You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা: শনিবার ৫ই ফাল্গুন, ১৩৭৯ ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩

আর আঞ্চলিকতা নয়

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নির্বাচনী সফরে তৃতীয় অধ্যায়ে চিটাগাং জেলার তিনটি জায়গায় বিরাট বিরাট জনসভায় বক্তৃতা শেষে গত পরশুদিন ঢাকায় ফিরে এসেছেন। এ সকল নির্বাচনী জনসভায় বক্তৃতা দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু একপর্যায়ে বলেছেন- “বাংলার মাটি থেকে চিরতরে আমাদেরকে আঞ্চলিকতার তুলে ফেলতে হবে। কোন প্রকার আঞ্চলিকতাকেই এ জাতীয় আর গ্রহণ করতে প্রস্তুত নয়।” বস্তুতঃ এক অঞ্চলের বিরুদ্ধে অন্য অঞ্চলের বিদ্বেষের দিন শেষ হয়ে গেছে। দীর্ঘ পঁচিশ বছর বাংলাদেশের মানুষ পাকিস্তানি নেতৃবৃন্দের কাছে আঞ্চলিকতাবাদী বলে আখ্যায়িত ছিল। তারা বাংলাদেশের ভাষা দাবি-দাওয়াকে আঞ্চলিকতাপ্রসূত সংকীর্ণতা বলে গালমন্দ করত। সেদিন বাংলাদেশের মানুষ আঞ্চলিকতার দুর্নাম মেনে নিয়েই সংগ্রাম করেছে এদেশের সাড়ে সাত কোটি অসহায় বাঙালির ভাগ্য নিয়ন্ত্রণে দাবি-দাওয়া নিয়ে। বিশ্বের ইতিহাসে ভৌগলিক দিক থেকে পাকিস্তান ছিল এক অত্যাশ্চর্য দেশ। বাংলাদেশে তখন যে কোন দাবি-দাওয়া উত্থাপন করলে তা হতো আঞ্চলিকতার দুর্নামে আখ্যায়িত। সেদিন গোটা বাঙালি জাতির স্বার্থে আঞ্চলিকতা দুর্নাম মেনে নেবার পেছনে যথেষ্ট কারণ ছিল। কিন্তু আজ গঠনের পরিক্রমণিকায় বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। বাংলাদেশ একটি ভাষা একটি জাতির সঙ্গবদ্ধ ঐতিহাসিক নিদর্শন। এই সঙ্ঘবদ্ধ জাতির মধ্যে কোনরূপ ভিন্ন চেতনার উৎস নেই। এদেশে কোন অঞ্চল নেই। এদেশে কোন বিভাগ নেই। এক ও অভিন্ন দেশ বাংলাদেশ। তবুও প্রশ্ন উঠেছে আঞ্চলিকতার। কিছু কিছু ঘটনায় আঞ্চলিকতার সংকীর্ণ চিত্র আমরা লক্ষ্য করেছি। বেশ কিছুদিন পূর্বে ঢাকার আদমজী মিলে আঞ্চলিক গান আঞ্চলিক কতগুলো ক্ষুদ্র বিষয় নিয়ে বহু অপ্রীতিকর ঘটনার অবতারণা হয়েছে। সেখানে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছিল। এরপর কিছু কিছু শ্রমিক এলাকায় এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। সম্প্রতি বাড়বকুন্ডোয় যে নিদারুণ ও মর্মান্তিক প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে তার পেছনেও নাকি এ ধরনের ঘৃণ্য আঞ্চলিকতা কারণ সক্রিয় রয়েছে। আমরা লক্ষ্য করেছি-শ্রমিক স্বার্থের ব্যাপারে এই আঞ্চলিকতার ঘটনা অত্যাধিক প্রকট। এবং মিল-কারখানা এলাকা থেকেই বিভিন্ন অপ্রীতিকর ঘটনার উন্মেষ। যার উৎসব ক্ষুদ্র আঞ্চলিক স্বার্থ। এ ধরনের ঘৃণ্য ক্ষুদ্রস্বার্থের বশবর্তী হয়ে যারা দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে তাদের ব্যাপারে সরকারকে অবশ্যই কঠোর হতে হবে। কোন অবস্থাতেই সংকীর্ণ স্বার্থের কাছে গোটা জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দেওয়া যাবে না। দেশের উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোর পক্ষ থেকে নানাবিধ দাবি-দাওয়া বহুদিন পূর্ব থেকেই সোচ্চারিত। তাদের দাবি সমূহের অধিকাংশই যে ন্যায্য একথা বঙ্গবন্ধু স্বয়ং জানেন। আর জানেন বলেই তিনি তাদের দাবি পূরণের ব্যাপারে সম্পূর্ণ সচেতন। ইতিমধ্যেই সরকার উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত জেলাগুলোর জন্য উন্নয়নমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। তাদের দাবি আদায়ের নামে যদি উত্তরাঞ্চল গোটা জাতীয় স্বার্থকে হেয় করে দেখে তাহলে যেমন বিপর্যস্ত হবে তাদের নিজেদের দাবী তেমনি ক্ষতিগ্রস্থ হবে জাতীয় স্বার্থ। তাহলে সেটা নিতান্তই দুর্ভাগ্য হবে জাতির জন্যে। কোন আঞ্চলিকতার শেষই শুভ হয় না। বাংলাদেশ সরকার দেশের যে সকল অঞ্চলের উন্নয়ন কাজ করা সর্বাগ্রে বা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রয়োজন মনে করবেন তা অবশ্যই করবেন। আর এ ব্যাপারে জনগণের সরকার যে সচেতন রয়েছেন তা আমরা বলতে পারি। কেননা অতীতের পাকিস্তান আমলে সারাদেশকে রোজা রেখে রাজধানী নামক মাথাকে মেদপুষ্ট করার ঘটনা ও তার পরিণতি জাতি এখনো বিস্মৃত হয়নি। বাংলাদেশের ব্যাপারে তাই অনেক অঞ্চলকে অনুন্নত রেখে বিশেষ কোন অঞ্চলকে উন্নত করার অশুভ প্রচেষ্টা গ্রহণ যোগ্য হতে পারে না। আমাদের দেশে এই আঞ্চলিক ক্ষুদ্র মনোবৃত্তির ধারক কিছুসংখ্যক ব্যক্তি বা কর্মকর্তা রয়েছে যারা চাকরি-বাকরি সুযোগ-সুবিধা প্রভৃতি ক্ষেত্রে এই এই ঘৃণ্য মনোবৃত্তি পরিচয় দিয়ে থাকে। এরাই সাধারণতঃ আঞ্চলিকতার ধুয়া তুলে কোন্দলের সৃষ্ট করে বা ইন্ধন জোগায়। সরকারকে এ বিষয়টাও একটা বার বিবেচনা করে দেখতে হবে অফিস ও মিল-কারখানায় যেসকল আঞ্চলিক দাবি ভিত্তিক গন্ডগোল হয় তার সবই ওই সকল কর্মকর্তা ও ব্যক্তিদের প্রশ্রয়-ইন্ধন প্রত্যক্ষ যোগসাজশের ফল। অতএব আঞ্চলিকতার নামে দিয়ে যে সকল অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে বা ঘটেছে তার মূলোৎপাটন করার প্রয়োজনেই এই সরকারকে ঘটনার উৎসমূলে আঘাত হানতে হবে সর্বাগ্রে।

লাসবেলায় টিক্কা খান

লাসবেলা বেলুচিস্তানের একটা জেলা। পাকিস্তানের জেনারেল টিক্কা খান হঠাৎ সেখানে উপস্থিত হলেন। এই অঞ্চলে প্রাদেশিক প্রশাসনের বিরোধিতা সত্ত্বেও আইন ও শৃংখলা পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে সেখানে সৈনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে।
সংবাদে প্রকাশ বেলুচিস্তানের গবর্ণর (যাকে ১৪ই ফেব্রুয়ারি রাতে বরখাস্ত করা হয়েছে) জনাব গাউস বক্স বেজেঞ্জোর সঙ্গে তাঁর প্রদেশের একাংশে সৈন্য মোতায়েন প্রশ্ন নিয়ে জেনারেল টিক্কা খাঁর মতবিরোধ ঘটে। বেলুচিস্তান থেকে সৈন্য সরিয়ে নেয়ার জন্য জোর দাবি জানালেও টিক্কা খাঁ তার কথায় কান দেননি। এদিকে বেলুচিস্তানের গবর্ণর জনাব গাউস বক্স বেজেঞ্জো ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের গবর্ণর জনাব আরবার সিকান্দার খান খলিলকে বরখাস্ত করার পর প্রেসিডেন্ট জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো বেলুচিস্তানের মন্ত্রিসভা বাতিল করে সেখানে প্রেসিডেন্টের শাসন জারী করেছেন।
রয়টারের খবরে প্রকাশ, কোয়াটাতে রেডিও পাকিস্তান, স্টেট ব্যাংক, ডাক ও তার ভবনসহ গুরুত্বপূর্ণ জায়গা গুলোতে অতিরিক্ত পাহারা মোতায়েন করা হয়েছে।
জেনারেল টিক্কা খানের লাসবেলা সফর থেকে আরম্ভ করে সৈন্য মোতায়েন ও কোয়েটার গুরুত্বপূর্ণ জায়গা গুলোতে অতিরিক্ত পাহাড়া মোতায়েন-এসব ঘটনা আমাদের কাছে অতি পরিচিত মনে হয়। সত্তর সালে বাংলাদেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবার পর ঠিক একই খেলা চলছিল। আওয়ামী লীগ নির্বাচনে নজর বিহীন সাফল্য লাভ করার পরও পরিষদের অধিবেশন আহ্বান না করায়, গোপনে বাংলাদেশের সৈন্য মোতায়েন এবং সর্বশেষে টিক্কা খানের আগমন। একের পর এক এসব ঘটনায় সেদিন ঘটেছিলো। তারপর রক্তাক্ত বিপ্লবের শুরু। টিক্কা খানের পলায়ন। মুক্তিসংগ্রামের জয়লাভ।
আজকের বেলুচিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের ঘটনাবলী ঠিক ফেলে আসা দিনের ছবিগুলোই আমাদের চোখের সামনে তুলে ধরেছে। সেখানে ভুট্টো শাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ চরমে উঠেছে। ভিডিও সাহেব স্বইচ্ছায় কোন কিছু করার ক্ষমতা আজ হারিয়ে ফেলেছেন। জেনারেল টিক্কা খান আস্তে আস্তে রঙ্গমঞ্চে এগিয়ে আসছেন। যে কোনদিন ভুট্টো সাহেব রঙ্গমঞ্চে থেকে বিদায় নিতে পারেন। এমনকি অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তানের দুটি প্রদেশের গবর্ণর ও কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা বাতিলের ফলে জনতার বিক্ষোভ আরো চরমে উঠবে। আর সেই বিক্ষোভকে কিভাবে দমন করা যায় তারই ‘মাস্টার প্ল্যান’ তৈরি করার জন্য টিক্কা খানের লাসবেলা সফর।
পাকিস্তানের ন্যাপ নেতা খান আব্দুল ওয়ালি খান বেলুচিস্তানে গণতান্ত্রিক সরকারকে বরখাস্ত করার প্রেসিডেন্ট ভিক্টর কার্যক্রমের তীব্র সমালোচনা করে বলেছেন যে, এটা একাত্তর সালের সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক অভিযানের সাথেই তুলনীয়।
বেলুচিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ কে নিয়ে যে ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের জাল বিছানো হয়েছে এতে কোনো সন্দেহ আজ আর কারো নেই। ইসলামাবাদে ইরাকি দূতাবাসে অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধারের পর এই ঘটনার সাথে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি কে জড়াবার জন্য পাকিস্তান সরকার চেষ্টা করেছেন এবং তারই পরিণতিতে মন্ত্রিসভা বাতিল ও প্রেসিডেন্টের শাসন জারি প্রভৃতি ঘটনা।
প্রেসিডেন্টের ঘোষণায় বলা হয়েছে যে ন্যাপ নেতা আতাউল্লাহ খান বেঙ্গলের নেতৃত্বাধীন বেলুচিস্তান কোয়ালিশন সরকার প্রদেশের গোলযোগ দমনে ব্যর্থ হয়েছেন। বরখাস্ত গবর্ণরের কাছে চিঠিতে প্রেসিডেন্ট ভুট্টো বলেছেন, পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে আমরা আস্থাভাজন ব্যক্তি নিয়োগে বাধ্য হচ্ছি।
সামগ্রিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বিরোধী দলগুলি কেন্দ্রীয় সরকারকে এই মর্মে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন যে কোনো মূল্যে বেলুচিস্তানে স্বায়ত্তশাসন খর্ব করার চেষ্টা প্রতিহত করা হবে। পাকিস্তানের বেলুচিস্তান উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের জনতা আজ বিক্ষুব্ধ। এ বিক্ষোভ যেকোনো সময় বিদ্রোহের আগুন জ্বালাতে পারে। পাকিস্তানের সামরিক জান্তা একদিন বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের বিক্ষোভকে দমন করতে চেয়েছিল কিন্তু পারেনি।
বিক্ষুব্ধ উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তানে আজ স্বাধিকারের দাবি উঠেছে। আর এ স্বাধিকারের দাবীই স্বাধীনতার দাবিতে রূপান্তরিত হবে একদিন। তারই ইঙ্গিত বহন করছে জেনারেল টিক্কা খানের লাসবেলা সফরের মধ্যে। অস্ত্র দিয়ে বাংলাদেশকে দমন করা যায়নি-অস্ত্র দিয়ে বেলুচিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশকেও দমন করা যাবে না ইতিহাস সে কথা বলে না।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!