You dont have javascript enabled! Please enable it!

জামাত ও গোলাম আযমের পুনরুত্থান | পাকিস্তানের এই নাগরিক সম্পর্কে তারা কি ভাবছেন

সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ২৭ এপ্রিল ১৯৮৪ | শাহরিয়ার কবির

‘….আজ এখানে দাঁড়িয়ে এই রক্ত গোধূলিতে অভিশাপ দিচ্ছি। আমাদের বুকের ভেতর যারা ভয়ানক কৃষ্ণপক্ষ দিয়েছিলো সেঁটে, মগজের কোষে কোষে যারা
পুঁতেছিলো আমাদেরই আপনজনের লাশ দগ্ধ রক্তাপ্লুত,
যারা গণহত্যা
করেছে শহরে গ্রামে টিলায় নদীতে ক্ষেত ও খামারে,
আমি অভিশাপ দিচ্ছি নেকড়ের চেয়েও অধিক
পশু সেই সব পশুদের।’
……… ………… ……….. …………. ………..
অভিশাপ দিচ্ছি এতটুকু আশ্রয়ের জন্যে, বিশ্রামের
কাছে আত্মসমর্পণের জন্যে
দ্বারে দ্বারে ঘুরবে ওরা প্রেতায়িত
সেই সব মুখের ‍ওপর—
দ্রুত বন্ধ হয়ে যাবে পৃথিবীর প্রতিটি কপাট।
অভিশাপ দিচ্ছি।
অভিশাপ দিচ্ছি,
অভিশাপ দিচ্ছি…….
(অভিশাপ দিচ্ছি/শামসুর রাহমান)

ইতিহাসের চির অভিশপ্ত সেই ঘাতকের দল, ’৭১-এর স্বাধীনতাযুদ্ধে যারা ছিল হানাদার বাহিনীর প্রত্যক্ষ দোসর, সেই জামাতীরা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। মাথাচাড়া দিয়েছে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের কথা বলে, থাবার ভেতর হিংস্র নখগুলো লুকিয়ে রেখে।
বর্তমান সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে ’৮৩ সালের জানুয়ারীতে ছাত্ররা যে আন্দোলনের সূচনা করেছিল বহু টানাপোড়েন ও ঘাত-প্রতিঘাতের ভেতর দিয়ে অতিক্রম করে সেই আন্দোলন বর্তমানে চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। ছাত্রদের পাশাপাশি শ্রমিকরাও আন্দোলনে নেমেছেন। বিভিন্ন পেশা ও বুদ্ধিজীবীরা আন্দোলনে এগিয়ে এসেছেন। আন্দোলনে নেমেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। আন্দোলনের প্রয়োজনে গঠিত হয়েছে ১৫ দলীয় এবং ৭ দলীয় জোট। এই দু’টি রাজনৈতিক দলের জোট আবার ৫ দফা সাধারণ দাবীর ভিত্তিতে ঐক্যমতে উপনীত হয়ে রচনা করেছে ২২ দলের কাঠামো, যার চাপ সামরিক সরকার প্রধান জেনারেল এরশাদও উপেক্ষা করতে পারেননি।
গোটা দেশব্যাপী আন্দোলনের এই অনুকূল পরিবেশ লক্ষ্য করে মাঠে নেমেছে ’৭১-এর স্বাধীনতাযুদ্ধে হানাদার বাহিনীর প্রধান সহযোগী ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যার নেপথ্য নায়ক জামাতে ইসলামীরা। অবশ্য মাত্র বছর তেরো আগেও ছিল তবে এবার কৌশল পাল্টেছে। তারা রাজনীতি করতো গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক শক্তির সরাসরি বিরোধিতা করে, এবার তারা মাঠে নেমেছে গণতন্ত্রের আন্দোলনকে সহায়তা করার কথা বলে। জামাত নেতা অধ্যাপক গোলাম আযম বাস্তবে যিনি কিনা এখনো পাকিস্তানের একজন বিশ্বস্ত নাগরিক, যার হাতে এখনো লেগে আছে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের ৩৯ লক্ষ শহীদের রক্তের দাগ, নরপিশাচ আলবদর আলশামসদের সেই অভিশ্প্ত অধিনায়ক থাবার ভেতর ’৭১-এর হিংস্র ধারালো নখ ‍লুকিয়ে রেখে কুম্ভিরাশ্রু বিসর্জন করছেন সামরিক শাসনে গণতন্ত্র বিপন্ন বলে। কাগজে বিবৃতি দিয়ে গণতন্ত্র কায়েমের কথা বলছেন। গণতন্ত্রের জন্য তাঁর মায়াকান্নায় মুগ্ধ হয়ে ২২ দলের নেতারাও তাকে নিজেদের দোসর বলে ভাবতে শুরু করেছেন। যদিও এরই ভেতর কোন কোন মহল থেকে প্রতিবাদ এবং আসন্ন বিপদ সম্পর্কে হুঁশিয়ারী বাক্য উচ্চারিত হয়েছে, আহ্বান এসেছে গোলাম আযম ও জামাতকে প্রতিহত করার জন্য কিন্তু রাজনৈতিক মহল এ ব্যাপারে বিস্ময়জনক নীরবতা প্রদর্শন করছে। আর জেনারেল এরশাদও রাজনৈতিক মহলের মনোভাব লক্ষ্য করে জামাতে ইসলামীর নেতাদের সঙ্গে সংলাপের টেবিলে বসে তাদের আশ্বাস দিয়েছেন গোলাম আযমকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদানের বিষয়টি নাকি তিনি ভেবে দেখবেন। অথচ মাত্র বছর তিনেক আগে মুক্তিযোদ্ধারা যখন গোলাম আযম ও জামাতের পুনরুত্থানকে প্রতিহত করার জন্য দেশব্যাপী দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন তখন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে জেনারেল এরশাদ সেই আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছিলেন।

পুনরুত্থানের পটভূমি
’৭১-এর নয় মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতাযুদ্ধের ভেতর দিয়ে এটা তো মীমাংসিত সত্য হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছে জিন্নার দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিকে পাকিস্তান নাম যে অস্বাভাবিক ও বিকলাঙ্গ রাষ্ট্রটির জন্ম হয়েছিল তার মৃত্যু ঘটেছে। এই সত্যই এদেশে কবর রচনা করেছে সাম্প্রদায়িক রাজনীতিরও। এ সত্য তাদের কাছেও স্পষ্ট ছিল যারা ধর্মের দোহাই দিয়ে ২৩ বছর এদেশের মানুষকে শোষণ-পীড়ন করেছে, এবং যারা তাদের সহযোগিতা করেছে মৃত্যুর অন্তিম মুহূর্তেও। তাই তারা মরণ কামড়েরর নীল নকশাটি (বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা) এঁকে পালিয়ে গিয়েছিল তাদের পিতৃভূমি পাকিস্তানে। গোলাম আযম দেশ থেকে চলে গেলেও রেখে গিয়েছিলেন তার শ্বাপদবাহিনীকে আলবদর আলশামস প্রভৃতি ঘাতক বাহিনীর ভেতর সংগঠিত করে। তারা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়েছে তাদের পিতৃভূমির জন্য। পরাজয়ের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত হত্যা করেছে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের।
গোটা জাতির জন্য এটা দুর্ভাগ্যজনক যে স্বাধীনতার এক বছর পেরুতে না পেরুতেই তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ‘সাধারণ ক্ষমা’ ঘোষণা করে কারাগার থেকে মুক্তি দিলেন তাবৎ রাজাকার, আলবদর, আলশামসদের যাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল জামাতে ইসলামী। মুখে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে এবং সংবিধানে তা লিপিবদ্ধ করা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ ও সরকার প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান টুপি মাথায় চাপিয়ে ধর্মীয় জলসা, মাদ্রাসা ইত্যাদিতে দাওয়াত রক্ষা করতে গেলেন এবং ছাড়া পাওয়া জামাতীরা দল করতে না পারলেও মহাউৎসাহে ‘আজিমুশশান জলছা’ আয়োজন করে ওরশ নামে ধর্মীয় নেতাদের দ্বারা নিন্দিত, অভিশপ্ত মওদুদীর মতবাদ প্রচার করতে লাগলো।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জিয়াউর রহমান গদিতে বসে ৫ম সংশোধনীর দ্বারা সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা মুছে ফেললেন এবং রাজনৈতিক দলবিধি জারী করে জামাতে ইসলামীকে রাজনীতি করার অবাধে সুযোগ দিলেন। সুযোগ ও মওকা বুঝেই পাকিস্তানী নাগরিক গোলাম আযম এসে বাংলাদেশে পাকাপোক্ত আস্তানা গেড়ে বসলেন।

’৮১-র আস্ফালন
অসুস্থ মাকে দেখার কথা বলে তিন মাসের ভিসা নিয়ে পাকিস্তানী নাগরিক গোলাম আযম ঢাকা এসেছিলেন ’৭৮-এর ১১ জুলাই। ৮ বছর পর বাংলাদেশে এসেই জামাতকে সংগঠিত করার কাজে ঝাঁপ দিলেন। অতিথি হিসেবে দু’একটি পুনর্মিলনী ধরনের সভায় যোগ দিয়েছিলেন বটে তবে জনসভা করতে গিয়ে জনতার রুদ্ররোষের শিকার হয়ে পালিয়ে আসতে হয়েছিল তাকে।
১৯৮১’র ১ জানুয়ারী বায়তুল মোকাররমে অনুষ্ঠিত প্যালেস্টাইনের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ দু’জন বাংলাদেশী নাগরিকের জানাজায় কোন ফাঁকে যেন ঢুকে কাতারে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন এই লোক। জানাজা শেষ হওয়া মাত্র উপস্থিত জনতা তাঁকে চিনে ফেলে। চেনামাত্র শুরু হয় জুতোপেটা। কোন রকমে সে যাত্রাও পালিয়ে বাঁচেন।
জনতার হাতে বার বার লাঞ্ছিত হওয়ার পর গোলাম আযম তার দলের শ্বাপদবাহিনীকে লেলিয়ে দিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে। জামাত নেতা আব্বাস আলী খান সাংবাদিক সম্মেলন (২৯-৩-১৯৮১) করে বললেন ’৭১-এ আমরা ভুল করিনি।’ গোলাম আযমও পত্রিকান্তরে সাক্ষাৎকারে বললেন। ’৭১-এ যা ঠিক মনে করেছি তাই করেছি, এখনও তাই করবো।’ পাকিস্তানী নাগরিকটি দম্ভোক্তি করলেন স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে বসে, ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে, যে রক্তে এখনো লাঞ্ছিত এই ঘাতকের দুই হাত।
’৮১ সালে গোলাম আযম ও জামাতের ভয়াবহ আস্ফালনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার আহ্বান জানালেন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নেতারা। তাঁরা প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুললেন থানা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে। সংসদ নেতারা ঘোষণা করলেন, গোলাম আযমদের এদেশের মাটিতে রাজনীতি করতে দেয়া হবে না। সাপ্তাহিক বিচিত্রায় প্রকাশিত হলো গোলাম আযম ও জামাতের রাজনীতি শীর্ষক আলোড়ন সৃষ্টিকারী প্রচ্ছদ কাহিনী, যেখানে উন্মোচিত হলো এই ফ্যাসিস্ট সংগঠনটির চরম ঘৃণিত ও অভিশপ্ত চেহারা। দেশব্যাপী প্রবল জনমত গড়ে উঠলো জামাতীদের বিরুদ্ধে। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানও স্বাধীনতার শত্রুদের বিরুদ্ধে সংগঠিত প্রতিরোধ আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করলেন। তদন্ত কমিটিও গঠন করলেন। কিন্তু এর অল্প কিছুদিন পরই তিনি নিহত হলেন। তাঁর হত্যাকান্ডের সঙ্গে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি যে জড়িত ছিল এ বিষয়ে আজ আর সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।

’৮৪-র পুনরুত্থান
জেনারেল এরশাদ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যখন সংলাপ শুরু করার কথা প্রথম ঘোষণা করেছিলেন তখন অনেকগুলো রাজনৈতিক দল সংলাপে অংশগ্রহণ করলেও ১৫ ও ৭ দলীয় জোট ৫ দফার পূরণের পূর্বশর্ত দিয়ে সংলাপে যোগদান থেকে বিরত থাকে। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ২২ দলের অনুকূলে থাকার প্রথম দফায় যারা সংলাপে গিয়েছিলেন তাঁরা খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি। জেনারেল এরশাদও বুঝেছিলেন ২২ দলকে সংলাপের টেবিলের আনতে না পারলে তাঁর উদ্দেশ্য সফল হবে না। পূর্বাপর পরিস্থিতি বিবেচনা করে জামাতে ইসলামও ধূর্ততার সঙ্গে প্রথম দফার সংলাপ বর্জন করে। ভাবখানা ছিল এই যে, তারা ২২ দলের আন্দোলনের সমর্থক। আর ২২ দলও আন্দোলনের মুখোশ পরা জামাতের আসল চেহারা বেমালুম ভুলে গিয়ে—‘আছে থাক’ এমন একটা ভাব দেখাতে লাগলো জামাতের প্রতি। এমনকি ৭ দলীয় জোটের কোন শরীক জামাতকে তাদের জোটে ঢোকানোর ব্যাপারেও উৎসাহী ছিল। অন্যরা এই ভেবে বিরোধিতা করেছে জামাতকে জোটে ঢোকালে ১৫ দলের সঙ্গে সমঝোতাপূর্ণ সম্পর্ক ব্যাহত হবে। তবে ৭ এবং ১৫ উভয় জোটের বেশির ভাগ শরীক জামাতকে তাদের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে মিত্র ভেবে বসে আছে।
জামাতীরা অবশ্য বেশিদিন থাবার ভেতর নখ লুকিয়ে রাখতে পারেনি। গত ১১ এপ্রিল ১৫ দল জেনারেল এরশাদের সঙ্গে প্রথমবার সংলাপে বসে যখন রাজশাহীর ছাত্রনেতাদের দন্ডাদেশ বাতিল করিয়ে নেয়, তখনই জামাতীদের কদর্য চেহারাটা বেরিয়ে পড়ে। জামাতের সঙ্গে সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবির পরদিনই ‍বিবৃতি দিয়ে ১৫ দলও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আদায়কৃত এই দাবীর বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করেন। বিবৃতিতে তারা প্রকৃতি ঘটনাকে এমনভাবে বিকৃত করে যাতে মনে হতে পারে সামরিক আইনে দন্ডিত ১৪ জন ছাত্রনেতা আসলেই যেন অপরাধী ছিলেন। শিবির নেতারা বিবৃতিতে বলেছেন—’৮২ সালের ১১ই মার্চ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামী ছাত্র শিবিরের নবাগত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে হামলা চালিয়ে শিবিরের চারজন কর্মীকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। আহত করা হয় অর্ধ-শতাধিক শিবির কর্মীকে। এ নৃশংস ও নির্মম হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে গোটা দেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। অন্যায়ভাবে ক্ষমতায় জেকে বসা সামরিক জান্তা দীর্ঘদিন অতিবাহিত হবার পরও এর কোন বিচার করেনি। অবশেষে এর বিচার হয়। কিন্তু বিচারের এ রায়কে কার্যকর করার পরিবর্তে টালবাহানার আশ্রয় নেয়া হয় এবং পরিশেষে সরকার তার নিজস্ব স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যেই দন্ডাদেশ মওকুফ করে দেয়। আমরা মনে করি অন্যায়ভাবে ক্ষমতা দখলকারী সামরিক জান্তার পক্ষ থেকে দন্ডাদেশ মওকুফের ঘোষণা আর একটি জঘন্যতম অপরাধ এবং শিক্ষাঙ্গনে প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যাকান্ড অনুষ্ঠানে সহযোগিতা করারই শামিল। তাই সামরিক জান্তার এ অন্যায় পদক্ষেপের বিরুদ্ধে আমরা তীব্র ক্ষোভ ও নিন্দা জ্ঞাপন করছি।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত ঘটনার প্রকৃত বিবরণ যাঁরা জানেন না তাদের জন্য শিবিরের এই বিবৃতি স্বাভাবিকভাবেই উদ্বেগজনক মনে হবে। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা জানা থাকলে বোঝা যাবে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার ক্ষেত্রে, নির্জলা মিথ্যাকে সত্য বলে প্রচারের ক্ষেত্রে জামাতীদের মত ধূর্ততা আর কেউ প্রদর্শন করতে পারবে না।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে কি ঘটেছিল?
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতাদের দন্ডাদেশ বাতিলের জন্য ছাত্র সংগ্রাম পরিষদই শুধু আন্দোলন করেনি, দেশের গণতন্ত্রকামী প্রতিটি মানুষ এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন। বিবৃতি দিয়েছেন রাজনৈতিক নেতারা, বুদ্ধিজীবীরা, আন্দোলনে নেমেছেন ছাত্ররা—নিশ্চয়ই কয়েকজন ‘খুনী’কে সমর্থন করার জন্য নয়। হত্যার দায়ে যেখানে অভিযুক্ত করা উচিত জামাতীদের সেখানে প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় কর্মীদের সামরিক আদালতে বিচার করে দন্ড প্রদান সুগভীর ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছু নয়।
ঘটনা সম্পর্কে বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন একটি তথ্যপূর্ণ দলিল প্রকাশ করে। এর অংশ বিশেষ আমরা উদ্ধৃতি করছি—
১৯৮২ সালের ১০ই মার্চ স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরুদ্ধাচরণকারী এবং আলবদর-রাজাকার ঘাতক বাহিনীগুলির মূল সংগঠক জামাতের লেজুড় ইসলামী ছাত্র শিবিরের একটি আপত্তিকর প্রচারপত্র বিলিকে কেন্দ্র করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ইসলামী ছাত্র শিবিরের কিছু পান্ডার সঙ্গে সাধারণ ছাত্রদের সঙ্গে বাক-বিন্ডতার সূত্রপাত হলে শিবিরের পান্ডারা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার কমান্ডার নূরুল হকসহ সাধারণ ছাত্রদের উপর আক্রমণ চালায়। এই একতরফা আক্রমণের ফলে মুক্তিযোদ্ধা নূরুল হক, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র নাজমুল আহত হয়। এই ঘটনায় সঙ্গত কারণেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে উত্তেজনা ও বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়।
ছাত্র শিবিরের এই ন্যাক্কারজনক হামলার প্রতিবাদ ও নিন্দা জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে পরেরদিন ১১ই মার্চ সকাল ন’টায় বাংলাদেশ বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রলীগ (মু-হা), ছাত্রলীগ (ফ-চ) ও বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় শহীদ মিনারে এক প্রতিবাদ সভা আহ্বান করা হয়। এই প্রতিবাদ সভায় যখন বিভিন্ন হল থেকে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা এসে জমায়েত হচ্ছিল এবং বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ এসে উপস্থিত হলেন, ঠিক তখনই প্রায় চার-পাঁচশ’ ছাত্র নামধারী সশস্ত্র গুন্ডা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ থেকে বেরিয়ে এসে এক সাথে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রী ও ছাত্র নেতৃবৃন্দের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাদের হাতে ছিল লাঠি, ছোরা, হকিস্টিক এবং আক্রমণের অন্যান্য মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র। এখানে উল্লেখ্য যে, যারা এই সশস্ত্র আক্রমণে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়, তাদের অধিকাংশই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নয়, বহিরাগত ও ভাড়াটে গুন্ডা। শিবির ও ছাত্র নামধারী এই ভাড়াটে গুন্ডারা আগের রাতে এসে মসজিদে অবস্থান নিয়েছিল ছাত্রদের উপর সংগঠিত ও অতর্কিত হামলা চালাবার ঘৃণ্য উদ্দেশ্যে।
এরপর তার আমতলার দিকে ধাওয়া করে এবং সেখানে বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্তভাবে যারা ঘোরাঘুরি করছিল, কিংবা ক্লাসে যাচ্ছিল তাদের উপরও হামলা চালায়। শিবিরের পূর্ব-পরিকল্পিত এই সকল হামলায় অসংখ্য নিরীহ ছাত্র আহত হয়।
এদিকে ইসলামী ছাত্র শিবিরের বেপরোয়া আক্রমণের ফলে নিরীহ ছাত্র-ছাত্রীদের আহত হওয়া এবং উত্তেজনাকর পরিস্থিতির খবর পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোক্টর জনাব কিউ, এম, হারুন ও ছাত্র উপদেষ্টা জনাব মনিরুজ্জামান, অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক জনাব ইউনুস, হবিবুর রহমান হলের প্রোভোস্ট এবং ডঃ শহীদুল ইসলাম ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন এবং তাঁরাও শিবিরের ছাত্র নামধারী গুন্ডাদের নারকীয় তান্ডবনৃত্য স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেন। তাঁরা সশস্ত্র হামলাকারীদের আক্রমণ ও হামলা থেকে বিরত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু দেখা গেল, হামলাকারীরা তাদের কথায় কর্ণপাত তো করলোই না, ‍উল্টো শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের উপরই হামলা চালাতে উদ্যত হয়েছে।
এই অবস্থায় সাধারণ ছাত্ররা নীরব দর্শকের ভূমিকা নিয়ে আর দাঁড়িয়ে থাকতে রাজী হয়নি। তারা ইসলামী ছাত্র শিবিরের ভাড়াটে গুন্ডাদের বিরুদ্ধে দৃঢ় প্রতিরোধ গড়ে তুলতে এগিয়ে আসে। এই প্রতিরোধে বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী অংশগ্রহণ করে। ফলে ইসলামী ছাত্র শিবিরের ছাত্র নামধারী গুন্ডারা পিছু হটতে এবং সবশেষে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
এখানে উল্লেখ্য, সাধারণ ছাত্রদের এই প্রতিরোধের মুখে ছাত্র নামধারী হামলাকারীরা মরিয়া হয়ে যে হামলা চালায় তাতে রাকসুর উপ-সহসভাপতি ও বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের নেতা অনিল চন্দ্র মরণ, রাকসুর সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির রানা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য বজলার রহমান ছানাসহ অনেক ছাত্র আহত হয়। এই সময় সশস্ত্র হামলাকারীদে বহন করা ছুরিতে তাদের দুষ্কর্মের তিনজন সঙ্গী প্রথমে আহত ও পরে মারা যায়। বিশেষভাবে লক্ষ্য করার বিষয়, যারা মারা যায়, তারা কেউই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নয়। অর্থাৎ, ইসলামী ছাত্র শিবির সাধারণ ছাত্র-ছাত্রী এবং ছাত্র নেতৃবৃন্দ ও কর্মীদের উপর পরিকল্পিতভাবে হামলা চালানোর উদ্দেশ্যেই যে বহিরাগতদের সংগঠিত করে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে নিয়ে এসেছিল, তা এই হামলাকারীদের বেপরোয়া হামলার শিকার তিনজনের পরিচয় থেকেই সকলের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়।
এখন প্রশ্ন হলো, ইসলামী ছাত্র শিবিরের পরিকল্পিত হামলার শিকার তিনজন বহিরাগতের দুঃখজনক মৃত্যুর জন্য দায়ী কারা? নিশ্চয়ই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্ররা কিংবা ছাত্র নেতৃবৃন্দ নন। এই ঘটনার যদি উচ্চপর্যায়ের নিরপেক্ষ বিভাগীয় তদন্ত হতো এবং তার ভিত্তিতে দেশের প্রচলিত স্বাভাবিক আইনে এর বিচার হতো তাহলে প্রকৃত দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে তাদের উপযুক্ত শাস্তি প্রদান সম্ভব হতো। আমরা বার বার সে দাবীই জানিয়ে এসেছি। কিন্তু রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের মতলব থেকেই সামরিক সরকার তা করেনি।
ঐদিন ঘটনার পর পরই রাকসুর সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির রানা বহিরাগতদের দ্বারা আক্রান্ত সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের পক্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোক্টরের মাধ্যমে থানায় একটি এজাহার দেন। ইসলামী ছাত্র শিবিরও নিজেদের অপরাধ ঢাকার জন্য ছাত্র নেতৃবৃন্দকে আসামী করে একটি পাল্টা এজাহার দেয়।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, ঢাকাস্থ একটি বিদেশী দূতাবাসের চাপের মুখে সর্বোচ্চ সরকারী কর্তৃপক্ষের নির্দেশে স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশ সাধারণ ছাত্রদের পক্ষ থেকে দায়েকৃত এহাজারের অভিযোগের কোন তদন্তই করেনি। পক্ষান্তরে ইসলামী ছাত্র শিবিরের দায়ের করা মিথ্যা এজাহারের ভিত্তিতে কোন তদন্ত ছাড়াই ১৭ জন ছাত্রনেতার বিরুদ্ধে চার্জশীট দাখিল করে।

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ঘটনা সম্পর্কে কি বলেছিলেন?
এই ঘটনার দু্ইদিন পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তদানীন্তন উপাচার্য প্রফেসর মোসলেম হুদার অনুমতি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ঘটনা সম্পর্কে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশের জন্য একটি বিবৃতি প্রদান করেন। বিবৃতিটি দেশের সকল জাতীয় দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
রেজিস্ট্রার কর্তৃক স্বাক্ষরিত বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের সেই বিবৃতিতে বর্ণিত ঘটনার বিবরণই দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রমাণ করে যে, (এক) ইসলামী ছাত্র শিবিরের পান্ডারাই এই ঘটনা এবং তিনজন বহিরাগতের দুঃখজনক মৃত্যুর জন্য দায়ী। (দুই) ইসলামী ছাত্র শিবির এবং তাদের রাজনৈতিক মুরুব্বিরা বিশ্ববিদ্যালয়ে অরাজকতা, নৈরাজ্য ও অশান্তি সৃষ্টি করার জন্য পূর্ব-পরিকল্পিতভাবে ছাত্র নামধারী সশস্ত্র বহিরাগতদের ঘটনার আগের দিন গভীর রাতে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে নিয়ে আসে এবং বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদে লাঠি, ছোরা, হকিস্টিক ও অন্যান্য মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে থাকার ব্যবস্থা করে এবং পবিত্র মসজিদকে ’৭১ সালের মতো দুষ্কর্ম সাধনের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে। (তিন) পুলিশের কাছে প্রদত্ত এজাহারে তারা রাকসুর কর্মকর্তা ও ছাত্র নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে যে সকল অভিযোগ এনেছে তা মিথ্যা, ভিত্তিহীন এবং হীন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
এই ঘটনার পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে এবং সংবাদপত্রে যে বিবৃতি দেয় তাতেও ইসলামী ছাত্র শিবির ও তাদের মুরুব্বিদের অপরাধ সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়। শিক্ষক সমিতির বিবৃতিতে এই ঘটনার জন্য দায়ী এবং প্রকৃত দোষী ব্যক্তিদের খুঁজে বের করে শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে শিক্ষার সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করার দাবী জানানো হয়েছিল। কিন্তু শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের সে দাবীর প্রতিও তৎকালীন সরকার কিংবা পরবর্তীকালের শাসক সামরিক জান্তা কর্ণপাত করেনি।

মামলাটি সাজানো ও হীন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত
ঘটনা সম্পর্কে পুলিশের কাছে প্রদত্ত ইসলামী ছাত্র শিবিরের এজাহারে আসামী হিসেবে যাদের নাম দেয়া হয়, ঘটনার দিন তাদের অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে উপস্থিত ছিলেন না। ছাত্রলীগ (মু-হা)-এর শ্যামল কুমার রায়, সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজার রহমান আজু, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের এনায়েত হোসেন (যিনি ঘটনার অনেক আগেই বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন), রাকসুর সহ-সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ—এরা কেউই ঘটনার দিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের আর একজন ছাত্র টাঙ্গাইলের সিরাজুল ইসলামকে এই মামলায় আসামী করা হয় এবং পরে বাদীপক্ষ ছাত্র শিবিরই কোর্টে এ্যাফিডেভিট করে তার নাম এজাহার থেকে খারিজ করার ব্যবস্থা করে।
মামলাটি কতটা হীন উদ্দেশ্যপ্রসূত ও মিথ্যা তা এই সব ঘটনা থেকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অথচ সমগ্র বিষয়টি নিয়ে যারা বিচার-প্রহসন করেছেন—তারা এসব যুক্তি কখনই বিবেচনায় আনাও প্রয়োজন মনে করেননি।
পক্ষান্তরে, যারা ইসলামী ছাত্র শিবিরের সেদিনের পরিকল্পিত হামলায় আহত ও আক্রান্ত হয়েছিলেন তাদেরই বিরুদ্ধে বিচার-প্রহসন করে সশ্রম কারাদন্ড ঘোষণা করা হয়েছে। যে ১৭ জন নেতার ‍বিরুদ্ধে পুলিশ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে চার্জশীট দিয়েছিল, বগুড়ার বিশেষ সামরিক আদালত তাদের ১৪কেই কারাদন্ডে দন্ডিত করেছে।

জামাত পানি ঘোলা করছে
‘গণতন্ত্র’ ‘আন্দোলন’ এসব কথা বলে রাজনীতির জোয়ারে খানিকটা গা ভাসিয়ে, ২২ দল আর জেনারেল এরশাদের প্রশ্রয় পেয়ে জামাত তার স্বভাব অনুযায়ী পানি ঘোলা করছে কাঙ্ক্ষিত মাছটি ধরার জন্য। জামাত আন্দোলনের জন্য একটি অপরিহার্য শক্তি একথা প্রমাণ করতে পারলে গোলাম আযমকে নাগরিকত্ব প্রদানের বিষয়টি সামরিক সরকারের কাছে ‘গণতন্ত্রকামী’ বিরোধী দলের দাবী হিসেবে জনগণের কাছে প্রতীয়মান হবে। তাছাড়া ক্ষমতা হস্তান্তরের জামাতী ফর্মূলার অন্তর্নিহিত রূপটি এখন পর্যন্ত কোন রাজনৈতিক দল ধরতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। বাংলাদেশের রাজনীতিতে নিজেদের পাকাপোক্ত করার ব্যবস্থা এবার তারা এভাবেই করার কথা ভাবছে।
২২ দলের নেতারা মনে হয় জামাতের শক্তিকে সব সময় বাড়িয়ে দেখছেন। শ্রেণী হিসেবে যাঁরা জামাতকে মিত্র মনে করেন কিংবা যারা একই গুরুর শিষ্য হিসেবে জামাতকে গুরু ভাই মনে করেন তাদের কথা আমরা বলছি না। তাঁরা জামাতের আপদে-বিপদে জাতীয় ঐক্যের ধুঁয়া তুলে জামাতকে রক্ষা করবেন, ‘মানবিক দৃষ্টিকোণ’ থেকে গোলাম আযমকে নাগরিকত্ব দিতে বলবেন—তাদের কথা আলাদা। কিন্তু যারা কথায় কথায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রাখার কথা বলেন, তারা মনে করেন মুক্তিযুদ্ধের ইজারাদারীত্ব এখনও তাদের আছে, তারা কেন জামাতের ভেতর ইতিবাচক দিক খোঁজার জন্য উদগ্রীব এটা আমাদের বোধগম্যের বাইরে। খেঁকী কুকুরের মাথায় উকুন হলে যাকে তাকে কামড়াতে চায় বটে কিন্তু সেটা তার শক্তির পরিচায়ক নয়। ’৮১ সালে মুক্তিযোদ্ধারা যেভাবে জামাতীদের কুকুর তাড়া করেছিলেন সেটা কি ২২ দলের নেতারা ভুলে গেছেন? কোন রাজনৈতিক দলের সমর্থন ছাড়া মুক্তিযোদ্ধারা যদি সারমেয় দমনে যথেষ্ট শক্তিশালী হন তবে কেন সেইসব আঁস্তাকুড়ের কুকুরদের সঙ্গে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের কথা বলে ২২ দলের নেতাদের এক থালায় ভাত খেতে হবে? ২২ দলের আস্কারা না পেলে একজন পাকিস্তানী নাগরিক কি করে বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতিতে নাক গলাবার সাহস পায়? এই ঘাতকের নাগরিকত্ব দাবী করার সাহস পায় কোত্থেকে? কিভাবে তারা আন্দোলনের মাধ্যমে আদায় করা দাবীকে বলতে পারে ‘সামরিক সরকারের চক্রান্ত।’
জামাত পানি ঘোলা করছে, ২২ দলের নেতারা তাদের সাহায্য করছেন। সব নেতা না হলেও বেশিরভাগ নেতা জামাতকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন। জামাত চায় ’৭১ সাল আবার ফিরে আসুক। দেশের ছাত্র-শ্রমিক-জনতা যখন তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের দাবীতে সোচ্চার হয়ে আন্দোলনে নেমেছেন জামাত চায় সেই মুহূর্তে এমন কিছু ঘটনা সৃষ্টি করতে যাতে আন্দোলন ভিন্নখাতে প্রবাহিত হয়, তাতে সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের আন্দোলন পরিচালিত হয় এক গৃহযুদ্ধের লক্ষ্যে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জের টেনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ওপর শিবিরের হামলা তারই এক বাস্তব উদাহরণ।
জামাত ২২ দলকে তাদের বিরোধিতা থেকে বিরত রেখেছে ২২ দলের আন্দোলনকে সমর্থন করার কথা বলে। জেনারেল এরশাদকে চাপ দিচ্ছে ২২ দলের সমর্থনের কথা বলে। তারা জানে মুক্তিযোদ্ধারা আগের মতো সংগঠিত নয়। আন্দোলনের যে জোয়ার এসেছে সেখান থেকে যতটুকু ফায়দা তোলা যায় জামাত অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে সেটুকু করে চলেছে। যার ফলে পানি ক্রমশ ঘোলা হচ্ছে। জনগণের আন্দোলনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ক্রমশ হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে।

২২ দলের আন্দোলন ও জামাতে ইসলামী
ক্ষমতাসীন সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে ১৫ ও ৭ দলীয় জোট গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য ৫ দফার ভিত্তিতে যে আন্দোলন শুরু করেছে জামাতে ইসলামীও সেই আন্দোলনকে পরোক্ষভাবে সমর্থন করে সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের কথা ঘোষণা করেছে। ২২ দলের অধিকাংশ শরীক নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী বলে দাবী করে। স্বাধীনতার শত্রুদের বিরুদ্ধে বক্তৃতায় বিবৃতিতে এইসব দলের নেতারা অনেক কথাই বলেন। তবে কার্যক্ষেত্রে তারা স্বাধীনতার চিহ্নিত শত্রুদের কতটুকু বিরোধিতা করেন বিশেষ করে জামাতে ইসলামীর মতো ফ্যাসিস্ট পার্টি সম্পর্কে তাঁদের বর্তমান মূল্যায়ন কি—বিষয়টি জানা দরকার। আমরা ২২ দলের কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে প্রশ্ন করেছিলাম ‘২২ দল বর্তমানে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন চালাচ্ছে এক্ষেত্রে জামাতে ইসলামী পার্টির ভূমিকাকে আপনারা কিভাবে দেখছেন?’
আমাদের প্রশ্নের জবাবে বাকশাল নেতা কর্নেল (অবঃ) শওকত আলী বলেছেন—‘জাতীয় রাজনীতিতে জামাতের অবস্থান আমাদের জানা আছে এবং সেখানে আমাদের সঙ্গে তাদের রাজনীতির মৌল বিষয়সমূহে প্রচুর মতপার্থক্য রয়েছে। জাতীয় রাজনীতিতে তাদের বিতর্কিত অবস্থানের কারণেই তারা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল এবং এখনো আছে। সম্ভবতঃ সে কারণেই সামরিক শাসনবিরোধী জাতীয় ঐক্যমত যা ১৫ দল এবং ৭ দলের তথা জাতীয় আন্দোলনের মাধ্যমে গড়ে উঠেছে—সেখানে সামরিক আইনের প্রশ্নে তারা কিছু ইতিবাচক প্রশ্ন জনগণের সামনে তুলে ধরেছে এবং এর মাধ্যমেই তারা জনগণের সাথে যে বিচ্ছিন্নতা আছে তা কাটিয়ে উঠতে চায়।’
আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন—‘জামাতে ইসলামীর বর্তমান রাজনৈতিক ভূমিকা গণতন্ত্রে উত্তরণের পথে সহায়তা করছে।’
জাসদ নেতা শাহজাহান সিরাজ বলেছেন—
‘আমার ধারণা জামাতে ইসলামীর রাজনীতিতে একটা নতুন চৈতন্য এসেছে। তারা মনে করছে পুরনো কায়দায় সামরিক শাসন বা স্বৈরতন্ত্রকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমর্থন করে—জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে রাজনীতিতে টিকে থাকা সম্ভব না। সম্ভবতঃ সে কারণেই তারা সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনের মধ্যদিয়ে নিজেদের অবস্থান সংহত করার চেষ্টা করছে।’
৭ দলীয় জোটের শরীক গণতান্ত্রিক পার্টির নেতা সিরাজুল হোসেন খান বলেছেন—
‘৫ দফার আন্দোলন চলছে। ৭ দলীয় ঐক্যজোট ও ১৫ দল তাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে এ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছে। এর বাইরেও অনেক রাজনৈতিক দল ৫ দফা দাবী ও আন্দোলনকে সমর্থন করছে। বিশেষ করে সামরিক শাসনের অবসান করে সার্বভৌম জাতীয় সংসদ এর নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর-এর ইস্যুটি হচ্ছে ৫ দফার মূল দাবী। এ দাবীর প্রশ্নে আজ একটা অপ্রতিরোধ্য ঐক্যমত (কনসেন্সাস) গড়ে উঠেছে। এ কনসেন্সাসকে জামাতে ইসলামী দৃঢ়ভাবে সমর্থন করছে এবং নিজ অবস্থান থেকে আন্দোলনের সহায়ক। অবশ্য জামাতে ইসলামীর নিজস্ব সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণ রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি আছে।’
বাসদ নেতা খালেকুজ্জামান বলেছেন—
‘শুধু জামাতে ইসলামী পার্টি বলে কথা নয়, একটা স্বৈরাচার বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে যে কোন শক্তি—তা তাদের ভাবাদর্শ, শ্রেণী দৃষ্টিভঙ্গি এবং লুকানো উদ্দেশ্যের যতই ক্ষতিকারক দিক থাক না কেন এবং জনসাধারণকে সতর্ক করার বিষয়গুলো যত গুরুত্ব নিয়েই অবস্থান করুক না কেন, তারা অংশগ্রহণ করতে পারে এবং সমর্থন দিতে পারে। উক্ত বিষয়সমূহকে ঠিক ঠিকভাবে আদর্শগত ও সাংগঠনিক উভয়ক্ষেত্রে উন্মোচিত এবং পরাস্ত করা গেলে এই ধরনের অংশগ্রহণ এবং সমর্থন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের কার্যকারিতাকে বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। আজকের দিনে স্বৈরাচার বিশেষ করে আমাদের দেশের স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠী বিভিন্ন কৌশলে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুভূতিকে সুড়সুড়ি দিয়ে এবং পশ্চাদপদ সকল ধ্যান-ধারণাকে আশ্রয় করে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক দল ও শক্তিসমূহকে তাদের সামাজিক সমর্থনের ভিত হিসাবে গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল শক্তি ও আন্দোলনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে। সেদিক থেকে বর্তমানে সামরিক স্বৈরশাসন বিরোধী মনোভাব ও প্রচারসহ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতি জামাতে ইসলামীসহ আরও কতিপয় ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক দল ও শক্তিসমূহের সমর্থনের যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে।’
ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা রাশেদ খান মেনন বলেছেন—
‘বর্তমান সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন চলছে সেক্ষেত্রে ২২ দল ও জামাতে ইসলামীর লক্ষ্যের ক্ষেত্রে ঐক্য থাকলেও, অবস্থান ভিন্ন। এই ভিন্ন অবস্থান ঐতিহাসিক কারণে। যার ফলে ২২ দল ও জামাতে ইসলামী সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে একই সময় অংশগ্রহণ করলেও, দুই ধারার কোন মিল হচ্ছে না। এবং জামাতে ইসলামী যদি তার মূলগত অবস্থান পরিবর্তন না করে তবে এই মিল হওয়ার সম্ভাবনাও কম।
একথা সুস্পষ্ট যে ২২ দল, বিশেষ করে ১৫ দলের সামরিক শাসনবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার কোন অবকাশ নাই। সেক্ষেত্রে জামাতে ইসলাম এখনও পর্যন্ত স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী আদর্শগত অবস্থান পরিবর্তন করেনি। গোলাম আযমের নাগরিকত্ব প্রদানের দাবী ও জামাত সমর্থক ইসলামী ছাত্র শিবিরের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৪ জন ছাত্রনেতার সামরিক কোর্টে দন্ডাদেশ প্রত্যাহারের বিরোধিতা জামাতের উক্ত অবস্থানেরই প্রমাণ দেয়। তবে জামাত সামরিক শাসনের বিরোধী অংশগ্রহণ করায় ২২ দলের আন্দোলন কিছু সুবিধা পেয়েছে। তবে এই সুবিধার কারণে মৌল বিষয়কে বিসর্জন দেয়া যায় না।’
ইউপিপি’র নেতা কাজী জাফর আহমেদ বলেছেন—‘৭ দলীয় ঐক্যজোট ও ১৫ দল যুগপৎভাবে জাতীয় দাবী ৫ দফার ভিত্তিতে যে আন্দোলন গড়ে তুলেছে তাতে জামাতে ইসলামী সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে।’
সিপিবি (বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি)’র নেতা মোহাম্মদ ফরহাদ বলেছেন—
‘জামাতে ইসলামীর সর্বশেষ রাজনৈতিক ভূমিকা অর্থাৎ বিবৃতির মাধ্যমে অধ্যাপক গোলাম আযমের রাজনৈতিক অঙ্গনে পদচারণা, জামাতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবির কর্তৃক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৪ জন ছাত্রনেতার দন্ডাদেশ মওকুফ সম্পর্কিত উক্তি সম্পর্কে দলগত মূল্যায়নের সময় এখনো পর্যন্ত হয়ে ওঠেন। তবে এ ব্যাপারে দলগত মূল্যায়ন ছাড়াও বলা যায়, সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনের আংশিক বিজয় হিসেবেই ছাত্রনেতাদের দন্ডাদেশ মওকুফ হয়েছে। এ ব্যাপারে শিবির-এর বক্তব্য আন্দোলনের বিজয় এর বিরুদ্ধেই গেছে। তবে এও স্বীকার্য, ১৫ দল ও ৭ দলের সামরিক শাসনের বিরোধী আন্দোলনে জামাত কিছু ইতিবাচক উপাদান রেখেছে। কিন্তু সার্বিক বিচারে মনে হয় সাম্প্রতিক সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে তারা শুধু তাদের অতীত ভূমিকার স্খলন করে চলতি ধারায় আসতে চেয়েছে। অধ্যাপক গোলাম আযমকে রাজনীতিতে পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই তারা সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে শরীক হয়ে তার ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করছে। সুতরাং জামাতের এ আন্দোলনে অংশগ্রহণ কতটা জাতির জন্য আর কতটা গোলাম আযম-এর স্বার্থে সঙ্গত কারণেই সে সন্দেহের উদ্রেক হয়।’

গোলাম আযমের নাগরিকত্ব সম্পর্কে নেতারা কি ভাবছেন?
’৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধে পাক-হানাদার বাহিনীর অন্যতম দোসর এবং ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যার নেপথ্য নায়ক জামাতে ইসলামীর নেতা অধ্যাপক গোলাম আযম পাকিস্তানী নাগরিক হয়েও দীর্ঘকাল বাংলাদেশে বসবাস করছেন এবং সময় সুযোগ বুঝে তাঁর দলের লোকজন তাঁকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদানের দাবী উত্থাপন করছে। এ সম্পর্কে আমরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নেতৃবৃন্দকে প্রশ্ন করেছিলাম—‘অধ্যাপক গোলাম আযমকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদানের ব্যাপারে আপনাদের বক্তব্য কি?’
আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা এ প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন—‘অধ্যাপক গোলাম আযমকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদানের ব্যাপারে কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না। সে তো পাকিস্তানী নাগরিক। একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ভিসা নিয়ে বাংলাদেশে এসেছে। তারপর কিভাবে সে এতদিন যাবৎ বাংলাদেশে আছে সে ব্যাপারটি রহস্যজনক। তাছাড়া সে বাংলাদেশে থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নাক গলাচ্ছে। বিবৃতি দিচ্ছে। সংবাদপত্রে তা ছাপাও হচ্ছে। এসবই হচ্ছে সরকারের দুর্বলতার কারণে। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন এ ব্যাপারে সরকারের দুর্বলতা কোথায়?’
জাসদ নেতা শাহজাহান সিরাজ এ সম্পর্কে বলেছেন—
‘অধ্যাপক গোলাম আযমকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেবার কোন কারণ থাকতে পারে না। কারণ, অতীতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী তার যে ভূমিকা তা ক্ষমাহীন এবং ন্যাক্কারজনক। পরবর্তী পর্যায়ে এসে তার অতীত ভূমিকা ব্যাখ্যা করে জাতির কাছে অনুশোচনা প্রকাশ করেননি। সেই গোলাম আযম কিভাবে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব আশা করেন?’
ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা রাশেদ খান মেননের বক্তব্য—
‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধিতা ও একাত্তরে গণহত্যার সাথে জড়িত থাকার কারণেই অধ্যাপক গোলাম আযম বাংলাদেশের নাগরিকত্ব হারিয়েছেন। তিনি যদি অনুতপ্ত হন এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে বিরোধিতার জন্য তার দোষ স্বীকার করেন, তবে তার নাগরিকত্ব পুনঃপ্রদানের বিষয় বিবেচনা করা যেতে পারে। এবং সেক্ষেত্রে তার কৃত অপরাধের দায়ও তাকে বহন করতে হবে।
এটা দুর্ভাগ্যজনক যে বিগত সরকার ও বর্তমান বিষয়টিকে ঝুলিয়ে রেখেছেন এবং একে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করছেন। এর অবসান হওয়া প্রয়োজন।’
‘অধ্যাপক গোলাম আযমকে নাগরিকত্ব দেয়ার প্রশ্নে ইতিমধ্যেই প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা এর প্রতিবাদ করেছে। ১৫ দল ও ৭ দল ’৭১-এর স্বাধীনতার ধারা এবং গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে প্রগতিশীল পথে দেশের গণমানুষের সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। এ সময় অধ্যাপক গোলাম আযমের নাগরিকত্ব প্রদানের দাবী সমর্থন দেয়া আমাদের জন্য কঠিন ব্যাপার।’
ইউপিপি’র নেতা কাজী জাফর আহমেদ বলেছেন—
‘অধ্যাপক গোলাম আযমের নাগরিকত্ব প্রদানের প্রশ্নে সরাসরি বক্তব্য রাখা কঠিন এ কারণে যে, স্বাধীনতাযুদ্ধে চলাকালীন সময়ের ভূমিকার জন্য তিনি জনগণ কর্তৃক নিন্দিত হয়েছিলেন একথা সর্বজনবিদিত। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশে তাঁর অবস্থানের প্রেক্ষিত ও ভিত্তি সম্পর্কে আমাদের সুনির্দিষ্ট তথ্য জানা নেই। এ সম্পর্কে সরকারের ভূমিকাও সম্পূর্ণ রহস্যজনক। বাংলাদেশের নাগরিক না হয়ে কিভাবে তিনি সংবাদপত্রে রাজনৈতিক বিবৃতি দিচ্ছেন এবং কিভাবে তিনি প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করছেন তা আমাদের বোধগম্য নয়। তবে আমরা মনে করি নাগরিকত্ব যে-কোন মানুষের জন্মগত মৌলিক অধিকার। এ অধিকার থেকে কাউকে বঞ্চিত করা কতটুকু সঠিক ও ন্যায়সঙ্গত তা গভীরভাবে চিন্তা না করে শুধু ভাবাবেগের দ্বারা পরিচালিত হওয়া সঠিক নাও হতে পারে। আমরা মনে করি যে, অধ্যাপক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে কোন সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে দেশের আইন অনুযায়ী তার বিচার ও কঠোর শাস্তি বিধান করা যেতে পারে। সুতরাং নাগরিকত্ব বিষয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করে বরং মূল বিষয়টিকেই পাশ কাটিয়ে যাওয়া হচ্ছে কিনা তাও গভীরভাবে ভেবে দেখা দরকার।’
বাসদ নেতা খালেকুজ্জামানের বক্তব্য—
‘সামরিক স্বৈরশাসন বিরোধী ঐক্যবদ্ধ গণতান্ত্রিক আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে যা এখনও পরিণত রূপ লাভ করতে পারেনি। এ ধরনের পরিস্থিতিতে এমন কোন বিতর্কমূলক বিষয় উপস্থাপন করা উচিত হবে না যা আন্দোলনকারী শক্তিসমূহের মধ্যে বিভেদ, বিভক্তি বা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে এবং স্বৈরাচারের হাতকে শক্তিশালী করতে পারে এবং জনতার দৃষ্টিকে মূল সমস্যা থেকে ভিন্ন দিকে সরিয়ে নিয়ে যেতে পারে। স্বৈরাচারবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বিজয়ের মধ্যদিয়ে অর্জিত একটি সুষ্ঠু ও পূর্ণাঙ্গ গণতান্ত্রিক পরিবেশেই যেকোন রাজনৈতিক বিতর্কের নিষ্পত্তি হওয়া বাঞ্ছনীয়।’
গণতান্ত্রিক পার্টির নেতা সিরাজুল হোসেন খানের বক্তব্য—
‘যে কারণে অধ্যাপক গোলাম আযম-এর নাগরিকত্ব গেছে অথবা যে কারণে তিনি বাংলাদেশ ছেড়ে পাকিস্তানের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছিলেন তার পূর্ণ ব্যাখ্যা দিয়ে জনগণের কাছে ক্ষমা প্রার্থনাই হবে তার নাগরিকত্ব প্রদানের প্রশ্ন বিবেচনার পূর্বশর্ত।’
মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদের আহ্বায়ক ও বাকশাল নেতা কর্নেল (অবঃ) শওকত আলীর বক্তব্য—
‘অধ্যাপক গোলাম আযম-এর মতো জন ও জাতিদ্রোহী ব্যক্তিকে কিছুতেই বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেয়া উচিত হবে না। নাগরিকত্ব ছাড়া দীর্ঘ বছর যাবৎ সে কিভাবে বাংলাদেশে আছে তা রহস্যজনক। তাছাড়া বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে তার যে তৎপরতা তাও যথেষ্ট দুরভিসন্ধিমূলক।’
০০০

মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সাক্ষাৎকার
‘গোলাম আযমসহ স্বাধীনতাবিরোধী সকল শক্তিকে এদেশের মাটি থেকে উৎখাত করবো’

জামাতে ইসলামীর বর্তমান রাজনৈতিক ভূমিকা ও অধ্যাপক গোলাম আযম-এর নাগরিকত্ব প্রদানের দাবীর প্রশ্নে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ-এর বর্তমান কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগযোগ করা হলে সংসদের চেয়ারম্যান জাকির খান চৌধুরী ও এর সেক্রেটারী জেনারেল মোহাম্মদ গিয়াউদ্দিন (বীর প্রতীক) বিচিত্রার বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। আমরা তা নিম্নে পত্রস্থ করলাম :

প্রশ্ন : ২২ দল বর্তমানে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন চালাচ্ছে, সেক্ষেত্রে জামাতে ইসলামের ভূমিকাকে আপনারা কিভাবে দেখছেন?
উত্তর : গণতন্ত্রে উত্তরণের আন্দোলনের সুযোগ নিয়ে জামাত অত্যন্ত সুকৌশলে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিদের পুনঃসংগঠিত করছে এবং ঘোলা জলে মাছ শিকার-এর অভিপ্রায় নিয়ে নিজেদেরকে রাজনীতিতে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থার সুযোগ নিয়ে তারা কিছুটা অগ্রসর হয়েছে এবং এটা জাতির জন্য নেহাৎ দুর্ভাগ্যজনক।

প্রশ্ন : অধ্যাপক গোলাম আযমকে নাগরিকত্ব প্রদানের ব্যাপারে আপনাদের বক্তব্য কি?
উত্তর : বাংলার মাটিতে এদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধারা এটাকে কোন মতেই মেনে নেবে না। বিদেশী নাগরিক গোলাম আযম এদেশে থেকে তার ভারপ্রাপ্ত আমীর-এর মাধ্যমে নিজেকে এবং তার দলকে রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। আমরা যে-কোন মূল্যে তার এ অপচেষ্টা প্রতিহত করবো। সে সঙ্গে দেশের যে রাজনৈতিক দলগুলো বর্তমানে দেশে গণতন্ত্রে উত্তরণের আন্দোলন চালাচ্ছে তাদের প্রতি আমাদের আবেদন স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিরা যেন কোনভাবেই এ আন্দোলনের সুযোগ না নিতে পারে সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখা। এবং তারা যেন কিছুতেই সে সুযোগ না দেয়।

প্রশ্ন : ’৮১ সালে আপনারা জামাতে ইসলামের বিরুদ্ধে যে বক্তব্য এবং আন্দোলন শুরু করেছিলেন তার ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হয়নি কেন?
উত্তর : সে সময়ে তৎকালীন সরকার আমাদের আন্দোলনের যৌক্তিকতা মেনে নিয়ে এ বিষয়ে জাতীয় পর্যায়ে একটি কমিটি গঠন করেন। সে জাতীয় কমিটির ‘টার্মস-অব-রেফারেন্স’-এর ওপর বর্তমান রাষ্ট্রপতি এবং মুক্তিযোদ্ধা সংসদ-এর প্রধান উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল এইচ, এম, এরশাদ তার ব্যক্তিগত মতামত উক্ত কমিটির নিকট ব্যক্ত করেন। এরপর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শহীদ হয়ে যান। সে কারণেই পরবর্তী পরিস্থিতির কারণে সে কমিটির কাজ স্থগিত হয়ে যায়।

প্রশ্ন : বর্তমান অবস্থায় আপনাদের সে আন্দোলন পুনরায় শুরু করার কোন পরিকল্পনা আছে কি না?
উত্তর : উত্তর সার্বিক অবস্থা মূল্যায়ন সাপেক্ষে অচিরেই আমরা এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছি। এ ব্যাপারে আমাদের পরিষ্কার বক্তব্য অধ্যাপক গোলাম আযমসহ স্বাধীনতাবিরোধী সকল শক্তিকে—স্বাধীনতা যুদ্ধের সকল শক্তিকে সঙ্গে নিয়ে যে-কোন মূল্যে বাংলাদেশের মাটি থেকে উৎখাত করবোই। এছাড়া আমাদের গত ’৮৩ সালের ২ এপ্রিলে অনুষ্ঠিত জাতীয় কাউন্সিলের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী স্বাধীনতাবিরোধীদের রাজনৈতিক অবস্থান (স্টেমাস) নির্ধারণের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। কারণ আমরা মনে করি স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির রাজনৈতিক অবস্থান এবং স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তির রাজনৈতিক অবস্থান বা মর্যাদা কোন মতেই এক হতে পারে না। আমরা মনে করি এটা শুধু আমাদেরই দাবী নয় এটা বাংলাদেশের সকল মুক্তিকামী জনতার দাবী। আমরা ভবিষ্যতে এ আন্দোলনের ডাক দেবো। সেই আন্দোলনে স্বাধীনতার স্বপক্ষের সকল শক্তি এগিয়ে আসবে এবং বাংলার মাটি থেকে গোলাম আযমসহ স্বাধীনতাবিরোধী সকল শক্তি উৎখাত হবেই।

বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের প্রাক্তন চেয়ারম্যান লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অবঃ) কাজী নূরুজ্জামান গত ১৮-৪-৮৪ তারিখে এ বিষয়ে সংবাদপত্রে একটি বিবৃতি দিয়েছিলেন। বিবৃতিতে তিনি বলেছেন—
‘আমি বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করছি যে, গত ১৭ই এপ্রিলে সংলাপ চলাকালে জামাতে ইসলামের দাবীর প্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট পাকিস্তানী নাগরিক গোলাম আযমকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদানের আশ্বাস দিয়েছেন। সম্প্রতি গোলাম আযম কর্তৃক বাংলাদেশ সম্পর্কে অবাঞ্ছিতভাবে বক্তৃতা বিবৃতি দেয়া সত্ত্বেও সরকার এবং রাজনৈতিক মহলের নিশ্চুপ ভূমিকা আমাকে মর্মাহত করেছে।
মরহুম প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমলে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি যখন মাথাচাড়া দিয়ে উঠছিল তখন বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ১৯৮১ সালের মার্চ মাসে সেই শক্তিকে প্রতিরোধ করার জন্য আন্দোলন শুরু করে। সেই আন্দোলন যখন বিশেষ স্তরে উপনীত হয় তখন প্রেসিডেন্ট জিয়া মুক্তিযোদ্ধা সংসদ নেতৃবৃন্দকে আলোচনার জন্য ডাকেন। উভয়পক্ষের মধ্যে মোট তিনটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের উপদেষ্টা হিসাবে জেনারেল এরশাদ সংসদের বর্তমানের চেয়ারম্যান জাকির খান চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে প্রেসিডেন্ট জিয়া স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির রহস্যময় উত্থান সম্পর্কে জানার জন্য এবং এই শক্তিকে প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে একটি কমিটি গঠন করেন। ১৯৮১ সালের মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে অনুষ্ঠিত শেষ বৈঠকে প্রেসিডেন্ট জিয়া স্বীকার করেন যে, স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে পুনর্গঠিত হওয়ার সুযোগ দিয়ে তিনি ভুল করেছেন। এই রাজনৈতিক ভুল রাজনৈতিকভাবে সমাধান করার জন্য তিনি আমার হাত ধরে আমার কাছে সময় চান এবং আন্দোলন কিছুদিনের জন্য স্থগিত রাখতে অনুরোধ জানান। এবং জামাতে ইসলামীকে সাংবিধানিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিষিদ্ধকরণ ও গোলাম আযমকে দেশ থেকে বহিষ্কারের প্রতিশ্রুতি দেন। জেনারেল এরশাদ মুক্তিযোদ্ধাদের সেই দাবীর সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু এই বৈঠকের মাত্র দশদিন পর তার প্রতিশ্রুতি রক্ষার প্রস্তুতি কালে প্রেসিডেন্ট জিয়াকে হত্যা করা হয়। তার মৃত্যুর পর স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি আরো সংগঠিত হয় এবং পাকিস্তানী নাগরিক গোলাম আযম বাংলাদেশে আরও পোক্ত হয়ে বসে বক্তৃতা বিবৃতি দিতে থাকে।’
‘আমি মনে করি যে, গোলাম আযমকে নাগরিকত্ব প্রদান, জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতার একটি প্রধান অংশ এবং জিয়ার স্মৃতির প্রতি চরম অপমানজনক। গোলাম আযমকে নাগরিকত্ব প্রদানের সরকারী আশ্বাস বাস্তবায়নকে প্রতিহত করার জন্য আমি দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।’

গোলাম আযমের নাগরিকত্বের দাবীর প্রেক্ষিতে রাকসুর সহ-সভাপতি ছাত্রনেতা ফজলে হোসেন বাদশা বক্তব্য—
‘এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ মতামত ব্যক্ত করেছে। নতুন করে আমার বক্তব্যের কিছু নেই। গোলাম আযমের নাগরিকত্ব দেয়া হলে নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টি হবে। বর্তমানে তিনি পাকিস্তানের নাগরিক। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতিপক্ষ এবং ৩০ লক্ষ ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, বুদ্ধিজীবী হত্যার নেতৃত্বদানকারী গোলাম আযমের নাগরিকত্বে প্রশ্ন একাত্তরের হত্যাযজ্ঞের বিচারের প্রশ্নের সাথে সম্পর্কযুক্ত। তাছাড়া একজন বিদেশী নাগরিকের দেশের জাতীয় প্রশ্নে মতামত ব্যক্ত করা বাংলাদেশে আবার নতুন করে ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করার শামিল। সরকারের কোন দুর্বলতার ফাঁকে ও কোন স্বার্থে একজন স্বাধীনতার শত্রু জাতীয় রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করতে পারে, তা জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে। তার ইঙ্গিতেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাম্প্রদায়িক অরাজকতা সৃষ্টি হচ্ছে। এক্ষেত্রে গোলাম আযমের নাগরিকত্ব প্রদান করা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে মীরজাফর ও বিশ্ব মানবের কাছে হিটলারকে শ্রদ্ধা করার শামিল। গোলাম আযমকে নাগরিকত্ব দেয়া হলে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাকে হেয় প্রতিপন্ন করা হবে বলে আমি মনে করি।’

বুদ্ধিজীবীদের বক্তব্য
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডীন অধ্যাপক ডঃ সিরাজুল ইসলাম গোলাম আযমের নাগরিকত্ব সম্পর্কে বলেছেন—
‘গোলাম আযম কি কখনো বলেছেন তিনি ’৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতা করে ভুল করেছেন। যে ব্যক্তি বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন না তিনি কিভাবে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দাবী করেন? আমি মনে করি গোলাম আযমকে নাগরিক অধিকার দেয়া হলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে। একই সঙ্গে ৩০ লক্ষ শহীদেরও অবমাননা হবে?’

বিশিষ্ট কবি ও সম্পাদক শামসুর রাহমান বলেছেন—
‘আমি অবশ্যই গোলাম আযমকে নাগরিকত্ব প্রদানের বিপক্ষে। আমি মনে করি তাকে নাগরিকত্ব প্রদান করা হলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অবমাননা হবে।’

বিশিষ্ট চিন্তাবিদ ডঃ আহমদ শরীফ বলেছেন—
‘যতক্ষণ পর্যন্ত গোলাম আযম এবং তার দল ’৭১ সালে তাদের কৃতকর্মের জন্য শর্তহীনভাবে দেশবাসীর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা না করবে ততক্ষণ পর্যন্ত গোলাম আযমের নাগরিকত্ব প্রদানের বিষয়টি বিবেচনা করা উচিত হবে বলে আমি মনে করি না।’

বিশিষ্ট সাংবাদিক নির্মল সেন বলেন—
‘আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে হাজার হাজার মানুষ হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতা করেছিল। তারা সাধারণ মানুষ, না বুঝে বা বিপদে পড়ে করেছে। কিন্তু কিছু লোক তো ছিল যারা গণহত্যার নীল নকশা এঁকেছিল, যারা সচেতন এবং সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে তাদের বিচার হওয়া উচিত ছিল অথচ হয়নি। আওয়ামী লীগ আমলেও বহু কুখ্যাত দালালকে ক্ষমা করা হয়েছে। গোলাম আযমের অপরাধের জন্য বহু আগেই বিচার হওয়া উচিত ছিল। এটাকে এভাবে ঝুলিয়ে রাখার মানে হয় না। আর নাগরিকত্ব প্রদানের তো প্রশ্নই ওঠে না।’

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের পরিচালক ডাঃ জাফরউল্লাহ চৌধুরী বলেছেন—
‘গোলাম আযমের নাগরিকত্ব বিবেচনার অর্থ হলো ’৭১ সালে ফিরে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে, বাংলাদেশের অভ্যুদয়, শত-সহস্র বুদ্ধিজীবী, তরুণ মুক্তিযোদ্ধা এবং ৩০ লক্ষ শহীদের আত্মাহুতি অস্বীকার করা। এই ৩০ লক্ষ শহীদই এই হত্যার নায়ক সম্পর্কে সিদ্ধান্ত দিতে পারে—কোন রাজনীতিবিদ, জেনারেল এরশাদ বা আমরা কেউ দিতে পারি না। মানুষকে ক্ষমা করা যায়। কিন্তু মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত কাউকে উন্মুক্তভাবে চলাফেরা করতে দেয়া যায় না। যার জন্যে গোলাম আযমকে হয় তার দেশে ফেরত পাঠানো যেতে পারে অথবা কঠিন নিরাপত্তাসহ চিরকালের জন্যে পাগলাগারদে আটকে রাখতে হবে। এ ধরনের হত্যাকারী জনপদের জন্য আবারো ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনতে পারে।’

উপসংহার
’৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ’৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধ পর্যন্ত এদেশে যত সফল আন্দোলন হয়েছে হোক তা গণতন্ত্রের জন্যে কিংবা জাতিগত পীড়নের বিরুদ্ধে—সবসময় সাম্প্রদায়িকতা ছিল আক্রমণের অন্যতম লক্ষ্য। আমাদের দেশে প্রদত্ত ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক কাঠামোর ভেতর সাম্প্রদায়িকতার বিরোধিতা ছাড়া কোন গণতান্ত্রিকভাবেই জয়যুক্ত হতে পারে না।…..স্বাধীনতাবিরোধী জামাতে ইসলামী নামক আন্দোলনের ঘোলাপানিতে মাছ ধরার জন্যই তারা ২২ দলের আন্দোলনকে সমর্থন করছে। জামাতীরা গণতন্ত্র বলতে কি বোঝে এটা কি কারো অজানা? জামাত বুঝে নিয়েছে ২২ দলের দিক থেকে এ মুহুর্তে কোন হামলা আসবে না। তাই তারা ক্ষমতা হস্তান্তরের ফর্মূলাও দিয়েছে। আর ২২ দলের কয়েক শরীক একান্ত নির্বোধের মতো জামাতী ফর্মূলার টোপটি বেমালুম গিলে বসে আছে। জামাতীদের অনেক সুহৃদই ২২ দলের ভেতর রয়েছে যেমনটি রয়েছে প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে।
২২ দলের অনেকে বলেছেন যে—এটা একাত্তর সাল নয়। রাজনীতির প্রেক্ষিত পাল্টায়। রাজনীতিতে চিরস্থায়ী শত্রু-মিত্র বলে কিছু নেই। এগুলো সবই যে নির্লজ্জ সুবিধাবাদ এবং ঘোরতরভাবে জনগণের স্বার্থবিরোধী এতে কি সন্দেহের কোন অবকাশ আছে? রক্তলোলুপ হায়না হিংসা ভুলে কি কখনো তৃণভোজী হতে পারে? বাঘে ছাগলে একঘাটে পানি খেতে পারে বটে—তাতে লাভ হয় বাঘেরই, ছাগলের নয়। জামাতের সঙ্গে সহ-অব্স্থানের তত্ত্ব তাই কোন অবস্থাতেই অনুমোদনযোগ্য নয়।
২২ দলের ভেতর জামাতের মিত্র কারা? বলা বাহুল্য তারাই যারা জামাতের গুরু ভাই। যাদের আন্তর্জাতিক প্রভু এক। খুঁটি যাদের বাঁধা পেট্রো-ডলারের সাম্রাজ্যে। কিন্তু যারা জামাতের গুরু ভাই নয়, তারা কেন জামাতকে এ মুহূর্তে মিত্র ভাবছে? এর জবাবও খুব স্পষ্ট। ২২ দলের ভেতর অনেক মুরুব্বী স্থানীয় দল রয়েছে যারা জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের আন্দোলনকে ভয় পায়। ভয় পায় ছাত্রদের সীমিত পরিসরের ১০ দফার আন্দোলনকেও। তারা চায় যেন-তেন প্রকারে ক্ষমতার একটা আপোস ভাগ-বাটোয়ারা জামাতকে একটা অংশ দিতেও তারা আপত্তি করবে না যদি নিরাপত্তার সন্ধান পাওয়া যায়।
যারা প্রকৃত অর্থে জনগণের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বিশ্বাসী তারা যদি গণতন্ত্রের আন্দোলনের সঙ্গে জামাত তথা সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী আন্দোলনকে যুক্ত করতে না পারেন তাহলে গণতান্ত্রিক আন্দোলনও সফল হবে না। আর জামাত তো সব সময়ের মতো সুযোগের অপেক্ষায় থাকবে প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তিকে নির্মূল করার জন্য। যেভাবে তারা ছুরিতে শান দিয়েছিল ’৭১-এ সেই ছুরি এখনো তারা শানাচ্ছে। কবির ভাষায় অভিশাপ বা বুদ্ধিজীবীদের ভাষায় ক্ষোভ কিংবা রাজনীতিবিদদের বিবৃতির ভাষায় নিন্দাজ্ঞাপন এই হায়নাদের প্রতিহত করার জন্য যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন জনগণের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ভেতর দিয়ে এর বিরুদ্ধে সক্রিয় প্রতিরোধ গড়ে তোলা প্রয়োজন এদেশের রাজনীতির এই বিষাক্ত ক্ষতকে চিরতরে নির্মূল করা। এটা শুধু ছাত্রদের দায়িত্ব নয়, একা মুক্তিযোদ্ধাদেরও নয়, এ দায়িত্ব সকল গণতান্ত্রিক শক্তিকে কাঁধে তুলে নিতে হবে।

সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন ফজলুল বারী
০০০

জামাত ও গোলাম আযমের পুনরুত্থান
জামাতের বক্তব্য

গত ২৭ এপ্রিল/৮৪-এর সাপ্তাহিক বিচিত্রার ‘জামায়াত ও গোল আযমের পুনরুদ্ধার’ শীর্ষক প্রচ্ছদ কাহিনী আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। দেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকটকালে এ প্রতিবেদন শুধু দুঃখজনকই নয় বরং অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং চরম উস্কানীমূলক। এতে যেসব কাহিনী সাজানো হয়েছে তা সবৈর্ব মিথ্যা এবং বিভ্রান্তিকর।
১৯৮১ সালের ১৭ এপ্রিল এই পত্রিকায় ‘গোলাম আযম ও জামায়াতের রাজনীতি’ শীর্ষক আরেকটি প্রচ্ছদ প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল। তার প্রতিবাদে আমরা বলেছিলাম ‘আমরা মনে করি এই প্রতিবেদনটি জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ তথা ইসলামী আন্দোলনের বিরুদ্ধে সরকারের ছত্রছায়ায় লালিত, সাম্রাজ্যবাদী শক্তির মদদপুষ্ট একটি বিশেষ চক্রের ষড়যন্ত্রের ফসল। (বিচিত্রা ১ মে/৮১)। এবারের প্রতিবেদনটিও ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী ও সাম্রাজ্যবাদের মদদপুষ্ট সেই চক্রেরই পুরনো কৌশল। এদেশের জনগণের কাছে এর কোন আবেদন নেই। এ প্রতিবেদনটি পাঠ করার পর এটাই প্রতীয়মান হয় যে, আদর্শিক ও রাজনৈতিকভাবে জামায়াতে ইসলামীর মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়েই এই হিংস্র ও অসহিষ্ণু পন্থার আশ্রয় নেয়া হয়েছে।
সাংবাদিকতার নীতিমালা লংঘন করে বিচিত্রার প্রতিবেদনে যেসব শব্দ ও ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে এবং অনাকাঙ্ক্ষিত হীনমন্যতার পরিচয় দেয়া হয়েছে সে সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। বিচিত্রার এই প্রচ্ছদ প্রতিবেদন সাংবাদিকতার ইতিহাসের এক ঘৃণ্য কলংক হয়েই থাকবে।
ভিন্নমত প্রকাশের সাংবাদিকতার প্রতি আমরা শ্রদ্ধাশীল। কিন্তু ভিন্নমত প্রকাশের নামে যাদের বিদ্বেষ এবং হিংস্রতা অরণ্যের বর্বরতাকেও হার মানায় তাদের প্রতি করুণা করা ছাড়া উপায় থাকে না।
জামায়াতে ইসলামীর সুনাম-সুখ্যাতি এবং ইসলামী আন্দোলনের নেতা, আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন ইসলামী চিন্তাবিদ ও রাজনীতিবিদ অধ্যাপক গোলাম আযমের ভাবমূর্তি খর্ব করার জন্যই সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় সাপ্তাহিক বিচিত্রায় প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়েছে। জনগণের অধিকার আদায় করার জন্য জামায়াত যে আপোসহীন সংগ্রাম চালাচ্ছে এটা তার বিরুদ্ধে শাসকগোষ্ঠী এবং প্রতিক্রিয়াশীল কায়েমী স্বাথান্বেষীদের একটি সুপরিকল্পিত চক্রান্ত।
সাপ্তাহিক বিচিত্রিা একটি সরকারী পত্রিকা। সম্পাদক থেকে শুরু করে এই প্রতিবেদনের সঙ্গে জড়িত সকলেই মূলতঃ সরকারী কর্মচারী। সামরিক সরকারসহ যখন যে সরকার আসে তার সেবা করাই তাদের কাজ। সম্পাদক সাহেব নিজেও বহাল তবিয়তে পাকিস্তান সরকারের চাকরি করেছেন। ২৭ এপ্রিল তারিখের বিচিত্রায় সম্পাদকীয় নিবন্ধে জামায়াতের ওপর মিথ্যাচার চাপিয়ে বলা হয়, ‘জামায়াতের ইসলামী সব সময়ই এস্টাব্লিস্টমেন্টের ছত্রছায়ায় বিশেষ করে গণতান্ত্রিক শক্তির বিরুদ্ধবাদীদের হয়ে কাজ করেছে অতীতে’। আমরা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতে চাই যে, একথা বলে তারা প্রমাণ করেছেন যে, হয় দেশের রাজনৈতিক ইতিহাস তারা জানেন না কিংবা জেনে শুনেই মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়েছেন। বিচিত্রার সম্পাদকমন্ডলীকে আমরা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, আইয়ুবের একনায়কত্বের বিরুদ্ধে জামায়াতে ইসলামীই সর্বপ্রথম আন্দোলনের সূচনা করে। মৌলিক মানবাধিকার ও প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারের দাবীতে এককভাবে আন্দোলনের কারণে একমাত্র জামায়াতে ইসলামীকেই বেআইনী ঘোষণা এবং জামায়াত নেতৃবৃন্দকে কারারুদ্ধ করা হয়।
১৯৪৮ সাল থেকে আদর্শ প্রস্তাব ও শাসনতন্ত্র প্রণয়নের আন্দোলন, কপ (কম্বাইন্ড অপজিশন পার্টিস), পিডি এম, (পাকিস্তান ডেমোক্র্যাটিক মুভমেন্ট) ডাক (ডেমোক্র্যাটিক এ্যাকশন কমিটি)সহ স্বৈরাচার ও একনায়কত্বের বিরুদ্ধে এবং গণতন্ত্রের পক্ষে সকল আন্দোলন জামায়াতে ইসলামী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা এদেশের রাজনৈতিক মহলে অজানা থাকার কথা নয়।
১৯৭১ সালে জামায়াতের ভূমিকা ছিল সাম্রাজ্যবাদ, আধিপত্যবাদ এবং ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে। জামায়াত দেশের জনগণের মতই বিশ্বাস করে ইসলামী আদর্শই হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের একমাত্র রক্ষাকবচ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ভারতের করুণার বস্তু হতে পারে না। বিগত একযুগে ভারতের বন্ধুত্বের পরিচয় দেশবাসী পেয়েছে। ফারাক্কা, তালপট্টি, আঙ্গুরপোতা-দহগ্রাম-তিনবাঘা, সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়াসহ হায়েনা প্রতিবেশী আগ্রাসী থাবার আঘাত আজও জনগণের বুকে দগ দগ করে জ্বলছে।
সম্পাদকীয়তে জামায়াতকে ‘ঘোরতর সাম্প্রদায়িক শক্তি’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আমরা এর তীব্র প্রতিবাদ জানাই। ইসলাম মানব জাতির জন্য এক সার্বজনীন এবং পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। জামায়াতে ইসলামী মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে পরিচালিত ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে একটি বিপ্লবী আন্দোলনের নাম। জামায়াত ভাষা, বর্ণ, গোত্র, ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতার বিরোধী এবং ইসলামের সাম্য, সৌভ্রাতৃত্ব, উদারতা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, পরমতসহিষ্ণুতা এবং অমুসলিমদের নিজ ধর্ম পালনের অধিকারে বিশ্বাসী। জামায়াতের সাহিত্য, জামায়াত নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতি কিংবা ভূমিকা থেকে কেউ একটি দৃষ্টান্ত দেখাতে পারবেন না যে জামায়াত সাম্প্রদায়িক। ইসলামের প্রচার-প্রসার ও শরীয়তী শাসন কায়েমের সংগ্রামকে কেউ যদি সাম্প্রদায়িকতা বলে চালাতে চান তাহলে জনগণের সামনে একথা তাদের খোলাখুলিভাবেই বলা উচিত।
প্রতিবেদনে ‘চির অভিশপ্ত’, ‘ঘাতকের দল’, আস্তাকুঁড়ের কুকুর’, সারমেয় ইত্যাকার যেসব শব্দ বা বিশেষণ ব্যবহার করা হয়েছে তা কোন শিক্ষিত ভদ্র ও রুচিসম্পন্ন ব্যক্তির পক্ষে কি করে সম্ভব হলো সে প্রশ্ন আজ সকলের। তবে প্রতিবেদক অত্যন্ত অভদ্র, অশালীন ও অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করে পাঠকবর্গের কাছে তার আত্মপরিচয় তুলে ধরেছেন। সেক্সপিয়র বলেছেন—‘এ ম্যান মে কনস্ট্রু আফটার হিজ ওন ফ্যাশন।’ প্রতিবেদকের ঐসব শব্দ ব্যবহার যে সংকীর্ণ রাজনৈতিক বিদ্বেষ প্রসূত তা বলার অপেক্ষা রাখে না এবং এতে ফ্যাসিস্ট মানসিকতাই ফুটে উঠেছে। আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাই। এই প্রতিবেদনে জামায়াত বিদ্বেষী মানসিকতার সঙ্গে সঙ্গে বিচিত্রার ইসলাম বিদ্বেষী চরিত্রেরও নগ্ন প্রকাশ ঘটেছে এবং সাংবাদিকতার সমস্ত নীতিমালাকে পদদলিত করে প্রকৃত প্রস্তাবে সাংবাদিকতা ও সংবাদপত্রের মর্যাদাকে ক্ষুন্ন করা হয়েছে। বিচিত্রার এই জঘন্য কার্যকলাপের বিরুদ্ধে বিবেকবান সাংবাদিকদের সোচ্চার হওয়া উচিত বলে আমরা মনে করি। সাংবাদিক সমাজ সাপ্তাহিক বিচিত্রার এই কলংকিত ও অশোভন আচরণ কোন অবস্থাতেই সমর্থন করতে পারেন না।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘জামায়াত পানি ঘোলা করছে, ২২ দলের নেতারা তাদের সাহায্য করছেন। সব নেতা না হলেও বেশির ভাগ নেতা জামায়াতকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন।’ আমাদের স্পষ্ট বক্তব্য, মিথ্যা প্রতিবেদন ছেপে জনগণের আন্দোলনকে বানচাল করার জন্য গণতান্ত্রিক আন্দোলনে শরীক জোট ও দলগুলোর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির অপচেষ্টা চালিয়ে বিচিত্রাই পানি ঘোলা করছে। জামায়াতে ইসলামী যে বর্তমান গণতান্ত্রিক আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে জনগণই এর সাক্ষী। তাছাড়া উল্লেখিত প্রতিবেদনে রাজনৈতিক নেতাদের সাক্ষাৎকারও তাই প্রমাণ করে। সামরিক শাসনবিরোধী জামায়াতের বর্তমান আন্দোলনের কথা দেশবাসী ভালোভাবেই জানেন। কারণ জামায়াত নিয়মতান্ত্রিক পথে জনগণের সমর্থন ও সহযোগিতা নিয়েই এগিয়ে চলেছে।
জনগণ জানেন জামায়াতই সর্বপ্রথম ১৯৮৩ সালের মার্চ মাসে ঘরোয়া রাজনীতির সূচনায় সারাদেশব্যাপী প্রচারপত্র বিলি করে স্থগিত সংবিধানের ভিত্তিতে সর্বাগ্রে সংসদ নির্বাচনের দাবী জানিয়ে সামরিক শাসনের অবসান ঘটানোর আহ্বান জানায়। জামায়াত সামরিক শাসনের অনিষ্টকারীতা সম্পর্কে জনগণকে সজাগ করে তুলি। নির্বাচিত সরকারকে অবৈধভাবে উৎখাত করে সামরিক সন্ত্রাস কায়েমের মাধ্যমে দেশকে অনিশ্চয়তার অন্ধকারে ঠেলে দেয়ার বিরুদ্ধে জামায়াত সারাদেশে জনমত সংগঠিত করে। গ্রামে-গঞ্জে, শহরে-বন্দরে জামায়াতের এই সংগ্রামী ভূমিকার সঙ্গে জনগণ সুপরিচিত।
১৯৮১ সালেও বিচিত্রা এপ্রিল ও মে মাসের কয়েকটি সংখ্যায় জামায়াতবিরোধী মিথ্যা প্রচারাভিযান চালিয়ে জনগণকে জামায়াত উৎখাত করার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার উস্কানী দিয়েছিল। এবারের প্রতিবেদনেও নগ্নভাবে মুক্তিযোদ্ধা এবং ছাত্র সমাজকে উস্কানী দিয়ে বলা হয়েছে, ‘প্রয়োজন জনগণের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ভেতর দিয়ে এর বিরুদ্ধে সক্রিয় প্রতিরোধ গড়ে তোলা প্রয়োজন এদেশের রাজনীতির এই বিষাক্ত ক্ষতকে চিরতরে নির্মূল করা। এটা শুধু ছাত্রদের দায়িত্ব নয়। একা মুক্তিযোদ্ধাদেরও কাজ নয়, এ দায়িত্ব সকল গণতান্ত্রিক শক্তিকে কাঁধে তুলে নিতে হবে।’ ১৯৮১ সালে একই ভাষায় মায়াকান্না করেছিল বিচিত্রা। কিন্তু তিন বছরের ব্যবধানে কী হয়েছে? এর জবাব প্রতিবেদনেই আছে। প্রতিবেদক আফসোস করেছেন, ‘তাই তারা ক্ষমতা হস্তান্তরের ফর্মূলাও দিয়েছে। আর ২২ দলের কয়েক শরীক দল একান্ত নির্বোধের মত জামায়াতী ফর্মূলার টোপটি বেমালুম গিয়ে বসে আছে। জামায়াতীদের অনেক সুহৃদই ২২ দলের ভিতর রয়েছে যেমনটি রয়েছে প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে।’ ১৯৮১ সালের এপ্রিলের প্রচ্ছদ প্রতিবেদনের পর ১৯৮৪ সালের এপ্রিল মাসে প্রতিবেদক ২২ দল ও প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জামায়াতের সুহৃদ দেখতে পাচ্ছেন। জানি না আগামীতে হয়তো বা প্রতিবেদক, সম্পাদক ও বিচিত্রার মুরুব্বীরা নিজেদের মধ্যে জামায়াতে ইসলামীকে দেখতে পাবেন। এমনটি হওয়াকে আমরা অস্বাভাবিক মনে করবো না। কেননা সত্য তার স্বাভাবিক গতিতে একদিন প্রকাশিত হবেই। সূর্যকে আড়াল করে যেমন কঠিন সত্যকে চাপা দেওয়াও তেমনি কঠিনতর।
আমরা এ কথাও স্পষ্টভাবে বলতে চাই, এই যে আজ জামায়াতে ইসলামীর অগ্রযাত্রা-এর জন্য জামায়াত গর্বিত নয় বরং আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছে। কেননা মহান আল্লাহর অশেষ মেহেরবাণী এবং জনগণের ভালোবাসা ও সহযোগিতাই জামায়াতের আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এ যাবত আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদ এবং যাদের দেশী এজেন্টরা জামায়াতকে উৎখাত করার যেসব চক্রান্ত করেছে তার সবকটাই ব্যর্থ হয়ে গেছে। জামায়াতের আদর্শ এদেশের জনগণের মধ্যে প্রোথিত বলেই ষড়যন্ত্র বানচাল হতে বাধ্য। তাছাড়া আল্লাহতায়ালা সর্বদাই মজলুমের পক্ষে এবং জালেমের বিরুদ্ধে।
আমরা আরো বলতে চাই, কেউ জামায়াতকে রক্ষা করলে জামায়াত রক্ষা পাবে বা কেউ প্রশ্রয় দিলেই জামায়াত আন্দোলন করবে এ ধারণা ভুল। ইসলামের শক্তি এবং আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থাই জামায়াতের শক্তির উৎস। বিচিত্রার ভাবখানা হচ্ছে এই যে, ২২ দল, মুক্তিযোদ্ধা বা ছাত্ররা কেন কোমর বেঁধে জামায়াত উৎখাতে নামছে না। আমরা বিচিত্রার মুরুব্বীদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, পত্রিকায় প্রচ্ছদ প্রতিবেদন ছাপা যত সহজ রাজপথে আন্দোলন গড়ে তোলা ততটা সহজ নয়। আবারও বলছি প্রচ্ছদ প্রতিবেদন ছেপে আদর্শিক আন্দোলন উৎখাত করা যায় না।
সাপ্তাহিক বিচিত্রা মিথ্যা কথাকে সত্যের মতো অনায়াসে বলতে পারি এর প্রমাণ প্রতিবেদনের ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে কি ঘটেছিল?’ শীর্ষক অংশটুকু। বিচিত্রার মতে একথাও আজ দেশবাসীকে বিশ্বাস করতে হবে যে, একটি দল অস্ত্রসজ্জিত হয়ে নিরস্ত্র অপর একটি দলকে আক্রমণ চালালো। আক্রমণে নিরস্ত্রদের গায়ে একটি আঁচড়ও লাগলো না বরং অস্ত্রধারীই চারজন শহীদ হয়ে গেলো নিরস্ত্রদের হাতে। বিচিত্রা সম্ভবতঃ একথাও বিশ্বাস করতে বলছে জনগণকে যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের মিছিলে এমনিতেই বোমা নিক্ষিপ্ত হয়ে শিবির কর্মীদের পা উড়ে গিয়েছিল এবং চট্টগ্রামে শিবির কর্মীদের কক্ষে অলৌকিকভাবেই আগুন লেগে গিয়েছিল।
বিচিত্রা কিভাবে মিথ্যাকে সত্য বলে চালিয়ে দিতে চায় তার আর একটি প্রমাণ এই যে প্রতিবেদনে জিয়া হত্যার সঙ্গে পরোক্ষভাবে জামায়াতে ইসলামীকে জড়িত করার ধৃষ্টতা প্রদর্শন করেছে। বিচিত্রা কি জনগণকে একথা বিশ্বাস করাতে চায় যে মেজর জেনারেল আবুল মঞ্জুরেরাও জামায়াতে ইসলামীর লোক ছিলেন?
প্রতিবেদনের ‘পুনরুত্থানের পটভূমি’ শিরোনামের অংশে অধ্যাপক গোলাম আযম পাকিস্তানে পালিয়ে গিয়েছিলেন বলে মিথ্যা প্রপাগান্ডা চালানো হয়েছে। গুয়েবলসীয় কায়দায় মিথ্যাকে বার বার প্রচার করে তারা সত্য বলে জনগণকে বিশ্বাস করাতে চায়। অথচ অধ্যাপক গোলাম আযম লাহোর গিয়েছিলেন জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে যোগদান করার জন্য। ৩ ডিসেম্বর তিনি ঢাকা ফেরার উদ্দেশ্যে করাচী থেকে বিমানে যাত্রা করেন। কিন্তু সেদিনই ভারত পাকিস্তান প্রকাশ্য যুদ্ধ শুরু হয়। ফলে অধ্যাপক আযমের বিমান বাংলাদেশের কাছে এসেও পথিমধ্যে ফেরত যেতে বাধ্য হয় এবং তা জেদ্দা বিমান বন্দরে অবতরণ করে। এরপর থেকেই তিনি বাংলাদেশে ফেরত আসার জন্য চেষ্টা করতে থাকেন এবং ১৯৭৮ সালে দেশে আসার অনুমতি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দেশে ফিরে আসেন। তাঁর বিরুদ্ধে আরেকটি প্রচারণা চালানো হয় যে তিনি পাকিস্তানী নাগরিক। অথচ ১৯৭১ সালের আগে এদেশের দশ কোটি মানুষই যেমন পাকিস্তানী নাগরিক ছিলেন তিনিও তাই ছিলেন এবং প্রতিবেদনের লেখকও সেরকম পাকিস্তানী নাগরিকই ছিলেন। তিনি যদি পাকিস্তানী নাগরিকই হবেন তাহলে তিনি কোন শক্তি বলে মগবাজারে তাঁর নিজ বাসভবনে অবস্থান করছেন?
বিচিত্রাকে আমরা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই এদেশের তৌহিদী জনতার প্রিয়নেতা অধ্যাপক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে প্রতিবেদনে যে ভাষায় বিষোদগার করা হয়েছে তা রাজনৈতিক অন্ধতা এবং প্রতিহিংসা পরায়ণতারই স্বাক্ষর। অধ্যাপক গোলাম আযম জন্মগতভাবেই বাংলাদেশের নাগরিক। ডাকসুর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন থেকে শুরু করে ’৪৮ ও ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, আইয়ুববিরোধী গণআন্দোলন, পিডিএম ও ডাকের আন্দোলন তথা এদেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে তাঁর ভূমিকাকে কিছুতেই খাটো করে দেখান সম্ভব নয়। রাজনৈতিক অন্ধতার কারণে ক্ষমতাসীন সরকারগুলো শেরে বাংলা একে ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মত নেতাকেও রাষ্ট্রদ্রোহী আখ্যায়িত করেছিল। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী জনগণ তাদেরকে নেতা হিসেবেই বরণ করে নিয়েছেন। তদ্রুপ অধ্যাপক গোলাম আযমের রাজনৈতিক ভূমিকাই তাঁর মর্যাদা নির্ধারণ করবে। পরাশক্তি ও আগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদের চক্রান্তের কারণে আজ তার নাগরিকত্ব স্বীকার করা হচ্ছে না বটে কিন্তু ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটবে ইনশাআল্লাহ। অধ্যাপক গোলাম আযম বাংলাদেশেই আছেন। বিদেশী নাগরিক হলে এত দীর্ঘ কাল তিনি কিভাবে আছেন? তিনি তো বলেন, ‘আমি বাংলাদেশের নাগরিক। আমার নাগরিকত্ব যদি কোন ব্যক্তি বিশেষ স্বীকার করতে না পারেন তাতে আমার কি যায় আসে?’
অধ্যাপক গোলাম আযমের সঙ্গে একই অজুহাতে অনেকের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়। তাদের মধ্যে যারাই নাগরিকত্ব ফিরে চেয়েছেন তাদের সকলের নাগরিকত্ব পুনর্বহাল করা হয়েছে। অথচ শুধু অধ্যাপক আযমের নাগরিকত্ব পুনর্বহাল করা নিয়েই চক্রান্ত হচ্ছে। এতে কি ক্ষমতাসীন সরকারগুলো এটাই প্রমাণ করছে না যে রাজনৈতিকভাবে অধ্যাপক আযমকে মোকাবিলা করতে তারা সাহসী নন।
সম্প্রতি জামায়াতের সঙ্গে সংলাপে প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ওয়াদা করেছেন যে তিনি অধ্যাপক গোলাম আযমের নাগরিকত্বের বিষয়টি বিবেচনা করবেন। এই ওয়াদা থেকে সরে আসার অজুহাত সৃষ্টি পটভূমি রচনার জন্যই বিচিত্রার এই তথাকথিত প্রচ্ছেদ কাহিনী ফাঁদ পাতা হয়েছে বলে আমাদের বিশ্বাস করার সংগত কারণ রয়েছে।
আমরা সরকারকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, নাগরিকত্ব মানুষের জন্মগত ও মৌলিক অধিকার। রাষ্ট্র বা সরকারের জন্মগত নাগরিকত্ব হরণ করার কোন অধিকার নেই। কোন নাগরিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে তার বিচার করা যেতে পারে। অথচ অধ্যাপক আযমের নাগরিকত্বের বিষয়টি একটি নজীরবিহীন চক্রান্তের শিকার হয়েছে। বিশ্বের কোন দেশে এ ধরনের একটি দৃষ্টান্ত আছে কি যেখানে একজন ব্যক্তির নাগরিকত্ব অস্বীকার করা হবে আর সেই ব্যক্তি তা অগ্রাহ্য করেই সেখানে অবস্থান করব্নে? এ থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে, স্বাভাবিকভাবেই বা প্রাকৃতিক আইনেই অধ্যাপক গোলাম আযমের নাগরিকত্ব বহাল হয়ে গেছে। বাস্তবভাবেই তিনি এখন বাংলাদেশের নাগরিক। এখানে আরো একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন যে কোন সরকার যদি একটি অবৈধ বা বেআইনী আদেশ দেয় জনগণ সে আদেশের আনুগত্য করতে বাধ্য নয়। অধ্যাপক আযমের নাগরিকত্ব হরনের আদেশটিও ছিল অনুরূপ অবৈধ আদেশ। তিনি দীর্ঘ দিন বাংলাদেশে নিজ বাড়িতে বসবাস করার ফলে সে আদেশটিও তার কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলেছে। সুতরাং কেউ স্বীকার করুন বা না করুন এটাই সত্য, বাস্তব এবং প্রতিষ্ঠিত যে অধ্যাপক গোলাম আযম বাংলাদেশের নাগরিক। তিনি যে বাংলাদেশের নাগরিক একথা আজ আর প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না। বরং অধ্যাপক গোলাম আযম বাংলাদেশের নাগরিক নন—একথা প্রমাণ করার দায়িত্ব এখন সরকারের।
রাজনৈতিক অঙ্গনে ভিন্নমত পোষণ করাটা খুবই স্বাভাবিক। জন্মগত অধিকার অস্বীকার করাটা মানবাধিকার লংঘনেরই শামিল। ব্যক্তির জন্মগত অধিকার যারা মানতে প্রস্তুত নন জনগণের অধিকার তাদের হাতে কিভাবে নিরাপদ হতে পারে? দেশ ও জাতির কল্যাণেই রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ এবং সহিষ্ণুতার প্রয়োজন। রাষ্ট্র পরিচালনার মত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব যারা গ্রহণ করতে চান তাদের বক্তব্যের ভাষাও হতে হবে তেমনি শোভন এবং শালীন। দেশবাসী তাদের কাছে এটাই আশা করে।
মুক্তিযোদ্ধারা দেশের সম্পদ। কিন্তু জাতিকে মুক্তিযোদ্ধা অমুক্তিযোদ্ধা বা স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি ও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি বলে বিভক্ত করার মধ্যে পরাশক্তি তথা সাম্রাজ্যবাদ, আধিপত্যবাদ বা সম্প্রসারণবাদের জন্য লাভজনক হতে পারে কিন্তু আমাদের দেশের জন্য তা ডেকে আনবে এক মহাবিপর্যয় এবং ভয়াবহ সংকট। জাতিকে যদি এভাবে বিভক্ত করার অপচেষ্টায় আগ্রাসী শক্তি সফলতা লাভ করে তাহলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হুমকির সম্মুখীন হতে বাধ্য।
পরিশেষে আমরা বিচিত্রাকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, তারা বা তাদের মুরুব্বীরা যা চান তা হবে না—হতে পারে না। ’৭১ সাল এবং ’৮৪ সালের মধ্যে পার্থক্য একযুগেরও বেশি। আর ইতিহাসের চাকাকে উল্টোদিকে ঘুরিয়ে দেয়া যায় না। বিচিত্রার সম্পাদকমন্ডলী ও প্রতিবেদকরা যদি পারেন তাহলে ইতিবাচক কাজই তাদের করা উচিত। বাংলাদেশের জনগণের আদর্শ ইসলামের বিরুদ্ধাচারণের মধ্যে তাদের নিজেদেরও কল্যাণ নেই। ইসলামের সুমহান সৌন্দর্য সম্পর্কে যদি তারা জানার চেষ্টা করতেন তাহলে এ ধরনের মিথ্যা প্রচ্ছদ কাহিনী পরিবেশন থেকে তারা অবশ্যই বিরত থাকতেন। আমরা ব্যক্তিগতভাবে তাদেরও কল্যাণকামী। ভবিষ্যতে তারা তাদের অনাকাঙ্ক্ষিত ভূমিকার সংশোধন করবেন আমরা আন্তরিকভাবে এই কামনাই করি।

মুহাম্মদ কামারুজ্জামান
প্রচার সম্পাদক,
জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ
০০০

প্রতিবেদকের বক্তব্য
২২ দলের আসরে কলকে পাওয়ার জন্য ‘গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে’ জামাতে ইসলামীকে শরীক হতে দেখে মনে হয়েছিল তারা বুঝি কৌশল পাল্টেছে, পাল্টেছে মতবাদ, বুঝি কিছুটা চৈতন্যোদয় হয়েছে, কিন্তু হায়, বদলায়নি তারা এতটুকুও, সেই ’৭১ সালের ভাষা, ’৭১-এর আস্ফালন হুমকি সবই আছে জামাতের প্রতিবাদে। পড়ে মনে হলো গত প্রতিবেদনে জামাতের মুখোশ উন্মোচন যথেষ্ট হয়নি এই সুযোগে তারা খানিকটা উন্মোচন করা যাক। কারণ জামাতকে বেঈমান ও মোনাফেক প্রমাণ করার জন্য তাদের প্রচার সম্পাদকের এই প্রতিবাদখানি চমৎকার দলিল হিসেবে কাজ করবে।
প্রতিবাদপত্রে জামাত বেশ কয়েকবার বলেছে, জামাতের বিরুদ্ধে লেখার অর্থ হচ্ছে ইসলামের বিরুদ্ধে লেখা, গোলাম আযমের বিরুদ্ধে লেখা মানে ইসলামী আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতার বিরুদ্ধে লেখা। বটে! ইসলামের এই স্বঘোষিত ইজারাদারদের সম্পর্কে এ প্রসঙ্গে আমি নিজে একটি মন্তব্যও করবো না, আমি শুধু কয়েকজন বিশিষ্ট আলেম ও ধর্মীয় নেতার মন্তব্য উদ্ধৃত করবো যেখানে তাঁরা এই নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে জামাতের স্বরূপ উন্মোচন করেছেন।

ইসলাম ধর্ম বনাম জামাত
বাংলাদেশের ৪৫৩ জন বিশিষ্ট ধর্মীয় নেতা, ইমাম, মাদ্রাসা শিক্ষক ও পীরের স্বাক্ষর করা এক ‘সতর্কবাণী’তে বলা হয়েছে, ‘বর্তমান যুগ ফেৎনার যুগ’, এই যুগে বুজর্গানে দ্বীনের পদাংক অনুসরণ করে নিজের দ্বীন ও ঈমানের হেফাজত করা সবচেয়ে জরুরী কাজ। এই ফেৎনার যুগে কোন কোন ফেৎনাত এমন রয়েছে যা প্রকাশ্য কুফর ও শিরক হওয়ার কারণে মুসলমানদের পক্ষে তা থেকে আত্মরক্ষা করা সহজ হয়, যেমন ‍খৃস্টানদের মিশনারী ফেৎনা এবং কাদিয়ানী ফেৎনা। কিন্তু অনেক ফেৎনার বাহ্যিক ইসলামী আবরণের কারণে সাধারণ মানুষ তার প্রকৃত রূপ সহজে ধরতে সক্ষম হয় না।
‘এমনি একটি জটিল প্রকৃতির ফেৎনা বর্তমানে দেশে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে যাকে ওলামায়ে কেরাম ‘মওদুদী ফেৎনা’ নামে আখ্যায়িত করেছেন। এই ফেৎনার প্রবর্তক হলেন জনাব আবুল আলা মওদুদী সাহেব। মওদুদী সাহেবের চিন্তাধারাকে তার অনুসারীরা মানুষের সামনে চিত্তাকর্ষক করে পেশ করার বিবিধ প্রচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছেন—ফলে মানুষ প্রতারিত হচ্ছে এবং ইসলামী নামের আবরণে লুক্কায়িত অনেক প্রকার ইসলাম বিরোধী ও গোমরাহীকারী মতবাদের বিষ ছড়াবারা গোপন ফাঁদকে ইসলামী আন্দোলন মনে করে স্বীয় দ্বীন ও ঈমান এবং আখেরাতের ক্ষতি সাধন করছে।’
এমন পরিস্থিতিতে ওলামায়ে কেরামের কর্তব্য হলো, এই ফেৎনা সম্পর্কে মুসলমানদের সতর্ক করা। আলহামদুলিল্লাহ! ওলামায়ে কেরাম তাঁদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে যাচ্ছেন। তাঁরা মওদুদী সাহেবের অবস্থা এবং তার রচিত বই-পুস্তক দেখে মুসলিম সমাজকে বার বার সতর্ক করেছেন যে, মওদুদী ফেৎনা একটি অত্যন্ত জটিল ফেৎনা এবং মওদুদী সাহেবের ‘জামাতে ইসলামী’ প্রকৃতপক্ষে ইসলামের মূল উৎপাটন প্রয়াসী একটি দল। ইসলামের নাম ভাঙিয়ে ক্ষমতা দখলিই এই দলের মূল লক্ষ্য।….
বাংলাদেশের মুফতীরে আজম হযরত মাওলানা মুফতী ফয়জুল্লাহ সাহেব (রাহমাতুল্লাহ আলাইহি) বলেছেন :-‘জামাতে ইসলামীতে শরীক হওয়া জীবন ধ্বংসকারী বিষপান তুল্য।’
‘…..আজকাল মওদুদী সাহেবের প্রদত্ত ‘বিষকে’ মধু মিশ্রিত করে জনসমক্ষে নতুনভাবে পেশ করার বিশেষ প্রয়াস পরিলক্ষিত হচ্ছে। অথচ এ প্রয়াস ব্যর্থ হতে বাধ্য। আমরা একটি সংক্ষিপ্ত দৃষ্টান্ত দ্বারা বিষয়টি পেশ করতে চাই, তা হলো এই যে, কোন এক ব্যক্তি তিক্ত ফলদানকারী একটি বৃক্ষচারা রোপণ করে মৃত্যুমুখে পতিত হলো। অতঃপর তার সন্তান-সন্ততি ও অনুসারীরা বৃক্ষটির মূলে এই আশায় সুমিষ্ট শরবৎ ঢালতে লাগল যে, তিক্ত ফলদানকারী এই বৃক্ষটি থেকে তারা মিষ্ট ফল লাভ করতে পারবে। বৃক্ষটি সুমিষ্ট শরবৎ পান করে বড় হলো, ফল ধরলো—কিন্তু আপনারা কি আশা করেছেন সেই ফল মিষ্ট হবে? অবশ্যই নয়। সেই ফল নিশ্চয়ই তিক্ত। মূলতঃ মওদুদী সাহেবের রোপণকৃত ‘জামাতে ইসলামী’ নামক বৃক্ষটির অবস্থাও অনুরূপ। এজন্য একজন হক্কানী আলেম মওদুদী সাহেবের জামাতে ইসলামী বৃক্ষের ফল কি হবে তার বর্ণনা দিয়ে বলেছেন,‘ইসলামের নামে একটি নতুন ধর্ম হবে।’
‘আমরা অত্যন্ত পরিতাপের সাথে লক্ষ্য করছি যে, মওদুদী সাহেব সাহাবায়ে কেরাম এবং সমস্ত ওলামায়ে উম্মতের বিরুদ্ধে যে নতুন ইসলাম পেশ করেছেন তাঁকে এ বিষয়ে বারে বারে সতর্ক করা সত্ত্বেও তিনি তার মত পরিবর্তন করেননি এবং তওবাও করেননি।….’
‘…..স্বভাবগত সীমাহীন খোদ পছন্দীতে (আত্মগর্বে) নিমজ্জিত থাকার কারণে মওদুদী সাহেব চরম গোমরাহীর শিকার হয়েছেন এবং এমন একটি ভ্রান্ত মতবাদ পেশ করেছেন যা ইসলামের মূল ভিত্তিতে কুঠারাঘাত করেছে। উর্দু ভাষায় তার ‍উল্লেখযোগ্য দখল থাকার কারণে সে মতবাদকে তিনি অত্যন্ত সুচতুরভাবে প্রকাশ করেছেন। ইসলামের মহব্বৎ আছে অথচ দ্বীনের পূর্ণ ও সহিহ তালীম হাসিল করেননি এমন ভাইয়েরা ভাষা চাতুর্যে মুগ্ধ হয়ে মওদুদী সাহেবের ‘জামায়াতে ইসলামী’ মতবাদকে একটি চমকপ্রদ ‘ইসলামী মতবাদ’ বলে ধারণা করেন অথচ প্রকৃতপক্ষে তা হলো একটি ইসলামবিরোধী মতবাদ।….’
(হযরত হাফেজ্জী হুজুর এবং অন্যান্য ওলামায়ে কারামের পক্ষ থেকে সতর্কবাণী’ মজলিসে দাওয়াতুল হক, বাংলাদেশ।)
উপরোক্ত পুস্তিকার পরিশিষ্টে দেয়া আছে জামাতে ইসলামের মূল তাত্ত্বিক ও নেতা মওদুদী কিভাবে ‘ইসলামের নাম ভাঙিয়ে ক্ষমতা দখলের’ উদ্দেশ্যে ইসলামকে বিকৃত করেছেন।
মওদুদীর মতবাদ যে ঘোরতরভাবে ইসলামবিরোধী এ বিষয়ে বাংলাদেশের ওলামারা শুধু নন অন্যান্য দেশের ইসলামী চিন্তাবিদ ও ধর্মীয় নেতারাও অনেক বই লিখেছেন। মওদুদী সম্পর্কে মওলানা আশরাফ আলী থানভী লিখেছেন, ‘এই ব্যক্তি না-পাকির সাথে মিশিয়ে কথা বলে।…..আমার দিল এ আন্দোলনকে কবুল করে না।’ মওলানা হোসাইন আহম্মদ মদনী লিখেছেন—‘জামাতে ইসলামী নামধারী দলের সাথে মিলেমিশে কাজ করা এবং তাদের সঙ্গে সহযোগিতা করা শরিয়ত মোতাবেক বৈধ নয়।….এই দলের লোকেরা মুসলমানদেরকে প্রতারণা করার জন্য ইসলাম এবং দ্বীনের নাম নিয়ে থাকে। যারা তাদের ধোঁকাবাজি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়, তারা এই প্রতারকদের দ্বীনদার মনে করে বসে।’
‘আপনাদের প্রতি আমার আশা এই যে, এই ফেৎনা হতে মুসলমানদেরকে নিরাপদ রাখার ব্যাপারে নীরবতা, উদাসীনতা ও সহনশীলতাকে বৈধ মনে না করে শেখ সাদীর (রাঃ) নিম্নবর্ণিত পংক্তিদ্বয়ের মর্মানুযায়ী সর্বাধিক প্রচেষ্টা নিয়োজিত করবেন। সাদী বলেন : ‘সদ্য অঙ্কুরিত গাছ একজন মাত্র ব্যক্তির শক্তি দ্বারাই উপড়ানো যায়।’ (অর্থাৎ যে গাছের শিকড় এখনও বেশি নিচে প্রসারিত হয়নি তা সামান্য শক্তি ব্যয়েই নিঃশেষ করা যায়।)’
মওলানা মুফতী কেফায়েতউল্লাহ লিখেছেন—‘….মুসলমানদের এই আন্দোলন থেকে দূরে থাকা উচিত। আর তাদের সঙ্গে মেলামেশা না করা তথা কোন রকম সম্পর্ক না রাখা কর্তব্য।’ মওলানা জাকারিয়া (মান্দাজিল্লুহুল আলী) লিখেছেন—‘আমি এই জামাতে অংশগ্রহণ ও তাদের বই-পুস্তক পড়া মুসলমানদের জন্য সীমাহীন ক্ষতিকর মনে করি।’ মওলানা জাফর আহম্মদ ওসমানী লিখেছেন—‘সুস্পষ্টভাবে লোকটি (মওদুদী) হাদিস অস্বীকারকারী, পথভ্রষ্ট, গোমরাহ ও বেদাতী এরকম লোক হতে মুসলমানদের দূরে থাকা উচিত।’ মওলানা ইউসুফ বিন্নোরী লিখেছেন—‘মওদুদী সাহেবের রচনাবলীতে এমন ভয়ঙ্কর বিষয়বস্তু এবং এমন বিষাক্ত বর্ণনাভঙ্গী রয়েছে যার দ্বারা নিয়মতান্ত্রিক ধর্মীয় এলেমদের ব্যাপারে অনভিজ্ঞ ব্যক্তিরা শুধু বিভ্রান্তিতেই নয়, বরং প্রকাশ্য কুফরীতে পড়ে যাবে।’ মওলানা মুফতী শফি লিখেছেন—‘….মওদুদী সাহেব এবং তার মতাবলম্বী জামাতে ইসলামপন্থীদের ঈমান বানানো জায়েজ হবে না।’
জামাতে ইসলামী ইসলামের নামে যে ধরনের কুফরীতে লিপ্ত রয়েছে প্রমাণের জন্য আরো বহু উদ্ধৃতি দেয়া যেতে পারে ইসলামের স্বীকৃত আলেমদের রচনা থেকে। আশা করি জামাতের অন্ধ অনুসারীরা এ থেকে শিক্ষা নেবেন যদি তাঁরা নিজেদের মুসলমান বলে দাবী করতে চান। বিচিত্রা জামাতীদের নির্মূল করার আহ্বান জানিয়েছে বলে তারা গোস্বা করেছে। কিন্তু শয়খুল ইসলাম হযরত মওলানা হাসাইন আহম্মদ মদনী (রাহমাতুল্লাহ আলাইহি) যখন তাদের নির্মূল করার আহ্বান জানান বিচিত্রার প্রতিবেদন ছাপার বহু আগে তখন অবস্থাটা কি দাঁড়ায়? হাকিমুল উম্মত হযরত থানভী (রাহমাতুল্লাহ আলাইহি) চল্লিশ বছর আগে জামাতের জন্ম মুহূর্তে এদের সম্পর্কে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন। জামাত এদের সম্পর্কেও কি বলতে চায় ‘অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’, চরম উস্কানীমূলক’, ‘সসৈর্ব মিথ্যা’, কিংবা ‘সাম্রাজ্যবাদের চক্রান্ত?’

হিংস্রতার সংজ্ঞা
জামাতের অভিযোগ বিচিত্রার প্রতিবেদন নাকি ‘হিংস্রতার অরণ্যের বর্বরতাকে হার মানিয়েছে।’ সত্যি নাকি! আমাদের প্রতিবেদন কি এমন হিংস্র ছিল যা তিরিশ লক্ষ শহীদের রক্তে লাঞ্ছিত স্মরণাতীত কালের নৃশংসতম হত্যাকান্ডের নায়কদের অস্বস্তির কারণ হয়েছে? বাংলাদেশের মানুষ ’৭১ সালে আলবদর বাহিনীর যে নৃশংসতা দেখেছে পৃথিবীতে এমন কোন লেখক কি আছেন শুধুমাত্র ভাষা দিয়ে ততখানি বর্বর বা হিংস্র হতে পারেন? ভাষা যদি ততখানি সমৃদ্ধ হতো তাহলে কি আমাদের ভাইদের হত্যাকারী অর বোনদের ধর্ষণকারীদের সম্পর্কে সেই ভাষা ব্যবহার করতাম না। নিশ্চয়ই করতাম। ‘ঘাতক’ গণহত্যার নেপথ্য নায়ক’ ইত্যাদি বললে জামাত কেন আপত্তি করে এটা আমাদের বোধগম্যের বাইরে। জামাত কি বলতে চায়? তারা কি ’৭১ সালের ২৫শে মার্চের গণহত্যার রাত থেকে হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের আগের দিন (১৫ ডিসেম্বর) পর্যন্ত গণহত্যার সঙ্গে যুক্ত ছিল না? জামাত কি ২৫শে মার্চের গণহত্যার জন্য হানাদার পাকবাহিনীকে অভিনন্দন জানায়নি? তারা কি রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেয়নি? আলবদর আলশামস নামের গুপ্তঘাতকের দল গঠন করে এদেশের শ্রেষ্ঠ মণীষীদের হত্যা করেনি? ১৩ বছরের ব্যবধানে রেকর্ডপত্র কি সব নিখোঁজ হয়ে গেছে? নাকি আমাদের স্মৃতি এতই দুর্বল?
জামাত তাদের প্রতিবাদে একথা অবশ্য স্পষ্টভাবে বলেনি ’৭১-এ আমরা গণহত্যার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না।’ তবে যেভাবে (হিংস্রতা চেপে না রেখে) তারা তাদের ক্রোধ ব্যক্ত করেছে ’৭১-এত স্মৃতিভ্রষ্টদের মনে হতে পারে। জামাত বুঝি তখনও সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য লড়াই করেছে। জামাত নিশ্চয়ই জানে ’৭১-এ তারা কি করেছে। জানে বলেই পৈশাচিক হিংস্রতায় দম্ভ করে বলতে পারে ‘একাত্তুরে আমরা ভুল করিনি।’ (ধন্যবাদ জামাতকে)। তারা অকপটেই ৩০ লক্ষ মানুষকে হত্যায় দায় মাথায় তুলে নিয়েছে। জামাত তখন সঠিক কাজটি কি করেছিল খবরের কাগজের পাতা ওল্টালেই জানা যাবে। আমরা জামাতীদের মুখপাত্র দেখার সুযোগ পাইনি। পেলে হিংস্রতার আরও বেশি বিশ্বস্ত ও ভয়াবহ নজির তুলে ধরতে পারতাম। তাদের কাগজে নিশ্চয়ই পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা রয়েছে কিভাবে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে, কসাইয়ের ছুরি দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের তারা হত্যা করেছিল। সংগ্রাম-এর ফাইল না পেয়ে শুধু সরকার নিয়ন্ত্রিত দৈনিক বাংলার (তৎকালীন দৈনিক পাকিস্তান) ফাইল থেকে কিছু সংবাদ উদ্ধৃত করছি—জামাতকে জানাবার জন্য নয়, স্মৃতিভ্রষ্টদের অবগতির জন্য যারা নাকি মনে করেন গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে জামাত ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে জামাতের অবদান
জামাত নেতা গোলাম আযম ’৭১-এর ১৮ জুন লাহোর বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের ‘পূর্ব পাকিস্তানী পরিস্থিতি’ সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘সেখানে এখনো কিছু দুষ্কৃতকারী বিভেদ সৃষ্টির কাজে নিয়োজিত রয়েছে, তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে আতঙ্ক সৃষ্টি করা এবং বিশৃংখলা পরিস্থিতিকে দীর্ঘায়িত করা।….এইসব বিশৃঙ্খলাকারীদের নেতৃত্ব দিচ্ছে নকশালপন্থী ও বামপন্থী শক্তি।
….দুষ্কৃতকারীরা শুধু তাদেরিই উপর হামলা চালাচ্ছে যারা পাকিস্তানের প্রতি একান্ত অনুগত।’ (দৈনিক পাকিস্তান ১৯ জুন ১৯৭১) পাকিস্তানের প্রতি এই একান্ত অনুগতদের সিংহভাগই জামাতী একথাও অধ্যাপক সাহেব পরে বলেছেন।
২২ জুন ’৭১-এর দৈনিক পাকিস্তানের একটি সংবাদে বলা হয়েছে, ‘পূর্ব পাকিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রচেষ্টা নির্মূল করে দেয়ার জন্য পূর্ব পাকিস্তান জামাতে ইসলামীর আমীর প্রফেসর গোলাম আযম পাকিস্তান সশস্ত্রবাহিনীকে গভীর শ্রদ্ধা জানান। গতকাল এখানে জামাতের ফাতেমা জিন্নাহ রোড অফিসে এক কর্মিসভায় তিনি বলেন যে, সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ ছাড়া দেশকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া থেকে রক্ষা করার অপর কোনই বিকল্প কিছু ছিল না।’
৭ আগস্ট কুষ্টিয়ায় এক ‘জনসভায়’ ভাষণ দিতে গিয়ে গোলাম আযম পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর বীর জওয়ানরা যথাসময়ে ব্যবস্থা গ্রহণ ও দেশের অখন্ডতা রক্ষা করায় তাদের ধন্যবাদ জানান ও আল্লার দরগায় শুকরিয়া আদায় করেন। অধ্যাপক গোলাম আযম দুষ্কৃতিকারীদের সম্পর্কে সতর্ক থাকার এবং রাষ্ট্রবিরোধীদের দমনের উদ্দেশ্যে শান্তি কমিটিসমূহ ও কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সহযোগিতা করার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানান।’ (দৈনিক পাকিস্তান ৮-১২-৭১)
২৩ আগস্ট ’৭১ তারিখে লাহোরে জামাতের আমীররা এক সভায় বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনা ভারত ও তার চরদের ষড়যন্ত্রের পরিণতি।’
‘জামাতে ইসলামীর প্রাদেশিক আমীররা দেশের বর্তমান সঙ্কটের জন্য দায়ী গলাবাজরা যাতে ভবিষ্যতে আর কখনো মাথা তুলতে না পারে তার নিশ্চয়তা বিধানের জন্য কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়েছেন।’…….
‘অনুষ্ঠানে বক্তৃতাকালে আমীররা সর্বসম্মত অভিমত ব্যক্ত করেন যে পূর্ব পাকিস্তানে যা ঘটেছে তা ভারত ও তার চরদের ষড়যন্ত্রেরই ফল।’
‘পূর্ব পাকিস্তান জামাতে ইসলামীর আমীর বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানে ইসলামী দৃষ্টিসম্পন্ন সংস্থাগুলোর কর্মীরাই ভারতীয় চরদের প্রধান শিকারে পরিণত হচ্ছে। তিনি বলেন যারা জামাতে ইসলামীকে দেশপ্রেমিক সংস্থা নয় বলে আখ্যায়িত করছে তারা হয় জানেন না বা স্বীকার করার সাহস পান না যে ইসলামী আদর্শ তুলে ধরা এবং বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরোধিতা করার জন্যই কেবল পূর্ব পাকিস্তানে জামাতের বিপুল সংখ্যক কর্মী দুষ্কৃতিকারীদের হাতে প্রাণ হারিয়েছে।’ (দৈনিক পাকিস্তান ২৪-৮-৭১)
৩১ আগস্ট ’৭১ হায়দ্রাবাদে এক সাংবাদিক সম্মেলনে গোলাম আযম বলেন, ‘বর্তমান মুহূর্তের আশু প্রয়োজন হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানের দেশপ্রেমিক ও ইসলামপ্রিয় লোকদের হাত শক্তিশালী করা। তিনি আরো বলেন, এসব লোক পূর্ব পাকিস্তানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যাপকভাবে সাহায্য করেছে এবং দুষ্কৃতিকারীদের রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপ ও বিদ্রোহীদের দমনে সেনাবাহিনী ও প্রশাসন কর্তৃপক্ষকে পূর্ণ সহযোগিতা দান করেছে।……তিনি দেশকে খন্ড বিখন্ড হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য সেনাবাহিনীর ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন যে, পাকিস্তানের পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে আসছে।’ (দৈনিক পাকিস্তান ১-৯-৭১)
২৬ সেপ্টেম্বর ’৭১ দৈনিক পাকিস্তানের এক সংবাদে বলা হয়েছে, ‘পূর্ব পাকিস্তান জামাতে ইসলামীর আমীর অধ্যাপক গোলাম আযম বলেছেন, জামাতে ইসলামীর কর্মীরা মুসলিম জাতীয়তাবাদের আদর্শকে বিসর্জন দিয়ে বাঙালী জাতীয়তাবাদকে মেনে নিতে রাজী নয়। তিনি বলেন, জামাত কর্মীরা শাহাদৎ বরণ করে পাকিস্তানের দুশমনদের বুঝিয়ে দিয়েছে যে তারা মরতে রাজী তবুও পাকিস্তানকে ভেঙে টুকরো টুকরো করতে রাজী নয়।…..তিনি বলেন, সারা প্রদেশ সামরিক বাহিনীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আসার পরও যে কয়েক হাজার লোক শহীদ হয়েছেন তাদের অধিকাংশ জামাত কর্মী।’
‘আইন সভার মাধ্যমে যে মন্ত্রিসভা গঠিত হয়নি সেই মন্ত্রিসভায় জামাতের যোগদান সম্পর্কে তিনি দলের নীতির ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, বর্তমানে প্রদেশের জনসংখ্যার শতকরা যে ২০ ভাগ লোক সক্রিয় রয়েছে তারা দু’ভাগে বিভক্ত। একদল পাকিস্তানকে ধ্বংস করতে চায়, আরেক দল পাকিস্তান রক্ষার জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত। জামাতে ইসলামী শেষোক্ত দলভুক্ত।’
‘তিনি বলেন, জামাতের যে দু’জন সদস্য মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছেন তাদেরকে দলের পক্ষ থেকে এই দায়িত্ব গ্রহণে বাধ্য করা হয়েছে।’
‘অধ্যাপক গোলাম আযম বলেন, যে উদ্দেশ্য নিয়ে জামাত রাজাকার বাহিনীতে লোক পাঠিয়েছে, শান্তি কমিটিতে যোগ দিয়েছে, সেই উদ্দেশ্যেই মন্ত্রিসভায় লোক পাঠিয়েছে।’
‘তিনি বলেন, এই মন্ত্রিপদ ভোগের বা সম্মানের বস্তু নয়। আমরা তাদের বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছি।’
২৯ সেপ্টেম্বর গভর্নরের নবনিযুক্ত মন্ত্রিসভার সদস্যদের সম্মানে শান্তি কমিটি কর্তৃক আয়োজিত এক সংবর্ধনা সভায় সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক গোলাম আযম। জামাত নেতা শিক্ষামন্ত্রী আব্বাস আলী খান এই সভায় বক্তৃতা দিতে গিয়ে বলেন যে, ‘পাকিস্তান আজ বিপদের সম্মুখীন হয়েছে। বহু ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের মাতৃভূমিকে রক্ষা করার দায়িত্ব দেশের সকল জনগণের। ইসলামের জন্য অর্জিত পাকিস্তানের সংহতি রক্ষা করার কাজে এগিয়ে আসার জন্য তিনি জনগণের প্রতি আহ্বান জানান।…..’
‘সভাপতির ভাষণে অধ্যাপক গোলাম আযম বলেন যে, পাকিস্তানকে ধ্বংস করা যাবে না। কারণ পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ও জনগণ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিতে বদ্ধপরিকর। এছাড়া তথাকথিত স্বাধীন বাংলাও কায়েম হবে না। কারণ দুষ্কৃতিকারীরা সেনাবাহিনীর মোকাবিলা করতে পারবে না। আর মিসেস ইন্দিরা গান্ধী স্বাধীন বাংলা কায়েম করে দিতে পারবে না। স্বাধীন বাংলা সম্পর্কে জনমনে নৈরাশ্য সৃষ্টি করার জন্য তিনি সকলের প্রতি আহ্বান জানান।’ (দৈনিক পাকিস্তান ৩০-৯-৭১)
১৬-১০-৭১ তারিখে বায়তুল মোকাররমে এক ‘গণজমায়েতে’ তথাকথিত বাংলাদেশের ভুয়ো শ্লোগানে কান না দিয়ে পাকিস্তানকে নতুনভাবে গড়ে তোলার জন্য প্রাদেশিক জামাতে ইসলামীর আমীর অধ্যাপক গোলাম আযম জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন….জামাত নেতা বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান দুর্দশার জন্য মূলত দায়ী নির্বাচন থেকে পালিয়ে আসা মওলানা ভাসানীর পার্টি, সোশ্যালিস্ট ও কম্যুনিস্টরা তাদের ছাত্রদল ও কর্মীবৃন্দ।….জনসাধারণ শেখ মুজিবকে ভোট দিয়েছিল এবং শেখ মুজিব স্বাধীনতার কথা বলেননি।’ (দৈনিক পাকিস্তান ১৭-১০-৭১)
১৯৭১ সালে যখন বাংলাদেশের সাত কোটি মানুষ স্বাধীনতার যুদ্ধে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িয়ে পড়েছেন, মুক্তিযোদ্ধারা যখন সমস্ত রণাঙ্গনে পাক-হানাদার বাহিনীর উপর আঘাতের পর আঘাত হেনে মরণপণ যুদ্ধে নিয়োজিত রয়েছেন বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য, সেই সময় জামাতের আমীর সাহেব ‘তথাকথিত বাংলাদেশের ভুয়ো শ্লোগানে কান না দিয়ে পাকিস্তানকে নতুনভাবে গড়ে তোলার জন্য জনসাধারণের কাছে আহ্বান জানাচ্ছেন।’ সরকারের কাছে আহ্বান জানাচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধাদের (ওদের ভাষায় ‘ভারতীয় চর’ ‘দুষ্কৃতিকারী’) বিরুদ্ধে আরও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য। ২৫শে মার্চের নারকীয় ধ্বংসলীলার জন্য পাক-হানাদার বাহিনীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর পরও গোলাম আযম সাহেবরা মনে করেছেন ‘আরও কঠোর ব্যবস্থা’ নেয়া দরকার। (৩০ লক্ষের অঙ্ক পূর্ণ করার জন্য বুঝি!)
পাক-সামরিক জান্তার এ ধরনের গোলামীর জন্যই বুঝি আমীর সাহেবের মুরুব্বীরা তাঁর নাম রেখেছিলেন ‘গোলাম আযম’। যার আক্ষরিক অর্থ ‘শ্রেষ্ঠ গোলাম’। তাঁর মতো সার্থক নামা ব্যক্তি পৃথিবীর ইতিহাসে দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হবে।
গোলাম সাহেবরা দাবী করেছেন। তাঁরা পাকিস্তানের সবচেয়ে খাঁটি দেশপ্রেমিক। মোটেই অযৌক্তিক নয় এমন দাবী। ’৭১-এর ফাইল ঘেঁটে দেখেছি সামরিক জান্তার খেদমতগারীতে তারা সবগুলো দলকেই হারিয়ে দিয়েছিলেন। প্রভুর এতটুকু ইশারা পাওয়া মাত্র লক্ষ্যবস্তুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। বিশ্বস্ততার যে নজীর তারা তখন স্থাপন করেছিলেন সেটাকে যদি মনে রাখতে চাই তাহলে অবশ্যই সারমেয়কুলকে বিশ্বস্ততার জন্য সাধুবাদ জানাতে হলে বলতে হলে ‘জামাতের মতো বিশ্বস্ত।’ জামাত গোস্বা করেছে ‘সারমেয়’ বলার জন্য। গোস্বার যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে। সারমেয়রা কি দলগতভাবে জামাতের মতো বিশ্বস্ততার কোন নজীর রেখেছে?
হানাদার বাহিনীর প্রতি বিশ্বস্ততার কুকুর দৌড়ে জামাত ভুট্টোর পিপলস পার্টিকেও হার মানিয়ে দিয়েছে। পিপিপি নেতা মওলানা কাওসার নিয়াজী উপনির্বাচনের বাস্তব পরিস্থিতি যাচাইয়ের জন্য পূর্ব পাকিস্তান সফর করে করাচী যাওয়ার আগে ঢাকায় বলেছিলেন, পূর্ব পাকিস্তানে উপনির্বাচন অনুষ্ঠানের বাস্তব পরিস্থিতি বিরাজ করছে না। তিনি আলবদর, রাজাকারদের বিরুদ্ধেও বক্তব্য রেখেছিলেন। রাজাকারদের বিরুদ্ধে বলার জন্য জামাতীরা তাকে হুমকি দিয়েছে এ তথ্যও তিনি সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন। (লাহোরো গিয়েও কাওসার নিয়াজী এই বক্তব্য রাখেন।) সঙ্গে সঙ্গে জামাত এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। জামাতের তৎকালীন প্রচার সম্পাদক নূরুজ্জামান এক বিবৃতিতে ‘মওলানা কাওসার নিয়াজীর রাজাকার ও মুজাহিদবিরোধী বক্তব্যে দুঃখ প্রকাশ করেন এবং জাতীয় স্বার্থের হানিকর ও শত্রুদের সাহায্য করতে পারে এমন কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকার জন্য তাঁকে অনুরোধ জানান।’ দৈনিক পাকিস্তান ২২-১০-৭১)
জামাতের সাধারণ সম্পাদক আবদুল খালেক গলা আরেক ধাপ চড়িয়ে ‘এক বিবৃতিতে পিপিপি’র মওলানা কাওসার নিয়াজী সম্প্রতি লাহোরে এক সাংবাদিক সম্মেলনে রাজাকার ও আলবদরদের যে সমালোচনা করেন তার প্রতিবাদ জানিয়ে এ ব্যাপারে সামরিক কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।’ (দৈনিক পাকিস্তান ১১-১১-৭১)
জামাত নেতা এ ব্যাপারে সামরিক কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বাধ্য হয়েছেন কারণ পিপিপি’র সঙ্গে শক্তি পরীক্ষায় একা নামতে সাহস পাননি। এভাবেই তারা সামরিক সরকারের ছত্রছায়ায় কাজ করেছেন। যখন কোন বিষয় নিজেরা মোকাবিলা করতে পারেননি তখনই সামরিক কর্তৃপক্ষের সাহায্য প্রার্থনা এবং গ্রহণ করেছেন। এরপরও কি জামাত বলবে তারা স্টাবলিশমেন্টের ছত্রছায়ায় রাজনীতি করেনি বা করে না?
জামাতী নেতার দেশ পাকিস্তানে ’৭৬ সালে নির্বাচিত সরকারের পতন ঘটিয়ে কারা সামরিক বাহিনীকে ডেকে এনে মন্ত্রিসভা গঠন করেছে এ তথ্য কি কারো অজানা! পাকিস্তানের ক্ষেত্রে কাজটি করেছেন সুযোগ পেলে বাংলাদেশেও সেটি করবেন না এটা কি জামাত হলপ করে বলতে পারবে? ’৭১-এও তো দেখেছি কিভাবে তারা মন্ত্রী হয়েছে।

‘একি কথা শুনি আজি মন্থরার মুখে’
প্রতিবাদের এক জায়গায় জামাত লিখেছে, ‘১৯৭১ সালে জামায়াতের ভূমিকা ছিল সাম্রাজ্যবাদ, আধিপত্যবাদ এবং ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে। জামায়াত…..বিশ্বাস করে ইসলামী আর্দশই হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের একমাত্র রক্ষাকবচ। সাবাশ! ’৭১ সালের ৮ অক্টোবর জামাতে ইসলামী প্রধান মওলানা মওদুদী লাহোরে কয়েকজন রাজাকারের সঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছিলেন পাকিস্তান টিকে থাকলে ইসলাম রক্ষা পাবে।’ (দৈনিক পাকিস্তান ৯-১০-৭১)
স্মৃতি যদি প্রতারণা না করে তাহলে দেখা যাবে এই মওদুদী ’৪৭ সালের আগে পাকিস্তান সৃষ্টিরও বিরোধিতা করেছিলেন।
জামাতের মুখে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষার কথা শতাব্দীর সেরা কৌতুক অথবা সেরা মোনাফেকীর উদাহরণ হতে পারে। যে জামাত এখনো বলতে পারে ‘একাত্তরে আমরা ভুল করিনি’, ’৭১-এর গোটা নয় মাস যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত লড়েছে তারা এখন বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষার তত্ত্ব ফেরি করছে! আমাদেরও তাই শুনতে হচ্ছে!!
বিচিত্রার প্রতিবেদনে জামাতকে ‘ঘোরতর সাম্প্রদায়িক শক্তি’ বলে আখ্যায়িত করাতে তারা ‘তীব্র প্রতিবাদ’ করেছে। জামাত যদি সাম্প্রদায়িক না হয় তাহলে রাজনীতির অভিধান থেকে এই শব্দটিকে চিরদিনের জন্য মুছে ফেলা উচিত। বিশ থেকে চল্লিশের দশকে এই উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িকতার যে বীভৎস চেহারা দেখেছি ’৭১-এ জামাতের চেহারা কি তার চেয়ে বেশি বীভৎস ছিল না? আঞ্জুমান আর হিন্দু মহাসভার সাম্প্রদায়িকতার যুগে একটি বিষয় পরিস্কার ছিল, অন্তত মুসলমানের হাত থেকে মুসলমান আর হিন্দুর হাত থেকে হিন্দু নিরাপদ। ’৭১-এ আমরা প্রথম দেখলাম জামাতীদের হাত থেকে স্বধর্মীয়রাও নিরাপদ নয় যদি না সে স্বদলীয় হয়। অবশ্য জামাতীদের যদি মুসলমান বলে গণ্য করা হয় তাহলেই কেবল তাদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আনা যাবে। জামাতীদের কাছে অজামাতীদের বিরুদ্ধে ‘জেহাদ’ করা আমাদের ‘ঈমানে’র অঙ্গ। এরপরও জামাত বলবে তাদের ‘ঘোরতর সাম্প্রদায়িক বলা অন্যায় হয়েছে?’
প্রতিবাদপত্রে জামাত নিজেদের এদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা বলে দাবী করেছে। গণতন্ত্র বলতে জামাত কি বোঝে এ বিষয়ে মওদুদীর কিছু উদ্ধৃতি দিলে আমরা বুঝবো জামাত কতটুকু গণতন্ত্রী।
জামাতের মূল নেতা মওদুদী বলেছেন, ‘যেসব জামাত কোনো শক্তিশালী আদর্শ ও সজিব সামগ্রিক (ইজতেমারী) দর্শন নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে তারা সব সময়ই সংখ্যালঘিষ্ঠ হয়। এবং সংখ্যালঘিষ্ঠতা সত্ত্বেও বিরাট বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠকে শাসন করে থাকে।…..’
মুসোলিনীর ফ্যাসী পার্টির সদস্য হলো মাত্র চার লাখ এবং রোমে মার্চ করার সময় ছিল মাত্র তিন লাখ। কিন্তু এই সংখ্যালঘিষ্ঠরা সাড়ে চার কোটি ইটালীয়দের উপর ছেয়ে গেছে। এই অবস্থা জার্মানীর নাজী পার্টিরও।….
‘জনগণের সরকার, জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য—এমত্বাদর্শের আমি সমর্থক নই।’ (‘সিয়াসঅ কাশমকাশ’ আবুল আলা মওদুদী। উদ্ধৃতি—আবদুল আওয়ালের ‘মওদুদীর চিন্তাধারা’)
‘…..এজন্যই আমি বলি, যেসব পরিষদ কিংবা পার্লামেন্ট বর্তমান যুগের গণতান্ত্রিক নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত, এসবের সদস্য হওয়া হারাম এবং তার জন্য ভোট দেয়াও হারাম।’ (রেসায়েল ও মাসায়ের ১ম খন্ড। উদ্ধৃতি—প্রাগুক্ত)
গণতন্ত্র সম্পর্কে এই যাদের মূল্যায়ন তারা যদি বলে ‘গণতন্ত্রের পক্ষে সকল আন্দোলনে জামায়াতে ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা….’ তাহলে তাদের আমরা কি বলতে পারি পাঠকই বিবেচনা করুন। এরা আবার আমাদের ফ্যাসিস্টও বলছে!!’
জামাতকে নিয়ে যারা ভারতীয় আগ্রাসন ঠেকাতে চান তাদের অবগতির জন্য বলি ’৪৮ সালে কাশ্মীর নিয়ে যখন পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়েছিল যখন সমস্ত পাকিস্তানবাসী ভারতের বিরুদ্ধে জেহাদের জন্য উন্মুখ তখন মওলানা মওদুদী বলেছিলেন…..হিন্দুস্তান ও পাকিস্তানের সরকারের মধ্যে পারস্পরিক চুক্তি থাকা অবস্থায় সরাসরি সশস্ত্র সংগ্রামে অংশগ্রহণ আমি জায়েজ মনে করি না। আমার জানামতে শরিয়তের নির্দেশ তাই।’….দুইটি জাতির মধ্যে কয়েকটি বিষয়ে চুক্তি সম্পর্ক এবং এক কিংবা দুটো বিষয়ে যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করা এমন বিপরীতধর্মী কথা যা কোনো যুক্তিসম্পন্ন লোক কল্পনা করতে পারবে না।’ (তরজমানুল কোরান জুন ‘৪৮। উদ্ধৃতি মওদুদীর চিন্তাধারা’ আবদুল আওয়াল)
অবশ্য এই জামাতীরাই তাদের শরিয়ত বরখেলাপ করে তাদের সকল যু্ক্তি জলাঞ্জলি দিয়ে ’৭১-এ ভারতের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছিল। জামাতের কোন চেহারা আসল? ‘শরিয়তের’ যুক্তি দিয়ে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ না করা, নাকি ‘শরিয়ত’কে গোল্লায় পাঠিয়ে ভারতের সঙ্গে জেহাদ করা। মোনাফেকদের নিয়ে এই হচ্ছে মুশকিল। তারা কখন কি যুক্তি দেখিয়ে কি করে বসে এটা ধারণা করাও অসম্ভব।
জামাতের প্রতিবাদে আমাদের সবচেয়ে বেশি বিস্মিত করেছে তাদের তিন শব্দের একটি বাক্য—‘মু্ক্তিযোদ্ধারা দেশের সম্পদ।’ জামাত সত্যি সত্যিই তাই মনে করে নাকি। আমরা যাবো কোথায়। মুক্তিযোদ্ধারা দেশের আমানত স্বরূপ একথা তারাই বলতে পারে যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী, যারা অংশ নিয়েছিল ’৭১-এর স্বাধীনতাযুদ্ধে। ’৭১ সালে জামাত এই পবিত্র আমানত কিভাবে খেয়ানত করেছিল তার কি পুনরুল্লেখ প্রয়োজন আছে? স্বাধীন বাংলাদেশে ’৮১ সালে যখন তারা প্রথম মাথাচাড়া দিল তখন সবার আগে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর কিভাবে হামলা চালিয়েছিল সে কথা মুক্তিযোদ্ধারা বিলক্ষণ মনে রেখেছেন। জামাতের মুক্তিযোদ্ধা প্রীতি তাদের ইসলাম প্রীতির মতোই ভয়াবহ। মুক্তিযোদ্ধারা সাবধান! গোটা ’৭১ সাল এই মুক্তিযোদ্ধাদের ‘দুষ্কৃতকারী’, ‘ভারতের চর’ আখ্যা দিয়ে তাদের নির্মূল করার অভিযান পরিচালনা করে আজ বলছে, ‘মুক্তিযোদ্ধারা দেশের সম্পদ।’ আবার একই নিঃশ্বাসে তারা বলে একাত্তরে আমরা ভুল করিনি। মোনাফেকী আর শয়তানীর আর কত উদাহরণ দেবো!

জামাতের হুমকি
প্রতিবাদপত্রে জামাত বিচিত্রাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে বিচিত্রা যা চায় তা হবে না—হতে পারে না। আরেক জায়গায় লিখেছে—‘আগামীতে হয়তো বা প্রতিবেদক, সম্পাদক ও বিচিত্রার মুরুব্বীরা নিজেদের মধ্যেই জামায়াতে ইসলামীকে দেখতে পাবেন।’ না, এটা আমরা অস্বীকার করবো না। জামাত এমন কাজ করতে পারে। ’৭১ সালে জামাতের আলবদর বাহিনীর অপারেশনাল ইন-চার্জ ছিল মঈনউদ্দিন। বুদ্ধিজীবী হত্যার অন্যতম প্রধান নায়ক এই ব্যক্তি। একে জামাতীরা পূর্বদেশ পত্রিকায় ঢুকিয়ে দিয়েছিল সাংবাদিকের ছদ্মবেশে। ফলে বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করা এর পক্ষে সহজ হয়েছিল। এই হচ্ছে জামাতের কর্মপদ্ধতি। জামাত যদি প্রশাসনের সাহায্য নিয়ে বিচিত্রায় এমন কিছু করতে চায় পারে বৈকি! আর এরকম একটা কিছু করতে পারলে বিচিত্রা যা চায় তা পারা যে সম্ভব হবে না এটাও জামাতীরা জানেন ভালো।
তবে জামাতের একটা হুমকি অযৌক্তিক। তারা বলেছে ‘সাংবাদিক সমাজ সাপ্তাহিক বিচিত্রার এই কলংকিত ও অশোভন আচরণ কোন অবস্থাতেই সমর্থন করতে পারেন না।’ জামাতপন্থী সাংবাদিক না পারেন তার মানে এই নয় যে গোটা সাংবাদিক সমাজ জামাতী হয়ে গেছে। জামাতকে সাংবাদিক সমাজের মুখপাত্র হয়ে এ ধরনের বাগাড়ম্বর করার অধিকার কে দিয়েছে বিনীতভাবে এ প্রশ্নটি আমি নিশ্চয়ই তুলতে পারি।

কে গুয়েবলস?
’৭১ সালে অধ্যাপক গোলাম আযম পাকিস্তান পালিয়ে গিয়েছিলেন এটা নাকি গুয়েবলসীয় কায়দায় মিথ্যা যা বিচিত্রা বার বার চালাচ্ছে—এই হচ্ছে জামাতের বক্তব্য। জামাত আরো বলেছে ‘তাঁর বিরুদ্ধে আরো প্রচারণা চালানো হয় যে তিনি পাকিস্তানী নাগরিক।….তিনি যদি পাকিস্তানী নাগরিক হবেন তাহলে তিনি কোন শক্তিবলে মগবাজারে তাঁর নিজ বাসভবনে অবস্থান করছেন?’ তার মানে নাগরিকত্ব প্রমাণের যুক্তি হচ্ছে নিজ বাড়িতে থাকা; নাকি! ধরা যাক—’৪৭-এর পর এক হরিদাস পাল মগবাজারে তার নিজের বাড়ি ছেড়ে ভারতে চলে গিয়েছিল। পরে ভিসা নিয়ে সে তার নিজের বাড়িতে এসে উঠেছে। তো দাবী করুক সে বাংলাদেশের নাগরিক। কেমন শোনায় ব্যাপারটা!’
গোলাম আযম যদি বাংলাদেশী নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য তাঁর বাংলাদেশী পাসপোর্ট খানা দেখান, নিদেনপক্ষে ভোটার লিস্টে নাম ছাপানো দেখান তাহলে তওবা বলে এই গোয়েবলসীয় প্রচারণা থেকে আমরা বিরত থাকবো। নইলে বলতেই থাকবো পাকিস্তানী! পাকিস্তানী!! ইয়ার্কী মারার সীমা থাকা উচিত। জামাত ধরে নিয়েছে এখন থেকে গোলাম আযমকে ক্রমাগত বাংলাদেশী নাগরিক বলে প্রচার করলে তিনি গোয়েবলসীয় কায়দায় বাংলাদেশী নাগরিক হয়ে যাবেন। সে গুড়ে বালি।

গোলাম আযম কোন শক্তিবলে বাংলাদেশে রয়েছেন?
জামাত দম্ভভরেই বলেছে ‘তিনি কোন শক্তিবলে…..অবস্থান করছেন?’ প্রশ্নটি আমরাও গত প্রতিবেদনে তুলেছিলাম পাকিস্তানের পাসপোর্টধারী এই ব্যক্তি সম্পর্কে। জামাত সরকারের কাছেও দাবী জানিয়েছে—সরকার প্রমাণ করুক গোলাম আযম বাংলাদেশের নাগরিক নন। অথচ এরা ক’দিন আগেই সংলাপে বসে গোলাম আযমের নাগরিকত্বের জন্য সরকার প্রধানের কাছে আবেদন জানিয়েছে।
গোলাম আযম বাংলাদেশে বসে আছেন ‍খুঁটোর জোরে। খুঁটোর জোরে যেমন ম্যাড়া কোঁদে তেমনি গোলাম আযমরাও কুঁদছেন শক্ত খুঁটোর জোরে, যে খুঁটো পোঁতা আছে পেট্রো-ডলারের দেশে। বাংলাদেশে আসার আগে গোলাম আযম ’৭১ থেকে ’৭৮ পর্যন্ত এই ‍খুঁটোই শক্ত করে পুঁতেছেন সৌদি রাজতন্ত্রের দেশে। বাংলাদেশের মত হতদরিদ্র একটি দেশের সরকারকে এই ঘাতককাঁটা ওপড়াতে হলে যে যথেষ্ট শক্তিধর হতে হবে একথা কি বলার অপেক্ষা রাখে! আবার নাগরিকত্ব দিলেও বিপদ। ২২ দলের সঙ্গে আন্দোলনের পোঁ ধরে জামাত যতই জাতে ওঠার চেষ্টা করুক মানুষ তো রাজনীতির অত মারপ্যাঁচ বোঝে না। তারা জানে খুনীকে ধরে গারদে পুরে রাখতে হয়, বিচার হয়, ফাঁসী হয়। তাই ‍খুঁটোর জোরে জামাত যতই কুঁদুক না কেন রাজা বাদশাহের আলখাল্লা ধরে আর যাই হোক বাংলাদেশের মাটিতে শেকড় গাঁড়া মুশকিল; নাগরিকত্ব আর গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম তো দূরস্ত!
সার কথা এই মানুষের জন্মগত অধিকার বলে কিছু নেই। বিশেষ করে নাগরিকত্ব তো নয়ই। জন্মসূত্রে কেউ একটি দেশের নাগরিক হতে পারেন আবার সেই দেশকে অস্বীকার করলে বা অন্য কোন কারণে নাগরিকত্ব খারিজও হয়ে যেতে পারে। জামাত বলেছে অনেকেরই তো নাগরিকত্ব খারিজ হয়ে গিয়েছিল আবার ফিরেও পেয়েছে। পেয়েছে বৈকি! আমরা যদিও এর পক্ষে নই তবু অনেকের সঙ্গে ঘাতককুল শিরোমণি গোলাম আযমের একটু পার্থক্য কি থাকতে নেই? গোলাম আযম নিজেই তো অপরাপর ইসলাম পছন্দ দলের সঙ্গে নিজেদের এই পার্থক্য ’৭১ সালে টেনেছিলেন। এখন কেন অনেকের কাতারে গিয়ে দাঁড়াতে চান? আবারও সেই চোগলখোরী।

শেষ কথা
জামাতের প্রতিবাদের প্রতি ছত্র ধরে দাঁতভাঙা জবাব দেয়া যায়। আমাদের অতো সময় নেই, বিচিত্রার পাতারও স্বল্পতা আছে। জামাত আমাদের প্রতিবেদনের মূল অভিযোগের কোন জবাব দেয়নি। অভিযোগুলো প্রশ্নাকারে আবারও আমরা তুলছি পাঠকদের অবগতির জন্য। জামাত সবশেষে বলেছে ’৭১ আর ’৮৪ সালের মধ্যে পার্থক্য একযুগেরও বেশি। এক যুগে কেন শতাব্দী অতিক্রম করলেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ইতিহাস মলিন হবে না। আমাদের পর আছে আমাদের বংশধররা। স্বাধীনতার চেতনা যে কোন জাতির পরম গৌরবের বস্তু। কোন সচেতন জাতি এই গৌরব ভুলে যেতে পারে না। পারে না বলেই ক্ষমা করতে পারে না স্বাধীনতার শত্রুদের। ইতিহাস এখনো রুডলফ হেসদের ক্ষমা করেনি। হেসকে ক্ষমা না করার ভেতরই রয়েছে জার্মান জাতির মহত্ত্ব।

শাহরিয়ার কবির
০০০

কোন ভাষায় প্রকাশ করব আলবদর পশুদের এই নৃশংসতা
(৭১ সালের ১৯ ডিসেম্বর জামাতী ঘাতকদের বধ্যভূমি আবিষ্কৃত হওয়ার পর তৎকালীন দৈনিক বাংলাদেশে এই মর্মস্পর্শী প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়।)
(বাংলাদেশ রিপোর্টার)
দৈনিক বাংলাদেশ গভীর বেদনা এবং ক্ষোভের সঙ্গে জানাচ্ছে যে আলবদর ও আলশামস বাহিনী হিংস্র শাপদের নখর বিস্তার করে সংঘবদ্ধভাবে গত কয়েকদিনে দেশের বহুসংখ্যক গুণী সাংবাদিক, সাহিত্যিক শিক্ষক, চিকিৎসক, আইনজীবী ও ছাত্রকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। গত কয়েক মাস যাবৎ হানাদার পাক বাহিনীর সহযোগী ফ্যাসিস্ট জামাতে ইসলামী ও অন্যান্য উগ্র দক্ষিণপন্থী দলের সংগঠিত আলবদর ও আলশামস বাহিনী বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকায় মধ্যযুগীয় বর্বতারর চেয়েও যে নিষ্ঠুর তান্ডবলীলা চালিয়ে যাচ্ছিল হানাদার বাহিনীর চরম পরাজয় প্রান্তেও তারা তা অব্যাহত রেখেছিল। আগের চেয়ে অধিকতর নারকীয় উল্লাস নিয়ে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ল আমাদের দেশের সাংবাদিক, সাহিত্যিক, চিকিৎসক, শিক্ষক ও আইনজীবীদের উপর। হানাদার পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে মিত্র বাহিনী চরম পর্যায়ে সংগ্রাম শুরু করার পর তারা বাড়ি বাড়ি হানা দিয়ে ধরে নিয়ে গেল প্রিয়স্বজনদের আমাদের দেশের সোনার সন্তানদের।
বিশিষ্ট সাংবাদিক সিরাজউদ্দীন হোসেন, শহীদুল্লাহ কায়সার, নিজামউদ্দীন আহমেদ, লাডু ভাই, নজমুল হক, আ ন ম গোলাম মোস্তফা আজ আমাদের মধ্যে নেই। এই রিপোর্ট লেখার আগ পর্যন্ত আমরা তাদের খুঁজে বেড়িয়েছি আলবদর শামসদের বধ্যভূমি শহরের একপ্রান্তে রায়ের বাজার বিল ও বসিলারে বিল এলাকায়। বর্বর পশুরা বহু লোককে হত্যার পূর্বে চেহারা বিকৃত করে দিয়েছে। কারো চোখ খুবলে নিয়েছে, কারো মুখের একাংশ কেটে নিয়েছে। মৃতদেহের স্তূপ থেকে প্রিয় মুনির ভাই—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ প্রফেসর মুনির চৌধুরী, বিশিষ্ট চিকিৎসক প্রফেসর আলীম চৌধুরী, প্রফেসর এম এফ রাব্বি, ডঃ আজাদ প্রমুখের লাশ সনাক্ত ও উদ্ধার করা হয়েছে।
গত কয়েকদিনে আরো বহুজনকে ধরে নিয়ে হত্যা করেছে আলবদর, আলশামসের পশুরা। আমাদের শোক প্রকাশের কোন ভাষা নেই। আমাদের সব কথা আজ এক নৃশংস আঘাতের ক্ষোভ ও বেদনায় স্তব্ধ হয়ে গেছে। আমাদের এই সব হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনদের স্মৃতি আমাদের অস্তিত্বের চারধারে ছবি হয়ে বিচরণ করছে; সর্বায়বয়বে জড়িয়ে রয়েছে। আমাদের এসব গুণী প্রিয়জন আমাদের চোখের সম্মুখ থেকে, চোখের মনির ভেতর হৃদপিন্ডের পরতে পরতে, রক্তের যন্ত্রণাময় সঞ্চালনে নিবিড় থেকে নিবিড় হয়ে মিশে রয়েছে। আমাদের তাদের কথা কোন ভাষায় প্রকাশ করবো?
কোন ভাষায় প্রকাশ করবো আলবদর পশুদের এই নৃশংসতা? আমাদের কোটি কোটি ‍ঘৃণা, ক্ষোভ এবং ধিক্কার কি সংবাদপত্রের প্রতিবেদনের এই ছত্রে ছত্রে তীব্রতমভাবে নিক্ষেপ করেও কি নিঃশেষ করা যাবে?
গতকাল শনিবার রায়ের বাজার বিল, কাটাসুর, বসিলার বিল এলাকায় আমি যখন পৌঁছলাম তার আগে পর্যন্ত বেদনার তীব্রতা যে কত বিধ্বস্ত করে দিতে পারে বুঝতে পারিনি। ১৯৭০ সালের নবেম্বরের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পর দুর্গত এলাকায় কখনো হাজারো হাজারো শবের এক একটি মিছিল দেখতে পেয়েছি। প্রকৃতির নিষ্ঠুর তান্ডবলীলা দেখে তখন বেদনাহত; বিধ্বস্ত ও বিপর্যস্ত হয়েছি। কিন্তু হানাদার বাহিনীর দোসর আলবদর, আলশামসদের এই বধ্যভূমিতে এসে মানুষের তান্ডবলীলা দেখে বেদনায় আমি যেন স্থবির হয়ে পড়েছি। আমরা বহু সাংবাদিক নিজেদের গৃহত্যাগ করে অন্যত্র অবস্থান করে অল্পের জন্য এই বর্বরতার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছি।
বিস্তীর্ণ মাঠের এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে লাশগুলো। কোথাও এক সঙ্গে বহু লাশ একত্র করে রাখা হয়েছে। এর মধ্যে মহিলাও রয়েছেন। রায়ের বাজার বিল ও বসিলার বিল এলাকায় যে মৃতদেহগুলো দেখতে পেলাম প্রায় সবগুলোই মাত্র দুই তিন দিনের বলে মনে হলো। এক জায়গায় দেখতে পেলাম মাটি চাপা দেওয়া দুটি লাশের অঙ্গ প্রত্যঙ্গের অংশ বিশেষ বেরিয়ে রয়েছে। এগুলো কয়েকদিনের পুরোনো বলে মনে হলো। লাশের পর লাশ। স্থানীয় এলাকা থেকে পালিয়ে যাওয়া লোকের মুখে শুনতে পেলাম অদূরে সাত গম্বুজ মসজিদ ও শিয়াদের ইমাম বাড়ির পশ্চিমদিকস্থ ঢালু এলাকায় আরও বহু শত লাশ পাওয়া গেছে। ওদিকে যাওয়া যায় না। এখনও নাকি গুলি ছোঁড়া হয়।
হঠাৎ কান্নার শব্দ পেলাম। পাশে ছিলেন অস্ট্রেলীয় সাংবাদিক মিঃ ফিনলে। তিনি ফুপিয়ে কাঁদছেন। কাঁদছেন একজন ভারতীয় সাংবাদিক। কাঁদছি আমি। কাঁদছে অনেকে।
বধ্যভূমিতে দাঁড়িয়ে অতলান্ত বেদনায় সাগর হয়েছে আমাদের শোকের পৃথিবী।
০০০

 

০০০

[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/05/1984.04.27-bichitra-golam-azam.pdf” title=”1984.04.27 bichitra golam azam”]

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!