You dont have javascript enabled! Please enable it! 1965.04.20 | ইত্তেফাক পত্রিকার ‘মিঠো-কড়া’ শীর্ষক আরও একটি উপ-সম্পাদকীয় - সংগ্রামের নোটবুক
                 শিরোনাম সূত্র তারিখ
ইত্তেফাক পত্রিকার ‘মিঠো-কড়া’ শীর্ষক আরও একটি উপ-সম্পাদকীয় দৈনিক ‘ইত্তেফাক’ ২০ এপ্রিল, ১৯৬৫

মিঠেকড়া

ভিমরুল*

মূলধন গঠন, সরকারী উন্নয়ন ব্যয়, বৈদেশিক সাহায্য বণ্টন, বৈদেশিক মুদ্রা বণ্টন, দেশরক্ষা ও প্রশাসনিক বিভাগে চাকুরী, সরকারী রাজস্ব বণ্টন, শিক্ষা সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে আনুকূল্য ও সুজগ-সুবিধা তথা জাতীয় জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তান অবিরাম কিভাবে বঞ্চিত হইয়া আসিতেছে, তাহা অধুনা বহুল আলোচনার বিষয়বস্তু। অতীতে প্রথম যখন এসব বৈষম্য বঞ্চনার কথা তোলা হয়,তখন অপরাঞ্চলের কায়েমী স্বার্থের মুখপাত্রগণ সরাসরি ইহার অস্তিত্ব অস্বীকার করিয়া ‘প্রাদেসিকতার’ ‘আঞ্চলিকতা’ ‘দেশানুগত্যহীনতা’ ইত্যাদি তিরস্কারের দ্বারা সমস্যাটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু আগুনকে যেমন ছাই-চাপা দিয়ে রাখা যায় না, তেমনি দুই অঞ্চলের গুরুতর বৈষম্যের বাস্তব সত্যকেও শেষ পর্যন্ত ঢাকা দেওয়া সম্ভব হয় নাই। ক্ষমতাসীন মহলের রক্তচক্ষু এবং রাজনৈতিক নির্যাতনের তাপ সহ্য করিয়াও জনগণ বিষয়টি তুলিয়া ধরিয়াছে। অবশেষে প্রধানতঃ কয়েকজন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদের সত্যানুসন্ধিৎসা ও বলিষ্ঠতার গুণেই সমস্যাটির প্রকৃতি স্বরূপ পরিষ্কারভাবে অনুধাবনযোগ্য হইয়া উঠে। আজ অবশ্য সরকারীভাবে সমস্যাটি স্বীকৃত এবং দায়িত্বশীল সরকারী মুখপাত্রগণও এ সমস্যার প্রতিবিধানকল্পে রীতিমতো মুখর।

  কিন্তু ইত্যবসরে এ ব্যাপারে নূতনতর একটি কথা চালু করার চেষ্টা চলিতেছে। বলা হইতেছে যে, সরকার যখন সমস্যাটির কথা স্বীকার করিয়া লইয়াছেন এবং উহার প্রতিকারের সংকল্প প্রকাশ করিতেছেন, তখন এ বিষয়ে আলাপ-আলোচনা ও লেখালেখি বন্ধ হওয়া উচিত। কারণ, বিষয়টি অধিক আলোচনা নাকি দুই প্রদেশের মধ্যে তিক্ততা বাড়াইয়া তুলিবে ও তাঁর ফলে জাতীয় সংহতি ও ঐক্য বাধাগ্রস্থ হইবে। বলা বাহুল্য, অতীতে দুই প্রদেশের বৈষম্যের কথা উঠিলে যে মহলটি উহাকে ‘প্রাদেশিকতা’ ও ‘আঞ্চলিকতা’ বলিয়া চিৎকার জুড়িয়া দিত, সেই বিশেষ মহলটিই উপরোক্ত যুক্তিটির উদ্ভাবক। এই যুক্তি যে প্রকৃতপখে সমস্যাটি হইতে দৃষ্টি সরাইয়া নিবার একটি কৌশল ছাড়া আর কিছুই নয় তাহা বলার অপেক্ষা রাখে না। কেননা, দুই প্রদেশের মধ্যে তিক্ততা যদি বৃদ্ধি পায়, তাহা হইলে উহা বৃদ্ধি পাইবে বৈষম্যের বাস্তব সমস্যাটিরই জন্য-তৎসংক্রান্ত আলোচনার জন্য নয়। সমস্যাটির প্রতিবিধান হইলে তিক্ততা কিভাবে দূর হইবে আমরা বুঝি না; বরং তদবস্থায় সন্দেহ সংশয় আরও বৃদ্ধিই পাইবে। তাই বারবার আমরা এ কথাই বলিয়া আসিয়াছি যে, তিক্ততার আসল কারণকে দূর করিতে হইবে, লক্ষণগুলিকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা অর্থহীন।

            দুই আঞ্চলের অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণ সম্পর্কে সরকারী মহলের প্রতিশ্রুতির মাত্রা অধুনা বৃদ্ধি পাইলেও সত্যিকার কাজ ঠিক সেভাবে হইতেছে কিনা, বলা কঠিন। আগামী কুডি বৎসরের মধ্যে দুই অঞ্চলের মধ্যে সমতা প্রতিষ্ঠিত হইবে বলিয়া যে সব আশ্বাসবাণী উচ্চারিত হইতেছে, তৎসম্পর্কে সজ্ঞান মহলে আদৌ কোন আস্থার ভাব সৃষ্টি হইতেছে না।

*আহমেদুর রহমান (ভিমরুল)

            বরং প্লান-পরিকল্পনার অর্থ বরাদ্দ, শিল্প বাণিজ্যের গতি প্রকৃতি এবং দেশরক্ষা ও প্রশাসনিক বিভাগ সমুহে লোক নিয়োগের বিশিষ্ট ধারার পরিপ্রেক্ষিতে অনেকের মনে এরূপ আশংকাই দেখা দিয়াছে যে, আগামী কুড়ি বৎসরে বৈষম্যের মাত্রা সংকুচিত হওয়ার পরিবর্তে প্রসারিতই হইবে। যাই হোক, এ সম্পর্কে আপাতত বিস্তৃত আলোচনায় না গিয়া সম্প্রতি প্রকাশিত একটি খবরের প্রতি আমাদের দৃষ্টি নিবন্ধ করিবে।

            বিদেশে অবস্থিত পাকিস্তানী দূতাবাস ও বাণিজ্য মিশনগুলিতে কর্মরত চাকুরীয়াদের ব্যাপারে একটি তুলনামূলক তথ্য উক্ত খবরে উল্লিখিত হইয়াছে। প্রকাশে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অবস্থিত পাকিস্তানী দূতাবাস, কূটনৈতিক মিশন ও বাণিজ্য মিশনসমুহে কর্মচারীর সংখ্যা আঠারো হাজারের কম নয়। এই আঠার হাজার কর্মচারীর মধ্যেও পূর্ব পাকিস্তানীর সংখ্যা মাত্র তিনশত দশ জন; অর্থাৎ শতকরা দুই জনেরও কম। উপরন্ত উক্ত কর্মচারীর মধ্যেও উচ্চপদে অধিষ্ঠিত অফিসারের সংখ্যা নগণ্য, অশিকাংশ কেরানী, টাইপিষ্ট, রিসেপশনিষ্ট, বয়-বাবুর্চি ইত্যাদি।

            পাকিস্তানের বৈদেশিক মিশনে পূর্ব পাকিস্তানীরা এই নিদারুণ সংখ্যাল্পতা শুধু তথ্য হিসেবেই চমকপ্রদ নয়, ইহার তাৎপর্যও নানা দিক হইতে বিচার্য। পাকিস্তানের সরকারী রাজস্বের সিঙ্ঘভাগ ব্যয়িত হয় দেশরক্ষা খাতে। দেশরক্ষার পরেই যে খাতে অধিক রাজস্ব ব্যয়িত হয় সেটা হইতেছে প্রশাসনিক বিভাগ। দেশরক্ষা বিভাগে পূর্ব পাকিস্তানীরা সংখ্যা কত তাঁর সঠিক তথ্য জানা না থাকিলেও উহা যে তিন চার পার্সেন্টের বেশী নয় তাহা কোন কোন ভূতপূর্ব জাতীয় পরিষদ সদস্যের বক্তৃতাদি হইতে জানা গিয়াছে। প্রশাসনিক বিভাগেও পূর্ব পাকিস্তানীর সংখ্যা অন্য অঞ্চলের চাইতে অনেক কম। ১৯৬৪-৬৫ সালে পাকিস্তান সরকারের প্রশাসনিক বিভাগে আটষট্টি কোটি টাকা ব্যয় হয়। তাঁর মধ্যে বত্রিশ কোটি টাকা ব্যয়িত হয় পাকিস্তানের বৈদেশিক মিশনগুলির জন্য। শতকরা হিসাবে উহা দাড়ায় প্রশাসনিক বিভাগের জন্য বরাদ্দকৃত মোট অর্থের শতকরা সাতচল্লিশ ভাগ। অতএব দেখা যাইতেছে, সরকারের যে দুইটি বিভাগে সর্বাধিক রাজস্ব ব্যয়িত হয়, সে দুই বিভাগে পূর্ব পাকিস্তানীর নিদারুণ সংখ্যাল্পতার দরুন প্রায় সমুদয় অর্থই এক অঞ্চলে থাকিয়া যায়। জনসাধারণের আয় বৃদ্ধির ক্ষেত্রে উপরোক্ত দুই বিভাগের খরচের যে প্রভাব, পূর্ব পাকিস্তানীরা তাহা হইতে প্রায় সম্পূর্ণরূপেই বঞ্চিত থাকিয়া যাইতেছে। পূর্ব পাকিস্তানীদের আর্থিক জীবনের পক্ষে যে ইহা খুব ক্ষতিকর তাহা বলার প্রয়োজন করে না।

            কিন্তু এই দিকটি ছাড়াও আরও একটি গুরুত্বসম্পন্ন দিক আছে। পূর্ব পাকিস্তান দেশের অধিকাংশ অধিবাসীর আবাসস্থল। বহির্বিশ্বে পাকিস্তান, সম্পর্কে কোন ধারণা সৃষ্টি করিতে হইলে পূর্ব পাকিস্তানকে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু বৈদেশিক মিশনগুলি যেভাবে পরিচালিত হইতেছে, তাহাতে অনিবার্যভাবেই দেশের পশ্চিমাঞ্চল পূর্বাঞ্চল অপেক্ষা বেশী প্রাধান্য পাইতেছে। পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কে অনেক বিদেশী রাষ্ট্রে যে ব্যাপক অজ্ঞতা বিদ্যমান, তাঁর কারণ ইহাই। ফলে পাকিস্তান বলিতে বিদেশে মোটামুটি পশ্চিম পাকিস্তানকেই বোঝাইয়া থাকে। একটি জাতি সম্পর্কে এরূপ খন্ডিত ধারণা যে সে জাতির জন্য কতটা ক্ষতিকারক, তাহা ব্যাখ্যা করিয়া বলার দরকার পড়ে কি? এই কারণেই অতীতে বহুবার বলিয়াছি যে, পাকিস্তানের, বৈদেশিক মিশনগুলি পুনর্গঠন করিয়া উহাতে পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায়সংগত প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্তা করা দরকার। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, কর্তৃপক্ষের কার্যকলাপ সেরূপ কোন উদ্যোগই পরিলক্ষিত হইতেছে না। পূর্ব পাকিস্তান অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যে বৈষম্য নীতির শিকার বৈদেশিক মিশনের চাকুরী বৈষম্য সেই বৃহত্তর বঞ্চনারই অঙ্গ। এই বাস্তব সমস্যার সমাধান না হইলে এ সম্পর্কে কথাবার্তা বন্ধ করিয়া দিয়া কিভাবে দুই প্রদেশের তিক্ততা দূর করা যাইবে, আমরা অন্তত তাহা বুঝিতে পারি না।