You dont have javascript enabled! Please enable it!

হাজী দানেশ : জীবন নিয়ে নিবেদিত মুক্তির সংগ্রামে | গুলবাহার হাসনাত/মেসবাহ কামাল

সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ১৪ ডিসেম্বর ১৯৮৪

৭ অক্টোবর ১৯৮৪। দিনাজপুরের বাণীরবন্দরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এক বিশাল কৃষক সমাবেশ। সভাপতিত্ব করছেন এদেশের কৃষক আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা হাজী মোহাম্মদ দানেশ। এ সভা শুরু হওয়ার মুহূর্ত কাল আগে একজন বৃদ্ধ কৃষক কথা বলার ছলে অত্যন্ত আবেগ জড়িত কন্ঠে প্রশ্ন করলেন, হাজী দানেশ সারাটা জীবন আমাদের জন্য লড়াই করে তিনি নিজে কি পেয়েছেন? একজন কৃষকের অতি সঙ্গত প্রশ্ন। সামগ্রিকভাবে এদেশের বাম রাজনীতি সম্পর্কেও এ প্রশ্ন উচ্চারিত হয়েছে, সহস্রবার।
হাজী দানেশ কি দিয়েছেন বা কি পেয়েছেন এ প্রশ্নের জবাব হয়তো দেয়া যাবে না। এর জবাব দেবে আগামী দিনের ইতিহাস। আমরা শুধু মানুষের মুক্তির সংগ্রামে নিবেদিত একটি মানুষের বিশাল জীবনের কিছু চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করবো।
এদেশের বিপ্লবী রাজনীতির ধারায় একটি পরিচিত নাম, হাজী মোহাম্মদ দানেশ। উপমহাদেশের কৃষক সংগ্রামের ইতিহাসে, বর্তমানে যেমন ভবিষ্যতেও তেমনই, এ নাম ঘুরেফিরে আসবে বার বার। বাম রাজনীতি দীক্ষা গ্রহণের দিন থেকেই অবিচল আদর্শবোধ ও নিষ্ঠা থেকে ব্যক্তিগত ভাগ্য গড়ার সব রকম উপকরণ হাতের কাছে তৈরি পেয়েও তা প্রত্যাখ্যান করে হাজী দানেশ গ্রহণ করেছেন সহজ সরল এক সংগ্রামী জীবন। ধর্মপ্রাণ মানুষের এই বাংলাদেশে বাম রাজনীতির ক্ষেত্রে তিনি নিজেই একটি বিশেষ ধারার প্রতিনিধিত্ব করেন। প্রগতিশীল রাজনীতির সুজন ও বিকাশে, বিশেষতঃ ব্যাপক সংখ্যক মুসলমানকে শ্রেণী রাজনীতিতে উদ্বুদ্ধ করার ক্ষেত্রে তার অবদান অবিস্মরণীয়।

প্রাথমিক পরিচয়
ব্যক্তিগত জীবনে দিনাজপুরের এক ছোট জোতদার পরিবারের সন্তান হাজী দানেশ উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করেন ‘মুসলমান পুনর্জাগরণের’ কেন্দ্র হিসেবে এককালে খ্যাত আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ইসলামের ইতিহাসে এমএ করার পর আইন শাস্ত্রে স্নাতক ডিগ্রী গ্রহণ করেন। জানা যায়, দিনাজপুর জেলায় হাজী দানেশ ছিলেন দ্বিতীয় মুসলমান এমএ। স্নাতক হয়ে তিনি দিনাজপুর শহরে স্থায়ীভাবে বসবাস ও আইন ব্যবসায় মনোনিবেশ করতে মনস্থ করেন। ত্রিশের দশকের প্রথমদিকে, একদিকে মহানন্দর করাল প্রভাব অন্যদিকে মানুষের অর্থনৈতিক জীবন-যাপনকে প্রতি মুহূর্তে দূরুহতর করে তুলেছে, অন্যদিকে বৃটিশ বিরোধী মনোভাব সমাজকে প্রতিদিনই আন্দোলিত করছে। এরকম একটা সময়ে হাজী দানেশ হজব্রত উপলক্ষ্যে যান মক্কা। তখন তাঁর বয়স মাত্র বত্রিশ।
বত্রিশ বছরের উচ্চ শিক্ষিত যুবক দানেশের ভবিষ্যত জীবন পরিকল্পনা কেমন যেন ওলট-পালট করে দিল এই মরুভূমি দেশ। ভক্তিবাদের প্রভাবে প্রভাবিত ভারতীয়রা নবীর মাজারে বা দেওয়ালে কদাচ চুমু খেলে বা মাজারে মাটি গায়ে মাথায় মেখে নিতে গেলেই নেমে আসে সৌদি পুলিশের অমানবিক নিপীড়ন দন্ড! অথচ এই এক অপরাধে অপরাপর দেশ থেকে আগত হাজীদের ক্ষেত্রে এ আচরণ সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। সেখানে শুধু মুখের নিষেধাজ্ঞা উচ্চারণেই ক্ষান্ত থাকে সৌদি পুলিশ। তীব্র কষাঘাত হানলো হাজী দানেশের মনোজগতে। ভাবলেন দুশ’ বছরের বৃটিশ পরাধীনতাই বুঝি দিয়েছে আমাদের প্রতি সীমাহীন উপেক্ষা আর অবজ্ঞা। প্রতিজ্ঞা করলেন দেশে ফিরে আর কোন বেহুদা কাজ নয়, মাতৃভূমিকে বিদেশী শাসনের শৃঙ্খল মুক্ত করাই হবে তাঁর একমাত্র লক্ষ্য।
হজ করতে গিয়ে এক ভিন্ন মানুষ হয়ে ফিরে এলেন হাজী মোহাম্মদ দানেশ। চোখে তাঁর তখন বৃটিশ বিতাড়নের স্বপ্ন।

কৃষক সভা ও রাজনৈতিক জীবনের সূত্রপাত
হাজী দানেশের প্রথম রাজনৈতিক জীবনে পদার্পণ ১৯৩৭ সালে, কৃষক সমিতির মাধ্যমে। প্রাদেশিক পর্যায়ে কৃষক সমিতি তখন সংগঠিত হতো মূলতঃ কমিউনিস্টদের দ্বারা, যদিও কংগ্রেস কর্মীরাও তখন ব্যাপক সংখ্যায় কৃষক সমিতিতে কাজ করতেন। কেন্দ্রীয়ভাবে এই প্রতিষ্ঠানের নাম ছিলো ‘সারা ভারত কিষাণ সভা।’ ১৯৩৬ সালের ১১ এপ্রিল কংগ্রেসের লক্ষ্মৌ অধিবেশনে আগত প্রতিনিধিদের নিয়ে স্বামী সহজানন্দের সভাপতিত্বে এবং কংগ্রেসের সমাজতন্ত্রী দলের জয়প্রকাশ নারায়ণ, আচার্য নরেন্দ্র দেব, ইউসুফ মেহের আলী, গুজরাটের গান্ধীবাদী নেতা ইন্দুলাল যাজ্ঞিক, বাংলার নীরারেন্দু দত্ত মজুমদার, আশরাফউদ্দিন চৌধুরী ও কমরেড বঙ্কিম মুখার্জী প্রমুখের উপস্থিতিতে গঠিত হয় সারা ভারত কৃষাণ কংগ্রেস। পরে এ সংগঠনের নাম পরিবর্তন করে সারা ভারত কিষাণ সভা করা হয়। লক্ষ্মৌ অধিবেশনে গৃহীত ইশতেহারে কিষাণ সভার লক্ষ্য, প্রধান কাজ ও দাবীগুলো উল্লেখ করা হয়। লক্ষ্য হিসেবে ‘অর্থনৈতিক শোষণ থেকে পূর্ণ মুক্তি অর্জন এবং কৃষক শ্রমিক ও অন্যান্য শোষিত শ্রেণীর পূর্ণ অর্থনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা অর্জন’, নির্ধারিত করা হয়। এ লক্ষ্যে কৃষকদের সংগঠিত করার কাজকে প্রধান কাজ হিসেবে গ্রহণ করা হয়। দাবীসমূহ ছিল দু’ধরনের—মূল দাবী ও ন্যূনতম দাবী। মূল দাবী ছিল জমিদারী উচ্ছেদ করে চাষীর হাতে জমি ন্যস্ত করা, আর ন্যূনতম দাবীর মধ্যে ছিল ঋণ মওকুফ, অলাভজনক ভূমি থেকে ভূমি রাজস্ব ও খাজনা বিলোপ, রাজস্ব ও খাজনা হ্রাস কৃষি শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরী, ফসলের ন্যায্যমূল্য সেচের সুবন্দোবস্ত, ভূস্বামী ও বণিকদের ওপর ক্রমাগত হারে আয়কর ও উত্তরাধিকার কর আরোপ ইত্যাদি।
১৯৩৬ সালের ১৬-১৭ আগস্ট কলকাতার এ্যালবার্ট হলে ২০টা জেলার প্রতিনিধিদের এক সম্মেলনে প্রকাশিত কৃষক সভার গোড়ার পত্তন হয়। প্রাদেশিক কৃষক সভায় কমিউনিস্টরা নেতৃত্বের ভূমিকা গ্রহণ করেন এবং কমরেড বঙ্কিম মুখার্জীকে আহ্বায়ক নির্বাচিত হন।
হাজী দানেশ দিনাজপুরে কৃষক সমিতির প্রতিষ্ঠা করেন কিছু প্রাক্তন সন্ত্রাসবাদীর সঙ্গে সম্মিলিতভাবে। কারাভ্যন্তরে থাকাকালীন সময়ে এরা মার্কসবাদে দীক্ষিত হন এবং ১৯৩৭ সালের গোড়ার দিকে ছাড়া পাবার পর কমিউনিস্ট পার্টির তৎকালীন পপুলার ফ্রন্টের নীতি অনুযায়ী স্ব স্ব এলাকায় এসে কংগ্রেসের মাধ্যমে কৃষক সমিতি বিভিন্ন পেশাভিত্তিক সংগঠন গড়ার কাজে মনোনিবেশ করেন। দিনাজপুরে কৃষক সমিতি গড়ার কাজে যাঁরা প্রাথমিক উদ্যোগ নিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন বিভূতি গুহ, সুশীল সেন, জনার্দন ভট্টাচার্য, অজিত রায়, নরেশ চক্রবর্তী, হৃষিকেশ ভট্টাচার্য, সত্য চক্রবর্তী, সরোজ বসু ও কালী সরকার। তারা কেন্দ্রীয় কৃষাণ সভার লক্ষ্য, প্রধান কাজ ও দাবীসমূহের ভিত্তিতে আঞ্চলিকভাবে বিভিন্ন আন্দোলন গড়ে তুলে গণমানুষের আস্থা অর্জনে সচেষ্ট হন। দিনাজপুর শহরের মুন্সিপাড়ার কৃষক সমিতির অফিস স্থাপিত হয়।
হাজী দানেশ তার ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে শোষণের বিপক্ষে—দরিদ্রের পক্ষে দাঁড়ানোর জন্য ইসলামের নির্দেশের কথা স্মরণ করে কৃষক সমিতিতে যোগদান করেন। কৃষকদের অর্থনৈতিক মুক্তির কোন সুস্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি তখন পর্যন্ত তাঁর ছিল না। কৃষকদের প্রতি সীমাহীন ভালোবাসায় তিনি ঝাঁপসা চিন্তাচেতনা নিয়ে যোগ দিয়েছিলেন কৃষক সমিতিতে।

আঞ্চলিক ও আংশিক সংগ্রামে ভূমিকা
এ সময়ে পার্টি বিভিন্ন এলাকায় কংগ্রেস কর্মীদের সাথে যোগাযোগ করে তাদের একটা অংশকে উদ্বুদ্ধ করে কৃষক সমিতিতে নিয়ে আসার লক্ষ্যে কাজ করতো। প্রাথমিক অবস্থায় কোন রকম সংঘর্ষ এড়িয়ে সমিতির সাংগঠনিক শক্তিকে দৃঢ় করার জন্য সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, সহজ দাবী নিয়ে কাজ শুরু করার—যা আদায় করার জন্য জোতদার বা সরকারের সাথে বড় ধরনের সংঘর্ষে লিপ্ত হতে হবে না। আন্দোলনের প্রথম ধাপ হিসেবে স্থানীয় জোতদারদের অত্যাচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে আঞ্চলিকভাবে সংগ্রামের ডাক দেয়া হয়। প্রথম এই ধরনের আন্দোলন গড়ে ওঠে আটওয়ারীতে এর পরবর্তীতে তা বালিয়াডাঙ্গী, ঠাকুরগাঁ, বীরগঞ্জ, বোচাগঞ্জ, কাহারোল প্রভৃতি থানায় ছড়িয়ে পড়ে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রাম গড়ে ওঠে ঠাকুরগাঁও মহকুমায়। এই মহকুমার কৃষক সমিতির দায়িত্বে ছিলেন হাজী মোঃ দানেশ, সত্যেন রায় ও গুরুদাস তালুকদার। হাজী দানেশ এই সময় সাংগঠনিক প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে ঠাকুরগাঁ কোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন। সারাদিন কাজের পর তিনি বিকেলে সাইকেলে চেপে একেকদিন একেক এলাকায় চলে যেতেন এবং কৃষকদেরকে সংগঠিত করার কাজে উদ্যোগ রাখতেন। তাঁর সাইকেলে পেছনের কেরিয়ারে থাকতো কৃষক সমিতির লিফলেট।

তোলাবটি আন্দোলন
সংগ্রামের দ্বিতীয় পর্যায় হিসেবে জেলা কৃষক সমিতি তোলাবটি আন্দোলন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয়। সংগঠিত কৃষকরা ধ্বনি তোলেন ‘কৃষকের তোলাবটি নাই’, ‘কৃষকের লেখাই নাই’, ‘সব ধরনের তোলাবটি বন্ধ কর, বন্ধ কর।’ আন্দোলনের স্বার্থে এ পর্যায়ে গঠন করা হয় কৃষক সমিতির স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী এবং ‘লাঠি কাটো সাড়ে তিন হাত’ শ্লোগান তুলে লাঠিধারী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করা হয়। এই আন্দোলন সর্বপ্রথম গড়ে ওঠে বীরগঞ্জের ডেমডেমী কালীর মেলায়। সে সময় জমিদারের নায়েবরা মেলায় ক্যাম্প করে বরকন্দাজসহ থাকতেন। কৃষক সমিতি তোলা বিরোধী আন্দোলন শুরু করতেই তারা বরকন্দাজের সাহায্য নিয়ে বাঁধা দেয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু কৃষক সমিতির পেছনে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন এবং শ’দুয়েক সংগঠিত লাঠিধারী স্বেচ্ছাসেবকের সামনে জমিদারের নায়েব তার পাঁচ/দশজন বরকন্দাজ নিয়ে দাঁড়াবার সাহস পাননি। সে সময় ক্রেতা হাট থেকে যে গরু বা ছাগলটি কিনতেন তা যে চোরাই জিনিস নয়—এই নিশ্চয়তা হিসেবে হাট বা মেলার মালিক টাকার বিনিময়ে ‘লেখাই’ দিতেন যার মধ্যে ক্রেতা ও বিক্রেতার নাম ও মূল্য ইত্যাদি লেখা থাকতো। কৃষক সমিতি এরপর সমিতির সীল দেয়া কাগজে ক্রেতা ও বিক্রেতার নাম লিখে গরুর বিবরণ ও দাম এবং ক্রেতা-বিক্রেতা ও রসিদ প্রদানকারীর সইসহ রসিদ বিনা পয়সায় দেয়া শুরু করে। কৃষক সমিতির দেয়া এই রসিদ আইনগত দিক দিয়েও জমিদারের দেয়া রসিদের মতোই গ্রহণযোগ্য ছিল, বস্তুতঃ রায়তকে ‘লেখাই’ দিতেই হবে এমন কোন আইন ছিল না। ফলে সম্মিলিত প্রতিরোধের মুখে তোলা ও লেখাই আদায় কেবল ডেমডেমী কালীর মেলাতেই বন্ধ হয়নি, ঠাকুরগাঁ, আটওয়ারী, বালিয়াডাঙ্গী, ফুলবাড়ী ও নবাবগঞ্জের বিভিন্ন হাট ও মেলাতেও তা বন্ধ হয়ে যায়।
ঠাকুরগাঁ ও পার্শ্ববর্তী থানাসমূহে এই আন্দোলন সংগঠন হাজী দানেশ পালন করেন একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। আন্দোলনের মধ্যদিয়ে তার দৃষ্টিভঙ্গি হতে থাকে স্বচ্ছ ও পরিণত। তিনি এ সময় আন্দোলনের স্বার্থে নিয়মিত পড়াশোনা আরম্ভ করেন। দিনাজপুরের কৃষক সমিতির অন্যতম নেতা বিভূতি গুহ এ সময়ে হাজী দানেশকে ডায়েলেক্টিক্যাল মেটোরিয়ালিজম পড়তে দেন কিন্তু কমরেড মোজাফফর আহমেদের বিরোধিতায় তাঁর তখন আর বস্তুবাদ চর্চা হয়ে ওঠেনি। কমরেড মোজাফফর হাজী সাহেবকে বিশেষ স্নেহ করতেন, তিনি বলেন যে, হাজী সাহেবের আপাততঃ কোরান-হাদিস এবং সাথে অন্যান্য কিছু বইপত্র পড়াই যথেষ্ট। পরবর্তীকালে নিজেই স্বীকার করেছেন যে সেদিন যদি তিনি প্রাথমিক অন্যান্য পড়াশোনা না করেই বস্তুবাদ অধ্যয়ন করতেন তাহলে তাঁর আর কখনোই বাম রাজনীতিতে টিকে থাকা সম্ভব হতো না। বরং বাকি জীবন কেটে যেতো একজন কট্টর কমিউনিস্ট বিরোধী মানুষ হিসেবে।

সুদ বন্ধ আন্দোলন
তোলাবটি আন্দোলনের সাফল্যের পরে, ১৯৩৯ সালের শেষের দিকে ধান কাটার মওসুমে জেলা কৃষক সমিতির নেতৃত্বে শুরু হয় সুদ বন্ধ আন্দোলন। প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে শুরু হয় গ্রামে গ্রামে বৈঠক ও মিছিল। প্রত্যেক গ্রামে গড়ে তোলা হতে থাকে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। ‘নিজ খামারে ধান তোল’ শ্লোগান তুলে তাকে বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে কৃষকদেরকে জোতদারের খামারে ধান না তুলে নিজ খামারে ধান তুলতে অনুপ্রাণিত করা হতে থাকে। ফলে কিছুদিনের মধ্যেই কৃষকরা লাঠিধারী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীসহ দল বেঁধে একেকদিন একেকজনের ক্ষেতের ধান কেটে জোতদারের খামারের পরিবর্তে আধিয়ারের বাড়িতে তোলা শুরু করে। এ পর্যায়ে জোতদাররা আধিয়ারদের বিরুদ্ধে ধান চুরির মামলা জুড়ে দিতে শুরু করলে আধিয়াররা ‘জোতদার যেন মামলা করতে শহরে যেতে না পারে’ তার ব্যবস্থা করার উদ্যোগ নেয়। সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে জোতদাররা যখন মামলা করতে শহরে যাবে তখন পথিমধ্যে সম্মিলিতভাবে বাঁধা প্রদান করতে হবে। সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হয় এবং কৃষকদের দ্বারা সর্বত্র আক্রান্ত ও অপমানিত হওয়ার পর জোতদাররা ভয় পেয়ে আধিয়ারদের বিরুদ্ধে মামলা করার চিন্তা বাদ দেন এবং সম্মিলিতভাবে ঘটনাবলীকে সরকারের গোচরে আনেন। অন্যদিকে ‘কর্জা ধানের সুদ নাই’ শ্লোগানকে সামনে তুলে ধরে সুদ বন্ধ আন্দোলন নতুন গতিবেগ অর্জন করে।
আন্দোলনের জঙ্গীরূপের মুখে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ সুপার এবং মহকুমা প্রশাসক থানাগুলোর বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে জনসভা শুরু করেন। এসব সভায় কৃষকদেরকে এই মর্মে হুঁশিয়ার করা শুরু হয় যে কৃষকদের কার্যকলাপ বেআইনী হতে শুরু করেছে এবং সরকার এরপর কঠিন ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু তাঁরাও বিভিন্ন জায়গায় সংগঠিত কৃষকদের দ্বারা বাঁধাপ্রাপ্ত হতে শুরু করেন এবং জোতদার-আধিয়ার বিরোধ মীমাংসার জন্য ঠাকুরগাঁ মহকুমা প্রশাসক জোতদার ও কৃষক সমিতির নেতাদেরকে একটা সমঝোতা সভায় বসার জন্য আহ্বান জানান। সমঝোতা সভায় কৃষকদের প্রতিনিধিত্ব করেন হাজী মোঃ দানেশ ও সত্যেন রায়, অন্যদিকে জোতদারদের প্রধান প্রতিনিধি ছিলেন হাজী কেরামত আলী। প্রশাসনের পক্ষ থেকে ছিলেন মহকুমা প্রশাসক আলতাফুর রহমান।
সমঝোতার আলোচনায় বসে জোতদাররা জানান যে কৃষকেরা যদি সুদ একেবারে না দেয় তাহলে তাদের ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়, কেননা কৃষকেরা যখন ধান ধার নেন তখন ধানটা থাকে শুকনো কিন্তু কাটার পরে যখন ফেরত দেন তখন ধানটা থাকে ভেজা, ফলে সে সময় ধান ওজনে ভারী থাকে যা পরে শুকিয়ে ওজনে কমে যায়। সমঝোতার আলোচনায় তাই সিদ্ধান্ত হয় যে এতদিন যেখানে কৃষককে বিশ কাঠা ধান ধার নেয়ার জন্য ফেরত দিতে হতো চল্লিশ কাঠা, এখন থেকে সেখানে ফেরত দিতে হবে মাত্র তেইশ কাঠা; অতিরিক্ত তিন কাঠাও সুদ হিসেবে নয়—ফেরত দেয়ার সময় ধান ভেজা থাকার ক্ষতিপূরণ হিসেবে। এছাড়া সিদ্ধান্ত হয় জোতদার ও আধিয়ারের সম্মতি অনুসারে সকলের সুবিধাজনক একটা স্থানে একটি কমন খামার বানানো হবে যেখানে কোন বিশেষ জোতদারের অধীনস্থ সকল আধিয়ার ধান তুলবেন।
এটা ছিল কৃষকদের জন্য একটি বড় সাফল্য। জয়লাভে উল্লসিত কৃষকদের নিজেদের শক্তির ওপর পূর্ণ আস্থা জন্মে। কৃষক সমিতি তাদের প্রাণের সংগঠনে এবং হাজী দানেশ ও সত্যেন রায় তাদের প্রাণের মানুষে পরিণত হন।

‘জাল যার জলা তার’ আন্দোলন
সুদ বন্ধ আন্দোলনে সাফল্য লাভের পর উদ্বেলিত কৃষকরা নিজেরাই আগ্রহ নিয়ে, কম্যুনিস্ট পার্টির সিদ্ধান্ত ছাড়াই, ‘জাল তার জলা তার’ শ্লোগান দিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলেন। কৃষকরা বলতে শুরু করেন যে ‘ভাতের তো জোগাড় হলো, এবার তরকারী জোগাড় করা দরকার।’ এরপর তারা দল বেঁধে যেয়ে জোর করে জমিদারের খাস পুকুর, জোতদারের পুকুর প্রভৃতিতে মাছ মারা শুরু করেন। এই আন্দোলন মূলতঃ ঠাকুরগাঁ ও বীরগঞ্জ অঞ্চলে ‍গড়ে ‍ওঠে এবং জঙ্গী কৃষকরা, নিজেরাই, বিশেষ করে কালা বর্মন, পদ্মলাল প্রমুখ এর নেতৃত্ব দেন। তবে ১৯৪০ সালের ৫ মে দিনাজপুরের পুলিশ সুপার কর্তৃক জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রদেয় একটি রিপোর্টে বীরগঞ্জের ধুন্দুলগাঁও নিবাসী অনাথ বর্মন ও হাজী মোঃ দানেশের বিরুদ্ধে এই মর্মে অভিযোগ উত্থাপন করা হয় যে, তারা স্বেচ্ছাসেবকদের নির্দেশ দিয়েছেন যেন তারা যে কোন পুকুরকে নিজেদের পুকুর মনে করে মাছ মারে। যাইহোক ঐ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষিতে দেশে তখন ‘ডিফেন্স অব ইন্ডিয়া এ্যাক্ট’ জারী করা হয়েছে। জাল যার জলা তার আন্দোলনের শুরুতেই কর্তৃপক্ষ ডিফেন্স অব ইন্ডিয়া এ্যাক্টের বলে আন্দোলনের সাথে সম্পর্কিত নেতাদের গ্রেফতার শুরু করে দেন এবং ফলে আন্দোলনের গতি স্তিমিত হয়ে আসে।

প্রথম গ্রেফতার ও জেলজীবন
সারা ভারতে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন তীব্র হওয়ায় ’৪০ সালে সরকার ‘ডিফেন্স অব ইন্ডিয়া এ্যাক্ট’-এর অসংখ্য রাজনৈতিক নেতাকে গ্রেফতার করে। হাজী দানেশকেও এ আইনের ২৬ এবং ৫৬ ধারা মোতাবেক গ্রেফতার করে মামলা দায়ের করা হয়।
দু’টি মামলায় তার দু’বছরের কারাবাস দেয়া হয়। দিনাজপুরের অন্যান্য যারা সে সময় গ্রেফতার হন তাঁদের মধ্যে ছিলেন সুশীল সেন, কালী সরকার, গুরুদাস তালুকদার, বিভূতি গুহ, জনার্দন ভট্টাচার্য, গনেশ ডাক্তার, শচীন চক্রবর্তী, অখিল ডাক্তার, রাজ্যেশ্বর রায়, কালা বর্মন, পদ্মলাল, জাল মোহাম্মদ, খোকা বাইশ, লালটু মোহাম্মদ ও চালটু বর্মন প্রমুখ।
সাজা ঘোষণার পরে হাজী দানেশকে দমদম জেলে ট্রান্সফার করা হয়। দমদম জেলে কাটানো দু’টি বছর হাজী দানেশের জীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় একথা বলা যায়। দমদম জেলের দু’টি বছর কাটিয়েছেন ভারতের নামী-দামী সব বাম নেতৃবৃন্দের সাথে। এদের মধ্যে ছিলেন বর্তমান ত্রিপুররা মুখ্যমন্ত্রী নৃপেন চক্রবর্তী, শ্রমিক নেতা আবদুল মোমেনসহ অনেকে।
দমদম জেলখানায় অন্যান্য অনেক জেলখানার মত মার্কসবাদীদের পরিচালিত বিশেষ রাজনৈতিক ক্লাসের ব্যবস্থা ছিল। হাজী দানেশও এ ক্লাসে নিয়মিত অংশগ্রহণ করতেন। যেহেতু দমদম জেলে বেশিরভাগই ছিল রাজনৈতিক বন্দী তাই এ জেলের পাঠাগারটিও ছিলো সমৃদ্ধ। এসব কিছুরই যথাযথ ব্যবহার করলেন হাজী দানেশ।
দমদম জেলে আসার কিছুকাল পরেও হাজী দানেশ ছিলেন, ‘কঠিন মুসলমান।’ নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ছাড়াও দৈনিক রাত্রে ওঠে তাহাজ্জুদ নামাজও আদায় করতেন। দৈনিক একপারা কোরানও পড়তেন। একদিকে এরকম ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের ঘটা অন্যদিকে রাজনৈতিক ক্লাস সমন্বিত করে চালিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি।
কমিউনিস্ট কর্মীরা লাগাতারভাবে হাজী সাহেবের পেছনে লেগে পড়লেন। চূড়ান্ত লড়াই শুরু হলো দুটি দার্শনিক মূল্যবোধের মাঝে। প্রথমদিকে হাজী সাহেব মারাত্মক ক্ষুব্ধ হলেন। আজীবন লালিত ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগার ফলস্বরূপ তিনি রাজনৈতিক ক্লাসে অংশগ্রহণ পর্যন্ত ছেড়ে দিলেন কিছুদিন। লাঠি নিয়ে তেড়েও গেছেন দু’একজনের ওপরে, ধর্মের বিরুদ্ধে কথা বলার কারণে। কিন্তু ক’দিন পরেই আবার কৌতূহলী হয়ে যোগ দিয়েছেন রাজনৈতিক ক্লাসে। এমনি করে তিলেতিলে হাজী দানেশ নিজেকে সমর্পিত করেন মার্কসীয় দর্শনের পাদপীঠে। জেলখানার নানা কমিউনিস্ট নেতৃবৃন্দ নিষ্ঠার সাথে হাজী সাহেবের অসংখ্য প্রশ্নের জবাব দিতেন। হাজী সাহেবও জানার প্রচন্ড আগ্রহ নিয়ে অধ্যয়ন শুরু করেন। এ সময়ের গভীর অধ্যয়নই তাঁকে পরবর্তীকালে দিনাজপুরের সুরেন্দ্রনাথ কলেজে ইতিহাসের সফল অধ্যাপক হিসেবে কাজ করতে সহায়তা করে।
’৪২ সালে জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার আগে অতি উদ্যোগী কিছু রাজনৈতিক কর্মীরা মিলে হাজী দানেশের দাড়ি কামিয়ে ফেলেন। কিন্তু পরে পার্টির ঊর্ধ্বতন নেতৃবৃন্দ এর বিরোধিতা করেন। হাজী দানেশও সিদ্ধান্ত নিলেন দাড়ি রাখার, তবে ঠিক হলো দাড়িটা এবার কলেবরে একটু ছোট হলেও চলবে। নিয়মিত নামাজ পড়াও চালিয়ে যেতে মনস্থ করেন তিনি। সেই থেকে আজ পর্যন্ত তিনি নিষ্ঠার সাথে নামাজ আদায় করে আসছেন।

কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ
জেল থেকে হাজী দানেশ যখন বের হয়ে আসেন তখন তিনি রাজনৈতিকভাবে অনেক বেশি পরিপক্ক, মানসিকভাবে আগের চেয়ে অনেক বেশি দৃঢ়। এছাড়া জাতীয়তাবাদী একজন মুসলমান হিসেবে এবং সাধারণ মানুষের প্রতি অপরিসীম ভালোবাসার তাগিদ থেকে আন্দোলন করতে নেমে কমিউনিস্টদের সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা তার পূর্বেই হয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতা ও জেলজীবনের তাত্ত্বিক জ্ঞানার্জন তাঁকে এই বিশ্বাসে উপনীত করায় যে খেটে খাওয়া মানুষের মুক্তির জন্য সমাজতন্ত্রের পক্ষে লড়াই ছাড়া কোন বিকল্প নাই। তাই তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদের জন্য আবেদন করেন এবং ১৯৪২ সালেই সদস্যপদ লাভ করেন।
পপুলার ফ্রন্টের লাইনের পরিপ্রেক্ষিতে কংগ্রেসের সাথে সহযোগিতার সম্পর্ক কমিউনিস্ট পার্টি তখনও বজায় রাখছিল। হাজী দানেশ কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করলেও প্রকাশ্যে কংগ্রেসে কাজ করে যেতে থাকেন এবং ঠাকুরগাঁ মহকুমা কংগ্রেস কমিটির সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের সময় কৃষক সমিতি ত্রাণ তৎপরতার সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এবং এই কার্যক্রমে নেতৃত্ব প্রদান করেন হাজী দানেশ ও সত্যেন রায়। এরপর তিনি বঙ্গীয় প্রাদেশিক কিষাণ সভার সভাপতিমন্ডলীর সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ছিলেন সভাপতিমন্ডলীর মধ্যে অন্যতম একজন।

তেভাগা আন্দোলন ও হাজী দানেশ
হাজী দানেশের সংগ্রামী জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ অধ্যায় হচ্ছে তেভাগা আন্দোলন এবং এর মাধ্যমেই তিনি নিবেদিতপ্রাণ একজন নেতা হিসেবে জাতীয় পর্যায়ে পরিচিত হয়ে ‍ওঠেন। এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল বাংলার ১৯টি জেলায়—দিনাজপুর, রংপুর, পাবনা, ঢাকা, ময়মনসিংহ, খুলনা, যশোর, ফরিদপুর, বগুড়া, চট্টগ্রাম, মেদিনীপুর, চব্বিশ পরগনা, হাওড়া, হুগলী, নদীয়া, বাঁকুড়া, বীরভূম, মালদহ এবং জলপাইগুড়িতে—এবং এতে অংশগ্রহণ করেছিলেন প্রায় ৬০ লক্ষ কৃষক। আর হাজী দানেশ ছিলেন এই আন্দোলনের প্রধানতম সংগঠকদের একজন। দিনাজপুরে এই আন্দোলন ব্যপ্তি লাভ করে সর্বাধিক—জেলার মোট আটাশটি থানার মধ্যে বাইশিটিতে এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। আবদুল্লাহ রসুল লিখেছেন—তেভাগা আন্দোলন চলাকালে মুসলিম লীগ সরকারের পুলিশ গুলি চালিয়েছিল ২২ বার, নারী ধর্ষণ করেছিল চব্বিশ পরগনা, রংপুর, দিনাজপুর, মেদিনীপুর ও ময়মনসিংহ জেলায়। বিভিন্ন জেলায় বিস্তর পুলিশ ক্যাম্প বসানো হয়েছিল, তার মধ্যে দিনাজপুরেই ৩৫টি….মোট ৭০ জনের বেশি কৃষক—হিন্দু, মুসলমান, আদিবাসী পুরুষ ও নারী—প্রধানতঃ পুলিশের গুলিতে এবং জোতদারের গুলিতেও নিহত হলেন এই আন্দোলনে। এর মধ্যে দিনাজপুরেই শহীদ হলেন ৪০ জন কৃষক।’ অর্থাৎ দিনাজপুরে এই আন্দোলন একটি ব্যাপক গণচরিত্র অর্জনে করেছিল এবং হাজী দানেশ ছিলেন এই জেলার প্রধানতম সংগঠকদের অন্যতম। আন্দোলনের বহু স্তরে তিনি ব্যক্তিগতভাবে নেতৃত্ব প্রদান করেছেন জোতদারদের সঙ্গে দাবী প্রসঙ্গে কৃষকদের প্রতিনিধিত্ব করেছেন এবং তার সক্রিয় ভূমিকার প্রেক্ষিতেই, বস্তুতঃপক্ষে, দিনাজপুর ও আশপাশের জেলাসমূহে তখন ব্যাপক সংখ্যক মুসলমান কৃষককে আন্দোলনে সামিল করানো সম্ভবপর হয়েছে। উচ্চশিক্ষিত, ধর্মপ্রাণ এই মানুষটির প্রতি মুসলমান কৃষকদের আস্থা ছিল অগাধ; অন্যথায়, সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ঐ যুগে, হিন্দু-নেতৃত্বের কৃষক সমিতিতে যোগদানের জন্য মুসলমান কৃষকরা সহজে আগ্রহী হতেন না।
তেভাগা আন্দোলন ছিল ফসলের অর্ধাংশের বদলে দুই-তৃতীয়াংশ লাভের জন্য ভাগ-চাষীদের আন্দোলন। অর্থনীতির পরিভাষায় বলতে গেলে এটা ছিল ভূ-স্বামীকে দেয় খাজনার পরিমাণ অর্ধাংশ থেকে এক-তৃতীয়াংশে কমিয়ে আনার জন্য ভাগ-চাষীদের সংগ্রাম। এই আন্দোলন জমির ওপর কৃষকের মালিকানা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ছিল না নিঃসন্দেহে, কিন্তু বিকশিত পর্যায়ে এই আন্দোলন একটি শ্রেণী-আন্দোলনের চরিত্র অর্জনের পথে অগ্রসর হয়।
প্রাদেশিক কৃষক সভার পরিকল্পনা অনুযায় তেভাগার জন্য আন্দোলন শুরু হয় ১৯৪৬ সালে এবং দিনাজপুর জেলার আটওয়ারী থানার অন্তর্গত রামপুর গ্রামে কৃষক-পুলিশ সংঘর্ষের মধ্যদিয়ে এর যাত্রা শুরু। তবে, এর আগে ত্রিশ দশকের গোড়ার দিকে, যশোরের ভাগ-চাষীদের সংগঠিত করে তেভাগার জন্য দাবী তুলেছিলেন সৈয়দ নওশের আলী। তিনি ছিলেন মুসলমান, অন্যদিকে এলাকার বেশিরভাগ ভূ-স্বামীরা ছিলেন হিন্দু। ফলে সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা হিসেবে চিহ্নিত করে আন্দোলনটিকে সহজেই দমিয়ে ফেলা হয়।
১৯২৯-এর সর্বগ্রাসী মহানন্দা বাংলার কৃষি ব্যব্স্থাকেও আঘাত করেছিল। ঋণে আকন্ঠ নিমজ্জমান কৃষকদের পক্ষে খাজনা দেয়া অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছিল আর খাজনা অনাদায়ে জমিদারী ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়। ক্রমবর্ধমান কৃষক অসন্তোষের মুখে বৃটিশরাজ ভূমি সম্পর্কের মৌলিক পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে বাধ্য হয়। ফলশ্রুতিতে ১৯৩৮-এর নবেম্বরে গঠিত হয় ভূমি রাজস্ব কমিশন, যা এর চেয়ারম্যান স্যার ফ্রান্সিস ফ্লাউডের নামানুসারে ফ্লাউড কমিশন নামে পরিচিত হয়। কমিশন সরকারের নিকট তার রিপোর্ট দাখিল করে ১৯৪০ সালের ২১ মার্চ। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের পক্ষে কৃষক সভা কর্তৃক উত্থাপিত দাবী কমিশন মেনে নেয় এবং অন্যান্য সুপারিশের পাশাপাশি বর্গাদারদের প্রসঙ্গে এই মর্মে সুপারিশ করে যে…….বর্গাদারদের সরাসরি সরকারের প্রজা বলে গণ্য করতে হবে। বর্গাদাররা উৎপন্ন ফসলের এক-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত খাজনা দেবে, তার বেশি নয়।’
ভূমি রাজস্ব কমিশন সরকারের নিকট তার রিপোর্ট পেশের আড়াই মাসের মধ্যেই ৮—৯ জুন ১৯৪০ তারিখে যশোরের কেশবপুর থানার পাঁজিয়া গ্রামে অনুষ্ঠিত হয় কিষাণ সভার চতুর্থ প্রাদেশিক সম্মেলন। সম্মেলনে সাত দফা দাবী নির্ধারণের পর তেভাগার জন্য সংগ্রামের ডাক দিয়ে বলা হয়—‘আইন কতদিনে হইবে অথবা আদৌ হইবে কিনা তাহার—ঠিক নাই। অথবা বর্গাচাষীরা আজ মারা যাইতেছেন। কাজেই কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুসারে ফসলের দুই-তৃতীয়াংশ পাইবার দাবী লইয়া চাষীরা আজই সংঘবদ্ধ হইয়া প্রবল সংগ্রাম শুরু করিয়া দিন।’
১৯৪০ সালেই বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষিতে জারী করা হয় ভারত রক্ষা আইন এবং এই আইনের বলে সর্বত্র ব্যাপক ধরপাকড় চলতে থাকে। মূলতঃ সরকারী দমন পীড়নের কারণেই পাঁজিয়া সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তেভাগার জন্য সংগ্রাম শুরু করা তখন সম্ভবপর হয়নি। তেভাগার জন্য আন্দোলন শুরু হয় ১৯৪৬ সালের শেষ ভাগে। কিন্তু এই আন্দোলনের পরিকল্পনা ও নেতৃত্ব প্রাদেশিক নেতৃত্বের কাছ থেকে আসেনি, কেননা ১৯৪৬ সালের ২১ থেকে ২৪শে মে পর্যন্ত খুলনার মৌভোগে অনুষ্ঠিত কিষাণ সভার নবম সম্মেলন থেকে ভাগ-চাষীদের আন্দোলনের কোন কর্মসূচী ঘোষণা করা হয়নি। তেভাগার জন্য আন্দোলনের পরিকল্পনা এসেছিল বস্তুতঃ জেলা নেতৃত্বের কাছ থেকে এবং এর মূল সংগঠক ছিলেন তাঁরাই। আর আন্দোলনের প্রাথমিক পরিকল্পনা থেকে পর্যায়ক্রমিক বিভিন্ন স্তরে মনিকৃষ্ণ সেন, মহী বাগচী, সুশীল সেন, কালী সরকারের পাশাপাশি হাজী দানেশ পালন করেন একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
দিনাজপুর, রংপুর ও জলপাইগুড়ির জেলা কৃষক সমিতি পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে ১৯৪৬ সালের শেষভাগের ফসল ওঠার মওসুমে তেভাগা আন্দোলন শুরু করার সিদ্ধান্ত নেন। ঠিক করা হয় যে আন্দোলনের প্রথম ধাপ হবে তিনভাগের দু’ভাগ ফসল আদায়ের লক্ষ্যে জোতদার-জমিদারের খোলনে ধান তোলার পরিবর্তে আধিয়ারের নিজ খোলনে ধান তোলা। সেই অনুযায়ী ‘আধি নয়, তেভাগা চাই’ বক্তব্যকে তুলে ধরে ‘নিজ খোলনে ধান তোলো।’ শ্লোগানটিকে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য ব্যাপক অভিযান শুরু করা হয়। আন্দোলনকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য তিন জেলার নেতৃস্থানীয় কর্মীদের নিয়ে রংপুরে আয়োজন করা হয় সপ্তাহব্যাপী প্রশিক্ষণ শিবির।
কিন্তু কয়েক মাস ধরে ব্যাপক প্রচার চালানোর মাধ্যমে তেভাগার দাবীকে জনপ্রিয় করে তোলা হলেও সারা জেলার সমস্ত এলাকায় ‘নিজ খোলনে ধান তোলার’ আন্দোলনকে ছড়িয়ে দেয়া দিনাজপুরের কৃষক সমিতির পক্ষে সম্ভবপর ছিল না। যে সমস্ত এলাকায় সংগঠন ছিল মজবুত অথবা যেসব এলাকায় জোতদাররা ছিলেন অপেক্ষাকৃতভাবে দুর্বল, কেবলমাত্র সেসব এলাকাতেই আন্দোলন গড়ে ওঠে। দিনাজপুরের যে সমস্ত থানায় এ আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে সেগুলো হচ্ছে আটওয়ারী, বালিয়াডাঙ্গী, ঠাকুরগাঁ, বীরগঞ্জ, কাহারোল, ফুলবাড়ী, চিরিরবন্দর, বালুরঘাট, ইটাহার, সেতাবগঞ্জ, পীরগঞ্জ ও রানীসংকোল।
দীর্ঘদিনের প্রচলিত নিয়মকে অস্বীকার করে জোতদারের খোলনের পরিবর্তে আধিয়ারের নিজস্ব খোলনে ধান তোলা এক এক আধিয়ারের পক্ষে আলাদাভাবে সম্ভবপর ছিল না। তাছাড়া নিজ খোলনে ধান তোলার চেষ্টা করলে জোতদার বরকন্দাজ বা পুলিশের সাহায্যে তাতে বাঁধা দেবে এটাই ছিল স্বাভাবিক। তাই কৃষক সমিতি সিদ্ধান্ত নেয় যে সংগঠিত কৃষকরা দলবদ্ধভাবে এক একদিন এক একজন আধিয়ারেরা ধান কাটবেন। সেই অনুযায়ী শুরু হয় ধান কাটা। জোতদাররা পুলিশ সহযোগে আসে বাঁধা দিতে, ফলে শুরু হয় কৃষক-পুলিশ সংঘর্ষ। কয়েক জায়গাতে গুলি চলে। চিরিরবন্দরে পুলিশের গুলিতে কৃষক-কর্মী সমীর দাই ও শিবরাম নিহত হলে জঙ্গী কৃষকদের প্রতি আক্রমণে, তীরের আঘাতে, দু’জন পুলিশ নিহত হয়।
চিরিরবন্দরে যেদিন গুলি বর্ষিত হয় তার পরদিন সিরাজগঞ্জের এক জনসভায় ভাষণদানকালে তৎকালীন সোহরাওয়ার্দী মন্ত্রীসভার ভূমি রাজস্ব মন্ত্রী ফজলুর রহমান ঘোষণা করেন যে বর্গাদার উচ্ছেদরোধ করার জন্য এবং তারা যেন দুই-তৃতীয়াংশ ফসল পায় সেই ব্যবস্থা করার জন্য সরকার শীঘ্রই একটি বিল আনবেন। কলকাতা গেজেটে ১৯৪৭ সালের ২২শে জানুয়ারী এই বিলটি ‘বেঙ্গল বর্গাদার্স টেম্পোরারী রেগুলেশন বিল’ নামে প্রকাশিত হয়। বিলটি, শেষ পর্যন্ত পাশ করা তো দূরে থাক, আইন সভাতেও পেশ করা হয়নি। তথাপি বিলটির কিছু ইতিবাচক দিক ছিল এবং এ বিল তেভাগা আন্দোলনের যথেষ্ট উৎসাহ জুগিয়েছিল। ‘তেভাগার দাবী বেআইনী’—একথা জোতদাররাও আর সরাসরি বলতে পারতেন না। তাছাড়া বর্গাদারদের জন্য দুই-তৃতীয়াংশের দাবী সরকার মেনে নিয়েছেন—এ খবর দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে নিরপেক্ষ, নিষ্ক্রিয়, দ্বিধান্বিত ব্যাপক সংখ্যক বর্গাদারও আন্দোলনের ব্যাপারে উৎসাহী হয়ে ওঠেন। বিশেষতঃ আন্দোলনের পরবর্তী স্তর ‘পুঁজ ভাঙ্গা আন্দোলন’ সংগঠনের এই বিলের প্রভাব ছিল প্রত্যক্ষ।
যেসব এলাকায় কৃষক সমিতির সংগঠন খুব শক্তিশালী ছিল না অথবা যেসব জোতদার খুব পরাক্রমশালী ছিলেন সেখানকার আধিয়াররা কৃষক সমিতির নিজ খোলনে ধান তোলার আহ্বানে সাড়া দিয়ে জোতদারের খোলনেই ধান তুলেছিলেন। বর্গাদার বিলের কথা প্রচারিত হতেই এরা ভাবলেন যে যেহেতু তার জোতদারের খোলনে-এর মধ্যেই ধান তুলে ফেলেছেন অর্থাৎ জোতদাররা হাতের মুঠোর মধ্যে ধান পেয়ে গেছে, সেহেতু তারা নিশ্চয়ই এ বছর ফসলের দুই-তৃতীয়াংশ দিতে অস্বীকার করবে। তাই তারা সংগঠিত হতে শুরু করেন এবং কখনো কখনো কৃষক সমিতির অনুমোদন ছাড়াই ছোট-বড় সমস্ত ধরনের জোতদারের পুঁজ (ধান কাটার পর মাড়াইয়ের জন্য সমবেত করে রাখা ধান) ভেঙে আনতে শুরু করেন। ফলে তেভাগার জন্য আন্দোলন একটি স্বতঃস্ফূর্ত চরিত্র গ্রহণ করে।
কৃষকদের ক্রম শক্তি সঞ্চয়কারী আন্দোলনের মুখে জোতদাররা, শেষ পর্যন্ত, কৃষকদের সাথে আপোষে আসার চিন্তা করতে থাকেন। তখন দিনাজপুরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট তোরাব আলী হাজী দানেশ ও সুশীল সেনের কাছে পত্র পাঠান আপোষ আলোচনায় বসার প্রস্তাব জানিয়ে। তাঁরা আলোচনায় বসতে রাজী হন এবং ঠাকুরগাঁ কোর্টের সামনে সামিয়ানা টানিয়ে আলোচনা শুরু হয়। এখানে অংশগ্রহণ করেন তোরাব আলী ছাড়াও সদর, বালুরঘাট ও ঠাকুরগাঁ মহকুমার এসডিওরা উপস্থিত ছিলেন। জোতদারদের পক্ষে ছিলেন কেরামত আলী, আজিমউদ্দিন চৌধুরী প্রমুখ। কৃষক সমিতির তরফ থেকে ছিলেন হাজী দানেশ, সুশীল সেন ও জানু সিংহ। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন ১১ থেকে ১২ হাজার কৃষক যাদের পক্ষ থেকে সমিতির নেতৃবৃন্দ ছাড়াও রামলাল, কালা বর্মন, বিনোদ, যুগল প্রমুখ প্রতিনিধিত্ব করেন।
জোতদার পক্ষের প্রস্তাব ছিল যে ফসলের ভাগাভাগি হবে ন’আনা, সাত আনা। আধিয়ার পাবেন ন’আনা আর জোতদার সাত আনা। কৃষক সমিতি বিকল্প প্রস্তাব রাখেন দশ আনা—ছ’আনার। আলোচনায় উভয় পক্ষই অটল থাকায় তা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
আপোসের আলোচনা ব্যর্থ হবার পর প্রশাসন কঠোর মনোভাব গ্রহণ করে। বালিয়াডাঙ্গীতে পুলিশের গুলিতে মুকুর সিংহ ও তার স্ত্রী, মাকটু সিং এবং নেন্দেলী সিং নিহত হন। পরবর্তীতে বালুরঘাট মহকুমার খাঁপুর গ্রামে পুলিশ প্রাণ সংহারের উন্মত্ত খেলায় মেতে ওঠে এবং সেখানে পুলিশের গুলিতে প্রাণ দেন চিয়ার সাঁই শেখসহ ২২ জন কৃষাণ-কৃষাণী।
কিন্তু পুলিশের সর্বতো সমর্থন পেয়েও জোতদাররা নিশ্চিন্ত হতে পারছিলেন না, তাই দিনাজপুরের জোতদার সমিতি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীর নিকট একটি প্রতিনিধিদল প্রেরণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। ‘গণতন্ত্রের মানসপুত্র’ সোহরাওয়ার্দী জোতদারদের প্রতিনিধি দলকে এই মর্মে আশ্বস্ত করেন যে ‘তাদের দুশ্চিন্তার কোন কারণ নাই এবং আধিয়ারদের ব্যাপারে যথাবিহীত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
সোহরাওয়ার্দী তার কথা ঠিকই রেখেছিলেন, তাই জোতদারদের প্রতিনিধি দল দিনাজপুরে প্রত্যাবর্তনের দু’তিনদিনের মধ্যেই ঘটে ঠাকুরগাঁর ঘটনা। সেখানে শান্তিপূর্ণ এক কৃষক সমাবেশের ওপর পুলিশ অকস্মাৎ গুলি চালালে পাঁচজন কৃষক ঘটনাস্থলেই নিহত হন এবং আহত হন অসংখ্য কৃষক-কর্মী। হাজী দানেশকে ঐদিনই গ্রেফতার করা হয় এবং একপক্ষকালের মধ্যে গ্রেফতার করা হন বঙ্গীয় আইনসভায় দিনাজপুর থেকে নির্বাচিত কমিউনিস্ট সদস্য রূপ নারায়ণ রায়, সুশীল সেন, গুরুদাস তালুকদার, সুধীর সমাজপতি, বসন্ত চট্টোপাধ্যায়, হৃষিকেশ ভট্টাচার্য, দিনেশ দাসসহ অনেক নেতা। এছাড়া, ট্রাকে ট্রাকে বোঝাই হয়ে গোর্খা রেজিমেন্টের সৈন্যরা ঢুকতে থাকে গ্রামে গ্রামে, চলে নির্বিচার মারপিট ও ধরপাকড়। কৃষক সভার পরিসংখ্যান অনুযায়ী সে সময় দিনাজপুরে গ্রেফতার হন ১২শ’ ‍কৃষক এবং আহত হন প্রায় ১০ হাজার। জেলার বিভিন্ন স্থানে পুলিশ ক্যাম্প বসানো হয় ৩৫টি। প্রচন্ড নির্যাতনের মুখে তেভাগার জন্য আন্দোলন স্তব্ধ হয়ে আসে।

দেশ বিভাগ ও পরবর্তী পরিস্থিতি
’৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর প্রেক্ষিত পরিবর্তনের ফলে আন্দোলন স্তিমিত হয়ে আসে। তবু ’৪৭ সালের পরবর্তী সময়ে বেশ কয়েকটি আন্দোলন সংগঠিত হয়।
দেশ বিভাগের পর রাজবন্দীদের প্রায় সকলেই মুক্তি পান, কিন্তু হাজী দানেশ ও সুধীর মুখার্জী মুক্তি পেলেন না। অজুহাত—এরা রাষ্ট্রের জন্য বিপজ্জনক। এঁদের মুক্তির ব্যাপারে কমিউনিস্ট পার্টির বঙ্গীয় শাখার সম্পাদক ভবানী সেন ঢাকায় আসেন এবং নাজিমউদ্দিন ও অন্যান্য মন্ত্রী পর্যায়ে আলাপ আলোচনা চালান। মন্ত্রীরা জানালেন এখন তো দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে, সুতরাং মুভমেন্ট-ফুবমেন্টের আর আমাদের দরকার নেই। যাইহোক হাজী সাহেব মুক্তি পেলেন। মুক্তি পেতে পেতে অক্টোবর মাস এসে যায়।
’৪৮ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। এই কংগ্রেসে বার্মা, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশের কমিউনিস্ট পার্টির পর্যবেক্ষক প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন।
কংগ্রেসে সেক্রেটারী হলেন বি টি রনদিভে। এ কংগ্রেসে মূল্যায়ন করা হয় যে, বৃটিশ গমনের মাধ্যমে এদেশের জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণীর হাতে রাষ্ট্র ক্ষমতা এসে গেছে। অতএব শ্রমিক কৃষক রাজ কায়েমের লক্ষ্যে সশস্ত্র সংগ্রাম গড়ে তোলা প্রয়োজন। শ্লোগান তোলা হয় ‘লাখো ইনসান ভূখা হ্যায় ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায়।’
পরিপূর্ণভাবে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে পার্টির কার্যক্রম নির্ধারণ করা হয়। এরপরেই যশোরের নড়াইল, ময়মনসিংহের নেত্রকোনাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষক আন্দোলন গড়ে উঠতে থাকে। নড়াইলে মোদাসসের মুন্সী ও নূর জালালের নেতৃত্বে তেভাগার দাবীকে দুর্বার কৃষক অভ্যূত্থান সংগঠিত হয়, যা পরে সহিংস আন্দোলনে রূপ লাভ করে। নেত্রকোনায় অনুষ্ঠিত হয় কৃষকদের এক বিশাল সমাবেশ, ইতিহাসে যা নাগরার কৃষক সম্মেলন নামে পরিচিত হয়ে আছে।
কৃষক আন্দোলনের পাশাপাশি শ্রমিক আন্দোলনও এ সময় জঙ্গীরূপে ধারণ করেন। পাবর্তীপুরে ধর্মঘটি শ্রমিকরা প্রায় এক মাইল রেল লাইন তুলে ফেলে।
এ পর্যায়ে দিনাজপুরের রানীসংকোলের নতুন করে তেভাগার দাবীতে আধিয়াররা আন্দোলন শুরু করে। এছাড়াও ইলা মিত্রের নেতৃত্বে নাচোলের কৃষক বিদ্রোহ এবং সিলেটের নানকার বিদ্রোহ কৃষক আন্দোলনের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে।
কিন্তু এসব আন্দোলন বেশিদূর এগিয়ে নেয়া সম্ভব হয়নি নানা বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে। প্রথমতঃ এ সময়ে আন্দোলন পরিচালনায় নেতৃত্বের সংকট দেখা দেয় মারাত্মকভাবে। ’৫০ সালের মধ্যে মুসলিম লীগ সরকার বেশিরভাগ নেতাকেই গ্রেফতার করেন। দ্বিতীয়তঃ জনসাধারণ পাকিস্তান মোহের কারণে পার্টির কার্যকলাপ সুনজরে দেখেনি। ‘লাখো ইনসান ভূখা হ্যায়, ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায়’ এ মত স্বাধীন পাকিস্তানের বিরোধী শ্লোগানকে জনগণ সরকারী প্রতিক্রিয়াশীল প্রচারণার ফলে ভারতীয় চক্রান্ত হিসেবে গ্রহণ করে। খুব সহজেই কমিউনিস্টদের ‘হিন্দুর দালাল’ বলে আখ্যায়িত করা হয়। ফলে হাজী দানেশসহ অসংখ্য নামী-দামী কমিউনিস্ট কর্মী নেতা জনগণ কর্তৃকও নিগৃহীত হন। এ সময়ে পার্টির একটা অংশ ছিল প্রকাশ্যে, অপর অংশ ছিল গোপন। গোপন কর্মীরাও নানা অত্যাচারের সম্মুখীন হন। একটি সাম্প্রদায়িক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত নতুন রাষ্ট্রে কমিউনিস্টরা দ্রুত জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন।
সরকারী ও জনতার রোষানলে পড়ে ক্রমান্বয়ে কৃষক সমিতির সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক তৎপরতা বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। তখন পার্টি কর্মীদের সশস্ত্র থাকার প্রবণতা ছিল। এসব অস্ত্রের আক্রমণাত্মক ব্যবহার ছিল না বলা চলে। বেশিভাগ ক্ষেত্রে আত্মরক্ষার্থে ভয় দেখাবার জন্য এ অস্ত্রের ব্যবহার হতো। ’৫৮ সাল পর্যন্ত এই ধারা অব্যাহত ছিল।
’৫৮ সালের একটি ঘটনা আইয়ুবের ক্ষমতা দখলের পর হাজী সাহেবের বাড়িতে পুলিশ ও মিলিটারীর এক যৌথ তল্লাশি চালান হয়। উদ্দেশ্য মার্কসবাদী বই পুস্তক পাওয়া যায় কিনা তা’ দেখা। ঘরে এ ধরনের কোন বই-পুস্তক ছিল না। সামরিক আইন জারীর সাথে সাথেই হাজী দানেশের স্ত্রী ঐসব বই-পুস্তক অন্যত্র সরিয়ে ফেলেন। কিন্তু আলমারীর মধ্যে কোরান শরীফের পেছনে লুকানো ছিল কিছু রিভলভারের গুলি। এছাড়া আলমারীতে ছিল এক বোতল আব-এ-জমজম। জনৈক মিলিটারীর সুবেদার আলমারী খুলে আব-এ-জমজম ও কোরান শরীফ দেখে ঘাবড়ে যান। এরপর তিনি আর ঐসব ছুঁয়ে দেখার সাহস করেননি, ফলে সে যাত্রা হাজী দানেশ অস্ত্রকেস থেকে রেহাই পেয়ে যান।
০০০

একান্ত সাক্ষাৎকার
‘এদেশে কখনো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ছিলো না’—হাজী দানেশ

বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর হাজী দানেশের এই সাক্ষাৎকার গ্রহণের জন্য বিচিত্রার পক্ষ থেকে গত ৩ অক্টোবর দিনাজপুরে গিয়ে পৌঁছি। কিন্তু রাজনৈতিক ব্যস্ততার কারণে ৮০ বছরের বৃদ্ধ হাজী দানেশের সন্ধান পেতে চারদিন সময় লেগে যায়। এরপরও তিনি এক সঙ্গে এই সাক্ষাতকারের জন্য সময় দিতে পারেননি।

প্রশ্ন : বর্তমানে দেশে বিরাজমান রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে আপনার মতামত কি?
উত্তর : আমি মনে করি দেশের বর্তমান পরিস্থিতি ভয়াবহ। বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের কারণে গ্রামাঞ্চলে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। এটা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে বলেই মনে হচ্ছে। দেশের অর্থনৈতিক অবনতি ঘটলে রাজনৈতিক ও সার্বিক আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে বাধ্য। দেশ আজ ভয়াবহ দুর্ভিক্ষাবস্থার সামনে দাঁড়িয়ে। অভাবের তাড়নায় মানুষের নৈতিক অবক্ষয় অবস্থা কোন পর্যায়ে আজ বোঝা যায়, যখন দেখি স্বামী তার স্ত্রীকে বিক্রি করে দিচ্ছে, পিতা তার কন্যাকে বিক্রি করে দিচ্ছে।
রাজনৈতিক সংকট সমাধানের পথরুদ্ধ হলে গৃহযুদ্ধের সম্ভাবনাও নাকচ করা যায় না। তবে গৃহযুদ্ধ এক্ষণি ঘটবে বলে আমার মনে হয় না।

প্রশ্ন : সামরিক শাসন বিরোধী দুটি মুখ্য ‘জোট’ এবং জোটের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বলুন।
উত্তর : জোটের শীর্ষস্থানীয় যারা এদের সকলকেই আমরা বিভিন্ন সময়ে দেখেছি। আওয়ামী লীগের আমলে গণতন্ত্রের কবর হয়েছিলো। আওয়ামী লীগ নিজে একটি পেটি বুর্জোয়া সংগঠন। ক্ষমতায় থাকার জন্য এরা সব রকমের চেষ্টা চালিয়েছে অতীতে। নিজেদের স্বার্থের দিকেই এদের নজর চিরকাল। এ অবস্থায় ক্ষমতায় গেলে তারা রাতারাতি ফেরেস্তায় রূপান্তরিত হবে এ আশা কেউ নিশ্চয় করবে না। যদিও আমি মনে করি এরা আর এককভাবে কখনোই ক্ষমতায় যেতে পারবে না।
বিএনপি সম্পর্কে একই কথা বলা যায়। সম্পূর্ণ নীতি আদর্শহীন একটি পার্টি হচ্ছে বিএনপি। এরাও ক্ষমতায় টিকে থাকতে চায় নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের জন্য। এদের দ্বারা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক মঙ্গল হতে পারে না। তাই এই দুই দলের নেতাত্বাধীন জোটও তাই পেটি বুর্জোয়া ও আত্মকেন্দ্রীক। এদের কাছে আমি বৃহত্তর কিছুমাত্র আশা করতে পারি না। এদের দ্বারা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে এটা ভাবা অর্থহীন।

প্রশ্ন : তাহলে আপনারা কেন জোটের সঙ্গে শরীক হয়েছেন?
উত্তর : একটি সুনির্দিষ্ট ইস্যুর ওপর লড়তে হলে অনেক সময় অপেক্ষাকৃত অপ্রধান শত্রুর সঙ্গেও মিত্রতা করতে হয়। আজ এই ইস্যু হচ্ছে সামরিক দুঃশাসনের বিরুদ্ধে।

প্রশ্ন : বর্তমান সরকার এবং ৭ দল ও ১৫ দলের জোটের মধ্যে শ্রেণী চরিত্রগত পার্থক্র আছে কি?
উত্তর : কোন পার্থক্য নেই। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি যে শ্রেণীকে প্রতিনিধিত্ব করে বর্তমান সামরিক শাসন এরশাদও সেই শ্রেণীরই প্রতিনিধি। এদের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব মূলতঃ ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। বাংলাদেশের সামন্ত-আমলা মুৎসুদ্দীরা কেউ বিএনপিতে না হয় আওয়ামী লীগে আছে। এদের কিছু অংশ আবার এখন জনদলে ঢুকেছে। এদের একটা অংশ মনে করে ইন্দো-সোভিয়েত শক্তি দ্বারা তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষা হবে, আরেকটি অংশ মার্কিনকেই তাদের স্বার্থরক্ষাকারী প্রভু মনে করে। শেষোক্ত দলই বর্তমানে বৃহত্তর।
এই প্রেক্ষিতেই কেউ আওয়ামী লীগে কেউ বিএনপি’তে আবার কেউ জনদলে নাম লেখায়। ক্ষমতার লড়াইটাই এদের বড়। জনগণের প্রকৃত বন্ধু কেউ নয়।

প্রশ্ন : সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনই যদি জোটের প্রধান লক্ষ্য হয়, তাহলে ৭ দল ও ‍১৫ দলের পরিবর্তে একটি জোট হলো না কেনো?
উত্তর : বড় দলগুলো তাদের নেতৃত্বের মোহটাকে প্রাধান্য দেয়ার জন্যে এটা সম্ভব হয়নি। এছাড়া পরাশক্তির স্বার্থরক্ষার দিকটাও উল্লেখযোগ্য। কেউ ইন্দো-সোভিয়েত স্বার্থের পাহারাদার আবার কেউ মার্কিনের। আমি কখনো বিশ্বাস করি না যে ৭ দল ও ১৫ দল এক জোট হয়ে আন্দোলনে যাবে। এটা হতে পারে না।
এছাড়া, ’৭২-এর সংবিধান বা স্থগিত সংবিধানের প্রশ্নেও বিরোধ আছে। আমরা অবশ্য সংসদীয় গণতন্ত্রের পক্ষে। এদিক থেকে ১৫ দলীয় জোটের সঙ্গে আমাদের দলের মতের মিল রয়েছে। তবু আমরা মনে করি বিষয়টি সংসদেই চূড়ান্ত করা উচিত।

প্রশ্ন : জোটের রাজনীতিতে বামপন্থীদের ভূমিকা ও ভবিষ্যৎ কি?
উত্তর : বামপন্থী বলে দাবীদার কেউ ৭ দলে, কেউ ১৫ দলে অবস্থান করছে। আমরা ৭ দলে আছি। টিপু বিশ্বাস, শরোদিন্দু দস্তিদারের নেতৃত্বে বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগও ৭ দলে আছে। ওয়ার্কার্স পার্টি, সাম্যবাদী দল (দুটি গ্রুপ) ১৫ দলে আছে। যারা যে জোটে আছে সেখান থেকে তাদের রাজনীতিকে এগিয়ে নিতে পারবে বলে মনে করে।
বর্তমানে যেভাবে বামপন্থীরা নিজেদের কাজ চালাচ্ছে তাতে এ সম্ভাবনা খুবই সীমিত। জোটের পাশাপাশি নিজেদের রাজনৈতিক কর্মসূচী বাদ দিয়ে তাদের অগ্রগতি সম্ভব নয়। নিজেদের তৎপরতাকে বন্ধক দিয়ে শুধু মার্শাল ল’র বিরুদ্ধে লড়ছি এই চিৎকার করে লাভ নেই।

প্রশ্ন : বামপন্থীদের ঐক্যবদ্ধ জোট হলো না কেন? ভবিষ্যতে এর সম্ভাবনা কতটুকু?
উত্তর : আমি নিজে অনেক চেষ্টা নিয়েছি। বর্তমান সামরিক সরকার আসার ৩ বছর আগে থেকেই এটা চেষ্টা করা হয়েছে। বর্তমান অবস্থায় প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এ চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।
ঐক্য না হওয়ার পেছনে বামপন্থীদের সংকীর্ণ চিন্তা চেতনা নেতৃত্ব হারানোর ভয় মুখ্য। নিকট ভবিষ্যতে এ ধরনের ঐক্যের সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। বাস্তব পরিস্থিতি ও পরিবেশ বদলের ফলে হয়তো হতে পারে।

প্রশ্ন : তৃতীয় বিশ্বে আমাদের মত কিছু দেশে নির্বাচিত সরকার উৎখাত করে সামরিক শাসন, আবার নির্বাচন, এরপর আবার একইভাবে সামরিক শাসন—এটা প্রথায় পরিণত হয়েছে। এর কারণ এবং উত্তরণের উপায় কি?
উত্তর : এসব দেশে মানুষের মধ্যে ‘সেন্স অব ডেমোক্রেসী’ খুবই কম। মানুষের চেতনার মান নীচু হওয়ার জন্য ‘আর্থ-সামাজিক’ অবস্থাই দায়ী। যার জন্য হঠাৎ একজন জেনারেল বন্দুক হাতে রাজা হয়ে বসেন।
এছাড়া জনগণের অর্থনৈতিক সংকট, ক্ষমতাসীন দলের নিপীড়ন ও আশা-আকাঙ্ক্ষার জলাঞ্জলির সুযোগ নিয়ে কিছু ‘এ্যাম্বিসাস’ জেনারেল ক্ষমতা গ্রহণ করে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিতো পেছনে থাকেই।
এ অবস্থা থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় একটি স্বাধীন অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েম করা যেখানে মানুষ কর্তৃক মানুষের শোষণ থাকবে না।

প্রশ্ন : আপনারা বলছে চিরতরে সামরিক শাসন বন্ধ করতে হবে, প্রেসিডেন্ট এরশাদও বলছেন। এ লক্ষ্যে এরশাদ সংসদের সেনাবাহিনীর অংশীদারিত্বের ফর্মূলা দিয়েছেন। এ সম্পর্কে আপনার মতামত কি?
উত্তর : এ যুক্তি আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়। পূর্বেই যেমনটা বলেছি চিরতরে সামরিক শাসন অবসানের জন্যে জনগণই যথেষ্ট। তাদের চেতনার মান বাড়াতে হবে।

প্রশ্ন : আপনি দীর্ঘদিন মওলানা ভাসানীর সঙ্গে কাজ করেছেন তার সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কি?
উত্তর : মওলানা ভাসানী একজন সেরা গরীব দরদী মানুষ ছিলেন। তিনি আন্তরিকতার সঙ্গে মানুষের মুখে হাসি দেখতে চাইতেন। নিপীড়িত মানুষের একদিন মুক্তি আসবে, আর তা একমাত্র কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে আসবে তা তিনি বিশ্বাস করতেন। তাই তিনি কমিউনিস্টদের ভালোবাসতেন শ্রদ্ধা করতেন।

প্রশ্ন : বিগত দিনের সরকারগুলোর মধ্যে কোন সরকার তুলনামূলক বিচারে গণতান্ত্রিক ছিলো বলে মনে করেন?
উত্তর : কোনো সরকারই গণতান্ত্রিক ছিলো না। কখনোই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ছিলো বলে মনে করি না।

প্রশ্ন : কেউ কেউ মনে করেন এদেশে বাম রাজনীতি সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে বা জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়েছে, এ ব্যাপারে আপনার অভিমত কি? ব্যর্থতার পাশাপাশি সাফল্য কিছু আছে বলে মনে করেন?
উত্তর : এদেশের বাম রাজনীতির অনেক ব্যর্থতা আছে ঠিকই তবে সাফল্যও কম নয়। এ প্রসঙ্গে একটা ঘটনা বলা যায়। ভূমি সংস্কার প্রসঙ্গে একবার একটা আলোচনাকালে প্রেসিডেন্ট জিয়া বলেন, হাজী সাহেব, আপনি আপনার ভূমি সংস্কারের প্রস্তাবটা লিখিত আকারে আমার কাছে দিন। আমি লিখিতভাবে ওটা তাকে দিলাম (যা সে সময় ‘বিচিত্রা’য় প্রকাশিত হয়), তখন তিনি আমাকে ভূমি সংস্কার বিষয়ক মন্ত্রীত্ব গ্রহণ করতে বলেন। আমি সে প্রস্তাব গ্রহণে অসম্মত হলে জিয়া বলেন, ‘পঞ্চাশ বছর ধরে সর্বহারা রাজনীতি করে কি পেলেন?’ জবাবে আমি বলেছিলাম, আর কিছু না পাই, অন্ততঃ আপনাদের মত জেনারেলদের মুখেও সমাজতন্ত্রের বুলি কপচানোর মত বাস্তব অবস্থা সৃষ্টি করতে পেরেছি।
বস্তুত আজ কোনো প্রতিক্রিয়াশীল দলের পক্ষেও সরাসরি সমাজতন্ত্রের বিরোধিতা করে টিকে থাকা সম্ভব নয়। সাধারণ মানুষের মধ্যে সমাজতন্ত্রই মুক্তির একমাত্র পথ এই প্রগ্রেসিভ আইডিয়াটা বামপন্থীরা ঢুকাতে পেরেছে। এটুকু তাদের অবদান তাদের এ্যাচিভমেন্ট।

প্রশ্ন : জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আজ আপনার অন্তিম কোনো বাসনা আছে কি? থাকলে বলুন।
উত্তর : আশাটা খুবই সিম্পল! মৃত্যুর আগে সমাজতন্ত্রটা দেখে যেতে চাই। মওলানা ভাসানী নব্বুই বছর বয়সেও গরীব দুঃখী মানুষের হাসি দেখতে চেয়েছেন, আমিও আশি বছর বয়সে শোষণহীন সমাজের প্রতিষ্ঠা দেখে যেতে চাই।

সাক্ষাতকার গ্রহণে : গুলবাহার হাসনাত
০০০

কারাবরণ ও মওলানা ভাসানীর সাথে পরিচয়
কমিউনিস্ট পার্টির সশস্ত্র তৎপরতার মোকাবেলায় সরকার ‘পাবলিক সিকিউরিটি এ্যাক্টের’ ব্যাপক প্রয়োগ শুরু করে এবং পার্টির ও কৃষক সমিতির অধিকাংশ নেতৃবৃন্দ গ্রেফতার হয়ে যান। ’৫০ সালে হাজী দানেশকে গ্রেফতার করা হয়। রাখা হয় রাজশাহী জেলখানায়। নেতৃবৃন্দকে সাধারণ অপরাধী হিসেবে তৃতীয় শ্রেণীতে রাখা হয়। হাজী দানেশের নেতৃত্বে রাজশাহী জেলখানায় ইংরেজ জেল কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কালাকানুন বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। হাজী দানেশ জেল হাসপাতালের দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। তিনি বন্দীদের প্রাপ্য সবকিছু মেপে ও হিসেব করে নেয়ার প্রথা চালু করেন। ফলে ’৫০ সালের এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে হাজী দানেশকে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে ট্রান্সফার করা হয়। হাজী সাহেবকে ঢাকা জেলে ট্রান্সফার করার মাত্র ৭ দিন পরে ২৪ এপ্রিল রাজশাহী জেলের খাপড়া ওয়ার্ডে বন্দীদের ওপর গুলি চালানোর নারকীয় ঘটনা ঘটে।
যেখানে যেভাবে পার এই সরকারে বিরোধিতা করতে হবে—এ ছিল তখন পার্টির নির্দেশ। জেল অভ্যন্তরেও এই বিরোধিতা ব্যাপকভাবে পেতে থাকে। মূলতঃ জেলে রাজনৈতিক বন্দীর মর্যাদার দাবীতে জেলে আন্দোলনের শুরু ’৪৯ সাল থেকেই। বন্দীরা অনশনের পর অনশন করতে থাকেন। তৃতীয়বার অনশন চলাকালে ’৫০ সালের গোড়ার দিকে ঢাকা জেলে শিবেন রায় মৃত্যুবরণ করেন। শিবেন রায়ের মৃত্যুর পর সরকার রাজনৈতিক বন্দীর মর্যাদা স্বীকার করে নিতে বাধ্য হন।
ঢাকা জেলে কমিউনিস্ট বন্দীদের রাখা হতো পুরনো হাজতে। কিন্তু হাজী দানেশকে সেখানে না দিয়ে রাখা হলো মওলানা ভাসানীর সাথে এক ওয়ার্ডে। মওলানা ভাসানী তখন আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি থাকা অবস্থায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গের অভিযোগে কারাবাস করছিলেন। এখানেই হাজী দানেশের সাথে মওলানা ভাসানী সাধারণ মানুষের প্রতি সীমাহীন অনুভূতি ও দরদসম্পন্ন একজন মানুষ।
হাজী সাহেবকে মওলানা ভাসানীর সাথে রাখার ‍উদ্দেশ্য ছিল, হাজী দানেশ মুসলমানের সন্তান, তার ওপরে হাজী মানুষ কমিউনিস্ট হয়ে যাচ্ছে। সুতরাং যদি মওলানার সাথে রেখে হাজী দানেশকে এ-পথ থেকে ফেরানো যায়। মূল লক্ষ্য হলো যদি মওলানার সাথে রেখে হাজী সাহেবকে বিপ্লবী রাজনীতি থেকে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির দাওয়াই গ্রহণ করানো যায়।
এক সাথে জেলখানায় কাটানো দিনগুলোতে গরীব কৃষকদের মুক্তির উপায় নিয়ে দু’নেতার মধ্যে আলোচনা হতে বেশুমার। হাজী দানেশ বোঝাতেন ‘সাংবিধানিক রাজনীতির সীমাবদ্ধতা’র কথা।
হাজী দানেশের নিজের ভাষায় দু’একটি উদাহরণ দিলেই বোঝা যাবে। একদিন আলোচনা প্রসঙ্গে হঠাৎ করে মওলানা সাহেব বললেন হাজী সাহেব বাইরে গেলে একসঙ্গে রাজনীতি করব। আমি বললাম মওলানা সাহেব, আমাদের সঙ্গে তো আপনার মিলবে না। কারণ আমরা সশস্ত্র সংগ্রামে বিশ্বাস করি। তিনি বললেন যদি আমরা শ্রমিক এবং দরিদ্র কৃষক শ্রমিক প্রতিনিধি আইন সভায় পাঠাই? আমি বললাম ১৯৩৫ সালে ফ্রান্সে মসিয়ে ব্লা’র নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক দলের সরকার হয়। কিন্তু শিল্প মালিকরা লাগাতার কল-কারখানা বন্ধ করে দিয়ে সে সরকারের পতন অনিবার্য করে তোলে। কাজেই আপনি শ্রমিক প্রতিনিধি পাঠিয়ে আইন পাশ করলেন। কিন্তু তা’ এক্সিকিউট করবে কে? সব আমলাইত’ এক ধরনের।’ একথায় মওলানা ভাসানী গভীর চিন্তায় পড়ে যান। শেষ পর্যন্ত হাজী দানেশের যুক্তি তিনি গ্রহণও করেন, (শাহরিয়ার কবির সম্পাদিত মওলানা ভাসানী সংগ্রাম ও জীবন-পৃষ্ঠা—১২৪) ‘এমনকি জেল বসে শেখ মুজিবের সঙ্গে সশস্ত্র সংগ্রামের বুদ্ধিও গ্রহণ করেন। মধুপুরের জঙ্গলকে সদর দফতর করার সিদ্ধান্তও তিনি নিয়েছিলেন।’
এ সময়ে চীন মাও সেতুঙের নেতৃত্বে কমিউনিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলেও কুওমিনটাঙ বাহিনীর সাথে বিভিন্ন জায়গায় টুকটাক লড়াই চলছিল। হঠাৎ কুওমিনটাঙদের বড় ধরনের একটা পরাজয়ের খবর আসে। মওলানা ভাসানী এ খবরে হাজী দানেশকে ডেকে খুশির সঙ্গেই বলেন, হাজী সাহেব কমিউনিজম তো এসে গেলো। হাজী দানেশ একটু রসিকতা করে বলেন, তা’ হলে তো আপনার দাড়ি কামাতে হবে। মওলানা সাথে সাথে জবাব দেন, কামাতে হয় হোক, তবু মানুষত’ দুটো খেয়ে পরে বাঁচতে পারবে।
জেল থেকে বেরিয়ে ’৫১ সালে হাজী দানেশ ইয়ার মহম্মদ খানের বাসায় মওলানা ভাসানীর সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করতেন। ভাসানী হাজী সাহেবকে আওয়ামী মুসলিম লীগে যোগ দেয়ার জন্য অনুরোধ করতে থাকেন। কিন্তু কমিউস্টি পার্টির সিদ্ধান্তের বাইরে হাজী দানেশের আওয়ামী মুসলিম লীগে যোগ দেয়া তখন হয়ে ওঠেনি।

গণতন্ত্রী দল গঠন ও যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন
’৫২-৫৩ সালে হাজী দানেশ গণতন্ত্রী দল গঠন করেন। হাজী দানেশ হন প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। সাধারণ সম্পাদক হন মাহমুদ আলী। গণতন্ত্রী দলে নেতৃস্থানীয় আরো ছিলেন দিনাজপুরের মীর্জা গোলাম হাফিজ, খুলনার এ্যাডভোকেট আবদুল জব্বার, সিলেটের নূরুর রহমান প্রমুখ। বেশকিছু কমিউনিস্ট নেতা তখন এই দলে কাজ করতেন।
গণতন্ত্রী দল গঠন ও এই দলের নেতৃত্বে থাকা সত্ত্বেও হাজী দানেশের সাথে মওলানা ভাসানীর সম্পর্ক ছিল চমৎকার। ’৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনকে সামনে রেখে গঠিত হলো ‘যুক্তফ্রন্ট।’ ‘যুক্তফ্রন্ট-এ হাজী দানেশের গণতান্ত্রিক দল অন্যতম শরীক সংগঠন হিসেবে অংশগ্রহণ করে। ‘যুক্তফ্রন্টে’র অপরাপর সংগঠনগুলো হচ্ছে, আওয়ামী মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলামী, কৃষক-শ্রমিক পার্টি ইত্যাদি। ইতিমধ্যে কমিউনিস্ট পার্টির অনেক কর্মী পার্টির সিদ্ধান্ত নিয়ে আওয়ামী মুসলিম লীগের মধ্যে ঢুকে গিয়ে কাজ করা আরম্ভ করে দিয়েছেন।
‘যুক্তফ্রন্ট’ নির্বাচনে গণতন্ত্রী দল ও আওয়ামী মুসলিম লীগের কমিউনিস্টদের মনোনয়ন দেয়ার বিরোধিতা করতে থাকেন গণতন্ত্রের মানসপুত্র কথিত সোহরাওয়ার্দী-ফজলুল হক উভয়েই। হাজী দানেশসহ অনেক কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যের মনোনয়ন দানের প্রচন্ড বিরোধিতার এ সংকীর্ণ নীতি গ্রহণ করেন সোহরাওয়ার্দী-হক চক্র। কিন্তু মওলানা ভাসানী দৃঢ়তার সাথে দাঁড়ালেন কমিউনিস্টদের মনোনয়ন দানের পক্ষে। শেষ পর্যন্ত মওলানা ভাসানীর আনুকূল্যে হাজী দানেশসহ কিছুসংখ্যক কমিউনিস্টকে মনোনয়ন দেয়া সম্ভব হলেও অনেক কমিউনিস্টকেই মনোনয়ন দেয়া সম্ভব হয়নি।
অন্যদিকে এ নির্বাচনে মুসলিম লীগ ও নানা বর্ণের প্রতিক্রিয়াশীলরা প্রচারণা শুরু করে যে, হাজী দানেশ কমিউনিস্ট, আল্লাহ, ইসলাম কিছুই মানে না। এদের সাথে যোগ দেয় একশ্রেণীর স্বার্থান্বেষী মৌলবী, মওলানা, পীর প্রভৃতি ধর্ম ব্যবসায়ী সম্প্রদায়। কিন্তু নির্বাচনের হাজী দানেশ এসব অপপ্রচারকে উপেক্ষা করে এবং বিপুল ভোটে মুসলিম লীগের প্রার্থী খোরশেদ আলীকে পরাজিত করে নির্বাচিত হন। হাজী দানেশের নিজের ভাষ্য অনুযায়ী এ নির্বাচনে তাঁর নিজের একটি পয়সাও খরচ করতে হয়নি বরং জনগণ কর্তৃক শুভেচ্ছা স্বরূপ প্রাপ্ত অর্থে তার নির্বাচনী খরচ সংকুলান হয়ে দু’একশ’ টাকা বেঁচে যায়।
‘যুক্তফ্রন্ট’ মন্ত্রীসভা গঠনকালে গণতন্ত্রী দল থেকে হাজী দানেশের নাম মন্ত্রীত্বের জন্য প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু সোহরাওয়াদী হাজী সাহেবের নামে কমিউনিস্ট গন্ধ ব্ড্ড বেশি এ অজুহাতে তাকে মন্ত্রীত্বদানে বিরোধিতা করতে থাকেন। অপরদিকে কমিউনিস্ট পার্টিও তাঁর মন্ত্রীত্ব গ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত দেয়, ফলে মন্ত্রী হলেন গণতন্ত্রী দলের অন্যতম এম এল এ নূরুর রহমান।
শতকরা ৯০ ভাগ আসনে বিজয়ী হয়ে যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতা দখলের দু’মাসের মধ্যে কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ সরকারের ষড়যন্ত্রে ও যুক্তফ্রন্টের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার সুযোগে ক্ষমতাচ্যুত করা হলো যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীসভা। ৯২ (ক) ধারা জারী করে কেন্দ্রের শাসনের ফরমান হাতে গভর্নর সেজে এলেন ইস্কান্দার মীর্জা। হাজী দানেশ যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীসভা ভেঙে যাওয়ার জন্য মূলতঃ হক-সোহরাওয়ার্দীর স্বার্থপরতা ও ব্যক্তিলিপ্সা বেশি দায়ী বলে মনে করেন।
কেন্দ্রের শাসন জারী হওয়ার সাথে সাথেই হাজী দানেশকে রাষ্ট্রবিরোধী সংগঠনের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। হাজী সাহেব এর প্রতিবাদ করে বলেন, যদি আমরা বেআইনী সংগঠনই করতাম তাহলে আমার নির্বাচনে অংশ নিতে গেলাম কেন? কিন্তু কোনই কাজ হলো না এসব যুক্তিতর্কে। অবশ্য হওয়ার কথাও নয়। জেলে থাকাকালে হাজী দানেশ আবার জেল কর্তৃপক্ষের কালাকানুনের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন। ফলে হাজী দানেশ, যামিনী লাড়িহীসহ কয়েকজন নেতার এক বছর করে জেল হয়।

আওয়ামী লীগের ক্ষমতারোহন ও ন্যাপ গঠন
’৫৬ সালে আওয়ামী লীগ দেশী-বিদেশী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির সাথে আঁতাতের মাধ্যমে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। মন্ত্রীত্ব পাওয়ার পর ক্রমাগত সোহরাওয়ার্দী সাহেবদের সাম্রাজ্যবাদ প্রীতি প্রকাশিত হয়ে পড়ার কারণে মওলানা ভাসানীর সাথে মতবিরোধ তীব্রতর হতে থাকে।
সোহরাওয়ার্দী তাঁর, ‘শূন্য যোগ শূন্য, সমান-সমান বৃহত্তর শূন্য তত্ত্ব প্রবর্তন করেন। সোহরাওয়ার্দী কর্তৃক ‘সিয়াটো’, ‘সেন্টো’ পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি সম্পাদনের বিরুদ্ধে মওলানা ভাসানী স্বাধীন ও নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতির দাবীতে ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলন ডাকে।’
সম্মেলনে ভাসানী মার্কিনী সাম্রাজ্যবাদের লেজুড়বৃত্তির বিরুদ্ধে তীব্র আঘাত হানেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের ‘সর্বাধিক’ স্বায়ত্তশাসনের দাবী তোলেন কিন্তু মওলানার কষাঘাতে কোনই ফল দেয়নি। অনেক দেরী হয়ে গেছে তখন। ক্ষমতার লালসা আর চক্রান্তের শেকড় অনেক দূর পর্যন্ত চলে গিয়েছে।
সোহরাওয়ার্দী বলেন, ইতিমধ্যেই পূর্ব পাকিস্তানকে ৯৮ ভাগ স্বায়ত্তশাসন দেয়া হয়ে গেছে। তিনি ‘সিয়াটো’ ‘সেন্টো’ চুক্তির পক্ষেও তার অটল মনোভাব ব্যক্ত করেন। ফলে ভাসানীর সাথে সম্পর্কের অবনতি অনিবার্য হয়ে ওঠে। ভাসানীর পক্ষে দাঁড়ালেন আওয়ামী লীগের অন্যতম অভ্যন্তরে কর্মরত কমিউনিস্টরা।
’৫৭ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে মওলানা ভাসানী পুনরায় কাগমারীতে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল আহ্বান করে বসেন। এ কাউন্সিলেই আওয়ামী লীগের চূড়ান্ত ভাঙন সম্পন্ন হয়ে যায়। আওয়ামী লীগের সাথে সম্পর্ক ছেদ করে মওলানা আওয়ামী লীগের প্রগতিশীল সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী অংশের সমর্থনে সারা পাকিস্তান প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মীদের এক সম্মেলন আহ্বান করেন। এ সম্মেলনের মধ্যদিয়ে পূর্ববঙ্গের মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের প্রগতিশীল অংশ, হাজী দানেশের নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক দল এবং তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানের বেলুচিস্তানের আবদুস সামাদ আচকজাই’র নেতৃত্বে ‘ভবোরে পাখতুন’, পাঞ্জাবের মিয়া ইফতেখারউদ্দিনের নেতৃত্বে ‘আজাদ পাকিস্তান পার্টি’, সীমান্তের খান আবদুল গফফার খানের নেতৃত্বে ‘খোদা-ই-খিদমতগার’, সিন্ধুর জি এম সাইদের ‘আওয়ামী মাহাজ’ এবং গাউস বকশ বেজোঞ্জোর নেতৃত্বে ‘উথমানগল’ প্রভৃতি সংগঠন ঐক্যবদ্ধভাবে গড়ে তোলে ‘ন্যাশনাল আওয়াম পার্টি’ বা ন্যাপ। ন্যাপের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হন মওলানা ভাসানী ও সাধারণ সম্পাদক হন পশ্চিম পাকিস্তানের মহমুদুল হক ওসমানী।
জন্মলগ্ন থেকেই ন্যাপ-এর মধ্যে কমিউনিস্টরা কাজ করতে থাকে। আর এভাবেই মওলানা ভাসানী সশস্ত্র রাজনীতি বিশ্বাসী না হওয়া সত্ত্বেও হাজী দানেশ ও অন্যান্য কমিউনিস্টরা এলেন একই ‘প্ল্যাটফর্মে’। হাজী দানেশ ও মওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক দর্শনে মৌলিক পার্থক্য থাকলেও দু’জনের মধ্যে কিছু মিলও লক্ষ্য করা যায়। উদাহরণস্বরূপ, হাজী সাহেবের রাজনৈতিক উত্থান কৃষক আন্দোলনের মধ্যদিয়ে, আবার মওলানা ভাসানীও তাঁর জীবনের ব্যাপক সময় কাটিয়েছেন কৃষকদের রাজনীতি নিয়ে।
পাকিস্তান হওয়ার পর নানা নিপীড়ন আর ধরপাকড়ের ফলে কমিউনিস্ট পার্টি নিয়ন্ত্রিত কৃষক সমিতির বিলোপ ঘটেছিল। মওলানা ভাসানী ’৫৭ সালেই কৃষক সমিতিকে নতুন করে সংগঠিত করার উদ্যোগ নেন। কমিউনিস্ট পার্টি তাঁর এ উদ্যোগের বিরোধিতা করে এই অজুহাতে যে, কৃষক সমিতির জন্ম হলে ন্যাপ-এ কর্মরত কমিউনিস্ট সদস্যদের প্রকাশ্য লেবাস নষ্ট হয়ে যাবে, কমিউনিস্ট হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যেতে হবে, ফলে পুনরায় সরকারী রোষানল থেকে রক্ষা পাওয়ার আর কোন উপায় থাকবে না। হাজী দানেশও এই অস্বচ্ছ রাজনৈতিক চেতনায় প্রভাবিত হয়ে কৃষক সমিতি সংগঠিত করার বিরোধিতা করতে থাকেন। কিন্তু মওলানা ভাসানী সব মত উপেক্ষা করে ’৫৭ সালের ডিসেম্বরে ব্রহ্মপুত্র চরের ফুল ছড়িয়ে এক বিশাল কৃষক সমাবেশ-এর মধ্যদিয়ে গঠন করেন কৃষক সমিতি। পরবর্তী সময়ে কৃষক সমিতি’র সংগঠন সারাদেশে এমন বিস্তৃত হয় যে ইউনিয়ন পর্যায়ে কৃষক সমিতির পতাকা উঠানো হয়। বলাবাহুল্য যে ইতিমধ্যে অধিকাংশ কমিউনিস্ট নেতাই কৃষক সমিতিতে যোগদান করেন।
’৫৮ সালে পাকিস্তানের এগারো বছরের জোড়াতালির অন্তঃসারশূন্য গণতন্ত্রের তামাসার প্রথম অধ্যায় শেষ হলো। আইয়ুব খান সমগ্র দেশবাসীর ওপর ফৌজি শাসন চাপিয়ে তার বহু বর্ণিত ক্ষমতারোহণ সম্পন্ন করেন। সামরিক শাসন জারী হওয়ার পরে স্বাভাবিকভাবেই রাজনৈতিক কর্মকান্ড স্তিমিত হয়ে আসে। এ সময়ে হাজী দানেশ গোপনে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে তাঁর রাজনৈতিক তৎপরতা যতটুকু সম্ভব অব্যাহত রাখেন।
’৬৪ সালে প্রকাশ্য রাজনৈতিক তৎপরতা শুরু হলে হাজী দানেশ, মওলানা ভাসানী আহুত সার্বজনীন ভোটাধিকারের দাবীতে আন্দোলন অংশগ্রহণ করেন। এ বছর তিনি আইয়ুবের মৌলিক গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে সর্বদলীয় ভোটাধিকার সংগ্রাম পরিষদের আন্দোলনেও সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ’৬৫ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সম্মিলিত বিরোধীদলের প্রার্থী মিসেস ফাতেমা জিন্নার পক্ষে বিভিন্ন অঞ্চলে কাজ করেন।
’৬৭ সালে অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের নেতৃত্বে রিকুইজিশন কাউন্সিল ডাকার মাধ্যমে ন্যাপ বিভক্ত হয়। হাজী দানেশ তখন জেলে। তিনি মওলানা ভাসানীকেই তাঁর সমর্থন জ্ঞাপন করেন।
আইয়ুবী মৌলিক গণতন্ত্রের তকমাআঁটা দুঃশাসনের বিরুদ্ধে ’৬৮ সালের শেষভাগে শুরু হলো ঐতিহাসিক গণ-অভ্যূত্থান। এই গণ-অভ্যূত্থানের বিশেষ একটি দিক ছিল ঘেরাও আন্দোলন। ২৯ ডিসেম্বর পাবনায় ডিসি’র বাড়ি ঘেরাও-এর মাধ্যমে ঐতিহাসিক ঘেরাও আন্দোলনের সূচনা করেন মওলানা ভাসানী। এছাড়া শহরের আন্দোলনের সাথে গ্রামের আন্দোলনকে সমন্বিত করার ‍উদ্দেশ্যে ভাসানী ঐদিনই গ্রামাঞ্চলের সমস্ত হাট-বাজারে হরতাল পালনের ডাক দিয়েছিলেন। এই উভয় কর্মসূচীকেই সাফল্যমন্ডিত করার ব্যাপারে অন্যান্য জনাকয়েকের পাশাপাশি হাজী দানেশ ছিলেন অত্যন্ত তৎপর।
২৯শে ডিসেম্বরে পাবনায় অনুষ্ঠিত জনসভাতেই মওলানা ভাসানী ‘মৌলিক গণতন্ত্রের’ অধীনে অনুষ্ঠিতব্য আসন্ন নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগসহ ‘ডাক’ নেতৃবৃন্দও ঐ নির্বাচন বর্জনের মিছিলে সামিল হন। জানুয়ারী প্রথম ভাগে ভাসানী ন্যাপের পক্ষ থেক ‘নির্বাচন বর্জন করিয়া সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী, স্বৈরতন্ত্র-বিরোধী গণতান্ত্রিক সরকারের পতাকা ঊর্ধ্বে তুলিয়া ধরুন’ শিরোনামে একটি পুস্তিকা প্রকাশিত হয়। ন্যাপের পক্ষে ঐ পুস্তিকাটি প্রকাশ করেন হাজী মোঃ দানেশ। গণ-অভ্যূত্থানের চূড়ান্ত পর্যায়ে, ’৬৯ সালের উত্তাল দিনগুলোতেও হাজী দানেশকে পুনরায় জেলে অন্তরীণ থাকতে হয়। ’৬৯ সালের মার্চ মাসে ‘লৌহমানব’ আইয়ুব খানের পতনের পর তিনি মুক্তি লাভ করেন।

কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপ-এর সাথে মতবিরোধ
হাজী দানেশ জেলে থাকাকালীন সময়েই তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (এম এল)-এর মধ্যে ভারতের চারু মজুমদারের শ্রেণী শত্রু খতমের তত্ত্বের প্রভাব বাড়তে থাকে। হাজী দানেশ দৃঢ়তার সঙ্গে ‘গলা কাটা চলবে’ এ মতবাদের বিরোধিতা করেন। তিনি সেদিন এই ব্যক্তি সন্ত্রাসবাদী লাইনের বিরোধিতা করে ব্যর্থ হন। এরপর কমিউনিস্ট পার্টির কার্যকলাপ থেকে নিষ্ক্রিয় হয়ে যান।
’৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয় নিয়ে ন্যাপের মধ্যে তুমুল মতবিরোধ দেখা দেয়। হাজী দানেশ নির্বাচনে অংশগ্রহণের পক্ষে তাঁর মত দেন। বস্তুতঃ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ন্যাপের অভ্যন্তরে এক নাজুক অবস্থার সৃষ্টি হয়।
নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য প্রথম দিকে ন্যাপ থেকে নির্দিষ্ট কিছু প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় সেই মত দিনাজপুর থেকে হাজী দানেশ, যশোর থেকে আলমগীর সিদ্দিকী, খুলনা থেকে আব্দুল জব্বার, পাকিস্তানের মিয়া আরিফ ইফতেখারসহ অনেকে ন্যাপ নেতা প্রার্থী হন। কিন্তু নির্বাচনে মাত্র ক’দিন আগে মওলানা ভাসানী ন্যাপের মধ্যকার নির্বাচন বিরোধী কমিউনিস্টদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে নির্বাচন বর্জনের কথা ঘোষণা করেন। ভাসানীর এই ঘোষণায় প্রার্থীরা কমবেশি বিচলিত এবং অসন্তুষ্ট হয়েছিল তাতে সন্দেহ নেই। কারণ ততোদিনে প্রার্থীদের নির্বাচনী ব্যয় ও শ্রমদান চূড়ান্ত পর্যায়ে। হাজী দানেশ ভাসানীর এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ন্যাপের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করেন। পদত্যাগের সময় পর্যন্ত হাজী দানেশ ন্যাপের সহ-সভাপতি ছিলেন। তিনি মওলানাকে একজন আনডেমোক্র্যাট ‘হমজিক্যাল’ ‘অটোক্র্যাট’ ইত্যাদি আখ্যায়িত করে সত্ত্বর একটি নতুন দল গঠনের কথা ঘোষণা করেন। উল্লেখ্য যে, হাজী দানেশ ন্যাপের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করলেও মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে পরিচালিত কৃষক সমিতির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিন্ন করেননি।

মুক্তিযুদ্ধ ও লেনিনবাদ কমিউনিস্ট পার্টি গঠন
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় পর্যন্ত এদেশের কমিউনিস্ট পার্টি কয়েকটি উপদল ও গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এ কথা সত্য যে, মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে বামপন্থী উপদলগুলোর মধ্যে নানা বিভ্রান্তি দেখা দেয়। হাজী দানেশ ’৭১ সালের মার্চে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ভারতে গমন করেন এবং ভারতে আগত বামপন্থীদের নিয়ে গঠিত ‘মুক্তি’ সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির অন্যতম সদস্য হিসেবে মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখেন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি কাজী জাফর আহমদ, রাশেদ খান মেনন, অমল সেন, হায়দার আকবর খান রনো প্রমুখদের নিয়ে গঠন করে লেনিনবাদী কমিউনিস্ট পার্টি। ’৭৩ সাল পর্যন্ত হাজী দানেশ এই পার্টির দিনাজপুর জেলা কমিটির সম্পাদক ছিলেন।

জাগমুই গঠন
’৭৩ সালে তিনি বহুধা বিভক্ত বামপন্থীদের একটি মাত্র সংগঠনে ঐক্যবদ্ধ করার লক্ষ্যে গড়ে তোলেন জাতীয় গণমুক্তি ইউনিয়ন, সংক্ষেপে ‘জাগমুই’। ‘জাগমুই’ গঠনের ব্যাপারে তাঁরা কাজী জাফর, হায়দার আকবর খান রনো, রাশেদ খান মেনন প্রমুখের সঙ্গে মতবিরোধ ঘটে। তিনি লেনিনবাদী কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। জাগমুই’র প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হন হাজী দানেশ।

পরবর্তী ভূমিকা
১৯৭৫ সালের ১১ ফেব্রুয়ারী চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমান এদেশে প্রতিষ্ঠা করেন একদলীয় শাসন। বিভিন্ন বিরোধী দলীয় নেতৃবৃন্দের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হয় বাকশালে যোগদানের জন্য। হাজী দানেশও সে সময় বাকশালে যোগদান করেন। যদিও বাকশাল সেসময় দেশের একমাত্র দল—তথাপি হাজী দানেশের দীর্ঘ ত্যাগের জীবনের শেষ পর্যায়ে এই সরকারী দলে যোগদান ব্যাপক প্রশ্ন তোলে বামপন্থী কর্মীদের মনে। এ প্রসঙ্গে হাজী দানেশের বক্তব্য হচ্ছে যে সম্পূর্ণভাবে তার মতের বিপক্ষে হলেও সে সময় বিশেষ পরিস্থিতিজনিত কারণে তাঁকে বাকশালে যোগদান করতে হয়। এমনিতেই তাঁর তখন বয়স তিয়াত্তর—শরীর ভেঙে পড়ছে, তার ওপর তার ক’দিন আগেই পেটে একটা বড় ধরনের অপারেশনের পর তার পক্ষে তখন অত্যন্ত সাবধানে চলাফেরা ও খাওয়া-দাওয়া না করে কোন উপায় ছিল না। এমতাবস্থায় বাকশাল গঠিত হবার পর অবস্থা এমন দাঁড়ালো যে হয় তাঁকে ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ জীবনে চলে যেতে হয় নয়তো জেলখানায়, নতুবা বাকশালে যোগ দিতে হয়। শারীরিক কারণেই প্রথম দুটোর-কোনটাই তখন সম্ভবপর ছিল না। ফলে তাঁদের গোপন পার্টির সভায় এই মর্মে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে তিনি বাকশালে যোগ দেবেন এবং সেখানে থেকে ‘ফ্রাকশনাল ওয়ার্ক’ করার চেষ্টা করবেন।
১৯৭৬ সালে মওলানা ভাসানীর ডাকে যে ঐতিহাসিক ফারাক্কা লং মার্চ অনুষ্ঠিত হয়, হাজী দানেশ তাকে সাফল্যমন্ডিত করে তোলার জন্য উদ্যোগী ভূমিকা রাখেন।
প্রেসিডেন্ট জিয়ার শাসনামলে যখন জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট গঠিত হয় তখন অন্যান্য অনেক দলের সঙ্গে জাগমুইকেও আমন্ত্রণ জানানো হয় ফ্রন্টে যোগদানের জন্য। এর পরিপ্রেক্ষিতে জাগমুই-এর তরফ থেকে উপস্থাপন করা হয় ভূমি সংস্কারের ক্ষেত্রে মৌলিক ফলাফল আনতে পারে এরকম একটি কর্মসূচী। প্রেসিডেন্ট জিয়ার শ্রেণীঅবস্থানগত কারণেই ঐ কর্মসূচী মেনে নেয়া সম্ভবপর ছিল না এবং যেহেতু হাজী দানেশ বা তার দল নীতি ছাড়া ঐক্য প্রতিষ্ঠার সাময়িকভাবেও রাজী ছিলেন না তাই তারা মন্ত্রীত্ব আর গ্রহণ করেননি।

সাম্প্রতিক ভূমিকা
১৯৮০ সালে আসে হাজী দানেশের রাজনৈতিক জীবনের পরবর্তী পর্যায়ে। ঐ সময় আরো কয়েকজনের সঙ্গে তিনি এদেশে জাতীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বিশ্বাসী বামমনা ব্যক্তি ও সংগঠনসমূহকে ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষেত্রে উদ্যোগ নেন এবং ৭ ও ৮ ডিসেম্বরে গঠিত হয় গণতান্ত্রিক পার্টি। হাজী দানেশ এই পার্টির স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। গণতান্ত্রিক পার্টির গঠন এদেশের বামপন্থীদের একটি অংশের মধ্যে আলোড়ন ও আশাবাদ সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছিল—কিন্তু তৎপরতা রাখতে না পারায় এই পার্টি তার কাছে ইপ্সিত ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়নি।
পরবর্তীতে ১৯৮১ সালে কয়েকটি বামপন্থী কৃষক সংগঠন সম্মিলিতভাবে গড়ে তোলে জাতীয় কৃষক সমিতি। হাজী দানেশ তখন জাতীয় কৃষক ফেডারেশনের সভাপতি। তিনি ও তাঁর সংগঠন এই ঐক্য প্রক্রিয়ায় যোগদান করেন এবং সম্মিলিতভাবে গড়ে তোলেন জাতীয় কৃষক সমিতি।
অতি সাম্প্রতিক সময়ের তিনি কৃষক আন্দোলন সংগঠিত করার ক্ষেত্রে তৎপর রয়েছেন। দিনাজপুরে আখ চাষীদের সংগঠিত করে তিনি একটি আন্দোলন গড়ে তোলেন এবং সংগঠিত কৃষকদের জোরদার দাবীর মুখে সরকার বন্ধ হয়ে যাওয়া সেতাবগঞ্জ চিনি কলটি পুনর্নিমাণ করতে বাধ্য হয়।

প্রত্যাশিত সংযোজন
কারো মতে হাজী দানেশ কিংবদন্তির নায়ক, কারো মতে একজন বিপ্লব আকাঙ্ক্ষী মানুষ, আবার কারো মতে এদেশের কৃষক সংগ্রামের ইতিহাসে একটি অনোপেক্ষণীয় নাম হাজী মোহাম্মদ দানেশ। বস্তুতঃ অশীতিপর বৃদ্ধ হাজী দানেশ আজো বেঁচে আছেন কাজ করার আনন্দে। বার্ধক্যে জীবন ধারণ শুধুমাত্র মৃত্যুর অপেক্ষায় এ ধারণাকে খন্ডিত করেছেন তিনি। যদিও বয়স বাড়ার সঙ্গে হারিয়েছেন গায়ের জোর, চোখের জ্যোতি, পা দু’টি আক্রান্ত হয়েছে সাইটিকায়। সহিষ্ণুতাও কমেছে আগের তুলনায় খানিকটা। তুলে না দিলে দাঁড়াতে পারেন না তবু সংগঠনের কাজে এখনো গ্রামাঞ্চলে পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়ান ক্লান্তিহীন। এদেশের বামরাজনীতির মতই হাজী দানেশের রাজনৈতিক কর্মকান্ড নিয়েও বিতর্ক আছে প্রচুর। তাঁর ফ্রাকশনাল ওয়ার্কের তত্ত্ব, বাকশালে যোগদান ইত্যাদি নিয়ে অনেকের অনেক প্রশ্ন থাকতে পারে। কিন্তু সবকিছু ম্লান হয়ে যায় যখন দেখি এই ৮৩ বছর বয়সেও পীরগঞ্জের এক ধুরন্ধর চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে আন্দোলনে এলাকার সহস্রাধিক কৃষককে সংগঠিত করতে হাজী দানেশ প্রাণপাত পরিশ্রম করেন।
যে আদর্শকে ভালোবেসে হাজী দানেশ তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠতম দিনগুলোকে উৎসর্গ করেছেন জেলখানার গভীর প্রকোষ্ঠে অথবা নিরন্ন কৃষকের দুয়ারে দুয়ারে, সে আদর্শ বাস্তবায়ন আজও তিনি সমান তৎপর। জীবনের একমাত্র অন্তিম ইচ্ছা মৃত্যুর আগে শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থাটা দেখে যাওয়া।
০০০

[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/05/dansesh.pdf”]

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!