You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী

ঢাকা: মঙ্গলবার ৮ই ফাল্গুন, ১৩৭৯  ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩

আফগানিস্তানের স্বীকৃতি দান

অবশেষে আফগানিস্থান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। গত ১৮ই ফেব্রুয়ারি আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে সরকারিভাবে একথা ঘোষণা করা হয়েছে। সেখানকার প্রধানমন্ত্রী জনাব মুশফিক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিকট প্রেরিত এক বাণীতে অতঃপর দুদেশের সম্পর্কে প্রশ্নে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন। আফগানিস্তানকে নিয়ে এ পর্যন্ত বিশ্বের একশটি দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিল।

আফগানিস্থান মুসলিম অধ্যুষিত দেশ। তাছাড়া এর ভৌগলিক অবস্থান পাকিস্তানের দোরগোড়ায়। পাকিস্তানকে খণ্ড-বিখণ্ড করার ষড়যন্ত্রে আফগানিস্তান লিপ্ত রয়েছে বলে পাকিস্তানের শাসক শ্রেণী বরাবর প্রচার চালিয়ে আসছিল। ভয় ছিল তাদের স্বাধীনচেতা পাখতুন জনসাধারণকে। পাকিস্তানের অভ্যুদয়ের পর থেকেই সেদেশের পাঞ্জাবি এবং বহিরাগত সামন্তবাদী শোষকশ্রেণী যে কায়েমী স্বার্থের দুর্গ গড়ে তোলে তাতে করে তদানীন্তন পাকিস্তানের পূর্বাংশের কথা বাদ দিলেও সীমান্ত এবং বেলুচিস্তানের শোষিত জনগোষ্ঠীর নিজেদের বঞ্চিত বোধ করতে থাকে। সেই বঞ্চনাবোধ এর প্রসার ঘটে অঞ্চল বিশেষের অবিরাম শোষণ-শাসন এবং নির্যাতনের ফলে। স্বশাসন তথা আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে দুর্বার আন্দোলন গড়ে ওঠে উযর মরু ও পার্বত্যঞ্চলে। নিজেদের দোষ কি অন্যের ঘাড়ে ছাপাবার চিরন্তন রীতি অনুসারে পাকিস্তানের শাসক শ্রেণী প্রতিবেশী রাষ্ট্র আফগানিস্তানকে এই ‘আঞ্চলিকতা’ উস্কে দেওয়া এবং ক্রমান্বয়ে তার স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগদানের অভিযোগে অভিযুক্ত করেন। সে অভিযোগ সময়ে-অসময়ে আজও উচ্চারিত হয় পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন মহলের কন্ঠে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে এবং তৎপরবর্তীকালে আফগানিস্থানে তড়িঘড়ি সমর্থনে অনীহা প্রকাশ এর অন্যতম কারণ যে সেই ‘পাকিস্তানী অভিযোগ’ তা অনেকেই মনে করেন।

আমরা সরকারিভাবে আফগানিস্তানের এই স্বীকৃতি দান কে স্বাগত জানাই। এই স্বীকৃতি দান যে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ তা মোটামুটি আজ করা যেতে পারে। মুসলিম অধ্যুষিত দেশ হিসেবে আফগানিস্তানের একটা বিষয়ের সম্পর্ক রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সমূহের সঙ্গে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন সম্বন্ধে যে বিভ্রান্তিমূলক অপপ্রচার মুসলিমপ্রধান দেশ গুলোতে চালানো হয়েছে তাতে করে এই সকল দেশের অনেকেরই মনে আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলন সম্বন্ধে সংশয় সন্দেহ সৃষ্টি করেছিল। এই সেদিনও মধ্যপ্রাচ্যের শ্রেষ্ঠতম রাজনীতিক চিন্তাবিদ জনাব হাসনাইন হাইকেল স্বয়ং স্বীকার করেছেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল বিষয় সম্বন্ধে আমরা কিছুই জানতাম না’ আরব জাহানে একে ‘বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্রকে দ্বিখন্ডিত করার বেদীনি ষড়যন্ত্র’ বলে চিত্রিত করার অপচেষ্টা হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যেও এখন বাস্তবতাবোধ ফিরে আসছে বলে অনুমান করা হচ্ছে। সাম্প্রতিককালে তাদের বক্তব্য বিবৃতি এমনকি অতিসম্প্রতি মিসরের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা সেই পরিবর্তিত নীতিরই বহিঃপ্রকাশ। এখন আফগানিস্তানে স্বীকৃতিদান মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহকেও বাস্তবতা স্বীকারে অনুপ্রাণিত করবে। সেই নয়া পথে নয় চলার ইচ্ছা নিয়ে আফগানিস্থানে গিয়ে এসেছে সে পথে আরো দশের এর পদচিহ্ন পড়ুক। শান্তিকামী মানুষের পক্ষ থেকে এটাই আমাদের আশা।

বাংলা প্রচলন কমিটি গঠন প্রসঙ্গে

গতকাল সংবাদপত্রে ফলাও করে সরকারি পর্যায়ে বাংলা প্রচলন কমিটি গঠিত হয়েছে বলে একটি খবর প্রকাশিত হয়েছে। জানা গেছে বঙ্গবন্ধু কাছে কোন ফাইল পেশ করতে হলে তা বাংলায় লিখতে হবে। ইতিপূর্বে বঙ্গবন্ধু অফিসে কাজ বাংলায় পরিচালনা করার জন্য কয়েকবার নির্দেশ দিয়েছিলেন তবু তা পালিত হয়নি। এইজন্য স্বাভাবিকভাবেই জনমনে একটা প্রশ্ন ছিল। প্রধানমন্ত্রীর মন্ত্রণালয় থেকে কেন বাংলা ভাষা অফিসের কাজে ব্যবহার করায় অসুবিধা হচ্ছে সে সম্পর্কে কোন বিজ্ঞপ্তি এর পূর্বে প্রচার করা হয়নি। বেমালুম বিষয়টা এতদিন চাপা পড়েছিল। ঠিক একুশে ফেব্রুয়ারিকে সম্মুখে রেখে মন্ত্রণালয়ের আশার কথা প্রচার করেছেন। তাদের প্রচার করার সময় ও কৌশল সম্পর্কে জনসাধারণ একেবারেই অনভিজ্ঞ এমন একটা ভাব তারা পোষণ করেছেন। সরকারি পর্যায়ে বাংলা প্রচলন কমিটি গঠিত হয়েছে এ সংবাদ প্রচার করলেও তারা জনগণকে আশ্বাস দিয়েছেন। জানা গেছে, তেরো সদস্য বিশিষ্ট এ কমিটির প্রধান রয়েছেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষামন্ত্রী। এঁরা যতদূর সম্ভব তাড়াতাড়ি ভাষার প্রতিষ্ঠার পথে বাধা গুলোর জরিপ করবেন এবং কারিগরি দিক দিয়ে যে সকল অসুবিধা রয়েছে তার দ্রুত সমাধানের পথ খুঁজে বের করবেন। আমাদের মনে হয় পাকিস্তান আমলে ভাষা প্রতিষ্ঠার জন্য যতটুকু অগ্রসর হওয়া সম্ভব হয়েছিল স্বাধীনতার পর বাস্তবতায় তার থেকে বেশি কিছু হয়নি। বেশি যা হয়েছে তা শুধু একুশে ফেব্রুয়ারিকে সামনে রেখে সরকারের মন্ত্রনালয় থেকে ভাষা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে একটু বেশি বিজ্ঞপ্তি প্রচার। গতকাল শহীদ দিবসকে উপলক্ষ করে যে কমিটি গঠিত হয়েছে, তার চাইতে সরকার বাংলা ষ্টেনো-টাইপিষ্টদের শিক্ষার টাইপরাইটার আমদানির জন্য কি ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন সে সংবাদ প্রচার করলে আরো বাস্তবতার দাবি রাখতে পারতো। দেশে বর্তমানে জরুরী ভিত্তিতে অবিলম্বে বাংলা ষ্টেনো-টাইপিষ্টদের প্রয়োজন আর এ জন্যই প্রয়োজন প্রচুর টাইপরাইটার আমদানির। ষ্টেনো টাইপিষ্টদের জন্যে বহুসংখ্যক শিক্ষালয় দরকার এবং সরকারের একটি অভিজ্ঞ ও কর্ম দক্ষ সংস্থারও প্রয়োজন। যাঁরা একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ভাষার প্রতিষ্ঠার জন্য আবশ্যক যা কিছু তা পূরণ করে দেবার দায়িত্ব নেবেন। কিন্তু যে কমিটি গঠিত হয়েছে জানিনা তা আবার আগামী বছরের শহীদ দিবসের পূর্বে তাঁদের রিপোর্ট প্রকাশ করবেন কিনা। অবশ্য বাংলার মানুষ বড় আশাবাদী, সহজেই তারা ভেঙে পড়ে না। কমিটির দ্রুত কোনো কার্যকরী ব্যবস্থা গৃহীত হয়ে তা জনসমক্ষে অবিলম্বেই প্রকাশিত হবে এটাই আমরা বিনীতভাবে আশা করি।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!