শান্তি স্থাপনে বাংলাদেশ নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবে
জাতিসংঘ, নিউইয়র্ক: পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হােসন শুধু উপমহাদেশেই নয় বরং সমগ্র বিশ্বে শান্তি স্থাপনের প্রতি তার দেশের পূর্ণ প্রতিশ্রুতির কথা আবার উল্লেখ করেছেন। বাসস জানিয়েছে, গতরাতে বাংলাদেশের জাতিসংঘ ভুক্তির পর সদস্য রাষ্ট্রগুলাের অভিনন্দন গ্রহণকালে তিনি এই প্রতিশ্রুতির কথা উল্লেখ করেন। ড. কামাল হােসেন বলেন, মানব সমাজের আশাআকাক্ষা দ্রুত বাস্তবায়িত করার উদ্দেশ্যে শান্তি ও ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে একটি আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা গড়ে তােলার জন্য বাংলাদেশ জাতিসংঘের নীতি ও আদর্শকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। তিনি বলেন, পারস্পরিক সার্বভৌমত্ব, সমতা, আঞ্চলিক অখণ্ডতা, অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার ভিত্তিতে বিশ্বের সকল দেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তােলার জন্য বাংলাদেশ সব সময়ই একটি স্বাধীন জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতি অনুসরণ করেছে। তিনি বলেন, আমরা প্রায় সকল দেশের স্বীকৃতি লাভ করেছি এবং বিশ্বের সকল দেশের সঙ্গে দ্রুত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলছি। গ্রানাডা ও গিনি বিসাউ এর জাতিসংঘভুক্তির কথা উল্লেখ করে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তাদের অন্তর্ভুক্তিকে আমরা জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের শক্তিসমূহের বিজয় বলে মনে করি। এই বিজয় অন্যান্য বিজয়ের সূচনা। বাংলাদেশের জাতিসংঘভুক্তিতে সন্তোষ প্রকাশকালে ড. কামাল হােসেন বলেন, এই সুযােগ বাঙালি জাতি জাতিসংঘ সনদের নীতিসমূহ উর্ধ্বে তুলে ধরার কথা আবার ঘােষণা করেছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিকভাবে জাতিসংঘে অন্তর্ভুক্তির আগেই স্বাধীনতা পরবর্তীকালে এবং সাম্প্রতিক বন্যার ফলে ক্ষয়ক্ষতি পূরণের জন্য জতিসংঘ যে বিপুল সাহায্য দিয়েছে তাতে আমরা কৃতজ্ঞ। তিনি সাধারণ পরিষদের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট আলজেরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল আজিজ বুতেফ্লিকাকে ধন্যবাদ জানান। উল্লেখ্য গতরাতে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ২৯তম অধিবেশনে বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করেছে। ৫৪টি সদস্য রাষ্ট্র বাংলাদেশের জাতিসংঘে অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব উত্থাপন করলে তা সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। এই দিন গিনিবিসাউ ও গ্রানাডাও জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে। জাতিসংঘে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকারের আর একটি বিরাট বিজয়।
আসন গ্রহণ: বাংলাদেশের জাতিসংঘে অন্তর্ভুক্তির কথা ঘােষণার পর পরই হর্ষ আনন্দধ্বনির মধ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হােসেন সাধারণ পরিষদে আসন গ্রহণ করেন। সাধারণ পরিষদের সভাপতি আলজেরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল আজিজ বুতেফ্লিকা ৩টি নতুন দেশের জাতিসংঘ অন্তর্ভুক্তিতে সন্তোষ প্রকাশ করেন। তিনি বাংলাদেশ ও আলজেরিয়ার মধ্যে বিদ্যমান বিষয় সম্পর্কে উল্লেখ করেন। বিপুল সংখ্যক প্রতিনিধি বাংলাদেশ ও অপর দুটি নতুন সদস্য দেশের প্রতি অভিনন্দন জানান এবং উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে তাদের ঐতিহাসিক সংগ্রামের কথা উল্লেখ করেন। তিনি নতুন সদস্য রাষ্ট্র বিশ্বসংস্থায় কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করবে বলে তার দৃঢ় আশা।প্রকাশ করেন।
সােভিয়েত ইউনিয়ন: সােভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিনিধি বাংলাদেশের জাতিসংঘ অন্তর্ভুক্তিকে স্বাগত জানিয়ে দু’দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কথা উল্লেখ করেন। সােভিয়েত প্রতিনিধি জ্যাকব মালিক উপমহাদেশে শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখতে ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দের ভূমিকার প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, সােভিয়েত জনগণ বাংলাদেশের জনগণকে শ্রদ্ধা করেন। উভয় দেশ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বহু ব্যাপারে সহযােগিতা করেছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন প্রতিনিধি ট্যাপলী বেনের্ট বাংলাদেশের প্রতি অভিনন্দন জানিয়ে বলেন ১৯৭২ সালের ৪ এপ্রিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় এবং ঐ বছরই ৮ মে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। এর পর থেকে তার দেশ বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য ও সাংস্কৃতিক সম্পর্কের উন্নতি ঘটাচ্ছে।
ভারত: ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার শরণ সিং বলেন, বাংলাদেশের সৌভাগ্য যে, সে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতাে একজন নেতা পেয়েছে। স্বদেশে বঙ্গবন্ধুর প্রভূত সম্মান রয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের জাতিসংঘ অন্তর্ভুক্তি সেদেশের জনগণের গর্বের বিষয়। আমরা তাদের বন্ধু। আমরা তাদের সালাম জানাচ্ছি। এবং যারা স্বাধীনতার বিরুদ্ধে আত্মাহুতি দিয়েছেন তাদের কথা স্মরণ করছি।
আলজেরিয়া: আলজেরিয়ার প্রতিনিধি বলেন, জাতিসংঘ সদস্য পদ লাভের আগেই বাংলাদেশ জোটনিরপেক্ষ দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন এবং আলজেরিয়ার জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে যােগদান করেছে। তিনি বলেন, জাতিসংঘভুক্তির ফলে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সমাজে স্থান লাভ সমাপ্ত হলাে।
ইরান: নতুন সদস্যদের অভিনন্দন জানিয়ে ইরানের প্রতিনিধি আশা প্রকাশ করেন যে, বাংলাদেশ জাতিসংঘের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করবে।
আফগানিস্তান আফগান প্রতিনিধি দলের নেতা স্বাধীনতা অর্জনের জন্য বাংলাদেশের জনগণের বীরত্বপূর্ণ আত্মত্যাগের কথা উল্লেখ করেন।
লেবানন: লেবাননের প্রতিনিধি আরব দেশসমূহের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কথা উল্লেখ করে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংকট নিরসনে সাহায্য করার জন্য সকলের প্রতি আহ্বান জানান।
অন্যান্য দেশ: অন্যান্য দেশের মধ্যে যুগােশ্লাভিয়া, কানাডা, নেপাল, পূর্ব জার্মানি, লাইবেরিয়া, হাইতি, উগান্ডা, গ্রীস, বুলগেরিয়া ও আর্জেন্টিনার প্রতিনিধিরা বাংলাদেশের জাতিসংঘে অন্তর্ভুক্তিকে অভিনন্দন জানান।৫১
রেফারেন্স: ১৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪, বাংলার বাণী
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭৪, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ ও শাহজাহান মৃধা বেণু সম্পাদিত