You dont have javascript enabled! Please enable it! 1973.02.17 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | ডলারের লেজ কাটা পড়ল | সমাসন্ন মহান একুশে | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকা: শুক্রবার ৪ঠা ফাল্গুন, ১৩৭৯ ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩

ডলারের লেজ কাটা পড়ল

ধনতান্ত্রিক দেশের মুরুব্বী মার্কিন মুল্লুকের মুদ্রামান হ্রাস করতে হয়েছে। কদিন ধরেই সংকট চরমে এসে দাঁড়িয়েছিল, মার্কের মহানুভবতাও ডলারকে তার ইজ্জতহানি থেকে রক্ষা করতে পারেনি।মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেছেন, এটা সাময়িক ব্যবস্থা গ্রহণ মাত্র। দুনিয়ার লোক জানে সমস্যার গভীরে প্রবেশ এর সদিচ্ছা বা সামর্থ্য হোয়াইট হাউসের গদীনসীন কারো নেই অন্ততঃ দেশের আভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারনে যতদিন ওয়ালষ্ট্রীট তাদের অভাব অক্ষুন্ন রাখবে। এক বছর আগেও সংকটের মুখে ডলারকে তার মূল্যবান আট শতাংশ হ্রাস করতে হয়েছিল আজও ধনতান্ত্রিক দেশসমূহের বিভিন্ন সভা বৈঠকের পর তাকে বাধা হয়ে হতে হয়েছে পুনরায় দশ শতাংশ হারে মুদ্রামান হ্রাস করতে। দু’টো বিশ্বযুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির কোন আঁচ গায়ে না লাগিয়ে মার্কিনী ঐশ্বর্য ও সম্পদ দেশের প্রয়োজনকে ছাড়িয়েও যেন উপচে পড়তে চাইছিল। সর্বগ্রাসী যুদ্ধের লেলিহান শিখায় পুড়ে ধনতান্ত্রিক ইউরোপকে অবশেষে সেই উপচে পড়া সম্পদ খুঁটে বেঁধে নিতে হয়েছিল। পশ্চিম ইউরোপের রাষ্ট্রসমূহ ছাড়াও আণবিক বোমায় বিধ্বস্ত জাপানও মার্কিন মুল্লুকের সেই প্রসাদ থেকে বঞ্চিত থাকেনি। সাহায্যের থলি এগিয়ে দেয়া হয়েছে এশিয়া, ল্যাটিন আমেরিকার অন্নুনত রাষ্ট্র সমূহে। সঙ্গে সঙ্গে সৃষ্টি করা হয়েছে আমেরিকার উদ্বৃত্ত পণ্যের জন্য সংরক্ষিত বাজার আজকের বাজার যে কাল হাতছাড়া হয়ে যাবে না এমন বিলাস ভাবনায় ধনতান্ত্রিক দেশের নব্য মুরুব্বী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বসেনি। সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে তাই তাকে নিতে হয়েছে সামরিক অভিভাবকত্বের ঠিকাদারিও। সামরিক সরবরাহের অধিকতর লাভজনক দিকটা কে সামনে রেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজিবাদী মহল সামরিক সম্ভার তৈরীতে অধিকতর আগ্রহী হয়ে ওঠে। রাজনৈতিক দিক থেকে পুঁজিবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে অধিকতর আঁতাত গড়ে ওঠে সামরিক মহলের। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ক্ষমতা কূক্ষিগত হয়ে পড়ে পুঁজিবাদী সামরিক চক্রের হাতে। অর্থনৈতিক দিক থেকে, উৎপাদনশীল ক্ষেত্র অবহেলিত হতে থাকে। অনুৎপাদনশীল সামরিক সম্ভার জমে ওঠে শিল্প কারখানার গুদাম সমূহে। ফলে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে ভোগ্য পণ্যের চেয়ে ঘাটতি দেখা দেয় তা পূরণের জন্য মার্কিন সাহায্যেই গড়ে ওঠা জাপান এবং পশ্চিম জার্মানি এগিয়ে আসে তড়িৎ গতিতে। এক হিসেবে দেখা যায় হাজার ১৯৭০ সালে যেখানে বাণিজ্যিক ঘাটতি ছিল ১০,৭০০০ হাজার মিলিয়ন ডলার সেখানে হাজার ১৯৭১ সালের প্রথমেই তা গিয়ে দাঁড়ায় ১২,০০০ মিলিয়ন ডলারে। আমদানির ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করলেও সেই সংকট থেকে রেহাই পায়নি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সামরিক খাতে উৎপাদন বৃদ্ধি, যুদ্ধবাজী নীতি অনুসরণ প্রভৃতি প্রকারান্তরে ডলারের সংকটকেই জিইয়ে রেখেছে।
ডলারের মূল্যমান রাষ্ট্রে দেশের অভ্যন্তরে অর্থনীতি স্বাভাবিক সূত্র অনুসারে বিরূপ প্রভাব সৃষ্ট করবে। বিশেষ করে স্বল্প ও নিম্নআয়ের লোকেরা, সীমিত আয়ে যাদের জীবন জীবিকা চলে তাদের উপর যে কী দুঃসহ বোঝা চেপে বসবে তা স্বাভাবিকভাবেই অনুমান করা চলে। কিন্তু আমাদের কথা তা নয়। পুঁজিবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে আলো থেকে মুখ ফেরানো যে নীতি অনুসরণের ফলে দিনের পর দিন তারা অবক্ষয়ের পথে এগিয়ে চলেছে ও উপর্যুপরি সংকট কি তাদের দিবাদৃষ্টি খুলতে সহায়তা করবে? সময় সম্ভার সরবরাহের মালিক মোক্তারি এবং সেই সরবরাহের প্রয়োজনে নানা অঞ্চলে উত্তেজনা সৃষ্টি ও সম্প্রসারণের যুদ্ধবাজী নীতি থেকে তারা কি সরে দাঁড়াবেন? যা মার্কিনী জনগণের সাধারণ স্বাস্থ্যের পরিপূরক তা বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রার সহায়ক। এই সাধারন সত্যটা পেন্টাগন-ওয়ালস্ট্রিটের রথী-মহারথীরা বোঝেন না এমন নয়। কিন্তু বাধ সাধছে স্বার্থ, আত্মস্বার্থ ; নেহায়েতই এই আমাদের আর মামাদের স্বার্থ। পুঁজিবাদী চিন্তার এই হল মুল বিপদ। জনতার স্বার্থ, নয় দেশি-বিদেশি সাধারণ শান্তিকামী মানুষের স্বার্থ নয়, উপচে পড়া প্রাচুর্যের উপর ঐশ্বর্যের লাগামহীন লালসা কে গড়িয়ে দেবার হীন স্বার্থই বড় কথা। রাষ্ট্র, প্রশাসন ‘গণতন্ত্র’ সেই স্বার্থেরই সেবাদাসী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনশক্তি কি সেই জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে পারবেন?

সমাসন্ন মহান একুশে

মহান একুশে ফেব্রুয়ারি সমাসন্ন। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত একুশে ফেব্রুয়ারি পালনের ধুমধাম লক্ষ করা যাচ্ছে। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ দ্বিতীয়বারের মতো একুশে ফেব্রুয়ারি এসেছে। ভাষা প্রতিষ্ঠার মহান প্রতিশ্রুতি বহন করে থাকে প্রতিবছরের একুশে ফেব্রুয়ারি। মূলতঃ বায়ান্ন সালের পর থেকেই একুশে ফেব্রুয়ারি প্রতিবছর এক নতুন সংগ্রামী আহ্বান নিয়ে আসতো। এই শহীদ দিবসে ছিল বাংলাদেশের প্রত্যেকটি সংগ্রামের একটি অন্যতম ভিত্তি বা উৎসস্থল। এখান থেকেই বাঙালি জাতি তার আত্মমর্যাদা সম্পর্কে সচেতন হবার সুযোগ লাভ করতো। একুশেকে সামনে রেখেই বাংলার মানুষ তাদের জাতিবোধের জাগরণ ঘটাতে সক্ষম হতো। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম যে ভাষা দিবস এ দেশে পালিত হয়েছে তার আবেদন বা প্রতিবেদন ছিল সম্পূর্ণ নতুন। বাঙালি জাতি প্রথম তার হৃদয় দিয়ে নিজের ভাষা সম্পর্কে উদ্বেল হয়ে উঠেছিল। এতদিন ভাষা দিবস ছিল একটি আন্দোলনের ভিত্তি। স্বাধীনতার পর ভাষা দিবস হল জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার জন্য বাস্তব কর্মসূচি গ্রহণের দিন। আমরা লক্ষ্য করছি, ঢাকা শহরে বিভিন্ন সংস্থা মহান একুশে ফেব্রুয়ারি পালন উপলক্ষে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ও বাংলা একাডেমি এ ব্যাপারে সপ্তাহব্যাপী সেমিনারের আয়োজন করেছে। এসকল কর্মসূচির মুখ্য উদ্দেশ্য দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে মাতৃভাষার প্রতিষ্ঠিা হলেও বাহ্যিক প্রকাশ হয়ে উঠেছে সম্পূর্ণ আনুষ্ঠানিক। ঢাকার বিভিন্ন সংস্থা যে সকল কর্মসূচি নিয়েছে তার উদ্দেশ্য মহৎ হলেও প্রথাগত প্রচেষ্টায় ভাষার প্রতিষ্ঠা হতে পারে না। ভাষা দিবস একদিন আন্দোলনের ডাক দিত কিন্তু আজকের ভাষা দিবস ভাষা প্রতিষ্ঠার জন্য বাস্তব কর্মসূচী ভিত্তিক আন্দোলনের প্রেরণা দেবে। এটাই হওয়া উচিত আজকের একুশে ফেব্রুয়ারি ভাবনা-চিন্তা। সরকার ভাষা প্রতিষ্ঠার জন্যসর্বস্তরে বাংলার প্রচলনের কথা সাড়ম্বরে ঘোষণা করলেও মূলতঃ কার্যকরী কোনো কর্মসূচি গ্রহণ করছে বলে মনে হয় না। একশ্রেণীর উর্দ্ধতন কর্মকর্তা ভাষা প্রতিষ্ঠার সরকারি সদিচ্ছাকে বানচাল করে দেবার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। আমলারা অতীতেও ভাষা প্রতিষ্ঠার কাজে বিরাট অন্তরায় ছিল। আজ সর্বস্তরে ভাষা প্রতিষ্ঠার জন্য যখন সরকার তার সদিচ্ছার কথা ঘোষণা করেছে, তখন কেন তা ঠেকিয়ে রাখা হচ্ছে এবং কেনই বা অযথা অজুহাত সৃষ্ট করে নানা অসুবিধার কথা বলা হচ্ছে তা আমরা জানিনা। এ দেশে সরকারি ইচ্ছা সত্ত্বেও ভাষা সর্বস্তরে তার প্রতিষ্ঠা পাবেনা বলে আমাদের বিশ্বাস। মাতৃভাষার প্রচলন শুরু প্রতিষ্ঠা করতে হলে একটি ব্যাপক আন্দোলনের সৃষ্টি করতে হবে এবং দেশের প্রতিটি মানুষের মনে প্রানে ভাষার গুণাগুণ ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সকল স্তরের মানুষ যখন ভাষার মর্যাদা সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন হবে তখনই সম্ভব ভাষা প্রতিষ্ঠার পথে অন্তরায় যারা তাদের সমাজ দেহ থেকে অপসারণ করা। ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী মনোবৃত্তির যারা আমলা তারা কোনদিন মাতৃভাষার মর্যাদা দিতে পারেনা। বৃটিশের অবৈধ শাসন যাদের মনোবৃত্তি একদা চাঙ্গা হয়ে উঠেছিল তারা বাংলার উন্মেষকে কোনদিন সহজভাবে গ্রহণ করতে পারে না। আসন্ন একুশে ফেব্রুয়ারিকে সামনে রেখে আমাদের ভাষা প্রতিষ্ঠার জন্য একটি ব্যাপক আন্দোলনের কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। শের কর্মসূচি সেমিনার, সংকলন ও গানের আসর মুখী হবে না। বরং তা হবে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের মতো একটি ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন