You dont have javascript enabled! Please enable it!

শিরোনামঃ শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দলের
ঘোষণা
সূত্রঃ শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল (প্রচারপত্র)
তারিখঃ ১৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭১

গণ-বিপ্লব দিবসে মেহনতী জনতার নেতৃত্বেবিপ্লবী সরকার কায়েমের শপথ নিন
শ্রমিক-কৃষক সমাজবাদী দলের ডাক

ভাইসব,

আটষট্টির অক্টোবরে করাচীর ছাত্রদেরস্বৈরাচারী আইয়ুবশাহীর বিরুদ্ধে আন্দোলনেরমাধ্যমে যে সংগ্রামের সূত্রপাত, উনসত্তরেরজানুয়ারী মাসে ঢাকায় ছাত্রদের সংগ্রামী জনতারবিপ্লবী ভূমিকায় সেই গণ অভ্যুত্থান ১৮ইফেব্রুয়ারি পর্যবসিত হয় এক রক্তাক্ত গণবিপ্লবে।আন্দোলন চলছে ছাত্রদের নেতৃত্বে,আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদ এবং দেশীয় একচেটিয়া পুঁজিপতিদের সাহায্যপুষ্টস্বৈরাচারী আইয়ুবশাহীর বিরুদ্ধে। চলছে ধরপাকড়, গোলাগুলি। শহীদ হল আদমজীরশ্রমিক মুজিবুল্লাহ, বরিশালের শ্রমিকমজিদ, ছাত্র আসাদ, মতিয়ুর এবং নাম না জানা আরো অনেকে। সংগ্রামের রূপ হল আরো তীব্র,আগুন জ্বলে উঠল শহর থেকে বন্দরে, গ্রাম থেকে গঞ্জে। নেমে এল ‘কারফিউ’।এবার সংগ্রামে বলিষ্ট নেতৃত্ব নিয়ে এগিয়ে এলো একনতুন শক্তি, ‘বিপ্লবী মেহনতী জনতা’। সে বৈপ্লবিক নেতৃত্বের সুবর্ণ সূচনাহলো কারফিউ ভঙের রক্তস্রোতের মধ্য দিয়ে।

১৮ই ফেব্রুয়ারী, কারফিউ ভঙ্গ করে মালিবাগের মেহনতী জনতা মশাল হাতে নেমেএল ঢাকার রাজপথে; যোগ দিল তেজগাঁও, নাখালপাড়া,আদমজী আর ডেমরার বিপ্লবী শ্রমিক, যোগ দিল খিলগাঁও কৃষক, নেমে এলফার্মগেট, গ্রীনরোড, হাতীরপুল, পুরানা পল্টন এবং মগবাজার এলাকার দিনমজুরআর খেটে মানুষের, সহদাগরী আর সরকারী অফিসের ৪র্থশ্রেণীর কর্মচারী আর কেরানী; নেমেএল ছাত্র, শিক্ষক, ছোট ছোট দোকানদার আর রাস্তার পাশের ফেরীওয়ালারা, লাখোলাখো মানুষ, মেহনতী মানুষ, সংগ্রামী জনতা, লাঠি আরজলন্ত মশাল হাতে।

১৮ই ফেব্রুয়ারী, সর্বপ্রথম সংঘবদ্ধ উপায়ে কারফিউ ভেঙে রাইফেল আর বেয়নেটেরপৈশাচিক হামলাকে তারা রাস্তায় পদদলিত করে লক্ষ লক্ষ মারমুখী মেহনতী জনতাসেদিন নেমে এসেছিল ঢাকার রাজপথে। রাস্তায় তুলেছিল বিপ্লবীব্যারিকেড, হাতাহাতি লড়াই করেছে তারা, রক্তে রক্তে সয়লাব হয়েছে ঢাকারকালো পীচ ঢালা পথ। তবুও তারা স্তব্ধ হয়নি। আগুন লাগিয়ে তারা জ্বালিয়েপুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছে স্বৈরাচারী আইয়ুবশাহীর অনুচরদের সাজানোপ্রাসাদ। যে বিদ্রোহের আগুনের লেহিহান শিখায় খতম হয়েছে আইয়ুব সরকার, খর্বহয়েছে রাষ্ট্রের উপর থেকে একচেটিয়া পুঁজিপতি, ভূ-স্বামী আর জায়গীরদারদেরঅপ্রতিদ্ধন্ধী প্রভাব। উন্মুক্ত হয়েছে গণতন্ত্রের পথ। ১৮ই ফেব্রুয়ারীপাকিস্তানের গণআন্দোলনের ইতিহাসে লাল অক্ষরে লেখা একটি দিন’ বিপ্লবী দিন।

মেহনতী জনতার নেতৃত্ত্বে ১৮ইফেব্রুয়ারী কারফিউ ভঙ্গ এবং ঢাকা অবরোধ, বিপ্লবী সর্বহারা শ্রেণীরনেতৃত্বে দীর্ঘস্থায়ী সমাজবাদী বিপ্লবের সুবর্ণ সূচনা।

সাবাস। ঢাকার বিপ্লবী মেহনতী জনতা!

অমর হোক গণবিপ্লবের দিন, রক্তাক্ত ১৮ই ফেব্রুয়ারী।কিন্তু সুস্পষ্ট শ্লোগান, বর্তমান লক্ষ্য এবং সর্বহারাদের শ্রেণীভিত্তিকরাজনৈতিক দলের অভাবে এই গণবিপ্লবের সম্পূর্ণ ফল লাভ করার এক হীনষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে অনুন্নত অঞ্চলের পুঁজিপতি শ্রেণী। উদীয়মানপুঁজিপতিদের নেতৃত্বে জানুয়ারীর গণঅভ্যুত্থানের মূল লক্ষ্য ছিল বৃহৎপুঁজিবাদ, জায়গীরদার জোতদারদের পৃষ্টপোষিত স্বৈরাচারী আইয়ুব সরকারেরউচ্ছেদ সাধন করে তথাকথিত সংসদীয় গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন যখন মেহনতী জনতার নেতৃত্বে ফেব্রুয়ারীর গণ-বিপ্লবে পরিণতহল, তখন এই গণ বিপ্লবের আপোষহীন আর রুদ্র রূপ দেখে এবং দেশের রাজনৈতিকঅর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এক সুদূরপ্রসারী পরিণতির আশংকায়, একদিকে বৃহৎপুঁজিপতি, জোতদার- জায়গীরদার; অন্যদিকে স্বৈরাচারবিরোধী অনুন্নত অঞ্চলেরউদীয়মান পুঁজিপতিরাও আন্দোলনের উপরথেকে তাদের নেতৃত্ব চলে যাওয়ার আশংকায় ভীত এবং সন্ত্রস্ত হয়ে নিজেদের মধ্যেআপোষ রক্ষার মাধ্যমে এই বিপ্লবের মূল লক্ষ্যকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টায়মেতে উঠলো। সর্বদলীয় গোলটেবিল ছিল ফেব্রুয়ারিরর বিপ্লবকে বিপথে পরিচালনাকরার এক ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র এবং আন্দোলনের নেতৃত্ব তাদের হাতে ফিরিয়ে নেবারজন্যই উদীয়মান পুঁজিপতিদদের রাজনৈতিক প্রতিনিধিরারা এই গোলটেবিলে যোগদিয়েছিলেন। দেশের সংবিধান রচনা এবং শান্তিপূর্ণ পথে ক্ষমতা হস্তান্তরেরউছিলায় “আইনগত কাঠামোর” জোয়ালে বিগত সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান সেইষড়যন্ত্রেরই আরেক পর্যায়। জাতীয়তাবাদী সম্মোহনী শ্লোগানের মায়াজালে একঅভূতপূর্ব উন্মাদনা সৃষ্টি করে এই উদীয়মান পুঁজিপতিরা নিষ্ঠুর আরনির্মমভাবে ব্যবহার করেছে এদেশের শোষিত মানুষের সহজ সরল আবেগকে, তাদেরশ্রেণীস্বার্থআদায়ের খোরাক আর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের হাতিয়ার হিসেবে। নির্বাচনেরফলাফল যাই হোক না কেন, দেশের সংবিধানের রূপ এবং কাঠামো যে কোন দফাভিত্তিকহোক না কেন, রাষ্ট্র পরিচালনার মূল শক্তি আজো যেমন জনতার শত্রুকায়েমীস্বার্থবাদীদের হাতে বর্তমান, ভবিষ্যতেও তেমনি থাকবে – যদি না রাষ্ট্রীয়
কাঠামোর একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয়। বিপ্লবী সমাজবাদীদের তাই আজকেরঐতিহাসিক দায়িত্ব এবং কর্তব্য হচ্ছে উদীয়মান পুঁজিপতিদেরনেতৃত্বে এই ভাঁওতাবাজি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বেএবং কৃষক ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর “মেহনতী জনতার গণতান্ত্রিক বিপ্লবে “পর্যবসিত করা। দেশের বর্তমান যে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, তাতে বৃহৎ ধনিকগোষ্ঠীর পরিবর্তে, উদীয়মান এবং বিক্ষুব্ধ বুর্জোয়াদের হাতে শাষন ক্ষমতাএলেই সাধারণ খেটে-খাওয়া মানুষের ভাগ্যের বা অবস্থার কোনই পরিবর্তন হচ্ছেনা। একমাত্র সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বে মেহনতী জনতার ক্ষমতা দখলের মধ্যদিয়েই এই পুঁজিবাদী শোষন ব্যবস্থা খতম হওয়া সম্ভব, অন্যথায় নয়।

১৮ইফেব্রুয়ারীর রক্তাক্ত গণ-বিপ্লবের মূল লক্ষ্য ছিল পাকিস্থানের বর্তমানেধনবাদী শোষন ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বে মেহনতীজনতার গণতান্ত্রিক সরকার। যার চূড়ান্ত লক্ষ্য একটি শোষনহীন সমাজবাদীরাষ্ট্র প্রতিষ্টা। সেই লক্ষ্যকে বাস্তবায়িত করতে পারে একমাত্র সর্বহারাশ্রেণীর নেতৃত্বেমেহনতী জনতার বিপ্লবী সরকার। তাই সমাজবাদী দলের আজকের শ্লোগানঃমেহনতী জনতার বিপ্লবী সরকার কায়েম কর।রক্তাক্ত ফেব্রুয়ারী বিপ্লব। তোমার কাছেআমাদের বিপ্লবী শপথঃসর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্ব মেহনতী জনতার বিপ্লবী সরকার আমার শেষ রক্তবিন্দু দিয়েওকায়েম করবোই।

রক্তাক্ত ফেব্রুয়ারী বিপ্লব অমর হোক।

ঢাকার কর্মসূচি
১৮ই ফেব্রুয়ারী সকালঃ প্রভাত-ফেরী।
১৫ই ও ১৬ই ফেব্রুয়ারীঃ পথসভা, গণসংগীত।
১৭ই ফেব্রুয়ারী সন্ধ্যাঃ বায়তুল মোকাররম
থেকে মশাল মিছিল।
১৮ই ফেব্রুয়ারী
পল্টনে জনসভা।
সন্ধ্যাঃ মশাল মিছিল ও বিপ্লবী শপথ গ্রহণ।
——————
শ্রমিক-কৃষক সমাজবাদী দলের পক্ষে হারুন-উর-রশিস কর্তৃক ২৪৬ মধুবাজার,
ঢাকা-৯ থেকে প্রচারিতও প্রকাশিত।

<2.152.635>

শিরোনাম সূত্র তারিখ
পাকিস্তান পিপলস পার্টির পরিষদে না যোগদানের আহবান দ্য ডন ১৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭১

 

আওয়ামী লীগ নমনীয় না হলে পাকিস্তান পিপলস পার্টি অ্যাসেম্বলিতে যোগ দিবে নাছয় দফা সংশোধনের দাবীদুইক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ কেন্দ্রীয় সরকার অগ্রহনযোগ্য

পেশোয়ারে জেড. . ভুট্টোর ঘোষনা; ১৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭১

পাকিস্তান পিপলস্‌ পার্টির চেয়ারম্যান জেড . এ. ভুট্টো আজ ঘোষনা দিয়েছেন সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের পক্ষ থেকে প্রকাশ্যে কিংবা গোপনে কোন প্রকার সমঝোতার আশ্বাস না পেলে আগামী ৩রা মার্চ থেকে ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে তার দল অংশগ্রহন করবে না।

জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে তিনি অ্যাসেম্বলি বয়কটের ঘোষনা না দিলেও বলেন, “শুধু একটা নির্দিষ্ট দলের তৈরী সংবিধান সমর্থন করার জন্য গিয়ে অপদস্থ হয়ে ফেরত আসার জন্য আমরা সেখানে যেতে পারি না। আমাদের কথা শোনা না হলে, আমাদের যুক্তিসংগত প্রস্তাবও মানা না হলে সেখানে যাবার কোন কারন আমি দেখি না।”

জনাব ভুট্টো বলেন আওয়ামী লীগের প্রস্তাবিত ছয় দফার প্রথম এবং শেষ দফা তার দল মেনে নিলেও (আলাদা প্রাদেশিক ফেডারেশন এবং প্রাদেশিক মিলিশিয়ার সাথে সম্পর্কযুক্ত) তিনি “দুই ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ কেন্দ্রীয় সরকার” এবং মুদ্রাব্যাবস্থা সংক্রান্ত দাবী দুইটি কোনভাবেই মেনে নিতে পারেন না। “বৈদেশিক বানিজ্য এবং শুল্ক সম্পর্কিত দাবীগুলো নিয়ে আমার এখনো আশা আছে” বলে তিনি মতামত প্রকাশ করেন। জনাব ভুট্টো আরো বলেন ছাত্রদের প্রস্তাবিত ১১ টি দাবীর ১০টি দাবীই তার দল মেনে নিলেও পশ্চিম পাকিস্তানে সাব-ফেডারেশন সম্পর্কিত দাবীটি মেনে নেয়া সম্ভব নয়।

যদিও তিনি বলেন, “আমি মনে করি উভয় দলকে সন্তুষ্ট করতে পারে এমন কোন সিদ্ধান্তে আমরা পৌঁছাতে পারি। পারষ্পারিক বোঝাপড়ার আশা আছে বলে আমি মনে করি। কিন্তু আমাদের যদি ঢাকা যেতে বলা হয় কেবলমাত্র আওয়ামী লীগের তৈরী সংবিধান সমর্থন দেয়ার জন্য যেটার তারা একচুল ও এদিক সেদিক পরিবর্তন করতে রাজী নয়, তাহলে ২ মার্চ সংরক্ষিত নারী আসনের ভোটের সময় আমাদের ঢাকায় পাবেন না।”

ভুট্টো বলেন ছয় দফা দাবী অনুসারে তৈরী সংবিধান “দেশের জন্য টেকসই ভবিষ্যৎ” প্রদান করতে পারবে না বলে তার দলের ধারনা। তারপরেও পাকিস্তান পিপলস পার্টি আওয়ামী লীগের দাবীর যত কাছাকাছী যাওয়া সম্ভব গিয়েছে, এমনকি খাদের কিনারা পর্যন্ত যার পরে কেবলই ধ্বংস।

জাতির বৃহত্তর স্বার্থ রক্ষার্থেই তিনি এই মতামতে পৌঁছেছেন বলে তিনি বলেন। দেশ এখন একটি ক্রান্তিলগ্ন পার করছে, যেখানে কেবল মাত্র একটি দিকেই যাওয়া সম্ভব বলে তিনি মতামত প্রকাশ করেন।

<2.152.636>

“শুধু আনুষ্ঠানিকতার জন্য আমরা সেখানে যেতে প্রস্তুত নই।”, বলেছেন ভুট্টো। যদি অন্যান্য নেতারা আওয়ামী লীগকে সাহায্য করার জন্য সেখানে যায় এমন প্রশ্নের উত্তরে ভুট্টো বলেন, “তাদের যেতে দিন” তারপরে যোগ করেন, “কিন্তু তাদেরকেও ফেরত আসতে হবে”।

যদিও তিনি বলেছেন, “ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে তৈরী সংবিধানের পথে আমি বাঁধা হয়ে দাড়াবো না। সেখানে যারা যাবে তাদেরকে নিয়ে আওয়ামী লীগ সেটা তৈরী করুক। পাকিস্তান পিপলস পার্টির উপর তখন আর কোন দায় বর্তাবে না।”

আওয়ামী লীগ সংবিধানের ব্যাপারে “ডবল স্ট্যান্ডার্ড” অনুসরন করছে বলে তিনি মতামত ব্যাক্ত করেন। সংবিধান তৈরীর অবস্থায় আসবার জন্য লীগ গনতান্ত্রিক পন্থা অবলম্বন করলেও নতুন সংবিধানের ক্ষেত্রে তারা অন্যান্য প্রদেশের গনতান্ত্রিক মতামতের কথা চিন্তা করছে না।

পশ্চিম পাকিস্তানের উপর চাপিয়ে দেয়া কোন সংবিধান মেনে নেয়া হবে না কোনভাবেই বলে দাবী করেন ভুট্টো। “আমরা চাই পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তান সমান সমান থাকুক কিন্তু তার মানে এইটা না যে আমাদের উপর যা খুশি চাপিয়ে দেয়া হবে।” আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে গোপনে কোন প্রকার সমঝোতার প্রস্তাব দেয়ার পরে যদি তা বাস্তবায়ন হবার সম্ভাবনা দেখা না যায় এরকম প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “যেকোন সময় ফেরত আসা সম্ভব আমাদের পক্ষে”।

তার নিজ দল এবং পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য দলের নেতাদের সাথে পরামর্শ করেই এ ধরনের সিদ্ধান্তে এসেছেন বলে জানান ভুট্টো।

                            *                                   *                                *                                   *

তিনি বলেন পূর্ব পাকিস্তানের জনগনকে তার দল সম্মান করে , এমনকি দলীয় সংবিধানে উল্লেখিত আছে যে পূর্ব পাকিস্তানের বাজে ভাবে শোষিত হয়েছে এবং ফলস্বরূপ জনগনের ক্ষুব্ধ হবার যথেষ্ঠ কারন রয়েছে। “অভ্যন্তরীন কলোনিয়াল প্রথা” রদ করার ব্যাপারেও সেখানে জোড় দেয়া হয়েছে বলে তিনি যোগ করেন।

পিপিপি প্রধান জোড় দিয়ে বলেন, আওয়ামী লীগ ছয় দফার উপর ভিত্তি করে নির্বাচনে জিতলেও পিপলস পার্টির অবস্থানের কথা তাদের একবার চিন্তা করা উচিৎ। মূলত এই সাফল্যের ভিত্তি অর্থনৈতিক এবং পররাষ্ট্র দফাগুলোর উপর ভিত্তি করে বলে তার মতামত। তার দলের মতে ছয় দফা দাবি রাজনৈতিক ভাবে গ্রহন করা উচিৎ, “টেস্ট টিউব” হিসেবে নয়।

বছরব্যাপী নির্বাচন প্রচারনার সময় ছয় দফার উপরে কোন মতামত প্রকাশ থেকে তার দল বিরত থাকলেও এখন “ডায়লগ” এর উপযুক্ত সময় বলে তাদের ধারনা।

পশ্চিম পাকিস্তানে বিভিন্ন মহলের “কায়েমি স্বার্থ” এর কারনে শেখ মুজিবুর রহমানের সেখানে যেতে না পারার ব্যাপারে দুঃখ প্রকাশ করে তিনি বলেন তিনি নিজে আওয়ামী লীগ নেতাদের “যথাপোযুক্ত সম্মান এবং নিরাপত্তা” এর জামিনদার হতে প্রস্তুত ছিলেন।

ছয় দফার উপরে কোনপ্রকার “আপস কিংবা সমন্বয়” এর অভাবেই ৩রা মার্চ হতে ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য অ্যাসেম্বলিতে তার দল উপস্থিত থাকবে না বলে মতামত প্রকাশ করেন জেড এ ভুট্টো।

দেশের জন্য একটি টেকসই এবং মানসম্মত সংবিধানের জন্য তার দল ছয় দফার ব্যাপারে তার দলের পক্ষে যতদূর যাওয়া সম্ভব গিয়েছে বলে ভুট্টোর মতামত। কিন্তু এখন সংবিধান তৈরী করার আগেই কেবলমাত্র সংবিধান মেনে নিতে ঢাকা তারা যাবেন না।

<2.152.637>

“সমঝোতা আর সমন্বয়ের আশ্বাস পেলে আমি আজকেই সেখানে যেতে প্রস্তুত।” বলে দাবী করেন ভুট্টো। “পাকিস্তান গড়ে তোলার জন্য আমরা আজকেই অ্যাসেম্বলিতে যোগ দিতে তৈরী।” যোগ করেন তিনি।

সংবিধান তৈরীর জন্য সকল ফেডারেশনের ঐক্যমত অপরিহার্য হলেও “সংবিধান ইতোমধ্যেই তৈরী হয়ে গেছে” আর আওয়ামী লীগ চায় কেবলমাত্র তার দলের “অনুমোদন”, বলে ভুট্টোর মতামত। পিপিপি প্রধান বলেন আওয়ামী লীগের মনোভাব এখন “গ্রহন কর, নাহয় ছেড়ে দাও।”

তিনি যোগ করেন যে আমাদের একটা নিশ্চয়তা দরকার যে আমাদের কথা শোনা হবে এবং যুক্তিপূর্ণ হলে সেটা মেনে নেয়া হবে। এধরনের কোনপ্রকার নিশ্চয়তা ছাড়া অ্যাসেম্বলিতে যোগ দিলে পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হবে। ভুট্টো জোড় দিয়ে বলেন গনতান্ত্রিক ব্যাবস্থায় “সমন্বয়ের জন্য জায়গা রাখতে হবে”। এই পরিস্থিতিতে অ্যাসেম্বলিতে যোগ দিলে সেটার ফলাফল হবে একধরনের অচলাবস্থা যা জাতীয় স্বার্থের জন্য প্রতিকূল। “আমি পরিস্থিতি আরো খারাপ করতে চাই না” বলে তিনি যোগ করেন তিনি কেবলমাত্র “বস্তুনিষ্ঠ আর যুক্তিযুক্ত”। পিপলস পার্টির অতীত অবস্থান নিয়ে জাতি ভালো করেই জানে বলে ভুট্টোর ধারনা করে বলেন, “জনগন সবসময় সঠিক বিচার করে।” তিনি বলেন, “ছয় দফা নিয়ে আমরা নির্বাচন প্রচারনার সময় কোন ধরনের কথা উঠাই নি।” অথচ পশ্চিম পাকিস্তানের অসংখ্য নেতা ছয় দফার সমালোচনা করেছে, মজার ব্যাপার হচ্ছে ওইসব নেতারাই এখন ছয় দফার গুনগান করছে কারন অ্যাসেম্বলিতে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ।

পশ্চিম পাকিস্তানে ছয় দফা নিয়ে অনেক “আশঙ্কা” ছিল বলে দাবী করেন ভুট্টো। আওয়ামী লীগ নেতাদের তিনি মনে করিয়ে দিতে চান ১৯৬৬ সালের অক্টোবরে তার পূর্ব পাকিস্তান সফরে তিনি যথাশীঘ্র ছয়দফা উপরে একটি সংলাপ আয়োজনের পরামর্শ দিয়েছিলেন। ব্যাপারটা পশ্চিম পাকিস্তানে আলোড়ন সৃষ্টি করে, এবং রাজনীতিবিদরা জানতে চায় কিভাবে তিনি ছয় দফার উপরে সংলাপে বসতে চান?

আমাদের গত ২৩ বছরের ইতিহাস মাথায় রাখলে বর্তমান ছয় দফা সঠিক ভাবে কাজ করবে না। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দদের তিনি নিশ্চয়তা দিয়ে বলেন ছয় দফার ক্ষেত্রে পিপলস পার্টির পক্ষে যতদূর যাওয়া সম্ভব যাবে। তিনি বলেন পিপলস পার্টির অভ্যন্তরীন আলোচনায় ছয় দফার ব্যাপারে “মিশ্র অনুভূতি” রয়েছে, অনেক নেতাই ছয় দফা কোনভাবেই মেনে নিতে প্রস্তুত নন এবং তাদের মতে পিপলস পার্টির তীব্র বিরোধিতা করা উচিৎ এ ব্যাপারে। আবার নেতাদের একটি ক্ষুদ্র অংশ চয় আওয়ামী লীগের ছয় দফা বাস্তবায়িত হোক। কিন্তু অধিকাংশ নেতার মতে বর্তমান পরিস্থিতিতেসমঝোতায় আসতে পারাই সব থেকে উপযুক্ত করনীয় ।

<2.152.638>

আগামী ২০ এবং ২১ ফেব্রুয়ারীর সভায় পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ ও তার দলীয় নেতাদের সাথে আলোচনা করে তারা “চূড়ান্ত এবং আনুষ্ঠানিক অবস্থান” জানাবেন বলেছেন পিপিপি নেতা। অ্যাসেম্বলির তারিখ ঘোষিত হলেও ঢাকায় যাবার পূর্বে তার এবং তার দলের নেতাদের এক ধরনের নিশ্চয়তা দরকার যে “সমঝোতা” হওয়া সম্ভব কিন্তু তার পূর্ব শর্ত তাদের এখনো অজানা বলে ভুট্টো বলেন। তিনি আশা করেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান পশ্চিম পাকিস্তানে আসবেন এবং তার সাথে আরো আলোচনার সুযোগ পাবেন ভুট্টো। কিন্তু এখন তার ধারনা তিনি(শেখ মুজিবুর রহমান) পশ্চিম পাকিস্তানে সফরে প্রস্তুত নন অনুকূল পরিস্থিতির অভাবে। আওয়ামী লীগের বর্তমান অবস্থানে “আদান-প্রদান” আর সমঝোতার সুযোগ আছে কিনা ভুট্টো জানেন না। শেখ মুজিবের এখানে যদি সম্ভব না হয়, ভুট্টোর পক্ষে ঢাকা সফর আরো কঠিন বলে তার ধারনা। ভারতের সাথে বর্তমান রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর পাকিস্তানের ব্যাপারে হুমকিস্বরূপ মনোভাব, ভারতের সাথে পররাষ্ট্রীয় সম্পর্কে পিপিপির অবস্থান ইত্যাদি পরিস্থিতিতে তার নিজের জনগনের সাথে পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থান করাই যুক্তিযুক্ত বলে মতামত প্রকাশ করেন ভুট্টো।

 ভুট্টো আরো যোগ করেন, “আমি নিজেকে নিয়ে ঝুকি নিতে প্রস্তুত, কিন্তু আমার অন্য ৮৩ জন দলীয় নেতাকে নিজে ঝুকি নেয়া আমার পক্ষে অসম্ভব বর্তমান রাস্ট্রীয় পরিস্থিতিতে।” তিনি বলেন ইন্ডিয়ার সাথে ঝুঁকিপূর্ন সম্পর্ক এবং ছয় দফার বিরোধিতার কারনে দলীয় নেতাদের তিনি দ্বৈত জিম্মি পরিস্থিতিতে ফেলতে পারেন না। তিনি বলেন তার দল খেটে খাওয়া মানুষদের দিয়ে তৈরী যাদের সবারই চাকরী কিংবা কাজ আছে, তাদের জানা দরকার পরিবার থেকে কতদিন দূরে থাকা প্রয়োজন হতে পারে তাদের। শুরুতে তারা জানতেন ঢাকায় কেবল একটি আনুষ্ঠানিক সম্মেলন হবে, কিন্তু বর্তমানে তার কাছে নিশ্চয়তা নেই তার দলীয় নেতাদের ঢাকায় লম্বা সময়ের জন্য অবস্থান করতে হবে নাকি অল্প কিছুদিনের জন্য।

  ভুট্টো বলেন তার দলের সদস্যদের ঢাকা যেতে হবে শুধু সংবিধান মেনে নিতে, তৈরী করতে না। এই পরিস্থিতিতে আগামী ৩ মার্চের অ্যাসেম্বলিতে ঢাকায় তারা যোগ দিতে পারেন না।   কিন্তু তারপরেও তিনি যোগ করেন যদি তাদের কোনপ্রকার নিশ্চয়তা দেয়া হয়, এমনি ব্যাক্তিগতভাবেও যে আদান-প্রদানের সুযোগ থাকবে, সম্মিলিত প্রয়াসে সংবিধান তৈরীর অবস্থা থাকবে, তাহলে তারা অ্যাসেম্বলিতে যোগ দিতে পারেন।

 পাকিস্তানের অন্যান্য নেতারা চাইলে অ্যাসেম্বলিতে যোগ দিতে পারেন, কিন্তু পিপিপির সদস্যরা সেখানে যাবে কেবল সমন্বয়ের সুযোগ থাকলেই, কারো নির্দেশিতসংবিধান মেনে নিতে না।

ভুট্টো বলেন আওয়ামী লীগ একদিকে গনতান্ত্রিক সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমে সংবিধান তৈরীর দাবী করছে আরেকদিকে দেশের ভৌগলিক বিশেষত্বের সুযোগ নিয়ে ছয় দফা বাস্তবায়ন করতে চাইছে। তিনি বলেন তারা সব কিছু একসাথে চাইতে পারে না! ছয় দফার উপর ভিত্তি করে যদি আওয়ামী লীগ সংবিধান রচনাই করতে চায় তাহলে, তাহলে দুই ফেডারেশনের মতৈক্য আমলে না নিয়ে শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে ভিত্তি করছে?

তারপরে তিনি বলেন এতকিছুর পরেও আওয়ামী লীগ যদি ছয় দফার উপর ভিত্তি করে সংবিধান রচনা করতে জোড় করে তাহলে পাকিস্তান পিপলস পার্টির উপর সেই সংবিধানের কোন দায় বর্তাবে না।

তিনি বলেন তিনি পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে করা মোটেই তার লক্ষ নয় বরং যেটা বস্তুনিষ্ঠ, বিজ্ঞানসম্মত এবং যুক্তিযুক্ত সেটাই প্রকাশ করা তার লক্ষ্য।

তিনি আরো জানান পুরো পরিস্থিতির দায়ভার তিনি একাই নিতে চান, এবং অতীতের অনেকবারের মত বন্দুকের গুলির সামনে তিনি একাই দাড়াতে প্রস্তুত। কিন্তু জনগনকে ফায়ারিং লাইন থেকে বাচিয়ে রাখাই তার অভীষ্ঠ লক্ষ।

অ্যাসেম্বলি বয়কট করছেন কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বিরোধিতা তা করেন।

ভুট্টো বলেন পরিস্থিতি ঘোলাটে করা মোটেই তার উদ্দেশ্য নয়। তিনি জানেন অতীতে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা পূর্ব পাকিস্তানে শোষন করেছেন, কিন্তু তাতে তার কোন হাত ছিল না। অতীতের শোষনের কারনে তার পূনরাবৃত্তি পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে হতে হবে তার কোন মানে নেই। পশ্চিম পাকিস্তান এখন নতুন নেতৃত্বের পরিচালিত, যা শোষনের চক্র শেষ করতে চায়, পূর্ব এবং পশ্চিম দুই পাকিস্তানেই। প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য রচিত কোন সংবিধান গ্রহন করা হবে না বলে তিনি যোগ করেন।

আরেক প্রশ্নের জবাবে ভুট্টো বলেন শেখ মুজিবের কাছ থেকে সংবিধান রচনার ব্যাপারে আদান-প্রদান ও সমঝোতার কোন আশ্বাস পেলেই তিনি তা গ্রহন করবেন, এমনকি সেই নিশ্চয়তা তাকে গোপনে দেয়া হলেও।

অন্য এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান এনডাব্লিউএফপি এর নেতাদের সাথে আলোচনায় তিনি “সন্তুষ্ট”। পেশোয়ারে দুইদিন অবস্থান কালে ভুট্টো পাকিস্তান মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট খান আব্দুল কাউয়ূম খান, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির প্রেসিডেন্ট খান আব্দুল ওয়ালী খান, জামায়াত-ই-উলামা-ই-ইসলামের জেনারেল সেক্রেরাটি মাওলানা মুফতি মাহমুদ প্রমুখের সাথে সাক্ষাত করেন।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!