শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
আস্থায়ী রাষ্ট্রপতি কতৃক আইন বলবৎকরন আদেশ জারী |
বাংলাদেশ সরকার, পররাষ্ট্র মন্তনালয়ের বহির্বিশ্ব প্রচার বিভাগ কতৃক প্রকাশিত পুস্তিকা বাংলাদেশঃ কন্টেম্পরারি ইভেন্ট এ্যান্ড ডকুমেন্টস | ১০ এপ্রিল ১৯৭১ |
আইনের ধারাবাহিকতা বলবৎকরণ আদেশ
মুজিবনগর,
তারিখ ১০ এপ্রিল ১৯৭১
আমি, বাংলাদেশের উপ-রাষ্ট্রপতি এবং অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, স্বাধীনতা ঘোষণাপত্র প্রদত্ত ক্ষমতাবলে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল তারিখে এ আদেশ জারি করছি যে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশে যে সকল আইন চালু ছিল, তা ঘোষণাপত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে একইভাবে চালু থাকবে, তবে প্রয়োজনীয় সংশোধনী সার্বভৌম স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের জন্য করা যাবে। এই রাষ্ট্র গঠন বাংলাদেশের জনসাধারণের ইচ্ছায় হয়েছে। এক্ষণে, সকল সরকারি, সামরিক, বেসামরিক, বিচার বিভাগীয় এবং কূটনৈতিক কর্মকর্তা ও কর্মচারী যারা বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করেছেন, তারা এতদিন পর্যন্ত নিয়োগবিধির আওতায় যে শর্তে কাজে বহাল ছিলেন, সেই একই শর্তে তারা চাকুরিতে বহাল থাকবেন। বাংলাদেশের সীমানায় অবস্থিত সকল জেলা জজ এবং জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং সকল কূটনৈতিক প্রতিনিধি যারা অন্যত্র অবস্থান করছেন, তারা সকল সরকারি কর্মচারীকে স্ব স্ব এলাকায় আনুগত্যের শপথ গ্রহণের ব্যবস্থা করবেন।
এই আদেশ ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ থেকে কার্যকর করা হয়েছে বলে গণ্য করতে হবে।
স্বাক্ষর:- সৈয়দ নজরুল ইসলাম
অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি।
<003.006.007>
.
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
বাংলাদেশবাসীর উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদের ভাষণ |
বাংলাদেশ সরকার, গণসংযোগ বিভাগ |
১১, এপ্রিল, ১৯৭১ |
বাংলাদেশবাসীর উদ্দেশে
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত
বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে
প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদের বেতার ভাষণ
(স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হ’তে ১১-৪-৭১ তারিখে প্রচারিত)
স্বাধীন বাংলাদেশের বীর ভাইবোনেরা,
বাংলদেশের সাড়ে সাত কোটি মুক্তিপাগল গণমানসের নেতা বজ্ঞবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর সরকারের পক্ষ থেকে আমি আপনাদেরকে আমার সংগ্রামী অভিনন্দন জানাচ্ছি আমরা শ্রদ্ধাভিরে স্মরণ করছি তাঁদের যাঁরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষা করতে গিয়ে তাঁদের মূল্যবান জীবন আহূতি দিয়েছেন যতদিন বাংলার আকাশে চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-তারা রইবে, যতদিন বাংলার মাটিতে মানুষ থাকবে ততদিন মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামের বীর শহীদদের অমর স্মৃতি বাঙালীর মানসপটে চির অম্লান থাকবে।
২৫শে মার্চ মাঝরাতে ইয়াহিয়া খান তার রক্তলোলুপ সাঁজোয়া বাহিনীকে বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর লেলিয়ে দিয়ে যে নরহত্যাযজ্ঞের শুরু করেন তা প্রতিরোধ করবার আহবান জানিয়ে আমাদের প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষনা করেন। আপনারা সব কালের সব দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামী মানুষের সাথে আজ একাত্ম। পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদার দস্যুবাহিনীর বিরুদ্ধে যে প্রতিরোধ আপনারা গড়ে তুলেছেন তা এমন এক ইতিহাস সৃষ্টি করেছে যে, পৃথিবীর সমস্ত স্বাধীনতাকামী মানুষের কাছে আপনাদের এ অভূতপূর্ব সংগ্রাম সর্বকালের প্রেরণার উৎস হয়ে রইল। প্রত্যেক দিনের সংগ্রামের দিনপঞ্জী আমাদের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করছে, বিশ্বের কাছে আমাদের গৌরব বৃদ্ধি করছে।
আপনাদের অদম্য সাহস ও মনোবল যা দিয়ে আপনারা রুখে দাঁড়িয়েছেন ইয়াহিয়ার ভাড়াটে দস্যুদের বিরুদ্ধে, তার মধ্যে দিয়ে আপনারা এইটেই প্রমাণ করেছেন যে, যুদ্ধক্ষেত্রাস্তীর্ণ ধবংসাবশেষের মধ্য দিয়ে ধূলি-কাদা আর রক্তের ছাপ মুছে এক নতুন বাঙালী জাতি জন্ম নিল। পৃথিবীর কাছে আমরা ছিলাম এক শান্তিপ্রিয় মানুষ। বন্ধুবাৎসল্যে, মায়া ও হাসি-কান্নায়, গান, সংস্কৃতি আর সৌন্দর্যের ছায়ায় গড়ে ওঠা আমরা ছিলাম পল্লী-বাংলার মানুষ। পৃথিবী ভাবত, আমরাও ভাবতাম যুদ্ধ ও রণঢংকা আমাদের থেকে অনেক দূরে। কিন্তু আজ?
আমাদের মানবিক মূল্যবোধ ও আদর্শের পতাকা সমুন্নত রেখে আমরা আবার প্রমাণ করেছি যে আমরা তীতুমীর-সূর্য্যসেনদের বংশধর স্বাধীনতার জন্যে যেমন আমরা জীবন দিতে পারি, তেমনি আমাদের দেশ থেকে বিদেশী শত্রুসেনাদের চিরতরে হটিয়ে দিতেও আমরা সক্ষম। আমাদের অদম্য সাহস ও মনোবলের কাছে শত্রু যত প্রবল পরাক্রম হোক না কেন, পরাজয় বরণ করতে বাধ্য। আমরা যদি প্রথম আঘাত প্রতিহত করতে ব্যর্থ হতাম তাহলে নতুন স্বাধীন প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হয়ত কিছুদিনের জন্য হলেও পিছিয়ে যেত। আপনারা শত্রুসেনাদের ট্যাঙ্ক ও বোমারু বিমানের মোকাবিলা করেছেন এবং আপনাদের যার হাতে যে অস্ত্র ছিল তাই নিয়েই রুখে দাঁড়িয়েছেন এবং তাদেরকে পিছু হটে গিয়ে নি শিবিরে আশ্রয় নিতে বাধ্য করেছে। বাংলাদেশে
<003.006.008>
.
আজ স্বাধীন, বাংলাদেশ আজ মুক্ত। বৈদেশিক সাংবাদিকরা আজ স্বাধীন বাংলাদেশের যে কোন জায়গায় বিনা বাধায় ঘুরে বেড়াতে পারেন এবং আপনাদের এ বিজয়ের কথা তাঁরা বাইরে জগৎকে জানাচ্ছেন।
আজ প্রতিরোধ আন্দোলনের কথা গ্রামবাংলার প্রতিটি ঘরে পৌঁছে গেছে। হাজার হাজার মানুষ আজকের এই স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দিয়েছেন। বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ই, পি, আর-এর বীর বাঙালী যোদ্ধারা এই স্বাধীনতা সংগ্রামের যে যুদ্ধ তার পুরোভাগে রয়েছেন এবং তাদেরকে কেন্দ্র করে পুলিশ, আনসার, মোজাহিদ, আওয়ামীলীগ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী, ছাত্র, শ্রমিক ও অন্যান্য হাজার হাজার সংগ্রামী মানুষ এই যুদ্ধে যোগ দিয়েছেন। অতি অল্প সময়ের মধ্যে এদেরকে সমর কৌশলে পারদর্শী করা হয়েছে ও শত্রুদের কাছে থেকে ছিনিয়ে নেয়া অস্ত্র ও গোলা-বারুদ দিয়ে বাংলার এ মুক্তিবাহিনীকে শত্রুদের মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। সাগরপারের বাঙালী ভাইয়েরা যে যেখানে আছেন আমাদেরকে অস্ত্র ও অন্যান্য সাযায্য পাঠাচ্ছেন।
সিলেট ও কুমিল্লা অঞ্চলে বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর খালেদ মোশাররফকে আমরা সমর পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছি। খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে আমাদের মুক্তিবাহিনী অসীম সাহস ও কৃতিত্বের সাথে শত্রুর সংগে মোকাবেলা করেছেন এবং শত্রুসেনাদেরকে সিলেট ও কুমিল্লার ক্যান্টনমেন্টের ছাউনিতে ফিরে যেতে বাধ্য করেছেন। আমাদের মুক্তিবাহিনী শীঘ্রই শত্রুকে নিঃশেষ করে দেবার সংকল্প গ্রহন করেছে।
দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে মেজর সফিউল্লার উপর। ময়মনসিংহ ও টাংগাইল এলাকা সম্পূর্ণভাবে মুক্ত করে আমাদের মুক্তিবাহিনী ঢাকার দিকে অগ্রসর হবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। পূর্বাঞ্চলের এই তিনজন বীর সমর পরিচালক ইতিমধ্যে বৈঠকে মিলিত হয়েছেন এবং একযোগে ঢাকা রওনা হবার পূর্বেই পূর্বাঞ্চলের শত্রুদের ছোট ছোট শিবিরগুলোকে সমূলে নিপাত করবার পরিকল্পনা গ্রহন করেছেন।
চট্টগ্রাম ও নোয়াখলী অঞ্চলের সমর পরিচালনার ভার পড়েছে মেজর জিয়াউর রহমানের ওপর। নৌ, স্থল ও বিমান বাহিনীর আক্রমণের মুখে চট্টগ্রাম শহরে যে প্রতিরোধসমূহ গড়ে উঠেছে এবং আমাদের মুক্তিবাহিনী ও বীর চট্রলের ভাই-বোনেরা যে সাহসিকতার সাথে শত্রুর মোকাবেলা করেছেন, স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস এই প্রতিরোধ স্ট্যালিনগ্রাডের পাশে স্থান পাবে। এই সাহসিকতাপূর্ণ প্রতিরোধের জন্য চট্টগ্রাম আজও শত্রুর কবলমুক্ত রয়েছে। চট্টগ্রাম শহরের কিছু অংশ ছাড়া চট্টগ্রাম ও সম্পূর্ণ নোয়াখালী জেলাকে “মুক্ত এলাকা” বলে ঘোষণা করা হয়েছে।
ময়মনসিংহ ও টাংগাইল অঞ্চলের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে মেজর সফিউল্লার উপর। ময়মনসিংহ ও টাংগাইল এলাকা সম্পূর্ণভাবে মুক্ত করে আমাদের মুক্তিবাহিনী ঢাকার দিকে অগ্রসর হবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। পূর্বাঞ্চলের এই তিনজন বীর সমর পরিচালক ইতিমধ্যে বৈঠকে মিলিত হয়েছেন এবং একযোগে ঢাকা রওনা হবার পূর্বেই পূর্বঞ্চাওলের শত্রুদের ছোট ছোট শিবিগুলোকে সমূলে নিপাত করবার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন।
দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে ই,পি আর এর বীর সেনানী মেজর ওসমানের ওপর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে কুষ্টিয়া ও যশোহর জেলার। কুষ্টিয়ার ঐতিহাসিক বিজয়ের পর আমাদের মুক্তিবাহিনী সমস্ত এলাকা থেকে শত্রুবাহিনীকে বিতাড়িত করেছে এবং শত্রুসেনা এখন যশোহর ক্যান্টনম্যান্ট ও খুলনা শহরের একাংশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। মেজর জলিলের ওপর ভার দেয়া হয়েছে ফরিদপুর-খুলনা-বরিশাল-পটুয়াখালীর।
উত্তরবংগে আমাদের মুক্তিবাহিনী মেজর আহমদের নেতৃত্বে রাজশাহীকে শত্রুর কবল থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত করেছেন। মেজর নজরুল হক সৈয়দপুরে ও মেজর নেয়াজেশ রংপুরে শত্রুবাহিনীকে সম্পূর্ন অবরোধ করে বিব্রত করে তুলেছেন। দিনাজপুর, পাবনা ও বগুড়া জেলাকে সম্পূর্ন মুক্ত করা হয়েছে। রংপুর ও সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট এলাকা ছাড়া জেলার বাকি অংশ এখন মুক্ত।
স্বাধীনতা সংগ্রামে আমাদের এ অভূতপূর্ব সাফল্য ভবিস্যতে আরও নতুন সাফল্যের দিশারী। প্রতিদিন আমাদের মুক্তিবাহিনীর শক্তি বেড়ে চলেছে। একদিকে যেমন হাজার হাজার মানুষ মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিচ্ছে, তেমনি শত্রুর আত্মসমর্পণের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলেছে। আর এই সংগে আমাদের নিয়ন্ত্রণে আসছে শত্রুর কেটে নেয়া হাতিয়ার। এই প্রথমিক বিজয়ের সাথে সাথে মেজর জিয়াউর রহমান একটি পরিচালনা কেন্দ্র গড়ে তোলেন এবং সেখান থেকে আপনারা শুনতে পান স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম কন্ঠস্বর। এখানেই প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের কথা ঘোষণা করা হয়।
<003.006.009>
.
আপাততঃ আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রধান কার্যালয় স্থাপিত হয়েছে দক্ষিন- পশ্চিম অঞ্চলের মুক্ত এলাকায়। পূর্বাঞ্চলের সরকারী কাজ পরিচালনার জন্যে সিলেট-কুমিল্লা এলাকায় বাংলাদেশ সরকারের আর একটি কার্যালয় স্থাপন করা হয়েছে।
আমরা এখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সংবাদপত্রের প্রতিনিধি, কুটনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রতিনিধিদের আমন্ত্রন জানাচ্ছি, তাঁরা যেন স্বচক্ষে এবং সরেজমিনে দেখে যান যে স্বাধীন বাংলাদেশ আজ সত্যে পরিণত হয়েছে। সাথে সাথে আমরা সমস্ত বন্ধুরাষ্ট্র ও পৃথিবীর সমস্ত সহানুভূতিশীল ও মুক্তিকামী মানুষের কাছে ও ‘রেডক্রস’ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে সাহায্যের আহ্বান জানাচ্ছি। যাঁরা আমাদের সাহায্য করতে ইচ্ছুক অথচ বর্বর ইসলামাবাদ শক্তি যাঁদের এই মানবিক কাজটুকু করবার বিরুদ্ধে নিষেধ উঁচিয়ে দাঁড়িয়েছে তাঁরা এখন স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের সাথে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করতে পারেন।
আমরা যদিও বিদেশ পাঠানো ত্রানসামাগ্রীর জন্যে কৃতজ্ঞ; কিন্তু এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, আজকের দিনে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় ত্রাণের বাণী বয়ে আনতে পারে উপযুক্ত এবং পর্যাপ্ত হাতিয়ার, যা দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ হানাদারদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে এবং রক্ষা করতে পারে তাঁর ও তাঁর প্রিয় পরিজনের জান, মাল আর সম্ভ্রম।
বৃহৎ শক্তিবর্গের অস্ত্রাগারে আধুনিক সরঞ্জামে সজ্জিত জেনারেল ইয়াহিয়ার হানাদার বাহিনী আজ আমাদের শান্তিপ্রিয় ও নিরস্ত্র বাঙালীর কণ্ঠ স্তব্ধ করে দেয়ার এক পৈশাচিক উন্মত্ততায় মত্ত। আমরা সেইসব বৃহৎ শক্তিবর্গের কাছে মানবতার নামে আবেদন জানাচ্ছি, যেন এই হত্যাকারীদের হাতে আর অস্ত্র সরবরাহ করা না হয়। এ সমস্ত অস্ত্র দেয়া হয়েছিল বিদেশী শত্রুর আক্রমন থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্যে-বাংলার নিষ্পাপ শিশুদেরকে ও নিরাপরাধ নরনারীকে নির্বিচারে হত্যা করার জন্যে নিশ্চয়ই এ অস্ত্র তাদের হাতে তুলে দেয়া হয়নি। বাংলাদেশের কৃষক-শ্রমিকের মাথায় ঘাম পায়ে ফেলে কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়ে যে অস্ত্র কেনা হয়েছে এবং যাদের টাকায় ইয়াহিয়া খানের এই দস্যুবাহিনী পুষ্ট, আজ তাদেরকেই নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে। আমরা অস্ত্র সরবরাহকারী শক্তিবর্গের কাছে আবেদন জানাচ্ছি যে, যে অস্ত্র তাদের হাতে তুলে দেয়া হয়ছে সে অস্ত্র দিয়ে সাড়ে সাত কোটি বাঙালীকে স্তব্ধ করে দেয়ার প্রয়াস বন্ধ করতে হবে।
পৃথিবীর জনমতকে উপেক্ষা করে আজও ইয়াহিয়ার ভাড়াটে দস্যুরা বাংলাদেশের বুকে নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে। তাই আমরা সমসত দেশের কাছে অস্ত্র সাহায্য চাচ্ছি এবং যাঁরা জাতীয় জীবনে স্বাধীনতাকে সর্বোচ্চ মূল্য দিয়ে এসেছেন ও নিজেদের দেশেও হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন তাঁরা আমাদের এ ডাকে সাড়া না দিয়ে পারবেন না, এ বিশ্বাস আমরা রাখি।
বিদেশী বন্ধুরাষ্ট্রসমূহের কাছে যে অস্ত্র সাহায্য আমরা চাইছি একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে- একটি স্বাধীন দেশের মানুষ আর একটি স্বাধীন দেশের মানুষের কাছে। এই সাহায্য আমরা চাই শর্তহীনভাবে এবং আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি তাঁদের শুভেচ্ছা ও সহানুভূতির প্রতিক হিসেবে- হানাদারদের রুখে দাঁড়াবার এবং আত্মরক্ষার অধিকার হিসেবে, যে অধিকার মানবজাতির শাশ্বত অধিকার। বহু বছরের সংগ্রাম, ত্যাগ ও তিতিক্ষার বিনিময়ে আমরা আজ স্বাধীন বাংলাদেশের পত্তন করেছি। স্বাধীনতার জন্যে যে মূল্য আমরা দিয়েছি তা কোন বিদেশী রাষ্ট্রের উপরাষ্ট্র হবার জন্যে নয়। পৃথিবীর বুকে স্বাধীন ও সার্বভৌম একটি শান্তিকামী দেশ হিসেবে রাষ্ট্রপরিবারগোষ্ঠীতে উপযুক্ত স্থান আমাদের প্রাপ্য। এ অধিকার বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের জন্মগত অধিকার।
আমাদের বাঙালী ভাইয়েরা, আপনারা পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তে থাকুন না কেন, আজকে মাতৃভূমির এই দুর্দিনে সকল প্রকার সাহায্য নিয়ে আপনাদেরকে এগিয়ে আসতে হবে। বিদেশ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে অস্ত্র কিনে আমাদের মুক্ত এলাকায় পাঠিয়ে দিন, যাতে করে আমাদের মুক্তিবাহিনীর সৈনিকরা অতি সত্ত্বর সে অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে তার মাতৃভূমিকে রক্ষা করবার কাজে।
3.006.010>
.
ইতিমধ্যেই আমাদের বাংলাদেশের ঘরে ঘরে প্রত্যেকেই নিজেদের হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছেন। যাঁদের হাতে আজও আমরা আধুনিক অস্ত্র তুলে দিতে পারিনি তাঁদেরকে আহবান জানাচ্ছি, যার হাতে য আছে তাই নিয়ে লড়াইয়ে অংশ নিন। আমাদের স্থির বিশ্বাস যে, শীঘ্রই আপনাদের হাতে আমরা আধুনিক অস্ত্র তুলে দিতে পারব। ইতিমধ্যে প্রত্যেক আধুনিক অস্ত্র ব্যবহারের ট্রেনিং নেবার জন্য নিকতবর্তী সংগ্রাম পরিষদের সংগে যোগাযোগ করুন। যাঁদের হাতে আধুনিক অস্ত্র নেই তাঁদেরও জনযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব এবং ক্ষমতা রয়েছে। শত্রুর ছত্রী ও গুপ্তবাহিনীকে অকেজো করে দেবার কাজে আপনি সক্রিয় অংশ গ্রহণ করতে পারেন। সম্মুখসমরে কাজ না করতে পারলেও আপনি রাস্তা কেটে, পুল উড়িয়ে দিয়ে এবং আরো নানাভাবে আপনার উপস্থিত বুদ্ধি দিয়ে শত্রুকে হয়রান ও কাবু করতে পারেন। নদীপথে শত্রু যাতে না আসতে পারে তার সম্ভাব্য সমস্ত ব্যবস্থা আপনাকেই গ্রহণ করতে হবে ও সবদিকে কড়া দৃষ্টি রাখতে হবে। নদীপথে সমস্ত ফেরী, লঞ্চ ও ফ্ল্যাট অকেজো করতে দিতে হবে। এ সমস্ত দায়িত্ব পালন করার জন্যে স্থানীয় সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে ছোট ছোট দলে সংগঠিত হতে হবে। এর জন্যে আপনার এলাকার সমরপরিচালকের সাথে সংগ্রাম পরিদষদেরর মাধ্যমে যোগাযোগ করতে হবে এবং তাঁর আদেশ ও নির্দেশাবলী মেনে চলতে হবে।
যুদ্ধে অংশ নেয়া ছাড়াই বাংলাদেশকে সব দিকে দিয়ে বাঁচিয়ে রাখবার দায়িত্বকেও অবহেলা করলে চলবে না। শাসনকার্যে অভিজ্ঞ ও সংশ্লিষ্ট বাঙালী অফিসারদের মধ্যে যাঁরা এখনও আমাদের সাথে যোগ দিতে পারেননি, তাঁরা যে যেখানে থাকুন না কেন, আমরা তাঁদের মুক্ত এলাকায় চলে আসতে আহবান জানাচ্ছি। অনুরুপভাবে আমরা আহবান জানাচ্ছি সমস্ত বুদ্ধিজীবী, টেকনিশিয়ান, ইঞ্জিনিয়ার, সংবাদপত্রসেবী, বেতারশিল্পী, গায়ক ও চারুশিল্পীদের-তাঁরা যেন অনতিবিলম্বে বাংলাদেশ সরকারের সাহায্যে এগিয়ে আসেন। আমাদের সামনে বহুবিধ কাজ, তার জন্যে বহু পারদর্শীর প্রয়োজন এবং আপনারা প্রত্যেকেই স্বাধীন বাংলাদেশের সেবায় আত্মনিয়োগ করার সুযোগ পাবেন। আমরা বিশেষ করে সমস্ত রাজনৈতিক দলের নেতাদেরকে বাংলাদেশের এই সংঘবন্ধ জনযুদ্ধে সামিল হতে আহবান জানাচ্ছি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামে সাড়ে সাত কোটি মানুষের এই ঐতিহাসিক প্রতিরোধ ও প্রতিরক্ষা আন্দোলনকে চিরচারিত রাজনৈতিক গন্ডীর ঊর্ধ্বে রাখবার জন্যে আমরা আবেদন জানাচ্ছি।
হানাদার শত্রুবাহিনীর সাথে কোন প্রকার সহযোগিতা করা বা সংশ্রব রাখা চলবে না। বাংলাদেশে আজ কোন মীরজাফরের স্থান নেই। যদি কেউ হঠাৎ করে নেতা সেজে শত্রুসৈন্যের ছত্রছায়ায় রাজনৈতিক গোর থেকে গাত্রোথান করতে চায়, যাদেরকে গত সাধারন নির্বাচনে বাংলার মানুষ ঘৃণভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে তারা যদি এই সুযোগে বাংলাদেশের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত হয়, তবে বাংলাদেশের মানুষ তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দিবে। তারা সাড়ে সাত কোটি বাংলাদেশবাসীর রোষবহ্নিতে জ্বলে খাক হয়ে যবে।
আমাদের মনে রাখতে হবে যে, আমাদের দেশের উপর একটা যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। কাজেই স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যহত হতে বাধ্য। হয়ত কোথাও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের ঘাটতি দেখা যেতে পারে।
আমাদের উচিত হবে যতদূর সম্ভব ব্যয় সংকোচ করা এবং জিনিসপত্র কম ব্যবহার করা। দোকানদার ও ব্যবসায়ীদের কাছে বিশেষ অনুরোধ তাঁরা যেন মজুতদারী ও কালোবাজারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেন এবং জিনিসপত্রের দাম যাতে সাধারণ লোকের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে না যায় তার দিকে দৃষ্টি রাখেন।
এ যুদ্ধে যে আমদের জয় অবশ্যম্ভাবী তাতে সন্দেহের কারণ নেই। আপনারা ইতিমধ্যে সাহস ও ত্যাগের বিনিময়ে যে বিজয় অর্জন করেছেন শত্রুপক্ষ আজকে তা স্পষ্টই বুঝতে পেরেছে। তারা ভেবেছিল যে, আধুনিক সমরসজ্জায় এবং কামানের গর্জনের নীচে স্তব্ধ করে দেবে বাঙালীর ভবিষ্যৎ আশা-ভরসা আর চোখ রাঙিয়ে ভয় দেখিয়ে বাঙালীকে তারা বুটের নীচে নিষ্পেষন করবে। কিন্তু তাদের সে আশা আজ ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। আমরা তাদের মারমুখি আক্রমনের বিরুদ্ধে লড়াই করে টিকে আছি এবং তাঁদেরকে যে প্রতিনিয়ত হটিয়ে দিচ্ছি এতে
003.006.011
তাদের সমস্ত ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়ে গেছে। তাদের খাদ্য সরবরাহের সকল পথ আজ বন্ধ- ঢাকার সাথে আজ তাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। উড়োজাহাজ থেকে খাবার ফেলে এদেরকে ইয়াহিয়া খান আর বেশী দিন টিকিয়ে রাখতে পারবে না। ওদের জ্বলানী সরবরাহের লাইন আমাদের মুক্তিবাহিনী বন্ধ করে দিয়েছে। ইয়াহিয়ার উড়োজাহাজ আর বেশী দিন বাংলাদেশের আকাশে দেখা যাবে না। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি উত্তাল জনসমূদ্রের মাঝখানে ওরা আজকে বিছিন্ন দ্বীপের মত। বাংলাদেশের আকাশে শীঘ্রই ঝড়ের মাতন শুরু হচ্ছে। ওরা জানে ওরা হানাদার। ওরা জানে ওদের বিরুদ্ধে প্রথিবীর সমস্ত মানুষের ভ্রূকুটি ও ঘৃণা। ওরা ভীত, ওরা সন্ত্রস্ত মৃত্যু ওদের সামনে পরাজয়ের পরোয়ানা নিয়ে হাজির। তাই ওরা উন্মাদের মত ধ্বংস লীলায় মেতে উঠেছে।
পৃথিবী আজ সজাগ হয়েছে। পৃথিবীর এই অষ্টম বৃহৎ রাষ্ট্র বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে আছে বিশ্বের মানুষ, যেখানে ওরা এ ধবংসের খেলায় মেতে উঠছে। বিশ্বের মানুষ আজ আর ইসলামাবাদ সরকারের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার মিথ্যা যুক্তি আর অজুহাত স্বীকার নিতে রাজি নয়। যে সমস্ত সাংবাদিক বাংলাদেশের এই যুদ্ধের ভয়াবহতা ও নৃশংসতা থেকে অব্যাহিতি পেয়েছেন তারা ইয়াহিয়ার এই অন্যায় ও অমানবিক যুদ্ধ আর ধবংসলীলার বিরুদ্ধে নিন্দা জানাচ্ছেন। অপরপক্ষে যে সমস্ত সাংবাদিক আমাদের মুক্ত এলাকা পরিদর্শন করেছে তাঁরা বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন বাংলাদেশের মানুষের এই বীর প্রতিরোধ যুদ্ধের খবর- আর বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন ইয়াহিয়া সরকারের ধ্বংস ও তান্ডবলীলার চাক্ষুস প্রমাণ।
ইতিমধ্যে সোভিয়েত রাশিয়া এবং ভারতবর্ষ এই নির্বিচার গনহত্যার বিরুদ্ধে তাঁদের হুশিয়ারী উচ্চারন করেছে এবং সোভিয়েত রাশিয়া অবিলম্বে এই হত্যাযজ্ঞ ও নিপীড়ন বন্ধ করবার আহবান জানিয়েছেন। গ্রেট ব্রিটেনও বাংলাদেশের এ অবস্থা সম্পর্কে সজাগ হয়ে উঠেছে। যে সমস্ত পাকিস্তানী বিমান মৃত্যুর সরঞ্জাম নিয়ে ঢাকা আসার পথে জ্বালানী সংগ্রহ করছিল তাদেরকে জ্বালানী সরবরাহ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র সিংহল ও ব্রক্ষ্মদেশ।
যদিও কোন কোন দেশ বাংলাদেশের ঘটনাবলীকে পাকিস্তানের আভ্যন্তরীন ব্যাপার বলে অভিহিত করেছেন, তবু একথা এখন দিবানলোকের মত সত্য হয়ে গেছে যে সাড়ে সাত কোটি মানুষেকে পিষে মারার চেষ্টা, তাদের কষ্টার্জিত স্বাধীনতাকে ব্যর্থ করে দেবার ষড়যন্ত্র একটি আন্তর্জাতিক ব্যাপারে পরিগণিত হয়েছে এবং এই সমস্যা আজ পৃথিবীর সমস্ত মানুষের বিবেককে নাড়া দিচ্ছে। বাংলাদেশের সরকারের পক্ষ থেকে আমরা বিদেশে অবস্থানরত বাঙালী ভাইদের বাংলাদেশের পক্ষে জনমত সৃষ্টি ও পৃথিবীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে অনুরোধ জানিয়েছি। পৃথিবীর বিভিন্ন রাজধানীতে আমরা আমাদের প্রতিনিধি পাঠাচ্ছি এবং বিদেশের সমস্ত রাষ্ট্রের কাছে কূটনৈতিক স্বীকৃতি ও আমাদের স্বাধীনতা ও আত্মরক্ষার সংগ্রামে সাহায্য ও সহানুভূতি চেয়ে পাঠাচ্ছি।
আমাদের সে সমস্ত ভাইবোন শত্রুকবলিত শহরগুলোতে মৃত্যু ও অসম্মানের নাগপাশে আবদ্ধ, আদিম নৃশংসতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে সাহস ও বিশ্বাসের সাথে মুক্তির পথ চেয়ে আছেন তাঁদেরকে আমরা এক মুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারি না। যাঁরা আমাদের সংগ্রামে শরিক হতে চান তাঁদের জন্যে রইল আমাদের আমন্ত্রণ যাঁদের পক্ষে নেহাৎই মুক্ত এলাকায় আসা সম্ভব নয় তাঁদেরকে আমরা আশ্বাস এবং প্রেরণা দিচ্ছি বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের পক্ষ থেকে, শহীদ ভাইবোনদের বিদেহী আত্মার পক্ষ থেকে। শহীদদের রক্ত বৃথা যেতে পারে না। ইনশাআল্লাহ্, জয় আমাদের সুনিশ্চিত।
আমাদের যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হবে না বলে আমাদের স্থিরবিশ্বাস; কারন প্রতিদিনই আমাদের শক্তি বৃদ্ধি হচ্ছে এবং আমাদের এ সংগ্রাম পৃথিবীর স্বীকৃতি পাচ্ছে। কিন্তু আমাদের মুক্তিবাহিনীর হাতে শেষ পরাজয় মেনে নেয়ার আগে শত্রুরা আরও অনেক রক্তক্ষয় আর ধবংসলীলা সৃষ্টি করবে। তাই পুরাতন পূর্ব পাকিস্তানের ধবংসাবশেষের ওপর নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলবার সংকল্পে আমাদের সবাইকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে। আমাদের এই পবিত্র দায়িত্ব পালনে এক মুহূর্তের জন্যেও ভুলে গেলে চলবে না যে এ যুদ্ধ গনযুদ্ধ এবং এর সত্যিকার অর্থে এ কথাই বলতে হয় যে এ যুদ্ধ বাংলাদেশের দুঃখী মানুষের যুদ্ধ। খেটে খাওয়া সাধারন কৃষক, শ্রমিক, মধ্যবিত্ত, ছাত্র-
<003.006.012>
.
জনতা তাঁদের সাহস, তাঁদের দেশপ্রেম, তাঁদের বিশ্বাস স্বাধীন বাংলাদেশের চিন্তায় তাঁদের নিমগ্নপ্রাণ, তাঁদের আত্মহূতি, তাঁদের ত্যাগ ও তিতিক্ষায় জন্ম নিল এই নতুন স্বাধীন বাংলাদেশ। সাড়ে সাত কোটি মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ফলপ্রসূ হইয়ে উঠুক আমাদের স্বাধীনতার সম্পদ। বাংলাদেশের নিরন্ন দুঃখী মানুষের জন্যে রচিত হোক এক নতুন পৃথিবী, যেখানে মানুষ মানুষকে শোষন করবে না। আমাদের প্রতিজ্ঞা হোক ক্ষুধা, রোগ, বেকারত্ব আর অজ্ঞানতার অভিশাপ থেকে মুক্তি। এই পবিত্র দায়িত্বে নিয়োজিত হোক সাড়ে সাত কোটি বীর বাঙ্গালী ভাইবোনের সম্মিলিত মনোবল ও অসীম শক্তি। যারা আজ রক্ত দিয়ে উর্বর করছে বাংলার মাটি, যেখানে উৎকর্ষিত হচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশের নতুন মানুষ, তাঁদের রক্ত আর ঘামে ভেজা মাটি থেকে গড়ে উঠুক নতুন গনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা; গণমানসের কল্যাণে সাম্য আর সুবিচারের ভিত্তিপ্রস্তরে লেখা হোক “জয় বাংলা”, “জয় স্বাধীন বাংলাদেশ”।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীসভা গঠন | দি টাইমস অফ ইন্ডিয়া –নয়াদিল্লী | ১৩ এপ্রিল, ১৯৭১ |
বাংলাদেশের যুদ্ধকালীন মন্ত্রীপরিষদ প্রধান মুজিব
১৩ এপ্রিল , ১৯৭১ এর সংবাদ প্রতিবেদন
আজ বাংলাদেশে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ছয়-সদস্য বিশিষ্ট যুদ্ধকালীন মন্ত্রীপরিষদ গঠিত হয়েছে যখন তার স্বাধীনতা বাহিনীর ঘাঁটিতে পশ্চিম পাকিস্তানীরা সর্বাত্নক আক্রমণ শুরু করেছে ।
বাংলাদেশের কোনো এক স্থানে আওয়ামী লীগের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ঘোষণা করেছেন যে, নজরূল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি এবং দলীয় সাধারণ সম্পাদক, জনাব তাজউদ্দীন আহমেদকে প্রধানমন্ত্রী করে গঠিত সরকার স্বাধীনতা যুদ্ধের দিকনির্দেশনা ও সমন্বয় করবে ।
২৫ মার্চে যখন সামরিক বাহিনী শেখকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলে পূর্ববাংলার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো, শেখ মুজিবুর রহমান কতৃক বাংলাদেশকে সার্বভৌম গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র দাবী করাকে আজকের ঘোষণা আনুষ্ঠানিক রূপ দিলো ।
ঘোষণা অনুসারে সরকারের পররাষ্ট্র সচিব জনাব খন্দকার মোশতাক আহমেদ।
সরকারের অন্যান্য সদস্যরা হলেন ক্যাপটেন মনসুর আলি এবং জনাব এ এইচ এম কামরুজ্জামান।
গনপরিষদ সদস্য এবং শীর্ষ আওয়ামীলীগ নেতাদের এক সভায় দীর্ঘ আলোচনার পরে এই সরকার গঠিত হল ।
বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ বিগত মাসের বিফল সাংবিধানিক আলোচনা চলাকালে উপদেষ্টা-পর্যায়ের বৈঠকে আওয়ামী লীগ দল এর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন .;
তিনি এবং জনাব কামরুজ্জামান, উভয়ই আওয়ামী লীগ এর সাধারন সম্পাদক ছিলেন ।
একইসাথে জনাব কামরুজ্জামান গণ পরিষদে আওয়ামী লীগ দলের সম্পাদক ছিলেন ।
জনাব খন্দকার মোশতাক আহমেদকে গন পরিষদের এর স্পিকার পদে আওয়ামী লীগ মনোনয়নপ্রাপ্ত বলে ধারনা করা হয়েছিল যা পরবর্তীতে হয়নি।
পাবনার জনাব মনসুর আলী ছিলেন প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগ দলের নেতা।
সদ্য প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে সরকার গঠনের ঘোষণা সম্প্রচার করা হয় এবং প্রেসিডেন্ট রহমান এর প্রেস উপদেষ্টা তা নিশ্চিত করেছেন ।
বেতারে বলা হয় নবগঠিত সরকারের আনুষ্ঠানিক শপথগ্রহন আগামীকাল সকাল ৯টায় অনুষ্ঠিত হবে।
<003.007.014>
.
মুক্ত অঞ্চল চুয়াডাঙ্গা হবে স্বাধীন বাংলা সরকারের সদর দপ্তর।
বেতারে বলা হয় মন্ত্রী পরিষদ পরবর্তীতে পরিবর্ধিত হবে ।
আরও বলা হয়, বাংলাদেশ সরকারের ভিত্তি হবে সমষ্টিগত দায়িত্ববোধ নীতি।
জনাব তাজউদ্দিন আহমেদ এর মন্ত্রীসভার সহকর্মীদের কার্যভার আগামীকাল ঘোষিত হবে আশা করা যায় ।
<003.008.015>
.
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
জনসাধারণের প্রতি বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশ | বাংলাদেশে সরকার, প্রচার দপ্তর | ১৩ এপ্রিল, ১৯৭১ |
জনসাধারণের প্রতি বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশ
নবগঠিত বাংলাদেশ সরকার জনগণের প্রতি এই নির্দেশগুলি জারী করেছেনঃ
১। চিকিৎসা ও সেবা-শুশ্রুষার জন্যে আহত ব্যক্তিদের ডাক্তার বা কবিরাজের কাছে নিয়ে যান।
২। মুক্তিসংগ্রামের বিশ্বাসঘাতকের শাস্তি দিন।
৩। আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের কাছ থেকে জেনে নিন কী করা উচিত।
৪। তরুণরা সকলে ট্রেনিং-এর জন্যে নিকটতম মুক্তিফৌজ দপ্তরে চলে আসুন-সেখানেই তাঁরা নির্দেশ পাবেন।
৫। প্রত্যেক গ্রাম-প্রধান আশপাশের গ্রাম বা গ্রামগুলির প্রধানদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষা করে চলুন এবং সমস্ত খবরাখবর সম্বন্ধে পরস্পরকে ওয়াকিবহাল রাখুন।
৬। মুক্ত অঞ্চলগুলির সরকারী কর্মচারীরা আওয়ামী লীগের স্থানীয় সদর দপ্তর থেকে নির্দেশ নিন।
৭। নদী-পরিবহন ব্যবস্থার সমস্ত কর্মচারী বাংলাদেশের সরকারের নির্দেশ মেনে চলুন ও রেডিও-পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্র থেকে প্রচারিত নির্দেশ উপেক্ষা করুন। ঢাকায় নদী-পরিবহনকর্মীরা দখলদার জঙ্গী-বাহিনীর নির্দেশ অমান্য করায় বাংলাদেশ সরকারের তাঁদের ধন্যবাদ জানাচ্ছেন।
৮। নিজের এলাকার মুক্তিফৌজ কম্যান্ডের নির্দেশ অনুযায়ী অসামরিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সমস্ত নিয়ম মেনে চলুন।
৯। আপনার এলাকায় সন্দেহভাজন লোক ঘোরফেরা করছে। তাদের সম্বন্ধে সাবধান থাকুন এবং তেমন কোনও লোকের খোঁজ পেলেই নিকটতম মুক্তিফৌজ কেন্দ্রে খবর দিন।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
জনগণের প্রতি বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশাবলী | বাংলাদেশ সরকার, প্রচার দপ্তর | ১৪ এপ্রিল, ১৯৭১ |
আল্লাহু আকবর
স্বাধীন বাংলার সংগ্রামী জনগণের প্রতি বাংলাদেশ সরকারের
নির্দেশাবলী
দেশবাসী ভাইবোনেরা,
হানাদার পাকিস্তানী পশুশক্তিকে বাংলাদেশের পবিত্র মাটি থেকে হটিয়ে দেবার ও বাঙ্গালীকে শোষণমুক্ত করে একটি নতুন সুখী-সমৃদ্ধ সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলবার দীপ্ত শপথ ও ব্রত নিয়ে বাঙ্গালীর প্রানপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধুর আদর্শে ও নেতৃত্বে গত ১২ই এপ্রিল রাত্রে বাংলাদেশ বেতার থেকে বাংলাদেশ সরকার ঘোষনা করা হয়েছে। এই ঘোষনা পর থেকে মুক্তি সংগ্রাম ঠিক পূর্বের মতই এক সুস্পষ্ট গতিতে চলছে। প্রতিটি বাঙ্গালী আজ নিজ নিজ ঘরে প্রতিরোধের গূর্গ গড়ে তুলে সংকল্পকে দৃঢ় থেকে আরও দৃঢ়তর করে তুলছে। মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। বিশ্বাসঘাতক জঙ্গী পশু সরকারকে বিনাশ করে বিশ্বের দরবারের আজ মাথা তুলে দাঁড়াতে পেরেছে বলে-বাঙ্গালীর যুদ্ধ আজ আরও তীব্রতর; বিশ্বাস আজ অটুট; প্রতিটি বাঙ্গালী আজ সংগ্রাম থেকে অবিচ্ছিন্ন।
বাঙ্গালীর আশা-আকাঙ্কার প্রতিফলনে এ সরকারের রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচিত হয়েছে স্বাধীন বাংলার মহানায়ক বাঙ্গালীর প্রিয় বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর তাঁর সহকারী রয়েছেন ত্যাগী ও শ্রদ্ধেয় নেতৃবৃন্দ।
সৈয়দ নজরুল ইসলাম,উপ-রাষ্ট্রপতি পদে নর্বাচিত। জনাব তাজউদ্দিন আহমদ প্রাধানমন্ত্রিত্বের দায়িত্ব পালন করবেন এবং দেশরক্ষা দপ্তরের দায়িত্বও অতিরিক্তভাবে তাঁর উপর ন্যস্ত। খোন্দকার মোশতাক আহমদ পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত। স্বাধীন বাংলা সরকারের মন্ত্রী পরিষদে আর যারা রয়েছেন তাঁরা হলেন জনাব মনসুর আলী, জনাব এ, এইচ, এম, কামরুজ্জামান।
জনযুদ্ধের আশু সাফল্য অর্জনের উদ্দেশ্যে সরকারের সম্প্রতি কতগুলো নির্দেশাবলী জারী করেছেন।
পাকিস্তানী শোষকগোষ্ঠী ও তাদের ভাড়াটিয়া হানাদার সৈন্যবাহিনী আজ বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি লোকের উপর নগ্ন, পৈশাচিক বর্বরতা চালিয়ে যাচ্ছে। বাঙ্গালীর অপরাধ তারা তারা অবিচারের অবসান চেয়েছে, বাঙ্গালীর অপরাধ তারা তাদের মা-বাপ, ভাইবোন, সন্তান-সন্ততিদের জন্যে অন্ন-বস্ত্র-শিক্ষা-চিকিৎসার দাবী জানিয়েছে, বাঙ্গালীর তারা মানুষের মর্যদা নিয়ে মাথা তুলে বাঁচতে চেয়েছে। বাঙ্গালীর অপরাধ আল্লাহতালার সৃষ্ট এ পৃথিবীতে, আল্লাহর নির্দেশমত সম্মানের সাথে শান্তিতে সুখে বাস করতে চেয়েছে। বাঙ্গালীর অপরাধ মহান স্রষ্টার নির্দেশমত অন্যায়, অবিচার, শোষন ও নির্যাতনের অবসান ঘটিয়ে এক সুন্দর ও সুখী সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলবার সংকল্প ঘোষনাকরেছে।
মানবতার বিরুদ্ধে হানাদার বাহিনী দানবীয়ে শক্তিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তাদের সহায় আধুনিক মারণাস্ত্র আর আমাদের সহায় পর করুণাময় সর্বশক্তমান আল্লাহতালার সাহায্য, বাংলাদেশের জনসাধারনের অটুট মনোবল, মুক্তিলাভের দৃঢ় সংকল্প, শত্রুসংহারের অবিচল প্রতিজ্ঞা।
.
বাংলাদেশের এ সংগ্রামে দল, মত, শ্রেনী ধর্ম নেই। বাংলার মাটি, পানি, আলো, বাতাসে লালিতপালিত মানুষের আজ একমাত্র পরিচয় আমরা বাঙ্গালী। তাই বাংলার ছাত্র-শিক্ষক, কৃষক-শ্রমিক, ধনিক-বণিক, নারী-পুরুষ সকলকেই মুক্তি বাহিনীর সঙ্গে সহায়তা করতে হবে, মুক্তি সৈনিকের পাশে এসে দাঁড়াতে হবে। বাংলার মাটি থেকে শত্রুকে উৎখাত করার জন্যে প্রত্যেককেই এগিয়ে যেতে হবে।
নির্দেশাবলী
১। প্রতি শহর/গ্রাম/মহল্লায় এক-একজন অধিনায়ক নির্বাচিত করে সমাজ জীবনে শৃঙ্খলা রক্ষা করতে হবে; আরও ঐক্যবন্ধ শক্তিতে শত্রুর সাথে অসহযোগ প্রতিরোধ সংঘাতের দুর্বার সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।
২। নিজ নিজ এলাকার খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির চাহিদার হিসাব রাখতে হবে আর চাহিদা মেটবার জন্যে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বাড়াবার আর সংগ্রহ করবার চেষ্টা করতে হবে।
৩। কালোবাজারি, মুনাফাখোরি, চুরি, ডাকাতি ইত্যাদি সমাজবিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে কঠোর দৃষ্টি রাখতে হবে। আদেশ অমান্য করলে শাস্তিদানের ব্যবস্থা করতে হবে।
৪। দৈনন্দিন জীবনের সংযম ও কৃচ্ছ্রতা চালিয়ে যেতে হবে। সর্বপ্রকার বিলাসিতা ত্যাগ করে জাতির বৃহত্তর কল্যাণে পারস্পরিক মমত্ববোধ ভ্রাতৃত্বের হাতকে দৃঢ়তর করতে হবে। আত্মশক্তির উপর বিশ্বাস রেখে আত্মনির্ভিরশীল বলিষ্ঠ সয়ামজ গড়ে তুলতে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
৫। শ্ত্রুকে চিনতে হবে। অবাঙ্গালী সামরিক বেসামরিক শত্রু তো আছেই। তারা কবেশী চিহ্নিত। মারাত্মক হলো ঘরের শত্রু। ধর্মের দোহাই দিয়ে, অখন্ডতার বুলি আওড়িয়ে কালোবাজারি মজুতদারীর বেশে শত্রুর চর সরলপ্রাণ বাঙ্গালীর আশপাশে ঘুরে বেড়ায়। এরা দোস্ত হিসেবে মনে ঠাই পেতে চায়। একবার ওদের খপ্পরে পড়লে আর নিস্তার পাওয়া যাবে না। এ ধরনের লোককে চিনে রাখতে হবে। বিশ্বাসঘাতকতার পথ ছেড়ে দেয়ার জন্যে তাদের বলতে হবে। তবুও যদি তাদের শুভবুদ্ধির উদয় না হয় তখন উর্ধতন কর্মকর্তার কাছে তাদের নাম-ঠিকানা জানিয়ে দিতে হবে এবং কর্তৃপক্ষ দেশদ্রোহীর নির্ধারিত শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থা করবেন।
৬। গ্রামে গ্রামে রক্ষীবাহিনীড় গড়ে তুলতে হবে। মুক্তিবাহিনীর নিকটতম শিক্ষণশিবিরে রক্ষীবাহিনীর স্বেচ্ছাসেবকদের প্রশিক্ষণ দানের ব্যবস্থা রয়েছে। গ্রামের শাস্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষা ছাড়াও এরে প্রয়োজনে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে প্রতিরোধ সংগ্রামে অংশ গ্রহণ করেছেন।
৭। গ্রাম/শহর অথবা মহল্লার নেতারা নিজেদের মধ্যে নির্বচন করে গ্রাম-গ্রামান্তরে যোগাযোগ ও পণ্য বিনিময় ব্যবস্থার সুযোগ-সুবিধা রক্ষার জন্যে প্রচেষ্টা চালাবেন। এর উপরের স্তরের শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব থাকবে প্রাদেশিক ও জাতীয় পরিষদে নির্বাচিত সদস্যদের হাতে।
৮। বাংলাদেশের সকল মুক্ত এলাকায় সরকারী, আধাসরকারী, বে-সামরিক কর্মচারীরা স্তরে স্তরে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নির্দেশে কাজ করবেন। শত্রু কবলিত এলাকায় জনপ্রতিনিধিরাই ব্যক্তিবিশেষে অবস্থানুযায়ী ব্যবস্থা করবেন।
৯। সকল সামরিক, আধা সামরিক, কর্মরত বা অবসরপ্রাপ্ত বাঙ্গালী কর্মচারী অনতিবিলম্বে নিকটতম মুক্তিসেনা শিবিরে যোগ দেবেন এবং কোন অবস্থাতেই শত্রুর সহযোগিতা করবেন না।
১০। যোগাযোগ ব্যবস্থার বিশেষভাবে নৌ-চলাচল সংস্থার কর্মচারীরা কোন অবস্থাতেই শত্রুর সাথে সহযোগিতা করবেন না এবং যতদূর সম্ভব যানবাহনাদি নিয়ে মুক্ত এলাকায় চলে আসবেন।
গুজবে কান দিবেন না। গুজব রটাবেন না। নিজের উপর বিশ্বাস হারেবন না। মনে রাখবেন আপনার এ সংগ্রাম ন্যায়ের সংগ্রাম, সত্যের সংগ্রাম। পশ্চিম পাকিস্তানী দুশমন বাঙ্গালী মুসলমান নারী-পুরষ, বালক-বালিকা কাওকে হত্যা করতে, বাড়ীঘর লুট করতে, জ্বালিয়ে দিতে, এতটুকু দ্বিধা করেনি। মসজিদের মিনারে আজান প্রদানকারী মুয়াজ্জেন, মসজিদে-গৃহে নামাজরত মুসল্লী, দরগাহ মাজারে আশ্রয়প্রার্থী হানাদারদের গুলী থেকে বাঁচেনি। এ সংগ্রাম আমাদের বাঁচার সংগ্রাম। সর্বশক্তিমান আল্লাহত’লার উপর বিশ্বাস রেখে ন্যায়ের সংগ্রামে অবিচল থাকুন।
স্মরণ করুনঃ আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন
“অতীতের চাইতে ভবিষ্যৎ নিশ্চয়ই সুখকর”
বিশ্বাস রাখুনঃ
“আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় নিকটবর্তী”।
জয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব!
জয় বাংলা!
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
অস্থায়ী সরকার কতৃক মুক্তিবাহিনীর পুনর্গঠন : কর্নেল ওসমানীকে সর্বাধিনায়ক পদে নিয়োগ | এশিয়ান রেকর্ডার- মে, ১৪-২০, ১৯৭১ | ১৪ এপ্রিল, ১৯৭১ |
মুক্তিবাহিনী পুনর্গঠন :
১৪ এপ্রিলে নবগঠিত “অস্থায়ী” সরকার একটি পুরোদস্তুর সক্রিয় ঘাঁটি, অন্তর্বর্তীকালীন রাজধানী স্থাপন ও সুনির্দিষ্টভাবে স্বাধীন অঞ্চলগুলোর জন্য অধিনায়ক নির্ধারণের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের সেনাবানীকে একটি সংগঠিত শক্তিতে রূপান্তরিত করার কার্যক্রম শুরু করে।
পূর্ব বাংলার এই উত্তপ্ত সময়কালের বেশ আগেই সক্রিয় চাকরি থেকে অবসর নেওয়া বেঙ্গল রেজিমেন্টের কর্ণেল ওসমানিকে ‘মুক্তিফৌজ’-এর সাধারণ কর্মকর্তা সর্বাধিনায়ক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়।
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ আঞ্চলিক অধিনায়কদের নাম ঘোষনা করেন। এরা হলেন : সিলেট-কুমিল্লায় মেজর খালেদ মুশারাফ; চট্টগ্রাম-নোয়াখালীতে মেজর জিয়াউর রহমান; ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইলে মেজর সফিউল্লা; এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে মেজর এম. এ. ওসমান।
Besides the interim capital located in the western zone, a regional unit had been
set in the Sylhet-Comilla zone with full administrative authority for the eastern
region.
পশ্চিমাঞ্চলে অন্তর্বর্তীকালীন রাজধানী ছাড়াও সিলেট-কুমিল্লা অঞ্চলে আরেকটি আঞ্চলিক ইউনিট স্থাপন করা হয় পূর্বাঞ্চলে পূর্ণ প্রশাসনিক কতৃত্বসহ।
তিনি বলেন সিলেট-কুমিল্লা অঞ্চলে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর খালেদ মুশারাফ পাকবাহিনীকে সিলেট ও কুমিল্লার সেনানিবাসে হটিয়ে দেন।
চট্টগ্রাম-নোয়াখালী সেক্টরে মেজর জিয়াউর রহমানের অধীনে মুক্তিবাহিনী পূর্ণ নিয়ন্ত্রনে ছিল যারা চট্টগ্রামের কিছু ছোট্ট পরিসরে শত্রুদেরকে কোণঠাসা করে রাখে।
পুরো ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল শত্রুমুক্ত করার পর মেজর সফিউল্লা সম্পূর্ণ প্রস্তত ছিলেন ঢাকার দিকে অগ্রসর হতে।
জনাব আহমেদ বলেন, মেজর ওসমান দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন এবং খুলনা, কুষ্টিয়া, যশোর, ফরিদপুর, বরিশাল ও পটুয়াখালির অনেকটা এলাকা শত্রুমুক্ত করেছেন। শত্রুপক্ষ যশোর সেনানিবাস ও খুলনা শহরে অংশবিশেষে অবরূদ্ধ ছিল।
উত্তরবঙ্গে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্* ও পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসের একটি যৌথবাহিনী রংপুর ও সৈয়দপুরের শত্রুদের গতি অবরোধ করে রাখে।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ ঘোষিত :
ইপিআর, আনসার আর মুজাহিদদের দলসহ দশ হাজার জনতার ভীড়ে তুমুল হর্ষধ্বনির মধ্য দিয়ে এপ্রিলের ১৭ তারিখে মুজিবনগরে আনুষ্ঠানিকভাবে গঠিত রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষিত হয়েছে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ, যা রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার দ্বারা পরিচালিত হবে।
003.010.020>
.
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ ঘোষণা দেন যে সরকারের আদেশাধিকার বহাল থাকবে অঞ্চলটির ৯০ শতাংশ জায়গায়, ব্যতিক্রম কেবলমাত্র সেনাবাহিনীর অধীনে থাকা সেনানিবাস ও কিছু প্রশাসনিক সদর দপ্তর। প্রায় ৫০ জন আন্তর্জাতিক সাংবাদিক কার্যপ্রক্রিয়াটি দেখেন ও লিপিবদ্ধ করেন।
ঘোষণাটিতে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপতি উল্লেখ করা হয়, তবে ব্যাখ্যায় বলা হয়, যদি রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবর রহমান “অনুপস্থিত থাকেন, কিংবা কার্য চালাতে না পারেন, অথবা অক্ষম থাকেন”, তাহলে জনাব ইসলাম রাষ্ট্রপতির দায়িত্বগুলো সম্পাদন করবেন।
নতুন একটি সংবিধান গঠনের আগ পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি সশস্ত্র শক্তির প্রধান ও আইনপ্রণয়নের একমাত্র ক্ষমতাধারী হিসেবে বহাল থাকবেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী ও তার সহকর্মীদেরকে নিয়োগ দেবেন, কর আদায় ও ব্যয়ের অনুমোদন প্রদান, এবং শাসনতান্ত্রিক সংসদ আহবান কিংবা স্থগিত করবেন।
ঘোষণাটিতে এই পদক্ষেপটির প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করা হয় এবং নিশ্চিত করা হয় যে এটা গত নির্বাচনের ফলাফলে প্রতিফলিত জনগণের দাবির ভিত্তিতেই করা হচ্ছে। এই নতুন রাষ্ট্র ও “জাতির” লক্ষ্য হবে মানুষের মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করা। জনাব ইসলাম বলেন, এটা শান্তিপূর্ণভাবে অর্জনের জন্য রাষ্ট্রটির সাড়ে সাত কোটি মানুষ গত ২৩ বছর ধরে প্রচেষ্টা চালিয়েছে। কিন্তু তাদেরকে হতাশ করেছে সামন্ততান্ত্রিক স্পৃহা আর সামরিক জান্তা।
তিনি বলেন, তাদের বর্তমান লড়াইটি বাংলাদেশের জনগণের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য ও একই সঙ্গে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্যও এবং “জয় আমাদের হবেই, আজ হোক, অথবা কাল, অথবা পরশু।”
মানুষের মুক্তি, মর্যাদারক্ষা ও মূল্যবোধ এবং তার সাথে গণতন্ত্রের স্বার্থে তিনি বিদেশী সাংবাদিকদের এই বার্তাটি নিজ নিজ দেশে পোঁছে দিতে জোরালো আহবান করেন যে বিশ্বের সকল ক্ষুদ্র ও বৃহৎ রাষ্টের উচিত, বিশেষ করে এশিয়া ও আফ্রিকান দেশগুলোর উচিত, তার সরকারকে স্বীকৃতি দেয়া ,এবং “এমন কিছু করা যা বাংলাদেশের মানুষের দুর্দশা লাঘবে ইতিবাচক হবে”।
তিনি আরো এক ধাপ এগিয়ে বলেন, অতীতে পাকিস্তান অন্যান্য দেশ থেকে অস্ত্র এনে সংরক্ষণ করে রেখেছে প্রধানত দেশটির প্রতিরক্ষার জন্য এবং তা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে নিয়োজিত মানুষের কঠোর পরিশ্রমের বিচারে চড়া দাম দিয়ে। এটা অত্যন্ত মর্মান্তিক যে এই অস্ত্রগুলো এখন ব্যহার করা হচ্ছে বাংলাদেশের নিরীহ মানুষের উপর।
তিনি এই দেশগুলোকে নতুন অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করতেই শধু আহবান জানাননি , বরং এই মারাত্মক অস্ত্রগুলো যেন বাংলাদেশের মানুষের ওপর আর ব্যবহার না করা হয়, সেটা নিশ্চিত করতে জোরালো অনুরোধ জানান।
<003.011.021>
.
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
বাংলাদেশ সরকার গঠনের পর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ- এর ভাষন | বাংলাদেশ সরকার, প্রচার দপ্তর | ১৭ এপ্রিল, ১৯৭১ |
সংবাদ বিজ্ঞপ্তি
প্রকাশনায়
জনাব তাজউদ্দিন আহমেদ
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী
১৭ই এপ্রিল, ১৯৭১
বিশ্বের জনগণের প্রতি
বাংলাদেশ আছে এক যুদ্ধে। পশ্চিম পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে জাতীয় মুক্তির লড়াই করে আত্মনির্ধারণ সুরক্ষিত করা ছাড়া তার সামনে আর কোন পথই খোলা নেই।
পাকিস্তান সরকারের বাংলাদেশে গণহত্যার যুদ্ধকে ঢাকতে মরিয়া হয়ে সত্যকে বিকৃত করার সুস্পষ্ট প্রচেষ্টার প্রেক্ষিতে বিশ্বকে সেই সকল পরিস্থিতির কথা জানানো আবশ্যক, যেগুলো বাংলাদেশের শান্তিপ্রিয় জনগণকে তাদের ন্যায্য আকাঙ্ক্ষাগুলোকে বাস্তবায়নের জন্য সংসদীয় রাজনীতির স্থলে সশস্ত্র লড়াইকে বেছে নিতে পরিচালিত করেছে।
পাকিস্তানের অখণ্ডতা সংরক্ষণের সর্বশেষ সম্ভবপর সমাধান হিসেবে পাকিস্তানে বাংলাদেশের স্বায়ত্তশাসনের জন্য আওয়ামী লীগ যথাসাধ্য আন্তরিকতার সাথে ছয় দফা দাবি উত্থাপন করে। ছয় দফার প্রসঙ্গ নিয়ে জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে লড়াই করে আওয়ামী লীগ ৩১৩ আসনের মধ্যে বাংলাদেশে ১৬৯টি আসনের ১৬৭টিই জিতে নেয়। দলটির নির্বাচনী বিজয় এতোটাই সুনির্ধারক ছিল যে জনগণের শতকরা ৮০ শতাংশ ভোটই দলটি জিতে নেয়। বিজয়ের এই সুস্পষ্ট ধরণই দলটিকে জাতীয় পরিষদে স্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতায় স্থান করে দেয়।
নির্বাচনোত্তর কালটি ছিল একটি প্রত্যাশার যুগ, কেননা সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে এর আগে কখনো জনগণ এ রকম স্পষ্ট রূপে তাদের কণ্ঠ প্রকাশ করে নি। উভয় পন্থীদের মধ্যেই ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করা হয়েছিল যে ছয় দফার উপর ভিত্তি করে একটি কার্যক্ষম সংবিধান গঠন করা যাবে। সিন্ধু ও পাঞ্জাবের প্রধান দল হিসেবে আবির্ভূত পাকিস্তান পিপল’স পার্টি (পিপিপি) ছয় দফার প্রসঙ্গটি তাদের নির্বাচনী প্রচারণায় উত্থাপন করা এড়িয়ে যায় এবং এটি প্রতিহত করার জন্য তাদের নির্বাচকমণ্ডলীর কাছে কোনো বাধ্যবাধকতা তাদের একেবারেই ছিল না। বেলুচিস্তানের প্রভাবশালী দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ছয় দফার প্রতি সম্পূর্ণ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল। এনডব্লিএফপিতে ন্যাপ, প্রাদেশিক পরিষদে প্রভাবশালী এই দলটিও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে সর্বোচ্চ স্বায়ত্তশাসনে বিশ্বাসী ছিল। প্রতিক্রিয়াশীল দলগুলোর পরাজয়কে চিহ্নিত করা এই নির্বাচনের গতিপথটি তাই পাকিস্তানের গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের ব্যাপারে আশাবাদী হওয়ার সব বার্তাই দিয়েছিল।
জাতীয় পরিষদ আহবানের পূর্বে রাজনৈতিক প্রাঙ্গণের প্রধান দলগুলোর মধ্যে আলাপ হওয়ার আশা ছিল। তবে, যদিও পরিষদে যাওয়ার পূর্বে আওয়ামী লীগ তার সাংবিধানিক অবস্থান ব্যাখ্যা করার জন্য ও অন্য দলগুলোর বিকল্প প্রস্তাবগুলো নিয়ে আলোচনা করার জন্য ইচ্ছুক ছিল, দলটি বিশ্বাস করতো যে সংবিধান নিয়ে বিতর্ক হওয়া এবং কোন গোপন বৈঠকের বদলে পরিষদে তার চুড়ান্তরূপ পাওয়াটাই প্রকৃত গণতন্ত্রের প্রাণশক্তি। এই লক্ষ্যে একটি প্রারম্ভিক পরিষদ আহবান করা নিয়ে দলটি জোরালো দাবি করে। এই অধিবেশনটির প্রতীক্ষায় আওয়ামী লীগ ছয় দফার ভিত্তিতে একটি খসড়া সংবিধান প্রস্তুত করতে দিনরাত কাজ করে এবং এরকম একটি সংবিধান রচনা ও কার্যকর করার সকল নিহিতফলগুলো যাচাই করে দেখে।
পাকিস্তানের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রথম বড় পরিসরে আলোচনা হয় জেনারেল ইয়াহিয়া এবং শেখ মুজিবর রহমানের মধ্যে, মধ্য জানুয়ারিতে। এই বৈঠকে জেনারেল ইয়াহিয়া আওয়ামী লীগের কর্মসূচির প্রতি তাদের প্রতিশ্রুতিবদ্ধতার ব্যাপ্তি অনুসন্ধান করে দেখেন এবং নিশ্চিত হন যে তারা এর নিহিতফলগুলো নিয়ে সম্পূর্ণ সচেতন ছিল। কিন্তু অপ্রত্যাশিতভাবে ইয়াহিয়া সংবিধানের ব্যাপারে তার নিজের ধারণাগুলো পরিষ্কার করে খুলে বলেন নি। তিনি ছয় দফায় তীব্র আপত্তিকর কিছু না পাওয়ার আভাস দেন, কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের পিপিপির সাথে একটি বোঝাপড়ায় আসার আবশ্যকতার উপর জোরারোপ করেন।
পরের দফার আলোচনা চলে ঢাকায় পিপিপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে ২৭ জানুয়ারি, ১৯৭১ থেকে যেখানে জনাব ভুট্টো ও তার দল আওয়ামী লীগের সাথে কয়েকটি বৈঠকে সংবিধান নিয়ে আলোচনা করে।
ইয়াহিয়া যেমনটি করেছিলেন, জনাব ভুট্টোও তেমনি সংবিধানের প্রকৃতি সম্পর্কে তার নিজের কোন সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা দেন নি। তিনি ও তার উপদেষ্টারা প্রধানত আগ্রহী ছিলেন ছয় দফার নিহিতফলগুলো সম্পর্কে আলোচনায়। যেহেতু তাদের সাড়া ছিল মূলত নেতিবাচক ও তাদের নিজেদের কোন প্রস্তুত বিবরণীসংক্ষেপ ছিল না, তাদের আলাপগুলোর এমন কোন প্রগাঢ় মীমাংসালাপে উন্নীত হওয়া সম্ভব হয় নি যেখানে দুই দলের মধ্যকার ফারাকের সেতুবন্ধন করার প্রচেষ্টা চালানো যেতো। এটা স্পষ্ট ছিল যে তখন পর্যন্ত জনাব ভুট্টোর নিজের এমন কোন আনুষ্ঠানিক অবস্থান ছিল না যেখান থেকে মীমাংসালাপ করা যেতো।
এটা পরিষ্কার করা আবশ্যক যে যখন পিপিপি ঢাকা ত্যাগ করে, তখন তাদের পক্ষ থেকে এমন কোন নির্দেশনা দেয়া হয় নি যে আওয়ামী লীগের সাথে তারা একটি নিশ্চলাবস্থানে পৌঁছেছে। বরং তারা নিশ্চয়তা দেয় যে সব দরজা খোলা আছে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে কয়েক দফা আলাপের পরে পিপিপি হয় আওয়ামী লীগের সাথে আরেকটি বা আরো কয়েকটি দফায় সারপূর্ণ আলাপে বসবে, অথবা সাক্ষাৎ করবে জাতীয় পরিষদে যার কমিটিগুলো সংবিধানের উপর বিস্তারিত আলোচনার জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ রেখেছে।
জনাব ভুট্টোর জাতীয় পরিষদ বর্জন করার ঘোষণা সেই কারণে এসেছিল পুরোপুরি বিস্ময় হিসেবে। এটা অপ্রত্যাশিত ছিল, কেননা ইতিমধ্যেই জনাব ভুট্টো একবার রাষ্ট্রপতির অনুকুলানুগ্রহ পেয়েছেন যখন তিনি শেখ মুজিবের ১৫ই ফেব্রুয়ারিতে একটি প্রারম্ভিক অধিবেশনের অনুরোধকে প্রত্যাখ্যান করেন, এবং তা জনাব ভুট্টোর মনোনয়ন মতো ৩রা মার্চে নির্ধারণ করেন।
পরিষদ বর্জনের সিদ্ধান্তের পরে জনাব ভুট্টো পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য দলগুলোর পরিষদে অংশগ্রহণ থেকে প্রতিহত করার জন্য ভীতিপ্রদর্শনের পথ বেছে নেন। জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইয়াহিয়ার ঘনিষ্ঠ সহযোগী লেফট্যানেন্ট জেনারেল উমর ভুট্টোর হাতকে আরো শক্তিশালী করার লক্ষ্যে ব্যক্তিগতভাবে বহু পশ্চিমা শাখার নেতাকে পরিষদে অংশগ্রহণ না করতে চাপ দনে বলে প্রমাণ আছে। জনাব ভুট্টো ও লে. জে. উমরের চাপকৌশলের এই প্রদর্শনী সত্ত্বেও পিপিপি ও কাইয়্যুম মুসলিম লীগ (কিউএমএল) ব্যতীত পশ্চিম পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের সকল সদস্য ৩রা মার্চের অধিবেশনের জন্য পূর্ব পাকিস্তানে যাওয়ার আসন সংরক্ষিত করেন।
কিউএমএলে অভ্যন্তরেই অর্ধেক সদস্য তাদের ভ্রমণাসন সংরক্ষিত করেন, আর পিপিপির অভ্যন্তরে অনেক সদস্যই ঢাকায় আসতে চাওয়ায় বিদ্রোহের লক্ষণ দেখা যায়। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এই যৌথ সংগঠনের ভাঙনের মুখোমুখি হয়ে জেনারেল ইয়াহিয়া ১লা মার্চে অধিবেশন, কোন নির্দিষ্ট সময়কালের জন্য নয়, বরং অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত করে, জনাব ভুট্টোকে বাধিতকরেন। তার উপর, তিনি পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর এডমিরা এস এম আহসানকে বরখাস্ত করেন যাকে ইয়াহিয়া প্রশাসনের অন্যতম মধ্যপন্থী হিসেবে বিশ্বাস করা হতো। বাঙালী সদস্যপূর্ণ মন্ত্রীপরিষদকেও অব্যাহতি দেয়া হয় যাতে সকল ক্ষমতা পশ্চিমা শাখা সামরিক জান্তার হাতে কেন্দ্রীভূত থাকে।
এ সকল পরিস্থিতিতে ইয়াহিয়ার পদক্ষেপকে জনাব ভুট্টোর সাথে মিলে ছলনা মাধ্যমে জনগণের ইচ্ছাকে ব্যর্থ প্রমাণ করার প্রচেষ্টা ছাড়া আর কোন ভাবে দেখা যায় না। জাতীয় পরিষদ ছিল একমাত্র ফোরাম যেখানে বাংলাদেশ তার কণ্ঠ দৃঢ়ভাবে প্রকাশ করতে পারতো, এবং এটাকে ব্যর্থ করে পরিস্কার ইঙ্গিত দেওয়া হয় যে পাকিস্তানে সংসদই প্রকৃত ক্ষমতার উৎস নয়।
এই স্থগিতকরণের প্রতিক্রিয়া ছিল অনিবার্য ও স্বতঃস্ফূর্ত এবং দেশ জুড়ে মানুষ রাস্তায় নামে স্বেচ্ছাচারী এই কাণ্ডের বিরুদ্ধে তাদের প্রতিবাদ জানান দিতে। জনগণ নিশ্চিতভাবে উপলব্ধি করে ইয়াহিয়া আসলে কখনোই ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চান নি এবং তিনি সংসদীয় রাজনীতি নিয়ে উপহাস করছিলেন। জনগণের উপলব্ধি করতে পারে যে বাংলাদেশের অধিকার কখনোই পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যে থেকে বাস্তবায়িত করা যাবে না, যার মধ্যে ইয়াহিয়া এতো নির্লজ্জভাবে এমন একটি অধিবেশন আহবানকে ব্যর্থ করতে পারে যা কিনা তার নিজের বিধানপত্রে ঘোষিত হয়েছে, এবং জনগণ শেখ মুজিবর রহমানকে আহবান জানায় যে অবশ্যই পূর্ণ স্বাধীনতার পথে যেতে হবে।
শেখ মুজিব তারপরও একটি রাজনৈতিক সমাধান খুঁজতে থাকেন। ৩ মার্চের অসহযোগের কার্যক্রমের উত্তরে তিনি দখলদারদের দলকে হুঁশে আনার প্রচেষ্টার অস্ত্র হিসেবে বেছে নেন শান্তিপূর্ণ মুখোমুখিতাকে। ২ ও ৩ মার্চে নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীদের উপর ঠাণ্ডা মাথায় গুলি করে এক হাজারেরও বেশী মানুষকে হতাহত করার মুখোমুখিতায় এটি স্বয়ং ছিল একটি বিশাল পদক্ষেপ।
অসহযোগ আন্দোলনের গতিপথ এখন একটি ইতিহাসের অংশ। বাংলাদেশে ১লা থেকে ২৫শে মার্চের মধ্যে যেমনটি দেখা গেছে, মুক্তির লড়াইয়ের ধারাপথে অসহযোগ কখনোই তার সীমা পর্যন্ত এভাবে টেনে নেয়া হয় নি। অসহযোগ ছিল সার্বিক। উচ্চ আদালতের কোন বিচারককেই নতুন গভর্নর লে. জে. টিক্কা খানের কার্যালয়ে শপথ বাক্য পাঠের জন্য খুঁজে পাওয়া যায় নি। পুলিশ ও পাকিস্তান জনসাধারণ সেবাসহ সমগ্র বেসামরিক প্রশাসন কার্যালয়ে উপস্থিত থাকতে অস্বীকার করে। জনগণ সেনাবাহিনীতে খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। এমনকি প্রতিরক্ষা স্থাপনার বেসামরিক চাকুরেরাও এই বর্জন কর্মসূচিতে যোগ দেয়।
অসহোযোগ আন্দোলনে কাজকর্ম থেমেছিল না। বেসামরিক প্রশাসন এবং পুলিশ তাদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী শেখ মুজিবুর রহমানকে সমর্থন দিয়েছিল এবং তার আদেশ পালন করছিল।
এই অবস্থায় আওয়ামীলীগ আনুষ্ঠানিকভাবে সরকার গঠন না করেও অর্থনীতি ও প্রশাসন চালাতে বাধ্য হয়েছিল যখন কিনা অসহযোগ আন্দোলন চলছে। এই কাজে তাদের কেবল মাত্র জনগণ নয়, প্রশাসন এবং ব্যাবসায়ী মহলের আকুন্ঠ সমর্থন ছিল। আওয়ামী লীগের কাছে তারা তাদের অধীনস্ততা স্বিকার করেছে এবং তাদের সকল সমস্যা সমাধানের একচ্ছত্র কতৃপক্ষ হিসেবে তাকে মেনে নিয়েছিল।
বাংলাদেশে আচমকাই উদ্ভূত এরকম রাজনৈতিক দায়িত্ব শূন্যতার অদ্ভূত সময়েও অর্থনীতি এবং প্রশাসন ঠিকই চলছিল । স্বীকৃত কোনো কতৃপক্ষ না থাকলেও আওয়ামীলীগের স্বেচ্ছাসেবীরা পুলিশের সাথে একত্র হয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় রাখতে সক্ষম হয়েছে যেটি মনে হচ্ছিলো স্বাভাবিক সময়ের চেয়েও ভালো।
আওয়ামীলীগের সমর্থনে এমন প্রতিবাদ এবং এই ঐতিহাসিক অসহোযগ আন্দোলনের মুখে , জেনারেল ইয়াহিয়া তার কৌশল পরিবর্তন করলেন বলে মনে হল। ৬ মার্চ মনে হয়েছিল সে তখনও সংষর্ষকে উসকে দিতে অনড়, যখন তিনি তার তীব্র প্রতিক্রিয়ামূলক ভাষনে সকল সকল কিছুর জন্য কেবল আওয়ামীলীগকেই দোষ দিলেন এবং এমন সংকট তৈরির মূল কারিগর ভুট্রোকে কিছু বললেন না। মনে হয়েছিল, সে চাচ্ছে ৭ তারিখ স্বাধীনতার ঘোষনা হোক । ঢাকার সেনাবাহিনীকে পুরোপুরি প্রস্তুত রাখা হয়েছিল আন্দোলন ধ্বংসের জন্য এবং জান্তার মধ্যে আরও কঠোর মনোভাব দেখানোর জন্য লেঃ জেনারেল ইয়াকুবকে সরিয়ে উড়িয়ে আনা হয়েছিল লেঃ জেনারেল টিক্কা খানকে।
যাই হোক না কেন, শেখ মুজিব, স্বাধীনতার পক্ষে এত বিপুল জনসমর্থন থাকা সত্যেও রাজনৈতিক মিমাংসাকে বেছে নিলেন। জাতীয় পরিষদে যোগ দেওয়ার জন্য ৪ দফা প্রস্তাব উত্থাপনের মাধ্যমে কেবল মানুষের ভাবনাকেই তিনি সংবরণ করেননি, ইয়াহিয়া যাতে রাজনৈতিক সমঝোতায় আসতে পারে, সেই রাস্তাও খোলা রেখেছিলেন।
এটা এখন পরিস্কার যে ইয়াহিয়া এবং তার জেনারেলদের কখনোই পাকিস্তানের রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের নূন্যতম ইচ্ছা ছিল না, বরং কেবল উদ্দেশ্য ছিল কালোক্ষেপনের মাধ্যমে যাতে বাংলাদেশে আরও সমরসজ্জা করা যায়। ইয়াহিয়ার ঢাকা পরিদর্শন ছিল কেবল মাত্র গন হত্যার পরিকল্পনা না বুঝতে দেয়া ।এটা এখন পরিস্কার যে এমন সংকটের সময় এই আকস্মিক পরিকল্পনা ,সংকট শুরুর আগে বেশ ভালোভাবেই শুরু হয়েছিল।
সীমান্ত রক্ষার জন্য. রংপুরে যে ট্যাংক পাঠানো হয়েছিল, পয়লা মার্চের কিছু আগে সেগুলোকে ঢাকা ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। পয়লা মার্চ থেকে সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের পরিবারে সাথে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে পশ্চিম পাকিস্তানের ব্যাবসায়ীদের পরিবারদেরও পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠানো শুরু হয়েছিল।
পয়লা মার্চের পর থেকে সমরসজ্জা দ্রুততর করা হয় এবং ২৫ মার্চ পর্যন্ত সংলাপের পুরো সময়টা জুড়ে চলতেই থাকে। সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের বেসামরিক পোশাকে পিআ-ইএর বাণিজ্যিক বিমানে করে সিলন হয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল। সি-১৩০ এ করে দূর্গের জন্য অস্ত্র এবং সৈনিকদের আনুসাংগিক জিনিস ঢাকাতে নিয়ে আসছিল। সহ ১-২৫ মার্চের মধ্যে আনুমানিক এক ডিভিশনের মতো সৈন্য, প্রয়োজনীয় জিনিস বাংলাদেশে আনা হয়েছিল। নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য বিমান বন্দর সম্পূর্নভাবে বিমান বাহিনীর নিয়ন্ত্রনে রাখা হয়েছিল এবং ভারী কামান এবং মেশিনগান দিয়ে কঠোরভাবে ঘিরে রাখা হয়েছিল হয়েছিল এবং যাত্রীদের চলাফেরা কঠোরভাবে নজরদারী করা হচ্ছিলো।
যাত্রী থাকাকালীন সময়ে মেশিনগান চলাচলকারী জাল কঠোরভাবে তত্ত্বাবধান করা হয়। নাশকতা ও হত্যার চোরাগোপ্তা অভিযানের জন্য একটি কমান্ডো গ্রুপকে বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ দিয়ে বাংলাদেশের মূল কেন্দ্রগুলোতে পাঠানো হয় এবং সম্ভবত ২৫ মার্চের আগেই ঢাকা ও সৈয়দপুরে বাঙালিদের হামলা দু’দিনে স্থানীয় এবং অ স্থানীয়দের সংঘর্ষ ঘটানোর জন্য দায়ী ছিল, তাই সামরিক হস্তক্ষেপের জন্য একটি কভার প্রদান জরুরি ছিলো। ইয়াহিয়া এই ছলচাতুরি কৌশলের অংশ হিসেবে মুজিবের সাথে তার আলোচনা সবচেয়ে মৈত্রীসূচক ভঙ্গি অবলম্বন করেন। ১৬ ই মার্চ থেকে শুরু হওয়া আলোচনায় পূর্বে কি ঘটেছিল এবং এর একটি রাজনৈতিক মীমাংসার জন্য তার আন্তরিক ইচ্ছা প্রকাশ করেন। শেখ মুজিবের সাথে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে আওয়ামী লীগের ৪ দফা প্রস্তাব নিয়ে জান্তার অবস্থানকে ইতিবাচক করতে অনুরোধ করা হয়েছিলো। তার ইঙ্গিতে কোন গুরুতর আপত্তি ছিল যে এটি একটি অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধানের নিজস্ব উপদেষ্টা কতৃক চার পয়েন্টে বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। মৌলিক পয়েন্ট যেসব চুক্তিতে পৌছানো হয়: (১) সামরিক আইন উদ্ধরণ এবং একটি প্রেসিডেন্সিয়াল ঘোষণার দ্বারা একটি বেসামরিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর। (২) সংখ্যাগরিষ্ঠ দুই দলের জন্য প্রদেশগুলোতে ক্ষমতা হস্তান্তর (৩) ইয়াহিয়া প্রেসিডেন্ট হিসেবে সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকা (৪) হাউসের এক যৌথ অধিবেশনে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের প্রস্তুতিমূলক থেকে জাতীয় পরিষদের সদস্যদের পৃথক অধিবেশনে সংবিধান চূড়ান্ত করা. এখন ইয়াহিয়া ও ভুট্টো পরিষদের উভয়েই পৃথক অধিবেশনে প্রস্তাব দ্বারা মিটমাট নেভানোর বিপরীতে ইয়াহিয়া দ্বারা সুপারিশ করেন জনাব ভুট্টো . তিনি থাকাকালীন ৬-দফার যে একটি টেকসই প্রতিচিত্র বাংলাদেশ ও তার সেন্টারে ওয়েস্ট উইং প্রয়োগে এ গুরুতর সমস্যার সৃষ্টি করবে যা সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণে ব্যবহারিক সুবিধা প্রদান করবে। ওয়েস্ট উইংকে এমএনএ এর ছয় দফা সংবিধান প্রেক্ষাপটে এবং এক-ইউনিট ভেঙে একটি নতুন প্যাটার্নে একসাথে কাজ করার অনুমতি দিতে হবে। নীতিগতভাবে এই চুক্তি শেখ মুজিব ও ইয়াহিয়া মধ্যে একমতে পৌছে করা হয়েছে যেখানে অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে বাংলাদেশ সামনা-সামনি সেন্টারের ক্ষমতা সংজ্ঞায়িত একমাত্র প্রশ্ন ছিলো। এখানে সবাই যৌথভাবে একমত হয়েছিলেন যে ক্ষমতার বন্টন যথাসম্ভব জাতীয় পরিষদের অনুমোদিত চূড়ান্ত সংবিধানের ‘ছয় দফা’ উপর ভিত্তি করে করা উচিত হবে। অন্তর্বর্তী ব্যাবস্থাপক এবং প্রেসিডেন্টের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড জনাব এম এম আহমেদ এই অংশের বাইরে কাজ করার জন্য বিশেষভাবে নিযুক্ত ছিল। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টাদের সঙ্গে তাঁর কথাবার্তায় এটা স্পষ্ট যে প্রদত্ত রাজনৈতিক মতৈক্যে পৌছাতে কোন অনতিক্রম্য সমস্যা ছিল এমনকি অন্তর্বর্তী সময়ের মধ্যে ছয় দফার কিছু আউট সংস্করণে কাজ করার জন্যও। আওয়ামী লীগের খসড়া যা তিনি পরামর্শ হিসেবে উপস্থাপিত তিনটি সংশোধনীর চূড়ান্ত তালিকার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে, সরকার ও আওয়ামী লীগের অবস্থানের মধ্যে ফাঁক আর নীতির সুনির্দিষ্ট এবং অন্যতম কিন্তু এর উপর নিছক রয়েছে।
প্রস্তাবের শব্দসমষ্টি। আওয়ামী লীগ ২৪মার্চের অধিবেশনে ভাষাগত কয়েকটি ছোটখাট পরিবর্তনের সঙ্গে সংশোধনী গ্রহন করে এবং যখন অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান চূড়ান্ত করা হবে তখন
একটি চূড়ান্ত খসড়া সেশন নম্বর হোল্ডিংয়ে
ইয়াহইয়া এবং মুজিবের উপদেষ্টাদের মধ্যে প্রতিরোধের কিছুই ছিল না। এটা স্পষ্ট করতে হবে যে তারা যে একটি চূড়ান্ত অবস্থানে ছিল সেটি এখন কোন পর্যায়ে আছে এবং আলোচনার কোন ভাঙ্গন জেনারেল ইয়াহিয়া বা তার দল দ্বারা সেটা করা যায়নি। ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য আইনি কভার প্রশ্ন ছিলো ইয়াহিয়া গণহত্যা ঢাকতে নিছক তার আরেকটি বিলম্বিত জালিয়াতি। তিনি এবং তার দল একমত হয়েছে যে, ১৯৪৭ ক্ষমতার ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স আইনের প্রাধান্য এবং সঙ্গে রাষ্ট্রপতি ঘোষণার দ্বারা সঙ্গতিপূর্ণভাবে ক্ষমতা স্থানান্তরিত করা যেতে পারে। লক্ষ করুন যে, পরবর্তীকালে জনাব ভুট্টো উত্থাপিত এবং জেনারেল ইয়াহিয়া সমর্থিত করার কোন শাসন ব্যাবস্থা কিভাবে আইনি কভার হবে যেখানে এটি শেখ মুজিব ও ইয়াহিয়া মধ্যে বিতর্কের উৎস ছিল না। এতে সামান্যতম সন্দেহ নেই যে ইয়াহিয়া ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে, জাতীয় পরিষদের সভায় ক্ষমতা হস্তান্তর অপরিহার্য ছিল, আওয়ামী লীগ এমন একটি ছোটখাট বৈধ কৌশলের উপর আলোচনা ভেঙে দিতো না। সর্বোপরি সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে এটি যেমন একটি সভা তাই একটি পৃথক অধিবেশনে বসার জন্য সিদ্ধান্ত তার গ্রহণযোগ্যতা থেকে ভয়ের কোন কারণ নেই যদিওপার্টির জন্য একটি মৌলিক স্ট্যান্ড চেয়ে জনাব ভুট্টোর সাথে বরং মিটমাট করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। প্রতিবাদী পক্ষের মধ্যে নীতিগতভাবে চুক্তিতে যে একমত হয়েছেন তা ২৫শে মার্চ জনাব ভুট্টোর নিজের প্রেস কনফারেন্স দ্বারা উপলব্ধ করা হয়। জেনারেল ইয়াহিয়া এবং জনাব ভুট্টোর মধ্যে পৃথক অধিবেশনে
পাস নির্দিষ্ট ছিলো না কিন্তু এটা প্রমাণ করে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আলাপ সম্পর্কে পিপিপি অবশ্যই ইচ্ছাকৃত মিথ্যাচার ছড়িয়েছে যারা বলেছিল শেখ মুজিব লোকদেখার জন্যই নির্ধারিত ছিলেন এবং দৈনিক তার চাহিদা বেড়ে উঠছিল। আওয়ামী লীগ দল এবং জেনারেল ইয়াহিয়ার উপদেষ্টাদের মধ্যে সভায় এইসব সন্দেহের সামান্যতম ইঙ্গিত উত্থাপিত হয়েছিলো তা বলাই বাহুল্য এবং যেখানে সহৃদয়তা এবং আশাবাদ শেষ হয়ে গিয়েছিল। যতক্ষণ না সুষ্ঠু ব্যাবস্থাপনার আশা উত্থাপিত হচ্ছে, আকস্মিকভাবে গোলাবারুদের জাহাজ এম ভি সোয়াত খালাস করার সিদ্ধান্ত দ্বারা উপলব্ধ করা হয় সেনাবাহিনীর উদ্দেশ্যের মধ্যে আরো অশুভ লক্ষণ আছে। প্রস্তুতিমূলক এই সিদ্ধান্ত ছিলো ব্রিগেডিয়ার মজুমদারের। একজন বাঙালি অফিসার, চট্টগ্রামে গ্যারিসন কমান্ডিং থেকে হঠাৎ তার কমান্ড সরানো এবং একটি পশ্চিম পাকিস্তানীকে তার সাথে প্রতিস্থাপিত করা হয়েছে। ২৪ এর রাতে তিনি সশস্ত্র পাহারার অধীনে ঢাকা নিয়ে যাওয়া হয় এবং সম্ভবত মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়েছিলো। নতুন কমান্ড নোটিশ অধীনে একটি সিদ্ধান্ত স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে দেওয়া হয়েছিল, সেনা বন্দর শ্রমিকের অসহযোগিতার মুখে গত ১৭ দিনের জন্য চট্টগ্রাম বন্দরের নোঙর ফেলা জাহাজ সত্ত্বেও এম ভি সোয়াত থেকে মাল খালাস করা সিদ্ধান্ত বাতিল ছিলো। এটি ছিলো একটি পুর্বনির্ধারিত বিরক্তি যা অবিলম্বে চট্টগ্রামের রাস্তায় ১০০০০০ মানুষকে আনে এবং নিজেদের পথ পরিস্কার করতে আর্মি ব্যাপক অগ্নিসংযোগ করেছিল। বিষয়টি আওয়ামী লীগের দ্বারা উত্থাপিত হয়েছিল, . জেনারেল পীরজাদা কেন আলোচনা থাকাকালীন এসবের অনুমতি দেয়া হয়েছিল সেই হিসাব এখনও চলছে। তিনি জেনারেল ইয়াহিয়ার কাছে এটি পাস করার জন্য একটি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকায় পরবর্তীতে এর কোন উত্তর দিলেন না। ২৪শে মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া এবং আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মধ্যে সর্বশেষ বৈঠক হয় যেখানে জনাব এম এম আহমেদ চূড়ান্ত সংশোধনী গৃহীত করেন , একটি কল সর্বশেষ অধিবেশনের জন্য জেনারেল পীরজাদার থেকে একটি কল আসতে পারে যেখানে খসড়া চূড়ান্ত হওয়ার একটা সম্ভাবনা ছিলো। এমন কোনো কল বাস্তবে রূপায়িত হয়নি এবং এর পরিবর্তে এটি জানা গেছে যে জনাব এম এম আহমেদ, যিনি আলোচনার কেন্দ্রীয় ছিল, হঠাৎ করে আওয়ামী লীগ দলকে কোনো সতর্কবাণী দেওয়া ছাড়াই 25এ সকালে করাচি ছেড়ে চলে গেছে।১১ টার মধ্যেই ২৫ এর সব প্রস্তুতি প্রস্তুত ছিল এবং সেনা সদস্যরা শহরের মধ্যে তাদের পজিশন নিতে লাগল। বিশ্বাসঘাতকতার অনুপম একটি আইন সমসাময়িক ইতিহাসের পুরবনিরধারিত গণহত্যার একটি প্রোগ্রাম ২৫ এর মার্চ মধ্যরাতেআওয়ামী লীগকে কোন প্রকার আলটিমেটাম ছাড়াই ইয়াহিয়া দ্বারা ঢাকার শান্তিপূর্ণ এবং অসন্দিগ্ধচরিত্র জনসংখ্যার উপর কার্যকর হয় হয়, কোন কারফিউ আদেশ জারি করা হয় নি যখনএমনকি মেশিনগান , কামান এবং ট্যাংক উপর কামান, মৃত্যু ও ধ্বংসের তাদের রাজত্ব কায়েম করে তখনো না।
সময় অনুযায়ী লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান কর্তৃক ইস্যুকৃত প্রথম সামরিক আইন ঘোষণা কোনো প্রতিরোধের প্রস্তাব ছাড়াই পরদিন সকালে কিছু ৫০০০০ মানুষ, তাদের অধিকাংশই সম্প্রচার করা হয়, এবং অনেক নারী ও শিশু, জবাই করা হয়েছিলো। ঢাকা দাবানল ডাই শহরের সবচেয়ে কোণ সঙ্গে একটি নরক থেকে পরিণত হয়েছিল. বাসিন্দা যারা আগুন সামরিক দ্বারা শুরু করে তাদের বাড়ী-ঘর থেকে আটকানো ছিল , মেশিন-গুলি ছিল যেমন তারা অগ্নিতে অব্যাহতি দৌড়ে. যতক্ষণ পুলিশ, ইপিআর এবং সশস্ত্র স্বেচ্ছাসেবকদের একটি বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধ গড়ে তোলেন প্রধান ‘ক্ষতিগ্রস্তরা দুর্বল নির্দোষ এবং অসন্দিগ্ধচরিত্র, যারা তাদের হাজার হাজার এ-রেণ্ডম নিহত হয়েছ। পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতির আদেশ, যা আমরা খুব শীঘ্রই প্রকাশ করা হবে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যার বিবরণ সরাসরি অ্যাকাউন্ট কম্পাইল করা হয়। স্কেল ও কর্মের বর্বরতা সভ্য বিশ্বের কিছু ছাড়িয়ে গেছে. ইয়াহিয়া নিজেকে সব বাঙালির ওপর গণহত্যা কমিট একটি খোলা লাইসেন্স সঙ্গে রাখার পাকিস্তান আর্মি, পরে 25 মার্চ রাতে ঢাকা ত্যাগ করেন. বর্বরতার এই আইনের জন্য তাঁর নিজের আত্মপক্ষ সমর্থন 8 রাত দশটা পর্যন্ত আসন্ন ছিল না পরের দিন যখন বিশ্বের এই হলোকস্ট জন্য তার প্রথম ব্যাখ্যা দেওয়া হয়. বিবৃতিতে স্ববিরোধী এবং ইতিবাচক লাইন মেশানো ছিল. বিশ্বাসঘাতক ও আসামীর, যাদের সঙ্গে, মাত্র ৪৮ ঘণ্টা আগে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য সমঝোতা ছিল করা যেমন একটি অংশ তাঁর ব্র্যান্ডিং; বাংলাদেশের পরিস্থিতি বা আলোচনার অবশ্যই কোন সম্পর্ক বিঁধ। জাতীয় পরিষদে “আওয়ামী লীগ যা বাংলাদেশের একমাত্র প্রতিনিধি ছিলেন এবং আসন সংখ্যাগরিষ্ঠতা অনুষ্ঠিত নিষিদ্ধ পর জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে তাঁর ওয়াদার ৭৫ লক্ষ বাঙালিকে অবাধে ভয়েস রেকর্ড বিদ্রুপ ছিল. দ্য বিবৃতির অসূক্ষ্মতা স্পষ্ট প্রমাণ যে ইয়াহিয়া পারেন যুক্তিবিজ্ঞান বা নৈতিকতা পিছনে আশ্রয় গ্রহণে আর আগ্রহী ছিলেন এবং বাংলাদেশের জনগণের পেষ তার বিড জঙ্গলের আইন রূপে ফিরিয়ে ছিল। পাকিস্তান এখন মৃত এবং একটি পর্বত নিচে চাপা লাশ. শত শত এবং হাজার হাজার মানুষ বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দ্বারা হত্যা পশ্চিম পাকিস্তান ও বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে একটি দুর্ভেদ্য বাধা হিসেবে কাজ করবে। প্রাক পরিকল্পিত গণহত্যা ইয়াহিয়া অবশ্যই জানা উচিত যে, সে পাকিস্তানের কবর খনন করা হয়েছিল অবলম্বী দ্বারা. পরবর্তী মানুষের উপর তার লাইসেন্সকৃত খুনীদের দ্বারা তার নির্দেশে সংঘটিত গণহত্যার একটি জাতির ঐক্য সংরক্ষণ করার জন্য ডিজাইন করা হয় নি. তারা বর্ণবাদী ঘৃণা ও ধর্ষকাম মানবতার এমনকি উপাদানের বর্জিত কাজ ছিল তাদের পেশাগত সৈনিকদের আদেশ লঙ্ঘন।
সামরিক সম্মানের কোডকে দেখা যায়, শিকারী পশু হিসেবে, যারা হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ ও বিনাশের এক বেলেল্লাপনাকে প্রশ্রয় দিয়েছিলো এবং মানবসভ্যতার ইতিহাসে অতুলনীয় ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ড চালিয়য়েছিলো। এসব কাজ ইঙ্গিত করে যে, দুই দেশের ধারণা ইতিমধ্যে গভীরভাবে ইয়াহিয়া ও তার সহযোগীদের মনে গভীর ভাবেই গেথে গিয়েছিল, যারা তাদের নিজের দেশের মানুষের উপর এরূপ নৃশংসতা চালাতে কুন্ঠিত হয় না। ইয়াহিয়ার গণহত্যার উদ্দেশ্য রাজনৈতিক ছিলো না। এটা শুধুমাত্র পাকিস্তানের দুঃখজনক ইতিহাসে শেষ অঙ্ক হিসেবে কাজ করে যা ইয়াহিয়া বাংলাদেশের মানুষের রক্ত দিয়ে লিখতে চেয়েছিলেন। উদ্দেশ্য ছিলো গণহত্যা এবং ঝলসিত পৃথিবী যাতে , তার সৈন্যরা বিতাড়িত বা প্যারিশভুক্ত না হয়। এই সময় তিনি চেয়েছিলেন, আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব, বুদ্ধিজীবি সমাজ এবং প্রশাসনকে ডুবাতে, ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন আমাদের শিল্প ও প্রকাশ্য সুযোগ-সুবিধাকে, সবশেষে তিনি আশা করেছিলেন, আমাদের শহর ধূলিসাৎ করতে। ইতিমধ্যে তার দখলদার বাহিনীর এই উদ্দেশ্যের দিকে সারগর্ভ অগ্রগতি অর্জন করেছে। বাংলাদেশকে 50 বছর আগেই সেইসব মানুষদের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের বিভাজিকা উপহার হিসেব স্থাপন করা হয়েছিলো, যারা তাদের নিজের সুবিধার জন্য তেইশ বছর ধরে শোষিত হয়েছে। এটি হলো সেই মহাক্ষমতার তাৎপর্য যেই ক্ষমতা Belsen এবং Auschwitz দিন থেকে গণহত্যার এই বৃহত্তম একক আইন উপেক্ষা করে আসছে। যদি তারা মনে করে তারা পাকিস্তানের ঐক্য সংরক্ষণ করছে , তারা এটা ভুলে যেতে পারেন কারণ পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ইয়াহিয়ার নিজের কোন বিভ্রম ছিলো না। তাদেরককে উপলব্ধি করতে হবে যে ইয়াহিয়ার হাতেই পাকিস্তানের মৃত্যু ঘটেছিলো-এবং স্বাধীন বাংলাদেশ একটি বাস্তবতা যা টিকে আছে ৭৫ লক্ষ বাঙালির অবিনশ্বর ইচ্ছা এবং সাহসিকতার জোরে যারা প্রতিনিয়ত তাদের রক্ত দিয়ে এই নতুন জাতিসত্তার শিকড়ের পৃষ্ঠপোষকতা করছে। পৃথিবীর কোন শক্তিই এই নতুন জাতিকে চ্যুত করতে পারবে না এবং তাড়াতাড়ি হোক বা দেরীতে, বড় এবং ছোট উভয় পরাশক্তিকেই বিশ্বভ্রাতৃত্বের দরুন এটিকে গ্রহণ করতে হবে। সৈন্যদের বন্দী করা এবং তাদেরকে ফেরত পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে আনার জন্য ইয়াহিয়া উপর বৃহৎ পরাশক্তিগুলোর পূর্ণ চাপ দেওয়া যতটা না রাজনীতির স্বার্থে তার চেয়ে বড় মানবিকতায়। আমরা USSR ও ভারত এবং সমগ্র বিশ্বের স্বাধীনচেতা মানুষদের কাছে আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ যারা আমাদের এই সংগ্রামে জোরালো সমর্থন দিয়েছেন : সেই সাথে স্বাগত জানাই গনচীন, আমেিরকা, ফ্রান্স, গ্রেট ব্রিটেন এবং বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের স্বাধীনতা পক্ষের শক্তিকে। নিজ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য প্রত্যেকেই নিজশ্ব উপায় চর্চা করে, পশ্চিম পাকিস্তানে তখন এই চর্চাটাই চলছিল ; ইয়াহিয়া আর একদিনের জন্যও বাংলাদেশের বিপক্ষে আগ্রাসন যুদ্ধে টিকে থাকতে পারছিলো না। বাংলাদেশ বিশ্বের অষ্টম জনবহুল দেশ হতে চলেছে। এর একমাত্র লক্ষ্য ছিলো যুদ্ধবিদ্ধস্ত জাতি থেকে ইয়াহিয়ার হানাদার বাহিনীর পিছনে থেকে একটি নতুন জাতি পুনর্নির্মাণের। এটি একটি বিস্ময়কর টাস্ক হবে কারণ আমরা ইতিমধ্যে বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলির একটি। কিন্তু আমাদের কাছে এখন একটি কারণ এবং এমন লোক আছে যারা প্রতিরোধের কঠিনীভূত হয়েছে, যারা তাদের জাতির জন্য তাদের রক্ত দিয়ে একটি মহাকাব্যিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তাদের স্বাধীনতা অর্জন করেছে যা সংঘটিত হয়েছিলো একটি আধুনিক সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নিরস্ত্র মানুষের দ্বারা। এই ধরনের একটি জাতি তার জাতিসত্তার ভিত সুরক্ষিত করার কাজের মধ্যে ভুল করতে পারেন না।
আমাদের টিকে থাকার সংগ্রামে আমরা সব মানুষের বন্ধুত্ব চাই ক্ষমতায় বড় এবং ছোট সবার। আমরা কোন সংযোজন বা চুক্তি যোগদানের জন্য উচ্চাভিলাষী না, কিন্তু কেউ স্বেচ্ছায় আমাদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ না করে শুভেচ্ছার মনোভাবে সহায়তা দিতে চাইলে তা নেয়া হবে। আমরা এ পর্যন্ত অত্যন্ত দীর্ঘ লড়াই করেছি আমাদের আত্মবিশ্বাসের সাথে যাতে যে কেউ আমাদেরকে আদর্শ ভেবে নিতে পারে।
এখন আমরাবিশ্বের সব দেশগুলির কাছে আমাদের জাতিসত্তার জন্য সংগ্রামে বস্তুগত ও নৈতিক উভয় ধরণের স্বীকৃতি ও সহায়তার জন্য আবেদন জানাচ্ছি। প্রতিদিনের দেরিতেসহস্র জীবন হারিয়ে যায় এবং বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ ধ্বংস করা হয়। মানবতার স্বার্থে এক্ষুনি পদক্ষেপ গ্রহণ করণ এবং আমারা আজীবন বন্ধুত্ব প্রদর্শন করবো
এখন আমরা এটা পৃথিবীর সামনে বাংলাদেশের মানুষের ‘কেস’ হিসাবে উপস্থাপন করি। কোনো জাতি জাতিসত্ত্বার জন্য এমন অধিকার আদায় করেনি, কোনো মানুষ অধিকার আদায়ে এমন যুদ্ধ করেনি।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
কলকাতাস্থ পাকিস্তানি ডেপুটি হাইকমিশনারের বাংলাদেশের পদাম্বলন | এশিয়ান রেকর্ডার- জুন ১১-১৭,১৯৭১ | ১৮ এপ্রিল ১৯৭১ |
বাংলাদেশে পাকিস্তানি কূটনীতিক ট্র্যান্সফার আনুগত্য: কলকাতায় পাকিস্তানের ডেপুটি হাইকমিশনার জনাব এম হোসেন আলী, 18 এপ্রিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের নিকট তার আনুগত্য প্রকাশ করেন। তার পাঁচজন কর্মকর্তাসহ কর্মীদের 70 জন বাঙালী সদস্য, বাংলাদেশ সরকারকে সাহায্য করার আকাঙ্খা প্রকাশ করেছিলেন। জনাব হোসেন আলী 30 জন অন্যান্য কর্মচারী, বেশিরভাগ সুপার কেরানী ও কর্মীদের জুনিয়র সদস্যদের বরখাস্ত করেন যারা পশ্চিম পাকিস্তানীদের সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ছিলো। তার এ পদক্ষেপ ছিলো বিদেশে বাংলাদেশ সরকারের প্রথম মিশন। তার কর্মীদের বাঙালী সদস্যদের কতৃক সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে, জনাব আলী তার মিশন শীর্ষে পাকিস্তানের পতাকা প্রতিস্থাপন করে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। অনুষ্ঠানে তার কর্মীদের কয়েকজন সিনিয়র সদস্যরাও উপস্থিত ছিলেন। পরে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, পাকিস্তান সরকারের কাছ থেকে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত “আমার নিজের” ছিল; তিনি খুশি ছিলেন যে তার কর্মীদের কয়েকজন বাঙালী সদস্যরা তাঁকে সমর্থন করেছিল। তিনি বলেন: “বর্তমানে পাকিস্তানের সরকারের প্রতিনিধিত্ব অব্যাহত রাখা অসম্ভব কারণ এটি বাংলাদেশে বাঙালিদের উপর চালানো একটি ইচ্ছাকৃত গণহত্যার সব প্রমাণ দ্বারা সীমাবদ্ধ হয়ে আছে ” তিনি 1600-শব্দের একটি বিবৃতি প্রদান করেন, যেখানে বর্ননা করেন কিভাবে পাকিস্তানি সরকার বাংলাদেশের একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচনের সুস্পষ্ট রায়কে কিভাবে বিদ্রুপ করেছিলো এবং “পরিকল্পিতভাবে বাঙালি জাতিকে পরিকল্পিতভাবে দমন করার প্রয়াসে” জড়িত ছিলো। সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তিনি বলেন, তিনি প্রধানমন্ত্রী এবং বাংলাদেশের অন্যান্য মন্ত্রীবর্গ, যারা কাল যোগাযোগ রক্ষা করতেন, “সবচেয়ে আন্তরিকতার সঙ্গে” তাঁকে ও তার বাংলা কর্মীদের যারা সরকারের প্রথম বৈদেশিক মিশন হিসেবে কাজ করেছিলেন, তাদেরকে স্বাগত জানান। তিনি বিগত কয়েক দিন ধরেই মিশনের কিছু বিশ্বস্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিভিন্ন গোপন বৈঠক ছিলেন , “আমাকে সতর্ক থাকতে হতো”, তিনি বলেন, “অন্তত আমাদের সিদ্ধান্ত সামনে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণার পূর্বেই যেন ফাঁস না হয়ে যায়”. ‘কলকাতায় একটি ব্যাংক সূত্র জানায়, একটি সিটি ব্যাংক কতৃক পাকিস্তানের ডেপুটি হাই কমিশনের ক্রেডিটের সমগ্র টাকা 17 এপ্রিল প্রত্যাহার করা হয়। এতে মিশনের সব সিনিয়র সদস্যদের অনুমোদন ছিল। এক সূত্র জানায়, ডেপুটি হাই কমিশনের আনুগত্য পরিবর্তন করার সিদ্ধান্তটি বিগত কয়েক দিন ধরে ইসলামাবাদ থেকে প্রেরণকৃত কয়েকটি টেলিগ্রামের বার্তা থেকে অনুসৃত ছিলো, এতে ছিলো মিশনের তথ্য বিভাগের উচ্ছেদের পাকিস্তান সরকারের সিদ্ধান্তের তথ্য, তাৎক্ষণিকভাবে রাওয়ালপিন্ডিতে তথ্য বিভাগের কর্মচারীদের পুনরাহ্বান এবং এতে কর্মীদের কয়েকজন বাঙালি সদস্যদের অবিলম্বে স্থানান্তর হওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে বলা হয়েছিল।
পাকিস্তানের সতর্কবার্তা :
২২ ফেব্রুয়ারিতে তৎকালীন কলকাতার ডেপুটি হাইকমিশনকে পাকিস্তানের ‘অবৈধ দখলদারিদের’ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে ‘তার ফল ভালো হবে না’ বলে ভারতকে হুমকি দেয় পাকিস্তান।
এর আগেই ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব এ কে রায় পাকিস্তানের হাই কমিশনার সাজ্জাদ হায়দারকে বলেছিলেন এটা পাকিস্তানের অন্তর্গত বিষয়ে ভারত আইনবিরোধী কোনও কাজে হস্তক্ষেপ করবে না।
এপ্রিল মাসের ২৩ তারিখে কলকাতায় পাকিস্তানের ডেপুটি হাইকমিশনার হিসেবে মেহেদী মাসুদকে নিয়োগ দেয়ায় কোনও প্রকার উস্কানি ছাড়াই মন্ত্রণালয়ে বিক্ষোভ করলেন।
হায়দার সাহেব এ কে রায় এর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করলো এমন সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাওয়া গেলো। যার মাধ্যমে জানা গেলো কলকাতার লোকাল অফিস ঠিক সময়ে ঠিক কাজটি করতে পারেনি, না হলে গতকালের এই বিচ্ছিরি ঘটনাটির অবকাশ হতো না।
ভারতের ডেপুটি হাই কমিশনও রাষ্ট্রবিরোধী (পাকিস্তান) কোনও কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করেনি। বরং পাকিস্তান এর একটি আইনি সমাধান চাইতে পারে, ভাতরের পক্ষ থেকে এমন পরামর্শ দেয়া হয়। পাকিস্তান যদি পররাষ্ট্রনৈতিক নিময়কানুন না মানেন, তবে এর জন্য সরকারি
ভারতীয়দের পরামর্শ অনুযায়ী পাকিস্তানের আইনগতভাবে একটা ব্যবস্থা নেয়া উচিত। বিবৃতি অনুযায়ী পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এর অধিনে কূটনৈতিক যে নিয়মকানুনগুলো আছে তাতে বিদেশী মিশনগুলো আদালতে যেতে পারবে না। তাতে কূটনৈতিক সীমা লংঘন হয়।
পরবর্তিতে একজন মূখপাত্র জানান, হায়দার সাহেবের এই আচরণ গণমাধ্যমের সাথে ভুল আচরণ কূটনৈতিক অসৌজন্যতা। তাকে যখন জিজ্ঞেস করা হলো ‘তার ফল ভালো হবে না’ মর্মে পাকিস্তান কি বুঝাতে চাইলো, তখন তিনি উত্তরে বলেন, এক হাতে তালি বাজে না। ভারতও একই সাথে অবমাননাকর হুমকি দিয়েছে।
আরও দুই কূটনৈতিকের রাজনৈতিক আশ্রয় প্রত্যাশা :
এপ্রিল মাসের ২০ তারিখে পূর্ব বাংলার দুই পাকিস্তানি হাই কমিশনের কূটনৈতিক নয়া দিল্লীতে রাজনৈতিক আশ্রয় চায় এবং তা দ্রুত তা পাশ হয়ে যায়।
রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়া কূটনৈতিকেরা হলেন যুগ্ম সচিব কে এম সাহাবুদ্দিন (৩০) এবং সহকারী প্রেস এটাসে আরনজাদুল হক (৩৩) সিদ্ধান্ত নিলেন পাকিস্তানি আর্মিদের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষদের ওপর যে ধ্বংসযজ্ঞ চলছে এ বিষয়ে ইসলামাবাদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করে দেবেন। তারাহুরার মধ্য দিয়েই মাঝরাত্রে সংবাদ সম্মেলন ডাকলেন তারা। সেই সংবাদ সম্মেলনে ভারতীয় সাংবাদিকদের সাথে বিদেশী সাংবাদিকরাও উপস্থিত ছিলো।
সাহাবুদ্দিন সাহেব ১৯৬৬ সালে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগ দিয়ে কিছুদিন নেপালে কাজ করেন। ১৯৬৭-র জানুয়ারি থেকেই নয়া দিল্লীতে কাজ করছিলেন তিনি।
আরনজাদুল হক ঢাকায় পাকিস্তান রেডিওতে আঞ্চলিক প্রোগ্রাম পরিচালক হিসেবে কাজ করতেন। ১৯৬৬ সালে তিনি এই পদে যোগ দেন এবং তখন থেকেই নয়া দিল্লীতে কাজ করছিলেন।
সাহাবুদ্দিন সাহেব তার দুই মেয়ে এবং স্ত্রী সহ এবং আরনজাদুল হক একাই (তিনি অবিবাহিত ছিলেন) রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেছিলেন।
বিবৃতিতে তারা বলেন, বাংলাদেশের মানুষদের ওপর ইসলামাবাদ ইতিহাসের জঘন্যতম নির্যাতন চালাচ্ছে। নিরপরাধ, নিরস্ত্র মানুষদের হত্যা করছে। এর ভয়াবহতা উপলব্ধি করতে শুরু করেছে বিশ্ব।
সংবাদ সম্মেলনে তারা বলেন, তারা একটি ফ্যাসিস্ট, স্বৈরাচারি সেনাবাহিনী পরিচালিত সরকারের হয়ে আর কাজ করবে না। এখন থেকে তারা সাতে সাত কোটি বাংলাদেশীদের জন্য দ্বৈর্থহীনভাবে কাজ করে যাবে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তারাই প্রথম পাকিস্তানি কূটনৈতিক হিসেবে ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছিলো।
পশ্চিমবঙ্গে থাকা যেসব বাঙ্গালি কূটনৈতিকদের তাদের কর্মস্থল থেকে বদলীর নির্দেশ দেয়া হয়েছে তাদেরকে রাজনৈতিক আশ্রয় নিতে এক সপ্তাহ আগেই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের খবরে রাজনৈতিক আশ্রয় নেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়। পশ্চিমবঙ্গে তখন তিনজন বাঙ্গালি কর্মকর্তাসহ ১৪জন কূটনৈতিক পাকিস্তান হাই কমিশনে কাজ করতেন। তাদের মাঝে ২জনকে ভারতে বদলি করা হয়েছিলো।
<003.013.033>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ তৃতীয় খন্ড
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
বিচারপতী আবু সায়ীদ চৌধুরীকে বহির্বিশ্ব ও জাতিসংঘে বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশনের বিশেষ প্রতিনিধি নিয়োগ | বাংলাদেশ সরকার,অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির কার্যালয় | ২১ এপ্রিল, ১৯৭১ |
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
২১ এপ্রিল,১৯৭১
প্রেরক
বিচারপতি জনাব আবু সায়ীদ চৌধুরী
উপাচার্য
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
জনাব,
স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজতাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে বিচারপতি জনাব আবু সায়ীদ চৌধুরীকে নিয়োগ করা হলো যেন সে বৈদেশিক বিভিন্ন নেতৃবৃন্দের সাথে যোগাযোগ ,জাতিসংঘ ও অন্যান্য বিভিন্ন সংস্থার সাথে বৈদেশিক কূটনৈতিক মিশন গুলোতে বাংলাদেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করতে পারে।
যথাসময়ে নির্দেশিত কাজের জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে বিশেষ ভাবে তাকে নিয়োগ করা যেতে পারে।
(সৈয়দ নজরুল ইসলাম)
অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি
খন্দকার মোশতাক আহমেদ
পররাষ্ট্র মন্ত্রী
ঢাকা হাইকোর্টের জ্যেষ্ঠ বিচারক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জনাব জিউসুক চৌধুরী সেনাবাহিনীর ক্র্যাক ডাউনের সময় যুক্ত্রারাজ্যে ছিলেন এবং তিনি সেখান ত্থেকেই বাংলাদেশ সরকারের প্রতি তার আনুগত্যের ঘোষণা দেন।
<003.014.034>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ তৃতীয় খন্ড
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
অস্ত্র সাহায্যের জন্য প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের আবেদন | টাইমস অব ইন্ডিয়া | ২১ এপ্রিল,১৯৭১ |
অস্ত্রের জন্য তাজউদ্দীনের আবেদন
২৮ এপ্রিল,১৯৭১ তাজউদ্দীন আহমদের আবেদনের প্রেস রিপোর্ট
কোহিমা,এপ্রিলের ২৮ তারিখে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ প্রতিবেশী রাষ্ট্র গুলোর প্রতি আবেদন জানান অবিলম্বে বাংলাদেশ কে স্বীকৃতি দিয়ে নিঃশর্তে অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করতে যেন সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুরতা থেকে সদ্য জন্ম নেয়া দেশটি মুক্ত হতে পারে।
বাংলাদেশ বেতারের মাধ্যমে জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া এক বার্তায় তিনি বলেন “ যারা আমাদের শোষোণ করে আমাদের টাকায় অস্ত্র কিনে আমাদের দেশের মানুষ কে হত্যা করছে ’’ সেই হানাদার বাহিনীকে তিনি দেশ থেকে তাড়িয়ে দেয়ার আহ্বান জানান।
তিনি আরো বলেন পশ্চিম পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীর থেকে রংপুর,দিনাজপুর,ফরিদপুর,বগুরা এবং ময়মনসিংহ (ক্যান্টনমন্টের এলাকা ছাড়া)মুক্ত করা হয়েছে এবং খুব শীঘ্রই বাকি অঞ্চল গুলোও বাংলাদেশে সরকারের অধীনে চলে আসবে।
তাজউদ্দীন আহমদ স্বদেশবাসীর উদ্দেশ্যে আরো বলেন যে লাখো বাঙালির অনুচ্চারিত আত্মত্যাগের স্বীকৃতি দেয়ার সময় এসেছে।
প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন সে সকল অগণিত মুক্তিযোদ্ধা যারা স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিয়েছে তাদের প্রত্যেকের নাম ইতিহাসের পাতায় উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।
তিনি বিদেশে অবস্থানরত সকল বাঙালির কাছে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য সম্ভাব্য সকল ধরণের সাহায্যের জন্য আবেদন করেন।
<003.015.035>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ তৃতীয় খন্ড
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উপর বাংলাদেশ সরকারের অর্থনৈতিক উপদেষ্টার একটি প্রতিবেদন | বাংলাদেশ সরকার |
১০ মে, ১৯৭১
|
বাংলাদেশঃ অবস্থা ও সুযোগ
– রেহমান সোবহান
বাংলাদেশ সরকারের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা
মে ১০ ১৯৭১
প্রাপ্ত তথ্যের আলোকে , বৃহৎ শক্তি এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর নীরবতা ও নিস্কৃয়তা বুঝতে পারা কস্টসাধ্য। আদর্শবাদী হিশেবে যখন ২,০০,০০০ বাঙালীর পরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞের বিশ্বের মনযোগী হওয়া উচিত, এটা দুঃখজনক যে তাদের রাজনৈতিক বিবেচনা এতোটাই বিকারগ্রস্ত যে তাঁরা প্রতিক্রিয়া জানানো থেকে বিরত থাকছে।
আমরা এখন একটি জনপ্রিয় নির্বাচিত দল এবং একে ধরে রাখা রাজনৈতিক শক্তিকে ধ্বংস করতে সামরিক জান্তার একটা চক্রান্ত দেখতে পাচ্ছি, যাদের নিজের অবস্থানই নড়োবড়ে। যখন অধিকাংশ বিপ্লবী নেতাদের অবস্থান এখনো পরিস্কার নয়, এ বিষয়ে কোনো দ্বিধা নেই যে শেখ মুজিবুর রহমান এবং আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের পক্ষে কথা বলছেন । ১৬৯ এর মাঝে ১৬৭ আসন এবং ৮০ শতাংশ ভোটে নির্বাচনে জয়লাভ তাদের প্রশ্নাতীত কর্তৃত্বের প্রমান দেয় । তাঁরা প্রতিনিধিত্ব করছে ৭.৫ কোটি মানুষকে কিংবা ৫৫ শতাংশকে যা এক সময় পাকিস্তান গঠন করেছিলো । বাংলাদেশের পক্ষে কথা বলার অধিকার নিয়ে ইয়াহিয়া ও তার জান্তাকে বৈধতা দেওয়া ৭.৫ কোটি বাঙালীকে অবমূল্যায়ন করে যারা বিশ্বের অষ্টম বৃহৎ জনগোষ্ঠী । গণতান্ত্রিক নীতির প্রতিজ্ঞা করার নামে এটা শুধু প্রহসনই নয় , এতে কোনো রাজনৈতিক প্রজ্ঞাও নেই ।
এখন পাকিস্তান সরকার মরিয়া হয়ে পুরো বিশ্বকে একথা বোঝাতে চাইছে যে বাংলাদেশ পুরোপুরি তাদের নিয়ন্ত্রনে আছে । তারা বলছে যে গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলো তাদের নিয়ন্ত্রনে আছে এবং বিদ্রোহ দমন করা হয়েছে । প্রমানস্বরূপ তাঁরা বলছে যে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের তাদের ঢাকার সভিবালয়ে তাদের অফিসেই পাওয়া যাবে ।
সেখানে তারা এটা বলছে না যে এখনো সচিবালয়ে কোনো কাজই চলছে না কারন আর্মির নির্বিচার হত্যায় আতংকিত হয়ে অধিকাংশ অধঃস্তন কর্মচারি এখনো পর্যন্ত ঢাকার বাইরে অবস্থান করছে । আর্মিরা যে দোকানপাটগুলো জ্বালিয়ে দেয়নি সেগুলোর মাত্র ৫০ শতাংশ খোলা রয়েছে এবং সেগুলোও আর্মিদের লুটপাট এর স্বীকার হবার আশংকায় ভীতকম্পমান অবস্থায় চলছে । ঢাকায় এপ্রিলের শেষ পর্যন্তও রাতে কারফিউ জারি ছিলো এবং সূর্য ডোবার পরে রাস্তা রাস্তাগুলো মূলত জনশুন্য থাকে। একসপ্তাহ আগেই আর্মিকে ঢাকার অদূরের গ্রামগুলোতে ‘দুষ্কৃতিকারী’ অপসারন করতে মর্টার হামলা চালাতে হয়েছে। ২৭ এপ্রিল আর্মিকে মার্শাল ল অর্ডার ১৪৮ জারি করতে হয়েছে, যাতে সরকারি স্থাপনায় সবধরনের নাশকতার জন্য মৃত্যুদন্ডের বিধান করা হয়েছে এবং বলা হয়েছেঃ
<003.015.036>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ তৃতীয় খন্ড
“সকল কিংবা যেকোনো ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা কিংবা এলাকারসমূহের অধিবাসিরা শাশ্তিমূলক ব্যবস্থার জন্য সম্মিলিতভাবে দায়বদ্ধ থাকবেন ।”
এটা শুধুমাত্রই প্রতিরোধ ব্যবস্থা এবং আর্মির প্রতিক্রিয়ার কাগুজে প্রমান দেয় যা সম্পর্কে ঢাকার বাইরে গিয়েছে এমন যে কেউই জানে।
তাঁরা বুঝতে পারবে সিলেট, যেখানে চা বাগানের ভেতরের বনাঞ্চলগুলো প্রাকৃতিক ঢাল হিশেবে কাজ করে, এখনো পর্যন্ত অপরিচিত এবং বেঙ্গল রেজিমেন্টের নিয়ন্ত্রনাধীন । চিটাগাং পার্বত্য অঞ্চল এখনো একটি ফোর্স দখল করে রেখেছে । সমগ্র বাংলাদেশেই সশস্ত্র বাঙালী গ্রামাঞ্চলগুলোতে সরে পড়ছে এবং এবং আর্মি ইউনিটগুলোর ওপর গেরিলা হামলা চালাচ্ছে। সামনে এর মাত্রা ও তীব্রতা আরও বাড়বে এবং এই ধরনের যুদ্ধ কৌশল প্রতিরোধ করতে আরও পারদর্শীতা, অতিরিক্ত রসদ যোগান ও অস্ত্রের প্রয়োজন যা পাক আর্মির কাছ থেকে বিপুল পরিমানে কেড়ে নেওয়া হয়েছে এবং মৌসুমী বর্ষা তাদের পন্য সরবরাহ ব্যবস্থার সমস্যাকে আরও অনিশ্চিত করে দিয়েছে । সেখানে আরও দীর্ঘ সময় ধরে যুদ্ধ চালিয়ে যাবার সামর্থ্য আছে এবং পাক আর্মির চালিয়ে যাওয়া যুদ্ধে বাছবিচারহীন গতিপ্রকৃতি জনগনের রাজনৈতিক উত্তেজনাকে আরও দৃঢ় করেছে। আর্টিলারির সীমারেখার মাঝের সমস্ত গ্রামকে ধ্বংস করে এবং সে স্থানগুলোকে ‘উন্মুক্ত গোলাবর্ষন এলাকা’ বলে ঘোষণা দিয়ে তাঁরা পাকিস্তান আর্মিকে ঘৃনার বস্তু এবং সাড়ে ৭কোটি বাঙালির নিরাপত্তার জন্য সরাসরি হুমকীতে পরিনত করেছে , যারা এই হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ কিংবা প্রতিরোধে সহায়তা করতে প্রস্তুত।
তীব্র আতংক এখন পর্যন্ত পাকিস্তান সরকারের জন্য খুব সামান্যই কাজে এসেছে । তাঁরা যে শহরগুলো নিয়ন্ত্রন করছে সেগুলো পরিত্যাক্ত , জনশুন্য , অর্থনৈতিক কার্যকলাপশূন্য এবং প্রশাসনিক কাঠামোহীন । জনসংখ্যার বড়জোর ১০ শতাংশ মানুষ সেখানে রয়ে গিয়েছে , তা হলে প্রশাসন, যারা মূলত শহরগুলো মুক্ত করার সময় প্রতিরোধের সাথে কাজ করেছিলো , সেখানেই থেকে যাবার কোনো সুযোগ নিচ্ছে না । তার অর্থ এই যে প্রদেশজুড়ে আর্মিদের নিয়ন্ত্রন থাকলেও বাস্তবে সাড়ে ৭ কোটি মানুষের বড়জোর এককোটি মানুষ তাদের তাদের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রনে আছে । আর্মি মূল সড়কগুলোর সংযোগস্থল দখলে রেখেছে এবং সড়ক ব্যবস্থার কাঠামোর উপর ভিত্তি করে সক্রিয় আছে, ফলে তাঁরা ভারিঅস্ত্রসজ্জিত মোটর কনভয়গুলো এক শহর থেকে আরেক শহরে স্থানান্তর করতে পারছে ।
দেশজুড়ে এমন অসার নিয়ন্ত্রনের কারনে অর্থনৈতিক জীবন স্থবির হয়ে পড়েছে । এমনকি ঢাকা , চট্টগ্রাম , খুলনার যে সকল ইন্ডাস্ট্রিগুলো ইচ্ছে করেই ধ্বংস করা হয়নি সেগুলোও ধুঁকে ধুঁকে চলছে কারন আর্মিদের পুনরায় হামলার আশংকায় শ্রমিকদের অধিকাংশই এখনো গ্রামে রয়ে গেছে । যোগাযোগব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় এবং বাজার ব্যবস্থা ব্যহত হওয়ায় রপ্তানি বন্ধ রয়েছে । পাট ও অন্যান্য পন্যদ্রব্য বাজারজাত করার সাথে জড়িত অনেক গুরুত্বপূর্ন ব্যক্তি, এবং আমদানিকারক, পশ্চিম পাকিস্তানি কিংবা হিন্দু । তারা পালিয়ে গেছে কিংবা খুন হয়েছেন , তাই অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশে আমদানি কিংবা রপতানি খুব কমই হবে বলে আশা করা যায় । বন্দর শ্রমিকেরা অব্যাহতভাবে অনুপস্থিত থাকায় চট্টগ্রাম বন্দর নিশ্চল হয়ে আছে যা সমস্যার প্রকোপ আরও বাড়িয়ে তুলেছে ।
বাংলাদেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়াটা ইয়াহিয়া সরকারের কাছে তেমন গুরুত্বপূর্ন নয় । যুক্তরাষ্ট্র অর্থসাহায্যের সাবরজেট কিংবা চাইনিজ মিগ ব্যবহার করে চালানো জ্বালাও-পোড়াও নীতিতে ধ্বংস হয়েছে শস্যভান্ডার , চা বাগান এবং … গুদাম [ব্রাহ্মনবাড়িয়া] যা আর্মির ভয়ভীতি প্রদর্শনের অস্ত্র হিশেবে দূর্ভিক্ষ এবং অর্থনৈতিক মন্দার দিকে নির্দেশ করছে ।
<003.015.037>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ তৃতীয় খন্ড
আপাতত বেশি দুর্ভাবনার হলো, দেশের বৈদিশিক মুদ্রার আয়ের ৫০ শতাংশের আনুষঙ্গিক ক্ষতি, যেটি বাংলাদেশ থেকে আসত পাটজাত পণ্যের মাধ্যমে। বাংলাদেশ থেকে রপ্তানির ৮০ শতাংশ মুক্ত বৈদিশিক বিনিময় কাজে লাগানো হতো পশ্চিম পাকিস্তানে। পশ্চিম থেকে রপ্তানি বাড়িয়ে এটির আশু বিকল্প বের করা সম্ভব নয়, বিশেষ করে বৈদিশিক বিনিময় ঘাটতির কারণে এখানকার শিল্প-কারখানাগুলোর উৎপাদন যখন ইতিমধ্যেই ৪০ শাতংশ কমে গেছে। পাকিস্তান সরকার এই প্রান্তিকে চাপ দিচ্ছে ঋণসেবার সম্ভাব্যতা পুনর্গঠন করতে, যেটি করতে জুনের শেষ নাগাদ সমস্ত পাওনাদারদের পরিশোধ করতে হবে প্রায় ১০০ মিলিয়ন পাউন্ড। সর্বোপরি, এসবের বাইরেও পাকিস্তানের প্রয়োজন নতুন নতুন সাহায্যের প্রতিশ্রুতি, বিভিন্ন পণ্যদ্রব্য আমদানি করে যাতে রুগ্ন শিল্পকে তাজা করা যায় এবং উন্নতির গতি ধরে রাখা যায়। বাংলাদেশের রপ্তান বন্ধের কারণে যখন বৈদিশিতক বিনিময় ভীষণ ভাবে কমে গেছে, নিজেদের বিনিময় বেশি ধরে রাখা প্রয়োজন। স্বাভাবিক সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানের রপ্তানির চেয়ে আমদানি দ্বিগুণ কিন্তু এখন বাংলাদেশের যুদ্ধে টিকে থাকতে তাদের অস্ত্র ও গোলাবারুদ কেনার প্রয়োজনীয়তা আরও বেড়েছে। ফরাসী অস্ত্র সরবাহকদের ঋন পরিশোধের মূলতুবির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে এবং ইনটেরালিয়া, ৩০ মিরেজ ফাইটারের মতো আরও ভালো অস্ত্রের চাহিদা দেওয়া হয়েছে। মার্কিন সামরিক বাহিনীর সরবাহের সত্যিকার বা প্রত্যাশিত মজুদের জন্য উন্মুক্ত অস্ত্র বাজারে নগদ বৈদিশিক বিনিময়ের প্রয়োজন হবে। মি. এম.এম আহমেদের সফর তাই বিশেষভঅবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ বিশ্বব্যাংক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দাতাদের কাছে পাকিস্তানের প্রত্যাশা এই অর্থনৈতিক সঙ্কট থেকে উদ্ধার করা এবং কার্যত বাংলাদেশে সামরিক অভিযানে সম্মতি দেওয়া। এই সাহায্য বাংলাদেশ দুর্ভিক্ষ দূর করায় এবং যুদ্ধজনিত ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ওঠায় ব্যবহৃত হবে বলে কোনো ধরণের কথা হলে সেটি ইচ্ছাকৃতভাবেই ভুল প্রচার। সরকারের আদেশ তার সীমার বাইরে সম্প্রসারিত হয় না এবং পরিকল্পিত সাহায্যের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ ও বাস্তবায়নের দক্ষতার ঘাটতিও আছে। পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পাঠানো সাহায্যগুলি হয়ত পশ্চিমে পাঠিয়ে হয়ত দখলদার সেনাবাহিনীর খাদ্যের জোগান দেওয়া হবে, অথব রাজনৈতিক দমন ও পৃষ্ঠপোষণার সহায়ক হিসেবে কাজে লাগানো হবে। এটির প্রেক্ষিতেই কোনো সাহায্য দাতার নিরপেক্ষ ভূমিকা পালনের কোনো প্রশ্ন নেই। পাকিস্তানী প্রশাসনের আহবানে সাড়া দিলে আদতে তারা কোনো মানবিক কাজ তে করবেই না, বরং সামরিক অভিযানকেই স্বীকৃতি দেবে। ঋণসেবার সম্ভাব্যতা পুনর্গঠনের পাকিস্তানের প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করে এবং প্রক্রিয়াধীনসহ সাহায্যসহ আরও সব ধরণের সাহায্যের প্রতিশ্রুতিকে স্থগিত করে এই সামরিক অভিযানের পুরো মূল্য সরকারকে চুকাতে বাধ্য করা যেতে পারে। গোটা বিশ্বকে বুঝতে হবে যে, ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর ও ১৯৬৮ সালে আয়ূব সরকারের পতনের পর যেমন ছিল, সাহায্য দেওয়ার ব্যপারটি কখনোই আর ‘যথারীতি কারবার’ চেহারায় ফিরবে না। হোক ঋন-ঘাটতি তা অন্য কোনো রূপে, পাকিস্তানকে সরলমতি বলে ফুটিয়ে তোলে, এই ধরণের যে কোনো চাতুরির বিরুদ্ধে এভাবেই অবস্থান নিতে হবে দাতাদের। নাম না জানা ২ লাখ নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের খুনিরা সরলমতির অর্থই জানে না। বাংলাদেশে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মূল্য ইতিমধ্যেই পশ্চিম পাকিস্তানকে দিতে হয়েছে নিশ্চিত বাজার হারিয়ে। পশ্চিম পাকিস্তানের রপ্তানির ৪০ শতাংশ যেত যেখানে, সেই বাংলাদেশে এখন কোনো ক্রেতা নেই, আয় বা বাজারজাতের কাঠানো নেই।
<003.015.038>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ তৃতীয় খন্ড
পাকিস্তান তাদের মোট রপ্তানির ৪০% বাংলাদেশে পাঠাই। শিল্প বাণিজ্য যা তাদের পণ্য বিশ্বের মূল্যের চেয়ে ১০০% উপরে তাদের পণ্য বিক্রি করতো তা ধ্বংশের মুখোমুখি হওয়াতে পশ্চিম পাকিস্তান অর্থনৈতিক মন্দার হুমকিতে পড়ে। ৫০% মূল্য মূদ্রাস্ফিতিও আশংকা করা হচ্ছে আগামী তিন মাসের মধ্যে শিল্পের ইনপুট ও আউটপুট পতনের কারণে। কড়কড়ে বৈদেশিক মূদ্রা আয় প্রাধান্য পাবে বিনামূল্যে আমদানি, ৪৭ টি আইটেমের আমদানি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধকরণ এবং নগদ অথবা বোনাস উভয় আমদানি লাইসেন্স প্রাপ্ত হবে। বস্তুত সব আমদানি বোনাসের মাধ্যমে এবং একটি আংশিক অবমূল্যায়ন ইতিমধ্যে ধার্য করা হয়েছে। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা দেশকে চাপে ফেলে যা দাতা দেশগুলো কর্তৃক দেয়া হয়ে থাকে।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত চাপ ব্যবহৃত হতে পারে রাজনৈতিক আলোচনার বিকল্প হিসেবে সামরিক পদক্ষেপ সমাপ্তির উপরই এর উদ্দেশ্য পরিষ্কার ভাবে নিহিত। এখানে আলোচনা একমাত্র নেতা ও বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মধ্যে হতে পারে। এগিয়ে যাওয়া প্রত্যাখ্যাত রাজনৈতিক হ্যাকার যা সাম্প্রতিক নির্বাচনে তাদের জন্য খোঁড়া রাজনৈতিক কবর হতে পুনরুত্থিত করেনা তা সরকারকে শুধুমাত্র উপহাসের পাত্র করে- যা বস্তুত কোন নিরাপদ সমঝোতা দেয় না।
আজ রাজনৈতিক নেতৃত্ব নির্বাচনে আওয়ামীলীগের হাতে তাদের রাজনৈতিক অবকাঠামো অক্ষত এবং সুরক্ষিত মুজিবের জন্য, যার শারীরিক উপস্থিতি বাংলাদেশ সরকারের আচার। সমগ্র পার্টি অনুক্রমে গঠিত মন্ত্রীপরিষদ, যা এপ্রিল ১৭, ১৯৭১ এ বিশ্বে নিজেকে উপস্থাপন করেছে। বেসামরিক প্রশাসনের যারা আর্মির বন্দুক পরিসীমা অতিক্রম করেছে বাংলাদেশ লিবারেশন আর্মির শক্তি তাদের সহযোগিতায় বাংলাদেশ সরকার গ্রামাঞ্চলে একটি আনুষ্ঠানিক প্রশাসনিক অবকাঠামো এবং কমান্ড লাইন স্থাপন করার চেষ্টা করছে। কাজটি ভীষণ কঠিন কারণ হলো- যৌক্তিক সমস্যার নতুনত্ব ও মহাত্ম।
কিন্তু একটা সময় পর এটি গেরিলা যুদ্ধকে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পরিকাঠামো প্রদান করবে- যেটা সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে হচ্ছে এবং অনির্দিষ্ট কালের জন্য টেকসই হতে পারে।
এই বিশ্বাসে বিশ্বকে প্রতারিত করা উচিৎ নয় যে, তারা অলস বসে থাকতে পারে তাদের মতামতে বিরত থাকতে পারে। যুদ্ধ যতই দীর্ঘায়িত হতে থাকছে ততই বর্তমান নেতৃত্ব এবং নিয়ন্ত্রণ কাঠামো ক্ষুন্ন হচ্ছে। আজ এখনও নেতৃত্ব মধ্যপন্থিদের হাতে, যারা বাংলাদেশের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক কাঠামো ধ্বংস করার জন্য নিরোধীতা প্রতিরোধের কৌশল হিসেবে মূল সেতু ও অত্যাবশ্যক অর্থনৈতিক স্থাপনা উড়িয়ে দিতে ব্যাপক উদ্ভগ্ন এখনও। আর্মি সন্ত্রাসী, দীর্ঘায়িত চরমপন্থা বাধ্য করবে বিদ্যমান সামাজিক জীব হিসেবে একটি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ চালিয়ে যেতে। দীর্ঘায়িত যুদ্ধের কারণে সামাজিক পরিণতি নিয়ে ইতিহাস অনেক শিক্ষা দেয় যা, উপলদ্ধিতে রাখা এক্ষেত্রে প্রয়োজন।
এরপরও পদক্ষেপহীনতা হতে পারে মানবজীবনের মূল্য দেয়া। পশ্চিম পাকিস্তানের আর্মি স্বয়ং লক্ষ ক্ষেত্রে বাঙালী জীবনের মূল্য নিতে পারে। যুদ্ধে পশ্চিমভাগে বাঙ্গালী ও পূর্বভাগে অবাঙ্গালীদের মধ্যে প্রতিহিংসামূলক সাম্প্রদায়িক হত্যাকান্ডের মাধ্যমে আর্মিদের দ্বারা যুদ্ধ সমাপ্ত হওয়ার পূর্বে আরো এক লক্ষ মৃত্যু যোগ করবে- যা দাঁড়াবে ২ লক্ষের উপরে। আমরা যদি দূর্ভিক্ষে মৃতর সংখ্যা যোগ করি তবে এটা হবে সম্ভবত ঐতিহাসিক মানব মৃত্যুর ঘটনা।
<003.015.039>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ তৃতীয় খন্ড
পরাশক্তি দ্বন্দ্বের প্রতিযোগিতায় প্রদেশটির মুক্ত থাকার কথা কেউ আশা ও করেনি।ভারত ও চীন উভয়ই বাংলাদেশকে ঘিরে রয়েছে এবং তারা নিষ্কৃয় দর্শকের মতো সীমান্তে ঘটে যাওয়া গৃহযুদ্ধের দাবানল দেখতে পারেনা।ভিয়েতনাম যুদ্ধের শেষ ধাপে আরো একটি বিধ্বংসী অগ্নিকান্ডের সাক্ষী হয়ে থাকা কদাচিৎ পরাশক্তির স্বার্থের মধ্যে পড়ে; তাও এমন একটি ভূখন্ডের যারা প্রতিজ্ঞা করেছে এ পর্যন্ত দেখতে পাওয়া সকল আয়তনের সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ার।
দেশটির জন্মলগ্নে আন্তর্জাতিক সংকট দেখা দিতে পারে।রাজনৈতিক সমঝোতার জন্য দেশে এখনো নেতৃত্ব প্রদানকারী দল রয়েছে।একটি শান্তিপূর্ণ উপায়ে দেশ বিভাজনের বন্দোবস্ত করা আবশ্যক।গণহত্যার দ্বারা পরিষ্কার ভাবে ইয়াহিয়ার যুদ্ধের নির্দেশ পাওয়া যায় এবং সে ধরে নেয় পাকিস্থান মৃত এবং সে জাতির জন্য মানবতা প্রকাশের কোনো লক্ষণই ছিলোনা।আকস্মিক এই যুদ্ধের ফলে সমগ্র বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া ক্ষয়ক্ষতির পুরণ অচিন্তনীয়।যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্থ এই জাতিকে ভবিষ্যতে টিকে থাকার জন্য দরিদ্রতা,অনাহার ও রোগ বালাই থেকে মুক্ত হবার জন্য বাস্তব্যতা নিরীক্ষণের মাধ্যমে একটি অর্থনৈতিক পরিকল্পনা কর্মসূচী নিতে হবে।এধরনের কোনো কর্মসূচী যার দ্বারা যুদ্ধের ভয়াবহতা সম্পর্কে বিশ্ববাসীর বিবেক কে জাগ্রত করতে পারে।পর্যাপ্ত পরিমাণের আন্তর্জাতিক সাহায্যের দ্বারা ক্ষয়ক্ষতি পূরণ করে ভবিষ্যতে গণতন্ত্র ও সামাজিক ন্যায়বিচারের অবকাঠামো তৈরী করতে পারবে।
<003.016.040>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ তৃতীয় খন্ড
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
বাংলাদেশবাসীর প্রতি সরকারের ৭- দফা নির্দেশাবলী | বাংলাদেশ সরকার, প্রচার দপ্তর | মে, ১৯৭১ |
স্বাধীন বাংলাদেশবাসীর প্রতি-
আজ দু’মাস যাবৎ সাড়ে সাত কোটি বাঙালী স্বাধীনতা সংগ্রামে লিপ্ত। বাঙালির বীরত্ব, সংকল্প এবং ত্যাগ বিশ্বের মুক্তিকামী সকল জাতিকে চমৎকৃত করেছে। বাঙালী প্রমাণ করেছে সে এক বীর জাতি। আমাদের শত্রু পরাক্রমশালী এত কোনো সন্দেহ নাই। তাদের কাছে আছে সর্বাধুনিক স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ। কিন্তু বাঙালীর স্বাধীনতার অনির্বাণ দীপ নেভানো তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। রক্তক্ষয় ছাড়া স্বাধীনতা আসে না। আমরা রক্ত দিয়েছি, দিচ্ছি এবং দেবো আজ সারা বিশ্বের জনমত আমাদের সপক্ষে, কেননা আমাদের সংগ্রাম ন্যায় ও সত্যের। জয় আমাদেরও অনিবার্য এবং আসন্ন। কোনো অবস্থাতেই তাই আমাদের মনোবল হারলে চলবে না। আমাদের মুক্তিফৌজ অবিশ্রান্তভাবে লড়ে চলেছেন দখলদার বাহিনীর সাথে। প্রতিদিন শত শত শত্রুসেনা নিহত হচ্ছে। আড়াই হাজার মাইল দূর থেকে ইয়াহিয়ারশাহীর পক্ষে এ যুদ্ধ বেশীদিন চালানো সম্ভব নয়। জয় আমাদের অবশ্যম্ভাবী। এই পরিপ্রেক্ষিতে সারা বাঙালী জাতির প্রতি স্বাধীন বাংলা সরকারের তরফ থেকে নিম্নলিখিত নির্দেশাবলী জারী করা হচ্ছে।
(ক) দখলদার বাহিনী এবং তথাকথিত পাক সরকারের সাথে কোনো প্রকার সহযোগিতা করা চলবে না। বাঙালী জাতির আনুগত্য শুধুমাত্র স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারই দাবী করেন। কোনো প্রকার খাজানা, কর এবং সরকারী শুল্ক ইত্যাদি পাক সরকারকে দেওয়া চলবে না।
(খ) আঠারো থেকে ত্রিশ বছর বয়স্ক সকল বাঙালী যুবক অবিলম্বে তাঁদের নিকটস্থ মুক্তিফৌজদের অধিনায়ক অথবা তাঁর প্রতিনিধির সাথে যোগাযোগ স্থাপন করবেন।
(গ) সারা বাংলাদেশের এক ইঞ্চি জমিতেও পাট চাষ করা চলবে না। বিকল্পে আউস ধান চাষ করতে হবে।
(ঘ) গণধিকৃত দালালদের চিহ্নিত করা নিঃশেষ করতে হবে। আমাদের সংগ্রাম বিরোধী গোয়েন্দাদের নির্মূল করা প্রতিটি বাঙালীর পবিত্র কর্তব্য বলে বিবেচিত হবে।
(ঙ) কোন অবস্থাতেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ক্ষুন্ন করা চলবে না। এই পরিপ্রেক্ষিতে সম্ভাব্য দাঙ্গাবাজদের চিহ্নিত করে তাঁদের নির্মূল করতে হবে।
(চ) মুক্তিফৌজদের সাথে সর্বপ্রকার সহযোগিতা আমাদের আশু মুক্তির একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। এটা স্মরণ রেখে তাঁদের সাথে কাঁধের কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে হবে। পক্ষান্তরে, দখলদার পাক বাহিনীর চলার প্রতিটি পদক্ষেপে সৃষ্টি করতে হবে দুর্লংঘ্য প্রতিবন্ধক। ছলে বলে নস্যাৎ করতে হবে তাদের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র।
(ছ) স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাসমূহের এবং সরকারী, আধা সরকারী ও বেসরকারী সকল কর্মচারীদের শত প্রলোভন সত্ত্বেও পাক সরকারের অধীনে কাজে যোগ দেওয়া চলবে না। অনতিবিলম্বেই তাঁদের স্বাধীন বাংলা সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করে মুক্তি সংগ্রামের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।
অতি শিগগিরই স্বাধীন বাংলার মুদ্রা ও ডাকটিকেট চালু হচ্ছে। বিশ্বের সব জায়গা থেকে আমরা অস্ত্রশস্ত্র এবং ত্রাণ সহ সর্বপ্রকার সাহায্য পাচ্ছি। প্রতিটি বাঙালী সরকারী কর্মচারী বাংলাদেশের প্রতি তাঁদের আনুগত্য ঘোষনা করেছেন এবং মুক্ত এলাকায় কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার অতিশীঘ্রই বিশ্বের
<003.016.041>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ তৃতীয় খন্ড
কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দেশের স্বীকৃতি লাভ করতে চলেছেন। দুর্বার গতিতে আজ সারা বাঙালী জাতি বিজয়ের পথে চলমান। কোনো বাধা কোনো বিঘ্নই আর তার গতি রোধ করতে পারবে না। যেহেতু আমরা নিঃশেষে প্রাণ দান করতে শিখেছি অতএব আমাদের ক্ষয় নেই, ক্ষয় নেই।
“জয় বাংলা”
স্বাধীন বাংলা সরকারের
প্রচার দপ্তর থেকে প্রচারিত।