শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর হামলার প্রতিবাদে এবং আন্দোলনের সমর্থনে বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় | লেখক স্বাধিকার সংরক্ষণ কমিটির প্রচারপত্র | ১৪ই জানুয়ারী, ১৯৬৯ |
চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর হামলার প্রতিবাদে
১৫ই জানুয়ারীর সভা ও মিছিলে
দলে দলে যোগদান করুন
চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা মানুষের একটি মৌলিক অধিকার। সকল উন্নত জাতির বিকাশের মূলেই রয়েছে এই অধিকারের নিশ্চয়তা। সে কারণেই প্রতিটি উন্নতিকামী স্বাধীন জাতিই চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে প্রাণেরও অধিক মূল্যবান বলে মনে করেন এবং তা সংরক্ষণের জন্য কোন ত্যাগ স্বীকারে দ্বিধাগ্রস্ত হন না। পক্ষান্তরে এও লক্ষণীয় যে, কোন জাতিকে দাবিয়ে রাখতে চাইলে তাদের শাসকবর্গ জাতির চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে কেড়ে নিতে এমন ষড়যন্ত্র নেই যার জাল বিস্তার করতে ইতস্ততঃ বোধ করেন, এমন কোন সরকারী মাধ্যম নেই যার সাহায্য সক্রিয় হয়ে উঠতে সামান্যতম দ্বিধাবোধ করেন। আমাদের বেলাতেও বিগত বাইশ বছরের ইতিহাসে দেখা গেছে সরকার স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত বিশেষ করে এই প্রদেশের জনসাধারণের কন্ঠ রোধ করা এক প্রধান নীতি হিসাবে অনুসরণ করে চলেছেন। কুখ্যাত প্রেস ও পাব্লিকেশনস্ অর্ডিন্যান্স জারী করে সংবাদপত্রের প্রকাশ বন্ধ করে দেওয়ার যে স্বেচ্ছাচারী নজির স্থাপন করা হয়েছে, তা শুধু বৃটিশের শাসন নীতির সঙ্গেই তুলনীয় হতে পারে। এই অর্ডীন্যান্স জারী করার পূর্বেই স্বাধীনতা লাভের পরপরেই পূর্ব বাংলার সংবাদপত্রের প্রকাশ বন্ধ করা হয়েছে এবং আজ পর্যন্ত প্রকাশনা ক্ষেত্রে সরকারী বিধিনিষেধের খাঁড়া সমানভাবে ঝুলে রয়েছে। এ ছাড়াও রয়েছে সংশ্লিষ্ট দফতরের যে কোন কর্মচারীর মাধ্যমে লিখিতি, অলিখিত যে কোন উপায়ে ‘প্রেস উপদেশ’ ও সংবাদ বিশেষের ওপর ‘এমবার্গো’ জাতীয় ব্যবস্থার সাহায্যে জনমতের স্বাধীনতার ওপর হামলা। অন্যদিকে জনসাধারণের অর্থে পরিচালিত রেডিও এবং টেলিভিশন সরকার সম্পূর্ণরুপে নিজস্ব প্রচারযন্ত্ররুপে কুক্ষিগত করে রেখেছেন। সকলের স্বাধীন মতামত প্রকাশের সুযোগ রেডিও, টেলিভিশনে তো নেই-ই, এমন কি এইসব প্রচারযন্ত স্বাধীনভাবে শব্দও ব্যবহার করা যায় না। বেসরকারী সংবাদপত্রের ওপরও এ ধরনের জুলুম প্রতিনিয়ত অব্যাহত রয়েছে এবং প্রতি মুহূর্তে এ- সবের সঙ্গে সংগ্রাম অথবা আপোষ করে তাদের টিকে থাকতে হচ্ছে। যেখানে আপোস আর সম্ভব হয় না সেখানে সরকারী বিজ্ঞাপন কমানো বা বন্ধ করার চাপ সৃষ্টি থেকে শুরু করে সাংবাদিক, সাহিত্যিকদের কারারুদ্ধ করা এবং অবশেষ কাগজ বন্ধ করা পর্যন্ত স্বৈরাচারী পদক্ষেপের কোনটাই প্রয়োগ করতে সরকারকে কখনো দ্বিধাগ্রস্ত হতে দেখা যায়নি। এই ধরনের কাজে সহায়তার জন্যে জাতীয় পুনর্গঠন ব্যুরো (———–) প্রভৃতি সংস্থার সাংস্কৃতিক গোয়েন্দাগিতিও অব্যাহত রাখা হয়েছে। এ দেশের চিন্তা ও মত প্রকাশ পরিস্থিতির রি হলো একদিকের চিত্র।
এরই পাশাওয়াশি রয়েছে গ্রন্থ প্রকাশের ওপর সরকারের ধারাবাহিকভাবে অনুসৃত দমননীতি। স্বাধীনতার পর এ প্রদেশে সরকার যে একে একে কত বই বাজেয়াপ্ত করেছেন তার হিসাব নেই। বিশেষ করে সম্প্রতি সেই কুখ্যাত প্রেস ও পাবলিকেশনস-এর কালাকানুনের সাহায্যেগ্রন্থ বিশেষের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারী করে, কারণ দর্শানোর নোটিশ জারী এবং কোন বই আটক ও বাজেয়াপ্তকরণের মাধ্যমে সরকার নতুনভাবে চিন্তা ও মত প্রকাশের কন্ঠরোধে তৎপর হয়ে উঠেছেন। এই হামলার হিড়িক আইয়ুবী আমলের স্বৈরাচারকেও ছাড়িয়ে গেছে। এ অবস্থার ফলে কেবল যে লেখকদের স্বাধীনভাবে লেখার উৎসাহ দমিত হচ্ছে তাই নয়, প্রকাশকরাও বই প্রকাশে নিরুৎসাহ হয়ে পড়েছেন এবং ফলে সংস্কৃতির জগতে নেমে আসছে চরম বন্ধ্যাত্ব। বস্তুতঃ স্বৈরাচারী শাসকবর্গের নিকটও একটি জারিকে অবদমিত রাখার জন্যে এটাই হলো সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা। যখন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে, ঠিক সেই মুহূর্তেই চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর এই পরিকল্পিত হামরলার ব্যাখ্যা কি? এই অসঙ্গতির মূল কথায়?
তাই এ মুহূর্তে লেখকদের স্বাধিকার সংরক্ষণ এবং চিন্তা ও মত প্রকাশের ওপর যে কোন প্রকারের হামলার প্রতিরোধে প্রতিটি নাগরিককে সচেতন ও ঐক্যবদ্ধ হতে আমরা আহ্বান জানাচ্ছি। শেষবারের মতো এই সত্য প্রতিষ্ঠিত করা আজ অপরিহার্য হয়ে উঠেছে যে, আমরা স্বাধীন জাতি এবং আমাদের চিন্তা ও মত প্রকাশের মৌলিক অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ। আমরা যে কোন মূল্যে প্রতিরোধ করব এবং এই অনাচারকে আমরা কিছুতেই কায়েম থাকতে দেব না।
সভার স্থানঃ বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণ
১৫ই জানুয়ারী, বিকাল ৩টা
সভাপতিঃ ডক্টর এনামুল হক
বক্তৃতা করবেনঃ শিল্পী জয়নুল আবেদিন, ডোক্টর আহমদ শরীফ, বেগম সুফিয়া কামাল, সিকান্দার আবু জাফর, কে.জি. মোস্তফা, রণেশ দাশগুপ্ত, শহীদুল্লাহ কায়সার, অধ্যাপক মনসুরউদ্দীন প্রমুখ। লেখক স্বাধিকার সংরক্ষণ কমিটির পক্ষ থেকে প্রচারিত ও সমকাল মুদ্রায়ন থেকে মুদ্রিত