You dont have javascript enabled! Please enable it!

জাতির উদ্দেশে বঙ্গবন্ধুর বেতার ভাষণ

ঢাকা: দেশ আজ এক জাতীয় দুর্যোগের সম্মুখীন। সতেরটি জেলা বন্যাকবলিত। মানুষের ঘড়বাড়ি, গবাদী পশু ও খামার বন্যার পানিতে ভেসে গেছে। একটু আশায় ও দুমুঠো অন্নের আশায় মানুষ হাত বাড়িয়ে আছে। এ দুযোর্গকে সাহসের সাথে মােকাবিলা করতে হবে। রােববার জাতির উদ্দেশ্যে এক বেতার ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একথা বলেন। তিনি অতীতের মতাে ঐক্যবদ্ধভাবে তাঁর ডাকে সাড়া দেওয়ার আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধু বলেন, জরুরি অবস্থা ঘােষণা করা হয়নি। তবে জরুরি অবস্থা বিরাজমান। সরকার সেই মনােভাব নিয়েই বিপন্ন মানুষকে রক্ষার জন্য সর্বশক্তি নিয়ােগ করেছেন। সরকারের সীমিত সামর্থ দুর্গতদের জন্য কাজে লাগানাে হচ্ছে।
বন্যার ধ্বংসলীলার বর্ণনা দিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, সরকার হতাশ হননি এবং মানুষের জন্য যা কিছু করা সম্ভব তাই করা হচ্ছে। তিনি দেশবাসীকে তাদের সাধ্যমতাে জনগণের পাশে গিয়ে দাঁড়ানাের অনুরােধ জানান। তিনি বলেন, বিপদের মােকাবিলা করাই তাদের বেঁচে থাকার একমাত্র পথ। তিনি স্বাধীনতার পর থেকে সরকার লক্ষ লক্ষ মানুষকে সম্ভাব্য মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করার জন্য কিভাবে খাদ্যাভাব, মুদ্রাস্ফীতি, বন্যা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ একটির পর একটি সমস্যা মােকবিলা। করেছেন তার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়ে বলেন, আমরা সব বিপদ সামাল দিতে পেরেছি কিনা জানি না। কিন্তু আপনাদের সহযােগিতার বলে বলীয়ান হয়ে অনেকটা সফলও হয়েছিল। তিনি যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের সহযােগিতায় যে সকল আন্তর্জাতিক বন্ধু এগিয়ে এসেছিলেন তাদের এবারও এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, স্বাধীনতার বত্রিশ মাসে আমরা যতটা এগিয়ে ছিলাম এই বন্যা আমাদের ঠিক ততটা পিছিয়ে দিয়েছে। তিনি ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে যাবার আহ্বান জানান।
প্রধানমন্ত্রী পাকিস্তানি আমলের নিষ্ঠুর অবহেলা ও শােষণের উল্লেখ করে বলেন, সিন্ধু অববাহিকা ও গােলাম মােহম্মদ বাঁধের কাজ করা হয়েছে কিন্তু ক্রুগ মিশনের রিপাের্ট অনুযায়ী কাজ করা হয়নি। বন্যা সমস্যা এখন জটিলতর হয়েছে। এবং আন্তর্জাতিক সাহায্য ছাড়া এই বিপুল প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। তিনি সরকারের সাফল্যের কথা উল্লেখ করে বলেন, ১২৬টি দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। জাতিসংঘের আসন আমরা লাভ করতে চলেছি, অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রেও কিছু সাফল্য অর্জিত হয়েছিল। বন্যা, ঝড়, মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধের প্রতিক্রিয়া ও আন্তর্জাতিক মুদ্রাস্ফীতির কারণে আবার আমরা চারদিক দিয়ে বিপদের সম্মুখীন হয়েছি। এই সংকট মুহুর্তে যারা দেশকে ভালােবাসেন তাদের আবার এগিয়ে আসতে হবে। সমাজশত্রু, কালােবাজারী ও মুনাফাখােরদের তৎপরতাকে অন্যতম সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে তিনি বলেন, যতটা সাফল্য অর্জন করা উচিত ছিল এদের কারণে ততটা করা যায়নি। এরা দুঃখী মানুষের দুঃখ বাড়িয়েই চলেছে।
বঙ্গবন্ধু বলেন, এদের দমন করার জন্যই বেসামরিক প্রশাসন ও সম্মিলিত বাহিনীর যৌথ অভিযান চালানাে হয়েছে। ফায়ারিং স্কোয়াডের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই ধরনের শত্রুদের দমন করার উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আসুন, আমরা পরস্পরকে সাহায্য করি।
বঙ্গবন্ধু বিশ্ববাজারে জিনিসপত্রের তুলনামূলক মূল্যবৃদ্ধির সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়ে বলেন, একটি আমদানিনির্ভর দেশ হিসেবে এর প্রতিক্রিয়া আমাদের ওপর এসে পড়েছে এবং এই সমস্যার সমাধানের কোন ‘জাদুমন্ত্র সরকারের হাতে নেই। তিনি ভােগবিলাস কমিয়ে উৎপাদন বৃদ্ধি, সমাজ শত্রুদের মােকাবিলা করা, অর্থহীন সমালােচনা পরিহার ও নিজ নিজ দায়িত্ব পালনের অনুরােধ জানান।
তিনি জনসাধারণের বন্যা পরবর্তী অসুবিধার কথা উল্লেখ করে বলেন, এদের পুনর্বাসনের কাজ খুবই কঠিন এবং এ কাজে জনগণ ও সরকারের সম্মিলিত উদ্যোগ দরকার। তিনি বলেন, সাহায্য সংগ্রহের চেষ্টা হচ্ছে এবং বাইরের দুনিয়া থেকেও সাড়া পাওয়া যাবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
তিনি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন যে, জনগণের দুঃখ দুর্দাশা ও রিলিফ নিয়ে যারা ছিনিমিনি খেলছে সেই পশুদের বাংলার মাটি থেকে উৎখাত করা হবে। প্রধানমন্ত্রী সরকারি কর্মচারীদের সভাবে নিঃস্বার্থভাবে কর্তব্য পালন ও মানুষের সেবা করে যাবার আহ্বান জানান। তিনি দুর্যোগে নিহতদের আত্মার শান্তির জন্য প্রার্থনা করারও আহ্বান জানান।৬১

রেফারেন্স: ১৮ আগস্ট ১৯৭৪, বাংলার বাণী
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭৪, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ ও শাহজাহান মৃধা বেণু সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!