You dont have javascript enabled! Please enable it!

রাজনীতিবিদদের পারিবারিক জীবন | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৫
এলাহী নেওয়াজ খান/ আমির খুসরু

১৯৩৭ সালে বাংলায় হক মন্ত্রী পরিষদের উপদেষ্টা বোর্ডের সভায় মন্ত্রীদের বেতন নির্ধারণকে কেন্দ্র করে এক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছিল -যার ভেতর দিয়ে রাজনৈতিক নেতাদের জীবনযাপনের এক অকথিত উন্মোচিত হয়। মুসলিম লীগ ও কৃষক প্রজা পার্টির কোয়ালিশন হক মন্ত্রিসভার কাজ শুরু হওয়ার আগে উপদেষ্টা বোর্ডের বৈঠকে সকল বিষয়ের সমাধান হলেও মন্ত্রীদের বেতনের প্রশ্নে আলোচনা বিলম্ব হয় এবং প্রচণ্ড বাকবিতণ্ডা শুরু হয়।(এই উপদেশটা বোর্ডকে তখন মন্ত্রী ও এম এল এরা ‘সুপার ক্যাবিনেট’ আখ্যা দিয়েছিলেন। কারণ এই বোর্ডের সিদ্ধান্ত মন্ত্রিসভা মানতে বাধ্য ছিল।) কৃষক-প্রজা পার্টির প্রতিষ্ঠাতা প্রস্তাব ছিল মন্ত্রীদের বেতন এক হাজার টাকা হবে। কিন্তু মুসলিম লীগ তা মেনে নিতে অস্বীকার করে। তাদের যুক্তি ছিল, মাত্র এক হাজার টাকায় মন্ত্রীদের চলা সম্ভব নয়। সুতরাং প্রস্তাবটি অবাস্তব। আবুল মনসুর আহমেদ তাঁর ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘লীগ নেতাদের এই যুক্তির জবাবে আমি বলিয়াছিলাম যে মন্ত্রীরা বিনা-ভাড়ায় বাড়ি পাইবেন, বিনা খরচে গাড়ি পাইবেন, ভ্রমণে টি, এ-ড-এ পাইবেন, বিনা খরচে চাপরাশি আর্দালি পাইবেন। অতএব টাকার অপ্রতুলতার যুক্তি ঠিক নয়। প্রস্তাবটা কাজেই অবাস্তব নয়। আমার প্রস্তাবের সমর্থনে কংগ্রেসের পাঁচ’শ টাকা মন্ত্রী-বেতনের এবং অন্যান্য দলের মন্ত্রী-বেতনের দু-একটা নজর দিলাম। এই তর্ক স্বভাবতঃ খুবই গরম হইয়াছিল। উভয় পক্ষ হইতে তীব্র ও রূঢ় কথাও আদান-প্রদান হইতেছিল। হঠাৎ শহীদ সাহেব উত্তেজিত সুরে আমাকে বলিলেন তুমি দেড়শ টাকা আয়ের মফস্বলের উকিল। তুমি কলকাতাবাসী ভদ্রলোকের বাসা খরচের জানো কি?
আমি এই আক্রমণে আরো রাগিয়খ গেলাম। পকেট হইতে এক টুকরা হিসাবের কাগজ সশব্দে টেবিলের উপর রাখিয়া ক্রোধ কম্পিত গলায় বলিলামঃ এই হিসাবে কলিকাতাবাসী একটি ভদ্র পরিবারের সমস্ত খরচ আবশ্যক করা হইয়াছে। এতে শুধু মদ ও মাগির হিসাব ধরা হয় নাই। ও দুইটা ছাড়া আর কি এই হিসাবে বাদ পড়ছে, দেখাইয়া দেন।’কিন্তু শেষ পর্যন্ত আবুল মনসুর আহমদের প্রস্তাব ধোপে টেকেনি। কোয়ালিশন পার্টি মিটিংয়ে মন্ত্রীদের বেতন আড়াই হাজার টাকা ও প্রধানমন্ত্রীর জন্য অতিরিক্ত পাঁচ’শ টাকা নির্ধারিত হয়। তখন কলকাতার সর্বোৎকৃষ্ট দাদখানি চাল এর মূল্য ছিল চার টাকায় এক মন। কলকাতার বাইরে দু’টাকায়ও এক মণ চাল পাওয়া যেত। কিন্তু এখন আর সে অবস্থা নেই‌। ভৌগোলিক পরিবর্তন ঘটেছে অনেক। সেইসঙ্গে জীবনযাত্রার মানও বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুণ। তাই ১৯৩৭ সালে আবুল মনসুর আহমদের প্রস্তাবে যখন গ্রাহ্য হয়নি, তখন বর্তমানে সে ধরনের প্রস্তাব অবান্তর বলেই মনে হবে। কিন্তু তা সত্ত্বেও আজকের রাজনীতিবিদদের জীবনযাপন সম্পর্কে সাধারণ মানুষের অদস্য কৌতূহল। পারিবারিক জীবনে তাঁরা কেমন থাকেন কেমন করে তাঁরা জীবন ও জীবিকা নির্বাহ করেন -তা জানার আগ্রহ সাধারণ মানুষের চিরন্তন এবং স্বাভাবিক।
বিশেষ করে যারা জনসাধারণের প্রতিনিধিত্ব করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা নিয়ে মুক্তিকামী মানুষের প্রতীক হিসেবে ঘুরে বেড়ান গ্রামে-গঞ্জে, শহরে-বন্দরে। তাই সাধারণ মানুষের প্রতি দৃষ্টি রেখে আমরা বিভিন্ন রাজনীতিবিদদের মুখোমুখি হয়েছি, জানতে চেয়েছি, তারা কেমন আছেন, কতটুকু ভালো থাকেন। এজন্য আমরা ২৪ জন রাজনীতিবিদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছি -যা সাধারণ মানুষের কৌতূহল কিছুটা মেটাবে -বলে বিশ্বাস। রাজনীতিবিদরা যে ধরনের জীবনযাপন করুন না কেন, তাঁরা আদর্শের জন্য সংগ্রাম করেন। তাদের জানার বিষয় হচ্ছে, তাদের অনুসৃত রাজনীতি।
প্রতিটি মানুষের জীবন যাপনের বৈশিষ্ট্য বা ধরন ভিন্নতর ও স্বতন্ত্র এবং প্রতিটি মানুষের অর্থনৈতিক ভিত্তি তা অর্থ আগমনের পথ ও ভিন্নতর। এটা সাধারন লোকদের ক্ষেত্রে যেমন সত্য তেমনি রাজনীতিবিদদের বেলায়ও একই রূপ। এখানে লুকোচুরি করার কিছুই নেই। আর রাজনীতিবিদদের ক্ষেত্রে তো আরও নেই। তথাপি আমরা বিভিন্ন রাজনীতিবিদদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করতে গিয়ে যেমন অনেকের কাছে, এ ধরনের কাজের জন্য অভিনন্দন পেয়েছি, তেমনি তীব্র বিরূপ প্রতিক্রিয়ারও সম্মুখীন হয়েছি। অনেকে সাক্ষাৎকার দিতে রাজি হননি, বরং তীব্র ভাষায় সমালোচনা করেছেন। যেমন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদিকা সাজেদা চৌধুরীর সঙ্গে টেলিফোনে সাক্ষাৎকারের বিষয়টি জানালে, তিনি বিতৃষ্ণা ও বিরক্তির স্বরে বলেন, রাজনৈতিক নেতাদের কোনো জীবনযাপন নেই। আর একথা জিজ্ঞাসা করারই বা কি আছে।’ তিনি এ ব্যাপারে কোনো কথা বলতে পারবেন না বলে দুঃখ প্রকাশ করেন। তোফায়েল আহমেদ সাক্ষাৎকার দিতে রাজি হলেও পরে বিষয়টি জেনে আর সাক্ষাৎকার দেন নি। আর যারা সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, তাদের অনেকে আবার আয়-ব্যয়ের কথা জিজ্ঞেস করাতে ক্ষেপে উঠেছেন। যেমন মুসলিম লীগের টি, আলী সাহেবকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি প্রচন্ড রেগে যান। বলেন, এসব প্রশ্নের কোন মানে নেই। আমি ভালো ভাবেই জীবন যাপন করছি। সবকিছু জেনে নিয়ে তবেই লিখবেন? আমার এইবারই দেখে আমার জীবন যাপনের বিচার করা যায় না।’এরপর তিনি অনেক প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যান এবং তাঁর ক্ষুব্ধতার কারণে কিছু প্রশ্ন করা যায়নি। বর্তমান আন্দোলনের ক্ষতি হতে পারে বলে মেজর (অবঃ) জলিল প্রথমে সাক্ষাৎকার দিতে অস্বীকার করেন। কিন্তু পরে সাক্ষাৎকার দেন। জাসদের আ স ম আব্দুর রব লিখিতভাবে আমাদের প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। তিনি সরাসরি কোনো উত্তর দিতে পারবেন না বলে জানান। তাই তাঁর কাছ থেকে লিখিত উত্তর নিয়েছি।
আমেনা বেগমের প্রতিক্রিয়া ছিল ভিন্ন ধরনের। তিনি সাক্ষাৎকারের বিষয়বস্তু শুনেই বললেনঃ আমাদের কি কোন জীবনযাপন আছে? আমরা তো আর শখের রাজনীতিতে আসিনি। এখন তো জীবন যাপন তাদের, যারা শখের রাজনীতি করে। আমার রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণের ফলে আমার স্বামীর চাকরি চলে যায়। তখন কতই না কষ্ট করেছি। আমি যখন আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি তখন বাপের দেয়া জমি বিক্রি করে আওয়ামী লীগ চালিয়েছি। এখন আওয়ামী লীগের লোকেরা বস্তায় বস্তায় টাকা পায়। জিয়ার বউ ৮ লাখ টাকার গাড়িতে চড়ে। সুতরাং তাদের রাজনীতিতে আর ব্যক্তিগত জীবন যাপনে অসুবিধা কোথায়? অন্যান্য রাজনীতিকের আমার মত কোনো আর্থিক অভাব নেই, অন্যদের যা অভাব -তা হচ্ছে দেশ প্রেম। সুতরাং আমাদের সম্পর্কে জেনেই বা কি হবে।
খিলাফত আন্দোলনের হাফেজ্জী হুজুর প্রশ্নমালা গ্রহণ করেও সাক্ষাৎকার দেন নি। প্রশ্নমালা দেয়ার আগে সাক্ষাৎকার চেয়ে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে, হাফিজি হুজুরের লিগাল অ্যাডভাইজার এডভোকেট আলহাজ্ব আবদুর রশীদ বলেন, আপনি প্রেম করেন কিনা এটা যেমন প্রশ্ন নয়, তেমনি আপনার এগুলোও কোনো প্রশ্ন নয়। আর এত বড় একজন পীরে কামেল আল্লাহর অলির কাছে এ ধরনের প্রশ্ন দেয়াটা সাংবাদিকতার নীতি বহির্ভূত। আমরা আশা করবো, এত বড় একজন লোকের সামনে সে ধরনের প্রশ্ন করা উচিত যা -মানায়।
বর্তমান সংখ্যায় জনদলের মহাসচিব মিজানুর রহমান চৌধুরী, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মালেক উকিল, জাসদের শাহজাহান সিরাজ, ইউপিপির কাজী জাফর আহমেদ, মুসলিম লীগের টি আলী, আইডিএল-এর মাওলানা রহিম, ওয়ার্কার্স পার্টির হায়দার আকবর খান রনো, বাকশালের আব্দুর রাজ্জাক, জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের মেজর (অবঃ) এম এ জলিল এর সাক্ষাৎকার পত্রস্থ করা হলো। আগামীতে যাবে মওদুদ আহমেদ, আবদুল মান্নান, মাওলানা মতিন, সিদ্দিকুর রহমান, টিপু বিশ্বাস, হাসানুল হক ইনু, দিলীপ বড়ুয়া, পংকজ ভট্টাচার্য,আ স ম আব্দুর রব, মুহাম্মদ ইউসুফী, মুহাম্মদ তোয়াহা, নজরুল ইসলাম, আমেনা বেগম, রাজিয়া ফয়েজ ও খালেকুজ্জামান ভূঁইয়ার সাক্ষাৎকার।
প্রশ্নঃ আপনি একজন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, একইসঙ্গে পারিবারিক জীবনে একজন পিতা, স্বামী ও দায়িত্বশীল অভিভাবক। এতগুলো দায়িত্ব পালনে আপনার কোন অসুবিধা হয় কি?
মিজান চৌধুরীঃ অসুবিধা খুব একটা হয়না অভ্যস্ত হয়ে গেছি।
মালেক উকিলঃ অসুবিধা কিছু হয় এবং তা বাস্তব। অন্য দশজন সাধারণ মানুষের মতোই আমাকে বিভিন্ন সময় সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। তবে তা ম্যানেজ করে নেই।
রাজ্জাকঃ বাংলাদেশের মত একটা অনুন্নত দেশের রাজনীতি করাটাই একটা কঠিন ব্যাপার। সেখানে যারা প্রকৃতভাবেই আদর্শের রাজনীতি করে তাদের দিনের বেশিরভাগ সময়ে রাজনীতির পেছনে ব্যয় করতে হয়। পরিবারকে উল্লেখযোগ্য সময় দেওয়া কঠিন। যে কারণে পরিবারের সবাই অনেক সময়ই মনঃক্ষুণ্ণ থাকে। কিন্তু কোন বিপর্যয় ঘটেনি বা জটিলতার সৃষ্টি হয়নি। আমি জেনে শুনেই বিয়ে করেছি। বিয়ের সময় বলে নিয়েছিলাম এবং স্ত্রীও জানত যে আমি রাজনীতিতে ব্যাপক সময় ব্যয় করি। স্ত্রী ও সন্তানেরা বঞ্চিত হয় ঠিকই কিন্তু সহযোগিতা করে।
টি, আলীঃ রাজনীতির কারণে আমি সন্তানদের খোঁজ খবর নিতে পারি না। সন্তানের প্রতি আমার যা কর্তব্য তা পালন সবসময়ই বিঘ্নিত হয়েছে। আমার স্ত্রীকে সবকিছু দেখতে হয়। ১৯৩৭ সাল থেকে রাজনীতিতে সক্রিয় আছি। আর ওই সময় থেকেই পরিবারের সদস্যদের জন্য খুব একটা সময় দিতে পারিনি।
মাওলানা রহিমঃ আমি প্রচলিত অর্থে রাজনীতি করি না। ইসলামী আদর্শ প্রচার ও বাস্তবায়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। বহুকাল পূর্বে আমি পারিবারিক জীবন শুরু করি। একজন পিতা, স্বামী ও দায়িত্বশীল অভিভাবক হিসেবে দায়িত্ব পালনে আমার তেমন কোন অসুবিধা হয়নি। প্রথমদিকে পিতা-মাতার পূর্ণ আনুকূল্য সহযোগিতা পেয়েছি। ফলে পারিবারিক দায়িত্ব পালনে আমার বরং সুবিধাই হয়েছে।
মেজর জলিলঃ রাজনীতিকে জীবনের হিসেবে গ্রহণ করেছি। সুতরাং রাজনীতিকে যারা জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছে বা করে, তাদের মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত দৃঢ় প্রত্যয়ের সাথে এগিয়ে যেতে হয়। এই চলার সাথে ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারের তাড়না থাকেনা। এমন একটি জীবনে ব্যক্তি কিংবা পারিবারিক কোনো সমস্যাই সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় না। সুতরাং আমার ব্যক্তিগত কিংবা পারিবারিক জীবনের কোনো সমস্যাকেই আমি সত্যিকার অর্থে সমস্যা বলে মনে করি না।
রনোঃ একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে আমি আমার দায়িত্ব পালনে যথাসাধ্য চেষ্টা করি। কিন্তু একজন অভিভাবক হিসেবে আমার দায়িত্ব কর্তব্য তা পুরোপুরি পালন করতে পারি না। যেমন অনেক ক্ষেত্রেই অনিচ্ছাকৃত ব্যর্থতা আছে।
শাহজাহান সিরাজঃ প্রকৃতপক্ষে সব দায়িত্ব পালন করিনা। রাজনীতিতেই বেশি সময় ব্যয় হয়ে যায়। বলতে পারেন দায়িত্ব পালন না করতে করতে দায়িত্ব পালন না করাটাই নিয়ম হয়ে গেছে।
কাজী জাফরঃ অবশ্য অসুবিধা হয়। বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশের স্বাভাবিক সামাজিক জীবন দূরের কথা, স্বাভাবিক রাজনৈতিক জীবনেরও কোনো অবকাশ নেই। আমার দীর্ঘ ৩০ বছরের রাজনৈতিক জীবনের প্রায় সাড়ে ১৩ বছর কেটেছে কারাগার বা হুলিয়ার বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে। আমার প্রথম ও দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম হয়েছে আমার আত্মগোপন অবস্থায়। তবুও অপেক্ষাকৃত স্বাভাবিক জীবনযাপনের সুযোগ যখন আসে তখন, রাজনৈতিক দায়িত্ব পালনের চেষ্টাকে প্রাধান্য দিয়ে ত্রিবিধ দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করি।
প্রশ্নঃ রাজনীতি কি আপনার পেশা না নেশা?
মিজান চৌধুরীঃ রাজনীতি আমার পেশা নয়। আসলে নেশা না থাকলে পৃথিবীর কেউ নিজের জীবনের অনেক কিছু ত্যাগ করে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে পারেনা।
মালেক উকিলঃ মাঝে মাঝে নেশা । আমার পেশা হচ্ছে আইন ব্যবসা। আর এটাতো অনেক বিখ্যাত রাজনীতিবিদদের পেশা।
রাজ্জাকঃ আমি সার্বক্ষণিক রাজনৈতিক কর্মী এবং পেশাদার বিপ্লবের ভূমিকায় কাজ করছি। যদি এডভোকেট হিসেবে তালিকাভুক্ত আছি। কিন্তু কখনো কোর্টে যাইনি।
টি, আলীঃ কলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করার মাধ্যমে আমি আমার পেশাগত জীবন শুরু করি। সুতরাং রাজনীতি আমার দায়িত্ব ও নেশা।
মাওলানা রহিমঃ রাজনীতি আমার পেশাও নয় নেশাও নয়। আমার রাজনীতি আমার স্রষ্টা ও তার প্রদত্ত বিধানের প্রতি ঈমানের ফলশ্রুতি। আমার স্পৃহা কর্তৃক আদিষ্ট বলে ইসলামী আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য রাজনীতি করা কর্তব্য বলে মনে করি।
জলিলঃ আমি রাজনীতিকে জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছি। সুতরাং রাজনীতি আমার কাছে পেশা কিংবা নেশা কোনটাই না। রাজনীতি যাদের জীবনের পেশা, তারা এ পেশাকে যেকোনো সময় চুকিয়ে ফেলে অন্য জীবন যাপন কিংবা অন্য জীবন যাপনের সুযোগ গ্রহণ করতে পারেন। অপরদিকে রাজনীতি যাদের নেশা তাদেরও যেকোনো সময় নেশা ভঙ্গ হতে পারে। যেমন অনেক নেশাই আকস্মিক এবং মানুষ সম্পূর্ণ বদলে যায়।
শাহজাহান সিরাজঃ রাজনীতি আমার কাছে পেশা ও নেশা দু’টোই।
জাফরঃ রাজনীতি আমার নেশা, আমার স্বপ্ন, আমার আকাঙ্ক্ষা এবং আমার আদর্শ বাস্তবায়নের হাতিয়ার। একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যকে সামনে রেখে একটি আদর্শের ভিত্তিতে আমি রাজনীতি করে চলেছি।
প্রশ্নঃ আপনার ছেলে মেয়ে কয়জন? তাদের বয়স কত এবং স্কুল কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে যায় কি?
মিজান চৌধুরিঃ আমার চার ছেলে এবং পাঁচ মেয়ে। তারা সবাই স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ে।
মালেক উকিলঃ আমার ছেলে মেয়ের সংখ্যা সাত জন । ছেলে দুজন এবং মেয়ে পাঁচজন। অনেকে শেষ করেছে এবং অন্যরা এখনো পড়াশোনা করে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় যায়।
টি, আলীঃ আমার ছেলে-মেয়ে পাঁচটি। মেয়ে মারা গেছে। ওরা সকলে পড়াশোনা শেষ করেছে।
রাজ্জাকঃ আমার দুটো ছেলে বেঁচে আছে। বড়টি কিন্ডারগার্টেনে প্লে গ্রুপে পড়ে। অন্যটির বয়স দেড় মাস।
মাওলানা রহিমঃ আমার ছেলেমেয়ে দশজন। এদের মধ্যে দুজন মেয়ে আটজন ছেলে। প্রথম আটজন পড়াশোনা শেষ করেছে। শেষের দু’জন পড়াশোনা করছে।
জলিলঃ আমার একটি মেয়ে। বয়স দেড় বছর।
রনোঃ আমার একটি মেয়ে। নাম রানা সুলতানা। বয়স দশ বছর। স্কুলে পড়ে।
শাহজাহান সিরাজঃ আমার এক মেয়ে এক ছেলে। মেয়ে সরোয়াদ সিরাজ শুক্লা। বয়স ১১ বছর। ছেলে রাজীব সিরাজ (অপু) । এরা স্কুলে পড়ে।
জাফরঃ আমার তিনটি মেয়ে। বড়টির বছর ১৫ বছর -এবার এসএসসি পরীক্ষা দেবে। দ্বিতীয়টির বয়স ১২ বছর। ষষ্ঠ শ্রেণীতে উঠেছে এবং ছোটটির বয়স ৬ বছর। নার্সরী গ্ৰুপে পড়ছে।
প্রশ্নঃ আপনি কি কখনো ছেলেমেয়েদের স্কুলে নিয়ে যান?
মিজান চৌধুরীঃ আগে নিয়ে যেতাম। কিন্তু ১৯৬৪/৬৫ সালের পর থেকে আর পারিনা। আর এখন তো প্রশ্নই ওঠে না।
মালেক উকিলঃ কোনদিনই না। স্ত্রীই সব সময় এ কাজটি করেছে।
টী, আলীঃ মন্ত্রী ও রাষ্ট্রদূত হওয়ার আগে নিয়ে যেতাম।
রাজ্জাকঃ মাঝেমধ্যে ছেলেকে স্কুলে নিয়ে যাই। সব সময় হয়ে ওঠে না।
মাওলানা রহিমঃ প্রথমদিকে ছেলেমেয়েদের স্কুলে নিয়ে গেছি। শেষে বড়রাই ছোটদের নিয়ে গেছে।
জলিলঃ আমার মেয়ের বয়স দেড় বছর এখনও স্কুলে যাওয়ার সময় হয়নি।
রনোঃ আমার মেয়ে তার দাদা-দাদীর কাছে থাকে এবং তাদের তত্ত্বাবধানেই পরিচালিত হয়। কদাচিত আমার মেয়েকে স্কুলে নিয়ে যাই।
শাহজাহান সিরাজঃ না, ছেলেমেয়েদের স্কুলে নিয়ে যাই না। আমার জীবনের শেষ সুযোগ কখনো পাইনি।
জাফরঃ আমি আমার মেয়েদের কখনো কখনো স্কুলে নিয়ে যাই। ইচ্ছা থাকলেও সব সময় নিয়ে যাওয়ার সুযোগ পাইনা।
প্রশ্নঃ আপনি কি কখনো বাজার করেন?
মিজান চৌধুরীঃ ষাটের দশকের পর থেকে আর বাজার করি না । এখন তো আর আমার বাসাটা দরবারের মত হয়ে গেছে। ভালো মাছ অনেকেই বাসায় আনে। যার ফলে ভালো বাজার করতে হয়না। বাজার বাসায় পৌঁছে যায়?
মালেক উকিলঃ বাজার এখন খুব একটা করিনা। তবে মাঝে মধ্যে টুকটাক বাজার যে করি না তা নয়। সময় একদমই পাইনা।
১৯৫৪ সালের পূর্বে যখন নোয়াখালীতে থাকতাম তখন বাজারে যেতাম। বনানী বাজারে মাঝেমাঝে যাই। কিন্তু দাম-দস্তুর করার সুযোগ পাইনা। দোকানদাররা আগেভাগেই ব্যাগে ঢুকিয়ে গাড়িতে তুলে দেয়।
টী, আলীঃ কলকাতায় থাকাকালে বাজারে যেতাম। কিন্তু ঢাকায় এসে মাত্র একদিনই নিউ মার্কেটে গিয়েছিলাম।
রাজ্জাকঃ বাজারে খুব কমই যাই। সময় হয়ে ওঠে না।
মাওলানা রহিমঃ বাজার আগে করতাম এখন ছেলেরাই করে। অবশ্য কিছুদিন আগ পর্যন্তও ছেলেদের নিয়ে মাসিক বাজার করতাম। তবে এখন মাঝে মাঝে বাজারে যাওয়া হয় না তা নয়। একদিন তো নিউমার্কেটে কাজী জাফর সাহেবের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল।
জলিলঃ গ্রামের বাড়িতে গেলে কখনো কখনো কাঁচা বাজারে যাই। শহরের কাঁচাবাজারে যাই না। তবে চলার পথে রাস্তার পাশে শাকসবজি পেলে কিনি।
রনোঃ খুব একটা যাওয়া পড়ে না।
শাহজাহান সিরাজঃ আসলে আমি বাজার করিনা । তবে সামরিক আইন জারির পর বাজার করেছি। তবে নিজের জন্য বাজার না করলেও বাজারে ঢুকে বাজার দর যাচাই করি।
জাফরঃ আমি মাঝে মাঝে যাই। বাজার করে আমি আনন্দ পাই। বাজারে গেলে অনেক রাজনৈতিক নেতা সঙ্গে দেখা হয়। তবে কোন বিপ্লবীকে কখনো বাজারে দেখি নি।
প্রশ্নঃ পারিবারিক আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গে কতটুকু যোগাযোগ রক্ষা করতে পারেন?
মিজান চৌধুরীঃ যোগাযোগ রক্ষা করার চেষ্টা করি। কিন্তু ষাটের দশক থেকে আর পারিনা। আত্মীয়-স্বজনরা যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন ।
মালেক উকিলঃ খুবই কম যোগাযোগ রক্ষা করতে পারি। আত্মীয়-স্বজনরাই আসে। অনেকে তো অভিমান করে আসে না। তবে আমি খোঁজখবর নেই এবং তাদের সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দেই।
টী, আলীঃ আমি আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে যাওয়ার সময় কখনই পাইনি । তারাই যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন । আর বিশেষ কোনো অনুষ্ঠান থাকলে যাই।
রাজ্জাকঃ খুব কম সময়ই যোগাযোগ রক্ষা করা সম্ভব হয়। তারা আমার বাসায় আসলেই যা দেখা-সাক্ষাৎ হয় ।
মাওলানা রহিমঃ সবসময় যোগাযোগ রক্ষা করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। কিন্তু খোঁজখবর নেই। তবে তাদের কোনো অভিযোগ নেই।
জলিলঃ আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক খুবই মধুর। তখন তারা আমার বাসায় আসে বা আমি যাই তখনই তাদের সাহায্য করি।
রনোঃ আমি একটি যৌথ পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। আমার পিতা-মাতা, ভাই একই পরিবারের বাস করি। সুতরাং আমার ব্যক্তিগত দায় দায়িত্ব নেই বললেই চলে।
শাহজাহান সিরাজঃ আসলে আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গে অনেক সময়ই যোগাযোগ রক্ষা করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। তবে রাজনৈতিক কাজে কোথাও গেলে আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করি। এছাড়া আত্মীয়র বাড়িতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে কখনো যাওয়া হয় না ।
জাফরঃ আত্মীয়-স্বজনদের সাথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে খুব একটা সময় পাইনা। তবে অধিকাংশ সময় তারাই যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন। যখন সময় পাই আমিও যোগাযোগ রক্ষা করার চেষ্টা করি।
প্রশ্নঃ আপনি কখনো কি স্ত্রী-পুত্র-কন্যা নিয়ে কোনো সামাজিক অনুষ্ঠান সিনেমা নাটক দেখতে যান?
মিজান চৌধুরীঃ সিনেমা নাটক তো দূরের কথা কোন সামাজিক অনুষ্ঠানেই যেতে পারিনা। ‘৬০ সালের পর থেকে ক্রমেই পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছি।
মালেক উকিলঃ কখনো গিয়েছি কিনা মনে করতে পারছি না। তাছাড়া, আমার স্ত্রীও রক্ষণশীল। নাতি-নাতনিদের কিছুটা সময় যা দিতে পারি।
টি, আলীঃ আমি আমার স্ত্রীকে নিয়ে কখনো যেতে পারিনি। আমার ঢাকার ৩০ বছরের জীবনে মাত্র দশ থেকে বারো বার সিনেমা-নাটকে গিয়েছি। যদি ছবি দেখি, তাহলে ক্লাসিক্যাল ছবিই দেখি। বাজে বা সস্তা ছবি দেখিনা । সস্তা বইও পড়ি না।
রাজ্জাকঃ আগে সিনেমা-নাটকে যেতাম । এখন আর সময় হয়ে ওঠে না । এখন মাঝেমধ্যে টেলিভিশন দেখি । আর যে সকল সামাজিক অনুষ্ঠানে না গেলেই নয় সে সকল অনুষ্ঠানে যাই।
মাওলানা রহিমঃ স্ত্রী-পুত্রদের নিয়ে আত্মীয়-স্বজনদের বিয়ে বা এধরনের অনুষ্ঠানে যোগ দেই। অন্য অনুষ্ঠানে স্ত্রীসহ দাওয়াত আসলেও তাকে সাথে নেই না। আমার স্ত্রী সেসকল অনুষ্ঠানে যাওয়া পছন্দ করেননা । অনেক সময় বললেও রাজি হন না।
জলিলঃ স্বাধীন বাংলাদেশের কোন সিনেমা দেখি নাই। নাটক একবারই দেখেছি বছর তিনেক আগে।
রনোঃ সময় সুযোগ পেলেই আমি নাটক-সিনেমায় যাই। সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে ও কখনও কখনও যোগদান করি।
শাহজাহান সিরাজঃ সিনেমাতে কিংবা অন্য কোনো অনুষ্ঠানে আমার খুব একটা যাওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। তবে পরিবারের সবাইকে নিয়ে দু’একটি নাটক দেখেছি।
জাফরঃ কোন কোন সামাজিক অনুষ্ঠানে বা নাটকে যাই। তবে সিনেমা দেখার সময় পাইনা।
প্রশ্নঃ রাজনীতিতে অনেক সময় ব্যয় করার ফলে স্ত্রীকে সময় না দেওয়ার জন্য কি কোন অনুযোগের সম্মুখীন হন?
মিজান চৌধুরীঃ অনুযোগ আছে, তবে তা হাসিমুখে।
মালেক উকিলঃ আমার বিয়ের কয়েক মাস পরেই আমি জেলে যাই। তখন আমার স্ত্রী খুব নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছিলেন। আমার প্রথম দিকে আমাকে রাজনীতিতে যোগ না দেয়ার জন্য নিষেধ করত। সে আমাকে বলতো, যদি তার ক্ষমতা থাকতো তবে সে আমাকে বন্দী করে রাখত। জেলে গেলে স্ত্রী ও পরিবারের সবাই শংকিত ও ভীত থাকে।
টি, আলীঃ সত্যি কথা বলতে কি স্ত্রীকে সময় কমই দিতে পেরেছি। তবে কোনো সময় কোনো সময় অনুযোগের সম্মুখীন হইনি।
রাজ্জাকঃ কিছু অনুযোগ, কিছু কথা তো হয়ই । তবে সেটা নিত্যনৈমিত্তিক নয়।

মাওলানা রহিমঃ বলতে গেলে গোটা জীবনের আদর্শের কথা বলছি। স্ত্রী-সন্তানদের কাছ থেকে পুরো সহযোগিতা পেয়েছি। তাই তাদের জন্য সময় কম দিলেও তাতে কোনো অভিযোগ নেই বরং তারা খুশিই থাকে।
জলিলঃ আমার স্ত্রীর কোন অনুযোগ নেই।
রনোঃ আমার স্ত্রী নিজেও রাজনীতি করেন। সুতরাং রাজনীতি করার কারণে সময় না দিতে পারলেও কোন অনুযোগের মুখোমুখি হই না।
শাহজাহান সিরাজঃ এধরনের অনুযোগের মুখোমুখি হওয়াটাই বাস্তব। তবে এখন এটা স্বাভাবিক হয়ে গেছে। এখন এমন অবস্থা হয়েছে যে কখনও সকাল সকাল বাসায় ফিরলে বা বাসায় বেশিক্ষণ থাকলে আমাকে অস্বাভাবিক মনে করেন।
জাফরঃ অবশ্যই অনুযোগের মুখোমুখি হই। তবে আমার স্ত্রী পরিস্থিতির সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়েছেন। আমার বিয়ে হয়েছে আত্মগোপন অবস্থায় , ভয়ের কারণে আমার বিয়ের অনুষ্ঠানে আমিসহ বরযাত্রীর সংখ্যা ছিল মাত্র ৭ জন। স্ত্রীর সাথে ঠিকমত দেখা হয়নি। ঐদিনই প্রথম থেখে বুঝে নিয়েছে সব ব্যাপার। তাই সে মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিল ওই সময় থেকেই। সে কারণে এখন তেমন কোনো অসুবিধা হবার কথা নয় এবং হয়ও না।
প্রশ্নঃ আমাদের দেশে প্রায়ই রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটছে। আপনার স্ত্রী কি এ ব্যাপারে কখনো শঙ্কাবোধ করেন?
মিজান চৌধুরীঃ মাঝে মাঝে আমার স্ত্রী বলেন -এধরনের রাজনীতি না করার জন্য।
মালেক উকিল হ্যাঁ শঙ্কাবোধ তো করেই। বিশেষ করে ১৯৭৫ সালের পর থেকে।
টি, আলীঃ ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর আমার স্ত্রী খুবই শংকিত ছিল। কিছু অস্ত্রধারী লোক আমাকে মারতে এসেছিল। আমি জানিনা কেন তারা দ্বিতীয় বার আসেনি। আমি এবং আমার পরিবারের কেউই হত্যার রাজনীতি পছন্দ করে না।
রাজ্জাকঃ এমন অবস্থার সৃষ্টি হলে তো শংকিত থাকার কথাই।
মাওলানা রহিমঃ আমাদের দেশে প্রায়শই রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটছে যা আমাদের জাতীয় কলঙ্ক। আমি যে রাজনীতি করছি তার জন্য আমাকে প্রাণ দিতে হলেও তা আমার এবং আমার স্ত্রী সন্তানদের জন্য অগৌরবের জিনিস হবে না, কাজেই তাদের কারো কোন শঙ্কাবোধ নেই।
জলিলঃ আমার স্ত্রী এ ব্যাপারে কখনো কিছু বলেনি।
রনোঃ দেশের অস্থিতিশীল অবস্থার কারণে যেটুকু শঙ্কাবোধ ও সতর্কতার প্রয়োজন তা আমার পরিবারের সদস্যদের আছে বলে মনে হয়। তবে এই শঙ্কাবোধের কারণে আমাকে রাজনৈতিক কার্যক্রম থেকে বা প্রয়োজনীয় ঝুঁকি নেওয়া থেকে বিরত থাকতে বলেন না। সম্ভবতঃ এ কারণেই গত ২৫ বছরে দেখা গেছে ‘ও কথা বলে লাভ নেই’।
শাহজাহান সিরাজঃ না, আমার স্ত্রীর তেমন কোন শঙ্কাবোধ নেই।
জাফরঃ এব্যাপারে স্ত্রী বা আমার সন্তানদের শঙ্কাবোধ থাকাটা খুবই স্বাভাবিক।
প্রশ্নঃ সাংসারিক ব্যয় নির্বাহের জন্য আপনারা আয়ের উৎস কি?
মিজান চৌধুরীঃ আমার আয়ের উৎস হচ্ছে – ইন্ডাস্ট্রিও পৈত্রিক সম্পত্তি।
মালেক উকিলঃ আমার আইন ব্যবসা ছাড়াও কিছু অর্থ সম্পত্তি থেকে আসে। আর স্ত্রীর সম্পত্তি থেকেও কিছু পাই।
টি, আলীঃ আপনি কেন এ প্রশ্ন করছেন? এগুলো তো ইনকাম ট্যাক্সের লোকেরাই করবে। আমার সম্পত্তি আছে। আমি জীবন-যাপনের একটা ‘স্টান্ডার্ড মেইনটেইন’ করে থাকি।
রাজ্জাকঃ আমার কোনো আয় নেই। শ্বশুর বাড়ি থাকি খাই। তবে মাঝেমধ্যে দেশের বাড়ি থেকে যা আসে তা সংযোজিত হয়।
মাওলানা রহিমঃ আমার লেখা বইপত্র বিক্রয়লব্ধ অর্থ দিয়ে পারিবারিক ব্যয় নির্বাহ করি।
জলিলঃ আমার কোনো আয়ের উৎস নাই। সকলের সাহায্যের উপর বেঁচে আছি। বলতে পারেন -‘আইএম চ্যারিটি’। তাছাড়া ‘মার্কসবাদ মুক্তির পথ’ এবং ওই ধরনের বই আছে তা দিয়ে অত্যন্ত সামান্য কিছু অর্থ আসে।
রনোঃ আমি যৌথ পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। পরিবারের প্রধান কর্তা আমার পিতা। তাঁর আয় থেকে গোটা পরিবারের খরচ চলে।
শাহজাহান সিরাজঃ আমার স্ত্রী চাকরি করেন। এটাই আমার পরিবারের আয়ের অন্যতম একটি উৎস। তবে সত্যি কথা বলতে কি , শ্বশুরের জায়গায় আমার একটি দোকান আছে। তাছাড়া আমার ব্যক্তিগত খরচ নির্বাহ হয় পার্টি থেকে।
জাফরঃ আমার আয়ের প্রধান উৎস পিতৃপ্রদত্ত অর্থ। তবে আমার একটি প্রেস আছে। সেখান থেকে সামান্য কিছু আয় হয়।
প্রশ্নঃ আপনার পারিবারিক খরচের বাজেট কত?
মিজান চৌধুরীঃ খরচের কোন বাজেট নেই । সংসার চলছে তো চলছেই। আর বাজেট রাখাও সম্ভব নয়।
মালেক উকিলঃ খরচের তো চূড়ান্ত কোন বাজেট করা সম্ভব হয় না। তবে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়।
টি, আলীঃ রাজধানীতে বসবাসকারী অন্যান্য পরিবারের দিকে তাকালেই বুঝতে পারবেন আমার বাজেট বা খরচ কত।
রাজ্জাকঃ আমিও আমার পরিবারের খাওয়া থাকার কোন খরচ নেই। এমনিতে একান্ত যে খরচ তা আমাকে বাদ দিয়ে হাজার খানেক হবে।
মাওলানা রহিমঃ বাজেট তেমনভাবে নেই তবে প্রায় ছয় হাজার টাকা খরচ হয় ।
জলিলঃ যখন যা পাই তা দিয়ে সংসার চালাই।
রনোঃ আগেই উল্লেখ করেছি আমার পিতার আয় থেকেই পরিবারের খরচ চলে। সে আয় কত, কি পরিমান তার সঠিক হিসাব আমার জানা নেই। তবে মোটামুটিভাবে আমাদের পরিবারকে একটি উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবার বলে গণ্য করা যায়।
শাহজাহান সিরাজঃ পারিবারিক বাজেট ছয়-সাত হাজার টাকার কম নয়।
জাফরঃ আমার বাড়ির খরচ আনুমানিক ১২ হাজার টাকা।
প্রশ্নঃ আপনার পিতার পেশা কি ছিল?
মিজান চৌধুরীঃ আমার পিতা জমিদার ছিলেন । এছাড়াও তিনি পাটের বড় ব্যবসায়ী ছিলেন।
মালেক উকিলঃ তিনি স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন ।
টি,আলী্ তিনি পুলিশ ইন্সপেক্টর ছিলেন।
রাজ্জাকঃ ব্যবসা করতেন ।
মাওলানা রহিমঃ পিতা ভূমি মালিক ছিলেন।
জলিলঃ বাবা ব্যবসায়ী ছিলেন। তবে আমার জন্মের পূর্বে তিনি মারা যান। তাই আমি মামারবাড়ীতে মানুষ হয়েছি।
রনোঃ আমার পিতা একজন প্রকৌশলী। তাঁর ব্যক্তিগত ব্যবসাও আছে। সেটা মূলত কনসাল্টিং ফার্ম।
শাহজাহান সিরাজঃ আমার পিতা একজন আইনজীবী ছিলেন। টাঙ্গাইলের প্রাক্টিস করতেন।
জাফরঃ আমার পিতা একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী।
প্রশ্নঃ উত্তরাধিকারসূত্রে কি পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়েছেন ?
মিজান চৌধুরীঃ এই কিছুতো পেয়েছি।
মালেক উকিলঃ বাড়ি ছাড়াও ১০ থেকে ১৫ একর জমি পেয়েছে ।
টি, আলীঃ না, আমার পিতা তেমন কোনো সম্পত্তি রেখে যাননি ।
রাজ্জাকঃ আমার পিতার ব্যবসায়ীক সম্পত্তি ভাগে পাইনি। যে সম্পত্তি ছিল তা ভাই-ভাইয়ের ছেলেরা ভোগ করছে। আমার পিতা মাত্র ৫ কাঠা জমি দিয়ে গেছেন ঢাকা শহরে।
মাওলানা রহিমঃ উত্তরাধিকারসূত্রে খুবই সামান্য পেয়েছি। আমার বোনদের শরীয়ত মতে দিয়ে দেওয়ার পর এখন জমি থেকে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা বেশি পাই নি।
জলিলঃ উত্তরাধিকারসূত্রে যা পেয়েছি তা এখন আমার ফুপু ভোগ করছেন। সে কারণে বলতে পারেন আমি কোন সম্পত্তি পাইনি ।
রনোঃ যৌথ পরিবারের অন্তর্ভুক্ত বলে এখনো আমি উত্তরাধিকারসূত্রে কোন সম্পত্তির মালিক হইনি।
শাহজাহান সিরাজঃ উত্তরাধিকারসূত্রে তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো সম্পত্তির মালিক হইনি। কারণ আমাদের জমিজমা তেমন ছিলনা। টাঙ্গাইল শহরে ৫ কাঠা জমি আছে। এছাড়া গ্রামেও কিছু জমিজমা আছে।
জাফরঃ আমার পিতামাতা জীবিত সুতরাং আমি এখনো কোন পৈত্রিক সম্পত্তির মালিক হইনি।
প্রশ্নঃ আপনার মোট সম্পত্তির আনুমানিক মূল্য কত?
মিজান চৌধুরীঃ (তিনি এ প্রশ্নের জবাবে কিছুই বলেননি।)
মালেক উকিলঃ (তিনি প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বললেন -আমি আসলে সেলফ মেইড ম্যান ।)
টি, আলীঃ( এ প্রশ্ন শুনে তিনি রেগে যান এবং উত্তর দেননি)
রাজ্জাকঃ হিসেব করে দেখুন কত দাঁড়ায়।
মাওলানা রহিমঃ (উত্তর দেননি।)
জলিলঃ সম্পত্তি নেই। তারপরে আবার মূল্য কি?
রনোঃ আমার নিজের কোন সম্পত্তি নেই।
শাহজাহান সিরাজঃ আমার বারিধারাতে একটা জায়গা আছে। উত্তরাধিকারসূত্রে তেমন কিছু পাইনি। আনুমানিক মূল্য কি আর বলবো।
জাফরঃ আমার নিজের কোন ব্যাংক একাউন্ট নেই। আর সম্পত্তি বলতে নিজের নামে একটি প্রেস এবং ১৯৬৪ সালে কারাগারে থাকাকালীন আমার নামে আমার পিতা ক্রয় করে করা ৫ কাঠা জমি আছে। অবশ্য এর অধিকাংশ এখন অন্যের দখলে।
প্রশ্নঃ নিজের বাড়িতে না ভাড়া বাড়িতে থাকেন? ভাড়া বাড়িতে থাকলে বাড়ি ভাড়া কত দেন?
মিজান চৌধুরীঃ নিজের বাড়ি আছে।
মালেক উকিলঃ নিজের বাড়িতে থাকি।
টি, আলীঃ নিজের বাড়ি আছে।
রাজ্জাকঃ শ্বশুর বাড়িতে থাকি।
মাওলানা রহিমঃ বলতে পারেন আমি আমার স্ত্রীর বাড়িতে থাকি। স্ত্রীর প্রাপ্য মোহরানা দিয়ে এ বাড়ি তৈরি এবং এ বাড়ির পেছনে আমার ব্যয়ই এর ভাড়া। বর্তমানে এভাবেই বাড়ি তিন তলা পর্যন্ত সমাপ্ত হয়েছে।
জলিলঃ ভাড়া বাড়িতে থাকি। বাড়ি ভাড়া তিন হাজার টাকা।
রনোঃ পৈত্রিক বাড়িতে থাকি।
শাহজাহান সিরাজঃ ভাড়া বাড়িতেই থাকি। ভাড়া মাসিক তিন হাজার টাকা।
জাফরঃ আমি ভাড়া বাড়িতে থাকি। মাসিক ভাড়া তিন হাজার টাকা।
প্রশ্নঃ টেলিফোন আছে কি? মাসে কত বিল দেন ?
মিজান চৌধুরীঃ টেলিফোন আছে দু’টো। যা বিল তা আমার ইন্ডাস্ট্রি থেকে দেয়া হয়। তাই কত কি বিল আমি জানিনা। তবে জনদল করার পর থেকে টেলিফোন পাবলিক কল অফিসের মত হয়ে গেছে।
মালেক উকিলঃ হ্যাঁ, টেলিফোন আছে । তবে টেলিফোন বিলের কোন ঠিক নেই।
টি, আলীঃ ( তিনি প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হন এবং এ প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যান।)
রাজ্জাকঃ টেলিফোনের বিল পার্টি দেয়। বিল মাসে এক হাজারের মতো হয়।
রহিমঃ টেলিফোন আছে। মাসে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা বিল দিতে হয়।
জলিলঃ টেলিফোন আছে। তবে বিলের কোন ঠিক নেই।
রনোঃ আমার নিজের নামে কোন টেলিফোন নেই । আমার পিতা টেলিফোনেই আমি ব্যবহার করি। তবে মাসে কত বিল হয় তা জানিনা।
শাহজাহান সিরাজঃ হ্যাঁ,টেলিফোন আছে। তবে গড়ে প্রতি মাসে ৫শ’ টাকা বিল দেই।
জাফরঃ আমার একটি টেলিফোন আছে। মাসে গড়পড়তা বিল হয় দু’হাজার টাকা।
প্রশ্নঃ আপনার গাড়ি আছে কি? তার পেছনে মাসে খরচ কত?
মিজান চৌধুরীঃ গাড়ি আছে দু’টো। কত খরচ হয় আমি তা জানি না । কারণ ইন্ডাস্ট্রি থেকে গাড়ির তেল খরচ আসে। নিজের কিনতে হয় না ।
মালেক উকিলঃ গাড়ি আছে একটি। এর পেছনে মাসে দুই থেকে তিন হাজার টাকা খরচ হয়।
টি, আলীঃ( ক্ষুব্দ হয়ে যাওয়ায় তাকে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা যায়নি।)
রাজ্জাকঃ গাড়ি আছে। পার্টি খরচ দেয়। মাসে তিন থেকে চার হাজার টাকার মতো খরচ হয়।
মাওলানা রহিমঃ আমার গাড়ি নেই। রিকশা এবং স্কুটার আমার গাড়ি । জলিলঃ গাড়ি আছে। তেলের খরচের ঠিক নেই। একজনকে ধরলে কিনে দেয়। ধরুন আপনাকে বললাম, আপনি কিনে দিলেন। এরকম ভাবে চলে।
রনোঃ আমার পিতার গাড়ি আছে। কখনো কখনো তা ব্যবহার করি। তবে সাধারনত আমি বাসে, রিকশায় ও স্কুটারে চলাফেরা করি।
শাহজাহান সিরাজঃ গাড়ি আছে। তবে তা পার্টির কাজেই ব্যবহৃত হয়। খরচের কোন ঠিক নেই ।
জাফরঃ আমি গাড়ি ব্যবহার করি ।তবে তার মালিক বাংলা শ্রমিক ফেডারেশন। ফেডারেশনের সভাপতি হিসাবে আমি ওই গাড়ি ব্যবহার করি। গাড়ির পেছনে আনুমানিক খরচ হয় দুই হাজার টাকা।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!