You dont have javascript enabled! Please enable it!

ত্যাগ ও সংগ্রামের আলোকে আওয়ামী লীগ

।। শফিকুল আজিজ মুকুল।।

প্রাথমিক এক জরীপ চালিয়ে দেখা গেছে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ন’ মাসে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী সতেরো হাজারেরও বেশী আওয়ামী লীগ কর্মী ও নেতাকে হত্যা করেছে। চূড়ান্ত জরীপে এই সংখ্যা আরো অনেক বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করা হচ্ছে। বস্তুতঃ স্বাধীনতা সংগ্রামী ন’ মাসে যে ত্রিশলক্ষ লোক এই বর্বর বাহিনীর হাতে শহীদ হয়েছেন তাদের প্রায় সব্বাই ছিলেন বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উদ্বুদ্ধ জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ সমর্থক। জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের ক্ষেত্র প্রস্তুতির জন্য ১৯৪৯ সাল থেকে আওয়ামী লীগ যে স্তরানুক্রমিক আন্দোলন চালিয়ে আসছিল বাংলার অধিকাংশ মানুষই তার সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে কখনো মিছিলে শরিক হয়ে আবার কখনো বন্দুক-বেয়নেটের মুখে বুকে বাড়িয়ে সোচ্চার কণ্ঠে ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। জরীপে যে সতেরো হাজার মানুষের কথা বলা হয়েছে তাঁরা ছিলেন আওয়ামী লীগের সক্রিয় সদস্য কর্মীনেতৃ স্থানীয় ব্যক্তিত্ব।
একাত্তরের পঁচিশে মার্চের রাত থেকে পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক সামরিক শক্তি বাংলার নিরস্ত্র মানুষের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য হামলা শুরু করলেও মার্চের প্রথম থেকেই শুরু হয়েছিল এ নরহত্যাযজ্ঞ। যেহেতু আওয়ামী লীগই ছিল ঔপনিবেশিকতা বিরোধী আন্দোলনের মূল শক্তি, সুতরাং পাকিস্তানী সামরিক চক্রের প্রধান লক্ষ্য ছিল এই সংগঠন। পঁচিশে মার্চের পূর্বেই তাই চট্টগ্রাম,খুলনা, সৈয়দপুর, রংপুর প্রভৃতি স্থানে সামরিক বাহিনীর লোকেরা বহু আওয়ামী লীগ কর্মীকে হত্যা করে।
এ তো গেল নিহতদের খতিয়ান। এ ছাড়া বহু কর্মীকে অত্যাচার ও নির্যাতনের মাধ্যমে পঙ্গু করে দেয়া হয়েছে আর যারা বর্বর বাহিনীর হাত থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন তাদের আত্মীয়স্বজন ও পরিবারের উপর চালানো হয়েছে অমানুষিক নির্যাতন, জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে তাদের অস্থাবর সকল সম্পদ, ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থ ও অলংকার লুট করে পাচার করা হয়েছে পাকিস্তানে। এত নির্যাতন ও অত্যাচারের মুখেও কিন্তু তারা তাদের সংগ্রামী লক্ষ্য থেকে এতটুকু বিচ্যুত হননি। অবশেষে জাতীয় স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে।
আওয়ামী লীগ কর্মীদের এই ত্যাগ ও সংগ্রামী চেতনা সম্বন্ধে সম্যক উপলব্ধি করতে হলে এর আদর্শ, চরিত্র ও পাকিস্তানের রাজনৈতিক পটভূমিকায় এর ভূমিকা সম্বন্ধে বিচার বিশ্লেষণ করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। পরবর্তীকালে এর সাংগঠনিক অস্তিত্ব পশ্চিম পাকিস্তানে অনুভব করা গেলেও মূলতঃ আওয়ামী লীগ তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের জনমানুষের রাজনৈতিক প্লাটফরম। বাংলার সাংস্কৃতিক আন্দোলন থেকে শুরু করে জাতীয় মুক্তির আন্দোলন সব্বার নেতৃত্ব ছিল আওয়ামী লীগের হাতে। একথা আজ সর্বজনস্বীকৃত যে, বাংলার রাজনৈতিক বাস্তবতা উপলব্ধি ও সময়োচিত কর্মসূচী প্রদানে আওয়ামী লীগই একমাত্র রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান যা রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছে। এ ছাড়া তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে যে সকল রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের দুর্বল অস্তিত্ব বজায় ছিল তাদের প্রগতিশীল মহলটি নানা প্রকার দ্বিধা দ্বন্দ্ব ও সংশয়ের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছিল।
প্রতিক্রিয়াশীল মহলে যারা চরম দক্ষিণপন্থী রাজনীতিতে অভ্যস্ত ছিল তারা প্রধানতঃ পশ্চিম পাকিস্তানের ইসলাম পছন্দ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের তল্পিবাহক হিসেবে তাদের কথা শুধু বাংলায় অনুবাদ করে কিছু মাসোহারা উপার্জনের পন্থা হিসেবে রাজনীতিকে ব্যবহার করে আসছিল।
বামপন্থী প্রগতিশীল মহলের নেতৃত্ব যেহেতু ছিল পশ্চিম পাকিস্তানীদের হাতে সেই হেতু বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে এই পশ্চিম পাকিস্তানী নেতৃবৃন্দের প্রণীত কর্মসূচী কোন দিনই সংগতিপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়নি। মুখ্যতঃ শ্রেনী চেতনা ও শ্রেণী সংগ্রামের কমন প্লাটফরম নির্মাণের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ তারা এত বেশী মগ্ন ছিল যে বাংলাদেশের মানুষের উপনিবেশ বিরোধী চেতনার সঙ্গে আর তাল মেলাতে তারা সক্ষম হয়নি। একটা মূল ভ্রান্তি তাদের বাংলাদেশের সচেতন জনগোষ্ঠি থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল। ঔপনিবেশিক শোষণে পর্যুদস্ত অঞ্চলের শোষিত শ্রেনীর সঙ্গে উপনিবেশবাদী ভূখন্ডের শোষিত শ্রেনীর যে কমেন প্লাটফরম নির্মাণ সম্ভব নয় এবং ঔপনিবেশিক শোষণে জর্জরিত জাতির জাতীয় মুক্তিলাভের মাধ্যমেই যে শোষিত শ্রেণীর মুক্তি আন্দোলনের ভিত্তি নির্মাণ সম্ভব এই সহজ বিশ্লেষণটি থেকে তারা আশ্চর্যজনকভাবে মুখ ফিরিয়ে রেখেছিলেন। তাই স্বাভাবিকভাবেই সর্বশ্রেণীর এবং সর্বস্তরের মানুষকে নিয়ে গঠিত একটি জাতীয় সংগঠনের মাধ্যমে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের স্তরানুক্রমিক পদক্ষেপ গ্রহণের দায়িত্ব এককভাবে আওয়ামী লীগকেই বহন করতে হয়।
পাকিস্তানের শাসক সম্প্রদায় শুধু সমরবাদী স্বৈরাচারীই ছিলনা, তারা ছিল ঔপনিবেশিক স্বার্থভোগী পুঁজিবাদী, আমলা। তাই গণতান্ত্রিক আন্দোলন তাদের যতটুকু মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়নি তার চাইতেও বেশী মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলন।
অবশ্য শ্রেণী চেতনা ও শ্রেণী সংগ্রাম যদি শক্তিশালী রূপ পরিগ্রহ করতে পারতো তাহলে তারা আরো বেশী আতঙ্কিত হয়ে পড়তো সন্দেহ নেই। কিন্তু তথাকথিত কিছু বামপন্থী নেতার হঠকারী কার্যকলাপ ও নিঃশর্তে নিজেদের রাজদরবারে বিকিয়ে দেবার পর তাদের দ্বারা যে কোন শক্তিশালী গণ-আন্দোলন অথবা গণ-বিপ্লব সাধন করা সম্ভব নয় এই মহাজনী বাস্তবতাটা পশ্চিম পাকিস্তানী পু্ঁজিপতি আমলা ও শাসক সম্প্রদায়ের কাছে অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল।
আর ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা এবং ঔপনিবেশিক শাসন চেতনা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানের শোষিত শ্রেণী যে কোন দিনই বাংলাদেশের শোষিত শ্রেণীর সঙ্গে এক প্লাটফরম গড়তে রাজী থাকতো না তা বলাই বাহুল্য। অতীত অভিজ্ঞতা আমার এ বক্তব্যকে সমর্থন করবে বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।
সুতরাং যারা পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অথবা শ্রেণী সংগ্রামের পাঁয়তারা কষতেন তাদের চাইতে বাংলাদেশে যারা উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনের প্রস্তুতি চালাচ্ছিলেন তারাই পাকিস্তানী শাসক চক্রের মাথা ব্যাথার প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ালো। আমি এখানে ছোট্ট একটা দৃষ্টান্ত তুলে ধরছি। ছিষট্টির প্রথম দিকে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নামে পশ্চিম পাকিস্তানের সরকার বিরোধী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গুলো যে ঐক্যবদ্ধ মোর্চা গঠন করে তার চাইতে যাতে শুদ্ধ মাত্র একটি প্রতিষ্ঠান আওয়ামী লীগের ৬-দফা প্রস্তাব সরকার এবং বিরোধী দল নির্বিশেষে পশ্চিম পাকিস্তানের সকল রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে একেবারে বেসামাল করে তোলে। অস্ত্রের ভাষা প্রয়োগের কথা তখন থেকেই শাসক সম্প্রদায়ের মধ্যে আলোচিত হতে থাকে।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!