বাংলার বাণী
ঢাকা: শনিবার ১২ই ফাল্গুন, ১৩৭৯ ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩
রাজায় রাজায় যুদ্ধ করে
লিবিয়ার একটি ৭২৭ বোয়িং বিমান। একশ’চারজন যাত্রী নিয়ে যাচ্ছিল ত্রিপলী থেকে বেনগাজি। তারপর শেষ গন্তব্যস্থল কায়রো। একুশে ফেব্রুয়ারি। স্থানীয় সময় বেলা সোয়া দু’টায় বিমানটির কায়রো পৌঁছার কথা। অথচ বিমানটি শেষ পর্যন্ত পৌঁছতে পারল না। সিনাই মরুভূমির উত্তরে বরদইল হ্রদের ওপর উড়ন্ত বিমাটির ফরাসি ক্যাপ্টেন কাররোর কন্ট্রোল টাওয়ার এর সাথে যোগাযোগ করেন। ক্যাপ্টেন জানান ইসরাইলি জঙ্গি বিমান গুলি তার বিমানের পশ্চাতে ধাওয়া করে আসছে। ঠিক পর মুহূর্তে ক্যাপ্টেন জানান তার বিমানে রকেটের আঘাত লেগেছে। তারপর বিমানটির সঙ্গে সকল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সবশেষ। বিমানটির চুরানব্বই জন যাত্রী নিহত। বাকি দশজন গুরুতর আহত।
সরাইলী জঙ্গি বিমানের রকেটের আঘাতে বিধ্বস্ত হলো লিবিয়ার অসামরিক যাত্রীবাহী বিমান। সারাবিশ্ব বিস্মিত। স্তম্ভিত। জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল ডঃ কুর্ট ওয়াল্ড হেইম এ ঘটনায় গভীর দুঃখ প্রকাশ করেছেন। বৃটিশ পররাষ্ট্র দফতর থেকে বলা হয় “এ ঘটনার নিন্দা করার ভাষা আমরা খুঁজে পাচ্ছিনা।” কানাডা সহ অন্যান্য দেশের সরকারও এ ঘটনার জন্যে দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
সারাবিশ্ব ক্ষুব্ধ ও ব্যথিত হলেও তেল আবিবের এক খবরে দাবি করা হয়, বিমানটি পালিয়ে যেতে চেষ্টা করলে জঙ্গী বিমানের পাইলটের বাধ্য হয়ে গুলি চালায়।
ইসরাইলি সরকারের বক্তব্য যে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো একটা কিছু এতে কোন সন্দেহ নেই। এ দুঃখজনক ঘটনা থেকে আবার একথাই প্রমাণিত হলো, রাজায় রাজায় যুদ্ধ করে উলু খাগড়ার প্রাণ যায়। কথায় বলে ভালোবাসা আর যুদ্ধে নাকি ন্যায়-নীতি বলে কোন কিছু নেই। সবার উপরে যুদ্ধ টাই হলো বড় কথা।
ইসরাইল যে ন্যাক্কারজনক ও মর্মান্তিক ঘটনার জন্ম দিয়েছে তার নিন্দা করার ভাষা আমরা খুঁজে পাচ্ছি না। গত বছরে মিউনিক অলিম্পিকে ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর বাহিনীর সদস্যরা বেশ কয়েকজন ইসরাইলী খেলোয়াড় কে হত্যা করার বিষয়ে বিশ্বের জনমত ইসরাইলের স্বপক্ষে গিয়েছিল। বিভিন্ন দেশের সরকার ও জনগণ সহানুভূতি ও সমবেদনা প্রকাশ করেছিলো। এমনকি একই ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর বাহিনীর সদস্যরা ব্যাংককে অবস্থিত ইসরাইলি দূতাবাসের নিরীহ নিরাপরাধ কর্মচারীদের আটক করাতে বিশ্বজনমত বিক্ষুব্ধ হয়েছিল। ইসরাইল অবশ্য বিশ্বজনমত আর বিবেক নিয়ে আদৌ মাথা ঘামায় না। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সাহায্য-সহযোগিতা জোরে ইসরাইল ক্ষমতার মদমত্ততায় অন্ধ। আর অন্ধ বলেই একটি অসামরিক বিমান কে গুলি করে ভূপাতিত করেছে ন্যায়নীতিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে।
ইজরাইলি ঘটনায় যে একক ঘটনা তাও নয়। বিশ্ব সর্বত্রই যেন একই নিরীহ-নিরপরাধ মানুষ হত্যার প্রতিযোগিতা চলছে। বিমান হাইজ্যাক, পত্রবোমা, দূতাবাস কর্মচারীদের হত্যা বা আটক এমনই আরো কত ঘটনাই ঘটছে অহরহ। ভিয়েতনামের নিরীহ-নিরাপরাধ জনসাধারণের ওপর নির্বিচারে বোমাবর্ষণ করে মার্কিন সরকার কারও চেয়ে কোন অংশে কম নয় তাই বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছেন।
বিশ্ব জনমতকে আজ তাই অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াবার জন্য সমবেতভাবে আওয়াজ তুলতে হবে। বলতে হবে সংকীর্ণ জাতীয় স্বার্থ অথবা সম্রাজ্যবাদী চক্রের পরিধি বিস্তারের জন্য নিরীহ নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা চলবেনা। রাজায় রাজায় যুদ্ধ করার যদি খায়েশ থাকে তারা সে খায়েস পূরণ করতে পারেন কিন্তু তাতে উলু খাগড়ারা কিছুতেই প্রাণ দেবে না। দিতে পারে না।
রেশন ডিলারদের কারচুপি
গতকাল বাংলার বাণীতে প্রকাশিত একটি চিঠিতে এই বলে অভিযোগ করা হয়েছে, রাজধানীর কোন একটি এলাকার রেশনের দোকানগুলোতে নাকি চাল থাকলে চিনি থাকে না, চিনি আছে তো তেল নেই, তেল থাকলে গম থাকে না এজাতীয় একটা অবস্থা বিদ্যমান।
অভিযোগকারী চিঠিতে যে বক্তব্য পেশ করেছেন তা যে শুধুমাত্র রাজধানীর একটি মাত্র এলাকাতেই হচ্ছে তার নয়, প্রায় সর্বত্রই একই অবস্থা। কিছুদিন আগেও এ নিয়ে লেখালেখি হয়েছে। সম্প্রতি সরবরাহ ব্যবস্থায় সামান্য এদিক-ওদিক হবার দরুন রেশন দোকান গুলোতে চাহিদা অনুযায়ী চাল সরবরাহ করা সম্ভব না হওয়াতে সাময়িকভাবে চালের যে সংকট দেখা দিয়েছিল তার অবসান হয় পরবর্তী সপ্তাহে। অথচ এই সামান্য ত্রুটি বিচ্যুতির সুযোগ নিয়ে রেশন ডিলাররা এক তুলকালাম কাণ্ড বাধিয়ে বসছিলেন। উদোর পিন্ডি বুদোর ঘাড়ে চাপিয়ে অনেকে আবার টুপাইস কামিয়েও নিয়েছেন। বর্তমানে ঠিক সেইরকম একটা অবস্থা না থাকলেও এটা নেই ওটা নেই এর ব্যাপারটি ঠিকই চলছে। এমনও দেখা যায় একই এলাকার রেশন দোকান গুলোতে এক দোকানগুলোতে কেরোসিন দেয়া হচ্ছে আর অন্য দোকানে কেরোসিন তেল নেই বলে রেশন কার্ড ধারীদের ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে। যারা রেশনের মাল তুলতে চান তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না এ রহস্যের কূল কিনারা করা। একদিকে এ অবস্থা অন্যদিকে ওজনের কারচুপি তো আছেই। রেশন দোকান থেকে মাল নিলে ওজনে কম হবেই এটা সতঃসিদ্ধ ব্যাপার। জনসাধারণ ও বাধ্য হয়ে এহেন ব্যাপারটিকে নিরুপায় হয়ে মেনে নিয়েছেন।
মাল সরবরাহে কারচুপি, ওজনে কম ছাড়াও রেশন ডিলার দের হাতে রয়েছে অনেক বেনামী কার্ড। যে কার্ডের সাহায্যে তারা ন্যায্যমূল্য মূল্যে মাল কিনে কালোবাজারে চালান করে থাকেন। মোদ্দাকথা হলো রেশন ডিলাররাও দুর্নীতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জনসাধারণের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছেন। এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বলবো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে কানে তুলো আর পিঠে কুলো বাঁধার সনাতনী কায়দা-কানুন কে পরিত্যাগ করে এগিয়ে আসতে। আর তাই যদি কতৃপক্ষ করেন তাহলে জিনিসপত্রের এই অগ্নিমূল্যের বাজারে রাজধানীর জনসাধারণ খানিকটা স্বস্তি বোধ করবেন বৈকি।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক