You dont have javascript enabled! Please enable it!
ভারতীয় রেডিওতে তাজউদ্দীনের ভাষণ প্রচারে বাধা কেন?
ইতােমধ্যে আমরা ৬ জন সেক্টর কমান্ডার নির্বাচন করেছি। ১০ এপ্রিলে তাজউদ্দীন সাহেবের যে বক্তৃতা প্রচার করা হবে সেই বক্তৃতাতেও সেক্টর কমান্ডারদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে এবং কে কোন্ সেক্টরের দায়িত্বে থাকবেন তারও উল্লেখ আছে। এদিকে গােলােক মজুমদারের সাথে আগে থেকেই ঠিক করা ছিল যে, সেই বক্তৃতার টেপটা তাকে দিয়ে দেব এবং শিলিগুড়ির ওখান থেকে এই ভাষণ রেডিওতে প্রচার করা হবে। সেই ব্যবস্থা অনুযায়ী আমি তাকে টেপটা দিয়ে দিলাম। এরই মধ্যে শেখ মণি তাজউদ্দীন সাহেবকে বললেন, ‘মামা, আপনার সঙ্গে একটু কথা আছে।‘ তাজউদ্দীন সাহেব এবং শেখ মণি একটা ঘরে গিয়ে আলাপ করতে লাগলেন। প্রায় ঘন্টাখানেক তারা আলাপ করার পর সেখানে আমাকে ডাকা হল। আমি যাবার পর তাজউদ্দীন সাহেব বললেন, “দেখেন, শেখ মণি বলছে টেপ করা বক্তৃতাটা আজকে যাতে প্রচার করা না হয়, এটা দু-তিনদিন পর হলেও কোন অসুবিধা হবে না। আমরা যখন আগরতলা যাচ্ছি, সেখানে যারা আছে তাদের সাথে আলাপ করে একমত হয়ে এটা করা যাবে।’ শেখ মণি বিপ্লবী সরকারের কথা বলেছিলেন এবং গতরাতেই একটা আলাপ আলােচনার মাধ্যমে যুক্তির মাধ্যমে আমরা সেটা কাটিয়ে উঠে একমত হতে সক্ষম হয়েছি। কিন্তু আগরতলাতে যাওয়ার পর এটা নিয়ে আবার একটা ঝামেলার যে আশঙ্কা তা আমি খুব অনুভব করলাম। সেইসাথে যারা সত্যিকার অর্থে তখন যুদ্ধে লিপ্ত তাদের কাছ থেকে আমরা চিঠিপত্র-খবরাখবর পাচ্ছি প্রত্যেকেই চাপ দিচ্ছেন যে সরকার গঠন করতে একদিনও যেন দেরি না হয়। দ্বিতীয়ত, এটা যদি প্রচারিত না হয় তাহলে দিল্লীতে এটা বুঝে ফেলবে যে, আমাদের সরকার গঠন করার ব্যাপারে নিজেদের মধ্যে কোন অসুবিধা রয়েছে এবং সেটা ভবিষ্যতে আমাদের যে কোন কাজে তাদের বিশ্বাস সৃষ্টিতে সহায়ক হবে না। এ সমস্ত ভেবে আমি এর প্রতিবাদ করলাম। কিন্তু শেখ মণি খুব উত্তেজিত হয়ে গেল। আমি তখন সমস্ত যুক্তিগুলাে তাদের দিলাম যে কেন এই সরকার গঠনের কথা এখনি প্রচার করার প্রয়ােজনীয়তা রয়েছে। সেইসাথে আরাে বললাম যে, আগরতলাতে হােক বা যেখানেই হােক, যাদের সাথে আমাদের দেখা হবে তারা এটা মেনে নিতে বাধ্য। কারণ, আমরা তাে এমন কাউকে নিয়ে সরকার গঠন করতে যাচ্ছি না যে লােকগুলাের নাম আগে ছিল না। যারা যেভাবে কাজ করছিলেন তারা সেভাবেই কাজ করতে থাকবেন। এটা হচ্ছে আমাদের ধারাবাহিকতা, এবং তাজউদ্দীন সাহেব যখন ঢাকাতে ছিলেন তখন তিনি প্রধানমন্ত্রীর মতই কাজ করছিলেন এবং বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপ্রধানের মতই কাজ করছিলেন। অতএব আমরা এটা নূতন কিছু করছি না যে এটা কেউ অনুমােদন করবে না। এটা তাে আগেই অনুমােদিত হয়ে আছে। তখন শেখ মণি বললেন, ‘আপনি অত বুঝবেন না আমাদের ভেতরের কথা, বঙ্গবন্ধু আমাদের কী অথরিটি দিয়ে গেছেন।’ এই কথাটাই মণি বলতে চাইলেন যে, বঙ্গবন্ধু তাকে একটা অথরিটি দিয়ে গেছেন। তাজউদ্দীন সাহেব আমার আর শেখ মণির মধ্যকার বিরােধটা মিটানাের জন্য বললেন, ঠিক আছে, মণি যখন বলছে যে আগরতলাতে গিয়ে এই সরকার অনুমােদন করানাের জন্য যা কিছু করা দরকার সে তা করবে, তখন তার কথাটা মেনে নিন।আমি খুব দ্বিধাগ্রস্ত মনে বললাম ঠিক আছে, দেখি আমি কী করতে পারি। ইতােমধ্যে বক্তৃতার টেপ ভারতীয় কর্তৃপক্ষের হাতে চলে গেছে, কাজেই এটা। ফিরিয়ে আনা যাবে কিনা আমি ঠিক জানি না।’ আমি বাইরে এসে গােলােক মজুমদারকে ফোন করলাম। আমি বললাম, “যে টেপটা আমি আপনাকে দিয়েছি সেটা কোথায় ?’ তিনি বললেন, যেখানে যাওয়ার কথা সেখানে সেটা চলে গেছে।’ আমি বললাম যে, ‘টেপটার সম্প্রচার আপাতত কি স্থগিত করা যায়?’ তখন তিনি বললেন, যদি আপনারা বন্ধ করতে চান তাহলে আমি হয়ত চেষ্টা করলে এখনাে করতে পারি। কিন্তু তা করা কি ঠিক হবে? বরং এটা করলে নানা জায়গায় নানা প্রশ্নের সৃষ্টি হবে।’ তখন আমি গােলােক মজুমদারকে বললাম যে, তাহলে যেভাবে এটা নির্ধারিত হয়েছে। সেভাবে চলতে থাকুক।’ এই একটিমাত্র কাজে আমি তাজউদ্দীন সাহেবের কথা অমান্য করেছিলাম। এটা ঠিক হয়েছিল, কি সঠিক হয়নি তা বিচার করবে আগামী ইতিহাস। আর পরবর্তীকালে যে সমস্ত ঘটনা ঘটেছে সেগুলাে দেখলে বােঝা যাবে এটা বন্ধ করার চেষ্টার পেছনে কী চিন্তাভাবনা বা ষড়যন্ত্র ছিল। আমি ফিরে এসে তাজউদ্দীন সাহেবকে বললাম ‘গােলােক মজুমদারকে আপনার ইচ্ছার কথা বলেছি। তিনি হয়ত বা চেষ্টা করবেন এটা বন্ধ করার ব্যাপারে। কিন্তু টেপটা এখন আর তার হাতে নেই।’ এর পরে রাতে আমরা খেতে বসেছি; খাবার টেবিলে শুধু তাজউদ্দীন সাহেব, শেখ মণি আর আমি। কারণ সেই সময় তােফায়েল আহমদ অসুস্থ হয়ে কলকাতাতে চলে গেছেন। মনসুর আলি সাহেবের জ্বর, তিনি শুয়ে পড়েছেন। আমি রেডিওটা অন করে দিয়েছি, এই সময় খবর হয়। রেডিও অন করতেই শুনি একটি ঘােষণা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের বেতার ভাষণ প্রচার করা হবে। আমরা তিনজনই তিনজনের চোখের দিকে তাকালাম। কারাে মুখে কোন কথা নেই, আমরা চুপচাপ। আমরা চুপচাপ রেডিও-র ঘােষণা শুনলাম আর খেয়ে নিলাম। সকলেই বুঝলাম যে কী হয়ে গেছে। তারপর এই খবরটাকে নিয়ে পৃথিবীর সব রেডিও, ভারতের রেডিও পরদিন সকালবেলা থেকে সব স্টেশনের মাধ্যমে অনরবত প্রচার করতে লাগল। এদিকে কামরুজ্জামান সাহেব যখন সরকারের প্রতি তাঁর পূর্ণ সমর্থন জানান তখন আমি মনসুর আলি সাহেবের সাথেও কথা বলি। তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেছিলেন, “আপনি তাজউদ্দীন সাহেবকে বলুন, এই সরকারে আমার সম্পূর্ণ মত আছে। গতকাল যেটুকু পার্থক্য ছিল তা আর কোনদিন আমার কাজের ভেতরে প্রকাশপাবে না।’ এখন থাকলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেব আর মােশতাক সাহেব। সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেব এতে মত দেবেন নিশ্চয়ই, কারণ তাঁকে উপ-রাষ্ট্রপতি করে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘােষণা করা হয়েছে। অতএব তার মত পেতে কষ্ট হবে না। এই চারজন যখন মত দিলেন তখন মােশতাক সাহেব কিছুতেই এটা ঠেকিয়ে রাখতে পারবেন না। সেদিক থেকে এই ক্যাবিনেট যে একটা কার্যকর ক্যাবিনেট হবে এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল। পরদিন সকালবেলা প্লেনে করে ময়মনসিংহের উপর যে তুরা পাহাড়, সেই পাহাড়ের কাছে আমরা নামলাম। ওখানে আমরা শুনতে পেলাম যে, সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেব এবং আবদুল মান্নান সাহেব একটা রেস্ট হাউসে আছেন, পাহাড়ের নিচে বিএসএফ-এর লােক পাঠানাে হল। প্রায় দেড় ঘণ্টা লাগল তাদের এসে পৌছাতে। আমরা সবাই একে অপরকে জড়িয়ে ধরলাম। সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেব এবং তাজউদ্দীন সাহেব দুজন সেখানেই একান্তে আলাপ করলেন। সমস্ত ঘটনা, যা ঘটেছে, সব বিবৃত করলেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেব ফিরে এসে বললেন যে, তার সম্পূর্ণ মত আছে এবং আমাদেরকে অভিনন্দন জানালেন। তারপর সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেবকে নিয়ে আমরা আগরতলার পথে রওনা দিলাম।
References:
ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলামের সাক্ষাৎকার,
তাজউদ্দীন আহমদ আলোকের অন্ততধারা | সিমিন হোসেন রিমি
সংগ্রামের নোটবুক
ড্রয়িং – গৌরব, সংগ্রামের নোটবুক
error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!