নীতি ও দলবদল এর রাজনীতি | শাহরিয়ার কবির এলাহী নেওয়াজ খান | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ২ নভেম্বর ১৯৮৪
উপমহাদেশের রাজনীতিতে নেতাদের দল ও নীতি পরিবর্তনের উদাহরণ আছে । তবে উল্লেখযোগ্য নেতাদের মধ্যে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এক্ষেত্রে অতুলনীয়। জিন্নাহ রাজনৈতিক জীবনের সূচনা হয়েছিল কংগ্রেসে যোগ দানের মাধ্যমে যখন তিনি আক্ষরিক অর্থেই ধর্মনিরপেক্ষতার রাজনীতিতে বিশ্বাস করতেন এবং হিন্দু মুসলমান ঐক্যের একজন প্রবক্তা ছিলেন। রাজনীতি থেকে ধর্মকে দূরে রাখার ক্ষেত্রে তার চেয়ে বড় যুক্তিবাদী কুড়ির দশকে আর কেউ ছিলেন বলে মনে হয়না। তিনি ১৯২১ সালে কংগ্রেস ত্যাগ করেছিলেন কংগ্রেসের খিলাফত ও অসহযোগ নীতির প্রতিবাদে। তার মতে খিলাফত আন্দোলন ছিল ‘অবসকিউরেন্টিস্ট’ ধর্মীয় গোঁড়ামি। খিলাফত আন্দোলন সমর্থন করার কারণে কংগ্রেসের প্রতি তিনি দোষারোপ করেছিলেন ‘রাজনীতিতে ধর্ম আমদানি’ করার জন্য। একইভাবে তিনি গান্ধীর হরিজন অস্পৃশ্যতা ও গোরক্ষা নীতিকে ‘অবসকিরেন্টিস্ট ধর্মীয় গোঁড়ামি বলে নিন্দা করেন এবং আবারও রাজনীতিতে ধর্মের আমদানির বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন।(আবুল মনসুর আহমেদের আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর দ্রষ্টব্য।) অথচ ভাগ্যের এমনই নির্মম পরিহাস, কিম্বা বুর্জোয়া রাজনীতির এমনই নির্দয় রসিকতা যে, এই জিন্নাহকেই উপমহাদেশের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতা আমদানির একজন পুরোগামী নেতা হতে হলো এবং ধর্মীয় দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে সৃষ্ট পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রেরও জনক হতে হলো।
জিন্নাহকি আসলেই সাম্প্রদায়িক ছিলেন? মনে হয় না। ধর্মকে তিনি প্রয়োজন মত ব্যবহার করেছেন নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য আবার প্রয়োজনমতো অস্বীকারও করেছিলেন ঠিক একই কারণে। ১৯৪৬ সালে গোটা উপমহাদেশে যে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়, যখন বাংলায় মুসলিম লীগ সরকার ক্ষমতায়, মুখ রক্ষার জন্য মুসলিম লীগের অসম্প্রদায়িক নেতারা সর্বত্র হন্যে হয়ে ঘুরছেন দাঙ্গা থামানোর জন্য, জিন্নাহ নিরাপদ দূরত্বে থেকে তখন নির্বিকার দার্শনিক উক্তি করেছেন -‘আমার দ্বিজাতিতত্ত্বের সঠিকতাই প্রমাণ করে।’ (আবুল হাশিমের আত্মজীবনী ইনরেট্রোস্পেকটিভ দ্রষ্টব্য।) জিন্নাহর দ্বিজাতি তত্ত্বের মূল কথা হলো ভারতবর্ষে হিন্দু মুসলমান কখনো এক রাষ্ট্রে থাকতে পারবে না। অথচ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ৪৮ সালে আইন সভার প্রথম ভাষণে জিন্নাহ্ বলেছিলেন, -পাকিস্তান মুসলমান হিন্দু খ্রিস্টান বৌদ্ধ সবাই সমান অধিকার ও মর্যাদা নিয়ে বাস করবে।
জিন্নাহকে একবার এক সাংবাদিক তাঁর দল বদল সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘ একসময় আপনি কংগ্রেস করতেন এখন আপনি মুসলিম লীগ করছেন, কেন? জবাবে এতোটুকু ইতস্ততঃ না করে বলেছিলেন, ‘একসময় কিন্ডার গার্টেনে পড়তাম, কিন্তু পরে তো ছাড়তে হয়েছে।’ বুর্জোয়া রাজনীতির কি চমৎকার নজির!
উপমহাদেশের রাজনীতিতে জিন্নাহর আগে এবং পরে বহু নেতা দল বদল করেছেন এবং নীতিও বদল করেছেন কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে তার মত সফল আর কেউ হতে পেরেছেন বলে মনে হয় না, যদিও এই সফলতা এসেছে জাতীয় জীবনের এক দুঃসহ বেদনাবহ, রক্ত পিচ্ছিল পথ বেয়ে।
নীতি ও দল বদলের কারণ
আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতাদের সিংহভাগই দলীয় স্বার্থের চেয়ে ব্যক্তিগত স্বার্থকে বড় করে দেখেন। ফলে প্রয়োজন মতো নীতি বা দল পরিবর্তন করতে এতোটুকু অস্বস্তি তাঁরা বোধ করেন না। বিশেষ করে যারা ‘পার্লামেন্টারি পলিটিক্স’ করেন তাদের ক্ষেত্রে এটা নিতান্তই ডাল-ভাত। বাংলার মুখ্যমন্ত্রীত্ব বজায় রাখার জন্য আমাদের অবিসংবাদি নেতা এ কে ফজলুল হককে ১৯৩৭ থেকে ৪০ সালের ভেতর ৪ বছরে চারবার নীতি পরিবর্তন করতে হয়েছিল। কৃষক প্রজা পার্টির নেতা হিসেবে নির্বাচনে জিতে প্রথমে মুসলিম লীগ, পরে হিন্দু সভা, আরো পরে কংগ্রেস, আবার মুসলিম লীগের সঙ্গে কোয়ালিশন করে, একসঙ্গে দুই ভিন্ন নির্দল কৃষক প্রজা পার্টি ও মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট থেকে ৪১ সালে অনাস্থা ভোটের কারণে তাঁকে গদি হারাতে হলো। আবুল মনসুর আহমদ তাঁর….’ রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ গ্রন্থে নেতাদের নীতি ও দল বদলের এক বিস্তৃত, কৌতুকময় এবং রোমহর্ষক বিবরণ দিয়েছেন।
তবে ক্ষমতার লোভ ছাড়াও দল বা নীতি বদল ঘটতে পারে। অগ্নিযুগের বিপ্লবী নেতা শ্রী অরবিন্দ যেমন পরবর্তী জীবনে আশ্রমের ঋষির জীবন বেছে নিয়েছিলেন। তাঁর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে সে সময়ের বহু চরমপন্থী বিপ্লবী যারা গণ্ডায় গণ্ডায় ইংরেজ মেরেছেন শেষ জীবনে নিরীহ আশ্রমবাসী হয়েছিলেন।
এর বিপরীত চিত্রও আছে। ত্রিশ দশকের গোড়ার দিকে যখন সন্ত্রাসবাদীদের উপর চরম নিগ্রহ নেমে আসে, সমস্ত জেলখানা যখন ভরিয়ে ফেলা হয় অনুশীলন আর যুগান্তর দলের নেতা-কর্মীদের দিয়ে, তখন তাঁদের অনেকে মার্কসবাদের সঙ্গে পরিচিত হন এবং পরবর্তী জীবনে কমিউনিস্ট আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। বাংলাদেশের সাম্যবাদী দলের প্রয়াত নেতা সুখেন্দু দস্তিদার এবং এই পরিবারের অনেকে প্রথম জীবনের সন্ত্রাসবাদি ছিলেন। সুখেন্দু দস্তিদারদের এই দল ও নীতি ছিল স্থবির ও পুরাতনকে বর্জন করে নতুন ও চলমানকে গ্রহণের রাজনীতি। ভাববাদ থেকে বস্তুবাদে উত্তরণের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার অন্তর্গত।
নীতি ও দলবদল যখন চেতনায় বিকাশের সঙ্গে সম্পর্কিত হয় তখন তার ফল হয় ইতিবাচক। কিন্তু বস্তুবাদ থেকে ভাববাদ ও উত্তরণের (!) ঘটনাও বিরল নয়। তবে এটাকে উত্তরণ না বলে বিচ্যুতি বলাটাই সংগত। এম এন রায়ের বিচ্যুতি এক্ষেত্রে যেমন স্মরণ করা যেতে পারে । আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের এক অসামান্য নেতা রায় -পরবর্তী জীবনে হয়েছিলেন রেডিক্যাল হিউম্যানিস্ট।’
আরও স্থুল কিছু উদাহরণ দেয়া যেতে পারে অতি সাম্প্রতিক একটি ঘটনা থেকে। আমাদের দেশের জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সাবেক সভাপতি একদা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র বিশ্বাসী এবং মার্কবাদে মুক্তির পথ গ্রন্থের প্রণেতা মেজর জলিল দল থেকে বহিষ্কৃত হয়ে মাথায় টুপি পড়ে এখন যেমন ইসলামী আন্দোলনে নেমেছেন।
এম এন রায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল অজানা সূত্র থেকে অর্থ প্রাপ্তির, আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের অসঙ্গতির। মেজর জলিলের বিরুদ্ধেও নাকি তাঁর দলের কর্মীরা একই অভিযোগ এনেছিলেন। এ ধরনের অভিযোগ যদি কোন নেতার বিরুদ্ধে উত্থাপিত হয় তাহলে তাঁর পক্ষে সেই দলে থাকা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। হলে দল ছাড়ার একটা যুক্তি দাঁড় করাতে হয়। এই যুক্তির ভিত্তিতে মাথায় নতুন তত্ত্বের টুপিও পরতে হয়। এই তত্ত্বের টুপি আরো সুন্দর হয় যদি নতুন কোন নীতির পালক এর সঙ্গে গুঁজে দেওয়া যায়।
এক ধরনের নেতা আছেন যারা তাদের এলাকার জনগণের চাপে নাকি সবসময় ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে থাকেন। ক্ষমতায় থাকলে নাকি জনগণের উপকার করা যায়। আমাদের প্রধানমন্ত্রী আতাউর রহমান খান যেমন বেশিদিন ক্ষমতার বাইরে থাকতে পারেন না। সুযোগ পেলে নিজের দল ছেড়ে ক্ষমতাসীন দলে যোগ দিয়ে বসেন ‘জনগণের দাবি’তে। কখনো অবৈধ রোজগারকে বৈধ করার জন্যও ক্ষমতাসীন দলে থাকতে হয় – যতবার দল বা নীতি বদল করার দরকার হোক না কেন।
বাংলাদেশে কমিউনিস্ট নামধারী পার্টির সংখ্যা এখন এক ডজনেরও বেশি। এমন বহু কমিউনিস্ট নেতা পাওয়া যাবে যাদের আট-দশটি পার্টি করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। এক্ষেত্রে নেতৃত্বে থাকার বাসনাকে দল বদলের প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। আবার একই সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টি ও পেটি-বুর্জোয়া/বুর্জোয়া পার্টি করার অভিজ্ঞতাও আমাদের দেশে প্রচুর রয়েছে। ন্যাপের প্রফেসর মোজাফফর আহমদ একইসঙ্গে ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টি করেছেন; এখন যদিও ধর্ম-কর্মের কথা বলছেন। বর্ষীয়ান কমিউনিস্ট নেতা মনি সিংহও ৭৫ সালে বাকশালে যোগ দিয়েছিলেন। সাম্যবাদী দলের নেতা মোহাম্মদ তোয়াহা যুগপৎ শ্রমিক শ্রেণী ও বুর্জোয়া শ্রেণীর (ভাসানী ন্যাপ-এর) নেতা ছিলেন।
কমিউনিস্ট নেতারা যখন এভাবে দল বা নীতি বদল করেন তখন তার জন্য বেশ কঠিন এক তত্ত্বের ভিত দাঁড় করান।’লেনিনের’এক পা আগে দুই পা পিছে, ‘সোশ্যাল ডেমোক্রেসির দুই রণকৌশল,’ ‘ বামপন্থী কমিউনিজম শিশুসুলভ বিশৃঙ্খলা’ কিংবা মাওয়ের কুয়োমিন টাঙে যোগদান থেকে বিস্তর উদাহরণ ও উদ্ধৃতি এনে দল বা নীতি বদলের রাজনীতির নাম দেন ‘রণকৌশল।’এভাবে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল আর শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচনের মাধ্যমে পার্লামেন্টে যাওয়ার রাজনীতি মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। কমিউনিস্ট নেতাদের সুবিধা এই যে, তাঁরা যা কিছু করুন না কেন সাহসের সঙ্গে আত্মসমালোচনা করে সবকিছু বৈধ করে ফেলেন। আত্মসমালোচনা অনেক সময় দলগতভাবেও করা হয়। তখন গালভরা শব্দ প্রয়োগ করা হয় ‘দক্ষিণপন্থী বিচ্যুতি’ বা ‘বামপন্থী হঠকারিতা’ বলে। তবে বুর্জোয়া নেতারা আত্মসমালোচনা না করে দু’কান কাঁটার মতো রাস্তার মাঝখান দিয়ে বুক ফুলিয়ে হাঁটেন।
কারণ যদি আরো গভীরে গিয়ে বিশ্লেষণ করতে হয় তাহলে শ্রেণীর প্রসঙ্গটিকে সামনে আনতে হয়। আমাদের দেশে যারা রাজনৈতিক দলগুলোকে নেতৃত্ব দেন তাদের ভেতর শতকরা ৯৯.৯ ভাগ পেটিবুর্জোয়া শ্রেণি থেকে আগত। এ’দের দার্শনিক ও সাংস্কৃতিক চেতনার স্তর যথেষ্ট উন্নত নয় বলে এই শ্রেণীর সংকীর্ণতা, স্বার্থপরতা, পরশ্রীকাতরতার যত রকমের সীমাবদ্ধতা আছে সবকিছু তাদের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে। তাছাড়া বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব ও বিকাশ যেভাবে একটি উপনিবেশিক সমাজকাঠামোয় সাম্রাজ্যবাদকে সহযোগিতা করার জন্য ঘটেছে -সে ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী অবস্থানে যাওয়া এ’দের পক্ষে অত্যন্ত কঠিন কাজ। বক্তৃতা, বিবৃতি বা লেখায় শ্রমিক-কৃষক মেহনতী মানুষের ভাগ্যের যত পরিবর্তনের কথা বলা হোক না কেন তাদের কষ্টকর জীবনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে মুক্তির জন্য সংগ্রাম করা এবং সেসব যদি দীর্ঘস্থায়ী হয় (বলাই বাহুল্য দীর্ঘস্থায়ী হবে) তখনই বুকের ভেতর লুকিয়ে থাকা মধ্যবিত্ত মোহ, ভিরুতা এবং সুবিধাবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ফলে দল বা দলের নীতি বদলও হয়ে ওঠে অনিবার্য।
বিএনপি’র জন্মঃ দলবদলের বিশাল আয়োজন
সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে অনেকে অদূরদর্শী বা কাঁচা রাজনীতির লোক বলে মনে করেন। আমরা কিন্তু তা করি না। এদেশের বুর্জোয়া রাজনীতিতে তার মত দক্ষ খেলোয়াড় খুব কমই দেখা যাবে। যেমন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে তিনি প্রথম ‘রাজনৈতিক দলবিধি জারি করে বললেন, রাজনীতি করতে হলে সরকারের বৈধ অনুমোদন লাগবে। এর পাশাপাশি বড়-ছোট সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে একান্ত আলাপ চালিয়ে যেতে লাগলেন। প্রত্যেকের নাকের ডগায় প্রলোভনের হাজারটা মূলা গোপনে ঝুলিয়ে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল এবং নতুন দল গড়ার এক মোচ্ছব লেগে গেল। ঐতিহ্যবাহী রাজনীতিবিদদের জন্য আক্ষরিক অর্থেই রাজনীতিকে তিনি ‘ডিফিকাল্ট’ করে তুললেন। তারপর নামলেন নিজের জন্য নতুন দল গড়ার খেলায়। প্রথমে নেপথ্যে থেকে করলেন জনদল, তারপর আরো প্রকাশ্যে এসে করলেন ফ্রন্ট এবং সবশেষে খোলাখুলি মাঠে নেমে করলেন বিএনপি। ডান, বাম, মধ্যপন্থী দল থেকেও পঙ্গপালের মত সবাই ধাবিত হলেন বিএনপির দিকে এবং অচিরেই বিএনপি বাংলাদেশের বৃহত্তম জগাখিচুড়ি রাজনৈতিক দল হিসেবে দাঁড়িয়ে গেল। পরে অবশ্য বিএনপির রাজনীতি নির্দিষ্ট একটি আকার ধারণ করেছে; তবে দুর্ভাগ্য এই যে জিয়াউর রহমান বেশিদিন এর ফল ভোগ করতে পারেননি। নেতার ভাগ্যে যাই ঘটুক না কেন বিএনপি’র অন্যরা কিন্তু দলবদলের সুফল ভালোভাবেই ভোগ করেছেন।
জিয়াউর রহমানের একটি বড় সাফল্য ছিল আওয়ামী লীগের মত বিশাল একটি রাজনৈতিক দলকে ভেঙে কয়েক টুকরো করা। আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে তাঁর গোপন বৈঠক ছাড়াও এর একটি বড় কারণ ছিল দেশের অর্থনীতি ক্ষেত্রে জিয়াউর রহমানের নতুন পলিসি। ৭১-এর যুদ্ধের পর আওয়ামী লীগকে বাধ্য হয়ে পাকিস্তানিদের ফেলে যাওয়া কলকারখানা জাতীয়করণ করতে হয়েছিল। ঐতিহ্যগতভাবে মার্কিনপন্থী আওয়ামীলীগকে যুদ্ধের সময় বেকায়দায় পড়ে রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক কর্মসূচি গিলতে হয়েছিল। তাছাড়া পরিত্যক্ত কলকারখানা কেনার মতো গাঁটের জোরও তাদের ছিল না। তাই জাতীয়করণ করে কল-কারখানা, ব্যাংক-বীমা প্রভৃতিতে প্রশাসক হিসেবে নিজেদের লোকদের বসিয়ে যথেচ্ছ লুটতরাজের মাধ্যমে অতি অল্প সময়ের ভেতর তাঁরা বিপুল পরিমাণ পুঁজি বিনিয়োগের জন্য রাষ্ট্রীয় নীতির পরিবর্তন জরুরি হয়ে উঠেছিল। শেখ মুজিবের মৃত্যুর পর জিয়াউর রহমান অবাধ অর্থনীতি চালু করে এই সুযোগটাই নিয়ে এলেন, যে জন্য আওয়ামী লীগকে ভাঙতে এবং তাঁর দল ভারী করতে তাঁকে এতোটুকু বেগ পেতে হয়নি।
এছাড়া ‘৭১ -এর স্বাধীনতার যুদ্ধে পরাজিত হলেও নরঘাতক আলবদর, রাজাকার ও জামাতিরা রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে উপেক্ষণীর ছিল না। শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষমা ঘোষণা করেই ক্ষান্ত ছিলেন কিন্তু জিয়াউর রহমান এদের আলাদাভাবে দল করার এবং নিজের দলে আসার সুযোগ দিলেন। সব মিলিয়ে জিয়াউর রহমানের আমলটা ছিল এ দেশের রাজনীতিতে দলবদলের এক আদর্শ সময়।
জেনারেল এরশাদ যদিও রাজনীতি ক্ষেত্রে জিয়াউর রহমানের একই নীতি গ্রহণ করে অগ্রসর হচ্ছেন তবু তাঁর সাফল্য সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ আছে। কারণ ইতিহাসে কোনো ঘটনাই দুইবার একইভাবে ঘটনা। যদি কখনো ঘটেও তার ফল প্রহসনে পরিণত হতে বাধ্য। যে কারণে জনদলকে কেন্দ্র করে নেতাদের দলবদল বিএনপি’র মত আসর মাত করতে পারেনি, যদিও কোনো কোনো ক্ষেত্রে যথেষ্ট মুখোরোচক সংবাদ সৃষ্টি করেছে।
প্রসঙ্গঃ আতাউর রহমান খান
দল ও নীতি বদলের উদাহরণ হিসেবে আমরা কয়েকজন বিশিষ্ট নেতাকে বেছে নিয়েছি। এর ইতিবাচক বা নেতিবাচক ভূমিকা যাই হোক না কেন উদাহরণ হিসেবে আতাউর রহমান খান একজন উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব।
ব্রিটিশ-ভারত থেকে শুরু করে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতি পর্যন্ত বহু ঘটনা, উত্থান-পতনের সাক্ষী এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, জনদলের ভাইস চেয়ারম্যান ও প্রবীণতম রাজনীতিবিদ আতাউর রহমানের রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় ১৯৩৪ সালে কৃষক-প্রজা পার্টির ঢাকা জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার মাধ্যমে। তারপর ১৯৪৪ সালে মুসলিম লীগে যোগদান এবং ঢাকা জেলা মুসলিম লীগের ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম হয়। আতাউর রহমান খান মুসলিম লীগের রাজনীতি বাদ দিয়ে আওয়ামী মুসলিম লীগের শরিক হয়ে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান এবং ১৯৫২ সালে ইস্ট বেঙ্গল পিস কমিটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের টিকেটে তিনি পূর্ব পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং ১৯৫৫ সালে জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়ে পরিষদের ডেপুটি লিডার হন। তিনি ১৯৫৬ সাল থেকে ১৯৫৮ সাল সামরিক আইন জারি হওয়া পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন।
১৯৬২ সালে সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে গঠিত ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টে যুক্ত ছিলেন। ১৯৬৩ সালে সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগ আতাউর রহমান খান এর সাথে শেখ মুজিবর এর বিরোধ সৃষ্টি হয়। ‘৭০ সালে এসে তিনি পাকিস্তান ন্যাশনাল লীগ গঠন করেন।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি পাকিস্তান ন্যাশনাল লীগে বাংলাদেশ জাতীয় লিগে রূপান্তরিত করেন এবং ১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে পার্লামেন্টে বিরোধী নেতা হন।
১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমান সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বাকশাল গঠন করলে তিনি বাকশালে যোগদান করেন।
১৯৭৯ সালে জিয়ার আমলে অনুষ্ঠিত পার্লামেন্ট নির্বাচনে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তারপর ১৯৮২ সালে ২৪ মার্চ সামরিক আইন জারি হয় এবং পার্লামেন্ট বাতিল ও রাজনৈতিক তৎপরতা বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু ১৯৮৩ সালে মধ্য ফেব্রুয়ারি ছাত্র হত্যা ঘটনার মধ্য দিয়ে সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হলে আতাউর রহমান খান আন্দোলনে অংশ নেন। একপর্যায়ে তিনি বিরোধী দলগুলোকে প্রণীত পাঁচ দফা আন্দোলনের অন্যতম নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন এবং বর্তমান সামরিক সরকারকে ‘গণতন্ত্র হত্যাকারী’ বলে অভিহিত করেন। কিন্তু ১৯৮৪ সালের ২৯ মার্চ তিনি আন্দোলন থেকে হঠাৎ সরে গিয়ে সামরিক সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও জনদলের ভাইস চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। প্রবীণ নেতা আতাউর রহমান খানের দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের রাজনৈতিক ধারাবাহিকতা থাকলেও দলের যে ধারাবাহিকতা নেই, তা অন্ততঃ ফুটে উঠেছে এই সংক্ষিপ্ত জীবন-চরিতে।
জনাব আতাউর রহমানের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রশ্নের লিখিত উত্তর দেওয়া হল।
প্রশ্নঃ আপনি ১৯৩৪ সালে কৃষক- প্রজা পার্টির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। কিন্তু ১৯৪৪ সালে মুসলিম লীগে যোগ দিয়েছিলেন কেন?
উত্তরঃ ১৯৩৭ সালে ওকালিত শুরু করি। ১৯৪২ সালে মুন্সেফী চাকরি নেই। ১৯৪৪ সালে চাকরি ছেড়ে আবার ওকালতি শুরু করি। এই বছর কৃষক-প্রজা পার্টির সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না। অধিকন্তু মুসলিমলীগ তখন জাতির আশা- আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হিসেবে গড়ে উঠেছিল। এ জন্য মুসলিম লীগে যোগদান করি।
১৯৪৯ সালে আওয়ামী লীগ গঠিত হয়। পাকিস্তান হওয়ার পর অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগকে ভেঙে দেওয়া হয়। পূর্ব পাকিস্তানের মৌলানা আকরাম খাঁকে আহ্বায়ক করা হয়। তাঁর অভিমত ছিল যে, মুসলিম লীগ একটি সরকারি দল। এটা এখন আর প্রতিষ্ঠান নয়, অর্থাৎ যে কেউ এ দলের সদস্য হতে পারবে না। ঢাকা শহরের সদস্য করার জন্য মাত্র চৌদ্দশ রশিদ প্রদান করলেন তাঁর বাছাই করা লোকের হাতে। আমরা অনেকেই রশিদ সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হই। এ বিষয়ে বিস্তারিত আমার লেখা ‘ওজারতির দুই বছর’ বই-এ উল্লেখ করা হয়েছে।
ইতিমধ্যে মাওলানা ভাসানী ঢাকা এসে পূর্ব-পাকিস্তানের সমগ্র মুসলিম লীগারদের ডাকলেন। নারায়ণগঞ্জে একটি সভায় সাব্যস্ত হল যে আমরা সরকারি মুসলিম লীগের না যেয়ে জনগণের মুসলিম লীগ অর্থাৎ আওয়ামী মুসলিম লীগ করব। ১৯৪৯ সালে ঢাকার গোলাপবাগে সম্মেলনে এ সিদ্ধান্তের চূড়ান্ত রূপ দেয়া হয়। এবং আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়। এর কয়েক মাস আগে মানকির পীরসাহেব উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের আওয়ামী লীগ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান দাঁড় করিয়েছিলেন। আমরা সরকারি মুসলিম লীগ মোকাবিলায় মুসলিম লীগ গঠন করলাম।
প্রশ্নঃ পাকিস্তান হওয়ার পর ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়। আপনি মুসলিম লীগের না থেকে আওয়ামী মুসলিম লীগের যোগ দিলেন কেন?
উত্তরঃ ১৯৫৩ সালে মুসলিম লীগের কেটে যাওয়ার পর আমরা সরাসরি আওয়ামী লীগ করি। শব্দ হিসেবে মুসলিম শব্দটি বাদ দেবার কোন প্রশ্ন ওঠে না। আওয়ামী মুসলিম লীগ মুসলিম লীগ এর পাল্টা প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলাই এর উদ্দেশ্য ছিল। একটি সরকারি লীগ অর্থাৎ মুসলিম লীগ, আমাদের জনসাধারণ লীগ সুতরাং আওয়ামী লীগ।
প্রশ্নঃ ১৯৫৩ সালে মুসলিম শব্দ বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ এবং ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগ থেকে ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠিত হয়। আপনি ন্যাপে যোগ না দিয়ে আওয়ামী লীগে থেকে গেলেন কেন?
উত্তরঃ ১৯৫৭ সালে আমি পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলাম বৈদেশিক নীতির প্রশ্নে আমাদের নেতা সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে মাওলানা ভাসানীর তীব্র মতানৈক্য হয়। মাওলানা সাহেব তখন পশ্চিম পাকিস্তানের বিশিষ্ট নেতৃবৃন্দকে নিয়ে নতুন সংস্থা গঠন করলেন। নাম দিলেন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি । পল্টন ময়দানে জনসভায় এই ঘোষণা করলেন। আমার মন্ত্রিসভার জনাব মোহাম্মদ আলী মৌলানার সঙ্গে যোগ দিয়ে ওই দলে চলে গেলেন। তজ্জন্য তাকে মন্ত্রিসভা হতে বাদ দেওয়া হয়। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি অর্থাৎ ন্যাপে আমার যোগদান করার প্রশ্নই ওঠে না।
প্রশ্নঃ ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট কোন সালে গঠিত হয় এবং এই ফ্রন্ট সম্পর্কে কিছু বলুন।
উত্তরঃ ১৯৫৮ সালে আইয়ুব-ইস্কান্দার সারা পাকিস্তানে সামরিক আইন জারি করে সমস্ত রাজনৈতিক দল অবৈধ ঘোষণা করলেন। আমরা এর প্রতিবাদে ঐতিহাসিক নয়-নেতার বিবৃতি প্রদান করি এবং সারা দেশ আমাদের ঘোষণাকে গ্রহণ করে।
রাজনৈতিক দল করা সম্ভব নয় বলে, আওয়ামী লীগ, মুসলিম লীগ, ন্যাশনাল পার্টি ও কৃষক প্রজা পার্টির নেতৃবৃন্দ সাব্যস্ত করলেন যে দল করা যখন সম্ভব নয়, তখন একটা নির্দলীয় সংস্থা গঠন করা হোক। সেই মর্মে ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট গঠন করা হয়।
প্রশ্নঃ আওয়ামী লীগ রিভাইভ কখন হয় এবং আওয়ামী লীগ রিভাইভ প্রশ্নে আপনাদের সিদ্ধান্ত কি ছিল?
উত্তরঃ খুব সম্ভব ১৯৬৪ সালে পুনর্জীবিত হয় এই প্রশ্নে আমাদের অনেকেরই সিদ্ধান্ত বিরুদ্ধে ছিল।
প্রশ্নঃ আপনি কেন শেখ মুজিবের রিভাইভড আওয়ামিলীগে থাকেন নি এবং ১৯৭০ সালে এসে কেন পাকিস্তান ন্যাশনাল লীগ করলেন?
উত্তরঃ রাজনৈতিক দল পুনর্জীবিত করা সম্বন্ধে নেতা সোহরাওয়ার্দির মত ছিল যে, যতদিন পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলির সুষ্ঠুভাবে কর্মসূচি গ্রহণ করে কাজ করতে পারবে না ততদিন পর্যন্ত দল গঠনের প্রশ্নই ওঠে না। শেখ মুজিব বৈরুতে যেয়ে সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে দুইটি ব্যাপারে আবেদন জানায়। প্রথম, পুনর্জীবন করা -দ্বিতীয় তাঁকে দেশে ফিরে আসার জন্য অনুরোধ করা। নেতা সোহরাওয়ার্দী উভয় আবেদন প্রত্যাখান করেন এবং শেখ মুজিবের এ ব্যাপারে প্রথমে আবুল মনসুর আহমেদকে পরে তাঁরই পরামর্শে অন্য সবাইকে জানালেন। আমরা অনেকেই পুনর্জীবন সম্পাদক ঘোর আপত্তি করি। বিশেষতঃ নেতার অভিমতের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে আপত্তি করি।
ইতিমধ্যে হঠাৎ সোহরাওয়ার্দী সাহেব ইন্তেকাল করেন। যেদিন তার লাশ কবরস্থ করা হয় সেদিন অনেক নেতা উপস্থিত ছিলেন। শেখ মুজিব তাদের বুঝিয়ে দেন যে পার্টি পুনর্জীবিত করতে হবে। অনেকে রাজি হয়। তখন আমার বাড়িতে ওয়ার্কিং কমিটির মিটিং ধার্য করা হয়। হঠাৎ জানতে পারলাম স্থান পরিবর্তন করে তার বাসভবনে মিটিং অনুষ্ঠানের জন্য ধার্য করেন। আমি এবং অনেকে পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পার্টি পুনর্জীবিত করার প্রস্তাব গ্রহণ করি না বলে তাঁর বাড়িতে মিটিংয়ে যাইনি এবং প্রায় ৩৭ জন নেতৃবৃন্দ এক বিবৃতি দিয়ে পুনর্জীবনের বিরোধিতা করি।
তার কয়েক বছর পর আমরা পাকিস্তান ন্যাশনাল লীগ গঠন করি।
প্রশ্নঃ ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমান সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে বাকশাল গঠন করেন। আপনি বাকশালে যোগ দিয়েছিলেন কেন?
উত্তরঃ বাকশালে যোগদান কৌশলগত কারণে এ কথা অনেক পূর্বে আমি বলেছিলাম। রাজনীতির সমস্ত দ্বার রুদ্ধ হয়ে একটিমাত্র প্রবাহে প্রচলিত করার ব্যবস্থা করা হলো। তখন একজন রাজনীতিক হিসেবে দুটি পথই খোলা ছিল। হয় রাজনীতি হতে অবসর গ্রহণ করা নতুবা বাকশালে যোগদান করা। আমি রাজনীতি হতে অবসর গ্রহণ করা সমীচীন মনে করিনি। এই কারণে বাকশালের যোগদান করি।
প্রশ্নঃ আপনি বিরোধী দলসমূহের বর্তমান ৫ দফা আন্দোলনের অন্যতম নেতা ছিলেন। কিন্তু হঠাৎ যে সরকারকে গণতন্ত্র হত্যাকারী বলেছিলেন, সেই সরকারে যোগ দিলেন কেন?
উত্তরঃ আমি পাঁচ দফা আন্দোলনের একজন উদ্যোক্তা। ছিলাম যখন প্রেসিডেন্ট এরশাদ আলাপ-আলোচনার জন্য আহ্বান করেন, তখন আমি অন্যান্য নেতাদের যোগদান করতে অনুরোধ করি। তাঁরা রাজি হননি। আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কেন যাব না তার সঠিক যুক্তি আমাকে দিতে পারলে আমি চিন্তা করে দেখব। তাঁরা কোনো যুক্তি দেখাতে পারেননি। আমি অন্যান্য কয়েকজন দলীয় নেত্রীবর্গ সহ প্রেসিডেন্টের সাক্ষাৎ করি। এই কারণে সাত দলের নেতৃবৃন্দ আমার বিরুদ্ধে চটে যায়। অবশ্য, পরবর্তীকালে তারা কয়েকবার বিভিন্ন পর্যায়ে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। প্রেসিডেন্ট এরশাদকে ‘গণতন্ত্র হত্যাকারী বলেছিলাম। কিন্তু তিনি আমাকে বুঝবার চেষ্টা করেছেন যে নিহত গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধার করবেন এবং গণতন্ত্র উত্তরণে তাকে সাহায্য করতে পারি কিনা। তাঁর গণতন্ত্র উত্তরণে ব্যবস্থার আন্তরিক আগ্ৰহে আমি আস্থা স্থাপন করি এবং যদি আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও শক্তি দ্বারা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব করতে পারি তা’হলে আমাকে তার সঙ্গে যোগদান সমীচীন মনে করি।
মেজর জলিলের দল ও নীতি বদল
দল ও নীতি পরিবর্তনের সাম্প্রতিক এবং উৎকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে মেজর (অবঃ) এম এ জলিল। তাঁর কর্মজীবন সেনাছাউনি থেকে শুরু। তিনি ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন মেজর হিসেবে যুদ্ধ করেন এবং নয় নম্বর সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন। স্বাধীনতার পর তিনি অবসর গ্রহণ করেন এবং ১৯৭২ সালে গঠিত জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সভাপতি হন। প্রায় ১৩ বছর ধরে জাসদের সভাপতি থাকার পর ১৯৮৩ সালে এসে জাসদ ত্যাগ করেন (একই সময় জাসদ থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়) এবং নতুন চিন্তাভাবনা শুরু করেন।
১৯৮১ সালে মেজর (অবঃ) জলিল ‘মার্কসবাদ মুক্তির পথ নামক একটি বই লিখে তার ভূমিকায় উল্লেখ করেন, ‘১৯৭২ সনের ৩১ অক্টোবর জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের আনুষ্ঠানিক জন্মের মাধ্যমেই আমি আমার সামমনা প্রাণপ্রিয় বিপ্লবী সাথীদের অঙ্গীকারবদ্ধ হই বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এ দেশের গরীব মেহনতী সর্বহারা জনগণের সার্বিক মুক্তি অর্জনে লৌহ কঠিন শপথে। আমার যাত্রাপথ কঠিন দীর্ঘ এবং ঘাত-প্রতিঘাতময় হবে একথা জেনেই পাড়ি জমিয়েছি ইস্পিত গন্তব্যে। একটি শ্রেণীবিভক্ত সমাজে বাঁচার মতো বেঁচে থাকার সংগ্রাম কঠিন এবং কণ্টকাকীর্ণ হলেও এ পথ অবলম্বন করা ব্যতীত অন্য কোন সহজ পথ নেই। বিগত আট বছরের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার আলোকে উপরোক্ত সত্যটি আমার কাছে আরো ভাস্বর হয়ে উঠেছে’। মেজর জলিল এই অঙ্গীকার এই শপথ গ্রহণের মাত্র তিন বছর পর সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে অবস্থান নিয়ে ১৯৮৪ সালের ২০ অক্টোবর ‘জাতীয় মুক্তি আন্দোলন’ নামে নতুন রাজনৈতিক দল ঘোষণা করে বলেন, ‘আল্লাহর নির্দেশিত সার্বভৌম রাজত্ব কায়েম করাই হবে মুক্তি আন্দোলনের উদ্দেশ্য এবং এই আন্দোলনের ভিত্তি হবে ইসলাম’।
বর্তমানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ৫ দফা আন্দোলনের অন্যতম নেতা এবং জাসদের সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ তাঁর দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহযোদ্ধা মেজর(অবঃ) এম এ জলিল সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, মেজর জলিল সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার নেই। গত দু-তিন বছরে পরস্পর বিরোধী বক্তব্য থেকে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে তিনি বিচ্যুতির কোন স্তরে পৌঁছেছেন। এছাড়া তিনি নতুন দল ঘোষণা উপলক্ষে জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে মে বিবৃতি দিয়েছেন তাতে তাঁর বিচ্যুতি নগ্নভাবে প্রকাশ পেয়েছে। রাজনৈতিক ইতিহাসে এধরনের বিচ্যুতি বিরল। তিনি বলেন, মেজর (অবঃ) জলের ব্যক্তিগত সুযোগ সুবিধার জন্য যেকোনো কিছুই করতে পারেন। তাকে জাসদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল, ফায়দা লোটার জন্য তাঁর বঙ্গভবনে গমন এবং পার্টি বিরোধী কার্যকলাপের জন্য। শাহজাহান সিরাজের মতে, জলিল সাহেবরা বর্তমানে যে ফ্রন্ট গঠন করেছেন তার লক্ষ্য হচ্ছে, সরকারের সহযোগিতায় বর্তমানের গণতান্ত্রিক ভাত-কাপড়-বাসস্থান আন্দোলনকে নস্যাৎ করা।
সাপ্তাহিক বিচিত্রার পক্ষ থেকে মেজর জলিলের নিম্নোক্ত সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করা হয়।
প্রশ্নঃ আপনি স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন বীর সৈনিক এবং একসময়ের জাসদের জঙ্গী সভাপতি হিসেবে আপনার কর্মকান্ড স্মরণযোগ্য। কিন্তু জাসদ ত্যাগ করার পর বেশ কিছুদিন সংগঠন থেকে দূরে অবস্থান করে বর্তমানে যে নতুন দল গঠন করেছেন তাঁর আদর্শ ও উদ্দেশ্য কি?
উত্তরঃ আমার জাসদ গঠনের একটি উদ্দেশ্য ছিল। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে ৯ নম্বর সেক্টরের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আমি অনুভব করেছিলাম যে, আওয়ামী লীগ নেতার চোখে মুখে কোনো দুশ্চিন্তা বা বেদনার ছাপ দেখিনি। তারা নির্বিঘ্নে সুখে শান্তিতে দিন কাটিয়েছে। এমনকি তারা মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পগুলোও পর্যন্ত দেখতে যায়নি। ফলে এই অভিজ্ঞতা থেকে আমার উপলব্ধি জাতির স্বার্থে চেয়ে তাদের দলীয় গোষ্ঠীস্বার্থ বড়। যুদ্ধ শেষে ঘটনা আরো মর্মান্তিক। যুদ্ধ শেষ হতে না হতেই খুলনায় এসে প্রত্যক্ষ করি বন্ধুর বেশে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবাধ লুন্ঠন এবং এ দৃশ্য আমাকে দারুণভাবে মর্মাহত করে। আওয়ামী লীগ দেশ চালাতে ব্যর্থ হবে। শুধু ব্যর্থই হবে না বরং তারা আমাদের স্বাধীনতাকে ভারতের কাছে বন্ধক রেখে ক্ষমতায় টিকে থাকার বাসনায় লিপ্ত হবে। যুদ্ধ কালীন অবস্থায় অনেক আওয়ামী লীগ নেতার সাথে আমার কথা হয়েছে। তাদের কথা থেকে উপলব্ধি করেছিলাম যে, দেশ পরিচালনার ব্যাপারে তাদের কোনো পরিকল্পনা ছিল না। ক্ষমতায় আসীন হওয়ার ছিল তাদের মূল লক্ষ্য। যুদ্ধের সময় কোন একজন দেশ প্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে লুন্ঠনের প্রতিবাদ জানাই। কিন্তু ফল হল উল্টো। প্রতিবাদের অপরাধে আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এতে বিস্মিত হই । তবে আমার প্রতিবাদ ছিল ভারতীয় জনগণের বিরুদ্ধে নয়, ভারতের লুণ্ঠনকারীদের বিরুদ্ধে। আওয়ামী লীগের যেহেতু ক্ষমতা আগলে রাখাই ছিল মূল লক্ষ্য। তাই তারা ভারতীয় সেনাবাহিনীকে লুন্ঠনের সুযোগ করে দিয়েছে।
আমার গ্রেফতারের পর থেকেই আমি রাজনীতি করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। তরুণ ছাত্রনেতা আ স ম আব্দুর রব, শাজাহান সিরাজ এদের নিয়ে জাসদ গঠন করি। আমি বিগত ১৩ বছর জাসদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছি। আমার ফাঁসির হুকুম হয়েছিল। পরে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। বহু জাসদ নেতা ও কর্মী আত্মহুতি দিয়েছে। কিন্তু আমি লক্ষ করলাম বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের মাধ্যমে মানুষের মন জয় করা যায় না এবং গন্তব্যস্থান সুদূরপরাহত। এছাড়া জনগণের সাথে মেশার ফলে আমার উপলব্ধি হলো যে জাসদকে জনগণ ইসলাম বিরোধী দল হিসেবে চিহ্নিত করে ফেলেছে। এটা আমাদের অগ্রগতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আমার স্থির বিশ্বাস জন্মালো যে, মানুষের সার্বিক মুক্তির একমাত্র পথ ইসলাম ও কোরআন-সুন্নাহ’ এবং গ্রহণযোগ্য পথ। আমাদের দেশে শতকরা ৯৫ ভাগ লোকই মুসলমান এবং তাদের নিজস্ব কৃষ্টি, স্বকীয়তা, আচার-আচরণ রয়েছে এবং এগুলো ইসলাম থেকেই জন্ম নিয়েছে। আমার এই অনুভূতি বা উপলব্ধি থেকেই আমি দীর্ঘ একযুগ জাসদের সাথে কাটিয়ে দেশ ও জাতির স্বার্থে জাসদের কাউকে কোন অপবাদ দিয়ে সংগঠনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই দলত্যাগ করেছি। আমি জাসদ থেকে ভেঙে বের হয়ে আসিনি। ইচ্ছে করলে তা পারতাম। এটা এক বিরল ঘটনা।
আমার লক্ষ্য কোন ব্যক্তিগত ফায়দা লোটা নয়। রাজনীতিতে আমার পদার্পণের ইতিহাস পাকিস্তানের শোষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার ইতিহাস। আমার ইতিহাস ভারতীয় সেনাবাহিনীর লুণ্ঠন এবং শেখ মুজিবুর রহমানের অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার ইতিহাস। এখন আমার এবং আমার দলের লক্ষ্য হচ্ছে, জাতির সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজের আমূল পরিবর্তন সাধন করা। এখানে ব্যতিক্রম এইটুকু যে, আমি জাসদ ছেড়ে সরকারি দলের যাইনি কিংবা মাঝামাঝি কোনো সুবিধাজনক ব্যবস্থা নেইনি। আমি জাতীয় মুক্তি আন্দোলন গঠন করেছি বিপ্লবের মাধ্যমে সার্বিক মুক্তির জন্য। আর এই বিপ্লব হবে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের পবিত্র কোরআন সুন্নাহর ভিত্তিতে।
প্রশ্নঃ আপনি বলছেন ইসলামী হুকুমত কায়েম করবেন। ইসলামী হুকুমত কিভাবে কায়েম হতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
উত্তরঃ অত্যাচার-নিপীড়ন, ঘুষ-দুর্নীতি, নারী নির্যাতন, বিচারহীনতায় দিশাহারা একটি সমাজকে রক্ষা করতে সঠিক আদর্শ ভিত্তিক একটি বিপ্লবের প্রয়োজন। কিন্তু এই বিপ্লব এই দেশে দুটি আদর্শের মাধ্যমে হতে পারে। এর একটি হচ্ছে কমিউনিজম এবং অন্যটি ইসলাম। কম্যুনিজম মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলোকে চিহ্নিত করে অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান মূখ্য ভিত্তি করে। কিন্তু একটি উপাদানকে অবহেলা করেছে সেটা হচ্ছে, একটি সর্বাঙ্গীন সুন্দর জীবন যাপন, অনুপস্থিতি মানুষকে প্রাচুর্যে গ্রাস করে জীবনকে ভারসাম্যহীন করে ফেলে। আর সেই উপাদান হচ্ছে আত্মা ,রুহ বা কালব। দ্বান্দিক বস্তুবাদে অকাট যুক্তি দিয়ে এসব কে অস্বীকার করা হয়েছে এবং সবকিছু গুলিয়ে ফেলা হয়েছে জ্বর বস্তুর সঙ্গে। আমার বিপ্লব ইসলাম ভিত্তিক বিপ্লব। এই বিপ্লব আল্লাহর অস্তিত্বের স্বীকার করার মধ্য দিয়ে মানুষকে তার নিজের অস্তিত্ব সুদৃঢ় করতে সহায়তা করে ও আত্মার রুহানি শক্তিকে জাগ্রত করে, একটি বিপ্লবের জন্য আত্মার রুহানী শক্তি জাগরণই হচ্ছে মূল হাতিয়ার। এই হাতিয়ার কমিউনিস্ট বিপ্লবে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত থেকে যাওয়ার ফলে কমিউনিজম ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা একটি হৃদয়হীন মেশিনে পরিণত হয়ে যায় সুতরাং আত্মার রুহানি শক্তি জাগরণের মাধ্যমেই ইসলামী হুকুমত কায়েম হওয়া সম্ভব।
প্রশ্নঃ আপনি তো ‘মার্কসবাদ মুক্তির পথ’ একটি বই লিখে মার্ক্সবাদকে মুক্তির একমাত্র পথ হিসেবে দিক নির্দেশনা দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন এমনকি ঘটনা ঘটলো যে মার্কসবাদ বাদ দিয়ে ইসলামী হুকুমত কায়েম এর কথা বলছেন?
উত্তরঃ ইসলামী ও কমিউনিজম এই বিপ্লবের বিশ্লেষণ পাশাপাশি রেখেই আমি মনে করি, কমিউনিজম ভিত্তিক বিপ্লব মানুষের অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, বাসস্থান ইত্যাদি বৈষয়িক সমস্যার কোনোরূপ একটি সমাধান দিতে পারে। কিন্তু মনকে বন্দি রেখে অন্ন দিলে মানুষের সার্বিক মুক্তি হয়না। আর এই উপলব্ধি থেকেই আমার নতুন পথের সন্ধান।
প্রশ্নঃ আপনি কি মনে করেন বর্তমান বিশ্বে মার্কসবাদ অচল হয়ে পড়েছে?
উত্তরঃ মার্কসবাদকে অচল হিসাবে চিহ্নিত করার কথা আমি বলছি না। আত্মার মুক্তিকে বাদ দিয়ে যারা শুধু অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ইত্যাদি বৈষয়িক সমস্যা মেটাতে আগ্রহী তাদের জন্য মার্কসবাদই উৎকৃষ্ট। কেবলমাত্র বৈষয়িক সমস্যা সমাধানের মার্কসবাদ এখনও অন্যান্য দর্শন থেকে উন্নত। মার্কসবাদ মুক্তির পথ এটা ছিল তাত্ত্বিক উপলব্ধি। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আমার দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার আলোকে ইসলামই একমাত্র মুক্তির পথ। অর্থাৎ আল্লাহর রসূল, কোরআন ও সুন্নাহ হতে পারে বিশ্ব মানবতার একমাত্র মুক্তির পথ।
প্রশ্নঃ আপনার নতুন দলের নাম দিয়েছেন ‘জাতীয় মুক্তির আন্দোলন।’ কিন্তু জাতীয় মুক্তি আন্দোলন কিভাবে আসতে পারে বলে আপনি মনে করেন।’
উত্তরঃ সবকিছু একই সঙ্গে বলা যায়না।
প্রশ্নঃ আপনারা ১০ দলীয় সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেছেন। পরিষদের ঘোষণায় বলা হয়েছে, তিন দফার ভিত্তিতে জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমে গণ অভ্যুত্থান ঘটিয়ে চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছানো হবে। এই গণ-অভ্যুত্থান কি ইরানের ইসলামী বিপ্লবের মত হবে।
উত্তরঃ আমাদের গণঅভ্যুত্থান শব্দটির মূল অর্থ হচ্ছে রুহানি শক্তি পুনর্জাগরণ। এর অন্য কোন উদ্দেশ্য নেই। যে শক্তি সকল অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর অনুপ্রেরণা যোগায়, যে শক্তি দেশ ও জাতিকে মুক্ত করার দৃঢ় প্রত্যয় ঘোষণা করে, সে শক্তির জাগরণী গণ-অভ্যুত্থান।
প্রশ্নঃ জামায়াতে ইসলামীসহ স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী অনেক রাজাকারও ইসলামী হুকুমত কায়েমের কথা বলছে। মুক্তিযুদ্ধের একজন অধিনায়ক হিসাবে আপনার দলে স্বাধীনতা বিরোধীরা যোগ দিতে চাইলে আপনি তাদের কিভাবে গ্রহণ করবেন?
উত্তরঃ ইসলামী হুকুমত কায়েম করার লক্ষ্যে তারাই ঐক্যবদ্ধ হবে যারা দেশ-জাতি, মানুষকে ভালোবাসে, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিশ্বাস করে এবং তার সংরক্ষণের জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত থাকে, যারা সর্বপ্রকার বৈদেশিক প্রভাব ও আগ্রাসনের বিরোধিতা করে জাতীয় কৃষ্টি, সংস্কৃতি, সভ্যতাকে রক্ষা করতে অঙ্গীকারবদ্ধ, যারা ব্যক্তি, গোষ্ঠী, দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে দেশ ও জাতির স্বার্থকে প্রাধান্য দেবে কেবল তারাই ‘জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে’ যোগ দিতে পারবে। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায় যে ‘জাতীয় মুক্তি আন্দোলন’ প্রচলিত অর্থে কোনো রাজনৈতিক দল নয়।
প্রশ্নঃ আপনি বলছেন আপনার সংগঠন রাজনৈতিক দল নয়। কিন্তু রাষ্ট্রক্ষমতায় না গেলে তো আপনি সর্বস্তরে ইসলামী হুকুমত কায়েম করতে পারবেন না। সেজন্য দরকার রাজনৈতিক সংগঠন।
উত্তরঃ আপনি ঠিকই বলেছেন। বর্তমান রাজনৈতিক দলগুলোর প্রচলিত কাঠামোর কথা বলছি। আমার দল ওই রকম কাঠামোগত নয়। সে দিক দিয়ে রাজনৈতিক দল নয়।
প্রশ্নঃ বর্তমান রাজনৈতিক সংকট কাটানোর লক্ষ্যে সরকার যদি কোনো ফ্রন্ট গঠন করেন, তাহলে আপনি সেই ফ্রন্টের যোগ দেবেন কি?
উত্তরঃ জাতীয় প্রতিটি সংকট দৈন্যে নয় বা ক্ষমতা দখল কিংবা ক্ষমতা সংরক্ষণের কোন্দল নয়। সংকট হচ্ছে আদর্শহীনতার। নির্দিষ্ট আদর্শ অনুশীলনের অপরাগতাই হচ্ছে মূল সংকট। তাই এখন কোরআন ও সুন্নাহর মাধ্যমে এই সংকট দূর করতে হবে। বর্তমানে এরশাদকে হটিয়ে দিলেই সমস্যার সমাধান হবে না। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি-কে ও ক্ষমতায় বসিয়ে দিলেই সমস্যার সুরাহা হবে না। আবার পাঁচ মিশালি সরকার গঠনের মাধ্যমে ও সমস্যার সমাধান নেই। তবে বর্তমান সংকটের একটা শান্তিপূর্ণ সমাধান হোক এটা যেমন সমগ্র দেশবাসীর কাম্য এবং আমারও কাম্য। আমাদের মৌ সংকটকে চিহ্নিত করে যদি বর্তমান সংকট কাটিয়ে ওঠার উদ্যোগ নেওয়া হয় তাহলে সে বিষয়টি আমরা সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করবো এবং আমার আপত্তি থাকার কথা নয়।
প্রশ্নঃ রাজনৈতিক দল চালাতে গেলে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। আজকাল টাকা ছাড়া মিটিং-মিছিল হয়না। আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর অর্থের জোগান কোত্থেকে আসে বলে আপনি মনে করেন?
উত্তরঃ জাতিগতভাবে আমরা সম্পূর্ণভাবে পরনির্ভরশীল এবং এ সত্যটিকে বিশ্লেষণ করলেই এর জবাব পাওয়া যাবে।
ক্যাপ্টেন আব্দুল হালিম চৌধুরীর নাটকীয় দলবদল
১৯৮৪ সাল, ২৯ জুলাই ধানমন্ডির একটি বাড়িতে পরবর্তী আন্দোলনের কর্মসূচি প্রণয়নের ব্যাপারে ১৫ ও ৭ দলের লিয়াজোঁ কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। বৈঠকে রাশেদ খান মেনন, আব্দুর রাজ্জাক, কাজী জাফর, ক্যাপ্টেন হালিম চৌধুরী সহ দুই জোটের অনেকেই উপস্থিত। সন্ধ্যা সমাগত। বৈঠকও শেষ হয়ে গেছে পরবর্তী কর্মসূচি নিয়ে। কিন্তু এদের সবার মাঝে একজনের মন তখন উসখুস করছে, অস্থির চঞ্চল ভাবে ফিরছে। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাতের গভীরতা বাড়তে লাগলো। এক সময় রাত দশটা বাজার ঘণ্টাধ্বনি বেজে উঠলো। তারপরেই বিস্ময়ের পালা। টেলিভিশনের পর্দায় সংবাদ শিরোনামে ঘোষণা করা হলো ক্যাপ্টেন আব্দুল হালিম চৌধুরী মন্ত্রী হিসেবে বঙ্গভবনে শপথ গ্রহণ করেছেন। এদিকে লিয়াজোঁ কমিটির বৈঠকে যাঁরা ছিলেন তাঁরা খবর শুনে বিস্ময়ে হতবাক। সবচেয়ে মজার ঘটনা, সেদিন হালিম চৌধুরীর বাড়িতে দশটা পর্যন্ত উপস্থিত ছিলেন মান্নান ভূঁইয়া ও কাজী জাফর আহমদ। তাঁরাও ঘুণাক্ষরে কিছু জানতে পারেননি। তখন হয়তো ক্যাপ্টেন হালিম চৌধুরীর মনে বারবার উঁকি দিচ্ছিল, হয়তো অনেকটা অস্থির হয়ে পড়েছিলেন যে, মান্নান ভূঁইয়া ও কাজী জাফর কখন বিদায় নিবেন। কারণ দশটা বাজলেই বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটতে এবং তা হবে তাঁর জন্য অস্বস্তিকর। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই নাটকীয়তা এই বিষয়ে নতুন কিছু নয়। ক্যাপ্টেন হালিম চৌধুরীও এর বাইরে নন, তবুও নির্দিষ্ট দর্শন ও আদর্শের চর্চার কথা বারবার চলে আসে। কি ক্ষমতাসীন কি ক্ষমতার বাইরে সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
ক্যাপ্টেন হালিম চৌধুরীর রাজনৈতিক জীবন বেশ দীর্ঘ। এই দীর্ঘ সময়ে তিনি অনেক চড়াই-উতরাই পার হয়েছেন। এখন তাঁর বয়স ৬২ বছর। তিনি তাঁর প্রথম জীবনের ক্যারিয়ার শুরু করেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে একজন কোন কমিশনড অফিসার হিসেবে। ১৯৬২ সালে শিক্ষা কমিশন আন্দোলনের সময় তিনি ছাত্র নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করেন। তখন তিনি ক্যাপ্টেন এবং ঢাকা ইউওটিসি’র দায়িত্বে নিয়োজিত। এ সময় সবার অজান্তে একটি ঐতিহাসিক ঘটনাও ঘটে যায়। সে ঘটনার রেশ আজো হালিম চৌধুরীর মনে অম্লান হয়ে আছে। ওই সময় তাঁর ইউওটিসি’র একজন ছাত্র এবং বর্তমানে প্রখ্যাত বামপন্থী তাত্ত্বিক নেতা হায়দার আকবর খান রনোর বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি হয়। তখনো হালিম চৌধুরী পদত্যাগ করেননি। একদিন তিনি হায়দার আকবর খান রনোকে গোপনে ডেকে বললেন, তোমরা কি চাও। তখন রনো বলেছিলেন, আমরা স্বাধীনতা চাই। সঙ্গে সঙ্গে হালিম চৌধুরী উত্তর দিলেন যদি বলো এখনি বন্দুক উল্টো দিকে ঘুরিয়ে ধরতে পারি। কিন্তু রনো বলেছিলেন এখনো সময় হয়নি। আরো দশ বছর সময় লাগবে। এ কথার সত্যতা প্রমাণ হয়েছে ৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে। এ ঘটনাটি ক্যাপ্টেন হালিম চৌধুরী ও হায়দার আকবর খান রনো একইভাবে বলেছেন বিচিত্রার প্রতিনিধিকে।
জনাব চৌধুরী সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগের পর পরেই রাজনৈতিক চিন্তা-ভাবনা শুরু করেন এবং ওই সময়ই নীলক্ষেতে প্রফেসর মাজেদের বাসায় রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে কয়েক দফা বৈঠকও করেন। তারপর ১৯৬৭ সালে প্রথম রাজনীতি শুরু করেন মোজাফফর ন্যাপে যোগদানের মাধ্যমে। তিনি অবশ্য রাজনীতিতে যোগদান সম্পর্কে বলেন, ‘ধরতে গেলে আমি প্রত্যক্ষ রাজনীতি শুরু করি আমার দশ বছর বয়স থেকে। তখন ছিল ব্রিটিশ খেদাও আন্দোলনের জোয়ার। সে আন্দোলনে আমি ওই বয়সেই যোগ দেই। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতেও আমি রাজনীতি থেকে দূরে ছিলাম না তার প্রমান ১৯৬২ সালে ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ। আর যদি সক্রিয় রাজনীতির কথা বলেন, তাহলে তা শুরু করি ওই ১৯৬৭ সালে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে (মোজাফফর) যোগদানের মাধ্যমে।
ক্যাপ্টেন হালিম চৌধুরী অন্য কোন দলে যোগ না দিয়ে মোজাফফর ন্যাপে যোগদান সম্পর্কে বলেন, আমার ধারণা ছিল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি জাতীয় গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। কিন্তু আমি তাদের মধ্যে লক্ষ্য করলাম যে, জাতীয় গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে বাদ দিয়ে একটি বিশেষ বিদেশী শক্তির সেবা করাই তাদের মূল লক্ষ্য। এখানে উল্লেখ্য যে ক্যাপ্টেন হালিম চৌধুরী ১৯৭০ ও ৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচনে ন্যাপের টিকিটেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। তিনি ঢাকা ওয়েস্টার এরিয়া কমান্ডার ছিলেন। দেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭৪ সালে তিনি কাজী জাফর আহমদ রাশেদ খান মেনন ও হায়দার আকবর খান রনোর ডাকে সাড়া দিয়ে নবগঠিত ইউপিপি’র সভাপতি হন।
ন্যাপের ইউপিপিতে যোগদান সম্পর্কে প্রশ্নোত্তরে জনাব চৌধুরী বলেন, আমি ইউপিপিতে যোগ দেয়নি, ইউপিপি গঠন করেছিলাম। আর ন্যাপ ছাড়ার প্রশ্ন আগেই এসে গিয়েছিল। স্বাধীনতার পরের ন্যাপের আওয়ামীলীগের সাথে লেজুড়বৃত্তি এবং তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে একটি কার্যকরী বিরোধী দল গঠনের লক্ষ্যে এবং ন্যাপ ত্যাগ করি। ন্যাপ তখন নির্লজ্জভাবে আওয়ামী লীগের ‘বি’ টিম হিসেবে কাজ করছিল।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঐতিহাসিক রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর শুরু হয় নতুন রাজনৈতিক ধারা। পর্যাক্রমে মোশতাক, সায়েম শেষতক জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসীন হন। ১৯৭৮ সালে তৎকালীন সামরিক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে ফ্রন্ট গঠন হলে ক্যাপ্টেন হালিম চৌধুরী ইউপিপিকে নিয়ে ফ্রন্টে যোগ দেন। কিন্তু ফ্রন্ট নিয়ে একটি দল গঠনের প্রশ্নে দ্বিমত পোষণ করে কাজী জাফর আহমদ সরকার থেকে বের হয়ে যান। এ সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে জনাব চৌধুরী বলেন-আমি মনে করেছিলাম এবং এখনো মনে করি জিয়া একজন জাতীয়তাবাদী ছিলেন এবং তাঁর সাথে রাজনীতি করা যায়। তাই জিয়ার নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদী দল গঠনে কাজ করি।
ক্যাপ্টেন হালিম পরবর্তীতে বিএনপি সরকারের মন্ত্রী ও দলীয় নেতা হিসেবে কাজ করতে থাকেন। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ বিপুল ভোটে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে সামরিক আইন জারি হলে বিএনপি’র পতন ঘটে। কিন্তু হালিম চৌধুরী ক্ষমতা হারিয়ে লড়াকু মনোভাব নিয়ে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান এবং ৫- দফা আন্দোলনের অন্যতম নেতা হিসেবে পরিগণিত হন। বলা যায় অনেকটা হালিম চৌধুরীর উদ্যোগেই বর্তমান ৭ দলীয় ঐক্যজোটের জন্ম হয়। কিন্তু ১৯৮৪ সালে ২৯ জুলাই ২২ দলের সবাইকে অবাক করে দিয়ে তিনি বর্তমান সামরিক সরকারের মন্ত্রী হিসেবে যোগ দেন।
সরকার ও জনদলে যোগদান সম্পর্কে ক্যাপ্টেন হালিম চৌধুরী বলেন, আমি আশা করি আমার সরকারে যোগদানের বিষয়টি এদেশের রাজনীতিবিদদের রাজনৈতিক সচেতন জনগণ যথাসময়ে যথার্থই মূল্যায়ন করবেন। তবে একথা বলতে পারি শান্তিপূর্ণভাবে গণতন্ত্র উত্তরণে কিছুটা অবদান রাখার জন্য সরকারে যোগ দিয়েছি। এ সম্পর্কে আরেকটি কথা বলা যায়, যদি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী নির্বাচন নিশ্চিত করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তার সেক্রেটারি বগুড়ার মোহাম্মদ আলীর ক্যাবিনেট মন্ত্রী হিসেবে যোগ দিতে পারেন, তাহলে আমি কোন দোষ করিনি।
প্রসঙ্গঃ সিরাজুল হোসেন খান
গণতান্ত্রিক পার্টির বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সিরাজুল হোসেন খানের দীর্ঘ কর্মজীবন আবর্তিত হয়েছে সাংবাদিক, রাজনীতিক ও শ্রমিক নেতা হিসেবে। তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রজীবন থেকে। ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। এই বছর গঠিত হয় মুসলিম ছাত্রলীগ। সিরাজুল হোসেন খান ছিলেন ছাত্রলীগের সিলেট প্রতিনিধি। তিনি সাংবাদিক জীবনও শুরু করেন ছাত্রজীবন থেকেই। পেশাগত দিক থেকে বিচার করলে দেখা যাবে সিরাজুল হোসেন খানের জীবনের বেশিরভাগ সময় সাংবাদিকতা পেশায় কেটেছে।
জাতীয় রাজনীতিতে তিনি আসনগুলোতে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন থেকে। ১৯৬৫ সালে গঠিত পূর্ব পাকিস্তান শ্রমিক পরিষদ (ইস্ট পাকিস্তান ওয়ার্কার্স কাউন্সিল)- এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হিসেবে ৬৬ সাল পর্যন্ত কাজ করেন এবং ৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত পূর্ব-পাকিস্তান শ্রমিক ফেডারেশন প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ‘৭১ সাল পর্যন্ত কাজ করেন। এটাই স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ শ্রমিক ফেডারেশন নাম ধারণ করে। পরে এই ফেডারেশন ও বিআইডিসি শ্রমিক ফেডারেশন সংযুক্ত হয়ে ১৯৭৩ সালে গঠিত হয় জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশন। জনাব খান এই সংগঠনের কার্যকরী সভাপতি হিসেবে ১৯৮০ পর্যন্ত কাজ করেন। ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারীতে জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশন এর একাংশ এবং আরো কয়েকটি সংগঠন মিলে গঠিত হয় বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স ফেডারেশন। তিনি এর সভাপতি হন এবং এ পদে এখনও বহাল আছেন।
অবশ্য তিনি ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে যোগদান করার পর থেকে ন্যাপ, ভাসানী ন্যাপের কেন্দ্রীয় কাউন্সিলর, এবং পূর্ব পাকিস্তান কৃষক সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। এরপর বাংলা কমিউনিস্ট পার্টিও করেছেন তিনি। ১৯৭২ সালে প্রবীণ বামপন্থী নেতা হাজী দানেশের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় জাতীয় গণমুক্তি ইউনিয়ন (জাগমুই)। সিরাজুল হোসেন এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হন। এই সময় তিনি গণবিপ্লবী পার্টিরও অন্যতম নেতা ছিলেন। এরপর ১৯৮০ সালে জাগো এবং অন্যান্য কয়েকটি দল নিয়ে গণতান্ত্রিক পার্টি গঠিত হলে, তিনি তাঁর স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য হন এবং বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন। বর্তমানে গণতান্ত্রিক পার্টি ৭ দলীয় জোটের একটি শরিক দল এবং সিরাজুল হোসেন খান বর্তমানে ৫ দফা আন্দোলনের অন্যতম নেতা। আমরা জনাব সিরাজুল হোসেন খানকে তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিলাম। নিম্নে তা পত্রস্থ হলো।
প্রশ্নঃ আপনি সাংবাদিকতা, রাজনীতির, শ্রমিক আন্দোলনে শরিক হওয়া থেকে শুরু করে সব শাখাতেই সমানভাবে কাজ করেছেন। এর ফলে আপনার সুষ্ঠুভাবে কাজে মনোনিবেশ করার ক্ষেত্রে কোনো বিঘ্ন সৃষ্টি হয়নি?
উত্তরঃ না, তা কখনোই হয়নি। কারণ সাংবাদিকতায় আমি যতটুকু করতে পারতাম ততটুকুই কাঁধে নিতাম। যতটুকু কমিটমেন্ট করেছি তা সম্পূর্ণরূপে পালন করেছি।
প্রশ্নঃ সাধারণভাবে শ্রমিক সংগঠন এবং রাজনৈতিক দলের মধ্যে চরিত্রের কিছুটা ভিন্নতা আছে। আমাদের দেশের শ্রমিক সংগঠনগুলো মূলত ‘বার্গেনিং এজেন্ট’ হিসেবে কাজ করে। কিন্তু আপনার ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, আপনি শ্রমিক নেতা এবং একই সঙ্গে রাজনৈতিক দলের নেতা। তাই প্রশ্ন এসে যায়, আপনি রাজনৈতিক নেতা না শ্রমিক নেতা হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতে চান?
উত্তরঃ শ্রমিক শ্রেণীর যে শোষণমুক্তির রাজনীতি আমি সেটাকে সঠিক মনে করি এবং রাজনীতির ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে ট্রেড ইউনিয়ন ও রাজনীতি একইসঙ্গে করেছে এবং করছি। এদুটো পরস্পরের পরিপূরক। ট্রেড ইউনিয়ন নিছক অর্থনৈতিক দাবি-দাওয়ার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠতে পারে না। আবার রাজনীতির যদি সমাজ পরিবর্তনের না হয়, তাহলে সেটা নেহায়েত ব্যক্তিস্বার্থের রাজনীতি হয়ে দাঁড়ায়। আমি অসুস্থ বা সমাজবিরোধী ট্রেড ইউনিয়ন রাজনীতির বিরোধী।
প্রশ্নঃ আপনি ভাসানী ন্যাপের কাউন্সিলর ছিলেন কোন সময় পর্যন্ত এবং কেন ন্যাপের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সংশ্লিষ্ট হননি?
উত্তরঃ আমি ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত ন্যাপের কাউন্সিলর ছিলাম। আমার নেবে সংশ্লিষ্ট না হওয়ার কারণ ছিল যে, আমি মূলত শ্রমিক সংগঠন করতাম এবং সেদিকেই আমার সময় চলে যেত। আমি শ্রমিকশ্রেণীর রাজনীতির প্রতি বেশি গুরুত্ব দিতাম। তাই ম্যাপের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সংশ্লিষ্ট হইনি।
প্রশ্নঃ ১৯৮৩ সালে মোঃ হাজী দানেশ এর নেতৃত্বে জাগমুই গঠন করেছিলেন এবং ১৯৮১ সালে এসে জাগমুইসহ আরো কয়েকটি দল নিয়ে গণতান্ত্রিক পার্টি গঠন করতে গেলেন কেন?
উত্তরঃ আমাদের দেশের বিদেশি শোষণ আধিপত্য, বিদেশি স্বার্থের সেবক, দালাল, পুঁজিপতি শ্রেণী আর জোরদার মহাজন’ শ্রেণীর স্বার্থে আমাদের দেশের যে রাজনীতি রাষ্ট্রনীতি এক কথায় সরকার ও সমাজ পরিচালিত হচ্ছে তার থেকে মুক্তি পাওয়া এবং বিদেশি শোষণ, আধিপত্য মুক্ত হয়ে একটি গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দেশে কৃষক-শ্রমিক, মেহনতি মানুষ, বুদ্ধিজীবী, মধ্যবিত্ত্য ও জাতীয় পুঁজিপতিসহ সকল দেশ প্রেমিক গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্য আনয়নের জন্যই জাগমুই গঠন করা হয়েছিল। পরবর্তীতে ঐক্যে পরিধি আরো বৃদ্ধি পায়। তাই একই রাজনীতি ও একই উদ্দেশ্য অবলম্বন করে অধিকতর ঐক্য অর্জন করার জন্য জাগমুই ও ন্যাপসহ গণতান্ত্রিক পার্টি গঠন করা হয়। আমি দৃঢ় মত পোষণ করি যে, সকল দেশ প্রেমিক গণতান্ত্রিক শক্তি সমন্বয়ে একটি ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক পার্টি ছাড়া আমাদের দেশের রাজনৈতিক, আর্থসামাজিক সমস্যা দূর করা সম্ভব নয়।
প্রশ্নঃ আপনি বলেছেন, অধিকতর ঐক্য অর্জনের জন্য গণতান্ত্রিক পার্টি গঠন করা হয়। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে গণতান্ত্রিক পার্টিই ঐক্যবদ্ধ না থেকে বরং ভেঙ্গে গিয়ে কমিউনিস্ট লীগ গঠিত হয়েছে। এর কারণ কি?
উত্তরঃ এর প্রধান কারণ হচ্ছে, গণতান্ত্রিক পার্টি প্রতিষ্ঠা লগ্নে ও পরবর্তীতে নেতৃত্তের ব্যর্থতা। দ্বিতীয়তঃ বিভিন্ন স্রোতধারা থেকে যেসব দেশ প্রেমিক গণতান্ত্রিক শক্তি একটা সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক দর্শন ও কর্মসূচি স্থিরীকৃত করে তাদের কেউ কেউ সেই অবস্থান থেকে দূরে সরে দাঁড়ান অথবা সেই স্থিরীকৃত রাজনীতি ও অর্থনীতি সম্পর্কে অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টি করেন। ফলে গণতান্ত্রিক পার্টি ভেঙে যায়।
উপসংহার
বাংলাদেশের মানুষ ঐতিহ্যগতভাবে অত্যন্ত সহিষ্ণু এবং কিছুটা নিয়তিবাদীও বটে। যে জন্য নেতাদের ঘড়ি ঘড়ি দলবদল বা নীতি বদলে তারা খুব একটা বিচলিত হয় না। ধরে নেয় বুঝি এমনই হওয়ার কথা ছিল। তবে দলবদল বা নীতি বদলের ক্ষেত্রে নেতিবাচক দিকটা যখন প্রধান হয় তখন স্বাভাবিক নিয়মেই নেতারা জনপ্রিয়তা হারান।
দল ও নীতি বদলের প্রবণতা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের রাজনীতিতেও আছে। তবে বাংলাদেশের মতো এতোটা মহামারী আকারে বোধ হয় আর কোথাও এর প্রাদুর্ভাব ঘটেনি। কারণ বিশেষ এক ধরনের মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে আগত নেতৃত্তের সীমাবদ্ধতা ও অদূরদর্শিতা। একজন সচেতন রাজনৈতিক নেতা তো শুধু অতীত ও বর্তমানের বিশ্লেষক নন তিনি ভবিষ্যতের সম্ভাবনা ও অনিবার্যতাও সমান ভাবে উপলব্ধি করতে পারেন। আর এই উপলব্ধির থাকলে দল বা নীতি বদল এর প্রয়োজন হয় না।
পাদটীকা
বিচিত্রার কার্টুন শিল্পী রনবীর রাজনৈতিক নেতাদের কার্টুন আঁকতে আঁকতে মন্তব্য করলেন,’দলবদল না বলে কোল বদলের রাজনীতি বললে ভাল হত’। আসলে যতবারই একজন নেতা দল বদলান না কেন, মানুষটি কিন্তু একই থেকে যান। এমনকি অনেক সময় নীতির বদল হলেও ভেতরের মানুষটির বদল হয় না। এ দিক থেকে বিবেচনা করলে রনবীর মন্তব্য লঘূ হলেও তাৎপর্যপূর্ণ।
[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/05/1984.11.02-bichitra.pdf” title=”1984.11.02 bichitra”]