You dont have javascript enabled! Please enable it!

মােশতাকের স্পিকার-হুইপ-মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ কপিরাইট সমস্যা যাতে না হয় সেকারণে সকল লেখা শুধুমাত্র ‘only Readable’, ‘non-downloadable’ ও ‘non-clickable’ রাখা হয়েছে। সংগ্রামের নোটবুকের সকল নথি-পত্রিকা-দলিল-সংকলন-বই থেকে নেয়া তথ্য-ছবি-ভিডিও শুধুমাত্র গবেষণার কাজে ব্যবহার্য। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষণার জন্য সংগ্রামের নোটবুক একটি অলাভজনক অবাণিজ্যিক স্বেচ্ছাশ্রমে গড়া প্রচেষ্টা।

বাঙালি জাতির প্রাণপ্রিয় নেতা, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বা শাসকগােষ্ঠী হত্যা করতে পারেনি। সে দুঃসাহস তাদের ছিল না। পাকিস্তানের লায়ালপুর কারাগারে কারারুদ্ধ থাকাকালে এক প্রহসনিক বিচারে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হলেও তা কার্যকর করার মতাে হিম্মত ছিল না ইয়াহিয়া কিংবা জুলফিকার আলী ভুট্টোর। পরবর্তী পর্যায়ে তাদের সেই অসম্পূর্ণ মিশন সম্পন্ন করিয়েছিল এদেশীয় এজেন্টদের মাধ্যমে। মুক্তিযুদ্ধকালে যেসব বিশ্বাসঘাতক স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরােধিতার মাধ্যমে প্রকারান্তরে অখণ্ড এক পাকিস্তান সংরক্ষণের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল, অতঃপর যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা মেনে নিতে পারেনি, তারাই পরবর্তী সময়ে বাঙালি জাতির সার্বভৌমত্ব বিপর্যস্ত করার জন্য তৎপর হয়ে উঠেছিল।
যারা একদিন বঙ্গবন্ধুর সামান্য সহানুভূতি পাওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকত, তারাই অতঃপর সংকীর্ণ স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে তাঁকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য হয়ে উঠেছিল অস্থির। এ ষড়যন্ত্রচক্রের অন্যতম হােতা ছিলেন খন্দকার মােশতাক আহমদ, শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন, কে এম ওবায়দুর রহমান ও তাহের উদ্দিন ঠাকুরের মতাে বঙ্গবন্ধুর আস্থাভাজন রাজনৈতিক নেতাগণ। এদের সাথে সামিল ছিল সামরিক-বেসামরিক আমলাগােষ্ঠী, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক কায়েমী স্বার্থবাদী গােষ্ঠী। এদের প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষ প্ররােচণায় বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। অতঃপর আপামর জনগণ ও বৈশ্বিক পরিসরে ধোকা দেওয়া ও ষড়যন্ত্রকারীদের জঘন্য হত্যাযজ্ঞ জায়েজ করার জন্য বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রি পরিষদের ও আওয়ামী লীগের নেতাদের দিয়েই গঠন করা হয়েছিল খন্দকার মােশতাকের সরকার কাঠামাে। এদের কেউ কেউ ছিলেন হত্যা ষড়যন্ত্রে সরাসরি সম্পৃক্ত, কেউ কেউ ছিলেন ঘটনার শিকার এবং কেউ কেউ ছিলেন বন্দুকের নলের মুখে সমর্পিত। অনেকেই পরবর্তী সময়ে খন্দকার মােশতাকের পতনের পর ফিরে গেছেন তাদের আওয়ামী লীগে। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত থেকেছেন বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের প্রতি সমর্পিত। কেউ কেউ নীতিচ্যুত হয়ে ডিগবাজি দিয়ে ভিড়েছেন স্বাধীনতার আদর্শবিরােধী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে। অনেকে স্থিত হয়েছেন তাদের

পৃষ্ঠা: ৪২
কাক্ষিত আওয়ামী লীগের ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও স্বাধীনতার মূল্যবােধ বিরােধী রাজনৈতিক সংগঠনে। এদের মধ্যে দুজন ছিলেন টেকনােক্র্যাট মন্ত্রী, এ দুজন ছিলেন বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত আস্থাশীল ও শ্রদ্ধাভাজন। এরাও কোনাে প্রতিবাদ জানাননি কিংবা মন্ত্রিত্বের প্রস্তাব প্রত্যাখান করেননি।
পরিতাপের বিষয় বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর খন্দকার মােশতাক আহমদ কর্তৃক গঠিত ২১ সদস্যবিশিষ্ট অবৈধ মন্ত্রিসভার ২০ জনই ছিলেন বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার সদস্য। জাতির পিতার সুদিনের এই সুহৃদরা যখন মন্ত্রিত্বের শপথ গ্রহণের জন্য ব্যতিব্যস্ত বা অপেক্ষমান ছিলেন; তখনও বঙ্গবন্ধু, তার পরিবার ও অন্যান্য শহীদের মরদেহ অযত্নে-অবহেলায় পড়ে ছিল ধানমন্ডি ৩২ নাম্বারের বাসভবনসহ অন্যান্য স্থানে। সেদিন তারা যদি এভাবে খুনি মােশতাকের প্রতি সমর্পিত না হতেন, ক্ষেত্র বিশেষে অস্ত্রের মুখেও মন্ত্রিত্ব গ্রহণে অস্বীকৃত হতেন, খুনি সরকারকে সমর্থন না করতেন, তাহলে হয়তাে ইতিহাস অন্যপথে প্রবাহিত হতাে, এমনটাই মনে করে থাকেন আজকের দিনের অনেক নেতাকর্মী-গবেষক। এই তথাকথিত আওয়ামী নেতারা যদি সেদিন চার জাতীয় নেতার মতাে অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করার প্রশ্নে অনড় থাকতেন, প্রয়ােজনে খুনিদের বন্দুকের নলের মুখে বুক পেতে দিতেন, তাহলে হয়তাে খুনিচক্র অত সহজে পার পেত না, দেশটিকেও স্বাধীনতার মূল্যবােধ বিরােধী স্রোতে ভাসিয়ে দেয়াও সহজ হতাে না। খুনিদের বিচারের জন্যও জাতিকে হয়তাে ৩৮ বছর অপেক্ষা করতে হতাে না।
খন্দকার মােশতাকের ৮১ দিনের অসাংবিধানিক শাসনামলে (১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সাল থেকে ৬ নভেম্বর পর্যন্ত) মন্ত্রিত্বের আসনে আসীন হয়ে সেই অবৈধ সরকারকে সহায়তা করেছিল বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভারই ২০ জন সদস্য। সে সময় খন্দকার মােশতাক উপরাষ্ট্রপতি পদে পদায়ন করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর শাসনামলের রাষ্ট্রপতি-মন্ত্রী পদে দায়িত্ব পালনকারী মােহাম্মদউল্লাহকে। জাতীয় সংসদের স্পিকারের দায়িত্বে বহাল রাখেন বঙ্গবন্ধুর শাসনামলের স্পিকার আব্দুল মালেক উকিলকে। চিফ হুইপ পদে পদায়িত করা হয় ডেপুটি চিফ হুইপ হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী আব্দুর রউফকে। সেসময় মন্ত্রিপরিষদে ১. আবু সাঈদ চৌধুরী-পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২. এম. ইউসুফ আলী-পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় ৩. ফণীভূষণ মজুমদার-স্থানীয় সরকার, পল্লি উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় ৪. সােহরাব হােসেন- গণপূর্ত ও গৃহায়ন মন্ত্রণালয় ৫. আব্দুল মান্নান-স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় ৬. শ্রী মনােরঞ্জন ধর-আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ৭. আব্দুল মমিন-কৃষি ও খাদ্য মন্ত্রণালয় ৮. আসাদুজ্জামান খান-বন্দর, জাহাজ চলাচল মন্ত্রণালয় ৯. ড. আজিজুর রহমান মল্লিক-অর্থ মন্ত্রণালয় এবং ১০. ড. মােজাফফর আহমেদ চৌধুরীকে-শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের

পৃষ্ঠা: ৪৩
মন্ত্রির দায়িত্বে পদায়িত করা হয়। (খান, আবেদ ষড়যন্ত্রের জালে বিপন্ন রাজনীতি (১২)। দৈনিক জাগরণ। ঢাকা। অক্টোবর ২, ২০১৯ এর আলােকে লিখিত)
এছাড়া প্রতিমন্ত্রী হিসেবে ১. শাহ মােয়াজ্জেম হােসেনকে বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয় ২. দেওয়ান ফরিদ গাজীকে বাণিজ্য ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় ৩. তাহের উদ্দিন ঠাকুরকে তথ্য, বেতার ও শ্রম মন্ত্রণালয় ৪. নূরুল ইসলাম চৌধুরীকে শিল্প মন্ত্রণালয়, ৫. নূরুল ইসলাম মঞ্জুরকে রেল ও যােগাযােগ মন্ত্রণালয় ৬. কে এম ওবায়দুর রহমানকে ডাক ও টেলিযােগাযােগ মন্ত্রণালয় ৭. মােসলেম উদ্দিন খান হাবু মিয়াকে পাট মন্ত্রণালয় ৮. ডা. ক্ষিতিশ চন্দ্র মণ্ডলকে ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয় ৯. রিয়াজউদ্দিন আহমদ ভােলা মিয়াকে বন, মৎস্য ও পশুপালন মন্ত্রণালয় ১০. সৈয়দ আলতাফ হােসেনকে যােগাযােগ মন্ত্রণালয় এবং ১১. মােমেন উদ্দিন আহমেদকে বন্যা, পানি ও বিদ্যুৎ মন্ত্রাণালয়ে পদায়ন করা হয়। (ইনি বঙ্গবন্ধুর ক্যাবিনেটে ছিলেন না) (দৈনিক ইত্তেফাক: ২১ আগস্ট, বৃহস্পতিবার)। (প্রাগুক্ত)।
খুনিচক্র প্রভাবিত মােশতাক সরকার কর্তৃক সামরিকআইন জারি করা হলেও জাতীয় সংসদ বহাল রাখা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মালেক উকিল সেই সংসদের স্পিকার হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন। সেসময় তিনি স্পিকারদের একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনেও যােগদান করেন। সংসদের চিফ হুইপ হিসেবে দায়িত্ব প্রদান করা হয়; বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে ডেপুটি চিফ হুইপের দায়িত্বে থাকা আব্দুর রউফ এমপি-কে। এ ছাড়াও মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক ও বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার প্রাক্তন সদস্য জেনারেল মুহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানীকে মন্ত্রীর সমমর্যাদায় রাষ্ট্রপতি মােশতাকের প্রতিরক্ষা বিষয়ক উপদেষ্টা পদে পদায়িত করা হয়। এই প্রবীণ সামরিক কর্মকর্তা বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রশ্নে শুধু নীরবই থাকেননি, পরবর্তী সময়ে খুনি সেনাদের হেফাজতকরণেও ছিলেন তৎপর। বঙ্গবন্ধু সরকারের রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রী; বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে খন্দকার মােশতাক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে পদায়িত করেছিলেন। তিনি মােশতাক সরকারের জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের তৎপরতায় যুক্ত ছিলেন। আবু সাঈদের মতাে বিশেষ ব্যক্তিত্বও সেসময় মােশতাক বিরােধী অবস্থান গ্রহণ করেননি। বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিরুদ্ধে কোনাে অবস্থান নেননি। অথচ ছাত্র জীবন থেকেই তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন।
প্রকাশ থাকে যে মােশতাকের মন্ত্রিপরিষদে পূর্ণমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী; ফণীভূষণ মজুমদার, সােহরাব হােসেন, আব্দুল মান্নান, শ্রী মনােরঞ্জন ধর, আব্দুল মমিন, আসাদুজ্জামান খান, প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী; দেওয়ান ফরিদ গাজী, নূরুল ইসলাম চৌধুরী, মােসলেম উদ্দিন

পৃষ্ঠা: ৪৪
খান হাবু মিয়া ও ডা. ক্ষিতিশ চন্দ্র মণ্ডল, স্পিকার আব্দুল মালেক উকিল এবং চিফ হুইপ আব্দুর রউফ পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পার্টির প্রতি বিশ্বস্ত ছিলেন। (শুধু আব্দুর রউফ পরবর্তী সময়ে গণফোরামে যােগদান করেছিলেন) অন্যদিকে উপরাষ্ট্রপতি মােহাম্মদ উল্লাহ, মন্ত্রী এম. ইউসুফ আলী, প্রতিমন্ত্রী শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, নূরুল ইসলাম মঞ্জুর, কে এম ওবায়দুর রহমান, রিয়াজউদ্দিন আহমদ ভােলা মিয়া ও মােমেন উদ্দিন আহমেদ পরবর্তী সময়ে জাতীয়তাবাদী দল ও জাতীয় পার্টিতে যােগদান করেছিলেন। এদের কেউ কেউ দলবাজ নেতা হিসেবে পর্যায়ক্রমে উভয় দলের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। সৈয়দ আলতাফ হােসেন ফিরে গিয়েছিলেন বাম ঘরাণার বলয়ে। প্রকাশ থাকে যে মােশতাকের মন্ত্রিপরিষদের উপরােক্ত প্রতিমন্ত্রিদের প্রথম চারজন বঙ্গবন্ধুবিরােধী ষড়যন্ত্রের সাথে পূর্ণ মাত্রায় সম্পৃক্ত ছিলেন। এরা ছাড়া আবু সাঈদ চৌধুরী, ড. আজিজুর রহমান মল্লিক ও ড. মােজাফফর আহমেদ চৌধুরী পরবর্তী সময়ে আর আওয়ামী লীগে ফিরে আসেননি। শেষােক্তজন হয়েছিলেন জেনারেল জিয়াউর রহমানের শিক্ষা উপদেষ্টা।
প্রকাশ থাকে যে খন্দকার মােশতাকের অবৈধ সরকার কাঠামাের সাথে যুক্ত (তিনজন ব্যতিরেকে) উপরাষ্ট্রপতি, স্পিকার, মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীগণ কেউই উড়ে এসে জুড়ে বসা পর্যায়ের নেতা ছিলেন না। তারা সকলেই আওয়ামী লীগের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন, দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নিজেদের পরীক্ষিত নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। অনেকে ছিলেন বঙ্গবন্ধুর সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধিত। স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রশ্নেও ছিলেন একই রথের সারথী, তদুপরি তারা জাতির পিতার প্রতি বিশ্বস্ত থাকেননি। শিশু রাসেলসহ বঙ্গবন্ধু ও পরিবারের সদস্যদের হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ তাে দূরের কথা অনুতাপও প্রকাশ করেননি। এ পর্যায়ে খন্দকার মােশতাকের অবৈধ সরকারের উপরাষ্ট্রপতি, স্পিকার, চিফ হুইপ, মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীদের ইতিবৃত্ত তুলে ধরা হলাে:
উপরাষ্ট্রপতি মােহাম্মদ উল্লাহ : জনাব মােহাম্মদ উল্লাহ পেশায় ছিলেন একজন আইনজীবী। আওয়ামী লীগে যােগদানের মাধ্যমে তার রাজনৈতিক জীবন সূচিত হয়েছিল। বর্তমান লক্ষ্মীপুর জেলাস্থ রায়পুর উপজেলার বামনী ইউনিয়নের সাইচা গ্রামে ২১ অক্টোবর ১৯২১ সালে জন্মগ্রহণ করেন। মায়ের নাম: জরিনা খাতুন, বাবা মুন্সী আব্দুল ওয়াহাব। বাবা ছিলেন একজন সমাজসেবক। রাখালিয়া জুনিয়র মাদ্রাসায় প্রাথমিক পাঠ শেষে; ১৯৩৮ সালে লক্ষ্মীপুর মডেল হাইস্কুল থেকে মেট্রিক এবং ১৯৪০ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন। অতঃপর ১৯৪৩ সালে ঢাকা

পৃষ্ঠা: ৪৫
বিশ্ববিদ্যালয় হতে ইতিহাসে অনার্সসহ স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। পরবর্তী সময়ে কলকাতার রিপন কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ১৯৪৮ সালে এলএলবি ডিগ্রি লাভ করেন। মােহাম্মদ উল্লাহর ওকালতি জীবন সূচিত হয় ১৯৫০ সালে, ঢাকা জজকোটে যােগদানের মাধ্যমে। পরবর্তী সময়ে-১৯৬৪ সালে আইনজীবী হিসেবে যােগদান করেন ঢাকা হাইকোর্টে।
ঢাকা জজকোর্টে আইনজীবী হিসেবে যােগদানের বছরেই-১৯৫০ সালে; মােহাম্মদ উল্লাহ স্বপ্রণােদিত হয়ে আওয়ামী মুসলিম লীগে যােগদান করেন। অতঃপর বঙ্গবন্ধুর প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপােষকতায় ১৯৫২ সালে দলটির দপ্তর সম্পাদক নির্বাচিত হন। ওই পদে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত বহাল থেকে নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয়দফা (১৯৬৬) কর্মসূচিভিত্তিক স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ ও কারাবরণ করেন। ১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনে নােয়াখালী-৯ আসন থেকে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে মুজিবনগর সরকারের সাথে সম্পৃক্ত থেকে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতিসৈয়দ নজরুল ইসলামের রাজনৈতিক উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে (১৯৭২) তিনি সংসদের ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হন। জাতীয় সংসদের প্রথম স্পিকার শাহ আব্দুল হামিদ দায়িত্ব গ্রহণের (দায়িত্ব গ্রহণ ১০ এপ্রিল ১৯৭২ এবং মৃত্যু ১ মে ১৯৭২) ১ মাস ২০ দিনের পর মুত্যুমুখে পতিত হলে মােহাম্মদ উল্লাহর ওপর স্পিকারের দায়িত্ব অর্পন করা হয়। সেসময় তিনি বাংলাদেশের প্রথম সাংবিধানিক সভায় সভাপতিত্ব করেন। ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে একই আসন থেকে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। অতঃপর ১৯৭৩ সালের ২৩ ডিসেম্বর; গণপ্রজাতন্ত্রী

পৃষ্ঠা: ৪৬
বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়ে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত উক্ত পদে বহাল ছিলেন। তাঁর স্বাক্ষরেই জারি হয়েছিল বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রবর্তিত বাকশালব্যবস্থার পরিপত্র। পরবর্তী সময়ে-১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মন্ত্রিসভায় ভূমি প্রশাসন ও ভূমি সংস্কার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়ােজিত হন। এছাড়া ১৯৭৫ সালে, জুনের ৬ তারিখে গঠিত ১১৫ সদস্যবিশিষ্ট বাকশাল কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটিতে তিনি ছিলেন অন্যতম সদস্য। একই বছর পনের আগস্টের মর্মান্তিক হত্যাযজ্ঞের পর খন্দকার মােশতাক আহমদের অবৈধ সরকারের উপরাষ্ট্রপতি পদে পদায়িত হন এবং ওইদিন সন্ধ্যায় (১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ সাল) শপথ গ্রহণ করেন।
খন্দকার মােশতাকের পতনের পাঁচ বছর পর-১৯৮০ সালে তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলে (বিএনপি) যােগ দেন। ১৯৮২ সালের ২৩ মার্চ, রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তারের অধীনে উপরাষ্ট্রপতি পদে যােগদান করেন। সে পদে মাত্র একদিনের জন্য পদায়িত ছিলেন। পরদিনই সেনাবাহিনী প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল হাে. মাে. এরশাদ কর্তৃক বন্দুকের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করা হলে তাঁকে পদচ্যুত করা হয়। ব্যাপক গণআন্দোলনের মুখে লে. জে এরশাদ ক্ষমতা হতে বিতাড়িত হবার পর মােহাম্মদউল্লাহ ১৯৯১ সালে বিএনপির মনােনয়নে লক্ষ্মীপুর-২ আসন হতে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে বিএনপি পরিত্যাগ করে পুনর্বার তিনি আওয়ামী লীগে যােগদান করেন। ১৯৯৯ সালে, নভেম্বরের ১১ তারিখে মােহাম্মদ উল্লাহ ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে বনানী কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।১
প্রকাশ থাকে যে স্বপ্রণােদিত হয়ে আওয়ামী রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে মােহাম্মদ উল্লাহ সকলের প্রিয়পাত্রে পরিণত হয়েছিলেন। বিশেষত খুব অল্পসময়েই তিনি কর্মনিষ্ঠার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর আস্থাশীল ব্যক্তি হয়ে ওঠেন। দলটির ক্রান্তিলগ্নে তার ওপরই অর্পিত ছিল আওয়ামী লীগের দাপ্তরিক কর্মকাণ্ডের পুরােটাই। বঙ্গবন্ধু তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে মােহাম্মদউল্লাহ প্রসঙ্গে সেসময়কার আওয়ামী লীগের স্থবির অবস্থা এবং অফিস পরিচালনার অচলাবস্থা বিষয়ে স্বল্প পরিসরে চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘ঢাকায় তখন একটা ত্রাসের রাজত্ব চলছে। ভয়ে মানুষ কোন কথা বলে না। কথা বললেই গ্রেফতার করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলােতেও একই অবস্থা। আওয়ামী লীগ অফিসে কেউই আসে না ভয়ে। আমি ও কামরুজ্জামান সাহেব বিকালে বসে থাকি। অনেক চেনা লােক দেখলাম, নবাবপুর দিয়ে যাবার সময় আমাদের অফিসের দিকে আসলেই মুখ ঘুরিয়ে নিতেন। দু’একজন আমাদের দলের সদস্যও ছিল। আমার সাথে কেউ দেখা করতে আসলে আমি বলতাম, অফিসে আমার সাথে দেখা করবেন, সেখানেই আলাপ করব।

পৃষ্ঠা: ৪৭
শহীদ সাহেব যখন এসেছিলেন, তাঁর এক ভক্তের কাছ থেকে একটা টাইপ রাইটিং মেশিন নিয়ে অফিসের জন্য দিয়ে গিয়েছিলেন। ঢাকার একজন ছাত্র সিরাজ, একহাত দিয়ে আস্তে আস্তে টাইপ করতে পারত। তাকে বললাম, অফিসে কাজ করতে, সে রাজি হল। কাজ করতে করতে পরে ভাল টাইপ করা শিখেছিল। একজন পিয়ন রাখলাম, প্রফেসর কামরুজ্জামান সাহেবের বাসায় থাকত।২ আওয়ামী লীগের এহেন এক সংকটময় পরিস্থিতিতে দপ্তর পরিচালনার হাল ধরেছিলেন এডভােকেট মােহাম্মদউল্লাহ এবং একটানা দীর্ঘ প্রায় বাইশ বছর তিনি সফলতার সাথে সেই দায়িত্ব পালন করেছেন। এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু একই গ্রন্থে আরও লিখেছেন; এই সময় একজন এডভােকেট আমাদের অফিসে আসলেন। তিনি বললেন, ‘আমি আপনাদের দলের সভ্য হতে চাই। আমার দ্বারা বেশি কাজ পাবেন না, তবে অফিসের কাজ আমি বিকালে এসে করে দিতে পারি।’ আমি খুব খুশিই হলাম। ভদ্রলােক আস্তে আস্তে কথা বলেন, আমার বয়সীই হবেন। আমার খুব পছন্দ হল। আমি তাকে অনুরােধ করলাম অফিসের ভার নিতে। তিনি বললেন, কোর্টের কাজ শেষ করে বাড়ি যাওয়ার পূর্বে রােজই আসব। সত্যিই তিনি আসতে লাগলেন এবং কাজ করতে লাগলেন। পুরানা অফিস সেক্রেটারি ভদ্রলােক কেটে পড়েছেন। পরে ওয়ার্কিং কমিটির সভায় আমি প্রস্তাব করলাম, তাঁকে অফিস সেক্রেটারি করতে। সকলেই রাজি হলেন। আজ ষােল বৎসর তিনি অফিস সেক্রেটারি আছেন। কোনােদিন কোনাে পদের জন্য কাউকেই তিনি বলেন নাই। আমার সাথে ব্যক্তিগত বন্ধুত্বও হয়ে গিয়েছে। তিনি কোনােদিন সভায় বক্তৃতা করেন না। তাঁকে অফিসের কাজ ছাড়া কোনাে কাজেও কেউ বলেন নাই। তিনিও চান না অন্য কাজ করতে। অফিসের খরচও আমি তার হাতে দিয়েছিলাম। হিসাবনিকাশ তিনিই রাখতেন। আমাদের আয়ও কম, খরচও কম। কোনােদিন কোনাে সরকার তাঁকে খারাপ চোখে দেখে নাই। আর গ্রেফতারও করে নাই। এবারেই তাঁকে কয়েকদিনের জন্য গ্রেফতার করে এনেছিল। তাঁর শরীরও ভালাে ছিল না। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ তাঁর মতাে অফিস সেক্রেটারি পেয়েছিল বলে অনেক কাজ হয়েছে। তার নামটা বলি নাই, মিস্টার মােহাম্মদ উল্লাহ। শহীদ সাহেব ও ভাসানী সাহেবও তাকে ভালােবাসতেন এবং বিশ্বাস। করতেন। অফিসের কাজ কখনাে পড়ে থাকত না।’৩
সেসময় যারা বঙ্গবন্ধুর সাথে কাজ করেছেন। আন্দোলন সংগ্রামে তাঁর সাথে সম্পৃক্ত থেকেছেন, তাঁদের প্রায় সকলের কথাই পরবর্তী সময়ে প্রকাশিত ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও কারাগারের রােজনামচা’ গ্রন্থে বিধৃত হয়েছে। সে নিরিখে মােহাম্মদউল্লাহর কথাও লেখা হয়েছে প্রাসঙ্গিকভাবে। ১৪-১৫ নভেম্বরে ময়মনসিংহে অনুষ্ঠিত দলের বিশেষ কাউন্সিল অধিবেশন বিষয়ক লেখনীতেও

পৃষ্ঠা: ৪৮
মােহাম্মউল্লাহ প্রসঙ্গে আলােকপাত করেছেন বঙ্গবন্ধু। তিনি লিখেছেন, মােহাম্মদউল্লাহ সাহেব, কোরবান আলী, হামিদ চৌধুরী, মােল্লা জালালউদ্দিন পূর্বেই পৌঁছে গিয়েছে। শহীদ সাহেবকে অভ্যর্থনা করবার জন্য ঢাকায় আসতে হল। তাঁকে নিয়ে ময়মনসিংহ পৌছালাম। আওয়ামী লীগ অফিস করবার জন্য কোন স্থান না পেয়ে হামিদ, জালাল ও মােহাম্মদ উল্লাহ আজিজুর রহমান সাহেবের বাসায় একটা কামরা নিজেরাই ঠিক করে নিয়েছিল। আমার একলার জন্য থাকার বন্দোবস্ত করেছিল হাশিমউদ্দিনের বাড়িতে।৪ বয়সে মাত্র দেড় বছরের কণিষ্ঠ হলেও তাঁর প্রতি বঙ্গবন্ধুর একধরনের শ্রদ্ধা মিশ্রিত ভাললাগার অনুভূতি জন্মেছিল। ছয়দফা আন্দোলন সূচিত হবার পর; তাঁকেও গভর্নর মােনায়েম খান গ্রেফতারি হতে রেহাই দেননি। অফিস সেক্রেটারির কারারুদ্ধের কথা জানতে পেরে বঙ্গবন্ধু তাঁর পরিবার ও শরীর-স্বাস্থ্য সম্পর্কে অনেকটাই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। এ বিষয়ক অনুভূতি প্রকাশ পেয়েছে তার ১৫ জুলাই ১৯৬৬ সাল, শুক্রবারের লিখিত দিনলিপিতে। মােহাম্মদউল্লাহ প্রসঙ্গে আলােকপাতকালে তিনি লিখেছেন, আজ সকালে আওয়ামী লীগের অফিস সেক্রেটারি মােহাম্মদ উল্লাহ এডভােকেট সাহেবকে গ্রেপ্তার করে এনেছে। ১০ সেলেই রেখেছে। ভদ্রলােক শুধু অফিসের কাজকর্ম দেখেন। কোনােদিন জীবনে একটা বক্তৃতাও করেন নাই, কোনাে সভা-সমিতিতে বেশি যেতেন না, কোনােদিন মফস্বলে যান নাই সভা করতে। আজ ১৫ বছর নীরবে অফিসের কাজকর্ম করে থাকেন। মােহাম্মদ উল্লাহ সাহেবকে যখন গ্রেপ্তার করেছে তখন আওয়ামী লীগের কাহাকেও আর বাইরে রাখবে না। মােহাম্মদউল্লাহ সাহেবের ছেলেমেয়েদের খুব কষ্ট হবে, কারণ অর্থাভাব কিছুটা আছে, উপার্জন না করলে চলে না। বড় নিরীহ ভদ্রলােক, কোনােদিন কিছু দাবি করে নাই। একবার জাতীয় পরিষদের সদস্য পদের জন্য নমিনেশন দেওয়া হয়েছিল, মাত্র ১২ ভােটে পরাজিত হয়। কয়েক বৎসর পূর্বে যক্ষ্মা রােগে ভুগে ভাল হয়ে গিয়েছিলেন। জেলে এসে আবার আক্রান্ত না হয়! একই কারাগারে থেকেও আমার সাথে দেখা হওয়ার উপায় নাই। ৫
বঙ্গবন্ধু তাঁকে যেমন বন্ধুর মতাে দেখতেন, তেমনই বিপদে-আপদেও তাঁর জন্য উদ্বিগ্ন হতেন। কারাগারে অবরুদ্ধকালে তার শারীরিক অবস্থার কথা জেনে যেমন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন, তেমনই কারারুদ্ধ হবার পূর্বে তাঁর অসুস্থতার কথা জেনে সহায়তার হাত প্রসারিত করেছিলেন। কারাগারে অবস্থানকালে পরিবারের আর্থিক সংকট সত্ত্বেও বঙ্গমাতার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু তাঁর সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিলেন। এ বিষয়ে মােমিনুল হক খােকা লিখেছেন, ..একদিন ভাবী আমাকে বললেন, মিঞাভাই জেল থেকে খবর পাঠিয়েছেন মােহাম্মদ উল্লাহ গুরুতর অসুস্থ, সুষ্ঠু চিকিৎসার জন্য তাঁকে বাইরে পাঠানাের

পৃষ্ঠা: ৪৯
ব্যবস্থা করতে হবে। আমি কিছুটা চিন্তিত হলাম, বিশেষ করে আমাদের আর্থিক অবস্থার কথা মনে করে। কিন্তু মােহাম্মদ উল্লাহ তখন একজন নিবেদিত প্রাণ আওয়ামী লীগ কর্মী। তাই শেষ পর্যন্ত তাঁকে পশ্চিম পাকিস্তানে মারী পাঠানাের ব্যবস্থা করা হলাে। মারীতে তাঁর সুচিকিৎসা হয়েছিল।৬ পরবর্তী সময়ে উদার চিত্তের বঙ্গবন্ধু এই নিরীহ অনুসারীর কর্মনিষ্ঠার মূল্যায়ন করেছিলেন যথার্থভাবেই। ১৯৭০ ও ১৯৭৩-এর নির্বাচনে মনােনয়ন দিয়েই থেমে থাকেননি বঙ্গবন্ধু, পরবর্তী সময়ে ডেপুটি স্পিকার, স্পিকার, এমনকি রাষ্ট্রপতির মতাে সর্বোচ্চ পদেও পদায়ন করেছিলেন। বাকশাল গঠিত হবার পরও মােহাম্মদ উল্লাহর অবমূল্যায়ন করা হয়নি, মন্ত্রিত্বের আসনে পদায়ন করা হয়েছিল। রাজনৈতিক জীবনে অপ্রাপ্তি বলে কোনকিছু কিছু ছিল না তাঁর, সবই পূর্ণ হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর বদান্যতায়। তারপরও আদর্শগত বাধ্যবাধকতার দিকটি বাদ দিলেও, ব্যক্তিগত সম্পর্কের দিকটি-কৃতজ্ঞতার দিকটি তার কাছে প্রণিধান হতে পারত। কিন্তু পরিতাপের বিষয়; তিনি সেভাবে তাঁর অবস্থান নির্ণয় করেননি। যে বঙ্গবন্ধু তার শারীরিক অসুস্থতার জন্য বিচলিত হয়ে বঙ্গমাতার মাধ্যমে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিলেন, সেই বঙ্গবন্ধু-বঙ্গমাতা ও পরিবারের সদস্যদের মর্মান্তিক হত্যাযজ্ঞে তিনি মর্মাহত হননি। ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক হত্যার বিরুদ্ধে কোনাে প্রতিবাদ জানানােরও তাগিদ বােধ করেননি, নিজেকে নিষ্ক্রিয় রাখতে পারেননি। অধিকন্তু খুনিচক্রের সাথে একাত্ম হয়ে লুফে নিয়েছিলেন উপরাষ্ট্রপতির পদ। বঙ্গবন্ধুসহ পরিবারের সদস্যদের নিষ্প্রাণ মরদেহগুলাে অযত্নে-অবহেলায় ৩২ নাম্বারের বাসভবনে পড়ে থাকা অবস্থায় তিনি খুনি মােশতাকের উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন।

তথ্যনির্দেশ :
১. খান, মােফাখখার হােসাইন। মােহাম্মদউল্লাহ। বাংলাপিডিয়া-বাংলাদেশ জাতীয় জ্ঞানকোষ। ৫ মার্চ, ২০১৫ আলােকে লিখিত।
২. মুজিবুর রহমান, শেখ। অসমাপ্ত আত্মজীবনী। ২০১৫ (পুনর্মুদ্রণ) ঢাকা। দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড। পৃষ্ঠা: ২১১
৩. প্রাগুক্ত। পৃষ্ঠা: ২১১-২১২।
৪. প্রাগুক্ত। পৃষ্ঠা: ২৪৭।
৫. প্রাগুক্ত। পৃষ্ঠা: ১৬৩-১৬৪
৬. খােকা, মমিনুল হক। অস্তরাগে স্মৃতি সমুজ্জ্বল-বঙ্গবন্ধু, তাঁর পরিবার ও আমি। ২০১৭ (চতুর্থ মুদ্রণ)। ঢাকা। সাহিত্য প্রকাশ। পৃষ্ঠা: ৭২

পৃষ্ঠা: ৫০
স্পিকার আব্দুল মালেক উকিল :

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করার পর খন্দকার মােশতাক আহমদের সরকার কর্তৃক সামরিক শাসন জারি করা হলেও জাতীয় সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়নি। স্পিকারের পদে পূর্ববর্তী স্পিকার আবদুল মালেক উকিলকেই বহাল রাখা হয়। স্পিকার পদে নির্বাচিত হওয়ার পূর্বে মালেক উকিল বঙ্গবন্ধুর ক্যাবিনেটে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্বে নিয়ােজিত ছিলেন। আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ আব্দুল মালেক উকিল ১৯২৫ সালের ১ অক্টোবর, নােয়াখালী জেলার সদর উপজেলাস্থ রাজাপুর গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। পিতা ছিলেন একজন ধর্মীয় আলেম। আলেম পিতার সিদ্ধান্ত মােতাবেক তিনি আহাম্মদিয়া হাই মাদ্রাসায় অধ্যয়ন করেন। ছাত্র হিসেবে ছিলেন অত্যন্ত মেধাবি। মাদ্রাসা হতে ম্যাট্রিকের সমমানের পরীক্ষায় অঙ্কে লেটারসহ প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করেন। ১৯৪৭ সালে তদানীন্তন যশাের জেলাস্থ মাগুরা কলেজ হতে উচ্চমাধ্যমিক পাশের পর; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ১৯৫১ সালে এমএ এবং ১৯৫২ সালে আইনশাস্ত্রে স্নাতক সনদ অর্জন করেন। অতঃপর নােয়াখালীর জেলা আদালতে আইনব্যবসার মাধ্যমে সূচিত হয় কর্মজীবন। ১৯৬২ সালে ঢাকা হাইকোর্ট বারের সদস্য পদ লাভ এবং হাইকোর্টে আইনজীবী হিসেবে প্রাকটিস আরম্ভ করেন। ছাত্রজীবন থেকেই সম্পৃক্ত ছিলেন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগের (পরবর্তী সময়ের পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র লীগ ) অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। পরিপূর্ণভাবে রাজনীতির সাথে যুক্ত হবার পর নােয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৬৪ হতে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ছিলেন। এছাড়া ১৯৬৫ হতে ৭২ সাল পর্যন্ত কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি

পৃষ্ঠা: ৫১
অ্যাসােসিয়েশনের সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৬ সাল হতে ৬৯ সাল পর্যন্ত ছিলেন ঢাকা হাইকোর্ট বার কাউন্সিলের সদস্য। ১৯৬৬ সালে লাহােরে অনুষ্ঠিত বিরােধীদলীয় সম্মেলনে এবং ১৯৬৯ সালে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান আহূত গােলটেবিল বৈঠকেও তিনি বঙ্গবন্ধুর সাথে সাথে অংশগ্রহণ করেছিলেন। আব্দুল মালেক উকিল ১৯৫৬, ১৯৬২ ও ১৯৬৫ সালে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ছিলেন। ১৯৬৫ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগের সংসদীয় দল এবং সম্মিলিত বিরােধী দলের নেতার দায়িত্ব পালন করেন।১
সে সময়কার সংসদীয় তৎপরতা প্রসঙ্গে আলােকপাতকালে কারারুদ্ধ অবস্থায় বঙ্গবন্ধু ১৯ জুন ১৯৬৬ সালে, রবিবারের দিনলিপিতে তাঁর সম্পর্কে লিখেছেন, ‘দি নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেস’ বাজেয়াপ্তকরণের উপর স্বতন্ত্র দলের নেতা জনাব আসাদুজ্জামানের ও গণপরিষদ সদস্যের অধিকার সংক্রান্ত মুলতবি প্রস্তাব এবং বিরােধীদলের নেতা আব্দুল মালেক উকিলের আনীত মুলতবি প্রস্তাব স্পিকার সাহেব কর্তৃক অগ্রাহ্য করার প্রতিবাদে বিরােধী ও স্বতন্ত্র দলীয় সদস্যরা পরিষদ কক্ষ ত্যাগ করেন।২ এভাবেই তিনি প্রাদেশিক আইনপরিষদে বাঙালি জাতিসত্তার স্বার্থ সম্পৃক্ত বিষয়ে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছেন। পরবর্তী সময়ে আইয়ুববিরােধী আন্দোলন ও ছয়দফা আন্দোলনকালে তাকেও অন্যান্য রাজনৈতিক নেতাকর্মীর সাথে নিরাপত্তাআইনে আটক করে করারুদ্ধ করা হয়। ইতিপূর্বেও; ‘আব্দুল মালেক উকিল তার রাজনৈতিক জীবনে বহুবার কারাবাসের সম্মুখীন হয়েছিলেন। ভাষা আন্দোলনের সময় ১১ মার্চ ১৯৪৮ সালে তাঁকে প্রথম গ্রেফতার করা হয় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে তাকেও ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হয়। পরবর্তীতে ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ এবং ১৯৫৪ সালের জুন মাসে ইস্ট বেঙ্গল পাবলিক সেফটি অধ্যাদেশের অধীনে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছিল।৩ ১৯৬৮ সালের ৩ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে প্রধান আসামী করে ৩৫ জন সামরিক-বেসামরিক বাঙালি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হিসেবে বহুল পরিচিত দেশদ্রোহী মামলা দায়ের করা হয়। সে সময় বঙ্গবন্ধু কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি ছিলেন। অতঃপর ১৭ জানুয়ারি রাতের অন্ধকারে তাকে মুক্তি দিয়ে কেন্দ্রীয় কারাগারের ফটকের সম্মুখে সেনাবাহিনীর মাধ্যমে আটক করে সেনানিবাসের অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। সে সময় বঙ্গবন্ধুর অবস্থান গােপন রাখা হয়। এমনকি পরিবারের লােকদেরও তাঁর অবস্থান সম্পর্কে কোনােকিছু জানানাে হয়নি। জেনারেল আইয়ুব খান ও গভর্নর মােনায়েম খানের পতনের প্রাক পর্যায়ে; তাদের দমন-পীড়ন ছিল তুঙ্গে। এহেন এক ভীতিপ্রদ অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর আটক ও অবস্থান সম্পর্কে জানার জন্য সােচ্চার হয়েছিলেন আব্দুল মালেক উকিল।

পৃষ্ঠা: ৫২
‘সেইসময় পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের বিরােধীদলীয় নেতা হিসেবে প্রদত্ত বক্তব্যে গভর্নর মােনায়েম সরকারের কাছে তিনি জানতে চেয়েছেন, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে রাতের গভীরে বাঙালিদের প্রিয় নেতা শেখ মুজিবকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে বাংলার মানুষ জানতে চায়? …মালেক উকিলের ওই বক্তব্য বিবিসিতে প্রচার হওয়ার পরদিন পাকিস্তান সরকার প্রেস নােটের মাধ্যমে শেখ মুজিবের অবস্থান সম্পর্কে দেশবাসীকে অবহিত করতে বাধ্য হয়েছিল।৪ পরবর্তী সময়ে-১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এবং নােয়াখালী-৪ আসন হতে সাংবিধানিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। মুক্তিযুদ্ধকালে-১৯৭১ সালে প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের সাথে সম্পৃক্ত থেকে সাহায্য ও পুনর্বাসন কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সেসময় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বজনমত সৃষ্টির নিমিত্ত সংসদীয় দলের সদস্য হিসেবে মালেক উকিল নেপাল, থাইল্যান্ড, জাপান ও মালয়েশিয়া সফর করেন। সেসব দেশে প্রতিনিধি দলের সাথে সফরকালে পাকিস্তানি-বাহিনীর বর্বরতার চিত্র তুলে ধরেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করেন।
স্বাধীনতার পর আব্দুল মালেক উকিল বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭২ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দ্বিতীয় মন্ত্রিসভায় তাঁকে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়ােগ করা হয়। ১৬ মার্চ ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত ওই দায়িত্বে

পৃষ্ঠা: ৫৩
নিয়ােজিত ছিলেন। ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চে অনুষ্ঠিত স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নােয়াখালী-১২ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। অতঃপর তৃতীয় মন্ত্রিসভায় তাঁকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিযুক্তি দেওয়া হয়। ১৬ জানুয়ারি ১৯৭৩ সাল হতে ১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বে নিয়ােজিত ছিলেন। পরবর্তী পর্যায়ে-২৭ জানুয়ারি ১৯৭৪ সালে আব্দুল মালেক উকিল জাতীয় সংসদের স্পিকার নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) গঠিত হবার পর তিনি বাকশালে যােগদান করেন। তিনি ছিলেন ১৫ সদস্য বিশিষ্ট বাকশাল পলিট ব্যুরাের সদস্য। খন্দকার মােশতাকের পতন ও জাতীয় সংসদ ভেঙে দেওয়ার আগ পর্যন্ত তথা ৫ নভেম্বর ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি জাতীয় সংসদের স্পিকার পদে বহাল ছিলেন।
পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগকে পুনরায় সংগঠিত করার জন্য; ১৯৭৬ সালের ২৫ আগস্ট মিজানুর রহমান চৌধুরীর ধানমন্ডির বাসভবনে সাবেক আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের এক বর্ধিত সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মহিউদ্দীন আহমেদ। এতে ৬০ জন প্রাক্তন গণপরিষদ সদস্য, ২৪০ জন সাবেক সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক জেলাসমূহের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ মােট এক হাজারের অধিক প্রতিনিধি যােগদান করেন।৫ সেই সভাতে অংশগ্রহণের মাধ্যমে তিনি আওয়ামী লীগের সাথে পুনর্বার সম্পৃক্ত হন। অতঃপর ১৯৭৮ সালের ৩-৫ মার্চ ঢাকার মতিঝিলস্থ হােটেল ইডেনে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের ১২ তম দ্বিবার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশনে আব্দুল মালেক উকিলকে সভাপতি পদে নির্বাচিত করা হয়। বঙ্গবন্ধু ও চার জাতীয় নেতার হত্যা পরবর্তী পর্যায়ের নেতৃত্ব শূন্য আওয়ামী লীগকে সংহতকরণের জন্য ওই ক্রান্তিকালে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, বিরূপ পরিবেশের মধ্যেও শত প্রতিকূলতা কাটিয়ে দলটিকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করতে সক্ষম হন। বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার দায়িত্ব গ্রহণের আগ পর্যন্ত তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্বে বহাল ছিলেন। ১৯৮১ সালের ১৪-১৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার হােটেল ইডেনে অনুষ্ঠিত হয় আওয়ামী লীগের ১৩তম দ্বিবার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশন। কাউন্সিলে উপস্থিত ছিলেন ৪ হাজার কাউন্সিলর ও ডেলীগেট। কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত মােতাবেক শেখ হাসিনাকে দলের সভাপতি নির্বাচন করা হলে; আব্দুল মালেক উকিল তাঁর সমীপে সভাপতির দায়িত্ব অর্পন করেন। অতঃপর তাঁকে নবগঠিত কমিটিতে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য করা হয়। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন। ১৯৮৬ সালের ৭ মার্চ, সেনাশাসক লে. জেনারেল হাে. মাে. এরশাদ কর্তৃক

পৃষ্ঠা: ৫৪
আয়ােজিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি নােয়াখালী-৪ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এ সময় তিনি সংসদে বিরােধী দলীয় উপনেতার দায়িত্বও পালন করেন। ১৯৮৭ সালের ১৭ অক্টোবর আব্দুল মালেক উকিল ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। আব্দুল মালেক উকিল ছিলেন নিবেদিত আওয়ামী লীগার, আগস্টের মর্মান্তিক হত্যাযজ্ঞের সময় স্পিকারের মতাে তাৎপর্যপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন, পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবনের ক্ষেত্রেও কার্যকর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। তদুপরি তাঁর অবস্থান থেকে আগস্ট হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাননি, অধিকন্তু তিনি খুনি সরকারের পক্ষে বিদেশে সংসদীয় দলের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন।

তথ্যনির্দেশ
১. রহমান, সিদ্দিকুর রহমান। উকিল, আব্দুল মালেক। বাংলাপিডিয়া-বাংলাদেশ জাতীয় জ্ঞানকোষ। ৫ মে, ২০১৪।
২. মুজিবুর রহমান, শেখ। কারাগারের রােজনামচা। ২০১৭। ঢাকা। বাংলা একাডেমি। পৃষ্ঠা: ১০৮।
৩. রহমান, মিজানুর। আব্দুল মালেক উকিলের ২৯ তম শাহাদাত বার্ষিকী। নোয়াখালী পেইজ। ১৭ অক্টোবর, ২০১৬
৪. টুকন, মাে. মহিউদ্দিন, দুর্দিনের দুঃসাহসী নেতা আবদুল মালেক উকিল। বাংলাদেশ প্রতিদিন। ঢাকা। ১৬ অক্টোবর, ২০১৮
৫. রশিদ, হারুন-অর। মূলধারার রাজনীতি: বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কাউন্সিল ১৯৪৯-২০১৬। ২০১৭। ঢাকা। বাংলা একাডেমি। পৃষ্ঠা: ১৭৯

পৃষ্ঠা: ৫৫
চিফ হুইপ আব্দুর রউফ :

খন্দকার মােশতাক আহমদের অবৈধ শাসনামলে আব্দুর রউফ ছিলেন জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ। তিনি তৎকালীন নিলফামারী মহকুমাস্থ ডােমার থানার বাগডােকরা গ্রামে জন্মেছিলেন। ছাত্র জীবন থেকেই ছাত্র রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৭৫ সালে আগস্ট হত্যাযজ্ঞের পূর্বে ছিলেন জাতীয় সংসদের ডেপুটি চিফ হুইপ। আবদুর রউফ ১৯৬৩-৬৪ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (রাকসু) সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এছাড়া ছিলেন সাবেক ছাত্র লীগ ফাউন্ডেশনের নেতা। আইয়ুববিরােধী আন্দোলন, ছয়দফার আন্দোলন, ঊনসত্তুরের গণঅভ্যুত্থান ও সত্তরের নির্বাচনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। ১৯৬৮-৬৯ সাল মেয়াদে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালনকালে এক সময় বহিস্কৃত হন। ১৯৬৯ সালে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের উত্থাপিত ১১ দফা দাবির খসড়া প্রণয়ন ও স্বাক্ষরদানকারিদের অন্যতম ছিলেন আব্দুর রউফ। তিনি পূর্বপাকিস্তান ছাত্র লীগের পক্ষে ১১ দফার খসড়ায় স্বাক্ষর করেছিলেন। ছাত্র নেতা আব্দুর রউফ ছিলেন বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত স্নেহভাজন। তাঁর অনুরােধের পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু ১৯৭০ সালের নির্বাচনি প্রচারণার জন্য অক্টোবরের ২৩ তারিখে ডােমার সফর করেন এবং নির্বাচনি জনসভায় ভাষণ দেন।
১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনে আব্দুর রউফ আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে রংপুর-১ (ডেমার-ডিমলা) আসন হতে পাকিস্তান সাংবিধানিক পরিষদের সদস্য (এমসিএ) নির্বাচিত হন। অতঃপর ১৯৭১ সালে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। সে সময় তিনি ৬ নম্বর সেক্টরে মুজিবনগর সরকারের প্রতিনিধির দায়িত্বে ছিলেন। এছাড়া মুক্তিযােদ্ধা কমান্ডার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৪ এপ্রিল; পাকিস্তানি বর্বরবাহিনী ও স্থানীয় রাজাকাররা আব্দুর রউফের গ্রামের বাড়িসহ বাগডােকরা গ্রাম পুড়িয়ে দেয় এবং পরবর্তী

পৃষ্ঠা: ৫৬
সময়ে তাঁর বাবাকে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করে। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে; বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন আব্দুর রউফ। ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চে অনুষ্ঠিত স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনােনীত প্রার্থী হিসেবে রংপুর-১ (পরবর্তী সময়ের নিলফামারী-১ আসন) আসন হতে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। অতঃপর ১৯৭৪ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁকে জাতীয় সংসদের ডেপুটি চিফ হুইপের দায়িত্বে নিযুক্ত করেন।
১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে, বঙ্গবন্ধুকে পরিবারসহ হত্যা করার পর খন্দকার মােশতাক আহমদের অবৈধ শাসনকালে তাঁকে জাতীয় সংসদের চিফ হুইপের দায়িত্বে নিয়ােগ করা হয়, এ দায়িত্বে তিনি ৬ নভেম্বর ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বহাল ছিলেন। খন্দকার মােশতাকের পতনের অনতিকাল পরে আব্দুর রউফ আওয়ামী লীগে প্রত্যাবর্তন করেন। তিনি আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবিতকরণ উদ্যোগের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। মােশতাকের পতনের নয় মাস পর-১৯৭৬ সালের ২৫ আগস্ট; মিজানুর রহমান চৌধুরীর ধানমন্ডির বাসভবনে আহূত বর্ধিত সভায় তিনি রংপুর জেলার প্রতিনিধিত্ব করেন। প্রকাশ থাকে যে, ১৯৭৮ সালের মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত কাউন্সিল অধিবেশনে অবশেষে আওয়ামী লীগের ভাঙন ঠেকিয়ে দলের কর্মকর্তাদের একক একটি প্যানেল নির্বাচন সম্ভব হলেও দলের এ ঐক্য বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। মাত্র ৫ মাসের ব্যবধানে ১৯৭৮ সালে ও ১১ই আগস্ট মিজানুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বে তাঁর ধানমন্ডির বাসভবনে কতিপয় সদস্য ও কিছু কর্মীর উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত একসভায় তাঁকে আহ্বায়ক করে দলের বাইরে পাল্টা আওয়ামী লীগ গঠন করা হয়।’ (রশিদ। পৃষ্ঠা: ১৫১) আওয়ামী লীগ (মিজান) গ্রুপ হিসেবে পরিচিত এ দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটিতে কৃষি সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন আব্দুর রউফ। পরবর্তী সময়ে-২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের মনােনীত প্রার্থী হিসেবে নিলফামারী-১ আসন হতে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। অতঃপর তিনি আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে ড. কামাল হােসেনের গণফোরামের সাথে যুক্ত হন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি ছিলেন গণফোরামের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য। জনাব আব্দুর রউফ ২৯ নভেম্বর ২০১১ সালে ঢাকায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এক সময়ের তুখােড় ছাত্রনেতা হিসেবে পরিচিত, বঙ্গবন্ধুর স্নেহভাজন আব্দুর রউফ আগস্টের মর্মান্তিক হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদ না করে খন্দকার মােশতাক আহমদের অবৈধ সরকারের সাথে সম্পৃক্ত থেকে চিফ হুইপের দায়িত্ব পালন করেন।

পৃষ্ঠা: ৫৭
সহায়ক গ্রন্থ ও তথ্যউৎস
১. রশিদ, হারুন-অর। মূলধারার রাজনীতি: বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কাউন্সিল ১৯৪৯ -২০১৬। ২০১৭। ঢাকা। বাংলা একাডেমি
২. সাবেক হুইপ আব্দুর রউফের সপ্তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। নিজস্ব প্রতিবেদক। এনটিভি অনলাইন। ২৯ নভেম্বর, ২০১৮
৩. সাবেক হুইপ আবদুর রউফ আর নেই। নিজস্ব প্রতিবেদক ও নীলফামারী প্রতিনিধি। প্রথম আলাে। ৩০ নভেম্বর ২০১১
৪. www.bsl.org.bd
৫. List of 11th Parliament Members Bangla. w.w.w.parliament.gov.bd

রাষ্ট্রপতি মন্ত্রী বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী
বঙ্গবন্ধু সরকারের রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর জন্ম ৩১ জানুয়ারি, ১৯২১ সালে। পিতার বাড়ি কালিহাতির নাগবাড়িতে হলেও জন্মেছেন মাতুলালয়ে; মানিকগঞ্জ জেলার এলাচিপুর গ্রামে। পিতা আব্দুল হামিদ চৌধুরী, মাতা শামসুন নেছা চৌধুরী। জমিদার পরিবারের পিতা আব্দুল হামিদ চৌধুরী ছিলেন একজন রাজনৈতিক নেতা, তিনি ব্রিটিশ বিরােধী আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন এবং ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া রায়বাহাদুর খেতাব বর্জন করেছিলেন, ১৯৬২ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের স্পিকার ছিলেন।
রাজনৈতিক পিতার উত্তরসূরি হিসেবে আবু সাঈদ চৌধুরীও ছাত্রজীবন থেকে রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি কলিকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৯৪০ সালে বিএ পাশ করেন, অতঃপর কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ ও আইনশাস্ত্রে স্নাতক হন। পরবর্তী সময়ে-১৯৪৭ সালে লন্ডনের লিকন ইন থেকে ব্যারিস্টারি পাশ করে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। ছাত্রজীবনে ছিলেন খ্যাতনামা ছাত্রনেতা। ১৯৪০ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক, নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯৪৬ সালে নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের ব্রিটিশ শাখার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।১

পৃষ্ঠা: ৫৯
সে সময় মুসলিম লীগের দু-গ্রুপে যখন প্রবল কলহ চলছিল, তখন আবু সাঈদ চৌধুরী ছাত্রদের বিরােধ নিষ্পত্তির জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। রাজনৈতিক অঙ্গনে তার একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান ছিল। আবু সাঈদ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন, এই সময়কার একজন ছাত্র নেতার নাম উল্লেখ না করলে অন্যায় হবে; কারণ, তিনি কোনাে গ্রুপে ছিলেন না এবং অন্যায় সহ্য করতেন না। সত্যবাদী বলে সকলেই তাঁকে শ্রদ্ধা করতেন। নেতাদের সকলেই তাকে স্নেহ করতেন। তার নাম এখন সকলেই জানেন, জনাব আবু সাঈদ চৌধুরী বার এট ল’। এখন ঢাকা হাই কোর্টের জজ সাহেব। তিনি দুই গ্রুপের মধ্যে আপােস করতে চেষ্টা করতেন। শহীদ সাহেবও চৌধুরী সাহেবের কথার যথেষ্ট দাম দিতেন।২ কর্মজীবনে প্রবেশের পর ১৯৬০ সালে পূর্ব পাকিস্তানের এ্যাডভােকেট জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। অতঃপর ১৯৬১ সালে ঢাকা হাইকোর্টের অতিরিক্ত বিচারক এবং পরবর্তী পর্যায়ে ১৯৬২ সালে স্থায়ী বিচারপতি হিসেবে পদায়িত হন। জেনারেল আইয়ুব খানের শাসনামলে, ১৯৬০-৬১ সালে পাকিস্তান শাসনতন্ত্র কমিশনের সদস্য এবং ১৯৬৩-৬৮ সাল পর্যন্ত কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বাের্ডের সভাপতি ছিলেন। ১৯৬৯ সালের ২০ নভেম্বরে তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে নিযুক্তি দেওয়া হয়। ১৫ মার্চ ১৯৬৯ সালে জেনেভায় অবস্থানকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশের গুলিতে ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে তিনি উপাচার্যের পদ হতে পদত্যাগ করেন। ১৯৭১ সালে তিনি পাকিস্তান সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে জাতিসংঘে অবস্থান করছিলেন, অতঃপর ২৫ মার্চে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বর্বরতার প্রতিবাদে পক্ষত্যাগ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করেন এবং বিশ্ববলয়ে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে জনমত গঠনে আত্মনিয়ােগ করেন।৩
স্বাধীনতা যুদ্ধকালে যে ক’জন মহান ব্যক্তিত্ব আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, পাক হানাদারদের গণহত্যা, ধর্ষণ ও ধ্বংসযজ্ঞের বিরুদ্ধে সােচ্চার হয়ে বিশ্ব জনমত গঠনে তৎপরতা চালিয়েছিলেন, তাঁদের অন্যতম ছিলেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। অপারেশন সার্চ লাইটের নামে হানাদার-বাহিনী কর্তৃক গণহত্যার সূচনাকালে (২৫ মার্চ) মানবাধিকার কমিশনের একসভা উপলক্ষ্যে তিনি জেনেভায় অবস্থান করছিলেন। হানাদার সেনাদের গণহত্যার সংবাদটি শােনামাত্র তিনি সভাস্থল ত্যাগ করে লন্ডন ফেরেন। লন্ডন ফিরেই তিনি বাঙালিদের মুক্তিযুদ্ধে যােগ দেন। তিনি ব্রিটিশ পররাষ্ট্র বিভাগের একজন উচ্চপদস্থ অফিসার মি. সাদারল্যান্ডের কাছে ঢাকার সাম্প্রতিক খবর শােনার পর ঘােষণা করেন, এই মুহূর্ত থেকে পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে আমার আর কোনাে সম্পর্ক রহিল না। আমি দেশ থেকে

পৃষ্ঠা: ৬০
দেশান্তরে যাব আর পাকিস্তানী সৈন্যদের এই নিষ্ঠুরতা, নির্মমতার কথা বিশ্ববাসীকে জানাব। তারা আমার ছেলেমেয়েদের হত্যা করেছে। এর প্রতিবিধান চাই।৪

মুজিবনগর সরকারের পক্ষ থেকে তাঁকে ২৩ এপ্রিল ১৯৭১ সালে বিশেষ দূত হিসেবে নিয়ােগ প্রদান করা হয়। তার তত্ত্বাবধানে বিশ্বপরিসরে স্বাধীনতার স্বপক্ষে সংগ্রাম পরিষদের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। লন্ডনের ট্রাফালগার স্কয়ারে তাঁরই উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয় প্রবাসী বাঙালিদের বিশাল সমাবেশ। সেসময় তিনি খুবই সফলতার সাথে জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বও করেন। মুক্তিযুদ্ধের এক পর্যায়ে খন্দকার মােশতাক-ইয়াহিয়া-নিক্সন চক্র মুক্তিযুদ্ধ নস্যাৎ করার ষড়যন্ত্রে তৎপর হয়ে উঠলে; সেই অপতৎপরতার সাথে তাকেও সামিল করার জন্য প্রলােভিত করা হয়। তিনি সেসমস্ত প্রলােভন সপ্রভিত স্বরে প্রত্যাখান করেন। এ প্রসঙ্গে শশাঙ্ক এস ব্যানার্জী লিখেছেন, তিনি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে বললেন যে ওয়াশিংটনে খুব তাড়াহুড়া করে ঠিক করা এক মিটিংএ তিনি ইউএস অ্যাসিসট্যান্ট সেক্রেটারি অফ স্টেট জোসেফ সিসকো’র সাথে তার বাসায় দেখা করেন। সিসকোর সাথে আর একজন ভদ্রলােক ছিলেন যিনি তার পরিচয় দেননি। তিনি সম্ভবত সিআইএ প্রধান। সে ঘটনার চমকের বিষয়টি হলাে কিছু সাধারণ আলাপের পরই জোসেফ সিসকো বেশ গুরুত্বের সাথে তাঁকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন বন্ধ করার অনুরােধ জানান। তার বদলে বিচারপতি চৌধুরীকে অনেক বড় পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। সেটা হলাে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি হবার প্রস্তাব। বিচারপতি চৌধুরী বেশ ধাঁধায় পড়ে গিয়েছিলেন যে ইউএস স্টেট ডিপার্টমেন্টের একজন মধ্যম সারির অফিসার পাকিস্তানের পক্ষে তাকে এই পরামর্শ দিচ্ছে।৫ এহেন প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে দেওয়া তাঁর জবাবটিও ছিল প্রবল দেশপ্রেমসঞ্জাত। এ বিষয়ে একই লেখক লিখেছেন, তিনি ইউএস অফিসিয়াল দুজনকেই একটি ক্যাটাগরিকাল বক্তব্য দিলেন যে তিনি আসলে উচ্চরাজনৈতিক পর্যায়ের সম্মান কিংবা আরাম খুঁজছেন না, বরং তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের সংগ্রামে এক সাধারণ কর্মী মাত্র। তাঁর দেশের স্বাধীনতার লক্ষ্য থেকে কোনকিছুই তাকে সরাতে পারবে না।৬ এভাবে এক অনড় অবস্থানে থেকে তিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। স্বাধীনতার পর তার মূল্যায়নও করা হয়েছিল যথার্থভাবে।

পৃষ্ঠা: ৬১
বয়সে এক বছরের কণিষ্ঠ হলেও ছাত্রজীবন থেকেই বঙ্গবন্ধু তাঁকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন। তাঁর ঐকান্তিক ইচ্ছেতেই বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে তিনি সদ্যস্বাধীন দেশটির রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত করেছিলেন। জাতির পিতা হয়েও বঙ্গবন্ধু যে তাঁকে কতটা শ্রদ্ধা করতেন একটি ঘটনার মাধ্যমে তার অনবদ্যতা বর্ণনা করেছে বিশিষ্ট কূটনীতিবিদ প্রয়াত ফারুক চৌধুরী। ১৯৭২ সালে, মার্চের ১৭ হতে ১৯ তারিখ ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী মতি ইন্দিরা গান্ধী রাষ্ট্রীয় সফর উপলক্ষ্যে বাংলাদেশে অবস্থান করছিলেন। সফরে দ্বিতীয় দিনের কর্মসূচী এমনভাবে প্রণীত হয়েছিল যে বঙ্গবন্ধুকে দুটি অনুষ্ঠানের মধ্যবর্তী বিরতির একঘণ্টা বঙ্গভবনে অবস্থান করতে হয়। এসময় তিনি অবস্থান করছিলেন দোতলার একটি কক্ষে নিচে রাষ্ট্রপতি হিসেবে অফিস করছিলেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। একাকীত্ব নিরসনের জন্য কূটনৈতিক কর্মকর্তা ফারুক চৌধুরী বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, সেই একটি ঘণ্টা কি তিনি তাঁর কামরায় বসে কাটাতে চান রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলাপ-আলােচনায়। বললাম, তাহলে রাষ্ট্রপতিকে দোতলায় নিয়ে আসা যেতে পারে। খবরের কাগজ থেকে মুখ তুলে তাকালেন প্রধানমন্ত্রী। বললেন, তুমি কি ভুলে গেলে প্রধানমন্ত্রীকে যেতে হয় রাষ্ট্রপতির কাছে। রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর কাছে আসে না। তবে তাঁর সঙ্গে গল্পগুজব করার তােমার প্রস্তাবটি উত্তম। চলাে, নিচে যাই।৭ স্বাধীনতার পর; ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। অতঃপর ১৯৭৩

পৃষ্ঠা: ৬২
সালের ২৫ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং মন্ত্রীর পদমর্যাদায় সরকারের আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে পদায়িত হন। বাকশাল গঠিত হবার পর; ১৯৭৫ সালে, ৮ আগস্টে তাঁকে বন্দর, জাহাজ চলাচল ও অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী পদে নিযুক্তি দেওয়া হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পরিবারসমেত হত্যা করার পর খােন্দকার মােশতাক আহমদ কর্তৃক তাঁকে অবৈধ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পদে পদায়ন করা হলে; ১৫ আগস্ট রাতেই তিনি অবৈধ সরকারের মন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। এ পদে তিনি ২০ আগস্ট হতে ৬ নভেম্বর ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বহাল ছিলেন। এসময় তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খন্দকার মােশতাক সরকারকে স্বীকৃতি প্রদানের প্রশ্নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
রাজনৈতিক বলয় হতে বিদায়ের পর ১৯৭৮ সালে জাতিসংঘের সংখ্যালঘু বৈষম্য প্রতিরােধ ও অধিকার সংরক্ষণ কমিশনের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮৫১৯৮৬ সালে ছিলেন জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে। বিচারপতি হিসেবে সমধিক খ্যাত প্রেসিডেন্ট আবু সাঈদ চৌধুরী লন্ডনে অবস্থানকালে ১৯৮৭ সালে, আগস্টের ২ তারিখে হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে টাঙ্গাইলের পৈতৃক বাড়ি নাগবাড়িতে সমাধিস্থ করা হয়। আবু সাঈদ চৌধুরী একাধারে ছিলেন বিচারপতি, বিশ্বদ্যিালয়ের উপাচার্য ও দেশের প্রেসিডেন্ট, একসময় দখলদার পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সােচ্চার হলেও স্বদেশের কতিপয় খুনিচক্রের বিরুদ্ধে তিনি সােচ্চার না হয়ে হয়েছেন সহযােগী, সেদিন যদি তাঁর মতাে ব্যক্তিত্ব মােশতাক চক্রের বর্বরতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেন, তাহলে হয়তাে বা পরিস্থিতি অন্যরকম হতাে।

তথ্যনির্দেশ:
১. বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন। টাঙ্গাইল জেলা। টাঙ্গাইল জেলার প্রখ্যাত ব্যক্তিত্বের আলােকে লিখিত।
২. মুজিবুর রহমান, শেখ। অসমাপ্ত আত্মজীবনী। ২০১৫ (পুনর্মুদ্রণ) ঢাকা। দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড। পৃষ্ঠা: ৩২।
৩. এনামুল হক। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। বাংলাপিডিয়া-বাংলাদেশ জাতীয় জ্ঞানকোষ। ২৬ নভেম্বর ২০১৪ এর আলােকে লিখিত।
৪. চৌধুরী, মফিজ। বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায়। ২০১৮ (দ্বিতীয় সংস্করণ)। ঢাকা। ইউনাইটেড প্রেস লিমিটেড। পৃষ্ঠা: ৬৭-৬৮
৫. ব্যানার্জী, শশাঙ্ক এস। ভারত, মুজিবুর রহমান, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও পাকিস্তান। ২০১৯। ঢাকা। সঞ্চিতা। পৃষ্ঠা: ৮৬
৬. প্রাগুক্ত। পৃষ্ঠা: ৮৬
৭. চৌধুরী, ফারুক। জীবনের বালুকাবেলায়। ২০১৮ (সপ্তম মুদ্রণ) ঢাকা। প্রথমা প্রকাশন। পৃষ্ঠা: ২২৬

মন্ত্রী অধ্যাপক মােহাম্মদ ইউসুফ আলী

আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের অন্যতম-স্বাধীনতা সংগ্রামের সক্রিয় সংগঠক শিক্ষাবিদ-রাজনীতিবিদ অধ্যাপক মােহাম্মদ ইউসুফ আলী ছয়দফার আন্দোলন, আইয়ুববিরােধী আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র বিরােধী আন্দোলন, উনসত্তুরের গণঅভ্যুত্থান, সত্ত্বরের নির্বাচন, তৎপরবর্তী অসহযােগ আন্দোলন ও স্বাধীনতা সংগ্রামে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি ১৯২৩ সালে দিনাজপুর জেলাস্থ বিরল উপজেলার ফরাক্কাবাদ গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। পিতাগফুরউদ্দিন শাহ। স্থানীয় বিদ্যালয় হতে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্তির পর; ১৯৪৪ সালে দিনাজপুর একাডেমি হাইস্কুল হতে ম্যাট্রিক পাশ করেন। অতঃপর দিনাজপুরের রিপন কলেজ হতে উচ্চমাধ্যমিক, সুরেন্দ্রনাথ কলেজ হতে স্নাতক এবং ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে বাংলাভাষা ও সাহিত্যে মাস্টার ডিগ্রি লাভ করেন। মােহাম্মদ ইউসুফ আলী শিক্ষা জীবন শেষে রাজশাহীর নবাবগঞ্জ কলেজে বাংলার অধ্যাপক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। অতঃপর দিনাজপুর সুরেন্দ্রনাথ কলেজে বাংলার অধ্যাপক পদে যােগ দিয়ে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত অধ্যাপনার সাথে যুক্ত ছিলেন।
অধ্যাপনার সাথে যুক্ত থাকাকালেই-১৯৬০ সালে রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হন। ১৯৬২ সালে আওয়ামী লীগের মনােনীত প্রার্থী হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান আইনসভার সদস্য এবং ১৯৬৫ সালে সম্মিলিত বিরােধী দলের প্রার্থী হিসেবে পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। সে সময়ে তিনি জাতীয় অর্থনৈতিক কাউন্সিলের (NEC) সদস্য ছিলেন। সুরেন্দ্রনাথ কলেজে

পৃষ্ঠা: ৬৪
অধ্যাপনাকালেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় হতে বিএল ডিগ্রি অর্জন করে দিনাজপুরের আদালতে আইনপেশায় প্রবেশ করেন। অতঃপর ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে দিনাজপুর-৮ আসন থেকে পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির চিফ হুইপ মনােনীত হন। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে মুক্তিযুদ্ধ সূচিত হলে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দসহ ভারতে গিয়ে মুজিবনগর সরকার গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মুজিবনগর সরকার গঠিত হবার পর ১৯৭১ সালে, ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে স্বাধীনতার ঘােষণাপত্র পাঠ করেন। মুক্তিযুদ্ধকালে মুজিবনগর সরকারের ইয়ুথ কন্ট্রোল বাের্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন ইউসুফ আলী। এছাড়া এ এইচ এম কামরুজ্জামানের দায়িত্বাধীন সাহায্য ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের অনারারি মহাসচিবের দায়িত্বও পালন করেন।
স্বাধীনতার পর মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী; তাজউদ্দীন আহমদের পুনর্বিন্যাসিত মন্ত্রিসভায় অধ্যাপক ইউসুফ আলীকে শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়ােগ করা হয়। পরবর্তী পর্যায়ে (১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত মন্ত্রিসভাতেও তাকে পূর্বোক্ত মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রিত্বে বহাল রাখা হয়। তিনি ২৯ ডিসেম্বর ১৯৭১ সাল হতে ২৬ জানুয়ারি ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত উপরােক্ত মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বপালন করেছেন। অতঃপর ১৯৭৫ সালে বাকশাল গঠিত হবার পর তাকে শ্রমমন্ত্রী পদে নিযুক্তি দেওয়া হয়। এছাড়া বাকশালের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শাখা হিসেবে বিবেচিত-শ্রমিক ফ্রন্ট পরিচালনার দায়িত্বও অর্পিত হয় তাঁর ওপর। তিনি ১৫ সদস্য বিশিষ্ট বাকশাল পলিট ব্যুরাের অন্যতম সদস্য ছিলেন।
স্বাধীনতা পূর্বকালের আন্দোলন-সংগ্রামে প্রায়শ বঙ্গবন্ধুর সহচর হিসেবে তিনি বিভিন্ন জেলা সফর করতেন। দৈনিক ইত্তেফাক। ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬। ‘শেখ মুজিবের চট্টগ্রাম ও নােয়াখালী সফর’ বিষয়ক প্রতিবেদনের মাধ্যমে জানা যায় তিনি ছয়দফা প্রচারণার কাজে বঙ্গবন্ধুর সফর সঙ্গী হয়েছিলেন। প্রতিবেদনটিতে লেখা হয়েছিল; পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবর রহমান চট্টগ্রাম ও নােয়াখালী জেলায় ৩ দিবসব্যাপী সফরে যাইতেছেন। শেখ মুজিবর রহমানের সঙ্গে থাকিবেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জনাব তাজউদ্দীন আহমদ, প্রচার সম্পাদক হাফেজ হাবিবুর রহমান, কোষাধ্যক্ষ জনাব নূরুল ইসলাম চৌধুরী, প্রাক্তন চীফ হুইপ খােন্দকার মােশতাক আহমদ, জাতীয় পরিষদ সদস্য অধ্যাপক ইউসুফ আলী ও জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরী। নেতৃবৃন্দ ২৫শে ফেব্রুয়ারি সকাল ৮টায় ‘উল্কাযােগে চট্টগ্রাম রওয়ানা হইয়া দুপুর ২টায় চট্টগ্রাম

পৃষ্ঠা: ৬৫
পৌছিবেন। শেখ মুজিবর রহমান ঐদিন বিকাল ৩টায় চট্টগ্রামে এক জনসভায় বক্তৃতাদান করিবেন এবং ২৭ ফেব্রুয়ারি সকালে জেলা আওয়ামী লীগ কাউন্সিল সভায় যােগদান করিবেন। (সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু: তৃতীয় খন্ড-ষাটের দশক-দ্বিতীয় পর্ব। পৃষ্ঠা: ২২১) এহেন একজন পরীক্ষিত (!) নেতাও পনের আগস্টের মর্মান্তিক হত্যাযজ্ঞের পর খন্দকার মােশতাকের অবৈধ সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রী হিসেবে ১৫ আগস্ট রাতেই শপথ গ্রহণ করেন।
একই বছর মােশতাক সরকারের পতন হলে তাঁর মন্ত্রিত্ব বিনাশ হয়। অতঃপর ১৯৭৭ সালে আওয়ামী লীগ পুনর্গঠিত হবার পর তিনি মিজানুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি জেনারেল পদে নিযুক্ত হন। ১৯৭৯ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মিজান গ্রুপের প্রার্থী হিসেবে দিনাজপুর-৭ আসন হতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং পরাজিত হন। অতঃপর দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক মতাদর্শ জলাঞ্জলি দিয়ে জেনারেল জিয়ার বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলে (বিএনপি) যােগদান করেন এবং ১৯৭৯ সালে বিএনপির মন্ত্রিসভায় বস্ত্রমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৯৮১ সালে একই দলের বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের নেতৃত্বাধীন সরকারে পাট ও বস্ত্র মন্ত্রী হিসেবে যােগদান করেন। ১৯৮২ সালে লে. জেনারেল হাে. মাে এরশাদের ক্ষমতা দখলের পূর্বে তিনি বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের দ্বিতীয় মন্ত্রিসভায় শিল্প মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী পদে আসীন ছিলেন। অতঃপর ১৯৮৫ সালে হাে. মাে. এরশাদ কর্তৃক রাজনৈতিক দল হিসেবে জাতীয় পার্টি গঠিত হলে বিএনপি পরিত্যাগ করে সেই পার্টিতে যােগ দেন এবং ১৯৮৬ সালে এরশাদ সরকারের ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়ােজিত হন। এর কয়েকমাস পরেই মন্ত্রিসভা হতে পদত্যাগ করেন এবং রাজনীতি থেকে স্থায়ীভাবে বিরত হন। ১৯৯৮ সালের ডিসেম্বর মাসে অধ্যাপক ইউসুফ আলী মৃত্যুবরণ করেন। বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত কাছের মানুষ হয়েও সুবিধাবাদী রাজনীতিবিদ অধ্যাপক ইউসুফ আলী ১৫ আগস্টের হত্যার প্রতিবাদে কোনাে ভূমিকা পালন করেননি। অধিকন্তু বঙ্গবন্ধু ও পরিবারের সদস্যদের লাশের কোনাে সুরাহা হবার আগেই খুনি মােশতাকের মন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেছিলেন।
সহায়ক গ্রন্থ ও তথ্যউৎস
১. মনিরুজ্জামান, মুহম্মদ। অধ্যাপক মােহাম্মদ ইউসুফ আলী। বাংলাপিডিয়া-বাংলাদেশ জাতীয় জ্ঞানকোষ। ১৭ জুন, ২০১৪)
২. সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু: তৃতীয় খন্ড-ষাটের দশক-দ্বিতীয় পর্ব। প্রধান সম্পাদক: মাে. শাহ আলমগীর। ২০১৭। ঢাকা। বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট
৩. List of 11th Parliament Members Bangla. W.w.w.parliament.gov.bd

মন্ত্রী ফণীভূষণ মজুমদার
বঙ্গবন্ধুর ক্যাবিনেটে অন্যতম প্রবীণ মন্ত্রী ছিলেন ফণীভূষণ মজুমদার। রাজনৈতিক দিক দিয়ে তিনি ছিলেন এক লড়াকু ঐতিহ্যের অধিকারী। ব্রিটিশ বিরােধী আন্দোলন-সংগ্রামে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। দেশ ভাগের পূর্বে মতাদর্শগতভাবে ভিন্ন ধারার রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত থাকলেও; সূচনা থেকেই আওয়ামী লীগের সাথে পরােক্ষ-প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। ফণীভূষণ মজুমদার জন্মেছিলেন ১৯০১ সালে। জন্মস্থান: বর্তমান মাদারীপুর জেলার রাজৈর উপজেলার সেন্দিয়া গ্রামে। পিতা : সতীশ চন্দ্র মজুমদার। মাদারীপুর উচ্চবিদ্যালয়ের অঙ্গন পেরিয়ে বাঁকুড়া কলেজ এবং কলকাতার বিদ্যাসাগর কলেজে অধ্যয়ন করেছেন। অতঃপর আইন বিষয়ে অধ্যয়ন করেছেন কলকাতার সুরেন্দ্রনাথ কলেজে। ছাত্রজীবন থেকেই ব্রিটিশ বিরােধী আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। ১৯১৯ সালে বিপ্লবী সমিতিতে যােগ দিয়ে গুপ্তকার্যক্রমের সাথে জড়িত হন। ১৯২৫ সালে ছিলেন মাদারীপুর শান্তি বাহিনীর সক্রিয় সদস্য। ব্রিটিশ বিরােধী রাজনৈতিক সংগ্রামে সম্পৃক্ততার কারণে তাঁকে ১৯৩০ হতে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত কারাগারে অন্তরীণ থাকতে হয়। পরবর্তী সময়ে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী হিসেবে ব্রিটিশ বিরােধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত হন। ১৯৪০ সালে সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে হলওয়েল মনুমেন্ট অপসারণ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন এবং গ্রেফতার হন। দীর্ঘদিন। কারাবাসের পর ১৯৪৬ সালে কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন।

পৃষ্ঠা: ৬৭
প্রান্তিক জনগােষ্ঠীর অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে ১৯৪৮ সালে মাদারীপুর মহকুমায় গঠন করেন তাঁতি সমবায় সমিতি। ভাষা আন্দোলনেও ফণীভূষণ মজুমদার সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন, যে কারণে ১৯৪৮ সালে এবং ১৯৪৯ হতে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত কয়েক পর্যায়ে তাকে গ্রেফতার ও কারারুদ্ধ করা হয়। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকেই তিনি দলটির সাথে যুক্ত ছিলেন। ১৯৫৪ সালে অনুষ্ঠিত যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে মাদারীপুরগােপালগঞ্জ নির্বাচনি এলাকা থেকে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিজয়ী হন। ১৯৫৮ সালে সামরিকআইন জারির পর তাকে গ্রেফতার করা হয়, অতঃপর দীর্ঘ কারাবাস শেষে ১৯৬২ সালে মুক্তি দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান নিরাপত্তাআইনে আটক করে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত কারাগারে আটক রাখা হয়।১ ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিবনগর সরকারের সাথে সম্পৃক্ত থেকে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সে সময় মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে জনমত সৃষ্টির জন্য ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল সফর করেন এবং ভারতীয় লােকসভা ও রাজ্যসভার যৌথ অধিবেশনে ভাষণ দেন। প্রকাশ থাকে যে বাংলা ভাগ হবার পরও তিনি পশ্চিম বাংলায় প্রবলভাবে জনপ্রিয় ছিলেন। তাঁর এহেন কর্মতৎপরতা ও জনপ্রিয়তা প্রসঙ্গে আলােকপাতকালে বীরেন্দ্রনাথ অধিকারী লিখেছেন, ‘ব্রিটিশ পেরিয়ে পাকিস্তান, তারপর স্বাধীকার আন্দোলন থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন এবং স্বাধীন বাংলাদেশে আমৃত্যু ফণী দার এই সার্বজনীন জনপ্রিয়তার বিন্দুমাত্র ঘাটতি দেখা যায়নি। মুক্তিযুদ্ধকালে বিভিন্ন শরণার্থী শিবির পরিদর্শন এবং অন্যান্য কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য প্রায়শই তিনি পশ্চিমবঙ্গে ট্রেনে ভ্রমণ করতেন। সে সময় ‘জয় বাংলা’র ভিড়ে ট্রেনে সিট পাওয়া দুরূহ ব্যাপার ছিল। কিন্তু তাতে কী! যখনই কেউ দেখেছে, ফণীভূষণ মজুমদার ট্রেনে দাঁড়িয়ে, অমনি সিট ছেড়ে উঠে তাঁকে বসার ব্যবস্থা করে দিয়েছে ওখানকার মানুষজন। ফণী দা বিব্রত হয়ে বলতেন, না, না, প্রয়ােজন নেই, আপনারা বসুন। কিন্তু ভারত বিভাগের দুই যুগ পার হয়ে গেলেও ওখানকার মানুষজন তাদের প্রিয় নেতাকে ভােলেনি, তার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে কার্পণ্য করেনি তারা। তাদের ভাষ্য ছিল, আপনি নেতাজির সহকর্মী, আপনি আমাদের নেতা, আপনি দাঁড়িয়ে থাকবেন, আর আমরা বসে যাব, তা হতে পারে না। শুধু পশ্চিমবঙ্গেই নয়, সে সময় মুক্তিযুদ্ধের প্রচারণায় ভারতবর্ষের যে প্রান্তেই ফণী দা গিয়েছেন সেখানেই তাকে ঘিরে ধরেছে সেখানকার লােকজন। ভারতীয়দের মধ্যে ফণী দার বিপুল এই জনপ্রিয়তাকে মােক্ষম কাজে লাগিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকার। সে সময় তিনি

পৃষ্ঠা: ৬৮
মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন না বটে, কিন্তু মন্ত্রীর পদমর্যাদায় তাঁকে এমন সব কর্মকাণ্ডের দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে, যে সব অন্য কাউকে দিয়ে সম্ভব ছিল না। ভারতীয় পার্লামেন্টের লােকসভা এবং রাজ্যসভার সদস্যদের যুক্ত অধিবেশনে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে ভাষণদানের জন্য ফণী দাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি বেশ কয়েকদিন আগে দিল্লি গিয়ে দলমত নির্বিশেষে পুরনাে সব শীর্ষস্থানীয় এবং প্রভাবশালী নেতবৃন্দকে সম্পূর্ণভাবে বাংলাদেশের পক্ষে কথা বলার জন্য রাজি করান। তাদের মধ্যে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী তাে বটেই, আরও ছিলেন গুলজারি লাল নন্দা, মােরারজি দেশাই, চরণ সিং, শরণ সিং, ওয়াই বি চ্যবন, ডি পি ধর, জগজীবন রাম, চন্দ্র শেখর, অটল বিহারী বাজপেয়ী প্রমুখ। ফণী দা বলেছেন, একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন জয়প্রকাশ নারায়ণ, যিনি উক্ত পার্লামেন্টে ফণী দা ভাষণদানকালে প্রতিবাদ করেছিলেন। তবে অন্য সদস্যরা তাকে নিবৃত করে বসিয়ে দেন। ফণী দার জ্বালাময়ী ভাষণে মুহুর্মুহু করতালি এবং জয়বাংলা’ স্লোগানে সেদিন প্রকম্পিত হয়ে ওঠে ভারতীয় পার্লামেন্ট। পরে জয়প্রকাশ ফণী দার কাছে দুঃখ প্রকাশ করেন এবং বাংলাদেশের পক্ষেই কাজ করেন।২
স্বাধীনতার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই বিপ্লবী নেতাকে ১২ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে খাদ্যমন্ত্রীর পদে নিযুক্ত করেন। পরবর্তী পর্যায়ে ৯ জুলাই ১৯৭৪ সাল হতে ২৪ জানুয়ারি ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন ভূমি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী। এছাড়া ১৯৭৫ সালে, জুনের ৬ তারিখে গঠিত ১১৫ সদস্যবিশিষ্ট বাকশাল কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটিতে তিনি ছিলেন অন্যতম সদস্য।
১৫ আগস্টের পর খন্দকার মােশতাক কর্তৃক তাঁকে অবৈধ সরকারের স্থানীয় সরকার, পল্লি উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়ােজিত করা হয়। তিনি মন্ত্রিত্বের জন্য শপথ গ্রহণ করেন আগস্টেও ১৫ তারিখ রাতে। সেই পদে মােশতাকের পতন পর্যন্ত বহাল ছিলেন। ১৯৭৭ সালে জেনারেল জিয়ার শাসনামলে তাঁকে সামরিকআইন বলে গ্রেফতার করা হয়। ইতিপূর্বে আওয়ামী লীগকে পুনরায় সংগঠিত করার জন্য; ১৯৭৬ সালের ২৫ আগস্ট মিজানুর রহমান চৌধুরীর ধানমন্ডির বাসভবনে সাবেক আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের এক বর্ধিত সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মহিউদ্দীন আহমেদ। এতে ৬০ জন প্রাক্তন গণপরিষদ সদস্য, ২৪০ জন সাবেক সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক জেলাসমূহের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ মােট এক হাজারের অধিক প্রতিনিধি যােগদান করেন।৩ সেই সভাতে অংশগ্রহণের মাধ্যমে ফণীভূষণ মজুমদারও আওয়ামী লীগে প্রত্যাবর্তন করেন। পরবর্তী বছরে; ১৯৭৭ সালের ৩ ও ৪ এপ্রিল ঢাকার ইডেন

পৃষ্ঠা: ৬৯
হােটেল প্রাঙ্গনে দুদিনব্যাপি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়।৪ উক্ত কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত মােতাবেক সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন কর্তৃক আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক কমিটির ৪৪ জন সদস্যর নাম ঘােষণা করা হয়। ১৫ এপ্রিল, ১৯৭৭ সালে ঘােষিত ওই সাংগঠনিক কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন ফণীভূষণ মজুমদার। অতঃপর ১৯৭৮ সালের ৩-৫ মার্চ ঢাকার মতিঝিলস্থ হােটেল ইডেনে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের ১২ তম দ্বিবার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশনে আব্দুল মালেক উকিলকে সভাপতি পদে নির্বাচিত করা হলে; সে সম্মেলনে ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য হিসেবে যে ৩৪ জনের নাম চূড়ান্তভাবে গ্রহণ করা হয়, তাদের অন্যতম ছিলেন ফণীভূষণ মজুমদার। পরবর্তী বছরে-১৯৭৯ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে ফরিদপুর-১১ আসন হতে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরবর্তী পর্যায়ে ১৯৮১ সালের ১৪-১৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার হােটেল ইডেনে অনুষ্ঠিত হয় আওয়ামী লীগের ১৩তম দ্বিবার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশন। কাউন্সিলে উপস্থিত ছিলেন ৪ হাজার কাউন্সিলর ও ডেলিগেট। কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত মােতাবেক শেখ হাসিনাকে দলের সভাপতি নির্বাচন করা হয়। উক্ত কমিটিতে ফণীভূষণ মজুমদারকে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য করা হয়। এর অনতিকাল পরেই-১৯৮১ সালে, অক্টোবরের ৩১ তারিখে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী মতি ইন্দিরা গান্ধী শােক প্রকাশ করেছিলেন।
জনকল্যাণে নিবেদিত দেশপ্রেমিক প্রবীণ নেতা ফণীভূষণ মজুমদারকে। অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার এহেন শ্রদ্ধাভাব প্রকাশ পেয়েছে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থ। তার প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘দুই দিন পরে খবর এলাে, আমাকে ফরিদপুর জেলে নিয়ে যেতে। আমি ফরিদপুর জেলে ফিরে এলাম। এবার আমাকে রাখা হলাে রাজবন্দিদের ওয়ার্ডে। এই ওয়ার্ডে দুইটা কামরা; এক কামরায় পাঁচজন ছিল। আরেক কামরায় গােপালগঞ্জের বাবু চন্দ্র ঘােষ, মাদারীপুরের বাবু ফণি মজুমদার ও আমি। এই দুইজনকে আমি পূর্ব থেকেই জানতাম। ফণি মজুমদার পূর্বে ফরােয়ার্ড ব্লকের নেতা ছিলেন। ইংরেজ আমলে আট নয় বৎসর জেল খেটেছেন। দেশ স্বাধীন হবার পরেও রেহাই পান নাই। বিবাহ করেন নাই। তাঁর বাবা আছেন…, পেনশন পান। ফণি বাবু দেশ ছাড়তে রাজি হন নাই। হিন্দু-মুসলিম জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে তাকে ভালােবাসত। কেউ কোনাে বিপদে পড়লে ফণি মজুমদার হাজির হতেন। কারাে বাড়িতে কেউ অসুস্থ হলে ফণি মজুমদারকে পাওয়া যেত। আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। সরকার যাদের কমিউনিস্ট ভাবতেন, তারা আছে এক কামরায়। আমরা তিনজন কমিউনিস্ট নই তাই আমরা আছি অন্য কামরায়।৫

পৃষ্ঠা: ৭০
চিরকুমার ফণীভূষণ মজুমদারও বঙ্গবন্ধুকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। একই কারাগারে আটক থাকাকালে অসুস্থ বঙ্গবন্ধুকে তিনি আন্তরিকভাবে দেখভাল করতেন। এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু একই গ্রন্থে কৃতজ্ঞচিত্তে লিখেছেন, ‘আমি ফরিদপুর জেলে আসলাম, স্বাস্থ্য খারাপ নিয়ে। এসেই আমার ভীষণ জ্বর; মাথার যন্ত্রণা, বুকে ব্যথা অনুভব করতে লাগলাম। চিকিৎসার ত্রুটি করছেন না জেল কর্তৃপক্ষ, তবুও কয়েকদিন খুব ভুগলাম। রাতভর চন্দ্র বাবু আমার মাথার কাছে বসে পানি ঢেলেছেন। যখনই আমার হুঁশ হয়েছে দেখি চন্দ্র বাবু বসে আছেন। ফণি বাবুও অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকতেন আমার জন্য। তিনদিনের মধ্যে আমি চন্দ্র বাবুকে বিছানায় শুতে দেখি নাই। আমার মাথা টিপে দিয়েছেন। কখনও পানি ঢালছেন, কখনও ওষুধ খাওয়াচ্ছেন। কখনও পথ্য খেতে অনুরােধ করছেন। না খেতে চাইলে ধমক দিয়ে খাওয়াতেন। আমি অনুরােধ করতাম, এত কষ্ট না করতে। তিনি বলতেন, ‘জীবনভরই তাে এই কাজ করে এসেছি, এখন বুড়াকালে কষ্ট হয় না। ডাক্তার সাহেব আমাকে হাসপাতালে নিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু চন্দ্র বাবু ও ফণি বাবু দেন নাই, কারণ সেখানে কে দেখবে? অন্যান্য রাজনৈতিক বন্দিরাও আমার জন্য অনেক কষ্ট করেছেন। কয়েকদিন পরেই আমি আরােগ্য লাভ করলাম।৬
এই নিষ্কলুষ-পরীক্ষিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের যথাযথ মূল্যায়ন করতে কার্পণ্য করেননি বঙ্গবন্ধু। তিনি তাঁকে অত্যন্ত সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত করেছিলেন। ১৫ আগস্টে; ‘ফণীভূষণ মজুমদার হৃদরােগে আক্রান্ত হয়ে পিজি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। যখন সেনা সদস্যরা তাকে বঙ্গভবনে নিয়ে যেতে

পৃষ্ঠা: ৭১
আসে তখন আরেকজন রােগী কবি জসিমউদ্দিন তাকে শক্ত করে ধরে রাখেন আর সেনা সদস্যদের কাছে আবেদন করেন ‘উনি একজন ভালাে মানুষ তাকে নিয়ে যেও না।৭ তারপরও মােশতাকের খুনি সেনারা তাঁকে বন্দুকের নলের মুখে বঙ্গভবনে যেতে এবং মন্ত্রিত্ব গ্রহণে বাধ্য করেছিল। শােনা যায়, তাঁকে নাকি শারীরিকভাবে অপদস্থ করা হয়েছিল। তদুপরি তিনি চার জাতীয় নেতা বা অন্যান্য আরও অনেক নেতাকর্মীর মতাে খুনিচক্রের বন্দুকের নলের মুখে প্রতিবাদী হতে পারেননি। প্রত্যাখান করতে পারেননি খন্দকার মােশতাকের প্রস্তাব। প্রয়ােজনে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে হলেও তাঁর মতাে প্রবীণ নেতার প্রতিবাদী পদক্ষেপ বহুলভাবে প্রত্যাশিত ছিল। এ বিষয়ে পরবর্তী সময়ে অনেকের মনেই অনেক প্রশ্ন উঠেছে। ভারতের প্রয়াত সাংবাদিক পরেশ সাহার বক্তব্য উদ্ধৃতিক্রমে বাংলাদেশের সাংবাদিক-সম্পাদক আবেদ খান এ প্রসঙ্গে লিখেছেন; ‘মােশতাকের কাছে উপস্থিত হয়ে তিনি তাে মন্ত্রগুপ্তির শপথ নিতে অস্বীকার করতে পারতেন? তিনি যদি মােশতাকের কাছে গিয়ে বলতেন, না সাহেব, আমি আপনার সঙ্গে নেই। মন্ত্রিত্ব আমি নেব না। মােশতাক তাহলে কী করতেন? ফণীবাবুর গর্দান নিতেন? তিনি তাে তাঁর জীবনে বহুবার এ ধরনের সংকটময় পরিস্থিতির মােকাবিলা করেছেন। তিনি না হয় আরও একবার সে ধরনের পরিস্থিতির মােকাবিলা করতেন। তা করতে গিয়ে যদি তার জীবনও যেত, তাহলে বাংলাদেশের ইতিহাসে মনুষ্যত্বের দীপ্ত মহিমায় তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকতেন।৮ পরেশ সাহা যথার্থই লিখেছেন ফণী বাবুর মতাে ব্যক্তিরা যদি জীবনের ঝুঁকি সত্ত্বেও আগস্টের হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে সােচ্চার হতেন, তাহলে হয়তােবা পরবর্তী ইতিহাস অন্যরকম হতাে। খুনিচক্রও বাধ্য হতাে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে। পরবর্তী বিপর্যয়গুলােও হয়তােবা নিরােধকরণ সম্ভব হতাে।

তথ্যনির্দেশ:
১. ফণীভূষণ মজুমদার। মুক্ত বিশ্বকোষ
২. অধিকারী, বীরেন্দ্রনাথ। স্মরণ। ফণীভূষণ মজুমদার। অনন্য এক বিপ্লবী। জনকণ্ঠ। ঢাকা। ৩১ অক্টোবর, ২০১৭
৩. রশিদ, হারুন-অর। মূলধারার রাজনীতি: বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কাউন্সিল ১৯৪৯- ২০১৬। ২০১৭। ঢাকা। বাংলা একাডেমি। পৃষ্ঠা: ১৭৯
৪. প্রাগুক্ত। পৃষ্ঠা: ১৭৪
৫. মুজিবুর রহমান, শেখ। কারাগারের রােজনামচা ২০১৭। ঢাকা। বাংলা একাডেমি। পৃষ্ঠা: ১৮৭-১৮৮
৬. প্রাগুক্ত। পৃষ্ঠা: ১৮৯।
৭. খতিব, এ. এল। হু কিলড মুজিব। ২০১৬। ঢাকা। আবিষ্কার। পৃষ্ঠা: ৩৫
৮. খান, আবেদ। ষড়যন্ত্রের জালে বিপন্ন রাজনীতি (১২) দৈনিক জাগরণ। ঢাকা। অক্টোবর ২, ২০১৯

মন্ত্রী মাে. সােহরাব হােসেন

রাজনীতিবিদ সােহরাব হােসেন ছিলেন বঙ্গবন্ধুর সমসাময়িক। বয়সের দিক দিয়ে এক বছরের কণিষ্ঠ। ১৯২১ সালে মাগুরার ভায়না গ্রামে তার জন্ম। মােশতাকের অবৈধ সরকারের মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করলেও পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগে প্রত্যাবর্তন করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সােহরাব হােসেন ১৯৪৬ সালে রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে বিএসসি পাশ করেন এবং যশােহর জেলা স্কুলে শিক্ষক হিসাবে যােগদান করেন। পরবর্তী সময়ে শিক্ষকতা পেশা ত্যাগ করে ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনবিভাগে ভর্তি হন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। আইনে স্নাতক ডিগ্রি লাভের পর ১৯৫৪ সালে মাগুরায় আইনজীবী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৪৮ সালে তিনি তৎকালীন ছাত্র নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সান্নিধ্য লাভ করেন। ১৯৫৪ সালে তারই উদ্যোগ-নেতৃত্বে মাগুরাতে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত তিনি মাগুরা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। অতঃপর ১৯৬৬ হতে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত মাগুরা মহকুমা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং ১৯৬৮ হতে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত যশােহর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন।

পৃষ্ঠা: ৭৩
১৯৬২ সালে তিনি মাগুরা-নড়াইল আসন হতে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৬ সাল হতে সূচিত ৬ দফা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯৬৮ সালের ১৯ ও ২০ অক্টোবর মতিঝিলস্থ হােটেল ইডেনে আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক নিয়মিত কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়।…উক্ত কাউন্সিলের শেষ দিনের অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে আওয়ামী লীগের নতুন কর্মকর্তা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।’ (রশিদ, হারুন-অর। পৃষ্ঠা: ১০৩ ও ১১৪) উক্ত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির কৃষি সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন সােহরাব হােসেন। ১৯৭০ সালের ৪-৫ জুনে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক সম্মেলনেও তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির কৃষি সম্পাদক পদে বহাল ছিলেন।
পরবর্তী সময়ের আন্দোলন-সংগ্রামেও তিনি স্থানীয় পর্যায়ে নেতৃত্ব দান করেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে সাংবিধানিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। স্বাধীনতা যুদ্ধকালে মুজিবনগর সরকারের সাথে সম্পৃক্ত থেকে নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের সংবিধান অনুমােদনকারীদের একজন সদস্য ছিলেন সােহরাব হােসেন। ১৯৭৩ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যশাের ১১ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিপরিষদে মােহাম্মদ সােহরাব হােসেন ১২ জানুয়ারি, ১৯৭২ হতে ১৬ মার্চ, ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং ১৬ এপ্রিল, ১৯৭৩ হতে ১১ নভেম্বর, ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিযুক্ত ছিলেন। এছাড়া তিনি নবগঠিত বাকশালে যােগদান করেছিলেন। ১৯৭৫ সালে, জুনের ৬ তারিখে গঠিত ১১৫ সদস্যবিশিষ্ট বাকশাল কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটিতে তিনি ছিলেন অন্যতম সদস্য। হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী ও বঙ্গবন্ধুর স্নেহভাজন মােহাম্মদ সােহরাব হােসেন-এলএলবি আগস্ট ট্রাজেডির পরও মন্ত্রিপরিষদ থেকে পদত্যাগ করেননি, খন্দকার মােশতাক আহমদের অবৈধ সরকার তাকে পূর্ব পদেই বহাল রেখেছিল। ১৫ আগস্ট রাতে তিনি মন্ত্রিত্বের শপথ নিয়েছিলেন। খন্দকার মােশতাকের পতনের পর ১১ নভেম্বর পর্যন্ত তিনি উক্ত পদে বহাল ছিলেন। জনাব মাে. সােহরাব হােসেন এলএলবি ১৯৯৮ সালে, জানুয়ারির ২৬ তারিখে মৃত্যুবরণ করেন।
১৯৭৫ এ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব শূন্য করার জন্য যেমন কারারুদ্ধ চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করা হয়, তেমনই আটক করে কারারুদ্ধ করা হয় শীর্ষ স্থানীয় নেতৃবৃন্দকে। এহেন এক সংকটময় পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগকে পুনরায় সংগঠিত করার জন্য; ১৯৭৬ সালের ২৫ আগস্ট মিজানুর রহমান চৌধুরীর ধানমন্ডির বাসভবনে সাবেক আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের এক বর্ধিত সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন আওয়ামী

পৃষ্ঠা: ৭৪
লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মহিউদ্দীন আহমেদ। এতে ৬০ জন প্রাক্তন গণপরিষদ সদস্য, ২৪০ জন সাবেক সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক জেলাসমূহের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ মােট এক হাজারের অধিক প্রতিনিধি যােগদান করেন।’ (রশিদ, হারুন-অর। পৃষ্ঠা: ১৭৯) উক্ত সভায় প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিতির মাধ্যমে সােহরাব হােসেন পুনরুজ্জীবিত আওয়ামী লীগে প্রত্যাবর্তন করেন। পূর্বোক্ত সভার অনুবৃত্তিক্রমে ১৯৭৭ সালের ৩রা ও ৪ঠা এপ্রিল ঢাকার ইডেন হােটেল প্রাঙ্গনে দুদিনব্যাপি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়।’ (রশিদ, হারুন-অর। পৃষ্ঠা: ১৭৪) কাউন্সিলের সিদ্ধান্তক্রমে ১৫ এপ্রিল সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন কর্তৃক কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক কমিটির যে ৪৪ জন সদস্য’র নাম ঘােষিত হয়, তাতে সদস্য হিসেবে ছিলেন সােহরাব হােসেন। ১৯৭৮ সালের কাউন্সিলেও তিনি ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য মনােনীত হয়েছিলেন।
প্রকাশ থাকে যে ১৯৭৮ সালের মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত কাউন্সিল অধিবেশনে নানা মত ও পথের অনুসারীদের সমন্বয়ে আওয়ামী লীগকে এক মঞ্চে সমবেতকরণের মাধ্যমে একটি গ্রহণযােগ্য কমিটি গঠন করা সম্ভব হলেও সে ঐক্য বেশিদিন টিকেনি। অচিরেই ভিন্নমতাবলম্বীদের উদ্যোগে বিভাজিত হয়ে পড়ে দলটি। উক্ত কাউন্সিলের মাত্র পাঁচ মাস পর; ১৯৭৮ সালের ১১ আগস্ট মিজানুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বে তাঁর ধানমন্ডির বাসভবনে কতিপয় সদস্য ও কিছু কর্মীর উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত একসভায় তাকে আহ্বায়ক করে দলের বাইরে পাল্টা আওয়ামী লীগ গঠন করা হয়।’ (রশিদ, হারুন-অর। পৃষ্ঠা: ১৫১) পরবর্তী সময়ে সােহরাব হােসেন আওয়ামী লীগ (মিজান) গ্রুপের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সহ-সভাপতি পদে নির্বাচিত হন। অতঃপর পুনরায় মূল আওয়ামী লীগে প্রত্যাবর্তন করে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত যশাের ও মাগুরা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। আওয়ামী লীগের পরীক্ষিত নেতা হয়েও সেদিন তিনি আগস্টের হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাননি কিংবা মন্ত্রিত্বও ত্যাগ করেননি।

সহায়ক গ্রন্থ ও তথ্যউৎস:
১. গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সরকারি ওয়েব সাইট
২. সােহরাব হােসেন। মুক্তবিশ্বকোষ।
৩. রশিদ, হারুন-অর। মূলধারার রাজনীতি: বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কাউন্সিল ১৯৪৯-২০১৬। ২০১৭। ঢাকা। বাংলা একাডেমি।
8. List of 11th Parliament Members Bangla. w.w.w.parliament.gov.bd

মন্ত্রী আব্দুল মান্নান

বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার অন্যতম মন্ত্রী আব্দুল মান্নান পেশাগতভাবে ছিলেন একজন আয়কর আইনজীবী। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯২৯ সালের ৭ অক্টোবর টাঙ্গাইল জেলার কাতুলি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা-তাজউদ্দিন জোয়ারদার, মা-খাতুন জোয়ারদার। টাঙ্গাইল বিন্দুবাসিনী সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয় হতে ১৯৪৪ সালে ম্যাট্রিক এবং সা’দত কলেজ হতে ১৯৪৬ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন। অতঃপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ১৯৫০ সালে অনার্সসহ বাণিজ্যে স্নাতক এবং ১৯৫১ সালে এম কম ডিগ্রি লাভ করেন। শিক্ষাজীবন সমাপ্তির পর মুন্সিগঞ্জের হরগঙ্গা কলেজ ও ময়মনসিংহের আনন্দমােহন কলেজে কিছুকাল অধ্যাপনা করেন। পরবর্তী সময়ে আয়কর উপদেষ্টা হিসেবে ঢাকা ইনকাম ট্যাক্স বারে যােগদান করেন।
আব্দুল মান্নান ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, পরবর্তী সময়ের ছয়দফা আন্দোলন, আইয়ুববিরােধী আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ও সত্তুরের নির্বাচনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তিনি ১৯৬৫ সালে টাঙ্গাইল মহকুমা আওয়ামী লীগের সভাপতি, ১৯৬৯ সালে টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদকের দায়িত্বে নিয়ােজিত ছিলেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে সাংবিধানিক পরিষদের সদস্য

পৃষ্ঠা: ৭৬
নির্বাচিত হন। পরবর্তী পর্যায়ে ১৯৭৩ ও ১৯৯৬ সালে টাঙ্গাইল সদর আসন হতে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালে, মুক্তিযুদ্ধকালে মুজিবনগর সরকারের প্রচার ও প্রকাশনা বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সেসময় সরকারের মুখপত্র হিসেবে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘জয়বাংলা’ পত্রিকার সম্পাদক মণ্ডলীর সভাপতি ছিলেন। এছাড়া আহম্মদ রফিক নামে তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হতে ‘বহুবন্ধুর বিচার প্রহসন’ শিরােনামে প্রচারিত কথিকা পাঠ করতেন।
স্বাধীনতার পরবর্তী পর্যায়ে ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গঠিত মন্ত্রিপরিষদে আব্দুল মান্নান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হন, এ পদে তিনি ১২ এপ্রিল ১৯৭২ সাল হতে ১৬ জানুয়ারি ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত বহাল ছিলেন। ১৯৭৩ সালের ১৬ মার্চ গঠিত বঙ্গবন্ধুর তৃতীয় মন্ত্রিসভায় তাকে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়ােগ দেওয়া হয়। এ পদে তিনি ১৬ মার্চ ১৯৭৩ হতে ২৪ জানুয়ারি ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত পদায়িত ছিলেন। সংবিধানের চতুর্থ সংশােধনীর পর রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার প্রবর্তিত হলে; ১৯৭৫ সালের ২৬ জানুয়রিতে রাষ্ট্রপতি-বঙ্গবন্ধুর অধীনে ১৭ সদস্যবিশিষ্ট মন্ত্রিপরিষদ গঠিত হয়, নবগঠিত মন্ত্রিসভায় আব্দুল মান্নানকে একই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে বহাল রাখা হয়। এছাড়া তিনি নবগঠিত বাকশালে যােগদান করেছিলেন। ১৯৭৫ সালে, জুনের ৬ তারিখে গঠিত ১১৫ সদস্যবিশিষ্ট বাকশাল কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটিতে তিনি ছিলেন অন্যতম সদস্য। ১৯৭৫-এর মর্মান্তিক পট পরিবর্তনের পর খন্দকার মােশতাকের পতন পর্যন্ত তিনি অবৈধ সরকারের অধীনে পূর্বোক্ত মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রিত্ব পদে বহাল ছিলেন। মন্ত্রিত্বের শপথ নিয়েছিলেন ১৫ আগস্ট রাতে।
পরবর্তী পর্যায়ে আওয়ামী লীগের পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত থেকে তিনি দলটিতে প্রত্যাবর্তন করেন। সে পর্যায়ে; ১৯৭৭ সালের ৩রা ও ৪ঠা এপ্রিল ঢাকার ইডেন হােটেল প্রাঙ্গনে দুদিনব্যাপি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়।’ (রশিদ। পৃষ্ঠা: ১৭৪) কাউন্সিলের সিদ্ধান্তক্রমে ১৫ এপ্রিল সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন কর্তৃক কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক কমিটির ৪৪ জন সদস্য’র একজন হিসেবে আব্দুল মান্নানের নামও ঘােষিত হয়। অতঃপর ১৯৭৮ সালের ৩-৫ই মার্চ ঢাকার হােটেল ইডেনে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক অধিবেশনে আব্দুল মান্নানকে সহসভাপতি পদে নির্বাচিত করা হয়। ১৯৮১ সালের ১৪-১৬ ফ্রেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত কাউন্সিলে তাকে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটিতে সভাপতি মণ্ডলির সদস্য হিসেবে মনােনীত করা হয়। অতঃপর ২০০২ সাল পর্যন্ত তিনি সভাপতি মণ্ডলির সদস্য হিসেবে বহাল ছিলেন। এছাড়া ১৯৯৬ সালের সপ্তম জাতীয়

পৃষ্ঠা: ৭৭
সংসদে তিনি স্থানীয় সরকার, পল্লি উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন। ২০০৫ সালের ৪ এপ্রিল আব্দুল মান্নান মৃত্যুবরণ করেন। বঙ্গবন্ধুর স্নেহভাজন হয়েও সেদিন তিনি প্রিয় নেতার হত্যার বিরুদ্ধে অবস্থান নেননি। নিজেকে সমর্পিত করেন বিশ্বাসঘাতক মােশতাক ও তার খুনিবাহিনীর পদতলে।

সহায়ক গ্রন্থ ও তথ্যউৎস:
১. প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব। টাঙ্গাইল জেলা। বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন। ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫
২. বাহার, মাে. হাবিবউল্লাহ। আব্দুল মান্নান। বাংলাপিডিয়া-বাংলাদেশ জাতীয় জ্ঞানকোষ। ৪ মার্চ ২০১৫
৩. রশিদ, হারুন-অর। মূলধারার রাজনীতি: বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কাউন্সিল ১৯৪৯-২০১৬। ২০১৭। ঢাকা। বাংলা একাডেমি।
8. List of 11th Parliament Members Bangla. w.w.w.parliament.gov.bd

মন্ত্রী শ্রী মনােরঞ্জন ধর

আওয়ামী লীগের প্রবীণ রাজনীতিবিদ শ্রী মনােরঞ্জন ধর ছিলেন বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার অন্যতম প্রবীণ সদস্য। ব্রিটিশ বিরােধী আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন, যুক্ত ছিলেন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস পার্টির সাথে। ১৯০৪ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে তিনি ময়মনসিংহ জেলার চাটল গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। পিতা, জগৎচন্দ্র ধর। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে বিএ এবং আইন বিষয়ে স্নাতক সনদ লাভ করেন। ১৯১৭ সালে অরবিন্দ ঘােষের যুগান্তর দলে যােগ দিয়ে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত স্বদেশিদের সাথে যুক্ত ছিলেন। ১৯২১ সালে অসহযােগ আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯২৮ সালে প্রাদেশিক ছাত্র সমিতির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিলে মাস্টার দা সূর্য সেনের নেতৃত্বে সংঘঠিত চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনে অংশগ্রহণ করেন। রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামের সাথে তিনি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেও যুক্ত ছিলেন। ১৯৩৮-৪০ সালে সাপ্তাহিক গণ-অভিযান পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। এ ছাড়া কংগ্রেসের সার্বিক কর্মকাণ্ডের ওপর রচনা করেছেন কয়েকটি গ্রন্থ। পরবর্তী সময়ে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে ফিরে এসে ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়ে বঙ্গীয় প্রাদেশিক আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৪৭ সালে পূর্ব বাংলায় আগত মহাত্মা গান্ধীর শান্তি মিশনের অন্যতম সদস্য ছিলেন মনােরঞ্জন ধর। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান জাতীয় কংগ্রেস গঠনের সাথেও যুক্ত ছিলেন, পরবর্তী সময়ে দলটির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত পূর্ব বাংলা প্রাদেশিক আইনপরিষদের সদস্য ছিলেন। বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনে আইনপরিষদে এবং রাজপথে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন, এ কারণে কারাবরণও করতে হয় তাঁকে। ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক আইনপরিষদ কর্তৃক গঠিত সংখ্যালঘু কমিশনের সদস্য ছিলেন। এছাড়া ১৯৫৬ হতে ৫৮ সাল পর্যন্ত তিনি প্রাদেশিক সরকারের অর্থ ও সংখ্যালঘু দফতরের মন্ত্রীর দায়িত্বে নিয়ােজিত ছিলেন।
১৯৭১ সালে সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। সেসময় তিনি ছিলেন সর্বদলীয় উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য। স্বাধীনতার পর-১৯৭২ সালে

পৃষ্ঠা: ৭৯
তাঁকে জাপানস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসে রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়ােগ দেওয়া হয়। ১৯৭৩ সালের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। অতঃপর বাংলাদেশের তৃতীয় মন্ত্রিসভায় আইন, সংসদ ও বিচার বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে নিয়ােগ লাভ করেন। এ দায়িত্বে তিনি ১৬ মার্চ ১৯৭৩ হতে ২৪ জানুয়ারি ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত নিয়ােজিত ছিলেন। বাকশাল ব্যবস্থার মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার প্রবর্তিত হবার পরও তাকে পূর্ব পদে বহাল রাখা হয়। তিনি বাকশালের ১৫ সদস্য বিশিষ্ট পলিট ব্যুরাের অন্যতম সদস্য ছিলেন।
অতঃপর খন্দকার মােশতাকের অবৈধ সরকারেও তাকে একই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রিত্বে বহাল রাখা হয়। ১৫ আগস্ট রাতেই তিনি অবৈধ সরকারের মন্ত্রিত্বের শপথ নিয়েছিলেন। তাঁর মাধ্যমেই খুনি সরকার কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেছিল। খন্দকার মােশতাকের পতনের অনতিকাল পরেই শ্ৰী মনােরঞ্জন ধর আওয়ামী লীগে প্রত্যাবর্তন করেন। আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিতকরণের জন্য ১৯৭৭ সালের ৩ ও ৪ এপ্রিল ঢাকার ইডেন হােটেলে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিবার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশনের সিদ্ধান্তক্রমে মনােরঞ্জন ধরকে কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক কমিটির সদস্য হিসেবে মনােনীত করা হয়। অতঃপর ১৯৭৮ সালের ৩-৫ মার্চ ঢাকার হােটেল ইডেনে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক কাউন্সিলে তাকে কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। ২০০০ সালের ২২ জুন শ্রী মনােরঞ্জন ধর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বয়সে প্রবীণ এবং দুঃসাহসিক রাজনৈতিক ঐতিহ্যের অধিকারী হয়েও সেদিন মনােরঞ্জন ধর বেইমান মােশতাক ও সেনাবাহিনীর খুনিচক্রের বিরুদ্ধে দাঁড়াননি। অধিকন্তু কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারির কারণে জনগণ কর্তৃক ধিকৃত হয়েছেন।

সহায়ক গ্রন্থ ও তথ্যউৎস:
১. আকবর, মাে. আলী। মনােরঞ্জন ধর। বাংলাপিডিয়া-বাংলাদেশ জাতীয় জ্ঞানকোষ। ২০ জানুয়ারি, ২০১৫
২. রশিদ, হারুন-অর। মূলধারার রাজনীতি: বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কাউন্সিল ১৯৪৯-২০১৬। ২০১৭। ঢাকা। বাংলা একাডেমি

মন্ত্রী আবদুল মােমিন অ্যাডভােকেট

আওয়ামী লীগের অন্যতম কেন্দ্রীয় নেতা আব্দুল মােমিন এডভােকেট বঙ্গবন্ধুর ক্যাবিনেটে কৃষি ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ছিলেন। তিনি ১৯২৯ সালে নেত্রকোণা জেলাস্থ মােহনগঞ্জ উপজেলার কাজিয়াটিতে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা-মরহুম খান সাহেব আবদুল আজিজ আহমদ। ১৯৪৫ সালে মােহনগঞ্জ হাইস্কুল হতে ম্যাট্রিক এবং ১৯৪৭ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ হতে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন। অতঃপর ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে বি এ অনার্স, ১৯৫১ সালে এম এ এবং ১৯৫৮ সালে এলএলবি সনদ লাভ করেন। ১৯৬৪ সালে আওয়ামী লীগে যােগদানের মাধ্যমে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন।
ছয়দফা প্রচারণার জন্য তিনি বঙ্গবন্ধুর সাথে দেশের বিভিন্নাঞ্চল সফর করেন। এ ধরনের এক সফর প্রসঙ্গে ‘দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় সিলেটে মুজিবের বিপুল সম্বর্ধনা’ শিরােনামে প্রকাশিত ১৫ মার্চ ১৯৬৬ সালের এক প্রতিবেদনে লেখা হয়েছিল; সিলেট, ১৪ই মার্চ। জেলা আওয়ামী লীগ সম্মেলন এবং জনসভা উপলক্ষে আজ সকালে শেখ মুজিবর রহমান এখানে আসিয়া পৌছেন। আওয়ামী লীগের পক্ষ হইতে তাঁহাকে রেল ষ্টেশনে বিপুল সম্বর্ধনা জানানাে হয়। শেখ মুজিবের সঙ্গে এডভােকেট আবদুল মােমিনও এখানে আগমন করেন। শেখ মুজিবকে আওয়ামী লীগের তৃতীয় অধিবেশনে ঢাকা হহইতে আগত নেতৃবৃন্দ যােগদান করেন। নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে ৬-দফা আদায়ের জন্য এডভােকেট আবদুল মােমিন কাউন্সিলারদের প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানান।’ (সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু: তৃতীয় খন্ড-ষাটের দশক-দ্বিতীয় পর্ব। পৃষ্ঠা: ২৭২) ১৯৬৬ সালে, ১৮-২০ মার্চে ঢাকার মতিঝিলস্থ হােটেল ইডেনে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক কাউন্সিলে আব্দুল মােমিন কেন্দ্রীয় কমিটির প্রচার সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন। একই বছরে নেত্রকোণা মহকুমা আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে নির্বাচিত হন। ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে ৬ দফা আন্দোলন সূচিত হবার অনতিকাল পরেই-জুনের ১ তারিখে তাকে গ্রেফতার করে কারারুদ্ধ করা হয়। আব্দুল মােমিনের সঙ্গে বরাবরই বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত আন্তরিক সম্পর্ক ছিল। তার কারারুদ্ধের বিষয়টি পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর লিখিত দিনলিপিতেও বিধৃত হয়েছে অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে। এ বিষয়ে

পৃষ্ঠা: ৮১
বঙ্গবন্ধু ২ জুন, ১৯৬৬ সালের দিনলিপিতে লিখেছেন। আব্দুল মােমিন এডভােকেট, প্রচার সম্পাদক আওয়ামী লীগ ওবায়দুর রহমান, সাংস্কৃতিক সম্পাদক। হাফেজ মুসা, ঢাকা আওয়ামী লীগের সভাপতি মােস্তফা সরােয়ার, নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের সভাপতি। শাহাবুদ্দিন চৌধুরী, সহ সভাপতি ঢাকা শহর আওয়ামী লীগ। রাশেদ মােশাররফ, সহ সম্পাদক ঢাকা শহর আওয়ামী লীগ , আওয়ামী লীগ কর্মী হারুনুর রশিদ ও জাকির হােসেন। দশ সেলে এদের রাখা হয়েছে। এত খারাপ সেল ঢাকা জেলে আর নাই।’ (মুজিবুর রহমান, শেখ। কারাগারের রােজনামচা। পৃষ্ঠা: ৫৬) এ সময় আব্দুল মমিনের কারাবাসের দুরবস্থার কথা প্রকাশের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু প্রকারান্তরে তাঁর সহকর্মীর প্রতি সহমর্মিতার কথাই ব্যক্ত করেছেন উদারচিত্তে। কারা নির্যাতন এবং পূর্বোক্ত প্রসঙ্গে প্রতিক্রিয়া ব্যক্তকালে একই বছর জুনের ৬ তারিখে বঙ্গবন্ধু তাঁর দিনলিপিতে আরও লিখেছেন, সরকার কর্মীদের বন্দি করেও অত্যাচার করেছে, ২৪ ঘণ্টা তালা বন্ধ করে রেখেছে জেলের মধ্যে। নারায়ণগঞ্জের মােস্তফা সারওয়ার, শামসুল হক ভূতপূর্ব এমপিএ, হাফেজ মুসা সাহেব, আব্দুল মােমিন এডভােকেট, ওবায়দুর রহমান, শাহাবুদ্দিন চৌধুরীর মতাে নেতৃবৃন্দকে ‘সি’ ক্লাসে রাখা হয়েছে। কি করে এই সরকার সভ্য সরকার বলে দাবি করতে পারে, আমি ভেবেও পাই না।’ (প্রাগুক্ত। পৃষ্ঠা: ৬৮)।
এক সময় আব্দুল মােমিন এবং বঙ্গবন্ধু কেন্দ্রীয় কারাগারের একই কক্ষে অবস্থান করেছেন। সে সুবাদে তিনি হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধুর নিসঃঙ্গ সময়ের একান্ত সঙ্গী। বিষয়টি খুব গুরুত্বের সাথে লিপিবদ্ধ হয়েছে বঙ্গবন্ধুর দিনলিপিতে। এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, ১৯৬৮ সালের ১৭ই জানুয়ারি রাত্রে যথারীতি খাওয়া দাওয়া শেষ করে ঘুমিয়ে পড়ি। দেওয়ানি ওয়ার্ডে আমি

পৃষ্ঠা: ৮২
থাকতাম। দেশরক্ষাআইনে বন্দি আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক আব্দুল মােমিন এডভােকেট আমার কামরায় থাকতেন। ১৭ মাস একাকী থাকার পর। তাকে আমার কাছে দেওয়া হয়। একজন সাথী পেয়ে কিছুটা আনন্দও হয়েছিল। হঠাৎ ১৭ই জানুয়ারি রাত ১২টার সময় আমার মাথার কাছে জানালা দিয়ে কে বা কারা আমাকে ডাকছিলেন। ঘুম থেকে উঠে দেখি নিরাপত্তা বিভাগের ডেপুটি জেলার তােজাম্মেল সাহেব দাঁড়াইয়া আছেন।’ (প্রাগুক্ত। পৃষ্ঠা: ২৫২) সে রাতে ডেপুটি জেলার তাঁকে মুক্তি দেওয়ার কথা জানাতে জেলখানার সেলে এসেছিলেন। প্রকাশ থাকে যে সে পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুকে রাতের অন্ধকারে মুক্তি দিয়ে সবার অলক্ষ্যে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাবার পাঁয়তারা করা হয়েছিল। সেসময় বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম থেকে কাস্টডি ওয়ারেন্ট, যশাের, সিলেট, ময়মনসিংহ, নােয়াখালী, পাবনা থেকে প্রডাকশন ওয়ারেন্ট ছিল। সে অবস্থায় রাতের আঁধারে মুক্তি দেওয়ার বিষয়টি ছিল অত্যন্ত রহস্যজনক। বিষয়টি বঙ্গবন্ধুকে প্রবলভাবে উদ্বিগ্ন করেছিল। তিনি সহবন্দি আব্দুল মমিনের সঙ্গেও এ বিষয়ে আলােচনা করেন। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘আমি মােমিন সাহেবকে বললাম, মনে হয় কিছু একটা ষড়যন্ত্র আছে এর মধ্যে। হতে পারে এরা আমাকে এ জেল থেকে অন্য জেলে পাঠাবে। অন্যকিছু একটাও হতে পারে, কিছুদিন থেকে আমার কানে আসছিল আমাকে ‘ষড়যন্ত্র মামলায় জড়াইবার জন্য কোনাে কোনাে মহল থেকে চেষ্টা করা হতেছিল। ডিসেম্বর মাস থেকে অনেক সামরিক, সিএসপি ও সাধারণ নাগরিক গ্রেফতার হয়েছে। দেশরক্ষা আইনে-রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা উপলক্ষ্যে, সত্য মিথ্যা খােদাই জানে। (প্রাগুক্ত। পৃষ্ঠা: ২৫২) শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর শঙ্কাই সত্য হয়েছিল, তাঁকে রাতের অন্ধকারে তথাকথিত মুক্তি দেওয়ার পর কারা ফটকেই আটক করে নিয়ে যাওয়া হয় সেনানিবাসের অজ্ঞাত স্থানে। সে পর্যায়ে তার অবস্থান দীর্ঘদিন গােপন রাখা হয়। পরবর্তী সময়ে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার নামে দেশদ্রোহীতার মামলা দায়েরের মাধ্যম তাঁকে হত্যা করারও আয়ােজন করা হয়। বঙ্গবন্ধুকে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাবার পর আরও কিছুদিন আব্দুল মােমিনকে কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক থাকতে হয়। পরবর্তী পর্যায়ে ব্যাপক গণআন্দোলনের প্রেক্ষাপটে সংঘটিত গণঅভ্যুত্থানের সময় অন্যান্য নেতার সাথে তাকেও ১৯৬৯ সালে, ফেব্রুয়ারির ৯ তারিখে কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়।
পরবর্তী পর্যায়ে ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদকের দায়িত্বে থেকে আব্দুল মােমিন তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সেসময় তার তত্ত্বাবধানে প্রচার বিভাগ থেকে প্রকাশিত ও প্রচারিত ‘সােনার বাংলা শ্মশান কেন?’ পােস্টারটি সারা প্রদেশে তুমুল

পৃষ্ঠা: ৮৩
আলােড়ন সৃষ্টি করেছিল। ওই পােস্টারের মাধ্যমে পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলের বিদ্যমান বৈষম্যের বিষয়টি নিপুণভাবে ফুটিয়ে তােলা হয়েছিল, যা জনসাধারণের মনে প্রবলভাবে পাকিস্তান বিরােধী প্রভাব বিস্তার করেছিল। এছাড়া সারাদেশব্যাপি ছয় দফার যে পুস্তিকা প্রচারিত হয়েছিল; আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক হিসেবে আব্দুল মােমিন ছিলেন সেই পুস্তিকার প্রচার সম্পাদক। অতঃপর আব্দুল মােমিন ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে নেত্রকোণা, বারহাট্টা ও মােহনগঞ্জ অঞ্চলের সমন্বয়ে গঠিত ময়মনসিংহ-২২ আসন হতে প্রাদেশিক পরিষেদের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে মুক্তিযুদ্ধ সূচিত হবার পর তিনি মহেষখলা সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেন এবং মুজিবনগর সরকারের সাথে সম্পৃক্ত থেকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য কাজ করেন। স্বাধীনতার পর তিনি বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়ার সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে পূর্বোক্ত আসন থেকে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। অতঃপর ১৬ মার্চ ১৯৭৩ সাল হতে ২৪ জানুয়ারি ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত কৃষি ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। তার মন্ত্রিত্বকালে-১৯৭৪ সালে, বাংলাদেশকে চরম খাদ্য সংকটে নিপতিত হতে হয়। তিনি দক্ষতার সাথে সে সঙ্কট সামাল দিতে পারেননি। রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার প্রবর্তিত হবার পরও তাকে একই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে বহাল রাখা হয়।
১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাযজ্ঞের পর খন্দকার মােশতাকের অবৈধ সরকারে তাকে পূর্বতন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী পদে বহাল রাখা হয়। তিনিও ১৫ আগস্ট রাতে মন্ত্রিত্বের শপথ গ্রহণ করেছিলেন। খন্দকার মােশতাকের পতনের পর তিনি আর তার সাথে থাকেননি। মােশতাকের পতনের নয় মাস পর আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য ১৯৭৬ সালের ২৫ আগস্ট মিজানুর রহমান চৌধুরীর ধানমন্ডির বাসভবনে সাবেক আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের এক বর্ধিত সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মহিউদ্দীন আহমেদ। এতে ৬০ জন প্রাক্তন গণপরিষদ সদস্য, ২৪০ জন সাবেক সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক জেলাসমূহের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ মােট এক হাজারের অধিক প্রতিনিধি যােগদান করেন।’ (রশিদ, হারুন-অর। পৃষ্ঠা: ১৭৯) উক্ত বর্ধিতসভায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে আব্দুল মােমিন আওয়ামী লীগে প্রত্যাবর্তন করেন। পরের বছর ১৯৭৭ সালে, এপ্রিলের ৩ ও ৪ তারিখে ঢাকার হােটেল ইডেনে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত মােতাবেক আব্দুল মােমিনকে কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক কমিটির সদস্য পদে মনােনীত করা হয়। পরবর্তী সময়ে; ১২ জুন ১৯৯৬ সালে এবং ১ অক্টোবর ২০০১ সালে অনুষ্ঠিত

পৃষ্ঠা: ৮৪
৭ম ও ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আব্দুল মােমিন নেত্রকোণা-৪ আসন হতে আওয়ামী লীগের মনােনীত প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সংসদ সদস্য থাকা অবস্থায় ২০০৪ সালে, জুলাইয়ের ১৬ তারিখে আব্দুল মােমিন বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। বঙ্গবন্ধুর এত স্নেহভাজন হয়েও সেদিন তিনি প্রিয় নেতার হত্যার বিরুদ্ধে অবস্থান নেননি। নিজেকে সমর্পিত করেছিলেন খুনিচক্রের পদতলে।

সহায়ক গ্রন্থ ও তথ্যউৎস:
১. মুজিবুর রহমান, শেখ। কারাগারের রােজনামচা। ২০১৮ সপ্তম মুদ্রণ। ঢাকা। বাংলা একাডেমি।
২. রশিদ, হারুন-অর। মূলধারার রাজনীতি: বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কাউন্সিল ১৯৪৯-২০১৬। ২০১৭। ঢাকা। বাংলা একাডেমি
৩. সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু: তৃতীয় খন্ড-ষাটের দশক-দ্বিতীয় পর্ব। প্রধান সম্পাদক: মাে. শাহ আলমগীর। ২০১৭। ঢাকা। বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট ৩. সাবেক খাদ্যমন্ত্রী আব্দুল মমিন-ফেসবুক।
8. List of 11th Parliament Members Bangla.w.w.w.parliament.gov.bd

মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান

বঙ্গবন্ধু সরকারের পাটমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান সরকারি চাকুরির মাধ্যমে কর্মজীবনের সূচনা করলেও পরবর্তী সময়ে রাজনীতির সাথে যুক্ত হন। তিনি ১৯১৬ সালে কিশােরগঞ্জ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ইতিহাসে এমএ এবং আইন শাস্ত্রে ডিগ্রি অর্জন করেন। অতঃপর ১৯৪১ সালে যােগ দেন বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসের বিচার বিভাগে। ১৯৪৫ সাল থেকে বিচার বিভাগের মুন্সেফ পদে চাকরি করার ছয় বছর পর সরকারি চাকুরি পরিত্যাগ করেন। অতঃপর ১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে অধ্যাপনা করেন এবং একই সাথে আইনজীবী হিসেবে হাইকোর্টে প্রাকটিস শুরু করেন।
আসাদুজ্জামান খান জেনারেল আইয়ুব খানের প্রবর্তিত মৌলিক গণতন্ত্রের ব্যবস্থাধীনে ১৯৬৫ সালে পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৬ সালে প্রাদেশিক পরিষদের স্বতন্ত্র সদস্যদের নির্বাচিত নেতা হিসেবে কার্যকর ভূমিকা পালন করেছেন। তার সংসদীয় কার্যক্রম প্রসঙ্গে আলােকপাতকালে কারারুদ্ধ অবস্থায় বঙ্গবন্ধু ১৯ জুন ১৯৬৬ সালে, রবিবারের দিনলিপিতে লিখেছেন, “দি নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেস বাজেয়াপ্তকরণের উপর স্বতন্ত্র দলের নেতা জনাব আসাদুজ্জামানের ও গণপরিষদ সদস্যের অধিকার সংক্রান্ত মুলতবি প্রস্তাব এবং বিরােধীদলের নেতা আব্দুল মালেক উকিলের আনীত মুলতবি প্রস্তাব স্পিকার সাহেব কর্তৃক অগ্রাহ্য করার প্রতিবাদে বিরােধী ও স্বতন্ত্র দলীয় সদস্যরা পরিষদ কক্ষ ত্যাগ করেন। (মুজিবুর রহমান, শেখ। কারাগারের রােজনামচা। পৃষ্ঠা: ১০৮) পরবর্তী সময়ে-১৯৬৯ সালে আসাদুজ্জামান খান তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগে যােগদান করেন। ১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনে তৎকালীন ময়মনসিংহ-২৬ আসন হতে সাংবিধানিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। স্বাধীনতা যুদ্ধকালে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কার্যকর ভূমিকা পালন করেন। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৩ সালের জাতীয় নির্বাচনে একই আসন হতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিজিত হন। বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় ১৯৭৩ হতে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত পাটমন্ত্রীর দায়িত্বে

পৃষ্ঠা: ৮৬
নিয়ােজিত ছিলেন। এছাড়া তিনি নবগঠিত বাকশালে যােগদান করেছিলেন। ১৯৭৫ সালে, জুনের ৬ তারিখে গঠিত ১১৫ সদস্যবিশিষ্ট বাকশাল কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটিতে আসাদুজ্জামান খান ছিলেন অন্যতম সদস্য। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক হত্যাযজ্ঞের পর তিনি খন্দকার মােশতাকের অবৈধ মন্ত্রিসভার বন্দর, জাহাজ চলাচল ও অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্বে নিয়ােজিত হয়ে ঐ দিন রাতেই মন্ত্রিত্বের শপথ গ্রহণ করেন। ওই মন্ত্রিত্ব পদে তিনি ২০ আগস্ট হতে খন্দকার মােশতাকের পতন তথা ৬ নভেম্বর ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত পদায়িত ছিলেন।
পরবর্তী সময়ে ১৯৭৬ সালের ২৫ আগস্ট মিজানুর রহমান চৌধুরীর ধানমন্ডির বাসভবনে আহূত বর্ধিত সভায় যােগদানের মাধ্যমে তিনি আওয়ামী লীগে প্রত্যাবর্তন করেন। পরের বছর ১৯৭৭ সালে, এপ্রিলের ৩ ও ৪ তারিখে ঢাকার হােটেল ইডেনে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত মােতাবেক আসাদুজ্জামান খানকে কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক কমিটির সদস্য পদে মননানীত করা হয়। অতঃপর ১৯৭৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি ময়মনসিংহ-১৮ (পরবর্তী সময়ের কিশােরগঞ্জ-১ আসন) আসন হতে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯ সাল হতে ২৪ মার্চ ১৯৮২ সাল পর্যন্ত জাতীয় সংসদে বিরােধী দলের নেতার দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯২ সালে, জানুয়ারির ২১ তারিখে আসাদুজ্জামান খান ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। আওয়ামী লীগের নীতি-আদর্শের প্রতি সমর্পিত সত্ত্বেও তিনি বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেননি। বঙ্গবন্ধুর রক্ত মাড়িয়ে মােশতাকের অবৈধ মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে শপথ গ্রহণ করেছেন ।

সহায়ক গ্রন্থ ও তথ্যউস:
১. রহমান, মাে. সিদ্দিকুর। খান, আসাদুজ্জামান। বাংলাপিডিয়া-বাংলাদেশ জাতীয় জ্ঞানকোষ । ৫ মে, ২০১৪
২. রশিদ, হারুন-অর! মূলধারার রাজনীতি: বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কাউন্সিল ১৯৪৯-২০১৬। ২০১৭। ঢাকা । বাংলা একাডেমি
৩. মুজিবুর রহমান, শেখ। কারাগারের রােজনামচা। ২০১৭। ঢাকা । বাংলা একাডেমি
8. List of 11th Parliament Members Bangla. w.w.w.parliament.gov.bd

মন্ত্রী ড. আজিজুর রহমান মল্লিক

বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত আস্থাভাজন হিসেবে; শিক্ষাবিদ ও ইতিহাসবিদ খ্যাত ড. আজিজুর রহমান মল্লিক স্বাধীনতা পরবর্তী সরকারের শিক্ষা সচিব, হাইকমিশনার ও অর্থমন্ত্রীর পদে পদায়িত হয়েছিলেন। তিনি বৃহত্তর ঢাকার ধামরাই উপজেলার রাজাপুর গ্রামের এক ভূস্বামী পরিবারে ১৯১৮ সালে, ডিসেম্বরের ৩১ তারিখে জন্মেছিলেন। বাবা-মােহাম্মদ ইসমাইল মল্লিক। মাবেগম সাজেদা খাতুন। সে সময় বাবার চাকরির কারণে তারা বার্মার রেঙ্গুনে পরিবার সমেত বসবাস করতেন, সে সুবাদে এ আর মল্লিকের শৈশব কেটেছে রেঙ্গুনে। শিক্ষা জীবনের সূচনা পর্যায়ে গৃহ শিক্ষকের কাছে আরবি ও কোরান শিক্ষা লাভ করেন। অতঃপর রেঙ্গুনের একটি ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে সরাসরি স্টান্ডার্ড ফোরে ভর্তি হন, সেখানে সপ্তম শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে পারিবারিক কারণে তাদের দেশে প্রত্যাবর্তন করতে হয়। অতঃপর ১৯৩৪ সালে মানিকগঞ্জ মডেল হাই স্কুল হতে মেট্রিক এবং ১৯৩৬ সালে ঢাকা সরকারি কলেজ হতে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে উচ্চশিক্ষার্থে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে। উক্ত বিভাগ থেকে ১৯৩৯ সালে অনার্সসহ বিএ এবং ১৯৪০ সালে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন।
শিক্ষা জীবন সমাপ্তির পর আজিজুর রহমান মল্লিক অধ্যাপনার সাথে যুক্ত হন এবং ১৯৪১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যােগদান করেন। পরবর্তী পর্যায়ে ১৯৪৩ সালে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে যােগদানের একমাসের মধ্যে তাকে রাজশাহী কলেজে বদলি করা হয়। সে সময় থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত তিনি রাজশাহী সরকারি কলেজে কর্মরত ছিলেন। ১৯৫১ সালে উচ্চতর শিক্ষার জন্য লন্ডনে গমন করেন এবং ১৯৫৩ সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব অরিয়েন্টাল এ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ হতে পিএইচডি অর্জন করেন। দেশে প্রত্যাবর্তনের পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে যােগদান করেন। সেখানে অধ্যাপনাকালে কলা অনুষদের ডিন, তৎকালীন জিন্নাহ হলের (বর্তমান শেরেবাংলা হল) প্রাধ্যক্ষ ও সাময়িক কালের জন্য লাইব্রেরিয়ানের দায়িত্বও পালন করেন। ১৯৬৫ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকালে আজিজুর রহমান প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন এবং প্রথম উপাচার্য হিসেবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যােগদান করেন।

পৃষ্ঠা: ৮৮
ছয়দফা আন্দোলন, উনসত্তুরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন ও তৎপরবর্তী আন্দোলন-সংগ্রামে তিনি তার অবস্থান থেকে বাঙালি জাতির জাতিগত জাগরণের ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেন। সাত মার্চে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানের আলােকে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের জন্য আবশ্যিক প্রস্তুতির উদ্যোগ গ্রহণ করেন এবং পরবর্তী পর্যায়ে তার ঐকান্তিক সহযােগিতায় স্বাধীনতার সূচনা লগ্নে বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে ওঠে মুক্তিকামী স্বাধীনতা যােদ্ধাদের প্রতিরােধ সংগ্রামের সূতিকাগার। ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ, তার সভাপতিত্বে চট্টগ্রামের প্যারেড গ্রাউন্ডে অনুষ্ঠিত হয় এক বিশাল জনসভা। সর্বসাধারণের উপস্থিতিতে সে সভাতে তিনি স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন। পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানি হানাদারবাহিনীর আক্রমণের শঙ্কায় ক্যাম্পাস ত্যাগ করেন এবং এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে রামগড় হয়ে ত্রিপুরার আগরতলায় গমন করেন। মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের আহ্বানে অতঃপর কলকাতায় উপস্থিত হন। কলকাতায় উপস্থিতির পর বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদদের সমন্বয়ে গড়ে তােলেন ‘লিবারেশন কাউন্সিল অব ইন্টালিজেন্টসিয়া’। এ সংগঠনের সভাপতির দায়িত্বে থেকে তিনি যেমন অন্যান্যদের সাথে ভারতের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়সহ পাটনা, বােম্বে, দিল্লি, লক্ষৌ ও বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে জনমত গঠনের জন্য জোরালাে তৎপরতা চালান, তেমনই বৈদেশিক পর্যায়েও সংগঠনের তৎপরতা জারি রাখেন। এক সময় আমেরিকায় শিক্ষকতা করার যােগসূত্রে অন্যান্য প্রতিনিধির সাথে তিনি ৩৬ দিনের তৎপরতায়; আমেরিকার হার্ভার্ড, ইয়েল, বস্টোন, পেনসিলভেনিয়া, স্ট্যানফোর্ড, নিউইয়র্ক, কলম্বিয়া, বার্কলি, লংবিচ, শিকাগাে, বাফেলাে, নর্থ ক্যারােলিনা, টেক্সাসসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে জনমত গঠনের জন্য পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরতার নানামাত্রিক চিত্র এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের যৌক্তিকতা তুলে ধরেন।

মন্ত্রী ড. মুজাফফর আহমদ চৌধুরী

ছাত্র সমাজের কাছে ম্যাক স্যার নামে বহুল পরিচিত ড. মুজাফফর আহমদ চৌধুরী ছিলেন; একাধারে শিক্ষাবিদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, উপাচার্য, মন্ত্রী ও বহু গ্রন্থের প্রণেতা। বয়সে দু-বছরের কণিষ্ঠ হলেও তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন। লক্ষ্মীপুর জেলার (তৎকালীন নােয়াখালি জেলা) বীরাহিমপুর গ্রামে ১৯২২ সালের ২৩ নভেম্বর জন্ম গ্রহণ করেন। পিতা মৌলবি ওবায়দুল্লাহ ছিলেন বাসিকপুর মাদ্রাসার হেড মওলানা। মুজাফফর আহমদ চৌধুরী নোয়াখালীর ফরাশগঞ্জ হাইস্কুল হতে ১৯৩৮ সালে ম্যাট্রিক ও ফেনী কলেজ হতে ১৯৪০ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। অতঃপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ হতে ১৯৪৩ সালে সম্মানসহ শতক এবং ১৯৪৪ সালে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬০ সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় হতে পিএইচডি অর্জন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্স সম্পন্ন করার পর১৯৪৫ সালে একই বিভাগে প্রভাষকের পদে যােগদানের মাধ্যমে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। অতঃপর ১৯৫০ হতে ৫২ সাল পর্যন্ত পালন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের দায়িত্ব। ১৯৬১ সালে রিডার এবং ১৯৬৯ সালে প্রফেসর পদে পদোন্নতি পান।
রাজনীতি সচেতন প্রফেসর মুজাফফর আহমদ ১৯৫২ সালে সংঘটিত ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ছাত্র হত্যা ও পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদে ফেব্রুয়ারির ২৩ তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসমাজ কর্তৃক আয়োজিত সভায় ২১ ফেব্রুয়ারির ছাত্রহত্যা ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রবল

পৃষ্ঠা: ৯১
প্রতিবাদ জানান এবং সরকারের গণবিরােধী ভূমিকা ও দমননীতির তীব্র সমালোচনা করেন। এহেন প্রতিবাদী অবস্থানের কারণে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক তাকে নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করে কারারুদ্ধ করা হয়। এক বছরেরও বেশি সময় কারাগারে আটক রাখার পর; ১৯৫৩ সালের ৫ মে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। ১৯৫৫ সালের অক্টোবর হতে ১৯৫৬ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিনি পাকিস্তান গণপরিষদের শাসনতান্ত্রিক উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৬ সালের নভেম্বর হতে ১৯৫৭ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ‘জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে পাকিস্তানের প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পূর্ব থেকেই তিনি বঙ্গবন্ধুর পরিচিত ও ঘনিষ্ঠজন ছিলেন। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তেও বঙ্গবন্ধু তার সম্পর্কে প্রাসঙ্গিকভাবে আলােকপাত করেছেন। এ প্রসঙ্গে লিখেছেন; ‘কারাগারের দিনগুলি কোনােমতে কাটছিল। খবরের কাগজে দেখলাম, আতাউর রহমান খান সাহেব জুরিখ যাচ্ছেন, শহীদ সাহেবের সাথে দেখা করতে। সেখান থেকে বিলাত যাবেন, মওলানা ভাসানীর সঙ্গে দেখা করতে। ভাসানীর সাথে আরও তিনজন আওয়ামী লীগ কর্মী গিয়েছিলেন। তারাও আর ফিরে আসতে পারেন নাই। প্রফেসর মােজাফফর আহমেদ, খন্দকার মােহাম্মদ ইলিয়াস আর এডভােকেট জমির উদ্দিন দেশে ফিরে আসলেই তাদের গ্রেফতার করা হত।’ (মুজিবুর রহমান, শেখ। অসমাপ্ত আত্মজীবনী । পৃষ্ঠা: ৩২)।
বাঙালি জাতির স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলন-সংগ্রামে বরাবরই তিনি মূলধারার সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৬৬ সালে ইতিহাসের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে বঞ্চিত বাঙালি জাতির মুক্তিসনদ ৬ দফা প্রণয়নেও রয়েছে তার অবদান। বয়সে কনিষ্ঠ হলেও বঙ্গবন্ধু তার অত্যন্ত প্রিয় ও শ্রদ্ধাভাজন প্রফেসর মুজাফফর আহমদকে সম্মান জানাতে বরাবরই ‘স্যার’ বলে সম্বােধন করতেন। (সরকার, বিমল। যুগান্তর। ঢাকা। ২৩ নভেম্বর, ২০১৮) ১৯৬৯ সালে আইয়ুববিরােধী গণঅভ্যুত্থানে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। সে পর্যায়ে তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথেও সম্পৃক্ত হন। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭১ সালের মার্চ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৯ সালে জেনারেল আইয়ুব খান কর্তৃক আহূত রাওয়ালপিন্ডির গােলটেবিল বৈঠকে তিনি আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দলের উপদেষ্টা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধকালে কলকাতাস্থ মুজিবনগর সরকারের পরিকল্পনা সেলের প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন।
স্বাধীনতার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐকান্তিক আগ্রহে ড, মুজাফফর আহমদ চৌধুরীকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে নিয়ােগ দেওয়া হয়। এ পদে তিনি ২১ জানুয়ারি ১৯৭২ হতে ১২ এপ্রিল

পৃষ্ঠা: ৯২
১৯৭৩ সাল পর্যন্ত দায়িত্বরত ছিলেন। এছাড়া পদাধিকার বলে তিনি ছিলেন ডাকসুর প্রথম সভাপতি। অতঃপর ১৯৭৩ সালের এপ্রিল মাসে তাকে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যানের দায়িত্বে নিযুক্ত করা হয়। তার হাতেই গঠিত হয় প্রতিষ্ঠানটি। ১৯৭৫ সালে দ্বিতীয় বিপ্লবের পদক্ষেপ হিসেবে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) গঠিত হলে; ড. মুজাফফর আহমদ চৌধুরী বাকশালে যােগদান করেন এবং ১৫ সদস্য বিশিষ্ট বাকশালের কার্যনির্বাহী কমিটির অন্যতম সদস্য মনােনীত হন। সে সময় তাকে বঙ্গবন্ধুর প্রেসিডেন্সিয়াল সরকারের মন্ত্রিসভায় শিক্ষামন্ত্রীর পদে নিয়ােগ দেওয়া হয়। এ পদে তিনি ২৬ জানুয়ারি ১৯৭৫ সাল হতে মােশতাক সরকারের পতন পর্যন্ত তথা ৬ নভেম্বর ১৯৭৫ সাল অবধি বহাল ছিলেন। তিনিও ১৫ আগস্ট রাতে মন্ত্রিত্বর শপথ গ্রহণ করেছিলেন। খন্দকার মােশতাকের পতনের পর তিনি শিক্ষামন্ত্রীর পদ হতে অপসৃত হন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার পেশায় প্রত্যাবর্তন করেন। সারা জীবন প্রগতিপন্থি রাজনীতির সাথে যুক্ত থেকেও তিনি এক পর্যায়ে সামরিক সরকারজেনারেল জিয়াউর রহমানের শিক্ষা উপদেষ্টা হন। ১৯৭৯ সালে তাকে সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা হিসেবে স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদান করা হয়।
ড. মুজাফফর আহমদ চৌধুরী লেখক হিসেবেও ছিলেন অত্যন্ত খ্যাতিমান। তিনি নিম্নোক্ত গ্রন্থসমূহের প্রণেতা; ‘T civil Service in Pakistan (1963), Constitutional Problems in Pakistan, An Examination of the Criticisms against Burcaucracy (1964), Government and Politics in Pakistam (1968), The Political System of Modern States, England USA, France, USSR and Germany. Rural Government in East Pakistan (1969), The Specialist in Government. মাত্র ৫৬ বছর বয়সে-১৯৭৮ সালের ১৭ জানুয়ারি ড. মুজাফফর আহমদ চৌধুরী মৃত্যুবরণ করেন। পরিতাপের বিষয় সারাজীবন অন্যায়ের বিরুদ্ধে সােচ্চার থেকেও, বঙ্গবন্ধুর এতটা শ্রদ্ধাভাজন হয়েও সেদিন তিনি খুনিচক্রের বিরুদ্ধে দাঁড়াননি। অধিকন্তু তাদের সহায়ক হয়ে মন্ত্রিত্বে বহাল থেকেছেন।

সহায়ক গ্রন্থ ও তথ্যউৎস:
১. মুজিবুর রহমান, শেখ। অসমাপ্ত আত্মজীবনী। ২০১৫ (পুনর্মুদ্রণ) ঢাকা। দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড
২. সরকার, মাহফুজুর রহমান চৌধুরী, মুজাফফর আহমদ। বাংলাপিডিয়া-বাংলাদেশ জাতীয় জ্ঞানকোষ। ২৬ নভেম্বর ২০১৪।
৩. সরকার, বিমল। একজন আদর্শ শিক্ষকের কথা। যুগান্তর। ঢাকা। ২৩ নভেম্বর, ২০১৮

প্রতিমন্ত্রী শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন

পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বরের হত্যাকাণ্ডের হােতা খন্দকার মােশতাক আহমদের অন্যতম সহযােগী শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন। তিনি ১০ জানুয়ারি, ১৯৩৯ সালে মুন্সিগঞ্জ জেলার দোগাছি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। অধ্যয়ন করেছেন ঢাকা কলেজ, জগন্নাথ কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৫৪ সালে মেট্রিক পাস করার পর ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। একই বছর ওই কলেজের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ছাত্রজীবন থেকেই তকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সাথে সম্পৃক্ত থেকে ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন। ১৯৫৭-১৯৬০ সালে আযহার আলীর বিদেশ গমনজনিত অনুপস্থিতির কারণে তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬০-১৯৬৩ সালে ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র লীগের সভাপতি। ১৯৬২ সালে আইয়ুববিরােধী শিক্ষা আন্দোলনের সময় তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। স্বাধীনতা পূর্বকালে; ছয়দফা আন্দোলন, আইয়ুববিরােধী আন্দোলন, ঊনসতুরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তুরের নির্বাচন, একাত্তরের অসহযােগ আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় (?) ভূমিকা পালন করেন। আন্দোলন-সংগ্রামের কাল-পর্বে ১৯৫২ হতে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত তিনি বিভিন্ন পর্যায়ে কারারুদ্ধ ছিলেন। কলেজে অধ্যয়নকালে ছাত্রলীগের সভাপতি আবদুল মুবিন তালুকদারের মাধ্যমে শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পরিচিত হন। অতঃপর তিনি বঙ্গবন্ধুর স্নেহভাজন হয়ে ওঠেন। কারাগারেও তাঁরা একসাথে বন্দি ছিলেন। ১৯৭০ এবং ১৯৭৩ সালের জাতীয় নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের মনােনীত প্রার্থী হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদ ও বাংলাদেশ। জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন।১

পৃষ্ঠা: ৯৪
স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় মুজিবনগর সরকারের সাথে পুরােমাত্রায় সম্পৃক্ত ছিলেন, এ সময় তিনি মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক হিসেবে ভারতীয় পার্লামেন্টের এক যৌথ অধিবেশনে দীর্ঘ আড়াই ঘণ্টা বক্তৃতা করেন। তদুপরি তিনি ছিলেন মুজিবনগর সরকারের ডান ঘরাণার নেতা খন্দকার মােশতাক আহমদের ষড়যন্ত্রিক বলয়ভুক্ত। সেসময় মােশতাকের সহযােগী হিসেবে বিতর্কিত ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেও বঙ্গবন্ধুর বদান্যতায় তাকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে জাতীয় সংসদের চিফ হুইপের দায়িত্বে নিয়ােজিত করা হয়। পনের আগস্টের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর তিনি উচ্ছ্বসিত চিত্তে খন্দকার মােশতাক আহমদের অবৈধ মন্ত্রিসভায় যােগদান করেন এবং প্রিয় নেতা ও পরিবারের লাশগুলাে ৩২ নাম্বারের বাসভবনে অযত্নে-অবহেলায় পড়ে থাকা অবস্থায় মন্ত্রিত্বের শপথ গ্রহণ করেন।
মােশতাকের পতনের পর তাদের উদ্যোগে গঠিত ডেমােক্রেটিক লীগের সাধারণ সম্পাদক হন। পরবর্তী পর্যায়ে লে. জেনারেল হাে. মাে. এরশাদ কর্তৃক বন্দুকের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করার পর জাতীয় পার্টি গঠিত হলে তিনি সেই স্বৈরাচারের পার্টিতে যােগদান করেন। অতঃপর এরশাদের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে দলটির মহাসচিব, মন্ত্রী, সংসদ উপনেতা ও উপ-প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন এবং পরবর্তী সময়ে জাতীয় পার্টি হতে বহিষ্কৃত হয়ে যােগদান করেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। ২০০৬ সালে বিএনপিতে যােগ দিয়ে ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মুন্সিগঞ্জ-১ আসন থেকে নির্বাচন করে পরাজিত হন। বর্তমানে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান পদে বহাল আছেন।
শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন বঙ্গবন্ধু বলয়ের অন্যতম একজন ছিলেন। রাজনৈতিক আন্দোলনে-সংগ্রামে ছিলেন বঙ্গবন্ধুর সহযােদ্ধা। কারাগারে আটক অবস্থায়ও বঙ্গবন্ধু তাকে স্মরণ করতেন সবসময়। কারারুদ্ধ অবস্থায় তার লিখিত দিনলিপিতেও বিভিন্ন পর্যায়ে উল্লেখিত হয়েছে শাহ মােয়াজ্জেমের নাম। ১৯৬৭ সালের ১৩ জানুয়ারিতে ঈদের দিনটিতে পরিবারের স্বজনেরা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। সেদিন কারাগারে অনুষ্ঠিত ঈদের জামাতে যে শাহ মােয়াজ্জেম উপস্থিত ছিলেন না, সে বিষয়টিও বঙ্গবন্ধুর পর্যবেক্ষণ থেকে বাদ যায়নি। এ প্রসঙ্গে ১ জানুয়ারি-২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৭ সালে লিখিত দিনলিপিতে তিনি লিখেছেন, ‘…১০ সেল থেকে শামসুল হক, মিজানুর রহমান চৌধুরী, আব্দুল মােমিন, ওবায়দুর রহমান, মােল্লা জালাল, মহীউদ্দিন (খােকা), সিরাজ, হারুন, সুলতান এসেছে। দেখা হয়ে গেল, কিছু সময় আলাপও হলাে। এরা সকলেই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী। রফিকুল ইসলাম, বজলুর রহমান ও শাহ মােয়াজ্জেম নামাজে আসে নাই।২ কারাগারে বাসকালেও উভয়ের মধ্যে

পৃষ্ঠা: ৯৫
ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। সুযােগ হলেই দুজনের মধ্যে আলাপ-আলােচনা হতাে। বিধি-নিষেধ উপেক্ষা করে দুজনেই মন খুলে কথা বলতেন। এ বিষয়ে ১৮ মার্চ ১৯৬৭ সালে বঙ্গবন্ধু তাঁর দিনলিপিতে লিখেছেন, ‘…রাত আটটায় হঠাৎ শুনতে পেলাম কে যেন আমাকে ডাকছে, ‘মুজিব ভাই’, ‘মুজিব ভাই’ বলে জানালা দিয়ে চেয়ে দেখি শাহ মােয়াজ্জেম। বললাম, কি ব্যাপার তুমি এখানে?’ ‘ডিপিআর থেকে মুক্তি পেয়েছি এখন-বিচারাধীন আসামী তাই ১০ সেল থেকে আমাকে নিয়ে এসেছে। ডিপিআরদের কাছে আমাকে রাখবে না। জমাদার সাহেবকে বললাম, কোথায় রাখবেন? বলল, রাতে আর কোথায় রাখব ২০ সেলে আমার কাছাকাছি। বললাম, কাপড় চোপড় বিছানা আছে?’ বলল, ‘যা আছে চলে যাবে, খাবারও ১০ সেল থেকে রাতের জন্য আসবে। আমার সাথে কথা বলা নিষেধ, তবু রাস্তা যখন পড়েছে আমার ঘরের কাছ দিয়ে তখন মুখে হাত দিয়ে তাে বন্ধ করতে পারবে না। বললাম, আর চিন্তা কি! মামলা দুটি আছে, জামিন পেয়েছে, আর দুই একদিন দেরি হতে পারে।”৩
২২ মার্চ ১৯৬৭ সাল, বুধবার। দিনটি ছিল কোরবানি ঈদের দিন। বিগত ঈদেও বঙ্গবন্ধুকে কারাগারেই অবস্থান করতে হয়েছিল। এই ঈদে বাড়ি থেকে তার জন্য খাবার পাঠানাে হয়েছিল। বাড়ি থেকে খাবার এলে বঙ্গবন্ধু কখনাে একা খেতেন না। রাজনৈতিক সহবন্দিদের নিয়ে খেতেন। কখনােবা সাধারণ বন্দিদেরও খাবারের ভাগ দিতেন। এ দিনটিতে তিনি অন্যান্যদের সাথে শাহ মােয়াজ্জেমকেও খাবারের নিমন্ত্রণ করেছিলেন। সেসময় তার কারামুক্তির প্রশ্নেও উদ্বিগ্ন ছিলেন বঙ্গবন্ধু। এ দিনকার দিনলিপিতে তিনি লিখেছেন, ‘…শাহ মােয়াজ্জেম হাইকোর্ট থেকে হেবিয়াস কর্পাস করে মুক্তি পেয়ে হাজতে আছে। তার বিরুদ্ধে দুইটা মামলা আছে। একটি জামিন পেয়েছে আর একটি জজকোর্ট থেকে জামিন পায় নাই। এখন হাইকোর্টে যেতে হবে। শাহ মােয়াজ্জেম একজন এডভােকেট, তার জামিন না দেওয়ার কি কারণ বুঝতে পারলাম না। বাড়ি থেকে খাবার পাঠাইয়াছিল। আমি শাহ মােয়াজ্জেম, নূরুল ইসলাম, নূরে আলম সিদ্দিকীকে নিয়ে খেলাম। হা খেতে হবে। রেনু বােধ হয় ভাের রাত থেকে পাক করেছে, না হলে কি করে ১২ টার মধ্যে পাঠাল! নামাজ পড়ার পরে শত শত কয়েদি আমাকে ঘিরে ফেলল। সকলের সাথে হাত মিলাতে আমার প্রায় আধাঘণ্টা সময় লেগেছিল।৪ পরবর্তী মাসেও বঙ্গবন্ধু শাহ মােয়াজ্জেমের কারামুক্তির প্রশ্নে উদ্বিগ্ন ছিলেন। তার সেই উৎকণ্ঠা প্রকাশ পেয়েছে ১১-১৩ এপ্রিল ১৯৬৭ সালে লিখিত দিনলিপিতে। শাহ মােয়াজ্জেমের মুক্তি প্রসঙ্গে সেদিন তিনি লিখেছেন, ‘…শাহ মােয়াজ্জেম হাইকোর্ট থেকে ডিপিআর আইনে মুক্তি পেলেও একটা মামলায় জামিন না পাওয়ার জন্য জেলে সাধারণ কয়েদি হয়ে কষ্ট পেতেছে। বক্তৃতার মামলায় সেশন জজ

পৃষ্ঠা: ৯৬
সাহেবও জামিন দেন নাই। হাইকোর্টে জামিনের জন্য আর্জি পেশ করা হয়েছে, আজ পর্যন্ত শুনানি হয় নাই। বড় দুঃখ করছিল, বলছিল সহকর্মীরা একটু চেষ্টা করলেই জামিন হয়ে যেত। পুরানা বিশ সেলে আছে। আমার সাথে মাঝে মাঝে দেখা হয়। আমি তাকে বােঝাতে চেষ্টা করি। সে নিজেও একজন এডভােকেট। তার অন্যান্য এডভােকেটের উপর দাবি বেশি।৫ মাঝে মধ্যে সংগীত প্রিয় বঙ্গবন্ধু কারাগারের ভেতরেই সংগীতানুষ্ঠানের আয়ােজন করতেন। কখনােবা নিয়ম-নীতির তােয়াক্কা না করে অন্যদের আয়ােজিত অনুষ্ঠানেও হাজির হতেন। সেসব আয়ােজন প্রসঙ্গেও বঙ্গবন্ধুর দিনলিপিতে শাহ মােয়াজ্জেমের নাম উল্লেখিত হয়েছে। এ বিষয়ে ১৪-১৫ এপ্রিল ১৯৬৭ সালের দিনলিপিতে লিখেছেন, ‘…বিকেলে পুরানাে বিশ সেলের সামনে নূরে আলম সিদ্দিকী, নূরুল ইসলাম ও হানিফ খান কম্বল বিছাইয়া এক জলসার বন্দোবস্ত করেছে। বাবু চিত্তরঞ্জন সুতার, শুধাংশু বিমল দত্ত, শাহ মােয়াজ্জেম আরও কয়েকজন ডিপিআর ও কয়েদি, বন্দি জমা হয়ে বসে আছে। আমাকে যেতেই হবে সেখানে, আমার যাবার হুকুম নাই তবু আইন ভঙ্গ করে কিছু সময়ের জন্য বসলাম। কয়েকটা গান হলাে, একজন সাধারণ কয়েদিও কয়েকটা গান করল। চমৎকার গাইল। শিক্ষিত ভদ্রলােকের ছেলে, প্রেম করে একজনকে বিবাহ করেছিল। পরে মামলা হয়। মেয়েটা বাবা মায়ের চাপে উল্টা সাক্ষী দেয় এবং নারী অপহরণ মামলায় ৭ বছরের জেল নিয়ে এসেছে। ছােট হলেও জলসাটা সুন্দর করেছিল ছেলেরা।৬
বন্দি অবস্থায় সহবন্দিদের সাথে কথা বলার সুযােগ পাওয়াও এক সৌভাগের ব্যাপার। এক্ষেত্রে কাছের লােক হলে; তা হয় বাড়তি পাওনা। এ ছাড়া সহবন্দিদের স্বাচ্ছন্দ্যময় অবস্থানের বিষয়টিও বঙ্গবন্ধুর ভাবনায় সবসময় গুরুত্ব পেয়েছে। ১৬-২২ এপ্রিল ১৯৬৭ সালের দিনলিপিতে এ বিষয়ে তিনি লিখেছেন, ..কিছু সময় আজকাল মােয়াজ্জেমের সাথে আলাপ করতে সুযােগ পাই। ডিপিআর থেকে মুক্তি পেয়েও বন্দি আছে কয়েদি হয়ে, এখনও জামিন পায় নাই, কয়েকদিনের মধ্যে জামিন হয়ে যাবে। পুরানা ২০ সেলে রেখেছে। প্রায় একমাস সাধারণ কয়েদি থেকে দুই তিন দিন হলাে ডিভিশন পেয়েছে।৭ প্রকাশ থাকে যে ছয়দফা উত্থাপন করার পর হতে সরকারের পক্ষ থেকে গণহারে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের কারারুদ্ধ করা হয়। কারারুদ্ধ হন শাহ মােয়াজ্জেম হােসেনও সে সময়ই বঙ্গবন্ধুর বিবেচনায় শাহ মােয়াজ্জেম হয়ে উঠেছিলেন একজন প্রভাবশালী নেতা। এ প্রসঙ্গে ২৩-২৭ এপ্রিল ১৯৬৭ সালে লিখিত দিনলিপিতে তিনি লিখেছেন, ‘…আমরা ৬দফা দাবির জন্য জেলে এসেছি। আজও প্রচার সম্পাদক আব্দুল মােমিন, কালচারাল সম্পাদক ওবায়দুর রহমান, অরগানাইজিং সেক্রেটারি মিজানুর রহমান চৌধুরী, প্রভাবশালী নেতা শাহ মােয়াজ্জেম, ওয়ার্কিং কমিটির

পৃষ্ঠা: ৯৭
সদস্য মােল্লা জালাল উদ্দিন, মহীউদ্দিন আহাম্মদ সিটি আওয়ামী লীগ সম্পাদক নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা সিটি অফিস সেক্রেটারি মােজাম্মদ সুলতান এবং ঢাকা জেলা অফিস সেক্রেটারি সিরাজউদ্দিন জেলে। পাকিস্তান আওয়ামী লীগ একটা প্রস্তাবও পাশ করে নাই আমাদের মুক্তির জন্য।’৮
কারাগারে মাঝে মাঝে বঙ্গবন্ধু নিজেই রান্না করে তাঁর রাজনৈতিক সহযােদ্ধা ও সাধারণ কয়েদিদের খাওয়াতেন। বন্দি জীবনের স্থবিরতা কাটাতে স্বপ্রণােদিত হয়েই তিনি এ ধরনের ভােজউৎসবের আয়ােজন করতেন। ডেকে এনে খাওয়াতেন প্রিয়জনদের। শাহ মােয়াজ্জেমও এ থেকে বাদ যেতেন না কখনাে। ২৮-৩০ এপ্রিল ১৯৬৭ সালের দিনলিপিতে এ ধরনের আয়ােজন ও আপ্যায়ন প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘…আমার পাশে ৮/১০ জন আছে। সকলকেই কিছু কিছু দেওয়া হলাে। ডিম ভাজা, ঘি ও অল্প অল্প মুরগির গােস্তও দেওয়া হলাে। গােসল করে যখন খেতে বসলাম তখন মনে হলাে খিচুড়ি তাে হয় নাই তবে একে ডাউল চাউলের ঘণ্ট বলা যেতে পারে। উপায় নাই খেতেই হবে কারণ আমিই তাে এর বাবুর্চি। শাহ মােয়াজ্জেম, নূরে আলম, নূরুল ইসলাম বলল, ‘মন্দ হয় নাই।’ একটু হেসে বললাম, যাক আর আমার মন রাখতে হবে না। আমিই তাে খেয়েছি। যাহা হােক খিচুড়ি সংগ্রাম পরিষদের দাবি আদায় হলাে, আমিও বাঁচলাম।৯ কারাগারে একসময় বঙ্গবন্ধু ও শাহ মােয়াজ্জেম পাশাপাশি সেলে থেকেছেন। সে সুবাদে তাদের মধ্যে আলাপআলােচনার সুযােগও প্রসারিত হয়। সময় কাটাতে মাঝে মধ্যে বসত তাসের আসর। বঙ্গবন্ধুর পার্টনার হতেন তাঁর প্রিয়ভাজন শাহ মােয়াজ্জেম। এ বিষয়ে ৩-২৩ মে ১৯৬৭ সালের দিনলিপিতে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘…শাহ মােয়াজ্জেম আমার পাশেই পুরানা বিশ সেলে আছে। হাইকোর্ট ডিপিআর থেকে খালাস দিয়েছে কিন্তু একটা মামলায় জামিন না হওয়ার জন্য জেলে পড়ে আছে। নূরুল ইসলাম, নূরে আলম সিদ্দিকীও পুরানা বিশে থাকার জন্য একটু আরামেই আছি। কারণ ওদের সাথে আলাপ আলােচনা করতে পারি মাঝে মাঝে, ফাঁকে ফাঁকে তাসও খেলে থাকি। যদিও তাস খেলা ভাল জানি না। ব্রীজ খেলতে গেলে উল্টা-পাল্টা খেলে বসি। মােয়াজ্জেম আমার সাথী, মুখ কালাে করে ফেলে, কিছু বলতে পারে না আর সইতেও পারে না। দুপুর বেলা বিছানায় শুয়ে থাকলে রাতে আর ঘুম হতে চায় না। তাই দুপুর বেলা খাওয়ার পরে কিছু সময় নষ্ট করি। আমি তাে একাকীই থাকি, কোনাে দেওয়াল ভিতরে না থাকায় ওরা চলে আসে। আর আমি তাে কয়েদি হয়েছি, রাজনৈতিক বন্দি তাে নই। আর মােয়াজ্জেমও বিচারাধীন আসামি। আর মেয়াজ্জেম কাছে থাকায় অনেক সময় গল্প করে কাটাতে পারি। মােয়াজ্জেম বলে, ‘মুজিব ভাই কিছু লেখেন। আমি বলি, ‘কি লিখব, বল, লেখার অভ্যাস তাে কোনােদিন করি নাই।’১০

পৃষ্ঠা: ৯৮
ছয়দফা উত্থাপিত হবার পর সরকারের পক্ষ থেকে একদিকে যেমন নিপীড়ন-নির্যাতন ও কারারুদ্ধকরণ চলতে থাকে, অন্যদিকে তেমনই চলতে থাকে ছয়দফা বিরােধী নানামাত্রিক ষড়যন্ত্র। ছয়দফার বিকল্প হিসেবে উত্থাপন করা হয় আটদফা, আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে গঠন করা হয় ‘পাকিস্তান ডেমােক্রেটিক মুভমেন্ট’ (পিডিএম) নামের একটি জোট। এ ইস্যুতে আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যে দেখা দেয় বিস্তর মতবিরােধ। অনেক আওয়ামী লীগ নেতাও ছয়দফার বিপক্ষে অবস্থান নেন। কিন্তু শাহ মােয়জ্জেমের মতাে নেতা বঙ্গবন্ধুর ছয়দফার পক্ষেই থেকে যান। এ বিষয়ে ৩২৩ মে ১৯৬৭ সালে লিখিত দিনলিপিতে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘…আপােষ হওয়ার কোনাে সম্ভাবনা নাই। জেলের ভিতর যারা আছে তাদের মধ্যেই মতবিরােধ আছে। তাজউদ্দীন, মােমিন সাহেব, ওবায়দুর, শাহ মােয়াজ্জেম ও মণি কিছুতেই ৬ দফা ছাড়া পিডিএম এ যােগদান করতে রাজী নয়। খােন্দকার মােশতাক যাতে দলের মধ্যে ভাঙন না হয় তার জন্য ব্যস্ত। যদিও আমার কাছে মিজানুর রহমান এ কথা ও কথা বলে, তবে সেও পিডিএম এর পক্ষপাতী। রফিকুল ইসলাম আমার কাছে এক কথা বলে আর বাইরে অন্য খবর পাঠায়। জালাল ও সিরাজের মতামত জানি না, কারণ কুমিল্লায় আছে। তাজউদ্দীন ময়মনসিংহ থেকে আমাকে খবর দিয়েছে। নারায়নগঞ্জের মহীউদ্দিনের মতামত আমি জানি না। তবে ছাত্র নেতা নূরুল আলম, নূরুল ইসলাম-আওয়ামী লীগ কর্মী, সুলতান ঢাকা সিটি কর্মী, শ্রমিক নেতা মান্নান ও রুহুল আমিনও আমাকে খবর দিয়েছে ৬ দফা ছাড়া আপােষ হতে পারে না।’১১
কারাগারে অবস্থানকালে শাহ মােয়াজ্জেম নিজে যেমন বই লিখতেন, তেমনই বঙ্গবন্ধুকেও লিখতে তাগিদ দিতেন। তার বই লেখা ও মুক্তি প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু ১৯৬৭ সালে, ২৭-২৮ মে তারিখের দিনলিপিতে লিখেছেন, ‘…শাহ মােয়াজ্জেম একটা বই লিখেছে, আমায় পড়ে শােনাল। ভালই লিখেছে, অনেকক্ষণ ওর সাথে আলাপ হলাে আজ। বােধ হয় ৫/৭ দিনের মধ্যে জামিন পেয়ে জেল থেকে চলে যাবে। আবার একলা পড়ে যাবাে। মাঝে মাঝে ২০ সেল ছেড়ে আমার কাছে চলে আসে। আমি চাই ওর মুক্তি হউক। আমার এই জীবনটাই একাকী কাটাতে হবে এই নিষ্ঠুর ইটের ঘরে।১২ একই সালের ২৯৩১ মে’র দিনলিপিতে বাড়ি হতে প্রেরিত খাবারের কথা লিপিবদ্ধ হয়েছে, যা বরাবরের মতাে অন্যদের সাথে নিয়ে, অন্যদের ভাগ দিয়ে খেয়েছেন বঙ্গবন্ধু। এ বিষয়ে লেখা হয়েছে, ‘…এক মাসের বেশি বিনাশ্রম কারাদণ্ড ভােগ করলাম। রেণু এসেছিল জেল গেটে মণিকে দেখতে। ছেলেমেয়েরা ভালই আছে। মাংস মাছ পাকাইয়া নিয়ে এসেছিল, গেট থেকে পাঠাইয়া দিয়েছে। গরম করে দুইদিন এগুলিই খেলাম। শাহ মােয়াজ্জেম, নূরে আলম, নূর ইসলাম ও চিত্ত

পৃষ্ঠা: ৯৯
বাবুকে রেখে তাে খেতে পারি না, তাদেরও ভাগ দিলাম। আজ দিলাম অন্যান্য সকলকে। বড় ভাল লাগে সকলকে দিয়ে খেতে। কয়েদিদের একঘেয়ে পাক খেতে খেতে জীবন অতিষ্ট হয়ে ওঠে। মাঝে মাঝে একটু পরিবর্তন হলে ভালই হয়। রাজনৈতিক বন্দি হিসেবে ঘরের জিনিস আনার হুকুম নাই। তবে কয়েদি হলে আনতে পারে। বিচিত্র দেশ, বিচিত্র আইন! রাজনৈতিক বন্দিদের ফল ফলাদি আনারও হুকুম নাই।১৩ এ সমস্ত লেখনীর মাধ্যমে সন্দেহাতীতভাবে একথা প্রমাণিত যে শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন বরাবরই বঙ্গবন্ধুর অনেক কাছের একজন ছিলেন। এছাড়া এক সময়ের তুখােড় ছাত্র নেতা হিসেবেও বঙ্গবন্ধুর পছন্দের তালিকার শীর্ষে ছিলেন। রাজনীতির বাইরেও সম্পর্কটি ছিল হৃদ্যতাপূর্ণ। পরস্পর পরস্পরের প্রতি ছিলেন আস্থাশীল-বিশ্বাসভাজন।
তদুপরি শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন আওয়ামী লীগের কার্য নির্বাহী কমিটিতে কখনাে কোনাে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। ১৯৬৬ সালের ১৮-২০ মার্চে হােটেল ইডেনে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক কাউন্সিলের মাধ্যমে গঠিত কমিটিতে তার কোনাে পদ ছিল না। এমনকি উক্ত কাউন্সিলে যে ২৫ জনের ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য মনােনীত হয়, সেখানেও তাকে সদস্য হিসেবে মনােনীত করা হয়নি। ১৯৬৮ সালের ১৯-২০ অক্টোবরে হােটেল ইডেনে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক কাউন্সিলে গঠিত কেন্দ্রীয় কমিটিতেও তার অবস্থান ছিল না। ১৯৭০ সালের ৪-৫ জুন হােটেল ইডেনে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক কাউন্সিলেও তাকে কোনাে পদে নির্বাচিত করা হয়নি। এ কাউন্সিলে যে ১০ সদস্যের পার্লামেন্টারি বোর্ড গঠিত হয় তাতেও তার অবস্থান ছিল না। ১৯৭২ সালের ৭-৮ এপ্রিল কাকরাইলস্থ আওয়ামী লীগের অফিস অঙ্গনে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিবার্ষিক কাউন্সিল। ওই কাউন্সিলে; ‘আওয়ামী লীগকে পুনর্গঠন করার জন্য কাউন্সিল অধিবেশনের কয়েকদিনের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কাউন্সিল কর্তৃক তার ওপর অর্পিত দায়িত্ববলে ৪৪ সদস্যবিশিষ্ট একটি সাংগঠনিক কমিটি গঠন করেন।১৪
উক্ত কমিটিতে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক শাহ মােয়াজ্জেম হােসেনকে সদস্য হিসেবে মনােনীত করা হয়। ১৯৭৪ সালের ১৮-২০ জানুয়ারি কাকরাইলস্থ আওয়ামী লীগের অফিস প্রাঙ্গনে অনুষ্ঠিত হয় আওয়ামী লীগের তিনদিনব্যাপি দ্বিবার্ষিক কাউন্সিল। উক্ত কাউন্সিলে উপস্থিত ডেলিগেটদের প্রবল আপত্তির পরও বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ হতে স্বেচ্ছায় সরে দাঁড়ান এবং সাধারণ সদস্য হিসেবে কমিটিতে অবস্থান করেন। অতঃপর নবনির্বাচিত সভাপতি; এ এইচ এম কামরুজ্জামান কর্তৃক ৯ ফেব্রুয়ারি ঘােষিত হয় ২৪ সদস্য বিশিষ্ট ওয়ার্কিং কমিটির নাম। উক্ত ওয়ার্কিং কমিটিতেও শাহ মােয়াজ্জেম হােসেনের কোনাে অবস্থান ছিল না। পার্টিতে জোরালাে অবস্থান না থাকা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুর

পৃষ্ঠা: ১০০
আস্থাভাজন হিসেবে শাহ মােয়াজ্জেম হােসেনকে সংসদের চিফ হুইপের মতাে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব অর্পন করা হয়। এছাড়া তিনি নবগঠিত বাকশালে যােগদান করেছিলেন। ১৯৭৫ সালে, জুনের ৬ তারিখে গঠিত ১১৫ সদস্যবিশিষ্ট বাকশাল কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটিতে শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন ছিলেন অন্যতম সদস্য। আস্থাভাজন এই শাহ মােয়াজ্জেম হােসেনরাই অতঃপর ঘরের শত্রু বিভীষণ হয়ে বঙ্গবন্ধুবিরােধী নানামুখী অপতৎপরতা চালিয়েছিল।
ছাত্রলীগের পর্যায় হতে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত থাকলেও প্রবলভাবে ডানপন্থি শাহ মােয়াজ্জেম হােসেনের বলয়ভুক্তরা বঙ্গবন্ধুর সমাজতান্ত্রিক ধারার সাথে কখনাে একাত্ম হননি। স্বাধীনতা যুদ্ধকালেও মুজিবনগর সরকারের সমাজতান্ত্রিক বলয় অভিমুখী প্রয়াসের বিপরীতে ছিল তাদের অবস্থান। সে সময়কার স্বাধীনতা বিরােধী চক্রের অন্যতম একজন ছিলেন শাহ মােয়াজ্জেম। তারা সেসময় মুক্তিযুদ্ধ বিরােধী ষড়যন্ত্রের জন্য প্রায়শ সমবেত হতেন কলকাতার ঐতিহ্যবাহী গ্রান্ড হােটেলে। লােক দেখানাে আড্ডার আড়ালে মেতে উঠতেন নানামুখী ষড়যন্ত্রে, তাদের সেসব অপতৎপরতাও বেশিদিন গােপন থাকেনি। বিষয়টি যেমন ভারতীয় সরকারের নজরে এসেছিল, তেমনই মুজিবনগর সরকারেরও গােচরীভূত হয়েছিল এবং সে নিরিখেই একপর্যায়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে তাদের ষড়যন্ত্র পুরােপুরি বানচাল করা হয়। সে সময়কার ষড়যন্ত্রিক আড্ডায় কারা অংশ নিতেন, সে বিষয়ে জ্যোতি সেনগুপ্তের উদ্ধৃতি দিয়ে আবেদ খান লিখেছেন, ‘..ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তাহের উদ্দিন ঠাকুর, ফরিদপুরের ওবায়দুর রহমান, মুন্সীগঞ্জের শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন, চট্টগ্রামের দৈনিক আজাদীর সম্পাদক মহম্মদ খালেদ, এরা দিন-রাত সেখানে গিয়ে মিলিত হয়ে নানা রকম আলােচনা করতেন। আর সেখানে সবকিছুর ব্যবস্থাপনায় ছিলেন ওই মাহবুবুল আলম চাষী। সেখানে কখনাে কখনাে মার্কিন অফিসারদের যাতায়াত হতাে, সে কথাও জ্যোতি সেনগুপ্ত তাঁর বইয়ে উল্লেখ করেছেন।১৫
সেসময় ষড়যন্ত্রিক সিদ্ধান্ত মােতাবেক মােশতাক-চাষী চক্ররা জাতিসংঘের মাধ্যমে মধ্যপথে মুক্তিযুদ্ধ থামিয়ে দিয়ে পাকিস্তানিদের সাথে কনফেডারেশন গঠনের পাঁয়তারা করেছিল। এক্ষেত্রে তারা বঙ্গবন্ধুর মুক্তির বিষয়টিকে উপজীব্য করে দুরাশা পূরণের পথে অগ্রসর হয়েছিল। এ বিষয়ে মুজিবনগর সরকারের কর্মকর্তা; বর্তমানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম ‘প্রথম আলাের মিজানুর রহমান খানকে প্রদত্ত এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘ভারতের কংগ্রেস নেতা ড. ত্রিগুণা সেন, যাকে মিসেস গান্ধী মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দিয়েছিলেন, তাঁরা বাংলাদেশ বিরােধী ছিলেন। আমেরিকাপন্থি হিসেবে ড. সেন ও তাঁর গ্রুপের একটা পরিচিতি ছিল। আর সেই গ্রুপের সঙ্গে খন্দকার

পৃষ্ঠা: ১০১
মােশতাকের দহরম-মহরম ছিল। তাদের মাধ্যমেই খােন্দকার মােশতাক, মাহবুব উল আলম চাষী, শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন প্রমুখের কলকাতার মার্কিন কনসাল জেনারেলের সঙ্গে যােগাযােগ ঘটে।১৬ কিন্তু মুজিবনগর সরকার, বিশেষত প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের বিচক্ষণ সিদ্ধান্তের কারণে তাদের সেই অভীলিপ্সা পূরণ হয়নি। ভগ্ন হৃদয়ে তাদেরকে দেখতে হয় পাকিস্তানের ভাঙন তথা বাংলাদেশের স্বাধীনতা।
স্বাধীনতার পরও শাহ মােয়াজ্জেমদের ষড়যন্ত্র থেমে থাকেনি। স্বাধীনতা সংগ্রাম থামিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হবার পর তাদের ষড়যন্ত্রের তীর তাক করা হয় বঙ্গবন্ধুর দিকে। সরকারের চিফ হুইপ হয়েও শাহ মােয়াজ্জেম বঙ্গবন্ধুকে উচ্ছেদের ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠেন। সেসময় এ ধরনের ষড়যন্ত্রমূলক বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে থাকে ধারাবাহিকভাবে। কুমিল্লার পল্লি উন্নয়ন একাডেমি (বার্ড), গাজীপুরের সালনা, মােশতাকের নির্বাচনি এলাকা এবং আগামসি লেনের বাড়ি হয়ে ওঠে ষড়যন্ত্রের কেন্দ্রভূমি। বিভিন্ন অনুষ্ঠান-উৎসব। আয়ােজনের আড়ালে অনুষ্ঠিত হতে থাকে বঙ্গবন্ধুবিরােধী নীল নকশা বাস্তবায়ন বিষয়ক বৈঠক। এ প্রসঙ্গে; রাজনীতিক-আমলা-সেনা চক্রের মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকের বিষয়ে আলােকপাতকালে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার অন্যতম সাক্ষী অধ্যাপক খুরশিদ আলম আদালতকে জানান, ‘…৭৫’র মে-জুনে খন্দকার মােশতাকের গ্রামে একটি ফুটবল টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলায় মােশতাকের আমন্ত্রণে শিক্ষামন্ত্রী ইউসুফ আলী, চিফ হুইপ শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, আলী আশরাফ এম. পি এবং তিনি উপস্থিত ছিলেন। খেলাশেষে তারা মােশতাকের বাড়িতে চা-চক্রে যােগ দেন। চা-পানের সময় বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন নীতি এবং কর্মসূচির সমালােচনা করতে থাকে খন্দকার মােশতাক, তাহের উদ্দিন ঠাকুর এবং শাহ মােয়াজ্জেম। সেই সমালােচনায় শাহ মােয়াজ্জেমকে অত্যন্ত উৎসাহী এবং সােচ্চার দেখা যায়।১৭
আইয়ুববিরােধী আন্দোলন, ছয়দফা আন্দোলন, ঊনসত্তুরের গণঅভ্যুত্থান, সর্বোপরি বঙ্গবন্ধুর সাথে একত্রে কারাবাসকারী; শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত কাছের মানুষ এবং জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগের চিফ হুইপ হয়েও বঙ্গবন্ধুবিরােধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতে দ্বিধা করেননি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর খন্দকার মােশতাক তাকে অবৈধ মন্ত্রিসভায় প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে নিয়ােগ দিয়েছিল। তার সম্পর্কে এ এল খতিব লিখেছেন, ‘শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন, যার নাম মুজিব হত্যার চক্রান্তের সাথে ওতােপ্রােতভাবে জড়িয়ে আছে। যদিও একসময় তাকে মুজিবের কাছের লােক মনে করা হতাে। তারপরও আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের চিফ হুইপ হওয়া সত্ত্বেও তাকে কোন মন্ত্রীর পদ কখনাে দেওয়া হয়নি। মােশতাক, শাহ মােয়াজ্জেমকে তার

পৃষ্ঠা: ১০২
মন্ত্রীসভায় একজন প্রতিমন্ত্রী করেছিলেন। ঘটনাচক্রে শাহ মােয়াজ্জেমই প্রথম আওয়ামী লীগ নেতা যিনি মার্কিন সরকারের আমন্ত্রণে সে দেশ সফর করেছিলেন। ১৯৭৩ সালের ১৮ অক্টোবর থেকে ১৭ নভেম্বর পর্যন্ত তার সে সফর সফল ছিল। মােশতাকের মতােই শাহ মােয়াজ্জেমও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নীতি থেকে ডান পন্থার দিকে বেশি ঝুঁকে ছিলেন।১৮
পরবর্তী সময়ে শাহ মােয়াজ্জেম হােসেনকে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা ও চার জাতীয় নেতার হত্যা মামলার আসামী করা হয়। সে দুটি মামলায় তাকে খালাস দেওয়া হলেও আদালতে প্রদত্ত সাক্ষীদের বয়ানে শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন সম্পর্কে অনেক তাৎপর্যপূর্ণ তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। এ বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাক্ষীদের সাক্ষ্য উদ্ধৃতিক্রমে সাংবাদিকদের জানায়,
..শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন এমপি হােস্টেলে বলেন, বঙ্গবন্ধু মারা গেছেন, কি হয়েছে ঘাবড়াবার কিছু নেই। পার্লামেন্ট তাে আছে। আওয়ামী লীগের চার নেতাসহ ২৬ জন কারাগারে রয়েছেন। মােশতাক সাহেব ১০/১৫ বছর ক্ষমতায় থাকবেন। তােমরা তাকে সাপাের্ট (সমর্থন) করাে। তা না হইলে কনসিকুয়েন্স (পরিস্থিতি) খারাপ হবে। জেলখানায় যারা আছেন, প্রয়ােজন বােধে তারা শেষ হয়ে যাবেন।১৯ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর খন্দকার মােশতাকের ক্ষমতা সংহত করার জন্য অতিমাত্রায় তৎপর ছিলেন শাহ মােয়াজ্জেম। এ প্রসঙ্গে আর এক সাক্ষীর বক্তব্য উদ্ধৃতক্রমে এটর্নি জেনারেল সাংবাদিকদের জানান, ‘…শাহ মােয়াজ্জেম, নুরুল ইসলাম মঞ্জুর ও কে এম ওবায়দুর রহমান চার নেতার অন্যতম মনসুর আলীকে নিয়ে খন্দকার মােশতাকের কাছে যান এবং মনসুর আলীকে মন্ত্রী হওয়ার অনুরােধ জানান। তিনি অস্বীকার করেন।২০
সেসময় সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং এ এইচ এম কামরুজ্জামানকেও অনুরূপ প্রস্তাব দেওয়া হয় এবং তারাও তা প্রত্যাখ্যান করেন। এই ঘরের শত্রু বিভীষণরা আগস্টের হত্যাযজ্ঞের পর নিজেদের অবস্থান সংহতকরণে প্রবলভাবে তৎপর ছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা বেশিদিন ক্ষমতায় থাকতে পারেননি। ৮১ দিন পরেই তাদেরকে বিদায় নিতে হয়। খন্দকার মােশতাকের পতনের পর এই ডান ঘরাণার ষড়যন্ত্রকারী মােশতাকের সাথে গঠন করেন ‘ডেমােক্রেটিক লীগ ‘ নামের রাজনৈতিক দল। গণভিত্তিহীন এ দলটি পরবর্তী সময়ে বেশিদিন টিকে থাকেনি। শাহ মােয়াজ্জেম হােসেনও পরবর্তী পর্যায়ে নিজেকে স্থিত করেন তার কাঙ্ক্ষিত ঠিকানায়। নীতিহীন এই শাহ মােয়াজ্জেমরা শুধু রাজনৈতিক পর্যায়েই বঙ্গবন্ধুর সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন না। ব্যক্তিগত সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন, অধিকন্তু বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সাথেও এদের হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল, তার পরও শিশু রাসেলের হত্যাযজ্ঞ, পরিবারের নিস্পাপ নারীদের হত্যাযজ্ঞেও এদের বিবেক কম্পিত হয়নি। এ নিয়ে কখনও কোনাে অনুতাপও বােধ করেননি।

পৃষ্ঠা: ১০৩
তথ্যনির্দেশ:
১. শাহ মােয়জ্জেম হােসেন। মুক্তবিশ্ব কোষ। ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০
২. মুজিবুর রহমান, শেখ। কারাগারের রােজনামচা। ২০১৮ সপ্তম মুদ্রণ। ঢাকা। বাংলা একাডেমি। পৃষ্ঠা: ২০২ প্রাগুক্ত। পৃষ্ঠা: ২১২
৪. প্রাগুক্ত। পৃষ্ঠা: ২১৩
৫. প্রাগুক্ত। পৃষ্ঠা:২১৮
৬. প্রাগুক্ত। পৃষ্ঠা: ২২৩
৭. প্রাগুক্ত। পৃষ্ঠা: ২২৪
৮. প্রাগুক্ত। পৃষ্ঠা: ২২৭
৯. প্রাগুক্ত। পৃষ্ঠা: ২৩৫
১০. প্রাগুক্ত। পৃষ্ঠা: ২৪০
১১. প্রাগুক্ত। পৃষ্ঠা:২৪১
১২. প্রাগুক্ত। পৃষ্ঠা: ২৪৭
১৩. প্রাগুক্ত। পৃষ্ঠা: ২৪৮
১৪. রশিদ, হারুন-অর। মূলধারার রাজনীতি: বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কাউন্সিল ১৯৪৯| ২০১৬। ২০১৭। ঢাকা। বাংলা একাডেমি। পৃষ্ঠা: ১৫১
১৫. খান, আবেদ। পাকিস্তান থেকে মুক্ত বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পাঠানাে হয় গুপ্তঘাতক। দেশে বিদেশে। টরেন্টো। কানাডা। ০৮-০৬-২০১৯
১৬. প্রথম আলাে। ঢাকা। ০৪ ডিসেম্বর ২০১৬ ‘
১৭. নেওয়াজ খান, জাহিদ কুমিল্লার বার্ড থেকে ঢাকার আগামসি লেন। ঢাকা। চ্যালেন আই অনলাইন। ১২ আগস্ট, ২০১৫
১৮. খতিব, এ.এল। হু কিল্ড মুজিব। ২০১৬। ঢাকা। আবিষ্কার। পৃষ্ঠা: ৬৭
১৯. বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর. কম। জেলহত্যা মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষ। ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৩
২০. প্রাগুক্ত

প্রতিমন্ত্রী দেওয়ান ফরিদ গাজী

খন্দকার মােশতাক আহমদের অবৈধ সরকারের বাণিজ্য ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন দেওয়ান ফরিদ গাজী। তিনি বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন। ১৯২৪ সালের ১ মার্চ হবিগঞ্জ জেলাস্থ (তৎকালীন মহকুমা) নবীগঞ্জ উপজেলার দেবপাড়া গ্রামে দেওয়ান ফরিদ জন্ম গ্রহণ করেন। পিতা দেওয়ান মােহাম্মদ হামিদ গাজী ছিলেন দিনারপুর পরগণার জমিদার। ফরিদ গাজী হযরত শাহজালাল মুজাররদ-ই-ইয়েমেনীর (র) সফরসঙ্গী হযরত তাজউদ্দিন কোরেশীর (র) ১৬তম বংশধর। দেওয়ান ফরিদ গাজী স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। অতঃপর মৌলভীবাজার জুনিয়র মাদ্রাসা এবং সিলেট আলিয়া মাদ্রাসায় অধ্যয়ন করেন। পরবর্তী পর্যায়ে ১৯৪৫ সালে সিলেট রসময় মেমােরিয়াল হাইস্কুল হতে প্রবেশিকা, ১৯৪৭ সালে সিলেট মুরারিচাঁদ কলেজ হতে উচ্চমাধ্যমিক এবং ১৯৪৯ সালে সিলেট মদন মােহন কলেজ হতে স্নাতক পাস করেন। ছাত্রজীবন থেকেই ফরিদ গাজী রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৪২ সালে ‘কুইট ইন্ডিয়া’ বা ভারত ছাড় আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৪৩ সালে মুসলিম লীগের অঙ্গ সংগঠন আসাম মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনে যােগ দেন। তিনি ছাত্র ফেডারেশনের আসাম প্রাদেশিক শাখার সহ-সম্পাদক এবং সিলেট এম সি কলেজ শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৪৫ সালে আসামে অহমীয়দের ‘বাঙ্গাল খেদাও’ অভিযানের প্রতিবাদ আন্দোলন এবং লাইন প্রথা বিলােপ আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। এসময় তাকে বহুবার পুলিশি নির্যাতনের শিকার হতে হয়। ১৯৪৭ সালে অনুষ্ঠিত সিলেটের গণভােটে তিনি তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৪৮ সালে, ভাষা আন্দোলনের সূচনাপর্বে সিলেটে আন্দোলন-সংগ্রামের নেতৃত্ব দেন। ১৯৫০ সালে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিহতকরণেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
শিক্ষা সমাপ্তির পর কর্মজীবনের সূচনায় দেওয়ান ফরিদ গাজী শিক্ষকতা ও সাংবাদিকতা পেশায় প্রবেশ করেন। ১৯৫০ সালে সিলেট রসময় মেমােরিয়াল হাইস্কুল ও সিলেট গভর্নমেন্ট হাইস্কুলে কিয়ৎকাল শিক্ষকতা করেন। ১৯৫২ সালে সিলেটের সাপ্তাহিক যুগভেরী (বর্তমানে দৈনিক) পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৩ সালে একই সাথে ইংরেজি সাপ্তাহিক ‘ইস্টার্ন

পৃষ্ঠা: ১০৫
হেরাল্ড’ (বর্তমানে অবলুপ্ত) পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত যুগভেরী এবং ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত সাপ্তাহিক ‘ইস্টার্ন হেরাল্ড’ পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। দেওয়ান ফরিদ গাজী ১৯৫২ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগে যােগ দেন এবং দলের সিলেট জেলা শাখার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে তিনি সিলেট জেলা নির্বাচন পরিচালনা কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন। ১৯৬৪ সালে সিলেটের তােপখানা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং সিলেট পৌরসভার কমিশনার নির্বাচিত হন। পরবর্তী সময়ে১৯৬৭ সালে আওয়ামী লীগের ছয়দফা আন্দোলনে অংশগ্রহণের দায়ে তাকে কারারুদ্ধ করা হয়। দীর্ঘ ১১ মাস কারাভােগের পর মুক্তি লাভ করেন। তার কারামুক্তির বিষয়ে বঙ্গবন্ধু ২২ জুন ১৯৬৭ সাল, বৃহস্পতিবারের দিনলিপিতে লিখেছিলেন, ২২ জুন খবরের কাগজে দেখলাম নারায়ণগঞ্জের বজলুর রহমান, ঢাকার হারুনুর রশিদ, তেজগাঁর মাজেদুল হক, রাজশাহী থেকে মুজিবুর রহমান, সিলেট থেকে জালালউদ্দিন সাহেব, দেওয়ান ফরিদ গাজী ও সিরাজউদ্দিন, টাঙ্গাইলের মােহাম্মদ আলী, খুলনার শেখ মুহাম্মদ আলী, চট্টগ্রামের মানিক চৌধুরীকে মুক্তি দেওয়ার হুকুম দিয়েছে। (মুজিবুর রহমান, শেখ। কারাগারের রােজনামচা। পৃষ্ঠা: ২৪৯) কারামুক্তির পর তিনি আইয়ুববিরােধী আন্দোলন, উনসত্তুরের গণঅভ্যুত্থান ও সত্ত্বরের নির্বাচনে জোরদার ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনে সিলেট সদর আসন থেকে পাকিস্তান সাংবিধানিক পরিষদের (এমসিএ) সদস্য নির্বাচিত হন।
অতঃপর ১৯৭১ সালে, মার্চের অসহযােগ আন্দোলনকালে তিনি সিলেট জেলায় আন্দোলন-সংগ্রাম সংগঠিত করেন। ২৫ মার্চের পর বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে ঝাঁপিয়ে

পৃষ্ঠা: ১০৬
পড়েন মুক্তিযুদ্ধে। সেসময় তিনি মুজিবনগর সরকারের অধীনে উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় রণাঙ্গনের ৪ ও ৫ নম্বর সেক্টরের বেসামরিক উপদেষ্টা এবং আঞ্চলিক প্রশাসনিক কাউন্সিলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। একইসাথে তিনি শরণার্থী তত্ত্বাবধানের দায়িত্বেও নিয়ােজিত ছিলেন। স্বাধীনতার পর দেওয়ান ফরিদ গাজী বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় প্রথমে স্থানীয় সরকার ও সমবায় মন্ত্রণালয় এবং পরবর্তী সময়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি সিলেট-৮ আসন হতে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। দেওয়ান ফরিদ গাজী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুব ঘনিষ্ঠজন ছিলেন। নবগঠিত বাকশালে তিনি যােগদান করেছিলেন। ১৯৭৫ সালে, জুনের ৬ তারিখে গঠিত ১১৫ সদস্যবিশিষ্ট বাকশাল কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন দেওয়ার ফরিদ গাজি। অতঃপর ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর তিনি খন্দকার মােশতাক আহমদের অবৈধ মন্ত্রিসভায় বাণিজ্য ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে নিযুক্ত হয়ে ১৫ আগস্টে মন্ত্রিত্বের শপথ গ্রহণ করেন। খন্দকার মােশতাকের পতন পর্যন্ত তিনি প্রতিমন্ত্রির দায়িত্বে বহাল ছিলেন।
খন্দকার মােশতাকের পতনের নয় মাস পর-১৯৭৬ সালের ২৫ আগস্ট; মিজানুর রহমান চৌধুরীর ধানমন্ডির বাসভবনে আহূত বর্ধিত সভায় যােগদানের মাধ্যমে দেওয়ান ফরিদ গাজী আওয়ামী লীগে প্রত্যাবর্তন করেন। পরের বছর১৯৭৭ সালে, এপ্রিলের ৩ ও ৪ তারিখে ঢাকার হােটেল ইডেনে অনুষ্ঠিত হয় আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশন, কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত মােতাবেক ১৫ এপ্রিল সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন কর্তৃক কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক কমিটির ৪৪ সদস্যের নাম ঘােষিত হয়। উক্ত কমিটিতে সদস্য হিসেবে তাকে মনােনীত করা হয়। ২০০২ সাল পর্যন্ত তিনি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে বহাল ছিলেন। অতঃপর ২০০৯ সালে অনুষ্ঠিত কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত মােতাবেক দেওয়ান ফরিদ গাজীকে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য করা হয়।
পঁচাত্তরের পর সামরিক শাসনবিরােধী আন্দোলন-সংগ্রামে তিনি সক্রিয় ছিলেন। বিশেষত হাে. মাে. এরশাদ বিরােধী আন্দোলনে ছিলেন অত্যন্ত তৎপর। দেওয়ান ফরিদ গাজী ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে হবিগঞ্জ-১ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০১ সালে এই আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সর্বশেষ ২০০৮ সালে ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একই

পৃষ্ঠা: ১০৭
আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি হিসেবে মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন।’ (সাজু। সিলেটের ডাক। ১৯ নভেম্বর ২০১৯) তিনি ২০১০ সালে, নভেম্বরের ১৯ তারিখে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। দেওয়ান ফরিদ গাজী আওয়ামী লীগের একজন পরীক্ষিত নেতা ছিলেন। ব্রিটিশ বিরােধী আন্দোলন, আইয়ুববিরােধী আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে অনবদ্য ভূমিকা পালন করেছেন। পরবর্তী সময়ে আদর্শচ্যুত না হয়ে আওয়ামী লীগে প্রত্যাবর্তন করে আমৃত্যু দলটির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। পরিতাপের বিষয় তিনিও খুনি মােশতাক ও তার খুনি বাহিনীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেননি। অধিকন্তু জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রক্ত মাড়িয়ে মন্ত্রিত্বের শপথ গ্রহণ করেন।

সহায়ক গ্রন্থ ও তথ্যউৎস:
১. খান মুয়াযম হুসায়ন। গাজী, দেওয়ান ফরিদ। বাংলাপিডিয়া-বাংলাদেশ জাতীয় জ্ঞানকোষ। ১৭ এপ্রিল ২০১৫
২. মুজিবুর রহমান, শেখ। কারাগারের রােজনামচা। ২০১৮ সপ্তম মুদ্রণ। ঢাকা। বাংলা একাডেমি।
৩. রশিদ, হারুন-অর। মূলধারার রাজনীতি: বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কাউন্সিল ১৯৪৯-২০১৬। ২০১৭। ঢাকা। বাংলা একাডেমি
৪. সাজু, মবরুর আহমদ। স্মরণ: দেওয়ান ফরিদ গাজী। সিলেটের ডাক। ১৯ নভেম্বর ২০১৯
৫. List of 11th Parliament Members Bangla. w.w.w.parliament.gov.bd

প্রতিমন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুর

বঙ্গবন্ধু হত্যা ও স্বাধীনতা বিরােধী ষড়যন্ত্রের অন্যতম কুশীলব ছিলেন তাহের উদ্দিন ঠাকুর। পেশায় সাংবাদিক, কাজ করতেন দৈনিক ইত্তেফাকে। জন্মেছিলেন তৎকালীন ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমার সরাইল থানায়। ছাত্রজীবনে বামধারার রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৬১ সালে তদানীন্তন ঢাকা হল ছাত্রসংসদে ছাত্র ইউনিয়নের প্যানেলে জেনারেল সেক্রেটারি নির্বাচিত হয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের কোনাে পর্যায়ের নেতা না হয়ে বঙ্গবন্ধুর বদান্যতায় ৭০ এর নির্বাচনে তৎকালীন কুমিল্লা-২ আসন থেকে প্রাদেশিক আইনপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৩ সালের জাতীয় নির্বাচনেও পূর্বোক্ত আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। অতঃপর তাকে বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় তথ্য প্রতিমন্ত্রীর পদে নিয়ােগ দেওয়া হয়। ১৫ আগস্টের হত্যাযজ্ঞের কাল পর্যন্ত তিনি উক্ত পদে বহাল ছিলেন। নবগঠিত বাকশালে যােগদান করেছিলেন তিনি। ১৯৭৫ সালে, জুনের ৬ তারিখে গঠিত ১১৫ সদস্যবিশিষ্ট বাকশাল কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন তাহের উদ্দিন ঠাকুর। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক হত্যাযজ্ঞের পর খন্দকার মােশতাকের অবৈধ মন্ত্রিসভায় তাকে বেতার ও শ্রম মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর পদে পদায়ন করা হয়। অত্যন্ত পুলকিত চিত্তে তিনি ১৫ আগস্ট রাতেই বঙ্গবন্ধুর রক্ত মাড়িয়ে খুনি সরকারের প্রতিমন্ত্রীর শপথ গ্রহণ করেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে তাহের উদ্দিন ঠাকুর খন্দকার মােশতাক আহমদের অন্যতম অনুসারী হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ বিরােধী ভূমিকায় অত্যন্ত সরব ছিলেন। স্বাধীনতার পর একই চক্রের বলয়ে সম্পৃক্ত ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর বদান্যতায় প্রতিমন্ত্রীর পদে পদায়িত থেকেও বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সরকার বিরােধী ষড়যন্ত্রে প্রবলভাবে তৎপর হয়ে ওঠেন তাহের উদ্দিন ঠাকুর। পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু ও চার জাতীয় নেতার হত্যা মামলায়; ১৯৯৬ সালের ১৪ আগস্ট তাহের উদ্দিন ঠাকুরকে গ্রেফতার করা হয়। অতঃপর ২০০৪ সালের ২০ অক্টোবর, বিএনপির শাসনামলে ঢাকা মেট্রোপলিটন দায়রা জজ আদালত (ট্রায়াল কোর্ট) কর্তৃক তাকে জেল হত্যা মামলার অভিযােগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। ২০০৯ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ধিকৃত তাহের উদ্দিন ঠাকুর কিডনি রােগে আক্রান্ত হয়ে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।

পৃষ্ঠা: ১০৯
স্বাধীনতাযুদ্ধকালে এবং স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধ বিরােধী ও বঙ্গবন্ধুবিরােধী ষড়যন্ত্রিক বলয়ের অন্যতম একজন ষড়যন্ত্রিক ছিলেন তাহের উদ্দিন ঠাকুর। বলা বাহুল্য; স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধুবিরােধী ষড়যন্ত্রের হােতাদের নেতৃত্বে ছিলেন আওয়ামী লীগের ডান ঘরাণার নেতা খন্দকার মােশতাক আহমদ। তার পেছনে যারা কাতারবদ্ধ হয়েছিলেন, তারা সকলেই ছিলেন মােশতাকের মতাে প্রবলভাবে স্বাধীনতা বিরােধী, পাকিস্তানপন্থি, পশ্চিমা ঘেঁষা ও সমাজতন্ত্র বিরােধী। বাহ্যিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করলেও এরা কখনাে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে মনে-প্রাণে মেনে নিতে পারেনি। মেনে নিতে পারেনি স্বাধীন সার্বভৌম দেশটির ধর্মনিরপেক্ষ নীতি, সমাজতান্ত্রিক নীতি ও পশ্চিমা বিরােধী অবস্থান। একইসাথে তারা সংকীর্ণ স্বার্থ হাসিলের জন্য বঙ্গবন্ধুর প্রতিও আন্তরিকভাবে নিবেদিত থাকেনি। বিশ্বাসঘাতকতার মাধ্যমে পেছন থেকে আঘাত করার জন্য হয়েছিল উদগ্রীব। মুক্তিযুদ্ধের সূচনাতেই তাহের উদ্দিন ঠাকুর এহেন স্বাধীনতা বিরােধী বিরূপ মনােভাব প্রকাশ্যে ব্যক্ত করেছেন। তার এ ধরনের স্বাধীনতা বিরােধী অবস্থানের দিকটি উন্মােচিত হয়েছে বীর মুক্তিযােদ্ধা-প্রয়াত কর্নেল (অবঃ) শাফায়াত জামিলের লেখনীতে। এ বিষয়ে বাস্তব অভিজ্ঞতার আলােকে শাফায়াত জামিল ‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্যআগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘…বিমান হামলার দু’তিনদিন আগের ঘটনা। ডিফেন্স পজিশনগুলাে তদারকির রুটিন কাজে ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাওয়ার সময় সিলেট সড়কে সরাইলের কাছে হঠাৎ করে তাহের উদ্দিন ঠাকুরের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলাে। রাস্তার পাশে একটা গাছতলায় দাড়িয়েছিলেন তিনি। ছােটোখাটো একটা জনতা তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে। তাহের উদ্দিন ঠাকুরের সঙ্গে আমার ছাত্রজীবনের পরিচয়। ১৯৬১ সালে তদানীন্তন ঢাকা হল ছাত্রসংসদে ছাত্র ইউনিয়নের প্যানেলে তিনি জিএস আর আমি সহ-ক্রীড়া সম্পাদক ছিলাম।

পৃষ্ঠা: ১১০
সত্তরের নির্বাচনে সংসদ নির্বাচিত হয়েছেন তাহের ঠাকুর। যেখানে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন সেটাই তার নির্বাচনী এলাকা। স্বভাবতই আমি গাড়ি থেকে নেমে সােৎসাহে তাকে ২৭ তারিখে আমার বিদ্রোহ করার কথা জানালাম। ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা সম্পর্কে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের নির্দেশনা কি, জানতে চাইলাম তার কাছ থেকে। আমাকে হতবাক করে দিয়ে তাহের উদ্দিন ঠাকুর রীতিমতো খাপ্পা হয়ে গিয়ে বলেছিলেন, ‘I don’t know anything. I have nothing to do with you. Who told you to revolt? We didn’t ask you to do so…you people in uniform always complicate the situation’ তাহের ঠাকুরের মনােভাব দেখে যারপরনাই বিস্মিত হলাম আমি। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে চাকরির নিশ্চয়তার প্রলােভন, নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তা তুচ্ছ করে দেশের জন্য নিরস্ত্র জনগণের জীবনরক্ষায় যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লাম, আর একজন জনপ্রতিনিধি হয়ে এই লােক বলে কি না, Who told you to revolt? তার সঙ্গে আর কোনাে কথা বলার প্রবৃত্তি হলাে না আমার। তক্ষুণি চলে এলাম সেখান থেকে।১
এভাবেই সেদিন মুক্তিযুদ্ধ বিরােধী মােশতাকচক্রের অন্যতম সদস্য তাহের উদ্দিন ঠাকুর স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরুদ্ধে রীতিমতাে বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন। অতঃপর অনেকটা বাধ্য হয়েই প্রবাসী সরকারের সাথে সম্পৃক্ত থেকেছেন এবং মুক্তিযুদ্ধের নয়মাস জুড়ে মােশতাকের সান্নিধ্যে থেকে স্বাধীনতা বিরােধী নানামাত্রিক তৎপরতা চালিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের সূচনাতেই তাহের উদ্দিন স্বরূপে আবির্ভূত হন। যে কারণে তাকে আখাউড়া এলাকায় স্থাপিত সাময়িক বেতার কেন্দ্র থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। এ বিষয়ে সুখনঞ্জন দাশগুপ্ত লিখেছেন, ‘ক’মাস আগেই স্বাধীন বাংলাদেশ রেতারকেন্দ্রের কর্মীরা সপরিষদ তাহেরউদ্দীন ঠাকুরকে তাড়িয়ে দেন সেখান থেকে। আখাউড়া সেক্টরে এক কিলােওয়াটের একটি বেতারযন্ত্র পরিচালনার ভার ছিল তাহেরউদ্দীনের ওপর। একবার ধরা পড়ল—সরকারি নির্দেশের সঙ্গে সম্পর্কহীন একটি নির্দেশ দেন তিনি মুক্তিফৌজকে। এতে বিভ্রান্ত হন কর্তব্যরত জওয়ানরা। ব্যাপারটা ধরা পড়ায় খালেদ মােশাররফের রােষ থেকে রক্ষা পেতে সাঙগাতদের নিয়ে সেখান থেকে চম্পট দেন তিনি। এসে আশ্রয় নেন মুজিবনগরে স্বাধীন বাংলাদেশ বেতারকেন্দ্রে। সেখান থেকেও বিতাড়িত হয়ে ঘোঁট পাকাতে লাগলেন।২ যুদ্ধ থামিয়ে দেওয়ার জন্য ডিসেম্বরের আগ পর্যন্ত এরা প্রাণপনে অপচেষ্টা চালিয়েছেন। এই মুখােশধারী দেশ বিরােধী বেইমান; স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর প্রশ্রয়ে পালিত হয়েও স্বাধীনতা বিরােধী তৎপরতা হতে সামান্যক্ষণের জন্য বিরত হননি, অধিকন্তু মােশতাকসহ অন্যান্য ষড়যন্ত্রকারীর সাথে একাত্ম হয়ে বঙ্গবন্ধুকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য প্রবলভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। | আরও অনেকের মতাে তাহের উদ্দিন ঠাকুরের জন্যও বঙ্গবন্ধুর দরােজা সবসময় খােলা ছিল। বস্তুত বঙ্গবন্ধু কখনাে কাউকে নিরাশ করতেন না। কারাে

পৃষ্ঠা: ১১১
জন্য তাঁর দরােজা নিজ থেকে বন্ধ করতেন না। কিন্তু পরিতাপের বিষয় বঙ্গবন্ধুর উদারতাকে উপজীব্য করে অনেকেই অনেক ফায়দা লােটার জন্য তাঁর প্রতি অতিমাত্রায় ঝুঁকে পড়তেন, যা অনেক সময় অনেক আলােচনাসমালােচনারও বিষয় হয়ে উঠত। তােষামােদিতে পারদর্শি তাহের ঠাকুর সম্পর্কে তৎকালীন পার্লামেন্টের একজন সদস্য লিখেছেন, ‘বিশেষ বিশেষণে বিশেষিত করে তাহের উদ্দিন ঠাকুর পার্লামেন্টে যে ভাষণ দান করতেন তা আমরা যারা সংসদ সদস্য ছিলাম তারা অত্যন্ত লজ্জা ও কৌতুকের সঙ্গে উপভােগ করতাম। কর্তা ভজানাে এইসব চাটুকার বেঈমানদের পাল্লায় বঙ্গবন্ধুর স্বাভাবিক কথাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে অতিরঞ্জিত করা হয়েছে। যেমন ১৯৭৩ সনে যৌতুক প্রথার বিরুদ্ধে বলতে গিয়ে এক বিয়ের আসরে বঙ্গবন্ধু আক্ষেপ করে বলেছিলেন, কবে যে বঙ্গললনা বেলী ফুলের মালা দিয়ে বিয়ে করবে! শুরু হয়ে গেল বেলী ফুলের দাবাদহ!৩ মতলববাজ তাহের ঠাকুর এভাবেই বঙ্গবন্ধুকে প্রীত করার অপচেষ্টায় তৎপর থাকতেন।
অধিকন্তু প্রাপ্যতার চেয়ে অধিক কিছুই প্রত্যাশা করতেন তাহের উদ্দিন কিন্তু বঙ্গবন্ধু কখনও তাকে তেমন গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করেননি। ক্ষেত্র বিশেষে তেমন পাত্তাও দিতেন না। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট কূটনীতিবিদ ফারুক চৌধুরী অভিজ্ঞতার আলােকে লিখেছেন, ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বরে তাঁর জাতিসংঘ সাধারণ সভার ভাষণটির কথা মনে পড়ে। তখন বাংলাদেশের তথ্য প্রতিমন্ত্রী ছিলেন তাহের উদ্দিন ঠাকুর নামক এক ব্যক্তি তার সঙ্গে আমার কখনাে চাক্ষুষ পরিচয় হয়নি। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে তিনি ছিলেন খন্দকার মােশতাক আহমদের দোসর। কিন্তু তার মাত্র এগারােটি মাস আগে ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যলাভের সর্বাত্মক প্রচেষ্টায়। আমি তখন লন্ডন থেকে ঢাকা এসে বঙ্গবন্ধুর প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে নিউ ইয়র্ক যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। একদিন তদানীন্তন পররাষ্ট্র সচিব ফখরুদ্দীন আহমদ আমাকে বললেন, জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রণয়নে সেই তথ্য প্রতিমন্ত্রী নাকি অহেতুক আগ্রহ প্রদর্শন করছেন। বাংলা ভাষায় নাকি তাঁর জবর দখল। যেহেতু বঙ্গবন্ধু সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে জাতিসংঘে বাংলা ভাষায়ই তিনি তাঁর ভাষণ প্রদান করবেন, সেই মন্ত্রিপ্রবর নাকি বাংলায় খসড়া একটি ভাষণ বঙ্গবন্ধুর সমীপে ইতােমধ্যে পেশ করেছেন। পরে শুনেছিলাম, বঙ্গবন্ধু তাকে দিয়েছিলেন পত্রপাঠ (এই ক্ষেত্রে ভাষণপাঠ!) বিদায়।৪ তদুপরি তাকে প্রতিমন্ত্রী পদে পদায়ন ও বহাল রেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাহের ঠাকুরের উচ্চাশা প্রসঙ্গে এ এল খতিব লিখেছেন, ‘সবার ধারণা ছিল ঠাকুর মুজিবের খুব কাছের লােক ছিলেন। যখন মুজিব লাহােরে ইসলামিক সম্মেলনে যােগ দিতে যান তখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল হােসেন এবং ঠাকুরকে সাথে নিয়ে যান। কিন্তু মুজিব তার বন্ধুদের বলেছিলেন ঠাকুর তার নিজের সম্পর্কে মিথ্যা উচ্চধারণা পােষণ

পৃষ্ঠা: ১১২
করেন। যখন ১৯৭৫ সালের ২৬ জানুয়ারি মন্ত্রীসভা পুনর্গঠন করেন তখন তিনি কুরবান আলী নামে একজন পুরােনাে আওয়ামী লীগ নেতাকে তথ্যমন্ত্রীর পদে বহাল করেন। পদোন্নতির আশায় থাকা ঠাকুর আবিষ্কার করেন যে তার গুরুত্ব অনেকটা কমে গেছে এবং এতে তিনি ক্ষুব্ধ হন। তার এক বন্ধু এতটাই হতাশ হন যে তিনি মন্তব্য করেন, ২৫ জানুয়ারি যে বিপ্লব শুরু হয় তা ২৬ জানুয়ারিতেই শেষ হয়ে যায়।৫ সেসময় তাহের ঠাকুর প্রতিমন্ত্রী পদে বহাল থেকেও পরিতুষ্ট হতে পারেননি। হীনউচ্চাকাঙ্খ পরবর্তী সময়ে তাকে প্রতিশােধপরায়ন করেছে। তিনি কৃতজ্ঞ হতে পারেননি। হয়েছেন কৃতঘ্ন। সংকীর্ণ স্বার্থ চরিতার্থ করতে ব্যর্থ হয়ে, হয়েছেন বিশ্বাসঘাতক। বেছে নিয়েছেন বেইমানির পথ। অতঃপর বেইমানি করেও সে তার অভীষ্ঠে পৌছতে পারেনি। ধড়িবাজ মােশতাক তাকে পূর্ণ মন্ত্রির পদে পদায়িত করেননি।
বঙ্গবন্ধুবিরােধী ষড়যন্ত্রের প্রতিটি পর্যায়ে সক্রিয় থাকলেও তাহের উদ্দিন ঠাকুর পরবর্তী সময়ে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের জন্য অনেক মনগড়া কথার অবতারণা করেন। বিশেষত বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার অভিযুক্ত আসামী হিসেবে আদালতে প্রদত্ত বক্তব্যর মাধ্যমে বােঝাতে চান যে, এ বিষয়ে তিনি কিছুই জানতেন না। আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে তিনি ১৯৭৪ সালে বন্যাজনিত কারণে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিপর্যয়, কৃত্রিম খাদ্য সংকট, শাসনতন্ত্র সংশােধনপূর্বক একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন এবং তৎপ্রেক্ষাপটে চাকরিচ্যুত কয়েকজন সামরিক অফিসারের অসন্তুষ্টির কথা ব্যক্ত করত; ষড়যন্ত্র ও বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে আদালতকে জানান, …১৯৭৫ সালের মে বা জুনের প্রথম দিকে ঢাকার গাজীপুর সালনা হাইস্কুলে ঢাকা বিভাগীয় স্বনির্ভর সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। মােশতাক সাহেব তাদের সংবাদমন্ত্রী সামসুল হক সাহেবের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। আমিও সেখানে উপস্থিত ছিলাম। সালনাতে মােশতাক সাহেব সেনা অফিসারদের জিজ্ঞাসা করেন, ‘তােমাদের আন্দোলনের অবস্থা কী?’ জবাবে তারা জানায় যে, ‘বস সবকিছুর ব্যবস্থা নিচ্ছেন। আমরা তার প্রতিনিধি।’ ১৯৭৫ সালের জুনে দাউদকান্দির মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে সেনা অফিসারদের মধ্যে মেজর রশীদ, মেজর বজলুল হুদা, মেজর শাহরিয়ার, মেজর ফারুক যােগদান করেন। ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট সচিবালয়ে পৌছাই। খন্দকার মােশতাক বলেন, এ সপ্তাহে ব্রিগেডিয়ার জিয়া দুইবার এসেছিলেন। সে এবং তাহার লােকেরা তাড়াতাড়ি কিছু একটা করার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছেন। আমি জিজ্ঞাসা করায় খন্দকার মােশতাক জানায় যে, বলপূর্বক মত বদলাইতে চায়, প্রয়ােজনবােধে যেকোনাে কাজ করতে প্রস্তুত। খন্দকার মােশতাককে জিজ্ঞাসা করায় তিনি জানান যে, তিনি তার মতামত দিয়েছেন। কারণ এ ছাড়া অন্য

পৃষ্ঠা: ১১৩
আর কাজ কিছু নাই। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সকাল অনুমান ৬টার সময় খাদ্যমন্ত্রী টেলিফোনে আমার কাছে জানতে চান যে, গুলির আওয়াজ শুনেছি কী না, আমি না বলে জানাই। পরে আমাকে পুনরায় টেলিফোনে রেডিও শুনতে বলে। রেডিওতে শুনি মেজর ডালিমের ঘােষণা, ‘শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে। বুঝলাম, তাদের সিদ্ধান্ত মােতাবেক কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এরপর খন্দকার মােশতাক টেলিফোন করে আমাকে রেডিও স্টেশনে আসতে বলে। সাঁজোয়া বাহিনীর পাহারায় রেডিও স্টেশনে আসি। এ ধরনের এক দায়সারা বয়ান আদালত সমীপে পেশ করেছেন তাহের ঠাকুর। পরবর্তী সময়ে তাকে আদালত কর্তৃক নির্দোষ ঘােষণা না করা হলেও বেনিফিট অব ডাউটের বদৌলতে আরােপিত অভিযােগ হতে অব্যাহতি দেওয়া হয়। আদালতে নির্দোষ হিসেবে বয়ান দিলেও তিনি যে বিভিন্ন সময় সামারিক অফিসারদের ষড়যন্ত্রিক সভায় উপস্থিত থাকতেন সে বিষয়ে কিছুই বলেননি। অথচ বাস্তবতা হলাে সেসব সভায় তিনি ষড়যন্ত্রকারী রাজনৈতিক নেতাদের যােগ দিনে কখনও একাও যােগ দিতেন। এ বিষয়ে সুখরঞ্জন লিখেছেন, ‘ফার ইস্টার্ন ইকনােমিক রিভিউ’তে একটি প্রবন্ধে চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ হয়ে পড়ে। তাতে বলা হয়, উনিশ শ পঁচাত্তরের সাত আগস্ট প্রায় সাতচল্লিশজন সামরিক অফিসারের এক বৈঠক হয়। সেখানে একজন মাত্র অসামরিক ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন, তিনি তাহের উদ্দীন ঠাকুর। মেজর, ক্যাপ্টেন এবং লেফটেন্যান্ট পদের ওইসব অফিসারই মুজিব হত্যার ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত।৭
পরবর্তী সময়ে এ এল খতিব বঙ্গবন্ধুর হত্যার সাথে সম্পৃক্তদের প্রসঙ্গে আলােকপাতকালে তাহের উদ্দিন ঠাকুরের কথাও বলেছেন। ১৫ আগস্টের ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞের রাতে তাহের উদ্দিন ঠাকুরও খন্দকার মােশতাকের মতাে প্রবলভাবে উত্তেজিত ও অস্থির সময় পার করছিলেন। খতিবের ভাষ্য অনুযায়ী সে রাতে; যে কোনাে ফোনকল আসামাত্রই তিনি আঁতকে উঠছিলেন। নামায পরে তিনি নিজের স্নায়ু ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করছিলেন। রাতে গােসল করে তিনি প্রস্তুত হয়েছিলেন, যেন ঐ অসময়েই তার কোন একটি বৈঠকে যাওয়ার কথা রয়েছে। বাড়িতে আসা একজন অতিথি তার এহেন উত্তেজিত অবস্থা দেখে বেশ অবাক হন।৮ এছাড়া আগস্টের বিয়ােগান্তক ঘটনার পর মােশতাকের খাস মানুষ হিসেবে তার অপতৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতাে। এই বিশ্বাসঘাতক সেদিনকার নারকীয় হত্যাযজ্ঞের জন্য ন্যূনতম অনুতপ্ত হওয়ারও তাগিদ বােধ করেনি। অধিকন্তু প্রকাশ করেছিল উচ্ছ্বাসসুলভ চপলতা। সেদিনের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে তাহেরের অবস্থান প্রসঙ্গে এ এল খতিব লিখেছেন, ‘মােশতাকে মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে তাহের উদ্দিন ঠাকুর এতটাই লজ্জা পাচ্ছিলেন যে নারীদের অনেকে তাকে ‘দুলা মিয়া’ বলছিলেন।’৯ এছাড়া মােশতাকের

পৃষ্ঠা: ১১৪
তথ্য প্রতিমন্ত্রী হিসেবে অবতীর্ণ হয়েছিল দালালের ভূমিকায়। হত্যাযজ্ঞ জায়েজ করার জন্য চালিয়েছে নানামাত্রিক অপপ্রচার। সে সময়; কুয়েতের দৈনিক আল রাই আল আমানকে তাহের উদ্দিন ঠাকুর বলেন, শেখ মুজিবের মৃত্যুর ফলে দেশ গৃহযুদ্ধ থেকে রক্ষা পেয়েছে।১০
শুধু সেসময়ে নয়, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় থেকেই ঠাকুর ছিলেন দেশ বিরােধী অপপ্রচারে পারদর্শি। স্বাধীনতার পরও তার সে প্রবণতা পতিত হয়নি। তথ্য প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকাকালে বৈদেশিক প্রচারণা জোরদার করার লক্ষ্যে তার উদ্যোগে খান্দানি পাকিস্তানি দালাল হিসেবে পরিচিত নাজিম উদ্দিন হাশিমকে যথাস্থানে নিয়ােগ দেওয়া হয়। হাশিম ছিলেন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের ‘প্রভু নয় বন্ধু’ গ্রন্থের মূল প্রণেতা। রাওয়ালপিন্ডির পাকিস্তান কাউন্সিলের সাবেক ডাইরেক্টর। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সংবাদ পরিবেশনার দায়িত্বে থাকলেন তথ্য প্রতিমন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুর এবং বৈদেশিক মন্ত্রণালয়; প্রচার বিভাগের দায়িত্বে থাকলেন আইউব-মােনায়েমের প্রিয়পাত্র নাজিম উদ্দিন হাশিম।…বিদেশে প্রচারিত হতে থাকল বাংলার বুভুক্ষু মানুষের জন্য প্রদত্ত সাহায্যের গম রেডক্রস প্রধান গাজী গােলাম মােস্তফার গরুর খামারে গাে খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। গাজী গােলাম মােস্তফার না ছিল গরু, না ছিল খামার। না ছিলেন তিনি খাদ্য ব্যবসায়ী। এ রকমের অপপ্রচার চলছিল।১১
প্রকাশ থাকে যে তাহের উদ্দিন ঠাকুরের মতাে একজন সুবিধাবাদী, বিশ্বাসঘাতক ও পাকিস্তানি মতাদর্শিক ভড়কে বঙ্গবন্ধু ঠিকই চিনেছিলেন। তাদের ষড়যন্ত্র সম্পর্কেও ছিলেন সম্যক অবগত, যে কারণে তাকে কখনও প্রতি থেকে পূর্ণ মন্ত্রী করেননি। হয়তােবা সময়মতাে এই বেইমানদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও গ্রহণ করতেন। এ বিষয়ে আবু সাইয়িদ লিখেছেন, একদিন রাত দশটার সময় আমরা গণভবন থেকে বেরিয়ে আসছি। হঠাৎ তাহের উদ্দিন ঠাকুর শেখ সাহেবের গাড়িতে উঠলেন। তারপর শেখ সাহেব অট্টহাসি দিলেন। মােশতাক ভাই ছিলেন, তােফায়েলও ছিল যদ্দুর মনে পড়ে। আমি মােশতাক ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম তাহের ঠাকুরকে বঙ্গবন্ধু গাড়িতে নিলেন কেন? গাড়িতে উঠিয়ে আবার অট্টহাসিই বা কেন দিলেন? মােশতাক ভাই বললেন: তুমি কেমন করে বলবা। মনে হচ্ছে তাহের ঠাকুরকে মন্ত্রীপদ থেকে ড্রপ করবে।…..শেখ সাহেব খুব ভােরে উঠতেন। আমি গেলে আমাকে সঙ্গে নিয়ে নাশতা করলেন। তার পর গণভবনে পৌছে জিজ্ঞাসা করলাম, কাল তাে গাড়িতে তাহের ঠাকুরকে সঙ্গে নিলেন মােশতাক ভাই বললেন, তাকে নাকি আপনি ড্রপ করবেন। একথায় রাগের কি হল বুঝলাম না। উনি বললেন, সবগুলাকে দেখে নেবাে। একটাকেও ছাড়ব না।’১২ পরিতাপের বিষয় বঙ্গবন্ধু

পৃষ্ঠা: ১১৫
আর ওদেরকে দেখে নেবার সময় পাননি। সে ধরনের সুযােগ ঘাতকরা তাঁকে তারা দেয়নি।
চুয়াত্তর-পঁচাত্তর সাল জুড়েই একটি পরিবর্তন বিষয়ক গুজব ছড়িয়ে দেওয়া হয় সর্বত্র। অনেক সময় অনেক ষড়যন্ত্রকারী প্রকাশ্যেই এবিষয়ে মতামত ব্যক্ত করতেন। মহামান্য প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়ােজিত বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারাও এসব কথা কখনও আমলে নেয়নি, গুজব হিসেবে উড়িয়ে দিয়েছে। বলাবাহুল্য যারা বিষয়টি আমলের নেওয়ার দায়িত্বে ছিলেন, তাদেরই অনেকে যুক্ত ছিলেন সেই ষড়যন্ত্রের সাথে। তদুপরি অনেক সাধারণ মানুষশুভাকাঙ্ক্ষীকেই সে সময় বিষয়টি উদ্বিগ্ন ও বিচলিত করেছিল। তাদেরই একজন ছিলেন বিমানের পাইলট-বীর মুক্তিযােদ্ধা আলমগীর সাত্তার (বীর প্রতীক)। নিয়তির কি নির্মম পরিহাস! বিষয়টি তিনি আলােচনা করেছিলেন ষড়যন্ত্রের অন্যতম কুশীলব তাহের উদ্দিন ঠাকুরের মতাে একজন বিশ্বাসঘাতকের সাথে। পরবর্তী সময়ে তিনি এ বিষয়ে লিখেছেন, ‘চুয়াত্তরপঁচাত্তর সালে শাহাব ও আমি মানুষ চেনার ব্যাপারে খুব অনভিজ্ঞ ছিলাম। ছিলাম যথেষ্ট আনাড়ি। আওয়ামী লীগের যে কোনাে নেতার সঙ্গে দেখা হলেই বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তার কথা, সম্ভাব্য ষড়যন্ত্রের কথা আলােচনা করতাম। পঁচাত্তর সালের শুরুতে একদিন আকরাম, শাহাব ও আমি তাহের উদ্দিন ঠাকুরের সঙ্গে দেখা করতে তার বাসায় গেলাম। আমরা তাকে বঙ্গবন্ধুর খুব ঘনিষ্ঠ এবং বিশ্বস্তজন বলেই জানতাম। তাই তার কাছে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে সম্ভাব্য ষড়যন্ত্রের কথা বললাম। চরম পরিহাসের বিষয়, তাহের উদ্দিন ঠাকুর নিজেই তখন বঙ্গবন্ধুর হত্যার ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে খন্দকার মােশতাকের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন। প্রায় অখ্যাত যে লােকটিকে বঙ্গবন্ধু এত আপন মনে করে মন্ত্রী বানিয়েছিলেন, তিনি কি কারণে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার জন্য ষড়যন্ত্রকারীদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন? বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে তিনি কি লাভ করতে চেয়েছিলেন? এসব প্রশ্নের উত্তর কে দিতে পারবে?১৩ তাহের ঠাকুরের মতাে অখ্যাত লােকগুলােকে বঙ্গবন্ধু মন্ত্রিত্ব পদে আসীন করলেও; এরা পরিতুষ্ট হয়নি, হয়েছে আরও লােভাৰ্ত, অধিকন্তু অলীক অভিলাষ পূরণের জন্য একজন হন্তারক হতেও এরা পিছ পা হননি। তাদের লালসার সাথে যুক্ত হয়েছিল তথাকথিত মতাদর্শিক দিকটি। এই পাকিস্তানপন্থিরা কখনও পাকিস্তানের ভাঙন তথা বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে মেনে নিতে পারেনি। পদোন্নতিগত বঞ্চনার দিকটি; বিষয়টিকে শুধু শানিত করেছিল। এ বিষয়ক মূল্যায়নে খতিব লিখেছেন, যা-ই হােক না কেন, এটা ভাবলে ভুল হবে যে ওবায়দুর রহমান ও তাহের উদ্দীন ঠাকুর তাদের আশা অনুসারে পদোন্নতি পাননি বলেই মুজিবের

পৃষ্ঠা: ১১৬
বিপক্ষে চলে গিয়েছিলেন। ২৬ জানুয়ারি ১৯৭৫-এ মন্ত্রীসভার রদবদলের বেশ কয়েক মাস আগে থেকেই তারা মুজিব হত্যার চক্রান্তে জড়িয়ে পড়েছিলেন।১৪
প্রকাশ থাকে যে তাহের উদ্দিন ঠাকুরের নেতিবাচক কার্যকলাপ সম্পর্কে সতর্ক করা হলেও বঙ্গবন্ধুর মতাে বিশাল ব্যক্তিত্বশালী নেতা কখনও তার মতাে একজন ঠুনকো ব্যক্তির বিষয়ে কর্ণপাতকরণ আবশ্যক মনে করেননি। এ বিষয়ে এ এল খতিব তাঁর ‘হু কিল্ড মুজিব’ গ্রন্থে লিখেছেন, একজন বন্ধু। মুজিবকে তাহের উদ্দিন ঠাকুর সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। মুজিব তখন জিজ্ঞেস করেছিলেন, সে কার প্রতি অনুগত?’ সে মােশতাকের অনুগত’, বন্ধুটি জবাব দিয়েছিলেন। মুজিবের জবাব ছিল; আর মােশতাক আমার অনুগত।’ এ বিষয়ে কথা এখানেই শেষ হয়েছিল।১৫ তাহের উদ্দিন ঠাকুর শুধু খন্দকার মােশতাকেরই অনুগত ছিলেন না, বাহ্যিকভাবে বঙ্গবন্ধুরও অনুগত ছিলেন, তার এহেন আনুগত্য মাঝে মাঝে মাত্রা ছাড়িয়ে যেত। বঙ্গবন্ধুর পায়ে পাদুকা পরিয়ে দিতেও তিনি দ্বিধা করতেন না। এ বিষয়ে প্রণব চন্দ্র রায় লিখেছেন, …১৫ আগস্টের কয়েকদিন আগে বঙ্গবন্ধু কয়েকজন মন্ত্রী, এমপি ও দলীয় নেতাদের নিয়ে গণভবনের একটি কক্ষে অনানুষ্ঠানিক আলাপআলােচনা শেষ করে অন্য কক্ষে যান। ওই বৈঠকে উপস্থিত তাহের উদ্দিন ঠাকুর বঙ্গবন্ধুর পায়ের স্যান্ডেলদ্বয় তার চরণযুগলে ঢুকিয়ে দিতে সাহায্য করেছিলেন।১৬
সেসময় এ ধরনের এক প্রতিমন্ত্রী পর্যায়ের তােষামদকারী পাতি-নেতার অপতৎপরতা আমলে নেওয়া আবশ্যক বলে মনে করেননি বঙ্গবন্ধু। বলাবাহুল্য তাহেরের মতাে ক্ষুদ্র অবস্থানের এ ধরনের অনুসারীদের তিনি সবসময় ভালােবেসে ‘তুই’ বলে সম্বােধন করতেন। এভাবে ‘তুই’ সম্বােধিত হয়ে এরা নিজেদের ধন্য মনে করত। এই ‘তুই’রা যে এতটা ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে বা এতটা দুঃসাহস দেখাতে পারে, তা ছিল বঙ্গবন্ধুর মতাে নেতার কাছে কল্পনাতীত। কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে এ ধরনের ছিচকে লােকেরাই একসময় সংকীর্ণ স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য ভয়াল রূপ ধারণ করতে ভয় করেননি।

তথ্যনির্দেশ:
১. জামিল, কর্নেল শাফায়াত (অব:)। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্যআগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর। ২০১৪। ঢাকা। সাহিত্য প্রকাশ। পৃষ্ঠা: ৩৭।
২. দাশগুপ্ত, সুখরঞ্জন। মুজিব হত্যার ষড়যন্ত্র। ২০১৯। ঢাকা। ভাষাচিত্র। পৃষ্ঠা: ২৬
৩. সাইয়িদ, অধ্যাপক আবু। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড ফ্যাক্টস এন্ড ডকুমেন্টস্। ১৯৯৬ (পুনর্মুদ্রণ)। ঢাকা। জ্ঞানকোষ। পৃষ্ঠা: ৭৯।
৪. চৌধুরী, ফারুক। জীবনের বালুকাবেলায়। ২০১৮ (সপ্তম মুদ্রণ)। ঢাকা। প্রথমা প্রকাশন। পৃষ্ঠা: ২৬৫
৫. খতিব, এ এল। হু কিল্ড মুজিব। ২০১৬। ঢাকা। আবিষ্কার। পৃষ্ঠা: ৬৬
৬. আসাদুজ্জামান। বস সবকিছুর ব্যবস্থা নিচ্ছেন: বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার জবানবন্দি থেকে। ঢাকা। প্রথম আলাে। ১৫ আগস্ট ২০১৮
৭. দাশগুপ্ত। পৃষ্ঠা: ৬৬
৮. খতিব। পৃষ্ঠা: ২৩
৯. প্রাগুক্ত। পৃষ্ঠা: ৩৫
১০. প্রাগুক্ত। পৃষ্ঠা: ৫৭।
১১. সাইয়িদ। পৃষ্ঠা: ৭৯
১২. প্রাগুক্ত। পৃষ্ঠা: ১৫৮
১৩. সাত্তার, আলমগীর। বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ এবং আমার জীবন। ২০১৮। ঢাকা। সাহিত্য | প্রকাশ। পৃষ্ঠা: ২৩৭
১৪. খতিব। পৃষ্ঠা: ৬৬।
১৫. প্রাগুক্ত। পৃষ্ঠা: ১০০
১৬. চন্দ্র রায়, প্রণব। ১৫ আগস্ট বেতারে বঙ্গবন্ধু হত্যার ঘােষণা যেভাবে দিয়েছিল কিলার গ্রুপ। দৈনিক ভােরের কাগজ। ঢাকা। ২৮ আগস্ট ২০১৫

প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরী

খন্দকার মােশতাক আহমদের অবৈধ মন্ত্রিসভায় শিল্প মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন নুরুল ইসলাম চৌধুরী। এর পূর্বে বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় ছিলেন প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে। ছাত্রজীবন থেকেই নুরুল ইসলাম চৌধুরীর রাজনীতিতে হাতেখড়ি। তিনি ১৯২৫ সালে চট্টগ্রাম জেলাস্থ পটিয়া উপজেলার গােবিন্দরখীল গ্রামের এক খান্দানি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ছাত্রজীবনের ১৯৪৬-৪৭ সালে তৎকালীন বঙ্গীয় মুসলিম ছাত্রলীগের চট্টগ্রাম শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের ধর্মঘটের সাথে সম্পৃক্ততার কারণে সলিমুল্লাহ মুসলিম হল হতে বহিস্কৃত হন। পরবর্তী সময়ে-১৯৫১ সালে আওয়ামী লীগে যােগদান করেন। ১৯৫২ সালে মহান ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫২ হতে ৫৪ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম জেলা যুবলীগের সভাপতি, ১৯৫৩ হতে ৫৮ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এবং ১৯৫৫ হতে ৫৮ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম সদর মহকুমা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এছাড়া চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতির দায়িত্বেও ছিলেন। কর্মজীবনের প্রথম দিকে অধ্যাপনার পেশায় যুক্ত ছিলেন। ১৯৫২ হতে ৭১ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রামের বিভিন্ন কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। সে সুবাদে তিনি অধ্যাপক হিসেবে পরিচিত। পরবর্তী সময়ে বেছে নেন আইনজীবীর পেশা। অতঃপর সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হিসেবে প্রাকটিস শুরু করেন, মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত সে পেশায় যুক্ত ছিলেন।

পৃষ্ঠা: ১১৯
আইয়ুববিরােধী আন্দোলন, ছয়দফার আন্দোলন, উনসত্তুরের গণঅভ্যুত্থান ও সত্ত্বরের নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেন। প্রিয়ভাজন হিসেবে সেসময় বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গীও হতেন। দৈনিক ইত্তেফাক’ এর ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬ সালে প্রকাশিত ‘শেখ মুজিবের চট্টগ্রাম ও নােয়াখালী সফর’ শিরােনাম সম্বলিত প্রতিবেদনের সুবাদে জানা যায়; বঙ্গবন্ধুর তিনদিনব্যাপি নােয়াখালী ও চট্টগ্রাম জেলা সফরের অন্যতম সঙ্গী ছিলেন নুরুল ইসলাম চৌধুরী। প্রতিবেদনটিতে লেখা হয়, ‘…শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে থাকিবেন। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জনাব তাজউদ্দীন আহমদ, প্রচার সম্পাদক হাফেজ হাবিবুর রহমান, কোষাধ্যক্ষ জনাব নূরুল ইসলাম চৌধুরী, প্রাক্তন চীফ হুইপ খােন্দকার মােশতাক আহমদ, জাতীয় পরিষদ সদস্য অধ্যাপক ইউসুফ আলী ও জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরী। নেতৃবৃন্দ ২৫শে ফেব্রুয়ারী সকাল ৮টায় ‘উল্কাযােগে চট্টগ্রাম রওয়ানা হইয়া দুপুর ২টায় চট্টগ্রাম পৌঁছিবেন। শেখ মুজিবর রহমান ঐদিন বিকাল ৩টায় চট্টগ্রামে এক জনসভায় বক্তৃতাদান করিবেন এবং ২৭শে ফেব্রুয়ারী সকালে জেলা আওয়ামী লীগ কাউন্সিল সভায় যােগদান করিবেন।১ এভাবে বঙ্গবন্ধুর সাথে ছয়দফার প্রচারণা-আওয়ামী লীগের সাথে সম্পৃক্ততার কারণে বিভিন্নসময় তাকে কারারুদ্ধ হতে হয়। তার কারাবাসের বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর লিখিত কারাগারের দিনলিপিতেও বেশ কিছু বিবরণ দেওয়া আছে। এ বিষয়ক বিবরণের কিছু অংশ এখানে তুলে ধরা হল; ১০ই জুন, ১৯৬৬ শুক্রবার। …নুরুল ইসলাম চৌধুরী, খােন্দকার মােশতাক আহমদ, জহুর আহমদ চৌধুরী, মুজিবুর রহমান (রাজশাহী) এবং তাজউদ্দীনকে পূর্বেই ঢাকা জেল থেকে বিভিন্ন জেলে আলাদা করে রেখেছে। আমাদের দলের আর যাদের গ্রেপ্তার করে এনেছে তাদের সবচেয়ে খারাপ সেলে রাখা হয়েছে। এদের খাবার কষ্টও দিচ্ছে। মাত্র দেড় টাকার মধ্যে খেতে হবে।২ ২০ শে জুলাই ১৯৬৬। বুধবার। …গতকাল থেকে আমার, তাজউদ্দীনের, খন্দকার মােশতাকের ও নুরুল ইসলাম চৌধুরীর রীট আবেদনের শুনানি শুরু হয়েছে। জানি না কি হবে। তবে আমাদের ছাড়বে না সরকার, তা বুঝতে পারি। দেশরক্ষা আইন থেকে মুক্তি পেলে, অন্য কোনাে আইনে জেলে বন্দি করতে পারে। আর আমার কথা আলাদা। আটটা মামলা চলছে, আরও কয়েকটা বন্দোবস্ত করে রেখে দিয়েছে। দরকার হলে চালু করে দিবে।৩ ২১ শে জুলাই ১৯৬৬। বৃহস্পতিবার।…বিচারপতি বি এ সিদ্দিকীর নেতৃত্বে গঠিত হাইকোর্টের এক বিশেষ বেঞ্চ সমীপে বিচারাধীন জনাব নুরুল ইসলাম চৌধুরী, তাজউদ্দীন আহমদ, খন্দকার মােশতাক আহমদ ও আমার হেবিয়াস করপাস মামলার শুনানি গতকাল শেষ হয়ে গেছে। বিচারপতি উপরােক্ত মামলাগুলির রায় দান

পৃষ্ঠা: ১২০
স্থগিত রেখেছেন। আব্দুস সালাম খান সাহেব ও অন্যান্য এডভােকেটগণ মামলা পরিচালনা করেন।৪ ১১ই এপ্রিল-১৩ই এপ্রিল ১৯৬৭।…নুরুল ইসলাম চৌধুরী, মােস্তফা, কামাল এসেছিল। কামাল পরীক্ষা ভালই দিয়েছে। এই খবরটার জন্য ব্যস্ত ছিলাম। আব্বা একটু ভালর দিকে চলেছেন। কিছু সময় কথাবার্তা বলে আমার পুরানা জায়গায় ফিরে এলাম।৫ ১৪ই এপ্রিল১৫ই এপ্রিল ১৯৬৭।…২৪ শে বৈশাখ তাজউদ্দীন আহমদ, খােন্দকার মােশতাক আহমদ, নুরুল ইসলাম চৌধুরী, জহুর আহমেদ চৌধুরী, মুজিবুর রহমান (রাজশাহী) ও আমাকে ডিপিআর হিসাবে গ্রেপ্তার করে ঢাকা জেলে বন্দি করে এবং চট্টগ্রামে জনাব এম এ আজিজকে গ্রেপ্তার করে চট্টগ্রামে বন্দি করে।৬ কারাগারে লিখিত বঙ্গবন্ধুর দিনলিপিতে লিপিবদ্ধ এ সমস্ত বিবরণীর মাধ্যমে নিঃসন্দেহে একথা প্রতীয়মান হয় যে নুরুল ইসলাম চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর অনেক কাছের অনুসারীদের একজন ছিলেন। তাকে তিনি খুব পছন্দও করতেন। যে কারণে তার প্রসঙ্গে বিভিন্ন পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু আলােকপাত করেছেন। তদুপরি নুরুল ইসলাম চৌধুরী ছয়দফার প্রশ্নে পুরােপুরি বিশ্বস্ত ছিলেন না। যে কারণে কারামুক্তির পর ছয়দফার বিকল্প হিসেবে উত্থাপিত ‘পাকিস্তান ডেমােক্রেটিক মুভমেন্ট’ (পিডিএম) এর আটদফার দিকে তিনি ঝুঁকে পড়েছিলেন। এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘৩রা মে-২৩ মে ১৯৬৭। ..ওয়ার্কিং কমিটির সভা শেষ করেই জনাব জহিরুদ্দিন, মশিয়ুর রহমান, মুজিবুর রহমান (রাজশাহী), আব্দুর রশিদ ও নুরুল ইসলাম চৌধুরী পিডিএম এ যােগদান করার জন্য লাহাের রওয়ানা হয়ে গিয়েছেন। তারাও সভায় যােগদান করেছে। বুঝতে আর বাকি রইল না এরা পিডিএম করতেই চায়। ৬ দফার আর প্রয়ােজন নাই তাদের কাছে।৭ প্রকাশ থাকে যে বঙ্গবন্ধু কারাগারে অবস্থানকালে একটি কায়েমী স্বার্থবাদী গােষ্ঠী ছয়দফার বিকল্প হিসেবে আটদফা দাঁড় করাতে তৎপর হয়ে ওঠেন। তাদের মতলব ছিল ছয়দফাভিত্তিক বাঙালিদের গণজাগরণের উত্থানকে নস্যাকরণ। এর সাথে এক সময় আওয়ামী লীগের ১৪ জন নেতা যুক্ত হন।
এ বিষয়ে ১৯ আগস্ট, ১৯৬৭ সালে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করা হয়, পিডিএম-এ অংশগ্রহণ না করার প্রস্তাব অনুমােদিত হয় এবং এ ধরনের বিভেদপন্থিদের দল থেকে বরখাস্ত করা হয়। ওই কাউন্সিল অধিবেশন প্রসঙ্গে ১৯৬৭ সাল; ২০ আগস্টে প্রকাশিত ‘সংবাদ’এর প্রতিবেদনে লেখা হয়, আওয়ামী লীগ কাউন্সিল অধিবেশনে ‘বিভেদপন্থী ১৪ নেতা সাসপেন্ড-পিডিএমে যােগদান না করার সিদ্ধান্তঃ ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের পক্ষে প্রস্তাব পাশ (নিজস্ব বার্তা পরিবেশক)। গতকাল (শনিবার) হােটেল ইডেনে অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের বিশেষ

পৃষ্ঠা: ১২১
কাউন্সিল অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে পি, ডি, এম-এ যােগদানের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত গৃহীত হইয়াছে। অধিবেশনে ৬-দফা কর্মসূচীর প্রতি নিষ্ঠার পুনরুক্তি ও পি, ডি, এম-এর ৮-দফা কর্মসূচীকে ৬-দফার মর্ম-বিরােধী আখ্যায়িত করা হয়। পি, ডি, এম প্রশ্নে আওয়ামী লীগ সংগঠনের মধ্যে ফাটল ধরাইবার অভিযােগে কাউন্সিল সভা ১৪ জন পি, ডি, এম পন্থী নেতাকে সাসপেন্ড করিয়াছে।
তাহাদিগকে ১৫ দিনের মধ্যে কারণ দর্শানাের জন্য নােটিশ প্রদানের ক্ষমতা সম্পাদককে প্রদান করা হইয়াছে এবং তাহাদের সম্পর্কে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের চূড়ান্ত ক্ষমতা একটি ৩ সদস্য বিশিষ্ট সাব-কমিটির উপর ন্যস্ত করা হইয়াছে। দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, সম্পাদিকা ও চট্টগ্রামের জনাব এম, এ, আজিজ এই সাব-কমিটির সদস্য। যাঁহাদিগকে সাসপেন্ড করা হইয়াছে তাঁহাদের নাম নিম্নে প্রদত্ত হইল:৮ এই বরখাস্তকৃত ১৪ জনের একজন ছিলেন নুরুল ইসলাম চৌধুরী। প্রকাশ থাকে যে আওয়ামী লীগের কিছু নেতা আটদফার প্রতি আকৃষ্ট হলেও, তারা ছয়দফার বিকল্প হিসেবে আটদফাকে জনগণের দরবারে দাঁড় করাতে পারেননি। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ছয়দফা ব্যতিরেকে অন্য কোনাে দফা বা দাবির দিকে সেসময় ফিরেও তাকাননি। বঙ্গবন্ধুর কারামুক্তির পর আটদফার আন্দোলন আরও বিপর্যস্ত হয়ে পথিমধ্যেই মুখ থুবড়ে পড়ে। দলছুটরাও এক পর্যায়ে মার্জনা পেয়ে প্রত্যাবর্তন করেন মূল দলে। সে সুবাদে এক সময়ের দলছুট নুরুল ইসলাম চৌধুরীও দলে ফিরে আসেন এবং পরবর্তী পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুর বদান্যতায় সত্তুরের জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযােগ লাভ করে সাংবিধানিক পরিষদের সদস্য পদে বিজয়ী হন।
অতঃপর ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে সংগঠক হিসেবে নুরুল ইসলাম চৌধুরী পূর্বাঞ্চলীয় ১ নম্বর জোনাল কাউন্সিলের চেয়ারম্যান এবং যুবশিবির। পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীনতার অনতিকাল পর বাংলাদেশের সংবিধান প্রণেতাদের অন্যতম সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে চট্টগ্রাম-১১ আসন হতে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। অতঃপর ১৯৭৩ হতে ১৯৭৫ সাল; বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পূর্বদিন পর্যন্ত প্রথমে শিল্প ও পরবর্তী সময়ে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে নিয়ােজিত ছিলেন। নবগঠিত বাকশালে যােগদান করেছিলেন তিনি। ১৯৭৫ সালে, জুনের ৬ তারিখে গঠিত ১১৫ সদস্যবিশিষ্ট বাকশাল কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন অধ্যাপক নূরুল ইসলাম চৌধুরী। ১৯৯৫ সালে, অক্টোবরের ৩ তারিখে অধ্যাপক খ্যাত রাজনীতিক নূরুল ইসলাম চৌধুরী মৃত্যুবরণ করেন।

পৃষ্ঠা: ১২২
অত্যন্ত বিশ্বাসভাজন ও আস্থাশীল মনে করেই নুরুল ইসলাম চৌধুরীকে বঙ্গবন্ধু প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মতাে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে নিয়ােগ দিয়েছিলেন। সঙ্গত কারণে অন্যান্য মন্ত্রীর তুলনায় তার সাথেই বঙ্গবন্ধুর আলােচনা-সাক্ষাৎ হতাে অনেক বেশি। ১৯৭৫ সালের ১ আগস্ট হতে ১৪ আগস্ট পর্যন্ত নিম্নোক্ত তারিখ ও সময়ে তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন; ১ আগস্ট শুক্রবার দুপুর ১টায়, ৭ আগস্ট বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে দশটায়, ৯ আগস্ট শনিবার সকাল ১১টায় এবং ১৪ আগস্ট সকাল ১১ টায়।৯ প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী হিসেবে প্রেসিডেন্টের প্রদত্ত সরকারি সূচি মােতাবেক উপরােক্ত দিন ও সময়ে তার সাথে বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎ হয়েছিল। এ ছাড়াও বিভিন্ন অনুষ্ঠান-সভাতেও সেসময় তার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাত হয়। প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী হিসেবে বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে তিনি পরিপূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছিলেন। অধিকন্তু এহেন মর্মান্তিক হত্যাযজ্ঞের পরও খুনি মােশতাকের মন্ত্রিসভায় যােগদান করতে অনুতাপ বােধ করেননি। অন্যান্য অনেক আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর মতাে প্রতিবাদী হননি, বরণ করেননি গ্রেফতারী বা বন্দুকের গুলি। ১৫ আগস্ট রাতেই তিনি বঙ্গবন্ধুর রক্ত মাড়িয়ে মন্ত্রিত্বের শপথ গ্রহণ করেছিলেন।
তার এহেন নেতিবাচক ভূমিকা প্রসঙ্গে প্রাক্তন মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মােশাররফ হােসেন সে সময়কার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন দৈনিক কালের কণ্ঠ’র এনায়েত হােসেন মিঠুকে দেওয়া এক সক্ষাতকারে। জানিয়েছেন; ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক হত্যাযজ্ঞের তৃতীয় দিনে তিনি জনাব কায়সারসহ নুরুল ইসলাম চৌধুরীর বাসভবনে যান এবং এ বিষয়ে তার সঙ্গে কথা বলেন। এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘আমি সেখানে চোখের পানি সামলে রাখতে পারিনি। প্রায় একঘণ্টা কেঁদেছি। কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতে শুয়ে পড়েছি। তাঁকে বলেছিলাম, আপনি কী করে বঙ্গবন্ধুর রক্তের সাথে বেইমানি করতে পারলেন? কী করে আপনি আজকে ঘাতকদের সাথে হাত মিলিয়ে শপথ নিলেন। আপনি তাে এটা করতে পারেন না!’-এসব বলার পর নুরুল ইসলাম চৌধুরী আমাদের বললেন, তােমরা এ রকম করলে আমার বিপদ হবে। তােমরা এখান থেকে চলে যাও। আমাদেরকে তিনি বাসা থেকে বিদায় করে দিলেন।১০ পরবর্তী সময়ে খন্দকার মােশতাকের পতনের নয় মাস পর ১৯৭৬ সালের ২৫ আগস্ট; মিজানুর রহমান চৌধুরীর ধানমন্ডির বাসভবনে আহুত আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় অন্য অনেকের মতাে উপস্থিতির মাধ্যমে তিনি আওয়ামী লীগে প্রত্যাবর্তন করেন। পরের বছর১৯৭৭ সালে, এপ্রিলের ৩ ও ৪ তারিখে ঢাকার হােটেল ইডেনে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত অনুসারে ১৫ এপ্রিল সৈয়দা

পৃষ্ঠা: ১২৩
জোহরা তাজউদ্দীন কর্তৃক কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক কমিটির ৪৪ সদস্যের নাম ঘােষিত হলে; উক্ত কমিটিতে সদস্য হিসেবে তাকেও মনােনীত করা হয়। এর পর তাকে আর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কোনাে কমিটিতে রাখা হয়নি।

তথ্যউৎস:
১. সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু: তৃতীয় খণ্ড-ষাটের দশক-দ্বিতীয় পর্ব। প্রধান সম্পাদক: মাে. শাহ আলমগীর। ২০১৭। ঢাকা। বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট। পৃষ্ঠা: ২২১
২. মুজিবুর রহমান, শেখ। কারাগারের রােজনামচা। ২০১৮ (সপ্তম মুদ্রণ)। ঢাকা। বাংলা একাডেমি। পৃষ্ঠা: ৭৮
৩. প্রাগুক্ত। পৃষ্ঠা: ১৭১-১৭২
৪. প্রাগুক্ত। পৃষ্ঠা: ১৭৩-১৭৪
৫. প্রাগুক্ত। পৃষ্ঠা: ২২০
৬. প্রাগুক্ত। পৃষ্ঠা: ২২৪
৭. প্রাগুক্ত। পৃষ্ঠা: ২৪২
৮. সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু। পৃষ্ঠা: ৭৮৩।
৯. ওয়াজেদ, জাফর। শেষের সেদিনে মুখােমুখি যারা। ঢাকা। দৈনিক জনকণ্ঠ। ৮ আগস্ট, ২০১৫
১০. মিঠু, এনায়েত হােসেন। ইঞ্জিনিয়ার মােশাররফ মােশাররফের স্মৃতিচারণ। কালের কণ্ঠ। ঢাকা। ৯ আগস্ট, ২০১৭

সহায়ক তথ্যউৎস
১. বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম। প্রতিমন্ত্রী নুরুল ইসলাম চৌধুরীর মৃত্যুবার্ষিকী। ১ অক্টোবর, ২০১৬

প্রতিমন্ত্রী মােহাম্মদ নূরুল ইসলাম মঞ্জুর

খন্দকার মােশতাক আহমদে অবৈধ মন্ত্রিসভার প্রতিমন্ত্রী মাে. নূরুল ইসলাম মঞ্জুর ছিলেন বঙ্গবন্ধুবিরােধী ষড়যন্ত্র বলয়ের অন্যতম একজন সহযােগী। রাজনৈতিকভাবে তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের বরিশাল এলাকার আঞ্চলিক নেতা। বাড়ি পিরােজপুর জেলাস্থ ভান্ডারিয়া উপজেলার নদমুলা ইউনিয়নের হেতালিয়া গ্রামে। বাবা হেমায়েত উদ্দিন আহমেদ ছিলেন স্যানিটারি ইন্সপেক্টর, তিনি বরিশালে কর্মরত থাকাকালে সেখানেই ১৯৩৭ সালের ১৬ নভেম্বরে মঞ্জুর জন্মগ্রহণ করেন। ছাত্রজীবন থেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন মঞ্জুর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে ছিলেন ইকবাল হলের (এখনকার সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ছাত্র নেতা।
১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নূরুল ইসলাম মঞ্জুর তৎকালীন বাকেরগঞ্জ-৮ (বর্তমান পিরােজপুর-২ আসন) আসন হতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনােনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরবর্তী সময়ে তাকে বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে নিযুক্তি দেওয়া হলেও অনতিকাল পরেই দুর্নীতির কারণে অপসারণ করা হয়। একইভাবে বাকশালের সদস্য পদ প্রদান এবং ১৯৭৫ সালে, জুনের ৬ তারিখে গঠিত ১১৫ সদস্যবিশিষ্ট বাকশাল কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির অন্যতম সদস্য হিসেবে মনােনীত করা হলেও পরবর্তী পর্যায়ে তা বাতিল করা হয়। দুর্নীতির অভিযােগে অভিযুক্ত মঞ্জুরকে মন্ত্রিসভা হতে বিদায় করার পর তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে মােশতাকচক্রের সাথে সামিল হন। ৭৫ এর নির্মম হত্যাযজ্ঞের পর মঞ্জুরকে খন্দকার মােশতাকের অবৈধ মন্ত্রিসভায় পূর্বোক্ত মন্ত্রণালয় তথা রেল ও যােগাযােগ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী পদে পদায়ন করা হয়। ১৫ আগস্ট রাতেই তিনি প্রতিমন্ত্রীর শপথ গ্রহণ করেন। পরবর্তী সময়ে সামরিক শাসক-প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের উদ্যোগে গঠিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলে (বিএনপি) যােগদান করেন এবং মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত বিএনপি-র রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। মাে. নূরুল ইসলাম মঞ্জুর ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের মনােনয়নে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং পিরােজপুর-২ আসন হতে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। অতঃপর ২০০১ সালে অষ্টম ও ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয়

পৃষ্ঠা: ১২৫
সংসদ নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে একই আসন হতে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হয়ে পরাজিত হন। ২৬ নভেম্বর ২০২০ সালে মাে. নূরুল ইসলাম মঞ্জুর ঢাকায় ইন্তেকাল করেন।
মাে. নূরুল ইসলাম মঞ্জুর জাতীয় পর্যায়ের কোনাে নেতা ছিলেন না। তদুপরি বঙ্গবন্ধুর বদান্যতায় তাকে ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৫ সালে; পুনর্বিন্যাসিত মন্ত্রিপরিষদে রেলপথ ও যােগাযােগ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী পদে নিযুক্তি দেওয়া হয়। প্রতিমন্ত্রী পদে পদায়নের অনতিকাল পরেই দুর্নীতির অভিযােগে অভিযুক্ত হলে; একই বছরের ২১ জুলাই তাকে মন্ত্রিপরিষদ হতে অপসারণ করা হয়। তার অপসারণ প্রসঙ্গে সেসময়-২২ জুলাই, ১৯৭৫ সালে দৈনিক বাংলা প্রত্রিকায় ‘দুর্নীতির অভিযােগে যােগাযােগ প্রতিমন্ত্রী অপসারিত’ শিরােনাম সম্বলিত সংবাদে লেখা হয়েছিল: রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দুনীতির গুরুতর অভিযােগে সােমবার যােগাযােগ প্রতিমন্ত্রী নূরুল ইসলাম মঞ্জুরকে প্রতিমন্ত্রীর পদ থেকে অপসারণ করেছেন। বাসস’র খবরে প্রকাশ, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৫৮ (৫) ধারা মােতাবেক জারিকৃত রাষ্ট্রপতির এই আদেশ সােমবার থেকে কার্যকর হয়েছে। জনাব নূরুল ইসলাম মঞ্জুরকে অপসারণের রাষ্ট্রপতির এই সিদ্ধান্ত একটি চিঠিতে তাকে জানানাে হয়েছে। সােমবার জনাব মঞ্জুরকে লেখা চিঠিতে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আপনার বিরুদ্ধে দুর্নীতির গুরুতর অভিযােগে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৫৮(৫) ধারা মােতাবেক আমি আপনাকে প্রতিমন্ত্রীর পদ থেকে অপসারণ করছি। এই আদেশ আজ থেকে কার্যকর হবে।’ (দৈনিক বাংলা। ২২ জুলাই ১৯৭৫) ১৯৯৯ সালে আওয়ামী লীগের শাসনকালে কে এম ওবায়দুর রহমান, শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন ও তাহের উদ্দিন ঠাকুরের সাথে নূরুল ইসলাম মঞ্জুরকেও চার জাতীয় নেতার হত্যা তথা জেল হত্যা মামলার আসামি হিসেবে

পৃষ্ঠা: ১২৬
গ্রেফতার করা হয়। পরবর্তী সময়ে-২০০৪ সালে বিএনপির শাসনামলে অন্যদের সাথে তাকেও জেল হত্যা মামলার অভিযােগ হতে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
দুর্নীতির অভিযােগে মন্ত্রিসভা ও বাকশাল হতে অপসৃত হবার পর মঞ্জুর এতটাই প্রতিশােধপরায়ণ হয়ে উঠেছিলেন যে ১৫ আগস্টে মর্মান্তিক হত্যাযজ্ঞের সকালেই তিনি অতিউৎসাহী হয়ে শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের আবাসস্থলে হাজির হয়ে সেখানকার শহীদদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেন। অতঃপর যখন জানতে পারেন; শহীদ সেরনিয়াবাতের পুত্র আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন, তখন অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। এ বিষয়ে এ এল খতিব ‘হু কিল্ড মুজিব’ লিখেছেন, ১৫ আগস্টের রক্তাক্ত সকালে মঞ্জুর সশরীরে সেরনিয়াবাতের বাড়িতে উপস্থিত হন কত দক্ষতার সাথে হত্যাকারী দলটি তাদের কাজ করেছে তা দেখতে। তিনি যখন জানতে পারেন সেরনিয়াবাতের পুত্র হাসনাত পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন তখন দলটিকে অভিসম্পাত করেন। (খতিব। পৃষ্ঠা: ৬৫)।

সহায়ক গ্রন্থ ও তথ্যউৎস:
১. বাংলা ট্রিবিউন। সাবেক প্রতিমন্ত্রী নূরুল ইসলাম মঞ্জুর আর নেই। মে ২৬, ২০২০
২. মুক্ত বিশ্বকোষ। নূরুল ইসলাম মঞ্জু। আপডেট: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২০ তারিখে
৩. দৈনিক বাংলা। দুর্নীতির অভিযােগে যােগাযােগ প্রতিমন্ত্রী অপসারিত। ঢাকা। ২২ জুলাই ১৯৭৫ (কৃতজ্ঞতা: জাফর ওয়াজেদ)।
৪. খতিব, এ এল। হু কিল্ড মুজিব। ২০১৬। ঢাকা। আবিষ্কার। পৃষ্ঠা: ৬৫
৫. List of 11th Parliament Members Bangla.w.w.w.parliament.gov.bd

প্রতিমন্ত্রী কে এম ওবায়দুর রহমান

রাজনৈতিক অঙ্গনে ৭৫ পরবর্তী পর্যায়ে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল’এর নেতা হিসেবে সমধিক পরিচিত কে এম ওবায়দুর রহমানের রাজনীতিতে হাতেখড়ি হয়েছিল ছাত্রলীগের মাধ্যমে। ছাত্রজীবন সমাপ্তির পর পরই তিনি আওয়ামী লীগে যােগ দেন। মুক্তিযুদ্ধকালে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মর্মান্তিক হত্যাযজ্ঞের পর খন্দকার মােশতাকের অধীনে মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করেন। অতঃপর বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পাটিতে (বিএনপি) যােগ দিয়ে (কিছুদিন বিরত) মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দলটির সাথে সম্পৃক্ত থাকেন। ওবায়দুর রহমান জন্মেছিলেন ১৯৪০ সালে, মে মাসের ৫ তারিখে। পৈতৃক বাড়ি ফরিদপুর জেলার নগরকান্দা উপজেলার লস্করদিয়া গ্রামে।
কে এম ওবায়দুর রহমান ছাত্র জীবন থেকেই রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। তিনি ১৯৬২-১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৬২ সালে আইয়ুব বিরােধী শিক্ষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৬৩ হতে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে এম এ পাস করেন। একই বছরের মার্চ মাসে কার্জন হল প্রাঙ্গণে আয়ােজিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে চ্যান্সেলার হিসেবে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মােনায়েম খান উপস্থিত হলে; ছাত্রদের প্রবল বিক্ষোভের মুখে অনুষ্ঠানটি শেষ পর্যন্ত পণ্ড হয়ে যায়। তৎপ্রেক্ষিতে অন্যান্য ছাত্র নেতার সাথে ওবায়দুর রহমানকেও অভিযুক্তকরত পাঁচ বছরের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় হতে বহিষ্কার করা হয়। অতঃপর একই বছরে তিনি আওয়ামী লীগে যােগদান করেন। পরবর্তী পর্যায়ে; ১৯৬৬ হতে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সমাজকল্যাণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। আইয়ুববিরােধী আন্দোলন, ছয়দফা আন্দোলন, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও সত্তুরের নির্বাচনে জোরদার ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে কে এম ওবায়দুর রহমান নগরকান্দা, সালথা ও কৃষ্ণপুর নির্বাচনি এলাকা হতে প্রাদেশিক আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭১

পৃষ্ঠা: ১২৮
সালে অসহযােগ আন্দোলনে এবং পরবর্তী পর্যায়ের মুক্তিযুদ্ধে উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালন করেন। এসময় তিনি জেলা সমন্বয়ক ও প্রতিরােধ কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে ফরিদপুর এলাকার আন্দোলন-সংগ্রাম সংগঠিত করেন। এপ্রিল মাসে পাকিস্তানি হানাদারবাহিনী কর্তৃক ফরিদপুর অধিকৃত হলে ভারতে চলে যান। সেখানে-ভারতের পুরুলিয়া মুক্তিযােদ্ধা প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে পলিটিক্যাল মােটিভেটরের দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তী পর্যায়ে কলকাতাস্থ আওয়ামী লীগের অস্থায়ী কার্যালয় পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত আস্থাভাজন ওবায়দুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচনে (১৯৭৩) জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। বঙ্গবন্ধুর বদান্যতায় ১৯৭৩ হতে ৭৫ সাল পর্যন্ত সরকারের ডাক ও তার প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে নিয়ােজিত ছিলেন। নবগঠিত বাকশালে যােগদান করেছিলেন তিনি। ১৯৭৫ সালে, জুনের ৬ তারিখে গঠিত ১১৫ সদস্যবিশিষ্ট বাকশাল কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন কে এম ওবায়দুর রহমান। ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নির্মমভাবে হত্যার মাধ্যমে রাজনৈতিক পট পরিবর্তিত হলে; তিনি খন্দকার মােশতাকের প্রতি সমর্পিত হয়ে ডাক ও টেলিযােগাযােগ প্রতিমন্ত্রী হিসেবে মােশতাকের অবৈধ সরকারে যােগ দেন এবং ১৫ আগস্ট রাতেই মন্ত্রিত্বের শপথ গ্রহণ করেন।১
খন্দকার মােশতাকের পতনের পর-১৯৭৮ সালে জেনারেল জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলে (বিএনপি) যােগ দিয়ে; দলটি গঠনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। পরবর্তী সময়ে সরকারের মৎস ও পশু পালন মন্ত্রণালয়সহ বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৬ সালে বিএনপির মহাসচিব নিযুক্ত হয়ে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত ওই পদে বহাল থাকেন। পরবর্তী পর্যায়ে রাজনৈতিক মতদ্বৈততার

পৃষ্ঠা: ১২৯
কারণে বিএনপি ত্যাগ করে বাংলাদেশ জনতা দল’ নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। ১৯৯১ সালে নিজের আসন ফরিদপুর-২ থেকে জনতা দলের চাকা মার্কায় নির্বাচন করে হেরে যান আওয়ামী লীগের সাজেদা চৌধুরীর কাছে। ১৯৯৬ সালে বিএনপিতে ফিরে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০১ সালেও তিনি বিএনপির সংসদ সদস্য ছিলেন।২ অতঃপর আমৃত্যু ছিলেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল’ এর স্থায়ী কমিটির সদস্য। ২০০৭ সালে, মার্চের ২১ তারিখে কে এম ওবায়দুর রহমান মৃত্যু বরণ করেন।
বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে একটি সংগ্রামমুখর জীবনের কালপর্বে কে এম ওবায়দুর রহমান বিভিন্ন পর্যায়ে কারারুদ্ধ ছিলেন, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেও করেছেন কারাবাস। ছাত্রলীগের মাধ্যমে রাজনৈতিক জীবন সূচিত হলেও, আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়িত থেকেও এবং বঙ্গবন্ধুর স্নেহের ছায়ায়। নিবিঢ়ভাবে সমর্পিত থাকার পরও কে এম ওবায়দুর রহমান বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের আদর্শের প্রতি পরবর্তী সময়ে বিশ্বস্ত থাকেননি। স্বাধীনতা যুদ্ধকালে যেমন স্বাধীনতা বিরােধী চক্রের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন, তেমনই স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর ক্যাবিনেটে প্রতিমন্ত্রীর পদে আসীন থেকেও বঙ্গবন্ধুবিরােধী ষড়যন্ত্রের সাথে ছিলেন পুরােমাত্রায় সম্পৃক্ত। কে এম ওবায়দুর রহমানের প্রতি বঙ্গবন্ধু যে কতটা স্নেহপরায়ণ ছিলেন, তার অনেক বর্ণনা বিধৃত হয়েছে কারাগারে লিখিত দিনলিপিতে। বঙ্গবন্ধুর সে সমস্ত লেখনী ও অনুভূতির। অংশবিশেষ এখানে তুলে ধরা হল:
১৯৬৬ সাল, জুনের ২ তারিখ-বৃহস্পতিবারে লিখেছেন, ‘…আব্দুল মােমিন এডভােকেট, প্রচার সম্পাদক আওয়ামী লীগ। ওবায়দুর রহমান, সাংস্কৃতিক সম্পাদক। হাফেজ মুসা, ঢাকা আওয়ামী লীগের সভাপতি। মােস্তফা সরােয়ার, নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের সভাপতি। শাহাবুদ্দিন চৌধুরী, সহ সভাপতি ঢাকা শহর আওয়ামী লীগ। রাশেদ মােশাররফ, সহ সম্পাদক ঢাকা শহর আওয়ামী লীগ , আওয়ামী লীগ কর্মী হারুনুর রশিদ ও জাকির হােসেন। দশ সেলে এদের রাখা হয়েছে। এত খারাপ সেল ঢাকা জেলে আর নাই।৩ ১৯৬৬ সাল, ৬ জুন-সােমবারের দিনলিপিতে লিখেছেন, …সরকার কর্মীদের বন্দি করেও অত্যাচার করেছে, ২৪ ঘণ্টা তালা বন্ধ করে রেখেছে জেলের মধ্যে। নারায়ণগঞ্জের মােস্তফা সারওয়ার, শামসুল হক ভূতপূর্ব এমপিএ, হাফেজ মুসা সাহেব, আব্দুল মােমিন এডভােকেট, ওবায়দুর রহমান, শাহাবুদ্দিন চৌধুরীর মতাে নেতৃবৃন্দকে ‘সি’ ক্লাসে রাখা হয়েছে। কি করে এই সরকার সভ্য সরকার বলে দাবি করতে পারে, আমি ভেবেও পাই না।৪ ১৯৬৭ সাল, ১ জানুয়ারি হতে ২০ ফেব্রুয়ারির মধ্যে জানুয়ারির ১৩ তারিখ ছিল ঈদের দিন। এ দিন পরিজনেরা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন কারাগারের ফটকে। এ

পৃষ্ঠা: ১৩০
দিনের ঘটনাবলি সম্পর্কে তিনি লিখেছেন। …১০ সেল থেকে শামসুল হক, মিজানুর রহমান চৌধুরী, আব্দুল মােমিন, ওবায়দুর রহমান, মােল্লা জালাল, মহীউদ্দিন (খােকা), সিরাজ, হারুন, সুলতান এসেছে। দেখা হয়ে গেল, কিছু সময় আলাপও হলাে। এরা সকলেই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী। রফিকুল ইসলাম, বজলুর রহমান ও শাহ মােয়াজ্জেম নামাজে আসে নাই।৫ ১৯৬৭ সাল, ২২ মার্চ-বুধবারের দিনলিপিতে লিখেছেন, ‘…তাজউদ্দীন এখনও ময়মনসিংহ জেলে আটক আছে। মােশতাক, জালাল, মােমিন সাহেব, ওবায়দুর রহমান, সিরাজ, সুলতান নামাজ পড়তে এসেছে ১০ সেল থেকে।৬ ১৯৬৭ সাল, ১৪ হতে ১৫ এপ্রিলে লিখেছেন, ‘…আমি ২৬ সেল থেকে নতুন বিশ সেলে হাজী দানেশ, সৈয়দ আলতাফ হােসেন, হাতেম আলী খান, সিরাজুল হােসেন খান ও মৌলানা সৈয়াদুর রহমান সাহেব, ১০ সেলে রফিক সাহেব, মিজানুর রহমান, মােল্লা জালাল উদ্দিন, আব্দুল মােমিন, ওবায়দুর রহমান, মহিউদ্দিন, সুলতান, সিরাজ এবং হাসপাতালে খােন্দকার মােশতাক সাহেবকে ফুল পাঠাইলাম নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে।৭ ১৯৬৭ সাল, ২৩ হতে ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত লিখেছেন, ‘…আমরা ৬ দফা দাবির জন্য জেলে এসেছি। আজও প্রচার সম্পাদক আব্দুল মােমিন, কালচারাল সম্পাদক ওবায়দুর রহমান, অরগানাইজিং সেক্রেটারি মিজানুর রহমান চৌধুরী, প্রভাবশালী নেতা শাহ মােয়াজ্জেম, ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য মােল্লা জালাল উদ্দিন, মহীউদ্দিন আহাম্মদ সিটি আওয়ামী লীগ সম্পাদক নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা সিটি অফিস সেক্রেটারি মােহাম্মদ সুলতান এবং ঢাকা জেলা অফিস সেক্রেটারি সিরাজউদ্দিন জেলে। পাকিস্তান আওয়ামী লীগ একটা প্রস্তাবও পাশ করে নাই আমাদের মুক্তির জন্য।৮ সেনানিবাসের কারাগারে অবস্থানকালে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন; …৬ দফা প্রস্তাব জনগণের সামনে পেশ করার পর থেকে সরকার আমার ওপর অত্যাচার চালাইয়া যাচ্ছে। ১২ টা মামলাও দায়ের করেছে। আমার সহকর্মী খােন্দকার মােশতাক, তাজউদ্দীন, আব্দুল মােমিন, ওবায়দুর রহমান, নূরুল ইসলাম, আমার ভাগনে শেখ ফজলুল হক মণি ও আরও অনেকে ১৯৬৬ সাল থেকে জেলে আছে এবং সকলের বিরুদ্ধে মামলাও দায়ের করা হয়েছে।৯ এভাবেই বঙ্গবন্ধু কারারুদ্ধ অবস্থায় কে এম ওয়াদুর রহমানকে প্রতিনিয়ত প্রিয়জন হিসেবে মূল্যায়ন করেছেন। আপন জন ভেবেছেন। কিন্তু ওবায়দুর রহমান যে তার প্রতি আন্তরিকভাবে সমর্পিত ছিলেন না, ছয়দফা ও স্বাধীনতার প্রশ্নে প্রতিজ্ঞ ছিলেন না, পরবর্তী সময়ে পদে পদে তা প্রমাণিত হয়েছে।
যুক্তিযুদ্ধকালে খন্দকার মােশতাক আহমদের সাথে সম্পৃক্ত থেকে স্বাধীনতা বিরােধী তৎপরতায় সরব ছিলেন। তার পরও বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ওবায়দুর রহমানকে পার্টিতে ও মন্ত্রিপরিষদে স্থান দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি সততার সাথে

পৃষ্ঠা: ১৩১
দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট থাকেননি। একপর্যায়ে তাকে সুনির্দিষ্ট অভিযােগের প্রেক্ষাপটে দায়িত্ব থেকেও সরিয়েও দেওয়া হয়। অতঃপর আওয়ামী লীগের অন্যান্য ডানপন্থিদের সাথে তিনিও মেতে ওঠেন বঙ্গবন্ধুবিরােধী ষড়যন্ত্রে। এসব ষড়যন্ত্র, অসততা ও বহিষ্কার প্রসঙ্গে এ এল খতিব লিখেছেন, ‘দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদনা পরিষদের সভাপতি মইনুল হােসেনের এবং মুজিব সরকারের একজন প্রতিমন্ত্রী কে এম ওবায়দুর রহমানের বাড়িতে বেশ কয়েকবার কয়েকজন ষড়যন্ত্রকারী বৈঠক করেন। ওবায়দুর রহমানকে আওয়ামী লীগের সমাজ সেবা সচিবের পদ থেকে ১৯৭২ সালে ত্রাণসামগ্রী অপব্যবহার এবং অর্থের বিনিময়ে বিশ্বাসঘাতকদের আশ্রয় দেওয়ার অভিযােগে সরিয়ে দেওয়া হয়।১০ এর পরও উদারচিত্তের বঙ্গবন্ধু ওবায়দুর রহমানের অপরাধ মার্জনাকরত তাকে ক্যাবিনেটে প্রতিমন্ত্রীর পদে অধিষ্ঠিত করেন। খতিব এ বিষয়ে লিখেছেন-তাকে, ১৯৭৩ সালে প্রতিমন্ত্রীর পদ দেওয়া হয়। অনেক আওয়ামী লীগ নেতা মনে করেন তাকে পুনর্বাসন করাটা একটা ভুল ছিল, কিন্তু কেউ-ই এটা বলতে পারেননি কিভাবে গুরুতর অভিযােগে দলের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ার এক বছরের মধ্যে তাকে রাজনীতিতে পুনর্বহাল করা হয়েছিল। ১৯৭৪ সালে ওবায়দুর রহমান তার শুভাকাঙ্ক্ষীদের বলেছিলেন যে তাকে খুব শীঘ্রই পূর্ণ মন্ত্রী করা হবে। যখন আশা অনুসারে তার পদোন্নতি হয়নি তখন তিনি ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন।১১ প্রতিমন্ত্রীর পদে বহাল হবার পর তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা আরও স্ফীত হয়। পূর্ণ মন্ত্রীর পদে অধিষ্ঠানের জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠেন। অতঃপর আশা ভঙ্গ হলে হয়ে ওঠেন বিশ্বাসঘাতক। অথচ বাকশাল গঠিত হবার পর ওবায়দুর রহমান সে প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত ছিলেন। স্বতঃস্ফূর্তভাবে বাকশালের পক্ষে প্রচারণাও করেছিলেন। ৭ আগস্ট, ১৯৭৫। কবি জসিম উদ্দিনের সভাপতিত্বে ভাঙ্গা থানা কল্যাণ সমিতির এক সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রতিমন্ত্রী কে এম ওবায়দুর রহমান নবপ্রবর্তিত ‘বাকশাল’ প্রসঙ্গে বলেন, ‘নয়া (বাকশালভিত্তিক) প্রশাসনিক ব্যবস্থা ইতিহাস সৃষ্টি করিবে।১২ এ ধরনের কথা বলার অনতিকাল পরেই তিনি আবির্ভূত হন স্বরূপে।
কে এম ওবায়দুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু যে কতটা স্নেহ করতেন, তার একটি অনবদ্য উদাহরণ বর্ণিত হয়েছে বিমানের ক্যাপ্টেন বীর মুক্তিযােদ্ধা আলমগীর সাত্তার (বীরপ্রতীক) এর লেখনীতে। এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ এবং আমার জীবন’ গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, বাসার গেটের মধ্যে প্রবেশ করার জন্য গাড়ির গতি একদম কমিয়ে আনা হলাে। গাড়ি চালাচ্ছিল আমাদেরই পুলিশ বন্ধু সার্জেন্ট মির্জাও তখন প্রমােশন পেয়ে পিএসপি হয়েছে। কিন্তু সবাই তাকে সার্জেন্ট মির্জা বলেই জানতাে। গাড়ির গতি কমানাের পর হেডলাইটের আলােতে বঙ্গবন্ধু আমাকে দেখে চিনতে পারলেন। গাড়ির জানালা দিয়ে ইশারা

পৃষ্ঠা: ১৩২
করে আমাকে বাসার ভেতরে যেতে বললেন। বাসার পশ্চিম পাশের দরজার কাছে বঙ্গবন্ধু গাড়ি থেকে নামলেন। সেদিন তাঁকে খুব হাসি-খুশি দেখাচ্ছিল। পরনে ছিল নিত্যদিনের মতাে সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি। মুজিব কোট অবশ্যই ছিল এবং গলায় জড়ানাে ছিল একখানা সুন্দর চাদর। হাতে ছিল তার একছড়া বকুল ফুলের মালা। বঙ্গবন্ধু আমাকে কাছে ডেকে নিয়ে আমার ঘাড়ের ওপর একখানা হাত রেখে ফুলের মালা দেখিয়ে বললেন, ওবায়েদের বিয়েতে গিয়েছিলাম। এই বলে ফুলের মালাটা আমার হাতে তুলে দিলেন।
বঙ্গবন্ধু যে ওবায়েদের কথা বলছিলেন, তিনি আর কেউ নন, ওবায়েদুর রহমান। ছিলেন বিএনপির মন্ত্রী, এমপি। ছিলেন বঙ্গবন্ধুর সময়েও মন্ত্রী। বঙ্গবন্ধু যাদেরকে খুব কাছের মানুষ মনে করতেন, ওবায়েদুর রহমান ছিলেন তাঁদেরই একজন। শুনেছি, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তিনি নাকি অনেকের কাছে সন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। তিনি খুনি মােশতাকের উপদেষ্টা (তিনি মােশতাকের উপদেষ্টা নয়, তার ক্যাবিনেটে প্রতিমন্ত্রী ছিলেন-লেখক) ছিলেন। অভিযােগ আছে, জেলখানা হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনার সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন। পরবর্তীকালে ওবায়দুর রহমানের সঙ্গে যখনই দেখা হয়েছে, তখনই বকুল ফুলের মালার কথা, পাকিস্তান থেকে প্রত্যাবর্তনের পর ঢাকা বিমানবন্দরে প্লেন থেকে নামার সিঁড়ির ওপর বঙ্গবন্ধুর কোল ঘেঁষে থাকা ওবায়দুর রহমানের ছবির কথা মনে পড়েছে।১৩ বঙ্গবন্ধুর এই উচ্চাভিলাষী প্রিয়ভাজনরাই একসময় সংকীর্ণ স্বার্থ হাসিলের জন্য ১৫ আগস্টের বর্বরতার পথ বেছে নিয়েছিল।
প্রকাশ থাকে যে স্বাধীনতার পূর্বে ওবায়দুর রহমানের মতাে অনেকেই ছয়দফা, আইয়ুব খানের বিরােধিতা ও পাকিস্তানের বিরাজমান আঞ্চলিক বৈষম্য অবসানের জন্য সােচ্চার হলেও পাকিস্তানের বিভাজন তথা বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে একাত্ম হতে পারেনি। পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর অনুসৃত ধর্মনিরপেক্ষা ও সমাজতান্ত্রিক নীতি আদর্শের প্রশ্নেও একাত্ম হতে পারেনি তারা। যে কারণে এরা যেমন স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরােধিতা করেছিলেন, তেমনই বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় অবস্থান করেও বঙ্গবন্ধুবিরােধী ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালে খন্দকার মােশতাক আহমদের নেতৃত্বে স্বাধীনতা বিরােধী ষড়যন্ত্রের সাথে যুক্ত ছিলেন কে এম ওবায়দুর রহমান। কলকাতার গ্রান্ড হােটেল ও সার্কাস এভিনিউয়ের ষড়যন্ত্রিক সভাগুলােতে নিয়মিত অংশগ্রহণ করতেন। স্বাধীনতার পর কুমিল্লার বার্ড ও আগামসি লেনে অনুষ্ঠিত বঙ্গবন্ধুবিরােধী সভাগুলােতেও তার উপস্থিতি ছিল সর্বজনবিদিত। এমনকি তার বাড়িতেও এ সমস্ত ষড়যন্ত্রিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হতাে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ওবায়দুর রহমান তার প্রত্যাশিত ধারার রাজনৈতিক বলয়েই নিজেকে সমর্পিত করেছিলেন।

পৃষ্ঠা: ১৩৩
ওবায়দুর রহমান ছিলেন আওয়ামী লীগের একজন পরীক্ষিত নেতা। ছাত্রজীবনেও ছিলেন দলটির সাথে সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত। একই সাথে বঙ্গবন্ধুসহ কারারুদ্ধও ছিলেন। বলাবাহুল্য বঙ্গবন্ধুর সাথে সম্পৃক্ত জনেরা সেসময় বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সাথে পরােক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন। ৩২ নাম্বার বাড়ির বঙ্গমাতা ও শেখ রাসেলের মতাে শিশুরা ছিলেন এ সমস্ত নেতৃবৃন্দের অনুভূতি-আবেগের বলয়ভুক্ত। ওবায়দুর রহমানও এর থেকে বিচ্যুত ছিলেন না। পরিতাপের বিষয় রাজনৈতিক পরিবর্তনের নামে সে বাড়ির নারী ও শিশুদের মর্মান্তিক রক্তপাতেও তার মত নেতার কোন অনুতাপ হয়নি।

তথ্যনির্দেশ:
১. সােবহান, আ.ন.ম আবদুস। রহমান, কে এম ওবায়দুর। বাংলাপিডিয়া: বাংলাদেশ জাতীয় জ্ঞান কোষ। ৮ মার্চ ২০১৫ অবলম্বনে লিখিত
২. ইকবাল, নাইর। ভােটের রাজনীতিতে ডিগবাজি। ঢাকা। প্রথম আলাে। ১৯ ডিসেম্বর ২০১৮
৩. মুজিবুর রহমান, শেখ। কারাগারের রােজনামচা। ২০১৮ (সপ্তম মুদ্রণ)। ঢাকা। বাংলা একাডেমি। পৃষ্ঠা: ৫৬
৪. প্রাগুক্ত। পৃষ্ঠা: ৬৮
৫. প্রাগুক্ত। পৃষ্ঠা: ২০২
৬. প্রাগুক্ত। পৃষ্ঠা: ২১৩
৭. প্রাগুক্ত। পৃষ্ঠা: ২২৩
৮. প্রাগুক্ত। পৃষ্ঠা: ২২৭
৯. প্রাগুক্ত। পৃষ্ঠা: ২৬৩।
১০. খতিব, এ এল। হু কিল্ড মুজিব। ২০১৬। ঢাকা। আবিষ্কার। পৃষ্ঠা: ৬৫
১১. প্রাগুক্ত। পৃষ্ঠা: ৬৫
১২. মুকুল, এম আর আখতার। মুজিবের রক্তলাল। ২০০০ (পঞ্চম মুদ্রণ)। ঢাকা। সাগর | পাবলিশার্স। পৃষ্ঠা: ২৪৩
১৩. সাত্তার, আলমগীর। বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ এবং আমার জীবন। ২০১৮। ঢাকা। সাহিত্য প্রকাশ। পৃষ্ঠা: ২২১-২২২

প্রতিমন্ত্রী মােসলেম উদ্দিন খান

খন্দকার মােশতাকের অবৈধ সরকারের পাট মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন মােসলেম উদ্দিন খান, তিনি মুখ্যত হাবু মিয়া নামে রাজনৈতিক অঙ্গনে পরিচিত ছিলেন। ইতিপূর্বে ১৯৭৩ হতে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত একই মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের এই রাজনীতিবিদ পেশায় ছিলেন আইনজীবী। মােসলেম উদ্দিন খান ১৯৩০ সালে তৎকালীন মানিকগঞ্জ মহকুমার গড়পাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে এমএ এবং ১৯৫৫ সালে এলএলবি পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকাল থেকেই রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হাবু মিয়া ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। শিক্ষাজীবন সমাপ্তির পর; ১৯৫৭ সালে মানিকগঞ্জ মহকুমা আদালতে আইন পেশায় যােগদানের মাধ্যমে সূচিত হয় তার কর্মজীবন। ৫০ বছরের বেশি সময় তিনি আইন পেশায় যুক্ত ছিলেন। ১৯৬৫ সালে মােসলেম উদ্দিন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে তৎকালীন প্রাদেশিক আইনপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং আনুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী লীগে যােগদান করেন।
১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয়দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনসহ সেসময়কার প্রতিটি আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। ১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের মনােনয়নে এমএলএ নির্বাচিত হন। স্বাধীনতা যুদ্ধকালে ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। সেসময় মুজিবনগর সরকারের নির্দেশনা মােতাবেক অন্যান্য এমএলএ ও এমপিএ-দের সাথে ভারতের বিহার রাজ্যে এক মাস মেয়াদি সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে তৎকালীন ঢাকা-২ আসন হতে প্রথম জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। পরবর্তী সময়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের তৃতীয় মন্ত্রিসভায় তাকে পাট মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে নিয়ােগ দেওয়া হয়। নবগঠিত বাকশালে যােগদান করেছিলেন তিনি। ১৯৭৫ সালে, জুনের ৬ তারিখে গঠিত ১১৫ সদস্যবিশিষ্ট বাকশাল কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন মােসলেম উদ্দিন খান। ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক হত্যাযজ্ঞের পর তাকে খন্দকার মােশতাকের

পৃষ্ঠা: ১৩৫
অবৈধ মন্ত্রিসভায় পূর্বোক্ত পদে পদায়ন করা হয়। ২০ আগস্টে তিনি প্রতিমন্ত্রীর শপথ গ্রহণ করেন।
খন্দকার মােশতাক আহমদের পতনের পর তিনি আওয়ামী লীগে প্রত্যাবর্তন করেন এবং আওয়ামী লীগ মিজান গ্রুপে যােগদান করেন। প্রকাশ থাকে যে; ‘৩-৫ নভেম্বর ১৯৭৮ ইডেন হােটেলে তিনদিনব্যাপি আওয়ামী লীগ (মিজান) এর কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। কাউন্সিলে ‘সার্বভৌম পার্লামেন্ট ও সংসদ নির্বাচনের দাবি জানানাে হয়। কাউন্সিল শেষে মিজানুর রহমান চৌধুরীকে সভাপতি, অধ্যাপক ইউসুফ আলীকে সাধারণ সম্পাদক, মহিউদ্দিন আহমদ (পিস্তল মহিউদ্দিন) ও মােজাফফর হােসেন পন্টুকে যুগ্ম আহ্বায়ক এবং নূরে আলম সিদ্দিকীকে সাংগঠনিক সম্পাদক করে একটি পূর্ণাঙ্গ কমিটি করা হয়।’ (রশিদ। পৃষ্ঠা: ১৫১) উক্ত কমিটিতে যে পার্লামেন্টারি বাের্ড গঠন করা হয়; তার অন্যতম সদস্য ছিলেন মােসলেম উদ্দিন খান। পরবর্তী পর্যায়ে দীর্ঘদিন মানিকগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। এছাড়া পালন করেছেন মানিকগঞ্জ জেলা মুক্তিযােদ্ধা সংসদের কমান্ডারের দায়িত্ব। মােসলেম উদ্দিন খান হাবু মিয়া ২১ নভেম্বর ২০১৩ সালে ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। আওয়ামী লীগের সাথে দীর্ঘকালীন সম্পৃক্ততা; একটি বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক ঐতিহ্যের ধারক এবং বঙ্গবন্ধুর প্রিয়ভাজন হয়েও মােসলেম উদ্দিন আগস্টের নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে অবস্থান নেননি, অধিকন্তু খুনিচক্রের পদতলে সমর্পিত হয়ে আসীন হয়েছিলেন প্রতিমন্ত্রীর পদে।

সহায়ক গ্রন্থ ও তথ্যউৎস:
১. বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম। ২২ নভেম্বর ২০১৩
২. মােসলেম উদ্দিন খান। মুক্তবিশ্বকোষ। ১২ অক্টোবর ২০২০
৩. রশিদ, হারুন-অর। মূলধারার রাজনীতি: বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কাউন্সিল ১৯৪৯| ২০১৬। ২০১৭। ঢাকা। বাংলা একাডেমি।
4. List of 11th Parliament Members Bangla. w.w.w.parliament.gov.bd

প্রতিমন্ত্রী ডা. ক্ষিতীশ চন্দ্র মন্ডল

খন্দকার মােশতাক আহমদের অবৈধ মন্ত্রিসভার প্রতিমন্ত্রী ছিলেন ডা. ক্ষিতীশ চন্দ্র মণ্ডল। বঙ্গবন্ধুর ক্যাবিনেটেও তিনি প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা ক্ষিতীশ চন্দ্র ছিলেন পিরােজপুর জেলার রাজনীতিবিদ, পেশায় চিকিৎসক। ১৩ অক্টোবর ১৯৩৯ সালে; তৎকালীন পিরােজপুর মহকুমার নাজিরপুর থানার শ্রীরামকাঠী ইউনিয়নের বাবলা গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। পিতার নাম, সারদা প্রসন্ন মণ্ডল। ডা. ক্ষিতীশ চন্দ্র মণ্ডল মাত্র ৩১ বছর বয়সে ১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনােনীত প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং পিরােজপুর মহকুমার নাজিরপুর-বানারীপাড়া নির্বাচনি এলাকা হতে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সূচনায় পিরােজপুর মহকুমা সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম সদস্য হিসেবে প্রতিরােধ সংগ্রাম সংগঠিত করেন। পরবর্তী পর্যায়ে ভারতে গিয়ে শরণার্থী ক্যাম্পের চিকিৎসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে; তিনি পিরােজপুর মহকুমা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ডা. ক্ষিতীশ চন্দ্র মন্ডল পিরােজপুর মহকুমার নাজিরপুর ও বানারীপাড়ার একাংশ নিয়ে গঠিত বাকেরগঞ্জ-১৫ আসন হতে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। অতঃপর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের তৃতীয় মন্ত্রিসভায় প্রথমে কৃষি মন্ত্রণালয় এবং পরবর্তী পর্যায়ে ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর পদে নিযুক্ত হন।

পৃষ্ঠা: ১৩৭
নবগঠিত বাকশালে যােগদান করেছিলেন তিনি। ১৯৭৫ সালে, জুনের ৬ তারিখে গঠিত ১১৫ সদস্যবিশিষ্ট বাকশাল কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন ডা. ক্ষিতীশচন্দ্র মণ্ডল। ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্টের পর তাকে মােশতাক আহমদের অবৈধ মন্ত্রিপরিষদে ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর পদে পুনর্বহাল রাখা হয়। ২০ আগস্ট তিনি প্রতিমন্ত্রিত্বের শপথ গ্রহণ করেন।
খন্দকার মােশতাকের পতনের পর ক্ষিতীশ চন্দ্র আওয়ামী লীগে প্রত্যাবর্তন করেন। ১৯৭৬ সালের ২৫ আগস্ট; মিজানুর রহমান চৌধুরীর ধানমন্ডির বাসভবনে আহুত বর্ধিত সভায় উপস্থিতির মাধ্যমে তিনি আওয়ামী লীগে প্রত্যাবর্তন করেন। পরের বছর-১৯৭৭ সালে, এপ্রিলের ৩ ও ৪ তারিখে ঢাকার হােটেল ইডেনে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশনের সিদ্ধান্ত অনুসারে ১৫ এপ্রিল সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন কর্তৃক কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক কমিটির ৪৪ সদস্যের নাম ঘােষিত হয়। উক্ত কমিটিতে ডা. ক্ষিতীশ চন্দ্র মন্ডলকেও সদস্য হিসেবে মনােনীত করা হয়। পরবর্তী সময়ে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে তিনি আলজেরিয়ায় অভিবাসিত হন। কয়েক বছর দেশটিতে অবস্থানের পর ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। অতঃপর ১৯৯৩ হতে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত ডা. ক্ষিতীশ পিরােজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬ সালে রাজনীতি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন। পরবর্তী দিনগুলি চিকিৎসা পেশা নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। ৯ মার্চ ২০২০ সালে রাজনীতিবিদ ডা. ক্ষিতীশ চন্দ্র মণ্ডল পিরােজপুর শহরস্থ শিকারপুরের বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। আপেক্ষাকৃত তরুণ নেতা হলেও তিনিও সেদিন জাতির পিতার হত্যার প্রতিবাদে খুনিচক্রের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেননি।

সহায়ক গ্রন্থ ও তথ্য উৎস:
১. ডা. ক্ষিতীশ চন্দ্র মণ্ডল। মুক্ত বিশ্বকোষ। ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০।
২. রশিদ, হারুন-অর। মূলধারার রাজনীতি: বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কাউন্সিল ১৯৪৯| ২০১৬। ২০১৭। ঢাকা। বাংলা একাডেমি
৩. ইত্তেফাক। সাবেক প্রতিমন্ত্রী ডা. ক্ষিতীশ চন্দ্র মণ্ডলের মৃত্যু। ১০ মার্চ ২০২০
4. List of 11th Parliament Members Bangla. w.w.w.parliament.gov.bd

প্রতিমন্ত্রী রিয়াজউদ্দিন আহমেদ ভােলামিয়া

বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় প্রতিমন্ত্রী ছিলেন রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ ভােলা মিয়া। ভােলা মােক্তার হিসেবেই সমধিক পরিচিত ভােলা মিয়া ছিলেন কুড়িগ্রাম মহকুমা আদালতের মােক্তার। ১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে তিনি জাতীয় পর্যায়ের রাজনীতিতে পদার্পন করেন। ভােলা মিয়া জন্মেছেন ১৯২৩ সালের ২৪ অক্টোবরে। পিতার নাম, দালাল উদ্দিন আহমেদ এবং মাতা রহিমা বেগম। পিতা ছিলেন কুড়িগ্রাম মহকুমা আদালতের একজন পরিচিত আইনজীবী। ভােলা মিয়া কোলকাতার ইসলামিয়া কলেজ হতে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। তার রাজনৈতিক উত্থান ছিল অনেকটাই আকস্মিক। ১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনে কুড়িগ্রাম-লালমনিরহাট নির্বাচনি এলাকায় আওয়ামী লীগের এমসিএ-র (মেম্বার অব কনস্টিটিউশনাল এসেলি) মনােনীত প্রার্থী ছিলেন দলটির কুড়িগ্রাম শাখার সভাপতি ও খ্যাতনামা মােক্তার জনাব আহাম্মদ হােসেন সরকার। সেসময় তার এক সন্তান আকস্মিকভাবে মৃত্যুবরণ করায় তিনি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান এবং তদস্থলে এলাকার ধনাঢ্য ব্যবসায়ী শ্ৰী শ্ৰী করণ জয়ীকে মনােনয়ন দেওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধুর সমীপে অনুরােধ জ্ঞাপন করেন। ইত্যবসরে রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ এমসিএ প্রার্থীতার মনােনয়নের জন্য বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সরাসরি যােগাযােগ করেন এবং কামিয়াব হন। প্রকাশ থাকে যে ১৯৪০-৪৬ সালে ভােলা মিয়া কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে অধ্যয়ন করেছেন, সে সুবাদে পূর্ব থেকেই তার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর পরিচয় ছিল। সেই পরিচিতি কাজে লাগিয়ে তিনি মনােনয়ন হাসিল করতে সক্ষম হন। প্রার্থী হিসেবে ভােলা মিয়া তেমন প্রভাবশালী প্রার্থী ছিলেন না। যে কারণে বঙ্গবন্ধুকে সেসময় তার নির্বাচনি এলাকায় গিয়ে জনসভায় বক্তৃতাও করতে হয়েছিল, সে সুবাদে ভােলা মিয়া নির্বাচনে জয়লাভ করতেও সক্ষম হয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছয় নং সেক্টরে সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের সাথেও সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চে অনুষ্ঠিত স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় নির্বাচনে তিনি তৎকালীন রংপুর-১৩ আসন হতে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরবর্তী পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুর বদান্যতায় মন্ত্রিপরিষদে প্রতিমন্ত্রীর পদে অধিষ্ঠিত হন। নবগঠিত বাকশালে যােগদান করেছিলেন

পৃষ্ঠা: ১৩৯
তিনি। ১৯৭৫ সালে, জুনের ৬ তারিখে গঠিত ১১৫ সদস্যবিশিষ্ট বাকশাল কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন রিয়াজউদ্দিন আহমেদ ভােলামিয়া। ১৯৭৫ এর পনেরাে আগস্টের পর তাকে মােশতাক আহমদের অবৈধ মন্ত্রীসভায় বন, মৎস্য ও পশুপালন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী পদে বহাল রাখা হয়, ২০ আগস্টে তিনি প্রতিমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন।
পরবর্তী পর্যায়ে তিনি জেনারেল জিয়াউর রহমান ও লে. জেনারেল হাে. মাে. এরশাদের মন্ত্রিসভার মন্ত্রী এবং জাতীয় সংসদেও ডেপুটি স্পিকার ছিলেন। দল বদলে পারদর্শী ভােলা মিয়া ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯ সালে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের প্রার্থী হিসেবে তৎকালীন রংপুর-১৫ (পরবর্তী সময় লালমনিরহাট-৩) আসন হতে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ৩ মার্চ ১৯৮৮ সালে অনুষ্ঠিত চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে লালমনিরহাট-৩ আসন হতে জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে পূর্বোক্ত আসন হতে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরশাদ সরকারের শেষ দিকে রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ ভােলা মিয়া জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকারের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের চতুর্থ ডেপুটি স্পিকার। ১৯৮৮ সালের ২৫ এপ্রিল হতে ১৯৯১ সালের ৪ এপ্রিল পর্যন্ত তিনি উক্ত দায়িত্বে নিয়ােজিত ছিলেন। ১৯৯৭ সালে, ফেব্রুয়ারির ৪ তারিখে রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ ভােলা মিয়া শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
আওয়ামী লীগের পরীক্ষিত নেতা না হয়েও; কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে অধ্যয়নের যােগসূত্রে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠজনদের অন্যতম হয়ে ওঠেন রিয়াজউদ্দিন আহমেদ ভােলামিয়া। বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত পছন্দে তাকে ৭০ এর

পৃষ্ঠা: ১৪০
নির্বাচনে এমসিএ পদপ্রার্থী হিসেবে মনােনয়ন দেওয়া হয়। স্বাধীনতার পর প্রতিমন্ত্রীর পদে পদায়ন করা হয়েছিল। এহেন সম্পর্কের কারণে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার পূর্বে ও পরে তার নির্বাচনি এলাকা সফর করেছিলেন। ক্ষেত্র বিশেষে তার আবদারও বঙ্গবন্ধু প্রসন্ন চিত্তে রক্ষা করেছেন। বাংলাদেশের রাজনীতির ক্ষতিকর ক্ষত হাে. মাে. এরশাদ ছিলেন ভােলা মিয়ার ভাগ্নে, স্বাধীনতা যুদ্ধকালে দেশ বিরােধী ভূমিকার কারণে পাকিস্তান প্রত্যাগত এরশাদ ছিলেন বাছাই কমিটি কর্তৃক কালাে তালিকাভুক্ত। তদুপরি ভােলা মিয়ার আবদারের পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক এরশাদকে সেনাবাহিনীতে পুনর্বহাল করা হয়। এতটা নিবিড় সম্পর্ক থাকার পরও রিয়াজ উদ্দিন বঙ্গবন্ধুর প্রতি বিশ্বস্ত ও কৃতজ্ঞ থাকেননি। ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাযজ্ঞে অনুতপ্ত হননি। জাতির পিতার লাশ যখন অযত্নে অবহেলায় ৩২ নাম্বার বাসভবনে পড়েছিল, তখন রিয়াজউদ্দিন খুনি মােশতাকের ক্যাবিনেটে প্রতিমন্ত্রী পদ গ্রহণের জন্য ব্যস্ত ছিলেন। পরবর্তী সময়ে মােশতাকের মন্ত্রিসভার অন্য অনেকে আওয়ামী লীগে প্রত্যাবর্তন করলেও তিনি কখনও আর বঙ্গবন্ধুর দলে ফিরে আসেননি। পরবর্তী পর্যায়ে ধানের শীষ ও লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে নির্বাচনি ময়দানে সরব থেকে সুবিধাবাদী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠার জন্য তৎপর থেকেছেন। হয়েছেন জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাকালীন প্রেসিডিয়াম সদস্য, মন্ত্রী ও ডেপুটি স্পিকার। বঙ্গবন্ধু বলয়ে রিয়াজউদ্দিন আহমেদ ভােলা মিয়া ছিলেন অন্যতম একজন অকৃতজ্ঞ-বেইমান।

সহায়ক গ্রন্থ ও তথ্যউৎস:
১. রেয়াজ উদ্দিন আহমেদ। মুক্ত বিশ্বকোষ। ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২০
২. ইকবাল, নাইর। ভােটের রাজনীতিতে ডিগবাজি। ঢাকা। প্রথম আলাে। ১৯ ডিসেম্বর ২০১৮
৩. শহীদুল্লাহ, মােহাম্মদ। স্মৃতিতে মুক্তিযুদ্ধ। ২০১৪। ঢাকা। নিঝর
৪. List of 11th Parliament Members Bangla. w.w.w.parliament.gov.bd

প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ আলতাফ হােসেন

খন্দকার মােশতাক সরকারের অবৈধ ক্যাবিনেটে যােগাযােগ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন বাম রাজনীতিক, সাংবাদিক সৈয়দ আলতাফ হােসেন। ইতিপূর্বে তিনি বঙ্গবন্ধুর ক্যাবিনেটে রেলপথ বিভাগের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। সৈয়দ আলতাফ হােসেন ১৯২৩ সালের ১৬ মার্চ কুষ্টিয়া জেলার বিষ্টুদিয়া গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। পিতা, সৈয়দ ইয়াদ আলী এবং মাতা, জরিনা খাতুন। তিনি কুষ্টিয়ার হরিনারায়ণপুর স্কুল থেকে ১৯৩৯ সালে ম্যাট্রিক, কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে ১৯৪১ সালে উচ্চমাধ্যমি এবং একই কলেজ থেকে ১৯৪৪ সালে মানবিক বিভাগে স্নাতক পাস করেন। অতঃপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৪৬ সালে আইনশাস্ত্রে স্নাতক এবং ১৯৪৭ সালে ইতিহাসে মাস্টার ডিগ্রি লাভ করেন। ছাত্রজীবন থেকেই সৈয়দ আলতাফ হােসেন সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত ছিলেন। ১৯৪৪ সাল থেকে কলকাতার ‘মর্নিং নিউজ পত্রিকার বার্তা বিভাগে কাজ করেন। ভারত বিভাগের পর কলকাতা ছেড়ে ঢাকায় এসে; ১৯৪৯ সালে পাকিস্তান অবজার্ভার’ পত্রিকার বার্তা বিভাগে যােগদান করেন। এ ছাড়া ‘দৈনিক ইত্তেহাদ’ পত্রিকায় কিছুকাল কাজ করেন। ১৯৫০ হতে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত ঢাকার ‘মর্নিং নিউজ পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগে কর্মরত ছিলেন। ১৯৫৬ সালে তার সম্পাদনায় ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয় ‘নিউ নেশন’ পত্রিকা।
ছাত্রজীবন থেকেই সৈয়দ আলতাফ হােসেন রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে অধ্যয়নকালে ছাত্র ফেডারেশনের সাথে যুক্ত ছিলেন। সেসময় তিনি সংগঠনটির ইসলামিয়া কলেজ শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৪০ সালে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে সংগঠিত

পৃষ্ঠা: ১৪২
হলওয়েল মনুমেন্ট অপসারণের আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫৩ সালে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগে যােগ দেন। পরবর্তী বছরে-১৯৫৪ সালের ৮-১২ মার্চে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে তিনি যুক্তফ্রন্টের মনােনীত প্রার্থী হিসেবে প্রাদেশিক আইনপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৪ সালের ৩০ মে। পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল গােলাম মােহাম্মদ কর্তৃক ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের ৯২ (ক) ধারা বলে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিপরিষদ বাতিলকরত প্রদেশে গভর্নরের শাসন প্রবর্তিত হলে; সৈয়দ আলতাফ হােসেনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরােয়ানা জারি করা হয়। সে নিরিখে ১৯৫৫ সালে তাকে আটক করে কারারুদ্ধ করা হয়। ওই পর্যায়ে তাকে কয়েক মাস কারাগারে আটক থাকতে হয়। একই বছরে তার বিরুদ্ধে পুলিশ ধর্মঘটে সম্পৃক্ততার অভিযােগ। আরােপকরত হুলিয়া জারি করা হলে তিনি আত্মগােপন করেন।
১৯৫৭ সালের ৬-১০ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলের কাগমারিতে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশনে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী ও মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর মধ্যে চরম মতদ্বৈততা দেখা দিলে; তৎপ্রেক্ষিতে মওলানা ভাসানী ১৮ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ হতে পদত্যাগ করেন। অতঃপর দলটির সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের নেতাকর্মীদের উদ্যোগে একই বছরের ২৪২৫ জুলাই ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে অনুষ্ঠিত হয় গণতান্ত্রিক কর্মী সম্মেলন। সম্মেলনের সিদ্ধান্তক্রমে পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠিত হলে; সৈয়দ আলতাফ হােসেন নবগঠিত ন্যাপের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। পরের বছর-১৯৫৮ সালে দেশে সামরিকশাসন জারি করা হলে রাজনৈতিক দলসমূকে নিষিদ্ধ করা হয়। এ সময় সৈয়দ আলতাফের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরােয়ানা জারি করা হলে তিনি প্রায় দুই বছর আত্মগােপনে থাকেন। পরবর্তী পর্যায়ে রাজনীতির ওপর আরােপিত নিয়ন্ত্রণ শিথিল করা হলে; ১৯৬৫ সালে সৈয়দ আলতাফ হােসেন পুনরুজ্জীবিত ন্যাপের পূর্ব পাকিস্তান শাখার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
১৯৬৬ সালে তিনি পুনর্বার গ্রেফতার হয়ে কারারুদ্ধ হন এবং ১৯৬৮ সালে মুক্তিলাভ করেন। এ পর্যায়ে কারাগারে অবস্থানকালে পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্য। তার প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু ২৩ মার্চ হতে ৭ এপ্রিল ১৯৬৭ সালের দিনলিপিতে লিখেছেন, ‘…কিছুদিন পূর্বে খাদ্য আন্দোলন করার অপরাধে ন্যাপ সহ-সভাপতি হাজী মােহাম্মদ দানেশ, সম্পাদক সৈয়দ আলতাফ হােসেন, সিরাজুল হােসেন খান ও কৃষক নেতা হাতেম আলী খানকে ধরে এনেছে। নতুন বিশ সেলে রাখা হয়েছে। ডিপিআর করে দিয়েছে, বিনা বিচারে বন্দি জেলজুলুম, অত্যাচার, গুলি সমানে পূর্ব বাংলায় চলেছে।’ (মুজিবুর রহমান, শেখ।

পৃষ্ঠা: ১৪৩
কারাগারের রােজনামচা। পৃষ্ঠা: ২২৩) কারাগারের সহবন্দিদের সাথে বঙ্গবন্ধু সবসময় সৌহার্যপূর্ণ সম্পর্ক রক্ষা করতেন। তাদের আবাসন, খাদ্যমান ও সার্বিক সুযােগ সুবিধার ঘাটতি নিয়ে যেমন উদ্বিগ্ন থাকতেন, তেমনই তাদেরকে প্রযােজ্য ক্ষেত্রে জেলের সেলে থেকেও শুভেচ্ছা পাঠাতেন। এমনি এক বিষয়ে ১১-১৩ এপ্রিল ১৯৬৭ সালে লিখিত দিনলিপিতে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘…আমি ২৬ সেল থেকে নতুন বিশ সেলে হাজী দানেশ, সৈয়দ আলতাফ হােসেন, …ফুল পাঠাইলাম নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে।’ (প্রগুক্ত। পৃষ্ঠা: ২২২-২২৩) কারাগারের বাইরে এবং কারাগারের অভ্যন্তরে এমনই এক প্রীতিময় সম্পর্ক ছিল সৈয়দ আলতাফের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর।
তার কারারুদ্ধ অবস্থায় ১৯৬৭ সালের ৩০ নভেম্বরে রংপুরে অনুষ্ঠিত হয় ন্যাপের কাউন্সিল অধিবেশন। উক্ত অধিবেশনে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নেতৃত্ব ও সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের প্রশ্নে দলটি; মাওপন্থি ও লেনিনপন্থি ধারায় বিভাজিত হয়ে পড়ে। এ সময় তিনি ন্যাপের মস্কোপন্থি অংশের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। অতঃপর ১৯৬৮ সালে হাইকোর্টের রায়ের মাধ্যমে কারাগার হতে মুক্তি লাভ করেন। মুক্তিলাভের কিছুদিন পর পুনরায় গ্রেফতার হয়ে কারারুদ্ধ হন। পরবর্তী সময়ে জামিনে মুক্ত হয়ে জেনারেল আইয়ুববিরােধী গণআন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। আইয়ুবরিবােধী দুর্বার আন্দোলনকালে একই বছরের নভেম্বর মাসে পুনরায় কারারুদ্ধ হন এবং ১৯৬৯ সালে; গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আইয়ুব খানের গদিচ্যুতির পর মুক্তিলাভ করেন। পরবর্তী সময়ে ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন। ১৯৭১ সালে, স্বাধীনতা যুদ্ধকালে তিনি ন্যাপ-ছাত্র ইউনিয়নের যােদ্ধাদের প্রশিক্ষণ কাজে সহায়তা এবং ন্যাপের নেতৃত্বাধীন ভারতের ৬০টি যুব ক্যাম্প পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীনতার পর দ্বিতীয় বিপ্লব সাধনের নিমিত্ত ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) গঠিত হলে তিনি দলগতভাবে বাকশালে যােগদান করেন এবং বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হন। এ সময় তাকে বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় রেলওয়ে বিভাগের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে নিযুক্তি দেওয়া হয়। ১৯৭৫ এর আগস্ট ট্রাজেডির পর তাকে খন্দকার মােশতাকের অবৈধ মন্ত্রিসভায় প্রতিমন্ত্রীর পদে বহাল রাখা হয়। তিনি ২০ আগস্টে প্রতিমন্ত্রী হিসেবে শপথগ্রহণ করেন।
খন্দকার মােশতাকের পতন এবং পরবর্তী পর্যায়ে সামরিক শাসন প্রত্যাহৃত হলে ১৯৭৮ সালে তিনি জাতীয় একতা পার্টি গঠন করেন। তিনি ছিলেন নবগঠিত দলটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। পরবর্তী পর্যায়ে ১৯৮৩ সালে হাে, মাে. এরশাদের সামরিকশাসন বিরােধী আন্দোলনের কারণে তাকে

পৃষ্ঠা: ১৪৪
গ্রেফতার করা হয়। মুক্তি লাভের পর ১৯৮৫ সালে পুনরায় তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরােয়ানা জারি হলে তিনি আত্মগােপন করেন। ১৯৮৬ সালে জাতীয় একতা পার্টি এবং ন্যাপের দুটি অংশের সমন্বয়ে গঠিত ঐক্য ন্যাপের আহবায়ক নির্বাচিত হন সৈয়দ আলতাফ। এরশাদ বিরােধী আন্দোলনকালে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য গঠিত ১৫ দলীয় জোট গঠনেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৮৬ সালে, মে মাসের ৭ তারিখে অনুষ্ঠিত তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি ১৫ দলীয় জোটের প্রার্থী হিসেবে কুষ্টিয়া-৩ আসন হতে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯০ সালে ঐক্য ন্যাপ এবং প্রজাতন্ত্রী পার্টির সমন্বয়ে গঠিত গণতন্ত্রী পার্টির সভাপতি নির্বাচিত হন সৈয়দ আলতাফ। আমৃত্যু তিনি উক্ত দায়িত্বে বহাল ছিলেন। রাজনীতির পাশাপাশি দীর্ঘদিন তিনি সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হিসেবে আইন পেশার সাথে যুক্ত ছিলেন। ১৯৯২ সালের ১২ নভেম্বর সৈয়দ আলতাফ হােসেন ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। সৈয়দ আলতাফ হােসেন আজীবন ইতিবাচক ধারার রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। গণমুক্তির প্রশ্নে ছিলেন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তদুপরি পাকিস্তানি সামরিক জান্তার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করতে পারলেও আগস্টের খুনিদের বিরুদ্ধে দাঁড়াননি।

সহায়ক গ্রন্থ ও তথ্যউৎস:
১. মুজিবুর রহমান, শেখ। কারাগারের রােজনামচা। ২০১৮ সপ্তম মুদ্রণ। ঢাকা। বাংলা একাডেমি
২. হােসেন, এ.টি.এম যায়েদ। হােসেন, সৈয়দ আলতাফ। বাংলাপিডিয়া-বাংলাদেশ জাতীয় জ্ঞানকোষ। ২৪ মার্চ ২০১৫
3. List of 11th Parliament Members Bangla. w.w.w.parliament.gov.bd

প্রতিমন্ত্রী মােমিন উদ্দিন আহমেদ

জনাব মােমেন উদ্দিন আহমেদ ১৯৭৩ সালের প্রথম জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকিটে খুলনা-৭ আসন হতে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। অনেক আগে থেকেই তিনি আওয়ামী লীগের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৫৫ সালের ২১-২৩ শে অক্টোবর পুরান ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগের তিনদিনব্যাপি কাউন্সিল অধিবেশন’ এর (রশিদ। পৃষ্ঠা: ১৫১) সমাপ্তি দিবসে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় কমিটির কর্মকর্তা নির্বাচনে মােমিন উদ্দিন আহমদ কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। এ ছাড়া ১৯৫৭, ১৯৬৬ এবং ১৯৬৮ সালে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক কাউন্সিলের মাধ্যমে গঠিত কার্যকরি কমিটিতেও মােমিন উদ্দিন সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। পরবর্তী পর্যায়ে ছয়দফার আন্দোলন চলা প্রক্কালে ছয়দফার বিকল্প হিসেবে পিডিএম কর্তৃক আট দফা উত্থাপিত হলে, মােমিন উদ্দিন ওই অপপ্রয়াসের সাথে যুক্ত হন। প্রকাশ থাকে যে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় ৬ দফা কর্মসূচি ব্যতিরেকে পিডিএম এর আট দফা অনুমােদন না হলেও দলের কিছু প্রবীণ নেতৃত্ব দমিত হননি। তারা পিডিএম-এ আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি মনােনয়ন জন্য দলের ওয়ার্কিং কমিটির রিকুইজিশন সভা আহ্বানের দাবি করেন। এসবকে কেন্দ্র করে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ , নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ও পশ্চিম পাকিস্তান আওয়ামী লীগের মধ্যে ভাঙন দেখা দেয়। এ সময় ১৯-২০ আগস্ট ১৯৬৭ সালে হােটেল ইডেনে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে গৃহীত সিদ্ধান্ত মােতাবেক ‘বিভেদপন্থী ১৪ নেতাকে সাসপেন্ড-এবং পিডিএমে যােগদানের বিষয়টি নাকচ করে দেওয়া হয়।
এ বিষয়ক সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে ‘দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে লেখা হয়, ‘ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের পক্ষে প্রস্তাব পাশ (নিজস্ব বার্তা পরিবেশক)। গতকাল (শনিবার) হােটেল ইডেনে অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের বিশেষ কাউন্সিল অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে পি, ডি, এম-এ যােগদানের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত গৃহীত হইয়াছে। অধিবেশনে ৬-দফা কর্মসূচীর প্রতি নিষ্ঠার পুনরুক্তি ও পি, ডি, এম-এর ৮-দফা কর্মসূচীকে ৬-দফার মর্ম

পৃষ্ঠা: ১৪৬
বিরােধী আখ্যায়িত করা হয়। পি, ডি, এম প্রশ্নে আওয়ামী লীগ সংগঠনের মধ্যে ফাটল ধরাইবার অভিযােগে কাউন্সিল সভা ১৪ জন পি, ডি, এম পন্থী নেতাকে সাসপেন্ড করিয়াছে।
তাঁহাদিগকে ১৫ দিনের মধ্যে কারণ দর্শানাের জন্য নােটিশ প্রদানের ক্ষমতা সম্পাদককে প্রদান করা হইয়াছে এবং তাঁহাদের সম্পর্কে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের চূড়ান্ত ক্ষমতা একটি ৩ সদস্য বিশিষ্ট সাব-কমিটির উপর ন্যস্ত করা হইয়াছে। দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, সম্পাদিকা ও চট্টগ্রামের জনাব এম, এ, আজিজ এই সাব-কমিটির সদস্য। (সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু: তৃতীয় খন্ড-ষাটের দশকদ্বিতীয় পর্ব। পৃষ্ঠা: ৭৮৩) ওই সংবাদে বরখাস্তকৃত ১৪ জনের নামের তালিকাও প্রকাশ করা হয়। তন্মধ্যে জনাব মােমেন উদ্দিন আহমদ (খুলনা) এর নামটিও অন্তর্ভুক্ত ছিল। পরবর্তী সময়ে অনেকের মতাে তিনিও আওয়ামী লীগে প্রত্যাবর্তন করেন এবং পরবর্তী পর্যায়ের আন্দোলন-সংগ্রামের সাথে শরিক হন।
খন্দকার মােশতাকের অবৈধ মন্ত্রিসভায় তিনিই একমাত্র প্রতিমন্ত্রী ছিলেন যিনি বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন না। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক পট পরিবর্তনের পর নববিন্যাসিত মন্ত্রিপরিষদে তিনি বন্যা, পানি ও বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে পদায়িত হন, শপথ গ্রহণ করেন আগস্টের ২০ তারিখে। ২০ আগস্ট হতে ৬ নভেম্বর ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত উক্ত দায়িত্বে নিয়েজিত ছিলেন। খন্দকার মােশতাকের পতনের পর তিনি আওয়ামী লীগে প্রত্যাবর্তন করেননি। পরবর্তী সময়ে হাে. মাে. এরশাদের মন্ত্রিসভায় শিক্ষামন্ত্রী হয়েছিলেন মােমিন উদ্দিন আহমেদ। ৭ মে ১৯৮৬ সালে অনুষ্ঠিত তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি জাতীয় পার্টির মনােনয়নে খুলনা-৬ (কয়রাপাইকগাছা) আসন হতে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরবর্তী সময়ে মােমিন উদ্দিন আহমেদ খুলনা জেলার জাতীয় পার্টির সভাপতি ছিলেন। আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে দীর্ঘদিন যুক্ত থাকা সত্ত্বেও তিনি ১৫ আগস্টের নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে দাঁড়াননি। অধিকন্তু লুফে নিয়েছিলেন প্রতিমন্ত্রিত্ব।

সহায়ক গ্রন্থ ও তথ্যউৎস:
১. রশিদ, হারুন-অর। মূলধারার রাজনীতি: বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কাউন্সিল ১৯৪৯-২০১৬। ২০১৭। ঢাকা। বাংলা একাডেমি
২. সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু: তৃতীয় খণ্ড-ষাটের দশক-দ্বিতীয় পর্ব। প্রধান সম্পাদক: মাে. শাহ আলমগীর। ২০১৭। ঢাকা। বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট 9
3. List of 11th Parliament Members Bangla.w.w.w.parliament.gov.bd

Reference: বেইমানির ইতিবৃত্ত এবং মোশতাকের মন্ত্রিসভা – মানিক মোহাম্মদ রাজ্জাক

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!