You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসীদের ভূমিকা ০১ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র - সংগ্রামের নোটবুক
শিরোনাম সূত্র তারিখ
১। বৃটেনে গঠিত ‘ইস্ট পাকিস্তান লিবারেশন ফ্রন্ট’ কর্তৃক স্বাধীনতা সংগ্রামের আহবান ‘ইস্ট পাকিস্তান লিবারেশন ফ্রন্ট নিউজ’ নভেম্বর ১৯৭০

এম এ ভূঁইয়া কর্তৃক প্রকাশিত। আহ্বায়ক এবং ডেপুটি আহ্বায়ক এম আহমেদ

অনুলিপি বিভাগ কর্তৃক পরিবেশিত , ১২৯ সোহো হিল, ব্রামিংহাম ১৯

ইস্ট পাকিস্তান লিবারেশন ফ্রন্ট নিউজ

২৯ শে নভেম্বর ১৯৭০, রবিবার দুপুর ২:০০ ঘটিকায় ডিগব্যাথসিভিক হলে ইস্ট পাকিস্তান লিবারেশন ফ্রন্টের সভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত আয়োজিত সভায় মিডল্যান্ড থেকে আনুমানিক দুই হাজার বাঙালী অংশগ্রহণ করেন।

প্রাক্তন ছাত্রনেতা জনাব তারিক আলি সভায় বক্তব্য প্রদান করেন। তিনি বলেন, “ইস্ট পাকিস্তান লিবারেশন ফ্রন্ট কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপ সমগ্র এশিয়ার জন্য উদাহরণ হয়ে থাকবে”। তিনি আরও বলেন, ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসনামলে একটি কথা প্রচলিত ছিল যে, “বাঙালী আজকে যা চিন্তা করতে পারে, ইন্ডিয়ার মাথায় সেটা আসে তার পরদিন”।

সভার আহ্বায়ক, জনাব আজিজুল হক ভূঁইয়া অবিলম্বে পূর্ব-পাকিস্তানের পূর্ণ স্বাধীনতার ডাক দেন; নিম্নলিখিত সিদ্ধান্তসমূহ কোনরূপ ভিন্নমত ব্যতীত সভায় গৃহীত হয়।

ইস্ট পাকিস্তান লিবারেশন ফ্রন্টের এই সভায়ঃ

১. ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনায় রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া ও তার সামরিক সরকারের ঔদাসীন্য ও ইচ্ছাকৃত অদক্ষতা প্রদর্শন এবং মৃতের সংখ্যা যথাসাধ্য কমিয়ে দেখানোর চেষ্টার তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করা হয়। এমতাবস্থায়, দুর্যোগ পরবর্তী সময়ে ১০০,০০০ মানুষের মৃত্যুর জন্য আমরা রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খানকে সরাসরি দায়ী বলে মানি। পাকিস্তান সরকার যদি দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করতো তবে এই মানুষগুলোকে বাঁচানো যেত। তাই আমরা অবিলম্বে ইয়াহিয়ার পদত্যাগ দাবী করছি।

২.সাম্প্রতিক সর্বনাশা ঘূর্ণিঝড়ের পরিপ্রেক্ষিতে সক্রিয়ভাবে ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম তদারকি করার জন্য এবং ত্রাণ কার্যক্রম যেন পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর একার দায়িত্বে ছেড়ে না দেয়া হয় সেটা নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক রেডক্রস, রেডক্রিসেন্টও চীন, রাশিয়া থেকে অনুরূপ সংস্থাসমূহ অন্তর্ভুক্ত করে আন্তর্জাতিক কমিটি গঠন করতে হবে। কারণ পাকিস্তানী বাহিনী মোটেও বিশ্বাসযোগ্য নয় ও বাঙালীর তাদের উপর কোন ভরসা নেই।

৩. বন্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম ও ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদির বিরুদ্ধে দীর্ঘস্থায়ী ব্যবস্থা (যেমন, স্থান খালি করা, দ্রুত সতর্কতা, আশ্রয়ের ব্যবস্থা) গ্রহণ করার জন্য বন্ধুপ্রতীম রাষ্ট্রসমূহের সাথে সমঝোতায় আসতে অনতিবিলম্বে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। কয়েক বছর আগে চীন সরকার এরকম কিছু কার্যক্রম পরিচালনা করার শর্ত-বিহীন প্রস্তাব দিয়েছিল, কিন্তু এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা হয়।

৪. ঢাকা বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ঘোষণা করতে হবে যেন জরুরী সংকটময় অবস্থায় এটি আরও দক্ষতার সাথে ব্যবহার করা যায়।

৫. সভায় পশ্চিম পাকিস্তানের পুঁজিবাদী সরকারের চালানো শোষণ – নিপীড়নের স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। বিগত ২৩ বছর যাবৎ বিশ্বাসঘাতকতার শিকার সাড়ে সাত কোটি বাঙালী নিজেদের রক্ষাকর্তা হিসেবে ১১০০ মাইল দূরের কোন সরকারের উপর আর নির্ভর করতে রাজী নয়। এই সরকার যারা বাঙালীকে নিরাপদে রাখতে পারে না, এমনকি নিরাপদে রাখতে চায়ও না, এই দুর্যোগের সময় তাদের মুখোশ ভালমতোই খুলে গেছে। তাই বাঙালী তাদের স্বাধীনতার চূড়ান্ত দাবী ঘোষণা করছে।

“পূর্ব-পাকিস্তান জিন্দাবাদ”

ইস্ট পাকিস্তান লিবারেশন ফ্রন্ট

ইস্ট পাকিস্তান লিবারেশন ফ্রন্ট হল পূর্ব-পাকিস্তানের ছাত্র ও শ্রমজীবী জনতা দ্বারা গঠিত একটি বিপ্লবী সংগঠন যাদের একটিই আদর্শ আর সেটা হল পশ্চিম-পাকিস্তানের পুঁজিবাদ অধীনস্থ সরকারের নির্মম শোষণ ও আধিপত্যের হাত থেকে পূর্ব-পাকিস্তানের জনগণকে মুক্ত করা। একইরকমভাবে তারা মনে করে যে পশ্চিম-পাকিস্তানের সাধারণ জনগণও একই পুঁজিবাদী শ্রেণী দ্বারা শোষিত হচ্ছে এবং তাদের মুক্তির ডাক তাদের ভিতর থেকেই আসতে হবে।

তারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে পূর্ব-পাকিস্তান হবে একটি সম্পূর্ণ স্বাধীন দেশ যার থাকবে জনতার সরকার এবং পূর্ব-পাকিস্তানের জনগণের চাহিদার সাথে খাপ খাওয়ানো অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। দেশের কৃষি ও শিল্প ব্যবস্থা এমনভাবে উন্নত করতে হবে যেন দেশের সকল সম্পদ দেশের জনগণের জীবনযাত্রার সামগ্রিক অগ্রগতির কাজে ব্যবহার করা যায়। কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণী সম্পূর্ণরূপে স্বাধীনতা ভোগ করতে পারবে। শাসক শ্রেণীর যেকোনো বৈষম্যের বিরুদ্ধে ইস্ট পাকিস্তান লিবারেশন ফ্রন্ট সমস্ত শক্তি দিয়ে লড়াই করবে।

ফ্রন্ট বিশ্বাস করে যে পূর্ব-পাকিস্তানের সাথে অনেকদিন ধরে ধর্মের নামে বিশ্বাসঘাতকতা করা হচ্ছে। নিজেদের স্বার্থ নিজেরা দেখভাল করতে পূর্ব-পাকিস্তানের জনগণ যথেষ্ট-মাত্রায় সক্ষম। পশ্চিম-পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক সরকারের আধিপত্য থেকে এই দেশকে মুক্ত করতে সাড়ে সাত কোটি বাঙালী আজ সোচ্চার ও ঐক্যবদ্ধ।

সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর স্বপ্নের স্বাধীন পূর্ব-বাংলা গঠনে ফ্রন্টের সাথে আছে আশীর্বাদ ও সমর্থন। প্রতিটি বাঙালীর অন্তরে লুকিয়ে আছে স্বাধীন পূর্ব-বাংলার স্বপ্ন।

পূর্ব-পাকিস্তানের জনগণকে ঔপনিবেশিক আধিপত্য ও পুঁজিবাদী শোষণের হাত থেকে মুক্ত করতে ফ্রন্ট তার স্বাধীনতার সংগ্রাম চালিয়ে যাবে। স্বাধীন পূর্ব-পাকিস্তান দীর্ঘজীবী হোক।

পূর্বপাকিস্তান জিন্দাবাদ

<৪,২,৪-৭>

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২। ইস্ট পাকিস্তান লিবারেশন ফ্রন্টের মুখপাত্র ‘বিদ্রোহী বাংলা’-র প্রকাশিত তথ্যাবলী ইস্ট পাকিস্তান লিবারেশন ফ্রন্ট ২১ মার্চ, ১৯৭১

 

বিদ্রোহী বাংলা

বিদ্রোহী বাংলা: পাক্ষিক পত্রিকা: ৩য় সংখ্যা: বার্মিংহামরবিবার, ২১ মার্চ, ১৯৭১

আটজন বাঙ্গালী সৈন্যের নির্মম মৃত্যু

চট্টগ্রাম ৮ই মার্চডেইলি টেলিগ্রাফে প্রচারিত আটজন বাঙ্গালী সৈন্যকেফায়ারিং স্কোয়াডকর্তৃক গুলি করিয়া হত্যা করা হয়। ঘটনার বিবরণে প্রকাশ, চট্টগ্রামে বিক্ষোভ মিছিলের উপর গুলি চালাইতে বলা হইলে ৮জন অল্প-বয়স্ক অফিসার গুলি চালাইতে অস্বীকার করে। তাহারা বলে যে নিরস্ত্র জনসাধারণের উপর গুলি চালান সৈনিকের কাজ নয়। তাদের কাজ বৈদেশিক আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করা। উক্ত প্রতিবাদের পরিপ্রেক্ষিতে চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিশেষ সামরিক কর্মকর্তা তাদেরকে প্রকাশ্য ময়দানে গুলি করিয়া মারার হুমকি দেয় এবং অনতিবিলম্বে পাঞ্জাবী ফায়ারিং স্কোয়াডের সৈন্যগণ তাদের গুলি করে হত্যা করে। পৃথিবীর ইতিহাসে এ ধরনের নজির আর কোথাও দেখা যায় না। এই শহীদ সেনানীদের রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা ছাড়া বাঙ্গালিদের আর কিছুই গ্রহণযোগ্য নয়।

পাকিস্তানি ব্যাংকগুলির দুষ্কৃতি

পুঁজিপতি শোষকদের সবচেয়ে মারাত্মক শোষণ-যন্ত্র হিসাবে কাজ করে যাচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানি ব্যাংকগুলি। ইদানিং পূর্ব পাকিস্তানের উপর অত্যাচার, হয়রানী ও হত্যার প্রতিবাদে ও আমানত খেয়ানতের ভয়ে বাঙালীগণ তাদের নিজের জমা ব্যাঙ্ক থেকে তুলতে গেলে পশ্চিম পাকিস্তানি তথা পাঞ্জাবিগণ (উচ্চ এবংনিম্নপদস্থসমবায়ে) তাদের সঙ্গে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যভাবে ব্যবহার করে এবং রীতিমত বিদ্বেষভাব প্রদর্শন করে শুধু তাই নয়, যাও অল্পসংখ্যক (নিম্নপদস্থ) বাঙালী কর্মচারী সে সমস্ত প্রতিষ্ঠানেকাজ করে তাদেরকে পরোক্ষভাবে নাজেহাল করে তাদের জীবন দুর্বিষহ করে তোলে।

এক্ষেত্রে সকল বাঙালিরই উচিত এই সমস্ত কুখ্যাত প্রতিষ্ঠানগুলোকে যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলা এবং তাদের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যে অসহযোগ করা। সবচেয়ে মজার বিষয় এই যে এর মধ্যে দু’-একজন বাঙালি তাঁবেদার এখনও সেই সমস্ত প্রতিষ্ঠানের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। মীরজাফর এখনও জন্ম নিচ্ছে। সাবধান, এদের কথায় যেন ভুল করবেন না।

আর কত দিন?

গত ১৬ই মার্চ ঢাকা থেকে প্রাপ্ত খবরে প্রকাশ, “ইয়াহিয়া-মুজিব” আলোচনার প্রাথমিক পর্যায়ে কোন প্রকার সমঝোতায় এখনও পৌঁছতে পারেননি। ইয়াহিয়ার সঙ্গে আলোচনার পর প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে আসার পথে সাংবাদিকগণ “জয় বাংলা” ধ্বনি করিয়া শেখ মুজিবকে সংবর্ধনা জানায়। কিন্তু শেখ মুজিবকে তাতে খুব প্রফুল্ল দেখায়নি। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি শুধু “আমাকে এখন জিজ্ঞেস করবেন না” বলে গাড়িতে উঠে পড়েন। গাড়ি চলতে শুরু করলে বাঙালি সাংবাদিকগণ ঘন ঘন “জয় বাংলা” ধ্বনি করিয়া শেখ মুজিবকে বিদায় সংবর্ধনাজ্ঞাপন করেন। সেনাবাহিনীর জনৈক উচ্চপদস্থ কর্মচারী জয় বাংলা ধ্বনি করিয়া ১০ বৎসরের সশ্রম কারাদণ্ডের ভয় দেখান। কিন্তু সাংবাদিকগণ তাতে মোটেই কর্ণপাত করেননি। দু’দিন আগেই হোক আর পরেই হোক জোড়াতালির পাকিস্তান আর কয়দিন।

আপোষ না সংগ্রাম (সম্পাদকীয়)

পূর্ব বাংলার জনসাধারণের এই অসহযোগ আন্দোলন নিয়ে এসেছে এক গণবিপ্লবের জয়জয়কার। এ গণবিপ্লব শুধু বাংলাদেশ আর পাকিস্তানই নয়, ভারত এবং দুরপ্রাচ্যে গণবিপ্লবের এক নতুন অধ্যায় খুলে ধরেছে।

মার্শাল এবং মিলিটারি নির্যাতন সত্ত্বেও বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলন যে গতিতে এগিয়ে চলেছে তাকে রোধ করা পাকিস্তানি পুঁজিপতি কেন সারা পৃথিবীর সাম্রাজ্যবাদীরা মিলেও রোধ করতে পারবে না।

গত ২৩ বছরের শোষণ নির্যাতন এবং বিড়ম্বনা আজ যতটা নগ্ন হয়ে পড়েছে তা বাঙালি কোনদিন কোনক্রমেই ক্ষমতা করতে পারবে না। তাই বাংলা মায়ের যোগ্য সন্তানেরা অকাতরে ঢেলে দিয়েছে তাদের তাজা কাঁচা তরুণ লাল রক্ত। তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে রূপায়িত করার জন্য বাংলার আনাচে-কানাচে আজ ধ্বনিত হচ্ছে “জয় বাংলা” বজ্রনিনাদ। বাংলার কিশোরেরা প্রস্তুত হচ্ছে মিলিটারিদের সঙ্গে লড়াই করারজন্য।তীর ধনু আর বাঁশের লাঠি নিয়ে বেরিয়ে পড়ার জন্য সার সার কাতারবন্দি হয়ে আছেনব বাংলার নতুন ক্ষুদিরাম আর তোরাব আশরাফ। কৃষাণ তৈরী হচ্ছে লাঙল রেখে, শ্রমিক আসছে কারখানা ছেড়ে, ছাত্রেরা বেরিয়ে এসেছে বিদ্যালয় থেকে। এরা সম্মিলিতভাবে আজ আওয়াজ তুলছে জুলুমের বিরুদ্ধে। এই শ্রেণিযুদ্ধে সাধারণের জয় অনিবার্য।

শোষক শ্রেণী বুঝতে পারছে তাদের পরাজয়ের কাল-কুক্ষণ থেকে দূরে নয়। আজ আমাদের এই বলিষ্ঠ পদক্ষেপকে বানচাল করার জন্য আপোষের বায়না নিয়ে হাজির হয়েছে কুচক্রী “ইয়াহিয়া”। এক্ষেত্রে আপোষ করা হবে বিপ্লবের এবং জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং তরুণদের আত্মবলির অপমৃত্যু। তাই আজ আমাদের কর্তব্য অচল-অটলভাবে আমাদের সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া। কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র ও আপামর জনসাধারণের শ্রেণীশত্রুদের নিঃশেষ ও নিশ্চিহ্ন না করা পর্যন্ত চালিয়ে যেতে হবে বিপ্লবী সংগ্রাম। সংগ্রামই মুক্তির একমাত্র পথ। “মুক্তির একই নাম-সংগ্রাম”।

________________________

সবুজ বাংলা লাল হলো

 আজিজ আল মোজাহিদ

মার্চ মাসের ৩ তারিখ বুধবার জাতীয় পরিষদের সম্মেলন শুরু হবার কথা। ১২ বছরের মিলিটারি শাসনের অবসান, উৎপীড়ন ও শোষণ শেষ হবে। জনসাধারণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা ভার নেবে জাতীয় বিভিন্নমুখী সমস্যা সমাধানের। গণতান্ত্রিক নিয়মে নির্ধারিত হবে দেশের ভবিষ্যৎ।

হঠাৎ করে পশ্চিম পাকিস্তানি নেতা ভুট্টো সাহেব ঘোষণা করলেন, তিনি অসহযোগ করবেন জাতীয় পরিষদের প্রথম বৈঠকে। কারণ ইসলামী ভ্রাতৃত্বের নামে কায়েমী স্বার্থবাদী শোষণ বোধ হয় আর সম্ভব হয়ে উঠবে না।

তাই ইয়াহিয়াকে তিনি কানে কানে বুঝালেন। বাঙালিরা এখন সংখ্যাগরিষ্ঠ। নিয়মতান্ত্রিক ভিত্তিতে এগুতে গেলে বাঙালির জয় হবে সুনিশ্চিত। বাঙালিরা ২৩ বছর থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে তাদের ন্যায্য দাবীদাওয়া এবং পাওনা থেকে।

তাই এবার তাদের পাওনা আদায় করবে কড়ায়-গন্ডায়।

শেখ মুজিব তার ছ’দফা ভিত্তিক দাবী আদায় না করে ছাড়বেন না। তাতে পাঞ্জাব রাজের শোষণনীতি ব্যাহত হয়ে পড়বে। ধসে পড়বে ঔপনিবেশিক শোষণের পথ, বন্ধ হয়ে যাবে পশ্চিম পাকিস্তানের দালান, ইমারত রাস্তাঘাট ও ড্যাম নির্মাণের কাজ।তাই যেমন করেই হোক বাংলাকে তার দাবী থেকে হঠাতে হবে বন্দুক দেখিয়ে। আর বন্দুকের বাহক পাঞ্জাবী মিলিটারির সাহায্যেচলতে থাকবে অবাধ শোষণ। ইয়াহিয়া খান ভাবলেন কথা মন্দ নয়। নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে দিয়ে যে ভুল করা হয়েছে তাকে শোধরাতে হলে এই একমাত্র পথ।

নির্বাচনের পূর্বে যে মনোভাব নিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সুযোগ দিয়েছিলেন, তা আর হয়ে উঠে নি। আশা ছিল মৌদুদী সাহেবকে দিয়ে ইসলামের দোহাই দিয়ে নির্বাচনে জয়ী হবেন। তাদের পাক্কা ২৩ বছরের অভিজ্ঞতা, বাংলার মানুষের মুখ বন্ধ রাখার একমাত্র উপায় ইসলাম। তা এবারে আর হয়ে ওঠেনি। মৌদুদীর “ইসলাম ডুবে গেল” কথার অর্থ যে কি, বাংলার জনসাধারণ তা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বুঝে নিয়েছে। ফল হলো সম্পূর্ণ উল্টো। জয়ী হলো বাংলার ছ’দফা। ছাই পড়লো বুর্জোয়া মিলিটারিগোষ্ঠী ও শোষণকারী পুঁজিপতিদের মুখে।

হেন অবস্থায় কি করা যায়? ‘পাঞ্জাব রাজ’ যে ডুবে যায়!তাই হুট করে বুদ্ধি নিলেন বন্দুক হাতে নেওয়ার। বন্দুক দেখলে বাঙালি হয়তো আর এগুবে না।

তাই বিমান ভর্তি করে আমদানি করা হলো পাঞ্জাবি মিলিটারি। পূর্ব বাংলার পথে-ঘাটে, শহরে-বন্দরে বেরিয়ে পড়ে খুনী রক্তপিপাসু নরঘাতকের দল। নারী-শিশু-পুরুষ নির্বিশেষে চালিয়ে গেল আমেরিকান বুলেট। হাজার হাজার বাঙালি রুখে দাঁড়ালো মৃত্যুভয়কে তুচ্ছ করে। সবুজ বাংলার শান্তিপ্রিয় সন্তানরা এবার বিপ্লবী হুংকারে বেরিয়ে এল রাজপথে। বিপ্লবীদের রক্তে লাল হয়ে গেল বাংলার মাটি। সবুজ বাংলা লাল হলো মিলিটারির গুলিতে। এ লালের লেলিহান রক্তিম আভায় লাল হয়ে উঠবে শুধু বাংলা নয়, সমগ্র দুরপ্রাচ্য।তা প্রতিরোধ করার চেষ্টায় ধ্বংস হয়ে যায় শোষণকারী পুঁজিপতি আর তাদের পদলেহী মানবতার শত্রু বুর্জোয়া শয়তানের দল।

হত্যার প্রতিবাদে

গত ৫ই মার্চ শুক্রবার পূর্ব পাকিস্তান লিবারেশন ফ্রন্টের সদস্যগণ পূর্ব পাকিস্তানে মিলিটারি নির্যাতন ও নৃশংস হত্যার প্রতিবাদে লন্ডনস্থিত পাকিস্তান হাই কমিশন ভবনের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। হাই কমিশনের দেওয়ালে দেওয়ালে “জয় বাংলা” “স্বাধীন বাংলা” ইত্যাদি শ্লোগান লাল কালিতে লিখে দেন।

ফ্রন্টের সদস্যদের সঙ্গে লন্ডনের কিছুসংখ্যক ছাত্র যোগদান করেন। বিক্ষোভকারীগণ পথচারীদের হাতে তাদের স্মারকলিপি প্রদান করেন। তারপর বিদেশী সংবাদপত্রের সংবাদদাতাদের উপস্থিতিতে ও BBC Television camera-এর সামনে পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা এবং ইয়াহিয়া খানের ছবি জ্বালিয়ে এই কথা ঘোষণা করেন যে,বাঙালিদের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানিদের কোন সম্পর্ক থাকতে পারে না এবং স্বাধীনতা অর্জন না করা পর্যন্ত কোনমতেই তারা সংগ্রাম থেকে পিছপা হবে না।

লন্ডনে বাঙালিদের বিক্ষোভ

বাংলাদেশে ইদানিং অবিচার, অত্যাচার এবং নরহত্যার যে যজ্ঞ শুরু করা হয় তার পরিপ্রেক্ষিতে গ্রেট ব্রিটেইন-এ বসবাসকারী বাঙালিগণ লন্ডনে এক বিরাট বিক্ষোভ মিছিলের আয়োজন করেন। এই মিছিল ৭ই মার্চ রবিবার অনুষ্ঠিত হয়।

ধর্ম, দল বা রাজনৈতিক মতামত নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর বাঙালি দশ ঘটিকা হতে GREAT BRITAIN-এর সকল প্রান্ত থেকে দলে দলে কোচ, ভ্যান, কার এবং রেলযোগ লন্ডনের হাইড পার্ক কর্নারে সমবেত হয় ও পার্কে পৌঁছবার সঙ্গে সঙ্গে জনতা “স্বাধীন বাংলাদেশ জিন্দাবাদ” “জয় বাংলা” “খুনী ইয়াহিয়ার মুণ্ডু চাই” ইত্যাদি ধ্বনি তুলে পশ্চিম লন্ডনের এই প্রান্তকে প্রকম্পিত করে তোলেন।

বিভিন্ন বক্তা বক্তৃতা করার পর জনতা পরম শৃঙ্খলার সঙ্গে পার্ক লেইন রাজপথ ধরে পাকিস্তান হাই কমিশন অভিমুখে যাত্রা করেন।

এই সময় রাস্তার সমস্ত যানবাহন বন্ধ হয়ে যায় এবং পুলিশের তত্ত্বাবধানে শ্লোগান দিতে দিতে হাই কমিশন অফিস প্রাঙ্গণে সমবেত হন।

ইতিমধ্যে দুরভিসন্ধিমূলক মনোভাব নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানি হাই কমিশনার আগে থেকে পুলিশ ডেকে বাধার সৃষ্টি করেন এবং হাই কমিশন ভবনের প্রবেশের দুই পাশের প্রবেশ পথ বন্ধ করে দেন। ফলে জনতা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন এবং পরে ‘হাই কমিশনার মহারাজ’ পুলিশ বেষ্টনি থেকে জনতাকে কিছু বলার চেষ্টা করেন।

ক্ষিপ্ত জনতা হাই কমিশনারকে ব্যানারে কাগজ এবং দন্ড ইত্যাদি নিক্ষেপ করে তার এই দুরভিসন্ধি দুষ্কর্মের প্রতিবাদ করেন। পুলিশের সঙ্গে ধস্তাধস্তির ফলে জনাকয়েক বাঙালি আহত হন এবং একজনকে হাসপাতালে পাঠাতে হয়।

Metropolitan Police সূত্রে জানা যায় যে, ইংল্যান্ডের ইতিহাসে অশ্বেতাঙ্গদের এত বড় বিক্ষোভ মিছিল এই প্রথম।

আনুমানিক দশ হাজারের অধিক বাঙালি এই মিছিলে অংশগ্রহণ করে এই কথা আবার প্রমাণ করে দিলেন যে সুদুর পাঁচ হাজার মাইলের ব্যবধানেও জননী জন্মভূমি বাংলাদেশের ডাকে বাঙালিরা বিপুলভাবে সাড়া দিয়েছে। _______________________________________________________________

বিদ্রোহী বাংলা। পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীনতা ফ্রন্ট কর্তৃক,৭১ রাইট স্ট্রিট থেকে প্রকাশিত।বার্মিংহাম-১০, টেলিফোনঃ ০২১-৭৭২-৮৩২৭ এবং ০২১-৭৭২-৭২৪৮ : সম্পাদক সেলিম আহমাদ, এ.ইসমাইল এবং দিপু।

<৪,৩,৮>

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩। বাংলাদেশে পাকিস্তানি  সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদে এবং স্বাধীনতার আহ্বানে শপথ সভার প্রচারপত্র। ‘জয় বাংলা’ বাংলাদেশ এ্যাকশন কমিটি। ২৮ মার্চ, ১৯৭১

জয় বাংলা

শপথ সভা,২৮শে মার্চ রবিবার,

স্মলহিথ পার্ক,বার্মিংহাম,বেলা ২ ঘটিকা

স্বাধীন বাংলাদেশের উপর বর্বর হামলা চালাচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানি মিলিটারি। নরঘাতক রক্তপিপাসু পশ্চিম পাকিস্তানি সাম্রাজ্যবাদীরা আমাদের নবঘোষিত স্বাধীন সোনার বাংলাদেশকে ধ্বংস করার হীন ষড়যন্ত্রে মরিয়া হয়ে উঠেছে।

তাদের আক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য এসেছে বাংলার নর-নারী আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা; রক্তগঙ্গা বয়ে যাচ্ছে প্রতিটি শহর, বন্দর এবং গ্রামে। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ কামান, বন্দুক আর বোমার সামনে প্রাণ দিয়ে চালিয়ে যাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ। “বাংলাদেশ” আর তার সাড়ে সাত কোটি লোককে বাঁচাতে হলে চাই অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ- আর তার জন্য চাই আপনার সাহায্য। আসুন শপথ সভায় যোগ দিয়ে আমাদের এই জীবন-মরণ সংগ্রামকে সার্থক করে তুলি। আসুন, এই সভাতে দলে দলে যোগ দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে বাংলার এই স্বাধীনতা আন্দোলনকে শক্তিশালী করে তুলুন।

আহ্বায়ক

বাংলাদেশ এ্যাকশন কমিটি

জয় বাংলা!!

____________________________

<৪, ৫, ৯>

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৪। স্বাধীন বাংলা স্বাধীনতা সংগ্রামের ওপর বুলেটিন বাংলাদেশ এ্যাকশন কমিটি ৩ এপ্রিল, ১৯৭১

স্বাধীন বাংলা

সংক্ষিপ্ত সংবাদ

(রোজ মঙ্গলবার ৩রা এপ্রিল ১৯৭১ সন)

৬টি শহর মুক্তিসেনার হস্তগত

সর্বশেষ সংবাদে জানা গেছে যে সিলেট, ময়মনসিংহ, যশোর, রংপুর, রাজশাহী ও খুলনা মুক্তি বাহিনী নরঘাতক ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনীকে তাড়িয়ে দিয়ে নিজের আয়ত্তে এনেছে।

যশোরে আমাদের মুক্তিসেনা শত্রুদের একটি বিমানধ্বংসী কামান ও ১০০ মেশিনগান দখল করে নিয়েছে। মুক্তিসেনার আক্রমণে  শত্রুপক্ষ যশোর থেকে ৪ মাইল দূরে আশ্রয় নিয়েছে। খবরে আরও জানা গেছে যে কুমিল্লা প্রায় মুক্তিসেনার হস্তগত। সেখানে প্রায় ৩০০ পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য ও ৫০০ মুক্তিযোদ্ধা মারা গিয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।

সিলেটে ১০০ ছাত্রের মৃত্যু

রক্তপিপাসু পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা একটি ছাত্রাবাসের উপর রাত্রি অন্ধকারে গুলিবর্ষণ করে ১০০ ছাত্রকে নির্মমভাবে ঘুমন্ত অবস্থায় হত্যা করে।

পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্র কর্তৃক পাকিস্তানের নিন্দা

রাশিয়া, জাপান, জাম্বিয়া ও কেনিয়া বাংলায় এ নৃশংস হত্যাকান্ডের তীব্র নিন্দা করেন। সিনেটর কেনেডি মার্কিন সরকারকে অনুরোধ করেছেন যেন পাকিস্তানে সামরিক ও বেসামরিক সর্ব প্রকার সাহায্য বন্ধ করে দেওয়া হয়।

শত্রুসৈন্যদের খাদ্য সংকট

বাংলাদেশে খুনী ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনী এক বিরাট খাদ্য সংকটেরসম্মুখীন বলে জানা গেছে। কোন বাঙালি তাদের খাদ্য সরবরাহ করছে না।

একটি আবেদন

বাংলাদেশ এ্যাকশন কমিটির RADIO MONITOR SERVICE থেকে প্রাপ্ত আবেদন হুবহু প্রকাশ করেছিঃ “বাংলার মুক্তিযোদ্ধারা আপ্রাণ যুদ্ধ করে যাচ্ছে।

পৃথিবীর সকল জাতির কাছ থেকে বিশেষ করে প্রবাসী বাঙ্গালীদের কাছে আমার আবেদন- অস্ত্রশস্ত্র, খাদ্যসামগ্রী ও সাহায্য পাঠাও”।

শেষ সংবাদ

১) জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল উ থান্ট পাকিস্তান থেকে সমস্ত জাতিসংঘের কর্মচারী অপসারণের আদেশ দিয়েছেন এবং পাকিস্তানে যে ১১টি উন্নত পরিকল্পনায় জাতিসংঘের সাহায্য ছিল তার কাজ বন্ধ করে দিয়েছেন।

২) বাংলাদেশে ১২টি শহরের উপর ভীষণভাবে বোমাবর্ষণ করেছে বলে সংবাদ পাওয়া গেছে। তাতে হতাহতের সংখ্যা ১ লক্ষের অধিক হবে বলে অনুমান করা হয়।

প্রচার দফতর, বাংলাদেশ এ্যাকশন কমিটি।

৫২ ওয়ার্ড সওয়ার্থ রোড, স্মলহিথ বার্মিংহাম।

<৪,৫,১০>

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৫। বৃটিশ এমপি কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সমর্থন এবং সাহায্যের আশ্বাস ইস্ট পাকিস্তান এসোসিয়েশন এ আর খানের প্রতি বৃটিশ এমপি-র চিঠি ৩ এপ্রিল,১৯৭১

লোকসভা

লন্ডন, এস ডব্লিউ আই

ফ্র্যাংকজুড এমপি

৩রাএপ্রিল ১৯৭১

জনাব খান

আপনি এবং আপনার বন্ধু পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাসমূহ সম্পর্কে আমার কাছে উদ্বেগ প্রকাশ করায় আমি খুবই খুশি হয়েছি। আমিও আপনাদের উদ্বেগের ভাগীদার।কোনোরকম দ্বিধা না করে যেকোনো সময় আমাকে সাহায্যের কথা জানাবেন এবং তার জন্য আমি আপনাদের চিঠির অপেক্ষায় থাকব।

আপনার অনুগত

এস/ডি

আশা করি আপনাদের সমাবেশ সফল হয়েছে।

জনাব খান

পূর্ব পাকিস্তান এসোসিয়েশন

৬ ব্রিটানিয়া রোড

পোর্টসমাউথ।

<৪,৬,১১>

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৬।স্বাধীন বাংলাদেশের সমর্থনে ও স্বীকৃতির দাবীতে সারা বৃটেনে সভা ও শোভাযাত্রার আহবান

বাংলাদেশে ছাত্র সংগ্রাম

পরিষদের প্রচার পত্র

৩ এপ্রিল, ১৯৭১

স্বাধীন বাংলাদেশের সমর্থনে

এবং

স্বাধীন বাংলার স্বীকৃতির দাবীতে

বৃটেনের সকল শহর, বন্দর ও নগরে আগামী ৪ঠা এপ্রিল রবিবার

সভা ও শোভাযাত্রা করুন

লন্ডনে আগামী ৪ঠা  এপ্রিল রবিবার বেলা দেড়টায় হাইড পার্ক স্পিকার্স কর্নারে দলে দলে জমায়েত হউন। আপনার দেশের স্বীকৃতির দাবীর জন্য বজ্রকন্ঠে আওয়াজ তুলুনঃ আমার দেশ তোমার দেশ- বাংলাদেশ বাংলাদেশ। শোভাযাত্রা করে বৃটিশ সরকার এবং বিভিন্ন দেশের দূতাবাসে গিয়ে স্বাধীন বাংলার স্বীকৃতির দাবী জানান।

বাংলাদেশ ছাত্র পরিষদের পক্ষ থেকে ৩৬ গ্যামেজেস বিল্ডিং, ১২০ হবোর্ন ইসি-১ থেকে প্রকাশিত ও প্রচারিত। টেলিফোনঃ ০১-৪০৫-৫৯১৬/৭

                     _______________________

<৪,৭,১২>

শিরোনাম সুত্র তারিখ
৭। শেখ মুজিবুর রহমান এর গ্রেফতারের খবর এবং কমন্স সভার সদস্যগণ কর্তৃক পাকিস্তানের যুদ্ধ বিরতির আহবান সম্পর্কিত তথ্য জনাব এ আর খানের প্রতি ব্রিটিশ এমপি-র চিঠি ৬ এপ্রিল, ১৯৭১

এমপি ফ্রাঙ্কজুডের পক্ষ থেকে

                                                                                      ৬ এপ্রিল, ১৯৭১

জনাব খান,

গত সপ্তাহে আপনি আমার সাথে দেখা করতে এসেছিলেন, এতে আমি আনন্দিত এবং আপনার পাঠানো ৫ এপ্রিলের চিঠিটি, যেটি আমি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রির কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি, সেটির জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে আজ আমি আপনাকে লিখছি।

আপনি জেনে হয়ত খুশি হবেন যে, ইতিমধ্যে পাকিস্তান হাইকমিশনের একটি চিঠি তদন্তাধীন আছে এবং তিনি লিখেছেন:

“কিছুদিন আগে শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকায় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক গ্রেফতার হয়েছিলেন এবং বর্তমানে তাকে হেফাজতে রাখা হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে পত্রিকায় আসা প্রতিবেদনগুলো এই পরিস্থিতির বিপরীত এবং অসত্য”।

এছাড়াও গতকাল সকালে হাউস অফ কমন্সে বিপুল সংখ্যক স্বাক্ষরসহ একটি প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়েছিল এবং সরকারের প্রতি আমার আহ্বান ছিল পাকিস্তানে একটি অস্ত্র বিরতি সংঘঠিত করার।

                                                                                               বিনীত

       এস ডি/-

জনাব এম এ রাজ্জাক খান

৬ ব্রিটানিয়া রোড

সাউথসি

পোর্টসমাউথ

_________________________

<৪,৮,১৩>

শিরোনাম সুত্র তারিখ
৮। বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতি সমর্থন এবং গণহত্যা ও বুদ্ধিজীবী নিধনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের আহ্বান জানিয়েবৃটিশ বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের সদস্যদের প্রতি বাংলাদেশের শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবীদের বিবৃতি বাংলাদেশের এ্যাসোসিয়েশন স্কটল্যান্ড প্রকাশিত প্রচারপত্র ৪ এপ্রিল, ১৯৭১

ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সদস্যদের প্রতি একটি নিবেদন

প্রিয় সহযোগীবৃন্দ,

প্রতিটি দিন অতিবাহিত হওয়ার সাথে সাথে আরও অসংখ্য নাম আমাদের সেইসব সহযোগীদের নামের তালিকায় যোগ হচ্ছে যারা বাংলাদেশ (প্রাক্তনপুর্ব পাকিস্তান) এ পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক গনহত্যার শিকার। সম্প্রতি ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত প্রত্যক্ষ প্রতিবেদনসমূহে নিম্নলিখিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বৃন্দের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা নিশ্চিত হয়েছে: বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ইন্নাস আলি, ইন্সটিটিউট অফ পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট মেডিসিনের পরিচালক অধ্যাপক নুরুল ইসলাম, দর্শন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক জিসি দেব, ইংরেজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক এস মুর্শেদ, পরিসংখ্যান বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মনিরুজ্জামান,  ইসলামের ইতিহাস বিভাগের প্রধান অধ্যাপক হাবিবুল্লাহ, বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ডঃ এ শরীফ, রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জনাব এ রাজ্জাক, পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের গবেষক ডঃ জে ঠাকুরদা, পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক জনাব এ ভট্টাচার্য, গণিত বিভাগের প্রভাষক জনাব এস আলি। তাছাড়া আরও হাজার খানেক ছাত্র এই হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে বলে আশংকা করা হচ্ছে।

সন্দেহের অবকাশ নেই যে, এই ঘটনা একটি বড় শোকাবহ ঘটনার অংশ মাত্র যার পূর্ণ রূপ এখনও উন্মোচিত হওয়ার অপেক্ষায়।

বুদ্ধিজিবীদের মেরে ফেলার জন্য এই সংগঠিত রাজনৈতিক এই হত্যাকাণ্ডের গুরুত্ব ও ধরণ বিবেচনায় এনে আমরা দেশে আমাদের সহযোগীদের কাছে এই হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে তাদের প্রতিবাদ জানানোর অবশ্য প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি।

                                                                                              বিনীত

                                                    স্কটল্যান্ডে উচ্চশিক্ষারত ঢাকা, চট্টগ্রাম

                                                           ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট

       কলেজসমূহের সদস্যকর্মীবৃন্দ

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন

স্কটল্যান্ড

১৫ এল্ডনস্ট্রীট

গ্লাসগো, সি৩

১৪.৪.১৯৭১

<৪,৯,১৪>

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৯। বাংলাদেশে গণত্যার প্রতিবাদ ও স্বাধীনতার প্রতি সমর্থনের জন্য চার্চসমুহের প্রতি বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন, স্কটল্যান্ড সভাপতির আহ্বান প্রচারপত্র

এপ্রিল,

১৯৭১

চার্চসমুহের প্রতি নিবেদন

বাংলাদেশ ( প্রাক্তন পূর্ব পাকিস্তান) থেকে প্রেরিত সকল প্রত্যক্ষ প্রতিবেদন স্বনামে নিশ্চিত করেছে যে, পরিস্থিতি সেখানে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। হাজার হাজার মানুষ পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাদের হাতে নিহত হয়েছে এবং লাখ লাখ মানুষ অনাহারে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে। পূর্ব পাকিস্তানে ঘূর্ণিঝড় সংক্রান্ত সহায়তার জন্য বৃটিশ ত্রাণ সমন্বয়ক ইয়ান ম্যাকডোনাল্ডের মতে,

“পনের লাখ মানুষ বর্তমানে অনাহারে রয়েছে (অথবা বলা যায় যে, তারা সপ্তাহ খানেকের মধ্যে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়বে যদিনা বাহিরের দেশ থেকে সাহায্য তাদের কাছে না পৌঁছায়)। এরাহল সেই সম্পূর্ণ নিঃস্ব মানুষরা, যারা গত বছরের ঘূর্ণিঝড় থেকে বেঁচে ফিরেছিল এবং যারা সম্পূর্ণভাবে বাহিরের ত্রাণের উপর নির্ভরশীল যখন দেশের বাকি অংশের শস্য নষ্ট হয়ে যায়, আরও ত্রিশ লাখ মানুষ এই দুর্দশাপুর্ণ অবস্থার মুখে পড়বে। তারাও সম্পূর্ণ রূপে বাহিরের ত্রাণের উপর নির্ভর করতে শুরু করবে এবং এই ত্রাণ তাদের কাছে পৌছাতে ব্যর্থ হলে তারাও কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাসের মধ্যে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়বে.”……… (দ্য পিস নিউজ, এপ্রিল ২৩, ১৯৭১)

পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের এই পরিস্থিতি সমাধানের জন্য কোন উদ্দেশ্য নেই। আন্তর্জাতিক রেড ক্রসকে বাংলাদেশে প্রবেশের অনুমতিও দেয়া হয়নি। পাকিস্তান সরকার কি অনাহারের মাধ্যমে নতি স্বীকার করানোর চেষ্টা করছে?  সমস্ত সাক্ষ্য প্রমাণ সে কথাই বলছে।

সুতরাং, আমাদের সবার জন্য একমাত্র সমাধান হল একটি আন্তর্জাতিক ত্রাণ উদ্যোগ স্থাপন করা যা পাকিস্তানি সরকার আপত্তি করবে না বা করার সাহস করবে না। কোন সন্দেহ নেই যে, আপনাদের তত্ত্বাবধানে চালিত ত্রাণ সংস্থা সবার আগে এগিয়ে এসে এই পরিস্থিতিকে প্রতিহত করবে। কিন্তু সময় ক্ষেপণ করলে অনেক বেশি দেরি হয়ে যাবে।

আমরা আশাবাদী যে, আপনাদের সংগঠনের প্রত্যেক সদস্যের একটি তড়িৎ প্রচেষ্টা বাংলাদেশের জনগণকে ভয়াবহতা ও মৃত্যু থেকে বাঁচাতে সক্ষম হবে।

১৫ এল্ডনস্ট্রীট

গ্লাসগো,সি ৩

টেলিফোনঃ ০৪১-৩৩-৬৫৭৯

                                                                                                   সভাপতি

                                                                                       বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন

                                                                                                  স্কটল্যান্ড

<৪,১০,১৫>

শিরোনাম সুত্র তারিখ
১০। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সমর্থনের জন্য বৃটিশ জনগণের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন, স্কটল্যান্ডের আহ্বান প্রচারপত্র ১৬ এপ্রিল, ১৯৭১

বৃটিশ জনগণের প্রতি একটি নিবেদন

আপনারা জেনে থাকবেন যে, ১৯৪৭ সালে সাবেক বৃটিশ ইন্ডিয়ার সময়কালে পাকিস্তান হাজার মাইলের ব্যবধানে দুই ভাগে বিভক্ত হয়েছিল যেটি সম্ভব হয়েছিল ১৯৪০  সালে  গৃহীত লাহোর প্রস্তাব দ্বারা, যেখানে বলা হয়েছিল,“…… যেসব এলাকায় মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, যেমন ভারতের উত্তর-পশ্চিমাংশ ও পূর্বাংশ, সেসব একত্রিত হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করবে যেখানে সংগঠনকারী একক গুলো হবে স্বায়ত্তশাসিত ও সার্বভৌম”।

১২ কোটি পাকিস্তানীর মধ্যে সাড়ে সাত কোটি মানুষ পূর্ব পাকিস্তানের, যারা শুরু থেকেই বেসামরিক বা সামরিক পশ্চিম পাকিস্তানি সরকারের কর্তৃক সকল প্রকার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে যাতে সরকার পূর্ব পাকিস্তানে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শোষণ বজায় রাখতে পারে।

শেখ মুজিব, যিনি গত ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনের পর জাতীয় সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে উদিত হয়েছিলেন, তাকে পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক জান্তা কর্তৃক সরকার গঠন করতে দেয়া হয়নি যেহেতু মুজিবের পাকিস্তানের ভাবাদর্শের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ৬ দফা কর্মসূচিরউদ্দেশ্য ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি শোষণের অবসান ঘটানো। সাড়ে সাত কোটি মানুষের গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত কে সম্মান জানানোর পরিবর্তে বর্বর সামরিক জান্তা বাংলায় বন্দুক,ট্যাংক, কামান ও যুদ্ধবিমান পাঠাল হাজার হাজার শিশু, নারী ও পুরুষকেতাদের বাড়িতে,রোগীদের হাসপাতালে ও ছাত্রদের তাদের ছাত্রাবাসে হত্যা করার জন্য।

বাংলায় এখন যে গণহত্যা সংঘটিত হচ্ছে সেটি মানবতা ও মানবজীবনের বিরুদ্ধে অপরাধ এবং এই গণতন্ত্রের আসন থেকেআমরা  আপনাদের কাছে নিবেদন করছি বাংলাদেশের মানুষদের গণতান্ত্রিক উপায়ে জীবনযাপন করার জন্য তাদের এই সংগ্রামে সমর্থন প্রদান করার।

                                                                                  বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন

                                                                                             স্কটল্যান্ড

<৪,১১,১৬-১৭>

অনুবাদকঃ মুশররাত আলম মৌ

শিরোনাম সুত্র তারিখ
১১। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সমর্থন এবং শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনরক্ষার প্রচেষ্টা চালানোর জন্য মার্কিন সিনেটরদের প্রতি ব্রিটেন-বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্টের আহ্বান বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্টের সভাপতির চিঠি ১৬ এপ্রিল, ১৯৭১

বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্ট

                                                                          ১০, লিচেস্টারগ্রোভ

লিডস ৭

যুক্তরাজ্য

                                                                         ১৬ এপ্রিল, ১৯৭১

মাননীয় সিনেটর,

যুক্ত্ররাষ্ট্র সরকার বাংলাদেশ (প্রাক্তনপূর্ব পাকিস্তান)-এর পরিস্থিতির প্রতি যে উদ্বেগ জানিয়েছে তা আমরা কৃতজ্ঞতার সাথে স্বীকার করছি। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সংগে জানাচ্ছি যে, পশ্চিম পাকিস্তানি বর্বরেরা আমাদের নিরাপরাধ ও নিরস্ত্র জনসাধারণের বিরুদ্ধে আপনাদের সরবরাহকৃত কামান ও বিমান ব্যবহার করছে। আমরা সবসময়ই যুক্ত্ররাষ্ট্রকে মুক্তি ও গণতন্ত্রের রক্ষক হিসেবে বিবেচনা করে এসেছি, কিন্তু আমরা আমাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য এই পর্যন্ত আপনাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত সহযোগিতার পরিমাণ বিবেচনা করে আমরা কিছুটা হতাশ।

তা সত্ত্বেও, এ ধরণের পরিস্থিতিতে যেসব কূটনৈতিক সমস্যার উদ্ভব হয়, তা আমরা উপলব্ধি করতে পারছি। কিন্তু এটাও আমরা জানাতে চাই যে, বাংলাদেশের উত্থান শুধু কষ্টসাধ্যই নয়, ব্যতিক্রমীও ছিল। আমরা ধারণা করছি আপনারা জানেন যে, পাকিস্তান আন্দোলনের ভিত্তি ছিল ১৯৪০ সালে উত্থাপিত লাহোর প্রস্তাব যেখানে বলা হয়েছে,

“অখণ্ড ভারত মুসলিম লিগের এই অধিবেশনের নির্ণীত ও বিবেচিত সিদ্ধান্ত অনুসারে কোন সাংবিধানিক পরিকল্পনা এই দেশে কাজ করবে না বা মুসলিম লীগের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না যতক্ষন না পর্যন্ত এটি নিম্নলিখিত কিছু মূলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিতহয় যেমন  ভৌগোলিকভাবে সংলগ্ন এলাকাগুলোকে সীমানা নির্ধারণ করে প্রদেশ অনুসারে গঠন করা উচিৎ প্রয়োজন অনুসারে এলাকাভিত্তিক পুনঃসমন্বয়ের মাধ্যমে। যে সকল অঞ্চল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ, যেমন ভারতের উত্তর-পশ্চিমাংশ ও পুর্বাংশ, তাদেরকে একত্র করে স্বাধীন রাজ্য গঠন করা উচিৎ যেখানে গঠনকারী এককগুলো হবে সার্বভৌম এবং স্বায়ত্তশাসিত।

ব্রিটিশ ভারত বিভাগের পরবর্তী সময়ে পশ্চিম পাকিস্তান খেয়ালমাফিকধারণা করে নিয়েছিল যে, লাহোর প্রস্তাবে দুই রাজ্যের সংস্থান একটি মুদ্রণজনিত ভুল এবং বাংলাদেশের উপর ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থা চাপিয়ে দিয়েছিল। যাইহোক, আমরা ধারণা করে নিয়েছিলাম যে, এই বিষয়টি গণতান্ত্রিকভাবে সমাধান করা সম্ভব। কিন্তু বিগত ২৩ বছর ধরে পাঞ্জাবিরা সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণ করেছে, আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে এবং যখন আমরা সর্বোপরি একটি সাধারণ নির্বাচনের জন্য জোর দিয়েছিলাম তখনই তারা তাদের আসল কদর্য রূপটি প্রকাশ করল। এখন এটি পরিষ্কার যে, এই পশ্চিমা অভিজাতরা স্পষ্টতই আসল ইংরেজদের চেয়ে  নিজেরা অধিকতর ইংরেজ। তারা কখনই গণতন্ত্র বা গণতান্ত্রিক সরকারের সংখ্যা গরিষ্ঠতার অধিকারকে বিশ্বাস করেনি (সংযুক্তি ‘ক’ দেখুন)।

অতএব, আগের রূপেই পাকিস্তানের অস্তিত্বের ব্যাপারে কোনরূপভ্রান্তি থাকা ঠিক হবে না। লাহোর প্রস্তাব দুইটি প্রদেশের পরিকল্পনা করেছিল; পাকিস্তানের মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তি বাঙালিদের উপর পাঞ্জাবি গণহত্যার মাধ্যমে সমাপ্ত হয়েছে এবং সেই সমস্ত মানুষদের কাছ থেকে গণতান্ত্রিক নিয়মকানুন আশা করার সম্ভাবনাও নেই যারা জন্মগত, প্রথাগত ভাবে সামন্তবাদী ও স্বৈরতান্ত্রিক ভাবে বেড়ে উঠেছে।

আমাদের নিবেদন থাকবে এটি উপলব্ধি করার যে, ইয়াহিয়ার চেয়ে মুজিবের বাংলাদেশের অনেক বেশি বৈধতা আছে (সংযুক্তি ‘খ’ দেখুন)।এবং বাংলাদেশকে অতিসত্বর একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করারও।

আমরা আমৃত্যু ইয়াহিয়ার বর্বর সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়ে যাব। আমরা জানি বিজয় আমাদের হবেই। আমরা আত্ববিশ্বাসী যে, আজ হোক বা কাল,এক সময় না এক সময় আমরা আপনাদের সরকারের সমর্থন পাবই। কিন্তু আমরা শংকিত যে, আমাদের আত্মসংকল্পের তোড়জোড় ইয়াহিয়াকে পাগল করে দিয়েছে। সে এখন আমাদের জনগণের উপর বোমা বর্ষন করছে,গ্রামগঞ্জ আগুনে পুড়িয়ে দিচ্ছে এবং আমাদেরকে দুর্ভিক্ষ ও মহামারীর হুমকি দিচ্ছে। আপনাদের সময়োচিত সমর্থনই পারে আমাদের হাজার জনগণকে রক্ষা করতে এবং আমাদেরকে সেই দেশ গড়ার মুল্যবান সময়টুকু দিতে পারে, যার ভিত্তি হবে আমাদের সযত্নে লালিত মূল্যবোধগুলোঃ গণতন্ত্র, সমানাধিকার ও ধর্মীয় সহিষ্ণুতা।

অনুমতি প্রদান করুন আমাদের আশু কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য এই নিবেদনের সমর্থনে ব্রিটিশ প্রেসের পক্ষ থেকে কিছু সম্পাদকীয় মন্তব্য আপনাদের কাছে উদ্ধৃত করার জন্য (সংযুক্তি গ, ঘ, ঙ, চ দেখুন)। আমরা বিশ্বাস করি সাড়ে সাত কোটি বাঙালির কণ্ঠআপনাদের হৃদয় স্পর্শ করবে এবং ধ্বংসের আগেই আমরা আপনাদের সমর্থন পাব।

যদিওবাএত শীঘ্রই বাংলাদেশের এই স্বীকৃতিকে কূটনৈতিকভাবে আপনাদের কাছে দুরূহ মনে হয়, তবুও অন্ততপক্ষে এইটুকু নিশ্চিত করবেন আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান যাতে হত্যার শিকার না হন এবং অনুগ্রহ করে ইয়াহিয়া খানকে চাপ প্রয়োগ করুন আওয়ামী লীগের মাধ্যমে রাজনৈতিক সমঝোতায় আসতে, যাতে জনগণের রায় আছে। অনুগ্রহ করে আরও নিশ্চিত করুন যেন অতিসত্বর পশ্চিম পাকিস্তানে সকল প্রকার সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য পাঠানো বন্ধ হয় এবং বাংলাদেশে ত্রাণসামগ্রী প্রেরিত হয়।

                                                                                          আপনার অনুগত                                                             এম এম হক                                                                                                  বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্টের পক্ষ থেকে

<৪,১২,১৮-২০>

অনুবাদকঃ মুশররাত আলম মৌ

শিরোনাম সুত্র       তারিখ
১২। বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধের প্রচেষ্টা এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সমর্থন দানের জন্য ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্যদের প্রতি বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্টের আহ্বান বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্টের সভাপতির চিঠি ১৬ এপ্রিল, ১৯৭১

সম্মানিত সংসদ সদস্য,

বাংলাদেশে (প্রাক্তন পূর্ব পাকিস্তান) পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যদের নজিরবিহীন গণহত্যা চালানোর ঘটনায় ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ও জনগণ যে স্বতস্ফুর্ত নিন্দা জ্ঞাপন করেছে, তা আমরা গভীর কৃতজ্ঞতার সাথে স্বীকার করছি। পুরো ঘটনা থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, এই ঘটনা পুর্ব পরিকল্পিত ও তা নিখুঁতভাবে সম্পন্ন করা হচ্ছে। ব্রিটিশ সরকার এই পরিস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনা করে যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, এতে আমরা কৃতজ্ঞ এবং আমরা এই সুযোগকে আমাদের মত প্রকাশ করার উপায় হিসেবে নিয়ে প্রয়োজনীয় এবং যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানাই –

(ক) অতিসত্বর নিরস্ত্র এবং বেসামরিক জনগণকে হত্যার অবসান,

(খ) অতিসত্বর আক্রান্ত জনগণের এবং আসন্ন দুর্ভিক্ষকে প্রতিরোধের জন্য ত্রাণ সরবরাহের ব্যবস্থা করা,

(গ) সার্বভৌম ও স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি,

বাংলাদেশের পরিস্থিতি বিয়াফ্রার থেকে ভিন্ন

(i) ২৩ মার্চ, ১৯৪০ এর ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবই ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের মূল ভিত্তি। এই প্রস্তাবে বলা হয়েছে,

“অখণ্ড ভারত মুসলিম লিগের এই অধিবেশনের নির্ণীত ও বিবেচিত সিদ্ধান্ত অনুসারে কোন সাংবিধানিক পরিকল্পনা এই দেশে কাজ করবে না বা মুসলিম লীগের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না যতক্ষন না পর্যন্ত এটি নিম্নলিখিত কিছু মূলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত না হয়, যেমন ভৌগোলিকভাবে পার্শ্ববর্তী এলাকাসমূহকে সীমানা নির্ধারন করে প্রদেশ অনুসারে গঠন করা উচিৎ প্রয়োজন অনুসারে এলাকাভিত্তিক পুনঃসমন্বয়ের মাধ্যমে। যে সমস্ত অঞ্চল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ, যেমন ভারতের উত্তর-পশ্চিমাংশ ও পুর্বাংশ, তাদেরকে একত্র করে স্বাধীন রাজ্য গঠন করা উচিৎ, যেখানে গঠনকারী এককগুলো হবে সার্বভৌম এবং স্বায়ত্তশাসিত।

লাহোর প্রস্তাব অখণ্ড ভারত মুসলিম লীগের সাধারণ দল কর্তৃক পাস করা হয়েছিল। এই প্রস্তাব সাংবিধানিকভাবে সংশোধিত হয়নি। প্রস্তাবিত পাকিস্তানের পক্ষে নির্বাচনী পরিষদের নব নির্বাচিত সদস্যদের একটি পৃথক সভায়, জনাব জিন্নাহ কর্তৃক বিধিবহির্ভূতভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, “স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ” একটি মুদ্রণজনিত ভুল এবং বাংলা মুসলিম লীগের সম্পাদক জনাব আব্দুল হাকিমের প্রতিবাদ সত্ত্বেও এই সিদ্ধান্ত বাংলার উপর চাপিয়ে দেয়া হয়।

(ii) যাই হোক, আশা করা হয়েছিল যে, পুরনো এই বিষয়টির গতিবিধি সম্পর্কে নির্বাচনী পরিষদ সিদ্ধান্ত নেবে এবং এই বিষয়ে জনগণের মতামত নির্ধারণের জন্য একটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আপনাদের জানা আছে বলে আমরা ধারণা করছি যে, পাঞ্জাবনিয়ন্ত্রিত সামরিক ও বেসামরিক আমলা তন্ত্র এই দেশে বিগত ২৩ বছরে কোন মুক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে দেয়নি (প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল ১৯৫৯ সালে, কিন্তু ১৯৫৮ সালে সামরিক সরকার ক্ষমতা দখল করে)।

(iii) সামরিক সরকার শেষ পর্যন্ত ১৯৭০-৭১ সালে সাধারণ নির্বাচন করতে বাধ্য হয়। বাংলাদেশ থেকে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সাধারণ পরিষদের সদস্যদের অধিকার ছিল পাকিস্তান আন্দোলনের মূল ভিত্তি লাহোর প্রস্তাবের উপর ভিত্তি করে দেশ কে একটি সংবিধান প্রদান করার। এই গণতান্ত্রিক বৈঠককে গ্রহণ করার পরিবর্তে বাংলাদেশের জনগনের গণতান্ত্রিক অধিকারকে গলা টিপে হত্যা করার জন্য পাঞ্জাবনিয়ন্ত্রিত সামরিক সরকার গণহত্যায় নিয়োজিত হল।

বাংলাদেশ এবং পশ্চিম পাকিস্তানদুটি ভিন্ন মানবসভ্যতা

(i) পশ্চিম পাকিস্তানি জনগণ নিজেদের আর্য বংশোদ্ভূত দাবি করে নিজেদের জাতিগতভাবে শ্রেষ্ঠ মনে করে এবং বাংলাদেশের জনগণকে জাতিগত ও সাংস্কৃতিকভাবে নিকৃষ্টতর জীব হিসেবে বিবেচনা করে উপেক্ষা করে। সাবেক রাষ্ট্রপতি আইয়ূব খান পুর্ব পাকিস্তানিদের ব্যাপারে যা লিখেছেন সেখান থেকে এই বিষয়টি প্রত্যক্ষ করা যায়। তার মতে, পুর্ব পাকিস্তানিরা কখনো প্রকৃত স্বাধীনতা বা সার্বভৌমত্বের স্বাদ পায় নি, তাদের মধ্যে আছে পদদলিত জাতির প্রশমন এবং তারা এখনও এই সদ্যোপ্রাপ্ত স্বাধীনতার সাথে মানসিকভাবে খাপ খাইয়ে নিতে সমর্থ হতে পারে নি। (আইয়ূব খান, ফ্রেন্ডস নট মাস্টার্স, ১৯৬৭,পৃ-১৮৭)

সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যার প্রতি সংখ্যালঘু পশ্চিম পাকিস্তানিদের এই আচরণ শুরু থেকেই এমন ছিল।  কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে প্রকৃত ঘটনা সম্পূর্ণ ভিন্ন।

ক) বাঙালি মুসলিমরা ১২০১ সাল থেকে ১৭৫৭ সাল পর্যন্ত  দিল্লির মুসলিম শাসকদের থেকে অনেকটাই স্বাধীনভাবে বাংলা ও আসাম, বিহার ও উড়িষ্যার উল্লেখযোগ্য অংশ শাসন করেছেন।

খ) মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলোর মধ্যে বাঙালি মুসলিমরা ছিলেন প্রথম যারা  ব্রিটিশ ভারতে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করেছিলেন।

গ) বাঙালি মুসলিমরা পাকিস্তান আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন যখন পাঞ্জাবিরা শিখদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছিল এবং তাদের ঈষদুষ্ণ সমর্থন ছিল এই আন্দোলনে এবং সীমান্তে স্বাধীনতার পরেও কংগ্রেসের পতাকা উড্ডয়ন করা হয়েছিল।

(ii) যাই হোক, এটি কোন আশ্চর্যের বিষয় নয় যে, পশ্চিম পাকিস্তানিরা পুর্ব পাকিস্তানিদের সম্পর্কে ভিন্নমত পোষণ করে। পুরো এলাকা মূলত কিছু জমিদারদের মালিকানাধীন এবং তারা শুধু সেখানকার জমিই নয়, অধিবাসীদেরও মালিক (সিন্ধু এলাকায় ৮০ শতাংশ জমি সামন্তবাদি জমিদারদের অধীনস্থ; পাঞ্জাব ও সিন্ধু এলাকায় এই অনুপাত ৫০ শতাংশ)। তাদের মূল্যবোধ স্বাভাবিকভাবেই সামন্তবাদী এবং তাদের সমাজ কিছু সামন্তবাদী নিয়মাবলি দ্বারাই সমর্থিত (পাঞ্জাবে বর্ণপ্রথা ও সীমান্তের গোষ্ঠীগত রীতিনীতি)। পশ্চিম পাকিস্তানে গণতন্ত্র মূল্যহীন যেহেতু সেখানে ভোট নিয়ন্ত্রিত হয় জমিদারদের এবং ধর্মীয় নেতাদের দ্বারা (ভুট্টো নিজে একজন বড় জমিদার এবং  পাঞ্জাবে তিনি তার অধিকাংশ ভোট পেয়েছিলেন পাঞ্জাবি জমিদারদের সাথে আপোষ-আলোচনার মাধ্যমে। পাগারোর পীর একাই প্রায় চল্লিশ লক্ষ ভোট নিয়ন্ত্রণ করেন।

অপরপক্ষে, বাংলাদেশের জনগণ গণতান্ত্রিক এবং সাম্যবাদী। তাদের কোন জাতি বা গোষ্ঠীগত অন্তর্ভূক্তি নেই। সকল জমি রাষ্ট্রের মালিকানাধীন থাকায় কোন সামন্তবাদি জমিদারের অস্তিত্ব নেই। বাঙালি মুসলিমরা সংখ্যালঘুদের প্রতি সহনশীল। পশ্চিম পাকিস্তানিরা এই সহনশীলতা বুঝতে অক্ষম (পাঞ্জাবে ভারতভাগের সময় লক্ষ লক্ষ সংখ্যালঘু নিহত হয়েছিল)। তারা এই সহনশীলতাকে ভারতঘেঁষা হিসেবে ব্যাখ্যা করে। বাস্তবে, গণতন্ত্র, সমানাধিকার ও ধর্মীয় সহনশীলতার আদর্শের প্রতি অনেক বেশিগুণ শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে বাঙালিরা সভ্যতার একটি ভিন্ন স্তরে অবস্থান করছে।

পশ্চিম পাকিস্তানিদের সামন্তবাদি মূল্যবোধ তাদের প্রশাসনের বিভিন্ন ক্ষেত্রেও প্রতিফলিত হয়। পশ্চিম পকিস্তান কোন স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান ছাড়াই অতিমাত্রায় কেন্দ্রীভূত। বাংলায় স্থানীয় সরকারের ঐতিহ্য বেশ শক্তিশালী এবং প্রশাসন অপেক্ষাকৃত বিকেন্দ্রীভূত। পশ্চিম পাকিস্তান তাদের সামন্তবাদি জমিদারদের দ্বারা খুন, ভয়ভীতি প্রদর্শন এবং এমনকি মহিলাদের অপহরণসহকারে নিয়ন্ত্রিত (হামজা আলভী ফর ভিলেজ পলিটিক্স ইন ওয়েস্ট পাকিস্তান ইন সাউথ এশিয়ান রিভিউ, জানুয়ারি, ১৯৭১)। অথচ বাঙালি গণতন্ত্র দখল করে আছে এক অদ্বিতীয় স্থান। এমন হাজারও ধরনের উদাহরণ অসংখ্যবার দেখানো যেতে পারে।

৩। বাংলাদেশে গণহত্যা

ব্রিটিশ গণমাধ্যম বাংলাদেশে নিরস্ত্র ও নির্দোষ মানুষদের উপর পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যদের অমানবিক গণহত্যার উপর অনেক বিবৃতি প্রকাশ করেছে। স্বাভাবিকভাবেই বিস্মিত হওয়ার বিষয় এই যে, বিংশ শতাব্দীতেও মানুষ এতটা অসভ্য হতে পারে। যাই হোক, আমরা বাংলাদেশের জনগণ, যারা পশ্চিম পাকিস্তানিদের সাথে বিগত ২৩ বছর ধরে আছি, তারা মোটেও বিস্মিত নই। পশ্চিম পাকিস্তানের অধিকাংশ মানুষ, বিশেষত পাঞ্জাবিরা নিজেদের রাজপুত গোত্রের বলে দাবি করে। এটি বলা যাবে না যে, আর্য বংশোদ্ভূত রাজপুতেরা কোন রকম বিতর্কের উর্দ্ধে গিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় যে, অধিকাংশ পাঞ্জাবি মুসলমান রাজপুত হান বা সিথিয়ান যোদ্ধাদের সজাত যারা বৌদ্ধ সভ্যতা ধ্বংসের জন্য ব্রাহ্মণদের সহায়তা করেছিল এবং পুরষ্কার হিসেবে দ্বিজাতিদের পদমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল (বিস্তারিত তথ্যের জন্য দেখুন, জে এম উইকিলি, পাঞ্জাবি মুসলমান, দ্য বুক হাউস, লাহোর, পশ্চিম পাকিস্তান)। বর্তমানে বাংলাদেশে যা ঘটছে, তা হল এক প্রকার “হান আক্রমণ”,  যা এবারে বাঙালিদেরকে সমূলে ধ্বংস করার জন্য বদ্ধপরিকর, যেমনটি তারা করেছিল পূর্বে বৌদ্ধদের সাথে এবং পশ্চিমে শিখদের সাথে।

অতএব, আপনাদের কাছে আমাদের নিবেদন রইল এই পরিস্থিতির তাৎপর্য উপলব্ধি করার। আমাদের পরিস্থিতি বিয়াফ্রার পরিস্থিতির মত নয়, লাহোর প্রস্তাব যেকোন ভবিষ্যৎ মীমাংসার মুল ভিত্তি হওয়া উচিৎ যেমনটি ছিল পাকিস্তান আন্দোলনের মূলভিত্তি হিসেবে এবং সেটি এখনও পর্যন্ত অবিসংবাদিত। পশ্চিম পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ একটি রাষ্ট্র হতে পারে না, কারণ তাদের সভ্যতা, মূল্যবোধ, আশা-আকাঙ্ক্ষা সবই ভিন্ন। আমরা বাংলায় হান বংশোদ্ভূত বর্বরদের আক্রমণের শিকার হয়েছি, আপাতভাবে ইয়াহিয়া বা ভুট্টোর কূটনীতি এই নগ্ন সত্যকে ধামাচাপা দিতে পারবে না, বৌদ্ধদের মত আমরাও ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি; বর্বরেরা আমাদের ধ্বংস করতে বদ্ধপরিকর। আমরা নিদারুণভাবে সকল সভ্য দেশগুলো বিশেষ করে যুক্তরাজ্যের প্রতি আমাদেরকে সাহায্য করার আবেদন করেছি, কারণ ব্রিটিশ জনগণ শুধুমাত্র গণতন্ত্রের ধারকই নয়, তারা আমাদের মুক্তি সংগ্রামের স্বরূপ সম্পর্কে শুরু থেকেই অবহিত। যেহেতু আমাদের সকল বুদ্ধিজীবী এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ পাঞ্জাবি বেনিয়াদের হাতে নিহত হয়েছেন, আমরা আশংকা করছি যে, আমরা আমাদের পরিস্থিতিকে সফলভাবে বিশ্বদরবারে উপস্থাপনে সক্ষম নাও হতে পারি। সুতরাং, আপানাদের নিকট আমাদের পরিস্থিতির বিবরণ জাতিসংঘে আরেকটিবার পেশ করার নিবেদন করছি।

                                                                                        আপনার বিশ্বস্ত                                                                                     এম মোজাম্মেল হক                                                                                         সভাপতি                                                                                     বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্ট                                                                                    ১০, লিচেস্টার গ্রোভ                                                                                                লিডস-৭

<৪,১৩,২১>

অনুবাদকঃ মুশররাত আলম মৌ

শিরোনাম সুত্র তারিখ
১৩। লন্ডনে ট্রাফালগার স্কয়ারে বাংলাদেশের সমর্থনে জনসভা অনুষ্ঠানের অনুমতি চেয়ে আবেদন বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটির সম্পাদকের চিঠি ১৭ এপ্রিল, ১৯৭১

সচিব                                    জনাব এম এ এইচ ভূঁইয়া

পরিবেশ মন্ত্রণালয় সচিব

বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটি

৫২, ওয়ার্ডসয়ার্থ রোড

স্মল হিথ

বার্মিংহাম– ১০

টেলিঃ ০২১-৭৭৩-১৪৫৬

জনাবা,

এতদ্বারা বাংলাদেশ সমর্থকদের জন্য  ট্রাফালগার স্কয়ারে রবিবার, ১৮ এপ্রিল, ১৯৭১ দুপুর ২ ঘটিকা থেকে ৪ ঘটিকা পর্যন্ত জনসভা আয়োজনের নিমিত্তে আপনার অনুমতি প্রার্থনা করছি। আমরা সম্প্রচারমূলক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে ইচ্ছুক। আমরা কেবলমাত্র হাতে ধরার ব্যানারসমূহ রাখার প্রস্তাব করছি। আমরা প্রচারপত্র বিলি করতে চাই।

আমরা দু’টি গাড়ি পার্ক করতে চাই। সভায় মূলত বক্তৃতা প্রদান করা হবে।

                                                                                         আপনার বিশ্বস্ত

 জনাব এম এ এইচ ভূঁইয়া

সচিব

বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটির পক্ষ থেকে