You dont have javascript enabled! Please enable it!

প্রচ্ছদকাহিনী
আওয়ামী লীগে ভাঙন ও জোড়াতালি
আহমেদ নূরে আলম মতিউর রহমান চৌধুরী।
শেহাব আহমেদ জগলুল আলম

শেষ অবধি তিনবার কাউন্সিল পিছিয়ে দেয়ার পর ১৪ ফেব্রুয়ারী ১৯৮১ আওয়ামী লীগ (মালেক)-এর কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।
ভাঙনের দরোজায় দাঁড়ানো আওয়ামী লীগ কাউন্সিল অধিবেশন-শেষে কি চেহারা নেবে এখন বলা মুশকিল। কিংবা কাউন্সিল কি শান্তিপুর্ন না মারামারি-হানাহানির রঙ্গ মঞ্চে পরিণত হবে তাও বলা কঠিন। হয়তো শেষ মুহুর্তের জোড়াতালি দেয়া আওয়ামী লীগের ভগ্নতরী অধিবেশনের ঝঞ্জা-বিক্ষুদ্ধ সমুদ্র কোনোমতে পার হয়ে যাবে। কারণ দ্বিধা-বিভক্ত নেতৃত্ব সাময়িক ঐক্যের মুখোশ পরে অততঃ এই কাজটুকু সম্পন্ন করতে চান।
বর্তমান মুহুর্তে আওয়ামী লীগের এক দেহ দুই মন। নেতৃত্বের দ্বন্দ ও কোন্দলের আঘাতে আঘাতে অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণে আওয়ামী লীগ ক্লান্ত দুর্বল। গত সম্মেলনের পর, তিন বছরে, দেশের সর্ববৃহৎ বিরোধী দলটি বিভ্রান্ত ও উদ্দেশ্যহীন পথচলার পর কাউন্সিলের মুখোমুখী দাঁড়িয়েছে। দলের কর্মীরা হতাশা, ক্ষোভ ও ক্রোধ নিয়েই আসবেন অধিবেশনে। সেটাই ভয়ের কারণ।
কোনদিকে যাবে আওয়ামী লীগ—এটাই ছিলো সবচেয়ে বড়ো দ্বন্দ। কারা বয়ে নিয়ে যাবে আওয়ামী লীগের বিবর্তনের ধারা-এটাও ছিলো প্রধান প্রশ্ন । যারা শহর থেকে দলের সুখ-দঃখের সাথী তারা ? না ‘অনুপ্রবেশকারী’ বলে দলের অভ্যন্তরেই প্রত্যাখাত তাই দলটিকে নিয়ে যাবে বিলীন হওয়ার লক্ষ্যে ? সৃষ্টির পর আওয়ামী লীগ নিজের চিন্তা-ভাবনা অভিজ্ঞতার আলোকে পথ চলেছে, কখনো সফল হয়েছে, কখনো ব্যর্থ হয়েছ। কিন্তু এবারের মতো ভয়ংকর সংকটের মুখোমুখী আর কখনো হয়নি । ১ ফেব্রুয়ারী দলের নেতৃত্ব ২ ভাগ হয়ে যায়। দল ভাগাভাগির প্রক্রিয়া চলে সারাদিন । অনৈক্যের ব্যবধান দ্রুত বাড়তে থাকে। দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে দু’দিকে চলে যাওয়ার দরোজায় পা রেখে অনিশ্চিত ভবিষ্যতকে ভয় করে নেতৃত্বের দুটি শিবিরই একই সামিয়ানার নীচে বসতে রাজী হয় শেষ মুহুর্তে। অতীতে মওলানা ভাসানী, শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শেখ মজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বারবার নেতৃত্বের সংকটে পড়লেও ‘একক বিরাট ব্যাক্তিত্বের ‘ হাতে পরিচালিত হওয়ার ফলে সংকট কাটিয়ে উঠতে (অস্পষ্ট) । কিন্তু ৮১ সালের প্রেক্ষাপট ভিন্ন । পর্দার অন্তরালে ‘আন্তর্জাতিক মুরুব্বী’দের চাপও আওয়ামী লীগের সামনে বিরাট বাধা। তাই নেতৃত্বের বৈঠক খানা থেকে সংকট প্রসারিত হয়েছে কর্মীদের মনের ভেতরেও। ভাঙ্গন ঠেকানোর জোড়াতালি হিসেবে গঠনতন্ত্র সংশোধন করে যৌথ নেতৃত্ব চালু করতে উভয় পক্ষই সম্মত হয়েছে। কিন্তু যৌথ নেতৃত্ব আওয়ামী লীগের জন্যে উপযুক্ত কিনা তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। কারণ, একক ব্যক্তিত্বের নেতৃত্বেই আওয়ামী লীগের বিকাশ ঘটেছে। আওয়ামী লীগ সার্বজনীন দল, সিপিবি বা জামাতের মত সুশৃঙ্খল দল নয়। তাই যৌথ নেতৃত্ব দিতে বিপরীত হতে পারে নেতৃত্বের অনৈক্য ও বন্দর অব্যাহত থাকলে। আর সে দ্বন্দ্ব থাকবেই আওয়ামী লীগে। বর্তমানের সকল দ্বন্দ্ব-বিবাদের উৎস আদর্শ। এসব আপাতত এড়ালেও শেষ অবধি কতদিন এ ঐক্য টিকে থাকবে এবং ব্যক্তি, আদর্শ ও আন্তর্জাতিক লবীর সংঘাতে জাতীয় রাজনীতিতে দলের কার্যকারিতা ও ভূমিকা কতটুকু থাকবে সেটাই দলের কর্মী ও নেতাদের বর্তমান ভাবনা।
বিগত দিনের মারপিট, হানাহানি, রক্তারক্তি ভুলে গিয়ে একের বদলে অনেক নেতৃত্বের জোড়াতালি দিয়ে দলটিকে টিকিয়ে রাখা গেলেও আন্তর্জাতিক লাইন অনুসরণ করে আওয়ামী লীগ ক্ৰমশঃ মোজাফফর ন্যাপের মত ক্ষুদ্র ও শক্তিহীন দলে পরিণত হয়ে যাবে নাতো ? এ প্রশ্ন দলের সাচচা কর্মীও নেতাদের।
বিভক্তি, জোড়াতালি—কিন্তু শেষ রক্ষা হবে কি?
১০ ডিসেম্বর ১৯৭৯ দলের নেতৃত্বের সংঘাতে এক নতুন ধারার সৃষ্টি হয়।
ন্যাপ (মো) থেকে বেরিয়ে যাবার পর ন্যাপ (হারুন)এর একটি ব্যাপক অংশ মতিয়া চৌধুরী এবং সিপিবির উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কর্মী সমর্থক আনুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী লীগে ‘অনুপ্রবেশ করেন।
তাদের এ যোগদানে ‘মস্কো লবীর’ শক্তি উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়ে যায়। বাড়তে থাকে অসন্তোষ ‘খাটি’ আওয়ামী লীগার দের মাঝে। তারা অনুপ্রবেশঝারীদের’ আগমনকে সন্দেহের চোখে দেখেন। মনে করেন এরা দলের নেতৃত্ব আবদুর রাজ্জাকের কাধে ভর করে দলকে সিপিবির পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে যাবে।
এ অসন্তোষ আরো ব্যাপক হয় ‘বঙ্গবন্ধু পরিষদ’ ও মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদ’—দলের এ দুটি সংগঠন অনুপ্রবেশ কারীদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে চলে যাবার পর।
এ অসন্তোষ প্রকাশকারীদের নেতা হিসেবে উঠে আসতে থাকেন দলের সাংগঠনিক সম্পাদক তোফায়েল আহমেদ।
পাশ্চাত্য ঘে’ষা লবীর যে অংশ দলে থেকে গিয়েছিলেন। মীজান চৌধুরীদের প্রস্থানের পর, তারাও এ সময় তোফায়েল আহমেদের পেছনে সমর্থন দেন।
এমনি অবস্থায় দলের ঢাকা নগর কাউন্সিলে শক্তি পরীক্ষা হয় দু’পক্ষের। আবদুর রাজ্জাকের প্রার্থীরা নগর কমিটিতে তাদের শক্তি সংহত করেন। এ সময় দল থেকে অনেকে পদত্যাগ করেন। বিভিন্ন স্থানে বিরোধ বাধতে থাকে।
এ পটভূমিতে ৩ মার্চ ১৯৮০ নির্ধারিত হয় দলের জাতীয় কাউন্সিল। কিন্তু বিভিন্ন স্থানের জেলা কাউন্সিলগুলোর নির্বাচন এ সঙ্কটের কারণে অনুষ্ঠিত না হবার ফলে পিছিয়ে যায়—এ কাউন্সিল।
অসন্তোষকে চাপা দেবার জন্যে নেতাদের মধ্যে প্রবনতা দেখা দেয় সরকার বিরোধী আন্দোলনের দিকে।
৩১ জানুয়ারী ১৯৮০ রাজশাহী কারাগারে সংঘঠিত ঘটনাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে দশ-দলের ঐক্যজোট। যাতে মস্কো “দিল্লী’ ঘেষা দলগুলোর প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়।
৯ ফেব্রুয়ারী হরতালকে কেন্দ্র করে আন্দোলনের অজুহাতে ৩ মার্চ কাউন্সিল পেছনের অন্যতম অজুহাত দেখিয়ে দলের সংকট চাপা দেবার চেষ্টা চালানো হয়।
পরবর্তী কাউন্সিলের তারিখ নির্ধারিত হয় জুন মাসে। কিন্তু মস্কো লবী আশা করছিলেন দশ দলের কাঠামোর ভেতর থেকে প্রগতিশীল’ কর্মসুচীর মাধ্যমে একটি জোট পূর্ণাঙ্গভাবে বের হয়ে আসবে। ফলে জুন মাসের কাউন্সিল তারিখ আর ঘোষিত হয়নি।
২৭ মার্চ ১৯৮০ দশ-দলের সভায় শেখ মুজিবের ছবি টাঙ্গানো নিয়ে আওয়ামী লীগ ও জাসদ কর্মীদের মাঝে মারপিট হয়। ফলে দশ-দলের অগ্রগতি আপাততঃ থেমে যায়।
এরপর আবার নতুন করে দলের কোন্দল বাড়তে থাকে। নতুন করে কাউন্সিল অধিবেশন ধার্য করা হয় ৩ নবেম্বর ১৯৮০।
২০ অক্টোবর খুলনা জেলের ঘটনায়, দশ-দল যা ন’-দলে রুপান্তরিত হয়েছিল তা আবার দশ-দলের কাঠামোয় ফিরে যায়।
২৮ অক্টোবর দশ-দল ও ১৫টি দলের উদ্যোগে হরতাল ডাকার আড়ালে এবং সর্বোপরি ১ নবেম্বর আওয়ামী লীগের তরফ থেকে আন্দোলনের কর্মসুচী ঘোষণা করে ‘জেলহত্যা দিবসের’ আড়ালে ৩ নবেম্বর হরতাল এককভাবে দলের তরফ থেকে ডাকা হয়। আবার কাউন্সিলের তারিখ দেয়া হয় ২৩ ডিসেম্বর। কিন্তু নেতারা কাউন্সিলের আগে ঐক্যমতে আসতে ব্যর্থ হন। এ ব্যর্থতার কারণে আবার ২ ডিসেম্বর কাউন্সিল ফের ধার্য করা হয় ১৪ ফেব্রয়ারী, ১৯৮১ অবধি। এই অবসরে ২ টি গ্রুপের নেতৃত্বের কোন্দল ভেতরেভেতরে তীব্রতর হতে থাকে ও পরিস্থিতি সংঘর্ষের দিকে যেতে থাকে যার পরিনতিতে জানুয়ারীতে দেশের বিভিন্নস্থানে দলের কর্মীদের মধ্যে মারপিট ঘটতে থাকে। ৫ জানুয়ারী নারায়ণগঞ্জে জেলা কাউন্সিল প্রথম পন্ড হয়।
কাউন্সিল তারিখকে কেন্দ্র করে তীব্রতর হতে থাকে দলের ভেতরের সঙ্কট। তবুও অনেকগলো জেলা কাউন্সিল অসমান্ত রয়ে যায় কমিটি গঠনে রফা না হওয়ায়। দু’পক্ষের নেতারা যার যার শক্তি বলয়ে প্রাধান্য বিস্তারের চেষ্টা চালাতে থাকেন।
চট্টগ্রামের ঘটনার সুত্র ধরে ঢাকায় ২৯ জানুয়ারী ওয়ার্কিং কমিটির নেতৃবন্দ কার্যালয়ে বৈঠক ফেলে অন্যত্র মিলিত হয়।
বৈঠক মুলতবী ঘোষণার পরই ওয়ার্কিং কমিটি কার্যত দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায়। এ ব্যাপারে প্রথম উদ্যোগ নেয় রাজ্জাক গ্রুপ পৃথক বৈঠক করে। সেখানে তারা বিশ্লেষণ করে দেখেন বিরোধী গ্রুপটিকে দল থেকে বের করে দেয়ার যথাযথ সময় এসেছে।
আবদুর রাজ্জাক ১৯৭৮-এর পর পরই তার নিজস্ব ‘ক্যাডার’ গঠনের মাধ্যমে দলের ভেতরে প্রচন্ড শক্তি সঞ্চয় করেন। অন্যদিকে তোফায়েল আহমেদের পেছনে দলের প্রবীণ নেতারা দলের স্বকীয়তা এবং নিজেদের প্রাধান্য বজায় রাখার চেষ্টা চালান। এই বৈঠকের পরিণতি একটি প্যানেলের জন্ম দেয় যাতে তোফায়েলসহ কিছু নেতা বাদ যান। এর জবাবে তোফায়েল গ্রুপ একটি পাল্টা প্যানেল তৈরি করেন যাতে রাজ্জাকসহ কিছু নেতা বাদ পড়েন। শুধু বাকী থাকে দল বিভক্তির আনুষ্ঠানিক ঘোষণা।
কিন্তু এরপর পরিস্থিতি দ্রুত বদলাতে থাকে। আন্তর্জাতিক চাপ বা উপদেশের মুখে রাজ্জাক গ্রুপ ফয়সালার প্রস্তাবে সাড়া দেয়।
এব্যাপারে একটি ক্ষুদ্র রাজনৈতিক দল প্রধান ভূমিকা নেয় বলে শোনা যায়। তোফায়েলদের দল থেকে বের করে দেয়ার ভাষা পরিত্যক্ত হয় এ কারণে যে, রাজ্জাক গ্রুপ’ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ষে লাইন অনুসরণ করছে তাতে বিপুল সংখ্যক কর্মী ও সমর্থক হারাবার একটা ভয়ঙ্কর ঝুকি রয়েছে।
তাই মারপিট উত্তেজনার মুখেও আবদুর রাজ্জাকে নেতৃত্বাধীন অংশ প্রথমতঃ দলে শক্তি বেশি থাকা সত্তেও দলে বিভক্তি শেষ অবধি এড়িয়ে যেতে মধ্যস্থতা বৈঠকে যোগ দেন।
এ মধ্যস্থতা করেন দু’পক্ষের মাঝে প্রবীন নেতাদের একটি অংশ। এতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন বহুদিন পরে বিদেশ থেকে ফিরে আসা । প্রাক্তন পররাষ্ট্র মন্ত্রী ডঃ কামাল হোসেন এবং বিরোধী দলের নেতা আসাদুজ্জামান খান প্রমুখেরা। দলের সভাপতি আবদুল মালেক উকিল প্রথমে আবদুর রাজ্জাকের অংশের সঙ্গে ঝুকে পড়লেও পরে তোফায়েল আহমেদের সঙ্গেও একটা সম্পর্ক বজায় রাখেন এবং শেষের দিকে বিরোধে মধ্যস্থতাকারীদের সঙ্গে যোগ দেন।
ডঃ কামাল হোসেনকে এক পর্যায়ে সভাপতি এবং আবদুর রাজ্জাকের সম্পাদক করে একটা ফয়সালার চেষ্টা চালানো হয় ২ ফেব্রুয়ারী দলের শাসনতন্ত্র ও ম্যানিফেস্টো কমিটির বৈঠকে।
ধারাবাহিকভাবে ১৫ সদস্য বিশিষ্ট এ কমিটি, যাতে দু’পক্ষ এবং মধ্যস্থতাকারীরাও রয়েছেন, তারা আপোষ প্রচেষ্টা চালিয়ে যান। কার্যতঃ শাসনতন্ত্র সংশোধনের জন্য এ কমিটি দলের বিভিন্ন নেতৃবৃন্দের বাড়িতে বৈঠক চালালেও আলোচনায় মুলতঃ আপোষ ফর্মুলা খুজে বার করার প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকে।
৬ ফেব্রুয়ারী নেতারা দলের নেতৃত্বের বর্তমান পদ্ধতি বদল করে প্রেসিডিয়াম এবং সেক্রেটারিয়েট গঠন করে বর্তমান সংকট নিরসনের চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এটা করা হয়েছে একক নেতৃত্বের বদলে যৌথ নেতৃত্ব দাঁড় করাবার জন্যে।
কিন্তু এ সিদ্ধান্ত ঐক্যবদ্ধভাবে গৃহিত হলেও ৯ ফেব্রুয়ারী আহত ওয়ার্কিং কমিটি অতঃপর ১১ ফেব্রুয়ারী বর্ধিত সভায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে চুড়ান্তভাবে কাউন্সিলে ১৪ ফেব্রুয়ারী অনুষ্ঠিত হবে।
কিন্তু প্রথম দিন থেকেই ঐক্যমত পোষণ করলেও তারা ৭ দিন বৈঠকের পরও প্রেসিডিয়ামে এবং সেক্রেটারিয়েটে কতজন সদস্য এবং তারা কে হবেন তা চুড়ান্তভাবে স্থির করতে পারেননি যদিও যৌথ নেতৃত্বে কারা থাকবেন সে গুজব শোনা যাচ্ছে ।
আবদুর রাজ্জাক সেক্রেটারী জেনারেল পদে বহাল থাকলেও সভাপতি কে হবেন তাও স্থির করতে পারেননি।
ধারণা করা হচ্ছে হয়ত শেষ অবধি ডঃ কামাল হোসেন কিম্বা প্রবীনদের প্রতিনিধি হিসেবে আবদুল মালেক উকিল আগের মতই ‘সমঝোতা’র সভাপতি মণ্ডলীর সভাপতি হবেন।
যতদূর জানা গেছে কাউন্সিলে কেবলমাত্র কাউন্সিলরদেরই প্রবেশ অধিকার থাকবে। স্ব স্ব জেলার নেতারা তাদের সনাক্ত করে প্রবেশ করতে দেবেন। এবং চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত গোপন ব্যালটে নেয়া হবে যদি কোন উত্তেজনাকর পরিস্থিতির উদ্ভব হয়।

প্রকাশ্য দ্বিধাবিভক্তি যেদিন থেকে
অনেক পর্যবেক্ষক বলেন যে, যেদিন থেকে মীজান চৌধুরী বেরিয়ে যান সেদিন থেকেই অনানুষ্ঠানিকভাবে দলটি বিভক্ত। কর্মী সমর্থন হারানোর ভয়ে এতোদিন কেউ মুখ খুলতে সাহস করেননি। বিভক্তি যেহেতু আদর্শিক, সেহেতু দ্বন্দ্ব ভেতরে ভেতরে দানা বেধেছে।
৮০ সালে দলীয় দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষের খবর পাওয়া যায়। সেগুলোও কম উলেখযোগ্য নয়। এবছরের শুরুতে কোন্দল ব্যাপকভাবে আত্মপ্রকাশ করে প্রথমে নারায়ণগঞ্জে। তবে চট্টগ্রামের ঘটনাই সর্বাধিক প্রচারিত। সাত জানুয়ারী চট্টগ্রামে জে এম সে হলে মহানগরী কাউন্সিল অনুষ্ঠানের দিন দু-টি গ্রুপ সামনা-সামনি সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। ২০ জন আহত হয়। ছুরিকাঘাতে আহত ৫ জন হাসপাতালে যায়। সংঘর্ষ নগরীর বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। বিপনি বিতান, নন্দনকানন ও আন্দরকিল্লা এলাকায় সংঘর্ষ ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করে।
সকাল ১০টায় সভাপতি আবদুল মালেক উকিল, সহসভাপতি কোরবান আলী, আবদুল মোমিন তালুকদার ও আবসুস সামাদ আজাদ এবং সাংগঠনিক সম্পাদক তোফায়েল আহমদ সম্মেলন প্যান্ডেলে হাজির হলে ‘দু’পক্ষ’ শ্লোগান-পাল্টা শ্লোগান দিতে থাকে। কেন্দ্রীয় নেতৃবন্দ মঞ্চে বসার পর একদল কর্মীর হাত মঞ্চের দিকে চেয়ার নিক্ষেপ করতে থাকে। কয়েকটি জুতাও এসে পড়ে মঞ্চে। হতভম্ব নেতৃবন্দের সামনে দু’টি দল পরস্পরকে আক্রমণ করে। নিক্ষিপ্ত একটি চেয়ার এসে মালেক উকিলের গায়ে পড়ে। তিনি সামান্য আহত হন। তোফায়েল আহমদ মারামারি বন্ধ করার চেষ্টা করলে তাকেও মারধোর করা হয়। এক পর্যায়ে ছোরাধারী এক ব্যক্তি তার দিকে এগিয়ে এলে তাকে পলায়ন করতে দেখা যায়। কোরবান আলীও সম্মেলন কক্ষ থেকে বেরিয়ে এসে হতভম্বের মত ঘুরতে থাকে। আবদুল মোমিন তালুকদার ও আবদুস সামাদ আজাদ খণ্ডযুদ্ধের মধ্যে সম্মেলন স্থগিত ঘোষণা করেন। এখানে শেখ মুজিবের প্রতিকৃতিও একটি গ্রুপ ভেঙ্গে ফেলে।
আওয়ামী লীগের এখানকার সম্মেলন গোলযোগের আশঙ্কায় এর আগে দু’বার স্থগিত ঘোষণা করা হয়। বিবদমান দুপক্ষের একটির সমর্থন দিচ্ছেন আবদুর রাজ্জাক, অন্যটির সমর্থন দিচ্ছেন তোফায়েল আহমদ।
চট্টগ্রাম থেকে দলীয় সংঘর্ষের আগমন সারাদেশে দলের ইউনিটগুলোর ছড়িয়ে পড়ে। চট্টগ্রামে কয়েকবার সংঘর্ষের পুনরাবৃত্তি ঘটে।
৩১ জানুয়ারী চট্টগ্রাম (দক্ষিণ) জেলা আওয়ামী লীগের মুলতবী কাউন্সিল প্রেস ক্লাবে ও জেএমসেন হলে অস্ত্রের ঝনঝনানির মধ্য দিয়ে এবং দুটি স্থানেই একাংশের অনুপস্থিতিতে সমাপ্ত হয়। রাজ্জাক সমর্থিত গ্রপের অস্ত্রের বিপুল মহড়ার মুখে তোফায়েল সমর্থকরা সম্মেলন কক্ষে প্রবেশ না করেই বাইরে অবস্থান করে এবং শেষে জেএমসেন হলে চলে যায়। অন্ত্রের মহড়া প্রদর্শনের ফলে প্রেসক্লাব সংলগ্ন এলাকায় থমথমে ভাব বিরাজ করতে থাকে। দোকান পাট বন্ধ হয়ে যায়। শান্তি ভঙ্গের আশঙ্কায় বিপুল সংখ্যক মেট্রোপলিটান পুলিশ মোতায়েন দেখা যায়।
প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে প্রবীণ কর্মী ও কাউন্সিলরদের উপস্থিতি ছিলো অত্যন্ত নগণ্য। তবে যুব লীগ ও ছাত্র লীগের কর্মীরা বিভিন্ন যায়গা থেকে এ সম্মেলনে যোগ দেয়। দিন শেষে দু জায়গায় অনুষ্ঠিত দুটি সম্মেলনে দুটি কমিটি গঠন করা হয় এবং এ-ঘোষণার মাধ্যমে সর্ব প্রথম দ্বিধাবিভক্ত নেতৃত্ব আনুষ্ঠানিকতা লাভ করে। এরই অনুসরণে ইতিমধ্যে রাজশাহী ও সৈয়দপুরে দুটি পৃথক কমিটি গঠিত হয়।
কেন্দ্রীয় ওয়ার্কিং কোন গ্রুপের কমিটিকে বৈধভাবে স্বীকৃতি দেবেন তা জানা যায়নি। সাত ফেব্রুয়ারী উভয় গ্রুপের তরফ থেকেই বলা হয়েছে যে, বৈধ কমিটি হিসেবে তাদের কমিটিগুলো কাউন্সিলে যোগ দেবে। যদি তা হয়, তাহলে মুখোমুখি দুটি কমিটির উপস্থিতির ফলে সংকটের চেহারা কল্পনা করা দুঃসাধ্য। এ-পরিস্থিতিতে কিছু পর্যবেক্ষকের ধারনা শেষ পর্যন্ত হয়তো সত্য হয়েও যেতে পারে। তাদের ধারণা, ১৪ ফেব্রুয়ারী কাউন্সিল অধিবেশন যদিও বা হয়, তাহলে তা হবে দুটি পৃথক স্থানে। উলেখ্য, গত বছর ঢাকা নগর কাউন্সিলের অধিবেশন ‘একই দিনে একই সময়ে কিন্তু দুটি পৃথক স্থানে’ অনুষ্ঠিত হবে বলে ঘোষিত হয়েছিলো। তবে নেতাদের শেষ মুহুর্তের মতৈক্যের ফলে একই স্থানে অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু এবার দ্বিধাবিভক্ত নেতৃত্ব তাদের ফলে সৃষ্ট কমিটিকে পরিত্যাগ করবেন কি করবেন না তার ওপরই নির্ভর করছে এক কাউন্সিলের’ ভবিষ্যত। ১১ ফেব্রুয়ারী নির্বাহী কমিটির বর্ধিত সভায় দুটি কমিটির মধ্যে ফয়সালা করে একটি কমিটি করে হয়তো ‘শেষ মুহুর্তের মতৈক্য ঘটতে পারে, সেরকম যদি না বটে তাহলে অবাক হওয়ায় কিছুই থাকবে না।

হঠাৎ সচকিত ঢাকা ,মনহীন ভ্রাতৃত্ব , গোপনআস্তানা
( অস্পষ্ট ) হয়ে ওঠে ১১ জানুয়ারী। একদল কর্মী দলের কার্যালয়ে হামলা চালায় । তখন কাতার থেকে (অস্পষ্ট) উদ্দেশ্যে (অস্পষ্ট) ঢাকা প্রত্যাবর্তনকারী সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক দলের নেতৃবৃন্দের কাছে সফর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছিলেন। হামলাকারীরা মস্কোপন্থীরা আওয়ামী লীগ ছাড়ো’, ‘আদম ব্যাপারী রাজ্জাক বঙ্গবন্ধুর দল ছাড়ো’, । চট্টগ্রামে হামলা কেনো জবাব দাও’, নানা শ্লোগান দিয়ে অফিস তছনছ করে। চেয়ার ভাঙ্গাভাঙ্গি ছোড়াছুড়ির কিল-থাপ্পড় ইত্যাদির, এক পর্যায়ে দলের কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক সম্পাদক এস এম ইউসুফ আহত হন। তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
এ-ঘটনার ব্যাপারে পরস্পর বিরোধী বক্তব্য পাওয়া যায়। কেউ কেউ বলেন সাত জানুয়ারী চট্টগ্রামে কাউন্সিল অধিবেশন পন্ড করা, সাংগঠনিক সম্পাদক তোফায়েলকে আহত করা, কোনো নেতার বিরুদ্ধে দূর্নীতির অভিযোগের বিরুদ্ধে এই বিক্ষোভ। আবার কেউ বলেন, মুজিব হত্যার প্রস্তাবিত তদন্তের জন্যে বৃটেন থেকে বেসরকারী তদন্ত কমিশনের ঢাকা আসার বিরোধিতাকারীরা এই মারপিটের সুচনা করেছেন। অন্য একটি সুত্রে জানা যায় । জনাব রাজ্জাক ও জনাব তোফায়েলের নেতৃত্বের কোন্দলের বহিঃপ্রকাশ হিসেবেই এই মারামারি।
১২ জানয়ারীঃ দলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। একটি নরম ভাষায় বিবৃতি দেন সংবাদপত্রে। বিবৃতিতে জনাব ইউসুফের অবস্থাও তারা এড়িয়ে যান।
১৩ জানুয়ারীঃ তদন্ত কমিশন ঢাকা আসেনি। সরকার কমিশনকে ঢাকা আসতে দেন নি বলে আওয়ামী লীগ একটি প্রতিবাদ সভা ডাকে বায়তুল মোকাররমে। জনাব উকিল, জনাব রাজ্জাক , জনাব তোফায়েল ও ডঃ কামাল সভায় ভাষণ দেন। তারা অভিযোগ করেন যে, এ সরকার বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে জড়িত, তা না হলে আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিশনের ঢাকা আগমনে বাধা সৃষ্টি করলেন।
১৭ জানুয়ারীঃ কার্যালয়ে সন্ধ্যায় দুদল কর্মীর মধ্যে সংঘর্ষ। সংঘর্ষের পর প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ। দলের কার্যালয়ের লবীর খবরঃ সাংগঠনিক সম্পাদক তোফায়েল আহমদের বহিষ্কারের খবরের প্রতিক্রিয়া হিসেবে এ-ঘটনা। এ-ব্যাপারে সভাপতি আবদুল মালেক উকিলের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি এমন কোন ঘটনার কথা শোনেননি বলে জানুন। তবে এও বলেন যে তিনি সন্ধ্যায় অফিসে ছিলেন না।
দলের সাংগঠনিক সম্পাদক তোফায়েল আহমদকে সাময়িক ভাবে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে বলে একটি খবর শোনা যাচ্ছে—খবরটি সত্যি কিনা জানতে চাওয়া হলে জনাব মালেক উকিল প্রথমে পাল্টা প্রশ্ন করেন । আপনারা কার কাছে শুনেজেন এ খবর ?
২৮ জানুয়ারীঃ চট্টগ্রাম ও ঢাকায় ‘গুরুতর দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ ও অশোভন আচরণ সম্পর্কে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্দেশে ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক শুরু।
২৯ জানুয়ারীঃ আবার সংঘর্ষ। দু-দলের মধ্যে প্রায় সারাদিন থেকে থেকে লাঠালাঠি হাতাহাতি মারামারি। সংঘর্ষে দশ জন ছুরিকাহত। সংঘর্ষ বিকেলের দিকে এমন পর্যায়ে পৌছে যে নেতৃবৃন্দ পেছনের দরোজা দিয়ে পালিয়ে যান। কেউ কেউ মইয়ের সাহায্যে নামেন। এরপর তারা এক গোপন আস্তানায়’ মিলিত হন। দলের তরফ থেকে এ-পর্যন্ত গোপন আস্তানার ঠিকানা জানানো হয় নি। তবে সে স্থানটি ডঃ কামাল হোসেনের বাসভবন—এটা এখন একটি ওপেন সিক্রেট। ২৯ জানুয়ারীর পর ছয়দিন কার্যালয়টিতে কোনো গ্রুপের নেতৃবৃন্দই আসেন নি।
ডঃ কামাল হোসেনের বাসভবনে ওয়ার্কিং কমিটি কি আলোচনা করেছে সে বিষয়ে সেদিন কিছুই বলা হয়নি দলে তরফ থেকে। পাঁচদিন পর দলের দফতর সম্পাদক সৈয়দ আহমদ সংঘর্ষ সক্রান্ত পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত খবর সম্পকে একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি দেন। সম্পূর্ণ বিভ্রান্তিকর ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত’ খবর সংবাদপত্রগুলো প্রকাশ করছে বলে অভিযোগ করে তিনি দলীয় নেতৃবৃন্দ ও বিশাল কর্মীবাহিনীকে বিভ্রান্ত না হওয়ার অনুরোধ জানান।
এই প্রেস বিজ্ঞপ্তিটি একটি গ্রুপের চাপে পড়ে ইস্যু করা হয় বলে জানা গেছে। এই বিজ্ঞপ্তিতেও নেতৃত্বের মধ্যে বিভেদ লক্ষ্য করা যায়। এতে বলা হয় যে, দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে যাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তা সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত’। এ-ব্যাপারে নেতৃবৃন্দের মধ্যে প্রবল কোনরুপ মত পার্থক্য হয় নি।
৩০ জানুয়ারীঃ ওয়ার্কিং পার্টির বৈঠক ৯ ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত মুলতবী ঘোষণা। কয়েকজনকে বহিষ্কারের শো-কজ নোটিশ-জারীর সিদ্ধান্ত।
এ-রাতে সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী ও নির্বাহী কমিটির সদস্য আবদুস সামাদ আজাদের বাসায় রাজ্জাক গ্রুপের নেতাদের বৈঠক । দলের নেতৃত্বের প্যানেল তৈরী সভাপতি পদে আবদুস সামাদ আজাদ ও সাধারণ সম্পাদক পদে আব্দুর রাজ্জাক। “মস্কোপন্থী” প্যানেল গঠন।
৩১ জানুয়ারীঃ যুগ্ম-সম্পাদিকা, সাজেদা চৌধুরীর বাসভবনে তোফায়েল গ্রুপের বৈঠক। পাল্টা প্যানেল গঠন। সভাপতি পদে ডঃ কামাল হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক পদে বেগম জোহর তাজদ্দিন। উভয় গ্রুপের কয়েকদফা পৃথক বৈঠক। তোফায়েল গ্রপের ‘আপোষ’ প্রস্তাব।
২ ফেব্রুয়ারী সকালে উভয় গ্রুপের কয়েক দফা বৈঠক পরে রাজ্জাক গ্রপে কতৃক তোফায়েল গ্রুপের ‘ফয়সালা’ প্রস্তাবে সাড়া। ডঃ কামালের বাসভবনে গঠনতন্ত্র কমিটির বৈঠক। উভয় গ্রুপের তিনদিন পর এটাই প্রথম যুগ্ম-বৈঠক। রাজ্জাক গ্রুপের বৈঠক যোগদান সম্পর্কে পর্যবেক্ষক মহলের মতব্য ; ‘আন্তর্জাতিক চাপের মুখে অনিচ্ছাতেই যুগ্ম-বৈঠকে রাজ্জাক যোগদান করে। কারণ, আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক লাইনের প্রশ্নে রাজ্জাক গ্রুপ বর্তমান সমর্থক ও কর্মীদের বিরাট অংশকে হারাতে পারে।
এ-বৈঠকে উভয় গ্রুপই ‘যৌথ নেতৃত্ব মেনে নিতে সম্মত হয়। যৌথ নেতৃত্বের ধরণ-ধারণ কি হবে তা ঠিক করার দায়িত্ব দেয়া হয় ডঃ কামাল হোসেনের ওপর।
পরবর্তী কয়েকদিন নেতৃত্বের ধরণ-ধারণ নিয়ে আলোচনার পর যৌথ নেতৃত্ব অর্থাৎ প্রেসিডিয়াম পদ্ধতির সংশোধন মেনে নেয়া হয়। ৭ ফেব্রুয়ারী সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, গঠনতন্ত্রের প্রস্তাবিত সংশোধন জাতীয় কাউন্সিল অধিবেশনে মনোনয়নের জন্যে পেশ করা হবে। একজন চেয়ারম্যানসহ ১১ সদস্যের প্রেসিডিয়াম এবং ১১৫ সদস্যের ওয়ার্কিং কমিটি গঠনের প্রস্তাব থাকবে গঠনতন্ত্র সংশোধনীতে। ১১ ফেব্রুয়ারী ওয়ার্কিং কমিটি প্রস্তাবিত সংশোধনীকে ‘সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণ করবে বলেও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

কয়েকজন যুবক ‘বিশৃঙ্খলাকারী’…….. .
বিভিন্ন নেতার বাসভবনে যখন বৈঠক চলছে, তখন চার-ফেব্রুয়ারী আওয়ামী যুব লীগ (আমু)-এর চেয়াম্যান ও সাধারণ সম্পাদক সংগঠনের তৃতীয় কংগ্রেস অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষনা করেন । অনুষ্ঠানের মাত্র মাত্র চার দিন আগে কেন কংগ্রেস স্থগিত করে হলো , তার ব্যাখ্যা চেয়ারম্যান আমীর হোসেন আমু বা সাধারণ সম্পাদক ফকির আবদুর রাজ্জাক দেয় নি। তারা সংক্ষেপে মন্তব্য করেছেনঃ কংগ্রেস অনিবার্য কারণবশত বন্ধ ঘোষণা করা হলো।’
দলের দ্বিতীয় বৃহৎ ও অঙ্গ-সংগঠন যুব লীগের কংগ্রেস স্থগিত করা ছাড়া কোনো উপায়ই ছিলো না। এ-মন্তব্য হচ্ছে যুবলীগের একজন প্রভাবশালী নেতার। তিনি আমাদের যা বললেন, তা সংক্ষেপে এই দাড়ায়—দলীয় নেতৃত্বের কোন্দল পার্টিতে হতাশা সৃষ্টি করছে। ছাত্র-যুবকরা ইতিবাচক রাজনীতি চান। চান আন্দোলনের একটা স্পষ্ট ছবি। আন্দোলন কি সরকার সরানো, বা বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার না পার্টিকে মজবুত ও শক্তিশালী করে গড়ে তোলা, কোনোটাই আসছে না তাদের বক্তব্য থেকে। যেমন দলের সভাপতি সেপ্টেম্বরে সাংবাদিক সম্মেলনে বললো, আওয়ামী লীগ সরকার হঠানোর আন্দোলন করবে। আন্দোলনের কথা বলে তারা কর্মীদেরকে একদিকে বিভ্রান্ত করলেন, অপরদিকে নেতৃত্বের স্বপ্ন নিয়ে মেতে রইলেন। তারা আবার বললেন, বঙ্গবন্ধুর হত্যা তদন্তের জন্যে আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিটি আসছে। এলো না। কর্মীদের তারা প্রতারিত করলেন। স্বাভাবিক কারণেই কর্মীদের মধ্যে বিতৃষ্ণা এসেছে। সে বিতৃষ্ণা ও আস্থাহীনতা থেকে দলের কার্যালয়ের মত পবিত্র স্থানও কর্মীদের হানাহানি ও মারামারির কুরুক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। এজন্যে ছাত্র-যুবকদের দায়ী করা অন্যায় হবে। সে কারণে, সংঘর্ষের ব্যাপারে ঢাকা ও চট্টগ্রামে যে-সব যুব ও ছাত্রলীগ কর্মীদের বিরুদ্ধে বহিষ্কারের নোটিশ জারী করা হয়েছে, তাদের পক্ষ থেকে প্রবল প্রতিবাদ এসেছে। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন, এ প্রতিবাদের উত্তর না দিয়ে কংগ্রেসে কিছুতেই অনুষ্ঠান করতে পারবে না কোনো নেতাই’। এ-দাবীর কাছেই লীগ নেতারা নতি স্বীকার করেছেন।
পর্যবেক্ষক মহলেরও ধারণা তাই। তারা মনে করছেন যে, ১১ জানুয়ারী আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে সংঘর্ষ ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার ব্যাপারে যাদেরকে, বিশেষ করে ঢাকায় যুব লীগের দু’জন নেতার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের ফলে সৃষ্ট অচলাবস্থা এখনো দুর হয় নি। চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল মারপিট ও অগ্নিকান্ডের মাধ্যমে ভন্ডুল হয়েছে। জতীয় কাউন্সিলে তাই ঘটতে পারে। এ-ভয় সকল নেতারই।
দলীয় নেতৃত্ব গৃহীত ব্যবস্থার প্রশ্নে এখন নমনীয় মনোভাব দেখাচ্ছেন। এ-বিষয়টি তারা বলতে গেলে প্রকাশ্যে ধামাচাপা দিয়েছেন। অভিযোগ তদন্তের জন্যে গঠিত দু সদস্যের কমিটিও কাজ করছে না। কার্যনির্বাহী কমিটির কাছে রিপোর্ট দেওয়ার কথা থাকলেও তা ‘আপাতত দেয়া হচ্ছে না। এ-বক্তব্য হচ্ছে নেতৃত্বের একটা অংশের।
অন্য অংশটি বলছেন তার উল্টো। নমনীয় মনোভাব নেওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। পার্টি এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে সর্বসম্মত প্রস্তাব নিয়েছে। দু-চারজন দুষ্কৃতকারী ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী কর্মীর ভয়ে এতো বড়ো রাজনৈতিক দল এ্যাকশান গ্রহনের রাস্তা থেকে পিছিয়ে যেতে পারে না ।

আওয়ামী লীগ , মুজিবের পর………..
সংকটের শুরু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। প্রায় ছ-ফুট লম্বা দীর্ঘদেহী সর্বাত্মক ব্যক্তিত্বের অধিকারী শেখ মুজিবুর রহমানের প্রস্থান ও তার কিছুকাল পর শেখ মুজিবের কাছাকাছি পাঁচ ব্যক্তিত্ব সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, কামরুজ্জামান, মনসুর আলীর মৃত্যু এবং খন্দকার মোশতাক আহমেদের দল থেকে সম্পর্কচ্ছেদ আওয়ামী লীগের প্রথম সারির নেতৃত্বের শূন্যতা এনে দেয়।
১৯৭৬ এর ‘পলিটিক্যাল পার্টিজ রেগুলেশন (পিপিআর) এর আওতায় জাতীয় সংসদের স্পীকার অবদুল মালেক উকিলের দরখাস্তে নতুন করে আওয়ামী লীগের পুনর্জন্ম এ শূন্যতাকে আরো ব্যাপক করে তোলে।
দ্বিতীয় সারির নেতাদের হাতে অর্পিত হবার ফলে জন্ম নেয় নেতৃত্বের সংকট। শেখ মুজিবের একক নেতৃত্বের বদলে শুরু হয় ব্যক্তিগত প্রাধান্যের প্রয়াস।
১৯৭৬ এর ডিসেম্বরে এ দ্বন্দের মুখে কোন একক ব্যক্তিত্ব দলের সামনে না আসায় অনেক টানাপোড়নের পর মোল্লা জালালউদ্দিন ও মীজানুর রহমান চৌধুরীকে যুগ্ম-আহবায়ক করে গঠিত হয় ৫৫-সদস্য বিশিষ্ট একটি আহবায়ক কমিটি।
১৯৭৭-এর এপ্রিলে দলের একটি বিশেষ সম্মেলনেও নেতৃত্বের সংকট মোচন সম্ভব হয় নি। অনেক টানা হেচড়ার পর তাজউদ্দিন আহমেদের বিধবা, পত্নী সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দিনকে আহবায়ক করে গঠিত হয় কেন্দ্রীয় আহবায়ক কমিটি।
মনি সিংহের কমিউনিস্ট পার্টির মহিলা পরিষদের নেই হিসেবে সমধিক পরিচিত জোহরা তাজউদ্দিনকে আপাতত সামনে রেখে আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় সারির নেতারা আপাততঃ আপোষ রফা করেন।
এরপর সংকট ক্ৰমান্বয়ে বাড়তে থাকে আওয়ামী সেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান ও বাকশাল হবার আগেকার আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক কারাগার থেকে বের হবার পর। তাঁর হাতে সংগঠনের অনেকখানি আয়ত্ব হয়। এমনি অবস্থায় দলের মাঝে অবস্থানরত ‘মস্কো লবী’ বলে চিহ্নিত ন্যাপের মহিউদ্দিন প্রমুখেরা রাজ্জাকের কাধে ভর করতে থাকে।
আবার পাশ্চাত্য ঘেষা লবী বিশেষ করে আওয়ামী লীগকে বাকশাল করনের বিরোধী মীজান চৌধুরীও তার শক্তি সংহত করার চেষ্টা করেন।
অপরদিকে সাজেদা চৌধুরী ও কোরবান আলীর নেতৃত্বেও একটি অংশ কাজ করতে থাকে দলের মাঝখানে।
ত্রি-ধারার এ নেতৃহের সংঘাত ফুটে উঠে ১৯৭৮ এ অনুষ্ঠিতব্য কাউন্সিল অধিবেশনকে কেন্দ্র করে।
১৯৭৮ এর নেতৃত্বের লড়াইয়ে ‘মস্কো দিল্লী’ লবীর কাছে পরাস্থ হন পাশ্চাত্য লবী। আর সমঝোতার প্রার্থী হিসেবে উঠে আসেন তদানীন্তন জাতীয় সংসদের স্পীকার প্রবীণ নেতা আবদুল মালেক উকিল সভাপতি হিসেবে এবং সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আবদুর রাজ্জাক।
মালেক উকিলের পিছনে জোর সমর্থন ছিল পরে পাশ্চাত্য ঘেষা লবীর। কিন্তু মালেক উকিল দলে মস্কো-দিল্লী’ লবীর জোর বেশী দেখে ঝুকে পড়েন তাদের দিকে।
এমন কি মীজান চৌধুরীর সঙ্গের অনেকেই বিশেষ করে আবদুল মান্নান ও অন্যান্যরা একই কারণে শেষ অবধি তাকে পরিত্যাগ করেন।

দ্বিধাবিভক্তিগত অধিবেশন থেকেই…..
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বে দ্বিধাবিভক্তি’ গত এক মাসের ঘটনা নয়। দ্বিধাবিভক্তির এই চেহারা দেখা গিয়েছিলো ১৯৭৮সালের ৩, ৪ ও ৫ মার্চ তিনদিনের কাউন্সিল অধিবেশনেই। হোটেল ইডেনে অনুষ্ঠিত এ-কাউন্সিলে প্রায় ৩ হাজার কাউন্সিলর ও ডেলিগেট যোগ দেন বলে দল থেকে জানানো হয়।
প্রথম দিনের অধিবেশনেই বিরোধের সূত্রপাত ঘটে যখন একদল যুবলীগ কর্মী পরলোকগত যুবলীগ প্রতিষ্ঠাতা শেখ মনির ছবি না থাকায় তুমুল প্রতিবাদ করেন। এরপর বিরোধ আরো গভীর হয় ডেলিগেটদের কার্ড নিয়ে। ঢাকা নগরের সদস্যরা অভিযোগ করেন যে, তারা কার্ড পান নি। নেতারা কৈফিয়ত দিয়ে বলেন, নগরে দুটি কমিটি গঠিত হওয়াতে কার্ড বিতরণ করা হয় নি। গোলমাল আরো বাড়ে যখন অনেক ব্যক্তি কার্ড ছাড়াই ভেতরে প্রবেশ করেন। তবে গোলমাল থামাতে নেতারা সমর্থ হন।
তিনটি অঘোষিত’ প্যানেল উত্থাপিত হয় দলের সাংগঠনিক কমিটির নেতা নির্বাচন বৈঠকে। কোরবান আলী, মালেক উকিল ও সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দিনের নাম উত্থাপিত হয় সভাপতি এবং আবদুর রাজ্জাক ও মতিউর রহমানের নাম প্রস্তাব করা হয় সাধারণ সম্পাদকের জন্যে। সমঝোতা প্রার্থী হিসেবে মালেক উকিল সভাপতি এবং আবার রাজ্জাক জেনারেল সেক্রেটারী মনোনীত হন।
৫ মার্চ তড়িঘড়ি করে শ্লোগান-পাল্টা শ্লোগান ও হাতাহাতির মাঝে শুধু মাত্র সভাপতি ও জেনারেল সেক্রেটারীর নাম ঘোষণা করে কাউন্সিল অধিবেশনের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়। যখন নাম ঘোষণা করা হয় তখন চরম উত্তেজনার মুখে মিজানুর রহমান চৌধুরী নীরবে সভাস্থল ত্যাগ করেন (এর আগে অবশ্য তিনি কেনো সভাপতির পদে প্রতিদ্বন্ধিতা থেকে সরে গেছেন জিজ্ঞাসা করা হলে বলেছিলেন, ‘আমি আওয়ামী লীগে ভাগনের দায়িত্ব নিতে চাই না। কিন্তু পরে তিনি দল থেকে বেরিয়ে আলাদা আওয়ামী লীগ গঠন করেন)।
দলের সভাপতি (উকিল) আলাদা-আলোচনা করে ওয়ার্কিং কমিটির নাম ঘোষণা করবেন এই বলে ঘোষণাও করা হয়।
এর ১৬ দিন পর (২১ মার্চ) আওয়ামী লীগের সভাপতি। আবদুল মালেক উকিল এক বিবৃতিতে দলের গঠনতন্ত্রের ১৩ ধারা অনুযায়ী ২৭ সদস্য বিশিষ্ট ওয়ার্কিং কমিটি ঘোষণা করেন।
পরদিন (২২ মার্চ) আবদুর রাজ্জাক এক বিবৃতিতে ৬৩ সদস্য বিশিষ্ট পাল্টা কমিটি গঠন করেন এবং সভাপতির কমিটিকে সম্পূর্ণ অবৈধ বলে পাল্টা ঘোষণা দেন।
২৩ মার্চ মালেক উকিল এক বিবৃতিতে তার জবাব দেন। তিনি দাবী করেন তার কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে রাজ্জাক ও জোহরা তাজউদ্দিনের পৃথক পৃথকভাবে দেয়া তাদের প্রস্তাবিত ২৭ সদস্য বিশিষ্ট ওয়ার্কিং কমিটির তালিকা থেকে । তিনি আরো দাবী করেন যে, এ দুজনের হাতে লেখা তালিকা তার কাছে রয়েছে।
২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে দুটি কমিটি পৃথক আলোচনা অনুষ্ঠান করে। সাভারে জাতীয় স্মৃতি সৌধে পৃথক পৃথক ভাবে দলীয় নেতৃবৃন্দ পুষ্পস্তবক অর্পন করেন। দু-দল কর্মীর মধ্যে এক পর্যায়ে খন্ড যুদ্ধ বেধে যায়। যার পরিণতিতে প্রস্তর নিক্ষেপে মালেক উকিল ও তার সমর্থকদের তিনটি গাড়ি ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
এরপর ২৭ মার্চ থেকে ৮ এপ্রিল পর্যন্ত কয়েকদফা বৈঠকে দড়ি টাটানির পর এক যুক্ত ইশতাহারের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ নেতারা ঐক্যমতে পৌছেন।

আওয়ামী লীগের ৩৪ বছরের বিবর্তন
৪৭ সালে পাকিস্তান আন্দোলন সফল হওয়ার পর ‘মুসলীম লীগ নেতাদের দুর্নীতি, দন্দ ও ক্ষমতার কাড়াকাড়ির কুৎসিত চেহারা প্রকাশিত হয়ে পড়ে। তখন বাইরের প্রগতিশীল ব্যক্তিরা পূর্ব পাকিস্তানে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে গঠন করেন আওয়ামী মুসলীম লীগ। অপরদিকে মিয়া ইকতেখার উদ্দিনের উদ্যোগে পশ্চিম পাকিস্তানে গঠিত হয় “জিন্নাহ মুসলিম লীগ। তখন আওয়ামী লীগের সঙ্গে ‘মুসলিম’ শব্দ যুক্ত করা যেমন ছিলো ‘পাকিস্তান আন্দোলনের সরিকা’ দাবী করা, তেমনি অপর দিকে মুসলিম লীগের সঙ্গে জিন্নাহ শব্দ ব্যবহার করে ‘কায়েদে আজমের উত্তরাধিকার’ দাবী করা। রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে শুধু আওয়ামী লীগ’ হয় তখন, যখন বোঝা গেলো যে ধর্ম আর দরকারী নয়। কারণ, পশ্চিম পাকিস্তান নিজের স্বার্থে ধর্মকে ব্যবহার করছে পর্ব পাকিস্তানকে শোষনের অস্ত্র হিসেবে—এটা ততদিনে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিলো। ততদিনে ‘জিন্নাহ মুসলিম লীগ’ অবলুপ্ত হয়ে যায়।
আওয়ামী লীগে ‘মুসলিম’ পরিত্যাগের প্রতিবাদে দলত্যাগী হন আবসুস সালাম খান (মরহুম), পরে খন্দকার মোশতাক আহমদ প্রমুখ। পরে খন্দকার মোশতাকসহ দলত্যাগীদের কেউকেউ ‘মুসলিম’ হীন আওয়ামী লীগে ফিরে আসেন। ৫৬ সালে প্রধান-মন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীর পররাষ্ট্র নীতির ‘বিরোধিতা’ করে মওলানা ভাসানী ন্যাপ’ গঠন করেন। ৫৮ সালে আইয়ুব মার্শাল ল জারী করার সময় আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানে ক্ষমতায় ছিলো। সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর শেখ মুজিবের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ব্যক্তিত্বের সংঘাতে আতাউর রহমান খানও আওয়ামী লীগ ত্যাগ করেন। ৬৬ সালে শেখ মুজিব স্বায়ত্ত শাসনের ছয় দফা দাবীর ভিত্তিতে আন্দোলন করে আওয়ামী লীগকে সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলে রপান্তরিত করেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ ‘নীতি ভিত্তিক হওয়ার বদলে ‘একক নেতা ভিত্তিক’ দলে পরিণত হয় আরো মজবুতভাবে। পাকিস্তানে ৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানের পর পর পাকিস্তানে শেখ মুজিবকে এবং পশ্চিম পাকিস্তানে জুলফিকার ভুট্টো একক ব্যক্তিত্বে’ উন্নীত হন। তাই ৭০ সালের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে শেখ মুজিব স্বায়ত্ত শাসন প্রতিষ্ঠার ভিত্তিতে এবং পশ্চিম পাকিস্তানে ‘গরীবের হুকুমত প্রতিষ্ঠার ভিত্তিতে নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন করেন। একক ব্যক্তিত্বের সংঘাতের দরুন আওয়ামী লীগের বিজয়কে ভুট্রো মেনে না নিয়ে প্রত্যাখান করেন। এই প্রত্যাখানের ভিত্তিতে পর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্ত শাসন” দাবী স্বাধীনতা’ দাবীতে রূপান্তরিত হয়। কিন্তু আওয়ামী লীগ স্বাধীনতা’ প্রশ্নে দ্বিধা-দ্বন্ধে পড়লে দলের তরুণদের দ্বারা প্রভাবিত অংশ শেখ মুজিবকে চ্যালেঞ্জ করে ৭১ সালের ৬ মার্চ রাতে। ৭মার্চ শেখ মুজিব রেসকোর্স ময়দানে ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম—এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বলে জনগণের প্রতি আহবান করেন। কিন্তু পরবর্তী দিনগুলোয় তার দ্বিধাদ্বন্ধ পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠিকে নিরস্ত্র জনতার ওপর নৃশংস হামলার প্রস্তুতি নিতে সুযোগ দেয়। ৭২ সালে আওয়ামী লীগ ‘গণতন্ত্রের’ সঙ্গে ‘সমাজতন্ত্র’ শব্দটিও যোগ করে দলের আদর্শের সঙ্গে । স্বাধীনতার পর দলের প্রথম ভাঙ্গনের ফলে ‘জাসদের সৃষ্টি জাসদের জন্মলগ্নে এদের একজন নেতা বিচিত্রা প্রতিনিধিকে বলেছিলেন, ‘শেখ সাহেব আমাদের সঙ্গে থাকবেন। শেখ সাহেব যান নি, বরং ৭৪ সালের ১৭ মার্চ শেখ সাহেব তার জন্মদিনে জাসদের ওপর সবচেয়ে বড় আঘাত হানেন। স্বাধীনতার পর দর্নীতি, লুটপাট, নির্যাতন ইত্যাদির দরুন আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা দ্রুত হ্রাস পেতে থাকলে ৭৫ সালে শেখ সাহেব আওয়ামী লীগের অবলুপ্তি ঘোষণা করেন ‘বাকশাল’ দল গঠনের মাধ্যমে। বিশেষ বক্তব্য নিয়ে তার বাকশাল গঠন স্বেচ্ছায় না বাধ্য হয়ে—এটা এখন বিতর্কের বিষয়।
৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর ৭৬ সালে বর্তমানে আওয়ামী লীগ গঠিত হয়। আওয়ামী লীগের সদস্যদের নিয়ে অন্যতম নেতা জেনারেল (অব) এম এ জি ওসমানী জাতীয় জনতা পার্টি, জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরী আওয়ামী লীগ (মিজান), প্রবীণ নেতা মওলানা আবদুস রশিদ তর্কবাগীশ গণআজাদী লীগ, খন্দকার মোশতাক আহমদ ডেমোক্রেটিক লীগ গঠন করেন। দলের এত বিভক্তির পরও মালেক উকিল পরিচালিত আওয়ামী লীগ ভাসানী-সোহরাওয়ার্দী-মুজিবের আওয়ামী লীগের উত্তরাধিকারী হিসেবে পরিচিত।

দ্বন্দ্ব-কোন্দলে আত্মঘাতী ছাত্রলীগ
অন্যতম সহযোগী সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (কাদের- চুন্নু) দ্বিধা বিভক্ত হয়ে আছে দু’বছর ধরে। কেবলমাত্র আনুষ্ঠানিক ঘোষণা বাকী ছিল। অবস্থা দুষ্টে মনে হচ্ছে আওয়ামী লীগ কাউন্সিলের পর পরই এই ভাঙন আনুষ্ঠানিকতা লাভ করবে। গত দু’বছর ধরে ছাত্রলীগের নেতারা ঐক্যবদ্ধভাবে কোন সভাসমিতিতে যোগ দিতে পারেননি। ডাকসুর নির্বাচনের সময় একটা প্যানেল নিয়ে প্রতিদ্বন্দিতা করলেও জহুরুল হক হলে দুটি প্যানেলের মধ্যে নির্বাচন হয়। এতে ওবায়দুল কাদের সমর্থিত মোঃ লিয়াকত জয় লাভ করে। ডাকসুতে ওবায়দুল কাদের ও বাহালুল “মজনুর চুন্নু পরাজিত হন বটে—তবে ভোটের পার্থক্য ছিল বিস্তর। ওবায়দুল কাদের প্রায় দু’হাজার ভোটের ব্যবধানে মান্নান কাছের পরাজিত হন। চুন্নুর সাথে আখতারুজ্জামানের ভোটের ব্যবধান কম থাকায় ওবায়দুল কাদের সমর্থকরা ধরে নেন যে, চুন্নু সমর্থকরা ভোট দেয়নি। এ নিয়ে জহুরুল হক হলে দু’গ্রুপের মধ্যে হাতাহাতিও হয়। চুন্নু সমর্থকরা প্রায় একসপ্তাহ জহুরুল হক হলে প্রবেশ করতে পারেননি। সূর্যসেন হলেও ওবায়দুল কাদের সমর্থকরা জয়লাভ করেন। ছাত্রলীগের মধ্যেকার সূর্যসেন দ্বিধা বিভক্তি অনেকটা আদর্শগত কারণেই। ওবায়দুল কাদের প্রায়ই বলে থাকেন যে, হঠকারী অতিবিপ্লবী ও সুযোগ সন্ধানীদেরকে ঝেটিয়ে দল থেকে বের করে দিতে হবে। তাঁর বক্তব্য অনুপ্রবেশকারীরা দলকে ভিন্ন পথে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছে। অপরদিকে চুন্নুর বক্তব্য প্রগতির দুষমনদের পার্টি থেকে বের করে দিতে হবে। এই আহবান নিয়ে উভয় গ্রুপই কর্মীদের কাছে যাচ্ছে। বিভিন্ন জেলা কমিটি ও কেন্দ্রের পথ ধরে বিভক্ত হয়ে গেছে। ছোট খাটো কলেজ নির্বাচনেও দুটি করে প্যানেল হবার খবর পাওয়া গেছে। আওয়ামী লীগের গ্রুপিং প্রকাশ পাবার আগেই ছাত্রলীগের গ্রুপিং প্রকাশ পেয়েছে। ছাত্রলীগেও রাজ্জাক-তোফায়েলের নামে গ্রুপ চলছে। নেতারা নিজেদের স্বার্থে গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ করে যাচ্ছে । ওবায়দুল কাদেরদের পেছনে যুব নেতা মোস্তফা মহসিন মন্টু মোহন, আতাউর, ও আওরঙ্গ বাহিনীর সমর্থন থাকা এদের শক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বেশি। তারা প্রায়ই চুন্নু সমর্থকদেরকে তাড়া করে বেড়ায়।
টুঙ্গি পাড়ায় সম্মেলন অনুষ্ঠান নিয়েও দু’গ্রুপের মধ্যে বিবৃতির ঝড় উঠেছিল। চুন্নু সমর্থকরা চেয়েছিল টুঙ্গি পাড়ায় সম্মেলন করতে। বাধ সেধেছিলেন কাদের সমর্থকরা। তাদের যুক্তি : টুঙ্গিপাড়ায় ছাত্রলীগের মত বৃহং সংগঠনের সম্মেলন করা সম্ভব নয়। কয়েক দিন বিবৃতির পাল্টা বিবৃতির পর শেষে রমনা গ্রীনেই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তবে কোন কমিটি গঠন করা সম্ভব হয়নি। নিশ্চিত দ্বিধা বিভক্তির আশঙ্কা দেখে আওয়ামী লীগ নেতারা পুর্বের কমিটিকে বহাল রেখে আরো ছয় মাস কাজ কররি ব্যাপারে ঐক্যমতে পৌছান। ছয় মাস অতিবাহিত হয়ে গেছে সম্মেলনের কোন খোঁজ খবরই নেই।

হানিফের অবস্থান এখনো অনিশ্চিত
ঢাকা নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও এককালে মরহুম শেখ মুজিবের ব্যক্তিগত সহকারী হানিফ বিবদমান রাজ্জাক-তোফায়েল গ্রুপের যে কোন একটিতে সমর্থন দেয়ার ব্যাপারে এখনে অনিশ্চিয়তায় ভুগছেন।
সারাদেশে আওয়ামী লীগের মোট ৬৯টি জেলা ইউনিটের মধ্যে ঢাকা নগর শাখা কর্মীসংখ্যা ও সাংগঠনিক দিক নিয়ে সবচাইতে শক্তিশালী।
বিগত দিনগুলোতে নগর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের প্রশ্নে গাজী গোলাম মোস্তফার সঙ্গে হানিফের যে অন্তর্দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছিলো, রাজ্জাক তাতে হানিফের পক্ষ হয়ে লড়েছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত হানিফের নেতৃত্বই হয়েছিলো জয়যুক্ত। কাজেই রাজ্জাকের প্রতি হানিফ রয়েছেন নীতিগতভাবে দুর্বল এবং কৃতজ্ঞতাই তাকে তোফায়েলের প্রতি বিরুদ্ধভাবাপন্ন হতে অনপ্রাণিত করেছে। তোফায়েল সমর্থকদের না রাগানোর যে পদ্ধতি এতদিন হানিফ মেনে চলছিলেন, শেষ পর্যন্ত তিনি সে নীতিতে অটল থাকতে পারেননি। ডঃ কামাল হোসেনের উদ্যোগে তারই বাসায় দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির যে আপোষ-বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় তাতে হানিফ যোগ দিয়েছিলেন দলীয় সভাপতি আব্দুল মালেক উকিলের বিশেষ আমন্ত্রণে। এ থেকেও বোঝা যায়, মালেক-রাজ্জাক গ্রুপ তার সমর্থক শক্তি হিসেবে হানিফের অবস্থিতি বিবেচনা করেছেন গুরুত্ব সহকারে।
বিচিত্রার সঙ্গে মোঃ হানিফের দেয়া সাক্ষাৎকারে হানিফ তার সমর্থনের প্রশ্নটিকে এড়িয়ে গেছেন। অর্থাৎ তিনি এখনো অফিশিয়াল কোন লবীতে পা রাখতে ভুগছেন অনিশ্চয়তায়।
প্রঃ আওয়ামী লীগের বর্তমান অন্তর্দ্বন্দ্ব কি কাউন্সিলের পর ও অব্যাহত থাকবে বলে মনে করো ?
উঃ দ্বন্দ বলতে আপনারা কি বোঝাতে চান তা আমি জানি না। তবে আমার মতে যেহেতু বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন ৫ দিন পরেই অনুষ্ঠিত হবে তাই আওয়ামী লীগের মত একটি বিরাট গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল সংগঠনে কিছুটা ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ , একেবারে অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে কাউন্সিলের পর এটা থাকবে বলে আমি মনে করি না।
প্রঃ কোন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নির্ধারনে ব্যর্থ হলে কি আপনারী শেখ হাসিনাকে নিয়ে পাকিস্তান পিপলস পার্টির মতো (বেনজীর ভুট্রো) কোন আপোষ-নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করবেন ?
উঃ নেতৃত্ব নির্ধারণের ব্যর্থতার জন্য নয় কিংবা কোন প্রকার আপোষ রফার জন্যও নয় বরঞ্চ আমি মনে করি বঙ্গবন্ধুকে দেশবাসীকে যে উদার রাজনীতি দিয়ে গেছেন সেই রাজনীতির স্বার্থেই একদিন প্রতিটি বাঙালী হাসিনা শেখের প্রয়োজন উপলব্ধি করবে। বেনজীর ভুট্টোর সাথে হাসিনার তুলনা করলেএটা হাসিনার প্রতি অবিচার করা হবে।
প্রঃ বিভিন্ন নেতার বাড়িতে খন্ড খন্ড যে সমস্ত বৈঠক আপনারা করেছেন এত অল্প সময়ে সেগুলোর সিদ্ধান্তের সমন্বয় সাধন কিভাবে সম্ভব হবে ?
উঃ খন্ড খন্ড বৈঠক নয়। গত ৪/৫ দিন যাবত আমাদের কয়েকজন শ্রদ্ধেয় নেতার বাড়িতে আপনারা বৈঠকের কথা শুনেছেন। সংগঠনকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে গঠনতন্ত্রে কিছুটা পরিবর্তনের ব্যাপারে গঠনতন্ত্র সংশোধনী সাব কমিটি আলাপ আলোচনা করেছেন।

পরজীবির অনুপ্রবেশ ক্ৰমশঃ বিবর্ণ আওয়ামী লীগ
‘অনুপ্রবেশকারীদের কবল থেকে পার্টিকে রক্ষা করতে হবে। আওয়ামী লীগকে তাঁর নিজস্ব রাজনীতি নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা। কথায় কথায় বলেন : দু’দিন হয় নাই যারা আওয়ামী লীগে এসেছে তাদের দাপট দেখে মনে হয় রাজনীতি ছেড়ে দেই।
আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারী বলতে সিপিবি সমর্থকদের বোঝায়। সিপিবির প্রভাব পাকিস্তান আমল থেকেই শুরু হয়েছে। শেখ মুজিব জীবিত থাকা অবস্থায় এরা খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি। বরং বেরিয়ে গেছে দল থেকে। মস্কোপন্থী বলে পরিচিত মহিউদ্দিন ও আবদুস সামাদ আজাদরা আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন করেছিলেন। এরপর শেখ মুজিব জীবিত থাকাকালেই তা আওয়ামী লীগে ফিরে আসেন। ধীরে ধীরে প্রভাব খাটানোর চেষ্টা চালান। বাকশাল গঠনের পর তাদের হাতে আসে সেই মোক্ষম সুযোগ। মস্কোপন্থী কমিউনিষ্টরা দল বেধে আওয়ামী লীগ দখল করার চেষ্টা চালান। শেখ মুজিবের জীবদ্দশাতেই একটা গোপন প্রচার পত্রে তাদের সকল পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে পড়ে। শেখ মুজিব ঘটনাটা জেনেছিলেন ৭৫ সনের মে মাসের দিকে। জেনে এ্যাকশন নেবার সুযোগ পাননি। ১৫ আগস্টের পর সকল কিছুই ওলট পালট হয়ে যায়। প্রচার পত্রে ছিলঃ স্থানীয়ভাবে আওয়ামী লীগের নেতাদের দুর্নীতি জনগণের সামনে তুলে ধরে নিজেদের অবস্থানকে সুনিশ্চিত করা। জনকল্যাণমূলক কাজে সকল সিপিবি কর্মীদেরকে নিয়োগ করতে হবে। শেখ মুজিব সম্পর্কে তাদের বক্তব্য ছিলঃ মুজিবকে দিয়ে সমাজতন্ত্র হবে না। তথাপি যতটুকু সম্ভব তাকে দিয়ে কিছু করিয়ে নিতে হবে।
সিপিবির মুখপাত্র কিছুদিন আগে এক প্রতিবেদনে বলেছে বাকশাল সমাজতন্ত্রে উত্তরণের পর্ণোঙ্গ কর্মসুচী ছিল । এই প্রতিবেদন প্রকাশিত হবার পর আওয়ামী লীগ মহলে দারুণ প্রতিক্রিয়া হয়।
১৯৭৫ সনের ১৫ আগস্টের পর কমিউনিস্টরা আওয়ামী লীগে না থেকে কমিউনিস্ট পার্টি পুনর্গঠন করেন। এ থেকেই বোঝা যায় বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে তারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট বেধে ছিলেন। কমিউনিস্ট পার্টি পুনর্গঠন করার পর আওয়ামী লীগে যারা ছিল তারা দুর্বল হয়ে পড়ে। এরপর থেকে তারা আওয়ামী লীগে পুনর্গঠন প্রবেশের চেষ্টা করতে থাকে। আবদুর রাজ্জাকের প্রতি তারা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। শোনা যায় জেলখানাতেই রাজ্জাকের সঙ্গে যোগাযোগ করে। তারা সফলও হয়। রাজ্জাক তাদের টোপ গিলেন। প্রকাশ্যেই মাস্কোর প্রশংসা করে বক্তৃতা দিতে শুরু করেন। আফগানিস্তান প্রসঙ্গে রাজ্জাক সাংবাদিক সম্মেলনে যে বক্তব্য রাখেন তা থেকেই সর্বমহলে তার অবস্থান সম্পকে সকল সন্দেহের অবসান ঘটে। দলে কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্ত ব্যতিরেকে রাজ্জাক দলীয় অফিসে সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করেন। আওয়ামী লীগ নেতার তার পাশে ছিলেন না। সিপিবির লালকার্ডধারী সদস্য বাংলাদেশ শান্তি পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আলী আকসাদ শুধু উপস্থিতই ছিলেন না সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবও দেন। সাংবাদিক সম্মেলনে রাজ্জাক যে বক্তব্য দেন তাতে আওয়ামী লীগের সকল পর্যায়ের নেতা, কর্মী শুভানুধ্যায়ীদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়। এ ব্যাপারে রাজ্জাককে দলের ওয়ার্কিং কমিটিতে জবাবদিহী করতে হয়। বেগম মতিয়া চৌধুরীর যোগদানও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। একটা দলের সাধারণ সম্পাদিকার পদ ছেড়ে মতিয়া চৌধুরী কি কারণে আওয়ামী লীগে দু’আনি সদস্য হয়ে এলেন তা আর কারো কাছে অজানা নয়। মতিয়া চৌধুরীর যোগদানকে প্রবীন আওয়ামী লীগ নেতারা ভাল চোখে দেখেননি। ওয়ার্কিং কমিটিতে এই নিয়ে বাক বিতণ্ডা কম হয়নি। রাজ্জাক মহিউদ্দিনের প্রচেষ্টায় মতিয়া গংরা আওয়ামী লীগে যোগ দেন। অন্যানরা মতিয়া চৌধুরীর সাথে যোগ দেন তাদের সম্পর্কে ওয়ার্কিং কমিটির এক বৈঠকে কয়েক টন সদস্য জানতে চান কার অনুমতিতে তারা যোগ দিয়েছেন। রাজ্জাক মহিউদ্দিন, মোমেন তালুকদার প্রমুখ নেতারা মতিয়াদের যোগদানকে স্বাগত জানান।” মতিয়া’ চৌধুরীর সঙ্গে সিপিবির পর লাল কার্ডধারী স্থপতি মাযহারুল ইসলামও ঢুকে পড়েছেন। তার বাসায় কয়দিন আগে রাজ্জাক গ্রুপের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু পরিষদ কমিউনিস্টদের ভাবমুর্তি প্রতিষ্ঠার অন্যতম বাহন হিসেবে কাজ করছে। প্রথম দিকে যারা ছিলেন তাদের কেউই আজ আর নেই। কমিউনিষ্টরা পুরোপুরি দখল করে নিয়েছে। মতিন চৌধুরী, খন্দকার ইলিয়াস, মাযহারুল ইসলাম, সন্তোষ গুপ্ত বজলুর রহমানরা এখন বঙ্গবন্ধু পরিষদের নেতা। এদের পরিচয় কারো অজানা থাকার কথা নয়। প্রায় সবকজনই লাল কার্ডধারী সদস্য।
মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদও অনুপ্রবেশকারীদের ইমেজ প্রতিষ্ঠা করছে। কয়দিন আগে যে কমিটি গঠিত হয়েছে তার মধ্যে সিপিবি সমর্থকের সংখ্যা ৩৯ জন। কমিটি হয়েছে ৫৯ জনের।

হতাশা, বিভ্রান্তি ও দলছুট
আওয়ামী লিগের কারো কারো মতে দলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ ও গ্রুপিংয়ের মুল কারণটা আদর্শগতর চাইতে অনেক বেশি ব্যক্তিগত। এই ব্যক্তিগত কোন্দল ও দ্বন্দ্ব দলটিকে শতধাবিভক্ত করে ফেলছে। দলের কেন্দ্রীয় প্রধান ও সাবেক মন্ত্রী তোদের অধিকাংশই নিজেকে দলের সভাপতি হিসেবে মনে করে থাকেন। সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নিজেদের যোগ্যতা সম্পর্কে প্রায় অর্ধডজন নেতাই দৃঢ় মনোভাব পোষণ করেন এবং প্রতিদিন যতই এই উচ্চাকাঙ্ক্ষা তাদের সবাইকে পীড়িত করে।
তাদের মতে আওয়ামী লীগের কর্মীরা এই নেতাদের এহেন চিন্তা চেতনার সঙ্গে একমত হতে পারেন না। আসলে আওয়ামী লীগের মত শক্ত হচ্ছে তার কর্মী বাহিনীকে মুজিব পরবর্তীকালে একক অঙ্গুলী হেলনে পরিচালিত করার যোগ্যতা বর্তমান। আওয়ামী লীগ নেতাদের কারো নেই। কর্মীদের মনে যে দু’জন ছিটা আস্থা লাভ করেন সে দু’জন হচ্ছেন আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমদ। এ দু’জন একত্রে থাকলে উক্ত প্রবীন ও মন্ত্রী নেতাদের অবস্থান অনেকটা শূন্যের কোঠায় এসে দাঁড়ায়। সে জন্যই এরা যেন অনেকটা পরিকল্পিত পন্থাতেই বিভক্ত হয়ে রাজ্জাক ও তোফায়েলের ওপর ভর করে পার্টির বিভক্তিটা বড় করে তুলছেন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মতিয়া চৌধুরীর। এরা রাজ্জাকের’ ওপর এমন ভাবে ভর করেছে যে, তার নাড়াচাড়ার শক্তিও যেন রহিত হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে তোফায়েলের ওপর ভর করেছেন দেশীয় পুজিবাদী শক্তির একটি অংশ শিল্পপতি আবিদুর রহমানের নেতৃত্বে। ফলে তার পক্ষে ও বিভিন্ন ব্যাপারে স্বাধীন মতামত দেয়া বিঘ্নিত হয়।
তারা বলেন এই দুই শক্তিমান নেতার এহেন দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও কোন্দলে টানাপোড়নে পড়ে দলের সাচচা এবং আদর্শবান কর্মীরা ভীষণ বিভ্রান্তি ও হতাশার মধ্যেই দিন কাটাচ্ছেন। এর সাথে সাথে দলের সমর্থকরাও বিভ্রান্তিতে ভুগছেন। হতাশা তাঁদের মধ্যেও প্রকট হয়ে উঠছে। আওয়ামী লীগ মুলতঃ একটি জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক সংগঠন, এবং সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে আধা বিশ্বাসী । তাদের সেই চেতনাকে এই দুই নেতার নেতৃত্বে মুল আদর্শ থেকে বেপথুকরা হচ্ছে বলে উক্ত কর্মী ও সমর্থকরা মনে করেছেন।
এই হতাশা বিভ্রান্তি এবং বিগত তিন বছরের ভাঙন, কোন্দল গ্রুপিং এবং দলীয় নেতৃত্বের অযোগ্যতা আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের একটি বিরাট সংখ্যক কর্মীর মনে বিভ্রান্তি অনাস্থা ও হতাশার জন্ম দিয়েছে ও দিচ্ছে। এই হতাশাই আওয়ামী লীগে অনেক কর্মীকে এখন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল’ যোগদানে উদ্বুদ্ধ করছে। কারণ কর্মসুচীবিহীন আদর্শের কপচানি এবং তার সাথে সাথে আদর বিভ্রান্তিকর ব্যাখ্যা এই কর্মীরা মেনে নিতে পারছিলেন না। এর প্রমাণ স্বরুপ বলা যেতে পারে, সিলেট পৌরসভার চেয়ারম্যান জনাব বাবরুল হোসেন বাবুল ওই পৌরসভার ৯ জন কমিশনার নিয়ে জাতীয়তাবাদী দলে যোগদান করেছেন। জনাব বাবুল ছিলেন সিলেট যুব লীগের সভাপতি ও আওয়ামী লীগের একজন প্রভাবশালী নেতা। কিছুদিন আগে চট্টগ্রামের মিরশরাই থানার প্রবীন ও প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা তোসারক হোসেন সিদ্দিকী এবং আওয়ামী লীগের জন্ম লগ্ন থেকে জড়িত ডাঃ নুরুন্নাহার জহুরও বি, এন, পিতে যোগদান করেছেন। আরো বহু সংখ্যক কর্মী এখনো বি,এন,পিতে যাবার কথা ভাবছেন। তারা কেবল রাষ্ট্রপতি জিয়ার একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের জন্যই অপেক্ষা করছেন বলে আওয়ামী লীগের একটি সূত্র জানান।

ডঃ কামাল হোসেন অভ্যুদয়
১৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগ থেকে একরকম স্বেচছা নির্বাসন বরণকারী এককালীন পররাস্ট্রমন্ত্রী ডঃ কামাল হোসেন বর্তমান কাউন্সিলের প্রাক্কালে আবার একজন শক্তিশালী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন। বর্তমানে তার ভুমিকা । দেখা যাচ্ছে অনেকটা মধ্যস্থতাকারী হিসেবে। ১৫ আগস্টের পরে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটিতে পর্যন্ত তার নাম ছিলোনা, অথচ দলে অভ্যন্তরীন কোন্দল দেখা দেয়ার পর বেশ কয়েকটা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে তার বাসায়, যেগুলোতে তিনি বিবদমান দলগুলোর মধ্যে আপোষ মীমাংসায় মধ্যমণি হিসেবে কাজ করছেন। দলের উচ্চ পর্যায়ের গরুত্বপুর্ন সভাগুলোতে উপস্থিত থেকে তিনি দুইটি গ্রুপকে এক করার ব্যাপারে প্রচেষ্টা চালিয়ে বেশ সফলও হয়েছেন। এছাড়া যৌথ নেতৃত্বে যে খসরা দাঁড় করানো হয়েছে সে খসড়া তিনিই প্রনয়ণ করেছেন বলে জানা গেছে।
বিচিত্রা-কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি দলের ঐক্যের ওপর। সবচেয়ে বেশী গরুত্ব আরোপ করেন।
সাক্ষাৎকার কালে ডঃ কামাল জানানঃ দীর্ঘদিন ছিলামনা, তাই দেগের বর্তমান দ্বিধা-সংঘাতের কোন প্রেক্ষাপট আমার জানা নেই। তবে ইদানিংকার ঘটনাবলীতে আমার মনে হয়েছে, এটা কোন কোন কর্মীর মাঝে সৃষ্ট ভুল বোঝাবুঝিরই পরিনতি। এ ধরণের ভুল বোঝাবুঝির নিরসন করসভব এবং তা করতেই হবে। এ ব্যাপারে দলের গঠনতন্ত্রের সুস্পষ্ট নির্দেশও রয়েছে। সর্বতোভাবে গঠনতন্ত্র মেনে চললে আমরা সব ত্রুটি-বিচ্য,তি ও বাধা বিঘ। অতিক্রম করতে পারবো বলে আমি বিশ্বাস করি।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের বর্তমান নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধু ও চারজন জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল, তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলী ও কামরুজ্জামানের অনুপস্থিতিতে তাদের নিজস্ব শ্রম ও প্রজ্ঞা দিয়ে দলকে একটি সুন্দর ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করেছেন, আমার প্রবীণ ও নবীন সহকর্মীদের শত বাধা ঝঙ্কা অতিক্রম করে দলকে আজ এতদুরে আনা সম্ভব হয়েছে, সে জন্য অবশ্যই তারা প্রশংসার পাত্র। তাদের সকলের সাথেই আমার উত্তম সম্পর্ক বিদ্যমান এবং আমি তাদের সাথে একত্রে কাজ করতে পারছি, এটাই আমার আনন্দ।
সাময়িকভাবে আওয়ামী লীগের দুইটি খন্ডিত ধারাকে একত্রিত করতে সক্ষম হলেও কামাল হোসেনের নেতৃত্ব ও উপহিতিকে ভিত্তি করেই আবার দলে দেখা যাচ্ছে পরিকার দুটি বিভক্তি। শেখ হাসিনার সঙ্গে ডঃ কামালের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ রয়েছে বলে রাজ্জাক-তোফায়েল গ্রুপের কেউই তাঁকে একেবারে এড়িয়ে যেতে পারছেনা। তবে এখন পর্যন্ত তোফায়েল গ্রুপের সঙ্গেই কামাল হোসেনের চলাফেরা দেখা যাচ্ছে বেশী।
ডঃ কামালের সঙ্গে তোফায়েলের অঘোষিত ঐক্যমতের ফলেই রাজ্জাক-মালেকের ঘনিষ্ঠতা বেড়ে গেছে। অনেকেই মনে করছেন, এমতাবস্থায় যে আবদুল মালেক উকিল অনেকটা অনিশ্চিতির পথে এগিয়ে গিয়েছিলেন, তিনি হয়তো রাজ্জাকের কর্মী বাহিনীর সমর্থন নিয়ে আবারো ফিরে আসবেন। নেতৃত্বের প্রশ্নে শেষ পর্যন্ত প্রবীণদের প্রাধান্যই টিকে থাকলে রাজ্জাক হয়তো মালেক উকিলকেই ঠেলে দেবেন সামনের দিকে।

হাসিনার আশীর্বাদ কর দিকে ?
হাসিনা শেখ বাংলাদেশের রাজনীতিতে জড়িয়ে গেছেন। দেশের বাইরে অবস্থান করেও তিনি পালন করছেন একটা বিশেষ ভুমিকা। আওয়ামী লীগ রাজনীতির সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক ছিল না । ১৯৭৫ সনের পরে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন।
গত দুবছর যাবত তাঁকে নিয়ে আওয়ামী লীগ মহলে জোর লড়াই চলছে। রাজ্জাক-তোফায়েল গ্রুপের মধ্যে বিরোধ যতই তীব্র হচ্ছে ততই হাসিনাকে ঘিরে নানা গুজবের সৃষ্টি হয়েছে। রাজ্জাক-তোফায়েল গ্রুপ উভয়েই কর্মীদের কাছে বলে বেড়াচ্ছেন হাসিনার সমর্থন তাদের পেছনে রয়েছে। এই সমর্থন লাভের জন্য দু-গ্রুপের পক্ষ থেকেই লন্ডন এবং দিল্লীতে হাসিনার সঙ্গে দেখা করেছেন বেশ ক-জন নেতা। আবদুস সামাদ, আজাদ, এম কোরবান আলী, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমদ, বেগম সাজেদা চৌধুরী, মোহাম্মদ হানিফ প্রমুখ নেতারা হাসির সঙ্গে কথা বলে এসেছেন। সবাই তাকে দেশে আসার অনুরোধ জানিয়েছেন। কিন্তু হাসিনা কোন কথা বলেন নি। বঙ্গবন্ধুর মেয়ে হিসেবে দলীয় কর্মীদের মধ্যে যে প্রভাব রয়েছে তা ব্যবহার করাই এদের উদ্দেশ্য। কয়েক দিন আগে হাসিনার সঙ্গে দেখা করেছেন এমন একজন বললেন : হাসিনা কোন গ্রুপের সঙ্গে নেই। দল এক থাকুক তাই তার একমাত্র কামনা । কিন্তু কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা সম্পর্কে তার রিজার্ভেশন রয়েছে। দলের বর্তমান সভাপতি আবদুল মালেক উকিল সম্পর্কে হাসিনার মনোভাব খুবই খারাপ। ৭৫ সনে শেখ মুজিবের মত সম্পর্কে লন্ডনে যে মন্তব্য করেছিলেন তা আজো হাসিনার মনে রয়েছে। কথায় কথায় হাসিনা প্রায়ই বলেন; কি দুর্ভাগ্য বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুতে যারা উল্লাস করলো তারাই বঙ্গবন্ধুর সংগঠনের নেতা। রাজ্জাক-তোফায়েল সম্পর্কেও তার এক কথা। এই দুজন ১৫ আগস্ট কি করেছেন। এদের হাতে তো প্রচুর ক্ষমতা ছিল। একজনের হাতে ছিল স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী ও একজনের নিয়ন্ত্রণে ছিল রক্ষী বাহিনী। মহিউদ্দিন সম্পর্কে হাসিনার বক্তব্যঃ বঙ্গবন্ধুকে যারা হত্যা করল তাদের আমলেই মস্কো গিয়ে মহিউদ্দিন সাহেব তাদের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন।
নির্ভরযোগ্য সূত্রের খবর : হাসিনা আওয়ামী লীগ নেতাদের উপর বিশ্বাস হারিয়েছেন অনেক কারণে। ১৯৭৮ সন পর্যন্ত কোন আওয়ামী লীগ নেতাই তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে নি। একটা চিঠি দিয়েও খবর নেন নি তারা কিভাবে আছে। দেশে আসার ব্যাপারে ব্যাপক প্রচারও তারা পছন্দ করছেন না। একজন বিদেশী সাংবাদিককে হাসিনা বলেছে দেশে ফিরতে । সরকারী ভাবে কোন বিধি নিষেধ নেই। তিনি নিজেই ফিরছেন না। তার ভাষায়ঃ কি হবে দেশে গিয়ে জন্মমাসে হাসিনা অপর একজন বিদেশী সাংবাদিককে কথায় কথায় বলেছেনঃ দেশে তার কেউ নেই। ১৫ আগস্টে সব মারা গেছে।
সাম্প্রতিক ঢাকা ও চট্টগ্রামের ঘটনায় হাসিনা ভীষণ মনোক্ষুন্ন হয়েছেন। টেলিফোনে অনেক কেন্দ্রীয় নেতাকে বলেছেনঃ এসবের শেষ কোথায় ? এসমস্ত ঘটনায় তার নাম না জড়ানোর অনুরোধ করেছেন। বেগম সাজেদা চৌধুরী গিয়ে ছিলেন কয়েকদিন আগে দিল্লীতে হাসিনার সঙ্গে তার দেখা হয়েছে কথাবার্তাও হয়েছে। তবে সাজেদা চৌধুরী কেন গিয়েছিলেন এবং কি নিয়ে এসেছেন তা সঠিক করে জানা যায় নি। ধারণা করা হচ্ছেই সমর্থন লাভের আশাতেই তিনি গিয়েছিলেন। সাজেদা চৌধুরী তোফায়েল গ্রুপে মুখ্য ভূমিকায় আছেন। হাসিনা এখন পর্যন্ত সরাসরি কোন গ্রুপকে সমর্থন না দিলেও যাদের সঙ্গে তার যোগাযোগ এদের সবাই তোফায়েল গ্রুপের সঙ্গে আছেন। শেখ মুজিবের অপর মেয়ে রেহানা শেখ লন্ডনে অবস্থান করছেন। রাজনীতির সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক নেই, আগ্রহও নেই। বড়বোন হাসিনা যা বলেন তাতেই সম্মতি দেন। ডঃ কামাল হোসেন সম্পর্কে নানা কথা শোনা যায়। কেউ কেউ বলেন হাসিনার তরফ থেকে ডঃ কামাল কাজ করছে। তিনিই তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন। ধারণা করার কারণও যথেষ্ট রয়েছে। ১৯৭৫ সনের ১৫ আগস্টের পর ডঃ কামালই হাসিনা ও রেহানাকে দেখা শোনা করেছে। সুখ দুঃখের ভাগাও হয়েছেন। লন্ডনে বসে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে ডঃ কামাল শেখ মুজিব হত্যা সম্পর্কে বক্তব্য তুলে ধরেছেন।

মালেক রাজ্জাক বহাল থাকছেনঃ
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের এই কাউন্সিলেও মালেক উকিল ও আবদুর রাজ্জাক তাঁদের সব সব পদে বহাল থাকছেন বলে দলের একটি মহল থেকে জানা গেছে। তাদের মতে, বর্তমান অবস্থায় আওয়ামী লীগ একটি ভাংগনের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার যে প্রক্রিয়া চলছে তাতে করে সাবেক সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে বহাল রাখা প্রয়োজন হয়ে পড়ছে। মালেক উকিলের বিকল্প হিসেবে এর আগে জোহরা তাজউদ্দীন, ডঃ উকিল হোসেন এবং আবদুস সামাদ আজাদের নাম শোনা গিয়ে ছিলো। জোহরা তাজদ্দীন ও ডঃ কামাল তোফায়েল গ্রুপের নমিনি কোরবান আলী-সাজেদা চৌধুরী গ্রপ দলে তাঁদের অবস্থান সমর্থকদের দিক থেকে এখন সর্বনিম্ন পার্জায়ে এটি করতে পেরে এতদিন বেশ কিছুটা চুপচাপ থাকার পর ইদানিং তোফায়েল গ্রুপকে প্রত্যাশা সমর্থন দিয়েও এই গ্রুপের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে পারেন নি। এদিকে ১৯৭৮ সালের কাউন্সিল হবার পর থেকেই জোহরা তাজুদ্দীন নিজেকে বিকল্প সভাপতি হিসেবে চিন্তা করে কাজ করে এলেও এখন তিনি আর তোফায়েল গ্রুপের নমিনি হাতে পারেন না। তার মতে ডঃ কামাল উড়ে এসে জুড়ে বসে তাকে স্থানচ্যুত করেছেন। আসলেই তাই।
এই মহল বলেন যে, ডঃ কামাল লন্ডন ও ভারত থেকে আসার সময় মুজিব কন্যা শেখ হাসিনার ও দলের বিদেশী হিত কার্মীদের আশাবাদ নিয়ে এসেছেন। ঢাকায় এসে তিনি প্রথমত দলের সকল গ্রুপের সমর্থন লাভের চেষ্টা চালান। তোয়ায়েলরা তাকে সঙ্গে সঙ্গে সমর্থন জানান। তোফায়েলদের এই তড়িঘড়ি সমর্থন তার জন্যে কিছুটা ক্ষতির সৃষ্টিই হয়েছে। রাজাকাররা এতে বেকে গেছেন এবং তাঁরা বলছেন, যদি সভাপতি বদলাতেই হয়। তবে ডঃ কামাল কেন, তার চাইতে সামাদ আজাদই অনেক উপযুক্ত। সামাদ অন্ততঃপক্ষে আমাদের দুর্দিনে সঙ্গে থাকবে -যার কোন প্রমাণ ডঃ কামাল দিতে পারেন নি অতীতে। এহেন অবস্থায় তোফায়েলদের আচরনে বিক্ষুদ্ধ হয় জোহরা তাজউদ্দীন যেমন রণে ভংগ দিয়েছেন, ঠিক তেমনি ডঃ কামাল গ্রুপিংয়ের সংখ্যালঘু অংশের নমিনি হয়ে তার ইমেজ নষ্ট করতে নারাজ। তাই ডঃ কামাল ৭ ফেব্রুয়ারী সন্ধ্যায় সামাদের বাড়িতে তার সঙ্গে এক দীঘস্থায় বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠকে শেষের দিকে কর্তব্যরত এতে উপস্থিত হন। বৈঠক শেষে তাঁরা তিনজনই মালেক উকিলের বাড়ি গিয়ে তাঁর প্রতি সমর্থন নিয়ে এসেছেন বলে এই মহল সুত্রে জানা গেছে।
রাজ্জাকের প্রশ্নেও ব্যাপারটা অনরুপ হলেও কিছুটা ভিন্নতর। রাজ্জাক অনেক ক্ষেত্রে ব্যর্থ ও সমালোচিত হলেও কর্মীদের সমর্থনের দিক থেকে এখনও সব চাইতে তিনি বেশ শক্তিশালী। তাছাড়া এবার বিভিন্ন জেলা সম্মেলনগুলোর সময় রাজ্জাক গ্রুপ যতটা পারকল্পিত পন্থায় কাউন্সিলর ও ডেলিগেট নির্বাচন করে নিজেদের সমর্থকদের আনতে পেরেছেন, অন্যরা তা পারেন নি। ফলে দলীয় কাউন্সিল ও ডেলিগেট গত অবস্থানে রাজ্জাকরা শতকরা ৬৮ থেকে ৭০ ভাগ অর্জন করেছেন। তদুপরি তোফায়েলের সঙ্গে রাজ্জাকের ব্যক্তিগত সমঝোতা তাকে এবং বহাল রাখার প্রশ্নে কার্যকর হচ্ছে বলেও এই মহল মনে করেন।
গঠনতন্ত্রের সংশোধনীর মাধ্যমে প্রেসিডিয়াম গঠিত হলে মালেক উকিল তার চেয়ারম্যান এবং জোহরা তাজুদ্দীন, ফণি মজুমদার, আসাদুজ্জামান খান, মহীউদ্দিন আহমেদ, আবদুস সামাদ আজাদ , কোরবান আলী, ডঃ কামাল হোসেন, জিল্লুর রহমান, আবদুল মমিন, আবদুল মোমিন তালুকদার ও শেখ আবদুল আজিজ প্রমুখ ১১ জন তার সদস্য হতে পারেন। আব্দুর রাজ্জাক সাধারণ সম্পাদক, তোফায়েল আহমদ ও সাজেদা চৌধুরী যুগ্ম সম্পাদক, এবং মতিয়া চৌধুরী, কর্নেল (অব) শওকত আলী, আমীর হোসেন আমু , সরদার আমজাদ, সৈয়দ আহমদ, নোয়াখালীর অধ্যাপক মোহাম্মদ হানিফ, মোফাজ্জল হোসেন মায়া’, আইভী রহমান, বুবলীগেয় শফিকুল আজিয মুকুল ও শেখ ফজলুল করিম সেলিম প্রমুখ সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য হতে পারেন বলে দলীয় লবীতে জোর গুজব চলছে।
উপসংহার
এ মুহুর্তে আওয়ামী লীগ সম্পর্কে কোন শেষ কথা নেই। ১৯৭৮ এর জাতীয় কাউন্সিলের পর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের দ্বিধাবিভক্ত ও সংকট সম্পর্কে ‘রাজা বনাম মালেক’ শীর্ষক বিচিত্রা প্রচ্ছদ প্রতিবেদনে ( বিচিত্রা, ১৪ এপ্রিল, ১৯৭৮) আমরা যে মন্তব্য করেছিলাম তার হুবুহু এবারও তুলে দিলামঃ
‘আওয়ামী লীগ এখন নেতা কেন্দ্রিক পার্টি থাকবে না। সে নেতৃত্ব আওয়ামী লীগের নেই। একক নেতৃত্ব অনেক। এক নেতৃত্ব আওয়ামী লীগের নেই। একক নেতৃত্বে যেমন এক সভব নয় তেমনি সম্ভব নয় শুধু সাইনবোর্ড রেখে রাজনীতি করা । এখন একতাবদ্ধ হতে হবে নীতি রাজনীতির ভিত্তিতে। কিন্তু সে রাজনীতি কি ? নীতিই বা কি হবে ?

এক পরিবারেও ঝগড়াঝাটি হয়
সভাপতি আবদুল মালেক উকিল দলের কার্যালয়ে আমাদের কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর দেন।
প্রশ্ন : আওয়ামী লীগের মধ্যে সাম্প্রতিক সংঘর্ষগুলো কি আদৰ্শগত কারণে ঘটেছে?
উত্তরঃ না। নির্বাচনের মুখে এরকম সব দলেই হয়। নির্বাচনকে সবাই আগ্রহের সঙ্গে গ্রহণ করেছেন। কাজেই এই যে আমাদের নির্বাচন-দ্বি-বার্ষিক কাউন্সিলকে সামনে রেখে কর্মীদের মধ্যে যে কর্মচাঞ্চল্য বা স্বতঃস্ফুর্ততা এগুলোকে বিবেচনা করা যায়। এ কর্মচাঞ্চল্যের মধ্যে যে কিছু ডিফারেন্স হবে না তা আমি অস্বীকার করি না। সে ডিফারেন্স সাময়িক এবং অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক যে, যে কোন রাজনৈতিক দলে, বিশেষ করে প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলে যাদের পাঁচ-সাতজন মাত্র রাজনৈতিক কর্মী আছে, তাদের মধ্যেও এমন দ্বন্দ থাকবেই। ভাসানী ন্যাপ, তোয়াহার দল, যাদের দুই-তিনজন কর্মী রয়েছে তাদের মধ্যেও এধরনের মন্দ দেখা যায়। আমাদের মধ্যে মিজান চলে যাবার পর আদর্শগত প্রশ্ন তেমন একটা আসেনি।
প্রশ্নঃ তবে বিরোধটা কি ব্যক্তিগত ?
উত্তরঃ তাও আমি বলছি না। কারণ বিচ্ছিন্ন দু’একটা ঘটনা ঘটেছে। কাউন্সিলকে কেন্দ্র করে , কর্মকর্তা নির্বাচন নিয়ে। নির্বাচনে প্রেসিডেন্টের জন্য দু’জন প্রার্থী হলেই হয় ঠোকাঠুকি। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রামে ঢাকায় বা রাজশাহীতে যা হয়েছে, তা সবাই দেখেছেন, সবাই জানেন। সেই নির্বচনকে কেন্দ্র করে যা হয় তা দলীয় কোন সংঘর্ষ বলে আমি মনে করি না। সেগুলো সবই বিচ্ছিন্ন ঘটনা। তারা সবাই বিচ্ছিন্ন লোক এবং খুব স্বল্পসংখ্যক লোকই তাতে জড়িত ছিল।
প্রশ্ন: বিচ্ছিন্ন যখন, তখন সেই নেতাদের কি আপনারা দল থেকে বহিষ্কার করবেন না?
উঃ কমিটি সে ব্যাপারে অলরেডী নোটিশে রয়েছে। এ নিয়ে বৈঠকে বসে যে সিদ্ধান্ত দেয়া হয়েছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে, যত ছোট বা বড়ই হোক না কেন এব্যাপারে সর্বসম্মত এ্যাকশান নেয়া হয়ে গেছে। এব্যাপারে ওয়ার্কিং কমিটি সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে আসা থেকে বোঝা গেছে যে গণ্ডগোল এর ভেতরেই ছিল।
প্র: এ ধরনের ঘটনা অব্যাহত থাকার কোন আশংকা রয়েছে কি ?
উঃ আমি তো একেবারেই সে রকম আশংকা করি না। নীতিগত ও আদর্শগত “বিচ্ছিন্নতা নিয়ে ১৯৭৮ সালে মতদ্বৈততার পর ১৯৭৯ সালে তারা (মিজান ও অন্যরা) চলে যায়। সেটা অন্য কথা। এখন যা হচ্ছে তা হচ্ছে শংখলার প্রশ্ন। কেউ ধমক দিয়ে বা রাগ করে কথা বললেও সেখানে শংখলাভঙের প্রশ্ন আসছে। আমাদের সংগঠন ছাত্র আছে, যুবক আছে, কৃষক আছে, শ্রমিক আছে, প্রৌঢ়, নবীন, প্রবীণ সবাই আছেন। এক পরিবারেও তো ঝগড়াঝাটি হয়।
প্রঃ আদর্শগত কোন দ্বন্দ্ব আওয়ামী ‘লীগে আছে কি?
উঃ না, আদর্শগত কোন দ্বন্দ্ব নেই। এ নিয়ে যারা ছিল তারা চলে গেছে। আমরা যারা গত তিন বছর ধরে কাজ করছি, তারা সবাই একই আদর্শের অনুসারী। একই আদর্শের পরিপন্থী কোন কাজ বা বক্তব্য আমাদের মাঝে আসেনি।
প্রঃ আগামী কাউন্সিলে তরুণ এবং প্রবীণদের নেতৃত্বের মধ্যে নীতিগত, আদর্শগত বা ব্যক্তিত্বের কোন বিরোধ আসতে পারে কিনা?
উঃ এটা হাইপোথেটিক্যাল প্রশ্ন। আমার পক্ষে উত্তর দেয়া সম্ভব নয়। কাজেই আমি এর জবাব দিতে পারবো না।
প্রঃ সমঝোতা হিসেৰে কি আপনারা প্রেসিভিয়াম পছন্দ করবেন, না শেখ হাসিনাকে পছন্দ করবেন ?
উঃ এটা কোন প্রশ্নই হলো না। আগে জিজ্ঞেস করতে হবে হাসিনা আসছে কিনা ? হোয়েদার শি ইজ ইন দি সীন।
প্রঃ তার অনুপস্থিতিতেও আপনারা সিন্ধান্ত নিতে পারেন……।
উঃ শি ইজ এ্যাবাভ কনট্রোভার্সি । কেউ যদি তাকে ব্যক্তিগত উদ্যোগে টেনে আনতে চান তবে তা করবে এ্যাট হিজ ওন রিস্ক। পার্টির প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমি যতটুকু জানি, সে এই কন্ট্রোভার্সির অনেক উর্ধ্বে ।
প্রঃ যদি কেউ আনতে চায়?
উঃ কেউ আনতে চায় কিনা আমি জানি না। আনতে চাইলেও তার নিজের দায়িত্বে। আমার মনে হয় এটা তার দুঃসাহস।
প্রঃ আপনি কি পার্টির পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন?
উঃ সেটা কাউন্সিল জানে।
প্র: আপনি কি মনে করছেন।
উ: আমি কিছুই মনে করছি না। কাউন্সিল যে রায় দেবে তাই আমি স্বাভাবিক বলে মনে করে নেবো।
প্র: সাম্প্রতিক বিভিন্ন ঘটনাবলীতে আপনার দলের জনপ্রিয়তা সম্মান, মান-মর্যাদা জনগনের কাছে কোনভাবে ক্ষতি হয়েছে কি? যদি হয়ে থাকে, তা আপনারা কিভাবে দেখবেন ?
উ: যে কোন অবাঞ্ছিত ঘটনা সবসময়ই অবাঞ্ছিত এবং নিন্দনীয়। অলরেড়া আওয়ামী লীগের প্রস্তাবে একে নিন্দনীয় বলা হয়েছে । আমার প্রেসিডেন্সীতেই এটা হয়েছে। নিন্দনীয় এবং গর্হিত কাজ কোন সময়েই ঠিক নয়। সেটা যাচাই করার অধিকার জনগণের।
প্রঃ বিভিন্ন পত্রপত্রিকা পড়ে বোঝা যাচ্ছে আপনাদের দলের মধ্যে একটা অভ্যরীণ কোন্দল বয়ে গেছে। অভ্যন্তরীণ দ্বন্দের সমাধান না করে দলের নেতৃত্বের কাঠামোয় পরিবর্তন কি স্থায়ী সমাধান দিতে পারবে বলে আপনি মনে করেন?
উঃ নেতৃত্ব নিয়ে কোন সমাধান হয় না। নেতৃত্ব নিয়ে সমাধান হলে বঙ্গবন্ধু এদেশের একচছত্র নেতৃত্ব দিতে পারতেন না। মওলান ভাসানী, আতাউর রহমান খান, নুরুল আমীন এই নেতৃত্ব দিতেন। নীতি ছাড়া কোন নেতৃত্ব টিকে না। এবং নীতি যেখানে সত্য সেখানে কোন কোন্দলও টিকে থাকতে পারে না।
প্রঃ বাকশাল প্রসঙ্গে আপনাদের মুল্যায়ন কি ?
উঃ এক কথায় বাকশালের মুল্যায়ন করা যাবে না। বাকশালের মুল্যায়ন আওয়ামী লীগের রেজুলিশনে গ্রহণ করে অর্থনৈতিক, সামাজিক, প্রশাসনিক, পররাষ্ট্রনীতি, কৃষি ইত্যাদি সবগুলো নীতিকে কর্মসুচী হিসাবে মেনিফেস্টোতে গ্রহণ করা হয়েছে।
প্র: সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রেক্ষাপট বাকশালের আদর্শ ও কর্মসুচী কিভাবে আপনারা দলের কর্মসুচীতে আনবেন? আপনারা তো আবার পার্লামেন্টে যাচ্ছেন।
উঃ এক কথায় এর জবাব দেয়া সম্ভব নয়। এব্যাপারে আমাদের মেনিফেস্টো বইতে বিস্তারিত জবাব দেয়া হয়েছে। সার্বভৌম পার্লামেন্টের যে নীতি আওয়ামী লীগ গ্রহণ করেছে তার সবই বইয়ে উলেখ করা হয়েছে।
প্রঃ ‘৮১ সালের কাউন্সিলে কি আপনারা নতুন কোন রাজনৈতিক, সাংগঠনিক বা আন্দোলনগত কর্মসুচী দেবেন?
উঃ নিশ্চয়ই আমরা নতুন আন্দোলনের কর্মসূচী দেবো। আমরা সে প্রত্যাশাই করি তবে ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করে সমষ্টিগতভাবে তা প্রকাশ করা হবে। বিভিন্নভাবে এ ব্যাপারে মন্তব্য করা যাবে না। সমস্ত কর্মসুচী ঠিক করে কাউন্সিলে তা পেশ করা হবে। কাউন্সিল তা গ্রহণ করতে পারে আবার নতুন করতে পারে। তবে সার্বিক সিদ্ধান্ত আসবে কাউন্সিল শেষ হবার পর।
প্রঃ চট্টগ্রাম এবং রাজশাহীতে আপনাদের দুটো করে কমিটি গঠন করা হয়েছে। এর মধ্যে কোন কমিটি কাউন্সিলে আসৰে।
উ: রাজশাহী ও চট্টগ্রামে অফিসিয়ালী একটি করেই কমিটি হয়েছে। পত্রিকায় কি লেখা হচ্ছে তা আমাদের বিবেচ্য নয় ।

আওয়ামী লীগ-এ আদর্শগত দ্বন্দ্ব নেই
‘বিচিত্রার’ ১৩টি প্রশ্নের উত্তর দেন দলের সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক। নীচে প্রশ্ন ও উত্তর দেওয়া হলো ।
প্রশ্নঃ আপনি কি মনে করেন, নির্ধারিত ১৪ই ফেব্রুয়ারীতেই আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন হবে ?
উত্তরঃ অবশ্যই হবে। এব্যাপারে কোন দ্বিধা -দ্বন্দ্বের অবকাশ নেই। ঢাকাসহ সারা দেশে এজন্য গৃহিত সকল রকমের প্রস্তুতি ইতিমধ্যেই সম্পন্ন হয়েছে।
প্রঃ গত এক মাস দেশের বিভিন্ন স্থানে দলের কর্মীদের মধ্যে কোয়েকবার সংঘর্ষ হয়েছে। এ সংঘর্ষ কি করলে হলো। সংঘর্ষ’ কি এড়াতে চান , না সমাধান করতে চান ?
উঃ যে সংশয় হয়েছে এবং যেটাকে আপনারা ফলাও করে বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশ করেছেন, এগুলো আসলে কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা মাত্র। চট্টগ্রামের ঘটনা, এখানে উল্লেখ করছি। সেখানে একটি আহবায়ক কমিটি ছিলো। সেটাকে একটি সম্মেলনের মাধ্যমে মূল কমিটি নির্বাচনকালে ওখানকার হ কর্মীদের কিছুটা ভুল বুঝাবুঝির জন্য হয়েছে। ঢাকায় ঘটনা সেই একইরপ ভুল বুঝাবুঝির পরিণতি। এ ধরনের সংঘর্ষ আর যাতে না হয়, তা নিরসনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। অবশ্যই এগলো এড়াতে চাই এবং ভুল বুঝাবুঝি আর যাতে না ঘটে তারও সমাধান অবশ্যই খুজে বের করবো।
প্রশ্ন: এ সংঘর্ষগলো কি আওয়ামী লীগে বিদ্যমান আদর্শগত না ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব থেকেই সৃষ্ট ? এ দ্বন্দ্বের অবসান কিভাবে হতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
উ: আওয়ামী লীগে কোন আদর্শগত দ্বন্দ নেই এবং থাকতে পারে না। কেননা আওয়ামী লীগের সকল স্তরের নেতা ও কর্মী একটিমাত্র আদর্শকে সামনে রেখেই কাজ করে যাচ্ছেন। সেটা হলো জাতিরজনক, আমাদের মহান শিক্ষক ও নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের আদর্শ। তাঁর সঙ্গে কোন আপোষ নেই। সেই আদর্শকে মেনে নিতে না পেরে অতীতে অনেকেই আওয়ামী লীগ থেকে চলে গেছেন। এখনও যদি কেউ তেমন কিছু করেন তবে তাতে বিস্মিত হবার কিছুই নেই। সেক্ষেত্রে আদর্শগত দ্বন্দের কোন প্রশ্নই ওঠে না। দ্বিতীয়তঃ আওয়ামী লীগ যেমন রাষ্ট্র পরিচালনায় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে শ্রদ্ধা করে, তেমনি দলের অভ্যন্তরেও সেই মুল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। সে কারণেই দলের অভ্যন্তরে প্রতিযোগিতা থাকাটা স্বাভাবিক। এটাকে কোন ব্যক্তিগত দল হিসেবে চিহ্নিত করা হয় না। করাটাও ঠিক নয়। তাছাড়া আওয়ামী লীগের মধ্যকার কোন বিরোধ নিষ্পত্তিতে দলের গঠনতন্ত্রই বড় কথা।
প্রশ্নঃ এ সংঘর্ষগুলোর ফলে দলের জনপ্রিয়তা ও সম্মান কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ?
উঃ যে কোন ঘটনা বা ঘটনায় একটি স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া আছে। এক্ষেত্রেও তেমনটি হওয়া স্বাভাবিক। তবে তা খুব বেশি কিছু নয়। কিন্তু বিভিন্ন সংবাদপত্রে এটাকে যেভাবে ফলাও করে প্রচার করা হয়েছে, সেই উদ্দেশ্যমুলক প্রচারের বিভ্রান্তিতে দলের ভাবমুর্তি কিছুটা ক্ষুণ্ন হয়েছে বলা যেতে পারে।
প্রশ্নঃ সম্মেলনের আগে বা সম্মেলনের সময় এ দ্বন্দ্বের অবসান ঘটবে বলে মনে করেন? না এ দ্বন্দ্ব সম্মেলনের পরও অব্যাহত থাকবে?
উঃ আওয়ামী লীগের নেতা ও কর্মীরা জাতীয় সংকটময় মুহুর্তে কোন ছোটখাটো দ্বন্দ্ব বা বিরোধকে বৃহত্তর স্বার্থের ক্ষেত্রে কিছুই মনে করেন না। বঙ্গবধুর আদর্শের কর্মীরা আজকের দিনের জাতীয় জীবনের সার্বিক পরিস্থিতিতে নিজেদের দায়িত্ব বুঝে নিতে সক্ষম হচ্ছেন, তাঁদের দায়িত্ব সচেতনতা এবং চিন্তা-চেতনা আরো শক্তিময় হয়ে উঠছে। সম্মেলনে সেই চেতনায় উজ্জীবিত একটি বাস্তব কর্মসুচি নিয়ে তারা দলকে সামনে এগিয়ে নেবার জন্য প্রত্যয়ী হয়ে উঠছেন। কাজেই সেক্ষেত্রে আপনাদের এসব দ্বন্দ্ব সংঘাতের স্থান কোথায়? আওয়ামী লীগাররা কাপুরুষ-ভীরু বা তার্কিক নয়, যে কথায় কথায় কেবল তর্কিক ও তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে দ্বন্দ আর সংঘাত খুজে বেড়াবেন। তারা কর্মী-কর্মে বিশ্বাসী। এই সম্মেলনে তাদের সেই কর্মের শক্তি আরো সুসংহত করবে।
প্রশ্নঃ অভ্যন্তরীণ দ্বন্দের সমাধান না করে দলের নেতৃত্বের কাঠামোর পরিবর্তন কি স্থায়ী সমাধান দিতে পারবে বলে মনে করেন?
উত্তর : আওয়ামী লীগের মত বৃহত্তর রাজনৈতিক সংগঠন কোন কোন ইস্যুতে কিছু কিছু মতামতগত ভিন্নতা সময়ে সময়ে উথাপিত হতে পারে, অতীতেও এমনটি হয়েছে। এবং সব সময়ই আমরা গণতান্ত্রিক রীতিনীতি অনুসরণ করে তা দুরিভুত করেছি, ঐক্য মতে উপনীত হয়েছি। এই সংগঠনে আদর্শগত ঐক্য এবং নিজ দৃষ্টিভঙ্গী ও পারস্পরিক মতামতের প্রতি সম্মানবোধ বিদ্যমান। তাই সময়ের প্রয়োজনে কাঠামোগত পরিবর্তন দলের মুলে ঐক্যের সুরকে আরো সুসংহত ও সুসংঘবদ্ধ করতে সহায়ক হবে।
প্রশ্নঃ দলীয় সমস্যারোধের জন্য বিভিন্ন নেতার বাড়িতে পৃথক পৃথথ বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সবগুলো বৈঠকের সিধান্তের সমন্বয় সাধন এত অল্প সময়ে সম্ভব হবে কি?
উত্তরঃ সম্বেলনকে সফল করার জন্য গঠিত বিভিন্ন সাব-কমিটিগুলোরই পৃথক পৃথক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিভিন্ন নেতার বাড়িতে অনুষ্ঠিত বৈঠকগুলে ছিলো মুলতঃ দলীয় গঠনতন্ত্র সংশোধন সম্পর্কিত সাব-কমিটির ঐক্যবদ্ধ বৈঠক। এই বৈঠকগুলোতে সার্বিক আলাপ-আলোচনা পর গঠনতন্ত্র সংশোধনের জন্য সর্বসম্মতিক্রমে বিভিন্ন প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে।
প্রশ্ন: বাকশাল প্রসঙ্গে আপনাদের মূল্যায়ন কি?
উত্তর : বাকশাল প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের মুল্যায়ন অতীতেও হয়েছে এবং তা পুস্তকাকারেও প্রকাশিত হয়েছে। আসলে বাকশাল কি ও কেন তা এদেশের মানুষের সামনে প্রমাণিত হবার আগেই সাম্রাজ্যবাদী মহলের ঘৃণ্য কারসাজীতে এদেশের প্রতিক্রিয়াশীল চক্র বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে, সেই দর্শনের বাস্তবায়ন বন্ধ করে দিয়েছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর থেকে এই দর্শনের বিরুদ্ধে একতরফা অপপ্রচার ও কুৎসা রটনা করা হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। আমরা মনে করি শত শত বছরের সামন্তবাদী ও ঔপনিবেশবাদী শোষণের দাসত্ব নিগড়ে আবদ্ধ বাঙালী জাতি আজ বিশ্বের একটি দরিদ্রতম দেশে পরিণত হয়েছে। অর্থনিতির একটি নিম্নতম কাঠামোও এদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। জাতীয় উৎপাদন ও জাতীয় পুজির অবস্থাও নিম্নতম পর্যায়ের রয়েছে। দেশের মানুষ উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত আছি বটে, কিন্ত তাদের মাঝেও দক্ষতা, সচেতনতা এবং সংঘবদ্ধতার অভাব প্রকট। দেশের প্রতিটি নগরিককে এই উৎপাদন কমকান্ডে দক্ষ সচেতন, সংঘবদ্ধ করে তুলে জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তা সুসম বণ্টনের প্রকিয়ায় সকলের জন্য তার সুফল পৌছে দেয়া ছিলো বকশালের অন্যতম কর্মসুচী । এর সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতিতে টোটালেটারিয়াম পদ্ধতি অনুসরণ। রাষ্ট্রীয় প্রশাসন ব্যাবস্থায় দেশের সকল মানুষের অংশগ্রহণ, উৎপাদন যন্ত্রের সঙ্গে উৎপাদকদের অংশীদারীত্ব এবং এই মাটি ও মানুষের সৃষ্ট সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও জাতীয় মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় বাকশালের ছিল এক সস্পষ্ট কর্মসুচী। এক কথায় বঙ্গবন্ধু বাকশাল দর্শনের মাধ্যমে এদেশ জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সাধন করতে চেয়েছিলেন।
প্রশ্ন: সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রেক্ষাপটে বাকশালের আদর্শ ও কর্মসুচি আপনারা কিভাব দলের কর্মসুচীর মাঝে আননে?
উত্তরঃ বাকশালের কর্মসুচী জনগণের সার্বিক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, প্রশাসনিক ও সাংস্কৃতিক জীবন ধারণ বৈপ্লবিক উন্নয়নের কর্মসুচী। জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা, স্বাধীনতা, যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত এই ৪ টি জাতীয় মুলনীতির ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধুর বাকশাল দর্শন জনগণের সামনে পেশ করেছিলেন। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমরা এই দর্শনের রাজনৈতিক কর্মসূচী স্থগিত রেখে অর্থনৈতিক সহ অন্যান্য কর্মসূচী সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্গে সমন্বয় ঘটিয়ে একটি কল্যাণকর অবস্থা সৃষ্টি করার কথা চিন্তা করছি। কেননা আমরা মনে করি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পরদিন পর্যন্ত দেশ, জাতি, রাষ্ট্র যে অবস্থায় ছিলো, তথা সমাজতন্ত্রে ‘উত্তরণের পথে যেভাবে ধাপে ধাপে এগিয়ে যাচ্ছিলো, মোস্তাকের প্রতিক্রিয়াশীল সরকার সে অগ্রগতি রুদ্ধ করে দিয়েছিলো এবং জিয়াউর রহমানের সরকার দেশকে তা থেকে আনেকগুনে পিছিয়ে নিয়ে গেছে। বাঙালী জাতীয়তাবাদকে তথাকথিত বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে নামে এক বিকৃত অবস্থায় নামিয়ে দিয়েছে। গণতন্ত্রের নামে আধা সামরিক শাসন চালানো হচ্ছে। সার্বভৌমত্বহীন সংসদ জাতির কোন কল্যাণ সাধন করতে পারছে না, বরং জাতীয় মৌলিক অধিকার ক্ষূন্নকারী আইন প্রণয়নের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হচ্ছে (উপদ্রুত এলাকা বিল তার প্রমাণ) । সমাজতন্ত্রকে ‘সামাজিক ন্যায়-নীতির’ নামে পরিবর্তন করে আসলে হত্যা, ধর্ষণ, রাহাজানি, ডাকাতি, ঘুষ, দর্নীতিসহ সকল প্রকারের সামাজিক অপরাধ সংঘটনের সংযোগ সৃষ্টি করে দেয়া হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষতাকে বাতিল করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির সংযোগ দিয়ে ধর্মের নামে উন্মাদনা সৃষ্টি করে সাম্প্রদায়িক তার বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে সে অবস্থায় গণতান্ত্রিক রীতিনীতির সঙ্গে বাকশালের কর্মসুচীর সমন্বয় সাধন করে জাতির সামনে এটি আসার আলো ফুটিয়ে তুলতে আমরা প্রচেট্টা চালাচ্ছি।
প্রশ্নঃ দশ-দলীয় ঐক্যজোটে আপনাদের বর্তমান ভুমিকা কি? এ জোট কোন ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের কর্মসূচী নিতে পারৰে কি?
উত্তরঃ প্রশ্নটি ১০ দল ৫ দলের নয় । আওয়ামী লীগ মনে করে যে, বর্তমান অবস্থায় সকল সাচচা দেশপ্রেমিক, গণতান্ত্রিক এবং সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, বর্ণবাদ, প্রতিবিপ্লবী স্বৈরাচারী ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি বিরোধী প্রগতিশীল শক্তির ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম ও সংগঠিত প্রযয়াস আজকের দিনে সব চাইতে বড় প্রয়োজন। এক্ষেত্রে অনেক বাধাবিঘ্ন আছে। কিন্তু আমাদের সেক্ষেত্রে বর্তমানকার গণদাবি ভিত্তিক ঐক্যবদ্ধ কর্মসুচী নিয়ে আন্দোলনে নামতে হবে এবং আসন্ন কাউন্সিলে এব্যাপারে আলোচনা হবে।
প্রশ্নঃ ১৯৮১ সালের কাউন্সিলে আপনারা নতুন কোন রাজনৈতিক, সাংগঠনিক ৰা আন্দোলনের কর্মসূচী দেবেন কি?
উত্তরঃ অবশ্যই। এই কাউন্সিল দলীয় কর্মকর্তা নির্বাচনই একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। এতে আমাদের দলের বিগত দু’বছর আড়াই বছরের কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করা হবে এবং তার সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় ও সাংগঠনিক অবস্থাও নিরুপিত হবে। সংগঠনকে আরো শক্তিশালী, তেজোদৃপ্ত করার সঙ্গে সঙ্গে জাতিকে বর্তমান স্বৈরাচারী অবস্থার হাত থেকে মুক্ত করার জন্য জাতির স্বাধীনতা আনয়নকারী রাজনৈতিক সংগঠন আওয়ামী লীগ তার অতীত ঐতিহ্যের মত একটি আপোষহীন সংগ্রাম গড়ে তুলবে ।
প্রশ্ন : দলের নেতা ও ঐক্য টিকিয়ে রাখতে পাকিস্তানের পিপলস পার্টির মত (বেনজীর ভুট্টো) শেখ হাসিনাকে আপনারা আপোষ নেতৃত্ব হিসেবে গ্রহণ করবেন কি ?
উত্তর : শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বঙ্গবন্ধুর অঞ্চলের কন্যা, আমার মত প্রতিটি আওয়ামী লীগারের কাছে বোনের মত। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকারীদের রক্তের যে জিঘাংসা দেখেছি, তাতে বলা যায় সেদিন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা যদি বাংলাদেশে থাকতো, তবে হয়ত তারাও ওই পৈশাচিক নির্মমতার হাত থেকে রেহাই পেতেন না, মোখানে রাসেললের মত কচি শিশু রেহাই পায়নি। আমাদের কাছে হাসিনা-রেহানার স্থান সব কিছুর ঊর্ধ্বে। তাদের দেশে আসার সুযোগ সৃষ্টির জন্য আমরা দাবি জানাই এবং মনে-প্রাণেও কামনা করি ওরা আসুক আওয়ামী লীগ তাদেরও প্রাণের সংগঠন এবং এই সংগঠনের জন্য তাদের ত্যাগ অপরিসীম সার্বোচ্চও। আওয়ামী লীগে এমন কোন অনৈক্য বা নৈতৃত্বের বিভেদ নেই যে, তাদের ব্যাপারে এ ধরনের বিভ্রান্তির সৃষ্টি করা যেতে পারে। শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর দর্শন বাকশালের কর্মসুচীর ভিত্তিতে এদেশের কোটি কোটি শোষিত মানুষের মুখে হাসি দেখতে চান। তার সেই কামনা-বাসনার ভিত্তিতে তিনি তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করতে পারেন এবং তাতে দল উপকৃত হবে। পিতৃহারা, মাতৃহারা, ভাইহারা , হাসিনা , রেহানা এদেশের শোষিত মানুষের চোখে-মুখে অবয়বে তাদের খুজে পাচ্ছেন—মহান পিতার আদর্শে উদ্বুদ্ধ তারা এদেশের মাটি আর মানুষের জন্যই কাজ করবেন ।
প্রশ্নঃ যদি কাউন্সিল আপনাকে দল থেকে বহিস্কার করে, তা আপনি কিভাবে নেবেন?
উত্তরঃ প্রশ্নটি অবান্তর। এটা বহিষ্কার করার কাউন্সিল নয়, দশকে সুসংহত করার কাউন্সিল

বহিষ্কার করলে মেনে নেব

‘ৰিচিত্রা’র ১৩টি প্রশ্নের উত্তর দেন সাংগঠনিক সম্পাদক তোফায়েল আহমদ। নীচে প্রশ্ন ও উত্তর দেয়া হলো।
প্রশ্ন: আপনি কি মনে করেন নির্ধারিত ১৪ ফেব্রুয়ারীতেই আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিশেন হবে ?
উত্তর—অবশ্যই হবে। দেশ ও সংগঠনের স্বার্থে কাউন্সিল হওয়া উচিত।
প্রশ্ন: গত এক মাসে দেশের বিভিন্ন স্থানে দলের কর্মীদের মধ্যে কয়েকবার সংঘর্ষ হয়েছে। সংঘর্ষ কি কারণে হলো? সংঘর্ষ কি এড়াতে চান না সমাধান করতে চান?
উত্তর : আমাদের কয়েকটা জেলা সম্মেলনকে কেন্দ্র করে দলীয় কর্মীদের মধ্যে কিছু ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে। দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী যদি সন্মেলনগুলো করা হতো তাহলে এই ভুলবোঝাবুঝি হতোনা। এ সমস্যার সমাধান অবশ্যই চাই। আমরা যদি ব্যক্তিতৃত্ব প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে লিপ্ত না হয়ে দলীয় ব্যার্থকে ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে স্থান দেই তাইলই সংঘর্ষ এড়ানো সম্ভব। তাছাড়া নীচের তরের কমিটিগুলোতে হস্তক্ষেপ না করে এদিকে নেতা নির্বাচনের সুযোগ করে দিতে হবে। আজকের অনেক ঘটনা নগ্ন হস্তক্ষেপরই পরিণতি।
প্রশ্নঃ এ সংঘর্ষগলো কি আওয়ামী লীগে বিদ্যমান আদর্শগত না ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব থেকে সৃষ্ট? এ দ্বন্দ্বের অবসান কিভাবে হতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
উত্তর : আওয়ামী লীগ একটা বিশাল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংগঠন। এই সংগঠনে লাখ লাখ কর্মী ও নেতা রয়েছেন। এখানে কিছুটা মত পার্থক্য থাকবেই। যে অন্যের কথা বলছেন তা আদর্শগত কিংবা ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বও নয়। ব্যক্তিগত পছন্দ, অপছন্দের উপর নির্ভর করে যদি আমরা সংগঠন পরিচালনা করতে চাই তাহলে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হবেই।
গঠনতন্ত্র হলো একটা পার্টির রক্ষা কবচ। গঠনতন্ত্র মোতাবেক সংগঠন পরিচালনা করলে । পরে অবসান হতে বাধ্য।
প্রশ্ন: এ সংঘর্ষগুলোর ফলে দলের জনপ্রিয়তা ও সম্মান কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে?
উত্তরঃ সম্মান ক্ষুণ্ণ হয়েছে, একথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। আওয়ামী লীগের কর্মীরা কোন নেতা বা ব্যক্তির পেছনে নয়। তারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের পেছনে ঐক্যবন্ধ। জীবন দিয়ে হলেও কর্মীরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বাস্তবায়ন চায়। কোন নেতা বা ব্যক্তি যদি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বঙ্গবন্ধুর আদর্শে গড়া এই সংগঠনকে দুর্বল করে তার জনপ্রিয়তা ও সম্মান ক্ষুন্ন করার চেষ্টা করেন তাহলে হাজার হাজার কর্মীরা অবশ্যই এর মোকাবিলা করবে। সাম্প্রতিক সংঘর্ষ থেকে আমাদের আগামী দিনে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে ।
প্রশ্নঃ সম্মেলনের আগে বা সম্মেলনের সময় এ দ্বন্দ্বের অবসান ঘটবে বলে মনে করেন? না এ দ্বন্দ্ব সন্মেলনের পরও অব্যাহত থাকৰে ?
উত্তর : আওয়ামী লীগের কর্মীরা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আদর্শের পেছনে ঐক্যবদ্ধ। তারা কোন অবস্থাতেই পার্টিতে দ্বন্দ্ব চায় না। সুতরাং বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় অবশ্যই এ দ্বন্দ্বের অবসান হবে। তবে আওয়ামী লীগে আদর্শগত কোন দ্বন্দ্ব নেই। জাতীয়ভাবে বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচী বাস্তবায়নে আমাদের মধ্যে কোন দ্বিমত নেই। আন্তজাতিক প্রশ্নে আমরা সক্রিয় জোট নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতিতে বিশ্বাসী হলেও আমাদের বন্ধু, চিহ্নিত। ১৯৭১ সনের মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে দুনিয়ার যে সমস্ত রাষ্ট্র আমাদের পাশে এসে দাড়িয়েছিল তারা অবশ্যই প্রথম বন্ধু।
প্রশ্নঃ অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের অবসান না করে দলের নেতৃত্বের কাঠামোর পরিবর্তন কি স্থায়ী সমাধান দিতে পারবে বলে মনে করেন?
উত্তরঃ—বঙ্গবন্ধুর মত একক ব্যক্তি সম্পন্ন নেতা আজ আমাদের মধ্যে নেই। তেতুলিয়া থেকে টেকনাফ পর্যন্ত লাখ লাখ কর্মী ছিলেন বংগবন্ধুর প্রতি আস্থাশীল। বঙ্গবন্ধুর চোখেও কর্মীরা ছিলেন সমান। তিনি দেশ ও জাতির স্বার্থে দলকে পরিচালনা করেছেন। ব্যক্তি স্বার্থের কোন স্থান তাঁর কাছে ছিল না। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে এই বহৎ সংগঠনকে এককভাবে সঠিক পথে পরিচালনা করা সম্ভব নয় বলেই আমরা যৌথ নেতৃত্বের কাঠামোর মাধ্যমে সংগঠন পরিচালনা করতে চাই। দল যদি সংগ্রাম ও আন্দোলনে লিত থাকে তাহলে অভ্যন্তরীণ বন্দের অবসান হবে। তবে এ ব্যাপারে একটা কথা পরিষ্কার করে বলতে চাইঃ দলের মূল নেতৃত্বকে ব্যক্তিস্বাথ পরিহার করে সংগঠনের স্বার্থকে সংরক্ষণের চেষ্টা করতে হবে।
প্রশ্নঃ দলীয় সমস্যা রোধের জন্য বিভিন্ন লৈভার বাড়িতে পখক পৃথক বৈঠক অনুষ্ঠিত হচেছ। সবগলে বৈঠকের সিদ্ধান্তের সময় সাধন এত অল্প সময়ে সম্ভব কি?
উত্তরঃ পথ পথিক বৈঠকের খবর সঠিক নয়। সমন্বয় সাধনের প্রশ্ন ওঠে না।
প্রশ্নঃ বাকশাল প্রসংগ আপনাদের মূল্যায়ন কি ?
উত্তর : বাকশাল সমাজতন্ত্রে উত্তরণের জন্য একটা বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। বাংলাদেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থায় সমাজতান্ত্রিক সমাজ গড়া ছাড়া এদেশের গরীব দুঃখী মানুষের মুক্তি আসতে পারে না। সমাজতন্ত্রে পৌছানোর জন্যই বঙ্গবন্ধু বাকশাল তথা দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসুচী ঘোষণা করেছিলেন। বাকশালের কর্মসুচী বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ একটা আত্মনির্ভরশীল জাতিতে পরিণত হতে পারত। তাই আওয়ামী লীগ মনে করে এদেশের শোষিত নির্যাতিত মানুষের সার্বিক মুক্তির জন্য বাকশাল একটি নির্ভুল এবং সঠিক পদক্ষেপ।
প্রশ্নঃ সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রেক্ষাপটে বাকশালের আদর্শ ও কর্মসুচী আপনারা কিভাবে দলের কর্মসুচির মাঝে আনবেন?
উত্তর: বাকশালের কর্মসূচী বাস্তবায়ন আমাদের মুল লক্ষ্য। কিন্তু আজকে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সংসদীয় গণতন্ত্রের মাধ্যমে বাকশালের অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক ও সামাজিক কর্মসুচী বাস্তবায়নে আওয়ামী লীগ তার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে।
প্রশ্ন: দশ দলীয় ঐক্যজোটে আপনাদের বর্তমান ভুমিকা কি? এ জোট কি কোন ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের কর্মসূচী নিতে পারবে?
উত্তরঃ বর্তমানে কাগযে কলমে ছাড়া দশ দলীয় ঐক্যজোটের কোন ভিত্তি নেই। আমরা নুন্যতম কর্মসূচীর ভিত্তিতে আন্দোলন গড়ে তোলার প্রয়াস শুরু থেকেই চালিয়ে এসেছি। দলীয় স্বার্থ পরিহার করলেই ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের কর্মসূচী নেয়া সম্ভব। আমি আশাবাদী যে, দেশের বর্তমান অবস্থায় প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক দলগুলো অন্দোলনের কর্মসুচী রচনায় এগিয়ে আসবেন।
প্রশ্নঃ ১৯৮১ সনের কাউন্সিলে আপনারা নতুন কোন রাজনৈতিক, সাংগঠনিক বা আন্দোলনের কর্মসুচী দেবেন কি?
উত্তর : একটা কাউন্সিল শুধু নেয় পরিবর্তনের জন্যই অনুষ্ঠিত হয় না। কর্মসুচী অবশাই থাকবে। দেশবাসী গভীর আগ্রহ নিয়ে আমাদের দিকে চেয়ে আছে। দেশ ও জোতিকে স্বৈরশাসনের বল থেকে বন্ধ করে শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যাপকভিত্তিক আন্দোলনের কর্মসূচী নেয়া হবে। অবশ্য কাউন্সিলের সিদ্ধান্তই হবে এ ব্যাপারে চুড়ান্ত।
প্রশ্নঃ দলের নেতৃত্ব ও ঐক্য টিকিয়ে রাখতে পাকিস্তানের পিপলস পার্টির মতো (ৰেনজীর ভট্রো ) শেখ হাসিনাকে আপনারা আপোষ নেতৃত্ব হিসেবে গ্রহণ করবেন কি?
উত্তর : শেখ হাসিনাকে অমরা অপোষ নেতৃত্ব হিসেবে মনে করি না। দেশবাসীর প্রয়োজানের তাগিদেই হাসিনা একদিন দলের নেতৃত্ব এগিয়ে আসলেন এটাই আমরা আশা করি।
প্রশ্নঃ যদি কাউন্সিল আপনাকে বহিষ্কার করে, তাহলে আপনি কিভাবে নেবেন?
উত্তর : যদিও প্রশ্নটা হাইপলিটিক্যাল তবুও বলছি কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত মাথা পেতে মেনে নেব। কারণ আমি গনতন্ত্রে বিশ্বাস করি ।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!