You dont have javascript enabled! Please enable it!

পঞ্চাশের দশকে আমরা | সৈয়দ মকসুদ আলী
সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৪

সাপ্তাহিক বিচিত্রার একুশে ফেব্রুয়ারী ১৯৮৪ সংখ্যায় প্রকাশিত এম, আর, আখতার (মুকুল)-এর নিবন্ধটি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এ নিবন্ধে ১৯৪৯—৫০-এর সলিমুল্লাহ হলের ছাত্র সংসদের নির্বাচন বিষয়ে তিনি যেসব তথ্য উল্লেখ করেছেন তা সম্পূর্ণ নির্ভুল নয়। প্রায় ৩৪ বছর আগের কথা লিখতে গেলে এরকম ভুল হওয়া বিচিত্র নয়।
একথা সত্য যে তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা মুস্তাফা নূর-উল-ইসলাম আমার বিপক্ষে হলের ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তিনি তাঁর নিবন্ধে বলেছেন যে আমাদের দলের চীফ হুইপ ছিলেন সাংবাদিক এস, এম, আলী এবং তাঁদের দলের চীফ হুইপ ছিলেন অলি আহাদ, যিনি বর্তমানে একজন প্রথমসারির রাজনৈতিক নেতা এবং রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগ্রামী ব্যক্তিত্ব। আসল ব্যাপার তা ছিল না। প্রকৃতপক্ষে অলি আহাদ আমাদের দলের চীফ হুইপ ছিলেন এবং এস, এম, আলী ছিলেন আমাদের দলীয় কর্মী। প্রয়োজন হলে একথার প্রমাণও দেয়া যাবে। মুকুল তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার নিকট থেকেও বিষয়টি যাচাই করে নিতে পারেন। এমনকি অলি আহাদ সাহেবেরও সাক্ষ্য নেয়া যেতে পারে এ ব্যাপারে।
আমাদের বিপক্ষে দলে অর্থাৎ মুস্তাফা নূর-উল-ইসলামের পক্ষে সকল প্রগতিশীল ছাত্র সমর্থন দিয়েছিলেন বলে নিবন্ধকার উল্লেখ করেছেন। এ উক্তির যথার্থতা প্রমাণের অপেক্ষা রাখে। একথা আমাদের কালের সলিমুল্লাহ হলের ছাত্ররা সবাই স্বীকার করবেন যে আমাদের কাল পর্যন্ত সলিমুল্লাহ হলের নির্বাচনে দলীয় জোট গঠিত হতো প্রধানতঃ জেলার ভিত্তিতে। এবং প্রগতিশীল ছাত্ররা বিশেষ একটি নির্বাচনী দলের সঙ্গে সংযুক্ত না থেকে বরং প্রতিদ্বন্দ্বী সকল নির্বাচনী দলেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতেন। যতদূর মনে পড়ে আমাদের দলে এরূপ প্রগতিশীল ছাত্রের সংখ্যা প্রতিপক্ষের চেয়ে কোন অংশে কম ছিল না। আমাদের দলের এমনও নির্বাচনী প্রার্থী ছিলেন যিনি প্রগতিশীল আদর্শের কারণে সরকারের কোপদৃষ্টিতে পড়েন এবং কারারুদ্ধ হন। তাছাড়া, তখনকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে আমরা যে অবদান রেখেছিলাম তার প্রগতিশীল চরিত্র সম্পর্কেও কখনো প্রশ্ন ওঠেনি। এমনকি তৎকালীন বহু পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত আমার কবিতা, গল্প ও নাট প্রগতিবাদিতার স্বাক্ষর বহন করতো। (একটু আত্মপ্রচার হলো সেজন্য দুঃখিত।) আমাদের দলীয় প্রচারপত্রের একটি উদ্বৃতি থেকেও আমাদের প্রগতিশীল চরিত্রটি ধরা পড়বে : ‘সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ১৮ই মার্চের (১৯৫০) দলীয় সভায় আমাদের মনোনীত সহ-সভাপতি সৈয়দ মকসুদ আলী যা বলেছিলেন সংস্কৃতিপ্রিয় প্রগতিবাদী ছাত্রবৃন্দ বোধহয় তা ভুলে যান : সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণ বলতে আমরা গণসাহিত্যের নবপ্রকাশ বুঝাতে চাই। কৃষক, শ্রমিক ও মধ্যবিত্তকে ঘিরে দেশে দেশে যে সাংস্কৃতিক অভিযান শুরু হয়েছৈ তারই ক্রান্তদশী প্রত্যাশা প্রকাশ পাচ্ছে আমাদের সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণের আওয়াজে। এই পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্ট হবে নতুন রাজনৈতিক চেতনা। আর এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োগেই আমরা গড়ে তুলবো নতুন পৃথিবী।’ (সংরক্ষিত প্রচারপত্র)
এম, আর, আখতার (মুকুল) মুস্তাফা নুর-উল-ইসলামের বিজয়কে সলিমুল্লাহ হলের নির্বাচনে প্রগতিশীলদের প্রথম বিজয় বলে উল্লেখ করেছেন। আত্মপ্রচার সবসময় দৃষ্টিকটু। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার প্রতি কনিষ্ঠের দুর্বলতা থাকা স্বাভাবিক, তাই বলে তাঁদের বিজয়কে সলিমুল্লাহ হলের নির্বাচনে প্রগতিশীলদের প্রথম বিজয় বলা ন্যায়সঙ্গত কিনা সেটা প্রশ্ন সাপেক্ষ। মুস্তাফা নূর-উল-ইসলাম আমার অন্যতম ঘনিষ্ঠ বন্ধু, এবং তিনি নিঃসন্দেহে প্রগতিশীলও বটে। তিনি নিশ্চয়ই নির্দ্বিধায় স্বীকার করবেন যে সে বছর (১৯৪৭-৪৮) সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাঁর মন্ত্রীসভা হলের জয়যাত্রা শুরু হয়। সৈয়দ নজরুল ইসলাম (মরহুম) ছিলেন আমাদের অন্যতম মহান জাতীয় নেতা এবং স্বাধীনতাযুদ্ধের বীরসৈনিক। ছাত্র জীবনেও তাঁর প্রগতিশীল চিন্তাধারার জন্য তিনি ছাত্র সমাজের অকুন্ঠ শ্রদ্ধা অর্জন করেন।…..
….আমি পরাজিত হই সত্য, তবে আমাদের বিপক্ষের প্রার্থীরা অধিকাংশ প্রার্থীই জয়ী হয়েছিলেন। আমাকে পরাজিত করার জন্য বিপক্ষ দল যে কৌশল অবলম্বন করে তা নিবন্ধকার অবশ্য নিজেই লিখেছেন। বিপক্ষ দল আমাদের ‘মন্ত্রীসভার’ নামে ‘রাষ্ট্রভাষা উর্দু চাই’ ইত্যাদি লিখে একটা প্রচারপত্র ছেড়েছিলেন একথাও নিবন্ধকার স্বীকার করেছেন। তবে এই প্রচারপত্র প্রকাশের ব্যাপারে তিনি অলি আহাদের সহযোগিতা নিশ্চয়ই পাননি, কারণ তিনি ছিলেন আমাদেরই দলের চীফ হুইপ।
স্মরণ করা যেতে পারে যে সে সময় বাংলা ভাষার দাবীতে গোটা বাঙালী ছিল সোচ্চার এবং আমাদের দলের প্রধান শ্লোগান ছিল ‘সকল স্তরে আমরা বাংলা ভাষার ন্যায্য অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করবো।’ সেদিন আমরা ব্যথিত হই এই ভেবে যে একটা হলের নির্বাচনে জয়লাভের জন্য বিপক্ষ দলের কয়েকজন আমাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে লিপ্ত ছিলেন। আমার দৃঢ়বিশ্বাস এসব অপপ্রচার মুস্তাফা নূর-উল-ইসলামের জ্ঞাতসারে হয়নি। আমি নিবন্ধকারের লেখা থেকেই এই প্রথম জানতে পেলাম যে আমাদের পক্ষ থেকে নাকি ‘বিপ্লবী মুস্তাফা নূর-উল-ইসলামের মন্ত্রীসভাকে ভোট দিয়ে হাজং কৃষকদের হত্যার জবাব দিন’ এই কথা সম্বলিত একটি প্রচারপত্র বিলি করা হয়েছিল। এধরনের প্রচারপত্র আমাদের পক্ষ থেকে আদৌ প্রচার করা হয়নি।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে আমাদেরও সক্রিয় ভূমিকা ছিল। এ আন্দোলনের সূত্রপাত হয় ১৯৪৮ সন থেকে। জিন্নাহ সাহেব রমনা রেসকোর্সে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) দাঁড়িয়ে যখন ঘোষণা করেন যে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু তখন আমরাও জনতার কন্ঠে কন্ঠ মিলিয়ে তীব্র প্রতিবাদ জ্ঞাপন করেছিলাম। তারপর কার্জন হলের মঞ্চে তিনি যখন একই কথার পুনরুক্তি করেন তখনও আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিবাদ জ্ঞাপন করি। এরপর থেকে শুরু হয় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন। আবদুল মতিন ছিলেন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের বিশিষ্ট পথিকৃৎ। তিনি এ আন্দোলনের কর্মসূচী সম্পর্কে আমাদের সঙ্গে প্রায়ই আলাপ-আলোচনা করতেন। তাঁর অনুপ্রেরণায় এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে আমরা প্রথম পর্যায়ে শোভাযাত্রা ও সচিবালয়ের সম্মুখে পিকেটিং-এ অংশগ্রহণ করি। পুলিশের লাঠিচার্জে আমাদের অনেকে একাধিকার আহত হয়েছেন। এই আন্দোলন চরম সাফল্যের দিকে এগিয়ে যায় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রজীবন শেষ হবার দু’বছর পর। যারা এ আন্দোলনে নেতৃত্বদান করেন তাদের অনেকেই ছিলেন আমার সহপাঠী বা অনুজ প্রতিম বন্ধু। এদের মধ্যে বিশেষ করে যাদের কথা মনে পড়ছে তারা হলেন আবদুল মতিন, অলি আহাদ, আমানুজ্জামান খান (বেবী), নূরুল ইসলাম (সাংবাদিক), নাজিমউল্লাহ (এডভোকেট), গাজীউল হক, আবদুর রহিম (প্রাক্তন আইজিপি), খালেক নেওয়াজ খান এবং সৈয়দ কমরুদ্দিন হোসেন (শহুদ)।
নিবন্ধকার এক জায়গায় লিখেছেন যে নির্বাচনের পূর্বে তাদের সঙ্গে নাকি এই মর্মে একথা অলিখিত চুক্তি হয়েছিল যে সে আমীনের দালাল বলবে না। এরকম কোন চুক্তি কখনো হয়নি, কারণ যেসব কথা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন তা নিয়ে কিভাবে চুক্তি হতে পারে সেটা আমার বোধগম্য নয়। বন্ধুবর মুস্তাফা নূর-উল-ইসলাম কম্যুনিস্ট ছিলেন না সেটা আমরা ভালোভাবেই জানতাম। এবং অপরদিকে, তখনকার রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে নূরুল আমীনও এমন কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব ছিলেন না যে জন্যে সলিমুল্লাহ হলের কোন ছাত্র তার দালালী করবে। এখানে মনে রাখা দরকার যে সলিমুল্লাহ হলের এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৫০-এর ২১শে মার্চ-এ, এবং নূরুল আমীনের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার প্রচন্ড বিক্ষোভ শুরু হয় ৫২-র ভাষা আন্দোলনের দিনগুলিতে, অর্থাৎ হল ইলেকশনের প্রায় দু’বছর পর। সময়ের এই ব্যবধানের কথা চিন্তা করলেও নিবন্ধকারের উক্তির অসারতা প্রমাণিত হবে।
এম, আর, আখতার (মুকুল) আমাদের সকলের শ্রদ্ধার পাত্র, কারণ তাঁকে আমরা মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সৈনিক হিসাবেই জানি। অপরদিকে তিনি আমার অনুজ প্রতিম; এ কারণে তাঁকে বলতে চাই যে পুরনো ঘটনা ইতিহাসের পাতায় সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ করা না হলে সে ইতিহাসের কোন মূল্য থাকে না।
সৈয়দ মকসুদ আলী
চেয়ারম্যান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
০০০

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!