শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
জলোচ্ছ্বাসের পর কেন্দ্রের ভূমিকার পরিপ্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট মওলানা ভাসানীর আহবান | মওলানা ভাসানী (প্রচার পত্র) | ৩০ নভেম্বর,১৯৭০ |
জনগণের প্রতি মওলানা ভাসানীর ডাকঃ
পূর্ব পাকিস্তানের আজাদী রক্ষা ও মুক্তি–সংগ্রামে ঝাঁপাইয়া পড়ুন
আজ আমি পূর্ব পাকিস্তানের সাত কোটি বাঙালীকে তাহাদের জীবন-মরণ প্রশ্নের বিষয়টি পুনর্বার এবং শেবারের মত দলমত নির্বিশেষে ভাবিয়া দেখিতে আকুল আবেদন জানাইতেছি। বিগত ২৩টি বছরের তো বটেই, এমনকি চলতি ১৯৭০ সালটিকেই শুধু যদি আমরা জাচাই করিয়া দেখি তবে নিঃসন্দেহে একটি চূড়ান্ত সুদ্ধান্তে পৌছাতে পারিব। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট হইতে আমাদের, পূর্ব পাকিস্তানীদের আজাদীর লড়াই নতুনতম এবং শেষ পরজায়ের রূপ লাভ করিবার অপেক্ষায় আছে মাত্র। সেই পর্যায়ে, আর কোন যুক্তি ও শক্তি দ্বারা ধামা চাপা কিংবা দাবাইয়া রাখিবার প্রয়াস সহ্য করা হইবে না। মরণ কামড়ে আর গগনবিদারী হুংকারে নিস্তব্ধতা ভাঙ্গিয়া দিতে হইবে। দুই যুগ ধরিয়া বৈষম্য আর বঞ্চনার যে লড়াই শুরু করিবার প্রচার ও প্রচেষ্টা চলিতেছে তাহারই সকল সংগ্রামী রূপায়ণে, আমাদের জীবনের বিনিময়ে হইলেও, ঝাপাইয়া পড়িতে হইবে। আজ হইতে ১৩ বৎসর পুরবেই ষড়যন্ত্র, অত্যাচার, শোষণ আর বিশ্বাসঘাতকতার নাগপাশ হইতে মুক্তি লাভের জন্য দ্যর্থহীন কন্ঠে “আচ্ছালামু আলায়কুম” বলিয়াছিলাম, হয়তো বঙ্গবাসী সেইদিন নাটকের সব কয়টি অংক বুঝিয়া উঠিতে পারে নাই। আজ আশা করি সচেতন ও শুভ বুদ্ধি সম্পন্ন কোন বাঙালীকে বুঝাইতে হইবে না যে, মানবতাবর্জিত সম্পর্কের মহড়া চুরান্ত পর্যায়ে উঠিয়াছে। এইবার নেমিসিসের অন্যায়ের সমুচিত শাস্তি বিধানের অপেক্ষায় আমরা আছি। জাহা হইবার তাহাই হইবে।
আমরা ভাবিয়াছিলাম ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত জিদ্ধ পাকিস্তানীদের নূতন শপথের সন্ধান দিবে। পূর্ব পাকিস্তানের বেতার, টেলিভিশন এবং সংবাদপত্র গুলি সেই পথ লক্ষ্য করিয়া যাবতীয় সার্ভিস দান করিয়াছিলেন। সরকারও লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করিয়া পুস্তক প্রকাশনার ও দেশী বিদেশী সাহিত্যিক সাংবাদিকদের সফরের আয়োজন করিয়াছিলেন; কিন্তু আজ ইহা স্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছে যে, সরকারের সকল প্রচেষ্টার লক্ষ্যে ছিল পশ্চিম পাকিস্তান, কোন ক্ষেত্রেই সমগ্র পাকিস্তান নহে। এই কারণেই পূর্ব পাকিস্তানের সব প্রয়াস ব্যর্থ হইয়াছে। যুদ্ধ তহবিলে কোটি কোটি টাকা সাহায্য, কওমী গানের আসর, সাংবাদিকের ফিচার, সাহিত্যিকের রচনা সবই ধীকৃত ও উপেক্ষিক্ত হইয়াছে। সবচেয়ে বড় কথা হইল, বরাবরই আমরা কেন্দ্রীয় সরকার ও আমলা অফিসারদের তরফ হইতে যে আচরন পাইয়া আসিতেছিলাম আজ পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিটি রাজনৈতিক নেতা, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক এক কথায় সকল মহল হইতেই সেই উপেক্ষা ও উদাসীনতা লাভ করিতেছি। ইহাতেও কি আমাদের চেতনার উদ্রেক হইবে না?
অতীতের ইতিহাস না আওড়াইয়া শুধু চলতি সালের ঘটনাবলী বিবেচনা করিয়া দেখিলে আমাদের লক্ষ্য শক্তির সংগ্রামে না পৌঁছাইয়া পারে না। পুনঃ পুনঃ বন্যা ও ঘূর্ণি বাত্যায়ে পূর্ব পাকিস্তান বিধ্বস্ত হইয়াছে এবং এইবার একই বৎসরে আমরা দুইটি বন্যা ও দুইটি ঘূর্ণিঝড়ে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হইয়াছি। প্রথম বারের বন্যায় পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে চারিশত কোটি টাকা মুল্যের ফসল, ঘর-বাড়ী, গবাদী পশু পানিতে ভাসিয়া গিয়াছে। দ্বিতীয় দফা বন্যা আমরা হারাইয়াছি অতিকষ্টে রোপন করা ধান, কলাই, তরিতরকারী ইত্যাদি। গত ২৩শে অক্টোবরের ঘূর্ণিঝড়ের পূর্ব পাকিস্তানের আটটি জেলার ঘর-বাড়ী, গাছ-পালা নির্ণয়াতীত ভাবে ধ্বংস হইয়া গিয়াছে। আর সর্বশেষ দক্ষিণাঞ্চলের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস যে ধ্বংসলীলা ও প্রাণহানি সংঘটিত করিয়াছে এবং বন্যা ও ঘূর্ণিনাত্যার পর পুনঃ পুনঃ কলেরা-মহামারীতে আক্রান্ত হিয়া সহস্র সহস্র লোক অকালে প্রাণ হারাইয়াছে ও হারাইতেছে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকবর্গ, ক্ষমতালোভী নেতৃবর্গ আর উদাসীন শিল্পী, সাহিত্যিক। সাংবাদিকবর্গকে তাহা নাড়া না দিলেও বিশ্বের তিনশত কোটি মানুষের চঞ্চল করিয়া তুলিয়াছে।
সরকার বরাবরের মত এই ধ্বংসলীলা ধামাচাপা দিবার প্রাণপণ চেস্তা করিয়া গেলেও শেষ পর্যন্ত সত্যের বিজয় হইয়াছে। আমি ভাষায় প্রকাশ করিতে পারিনা যে আমাদের এহেন দুর্দিনে সরকার কি ধৃষ্টতা প্রদর্শন করিয়াছে। মানুষের হৃদয় নিঃসৃত ভালবাসা আর প্রজ্ঞা-প্রসূত বিবেওচনার সম্মুখে প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিছুই নহে; কিন্তু এই দুইটিরই আভাব আমরা মর্মে মর্মে অনুভব করিয়াছি। সরকার ও পশ্চিম পাকিস্তানীদের নিকট হইতে সেই ভালবাসা ও বিবেচনা পূর্ব পাকিস্তান পায় নাই বলিয়াই যেন প্রাকৃতিক দুর্যোগটি শতগুণ আঘাত হানিয়াছে। ইহার নতিজা সরকারকে ভোগ করিতেই হইবে। একজন মন্ত্রী মারা গেলে বেতার, টেলিভিশন ও অন্যান্য সরকারী প্রচারযন্ত্র কিভাবে মাতম শুরু করে তাহা আমাদের ভালোভাবেই জানা আছে। আর পশ্চিম পাকিস্তানী সরকার নিয়ন্ত্রিত বেতার তেলিভিশনে ১২ লক্ষাধিক লোকের প্রানহানিতে কিরুপ বিশ্বাস ঘাতকতা ও ক্ষমাহীন ধৃষ্টতার পরিচয় দিয়াছে তাহা আজ সাতকোটি বাঙালীকে ভাবেয়া দেখিতে হইবে। লন্ডন, পিকিং, ওয়াশিংটন, তেহরান, আম্মান, সিডনি, টোকিও ও কলিকাতার বেতার যখন বিশ্ববাসীর নিকট সর্বনাশা জলোচ্ছ্বাসের বিশদ বিবরণ তুলিয়া ধরিয়াছে, সাহায্য সামগ্রী পাঠানোর আবেদন জানাইতেছে, তখনও পাকিস্তানের বেতার, টিভি, বিশ্বাসঘাতকতা ও চরম মিথ্যাবাদীর ভূমিকা পালন করিতেছে; তখন তাহাদের আহলাদমাখা অনুষ্ঠানের কমতি হয় নাই; বার লক্ষাধিক রুহের মাগফেরাত কামনা করা হয় নাই। লক্ষ লক্ষ লাশের দাফন কাফনের কর্তব্যের কথা স্বীকার করা হয় নাই। ের চেয়ে আফসোসের বিষয় আর কি হইতে পারে?
আজ তাই আমাদের সম্মুখে কর্মসূচী পরিস্কার হইয়া উঠিয়াছে। সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজের বিরুদ্ধে আমরা লড়াই করিয়াছি। অনেক ত্যাগ স্বীকার করিয়াছি, অনেক কোরবান দিয়াছি। আজ আমাদের হাতে যাহাই অবশিষ্ট আছে সব কিছুই উৎসর্গ করিয়া সংগ্রামে ঝাঁপাইয়া পড়িতে হইবে। এই সংগ্রাম ভাষণ বিবৃতি নয়, প্রত্যক্ষ মোকাবেলা। এই মোকাবেলা আপোষ নিস্পত্তিকল্পে চাপ সৃষ্টি করার সংগ্রাম নয়- পূর্ব পাকিস্তানের সাত কোটি শোষিত নির্যাতিত মানুষের মুক্তির সংগ্রাম। দলমত নির্বিশেষে আজ সবাই আসুন আমরা এক ও অভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করি। এবং ইহারই পরিপ্রেক্ষিতে মিছিল ও জনসভার আয়োজন করুন। তাই মিছিল ও জনসভা অনুষ্ঠান করার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের নিকট জরুরী আবেদন করিতেছি।
এইদিন আপনারা আওয়াজ তুলুনঃ পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে এবং আমাদের আজাদী রক্ষা করিতেয়ামরা সর্বস্ব কোরবান দিতে সদা প্রস্তুত। সেই সাথে আপনার বজ্রকন্ঠে আওয়াজ তুলুনঃ আমরা স্বাবলম্বী, আত্ম-নির্ভরশীল এবং শৃঙ্খলামুক্ত হইতে চাই। আমরা বিশ্বাসঘাতক আমলাদের শায়েস্তা করিতে চাই।
আমি বিশ্বাস করি মানবতার নামে আজাদীর লড়াইয়ে আমাদের সাফল্য অনিবার্য। সকল প্রাকার বাধা-বিপত্তি ও ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করিয়া আমরা ঈপ্সিত লক্ষ্য পৌছাব আশা করি বিশ্বাসীরও ইহাই বিশ্বাস। কিন্তু এই প্রসঙ্গে আমি একটি হুঁশিয়ারিও উচ্চারণ করিতে চাই- আমাদের দুর্যোগ ও দুর্দিনকে সম্বল করিয়া যাহারা আন্তর্জাতিক রাজনীতির কোন চাল চালাইতে চায় তাহাদিগকে আমরা বরদাস্ত করিব না। আমাদের প্রয়োজনে যাহারা সাহায্য লইয়া আগাইয়া আসিতেছে তাহাদিগকে আন্তরিক মোবারকবাদ জানাই; কিন্তু সেবার নামে কেহ যদি ষড়যন্ত্রের বেড়াজালে আমাদিগকে আটকাইতে চায় তবে তাহাকেও তল্পীতল্পাসহ আমরা তাড়াইতে বাধ্য হইবে।
বাঙালীকে কোন দিন শিকলের বন্ধকে মানিয়া লয় না আর লইবেও না। বিদেশী সৈন্যই হউন, কূটনীতিকই হউন, আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের এই বৈশিষ্ট্য লক্ষ করিয়া কাজ করিবেন ইহাই আমাদের বিশ্বাস।
বাঙালী জাতির মুক্তি-সংগ্রামে রুখিতে পারে পৃথিবীর এমন কোন শক্তি নাই। সাফল্য আমাদের সুনিশ্চিত।
- পূর্ব পাকিস্তান- জিন্দাবাদ!
- জনগণের সংগ্রামী ঐক্য- জিন্দাবাদ!
- ইঙ্গ মার্কিন দস্যুরা- বাংলা ছাড়!
- দুর্গত-জনসেবায় আত্মনিয়োগ কর!
নাছরুম মিনাল্লাহে ফাতহুন কারিব
(জয় আমাদের নিকটবর্তী)
মোঃ আবদুল হামিদ খান ভাসানী
৩০-১১-১৯৭০ইং
<2.136.587-589>
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
শেখ মুজিবুর রহমানের নির্বাচনী আবেদন | আওয়ামী লীগ (প্রচার পত্র) | ১ ডিসেম্বর, ১৯৭০ |
আমার প্রিয় দেশবাসী ভাইবোনেরা,
আসসালামু আলায়কুম
আমার সংগ্রামী অভিনন্দন গ্রহন করুন।
আগামী ৭ই ডিসেম্বর সারা দেশব্যাপী জনগনের প্রত্যেক্ষ ভোটে প্রথম সাধারন নির্বাচনের তারিখ ধার্য করা হয়েছে। জনগনের ত্যাগ ও নিরবিচ্ছিন্ন সংগ্রামের ফল হচ্ছে এই নির্বাচন। সারা দেশ ও দেশের মানুষকে তীব্র সংকট ও দূর্নীতি থেকে চিরদিনের মতো মুক্তি করার সুযোগ এই নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে গ্রহন করা যেতে পারে।
দীর্ঘ তেইশ বছরের অবিরাম আন্দোলনের পথ বেয়ে শত শত দেশপ্রেমিকের আত্মদান, শহীদের তাজা রক্ত আর হাজার হাজার ছাত্র-শ্রমিক ও রাজনৈতিক কর্মীর অশেষ নির্যাতনভোগ ও ত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশের জনগনের সামনে আজ এক মহা সুযোগ উপস্থিত। এই নির্বাচনের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, নির্বাচিত হবার পরপরই পরিষদ সদস্যরা বা রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতার গদিতে বসে পড়তে পারবেনা। তাঁদেরকে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দেশের শাসনতন্ত্র প্রনয়নের কাজ সমাধা করতে হবে। বস্তুতঃ স্বাদীনতার তেইশ বছররের মধ্যে শাসনতন্ত্র প্রণয়নের মূল দায়িত্ব এবং অধিকার সর্বপ্রথম এবারই জনগনের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা লাভ করেছে। তাই তি এই নির্বাচনের গুরুত্ব অপরিসীম।
আমার দেশবাসী,
আমার দীর্ঘদিনের সংগ্রাম, ত্যাগ ও তিতিক্ষার পরেও যদি কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের প্রতিনিধিগণ দেশের ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্র প্রণয়নের দায়িত্ব থেকে বঞ্চিত হয় তাহলে পাকিস্তান বিশেষ করে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ চিরতে দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হবে। কেননা সম্পদ লুণ্ঠনকারী ও একনায়কত্ববাদের প্রতিভূরা দেশের কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের ইচ্ছানুযায়ী শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করার কাজে পদে পদে বাধা দেবে। ভোটাধিকারের নির্ভুল প্রয়োগ করার মাধ্যমে সেই মহা সুযোগ আমরা কুচক্রীদের কাছ থেকে ছিনিয়ে আনতে পারি, তাহলে কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের দুঃখমোচন ও বাংলার মুক্তি সনদ ৬ দফা ও ১১ দফা বাস্তবায়িত করা যাবে। একমাত্র এই কারণেই আওয়ামী লীগ আসন্ন নির্বাচনে অংশ গ্রহন করতে যাচ্ছে এবং বাংলাদেশের প্রতিটি আসনে প্রার্থী দাঁড় করিয়েছে।
প্রিয় দেশবাসী,
কারাগার থেকে বেড়িয়ে আমরা জনসংখ্যাভিত্তিক প্রতিনিধিত্ব অর্থাৎ এক ব্যাক্তি ভোট এক ভোটের দাবী তুলেছিলাম; আজ সেটা আদায় হয়েছে। তাই ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্র প্রণয়নের ক্ষেত্রে আমরা বিশেষ যোগ্যতা ও সুযোগের অধিকারী। এখন বাংলাদেশ থেকে নির্বাচিত পরিষদ সদস্যরা যদি একই দলের কর্মসূচী ও আদর্শের সমর্থক হন অর্থাৎ সকল প্রশ্নে তাঁরা ঐক্যমতে থাকতে পারেন তবে আমরা অতীতে চাপিয়ে দেয়া সকল অবিচার, বৈষম্যমূলক আচরণ, আইন-কানুন এবং বে-ইনসাফী শোষনের পরিসমাপ্তি ঘটাতে পারব। আমাদের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা ও সম্মিলিত দাবীর মুখে দেশের অপ্র অংশের পরিষদ সদস্যগণ বাংলাদেশের মানুষের মুক্তি সনদ ৬-দফা ১১-দফা মেনে নিতে বাধ্য থাকবেন। এর কারণ, পরিষদে আমরা সংখ্যা থাকব। আর আমরা যদি বিভক্ত হয়ে যাই এবং স্বার্থের দ্বন্দ্ব ও মতাদর্শের অনৈক্যের দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়ে আত্মঘাতী সংঘাতে মেতে উঠি তাহলে যারা এদেশের মানুষের ভালো চান না ও এখানকার সম্পদের উপর ভাগ বসাতে চান তাদেরই সুবিধা হবে এবং বাংলাদেশের নির্যাতিত, নিপীড়িত, ভাগ্যাহত ও দুঃখী মানুষের মুক্তির দিনটি পিছিয়ে যাবে।
আমার ভাইবোনেরা,
শেরে বাংলা আজপরোলোকে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আমাদের মাঝে নেই। যাঁরা প্রবীনতার দাবী করছেন, তাদের অধিকাংশই হয় ইতিমধ্যেই পশ্চিম পাকিস্তানের এক শ্রেনীর বাঙালী বিদ্বেষীদের নিকট নিজেদের বিকিয়ে দিয়ে তল্পীবাহকের ভূমিকা গ্রহন করেছেন; নয়তো নিষ্কর্মা, নির্জীব হয়ে পড়েছেন এবং অন্যের সলা-পরামর্শে বশীভুত হয়ে কথায় ও কাজে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন। আমি নিশ্চিত বুঝতে পারছি, ভাগ্য-বিপর্যস্ত মানুষের হয়ে আমাদেরকেই কথা বলতে হবে।তাদের চাওয়া ও পাওয়ার স্বার্থক রুপদানের দায়িত্ব আওয়ামী লীগকেই গ্রহন করতে হবে। এবং সে কঠিন দায়িত্ব গ্রহনে আমরা সম্পূর্ন প্রস্তুত। তার উপযোগী করেই আমাদের প্রিয় প্রতিষ্ঠান আওয়ামী লীগকে গড়ে তোলা হয়েছে। নিজেদের প্রান দিয়ে হলেও যদি এদেশের ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জীবন কন্টকমুক্ত করতে পারি, আগামী দিনগুলোকে সকলের জন্য সুখী, সুন্দর ও সমৃদ্ধিশালী করে তুলতে পারি এবং দেশবাসীর জন্যে যে কল্পনার নিকশা এতদিন ধরে মনের পটে এঁকেছিলাম – সে স্বপ্নের বাস্তব রুপায়নের পথ প্রশস্ত করে দুঃখের বোঝা বোঝা যদি কিছুটাও লাঘব করে যেতে পারি – তাহলে আমাদের সংগ্রাম স্বার্থক হবে।
আমার প্রিয় দেশবাসী,
আমি ক্ষমতার প্রত্যাশী নই। কারণ, ক্ষমতার চেয়ে জনতার দাবী আদায়ের সংগ্রাম অনেক বড়। এখন নির্বাচনের মাধ্যমে বক্তব্য পেশ ও দাবী আদায়ের দায়িত্ব যদি আমাদের উপর ন্যস্ত করতে চান তাহলে আমাদেরকে শক্তি সঞ্চয় করতে হবে। সে শক্তি হলো সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ। কারণ, এই সংখ্যাগরিষ্ঠতা হচ্ছে অধিকার আদায়ের চাবিকাঠি। তাই আমার জীবনের সুদীর্ঘ সংগ্রামের এই ঐতিহাসিক যুগসন্ধিক্ষনে দাঁড়িয়ে আপনাদের কাছে আমার একটি মাত্র আবেদন – বাংলাদেশের সকল আসনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীদেরকে ‘নৌকা’ মার্কায় ভোট দিন।
সংগ্রামী দেশবাসী,
সর্বশেষে, আমি ব্যক্তিগত পর্যায়ে আপনাদের কাছে কয়েকটি কথা পেশ করতে চাই। আপনারা জানেন ১৯৬৫ সালের ১৭ দিনের যুদ্ধের সময় আমরা বাঙালীরা কিরূপ বিচ্ছিন্ন, অসহায় ও নিরুপায় হয়ে পড়েছিলাম। বিশ্বের সাথে এবং দেশের কেন্দ্রের সঙ্গে প্রায় আমাদের সকল যোগাযোগ ও সম্পর্ক ভেঙে পড়েছিলো। অবরুদ্ধ দ্বীপের ন্যায় বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ কেবলমাত্র আল্লহর উপর ভরসা রেখে এক সীমাহীন অনিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছিল। তথাকথিত শক্তিশালী কেন্দ্রের প্রশাসনযন্ত্র বিশেষ ভৌগোলিক অবস্থানের কারনে সেদিনের সেই জরুরী প্রইয়োজনের দিনেও আমাদের নাগালের বাইরে ছিল। তাই আমার নিজের জন্য নয়, বাংলার মানুষের দুঃখের অবসানের জন্য ১৯৬৬ সালে আমি ৬-দফা প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলাম। এই দাবী হচ্ছে আমাদের স্বাধীকার, স্বায়ত্বশাসন ও আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আদায়ের দাবী; অঞ্চলে অঞ্চলে যে বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে তার অবসানের দাবী। এই দাবী তুলিতে আমি নির্যাতিত হয়েছি।একটার পর একটা মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে আমাকে হয়রানী করা হয়েছে। আমার ছেলেমেয়ে, বৃদ্ধ পিতা-মাতা ও আপনাদের কাছ থেকে আমাকে ছিনিয়ে নিয়ে কারাগারে আটকে রাখা হয়েছিল। আমার সহকর্মীদেরকেও একই অন্যায়-অত্যাচারের শিকার হতে হয়েছে। সেই দুর্দিনে পরম করুনাময় আল্লাহর আশীর্বাদস্বরুপ আপনারাই কেবল সাথে ছিলেন।
কোন নেতা নয়, কোন দলপতি নয়, আপনারা – বাংলার বাংলার বিপ্লবী, ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক ও সর্বহারা মানুষ রাতের অন্ধকারে কারফিউ ভেঙে মনু মিয়া, আসাদ, মতিয়ুর, রুস্তম, জহুর, জোহা, আনোয়ারের মতো বাংলাদেশের দামাল ছেলেমেয়েরা প্রাণ দিয়ে আন্দোলন গড়ে তুলে আমাকে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কবল থেকে মুক্ত করে এনেছিলেন। সেদিনের কথা আমি ভুলে যাইনি, জীবনে কোনদিন ভুলবো না, ভুলতে পারবো না। জীবনে আমি যদি একলাও হয়ে যাই, মিথ্যা আগরতলা ষড়যন্ত্র মমলার মত আবার যদি মৃত্যুর পরোয়ানা আমার সামনে এসে দাঁড়ায়, তাহলেও আমি শহীদের পবিত্র রক্তের সাথে বেইমানী করবো না। আপনারা যে ভালোবাসা আমার প্রতি আজও অক্ষুন্ন রেখেছেন, জীবনে যদি কোনদিন প্রয়োজন হয় তবে আমার রক্ত দিয়ে হলেও আপনাদের এ ভালোবাসার ঋণ পরিশোধ করবো।
প্রিয় ভাইবোনেরা,
বাংলার যে জননী শিশুকে দুঃখ দিতে দিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে তেজগাঁর নাখালপাড়ায় মারা গেল, বাংলার যে শিক্ষক অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গনে ঢলে পরলো, বাঙলার যে শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তুলতে গিয়ে জীবন দিলো, বাঙলার যে ছাত্র স্বাধীকার আন্দোলনের সংগ্রামে রাজপথে রাইফেলের সামনে বুক পেতে দিলো, বাঙলার যে সৈনিক কুর্মিটোলার বন্দী শিবিরে অসহায় অবস্থায় গুলীবিদ্ধ হয়ে শহীদ হলো, বাঙলার যে কৃষক ধানক্ষেতের আলের পাশে প্রাণ হারালো – তাদের বিদেহী অমর আত্মা বাংলাদেশের পথে-প্রান্তরে ঘরে-ঘরে ঘুরে ফিরছে এবং অন্যায় অত্যাচারের প্রতিকার দাবী করছে। রক্ত দিয়ে, প্রাণ দিয়ে যে আন্দোলন তাঁরা গড়ে তুলেছিলেন, সে আন্দোলন ৬-দফা ও ১১-দফার। আমি তাঁদেরই ভাই।আমি জানি ৬-দফা ও ১১-দফা বাস্তবায়নের পরই তাদের বিদেহী আত্মা শান্তি পাবে। কাজেই আপনারা ওয়ামী লীগের প্রতিটি প্রার্থীকে ‘নৌকা’ মার্কায় ভোট দিয়ে বাংলাদেশের প্রতিটি আসনে জয়যুক্ত করে আসেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, যে জালেমদের ক্ষুরধার নখদন্ত জননী বঙ্গভূমির বক্ষ বিদীর্ণ করে তার হাজারো সন্তানকে কেড়ে নিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমরা জয়যুক্ত হবো।
শহীদের রক্ত বৃথা যেতে পারে না। ন্যায় ও সত্যের সংগ্রামে নিশ্চয়ই আল্লাহ আমাদের সহায় হবেন।
জয় বাংলা।। পাকিস্তান জিন্দাবাদ।
নিবেদক-
আপনাদেরই
শেখ মুজিবুর রহমান।
আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় নির্বাচনী দফতর ৫১, পুরানা পল্টন, ঢাকা হইতে আব্দুল মতিন কর্তৃক প্রকাশিত ও পাইওনিয়ার প্রেস, ঢাকা হতে মূদৃত।