You dont have javascript enabled! Please enable it! 1984.11.30 | বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির পুনরুত্থান | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ৩০ নভেম্বর ১৯৮৪ - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির পুনরুত্থান | ডঃ সৈয়দ আনোয়ার হোসেন

সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ৩০ নভেম্বর ১৯৮৪

বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন অশান্ত। মায়ামৃগ গণতন্ত্র (না ক্ষমতা?) রাজনৈতিক দল—উপদলের নিষ্ঠাবান দেশপ্রেমিক নেতা/কর্মীদের নিদ্রাহরণকারী। স্বাধীনতার পর এক যুগ পেরিয়ে গেলেও গণতন্ত্র আর রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা যেন বাংলাদেশ থেকে পলাতক। কেন এমন হলো? এমনটি হবার কথা তো ছিল না! একাত্তরের সংগ্রামী আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা শোষণ-বঞ্চনার আঁধার পেরিয়ে মুক্তির সোনালী দিনের আশায় বুক বেঁধেছিল। কিন্তু সোনালী দিন এলো না; এলো না শোষণ-বঞ্চনা থেকে মুক্তি।

বলা প্রয়োজন, এমনি অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একমাত্র দৃষ্টান্ত নয়। তৃতীয় বিশ্বের অন্যান্য ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের স্বাধীনতা পরবর্তী অভিজ্ঞতাও প্রায় এমনি। ঔপনিবেশিক আমলের ঐতিহ্য হিসেবে বিরাজমান ধন-বৈষম্য আরও ব্যাপক হয় স্বাধীন দেশের ক্ষমতাসীন সরকারের অনুসৃত ভ্রান্ত রাষ্ট্রীয় নীতির কারণে। ফলে অশান্ত-বিক্ষুব্ধ সমাজের রাজনীতিতে সমাজকে আলোড়িত করে প্রভাবিত করে এমনি বহু ব্যাপক প্রশ্নে ঐক্যমত প্রতিষ্ঠা হয়ে ওঠে সুদূরপরাহত। সেই কারণে গড়ে ওঠে বহু-বিভিন্ন রাজনৈতিক মত ও দল। বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলের সংখ্যা বোধহয় শতের ঘরে পৌঁছেছে। এবং একই কারণে বাংলাদেশের মত তৃতীয় বিশ্বের অন্যান্য ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলিতে রাজনৈতিক সমস্যা-সংঘাতের বা ক্ষমতার লড়াইয়ের মীমাংসা হয় সহিংস্র পদ্ধতি; গণতান্ত্রিক উপায়ে নয়। রাজনীতিতে অস্ত্র আর বুলেট-এর ভূমিকা সদা সক্রিয়। এমনি বিভিন্নতর কারণের প্রভাবে তৃতীয় বিশ্বের রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা অত্যন্ত দুর্লভ বস্তু। গত ১২ বছরে বাংলাদেশে ক্ষমতার হাত বদল হয়েছে আটবার (মুজিব, মোশতাক, খালেদ মোশাররফ, সায়েম, জিয়া, সাত্তার এবং এরশাদ)। এবং উল্লেখ্য যে, এদের মধ্যে দু’জন ক্ষমতা থেকে অপসারিত হয়েছেন নৃসংশ হত্যার মাধ্যমে।

বাংলাদেশের এমনি রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আরো জটিল হয়েছে এককালের স্বাধীনতা বিরোধী ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর সুযোগ সন্ধানী ভূমিকার ফলে। স্বাধীনতার লগ্নে বা তার কিছুদিন পর পর্যন্ত মনে হয়েছিল এদেশে ধর্মের নামে রাজনীতি বা রাজনৈতিক কারণে ধর্মের ব্যবহারের দিন শেষ হয়েছে। ক্ষমতাসীন সরকারের প্রাথমিক নীতি ও কর্মকান্ড সে বিশ্বাসকেই দৃঢ় করেছিল। কিন্তু বেশিদিন স্থায়ী হয়নি এমন পরিবেশ-পরিস্থিতি। রাজনৈতিক অঙ্গনের বিশৃংখলার সুযোগে এবং অন্যান্য অনুকূল পরিস্থিতির আড়ালে ধর্মের মুখোশধারী রাজনীতির পুনরার্বিভাব ঘটেছে। কেন এং কি করে এ ঘটনাটি ঘটলো তার আলোচনায় এখন আমরা যাবো।

বাংলায় ইসলাম : তেরো শতক থেকে পাকিস্তানী আমলঐতিহাসিক পটভূমি

বাংলায় ইসলাম ধর্মের প্রথম প্রচারক ছিলেন সুফী সম্প্রদায়; অসির মাধ্যমে যে ইসলাম, তা এসেছে অনেক পরে। আর সে কারণেই বাংলাদেশে ইসলামের প্রকৃতিতে প্রথম থেকেই গড়ে উঠেছে সুফীবাদের মানবমুখীন চেতনা। এ চেতনা কট্টর ইসলামী বিধি-বিধান থেকে ভিন্নতর। ফলে সনাতন শরিয়তী ইসলাম কোনদিনই আপামর বাঙালী মুসলমানের মানস প্রকৃতিতে গভীরভাবে স্থান করে নিতে পারেনি। এছাড়া ভৌগোলিক প্রেক্ষিতে মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামী কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল অনেক দূরে। ফলে মধ্যপ্রাচ্য সংলগ্ন অন্যান্য মুসলিম অধ্যূষিত এলাকাগুলোর চেয়ে এদেশের মুসলমানদের ধর্মীয় চেতনা তুলনামূলকভাবে কম প্রখর ছিল।

অপরদিকে যে ভূ-খন্ডটি বর্তমানে পাকিস্তান নামে পরিচিত তার বেশিরভাগই মুসলমানরা পদানত করেছিল প্রথমত অসির মাধ্যমে। প্রথমে রাজনৈতিক বিজয় এবং পরে হয়েছিল ইসলাম ধর্মের প্রচার। অর্থাৎ বাংলাদেশের ঠিক উল্টো ব্যাপারটি ঘটেছিল পাকিস্তানের ক্ষেত্রে। মুসলিম প্রশাসক ও সৈনাধ্যক্ষবৃন্দ প্রথম থেকেই সেখানে এমন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন যার ভিত্তি ছিল শরিয়ত। ফলে অসির ছত্রছায়ায় যে ইসলামের প্রবর্তন হয়েছিল, তা ছিল কট্টর এবং ইসলামী বিধি-বিধানের একনিষ্ঠ অনুসারী। মধ্যপ্রাচ্য সংলগ্ন ভৌগোলিক অবস্থানের ফলে এমনি ধরনের ইসলামী ব্যবস্থা ও চেতনা সহজাতভাবেই গড়ে উঠতে থাকে।

বৃটিশ ভারতে মুসলিম সমাজ ক্রমেই দুর্বল হতে থাকে। তবে ভারতের সব এলাকায় সমানভাবে এই দুর্বলতার লক্ষণ পরিস্ফূট হয়নি। বাংলাদেশে এই লক্ষণের প্রকাশ তুলনামূলকভাবে চতুতর ছিল। কারণ, আঠারো শতকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী প্রথমে এখানেই বৃটিশ ভারত সাম্রাজ্যের সূচনা করে। ক্ষমতার হাত বদল হয়েছিল শাসক মুসলিম সম্প্রদায় থেকে বৃটিশ বনিকদের কাছে। কাজেই নতুন বৃটিশ শাসকবর্গ এই এলাকার ক্ষমতায় উত্তরসূরী মুসলমানদের সব সময়ে সন্দেহের চোখেই দেখতো। কাজেই সুপরিকল্পিতভাবে এবং সামগ্রিক বিচারে মুসলমান বিরোধী ইংরেজ নীতি অনুসরণ করা হতে থাকে। কাজেই বাংলার মুসলমান সমাজ দ্রুত অবক্ষয় ও পতনের দিকে এগিয়ে যায়।

এ সময়েও পাকিস্তানে ঘটেছিল অন্য রকম ঘটনা। এই এলাকায় বৃটিশ শাসনের বিস্তৃতি ঘটেছিল ঊনিশ শতকে; এবং এমন একটি সময়ে যখন সরকারীভাবে মুসলিম বিরোধী নীতির অবসান হয়েছিল। ১৮৫৭-র সিপাহী বিদ্রোহ ইংরেজ শাসকদের নীতি এই পরিবর্তন এনেছিল। উপরন্তু পাকিস্তানের এই ভূ-খন্ডকে বৃটিশ ভারত সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত করার পেছনে সামরিক ও ‘স্ট্র্যাটেজিক’ কারণ দায়ী ছিল। এর ফলেই দেখা যায় যে বাংলার সমাজ সংস্কৃতিতে ঔপনিবেশিক হস্তক্ষেপ যত ব্যাপক ছিল পাকিস্তানে তা হয়নি। এমনকি মোটেই ছিল না বললেই চলে। পাকিস্তান ও বাংলায় মুসলমানদের প্রতি ঔপনিবেশিক শাসকের অনুসৃত নীতির বিভিন্নতার কারণে ভিন্ন ধরনের সামাজিক ফল সৃষ্টি হয়েছিল। যেমন, বাংলায় মুসলিম সমাজ ইংরেজদের নেতিবাচক নীতির কারণে দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে পড়ে। অপর পক্ষে পাকিস্তানের মুসলিম সমাজ প্রায় অক্ষত থেকে যায়। আর ধর্মীয় ফলাফলের বিচারে দেখা যায় যে, পাকিস্তানে ইসলামী চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গি সনাতন শক্তি নিয়ে বিরাজ করতে থাকে; কিন্তু বাংলায় ইসলামী ঐতিহ্য ম্রিয়মান হতে থাকে; এমনকি ঊনিশ শতকে বাংলার মুসলমান সমাজে ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার সূচনাও হয়।

পাকিস্তানে সনাতন ইসলামী ভাবধারার অটুট অবস্থা এবং বাংলায় এই ভাবধারায় বিপর্যয়ের পেছনে ভাষারও কিছু ভূমিকা ছিল। ঊনিশ শতকে ইংরেজী ভাষা প্রবর্তনের পর ফরাসী ও আরবী ভাষার বিলোপ হয়। একই সময়ে দেখা যায় স্থানীয় ভাষা হিসেবে উর্দু ও বাংলার ব্যাপক ব্যবহার। এই দুটো ভাষায় যে সাহিত্য রচিত হয়েছিল তা বক্তব্য বিষয় ও ভাবরীতিতে ছিল পরস্পর থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। উল্লেখ্য যে, বাংলা ভাষা ঊনিশ শতকে হিন্দু সমাজের, পুনর্জাগরনের বাহন ছিল, মুসলমানদের নয়। বাংলা সাহিত্য রচনায় বাঙালী হিন্দুদের প্রাধান্য লক্ষণীয়। এর ফল হলো এই যে বাংলার মুসলমান বিগত দিনের ইসলামী ভাষা ফার্সী বিসৃত হলো, অপর দিকে যে বাংলা ভাষা চর্চা করতে শুরু করলো তা হিন্দু বা ধর্মনিরপেক্ষ ভাবধারা সম্বলিত ছিল।

অপরদিকে উর্দু প্রথম থেকেই ইসলামী ভাবধারা সম্বলিত ভাষা ছিল। ঊনিশ শতকের উর্দু রচনায় ইসলামী চেতনা পরিস্ফূট। উর্দুর সঙ্গে ইসলামী চেতনার এত গভীর সম্পর্কের কারণে বর্তমান পাকিস্তানের যে উদারপন্থী/ধর্মনিরপেক্ষ রচনা, তার বেশির ভাগই ইংরেজীতে। কাজেই উর্দু ভাষার ব্যবহারের মাধ্যমেও পাকিস্তানে ইসলামী ঐতিহ্য অক্ষুন্ন থাকে। কিন্তু বাংলায় ইংরেজী ও বাংলা ভাষার প্রচলনের ফলে পাশ্চাত্যমুখীন এবং ধর্মনিরপেক্ষ ভাবধারার ব্যাপক প্রসার হয়।

ওপরের সংক্ষিপ্ত বর্ণনায় তেরো শতক থেকে ইংরেজ শাসন আমল পর্যন্ত পাকিস্তান ও বাংলাদেশে ইসলামের যে ইতিহাস আমরা পেলাম, তা থেকে বলা যায় যে, গোড়া থেকেই বাঙালী মুসলমানের চেতনায় সনাতন কট্টর ইসলাম কোন স্থান পায়নি। বরং ইসলাম এদের কাছে আত্মশুদ্ধি ও আত্মোন্নতির মাধ্যম হিসেবেই গৃহীত হয়েছিল, ব্যাপক অর্থে সামাজিক রাজনৈতিক কিছু নয়।

’৪৭-এর ভারত বিভাগ এবং পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটো রাষ্ট্রের জন্মের পেছনে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ভূমিকা ছিল। উপমহাদেশের সংখ্যালঘিষ্ঠ মুসলমান সমাজ বুঝেছিলেন যে, ইংরেজহীন অবিভক্ত স্বাধীন ভারতে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সমাজের হাতে তাদের স্বার্থে নিরাপদ হবে না। কাজেই জন্ম হলো সম্প্রদায় ভিত্তিক দুটো রাষ্ট্রের। মূলতঃ হিন্দু ও মুসলিম উভয় নেতৃত্ব রাজনৈতিক স্বার্থে ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতাকে ব্যবহার করেছিলেন। এর ফলেই বাংলার মুসলমানকে পাকিস্তানী মুসলমানদের সঙ্গে সংঘবদ্ধ হতে হয়েছিল।

প্রায় হাজার মাইলের ব্যবধানে অবস্থিত পাকিস্তানের দুই প্রদেশের মধ্যে একমাত্র বন্ধন ছিল তথাকথিত ইসলাম। তবে পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রাথমিক পদক্ষেপগুলো থেকে মনে হয় যেন ধর্মকে সযত্নে পাশ কাটিয়ে একটি ধর্মনিরপেক্ষ ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রয়াস চলছিল। জিন্নাহর প্রাথমিক চিন্তা ও বক্তব্য এ কথাই প্রমাণ করে। অবিভক্ত ভারতে একনিষ্ঠ কংগ্রেস অনুরাগী জিন্নাহ কংগ্রেস ত্যাগ করেছিলেন কংগ্রেসের সাম্প্রদায়িক মনোভাবের কারণে। কিন্তু সেই জিন্নাহই পাকিস্তানের কারণে সাম্প্রদায়িক মুসলিম লীগ নেতা হয়েছিলেন। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর জিন্নাহর মানসিক পরিবর্তন হতে সময় লাগেনি। যথার্থ ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় গড়িমসি বা ব্যর্থতার কারণে সেকালের মুসলিম লীগ এক পর্যায়ে কট্টর ইসলামপন্থীদের কড়া সমালোচনার সম্মুখীন হতে থাকে। মওলানা মওদুদীর নেতৃত্বে জামায়াত ইসলামী এই সমালোচনার সূচনা করে। ১৯৬২-তে আইয়ুব সরকার রচিত সংবিধানেই প্রথম ইসলামী শর্তাবলী অন্তর্ভূক্ত হয়। ১৯৬৪-র এক সংশোধনীর মাধ্যমে পাকিস্তানকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করা হয়।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বাঙালী মুসলমান বৈষম্য, শোষণ ও বঞ্চনার শিকার হতে থাকে। ক্রমবর্ধমান বাঙালী অভিযোগ ও প্রতিবাদের উত্তরে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ ইসলামী সংহতির যুক্তি দেখাতে শুরু করেন। কাজেই ষাটের দশকে থেকেই বাংলার মানুষ বুঝেছিল ইসলাম পশ্চিম পাকিস্তানী নেতৃবৃন্দের জন্যে রাজনৈতিক মুখোশ মাত্র। অবশ্য একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ সে মুখোশ উন্মোচন করে দেয়। একাত্তরে বাঙালী নিধনের যুক্তি ছিল বাঙালী ইসলামী সংহতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে এবং ‘কাফের’ হয়ে গিয়েছে। কাজেই পাকিস্তানের ‘জেহাদ’! ইসলামের চৌদ্দশ’ বছরের ইতিহাসে এমনি কলঙ্কজনক অধ্যায় আর নেই। তবে বাংলাদেশের অভ্যূদয় প্রমাণ করেছে যে, ধর্ম কখনও রাষ্ট্রের সংহতি সৃষ্টি করতে পারে না, বা ধর্মীয় চেতনার ভিত্তিতে জাতীয়তাবোধও গড়ে উঠতে পারে না। বাংলাদেশের জন্মলগ্নে মনে হয়েছিল, এ দেশের মাটিতে আর কোনদিন ধর্ম ব্যবসায়ী রাজনীতির আবির্ভাব হবে না। কিন্তু তবুও তা হয়েছে।

বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি : মুজিব আমল, ১৯৭২১৯৭৫

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানের অন্যতম মূলনীতি ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা। ১৯৭২-এর ৪ নবেম্বর গৃহীত এই সংবিধানে সাম্প্রদায়িকতা, রাষ্ট্রীয় কর্মকান্ডে ধর্মের প্রভাব এবং ধর্মভিত্তিক বৈষম্য—ইত্যাদি বিলোপ করা হয়েছিল। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ইসলাম পসন্দ দলগুলোর গণবিরোধী ভূমিকার কারণে স্বাধীন বাংলাদেশের এমনি রাষ্ট্রীয় নীতি অবশ্যম্ভাবী ছিল। তবে মনে রাখা প্রয়োজন এই ধর্মনিরপেক্ষতা প্রচলিত অর্থে সাধারণ নিরপেক্ষতা ছিল না; সামগ্রিক ধারণায় কিছুটা ব্যতিক্রম ছিল। শেখ মুজিবের বহু বক্তৃতা ও বক্তব্যে এটা পরিষ্কার হয়েছিল যে, ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ ধর্মহীনতা নয়। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ঢাকা বিমানবন্দরে এসে তিনি যে বক্তব্য রেখেছিলেন তা স্পষ্ট করে উল্লেখ করেছিল যে, রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্বের জন্যে একটি নতুন সংযোজন। এখানে দু’ধরনের ব্যাখ্যার অবকাশ আছে। প্রথমত, ধর্মনিরপেক্ষতার মাধ্যমে শেখ মুজিব রাষ্ট্রীয় নীতি ও কর্মকান্ডকে অবাঞ্ছিত ধর্মীয় প্রভাব থেকে মুক্ত রাখতে চেয়েছিলেন। এই নীতির মাধ্যমে ব্যক্তিগত পর্যায়ে অনুসৃত ও লালিত কোন ধর্মের অবমূল্যায়ন করা হয়নি। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশকে ইসলামী বিশ্বের অংশ হিসেবে ঘোষণা করার সময়ে শেখ মুজিব একটি ভবিষ্যৎ ইসলামী রাষ্ট্রের কথা বলেননি।

রাষ্ট্রীয় নীতি বাস্তবায়নের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ১৯৭২-এ গণবিরোধী ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। দেশের আপামর জনসাধারণ এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছিল। তবে ১৯৭৩-৭৪-এর অর্থনৈতিক সংকটের সময় থেকে রাষ্ট্রীয়, এবং বিশেষ করে পররাষ্ট্রনীতিতে একটি সূক্ষ্ম পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। ব্যাপক অর্থনৈতিক বিপর্যয় এড়ানোর জন্যে ইসলামী বিশ্বের পেড্রো ডলারের প্রয়োজন তৎকালীন নেতৃবৃন্দ গভীরভাবে অনুভব করেন। উপরন্তু জ্বালানী তেল সংকটের শিকার বাংলাদেশের দৃষ্টিতে তেল সমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের একটি বিশেষ তাৎপর্য ছিল। ফলে ইসলামী কর্মকান্ডের (রাজনৈতিক নয়) প্রতি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। এছাড়া ’৭৪-এর ফেব্রুয়ারী মাসে ইসলামী সম্মেলন সংস্থার লাহোর শীর্ষ সম্মেলনে শেখ মুজিব ব্যক্তিগতভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এবং তারপর থেকেই ইসলামী বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক হতে শুরু করেছিল। যা হোক, রাষ্ট্রীয় নীতিতে ইসলামের প্রভাবের দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায় ১৯৭৫-এ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কথার উল্লেখ্য, ১৯৭২-এ এই প্রতিষ্ঠানটি বিলোপ করা হয়েছিল। পুনঃপ্রতিষ্ঠার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তৎকালীন শ্রম, সমাজ কল্যাণ, ক্রীড়া ও সংস্কৃতিমন্ত্রী অধ্যাপক ইউসুফ আলী বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ ইসলামের আদর্শ ও শিক্ষার প্রতি আস্থাশীল; এবং সে ইসলামী আদর্শ শান্তি ও বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্যে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবে।’ তৎকালীন বাংলাদেশের এই নতুন ইসলামী প্রবণতার ব্যাখ্যা প্রয়োজন। প্রথমত, এটা ধারণা করা অযৌক্তিক হবে যে, বাংলাদেশ ইসলামী রাষ্ট্রের পথ ধরেছিল। দ্বিতীয়ত, মনে হয় এই নীতি অনেকটাই প্রচার সর্বস্ব ছিল; লক্ষ্যবস্তু ছিল মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামী রাষ্ট্রগুলো। প্রচারের উদ্দেশ্য ছিল এটাই প্রমাণ করা যে, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হলেও বাংলাদেশ ইসলাম ধর্মকে বর্জন করেনি।

জিয়া আমল : ১৯৭৫১৯৮১

অবশ্য ধর্মভিত্তিক রাজনীতির পুনরুত্থান বলতে বা বুঝার তার পথ সুগম হয় ১৯৭৫-এর পর সৃষ্ট রাজনৈতিক পরিবেশের ফলে। ১৯৭৫-এর আগস্ট মাসে শেখ মুজিবের নৃশংস হত্যাকান্ডের ফলে ধর্মনিরপেক্ষ সরকারের পতন হয়। সে বছরই নবেম্বরে ঘটে যায় আরও একটি সামরিক অভ্যূত্থান, যার নেতৃত্বে ছিলেন খালেদ মোশাররফ। এই দুই অভ্যূত্থানের অন্তবর্তীকালে সরকার প্রধান ছিলেন খন্দকার মোশতাক। এ সময়ে শোনা গিয়েছিল, বাংলাদেশের সাংবিধানিক নাম গণপ্রজাতন্ত্রী বদলিয়ে করা হবে ইসলামী প্রজাতন্ত্র। অবশ্য পরবর্তীকালে তা হয়নি; বা করা সম্ভব হযনি। তবে এটাও ঠিক যে, কিছুদিনের মধ্যেই সংবিধান সংশোধিত হয়; এবং মূলনীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা বিদায় নেয়।

১৯৭৬-এর জানুয়ারী মাসে নতুন সামরিক সরকার ঘোষণা করেন একটি বিশেষ অধ্যাদেশ। এই অধ্যাদেশ অনুযায়ী ১৯৭২-এর অধ্যাদেশের অধীনে যত স্বাধীনতা বিরোধী ব্যক্তিবর্গের যে ধিক্কার চলছিল, তার অবসান করা হয়। একই বছর আগস্ট মাসে ঘোষিত রাজনৈতিক দল অধ্যাদেশ। ৭৫-এর সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠার পর যে দলগুলোকে বা রাজনৈতিক কর্মকান্ডকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল তাদের পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয় এই অধ্যাদেশের মাধ্যমে। তবে রাজনৈতিক দলের পুনরাবির্ভাব ও নতুন কর্মকান্ড শুরু করার কিছু পূর্বশর্ত আরো করা হয়েছিল। যেমন, রাজনৈতিক দল হিসেব স্বীকৃতি পেতে হলে পূবেই সামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে তাদের সংবিধান ও মেনিফেস্টোসহ আবেদন করতে হবে। নবেম্বর মাসের মধ্যে প্রায় ৫৬টি দল আবেদন করে, এদের মধ্যে মাত্র ১৭টি দল সামরিক সরকারের স্বীকৃতি পেতে সমর্থ হয়।

১৯৭৭-এর ২১ এপ্রিল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি হিসেবে ক্ষমতাসীন হন। রাষ্ট্রপতি হিসেবে তাঁর প্রথম কাজ ছিল সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতাকে বিদায় দেয়া। এই পরিবর্তন সমালোচনার ঝড় তুলেছিল। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিপ্রাপ্ত সে সময়ের মোট রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ছিল মোট ২১টি। এদের মধ্যে মাত্র ৫টি দল জিয়াউর রহমানের নীতির প্রতি অকুন্ঠ সমর্থন জানায়; এবং তারা হলো, মুসলিম লীগ, ইসলামিক ডেমোক্র্যাটিক লীগ, জামায়াত-ই-ইসলামী, নেজাম-ই-ইসলাম ও খেলাফত-ই-রব্বানী। বলা বাহুল্য, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে গণবিরোধী ভূমিকার জন্যে ৭২-এ দলগুলো নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। কাজেই দেখা যায়, জিয়াউর রহমানের আমলেই এই দলগুলোর পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়। সেই থেকে শুরু স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে স্বাধীনতা বিরোধী ধর্মভিত্তিক রাজনীতির পুনরুত্থান; আজ তা ব্যাপক আকার ধারণ করেছে।

তবে যদি বলা হয় এই ধর্মভিত্তিক রাজনীতির পুনরাবির্ভাবের জন্যে শুধুমাত্র জিয়াউর রহমানই এককভাবে দায়ী, তবে ঐতিহাসিক সত্যের অপলাপ হবে। আমরা দেখেছি, এই প্রক্রিয়ার সূচনা মুজিব আমলের শেষ পর্যায় থেকে। আবার এটাও মনে রাখা প্রয়োজন যে, জিয়াউর রহমান কোনদিনই ইরান বা পাকিস্তানের মতো একটি গোঁড়া ইসলামী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চাননি; বা তা সম্ভবও ছিল না। অন্তত জিয়াউর রহমানের বিভিন্ন কর্মকান্ড তাই প্রমাণ করে। ক্ষমতাসীন হবার পরই তাঁর ‍ওপর একটি বিশেষ মহল থেকে প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল যেন অনতিবিলম্বে বাংলাদেশকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করা হয়; এই দাবীর স্বপক্ষে ১৯৭৬-এর মার্চ মাসে এয়ার ভাইস মার্শাল মোহাম্মদ গোলাম তওয়াব ও জামায়াত-ই-ইসলামী এক গণজমায়েত ও বিক্ষোভের আয়োজন করে। এর উত্তরে জিয়া ৭৬-এর ৩০ এপ্রিল তওয়াবকে অবসর গ্রহণ ও দেশত্যাগ করতে বাধ্য করেন।

তবুও সামগ্রিক বিচারে দেখা হয় যে, জিয়ার আমলেই ধর্মভিত্তিক রাজনীতির শক্তি সঞ্চয়ের সূচনা হয়েছিল। জিয়া যদি গোঁড়া ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে নাই চেয়েছিলেন তবে তাঁর বা তাঁর সরকারের ইসলাম প্রবণতার ব্যাখ্যা কি হতে পারে? সম্ভবতঃ স্বাধীনতাপন্থী ও স্বাধীনতাবিরোধী পক্ষ দুটোর মধ্যে একটি সামাজিক-রাজনৈতিক আপোষ সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন। বোধহয় জিয়া ভেবেছিলেন, এই দুই পক্ষের মধ্যে বিরাজমান বৈরী সম্পর্ক ও মানসিক দূরত্ব অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ পর্যন্ত চলতে থাকলে একটি ব্যাপক সামাজিক-রাজনৈতিক সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। রাজনৈতিক কৌশলের বিচারে জিয়ার এই পদক্ষেপ আকর্ষণীয় সন্দেহ নেই; এবং এর তুলনা করা যেতে পারে ১৯৩০-এর দশকে বৃটেন/ফ্রান্স অনুসৃত ‘তোষণনীতি’ বা ১৯২৫-এ স্বাক্ষরিত লোকার্নো চুক্তিসমূহের সঙ্গে। উভয় পদক্ষেপের মাধ্যমে দুই মহাযুদ্ধের অন্তবর্তীকালের ইউরোপে বিজয়ী ও বিজিত শক্তির মধ্যে ক্রমবর্ধমান বৈরীতার অবসান করার ঐকান্তিক প্রয়াস নেয়া হয়েছিল। কিন্তু সে সময়ের পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে উভয় পদক্ষেপই বাস্তববর্জিত ছিল, এবং এই অবাস্তব নীতি অনুসরণের কারণে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়েছিল। তোষণনীতি ছিল হিটলারের প্রতি প্রসারিত নেভিল চেম্বারলেনের সমঝোতার হাত। হিটলারের কিছু যুক্তিসঙ্গত অভিযোগ ছিল, যার সমাধান সম্ভব ছিল এই নীতির মাধ্যমে। কিন্তু সমঝোতার মানসিকতাকে হিটলার বৃটেনের দুর্বলতা হিসেবে বিবেচনা করলেন। হিটলার প্রকাশ্যে সমঝোতার মনোভাব দেখালেও গোপনে যুদ্ধের প্রস্তুতি অব্যাহত রেখেছিলেন। আর বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের পুনর্বাসন করতে গিয়ে জিয়া বাস্তববর্জিত একই বিভ্রান্তির শিকার হলেন।

জিয়ার আমলে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি কতটুকু শক্তি সঞ্চয় করেছিল তার নির্দেশক হিসেবে অনেকে ৮১-র রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে হাফেজ্জী হুজুরের তৃতীয় স্থান অধিকারের বিষয়টি উল্লেখ করেন। নির্বাচনের আগে গোঁড়া ইসলামপন্থী হাফেজ্জী হুজুর বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে একজন অজানা-অচেনা ব্যক্তিত্ব ছিলেন। কিন্তু তিনিই কিনা অন্যান্য প্রগতিবাদী ও বামপন্থী দলকে অতিক্রম করে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের পরে তৃতীয় স্থান দখল করলেন। এই ঘটনাটিই কি বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির অগ্রযাত্রা সূচনা করে? মনে হয় ব্যাপারটা একটু তলিয়ে দেখা দরকার এবং এর জন্যে প্রয়োজন এই প্রথম তিনটি দলের প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যাতাত্ত্বিক পরিমাণ ও শতকরা হার।

রাষ্ট্রপতি নির্বাচন১৯৮১

মোট ভোটার সংখ্যা : ৩,৮৯,৫১,০১৪
মোট ভোটদানের সংখ্যা : ২,১৬,০৭,২৫৩
ভোটদানের শতকরা হার : ৫৫.৪৭%

প্রার্থী প্রাপ্ত ভোট শতকরা হার
আবদুস সাত্তার ১,৪২,১৭,৬০১ ৬৫.৮০%
কামাল হোসেন ৫৬,৯৪,৮৮৪ ২৬.৩৫%
হাফেজ্জী হুজুর ৩,৮৭,২১৫ ১,৭৯%

উৎস : হলিডে, ২২ নবেম্বর ১৯৮১।

ওপরের সারণি থেকে হাফেজ্জী হুজুরের বিজয়ের অন্তঃসারশূন্যতা লক্ষ্য করা যায়।

 

এরশাদ আমল : ১৯৮২

৮২-র শুরুতে এরশাদ সরকারের ক্ষমতাসীন হবার পর রাষ্ট্রীয় কর্মকান্ডে ইসলামী প্রবণতা এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতি যেন নতুন করে প্রাণ ফিরে পায়। শুরু থেকেই এরশাদ এ মত প্রকাশ করেছেন যে একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের প্রধান মূলনীতি হবে ইসলাম। ডিসেম্বর মাসে সচিবালয় কর্মচারীদের উদ্দেশ্যে এক বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের সংবিধানে ধর্ম হিসেবে ইসলামকে তার যোগ্য মর্যাদা দিতে হবে। যদি ইসলামকে রাষ্ট্র ধর্মের মর্যাদা দেয়া যায় তাহলে ভয়ের কি আছে? মোটের ওপর, ইসলাম হলো সহিষ্ণুতা ও সমঝোতার ধর্ম।’ একই বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি হয় ৮৩-র জানুয়ারীতে আর একটা বিবৃতিতে। কিন্তু এমনি বক্তব্য/বিবৃতি প্রচন্ড সমালোচনার ঝড় সৃষ্টি করে। ১৫ দল এক বিবৃতির মাধ্যমে এরশাদের এ ধরনের বক্তব্যগুলোর কঠোর সমালোচনা করে।

ঢাকার একটি ইংরেজী সাপ্তাহিক ‘দি বিগটস আর ব্যাক’ শিরোনামে এক জোরালো প্রতিবেদন প্রকাশ করে। কিছুদিন গুজবও শোনা গেল বাংলাদেশের জন্যে একটি ইসলামী সংবিধান রচনা করা হচ্ছে; এবং এর অন্যতম রচয়িতা একজন প্রবাসী বাঙালী রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। কিন্তু তীব্র সমালোচনার ঝড়, জাতীয় মানসিকতার সুস্পষ্ট প্রবণতা—ইত্যাদির কারণে এরশাদ সম্ভবতঃ যথেষ্ট বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েই এ বিষয়টি নিয়ে পরবর্তীকালে নতুন কোন পদক্ষেপ নেয়া থেকে বিরত থাকেন। অবশ্য অন্যান্য জটিল সমস্যার গুরুভারও তাঁকে অন্যদিকে দৃষ্টি দিতে বাধ্য করে। ফলে ইসলামী সংবিধান আজ পর্যন্ত রচিত হয়নি। একই কারণে সে সময়ের শিক্ষামন্ত্রী মজিদ খানের ইসলামী শিক্ষার নীল নকশাটিও বাস্তবায়িত হতে পারে না।

তবে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, ’৮২ থেকে আজ পর্যন্ত ধর্মভিত্তিক রাজনীতি যতটুকু শক্তি সঞ্চয় করেছে তা পুর্ববর্তী যে-কোন সময়ের চেয়ে বেশি। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো আজ সরাসরি ‘ইসলামী হুকুমত’ কায়েমের জন্যে সোচ্চার। শুধু জামায়াতই নয় এদের সঙ্গে মুসলিম লীগের মতো দলও ইসলামী রাষ্ট্রের জন্যে উচ্চকন্ঠ; এবং এমনকি গণতন্ত্রের (!) জন্যেও। কিন্তু একটি বিরাট প্রশ্ন রয়ে যায়। ৭১-পূর্ব সময়ে যখন বাঙালী শোষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে এবং গণতন্ত্রের স্বপক্ষে আন্দোলন গড়ে তুলেছিল, তখন এ দলগুলোই ইসলামের দোহাই দিয়ে গণতন্ত্র বিরোধী ও বাঙালী বিরোধী ভূমিকায় লিপ্ত ছিল। কাজেই প্রশ্ন : এ দলগুলোর গণতন্ত্রের সংজ্ঞা কি?

ধর্মভিত্তিক রাজনীতির এই নতুন প্রবাহের আর একটি বৈশিষ্ট্য হলো, ইসলামী মেনিফেস্টো নিয়ে কিছু নতুন দলের আত্মপ্রকাশ বা এককালের মোটামুটি মুক্তমনা নেতৃত্বের ইসলামী কাফেলায় শরিক হওয়া। এ প্রসঙ্গে মেজর জলিলের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এককালে ভারতীয় প্রভুত্ববাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে জাসদ নিয়ে এবং ‘মার্কসবাদ মুক্তির পথ’ লিখে তাঁর সৈনিক জীবনের ইতি ও রাজনৈতিক জীবনের সূচনা; বর্তমানে তিনি তাঁর ‘জাতীয় মুক্তি আন্দোলন’ দল নিয়ে ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠার প্রয়াসে রত।

ধর্মভিত্তিক রাজনীতির কারণসমূহ

ধর্মনিরপেক্ষ স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির পুনরুজ্জীবনের জন্যে আমরা মোটামুটি চারটি কারণ নির্দেশ করতে পারি। প্রথমত, ক্ষমতাসীন সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা। ’৭২ থেকে ’৮৪ এই পৃষ্ঠপোষকতার গুণগত রকমফের হয়েছে, এবং তা হয়েছে বিভিন্ন সরকারের প্রকৃতির কারণে। আলোচনার শুরুতে আমরা উল্লেখ করেছি মুজিব সরকারের ইসলাম প্রবণতার কথা। আরো উল্লেখিত হয়েছে যে, এর জন্যে রাজনৈতিক-কূটনৈতিক চিন্তা চেতনা কার্যকরী ছিল। জিয়া (সামরিক) ও এরশাদের সরকার গণতান্ত্রিক অর্থে অবৈধ। কাজেই গণমানসে বৈধতার আবরণ (রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিভাষায় যাকে ‘লেজিটিমেসী’ বলা হয়) সৃষ্টি করার কারণেই ইসলামের শরণাপন্ন হতে হয়েছে; তুলতে হয়েছে ইসলামের শ্লোগান। দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক দলগুলোর (যারা ইসলাম পসন্দ দল) রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ধর্মীয় শ্লোগান ব্যবহার। এটা অনস্বীকার্য যে, বাংলাদেশের সাধারণ মুসলমান সরল মানসিকতাসম্পন্ন এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে ধর্মপ্রাণ। কাজেই তাদের কাছে ধর্মের আফিমের একটা তাৎপর্য আছে। আর সেই কারণেই ইসলামী শ্লোগান।

মেজর জলিলের একটি বক্তব্যে বিষয়টি বেরিয়ে এসেছে; ‘আমি লক্ষ্য করলাম বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের মাধ্যমে মন জয় করা যায় না এবং গন্তব্যস্থল সুদূরপরাহত। এছাড়া জনগণের সাথে মেশার ফলে আমার উপলব্ধি হলো যে, জাসদকে জনগণ ইসলাম বিচ্যূত দল হিসেবে চিহ্নিত করে ফেলেছে। এটা আমাদের অগ্রগতির পথে বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আমার স্থির বিশ্বাস জন্মালো যে, মানুষের সার্বিক মুক্তির একমাত্র পথ হচ্ছে ইসলাম ও কোরান সুন্নাহ এবং এটাই গ্রহণযোগ্য (বিচিত্রা, ২ নবেম্বর ১৯৮৪)। কাজেই ইসলামের অন্তর্নিহিত আবেদন নয় বরং জনগণের গ্রহণযোগ্যতার কারণেই ইসলামী রাজনীতি। কিন্তু প্রশ্ন হলো : বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রকে সহজ ও সরলভাবে জনগণের বোধগম্য করে উপস্থাপনের কোন চেষ্টা কি আজ পর্যন্ত হয়েছে। শহরভিত্তিক বুর্জোয়া রাজনীতির পরিমন্ডলে দেশের আপামর জনগণের সঙ্গে নেতৃবৃন্দের যোগাযোগ কোথায়? তৃতীয়ত, স্বাধীনতার পর ইসলাম পসন্দ নেতৃবৃন্দ মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামী রাষ্ট্রগুলোকে বুঝিয়েছিলেন বাংলাদেশে ‘ইসলাম ইন ডেঞ্জার’; মুক্তিযুদ্ধের সময় ধ্বংস হয়েছে অসংখ্য মসজিদ। কাজেই ৭৫-এর পর থেকে আসতে শুরু করলো পেড্রো-ডলারের সাহায্য। এই সাহায্য শুধু জাতীয় পুনর্গঠনের জন্যেই নয়, বরং বিভিন্নভাবে ইসলামের পুনর্গঠনের জন্যেও। ফলে রাতারাতি বাংলাদেশে গড়ে উঠলো সীরাত মজলিশ, মসজিদ সমাজ—ইত্যাদি; শুরু হলো ব্যাপক ইসলামী কার্যক্রম। চতুর্থত, মনে হয় ’৭২-’৭৫-এর ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সরকারের যে ব্যর্থতা, তার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হিসেবে জনমনে যে দ্বিধা-দ্বন্দ্বের সূচনা হয়েছিল, তারই সুযোগে ইসলামী রাজনীতির অনুপ্রবেশ হয়েছে।

ধর্মভিত্তিক রাজনীতি অবাঞ্ছিত কেন?

মুক্তমন নিয়ে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, বহুবিধ কারণেই ধর্মভিত্তিক রাজনীতি অবাঞ্ছিত। প্রথমত, বিশ্বের ইতিহাস আলোচনা থেকে একটি বিরাট সত্য বেরিয়ে আসে; আর তা হলো, যখন সমাজে ধর্ম আর রাজনীতি মিলিত হয়েছে তখনই সৃষ্টি হয়েছে বিশৃংখলা। ধর্ম রাজনীতির অঙ্গনে সব সময়েই সামাজিক বিভেদ সৃষ্টিকারী মাধ্যম হিসেবে কাজ করেছে। পাশ্চাত্যের রাষ্ট্রগুলোতে শৃংখলা ও স্থিতিশীলতা ফিরে এসেছে তখনই যখন রাজনীতিকে ধর্মমুক্ত ও ধর্মকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে সীমিত করা হয়েছে। উপরন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট বিচার করলে বলা উচিত যে, স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির কোন অধিকার নেই। কারণ, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে এরা ছিল গণহত্যার সক্রিয় সহযোগী। আল-বদর/আল-শামস ছিল পাকিস্তানী সামরিক চক্রের দোসর এবং বুদ্ধিজীবী নিধনের নীল-নকশা প্রণয়নকারী ও বাস্তবায়নকারী। এছাড়া আরো কারণ আছে। এদের অনেকে বাংলাদেশের আদর্শিক ভিত্তিকে গ্রহণ করে না। কিছুদিন আগে জামায়াত নেতা গোলাম আযম বলেছিলেন,‘বাংলাদেশ মাটির নাম, আদর্শের নয়।’ অবশ্য তিনি তা বলতে পারেন। কারণ, তিনি এখনও পাকিস্তানের নাগরিক এবং পাকিস্তানী পাসপোর্ট বহনকারী। কিন্তু প্রশ্ন হলো : বাংলাদেশের আদর্শ যদি গ্রহণযোগ্য না-ই হয় তাহলে এদেশের মাটিতে তাঁর দল ‘গণতন্ত্রের (?) সংগ্রাম করছে কেন? উদ্দেশ্য কি?

উপসংহার

আলোচনার শুরুতে উল্লেখ করা হয়েছে বাংলাদেশ ইসলামের ব্যতিক্রমধর্মী বৈশিষ্ট্যের কথা। এই প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বাংলাদেশে ইরান বা পাকিস্তানের মতো ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা অযৌক্তিক এবং অবাঞ্ছিত। ’৪৭ থেকে ৭১ পর্যন্ত ইসলামী রাষ্ট্রের অঙ্গ হিসেবে আমাদের যে অভিজ্ঞতা তাও একটি বিবেচ্য বিষয়। উপরন্তু ৭১-এ ইসলামী সংহতি রক্ষার নামে অগণিত ধর্ষিত নারী ও নিহত প্রাণের কাছে আমাদের জবাব কি?

০০০

ইসলামী দলসমূহের অন্তর্বিরোধ

এলাহী নেওয়াজ খান

বর্তমানে বাংলাদেশে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ও ইসলামী হুকুমত কায়েমের জন্য একদিকে এককভাবে জামায়াতে ইসলামী যেমন তৎপর অন্যদিকে বেশ কয়েকটি ফ্রন্ট গঠিত হয়েছে। ইতিমধ্যে ৬৫টি দল নিয়ে ৪টি ফ্রন্ট তৎপরতা আরম্ভ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে হাফেজ্জী হুজুরের নেতৃত্বে ১১ দলীয় সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদ, ইসলামী যুক্তফ্রন্ট নামে ১৭টি করে দল নিয়ে দু’টি আলাদা ফ্রন্ট—একটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন বাংলাদেশ ইসলামী বিপ্লবী পরিষদের চেয়ারম্যান মওলানা শেখ ওবায়দুল্লাহ বিন জালালাবাদী এবং অপরটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন কৃষক শ্রমিক পার্টির সভাপতি এ এস এম সোলায়মান। এছাড়া ইসলামী ফ্রন্ট নামে ২০ দলীয় ফ্রন্ট আছে। এই ফ্রন্টের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, ন্যাশনাল প্রগ্রেসিভ পার্টির সভাপতি মফিজুর রহমান রোকন।

ফ্রন্টসমূহের দ্বন্দ্ব

বাংলাদেশে ইসলামী শিবির এতভাবে বিভক্তির কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে বিভিন্ন দল, নেতা, ফ্রন্ট সম্পর্কে পরস্পরের অনেক প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্য পাওয়া গেছে। যেমন জামায়াতে ইসলামী সম্পর্কে ইসলামী যুক্তফ্রন্টের (সোলায়মান) নেতা এ এস এম সোলায়মান বলেছেন, অতীতে জামায়াতের রাজনৈতিক আন্দোলন সম্বন্ধে অনেক ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে। এখনো ইসলামী আন্দোলনের নামে তারা এদেশে মওদুদীবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। তারা দেশের অন্যান্য ইসলামী শক্তিগুলোর সাথে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার জন্য কোন প্রচেষ্টা চালাননি। যার ফলে জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির লক্ষ্য ও আদর্শ সম্পর্কে যথেষ্ট স্পষ্ট ধারণার অভাব রয়েছে।

মওলানা জালালাবাদী জামায়াত সম্পর্কে বলেন, জামায়াতে ইসলামীকে আমরা আর দশটা দলের মতই মনে করি। ইসলামের প্রচারক অথবা খাঁটি ইসলামী সংগঠন বলতে যা বোঝায় জামায়াতে ইসলামীকে আমরা তা মনে করি না। কারণ জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা মওলানা মওদুদী ইসলাম সম্পর্কে যেসব ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ দিয়েছেন, তার সাথে হক্কানী আলেম সমাজ কোনকালেই একমত নন। মওদুদী সাহেব রসুলাল্লার পবিত্র হাদিসকে অমান্য করে বিভিন্ন সময়ে এমন সব বক্তব্য রেখেছেন যা কোন মোমিনই গ্রহণ করতে পারেন না। সুতরাং মুনকিরে হাদিস বা হাদিস অস্বীকারকারী লোকের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত পরিচালিত তথাকথিত জামায়াতে ইসলামীকে আমরা ইসলামের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন হিসাবে গ্রহণ করতে রাজী নই। তবে হাফেজ্জী হুজুর জামায়াত সম্পর্কে বলতে গিয়ে শুধু এতটুকুই বলেছেন যে, জামায়াত সম্পর্কে উপ-মহাদেশের হক্কানী ওলামায়ে একরামরা জামায়াতের জন্মলগ্ন থেকেই সুস্পষ্ট বক্তব্য রেখেছেন। আমি নিজেও একাধিকবার এ সম্পর্কে  আমার বক্তব্য পেশ করেছি।

অপরদিকে খেলাফত আন্দোলনের সাথে জামায়াতের বিরোধ কোথায়—এ সম্পর্কে জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমীর আব্বাস আলী খান বলেন, আমাদের দিক থেকে তাদের কোন বিরোধ নেই। তবে হাফেজ্জী সারাজীবন রাজনীতি থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন থেকে হঠাৎ ১৯৮১ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাধ্যমে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। কিছুদিন পর তিনি খেলাফত আন্দোলন নামে একটি দল গঠন করেন। হাফেজ্জীর বক্তব্য-বিবৃতি ছাড়া তাদের সম্পর্কে অতিরিক্ত কিছু আমাদের জানার সুযোগ হয়নি।

এদিকে হাফেজ্জী হুজুর সম্পর্কে এ এস এম সোলায়মানের বক্তব্য হচ্ছে যে, তিনি একজন প্রখ্যাত আলেম হিসাবে দেশবাসীর শ্রদ্ধারপাত্র। কিন্তু রাজনৈতিক অঙ্গনে তার অবস্থান খুব বেশিদিনের নয়। তিনি যেসব রাজনৈতিক মতবাদ বা নীতি ঘোষণা করেছেন এগুলো অনেক ক্ষেত্রেই অবাস্তব এবং অস্পষ্ট।

মওলানা জালালাবাদী হাফেজ্জী হুজুর সম্পর্কে বলেন, তিনি অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তিত্ব। তিনি আমাদের সকলের শ্রদ্ধার পাত্র। ইসলামী হুকুমত কায়েমের জন্য সামরিক শাসনের অবসানের লক্ষ্যে প্রয়োজনবোধে হাফেজ্জী হুজুরের দলসহ যে-কোন রাজনৈতিক দল ও জোটের সাথে ঐক্যবদ্ধভাবে আমরা ইসলামী যুক্তফ্রন্ট কাজ করতে রাজী আছি। তবে হাফেজ্জী হুজুরের আশপাশে যে সমস্ত লোক সংঘবদ্ধ হয়েছেন—তাদের সম্পর্কে নানা কথা শোনা যায়। তাই আমরা তাদেরকে এখনো পর্যবেক্ষণ করে চলেছি।

 

ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে একটি মূল্যায়ন

বর্তমানে ইসলামী প্রজাতন্ত্র কায়েম আন্দোলন, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি এবং বিভিন্ন ইসলামী জোট ও দল সম্পর্কে বাংলাদেশ আওয়ামী ওলামা পরিষদের সভাপতি মওলানা আবদুল আউয়াল বলেন, গণধিকৃত এসব দল ও জোট বর্তমান গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য বিশেষ মহলের সুতার টানে মাঠে নেমেছে।

মওলানা আবদুল আউয়াল বর্তমানে জামায়াতে ইসলামের ভূমিকা সম্পর্কে বলেন, আমি মনে করি আজকের জামায়াত পাকিস্তান আমলে যে জামায়াত ছিল তার থেকে ব্যতিক্রম কিছু না। এমনকি বৃটিশ-ভারতে যে জামায়াত ছিল তার থেকেও ভিন্নধারার বহির্প্রকাশ। তিনি বিভিন্ন সময়ে পবিত্র ইসলামকে বা মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিকে বিভিন্ন সময়ে কায়েমী স্বার্থবাদীদের স্বার্থে ব্যবহার করেছেন। ১৯২৮ সাল থেকে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত মওদুদী হায়দ্রাবাদের নিযামের স্বার্থে ইসলামকে ব্যবহার করেছেন। তারপর থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত তিনি ভারতে বৃটিশ ঔপনিবেশিক স্বার্থে অত্যন্ত সু-কৌশলে ইসলামকে ব্যবহার করেছেন। ইসলামকে বৃটিশ স্বার্থে ব্যবহারের এক পর্যায়ে তিনি জামায়াতে ইসলামী গঠন করেন। এই সময়ে তার বিভিন্ন বই-পুস্তক, বক্তৃতা-বিবৃতিতে একদিকে কংগ্রেসকে গালিগালাজ করা হত, অন্যদিকে মুসলিম লীগের সমালোচনা করা হত। এই সুযোগে তিনি বলতেন, বৃটিশরা ছয় হাজার মাইল দূর থেকে এদেশ শাসন; এক্ষেত্রে বৃটিশদের সাথে ইসলামের কোন বিরোধ নেই। এই সময়ে তিনি আরো বলতেন, গণতন্ত্র ও ইসলামের মধ্যে সাপে-নেউলে সম্পর্ক। যারা এক পা গণতন্ত্রের থেকে এগিয়ে যায়, তারা দু’পা আল্লাহ ও রসুলের বিরোধিতায় এগিয়ে যায়। এসব তিনি বলতেন ইসলামী ব্যাখ্যা বিবৃতির আলোকে। পরবর্তীকালে আবার পাকিস্তান আমলে তিনিই বলেছেন ইসলামের সার কথাই হচ্ছে গণতন্ত্র।

পাকিস্তান আমলে মওলানা মওদুদী ইসলামকে ব্যবহার করেছেন পাকিস্তানী শাসক ও শোষক গোষ্ঠীর স্বার্থে। তার এই কাজে বর্তমান বাংলাদেশে গোলাম আযম, মওলানা আব্বাস আলী খান, মওলানা আবদুর রহিম প্রমুখরা জামায়াতে ইসলামীর ব্যানারে গিয়ে সহায়তা করেছেন। ১৯৭১ সালে জামায়াতের ভূমিকা উল্লেখের অপেক্ষা রাখে না।

আজকে জামায়াত যে গণতান্ত্রিক ভূমিকায় মাঠে নেমেছে তা সাময়িক বলেই আমি মনে করি। কেননা তারা নিজেদের অতীত গণবিরোধী ভূমিকা ধামাচাপা দেয়া এবং নিজেদের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার জন্যই বর্তমানে গণতন্ত্রের কথা বলছেন। সুযোগ পেলেই আবার তারা তাদের অতীত ফ্যাসিবাদী ভূমিকায় আত্মপ্রকাশ করবে। জামায়াতে ইসলামী সম্পর্কে ‘মওদুদী চিন্তা’ শীর্ষক আমার একটি বই আছে, তাতে আমি ১৯২৮ সাল থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত বিস্তারিত আলোচনা করেছি।

মওলানা আউয়াল খেলাফত আন্দোলন ও ১১ দলীয় সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদ সম্পর্কে বলেন, খেলাফত ও জেহাদ এই দু’টো শ্লোগান নিয়ে খেলাফত আন্দোলন ও ১১ দলীয় জোট মাঠে নেমেছে। এ দু’টো শ্লোগান মানুষের কাছে আকর্ষণীয়। খেলাফত আরবী শব্দের অর্থ হচ্ছে—রিপাবলিক বা প্রজাতন্ত্র। পবিত্র কোরানের ভাষায়, আল্লাহ আগেও অনেক জাতিকে ফেলাফত বা প্রজাতন্ত্র দান করেছে। এই অর্থে বাংলাদেশ একটি খেলাফত বা প্রজাতন্ত্র। তাহলে খেলাফত আন্দোলন প্রধান হাফেজ্জী হুজুর কি খেলাফত প্রতিষ্ঠা করতে চান আমাদের বোধগম্য নয়। আর জেহাদ অর্থ হচ্ছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। মহানবী (দঃ) বলেছেন, ‘অত্যাচারী শাসকের সামনে সত্য কথা বলা সর্বশ্রেষ্ঠ জেহাদ।’ এই অর্থে বাংলাদেশের মানুষ জেহাদ বা আন্দোলনে আছে। তাহলে তারা কিসের আন্দোলনের কথা বলছে আমরা বুঝি না। আমরা মনে করি জনগণের অধিকার আদায়ের আন্দোলনকে বানচাল করার জন্য তারা মুখরোচক কথাবার্তা বলছেন।

হাফেজ্জী হুজুর ও তাঁর জোট আরো বলেছেন যে, তারা ইসলামী প্রজাতন্ত্র কায়েম করবেন। তাদের এই শ্লোগানও জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করার জন্যই উঠানো হয়েছে।

মওলানা আউয়াল ধর্মভিত্তিক রাজনীতি সম্পর্কে বলেন, উপ-মহাদেশের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, আর্যদের আমল থেকে পাকিস্তান আমল পর্যন্ত যখনই কোন জাতি উপমহাদেশে বা তার কোন অংশে ধর্মভিত্তিক শাসন কায়েমের শ্লোগান তুলেছে, তাতে মুষ্টিমেয় কিছু লোকই লাভবান হয়েছে। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জীবনে নেমে এসেছে, শোষণ, বঞ্চনা ও নির্যানের স্টিমরোলার। মানবতার মূ্ল্যবোধ সমাজ থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হয়েছে। এমনকি রাষ্ট্র-কাঠামো ও ভৌগোলিক অখন্ডত্বেও নেমে এসেছে বিপর্যয়।  আর্যদের আর্যাবর্ত, আওরঙ্গজেবের আমলের মোগল সাম্রাজ্য ও পাকিস্তানই তার জ্বলন্ত প্রমাণ।

ইসলামী প্রজাতন্ত্র সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য হচ্ছে ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের দাবীদার তথাকথিত ইসলামিক ফ্রন্টগুলো নিজেরই তাদের দাবীর প্রতি আন্তরিক নয়। তাদেরকে চাবি দেয়া পুতুলের মত বলা চলে। তাদের পেছন থেকে যা শিখিয়ে দেয়া হয়, তাই তারা বলছে। তারা বর্তমান গণআন্দোলনকে বিভ্রান্ত করার কু-মতলবে শুধু ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের শ্লোগান দিচ্ছে। কিন্তু দেশের আপামর জনসাধারণের অধিকার, দুঃখ-দুর্দশা ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক শোষণ-বঞ্চনা-নির্যাতন সম্পর্কে টু-শব্দটিও করছে না।

লেবার পার্টির মওলানা মতিন ইসলামী প্রজাতন্ত্র কায়েম সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, আমি এবং আমার দল পরিপূর্ণভাবে দেশে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কায়েম হোক সেটাই মনে প্রাণে চাই। তবে ইসলামী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য যে নেতা, কর্মী বিশেষতঃ ক্যাডার প্রয়োজন, তা সৃষ্টি না করে ইসলামী হুকুমত বা ইসলামী প্রজাতন্ত্র কায়েম বুমেরাং হয়ে দেখা দেবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। যেমন মহানবী (দঃ) নবুয়তি প্রাপ্তির পর সুদীর্ঘ ১৩ বছর সংগঠন এবং পরিবেশ সৃষ্টি করেছিলেন। ফলে ইসলামী প্রজাতন্ত্র অথবা ইসলামী রাজ্য প্রতিষ্ঠা সহজসাধ্য হয়েছিল।

মওলানা মতিন জামায়াতে ইসলামী সম্পর্কে বলেন, জামায়াত মূলতঃ মওলানা মওদুদীর চিন্তাধারার ওপর ভিত্তি করে ইসলামের নামে দল করেছে। মওলানা হাফেজ্জী হুজুর সম্পর্কে তাঁর ধারণা হচ্ছে হাফেজ্জীর নেতৃত্বে খেলাফত আন্দোলন এবং তার  ১০ দলীয় জোট ইসলাম প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ইসলামী যুক্তফ্রন্ট সম্পর্কে তার মন্তব্য হল এইসব হঠাৎ গজিয়ে ওঠা দল বা ফ্রন্ট ইসলামের নামে যে মায়া কান্না করছে তা আদৌ ইসলামী হুকুমত কায়েমের লক্ষ্যে কিনা সে সম্পর্কে দেশবাসীর সন্দেহ রয়েছে। তিনি ধর্মভিত্তিক রাজনীতি সম্পর্কে হতাশা ব্যক্ত করে বলেন, এদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করা কষ্টসাধ্য। কারণ পাকিস্তান সৃষ্টির পর হতে ধর্মকে ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থেই শুধু ব্যবহার করা হয়েছে। ফলশ্রুতিতে ধার্মিক জনগোষ্ঠী এখন ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ব্যাপারে খুব সন্দিহান।

খেলাফত আন্দোলনেরচার কুচক্রী

বিদেশ থেকে প্রাপ্ত অর্থ আত্মসাৎ, স্বজনপ্রীতি, সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদ গঠন, সরকারী লেজুড়বৃত্তির অভিযোগ এবং ইরান-ইরাক লাইন নিয়ে হাফেজ্জী হুজুরের নেতৃত্বে গঠিত খেলাফত আন্দোলনের অভ্যন্তরে ব্যাপক অন্তর্দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে; যা দলকে বড় ধরনের ভাঙনের মুখোমুখি ঠেলে দিয়েছে। ইতিমধ্যে দলের ভেতর থেকে অভিযোগ উঠেছে যে, হাফেজ্জী হুজুরের ছেলে মওলানা হামিদুল্লাহ, জামাতা ফজলুল হক আমিনী, নাতিন জামাতা এডভোকেট সিরাজদ্দৌলা ও দলের সেক্রেটারী এবং সাবেক জামায়াত নেতা অধ্যাপক আখতার ফারুক ইরান থেকে প্রাপ্ত অর্থ আত্মসাৎ এবং হুজুরের মূলনীতিকে জলাঞ্জলি দিয়ে হুজুরকে প্রায় বন্দী করে ফেলেছেন। অভিযোগকারীদের ভাষায়, ‘এরা ৪ জন কুচক্রী এবং এদের চক্রান্তের ফলে দলের নেতৃত্বে গভীর সংকট দেখা দিয়েছে।’

দলের অভ্যন্তরে ইতিমধ্যে ‘চার কুচক্রী’র বিরুদ্ধে ব্যাপক জনমত গড়ে উঠেছে। গত ২৫ অক্টোবর খেলাফত আন্দোলনের ১৩ জন কর্মীর স্বাক্ষরিত এক বিবৃতি বলা হয়, গোল টেবিল বৈঠক থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত হাফেজ্জী হুজুরের নাম ভাঙিয়ে ‘কুচক্রী’র এমন সব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে, যা স্ববিরোধী এবং হীন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। কুচক্রীদের সর্বশেষ সাফল্য হচ্ছে, খেলাফত আন্দোলনকে নিয়ে ১১ দলীয় সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদে রূপান্তর করা। এই সংগ্রাম পরিষদ হাফেজ্জী হুজুরকে জাতীয় নেতৃত্ব হতে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করেছে।

১০ নবেম্বর সংগঠনের বিভিন্ন নেতৃবৃন্দ আরেকটি বিবৃতিতে অবিলম্বে খেলাফত আন্দোলনের অভ্যন্তরীণ সংকট নিরসন এবং কুচক্রীদের সংগঠন থেকে বহিষ্কারের আহ্বান জানানো হয়। এই বিবৃতিতে অন্যান্যের মধ্যে স্বাক্ষর করেন, খেলাফত আন্দোলনের টঙ্গী থানা শাখার আমীর মওলানা মোহাম্মদ আবদুর রউফ, আদমজী নগর শাখার আমীর মওলানা জাকেরউল্লাহ, ডেমরা শিল্প এলাকা শাখার আমীর মোহাম্মদ ফজলুল হক, কলাবাগান শাখার নায়েবে আমীর মোহাম্মদ আলী কামাল ও তেজগাঁ থানা শাখার নায়েবে আমীর মওলানা মাহমুদুল হাসান।

অপরদিকে ১৭ নবেম্বর খেলাফত আন্দোলনের ফেনী জেলা শাখা সর্বসম্মতভাবে ৫টি প্রস্তাব পেশ করে। প্রস্তাবগুলোর মধ্যে রয়েছে, খেলাফত আন্দোলনের অভ্যন্তরীণ সংকট দূর করার জন্য বর্তমান এবং সাবেক মজলিশে শুরার সদস্যদের নিয়ে জরুরী অধিবেশনে বসা, হুজুরের ছেলে, জামাতা, নাত জামাতাদের বাদ দিয়ে মজলিশে শুরা এবং মজলিশে আমেনা পুনর্গঠন করা, গঠনতন্ত্র সংশোধন করা, অধ্যাপক আখতার ফারুককে বহিষ্কার করা এবং খেলাফত আন্দোলনের অর্থের পূর্ণাঙ্গ হিসেব সর্বসাধারণ্যে প্রকাশ। হুজুরের সাবেক প্রেস সেক্রেটারী এবং ভিন্ন মতাবলম্বীদের মুখপাত্র মওলানা ইসহাক ওবায়দী জানিয়েছেন, ২১ ডিসেম্বর সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদের জাতীয় সমাবেশের আগেই মজলিশে শুরার সাবেক এবং বর্তমান সদস্যদের ডেকে জরুরী ভিত্তিতে সংকটের সমাধান না করা হলে, তারা সাংবাদিক সম্মেলন করে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

খেলাফত আন্দোলন ও হিজবুল্লাহ গ্রুপ

খেলাফত আন্দোলনের মধ্যে একটি গ্রুপ সবচেয়ে বেশি সক্রিয়, সেটি হচ্ছে হিজবুল্লাহ গ্রুপ। এই গ্রুপের মূখ্য কাজ হচ্ছে বাংলাদেশে ইরানের মত ইসলামী বিপ্লব ঘটানো। এই গ্রুপের মাধ্যমে নাকি হাফেজ্জী হুজুরের সাথে ইরানের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপিত হয়। প্রাথমিকভাবে দলের খুব আর্থিক সংকট চলছিল। কিন্তু ইরানের সাথে যোগাযোগের পর ধীরে ধীরে সে সংকট কেটে যায়। সম্প্রতি হিজবুল্লাহ গ্রুপের দুই নেতা কাজী আজিজুল হক ও মোহাম্মদ নিজামউদ্দিন হাফেজ্জী হুজুরের কাছে প্রেরিত একটি চিঠিতে অভিযোগ করেছেন যে, হুজুরের ছেলে হামিদুল্লাহ ও তাদের সহায়তায় এ পর্যন্ত প্রায় এক কোটি টাকা সংগ্রহ করা হয়েছে। কিন্তু মওলানা হামিদুল্লাহ সে টাকা খেলাফত তহবিলে জমা না দিয়ে ব্যক্তিগত একাউন্টে জমা রেখে সংগঠনকে তার ওপর নির্ভরশীল করে তুলেছে। সেই সঙ্গে তার সাথে যোগ দিয়েছে অধ্যাপক আখতার ফারুক ও শাহ আলম। তারা পার্থিব সুবিধা দিয়ে দলের অন্যান্য নেতৃবৃন্দকে দলে টেনে নিয়েছে এবং সংগঠনকে মওদুদীদের অনুসারী করে তুলেছে।

ইরান ও সৌদি আরবের সাথে সম্পর্ক

ইরানের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের পর হুজুরের ছেলে ও জামাতার সাথে ইরানী দূতাবাসের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন হয়। এতে ইরানের সাথে সরাসরি যোগাযোগ রক্ষাকারী হিজবুল্লাহ গ্রুপের কর্মকর্তারা রুষ্ট হয়ে যায় এবং খেলাফতের উক্ত নেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হয়ে ওঠে। এরকম অবস্থায় হিজবুল্লাহ নেতারা তাদের অপছন্দের কথা খেলাফত নেতা ও ইরানী বিপ্লবী পরিষদকে জানিয়ে দেন। ফলে ইরানের আর্থিক আনুকূল্য কমে যায় এবং মওলানা হামিদুল্লাহ ও সিরাজদ্দৌলা বিকল্প অর্থ যোগানের জন্য সৌদি একটি সূত্রের সাথে যোগাযোগ করে এবং সাফল্যও লাভ করেন। এ বছর হজে সৌদি বাদশার বিশেষ অতিথি হিসাবে দলের নায়েবে আমীর মওলানা আজিজুল হক, শিক্ষা সম্পাদক মওলানা মাযহারুল ইসলাম, দফতর সম্পাদক মওলানা আবুল কালাম এবং মজলিশে শুরার সদস্য এস এম আজিজুল হক সৌদি আরব সফর করেন।

অভ্যন্তরীণ বিরোধ ও সাংগঠনিক সম্পাদকের পদত্যাগ

অভ্যন্তরীণ বিরোধের কারণে সম্প্রতি খেলাফত আন্দোলনের সাংগঠনিক সম্পাদক হাবিবুল্লাহ মেজবাহ ‘ব্যক্তিগত অসুবিধার কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ করেছে।’ তিনি ব্যক্তিগত কারণ উল্লেখ করলেও ভিন্নমতাবলম্বীরা বলছেন এটা চরম বিরোধের ফলশ্রুতিতেই ঘটেছে। এদিকে দলের ২১ জন প্রকাশ্য বিবৃতি দিয়ে দলত্যাগ করেছেন। যদিও এদের কাছে হাফেজ্জী হুজুর আধ্যাত্মিক গুরু হিসাবে চিহ্নিত।

আখতার ফারুকের পাসপোর্ট ও বিদেশ গমন

এদিকে ২১ ডিসেম্বর মানিক মিয়া এভিনিউতে অনুষ্ঠিতব্য সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদের জাতীয় সমাবেশকে সফল করার লক্ষ্যে বিদেশ থেকে অর্থ আনার জন্য খেলাফত আন্দোলনের দুই সদস্য মওলানা হামিদুল্লাহ ও অধ্যাপক আখতার ফারুকের পাসপোর্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আদেশবলে আটক থাকা সত্ত্বেও তারা গোপনে বিদেশ গমন করেছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ইমিগ্রেশন—১ নং এ-৪৫/৮৩—বিওএইচআই (১) তাং ২৭-৮-৮৩ আদেশবলে এদের পাসপোর্ট আটক থাকলেও গত ১৫ নবেম্বর তারা ঢাকা ত্যাগ করেছে।

হুজুরের সাথে প্রেসিডেন্টের বৈঠক ও একজন নেপথ্য নায়ক

প্রেসিডেন্টের সাথে হাফেজ্জী হুজুরের সাক্ষাৎ এবং ১১ দলীয় সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদ গঠনের পেছনে একজন নেপথ্য নায়ক কাজ করেছেন বলে দলের ভিন্নমতাবলম্বী সূত্র থেকে জানা গেছে। এই নেপথ্য নায়কের নাম হচ্ছে, তোহা বিন হাবিব। তিনি ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়ে জেনারেল টিক্কা খানের দোসর ছিলেন এবং তাঁর গাড়িতে হর-হামেশা চলাফেরা করতেন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাক-হানাদার বাহিনী ভারতীয় সৈন্যদের কাছে আত্মসমর্পণ ও বন্দী হলে, জনাব হাবিবও বন্দী হন এবং পাক-বন্দী সেনাদের সঙ্গে ভারতে যান। ভারত থেকে পাক যুদ্ধবন্দীরা মুক্তি পেলে তিনিও তাদের সাথে মুক্তি পেয়ে পাকিস্তান চলে যান। তারপর তিনি পাকিস্তান থেকে সৌদি আরবে গিয়ে সৌদি রাজ পরিবারের আশ্রয়ে বাস করতে থাকেন। ৮ বছর সৌদি আরবে বাস করার পর তিনি কোটিপতি হয়ে বাংলাদেশে ফিরে আসেন। তবে তার ব্যবসা কি তা কেউ জানে না। তিনি জয়দেবপুরে ১শ’ বিঘা জমি ক্রয় করেছেন এবং মীরপুরে ১ নম্বর সেকশনে একটি বাড়ি করে সেখানে একটি ইসলামী কমপ্লেক্স খুলেছেন। সামরিক-বেসামরিক উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। প্রেসিডেন্টের সঙ্গে হাফেজ্জী হুজুরের সাক্ষাতের ব্যবস্থাটি তিনি এবং বুদ্ধিজীবী হত্যাকারী নায়ক হিসাবে চিহ্নিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী বিভাগের প্রফেসর ডঃ মোস্তাফিজ করিয়ে দেন। ইরানী রাষ্ট্রদূত এবং সৌদি চার্জ দ্য এফেয়ার্সের সঙ্গেও তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। তিনি আবার ইসলামী ডেমোক্র্যাটিক লীগেরও প্রধান উপদেষ্টা।

খেলাফত আন্দোলনের ভিন্নমতাবলম্বীরা জানিয়েছে. এই তোহা বিন হাবিবই সরকারের পক্ষে কাজ করার জন্য ১১ দলীয় সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদ নেপথ্য স্থপতি।

বিরোধ সম্পর্কে খেলাফতের বক্তব্য

খেলাফত আন্দোলনের সাম্প্রতিক কোন্দল, হুজুরের ছেলে ও জামায়াতের অর্থ আত্মসাৎ সম্পর্কে খেলাফত নেতা জেহাদ ও প্রশিক্ষক সম্পাদক মওলানা জাফরুল্লাহ খান বলেন, এসব মিথ্যা রটনা। শত্রুরা এইসব অপপ্রচার চালাচ্ছে। সম্প্রতি পত্র-পত্রিকায় প্রকাশত হাফেজ্জী হুজুরের সাবেক সেক্রেটারী ইসহাক ওবায়দীর বিভিন্ন বিবৃতির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, ইসহাক ওবায়দী ইসলামের শত্রুদের পক্ষে অপপ্রচার চালাচ্ছে। মওলানা ইসহাক খেলাফতের কোন কর্মকর্তা বা কর্মী ছিল কিনা; সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মওলানা ইসহাক ওবায়দী কোনকালেই খেলাফত আন্দোলনের কোন নেতা বা কর্মী ছিলেন না। তিনি হুজুরের একটি মাদ্রাসায় চাকরি করতেন। ১৯৮১ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় তিনি হুজুরের সঙ্গে বিভিন্ন স্থান গিয়েছেন মাত্র।

মওলানা ইসহাক অবশ্য বলেছেন, ওদের কথা চরম মিথ্যা। কারণ এখনও আমার প্রাথমিক সদস্যপদ রয়েছে। অথচ খেলাফত আন্দোলনে এমন কর্মকর্তাও আছেন; যাদের প্রাথমিক সদস্যপদ পর্যন্ত নেই।

ইসলামী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সাক্ষাৎকার

প্রশ্ন : গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে আপনার ধারণা কি?

আব্বাস আলী : গণতন্ত্র বলতে আমরা বুঝি রাষ্ট্র পরিচালনায় জনগণের অংশীদারিত্ব। জনগণের রায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সরকার গঠন করবেন এবং জনগণের মতামতের ভিত্তিতেই সরকার পরিবর্তন হবে। অস্বাভাবিক পন্থায় সরকার উৎখাত বা অপসারিত হবে না। নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় ব্যালটের মাধ্যমে সরকার বদল হবে। আধুনিক বিশ্বে শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য গণতন্ত্রের চাইতে উত্তম পন্থা আমাদের জানা নেই। সরকার গঠন ও পরিবর্তনে জনমতের ইচ্ছার প্রতিফলন এ ব্যবস্থার বিকল্প পন্থা সন্ত্রাস ছাড়া আর কিছুই নয়। শক্তি বলে ক্ষমতা দখল করার নীতি বর্জন করতে হলে গণতন্ত্র একমাত্র  বিকল্প।

ইসলামেও জনগণের মতামতের ওপর ভিত্তি করে সরকার গঠনের বিধান রয়েছে। জনগণের রায় না নিয়ে কেউ নিজেকে রাষ্ট্রপ্রধান বা প্রেসিডেন্ট কিংবা খলিফা বলে ঘোষণা করতে পারেন না। এক্ষেত্রে খোলাফায়ে রাশেদীনের দায়িত্ব গ্রহণই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তদানীন্তন সমাজে সম্ভাব্য পন্থায় জনমত যাচাইয়ের ভিত্তিতে জনগণের রায় নিয়েই তারা রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন। একথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করি যে, আমরা গণতন্ত্র বলতে হুবহু পশ্চিমা সংজ্ঞা বা মডেলের কথা বুঝাই না। সার্বভৌম ক্ষমতা কার হাতে থাকবে এ সম্পর্কে সেকুলার গণতন্ত্রের সাথে ইসলামের বুনিয়াদী পার্থক্য রয়েছে। ইসলাম কোরান ও সুন্নাহর খেলাফ কোন আইন রচনা করার অধিকার পার্লামেন্টকে দেয় না। গণতন্ত্র সম্পর্কে মোদ্দা করা হলো গণতন্ত্র হচ্ছে সরকার গঠন ও রাষ্ট্র পরিচালনায় শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের একটি প্রক্রিয়া।

আধুনিক যুগে ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ হলো ধর্মকে ব্যক্তি জীবনে সীমাবদ্ধ রাখা। ইসলাম এ জাতীয় কোন ধর্ম নয় এবং শুধু ব্যক্তিজীবনে সীমাবদ্ধ নয়। একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান হিসাবে ইসলামের নিজস্ব রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক বিধান আছে। সূরা বাকারার ৮৫ নং আয়াতে বলা হয়েছে যে, ‘তোমরা কি কোরানের এক অংশই মানো এবং আরেক অংশ অস্বীকার কর?’ ইসলামের কোন একটি দিক অস্বীকার করা গোটা ইসলামকে অস্বীকার করার নামান্তর।

হাফেজ্জী হুজুর : জাতি-ধর্ম ও শ্রেণী নির্বিশেষে গোটা মানব জাতিকে ইসলাম যে সমস্ত মৌলিক ও মানবিক অধিকার দিয়েছেন তা মানব রচিত কোন ব্যবস্থাতেই সম্ভব নয়। আমি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে চাই যে, প্রচলিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পৃথিবীর কোন মানুষের মৌলিক ও মানবিক অধিকার সংরক্ষণের একটি নজির স্থাপন করতে পারেনি। তাছাড়া গণতন্ত্রের সংজ্ঞাও অভিন্ন নয়।

আর ধর্ম নিরপেক্ষতা মূলতঃ আধুনিক রাজনীতির একটি দুর্বোধ্য শব্দ। অনেকে বলে থাকেন যে ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা, কিন্তু এটা নিছক নেতিবাচক বিশ্লেষণ। আমার বক্তব্য এই যে, ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ যদি হয় সকল ধর্মের প্রতি সহিষ্ণুতা এবং সকলকে স্ব-স্ব ধর্ম পালনের অধিকার প্রদান, তবে ইসলামই হচ্ছে একমাত্র ধর্মনিরপেক্ষ ব্যবস্থা। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ যদি সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা থেকে ইসলামকে নিয়ে গুটিকতক আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে আবদ্ধ করে রাখা তবে আপনিই বলুন ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মহীনতার মধ্যে পার্থক্য কোথায়।

 

সোলায়মান : স্বাধীন চিন্তাধারা প্রকাশ এবং সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও দায়িত্ব পালনে সুযোগ দেয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় গণতন্ত্রের বিরোধীরাও কাজ করার সুযোগ পায়। তবে গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় দায়িত্ব পালনের জন্য দায়িত্ববান নাগরিকের দরকার। কারণ  চরিত্রহীন দেশপ্রেম সন্ত্রাসবাদের জন্ম দেয়। একমাত্র ধর্মীয় অনুশীলনই চরিত্রবান নাগরিক সৃষ্টি করে—যা গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য। অতীতে ধর্মীয় ব্যবস্থায় গণতন্ত্র বিকাশের সহায়ক হয়েছে এবং তার প্রয়োজন এখনো একইভাবে প্রযোজ্য।

ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটি একটি ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি করেছে। যারা ধর্মনিরপেক্ষতার প্রবর্তক, তারা নিজেরাও ধর্ম বিশ্বাসী ছিলেন না। মধ্যযুগে ধর্মীয় প্রকারের সঙ্গে সঙ্গে পাপের অসহিষ্ণু রাজনৈতিক প্রভাবকে খর্ব করার জন্য ধর্মনিরপেক্ষতার জন্ম হয়। বর্তমান সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহে ধর্মনিরপেক্ষতার নামে প্রকৃতপক্ষে ধর্মীয় ব্যবস্থার প্রতি বিরোধিতা না থাকলেও কোন মর্যাদা প্রকাশ করা হয় না। এর ফলে ধর্মীয় ব্যবস্থার উন্নয়ন ও বিকাশের সুযোগ অত্যন্ত কম। যদিও এসব দেশে রাজনৈতিক কারণে ধর্মীয় সম্মেলনের ব্যবস্থা হয়ে থাকে। এর ফলে ধর্মনিরপেক্ষতা যথেষ্ট ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি করেছে। প্রকৃতপক্ষে কোন ধর্মই অপর ধর্মকে অস্বীকার বা অমর্যাদা প্রকাশ করে না। সুতরাং ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটি ব্যবহার না করে নীতিগতভাবে সকল ধর্মের সমান অধিকারের ব্যবস্থা করা যায়।

জালালাবাদী : গণতন্ত্রের বিখ্যাত সংজ্ঞা হচ্ছে, গভর্নমেন্ট অব দ্য পিপল ফর দ্য পিপল বাই দ্য পিপল। কিন্তু আমরা গণতন্ত্রের এই বল্গাহীন সংজ্ঞায় বিশ্বাস করি না। ইসলামী বিশ্বাসী হিসাবে আমরা বিশ্বাস করি সার্বভৌমত্ব একমাত্র আল্লাহর। আমরা তাঁর প্রতিনিধিরূপে তারই মর্জি মোতাবেক আমাদের অধিকার প্রয়োগ করবো। সুতরাং কোরান-হাদিস নিষিদ্ধ কোন ব্যাপার ভোটারদের মর্জির ওপর ছেড়ে দেওয়া যায় না। কেবল এর প্রয়োগ পদ্ধতি সম্পর্কে সীমিত মতামতই আমরা চাইতে পারি বা দিতে পারি। সুতরাং রাষ্ট্র ইসলামী আইন মোতাবেক চলবে নাকি পাশ্চাত্য বা প্রাচ্যের কোন রচিত ইজম অনুসারে চলবে, তা নিয়ে মুসলমানদের কাছে গণভোট চাওয়ার কোন অর্থ হয় না। কেননা মুসলমান মাত্রই কোরান-হাদিস অনুসারে রাষ্ট্র পরিচালানার পক্ষপাতি হবে এটাই স্বতঃসিদ্ধ। বর্তমানে বাংলাদেশে ইসলামের কথা স্থগিত রেখে গণতন্ত্রের প্রবক্তা জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা ও দর্শনদাতা মওলানা আবুল আলা মওদুদী পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ঘোর বিরোধিতা করে বলেছিলেন, ‘রাষ্ট্র যদি গণতন্ত্র অনুসারে চলে তবে এমন রাষ্ট্রে ইসলামের ভবিষ্যৎ নেই।’ অথচ এই ভদ্রলোকই ১৯৬৪ সালে তাঁর জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে নিজেই গণতন্ত্রের স্বার্থে ইসলামকে মূলতবী রেখে গণতন্ত্রের আন্দোলনে নেমে তাঁর অনুসারীদের গণতন্ত্রের অনুসারী হওয়ার সবক দিয়েছিলেন। আজকের বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী এরই অনুসরণ করে যাচ্ছে।

এদিকে ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতাকে অনেক সমার্থক বলে মনে করেন। অথচ মুসলমানের জীবনের মূল কথা হচ্ছে ‘আমার ইবাদত-বন্দেগী জীবন-মৃত্যু সবই আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের জন্য নিবেদিত (আল-কোরান)। সুতরাং রাজনীতির মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কি করে ধর্মনিরপেক্ষ হতে বা ধর্মীয় অনুশাসনের গন্ডীকে লংঘন করতে পারে? ইসলামেই ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের অধিকার সুসংরক্ষণের উত্তম ব্যবস্থা রয়েছে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলে পরিচিত ভারতেও ধর্মনিরপেক্ষতা বলে কিছু নেই। সেখানে গরু জবাইয়ের মত একটি ধর্মীয় ইবাদতকে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতে আনুকূল্যে বা তাদের কাছে জনপ্রিয় হওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর নিজ প্রভাব প্রয়োগের মাধ্যমে বন্ধ করে দেয়া হয়। অপরদিকে পাশ্চাত্যে অবস্থা কি ভারতের চাইতে ভালো? কৃষ্ণাঙ্গ মোহাম্মদ আলী কি শ্বেতাঙ্গ সমাজের গণতন্ত্রের কনসেশন পেয়েছিলেন?

প্রশ্ন : ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আপনি এবং আপনার দলের ভূমিকা কি ছিল এবং তা কি সঠিক ছিল?

আব্বাস আলী : ১৯৭১ সালে আমি এবং আমার দলের ভূমিকা ছিল ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ এবং আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে। উপমহাদেশের মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের ফলশ্রুতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত একটি দেশের সংহতি রক্ষা করাকে আমরা জনগণের জন্য কল্যাণকর মনে করেছিলাম। দেশে অবস্থান করে এবং জনগণের পাশে থেকে আমরা যে ভূমিকা পালন করেছিলাম তা জনগণের কাছে সুস্পষ্ট। এটা ছিল আমাদের একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। ৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের আগ পর্যন্ত আমরা রাজনৈতিকভাবে পাকিস্তানের অখন্ডত্বে বিশ্বাসী ছিলাম। কিন্তু বাংলাদেশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা বাস্তবতাকে মেনে নিয়েছি। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের নাগরিক হিসেবে বিশ্বস্ততা ও দেশপ্রেমিকতার পরিচয় দিয়েছি। বাংলাদেশ হওয়ার পর এদেশের বিশ্বস্ত নাগরিক হিসেবে আমাদের মূল আন্দোলন ইসলাম প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছি। বর্তমানে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষার সংগ্রামে আমরা জনগণের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যে ভূমিকা পালন করছি তাই প্রমাণ করে আমাদের ঐকান্তিকতা এবং আন্তরিকতা। তাই আমাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ যাই বলুক না কেন প্রকৃতপক্ষে জনগণই বলতে পারেন আমাদের ভূমিকা সঠিক ছিল কি অঠিক ছিল?

হাফেজ্জী হুজুর : (এই প্রশ্নটি হাফেজ্জী হুজুরকে করা হয়েছিল এইভাবে যে, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আপনার ভূমিকা কি ছিল? কারণ তখন তার দল ছিল না। তাই প্রশ্নে দল আনা হয়নি। তবে হাফেজ্জী হুজুর তার প্রশ্নোত্তরে বলেছেন) তখন রাজনৈতিক অঙ্গনে আমার সক্রিয় অংশ ছিল না। তবে জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের বিজয় অর্জনের জন্য আল্লাহ পাকের দরবারে ফরিয়াদ করেছি এবং প্রয়োজনবোধে শাসকদেরকে হিতোপদেশের মাধ্যমে সৎ পথ দেখানোর চেষ্টা করেছি।

সোলায়মান : আমার রাজনৈতিক আদর্শ হিসাবে আমি সব সময় লাহোর প্রস্তাবে বিশ্বাসী। ১৯৭০ সালে ৪ ডিসেম্বর পল্টন ময়দানের জনসভায় মওলানা ভাসানীর সঙ্গে আমি লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে তৎকালীন পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র রচনার দাবী করেছিলাম। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ আওয়ামী লীগ নেতারা যখন দেশত্যাগ করে চলে যান এবং আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান স্বেচ্ছায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে কারাববরণ করলে আমাদের মাঝে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। ফলে আমাদের পক্ষে দেশ ত্যাগ করে ভারত যাওয়া সম্ভব হয়নি। সর্বোপরি আমি কখনো বিশ্বাস করিনি যে স্বাধীনতা সংগ্রাম দেশের বাইরে থেকে পরিচালনা করে স্বাধীনতা অর্জন করা যাবে। তাছাড়া সে সময় আওয়ামী লীগ নেতারা এ দেশের কোটি কোটি মানুষকে আশ্রয়হীন অবস্থায় ফেলে ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেন। সে সময় দেশবাসীকে নির্যাতন থেকে রক্ষার লক্ষ্যেই ডাঃ মালেক নির্দলীয় মন্ত্রীসভা গঠন করেছিলেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ ও পরিষদ সদস্যগণ এই সরকার গঠনে সর্মর্থন জানিয়েছিলেন এবং দুই জন আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য মন্ত্রীসভায় যোগদান করেছিলেন। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যায় যে, এই মন্ত্রীসভা গঠনের কিছু পূর্বে বৃট্শি পার্লামেন্টারী ডেলিগেশন তৎকালীন পূব পাকিস্তান সফর করেন। বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা ও পরবর্তীকালে পাকিস্তানে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মরহুম জহিরুদ্দিন সাহেব বৃটিশ পার্লামেন্টারী ডেলিগেশনকে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে সংবর্ধনা দেন এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে একটি বেসামরিক সরকার গঠনের দাবী জানান। মালেক মন্ত্রীসভার কোন সামরিক ভূমিকা ছিল না। পরবর্তীকালে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর এই মন্ত্রীসভার সদস্যদের বিচারকালে তাদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামবিরোধী অথবা মানবতাবিরোধী কোন কার্যকলাপের অভিযোগ উত্থাপন করা হয়নি।

 

জালালাবাদী : ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে আমি অংশগ্রহণ করেছিলাম এবং ভারতে প্রশিক্ষণ নিতে গিয়েছিলাম।

প্রশ্ন : দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছিল এবং এই তত্ত্বকে অবধারিত সত্য বলে ধরে নেয়া হয়েছিল। কিন্তু ১৯৭১ সালে সাবেক পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন বাংলাদেশে রূপান্তরের ফলে দ্বি-জাতি তত্ত্বের অসারতা কি প্রমাণ হয়নি?

আব্বাস আলী : ১৯৭১ সালে সাবেক পূর্ব পাকিস্তান বাংলাদেশে রূপান্তরের ফলে দ্বি-জাতি তত্ত্ব আরো মজবুত হয়েছে। যদি বাংলাদেশ স্বাধীন অস্তিত্ব লাভ না করে ভারতের সঙ্গে বিলীন হয়ে যেতো তাহলেই দ্বি-জাতি তত্ত্বের অসারতার প্রশ্ন দেখা দিত। ভারতীয়রা একজাতি—কংগ্রেসের এই তত্ত্বের মোকাবিলায় হিন্দু ও মুসলিম দু’টি আলাদা জাতি সত্তা এবং তাদের ইতিহাস ঐতিহ্য সবই আলাদা এটাই ছিল দ্বি-জাতি তত্ত্বের মূল কথা। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তি হয়েছে দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে। সাবেক ভারত এখন তিনটি নেশন স্টেটে বিভক্ত। বর্তমান ভারতের অভ্যন্তরেও পৃথক জাতি সত্তার সংগ্রাম চলছে এবং ইদানীং তা ভারতীয় রাজনীতির অন্যতম কেন্দ্র বিন্দুতে পরিণত হয়েছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান ভেঙে তার একাংশ স্বাধীন বাংলাদেশ হিসাবে বিশ্বের মানচিত্রে আত্মপ্রকাশ করেছে এটা নিঃসন্দেহে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। কিন্তু এ ঘটনার মধ্যে উপমহাদেশে মুসলিম জাতি-সত্তা বিলুপ্ত হয়ে গেছে সূত্র অনুসন্ধান করার কোন যৌক্তিকতা নেই। বাংলাদেশের একটি পৃথক জাতি-সত্তা হিসেবে টিকে থাকাটাই হচ্ছে দ্বি-জাতি তত্ত্বের প্রত্যক্ষ ফল। প্রস্তাবে ভারতের জটিল রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানের জন্য তিনটি পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করেছিলেন। লাহোর প্রস্তাবের ফলে সৃষ্ট পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর নতুন রাষ্ট্রে বাঙালী, পাঠান, সিন্ধী প্রর্ভতি জাতির অস্তিত্ব সম্পর্কে সম্যক ধারণার অভাবে শাসনতান্ত্রিক সংকটের সৃষ্টি হয় এবং বাঙালী জাতির প্রতি যে অবিচার করা হয়, তারই ফলশ্রুতিতে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যূদয় ঘটে।

হাফেজ্জী হুজুর : কোরান ও সুন্নাহ ভিত্তিক ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার ওয়াদা করে মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাসভূমি প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। আল্লাহর সঙ্গে ওয়াদা খেলাপীর পরিণতিতেই পাকিস্তান দ্বি-খন্ডিত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যূদয় ঘটেছে। কিন্তু নাম বদল হলেও ভূ-খন্ড বদলায়নি। আমি মনে করি বাংলাদেশের জমিনে ইসলামী হুকুমত কায়েমের মাধ্যমে আল্লাহর সঙ্গে কৃত ওয়াদা পূরণই জাতীয় মুক্তির বিকল্পহীন পথ।

সোলায়মান : ভারত বর্ষে কোনকালেই এক জাতি ছিল না এবং এখনো নেই। ভারতের সংবিধানেই বহু জাতির অস্তিত্ব স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। বৃটিশ ভারতে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ব্রাহ্মণ্য সাম্রাজ্যবাদ সৃষ্টির জন্য যে প্রচেষ্টা চলে এবং যে উগ্র সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি করা হয়, তারই ফলে অপেক্ষাকৃত পশ্চাতপদ মুসলিম জনসংখ্যা তাদের জন্য একটি পৃথক বাসভূমি দাবী করে।

জালালাবাদী :  বাংলাদেশের অভ্যূদয়ে দ্বি-জাতি তত্ত্বের অসারতা মোটেই প্রমাণিত হয়নি। দ্বি-জাতি তত্ত্ব বলেই তো পশ্চিমবঙ্গের দাদারা ১৯০৫ সালে যে বঙ্গভঙ্গকে ‘মাতা দ্বি-খন্ডিতকরণ’ বলে ‘মাগো তোমার নয়ন জলে ভাসি’ উচ্চারণ করে বুক চাপড়িয়ে ছিলেন; তারা এরপর ৪১ বছর পার না হতেই অখন্ড বাংলাকে পূর্ব ও পশ্চিম দুই বঙ্গে বিভক্ত করার জন্য জেদ ধরেন এবং কৃতকার্যও হন। দ্বি-জাতি তত্ত্ব যদি সত্যই না হবে তবে মহাত্মা গান্ধীর মত মহান হৃদয় ও অপেক্ষাকৃত কম সাম্প্রদায়িক মণীষী কি করে বাংলার হিন্দু সমাজকে এ জাতীয় দাবী তোলার জন্য উৎসাহিত করেছিলেন? দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে আমাদের রাষ্ট্রীয় স্বতন্ত্রের যৌক্তিকতা নিহিত। নতুবা আমাদেরকে কলকাতার দাদাদের মতই দিল্লীর জয়গান গাইতে হবে। স্বতন্ত্র বাংলাদেশের অস্তিত্ব ও কাঁটা তারের বেড়া নিরর্থক হয়ে যাবে। ’৭১ সালে আমরা কেবলই পাকিস্তানীদের অত্যাচার ও শোষণ থেকে মুক্তি চেয়েছি। ইসলামের বা মুসলিম জাতীয়তার বিরুদ্ধে আমরা জেহাদ ঘোষণা করিনি। মূলতঃ ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবে এক জাতির জন্য দুটি স্টেট চাওয়া হয়েছিল। বস্তুতঃ ’৭১ সালে বাংলাদেশের অভ্যূদয়ে দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভুল প্রমাণিত হয়নি; বরং অপূর্ণতারই প্রমাণিত হয়েছে। ভারতীয় জাতীয়তাবাদী নেতাদের ভারতীয়রা এক জাতি বলার জবাবেই কেবল দ্বি-জাতি তত্ত্বের ফর্মূলা দেওয়া হয়েছিল। যা এখনকার জন্য প্রযোজ্য ছিল। ’৭১ সালে প্রমাণিত হয়েছে ভারতবর্ষের মুসলমানরা তিন জাতি যথা : ভারতীয়, পাকিস্তানী ও বাংলাদেশী।….

প্রশ্ন : ধর্ম ব্যক্তির নিজস্ব ব্যাপার। এটা সামাজিক বা রাষ্ট্রীয়ভাবে চাপিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন আছে কি?

আব্বাস আলী : ধর্মকে যদি ব্যক্তিগত আচার অনুষ্ঠান বলে ধরে নেওয়া হয় তাহলে ধর্মকে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যাপার বলে চালিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু ইসলাম আমাদেরকে ধর্ম সম্পর্কে যে ধারণা দেয় এবং ইসলামের শেষ নবী (দঃ) তাঁর বাস্তব জীবনে যেভাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সে আলোকে সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলাম না মেনে চলার কোন যৌক্তিকতা নেই। বরং মানুষ ব্যক্তি সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে একমাত্র আল্লাহর হুকুমই মেনে চলবে এটাই ইসলামের শিক্ষা। এখানে চাপিয়ে দেয়ার প্রশ্ন আসে না। জনগণের রায় ও অনুমোদন নিয়েই ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হবে। যেমন মক্কার জনগণ ইসলাম মেনে নেয়নি পক্ষান্তরে মদীনার জনগণ ইসলামকে স্বাগত জানিয়েছিল বলেই মহানবী (দঃ) সর্বপ্রথম মদীনায় ইসলাম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন।

হাফেজ্জী হুজুর : ব্যক্তি জীবন, সমাজ জীবন ও রাষ্ট্রীয় জীবনের সকল ক্ষেত্রেই ইসলামের সুস্পষ্ট ও পূর্ণাঙ্গ বিধান রয়েছে। ইসলামকে আল্লাহর মনোনীত দ্বীনরূপে স্বীকার করে নেওয়ার পর সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে ইসলামের অনুশাসন মেনে নিতে কোন মুসলমানের মনেই দ্বিধা থাকার কথা নয়।

সোলায়মান : যেহেতু ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন পদ্ধতি, সেহেতু এটা ব্যক্তিগতভাবে চাপানোর ব্যাপার নয়। জীবন যাপনের সর্বস্তরে ইসলামী অনুশাসন প্রতিষ্ঠা আবশ্যক।

জালালাবাদী : আল্লাহ বলেছেন, যারা আল্লাহর অবতীর্ণ হুকুম অনুযায়ী শাসন করে না তারা কাফের (আল কোরান)। সুতরাং আল্লাহ এবং তাঁর রসুলের ওপর যাদের আস্থা আছে, তাদের সকলেরই উচিত সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে আল্লাহর উক্ত নির্দেশের প্রতিফলন ঘটানোর ব্যবস্থা করা।

প্রশ্ন : পৃথিবীর বহু মুসলিম দেশ আছে যেখানে ইসলামকে জীবন যাপনের ক্ষেত্রে প্রধান স্থান দিলেও রাষ্ট্রকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করা হয়নি। এ ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কি?

আব্বাস আলী : রাষ্ট্র পরিচালনা থেকে শুরু করে জীবনের সর্বক্ষেত্রে ইসলামী আদর্শ বাস্তবায়ন করতে হবে এটাই ইসলামের দাবী। শুধুমাত্র ইসলামী প্রজাতন্ত্র ঘোষণার মধ্যে কোন তাৎপর্য নেই। ইসলামী প্রজাতন্ত্র গড়ে তোলার জন্য চাই সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও কর্মসূচী। অতীতেও ইসলামী প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু ইসলামের আলোকে ইনসাফভিত্তিক শোষণহীন সমাজ কায়েম হয়নি। সুতরাং ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠাই হচ্ছে বড় কথা। আর জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশে এজন্যে বিশ্ব মানবতার মুক্তিদূত হযরত মুহাম্মদ (দঃ)-এর প্রদর্শিত বৈজ্ঞানিক পন্থা ও কর্মসূচী নিয়ে আপোষহীন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। এ আলোকে বিভিন্ন দেশে ইসলামকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠার আন্দোলন চলছে। তারই ফলে কোন কোন দেশে ইসলামী আইন ও সমাজ ব্যবস্থা ক্রমান্বয়ে চালু হচ্ছে।

সোলায়মান : মালয়েশিয়ায় ইসলামকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও ইসলামী প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করা হয়নি। তবে ঐদেশে ইসলামী আইনের বাইরে কিছু হয় না। সুতরাং ইসলামী আইন প্রবর্তন করতে ইসলাম প্রজাতন্ত্র ঘোষণার সমস্যা কোথায়।

জালালাবাদী :  বিশ্বের সবগুলো মুসলিম রাষ্ট্র ইসলামী অনুশাসন অনুযায়ী চলুক এটাই আমাদের কাম্য।

প্রশ্ন : ধর্ম ও রাজনীতি একই সঙ্গে চলতে পারে কি? যদি পারে তাহলে আমাদের দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি কেন বার বার ব্যর্থ হচ্ছে?

আব্বাস আলী : আমাদের দেশের অধিকাংশ লোক ইসলামের অনুসারী। ইসলাম প্রচলিত অর্থে কোন ধর্ম নয়। ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান, একটি বিশ্বজনীন বিপ্লবী আদর্শ। কোরানের ভাষায় আল্লাহর পক্ষ থেকে ইসলামই হচ্ছে একমাত্র মনোনীত জীবন ব্যবস্থা (ইন্নাদ্দিনা এনদাল্লাহেল ইসলাম—আল কোরান—সূরা আল এমরান ১৯ নং আয়াত)। মানব জীবনের এমন কোন ক্ষেত্র নেই, যে সম্পর্কে ইসলাম মূলনীতি নির্ধারণ করেনি। ইসলামে ধর্ম ও রাজনীতিকে আলাদা করার কোন অবকাশ নেই। রাজনীতি ইসলামের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাই আমার বক্তব্য হচ্ছে ইসলামের দৃষ্টিতে ধর্ম ও রাজনীতি আলাদাভাবে চলতেই পারে না।

আমাদের দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ব্যর্থ হয়েছে একথা ঠিক নয়। বরং সত্যিকারভাবে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি না করে কিছুসংখ্যক লোক রাজনৈতিক স্বার্থে ধর্মকে ব্যবহার করেছে জনগণের সমর্থন আদায় করার জন্য। ইসলামের ভিত্তিতে রাজনীতি পরিচালিত হয়নি। সুতরাং ব্যর্থতার প্রশ্নেই ওঠে না। বরং বলা যায় আমাদের দেশের রাজনীতিতে বার বার ইসলামের প্রভাবই প্রমাণিত হয়েছে। ইসলামী রাজনীতির চর্চা দিন দিন আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে।

হাফেজ্জী হুজুর : প্রতিটি মুসলমানের একথা বিশ্বাস করতে হবে যে, ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ ইহকালীন ও পরকালীন জীবন ব্যবস্থা। অতএব রাজনীতিহীন ধর্ম কিংবা ধর্মহীন রাজনীতি কোনটাই ইসলাম নয়। রাজনীতির অঙ্গনে ধর্মকে টেনে এনে ধর্মের পবিত্রতা নষ্ট না করার কথা বলা হচ্ছে। আমি মনে করি প্রচলিত রাজনীতি অপবিত্রতা দূর করার জন্যই ইসলামী রাজনীতির প্রয়োজন রয়েছে। তওবা ভিত্তিক রাজনীতিক এটাই হলো মূল কথা।

বর্তমান সামরিক সরকারসহ অতীতের ক্ষমতাসীন মহল নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের হীন উদ্দেশ্য বার বার ইসলামের নাম অপব্যবহার করে ইসলামী আন্দোলনের যথেষ্ট ক্ষতিসাধন করছে। তবে নয় কোটি তাওহিদী জনতা আজ পূর্ণ সচেতন।

সোলায়মান : মহাত্মা গান্ধী একবার বলেছিলেন, ‘ধর্ম ছাড়া যারা রাজনীতির কথা চিন্তা করেন, তারা নাকবিহীন মানুষের মত অবস্থাকেই সমর্থন করে।’ আসলে ধর্ম একটা জীবন পদ্ধতি। এটা সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে। বাঙালী প্রকৃতপক্ষে ধর্মভীরু জাতি। আমাদের জাতীয় জীবনে ধর্মের প্রভাব অসামান্য। এজন্য রাজনৈতিক কর্মকান্ড থেকে ধর্মকে বাদ দেয়া সম্ভব নয়। এটা পরস্পর পরিপূরক। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাও ধর্ম ছাড়া টিকে থাকতে পারে না। বিশ্বের যেসব দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সাফল্য লাভ করেছে—সেখানে আদর্শ জাতীয় চরিত্র সৃষ্টিতে ধর্ম অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছে। আমাদের দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ব্যর্থ হয়েছে এটা ঠিক নয়। বরং গণতান্ত্রিক নীতিমালার ওপর আমাদের আস্থার অভাবই রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টির মূল কারণ।

জালালাবাদী : ধর্ম ও রাজনীতি এক সঙ্গে চলতে পারে না এতে কোন সন্দেহ নেই। তবে প্রয়োগ করার পরই ব্যর্থতার প্রশ্ন ওঠে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত প্রয়োগ হয়নি।

প্রশ্ন : ইরানের ইসলামী বিপ্লব সম্পর্কে আপনাদের বক্তব্য কি?

আব্বাস আলী : ইরানের জনগণ ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের মাধ্যমে জালেম শাহের ডিক্টেটরশীপের পতন ঘটায় বলেই জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ ইরানী জনগণকে মোবারকবাদ জানায়। আমরা কামনা করি যে ইরান একটি সত্যিকারের ইসলামী রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে উঠুক। আমরা ইরানকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছি। এ ব্যাপারে চূড়ান্ত মতামত দেবার সময় এখনো আসেনি।

হাফেজ্জী হুজুর : (ইরানের বিপ্লব সম্পর্কে হাফেজ্জী হুজুরকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘আপনারা ইসলামী বিপ্লবের কথা বলছেন। এটা কি ইরানের ইসলামী বিপ্লবের মত হবে? হাফেজ্জী হুজুর তার উত্তরে বলেছেন) ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ ও চিরন্তন জীবন ব্যবস্থা এবং রসুলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাই ওয়াছাল্লাম ও খোলাফোয়ে রাশেদীনের পবিত্র জীবনই হচ্ছে ইসলামী রাষ্ট্রের নমুনা। এরপর অন্য কোন মডেল যুক্ত করতে যাওয়া নিছক শয়তানী।

সোলায়মান : এটা তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। ইরানে না গিয়ে বাইরের থেকে আমরা যে খবরাদি পাই তা দিয়ে প্রকৃত মূল্যায়ন সম্ভব নয়।

জালালাবাদী : রাজতন্ত্রকে অপসারণ করে ইরানে ইসলামী বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে। তাতে আমরা বেশ উৎসাহবোধ করছি। তবে ইরান এবং ইরানের বর্তমান নেতাদের সম্পর্কে পাশ্চাত্যের প্রচার মাধ্যমগুলো যেভাবে খবরাদি প্রচার করছে তাতে আমরা সন্দিহান।

 

ইসলামী ফ্রন্ট নেতার মূল্যায়ন

ইসলামী ফ্রন্টের চেয়ারম্যান মফিজুর রহমান রোকন জামায়াত সম্পর্কে বলেন, দেশে একটা ইসলামী জাগরণ এসেছে। এই জাগরণকে অন্যদিকে ধাবিত করার জন্য গণধিকৃত এই দলটি মওদুদীর ইসলাম কায়েমের জন্য মাঠে নেমেছে। এরা ১৫ দলের কর্মসূচীকে অনুসরণ করছে। ১৫ দল যদি আরেকবার সরকার গঠনের সুযোগ পায়, তাহলে তারা ধর্মনিরপেক্ষতার নামে মানুষকে ধর্মহীন, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকার হরণ এবং বাংলাদেশকে ভারতের সিকিমে পরিণত করবে।

তিনি হাফেজ্জী হুজুর সম্পর্কে বলেন, আমরাই প্রথম বায়তুল মোকাররমে ইসলামী হুকুমতের কথা বলি। এর আগে হাফেজ্জী হুজুর কোন কথা বলেননি। তিনি নাম উল্লেখ না করে বলেন যে, একজন প্রভাবশালী পীরের নেতৃত্বে পরিচালিত একটি দল বাংলাদেশে খোমেনীর ইসলাম কায়েম করার জন্য কাজ করছে। আমরা মনে করি রসুল (দঃ) যে ইসলাম দিয়েছেন সেটাই প্রকৃত ইসলাম। এর বাইরে খোমেনী কিংবা মওদুদীর ইসলাম এদেশের জনগণ গ্রহণ করবে না।

জনাব রোকন ইসলামী যুক্তফ্রন্টের এ এস এম সোলায়মানের প্রতি ইসলামী ফ্রন্টের নামে অর্থ আত্মাসাতের অভিযোগ এনে বলেন, সোলায়মান সাহেব একটি মহল থেকে ১৫ লাখ টাকা এবং প্রতিবেশী একটি দেশের একটি রাজ্যের মূখ্যমন্ত্রীর কাছ থেকে ফান্ড লাভ করেছেন এবং তিনি তা আত্মসাৎ করেছেন। জনাব সোলায়মান তখন আমাদের সঙ্গে ইসলাম ফ্রন্টে কাজ করতেন। এই অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ সম্পর্কে আমরা তদন্ত কমিটি গঠন করি। কিন্তু সোলায়মান সাহেব তদন্ত কমিটি মোকাবিলা করার ভয়ে ফ্রন্ট ত্যাগ করে পরবর্তীতে ইসলামী যুক্তফ্রন্ট গঠন করেছেন। তিনি বলেন, সোলায়মানের ফ্রন্টের একজন শরীক এ কে এম ফারুক বিএডিসির বীমা বিভাগের কেরানী এবং এই ফ্রন্টের আরেকজন নেতা দেলোয়ার হোসেন একাধারে যুক্তফ্রন্টের নেতা, অপরদিকে ওলামা পরিষদের মহাসচিব এবং জনস্বাধীন ট্রেড ইউনিয়নের অতিরিক্ত মহাসচিব।

০০০

জামাতে ইসলাম ছাড়া ৬৫টি ইসলাম পসন্দ দলের ফ্রন্টসমূহ

সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদ

১। খেলাফত আন্দোলন—সভাপতি মওলানা মোহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর।

২। জাতীয় মুক্তি আন্দোলন—সভাপতি মেজর (অবসরপ্রাপ্ত) জলিল।

৩। ইসলামিক ডেমোক্র্যাটিক লীগ—সভাপতি মওলানা আবদুর রহিম।

৪। জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম ও নিজামে ইসলাম পার্টি—সভাপতি মওলানা আবদুল মালেক হালিম।

৫। খেলাফতে রব্বানী পার্টি—সভাপতি প্রিন্সিপ্যাল আবুল কাসেম।

৬। ইসলামী যুব শিবির—সভাপতি আহমেদ আবদুল কাদের।

৭। খাদেমুল ইসলাম জামায়াত—সভাপতি মওলানা হোসেন আহমেদ।

৮। মজলিশে তাহাফুজে খতমে নবুয়ত—সভাপতি মওলানা আবদুল জব্বার।

৯। মজলিশে দাওয়াতুল হক—সভাপতি মওলানা আবদুল হাই।

১০। ইসলামিক রিপাবলিক পার্টি—সভাপতি এডভোকেট হাবিবুল্লাহ চৌধুরী।

১১। ইসলামী যুব আন্দোলন—সভাপতি এ টি এম হাপেজ হেমায়েতউদ্দিন।

০০০

ইসলামী যুক্তফ্রন্ট (সোলায়মান)

১। কৃষক শ্রমিক পার্টি—সভাপতি এ এস এম সোলায়মান।

২। ইসলামিক ডেমোক্র্যাটিক লীগ—সভাপতি শফিকুল রহমান।

৩। রিপাবলিক পার্টি—সভাপতি এডভোকেট শরাফত হোসেন।

৪। প্রগশ—সভাপতি হারুনার রশিদ।

৫। ওলামা ফ্রন্ট—সভাপতি মওলানা হাবিবুল্লাহ।

৬। ইসলামী সংহতি পরিষদ—মওলানা মোহাম্মদ সাদেক।

৭। বাংলাদেশ তানজিমুল ওলামা পার্টি—সভাপতি ক্বারী ‍রুহুল আমিন।

৮। বাংলাদেশ ইসলাহুল মুসলিম পার্টি—আলহাজ মওলানা আবুল বশার।

৯। নেজাম-ই-ইসলাম পার্টি—আলহাজ মোহাম্মদ আকিল।

১০। বাংলাদেশ জাতীয় দল—আর আর সিদ্দিকী।

১১। বাংলাদেশ ওলামা দল—মওলানা এ কে এম ফারুক।

১২। বাংলাদেশ ওলামা সমিতি—মওলানা আবদুল কাদের শরিয়তপুরী।

১৩। বাংলাদেশ ন্যাশনাল ওলামা পার্টি—সভাপতি মওলানা মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন।

১৪। বাংলাদেশ গণমুসলিম লীগ—সভাপতি কাজী আবুল বশার।

১৫। কৃষক সমিতি ভাসানী—সভাপতি সৈয়দ হারুন-উর-রশীদ।

১৬। হুকুমতে রব্বানী পার্টি—কাজী হাফেজ মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ।

১৭। বাংলাদেশ ভূমিহীন কৃষক সমিতি—সভাপতি মজিবুল হক।

০০০

ইসলামী যুক্তফ্রন্ট (জালালাবাদী)

১। বাংলাদেশ ইসলামী বিপ্লবী পরিষদ—চেয়ারম্যান মওলানা শেখ ওবায়দুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী।

২। প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তি—সভাপতি আলতাবউদ্দিন তালুকদার।

৩। ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি—সভাপতি মেজর (অবসরপ্রাপ্ত) আফসারউদ্দিন।

৪। আওয়ামী ওলামা পার্টি—মওলানা খায়রুল ইসলাম যশোরী।

৫। মুসলিম জাতীয় দল—সভাপতি এম এ লতিফ মজুমদার।

৬। জাতীয় সেবক দল—সভাপতি মওলানা এনায়েতুল্লাহ টুকেরবাজারী।

৭। খাকসার পার্টি—সভাপতি মৌলবী আবদুস সামাদ।

৮। জাতীয় ওলামা দল—সভাপতি মওলানা রুহুল আমিন।

৯। ইসলামী ন্যাশনালিস্ট পার্টি—সভাপতি আবদুল হাফিজ চৌধুরী।

১০। ইসলামী ডেমোক্যাটিক পার্টি—সভানেত্রী মহাতারেমা আরেম বেগম।

১১। হুকুমতে রব্বানী পার্টি—সভাপতি কে এম সিদ্দিকুল্লাহ।

১২। কৃষক সমিতি ভাসানী—সভাপতি নূরুদ্দিন খান টেপু।

১৩। ইসলামী সেবক দল—সভাপতি—

১৪। বাংলাদেশ ওলামা পার্টি—সভাপতি মওলানা ইব্রাহিম খলিল আজাদী।

১৫। ন্যাশনাল প্রগ্রেসিভ পার্টি—সভাপতি মওলানা আলী আক্কাস।

১৬। ইসলামী গণতন্ত্রী দল—সভাপতি শেখ মোহাম্মদ সাঈদ।

০০০

ইসলামী ফ্রন্ট

১। ন্যাশনাল প্রগ্রেসিভ পার্টি—সভাপতি মফিজুর রহমান রোকন।

২। মুসলিম ডেমোক্র্যাটিক লীগ—সভাপতি ডাঃ এ বি কাবিল আহমেদ।

৩। বাংলাদেশ লেবার পার্টি—চেয়ারম্যান শেখ ওয়াহিদুল হক।

৪। বাংলাদেশ লেবার পার্টি (সিকদার)—চেয়ারম্যান ডাঃ আবদুল মোতালেব সিকদার।

৫। জামায়াতে তালিমুদ্দিন—সভাপতি মওলানা মোহাম্মদ মোস্তফা আমির।

৬। ন্যাশনাল ইসলামী পার্টি—আহ্বায়ক মওলানা মাযহারুল ইসলাম।

৭। জাতীয় ওলামা পার্টি—আহ্বায়ক মওলানা আহমেদুল হক।

৮। ইসলামী বাস্তুহারা পার্টি—সভাপতি আফতাবউদ্দিন মাস্টার।

৯। জাতীয় ইসলামী দল—আহ্বায়ক মওলানা আলী হোসেন।

১০। মুসলিম রিপাবলিকান পার্টি—আহ্বায়ক এ টি এম শহীদুল হক।

১১। ইসলামী খেলাফত পার্টি—চেয়ারম্যান মওলানা মাহবুবুল আলম।

১২। ইসলামী কৃষক পার্টি—আহ্বায়ক আবদুল ওয়াহাব।

১৩। ন্যাপ (হাওলাদার)—সভাপতি এডভোকেট শওকত আলী হাওলাদার।

১৪। বাংলাদেশ জিকিরুল্লাহ পার্টি—সভাপতি মওলানা আমির হোসেন খান।

১৫। ইসলামী গণ-আন্দোলন—চেয়ারম্যান ডাঃ নজরুল ইসলাম চৌধুরী।

১৬। ন্যাশনালিস্ট ইসলামী পার্টি—সভাপতি হাফিজউদ্দিন চৌধুরী।

১৭। পল্লী ভূমিহীন কৃষক সমিতি—চেয়ারম্যান আজাদ সুলতান।

১৮। ইসলামী মুজাহিদ পার্টি—আহ্বায়ক ডাঃ কামাল আহমেদ।

১৯। তাজদিদে ইসলাম—সভাপতি মওলানা হাফিজুল্লাহ।

২০। ইসলামী মুক্তি আন্দোলন—সভাপতি ডাঃ মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন।

০০০

[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/05/1984.11.30-bichitra.pdf” title=”1984.11.30 bichitra”]