You dont have javascript enabled! Please enable it!

পঞ্চাশের দশকে আমরা | সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৪

৫০ দশকে আমি স্কুল ছেড়েছি, কলেজ ছেড়েছি, বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়েছি। কিন্তু যাচ্ছি আমি কোন দিকে? যাচ্ছি আমরা কোন দিকে? না, সেটা ঠিক জানা ছিল না।
তবে আমি মিছিলে গিয়েছিলাম। ৫২-র ৪ঠা ফেব্রুয়ারী ছাত্র ধর্মঘট, তারপর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মিছিল। তখনও আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নই, ছাত্র আমি কলেজের, সেও এক অপরিচিত, ছোট্ট কলেজের, সেন্ট গ্রেগরিজ কলেজের, যে কলেজ তখনো নটরডেম কলেজ হয়নি, যার আমরা দ্বিতীয় ব্যাচের ছাত্র। সে কলেজ তখন পুরনো ঢাকায় লক্ষ্মীবাজারের এক গলিতে, তার ছাত্রসংখ্যা তখন ৫০ জনের বেশি হবার কথা নয় কোন হিসাবেই। কিন্তু আমি কলেজ থেকে আসিনি সেই মিছিলে। কলেজে কোনই আন্দোলন নেই, আমি এসেছি আজিমপুর থেকে, আজিমপুরে তখন কলোনী হয়েছে, পাঁচশ’ সরকারী কর্মচারী থাকে সপরিবারে, সেখান থেকে এসেছি আমি। আমি একাই। সভা হলো, সভা শেষে মিছিল হলো। সেই মিছিলে দেখি আমিও আছি। পরিচিত নবাবপুর, জেলখানার পাশের আবুল হাসনাত রোড, সব সেদিন, সেই মিছিলে চলতে চলতে, কেমন নতুন, প্রাণবন্ত মনে হয়েছিল আমার। কাউকে চিনি না, অথচ অপরিচিত মনে হচ্ছে না কাউকে।
সেই আমার প্রথম মিছিলে যাওয়া। কিন্তু মিছিল তো তখন প্রায়ই হচ্ছে। আরমানিটোলায় জনসভা হয় বিরোধী দলের, সভা শেষে শোভাযাত্রা। জনসভায় মওলানা ভাসানী বক্তৃতা করেন। ৫০-এর দশক ভাসানীরই দশক আসলে। শেখ মুজিব আছেন, শেখ মুজিব বক্তৃতা করেন, মিছিলের সামনে থাকেন, বোঝা যায় আগামী দিনগুলোতে তিনি আরো বড় ভূমিকা পালন করবেন। শামসুল হক আছেন, টাঙ্গাইল উপ-নির্বাচনে জিতেছিলেন তিনি, জিতে এমন ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন মুসলিম লীগকে যে তারা আর সাহস পায়নি দ্বিতীয় কোন উপনির্বাচন দিতে। শামসুল হকও তীব্র ছিলেন, দরাজ ছিল তাঁর গলা। কিন্তু পরের বছরগুলোতে দেখেছি তিনি কেমন যেন স্তিমিত হয়ে আসছেন।
সেই মিছিলে আমরা ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ বলে খুব জোরে আওয়াজ করেছি। তারই মধ্যে অতি উৎসাহী কেউ কেউ ঐ শ্লোগানের সঙ্গে ছন্দ মিলিয়ে তারই প্রবলতার ভেতর থেকে শ্লোগান দিয়েছে ‘বাংলাভাষা রাষ্ট্র চাই।’ আমি দেখেছি অলি আহাদকে, তিনি ছুটে এসেছেন, এসে থামিয়েছেন সেই ধ্বনি। কিন্তু ধ্বনিটা উঠেছিল, সেই ধ্বনি পরে ষাটের দশকে প্রবল হয়েছে। ৭০ দশকে সত্যি সত্যি বাংলা ভাষার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয়েছে।
একুশে ফেব্রুয়ারীতে আমরা মিছিল করে যাইনি। সলিমুল্লাহ হলের সামনে দিয়ে বেরিয়েছি, কিন্তু পরিষদ ভবনের সামনে দিয়ে যেতে পারিনি। পরিষদ ভবন মানে তো জগন্নাথ হলের মিলনায়তন, সবকিছুই কাছে কাছে তখন, পরিষদ ভবন পার হয়ে মেডিকেল কলেজ, তারপর কলাভবন। দূরে নয় কোনটাই, তখনও মেরুকরণ হয়নি, ঢাকা তখন অবিভক্ত শহর, তার নতুন ও পুরাতন নেই, সবটাই পুরাতন, ‘ধনবৈষম্যও নেই তখন আজকের মতো দৃষ্টিগ্রাহ্য রূপে। ১৪৪ ধারা ছিল, আমরা ঘুরে গিয়ে পৌঁছেছি কলাভবনের সামনে। আমরা দু’তিনজন, আজিমপুরের বন্ধুরা। খেয়ে-দেয়ে বেরিয়েছি আমরা সারাদিনের জন্য, তখন তাই নিয়ম ছিল দশটা-পাঁচটার সময়সূচী ছিল, খেয়ে দেয়ে বের হতো সবাই দিনমানের জন্য। আমরা ভেতরে যেতে পারছি না। আমরা বাইরে দাঁড়িয়ে দেখছি দলে দলে ছাত্ররা বের হচ্ছে আর পুলিশ তাদেরকে ধরে ধরে তুলছে গাড়িতে। একসময়ে দেখি ধাওয়া করেছে পুলিশ। ভেতরে ঢুকেছে। টিয়ার গ্যাস ছুঁড়ছে। আমরা দাঁড়িয়েছিলাম খেলার মাঠের কাছে। সেখানেও দাঁড়ানো যাচ্ছে না। আমরা ঘোরাঘুরি করছি। কিছু একটা ভয়ঙ্কর হচ্ছে বুঝতে পারছি। কিন্তু গুলি হবে এ আমরা কল্পনাও করতে পারিনি। না, গুলির কোন অভিজ্ঞতা তো ছিল না ঢাকাবাসীর। সেই প্রথম প্রকাশ্যে, আইন পরিষদের সামনে, মেডিকেল কলেজের প্রায় ভেতরেই গুলি হয়ে গেল।
তখন দেখি দ্রুত বদলে গেছে দৃশ্যপট। আতঙ্ক প্রথমে। পরে দেখি ছুটছে লোকে মেডিকেল কলেজের দিকে। হাজার হাজার মানুষ। তখন ঢাকায় এতো লোক ছিল না আজ যেমন আছে। কিন্তু এতো লোক এলো কোত্থেকে? আমরাও গেছি পেছনে পেছনে। পুরনো ঢাকার স্থানীয় লোকেরা যে রাষ্ট্রভাষার দাবীর প্রতি এর আগে পুরোপুরি সমর্থন করতো তা নয়। তারা অনেকেই ভাবতো তাদের ভাষা আলাদা, তারা উর্দু বলতো এবং তাই নিয়ে অভিমান ছিল ভেতরে ভেতরে। কিন্তু আমরা দেখলাম বদলে গেছে মানুষ। স্থানীয় লোকেরা বলছে একথা যে, এমন তো হবার কথা নয়। বলছে এমনও কথা যে, ইংরেজরা গুলি করতো পায়ের দিকে, এরা গুলি করেছে মাথা লক্ষ্য করে।
সারা শহর জেগে উঠেছে। আমরা ফিরে এসেছি আজিমপুরে। আমরা কি করবো ভেবে পাচ্ছি না। ভেতরে ক্রোধ জ্বলছে। সন্ধ্যায় আমরা গিয়েছি ‘আজাদ’ পত্রিকার অফিসে, আজাদ অফিস আমাদের কলোনীর পাশেই। আমরা সম্পাদকদের ঘরে গিয়ে হাজির হয়েছি। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি ছবিটা। আমরা বলছি খবর যেন ঠিকমতো ছাপা হয়। যেন গোপন না করা হয় সত্যকে। ঢাকেশ্বরী মন্দিরের কাছে রোজ সকালে খবরের কাগজ বিলি হয় হকারদের মধ্যে। দেখি সম্পূর্ণ উল্টো খবর ছেপেছে ‘মর্নিং নিউজ’ ও ‘সংবাদ’—সরকারী প্রেস নোটকেই খবর হিসাবে ছাপিয়ে দিয়েছে বড় বড় হেডিং দিয়ে। ঠিক কি মনে নেই, আমাদের মধ্যেই একজন এগিয়ে গিয়ে ‘মর্নিং নিউজের’ গাদাটা তুলে নিল, আরেকজন নিলো ‘সংবাদের’ গাদা, তারপর অতিদ্রুত কোথা থেকে দেশলাই এলো জানি না। দেখছি কাগজগুলো পুড়ছে। সেও নতুন অভিজ্ঞতা আমাদের জন্য, আগুন জ্বালানো। তবু মনে হলো কিছু একটা করেছি আমরা রাষ্ট্রভাষার জন্য। তারপর পিকেটিং করেছি পাড়ার সামনে, কেউ যেন অফিসে না যান। সেদিন করেছি, পরের দিন করেছি। স্বতঃস্ফূর্ত ঘটনা সব। আমরা ছোটাছুটি করি, গায়েবী জানাজায় যাই, মিছিল করি, যা করতে হবে শুনি তাই করি।
সেই একটা স্রোত, একটি নতুন স্রোত, পাকিস্তানী পরিচয়কে ছাপিয়ে উঠতে চাইছে বাঙালী পরিচয়, ‘বাংলা ভাষা রাষ্ট্র চাই’ শ্লোগানটা কেমন যেন অস্পষ্ট জাগছে আমাদের ভেতরে, আমাদের অজান্তেই, সব নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও, নিষেধাজ্ঞার ভেতরেও। রাজনীতি এসে গেছে আমাদের জীবনে। প্রত্যক্ষ রাজনীতি। শহীদ মিনার তৈরি হয়েছে রাতারাতি, সেখানে যাচ্ছে সবাই, মেয়েরাও যোগ দিচ্ছে, কে একজন মহিলা গলার হার খুলে রেখে দিয়েছেন সেই হাতে-গড়া শহীদ মিনারের কাছে। তারপর প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারী উদযাপন করছি আমরা, আমরা প্রভাতফেরীতে অংশ নিচ্ছি, আমরা খালি পায়ে হাঁটছি। এসব অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ নতুন আমাদের জন্য। রাজনীতি ও সংস্কৃতি মিশে যাচ্ছে। কত প্রচন্ড হয়ে উঠছে মানুষের বিক্ষোভ শাসকরা তা বুঝতে পারছে না। বুঝেছে বোধকরি শেষ ১৯৫৪-র নির্বাচনে, যখন একেবারে ভরাডুবি হয়েছে তাদের।
কিন্তু এটাই একমাত্র স্রোত ছিল না আমাদের জীবনে। আরো একটা স্রোত ছিল, বরঞ্চ সেটাই ছিল স্বাভাবিক ও শক্তিশালী। সে আমাদের নিম্ন-মধ্যবিত্ত জীবনের স্রোত, যে স্রোত আমাদেরকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে : বলছে পরীক্ষায় ভালো করো, ভালো চাকরি-বাকরি পাবে, সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দাও, একটা না একটা চাকরি জুটে যাবে তোমার। সেটা বিকল্প স্রোত নয়, মূল স্রোত। কোনদিকে যাচ্ছি জানি না। কিন্তু সেটাই স্রোত ঠেলছে আমাকে, ঠেলছে আমাদের প্রত্যেককে। তারই মুখে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হয়ে গেলাম ঐ ৫২-তেই, শেষের দিকে।
কলেজে বড় মনমরা ছিলাম, ছোট কলেজ বলে। সে কলেজের একটা আকর্ষণ ছিলেন অমিত কুমার গুহ। তিনি খন্ডকালীন শিক্ষক ছিলেন, কিন্তু পড়াতেন এতো ভালো যেন মনে হতো বেশি কেন ক্লাস থাকে না তাঁর। মাইকেলে কবিতা প্রথম দিনের ক্লাসেই আবৃত্তি করে শুনিয়েছিলেন, শুনে চমকে উঠেছিলাম, অমিত্রাক্ষর কি বস্তু সে তো আমরা আগে জানতাম না। কলেজের নাটক হয়েছিল, সেখানেও তিনি ছিলেন। কিন্তু নাটকটি ছিল ইংরেজী, শেক্সপীয়রের ‘দি টেমপেস্ট’; একেবারে মূল ইংরেজীতে। ইংরেজ চলে গেছে, কিন্তু ইংরেজী বড়ই প্রবলভাবে ছিল আমাদের জীবনে। এক বাংলা ছাড়া সবকিছুই তো আমরা ইংরেজীতে পড়তাম সেকালে। আমরা ইংরেজী খবরের কাগজ পড়তাম বাসায়, ‘পাকিস্তান অবজারভার’ ছিল আমাদের অবশ্য পাঠ্য, কলকাতার ‘স্টেটসম্যান’ পড়তাম পাওয়া মাত্রই। সেই ইংরেজী নাট্যাভিনয়ের প্রাণকেন্দ্র অবশ্যি ছিল অন্য একজন শিক্ষক, ফাদার মার্টিন, যিনি আমাদের ইংরেজী সাহিত্য পড়াতেন। অসম্ভবকে সম্ভব করলেন ফাদার মার্টিন, জন পঞ্চাশেক ছাত্রের কলেজে পুরো নাটকটি করালেন, এক রাত নয়, দু’রাত পর পর। আমরা অনেকেই অভিনয় করলাম, ডঃ কামাল হোসেন (আমাদের পরের ব্যাচের ছাত্র) ও গিয়াসউদ্দিন আহমদ (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষক, আল-বদরের হাতে শহীদ) ও আমি সেজেগুজে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে অনর্গল বলে গেলাম সেই আশ্চর্য সুন্দর স্বীকার করে লাভ নেই, ৫০ দশকে ঐটে একটা লক্ষ্য ছিল আমাদের জীবনের, অনর্গল ইংরেজী বলতে পারা। সেই ফাদার মার্টিন, তাঁর প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা ছিল আমার, তিনিই বড় একটা ধাক্কা দিয়েছিলেন আমাকে।–মনে পড়ে সেই দৃশ্য। একুশে ফেব্রুয়ারীর পরে একদিন কলেজে গেছি। তাঁর সঙ্গে কথা হচ্ছে আমার। অজিত গুহ জেলে চলে গেছেন। সে নিয়ে দুঃখ করছি আমি, কিন্তু তিনি দেখছি সাড়া দিচ্ছেন না তেমন, এবং যা বলছেন আমতা আমতা করে তার অর্থ দাঁড়ায় অজিত গুহ কম্যুনিস্ট ছিলেন, আর কম্যুনিস্টদের তো সরকার ধরবেই। আমি তাঁকে বলতে পারিনি যে আমিও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সমর্থক, আমরা সকলেই তার সমর্থক। কিন্তু আমি বুঝেছি আমরা দু’জন বিভাজনের একটি নদীর দুই বিপরীত পাড়ে দাঁড়িয়ে আছি। আমি বুঝলাম এই নদীর ওপারে কোন সেতু তৈরি সম্ভব নয়। সেজন্যেই আইএ পাস করার পর ফাদার মার্টিন যখন বললেন, ঐ কলেজেই বিএ পড়ো, আমি তখন প্রায় দৌড়ে পালিয়ে এলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি কি পড়বো তা জানতাম না। কিন্তু আমার আব্বা জানতেন। তিনি জানতেন অর্থনীতি পড়বো আমি, সেটাই তখন সবচেয়ে দামী বিষয়। তাছাড়া তিনি জানতেন, আমি সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দেবো। আমার মা’ও তাই জানতেন। আত্মীয়-স্বজন সবাই জানতো। গোটা পরিবেশ জানতো। আমরা সবাই তখন ভেতরে ভেতরে আমলা। সরকারী চাকরির বাইরে কি আছে, কি থাকতে পারে আমাদের জানা ছিল না। পিতা জানতেন না, ছেলেরাও জানতো না। আমাদের বন্ধুদের ভেতর কেউ বড় ডাক্তার হয়েছে, কেউ বড় ইঞ্জিনিয়ার, কিন্তু সকলেই আমলা আসলে—ভেতরে ভেতরে। আমার স্কুলের বন্ধু লুৎফর রহমান খান, যার সঙ্গে ময়মনসিংহে অল্প ক’দিনের পরিচয়ে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব হয়েছিল, যে এই সেদিন মারা গেল ক্যান্সারে যার সঙ্গে একই বছর এমএ পাস করলাম আমরা। ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে, আমি ইংরেজীতে। তারপর একই সময়ে শিক্ষকতা শুরু করলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে, সেও জানতো কোথায় যেতে হবে। সে অনেক, অনেক কিছু জানতো, আর জানতো যে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দিতে হবে তাকে। দিলো, এবং উপরের দিকে জায়গা পেলো। আমি শুধু এটুকু জানতাম যে ঐ পরীক্ষা আমার দেয়া হবে না। কেন জানতাম তা স্পষ্ট জানি না। একটা কারণ বোধহয় ঢাকা ছেড়ে চলে যাবার ভয়। ঢাকা আমার ভীষণ ভালো লাগতো। এখনো লাগে। এবং নিতান্ত বাধ্য হয়ে যে ক’বছর বিদেশে কাটাতে হয়েছে আমাকে সে ক’বছর খারাপই লেগেছে আমার, দূরে থাকতে হয়েছে বলে।
সে যাই হোক, আমি বাংলা পড়বো, আমার পিতা আমাকে অর্থনীতি পড়াবেন, এর মধ্যে সমঝোতামূলক ব্যবস্থা হিসাবে ইংরেজীতে ভর্তি হলাম আমি, তবুও সান্ত্বনা সাহিত্য তো পড়া হলো। আমরা ৫২-র পরের ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের, তার প্রভাব পড়েছে আমাদের ওপর, যার জন্য প্রবল হয়েছে ঐ সাহিত্যপ্রীতি। কিন্তু রাজনীতিও টানে আমাকে। আমি সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে থাকি না, বাসায় থাকি, সেখানে পাড়ায় আমরা ছাত্রসংঘ করেছি। আমরা জন্মদিবস পালন করি বিভিন্ন কবি’র। সেখানে দেখি রাজনীতি আসছে। আমরা সুকান্তের জন্মদিবস পালন করতে চাই। আমরা ছায়ানাটক করি। আমরা পাঠাগার গড়েছি, তাতে পশ্চিমবঙ্গের বই পেলে যত্ন করে রাখি। বিশেষ করে রাজনীতির বই। কিন্তু সে-সব বই পাওয়া যায় না। তখন আমার খুব পছন্দ নাজিম হিকমতের কবিতা, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস। আমরা অচ্যু গোস্বামী ও নরহরি কবিরাজের লেখা পেলে ভীষণ উৎসাহী হয়ে উঠি। ‘পরিচয়’ ও ‘নতুন সাহিত্যের’ প্রতিটি লেখা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ি। বিষ্ণুদে’র কবিতা ক্রমশঃ সহজবোধ্য হচ্ছে দেখে আমরা আশ্বস্ত বোধকরি, জীবনানন্দ দাশের কবিতা আবৃত্তি করি, সুধীনন্দ্রনাথ দত্তের গদ্যের বই হাতে রাখি আর প্রায় পাগল হয়ে যাই বুদ্ধদেব বসুর বই পেলে। আর আমার বন্ধু আফলাতুনকে রাগিয়ে দিয়ে ভীষণ আগ্রহে পড়ি আমি শিবরামের লেখা।
ঢাকায় তখন পত্র-পত্রিকার নামগুলোই বলে দিচ্ছে সাংস্কৃতিক চেতনার বিদ্যমান স্তরটা কি। দৈনিক পত্রিকা তখন ‘আজাদ’, ‘ইনসাফ, ‘মিল্লাত’। বিরোধী দলের পত্রিকার নাম ‘ইত্তেফাক’। প্রধান তিনটি মাসিক পত্রিকার নাম ‘মাহেনও’, ‘মোহাম্মদী’ ও ‘দিলরুবা’। পরে দৈনিক ‘ইত্তেহাদ’ বের হয়েছে। ‘সংবাদ’ যখন বের হলো তখন তা বিশেষ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করলো তার নামের জন্য। ‘সমকাল’ বের হলে আমরা আশ্বস্ত হলাম খাঁটি বাঙালী একটি পত্রিকা পাওয়া গেল দেখে। আমরা তখন ইংরেজী বইয়ের দারুণ ভক্ত। কিন্তু সে বই আসে না তেমন। রেল লাইন পার হয়ে সেই আরমানিটোলায় অবিশ্বাস্য রকম ছোট একটি ঘরে ছিল ‘ওয়ার্সী বুক সেন্টার’ আমরা সেখানে গিয়ে হানা দিই বিদেশী বইয়ের খোঁজে। টি, এস, এলিয়টের ‘সিলেকটেড এসেজ’ এলো যখন আমরা যে কি হুড়োহুড়ি করে কিনলাম সে দৃশ্য আজো দেখতে পাই সামনে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসে টার্নার সাহেব আমাদেরকে মিল্টনের মহৎ জীবনদৃষ্টি বোঝান; কারো কাছে আমরা ইংরেজী শব্দের অর্থ শিখি, কারো কাছে উচ্চারণ। মনে পড়ে ডঃ সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন একদিন বলেছিলেন প্রাচীন এ্যাথেন্স ও স্পার্টার মধ্যে যে ব্যবধান সেটা এখনো বেঁচে আছে আমেরিকার সাথে রাশিয়ার ব্যবধানের মধ্যে। আমাকে নাড়া দিয়েছিল কথাটা, কেননা এটা ছিল ৫০ দশকের একটি প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক বক্তব্য। আমাদের শিক্ষকরা সত্যি সত্যি বিশ্বাস করতেন রুশ দেশে মানুষ খুব কষ্টে আছে, কেননা সেখানে ব্যক্তি স্বাধীনতা নেই। সৈয়দ আলী আশরাফ এসেছিলেন কেমব্রিজ থেকে ফিরে, মনে আছে তিনি কীটসের ‘ওড টু এ নাইটিঙ্গেল’ পড়িয়েছিলেন সম্পূর্ণ নতুনভাবে, যাকে বলে প্রাকটিক্যাল ক্রিটিসিজম সেই পদ্ধতিতে। আর ছিলেন জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, যিনি এম, এন, রায়ের ওপর আলোচনা সভা করেছিলেন একবার। যিনি একসময়ে ‘মুকতি’ নামে মাসিক পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তিনি রবীন্দ্রনাথের কবিতার সঙ্গে ইংরেজী কবিতাকে পাশাপাশি রেখে পড়াতেন কখনো কখনো।
এটাই মূল স্রোত ছিল আমাদের জীবনে। কিন্তু রাজনীতির স্রোতটা প্রবল হচ্ছিল ক্রমশ। সেটা আমাদেরকে ডাকতো। প্রথম বছরেই সলিমুল্লাহ হলের নির্বাচনের দাঁড়িয়ে গিয়েছিলাম আমি। সেই আমার প্রথম ও শেষ নির্বাচন পদপ্রার্থী হওয়া—ছাত্র জীবনে। আমি বুঝেছি ভোট চাওয়া কি কঠিন কাজ; কিন্তু হল নির্বাচনে ভীষণভাবে লিপ্ত ছিলাম আমরা—সে ছিল আমাদের বার্ষিক উৎসব। সেই প্রথম বছর, ৫২-র পর ৫৩-তে সলিমুল্লাহ হলে ‘গণতান্ত্রিক যুক্তফ্রন্ট’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। এর অনুপ্রেরণাটি এসেছিল সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ থেকে। আমরা দাবী করতাম পরবর্তীকালে লীগ বিরোধী যুক্তফ্রন্টের ধারণার সূতিগাকার ছিল হল নির্বাচনে আমাদের ঐ যুক্তফ্রন্ট। সেই নির্বাচনেই সদস্য পদপ্রার্থী হয়ে আমার দাঁড়ান এবং বলা বাহুল্য লীগবিরোধী স্রোতে অতিসহজেই জয়লাভ। আমাদের ভিপি ছিলেন শামসুল হক, যিনি যুক্তফ্রন্ট থেকে মনোনয়ন পেয়ে পরে এমপি হন। সেই নির্বাচনী কর্মকান্ডের মধ্যে মোহাম্মদ সুলতানকে দেখেছি আমি। ‘গণতান্ত্রিক’ কথাটা তাঁরই সংযোজনা। যুক্তফ্রন্ট হয়েছে ঠিকই, কিন্তু আমি চারপাশে দেখেছি তৎপরতা চলছে উপদলীয়। দলের ভেতর উপদল। এজন্যেই পরে যখন রাজনৈতিক যুক্তফ্রন্ট ভেঙে গেল তার অবিশ্বাস্য নির্বাচন বিজয়ের পর। তখন আমি মোটেই অবাক হইনি। আমার কাছে মনে হয়েছে ছাত্রদের যুক্তফ্রন্টে যা ঘটেছে বড় যুক্তফ্রন্টেও তাই বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।
এরি মধ্যে আমাকে ভীষণভাবে আকর্ষণ করছিল দু’টি প্রতিষ্ঠান। একটি রেডিও, অপরটি পত্রিকা। রেডিওতে প্রথম অনুষ্ঠান করেছি যখন তখন আমি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র, বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমার বন্ধু আমির হোসেন ছিল এক কাঠি ওপরে। রেডিওতে সে খবর পড়তো নিয়মিত। আজিমপুরেই, বাসার কাছে ছিল সাপ্তাহিক ‘সৈনিকের’ অফিস। সেখানে একবার গল্প পাঠিয়েছিলাম অন্যের হাত দিয়ে। সে গল্প ছাপা হয়েছিল। আর ছিল ‘আজাদ’ ও ‘মাহেনও’। আহসান হাবীব ছিলেন ‘আজাদ’ ও ‘মোহাম্মদী’তে তাঁর কাছে আমি গল্প নিয়ে যেতাম দুরু দুরু বক্ষে। যেতাম কবি আবদুল কাদিরের অফিসে, ‘মাহেনও’-এর অন্য গল্প নিয়ে। নাজিমুদ্দিন রোডের রেডিও অফিসের সামনের রেস্টুরেন্টে দরবার বসতো কবি ফররুখ আহমদের; আমরা চা, খেতাম তাঁর চারপাশে বসে, আর শুনতাম নানা বিষয়ে তাঁর বক্তব্য।
তখন মেরুকরণ ঘটেনি আজকের মতো একথা বলেছি। সে কথাটা সত্য ছিল নানা দিক দিয়ে। আমরা সকলেই তখন পাজামা-সার্ট পরি, একবার এক সহপাঠী ভুল করে লুঙ্গি পরে চলে এসেছিল কলাভবনে; পরে অবশ্য সংশোধন করেছে সে তার ভুল, কিন্তু পোশাকে তেমন বৈচিত্র্য ছিল না আমাদের। কলাভবনে গাড়ি ছিল একটাই, প্রক্টর মযহারুল হকের, সেও বিংশ-শতাব্দীর প্রথম দিককার গাড়ি এটি, প্রায় অচল ফোর্ড। বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল অফিসার আসতেন ঘোড়ার গাড়িতে করে। ঘোড়াটি ঘাস খেতো ছাড়া পেয়ে। পুরনো ঢাকায় আমরা বাসে যেতাম, নয়তো পায়ে হেঁটে হেঁটে যেতাম সেখানে। দুপুরে সেখানে থেকে বিকেলে গরুর দুধ ও খাঁটি হাওয়া খেয়ে ফিরতাম বাসায়। লোকজন ছিল কম, গাড়ি-ঘোড়া আরো কম। ঘোড়ার গাড়ি উঠে যায়নি, রিকশা আসেনি এত অধিক সংখ্যায়। গ্রামের সঙ্গে যোগ ছিল ঘনিষ্ঠ; আমরা ছুটিতে গ্রামে যেতাম চলে, গ্রামের আত্মীয়েরা আসতেন যখন তখন। ১২ টাকা মণের চাল ছিল বাজারে। টাকার ছড়াছড়ি ছিল না। মস্ত ধনী হওয়ার কথা প্রায় কেউই ভাবতো না। গন্ডিটা ছোট ছিল আমাদের।
কিন্তু সুযোগ ছিল বেশি। আমাদের সঙ্গের ছেলেরাই তো সবাই বড় বড় জায়গায় গেছে চলে। রেক্স রেস্টুরেন্টে চা খাবার সময়ে (কত কম রেস্টুরেন্ট ছিল তখন ঢাকায়, কত কম ছিল সিনেমা হল) একদিন এক সহকর্মী বলেছিলেন আমাকে যে, সামনের দিনগুলোতে আমাদেরকে প্রস্তুত থাকতে হবে নানা রকম দায়িত্ব নেবার জন্য। সত্যি সত্যি তাই ঘটেছে, তিনি নিজে অবশ্যি একটু বেশি তৎপর ছিলেন যে জন্য আজ দেশে নেই, থাকেন আমেরিকায়। কিন্তু আমরা তো প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হইনি আজকের ছেলেমেয়েরা যেমন হচ্ছে। আমরা ভর্তি হয়েছি সহজে, আমরা বেকার থাকিনি কেউ। মুন্সীগঞ্জের হরগঙ্গা কলেজে আমি চাকরি পেয়েছি এমএ পরীক্ষার ফল প্রকাশের আগেই; সে চাকরিতে আমার আগে ছিলেন এ, এম, এ মুহিত সাবেক অর্থমন্ত্রী, যিনি আমার আগে বছরের ছাত্র। আমার দু’বছর আগের ছাত্র আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ খান সিভিল সার্ভিসে যোগ দিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে আর তাঁর জায়গায় ঢুকে পড়লাম আমি। কোন অসুবিধা নেই, যেন লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছি এবং স্থান আছে বসে। আমার যে পরিচিত ছেলেটি মার্চেন্ট শেভিতে গেছিল চলে, শিপিং কোম্পানীতে এখন সে মস্ত চাকরি করে। আমাদের সহপাঠীরা বড় ব্যারিস্টার হয়েছে, হাইকোর্টের বিচারপতি হয়েছে, মন্ত্রী হয়েছে, এ্যাডভাইজার হয়েছে। সামরিক বাহিনীতে গিয়েছে যারা তারা বড় পদে আছে। মোটামুটি আমরা আমরাই।
তাই কি? না, সর্বাংশে নয়। অনেকে পারেনি। ঐ আজিমপুরেই যারা বোনের কিংবা মামার বাসায় থাকতো তারা অনেকেই হারিয়ে গেছে কে কোথায়। আর যারা মফস্বলে ছিল তারা কোথায় কে খবর রাখে। আর তাছাড়া মেরুকরণ শুরু হয়ে গিয়েছিল। ক্রমশ গ্রাম থেকে সরে আসছিলাম আমরা। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ দেখতাম রাতের বেলা স্যুট পরে বের হচ্ছে, ভবিষ্যতের ড্রেস রিহার্সেল বুঝি-বা। কেউ কেউ বিদেশে যাচ্ছে।
সেকালে আমরা সাংস্কৃতিকভাবে এগুচ্ছিলাম, বৈষয়িকভাবে যত এগিয়েছি তার চেয়ে বেশি এগিয়েছি সাংস্কৃতিকভাবেই। তবে সাংস্কৃতিক চিন্তা স্পষ্টতই বিভক্ত হয়ে যাচ্ছিল। সেখানে অনিবার্য বিভাজন ঘটছিল। পূর্ব বাংলা পূর্ব পাকিস্তান হয়ে গেল একদিন, তার সঙ্গে চললো পাকিস্তানী সংস্কৃতির তৎপরতা। লিপি বদলের ষড়যন্ত্র। বিএনআর-এর কাজকর্ম। আইয়ুব খানের সামরিক শাসন আসার পরে ‘পাকিস্তান লেখক সংঘ’ গঠিত হলো, যার আকর্ষণ দুর্নিবার হয়ে পড়লো অনেকের জন্যই। এর বিপরীতে বাঙালী জাতীয়তাবাদী ধারাও প্রবল হচ্ছিল, প্রকাশ্য হচ্ছিল ক্রমশ।
আরেকটি উল্লেখযোগ্য প্রবণতা আমেরিকার প্রভাব। পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি সম্পাদনের পর থেকে এ প্রভাব দ্রুতগতিতে বাড়ছিল। আমরা দেখছিলাম ইউ, এস, আই, এস নানাভাবে প্রভাবিত করছে বুদ্ধিজীবীদের। মুনীর চৌধুরী জেল থেকে বের হয়ে ইংরেজী পড়ালেন অল্প ক’দিন, তারপর চলে গেলেন বাংলায়। আমার তার প্রথম বক্তৃতাতে মুগ্ধ হয়ে পড়েছিলাম। তিনি বন্ধুর মতো ছিলেন, শিক্ষক হয়েও। পরে যখন শিক্ষক হয়েছি আমি নিজেও তখন শিক্ষকদের কমনরুমে তিনি ছিলেন একটি বড় আকর্ষণ। কিন্তু একসময়ে রকফেলার ফাউন্ডেশন তাঁকে বৃত্তি দিয়ে পাঠিয়ে দিল আমেরিকায়। শোনা গেল এবং বোঝাও গেল যে, আমেরিকানরা কৌশল বদলে ফেলেছে। এখন তারা বামপন্থীদেরকে বেছে বেছে বৃত্তি দেবে। দেখা গেল অর্থনীতির ডঃ আবু মাহমুদও যাচ্ছেন চলে। কংগ্রেস ফর কালচারাল ফ্রিডম তাদের কর্মসূচী সম্প্রসারিত করে দিল। প্যাস্টেরনাকের ডঃ জিভাগো যখন নোবেল পুরস্কার পেল তার কিছুদিন পরেই দেখি ও বই এসে গেছে আমাদের নামে নামে, কংগ্রেস ফর কালচারাল ফ্রিডমের সৌজন্যে, বইটি কম্যুনিজমের সমালোচনা করেছে বলে। ৫০ দশকে ঐ বিশেষ শব্দটি যত ভীতির সঞ্চার করতো শাসকদের মনে ততো বোধহয় আর কিছু নয়।
তবু যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন বিজয়ের পর কম্যুনিস্টরা বেরিয়ে এসেছিলেন জেল থেকে। সরদার ফজলুল করিমকে দেখলাম আমরা সামনাসামনি। শহীদ সাবের এলেন আমাদের পাড়াতেই। রাজনৈতিকভাবে ওভাবে এগিয়ে যাচ্ছিল দেশ। মেরুকরণও ঘটছিল। আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রথমে নাম থেকে ‘মুসলিম’ ফেলে দিয়ে হালকা হলো কিছুটা। তারপর আমেরিকার দিকে ঝোঁকা না ঝোঁকার প্রশ্নে দু’ভাগ হয়ে গেল। মওলানা ভাসানী পাকিস্তানকে ওয়ালাইকুম সালাম জানাতে হতে পারে বলে প্রবল ক্রোধ ও ত্রাসের সৃষ্টি করলেন শাসকমহলে। তিনি মনে হয় জানতেন, যদিও আমরা জানতাম না, যে পূর্ববঙ্গ কোনদিকে এগুবে। তিনি সমাজতন্ত্রের কথাও বলতেন, যদিও সামনে বিশেষণ থাকতো ‘ইসলামী’। তিনি ছিলেন প্রবলভাবে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী।
৫০ দশকে আমি তো গল্প লিখতাম। এক সময়ে দেখি আর গল্প লিখতে পারছি না। তার কারণ ছিল। কারণটা অভিজ্ঞতার অভাব। আমাদের বৃত্তটা ছিল ছোট। সেই বৃত্তের ভেতর দেখা দিয়েছিল বন্ধ্যাত্ব। কারো একার নয়, সকলের জন্যই সত্য এটা। এই যে এতসব অগ্রগতি, এত রকমের উত্থান, সমস্ত কিছুর অভ্যন্তরে একটা বড় রকমের বন্ধ্যাত্ব দেখা দিচ্ছিল। সেই বন্ধ্যাত্বকেই আঘাত করেছিল ৫২-র ২১শে ফেব্রুয়ারী। মনে হয়েছিল বৃত্তটা ভেঙে যাবে। কিন্তু গেল না। যুক্তফ্রন্টের বিজয় হলো, কিন্তু যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতায় থাকলো না। ক্ষমতায় এলেন আইয়ুব খান। তিনি টাকা ঢাললেন প্রচুর, সুযোগ আরো বৃদ্ধি করে দিলেন, কিন্তু বন্ধ্যাত্ব আরো গভীর হলো।
অন্যেরা যেমন যায়, তেমনি আমিও বিলেত গেলাম ৫৯ সালে। করাচী গিয়ে মনে হলো সত্যি সত্যি ভিন্ন দেশে এসেছি। তারপর বিলেতে থেকে অনেক জিনিস বুঝলাম যা দেশে থাকতে বুঝিনি। সেখানে যাব সঙ্গে দেখা হয় আমরা দেশের কথা বলি। পশ্চিম পাকিস্তানীদের সঙ্গে ওঠা-বসা করি, কিন্তু বন্ধুত্ব হয় না। আরো স্পষ্ট করে ধরা পড়লো যে, আমরা আসলেই বাঙালী যে পরিচয় পাকিস্তানী পরিচয় দিয়ে অবলুপ্ত করা যাবে না। ৫২-র আন্দোলন যে সত্যটা তুলে ধরেছে সে সত্যটা ক্রমশ বড় হয়ে আঘাত করবে পাকিস্তানকে। পাকিস্তান যে শোষণের যন্ত্র সেটা বিদেশে গিয়ে যতটা স্বচ্ছভাবে দেখতে পেয়েছি ততটা দেশে বসে দেখা সম্ভব ছিল না।
৫০-এর দশকে আমরা ব্যক্তিগতভাবে যে যেদিকেই যাই না কেন, সমষ্টিগতভাবে এগুচ্ছিলাম একটি অনিবার্য লক্ষ্যপথেই—সেটি যুদ্ধ, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ এগুচ্ছিল ‘বাংলা ভাষা’ রাষ্ট্র চাই অভিমুখে।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!