জয় বাংলা
(কথিত স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের প্রচারপত্র)
[অক্টোবর ১৯৭০]
সাধারণ নির্বাচন অত্যাসন্ন।
এই নির্বাচন ক্ষমতা দখলের জন্য নয়, বরং বাংলার মানুষের ভাগ্য নির্ধারণের একমাত্র পরীক্ষা। আর সে পরীক্ষার ভিত্তি হলাে ঐতিহাসিক ৬ দফা ও ১১ দফা।
এই নির্বাচনকে গণভােট হিসেবে ঘােষণা করা হয়েছে। গণভােটের অর্থ কেবল ক্ষমতাসীন পরিষদের ৩০০ জনের মধ্যে ১৫০ জনের অধিক সংখ্যাগরিষ্ঠতাই নয়, তার সঙ্গে সারা দেশের মােট ভােটের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠতাও বটে। তাহলেই সে সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে জাতির পক্ষ থেকে রায় বলে গণ্য করা হবে। এ ক্ষেত্রে ছাত্রসমাজ তথা যুবসমাজের দায়িত্ব সবচেয়ে অধিক, কারণ আমাদের মতাে অনুন্নত দেশে ছাত্ররাই সবচেয়ে বেশি প্রগতিবাদী ও সংগ্রামী। সে জন্যই সাধারণ মানুষের কাছে ছাত্ররা শ্রদ্ধার পাত্র।
প্রত্যেক ছাত্রকে নিজ দায়িত্বে অত্যন্ত স্পষ্ট ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সতর্কতার সঙ্গে অগ্রসর হতে হবে।
প্রত্যেক ছাত্রের কর্তব্য নিম্নরূপ :
ক. প্রত্যেককে নিজ নিজ থানা কার্যক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিতে হবে।
খ. সমকক্ষ একাধিক ছাত্র এক থানার অধিবাসী হলে সহযােগিতার মধ্য দিয়ে একই থানায় কাজ করতে হবে।
গ. প্রতিটি সভা-সমিতি ও কর্মিসভায় যােগ দিয়ে স্বীয় মতামত ব্যক্ত করতে হবে।
ঘ. কেবল বক্তৃতা বা বিবৃতির মধ্যে কাজকে সীমাবদ্ধ না রেখে আন্দোলন-উৎসাহী কর্মী সৃষ্টি করতে হবে।
ঙ. উৎসাহী কর্মীদের নিয়ে রীতিমতাে রাজনৈতিক আলাপ-আলােচনা, আন্দোলনের গতিধারা আপসমূলক মনােভাব সৃষ্টির পরিবর্তে সংগ্রামী মনােভাবের অনুপ্রেরণা, সর্বোপরি ভবিষ্যৎ আন্দোলন সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য থানাভিত্তিক ও গ্রামভিত্তিক কর্মীদের নিয়ে একটি সাংগঠনিক রূপ দিতে হবে। এই সংগঠন কেবল আন্দোলন পরিচালনার জন্যই গঠন করতে হবে।
চ. এই সংগঠন সর্বদা ঢাকা থেকে ঘােষিত বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করবে।
এই সংগঠনের দায়িত্ব নিম্নরূপ
ক. ছাত্রদের মধ্যে ব্যাপক তৎপরতার দ্বারা আদর্শ ও আন্দোলনের প্রতি ছাত্রদের অনুপ্রাণিত করবে।
খ. গ্রামে গ্রামে কৃষকদের মধ্যে রাজনৈতিক আলাপ-আলােচনা, কৃষকদের সমস্যাভিত্তিক আলােচনা ও সমাধানের রূপরেখা নির্ধারণ করে এবং কৃষকদের সংগঠিত করার চেষ্টা করবে।
গ. শ্রমিকদের মধ্যে অনুরূপভাবে আলােচনা করবে ও শ্রমিকদের সংগঠিত করবে।
ঘ. শিক্ষিত সমাজের মধ্যে, অর্থাৎ শিক্ষক, বিভিন্ন অফিসের কর্মচারী, উকিল মােক্তারদের মধ্যেও রাজনৈতিক আলাপ-আলােচনা করবে।
ঙ. প্রতিটি স্কুলের কমপক্ষে একজন শিক্ষককে আদর্শে অনুপ্রাণিত করে সে অঞ্চলের দায়িত্ব অর্পণ করতে হবে।
চ. বেকার যুবকদের সংগঠিত করতে হবে।
ছ, প্রয়ােজনীয় প্রচারপত্র ও প্রাচীরপত্র বিলি করবে।
সংগঠন নিম্নরূপভাবে গড়তে হবে
ক. প্রতিটি থানায় ৫, ৭ বা ৯ সদস্যবিশিষ্ট যুবকদের নিয়ে কমিটি গঠিত হবে। এই কমিটি সমগ্র থানার দায়িত্বভার পালন করবে।
খ. থানা কমিটির তত্ত্বাবধানে প্রতিটি ইউনিয়নে ৩, ৫ বা ৭ সদস্যের কমিটি গঠন করতে হবে।
গ. থানা ও ইউনিয়ন কমিটির তত্ত্বাবধানে প্রতিটি গ্রামে এক বা একাধিক যুবককে গ্রামের দায়িত্ব দিতে হবে।
ঘ. এই কমিটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের, অর্থাৎ ৭ ডিসেম্বরের আগে অবশ্যই গঠিত হতে হবে।
উল্লিখিত গঠিত কমিটির প্রতি নির্দেশ
ক. জাতীয় পরিষদে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও যেকোনাে কারণে ৬ দফা ও ১১ দফাভিত্তিক শাসনতন্ত্র প্রণীত না হলে বাঙালির মুক্তি আন্দোলনই হবে পরবর্তী কর্মসূচি এবং পশ্চিমা শাসক ও শােষকগােষ্ঠীর সঙ্গে সেখানেই প্রত্যক্ষ সংগ্রাম শুরু।
খ. সে সংগ্রাম নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন হিসেবে শুরু হলেও পরবর্তীকালে অসহযােগ, ট্যাক্স বন্ধ, পণ্য বর্জন ইত্যাদি আন্দোলনে পরিণত হবে এবং আরও পরে রক্ত দেওয়া ও রক্ত নেওয়ার পর্যায়ে উপনীত হবে। সে জন্য প্রত্যেককে মানসিক ও দৈহিক দিক থেকে প্রস্তুত থাকতে হবে।।
গ. ৬ দফা ও ১১ দফাভিত্তিক শাসনতন্ত্র প্রণীত হলেও বাংলা ও বাঙালির স্বাধীন সত্তা প্রতিষ্ঠার জন্য অনুরূপভাবে এগিয়ে যেতে হবে।
ঘ. পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জিত না হলে বাংলা ও বাঙালির মুক্তিসংগ্রাম ঘােষণা করা ছাড়া অন্য কোনাে পথ থাকবে না।
কেন নির্বাচন চাই
ক. জাতীয় পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার দ্বারা প্রমাণ করতে হবে, বাংলার মানুষ একবাক্যে ৬ দফা ও ১১ দফার পক্ষে।
খ. সংখ্যাগরিষ্ঠতা সত্ত্বেও ৬ দফা ও ১১ দফা পশ্চিমা শাসকগােষ্ঠী স্বীকার না করলে দেশবাসী জনসাধারণের কাছে স্পষ্ট হবে যে পশ্চিমারা বাঙালিকে গােলাম হিসেবে শাসন করতে চায় এবং দেশবাসী বুঝবে যে সে ক্ষেত্রে বাঙালির মুক্তিসংগ্রামই একমাত্র খােলা পথ।
গ. বিশ্বের মানুষ ও বিদেশি রাষ্ট্রগুলাে বুঝবে যে সংখ্যাগরিষ্ঠের রায় না মানার অর্থ বাংলার সাত কোটি মানুষকে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে রাখা। এবং সে ক্ষেত্রে বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের প্রতি সমর্থনদান করতে বিদেশি রাষ্ট্রগুলাে নীতিগতভাবে বাধ্য। বর্তমান বিশ্বে বিশ্বজনমতের সমর্থন ছাড়া মুক্তিসংগ্রাম প্রায় অসম্ভব।
ঘ. নির্বাচন অর্থ, জনমত অর্থ, নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন ব্যর্থ হলে অনিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন শুরু করা যায়। এ ক্ষেত্রে অনিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতি দেশবাসীর যে সমর্থন তা স্বপ্রমাণিত। আমরা বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে লিপ্ত, অর্থাৎ বাংলা ও বাঙালির সার্বিক মুক্তি আন্দোলন—এই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মূল বক্তব্য চারটি :
১. বিশ্বের মানচিত্রে ৫৬ হাজার বর্গমাইলবিশিষ্ট একটি আবাসভূমির স্বীকৃতি।
২. সাত কোটি মানুষের বাঙালি জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা এবং বাংলার কৃষ্টি| সংস্কৃতি, সাহিত্য ও সভ্যতার পরিপূর্ণ বিকাশ।
৩. সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির রূপরেখা নির্ণয়।
৪. প্রতিটি মানুষের জাগ্রত গণতান্ত্রিক চেতনাবােধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।
ওপরে বর্ণিত আদর্শ কর্মসূচি ও সংগঠন মােতাবেক সারা দেশে আগামী দিনের সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে এবং এ দেশে বর্তমানে প্রতিটি জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক সংগঠন, ছাত্রসংগঠন ও শ্রমিক সংগঠনের নির্দেশে আন্দোলন পরিচালনা করতে হবে।
জাতীয় নেতার প্রতি অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস, আদর্শের প্রতি অবিচল নিষ্ঠা, সর্বোপরি দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রত্যেক কর্মীকে মুক্তিযােদ্ধা হিসেবে সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হবে।
শত প্রতিবন্ধকতা, লােভ-লালসা, আত্মকলহ, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব দূর করে এগিয়ে যেতে হবে। মনে রাখতে হবে, ‘জয় বাংলা’ আমাদের ধ্যানধারণা, জয় বাংলা’ কেবল একটি স্লোগান নয়, ‘জয় বাংলা একটি আদর্শ। ‘জয় বাংলা’ আমাদের মূল উৎস। ‘জয় বাংলা’ আমাদের চলার পথের শেষ প্রান্ত। জয় বাংলা।