You dont have javascript enabled! Please enable it!

মায়ের কবরের পাশে সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানীর শেষ শয়ন | সর্বাধিনায়ক ওসমানী ১৯১৮-১৯৮৪
সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৪

মায়ের কবরের পাশে সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানীর শেষ শয়ন

মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক গণতন্ত্রের আপোসহীন সংগ্রাম পুরুষ এম, এ, জি, ওসমানী গত ১৬ ফেব্রুয়ারী লন্ডনের একটি হাসপাতালে মারা গেছেন। বার্ধক্যজনিত রোগে তিনি মারা যান। মৃত্যুকালে তার বয়স ছিল ৬৬। তার মৃত্যুতে বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষ শোকে বিহ্বল হয়ে পড়ে। প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল এইচ, এম, এরশাদসহ দেশের সকল রাজনৈতিক নেতা ও বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ গভীর শোক করেন। প্রেসিডেন্ট তাঁর শোক বার্তায় বলেন, ‘এই বীর মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুতে তাঁর সাথে সমগ্র জাতি শোকে মুহ্যমান।’ তিনি বলেন, একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় মুক্তিযুদ্ধে জেনারেল ওসমানীর অবদানের কথা প্রতিটি মানুষ জানে। বাংলাদেশের ৯ কোটি মানুষ মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানীকে একজন সৈনিক, রাজনীতিক ও রাষ্ট্রনায়ক হিসাবে সব সময় স্মরণ করবে। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদ, বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বেগম খালেদা জিয়া, জনদলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের চেয়ারম্যান বিচারপতি আহসানউদ্দিন চৌধুরী, মহাসচিব এম এ মতিন, জাসদের (চিত্ত-রব) কার্যকরী সভাপতি চিত্তরঞ্জন গুহ ও সাধারণ সম্পাদক আ স ম আবদুর রব, জাসদ (রাজা-সিরাজ)-এর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মীর্জা সুলতান রাজা ও শাহজাহান সিরাজ, ডেমোক্র্যাটিক লীগের খন্দকার মোশতাক আহমদ, ইউপিপি’র চেয়ারম্যান কাজী জাফর আহমদ, জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত আমীর আব্বাস আলী, বাকশালের সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাকসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনগুলি শোক বার্তায় শোক প্রকাশ করেন। বাংলাদেশ সংবাদপত্র পরিষদের সভাপতি ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক হাবিবুল বাশার, বিএফইউজে’র সভাপতি আহমেদ হুমায়ুন, সাধারণ সম্পাদক রিয়াজউদ্দিন আহমদ, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি ইকবাল সোবহান চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান মিয়া, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি গিয়াস কামাল চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক শফিকুর রহমানও শোক প্রকাশ করেন।
২০ ফেব্রুয়ারী সকাল ৭টা ৫৮ মিনিটে বাংলাদেশের জাতীয় বিমান সংস্থার বৃহদাকার বিমান (ডিসি-১০) ‘সিটি অব শাহ জালাল’ জেনারেল ওসমানীর কফিন বহন করে ঢাকার মাটির স্পর্শ করে। কফিন আসার সঠিক সময়ের তথ্য সরবরাহে কর্তৃপক্ষীয় ব্যর্থতা সত্ত্বেও ২০ তারিখ সকাল থেকে ট্রাক-বাস ও বিভিন্ন যানবাহনে চড়ে, রাজনীতিক নেতা, কর্মী, মুক্তিযোদ্ধাসহ সর্বস্তরের শোকার্ত জনগণ বিমান বন্দরে উপস্থিত হন। ‘সিটি অব শাহ জালাল’ ঢাকার মাটি স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গে শোকার্ত মানুষ কান্নায় ভেঙে পড়ে। প্রেসিডেন্ট এরশাদ, উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকদ্বয় ও পদস্থ কর্মকর্তাদের নিয়ে গ্যাংওয়েতে যান। সশস্ত্র বাহিনীর জওয়ানরা জাতীয় পতাকায় জড়ানো পুষ্পস্তবকে ঢাকা কফিন বিমান থেকে নামানোর সময় প্রেসিডেন্ট এরশাদ কফিন স্পর্শ করেন। পরে ট্রলির উপর কফিন রেখে তিন বাহিনী প্রধান মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়কের উদ্দেশে সামরিক অভিবাদন জানান। এ সময় শোকার্ত জনতা ‘লা শরীকাল্লাহু লা ইলাহা ইল্লালাহ’ ধ্বনিতে বেদনার অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে থাকেন। সর্বাধিনায়কের কফিন বিমান বন্দর থেকে ০৮৭৮২১ নম্বর সামরিক ট্রাকে করে সংসদ ভবনের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। এসময় কফিনের অনুগামী হয় প্রায় আধ মাইল দীর্ঘ মোটর সারি। কফিন ৮টা ৫২ মিনিটে সংসদ চত্বরে পৌঁছে। পথে পথে জনতা নীরবে দাঁড়িয়ে তার প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাতে থাকে। সামরিক বাহিনীর সদর দফতরের তোরণে তোরণে তার উদ্দেশ্যে সামরিক অভিবাদন জানানো হয়। সকাল ৯টায় রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সংসদ ভবনের চত্বরে তার কফিন রাখা হয়। প্রথমে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন সশস্ত্র বাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোর।
সংসদ ভবনের সমন্বয় চত্বর হতে আঁকা-বাঁকা ভঙ্গিমায় মানিক মিয়া এভিনিউর পূর্ব-মধ্য প্রান্ত পর্যন্ত অজস্র মানুষ জেনারেল ওসমানীকে দেখার জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। কিন্তু অব্যবস্থার কারণে অনেকেই তাদের প্রিয় ব্যক্তিত্বকে শেষবারের মতো দেখতে পারেনি। অব্যবস্থার কারণে অনেক দর্শনার্থী আহতও হয়।
বেলা ১১টা ২০ মিনিটে সংসদ ভবনের পূর্বদিকের সর্ব অঙ্গনে লাশসহ কফিন জানাজার জন্য আনা হয়। জানাজায় ইমামতি করেন বায়তুল মোকাররমের ইমাম মওলানা মুখলেসুর রহমান। জানাজায় শরীক হবার জন্য আগত লাখো জনতার অনেকেই নামাজে শরীক হতে পারেনি। এর কারণ অব্যবস্থা এবং একটি মাইকও বিকল হয়ে যাওয়া। এতে উপস্থিত জনতা ক্ষুব্ধ শ্লোগানমুখর হয়। এ সময় তড়িঘড়ি করে মরহুমের লাশ ১১ টা ৫২ মিনিটে) সহ কফিন হেলিকপ্টারে তোলা হয়। অপেক্ষমান জনতা ছল ছল চোখে তার বিদায় প্রত্যক্ষ করেন।
দুপুর ১টা ১০ মিনিটে কফিন বহনকারী বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টার সিলেট স্টেডিয়ামে অবতরণ করেন। অগ্রবর্তী হেলিকপ্টারে সিলেট প্রেসিডেন্ট এরশাদ। তিনি জেনারেল ওসমানীর লাশ গ্রহণ করেন। আত্মায়-স্বজনদের দেখার সুবিধার্থে লাশ কিছুক্ষণের জন্য প্যাভিলিয়ন গ্রাউন্ডে রাখা হয়। সর্বসাধারণের জন্য আড়াই ঘন্টার জন্য জেনারেল ওসমানীর কফিন সিলেট অডিটোরিয়ামে পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় রাখা হয়। বিকেল ৩টা ৫০ মিনিটে সিলেট আলিয়া মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে পুনরায় নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। বিকেল ৪টা ২৫ মিনিটে পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানীর লাশ হযরত শাহ জালালের মাজারের পশ্চিমে মায়ের কবরের পাশে দাফন করা হয়।
০০০

প্রচ্ছদ কাহিনী
সর্বাধিনায়ক ওসমানী ১৯১৮-১৯৮৪
বিচিত্রা প্রতিবেদন : কাজী জাওয়াদ

মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক, বাংলাদেশের স্বপ্নের অন্যতম নায়ক, প্রতিবাদের কন্ঠস্বর জেনারেল ওসমানী আর নেই।
বাংলাদেশের মানুষদের দুঃসময়ে আশার বাণী শোনাতেন যে মানুষটি তিনি আর নেই। প্রবাসে এক কঠিন ব্যাধি তার জীবনদীপ নিভিয়ে দিয়েছে। আকস্মিকভাবে দেশবাসীর কাছে এসেছে তাঁর মৃত্যু সংবাদ।
এসময়ে কেউই এ সংবাদটির জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। কেউ বুঝতেই পারেননি চিকিৎসার জন্যে এই যাত্রাই হবে তার শেষ যাত্রা। তবু অনিবার্য মৃত্যুকে মেনে নিতে হয়েছে, শোকের মধ্যদিয়ে আবিষ্কার করতে হয়েছে তাঁর উপস্থিতির প্রয়োজনীয়তা।
বাংলাদেশের মানুষদের কাছে জেনারেল ওসমানী এক প্রিয় নাম। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এই নাম সাহস ও প্রত্যয়ের গভীর ব্যঞ্জনা নিয়ে সকলের মুখে মুখে ফিরেছে। জীবদ্দশায় যাকে ঘিরে বহু কিংবদন্তী রচিত হয়েছে, সেই বিরল সংখ্যক ব্যক্তিত্বের ভেতর ওসমানী একজন। সততা, সাহস, বিচক্ষণতা, পরমতসহিষ্ণুতা এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি প্রগাঢ় আস্থা তাঁকে একজন রাষ্ট্রনায়কের গুণে গুণান্বিত করেছে।
যে জাতি অন্য কোন পরাক্রমশালী দেশের দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনে সে জাতির সর্বাধিনায়কের মৃত্যুতে শোকগাথা কেমন করে লিখতে হয় তা আমাদের জানা নেই। সে অভিজ্ঞতা দ্বিতীয়বারের জন্যে লাভ করা যাবে এমন সন্দেহও বিন্দুমাত্র নেই। তাই আজ আমাদের মনে হচ্ছে ওসমানীর মৃত্যুর খবর সারা দেশবাসী জানে তো? ওসমানীর উত্থান সে তো সবার জানা। এতো সেই ওসমানী যার নাম বুকে নিয়ে পাকিস্তানী সৈন্যের অত্যাচার সহ্য করা গেছে। এই সেই নাম যাতে পুঞ্জিভূত হয়েছে এ জাতির সমগ্র বিশ্বাস। এজন্যেই হয়তো একজন মুক্তিযোদ্ধার প্রতিক্রিয়া ‘ওসমানীর মৃত্যুতে কি আমি অভিভাবকহীন হলাম? নিজেকে প্রশ্ন করি জবাব পাই না।’
আর একজন মুক্তিযোদ্ধার বক্তব্য, ‘এ সমাজে আমি এখন দায়িত্বশীল পদে অধিষ্ঠিত। কিছুদিন আগেও ওসমানী আমার সঙ্গে যথেষ্ট সম্মান দিয়ে কথা বলেছেন। কিন্তু আমার স্মৃতিতে তা তো আসছে না। কেবলই মনে হচ্ছে ওসমানীকে প্রথম যখন দেখি সেদিনের কথা। আমি তখন মুক্তিযোদ্ধা। ওসমানী আমাদের গার্ড অব অনার গ্রহণ করেন সেদিন। সঙ্গে ছিলেন সেক্টর কমান্ডার। সেদিন আমার রক্তে বীরত্ব অনুরণন তুলেছিল—যুদ্ধ ক্ষেত্রে আমি একা নই। আমার সর্বাধিনায়ক আছেন। তিনি আমাদের পরিদর্শন করেছেন।’
এজন্যেই কি আমাদের মনে হয় ওসমানীর মৃত্যুর সংবাদ স্বাধীন দেশের সংবাদপত্রে ব্যানার হেডিংয়ে ছাপা হতে পারতো। আসলে স্বাধীনতার সচেতনতা আমাদের অনেক কম বলেই হয়তো আমরা দু’তিন কলামের মাপে তাঁকে সীমাবদ্ধ করার চেষ্টা করেছি। তেমনি অপচেষ্টা আরেকবার হয়েছিল মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর মৃত্যুর পর। সংবাদপত্রে আমরা যত ভুলই করি না কেন পাঠক তার চাহিদা ঠিকই আদায় করে নিতে চায়। তাই আমাদের মূঢ়তায় ওসমানীকে খাটো করতে চাইলেও সে অজ্ঞানতা বেশীক্ষণ স্থায়ী হয়নি। তাঁর লাশ আগমনের খবর আট কলামে প্রকাশ করা হয়।
জেনারেল ওসমানীর মৃত্যু সংবাদ পরিবেশন করতে গিয়ে প্রথম সংবাদে ‘দৈনিক দেশ’-এ লেখা হয়,
‘বিশিষ্ট সমরনায়ক, প্রাজ্ঞ, সৎ, আপোসহীন এবং বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রতি আজীবন শ্রদ্ধাশীল এই মানুষটির মৃত্যুর খবর সরকারীভাবে ঘোষণার আগেই সমগ্র মহানগরীতের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। ফাগুনের আকাশের একখন্ড কালো মেঘের মতো ছড়িয়ে পড়া শোকে মুহ্যমান মানুষ একে অপরের কাছে জানতে চায় নক্ষত্র পতনের মতো এই অবিশ্বাস্য সংবাদের সত্যতা। সংবাদপত্র, রেডিও এবং টিভিসহ সকল সংবাদ মাধ্যমের দফতরে আসতে থাকে অসংখ্য টেলিফোন। সবাই জানতে চায় জেনারেল ওসমানীর খবর।
আজীবন অকৃতদার এই মানুষটিকে মৃত্যুর মতো বেদনাদায়ক এক অনিবার্য সত্য এসে গতকাল বাংলাদেশ সময় বিকাল ৪টায় ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। সাথে সাথে অবসান ঘটেছে বাংলাদেশের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধের এক জীবন্ত ইতিহাসের। মহানায়কের মতো নানা ঘটনা ও বৈচিত্র্য পূর্ণ জীবনের অধিকারী জেনারেল ওসমানী গত এক বছরে ধরেই বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগে ভুগছিলেন। চিকিৎসার জন্যে ডিসেম্বরে যান লন্ডনে। এ যাত্রাই হলো তার শেষ যাত্রা।
দেশের গণমানুষের কাছে জেনারেল ওসমানী এই সংক্ষিপ্ত নামে পরিচিত মোহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানী একজন সুদক্ষ ও সফল সেনানায়কই ছিলেন না, আপোসহীন সংগ্রামী ও প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদ হিসেবেও দেশবাসীর কাছে তিনি ছিলেন এক অনন্য ব্যত্তিত্ব। বিশুদ্ধ গণতন্ত্রী হিসেবেও তিনি জাতির কাছে রেখে গেছেন এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। বিশেষ করে ১৯৭৫ সালে একদলীয় ও অগণতান্ত্রিক বাকশাল গঠনের সময় তাঁর ভূমিকা এক স্মরণীয় ঘটনা। সে-সময় তিনি ক্ষমতাসীন দলের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন এবং সংসদ সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করেন।’
এছাড়াও সকল জাতীয় দুর্যোগে ওসমানী সব সময় এগিয়ে এসেছেন একজন নির্ভীক সৈনিক এবং দেশপ্রেমিক নেতার মতো। খ্যাতনামা সাংবাদিক আহমেদ হুমায়ুন ‘স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের সেই যোদ্ধা’ শীর্ষক উপ-সম্পাদকীয় নিবন্ধে লিখেছেন, ‘জেনারেল ওসমানীও চলে গেলেন।’
গভীর এক শূন্যতাবোধ থেকেই কথাটা উচ্চারণ করতে হচ্ছে। আমাদের মাঝ থেকে বোধহয় শেষ মানুষটি চলে গেলেন জাতীয় সংকটে আর সমস্যায় যাঁর কাছে গিয়ে দাঁড়ানো যেত, পরামর্শ চাওয়া যেত।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসামনী। গণতন্ত্রের আপোসহীন যোদ্ধা। পরিচ্ছন্ন মূল্যবোধের অধিকারী একজন মানুষ। আমাদের রাজনৈতিক ও সমাজ জীবনে অনেকখানি জায়গা খালি করে রেখে সেই চলে গেছেন জেনারেল ওসমানী।’……
‘স্বাধীনতার পর মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানী তৎকালীন প্রশাসনের কাছ থেকে যথার্থ স্বীকৃতি পেয়েছিলেন কিনা সে বিতর্ক আজ তোলা অর্থহীন। ১৯৭২ সালে তিনি মন্ত্রী হন। ১৯৭৩ সালে নির্বাচিত হন জাতীয় সংসদের সদস্য। কিন্তু মন্ত্রীত্বে গদি তাঁকে সুখ দেয়নি, সন্তুষ্টিও না। তিনি দেখতে চেয়েছিলেন একটি জাতির নবঊত্থান। তৎকালীন রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহকে এজন্যেই তিনি মেনে নিতে পারেননি। ১৯৭৪ সালে মন্ত্রীত্ব থেকে ইস্তফা দেন জেনারেল ওসমানী। দেশের রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহ তখন একদলীয় অগণতান্ত্রিক খাতে মোড় নিতে শুরু করেছে। সাধারণ মানুষের মনে তখন প্রশ্ন আর ক্ষোভ। ১৯৭৫ সালে একদলীয় বাকশাল শাসন প্রতিষ্ঠার অগণতান্ত্রিক পাঁয়তারার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে প্রতিবাদী মানুষের কাতারে নেমে এলেন জেনারেল ওসমানী। দেশের স্বাধীনতার জন্যে তিনি লড়াই করেছিলেন—নতজানু রাজনীতি আর একদলীয় শাসনের জন্যে নয়। বাকশাল গঠনের প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় সংসদের সদস্যপদ ছাড়লেন জেনারেল ওসমানী গঠন করলেন জনতা পার্টি।’
আমাদের দেশের রাজনৈতিক ছকে নিতান্ত বেমানান ছিলেন তিনি। বড় বেশি নীতিপরায়ণ ছিলেন। নিজের মূল্যবোধে অবিচল ছিলেন। কিন্তু একটু-আধটু আপোস না করলে কি ক্ষমতার মধুচক্রে একটি কায়েমী আসন তৈরি করা যায়? তাঁর জনতা পার্টি ক্ষমতায় যায়নি। জেনারেল ওসমানীও আর মন্ত্রীত্বের গদিতে বসেননি। কিন্তু জনগণের হৃদয়ে ঠাঁই করে নিয়েছিলেন তিনি। জাতির সংকটময় দিনে তিনি বার বার এগিয়ে এসেছেন—রাজনৈতিক মান-অভিমান তিনি মনে রাখেননি। দেশ ও জাতির কথাই তিনি সব কিছুর আগে ভেবেছেন।
….১৯৮২ সালেও প্রেসিডেন্ট পদে পুনরায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। নিজে হেরে গেলেও সেদিন গণতন্ত্রের বিজয়ে তিনি সহায়তা করেছিলেন। জাতি তাঁর পরাজয়কে মনে রাখেনি; মনে রেখেছে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের এ আপোসহীন যোদ্ধার কথা।
আমাদের দেশের রাজনীতিতে সাফল্যের চূড়ায় উঠতে গেলে বোধ হয় একটু নমনীয়, একটু কৌশলী হতে হয়। কিন্তু স্পষ্টবাদী, নীতিপরায়ণ এই মানুষটি তেমনভাবে এ্যাডজাস্ট করতে শেখেননি। তাঁকে বাগ মানাতে গিয়ে অনেককেই হার স্বীকার করতে হয়েছে। রাজনীতির ধূলিমলিন অঙ্গনে তিনি নিজেও যা চেয়েছিলেন তা হয়তো খুঁজে পাননি। কিন্তু মূল্যবোধ তিনি আঁকড়ে ধরেছিলেন, দরজির ফিতার মাপে তাঁকে কাটা যায়নি।
কাউকে কটাক্ষ করার জন্যে বলছি না। কাউকে ছোট করার জন্যেও না। আমাদের দেশে দলীয় রাজনীতির টানাপোড়েন আর সংকীর্ণতা এমনই একটা স্তরে গিয়ে পৌঁছেছে যে দলীয় সীমাবদ্ধতার উর্ধ্বে রাজনীতির সুর আর তেমন করে বেজে উঠে না। সবাই যেন দলীয় মাপে কাটছাঁট করা মানুষ। জাতীয় সংকটে অভিভাবকের মত ভূমিকা পালন করার মত মানুষের সংখ্যা ক্রমেই কমে আসছে আমাদের সমাজে। জেনারেল ওসমানীর মৃত্যু সেই শূন্যতাকে আজ বাড়িয়ে তুলেছে।
সহজ, সরল নীতিনিষ্ঠ আর কঠোর শৃংখলা বোধের অধিকারী এ মানুষটির অন্তর্ধানে আমাদের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যে ফাঁক সৃষ্টি হয়েছে তা সহজে ভরে তোলা যাবে না। জেনারেল ওসমানীর জীবন কাহিনী বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে তিনি জাতীয়তাবাদী আর গণতান্ত্রিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ ছিলেন। বাংলাদেশে সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা চেয়েছিলেন, চেয়েছিলেন পরিচ্ছন্ন প্রশাসন।
বাংলাদেশের মানুষ শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে মনে রাখবে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক, গণতন্ত্রের আপোসহীন যোদ্ধা জেনারেল ওসমানীকে। সংকটের মুহূর্তে আবারও মনে পড়বে তাঁর কথা, যাঁর কাছে গিয়ে দাঁড়ানো যেত।’
আমরা কি ওসমানীর মৃত্যুতে ওয়াল্ট হুইটম্যানের মতে ‘ও ক্যাপ্টেন মাই ক্যাপ্টেন’ বলে বিলাপ করে একবার তার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পারি না? সম্ভবতঃ পারা উচিত নয় বলেই বাংলাদেশ অবজারভার পত্রিকায় ওসমানীর মৃত্যুর ঊর্ধ্বে স্থান পেয়েছে ১৯৮০ সালের সম্ভাব্য বেকার সমস্যার কথা, গুরুত্ব পেয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ার অগ্রগতির কথা। একুশে ফেব্রুয়ারী শহীদ মিনারে বাঁদর নাচানোর মত লজ্জাকর ঘটনার চেয়ে এ মানসিকতা কম ধৃষ্টতাপূর্ণ নয়। এবং সে কারণেই জাতি ও সমাজ তাকে গ্রহণ করে না। নিজ গৃহেও তাকে পরদেশী হয়েই থাকতে হয়।
ওসমানী সততার অনুপ্রেরণা পেতেন এদেশের মাটি ও মানুষের মধ্য থেকেই। নির্বাচনী প্রচারণায় তিনি বলেছেন, ‘আমার পূর্বপুরুষ এদেশে ইসলাম প্রচার করেছেন। আমি আপনাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবো না।’ ওসমানী বিশ্বাসঘাতকতা করেননি। আওয়ামী লীগ ‘বর্বর গরিষ্ঠতা’র অহংকার একদলীয় শাসন পদ্ধতির প্রবর্তন করলেও তিনি যে অঙ্গীকারে জনগণের বিশ্বাস অর্জন করেছিলেন তাকেই ঊর্ধ্বে তুলে ধরেন। ভীত সংকুচিত বিরোধী দলের নেতারা তখন প্রাবাল্যের কাছে নিজেদের সমর্পণ করেছিলেন। তাঁদের সামনে আশার ঝলকানিও ছিল না এমন নয়।
রাজনৈতিক স্বার্থ এবং ব্যক্তি স্বার্থকে জেনারেল ওসমানী দুই সীমানায় আবদ্ধ রেখেছিলেন। ১৯৮১ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচার অভিযান চলাকালে এর যথেস্ট প্রমাণ মেলে। নাগরিক কমিটি জাতীয় জনতা পার্টির কাছ থেকে স্বীকৃতি চায় জেনারেল ওসমানীকে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী করার। বিভিন্ন দলের সমর্থনও তিনি পান। মুক্তিযোদ্ধা সংসদও তাকে সমর্থন দেয়। এ সময়ে বিভিন্ন স্থান সফরে তিনি প্রচারণার ব্যয় এবং তার ব্যক্তিগত ব্যয় আলাদা তহবিল থেকে করতেন। তাঁর কোন উৎসাহী ভক্ত কোন টাকা পয়সা দিলে তা ব্যবহৃত হতো নির্বাচন ব্যয়ে। তার খাবার এবং অন্যান্য ব্যক্তিগত প্রয়োজনীয় ব্যয় হতো তাঁর নিজের সামান্য আয় থেকে।
প্রচার অভিযানের শেষ দিকে পাবনা থেকে তাঁকে যশোরে যেতে হয়। তার সঙ্গীরা তার কাছে কি পরিমাণ টাকা আছে জানতে চাইলে তাঁর নোট বই খুলে দেখতে পান তার সম্বল মাত্র ষাট টাকা। অনেক বুঝিয়ে নির্বাচনের ব্যয়ের জন্যেই যশোরে প্রয়োজন হতে পারে এই বলে তাকে মাত্র দু’শো টাকা গ্রহণ করতে সম্মত করানো যায়। যশোর থেকে ঢাকায় ফিরেই তিনি তার প্রতি পাইয়ের হিসেব বুঝিয়ে দেন।
জেনারেল ওসমানী গর্ব অনুভব করতেন তার বইয়ের সংগ্রহের জন্যে। অবশ্য এ ছিল তাঁর তিন পুরুষের সংগ্রহ। এজন্যেই বোধহয় তাঁর অনুভব অহংকার মিশ্রিত ছিল না। তাঁর এই সংগ্রহ পাক-বাহিনী ধ্বংস করে দেয়। ওসমানী ছিলেন শৌখিন। কিন্তু বিলাসী নন। ভালো পোশাক পরতে পছন্দ করতে কিন্তু জৌলুস দেখাতেন না। ১৯৮১ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার আগে জনতা ভবনের একটি কামরায় তিনি মেঝেয় রাত কাটাতেন। একটি ক্যাম্বিসের সতরঞ্জি সাদা লয়েন ক্লথ বিছানার চাদর, একটি বালিশ এবং একটি কাঁথা ছিল তাঁর শয্যা। হালকা নীল রঙের পুরনো একটি স্যুট এবং একটি টাই ছিল তাঁর। দুটো পাঞ্জাবী দুটো জামা এবং দুটো পাজামা ছিল তার পরিধেয়। আর ছিল একজোড়া সুন্দর কাটা চামচ। এ অবস্থায় থেকে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন। ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরীর পীড়াপীড়িতে তারই দেয়া একটি খাট এবং একটি বৈদ্যুতিক পাখা তিনি গ্রহণ করেন। কিন্তু সে খাটেও তিনি তোষক পেতেই তিনি থাকতেন। নির্বাচনের আগে লন্ডন গেলে সেখানকার বাঙালীরা তাকে দুটো স্যুট উপহার দেয়। সে দুটো পেয়ে তিনি খুব খুশী হয়েছিলেন।
অনেকে বিশ্বাস করেন ওসমানী সরল ছিলেন বলেই কৌশল বুঝতেন না। এটা আদৌ ঠিক নয়। ওসমানী কৌশল প্রয়োগ করতেন সত্যকে মেনেই। যেমন যখন তিনি বুঝতে পারেন মুক্তিযুদ্ধ সংক্ষিপ্ত করার প্রচেষ্টা চলছে তখন সবগুলো সেক্টরে যুদ্ধক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে সাক্ষাতের কর্মসূচী গ্রহণ করেন। তার এ কর্মসূচী বাস্তবায়নে বাঁধা দিতে মহল বিশেষের চেষ্টার অন্ত ছিল না। এসময় অবশ্য শেখ কামাল থাকতেন তার সঙ্গেই। কুমিল্লায় এবং সিলেটে তিনি দেখতে পান ভারতীয় বেসামরিক কর্মকর্তা। সিলেট পূর্ণ মুক্ত হতে সময় বেশি লাগলেও তাকে তা জানানো হয়নি। যে কারণে তার জীবন হানির আশংকাও দেখা দেয়। তার একজন ঘনিষ্ঠ সহকর্মী সে সময় মারাও যান।
স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস যাতে বিকৃত না হয় সেদিকে তার দৃষ্টি ছিল তীক্ষ্ম। ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর নিয়াজীর আত্মসমর্পণ তার কাছে হোল না কেন এ প্রশ্ন করলে তিনি তাঁর জবাব এড়িয়ে যেতেন। বলতেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের এমন অনেক ঘটনা আমি জানি যাতে অনেকেরই অসুবিধা হবে। আমি একটি বই লিখছি। তাতে সব ঘটনাই পাবে।’
জেনারেল ওসমানী ছিলেন সদালাপী। অমায়িক। কিন্তু বিরোধিতা এবং প্রতিবাদের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অটল। বৃটিশ সেনাবাহিনীতেও তার দৃঢ়তা সাদা চামড়ার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিয়েছে।
জেনারেল ওসমানীর বাবা মারা যান মক্কায়। তিনি তাঁর কবর খোঁজার চেষ্টা করেও পাননি। পিতার চেয়ে তার মায়ের সঙ্গেই সম্পর্ক ছিল ঘনিষ্ঠতর। অবশ্য পিতার মৃত্যু তাঁকে জাগতিক সুবিধা ত্যাগীতে পরিণত করে। এমনকি আইয়ুব খানও তাকে মদ্যপান আকৃষ্ট করানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হন।
জেনারেল ওসমানী ছিলেন আকৃষ্ট করার মত ব্যক্তিত্ব। সকলের কাছে পিতৃতুল্য। নির্বাচনী প্রচার অভিযান চলাকালে তিনি তখন অবস্থান করছিলেন হবিগঞ্জে। হবিগঞ্জ ডাকবাংলোয় একটি কক্ষে সাংবাদিকরা একটি মাত্র টেলিফোন দিয়ে তার সভার খবর পাঠাচ্ছেন ঢাকায়। খবর পাঠানো শেষ হলে তাঁদের প্রায় সবাই শুয়ে বসে গল্প গুজব করছিলেন। কেউ কেউ উদ্বিগ্ন ট্রাঙ্ক লাইনের জন্যে। মাঝে মধ্যে ডঃ এম, আর, খান (মরহুম) এসে খোঁজ খবর নিচ্ছেন। আর একটা চকলেট, দুটো বাদাম, এক টুকরো আমসত্ত্ব দিয়ে যাচ্ছেন কারও কারও হাতে। রান্না হতে দেরী ছিল বলেই এ অবস্থা। এমন সময় সে ঘরে ঢুকলেন জেনারেল ওসমানী সাংবাদিকদের খোঁজ খবর নিতে। শুরু করলেন গল্প। সাংবাদিকরা যারা তার সঙ্গে থাকতে থাকতে তাঁর হিতাকাঙ্ক্ষী হয়ে পড়েছেন, তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের গল্প শুনতে চাইলেন। তিনি শুরু করলেন বহু গল্প বহু কথা তার জীবনের খন্ড খন্ড কাহিনী এদেশের মানুষের সমস্যা এবং তাঁর পরিকল্পনার কথা। সে রাতে খাবার তৈরি হলেও খেতে দেরী হয়ে গিয়েছিল। তিনি বলেছিলেন তার অবিবাহিত থাকা নিয়ে রসিকতার কথা। সে কাহিনী একজন ভারতীয় সেনানায়কের। যিনি বলতেন, ‘ওসমানী মরে গেলেও আত্মসমর্পণ করবে না। কারণ আত্মসমর্পণ কাকে বলে তা সে জানে না। জানে না বলে সে বিয়েই করতে পারেনি।’
জেনারেল ওসমানী কোটি জনতার হৃদয়ে অধিষ্ঠিত থেকেও ছিলেন একদম একা। সবকিছুর মাঝে একাকিত্ব তাকে আনন্দ দিতো। ওসমানী তা অনুভব করতে পেরেছিলেন মায়ের দেয়া শাস্তি থেকে। তাঁর মা ছিলেন অত্যন্ত নিয়মনিষ্ঠা মহিলা। নিয়মের সামান্য ব্যত্যয় তিনি পছন্দ করতেন না। তাই বালক ওসমানীকে প্রায়ই শাস্তি পেতে হতো রাত্রির জন্যে টং ঘরে নির্বাসন। টং-ঘরে থেকে তিনি রাত্রির সৌন্দর্য পানে অভ্যস্ত হয়েছিলেন। অবশ্য বন্যজন্তুর ক্রুদ্ধ চিৎকার তাকে ভয় পাইয়ে দিতো। তখন মা’ই পাঠাতেন পাহারাওয়ালাকে তাকে নিয়ে যেতে। আর শুরু হতো ওসমানীর শোধ গ্রহণের পালা, কিছুতেই ফিরে যেতে চাইতেন না। মা’র কান্নাও তাঁকে পরাস্ত করতো না। অবশ্য পাহারাওয়ালা তাকে কাঁধে তুলে ফিরিয়ে নিয়ে যেতেন।
চিরজীবন ছিলেন একা। এককভাবেই যেন লড়ে গেছেন। নীরবে দেশের থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে যেন এক অভিমানে বিদায় নিলেন। লিখে রেখে গেলেন মায়ের পাশে কবরের বাসনা।
জাতির ইতিহাসের নিয়ন্তা পুরুষ জাতির কাছে কিছু চাইলেন না।

জীবন কাহিনী
মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল মোহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানী ১৯১৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর সিলেটের সুনামগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম খান বাহাদুর মফিজুর রহমান। পিতামহ মরহুম আবদুস সোবহান ছিলেন জ্ঞানী দার্শনিক, ধর্মপরায়ণ ব্যক্তি, মাতামহ মরহুম মোসাম্মৎ আকিল চৌধুরী ছিলেন বিশিষ্ট জমিদার। জেনারেল ওসমানীর আরব দেশীয় পূর্বপুরুষ ছিলেন হযরত শাহ জালাল (রাঃ)-এর সাহাবী। ১৩শ’ শতাব্দীতে গৌরগোবীন্দের রাজত্বকালে এদেশে ইসলাম বিস্তারের জয়যাত্রা অব্যাহত রাখতে হযরত শাহ জালাল (রাঃ)-এর সঙ্গী হয়ে সিলেটে যেসব সাহাবীর আগমন ঘটে তাদের মধ্যে ছিলেন শাহ নিজামউদ্দিন ওসমানী। তাঁর পিতা খান বাহাদুর মফিজুর রহমান ছিলেন ১৮৯৯ সালের গ্র্যাজুয়েট। ১৯০১ সালে তিনি ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরি গ্রহণ করেন এবং পরে আসামের জেলা প্রশাসকের দায়িত্বে নিয়োজিত হন। তিনি একসময় সিলেট জেলা বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের সময় তিনি ছিলেন আসামে ল্যান্ড রেকর্ডস এর ডাইরেক্টর।
ওসমানী ছিলেন তিন ভাই-বোনের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ। ভাই বোন দু’জনই লোকান্তরিত। বড় ভাই ছিলেন তাঁর চেয়ে ১১ বছরের বড়ো। বোনের সঙ্গে তাঁর বয়সের ব্যবধান আট বছর। ফলে শিশু ওসমানী বেড়ে ওঠেন একাকী। যাদের হাতে তিনি মানুষ হয়েছেন, তাদের একজন রুস্তম আলী।
পিতা যখন আসামের বিভিন্ন স্থানে চাকরিরত তখন তাঁর সহকর্মী বা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সন্তানদের সঙ্গে তার শৈশব কেটেছে। বৃটিশ ভারতের হোম সেক্রোটারী স্যার চার্লস রোডসের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে তাঁর শৈশব কাটে জোড়হাটে।
ওসমানীর ছাত্র জীবনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করেছে সিলেট গভর্নমেন্ট হাইস্কুলে পাঠকালীন সময়। ইউরোপীয় প্রতিবেশীদের সাহচর্যে থাকলেও বাঙালী স্কুলে ভর্তির কারণ তার মা।
স্কুল জীবন শেষে তিনি চলে যান আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে। সে সময়ে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় ছিল যথেষ্ট পরিচিত এবং হলে স্থান না পেলে পড়াশোনা ছিল অসম্ভব। আজকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে আলীগড়ের তৎকালীন পরিবেশ ছিল মুক্ত ও স্বাধীন। মুক্ত বুদ্ধির চর্চা হতো সেখানে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল আত্মসম্মান ও বড়দের প্রতি সম্মান প্রদর্শন। আর শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে এখানে শেখানো হতো আত্মসংযম।
এই আলীগড়ের আবহাওয়াই জেনারেল ওসমানীর পরবর্তী জীবনে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে। এখানকার শিক্ষা, মানুষের প্রতি শোভন আচরণ, নিজের সম্পদ ও পারিবারিক ঐতিহ্যের বড়াই না করা, নিঃস্বার্থ হওয়া ইত্যাদি মেনে চলেন তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ওসমানী সামরিক বাহিনীতে যান ক্যাডেট হিসেবে। সামরিক বাহিনীতে সে সময় প্রাধান্য ছিল ইংরেজদের। বিশেষ করে অফিসার পদে। একটা ব্যাচে বৃটিশ ভারত থেকে রিক্রুট হতেন ৩০ জন—পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষার মাধ্যমে। বাকিরা রিক্রুট হতেন ইংল্যান্ড থেকে। বছরে ৩০০ অফিসারের মধ্যে ৩০ জন রিক্রুট হতেন ভারত থেকে। সর্বভারতীয়দের এই ত্রিশের কোটা থেকেই তিনি নির্বাচিত হন সেনাবাহিনীতে।
বৃটিশ সেনাবাহিনীতে ইংল্যান্ড থেকে যারা অফিসার হতো তারা ছিলেন বৃটিশ পাবলিক স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট ছাত্র। তাদের সঙ্গে ট্রেনিং-এর সময়ে সব বিষয়ে প্রতিযোগিতা করে গড়ে উঠতে হয়েছে তাঁকে। তাদের সঙ্গে থাকতে থাকতে বৃটিশদের কিছু কিছু বিশেষ গুণ যেমন মূল্যবোধ, ন্যায়-পরায়ণতা ও আনুগত্য প্রভৃতি গুণে গুণান্বিত হয়ে ওঠেন তিনি। তাঁদের আনুগত্যও আবার পারস্পরিক শ্রদ্ধার উপর প্রতিষ্ঠিত। ওসমানীও তাই পারস্পরিক বিশ্বাস নিয়মনিষ্ঠা ও শ্রদ্ধার মধ্য দিয়ে আনুগত্য প্রকাশ করে থাকেন এবং বিশ্বাস করেন।
আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হতো ছাত্রদের মাধ্যমে। এখানে এসে ও্রসমানী শিক্ষা পেলেন নেতৃত্বের। বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল পদে তিনি হয় নির্বাচিত নয়তো মনোনীত হয়েছেন। ছাত্ররাই চালাতেন ৪টি হাউস এবং নিয়ন্ত্রণ করতে শৃঙ্খলা। আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন ছাত্রের গায়ে পুলিশের হাত দেয়া ছিল অসম্ভব ব্যাপার। কোন ছাত্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে তা পুলিশ শৃঙ্খলা বিভাগে জানিয়ে দিতো। এই শৃঙ্খলা বিভাগেরও সদস্য, মনিটর বা কর্মাধ্যক্ষ ছিলেন ওসমানী। দু’বছর এই অর্জনপ্রিয় দায়িত্ব পালনের কাজটি করেছেন। এ কাজে ছাত্রীদের চেক করতে গিয়ে বেশ অসুবিধায় পড়তো হতো। কারণ তাদের দেখাতে হতো সম্মান কিন্তু করতে হতো শাসন। শৃঙ্খলা-রক্ষার কাজ তাঁকে নিজ জীবনে শৃঙ্খলাবদ্ধ হতে এবং আইন ও শৃঙ্খলার প্রতি কঠোরভাবে অনুগত থাকার প্রশিক্ষণ দেয়।
সৈনিক জীবনে তার এই শৃঙ্খলাপ্রিয়তা তাকে একজন সফল এবং জনপ্রিয় সেনানায়ক হতে সাহায্য করে। এ শিক্ষাই ওসমানীকে আইনভঙ্গের বা ন্যায়নীতি ভঙ্গের প্রতিবাদে সাহস যুগিয়েছে। সামরিক বাহিনীতে থাকাকালে একদিনের ঘটনা—দিল্লীর লালকেল্লার একাংশে অবস্থান ছিল ডিউক অব ওয়েলিংটন রেজিমেন্টের। ওসমানী এই রেজিমেন্টে সাময়িকভাবে এটাচড্ রূপে নিযুক্ত ছিলেন। এখানে থাকতো একটি কোম্পানী। কোম্পানীতে ছিল ৬ জন অফিসার, ২ জন ক্যাপ্টেন, ৪ জন লেফটেন্যান্ট ও সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট। মেসে তাদের ডিনার খেতে হতো। সেখানে একজন ক্যাপ্টেন ছিলেন স্যার রিচার্ড সেগরির ছেলে। সেগরি ছিলেন তাদের সামনে আদর্শ। অন্যজন ছিলেন ক্যাপ্টেন মরাল। তিনি জেনারেল পদেও উন্নীত হয়েছিলেন। একরাতে ডিনারে ক্যাপ্টেন সেগরি বলে ফেললেন, ‘কংগ্রেসী ব্যাটারা রাজা এবং রাষ্ট্রের শত্রু। সব ব্যাটাকে আন্দামানে পাঠানো উচিত।’ স্যুপ খেতে খেতে ওসমানী চিন্তা করলেন, একথাটি ঐতিহ্যবাহী সামরিক শৃঙ্খলার পরিপন্থী। মেসে নারী, রাজনীতি এবং ধর্ম বিষয়ে আলোচনা নিষিদ্ধ ছিল। তিনি তখন লেফটেন্যান্ট। এর প্রতিবাদ করে বললেন, ‘স্যার আমি মর্মাহত, সামরিক শৃঙ্খলার পরিপন্থী কাজ আপনি করেছেন।’ একথা বলায় সবাই চুপ করে গেলেন। সে রাতে অন্যান্য রাতের মত রেডিওতে বিবিসি’র অনুষ্ঠান শোনা হয়নি। যে যার কক্ষে ফিরে গেলেন। রাতেই বাকি তিনজন শ্বেতাঙ্গ লেফটেন্যান্ট তার রুমে এলেন। ভয় পেয়ে গেলেন ওসমানী। ভেবেছিলেন ওরা বোধহয় ক্রুদ্ধ। কিন্তু না। সবাই তাকে অভিনন্দন জানালো। বললো লিখিতভাবে কর্মকর্তাদের জানাতে। তিনি পরদিন তাই করলেন। তারপর তা ভুলে গেলেন। প্রায় একমাস পর ক্যাপ্টেন মরাল তাকে জানালেন পল্টনের অধিনায়ক তাঁকে ডেকেছেন ৫/৬ মাইল দূরে নতুন ক্যান্টনমেন্ট হেড কোয়ার্টারে। তখনকার দিনে কর্নেলের সঙ্গে লেফটেন্যান্টের দেখা করা ছিল প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। নির্ধারিত দিনে একই গাড়িতে ক্যাপ্টেন মরাল সেগরি এবং ওসমানী গেলেন অধিনায়কের দপ্তরে। অধিনায়ক কর্নেল ফেজার বললেন, ‘ওসমানী আমি তোমার অভিযোগ পড়েছি। আমি দুঃখিত ও লজ্জিত যে আমার বাহিনীতেও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। তবে আমি আনন্দিত এ কারণে যে তুমি তার প্রতিবাদ করেছো। আমি আশা করি তুমি যখন অধিনায়ক হবে তখন তোমার রেজিমেন্টে এ ধরনের ঘটনা যাতে না ঘটে তুমি সেদিকে লক্ষ্য রাখবে।’ ফিরতি পথে সেগরি এবং ওসমানী আবার একই গাড়িতে ফিরে চললেন। পথে সেগরি তার কাছে মাফ চেয়ে নেন।
এ ঘটনা ওসমানীর মনে বহুদিন প্রভাব বিস্তার করেছে। পরবর্তী জীবনে এ ঘটনা তাঁকে অধীনস্তদের মতামতের প্রতিও শ্রদ্ধাশীল করে তোলে।
পরিবারের আশা ছিল অন্য সবার মত ওসমানীও সিভিল সার্ভিস এ সরকারী চাকরি করবেন। ওসমানীও তাই মনে করতেন। অন্য কোন দিকে তার ঝোঁক ছিল না। সেজন্য লক্ষ্য ছিল সরকারী চাকরি করেন।
আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ঘটনা ওসমানীর জীবনকে প্রভাবিত করেছে। বিভিন্ন ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে এসে তিনি নিজের চিন্তাধারাকে সম্পৃক্ত করেছেন। এমনি এক ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে তার জীবনকে বদলে দিয়েছে—এককালের হবু আই সি এস ওসমানী যে কারণে সামরিক বাহিনীতে যোগ দিয়েছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ওসমানী ছিলেন ইউওটিসি বাহিনীর সদস্য। তখন দেরাদুনে ভারতীয় স্যান্ডহার্স্ট প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেশ কিছু ছাত্র কিংস কমিশন নিয়ে সামরিক বাহিনীতে যোগ দিয়েছেন। তখনও সামরিক বাহিনীতে যোগ দেয়ার চিন্তা তার মাথায় ঢোকেনি। ১৯৩৬ সালে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় ইউওিটিসিতে এ্যাডজুট্যান্ট হয়ে এলেন লর্ড বংশোদ্ভূত একজন সামরিক অফিসার ক্যাপ্টেন উইলান্স, পরবর্তীকালে যিনি বিখ্যাত সমরবিদ ফিল্ড মার্শাল মন্টেগোমারীর এ্যাডজুট্যান্ট হয়েছিলেন।
১৯৪০-এর ৫ অক্টোবর তিনি ইন্ডিয়ান মিলিটারী একাডেমী দেরাদুন থেকে সামরিক শিক্ষা সমাপ্ত করে বৃটিশ ইন্ডিয়ান আর্মিতে কমিশন পান। এরপর দ্রুত পদোন্নতি লাভ করে—১৯৪১-এর ফেব্রুয়ারী মাসে ক্যাপ্টেন এবং ১৯৪২-এর ফেব্রুয়ারী মাসে তৎকালীন বৃটিশ সাম্রাজ্যের সর্বকনিষ্ঠ মেজর হন। মাত্র ২৩ বছর বয়সে একটি ব্যাটেলিয়ন (যান্ত্রিক পরিবহন ব্যাটেলিয়ন)-এর অধিনায়ক হয়ে তিনি রেকর্ড সৃষ্টি করেন। সামরিক ইতিহাসে এত অল্প বয়সে একটি ব্যাটেলিয়ন পরিচালনা করার অন্য কোন নজির নেই। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে বেশির ভাগই বিভিন্ন যোদ্ধা সামরিক ফরমেশন-এর সঙ্গে একটি ইন্ডিপেন্ডেন্ট বা স্বতন্ত্র যান্ত্রিক পরিবহন বাহিনীর অধিনায়কত্ব করেন। তিনি বার্মার রণাঙ্গনে তাঁর বাহিনীকে ১৬ কোরের অধীনে সমাবেশ ও পরিচালনা করেন এবং ঐ যুদ্ধাঞ্চলে তিনি ছিলেন অতি অল্প কয়েকজন অশ্বেতাঙ্গ অধিনায়কদের অন্যতম।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর ১৯৪৬ সনে বৃটিশ সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ড সিলেকশন কমিটি কর্তৃক তাঁকে যে কোন স্টাফ কলেজে লং কোর্স বা উচ্চশিক্ষার দীর্ঘমেয়াদের অধ্যয়নের জন্য যোগ্য বলে মনোনীত করেন এবং তদানুসারে ১৯৪৭-এর ফেব্রুয়ারী মাসে অনুষ্ঠিত ফার্স্ট পোস্টওয়ার স্টাফ কলেজ প্রতিযোগিতামূলক এন্ট্রেস পরীক্ষায় বৃটিশ ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর অফিসারদের মধ্যে উচ্চ স্থান লাভ করে উত্তীর্ণ হন ও স্টাফ কলেজে ১৯৪৮ সনের কোর্সে স্থান লাভ করেন। এখানে উল্লেখযোগ্য, তিনি আইসিএসএ কোয়ালিফাইড হওয়ায় ইন্ডিয়ান পলিটিক্যাল সার্ভিসের জন্যও ১৯৪৬ সনে মনোনীত হন। কিন্তু তিনি সৈনিক জীবন পরিত্যাগ করতে অস্বীকার করেন। পরে ১৯৪৭-এর শুরুতে বিমান যোগে দিল্লী পৌঁছানোর জন্য সরকার কর্তৃক আহূত হয়ে তৎকালীন ভারতীয় অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র সচিব মিঃ জওহরলাল নেহেরুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। কিন্তু ওসমানী কূটনৈতিক পদ গ্রহণের প্রস্তাব সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন।
১৯৪৭ সনের প্রথমদিকে লেফটেন্যান্ট কর্নেলের পদে উন্নীত হবার যোগ্যতা যাচাইয়ের উদ্দেশ্যে ফার্স্ট স্পেশ্যাল সিনিয়র অফিসার্স কোর্সের জন্য তিনি মনোনীত হন। কৃতিত্বের সঙ্গে কোর্স সমাপ্ত করে তিনি বৃটিশ ভারতের সিমলাস্থ জেনারেল হেড কোয়ার্টার-এ মাস্টার জেনারেলের শাখায় সেকেন্ড গ্রেড স্টাফ অফিসার নিযুক্ত হন এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদের জন্য উপযুক্ত বলে মনোনীত হন। ভারত বিভাগ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই সিমলাস্থ কোয়ার্টার মাস্টার জেনারেল শাখায় পাকিস্তানের জন্য অংশ নির্ধারণ করার দায়িত্ব ওসমানীর উপর পড়ে। তিনি সিমলায় এর জন্য ‘পাকিস্তান সেল’ গঠন করে কাজ সম্পাদন করেন। পরবর্তী পর্যায়ে নতুন দিল্লীতে অবস্থিত সুপ্রীম কমান্ডার ফিল্ড মার্শাল অকিনলেকের অধীনে এ্যাডজু্ট্যান্ট জেনারেলের শাখায় তিনি পাকিস্তানের পক্ষ হতে বিভাগ কাজ সম্পাদন করেন। উভয়স্থলে অর্থাৎ সিমলায় ও দিল্লীতে অত্যন্ত জটিল ও সঙ্কটাপন্ন পরিবেশের মধ্যে নিজের জীবন বিপন্ন করে এই গুরুদায়িত্ব প্রতিপালন করেন।
১৯৪৭ সনের ৭ অক্টোবর পাকিস্তানে আগমনের দিনই তিনি লেফটেন্যান্ট কর্নেলের পদে উন্নীত হন এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গঠনরত সর্বপ্রধান কার্যালয়ে কোয়ার্টার মাস্টার জেনারেল শাখায় ফার্স্ট গ্রেড স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে বিভিন্ন বিভাগের কার্যনীতির সমন্বয়, পরিকল্পনা ও অধীনস্থ বিভাগের অফিসার ও অন্যান্য স্তরের আমলাদের নিয়োগ, উন্নতি, সংখ্যা নির্ধারণ ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ের গুরুদায়িত্ব পালন করেন। এই উচ্চ পদে তিনি স্টাফ কলেজে শিক্ষা লাভ করার আগেই নিযুক্ত হয়ে এবং মাত্র বছর চাকরি জীবনের মধ্যে বহু সিনিয়র অফিসারকে অতিক্রম করে লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে উন্নীত হয়ে একটি নতুন রেকর্ড স্থাপন করেন। এই পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার কিছুকাল পর তিনি কোয়েটা স্টাফ কলেজে ১৯৪৮ সনের স্টাফ কোর্সে যোগদান করেন। উল্লেখ্য, সদ্য প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানে বিদেশের স্টাফ কলেজে পাঠাবার কোন ব্যবস্থা তখন ছিল না।
১৯৫১ সনে জরুরী অবস্থা উপস্থিত হলে তাঁর অধিনায়কত্বে পাঞ্জাব পল্টন দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে পাঞ্জাব সীমান্তে নিজেদের চাইতেও বহুগুণ সংখ্যাগুরু ভারতীয় সেনাবাহিনীর দৃঢ় মোকাবেলায় সন্নিবেশিত হয়। সেই সময় তাঁর ব্যাটেলিয়ন পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক পরিদর্শিত ও প্রশংসিত হয়। পল্টনের অধিনায়কত্বে তাঁর দক্ষতা সম্বন্ধে অনুকূল রিপোর্টের পর ওসমানীকে তাঁর চাকরি জীবন প্রথমবারের জন্য তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে বদলি করা হয়।
প্রথমে তিনি মাত্র তিন বছর বয়স্ক ফার্স্ট ব্যাটেলিয়নের অধিনায়কত্ব করেন। এই সময় খুলনায় পুলিশ ও আর্মির মধ্যে এক উত্তেজনা সৃষ্টি হলে তৎক্ষণাৎ তিনি সুচারু কার্যকরী ব্যবস্থা (বেসামরিক কর্তৃপক্ষের সাহায্যে) গ্রহণ করেন। তৎকালীন প্রাদেশিক সরকারের রাজশাহী বিভাগের বাৎসরিক প্রশাসনিক রিপোর্টে এ বিষয়ে প্রশংসনীয় উল্লেখ করা হয়। পরে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেন্টারের পরিচালনা ভার গ্রহণ করেন কুর্মিটোলা অবস্থিত অস্বস্তিকর ব্যবস্থাপনার আওতাভুক্ত করে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে সেন্টারের স্থায়ী নিবাসে রেজিমেন্ট স্টোর স্থানান্তরিত করেন। চট্টগ্রাম সেনানিবাস তিনিই প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯৫৩ সনে ১০৭ নম্বর ব্রিগেডে স্থায়ী কমান্ডারের অনুপস্থিতিতে তিনি চার মাসকাল অস্থায়ীভাবে ব্রিগেড কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৫১ হতে ১৯৫৫ সালের মধ্যে তিনি খুলনা, যশোর, ঢাকা এবং চট্টগ্রামের স্টেশনের দায়িত্ব পালন করেন।
পরবর্তীকালে ১৯৫৫ সনে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস (ই, পি, আর)-এর অতিরিক্ত কমান্ডান্ট (যাকে বর্তমানে ডেপুটি ডি, জি, বলা হয়) হিসাবে পূর্ব বাংলা সরকারের অধীনে তাঁকে বহাল করা হয়।
এই পদে থাকাকালে ১৯৫৫-এর পুলিশ ধর্মঘটে ঢাকাস্থ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব তাঁকে প্রদান করা হলে তিনি স্থিরবুদ্ধি ও দক্ষতার সঙ্গে ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। ই, পি, আর-এ অবাঙালীদের নিয়োগ তিনি ব্ন্ধ করেন ও প্রথমবারের মত পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয়দের ই, পি, আর-এ নিয়োগের ব্যবস্থা করেন।
ই, পি, আর-এর অস্থায়ী নিয়োগ থেকে ফিরে এসে তিনি জেনারেল স্টাফ অফিসার গ্রেড—১ রূপে প্রতিষ্ঠিত হন। অল্প সময় পরেই জেনারেল হেড কোয়ার্টার্সের জেনারেল স্টাফ-এ ১৯৫৬ সালের মে মাসে মিলিটারী অপারেশনের ডেপুটি ডাইরেক্টর অর্থাৎ দেশ রক্ষার যুদ্ধ সম্পর্কীয় কার্য ও পরিকল্পনার সহ-পরিচালকের গুরুদায়িত্বে নিযুক্ত হয়ে কর্নেল পদে উন্নীত হন। প্রথমে তিনি দেশরক্ষা পরিকল্পনা ও দেশরক্ষা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ের সংযোজনায় নিয়োজিত হন। পরবর্তীকালে সেন্টো এবং সিয়াটোতে পাকিস্তানের অংশ গ্রহণের কারণে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পাকিস্তানের দেশরক্ষার পরিকল্পনায় নিয়োজিত হন এবং আন্তর্জাতিক সামরিক ও পরিকল্পনা বৈঠকে বিদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতিনিধিত্ব করেন। তাঁর সামরিক জ্ঞান দক্ষতা এবং সেই সঙ্গে সামরিক পর্যায়ে দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে অনমনীয় মনোভাব সদস্য রাষ্ট্রের সামরিক সর্বাধিনায়কদের প্রশংসা অর্জন করে। একবার সেন্টোর এক সদস্য রাষ্ট্রের চীফ অব স্টাফ অর্থাৎ সামরিক বাহিনীর প্রধান একটি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক সমস্যা বিবেচনার জন্য গঠিত কমিটিতে ওসমানীকে তাঁর পক্ষ থেকেও প্রতিনিধিত্ব করার অনুরোধ করেছিলেন। পাকিস্তান এয়ার ডিফেন্স কমিটিরও তিনি সদস্য ছিলেন। বিভিন্ন যুক্ত সামরিক অনুষ্ঠানে যোগদান করা ছাড়াও তিনি সেনাবাহিনীর জেনারেল হেড কোয়ার্টার্সে দুইট কমিটির সভাপতিত্ব ও পরিচালনা করেন। এই কমিটি দুইটি ছিল ভবিষ্যৎ যুদ্ধে স্থলবাহিনীর জন্য কি পরিমাণ রিজার্ভ বা অতিরিক্ত জনশক্তি ও যুদ্ধ সামগ্রীর প্রয়োজন তা নির্ধারণের জন্য গঠিত। কিছুকালের জন্য তিনি অস্থায়ী ব্রিগেডিয়ারের পদে ডাইরেক্টর অব মিলিটারী অপারেশন অর্থাৎ যুদ্ধ সম্বন্ধীয় কার্য ও পরিকল্পনার পরিচালক ছিলেন।
১৯৬১ সনে পাকিস্তানে প্রেসিডেন্ট যখন বিভিন্ন চুক্তিতে দেশের যোগদানের পুনর্বিবেচনা করার নির্দেশদান করেন এবং এর জন্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী একটি ইন্টারমিনিস্টারিয়াল কমিটি গঠন করেন, এতে ওসমানী প্রতিরক্ষ মন্ত্রণালয়ের প্রধান প্রতিনিধি ও মুখপাত্র মনোনীত হন এবং পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতির পুনর্বিবেচনা ও তৎসংশ্লিষ্ট সিদ্ধান্তের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
১৯৬৪ সনে তাঁকে আধুনিক সামরিক ব্যবস্থা ও বৈজ্ঞানিক উন্নতি অনুধাবন ও মূল্যায়ন করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাঠান হয়। সাঁজোয়া, ক্ষেপণাস্ত্র, গোলন্দাজ ও পদাতিক বাহিনী এবং বিমানবাহী শত্রু ও অস্ত্রের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা বাহিনী এবং পেন্টাগণসহ গুরুত্বপূর্ণ সামরিক প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন ও যুক্তরাষ্ট্রে জাতীয় ভিত্তিতে পরিকল্পনার সমন্বয় ব্যবস্থা লক্ষ্য করে দেশে প্রত্যাবর্তনের পর সংশ্লিষ্ট ব্যাপারে জেনারেল হেড কোয়ার্টার্স এবং পাকিস্তান এয়ার ডিফেন্স কমিটির নিকট বিস্তারিত রিপোর্ট পেশ করেন।
১৯৬৬-এর সেপ্টেম্বরের পাক-ভারত যুদ্ধে ডেপুটি ডাইরেক্টর অব মিলিটারী অপারেশন হিসেবে যুদ্ধরত বিভিন্ন সামরিক হেড কোয়ার্টার্সের সঙ্গে সংযোগার্থে যুদ্ধক্ষেত্রে যাওয়া ছাড়া যুদ্ধের প্রাক্কালে, যুদ্ধের সময় ও পরবর্তীকালে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সুনাম ও উন্নতির প্রতি তাঁর গভীর আগ্রহ তাঁকে বেদিয়ানকাসুর ফ্রন্টে যুদ্ধরত ফার্স্ট ব্যাটেলিয়নের প্রতি বার বার আকর্ষণ করতো।
চাকরি শেষের কয়েক মাস নিজের দায়িত্ব ছাড়া আর এক কর্মভার তাঁকে সমর্পণ করা হয়। তাঁকে সেনবাহিনীর ক্রীড়া নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের প্রেসিডেন্টও নিযুক্ত করা হয়। তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এককালীন উন্নতমানের গৌরব পুনরুদ্ধারে ব্রতী হন। ক্রীড়ার মান অবনতির কারণ যে সামরিক বাহিনীর ক্রীড়া সংস্থাগুলিতে তরুণ খেলোয়াড়দের অনুপস্থিতি এটা অনুধাবন করে তিনি এ সম্বন্ধে জরুরী ও কার্যকরী ব্যবস্থা অবলম্বন করেন। সর্বপ্রথম তাঁর দৃষ্টি সামরিক হকি টিমের উপর নিপতিত হয়। তাঁর দূরদৃষ্টির ফলেই মাত্র তিন মাসের মধ্যে ১৯৬৬ সনে অনুষ্ঠিত জাতীয় হকি চ্যাম্পিয়নশীপ খেলায় সামরিক দল কৃতিত্বের সঙ্গে ফাইনালে উন্নীত হয়।
১৯৬৫ সনের যুদ্ধের সংশ্লিষ্ট জরুরী পরিস্থিতিতে কর্নেল পদের জন্য নির্ধারিত চাকরি সীমার চেয়েও দীর্ঘকাল কর্তব্যরত থাকার পর এবং যুদ্ধ সম্বন্ধীয় কার্য ও পরিকল্পনার সহ-পরিচালক ও কর্নেল পদে উন্নীত হবার ঠিক দশ বছর পর ১৬ই মে ১৯৬৬ সালে ওসমানী অবসরের প্রাক্কালে ছুটি নেন এবং ১৬ই ফেব্রুয়ারী ১৯৬৭ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
১৯৭০ সনের জুলাই মাসে তিনি রাজনীতিতে যোগ দেন এবং ঐ বৎসরের ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে চারটি থানা (বালাগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, বিশ্বনাথ) সমন্বয়ে গঠিত পাকিস্তানের বৃহত্তম নির্বাচনী এলাকা থেকে তাঁর চারজন প্রতিদ্বন্দ্বীকে বিপুল সংখ্যক ভোটে পরাজিত করে জাতীয় পরিষদে জয়লাভ করেন।
১৯৭১ সনের ২৫শে এবং ২৬শে মার্চের মধ্যবর্তী রাত্রে পাকিস্তানী কমান্ডোদের একটি কোম্পানী বনানীতে ওসমানী যে বাড়িতে (তাঁর ভাইয়ের বাড়িতে) থাকতেন তার উপর আক্রমণ করে এবং তাঁকে মারার জন্য খোঁজে কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে তিনি রক্ষা পান। ওসমানীর প্রভুভক্ত সরালি কুকুর দু’টি কমান্ডোদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। পাকিস্তানী কমান্ডোরা কুকুর দু’টিকে সঙ্গীন দিয়ে মারে এবং গুলিও করে যদিও তারা বেঁচে যায়। নিউ ইস্কাটনের এক বাড়িতে আক্রমণকারী পাকিস্তানী ট্যাঙ্ক ও পদাতিক বাহিনীর বলতে গেলে নাকের ডগায় চার রাত ও তিনদিন একা থাকার পর ওসমানী ঢাকা ত্যাগ করেন। নৌকাযোগে ও পরে পায়ে হেঁটে তিনি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের যুদ্ধরত ব্যাটেলিয়নের সঙ্গে মিলিত হন।
মুক্তিযুদ্ধের আরম্ভে ওসমানী সক্রিয় তালিকা (Active List)-এ আহুত হন এবং ১৯৭১ সনের গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠনের সঙ্গে সঙ্গেই ওসমানীকে ১২ এপ্রিল হতে মন্ত্রী সমমর্যাদা সহ বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীসহ মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক নিযুক্ত করা হয়। তিনি দ্রুতবেগে নিয়মিত বাহিনী পুনর্গঠন করেন ও এ বিরাট গেরিলা বাহিনী (যাকে গণবাহিনী বলা হতো) গড়ে তোলেন এবং চরম বিপর্যয়ের মোকাবিলায় অটল সাহস ও অক্লান্ত পরিশ্রমের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেন। তার জন্য তিনি মিত্র ও শত্রু উভয়েরই প্রশংসা অর্জন করেন।
জাতির প্রতি তাঁর সেবার স্বীকৃতি স্বরূপ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্নেল এম. এ. জি. ওসমানী, পি; এস; সি;কে জেনারেল পদে উন্নীত করেন। ১৯৭২ সনের ৭ এপ্রিল হতে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়কের পদ বিলুপ্ত হওয়ায় তিনি সামরিক বাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেন এবং বাংলাদেশের গণ-পরিষদের সদস্য রূপে শপথ গ্রহণ করে পরিষদের আসন গ্রহণ করেন।
১৯৭২ সনের ১২ এপ্রিল জেনারেল ওসমানী বাংলাদেশ সরকারের জাহাজ চলাচল, অভ্যন্তরীণ নৌ ও বিমানমন্ত্রী হিসাবে কেবিনেটের সদস্যরূপে শপথ গ্রহণ করেন এবং এরপর হতে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন ব্যবস্থার পুনর্বাসন এবং শূন্য হতে দেশের জন্য একটা সুষ্ঠু জাহাজ ও বিমান পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। এ কাজ করতে গিয়ে তিনি আমাদের বন্ধু দেশেরও বিরাগভাজন হন কিন্তু তাকে তাঁর দেশপ্রেম ও কর্তব্যজ্ঞান কখনো সিদ্ধান্ত থেকে বিচলিত হতে দেয়নি।
১৯৭৩ সনের ৭ মার্চ স্বাধীন বাংলার প্রথম সাধারণ নির্বাচনে জেনারেল ওসমানী বালাগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ, এই দু’টি থানার সমন্বয়ে গঠিত নির্বাচনী এলাকা হতে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীকে বিপুল সংখ্যক ভোটে পরাজিত করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। জেনারেল ওসমানী শতরা ৯৪টি ভোট লাভ করেন।
বাংলাদেশের কেবিনেট মন্ত্রীপদে পুনর্নিয়োগের পর তাঁকে আগেকার মন্ত্রণালয়ের ভার ছাড়াও কয়েক মাসের জন্য ডাক, তার ও টেলিফোন যোগাযোগের দায়িত্ব দেয়া হয়।
১৯৭৪ সালে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী গ্রহণের মাধ্যমে বাকশাল গঠন করার প্রাক্কালে ওসমানী এর প্রতিবাদে সংসদ সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করেন। তারপর তিনি ছিলেন জনচক্ষুর অন্তরালে। ১৫ আগেস্টর প্রায় দু’সপ্তাহ পর দুপুরে ওসমানী তৎকালীন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাকের আমন্ত্রণে বঙ্গভবনে যান। খন্দকার মোশতাক তাঁকে সেখানে দেশরক্ষামন্ত্রীর পদ গ্রহণের অনুরোধ করেন। ওসমানী বাকশাল সংবিধানের প্রতি আনুগত্য দেখাবেন না বলে অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন। এছাড়া মোশতাক সরকার সম্পর্কেও তার প্রশ্ন ছিল। খন্দকার মোশতাক তাঁর সরকার বঙ্গবন্ধুরই মন্ত্রীপরিষদ সমন্বয়ে গঠিত বলে তাঁকে প্রতিরক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করতে বললে তিনি বলেন, প্রতিরক্ষার কথা বলে ১৯৭০ সালে তাকে রাজনীতিতে টেনে আনা হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেখা গেল অন্যরাও প্রতিরক্ষা খুব বোঝেন। খন্দকার মোশতাক যখন প্রতিশ্রুতি দিলেন সংসদীয় গণতন্ত্র প্রৃতিষ্ঠা করবেন এবং যখন জাতীয় সংকটের কথা বিশেষভাবে বললেন, তখন তিনি আনুগত্যের শপথ না নিয়ে অবৈতনিক প্রতিরক্ষা উপদেষ্টার পদ গ্রহণ করেন জাতীয় দায়িত্ব হিসেবে, সরকার নিযুক্ত ব্যক্তি রূপে নয়।
২রা ও ৩রা নবেম্বর ৭৫-এর মধ্যবর্তী রাতে মোশতাক আহমেদ কয়েকজনকে নিয়ে সংবিধান পরিবর্তন করে সংসদীয় গণতন্ত্র উত্তরণের পথ বের করার জন্য আলোচনায় বসেন। ওসমানী তাকে লিখিত প্রস্তাব দেন। আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন মনোরঞ্জন ধর, মালেক উকিল, ইউসুফ আলী, মুজাফফর আলী চৌধুরী প্রমুখ। আলোচনার এক পর্যায়ে তাঁরা সিদ্ধান্ত করলেন—যে সংসদ বাকশাল কায়েম করেছিল সে সংসদই গণতন্ত্র কায়েম করবেন। ওসমানী এতে সন্দেহ পোষণ করলে তাকে বলা হলো সংসদের মাধ্যমে সরকার এটা করতে সক্ষম হবেন এবং সামরিক আইনের মাধ্যমে এটা করা উচিত হবে না।
আলোচনার শেষে ওসমানী তাঁর বাসভবনে চলে যান। গাড়ির ড্রাইভার তাকে পৌঁছে দিয়ে গিয়ে টেলিফোনে জানায় বঙ্গভবন থেকে সেনাবাহিনীর প্রহরা উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। তিনি সঙ্গে সঙ্গে জিয়াউর রহমনকে টেলিফোন করেন। জিয়া তাঁকে জানান, তিনি খোঁজ নিচ্ছেন কি হলো। এরপর জেনারেল খলিলুর রহমানকে ঘটনা জানান এবং নির্দেশ দেন প্রয়োজনবোধে বি. ডি. আর দিয়ে প্রহরার ব্যবস্থা করার জন্যে। পরে আবার টেলিফোন করলেন জিয়াকে। বেগম খালেদা জিয়া টেলিফোন ধরলে তিনি জিয়াকে চান। বেগম জিয়া আমতা আমতা করলেন। টেলিফোন ছেড়ে দেন ওসমানী। পরে তিনি টেলিফোন করলেন খালেদ মোশাররফকে। উত্তর নেই। তারপর টেলিফোন করেন কর্নেল শাফায়াত জামিল ও আমিনুল হককে। উত্তর নেই। আবার জিয়াকে টেলিফোন করলেন। বেগম ধরলেন—উদ্বিগ্ন মনে হয় না! কিন্তু জিয়াকে পাওয়া গেল না। আবার চীফ অব জেনারেল স্টাফ খালেদ মোশাররফকে টেলিফোন করলেন। আবার আমিনুল হককে টেলিফোন করলেন। তিনি ধরেই বললেন সি জি এস তক্ষুণি এসেছেন। ওসমানী তার সঙ্গে কথা বললেন। জিজ্ঞেস করলেন—কি হচ্ছে? খালেদ মোশাররফ বললেন তিনি কিছুই জানেন না। ইতিমধ্যে টেলিফোন পেলেন বিমান বন্দর, টেলিফোন, বেতার কেন্দ্র দখল করা হয়েছে। আবার টেলিফোন করলেন খালেদ মোশাররফকে। জিজ্ঞেস করলেন, কি হচ্ছে? খালেদ মোশাররফ আশংকা করে বললেন যে ট্যাংক বাহিনী সম্ভবতঃ আক্রমণ করতে পারে। ওসমানী বললেন, ট্যাংক বাহিনী আক্রমণ করে কিছু্‌ করতে পারবে না। খালেদ মোশাররফ জানালেন তিনি দেখছেন কি করা যায়। কিছুক্ষণ পরে শব্দ পাওয়া গেল জেট বিমান টেক অফের। এরপর বাড়িওয়ালা গ্রুপ ক্যাপ্টেন হকের সঙ্গে তার গাড়িতে চড়ে ওসমানী বের হয়ে গেলেন। তার আগে ডি জি এফ আই এয়ার কমোডর কে এম ইসলামকে ফোন করে বললেন, এটা খুব খারাপ হচ্ছে। এ সম্বন্ধে তার সংস্থার ব্যর্থতা সম্পর্কেও প্রশ্ন করেন ওসমানী। বলেন এভাবে জাতি ধ্বংসের পথে চলে যাবে। গৃহযুদ্ধও বেঁধে যেতে পারে। এয়ার কমোডর বললেন যে তিনি বা তার লোকজন ঢুকতে পারছেন না। ওসমানী বের হয়ে এসে তেজগাঁ বিমানবন্দরের সামনে এয়ারফোর্সের কে এম সালামের বাংলোতে ঢুকে পড়লেন। ঢুকে দেখলেন সেখানে আর এক ব্যক্তি বসা। ঐ ব্যক্তি অনুরোধ করলেন তিনি যে ওখানে গিয়েছেন তা যেন কেউ না জানে। তিনি যখন বের হয়ে আসছেন তখন আর একজন ভিআইপিকে দেখলেন। সেখান থেকে ওসমানী এলেন বঙ্গভবনে। দেখলেন খন্দকার মোশতাক শুয়ে আছেন এক সোফায়। এখানে থাকতে থাকতেই রেসকোর্সের ট্যাংক ফোর্স কেন্দ্র থেকে টেলিফোন এলো জেট বিমানটি গুলি করে নামানোর অনুমতি চেয়ে। ওসমানী সে অনুমতি দেননি। টেলিফোন করে খালেদ মোশাররফকে বললেন, বিমান নামিয়ে দিতে। খালেদ মোশাররফ বললেন তিনি চেষ্টা করছেন। দুপুরের দিকে কয়েকজন অফিসার এলেন বঙ্গভবনে। এসে বললে, তারা খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে গোপনে কথা বলতে চান। কিছুক্ষণ পর তাদেরই সিনিয়র একজন অফিসার এসে ওসমানীকে ডেকে নিয়ে গেলেন আলোচনা কক্ষে। তাঁরা কয়েকটা কথা বলে ওসমানীকে বললেন, খন্দকার মোশতাককে তা মেনে নিতে বলতে। ওসমানী তাতে রাজী হননি। ইতিমধ্যে অন্য এক ঘটনার সঙ্গে জড়িত এক ব্যক্তিও এসে ওসমানীকে অনুরোধ করেন। ওসমানী অসম্মতি জানালে ঐ ব্যক্তি মন্তব্য করেন ‘ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব নাকি আপনার সম্পর্কে বলেছিলেন—‘স্টাবর্ন ক্যারেক্টার’ আজে দেখছি আইয়ুব ঠিকই বলেছিলেন।’ এরপর বিকেলে দিকে খালেদ মোশাররফ জানান যে, তিনি সন্ধ্যার পর বঙ্গভবনে আসতে চান। সন্ধ্যার অনেক পর এয়ার ভাইস মার্শাল এম, জি, তাওয়াব, রিয়ার এডমিরাল এম এইচ খান এবং খালেদ মোশাররফ এসে জানান, কয়েকজন লোককে দেশের বাইরে পাঠাতে গিয়ে তাদের দেরী হয়ে গেল। ওসমানী তখন ক্লান্ত। তাই সেদিন আর কোন কথা হয়নি।
পরদিন উক্ত তিন বাহিনী প্রধান এসে জানান, খন্দকার মোশতাকের প্রতি তারা অনুগত। এই বৈঠকে খালেদ মোশাররফ পকেট থেকে বের করে জিয়াউর রহমানের পদত্যাগ পত্র দেখান। এই পর্যায়ে একজন নতুন চীফ অব আর্মি স্টাফ নিয়োগের জন্য চাপ দেয়া হয়। খন্দকার মোশতাক বলেন মন্ত্রীসভার পরামর্শ ছাড়া তিনি কিছু করতে পারবেন না।
সন্ধ্যায় মন্ত্রীসভার বৈঠক বসে। প্রতিরক্ষা বাহিনী প্রধান এবং নৌ ও বিমান বাহিনী প্রধানের পক্ষে খালেদ মোশাররফ এসে সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে চলে যান। তারপর মন্ত্রীসভা জেলহত্যা সম্পর্কে আলোচনা শুরু করে।
কিছুক্ষণ পর কেবিনেট রুমের দরজা খুলে তাওয়াব ইশারা করলেন ওসমানীকে বাইরে যেতে। ওসমানী বাইরে এসে দেখেন তাওয়াব ও খালেদ মোশাররফ—দাবী করলেন, খুব শীঘ্রই চীফ অব স্টাফ নিয়োগ করতে হবে। তখন এডমিরাল এম এইচ খানও উপস্থিত ছিলেন। খন্দকার মোশতাক বাইরে এসে তৎক্ষণাৎ চীফ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না বললে কিছুক্ষণের মধ্যে শাফায়াত জামিলের নেতৃত্বে কয়েকজন অস্ত্রধারী ব্যক্তি কেবিনেট রুমে ঢুকে পড়ে এবং সবার দিকে অস্ত্র তাক করে। ওসমানী এসে কাউকে কিছু না বলে সবাইকে ধরে ধরে বাইরে নিয়ে যেতে শুরু করেন। একটু পরেই শাফায়াত জামিল এসে খন্দকার মোশতাককে বললেন ‘আপনাকে ও মন্ত্রীসভাকে পদত্যাগ করতে হবে এবং বিচারপতি সায়েমকে রাষ্ট্রপতি বানাতে হবে।’ এ পর্যায়ে মনোরঞ্জন ধর অথবা আসাদুজ্জামান বলেন ‘তাহলে স্পীকার মালেক উকিলকে রাষ্ট্রপতি করতে হবে।’ এতে ক্ষুব্ধ হয়ে শাফায়াত জামিল কটু মন্তব্য করে বলেন যে ‘আপনারা যদি সংসদীয় গণতন্ত্র বাদ দিয়ে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারেন, এটাও পারবেন করতে।’ এরপর ওসমানী তাকে সতর্ক করায় শাফায়াত জামিল ওসমানীর সঙ্গেও রূঢ় ব্যবহারের প্রতিবাদ করায় জেনারেল খলিলুর রহমানকে শাফায়াত জামিল বলেন, ‘আপনি বন্দী।’ এরপর খালেদ মোশাররফ শাফায়াত জামিলকে সরিয়ে নিয়ে যান।
বেশ কিছুক্ষণ পর বঙ্গভবনে একজন অফিসার এসে ওসমানীকে বলেন, প্রধান বিচারপতি সায়েম তার সঙ্গে দেখা করতে চান। বিচারপতি সায়েম জানতে চান, তাকে কেন আসতে বলা হয়েছিল। ওসমানী বললেন, তিনি তাকে আসতে বলেননি। বিচারপতি সায়েম বললেন, তাহলে কেন তারা তাকে নিয়ে এসেছে? এ সময় ওসমানী ভাবলেন, বিচারপতি যদি রাষ্ট্রপ্রধান হয় তাহলে দেশটা অন্ততঃ আইনের পথে চলবে। সবাই তখন আতংকিত। এরপর মন্ত্রীসভার সদস্যদের চলে যেতে বলা হয়। রয়ে গেলেন তাহের ঠাকুর, শাহ মোয়াজ্জেম এবং আরেকজন। খন্দকার মোশতাক তখনো সেখানে বসেছিলেন। ওসমানী বললেন, তিনি তখনও রাষ্ট্রপতি। তাকে এভাবে বসিয়ে রাখা ঠিক নয়। তখন ব্রিগেডিয়ার মরহুম মশহুরুল হক নির্দেশ প্রাপ্ত হয়ে খন্দকার মোশতাককে উপরের তলায় রাষ্ট্রপতির কক্ষে নিয়ে যান। এরপর ওসমানী বাসায় চলে যান। পরদিন রেডিওতে শোনেন স্পীকার ছাড়াও কোন মনোনীত ব্যক্তি রাষ্ট্রপতি হতে পারবেন বলে খন্দকার মোশতাক অধ্যাদেশ জারী করেছেন।
৭ নবেম্বর সকালে যখন ওসমানী নীচতলায় বাড়িওয়ালাদের সঙ্গে বসে চা খাচ্ছিলেন তখন খন্দকার মোশতাকের টেলিফোন আসে। টেলিফোনে খন্দকার মোশতাক জানান কিছু সামরিক ও বেসামরিক লোক তাকে বেতার কেন্দ্রে নিয়ে এসেছে। মোশতাক সাহেবের অনুরোধে রেডিও খুলে ওসমানী জিয়ার বক্তৃতা শুনতে পান। জিয়া বলছেন, তিনি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক। আইনের চোখে তখন দেশের তিনজন কর্ণধার দাঁড়িয়ে গেছেন।
ওসমানী বের হয়ে এলেন ঘটনা সম্পর্কে খোঁজ নেয়ার জন্য প্রবল গোলাগুলি ও সিপাহী জনতার ভীড় ঠেলে বেতার কেন্দ্রে এসে দেখলেন খন্দকার মোশতাক এক সোফায় শুয়ে আছেন। মোশতাক বললেন, তাঁকে কিছু সামরিক ও বেসামরিক লোক বেতার কেন্দ্রে নিয়ে এসেছে এবং রাষ্ট্রপতি হতে বলেছে। তিনি রাষ্ট্রপতি হতে পারবেন না, যেহেতু আগের দিনই বিচারপতি সায়েম রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নিয়েছেন।
বহু চেষ্টার পর জেনারেল জিয়াকে টেলিফোনে যোগাযোগ করে তাঁর অবস্থান সম্পর্কে খবর নিয়ে ওসমানী প্রতিরক্ষা বাহিনীর তিন প্রধান এবং প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রধানকে আর্টিলারী রেজিমেন্টের দফতরে সমবেত হতে অনুরোধ জানালেন।
ওসমানী তৎকালীন রাষ্ট্রপতির প্রধান সচিব মাহবুবুল আলম চাষীকে ডেকে সঙ্গে নিয়ে গোলাগুলির ভেতর রওয়ানা দেন। পথে যেত যেতে ওসমানী কতকগুলো ব্যাপার টুকে নেয়ার জন্য জনাব চাষীকে বলেন। তিনি বলেন নির্ধারণ করতে হবে রাষ্ট্রপতিকে, এই সরকারে লক্ষ্য কি গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের পথ কি হবে প্রর্ভতি।
আর্টিলারী রেজিমেন্টের দফতরে গিয়ে দেখলেন সেখানে জিয়া ও কর্নেল তাহের বসে আছেন। ওসমানী জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি ব্যাপার আবু তাহের তুমি এখানে কেন?’ আবু তাহের জবাব দিলেন—তিনিই জিয়াকে মুক্ত করেছেন। ওসমানী জিয়ার দিকে তাকাতে তিনি সম্মতিসূচক মাথা নাড়েন।
সেখানে আয়োজিত সভায় ঠিক হয় গৃহযুদ্ধ ঠেকাতে রাষ্ট্রপতি সায়েমকেই হতে হবে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক। তখন জিয়া বলেন তিনি উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হবেন। এতে অন্য দুই বাহিনী প্রধান আপত্তি করলেন। ঠিক হয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য এই সরকারের লক্ষ্য হবে বেসামরিক রাজনৈতিক ব্যক্তিদের নিয়ে একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করা। সেদিনকার এই বৈঠকে গৃহীত সবগুলো সিদ্ধান্ত প্রণয়ন সম্পর্কে উপদেশ দিয়েছিলেন ওসমানী।
এরপর তিনি বিচারপতি সায়েমের বাসভবনের দিকে রওয়ানা হন। ইতিমধ্যে সেনাবাহিনীর বেশ কিছু লোক এসে জিয়াকে ঘিরে ধরে দাবী করে তারা খন্দকার মোশতাককে রাষ্ট্রপতি হিসেবে দেখতে চায়। জিয়া তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। সেখান থেকে তারা প্রথম বেতার কেন্দ্রে আসেন। বেতার কেন্দ্রে জিয়া খন্দকার মোশতাককে জানান, সৈনিকরা তাঁকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখতে চায়। খন্দকার মোশতাক তাতে অসম্মতি জানান। সেখানে ঠিক হলো বিচারপতি সায়েম এবং খন্দকার মোশতাক বেতারে ভাষণ দেবেন। এ সম্পর্কে জিয়াই ঘোষণা করে জানিয়েছেন বেতার কেন্দ্র হতে। সে ভাষণ প্রচারিত হয়েছিল সেদিন রাতে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় তিন তিনবার ওসমানী মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে বেঁচে যান। প্রথমবার যুদ্ধের প্রথম দিকে একটি জীপ চালাতে চালাতে ভুলক্রমে শত্রুপক্ষের একটি অবস্থানে ঢুকে পড়েন। সেখানে দেখতে পান হেলমেট পরা পাঞ্জাবী সৈন্যরা ট্রেঞ্চ খুঁড়ছে। ওসমানী তাদের কাছে গিয়ে নিঃশব্দে নির্বিঘ্নে জীপ চালিয়ে চলে আসেন। যুদ্ধের শেষ দিকে কুমিল্লার ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট দখল নেয়ার পর একদিন পরিদর্শনে বের হন। একটি পুকুরের পাড়ে যেতেই তাঁর দিকে লক্ষ্য করে মেশিনগানের গুলি ছোঁড়া হয়। তিনি পুকুরের পাড়ের আড়ালে লুকিয়ে প্রাণ বাঁচান। পরে দেখা যায় গুলি তাঁর থেকে মাত্র ১৮ ইঞ্চি দূরে পড়েছিল। অপর ঘটনা হলো হেলিকপ্টারে ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় আসার পথে। সেখানে মেশিনগানের গুলিতে তেলের ট্যাংক ফেটে যায়। তবু হেলিকপ্টারটি ১০ মিনিট আকাশে ভেসে থাকে। এবং তারা নিরাপদে অবতরণ করেন। ওসমানীর সঙ্গে হেলিকপ্টারে ছিলেন তৎকালীন চীফ অব স্টাফ জেনারেল রব এবং ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী।
ওসমানী সারা জীবন ধরে যদি কোন রাজনৈতিক দর্শন পছন্দ করে থাকেন তবে তা হচ্ছে সংসদীয় গণতন্ত্র। তিনি বিশ্বাস করেন বাংলাদেশের মানুষ দীর্ঘ ২৩ বছর সংসদীয় গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছে। তিনি দেখলেন বাকশাল হচ্ছে একদলীয় রাষ্ট্রপতি শাসিত ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা, স্বৈরাচারী ব্যবস্থা। এটা মানবতাবাদী নয় বলে তিনি একে ভয় করতেন। তিনি মনে করেন বাকশাল ছিল জনগণের কাছে আওয়ামী লীগের দেয়া প্রতিশ্রুতির বরখেলাপ। বাকশাল সৃষ্টির কয়েক মাস আগে অন্য একটি দলের নেতারা এসে বাকশাল চিন্তাধারার অনুরূপ সংগঠন গড়ার সম্ভাবনার কথা বললে ওসমানী তখনই বিরোধিতা করেন।
১৯৭৫ এর ক্রান্তিলগ্নে, বাকশাল গঠিত হলে এই মহান ব্যক্তিত্ব যিনি তার কাঠামোর পুরোটাই মানবিক গুণাবলীতে সম্পৃক্ত করেছেন, আর একবার এক পর্বতসম গণতন্ত্র বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন।
১৯৭৬ সালে তিনি জাতীয় জনতা পার্টি গঠন করেন। ৭৮ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে গণ ঐক্যজোটের প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ৮১ সালে তিনি নাগরিক কমিটির জাতীয় প্রার্থী হিসাবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।
এ নির্বাচনের আগেই গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখার প্রশ্নে জনমনে সন্দেহের উদ্রেক হলে তিনি স্পষ্টভাষায় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পক্ষে বক্তব্য তুলে ধরেন। জেনারেল ওসমানীর সে বক্তব্য অচিরেই অভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হয়।
জেনারেল ওসমানী সম্পর্কে ডঃ আহমদ শরীফ বাংলা একাডেমীর আলোচনা সভায় বলেছিলেন, ‘জেনারেল ওসমানী সৎ ছিলেন। সৎ মানুষেরা সরল হয়। সরল বটেই তিনি প্রতারিত হয়েছেন। জাতিকে বিশ্বাস করে গণতন্ত্রের পক্ষে তিনি রায় চেয়েছিলেন জাতি সে বিশ্বাসের দাম দিতে পারেনি। সেনাবাহিনীর মধ্য থেকে কিভাবে গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হয় তিনি হলেন তার সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ।’

[জীবন কাহিনী জেনারেল ওসমানীর সঙ্গে সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে রচিত।]

[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/05/1984.02.24-osmani.pdf” title=”1984.02.24 osmani”]

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!