষক সমাজে শক্তিশালী সমর্থন ছিল এবং ট্রেড ইউনিয়নে কিছু প্রভাব ছিল। নামেই বোঝা যায়,এনএপি ছিল একটি জাতীয় দল,যাদের অনুসারীর মধ্যে ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের কৃষক সমাজ,পাঞ্জাবের শিক্ষার্থী সমাজ,করাচীর শিক্ষার্থী এবং কর্মজীবি সমাজ। সেনাবাহিনী স্বেচ্ছায় ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না জেনে, এনএপি ডিসেম্বরের নির্বাচন বর্জন করে।
এনএপি, মস্কো এবং বেইজিং—এই দুই দলে বিভক্ত, যাদের মধ্যে মূল পার্থক্য হয়ে দাঁড়িয়েছে হয় শান্তিময় সমাজতন্ত্রের পথ অনুসরণ করো নাহয় অস্ত্র ধরো। মস্কোর ভাগটি পরিচালিত হয় বাংলার জাতীয়তাবাদী চেতনায় বলীয়ান, ছিয়াশী বছর বয়স্ক মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে। টাইমস অফ ইণ্ডিয়া একবার তাকে বেইজিং এর পক্ষে মনে করে প্রচার করে যে, “ভাসানী বেইজিং এর পক্ষে থাকার কলঙ্ক এখনো বহন করেন তা অবশ্যই ভুলে যেতে হবে”। কারণ, সম্ভবত,তিনি সম্প্রতি ভারতের আসাম প্রদেশ পরিদর্শনে গিয়েছিলেন, ইন্দিরা গান্ধীর চায়না বিরুদ্ধ সরকারের থেকে অস্ত্র জোগাড়ের উদ্দেশ্যে।
তবুও, মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে এনএপি ব্যানারের অধীনে প্রায় ৫৫,০০০ সুসংগঠিত কৃষকের নেতৃত্বে ছিলেন। এবং যেখানে এনএপির কোন নির্ধারিত সমাজতান্ত্রিক কর্মসূচি ছিল না, এটি বাংলার কৃষি সমাজের আবশ্যিক প্রগতিবাদের চিত্র তুলে ধরে।
গৃহযুদ্ধের শুরু থেকেই,পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট দল – মার্ক্স লেনিনপন্থী ক্যাডারদের সাথে যোগ দিয়ে এনএপির কনিষ্ঠ সদস্যেরা আত্মগোপন করেন। মোহাম্মদ তোহা, যশোর এলাকার একজন অভিজ্ঞ সাংগঠনিক,মাওবাদী এপিসিপি এমএল এর নেতৃত্ব দেন। চল্লিশোর্ধ, শিক্ষিত তোহা ছিলেন ভাসানীর ডান হাত এবং ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত, এনএপির সম্পাদক।
এপিসিপি- এমএল বাইরে এর সংখ্যাসূচক শক্তি সম্পর্কে কেউ নিশ্চিত জানে না। যদিও ধারণা করা হয়,তা খুবই কম ছিল। কিন্তু জানা গেছে,এই মাওবাদীরা সুসংগঠিত, তারাই পাকিস্তানে একমাত্র জ্ঞাত গোপনস্থান গঠিত করেছে।
যখন ইয়াহিয়া পশ্চিম পাকিস্তানে শেখ মুজিবকে বন্দী করে রাখেন,কলকাতায় আওয়ামী লীগের কর্মকর্তাগণ বাংলাদেশের একটি “অস্থায়ী সরকার” গঠন করেন এবং ভারত ও যুক্তরাজ্যে প্রতিনিধি পাঠিয়ে “স্বাধীনতা যুদ্ধ” শুরু করার জন্য বন্দুক ও অন্যান্য সাহায্য এবং কূটনৈতিক সমর্থন চান।
বিদেশী শক্তি
গণহত্যার প্রতি বেশিরভাগ কূটনৈতিক মতবাদই ছিল বাগাড়ম্বরপূর্ণ। যুক্তরাজ্য এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশে,পশ্চিম পাকিস্তানীদের চালানো গণহত্যার সমালোচনা করে এবং পাকিস্তানের “অভ্যন্তরীণ” সমস্যার একটি “শান্তিপূর্ণ সমাধান” দাবি করে। যুক্তরাষ্ট্রের সরকার প্রথমে সমস্যাটির প্রতি নিজেদের “উদ্বেগ” প্রকাশ করে,যদিও, তারাও এটিকে বলেছিল “অভ্যন্তরিণ সমস্যা”। তারপর, এপ্রিলের মাঝখানে,এক আকস্মিক পরিবর্তনে ভারতীয় অবস্থান সমান্তরাল হয়।
নয়া দিল্লীর আমেরিকান রাষ্ট্রদুত কেনেথ কেটিং হত্যাকান্ডের নিন্দা জানান এবং বলেন, “পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যা সমগ্র বিশ্বের জন্যে উদ্বেগের বিষয় এবং এটা অবশ্যই শুধুমাত্র পাকিস্তানের অভ্যন্তরীন সমস্যা না।”
ঔপনিবেশিক শক্তি সরে গেলে এশিয়ার অন্যান্য অনেক জায়গার মত পাকিস্তানেও বিগত প্রায় পচিশ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র তাদের শুন্যস্থান পূরণ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে ধারাবাহিক সামরিক শাষন বজায় রাখার জন্যে বিলিয়ন ডলারের উপরে অর্থনৈতিক সাহায্য প্রদান করেছে যাকে জন ফস্টার ডুলস “স্বাধীনতার দুর্গ” বলে আখ্যায়িত করেছেন। চলমান বছরের জন্যে যুক্তরাষ্ট্র ১৭৫ মিলিয়ন ডলার সাহায্য প্রদানের আশ্বাস দিয়েছে। বেশির ভাগ সাহায্যই যথারীতি পশ্চিম পাকিস্তানে যাচ্ছে। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মুখ্য সরবরাহকারী এবং ১৯৫০ সাল থেকে ৪,০০০ এরও বেশী পাকিস্তানি অফিসারদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে—যা পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসার সেনাবাহিনীর একটি বৃহৎ অংশ। অন্যান্য আমেরিকান নব্য উপনিবেশের মতোই, সরাসরি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৬১ থেকে পাকিস্তানের পুলিশকে সক্রিয়ভাবে প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছে।
পাকিস্তানের অত্যন্ত অসামঞ্জস্যপূর্ন উন্নয়ন প্রকল্পসমূহ ও পাঁচ বছরের পরিকল্পনাগুলোর জন্য সাহায্য মূলত যুক্তরাষ্ট্রের “মানবতাবাদীগণ” ও বিশিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ, বিশেষ করে হার্ভার্ড উন্নয়ন উপদেষ্টা সেবা ও স্ট্যানফোর্ডের গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে আসতো, যাদের আর্থিক জোগানদাতা ফোর্ড ফাউন্ডেশন। যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের সমাজ বিজ্ঞানীরা পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়ন নিয়ে পরীক্ষা নীরিক্ষা করছিলেন সেখানে পূর্ব বাংলা যুক্তরাষ্ট্রের উপর খাদ্য সহায়তার জন্য বিশেষ করে পিএল ৪৮০ (“শান্তির জন্য খাদ্য”) প্রকল্পের উপর নির্ভর করেছে। নাগরিক বিক্ষোভের কারনে যুক্তরাষ্ট্র সব পিএল৪৮০এর চালান বন্ধ করে দেয়, কারণ তারা বন্টন করতে পারছিল না।
পিএল-৪৮০ বন্ধ করে দেওয়ার ফলে বাংলাদেশে মারাত্মক খাদ্যঘাটতি দেখা দেয়। গত শরতের মারাত্মক সাইক্লোন গ্রামের পর গ্রাম নিশ্চিহ্ন করে ফেলেছে, লবণাক্ত পানিতে শষ্যক্ষেত্র ভরে যাওয়াতে আনুমানিক বাৎসরিক খাদ্যের ৫ শতাংশ ধ্বংস হয়ে গেছে। এবং যেহেতু গ্রীষ্মের শষ্য কাটার আগেই যুদ্ধ হয়ে গেছে তাই বিদ্রোহী কৃষকদের জন্য বছরের পরের দিকে নিজেদের খাদ্য জোগান দেওয়া কঠিন ব্যাপার হয়ে যাবে।
যদি পশ্চিম পাকিস্তান আর্মি পূর্ব বাংলার বড় শহর ও বন্দরগুলোতে দখল ধরে রাখতে পারে, তবে যুক্তরাষ্ট্র খাদ্য চালান পুনরায় দিবে কিনা সেই সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক গুরুত্ব বহন করবে। এমন যদি হয় পাকিস্তান আর্মি দ্বারা বন্টিত যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বৃত খাদ্য ও সাধারন জনতার মাঝে বাধা শুধু “কিছু কমিউনিস্ট সন্ত্রাসী”, তবে পাকিস্তানি আর্মির জনগনের সৈন্যদলের উপর তাদের আক্রমণ এবং যুক্তরাষ্ট্রের পাকিস্তানকে অস্ত্র, হেলিকপ্টার এমনকি “উপদেষ্টা” সরবরাহকে যথাযথ প্রমাণ করা সহজ হয়ে পড়বে।
কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ সম্ভবত স্বাধীন বাংলাদেশ ছুড়ে ফেলবে না, অন্তত পশ্চিমা অনুকূলে থাকা আওয়ামী লীগের হাতে এমন হবে না। এই ধারনার উপর নির্ভর করে যুক্তরাষ্ট্রের কিছু অভিজাত সিদ্ধান্তগ্রহনকারী দলের সদস্য ইতোমধ্যে “একটি বাংলাদেশ লবি” হিসাবে জনসমাবেশ শুরু করেছেন। এদের মধ্যে আছেন পররাষ্ট্র দপ্তর ও বিশ্ব ব্যাংকের লম্বা সময়ের উপদেষ্টা, পাকিস্তানে ফোর্ড-হার্ভার্ড উন্নয়ন প্রকল্পের প্রধান স্থাপতি, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এডওয়ার্ড ম্যাসন। সরকার ও শিক্ষাবিদদের মধ্যে ম্যাসন গনহত্যার পরে এর উপরে প্রতিবেদন লিখেছেন এবং সুপারিশ করেছেন যাতে যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিম পাকিস্তানকে সহায়তা দেওয়া বন্ধ করে দেয় কারন নাহলে “আমরা পূর্ব পাকিস্তানকে অন্য একটা ক্ষমতার অধিনে ঠেলে দিবো – চীন। ”
পাকিস্তানের দীর্ঘমেয়াদী শত্রু, ভারত, প্রকাশ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে সহানুভুতিশীল, যদিও যুক্তরাষ্ট্রের মত ভারতও বুর্জোয়া ব্যবস্থায় সবচেয়ে সন্তুষ্ট। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা ধারার বাঙ্গালী জাতি। ভারত এর সীমান্ত খুলে দিয়ে এক মিলিয়ন শরনার্থী আশ্রয় দিয়েছে, তাদের চিকিৎসা, আশ্রয় ও কিছু খাদ্য সরবরাহ দিচ্ছে। ভারত বাংলাদেশী মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছে এবং পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ইতিমধ্যে গুলি বর্ষন করেছে ভারতীয় সীমান্তের গ্রামগুলোতে—বাংলাদেশী শরনার্থীদের জন্যে দেশান্তরের নিরাপদ আশ্রয়।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের সরকার—যেখানে মস্কোপন্থী সাম্যবাদীদের নির্বাচনী ক্ষমতা শক্তিশালী—পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার পক্ষে সমর্থন জানিয়েছে। কিন্তু তাদের হাতে সেই সমর্থনকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার ক্ষমতা সীমিত।
পূর্ববঙ্গের মত পশ্চিমবঙ্গও সম্পূর্নভাবে অবাঙ্গালীদের দ্বারা শোষিত। দেশের অন্য যে কোন জায়গা থেকে বেতন এক তৃতীয়াংশ, বেশির ভাগ বানিজ্য ও বিনিয়োগ স্থানীয় নয়। পশ্চিমবঙ্গবাসী মনে করে অবাঙ্গালীরা কলকাতায় আসে শুধুমাত্র টাকা বানাতে এবং তা তারা পরে এই রাজ্য থেকে রপ্তানী করে।
এমনকি পশ্চিমবঙ্গবাসীর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উপর সক্রিয় রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রন নেই। সাম্যবাদী নেতা ই এম এস নামবদ্রিপাদ এপ্রিলের ২৩ তারিখে ব্যাখ্যা করেন যে, যেখানে পশ্চিমবঙ্গ সরাসরি সামরিক শাষনের অধিনে নেই (যেমন পূর্ববঙ্গ ছিলো), রাজ্যের প্রশাসন সেনাবাহিনীই আসলে চালাচ্ছে। যখন থেকে পশ্চিমবঙ্গের নকশাল—যা পূর্ববঙ্গের ইপিসিপি-এমএল এর সহোদর—তাদের মাওবাদী আন্দোলন এক বছরের বেশী সময় ধরে শুরু করেছে, তখন থেকে কয়েক হাজার ভারতীয় সেনা পশ্চিমবঙ্গে নিয়ন্ত্রন আনার জন্যে সংস্থিত করা হয়েছে। ১৯৬৮ সালে ছাত্র এবং কৃষকদের আন্দোলনের মিশ্রণ থেকে জন্ম নেয়া নকশাল কলকাতার বেকার এবং আধ-বেকারদের সহ আশেপাশের গ্রামগুলোর কৃষকদের মধ্যে ব্যাপক সমর্থন অর্জন করেছে। শহরে নাশকতা বেড়ে চলেছে, এবং জমিদারেরা শহরগুলোতে নকশাল আক্রমণের একটি তরঙ্গের পর গ্রামের কিছু জায়গা ছেড়ে চলে গেছে।
ভারতীয় সরকার বাস্তবিক ভাবেই ঝামেলায় আছে। যেখানে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বিভক্ত পাকিস্তান ব্যাতিত কিছু চান না, সেখানে তারও সবার চেয়ে বড় আতঙ্ক পূর্ববঙ্গের আন্দোলনটি ইপিসিপি-এমএল এর নেতৃত্বে মাওয়াবাদী হয়ে চলেছে, এবং এই স্বাধীনতা যুদ্ধ ভারতেও ছড়িয়ে পরতে পারে। তিনি সন্দেহাতীতভাবে মনে করেন, ভারতের অস্ত্র হয়তো যারা আওয়ামী লীগ তাদের হাতে না পরে মাওবাদী গেরিলাদের হাতে পরবে এবং, সময় হলে, সেগুলো হয়তো তার সরকারকে হুমকি প্রদানকারী নকশালের হাতে করে ভারতে ফিরবে। যেখানে পশ্চিমবঙ্গের “শান্তিপ্রিয় পথের” সাম্যবাদীরা হাতগুটিয়ে বসে আছে এবং বলছে পূর্ববঙ্গের স্বাধনীতা যুদ্ধে সাহায্যের জন্যে তাদের কিছু করার নেই, সেখানে নকশালপন্থীরা সীমান্ত অতিক্রম করে তাদের পূর্বের ভাইদের সাহায্য করছে। তারা বলছে এটা উভয়, পূর্বের সংগ্রামকে সাহায্য করে এগিয়ে নেওয়া ও তাদের পশ্চিমের সংগ্রামের জন্যে “অভিজ্ঞতা অর্জন” এর জন্য।
শ্রীমতী গান্ধী আসামেও একই রকম কঠিন সমস্যার মুখোমুখি হন, বার্মা ও পূর্ববঙ্গের মধ্যে পাহাড় পরিবেষ্টিত ভারতীয় অঙ্গরাজ্য, যার চীনের সাথে অনেক বড়ো সীমান্ত রেখা রয়েছে। অনেক বাঙ্গালী পালিয়ে আসামে গেছেন, যেখানে ভারতীয় সেনাবাহিনী কয়েক বছর ধরে বিদ্রোহী এবং চেয়ারম্যান মাও এর চিন্তা ও চাইনিজ একে ৪৭ এ সজ্জিত বিদ্রোহী নাগা ও মিজো উপজাতির লোকের সাথে লড়াই করছে। যেহেতু পূর্ব পাকিস্তানে সংগ্রাম একটি প্রকৃত গণযুদ্ধে পরিণত হয়েছে, এমন অস্ত্রসস্ত্র নিঃসন্দেহে পাহাড়ি রাস্তা ধরে পূর্ববঙ্গে যাবে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী হামলা শুরু করার দশদিন পর, চীনের সতর্কভাবে চয়নকৃত গৃহযুদ্ধ সংক্রান্ত বিবৃতিতে পাকিস্তানের গনহত্যার কোন নিন্দা ছিলো না। অন্যদিকে চীন ইয়াহিয়া খানের সরকারকে সমর্থন দিচ্ছিলো। কিন্তু এখন পর্যন্ত চীনের প্রাথমিক মতামত ছিলো এই যুদ্ধকে নিজেদের অভ্যন্তরীন ব্যাপার বলার এবং ভারতকে এই ব্যাপারে জড়িত না হতে সাবধান করা। ইয়াহিয়া খানকে একটি চিঠিতে চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন–লাই প্রতিশ্রুতি দেন যে ভারত আক্রমন করতে হলে পাকিস্তানকে চীন সাহায্য করতে আসবে। এটাও বলেন যে ইয়াহিয়া খানের প্রচেষ্টা পাকিস্তানে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনবে। চৌ আরো যোগ করেন, “পাকিস্তানের ঐক্যবদ্ধতা…… এর টিকে থাকা ও উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন।”
চীনের পাকিস্তানের সামরিক শাষকের সাথে ভারত বিরোধী ঐক্য ১৯৬২ সালের সিনো-ভারতীয় যুদ্ধের পরেই হয়েছিলো, এবং এরপর থেকেই চীন পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক ও সামরিক সাহায্য দিয়ে আসছে। রেডিও পাকিস্তান সম্প্রতি ঘোষনা করেছে, ইউপিআই এর মতে (নতুন দিল্লী, ২রা মে) চীন ইয়াহিয়া খানের ১৯৭০ এর নভেম্বরে পিকিং ভ্রমনের সময় দীর্ঘমেয়াদে ২১০ মিলিয়ন ডলার দেওয়ার প্রস্তাব করেছিল সেই তহবিল “অধিকন্তু” বাড়ানোর প্রস্তাব করছে। পাকিস্তানী বামপন্থীরা অভিযোগ করে যে, এই ঐক্য ন্যাপের জন্যে বাধা সৃষ্টি করছে, যা বিরোধী দলকে সরকারের কাছে হালকা করে তুলছে।
চীনের অভিপ্রায় মনে হয় পূর্ববঙ্গে গৃহযুদ্ধের সংগ্রাম চালু রাখা এবং এখন পর্যন্ত যতটা কুটনৈতিকভাবে সম্ভব—ভারতকে (এবং এর পিছনে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র) আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন পূর্ববঙ্গে বুর্জোয়াদের সমর্থন দিতে রহিত করা। চৌ তার ইয়াহিয়া খানকে লেখা চিঠিতে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, “পাকিস্তানের ঐক্য নষ্টকারী ক্ষুদ্র দলকে বৃহৎ জনগোষ্ঠী থেকে আলাদা করা প্রয়োজন” পরিস্কারভাবেই যা শেখ মুজিবর ও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে যা নির্দেশ করে। মুজিবর নিজেই সতর্কবাণী দিয়েছেন, “আমি একাই পূর্ব পাকিস্তানকে কমিউনিজম হতে রক্ষা করতে পারি।” মাঝে মাঝেই “বাংলাদেশের চিয়াং কাই শেক” হিসাবে পরিচিত মুজিবকে বাঙ্গালী বামপন্থীরা “আমেরিকার দালাল” হিসাবে অবহিত করতো – যা পুরোপুরি সত্য না হলেও রূপক অর্থে সত্য।
চীন হয়তো বাংলাদেশকে সমর্থন করবে যখন স্থানীয় নয় জাতীয় নেতৃত্ব ভিয়েতনামের মত জোটবদ্ধ স্বাধীনতা ফ্রন্ট গঠনে সমর্থ হবে তখন। চীনের সবার সামনে ভারতের হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে পাকিস্তানকে সমর্থ করা, একই সাথে গোপনে বাঙ্গালীদের অস্ত্রের চালান দেওয়ার সম্ভবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
এপ্রিলের শেষ ভাগে এসে খবর থেকে ভারী যুদ্ধের প্রতিবেদন কমে গেলেও, সিবিএস প্রতিবেদন করেছে যে পশ্চিমবঙ্গের নকশালীরা চীনকে উদ্দেশ্য করে বার্তা দিয়েছে যে, পূর্ববঙ্গের স্বাধীনতা যুদ্ধ সত্যিকারের জনগনের যুদ্ধ যার নিয়ন্ত্রণ আওয়ামী লীগের হাতে ছিলো না।
এর মাঝে, আগামী কয়েকমাসে ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানকে সমর্থন করার অর্থ কি হবে তা পরিস্কার না। পূর্ববঙ্গে সেনাবাহিনীর ঝটিকা অভিযানে পাকিস্তানের বিলম্বিত ও বিপর্যস্থ রপ্তানীতে প্রায় ২০০ মিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়েছে, এবং কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিবেদন অনুযায়ী পাকিস্তানের স্বর্ণের রিজার্ভ ৩৫ শতাংশ কমে ৮২ মিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। প্রতিমাসে গড়ে প্রায় ২০ মিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা নিঃসৃত হওয়ার ফলে, পাকিস্তানের এর আমদানী তীব্রভাবে কমাতে হবে, পশ্চিমের ফ্যাক্টরীগুলো কাঁচামালের অভাবে পড়েছে এবং বেকারত্বের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
পশ্চিমের কাটছাট করা প্রতিবেদন (সমগ্র পাকিস্তান মুদ্রন বিবাচনের অধীন) বলছে যে খাদ্য সংকট চলছে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের প্রাদেশিক অঞ্চলে কিছু প্রান্তিক কৃষক তাদের খাজনা দিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে। পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্প কেন্দ্রগুলো কর্মী ছাত্র অস্থিরতার খবর পাওয়া গেছে, এর মাঝে কিছু ধর্মঘটকারীকে সরকারী সৈন্যরা গুলি করার খবরও পাওয়া গেছে। পূর্বে, আওয়ামী লীগ নেতারা বাঙ্গালী কৃষকদের পাটের পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের খাওয়ানোর জন্যে ধান চাষের আহ্বান জানিয়েছে, এবং পাট শিল্পের অবস্থা ভয়াবহ বিপর্যস্ত, কিছু প্রক্রিয়াজাতকরন কারখানা যুদ্ধে ধ্বংস হয়ে গেছে। পাকিস্তানের বিশ্ব ব্যাঙ্কের কাছে তিন মিলিয়ন ডলার ঋণ আছে যা এই জুনে শোধ করতে হবে, কোন দেশই ইয়াহিয়ার সমস্যাক্রান্ত সরকারকে সাহায্যের জন্যে এগিয়ে আসবে না। কিন্তু পূর্ববঙ্গে কমিউনিজম প্রতিষ্ঠা বন্ধে এর প্রচেষ্ঠার জন্যে যুক্তরাষ্ট্র কেন্দ্রীয় সরকারের উপর বাজী ধরতে পারে। পাকিস্তানের অর্থনীতিতে আরো ধার দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব পুঁজির মাধ্যম্যে পাকিস্তানকে প্রবেশ করাতে পারবে।
সার্বিক ভাবে মনে হচ্ছে যে পশ্চিম পাকিস্তানে অস্থিরতা তৈরী ছাড়া সেনাবাহিনী বর্ষাকালে পূর্ববঙ্গে সাহসীভাবে টেকার সম্ভবনা কম। পশ্চিম পাকিস্তানী অভিজাতদের যুক্তিসঙ্গত দাবী পূরন করতে ইয়াহিয়া খান হয়তো পশ্চিম পাকিস্তানী পিপলস পার্টির নেতা এবং পশ্চিম পাকিস্তানে ডিসেম্বরের নির্বাচনে জয়ী জুলফিকার আলি ভুট্টোকে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্যে পদত্যাগ করবে।
ভুট্টো আইয়ুব খানের শাষনামলে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রী ছিলো, ইন্দো-পাক যুদ্ধবিরতির চুক্তি সম্পাদনের প্রতিবাদে সে পদত্যাগ করে। বিপুল পরিমান জমির মালিক যে সমাজতন্ত্রএর কথা বলে- ব্যাংক, ইন্সুরেন্স ও মৌলিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করনের কথা বলে—একই সাথে ভুট্টো এমন পারিপার্শ্বিক অবস্থার কথা বলে যেখানে শিল্প কারখানা ব্যক্তিমালিকানাধীন হবে। পূর্ব বাঙালীদের নিকট অপ্রিয় ভুট্টো পশ্চিম পাকিস্তানেও সম্পূর্ণ জনপ্রিয় ছিলো না। টাইমস অফ ইন্ডিয়ার প্রতিবেদন অনুযায়ী সাম্প্রতিককালে পাঞ্জাবের বিভিন্ন শহরে ভুট্টোর বিরুদ্ধে ছাত্র ও কর্মজীবিরা প্রতিবাদ সভা করেছে।
কিন্তু যেই কেউই বছরের আগামী কয়েক মাস পাকিস্তানের শাষনভারে থাকবে, পূর্ববঙ্গ বাংলাদেশ এর জনগনের যুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে আছে, যারা শুধুমাত্র সাড়ে সাত কোটি লোক স্বাধীনতার জন্য একতাবদ্ধ হয়েছে, যাদের বাইরের কোন সাহায্য, কোন অস্ত্র, এমনকি কোন সামরিক প্রশিক্ষনও নেই। যেভাবে আওয়ামী লীগ থেকে নেতৃত্ব আরো বিস্তৃতভাবে ছড়িয়ে পড়ছে, চীন হয়ত তাদের সর্বোচ্চ সাহায্য প্রস্তাব করবে। সেটা হোক আর না হোক বাংলাদেশ খুব সম্ভবত স্বাধীন হয়ে যাবে। ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউয়ের টি.জে.এস জর্জকে একজন ন্যাপের নেতা বলেন, “চীন সরাসরি আমাদের সমর্থন করলো কিনা, রাশিয়া মধ্যস্থতা করার চেষ্টা করছে কিনা কিংবা যুক্তরাষ্ট্র ইয়াহিয়া খানকে বদলানোর চেষ্টা করছে কিনা তা নিয়ে আমরা চিন্তিত নই। আমাদের যুদ্ধ আমাদেরই চালাতে হবে এবং আমরা নিশ্চিত আমরা জয়ী হবো।”
_____________________________________
এই পুস্তিকা প্যাসিফিক স্টাডিজ সেন্টারের সদস্যগণ, পূর্ব পালো আলতোর একটি অলাভজনক সহকারী গবেষণা সংস্থা, তৈরী করেছে। এই প্রকাশনায় ব্যক্ত মতামত লেখকের নিজস্ব এবং তা প্যাসিফিক স্টাডিজ সেন্টারের মতামত হিসাবে বিবেচ্য নয়।
অনেকগুলো সংখ্যা নিলে প্রতি ৫০০ সংখ্যার জন্যে খরচ সহ ৬.৫০ ডলার খরচ পড়বে। সাহায্য শুল্কমুক্ত।
পুনঃমুদ্রন অনুমোদিত (অলাভজনক)। প্রবন্ধগুলো যথাযথ কৃতজ্ঞতা ও সম্মানী প্রদান করতে অনুরোধ করছি।
প্যাসিফিক স্টাডিজ সেন্টার নিয়মিত (দ্বিমাসিক) প্যাসিফিক রিসার্চ ও ওয়ার্ল্ড এম্পায়ার টেলিগ্রাম প্রকাশ করে, যেখানে তথ্যসম্বৃদ্ধ এশিয়া এবং প্যাসিফিক অঞ্চলের রাজনৈতিক অর্থনীতির তথ্যসম্বৃদ্ধ বিশ্লেষন এবং গুরুত্বপূর্ন জাতীয় সমস্যা নিয়ে প্রবন্ধ করে। ব্যক্তিগত নিবন্ধন (বারো সংখ্যার জন্য) করার জন্যে পাঁচ ডলার এবং প্রতিষ্ঠানের জন্যে পনের ডলার খরচ পরবে।
অনুসন্ধান এবং আদেশ উদ্দেশ্য করা হচ্ছে-
প্যাসিফিক স্টাডি সেন্টার
১৯৬৩ ইউনিভার্সিটি অ্যাভেন্যু
ইস্ট পালো আল্টো, ক্যালিফোর্নিয়া
৯৪৩০৩
সত্ত্ব মে ১৯৭১, প্যাসিফিক স্টাডিস সেন্টার
নির্বাচিত উৎসঃ
আহমেদ. নাফিস. এন ইকোনমিক জিওগ্রাফি অফ ইস্ট পাকিস্তান, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি ১৯৫৮.
আলাভি; হামজা এবং খুসরো, আমির, “পাকিস্তানঃ দ্যা বারডেন অফ ইউ এস এইড ইম্পেরিয়ালিস্ট” এন্ড আন্ডারডেভেলপমেন্ট, এড. রোডস রবার্ট, মানথলি রেভিউ, ১৯৭০.
আলি, তারিক, “ক্লাস স্ট্রাগল ইন পাকিস্তান,” নিউ লেফট রিভিউ. সেপ্ট.-অক্ট. ১৯৭০, ইংল্যান্ড.
আলি, তারিক. পাকিস্তানঃ মিলিটারি রুল অর পিওপল পাওয়ার, মোরোও, ১৯৭০.
ভুট্টো. যুলফিকার আলি. দ্যা মিথ অফ ইন্ডেপেন্ডেন্স, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি, ১৯৬৯.
দাত্ত, আর. পি. , ইন্ডিয়া টুডে, পিওপলস পাবলিশিং হাউস, বোমবে, ১৯৪৭.
জ্যাক. জে. সি.,ইকোনমিক লাইফ অফ ব্যাঙ্গাল ডিসট্রিক্ট, অক্সফোর্ড, ১৯১৬.
নাটলি, তিমোথি অ্যান্ড লুইস, “পাকিস্তানঃ দ্যা বিজি বি রুট টু ডেভেলোপমেন্ট” ট্রান্সেকশান, ফেব্রুয়ারি ১৯৭১.
পাপানেক, গুস্তাভ, পাকিস্তান্স ডেভেলোপমেন্ট, /হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস. ১৯৬৭.
সাময়িক পত্রিকা
ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভেউ, হংকং
ল্যা মন্ডে, প্যারিস, ফ্রান্স
টাইমস অফ ইন্ডিয়া, নিউ দিল্লি, ইন্ডিয়া
ম্যানচেস্টার গার্ডিয়ান, ইংল্যান্ড
নিউ ইয়র্ক টাইমস, নিউ ইয়র্ক
টাইমস অফ লন্ডন, লন্ডন
পেকিং রিভিউ, নাম্বার ১৬
__________________________________
আমার সোনার বাংলা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি।
চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস, আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি।
ও মা, ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে,
মরি হায়, হায় রে—
ও মা, অঘ্রাণে তোর ভরা খেতে আমি কি দেখেছি মধুর হাসি।
কী শোভা, কী ছায়া গো, কী স্নেহ, কী মায়া গো,
কী আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে, নদীর কূলে কূলে।
মা, তোর মুখের বাণী আমার কানে লাগে সুধার মতো,
মা, তোর বদন খানি মলিন হলে আমি নয়ন জলে ভাসি।
তোমার এই খেলাঘরে শিশুকাল কাটিল রে,
তোমারি ধুলামাটি অঙ্গে মাখি ধন্য জীবন মানি।
তুই দিন ফুরালে সন্ধ্যাকালে কি দীপ জ্বালিস ঘরে,
মরি হায়, হায় রে—
তখন খেলাধুলা সকল ফেলে, ও মা, তোমার কোলে ছুটে আসি।
ধেনু- চরা তোমার মাঠে, পাড়ে যাবার খেয়াঘাটে,
সাড়া দিন পাখি-ডাকা ছায়ায়–ঢাকা তোমার পল্লীবাটে,
তোমার ধানে-ভরা আঙিনাতে জীবনের দিন কাটে,
মরি হায়, হায় রে—
ও মা, আমার যে ভাই তারা সবাই, ও মা, তোমার রাখাল তোমার চাষি।
ও মা, তোর চরণেতে দিলাম এই মাথা পেতে—
দে গো তোর পায়ের ধুলা, সে যে আমার মাথার মাণিক হবে।
ও মা, গরিবের ধন যাই আছে তা দেব চরণতলে,
মরি হায়, হায় রে—
আমি পরের ঘরে কিনব না আর, মা তোর ভূষণ ব’ লে গলার ফাঁসি।
কানাডায় প্রবাসী বাঙ্গালীদের তৎপরতা
<৪,১৬১,৩২৩>
অনুবাদকঃ নাজিয়া বিনতে রউফ
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৬১। বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশন অব কানাডা (টরেন্টো) এর কর্মতৎপরতা সৎক্রান্ত তথ্য | এ্যাসোসিয়েশনের প্রচারপত্র |
………… ১৯৭১ |
বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশন অব কানাডা (টরেন্টো)
ইহার বর্তমান উদ্দেশ্যসমূহ
পাকিস্তানী সেনাবাহিনী কর্তৃক বাংলাদেশে চলমান দখলদারীত্ব এবং ঔপনিবেশিক শোষণের কারণে কানাডার এ্যাসোসিয়েশনের উপর একটি জাতিগত গোষ্ঠীর স্বাভাবিক কার্যক্রম ছাড়াও বিশেষ দায়িত্ব পালন করার দায়ভার পড়েছে । আগ্রহের বিষয়বস্তুগুলো নিম্নলিখিতঃ
১. কানাডা এখনও বাংলাদেশকে স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয় নি এবং সেখানে কোন বাঙ্গালী কূটনৈতিক মিশনও নেই। তাই মুক্তির জন্যে সশস্ত্র সংগ্রামরত ভিনদেশী দখলে থাকা একটি দেশকে প্রতিনিধিত্বকারী কূটনৈতিক মিশনের দায়িত্ব পালন করতে হবে এ্যাসোসিয়েশনকেই।
২. কানাডায় বাঙ্গালী স্বার্থ আদায়ের জন্যে আর্থ-সামাজিক প্রতিষ্ঠানের কোন অস্তিত্ব ছিল না। সুতরাং বাঙ্গালীদের উচিত এ্যাসোসিয়েশনের মাধ্যমে এমন প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন মেটানোর চেষ্টা করা এবং প্রতিরোধ আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করা।
স্পষ্টবাক্যে, এ্যাসোসিয়েশনের দায়িত্বের মধ্যে আছেঃ
- বাংলাদেশের সংবাদ ছড়িয়ে দেয়া,
- সর্বসাধারণ ও প্রশাসন উভয় পর্যায়ে বাংলাদেশের জন্যে প্রচার ও প্রোপাগান্ডা,
- পাকিস্তানী দখলদারী শক্তিকে সাহায্য না করার জন্যে বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানকে রাজী করানো,
- বাংলাদেশের প্রতিরোধ আন্দোলনের জন্যে তহবিল সংগ্রহ করা।
___________________________________________________________________________
পোস্টাল বক্স ৬২৪৭, স্টেশন ‘এ’। টরন্টো আই. অন্টারিও, কানাডা।
<৪,১৬২,৩২৪>
অনুবাদকঃ নাজিয়া বিনতে রউফ
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৬২। বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশন অব কানাডা প্রকাশিত মুখপাত্র ‘বাংলাদেশ’ –এর দুটি খবর | বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশন অব কানাডার দলিলপত্র | ৩১ জুলাই, ১৯৭১ |
ঘোষণাঃ
বাংলাদেশ বিষয়ক সম্মেলনঃ– বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশন অব কানাডা (টরন্টো) একটি বাংলাদেশ বিষয়ক সম্মেলনের আয়োজন করেছে। আমাদের প্রধান বক্তা মি. এন্ড্রু ব্রউইন, এম.পি., কানাডার সংসদ প্রতিনিধিবর্গের সদস্য, যিনি সম্প্রতি ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ সফর থেকে ফিরেছেন। তিনি প্রকৃত অবস্থা উদঘাটনের মিশনে ভারত ও পাকিস্তান সরকারের অতিথি হিসেবে সেখানে যান।
সমাবেশে কানাডার অন্যান্য প্রত্যক্ষদর্শীরাও বক্তব্য রাখবেন। হাতে সময় থাকলে তথ্যচিত্র ও চলচ্চিত্র প্রদর্শনী প্রদর্শনী হবে। উক্ত সম্মেলনের আপনি সাদরে আমন্ত্রিত। সময়ঃ সন্ধ্যা ৭.৩০ ঘটিকা। স্থানঃ মেডিকেল সায়েন্স বিল্ডিং অডিটরিয়াম(কিংস কলেজ সার্কেল, ইউনিভার্সিটি অব টরন্টো প্রধান ক্যাম্পাস),তারিখঃ ৫ই অগাস্ট, ১৯৭১।
—————-
বাংলা চলচ্চিত্র প্রদর্শনী
২৬শে অগাস্ট, ১৯৭১, বৃহস্পতিবার ODEON (ডানফোর্থ এন্ড পেপ, পেপ সাবওয়ের পাশে)-এ সত্যজিৎ রায়ের বাংলা চলচ্চিত্র ‘দুই কন্যা’(ইংরেজী সাবটাইটেলসহ)-এর প্রদর্শনী হবে। চারটি প্রদর্শনী থাকবে। ভারতে অবস্থানরত বাংলাদেশী রিফিউজিদের সাহায্যার্থে, ICA এর সার্বিক সহযোগিতায় প্রদর্শনীটির আয়োজন করা হয়েছে। টিকিট বিক্রি করার জন্যে আমাদের স্বেচ্ছাসেবী প্রয়োজন।
<৪,১৬৩,৩২৫>
অনুবাদকঃ নাজিয়া বিনতে রউফ
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৬৩। বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশন অব কুইবেক-এর তৎপরতা সংক্রান্ত তথ্য | এ্যাসোসিয়েশন প্রকাশিত মুখপাত্র ‘স্ফুলিঙ্গ’ | ১ আগস্ট, ১৯৭১ |
কানাডা ও ইউ.এস.এ. থেকে সংবাদ
বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশন অব বি.সি. এর সভাপতি শাহজাহান কবির, ভ্যাঙ্কুভার থেকে জানাচ্ছেন!
দ্য বি.সি. এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রকে অব্যাহত অর্থনৈতিক ও সামরিক সাহায্য চালান পাঠানোর প্রবল প্রতিবাদ করছে। ইয়াহিয়া খান প্রশাসনের হাতে এই ধরনের সাহায্য সরাসরি বাংলাদেশ- তথাকথিত ইস্ট পাকিস্তানে আমাদের মানুষদের গণহত্যায় যাচ্ছে।
পাকিস্তানের ইয়াহিয়া খান প্রশাসনকে আমেরিকার সামরিক সাহায্য পাঠানোর প্রতিবাদে ২২ জুলাই ভ্যাঙ্কুভারে আমেরিকান দূতাবাসে উপস্থাপিত চিঠির অংশবিশেষ এটি।
বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সংগ্রামকে ভ্যাঙ্কুভারবাসী কিভাবে সমর্থন করতে পারেন? দুটি কর্মপরিকল্পনা আমরা আপনাদের সমর্থন করার জন্যে অনুরোধ করছিঃ
শিক্ষাঃ ভ্যাঙ্কুভার সিটি কলেজ(ল্যাঙ্গারা); ২৯ জুলাই দুপুর ২.৩০ ঘটিকা
র্যালিঃ আমেরিকান দূতাবাস, শুক্রবার, ৩০ জুলাই, সন্ধ্যা ৬.০০ ঘটিকা
বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশন অব কানাডা, টরন্টো ও বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশন অব কানাডা, অটোয়া, ইয়াহিয়ার দুই পা-চাটা, হামিদুল হক চৌধুরী ও মাহমুদ আলীর বিরুদ্ধে ১৮ জুলাই ও ২২ জুলাই দুটি বিক্ষোভ কর্মসূচির আয়োজন করে। এই দুই ইয়াহিয়ার সাহায্যকারী ও সাম্রাজ্যবাদের দালালরা সম্প্রতি তাদের প্রভূদের হয়ে কথা বলার জন্যে কানাডা সফর করে যায়। বিক্ষোভকারীরা এই দুই বিমর্ষ রাজনীতিবিদদ্বয়ের পটভূমি সম্বলিত প্রচারপত্র বিতরণ করে।
বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশন অব টরন্টো থেকে মতিউর রহমান জানাচ্ছেনঃ
বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশন, ইউনিভার্সিটি অব টরন্টো “ক্রাইসিস ইন বেঙ্গল” নামক একটি সমাবেশ আয়োজন করেছে। স্থানঃ ইউনিভার্সিটি অব টরন্টো, প্রধান ক্যাম্পাস। সময়ঃ সন্ধ্যা ৭.৩০ ঘটিকা, তারিখঃ বৃহস্পতিবার, ৫ আগস্ট, ১৯৭১। ___________________
<৪,১৬৪,৩২৬>
অনুবাদকঃ মাহীন বারী
শিরোনাম | সুত্র | তারিখ |
১৬৪। বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব কানাডার সাধারণ সম্পাদকের চিঠি | বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব কানাডার দলিল | ১৬ আগস্ট, ১৯৭১ |
বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অবকানাডা
পি ও বক্স-৬২৪৭, থানা-এ টেলিফোন
টরন্ট ১ (৪১৬) ৩৬৩_২৮৩৪
অন্টারিও, কানাডা আগস্ট ১৬, ১৯৭১
প্রিয় জনাব,
আপনি অবগত আছেন যে আমাদের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতারণার অভিযোগে আনা ভিত্তিহীন মামলার বিচারকার্য গোপনে আরম্ভ হয়েছে। আমরা মনে করছি যে আমাদের পক্ষ থেকে যতটুকু সম্ভব কিছু করা উচিৎ যাতে করে এই অন্যায় প্রহসনমূলক বিচারকার্যের বিরুদ্ধে সমগ্র বিশ্বের একটি জনমত গড়ে উঠে। এখানে টরন্টতে কানাডাবাসীদের একটি স্বাধীন দল যথাযত আন্তর্জাতিক কর্তৃপক্ষের নিকট পাবলিক পিটিশন করবার উদ্যোগের চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমরা মনে করি বাঙ্গালী হিসেবে আমাদেরও উচিৎ তাদেরকে সহযোগিতা করা। এই উদ্দেশ্যে এখানে উক্ত পিটিশনের একটি কপি সংযুক্ত করা হল। অনুগ্রহপূর্বক প্রয়োজনীয় সংখ্যক কপি তৈরি করুন এবং যতবেশি সম্ভব স্বাক্ষর সংগ্রহ করুন। যদি আপনারা ইতোমধ্যে এই ধরণের উদ্যোগ নিয়ে থাকেন তবে অনুগ্রহ করে একটি তালিকা অথবা তার একটি কপি আমাদের নিকট পাঠিয়ে দিবেন যাতে করে একটি সমন্বিত পিটিশন প্রস্তুত করা যায়।
অনুগ্রহ করে এটি অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা করবেন। খুবসম্ভবত আমরা পিটিশনটি আমাদের নেতার মৃত্যুদণ্ডের পূর্বেই জমা দিতে পারব, এবং অবশ্যই উনি এখনও জীবিত রয়েছেন। এই অবস্থায় এই পিটিশনের মাধ্যমে বিশ্ব জনমত গড়ে তুলতে সহায়তা করবে।
আপনার একান্ত,
এম এম রাহমান
সাধারণ সম্পাদক
পাকিস্তান জাস্টিস রেজ্যুলশন
নিম্ন স্বাক্ষরিত আন্দোলন পাকিস্তান সরকারের কার্যকলাপ যা শেখ মুজিবুর রহমানের গোপন সামরিক বিচার কার্যের বিরুদ্ধে সমর্থন দেয়। সকল ধরণের প্রচলিত বিচার বিষয়ক আচার বিধি এবং সুরক্ষা বিধির বরখেলাপ আসামিপক্ষের সুনাম হানি ঘটায়। যদি এই বিচার কার্যের শেষ হয় শেখ মুজিবুর রহমানের বিনাশের মাধ্যমে, তবে তার ফলাফল স্বরূপ আর ও রক্তের বন্যা বয়ে যাবে দেশটির উপর দিয়ে যেখানে এটি বর্তমানে অত্যন্ত কঠিন সময়
পার করছে।
আমরা আপনাদেরকে আহবান করছি আপনার ভালো কার্যালয়গুলোকে ব্যবহারের জন্য যাতে করে পাকিস্তান সরকারকে এই অসৎ এবং অন্যায় প্রণালী থেকে বিরত রাখতে বোঝানো যায় যেন তা পূর্ব পাকিস্তানে শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একটি ধাপ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
স্বাক্ষর ঠিকানা
<৪,১৬৫,৩২৭-৩২৮>
অনুবাদকঃ মাহীন বারী , ফাহমিদা আক্তার বৃষ্টি
শিরোনাম | সুত্র | তারিখ |
১৬৫। বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব কানাডার মুখপাত্র “বাংলাদেশ” এর সম্পাদকীয় এবং সমিতির কর্ম তৎপরতা সংক্রান্ত আর ও তথ্য | সমিতির দলিলপত্র | ২৫ আগস্ট, ১৯৭১ |
বাংলাদেশ, ২৫ আগস্ট, ১৯৭১
সম্পাদকীয়
যখন থেকে বাংলাদেশ সংগ্রাম করে চলেছে, গণতন্ত্র টগবগিয়ে চলছে লম্বা সময় ধরে, বাঁধাগ্রস্থ হয়েছে গত মার্চের তীব্র কার্যকলাপ দ্বারা, এবং আমাদের আত্মাবাঙ্গালী মানুষের কষ্ট ও আশা দিয়ে ছুয়ে গিয়েছে।
পুরো বিশ্ব অবাক হয়ে গিয়েছে যেভাবে গণহত্যা কয়েক লক্ষ বাঙ্গালীকে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য করেছে। তাদেরকে নিজ দেশ পরিত্যাগ করে ভিনদেশে অসুস্থতা ও পুষ্টিহীনতার জীবন বেছে নিতে বাধ্য করা হয়েছে যেন তারা নিজ দেশের গণহত্যাকারী লোকদের থেকে বাঁচতে পারে। ভয়ংকর অভিজ্ঞতা থেকে বেঁচে ফেরাটা তাদের কাছে এখনও অবিশ্বাস্য মনে হয়, তারা এক অনির্ধারিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের পাকিস্তানে ফেরত যাওয়াটা হবে আত্মহত্যার নামান্তর। “রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা” জাতীয় সম্ভাবনা একেবারেই নেই। তারা কেবলমাত্র একটি আশা দেখতে পাচ্ছে যেখানে তাদের ভবিষ্যৎ আলোকিত হতে পারে – আর তা হল বিজয়, মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয়, বাঙ্গালী জনগণের বিজয়।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ইয়াহিয়া খানের সৈন্যবাহিনী অরাজাকতা জারি রেখেছে। পীড়ন কখনও এমন ছিল না, কেউ কোন কথা বলবার সাহস পায় না। কিন্তু সকলের মনে কেবল মাত্র একটি কথাই বাজে- যখন সময় হবে, নিপীড়কের হাত থেকে জোর করে অস্ত্র ছিনিয়ে নেয়া হবে, এবং দেশ স্বাধীন হবে। পাকিস্তান সরকারও এটি জানে। এবং এই জন্যেই তারা মানুষজনদেরকে আদর্শ বিচ্যুত করবার জন্য নানা ধরণের পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা জনপ্রিয় চেহারাগুলোকে বলছে “দুষ্কৃতিকারী” এবং পুরো যুদ্ধকে বলছে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের শয়তানী কর্মকাণ্ডের অংশ। তারা ধর্মকে বিবাদ সৃষ্টির অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চাচ্ছে, যাতে করে হিন্দু হলেই যেকোনো অপরাধ করা যায়। তারা “শান্তিবাহিনী” তৈরি করছে স্থানীয় সহযোগীদের নিয়ে। আর সব কিছুই হচ্ছে একটিমাত্র উদ্দেশ্য সামনে রেখে- মানুষদের দমন।
এইমুহূর্তে এমনকি আছে যা এই কোটি কোটি মানুষদের প্রানে আশা যোগাবে যেখানে তারা সর্বদা নিপীড়নের মধ্যে বাস করছে, যাদের জীবন সম্পদ কোন কিছুই কক্ষনো সুরক্ষা পায়না, যারা প্রতিনিয়ত সুতীব্র দুর্দশা ভোগ করে চলেছে বর্তমান দুর্দিনে? তাদের জন্য “ইসলামিক” পাকিস্তান প্রজাতন্ত্রের জন্য “একতা ও সংবদ্ধতা” এর মানে হচ্ছে বিচ্ছিন্ন কলোনির মধ্যে নিজেদেরকে উজার করে দেয়া। তাদের জন্যও কেবল একটি আশা – বিজয়। মুক্তি শক্তির বিজয়। বাংলার জনগণের বিজয়।
প্রবাসী বাঙ্গালীদের জন্য সুযোগ রয়েছে এই বহুল আকাঙ্ক্ষিত বিজয় পেতে ভুমিকা রাখবার। আপানারা স্বৈরশাসকের বিপক্ষে কথা বলুন, বিশ্বেরসচেতন ও সুনাগরিকদের কাছে বাংলাদেশের ঘটে চলা এ সকল দুর্দশার চিত্র তুলে ধরুন। তাদের সমর্থন ও সহযোগিতা পেতে সহায়তা করুন। আপনার চুপ করে থাকবার কোন কারণ নেই। আপনার চুপ করে থাকাটা আপনার সজনদের নিরাপদে ঘরে ফিরতে কোনরূপ সাহায্য করবেনা। সেখানে কেউই নিরাপদ নয়। তাই বাংলাদেশের পক্ষে কথা বলুন।
অন্য একটি উপায়ে এই মানুষগুলোর বিজয়ের পথে আপনি অবদান রাখতে পারেন, তা হলো আপনার আর্থিক সহায়তার মাধ্যমে। হতে পারে আপনি খুব সামান্য পরিমাণ দিতে পারেন, কিন্তু এই সামান্য পরিমাণও অন্যান্য অবদানের সাথে যুক্ত হয়ে প্রয়াসটির সাথে একটি শক্ত সমর্থন দিবে। প্রতি মাসেই কিছু পরিমাণ দিন। আপনাদের অব্যাহত আর্থিক সহায়তা প্রয়োজনীয়। লোকজন মারা যাচ্ছে, কিন্তু আপনাদের কাছ থেকে শুধুমাত্র একটি ত্যাগের প্রয়োজন, তা আর্থিক সহায়তা। উদার হতে দ্বিধা করবেন না।
বাংলাদেশ আর্থিক শোষণ থেকে মুক্তি চায়। এটি চায় জনগণের কথার শাসনের সত্যিকার গণতন্ত্র। এটি চায় একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাজ্য, যেখানে সবার জন্য সাম্য থাকবে। এটি বাস্তবে পরিণত করতে অনেক বাধা পার করতে হবে। আপনাদের নিবেদিত সমর্থন এই স্বপ্নকে সত্যি করতে সহায়তা করতে পারে। আপনাদের দুর্দশাগ্রস্ত স্বদেশবাসীকে হেরে যেতে দিবেন না। আপনাকে সংগ্রামে নিযুক্ত করুন। বাংলাদেশের চূড়ান্ত বিজয়কে আপনার বিজয় করে নিন।
বাংলাদেশ বিষয়ক আলোচনাসভা
“বাংলাদেশে সঙ্কট” বিষয়ক একটি আলোচনাসভা বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব কানাডা (টরোন্টো) এর মাধ্যমে আয়োজিত হয়েছিলো ১৯৭১ সালের ৫ই আগস্ট। মিস্টার এন্ড্রু ব্রুইন, এম. পি. , কানাডিয়ান সংসদীয় প্রতিনিধি দলের একজন সদস্য যা গত মাসে ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ ভ্রমণ করেছিলো, প্রধানবক্তা ছিলেন। প্যানেলের অন্যান্যদের মধ্যে ছিলেন, যারাও সম্প্রতি ভারত থেকে গিয়েছেন, টরোন্টো টেলিগ্রামের মিস্টার ফ্রেডরিক নজাল, অক্সফামের লেজলি স্মিথ এবং ইউনিসেফের মিস্টার পল ইগনিটাইফ। মিস্টার স্টেনলি বার্ক ছিলেন চেয়ারম্যান।
সকল বক্তারাই ভারতে অবস্থানকারী সাত মিলিয়ন শরণার্থীদের সম্পর্কে ভয়াবহ বর্ণনা দিয়েছিলেন। যেখানে মিস্টার স্মিথ এবং মিস্টার ইগনিটাইফ নিজেদেরকে শুধুমাত্র শরণার্থী সমস্যায় সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন, মিস্টার ব্রুইন এবং মিস্টার নজাল রাজনৈতিক ও অন্যান্য বিষয় সম্পর্কেও বলেছিলেন। মিস্টার ব্রুইন তার মতামতে বলেছিলেন বাংলাদেশ সঙ্কটের একমাত্র সমাধান একটি স্বাধীন বাংলাদেশ। মিস্টার স্মিথ তার বক্তৃতায় শরণার্থী শিবিরের ছবি নথিভুক্ত করেছিলেন।
তথাকথিত পাকিস্তান সংহতি কমিটির সাথে যুক্ত পশ্চিম পাকিস্তানের একটি দল ও দুইটি বাঙালি প্রতারকবাহিনী এক শাসনাতীত প্রদর্শনের মঞ্চায়ন করেছিলো এবং অগ্রগতিকে ব্যহত করতে অপরিণত আচরণের এক লজ্জাজনক প্রদর্শনের মাধ্যমে তাদের সর্বোত চেষ্টা চালিয়েছিলো। কিন্তু যখন তারা দেখলো সাধারণেরা তাদের রাহাজানির প্রতিকূলে, তারা দ্রুত তাদের সাক্ষাৎ বাতিল করে দিয়েছিলো। তাদের পরে একজন কানাডিয়ানকে উল্লেখ করতে শোনা যায়, “এখন আমি জানি কোথায় সমস্যা অন্তর্হিত।’’ অন্যজন বলেছিলেন, “আমি বুঝি না যদি কোন দেশের পথ-প্রদর্শকের তার স্বদেশবাসীর প্রতি এমন মনোভাব থাকে, তাহলে কীভাবে সেখানে কোন অর্থপূর্ণ সহাবস্থান থাকতে পারে।”
আলোচনাসভাটি অনেক সফল হয়েছিলো পাঁচশতের বেশি লোক যোগদান করেছিলো।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রদূতের টরোন্টো পরিদর্শন
জনাব এম. আর. সিদ্দিকী, যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডায় নবনিযুক্ত বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূত দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক আন্তর্জাতিক সভায় যোগ দিতে টরোন্টোতে ছিলেন। আগস্টের ২২ তারিখে, তিনি বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব কানাডার (টরোন্টো) সদস্যদের সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন এবং তাদরে অভিভাষণ জানিয়েছিলেন।
<৪,১৬৬,৩২৯>
অনুবাদকঃ ফাহমিদা আক্তার বৃষ্টি
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৬৬। বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব কুইবেক-এর মার্কিন বিরোধী বিক্ষোভ মিছিল।
|
মুখপত্র ‘স্ফুলিঙ্গ’ | ১ সেপ্টেম্বর,১৯৭১ |
বাঙালি ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের মদতদানের সমালোচনা করলেন বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব ভ্যানকভারের সদস্য এবং সমর্থকগণ:
বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব বি. সি. এর সদস্য এবং সমর্থকেরা যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস প্রাঙ্গণে শুক্রবার, ৩০ জুলাই বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। এক মিছিলের পরে তারা তারা বাংলাদেশের যুদ্ধে “যুক্তরাষ্ট্রের কুকর্মের সহকারিতা”র নিন্দা জানায়, যাতে দশ লক্ষ্য বাঙালি খুন হয় এবং আরো দশ লক্ষাধিক বাঙালি ভারত সীমান্তজুড়ে কলেরা আক্রান্ত শরণার্থী শিবিরে বিতাড়িত হয়েছলো।
তিন বাঙালি নাবিক কানাডায় রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী
তিন বাঙালি নাবিক সূতলেজ নামক এক পাকিস্তানি জাহাজ পরিত্যাগ করে আসে ১৭ই আগস্ট। মনট্রিলে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তারা জানায় তারা পাকিস্তানে ফিরে যাওয়া নিরাপদ মনে করেননি। তারা জাহাজটিকে সহযোগিতা করাও পছন্দ করেননি, যেটি পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর জন্য আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাঠানো অস্ত্র পরিবহণ করছিলো। বর্তমানে তারা বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব কিউবেকের সাথে অবস্থান করছে।
<৪,১৬৭,৩৩০>
অনুবাদকঃ ফাহমিদা আক্তার বৃষ্টি
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৬৭। বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব ব্রিটিশ কলম্বিয়া কর্মকর্তার প্রতিবেদন
|
সমিতির দলিলপত্র | ২৭ সেপ্টেম্বর,১৯৭১ |
বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব বৃটিশ কলম্বিয়া
৯০৫-৫৫০ পশ্চিম ১২তম এভিনিউ,
জয় বাংলা ভ্যানকভার ৯, বি. সি. , কানাডা
টেলিফোন: (৬০৪)৮৭৬-৮৪৫৩
সেপ্টেম্বর ২৭, ১৯১১.
প্রায় ছয় মাস হলো যখন থেকে বাংলাদেশের (অতীতের পূর্ব-পাকিস্তান) পঁচাত্তর মিলিয়ন মানুষ শুধুমাত্র তাদের মৌলিক অধিকার দাবি করতে একটি সংগ্রামেই লিপ্ত হয়নি, টিকে থাকার এক ভয়ানক সংগ্রামেও লিপ্ত হয়েছে।
পশ্চিম পাকিস্তানি সংখ্যালঘুদের কয়েক দশকের বিদ্বেষপূর্ণ শাসনের পর, পূর্ব-পাকিস্তানিরা প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন চেয়েছিলো। ১৯৭০ সালে দেশটির সাধারণ নির্বাচনে, আওয়ামী লীগ এক পরম সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জাতীয় সভায় জয়লাভ করেছিলো। তার ফলাফল ছিলো পশ্চিম পাকিস্তানি সৈনিকদের দ্বারা পূর্ব-পাকিস্তানিদের গণহত্যা, যখন কিনা একটি সুষ্ঠূ-পরিচালিত শান্তিপূর্ণ নির্বাচন এমন একটি ফলাফল দিয়েছিলো যা সেনাবাহিনী বরদাস্ত করতে পারেনি আওয়ামী লীগ পূর্ব-পাকিস্তান থেকে আপসারণ চায় না। শেখ মুজিবুর রহমান আগে থেকেই কিছু আন্দাজ করতে পেরে বাঙালি স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি। তিনি মূলতঃ বৈধভাবে যে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের জন্য লড়েছিলেন ও নির্বাচনে জয়লাভ করেছিলেন, তার চেয়ে বেশি কিছু চাননি।
নিরস্ত্র নাগরিকদের হত্যার পূর্ব-পরিকল্পিত উপায় অবলম্বন করে, বাছাইকৃত বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের ধ্বংস করে এবং প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন সমূলে উৎপাটন করে দিতে হিন্দুদের শিরোচ্ছেদ করে ইয়াহিয়া খান এবং পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী প্রমাণ করেছিলো যে পাকিস্তানের দুই ভাগ ভৌগলিক এক হাজার মাইলের ফারাকের চেয়েও বেশি কিছুর মাধ্যমে আলাদা এবং পূর্ব-পাকিস্তানিদের বাধ্য করেছিলো স্বাধীন বাংলাদেশের ঘোষণা দিতে।
সাহায্যের জন্য বাঙালিদের আর্তনাদে বিশ্বের সাড়া ছিলো দুঃখজনকভাবে হতাশাব্যঞ্জক। প্রত্যেকটা দিন বাড়ার সাথে এই যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়ার মানেই দুর্ভোগ বাড়ার সাথে জান-মালের বিনাশ।
দুঃখজনকভাবে এই দ্বন্দে যুক্তরাষ্ট্র তার অভিব্যক্ত নিরপেক্ষতা সত্ত্বেও সেই পশ্চিম পাকিস্তানি জেনারেলদের অস্ত্র সরবরাহ করে যাচ্ছিলেন যারা এই রক্তগঙ্গার শুরু করেছিলেন। রাষ্ট্রপতি নিক্সন সম্প্রতি পাকিস্তানিদের কোনরকম সহায়তা দেওয়া বন্ধের কোনরকম নড়চড়ের ঘোর বিরোধিতা করেছিলেন। সন্দেহাতীতভাবে আমেরিকার প্রচুর অস্ত্র সরবরাহ শত হাজার বাঙালির হত্যার জন্য দায়ী, যেখানে পাকিস্তান সরকারের আর্থিক সহায়তা হাস্টিংসে একটি বড় অধিষ্ঠিত সেনাবাহিনীকে সহায়তা করে যাচ্ছিলো। যুদ্ধে এটা অবশ্যই কোন নিরপেক্ষ অবস্থান নয়। বিশ্বজুড়ে স্বাধীন বিশ্ব এবং গণতন্ত্রের রক্ষক হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা তার অধীকৃত ভূমিকার সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে, এবং লাখ লাখ ক্ষুধার্ত, অসুস্থ এবং ক্রুদ্ধ শরণার্থীদের ভারতে ধাবিত করার জন্য ও উপমহাদেশের শান্তি ও স্থিতি ঝুঁকির দিকে ঠেলে দিতে আংশিকভাবে দায়ী।
আমরা বাংলাদেশি জনগণ ও মানবতার নামে আপনার বিবেকের নিকট আবেদন জানাই, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে কোনরকম আর্থিক এবং/ অথবা ইয়াহিয়া খানের সামরিক বাহিনীর গুপ্তসভায় কোনরকম সহায়তা দেওয়া থেকে নিবৃত্ত হতে আপনার সরকারের উপর চাপ দেওয়ার জন্য আপনার সকল প্রকার প্রভাব প্রয়োগ করতে। কেননা এই ধরনের সহায়তা শুধুমাত্র তাদের একগুঁয়েমি এবং গণহত্যার যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করতে পারে। সর্বোপরি আমাদের সঠিক আত্মপ্রত্যয়কে শ্রদ্ধা করতে আমরা আপনার এবং আমেরিকাবাসীর নিকট আবেদন জানাই।
আপনার বিশ্বস্ত,
(ডক্টর এ. এম. খান)
বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব বৃটিশ কলম্বিয়া
<৪,১৬৮,৩৩২-৩৩৩>
অনুবাদকঃ নাজিয়া বিনতে রউফ
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৬৮। বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব বৃটিশ কলম্বিয়া কর্মকর্তার কাছে লিখিত মার্কিন সিনেটরদের চিঠি | মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট | ৪-৭ অক্টোবর, ১৯৭১ |
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট শ্রম ও জনকল্যাণ কমিটি ওয়াশিংটন, ডি.সি. ২০৫১০ |
||
ড. এ.এম. খান সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব ব্রিটিশ কলম্বিয়া ৯০৫-৫৫০ পশ্চিম ১২তম এভিনিউ ভ্যাঙ্কুভার ৯, বি.সি., কানাডা |
৪ঠা অক্টোবর,১৯৭১ | |
প্রিয় ড. খান, পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি সম্পর্কিত আপনার সাম্প্রতিক চিঠির জন্যে ধন্যবাদ। আমি পূর্ব পাকিস্তানে চলমান দ্বন্দ্বের ব্যাপারে আপনার মতই উদ্বিগ্ন। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে আমাদের অবশ্যই এই যুদ্ধ-বিগ্রহ থামানোর জন্য ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে এবং একটি রাজনৈতিক সমাধানকে তরান্বিত করতে হবে। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্যে আমি এস.কন.রেস.২১ এবং পররাষ্ট্র সহায়তা আইনের ১৫৯তম সংশোধনী বিলের সহ-পৃষ্টপোষক হিসেবে কাজ করছি। আমি সাম্প্রতিক একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তির কপি যুক্ত করছি যা এই বিষয়ে আমার মতামত সম্পূর্ণরুপে ব্যাখ্যা করছে। আন্তরিক শুভেচ্ছাসহ, |
||
আপনার অনুগত, এসডি/- গ্লেন বিয়েল, জুনিয়র |
||
২
ড. এ.এম. খান বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব ব্রিটিশ কলম্বিয়া ৯০৫-৫৫০ পশ্চিম ১২তম এভিনিউ ভ্যাঙ্কুভার ৯, বি.সি., কানাডা |
৬ই অক্টোবর,১৯৭১ |
|
প্রিয় ড. খান, পাকিস্তানে সাম্প্রতিক রক্তারক্তির ঘটনায় আমি আপনার মতোই ভয়ার্ত ও আতঙ্কিত এবং আমি করাচি সরকারকে অস্ত্র সহায়তা কমানোর ব্যাপারে আইন সমর্থন করবো বলে ঠিক করেছি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র সাহায্য এর প্রাপকরা প্রায়শই কতটা ঘৃণ্য অপব্যবহার করে তার আরো একটি উদাহরণ এটি। বন্ধুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রকে সম্ভাব্য কমিউনিস্ট আগ্রাসন থেকে আত্নরক্ষায় সাহায্য করার সুস্পষ্ট উদ্দেশ্যে আমরা যে অস্ত্র প্রদান করে থাকি, সেগুলো শেষ পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ অসন্তুষ্টিকে মাটিচাপা দেয়ার কাজে ব্যবহৃত হয় যেমনটা কয়েক বছর আগের পাক-ভারত সীমান্ত যুদ্ধের সময়, শত্রুভাবাপন্ন প্রতিবেশীদের সাথে পুরোনো হিসাব চুকাতে ব্যবহৃত হয়। আমাদের সমস্ত অস্ত্র সহায়তা কর্মসূচী পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন এবং আমি এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করব বলে ঠিক করেছি। আপনাকে ধন্যবাদ আপনার গভীর উদ্বেগ আমার কাছে প্রকাশ করার জন্যে।
|
||
বিনীত এসডি/- ভেন্স হার্টকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর |
||
৩. ডক্টর এ.এম. খান, সাধারণ সম্পাদক বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব বৃটিশ কলম্বিয়া ৯০৫-৫৫০ পশ্চিম ১২তম এভিনিউ ভ্যাঙ্কুভার ৯, বৃটিশ কলম্বিয়া কানাডা ৭ই অক্টোবর, ১৯৭১ |
প্রিয় ডক্টর খান, পাকিস্তানে দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতির ব্যাপারে আপনার চিঠির জন্যে ধন্যবাদ। পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধের ফলস্বরুপ সকল আমেরিকানই গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। এটা স্পষ্ট যে জীবন ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অত্যন্ত ব্যাপক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার বারবার বলেছে যে, সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর কারণে সৃষ্ট দুর্ভোগ লাঘব করতে যেকোন আন্তর্জাতিক মানবিক প্রচেষ্টাকে সাহায্য করতে এরা প্রস্তুত। সাম্প্রতিক অনেক প্রতিবেদনের বিপরীতে, মার্কিন পররাষ্ট্র বিভাগ দাবী করছে যে আমরা বর্তমানে পাকিস্তানকে কোন ধরণের বৃহদাকার সামরিক সাহায্য প্রদান কর্মসূচী পালন করছি না। সীমিত পরিমানে একটি সরবরাহ পাঠানো হয়েছিল কিন্তু পররাষ্ট্র বিভাগ আমাকে জানিয়েছে যে বর্তমান পরিস্থিতির উপর পর্যালোচনা মূলতবি থাকা অবস্থায় আর কোন সরঞ্জাম পাঠানো হবে না। এই গুরুতর পরিস্থিতির ব্যাপারে আপনার মতামত জানার সুযোগ পেয়ে আমি আনন্দিত। আপনি নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন আপনি যে চিন্তা প্রকাশ করেছেন তা মাথায় রেখে এই ব্যাপারে ভবিষ্যত অগ্রগতিসমূহ আমি ঘনিষ্টভাবে পর্যবেক্ষণ করব।
|
আপনার অনুগত এসডি/- জোয়েন জি. টাওয়ার |
<৪,১৬৯,৩৩৪-৩৩৭>
অনুবাদকঃ নাজিয়া বিনতে রউফ
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৬৯। বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব কানাডার মুখপত্র ‘বাংলাদেশ’-এর সম্পাদকীয়, এসোসিয়েশনের কর্মতৎপরতা ও প্রাসঙ্গিক তথ্যাদি | মুখপত্র ‘বাংলাদেশ’ | ১৫,৩১ অক্টোবর, ১৯৭১ |
বাংলাদেশ ১৫ই অক্টোবর,১৯৭১
সম্পাদকীয়
বাংলাদেশের মুক্তিকামী জনগণ পাঁচ দলীয় দূতাবাসীয় কমিটি গঠনকে সাদরে গ্রহণ করেছে এবং এই ঘটনা স্বাধীনতা যুদ্ধে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এটি গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর মধ্যে ঐক্য ও আস্থা আরও দৃঢ় করেছে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে অর্থপূর্ণ সমন্বয় তৈরীর পথ খুলে দিয়েছে। বাংলাদেশে জনগণের পক্ষের দলগুলোর মধ্যে সহযোগীতার কারণে কৃষক, চাকরীজীবি, ছাত্র ও বুদ্ধিজীবিদের মধ্যে ঐক্যের বন্ধন ও ভ্রাতৃত্ব আরও জোরদার হয়েছে। এটি কোন আশ্চর্যের বিষয় নয় যে বর্তমানে যারা দুষ্ট ও বিভ্রান্তিকর প্রচারণা ছড়ানোর মাধ্যমে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে আমাদের কর্মীদের মধ্যে বিভেদ তৈরী করতে, সেই সাম্রাজ্যবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির চক্ষুশূল হয়ে দাড়িয়েছে এই একীভূত ঐক্য। তারা এমন একটা ধারণা তৈরী করার চেষ্টা করছে যে বৈদেশীক চাপের মাধ্যমে দূতাবাসীয় কমিটি গঠন করে তা বাংলাদেশের সরকারের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। তারা হঠাৎ করে খুব সহানুভূতিশীল হয়ে গেছে(১) এবং বলছে যে চলমান সঙ্কটের একমাত্র সমাধান হচ্ছে ‘পূর্ব-পাকিস্তান’-এ পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসন। চারিদিকে গুজব ছড়ানো হচ্ছে যে বাংলাদেশ খুব শীঘ্রই স্বাধীন হতে যাচ্ছে।
বাংলার ইতিহাস সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে অবিরত সংগ্রামের ইতিহাস। বাংলার সাধারণ মানুষ কখনো বিদেশী প্রভূদের কাছে মাথা নত করেনি এবং কখনও করবেও না। যখন মস্কো, ওয়াশিংটন বা পিকিং-এ বৃষ্টি হয় তখন আমরা আমাদের মাথায় ছাতা ধরায় বিশ্বাসী নই, তাই আমাদের বর্তমান স্বাধীনতা সংগ্রামের ক্ষেত্রেও এটা প্রযোজ্য। সুতরাং আমাদের উপর কারো কোন শর্ত আরোপ করার প্রশ্নই উঠে না। গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর মধ্যে ঐক্য গড়ে উঠেছে, এজন্যে নয় যে এতে বিদেশী শক্তির স্বার্থ সিদ্ধি হবে বরং এজন্যে যে এটাই বাংলাদেশের জনগণের ঐকান্তিক ইচ্ছা ছিল। অপরপক্ষে ব্যাপকভিত্তিক দূতাবাসীয় কমিটি গঠনের কারণে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী শিবিরে আমাদের জন্যে সম্মান ও সমর্থন তৈরী হয়েছে।
যারা ভবিষ্যতবাণী করছে যে বাংলাদেশ খুব শীঘ্রই স্বাধীন হতে যাচ্ছে, তারা ইচ্ছাকৃতভাবে হোক বা অজ্ঞতাবশত হোক, স্বাধীনতা যুদ্ধের উদ্দেশ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে এবং সরাসরি সাম্রাজ্যবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির হাতের পুতুল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
যদিও আমরা অবশ্যই চাই বাংলাদেশ যত দ্রুত সম্ভব স্বাধীনতা পাক এবং নিশ্চিত যে চুড়ান্ত জয় আমাদেরই হবে, আমরা এটাও জানি যে, মিথ্যা আশা যা বারবার অসত্যে পরিণত হয় তা মানুষের মনোবল ভেঙ্গে দিয়ে তাকে হতাশ করে তোলে। এটা নিশ্চিতভাবে ভারতের শরনার্থী শিবিরে দরিদ্র ও নিঃস্ব মানুষ আর বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গৃহহীন মানুষদের সাথে খুব নিষ্ঠুর রসিকতা।
যে শক্তি বাঙ্গালীদের মধ্যে বিভক্তি ও মতভেদ তৈরী করতে চেষ্টা করছে, তারা স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরু থেকে বলে যাচ্ছে যদি অবিলম্বে একটা সমঝোতায় পৌঁছানো না যায় তবে নেতৃত্ব কমিউনিস্টদের হাতে চলে যাবে। যে কমিটির “সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া বাংলাদেশের মানুষের কাছে আর কিছুই গ্রহণযোগ্য নয়” শীর্ষক ঘোষণা তাদের পরিকল্পনা ভেস্তে দিয়েছে, সেই দূতাবাসীয় কমিটি গঠনের পর থেকে তাদের প্রচারণা গতি পেয়েছে। তারা হঠাৎ করেই খুব সহানুভূতিশীল হয়ে পড়েছে আর বলছে যে বর্তমান সঙ্কটের একমাত্র সমাধান হল “পূর্ব পাকিস্তানে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসন”। এই অভিমত ছড়ানোর জন্যে বেশ কিছু সংস্থা ও সরকার বিপুল পরিমাণে অর্থ খরচ করছে। পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যে যদি একটি রাজনৈতিক সমাধান গৃহীত না হয় তবে শেখ মুজিবের জীবনের নিশ্চয়তা “কেউ” দিতে পারবে না, এ ধরণের একটা কথা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু এসব হুমকিতে কাজ হবে না। কারণ আমাদের প্রিয় নেতা তার জীবনের বিনিময়ে কখনও খুনী, ধর্ষকদের সাথে সমঝোতা করবেন না।
বাংলার সংগ্রামী জনতা কোন ধরণের আপষ কখনও মেনে নেবে না। তারা অনেক রক্ত দিয়েছে আর শেষ মানুষটা দাড়িয়ে থাকা পর্যন্ত তারা লড়াই চালিয়ে যাবে, কিন্তু স্বাধীনতা ছাড়া অন্য কিছু তারা গ্রহণ করবে না। জনগণের মধ্যে ঐক্য সংহত করা ও দূতাবাসীয় কমিটির কর্মসূচী বাস্তবায়ন করার মাধ্যমে আমাদের উচিত এই দুষ্কৃতিকারী ও প্রতিক্রিয়াশীল সাম্রাজ্যবাদী কালো শক্তিকে উপযুক্ত জবাব দেয়া।
পাকিস্তানের সামরিক জান্তা শক্তিশালী বিদেশী মিত্র দ্বারা সমর্থিত। তাই আমাদের উচিত হবে একটি লম্বা ও দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের জন্যে নিজেদের প্রস্তুত রাখা। এই সংগ্রাম চলাকালীন সময়ে আমাদের অনেক কষ্ট ও পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হবে কিন্তু আমরা এক মুহূর্তের জন্যেও আমাদের লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হব না। আমরা কোনভাবেই শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না।
স্থানীয় সংবাদ
টরন্টোতে প্রফেসর মুজাফফর
প্রফেসর মুজাফফর আহমেদ, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সভাপতি ও দূতাবাসীয় কমিটির সদস্য, তিনি জাতিসংঘের বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে নিউ ইয়র্ক আসেন এবং বাংলাদেশ ফেরত যাবার পথে টরন্টো ঘুরে গেছেন। ৭ই অক্টোবর তিনি টরন্টোতে প্রবাসী বাংলাদেশী নাগরিকদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখেন।
তিনি জাতিসংঘে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের অগ্রগতি ও কূটনৈতিক ক্ষেত্রে সামগ্রিক অগ্রগতির ব্যাপারে রিপোর্ট করেন। তিনি সর্বশেষ পরিস্থিতির চিত্র সামনে তুলে ধরেন। এই জাতীয় সঙ্কটের মুহূর্তে তিনি ঐক্যের প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি বলেন যে, যদিও বাংলাদেশের মানুষ এই চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধের শেষ দ্রুতই দেখতে চায় তবে তারা অনেক দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধের জন্যেও তৈরী এবং মাতৃভূমিকে স্বাধীন করতে শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে চেষ্টা করে যাবে।
দক্ষিণ এশিয়া ক্রাইসিস কমিটি
মি. স্ট্যানলি বুরকে, সাবেক সিবিসি সম্প্রচারকারী ও পরিচালক-কে নিয়ে সম্প্রতি টরন্টোতে দক্ষিণ এশিয়া ক্রাইসিস কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই গোষ্ঠীর উদ্দেশ্য হল বাংলাদেশে আসন্ন দুর্ভিক্ষের ব্যাপারে কানাডিয়ান মানুষকে জানানো। মি. বুরকে কমিটির কার্যক্রম জাতীয় পর্যায়ে ছড়িয়ে দিতে চান। বর্তমানে বিভিন্ন ক্যাম্পাস গ্রুপ মানুষকে সক্রিয়ভাবে শিক্ষিত করার কাজ করছে। “জনগণকে জেগে উঠতে হবে”, মি. বুরকে বলেন,”যখন লক্ষ লক্ষ মানুষ মৃত্যুর জন্যে তৈরী”।
ঘোষণা
২০ অক্টোবর সন্ধ্যা সাতটায় হ্যামিল্টনের ম্যাকমাস্টার ইউনিভার্সিটিতে বাংলাদেশের ওপর একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে, বক্তারা হলেন জাতিসঙ্ঘের বাংলাদেশি প্রতিনিধিদলের সদস্য জনাব এস. এ. সুলতান এবং জনাব মফিজ চৌধুরি।
বাংলাদেশ, ৩১ অক্টোবর, ১৯৭১
সম্পাদকীয়
সাম্প্রতিককালে পত্রিকাগুলো বাংলাদেশ ও ভারত অধ্যুষিত সীমান্তসমূহে ঘটা বিপুল গোলাবষর্ণ নিয়ে প্রতিবেদন করছে। পশ্চিম পাকিস্তানের ভারতের পাশাপাশি গ্রামগুলো থেকে মানুষ সরিয়ে দেয়া হচ্ছে আর মূল সড়কের গাড়ি ও বাসগুলোতে “ভারত নিপাত যাক” লেখা স্টিকার লাগানো হচ্ছে। সীমান্ত এলাকাসমূহে রাতের বেলা সম্পূর্ণ বিদ্যুৎহীন করে রাখা হচ্ছে। শহরের মানুষদেরকে ‘সেহরি’ আর ‘ইফতার’ এর সময় জানাতে আর সাইরেন বাজানো হচ্ছে না। সীমান্তে ভারত ও পাকিস্তান উভয়েই তাদের অবস্থান জোরদার করেছে। “মনে হচ্ছে যুদ্ধ অনিবার্য”।
এমন পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার পেছনের কারণ এবং যুদ্ধ লেগে গেলে, তা বাংলাদেশের ওপর কী প্রভাব ফেলবে, তা নিয়ে ভেবে দেখার সময় হয়েছে। সীমান্ত উত্তেজনা স্বাভাবিক করে তোলার বিষয়ে ইয়াহিয়া খানের সাথে কথা বলার জন্য পশ্চিমের নেতারা গোপনে মিসেস গান্ধীকে অনুরোধ করছেন। কিন্তু তিনি ‘স্পষ্টতই’ উল্লেখ করেছেন যে, এই সমস্যার মুল হল বাংলাদেশের প্রতি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বরতা, আর ভারত হল পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ সমস্যার কোন্দলে পড়া এক হতভাগ্য শিকার। তাছাড়া ইতোমধ্যেই ভারতে পালিয়ে আসা লক্ষাধিক শরণার্থী পরিবার তাদের দুর্দশাগ্রস্ত অর্থনীতির ওপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করছে। মিসেস গান্ধীর মতে, স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনতে ইয়াহিয়া খানের বাংলাদেশে ত্রাসের রাজত্ব বন্ধ করে পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সাথে সরাসরি কথা বলা উচিত।
ভারত ও বাইরের কিছু মানুষের মতে, নিজেদেরকে এই ঝামেলা থেকে মুক্ত করার জন্য ভারতের একমাত্র উপায় হল বাংলাদেশে বাঙালি সরকার গঠন করে দেয়া। তারা মনে করে, এটি লক্ষাধিক শরণার্থীকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ভরণপোষণ দেয়ার চাইতে সাশ্রয়ী হবে। ভারতের মূল সমস্যার প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করে তাদের সহযোগিতার জন্য কৃতজ্ঞতা ও আনুগত্য প্রকাশ করতে গিয়ে আমরা অনুভব করছি যে এই যুদ্ধ আমাদের ও ভারতের উভয়ের উদ্দেশ্য সাধনেই ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে। আমাদের পক্ষ থেকে যুদ্ধটা হল একটি ঔপনিবেশিক শাসন থেকে নিজেদেরকে মুক্ত করার। বিশেষ কোন পশ্চিম পাকিস্তানির বিরুদ্ধে নয়, বরং সকল শোষকদের বিরুদ্ধেই আমাদের যুদ্ধ।
এমন একটি কাজের নিষ্ফলতা সম্পর্কে মিসেস গান্ধী বুঝতে পেরেছিলেন বলেই ঐ ধরণের সব পরামর্শ তিনি প্রত্যাহার করেছিলেন, কারণ ভারত একটি শান্তিপ্রিয় জাতি। ভারত যদি সত্যই যুদ্ধের পক্ষে থাকত, তাহলে তিনি এতকাল ধরে অপেক্ষা করতেন না।
তাহলে সীমান্ত এলাকাসমূহে কেন এই অস্ত্রের ঝনঝনানি আর যুদ্ধের দামামা? এটা মোটামুটিভাবে পরিষ্কার যে আর্মি জেনারেলরা (তারা যতই বোকা হন না কেন) বুঝতে পেরেছেন যে বাংলাদেশকে জোরপূর্বক দমিয়ে রাখা আসলে অসম্ভব। তারা মুক্তিবাহিনীর হাতে দারুণভাবে পরাজিত হচ্ছে এবং পাকিস্তানের অর্থনীতিও এখন ধ্বংসের শেষ প্রান্তে। তাছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ বাংলাদেশে তাদের সেনাবাহিনীর দৌরাত্ম্যেরর পরিণাম এখন বুঝতে পেরেছে। তাই সীমান্তে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এখন দুই ধরণের উদ্দেশ্য সাধনে বাধ্য।
প্রথমত, পশ্চিম পাকিস্তান ও অন্যান্য দেশের জনগণের মনযোগ ঘোরানোই এর উদ্দেশ্য। পাকিস্তানের একতা ও ন্যায়পরায়ণতা সর্বদাই ‘ভারত বিদ্বেষ’ কিংবা ‘ভারত নির্মূল’ প্রচারণার ওপরে প্রতিষ্ঠিত ছিল। তাই, যুদ্ধের রব তুলে পাকিস্তানের যে অংশই শাসন করুক না কেন, ইয়াহিয়া চেয়েছিল জনগণের মধ্যে একটি একতা গড়ে তোলার।
দ্বিতীয়ত, যুদ্ধের এই তীব্রতা তৈরি করা হয়েছিল বিশ্বসম্প্রদায়কে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত রাখার জন্য ভয় দেখাতে, বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক রূপ দিতে ও বিশ্বের দৃষ্টি মূল বিষয়, অর্থাৎ সাড়ে সাত কোটি জনতার আশা ও স্বাধীনতার অধিকার থেকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিতে ও নিজেদের নির্মমতা ও বাংলাদেশে বর্বরতা ও ত্রাসের রাজত্বের ঘটনা লুকোতে। ভারতকে আক্রমণ করলে পাকিস্তানের সুবিধাই হয়: তাদের আশা যে এর ফলে ভারতের সাথে সীমান্তের দু’পাশেই যুদ্ধবিরতি সৃষ্টি হবে। এর ফলে বাংলাদেশের ওপর নিয়ন্ত্রণ আনা তার জন্য সহজ হবে এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে মুক্তিবাহিনীর কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে পারবেন। বাঙালিরা নিজেদের স্বাধীনতা অর্জনের পাশাপাশি এই যুদ্ধ থামাতে সাহায্য করা সকল শান্তিপ্রিয় ও গণতান্ত্রিক মানুষের কর্তব্য। সত্য ও সুবিচার পক্ষে থাকলে বাংলাদেশি মুক্তিবাহিনী বিজয় লাভ করবেই।
স্থানীয় খবর
বাংলাদেশ বিষয়ে আলোচনাসভা
হ্যামিল্টন, ৬ অক্টোবর: ৬ অক্টোবর হ্যামিল্টনে ক্যারিবিয়ান ছাত্র সংস্থা ও ম্যাকমাস্টার ইউনিভার্সিটির বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশনের যৌথ উদ্যোগে বাংলাদেশ বিষয়ে একটি আলোচনাসভার আয়োজন করা হয়েছিল। জাতিসঙ্ঘের বাংলাদেশি প্রতিনিধিদলের সদস্য জনাব এস এ সুলতান এবং জনাম এস আহমেদ সভার বক্তব্য রাখেন এবং জনতার প্রশ্নের উত্তর দেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্র ও শিক্ষক এই সভায় অংশগ্রহণ করেন। সভা সফলভাবে সম্পন্ন হয়।
পরদিন বক্তারা দু’জনই ম্যাকমাস্টার ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞান অ্যাসোসিয়েশনে বক্তব্য দেন এবং বিকেলে টরন্টোতে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অভ কানাডার অফিসে সদস্যদেরকে আহ্বান জানান। উভয়েই এই জাতীয় সংকট মুহূর্তে সকলের ঐক্য কামনা করেন।
৫ নভেম্বর আমাদের সাথে যোগ দিন।
শনিবার, ৬ নভেম্বর দুপুর ২টায় ভিয়েতনাম সংহতি কমিটির আয়োজনে অ্যালাস্কার অ্যামচিটকায় পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের প্রতিবাদে টরন্টোর বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অভ কানাডা যুদ্ধবিরোধী একটি মিছিলে যোগ দেবে।
পৃথিবীর সকল নির্যাতিত মানুষের সাথে সংহতি প্রকাশ করে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন তাদের নিজস্ব ব্যানার, প্ল্যাকার্ড ও স্লোগান সাথে নিয়ে মিছিলে যোগ দেবে। আমরা কানাডার জনগণকে জানাতে চাই যে আমরা যুদ্ধ চাই না, আমাদের ওপর যুদ্ধ জোর করে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। কুইনস পার্কে বেলা দুইটায় আমাদের মিছিলে যোগদান করুন।
বাংলাদেশি ডাকটিকেট
আমাদের কাছে এখন বাংলাদেশি ডাকটিকিটসমূহের একটি পূর্নাঙ্গ সেট পাওয়া যাবে। ডাকটিকিটের একটি সেট নিতে চাইলে জনাব খানের সাথে যোগাযোগ করুন এই নাম্বারে: ৩৬৩-২৮৩৪। এ অর্থ স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রয়োজনে ব্যয় করা হবে।
(টরন্টোর বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অভ কানাডার পক্ষে প্রচারণা কর্মকর্তার মাধ্যমে সম্পাদিত ও প্রচারিত।)
<৪,১৭০,৩৩৮>
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৭০। বৃটিশ কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ডীনের কাছে বাংলাদেশ এসোসিয়েশনের কর্মকর্তার পত্র |
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশোন অভ ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার দলিল
|
১৫ নভেম্বর, ১৯৭১ |
জনাব ফিলিপ এইচ. হোয়াইট
ডিন: বাণিজ্য ও ব্যবসা প্রশাসন
ব্রিটিশ কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়
১৫ নভেম্বর, ১৯৭১
জনাব,
গত আট মাস ধরে বাংলাদেশ (পূর্ব পাকিস্তান) এর জনগণ স্বাধীন নাগরিক হিসেবে বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য এবং বেঁচে থাকার যে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে, সে সম্পর্কে নিশ্চয়ই আপনি জানেন। নিরস্ত্র বাংলাদেশি নাগরিকদের ওপরে সেনাবাহিনীর বর্বরোচিত হামলার কারণে লক্ষাধিক মানুষ ভারতে পালিয়ে গিয়েছে এবং ১০-৩০ লাখ মানুষ অনাহারে ভুগছে। সেইসব হতভাগ্য মানুষদেরকে সাহায্য করতে অর্থ সংগ্রহের জন্য আমরা একটি প্রচারণা চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এই অর্থ শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও স্কুলের শিক্ষকদের সাহায্যে ব্যয় করা হবে, যারা নিঃস্ব এবং বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ ও ভারতের অন্যান্য রাজ্যে অবস্থান করছেন।
আমরা এবং যুক্ত্রাজ্যের লন্ডনের ‘মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন অভ বাংলাদেশ’ সরাসরি যুদ্ধের শিকার মানুষদের কাছে এ অর্থ পাঠিয়ে দেব।
১৫ নভেম্বর থেকে বাড়িতে বাড়িতে এই প্রচারণা ১ক সপ্তাহের জন্য চালানো হবে।
অনুগ্রহ করে আমাদেরকে এই অর্থ সংগ্রহ প্রচারণার অনুমতি দিয়ে পূর্ব বাংলার হতভাগ্য ও নিঃস্ব মানুষদেরকে সাহায্য করার সুযোগ দিয়ে বাধিত করবেন।
ধন্যবাদান্তে।
বিনীত নিবেদক
(ড. এ. এম. খান)
জেনারেল সেক্রেটারি
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অভ ব্রিটিশ কলাম্বিয়া
<৪,১৭১,৩৩৯>
অনুবাদকঃ সাফানুর সিফাত
শিরোনাম | সুত্র | তারিখ |
১৭১। ভ্যাঙ্কুভাবে প্রবাসী বাঙালী ও ফ্রেজার গ্রুপ প্রকাশিত ‘বায়াস’ পত্রিকার একটি আবেদন |
‘বায়াস’ খন্ড-২ সংখ্যা-৪ |
————— ১৯৭১ |
আপনারা যা করতে পারেন
১. একদম প্রাথমিক পর্যায়ে এই সংগ্রামের সত্যিকার প্রকৃতি সম্পর্কে নিজেদের এবং অন্যদের অবহিত করা অব্যাহত রাখতে পারেন।আপনারা দাবি করতে পারেন যে স্থানীয় গণমাধ্যম গুলো এর প্রকৃত কারনের গভীরে গিয়ে নিরপেক্ষ ভাবে রিপোর্ট করুক।গণমাধ্যম গুলর জন্য রিফিউজি ক্যাম্প, নৃশংস গণহত্যা, কলেরা মহামারির ওপর রিপোর্ট করা সহজ, যখন এই বিষয়টাকে উপেক্ষা করা হয় যে এসবই হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানি সরকারের একটি ইচ্ছাকৃত গণহত্যা কর্মসুচির কারনে। কদাচ এই বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে যে কানাডা এবং ইউ.এস. সরকার প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে এই সরকারকে সমর্থন করছে। আপনাদের পত্রিকায় লিখুন এবং এই সরকারের সাথে পশ্চিমাদের আপষের এই প্রচেষ্টার নিন্দা জানান।
২. এটা খুবই গুরুত্বপুর্ন যে আপনারা আপনাদের নিজেদের সচেতনতার মাধ্যমে ওই সকল ব্যাক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ওপর চাপ প্রয়োগ করুন যারা এই সংগ্রামের ফলাফলকে এবং মানুষের চিন্তা ভাবনাকে প্রভাবিত করতে পারে।এই পর্যায়ে আমরা আপনাদের কাছে অনুরোধ করছি যে, আপনারা আপনাদের সরকারের কাছে দাবি করুন, তারা যেন পশ্চিম পাকিস্তানের সকল সাহায্য ও সামরিক সরবরাহ বন্ধ রাখে এবং বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারকে স্বীকৃতি দেয়।
৩. গেরিলা আন্দলনের প্রবৃদ্ধিতে অবদান রেখে আমরা বাংলাদেশে চলমান সংগ্রামকে সাহায্য করতে পারি।এটা মানুষ এবং ভবিষ্যতের জন্য যুদ্ধ। উত্তর আমেরিকায় বাংলাদেশি এসোসিয়েশন আছে। ত্রাণ এবং চিঠিপত্র বি.সি. এর শাখায়(#১) পাঠানো যাবে।অথবা নিকটস্থ এই সংস্থা গুলর সাথে যোগাযোগ করুনঃ
১. বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব ব্রিটিশ কলাম্বিয়া,
আকাদিয়া টাওয়ার, #১৪০১
২৭২৫ মেলফা রোড, ভেনকুভার, বি.সি.
২. বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব কানাডা,
৩৫২০ লর্ন এভিন্যু, সুইট ৫, মন্ট্রিয়াল, কিউবেক।
৩. বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব কানাডা,
১১৭ কারটন স্টেট, টরোনট, ২০০, অন্টারিও।
৪. বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব সাস্কাচিওয়ান
১২২০ যুবিলি এভিন্যু, রেজিনা সাস্ক।
৫. বাংলাদেশ লীগ অব আমেরিকা ইনকর্পোরাট,
৫২৪৫, সো। কেনউড, শিকাগো, III ৬০৬১৫, ইউ.এস.এ.
৬. বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব নর্থ আমেরিকা
৭৫৯ ই. ১৮’শ স্টেট,
ব্রুকলিন, নিউ ইয়র্ক, এন.ওয়াই. ইউ.এস.এ.
<৪,১৭২,৩৪০-৩৪২>
অনুবাদকঃ সাফানুর সিফাত
শিরোনাম | সুত্র | তারিখ |
১৭২। বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব বৃটিশ কলম্বিয়ার একটি প্রতিবেদন | এসোসিয়েশন এর দলিল | নভেম্বর, ১৯৭১ |
বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব বৃটিশ কলম্বিয়া
৯০৫-৫৫০ ওয়েস্ট ১২’শ এভিন্যু
জয় বাংলা ভ্যাঙ্কুভার ৯. বি.সি. কানাডা
টেলিফোনঃ (৬০৪)৮৭৬-৮৪৫৩
হত্যাকান্ড ** গণহত্যা ** রক্তগঙা ** সন্ত্রাস
এবং এখন দুর্ভিক্ষঃ সব একটি খেলার অংশ
বাংলাদেশ ট্রাজেডি(পুর্ব পাকিস্তান)
যুদ্ধ, বন্যা এবং ঘুর্ণিঝড়ের কারনে সৃষ্ট ধ্বংস আর বিপর্যয়ের ফলস্বরুপ আগামী কয়েক মাসের মধ্যে পুর্ব বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের মধ্যে ১ থেকে ৩ কোটি মানুষ দুর্ভিক্ষের কবলে পরবে।পশ্চিম পাকিস্তানি মুখপাত্রের ক্রমাগত মৃদু নিশ্চয়তার বিপরীতে পরিস্থিতি ছিল প্রশ্নাতীত ভাবে হতাশাজনক এবং একটি বড় শোকাবহ ঘটনা এড়ানোর জন্য প্রয়োজন বৃহদাকার আন্তর্জাতিক ত্রাণ সহায়তা।জনগণকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য মজুত খাদ্য যত দিন চলবে, পরিস্থিতি স্বভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে সম্ভবত তার চেয়ে বেশি সময় লাগবে।যে বিষয় গুলো দুর্ভিক্ষের জন্য দায়ী, একটা পর্যায়ের পর আর সেগুলোকে পরিবর্তন করা যায় না।দ্রুত এবং শক্তিশালী আন্তর্জাতিক পদক্ষেপই হয়ত পুর্ব পাকিস্তানিদের একমাত্র প্রতিরোধ।
গত মার্চ থেকে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ মৌলিক অধিকারের জন্য সংগ্রাম এবং টিকে থাকার ভয়ানক লড়াইয়ে নেমেছে।
নিজের জনগণের ওপর ইতিহাসের সবচেয়ে নৃশংস রক্তগঙা বইয়ে দেয়ার পর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এখন তাদের অনাহারে মারার পরিকল্পনা করছেন।
১৯১০ সালের নভেম্বরে একটি ঘুর্ণিঝড় অনেক মানুষ জীবন নিয়েছিল। সেটা ছিল প্রাকৃতিক বিপর্যয়। ১৯৭১ সালের মার্চে পরিকল্পিত ভাবে এই অঞ্চলের যুবক, বুদ্ধিজীবী ও লাখো নির্দোষ ভুক্তভগীকে হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশে আর একটি দুর্যোগ আঘাত হানল। এবার অপরাধী ইয়াহিয়া খান।
আমরা, এই সাড়ে সাত কোটি বাংলাদেশি জনগণের পক্ষ থেকে আপনাদের কাছে আবেদন করছি, আপনারা আপনাদের সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করুন, তাদেরকে বলুন পাকিস্তানে সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য বিলম্বিত করতে এবং বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা করা থেকে সামরিক সরকারের জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে বিরত রাখতে তার বিরুদ্ধাচারন করতে।
দয়া করে অনুদান দিয়ে আমাদের বাংলাদেশ সপ্তাহকে সমর্থন করুন, যা কিনা একটি চাঁদা সংগ্রহ প্রচারনা(নভেম্বর ১৫-১৯)
<৪,১৭৩,৩৪৩-৩৪৬>
অনুবাদকঃ ফাহমিদা আক্তার বৃষ্টি
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৭৩। পচিশে মার্চের হত্যাযজ্ঞে ইন্দোনিশিয়া সরকার ও জনগণের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া এবং প্রচার অভিযান সম্পর্কে বাংলাদেশ সরকারকে লেখা চিঠি | প্রবাসী বাঙ্গগালিদের সংগঠন “আমরা” | ১৪’ই মে,১৯৭১ |
জাকার্তা ১৪/০৫/৭১
১) যশোর, খুলনা এবং চট্টগ্রামে হত্যালীলার প্রতিবেদন দিয়েছে এপি। ইন্দোনেশিয়ান অবজার্ভার, একটি প্রধান দৈনিক, প্রতিবেদন পেয়েছে। সেখানে বাঙালি বিহারি এবং সামরিক বাহিনী উভয়পক্ষই বাঙালিদের উপর নির্বিশেষে নারকীয়তা শুরু করেছিলো।
২) ঢাকার উপরও এখানে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। সেনা কার্যকলাপ বিভীষিকাময় হিসেবে দেখানো হয়েছে। পঁচিশে মার্চের পূর্বে এখানকার লোকজন আওয়ামী লীগের উপর হত্যাযজ্ঞের দোষারোপ বিশ্বাস করতে নারাজ। তারা আর্মিদের করা প্রতিবেদন থেকে নৃশংসতার যথেষ্ট প্রমাণ টের পেয়েছে।
৩) প্রত্যক্ষ অভিগমন এই সরকারের মনোভাব লক্ষণীয়ভাবে পুনর্গঠন করতে পারে।
৪) পাকিস্তান অপপ্রচারটিকে তীব্রতর করেছে। আমরা আমাদের সীমিত উপায়ে আমাদের নিজস্ব পন্থায় এটি মোকাবেকার চেষ্টা করছি। পাকিস্তানের অপপ্রচার কদাচিৎ জায়গা পাচ্ছে সংবাদে।
৫) পর্যবেক্ষকেরা এখানে একটি গুজব বিশ্বাস করে যে বাঙালিদেরকে ধীরে ধীরে বাইরের মিশন থেকে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে। তাদেরকে পরবর্তীতে একটি শিবিরে একত্রিত করা হবে আদালতের বিচারের সম্মুখীন করতে অথবা মৃত্যুদণ্ড দিতে। যদি সম্ভব হয়, বাঙালিদেরকে রক্ষা করতে এবং প্রয়োজনীয় সহায়তা দিতে বিজ্ঞপ্তি এবং রেডিওর মাধ্যমে বিভিন্ন সরকারের কাছে একটি আবেদন করা হতে পারে। বাঙালিদেরকে আরো সতর্ক থাকতে হবে ইসলামাবাদে বন্দী-শিবিরে ফিরে না যাবার ব্যাপারে।
৬) তিনটি জাহাজ চট্টগ্রামে গিয়েছিলো পূর্ব পাকিস্তানিদের জন্য জাপানি চাল নিয়ে। তাদেরকে করাচিতেই চালগুলো নামানোর জন্য পরিচালিত করা হয়েছিলো। জাহাজ মালিকেরা তা প্রত্যাখান করেছিলো এবং জাকার্তায় ফিরে এসেছিলো এবং চাল খালাস করেছিলো।
৭) কলকাতা থেকে প্রচারিত উপরাষ্ট্রপতির ভাষণ রেডিওতে শোনা যায়। যা ছিলো অনুপ্রেরণামূলক। বিশ্বাসঘাতকদের দেওয়া তার সতর্কতা আরো অনুপ্রেরণামূলক। পাকিস্তান বাঙলায় এই পরিস্থিতিতে বিশ্বাসঘাতকের ভাষান্তর ব্যবহারের চেষ্টা করে যাচ্ছে।
৮) আমাদের কার্যকলাপের উপর নজরদারি করা হয় এবং বাধাগ্রস্ত করা হয় আইপিএসিসি এর এম. এ. আজিজের মাধ্যমে। পাঞ্জাবদের সহযোগে তিনি এবং তার স্ত্রী আমাদের উদ্দেশ্যের বিরুদ্ধে মতামত সংগ্রহ করতে খুব সক্রিয়। এমনকি তিনি অপপ্রচার চালান যে মুজিব, ভাসানী, তাজউদ্দিন এবং তাদের সহযোগিরা সকলে বামপন্থী। বামপন্থিরা এই দেশে ঘৃণিত।
৯) খালিক ফখরুদ্দিন নামে এক পাঞ্জাবীর বাসায় আজিজ এক ফতেহ খানির আয়োজন করেছিলো এবং দোয়া করেছিলেন যেন বাঙালিরা আওয়ামী লীগের দ্বারা ভুল পথে পরিচালিত না হয়।
১০) পাক-মিশন দিল্লীর জনাব এইচ. আর. চৌধুরী এখানে পরামর্শদাতা ছিলেন। তিনি নৈতিকভাবে বিচলিত ছিলেন। বর্তমান সংকটে তার কার্যরীতি কোন শত্রু এখনো তাকে বিজড়িত করার চেষ্টা করে যাচ্ছে।
১১) তথ্যের জন্য এপির প্রতিবেদনের একটি প্রতিলিপি সংযুক্ত করা হলো। জাকার্তা পেপারও এটি সম্পূর্ণরূপে বহন করে।
১২) জয় বাঙলার প্রকাশনা জানতে পেরে খুব আনন্দিত। আমরা এখানে এটির ব্যবহার করবো। দয়া করে নিম্নলিখিত ঠিকানায় নিয়মিত একটি করে প্রতিলিপি পাঠাবেন। আমরা প্রতিলিপিগুলো ব্যাক্তিগতভাবে প্রচার করার চেষ্টা করবো।
জাকার্তা-ইন্দোনেশিয়া
১) বাংলাদেশের মন্ত্রীসভা সম্পর্কে তথ্য ও অবগতির জন্য সংবাদপত্রের এই অংশগুলো জাকার্তার একটি প্রধান দৈনিকের। পরবর্তীতে আরো তথ্য পাঠানো হবে। ইন্দোনেশিয়ার সব পত্রিকার ঘটনাগুলো।
ক) ১৫ ই এপ্রিলে জাকার্তা টাইমসের সম্পাদকীয় “পূর্ব পাকিস্তানের জটিল সমস্যা”।
খ) ১৫ ই এপ্রিলে জাকার্তা টাইমসের প্রবন্ধ “ইসলাম কি মৃত?”
গ) ৬ ই এপ্রিল জাকার্তা টাইমসের সম্পাদকীয় “পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা”।
ঘ) ২০ শে এপ্রিল জাকার্তা টাইমসের সম্পাদকীয় “বাংলাদেশ”।
ঙ) ইন্দোনেশিয়ান অবজার্ভার (জাতীয়তাবাদী পত্রিকা) এর সম্পাদকীয় “পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় সহানুভূতি”।
২) অনুপ্রেরণামূলক বক্তৃতা। সংবাদ সম্মেলন এবং বৈঠক যোদ্ধা ও জনগণের মনোবল বাড়াবে। দুঃখজনক, আমরা নেতাদের কাছ থেকে খুবই কম শুনি।
৩) তরুণ শক্তিকে সংগঠিত ও সুসজ্জিত করুন আক্রমণাত্মক যুদ্ধের জন্য।
৪) বাঙালি এবং দেশের বাইরে অবস্থানরত বা কর্মরত সমর্থকদের কাছ থেকে অনুদান সংগ্রহের ব্যবস্থা করুন। এতে অবশ্যই সন্তোষজনক সাড়া পাওয়া যাবে। সংবাদের মাধ্যমে ঘোষণা করুন কোথায় অনুদান জমা দিতে হবে।
৫) চিঠি/ টেলিগ্রাফ/ প্রতিনিধিদের মাধ্যমে রাজ্যের সকল প্রধানদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করুন। নেপথ্য দিয়ে আগ্রাসনকারীদের অভিযুক্ত করুন। দয়া করে ইন্দোনেশিয়াকে বাদ দিবেন না, যদিও এটা সহানুভূতিশীল নয়।
৬) অত্যধিক প্রচারণা জরুরী। আমরা আমাদের মতো করে যাচ্ছি।
৭) যে কোন সূত্র থেকে অস্ত্র এবং গোলাবারুদের ব্যবস্থা করুন।
৮) সাহায্যের জন্য প্রতিদিন বিশ্ব সংস্থাগুলোর নিকট আবেদন করুন চিঠি অথবা সংবাদের মাধ্যমে এবং তাদেরকে অনুরোধ করুন দুর্ভোগের বিশালতা দেখে যেতে।
৯) নেতাদের উচিৎ বার বার বেশি করে যোদ্ধাদের সাথে দেখা করা এবং তাদেরকে জয়ের আশ্বাস দেওা। এটা অত্যাবশ্যক।
১০) নুরুল আমিন, হামিদুল হক, সবুর ও অন্যান্যদের বিশ্বাসঘাতক হিসেবে ঘোশণা। তারা আদালতের সম্মুখীন হবে এবং বিশ্বাসঘাতকতার জন্য তাদের উপযুক্ত সাজা পাবে ।
১১) সর্ব প্রকারে এবং ত্যাগের মাধ্যমে ঐক্য রক্ষা করতে হবে, কোনরকম দলীয় সংযোগের বিবেচনা ছাড়া।
প্রাপক,
জনাব হুসাইন আলী
বাংলাদেশ মিশন,
৯, সার্কাস এভিনিউ,
কলকাতা-১৭
১) সংবাদ কর্তিতাংশ পাঠাবেন। ইতোমধ্যেই বিমানযোগে পাঠানো হয়েছে।
২) যোদ্ধা এবং জনগণের মনোবল বাড়াতে বিবৃতি জারি হয়েছে এবং সংবাদ সম্মেলন হয়েছে।
৩) আক্রমণাত্মক যুদ্ধের জন্য যুবশক্তি সংগঠন এবং সুসজ্জিতকরণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
৪) বিদেশের ব্যক্তিবর্গ এবং সংগঠনগুলোর নিকট সাহায্য এবং অনুদানের জন্য ইতোমধ্যেই একটি আবেদন জারি করা হয়েছে- বৈদেশিক ব্যাংকগুলোতে হিসাব নাম্বার কখন এবং কীভাবে গঠিত হয়েছে।
৫) ইন্দোনেশিয়াসহ রাজ্যের সকল প্রধানেরা আনুষ্ঠানিকভাবে এগিয়ে এসেছে।
৬) বাংলাদেশের ভিতরের এবং বাইরের সাহায্যকারীদের কখনো কখনো সতর্ক করা হচ্ছে।
৭) অস্ত্র এবং গোলাবারুদের জন্য প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে।
১) প্রচারাভিযান তরান্বিত করা প্রয়োজন। নেতাদের নীরবতা সতর্কতা এবং হতাশা সৃষ্টি করে।
২) দলগুলোর মধ্যে অনৈক্যের খবর পাওয়া গেছে। যেকোন মূল্যে ঐক্য রক্ষা করতে হবে।
৩) ইন্দোনেশিয়ান সংবাদ মাধ্যমগুলা এখন খুব একটা খবর ছাপছেনা।স্থানীয় পাকিস্তানিরা (পাঞ্জাবীরা) বিশাল টাকায় তাদের অধিকাংশদের কিনে ফেলেছে। সরকারি মনোভাব বাংলাদেশের জন্য সহায়ক নয়। উলামাদের নাম করে কিছু মিথ্যা প্রচার করা হচ্ছে রেডিও পাকিস্তানের মাধ্যমে। ইন্দোনেশিয়া পাকিস্তানকে আদতে সাহায্য করে বলে মনে হয় না। ছিনতাইয়ের উপর তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশের পর, পাকিস্তান রাষ্ট্রদূত বৈদেশিক মন্ত্রীর নিকট উপহাসের পাত্র হন। এটি গোপনভাবে জানা যায়।
৪) এখানে জনগণের মতামত এই যে পাকিস্তানের ঐক্য চিরতরে ভেঙে গেছে। বাঙালি সংগ্রামীদের জন্য যুদ্ধ আর কয়েক সপ্তাহ চলবে।
৫) এই সরকারের প্রত্যক্ষ অভিগমন হস্তক্ষেপ না করার সম্মিলিত মনোভাব দূর করতে পারে। যদি সম্ভব হয়, দয়া করে তাড়াতাড়ি এটি করার চেষ্টা করুন।
৬) কিছু প্রধান বৈদেশিক পত্রিকা তাদের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে অনুপ্রেরণামূলক প্রবন্ধ প্রচার করে যাচ্ছে। এমনকি তাদের মধ্যে কিছু কিছু ইতিহাস অনুসন্ধান করে এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিবরণ দেয় যা শেষ পর্যন্ত বর্তমান ঘটনার জন্ম দেয়। জনগণ বুঝতে পেরেছে এবং সহানুভূতি আছে।
৭) বিশ্বাসঘাতকেরা সর্বত্রই। এখানে একজন। এম. এ. আজিজ, আইপেকের সেক্রেটারি জেনারেল। যদিও একজন বাঙালি, একজন বালাই বটে। সে বাঙালিদের বিরুদ্ধে গোয়েন্দাগিরি করছে এবং শুভান্যুধ্যায়ী ও পৃষ্ঠপোষকদের প্রতারণা করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমাদের কার্যে সে একজন অবিশ্বাসী। দয়া করে ভবিষ্যৎ কর্মপ্রক্রিয়ার জন্য এটি চিহ্নিত করে রাখুন।
৮) অর্থ সরবরাহের আয়োজন জানতে পারলে খুশি হবো। আমরা আমাদের অনুদান দিতে প্রস্তুত।
জনাব হুসাইন আলী,
বাংলাদেশ মিশন, ৯ সার্কাস এভিনিউ,
কলকাতা-১৭
______________________
<৪,১৭৪,৩৪৭>
অনুবাদকঃ ফাহমিদা আক্তার বৃষ্টি
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৭৪। আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবক ব্রিগেডের প্রাক্তন প্রধান কর্তৃক বাংলাদেশের পক্ষে যুদ্ধ করার ইচ্ছা প্রকাশ | ব্যাক্তিগত চিঠিপত্র | ১৫’ই মে,১৯৭১ |
পিয়াসাংগান লামা ১১১/৩৯, জাতিনেগারা, জাকার্তা-ইন্দোনেশিয়া
মে ১৫,১৯৭১
প্রিয় জনাব হুসাইন আলী,
আমি নোয়াখালী জেলায় জন্মগ্রহণ করেছি এবং ব্রিটিশ ভারত সেনাবাহিনীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যোগদান করেছিলাম। ১৯৪৫ সালে আমি ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাথে ইন্দোনেশিয়া আসি। আমি ইন্দোনেশিয়াতে স্বাধীনতা সংগ্রামের আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবক সৈন্যদলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলাম। আমি তখন থেকেই ইন্দোনেশিয়াতে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছি এবং বর্তমানে একজন বৃত্তিভোগী লোক।
আপনি যেহেতু ইন্দোনেশিয়ান স্বাধীনতার মর্ম উপলব্ধি করতে পারেন, আমাদের গেরিলা যুদ্ধবিষয়ক বিশেষজ্ঞ আছে এবং এখনো আমার কাছে এই বিষয়ক ২০০০ কর্মিবৃন্দ আছে।
আমি তবুও এই ধারণায় ছিলাম যে এই অনুশোচনীয় হত্যার শেষ হবে এবং চূড়ান্ত নিষ্পত্তিতে এই সমস্যার একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান একটি বা অন্য উপায়ে আসবে । কিন্তু এটি মনে হচ্ছে যে পশ্চিম পাকিস্তানিরা আন্তর্জাতিক মতবাদ ছাড়া এই হত্যাকাণ্ড বন্ধ করবে না।
আমার অভিপ্রায় যে আমি আমার ২০০০ কর্মিবৃন্দসহ বাঙলায় ছেড়ে আসা আমার আত্মীয়স্বজন, যারা এখন শোচনীয়ভাবে দুর্ভোগ পোহাচ্ছে এবং নির্বিচারে খুন হচ্ছে, তাদের মুক্ত করতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে পারতাম। আমি ইন্দোনেশিয়ার গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে একটি স্বেচ্ছাসেবক সৈন্যদল গঠনের জন্য অনুমতি চাইতে পারি কিন্তু তার অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে সে এটির আর্থিক যোগান দিতে পারবে না। আপনাদের সংগ্রামে একটি সক্রিয় অংশগ্রহণের জন্য আমার প্রস্তাব দৃঢ় থাকবে, যদি সৈন্যদের ব্যয়ভার বহন এবং বস্তুগত সাহায্য পাওয়া সম্ভব হয়।
দয়া করে আমার সম্মান এবং শুভ কামনা গ্রহণ করুন বাংলাদেশ সরকার এবং তার জনগণের জন্য এবং আমাকে জানান যদি আমি আমার মাতৃভূমির কোন কাজে বা ব্যবহারে আসতে পারি। সকল সহানুভূতি এবং সমর্থন।
আপনার অনুগত,
প্রাক্তন মেজর আব্দুল মতিন
প্রাক্তন প্রধান কমান্ডার,
আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবক সৈন্যদল।
<৪,১৭৫,৩৪৮-৩৫১>
অনুবাদকঃ জয়ন্ত সেন আবীর
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৭৫। প্রবাসী বাঙালীদের সংগঠন ‘আমরা’গোষ্ঠী কর্তৃক বাংলাদেশ সরকারকে প্রেরিত ইন্দোনেশীয় প্রচার মাধ্যমের প্রতিক্রিয়ার সংক্ষিপ্ত বিবরণী | ‘আমরা’ | ২১ মে, ১৯৭১ |
অনুবাদকঃ
জাকার্তা ২১/৫/১৯৭১
এপি এর মে মাসের ২ তারিখের প্রতিবেদন দৈনিক ‘ইন্দোনেশিয়ানঅবজারভার’এ১৫তারিখেপ্রকাশিতহয়।এই প্রতিবেদনটির চুম্বক অংশগুলো হলঃ
ক) মার্চের ২৫ তারিখে গৃহযুদ্ধ শুরু হবার পর থেকে ৪ লাখেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
খ) অনেক এলাকার রেল ও সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
গ) মাত্র ৫৫টি পাটকল কেবল ১৫% জনশক্তি নিয়ে কাজ করছে।
ঘ) লাখ লাখ মানুষ অনাহারের সম্মুখীন।
ঙ) ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে যে ইয়াহিয়া এই বছরের শেষ পর্যন্ত ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারবে না।
চ) সেনাবাহিনী কর্তৃক দোকান লুটের ঘটনা ঘটেছে।
ছ) পশ্চিম পাকিস্তানের এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়ীর মতানুসারে, তাদের উৎপাদিতপ্রায় ৬০ রকম দ্রব্য ও সেবারএক বিরাট বাজার হাতছাড়া হয়ে গেছে।
জ) পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থা টালমাটাল হয়ে পড়েছে।
২) রাজনৈতিক এবং সামাজিকভাবে গণ্যমাণ্য ব্যক্তিদের একটি তালিকা নিচে দেয়া হল। বর্তমান সংকটের পেছনের কারণ সম্বলিত কাগজপত্র হাতে পেলে হয়তো তারা আমাদের সাহায্য করবেন। তারা নীতির পরিবর্তনেও প্রভাব রাখতে পারেন।
৩) পূর্বের অনুরোধ মোতাবেক ‘জয় বাংলা’ এর একটি কপি নিয়মিতভাবে আমাদের ঠিকানা বরাবর পাঠানো যেতে পারে। আমরা এর সর্বোচ্চ ব্যবহার করার ক্ষেত্রে আশাবাদী। সম্ভব হলে বিতরণের জন্য আরো কিছু কপি রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের কাছে পাঠানো যেতে পারে।
৪) গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকাগুলো লক্ষণীয়ভাবে আবারো প্রতিবেদন প্রকাশ করা শুরু করেছে। সরকার নিশ্চুপ, কিন্তু নৃশংসতা যে ঘটেছে সে ব্যাপারে তাদের কোনো সন্দেহ নেই। সরকার পাকিস্তানী প্রচারণায় পুরোপুরি বিশ্বাসী নয়। এটা নিশ্চিত যে সরকার পাকিস্তানকে কোনো উপকরণ দিয়ে সাহায্য করবে না। এরূপ বহু অনুরোধে তারা কর্ণপাত করে নি।
৫) আইপিইসিসি এর জনাব এম. এ. আজিজের স্ত্রী, জনাবা এম. এ. আজিজ বাংলায় লেখা চিঠিপত্রের যাচাই-বাছাই কাজে নিযুক্ত আছেন। খবর পাওয়া গেছে কিছু চিঠি তাদের ঠিকানায় পৌঁছেনি।
৬) এস ও পরীক্ষায় তার সাফল্য ও মনোনয়ন পাওয়া উদযাপন করতে জনাদ রাং এলাহী (একজন পাঞ্জাবী) স্থানীয় পাকিস্তানীদের (বেশিরভাগই পাঞ্জাবী) নিয়ে এক ডিনার অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। সেখানে জনাব আজিজ ১৯৫৪ সালে ফজলুল হক, সোহরাওয়ার্দী এবং ভাসানী কর্তৃক স্বায়ত্বশাসন লাভের লক্ষ্যে নেয়া চেষ্টাসমূহের ব্যর্থতার কথা উল্লেখ করেন। জনাব সোহরাওয়ার্দীর গ্রেপ্তার বিষয়ে তিনি বলেন “সেখানে কিছু একটা ছিল”। “ভাসানী সবসময়েই এক ধ্বংসাত্মক শক্তি”। পূর্ব পাকিস্তানে সম্পূর্ণ শান্তি বিরাজ করছে। কিছু অতিথির মনে এসকল মন্তব্য এক তিক্ত অনুভূতি ছড়ায়।
৭) ‘ফার ইস্টার্ণ ইকোনমিক রিভিউ’ তার ১৯ নম্বর সংখ্যায় ‘যুদ্ধের কথামালা’ শীর্ষক এক লেখনী প্রকাশ করেছে। এই লেখাটা ছিল আনন্দ ও হতাশার এক সংমিশ্রণ। এতে বলা হয় বর্তমান পরিস্থিতিতে নুরুল আমিন ক্ষমতা গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। ইয়াহিয়া আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সদস্যদের নিজের পক্ষে টানার ব্যাপার আশাবাদী। তারা যদি শেখ মুজিবের পক্ষ ত্যাগ করে আইনসভায় স্বতন্ত্র হিসেবে যোগদান করে তবে তাদের স্বায়ত্বশাসনের নিশ্চয়তা দেয়া হবে। পরিদর্শকগণ এই চালের সাফল্য সম্পর্কে সন্দিহান। এতে আরো বলা হয় প্রদেশটি বাস্তবিকপক্ষে সেনাবাহিনী দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। মুক্তিবাহিনী নিষ্ক্রিয়।
৮) সরকারী সংবাদ সংস্থা ‘অন্তরা’, ওয়াশিংটন থেকে রয়টার এর উদ্ধৃতি দিয়ে ১৯/৫/৭১ এ জানায় যে আমেরিকা থেকে অর্থনৈতিক সাহায্য লাভের ক্ষেত্রে জনাব এম. এম. আহমেদ তেমন অগ্রসর হতে পারেন নি। পরিস্থিতি পর্যালোচনার পূর্বে আমেরিকা কোনোরূপ প্রতিশ্রুতি দিতে নারাজ। ইয়াহিয়া এর আগে ইউ. থান্ট এর আবেদন অগ্রাহ্য করলেও পাকিস্তান বাংলার জন্য ত্রাণ সাহায্য অবশেষে স্বীকার করেছে। অনুমান করা যায় এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য তারা চাপের মধ্যে ছিল।
৯) স্থানীয় ভাষার পত্রিকাগুলো এখনো মুক্তি বাহিনীর একত্রিকরণ, পুনসংগঠন এবং ট্রেনিং এর উৎসাহব্যঞ্জক খবর প্রকাশ করে যাচ্ছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারা ছবিও দেয়।
১০) সরাসরি অগ্রসর হলে ইন্দোনেশীয় সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদান এবং সাহায্য প্রদানের বিষয়টি ভেবে দেখতে পারে। এক সংবর্ধনায় আদাম মালিক এই মন্তব্য করেন।
১১) বিশিষ্ট সাংবাদিক এবং পত্রিকা মালিকদের পাকিস্তানী রাষ্ট্রদূত এক জাঁকজমকপূর্ণ ডিনার অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানান। পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কে রক্ষণশীল মনোভাব ধারণের জন্য তাদের অনুরোধ জানান হয়। এই প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। সাবেক তথ্যমন্ত্রী বি.এম ডিয়া এই ডিনার অনুষ্ঠানে যোগদান করেন কিন্তু তার পত্রিকা ইন্দোনেশিয়ান অবজারভার এর পরের দিনই পূর্ব পাকিস্তান বিষয়ে এপি এর প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে।
১২)একটি স্থানীয় ভাষার পত্রিকা পিপলস পার্টির অভ্যন্তরে বড়সড় ফাটল ধরার খবর প্রকাশ করেছে। ভুট্টোর বিরুদ্ধে কথা বলায় বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট নেতাকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। প্রতিবেদনে আরো বলা হয় যে কঠিন অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং সম্ভাব্য মূল্যস্ফীতিই সেখানকারব্যবসায়ী সমাজের বর্তমান প্রধান চিন্তা।
১৩) এপির প্রতিবেদনটি সাথে সংযুক্ত করা হল। এরূপ প্রতিবেদন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। এমন প্রতিবেদনের মোকাবেলা করা সম্ভব এবং করা উচিত।
‘আমরা’
জালান পেমান্ডআংগান ১১/১০
গুন. সাহারি. আনতজল ডিপান এ১পি
জাকার্তা-উলারা
ইন্দোনেশিয়ান অবজারভার; মে ১৯
সিঙ্গাপুর, মে ১৭ (এপি)
২৩ বছর ধরে মুসলিম ধর্মে বিশ্বাস পাকিস্তানের দুই দূরবর্তী অংশকে সংযুক্ত রেখেছে। এখন সেখানকার নেতারা বুঝতে পারছেন যে একত্রিত থাকতে চাইলে তাদের আরো মজবুত গাঁথুনি দরকার হবে।
মার্চের ২৬ তারিখে পূর্ব পাকিস্তানে শুরু হওয়া এক ভয়ানক গৃহযুদ্ধ এখন পর্যন্ত সম্ভবত ৫ লাখ লোকের প্রাণহানি ঘটেছে, অত্যাচারিত হয়েছে আরো অনেকে। তারা ভিন্ন ভাষায় কথা বলে বা ভিন্ন অঞ্চলের মানুষ, কেবলমাত্র এ কারণেই এই নৃশংসতাসংঘটিত হয়।
স্বাধীন পূর্ব বাংলার পক্ষাবলম্বন করা বাঙালিদের হাতে স্বামী, মা, সন্তান হত্যার ঘটনা অবাঙালিরা সহজে ভুলবে না। আর বাঙালিরা সেনাবাহিনীর ভয়ানক এবং ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ দীর্ঘদিন মনে রাখবে।
পাকিস্তানের পূর্ব অংশের অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে গেছে। পুনর্নির্মাণের জন্য পশ্চিম অংশকেই এগিয়ে আসতে হবে। দুই অংশের মাঝে দূরত্ব ১,০০০ মাইল বিমান পথে যা অতিক্রম করতে সময় লাগে ৬ ঘণ্টা, কিন্তু ভারত তার উপর দিয়ে বিমান চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে।
ব্রিটিশ ভারত ভাগ হয়ে ভারত এবং পাকিস্তান হবার সময় পূর্ব পাকিস্তানে থেকে যাওয়া ১২ শতাংশ হিন্দুর উপরেই এই অংশের অর্থনৈতিক অবকাঠামো প্রবলভাবে নির্ভরশীল ছিল।
এখানে বেশ কয়েক লাখ বিহারীও রয়েছে। এরা ছিল দেশভাগের সময় ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল, বিশেষ করে বিহার থেকে আসা মুসলিম অধিবাসী। আরো ছিল গুরুত্বপূর্ণ পশ্চিম পাকিস্তানী ব্যবসায়ী ও ম্যানেজারগণ।
সেনাবাহিনীর হাতে অসংখ্য হিন্দুর মৃত্যু ঘটেছে। হাজার হাজার হিন্দু হয় ভারতে অথবা প্রদেশটির দুর্গম অঞ্চলে পালিয়ে গেছে। একসময়কার ছবির মত সুন্দরঢাকার হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে অগ্নিসংযোগ করে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে বাঙালিদের হাতে বিহারী ও পশ্চিম পাকিস্তানীদের হত্যার ঘটনা ঘটেছে। বেঁচে যাওয়া অনেকেই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পালিয়ে গেছে।
উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হল বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই হত্যার কোনো সাম্প্রদায়িক ভিত্তি ছিল না। প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ অনুযায়ী, নবী মুহাম্মদ (সাঃ) এর শিক্ষাকে তোয়াক্কা না করে মসজিদের ভেতরেই বাঙালি মুসলিমদের হাতে বিহারী মুসলিমদের হত্যা করা হয়েছে।
প্রতিশোধপরায়ণ পাঞ্জাবী এবং পাঠান মুসলিম সৈনিকেরাও বদলা নেবার সময় কে কোন ধর্মে বিশ্বাসী তা যাচাই করার প্রয়োজন বোধ করে নি।
পাকিস্তানের জাতির পিতা, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর দেয়া তত্ত্ব অনুযায়ী ভৌগলিক এবং জাতিগত বিশাল ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও ইসলামে বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে পাকিস্তান একটি জাতি হিসেবে টিকে থাকবে।
পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সকল সরকারী দপ্তরের দেয়ালেই এখনো জিন্নাহর ছবি ঝুলতে দেখা যায়। কিন্তু অনাগ্রহী নেতৃবৃন্দ এখন বুঝতে পারছেন যে জিন্নাহর দেয়া ধারণায় পরিবর্তন আনা অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে। তবে সমস্যাটা হচ্ছে কেউই জানেনা সেটা কিভাবে সম্ভব।
বাংলাদেশ বা বাংলা রাষ্ট্রের সুসময়কালীন সংক্ষিপ্ত অবকাশে বাঙালি মুক্তি বাহিনীর মেজর এম এ ওসমান বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন “২৩বছরধরেপশ্চিম পাকিস্তান আমাদের শোষণ করেনিজেরা উন্নত হয়েছে”।
বিদেশী অর্থনীতিবিদদের মতে যেখানেমোট বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ৬৫ শতাংশেরও বেশি আসতোপূর্ব পাকিস্তান থেকে, সেখানে বৈদেশিক সাহায্যের ৬০-৭০ শতাংশই ব্যয় হত পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নে।
শুল্ক নির্ধারণ এবং অন্যান্য নীতির ক্ষেত্রেও পশ্চিমাদের প্রাধান্য দেয়া হত। যদিও তাদের উৎপাদিত কৃষিজ ও শিল্পজাত পণ্য পূর্বাংশের দিকে চাপিয়ে দেয়া হত যেখানে দেশের মোট জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ বসবাস করে।
পশ্চিমের কেউ কেউ আস্তে আস্তে পূর্ব থেকে সরে এসে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে যাবার পক্ষপাতী। কিন্তু সামরিক সরকারের মাধ্যমে যেকোনো মূল্যে অখণ্ড পাকিস্তান রক্ষা করার মনোভাবের সামনে এই প্রক্রিয়া ফলপ্রসূ হবার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।
অর্থনৈতিক এবং মানবিক দিক দিয়ে ভয়াবহ এই ক্ষয়ক্ষতি সামনেও একই হারে চলবে বলেই মনে হচ্ছে। বাঙালিরা এখন তাদের পোশাকে পাকিস্তানী পতাকা লাগায় এবং বাড়ির ছাদে সে পতাকা উড়ায়, কিন্তু তা শুধুই নিরাপত্তা লাভের জন্য।
একটি শহরে একজন প্রতিবেদককে একজন ছাত্র বলেন “দেখুন সেনাবাহিনী কী করেছে”। তার চোখে ছিল গভীর বিতৃষ্ণা। এরপর একজন কর্মকর্তা এগিয়ে এলে ছাত্রটি হেসে তাকে স্বাগত জানায় এবং দেশপ্রেমিক কিছু বুলি ছুঁড়ে দেয়।
এরূপ প্রতিক্রিয়া এই ভগ্ন, পরাজিত প্রদেশের সর্বত্রই দেখতে পাওয়া যায়। নিজেদের পরিবারের ভরণপোষণের জন্য বাঙালিদের একসময় কাজে ফিরতেই হবে। তারা খুবই খারাপভাবে পরাজিত হয়েছে এবং সশস্ত্র সংগ্রামের তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
কিন্তু পাকিস্তান পুনর্গঠন করতে এই অনিচ্ছুক সাহায্যের চেয়েও আরো বেশি কিছু প্রয়োজন। যুদ্ধাবস্থার আগেও এটি ছিল অর্থনৈতিক দুর্দশা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে আক্রান্ত একটি দেশ।
মেনে নেবার বা সহ্য করবার বিষয়টি আসলে আবেগের। সামরিক শাসকেরা তাদের গোপনীয়তার জাল ব্যবহার করে পূর্ব পাকিস্তানে চলা সবরকম দুষ্কর্মের খবর পশ্চিম অঞ্চলে পৌঁছা থেকে বিরত রেখেছে।
শেষ পর্যন্ত সত্য অপর পাশের মানুষের কাছে পৌঁছাবেই।
চোখের সামনের বিপদগুলোর মাঝে একটি হল খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা ভেঙ্গে গেছে আর ত্রাণ কার্যক্রমও বাধাগ্রস্ত। কিছু বিদেশী পর্যবেক্ষকের মতে এরা মিলিতভাবে এই গ্রীষ্মে একসর্বনাশা মহাদুর্ভিক্ষের জন্ম দিতে পারে।
আরেকটি ভয় হল পাটের ক্রেতারা বিশ্বের অন্যান্য স্থিতিশীল অঞ্চল থেকে অন্য কোনো প্রকার আঁশ কেনার দিকে সরে যেতে পারেন। বিশ্বের মোট পাট উৎপাদনের ৮০ শতাংশ পূর্ব পাকিস্তানে উৎপাদিত হয়, কিন্তু রপ্তানিকারকেরা আশংকা প্রকাশ করেন যে সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়াতে এরই মধ্যে ক্রেতারা নতুন কোনো বাজারের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠবেন।
এমন হলে তা পূর্বের অর্থনীতির প্রতি এক চরম আঘাত হিসেবে পরিগণিত হবে এবং পশ্চিমের কাছে একে কম আকর্ষনীয় হিসেবে তুলে ধরবে।
“পরবর্তীতে কী হবে তা এখনই বলা যাবে না” – অর্থনীতি এবং রাজনীতি দুই সম্বন্ধেই ওয়াকিবহাল এক বিদেশীর অভিমত, “তবে এটুকু বলা যায় যে পূর্ব এবং পশ্চিমের মাঝে কোনোকিছুই আর আগের মত থাকবে না”।
<৪,১৭৬,৩৫২-৩৫৩>
অনুবাদকঃ সজীব কুমার সাহা, জেসিকা গুলশান তোড়া
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৭৬। পাকিস্তান দূতাবাসের বাঙ্গালী কর্মচারীর কলকাতা গমন সক্রান্ত চিঠি | বাংলাদেশ সরকার | ২৬শে মে এবং ১ জুন ,১৯৭১ |
IPEC জাকার্তার জনাব সানাউল্লাহর লিখিত চিঠির সারাংশ
১. জনার সানাউল্লাহ M/o Finance এর একজন অভিঞ্জ বাঙ্গালি শ্রুতিলেখক , ১৯৬৭ সাল থেকে জাকার্তায় IPEC এর প্রতিনিধিত্ব করছে । তার জীবন বৃত্তান্ত সংযুক্ত করা হল ।
২.সে মনে করে যে, যহেতু তিনি বাঙ্গালী এবং আমাদের ব্যাপারে সহানুভূতিশীল , তাকে পশ্চিম পাকিস্তানে স্থানান্তর করা হবে যদিও যারা IPEC তে তার পরে যোগদান করেছেন , এবং এটা অব্যাহত আছে ।
৩. তিনি ছুটির জন্য আবেদন করেছিলেঙ্কিন্তু এটি ২৫শে মার্চ তারিখে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে । যদি তিনি অতিসত্বর HQrs এ যোগদান না করেন তবে তার ভয়ানক পরিনতী হবে বলে হুমকি দেয়া হচ্ছে । তাকে গুপ্ত হুমকি দিয়ে বলা হয়েছে যে তাকে ফিরে যাওয়ার জন্য আইন মন্ত্রনালয়ের কতৃপক্ষের নিকট হস্তান্তর করা হবে ।
৪. সে তার ভাড়া প্রদান করছে কিন্তু সে ২ মাস ধরে তার বেতন পাচ্ছে না ।
৫. তিনি রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য প্রাক্তন মন্ত্রীসহ বিশিষ্ট ব্যাক্তির সরনাপন্ন হয়েছিলেন । কিন্তু ইন্দোনেশিয়ার সরকারের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক আশ্রয় পাবার প্রত্যাশা ক্ষীন । যাই হোক না কেন , তাকে বলা হয়েছে যে , তিনি জাকার্তায় থাকতে পারেন । তিনি জানতে চেয়েছেন যে , যদি পাকিস্তান সরকার জোর করে তাকে বিতাড়িত করতে চায় , তাহলে ইন্দোনেশিয়া সরকারের পদক্ষেপ কি হবে ? তাকে বলা হয়েছে যে , পরিস্থিতি অনুযায়ী পদক্ষেপ নেয়া হবে। তিনি সন্মানের সহিত একটি শ্রেণীগত নিশ্চয়তা পেতে ব্যার্থ হয়েছেন । তা সত্বেও তিনি জাকার্তায় থাকবেন।
৬. তার লিখিত ৫ পৃষ্ঠার পত্রের প্রথমাংশে , তিনি বাঙ্গালিদের উপর পশ্চিম পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত এবং অন্যান্য পশ্চিমাদের দারা সংঘটিত অবিচারের বিশদ বিবরন দিয়েছেন । তিনি জাকার্তায় বাঙ্গালিদের বিপরীত আনুগত্যেরও বিবরণ দিয়েছেন ।
তার মতে , সেখানে ২২ জন কর্মচারীর মাঝে ৯ জন বাঙ্গালী কর্মচারী রয়েছে । তার বর্ণনা অনুযায়ী ২-১ জন বাঙ্গালী ছাড়া সকলের নিজেদের প্রকাশ্যে চিহ্নিত করতে অনিচ্ছুক ।
৮. তিনি জানতে চান এখন তিনি কি করবেন এবং বাংলাদেশ সরকার তাকে কীভাবে সহায়তা করবে । তিনি আশংকা করছে নিকট ভবিষ্যতে অন্যান্য বাঙ্গালীরাও একই সমস্যার সন্মূখীন হবেন যা তিনি এখন সন্মুখীন হচ্ছেন ।
৯. তিনি ন্যায় প্রতিষ্ঠার উপর জোর দিয়ে তার পত্র শেষ করেছেন এবং আমাদের সকলকে স্রষ্টার উপর বিশ্বাষ রাখতে বলেছেন ।
S d/-
PA to HOM
26.5.71
জনাব সানাউল্লাহ সাহেব,
আপনার ১৩ই মে তারিখের জনাব হোসেন আলী সাহেবের কাছে লিখিত পত্র পেলাম। ওখানে আপনার কাজের জন্য তিনি সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। আপনার এখানে আসার বিষয়ে সকল দিক বিবেচনা করে জানানো হচ্ছে যে, একজন স্টেনোগ্রাফারের পক্ষে এখানে কর্মের ব্যবস্থা করা হয়ত খুব কঠিন হবেনা। বাংলাদেশ সরকার আপনার কর্মব্যবস্থা করে দিতে পারবেন বলে আশা করা যায়। তবে প্রশ্ন হলো বাসস্থানের। বাসস্থানের সমস্যা একটা আন্তর্জাতিক সমস্যা এবং কলকাতা তার কোন ব্যতিক্রম নয়। তদপুরি বাংলাদেশ থেকে লোক চলে আসায় সমস্যা আরও তীব্রভাবে দেখা দিয়েছে। আপনাকে নিজ চেষ্টায় বাসস্থানের সন্ধান করে নিতে হতে পারে। এ সমস্ত বিবেচনা করে যদি আপনি এখানে চলে আসা মনস্থ করেন,তখন আমাদেরকে জানাবেন। যতদিন ওখানে থেকে বাংলাদেশের জন্য কাজ করতে পারেন তার চেষ্টা করবেন এবং যদি নিতান্তই আপনাকে এখানে আসতে হয় তাহলে টি-এ ও ডি-এ নিয়ে নেবেন। একথা জানিয়েছেন মিঃ হোসেন আলী সাহেব।
পৃথকভাবে আপনাকে আমাদের রিলিজ, পুস্তিকা ইত্যাদি পাঠানো হলো।
শুভেচ্ছান্তে-
(এম. মকসুদ আলী)
<৪,১৭৭,৩৫৪-৩৫৫>
অনুবাদকঃ মুশাররাত আলম মৌ
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৭৭। প্রবাসী বাঙালিদের তৎপরতার উপর ভিত্তি করে “আমরা” গোষ্ঠী কর্তৃক প্রেরিত একটি প্রতিবেদন | “আমরা” | ১৩ জুন, ১৯৭১ |
জাকার্তা
১৩-৬-৭১
১। শরনার্থী সমস্যা নিয়ে ইউ থ এর মতামত এবং তার সহায়তার আবেদন গণমাধ্যমে ব্যাপক ভাবে প্রচারিত হয়েছে।রেডিও এবং টিভি এই কর্মসুচিতে যুক্ত আছে। শরনার্থীদের সঙ্কটাপন্ন অবস্থা টিভিতে প্রচারিত হয়েছে। এটি পাকিস্তানীদের যথেষ্ট বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছিল এবং পাকিস্তানীদের উদ্দেশ্য সফল করার যে প্রচেষ্টা তার বিপক্ষে ছিল।
২। শরনার্থী সমস্যা মুক্তিসেনাদের যুদ্ধের প্রতিবেদনকে অনেকটা আড়াল করে দিয়েছে। তবুও ৩০০ পাকিস্তানী সৈন্যকে হত্যার প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। পুর্ব পাকিস্তানের যে কোন জায়গায় অবস্থিত বাংলাদেশ সদর দপ্তর থেকে এই সংবাদ আনিয়ারা প্রতিবেদক কর্তৃক প্রেরিত হয়েছে যাতে উদ্ধৃত করা হয়েছে।
৩। আইপিইসিসি এর ভবিষ্যৎ ধূসর মনে হচ্ছে। গত সভায় পাকিস্তানের আগ্রহ এটিকে জিইয়ে রেখেছিল। পাকিস্তান এই শাখা চালানোর সকল খরচ বহনের প্রতিজ্ঞা করেছে। জনাব সানাউল্লা এর সাথে যিনি ১ মার্চ বদলি হয়েছেন এবং আরেকজন রঙ এলাহি খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বদলি হওয়ায় ধারণা করা হচ্ছে যে এসও পদে পরবর্তী সময়ে বিকল্প কিছুর কোন সম্ভাবনা নেই। সানাউল্লাহ চিঠি পেয়েছেন। তিনি পরবর্তী কার্যাবলি কি হবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। আইপিসিসি তার গুরুত্ব ও উদ্দেশ্য হারিয়ে ফেলেছে। এ আজিজ একজন সার্বজনীন অতিথি যিনি পাঞ্জাবিদের যে কোন সভা ও মিলাদে উপস্থিত থাকেন।
৪। পাকিস্তানে উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সহায়তা ও ঋণ দেয়ার জন্য ব্রিটিশদের অভিপ্রায়ের প্রতিবেদন আন্তারা, জাকার্তা ও স্ট্রেইটস টাইমস, সিঙ্গাপুরে প্রকাশিত হয়েছে।এই সহায়তা ও ঋনের ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিলযুদ্ধের পুর্বেই।
৫। ইসলামাবাদে তথ্য মন্ত্রনালয়ের দুইজন তথ্য সহকারীকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। এই সংবাদ অন্যান্য বাঙালিদের মনে ভয়ের সৃষ্টি করেছে। অন্যান্য মন্ত্রণালয়গুলো থেকেও আরও অব্যাহতির বিশ্বাসযোগ্য গুজব শোনা গেছে। যতক্ষণ নাপি আই এ এর অধিকর্তারা সততা ও বিশ্বাসযোগ্যতার সনদপত্র না দিচ্ছেনততক্ষণ পর্যন্ত বাঙালিরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারবে না। কিছু ক্ষেত্রে টি এ ব্যাতিত ছুটি মঞ্জুর করা হচ্ছে । যদিও অনেক ক্ষেত্রে ছুটির আবেদন প্রত্যাখান করা হচ্ছে। এটা করা হচ্ছে তাদেরকে বন্দী করা রাখতে এবং বাংলাদেশে তাদের প্রবেশ ঠেকাতে।
৬। ভারতের দিক থেকে সম্ভাব্য আক্রমনের জন্যপাকিস্তান সৈন্যবাহিনীর সদর দপ্তর সতর্কতা জারি করেছে বলে খবর পাওয়া গেছে।তারা এই ধরনের কোন কিছুর আশঙ্কা করছে এবং এই পথে তাদের প্রচারনা চালিত করছে।
৭। ধরা পড়া শত্রুদের ছবি এখানের সংবাদমাধ্যমে পাঠানো হয়ে থাকতে পারে।
৮।সরকার বৈদেশিক ঋণের বোঝাকে লাঘব করার জন্য পাকিস্তানে আয়ের ২০ শতাংশ প্রদানের সিদ্ধান্ত জুন থেকে কার্যকর করেছে।
৯। খবর পাওয়া গেছে যে দিল্লিতে বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থনের দাবীতে ইন্দোনেশিয়া ও ব্রিটিশ দুতাবাসের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হয়েছে।
১০। রেডিও পাকিস্তান ইন্দোনেশিয়ান ভাষায় সংবাদ ও প্রচারণা চালানোর জন্য আরও সময় বরাদ্দ করেছে। এটি বৈকালিক পর্যবেক্ষন সময়কে কমিয়ে দিয়েছে।
১১। প্রতিবেদন অনুযায়ী মাওলানা মউদুদি সকল মুসলিম রাষ্ট্র প্রধানদের কাছে চিঠি লিখেছেন। তার ভাষ্যমতে, পুর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ শিক্ষক এবং অধ্যাপক হলেন হিন্দু এবং ছাত্রদের হিন্দুদের দ্বারা লিখিত বই পড়ানো হচ্ছে এবং তারা হিন্দুনীতি ও ভাবনা দ্বারা প্রভাবিতহচ্ছে। বাস্তবিকভাবে সেখানেমুসলিমতারা শুধুনা মে,কর্মে নয়।
১২।জনাব স্বরনসিং এর মস্কো, প্যারিস এবং জার্মানি ভ্রমণ স্থানীয় ও বৈদেশিক ভাষার সংবাদপত্র গুলোতে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। প্রতিবেদন অনুসারে, সংবাদমাধ্যম ও নেতাদের সাথে তার সাক্ষাৎকার ও বক্তৃতাগুলো উৎসাহব্যঞ্জক ছিল।
১৩। কসিজিং এর ইসলামাবাদ ও দিল্লি ভ্রমণ এবং দুতাবাসের জনবলের পুনঃবিভক্তির ব্যাপারে আলাপ এর গুজব ছড়ানো হয়েছিল যা এখানে প্রকাশিত হয়েছে।
১৪। আসন্ন সাধারণ নির্বাচনে তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক স্বার্থ হারানোর ভয়ে, সহানুভূতিশীল নেতারা বাংলাদেশের ঘটনায় সরকারের ঔদাসিন্যের কোন গুরুতর সমালোচনা করছেন না।
১৫। সম্পাদক ও অন্যান্যদের কাছে প্রেরিত ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপক পত্র আমাদের স্বার্থ প্রচারে সহায়তা করবে। তারা ইতোমধ্যেই অমুল্য সেবা প্রদান করেছেন। তাদের কাছে নিয়মিত প্রকাশের জন্য উপাদান প্রদান করা যেতে পারে।
১৬। এই সরকার বাংলাদেশের ব্যাপারে কোন হস্তক্ষেপ করছে না কিন্তু তারা এখনও সংবাদমাধ্যমের উপর কোন বিধিনিষেধ প্রয়োগ করে নি। এটিকে বলা যেতে পারে আমাদের অবস্থানের আংশিক স্বীকৃতি।
১৭। আমাদের কাছে উপাদান ও নির্দেশনার সীমাবদ্ধতা আছে। এর পুর্বে আমারা আবেদন করেছিলাম।
১৮। নিবন্ধিত চিঠিপত্র বেসরকারি ঠিকানাগুলোতে পাঠানো হয়নি। অনুগ্রহপুর্বক সাধারণ ডাকে যোগাযোগ রক্ষা করুন।
১৯। আন্তারায় প্রকাশিত একটি খবরে বলা হয়েছে যে, বাকি সকলের মধ্যে ইপিআর ও পুলিশের ২০০০ বিদ্রোহী টিক্কা খানের ডাকে আত্মসমর্পন করেছে এবং ৫০০০ শরনার্থী পুর্ব পাকিস্তানে ফিরে গেছে। কলকাতার আন্তারা প্রতিনিধি এই প্রতিবেদন তৈরি করেছেন।
২০। লন্ডনটাইমস একটি খবর প্রকাশ করেছে যে, ৫০টি ভারতীয় ক্যাম্পে মুক্তিসেনাদের প্রশিক্ষন দেয়া হচ্ছে।
২১। পশ্চিম বাংলায় স্থানীয় ও শরনার্থীদের মধ্যে গভীর অসন্তোষের খবর প্রকাশিত হয়েছে। প্রায় আসন্নএকটি দাঙ্গার পরিস্থিতি স্থানীয় কর্তৃপক্ষ সামলে নিয়েছেন।
২২। জনাব শার্প এবং ইসমত কিত্তানির পাকিস্তান সরকারের সাথে আলোচনার খবর প্রকাশিত হয়েছে। তারা বলেছেন যে, আলোচনা ফলপ্রসূ ছিল। পাকিস্তান সহায়ক ভুমিকায় আছে এবং পুর্ব পাকিস্তানে ত্রাণ দ্রব্য বিতরণ স্থানীয় প্রশাসন করবে যা জাতিসংঘ প্রতিনিধিদল তত্ত্বাবধান করবে। ত্রান বিতরনের জন্যজাতিসংঘ বৃহত্তর জনশক্তির বাহিনী সরবরাহ করতে পারবে না।
<৪,১৭৮,৩৫৬-৩৫৭>
অনুবাদকঃ স্বজন বনিক
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৭৮। পরিস্থতি সম্পর্কে ইন্দোনেশিয় পত্রিকার মূল্যায়ন | ‘আমরা’ | ২০-২৩ জুন,১৯৭১ |
পররাষ্ট্র মন্ত্রির জন্য সংক্ষিপ্তসার
১৩ জুন ১৯৭১ তারিখ সকাল ১০-৩০ ঘটিকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রীর সাথে দেখা করার জন্য ইন্দোনেশীয় দৈনিক পেডোমানের প্রতিনিধি মোঃ আব্দুল্লাহ আলমুদি রওয়ানা হবেন । তিনি বর্তমানে ভারত সরকারের অতিথি হিসেবে ভারত সফর করছেন। তার সঙ্গী হিসেবে ভারত সরকারের দূতবৃন্দ থাকবেন। এখানে আসার পূর্বে তিনি ইতোমধ্যে ছয় সপ্তাহ যাবত ইউরোপীয় দেশগুলো ভ্রমন করেছেন। সূত্রমতে দৈনিক পেডমান একটি সমাজতান্ত্রিক ও জাতীয়তাবাদী মনোভাবে প্রভাবিত পত্রিকা।
(ক)বাংলাদেশের প্রতি ইন্দোনেশিয়ান সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিঃ
সমগ্রভাবে ইন্দোনেশিয়ান সরকারের মনোভাব খুব একটা অনুকূলে নয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রী আদম মালিক বর্তমান অবস্থাকে পাকিস্তানের “অভ্যন্তরীণ ব্যাপার”হিশেবেঅভিহিতকরেছেন।এটা অবশ্য মনে হচ্ছে যে সরকারকে সরাসরি প্রস্তাবের ফলে হস্তক্ষেপের প্রতি বিরূপ মনোভাব সৃষ্টি হতে পারে এবং স্বীকৃতির বিষয়ে এর প্রভাব পরতে পারে। বর্তমানে মনে হচ্ছে সরকার পাকিস্তান আর্মির বর্বরতার বিষয়টি উপলব্ধি করতে পেরেছে এবং পাকিস্তানের প্রজ্ঞাপন সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাস করেনি । ইন্দোনেশিয়া পাকিস্তানকে কোন প্রকার সাহায্য প্রদান থেকে বিরত থাকছে।
(খ)জনসাধারণ ও গণমাধ্যমের প্রতিক্রিয়া :
ইন্দোনেশিয়ান গণমাধ্যমের একটি অংশ বাংলাদেশের আন্দোলন বেশ ভালভাবে প্রচার করেছে। ঢাকায় পাকবাহিনীর নির্মম বর্বরতার এবং মুক্তিবাহিনীর কার্যকলাপ স্থানীয় পত্রিকাগুলোতে প্রকাশ পেয়েছিলো। জনশ্রুতি ছিল যে কিছু সংবাদপত্র নিজেদের পক্ষে নেয়ার জন্যপাকিস্তান বিরাট পরিমাণ অর্থ ব্যয় করছে।
সাধারণ জনগণ মনে করছে পাকিস্তানের অখণ্ডতা চিরতরে বিনষ্ট হয়েছে। এছাড়াও তারাবিশ্বাস করতে অনাগ্রহী যে সম্পূর্ণ দায়ভার আওয়ামী লীগের। জনাব আছমেদ সাইচো,ইন্দোনেশিয়ান পার্লামেন্টের স্পীকার ওআন্তর্জাতিক ইসলামিক সংস্থার চেয়ারম্যান এবং সাবেক প্রধান মন্ত্রী ও মাসজুমি পার্টির (নিষিদ্ধ) নেতাডঃ মোহাম্মাদ নাতচির পাকিস্তানকে বিবেচনার সঙ্গে পদক্ষেপ ও দ্রুত সমাধান খোজার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন।
(গ)বৈঠকে যে বিশেষ বিষয়গুলি উঠে আসতে পারেঃ
১২ জুন ১৯৭১ তারিখের জনাব আলমুদির সাথে কলকাতা মিশনের প্রধানের আলোচনায় দেখা যায় যে ঊর্ধ্বতন কেউ কোন বিশেষ বিষয়ে চাপ প্রয়োগ করতে অনিচ্ছুক। যদিও তিনি জানতে আগ্রহী যে কেন আওয়ামী লীগ কে স্বাধীনতা ঘোষণার মত একটি বড় পদক্ষেপ নিতে হল।
সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদন
জাকার্তা ২৩/৪/৭১
১. স্বরন সিং এর সফর এখানকার গণমাধ্যমে বেশ ভালভাবে আলোচিত হয়েছে। তাঁর এবং দুই ভারতীয় মন্ত্রির সফর সফল হিসেবে বিবেচিত হয়।
২. ১২০ ব্রিটিশ সাংসদ কর্তৃক পাকিস্তানকে সাহায্য প্রদান থেকে বিরত থাকার জন্য উত্থাপিত প্রস্তাব বিশালাকারে প্রচারিত হয়। প্রত্যেকটি সংবাদপত্র খবরটি গুরুত্বের সাথে প্রচার করে। ত্রাণ সাহায্যের প্রতিবেদনগুলি সবিস্তারে ছাপা হয়।
৩.জনাব হুসাইন আলির বিবরণীতে পাকিস্তান আর্মির যুদ্ধ ও ক্ষতির এবং নির্যাতনে আহতদের কথা উন্মোচিত হয়। সাধারণ মানুষের আলোচনার বিষয় হয়ে উঠে এটি।
৪.দেশটি বাংলাদেশের সঙ্গীন অবস্থার ব্যাপারে জ্ঞাত ছিল। কিছু সময়ের জন্য, অন্তত আসন্ন নির্বাচন পর্যন্ত তাদের নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় থাকবে। সেখানের গণমাধ্যমগুলো সর্বদাবাংলাদেশকে সব ধরণেরসমর্থন দিয়ে যাচ্ছিলো।
৫.মর্নিং নিউজ এর সহ-সম্পাদক বাংলাদেশে ঘটা পাশবিকতার বিবরণী সানডে টাইম্স এ প্রকাশ করেন।লন্ডনের গণমাধ্যমে এটি সাড়া ফেলে দেয়। এটি ছিল একটি সুলিখিত ও তথ্যসমৃদ্ধ প্রতিবেদন। জনগণ স্তব্ধ হয়ে যায় রিপোর্টটি পড়ে। সরকারের প্রতি জনগনের একটি নীরব ঘৃণার সৃষ্টি হয়।
৬.কিছু পত্রিকায় ইঙ্গিত দেয়া হয় যে পাকিস্তান ভুট্টোকেদেশের বাইরে পাঠিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করছে। উদ্দেশ্য ছিল স্বরন সিং কর্তৃক আরোপিত অভিযোগগুলোর মোকাবিলা করা। ভুট্টো এখানে ভালভাবে অভ্যর্থিত হবেন না। তিনি পাকিস্তানের সুবেন্দ্রীয়হিসেবে পরিচিত।
৭.গণমাধ্যম মারফত বাংলাদেশের পরিস্থিতির জন্য আওয়ামীলীগকে দোষী করার একটি সূক্ষ্ম চাল হয়। সমর্থকেরা এগুলোর তীব্র সমালোচনা করে।
৮.আগের একটি প্রতিবেদনে সংবাদপত্র ও সম্পাদকদেরতালিকা দেয়া হয়।সেখানে ধন্যবাদ জানিয়ে চিঠি লেখার জন্য অনুরোধ করা হয়। এখন পর্যন্ত জানা যায়নি যে এরকম কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে কিনা।
৯.কয়েকবার অনুরোধের পরেও এর কোন উত্তর আসেনি।ধারণা করা হচ্ছে যে পাঠানো রিপোর্টগুলোর ওপর গুপ্তচরবৃত্তি করা হচ্ছে অথবা আমাদের ঠিকানায় পাঠানো চিঠিগুলো বিপক্ষ দ্বারা পথিমধ্যে আটকানো হচ্ছে। আমাদের সন্দেহ কেটে যাবে যদি তৎক্ষণাৎ নিশ্চিত করা সম্ভব হয় যে চিঠি প্রাপকের কাছে পৌঁছেছে।তা না হলে আমাদের চিঠি লেখা হতে বিরত থাকতে হবে।
১০.জনাব জে.পি.নারায়ণের রাজধানী সফর সফল হয়নি। কিন্তু এটি অনুকূল অবস্থার সৃষ্টি করেছে। স্থানীয় সংবাদপত্রগুলি ফলাওভাবে তাঁর ইন্টারভিউ এবং প্রকৃত অবস্থার প্রতি তার অবস্থান প্রচার করে ।
১১.আন্তারা উদ্ধৃত করে একটি প্রতিবেদনে বলা হয় প্যারিসেপাকিস্তানকে সাহায্যের উপর স্থগিতাদেশ জারি করা হয়েছে। খবরটি প্রথম সারির পত্রিকাগুলোতে প্রচারিত হয়।
<৪,১৭৯,৩৫৮>
অনুবাদকঃ স্বজন বনিক
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৭৯। বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ইন্দনেশিয়ায় অবস্থানরত বেসরকারি বাঙালীদেরকর্তব্যসম্পর্কে লিখিত চিঠি | বাংলাদেশ সরকার | ২৪ জুন,১৯৭১ |
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
৯ সার্কাস অ্যাভিনিউ
কলিকাতা-১৭
MISSION OF THE
PEOPLE’S REPUBLIC OF Bangladesh
9 Circus Avenue
Calcutta-17
জনাব আব্দুল মতিন,
আমরা গত ১৫ মে ১৯৭১ তারিখে তারিখে জনাব ইউসিন আলির ঠিকানায় প্রেরিত আপনার চিঠি পেয়ে কৃতজ্ঞ বোধ করছি। বাংলাদেশের প্রতি সমর্থন ও সহানুভূতির জন্য আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।
২। যেহেতু আপনি ইন্দোনেশিয়ায় স্থায়ীভাবে আছেন,তাই যদি আপনি বাংলাদেশের পক্ষে জাকার্তায় জনমত গঠন ও তহবিল জোগাড় করার উদ্দেশে একটি কমিটি গঠন করতে পারেন তবে আমরা বিশেষ ভাবে উপকৃত হব। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে প্রবাসী বাংলাদেশি নাগরিকগণ বাংলাদেশকে সহযোগিতা করার উদ্দেশ্যে এধরণের কমিটি গঠন করেছেন। বাংলাদেশের মাটি থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে বিতাড়িত করতে ইন্দোনেশিয়ার ভাতৃপ্রতিম জনগণের সমর্থনের বিশেষ প্রয়োজন। আমরা আশাবাদী যে এ ব্যাপারে আপনি ও আপনার পরিচিত সকলে আমাদের সাহায্য করতে সক্ষম হবেন।
৩। আপনার স্বেচ্ছাসেবক পাঠানোর প্রস্তাবটি বিবেচনায় রেখে সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর পর যথাশীঘ্রইআপনাকে অবহিত করা হবে।
৪।অনুগ্রহ করে আপনার বাংলাদেশকে সমর্থন যোগানো সম্পর্কিত কার্যকলাপ সম্পর্কে আমাদেরকে অবহিত করবেন। আমরা নিশ্চিত যে আপনার সহযোগিতা ও পূর্ণ সমর্থনে খুব শীঘ্রই বাংলার এই পবিত্র মাটি পাকবাহিনী মুক্ত হবে।
বিনীতভাবে,
প্রেরক/-
(আনোয়ারউল করিম চৌধুরী)
মিশনপ্রধানের পক্ষ হতে
মেজর(অবঃ) আব্দুল মতিন
পিসাঙ্গান লামা ৩/৩৯,
জাতিনেগারা, জাকার্তা,
ইন্দোনেশিয়া
<৪,১৮০,৩৫৯>
অনুবাদকঃ স্বজন বনিক
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৮০। “আমরা”গোষ্ঠীর প্রচার তৎপরতা সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন | “আমরা” | ২৪ জুন,১৯৭১ |
জাকার্তায় আমাদের প্রতিনিধির প্রতিবেদনটি দেখা হয়েছে এবং মূল বিষয়গুলি চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রচার বিভাগ দ্বারা গৃহীত পদক্ষেপগুলিঃ
(১)আমাদের প্রতিনিধিকে “জয় বাংলা”এর সাপ্তাহিক কপি প্রেরণ করা।
(২)যেসব সংবাদপত্র আমাদের সমর্থন যুগিয়েছে তাদের তালিকা তৈরি করা ও ঠিকানা যোগাড় করা। এই দুইটি বিষয়ের ওপর ভিত্তি পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক তথ্য ও যথাযথ প্রচারণার উপকরণ উপরোক্ত সংবাদপত্রগুলোকে সরবরাহ করা হবে।
জাকার্তার যেসব পত্রিকা আমাদের কার্যে সমর্থন দিয়েছেসেইসব পত্রিকাগুলো বরাবর শুভেচ্ছাপত্র পাঠানো হচ্ছে। যেসব টেলিভিশন ও রেডিওতেও ভাল সাড়া দিচ্ছে এবং ধন্যবাদ তাদেরও প্রাপ্য।
জাকার্তায় আমদের প্রতিনিধির ঠিকানা
“আমরা”
ডি.জে.এল পেমান্দাগান ১১/১০
জেনারেল সাহারি আন্টজল
দীপন, এ.আই.পি
জাকার্তা, ইউটারা
এ.পি.এ
জনাব সালাউদ্দিন
প্রেরক
বৈদেশিক প্রচারণা বিভাগ
<৪,১৮১,৩৬০>
অনুবাদকঃ জেসিকা গুলশান তোড়া
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৮১। বাংলাদেশ আন্দোলনের অংশগ্রহণকারী কর্মীর কাছে লিখিত বংলাদেশ সরকারের প্রশংসাপত্র | বাংলাদেশ সরকার | ২৫ জুন, ১৯৭১ |
তারিখঃ ২৫ জুন, ১৯৭১
জনাব সানাউল্লাহ সাহেব,
আপনার ১৫-০৬-৭১ তারিখের পত্র পেলাম। আপনি যে উৎসাহ নিয়ে বাংলাদেশের জন্য ইন্দনেশিয়ায় কাজ করে যাচ্ছেন তা সত্যিই প্রশংসনীয়। আশা করি সম্ভাব্য সবকিছু আমাদের মুক্তির জন্য ভবিষ্যতেও এভাবে কাজ করে যাবেন।
গতকাল মতিন সাহেবের কাছে পত্র দেয়া হল। তার কপি আপনার কাছেও পাঠানো হয়েছে।
এর সঙ্গে কিচু পুস্তিকা ও আমাদের রিলিজ পাঠালাম।
শুভেচ্ছান্তে
(এম মকসুদ আলী)
প্রেস এ্যাটাচি
আলহাজ এ বি এম সানাউল্লাহ
জাকার্তা
ইন্দোনেশিয়া
<৪,১৮২,৩৬১>
অনুবাদকঃ মুশাররাত আলম মৌ
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৮২। “আমরা” গোষ্ঠীর সাথে প্রচার ব্যবস্থা জোরদার করা সম্পর্কে লিখিত বাংলাদেশ সরকারের চিঠি | বাংলাদেশ সরকার | ১ জুলাই, ১৯৭১ |
তথ্য নং ১০/১০/৭১
তারিখ ১ জুলাই, ১৯৭১
আমাদের প্রিয় “আমরা”
আমরা তোমাদের “জয় বাংলা” এর একটি কপি পাঠিয়েছি যেভাবে এবং যখন এটি প্রকাশিত হয়েছিল। আমরা এখন বুঝতে পারছি যে ওগুলো তোমাদের কাছে পৌছয়নি। যাইহোক, আমরা এখানে নিম্নোক্তগুলো পাঠাচ্ছিঃ
ক।সাপ্তাহিক “জয় বাংলা”– জুন ৯, জুন ১৬, জুনে ২৫ সংখ্যা
খ। সাপ্তাহিক “দ্য পিপল”- জুন ১ সংখ্যা
এই সাপ্তাহিক পত্রিকাগুলোর পরবর্তী সংখ্যাগুলো নিয়মিত তোমাদের কাছে পাঠানো হবে।
২। আমরা ইতোমধ্যে “দ্য জাকার্তা টাইমস” ও “ দি ইন্দোনেশিয়ান অবজার্ভার” এর সম্পাদকদের কাছে বাংলাদেশের স্বার্থকে সমর্থন করে সম্পাদকীয় ও প্রবন্ধ প্রকাশ করার জন্য ধন্যবাদ সুচক পত্র প্রেরণ করেছি। আপনারা কি অনুগ্রহ করে অন্যান্য দৈনিক ও সাপ্তাহিক যারা আমাদের স্বার্থকে সমর্থন করছে তাদের নাম ও ঠিকানা আমাদের জানাতে পারবেন?
৩। অনুগ্রহপুর্বক সাপ্তাহিক গুলোর রসিদ রেখে দিবেন।
শুভেচ্ছা সহ
বিনীত
এম মাকসুদ আলী
সংবাদ সহদুত
প্রতি,
“আমরা”
জালান পেমাদাঙ্গান ১১/৬
গুনাং সাহাদ আন্তজল
দাপ্পান এ আই পি
জাকার্তা-উতারা
ইন্দোনেশিয়া
<৪,১৮৩,৩৬২-৩৬৪>
অনুবাদকঃ মুশাররাত আলম মৌ
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৮৩। “আমরা” গোষ্ঠী ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে বিনিময়কৃত প্রচার ও বিভিন্ন বিষয়ে লিখিত কয়েকটি চিঠি | “আমরা” ও বাংলাদেশ সরকার |
২৮ জুলাই থেকে ৭ আগস্ট, ১৯৭১
|
জাকার্তা, জুলাই ২৮, ১৯৭১
জনাব মাকসুদ আলী,
১। একটি খসড়া ডি.ও এখানে সংযুক্ত আছে। এটি আপনাদের তরফ থেকে এই চিঠির নিম্নে উল্লেখিত দুই ব্যক্তির নামে প্রেরণ করা হয়েছে। ১ নং ভদ্রলোকের ব্যাপারে আমাদের পুর্বোক্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। দ্বিতীয় জনের ব্যাপারে অল্প কিছু দিনের মধ্যেই প্রতিবেদন প্রকাশিত হবে। যাইহোক নির্দিষ্ট ভাবে এই দুই ভদ্রলোকের ব্যাপারে কোন দৃষ্টিভঙ্গি গঠন করার পুর্বে আমরা তাদেরকে তাদের মনোভাব বদলানোর আরেকটি সুযোগ দেয়ার ইচ্ছা পোষণ করেছি। আপনাদের পক্ষ থেকে প্রস্তাবিত ডি.ও গ্রহণ করার পড়ে আমরা তাদের প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষন করব। অনুগ্রহ পুর্বক আপনাদের গৃহীত কার্যক্রম সম্পর্কে আমাদের অবহিত করবেন।
২। আপনাদের কাছে পাঠানো আগের একটি চিঠিতে আমি কিছু শুভাকাঙ্ক্ষীদের ব্যাপারে জানতে চেয়েছিলাম। আমি আনন্দিত হব যদি আপনি তাদেরকে কিছু লেখার জন্য অনুরোধ করেন।
৩। আমি কি জানতে পারি প্রতিবেদন ও খবরের খণ্ডাংশ গুলো আপনার কাছে নিয়মিত পৌঁছচ্ছে কিনা? আমি আশঙ্কা করছি যে, সেগুলো হারিয়ে যাচ্ছে না বা সেগুলো অন্য কারো হাতে পরছে না। এখনও পর্যন্ত কোন উপকরন পৌছয়নি যেমনটি আপনি ১ জুলাই এর চিঠিতে ইঙ্গিত করেছিলেন। কিছু জিনিস অন্যান্য সূত্র থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে এবং সেগুলোর উপযুক্ত ব্যবহার করা হচ্ছে।
শুভেচ্ছা সহ
বিনীত
আমরা
জনাব মাকসুদ আলী
সংবাদ সহদুত
বাংলাদেশ মিশন
কলকাতা
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
প্রিয় দেশবাসী,
বাংলাদেশের সংগ্রাম এর ইতিহাস সম্পর্কে আপনাদের কাছে বর্ননা করা প্রয়োজন বলে মনে হয় না। বাঙালিরা অভুতপুর্ব ভাবে আত্মত্যাগ স্বীকার করছে এবং সংযুক্ত পাকিস্তানের জন্য অনেক কষ্টের মধ্য দিয়ে গেছে। কিন্তু লোভী শাসকেরা আমাদের ২৩ বছরের আত্মত্যাগ ও কষ্টে সন্তুষ্ট ছিল না। পরিষ্কারভাবে তাদের কার্যকলাপও উদ্দেশ্য ছিল আমাদের দাসত্বে আবদ্ধ করা।
২। বাঙালিরা এখন যেকোন ধরনের সশস্ত্র, রাজনৈতিক অথবা অর্থনৈতিক অত্যাচারকে প্রতিরোধ ও নির্মুল করার জন্য দৃঢ় সংকল্পের সাথে জেগে উঠছে। যতক্ষণ পর্যন্ত একজন পাকিস্তানী সৈন্যও এই দেশের মাটিতে থাকবে ততক্ষণ বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ বিশ্রাম নেবে না। জনগনের এই সংকল্প তাদের সাফল্য ও গৌরবের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বিশ্ব এই সত্যকে স্বীকার করে নিয়েছে এবং দেশগুলো তাদের নীতিকে ধীরে ধীরে গঠন ও রুপায়ন করছে।
শত্রুরা আতঙ্ক তাড়িত হচ্ছে এবং প্রতিদিন পরাজিত হচ্ছে। বাংলাদেশের বিজয় অতি নিকটে।
৩। এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বাংলাদেশ এখন একটি বাস্তবতা। বন্ধু, শুভাকাঙ্খী এবং বিশেষত বাঙালিরা যে যেখানে অবস্থান করছে, তাদের এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ থাকা উচিত নয়।
আমাদের প্রবাসী জনগনের দেয়া সেবাকে বাংলাদেশ সরকার স্বীকার করে। তারা ইতোমধ্যে তাদের নীতি ঘোষণা করেছে যে, বাংলাদেশের প্রয়োজনের সময়ে দেয়া আত্মত্যাগ ও সেবাকে যথাযথভাবে পুরস্কৃত করা হবে। সরকারে কাছে পাকিস্তানের সহযোগী ও দালালদের কার্যক্রম সম্পর্কেও তথ্য ও প্রমান আছে এবং যথা সময়ে তাদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
বিনীত,
১। জনাব এম এ আজিজ
আইপিইসিসি এর ডেপুটি সেক্রেটারি জেনারেল
হাউস নগ-৫৩ ডিজেএল, তান্ডজাং (মেন্তাং) জাকার্তা
২। জনাব জয়নুল আবেদিন
পাকিস্তানের প্রেস কাউন্সেলর
৫১, ডিজেএল, তান্ডজাং (মেন্তাং)
জাকার্তা।
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ __
ডিজেএল পেমান্দাঙ্গান ১১/১০
গুনাং সাহারি, আন্তজল দেপান এআইপি
জাকার্তা-উতারা, জাকার্তা
জুলাই ২১, ১৯৭১
জনাব মাকসুদ আলী,
আপনার পাঠানো ১ জুলাই এর চিঠির জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। এটি আমাদের অনেক আনন্দ দিয়েছে। এটি বিভিন্ন দিক থেকে আমাদের শঙ্কা ও সন্দেহ দুর করেছে। আমরা আপানার কাছ থেকে নিয়মিত চিঠি পাবার আশা করি অন্তত কি প্রেরিত হচ্ছে সেটি সম্পর্কে অবহিত থাকার জন্য।
আমি এখানে অনেক লোকের কাছ থেকে আপনার কোথা শুনেছি। আপনাকে এখনও আপনার বন্ধু ও অনুরাগীরা আন্তরিকভাবে মনে রেখেছে। আপনি তাদের মনে চিরস্থায়ী ছাপ রেখে গিয়েছেন।
আপনার সাথে সেখানে আমার অনেক বন্ধু আছেন। তারা হলেনঃ বাশার ভুইয়া, এ বাশার (পাটোয়ারি), এবং সিরাজুল হক। প্রথম জন এবং আমি একই গ্রামের অধিবাসী। আমি উপরোক্ত ঠিকানায় তাদের চিঠি পেলে অত্যন্ত আনন্দিত হব। অনুগ্রহপুর্বক আমার শুভেচ্ছা তাদের নিকট পৌছিয়ে দেবেন।
বিভিন্ন বাঁধা বিপত্তি পেড়িয়েও আমরা বেশ ভালই আছি। সব কিছু আগের মত করার চেষ্টা এখনও চলমান রয়েছে।
শুভেচ্ছা সহ…
বিনীত
আমরা
জনাব মাকসুদ আলী
সংবাদ সংযুক্তি
আগস্ট ৭,১৯৭১
নং তথ্য ১০/০১/৭১
আমার প্রিয় ‘আমরা’
২১ ও ২৮ জুলাই, ১৯৭১ তারিখের আপনাদের চিঠিগুলোর দিকে সদয় দৃষ্টিআকর্ষণ করছি।
আপনাদের দেয়া পরামর্শের ভিত্তিতে ইতোমধ্যে আমরা উভয় ব্যক্তির উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র সচিবের স্বাক্ষর সহ চিঠি পাঠিয়েছি।
আমরা আপনাদের কাছ থেকে প্রতিবেদন ও সংবাদপত্রের খণ্ডাংশ পাচ্ছি। আমরাও আপনাদের কাছে নিয়মিত “জয় বাংলা”, “দ্য পিপলস”, এবং সাপ্তাহিক বুলেটিন “বাংলাদেশ” এর কপি পাঠাচ্ছি। অনুগ্রহপুর্বক আমাদের জানাবেন আপনারা নিয়মিত সেগুলো পাচ্ছেন কিনা।
এখানে আপনাদের বন্ধুদের ব্যাপারে বলতে গেলে, এই মিশনে দুই জন বাশার সাহেব আছেন। কিন্তু দুইজনের একজনও আপনাকে চেনেন বলে মনে হয় না। জনাব সিরাজুল হক, শ্রুতিলেখক, বহুদিন আগে মিশন ছেড়ে চলে গিয়েছেন।
শুভেচ্ছা সহ।
বিনীত
স্বাক্ষরিত
জনাব মাকসুদ আলী
সংবাদ সহদুত
প্রতি
‘আমরা’
জাকার্তা ১, পেমিন্ডাঙ্গান ১১/১০,
গুনাং সাহারি
আন্তজল দেপান এ আই পি
জাকার্তা-উতারা, ইন্দোনেশিয়া
<৪,১৮৪,৩৬৫>
অনুবাদকঃ মুশাররাত আলম মৌ
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৮৪। ইন্দোনেশিয়ার জনমত সম্পর্কে ‘আমরা’ গোষ্ঠী কর্তৃক প্রেরিত প্রতিবেদন | ‘আমরা’ | ১লা আগস্ট, ১৯৭২ |
জাকার্তা , ১-৮-১৯৭১
১। ১১-১৩ আগস্টের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার জন্য এই রাজধানীতে জনাব স্বারান সিং এর প্রস্তাবিত সফর সম্পর্কে এখানে প্রকাশিত হয়েছিল। এটি পররাষ্ট্র মন্ত্রী আদম মালিক কর্তৃক প্রকাশ করা হয়েছে।
২। ইউ এন পর্যবেক্ষকদের নিযুক্ত করার ব্যাপারে ইন্ডিয়ার প্রত্যাখান এর প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, ইন্ডিয়ার দৃষ্টিকোন হল যে, এটি বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যকার সমস্যা। ইউ এন পর্যবেক্ষকগন ইন্ডিয়ার এলাকায় অবস্থান করতে পারে না।
৩। অগাস্টে ইয়াহিয়া কানের ঢাকা সফরের পরিকল্পনা এখানে প্রকাশিত হয়েছে। সম্প্রতি করাচিতে ইয়াহিয়ার টেলিভিশন সাক্ষাতকারে বিবিসি প্রতিনিধি আমন্ত্রিত ছিলেন না।
৪। আন্তারায় প্রকাশিত একটি খবরে বলা হয়েছে যে, ইন্ডিয়া ইরানিয়ান এবং কুয়েতি প্রতিনিধিদের মালয়েশিয়ার টেংকু আব্দুল রহমানের সাথে শরনার্থী শিবির পরিদর্শনের অনুমতি দেবে না। এই খবরে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে যে, ইরান এবং কুয়েতের এতে সমর্থন ছিল।
৫। দুইটি তালিকা ইহার সাথে প্রকাশ করা হয়েছে- একটি সংবাদপত্রের এবং আরেকটি মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের। এগুলো হল সম্পুর্ন তালিকা। উভয় তালিকায় গুরুত্বপুর্নদের তারকা দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের প্রয়োজনীয় উপকরন সরবরাহ করা হতে পারে। যদি এটি করা হয়ে থাকে তবে অনুগ্রহপুর্বক জানাবেন।
৬। কিছু স্থানীয় ভাষার পত্রিকার সম্পাদকীয়তে বাংলাদেশের সংগ্রামকে শক্তভাবে সমর্থন করা হয়েছে। সম্পাদকীয়গুলোতে সৈন্যবাহিনীর বর্বরতার পূর্ণ বিবরণ প্রকাশ করা হয়েছে এবং সরকার কি উপায় গ্রহণ করতে পারে সেটির ব্যাপারে পরামর্শ দেয়া আছে।
৭। তাদের পক্ষ থেকে ইস্যু করার জন্য পুর্বে একটি খসড়া চিঠি পাঠানো হয়েছে। অনুগ্রহপুর্বক অতিসত্বর সেটি ইস্যু করুন। জনাব এম এ আজিজ এখনও বাঙালি প্রতিরোধের সম্পর্কে জনগণকে নিরুৎসাহিত করতে তৎপর।
৮। ইয়াসির আরাফাত (ফিলিস্তিনের গেরিলা নেতা) অভিযোগ করেছেন যে, পাকিস্তানী সেনাপ্রধান গেরিলাদের বিপক্ষে সম্প্রতি যুদ্ধে জর্ডানিয়ান সৈন্যবাহিনীকে নিযুক্ত করেছেন। এই অভিযোগ এখানে সংবাদপত্রগুলোতে প্রকাশিত হয়েছে।
৯। পাকিস্তান ইয়াসির আরাফাতের অভিযোগে দুঃখ প্রকাশ করে বলেছে যে, ইসরাইলের বিপক্ষে মুসলিম দেশগুলোকে এটি নিছক সাহায্য করছিল।
১০। ইউ এন ত্রাণ কর্মকর্তাদের প্রেরনের ব্যাপারে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। উ থান্ট দৃঢ় ভাবে অস্বীকার করলেও প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে যে, কর্মকর্তাদের পর্যবেক্ষনের কাজে নিয়োজিত করা হয়েছে।
১১। লন্ডন থেকে জনাব মহিউদ্দিন আহমেদ এর দলত্যাগের খবর প্রকাশিত হয়েছে।
১২। আন্তারা ও অন্যান্য পত্রিকায় পাকিস্তান ও গ্রিসে ইউ এস ত্রানের বন্ধের খবর প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু বন্ধ করার জন্য প্রস্তুতকৃত বিলে একটি ত্রুটিপূর্ণ ধারা রাষ্ট্রপতি নিক্সন কে গ্রিসে ত্রাণ পাঠানোর অনুমোদন দিতে পারে। কিন্তু পাকিস্তানের ক্ষেত্রে এটি চূড়ান্ত।
প্রতিঃ জনাব মাকসুদ আলী
সংবাদ সহদুত
বাংলাদেশ মিশন
৯ সার্কাস এভিনিউ, কলকাতা-১৭,ইন্ডিয়া
<৪,১৮৫,৩৬৬-৩৬৮>
অনুবাদকঃ মুশাররাত আলম মৌ
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৮৫। পত্রপত্রিকার মাধ্যমে প্রচার অভিযান চালানো সংক্রান্ত ‘আমরা’ গোষ্ঠী কর্তৃক বাংলাদেশ সরকারকে প্রেরিত প্রতিবেদন | ‘আমরা’ | ৯ আগস্ট, ১৯৭১ |
আলহাজ্ব এ বি এম সোনাউল্লাহ
৩১, ডিজেএল সুলতান আগুং
গুনলার, জাকার্তা
তারিখ-অগাস্ট ৯, ১৯৭১
প্রিয় মাকসুদ আলী সাহেব,
অনুগ্রহপুর্বক জুলাই ১, ১৯৭১ এর ১০/১০/৭১ নং চিঠির উল্লেখক্রমে যেটি ছিল সাপ্তাহিক “জয় বাংলা” এবং “দ্য পিপল” পত্রিকার কপি প্রেরণ সংক্রান্ত পত্র। তখন থেকে আর কোন কপি পাওয়া হয়নি। আমি কৃতজ্ঞ থাকব আপনি যদি আপনি অনুগ্রহপুর্বক উপরোক্ত পত্রিকাগুলোর এবং আপনার ইস্যু করা “বাংলাদেশ” বুলেটিন সহ অন্যান্য প্রকাশনার নতুন কপি আমাকে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।
এছাড়াও অনুগ্রহপুর্বক “দ্য পিপল”, “বাংলাদেশ” বুলেটিন এবং অন্যান্য এই সম্পর্কিত প্রকাশনা এর সাথে সংযুক্ত তালিকায় উল্লেখিত ঠিকানা গুলোতে সরাসরি পাঠানোর ব্যবস্থা করুন।
এটি আমাদের স্বার্থের জন্য অত্যন্ত সহায়ক হবে যদি আপনি অনুগ্রহপুর্বক ধন্যবাদজ্ঞাপক বা প্রশংসাসূচক পত্র বাহাসা ইন্দোনেশিয়ান সাপ্তাহিক যেমন “মেরদেকা”, “কামি”-ছাত্র দৈনিক, “সিনার হারাপান”, “পেদোমান”, “কম্পাস”, “বেরিতা বুয়ানা” (পুরনো নাম বেরিতা ইয়ুদ্ধা), এবং বিশেষভাবে “আবাদি” এবং অন্যান্য গুলোতে সাধারনভাবে, এবং এছাড়াও আন্তারা সংবাদ সংস্থা, ডিআরএস, সুমাদি, টেলিভিশন রিপাবলিক ইন্দোনেশিয়া এর পরিচালক, সেনাজান জাকার্তা এবং জনাব আব্দুল হামিদ, রেডিও রিপাবলিক ইন্দোনেশিয়া এর পরিচালক, ডিজেএল মেরদাকা জাকার্তা; সংবাদ প্রচারের উদ্দেশ্যে ইস্যু করার ব্যবস্থা করেন। হয়তবা এটি আরও যথাযোগ্য হবে যদি এটি সরকার এবং জনগনের পক্ষ থেকে অভিব্যক্ত করা হয়। যদি সম্ভব হয় তবে এক কপি আমাকেও পাঠিয়ে দেবেন।
যেমনটি সম্প্রতি হয়েছে তেমন ব্যক্তিগত যোগাযোগ ব্যতীত, “আমরা” এর অধিকৃত নামে সকল চিঠিপত্র অনুগ্রহপুর্বক উপরোক্ত একই ঠিকানায় পাঠিয়ে দেবেন, ।
শুভেচ্ছা সহ
বিনীত
স্বাক্ষরিত
জনাব এম মাকসুদ আলী
সংবাদ সহদুত
গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ মিশন
৯, সার্কাস এভিনিউ
কলকাতা-১৭।
ইন্দোনেশিয়া
‘দ্য পিপল’, ‘বাংলাদেশ’ বুলেটিন এবং বাংলাদেশের অন্যান্য প্রকাশনার প্রেরণ তালিকা ইংরেজিতেঃ
১। কে এইচ ডঃ ইড হাম চালিদ, ডিজেএল, কেএস রাষ্ট্রের জনকল্যান মন্ত্রী
মাংগুনসারকোরা নং-৫১, মেন্তাং, জাকার্তা সহ সভাপতি, এন ইউ
২। হাদজি আদম মালিক ডিজেএল পররাষ্ট্র মন্ত্রী
দিপনেগরা নং-২৯, জাকার্তা
৩। হাদজি আচমাদ জাইকু কম্প, বিডিএন, ডিজেএল, এলইটি, ডিজিএনএন, এস, পারমান, সিলিপি, জাকার্তা চেয়ারম্যান, হাউস অফ রিপাবলিক, এন ইউ
৪। জনাব এম এইচ ইসনানি ডিজেএল, ইমাম বন্দজল ন-২৮, মান্তাং, জাকার্তা সহ সভাপতি, হাউস অফ রিপাবলিক, চেয়ারম্যান, ন্যাশনাল পার্টি
৫। লেফটেন্যান্ট জেনারেল এইচ আলমসিজাহ ডিজেএল প্রকলামসি নং-৩৬, জাকার্তা স্টেট সেক্রেটারি, রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা
৬। মি উইলোপো এস এইচ, ডিজেএল, শ্রিউইদজাজা নং-২০,ব্লক নং কে-১১, কচবাজরান বারু, জাকার্তা, চেয়ারম্যান, সুপ্রিম অ্যাডভাইসরি কাউন্সিল, সাবেক প্রধানমন্ত্রী
৭। ডঃ মোহাম্মাদ নাতসির, ৪৬, ডিজেএল, এইচওএস, জকরয়ামিনোতো, জাকার্তা
সাবেক প্রধান মন্ত্রী, ধর্মীয় পণ্ডিত
৮। হাদজি আনোয়ার জকরয়ামনোতো, ডিজেএল সিঙ্গামাঙ্গারাদজা নং-২৯, কচবাজরান বারু জাকার্তা সহ সভাপতি, সুপ্রিম অ্যাডভাইসরি কাউন্সিল
সভাপতি, পিএসআইআই
৯। হাদজি ইমরন রসজাদি এস এইচ ডিজেএল, চুকুউমার নং-৩০/পিএভি, জাকার্তা সভাপতি, সংসদীয় কমিশন ২ যেটি প্রতিরক্ষা বিভাগ ও পররাষ্ট্র বিভাগ নিয়ে কাজ করে।
সেক্রেটারি জেনারেল, এএআইও
১০। মি ফাহিম ইদ্রিস (ছাত্রনেতা)
সেক্রেটারি জেনারেল, জেরেকান মাহাসিসয়া
জাকার্তা
ইন্দোনেশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, অর্থনীতি বিভাগ, ডিজেএল
সালেম্বা নং-৪, জাকার্তা।
সংবাদপত্র সমূহ
১১। হাদজি মাকবুদ জুনায়েদি
সম্পাদক, দুতা মাসজারাকাত
ডিজেএল, মেন্তাং রায়া নং-২৪, জাকার্তা
১২। মি নোনো আনোয়ার মাকারিম
সম্পাদক , কামি (ছাত্র দৈনিক)
ডিজেএল, ক্রামাত ৮/২, জাকার্তা
১৩। মি ১৩ এম দিয়াহ (সাবেক তথ্য মন্ত্রী)
সম্পাদক, মেরদেকা
ডিজেএল, পেতোদজো সেলাতান ১১, জাকার্তা
১৪। ব্রিগেডিয়ার জেন হাদজি সুগান্ধি
সম্পাদক, পেলোপার বারু ( দৈনিক, সেকবার গোলকারের মালিকানাধীন)
ডিজেএল, আসেমকা ২৯-৩০, জাকার্তা
১৫। মি জে সি টি সিমোরাংকির এস এইচ
সম্পাদক, সিনার হারাপান ( খ্রিস্টান পার্টি দৈনিক )
ডিজেএল পিন্তু বেসার সেলাতান নং-৯৩, জাকার্তা
১৬। মি মখতার লুবিস
সম্পাদক , ইন্দোনেশিয়ান রায়া
ডিজেএল মেরাকেদা উতারা ১১, জাকার্তা
১৭। মি ফাহমি মু’থি
জাকার্তা টাইমস
এফজেএল, হাজাম বুরুক নং-৮, জাকার্তা
১৮। মিসেস হেরাবাতি দিয়াহ
সম্পাদক, ইন্দোনেশিয়া অবজার্ভার
ডিজেএল পেতোদজো সেলাতান ১১, জাকার্তা
<৪,১৮৬,৩৬৯-৩৭০>
অনুবাদকঃ খন্ডকার কাফি আহমেদ
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৮৬। বাংলাদেশ সরকারকে আন্দোলনের অগ্রগতি ও সমস্যা সম্পর্কে লিখিত “আমরা” গোষ্ঠীর চিঠি | ‘আমরা’ | ১১ আগস্ট, ১৯৭১ |
জাকার্তা, ১১ই আগস্ট,১৯৭১
প্রিয় জনাব মাকসুদ আলী,
ইতোমধ্যে আপনাকে আমাদের পথের বাধা ও প্রতিকূলতা সম্পর্কে অভিহিত করেছি। আমাদের উৎসাহী জনগণ সেই সঙ্গে সমর্থকরা লক্ষ লক্ষ মনকে আন্দোলিত রাখছিলো এবং অনুকূল মতামতের একটি কাঠামো গঠন শুরু হয়েছিল। কিন্তু আমাদের ভুলের কারণে সম্প্রতি শত্রুরা বিপুল অর্থের বিনিময়ে বাংলাদেশের ঘটনা প্রবাহের তথ্য প্রকাশ হতে বিরত রাখতে কিছুটা সাফল্য অর্জন করেছে। মিশন থেকে বড় মাপের দল ত্যাগ সাংবাদিক এবং পাঠক সমাজকে আবারো আশ্বস্ত করেছে যে পাকিস্তানের কঠোর নিপীড়ন ও নগ্ন মিথ্যার পরও বাংলাদেশের আন্দোলন এখনো টিকে আছে। নিচে বহুল পঠিত ইংরেজী দৈনিক দ্য জাকার্তা টাইমস এ বিলি’র কলামে সমালোচনাভরে মন্তব্য করা হয়েছে যে (পেপার কাটিং সংযুক্ত করা হল),
“ওয়াশিংটনে ৭ জন এবং লন্ডনে ২ জন কূটনীতিক পদত্যাগ করেছেন এবং ‘বাংলাদেশ’ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছেন। আমার মনে হল ‘বাংলাদেশ’কে এরই মধ্যে পুরোপুরি মেনে নেওয়া হয়ে গেছে। এটি ছিল পাকিস্তানী ইনফরমেশন সার্ভিসের উক্তি, বুঝতেই পারছেন!”
এমন পরিবর্তীত অবস্থায়, আমরা আমাদের কৌশল পরিবর্তনের কথা চিন্তা করেছি। এর সঙ্গে আমরা একটি বৃহৎ নির্বাচিত প্রভাবশালী অভিজাত শ্রেণী গঠনের প্রস্তাব করেছি। কিন্তু আপনি জানেন এখনও আমাদের চাওয়া স্পষ্টতই খোলাখুলি প্রকাশ করা যাচ্ছে না। যা হউক কিছু গুরুত্বপূর্ণ নাম আপনাকে পাঠাচ্ছি। আমরা সুপারিশ করেছি যে তাদের “দ্য পিপল” পত্রিকার কপি নিয়মিত সরবরাহ করা হবে। এসবের খরচ তাৎক্ষনিক পরিশোধের জন্য আমাদের কাছে বিলগুলো পাঠাবেন। আমরা অন্যদের কাছে প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহ করা শুরু করেছি। আমরা আশা করতে পরি যে, শত্রুপক্ষের ছড়ানো মিথ্যা মোকাবেলা করতে পারব এবং আপনাদের সহযোগীতা অবিলম্বে আমাদের কাছে পৌছাবে।
আমরা কি আশা করতে পারি যে, পূর্বের পত্র দ্বারা যে সমস্ত পদক্ষেপ প্রস্তাবিত হয়েছিল তা আপনারা গ্রহন করেছেন?
আমরা এখনও জানি না জনাব হোসেন আলী কর্তৃক প্রেরিত অর্থ আপনারা পেয়েছেন কি না, দয়া করে জানাবেন কি?
সালাম রইল।
আপনার বিশ্বস্ত,
(আমরা)
জনাব এম মাকসুদ আলী,
প্রেস কর্মকর্তা,
বাংলাদেশ মিশন
৯ সার্কাস এভিনিউ,
কলকাতা-১৭,
ভারত।
নং। তথ্য ১০/০১/৭১ আগস্ট ২১, ১৯৭১
প্রিয় আমোরা,
আপনাদের প্রেরিত আগস্ট ১ তারিখের রিপোর্ট এবং আগস্ট ১১ তারিখের পত্রের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
আমাদের আগস্ট ৭, ১৯৭১ তারিখের চিঠিতে আমরা আপনাকে জানিয়েছিলাম যে, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র সচিব স্বাক্ষরিত পত্র উভয় ব্যক্তির নিকট প্রেরণ করা হয়েছে। আপনি হয়তো আমাদের চিঠি পেয়েছেন। বস্তুত আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আপনাদের প্রতিষ্ঠানসহ সকল বাঙ্গালী কূটনীতিক যারা প্রবাসে কাজ করছেন তাদের কাছে লিখেছে। আমরা ইন্দোনেশিয়ায় কিছু পত্রিকার এবং মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের ঠিকানার লিস্ট পেয়েছি। বর্তমানে আমরা আপনাকে ২০ কপি সাপ্তাহিক বুলেটিন বাংলাদেশ এবং এক কপি ‘দ্য পিপল’ সরবরাহ করছি। আমরা মনে করি বুলেটিন এবং ‘দ্য পিপল’ এর কপি আপনার দেয়া ঠিকানায় পাঠানোর পরিবর্তে বর্ধিত পরিমান কপি আপনাদের সরবরাহের পর সেখান থেকে বিতরণ করা সুবিধাজনক হবে। আমরা সেখানে এই কপি বিতরনে অসুবিধা সম্পর্কে অবগত নই। আমরা অবশ্য আপনার প্রচারণার খরচের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থের ব্যবস্থা করতে পারি।
যদি আপনারা বিতরণ কার্য সম্পাদন করেন দয়াবশত জানাবেন কি আমাদের কোথায় এবং কার কাছে অর্থ পাঠাতে হবে?
আমরা জনাব মাহমুদের কাছ থেকে মোট ৫০ ইউ এস ডলার পেয়েছি এবং এখন পর্যন্ত এটিই ইন্দোনেশিয়া থেকে মিশনের পাওয়া প্রথম সাহায্য।
বিনীত,
স্বাক্ষরিত
(এম মাকসুদ আলী)
জনাব আমোরা
জাকার্তা পেমান্ডাঙ্গান ১১/১০
জিএন সেহারিয়ান্টজাল
ডেপান এ ১ পি
জাকার্তা উতারা
ইন্দোনেশিয়া
<৪,১৮৭,৩৭১-৩৭২>
অনুবাদকঃ ফাহমিদা আক্তার বৃষ্টি
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৮৭। বাংলাদেশের সরকারের পক্ষে ইন্দোনেশীয় জনগণের তৎপরতা সম্পর্কে লিখিত প্রতিবেদন | ‘আমরা’ | ১৬ আগস্ট, ১৯৭১ |
জাকার্তা- ১৬-৮-৭১
১) প্রায় সব পত্রিকা, রেডিও এবং টিভিই ইন্দো-সোভিয়েত চুক্তির সংবাদ অন্তর্ভুক্ত করেছিলো। নীতিগতভাবে মন্তব্যগুলো তেমন একটা পৃথক ছিলো না। একটি বিষয়ে প্রায় সকলেই সম্মত ছিলো যে পাকিস্তানের দেওয়া যুদ্ধের হুমকি এবং পাকিস্তান প্রতি চীনাদের সমর্থনের কারনে চুক্তিটি ত্বরান্বিত করা হয়েছিলো (সমঝোতা প্রথমে শুরু হয়েছিলো ১৯৬৯) ।
২) পাকিস্তান পরিদর্শনে কেনেডিকে প্রত্যাখান, প্রত্যাখানের ব্যাপারে ইউ এস স্টেট ডিপার্টমেন্টের অনুতাপ ও উদ্বিগ্নতা এখানকার স্থানীয় ও বিদেশি ভাষার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিলো।
৩) কেনেডির আগরতলা, মেঘালয় এবং অন্যান্য শরণার্থি এলাকা পরিদর্শন এবং তাকে স্বাগত জানানোকালে একসাথে চিৎকার করে বলা “জয় বাংলা”, “শেখ মুজিব দীর্ঘজীবী হোক” এখানের পত্রিকাগুলো প্রচার করেছিলো। তার মন্তব্যগুলোও প্রকাশিত হয়েছিলো।
৪) ঢাকা ইন্টারকন্টিনেন্টালে বোমা হামলায় ১৫ জনের মতো লোকের হতাহতের ঘটনায় লোকজন বুঝেছিলো যে বাংলাদেশি গেরিলারা এখনও সজীব আছে এবং তাদের কার্যকলাপ আরো তীব্রতর করছে।
৫) শেখ মুজিবুরের বিচারিক কার্যক্রম তার ছবিসহ ছাপা হয়েছিলো। খবরটি সব পত্রিকাই ছাপিয়েছিলো। জাকার্তা টাইমসের সম্পাদকীয় ছিলো সাহসী, বাস্তবিক এবং ন্যায়নিষ্ঠ (কর্তিত অংশ যুক্ত করা হলো)।
৬) শেখ মুজিবুরের বিচারিক কার্যক্রম নিয়ে ইউএস স্টেট ডিপার্টমেন্টের দুঃশ্চিন্তা এবং বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে ইউ ট্যান্টের সাথে রজারের আলোচনা এখানে ছাপা হয়েছিলো।
৭) কতগুলো ঠিকানার একটি তালিকা গত সপ্তাহে পাঠানো হয়েছে। এতে দশটি নাম রয়েছে। অনুগ্রহপূর্বক তাদের নিকট “দ্য পিপল” এর কপি নিয়মিত পাঠাবেন । এই বিষয়ে ব্যয়ভারের জন্য অর্থ প্রেরণের আয়োজন করছি আমরা।
৮) জনাব মাকসুদ আলীর পাঠানো ৭ই আগস্টের চিঠির জন্য ধন্যবাদ। আমরা নিয়মিত সংবাদপত্র এবং অন্যান্য তথ্য পাই না। জরুরি প্রয়োজনের বিষয়ে উপদেশ চাওয়া চিঠিটির উত্তর সম্ভব হলে দ্রুত প্রেরিত হোক।
৯) দুই ভদ্রলোকের আচরণে এখনও কোনোরকম পরিবর্তনের লক্ষণ নেই। তা সত্ত্বেও তাদেরকে আরো কিছু সময় সতর্কতার সাথে বুঝা এবং পর্যবেক্ষণের পরে একটি প্রতিবেদন আসবে।
১০) স্বাধীনতা দিবসে মিসেস গান্ধীর বক্তৃতা এবং তার উল্লেখ করা বাংলাদেশ সংগ্রামের বিষয়টি সব পত্রিকাই সংগ্রহ করেছিলো।
১১) শেখ মুজিবের মুক্তি ও নিরাপত্তার জন্য স্টেটের চব্বিশ জন প্রধানের নিকট মিসেস গান্ধীর আবেদন এখানে প্রকাশিত হয়েছিলো।
১২) সরকারের বিভিন্ন বিভাগ, সংবাদ বিভাগ এবং উচ্চ ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে পাকিস্তান বেশকিছু ‘শ্বেতপত্র’ প্রচার করে । সংবাদ বিভাগকে এর বিষয়বস্তু নিয়ে খুব একটা আগ্রহী মনে হয়নি। কিছু সংবাদপত্র এটি খুবই সংক্ষিপ্ত আকারে প্রকাশ করেছিলো।
১৩) পাকিস্তানের প্রাক্তন তথ্যমন্ত্রী স্লায়ার আলী বর্তমানে এই শহরে একটি সফরে আছেন, সম্ভবত স্বরন সিং এর বিরোধিতা করতে এবং সরকারের ও জনগণের মনের ঝোঁক সম্পর্কে তার সরকারকে প্রতিবেদন দিতে। তাকে আমলা ও কূটনীতিকদের পরিমণ্ডলে ঘুরাঘুরি করতে দেখা গিয়েছিলো।
১৪) স্বরন সিং এর সফর মনে হয় রাজধানীর কঠোর মনোভাব কিছু পরিমাণে নরম করতে পেরেছে। যৌথ প্রজ্ঞাপনে এটি বাংলাদেশ পরিস্থিতি এবং শরণার্থি সমস্যা নিয়ে দুঃশ্চিন্তা প্রকাশ করেছে। সারসংক্ষেপ সংযুক্ত করা হলো।
১৫) শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার কার্যক্রমের ব্যাপারে সংবাদপত্রগুলোর মন্তব্য ছিলো প্রায় সর্বসম্মত যে, এই ধরণের সচিবেরা তাকে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করতে পারে। বিচার বিষয়ে অন্যান্য প্রদেশে প্রকাশিত মন্তব্যও বহন করেছিলো সংবাদপত্রগুলো।
১৬) সম্প্রতি যেসব পর্যবেক্ষকেরা বাংলাদেশ সফর করেছিলো, এই মতে ছিলেন যে গেরিলা যুদ্ধ তীব্রতর হয়েছে এবং দখলদার শক্তি ইতোমধ্যেই সাহস এবং নৈতিকতা হারিয়েছে।
(আমরা)
প্রাপক
জনাব এম মকসুদ আলী,
প্রেস সহদূত
বাংলাদেশ মিশন,
৯ সার্কাস এভিনিউ, কলকাতা-১৭,
ভারত।
<৪,১৮৮,৩৭৩-৩৭৪>
অনুবাদকঃ ফাহমিদা আক্তার বৃষ্টি
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৮৮। ‘আমরা’ গোষ্ঠী কর্তৃক সাংকেতিক নাম ব্যবহার এবং আন্দোলনের বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে বাংলাদেশ সরকারকে লিখিত চিঠি | ‘আমরা’ | ১৯ আগস্ট, ১৯৭১ |
গোপন
জাকার্তা-আগস্ট ১৯,১৯৭১
প্রিয় হোসাইন আলী সাহিব,
বাংলাদেশের প্রতি আপনার আনুগত্যসূচক ঐতিহাসিক ঘোষণার আগে আমরা দেশের স্বার্থে কিভাবে নিজেদের কার্যকরি করতে পারি তা নিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়তার গভীর সাগরে ছিলাম। আপনার প্রক্রিয়া অন্যান্য অনেককেই দেশের বাইরে উদ্যোগ সংগঠিত করার জন্য যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করতে ও উপদেশ প্রার্থনা করতে পথ দেখিয়েছিলো এবং গতিপথ খুলে দিয়েছিলো। যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার পর থেকে, শহরের প্রবণতা ও অগ্রগতির উপর আমরা নিয়মিত আপনাকে প্রতিবেদন পাঠাচ্ছি। আপনার মিশনের উপর কাজের বিশাল বোঝা ও ভয়াবহ চাপ সত্ত্বেও আমরা খুশি যে, গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর আমাদের আইনগত অনুসন্ধানের উপর মনোনিবেশ করা হচ্ছে।
আমাদের কিছু সংখ্যক সমস্যা ও সীমাবদ্ধতা আছে যেসব আমরা আপনার সাথে আলাদাভাবে উন্নতিসাধনের চেষ্টা করতে পারি। এই চিঠিটি আপনাকে সংক্ষেপে জানানোর জন্য যে, মারাত্মক বিরোধ ও বাধা, বিশেষ করে নীতি নির্ধারকদের কঠিন মনোভাব সত্ত্বেও আমাদের প্রচেষ্টা আংশিক সফলতার দেখা পেয়েছে। যাইহোক, আমরা আমাদের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
আপনি আমাদের বিভিন্ন প্রতিবেদন ও সংবাদের বিভিন্ন কর্তন করা অংশ থেকে এখানকার সংবাদ মাধ্যমগুলোর হাওয়া বুঝতে পেরেছেন এবং আমরা যোগ করতে পারি যে, লাখ লাখ জনগণ আমাদের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেছে এবং আপনাদের দুর্দশার প্রতি সমব্যাথী।
এই দেশে বাঙালি বসতি স্থাপনকারীরা খুবই কম এবং কদাচিৎ। জাকার্তায় শুধুমাত্র দুইটি পরিবার আছে এবং তারা আর্থিকভাবে খুবই অক্ষম ও সামাজিকভাবে অনগ্রসর। আমরা আপনার উপদেশ বিবেচনা করেছিলাম। তাদেরকে খোলামেলাভাবে কোনকিছু করতে বলার জন্য উৎসাহিত করা সম্ভব না। উপরন্তু কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপের ও আমাদের প্রকাশ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। যদি পরিস্থিতি অনুকূলে থাকে, তাহলে সঙ্ঘটি প্রশ্নের সাথে যথাযথভাবে গ্রহণ করা হবে। যাইহোক, আমরা আপনাকে জানাতে পারি যে, আপনার অফিসের সাথে যোগাযোগের শুরুতে আমরা নিম্নলিখিত তিনজন সদস্য নিয়ে “আমরা” দল গঠন করি যেন সীমিত সম্পদ নিয়ে ও বিভিন্ন অক্ষমতার বিরুদ্ধেও যা কিছু সম্ভব করা যায়:
নাম কোড-নেম কাজের বণ্টন
১) আ. ফ. ম. শামসুজ্জামান কামাল সমন্বয় ও গবেষণা
২) আ. ব. ম. সানাউল্লাহ সুফি সংগঠন ও জনসংযোগ
৩) সিদ্দিক আহমেদ রুমি সংবাদ ও প্রকাশনা
নিরাপত্তার কারণে, আমরা এই চিঠিটি এখানকার ভারতীয় দূতাবাসের সৌজন্য মাধ্যমে পাঠাচ্ছি। আমাদের ঠিকানা যা ইতোমধ্যেই আপনাদের অফিসে আছে ( পামাডাঙ্গান ২/১০, সাহারী পর্বত, এ. আই. পি. ভবনের সম্মুখে, উত্তর জাকার্তা), সাধারণ বার্তা পাঠাতে ব্যবহৃত হতে পারে। অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে, যদি আপনি এটি যুক্তিযুক্ত মনে করেন, পরবর্তী ঠিকানাটি অনুগ্রহপূর্বক খামের উপরে ব্যবহৃত হতে পারে: দলনেতা এন. সিনহা রায়, ভারতীয় দূতাবাস, জাকার্তা, প্রাপক পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রী, নয়াদিল্লী। ভেতরের খামে শুধুমাত্র “আমরা” উল্লেখ করা যেতে পারে। যদি যোগাযোগের অন্য কোন নিরাপদ ও নিশ্চিন্ত উপায় থাকে, তাহলে দয়া করে আমাদের পরামর্শ দিতে পারেন।
অন্যান্য দেশে আমাদের সংগঠনের সাথে প্রায়ই আমাদের তথ্য আদান-প্রদানের দরকার হতে পারে। আমরা কৃতজ্ঞ থাকবো আপনার কাছে যদি আশু একটি তারিখে আপনি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নাম ও ঠিকানা আমাদের সরবরাহ করতে পারেন। আমাদের ঠিকানাও তাদের কাছে প্রচার করা যেতে পারে। তবুও নিরাপত্তার খাতিরে ভবিষ্যতে দয়া করে আমাদের সাংকেতিক নাম ব্যবহার করবেন।
এই চিঠিটি আমাদের ক্ষমতাপ্রাপ্ত সদস্যদের সাংকেতিক স্বাক্ষরের মাধ্যমে প্রেরণ করা হচ্ছে। যদি কোন গুরুত্বপূর্ণ চিঠি এই স্বাক্ষর বহন না করে, এমন চিঠি উপেক্ষা করা যেতে পারে।
আমাদের ব্যক্তিগত গভীর সম্মানের সাথে,
জয় বাঙলা
আপনার অনুগত,
আমরা
জনাব হোসাইন আলী
বাংলাদেশ মিশনের প্রধান
কলকাতা।
<৪,১৮৯,৩৭৫-৩৭৭>
অনুবাদকঃ কাজী ইসরাত জাহান তন্বী
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৮৯। ‘আমরা’ গোষ্ঠীর তৎপরতা এবং অর্থনৈতিক অবস্থা জানিয়ে বাংলাদেশ সরকারকে লিখিত চিঠি | ‘আমরা’ | ৩১ আগস্ট, ১৯৭১ |
জাকার্তা-৩১শে অগাস্ট,১৯৭১
প্রিয় হোসেইন আলি সাহেব,
গত সপ্তাহে আপনাকে আমরা শুরুর দিককার কিছু সদস্যদের নাম, কোড এবং কাজের অবস্থা জানিয়ে চিঠি দিয়েছিলাম। চিঠি প্রাপ্তি হয়ত স্বীকার করে থাকবেন।
জনগন সহানুভূতিশীল হলেও নীতিনির্ধারকেরা তাদের কাঠিন্যের ব্যাপারে অনড়। আমরা প্রতিনিয়ত সহানুভূতিশীলদের এবং অন্যান্য বিখ্যাত মানুষদের কী হচ্ছে, কী পাচ্ছি তা জানাচ্ছি এবং পাঠকদের প্রতিনিয়ত আমাদের অবস্থা জানাচ্ছি যাতে তারা এই বিষয়ে জানতে পারে। শুরুর দিকে এবং তাড়াহুড়ার মধ্যে উপকরনের অপার্যপ্ততার মধ্যেও কামালের রচিত “পাকিস্তান-এর জন্ম এবং মৃত্যু” শীর্ষক একটি রচনা পত্রিকায় প্রকাশ পায়। এটি বাংলাদেশের ইতিহাস এবং বর্তমান আন্দোলন ও স্বাধীনতা সংগ্রামের বিস্তৃত বর্ননা্র প্রতিনিধিত্ত করে। এই পত্রিকা অসংখ্য রাজনিতিবিদ, নেতা এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ দ্বারা প্রচারিত হয়েছিল। আপনি নিশ্চত থাকতে পারেন যে, এই প্রচার অবশ্যই কিছু মানুষকে প্রভাবিত করবে। এক কপি আপনাকে পাঠালাম। পুনরায় প্রাচারিত হবার সময় কি কি বিষয় পরিবর্ধন ,পরিমার্জন করা লাগবে দয়া করে এই বিষয়ে উপদেশ দেবেন।
আপনি আমাদের সম্পদের অপ্রতুলতার কথা জানেন। তা থেকে একটি পঞ্চাশ ডলারের ডোনেশন পাঠালাম। আমরা কিছু পরিমান অর্থ বিভিন্ন ক্যাবল, বিশিষ্ট ব্যক্তিদের এবং মুসলিম নেতাদের চিঠি পত্র পাঁঠাতে ব্যায় করেছি। স্থানীয় খরচাও প্রচুর। এই সব খরচার বেশীরভাগ কামাল ই যোগাচ্ছে। তবে তাকে আর যারা সাধ্যমত তাকে চেষ্টা করছে, তারা হলঃ
১। রুমি
২। রোহানি(জনাব এ এইচ সরকার)
৩। সাপড়ি(জনাব রুহুল আমিন)
ইতোমধ্যে আমরা জনাব মাকসুদ সাহেব কে একটি চিঠি দিয়ে অনুরোধ করেছি যাতে সমাজে, রাজনীতিতে, সাংবাদিকতায় প্রভাবশালি তালিকাভুক্ত ১০ জন ব্যাক্তির নিকট নিয়মিত “দ্য পিপল” পাঠাতে। পত্রিকার খরচ আমরা নিজেরা খরচ বহনের ব্যাপারে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছি এবং সে মত এতদসংগে ২৫ডলার প্রেরণ করছি। এ ব্যাপারে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে কিনা জানালে কৃতজ্ঞ থাকব।
আমাদের কাজ প্রতিনিয়তই কঠিন হচ্ছে তাই আমাদের সরকারের কর্মকান্ডের খবরাখবর যদি সাধারন মানুষের পাশাপাশি সাংবাদিক এবং ওইসব লিস্টেড বিখ্যাত মানুষদের জানাতে পারি এবং তাদের যদি পাশে পাই তাহলে আমরা বিনা ডাকমাসুলে প্রচারনা চালাতে পারব।
আমরা আপনাকে আরও অনুরোধ করেছিলাম যেন অন্যান্য দেশে বাংলাদেশের মিশন/এসোসিয়েশন/অর্গানিজেশনের ঠিকানা পাঠানো হয়। এর ফলে আমরা তথ্য ও পরামর্শ প্রদান করতে পারব। আপনি আশু পদক্ষেপ নিলে চির কৃতজ্ঞ থাকব।
শ্রদ্ধা সমেত
জয় বাংলা
বিনীত নিবেদক,
(আমোরা)
জনাব হুসেইন আলি,
হেড অব বাংলাদেশ মিশন,
৯ সার্কাস এভিনিউ,কলকাতা-১৭
ভারত
আমোরা
জাকার্তা
অনুদানসমুহ
(৩১অক্টোবর, ১৯৭১ অনুযায়ী)
নাম ইউএস ডলার ইন্ডন.আরপি
০১.কামাল — ৫০/- ৫২,০০০/-
০২.সুফি — — —
০৩.রুমি — ৩৫/- —
০৪.সাপড়ি — ২০/- —
০৫.রূহানী — ২০/- —
০৬.আনসার(নিজ খরচ সমেত হামিদকেও
সাহায্য করেছে) ১০,০০০/-
——————————————
মোট ১২৫ ৬২,০০০/-
অথবা,১৬০ ইউএস ডলার
খরচাসমুহ
(৩১/১০/১৯৭১ অনুযায়ী)
১,বাংলাদেশ মিশনে প্রেরিত রেমিটেন্স ৫০/- —
(জনাব হুসেইন আলি)
২,বিভিন্ন কাগজ পত্র বাবদ
বাংলাদেশ মিশনে প্রেরিত রেমিটেন্স ২৫/- —
(জনাব মাকসুদ আলি)
৩, একটি টাইপ রাইটার ক্রয় বাবদ
(পুরাতন) ১২০০০/-
৪,জাতিসংঘ এবং অন্যান্য
আন্তর্জাতিক চিঠিপত্রের ডাকমাসুল বাবদ ২০০০০/-
৫,সুফি এবং হামিদের পরিবহন খাতে খরচ ১০০০০/-
৬,হামিদের অর্থনৈতিক সাহায্য(স্থানিয় এজেন্ট) ৩১০০/-
৭,আনসারের হামিদ কে সাহায্যসহ পরিবহন খাতে খরচ ১০০০০/-
৮,অপারেশনের খরচা(বিভিন্ন ডাকমাসুল সহ) ২৬৯০০/-
——————-
মোট ৭৫/- ৮২,০০০/-
ব্যালেন্স (+) ৫০/- (-) ২০,০০০/-
ডলার ব্যালেন্স দ্বারা ঘাটতি রুপি সমন্বয় করা হল (+)২০,০০০/-
অবশিষ্ট ব্যালেন্স পাঠিয়ে দেয়া হল।
অবগতির জন্যঃ
১। জনাব হুসেইন আলি
২। জনাব মাক্সুদ আলি
৩। কাজি আনওয়ারুল ইসলাম
(রুমি)
আমরার পক্ষ থেকে
——————
<৪,১৯০,৩৭৮-৩৭৯>
অনুবাদকঃ জয়ন্ত সেন আবীর
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৯০। ‘আমরা’ গোষ্ঠী কর্তৃক প্রচারিত একটি প্রতিবেদন | ‘আমরা’ | ৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ |
জাকার্তা, ৫ সেপ্টেম্বর
রিপোর্ট
(২ নং)
১) প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সবার জন্যে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছেন। এর মধ্যে বিদ্রোহী রাজনীতিক, বেসামরিক এবং সামরিক কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং অন্যান্য সকল ব্যক্তিবর্গ যারা ১ মার্চ থেকে ৫ সেপ্টম্বর পর্যন্ত এরূপ কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন। ঘোষণা অনুযায়ী পক্ষ বদলকারী কূটনীতিকরা তাদের নিজ নিজ মিশনে কাজে যোগদান করতে পারবে।
২)সাধারণ ক্ষমার আওতায় জনাব আতাউর রহমান খান বন্দিদশা থেকে মুক্তিলাভ করেছেন বলে সংবাদ পাওয়া গিয়েছে। এখানকার কিছু কিছু সংবাদপত্র এই ঘোষণাকে ইয়াহিয়ার বেসামরিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রতি একটি পদক্ষেপ হিসেবে উষ্ণভাবে গ্রহণ করেছে।
৩) ঘোষণাটিতে শেখ মুজিবুর রহমান অথবা আটক বা আত্মগোপনে থাকা আওয়ামী লীগের অন্যান্য উচ্চপর্যায়ের নেতাদের সম্পর্কে পরিষ্কার করে কিছু বলা হয় নি। বলা হচ্ছে যে ঘোষণাটি সকলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে।
৪) টিক্কা খানের জায়গায় গভর্নর হিসেবে ড. মালিকের নিয়োগ এখানকার ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক চক্র সাদরে গ্রহণ করেছে। প্রেস এবং অন্যান্য গোষ্ঠী ইয়াহিয়ার উদ্দেশ্য সম্বন্ধে সন্দিহান। গভর্নরকে ইয়াহিয়া কতটুকু ক্ষমতা দিবে এবং যখন পর্দার পেছন থেকে সেনাবাহিনীইসবকিছু পরিচালনা করছে তখন আসলে নতুন গভর্নর কতটুকু সফল হতে পারবেন সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ থেকে যায়। কয়েকটি পত্রিকার মতে এটি হল চূড়ান্ত আত্মসমর্পণের দিকে প্রথম পদক্ষেপ।
৫) কিছু কিছু সূত্রমতে, শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার ৩ মাসের জন্যে পিছিয়ে দেয়া হয়েছে। এই পদক্ষেপকে কূটনৈতিক গোষ্ঠী দুই ভাবে বিচার করছে। প্রথমত, বিশ্ব জনমত বিপক্ষে চলে যাওয়ায় এবং সম্ভাব্য গভীর প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কায় অখণ্ড পাকিস্তান বজায় রেখে কোনো সমাধানে আসবার চেষ্টা করা। দ্বিতীয়ত, ইয়াহিয়া এবং তার উপদেষ্টামণ্ডলী বাংলাদেশকে নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে সকল আশা পরিত্যাগ করেছে। এই বিচার বাংলাদেশ এবং সারা বিশ্বে ভয়ানক প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়া ছাড়া আর কোনো ফল বয়ে আনবে না।
৬) বহু ক্ষেত্রে পাকিস্তানিদের দ্বন্দ্ব আগ্রহী গোষ্ঠীদের গোচরে এসেছে। সম্প্রতি এমন একটি দ্বন্দ্বের উদ্ভব হয় শরণার্থীদের সংখ্যা নিয়ে।
৭) আমাদের যোগাড় করা জিনিসপত্র বিভিন্ন সূত্রের মাধ্যমে আগ্রহী ও সহানুভূতিশীল এলাকাগুলোতে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। গত সপ্তাহে আমরা নিম্নলিখিত সামগ্রী হস্তান্তর করেছি-
i)১ আগস্ট লন্ডনের সানডে টাইমসে প্রকাশিত “অ্যা প্লট এগেইন্সট ইয়াহিয়া খান (ইয়াহিয়ার বিরুদ্ধে একটি ষড়যন্ত্র)”
ii)রেগ প্রেন্টিসের লেখাদ্যা পিপল পত্রিকায় প্রকাশিত “অ্যাক্টস অফ রিপ্রেশন ইন বাংলাদেশ (বাংলাদেশে নির্যাতনের নাটক)”
iii)৬ আগস্ট দ্যা ম্যানচেস্টার গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত “হোয়াইল পেপার অ্যাডসলিটল টু বেঙ্গল স্টোরি (পত্রিকাগুলো যখন বাংলাদেশ সম্পর্কে খুব কমই বলছে)”
iv)৩১ জুলাই লন্ডনের ইকোনোমিস্টে প্রকাশিত “টাইম ইজ রানিং আউট ইন বেঙ্গল (বাংলায় সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে)”
v)১০ আগস্ট নিউ ইয়র্ক নিউজ উইকে প্রকাশিত“বেঙ্গলঃদ্যা মার্ডার অফ পিপল (বাংলাঃ সাধারণ জনগণের মৃত্যু)”
vi)২ আগস্ট নিউ ইয়র্ক টাইম ম্যাগাজিনে প্রকাশিত“গুড সোলজার ইয়াহিয়া খান (ইয়াহিয়া, একজন দক্ষ সৈনিক)
vii)২ আগস্ট লন্ডনের“দ্যা ডেইলি টেলিগ্রাফ” পত্রিকার সম্পাদকীয়।
৮) আমরা এখনো জানি না যে “দ্যাপিপল”এরকপি সেখান থেকে সরাসরি প্রেরণের কাজটি ঠিকভাবে করা হয়েছে কি না। আমরা ১০টি নাম সুপারিশ করি এবং প্রেস অ্যাটাচে এর কাছে মুদ্রাও প্রেরণ করা হয়।
৯) এশিয়ার প্রেস ফাউন্ডেশন পাকিস্তানে প্রেসের স্বাধীনতা খর্ব হবার ব্যাপারে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সংগঠনটি এর সভায় পূর্ব পাকিস্তানে সংবাদকর্মীদের হত্যা এবং পশ্চিম পাকিস্তানে তাদের কারারুদ্ধকরণের ব্যাপারে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
১০) ইন্দোনেশিয়ান অবজারভার এ আগস্টের ৩০ এবং সেপ্টেম্বরের ৩ তারিখে প্রকাশিত দুটো সম্পাদকীয়তে বাংলাদেশ প্রশ্নে এর পূর্ববর্তী অবস্থান থেকে সরে আসবার প্রমাণ পাওয়া যায়। এই দুটো সম্পাদকীয় এর কপি সাথে যুক্ত করা হল।
(আমরা)
প্রেস অ্যাটাচে
বাংলাদেশ মিশন
৯ সার্কাস অ্যাভিনিউ, কলকাতা-১৭
ভারত
<৪,১৯১,৩৮০-৩৮১>
অনুবাদকঃ জয়ন্ত সেন আবীর, সাবরিনা
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৯১। প্রচার মাধ্যমে বাংলাদেশের পক্ষে মতবাদ গড়ে তোলার সাফল্যের সংবাদ জানিয়ে বাংলাদেশ সরকারকে চিঠি | ‘আমরা’ | ৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ |
জাকার্তা, ৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
প্রিয় মাকসুদ সাহেব,
আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে আমরা আপনাকে ১০ জনের নামের একটি তালিকা পাঠিয়েছিলাম। আমরা আপনাকে এদের প্রত্যেকের কাছে “দ্যাপিপল”এরকপিপাঠাতেঅনুরোধকরেছিলাম।খরচাপাতি বহন করবার দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে আমরা ইতোমধ্যেই আপনাকে ২৫ মার্কিন ডলার পাঠিয়ে দিয়েছি। ইতোমধ্যে এ সংক্রান্ত কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে কি না জানতে পারলে আমরা খুশি হব।
আমরা আপনাকে আরো অনুরোধ করেছিলাম যেন আপনি এই তালিকাভুক্ত মানুষগুলোর কাছে আমাদের মিশন কর্তৃক প্রকাশিত যেসব বুলেটিন বা অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র বিনামূল্যে বিতরণযোগ্য সেসব পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করেন।আমরা নিশ্চিত করেছি যে এসবেরপোস্টাল খরচ আমরাই বহন করব।
আগস্টের ৩০ তারিখের ইন্দোনেশিয়ান অবজারভার পত্রিকার সম্পাদকীয়ের একটি কপি সাথে সংযুক্ত করা হল। আপনি লক্ষ্য করলে পূর্ববর্তী অবস্থান থেকে এতে মনোভাবের পরিবর্তন দেখতে পাবেন। এর পেছনে আমাদের কর্মকাণ্ডে তীব্রতার অভাবই ভূমিকা রেখেছে। আমরা আমাদের কাজকর্ম খোলামেলা ভাবে এবং তীব্রতার সাথে পরিচালনা করতে পারি না এবং এর কারণ স্পষ্টতই প্রতীয়মাণ। আরেকটি কারণ হল আমাদের প্রতিপক্ষের লোকজন কর্তৃক ক্রমাগত ভুল ধারণার সঞ্চালন। যাহোক, এখনো আমাদের জন্য হতাশাব্যঞ্জক কিছু ঘটে নিআর আমরা আমাদের লক্ষ্যের প্রতি অনুকূল, না হলে অন্তত যথাযথ একটি ধারণা গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। আমরা বিশ্বাস করি কাগজপত্রগুলো সরাসরি আপনাদের কাছ থেকে তাদের কাছে পৌঁছালে তাদের মনোভাব সহজেই আমাদের অনুকূলে পরিবর্তন করা সম্ভবপর হবে। আপনি ইতোমধ্যেই এ ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন কিনা জানালে কৃতজ্ঞ থাকব।
তথ্য উপকরণ ও সংবাদপত্রের সরবরাহ আমারা নিয়মিত পাই না। মাঝেমধ্যে এগুলো হাতে পেতে এতটাই দেরী হয়ে যায় যে এদের উপযোগিতা এবং তাদের প্রতি আগ্রহ উভয়েইশেষ হয়ে যায়। প্রতিদিন আপনার কি পরিমাণ চাপ এবং কাজের বোঝা মাথায় নিয়ে থাকেন তা আমরা উপলব্ধি করি। তবে এই কঠিন ক্ষেত্রে আমাদের কর্মকাণ্ডে গতি সঞ্চারের লক্ষ্যে আপনি যদি দয়াবশত উপকরণ এবং সংবাদপত্রের নিয়মিত সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারেন তবে আমরা কৃতার্থ হব।
আন্তরিকতার সাথে,
আপনাদের
‘আমরা’
জনাব মাকসুদ আলী
প্রেস অ্যাটাচে
বাংলাদেশ মিশন
৯ সার্কাস অ্যাভিনিউ
কলকাতা-১৭
ইন্দোনেশিয়ান অবজারভার
সোমবার,৩০শে আগস্ট,১৯৭১
সম্পাদকীয়
পূর্ব পাকিস্তানের ট্র্যাজেডি
পূর্ব পাকিস্তানে ঘটমান ঘটনাগুলো বহির্বিশ্বের সামনে সংবাদপত্রের মাধ্যমে উঠে আসছিল যার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল পূর্ব পাকিস্তানের উদ্বাস্তুদের বাংলাদেশের সীমানা পার করে ভারত পাড়ি দেওয়াতে তাদের যে অভূতপূর্ব দুঃখদূর্দশা পোহাতে হচ্ছিলতা প্রকাশ পাচ্ছিল। মার্কিন সিনেট জুডিশ্যারি সাবকমিটির চেয়ারম্যান সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে রিফিয়্যুজি ক্যামপ পরিদর্শনের পর নিশ্চিত করন যে পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার পাঁচ মাসব্যাপী সংঘাতের ফলে প্রায় ৭…৫ মিলিয়ন বাঙ্গালি ভারতে উদ্বাস্তু হিসেবে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে।সহায় সম্পত্তি বা নিকটাত্মীয়হারানোই শেষ নয়, অনেক উদ্বাস্তু ইতোমধ্যে মারা গেছে বা বিভিন্ন রোগের কারণে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। অবস্থা এমনই যে মৃত্যুও বেশি আকাঙ্খিত তাদের কাছে।ভারতের কিছু শরণার্থী শিবিরে ঘুরে কেনেডি বলেন“এটা ছিল সমসাময়িক সময়ের মানব দুর্দশার সবথেকে মর্মান্তিক চিত্র”।
নিক্সন সরকারের ইয়াহিয়া খানের সাথে সকল কূটনীতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্য শরণার্থী শিবিরে শরণার্থীদের ভোগান্তির পরিমাণ সম্পর্কে কেনেডির বর্ণনার পর আর কোনো প্রমাণ লাগেনা এবং রাওয়ালপিন্ডিতে তার শাসন হঠকারীতা ছাড়া আর কিছুই নয়। পূর্ব পাকিস্তানে ইয়াহিয়ার সৈন্যবাহিনীর নৃশংসতার তিরস্কার করা একরকমআর একটা সমগ্র জাতি,এর সরকার আর এর জনগণকে বর্জন করাকিন্তুসম্পূর্নভিন্ন ব্যপার।এটা কখনোই কারো ভূল শুধরানোর জন্য সঠিক উপায় নয়। ইয়াহিয়া সরকারের উপর এই দোষ বর্তায় যে তারা একটা রাজনৈতিক সমস্যাকে মিলিটারি উপায়ে সমাধানের চেষ্টা করছিল যা আইয়ুব খানের শাসনামল থেকেই শুধু পূর্ব পাকিস্তান নয় বরং সমগ্র জাতির উপর চলে আসছে। ইয়াহিয়া খান তার পূর্বপুরুষদের থেকেও খারাপ ছিল কারণ সে স্বশস্ত্র সৈন্যবাহিনীকে পূর্ণ ক্ষমতায় নিরস্ত্র বাঙালীর উপর লেলিয়ে দিয়েছিল যার জন্য অনেক মানুষ ভারত পাড়ি দেয় আবার কোথাও কোথাও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। এছাড়াও শেখ মুজিবর রহমান কে গ্রেফতার করা এবং তার আন্দোলনে সমর্থনের জন্য তাকে সামরিক আইনের আওতায় নিয়ে যাওয়া আরো একটি অযৌক্তিক এবং নিন্দনীয় পদক্ষেপ ছিল।
ইয়াহিয়া খানের এভাবে শক্তি প্রয়োগ করে বিরোধীদেরদমিয়ে রাখা বা শেখ মুজিবর রহমানকে এভাবে মিথ্যা আইনের আশ্র্ররয়ে কোর্টে পাঠানো এগুলা সব ভূল হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের জন্মের যে দাবি তাগ্রহণ করা হয়নি।এটা স্পষ্ট ছিল যে বড় বড় শক্তিবর্গ এই বিভাগীকরণ প্রস্তাবনায় খুব বেশী আগ্রহ দেখায়নি।এমতাবস্থায় শরণার্থীদের চাপ থাকা সত্ত্বেও ভারতের অবস্থান ছিল প্রশংসনীয়। নিঃসন্দেহে এমন অনেক মানুষ ছিল যারা বাংলাদেশের জন্মের দাবীকে সমর্থন করত। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমগ্র মহাদেশেই সমর্থক ছিল।উদাহরণস্বরুপ,এক সপ্তাহ আগেই যাকার্তার এক অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির কাছ থেকে সম্পাদকমণ্ডলীর কাছে“বাংলাদেশ” প্রজ্ঞাপনের কিছু অনুলিপিসহ একটি চিঠি আসে। এটাই প্রমাণ করে যে ইন্দোনেশিয়াতেও বাংলাদেশের সমর্থক আছে।যাই হোক, এটা সেগুলার ভিতরে ছিলনা।
<৪,১৯২,৩৮২-৩৮৩>
অনুবাদকঃ নাজিয়া বিনতে রউফ
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৯২। ইন্দোনেশিয়ায় জনগণের মতামতের উপর প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন | ‘আমরা’ | ১৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ |
জাকার্তা
১৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
রিপোর্ট
(নং. ৪)
১. ১০/৯/৭১ তারিখে রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়ার প্রস্তাবিত ইরান সফরের খবর এখানে প্রথম প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদন অনুযায়ী, সফরের উদ্দেশ্য ছিল ইরানী রাজতন্ত্রের ২৫০০ তম বার্ষিকী অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা।
২. OMEGA ত্রাণ কার্যক্রম দলের ৪জন সদস্যের গ্রেফতারের খবর এখানে প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে এটাও বলা হয় যে তাদের সাথে সম্মানজনক ব্যবহার করা হয়নি।
৩. বাংলাদেশের কাজে সমন্বয় সাধনের জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে ৮সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠনের খবর এই পত্রিকায় ছিল।
৪. বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর টেলিভিশন সাক্ষাতকার সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল। তিনি বলেন “আলোচনার পরিস্থিতি সবসময়ই আছে, কিন্তু দরকষাকষির মিমাংসার বিনিময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে দূরে ঠেলে দেয়া যেত না।” ইসলামাবাদের সামরিক শাসকদের সাথে রাজনৈতিক মিমাংসার সূত্রপাত অবশ্যই বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানী সৈন্য প্রত্যাহারের মাধ্যমে করতে হবে।
৫. জাতিসংঘের অধিবেশনে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে দল পাঠানোর ব্যাপারে বিবেচনা করা হচ্ছে, পররাষ্ট্র সচিবের এই ঘোষণা এখানে প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে এও প্রকাশিত হয়েছিল যে, প্রতিনিধিদলের প্রধান হবেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং এর অন্যান্য সদস্যবৃন্দের মধ্যে থাকবেন জনাব আবুল ফতেহ ও জনাব মাহবুব-উল-আলম।
৬. এই সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয় যে চায়নার সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ইচ্ছা পোষণ করেছে ভারত। কিন্তু চৌ-এন-লেই’কে দেয়া প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর চিঠির জবাব এখনও পাওয়া যায়নি।
৭. পাকিস্তান কর্তৃক প্রচারিত হোয়াইট পেপার প্রশংসার জন্ম দিতে পারেনি বরং এর মিথ্যাচারের কারণে বেশ কিছু মহলে বিতৃষ্ণার সৃষ্টি হয়েছে।
৮. এখানকার সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল যে, ইয়াহিয়া খানের সাথে ভুট্টোর সাক্ষাত কোন ফলাফল বয়ে আনতে ব্যর্থ হয়। এটাও প্রকাশিত হয়েছিল যে বেসামরিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা না হলে ভয়াবহ পরিণতির হুমকি দিচ্ছিলেন ভুট্টো। তিনি এটাও বলেন যে পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাবলী পশ্চিম পাকিস্তানে পুনরাবৃত্তি করা হবে।
৯. বিশ্বাসযোগ্য সূত্র থেকে জানা যায় যে, বেসামরিক সরকার চালু করার জন্য যদি পরবর্তীতে আন্দোলন শুরু হয় তবে সেক্ষেত্রে ন্যাপ (পশ্চিম পাক) প্রধান ওয়ালী খান ভুট্টোকে সমর্থন করবে। মিসেস ভুট্টো গত মাসে কাবুল সফরে ওয়ালী খানের সাথে যোগাযোগ করেন।
১০. মিশনে সংশ্লিষ্ট সকল পূর্ব পাকিস্তানীর পাসপোর্ট ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে।
১১. “বাংলাদেশ” সংবাদ বিজ্ঞপ্তি নং ৭ আগ্রহী মহলে প্রচারিত হয়েছে। ঠিকানাসমূহে (ইতিমধ্যে সরবরাহকৃত) দ্রুত সংবাদপত্র প্রেরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে কিনা সেটা এখনও জানা যায়নি।
(আমরা)
১২. গুরুত্বপুর্ণ সংবাদ সংযুক্ত করা হল।
সংবাদ দূত,
বাংলাদেশ মিশন,
৯ সার্কাস এভিনিউ,
কলকাতা-১৭।
বিদ্রঃ-১৩. জনাব আবু হানিফের নেতৃত্বে ড. নাসিরসহ এক বিশেষ প্রতিনিধিদল শনিবার বোম্বে পৌঁছেছে। প্রতিনিধিদল উদ্বাস্তু শিবির পরিদর্শন করবেন। উক্ত দলের প্রতিনিধিত্ব করছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, উচ্চ ব্যক্তিত্ব ও সমাজের অভিজাত ব্যক্তিবর্গ। আমরা তাদের নিয়মিত প্রয়োজনীয় জিনিস সরবরাহ করেছি।
<৪,১৯৩,৩৮৪–৩৮৮>
অনুবাদকঃ নাজিয়া বিনতে রউফ, সাদ্দিউন জয়, নুরুন নাহার জুঁই
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৯৩। ‘আমরা’গোষ্ঠী কর্তৃক প্রচারিত দুটি প্রতিবেদন | ‘আমরা’ | ২৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ |
জাকার্তা
২৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
নিম্নোক্ত সংযুক্তিতে আছে আমাদের তৈরি করা দুটি পত্রিকা যা কাজের প্রেক্ষাপটেই তৈরিঃ
১. ৩০ আগস্টের সম্পাদকীয় সম্পর্কে কিছু কথা নিয়ে ১৫ সেপ্টেম্বর তারিখে ইন্দোনেশিয়ান অবজারভার পত্রিকার সম্পাদকের নিকট চিঠি।
২. ২১ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত বাংলাদেশ সমস্যা সমাধানের উপায় সম্পর্কে স্বাধীন পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে মতামত
‘আমরা’
জনাব মকসুদ আলী,
৯ সার্কাস অ্যাভিনিউ,
১৭ কলকাতা, ভারত
———————
সম্পাদক, ইন্দোনেশিয়ান অবজারভার
১৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
প্রিয় সম্পাদক,
আমি সাংবাদিকদের জন্য এক গভীর শ্রদ্ধাবোধ লালন করে থাকি। আমাদের দেশের সাংবাদিকদের জন্য একটি গভীর শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। তারাই সাংবাদিক যারাআমাদের কাছেবিশ্বের খবর নিয়ে আসেন। তারাই সাংবাদিক যারা বিশ্বের যেকোন জায়গায় যেকোন অত্যাচারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে সোচ্চার হন ।সব কিছুর পরে তারাই সাংবাদিক যার মতামত এবং নির্দেশনা একটি জাতি এবং অবশ্যই জনগণের ভাগ্য নির্ধারনে মূল্যবান ভূমিকা পালন করে। আমি বিশ্বাস করি, সাংবাদিক কোন শাসকশ্রেণীর অন্তর্গত না। তারা মানবতার পক্ষে
সোচ্চার থাকে।মানুষের জীবনের উপর যেকোনো ধরণের আক্রমণের বিষয়ে তারাই প্রথম উচ্চ কণ্ঠে প্রতিবাদ করে।
আপনার পত্রিকার মাধ্যমে পাকিস্তানের ভয়াবহ অবস্থাএবং সেখানের মানুষের কষ্টের খবর আমি পড়েছি। ধর্ম,ভূগোল, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ইত্যাদি বিষয়েই ন্দোনেশিয়া ও পাকিস্তানের অনেক মাঝে অনেক মিল। পাকিস্তানের জন্য আমারব্যক্তিগত ভালবাসার কারণ হচ্ছে পেশাগত প্রয়োজনে পাকিস্তানে বিভিন্ন সময়ে আমাকে পাকিস্তান পরিদর্শন করতেহয়। আমি দেশের উভয় অংশ নিজেই দেখেছি এবং দুই অংশের জনগণের মধ্যে তিক্ততা ও ঘৃণার কারণ দেখেছি।
তোমাদের কাছে আমি আমার মতামত প্রকাশ করারজন্যঅনুমতিচাচ্ছি।
দুই অংশের মধ্যে অর্থনৈতিক ভারসাম্যহীনতার বৃদ্ধিবর্তমানসংকটেরমূল কারণ বলেআমিমনে করি। বৈষম্য ও অবহেলার পরিষ্কার উদাহরণ পর্যটক এবং পরিদর্শকদের কাছে স্পষ্ট দৃশ্যমান।
কেন্দ্রীয় সরকারের কেন্দ্র পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত,পূর্ব পাকিস্তানের সহযোগীদের অবহেলার মাধ্যমে প্রশাসন এবং সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে ।ব্যবসার ক্ষেত্রে ,দাপ্তরিক সাহায্য ও স্বজনপ্রীতির ফলে অনেক পশ্চিম পাকিস্তানীদের পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিষ্ঠিত রূপে পাওয়া গিয়েছে। অর্থনীতি, শিক্ষা, এবং চাকরির বাজারে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে কোণঠাসা করে রাখা হত।
তাদের চাহিদা উপলব্ধি করার জন্য পূর্ব পাকিস্তানে বিভিন্ন গণতান্ত্রিক প্রচেষ্টা অব্যাহত ছিল।তারা কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের থেকে প্রতিশ্রুতি ছাড়া কিছুই পাননি। প্রাদেশিক বিভাজনের দাবী সমর্থনকারীদের প্রায়শই ঘৃণিতভাবে বলা হয় ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ প্রাদেশিকবাদী বা কমিউনিস্ট। পূর্বপাকিস্তানের দেশপ্রেমী জনপ্রিয় বর্ষীয়ান নেতা ফজলুল হক (শের-ই-বাংলা), সোহরাওয়ার্দী এবং ভাসানীকে ডাকা হতো শত্রুদের চর হিসেবে। বর্তমান নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
প্রশাসন ও অর্থনীতির লাগাম হারানোর ভয়েই পাকিস্তানে কঠিন ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে গণতন্ত্র চর্চা করার অনুমতি দেওয়া হয়নি। পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানকে এই ষড়যন্ত্রকারণেই হত্যা করা হয়। পরবর্তী কালে আইয়ুব খানের মন্ত্রণালয়সমূহ শিথিলকরণ, এবং সামরিক আইনজারি ছিল গণতন্ত্রকে হত্যা করা ও দুর্বল অঞ্চলে নিজেদের শক্ত প্রভাব বজায় রাখা। বর্তমান উদাহরন, ইসলামের নামে এবং ঐক্য এবং জনগণের শুভেচ্ছা এবং উৎসাহকে গণতন্ত্রের মাধ্যমে সম্মানিত করার পরিবর্তে চরম অসম্মান করে সেনা অভিযানের পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। অনেক প্রতিবেদন, নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক এবং দশ লক্ষ হত্যার প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, সত্তর লাখেরও বেশি পালিয়ে গিয়েছে এবং ২০ লাখমানুষ গ্রাম ওবাস্তুচ্যুতহয়েছে। এ ধরণের ঘটনা অভূতপূর্ব এবং ক্ষমার অযোগ্য।
এই প্রেক্ষাপটের সাথে প্রাসঙ্গিক অন্য কয়েকটি পয়েন্ট আছে যেগুলো পাকিস্তানের নিজের মূর্খতা, মিথ্যাও নিজস্ব অসঙ্গতি এবং নোংরা রাজনীতির ফলে সবার সামনে উন্মুক্ত হয়েছে। কাশ্মীরি স্বাধীনতা যোদ্ধাদ্বারা ভারতীয় বিমান ছিনতাই করা হয়েছে বলে ঘোষণা করা হলে আলী ভুট্টো তাকে অভিনন্দিত করেন। পরবর্তীতে পাকিস্তানী আদালত ঘোষণা করেএই ঘটনা ছিল পাকিস্তানের দুই অংশের মাঝে চলমান যুদ্ধ মাঝপথে থামিয়ে দিতে ভারতীয় ষড়যন্ত্র। সরকারের পক্ষ থেকে একে পাকিস্তানকে ভেঙ্গে ফেলার পরিকল্পিত ভারতীয় ষড়যন্ত্র হিসেবে অভিহিত করা হয়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান নিজে মুজিবকে ভবিষ্যত প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেন, আবার তিনি নিজেই পরে মুজিবর রহমানকে বিশ্বাসঘাতক বলেন, ছয় দফা দাবির ভিত্তিতে আওয়ামীলিগ নির্বাচনেরজন্য সংগ্রাম ছিল বলে ঘোষণাকরেন।ইয়াহিয়া খান এর আগে কখনও এই দাবির বিরুদ্ধে কথা বলেননি। সেই তিনিই এখন এটিকে বিচ্ছেদের জন্য একটিকারণ হিসেবে ঘোষণা করেছেন। ২৭ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। তা সত্ত্বেও, ৫মাস পর এখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে দুর্বৃত্তরা যুদ্ধকরে যাচ্ছে। সেনা অভিযানের শিকার দুর্বৃত্ত ছিল অল্প কয়েকজন এবং মানুষ দূরে পালিয়ে ভারতীয় অনুপ্রবেশকর ছিলেন।আশ্চর্যের বিষয়, যদি উদ্বাস্তু বহিঃপ্রবাহ ভর্তি হন।ত্রাণসামগ্রী নিয়ে আসা আন্তর্জাতিক মানবিক সংগঠনের জাহাজকে পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি।এমন ভাবে কাজটা করা হয়েছে যেন এর প্রয়োজন ছিলনা ।আমি পরে সাহায্যের জন্যজাতিসংঘের কাছে আকুল আবেদন শুরু করি। সবকিছু পূর্ব পাকিস্তানে শান্তিপূর্ণ ছিল কিন্তু সর্বশেষ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সড়কও যোগাযোগের অন্যান্য উপায়সমূহ বিদ্রোহের ফলেশোচনীয়ভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে ।
30 আগস্ট আপনার সম্পাদকীয়তে আমেরিকান নিক্সন সরকারের প্রতি সিনেটর কেনেডিরকরা পাকিস্তান বয়কট এবং তাদের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করারবিষয়টি আপনি অনুমোদনকরেননি।আপনি তার পরিবর্তে দুঃখ প্রকাশ ও নিন্দা করার প্রস্তাব দিয়েছেন।দুঃখ প্রকাশের ব্যাপারে পাকিস্তানের কূটনীতিক তৎপরতা এত সহজে প্রতিক্রিয়াশীল হবে বলে মনে হচ্ছেনা। পাকিস্তানের অহংকারের পাত্র আগে থেকেই ভর্তি হয়ে আছে। নির্লজ্জের মত এরকম আরও কিছু করতে তাদের একটুও হাত কাঁপবে না।
আপনি সেই একই সম্পাদকীয়তে বলে ছিলেন বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অন্য মহাদেশ এবং অন্যান্যদেশে সহযোগী আছে। তাদের দ্বারাই খবর ফলাও করে ছড়ানো হয়।আমি মনে করি,অসহায় মানুষের দুর্ভোগে মানুষের প্রতিক্রিয়াটাই মূখ্যজিনিসছিল। আমি মানুষের সাথে বন্ধুত্ব করতে আগ্রহী এবং তাদের ভোগান্তির জন্য জানাচ্ছি। অমানবিকতা বন্ধ করতে হবে এবং তাদের বাহিনী বর্জন করা আবশ্যক।
কোনো এজেন্ট বা প্রচারণা দ্বারা প্রভাবিত হওয়া ছাড়াই আমি সুপারিশ করতে চাই, জাতিসংঘতার নামের সার্থকতা প্রমান করে আক্রান্ত এলাকাসমূহে মানুষের জীবন নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং বিশ্বের শান্তি সংরক্ষণের জন্য সঠিক তদন্তের মাধ্যমে ঐসব এলাকার জনগণের দাবি এবং আকাঙ্খা সম্পর্কে জানার চেষ্টা করতে হবে। সাড়ে সাত কোটি মানুষকে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোন কাজ করানো সম্ভব না। ধর্ম বা যেকোন কিছুই একটি জাতির আর্থিক চাহিদা ও মানসিক তাড়নার বিষয়টি পূরণ করতে পারে না। আমি ব্যক্তিগতভাবে ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের পক্ষে আছি। আমার মতের পক্ষে আমি অনেক কারণ দেখাতে পারি। কিন্তু যদি এই ঐক্য অন্য মানুষের জন্য শান্তির উপর একটি বোঝা হয়ে যায়, তবে আমি সেই ঐক্যকে ঘৃণা করি।
আমি আমাদের দুইজনের সম্পর্ক দূর্বল হয়ে যাবার ভয়ে আমার নাম প্রকাশ করতে পারলাম না ।দয়া করে আমাকে এই জন্য ক্ষমা করবেন।
ইতি,
A B C
সম্পাদক,
ইন্দোনেশীয় অবজারভার,
জাকার্তা।
২১-০৯-৭১ তারিখে প্রচারিত
ইন্ডিপেনডেন্ট অবজারভার
বাংলাদেশের একক সমস্যার নিষ্পত্তি
পাকিস্তানের শান্তিপ্রিয় মানুষ দীর্ঘদিনের অস্থিরতায় ইদানিং অধীর হয়ে পরেছে। সংবাদপত্রের প্রতিবেদন যদি কোন মানদণ্ড হয়, তাহলে বলতে হয় পরিস্থিতি খারাপ থেকে অধিকতর খারাপ হচ্ছে। পরিস্থিতি এমনও হতে পারে যে, আশেপাশের সমস্ত এলাকা আগুনে জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে। সংস্কারমুক্ত চিন্তাবিদ ও দার্শনিকরা বিশ্ব নেতৃবৃন্দ এবং নীতিনির্ধারকদের বিশ্বশান্তির বিপদের আশঙ্কায় সতর্ক করে সতর্কতা ও যত্নের সঙ্গে পরিস্থিতি সামাল দিতে বলেছেন।
বর্তমানে বিভিন্ন রাজধানীতে পরিস্থিতির রাজনৈতিক সমাধানের ব্যাপারে আলোচনা চলছে।এছাড়া তাদের কিছু অংশ মদ্ধ্যস্থতার পরিকল্পনা করেছে এবং কেউ কেউ তাদের সেবা দেবার প্রস্তাব ও করেছে। দেরিতে হলেও এটা একটা ভালো পদক্ষেপ।
ইতোমধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে কি ঘটেছে আর এসব মর্মান্তিক ঘটনার আসল কারণ নিয়েপুং খানুপুংখ আলোচনা হচ্ছে মদ্ধ্যস্থতাকারিদের পূর্বশর্ত।
এখন পর্যন্ত যুদ্ধরত দলগুলোর মধ্যে থেকেএই সমস্যা সমাধানের জন্য কোনও উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ দেখা যায়নি। প্রত্যেকেই নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গিতে অনড়- পাকিস্তান একে প্রতিষ্ঠিত স্বাভাবিকতা বলে সরবে ঘোষণা করছে আর বাঙালি গেরিলারা সগর্বে দাবি করছে তারা বেশিরভাগ এলাকা মুক্ত করেছে।
যদি সত্যিই মানব সমাজের জন্য দীর্ঘস্থায়ী সুখশান্তি কাম্য হয়ে থাকে, তাহলে নিম্নোক্ত পয়েন্টগুলো এই সমস্যার অর্থবহ সমাধানের জন্য আমলে নেয়া প্রয়োজনঃ
সমস্যার কারণগুলো কী কীঃ
সব রিপোর্ট ও মতামত সর্বসম্মত যে, পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে শিক্ষা, চাকুরি, সেবা, শিল্প ও অর্থনীতির যে বৈষম্য, তা দেশ সৃষ্টির পর প্রকট হয়েছে। এই অসমতা পশ্চিম পাকিস্তানের দ্বারা শাসিত কেন্দ্রীয় সরকারের তৈরি। শাসকগন তাদের ভুল প্রকাশ্যে স্বীকার করেছিল এবং সংশোধনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। আসলে এগুলো কিছুই করা হয়নি।
গত সাধারন নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দল এটার বিরুদ্ধে লড়েছিল। আওয়ামীলীগ লড়েছিল ১৯৬৬ সালে গৃহীত ছয় দফা দাবীর ভিত্তিতে। ছয় দফা দাবীর লক্ষ্য ছিল প্রদেশের প্রতি অতীত অবিচার ও বৈষম্য দূর করা এবং কেন্দ্রীয় সরকারের আধিপত্য কমানো। এই সুত্র জনগণকে সন্তুষ্ট করে। পরিষদের ৩১৩টি আসনের ১৬৭টিতে দল জয়লাভ করে। সামরিক আইনের অধীনে নির্বাচন হয়েছিল আর সবার মতেই এটা ছিল শান্তিপূর্ণ সুষ্ঠু নির্বাচন।
ভুট্টোর নেতৃত্বে পিপলস পার্টি পরিষদে ৮১টি আসন পেয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল। ৩রা মার্চ দেশের তৃতীয় সংবিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে পরিষদ আহবান করা হয়(প্রথম দুটি বাতিল করা হয়েছিল)।
গণতন্ত্রের নীতি হল সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন। ভুট্টো, দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা, ক্ষমতায় তার দলকে অংশ না দিলে আন্দোলন আরম্ভ করার হুমকি দিয়েছে। অধিবেশন মুলতবী করা হয় এবং যার ফলশ্রুতিতে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানে অসহযোগের ডাক দেয় যা শান্তিপূর্ণ এবং সফল ভাবে সম্পন্ন হয়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবর রহমানের সাথে মধ্যস্থতা করতে পূর্ব পাকিস্তানে আসেন কিন্তু পরবর্তী ঘটনাগুলো থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে এই মধ্যস্থতা শুধুমাত্র পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর পূর্ব পাকিস্তানে এসে প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য কিছু সময় বের করার অজুহাত ছিলমাত্র।
পাকিস্তানী সেনাদের এই আক্রমণে প্রায় ১০ লাখ মানুষ মারা যায়, ৮০ লাখ মানুষ ভারত চলে যেতে বাধ্য হয় এবং প্রায় আড়াই কোটি মানুষ গৃহহারা হয়। সহায়-সম্পত্তি আর ফসলের ক্ষতি ছিল আনুমানিক কয়েক বিলিয়ন। যে ভয়াবহ মানহানি, দূর্দশা, ভোগান্তি মানুষকে পোহাতে হয়েছিল তা ভোলার মত নয় এবং ক্ষমার অযোগ্য। এই ঘটনার ফলশ্রুতিতে বাঙালীদের ভিতর প্রতিরোধের সূত্রপাত ঘটে এবং স্বাধীন বাংলাদেশের ঘোষণা দেওয়া হয়। পূর্ব পাকিস্তানের লুকিয়ে থাকা নেতারা সীমান্তবর্তী এক গ্রামে সমবেত হয়ে খুব সাধারন এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের ঘোষণা দিলেন। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বিশ্বের দরবারে আহবান জাননোহয় এই গণহত্যা বন্ধের জন্য এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে রূখে দাড়াতে অনুরোধ করা হয়। বিশ্ববাসীর প্রতিক্রিয়া ততটা উৎসাহজনক ছিলনা এবং বিশেষ করে মুসলিম দেশগুলো এক্ষেত্রে নির্বাক হয়ে আছে। বাঙালী গেরিলা বাহিনী ব্রীজ, রাস্তাঘাট উড়িয়ে দিয়েছে, জলযান থামিয়ে দিয়েছে, পাওয়ার হাউস ধ্বংস করা ছাড়াও বিভিন্ন স্থানে ওৎ পেতে থেকে পাকিস্তানী সেনাদের জব্দ করেছে। এতে করে পাকিস্তানী বাহিনীকে নানা প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। তাদেরকে অসহনীয় অর্থনৈতিক চাপ সহ্য করতে হচ্ছে।
পূর্ব পাকিস্তানের বেশীর ভাগ অসামরিক সরকারী কর্মকর্তা তাদের কর্মস্থান ত্যাগ করে চলে এসেছেন। বেশীরভাগ বাঙালী কূটনীতিবিদ দল ত্যাগ করে বাংলাদেশ সরকারের সমর্থনে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছেন। ফলে সর্ব ক্ষেত্রে বাঙালীদের সন্দেহ ও ঘৃণার চোখে দেখা হচ্ছে। তাদেরকে রাষ্ট্রদ্রোহী আর বিশ্বাসঘাতকের পর্যায়ে ফেলা হচ্ছে। মিশনে তাদের পাসপোর্ট কেড়ে নেওয়া হয়েছে আর তাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দাবিও প্রত্যাখ্যান করা হচ্ছে। তদের চলাফেরা এমনকি একত্রে মিলিত হওয়াও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এছাড়াও তাদের পূর্বের রেকর্ড পুনরায় অনুসন্ধান করা হচ্ছে।
সব বাঙালীই কোনো না কোনো ভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের বিরোধিতা করছিল। তারা ছয় দফা দাবীর সমর্থনে ভোট দেয়, তাদের দাবী-দাওয়া পেশ করে আর তাদের অধিকার আদায়ে সচেষ্ট হয়। ফলে তাদের সকলকেই আওয়ামীলীগের সমর্থক ধরে নেওয়া হয়। আন্তর্জাতিক ত্রাণ সামগ্রী তাদের কে না দিয়ে সেনা কর্মচারী আর কতিপয় সেনা সমর্থকদের মাঝে বিতরণ করে দেওয়া হয়। এভাবে তাদেরকে পদে পদে নত করা হত। এমনকি তাদেরকে অনাহারে রাখা হত।
সামরিক, পুলিশ, অসামরিক এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে নতুন করে নিয়মিতভাবে পশ্চিম পাকিস্তানিদের নিয়োগ দেওয়া হত। বাঙালীদের কাছে এসব কিছুই ছিল বাঙ্গালীদের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানীদের বর্বরতা আর নিষ্ঠুরতারপ্রমান।
সমস্যার সমাধানঃ
এটা একটা রাজনৈতিক সমস্যা ছিল যার সমাধানও রাজনৈতিক হওয়া উচিত ছিল। একটা শান্তিপূর্ণ সমাধানের ভার বাংলাদেশ আর ইসলামাবাদ সরকারের উপর বর্তায়। যদি জাতিসংঘের তত্ত্বাবধায়নে উভয় পক্ষ একসাথে বসে আলোচনা সাপেক্ষে সীদ্ধান্তে আসত এই নীতিতে যে “নিজে বাঁচুন; অন্যকে বাঁচতে দিন”সেটা ছিল সর্বোত্তম। আশা এটাই শান্তির পূজারী হয়তো দুই বিবাদী দলকে অনুপ্রাণিত করতে পারবে যদি তারা সত্যিকার অর্থেই শান্তি চায়।
<৪,১৯৪,৩৮৯-৪০৩>
অনুবাদকঃ সুদীপ্ত কুমার সাহা, নুরুন নাহার জুঁই, শিরোনামহীন-১, মাহীন বারী, মুশাররাত আলম মৌ
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৯৪। ‘আমরা’ গোষ্ঠী কর্তৃক প্রেরিত বিভিন্ন ইন্দোনেশিয় প্রচার মাধ্যমে প্রচারের জন্য লিখিত বাঙ্গলাদেশ সম্পর্কিত একটি দলিল | ‘আমরা’ | ১৬ অক্টোবর,১৯৭১ |
মহামান্য,
ভিতরে আটকানো পাবেন একটি বিস্তারিত রচনার প্রতিলিপি যেটি তৈরী করেছিল “কামাল” ১৯৭১ সালের এপ্রিলে স্থানীয় প্রচার,তথ্য এবং মন্তব্যের(যদি থাকে) জন্য।
দয়া করে এটিও মনে রাখবেন যে “মৃতঃ এমএস ইসলাম” অভিহিত প্রবন্ধটি যেটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৫ই এপ্রিল,১৯৭১ এর “জাকার্তা টাইমস” এ সেটিও “কামাল” এর লেখা ছিল ও সেটিতে “কামাল” এর অবদান ছিল।
গুরুত্বপূর্ন বিষয়ে প্রত্যুত্তর/পরামর্শ নিম্নোক্ত ঠিকানায় পাঠানোর জন্য অনুরোধ করা হচ্ছেঃ
জনাব কামাল গুপ্ত
C/O গ্রুপ অধিনায়ক এন সিনহা রায়
ভারতীয় দূতাবাস,জাকার্তা,ইন্দোনেশিয়া।
পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের মাধ্যমে
ভারত সরকার,নয়া দিল্লী
বিনম্র শ্রদ্ধার সহিত
জয় বাংলা
আপনার আন্তরিক
“আমরা”এর জন্য কামাল
এইচ.ই.জনাব হোসাইন আলী
হাই কমিশনার বাংলাদেশ,ভারতে,কলকাতা।
পাকিস্তান-এর জন্ম এবং মৃত্যু
ভূমিকা
১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট পাকিস্তান ব্রিটিশ ভারত থেকে উৎপত্তি হয়েছিল।পাকিস্তান গঠিত হয়েছিল দুইটি অংশ নিয়ে-পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান।এই দুইটি অংশ ১৬০০ কিলোমিটার ভারতীয় অঞ্চল দ্বারা বিভাজিত ।দুইটি অংশের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম ছিল আকাশপথ যেটাতে সময় লাগে প্রায় ৩ ঘন্টা এবং সমুদ্রপথ যেটাতে সময় লাগে প্রায় এক সপ্তাহ।পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল প্রায় সাড়ে সাত কোটি এবং পশ্চিম পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি।দুটি অংশই ভূগোল,জাতি,ভাষা,সংস্কৃতি,রীতি-নীতি এবং অভ্যাসের দিক দিয়ে একে অপরের থেকে ভিন্ন ছিল।পূর্ব পাকিস্তান অবস্থিত দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ায় যেখানে পশ্চিম পাকিস্তান অবস্থিত মধ্য এশিয়ায়।দুইটি অঞ্চলের জনগনের মধ্যে একমাত্র সাধারণ বিষয় ছিল ধর্ম,যা ছিল ইসলাম।পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় ৯০ শতাংশ জনগণ মুসলিম ধর্মাবলম্বী-প্রায় সবাই সুন্নী।বাকিরা ছিল হিন্দু,বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান।
পশ্চিম পাকিস্তানিরা মূলত মুসলিম,কিন্তু তারা শিয়া,সুন্নী,আহমাদিয়া(কাদিয়ানি) ইত্যাদি বিভাগে বিভক্ত।প্রসঙ্গক্রমে বর্তমান পাকিস্তানি রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান একজন শিয়া।
II.পাকিস্তান আন্দোলন
ব্রিটিশ ভারতে পাকিস্তান আন্দোলন শুরু করে মুসলিম লীগ যেটি প্রতিষ্ঠা করেছিল বাঙালি নেতারা ১৯০৬ সালে ঢাকায়(পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী)।পাকিস্তান গঠনের পরিকল্পনা ১৯৪০ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত মুসলিমের লীগের সম্মেলনে উত্থাপন করেন বিখ্যাত বাঙালি নেতা এ কে ফজলুল হক।লাহোর পরিকল্পনা বিবেচনা করে যে পাকিস্তান গঠিত হবে এমন কয়েকটি সার্বভৌম রাজ্য নিয়ে যেসব অঞ্চলে মুসলিম জনসংখ্যা বেশি।পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা যারা মুসলিম স্বাধীনতা আন্দোলনের পথপ্রদর্শক ছিল তারা কিন্তু স্বাধীনতা লাভের সময় স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান দাবি করেনি।তারা এই আত্মত্যাগটি করে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতি তাদের ভ্রাতৃত্ববোধের কারনে।যাই হোক পরের ইতিহাস প্রমাণ করে যে, পাকিস্তান সৃষ্টির আগে ও পরে তাদের করা সকল অবদান ও আত্বত্যাগ ছিল অস্বীকৃত।
III.পাকিস্তানে পূর্ব বাঙালিদের অবস্থা
সংখ্যাধিক্য থাকা সত্ত্বেও শুরু থেকেই পূর্ব বাঙালিরা প্রশাসন,পরিষেবা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে নিজেদের প্রাপ্য ভাগ পাচ্ছিলো না।পাঞ্জাবীরা যারা প্রতিরক্ষা ও বেসামরিক বিভাগে আধিপত্য বিস্তার করেছিল আত্মপ্রকাশ করে দেশের নতুন শাসক ও বাঙালিদের নিয়ন্ত্রক হিসেবে।তারা শুধু বাঙালিদের উপেক্ষাই করেনি,তারা বাঙালিদের চিহ্নিত করে দেশপ্রেমহীন,রাষ্ট্রের শত্রু,ভারতীয় দালাল ইত্যাদি হিসেবে।এ কে ফজলুল হক,যিনি অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন এবং পাকিস্তান গঠনের পরিকল্পনা লাহোরে এনেছিলেন,মুসলিম লীগ থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর দ্বারা। তিনি অনেক হয়রানির শিকার হয়েছিলেন এবং তার দেশপ্রেম নিয়ে পাকিস্তানের পাঞ্জাবী শাসকরা সন্দেহ প্রকাশ করতো। ঢাকার খাজা নাজিমউদ্দীন,যিনি জনাব জিন্নাহর মৃত্যুর পর গভর্নর জেনারেল হন এবং পরে জনাব লিয়াকত আলী খানের গুপ্তহত্যার পর প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহন করেন, পাঞ্জাবী গভর্নর জেনারেল গুলাম মুহাম্মদের দ্বারা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে অপসারিত হন।বগুড়ার(পূর্ব পাকিস্তান) মোহাম্মদ আলী, যিনি ঐতিহাসিক ব্যান্ডাং সম্মেলনে অংশগ্রহন করেছিলেন, তিনিও প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে অপসারিত হয়েছিলেন।
আরেক বিখ্যাত বাঙালি নেতা হোসাইন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, যিনি পরে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন, তিনিও পাকিস্তান সৃষ্টির পর পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের দ্বারা অনেক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন।মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাষানী, যিনি শুধু একজন বিখ্যাত রাজনৈতিক নেতাই ছিলেন না ছিলেন একজন সুপরিচিত ধর্মীয় নেতা যার পূর্ব পাকিস্তানে ছিল বিশাল সমর্থকগোষ্ঠী তিনিও নির্বিচারে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের দ্বারা সাম্যবাদী ও রাষ্ট্রের শত্রু বলে চিহ্নিত হয়েছিলেন।মওলানা ভাষানী ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন বর্তমান আওয়ামী লীগের দুইজন প্রতিষ্ঠাতা।শেখ মুজিবর রহমান,আওয়ামী লীগের বর্তমান প্রধান,তার রাজনৈতিক প্রশিক্ষন পান সোহরাওয়ার্দী ও ভাষানী দুইজনের কাছ থেকে।শক্তিশালী ছাত্রনেতা হিসেবে তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় উল্লেখেযোগ্য অবদান রাখেন।তার জন্ম পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যবিত্ত পরিবারে এবং তিনি ইসলামি ন্যায়বিচার ও সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী।তাকে মনে করা হয় মধ্যমপন্থী।পাকিস্তান সৃষ্টির পর তিনি সর্বদাই পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার নিয়ে লড়াই করেছেন।পূর্ব পাকিস্তানের উপর পশ্চিম পাকিস্তানি আমলা ও শিল্পপতিদের উপনিবেশ স্থাপন ও শোষণের বিরুদ্ধে তার প্রতিবাদের কারণে তার কুখ্যাতি হয় রাষ্ট্রের শত্রু এবং ভারতীয় দালাল হিসেবে এবং এ কারণে অনেক বছর কারাদন্ড ভোগ করেছিলেন।
এ কে ফজলুল হক,মওলানা ভাষাণী ও সোহরাওয়ার্দী এর গঠিত যুক্তফ্রন্ট ১৯৫৪ সালের নির্বাচন জেতে এবং পূর্ব পাকিস্তানে সরকার গঠন করে।যুক্তফ্রন্ট প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন দাবি করে।এই কারনে যুক্তফ্রন্ট সরকার নির্বিচারভাবে কেন্দ্রীয় সরকার দ্বারা অপসারিত হয়।যখন ১৯৪৮ সালে বাঙালি ছাত্ররা দাবি করলো যে,বাংলা বাংলাদেশের ৫৬ শতাংশ জনগণের ভাষা,উর্দুর সাথে বাংলারও দেশের রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত তখন জনাব জিন্নাহ তাদের চিহ্নিত করেন সাম্যবাদী,পঞ্চম বাহিনী,রাষ্ট্রের শত্রু এবং ঘোষনা করেন উর্দুই হবে রাষ্ট্রের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।পাঞ্জাবী সেনা দ্বারা অনেক ছাত্রনেতা ও ভাষা আন্দোলন সমর্থকের হত্যার পর ১৯৫৬ সালে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহন করা হয়।
- পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক ভেদাভেদঃ
পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানীদের মধ্যে গড় আয়ের ব্যবধান বাড়ছিলো। ১৯৫৯-৬০ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় পূর্ব পাকিস্তান থেকে ৩২ শতাংশ বেশি ছিল।পরের ১০ বছরে বার্ষিক আয় বৃদ্ধির হার পশ্চিম পাকিস্তানে ছিল ৬.২ শতাংশ যেখানে পূর্ব পাকিস্তানে ছিল ৪.২ শতাংশ।এই কারণে ১৯৬৯-৭০ সাল নাগাদ পশ্চিম পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় পূর্ব পাকিস্তান থেকে ৬১ শতাংশ বেশি হয়।এইভাবে দশ বছরে আয়ের ব্যবধান দ্বিগুন হয়ে যায়। সঠিক হিসাবে এটি আরো বেশি বৃদ্ধি পায়।এই ভেদাভেদের কারন হলঃ(i)পাকিস্তানের সম্পদ এবং বিদেশী সাহায্য,যা অন্যায়ভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নে ব্যবহার করা হয় যেখানে পূর্ব পাকিস্তানকে সম্পূর্নরূপে অবহেলা করা হয়।পূর্ব পাকিস্তানের বাণিজ্যিক উপার্জন পশ্চিম পাকিস্তানমুখী হয় মূলধন যোগানো আমদানী হিসেবে।অর্থনৈতিক শাসন-প্রণালী পূর্ব পাকিস্তানের তুলনায় পশ্চিম পাকিস্তানের অনুকূলে ছিল।বিশেষভাবে শুল্ক,আমদানী নিয়ন্ত্রন এবং দ্রব্য বিক্রয়ের অনুমতি পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিশ্ব বাজার মূল্য থেকে অনেক বেশি দামে পণ্য ক্রয় করতে বাধ্য করে।
৫৬ শতাংশ জনগণ নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের মোট উন্নয়ন খরচ ১৯৫০/৫১-১৯৫৪/৫৫ সময়কাল পর্যন্ত সর্বনিম্ন ২০ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ৩৬ শতাংশ পর্যন্ত(শুধু কাগজে-কলমে) তৃতীয় পাঁচ বছর পরিকল্পনা ১৯৬৫/৬৬-১৯৬৯/৭০ সময়কাল পর্যন্ত।পুরো সময় ধরে সাধারণ বিনিয়োগে পূর্ব পাকিস্তানের ভাগ ছিল অত্যন্ত কম এবং সাম্প্রতিক বছরে পরিমাণ ছিল ২৫ শতাংশের একটু বেশি।
গত দুই দশক ধরে পূর্ব পাকিস্তানের মোট রপ্তানী উপার্জন ছিল প্রায় ৭০ শতাংশের মত এবং সাম্প্রতিক বছরে তা কমে ৫০-৫৫ শতাংশে চলে আসে, যেখানে এর আমদানী খরচ সাধারনত ৩০ শতাংশের আশেপাশে।বিদেশী বিনিময় হিসাবে উল্লেখযোগ্য উদ্বৃত্ত দেখানোর বিপরীতে পশ্চিম পাকিস্তানের বিদেশী বাণিজ্য শক্তিশালী ও দীর্ঘস্থায়ী ঘাটতি দেখায়,যা সকল বিদেশী বিনিময় বস্তুত শোষণ করে, যা প্রাপ্ত হয় বিদেশী সাহায্যের মাধ্যমে।পশ্চিম পাকিস্তানের তাদের মালপত্র ও পণ্যের জন্য পূর্ব পাকিস্তানে সংরক্ষিত বাজার ছিল।সাম্প্রতিক বছরে,পশ্চিম পাকিস্তানের রপ্তানির প্রায় ৫০ শতাংশ পূর্ব পাকিস্তানের কাছে বিক্রি করা হয়।
বিদেশী বাণিজ্যের একটি বিশ্লেষণ যুক্তিসংগত অনুমানের সাথে মিলিত হয় যে পূর্ব পাকিস্তানে বিদেশী সাহায্যের নায্য অংশ হবে একটি অনুপাত,যা পাকিস্তানে এরজনসংখ্যার অনুপাতের সমান,নির্দেশ করে যে একটি বড় নিট সাহায্যের হস্তান্তর হয় পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে।সরকারী তথ্য ও প্রদত্ত ভাতার ওপর ভিত্তি করে
বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়ের হিসাবে ১৯৪৮/৪৮-১৯৬৯/৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তান হতে পশ্চিম পাকিস্তানে পাচারকৃত মুদ্রার পরিমাণ ৩১ বিলিয়ন(৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার)
পাকিস্তানের অর্থনৈতিক নীতি পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ক্ষতিকর ছিল । কেন্দ্রীয় সরকারের পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকদের জন্য পূর্ব পাকিস্তানের উপর অর্থনৈতিক শোষণ আরো প্রকট আকার ধারণ করছিল । ১৯৫৮ সাল থেকে পাকিস্তানে সামরিক শাসন চলে এসেছে এবং সীদ্ধান্ত গ্রহণের সকল বিষয় ছিল সুরক্ষিত বেসামরিক কর্মকর্তা ও তাদের সামরিক ঊর্ধতন কর্মকর্তাদের উপর । প্রশাসনের বেশীরভাগ উর্ধতন কর্মকর্তায় ছিল পশ্চিম পাকিস্তানী ; এছাড়াও ১৯৬০ সালে কেন্দ্রীয় বেসামরিক প্রশাসনের শতকরা প্রায় ৮৭ ভাগ উর্ধতন কর্মকর্তায় ছিল পশ্চিম পাকিস্তানী এবং এই সংখ্যার খুব বেশী পরিবর্তন দেখা যায়নি । পরিকল্পনা বিভাগের ডেপুটি চেয়্যারম্যান , কেন্দ্রীয় অর্থনৈতিক মন্ত্রী ও সচিব , সম্পদ বণ্টনকারী রুই-কাতলা প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ সবসময় পশ্চিম পাকিস্তান থেকেই ছিলেন । পাকিস্তান থেকে দেশের বাইরে প্রায় ৫০ কূটনীতিক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় যার মাত্র ৫টি বাঙ্গালী নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত হয় । কেন্দ্রীয় সরকারের উপবাসনও ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে । এসব কারণে পশ্চিম পাকিস্তানে শিল্প প্রতিষ্ঠান আর উদ্যোক্তাদের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছিল ।
কৃষি, শিল্প, যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিদ্যুত সরবরাহ, শিক্ষাব্যবস্থা, চিকিৎসা, সামাজিক কল্যাণ ,চাকরি, প্রশিক্ষন, বীমা প্রতিক্ষেত্রেই দুই প্রদেশের ভিতর বৈষম্য জ্বাজল্যমান ছিল । পশ্চিম পাকিস্তানে বড় অঙ্কের প্রকল্পগুলোর পরিকল্পনা,অর্থায়ন ও বাস্তবায়ন অতি দ্রুত করা হত । কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষেত্রে অনেক ছোট অঙ্কের উন্নয়ন পরকল্পনাও অনুমোদিত হতে অনেক সময় লাগত আর তা বাস্তবায়িত হতে কয়েক বছর লেগে যেত । পূর্ব পাকিস্তানে প্রতি বছরই বন্যা, সাইক্লোন হত যা প্রচুর জীবননাশসহ ফসল ও সম্পদের ভয়াবহ ক্ষতিসাধন করত । কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার তখনো পর্যন্ত বন্যা নিয়ন্ত্রণ পরকল্পনা হাতে নেয়নি । জাতীয় রাজস্বখাতের প্রায় ৬০% ই বরাদ্দ ছিল প্রতিরক্ষা বাহিনীর জন্য যার প্রায় সিংহভাগই ব্যয় হত পশ্চিম পাকিস্তানী প্রতিরক্ষা বাহিনীর জন্য ।
V.পূর্ব পাকিস্তানে স্বায়ত্তশাসনের দাবীঃ
পূর্ব পাকিস্তানের উপর পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক শোষণ ও রাজনৈতিক অধীনতা ক্রমেই শেখ মুজিবর রহমানের আওয়ামিলীগের নেতৃত্বে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবী আরো জোরদার করছিল । আওয়ামী লীগের ছয় দফা দাবী অনুযায়ী বৈদাশিক সাহায্য, অর্থ ও করারোপণের ক্ষমতা প্রতি প্রদেশের নিয়ন্ত্রণে থাকবে যেন সম্পদ বন্টনের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের অসামঞ্জস্যতায় কোনো প্রদেশ বঞ্চিত না হয় । আওয়ামী লীগের ছয় দফা দাবীগুলো ছিল নিম্নরুপঃ
(i) লাহোর চুক্তি অনুযায়ী ফেডারেশন সরকার গঠন যার সংসদ ও সরকারের কাঠামো গঠিত হবে আইনসভার অধীনে প্রাপ্তবয়স্কদের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত প্রার্থী নিয়ে।
(ii) ফেডারেশন সরকারের অধীনে শুধু প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক সম্পর্ক থাকবে এবং বাকী সকল সংশ্লিষ্ট বিষয় ফেডারেশন রাষ্ট্রের অধীনে থাকবে।
(iii) দুই প্রদেশের জন্য হয় দুইটি স্বাধীনভাবে বিনিমেয় মূদ্রাব্যবস্থা চালু থাকবে অথবা একটিমাত্র মূদ্রাব্যবস্থা চালু থাকবে যদি পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে মূলধনের অবাধ গমন রোধে সংবিধানে কার্যকর নিয়ম থাকে। পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক ব্যাংক এবং পৃথক রাজস্ব ও অর্থনৈতিক নিয়ম থাকতে হবে।
(৪)কেন্দ্রীয় সরকারকে কর দিতে অস্বীকার করা; প্রাদেশিক সরকারের হাতে কর আরোপের ক্ষমতা ন্যাস্ত করা এবং সেইখান থেকে একটা নির্দিষ্ট অংশ পাবে কেন্দ্রীয় সরকার।
(৫) বৈদেশিক বানিজ্যঃ পাঁচ ধাপ গ্রহণ করা হবে-
– বৈদেশিক মুদ্রার দুটি আলাদা হিসাব থাকবে দুই প্রদেশের জন্য।
-পূর্ব পাকিস্তানের উপার্জন পূর্ব পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণাধীন থাকবে, আর পশ্চিম পাকিস্তানের উপার্জন পশ্চিম পাকিস্তানের।
-কেন্দ্রীয় সরকারের বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা হয় দুই প্রদেশ সমানভাবে পুরন করবে, অথবা একটি নির্দিষ্ট অংশ বরাদ্দ করে দিতে হবে।
-দুই প্রদেশের মধ্যে দেশীয় পণ্যের শুল্ক মুক্ত আদান প্রদান থাকবে।
-সংবিধান একক সরকারকে ব্যবসা ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন, ব্যাবসায়িক মিশন স্থাপন এবং বিদেশী রাষ্ট্রের সংগে চুক্তি স্থাপনের ক্ষমতা প্রদান করবে।
(৬)পূর্ব পাকিস্থানের দ্বারা একটি মিলিশিয়া বা প্যারা মিলিটারি ফোরস গঠন করা।
ছয় দফায় পরিস্কার ভাবে এক প্রদেশের উপর অন্য প্রদেশের অর্থনৈতিক শোষণ বন্ধের কথা বলা হয়েছিল এবং পশ্চিম পাকিস্তানি কায়েমি স্বার্থ দ্বারা যেমন ইচ্ছা পূর্বক অপব্যাক্ষা প্রচারিত হয়েছে, এটা তেমন কোনও বিচ্ছিন্নতাবাদী পদক্ষেপ ছিল না। আওয়ামী লীগ কোনও বামপন্থী, ইসলাম বিরোধী বা প্রাদেশিক সংগঠন ছিল না। তারা চেয়েছিল সব প্রদেশে জনগনের শাসন ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে। তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে স্পষ্ট উল্লেখ ছিল যে , কোরআন ও সুন্নাহ-র পরিপন্থী কোনও আইন প্রণয়ন করা হবে না। পশ্চিম পাকিস্তানেও আওয়ামী লীগের সমর্থক ছিল, বিশেষত সিন্ধু এবং বেলুচিস্তানে, যেখানে সাধারন মানুষ ছিল অর্থনৈতিক শোষণের স্বীকার ও মৌলিক অধিকার বঞ্চিত। উল্লেখ্য যে, জুলফিকার আলী ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি ছিল পশ্চিম পাকিস্তান ভিত্তিক বামপন্থী দল।
ছয় দফা কর্মসূচী ঘোষণার মাত্র দুই মাস পরেই শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা আনার জন্য অনেক সিভিল এবং মিলিটারি অফিসার ষড়যন্ত্র করছে দেখিয়ে ১৯৬৮ সালের জানুয়ারি মাসে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করা হয়। পরবর্তীতে শেখ মুজিব, যিনি জেলেই ছিলেন তখন, তাকেও বিচারের আওতায় আনা হয়।
১৯৬৮ সালের শেষ দিকে আইয়ুব বিরোধী গণ আন্দোলন হয় এবং পূর্ব পাকিস্তানে এর নেতৃত্ব দিয়েছিল সকল ছাত্রদের প্রতিনিধিত্বকারী ছাত্র মৈত্রী কমিটি। ছাত্রদের এগারো দফা দাবীর মধ্যে ছয় দফার লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য গুলিও অন্তর্ভুক্ত ছিল। আইয়ুব বিরোধী গণআন্দোলন সরকারকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা তুলে নিতে বাধ্য করে এবং ১৯৬৯ সালের শুরুতেই মুজিব জেল থেকে ছাড়া পান।
অবশেষে তাঁকে রাওয়ালপিন্ডিতে যৌথ গোলটেবিল বৈঠকে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান কর্তৃক আমন্ত্রণ জানানো হয়। সম্মেলনে মুজিব উল্লেখ করেছিলেন যে, জাতীয় প্রশ্নই হচ্ছে পাকিস্তানের মূল প্রশ্ন কিন্তু এটা নতুন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকেই ক্ষমতায় যারা ছিল তাদের দ্বারা বাইপাস করার চেষ্টা করা হয়েছে। তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে ভূগোল, অর্থনীতি, ভাষা ও সংস্কৃতির অপরিবর্তনীয় তথ্য দেওয়া একটি পৃথক সত্তা ছিল। এসব তথ্য থেকে রাষ্ট্র ও সরকার প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃত করা ছিল। তিনি ছয় দফা স্বীকৃতির জন্য চাপ দিয়েছিল।
আইয়ুব খানের সরকার কয়েকদিনের মধ্যেই ধসে পড়ে। এটি দ্বিতীয় সামরিক কর্তৃত্ব গ্রহণ ছিল।
আইয়ুব খান ২৫ মার্চ, ১৯৬৯ ইয়াহিয়া খান দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়। নতুন শাসকদের লক্ষ্য অনুযায়ী ইয়াহিয়া খানের মাধ্যমে তিনটি ঘোষণা জারি করা হয় ১৯৬৯ এবং ১৯৭০ সালে যে টালিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক কতৃক অনুমোদন হয় মার্চ ৩০,১৯৭০ । ইয়াহিয়া পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের অঙ্গীকার প্রসঙ্গ সরাসরি এড়িয়ে যান। তিনি বলতেন তিনি প্রদেশে সর্বোচ্চ স্বায়ত্তশাসন, প্রসঙ্গত কেন্দ্রীয় সরকারের একটি দক্ষ পরিশ্রমী চাহিদা দান করতে চেয়েছিলেন।
V i. জনসাধারণের রায় এবং আওয়ামীলীগের অবস্থানঃ
লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার অনুযায়ী, নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের প্রথম সভার তারিখ থেকে 120 দিনের মধ্যে একটি সংবিধান পর্যন্ত প্রণয়ন করতে হবে। জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক আইনসভা নির্বাচন সামরিক শাসনের কঠোর তত্ত্বাবধানে ডিসেম্বর ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামীলীগের শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৬৯ আসনের জাতীয় পরিষদে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দকৃত ১৬৭টি আসনে জয়লাভ করে এবং ৩১৩ আসনের মধ্যে একটি নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা লাভ করে। প্রাদেশিক আইনসভা এছাড়া ও নির্বাচনে আওয়ামীলীগ অস্বাভাবিক রকম জয়লাভ করে।
জানুয়ারী ১৯৭১ সালে ইয়াহিয়া খান ,মুজিব ও অন্যান্য আওয়ামীলীগ নেতাদের সঙ্গে আলোচনার জন্য ঢাকায় আসেন। তার সফর শেষে ১৪ জানুয়ারি, ইয়াহিয়া মুজিবকে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে উল্লেখ করে বলেন যে , ক্ষমতা তাড়াতাড়ি তাঁকে হস্থান্তর করা হবে। কিন্তু তিনি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন জন্য একটি তারিখ নির্ধারন প্রত্যাখ্যান করেন। ভেবে দেখার মত বিলম্বের পরে,জাতীয় পরিষদ ৩ ই মার্চ ১৯৭১ ঢাকায় দেখা করার জন্য আহবান করেছিল। জুলফিকার আলী ভুট্টু, যার পিপলস পার্টি, জাতীয় পরিষদে ৮৩ টি আসন লাভ করেছিল সে অধিবেশন বয়কট করার হুমকি দেয় যদিনা আওয়ামীলীগ তাঁদের ছয় দফা কর্মসূচি পরিবর্তন করে । ভুট্টো বিশেষত করারোপণ এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ব্যাপক ক্ষমতা দিয়ে একটি শক্তিশালী কেন্দ্র চেয়েছিলেন। মুজিব ঘোষণা করেন যে,” পূর্ব বাংলার জনগণ পূর্ণ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ভিত্তিক ছয় দফা কর্মসূচির পক্ষে একটি স্পষ্ট রায় দিয়েছিল এবং এই রায় সম্মান করতে হবে। দেশের সংবিধান ছয় দফা উপর ভিত্তি করে করতে হবে।“
পরিষদের অধিবেশনের জন্য ভুট্টোর হুমকি সত্ত্বেও , আওয়ামীলীগের সংবিধান কমিটির খসড়া সংবিধানের ছয় দফা কর্মসূচীর ভিত্তিতে দল দ্বারা প্রস্তুত পর্যালোচনা করতে বসল। ভুট্টো অধিবেশন স্থগিত করার জন্য ক্রমাগত চাপ দিয়ে গেল এবং হুমকি দেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানে তীব্র আন্দোলন হবে যদি অধিবেশ অনুষ্ঠিত হয় এবং পশ্চিম শাখার কোন সদস্য অধিবেশন যোগদান করলে তাঁকে গুরুতরভাবে মোকাবিলা করা হবে। হঠাৎ, ১ই মার্চ ইয়াহিয়া খান অনির্দিষ্টকালের জন্য অধিবেশন স্থগিত করলেন । তিনি বলেন, দুইপক্ষের নেতাদের মনোভাব পরিতাপের বিষয় ছিল এবং সে জন্য পাকিস্তানকে মূল্য দিতে হবে।
রাষ্ট্রপতির মন্ত্রীসভাকে বরখাস্ত করা হয়েছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের প্রদেশগুলোর গভর্নরদেরকে নিজ নিজ এলাকায় সামরিক শাসন পরিচালনার ভার দেয়া হল। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের বদলে নতুন আরেকজন সামরিক শাসন পরিচালককে নিয়োগ দেয়া হল।
একটি সংবাদ সম্মেলনে মুজিব স্থগিতকরণের এই ষড়যন্ত্রের নিন্দা জানালেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সাথে কোনরকম পরামর্শের তোয়াক্কা না করেই রাষ্ট্রপতির অধিবেশন মূলতবি করা নিয়ে তিনি দুঃখপ্রকাশ করলেন। তিনি দেশ জুড়ে সাধারণ ধর্মঘট আহ্বান করলেন। ঢাকায় স্বতঃস্ফুর্ত বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হল। যেহেতু বিক্ষোভকারীরা প্রতিশোধ নেয়ার দাবি জানাচ্ছিল, মুজিব তাদেরকে ধৈর্য্য ধরার পরামর্শ দিয়ে বললেন, “আমরা একটি শান্তিপূর্ণ সাংবিধানিক আন্দোলন প্রতিষ্ঠা করব”। কিন্তু পাকিস্তানি নিরাপত্তা বাহিনী জনগণের ওপর গুলিবর্ষণ করায় ঢাকায় সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ল। ঢাকা এবং অন্যানয় এলাকায় কার্ফিউ জারি করা হল এবং সামরিক আইন প্রশাসন পূর্ব পাকিস্তানে প্রেস সেন্সরশিপের আদেশ জারি করে। ৩ মার্চে মুজিব অহিংস অসহযোগ আন্দোলন শুরুর ঘোষণা দেন, যা “পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত” হবার আগ পর্যন্ত চলার কথা ছিল। একই দিনে, ইয়াহিয়া খান দু’টি অংশের নেতাদেরকে ১০ মার্চ, ১৯৭১ তারিখে একটি সমাবেশে তাদের সংবিধান প্রণয়নে পার্থক্যসমূহ নিয়ে আলোচনার জন্য আমন্ত্রণ জানান। সেনাবাহিনী কর্তৃক শত শত বিক্ষুব্ধ প্রতিবাদকারী ও নিরাপরাধ মানুষকে হত্যা ও আহত করার কারণে মুজিব সমাবেশে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি বলেন, “আমরা কোন গণহত্যার মূল হোতাদের সাথে আলোচনায় বসব না”। তিনি সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফেরত পাঠাবার অনুরোধ করেন। তার এই অনুরোধকে পাত্তা না দিয়ে বরং পরের কয়েকদিন আরও কিছু বিক্ষোভকারীদেরকে মেরে ফেলা হয়। সামরিক সরকার পূর্ব পাকিস্তানে প্লেন ও জাহাজে আরও বেশি সৈন্য ও সরঞ্জামাদি পাঠিয়ে সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করে তোলার পর ইয়াহিয়া খান ২৫ মার্চে জাতীয় সমাবেশ অধিবেশনের ডাক দিলেন। তিনি অবশ্য সতর্ক করে দেন এই বলে যে, সশস্ত্র বাহিনীর হাতেই পাকিস্তানের অখণ্ডতার ‘পূর্ণ ও একমাত্র’ ক্ষমতা বজায় থাকবে।
শেখ মুজিব ঘোষণা দেন যে, তাঁর দল অধিবেশনে অংশগ্রহণের বিষয়টি বিবেচনা করে দেখবে যদি ইয়াহিয়া খান তাৎক্ষণিকভাবে ১) সামরিক আইন তুলে নেন, ২) সেনাবাহিনীকে ফিরিয়ে নেন, ৩) বেসামরিক শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন, এবং ৪) পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ড নিয়ে জবাবদিহিতার আদেশ দেন। মুজিবের এই চার দফায় সকল পূর্ব পাকিস্তানিরাই জোরালো সমর্থন জানায়। এমনকি ভুট্টো এবং আব্দুল কাইয়ুম খান বাদে পশ্চিম পাকিস্তানি নেতারাও এই চারটি শর্তকে যুক্তিযুক্ত হিসেবে বিবেচনা করেন এবং রাষ্ট্রপতিকে তা গ্রহণ করার পরামর্শ দেন। মুজিবের চার দফায় সমর্থনকারী পশ্চিম পাকিস্তানি নেতৃবৃন্দের মধ্যে ছিলেন মুসলিম লীগের পরিষদ প্রধান মিয়া মমতাজ দৌলতানা, জামিআতুল-উলেমায়-ইসলামের নেতা মাওলানা মুফতি মাহমুদ, জাতীয় আওয়ামি পার্টির প্রধান খান আব্দুল ওয়ালি খান, মুসলিম লীগ পরিষদের সর্দার শওকত হায়াত খান, জামিআতুল-উলেমা-ই-পাকিস্তানের মাওলানা শাহ আহমেদ নূরানী, জামাত-ই-ইসলামির প্রফেসর আব্দুর গফুর, মুসলিম লীগ সভার জনাব জামাল মোহাম্মদ কোরেজা, জাতীয় সমাবেশের স্বতন্ত্র সদস্য মাওলানা জাফর আহমেদ আনসারি, জাতীয় সমাবেশের স্বতন্ত্র সদস্য সর্দার মাওলা বখশ সুমরু, তেহরিক-ই-ইসতিকলালের প্রধান এয়ার মার্শাল (অবঃ) আসগর খান, বেলুচিস্তানের রাজনৈতিক নেতা নওয়াব আকবর খান বুগাতি, ভাওয়ালপুর যুক্তফ্রন্টের বেগম তাহিরা মাসুদ, রাওয়ালপিন্ডি মুসলিম লীগ পরিষদের সভাপতি জনাব মাহমুদ আহমেদ মিন্টু, জাতীয় আওয়ামি পার্টি (ওয়ালি গ্রুপ)- এর সাধারণ সম্পাদক জনাব হোক ওসমানি ও প্রমুখ। ভুট্টোর পিপল’স পার্টি এবং আব্দুল কাইয়ুম খানের সমগ্র পাকিস্তান মুসলিম লীগ বাদে পশ্চিম পাকিস্তানের সমস্ত রাজনৈতিক দলই ভুট্টোকে এই রাজনৈতিক সংকট তৈরির জন্য দায়ী করে। উপরিউল্লেখিত পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ এবং করাচি বার অ্যাসোসিয়েশন ও করাচির অধিবাসীরা বিভিন্ন বিবৃতি এবং বৈঠকে ভুট্টোকে সতর্ক করে বলে যে, তার দেশভঙ্গ করা উচিত না এবং দেশ ও পরিস্থিতি রক্ষায় তাকে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল, অর্থাৎ শেখ মুজিবের আওয়ামি লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরামর্শ জানায়।
সমগ্র পূর্ব বাংলা এক হয়ে শেখ মুজিব ওর তাঁর আওয়ামি লীগের পাশে এসে দাঁড়াল। অন্যান্য রাজনৈতিক দলসমূহের বাঙালি নেতৃবৃন্দ যেমন পাকিস্তান গণতান্ত্রিক দলের প্রধান জনাব নূরুল আমিন, পূর্ব পাকিস্তান জামাত-ই-ইসলামি প্রধান প্রফেসর গোলাম আযম, ন্যাপ (ভাসানি গ্রুপ) এর প্রধান মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানি, পাকিস্তা জাতীয় লীগ প্রধান জনাব আতাউর রহমান খান, কৃষক শ্রমিক দলের প্রধান জনাব এ এস এম সোলায়মান, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ পরিষদের সভাপতি জনাব শামসুল হুদা, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জনাব এ এন এম ইউসুফ ও প্রমুখের কাছ থেকেও স্বতঃস্ফুর্ত সমর্থন পাওয়া গিয়েছিল।
শেখ মুজিবের অসহযোগ ডাকে সাড়া দিয়েছিল সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান। এমনকি এই ডাকে প্রধান বিচারপতি ও ঢাকা হাইকোর্টের সকল বিচারপতিরাও সাড়া দিয়েছিল। ১৫ মার্চ প্রদেশের স্বচ্ছন্দ পরিচালনা ও নিখুঁত আইন-শৃংখলা রক্ষ্ণাবেক্ষণের জন্য শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানিদের কাছে ৩৫টি নির্দেশনার একটি সেট প্রেরণ করেন। এই ঘোষণার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই ইয়াহিয়া খান ঢাকায় পৌঁছান এবং ১৬ মার্চে তাদের দু’জনের মধ্যে আলাপ-আলোচনা শুরু হয়। পরবর্তীতে ভুট্টো ও অন্যান্য পশ্চিম পাকিস্তানি নেতারাও আলোচনায় যোগ দেন।
৭. ক্ষমতাসীন শাসকদের ষড়যন্ত্র ও বিশ্বাসঘাতকতা এবং স্বাধীন বাংলাদেশের ঘোষণা
১০ দিন ধরে ইয়াহিয়া খান ও শেখ মুজিব এবং অন্যান্য উপদেষ্টাদের মধ্যে আলোচনা চলে। কোন পর্যায়েই আলোচনা থামার কোন আভাস পাওয়া যায়নি। অপরদিকে, চার দফার উপর একটি চুক্তি হওয়ার আভাস পাওয়া গিয়েছিল। সেগুলো ছিল: সেনাশাসন তুলে নেয়া এবং রাষ্ট্রীয় ঘোষণার মাধ্যমে একটি বেসামরিক সরকারের হাতে ক্ষমতা তুলে দেয়া, প্রাদেশিক ক্ষমতা সংখ্যাগরিষ্ঠ দলগুলোর হাতে তুলে দেয়া; ইয়াহিয়া খানকে রাষ্ট্রপতি এবং কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতায় রাখা এবং সংবিধান চূড়ান্ত করার জন্য সংসদের প্রস্তুতিমূলক যৌথ সমাবেশ হিসেবে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জাতীয় সমাবেশের সদস্যদের পৃথক অধিবেশন করা। একবার এই চুক্তি মুজিব আর ইয়াহিয়ার মাঝে উত্থাপিত হলেই অন্তর্বর্তী সময়ে পূর্ব পাকিস্তান ও কেন্দ্রীয় ক্ষমতার বিষয়ে প্রশ্ন উঠবে।
কিন্তু মার্চের ২৫ ও ২৬ তারিখ রাতের অন্ধকারে ইয়াহিয়া আচমকা ঢাকা ছেড়ে গেল। একই সময়ে পাকিস্তানি সেনারা পূর্বাংশে তাদের ক্ষমতা পুনঃপ্রতিষ্ঠার কাজে লেগে গেল। এদিকে পশ্চিম পাকিস্তানে আওয়ামি লীগকে বয়কট ও মুজিবকে রাষ্ট্রদোহিতায় অভিযুক্ত করে ইয়াহিয়া খান একটি বার্তা প্রচার করল। এবং ২৬ মার্চ তারিখে, শেখ মুজিব সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী একটি দেশ হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন। দু’দিন পর একটি অস্থায়ী সরকার গঠনের ঘোষণা দেয়া হল এবং ১৭ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা করা হল।
সন্দেহাতীতভাবেই এতে প্রমাণিত হয় যে, ইয়াহিয়া ও তার দলের কোনকালেই শান্তিপূর্ণভাবে পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকট নিরসনের ইচ্ছা ছিল না। তারা কেবল আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সেনাবাহিনীর শক্তিবৃদ্ধিতেই আগ্রহী ছিল। বেসামরিক অসহযোগ আন্দোলনের অভূতপূর্ব সাফল্যে পাকিস্তান সরকার নিশ্চিত হয়ে গেছে যে, পূর্বাংশে তাদের ঔপনিবেশীক শোষণের দিন চিরদিনের মত শেষ হতে চলেছে। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক ও ধনতান্ত্রিকগণ কেবল পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণের প্রতিই আগ্রহী ছিল। সে কারণেই তারা শান্তিপূর্ণভাবে সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের দিকে নজর দেয়নি। বরঞ্চ তারা স্বায়ত্বশাসনের নিমিত্তে নিষ্ঠুরভাবে আন্দোলনের সাথে জড়িত প্রত্যেক বাঙালি – আওয়ামি লীগ নেতা, শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং সকল বুদ্ধিজীবীদেরকে হত্যার মাধ্যমে আন্দোলন ভেঙে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। পাঞ্জাবি সৈন্য অধ্যুষিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এই বর্বরোচিত ও নির্বোধ কর্মকান্ডই পাকিস্তানের মৃত্যুধ্বনি হিসেবে কাজ করে এবং পূর্ব পাকিস্তানে জনপ্রিয় ও আনুষ্ঠানিকভাবে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম দিতে বাধ্য করে, যার নাম “বাংলাদেশ”।
৮. বাংলাদেশে গণহত্যা
সবচাইতে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সমৃদ্ধ এবং বিমান ও নৌবাহিনী কর্তৃক সমর্থিত পশ্চিম পাকিস্তানের সুপ্রশিক্ষিত পেশাদার সেনাবাহিনী ২৫ মার্চ রাতে সারা বাংলাদেশের মানুষদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। সেনাবাহিনীর এই কর্মকাণ্ড ছিল সুপরিকল্পিত এবং সকল গুরুত্বপূর্ণ শহরে তা একযোগে শুরু হয়। শুধুমাত্র রাজনৈতিক নেতা কিংবা বুদ্ধিজীবীদেরকেই নয়, নারী ও শিশুসহ নিরাপরাধ নিরস্ত্র মানুষদেরকেও নির্মম ও ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করা হয়। মৃত্যু ও ধ্বংসের সঠিক পরিসংখ্যান, যা এখনও চলছে, তা কোনদিনই জানা হবে না। গণযোগাযোগের উপর ইয়াহিয়া খানের সরকার পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে এবং ২৬ মার্চ ৩৫ জন বিদেশি সাংবাদিককে ঢাকা থেকে অপসারণ করেছে। ইয়াহিয়া-টিক্কা খান সরকারের ষড়যন্ত্রের উদ্দেশ্য ছিল বহির্বিশ্বকে পূর্ব পাকিস্তানে কী ঘটেছে তা জানতে না দিয়ে ৭২ ঘন্টার মধ্যে নির্দিষ্ট কিছু গণহত্যার মাধ্যমে বাঙালিকে বশে নিয়ে আসা।
বহির্বিশ্বের কাছে নিজেদের জঘন্য অপরাধ গোপণ করতে এবং পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি সম্পর্কে বিভ্রান্তি তৈরিতে তারা খানিকটা সফল হয়েছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পাশবিকতা ও নৃশংসতার কথা প্রত্যক্ষদর্শী বিদেশি সাংবাদিকদের মাধ্যমে পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে, মে মাসে সেনাবাহিনী কর্তৃপক্ষ পরিচালিত একটি সফরে নির্বাসিত সাংবাদিকদেরকে পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানোর সময় তারা বিপুল ধংসযজ্ঞ ও হত্যাকাণ্ডের নমুনা দেখতে পায়। তাদের হিসেব অনুযায়ী, মৃতের সংখ্যা ৫ থেকে ১০ লক্ষের মত। তারা দেখে জনশূন্য ও অর্ধমৃত শহর, ধ্বংসপ্রাপ্ত অর্থনৈতিক কার্যক্রম এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাঘাত। তারা স্তম্ভিত ও ভীত হয়ে পড়ে। পূর্ব পাকিস্তান থেকে ফাঁস হওয়া খবরে আভাস পাওয়া যায় যে, এই ত্রাস ও নিপীড়ন এখনও চলছে। চলছে নৈরাজ্য। যে কাউকে গুলি করার, তাদের সম্পত্তি লুট করার, যেকোন নারীকে ধর্ষণ করার এবং যেকোন বাড়ি পুড়িয়ে দেয়ার লাইসেন্স আছে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের সমর্থক অবাঙালি জনগোষ্ঠীর। প্রায় ৬০ লাখ পূর্ব বাঙালির নিজেদের বাড়িঘর ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়া এবং শরণার্থী হিসেবে এখনও প্রতিদিন প্রায় ৫০,০০০ থেকে ১ লাখ হারে মানুষের পালিয়ের যাবার বিষয়টি থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, পূর্ব পাকিস্তানে কোন আইন নেই, নেই নিরাপত্তা, নেই কোন স্বাভাবিক অবস্থা এবং সেই বিধ্বস্ত এলাকায় রয়েছে খাদ্য, ওষুধপত্র আর অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসের ভয়ানক ঘাটতি।
৯. সেনা বর্বরতার প্রত্যক্ষদর্শী
২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় অবস্থিত ৩৫ জন বিদেশি সাংবাদিক সেনাবাহিনীর কর্মকান্ডের কিছুটা দেখতে পায়। তাদের মধ্যেই কেউ কেউ ঢাকা থেকে তাদেরকে অপসারণের পর সেনাবাহিনী কীভাবে ঘুমন্ত মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, তাই নিয়ে রিপোর্ট করে। সেনাবাহিনী মানুষকে হত্যা করতে এবং তাদের ঘড়বাড়ি ও সম্পত্তি ধ্বংস করতে ট্যাংক, মর্টার, বাজুকা এবং অন্যান্য আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করে। কিছু কিছু বিদেসি সংবাদদাতা ভারতীয় সীমান্ত দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশ করে নিজ চোখে সেনাবাহিনীর নির্মমতা এবিং পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাদের হাত থেকে নিজেদের মাতৃভূমিকে রক্ষার জন্য বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের দৃঢ় সংকল্প প্রত্যক্ষ করেছিল। বিদেশি সংবাদদাতা, যাদের সাক্ষ্য বিভিন্ন পত্রিকা এবং সাময়িকীতে প্রকাশ পেয়েছিল, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন আর্নলদ যেইলটিন (এপি), মিশেল লরেন্ট (এপি), ডেনিস নিল্ড (এপি), মরট রোজেনব্লাম (এপি), সিডনি শ্যামবার্গ (নিউ ইয়র্ক টাইমস), টি জে এস জর্জ (ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউ), নয়ন চন্দ্র (ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউ), ড্যান কগিংস (টাইম), টনি ক্লিফটন (নিউজউইক), লরেন জেনকিনস (নিউজউইক), মিলান জে কিউবিক (নিউজউইক), সাইমন ড্রিক (ডেইলি টেলিগ্রাফ)।
জন রোড, একজন মার্কিন সাহায্যকর্মী, যিনি নৈরাজ্যের সময় ঢাকায় ছিলেন এবং পাকিস্তানি সেনাদের ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম নিজ চোখে দেখেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট ফরেইন রিলেশানস কমিটির প্রকাশিত এক চিঠিতে রোড বর্ণনা করেন কীভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসগুলোকে ট্যাংক দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়া হয় আর এর বাসিন্দাদেরকে জবাই করে ফেলা হয়। “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগ অধ্যাপকসহ বুদ্ধিজীবী সমাজকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা” সম্পর্কে তিনি বলেন। তার মতে, “পূর্ব পাকিস্তানে নৈরাজ্য বিরাজ করছে, যেখানে নিরস্ত্র নাগরিকদের গণহত্যা, পরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়কে সরিয়ে দেয়া”-র পায়তারা চলছিল। ডেইলি টেলিগ্রাফের সাংবাদিক, সায়মন ড্রিক ছিলেন ঢাকা হত্যাকাণ্ডের একজন প্রত্যক্ষদর্শী। তিনি বলেন যে, ২৬ মার্চ সকালে সেনাবাহিনী সুপরিকল্পিতভাবে প্রায় ১১ ঘন্টা ধরে সমগ্র পুরনো ঢাকাশহরকে ধ্বংস করে। মানুষকে নিজ গৃহে পুড়িয়ে দেয়া হয়। মানুষ শহর থেকে পালিয়ে যাবার সময় সেনারা তাদের ধাওয়া করে। কীভাবে বাজারে ঘুমন্ত মানুষদেরকে গুলি করে মারা হয় এবং সকালেও কীভাবে তারা বস্তা গায়ে জড়িয়ে তারা পড়েছিল, যেন তারা তখনও ঘুমিয়ে, সেকথা বর্ণনা করেন ড্রিক। “গণহত্যা শব্দটি যে এই পরিস্থিতির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই”, বলেন ঢাকার একজন বিদেশি কুটনীতিক। আরেকজন পশ্চিমা কর্মকর্তা বলেন, “এ যেন একেবারে রক্তগঙ্গা! সেনারা খুবই নির্দয় ছিল”। ঢাকা থেকে অপসারিত একজন ব্রিটিশ নারী ২ এপ্রিল সিঙ্গাপুরে বলেন, “আমার বাড়ি থেকে বিমান বন্দরের যাবার রাস্তাটা ছিল একটা গণকবর। রাস্তার ধারগুলো ভর্তি ছিল বেশিরভাগ নারী আর শিশুদের মরদেহ দিয়ে”। তিন লাখ লাশের খবর নিয়ে করা রিপোর্টগুলো অতিরঞ্জন ছিল না বলে তিনি দাবি করলেন। নিল ও’টুল, চট্টগ্রামে থাকা একজন মার্কিনী বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় বন্দর নগরী যুদ্ধের কারণে পরিণত ভৌতিক এক নগরীতে। ৪ এপ্রিল পর্যন্ত চট্টগ্রামে থাকা এক ড্যানিস শিক্ষার্থী নিরস্ত্র নাগরিকদের ওপর সেনাবাহিনীর নৃশংসতা এবং তাদের বাজার, বাড়িঘর ও কারখানা ধ্বংস ও পুড়িয়ে ফেলার লোমহর্ষক গল্প শোনায়। চট্টগ্রামের এক জুট কারখানার ম্যানেজার জানান যে তার সব কর্মীদেরকেই হত্যা করা হয়েছে। পিটারবোরোর একজন ইঞ্জিনিয়ার, যিনি চট্টগ্রামে ছিলেন, তিনি জানান যে মানুষকে ঘিরে দাঁড়িয়ে তাদেরকে গুলি করছিল সেনাসদস্যরা। অন্যান্য শহ৯র যেমন যশোর, খুলনা, রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর, সিলেট, কুমিল্লা, ময়মনসিংহতেও একইরকম ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছিল। বর্বর পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনী শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং বুদ্ধিজীবীদেরকে জবাই, নিরস্ত্র নাগরিকদেরকে গুলি, নারীদেরকে ধর্ষণ, বাড়িঘর পোড়ানো, ব্যাংক লুট এবং কারখান ধ্বংস করেছিল।
দু’জন ব্রিটিশ সংসদ সদস্য, জাতিসঙ্ঘের দু’জন প্রতিনিধি, একজন মার্কিন কংগ্রেসম্যান এবং অন্যান্য স্বতন্ত্র পর্যবেক্ষকগণ পূর্ব বাংলার সীমান্ত এলাকাসমূহ ও শরণার্থী শিবিরগুলো পরিদর্শন করেন এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক সংঘটিত বর্বরতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা লাভ করেন। ভারতে বাঙালি শরণার্থী, যাদের সংখ্যা ৬০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে, তারা সেনাবাহিনীর বর্বরতার প্রাণবন্ত বর্ণনা দিয়েছেন। অনেক শরণার্থীর শরীরেই রয়ে গেছে গুলির দাগ।
১০. মানবাধিকার লঙ্ঘন
পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ওপর অত্যাচার ও নিপীড়নমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ইয়াহিয়া খানের সরকার আন্তর্জাতিক আইনের সবচেয়ে মূল্যবান নীতিগুলোকে নির্লজ্জের মত লঙ্ঘন করেছে। তারা জাতিসংঘ সনদের প্রস্তাবনা ও ১, ৫৫ ও ৫৬ নিবন্ধ, মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্র, নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার ১৯৫৬ এর আন্তর্জাতিক রীতিনীতি, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারসমূহের আন্তর্জাতিক চুক্তি্, ১৯৬৬, হেগ আইন ১৯০৭ এর নিবন্ধ ২৩, জেনেভা চুক্তির নিবন্ধ ৩, ১৯৪৯, বিবদমান আক্রমণ ও গণহত্যা চুক্তি ১৯৪৮ থেকে বেসামরিকদের মুক্তির মতবাদ লঙ্ঘন করেছে।
১১. সেনাবাহিনীর নৃশংসতার বিশ্বজুড়ে নিন্দা
পূর্ব পাকিস্তানে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পাশবিকতা ও নৃশংসতার বিশ্বজুড়ে নিন্দা হয়েছে। বিশ্ব সংবাদমাধ্যম জোরালোভাবে ইয়াহিয়া খান সরকারের কর্মকান্ডের সমালোচনা করেছে এবং অনেক প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা ও পাঞ্জাবি-পাঠান সৈন্যদের অপ্রত্যাশিত পাশবিকতার নির্ভরযোগ্য গল্প প্রকাশ করেছে। বেশিরভাগ দেশেরই বিশেষ করে ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, জাপান, অস্ট্রেলিয়ার বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র ও সাময়িকীতে হত্যাকান্ড বন্ধ করার এবং শান্তিপূর্ণভাবে পূর্ব বাঙালিদের কাছে গ্রহণযোগ্য উপায়ে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান দিতে আহ্বান জানানো হয়েছে। নানা দেশের রাজনৈতিক চিন্তাবিদ, আলেম, শিক্ষার্থী ও আলোকিত মানুষেরা বাঙালিদের দুর্দশায় সমবেদনা জানিয়ে সেনাবাহিনীর কর্মকান্ডের নিন্দা জানিয়েছে এবং বহির্বিশ্ব ও বিশ্বশক্তিকে অনুরোধ জানিয়েছে ইয়াহিয়া খানের ওপর চাপ তৈরি করে তাকে পূর্ব পাকিস্তানের ওপর থেকে ক্ষমতা সরিয়ে নিয়ে এই রক্তের খেলা বন্ধ করতে। বিশ্বের সামাজিক ও দাতব্য সংস্থাগুলো তাদের সমবেদনা জানিয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের ত্রাণ পাঠানোর ইচ্ছা পোষণ করেছে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রপতি নিকোলাই পোজোর্নি রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খানকে এক বার্তায় পূর্ব পাকিস্তানে রক্তপাত বন্ধ এবং শান্তিপূর্ণভাবে রাজনৈতিক আপোষে আসতে বলেছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাদের এই বাছাইকৃত গণহত্যা ও বাঙালিদেরকে ধ্বংস করার প্রক্রিয়ায় নিন্দা জানিয়েছেন এবং পূর্ব বাংলার নিপীরিত জনগণের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করেছেন। তিনি বিশ্বশক্তিকে এযাবতকালের সবচাইতে বড় দুঃখজনক ঘটনাটিতে হস্তক্ষেপ এবং শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধান প্রদানের আহ্বানও জানান। জাতিসঙ্ঘের মহাব্যবস্থাপক উ থান্ট বলেন, মার্চের শেষের দিকে এবং এপ্রিলে পূর্ব পাকিস্তানে যা ঘটেছে, তা “মানব ইতিহাসে অত্যন্ত ভয়ংকর একটি ঘটনা”, যেখানে অনেক দেশই পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, সেখানে বেশিরভাগ সরকারই এই বিষয়ে উদাসীন আচরণ করছে ইয়াহিয়া সরকারের অভ্যন্তরীণ বিষয়ের অজুহাতে। দুর্ভাগ্যবশত বিশেষ করে মুসলিমপ্রধান দেশগুলোর প্রতি এই অবহেলা ও উদাসীনতা পূর্ব পাকিস্তানিদের জন্য আশ্চর্যের এবং তা সামরিক সরকারকে অত্যাচার ও নিপীড়ন চালিয়ে যাওয়ার সাহস যুগিয়েছে। তা সত্ত্বেও, বেশিরভাগ সরকারই এই ভয়াবহ ঘটনার ব্যাপারে ওয়াকিবহাল এবং সাহায্যকারী দেশগুলোর সরকারও ইয়াহিয়া খানের সরকারকে সমস্যার শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধান প্রণয়নে পরোক্ষভাবে চাপ দিয়ে যাচ্ছে।
তারা স্থানীয় জনসাধারণের কাছ থেকে জোরপুর্বক সহায়তা আদায় করতে চরম ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া প্রতিবেদন এবং বিভিন্ন মিথ্যা ও বিপরীতমুখী সংবাদ যা সামরিক কর্তৃপক্ষ সরবরাহ করছে এটি প্রমাণ করার জন্য যে, পুর্ব পাকিস্তানে কোন আইন, শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা, শান্তি এবং স্বাভাবিক কোন অবস্থা বিরাজ করছে না। সামরিক নিয়ম জারির কয়েক দিনের মধ্যে সামরিক কর্তৃপক্ষ দাবি করে যে, পুর্ব পাকিস্তানে সব কিছু স্বাভাবিক ছিল। এক দিকে তারা এখনও স্বাভাবিকতার দাবি করে, অন্যদিকে তারা ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী ও দুষ্কৃতিকারীদের দ্বারা বৃহৎ মাত্রায় হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের কথা বলে। যখন বাইরের বিশ্ব এই নজিরবিহীন হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের কথা জানতে পারল, তারা বাঙালিদের, অজ্ঞাত পরিচয় দুষ্কৃতিকারীদের এবং ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীদের এই দুঃখজনক ঘটনার জন্য দোষারোপ করা শুরু করল। ইয়াহিয়া খান প্রথমে বললেন যে, ভারতে কোন বাঙালি শরনার্থী নেই, এখন তিনি শরনার্থীদের ফিরিয়ে আনার জন্য অভ্যর্থনা কেন্দ্র খুলেছেন। ইয়াহিয়া খান শুরুতে পুর্ব পাকিস্তানের জন্য আন্তর্জাতিক সাহায্য প্রত্যাখান করেছিলেন, কিন্তু তিনি এখন জাতিসংঘের কাছ থেকে ব্যাপক মাত্রায় সাহায্য পাওয়ার জন্য আবেদন করেছেন। তিনি যাই হোক জোর করেছেন যে, সকল সাহায্য তার সরকারের দ্বারা পরিচালনা করা উচিত। তার পরিকল্পনা হতে পারে সৈন্যদের জন্য সাহায্যকে সর্বোত্তম ভাবে কাজে লাগানো এবং বাঙালিদের অনাহারে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া।
রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান নির্বাচনের পরে ঘোষণা দিয়েছিলেন যে শেখ মুজিবুর রহমান একজন মহান শ্রদ্ধেয় নেতা এবং দেশের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী, কিন্তু ২৬ মার্চ তিনি তাকে দেশদ্রোহী উপাধি দিলেন এবং তাকে গ্রেপ্তার করলেন এবং তাকে পশ্চিম পাকিস্তানি কারাগারে প্রেরণ করলেন। ইয়াহিয়ার শাসনকাল কূটনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি করে এবং ইন্ডিয়ার সাথে সীমান্ত সমস্যা তৈরি করে । এই বিষয়কে অন্য গতিপথে নেয়ার চেষ্টা করছিল। পাকিস্তান ইন্ডিয়ার উপর সকল দোষারোপ করে। ইন্ডিয়ান বিমানের ছিনতাইকারীদের ভুট্টো, পশ্চিম পাকিস্তানী জনগন এবং সরকার মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বাগত জানান। তারপর একটি প্রহসনের বিচার অনুষ্ঠিত হয় এবং এই ছিনতাইকে একটি ভারতীয় ষড়যন্ত্র হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়। সামরিক শাসন পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণদের পুর্ব পাকিস্তানের আসল অবস্থা সম্পর্কে অজ্ঞ রেখেছিল। তারা পশ্চিম পাকিস্তানীদের মধ্যে আরও চেষ্টা করছিল প্রাদেশিক বোধ ও ঘৃণা জাগিয়ে তোলার। তারা মিথ্যা প্রতিবেদন প্রচার করছিল যে, বেশ কিছু সংখ্যক অবাঙালি বাঙালি বিদ্রোহীদের দ্বারা নিহত হয়েছে। এই সরকারে কার্যকলাপ সভ্যতাবর্জিত এবং এর আচরন সহানুভুতিহীন।এই সরকার, যাই হোক, জনগণকে উপস্থাপন করে না। এই সরকার পুর্ব বাঙালিদের কাছে একটি বিদেশী, প্রতিপক্ষ সরকার। এমনকি পশ্চিম পাকিস্তানেও অসন্তোষ ও অস্থিরতা বিরাজ করছে। ভুট্টো এই অবস্থার প্রেক্ষিতে ক্ষমতা তার দলের কাছে বদলি করার জন্য অনুনয় করেছেন যে, আমলাতন্ত্র জাতীয় সমস্যা সমাধান করতে পারে না। সে এবং তার দল আপাতদৃষ্টিতে এই শাসন কালের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন। কায়ুম খানের মুসলিম লীগ ব্যতীত অন্যান্য সকল পশ্চিম পাকিস্তানী রাজনৈতিক দল পুর্বে সমর্থঙ্করেছিল যে, ক্ষমতা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে হস্তান্তর করা উচিত। এটি প্রমাণ করে যে, সামরিক জান্তা জনসমর্থন বা আস্থার উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এটি কোন আশ্চর্যের ব্যাপার নয় যে, এমন একটি অভিজাত শাসনব্যবস্থা যেটি শুধুমাত্র অস্ত্রের সাহায্যে শাসন করে, তারা এমন বর্বর ও বেআইনি উপায়ে শাসন করবে। এই শাসনকাল শুধুমাত্র জনমতকেই নয়, বহির্বিশ্বকেউ উপেক্ষা করেছে।চিনের সাথে পাকিস্তানের বিশেষ সম্পর্ক এবং চিনের কাছ থেকে এটি যে বিশাল অর্থনৈতিক ও সামরিক সাহায্য পাচ্ছে, সেটি অন্যান্য ক্ষমতাশালী দেশকে উপেক্ষা করার জন্য উৎসাহিত করছে। চীন ও পাকিস্তানের মধ্যে সকল সুসম্পর্কের সুচনা দুই দেশের মধ্যে পরবর্তী সম্পর্ককে পোক্ত করেছে। চীন এখন পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতি তাদের স্বার্থ অর্পন করেছে এবং সকল পরিস্থিতে সামরিক শাসনকালকে সমর্থনের ওয়াদা করেছে।
১৫। দৃষ্টিভঙ্গি
রাজনৈতিক চিন্তাবিদ এবং নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকেরা বিশ্বাস করেন যে, পাকিস্তানের মৃত্যু হয়েছে যাকে কখনো পুনর্জীবিত বা একত্রিত করা যাবে না। এই মুল বিষয়টি পাকিস্তানকে অটুট রাখার বিষয়ে নয় বরং এই মানব ইতিহাসের বিয়োগান্ত ঘটনার অবসান ঘটানো এবং পুর্ব পাকিস্তানের সাড়ে সাত কোটি মানুষকে তাদের মাতৃভুমিতে শান্তিতে ও নিরাপত্তায় বসবাসে সমর্থ করার জন্য এবং বর্বরতা এবং বাইরের সৈন্যবাহিনীর পাশবিকতার বিপদ থেকে মুক্ত রাখার জন্য। জাতিসংঘের অবিলম্বে চেষ্টা গ্রহণ করা উচিত, সকল ক্ষমতাধর দেশ এবং মুসলিম দেশগুলোকে ইয়াহিয়া খানের সরকারকে এই অত্যাচারের অবসান ঘটানো এবং পুর্ব পাকিস্তানের জনগনের কাছে গ্রহণযোগ্য শান্তিপুর্ন রাজনৈতিক সমাধানে আসার জন্য বাধ্য করা উচিত। এই চেষ্টাকে সফল করার জন্য, নিম্নোক্ত শর্তগুলোকে সামনে রাখা উচিতঃ
১। শেখ মুজিবুর রহমানকে অতিসত্বর কোন শর্ত ব্যতীত মুক্তি দিতে হবে।
২। পুর্ব পাকিস্তানের পরবর্তী অবস্থা সম্পর্কে শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার আওয়ামী লীগ দ্বারা গঠিত প্রাদেশিক সরকারে সাথে মধ্যস্থতা করতে হবে।
৩। সামরিক শাসন প্রত্যাহার করে নিতে হবে এবং সকল সৈন্যদলকে পুর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে প্রেরণ করতে হবে।
৪। আওয়ামী লীগ সরকারকে পুর্ব পাকিস্তানের বিধিসম্মত ভাবে গঠিত সরকার হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে ।
৫। সকল শরনার্থীদের দেশে ফেরত আসার জন্য সমর্থ করতে সকল সুযোগ সরবরাহ করতে হবে। শরনার্থীরা পাকিস্তানী সরকারের মাধ্যমে তাদের যে সকল ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে তার জন্য পুর্ন ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
৬। যদি বাংলাদেশের প্রাদেশিক সরকার ছয়দফা দাবিতে সন্তুষ্ট না থাকে, তাদের শর্তানুযায়ী মধ্যস্থতা করতে হবে।
৭। যদি ইয়াহিয়া খানের সরকার এই শর্তগুলো না মেনে নয়, তবে এই সমস্যা নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপন করে হবে। এর পুর্বে ত্রাণ সরবরাহকারী দেশগুলো এবং বন্ধু দেশগুলোকে সামরিক শাসনের উপর চাপ প্রয়োগ করতে হবে যাতে ইয়াহিয়া খান অবিলম্বে বোঝাপড়ায় আসেন।
<৪,১৯৫,৪০৪-৪০৫>
অনুবাদকঃ সাদিয়া
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৯৫। আমরা গোষ্ঠীর সদস্যদের সাংকেতিক নাম ব্যবহার সংক্রান্ত চিঠি |
‘আমরা’ | ৪ নভেম্বর, ১৯৭১ |
প্রিয় মাকসুদ আলী,
জাকারতা, নভেম্বর.৪.১৯৭১
এখানে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হতে প্রচারিত শীলা ইসলামের লেখা ১৪টি গান ও ব্যাঙ্গ কাব্য আছে, দয়া করে বুঝে নিয়েন। এখানে জয় বাংলা অথবা অন্য যেকোন বাংলা সাময়িক পত্রিকা হতে প্রকাশিত তার আরো দুটি কবিতাও আছে। আমি আশা করব এগুলা প্রচারনা অথবা প্রকাশনার জন্য যা দরকার আপনি করবেন।
শীলা ইসলাম ছিলেন মিসেস রওশন আরা জামান করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে (এম.এবাংলা) ,দুই বছর ধরে বাংলা একাডেমীর সহকারী সম্পাদক ছিলেন, দুই বছর করাচির PECHS কলেজের অধ্যাপক ছিলেন ।তিনি বাংলা কবিতা, গান, ছোটগল্প এগুলোতে বেশ জনপ্রিয় ছিলেন।এখানে তার নিরাপত্তার জন্য আসল নাম প্রকাশ করা হয়নি।
আমি এরকম আরো উল্লেখযোগ্য ব্যক্তির নাম যুক্ত করছি। আমরা এইসব ছদ্মনাম ব্যবহার করব এবং আমি আপনাকে অনুরোধ করছিএগুলো চিহ্নকরে রাখতে এবং ভবিষ্যতে এই ছদ্মনামগুলো ব্যবহার করতে। এখানে আরো যোগ করা যায় যে এই বাঙালীগুলোর জীবনবৃত্তান্ত রুমি পাঠিয়েছেন। দয়া করে এই সবগুলির রশিদ আপনি বুঝে নিয়েন।
আমাকে অথবা আমরা-কে লিখতে হলে দয়া করে নিম্নের ঠিকানা ব্যবহার করবেন-
- জনাবকামাল; সি/ও মিসেসবাদরোএন, ডিজেএল। কাম্পার-৪
(টিজেদিনোবারএট), ডিজাকারতা, ইনদোনেশিয়া।
- জনাব কামাল গুপতা সি/ও গ্রুপ ক্যাপ্টেন এন সিনহা রায়,
ইন্ডিয়ান এমবাসি, ডিজেকারতা, পুরো সেকশন জুড়ে,
পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়, নিউ দিল্লী।
একটি প্রাথমিক উত্তরের অপেক্ষায়।
আন্তরিকতার সাথে, আপনারআন্তরিক
জনাব.এম.মাকসুদ আলি কামাল
বাংলাদেশ মিশন
৯,সারকাস এভিনিউ, কলকাতা-১৭
ক্রমিক নং | নাম | সাংকেতিক নাম |
১ | জনাব জয়নুল আবেদিন | জাফর |
২ | জনাব এ. এফ. মো. সামসুজ্জামান | কামাল |
৩ | জনাব এম.এ.আজিজ | আরাব |
৪ | জনাব এম ফারুক মোহাম্মদ | বদর |
৫ | জনাব এ: বি এম সানাউল্লাহ | সুফি |
৬ | জনাব সিদ্দিক আহমেদ | রুমি |
৭ | জনাব রুহুল আমিন | সাফরি |
৮ | জনাব হালিম সরকার | রুহানি |
৯ | জনাব মাহমুদ হোসেন | আনসার |
১০ | জনাব এম. এ. মতিন | হামিদ |
উপরের ছদ্মনাম গুলো চিহ্নিত করে রাখবেন।
** ভারতীয় দূতাবাস থেকে যখন জনাব কামালকে চিঠি পাঠান হবে তখন তাকে কামাল গুপ্তা বলে অভিহিত করা হবে।
-আমরা
জাকার্তা
- এইচ.ই. জনাব এম. হোসেন আলী,
- জনাব এম. মাকসুদ আলী.
- জনাব সাইদুর রহমান.
- কাজী নরুল ইসলাম
<৪,১৯৬,৪০৬-৪০৭>
অনুবাদকঃ আফসানা আহমেদ রিয়া
শিরোনাম | সুত্র | তারিখ |
১৯৬। বাংলাদেশ সরকার কতৃর্ক “আমরা” গোষ্ঠীর সদস্যদের প্রচারকার্য সম্পর্কে লিখিত চিঠি | বাংলাদেশ সরকার | ১৮ নভেম্বর, ১৯৭১ |
-১-
ভারতস্থ গনপ্রজাতন্ত্রী
বাংলাদেশ হাই কমিশন
৯ সার্কাস এ্যভিনিউ
কলিকাতা
নং- বি-৫/৫০/৭১ নভেম্বর ১৮, ১৯৭১।
প্রিয় জনাব রুমি,
১ নভেম্বর, ১৯৭১ তারিখ উল্লেখিত চিঠির জন্য আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।
চিঠিপত্র আর প্রচার উপকরনের জন্য আপনার দিক- নির্দেশনা মেনে চলার ব্যাপারটি আমরা অবগত হয়েছি । অতীতে আমাদের পক্ষ থেকে উত্তর পাঠাতে নিশ্চিতভাবেই বিলম্ব হয়েছে । ভবিষ্যতে আমরা নিয়মিত চিঠিপত্রের নিশ্চয়তার চেষ্টা করব ।
দয়া করে আমাদের জানাবেন যে আপনি সংবাদপত্র ও অন্যান্য প্রকাশনা গ্রহন করছেন কিনা । আমরা আনন্দিত যে স্থানীয় সংবাদ মাধ্যম আমাদের পক্ষে আগ্রহ দেখাচ্ছে । দয়া করে সংবাদপত্রের কেটে রাখা অংশ আপনি আমাদের পাঠান যাতে করে সেখানে প্রকাশিত খবরাখবর আমরা আমাদের প্রকাশনায় প্রকাশ করতে পারি ।
ধন্যবাদান্তে,
আপনার অনুগত,
সাইদুর রহমান
হাই কমিশনারের পক্ষে।
মি. কামাল
সি/ও মিসেস. ব্যাডরইন
ডিযেএল, ক্যামপণ ৪,
টিযিড্যান বারাত (ডেকাট ডিযেএল. মুসি)
ডিজাকার্তা, ইন্দোনেশিয়া।
-২-
নং- বি-৫/৫০/৭১ তারিখ-নভেম্বর ১৮, ১৯৭১।
প্রিয় জনাব রুমি,
জাকার্তা টাইমসে প্রকাশিত আপনার বিশেষ প্রতিবেদন এবং পশ্চিম পাকিস্তানি সংবাদ দাতা আজিজ বেগের ক্লিপের জন্য অশেষ ধন্যবাদ।
২. আজিজ বেগের দুঃসাহসিক অশুভ সংকেত সূচক প্রতিবেদনের উপর করা আপনার প্রতিবেদনে জন্য আমরা কৃতজ্ঞ । পশ্চিম পাকিস্তানের অস্ত্রের অপপ্রচার বাংলাদেশের জনগনকে ধ্বংসের ষড়যন্ত্রকে আরো গভীর করেছে এবং বিদেশীদের কাছে ব্যাপারটি আক্রমনাত্মক বলে বিবেচিত হয়েছে । আক্রমনাত্মক এ মনোভাব বিশেষ করে মুসলিম দেশগুলোতে তীব্র প্রতিক্রিয়া ছড়িয়েছে ।
৩. পৃথক দুটি চিঠিতে আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের উপর করা আমাদের পর্যালোচনা পাঠাচ্ছি । তথ্য ও যুক্তির সাথে আপনার সাক্ষাৎ হবে যা পশ্চিম পাকিস্তানের অপপ্রচার বিদেশে যে আপত্তি ছড়িয়েছে তার চ্যালেঞ্জকে ঊপস্থাপন করবে । সম্ভব হলে, এ পর্যালোচনার বিষয়বস্তুকে সম্পাদকীয় কিংবা স্থানীয় পত্রিকার নিবন্ধ হিসেবে প্রতিফলিত করুন ।
ধন্যবাদান্তে,
আপনার অনুগত,
সাইদুর রহমান
হাই কমিশনারের পক্ষে।
প্রতি,
তুয়ান কামাল,
সি/ও মিসেস. ব্যাডরইন
ডিযেএল, ক্যামপণ ৪,
টিযিড্যান বারাত
(ডেকাট ডিযেএল. মুসি)
ডিজাকার্তা, ইন্দোনেশিয়া।
<৪,১৯৭,৪০৮-৪১৩>
অনুবাদকঃ ফাহমিদা আক্তার বৃষ্টি
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৯৭। “আমরা” গোষ্ঠীর ভূমিকার উপর লিখিত প্রতিবেদন | “আমরা” | ২২ নভেম্বর, ১৯৭১ |
গোপন
“আমরা”
জাকার্তা
নভেম্বর ২২, ১৯৭১
ইন্দোনেশিয়ায় বাংলাদেশ আন্দোলনের মূল্যায়ন
সবচেয়ে বড় মুসলিম রাজ্য হিসেবে, ইন্দোনেশিয়াতে পাকিস্তান এক সম্মান উপভোগ করেছিলো। এটি গত দশক থেকে তার দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্যও (পশ্চিম পাকিস্তানে) এক সুনাম পেয়েছিলো। পাকিস্তান বিষয়াবলী সবসময়ই ইন্দোনেশিয়ান জনগণকে আগ্রহী করেছে। আইয়ুব খানের পতন, ইয়াহিখানের ক্ষমতা গ্রহণ, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন, শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগের অসাধারণ বিজয় এবং তারপর থেকে বিভিন্ন ঘটনাবলী বিভিন্ন জনস্তরের লোকদের মাধ্যমে খুব কাছ থেকে পরিলক্ষিত হয়েছে। ইন্দোনেশিয়ার সামরিক শাসকগণ এটা দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে যায় যে পাকিস্তানে সামরিক শাসন ব্যবস্থা টিকেছে এবং একটি অবিচ্ছিন্ন পাকিস্তানকে শাসন করে চলেছে। মুসলিম নেতাগণ কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া চেয়েছিলেন যেন পাকিস্তান ইসলামী প্রজাতন্ত্রের অখণ্ডতা মেনে চলা হয়, যেখানে আশা করা হয় যেন বর্তমান সমস্যাও আপোসে মীমাংসিত হয়। সুমাত্রান নেতাগণ, যেহেতু তাদের দ্বীপ রাষ্ট্রের কাছ থেকে নেওয়ার চেয়ে বেশি দেয় বলে কিছুটা বঞ্চিত এবং হতাশ বোধ করে, তাদের নিকট বাঙালি স্বাধিকার আন্দোলনে এক মৌন সমর্থন আছে। বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ এবং সংবাদ মাধ্যমগুলো পাকিস্তানে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়ার পক্ষে। সংবাদ মাধ্যম, রেডিও এবং টেলিভিশনগুলো বাংলাদেশে দুঃখদায়ক ঘটনার ব্যাপক প্রচারণা দিয়ে যাচ্ছে। ফলাফলস্বরূপ, ইন্দোনেশিয়ান জনগণ, হোক তারা বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ, কর্মকর্তাবৃন্দ, ব্যবসায়ী অথবা রিকশাচালুক, গৃহ পরিচারক বা পরিচারিকা অথবা রাস্টার সাধারণ লোকজন, তারা পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর নৃশংসতা ও বর্বরতা এবং সামরিক শাসনতন্ত্রের অনুসৃত দমননীতি সম্পর্কে জানতে পারে। এখন ইন্দোনেশিয়ান জনগণ সাধারণভাবেই পাকিস্তানিদের ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখে, পশ্চিম পাকিস্তানিদের ঘৃণা করে এবং পূর্ব পাকিস্তানিদের জন্য দুঃখ করে।
২) ইন্দোনেশিয়ান ছাপাখানাগুলো বাংলাদেশকে ইন্দোনেশিয়াতে অভিক্ষিপ্ত করতে এক বিরাট ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৭০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত, যখন পূর্ব পাকিস্তানে এক নির্মম ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছিলো, পাকিস্তান সম্পূর্ণ সুস্পষ্টরূপে সংবাদ মাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত হয়ে আসছিলো। নির্বাচন, আওয়ামী লীগের জয়, পরিষদের বৈঠক স্থগিতকরণ, অসহযোগ আন্দোলন, বিশ্বাসঘাতকতার কথা, সেনাবাহিনীর কার্যকলাপ, ঔদ্ধত্য, স্বাধীনতার ঘোষণা ইত্যাদি ভালো জায়গা পেয়েছিলো। রেডিও এবং টেলিভিশনও একই ধরনের প্রচারণা দিচ্ছিলো। অধিকাংশ পত্রিকাগুলোই সন্তোষজনক সম্পাদকীয় লিখেছে। তারা সেনাবাহিনীর কার্যকলাপের অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রশ্ন করেছে, দমনের সমালোচনা করেছে এবং বাংলাদেশের জনগণের জন্য সহানুভূতি দেখিয়েছে। বাংলাদেশ পরিস্থিতির উপর সংবাদ, প্রবন্ধ, সম্পাদকীয়সমূহের মন্তব্য নিয়মিত প্রকাশিত হয়ে আসছিলো। যদিও সহানুভূতিশীল ছিলো, ছাপাখানাগুলো সরাসরি বাংলাদেশ স্বাধীনতা আন্দোলনের সমর্থন দেয়নি। এটা হতে পারে সরকারের অন্যের ব্যাপারে নাক না গলানোর নীতি এবং সর্বত্র জনপ্রিয় আবেগের কারণে যে এটা খুবই দুঃখজনক হবে যদি শ্রেষ্ঠ মুসলিম রাজ্য দুই ভাগ হয়ে যায়। যাইহোক, সংবাদগুলো এই মতবাদের উপর জোর দেয় যে সামরিক শাসনতন্ত্রের উচিৎ সমস্যাটির একটি রাজনৈতিক সমাধান অনুসন্ধান করা। ইন্দোনেশিয়ান অবজার্ভার এবং জাকার্তা টাইমসের মতো কিছু পত্রিকা পূর্ব পাকিস্তানে দমন নীতি চালিয়ে যাওয়ার ফলাফল সম্পর্কে সতর্ক করেছে।
সংবাদপত্রগুলোর একটি প্রবণতা হলো অবিরত ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি জরিপ করা। পাকিস্তান তথ্য সেবার প্রকাশ সংবাদ মাধ্যমগুলোর দ্বারা সাধারণভাবে অধিগত হয়নি। পাকিস্তান দূতাবাস এবং স্থানীয় পাকিস্তানি গোষ্ঠী কিছু পত্রিকাকে তাদের প্রবন্ধ বা চিঠি প্রকাশ করতে মোটা পরিমাণের টাকা দিতে হয়। ইন্দোনেশিয়ান অবজার্ভার এক মাস পূর্বেই জাকার্তা ভ্রমণ করে যাওয়া আজিজ বেগের একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করতে প্রত্যাখান করে। কিন্তু সংবাদপত্রগুলো পাকিস্তান বিরোধী নয়, কিন্তু সামরিক শাসনতন্ত্রের নীতির প্রতি এটির প্রতিক্রিয়া অবশ্যই অসন্তোষজনক এবং বাংলাদেশের নিপীড়িত জনগণের প্রতি এর মনোভাব সহানুভূতিপূর্ণ।
৩) মোটের উপর, ইন্দোনেশিয়ার জনগণ বুঝতে পেরেছে যে অধিকাংশ পাকিস্তানি জনগণ পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত গণহত্যার জন্য অপরাধবোধ করে। ১৯৬৫ সালের বড় বিয়োগান্তক অভিজ্ঞতা থেকে, তারা যে কোন হত্যাকাণ্ডের খবরেই কেঁপে উঠে। জনগণ এখন জানে যে পূর্ব পাকিস্তানিরা সবসময় পশ্চিম পাকিস্তানিদের দ্বারা শোষিত হয়ে আসছে।কিন্তু এদের অনেকেই এই উদ্ভট রাজ্যের বিশেষত্ব নিয়ে এবং দুই অংশের মধ্যে বৈষম্যের কারণ নিয়ে সচেতন নয়। ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের নামও দ্বিধার সৃষ্টি করে। তারা প্রায়ই ভাবে যে পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার সমস্যা অনেকটাই সুমাত্রা এবং জাভার মধ্যে বিদ্যমান সমস্যার মতোই। কিন্তু যদি ব্যাখ্যা করা হয়, তারা পাকিস্তানের অযৌক্তিকতা এবং স্বাধীন বাংলাদেশের বাস্তবতা বুঝতে পারে। ব্যক্তিগত আলোচনায়, জ্ঞান জনগণকে বাঙালিদের স্বাধীনতা আন্দোলনকে মূল্যায়ন করতে এবং সমর্থন করতে সক্ষম করে। কিন্তু সামরিক আধিপত্য বিস্তৃত চুপ থাকার সরকারি নীতির কারণে তারা জনসম্মুখে কোনকিছু বলতে কুণ্ঠাবোধ করে। তবুও, দুই মুসলিম নেতা ড. রোয়েম এবং ড. আবু হানিফাহ, যারা নয়া দিল্লীতে বাংলাদেশ সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলো, পাকিস্তানের দুই ভাগের মধ্যে সমস্যা এবং বৈষম্য নিয়ে কথা বলার এবং লেখার সাহস দেখিয়েছিলো। যাইহোক, এটা মনে হয় যে লোকজনের নিকট ড. আবু হানিফাহের দৃষ্টিভঙ্গির চেয়ে ড. রোয়েমের দৃষ্টিভঙ্গি বেশি গ্রহণযোগ্য হয়েছিলো, যেহেতু ড. রোয়েম পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যেই একটা সমাধানের ইঙ্গিত দেওয়ার ব্যাপারে নজর দিয়েছিলেন।
৪) ইন্দোনেশিয়ান সরকার প্রাথমিকভাবে পাকিস্তানের পক্ষ সমর্থনে খুবই প্রগলভ ছিলো যে পূর্ব পাকিস্তান সঙ্কট পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়। আদম মালিক বেশ কয়েকবার এই ঘোষণা দিইয়েছিলেন। ইন্দোনেশিয়ান সরকার জনশ্রুতি দিয়ে সংবাদপত্রগুলোর উপর চাপ প্রয়োগ করে যেন এমন কিছু প্রকাশ না করে যা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা হয়েছে বলে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। কর্তৃপক্ষ কয়েকজন ছাত্র নেতাকে হেফাজতে নেয় যারা পাকিস্তান দূতাবাসের সামনে পূর্ব পাকিস্তানে হত্যার বিরুদ্ধে প্রদর্শন করেছিলো। ইন্দোনেশিয়ান সরকার সম্পর্কেও ধারণা করা হয় যে পাকিস্তান সরকারের সামনে পূর্ব পাকিস্তান সমস্যার সমাধান কীভাবে করা যায়, সে সম্পর্কে কিছু নির্দিষ্ট পরামর্শ উপস্থাপন করে। কিন্তু ধীরে ধীরে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে থেকে, বাংলাদেশের পক্ষে নয়, পাকিস্তানি জেনারেলদের নীতির বিরুদ্ধে। এটি পাকিস্তান সরকার এবং দূতাবাসের কাছ থেকে পাওয়া অযৌক্তিক অনুরোধের প্রতি অনিচ্ছা বা উদাসীনতা দেখায়। অনেক তদবিরের পরেও, পাকিস্তান দূতাবাস জয় প্রকাশ নারায়ণের জাকার্তা ভ্রমণের জন্য পদাঙ্ক নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়, যেন ড. রোয়েম এবং ড. হানিফাহকে নয়া দিল্লীতে বাংলাদেশ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করা থেকে থামানো যায় যাতে এই দুই পণ্ডিত বাংলাদেশ সম্পর্কে এবং জোরপূর্বক উচ্ছেদকৃত ইন্দোনেশিয়ান সুফিদের সম্পর্কে কোনকিছু বলতে বা লিখতে না পারে। সরকারটি পাকিস্তান থেকে আগত দর্শনার্থীদের দিকে তেমন মনোযোগ দেয়নি। এটি সংবাদপত্রগুলোর সাথে বাংলাদেশের ব্যাপারে কোন সংবাদ বা মতামত তুলে ধরার বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেনি। কিছু সময় পূর্বে সরকারি টিভিতে দেখা গিয়েছিলো, একজন সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীর করা গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা বিষয়ক এক প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিলেন আমাদের বৈদেশিক মন্ত্রী খন্দকার মুশতাক আহমেদ। এটা মনে হলো যে সরকার ধীরে ধীরে সমস্যাটি এবং সত্যটি বুঝতে পারছে। এটি সম্ভবত বাংলাদেশের পক্ষে কোন উন্মুক্ত প্রচারণার অনুমতি দেয়নি, যেহেতু তারা এখনও পাকিস্তানকে অবিভক্ত দেখতে চেয়েছিলো।
৫) জাকার্তায় অবস্তানরত বিদেশি কূটনীতিকগণ এবং বিদেশি সংবাদদাতাগণের বাংলাদেশের বাস্তবতা নিয়ে কোন সন্দেহ ছিলো নাই।তারা বিশ্বাস করে যে আগের পাকিস্তান মৃত এবং এটি সময়ের প্রশ্ন যে কখন স্বাধীন বাংলাদেশ স্বীকৃতি পাবে। তারা আরো ভাবে যে বিষয়টি আন্তর্জাতিক করতে পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ ঘোষণা করবেীবং বাংলাদেশ সঙ্কট বিষয়ে মুখ বাচাবে। প্রায় পনের দিন আগে কিছু সংবাদদাতা বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং ভারতের উদ্দেশ্যে জাকার্তা ত্যাগ করে উপমহাদেশের অগ্রগতি সম্পর্কে প্রতিবেদন করতে।
৬) পাকিস্তানের সামরিক শাসকগণ বিশ্বাস করে যে ইন্দোনেশিয়া এখনও তাদের পাশেই আছে। এই বড় মুসলিম রাজ্যের চলমান সমর্থন পেতে, তারা যা কিছু সম্ভব করে যাচ্ছে। পাকিস্তান দূতাবাস এবং স্থানীয় পাকিস্তানি সম্প্রদায় ( যা বাস্তবিকই বড় এবং সম্পদশালী) সংবাদপত্রগুলোকে তাদের মতবাদ প্রচার করতে প্রলুব্ধ করার জন্য বিশাল অংকের টাকা খরচ করছে ।তারা মাঝেমধ্যে তাদের চিঠি বা প্রবন্ধ প্রকাশ করতে একটি বা দুটি পত্রিকা কিংবা দ্বিতীয় শ্রেণির কিছু সাংবাদিককে কিনতে সক্ষম হয়েছে। তারা প্রায় সময়েই বাংলাদেশের পক্ষে বা পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রকাশনা বন্ধ করতে আংশিকভাবে সফল হয়েছে। কিন্তু মোটের উপর তাদের প্রচেষ্টা অকার্যকর হয়েছে। সংবাদপত্রগুলো কদাচিৎ পাকিস্তান দূতাবাসের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য বহন করে। পাকিস্তান দূতাবাস তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ছড়িয়ে দিতে এখানে সাংবাদিক, বিজ্ঞজন, কর্মকর্তাবৃন্দ এবং শিল্পপতিদের পাঠাচ্ছিলেন। আজিজ বেগ, ড. আই. এইচ. কুরেশি, আমির আলী ফ্যান্সি এবং এয়ার ভাইস মার্শাল ইউসুফ সম্প্রতি জাকার্তা ভ্রমণ করেছেন। কিন্তু তারা কোনভাবেই তাদের উপস্থিতি অনুধাবন করাতে কোন অংশেই সফল হয়নি। যদিও জনসম্মুখে তারা তাদের প্রভুরা যেমনটা শিখিয়েছে তেমনটাই বলেছিলো, কিন্তু ব্যক্তিগত আলোচনায় তারা তাদের আতঙ্ক এবং হতাশা গোপন করেনি। ড. কুরেশি বলেছিলেন সেনাধ্যক্ষরা কোন রাজনীতিবিদ ছিলেন না এবং তারা কোন রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করতে অক্ষম। তিনি যোগ করেন, যদি কোন রাজনৈতিক সরকার থাকতো তাহলে হয়তো এই পরিস্থিতির উদ্ভব হতো না। তিনি আরো স্বীকার করেন যে, এল.এফ.ও এবং সরকারি বিবৃতি ছিলো এক সাঙ্ঘাতিক ভুল। মিসেস ইউসুফ, যিনি তার স্বামীর সাথে এসেছিলেন, উল্লেখ করেন, তারা তাদের সন্তানদেরকে রাজ্যের সার্থক নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে শান্তি চেয়েছিলেন এবং চেয়েছিলেন কামানের শিকার না করতে। আজিজ বেগ বলেন, ভারতের সাথে যুদ্ধ অপরিহার্য ছিলো, যেহেতু তারা চলমান হয়রানিতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। আমির আলী ফ্যান্সি ভুট্টো এবং সরকারের সমালোচনা করেন। লাহোরের একজন সাংবাদিক, খালিদ হাসান, যিনি ভিসা ছাড়াই পৌছেছিলেন, বিমানবন্দর থেকে বের হওয়ার অনুমতি পাননি এবং ঠিক তার পরের লভ্য বিমানে করে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। মিয়া জিয়াউদ্দিন, প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত, বৈদেশিক অফিসের পরিচালক এ. ডব্লিউ. শামসুল আলমের সাথে পূর্বনির্ধারিত ৬ ডিসেম্বরে পৌছান। মিয়া জিয়াউদ্দিন ছিলেন ইয়াহিয়ার বিশেষ দূত এবং রাষ্ট্রপতি সুহার্তোর জন্য ইয়াহিয়ার কাছ থেকে একটি চিঠি নিয়ে এসেছিলেন। পাকিস্তান সরকার বিভিন্ন কর্মকর্তা কর্মচারিদের পাকিস্তান ভ্রমণের জন্য আমন্ত্রণেরও প্রসার করে যাচ্ছেন। কিন্তু তবুও এপাশ থেকে খুব কম সাড়া পাওয়া যায়। অনেক প্রচেষ্টার পরে তারা শ্রী সুলতান হামেঙ্কু বুয়েনোকে তেহরান থেকে নয়া দিল্লী ভ্রমণের পথে পশ্চিম পাকিস্তান ভ্রমণে রাজি করাতে সক্ষম হয়েছিলো। তাদের আমন্ত্রণে রেডিও এবং টিভির তিনজন কর্মকর্তা নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। কিন্তু পাকিস্তান সরকার এবং তার দালালগণ তবুও বাংলাদেশের উদ্দেশ্য এবং আন্দোলনকে দমন করতে এখানে তাদের অব্যাহত প্রচেষ্টা অবিরতভাবে এবং সহিংসভাবে চালিয়ে যাচ্ছে।
৭) আমাদের দেশের গণতান্ত্রিক জনগণের উপর নৃশংস সেনাক্রিয়ার পর, আমাদের নেতাদের স্বাধীন বাংলাদেশের ঘোষণার সংবাদ কিছু বাঙালি হৃদয়কে প্রজ্জ্বলিত করে, যারা সম্ভাব্য উপায়ে বিদ্যমান অবস্থায় এবং সীমিত সম্পদের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে জাতির স্বার্থে কাজ করতে এগিয়ে এসেছিলেন। “আমরা” নামে একটি গুপ্ত কমিটি অপারেশন সংগঠিত করতে ও প্রচেষ্টা সমন্বয় করতে “কামাল” এর সাথে প্রধান সমন্বয়সাধক হিসেবে এবং রাম্প ও সাফটকে সদস্য হিসেবে নিয়ে গঠিত হয়। প্রথম পদক্ষেপ ছিলো স্থানীয় বুদ্ধিজীবীদের আসল সমস্যাগুলো অবগত করানো যেমন, পাকিস্তানের পটভূমি, পূর্ব বাঙলার অবদান, বাঙালিদের অবস্থান, পশ্চিম পাকিস্তানিদের দ্বারা শোষণ, গণতন্ত্রের দাবি, ১৯৭০ এর নির্বাচন এবং তার পরের ঘটনাসমূহ এবং সম্ভাব্য সমাধান যা বাঙালিদের নিকট গ্রহণযোগ্য হতে পারে। “পাকিস্তান-এর জন্ম এবং মৃত্যু” শিরোনামে একটি বর্ণনাত্মক কাগজ “কামাল” এর মাধ্যমে এই উদ্দেশ্যে প্রকাশিত হয় এবং স্থানীয় নেতাদের মাঝে বিতরণ করা হয়। (এই কাগজের একটি প্রতিলিপি আমাদের কলকাতা মিশনে সরবরাহ করা হয়)। একইসাথে সমস্যাটি প্রচার করার জন্য এবং পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাদের নৃশংসতা ও বাংলাদেশের বিষয়টি প্রচার করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। এটি করা হয় বিভিন্ন ছদ্ম নামে সংবাদপত্রে একটি সিরিজ আকারে প্রবন্ধ ও চিঠি কাজে লাগানোর মাধ্যমে। “ইসলাম কি মৃত” শিরোনামে একটি অজ্ঞাত প্রবন্ধও “কামালের” অবদান। জাকার্তা টাইমসে ১৯৭১ সালের ১৫ ই এপ্রিলে প্রকাশিত এই প্রবন্ধটি এক চেতনার তৈরি করে। ( এটি সন্তোষজনক যে এটি বাংলাদেশ প্রকাশনায় জায়গা পেয়েছে) জাকার্তা টাইমসে জায়গা করে নেওয়া অন্যান্য প্রবোধক এবং চিন্তা-জাগানিয়া প্রবন্ধের মধ্যে রয়েছে- দ্য রোল অব ইউ এন ভিজ-আ-ভিজ বাংলাদেশ (কামাল), পাকিস্তান এন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড (রুমি), বাংলাদেশ রিফ্যুজিস (রুমি), এবং বাংলাদেশ রেভ্যুলেশনস (রুমি)। এছাড়াও কামাল এবং রুমি সংবাদপত্রে আরো কিছু সংখ্যক চিঠি পাঠিয়েছিলো বিষয়টিকে জীবিত রাখতে। এছাড়াও বেশ কিছু সংখ্যক টেলিগ্রাম কামালের মাধ্যমে বিশ্ব নেতাদের কাছে পাঠানো হয় যুদ্ধ হত্যা বন্ধ করা, বঙ্গবন্ধুর মুক্তি, এবং বাংলাদেশে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়ে। বাংলাদেশ সংবাদপত্র এবং সরকারি প্রকাশনাগুলো প্রধান কাগজ এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বদের কাছে পাঠানোর জন্য বিশ্ব সংবাদ সংস্থাগুলোর খবর ও মতামতের প্রতিলিপি স্থানীয় সংবাদপত্রগুলোর নিকট সরবরাহ করার ব্যবস্থা করা হয়। স্থানীয় পত্রিকাগুলোতে জায়গা পাওয়া খবর, মতবাদ এবং সম্পাদকীয় পাতা কলকাতায় বাংলাদেশ মিশনে সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়। এই কাজগুলো নিয়মিত রুমির মাধ্যমে সম্পন্ন হচ্ছিলো। এই কাজের ব্যয়ভার কিছু সংখ্যক সদস্যের মাধ্যমে পূরণ হচ্ছিলো (অবদানকারীরা হলেন কামাল, রুমি, সাফ্রি, রুহানি, এবং বদর। অনুদানকৃত মোট টাকার অঙ্কের পরিমাণ প্রায় ৪৩০ মার্কিন ডলার হতে পারে) । বাংলাদেশ ফান্ডে একটা ছোট অবদান রাখা হয়। একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ ব্যয় করা হয় “পিপল” এর সম্মতির জন্য, এবং কিছু স্থানীয় পত্রিকা ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের জন্য। আমাদের ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে আমাদের বীর যোদ্ধাদের জন্য ৯০ পিস গরম কাপড় কেনা হয়েছে এবং প্রেরণ করা হয়েছে। বাহিনীটির আরো কার্যকরী কাজের জন্য তাদের কার্যকলাপ আরো তীব্রতর করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। এটির দরকার উতসাহ, উপদেশ, দিক নির্দেশনা, এবং নিয়মিত প্রচারের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসের সরবরাহ। কমিটির কোন নিয়মিত অফিস নেই। অধিকাংশ অফিস এবং টাইপের কাজ রুমির মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে আসছে। যখন উন্মুক্ত কার্যকলাপের জন্য সময় উপযুক্ত নয়, পরিস্থিতি সন্তোষজনক নয়, কমিটি একটা ভালো ফলাফল তৈরি করতে পারতো যদি এর একটি উপযুক্ত অফিস, টাইপিং, সাইক্লোস্টাইলিং এবং অনুবাদের সুবিধা থাকতো। “সুফি” কে একজন টাইপরাইটারের যোগান দেওয়া হয় এবং আমাদের কলকাতা মিশনে সাময়িকী প্রতিবেদন জমা দেওয়ার এবং “হামিদ” এর সহায়তায় স্থানীয় নেতা এবং বুদ্ধিজীবীদের সাথে যোগাযোগের দায়িত্ব দেওয়া হয়। সে কত কয়েক মাস যাবত গ্রুপের সংস্পর্শে নেই। সম্ভবত সে তার ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়ে ব্যস্ত। যদিও দলটি সুফির কাজের অয়াব বোধ করছে, এটি সাফ্রি, রুহানি এবং আনসারের মতো উদ্যমী সদস্যদের সমর্থন পেয়ে ভাগ্যবান। এটির সর্বশেষ অর্জন হলো বদরের সমর্থন লাভ করা। যদিও এখানে চিত্তপ্রসাদের কোন জায়গা নেই, গ্রুপটি জাতির স্বার্থে তার ছোট্ট অবদান তৈরিতে বিশ্বাসী।
৮) এই প্রতিবেদনটি নিচের মন্তব্য বা পরামর্শের সাথে শেষ করা যেতে পারে:
ক) যদিও বাংলাদেশের প্রতি ইন্দোনেশিয়ান সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি বর্তমানে অসন্তোষজনক এবং অবন্ধুত্বপূর্ণ, তাদেরকে আমাদের দিক বুঝাতে এবং তাদের সমর্থন লাভ করতে অব্যাহত প্রচেষ্টা প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। মুসলিম বিশ্বে এটা প্রয়োজন এই দেশের অবস্থানের দৃষ্টিকোণ থেকে, নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে এবং যেহেতু অধিকাংশ জনগণ আমাদের উদ্দেশ্যের প্রতি সহানুভূতিশীল। বাংলাদেশ প্রচারণার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়মিত কর্মকর্তাদের এবং কর্মচারীদের নিকট সরবরাহ করা উচিৎ (ইতোমধ্যেই তালিকা সরবরাহ করা হয়েছে)। বাংলাদেশি নেতাদের মাঝে মাঝে ইন্দোনেশিয়াকে সম্ভাষণ করা উচিৎ সমর্থন, সহানুভূতি এবং সাহায্যের জন্য। যদিও ইন্দোনেশিয়ান সরকার কোন বাংলাদেশি প্রতিনিধিকে এই দেশ ভ্রমণে অনুমতি নাও দিতে পারে, আমাদের সরকারকে তবুও প্রতিনিয়ত এখানে প্রতিনিধি পাঠানোর চেষ্টায় উদ্যমী হতে হবে। বিমুক্ত এলাকা এবং ভারতের শরণার্থি শিবির দর্শন করতে আগ্রহী বিশিষ্ট ইন্দোনেশিয়ান নেতাদের প্রতি আমন্ত্রণ পাঠানো যেতে পারে।
খ) সেনা নৃশংসতা, জনগণের এবং শরণার্থিদের দুর্ভোগ সকলের দৃষ্টিগোচর করতে এবং বাংলাদেশ ইস্যুটি ছড়িয়ে দিতে ইন্দোনেশিয়ান সংবাদ মাধ্যমগুলোর পালন করা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা উপযুক্তভাবে আমাদের সরকারের স্বীকৃতি দেওয়া উচিত। মাঝে মাঝে সংশ্লিষ্ট পত্রিকাগুলোকে মর্যাদা দিয়ে চিঠি পাঠানো যেতে পারে। স্থানীয় পত্রিকাগুলোতে প্রকাশিত সম্পাদকীয়, প্রবন্ধ এবং চিঠির সারাংশ আবারো প্রকাশ করা উচিৎ এবং ওখান থেকে প্রতিলিপিগুলো এখানে সংবাদ মাধ্যমগুলোতে সরবরাহ করা যেতে পারে। এটি তাদেরকে উৎসাহিত করবে। তারা গ্রহণ করুক বা নাই করুক, বিশিষ্ট সাংবাদিকেরা বিমুক্ত এলাকা এবং শরণার্থি শিবির পরিদর্শন করতে আমন্ত্রণ পাঠাতে পারে। উদ্দেশ্য হলো তাদের সাথে অব্যাহত যোগাযোগ রক্ষা করা। সংবাদ মাধ্যমগুলোকে নিয়মিত বাংলাদেশের কাগজ এবং প্রকাশনার সরবরাহ পেতে হবে।
গ) “আমরা গ্রুপ” কে নিয়মিত সকল প্রচারণা সামগ্রী এবং সংবাদপত্রের পর্যাপ্ত সংখ্যক প্রতিলিপির সরবারাহ দিতে হবে যেন তারা তাদের বাছাই নীতির উপর স্থানীয় বিতরণের ব্যবস্থা করতে পারে। গ্রুপটি এই সরবরাহের উপর অনেকাংশেই নির্ভরশীল, কেননা এটি গোপনীয়তার সাথে তার নগণ্য সম্পদ নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানিদের সংগঠিত প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে কাজ করে যাচ্ছে। দলটিকে জোরালো করতে ও তাদের কার্যকলাপ তীব্রতর করতে তাদের প্রয়োজন উপদেশ, নির্দেশনা এবং কিছু স্বীকৃতি। উত্তরোত্তর সদস্যরা এই দলটিকে সহায়তা করতে এগিয়ে আসছে। এই গোপন দলটিকে এমন একটি উপায়ে সংগঠিত করা হচ্ছে যেন একজন নির্দিষ্ট সদস্য দল বা ঘাঁটি ছেড়ে গেলেও এর কাজের কোন ক্ষতি না হয়। এটা অনুভূত হয় যে কোন স্বীকৃতি এই কাজকে সহজতর করবে, এমনকি সুফির কার্যোপযোগিতাও পুনরায় ফিরে পাওয়া সম্ভব করতে পারে যে কিনা উদ্দেশ্যহীনভাবে ও ব্যক্তিগত স্বার্থে কাজ করে যাচ্ছিলো এবং ব্যর্থ ও নকল প্রচেষ্টা করে যাচ্ছিলো।
ঘ) যদিও বর্তমান পরিস্থিতে জাকার্তায় উন্মুক্ত অফিস কিংবা উন্মুক্ত প্রচারণা সম্ভন না, দলটি ভালো ফলাফল বের করতে পারতো যদি এর কোন দোভাষী টাইপিস্ট অফিস এবং সেবা থাকতো। ভাষা সমস্যার কারণে এটি স্থানীয় ভাষার পত্রিকাগুলোর সাথে সঠিক যোগাযোগ রক্ষা করতে এবং যেসব বিষয় ইংরেজি থেকে বাহাসা কিংবা বাহাসা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করা প্রয়োজন, সেসব তথ্যগুলো পরিপূর্ণভাবে ব্যবহার করতে পারছে না। এর সীমিত সম্পদের সাথে, দলটি একজনকে অনুবাদকের কাজে কাউকে নিয়োগ করার মতো অবস্থায় নেই। এই বিষয়ে উপদেশ অনুরোধ করা গেলো।
ঙ) তাদের কি করা উচিৎ বা কি করা উচিৎ নয় এই ব্যাপারে বাঙালিরা এখানে কোন সুনির্দিষ্ট দিক নির্দেশনা এখনও পায়নি। বদলির ক্ষেত্রে কোন পথ গ্রহণ করতে হবে, তা খুব পরিষ্কার নয়। সংশ্লিষ্ট সকলের অবগতির জন্য এই ব্যাপারে সরকারি দিক নির্দেশনা বা বিজ্ঞপ্তি হতে পারে।
কামাল
_________________________________________________________________________________
প্রতিবেদনটির উপর এবং এর কার্যকারিতার উপর যেকোন মন্তব্য সমাদৃত হবে।
(কামাল)
আমরা, জাকার্তা
নভেম্বর ২২, ১৯৭১
জ্ঞাপিত:
১) কার্যনির্বাহক রাষ্ট্রপতি, বাংলাদেশ।
২) বৈদেশিক মন্ত্রী, বাংলাদেশ।
৩) বৈদেশিক সচিব, বাংলাদেশ।
৪) হাই কমিশনার, বাংলাদেশ মিশন, কলকাতা।
৫) রাজনৈতিক শাখা (জনাব আনোয়ারুল করিম চৌধুরী)।
৬) তথ্য শাখা (জনাব মকসুদ আলী)।
<৪,১৯৮,৪১৪>
অনুবাদকঃ উম্মে তৈয়বা নিশাত
শিরোনাম | সুত্র | তারিখ |
১৯৮। বাংলাদেশ সরকার কতৃর্ক মুক্তিবাহিনীর স্যফল্য প্রচার করার উদ্দেশে “আমরা” গোষ্ঠীকে প্রেরিত বিভিন্ন তথ্য | বাংলাদেশ সরকার | ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭০ |
ভারতস্থ গনপ্রজাতন্ত্রী
বাংলাদেশ হাই কমিশন
৯ সার্কাস এ্যভিনিউ
কলিকাতা-১৭
নং-বি-৫/৫০/৭১ তারিখ-৩-১২-১৯৭১
প্রিয় জনাব কামাল,
১. বাংলাদেশের মানুষের সেবা করার জন্য আমরা আপনার নিকট কৃতজ্ঞ।
২.অনুগ্রহপূর্বক বাংলাদেশে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনার প্রতিবেদনের ফটোকপি সমূহ সংযুক্ত করবেন। আমরা আশা করি যে আপনি তা সমর্থন প্রচারের জন্য ব্যবহার করবেন।
৩.অন্তর্গত ধাপসমূহ:
ক) পশ্চিম পাকিস্তানের মিলিটারি জান্টা কর্তৃক ভারতের বিপক্ষে যুদ্ধ প্রস্তুতি পাকিস্তান-বাংলাদেশের সংঘর্ষ ভারত-পাকিস্তানের বিতর্কে পরিবর্তন করার জন্য এবং বাংলাদেশ বিষয়ে বিশ্বের মনোযোগ অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য এটা ছিলো একটি দূর্দান্ত আদেশ।
খ) বাংলাদেশের মানুষের উপর পশ্চিম পাকিস্তান যুদ্ধের গণহত্যা অপ্রতিহত ভাবে চলছিল। বাংলাদেশ সম্পর্কে স্বাভাবিক অবস্থার প্রজ্ঞাপন টি ছিলো বিষ্ময়কর শয়তানি। ভয় এবং দুঃখের চাদর আবৃত করে রেখেছে অধিষ্ঠিত এলাকা সমূহকে। শত্রু সেনাবাহিনীর চলমান সন্ত্রাসবাদের কারনে ভারতের দিকে প্রস্থান বেড়ে যাচ্ছিল।
গ) বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর সফলতা। বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনী এবং সাধারন মানুষ শত্রু সেনাবাহিনীর মোকাবিলা করছে বীরত্বপূর্ণ ভাবে।
ঘ) পশ্চিম পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নৃশংসতায় ক্ষতিগ্রস্তরা দূর্ভিক্ষ এবং স্বাস্থ্য ঝুঁকির মুখোমুখি হচ্ছিলো।
৪. আমরা কৃতজ্ঞ হবো যদি অাপনি অনুগ্রহপূর্বক বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য অারও সহায়তা দেওয়ার চেষ্টা করেন এবং ভুক্তভোগী মানুষের জন্য বিশাল পরিমাণে ত্রানের ব্যবস্থা করেন।
ধন্যবাদান্তে,
আপনার অনুগত
সায়িদুর রহমান
হাই কমিশনারের পক্ষে।
প্রতি
জনাব তুয়ান কামাল
পক্ষে এন.জে.বাদ্রোইন ডি.জি.এল ক্যাম্পেইন ৪
জিদেং বারত (ডিকাত ডি.জে.এল মুসি)
জাকার্তা, ইন্দোনেশিয়া
<৪,১৯৯,৪১৫-৪১৭>
অনুবাদকঃ সাফায়েত জামিল
শিরোনাম | সুত্র | তারিখ |
১৯৯। বিজয়োত্তরকালে বাংলাদেশ সরকার কতৃর্ক “আমরা” গোষ্ঠীকে লিখিত চিঠি | ‘আমরা’ | ১৮ ডিসেম্বর, ১৯৭১ |
ভারতস্থ গনপ্রজাতন্ত্রী
বাংলাদেশ হাই কমিশন
৯ সার্কাস এ্যভিনিউ
কলিকাতা-১৭
নং-বি-৫/৫০/৭১ ডিসেম্বর ১৮, ১৯৭১
প্রিয় জনাব কামাল,
এক গৌরবান্বিত উপসংহারের মধ্য দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানি ফ্যাসিস্টের বিরুদ্ধে বাংলাদেশি মানুষের মুক্তির সংগ্রামের সমাপ্তি ঘটে । বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধে জয় লাভ করে। বীর মুক্তিযুদ্ধাদের পাল্টা আক্রমণের মুখে পাক হানাদার বাহিনী সার্বজনীনভাবে বাংলাদেশ মুক্তি বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পন করে। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্ভর বিকেল বেলা এই ঘটনা ঘটে। সমগ্র বাংলাদেশ এখন পশ্চিম পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত।
বাংলাদেশি জনগণের উপর পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক জান্তা কর্তৃক পরিচালিত গণহত্যা শেষ করতে বাধ্য হয়।
কালো সন্ত্রাসের দীর্ঘ রাত বিতাড়িত হওয়ার মধ্য দিয়ে আমাদের জনগণ তাদের বাস্তব স্বাধীনতা খুঁজে পায়।
এটা কেবল একটি মহান সামরিক বিজয় নয়, এটা ছিল বর্বরতা এবং নারকীয় আচরণের বিরুদ্ধে উচ্চনীতি ও উন্নত চরিত্রের এবং ঔপনিবেশবাদের উপর গণতন্ত্রের বিজয়। পশ্চিম পাকিস্তানি ফ্যাসিস্টদের লজ্জাজনক পরাজয় বরণ করতে হয় যখন তারা দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে ঔপনিবেশিক উপায়ে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ শাসন করে এবং ধর্ম,বয়স ও লিঙ্গ নির্বিশেষে গণহত্যার মাধ্যমে ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
যুদ্ধ শেষ। দেশে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ ধ্বংসলীলা মেরামত, ভারতে আশ্রয় নেওয়া দশ মিলিয়ন উদ্বাস্তু ফেরত আনা , পশ্চিম পাকিস্তানি বর্বর দ্বারা গৃহহীনদের পুনর্বাসন সহ বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্রকে হিমালয় সম কাজের সম্মুখীন হতে হয়। ট্রাজেডি হল,ফ্যাসিস্ট পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের লুটতরাজ সৈন্য কর্তৃক হিংস্রতার শিকার হওয়া লক্ষ্যাধিক বাঙালি এবং আরো কয়েক লাখ যারা দীর্ঘ আট মাসের শরণার্থী জীবন থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব ছিল না। বাংলাদেশকে স্বাধীনতার জন্য চরম মূল্য দিতে হয়েছিল।
আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বাংলাদেশ সমস্ত জাতি থেকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রার্থনা করে। বৃহত্তম গণতান্ত্রিক ভারত ও উদার ভুটান স্বীকৃতি নতুন রাজ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিতে একমত হয়। অভ্যন্তরীণ পরিমণ্ডলে তাৎক্ষণিক লক্ষ্য ছিল,আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুনঃপ্রতিষ্ঠার পাশাপাশি পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী দ্বারা সৃষ্ট ধ্বংসলীলা মেরামত করা এবং দেশের অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করা।
সকল প্রচেষ্টা এখন এসব লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য। স্বদেশবাসী,বন্ধু এবং বিদেশী সমর্থকদের কাছে আমাদের আশা,তাদের সমর্থন এবং সাহায্যের হাত যেন অব্যাহত থাকে। বাংলাদেশকে তাদের স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করার জন্য জাতিসংঘ এবং বহির্বিশ্বে পশ্চিম পাকিস্তানি এবং তাদের পৃষ্টপোষক মদতদাতার আক্রমণাত্মক কূটনৈতিক প্রচেষ্টার কারণে জাতীয় স্বাধীনতার আনন্দে আমরা চোখ বন্ধ রাখতে পারিনা। পশ্চিম পাকিস্তানের আক্রমণাত্মক কূটনীতি,রাজনীতি এবং বিশাল শক্তির গানবোট কূটনীতিকে নস্যাৎ করার জন্য আমাদের আন্তর্জাতিক সমর্থন লাভের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।
ধন্যবাদান্তে,
আপনার অনুগত
সায়িদুর রহমান
হাই কমিশনারের পক্ষে।
জনাব তুয়ান কামাল
পক্ষে এন.জে.বাদ্রোইন
ডি.জি.এল ক্যাম্পেইন ৪
জিদেং বারত
(ডিকাত ডি.জে.এল মুসি)
জাকার্তা, ইন্দোনেশিয়া
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহঙ্কারী বিভিন্ন সংগঠনের তৎপরতা
<৪,২০০,৪১৯-৪২১>
অনুবাদকঃ জেসিকা গুলশান তোড়া
শিরোনাম
|
সূত্র
|
তারিখ
|
২০০। স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার আহবান
|
পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি
|
২৯ মার্চ, ১৯৭১
|
শত্রুবাহিনীকে মোকাবেলায় প্রস্তুত হউন
গণস্বার্থে স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার
সংগ্রাম অব্যাহত রাখুন
ভাইসব,
বাংলাদেশের জনগণ আজ গণতন্ত্র ও নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য এখানে একটা পৃথক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র কায়েম করিতে বদ্ধপরিকর হইয়াছেন এবং এই জন্য এক গৌরবময় সংগ্রাম চালাইতেছেন। এই সংগ্রামে জনগণ সশস্ত্র সেনাবাহিনীকে অসমসাহসিকতার সহিত মোকাবেলা করিতেছেন এবং নিজেদের আশা-আখাংখা পূরণের জন্য বুকের রক্ত ঢালিতেও দ্বিধা করিতেছেন না। কমিউনিস্ট পার্টি পূর্ব বাংলার সংগ্রামী বীর জনগণকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাইতেছে। পূর্ব বাংলার কমিউনিস্টরা দীর্ঘকাল হইতেই বাঙ্গালীসহ পাকিস্তানের সকল ভাষাভাষী জাতির বিচ্ছিন্ন হইয়া পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের অধিকার তথা আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার দাবী করিয়া আসিতেছে। পূর্ব বাংলার জনগণ আজ অনেক ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতের ভিতর দিয়া পূর বাংলায় একটি পৃথক ও স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের দাবী উত্থাপন করিয়াছেন, আমরা উহাকে ন্যায্য মনে করি, তাই পূর্ব বাংলার জনগণের বর্তমান সংগ্রামে আমরাও সর্বশক্তি লইয়া শরিক হইয়াছি।
জনগণের দুশমন কাহারা?
বাংলাদেশে পৃথক ও স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের এই সংগ্রামে জনগণের দুশমন হইলো পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল শাসকগোষ্ঠী ও বর্তমান সামরিক সরকার। পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল শাসকগোষ্ঠী বিদেশী সাম্রাজ্যবাদ বিশেষতঃ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, বড় বড় জোতদার-জায়গীরদার-মহাজন ও একচেটিয়া পূঁজির মালিক ২২টি পরিবারের কায়েমী স্বার্থ রক্ষার জন্য গত ২৩ বৎসর যাবৎ বাংলাদেশের শ্রমিক-কৃষক-মধ্যবিত্ত-ছাত্র প্রভৃতি জনগণকে শোষণ এবং নিপীড়ন করিয়াছে। সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থে শাসকগোষ্ঠী পূর্ব বাংলার সমগ্র জনগণকে জাতীয় অধিকার ও গণতান্ত্রিক অধিকার হইতে আগাগোড়া বঞ্চিত করিয়াছে। আজও উহাদের স্বার্থেই ইয়াহিয়া সরকার প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীসমূহের নব্য নেতা ভুট্টোর সহিত ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হইয়া জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে নস্যাৎ করে ও গণতন্ত্র, জাতীয় অধিকার এবং শাসন ক্ষমতা হস্তান্তরের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করে। এই প্রতিক্রিয়াশীল শাসকগোষ্ঠী পূর্ব বাংলার জনগণের বর্তমান সংগ্রামকে দমনের জন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রহিয়াছে এবং সেনাবাহিনীকে জনগণের বিরুদ্ধে নিয়োগ করিয়াছে। সেনাবাহিনী পূর্ব বাংলায় ইতিমধ্যেই গণহত্যা ঘটাইয়াছে এবং রক্তের বন্যায় পূর্ব বাংলার জনতার সংগ্রামকে স্তব্ধ করিবার জন্য সেনাবাহিনী প্রস্তুত হইয়া রহিয়াছে।
তাই বাংলাদেশের জনগণের দুশমন হইল সাম্রাজ্যবাদ-সামন্তবাদ ও একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থকামী সরকার ও উহাদের সেনাবাহিনী। পশ্চিম পাকিস্তানের বেলুচ, সিন্ধি, পাঠান, পাঞ্জাবী জাতিসমূহের মেহনতী জনতা পূর্ব বাংলার জনগণের শত্রু নয়। বরং পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের গণতন্ত্র ও বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর জাতীয় অধিকারকেও পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল শাসকগোষ্ঠী নস্যাৎ করিয়া রাখিয়াছে। পূর্ব বাংলার অবাঙ্গালী উর্দু ভাষাভাষি মেহনতী জনগণকেও ঐ শাসকগোষ্ঠী শোষণ ও নিপীড়ন করিতেছে। তাই ঐ দুশমনের পরাজিত করিয়া বাংলাদেশের জনগণের দাবী কায়েম করার জন্য আজ এখানে গড়িয়া তুলিতে হইবে বাঙ্গালী-অবাঙ্গালী, হিন্দু-মুসলমান জনগণের দুর্ভেদ্য একতা। ঐ দুশমনের বিরুদ্ধে সংগ্রামে বাংলাদেশের জনগণকে বেলুচ-পাঠান-সিন্ধি-পাঞ্জাবী মেহনতী জনগণকে মিত্র বলিয়া মনে করিতে হইবে এবং পূর্ব বাংলার সংগ্রামে তাহাদের সাহায্য পাইতে সর্বদাই সচেষ্ট থাকিতে হইবে। এই সংগ্রামে এখানকার জনগণের সুদৃঢ় ঐক্য ও বেলুচ-পাঠান প্রভৃতির সমর্থন যত বেশী গড়িয়া উঠিবে গণ-দুশমনের পরাজয়ও ততই নিশ্চিত হইবে।
প্রকৃত মুক্তির লক্ষে অবিচল থাকুন
ঐক্যবদ্ধ গণশক্তি ও জনতার সংগ্রামের জোরে গণ দুশমনদের ও উহাদের সেনাবাহিনীকে পরাস্ত করিয়া এখানে জনগণের দাবী মতে ‘স্বাধীন গণতান্ত্রিক বাংলা’ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম অগ্রসর করিয়া লইতে হইবে। কিন্তু স্বাধীন বাংলা করতে সাম্রাজ্যবাদীদের জুলুমের শৃংখলে বাঁধা না পড়ে, স্বাধীন বাংলার কৃষক সমাজের উপর যেন জোতদার-মহাজনদের শোষণ ও নিপীড়নে ধুঁকিয়া ধুঁকিয়া মরিতে না হয়, সেজন্য ও সংগ্রামকে দৃঢ়ভাবে আগাইয়া লওয়ার জন্য কমিউনিস্ট পার্টি শ্রমিক-কৃষক-ছাত্র-মধ্যবিত্ত জনতাকে তাহাদের সংগ্রাম আগাইয়া লওয়ার আহবান জানাইতেছে।
কমিউনিস্ট পার্টি বাংলাদেশে এমন একটি স্বাধীন গনতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রামের আহবান জানাইতেছে যেখানে সাম্রাজ্যবাদ-সামন্তবাদ উৎখাত করিয়া ও পুঁজিবাদী বিকাশের পথ পরিসর করিয়া জনগণের স্বার্থে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সমাধান করা ও সমাজতন্ত্রের পথে অগ্রসর হইবার বিপ্লবী পথ উন্মুক্ত হইতে পারে।
বিভ্রান্ত হইবেন না
কতকগুলি তথাকথিত ‘কমিউনিস্ট পার্টি’ জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্যা “ধর্মঘট অসহযোগ আন্দোলন প্রভৃতি প্রয়োজন নাই”, “গ্রামে গ্রামে কৃষি বিপ্লন শুরু কর”, “জোতদারদের গলা কাট” প্রভৃতি আওয়াজ তুলিতেছে। কোন কোন নেতা ‘স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠা হইয়া গিয়াছে’ বলিয়া ধ্বনি তুলিয়া স্বধিকার গণসংগ্রামের উদ্দীপনা, সংকল্প ও প্রস্তুতিতে ভাটা আনিয়া দিতে চাহিতেছেন। মার্কিনী এরেস্টন এই সংগ্রামে অনুপ্রবেশ করিয়া সংগ্রামকে বিপথগামী করার প্রচেষ্টা করিতে পারে। শাসকগোষ্ঠী ও প্রতিক্রিয়াশীলদের উস্কানিতে সমাজবিরোধী দুষ্কৃতকারীরা দাঙ্গা-হাঙ্গামা, লুটতরাজ প্রভৃতি বাধাইয়া সংগ্রামকে বিনষ্ট করিতে তৎপর হইতে পারে। এই সকল বিষয়ে হুশিয়ার ও সজাগ থাকার জন্য আমরা জনগণের প্রতি আহবান জানাইতেছি।
দৃঢ় সংকল্প বজায় রাখুন
বাংলাদেশের জনগণ আজ অভুতপূর্ব দৃঢ়তা ও একতার সাথে অফিস-আদালতে হরতাল, বাজনা-ট্যাক্স বন্ধ প্রভৃতির যে সংগ্রাম চালাইতেছেন, সে সংগ্রাম ইতিমধ্যেই ইতিহাসে এক নতুন নজীর স্থাপন করিয়াছে। সামরিক সরকারের হুমকি, দমন-নীতি, অভাব-অনটন প্রভৃতির মধ্যেও সে সংগ্রাম শিথিল বা দমিত হইবে না এবং শত্রুর নিকট আমরা কখন ও নতি স্বীকার করিব না- এই দৃঢ় সংকল্প আজ বাংলার ঘরে ঘরে জাগিয়া উঠুক।
ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধ্য করুন
নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর, সামরিক শাসন প্রত্যাহার প্রভৃতি যে দাবীগুলি আওয়ামী লীগ প্রধান উত্থাপন করিয়াছেন, সেগুলি আদায় করিতে পারিলে ‘স্বাধীন বাংলা’ কায়েমের সংগ্রামে অগ্রগতির সুবিধা হইবে-ইহা উপলব্ধি করিয়া এ দাবীগুলির পিছনে কোটি কোটি জনগণকে সমবেত করা এবং ঐ দাবীগুলি পূরণে ইয়াহিয়া সরকারকে বাধ্য করা, ইহা হইলো এই মুহুর্তে জরুরী কর্তব্য।
সেনাবাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করুন
বস্তুতঃ হরতাল, লক্ষ লক্ষ জনতার সমাবেশ, মিছিল, সরকারী অফিস-আদালত ও সামরিক বাহিনীর সহিত অসহযোগ প্রভৃতি শান্তিপূর্ণ পন্থায় বর্তমান পর্যায়ে জনগণের আকাংখিত স্বতন্ত্র স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চালাইতে হইবে।
কিন্তু জনগণকে আজ সংগ্রাম করিতে হইতেছে প্রত্যক্ষভাবে সশস্ত্র সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। তাই শান্তিপূর্ণ পন্থায় শেষ পর্যন্ত জনগণের সংগ্রাম বিজয়ী হইবে এইরুপ মনে করিবার কারণ নাই। প্রতিক্রিয়াশীল শাসকগোষ্ঠীর আজ্ঞাবাহী সেনাবাহিনী জনগণের উপর সশস্ত্র হামলা শুরু করিতে পারে। তাই আত্মসন্তুষ্টির কোন কারণ নাই। সংগ্রাম যে কোন সময়ে সুতীব্র রুপ ধারণ করিতে পারে। এই অবস্থায় স্বতঃস্ফুর্ততার উপর নির্ভর না করিয়া সুশৃংখলভাবে সংগ্রামের সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করা দরকার। সেনাবাহিনীর আক্রমণ মোকাবেলা ও উহা প্রতিরোধ করার জন্য শহর-গ্রাম সর্বত্র জনগণকে সংগঠিতভাবে প্রস্তুত হইবার জন্য আমরা জনগণের প্রতি আহবান জানাইতেছি।
এই জন্য পাড়ায়, মহল্লায়, গ্রামে, কল-কারখানায় সর্বত্র দলমত নির্বিশেষে সমস্ত শক্তি নিয়া গড়িয়া তুলুন স্থানীয় সংগ্রাম কমিটি ও গণবাহিনী। সেনাবাহিনী আক্রমণ করিলে উহা প্রতিরোধের জন্য ব্যারিকেড গঠন করুন, যাহার যাহা আছে উহা দিয়াই শত্রুকে প্রতিহত করুন।
শ্রমিক–কৃষক ভাইয়েরা এগিয়ে আসুন
অধিকার সংগ্রাম জনগণের ন্যায্য সংগ্রাম। পশু শক্তির বিরুদ্ধে এই সংগ্রামে বিজয়ের বহু কঠিন শপথ ও সংকল্প নিয়া আগুয়ান হওয়ার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি আজ নারী-পুরুষ, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে বাংলাদেশের সমস্ত জনগণকে বিশেষতঃ শ্রমিক, শহরের গরীব বস্তিবাসী, কৃষক ও ছাত্র সমাজের প্রতি আহবান জানাইতেছে। সাহসের সহিত শত্রুর বিরুদ্ধে সঠিকভাবে সংগ্রাম চালাইতে পারিলে আমাদের জনগণের বিজয় সুনিশ্চিত।
কেন্দ্রীয় কমিটি
পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি
ঢাকা
২৯-৩-৭১