প্রচ্ছদ কাহিনী | স্বরূপ অন্বেষা | একটি জাতীর স্বপ্ন ও মুক্তির যুদ্ধ | আনু মুহাম্মদ | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ২৬ মার্চ ১৯৮০
বহু বছর ধরে বঞ্চিত কিন্তু ভীতু আর ভেতো জাতি হিসেবে কথিত একটি জাতি তার সমস্ত অহংকার আর শক্তি দিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছিলো। তার রক্তে তখন ছিল একটিমাত্র ধবনি প্রতিশোধ। আহত অহংবোধের দু’ত প্রতিহিংসায় বাংলাদেশের অনভ্যস্ত ‘নিরীহ’ মানুষের হাতে উঠছিল অস্ত্র। খালি হাত পরিণত হয়েছিল যোদ্ধার হাতে। হাজার বছর ধরে শুধু বিশ্বাসঘাতকতা আর নির্যাতনের পর সে জাতি গড়িয়ে যাবার আগে একবার রুখে দাড়িয়েছিল। যুদ্ধক্ষেত্র ছিল বাংলাদেশের নরম প্রকৃতি, নেতৃত্বে হলেন গ্রামের মানুষ, জীবন আর যুদ্ধের ভিন্ন কোন চেহারা ছিল না । যুদ্ধে তখন দৈনন্দিন অভ্যাস প্রতিরোধ তখন একমাত্র কাজ প্রতিদিন আর সে যুদ্ধে জাতির স্বপ্ন ছিল নতুন জীবনের।
নয়মাসের সে যুদ্ধে রক্তে স্নাত হয়েছে সমস্ত জাতি, লক্ষ লক্ষ মানুষের রক্ত আর সম্মানের উপর দাঁড়িয়ে জাতি যুদ্ধ করেছে। পরাজিত-হয়নি। পরাজিত করেছে সুশিক্ষিত সশস্ত্র বর্বর এক সেনাবাহিনী আর তাদের পাচাটা কুকুর, বাংলাদেশের কলঙ্ক, দালালদের ।
তার পর প্রায় দশটি বছর গেছে। বাংলাদেশের মানুষের গর্ব করার মতো একটি ঘটনা সেই যুদ্ধ আজ কি স্মৃতি থেকে ম্লান ? মুক্তিযোদ্ধারা আজ বিচ্ছিন্ন, রাষ্ট্রযন্ত্র তাদের দেখে ভীত কোণঠাসা করে রুখে তাদের সর্বশক্তি দিয়ে। মুক্তিযোদ্ধা আত্মহন্তা করে বেকারত্বের যন্ত্রণায়, লক্ষ লক্ষ বেকারের সঙ্গে একাত্ম হয়ে । মুক্তিযোদ্ধা অত্যহত্যা করে জীবনের দায়িত্ব বহন করতে না পেরে বঞ্চিত আর পরাজিত কোটি কোটি মানুষ; ক্লান্ত বিব্রত আর বিতশ্রদ্ধ (অস্পষ্ট) মুক্তিযোদ্ধারাও।
বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার দশ বছর পর আবার স্বাধীনতার, বাঙ্গালী জাতীর চিরদিনের শত্রুরা আবার তৎপর। মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাভাবিকভাবেই আমরা ভেবেছিলাম পুরনো জাতিগত শত্রুরা নিশ্চিহ্ন হয়েছে—এবার মেরুকরণের প্রক্রিয়া চলবে জনগণের মধ্যে। এবারের দ্বন্দ্ব নতুন। কিন্তু দশ বছর পরে আবারো দেখছি পুরনো যুদ্ধই এখনো শেষ হয়নি—পুরনো শত্রুদের অস্তিত্ব আজো প্রকট। নতুন আর পরনো যধ এখন একাকার। এখনো বিতর্ক হয় স্বাধীনতা ঠিক ছিল কি না, এখনো এই স্বাধীন দেশেও বলা হয় রাজাকাররা ঠিক ছিল। অস্ত্র ধরেছিলো লক্ষ লক্ষ মানুষ যে যুদ্ধে সে যুদ্ধের সমস্ত গর্ব ধুলিসাৎ করবার ঢাকাত চলছে। গণতন্ত্রের নামে রাজাকাররা অনির্বান শিখার বিরুদ্ধে বক্তব্য রেখেছে।
এসব ঘটনার জন্যেই নিজেদের কাছেই আমাদের নিজদের জিজ্ঞাসা—কেন এই ব্যর্থতা ? আমাদের দুর্বলতা কোথায় ? বিশাল ত্যাগেও কেন কাঙ্ক্ষিত ফসলের দেখা পাওয়া যায় না। প্রয়োজন ছিল কিসের, ঘাটতি ছিল কিসের ? আমাদের রক্ত কি লাল ছিল না? আমরা কি করেছি আর কি করিনি। আমাদের সেই উদ্ধুত প্রতিবাদী শক্তি এভাবে ম্লান কেন আজ ? আমাদের অস্তিত্ব এভাবে বারবার কেন পরাজিত হয়, লাঞ্ছিত হয় ? আমাদের অহংবোধ কেন বারবার আহত হলেও আমরা যথাসময়ে যথার্থই ভাবে প্রতিশোধে প্রতিরোধে জঙ্গী হতে পারি না ? সে প্রশ্ন খুজতেই আমরা মুক্তিযুদ্ধের সামগ্রিক ঘটনাবলী বিচার করতে চাই।
[দুই]
১৯৭১-এর ১লা মার্চ থেকে সারাদেশের মানুষের সর্বত্র বিক্ষোভ, মিছিল, প্রতিরোধ, আলোচনা থেকে সুম্পষ্ট হয়ে উঠেছিল তাদের আকাক্ষা এবং দাবির মধ্যে একটি গুণগত পরিবর্তন এসেছে। ৬ দফা, ১১ দফার চাইতে অনেক অগ্রসর হয়ে গেছে মানুষের চেতনা, মানুষের দাবি।
ইয়াহিয়ার পরিকল্পিত বিশ্বাসঘাতকতা প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গে সারাদেশে যে তোলপাড় শুরু হয় তা ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। ঢাকা শহরে নেতৃত্বের নির্দেশ ছাড়াই সমস্ত অফিস, আদালত, দোকানপাট বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। নেতৃত্বের নির্দেশ ছাড়াই সর্বস্তরের মানুষ নেমেছিল পথে, নিদেশ ছাড়াই মানুষের মধ্যে থেকে স্বতঃস্ফর্ত এবং দৃঢ় দাবী উঠেছিলো ‘জনগণের এক দফা—বাংলাদেশের স্বাধীনতা’।
১লা মার্চ থেকে শুরু করে ২৫ মার্চ পর্যন্ত মানুষের আগে নেতৃত্ব ছিল না, নেতৃত্বের আগে ছিল মানুষ। জনগণের অগ্রসরতায় প্রতিরোধের কঠিন প্রত্যয়ে ভীত বিব্রত এবং দুর্বল নেতৃত্ব এই পুরো সময় ছিল দ্বিধাগ্রস্ত। নেতৃত্বরক্ষা, নিজেদের মৌলিক অবস্থান রক্ষা এই দুইয়ের দ্বন্দ্ব নেতৃত্বের মধ্যে প্রকটভাবে দেখা গেছে সে সময়।
সে সময় নেতৃত্বে ছিলেন শেখ মুজিব। নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে শেখ মুজিবকে নিজেদের নেতা নির্বাচিত করেছিলেন। জনগণই তাকে টেনে এনেছেন সামনে; গ্রেফতার হবার পরও অনুপস্থিত থেকেও তিনি নেতার আসনে ছিলেন। জনগণের নিজস্ব লড়াই-এ তিনি ছিলেন প্রতীক নেতা।
লণ্ডনের ডেইলী টেলিগ্রাফের দক্ষিণ এশিয়া প্রতিনিধি ডেভিড লোশাক ১৯৭১ প্রকাশিত তার এক প্রতিবেদনে বলেছিলেন, ‘১৯৭১-এর প্রথম দিকে পিআইএ-র করাচী-ঢাকা ফ্লাইট সিট পাওয়া ক্রমেই দুষ্কর হয়ে উঠছিলো। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সামনে ছিল সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। সাধারণ পোশাকে সেনাবাহিনীর লোকেরা বিমানযোগে ঢাকায় অবতরুণ করতো। সে সময়ই ২০,০০০ পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য পূর্ব বাংলায় অবস্থান করছিল। রুমে এ সংখ্যা ৩৫-৪০,০০০ এবং তারপর ৬০,০০০ পর্যন্ত পৌঁছে; ৩,০০০ মাইল দূর থেকে এভাবে সমরসজ্জার যোগান দিয়ে পূর্ণ প্রস্তুত হবার জন্যে সেনাবাহিনীর অন্ততঃ দু’মাস সময় লেগেছিল এবং সেভাবেই তারা কাজ শুরু করেছিল।
(ডেভিড লোশাক, পাকিস্তান ক্রাইসিস, লণ্ডন, ১৯৭১)
অন্যদিকে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসকে মোটামুটি নজরবন্দী করে রাখা হয়েছিলো, অনেক স্থানে তাদের কাছ থেকে অস্ত্র কেড়ে নেয়া হয়েছিল। একই ধরনের ব্যবহার করা হচ্ছিল ইস্ট বেঙ্গল পুলিশ, আনসার এবং মুজাহিদদের সঙ্গেও। কিন্তু পাকিস্তানী শাসকচক্র এ কাজগুলো খুব সহজে করতে সক্ষম হয়নি। ১৭ মার্চের মধ্যে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব দেশের অনেক স্থান থেকে এসব বাহিনী নিরস্ত্র করবার খবর পান।
শেখ মুজিব জানতেন পাকিস্তানী জান্তা অস্ত্রে আর গণহত্যার পরিকল্পনায় সজ্জিত হচ্ছে—কিন্তু তা প্রতিরোধ করবার শক্তি কিংবা পরিকল্পনা তাঁর ছিল না। ২৫ মার্চের গণহত্যার পর ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ানের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তাঁর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা রেহমান সোবহান বলেছিলেন, ‘আয়ুব শাহীর বিরদ্ধে—গণ অভ্যুত্থানের সময় স্পষ্ট হয়ে উঠেছিলো বাঙ্গালী জাতির প্রকৃত শক্তি এবং তারপর থেকেই সশস্ত্রবাহিনীকে আরও শক্তিশালী করা হতে থাকে এবং তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় সম্ভবতঃ ১লা থেকে ৬ই মার্চের মধ্যে এবং এর লক্ষণ দেখা যায় ৭ মার্চে লেঃ জেনারেল টিক্কা খানের নিয়োগের মধ্যেই।‘ মূলতঃ জানুয়ারী ফেব্রুয়ারী থেকেই বাংলাদেশে সৈন্য আমদানী হঠাৎ করেই অস্বাভাবিক রপ লাভ করে। সাধারণতঃ সেনা-পরিবহন হিসেবে জাহাজ ব্যবহার করে, কিন্তু ৭১-এর জানুয়ারী থেকেই আমরা শুনতে থাকলাম, বিমানযোগে সৈন্য আমদানী করা হচ্ছে কখনো সাদা পোশাকে কখনো বাহিনী পোশাকে। অতটা তাড়াহুড়ার কারণ তখনো স্পষ্ট বুঝতে পারিনি। কিন্তু অনেকের মতো আমিও সে সময় একটা অশভ কিছুর ইঙ্গিত পাচিছলাম’ (কর্নেল (অবঃ) কিউএন জামান)।
মার্চ মাসে সশস্ত্রবাহিনী শক্তিশালী করবার তৎপরতা কয়েকগুণ বৃদ্ধি পায়। পাকিস্তানী জেনারেলরা এখানে আসতে থাকে, পি আই এ সি-১৩০৬ বিমানে প্রতিদিন সাদা পোশাকে সেনাবাহিনীর লোক, অস্ত্রশস্ত্র আনা হয়। ট্যাঙ্কে রবার বেল্ট পরানো হয় শহরের রাস্তায় চলার জন্যে। এগুলো বিভিন্ন স্ট্র্যাটেজিক পয়েন্টে অবস্থান নেয়, এসএসজি পাকিস্তানী কম্যাণ্ডো গ্রপ ঢাকায় অবতরুণ করে। আর্টিলারী এবং মেশিন গান নেট বসানো হয় বিভিন্ন চুম্বক স্থানে। ৩ মার্চ থেকে বঙ্গোপসাগরে অত্রশস্ত্রবাহী জাহাজ ‘এম ভি সোয়াট’ অপেক্ষা করতে থাকে। ১৮ মার্চ এম ভি সোয়াট থেকে অস্ত্রশস্ত্র খালাসের উদ্যোগ নিতেই কয়েক হাজার জনতা তা প্রতিরোধ করে; সংঘর্ষ হয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে জনতার। শহীদ হন কয়েকশ বাঙ্গালী। জয়দেবপুরেও একই ঘটনা ঘটে, বাঙ্গালী সৈন্যদের নিরস্ত্র করা, এবং ট্রাক ভতি অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করতে গেলে সেখানেও জনতার সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে প্রায় ১২০ জন বাঙ্গালী শহীদ হন সেখানেও। ৭ মার্চ রেঙ্গুনের ওয়ার্কিং পিপলস ডেইলী জাহাজ এবং বিমান যোগে বিরাট আকারে বাংলাদেশে পাকিস্তানী সৈন্য আমদানীর খবর পরিবেশন করে। ৭১-এর প্রথম দিকে যেখানে সৈন্য ছিল মাত্র চার ব্রিগেড ২৫ মার্চের মধ্যে তা প্রায় দ্বিগুণ করা হয়। সেনাবাহিনীর তৎপরতা মার্চের প্রথম থেকেই স্পষ্টতঃই অস্বাভাবিক ছিল, সে জন্যে বারবার বিভিন্ন এলাকা থেকে বাঙ্গালী সুবেদার, অফিসার সাধারণ সিপাইরা এ সুম্পর্কে অবগত করেছেন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে। এবং বারবার সিদ্ধান্ত জানতে চেয়েছেন—তারা কি করবেন জানতে চেয়েছেন; কিন্তু কোন সিদ্ধান্ত তারা পাননি। অসহায়ভাবে তাদের দেখতে হয়েছে—শত্রুসৈন্যদের সকল প্রস্তুতি। মুজিব এ তৎপরতার কথা জানতেন। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশারফ ৭৪ সালে বিচিত্রার এক নিবন্ধে লেখেনঃ মার্চের প্রথম দিকে আমি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করি এবং জেনারেল ওসমানীর সঙ্গেও আলোচনা হয়।’ ৭১ সালে খালেদ ছিলেন পাকিস্তানী ৫৭ নং ব্রিগেডের ব্রিগেড মেজর। কিন্তু অহিংস এবং অসহযোগ আন্দোলনের ধজাধারী এই নেতৃত্ব উথান্টের কাছে এটি ঠেকানোর নিস্ফল আবেদনই শুধু করতে পেরেছে; নিজের জনগণকে রক্ষা করবার কোন পন্থা গ্রহণ করেনি। একদিকে পাকিস্তানী জান্তার অস্ত্রসজ্জা এবং যুদ্ধের প্রস্তুতি এবং অন্যদিকে বাঙ্গালী জনতার নিরস্ত্র এবং অসমন্বিত বিদ্রোহের মধ্যে শেখ মুজিবের কাছে বারবার ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলের লোকেরা এসেছে—কিন্তু শেখ মুজিব তাদের যেকোন উদ্যোগ নিতে নিরৎসাহিত করেছেন। (এন্থনি ম্যাসকারেনহাস)
শেখ মুজিব বাংলাদেশের মানুষের প্রতিরোধের শক্তি এবং তাদের আকাঙ্ক্ষার গতি বুঝতে অক্ষম ছিলেন, বোঝেননি এর বিরুদ্ধে পাকিস্তানী জান্তার প্রস্তুতির চরিত্রও। গান্ধীর অনুসরণ করে এই পুরোটা সময় পাকিস্তানী সৈন্যদের সমর সজ্জার পাশাপাশি তিনি অহিংস এবং অসহযোগ আন্দোলন চালিয়ে গেছেন ‘(মুহাম্মদ আইয়ুব, কে সুব্রামানিয়ম : দ্য লিবাবেশন ওয়ার)। শুধু তাই নয় এরপরও শেখ মজিব সহ আওয়ামী লীগ নেতৃবন্দ ইয়াহিয়ার পাতা আলোচনার ফাদে নিশ্চিন্তমনে আটক থেকেছে ১৬ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত, পাকিস্তানী জান্তার গণহত্যার পুর্ণ প্রস্তুতির পুর্ব পর্যন্ত।
নেতৃত্বর এই ভুমিকা সত্তেও সারা বাংলাদেশ জুড়ে জনগণের মধ্যে স্বাধীনতার দাবী এতটুকু ম্লান হয়নি। নেতৃত্বর দোদুল্যমানতায় অস্থির অধৈর্য মানুষ বারবার দাবী জানিয়েছে, জমায়েত হয়েছে শেখ মুজিবের বাসায়। ২ মার্চ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ স্বাধীনতার ইশতেহার প্রকাশ করে। ২ মার্চ শুধু, ঢাকায় হরতালের ডাক দিলেও সারা বাংলাদেশে স্বতঃস্ফূতভাবে হরতাল পালিত হয়, ৩ মার্চেও হরতাল পালিত হয়। ১ মার্চ থেকেই দেশের বিভিন্ন এলাকায় নিরস্ত্র বিক্ষুদ্ধ জনতার উপর গুলিবর্ষণ হতে থাকে। সারা দেশে পাকিস্তানী শাসন ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে ১ মার্চ থেকে। সমস্ত অফিস আদালতে সর্বস্তরের কর্মচারীর কাজ বন্ধ করে দেন। কর প্রদান বন্ধ হয় ; বেতার টিভি স্বাধীনতার প্রচার মাধ্যম হিসেবে কাজ করতে থাকে। চট্টগ্রামে জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাস করায় বাধা দিলে বিক্ষদ্ধ জনতার উপর গুলিবর্ষণের নির্দেশ অমান্য করে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস। ব্যাংকের মাধ্যমে সম্পদ পাচার বন্ধ হয়। সারাদেশে কালো পতাকা উত্তোলিত থাকে। ৯ মার্চ মওলানা ভাসানী এক জনসভায় বলেন, “পূর্ব বাংলা অবশ্যই স্বাধীন হবে। আমরা আর পাকিস্তানকে অখণ্ড রাখতে পারি না।……আমি অহিংসায় বিশ্বাস করি না।”
২৩ মার্চ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহবানে সারাদেশে ‘পাকিস্তান দিবসে’র পরিবর্তে পালিত হল প্রতিরোধ দিবস। সারাদেশে স্বাধীন বাংলাদেশের নতুন প্রতীক লাল-সবুজ পতাকা উড়লো। শেখ মুজিবকে বাধ্য করা হল সে পতাকা উড়তে। ঘটনাস্থলে খেলনা পিস্তল দিয়ে এক তরুণ তোপধবনির ক্লিয়া সম্পাদন করলো।
এই দিনই শেখ মুজিব সাংবাদিকদের বললেন সেই বড় সিপাহসালার যে কম রক্ত ক্ষয়ে বেশি জয় করতে পারে।
বিচারালয়েও অসহযোগ চলছিল। ঢাকা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য বিচারকেরা টিক্কা খানের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে অস্বীকৃতি জানালেন। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী এই প্রস্তুতির ব্যাপারে নিরস্ত্র জনগণ নির্বিকার ছিলেন না। বিচ্ছিন্নভাবে ভিন্ন ভিন্ন সংগঠন গ্রুপ বা ব্যক্তির উদ্যোগে তরুণদের সামরিক প্রশিক্ষণ দেবার চেষ্টা করা হয়। প্রতিটি পাড়ায় তরুণদের নিয়ে প্রতিরোধ বাহিনী গঠন করা হয়। প্রতিটি রাস্তায় সৃষ্টি করা হয় ব্যারিকেড। কিন্তু নেতৃত্বের নির্বিকারত্ব এবং অহিংসা’-র জন্যে এগুলোর মধ্যে কোন সমন্বয় সাধন করা যায়নি। যার ফলে পাকিস্তানী বাহিনীর আক্রমণের বিরুদ্ধে নুন্যতম প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও জনগণের মধ্যে ছিল না। শুধু তাই নয়, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস, ইস্ট বেঙ্গল পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ বাহিনীর সদস্যরাও বারবার তাগিদ দিয়েও কোন সাড়া না পেয়ে নিজেরা কোনরকম প্রস্তুতি নেবার অবকাশ পায়নি। যার ফলে অপ্রস্তুত নিরস্ত্র অবস্থায় সর্বস্তরের জনগণের উপর পাকিস্তানী বর্বর সেনাবাহিনীর গণহত্যা সংগঠিত হয়েছিল।
১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি ঘটনা ছিল ৭ মার্চে শেখ মুজিবের ভাষণ। রেসকোর্সে সেদিন জমায়েত হয়েছিলেন লক্ষ লক্ষ মানুষ – হাতে সবার লাঠি, বল্লম, রড (ছবি সর্বাধিনায়ক কর্ণেল এমএজি ওসমানী) ইত্যাদি। জঙ্গী মানুষের চেতনায় একটিই প্রত্যাশা—আজই আসবে স্বাধীনতার ঘোষণা। কিন্তু এল না, শেখ মুজিব অস্বাভাবিকভাবে ৫০ মিনিট বিলম্বে সভাস্থলে এলেন। যুদ্ধ ঘোষণা করলেন না তিনি। কিন্তু জনগণের দাবীর কাছে অনেকখানি নতিস্বীকার করলেন।
দেশী বিদেশী অনেক বিশেষজ্ঞ এখনও মনে করেন?
মার্চের প্রথম দিক থেকে, যে সময় থেকে পাকিস্তানী জান্তা বাংলাদেশে তাদের সামরিক শক্তি দ্রুত বৃদ্ধি করতে থাকে সেসময় যদি শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা দিতেন তবে বাঙালী সৈন্য, পুলিশ, ইপিআর, আনসার, মুজাহিদ সর্বোপরি পুরো জঙ্গী জাতির পক্ষে খুব সহজ হতো ক্ষমতা ছিনিয়ে নেয়া। ৩০ লক্ষের পরিবর্তে বড়জোর প্রাণ দিতে হতো কয়েকশো ব্যক্তির।
জাতীয় স্বাধীনতার দাবী যখন বাংলাদেশের মানুষের মুল দাবী, যখন এ দাবীতে বাংলাদেশের মানুষ অভুতপুর্ব একতা এবং দৃঢ়তা প্রদর্শন করছে সে সময় তাদের নেতৃত্ব দেয়ার মতো যোগ্য সংগঠন ছিল না; যে নেতৃত্ব ছিল তা বারবার আপোষের চোরাবালিতে পা দিয়েছে। নেতৃত্বহীন জাতি শত্রুর হিংস্র থাবার নীচে পড়েছে অসহায় ভাবে—ক্ষতবিক্ষত হয়েছে কিন্তু নিশ্চিহ্ন হয়নি। ২৫ মার্চের যে মুহূর্তে থেকে পাকিস্তানী বাহিনীর গণহত্যা, নির্যাতন শুরু হয়েছে সে মুহূর্তেই শুরু হয়েছে সশস্ত্র প্রতিরোধ। বিভিন্নভাবে হলেও তার শক্তিও নগণ্য ছিল না।’ কেননা, তাতে ছিল দস্ত দেশপ্রেম।
[তিন]
শেখ-ভুট্টো-ইয়াহিয়ার আলোচনা চলছে একদিকে অন্যদিকে প্রস্তুতি চলছে জনগণের উপর সর্বাত্মক আক্রমণের। ২৫ মার্চ সকাল ১০টার দিকে একটি কালো শেভ্রোলেটে জেনারেল হামিদ, ওমর, মিঠা, পীরজাদা এবং টিক্কা খান প্রেসিডেন্ট ভবনে যান। ৩০ মিনিট ব্যাপী তাদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ইয়াহিয়ার সঙ্গে। সম্ভবতঃ সে বৈঠকেই গণহত্যার চুড়ান্ত নীলনকশা অনুমোদন করা হয়। একই দিন আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ হতবাক হয়ে শোনেন যে দুপক্ষের আলোচনার শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি ইয়াহিয়ার অর্থনৈতিক উপদেষ্টা এম, এম, আহমদ ঢাকা ত্যাগ করেছেন। ইয়াহিয়া সেদিন বিকেল পাঁচটায় পি,আই,এ-র চলন্ত বোয়িং বিমান থামিয়ে ঢাকা ত্যাগ করেন।
সন্ধ্যার মধ্যেই শেখ মুজিব সহ আওয়ামী লীগ নেতৃবন্দ জেনে গেছেন আলোচনার প্রহসণ শেষ হয়েছে। শেখ মুজিব লীগ নেতৃবন্দকে সরে যাবার নির্দেশ দিলেন। নিজে সরলেন না সকলের উপর্যুপরি অনুরোধ সত্তেও,-গ্রেফতার হয়ে পাকিস্তানী জেলে আটক থাকলেন যুদ্ধের পুরোটা সময়।
২৫ মার্চ রাত সাড়ে দশটার দিকে পাক সেনাবাহিনী রেডিও টিভির পুর্ণ নিয়ন্ত্রণভার নিয়ে নিলো। রাত সাড়ে এগারোটার দিকে শুরু হলো তাদের সামগ্রিক অপারেশন। রাত সাড়ে বারোটার দিকে ট্যাংক ও অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র সহ প্রায় এক’শ সামরিক গাড়ি, লরী, জীপ প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে বেরিয়ে বিভিন্ন এলাকায় পুর্ব পরিকল্পনামতো ছড়িয়ে পড়লো। আক্রান্ত হলো রাজারবাগ পুলিশ ক্যাম্প, পিলখানা ইপিআর তৎকালীন ইকবাল হল, জগন্নাথ হল, রোকেয়া হলসহ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রাবাস ও শিক্ষকদের আবাসিক এলাকা, শাখারীপট্টি সহ বিভিন্ন আবাসিক এলাকা। সারা ঢাকা যখন আগনে পড়ছে হাজার হাজার লোক মরছে বিকট এবং অকল্পনীয় আক্রমণে সেসময়েই প্রতিরোধ শুরু হয়েছে। প্রথমেই প্রতিরোধ শুরু করেছেন পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা, তারা কয়েকঘন্টা ধরে তাদের সামান্য অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে প্রতি রোধ করেছেন, লড়েছেন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস-এর সদস্যরা, বিভিন্ন পাড়ায় তরুণরাও নিজেদের হাতের কাছে পাওয়া অস্ত্র দিয়ে চেষ্টা করেছিল। পাকবাহিনী তাদের হত্যাযজ্ঞের প্রথমেই যাদের উপর আক্রমণ চালিয়েছিল তারা হচ্ছে : বাঙালী সৈন্য, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস-এর সদস্য, আনসার, মুজাহিদ, বস্তি বাসী দরিদ্র মানুষ, বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের কর্মী, ছাত্রছাত্রী, বাঙালী বুদ্ধিজীবী। পাকবাহিনীর প্রথম অপারেশন ঢাকাতে ২৭ তারিখ পর্যন্ত একটানা চলে। নিহত হন প্রায় ১০,০০০ মানুষ। ২৬ তারিখ সকালে ঢাকায় অবস্থানরত বিদেশী সাংবাদিকদের ৬০ মিনিটের মধ্যে ঢাকা ত্যাগের নির্দেশ দেয়া হয়।
২৫ মার্চ তারিখ থেকে যে হত্যা, লুট, অগ্নিসংযোগ নারী নির্যাতন শুরু হয় তা ক্রমে ঢাকা থেকে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। সেই সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে প্রতিরোধ। ঢাকায় ইপিআর এবং পুলিশের ৫,০০০ সদস্যের খুব কম অংশই লড়াই করে বাঁচতে পেরেছিলেন। সেসময় ইবিআর, ইপিআর এবং পুলিশের ঢাকার বাইরে অবস্থানরত সদস্যরা গণহত্যার খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিরোধের জন্যে সংগঠিত হবার চেষ্টা করতে থাকেন। এবং যুদ্ধ তারা করেন, করেন জনগণও। অসম যুদ্ধ হলেও এই প্রতিরোধের জন্যেই পুরো দেশের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্যে পাকবাহিনীর পুরো এপ্রিল মাস প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশে সে সময় ইবিআরের পাঁচটি ব্যাটেলিয়নের মধ্যে মাত্র ৩,০০০ সদস্য বেচে থাকতে পেরেছিলেন ; ১৪,০০০ ইপিআর সদস্যদের মধ্যে বেচে থাকতে পেরেছিলেন মাত্র ৮,০০০।
[মওদুদ আহমদ : বাংলাদেশ : কনস্টিটিউশনাল কোয়েস্ট ফর অটনমি; এস, কে, চক্রবর্তী: দ্য এভুলিউশন অব পলিটিকস ইন বাংলাদেশ ; মুহাম্মদ আইয়ুব, কে, সুব্রামানিয়াম : দ্য লিবারেশন ওয়ার- এন্থনি মাসক্যারেনহাস : বাংলাদেশে গণহত্যা)।
জনগণ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। তাদের সে সুযোগ দেওয়া হয়নি। কিন্তু এসময় কানাঘুষায় দু-একটি নাম শোনা যেতো। লোকে বলতো নাদেরের নাম যে একা যুদ্ধ করেছিল নবাবপুর রোডে পাক কনভয়ের সঙ্গে। শেরে বাংলা নগরে, মীরপুর রোড়ে এক পাখি শিকারী নাকি গুলিবিদ্ধ করেছিল বেশ কয়েকটা পাক হায়নাকে।
এগুলো হয়তো গল্প। কিন্তু এসময় এসব গল্প সাধারণ মানুষকে উজ্জীবিত রেখেছিল।
[চার]
“২৫ মার্চ গণহত্যা শুরু হবার পর আমরা ঢাকার আরও অনেকের মতো ঢাকার বাইরে চলে যাই। সেসময় আমি ঘুমাতে পারতাম না। ২৪ ঘন্টা রাগে, ক্ষোভে, অপমানে আর নিজের অক্ষমতায় জ্বলতাম। কেদেছি এমনকি আত্মহন্তা করবার কথাও চিন্তা করেছি তখন। আমার মতো একজন তরণের সম্মুখে আমার পিতা মাতাকে হত্যা করবে, আমার বোনের উপর নির্যাতন চালাবে সে অপমান আমি সহ্য করতে পারছিলাম না। এরকম একটি অসহনীয় অবস্থার মধ্যে দু’দিন পর হঠাৎ একসময় দেখি গ্রামের মানুষের উল্লাস। উল্লাসের কারণ “স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র”। বেতার কেন্দ্রে স্বাধীনতার ঘোষণা শুনে মানুষ নিজেদের অহংকারী প্রতিবাদী অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছে, এ উল্লাসের মধ্যে ছিল নিজেদের ফিরে পাওয়ার আনন্দ। আমিও সে সময় নিজের পথ খুঁজে পেলাম। কান্না, বেদনা আর অক্ষম রাগের বদলে এল দুরন্ত প্রতিশোধ স্পৃহা। ঢাকার পাশেই ত্রিমোহনী গ্রামেও খবর এলো চট্টগ্রাম প্রতিরোধ করেছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, জয়দেবপুর, পাবনায় যুদ্ধ করছে বাঙ্গালীরা।” এ কথাগুলো একজন মুক্তিযোদ্ধার। কিন্তু এ অনুভূতি শুধু একজন মুক্তিযোদ্ধার নয়। বাংলাদেশের অনুভূতি প্রবণ প্রতিটি তরুণ এই অপমানবোধে জলেছে সে সময়, যে অপমানবোধ থেকে জন্ম নিয়েছে পরবর্তী কালের ক্ষিপ্র প্রতিরোধ বাংলাদেশের মানুষ প্রতিরোধ সংগ্রামে কোন কালেই পিছিয়ে থাকেনি, এবার প্রয়োজনে হাতে তুলে নিয়েছে অস্ত্র। হাতে ছিল এদ্দিন বাঁশ, বল্লম, তীর। অপ্রয়োজনীয় হয়ে গেছে সেগুলো। ২০ দিন, ২৫ দিন ১ মাসের প্রশিক্ষণ নিয়ে এক একজন যুদ্ধ শুরু করেছে। হাতে নতুন অস্ত্র।
বাঙালী সৈন্যদের মধ্যেও সিদ্ধান্ত নিতে এরপর বিলম্ব হয়নি। এতদিন রাজনৈতিক নেতৃত্ব যে সিদ্ধান্ত দিতে পারেনি, সে সিদ্ধান্ত তারা নিজেরা নিয়ে নিয়েছে। অন্যান্যদের মধ্যে মেজর জিয়া বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন। চট্টগ্রাম থেকে, তিনি কালুঘাট ট্রানসমিশন স্টেশন থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করলন ২৭ মার্চ। মেজর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে কুমিল্লা-সিলেট সেক্টরে ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট বিদ্রোহ ঘোষণা করলো ২৭ মার্চ সকালে। মেজর শফিউল্লা জয়দেবপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন এবং টাঙ্গাইল ময়মনসিংহের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। মেজর জলিল বরিশালের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করলেন। একইভাবে অন্যান্য এলাকায় হয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, নয়তো ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস অথবা ইস্ট বেঙ্গল পুলিশের নেতৃত্বে প্রতিরোধ যুদ্ধ সংগঠিত হল। বগুড়া এবং রাজশাহীতে মেজর নাজমুল হক এবং ক্যাপ্টেন গিয়াসের নেতৃত্বে ইপিআর এবং পুলিস পাকিস্তানী বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করে। ২৬ মার্চ পাবনায় পাকিস্তান বাহিনীকে প্রতিরোধ করে পুলিশ এবং সাধারণ মানুষ, এবং ২৭ মার্চ পাবনাকে মুক্ত এলাকা ঘোষণা করা হয়। চাপাইনওয়াবগঞ্জে ইপিআর সদস্যরা পাকিস্তান আর্মি ক্যাম্প দখল কর। এভাবে ঢাকার বাইরে প্রায় প্রতিটি জেলায়, প্রতিটি এলাকায় গড়ে উঠে প্রতিরোধ, যদিও দুর্বল তবুও এগুলো ছিল মানুষের প্রখর দেশপ্রেমের শক্তিতে দৃপ্ত। এবং এ প্রতিরোধগুলোই ছিল হঠাৎ আক্রমণে হতবাক মানুষের সামনের মাইলস্টোন। প্রতিরোধ করতে হবে, যুদ্ধ করতে হবে। জনগণ, আহত জনগণ তখন খুজতেন সশস্ত্র মানুষকে, খুজতেন বাঙালী সৈন্য, ইপিআর অথবা পুলিশকে। এখন প্রয়োজন যুদ্ধ—এই অবশ্যম্ভাবী সত্য প্রতিটি বাঙালীর হদয়ে তখন স্পষ্ট। সেজন্যেই তারা সশস্ত্র প্রতিরোধ দেখতে চাইতেন, দেখলে উল্লাসিত হতেন। ঢাকাতেও শহরের বাইরে জমায়েত হওয়া প্রতিটি মানুষ সারাদিন উৎকর্ণ হয়ে থাকতেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শোনার জন্যে, শুনতেন তারা। অশাবাদী হয়ে উঠতেন। তাদের প্রত্যাশায় সেসমস্ত বাস্তবতা কম ছিল। মার্চের শেষ দিকে ঢাকার বাইরে এসব এলাকায় মানুষের বিশ্বাস ছিল, বাঙালী আর্মি যুদ্ধ করতে করতে এগিয়ে আসছে আর ক’দিনের মধ্যেই ঢাকার পতন হবে। তারা তখনও জানতেন না সে সম্ভাবনা আগেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে বাস্তবতাবর্জিত স্বপ্নের দিন শেষ হলো। সুশিক্ষিত বর্বর পাকবাহিনী ধীরে ধীরে পুরো দেশ গ্রাস করে বসলো। নিজেদের সমস্ত শক্তি দিয়ে যুদ্ধ করতে করতে পিছিয়ে গেলেন ইবিআর , ইপিআর, পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ এবং যুদ্ধরত জনসাধারণ । শহীদ হলেন অনেকে যারা বেচে রইলেন তারা যুদ্ধের জন্যই বেচে রইলেন। মুক্তিযুদ্ধের সাংগঠনিক কোন ভিত্তি তখনো গড়ে উঠেনি। প্রত্যাশার মধ্যে বাস্তবতা এল। সবার মধ্যে চিন্তা এলে, প্রয়োজন গেরিলা যুদ্ধের। এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যেই বিভিন্ন সেক্টরে যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধারা বিশেষ করে বাঙালী সৈন্যরা বুঝে ফেললেন সম্মুখ সমরে ফলপ্রসু হবে না। প্রয়োজন গেরিলা যুদ্ধ। এসময় পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এলেন। মেজর মঞ্জুর , মেজর তাহের, মেজর জিয়াউদ্দীন, ক্যাপ্টেন ডালিম প্রমুখ ।
রাজনৈতিক ভাবে সাংগঠনিক ভিত্তি স্থাপনের জন্যে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব তখনো তৎপর নন। তারা বিছিন্নভাবে ভারতে গিয়ে উঠেছেন সবাই। বিভিন্ন প্রতিরোধ যুদ্ধের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ ছিল না। অনেক নেতা দেশে পলাতক। বেঙ্গল রেজিমেটের লোকেরা নেতা খুজছে। মন্ত্রীসভা গঠনের জন্যে নেতা প্রয়োজন। ‘৫ এপ্রিল খালেদ মোশাররফ তেলিয়াপাড়াতে আমাকে জানান যে যদি নেতৃত্ব দিতে রাজনীতিবিদ এগিয়ে না আসেন তবে সনাবাহিনী অফিসাররাই একটি বিপ্লবী কাউন্সিল গঠন করবেন। খালেদ মোশাররফ সেসময় কুমিল্লা, সিলেট এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পাকিস্তানী বাহিনীর সঙ্গে বড় ধরনের কয়েকটি যুদ্ধ করেছেন। এবং তার সঙ্গে অন্যান্য আর্মি অফিসারদেরও যোগাযোগ রয়েছে। সেনাবাহিনী থেকে বিদ্রোহ করেছেন তারা স্ত্রী-পুত্র। পরিবার সম্পর্কে কোন ব্যবস্থা নেবার সময় পাননি, কাজেই তাদের অনেকের স্ত্রী-পুত্র পাকবাহিনীর হাতে নিহত অথবা নির্যাতিত হয়েছেন। যুদ্ধ তাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকিয়েছে। তাদের যুদ্ধে জিততেই হবে। এসময়ে জিয়া, শফিউল্লাহ, খালেদের মতো সিনিয়র মেজর এবং সাধারণ যুদ্ধে সক্রিয় কয়েকজন নাগরিক নিয়ে বিপ্লবী কাউন্সিল গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। কিন্তু এর মধ্যেই তাজুদ্দিনের নেতৃত্বে প্রবাসী সরকার গঠনের সংবাদ আসে ‘(মওদুদ আহমেদ, ১৯৭৬)। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিভিন্ন অংশ থেকে ভীষণভাবে চাপ দেয়া হচ্ছিল প্রবাসী সরকার গঠনের জন্যে।
“কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব সেসময় ভয় পেয়েছিলেন। দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। আমরা সবসময় চাপ দিয়ে যাচ্ছিলাম সরকার গঠনের জন্যে। কিন্তু তারা ভয় পেতেন, নাম প্রকাশ পেলে তাদের পরিবার পরিজনের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে বলে।” (কর্ণেল কিউ এন জামান, ১৯৮০)।
১০ থেকে ১২ এপ্রিল আগরতলায় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত নেন। এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত আমাদের প্রতি ভারতের মনোভাব আমরা বুঝতে পারিনি। (শামসুল হক। প্রাক্তন মন্ত্রী) তাজুদ্দিন দিল্লীতে যান, ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আলোচনা করবার একটি ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায়। সে সময় পর্যন্ত নেতৃবৃন্দের সঙ্গে মাত্র ৩৫ জন এম এন এ ও এমপিএ-র যোগাযোগ ছিল। প্রবাসী সরকার শপথ গ্রহণ করেন ১৭ এপ্রিল। ইবিআর এবং ইপিআরের সদস্যদের নিয়ে গঠন করা হয় মুক্তি বাহিনী এবং কর্ণেল (অবঃ) আতাউল গণি ওসমানী এর সর্বাধিনায়ক নিযুক্ত হন।
সেসময় মুক্তিযুদ্ধ করবার ব্যাকুলতা নিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের তরণেরা সীমান্ত এলাকায় আসা শুরু করেছে। সীমান্ত এলাকা বরাবর যুব ক্যাম্প খোলা হয়েছে। যুব ক্যাম্পে তরুণরা এসে উঠেন। সেখান থেকে তাদের মধ্যে থেকে প্রশিক্ষণের জন্যে নির্বাচন করা হয় এবং এক-দেড়মাস প্রশিক্ষণের পর তাদের দেশের অভ্যন্তরে পাঠানো হতো। ঘটনাটি এতটা সহজভাবে ঘটতো না।
আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ ভারতে এসে প্রথমে নিজের আশ্রয় খুজতো, সেটা ঠিক করে নিয়েই নিজের রাজনৈতিক অবস্থান ঠিক করতে ব্যস্ত হতো—ভারতীয়দের কাছে। মুক্তিযুদ্ধে কি হচ্ছে না হচ্ছে তা অনেকের কাছেই অজ্ঞাত। কিন্তু শেষের দিকে যখন মুক্তিযুদ্ধ নিজের পথ খুজে নিয়েছে—তখন তাদের খেয়াল হয় এ যুদ্ধ তাদের হাতে নেই। তখনই তারা ধর্ণা দেয় ভারতীয় কতৃপক্ষের কাছে ।
[পাঁচ]
১৯৬২ সালে একবার পূর্ব বাংলা স্বাধীনতা দল নামে একটি দল বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপক্ষে প্রচারণা শুরু করে এবং সংগঠিত হবার চেষ্টা করে; নির্মমভাবে আয়ুব সরকার তাদের দমন করে। এরপর ১৯৭০ এর পুর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে কারও কোন প্রচার বা উদ্যোগ নেবার কথা জানা যায় না। ১৯৭০ সালে পূর্ব বাংলার শ্রমিক আন্দোলন (সিরাজ সিকদার) সর্বপ্রথম স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পর্বে বাংলার কর্মসুচী পেশ করে। এসময় পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (মতিন-আলাউদ্দিন) পূর্ব বাংলার জনগণের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানী একচেটিয়া পুজির স্পন্দনকেই ঘকেই প্রধান স্পন্দন হিসেবে চিহ্নিত করেন। ৭০-এর ৭ ডিসেম্বরের পূর্বেই ভাসানীর নেতৃত্বে কমিউনিস্ট বিভিন্ন গ্রুপ থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার দাবি তোলা হয় , প্রকাশ্যে। এরপর অনবরত এ দাবী উচ্চারিত হয় এবং ব্যাপক জনসমর্থনও লাভ করে। ১৯৭১ সালে গোপন এই পার্টিগুলো এবং তাদের প্রকাশ্য-গণসংগঠন ও রাজনৈতিক দল স্বাধীনতার পক্ষে দ্বিধাহীন প্রচার, সামরিক প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করে; একই সঙ্গে এ প্রশ্নে শেখ মুজিবের দুর্বলতার সমালোচনা করতে থাকে এবং শেখ মুজিবের কাছে এদের অনেকের পক্ষ থেকে স্বাধীনতার কর্মসূচী ঘোষণার জোর দাবী জানানো হয়।
২৫ মার্চের গণহত্যার পরও এই গ্রুপগুলো পাক বাহিনী প্রতিরোধে অত্যন্ত সক্রিয় এবং কার্যকর ভূমিকা পালন করতে থাকে। সাংগঠনিক দৃঢ় শৃঙ্খলা, সুস্পষ্ট লক্ষ্য এবং প্রখর দেশপ্রেমের ফলে তাদের পক্ষে এ কাজ সহজতর হয়। কিন্তু বাংলাদেশের এই জাতিগত যুদ্ধের ব্যাপারে চীনের ভুল নীতির ফলশ্রুতিতে এখানকার কমিউনিস্ট গ্রুপগুলোর নেতৃত্বে সৃষ্টি হয় বিভ্রান্তি। তখনকার কমিউনিস্ট নেতৃত্বের অধিকাংশই নিজেদের দেশের পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হন। যার ফলে তাদেরকে এই বিভ্রান্তির শিকার হতে হয়। যে সংগঠনগুলো অন্যদের অনেক আগে থেকেই সঠিকভাবে স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলার দাবী তুলতে থাকেন তারাই যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ের পর থেকে সাংগঠনিক সিদ্ধান্তহীনতার জন্যে অনেক দুর্বল এবং নিক্রিয় হয়ে পড়েন। তবুও এসব গ্রুপ থেকে উল্লেখযোগ্য কিছু অংশ দুর্বল হলেও মুক্তিযুদ্ধ চালাতে থাকেন। সেসময় পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি (এম,এল) পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির একটি বড় অংশ ভারতে বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি গঠন করেন কিন্তু তারা যুদ্ধ কার্যকর কোন ভূমিকা রাখতে পারেননি দৃঢ় সিদ্ধান্ত এবং সাংগঠনিক প্রক্রিয়ার অভাবে।
কমিউনিস্ট পার্টি গুলোর অন্যান্য অনেক গ্রুপ দেশের ভেতরে থেকেই পাক বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করতে থাকেন, তারা দেশের ভেতরেই প্রশিক্ষণ দেয় এবং দেশের ভেতরেই ঘাটি প্রতিঠোর পরিকল্পনা গ্রহণ করে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে তা বাস্তবায়নও করে।
“পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির (তোয়াহার নেতৃত্বাধীন) একটি গ্রুপ বাংলাদেশের প্রতি চীনের ভূমিকার নিন্দা করে এবং একই সঙ্গে আওয়ামী লীগের ভূমিকাকে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ এবং রুশ সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের চক্রান্তের অংশ হিসেবে বিবেচনা করে। এই গ্রুপে নোয়াখালির রামগতিতে প্রায় ১০,০০০ ‘লাল গেরিলা সংগ্রহ করে এবং পূর্ণ কমিউনিস্ট নেতৃত্ব বাংলাদেশের একটি অংশ মুক্ত করবার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। কিন্তু প্রতিরোধ যুদ্ধে তাদের অধিকাংশই নিহত হন।
পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (মতিন-আলাউদ্দিন) অন্যদিকে মার্চ এপ্রিলের দিকে পাবনা জেলায় প্রতিরোধ যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। তাদের ক্যাডাররা পুলিশ এবং আওয়ামী লীগ কর্মীদের সঙ্গে একত্রিত হয়ে যুদ্ধ করেন এবং প্রায় ১০০ পাক-সেনাকে হত্যা করেন। তারা সেসময় প্রকাশিত তাদের এক প্রচারপত্র জাতীয়তাবাদী সকল শ্রেণীর মৈত্রীর ভিত্তিতে যুদ্ধের আহবান জানান।
ওহিদুর নেতৃত্বাধীন এই পার্টির অন্য একটি অংশ রাজশাহীর আত্রাই-এ পুরো যুদ্ধের সময়েই পাক বাহিনীর ৱিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন।
১৯৭১ সালের ২ মার্চ পূর্ব বাংলার শ্রমিক আন্দোলন জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ ঘোষণা করবার পর থেকে এই সংগঠনের ক্যাডাররা মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু অভাব ছিল সামগ্রিক সমন্বয়ের। মোটামুটিভাবে কমিউনিস্ট সংগঠনগুলো সাংগঠনিকভাবে দৃঢ় ও ধারাবাহিক সিদ্ধান্তহীনতার জন্যে দুর্বল থাকলেও এ সংগঠনগুলোর কোন কোন গ্রুপ , কোন কোন নেতা এবং সাধারণভাবে এর ক্যাডাররা প্রধানতঃ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
কিন্তু নেতৃত্বের বিভ্রান্তির জন্যে তারা শক্তিশালী ভিত্তি তৈরী করতে পারেননি, পারেননি বিচ্ছিন্নভাবে ক্রিয়াশীল ক্যাডার এবং ব্যাপক কৃষক-শ্রমিক জনতার চেতনার বিকাশের ধারাকে ধরে মুক্তিযুদ্ধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে। যার ফল বিচ্ছিন্ন অবস্থায় একদিকে পাকবাহিনী অন্যদিকে ভারতীয় বাহিনী, আওয়ামী লীগের হাতে তাদের ক্রমাগতঃ মার খেতে হয় এবং ৭১ সালে যেখানে জনগণ ছিলেন তাদের অধিকতর কাছাকাছি সেখানে তারা জনগণ থেকে আরও দুরে সরে যান। যার রেশা বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরবর্তী সময়েও দেখা গেছে।
কিন্তু কমিউনিস্ট সংগঠনগুলোর এই অবস্থা সত্বেও যুদ্ধ ক্রমশঃ জনযুদ্ধের দিকে যাচ্ছিলো। সারা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিপ্লবী আদর্শে উদ্বুদ্ধ ক্যাডারদের সর্বাতক প্রচেষ্টায় এবং মুক্তিযুদ্ধের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ক্রমশঃ বিপ্লবী ধ্যান ধারণা জগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ায় যুদ্ধ জনগণের নিয়ন্ত্রণে চলে আসছিল। সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল নতুন বিপ্লবী কার্যকর নেতৃত্বের। সে সম্ভাবনা আওয়ামী লীগের দল, জাতীয় স্বার্থবিরোধী তথা মুৎসুদ্দী নেতৃত্বের স্বার্থবিরোধী ছিল বলেই ভারতীয় শক্তির সঙ্গে একাত্ম হয়ে তারা প্রথম থেকেই এর বিরুদ্ধে চক্রান্ত করে গেছে।
[ছয়]
মুক্তি বাহিনীর যুদ্ধ পরিচালিত হচ্ছিল ১১টি সেক্টরের মাধ্যমে। প্রতিটি সেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন প্রধানতঃ সেনাবাহিনী অফিসাররা। এছাড়াও বিমান বাহিনীর অফিসারও ছিলেন একটি সেক্টরের দায়িত্বে। প্রতিটি সেক্টরের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন একজন করে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অফিসার। এরা ছিলেন ভারতীয় কতৃপক্ষের সঙ্গে বিভিন্ন সেক্টর প্রধানদের যোগাযোগ মাধ্যম। অস্ত্রশস্ত্র বরাদ্দ, রেশন ইত্যাদি তার বা তাদের মাধ্যমেই আসতো। অন্যভাবে সেক্টর গুলো ছিল সম্পূর্ণভাবে সেক্টর কমান্ডারের ব্যক্তিত্বের উপর নির্ভরশীল। যে কমান্ডার যেমন ছিলেন তিনি সেভাবেই ভারতীয় হস্তক্ষেপ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতেন। যেমন (অস্পষ্ট) কোন সেক্টরে বাংলাদেশী অফিসাররাই গেরিলা ট্রেনিং দিতেন এবং গেরিলা রিক্রুট করতেন। সেক্টর টু-এর প্রায় সব গেরিলাই সেই সেক্টরে ট্রেনিং নিয়েছিল। সেগুলোর কর্মপ্রক্রিয়ার উপর ভারতীয় অফিসারদের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদির ফলে মে-জুন থেকেই বিভিন্ন সেক্টরে সেক্টরে প্রধান ও সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ এবং ভারতীয় বাহিনীর দ্বন্দ বাড়তে থাকে। বিরোধের কারণ ছিল অনেক ; আওয়ামী লীগ এমপিএ-রা মুক্তিবাহিনীর সদস্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ শুরু করে। যুদ্ধের জন্যে যোগ্য দেশপ্রেমিক অনেক মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে বামপন্থী বলে অভিযোগ আনে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর অফিসাররা বামপন্থীদের হাতে অস্ত্র চলে যাবার ভয়ে প্রথম থেকেই অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছিলেন। মুক্তি বাহিনীর ছেলেরা কখনোই তাদের প্রয়োজন মতো অস্ত্র পায়নি। প্রধানতঃ তাদের শুধু দেয়া হতো গ্রেনেড এবং এক্সপ্লোসিভ। মুক্তিযোদ্ধারা এজন্যে প্রথম দিকে অসুবিধায় পড়লেও “পরে যুদ্ধের স্বাভাবিক রীতিনীতি অনুযায়ী তারা অসুবিধা কাটিয়ে উঠেছিলেন। শত্রুর অস্ত্রই ছিল তাদের অস্ত্র।
অস্ত্রশস্ত্রের এই নিয়ন্ত্রণজনিত সংকট কাটানোর জন্যে একাধিক সেক্টর কমান্ডার বাংলাদেশ সরকারকে বলেছেন অস্ত্র ধার হিসেবে কিনে নেবার জন্যে। একজন সেক্টর কমান্ডার এ প্রসঙ্গে জানিয়েছেন, “আমরা তখন ধারে অস্ত্র কিনবার পরামর্শ দিয়েছিলাম এবং বলেছিলাম আমাদের কি কি অস্ত্র লাগবে এবং কিভাবে আমরা প্রশিক্ষণ নেবো সেটা আমরা সিদ্ধান্ত নেবো । কিন্তু বাংলাদেশ সরকার রাজনৈতিক এবং দু দেশের সম্পর্কের ব্যাপারে আমাদের নাক গলাতে নিষেধ করেছেন। স্বাধীনতার পরে দেখেছি এগুলোর দাম শুধু নয়, তার কয়েকগুণ দাম তারা এখান থেকে নিয়ে গেছে।”
যুব ক্যাম্পগুলোতে কতজন থাকতে পারবে সে ব্যাপারেও একটা বিধিনিষেধ ছিল কোন কোন স্থানে। কেননা মে-র পর মুক্তিবাহিনীতে যোগদানের জন্যে দেশের অভ্যন্তর থেকে তরুণদের চলে আসবার হার অস্বাভাবিকরকম বেড়ে যায়। এবং এতে খুশি হবার পরিবর্তে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের মধ্যে অস্বস্তিই দেখা যায় বেশি। এই যুব ক্যাম্প থেকেই বেশিভাগ ক্ষেত্রে যোদ্ধা, রিক্রুট হতো। অনেকে ট্রেনিং-এ বাদ পড়তো, অনেকে এ্যাকসনে গিয়ে দলত্যাগী হতো যেসব সেক্টরে ট্রেনিং হতো সে সেক্টরের কমান্ডার কখনোই আসল সংখ্যা প্রকাশ করতে না ভারতীয় বা আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছে।
এবং এই সমস্যা নিরসনের জন্যে সেক্টর কমান্ডাররা অনেক সময়েই উপস্থিত সংখ্যার চাইতে কম করে বলতেন। এবং সে অনুযায়ী বরাদ্দকৃত খাদ্য সবাইকে ভাগ করে খেতে হতো। অনেক ক্ষেত্রে একজনের খাদ্য তিনজন খেতো।
সেসময় যুদ্ধক্ষেত্রে খাবারের কোন ঠিক ছিল না। অনেক সময় দুপুরে এবং রাতের খাবার দু’বেলা না করে বিকেলের দিকে দেয়া হতো, যাতে দু’বেলাই খাওয়া হয়। সকালের নাস্তা কোথাও ছিল একটি পুরি (ডাল কিংবা আলু ছাড়া) এবং চা। কোথাও ছিল গাছের গুড়ির উপর তৈরি করা একটি আটার রুটি’; সে রুটি খাবার জন্যে আবার ঝাল মরিচ খেয়ে মুখ অবশ করে নিতে হতো। কোথাও কোথাও সকালের নাস্তাও ছিল না। রাতে শোবার ব্যবস্থাও ছিল একই রকম।
মুক্তিবাহিনীর জন্যে তরুণদের মনোনয়ন করা ছাড়াও আওয়ামী লীগ এমপিএ-দের আরেকটি দায়িত্ব ছিল প্রতিটি রিফিউজি ক্যাম্প তদারক করা। কিন্তু তাদের ঘটনাস্থলে পাওয়া যেত খুব কম। প্রকৃতপক্ষে তাজউদ্দিন সহ কয়েকজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ছাড়া যুদ্ধ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দকে পাওয়া খুব দুষ্কর ছিল। রিফ্যুজি ক্যাম্প নিয়ে অমানুষিক দুর্নীতিও দিন দিন বেড়েই যাচ্ছিলো।
বিদেশ থেকে আসা সাহায্য-সামগ্রী প্রতিটি রিফিউজি ক্যাম্পের জন্যে বরাদ্ধ করা হতো, পাঠানোও হতো কেন্দ্রীয় গোডাউন থেকে কিন্তু সেগুলো খুব কম সময়ই ক্যাম্পগুলোতে এসে পৌছতো। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ এবং স্থানীয় ভারতীয় আমলাদের যোগসাজশে সে অবস্থাতেও দুনীতি চলতে অবিশ্বাস্য হারে।
আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের এই ভূমিকার জন্যে তারা স্বাভাবিকভাবেই মুক্তিযুদ্ধ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। যুদ্ধ ক্ষেত্রে তাদের পাওয়া যেতো না, যুদ্ধ সমন্দধে তারা কিছু জানতেনও না আওয়ামী লীগ , ছাত্রলীগের , শ্রমিক লীগের বহু কর্মী মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহন করেছেন এবং যুদ্ধ করতে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব সম্পর্কে তাদের বিরুপ উপলব্দধি স্পষ্টতর হয়েছে, যার জন্যে তাদের সঙ্গে নেতৃত্বের বিরোধ অনিবার্য হয়ে উঠেছে। যার ফলশ্রুতি আমরা স্বাধীনতার পরেও পেয়েছি। যারা সক্রিয় যুদ্ধ করেছিলেন সেসময়, তাদের অধিকাংশ আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। হয় ভিন্ন সংগঠন করেছেন, নয়তো নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন।
সেসময় আওয়ামী লীগ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সম্পর্কে ক’জন মুক্তিযোদ্ধার অভিজ্ঞতা এখানে প্রাসঙ্গিক।
“……আমি তখন দেশ থেকে মাত্র গেছি। রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে যোগাযোগ করা আমার জন্যে দরকার ছিল। যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের পেলাম না। গেলাম কলকাতায়, তাদের খুজতেই একজন ভারতীয় আমাকে বললেন, যেকোন সিনেমা হলের সামনে গিয়ে দাড়ান; সিনেমা ভাঙার সময় হলেই পেয়ে যাবেন, অনেককেই ।……”
“লন্ডন থেকে ভারতে এসেই আমরা দু’জন প্রথমে বিপ্লবী সরকারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করি। আমাদের ভেতর তখন যুদ্ধের উন্মাদনা সামনে আর কোন লক্ষ্য নেই যুদ্ধ ছাড়া।
কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম, তারা বললেন, কষ্ট করে এসেছেন, দেখে ফিরে যান।“ তারা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন আমাদেরকে এয়ারকন্ডিশনড রুমে রাখবার জন্যে যেহেতু লন্ডন থেকে এসেছি। দেখলম এক মন্ত্রীর রাগারাগি -তার রুমে এটাচড বাথ নেই বলে। প্রায় একস্থানে একজনের ক্ষোভ দেখলাম তাকে চিকন চালের ভাত দেওয়া হয়নি বলে। এসব দেখে শুনে আমরা হতবাক ; রাগ আর হতাশার আমরা জলছি তখন। একবার সিদ্ধান্ত নিলাম, এই যদি যুদ্ধ হয় তবে আমরা ফিরে যাবো। পরে ভাবলাম, যুদ্ধ ক্ষেত্রে গিয়ে দেখা যাক কি হচ্ছে। ২নং সেক্টরে গেলাম ; দেখলাম তাঁবুতে মাটিতে পাতা বাঁশের উপর ঘুমচ্ছে সবাই ; তেলের ড্রামে রান্না হচ্ছে ভাত। হাজার হাজার তরুণ যুদ্ধ করতে যাচ্ছে, যুদ্ধ করে ফিরে আসছে। এদের একমাত্র কর্ম যুদ্ধ। গর্বে ভরে উঠলো বুকে। নিজেদের ফিরে পেলাম। রয়ে গেলাম সেখানেই।”….. “
“ঢাকা থেকে বিভিন্ন এলাকা হয়ে প্রথমে আগরতলা পৌছিলাম। খুজলাম এক নেতাকে, পেলাম কিন্তু তার সঙ্গে দেখা হওয়া খুব কষ্টকর ছিল। তিনি একটি ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন। বহু অনুমুতি, খবর ইত্যাদি দিয়ে তার সঙ্গে দেখা হল। ইতিমধ্যে আমি হতাশ হয়ে পড়েছি। দেখা হবার পর যুদ্ধের খবর জিজ্ঞেস করলাম। তিনি কোন খবরই রাখেন না। তিনি আমার পূর্ব পরিচিত ছিলেন। আমন্ত্রণ জানালেন সিনেমা দেখতে।…… “অনেক এমপি ওপারে বসেও জমজমাট পাটের ব্যবসা করে গেছেন, কেউ করেছেন জুতো বা জিরার ব্যবসা।
যুদ্ধের সময় অর্থ সঙ্কট ছিল প্রতিটি সেক্টরে। প্রয়োজন ছিল খাদ্য, শীতের কাপড়, ওষুধ, অস্ত্র ইত্যাদি। প্রয়োজন ছিল প্রায় ১ কোটি রিফুজির ভরণপোষণের জন্যে অর্থ। যুদ্ধ পাগল কয়েক লক্ষ তরুণের যুদ্ধের জন্যে প্রয়োজন ছিল অর্থের। সে সময় কি প্রবাসী সরকারের পক্ষে নিজেদের পায়ে দাঁড়িয়ে এ অর্থ জোগাড় করা সম্ভব ছিল ? লন্ডনে প্রবাসী এক বাঙ্গালী জানালেন, ‘সম্ভব ছিল। লন্ডনে আমরা সে উদ্যোগ করেছিলাম । লন্ডনে তখন প্রায় দেড় লাখ বাঙ্গালী অবস্থান করছেন। দেড় লাখ বাঙ্গালী অবস্থান করছেন। দেড় লাখের মধ্যে যদি পঞ্চাশ হাজারও বাদ দেয়া যায়, বাকি এক লক্ষের মাথাপিছু , কমপক্ষে পাঁচ পাউন্ড করে সংগ্রহ করা খুবই সহজ ছিল। এতে কমপক্ষে পাঁচ লাখ পাউন্ড সংগ্রহ করা যেত প্রতি মাসে । এবং এভাবে চাদা তুললে তা দিয়ে নিজেদের খরচ নিজেরা চালানো কঠিন হতো না । একবার উদ্যোগ আমরা নিয়েছিলাম, কিন্তু এ টাকা সঠিকভাবে খরচ করার ব্যাপারে এবং অধিকতর অর্থ তোলার ব্যাপারে প্রবাসী সরকার কোন আগ্রহ দেখাননি। যে জন্যে ভারতের উপর অধিক থেকে অধিকতর হারে আমাদের নির্ভরশীল থাকতে হয়েছে। যার মাশুলও আমরা দিয়েছি, দিচ্ছিও।
যুদ্ধের ব্যাপারে সরকারের এ ধরনের নির্ভরশীল ভূমিকাসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে প্রতিটি সেক্টরেই বিক্ষোভ দেখা দিয়েছিল কেননা এসবের ফলে মক্তিযুদ্ধ যতটা গতিশীল হবার সম্ভাবনা ছিল ততটা হতে পারছিল না। বিক্ষোভ ছিল সেক্টর কমাণ্ডার থেকে শুরু করে সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা পর্যন্ত। যে জন্যে একবার একটি সেক্টরের ক’জন ব্যক্তি পাশ্চাত্যের একটি দেশ থেকে অস্ত্রকনার চেষ্টা করেন। নিজদের যুদ্ধে নিজের নিয়ন্ত্রণ করা এবং প্রয়োজনীয় অস্ত্র পাবার জন্যে এটি একটি অপরিহার্য দিক ছিল। কিন্তু ব্যবস্থা পাশাপাশি হলেও ভারতীয় সরকারের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে এ ব্যবস্থা বাতিল হয়ে যায়। কিছু অস্ত্র লণ্ডন থেকে এসেছিল অষুধের প্যাকেটে। কিন্তু ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তা সীজ করে ।
যুদ্ধ যত বিস্তৃত হচ্ছিল, জনগণ যত যুদ্ধের মধ্যে জড়িয়ে যাচ্ছিলেন ততই যুদ্ধ পাচ্ছিলো জনযুদ্ধের রুপ একই সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ভারত এবং আওয়ামী লীগ বিরোধিতা ক্রমশঃ বিস্তৃত হচ্ছিল। যার ফলে যুদ্ধের উপর আওয়ামীলীগ সরকার এবং ভারত ক্ৰমশঃ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছিল। এ বিষয়ে ভারত ছিলেন অতিমাত্রায় সচেতন। যার লক্ষণ পাওয়া শুরু হলো জুলাই থেকে। কয়েকটি ঘটনায় প্রমাণিত হলো মুক্তিবাহিনীকে তারা বিশ্বাস করে না।
জুলাই মাসের দিকে শেখ মুজিবের ঘনিষ্ঠ চারজন তোফায়েল আহমেদ, শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান এবং আবদুর রাজ্জাক গঠন করেন মুজিববাহিনী বা বি এন এফ। এই বাহিনীর সঙ্গে প্রবাসী সরকারের কোন সম্পর্ক ছিল না। ছিলনা বাংলাদেশ সেনা বাহিনীর। সম্পর্ক ছিল সরাসরি ভারতীয় উর্ধতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে। মুজিববাহিনীর জন্যে মনোনয়ন হতো গোপনে, এবং এ মনোনয়ন অত্যন্ত কঠোরভাবে শুধুমাত্র ছাত্রলীগের বিশ্বস্ত সদস্যদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা হতো। মুজিববাহিনীর প্রশিক্ষণাস্থান ছিল ভিন্ন, সীমান্ত এলাকা থেকে বহু দুরে উত্তর প্রদেশের দেরাদনে। তাদের প্রশিক্ষণের ভিন্ন ব্যবস্থা ছিল, প্রশিক্ষণ কাজ পরিচালনা করতেন প্রধানতঃ জেনারেল ওবান। সামরিক প্রশিক্ষণ ছাড়াও এখানে নিয়মিত রাজনৈতিক ক্লাশ নেয়া হতো। মুজিববাহিনীতে ছিলেন এমন ক’জন তরুণের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, সে ক্লাশগুলোতে শেখ মুজিবের আদর্শ রক্ষা এবং এর বিরোধী শক্তিগুলোকে নির্মুল করবার কথা বলা হতো। এমনও বলা হয়েছে, আমাদের যুদ্ধ এখন নয়, তা শূর হবে স্বাধীনতা যুদ্ধ শেষ হবার পর।
মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের মত মুজিববাহিনীর সদস্যদের খাদ্য, আশ্রয়, অর্থ, অস্ত্র ইত্যাদিতে অনিশ্চয়তা কিংবা সংকটে পড়তে হয়নি। বরঞ্চ তাদের খাদ্য, আশ্রয়, অত্র ইত্যাদি সবই ছিল উন্নতমানের। মুক্তিবাহিনী থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় ভারত সরকারের সরাসরি আশীর্বাদপুস্ট এই বাহিনীতে সদস্য সংখ্যা ৭ থেকে ৮ হাজার পর্যন্ত দাঁড়িয়েছিল। তাদের প্রথম গ্রুপের প্রশিক্ষণ শেষ হয় সেপ্টেম্বর মাসে।
‘প্রথম গ্রুপের প্রশিক্ষণ শেষ হবার পরই তারা যখন বাংলাদেশে প্রবেশ করতে যান তখনই তাজুদ্দিনের সঙ্গে এ নিয়ে বিরোধ হয়। তাজুদ্দিন দৃঢ়ভাবে বলেন যে মুজিববাহিনীর কোন সদস্য বাংলাদেশ সরকারের অনুমতি ছাড়া বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারবে না। এ নিয়ে ভারত সরকারের কাছে তিনি জানতে চান কেন বাংলাদেশ সরকারের অজ্ঞাতে এরকম বাহিনী করা হল। যেখানে সুসংগঠিত মুক্তিবাহিনী রয়েছে। এ বিরোধ বেশ ক’দিন চলে। এরপর শেখ মণি একদিন একটি কাগজ নিয়ে এসে তাজুদ্দিনকে দেন, পরে আমরা জানতে পারি কাগজে ডিপিধরের লেখা ছিল। এরপর আপোষ হয়ে যায় এবং মুজিববাহিনী বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ কর।’ (শামসুল হক, প্রাক্তন পাটমন্ত্রী)।
বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে বিরোধ মিটলেও মুজিববাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর বিরোধ কখনোই মেটেনি। না মেটার কারণও ছিল। মুক্তিবাহিনীর একমাত্র লক্ষ্য ছিল পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ করে দেশকে মুক্ত করা। আর মুজিববাহিনীর লক্ষ্য ছিল মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের উপর নজর রাখা এবং আওয়ামী লীগ বিরোধী বামপন্থী কর্মীদের হত্যা করা। কয়েকস্থানে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে মুজিববাহিনীর সংঘর্ষও হয়। ৭নং সেক্টর একবার বাজার লুট করতে গিয়ে মুজিববাহিনীর সদস্যরা মুক্তিবাহিনীর কাছে বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং কয়েকজন গ্রেফতারও হয়, পরে প্রভাবশালী ঊর্ধবতন মহলের নির্দেশে তাদের ছেড়ে দিতে হয়। এ ধরনের বহু ঘটনা রয়েছে বিভিন্ন সেক্টরে। মুজিববাহিনীর প্রথম গ্রুপ বাংলাদেশে প্রবেশ করেই কর্নেল খালেদের বাহিনীর হাতে বন্দী হয়। এই দলে ছিল ৫৬ জন সদস্য। পরে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ এদের মুক্তির ব্যবস্থা করে। অস্ত্রের ব্যাপারে মুক্তিবাহিনী যেখানে সব সময়ই সংকটের সম্মুখীন হয়েছেন, অস্ত্রের অভাবে অনেক পরিকল্পনা বাতিল করতে হয়েছে সেখানে মুজিববাহিনীর কাছে সরবরাহ করা হতো প্রয়োজনের অতিরিক্ত অস্ত্র। সর্বোপরি মুক্তিবাহিনীর মতো তাদের কাছে এক্সপ্লোসিভ দেয়া হতো না, দেয়া হতো ব্রিটিশ স্টেন, এল, এম, জি, এস, এল, আর। দেয়া হতো পিস্তল, যা মুক্তিবাহিনীর জন্যে ছিল একরকম নিষিদ্ধ অন্যদিকে মুক্তিবাহিনী সাধারণতঃ পেত হ্যান্ড গ্রেনেড এবং এক্সক্লোসিভ কখনো কখনো ভারতীয় স্টেন। পোষাকের ক্ষেত্রেও মুজিববাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর ভিন্নতা ছিল—মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের পরিবেশ ছিল সাধারণতঃ কাছামারা লুঙ্গি, অথবা হাফপ্যান গেঞ্জি। মুজিববাহিনীর পরনে থাকতো ধোপদুরস্ত কাপড়, নিরাপদ এলাকায় তাদের ছিল ভিন্ন সামরিক পোষাক। পাবনার একজন মুক্তিবাহিনীর সহযোগী জানিয়েছেন মুজিববাহিনী সেসময় সাধারণ মানুষের কাছে পরিচিত নকশাল মারা ফৌজ। অভিযোগ রয়েছে সেসময় ভারতের বড় পুজিপতি এবং বহু জাতিক সংস্থাগুলো মুজিববাহিনীকে প্রচুর অর্থ সাহায্য দিয়েছে । আমাদের এপারে ভিন্নপ্রকতির ষড়যন্ত্রও ছিল। প্রবাসী ‘বাংলাদেশ সরকারেরই একটি গ্রুপ, যার নেতৃত্বে ছিলেন খোন্দকার মুশতাক আহমদ। সেসময় আমেরিকার মাধ্যমে পাকিস্তানের সঙ্গে দর কষাকষির চেষ্টা করে এবং কনফেডারেশনের প্রস্তাব দেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ ষড়যন্ত্রে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে।‘ (শামসুল হক, প্রাক্তন পাটমন্ত্রী)
[সাত]
সীমান্তের ওপারে মুক্তিযুদ্ধের জন্যে প্রতিবন্ধক এতসব ঘটনা সত্বেও মুক্তিযুদ্ধ ক্রমেই বিস্তৃত হয়ে পড়ছিল। পাকহানাদার বাহিনীর বর্বর নির্যাতন ছড়িয়েছে সঙ্গে সঙ্গে ছড়িয়েছে মুক্তিযুদ্ধ। সেপ্টেম্বরের মধে বাংলাদেশের এমন কোন এলাকা ছিল না যেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান টের পাওয়া যায়নি। পাকবাহিনীর মুখোমুখি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান। মুক্তিযোদ্ধাদের এই অপ্রতিরোধ্য অগ্রাভিযানে শঙ্কিত হয়ে উঠেছিল পাকজান্তা এবং তাদের পা-চাটা এদেশীয় কুকুরের! যে জন্যে বাংলাদেশের মানুষের উপর সশস্ত্র নির্যাতন আরও সুপরিকল্পিত এবং সুসংগঠিত আকারে দেয়ার চেষ্টা করা হয়। জুলাই মাসের বাংলাদেশের মানুষের চিরদিনের জাতিগত শত্রু হিসেবে চিহ্নিত জামাত-ই-ইসলাম, মুসলিম লীগের বিভিন্ন অংশ নেজামে ইসলাম এবং জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের সদস্যরা কেন্দ্রীয়ভাবে এবং জেলা মহকুমা থানা এবং গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত শান্তি কমিটি গঠন করে। তাদের মধ্যে অনেকেই পাক-বাহিনীর গোয়েন্দা হিসেবে কাজ করতো। কেন্দ্রীয়ভাবে এসব সংগঠনের নেতারাই ছিল পাক বাহিনীর প্রধান পরামর্শদাতা; যারা পরে এদেশে দালাল সরকারও প্রতিষ্ঠা করেছিল। আগস্টের পর থেকে যখন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের অপারেশনের মাত্রা বাড়তে থাকে সে সময় গেরিলা যোদ্ধাদের ঠেকানোর জন্যে পাক-বাহিনী শান্তি কমিটির নেতৃস্থানীয় দালালদের নিয়ে এবং কিছু দালাল বাংগালী পলিশ-সৈন্যদের পরিচালনায় প্রায় ১ লাখ সদস্যের রাজাকার বাহিনী গঠন করে। এই রাজাকার বাহিনীর অধিকাংশ সাধারণ সদস্যই বাধ্যতামূলকভাবে এ বাহিনীতে যোগ দিয়েছিল। এরা ছিল শান্তি কমিটির অধীনস্থ। এবং পাক বাহিনীর স্থানীয় ভিত্তি।
পাকবাহিনী এবং কেন্দ্রীয় দালালদের উদযোগে সেপ্টেম্বর অক্টোবরের দিকে শিক্ষিত দালালদের নিয়ে গঠন করা হয় আরও দুটি বাহিনী আল-বদর এবং আল-শামস। যারা ছিল প্রধানতঃ তৎকালীন ইসলামিক ছাত্র সংঘের সদস্য। ধর্মান্ধ এই দু’বাহিনীর কার্যক্রম ছিল সুপরিকল্পিত তারা পাকিস্তান রক্ষার আদর্শ প্রচার। পাকিস্তান বিরোধী গ্রন্থ—প্রচারপত্র পোড়ানো এবং নেতৃস্থানীয় বামপন্থী বাঙালী বুদ্ধিজীবী হত্যার কাজে নিয়োজিত ছিল।
স্বাধীনতার পর কেন্দ্রীয় দালালদের পুনর্বাসন হয়েছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে, এমনকি বর্তমান রাষ্ট্রযন্ত্রেও তাদের প্রভাব উল্লেখযোগ্য। প্রশাসন, সেনাবাহিনী, পুলিশ ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রেই ‘৭১ এর গণহত্যার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের মুখ্য বহু নায়ক পনর্বাসিত হয়েছে।
১৯৬৫ থেকে ৭১ এই ক’বছরে ১১৩ জন সিনিয়র এবং মাঝারি র্যাংকের পুলিশ অফিসার যুক্তরাষ্ট্রে বিশেষ (ও,জি,এস,) প্রশিক্ষণ লাভের জন্যে যান। এবং প্রশিক্ষণলাভের পর এরাই হয়ে উঠেন স্ব স্ব বাহিনীর প্রধান নিয়ন্ত্রক। এদের মধ্যে ৪০ জনেরও বেশি ছিলেন বাঙ্গালী অফিসার। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যাবার পরও এদের অনেকে স্বেচছায় প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে থাকে এবং প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফিরে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীকে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করতে থাকে। এদের কয়েকজন মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে এরা দেশে ফিরে আসে এবং সক্রিয়ভাবে পাকবাহিনীর দালালি করা শুরু করে। কেউ গোয়েন্দাবৃত্তিতে কাউন্টার-ইনসার্জেন্সীর কাজে ফিরে যায় এবং আর একজন কুখ্যাত রাজাকার বাহিনীর সাংগঠনিক কম্যাণ্ড গ্রহণ করে। এরকম আরেকজন যে চিহ্নিত দালাল ছিলো, স্বাধীনতার পর মুজিব আমলেই তাকে ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে চাকরি দেয়া হয় যেখানে দুর্নীতি হয়, কোটি কোটি টাকার।’ (লরেন্স লিপসুজঃ দ্য আননিশড রেভ্যুলিউশন) এ দুজনই মুজিব আমলেই এরা প্রশাসনের উচ্চপদ লাভ করে, বর্তমানে তাদের আরও পদোন্নতি হয়েছে। এবং এমন দৃষ্টান্ত প্রচুর।
[আট]
১৯৭১-এর যুদ্ধে বাঙালী জাতির মুল ছিল তাদের দেশপ্রেম। যুদ্ধ যত ছড়িয়ে পড়েছে ততই তা জীবনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছে। জাতীয় স্বপ্ন, নিজের জীবনের শত্রুদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ তখন দৈনন্দিন অভ্যাসের অঙ্গ। যুদ্ধ তখন বাঁচার পথ ; যুদ্ধ না করলেও মরতে হবে—যুদ্ধ করলেও মৃত্যু হবে কিন্তু দ্বিতীয় মৃত্যু-সম্মানজনক। “ওরা মানুষ হত্যা করছে, আসুন আমরা পশু হত্যকারি”। তখন সব মুক্তিযোদ্ধার হৃদয়ে তীক্ষ। তীব্র। দিন দিন বাড়ছে ঘরছাড়া তরুণদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে যুদ্ধের উন্মাদনা। পাগল তখন বাংলাদেশের ছেলেরা। সামনে শত্রু-হাতে—অস্ত্র চাই বুকে- আগন। যারা বাধা দেবে,যারাই শত্রুদের সঙ্গে তাদেরই হত্যা করতে হবে। শত্রু গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়, আর্ত চিৎকারের মধ্যে ফুটন্ত , গুলিবিদ্ধ হয় পাখির মতো, অট্টহাসি হাসে । পশু সৈন্য আর রাজাকার বদররা। পিতামাতার সম্মুখে কন্যাকে, স্বামীর সম্মুখে স্ত্রীকে, সন্তানের সন্মখে মায়ের উপর চালায় তারা নির্যাতন। বেয়োনেট, বুট গলি সবকিছ. চলে স্বাধীনতাকামী মানুষের উপর। দুগ্ধপোষ্য শিশুকে বেয়োনেটের খোঁচায় খোঁচায় হত্যা করা হয়। চোখ উপড়ে শরীর ছিলে দিনের পর দিন অত্যাচার করা হয় বন্দী মানুষের উপর। দিনে দিনে শহীদের সংখ্যা বাড়ছে, বাড়ছে অপমানিত বঙ্গললনার সংখ্যা পড়ছে গ্রামের পর গ্রাম। ওদের একমাত্র লক্ষ্য বাংলাদেশের মানুষের শরীরের রক্ত, মাথার মগজ, বুকের হৃদয়, পিঠের মেরুদন্ড ধবংস করে দেয়া।
বাংলাদেশের সন্তানেরা বোধশক্তিহীনতায় ভোগে না কখনো তখনো ভোগেনি। প্রতিশোধ স্পৃহায় ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে। সারা বাংলাদেশের মানুষ তখন মুক্তিযুদ্ধে রত। কেউ সামনে, কেউ পিছনে
মুক্তিযোদ্ধাদের সামনে তখন যুদ্ধ ছাড়া আর কোন লক্ষ্য ছিল না। একবার এক ক্যাম্পে বাংলাদেশ সরকারের এক মন্ত্রী এসে বলেছিলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমতা দেয়া হবে……শিল্পের শেয়ার দেয়া হবে……ইত্যাদি। এসময় মুক্তিযোদ্ধারা উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন ‘আমরা ওসব কিছু চাই না, আমাদের অস্ত্র দিন। অস্ত্র চাই এখন, শত্রু হত্যা করতে হবে—মুক্ত করতে হবে, আট কোটি মানুষকে, মক্ত করতে হবে বাংলাদেশকে।
১০/১২ বছরের অনেক বালক-কিশোর হাজির হয়েছে গিয়ে ; প্রশিক্ষণের জন্যে মনোনীত না করায় রাগে ক্ষোভে কেদেছে চিৎকার করেছে। তাকে নিতে হয়েছে যুদ্ধ করবার জন্যে। যুদ্ধ তারা করেছে। বাবা-মা ভাই বোনদের অপমান তাদের বুকে, তারা নির্বিকার থাকে কি করে ?
দেশের ভেতরে মুক্তিযোদ্ধারা যখন অপারশনে আসতেন, গ্রাম ছিল তাদের ঘাঁটি, গ্রামের মানুষ ছিলেন তাদের আশ্রয়। গ্রামের মানুষ তাদের দেখে ভয় পেতেন—স্বজন এই ছেলেদের হারানোর ভয়—আনন্দ পেতেন স্বস্তি পেতেন যার মধ্যে থাকতো গর্ব। গ্রামের তরুণরাও তখন মুক্তিযুদ্ধে
গ্রামের মানুষই তাদের খাদ্য দিয়েছে, আশ্রয় দিয়েছে। এক-বার এক বাড়িতে উঠেছিলেন দশ/বারোজন মুক্তিযোদ্ধা। তারা অভ্যস্ত সাধারণ খাবারে। কিন্তু তারা যখন দেখলেন মোরগের ব্যবস্থা হচ্ছে তারা বাধা দিলেন; ক্ষিপ্ত গ্রামের বৃদ্ধ জবাব দিলেন ‘চোপ’! আর্মি আইয়া চাইলে নিজের মাইয়াডারে দিয়া দিতে অইব। তুমরা আমাগো জন্যে যুদ্ধ করতাছো তুমগো জন্যে মুরগী দিতে পারম না ?” মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় শক্তি, লক্ষ্য এই জনগণ যাদের আশ্রয় নেই; যারা পশুদের কবলের মধ্যে।
একজন মুক্তিযোদ্ধা বলছিলেন, “আমরা এক গ্রাম পাড়ি দিচ্ছি , কিছু দুরেই এক গ্রুপ মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে আর্মির যুদ্ধ হচ্ছে। আমরা দেখলাম একজন বয়স্ক লোক গাছতলায় বসে একদৃষ্টিতে যুদ্ধস্থলের দিকে তাকিয়ে আছেন। আমরা সন্দেহ করলাম লোকটা হয়তো দালাল। কাছে গেলাম। আমাদের কাছে অস্ত্র ছিল উনিই জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা মুক্তিযোদ্ধা ? আমরা কঠোরভাবে বললাম, হ্যাঁ। আপনি এখানে বসে আছেন কেন ? লোকটি যুদ্ধস্থলের দিকে ইঙ্গিত করে ভরা গলায় বললেন ঐখানে আমার ছেলে যুদ্ধ করছে। ও-ও মুক্তিযোদ্ধা। পিতা বসে আছেন মুক্তিযোদ্ধা একমাত্র পুত্রের যতটা কাছাকাছি থাকা যায়। আমরা পরে আর জানতে পারিনি সেই মুক্তিযোদ্ধা বেচে ছিলেন কিনা ?
ভারত থেকে একমাস-দেড়মাস প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশের ভেতরে আরও অসংখ্য তরুণকে দিচ্ছিলেন প্রশিক্ষণ। এভাবে কয়েকগুণ হারে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছিলো। যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে এরা প্রমাণ করেছেন যুদ্ধে প্রশিক্ষণের চাইতেও বেশি প্রয়োজন দেশপ্রেম আর তাই তাদের মধ্যে ছিল।
মুক্তিযোদ্ধা কারা ছিলেন ? অধিকাংশ, শতকরা প্রায় ৯০ ভাগ-ছিলেন গ্রামের সন্তান। ছিলেন দরিদ্র পরিবারের সন্তান। এমনিতেই যাদের অনিশ্চিত জীবন। সে জন্যে তাদের প্রশ্ন ছিল ‘স্বাধীন হলে কি হবে ?’ উত্তর দিতে হতো নেতৃস্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের।
একাধিক মুক্তিযোদ্ধা কম্যান্ডার বলেছেন, ‘আমরা সে সময় বলতাম আমাদের সম্মুখে দু’টো যুদ্ধ। এই যুদ্ধে আমরা দেশ স্বাধীন করবো। তার পরের যুদ্ধে আমরা শেষ করবো সবধরনের শোষণ। মানুষের সমাজ কায়েম করবো আমরা।’
নিরক্ষর সাধারণ পরিবার থেকে আগত অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধা রাজনৈতিক দীক্ষায় দীক্ষিত ছিলেন না। কিন্তু যুদ্ধে এসে তাদের চেতনা তীক্ষ্মতর হয়েছিল। তাঁদের সামনে স্বপ্ন এসেছে নতুন জীবনের নতুন সমাজের।
একজন মুক্তিযোদ্ধা বলেছিলেন, “আমরা তখন এ ব্যাপারে এতটা গভীরভাবে ভাবিনি । ভাবতাম, আমরা যুদ্ধ করছি—আমরাই তো দেশ চালাবো, দেশ খারাপ হবে কেন?”
একজন সেক্টর কমান্ডার বলেছেন, “সেসময় দেখতাম দুটো প্যান্ট তিনজনে ভাগ করে পরতে। একজনের খাবার তিনজনে ভাগ করে খেতে। মুক্তিযোদ্ধা গরীব, ধনী এক সঙ্গে তখন। তাদের কথাবার্তা শুনেছি আমরা এখন যেমন আছি খারাপ কি ? স্বাধীন হলে এভাবেই থাকবো—আগে দেশ গড়বো সুন্দর করে তার পর ভালভাবে থাকবো।” একজন সর্বহারা সন্তান আর একজন শিক্ষিত সন্তান দু’জনের হাতেই তখন অস্ত্র, লক্ষ্য এক, যুদ্ধে এসে শহরের শিক্ষিত ছেলেরা একাত্ম হয়েছে গ্রামের কৃষকের সঙ্গে, কলের শ্রমিকের সঙ্গে। দু’জনের চেতনা এক হয়ে গেছে নতুন সমাজ গড়বার চিন্তায়। যুদ্ধ ক্ষেত্র, গ্রামীণ আশ্রয়, শহরের মানুষের গ্রামে বাস শরণার্থী ক্যাম্প ইত্যাদি মানুষকে এক শ্রেণীভুক্ত করে দিয়েছিল। যুদ্ধ শেষে তার ধারাবাহিকতা রাখা হয়নি। শেখ সাহেব মুক্তিযোদ্ধাদের বললেন, যার যার পেশায় ফিরে যাও।‘
” তাই হলো। সবাই ন’মাসের অভিজ্ঞতা, ত্যাগ ভুলে তার পুরনো অবস্থানে ফিরে গেল। একজন রাজনৈতিক সচেতন মুক্তিযোদ্ধা বললেন, “ক্যাম্পে আমরা রাজনৈতিক পড়াশোনার ব্যবস্থা করেছিলাম। প্রতিদিন রাতে রাজনৈতিক আলোচনা করতেন। দেখতাম ছেলেদের মধ্যে বিশাল আগ্রহ। তার দায়িত্ব নিয়েছে দেশের। তারা বুঝতে চায় কোন পথে দেশের মঙ্গল। তারা জানতে চায় এ যুদ্ধে তারা কি পাবে। কিন্তু ভারতীয় কর্তৃপক্ষ, আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব, মুজিববাহিনী সবাই আমাদের সন্দেহের চোখে দেখতো। আমরা দেশের অভ্যন্তরে চলে গেলাম। যুদ্ধের পাশাপাশি চল’লা রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত করবার কাজ। বইয়ে পড়া মুখস্ত রাজনীতি নয়, তাই গ্রামের গেরিলাদেরও বুঝে নিতে দেরী হতো না। কারণ সে তরুণ রাইফেল হাতে জেনে গেছে তার ক্ষমতা কি জেনে গেছে জনগণের ক্ষমতা।
পাক বাহিনী, রাজাকার, বদরদের দুর্গে ঢাকা শহরকেও মুক্তিযোদ্ধারা কাঁপিয়ে দিয়েছিল। পাওয়ার স্টেশন, টিভি কেন্দ্র, ইন্টারকন, মার্কেট ইত্যাদি স্থানে বীরত্বপর্ণ অপারেশন চলছে খানসেনা হত্যা করে ঢাকাতেই ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। পরিকল্পনা করা হয়েছে এয়ারপোর্টে বিমান উড়িয়ে দেবার, সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন অকেজো করে দেবার। সময় হয়নি। দেশের প্রতিটি অঞ্চলে, প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে তখন মুক্তিযোদ্ধাদের বন্ধ রয়েছে, সবাই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করছেন। থানা জনগণই দখল করে নিছিলো নবেম্বরের শেষ থেকে। স্থানীয় প্রশাসন চালু করছিল।
‘অস্ত্র হাতে এলে গণতন্ত্রের অর্থ ভিন্ন হয়ে যায়, অস্ত্র হাতে এলে অধিকারের দাবি জোরদার হয়। সে জন্যে মুক্তিযোদ্ধারা বিপ্লবী নেতৃত্বের কথা বলতে, সেই নেতৃত্বকে বিশ্বাস করতো যা আওয়ামী লীগের অনুচরদের ভীত করে তুলেছিল।
‘একমাত্র সাভারেই ১৩জন মুক্তিযোদ্ধা যারা সিরাজ সিকদারের কর্মী ছিল তাদের হত্যা করে মুজিববাহিনী কাপুরুষের গত বন্ধু বেশে, ভারতীয় নির্দেশে।’
এখানে প্রশ্ন হবে তবে মুক্তিযুদ্ধে কারা নেতৃত্ব দিয়েছে। এ প্রশ্ন বার বার উঠে। প্ৰকত সত্য বর্ণিত সত্য থেকে ভিন্ন। যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে সুবেদার হাবিলদার পুলিশ, ইপিআর, যারা গ্রামের সন্তান, যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন বিশ্ব বিদ্যালয় কলেজের ছাত্র, যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছন শ্রমিক। মুক্তিযুদ্ধ দু’টো সরকারী বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ ছিল না; ছিল একটি সরকারী পিশাচবাহিনীর সঙ্গে সমগ্র জনগণের যুদ্ধ। যেজন্যে জনগণের এই যুদ্ধে জনগণের পক্ষ চেতনা আর শক্তিই জোরদার হচ্ছিল। যুদ্ধ যখন জনযুদ্ধের দিকে যাচ্ছে; মুক্তিযুদ্ধ যখন সারাদেশে সামগ্রিক সুষ্ঠ একটি রূপ লাভ করছে ঠিক সে সময়েই যুদ্ধ শেষ হলো। যুদ্ধ শেষ হলো অসম্পূর্ণ অবস্থায়।
মুক্তিযুদ্ধের উপর যাদের নিয়ন্ত্রণ ছিল না, যারা যুদ্ধ থেকে জনগণ থেকে অনেক দূরে ছিল তারাই ভারতীয় বাহিনীর সহায়তায় ক্ষমতা দখল করলো। ক্ষমতা দখলের জন্যে ভারতীয় বাহিনীর সহযোগিতা তাদের জন্য অপরিহার্য ছিল। কেননা, জনগণ মুক্তিযোদ্ধারা তাদের সঙ্গে ছিল না।
স্বপ্ন ভেগে গেলে। মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্ন ভেঙ্গে গেলো একটি জাতির।
বিদেশের সৈন্য দেশে অবস্থান করছে দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের নির্দেশ দেয়া হলো তাদের হাতে অস্ত্র জমা দিতে।
[নয়]
বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর ৭১-এর একজন নিরক্ষর বীর মুক্তিযোদ্ধা মুক্তার হাইজ্যাকিং, ডাকাতি করতো। তার বন্ধু মুক্তিযোদ্ধারা যখন তাকে জিজ্ঞেস করেছিল কেন তুই এসব করছিস ?তার স্পষ্ট উত্তর ছিল শেখ সাহেব তো কইছে, যার যার পেশায় ফিরে যাও যুদ্ধের আগে আমি ভালো লোক আছিলাম না।“ স্বাধীনতার পরবর্তী নেতৃত্ব মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে অস্ত্র কেড়ে নেবার জন্যে প্রথমেই পাগল হয়ে উঠেছিল—অন্ত্র কেড়ে নেবার পর পাগল হয়ে উঠেছিল সামগ্রিক লুটপাট, (অস্পষ্ট) । মুক্তিযোদ্ধাদের তারা ক্রমশ জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করবার চেষ্টা করেছে। জনগণের শক্তিকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করবার চেষ্টা করেছে। সফল হয়েছেও অনেকখানি।
৭৩-এ গ্রামের একজন মুক্তিযোদ্ধা শহরে এসে আত্মহন্তা করেছিল। পরিবারে তার মা ছিল, বোন ছিল। তারা যুদ্ধের আগেও আধপেটা খেতো, যুদ্ধের পর তাদের না খেয়ে থাকতে হতো। কিন্তু যুদ্ধের সক্ষ্য ছিল স্বাধীনতা। সেই স্বাধীনতা এসে যওয়ায় তাদের দাবি বেড়েছে। স্বাভাবিকভাবেই তারা দু’বেলা ভাত চেয়েছে, পরনের কাপড় চেয়েছে। দিতে পারেনি মুক্তিজোদ্ধা সুজন। মা বলেছিল খেতে দিতে পারবি না তবে যুদ্ধ করেছিলি কি জন্যে ।
আত্মহন্তা এখনও করতে হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধাদের সেই একই গ্লানিতে। গত দু’সপ্তাহে দু’জন বীর মুক্তিযোদ্ধা আত্মহন্তা করেছে। একজন দীর্ঘ ন’বছরের বেকারত্বের যন্ত্রণায় গ্রামে আরেকজন হতাশায়, অক্ষমতায় পিজি হাসপাতালে।
অত্মহত্যার আগে আবু তাহের বলেছেন, যে দেশে রাজাকাররা শাসন করে সেই দেশে আমরা কি করে বাঁচবো ? কেন যুদ্ধ করেছিলাম, কি লাভ হল ? এ গ্লানি, এ ক্ষোভ শুধু,আবু তাহেরের নয়। প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধার, জনগণের আজ মুক্তিযোদ্ধা হলে পাসপোর্ট পাওয়া যায় না, মুক্তিযোদ্ধা হলে পুলিশ খোঁজে, মুক্তিযোদ্ধা হলে জেলে ভরে রাখা হয়। কেন? ভয়ে, মুক্তিযোদ্ধাদের ভয় পায়। মুক্তিযোদ্ধারা জনগণের অনেক কাছাকাছি—মুক্তিযোদ্ধারা জনগণের, একটি জাতির বনের প্রতিনিধিত্ব করেন। গণবিরোধীদের সঙ্গে ৭১-এও মুক্তিযোদের লড়তে হয়েছে। এখনও হচ্ছে। প্রতিপক্ষ ভয় পায় সে জন্যেই।
মুক্তিযুদ্ধের সময় মনে হয়েছিল জাতিগত শত্রু, এ যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবে, শুরু হব নতুন যুদ্ধ যে যুদ্ধ শ্রমজীবী মানষের, উৎপাদকের অধিকার প্রতিষ্ঠা করবে—যে যুদ্ধ নতুন সমাজ সৃষ্টি করবে। কিন্তু তা ঠিক হয়নি। এখনও সে জাতিগত শত্রুরা রয়েছে -রয়েছে সদম্ভে। তাদের পুনর্বাসিত করেছে আমাদেরই রাষ্ট্রযন্ত্র ৭২ সাল থেকে। রাজাকাররা মৃতদেহে প্রাণ ফিরে পেয়ে আবার অস্ত্র ধরেছে। আঘাত হানছে। মুক্তিযোদ্ধারা নতুন যুদ্ধ শুরু করার আগেই দেখছে মৃত শত্রু আবার উঠে দাঁড়িয়েছে পেছনে, হাতে তার কৃপান। সামনে এগিয়ে যাবার লড়াই থেমে গেছে। আবার লড়তে হচ্ছে পুরানো মৃত শত্রুর সঙ্গে।
সেক্টর ও কম্যান্ড
‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে সময়
বাংলদেশকে নিম্নলিখিতভাষে ভাগ করা হয়েছিল যুদ্ধের সবিধার জন্য :
(১) চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও ফেনী নদী পর্যন্ত ফেনী নিয়ে গঠিত হয় এক নম্বর সেক্টর । সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান জুন মাস পর্যন্ত। এর পর দায়িত্ব নেন ক্যাপ্টেন (পরে মেজর) মোহাম্মদ রফিক।
(২) নোয়াখালী জেলা, আখাউড়া-ভৈরব রেল লাইন পর্যন্ত কুমিল্লা জেলা, সিলেট জেলার হবিগঞ্জ মহকুমা ঢাকা জেলার ঢাকা ও ফরিদপুর জেলার কিছু অংশ নিয়ে গঠিত হয় দুই নম্বর সক্টর। এ সেক্টরের কম্যান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। এর পর দায়িত্ব নেন মেজর এ টি এম হায়দার।
(৩) আখাউড়া-ভৈরব রেললাইন থেকে পূর্ব দিকে কুমিল্লা সুজলা, সিলেট জেলার হবিগঞ্জ মহকুমা, ঢাকা জেলায় অংশ ও কিশোরগঞ্জ নিয়ে গঠিত হয় তিন নম্বর সেক্টর। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ সেক্টর কম্যান্ডার ছিলেন মেজর কে এম শফিউলাহ। এর, পর দায়িত্ব নেন ক্যাপ্টেন (পরে মেজর) এ এন এম নুরুজ্জামান
(৪) সিলেট জেলার পূর্বাঞ্চল খোয়াই শায়েস্তাগঞ্জ রেল লাইন ছাড়া পূর্ব ও উত্তর দিকে সিলেট ডাউকি সড়ক নিয়ে গঠিত হয় চার নম্বর সেক্টর। এর দায়িত্বে নিয়োজিত ছলেন মেজর সি আর দত্ত ।
(৫) সিলেট জেলার পশ্চিমাঞ্চল সিলেট-ডাউকি সড়ক হতে সুনামগঞ্জ-ময়মনসিংহ সড়ক পর্যন্ত এলাকা নিয়ে গঠিত হয় পাঁচ নম্বর সেক্টর। এর কম্যান্ডার ছিলেন মেজর মীর শওকত আলী।
(৬) রংপুর জেলা ও দিনাজপুরের ঠাকুরগাঁও মহকুমা নিয়ে গঠিত হয় ছয় নম্বর সেক্টর। পরে
যুদ্ধে পরিচালনার সুবিধার জন্য রংপুর জেলার ব্রহ্মপুত্র নদী তীরস্থ অঞ্চল ১১ নম্বর সেক্টরের অধীনে দেয়া হয়। এ সেক্টরের কম্যান্ডার ছিলেন উইং কম্যান্দার এম বাশার।
(৭) দিনাজপয়ে জেলার দক্ষিণাঞ্চল রাজশাহী পাবনা ও – বগুড়া জেলা নিয়ে গঠিত হয় সাত নম্বর সেক্টর। এ সেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন মেজর কাজী নুরুজ্জামান।
(৮) কুষ্টিয়া, যশোর, ফরিদপরের অধিকাংশ এবং খুলনা জেলার দৌলতপুর-সাতক্ষীরা সড়ক পর্যন্ত এলাকা নিয়ে গঠিত হয় আট নম্বর সেক্টর। এর দায়িত্বে ছিলেন আগস্ট পর্যত মেজর আবু ওসমান চৌধুরী। পরে এর দায়িত্বভার মেজর এম এ মঞ্জুরের ওপর দেয়া হয়। যুদ্ধের শেষের দিকে এম এ মঞ্জুর নয় নম্বর সেক্টরেরও দায়িত্ব নেন।
(৯) দৌলতপুরে- সাতক্ষীরা সড়ক থেকে খলনা জেলার দক্ষিনাঞ্চল বরিশাল ও পটুয়াখালী জেলা নিয়ে গঠিত হয় নয় নম্বর সেক্টর। এ সেক্টর কম্যান্ডার ছিলেন মেজর এ জলিল ডিসেম্বর মাস শুরু পর্যন্ত। পরে এর দায়িত্ব দেয়া হয় -মেজর জয়নাল আবেদীনকে। ।
(১০) দশ নম্বর সেক্টরের অধীনে ছিল নৌ কমান্ডো, সমুদ্র উপকুলীয় অঞ্চল ও অভ্যন্তরিন নৌ-পথ।
(১১) কিশোরগঞ্জ মহকুমা ছাড়া ময়মনসিংহ জেলা ও টাঙ্গাইল জেলা নিয়ে গঠিত হয় এগার নম্বর সেক্টর। এর দয়িত্বে ছিলেন মেজর আবু তাহের। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট এম হানিফউল্লাহ নভেম্বরে মেজর আবু তাহের গুরুতর আহত হলে দায়িত্ব নেন। প্রতিটি সেক্টরকে ভাগ হয়েছিল কয়েকটি সাব-সেক্টরে।
এছাড়া তিনট ব্রিগেড আকারে ‘ফোর্স’ গঠন করা হয়। ফোর্সের নামকরণ করা হয় অধিনায়কদের নামেয় আদ্যাক্ষ দিয়ে। এ তিনটি ফোর্সের অধিনায়ক ছিলেন যথক্রমে লে: কর্নেল খালেদ মোশাররফ লেঃ কর্নেল কে এম শফিউল্লাহ ও মেজর (পরে লেঃ কর্নেল) জিয়াউর রহমান। ফোর্সগলোর নাম ছিল যথাক্রমে ‘কে’ ফোর্স ‘এস’ ফোর্স এবং জেড ফোস। জেড ফোর্সে নিয়মিত বাহিনীর শক্তি ছিল ৩ ব্যাটোলিয়ন ‘কে’ ফোর্সে ছিল ও ব্যাটেলিয়ন এবং এস ফোর্সে ছিল ২ ব্যাটেলিয়ন সৈন্য।
১৩ই মার্চ শুরু হলো বঙ্গবন্ধুর সাথে ইয়াহিয়ার আলোচনা। আমরা সবাই ক্ষণিকের জন্য স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। আমরা আশা করলাম পাকিস্তানী নেতারা যুক্তি মনবে এ পরিস্থিতির ভন্নতি হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে পাকিস্তানী দের সামরিক প্রস্তুতি হ্রাস না পেয়ে দিন দিনই বৃদ্ধি পেতে শুরু করলো। প্রতিদিনই পাকিস্তান থেকে সৈন্য আমদানী করা হলে। বিভিন্ন স্থানে জমা হতে থাকলো অস্ত্রশস্ত্র আর গোলাবারুদ। সিনিয়র পাকিস্তানী সামরিক অফিসাররা সন্দেহজনকভাবে বিভিন্ন গ্যারিশনে আসাযাওয়া শুরু করলো। চট্টগ্রামে নৌবাহিনীরও শক্তি বৃদ্ধি করা হলো।
১৭ই মার্চ স্টেডিয়ামে লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম আর চৌধুরী, আমি, ক্যাপ্টেন ওলি আহমদ ও মেজর আমিন চৌধুরী এক গোপন বৈঠকে মিলিত হলাম। এক চুড়ান্ত যুক্ত পরিকল্পনা গ্রহণ করলাম। লেঃ কর্নেল চৌধুরীকে অনুরোধ করলাম নেতৃত্ব দিতে।
দুদিন পর ইপিআর-এর ক্যাপ্টেন (এখন মেজর) রফিক আমার বাসায় গেলেন এবং ইপিআর বাহিনীকে সঙ্গে নেয়ার প্রস্তাব দিলেন। আমরা ইপিআর বাহিনীকে আমাদের পরিকল্পনাভূত করলাম।
এর মধ্যে পাকিস্তানী বাহিনীও সামরিক তৎপরতা শুরু করার চুড়ান্ত প্রস্তুতি গ্রহন করলো। ২১শে মার্চ জেনারেল – আবদুল হামিদ খান গেল চট্টগ্রাম – ক্যান্টনমেন্টে। চট্টগ্রামে সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের চুড়ান্ত পরিকল্পনা প্রণয়নই তার এই সফরের উদ্দেশ্য। সেদিন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট মেন্টারের ভোজসভায় জেনারেল হামিদ ২০তম বালুচ রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফাহমীকে বললো—ফাহমি সংক্ষেপে, ক্ষিপ্রগতিতে আর যত কম সম্ভব লোক ক্ষয় করে কাজ সারতে হবে। আমি এই কথাগুলো শুনেছিলাম।
২৪শে মার্চ ব্রিগেডিয়ার মজুমদার ঢাকা চলে এলেন। সন্ধ্যায় পাকিস্তানী বাহিনী শক্তি প্রয়োগে চট্টগ্রাম বন্দরে যাওয়ার পথ করে নিল। জাহ- সোয়াত থেকে অস্ত্র নামানোর জন্যেই বন্দরের দিকে ছিল তাঁদের এই অভিযান। পথে জনতার সাথে ঘটলো তাদের কয়েক দফা সংঘর্ষ। এতে নিহত হলো বিপুল সংখ্যক বাঙালী। সশস্ত্র সংগ্রাম যে কোন মুহূর্তে শুরু হতে পারে, এ আমরা ধরেই নিয়েছিলাম। মানসিক দিক দিয়ে আমরা ছিলাম প্রস্তুত। পর দিন আমরা পাথের ব্যারিকেট অপসারনের কাজে ব্যস্ত ছিলাম।
তারপর এলো সেই কালো রাত। ২৫শে ও ২৬শে মার্চের মধ্যবর্তী কালো রাত! রাত ১২টায় আমার কমান্ডিং অফিসার আমাকে নির্দেশ দিলো নৌবাহিনীর ট্রাকে করে চট্টগ্রাম বন্দরে যেয়ে জেনারেল আনসারীর কাছে রিপোর্ট করতে। আমার সাথে নৌবাহিনীর (পাকিস্তানী) প্রহরী থাকলে তাও জানানো হলো। আমি ইচ্ছা করলে আমার সাথে তিন জন লোক নিয়ে যেতে পারি। তবে আমার সাথে আমারই ব্যাটেলিয়ানের একজন পাকিস্তানী অফিসারও থাকবে। অবশ্য কমান্ডিং অফিসারের মতে সে যাবে আমাকে গার্ড দিতেই।
এ আদেশ পালন করা আমার পক্ষে ছিল অসম্ভব। আমি বন্দরে যাচ্ছি কিনা তা দেখার জন্য একজন লোক ছিল। আর বন্দরে শবরীর মত প্রতিক্ষায় ছিল জেনারেল আনসারী। হয়তো বা আমাকে চিরকালের মতোই স্বাগত জানাতে।
আমরা বন্দরের পথে বেরোলাম। আগ্রাবাদে আমাদের থামতে হলো। পথে ছিল ব্যারিকেড। এই সময়ে সেখানে এলো মেজর জেনারেল খালেকুজ্জামান চৌধুরী ক্যাপ্টেন ওলি আহমদের কাছ থেকে এক বার্তা এসেছে। আমি রাস্তায় হাটছিলাম। খালেক আমাকে একটু দূরে নিয়ে গেল। কানে কানে বললো তারা ক্যান্টনমেন্ট ও শহরে সামরিক তৎপরতা শুরু করেছে। বহু বাঙালীকে ওরা হত্যা করেছে। এটা ছিল একটা চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময়। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আমি বললাম -আমরা বিদ্রোহ করলাম। তুমি ষোল শহর বাজারে যাও। পাকিস্তনী অফিসারদের গ্রেফতার করো। অলি আহমদকে বলা ব্যাটেলিয়ন তৈরি রাখতে, আমি আসছি।
আমি নৌবাহিনীর ট্রাকের কাছে ফিরে গেলাম। পাকিস্তানী অফিসার, নৌবাহিনীর চীফ পোর্ট অফিসার ও ড্রাইভারকে জানালাম যে আমাদের আর বন্দরে যাওয়ার দরকার নেই।
এতে তাদের মনে কোন প্রতিক্রিয়া হলো না দেখে আমি পাঞ্জাবী ড্রাইভারকে ট্রাক ঘুরাতে বললাম। ভাগ্য ভালো, সে আমার আদেশ মানলো। আমরা আবার ফিরে চললাম। ষোল শহর বাজারে পৌছেই আমি গাড়ি থেকে নেমে একটা রাইফেল তুলে নিলাম। পাকিস্তানী অফিসারটির দিকে তাক করে বললাম, হাত তুলো। আমি তোমাকে গ্রেফতার করলাম।
নৌবাহিনীর লোকেরা এতে বিভ্রান্ত হয়ে পড়লো। এর পর মুহর্তেই আমি নৌবাহিনীর অফিসারের দিকে রাইফেল তাক করলাম। তারা ছিল আট জন। সবাই আমার নির্দেশ মানলো এবং অস্ত্র ফেলে দিল।
আমি কমান্ডিং অফিসারের জীপ নিয়ে তার বাসার দিকে রওয়ানা দিলাম। তার বাসায় পৌছে হাত রাখলাম কলিং বেলে কমান্ডিং অফিসার পাজামা পরে। বেরিয়ে এলো। খুলে দিল দরজা। ক্ষিপ্রগতিতে আমি ঘরে ঢুকে পড়লাম এবং কলার টেনে ধরলাম। দ্রুত গতিতে আবার দরজা খুলে কর্নেলফে আমি বাইরে টেনে আনলাম। বললাম, বন্দরে পাঠিয়ে আমাকে মারতে চেয়েছিলে ? এই আমি তোমাকে গ্রেফতার করলাম।…… (একটি জাত্রি জন্ম। মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। বিচিত্রা : স্বাধীনতা দিবস সংখ্যা, ১৯৭৪)
এ সময় আমার নতুন পদ হল : বিগ্রেড মেজর, ৫৭ নং ঢাকা বিগ্রেড। আমাকে ২২শে মার্চ মার্চ বদলি করে দেয়া হয়। ১লা মার্চ থেকে ২২শে মার্চ পর্যন্ত আমি মুভমেন্ট সম্পর্কে আমার কিছুটা ধারণা হয়েছিল। যার জন্যে মার্চ মাসের প্রথম দিকে আমি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করি এবং পরে জেনারেল ওসমানীর সঙ্গেও আলোচনা হয়। ২২শে মার্চ আমার পোস্টিং হয় কুমিল্লায়, ফোর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টে, সেকেণ্ড-ইন-কমান্ড। এটা আমার অরিজিন্যাল ব্যাটেলিয়ন। ২৪শে মার্চ আমি ফোর্থ বেঙ্গলের সে সময়কার পাঞ্জাবী কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল খিজির হায়াত খানের কাছ থেকে দায়িত্ব বুঝে নিলাম। দায়িত্ব বুঝে নেবার পর মুহূর্তে একটা অর্ডার ইস্যু হলো আমার নামে : আমাকে তখনই রওয়ানা হতে হবে শমশের নগর, একটা কোম্পানী নিয়ে। কারণ হিসেবে বলা হল ভারত থেকে সশস্ত্র নকশালয় অনুপ্রবেশ করেছে। খটকা লাগলো।
প্রশ্ন করেছিলাম, আমি ব্যাটেলিয়নের সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ড, একটা কোম্পানী নিয়ে যাবো কেন?
আমাকে এভাবে হঠাৎ প্রশ্ন করতে দেখে লেঃ কর্নেল খিজির স্পষ্টভাবে চমকে গেলেন। বললেন, ওখানে একটা ইপিআর কোম্পানী আগে থেকেই আছে। সেজন্য একজন সিনিয়র অফিসার খাওয়া প্রয়োজন।
অস্ত্র সংগ্রহ করার সময় আমার মনে সন্দেহটা স্পষ্ট হল। কৈাম্পানীকে পরে অস্ত্রে সজ্জিত করে আমি সেদিনই রওনা হলাম শমশের নগরের উদ্দেশ্যে। যাবার আগে রেজিমেন্টের বাঙালী অফিসারদের সাবধান থাকতে বলে গেলাম। ফোর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের অন্য একটা কোম্পানী ব্রাহ্মণবাড়িয়া গিয়েছিল। আমি যাচ্ছি শমশের নগর। তার মানে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট খালি করা হচ্ছে। বিচিছন্নভাবে ছড়িয়ে দিয়ে বেঙ্গল রেজিমেন্টের শক্তিকে নিউট্রল করা হচ্ছে।
দেশব্যাপী তখন গণজাগরণের জোয়ার। শমসের নগর যাবার পথে বাধা পেলাম হাজার মানষের কাছ থেকে। তারা আমাদের কিছুতেই যেতে দেবে না। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একজন স্থানীয় লোক আমার গাড়ির সামনে শুয়ে পড়লো। বললে যেতে হলে আমার সামনে দিয়ে যাবেন। আমি আশ্বাস দিলাম যে শেখ সাহেব বললেই আমদের সংগ্রাম শুরু হবে। আমরাও প্রস্তুত। দরকার হলে দেখবে যে আমরও তোমাদের পাশে দাঁড়িয়েছি।
শমসের নগর যাবার পথে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ফোর্থ বেঙ্গলের অন্য একজন অফিসার, মেজর শাফায়েত জামিলের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করি। কিন্তু শমসের নগর পেীছে পর দিন খোঁজ নিতে গিয়ে দেখি নকশাল অথবা ইপিআর কোনো কিছুরই পাত্তা নেই। এসেছিলাম পাকা ছেড়ে কাঁচা রোড দিয়ে পাকা রোডের পাশে মৌলভী বাজারে ৩১ পাঞ্জাবের একটি কোম্পানী ওখানে আগেই পোস্টেড ছিলো ওদের খবর পেলাম ২৬শে মার্চ। এর আগে চা বাগানলোয় গিয়ে আশ্চর্য হয়ে দেখি অবাঙালী টি ল্যান্টাররা আগেই সরে পড়েছে। বা সরিয়ে দেয়া হয়েছে।
আমি কুমিল্লার সঙ্গে অয়ারলেসে যোগাযোগের চেষ্টা করলাম কিন্তু কেনো সাড়া পেলাম না। ২৬শে মার্চের বিকেলে একজন খবর নিয়ে এলো ঢাকায় আর্মি ব্যাপক আকারে গণহত্যা শুরু করেছে। এবার যোগাযোগের চেষ্টা করলাম ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সঙ্গে। ওদের পেলাম। শুনলাম, ফোর্থ বেঙ্গলের কমাণ্ডার এখন ওখানে পুরো ব্যাটেলিয়ন নিয়ে এসেছে। শাফায়েতকে শুধু বললাম, আমি আসছি।
চার দিকের আলো নিভিয়ে দিয়ে অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে ২৬শে মার্চ রাত দশটায় আমি আমার কনভয় নিয়ে রওনা হলাম ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পথে। এ সময় প্রতিটি মুহূর্ত আমার পাশে থেকে আমাকে সাহায্য কষ্টেছিল তরুণ ক্যাপ্টেন মাহবুব। পথে ব্যারিকেড সরিয়ে সরিয়ে অগ্রসর হতে সময় লাগছিল। শাফায়েত আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিল।
ভোর ছটা।
২৭শে মার্চ শাফায়েত জানালো। কমান্ডার সকাল ১০টায় অফিসারদের মিটিং ডেকেছে। বুঝলাম তখন কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। বললাম, তুমি তোমার কাজ শেষ করে ফেল আমি কাছে এসে পড়েছি। শাফায়াতের নেতৃত্বে ঠিক ন’টায় ফোর্থ বেঙ্গল রেজিমেণ্টের অফিসাররা পাঞ্জাবী কমান্ডার অফিসার ও জোয়ানদের বন্দী করে। আমি দুপুরে ওদের সঙ্গে যোগ দিলাম!
এদিন থেকেই শুরু হল প্রতিরোধের যুদ্ধ।
০ ০ ০
আমরা যুদ্ধ করেছি তিন ফ্রন্টে। অর্থনৈতিক রাজনৈতিক ও সামরিক। পাকিস্তানের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিয়েছিল আমাদের গেরিলা ইউনিট ও ফ্রগম্যানরা। ওরা ব্রীজ উড়িয়েছে , যোগাযোগ বাবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে, পাটের গুদামে আগুন লাগিয়েছে সমুদ্র জাহাজ ডুবিয়েছে। বন্ধ করে দিয়েছে বিদেশী মুদ্রা অর্জনের সমস্ত উপায়। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যুদ্ধ করেছি পাকিস্তানের শাসন কাঠমো ভেঙ্গে দিয়ে। ইয়াহিয়ার অনাচরদের হত্যা করেছে আমাদের ছেলেরা। বিশ্ব সংবাদ তৈরি হতে এমন সব টার্গেট বেছে নিয়েছে এরা। যেমন ইন্টারকন্টিনেন্টাল ও ডিআইটিতে এক্সপ্লোসিভ বসায়। এই সব ছেলের ঢাকা পাওয়ার স্টেশন উড়িয়েছে, সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশনে ক্ষতি সাধন করেছে, গ্যাস লাইন নষ্ট করেছে। এসব কাজে আমি গেরিলাদের ব্যবহার করেছি। সামরিক ক্ষেত্রে আমি আরো দুধরনের পদ্ধতি ব্যবহার করেছি।
এক—ফ্রন্টাল ফাইট। প্রচলিত প্রথায় ডিফেন্স লাইন বসিয়ে যে যুদ্ধ হয় তাই।
০ ০ ০
ঢাকা শহরের এক ফল বিক্রেতা আমার সেক্টরের একজন গেরিলা কমান্ডার হয়েছিলেন। যুদ্ধ করেছে ঢাকা বিশ্ববিদালয়ের সেরা ছাত্র থেকে শুরু করে প্রত্যেকে। বিদেশে নিরাপদ আশ্রয় পেয়েও তাই আমরা তিব্বতের দালাইলামা হয়ে যাইনি। অন্যের গলগ্রহ হয়ে – থাকিনি। আমরা দেশ স্বাধীন করেছি তার জন্য আমি প্রতিটি বাঙালীর মতই গর্বিত। গর্ববোধ করি এজন্যই যে আমরা গণযুদ্ধে অংশগ্রহন করেছি। জনতার এক জন হিসেবে যুদ্ধ করেছি।
(জনতার একজন হিয়েবে যুদ্ধ করেছি। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ/বিচিত্রা : স্বাধীনতা দিবস সংখ্যা, ১৯৭৪)
দেশের অশান্ত পরিবেশ ও অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ বিশেষ করে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাবেক পূর্ব পাকিস্তান আক্রমণের পরিকল্পনার অলৌকিক বাহিনীকে মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত থাকার নির্দেশ ছিলো ‘পাক সামরিক সরকারের।
তখনকার ৫৭ ব্রিগেডের অধিনায়ক ২৭শে ফেব্রুয়ারীতে এক জরুরী সামরিক সম্মেলনের জন্যে তার অধীনস্থ সমস্ত ব্যাটেলিয়ন ও রেজিমেন্টের অধিনায়কাদেয়র এক গোপন মন্ত্রণা সভা ডাকলেন। ঢাকা ৫৭ ব্রিগেডের অধীনে তখন ৪টি পদাতিক ব্যাটেলিয়ন দুইটি গোলন্দাজ রেজিমেন্ট ও দশটি উন্মুক্ত বিশিষ্ট একটি স্কোয়াড্রন। এছাড়া জয়দেবপুরে ১০ই মার্চের সে ঘটনার পর এ ২৫শে মার্চের মধ্যে সব পরিস্থিতির অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। ২৫শে মার্চের বিকালের মধ্যে ঢাকা ও জয়দেবপুরে অবস্থানরত ব্যাটেলিয়নের সদর দফতর-এর মধ্যে সমস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। একটি মাত্র অয়্যারলেস সেটা ছিল, যা দিয়ে শুধু ব্যাটেলিয়ন ও ব্রিগেডের যোগাযোগ করা যেত—এক ব্যাটেলিয়ন থেকে অন্য ব্যাটেলিয়নেরও যোগাযোগ কেটে দেয়া হয়েছিল।
ব্রিগেড সদর দফতর এই ব্যবস্থা করেছিল যাতে আমরা বাকি সব জায়গায় কি হচ্ছে তা জানতে না পারি। সবচেয়ে মজার কথা ঐ বেতার যন্ত্রটি পরিচালিত হচ্ছিল একজন পশ্চিম পাকিস্তানী সংকেত প্রেরক স্বার।
২৫শে মার্চের কালরাত্রির ঘটনা ২৬শে মার্চ সন্ধ্যা পর্যন্ত আমরা জানতে পারিনি। ২৭শে মার্চে যখন লোকমখে শুনলাম তখনই আমরা যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করে ব্যাটেলিয়নকে ময়মনসিংহে কেন্দ্রীভুত হবার আদেশ দিলাম। ২৮শে মার্চের বিকালের মধ্যে আমার ব্যাটেলিয়ন, সাবেক ইপিআর ও ময়মনসিংহ জেলার সমস্ত সৈন্য সমবেত হল ময়মনসিংহে।
সে রাতেই আমি আমার যুদ্ধ পরিকল্পনা করে ফেললাম। পুলিশ ও সাবেক ইপিআর বাহিনীর কিছু অংশ পাঠালাম বাহাদুর বাদ ঘাটে। অন্য এক অংশ সিরাজগঞ্জ ঘাটে বাকি সমস্ত সৈন্য নিয়ে ঢাকার দিকে যাত্রা করার মনস্থ করলাম।
আমি ঢাকায় আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম এই ভেবে যে ঢাকা ছিল তখনকার পাক সৈন্য-সামরিক যান্ত্রর প্রধান কেন্দ্রস্থল। এমতাবস্থায় যদি কোনক্রমে ঢাকাকে বাংলাদেশের অন্যান্য অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায় তাইলে চট্টগ্রাম, সিলেট যশোর ও উত্তয় বাংলাকে আরও সামরিক সাহায্য থেকে বঞ্চিত করা যাবে।
এসব কথা চিন্তা করে ২৯শে মার্চ তারিখে আমি তিনটি সাবেক ইপিআর কোম্পানীকে মীরপুর, মোহম্মদপুরে ও ঢাকা বিমান ঘটির দিক থেকে ঢাকা অভিমুখে যাত্রা করার নির্দেশ দিলাম। ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও বাকি সাবেক ইপিআর বাহিনী নিয়ে আমি ট্রেনে কিশোরগঞ্জ, ভৈরব বাজার, নরসিংদী হয়ে পদবজে পুরনো ঢাকা মতিঝিল হয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট অভিমুখে রওনা হলাম।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যেতে পারে পাক বাহিনী হিসাবের গোলমলে ২৯শে মার্চ তারিখে আমাদেরকে জয়দেবপুর রাজবাড়িতে উপর থেকে বিমানের সাহয্যে বোমা ও গুলিবর্ষণ করে।
৩০শে মার্চ আমার সৈন্যরা ঢাকা শহরের পূর্ব ও পশ্চিমদিক থেকে শত্রু, সৈন্যের সম্মুখীন হয়। অয়্যারলেস সেট না থাকার দরুন পশ্চিম দিক থেকে আগত আমার সৈন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। যা হোক লোক মারফত আমি নিয়মিত খবরাখবর পাচ্ছিলাম যে, আমার সৈন্যরা! শত্রু, সৈন্যদের সঙ্গে বার বার সংঘর্ষে ৰীরত্বের সঙ্গে লড়াই করে যাচ্ছে। কিন্তু শত্রু, সৈন্যের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও তাদের আধুনিকতম অন্ত্রের মোকাবিলা করতে না পেরে শেষ পৰ্যন্ত পিছু হটতে বাধ্য হয়ে ছিল।
৩০শে মার্চ যখন পাক সৈন্যদের একটি ব্রিগেড নরসিংদী অভিমুখে রওয়ানা হয় তখন আমি তাদের অগ্রগতিতে বাধা দেয়ার জন্যে শীতলক্ষ্যার পূর্ব তীরে আমার সৈন্য মোতায়েন করি।
ঠিক এমনি সময়ে মেজর (বর্তমানে বিগ্রেডিয়ার) খালেদ মোশাররফ-এর এক বার্তায় জানতে পারি ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমা ও সিলেট জেলার কিছু অংশ এখন তার আয়ত্তাধীনে এবং আমরাও যেন একযোগে ঐ এলাকা রক্ষা করার চেষ্টা করি। সেই মোতাবেক এক কোম্পানীর বেশি সৈন্য নরসিংদীতে রেখে আমি মেঘনা নদীর পূর্ব তীরে চলে যাই।
(সেকেণ্ড বেঙ্গল রেজিমেন্ট, মার্চ, ১৯৭১: মেজর জেনারেল শফিউলাহ/বিচিত্রা, স্বাধীনতা দিবস সংখ্যা, ১৯৭৪)।