পাকিস্তানে আটক বাঙালী ও ভুট্টো-রাজনীতি
।। মুশতাক ইলাহী ।।
পাকিস্তানে আটক বাঙালীদের স্বদেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে আজ পর্যন্ত জাতিসংঘের কাছ থেকে তেমন কোন চাপ পরিলক্ষিত হচ্ছেনা। বাংলাদেশ সরকার এব্যাপারে জাতিসংঘ, মানবাধিকার সমিতি, রেডক্রস প্রভৃতি আন্তর্জাতিক সংগঠনের মাধ্যমে বিশ্ব বিবেকের কাছে পাকিস্তানে আটক বাঙালীদের স্বদেশে ফেরতদান এবং তাদের প্রতি নির্যাতনমূলক নীতি পরিহার করার জন্য পাকিস্তানী সামরিক জান্তার উপর চাপ সৃষ্টির আবেদন করেছেন। কিন্তু প্রতিবারই পাকিস্তানী সামরিক জান্তা বাংলাদেশে অবাঙালীদের প্রতি অন্যায়-আচরণ করা হচ্ছে বলে পাল্টা অভিযোগ তুলে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে রাখবার চেষ্টায় মেতে আছে। এমন কি কোন কোন মহলের ধারণা, পাকিস্তানের এককালীন বিশ্বস্ত বন্ধু জাতিসংঘের জনৈক কর্মকর্তার বাংলাদেশ আগমন এ ব্যাপারেই নেপথ্যে তদন্তকারীর ভূমিকা হিসাবে বিবেচনা করা চলে। অপর দিকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছেন কখন পাকিস্তানী প্রেসিডেন্ট ভুট্টো সাহেব এ সিদ্ধান্তে সবিশেষ গোস্বা জানিয়েছেন।
যুদ্ধবন্দীদের বিচার করাটা একটা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ব্যবস্থা। প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে যারা যুদ্ধাপরাধী হিসাবে পরিগণিত হয়েছে— যুদ্ধে জয়লাভ করে মিত্রবাহিনী তাদের বিচার করেছে এবং শাস্তি বিধানও করেছে। এমন কি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের দীর্ঘ ২২ বছর পরও নাৎসী জেনারেল হের আইখমানকে দক্ষিণ আমেরিকা থেকে গ্রেফতার করে তার বিচার করা হয়েছে। এ ব্যাপারে পূর্ব বা পশ্চিম জার্মানী সরকার আপত্তি তোলেন নাই। কিন্তু পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম ঘটানোর দাবী তোলার হেতু আমাদের কাছে খুব বেশী একটা বোধগম্য হচ্ছে না।
কারণ, এতদিন প্রতিটি পদক্ষেপ ও সিদ্ধান্তে বর্বর সামরিক জান্তা এক উগ্র মধ্যযুগীয় মনোভাব ও মানসিকতা প্রকাশ করে এসেছে। যুদ্ধবন্দী প্রশ্নেও তাদের এই নীতি সেই মানসিকতারই প্রকাশ ঘটিয়েছে। সভ্য সমাজের কোন দেশই অন্ততঃ অপরাধীদের আইনত বিচারের বিরোধিতা করেনি। এক্ষেত্রে ভুট্টোই মনে হয় এক ব্যক্তি যিনি অপরাধীদের পক্ষ সমর্থন করে তাদের আন্তর্জাতিক আইনসম্মত বিচার ব্যবস্থার বিরোধিতা করলেন। অদ্যাবধি ভুট্টো কি বলতে চান তা পরিষ্কার নয়। তবে এইটুকু বোঝা গেছে যে, ভুট্টো সাহেব পাকিস্তানে আটক অসামরিক ও নির্দোষ বাঙালীদের পরিবর্তে বাংলাদেশে নরক সৃষ্টিকারী তার পাষণ্ড যুদ্ধাপরাধী যুদ্ধবন্দীদের ফেরৎ চান। এটা যে ভুট্টো সাহেবের অন্যায় আবদার তা বুঝবার ক্ষমতা প্রতিটি বিশ্ববাসীরই আছে। কেননা, কোনদিন কোথাও অসামরিক আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার পরিবর্তে যুদ্ধ বন্দী সামরিক ব্যক্তিদের ফেরৎ দানে প্রসঙ্গ ওঠেনি। অন্য দেশের বিপুল সংখ্যক নাগরিককে আটকে রেখে দর কষাকষি করাটা যে কোন সভ্য দেশের বা সভ্য সমাজের নীতি বহির্ভূত কাজ। পাকিস্তানে আটক বাঙালীরা প্রয়োজনের তাগিদে বা পাকিস্তানী আমলে চাকরীর খাতিরে সে দেশে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। সামরিক ও অসামরিক বিভাগগুলো ছাড়াও ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষেত্রেও পাকিস্তানে বাঙালীর সংখ্যা নিতান্ত কম নয়। আজ তাঁরা সবাই এক সন্ত্রাসের রাজ্যে অনিশ্চিতের ভেতর জীবন যাপন করছেন। তাঁদের সেখানে আটক করার পেছনে পাকিস্তান সরকারের কোন যুক্তিযুক্ত কারণও নেই। স্বাভাবিকভাবেই আশা করা গিয়েছিল যে, বাংলাদেশে অবস্থানকারী অবাঙালীদের পরিবর্তে সে দেশ থেকে বাঙালীদের আনার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ভুট্টোর মতামত নেতিবাচক। তার কথায় বাংলাদেশে বসবাসকারী অবাঙালীরা সিন্ধি, বেলুচ, পাঠান, পাঞ্জাবী বা সোজা কথায় পাকিস্তানী নয়। বরং তারা ভারত থেকে আগত “ভারতীয়”। কাজেই তিনি তাদের পাকিস্তানে গ্রহণ করবেন না। ( এখানেও ভুট্টোর মানসিক বিভ্রান্তি প্রকাশ পায়। একদিকে তিনি যখন তখন বাংলাদেশের অবাঙালীদের প্রতি উৎকণ্ঠা প্রকাশ করছেন, অপরদিকে তাদেরকে তাঁর দেশের নাগরিক বলে গ্রহণ করতে তাঁর অনিচ্ছা।)
পাকিস্তান সৃষ্টির আমলে বহু উদ্বাস্তু অবাঙালী কর্মচারী, শিল্পপতি এমন কি নেতা ভারত ত্যাগ করে পাকিস্তানের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছিল। বাংলাদেশের ‘বিহারী’রা ও তাদের থেকে ব্যতিক্রম নয়। এমন কি স্বয়ং ভুট্টো সাহেবেই আইয়ুবী আমলে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালীন সময়েও ভারতের পাসপোর্টধারী ভারতীয় নাগরিক ছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছিল। তাঁর পিতা, প্রপিতামহ প্রমুখও ভারতীয়। এই সব কথা প্রকাশ পেয়েছিল আইয়ুব আমলেই— তাঁর অপর দোসর তথ্যমন্ত্রী শাহাবুদ্দিনের উক্তিতে।
আজ ভুট্টো সাহেব পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক প্রশাসক হয়ে সে কথা বিস্মৃত হয়েছেন মনে হয়। পাকিস্তানের নাগরিকরা এই কথাটি বিস্তৃত হয়নি বলে আমাদের বিশ্বাস। ভুট্টো যে অর্থে বাংলাদেশের অবাঙালীদের ‘ভারতীয়’ বলেছেন, কয়দিন পরেই পাকিস্তানীরাও সেই অর্থে জনাব ভুট্টোকে ‘ভারতীয়’ বলবে। সব কথার শেষ কথা হল— সময় থাকতে পাকিস্তানে আটক বাঙালীদের নিজ দেশে সুস্থ ও স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরৎ পাঠানোর ব্যবস্থা করা।
এদের সঙ্গে নরপিশাচ পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধী বিনিময়ের কোন প্রশ্নই ওঠে না। কারণ, পাকিস্তানে আটক বাঙালীরা কোন অর্থেই অপরাধী নয়। সুতরাং অপরাধীদের সঙ্গে তাদের বিনিময় চলতে পারেনা। অপরাধীদের বিনিময় হয় সাধারণতঃ অপরাধীদের সঙ্গেই। পাকিস্তানে আটক বাঙালীদের অপরাধীদের সমপর্যায়ভুক্ত করতে বাংলাদেশ সরকার রাজি নন।
এখন প্রশ্ন, পাকিস্তানে আটক বাঙালীরা কি তাহলে শীঘ্রই দেশে ফিরে তাদের পরিবার-পরিজনের সঙ্গে মিলিত হতে পারবেননা? আমরা দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে পারি, তারা পারবেন। পাকিস্তানে ভুট্টো রাজনীতি আজ বালুর চরায় আটকে গেছে। তার মাথার উপরে জল্লাদ টিক্কা খাঁ। পায়ের নীচে জনসমর্থনের মাটি সরে গেছে। ভুট্টো সাহেবের এখন ত্রিশঙ্কু অবস্থা। যে কোন সময় তিনি তাঁর সাধের ক্ষমতার তখতে তাউস থেকে পপাৎ ধরণীতল হতে পারেন।
ক্ষমতায় টিকে থাকার শেষ চেষ্টা হিসাবে ভুট্টো সাহেব লক্ষ লক্ষ বাঙালীকে জিম্মি করে রেখেছেন। কিন্তু এই জিম্মিদের ছেড়ে দিতে হবে। বাঙলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভুট্টো সাহেবকে যেমন পরাজয় স্বীকার করতে হয়েছে, কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধু কে মুক্তি দিতে হয়েছে, তেমনি অদূর ভবিষ্যতেই তাকে লক্ষ লক্ষ আটক বাঙালীকেও মুক্তি দিতে হবে। কারণ, পাকিস্তান আজ বিশ্ববাসীর কাছে শত অপরাধী অপরাধী, মানবতাদ্রোহের অভিযোগে অভিযুক্ত। অন্যদিকে ভুট্টো সাহেবের ক্ষমতার গদীও টলটলায়মান। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সরকারের দৃঢ়তার সামনে ভুট্টো বেশীদিন তাঁর গোঁ বজায় রাখতে পারবেন না। অন্যদিকে জাতিসংঘ ও বৃহৎ শক্তিবর্গ আটক বাঙালীদের মুক্ত করার ব্যাপারে সক্রিয় হলে ভুট্টো সাহেবকে আরো আগে গোঁফ নামাতে হবে।