সত্তরের দশকের বাংলাদেশ | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ২৮ ডিসেম্বর ১৯৭৯
’৭০ দশক
প্রচ্ছদ কাহিনী
বাংলাদেশ
চন্দন সরকার/ আনু মুহম্মদ/ রেজোয়ান সিদ্দিকী
লোকক্ষয় দিয়ে শুরু হয়েছিল এ দশক। টর্নেডো, বন্যা আর সাইক্লোনে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটেছিল দশক শুরুর প্রথম বছর ৭০ সালেই। ১২ নবেম্বরের মারণ ছোবলে কত লোক প্রাণ হারিয়েছিলো, কত টাকার সম্পত্তি নষ্ট হয়েছিল তার সঠিক কোন হিসেব এখনো নেই। তবে সাধারণভাবে বলা হয় প্রায় ১৫ লক্ষ লোকের প্রাণহানি ঘটেছিলো। বলা হয় ইতিহাসের ভয়াবহতম প্রাকতিক দুর্যোগের একটি ছিল এটি।
যে লোকক্ষয়ের মধ্য দিয়ে এ দশকের সুত্রপাত; যে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্য দিয়ে আমরা পা রেখেছিলাম এ দশকে তা অব্যাহত থাকে দশকের শেষ পর্যন্ত। ঘূর্ণিঝড় দিয়ে শুরু হয়ে খরা দিয়ে শেষ হয়েছে দশক।
জাতীয় ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবময় দশকও এটি। কারণ জাতি হিসেবে, স্বাধীন সত্তা হিসেবে আমরা স্বীকৃতি অর্জন করেছি এ দশকেই। একটি গৌরবময় যুদ্ধের মধ্য দিয়ে এ স্বীকৃতি আদায় করেছে এদেশের জনগণ। এ দশকে আমরা কখনও উদ্বেলিত হয়েছি, জীবন বাজি রেখেছিঃ জাতিগত ঐক্যের পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছি, কখনও হতাশ হয়েছি, কখনও হয়েছি দ্বিধান্বিত। এ দ্বিধা দ্বন্দ্ব এখনও অব্যাহত রয়েছে। এ দশকের অভিজ্ঞতা নিয়ে পা রাখছি নতুন দশকে। তাই প্রয়োজন অভিজ্ঞতার সার সংকলন। তারই প্রচেষ্টা এটি। যে লোক্ষয়ের ঘটনা দিয়ে দশকের শুরু সেখান থেকেই শুরু করা যাক সার সংকলন।
১২ নবেম্বর ‘৭০
১২ নভেম্বর দেশের উপকুলীয় অঞ্চলে ক্রুদ্ধ আঘাত হানে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় আর সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস। এর স্থায়িত্ব ছিলো পরদিন ভোর পর্যন্ত। ক্রুদ্ধ সাগরের ছোবলে সমগ্র উপকুলীয় অঞ্চল বিদ্ধস্ত হলেও রাজধানীতে এর সংবাদ আসে- ১৩ নবেম্বর সন্ধ্যায়।
১৩ নবেম্বরের সংবাদে জানা যায়, অগণিত গবাদি পশুর মৃতদেহ ভেসে যাচ্ছে নদী-নালা; খাল-বিল দিয়ে। পশুর মৃতদেহ ভেসে যাচ্ছে নদী-নালা খাল-বিল দিয়ে। তলিয়ে গেছে আড়াই ফুট পানির নীচে। হাতিয়ার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে ২১ ফুট উচু জলোচ্ছ্বাস।
১৪ নবেম্বরের সংবাদ ১২ নবেম্বরের কাল রাত্রির মারণ ছোবলে কয়েক লক্ষ গবাদি পশু হয়েছে নিশ্চিহ্ন; বিনষ্ট হয়েছে হয়েছে কোটি কোটি টাকার ঘরবাড়ি; সম্পত্তি আর মাঠের ফসল। সরকারী খবরে বলা হল; শুধু নোয়াখালী জেলাতেই প্রাণহানি ঘটেছে দশ হাজার লোকের। নিখোঁজ হয়েছে আরো দু’হাজার লোক।
১৫ নবেম্বরের সংবাদে বলা হল নিহতের সংখ্যা তিন লাখে উপনীত। দুরবতী দ্বীপগুলোর কোন খবর তখনো নেই। পথঘাট সহ যোগাযোগ ব্যবস্থার কোন চিহ্ন নেই। এদিন নিহতের সংখ্যা ছিলো এরকমঃ নোয়াখালী—এক লাখ; হাতিয়া—৭০ হাজার; পটুয়াখালী-৫৬ হাজার; ভোলা—৫০ হাজার; রামগতি-১৫ হাজার। এর পরও মতের সংবাদ ক্রমেই বাড়ছে।
১৬ নবেম্বর প্রাদেশিক গবর্নর তার ক্যাম্প স্থানান্তরিত করেন তজুমুদ্দীনের মনপুরায়। সরকারীভাবে স্বীকার করা হয় একমাত্র ভোলাতেই নিহতের সংখ্যা এক লাখের ওপর দাঁড়ায়।
এদিন বিভিন্ন সংবাদপত্রের খবরে বলা হয়; বহু বাড়ির একটি লোকও জীবিত নেই। অথচ এসব বাড়িতে শতাধিক লোকেরও বাস ছিল। মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে যারা বেচেছে তাদের তখন নেই বলতে কিছুই নেই। মাথার ওপর আচছাদন নেই; শীত নিবারণ দুরের কথা-লজ্জা নিবারণের কাপড় নেই; খাদ্য দরের কথা; নেই তৃষ্ণা নিবারণের পানিও। একজন বিদেশী সাংবাদিকের মন্তব্য ছিল: আমি পেরুর ভূমিকম্প দেখেছি। এ ধংসলীলা তার চেয়েও ভয়াবহ ও মারাত্মক।
এরপরও প্রায় একমাস ব্যাপী ক্ষয়ক্ষতি ও মারাত্মক ধংসলীলার সংবাদ আসতে থাকে। কিন্তু তার চেয়েও মারাত্মক সংবাদ ছিলো সানডে টাইমসের। সংবাদে বলা হয় এ ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার আগেই চট্টগ্রাম আবহাওয়া অফিসকে এ সম্পর্কে অবহতি করেছিল ওয়াশিংটন বিশেষ জরুরী টেলেক্সে। অথচ এ সংবাদ প্রচারে পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিস চরম ব্যর্থতার পরিচয় দেয়।
হুশিয়ারী সংকেত প্রচারে ব্যর্থতার চেয়েও বড় ব্যর্থতা ছিলো ত্রাণকাজ সংগঠনের ক্ষেত্রে। এব্যাপারে সরকারী প্রচেষ্টা ছিল সমানা। তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট এবং পুর্ব পাকিস্তানের গভর্নর দুর্গত এলাকা সফর করলেও ব্যপক ত্রান কাজ চালাতে ব্যর্থতার পরিচয় দেন। বরং ত্রাণকাজ চলে বেসরকারী পর্যায়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের তরফ থেকে। সবচেয়ে দুঃখের ব্যাপার পাকিস্তানের ঐক্য সংহতি নিয়ে চিৎকার করলেও এই চরম দিনগুলোতে কেউ আসেননি পশ্চিমা পাকিস্তানি থেকে। একমাত্র ওয়ালী খান ছাড়া।
জলোচ্ছ্বাসে প্রাণহানি, গবাদি পশুহানি ও ঘরবাডিসহ কোটি কোটি টাকার সম্পদ হানির পর আরো মারাত্মক প্রশ্ন নিয়ে আসে এদেশে বিদেশী সৈন্যের উপস্থিতি। ত্রাণের নামে মার্কিন ও বৃটিশ সৈন্য চলে আসে এদেশে।
একদিকে নির্বাচনী ঘোষণা ও অন্যদিকে এই ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাসের তাণ্ডবলীলার মাঝে দেশের রাজনীতিতেও ঘটে মেরুকরণ। একদিকে মওলানা ভাসানীর ন্যাপ নির্বাচনের বিরুদ্ধে যায়। অন্যদিকে শেখ মুজিবর রহমানের আওয়ামী লীগ নির্বাচনৈর পক্ষে থাকে। ন্যাপ প্রধান মওলানা ভাসানী ২৩ নবেম্বর ও ৪ ডিসেম্বর পল্টনের দুটো জনসভায় ভাষণ দেন। ভাষণে তিনি বিভিন্ন কাজে বিশেষ করে বন্যাত্রাণে ব্যর্থতার জন্যে সরকারের পদত্যাগ দাবি করেন। নির্বাচন বিরোধিতা করে তিনি দেশবাসীকে আহ্বান জানান স্বাধীন সার্বভৌম পূর্ব পাকিস্তান কায়েমের জন্য। তিনি দাবি তোলেন বিদেশী সৈন্য হঠানোর; তিনি নির্বাচন পন্থিদের কঠোর সমালোচনা করে বলেন; ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের পর দেশের ব্যাপক জনসমষ্টি যখন শোকে মহামান উলঙ্গ ও ক্ষুধার্ত তখন নির্বাচন করে ক্ষমতায় যারা যেতে চায় তারা লোভী। ২১ নবেম্বরকে মওলানা ভাসানী সারাদেশে শোক দিবস পালনের আহ্বান জানান ১৬ নবেম্বর বিবৃতিতে। তার ডাকে পালিত হয় সারাদেশে শোক দিবস। এর আগে অবিশিষ্ট সমগ্র দুর্গত এলাকা তিনি সফর করেন। তিনি আহ্বান জানান সম্মিলিত রিলিফ কার্যক্রমের।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবও দুর্গত এলাকা ঘুরে এসে দুর্গত ত্রানে সকলকে তৎপর হওয়ার আহ্বান জানান। তিনি পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকারের অবহেলা ও সম্পুর্ন ব্যর্থতার অভিযোগও আনেন। এছাড়া তিনি ২৬ নভেম্বর দুর্গত এলাকা ঘুরে এসে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, নিবাচন বানচাল হলে বাংলাদেশের জনগণ চরম আত্মত্যাগ করবে। প্রয়োজন বোধে ঘুর্ণিঝড়ে নিহত দশ লক্ষ লোক ছাড়াও আরো দশ লক্ষ লোক প্রাণ দেবে। তিনি বলেন, দুর্গত এলাকায় কয়েক সপ্তাহর জন্য নির্বাচন পিছানো যেতে পারে। তবে এমনি এই প্লার নির্বাচন স্থগিত রাখার বিরোধিতা করেন তিনি। তিনি বলে যে সব দল নির্বাচন স্থগিত রাখার কথা বলছে তারা আসলে সামরিক সরকারকে টিকিয়ে রেখে নিজেদের নেতৃত্ব বজায় রাখতে চাইছে।
এদিকে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করে যথাসময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবেই এমনি পরিস্থিতির মধ্যে যেসব দল নির্বাচনী প্রতিযোগিতা থেকে নাম প্রত্যাহার করে এরা হচ্ছে ন্যাপ (ভাসানী); জাতীয় লীগ কেএসপি ইত্যাদি। অন্যদিকে যারা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করে তারা হচ্ছে আওয়ামী লীগ, জামাতে ইসলাম: নেজামে ইসলামী ন্যাপ (মস্কো)। পরে অবিশ্যি নির্বাচন কমিশন ঘোষনা করে, দুর্গত এলাকার ১টি জাতীয় পরিষদ ও ১৮টি প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচন আপাতত মুলতবী থাকবে। বাকি আসনগুলোর নির্বাচন নির্ধারিত দিনেই সম্পন্ন হবে।
নির্বাচন ‘৭০
জলোচ্ছ্বাস আর নির্বাচনী বিবৃতি পাল্টা বিবৃতির মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথমবারের মত প্রতি বয়ষ্কদের ভোটে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭০-এ ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় পরিষদ নির্বাচন প্রথমে এ নির্বাচনের সময় ছিলো অক্টোবর মাসের যে কোন দিন কিন্তু ভয়াবহ বন্যার কারণে নির্বাচন পিছিয়ে নিয়ে যাও হয় ডিসেম্বরে। কিন্তু এর মধ্যে ১২ নভেম্বর দেশের উপকুলীয় অঞ্চলের নজিরবিহীন ঘূর্ণিঝড়ের প্রেক্ষিতে গত এলাকার ৯টি জাতীয় পরিষদ ও ১৮টি প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন স্থগিত রাখা হয়।
এর আগে ৬১-এ ব্যাপক গণঅভ্যুথানের মুখে আইয়ুব খান ক্ষমতা হাস্তান্তর করেছিলেন ইয়াহিয়া খানকে। ক্ষমতায় এসে প্রথম বেতার ভাষণে ইয়াহিয়া খান ওয়াদা দিয়েছিলেন দেশে সাধারণ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নির্বাচিত সংসদের কাছে ক্ষমতা দিয়ে তিনি বিদায় নেবেন।
সেই অনুযায়ী ৭ ডিসেম্বর ‘৭০ পাকিস্তানের মোট ২’শ ৯০টি জাতীয় পরিষদ আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে মোট ২৫টি রাজনৈতিক দলের ১ হাজার ৫ শত ৫৫ জন প্রাথী প্রতিদ্বন্দিতা করেন। স্বতন্ত্র প্রার্থীর সংখ্যা ছিল ৩’শ ২৮ জন। নির্বাচনে পুর্ব পাকিস্তানের আসন ১৪২ টি। এর মধ্যে ঘূর্ণিঝড়ের কারণে ৯টি আসনে নির্বাচন স্থগিত রাখা হয়।
সারা পাকিস্তানে নির্বাচনের চুড়ান্ত ফলাফল (অস্পষ্ট) রকমঃ আওয়ামী লীগ ১৫১; পিপলস পাটি (অস্পষ্ট) মুসলীম লীগ ৯; জমিয়াতে ওলামায়ে ইসলাম (অস্পষ্ট) ৮: কাউন্সিল মুসলীম লীগ ৭; মারকাজী জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম (পিয়ালভী গ্রুপ) ৬; ন্যাপ (ওয়ালী) (অস্পষ্ট) ইসলামী ৪; কনভেনশন মুসলীম লীগ ২;(অস্পষ্ট) স্বতন্ত্র ১৬।
পরে ঘূর্ণিঝড় উপদ্রুত এলাকার ৯টি আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং সব কটি আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা নির্বাচিত হন। ফলে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সদস্য সংখ্যা দাঁড়ায় ১৬০-এ। নির্বাচনের এ ফলাফল সুবাদে পূর্বাঞ্চলে আও’য়ামী লীগ এবং পশ্চিমমাঞ্চলে জুলফিকার আলী ভুট্টোর পিপিপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। সারা পাকিস্তানে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে আওয়ামী লীগ।
ভাসানী ন্যাপ পশ্চিম পাকিস্তানে ভুট্রোর পিপলস পাটির মধ্যে বিলীন হলেও পূর্বাঞ্চলে এরা স্বতন্ত্রভাবে রাজনীতি করতে থাকে। ভাসানী ন্যাপের পূর্ব পাকিস্তান শাখার অধিকাংশ নেতাই ছিলেন গোপন কমুনিস্ট পার্টির সঙ্গে সম্পর্কিত। রাজনৈতিক লাইন নিয়ে এদের অভ্যন্তরে চলছিল তখন বিতর্ক। তবে এরা সবাই ছিল নির্বাচন বয়কট করে সশস্ত্র সংগ্রামের পক্ষে। ফলে ‘৭০-এর নির্বাচনের অনেক আগে থেকে ভাসানী ন্যাপ ছিল নির্বাচন বিরোধী। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের পাল্টা সংগঠন হিসেবে ভাসানী ন্যাপই ছিল শক্তিশালী। ভাসানী ন্যাপের নির্বাচন বয়কট তাই আওয়ামী লীগের ব্যাপক বিজয়কে করেছিল সহজ।
নির্বাচনী ফলাফলেই পাকিস্তানে দেখা দেয় একটা শাসনতান্ত্রিক সংকট।
নির্বাচনের প্রতিক্রিয়া
ইয়াহিয়া খান তাঁর কথামত নির্বাচন দিয়েছিলেন। নির্বাচনী ফলাফল যা হবার কথা ছিলো তাই হয়েছে। মূলত নিবাচনী ফলাফলই পরবর্তীকালের ঘটনাকে এগিয়ে আনে। ইয়াহিয়ার ঘোষণা অনুযায়ী নির্বাচিত পার্লামেন্ট একটা কার্যকরী সংবিধান দেবেন। এই সাংবিধানিক প্রশ্নেই সুত্রপাত ঘটে মতান্তর; নান্তর এবং যুদ্ধ। ইয়াহিয়া খান বাধ্য হন পাঞ্জাবী সামরিক আমলা চক্রের ষড়যন্ত্রের শিকার হতে এবং ভঙ্গ করেন নিজের ওয়াদা।
৭০ সালের প্রথম দিনটিতে (১ জানুয়ারী) ইয়াহিয়া খান রাজনৈতিক কর্মকান্ডের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন। কিন্তু তখনও পাকিস্তানে জনগণের মন থেকে ‘৬৯ এর আন্দোলনের ঢেউ মুছে যায়নি। একদিকে ভাসানী ন্যাপের সার্বভৌম পুর্ব বাংলার দাবি এবং অন্যদিকে আওয়ামী লীগের ৬-দফা দাবীতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানীরা মুখর। পশ্চিম পাকিস্তানে ধর্মীয় দক্ষিণ পন্থী দলগুলো ছাড়া সবাই মুখের রয়েছেন এক ইউনিট বাতিলের দাবীতে।
এই দুই দাবির মোকাবিলায় ইয়াহিয়া খান প্রথম রাজনৈতিক চালটি দেন। জামাতে ইসলামীর নেতৃত্বে ধর্মান্ধ রাজনৈতিক দলগুলো দিয়ে দাবি ওঠান ‘৫৬ সালের সংবিধান চালু করার। এ সংবিধানের মৌল সুত্র ছিল জাতীয় পরিষদে সংখ্যা সাম্য নীতি। অবিশ্যি পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলের জনগণের ব্যাপক বিরোধিতায় এ প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।
ইয়াহিয়া খান পশ্চিম পাকিস্তানের এক ইউনিট ভেঙ্গে দেন। ১৯৭০ সালে ৩০ মার্চ জারি করেন লিগাল ফ্রেম ওয়াক। এর মুল ভিত্তি ছিল ইসলামিক আদর্শ, গণতান্ত্রিক অধিকার, শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার প্রদেশগুলোর সর্বাধিক স্বায়ত্তশাসন (বিচার প্রশাসন ও অর্থনৈতিক বিষয়ে) এবং প্রদেশগুলোর জন সংখ্যা অনুপাতে সকল কিছুর বন্টন। এ আদেশে বলা ছিল। আগামী সংবিধান এসব মৌলনীতির ভিত্তিতেই প্রতিষ্ঠিত হবে।
এর পর ১২ নভেম্বরের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় এবং ৭ ডিসেম্বরের নির্বাচন পরিস্থিতিকে সম্পূর্ণ পাল্টিয়ে দেয়। ন্যাপ (ভাসানী) নির্বাচন বয়কট করে সার্বভৌম পূর্ব পাকিস্তানের দাবি তোলে ১২ নবেম্বরের ঝড়ের পরে। আওয়ামী লীগ তাদের ৬ দফার ম্যান্ডেট নিয়ে নির্বাচনে অর্জন করে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা। নির্ধারিত হয়ে যায় বাঙালীরা আর জাতিগত নিপীড়ন মানতে রাজী নয়। ইতিমধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানে ভুট্টোর পিপিপি ৮৮টি আসন পেয়ে দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ইয়াহিয়া খান সর্বশেষ চালটি চালেন ভুট্টোকে সঙ্গে নিয়ে। আর একাজে হাতিয়ার হয় ৫ দফা লিগ্যাল ফ্রেম ওয়াক।
নির্বাচনে জয়ী হবার পর আওয়ামী লীগ ৬ দফার ভিত্তিতে সংবিধান রচনার দাবিতে সোচ্চার হয়। ভট্রো বলেন তার দলের মতামত ছাড়া সংবিধান এবং কেন্দ্রীয় সরকার হতে পারবে না। বিতর্ক শুরু হয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন কোথায় বসবে তা নিয়ে। আওয়ামী লীগের দাবি প্রথম অধিবেশন ঢাকাতেই হবে। ভুট্টোর দাবি প্রথম অধিবেশন হবে পশ্চিম পাকিস্তানে। ভুট্টো দাবি তোলেন আওয়ামী লীগকে যেমন পূর্ব পাকিস্তানীরা ম্যান্ডেট দিয়েছে তেমনি পিপিপিকে দিয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানীরা। এর আগে অবিশ্যি ভট্রো-মুজিব একদফা বৈঠক সমাপ্ত হয়েছে ঢাকায়। কিন্তু তা ছিল ব্যর্থ পরিস্থিতির ফসল ঘরে তোলার জন্য ইয়াহিয়া খান ছিলেন উদগ্রীব। তার স্বার্থ হাসিলের জন্য এবার তিনি মাঠে নামলেন। লারকানায় ভুট্টোর সঙ্গে বৈঠক শেষে এলেন ঢাকায়। উদ্দেশ্য শেখ মুজিবের সঙ্গে পরামর্শ। কিন্তু প্রকাশ্য এ উদ্দেশ্য ছাড়াও উদ্দেশ্য ছিল গোপন। ঢাকা ত্যাগের প্রাক্কালে তিনি বললেন, আওয়ামী লীগ ও পিপলস পার্টির মাঝে সমঝোতা প্রয়োজন। আবার ক্ষমতা লিপসু আওয়ামী নেতাদের আশ্বস্ত করার জন্য আভাস দিলেন, পাকিস্তানের ভাবী প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন শেখ মুজিব।
ইতিমধ্যে ভারতীয় বিমান ছিনতাই হয়ে নামলো লাহোরে। পরিস্থিতি আরো জটিল হলো। কিন্তু সকল চক্রান্তই তখন বাঙালীর ঐক্যের কাছে পরাভুত। দোদুল্যমান আওয়ামী নেতাদের পাশ কাটিয়ে ততদিনে স্বাধীনতার কথাটা উঠে এসেছে। বাঙালী চেতনায় এনে দিয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসনের বৈরিতা। ইতিমধ্যে ঘোষণা করা হয়েছে ঢাকায় জাতীয় সংসদের অধিবেশন বসবে ৩ মার্চ।
ভুট্টো তখনও বার বার বলছেন, সমঝোতা ছাড়া ঢাকা যাবো না। আওয়ামী লীগর ৬-দফার প্রথম ও শেষ দফা মানতে রাজী। অন্যগুলো নয়। ভুট্টোর সিধান্তে সমর্থন জানায় একমাত্র কাইয়ুম মুসলিম লীগ। অন্য সবাই ঢাকায় জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে ভুট্টোর যোগ দেয়া উচিত বলে মন্তব্য করে। ১৬ ফেব্রুয়ারী মওলানা ভাসানী বলেন, পুর্ব বাংলা কোন হুমকী বা চাপের মুখেই মাথা নত করবে না। এদিন আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের নেতা নির্বাচিত হন শেখ মুজিব। ১৭ ফেব্রুয়ারী শহীদ দিবস অনুষ্ঠানে শেখ মুজিব বলেন, বাঙালীর জীবন দিতে শিখেছে। পথিবীতে এমন কোন শক্তি নেই যাৱা বাঙালীর মাথা নোয়াতে পারবে। কিন্তু তখনও তিনি ভুট্টোর ওপর কোন মন্তব্য করতে করেন অস্বীকার। ২১ ফেব্রুয়ারী পুনর্বার শেখ মুজিব পশ্চিম পাকিস্তানী নেতাদের আলোচনার জন্য আহ্বান জানান। কিন্তু একই দিন ইয়াহিয়া খান বেসামরিক সরকার বাতিল করে দেন এবং সামরিক গভর্নর সামরিক প্রশাসক, বিমান বাহিনী ও নৌবাহিনীর প্রধানদের সঙ্গে এক বৈঠকে মিলিত হন। সম্ভবত এদিনই তিনি ভবিষ্যতের কু প্রিন্টটিও ঠিক ঠাক করে নেন।
১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ ‘৭১
ফেব্রুয়ারীর (‘৭১) শেষ সপ্তাহে পাকিস্তানের সমগ্র সেনাবাহিনীকে সতর্ক করে দেয়া এবং ব্যাপক ট্রান্সফার চলতে থাকে। ভুট্টো এবং জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের চেয়ারম্যান জেনারেল ওমর ঢাকায় না আসার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানী সংসদ সদস্যদের প্রকাশ্য ভীতি প্রদর্শন শুরু করেন। এরপরেও ১ মার্চ পুর্ব পাকিস্তানের ১৬৯ জন সংসদ সদস্য ছাড়াও ৩৬ জন পশ্চিম পাকিস্তানী সংসদ সদস্য ঢাকায় উপস্থিত হন। কিন্তু এদিনই ভুট্টোর দাবী মোতাবেক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করলেন, জাতীয় পরিষদ অধিবেশন অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ থাকবে।’ কারণ হিসেবে বললেন; ‘পশ্চিম পাকিস্তানের বৃহত্তম দল; পিপিপি সহ বেশ ক’টি দল ৩ মার্চ অধিবেশনে বসতে রাজী নয় এবং ভারত সীমান্ত পরিস্থিতিকে আরো উদ্বেগজনক করে তুলেছে।
এ ঘোষনার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকার জনজীবন সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়ে যায়। দোকান-পাট; অফিস-কাচারী ফেলে লোকজন নেমে আসে রাজপথে। রাজপথে স্লোগান ওঠে স্বাধীনতার। হোটেল পুর্বাণীতে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারী পার্টির বৈঠক চলছিল তখন। পুর্বাণীর সামনে জমায়েত বিপুল জনগণ। তারা উদগ্রীব শেখ মুজিব কি বলেন তা শোনার জন্য। শেখ মুজিব বললেন হরতালের কথা এবং ৭ মার্চ জনসভার কথা। আইন অমান্য আন্দোলনের ডাক দিলেন তিনি। এদিকে আইন অমান্য আন্দোলন করতে গিয়ে প্রতিদিন দেশের কোথাও না কোথাও প্রাণহানি ঘটছে; রক্তাক্ত হচ্ছে গ্রাম -গঞ্জ বন্দর।
এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানো হচ্ছে। জাতীয় সংগীত গাওয়া হচ্ছে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে জাতীয় সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা করার দাবি জানান হয় শেখ মুজিবের প্রতি। কিন্তু শেখ মুজিব তখনও ছিলেন দ্বিধান্বিত।
এদিকে ‘বেলুচিস্তানের কসাই’ টিক্কা খানকে বাংলাদেশে পাঠানো হলো সেনাবাহিনীর প্রধান ও মার্শাল ল’ গভর্নর হিসেবে। ঢাকা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতিসহ কেউই রাজী হলেন না তাকে শপথ গ্রহণ করাতে। ৭ মার্চ ঐতিহাসিক ভাষণ দিলেন শেখ মুজিব রেসকোর্সে। ১৬ মার্চ ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এলে আলোচনায় বসলেন তিনি।
১৬ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত আলোচনা করলেন তারা। কিন্তু প্রতিদিনের আলোচনা কি হচ্ছে তা জানতে পারেননি সাধারণ মানুষ। অথচ এ সময়ে প্রতিদিন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নতুন সৈন্য আসছে; অত্র আসছে। চট্টগ্রাম বন্দরে অস্ত্র নামানোতে বাধা দেয়ায় প্রাণহানি ঘটেছে। খবর আসছে সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনীর বাঙালী সদস্যদের অতস্ত্র সংবরণ করানো হচ্ছে অথবা নত করে রাখা হচ্ছে। মোট কথা পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ তথা ইয়াহিয়া খানের ভবিষ্যত কর্মপন্থা তখন স্পষ্ট। শেখ মুজিব তখনও দ্বিধান্বিত চুড়ান্ত ডাক দেয়ার বেলায়। আর এই শংকিত দ্বিধান্বিত অবস্থায় ২৫ মার্চ রাতের অন্ধকারে পাকিস্তানী বাহিনী সার্বিক আক্রমণ চালায় নিরীহ দেশবাসীর ওপর।
স্বাধীনতা যুদ্ধ ৭১
২৫ মার্চ সন্ধ্যা পর্যন্ত শেখ মুজিবের সঙ্গে আলোচনার ভান করলেন জেনারেল ইয়াহিয়া খান। এর পর সবার অলক্ষ্যে ঐ দিন রাতের আধারে বেলুচিন্তানের কসাই টিক্কা খানের নেতৃত্ব তাঁর হায়না বাহিনীকে নিরস্ত্র জনগণের ওপর লেলিয়ে দিয়ে তিনি পালিয়ে গেলেন। ২৫ মার্চের সেই কালো রাতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ঝাপিয়ে পড়ে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা রাজারবাগ পুলিশ ক্যাম্প, পিলখানার ইপিআর ক্যাম্প থেকে বস্তি এলাকা ও পুরনো ঢাকার ঘন বসতি এলাকায়। আক্রমণ চালায় ইত্তেফাক-সংবাদ অফিসেও। আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ের সকল নেতৃবৃন্দ গা ঢাকা দিলেও হানাদার বাহিনীর কাছে ঐ ২৫শে’র রাতেই ধরা দেন শেখ মজিবুর রহমান। মোট কথা এদিন রাতে সমগ্র ঢাকা শহরে চলে প্রেতের উৎসব লীলা।
২৫ মার্চের রাতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী যখন চালাচ্ছে এই অবাধ হত্যা, ধর্ষণ, ভস্মীভূত করার পালা; তখন চট্টগ্রাম, দিনাজপুর, কুমিললা, ময়মনসিংহ যশোর খুলনা কুষ্টিয়া ও রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বাঙ্গালী সৈনঃবাহিনী, ইবিআর, ইপিআর, পুলিশ একসঙ্গে বিদ্রোহ করে বসে। প্রতিরোধের দীক্ষায় ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক জনতা নেমে আসে রাস্তায়। শুরু হয় প্রতিরোধ যুদ্ধ। কিন্তু সব কিছুই চলে বিচ্ছিন্ন ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে। কারণ যাদের নেতৃত্ব দেয়ার কথা তাঁরা নিজেরাই তখন বিচ্ছিন্ন। ঠিক এই অনিশ্চিত অবস্থার মধেই ভেসে এলো একটি কণ্ঠস্বর। যা সঞ্চার করলো আশার।
২৬ মার্চ চট্টগ্রাম থেকে ভেসে এলো, “আমি মেজর জিয়া বলছি। আমি মেজর জিয়া বাংলাদেত্রে অস্থায়ী সেনাপতি শেখ মুজিবর রহমানের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি।
‘আমি আরো ঘোষণা করছি যে আমরা ইতিমধ্যেই শেষ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বাধীনে একটি সার্বভৌম আইনানুগ সরকার গঠন করেছি, যা সংবিধান ও আইনানুযায়ী কাজ চালাতে প্রতিশ্রুত। সুতরাং আমরা বিশ্বের সকল গণতান্ত্রিক ও শান্তিকামী দেশের প্রতি আইন সঙ্গত ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ সরকারের প্রতি অবিলম্বে স্বীকৃতি প্রদানের আহ্বান জানাচিত।’ আর তিনি এ আহ্বান জানিয়েছিলেন চট্টগ্রামের অস্থায়ী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে।
এরপর থেকে সরাসরি যুদ্ধই শুর হয়। তবে তা ছিল বিচ্ছিন্ন ও স্বতন্ত্র ইতিমধ্যে যেসব আওয়ামী লীগ নেতা আত্মগোপন করেছিলেন তারা ১০ এপ্রিল মুজিব নগরে’ ‘স্বাধীনতার সনদ ঘোষণা জারি করেন। এদিনই শেখ মুজিবর রহমানকে প্রেসিডেন্ট এবং সেনাবাহিনীর সুপ্রীম কমাণ্ডার ঘোষণা করা হয়। সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী নিয়োজিত হন নতুন প্রজাতন্ত্রের। ঘোষণায় শেখ মুজিবর রহমানের অনুপস্থিতিতে সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পান।
১২ এপ্রিল কর্নেল আতাউল গনি ওসমানীকে মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়কের পদ দেয়া হয়। কর্নেল ওসমানীর নেতৃত্বে যুদ্ধের সুবিধার জন্য সমগ্র বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। এই সেক্টরগুলো ছিলো নিম্নরুপঃ
(১) চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও ফেনী নদী পর্যন্ত ফেনী নিয়ে গঠিত হয় এক নম্বর সেক্টর। সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান জুন মাস পর্যন্ত। এর পর দায়িত্ব নেন ক্যাপ্টেন (পরে মেজর) মোহাম্মদ রফিক।
(২) নোয়াখালী জেলা, আখাউড়া-ভৈরব রেল লাইন পর্যন্ত কুমিল্লা জেলা, সিলেট জেলার হবিগঞ্জ মহকুমা ঢাকা জেলার ঢাকা ও ফরিদপুর জেলার কিছু অংশ নিয়ে গঠিত হয় দুই নম্বর সেক্টর। এ সেক্টরের কমান্ডার মেজর খালেদ মোশারফ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। এর পর দায়িত্ব নেন। মেজর এ টি এম হায়দার।
(৩) আখাউড়া-ভৈরব রেললাইন থেকে পূর্বদিকে কুমিল্লা জেলা, সিলেট জেলার হবিগঞ্জ মহকুমা, ঢাকা জেলার অংশ ও কিশোরগঞ্জ নিয়ে গঠিত হয় তিন নম্বর সেক্টর। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন মেজর কে এম শফিউল্লাহ। এরপর দায়িত্ব নেন ক্যাপ্টেন (পরে মেজর) এ এন এম নুরুজ্জামান।
(৪) সিলেট জেলার পুর্বাঞ্চল খোয়াই শায়েস্তাগঞ্জ রেললাইন ছাড়া পূর্ব ও উত্তর দিকে সিলেট ডাউকি সড়ক নিয়ে গঠিত হয় চার নম্বর সেক্টর। এর দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন মেজর সি আর দত্ত।
(৫) সিলেট জেলার পশ্চিমাঞ্চল সিলেট-ডাউকি সড়ক হয়ে; সুনামগঞ্জ-ময়মনসিংহ সড়ক পর্যন্ত এলাকা নিয়ে গঠিত হয় পাঁচ নম্বর সেক্টর। এর কমান্ডার ছিলেন মেজর মীর শওকত আলী।
(৬) রংপুর জেলা ও দিনাজপুরের ঠাকুরগাঁও মহকুমা নিয়ে গঠিত হয় ছয় নম্বর সেক্টর। পরে যুদ্ধ পরিচালনার সুবিধার জন্য রংপুর জেলার ব্রহ্মপুত্র নদী তীরস্থ অঞ্চল ১১ নম্বর সেক্টরের অধীনে দেয়া হয়। এ সেক্টরের কমাণ্ডার ছিলেন উইং কমান্ডার এম বাশার।
(৭) দিনাজপুর জেলার দক্ষিণাঞ্চল, রাজশাহী, পাবনা ও বগুড়া জেলা নিয়ে গঠিত হয় সাত নম্বর সেক্টর। এ সেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন মেজর কাজী নুরুজ্জামান।
(৮) কুষ্টিয়া, যশোর, ফরিদপুরের অধিকাংশ এবং খুলনা জেলার দৌলতপর-সাতক্ষীরা সড়ক পর্যন্ত এলাকা নিয়ে গঠিত হয় আট নম্বর সেক্টর। এর দায়িত্বে ছিলেন আগস্ট পর্যন্ত মেজর আবু ওসমান চৌধুরী। পরে এর দায়িত্বভার মেজর এম এ মঞ্জুরের ওপর দেয়া হয়। যুদ্ধের শেষের দিকে মেজর এম এ মঞ্জুর ৯ নম্বর সেক্টরেরও দায়িত্ব নেন।
(৯) দৌলতপুর-সাতক্ষীরা সড়ক থেকে খুলনা জেলার দক্ষিণাঞ্চল, বরিশাল ও পটুয়াখালী জেলা নিয়ে গঠিত হয় নয় নম্বর সেক্টর। এ সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন মেজর এ জলিল। ডিসেম্বর মাস শুরু পর্যন্ত। পরে এর দায়িত্ব দেয়া হয় মেজর জয়নাল আবেদীনকে।
(১০) দশ নম্বর সেক্টরের অধীনে ছিল নৌ কমান্ডো সমুদ্র উপকুলীয় অঞ্চল ও অভ্যন্তরীণ নৌ-পথ।
(১১) কিশোরগঞ্জ মহকুমা ছাড়া ময়মনসিংহ জেলা ও টাঙ্গাইল জেলা নিয়ে গঠিত হয় এগার নম্বর সেক্টর। এর দায়িত্বে ছিলেন মেজর আবু তাহের। ফ্লাইট লেফটেনান্ট এম হানিফউল্লাহ নভেম্বরে মেজর আবু তাহের গুরুতর আহত হলে দায়িত্ব নেন।
প্রতিটি সেক্টরকে ভাগ করা হয়েছিল কয়েকটি সাব-সেক্টরে।
এছাড়া তিনটি ব্রিগেড আকারের ফোর্স গঠন করা হয়। ‘ফোর্সের নামকরণ করা হয় অধিনায়কদের নামের আদ্যাক্ষর দিয়ে। এ তিনটি ফোর্সের অধিনায়ক ছিলেন যথাক্রমে লেঃ কর্নেল খালেদ মোশাররফ, লেঃ কর্নেল কে এম শফিউলাহ ও মেজর (পরে লেঃ কর্নেল) জিয়াউর রহমান। ফোর্স গুলোর নাম ছিল যথাক্রমে ‘কে’ ফোর্স এস ফোর্স এবং জেড ফোর্স। জেড ফোর্সে নিয়মিত বাহিনীর শক্তি ছিল ৩ ব্যাটেলিয়ন, ‘কে’ ফোর্সে ছিল ৩ ব্যাটেলিয়ন এবং এম ফোর্সে ছিল ২ ব্যাটেলিয়ন সৈন্য।
সমগ্র বাহিনীকে বলা হতো বাংলাদেশ আর্মড ফোর্সেস। এরা ছিল দুই ভাগে বিভক্ত। প্রথম মুক্তিবাহিনী যা গঠিত ছিল নিয়মিত বাহিনী দিয়ে এবং দ্বিতীয় সেক্টর ট্রুপ বা গেরিলা বাহিনী যা গঠিত ছিল ইপিআর, পুলিশ ও ট্রেনিংপ্রাপ্ত বেসামরিক লোক নিয়ে। এরা বাহিনীতে যুক্ত হতেন ভারতে ট্রেনিং নিয়ে।
যুদ্ধের কৌশলও ছিল দ্বিমুখী। প্রথমতঃ নিয়মিত বাহিনীর সাহায্যে সীমান্ত এলাকায় কনভেনশনাল যুদ্ধের মাধ্যমে সীমান্তে পাক বাহিনীকে ব্যস্ত রাখা। গেরিলাদের দ্বারা আঘাতে হানো এবং সরে যাও’ পদ্ধতিতে দেশের অভ্যন্তরে পাকজান্তাকে ব্যতিব্যস্ত করা। অন্যদিকে ঢাকাসহ বড় বড় শহরে এ্যাকশনের মাধ্যমে মনস্তাত্তিক চাপ বাড়ানো। জনগণের মনোবল বুদ্ধি করা এবং দেশে-বিদেশের সংবাদপত্রে প্রচার করা। এভাবে যুদ্ধের সাফল্যে পরিকল্পনা করা হয় নবেম্বরের শেষভাগে ঢাকাকে ঘেরাও করা হবে।
এভাবেই বাংলাদেশ আর্মড ফোর্সেস-এর মোট সংখ্যা নিয়মিত ও গেরিলাসহ দাড়িয়েছিল প্রায় দু’লাখ। নবেম্বরের শেষ দিকে শহরাঞ্চল দেশের বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চলে মুলতঃ মুক্তিবাহিনীর ‘ কতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। উল্লেখ্য যে, ৩রা ডিসেম্বরে পাক-ভারত যুদ্ধের শুরুর পুর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশ বাহিনীই দেশের অভ্যস্তরে ও সীমান্তে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়েছে। আরো উলেখ্য যে, যুদ্ধের সিদ্ধান্ত গ্রহণে সেক্টরগুলো ছিল স্বয়ং শাসিত।
এ বাহিনী গড়ে উঠেছিল দেশ প্রেমিকদের নিয়ে—দলমতের ঊর্ধ্বে।
যুদ্ধের নেতৃত্বে এদের দেখে ভীত হয়ে নেতৃত্ব হারানোর ভয়ে আওয়ামী লীগ ভারতীয় সরকারের যোগসাজশে তৈরি করে পাল্টা বাহিনী বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (বি এল এফ) বা মুজিব বাহিনী। মুজিব বাহিনীর প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার সেনা ভারতে বিশেষ ধরনের ট্রেনিং সমাপ্ত করে ডিসেম্বর ‘৭৯ মাসে। এ বাহিনী তৈরির উদ্দেশ্য ছিল যুদ্ধে নেতৃত্ব যাতে চরম ও উগ্রপন্থী দলের হাতে না যায় তার ওপর নজর রাখা।
৩ ডিসেম্বর শুরু হয় ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ। ভারতীয় ও বাংলাদেশ বাহিনীর সময়ে যৌথ কম্যাংড গঠন করে বাংলাদেশ। ১৬ ডিসেম্বর যৌথ কমান্ডের অধিনায়ক জেনারেল অরোরার কাছে। যৌথ কম্যাংন্ডের বাংলাদেশ বাহিনীর অধিনায়ক কর্নেল ওসমানী দেশে থাকলেও তাকে আত্মসমর্পণের সংবাদ জানানো হয় না। উপস্থিত থাকতেও দেয়া হয় না। ইতিমধ্যে মুজিব বাহিনীকেও দেশে পাঠানো হয়। যদিও এদের ট্রেনিং তখনই কেবল শেষ হয়েছিল।
আর এভাবেই নয় মাসের যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে। অভ্যুদয় ঘটে বাংলাদেশের।
স্বাধীনতা উত্তর ক্ষমতার দ্বন্দ্ব
‘৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ভারতীয় সেনাবাহিনীর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে। অভ্যুদয় ঘটে বাংলাদেশের। এরও সপ্তাহখানেক পর প্রাবাসী বাংলাদেশ সরকার ভারতের বিমানে ঢাকায় নামেন। যৌথ কমান্ডের বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল ওসমানী ঢাকায় আসেন। এর পর ক্ষমতাসীন হন আওয়ামী লীগ সরকার। এ সরকার গঠনের ভিত্তি ছিল ‘৭০ এর নির্বাচন।
ইতিমধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে দাবি করা হয় সর্বদলীয় সরকার নেই আওয়ামী লীগ রাজি ছিলো না। এমনকি মুজিব বাহিনীর নাম নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদেরও পাশ কাটানো শুরু করেন তারা। ক্ষমতায় বসে আওয়ামী লীগ সমাজতন্ত্র কায়েমের ঘোষণা দেয়। আওয়ামী লীগের সমাজতন্ত্র কায়েম নিয়েও এসময় বিতর্কের সুত্রপাত ঘটে। বিভিন্ন বামপন্থী সংগঠনের মত ছিল যেহেতু আওয়ামী লীগ সমাজতান্ত্রিক পার্টি নয় তাই তাদের পক্ষে সমাজতন্ত্র কায়েম (অস্পষ্ট) তবে মস্কোপন্থীরা আওয়ামী লীগকে এ ব্যাপারে সমর্থন করে।
এদিকে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর এবং তার অব্যবহিত পরের সময়ের জনগণের আকাঙ্ক্ষায় চিড় ধরতে শুর করে। দেশে আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ক্রমবর্ধমান হারে বাড়তে থাকে ডাকাতি, গুণ্ডামী, অনাচার, অত্যাচার, উৎপীড়নঃ মজুতদারি।
দেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক, সামাজিক ও আইন – শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবণতি: সর্বদলীয় সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি প্বভৃতির মোকাবিলায় আওয়ামী লীগ নিয়ে আসে নতুন বাদ— মুজিববাদ।
মুজিববাদের প্রথম ঘোষণা দেন মুজিববাহিনী নেতা তোফায়েল আহমদ ১৯৭২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারী। মুজিববাদের ব্যাখায় বলা হল; “মহান মার্কিন নেতা আব্রাহাম লিঙ্কন জনগণকে গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা দিয়েছেন। কিন্তু সমাজতন্ত্র দিতে পরেননি। জার্মান নেত কাল মার্কস সমাজতন্ত্র প্রচার করেন। কিন্তু গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা দিতে পারেননি। মুজিববাদে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র বিধস্ত হয়েছে। সুতরাং এ হচ্ছে বিশ্বের তৃতীয় মতবাদ।
এই ‘মুজিববাদ’ই পরে আওয়ামী লীগে সৃষ্টি করে অন্তর্বিরোধ। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এর বিরোধিতা করে বলেন, “বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চাই, খাঁটি সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবে বাংলাদেশে অন্য কিছু হবে নয়।’ (দৈনিক বাংলা ২-৪-৭২)।
মুজিববাদ প্রতিষ্ঠার জন্য ইতিমধ্যে গড়ে উঠতে থাকে মুজিববাদ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, বেসামরিক লাঠিয়াল বাহিনী, জয় বাংলা বাহিনী, লাল বাহিনী প্রভৃতি।
অন্যদিকে ৭২-এর ১২ মে ছাত্রলীগের চার নেতা প্রকাশ্যে ভাগ হয়ে যান এই মুজিববাদ প্রশ্নেই। আ স ম আব্দুর রব ও শাহজাহান সিরাজ একদিকে। অন্যদিকে আব্দুল কুদ্দুস মাখন ও নুরে আলম সিদ্দিকী। রবরা চাইলেন বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র কায়েম করতে হবে। শেষেক্ত দু’জন বললেন, মুজিববাদই প্রতিষ্ঠা করব।
মুজিববাদ ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা নিয়ে বিতর্ক এখন জমে উঠছে তুই ছাত্রলীগ (রব) ও শ্রমিক লীগ ‘৭৫ সালের নির্বাচিত গণপরিষদ ভেঙ্গে দিয়ে সর্বদলীয় বিপ্লবী সরকার গঠনের আহ্বান জানায়। শুধু তাই নয় ৭২ সালের ৩ মার্চে এক ভাষণে রব বলেছিলেন জীবনের সকল ক্ষেত্রে আমুল পরিবর্তনের জন্য জাতি কেবল আর একটি বিপ্লবের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। বেশ কিছু সরকারি আমলা ও শিল্পপতি এবং আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের লোকজন পরবর্তি বিপ্লবের জন্য আমাদের প্রস্তুতির বিরুদ্ধে চক্বান্ত করে চলেছে। ২৩ মে আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান ও আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক দিন অরিখ দিয়ে বলেন, ‘৭ জুন থেকে মুজিববাদ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম শুরু হবে। ১৩ জনের ছাত্রলীগের (অস্পষ্ট) বলা হয় মুজিববাদের ভিত্তিতে দেশের ভবিষ্যত শাসন তৈরী করতে হবে। ১৬ জুলাই ঢাকায় ছাত্রলীগ (মাখন-সিদ্দিক) সভায় প্রস্তাব করা হয় ‘মাওবাদী বিভ্রান্ত নেতৃত্বে সিআইএ এজেন্ট দল ছাত্রলীগ নামধারী বিভ্রান্ত নেতৃত্ব পলাতক আল-বদর, আল-শামস, রাককার, শান্তিকমিটি, তিন মুসলিম লীগ,জামাত, নেজাম, জমিয়তে ওলামায়, পিডিপিসহ, (অস্পষ্ট) সংগঠনগুলোর (অস্পষ্ট) মুজিববাদ প্রতিষ্ঠার বিরাট বানাচাল করতে চায়। এর পর ৩১ জুলাই আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কমিটিতে সকল ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে মুজিববাদ কায়েমের শপথ নেয়া হয়। ২০ আগস্ট রাজ্জাক বলেন,
বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র ধার করা আদর্শ এবং মাওবাদী চক্রান্ত। এর আগে ১২ আগস্ট অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ভাওয়ালে বলেন, ‘ সমাজতন্ত্রের প্রতি বাধা এলে গণতন্ত্র ত্যাগ করবো।’
মুজিববাদ নিয়ে এভাবেই আওয়ামী লীগের মধ্যে ক্রমশঃ অন্তর্বিরোধ বাড়তে থাকে। বিরোধ যত প্রকট হতে থাকে বিরোধীদের ওপর মুজিববাদীদের হামলাও তত বাড়তে থাকে। নির্যাতনের অভিযোগ আনে ছাত্রলীগ (রব-সিরাজ), কাজী জাফর আহমদ ও ভাসানী ন্যাপ। ‘৭২-এর ১২ জুলাই ছাত্রলীগ (রব-সিরাজ) এক বিবৃতিতে অভিযোগ করে বলে ছাত্রকর্মী ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে পুলিশী নির্যাতন চলছে।
২১ জুলাই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ও পল্টনে অনষ্ঠিত হয় দুই ছাত্রলীগের পৃথক পৃথক সম্মেলন। সোহরাওয়ার্দী উদ্দানে সম্মেলনের আয়োজন করে ছাত্রলীগ (মাখন-সিদ্দিকী)। এটি উদ্বোধন করেন শেখ মুজিবর রহমান। এখানে মুজিববাদ প্রতিষ্ঠার পুনঃ সকল্প ঘোষণা করা হয়। ছাত্রলীগের (রব-সিরাজ) সম্মেলন হয় পল্টনে। এখানে আ স ম আব্দুর রব বলেন, শ্রেণী শত্রু খতম করে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হবে। কার্ল মার্কসের পর সমাজতন্ত্রের কোনো নতুন সংজ্ঞা কেউ দিতে পারে না। সমাজতন্ত্র সম্পর্কে তার সিদ্ধান্তই চুড়ান্ত এবং আমাদের দেশে এই সমাজতন্ত্রই কায়েম করা হবে। মুজিববাদ কোন সমাজতান্ত্রিক রুপরেখা নয়।
আওয়ামী লীগের এই বিতর্কে শেখ মজিবুর রহমান এর আগ পর্যন্ত ছিলেন নিরপেক্ষ অথবা দ্বৈত। কিন্তু এ সম্মেলনেই তিনি প্রথম প্রকাশ্যে মুজিববাদীদের প্রতি তার অকুন্ঠ সমর্থন জানান।
এরপর রব-সিরাজ ও মেজর জলিলের নেতৃত্বে জলিল ও রবকে যুগ্ম আহবায়ক করে ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর আওয়ামী লীগের ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের অনুসারীরা গঠন করেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল। তাঁরা ঘোষণা করেন বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রই তাদের লক্ষ্য।
হত্যা, খুন, রাহাজানী
ক্ষমতার দ্বন্দের ওপর কাঠামোয় যখন চলছে বিতর্ক, তখন সাধারণ মানুষ বিনিদ্র রজনী কাটাচ্ছে খুন, হত্যা, রাহাজানীর আতঙ্কে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রবাসী সরকার দেশে ফেরার পূর্ব পর্যন্ত সবচেয়ে অনিশ্চিত ও নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থার মধ্যেও দেশ ছিল শান্ত। কিন্তু এর পরই কমবর্ধমানহারে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে থাকে। শুরু হয় অস্ত্রের মুখে অর্থ সম্পত্তি দখল করে নেয়া প্রতিশোধ গ্রহণ করা এবং প্রকাশ্য দিবালকে পিটিয়ে হত্যা—নিয়মিত ঘটনায় এসে দাঁড়ায়। গ্রামে গঞ্জে চুরি ডাকাতিও বেড়ে যায়। কায়েম হয় বিভিষিকা আর সন্ত্রাসের রাজত্ব।
৭২ সালে যে সুত্রপাত ঘটে ৭৩-এ এসে তা ভয়াবহ রুপ নেয়। ৭৩ সালের ৫ জুলাই সংসদে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানান – গোটা দেশে গুপ্ত হত্যার শিকার ২০৩৫ জন। ‘৭২ সাল থেকে ৭৩-এর মে মাস পর্যন্ত ১৭ মাসে দুষ্কৃতকারীর হাতে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৪১২৫ জন। এই সময়ের মধ্যে হামলা ও লুট হয় ৬০টি থানা। ১ আগস্ট স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানান সুচক থেকে লুট হয়েছে ৪০ লাখ টাকা। ২১ সেপ্টেম্বর সংসদে জানানো হয় এই ব্যাঙ্ক লুটের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৯ লক্ষ টাকায়।
এই ব্যাঙ্ক লুটের অঙ্কের বাইরে রয়েছে ছিনতাই, রাহাজানী ও ডাকাতির টাকার অঙ্ক। লুট হয়েছে টেক্সটাইল মিলের দেড় লাখ টাকার সুতো।
জীবন হননের প্রকিয়া চলে সাধারণ মানুষ থেকে রাজনীতিবিদ, কেরানী, পথচারী, ছাত্র, শিক্ষক পুলিশ সকলের জীবন পর্যন্ত। রাজধানীর রাজপথ থেকে গ্রামের মেঠো পথ সর্বত্র হননের গতি ছিল অবারিত। মোট কথা দেশের সমগ্র জনগণের জীবন চলে আয় এক অনিশ্চয়তার মাঝে।
এখানে উল্লেখ্য, দেশে যখন এই ভয়াবহ তান্ডব চলছে তখন মুজিববাদের’ ম্যাণ্ডেটের নির্বাচন হচ্ছে, রক্ষী বাহিনী সংগঠিত করা হয়েছে বিরোধীদের ওপর নির্যাতন হয়েছে। কিন্তু না করতে তৎকালীন সরকার ব্যর্থ হয়েছেন তা হচ্ছে জনগণের জীবনের নিশ্চয়তা দিতে। এমনকি শেখ মুজিবও আক্ষেপ করেছেন, দেশে মানুষ শান্তিতে ঘুমাতে চায়। কিন্তু তিনি তা নিশ্চিত করতে হয়েছেন সম্পূর্ণ ব্যর্থ। এখানে উল্লেখ্য, বিচিত্রা ৭৩ সালকে চিহ্নিত করেছিল হত্যার বছর হিসেবে এবং আলোচিত চরিত্র করেছিল আততায়ীকে।
নির্বাচন ৭৩
মুজিববাদ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় নিয়ে শেখ ফজলুল হক মনির নেতৃত্বে ৭২-এর ১১ নবেম্বর গঠিত হয় আওয়ামী যুবলীগ। এর পর ৭২ সালেরই শেষের দিকে নির্বাচনের দিন ঘোষণা করা হয় ৭৩-এর সাতই মার্চ। এদিকে ৭৩-এর পহেলা জানুয়ারী মস্কোপন্থী ছাত্র ইউনিয়নের ভিয়েতনাম দিবস উপলক্ষে মার্কিন তথ্য কেন্দ্রের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শনকালে পুলিশের গুলীতে দু’জন ছাত্র প্রাণ হারায়। এর প্রতিবাদে পরদিন হরতাল পালিত হয় সারাদেশে। প্রতিবাদে রাস্তায় বেরিয়ে আসেন সাধারণ মানুষ। স্বাধীন দেশে বর্বরোচিত এই হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে মানুষের স্বতঃস্ফুর্ত প্রতিবাদকে নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত বলে অভিহিত করে আওয়ামী লীগ।
৭ মার্চ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর ৮ মার্চ নির্বাচনের ফলাফল জানানো হয়। মোট তিনশ’ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ পায় ২৯১টি আসন। অন্যদের মধ্যে ছিল জাতীয় লীগ একটি (আতাউর রহমান), মোজাফফর ন্যাপ ১টি (সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত) জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল লাভ করে ১টি এবং নির্দলীয়রা পায় ৫টি আসন।
নির্বাচনের ফলাফল যাই হোক না কেন এর নিরপেক্ষতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করা হয় আগে থেকেই। নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ আনা হয়। এছাড়াও নির্বাচনের আগে থেকেই সারা দেশে ত্রাসের রাজত্ব কয়েম করা হয়। এর আগে ৭২ সালের ৪ নবেম্বর ৭০ সালে নির্বাচিত সংসদে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান গৃহীত হয়। এতে ধর্মঘট নিষিদ্ধ ও বিনা বিচারে আটক আইন বহাল থাকে।
নির্বাচনের বিরোধী দলগুলোর দাবি ছিল বর্তমান মন্ত্রী সভার পদত্যাগ করতে হবে। কিন্তু তা হয়নি। বরং মনোনয়নপত্র দাখিল নিয়ে অভিযোগ আসতে থাকে প্রচুর। ৫ ফেব্রুয়ারী জাসদ অভিযোগ করে, বিভিন্ন স্থানে তাদের প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র দাখিল করতে দেয়া হয়নি। খবর আসতে থাকে হত্যাকাণ্ডের। ৪ মার্চ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল অভিযোগ করে যে, ক্ষমতাসীন দল ত্রাস সৃষ্টি করে নিয়ন্ত্রিত দল ও একদলীয় শাসন কায়েমের চেষ্টা করছে।”
এ নির্বাচনে কতটা কারচুপি হয়েছিল তার প্রমাণ মিলবে সে সময়কার সংবাদপত্রের পাতায়। এ সম্পর্কে ৯ মার্চ (৭৩) এক সাংবাদিক সম্মেলনে মোজাফফর ন্যাপ জানান যে কমপক্ষ ৭০টি আসনে বিরোধী দলের প্রার্থীদের বিজয়ের সম্ভাবনা ছিল।
আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করে ও বিভিন্ন অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপের মাধ্যমে নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করেছে। তারা ভুয়া ভোট দিয়েছে, এজেন্ট অপহরণ কমেছে, মৃত ব্যক্তির নামে ভোট কাস্ট করা হয়েছে। বিরোধী দলগুলো অভিযোগ করে যে যেখানেই দেখা গেছে যে, ভোট গণনায় বিরোধীরা এগিয়ে আছে, সেখানেই গণনা বন্ধ করে কেন্দ্র থেকে ব্যালট বাক্স থানা হেড কোয়ার্টারে নিয়ে আসা হয়েছে এবং পরে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে জয়ী ঘোষণা করা হয়েছে।
৯ মার্চ তারিখে আতাউর রহমান খান এই নির্বাচনকে ‘এক দুঃস্বপ্নের অভিজ্ঞতা বলে অভিহিত করেন। একই অভিযোগ করেন ডঃ আলীম আল-রাজীও।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারেও মুজিববাদের পক্ষে চাওয়া হয়েছে ম্যান্ডেট। নির্বাচনের মুল লক্ষ্য ছিলো যে কোন প্রকারে এই ম্যান্ডেট আদায় করা।
চোরাচালান/মজুতদারি /(অস্পষ্ট)
বাংলাদেশে ১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচনে ম্যান্ডেট আদায়ের পর রাজনৈতিক হোমরা-চোমরা ব্যাক্তিদের ছত্রছায়ায় দেশ থেকে পাচার হয়ে যেত থাকে শত শত কোটি টাকার পণ্য। পাচায় হয়ে যায় একমাত্র বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী সম্পদ-পাট। পাচার হয়ে যায় বাংলাদেশের মানুষের মুখের গ্রাস চাল ধান। আর এই চোরাচালানের ওপর ভরসা করে ভারত সচল হয় সীমান্তের পাকল। সরকার সেই দৃশ্যে শুধু তাকিয়েই দেখেন। একই সময়ে ৭৪ সালে দেশে যে বন্যা হয়, তারও সুযোগ গ্রহণ করেন শাসকবর্গ। এই বন্যার পর রিলিফ সামগ্রী হিসেবে আসা কোটি কোটি টাকার পণ্য আত্মসাৎ করে কর্তাব্যক্তিরা। অর্থনীতিবিদগণ বলেছেন, ৭২ থেকে ৭৫ পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকার সম্পদ বাইরে পাচার হয়ে গেছে।
এই চোরাচালানের পাশাপাশি ম্যান্ডেটধারীরা গড়ে মজুতের পাহাড়। দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত রিপোর্টে দেখা যায়। পুলিশ বলেছে, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মজুত আছে জানি, কিন্তু ধরার ক্ষমতা নেই আমাদের। মজুত বিরোধী আইন-আদেশ জারি করা হয়েছে লোক দেখানোর জন্য। কিন্তু সেই আইনে পুলিশ রাঘর বায়াল ধরতে পারেনি। সরকারী ছত্রছায়ায় মজুতদারীরা নতনে নতুন পণ্য মজুত করতে শুরু করে। দাররা, অশানেয়া প্রকাশ্যে। সবচেয়ে বড় নজির স্থাপন করে লবণ মজুত করে। তারা লবণের সের করেছিলেন ৩২ টাকা পাক-ভারত-বাংলাদেশের ইতিহাসে এটি এখন পর্যন্ত একটি অনতিক্রমনীয় রেকর্ড।
এই অবস্থাকে সামনে নিয়ে আসে ৭৪-এর ভয়াবহ মন্বন্তর। শাসকগোষ্ঠী সুষ্ট সেই দুর্ভিক্ষে বাংলাদেশের ছয় লক্ষ মানুষকে অসহায়ভাবে প্রাণ দিতে হয়। প্রতিদিন হাজার হাজার লাঙ্গলচষা মানুষে গ্রাম থেকে দেশের শহরগুলোতে অন্নের আশায় বস্ত্রের আশায় আসতে থাকেন। সে সময় রাস্তায় রাস্তায় দেখা যায় বেওয়ারিশ লাশ।
এই দুর্ভিক্ষ মোকাবিলার জন্য লাখ লাখ মণ খাদ্যশস্যদেয়া হয়েছিল। কিন্তু তা রিলিফ ক্যাম্পগুলোতে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত মাথাপিছু এক টাকা করেও পৌছেনি। আত্মসাৎ হয়েছে। পাচার হয়ে চলে গেছে প্রতিবেশী রাষ্ট্রে। এই সময় সারাদেশে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতিরও মারাত্মক অবনতি ঘটে। খাদ্য প্রতিমন্ত্রী আগস্টে (৭৪) জানান, যে বন্যায় প্রায় এক কোটি লোক গৃহহীন হয়েছে। ‘ভয়াবহতা আরো প্রকট হয়। সারাদেশে ৫৭৫৭টি লঙ্গরখানা খোলর নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু অস্বাস্থ্যকর খাবার সরবরাহের ফলে লঙ্গরখানাগুলোতে মহামারী দেখা দেয়। ঢাকার রাস্তা থেকে আঞ্জুমান মফিদুল ইসলাম প্রতিদিন গড়ে ৫০টি করে বেওয়ারিশ লাশ দাফন করে।
পরে বিঅইডিএস (বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ)-এর এক জরিপে দেখা গেছে রংপুরে ৭৪-এর দুর্ভিক্ষে যারা প্রাণ হারিয়েছে তাদের বেশির ভাগই ছিলেন হয় ক্ষেত মজুর অথবা স্বল্প জমির মালিক। বিভিন্ন জেলার আটটি লঙ্গরখানা জরিপ করে বিআইডিএস দেখেছেন যে লঙ্গরখানায় আশ্রয়গ্রহণকারীদের শতকরা ১৭৮৯ ভাগ ছিল দরিদ্র চাষী, শতকরা ৪৪৯২ ভাগ কৃষিশ্রমিক ২০.৪৩ ভাগ অকৃষি মজুর এবং বাকী অন্যান্য ১৬.৪৩ ভাগ। যাদের সাড়ে সাত একর জমি ছিল, তাদের মধ্য থেকৈ মাত্র শতকরা পাঁচ ভাগ লোক লঙ্গরখানায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। যাদের আড়াই একর থেকে পাঁচ একর জমি ছিল তাদের মধ্য থেকে শতকরা ২৬ ভাগ লঙ্গরখানায় আশ্রয় নিয়েছিল। লঙ্গর থানায় আশ্রয় গ্রহণকারীদের শতকরা ৬ জন তাদের সমস্ত জমি বিক্রি করে ফেলেছিলেন, শতকরা ৭ জন তাদের জমির ৫০ ভাগ থেকে ১০০ ভাগ কি ছিলেন, ১৫ ভাগ লোক তাদের মোট জমির ৫০ ভাগ বিক্রি করে দিয়েছিলেন। শতকরা ৫২ জন জমি ছাড়াও অন্যান্য সম্পদ বিক্রি করেছিলেন। লঙ্গরখানার হিসাব মতে শতকরা ৮৪টি পরিবার তাদের সর্বস্ব খুইয়ে ছিন্নমুলে পরিণত হয়েছেন। গোটা উত্তরবঙ্গে এই সমস্যা ছিল সবচেয়ে প্রকট।
বেসরকারী হিসেব মতে ৭৪-এর আওয়ামী লীগ সৃষ্ট মন্বন্তরে মৃতের সংখ্যা ৬ লাখেরও বেশি। আওয়ামী সরকার প্রথমে বলেছিল সকারের কাছে, দুর্ভিক্ষে মৃত্যুর কোনো হিসেব নেই। পরে বলেছেন ২৭ হাজার। এই দুর্ভিক্ষ, বেওয়ারিশ লাশের জন্য বিচিত্রা এ বছর দায়ী করেছিল স্মাগলারকে এবং এ বছরের আলোচিত চরিত্র ছিল স্মাগলার।
বিশেষ ক্ষমতা আইন/জরুরী ক্ষমতা আইন
এই দুর্ভিক্ষের সময় সরকারের বিরুদ্ধে সারাদেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। প্রতিবাদের মুখে এদের চরিত্রও স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হতে থাকে। এর সুচনা হয়ছিল ১৯৭৩ সালেই। ৭৩. এর ২০ সেপ্টেম্বর সংসদে নিবর্তনমূলক আটক আইন জারি করার ক্ষমতা দেয়া হয় রাষ্ট্রপতিকে। আইয়ুব আমলে এই আটক আইনে সাজা পেয়েছিলেন শেখ মুজিবর রহমান নিজে সাজা গেয়েছিলেন তাজউদ্দীন আহমদও।
১৯৭৪ সালের ২৮ জানুয়ারী আওয়ামী লীগের বর্তমান সভাপতি ও তৎকালীন স্পীকারের নেতৃত্বে সংসদে পাস হয় রক্ষী বাহিনী বিল। এতে পুলিশ বাহিনীকে ওভারটেক করে রক্ষীবাহিনী অফিসারদের বিন ওয়ারেন্টে যে কোনো স্থানে তল্লাশী এবং যে কোনো লোককে আটক করার ক্ষমতা দেয়া হয়।
এপর ৭৪ সালেই পাচই ফেরুয়ারী আবদুল মালেক উকিল সাহেবরই পৌরোহিত্য সংসদে পাস হয় আর এক কলা-কানুন বিশেষ ক্ষমতা আইন। যার অন্তর্ভুক্ত ছিল নিবর্তনমূলক আটক আইন আর প্রেস সেন্সরশীপ। দু’টি আইনই ছিল গণবিরোধী।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল এর প্রতিবাদে ৮ ফেব্রুয়ারী। এক সভা ডাকে পল্টনে। আওয়ামী লীগের রক্ষাবাহিনী এবং বেসামরিক বাহিনী সেই মিছিলে যে হামলা চালায় তার সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় পরের দিনের দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায়। তারপর ১০ মার্চ (৭৪) জাসদ আর একটি সভা ডাকে পল্টনে। হামলা চলে এখানেও একই কায়দায়।
ইতিমধ্যে জানুয়ারী মাঝামাঝি থেকে পর্যায়ক্রমে সারা দেশে ১৪৪ ধারা জারি করে মিছিল সমাবেশের সকল পথ রথ কয়ে দেয়া হয়। গণকণ্ঠসহ অনেকগুলো পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়া হয়।
এসময় অরাজকতা দমনের নামে বিভিন্ন বাহিনীর পরেও গঠন করা হয় গ্রামরক্ষীবাহিনী। ৭৩ সালের ২৩ অ’ক্টাবর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মালেক উকিল জানিয়ে দেন যে গ্রামরক্ষী দল গঠনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। প্রত্যেককে একটি করে শটগান দেয়া হবে। কাজের মেয়াদ শেষ হলে এসব অস্ত্র থানায় জমা দেয়া হবে।…এ ব্যাপারে মহকুমা হাকিমের অনমোদন সাপেক্ষে স্থানীয় প্রভাবশালী ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি এবং এমপির সঙ্গে আলোচনা করে গ্রামরক্ষী দল গঠনের জন্য ওসির প্রতি নিদেশ দেয়া হয়েছে। কেবল এই বাহিনী গঠনই নয় জনাব মালেক ৩১ ডিসেম্বর (৭৩) ঘোষণা করেন যে, দেশের আইন শঙ্খলা রক্ষার্থে প্রয়োজনবোধে আওয়ামী স্বেচছাসেবক বাহিনীর হাতে অস্ত্র দেয়া হবে। এর পর অভিযোগ ওঠে ৩০ হাজার নাগরিক খুনের।
১৯৭৪ সালের ২৯ অক্টোবর সারাদেশে ধর্মঘট নিবন্ধ ঘোষণা করা হয়। ১৯৭৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর জারি করা হয় জরুরী ক্ষমতাবিধি। ৬ জানুয়ারী তাঁরা ঘোষণা করেন যে, সরকারী কর্মচারীরা সমবায় সমিতি ছাড়া অন্য কোনো সংগঠনের সদস্য হতে পারবে না। এ ঘোষণার মধ্য দিয়ে সরকরী কর্মচারীরা হারান তাদের ট্রেড ইউনিয়ন করার জাতিসংঘ স্বীকৃত অধিকার।
জরুরী আইন জারির ৪ দিনের মধ্যেই সর্বহারা পার্টি নেতা সিরাজ সিকদার হত্যাকাণ্ড জনমনে ত্রাস সৃষ্টি করে।
বাকশাল
আসলে এই জরুরী আইনই ছিল পরবর্তীকালের বাকশাল’ সৃষ্টির পর প্রস্তুতি। ১৯৭৫ সালের ২০ জানুয়ারী জাতীয় সংসদের কলংকিত অধিবেশন বসে। গণতন্ত্র সমাহিত রাগ যজ্ঞ সমাপ্ত হয়। ২৫ জানুয়ারী ৭৫ পাস হয়ে যায় সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী। সংসদের এক বেলার অধিবেশনে জারি হয়ে যায় সংসদীয় গণতন্ত্রের বদলে প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতির সরকার। কায়েম হয় একদলীয় সরকার।
চতুর্থ সংশোধনীতে বলা হয: আইন প্রণয়নের অব্যবহিত পূর্বে যিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন, তিনি রাষ্ট্রপতির পদে থাকবেন না এবং রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হবে। শেখ মুজিবর রহমান বাংলাদেশের রাস্ট্রপতি হবেন এবং রাষ্ট্রপতির কার্জভার গ্রহন করবেন এবং উক্ত আইন প্রবর্তন হতে তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির পদে বহাল থাকবেন। যেন তিনি এই আইনের দ্বারা সংশোধিত সংবিধানের অধীনে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছেন।
আওয়ামী লীগের অবস্থা এমনই সংগীন হয়েছিল যে আইন বলে শেখ মুজিব প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে গেলেন।
সংশোধনীতে আরও বলা হয়। রাষ্ট্রপতিকে তার দায়িত্ব পালনে সাহায্য ও পরামর্শ দানের জন্য একটি মন্ত্রীপরিষদ থাকবে। রাট্রপতি তার বিবেচনায় সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে কিংবা সংসদ সদস্য হওয়ার যোগ্য এরুপ ব্যক্তিদের মধ্য হতে একজন প্রধানমন্ত্রী ও আবশ্যক মনে করলে অন্যান্য মন্ত্রী প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী নিয়োগ করতে পারবেন। রাষ্ট্রপতি মন্ত্রীপরিষদের সভায় সভাপতিত্ব করবেন অথবা তার নির্দেশে উপরাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রীসভায় সভাপতিত্ব করবেন। মন্ত্রিগণ রাষ্ট্রপতির সন্তোষ অনুযায়ী সময়সীমা পর্যন্ত স্বীয় পদে বহাল থাকবেন। চতুর্থ সংশোধনীতে উলেখ করা হয় যে, কোনো ব্যক্তি জাতীয় দল (বাকশাল) ছাড়া অন্য কোনো রাজনৈতিক দল গঠন করতে কিংবা এর সদস্য হতে অথবা কোনো রাজনৈতিক কার্যকলাপে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না।’
নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী শেখ মুজিবর রহমান ৭৫-এর ২৪ ফেব্রুয়ারী এক আদেশ বলে দেশে একটি মাত্র রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ বা বাকশাল গঠন করেন এবং নিজেকে এর চেয়ারম্যানও যোষণা করেন।
ঘোষণার ৩ নং আদেশে বলা হয় ‘রাষ্ট্রপতি অন্য কোনো নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত জাতীয় সংসদের অবলুপ্ত আওয়ামী লীগ দলীয় সকল সদ্য মন্ত্রীপরিষদের সদস্যবৃন্দ প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীবৃন্দ বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের সদস্য বলে বিবেচিত হবেন। এবং ঘোষণা করা হয় যেসব সংসদ সদস্য বাকশালে যোগ দেবেন না তাদের সদস্যপদ খারিজ হয়ে যাবে।
বাকশাল অন্যান্যের মধ্যে যোগ দেন আতাউর রহমান খান মোজাফর আহমদ, হাজী দানেশ প্রমুখ। এই স্বৈরতান্ত্রিক ও চিরস্থায়ী শাসন কায়েমের পক্ষে ১৬ জন ৭৪ দেশে চারটি মাত্র সংবাদপত্র আর সকল সংবাদপত্রের ডিক্লারেশন বাতিল করা হয়।
১৫ আগষ্ট ‘৭৫
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট এবং মাত্র কয়েকমাস আগে গঠিত একদল বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের অর্থাৎ বাকশালের চেয়ারম্যান শেখ মুজিব এক সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হন। সামরিক আইন জারি হয় এবং ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বাধীন বাকশালেরই এক অংশ। প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন বাকশালী প্রাক্তন মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদ। ভাইস প্রেসিডেন্ট হন বাকশাল গঠন পর্যন্ত যিনি আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রেসিডেন্ট এবং পরবর্তীকালে মন্ত্রী মুহম্মদউল্লাহ। মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন বাকশাল মন্ত্রী ও প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট আবু সাঈদ চৌধুরী, বাকশালী মন্ত্রী অধ্যাপক ইউসুফ আলী ফণিভূষণ মজুমদার; মনোরঞ্জন ধর আবদুল মোমিন তালুকদার আসাদুজ্জামান, এ আর মল্লিক, ডঃ মোজাফফর আহমদ চৌধুরী, আবদুল মান্নান ও সোহরাব হোসেন। প্রতিমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন বাকশালের শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, দেওয়ান ফরিদ গাজী, তাহেরউদ্দিন ঠাকুর, নুরুল ইসলাম চৌধুরী। নুরুল ইসলাম মনজর ও কে এম ওবায়দুর রহমান। ২০ আগস্ট প্রতিমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন: মোসলেমউদ্দিন খান ডঃ ক্ষিতিশ চন্দ্র মণ্ডল, রিয়াজউদ্দিন আহমদ, সৈয়দ আলতাফ হোসেন ও মোমিনউদ্দিন আহমদ।
এ সময় সামরিক আইন জারি থাকলেও সংবিধান এবা সংসদ বলবত থাকে। সংসদের স্পীকার। থাকেন আবদুল মালেক উকিল।
এ সময় থেকে শুরু করে ১ নবেম্বর পর্যন্ত গুরত্বপণ যে ঘটনাগুলো ঘটে তার মধ্যে রয়েছে: প্রেসিডেন্টের মহা সচিব পদে মাহবুবুল আলম চাষীর নিয়োগ, ৭২ সালের প্রেসিডেন্টের ৯ নং আদেশ বাতিল, ইত্তেফাক ও সংবাদ মালিকের কাছে প্রত্যর্পণ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজুদ্দিন আহমদ, মনসুর আলী ও কামরুজ্জামানসহ ২৬ জনকে সামরিক আইনবিধি বলে আটক, সেনাবাহিনী প্রধান পদে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের নিয়োগ, কেবিনেট ডিভিশনের নয়া সচিব হিসেবে শফিউল আজমের নিয়োগ, প্রস্তাবিত ৬১টি জেলা প্রশাসন ব্যবস্থা, একদলীয় ব্যবস্থা ও বাকশাল পাটি বাতিল। গাজী গোলাম মোস্তফা গ্রেফতার, রাজনৈতিক দল ও কর্যকলাপ নিষিদ্ধ, সাপ্তাহিক হলিডের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার, অস্ত্র আইনে টিপু বিশ্বাসসহ ৬ জনকে ১৪ বছর করে ও ১ জনের ৭ বছর কারাদণ্ড দেয়া হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য যথাক্রমে ডঃ আবদুল মতিন চৌধুরী ও ডঃ মাজহারুল ইসলামকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দান; ডঃ মাজহারুল ইসলাম গ্রেফতার হন দুনীতির অভিযোগে জাতীয় রক্ষীবাহিনীকে সেনাবাহিনীভুক্ত করা হয়, বিমান বাহিনী প্রধান পদে এয়ার ভাইস মার্শাল এম জি তোয়াব নিয়োগ।
৩ নবেম্বর এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ সেনাবাহিনীর চীফ অব আর্মি স্টাফ নিযুক্ত হন এবং মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হন। ৪ নবেম্বর কারাগারে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজদ্দিন আহমদ, মনসুর আলী ও কামরুজ্জা মান নিহত হন। এ সময়টাতে সারাদেশে থমথমে অবস্থা বিরাজ মান ছিল। গজব ছিল মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান গৃহবন্দী।
৫ নবেম্বর প্রেসিডেন্ট মোশতাক বিচারপতি সায়েমের সপক্ষে প্রেসিডেন্ট পদে পদত্যাগ করবার ইচ্ছে প্রকাশ করেন, ৬ নবেম্বর বিচারপতি সায়েম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ। করেন। জাতীয় সংসদ বাতিল এদিকে বাকশালী বিভিন্ন শক্তির পুনরুত্থান আ বার সুস্পষ্ট হয়ে উঠে। ৬ই নবেম্বর রাতে দেশের বিন্নি সেনানিবাস থেকে কয়েক ব্রিগেড সৈন্য ঢাকায় চলে আসেন এবং জিয়াকে মুক্ত করেন।
৭ নবেম্বর ‘৭৫
জিয়ার নেতৃত্বে সংঘটিত হয় ৭ নবেম্বরের ঐতিহাসিক সিপাহী জনতার অভ্যুথান। এ অভ্যুত্থান সকল প্রকার বৈদেশিক আধিপত্য থেকে দেশকে মুক্ত করার লক্ষ্যে স্বতঃস্ফুর্তভাবে সংঘটিত হয়েছিল। মেজর জেনারেল জিয়া পুনরায় সেনাবাহিনী প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই অভ্যুধানে কর্নেল তাহেরেরও নামও জড়িত ছিল। ৬ নবেম্বর রাতে এক সংঘর্ষে নিহত হন। মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফসহ কয়েকজন অফিসার। খালেদ মোশাররফের এই আগমন উল্কার সঙ্গে তুলনীয়। প্রেসিডেন্ট সায়েম প্রেসিডেন্ট এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসবে বহাল থাকেন। তিনজন উপ-সামরিক শাসনকর্তা হিসেবে। তিনবাহিনী প্রধান নিযুক্ত হন।
৭ এবং ৮ নবেম্বর জাসদ-এর মেজর (অবসরপ্রাপ্ত) এম এ জলিল, আ স ম আবদুর রব, জামাতে ইসলামীর সৈয়দ ফরিদ আহমদ, ন্যাপ-এর খন্দকার মো চৌধুরী বাকশাল-এর তাহের ঠাকুর শাহ মোয়াজ্জেম জাসদের আবদুল আউয়াল মোহাম্মদ শাহজাহান, সুলতান মীর্জার মুক্তি লাভ। ২৬ নবেম্বর প্রেসিডেন্ট সায়েম উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করেন। তাতে যোগ দেন অধ্যাপক আবুল ফজল, উঃ আবদুর রশীদ, ডঃ এম এন হুদা প্রমুখ। ২৬ নবেম্বর ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনারকে অপহরণের চেষ্টা ব্যর্থ হয়, পলিশের গুলীতে দু’জন নিহত এবং দু’জন গ্রেফতার হন। এরা জাসদের কর্মী বলে শনাক্ত করা হয়।
৩০ ডিসেম্বর সরকার ২৪টি পত্রিকা ও সাময়িকী প্রকাশের পুনরাদেশ দেন।
১৯৭৬: ভারতীয় আগ্রাসন ও ফারাক্কা মার্চ
১৯৭৬ সালের পর থেকে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত বাংলাদেশের জাতীয় অস্তিত্বের বিরুদ্ধে নানাভাবে হুমকি দিয়ে থাকে। সীমান্তে হামলা আন্তর্জাতিক নদী গঙ্গার পানি অবৈধ এবং নির্লজ্জভাবে প্রত্যাহার করে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করার চেষ্টা, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার ইত্যাদি মাধ্যমে ভারত শহর ভুমিকা পালন করতে থাকে। জানুয়ারী থেকেই বহুবার সীমান্তে হামলা চালানো হয়। জুন মাসে যখন বাংলাদেশ-ভারত উচ্চ পর্যায়ের। বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে সে সময় মাধবপুরে সীমান্তে অনুপ্রবেশ করে ভারতীয় সীমান্তবর্তী বাহিনীর সদস্যরা ২৪ জন বা’লাদেশী নাগরিককে অপহরণ করে নিয়ে যায়। সে সময় সারা দেশে এ হামলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সোচ্চার হতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধা সংসদের আহ্বায়ক সে সময় মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে বলেন… | ‘যারা মনে করেন যে স্বাধীনতা কার দান তার আহাম্মকের স্বর্গে বাস করছেন। এরপর অগস্ট সেপ্টেম্বর এবং পরবর্তী সময় বছরের শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে সীমান্তে হামলা চলে। এ বছর হামলা চালানো হয় মোট ১৩১৬টি। ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে ভারত অবৈধ ভাবে পানি প্রত্যাহার করায় উত্তরবঙ্গে বিরাট এলাকায় নদী শুকিয়ে চর পড়ে যায়, কয়েকটি নদীতে নৌচলাচল বন্ধ হয়ে পড়ে। লবণান্ততা বৃদ্ধিতে এবং পানির অভাবে বাংলাদেশের সামগ্রিক প্রতিবেশের উপর চরম বিপর্যয় নামার আশঙ্কা দেখা দেয়। ফারাক্কার মাধ্যমে গঙ্গার ৫৫,০০০ কিউসেক পানির মধ্যে ৪০.০০০ কিউসেক পানি প্রত্যাহারের অবৈধ কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণের মধ্য থেকে সচেতন প্রতিরোধের প্রকাশ ঘটে।
১৬ মে তে অনুষ্ঠিত হয় ঐতিহাসিক ফারাক্কা মহামিছিল। রাজশাহী মাদ্রাসা ময়দান থেকে কানসার্ট পর্যন্ত প্রায় ৬০ মাইল পথের এই মহামিছিল। এই মহামিছিলে অংশ নেন লক্ষ লক্ষ সচেতন বাংলাদেশী। এই মহামিছিলে নেতৃত্ব দান করেন মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী। আগস্ট মাসে বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে ফারাক্কা বিরোধের প্রশ্নটি সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে উত্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয় এবং নবেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের বিশেষ রাজনৈতিক কমিটির সর্বসম্মত ঘোষণায় বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে মন্ত্রীপর্যায়ের বৈঠকের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
রাজনৈতিক দলবিধি ৭৬
১৯৭৬ সালের ২৮ জুলাই প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক রাজনৈতিক দলবিধি ৭৬ জারি করেন। এই বিধি অনুসারে কোনো রাজনৈতিক দলকে তৎপরতা শুরুর আগে সরকারের কাছে তার লক্ষ্য উদ্দেশ্য ও কর্মসূচী সম্বলিত মেনিফেস্টো দাখিল করতে হয়। সরকারী অনুমোদন লাভের পর ঐ দল রাজনীতি শুরু করতে পারবেন। রাজনৈতিক দলবিধির শর্তমালা পূরণ করে ১৯৭৬ সালের নবেম্বর পর্যন্ত ৫৬টি দল অনুমোদনের আবেদন করে। বাকশাল চারটি দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এ সময় পর্যন্ত রাজনীতি করবার অনুমোদন পায় ২১টি দল। এর মধ্যে উল্লেখ যোগ্য দলগুলো হচ্ছে ইউনাইটেড পিপলস পার্টি, জাতীয় জনতা পার্টি, বাংলাদেশ পিপলস লীগ, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্মি (ভাসানী), বাংলাদেশ জাতীয় গণমতি ইউনিয়ন বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল বাংলাদেশ জাতীয় লীগ, বাংলাদেশ ডেমোক্র্যাটিক লীগ, জাতীয় দল বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মো), বাংলাদেশের কমিউনিষ্ট পার্টি (মনি সি) বাংলাদেশ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (আউয়াল), বাংলাদেশ ইসলামিক ডেমোক্র্যাটিক লীগ, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, গণমুক্তি পার্টি, বাংলাদেশ লেবার পার্টি, বাংলাদেশ কনভেনশন মুসলিম লীগ তফসিলী ফেডারেশন আওয়ামী লীগ প্রভৃতি।
জিয়াউর রহমান প্রেসিডেন্টঃ গণভোট
১৯৭৬ সালের ৩০ নবেম্বর মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল ভগ্ন স্বাস্থের পূরণে বিচারপতি এ এম সায়েম প্রেসিডেন্ট পদ থেকে পদত্যাগ করেন। মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ২২শে এপ্রিল প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এক বেতার ভাষণে ৩০শে মে সারাদেশে গণভোট এবং ৭৮-এর ডিসেম্বরে সংসদের নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেন। ৩০শে এপ্রিল প্রেসিডেন্ট জিয়া তাঁর ১৯ দফা কর্মসূচী ঘোষণা করেন।
৩০ মের গণভোটে প্রেসিডেন্ট জিয়া শতকরা ৯৮.৮৮টি আস্থাভোট অর্জন করেন। এ বছর প্রেসিডেন্ট জিয়া চীন, ইরান সৌদী আরব, মিসর, বার্মা, নেপাল, ভারত ও পাকিস্তান সফর করেন এবং কমনওয়েলথ সম্মেলনে যোগ দেন। প্রেসিডেন্ট এ সম্মেলনে দরিদ্র দেশগুলোর বিশেষ পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্যে ৫ দফা ফর্মূলা দেন।
এ বছরের সবচাইতে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে প্রেসিডেন্ট – কর্তৃক একটি রাজনৈতিক ফ্রন্ট খোলার ঘোষণা। এ বছরই সরকার রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপ চালানোর অভিযোগে বৈধ তিনটি রাজনৈতিক সংগঠনকে অবৈধ বলে ঘোষণা করেন।এগুলো হচ্ছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল ও ডেমোক্র্যাটিক লীগ।
২৮ সেপ্টেম্বর থেকে দীর্ঘ ১০৫ ঘন্টা ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে জাপানী একটি বিমান ছিনতাই করে আটকে রাখা হয়। এর মধ্যে একটি সামরিক অভ্যুত্থানের চেষ্টা হয়। সরকার দঢ়ভাবে তা মোকাবিলা করে।
১৯৭৮: ধর্মঘট, দলভাঙ্গা, নির্বাচন
১৯৭৮ সাল এ তিনটি ঘটনায় বিশেষভাবে বৈশিষ্ট্য মণ্ডিত ছিল বলে এ বছরকে বিচিত্রা, ধর্মঘট, দলভাঙ্গা এবং নির্বাচনের বছর বলে চিহ্নিত করেছিল।
এ বছরের ৩ জন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। বছরের একটি গুরত্বপূর্ণ ঘটনা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দুটো ফ্রন্ট গঠিত হয়, দুটো ফ্রন্ট থেকে দু’জন – প্রার্থী এ নির্বাচনে মুলতঃ প্রতিদ্বনিবতা করেন। প্রেসিডেন্ট
জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত হয় জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট। এতে যোগ দেয় জাগদল, ইউপিপি, ন্যাপ (ভাসানী). মুসলিম লীগ (শাহ আজিজ), লেবার পার্টি ও তফশিলী ফেডারেশন; ফ্রন্ট থেকে প্রাথী ছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নিজে। অন্য ফ্রন্টটির নাম ছিল গণঐক্যজোট; এতে যোগ দেয় আওয়ামী লীগ জনতা পার্টি পিপলস লীগ, গণআজাদী লীগ, ন্যাপ (মো), ন্যাপ (স্বতন্ত্র) ও তৎকালে নিষিদ্ধ ঘোষিত কমিউনিষ্ট পাটি (মনিসিং)। এই ফ্রন্টের প্রার্থী ছিলেন জেনারেল ওসমানী।
নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট জিয়া জয়লাভ করেন শতকরা ৬৮ দশমিক ২৬ ভাগ ভোট পেয়ে। এর বিপরীতে জেঃ ওসমানী পান ২৭ দশমিক ৫৬ ভাগ।
এ বছর পূর্ব বছরের ঘটনা অনুসরণ করে দল ভাঙ্গা তীব্রতর রূপ নেয়। জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট রপান্তরিত হয় জাতীয়তাবাদী দলে, এতে ফ্রন্টের শরীকরা আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে বিলীন হয়ে যায়। উল্লেখ্য যে এ বছরই ১লা মে থেকে ‘ঘরোয়া রাজনীতি থেকে খোলা রাজনীতি শুরু হয়। খোলা রাজনীতির ধাক্কায় আওয়ামী লীগ, সাম্যবাদী দল ইউপিপি, মুসলিম লীগ, ন্যাপ (ভাসানী) দ্বিধা কিংবা ত্রিধাবিভক্ত হয়। বর্তমানেও এধারা অব্যাহত রয়েছে।
ধর্মঘট অব্যাহত ছিল। ধর্মঘট আইনত নিষিদ্ধ থাকলেও তা ১৯৭৮ সালের প্রথম-সপ্তাহ থেকে শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত অব্যাহত থেকেছে। কল-কারখানা, অফিস আদালত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কোন কিছুই এর বাইরে ছিল না। ধাঙ্গড়রাও এ বছর তাদের ৪ দফা দাবি নিয়ে ধর্মঘট করে ধর্মঘট চালানোর সময় পুলিশ তাদের উপর লাঠিপেটা করে। উলেখযোগ্য ধর্মঘটগুলো অনুষ্ঠিত হয় বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ক, বিভিন্ন সরকারী বেসরকারী প্রতিঠান ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ছাত্র শিক্ষকদের মধ্যে। পেশাগত ভিত্তিতে ধর্মঘট এ বছর তুলনামূলকভাবে বেশি হয়। বিচিত্রা এ সময় ধর্মঘট বা কর্মবিরতি সম্পর্কে লিখেছে……’ কর্মবিরতি চালিয়ে যেতে কোন কোন ক্ষেত্রে কর্মচারীদের সহ্য করতে হয়েছে পুলিশী নির্যাতন, প্রতিদ্বন্দী কর্মচারী সমিতির হুমকি মাথা পেতে নিতে হয়েছে রাজারাষ। তবু কর্মবিরতি থামেনি।
এ বছর ১৭ই নবেম্বর বাতিল হয় রাজনৈতিক দলবিধি।
বছরের শেষ দিন ৩১ ডিসেম্বর ৭৮ সকালে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী ও কারারক্ষীদের মধ্যে এক সংঘর্ষে ৫০ জনেরও বেশি আহত হয়। ১৪ ডিসেম্বর প্রেসিডেন্ট জিয়া চতুর্থ সংশোধনী সংশোধন করে ঘোষণা দেন যে, প্রধানমন্ত্রী হবেন সংসদের আস্থাভাজন ব্যক্তি এবং অসংসদ সদস্য মন্ডলীর সংখ্যা মোট মন্ত্রীর একপঞ্চমাংশের বেশি হবে না। এবং প্রেসিডেন্টের কোন ভেটো ক্ষমতা থাকবে না এবং প্রেসিডেন্ট নির্বাচন পদ্ধতি সংশোধনের জন্য গণভোট লাগবে। সরকারী চাকুরে সংসদ সদস্য হতে পারবে না।
পার্লামেন্ট নির্বাচন ৭৯
পার্লমেন্ট নির্বাচন পিছিয়ে অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারীতে। ১৮ই ফেব্রয়ারীতে অনুষ্ঠিত এ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন বড় ছোট মোট ২৯টি দল। এর মধ্যে ২০টি দল কোন আসনই পায়নি। নির্বাচনের পূর্বে বিরোধী দলগুলোর অধিকাংশই নির্বাচনের পূর্বে বিরেধী দলগুলোর অধিকাংশ নর্বাচন বর্জনের হমকি দিলেও পরে নির্বাচনে অংশ নেয়। জেঃ ওসমানীর নেতৃত্বে জাতীয় জনতা পার্টি নির্বাচন বর্জন অব্যাহত রাখে। নির্বাচনের মোট তিনশো আসনের জন্যে প্রার্থী সংখ্যা ছিল মোট ২১২৫ জন। এর মধ্যে ৪২৫ জন ছিলেন স্বতন্ত্র প্রার্থী। ভোট কেন্দ্রের সংখ্যা ছিল ২১,৯০০টি। মোট ভোটারের সংখ্যা ছিলো ৩ কোটি ৮৬ লাখ ৩৭ হাজার ৬৬৪ জন।
নির্বাচনে ৩০০টি আসনের মধ্যে বিএনপি ২০৫, আওয়ামী লীগ (মালেক) ৪০, আওয়ামী লীগ (মিজান)-২, মুসলিম লীগ-ইসলামিক ডেমোক্র্যাটিক লীগ—১৯, জাসদ—৯, জাতীয় লীগ-২, গণতান্ত্রিক আন্দোলন-১, গণফ্রন্ট-২ ন্যাপ (মো)-১ একতা পার্টি-১ বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল-১ এবং সর্বর্দলীয়-১৬টি আসন লাভ করে। নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ (মালেক), জাসদসহ কয়েকটি দল ও বিজয়ী-পরাজিত নর্বাচনে কারচুপির অভিযোগ আনেন।
রংপর ৭১
বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর জনগণের সঙ্গে শাসকশ্রেণীর বিশ্বাসঘাতকতা, দুনীতি, লুটপাট, চোরাচালান ইত্যার ফলশ্রুতিতে যে বণিক পুজির দৌরাত্ম্য শুরু হয় তার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় মানুষের দারিদ্র কয়েকগুণ বেড়ে যায়। বন্যাকে উপলক্ষ করে সে দৌরাত্ম আরও বেড়ে গেলে সারাদেশে দুর্ভিক্ষে মারা যায় ৬ লাখ মানুষ ৭৪-এ। ক’বছর যেতে না যেতে ১৯৭৯ সালে আবার ধরাকে উপলক্ষ করে তেমন দুর্ভিক্ষের হাওয়া বইতে শুরু করে। অনাহারে মারা যায় অনেকেই পঙ্গু কর্মক্ষমহীন হয়ে পড়ে লক্ষ মানুষ। রংপরে এ অবস্থা সেপ্টেম্বর অক্টোবর মাসে চুড়ান্ত আকার নেয়। এখানে পাট ২৫-৩০ টাকায় বিক্রি হয়, যার ফলে দরিদ্র কষকের সর্বস্বান্ত হয়। বছরের পরিসংখ্যানে দেখা যায় রংপুরের কুড়িগ্রাম মহকুমার চিলমারী থানার সাব-রেজিষ্ট্রি অফিসে ১-৮-৭৯ থেকে ২৭-১০-৭১ সময় পর্যন্ত ৬৫১টি দলিল রেজিস্ট্রি হয়। গবাদি পশু বিক্রি হয় প্রচুর। এ সময় দুর্ভিক্ষ ঠেকানোর জন্যে ৩ লাখ মণ গম বিতরণ করা হয় যা মুলতঃ কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসুচীর অধীনে সরবরাহ করা হয়। এ নিয়ে ঘাটতির অভিযোগে রংপুরে ভুক্তভোগী মানুষদের প্রতিবাদের দাবিতে প্রায় ১০০ জন ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্য গ্রেফতার করা হয়েছে। কম দামে পাট কেনার প্রতিবাদে দেশের একাধিক স্থানে প্রতিবাদ মিছিল হয়।
খালখননঃ ‘বিপ্লব’
১৯৭৯ সালের সেপ্টেমবর মাসে প্রথম প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের বিপ্লবের কথা বলেন। প্রথমে তিনি ১৯ দফাকেই বিপ্লবের কর্মসুচি বলে গ্রহণ করতে বলেন। তিনি এ সময় এক ভাষণে বলেন, “আমাদের বিপ্লব হবে শান্তিপুর্ন ও গণতান্ত্রিক পন্থায় এবং এটি পরিচালনা করবেন আমাদের পার্টির নেতা এবং কর্মীরা অন্য কেহ নহে।’ অন্য এক ভাষণে বলেন ‘বিপ্লব শান্তিপুর্ণভাবে সংগঠিত না হলে রক্তক্ষয়ী বিপ্লব সংগঠিত হবে।’ ১৮ই নবেম্বর এক বেতার ভাষণে প্রেসিডেন্ট খাল খননের কর্মসুচীকে বিপ্লবের প্রথম ধাপ হিসেবে ঘোষণা করেন।
এ বছরেরই শেষের দিকে সীমান্তে আবার ভারতীয় বাহিনীর গুলীবর্ষণ শুরু হয়। নবেম্বর থেকে এ গুলীবর্ষণ চলছে, বারবার প্রতিবাদ সত্তেও তা থামানো হয়নি। এ বিরোধ মুহুরি নদীতে ওঠা চরে অমীমাংসিত এলাকার মালিকানা নিয়ে।
বিদায় ৭০ দশক
যে দুটি ঘটনার মাধ্যমে আমাদের সমকালীন ইতিহাস সত্তর দশকে প্রবেশ করেছে তার বিশালতা গোটা জাতিকে করেছে আলোড়িত এবং তার কান্তি গোটা দশক অবধি বিস্তৃত ছিলো। এর একটি ৭০-এর সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস মানবজাতির স্মরণকালের বৃহত্তম প্রাকৃতিক বিপর্যয় এবং অপরটি ৭০ এর নির্বাচন যার অনিবার্য পরিণতি ঘটেছে স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে। যদিও এই যুদ্ধের স্থায়িত্ব ছিলো নয় মাস তবু পরবর্তী বছরগুলিতে বিশেষ ভাবে এই দশকের শেষার্ধে স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব সংরক্ষণের বিষয়টি বার বার ঘটনাবর্তের কেন্দ্রে অবস্থান করেছে।
সত্তর দশক বাংলাদেশের রাজনীতি ও অর্থনীতির ইতিহাসে ক্রান্তি কালের দশক। পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে উত্তরণ বিশ্বের মানচিত্রে একটি স্বাধীন দেশের অভ্যুদয়, যুদ্ধোত্তর বিপর্যস্ত অর্থনীতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা সব কিছুই এই ক্রান্তিকালের অন্তর্গত। ক্রান্তিকালের এই দোলাচলেই প্রতি বিঘ্নিত হয় ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা।
সত্তরের দশকে আমরা বহু কিছু হারিয়েছি। পেয়েছিও অনেক। ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। যদিও এই ক্রান্তিকালের দশক স্বাধীনতা ইপ্সিত ফল আমাদের ভোগ করতে দেয়নি, যদিও শাসন শোষণের সামাজিক ভিত অটুট রয়ে গেছে তবু পরিবর্তন এসেছে চেতনায়। একটি গোটা জাতি নয় মাসের সশস্ত্র লড়াইয়ের মাধ্যমে এমন এক জঙ্গী চেতনা প্রাপ্ত হয়েছে দেশী বিদেশী কোন শাসক-শোষকের পক্ষেই এই জাতিকে বেশীদিন দমিত রাখা সম্ভব হবে না। সত্তর দশকে যুদ্ধের অভিজ্ঞতা, পরশ্রমজীবীদের রাজনীতির অন্তসার শুন্যতা ও ব্যর্থতা, ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সংকট এই চেতনাকে আরো তীক্ষ করেছে, জনগণের শত্রুকে আরো বেশি নগ্ন করেছে এবং এটাই আমাদের জাতীয় জীবনে সত্তর দশকের সবচেছে বড় অবদান। এই চেতনাই আমাদের আগামীর পথ নির্ধারণ করবে, ক্লান্তিকালীন সংকট থেকে নিশ্চিত ভবিষ্যতে উত্তরণ ঘটবে।
সত্তর দশকে যাঁদের হারিয়েছি
রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব
সত্তরের দশকে আমরা বহু গুরুত্বপুর্ণ রাজনৈতিক নেতাকে হারিয়েছি যারা এদেশের রাজনীতিতে কোন না কোন সময়ে নির্ধায়ক ভূমিকা পালন করেছেন। রাজনৈতিক নেতাদেৱ কারো মৃত্যু ঘটেছে স্বাভাবিক ভাবে কারো ঘটেছে অস্বাভাবিক ভাবে। অস্বাভাবিক মৃত্যুর শিকার অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ব্যক্তিরাই হয়ে থাকেন। যদিও ৭১ এর যুদ্ধে আমরা আগনিত নাম না জানা মেহনতি মানুষ, সৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধার পাশাপাশি বহু, শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীকে হারিয়েছি। তার পাশাপাশি বহু রাজনৈতিক ব্যক্তিকেও হারিয়েছি। ৭১ এর শহীদ শহীদুল্লাহ কায়সার পুনেন্দু দস্তিদার বা সাইদুল হাসান সাংবাদিক সাহিত্যিক বা শিল্পপতিই ছিলেন না, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবেও তাঁরা সমানভাবে পরিচিত ছিলেন। ৭১ এর যুদ্ধে হানাদর বাহিনীর গুলিতে নিহত হয়েছেন বর্ষীয়ান রাজনৈতিক নেতা ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। আওয়ামী লীগের ৮ জন গণপরিষদ সদস্য শহীদ হয়েছেন যুদ্ধের নয় মাসে। শহীদ হয়েছেন আরো ও অনেক রাজনৈতিক কর্মী।
যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের রাজনীতি ছিলো, অনিশ্চয়তা এবং সন্ত্রাসের আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নির্মম হস্তে বিরোধী রাজনৈতিক ব্যক্তিদের নির্মল করার ব্যাপক পরিকল্পনা প্রনয়ণ করে। পাশাপাশি চলতে থাকে লাগামহীন লুণ্ঠন শোষণ ও উৎপীড়ন। এর বিপরীতে জনসাধারণের ভেতর কোথাও স্বতস্ফূর্তভাবে আবার কোথাও বিচিছন্ন ভাবে সংগঠিত প্রতিরোধও গড়ে ওঠে। ৭২ এর এপ্রিল মাসে আত্রাই অঞ্চলে তৎকালীন পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির (মাঃ-লেঃ) নেতৃত্বে যে প্রতিরোধ যুদ্ধ হয় তাতে এই পার্টির ” অন্যতম নেতা আবদুস সামাদ সহ বেশ কয়ে কজন নেতৃস্থানীয় কর্মী নিহত হন। এর কিছুদিন পরই অপর এক সংঘর্ষে নিহত হন এই দলের অন্যতম নেতা বাদল দত্ত। এর বিপরীতে আওয়ামী লীগেরও কয়েকজন সংসদ সদস্য ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি নিহত হন। বামপন্থী বিভিন্ন রাজনৈতিক দল দাবী করেছে এই সময়ে অন্ততপক্ষে ২০ হাজার রাজনৈতিক নেতাও কর্মী নিহত হয়েছেন যাদের ভেতর বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির চেয়ারম্যান সিরাজ সিকদার। (বিবরণ দ্রষ্টব্য) সিরাজ সিকদারের মৃত্যুর প্রায় দু’মাস পরই নিহত হন পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির (মাঃ-লেঃ)। সাধারণ সম্পাদক মনিরুজ্জামান তারা, এক সময় যারা উত্তরবঙ্গে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছিলো। সত্তর দশকে প্রয়াত রাজনৈতিক নেতাদের ভেতর যাঁরা অস্বাভাবিক প্রক্রিয়ার মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের ভেতর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন শেখ মুজিবর রহমান। (বিবরণ দ্রষ্টব্য) এর পরই উল্লেখযোগ্য হচ্ছে করিগারে আক অবস্থায় নিহত আওয়ামী লীগের চার নেতা-তাজুদ্দীন আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম ‘ কামরুজ্জামান ও মনসুর আলী আওয়ামী লীগের ভেতর শেখ মুজিবর রহমানের পরেই ছিলো এদের স্থান। ৭১ এর ১৭ই এপ্রিল প্রবাসী বাংলাদশ সরকার গঠনের সময় থেকে মুজিব সরকারের পতন পর্যন্ত এরা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। এরা চার জনই আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। ৭৫-এর সামরিক অভ্যুত্থানের পর এদের গ্রেফতার করা হয়। বন্দী অবস্থায় এর ৩রা নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিহত হন। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সায়েম এই হত্যাকাণ্ড তদন্ত করার জন্য বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠন করেন। ১৫ আগস্টের সামরিক অভ্যুথানে নিহত হন আওয়ামী লীগের আরো দু’জন নেতা–আবদুর রব সেরনিয়াবাত ও শেখ ফজলুল হক মনি। সত্তর দশকের অরেকটি উল্লেখযোগ্য মৃত্যু কনেল (অবঃ) আবু তাহের (বিবরণ দ্রষ্টব্য)।
সত্তর দশকে যে মৃত্যু এদেশের মেহনতি জনগণের আন্দোলনে বিশাল শুন্যতার সৃষ্টি করেছে সেটা মওলানা ভাসানী মৃত্যু। (বিবরণ দ্রষ্টব্য) পরিণত বয়সে স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করলেও তাঁর শুন্যতা এদেশের রাজনীতিতে যুগ যুগ ধরে অনুভুত হবে। ৭১ এর ১২এ মার্চ মারা গেছেন মাওলানা ভাসানী দির্ঘদিনের সহযোগী ভাসানী ন্যাপের চেয়ারম্যান পরবর্তী কালে জাতীয় ভাসানী দলের অন্যতম প্রধান নেতা মশিউর রহমান (৫৬)। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরন জনিত কারনে তিনি মারা যান। মৃত্যুকালে তিনি প্রেসিডেন্ট জিয়ার মন্ত্রীসভার সিনিয়র মন্ত্রী ছিলেন। পাকিস্তান আমলে এবং মুজিব আমলেও বিরোধী দলীয় নেতা হিসাবে তিনি বারবার কারাবরন করেন।
বাংলাদেশের সাম্যাদী দল (এম-এল) এর প্রতিষ্ঠিত সেক্রেটারি এদেশের কমিউনিস্ট আন্দোল্পনের অন্যতম নেতা সুথেন্দু দস্তিদার (৬৫)। ৭৮ এর ১০ ই জুনে ঢাকায় মৃত্যুবরন করেন। তিনি দীর্ঘদিন বহুমুত্র ও জটিল পেটের পিড়ায় ভুগছিলেন(অস্পষ্ট) প্রধান ছিলেন তিনি।
প্রবীণ রাজনীতিবিদ আবুল মনসুর আহমদ (৮১)। ৭১ এর ১৮ই মার্চ মৃত্যুবরন করেন। বৃটিশ ভারত বাংলাদেশের পুর্বোগামী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের অন্যতম আবুল মনসুর আহমদ ছিলেন ফজলুল হক ও সোওরাওয়ার্দী ঘনিষ্ট সহযোগী ১৯৫০ সালে তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। পঞ্চাশের দশকে যুক্তফ্রন্ট সরকারে আমলে তিনি কিছু সময়ের জন্য পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। রাজনীতিবিদ ছাড়াও একজন তীক্ষ্ণ স্যুটয়ার লেখক অ সাংবাদিক হিসেবে তিনি আমাদের জাতীয় জীবনে যথেষ্ট অবদান রেখেছেন।
বৃটিশ ভারত অবিভক্ত বাংলার মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুক হাশিম মৃত্যুবরন করেছেন ৭৪ এর ১২ ই নভেম্বর। বৃটিশ ভারত মুসলিম লীগের গনতন্ত্রে বিরোধী নেতৃবৃন্দের ভেতরে তিনি ছিলেন বিশিষ্ট বাগ্মী ও পণ্ডিত আবুল হাশীম পাকিস্তান হওয়ার পর রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহন করেন।
বিশিষ্ট প্রগতিশীল রাজনীতিবিদ মওলানা ভাসানীর ঘনিষ্ট সহকর্মী সাবেক প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য অ বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা আব্দুল করিম (৫৫)। ৭৯ এর ১৩ই নভেম্বর মৃত্যুবরন করেন। ৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে তিনি ছিলেন প্রাদেশিক পরিষদের কনিষ্ঠতম সদস্য।
বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম কেন্দ্রীয় নেতা আব্দুস সালাম(অস্পষ্ট) সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর ভাবে আহত হয়ে তিনি ৭১ এর ১০ই অক্টোবর মৃত্যুবরন করেন।
সত্তর দশকে প্রয়াত রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে যারা নানা কারনে উল্লেখযোগ্য তাদের কথা এখনি বলা হলো। এই দশকে মৃত্যুবরন করেছেন প্রতিক্রিয়াশিল(অস্পষ্ট) নুরুল আমিন ও মোনায়েম খান। নুরুল আমিন মারা গেছেন পাকিস্তানে আর মোনায়েম মারা গেছেন ৭১ এ মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে। জেলে মারা গেছেন এই ধারার আরেকজন রাজনৈতিক নেতা ফজলুল কাদের চৌধুরী।রাজনীতির প্রতিক্রিয়াশীল শিবিরে এবং প্রগতির শিবিরে আরো অনেক নেতৃস্থানীয় ব্যাক্তি মারা গেছেন। এদেশের কারো কারো মৃত্যু ছিলো পালকের মতো হালকা যার কোন ছাপ কোথাও পড়েনি কিংবা কারো মৃত্যু ছিলো হিমালয় পর্বতের মতো ভারি, গোটা জাতিকে না বিচলিত স্তম্ভিত এবং অসহায় করেছে।
সাংবাদিক
গত দশকে আমরা যে ক’জন প্রখ্যাত সাংবাদিক হারিয়েছে তারা হলেন আব্দুস সালাম,আবুল মনসুর আহমদ, আব্দুল কালাম শামসুদ্দিন মাহাবুবুল আলম, শহীদুল্লাহ কায়সার, সিরাজুদ্দিন হোসেন, নিজামুদ্দিন আহমেদ, খোন্দকার আবু তালেব, এস এম পারভেজ। এদের মধ্যে কুখ্যাত আল বদর বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন শহীদুল্লাহ কায়সার, সিরাজুদ্দিন হোসেন, নিজামুদ্দিন আহামেদ খোন্দকার আবু তালেব, গোলাম মোস্তফা খোন্দকার আবু তালেব।
পুর্ব্দেশ সম্পাদক মাহাবুবুল আলম মারা যান ১৯৭৩ সালে। এ বছরেই মারা যান চিত্রালির প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক এস এম পারভেজ।
বিশিষ্ট সাংবাদিক সাহিত্যিক এবং রাজনিতীক আবুল মনসুর আহমদ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এ বছরের ১৮এ মার্চ। তিনি ১৮৯৮ সালের ৩রা সেপ্টম্বর ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল থানার অন্তর্গত ধানীখোলা গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। ১৯২৯ সালে তিনি আইনে ডিগ্রী লাভ করলেও শুরু করেন সাংবাদিকতা। সাংবাদিকতা জীবনে তিনি সুলতান মোহাম্মদ, দি মুসলমান, খাদেম দৈনিক কৃষক দৈনিক নবযুগ ও দৈনিক ইত্তেহাদ পত্রিকা সম্পাদক, সহকারী সম্পাদক ও সহ-সম্পাদক পদে দায়িত্ব পালন করেন সাংবাদিকতা জীবনেই, তিনি রাজনীতিতে জোড়িয়ে পড়েন। সাহিত্য ক্ষেত্রে আবুল মনসুর আহমদের অবদানও উল্লেখযোগ্য।
দৈনিক বাংলার সাবেক সম্পাদক আল কালাম সামসুদিন পরলোক গমন করেন ১৯৭৫ সালের ৪ মার্চ। অবুল কালাম শমসুদ্দিন শুধু একজন সাংবাদিকই ছিলেন না, ছিলেন একজন সাহিত্যিক এবং সাহিত্য সমালোচকও।
আবুল কালাম শামসুদ্দিন সওগাত-এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। সওগাত ও সাপ্তাহিক সওগাত উভয় কাগজের সাহিত্য ও পুস্তক সমালোচনার ভর তার উপর অর্পিত হয়েছিল।
সাওগাতের পর তিনি মাসিক মোহাম্মদি এবং দৈনিক আজাদ পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১৯৬৪ সালের নবেম্বর মাসে তিনি তৎকালিন দৈনিক পাকিস্তানের সম্পাদক নিযুক্ত হন এবং ১৯৭১ সালে দৈনিক বাংলা সাম্পাদক হিসাবে অবসর গ্রহণ করেন।
১৯৭৭ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারী এদেশের সাংবাদিকতার জগতের উজ্জল নক্ষত্র আবদুস সালাম হৃদরোগে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৬ বছর। সাংবাদিকতায় তার ২৮ বছরের জীবন ছিল কর্মময়। তাঁর তীক্ষ্ণধার ও পাণ্ডিত্যপুর্ন লেখনী তকে পেশাগত ক্ষেত্রে সম্মানের শীর্ষে প্রতিষ্ঠিত করে। তিনি পুর্ন সফলতার সঙ্গে তৎকলীন পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকার সম্পাদক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। স্বাধীনতার পর সম্পাদকের পদ ত্যাগ করতে তাকে বাধ্য করা হয়। বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট স্থাপিত হওয়ার পর তিনি এর মহাপরিচালক পদে নিযুক্ত হন। গুরুতপুর্ন অবদানের জন্যে ৭৬ সালে তিনি সর্বোচ্চ জাতীর সম্মান একুশে পদকে ভূষিত হন। প্রেস ইনস্টিটিউটের দায়িত্বে থাকাকালেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
১৯৭৮ সালের ৩ আগষ্ট সাংবাদিক সাহিত্যিক মোহাম্মদ ওয়ালিউল্লাহ মারা যান। তিনি সন্দীপের ‘ওয়ালী গান্ধী লাল কোর্তা’ নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি ১৯৩৪ সালে সাংবাদিকতায় যোগ দেন। দি রেঙ্গুন, ডেলী নিউজ, স্টার অব ইণ্ডিয়া সহ দেশের প্রথম সারির বিভিন্ন দৈনিকের গুরত্বপূর্ণ পদে আসীন ছিলেন। মোহাম্মদ ওয়ালিউল্লাহ ১৯০৪ সালে সন্দীপে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯২১ সালে খিলাফত আন্দোলনে যোগদান করেন এবং কারাবরণ করেন।
শিল্পী-সাহিত্যিক।
উথান-পতন দ্বন্দ্বসংঘাতের (অস্পষ্ট) দশক শিল্প সাহিত্যের জগতেও নিয়ে এসেছেন নতুন সম্ভাবনা। সেই সঙ্গে আমার হারিয়েছি বহু সাহিত্যিক ব্যক্তিত্বকে। এদের অনেকেই ছিলেন বাংলা সাহিত্যের শির্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্ব। ৭৬ সালের ১৪ই মার্চ হারিয়েছি আমরা পল্লী কবি জসীমউদ্দিনকে। তার প্রসিদ্ধ কাব্য গ্রন্থ নক্সী কাঁথার মাঠ ও সোজন বাদিয়ার ঘাট সাধারণ পাঠকের কাছেও অত্যন্ত প্রিয়। ঐ বছরই ২১শে আগস্ট হারিয়েছি কবি নজরুল ইসলামকে। রবীন্দ্রোত্তর বাংলা সাহিত্যে তিনি হচ্ছেন সর্বাধিক জনপ্রিয় কবি, গীতিকার ও সুরকার। তাঁর সর্বাধিক পঠিত ও বিতর্কিত কবিতা ‘বিদ্রোহী’ একদা গোটা বাংলা সাহিত্যে বিষয়বস্তু ও আঙ্গিকের দিক দিয়ে নতুন জোয়ার এনেছিলেন। বাংলাদেশের শিল্পকর্মে যার অবদান সর্বাধিক স্বীকৃত সেই শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনকে আমরা হারিয়েছি ৭৬ এর ২৮শে মে তারিখে। এদেশের মানুষের দুঃখ কতষ্ট সংগ্রাম ও ভালোবাসার কথা তার চিত্রাবলীতে মুর্ত হয়ে উঠেছে। ঢাকা আর্ট কলেজও সোনার গালোক শিল্প যাদুঘর সৃষ্টির পিছনে তাঁর দান অপরিসীম। ৭৪ সালের ৫ই অগস্ট মৃত্যুবরণ করেছেন কটি সিকান্দার আবু জাফর। কবিতা ছাড়াও তাঁর একটি উল্লেখযোগ্য কীর্তি হচ্ছে সাহিত্য মাসিক ‘সমকালের’ সম্পাদনা। ঐ বছরই ১৯শে অক্টোবর পরলোকগমন করেছেন কবি ফররুখ আহমদ। ৪০-এর দশকে একজন শীর্ষস্থানীয় কবিদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। ইসলামের পুনর্জাগরণর কথা বারবার ধ্বনিত হয়েছে তার কবিতায়। তা সত্তেও তার লাশ’ ও ‘ডাহুক’ কবিতা পদে দুটো সকল শ্রেণীর পাঠককে মুগ্ধ করেছে।
এ দশকে আমরা হারিয়েছি এমন কয়েকজন লেখক ও কবিকে যারা তিরিশ ও চলিশ দশকে সুচনা করেছিল নতুন এক সম্ভাবনার। বাংলা সাহিত্যে বিদ্রোহ নিয়ে এসেছিল বিষয়বস্তু ও আঙ্গিকে। কেউ কেউ সৃষ্টি করেছেন এক একটি স্বতন্ত্র ধারার, যা সম্পুর্ন নতুন না হলেও বাংলা সাহিত্যে তা ছিল উল্লেখযোগ্য সংযোজন।
আমরা একাত্তর সালের মুক্তি যুদ্ধে হারিয়েছি বহু শিল্পী-সাহিত্যিকদের। এ ছাড়াও কালের নিয়মে শিল্পসাহিত্যের জগত থেকে ঝরে গিয়েছে বহু শিল্পসাহিত্যিক সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর মতো শিল্পীও হারিয়ে গিয়েছে এই দশকেই।
৭৬ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বর আমরা হারিয়েছি কবি ও সাংবাদিক আবদুল গনি হাজারীকে। মুলত কবি হলেও চিন্তাধর্মী প্রবন্ধ ও ব্যঙ্গাত্মক রচনাতে তিনি ছিলেন পারদর্শী। তাঁর বিখ্যাত কবিতা কতিপয় আমলার স্ত্রী এক সময় সুধী মহলে দারুন আলোড়ন তুলেছিল।
এ দশকে সঙ্গীত জগতের কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় শিল্পপীকেও আমরা হারিয়েছি। ৭৪ সালের ২০শে জুলাই হারিয়েছি কমল দাশ গুপ্তকে। নজরুল গীতিকে জনপ্রিয় করার মুলে সুরকার হিসেবে তার অবদান সর্বাধিক। ঐ বছরই ৫ই সেপ্টেম্বর হারিয়েছি মরমী শিল্পী আবদুল আলীমকে। এদেশের সঙ্গীত প্রিয় জনসাধারণের কাছে আবদুল আলীম ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয় নাম। এর আগের বছর ১১ই এপ্রিল আমরা হারিয়েছি ওস্তাদ মুন্সী রইসউদ্দীনকে।
৭৬-এর ২১ নবেম্বর আমরা হারিয়েছি উচচাঙ্গ সঙ্গীত শিল্পী আভা আলমকে। ৭৮-এর ১২ আগস্ট পরলোক গমন করেছেন। গীতিকার ও কবি আজিজুর রহমান। দেশে পঞ্চাশের শুরুতে গান লিখতে শুরু করে যারা তাঁদের সাধনাকে অব্যাহত রেখেছেন, আজিজুর রহমান তাঁর মধ্যে প্রধান।
২ নবেম্বর হারিয়েছি সাহিত্যিক ও ঐতিহাসিক মোহাম্মদ বরকতউল্লাহকে। বাংলা সাহিত্যের এই বিশিষ্ট লেখক তার সুবিখ্যাত গ্রন্থ পারস্য-প্রতিভা ও মানুষের ধর্ম ও অন্যান্য গ্রন্থের জন্য স্মরণীয় হয়ে আছেন।
শিশু সাহিত্যের জগৎ থেকেও হারিয়ে গিয়েছেন কয়েকজন ব্যক্তি। এর মধ্যে ৭২ সালের ১৭ জুন আমরা হারিয়েছি কবি হাবীবুর রহমানকে। তার বিখ্যাত গ্রন্থ: উপাত্ত বন মোরগের বাসা, বন-বাদাড়ে, লেজ দিয়ে যায় চেনা ইত্যাদি। দৈনিক সংবাদের খেলাঘর অসরের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনি। ঐ বছরই ১ আগস্ট মারা গেছেন কবি মোজাম্মেল হক তাঁর কাব্য গ্রন্থ: জাতীয় মঙ্গল। শিশুদের কাছে অত্যন্ত প্রিয় লেখক নাসির আলীকে আমরা হারিয়েছি এ দশকেই।
বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেতে যাঁদের অবদান স্মরণীয় তাঁর মধ্যে ডঃ কুদরত ই-খুদা প্রধান। ১৯৪৬ সালে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানের বিচিত্র কাহিনী নামে তার একটি গ্রন্থ কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়। এরপর (অসমাপ্ত)
অনেকে মনে করেন ইন্দিরা ক্ষমতা পেলে বাংলাদেশের ক্ষমতার মুকুট তাদের মাথায় এসে পড়বে
সাক্ষাৎকার মিজানুর রহমান চৌধুরী
জাতীয় সংসদ সদস্য মিজানুর রহমান চৌধুরী আওয়ামী লীগের (মিজান) সভাপতি। রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন ছাত্রাবস্থায়ই। এক সময়ে বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের সংগঠক ছিলেন। ১৯৪৭ সালে ছাত্রলীগের চাঁদপুর শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ফেনী কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক হন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৯৫০ সালে। ১৯৫৯-৬০ সালে চাঁদপুর পৌরসভা ও ইউনিয়ন কাউন্সিলের সভাপতি হন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। ৬২ সালে জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ৬৪ সালে রাজনৈতিক কারণে গ্রেফতার হন। ৬৫ সালে পুনরায় নির্বাচিত হন। ৬৬ সালে শেখ মুজিব এবং তাজউদ্দিন আহমদের গ্রেফতারের পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদককের ভারপ্রাপ্ত হন। ৬৬ সালেই ৭ জুন ৬ দফা ঘোষণা করেন এবং ২২শে জন আবার গ্রেফতার হন। ৬৭ সালে পাকিস্তান সুপ্রীম কোর্টের ফুলবেঞ্চের সর্বসম্মত রায়ে নবেম্বরের শেষ দিকে মুক্তি লাভ করেন এবং আবার আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ৬৮ সালে পর্যন্ত বিরোধীদলের আহবায়কের দায়িত্ব গ্রহণ করেন যার পর ‘ডাক’ (ডেমোক্র্যাটিক এ্যাকশন কমিটি’ ) গঠন করা হয়। ৬৯ সালের গণ-আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন।
৭১ সালে ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করলে তার উপর প্রবাসী বাঙ্গালীদের মধ্যে আওয়ামী লীগ সংগঠনের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর শেখ মুজিবের মন্ত্রীসভার সদস্য হন এবং তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। ৭৩ সালের মে মাসে মন্ত্রীত্ব ত্যাগ করেন। আওয়ামী লীগ পুনর্গঠনের পর বিগত সংসদ নির্বাচনে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন।
প্রশ্ন-বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এখন কেমন?
উত্তর—কোন দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক অবস্থাকে বিচার করতে হলে দেখতে হবে সে দেশের সাধারণ মানুষ কিভাবে বসবাস করছেন। বাংলাদেশ এখন চরম অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের দিকে যাচ্ছে। কিন্তু এ বিপর্যয়ের আসল রুপ এখনও প্রকাশ পায়নি। কারণ এ বিপর্যয়ের প্রক্রিয়া এখনও অর্থনৈতিক কাঠামোর মধ্যে। গত বছরের চেয়ে পাট বিক্রয় করে এ বছর কৃষকরা পেয়েছেন অর্ধেকেরও কমদাম অনেকের ঘরেই পাট রয়ে গেছে। অনেক চাষীই পাট বিক্রয় করতে পারেননি। অন্যদিকে তাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম প্রতিদিনই বেড়ে চলেছে। সাধারণ মানুষ যা কেনে তার দাম বেড়েই চলেছে। অথচ এমন কোন প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন নেই যা চাষীদের সংগঠিত করে অবস্থার উন্নয়নের দিকে নিয়ে যেতে পারে। দুরবস্থার প্রতিকার চাওয়ার জন্য বা কোন ‘ দাবীনামা দাখিল করার কোন স্থান তার নেই। অথচ তারাই হলেন উৎপাদিকা শক্তি। তাদের শ্রমলব্ধ ফসল ইত্যাদিই আমাদের অর্থনীতির মূল চাবিকাঠি। এই চাষীদের অবস্থা যখন খারাপ থাকে তখন দেশের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক অবস্থা ভাল হতে পারে না।
প্রশ্নঃ—দেশের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থার বিরোধী দলগুলো যে ভুমিকা পালন করছে তা কি সন্তোষজনক?
উত্তর-বিরোধী দল প্রতিপক্ষ চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। এ ব্যর্থতার ফলেই বিরোধী দলের ভূমিকা সন্তোষজনক মনে নাও হতে পারে। অধুনা বিরোধীদলের মধ্যে একটা ঐক্যের প্রচেষ্টা চলছে। ধরে নেয়া যাক সবগুলো বিরোধী দল মিলে একটা ঐক্য প্রতিষ্ঠিতও হয়ে যাবে। কিন্তু এ ঐক্য কার বিরদ্ধে কিসের জন্য এটা আগে সাব্যস্ত করতে হবে। তা না হলে এ ঐক্য দীর্ঘ স্থায়ী এবং কোন কাজের হবে না। এর আগেও আমি আমার সবসভাতেই একটা ঐক্যের আহান জানিয়েছি। আমার দল ছাড়া আরও অনেক দল ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছে কিন্তু এখনও তা ফলপ্রসু কিছু হয়নি। এই জন্যই প্রেসিডেন্ট জিয়া বলেছেন যে দেশের রাজনীতি শেষ হয়ে গেছে। প্রেসিডেন্টের এই উক্তি যদি সত্য হয় তবে প্রশ্ন থেকে যায় প্রেসিডেন্ট জিয়া নিজে যা করছেন তা কি? তিনি কি করছেন। তিনি যা করছেন তা কি স্বৈরনীতি মার্শাল নীতি না স্বীয়দলের মধ্যে ভাগবন্টনের নীতি। রাজনীতি যদি শেষ হয়ে গিয়েই থাকে তাহলে অবস্থাদৃষ্টে আমাদের ধরে নিতে হয় যে তারপর একটা জঙ্গী নীতির অস্তিত্ব আছে।
প্রশ্ন—আপনি বলেছেন যে বিরোধীদল প্রতিপক্ষ চিহ্নিত করতে পারেনি। আপনার মতে বাংলাদেশে বিরোধীদলের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ কে?
উত্তর—আমাদের দেশে সাধারণ রাজনৈতিক ইস্যুতে বর্তমনি সরকারই প্রধান প্রতিপক্ষ। এছাড়া বিরোধীদলের দলগুলোর মধ্যেও আদর্শগত পার্থক্য রয়েছে। যেমন আমাদের দল বহুদল ভিত্তিক নির্ভেজাল সংসদীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে। অপরদিকে মালেক সাহেবদের দল একদল ভিত্তিক বাকশালী গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে। আবার কোন কোন রাজনৈতিক দল বাংলাদেশের বাইরের অনুপ্রেরণায় এদেশে রাজনীতি করে। আমরা প্রেরণা পাই দেশবাসীর আশা আকাঙ্ক্ষার মধ্য থেকে। আমি মনে করি দেশের সবগুলো বিরোধী দলেরই উচিত নির্ভেজাল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং জনগণের অথনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার অর্জনের জন্য ঐক্যবদ্ধ হওয়া।
প্রশ্ন—আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের নির্বাচনে যদি মিসেস ইন্দিরা গান্ধী পুনরায় ক্ষমতায় আসেন তবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে তার কি প্রভাব পড়তে পারে?
উত্তর—কিছু কিছু লোক মনে করেন ইন্দিরা কংগ্রেস ভারতের ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশের ক্ষমতার মুকুট তাদের মাথায় এসে পড়বে। এই লোকগলো জানেননা যে তারা আহাম্মকের স্বর্গে বাস করছেন। ভারতের নির্বাচনে ভারতবাসী যাকেই নির্বচিত করবেন আমরা তাকেই অভিনন্দন জানাবো। ভারতে যদি প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তি নির্বাচিত হয় তবে আমি খুশী হব। আমি ভারতের জনগণের অতীত ইতিহাস ঐতিহ্য যতখানি জানি তাতে আমি মনে করি আসন্ন নির্বাচনেও আমার খুশী হওয়ার মতই কিছু হবে।
প্রশ্ন—যে লোকগুলো মনে করেন যে ইন্দিরা গান্ধী নির্বাচিত হলে তাদের মাথায় ক্ষমতার মুকুট এসে পড়বে এবং যারা বিদেশের অনুপ্রেরণায় এদেশে রাজনীতি করেন তারা কারা?
উত্তর—এ প্রশ্নের জবাব আমি এখন দেব না।
প্রশ্ন—আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে যে সরকারে মদদে আপনি আওয়ামী লীগ ভেঙ্গেছেন এবং এখন জাতীয় সংসদে সরকারের সঙ্গে বিরোধীতা করছেন না। এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কি?
উত্তর—আমার সম্পর্কে খোলামনে বিচার না করে কেউ যদি উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে কোন মিথ্যা রটনা করে আমি তাতে কি করতে পারি? আমি একজন রাজনৈতিক কর্মী। একজন রাজনৈতিক কর্মীয় কর্মপন্থা নির্ধারিত হয় তার রাজনৈতিক আদর্শ দ্বারা। কারও প্রভাব বা মদদে নয়। তবে অন্যায় মদদে যারা রাজনীতি করেন তারা সকলকেই ঐরকম মনে করেন। যাই হোক আমি একথা শুনে অত্যন্ত ব্যথা পাই যে কিছু লোক দুরভিসন্ধিমূলক মনোভাব নিয়ে প্রচারণা চালিয়ে আমার রাজনৈতিক অতীতকে মুছে ফেলার একটা অপচেষ্টা চালাচ্ছে। আপনারা সকলেই জানেন দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে আমি এমন কোন কাজ করিনি যা রাজনৈতিক আদর্শ বা বিবেকের বাইরে। আমি আত্মপক্ষ সমর্থনে একথা বলছি না। বলছি আমার বিরদ্ধে মিথ্যা রটনার প্রতিবাদ হিসেবে। তবে আমি বিশ্বাস করি মিথ্যা কোন দিনই প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারে না, জনগণ কুৎসা রটনাকারীকে বিশ্বাস করে না।
প্রশ্ন—তাহলে আপনি আওয়ামী লীগ (মালেক) থেকে বের হয়ে এলেন কেন?
উত্তর—আমি আওয়ামী লীগ থেকে সরে এসেছি কেন সে প্রশ্নের জবাব পাওয়া যাবে মতিয়া চৌধুরী কেন আওয়ামী লীগে গেলেন তার জবাব থেকেই। আর আমি আওয়ামী লীগ থেকে বের হয়ে আসিনি বা আমাকে কেউ বেরও করেনি। মালেক সাহেবদের দলের সঙ্গে আমার বিরোধ আদর্শগত কারণে। ওয়ার্কিং কমিটির মিটিংয়ে দরজা বন্ধ করলেই বলা হতো পচা গণতন্ত্রে কোন কাজ হবে না, আমাদের বাকশাল করতে হবে। প্রস্তাব গ্রহণ করা হতো বাকশাল অতীতে সঠিক ছিল, বর্তমানের জন্য সঠিক, ভবিষ্যতেও সঠিক থাকবে। তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে সংসদীয় গণতন্ত্রই আমাদের কাম্য।’ মালেক সাহেবদের এই সুবিধার রাজনীতি, বক্তব্য ও প্রস্তাবের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে যে আদর্শ এবং রাজনৈতিক লক্ষ্য প্রতিষ্ঠার জন্য, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী এবং তদানীন্তন শেখ মুজিব আওয়ামী লীগ গঠন করেছিলেন অওয়ামী লীগকে সেই ঐতিহ্যবাহী সঠিক পথে পরিচালনার জন্য আমরা দলকে পুনর্বিন্যাস করেছি। এই পুনর্বিন্যাস প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল কারণ জনগণ চায় সংসদীয় গণতন্ত্র এবং মালেক সাহেবদের দল চায় বাকশালী গণতন্ত্র।
প্রশ্ন–ক্ষমতায় আরোহনের মইয়ের কোন ধাপে বর্তমানে আপনার অবস্থান?
উত্তর—মই ছিল আমার নির্বাচনী প্রতীক। মইয়ের কোন ধাপে আমার অবস্থান তা বলা যাবে না। তবে বিগত নির্বাচনেই প্রমাণিত হয়েছে যে মই গণধিকৃত নয়। আমরা বিশ্ববাস করি বাংলায় মানুষের কাছে আমাদের বক্তব্য গ্রহণযোগ্য হবে। এবং জনগণের কাছে এই বক্তব্য যদি আগামী নির্বাচন পর্যন্ত পৌছতে পারি তাহলে ইনশাআল্লাহ আমরা ক্ষমতায় আসবো। পশ্চাৎবার দিয়ে ক্ষমতায় আসাকে আমি পছন্দও করিনা বিশ্বাসও করি না। তাই এছাড়া ক্ষমতায় যাওয়ার আমার আর কোন পথ নেই।
প্রশ্ন—বিশ্বের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি কেমন?
উত্তর—বর্তমান আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি অত্যন্ত ঘোলাটে। সমস্ত আন্তর্জাতিক বিধি বরখেলাফ করে ইরানে যা ‘ঘটানো হচ্ছে তা কোনক্রমেই সমর্থনযোগ্য নয়। কারণ ভায়োলেন্স যার বিরুদ্ধে করা হয় তাকেও সঙ্গে সঙ্গ ভায়োলেন্সের পথ গ্রহণ করার অধিকার দিয়ে দেয়া হয়। আমি প্রেসিডেন্ট কার্টারকে পরাশক্তি হওয়া সত্তেও সংযমের পথ অনুসরণ করার জন্য অনরোধ করবো। সঙ্গে সঙ্গে আমি আশা করি ইরানের শুভবুদ্ধির উদয় ঘটবে। ইসলাম ধর্মের নামে যারা ভায়োলেন্সের পথ গ্রহণ করেছেন তাদের জানা উচিত যে ইসলাম প্রতিক হজরত মহাম্মদ (দঃ) ও যাদের জন্য দেশে থাকতে পারেননি ফিরে এসে তিনি তাদের মাফ করে দেন। হজরত আলী (রাঃ) ও মৃত্যুশয্যায় তার প্রতিপক্ষকে মাফ করে দেন।
প্রশ্ন—আপনি কি মনে করেন এখনই জাতীয় সংসদের ‘অধিবেশন ডাকা উচিত?
উত্তর-সংসদের অধিবেশন অবিলম্বে ডাকা উচিত। দেশের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে সংসদ সদস্যরা আলোচনা করতে পারলে তাতে সরকারই লাভবান হতেন।
স্বাধীনতা-পুর্বসংস্কৃতি চর্চার স্বরুপ
আহমদ রফিক
নিশ্চিত গর্বের আত্মপ্রসাদে নিয়ে আমরা স্বাধীনতা’ শব্দটি উচ্চারণ করে থাকি। শুধু উচ্চারণ নয়, স্বাধীনতার প্রসঙ্গ এলেই আবেগে উত্তাল হয়ে উঠি। একবারও লক্ষ্য করে দেখি না আমাদের আত্মপ্রসাদে স্ফীত বেলুনটির বাহারী চেহরা জনমানসের অঙ্গনে কোনরুপ নিয়ে বিধৃস্ত।
এই বাতিক্রমের কালি খুজতে গেলে কিছু তীক্ষ্ণ প্রশ্ন মাথা উচিয়ে ছুটে আসে। প্রশ্ন উঠেঃ এ স্বাধীনতা জনসাধারণের স্বার্থে অজিত? এই ‘পাওয়ার মধ্যে কি প্রতিটি মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্র কৃষকশ্রমজীবী, ভুমিহীন ক্ষেতমজুর ও দিনমজুর মানুষের অর্থনৈতিক স্বার্থ সংরক্ষিত হয়েছে কিংবা সংরক্ষণের চেষ্টা চলেছে? যদি তা না হয়ে থাকে, তাহলে কাদের স্বার্থে কোন শ্রেণীর স্বার্থে এই স্বাধীনতা? প্রাথমিক আবেগ সুস্থির হবার পর আজ প্রায় সবাই স্বীকার করবেন, আমাদের স্বাধীনতা সর্বজনীন স্বার্থে অজিত হয়নি, এবং হবার কথা নয়। সংখ্যালঘিষ্ঠ উঠতি বিত্তবান ও শিক্ষিত শ্রেণীর একাংশের স্বার্থে এই স্বাধীনতার অর্জন ও সংরক্ষণ।
স্বাধীনতার প্রশ্নেই আমরা সংস্কৃতি ও সংস্কৃতি চর্চার অঙ্গনে পৌছে যাই। কারণ, অস্বাভাবিক শোনালেও সত্য যে আমদের স্বাধীনতা সংস্কৃতি-আন্দোলনের পথ বেয়ে রাজনৈতিক উপপ্লবের বজ্র্য-বিদ্যুতের মাধ্যমে অর্জিত। সাংস্কৃতিক আন্দোলন এই পদযাত্রার সুচনা ঘটিয়েছে। সেই আটচল্লিশে যার সুচনা বায়ান্নে তার বহুমুখী সম্ভাবনার দিক উদ্ভাসনের পর এবং পরবর্তী প্রায় দুই দশকে সেই প্রক্রিয়ায় বিকাশ ও উত্তাল তরঙ্গ। পরিণামে ষোল ডিসেম্বর ১৯৭১। কালি-কলম সাক্ষর ইত্যাদি। তাই আমাদেরই সংস্কৃতি চর্চা চারিত্রাধর্মেও খুজে পাওয়া যায় স্বাধীনতায় চারিত্ত্রাবৈশিষ্ট্য, তার শ্রেণী-স্বার্থের পরিচয়।
বিশদ পর্যালোচনায় না যেয়েও স্বাধীনতা-পুর্ব সংস্কৃতি চর্চার কিছু লক্ষণ থেকেই দেখা যায় পাকিস্তানী আমলের শুরুতেই কিছু সচেতন সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টায় সীমিত বৃত্তে ভাষা ও ভুখন্ড ভিত্তিক জাতীয়তাবোধে নিযুক্ত সংস্কৃতি নির্মাণের চেষ্টা চলছে।শুধু শিল্পকলায় বা জীবনযাত্রার চলমান বৈশিষ্ট্যেই নয়; ভাষা, বর্নমালা, শিক্ষা প্রভৃতি সমস্যা ঘিরে সংগঠিত ও সংঘতি প্রতিব’দী কার্যক্রম এই প্রয়াস পরিস্ফুট। এই সব সাংস্কৃতিক আন্দোলনে উৎস -মুখ শিল্প-সাহিত্য-সঙ্গীত ও সংস্কতির অন্যান্য ধারায় এক গণতান্ত্রিক চেতনার বিকাশ তারই রুপান্তর ঘটেছে রাজনৈতিক চেতনায় এবং ক্রমশঃ কেন্দ্রীভুত রাজনৈতিক শক্তিতে। অর্থাৎ সমগ্র প্রচেষ্টার মুলে ছিল শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী। এর মধ্যে তাদের আপন স্বার্থ যেমন নিহিত ছিল, তেমনি ছিল প্রতিবাদী কার্যক্রমের রাজনৈতিক রুপান্তরের সঙ্গে সঙ্গে উঠতি বিত্তমনস্ক শ্রেণীর স্বার্থ। তাদের সাহায্যেই রাজনৈতিক পর্যায়ে এর তীব্রতা ও ব্যাপকতা গড়ে উঠেছিল। সংস্কৃতি চর্চা এই শ্রেণী-বৈশিষ্ট্য প্রায়শঃ ভুলে যাই সলেই এক রাজনৈতিক ফলশ্রুতিতে বা বিস্তারে আমরা এক অসম্ভব প্রত্যাশা জুড়ে দেই এবং পরিণামে হতাশা আমাদের মনোযন্ত্রণার কারণ হয়ে উঠে।
সংস্কৃতি চর্চার স্বরুপে ধৃত এই সীমাবদ্ধতা ও তার চারিত্রিক বৈশিষ্টের উৎস সন্ধান করতে গেলে দেখা যায়, আমাদের সংক্ষতি চর্চা যে কয়েকটি বিশেষ প্রভাবের অধীনে এগিয়ে গেছে, তার মধ্যে ভাষা- ভুখন্ড-চেতনা, রক্ষণশীলতায় সামাজিক-ধর্মীয় চেতনা, ঐতিহ্য চেতনা ও সমাজ -প্রগতিরর চেতনা ছিল প্রধান।
আমরা যানি, বিভগোত্তরকালে বাঙ্গালী সংস্কৃতির প্রাতি শাসক-শক্তির নানামুখী আঘাত বাঙ্গালী জাতিসত্তা ও ঐতিহ্যের প্রতি তাদেশ প্রত্যাশা অবজ্ঞা এবং সর্বোপরি অর্থনৈতিক শোষণের প্রবণতা সাধারণভাবে শিক্ষিত জনমানসে এবং বিশেভব সচেতন জনমানসে যে বিক্রিয়ার (রিএ্যাকশান) নাম দিয়েছিল তারই নিহিত শক্তির নেপথ্য শক্তিরুপে আমাদের সংস্কৃতির নৌকাটিকে চালিয়ে নিয়ে গেছে। ফল হয়েছে অনেকটা অন্ধকারে বৈঠা চালানোর মতন। সংস্কৃতি চর্চার এই বৈশিষ্ট তখন আমাদের চেতনা দেয়নি। তাই সংস্কৃতি চর্চায় ব্যাপক পটভুমি সৃষ্টির কথা জোরালো ভাবে আমাদের নাড়া দেয়নি।
উল্লিখিত কারণে ঐতিহ্য চেতনা সংস্কৃতি-চর্চার সহায়ক উপাদান হিসেবে কাজ করেছে এবং তাও সর্বক্ষেত্রে নয়। আমাদে সম্প্রদায়-চেতনার পটভুমিতে এর প্রভাব শক্তিমান হয়ে উঠতে পারেনি। হয়তো তাই এর পথচলা অংশতঃ জাতীয়তাবোধের হাত পারে। শ্রেণীচেতনার বিকাশে এর অবদান যেমন দুর্বল তেমনি অতি ক্ষুদ্র পরিধিতে সীমাবদ্ধ। অন্যদিকে, সমাজ চেতনা এই সব কারনে এবং সর্বোপরি সাধারণ্যে রাজনৈতিক চেতনার নিম্নমানের দরুন শ্রেণীচেতনার বিকাশে প্রধান কোন ভূমিকা নিতে পারেনি। বরং তবু প্রভাব ঘরেফিরে গণতান্ত্রিকতার পথে ঐ জাতীয়তাবোধের বেগবান শ্রোতেই শক্তি যুগিয়েছে।
এগুলোর পাশাপাশি ধর্মভিক্তিক জাতীয়তাকে কেন্দ্র করে শাসকশ্রেণীর আনুকুলে সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার একটি প্রচেষ্টা বাঙ্গালী সমাজের একাংশে বরাবরই সক্রিয় ছিল। এবং এই প্রচেষ্টা প্রতিক্রিয়ায়, শ্রেণীচেতনা নয়, বরং জাতীয়তাবাদী ধচেতনায় ক্রমশ শক্তি সঞ্চয় করেছে। পুর্বোক্ত চর্চার পেছনে সামজিক রক্ষনশীলতা ও প্রতিক্রিয়ার টানে পরিস্ফুট ছিল বলে বাঙ্গালী জাতীয়তাবোধের শক্তি বুদ্ধিকেই আমরা একদিকে সামাজিক প্রগতির ‘চাপে অন্যদিকে জনমানসে রাজনৈতিক চেতনায় শীর্ষোন্নতি রুপে গৃহিত করেছি। গাটা বিষয়টির বিশদ পর্যালোচনা যেমন করিনি তেমনি শতাব্দী-সঞ্চিত সামাজিক রক্ষণশীলতাকে আদৌ বিচারে অনিনি এবং গুরুত্ব দেইনি। ভাবিনি এর অপসারন সীমাবদ্ধ বৃত্তের সচেতনতায় সম্ভব হবে না এবং শ্রেণীচেতনার বিকাশ ঘটাতে না পরষ্পর প্রতিক্রিয়ার পরিবেশে এক উদ্ভাস দেখা যাবে। এক কথায় রাজনৈতিকভাবে আমরা সমস্যাটির নিষ্পত্তি করিনি বা করতে পারিনি অথবা সংক্ষিপ্ত পথের তাড়ায় আদৌ করতে চাইনি।
একটি চমৎকার চতুষ্কোণী সংস্কৃতি চর্চার অবশেষ পরিনামে দেখা গেল জাতীয়তাবাদে সংশ্লিষ্ট শেনীবিশেষের অর্থনৈতিক স্বার্থকেই প্রাধান্য করে তোলা হয়েছে। এবং তার সপক্ষে শক্তিমান শ্রোতধারা সৃষ্টি করা হয়েছে। পক্ষান্তরে এই চর্চা শ্রেণীসচেতন সাংস্কৃতিক ধারার লক্ষণীয় প্রভাব সৃষ্টি করেনি। যদিও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত তথা বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় সংস্কৃতি চর্চার প্রধান কারিগর, তবু এদের সচেতন অংশই তো গণতান্ত্রিক চেতনার যাত্রাপথে শ্রেণীচেতনার উপদান সংযোজন করতে থাকে। কিন্তু বর্তমান ক্ষেত্রে তা ঘটেনি। এবং ঘটেনি বলেই স্বাধীনতা-উত্তরকালে পরিবেশ আনুকুল্যে বিপরিত স্রোতের টান প্রবল হতে পেরেছে।
স্বাধীনতা-পুর্ব সময়ে আমাদের সংস্কৃতি চর্চা একটি প্রতিবাদী রুপ অর্জন করা সত্তেও তা যত না ছিল সমাজচেতনা জাতি তারচে’ বহুগুণ অধিক আঘাতের প্রতিক্রিয়া-জাত। তাই সংস্কৃতি প্রত্যক্ষ কারিগর অর্থাৎ শিক্ষিত, বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ই এই আঘাত ও তা প্রতিক্রিয়ায় প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট হয়েছিল। কিন্তু একে ব্যাপক চরিত্রে উত্তীর্ণ করার কথা অর্থাৎ জনসংস্কৃতিতে সংশিষ্ট করার কথা আমাদের চেতনায় ধরা দেয়নি। আপাত-বিচারে এই প্রতিবাদী সংস্কৃতিব চব্চয় বুদ্ধিজীবীর চেতনা নির্ভেজাল বাদে শিকতা বা গণতান্ত্রিক জাতীয়তা রুপে পরিক্ষা হওয়া সত্তেও বাস্তব বিচারে সেটা ছিল সংশ্লিষ্ট শ্রেণীবিশেষের স্বার্থ নির্ভর ক্রিয়াকর্মের চেতন-অচেতন প্রতিফলন। ছিল শিক্ষিত শ্রেণীর আত্ম বিস্তারের পদক্ষেপ এবং উঠতি মুৎসুন্দি স্বার্থের প্রতিপত্তি বিস্তারের সপক্ষে অনুষ্ঠিত কর্মকাণ্ড। সম্ভবতঃ এ জন্যই আমাদের ” গণতান্ত্রিক প্রগতির সংস্কৃতি চর্চা, এমন কি তথাকথিত জনসংস্কৃতি, চর্চা নাগরিক সীমানার বাইরে জনজীবনের প্রাঙ্গণে প্রসারিত করে দেবার প্রয়োজন অনুভূত হয়নি।
এর আরো একটি কারণ সম্ভবতঃ মত ও পথের বিভিন্নতা ও বিরোধিতা দ্বিধ হত এবং দুর্বল বামশক্তির সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণে ভ্রান্তি। দৈশিক ও আন্তর্জাতিক হিসেবনিকাশে ভ্রান্তির ফলে পথের সঠিক চরিত্র চিহ্নিত করা এবং তার যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে অনিষ্ট জনমানসে পৌছানো তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। এমনকি এ কাজে প্রয়োজনীয় শ্রম ও নিষ্ঠা ব্যবহারে এরা কতখানি আন্তরিক ছিলেন, তেমন প্রশ্ন তেলাও সম্ভবতঃ অর্বাচীন নয়। অর্থাৎ মুল পথের পাশ কাটিয়ে শপথ গ্রহণের প্রবণতা আমাদের প্রগতিপথীদের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করেছিল।
এর ফলে গণতান্ত্রিক জাতীয়তার উপাদানগুলোকে সামনে দেখেও তাদের চরিত্র ও শক্তি চিনতে ভুল হয়েছে, এবং সেজন্য সেগুলোকে কাজে লাগানো সম্ভব হয়নি সঠিক পথের ঠিকানায় নিয়ে বসা সম্ভব হয়নি। ভাষা শিক্ষা সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট আন্দোলনের দীর্ঘস্থায়ী উত্তাপ ও শক্তির প্রায় সবটুকুই জাতীয়তাবাদী রাজনীতির একাংশ দলীয় প্রয়োজনে ব্যবহার করেছে। এইদিক থেকে বিচার করতে গেলে অস্বীকারের উপায় নেই যে বাম রাজনীতি শুধু ব্যর্থতার দায়ভার বহন কয়েছে। আরো স্বীয় করতে হয়: যে বামপন্থার সঠিক পথ গ্রহণে ব্যর্থতার ফলে বাঙ্গালী চেতনায় আত্মঅন্বেষা ও আত্মপ্রকাশ দিয়ে উদ্ভুত আবেগ সুবিধাবাদী অঙ্গনেই ব্যবহৃত হয়েছে সর্বাধিক। এবং এতে করে মধ্যবিত্তের সুবিধাবাদী মানসিকতাই বার বার প্রমাণিত হয়েছে।
সত্য বলতে কি ভাষা ও সংস্কৃতি উপকরণগুলো ঘিরে বাঙ্গালীর আবেগশ্রেত চেতনা সংস্কৃতি চর্চায় যেসব দিক স্পর্শ করেছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক দূরদর্শিতার অভাব কিংবা স্ববিরোধিতার লক্ষণ পরিষ্ফুট। এতো গেল একদিক। অন্য দিকে ভাষা সংক্রান্ত আন্দোলনের বিভব ও প্রভাব রাজনৈতিক প্রয়োজনে ব্যবহৃত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু পাশাপাশি সংস্কৃতি আন্দোলনে নতুন গুণগত অর্থে সমৃদ্ধ পথ খুলে দেবার চেষ্টা কিংবা তাকে বৃহতর জনমানসের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে তোলার চেষ্টা আদৌ করা হয়নি।
অথচ ভাষা-শিল্প-সাহিত্য-সঙ্গীত ইত্যাদি ঘিরে বিকশিত জাতীয়তাবোধের এই উপন্তরীয় বিস্তার আমাদের চোখে জাতীয় সংস্কৃতি ও বাঙ্গালী সংস্কৃতির চেতনারুপে প্রতিফলিত হয়েছে। একদিকে এতে বৃহত্তর বাঙ্গালী জনমানসের উপস্থিতি যেমন ছিল না, অন্যদিকে এর প্রতিফলন প্রধানতঃ ঘটেছে জীবনের বৈঠকখান অন্দর মহলে কদাচিৎ। বহিরঙ্গে প্রাধান্য পাবার ফলে বৈঠকখানায় ক্ষণকালীন অতিথি আপ্যায়নের মতই তার সম্ভাবনার স্থায়িত্ব ছিল ক্ষণকালীন।
এই প্রক্রিয়ার প্রতিফলন হিসেবেই পঞ্চাশ দশকের সচেতন ছাত্রসমাজ ও সংস্কৃতিমনস্ক ব্যক্তি আবেগ-নির্ভর হয়ে বাংলা ছায়া ছবিতে ভিড় জমিয়েছে, সেই সঙ্গে নির্বাচিত প্রগতিধর্মী ইংরেজী ছবি দেখেছে। সঙ্গীত, নৃত্যকলা নাট্য ও অন্যান্য ক্ষেত্রে বাঙ্গালী ঐতিহ্যের প্রতিফলন ঘটানোর চেষ্টা চলেছে। চিত্রকলার ছাত্র ও কর্মীদের হাতের টানে রাজপথ আপনার লালিত্যে ভরে উঠেছে। এবং এই সব প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে নকশী কাথার কারুকর্মে, সরা-কুলা হাড়ি-কলসির গায় সুদর্শন নকশায় আমাদের ঐতিহ্যপ্রীতি ও জাতীয়তাবোধ ধরা দিতে চেয়েছে।
সামাজিক কিংবা পারিবারিক অনুষ্ঠান এমনকি ব্যক্তিগত আচার-আচরণেও বাঙ্গালীয়ানার মানসিকতা বুদ্ধিজীবী মহলে ক্রমশঃ বিস্তার লাভ করেছে। লোকসঙ্গীতের প্রতি অনুরাগ ও লোকায়ত শিল্পকলার প্রতি আকর্ষণ একই চেতনার অপর পিঠ ! মরমী, বাউল এবং কবিগান প্বভৃতির মাধ্যমে গণচেতনার যে প্রকাশ্য দেখা গেছে, তা প্রধানতঃ প্রগতিবৃত্তের অন্তর্ভুক্ত হওয়া সত্তেও সমাজচেতনা ও জাতীয়তার সমন্বিত মূলধন। এগিয়ে যাবার কাজে বামপন্থিকে বড় একটা সাফল্য অর্জন করতে দেখা যায়নি। সম্ভবতঃ বহত্তযর জাতীয় ক্ষেত্রে রাজনৈতিক চেতনা শ্রেণীগত বিচারে নিম্নমানের ছিল বলেই এই দুরুহ পথে বিভিন্ন বাধা পেরিয়ে এগিয়ে যাওয়া খুব সহজসাধ্য ছিল না। প্রগতি’শক্তিকে তখন দুই বিভিন্ন পথের প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে একসঙ্গে লড়াই করে এগুতে হয়েছে। এতসব সত্তেও আমাদের সংস্কৃতি ক্ষেত্রে প্রগতিপ্ববণা যে শহর-নগরে সীমাবদ্ধ রইলো শিকড়ের সঙ্গে সংযোগ খাতে এগিয়ে গেল না, সেখান থেকে পুষ্টি অহরণের কথা মনে হলো না-এ ভ্রান্তি অস্বীকারের পথ কোথায়?
দেশকালে, পটভুমিতে পঞ্চাশ দশকে সংস্কৃতি চর্চার বিচার এবং পরবর্তী দশকে তার ক্রমানুবর্তিতায় অনুধাবনে দেখা যায়। সেখানে যেমন রয়েহে গণতান্ত্রিক ও মানবিক চেতনার লক্ষণাদি তেমনি রয়েছে ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত সমাজচেতনার কিছু বলিষ্ঠ স্বাক্ষর। আবার এর পাশাপাশি রয়েছে দুর্বলতা, সীমাবদ্ধতা, আদর্শগত বিধান। সংশয় ও পরম্পর-বিবোধিতার চিহ্ন সর্বোপরি শিকড় থেকে বিচ্ছিন্নতা। আমাদের সংস্কৃতিচর্চা একাধারে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রতিবাদ-প্রতিরোধের ভুমিকা পালন করে পরিশেষে এক উপলবের জন্ম দিয়েছে বলেই ভেবে দেখা প্রয়োজন যে, এই ভাষা-ভূখণ্ডে স্থানিকতায় উদ্ভুত জাতীয়তায় সাংস্কৃতিক চর্চা ও চর্চায় রেনেসীর কোন চবিত্র সীমাবদ্ধভাবে হলেও জন্ম নিয়েছিল কি না?
পুরনো সমাজব্যবস্থা এবং পুরনো মূল্যবোধের অবক্ষয়। অস্তিত্ব ও প্রতিক্রিয়াধর্মী ধ্যান-ধারণা থেকে (কি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে, ‘ কি সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে) মুক্তি এবং সেইসঙ্গে সমাজ কিংবা সংস্কৃতি ‘ অথবা উভয় ক্ষেত্রে প্রগতিধর্মী নতুন ব্যবস্থা ও নতুন মল্যবোধের আবির্ভাব যদি রেনেসা’র অন্যতম লক্ষণ হয়ে থাকে, তাহলে স্বাভাবৎই প্রশ্ন ওঠেঃ রেনেসা’র উর্বর ভিত্তিতে দাঁড়াবার সুযোগে আমাদের কোথায় ছিল। এতসব কিয়াকর্ম সত্তেও আমরা সেই সংগ্রামের সিদ্ধি অর্জন করতে পারিনি।
আমাদের সংস্কৃতি চর্চার যে বৈশিষ্ট্য গুণগত পরিবর্তনের ও সাফল্যের বড় একটা সহায়ক হয়নি, তা হল আবেগ-বাহুলা। তাই বিভিন্ন শাখায় সংস্কৃতি চর্চার বিস্তর সত্তেও একে সমন্বিত একটি ধারাস্রোতে সংহত করা যায়নি; এতে রেনেসা’র তাৎপর্য আরোপ করা যায়নি; সর্বোপরি একে নাগরিক বৃত্তের বাইরে এনে প্রস্তরে পৌছানোর পথ তৈরি করা যায়নি। অথচ আমরা জানি সংস্কৃতিক্ষেত্রেও অন্ততঃপক্ষে একটি রেনেসাঁ’র নিশ্চিত প্রয়োজন আমাদের ছিল, যা গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবোধকে জীবন বাস্তবতায় গভীরে নিয়ে যেতে পারতো বৃহত্তর জনজীবনের প্রান্তরে এর বিস্তার ঘটাতে পারতো। এবং তার ফলে সংস্কৃতিচর্চাকে জাতীয়তাবাদী চেতানার সংকীর্ণ শ্রেনীবৃত্ত থেকে তুলে এনে উর্বর প্রান্তরে মাটির পে শকরসের সংগে স্থাপন করা সম্ভব হতে পারতো যাতে এর স্থায়িত্তের প্রক্রিয়া নিশ্চিত হয়। কিন্তু না, অই পালল মাটিতে শিকড় চালাবার বিচক্ষণতা ও শ্রমসাপেক্ষ চেষ্টা কোন নগরবাসী ‘বোধিদ্রমেরই ছিল না। এমনকি ‘আবেগ যথাযথভাবে সংহত করে সঠিকভাবে ব্যবহার করা গেলেও তাতে সুফসল ফলতে পারতো। কিন্তু সেদিকেও আমাদের নজর যায়নি!
আমাদের সংস্কৃতিচর্চায় নব-উত্তরণের পথে যাত্রায় নিহিত দুর্বলতা, অক্ষমতার কায়ণ সন্ধানে আরো একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির উপর শাসকশ্রেণীর আঘাতের চরিত্র প্রধান অর্থনীতি-নির্ভয় ও উপনিবেশিক ধর্মী হবার ফলে শ্রেণী হিসেবে বাঙ্গালী মাধ্যবিত্ত-উচ্চমাধ্যবিত্ত-মুৎসুন্দি এবং তাদের উপশ্রেণী বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষিত সমাজে যে গভীর প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল তারই ফসল সেই সংস্কৃতিচর্চা, অর আবেগ, তার ইতি বাচক চরিত্র। কিন্তু এই সংস্কৃতি চর্চার আপাত-রুপ ইতিবাচক হওয়া সত্ত্বেও আমাদের বিবেচনায় এর অন্তর্নিহিত কারণটি নৈতিবাচক। অর্থাৎ আমাদের সংস্কৃতি চর্চর আবেগ যত না নতুন সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রয়োজনে তার চেয়ে অনেক বেশি পাকিন্তানী আঘাতের প্রতিক্রিয়াজাত। তত্ত্বগত বিচারে সুক্ষ্ণ হলেও এই কারণটি উপেক্ষার না।
এর ফলে আমাদের আত্মচেতনা ও জাতিসত্তা নির্মাণের ইতিবাচক উদ্দীপনা শিকড় ছুয়ে সৃষ্টিকর্মে মনোনিবেশ করতে পারেনি বলে এতে ব্যাপক জনমানসের অভিব্যক্তি সংযুক্ত হয়নি। এবং সংস্কৃতির প্রসার মাটির গভীরে যেতে পারেনি। এ প্রসঙ্গেই প্রশ্ন ওঠে। কারা সেই সীমিত সংখ্যক সংস্কৃতিমনস্ক ভাগ্যবান, যারা সংস্কৃতি চর্চার ধারায় সাংস্কৃতিক নব-নির্মাণের দায় গ্রহণ করেছিলেন? সন্দেহ নেই তারা প্রধানতঃ মধ্যবিত্ত-উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু সমাজবিজ্ঞানের বিচারে সংস্কৃতির সত্যকার নির্মাণ, রূপান্তর চারিত্র বদল ইত্যাদি প্রক্রিয়ায় প্রধান উৎস তো বৃহত্তর জনসমাজ। অথচ সেই জনমানসের উপস্থিতি ছাড়াই বুদ্ধিজীবী চেয়েছি (অবশ্য সকল সদিচ্ছা নিয়েই) সংস্কৃতির সুস্থ সচল রূপ, তার প্রগতি-চরিত্র গড়ে তুলতে। ভগ্নাংশের সংস্কৃতিচর্চায় গড়ে-ওঠা বালুচরকে পালল সংস্কৃতির তথ্য জনসংহতির ভিত্তিভূমি রুপে দেখতে চেয়েছি। এতে অতি-উৎসাহী ইচ্ছা পূরণ ও আত্মতৃপ্তির কাজটি সম্পন্ন হয়েছে মাত্র। নিজ শ্রেণীস্বার্থের শহ্য ঘরে তোলা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু এতে করে সংস্কৃতিচর্চা পুরনে অভ্যাসের বৃত্তেই আবর্তিত হয়েছে, তাতে নতুন গুণগত চরিত্র সংযোজিত হয়নি।
স্পষ্টতঃই দেখা যাচ্ছে, আমাদের সংস্কৃতিচর্চা, এই ভূখন্ড ভিত্তিক জনগোষ্ঠীর পটভূমিতে ‘জাতীয়’ ‘জাতীয়তা’ প্রভৃতি শব্দাবলীর সম্পৃক্তি সত্ত্বেও সুপষ্ট শ্রেণীবিশেষের সাথে নাগরিক বৃত্তে বাধা ছিল। সংখ্যালঘিষ্টের সংস্কৃতিচর্চায় বৃহত্তর প্রাকৃত জনসংখার জৈবনিক প্রতিফলন ছিল না। আর ছিল না বলেই একে ‘জাতীয়তাবাদী সংস্কৃতি বলা হয়তো চলে, কিন্তু জাতীয় সংস্কৃতি বলা কোনোমতেই চলে না। পাকিস্তানী আমলে যা ছিল প্রতিবাদি চরিত্রের গুণসম্পন্ন জাতীয়তাবাদী সংস্কৃতিচর্চা’, ষোল ডিসেম্বর একাত্তর পার হবার পর তার নিশ্চিত চারিত্র বদল হল, অবস্থান বদল হল।
কিন্তু এটা আপাতঃ বদল। কেননা, আমাদের কিছুসংখ্যক বুদ্ধিজীবীর একদ। (সেই প্রতিবাদী পর্যায়ে শাসক-পক্ষপাতিত্বের মতোই তখনো নতুন পারিবেশে সংস্কৃতির প্রধান অংশের চর্চা শাসনবৃত্তের অন্দরমহলে গিয়ে দাঁড়ালো। দাড়ালো সহায় সমর্থনের জন্য লোভের-লাভের প্রত্যাশায়। একাত্তর পরবর্তী এই অবস্থাতেও আমাদের আপত্তি ছিল না, যদি সেখানে জনসংস্কৃতির বাস্তব উপকরন সংযোজিত হতো। এবং সত্য সত্যই সেখানে গুঙ্গত পরিবর্তনের সুচনা দেখা দিতো, নতুন দিক-দর্শনের সম্ভাবনা উন্মোচিত হতো। কিন্তু তার বদলে সামাজিক-রাজনৈতিক শ্রেণীদ্বার্থে এই পথ, সামান্তরাল পথ সংস্কৃতিচর্চায় গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হলো। তাই নতুন পরিবেশে দাঁড়িয়ে, ভূখণ্ডের নতুন পরিচয়ের দিকে লাঘর চোখ মেলে দিয়ে জাতীয় সংস্কৃতি খণ্ড রুপকে তার পুর্নবিয়ব রুপে পরিচিত, চিহ্নিত ও প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টায় আমরা সচেতন বুদ্ধিজীবীও গতানুগতিক পথের বাইরে পা রাখতে সক্ষম হইনি। এ সীমাবদ্ধতা ও অক্ষমতা বুদ্ধিজীবীর মননের ও চৈতন্যে। আমাদের বিশ্বাস, স্বাধীনতা-পুর্ব সংস্কৃতিচর্চার চরিত্র ও গতি প্রকৃতির বিশদ পর্যালোচনা ও পরিচয় প্রহণের মধ্য দিয়ে বুদ্ধিজীবী তার অনুসরণযোগ্য সঠিক পথের সন্ধান পেতে পারে। এবং সংস্কৃতি ভাবনার রোমান্টিক আবেগ-উচ্ছাস থেকে মুক্তি পেতে পরে। আর রোমান্টিক উচ্ছাস, বলাবাহুল্য, একেবারেই মধ্যবিত্ত পুজি যার ভিত মোটেই গভীর নয় এতটুকু শক্ত নয়।
’৭০ দশক
শেখ মুজিবুর রহমান
এ দেশের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রধান নেতা শেখ মুজিবর রহমান ক্ষমতাসীন অবস্থায় ৭৫-এর ১৫ই আগস্টের সামরিক অভ্যুথানে সপরিবারে নিহত হন। সত্তর দশকের প্রথম যে বাংলাদেশের রাজনীতি প্রধান ব্যক্তি ছিলেন শেখ মুজিব। তাঁর জনপ্রিয়তা ছিলো যে কোন রাজনৈতিক নেতার পক্ষে ঈর্ষা জনক। সাড়ে তিন বছরের স্বৈরাচারী শাসনের পর সমপরিমান জনবৈরিতার শিকারও হয়েছিলেন তিনি।
৭০-এর নির্বাচনে শেখ মুজিবর রহমানে নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। এই ঘটনা শেখ মুজিবর রহমানকে এমন এক ইতিহাস নির্ধারিত পথে ঠেলে দেয়া হয় স্বাধীনতা ছাড়া যেখান থেকে ফিরে আসার কোন পথ ছিলো না, যদিও স্বাধীনতার কথা ঘোষণা করার জন্য তাঁকে ৭১-এর ৭ই মার্চ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিলো।
৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধের অদৃশ্য নেতা ছিলেন শেখ মুজিব। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্ব মুহুর্তে শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করা হয়। যুদ্ধের নয় মাস তিনি পাকিস্তানের শিয়ালকোট কারাগারে আটক ছিলেন। ৭১-এর ১৭ই এপ্রিল মুজিবনগরে গঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলা দেশের প্রবসী সরকারের প্রেসিডেন্ট তাঁকেই করা হয়েছিলো। এবং ২৬শে মার্চ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছিল তার নামেই। ৭২-এর ১০ই জানারী দেশে ফিরে তিনি প্রধানমন্ত্রী হন পরে আবার ৭৫-এর ২৫ জানুয়ারী জাতীয় সংসদে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী বিল পাশ করে প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির সরকার ঘোষণা করে। তিনি প্রেসিডেন্ট হন। প্রেসিডেন্ট ও প্রধান মন্ত্রী থাকাকালীন তাঁর সরকার দেশের বিরোধী রাজনৈতিক দল ও মতকে কঠোর হস্তে দমন করে। চোর চালান, লুণ্ঠন ও উৎপীড়নের কারণে সাধারণ মানুষের জীবনে নেমে আসে এক ভয়াবহ বিপর্যয় যার পরিণতিতে ৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে ৬ লক্ষ মানুষ মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর আমলে ৩০ হাজার রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী হত্যা করা হয় বলে অভিযোগও করা হয়েছে। সংবাদপত্রের কন্ঠরোধ করা হয় এবং চড়ান্ত পর্যায়ে একদলীয় শাসন কায়েম করা হয়। ৭৫-এর সামরিক অভ্যুত্থান ও পরিবর্তনকে এই কারণেই সাধারণ মানুষ স্বাগত জানিয়েছিলেন।
বাঙালী জাতির ভাবাবেগ ও অনুভুতিকে শেখ মুজিব অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তাঁর স্বার্থে ব্যবহার করতে পেরে ছিলেন। আবেগময় বক্তৃতায় তিনি অনায়াসে আপ্লুত করতে পারতেন বিশাল জনসমাবেশকে। একে ফজলুল হক ও শহীদ সোহরাওয়ার্দীর উত্তরসুরী হিসেবে তিনি যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন মেধার চেয়ে বেশি আবেগের ক্ষেত্রে। সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় তিনি আওয়ামী লীগের অপরাপর নেতাদের ভেতরও যুক্তির চেয়ে বেশী পরিচালিত হতেন আবেগের দ্বারা।
তাঁর মৃত্যুর পর বিশিষ্ট সাংবাদিক এনায়েতুল্লহ খান বিচিত্রার (ঈদ সংখ্যা ৭৬) লিখেছিলেন, ‘শেখ মুজিবর রহমানের রাজনৈতিক কর্মকান্ড একদিকে নাটকীয়তায় চমকপ্রদ অন্যদিকে দ্বৈধতায় খন্ডিত। তাঁর ক্ষমতারোহণের অভিষত্বা বিগত এক দশকে অপ্রতিহত গতিতে এগিয়ে চলেছিল। অগণিত আত্যদান এবং এক ঝুড়ি রুপকথা মিলিয়ে তৈরি হয়েছিল তাঁর স্বর্গের সিড়ি। ব্যক্তিত্বের অপরিমিত শৌর্ষ ও অনুকুল ইতিহাসের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছিল তার রাজকাহিনী। তিনি ছিলেন রূপকের রাজা। সত্যিকারের মুকুটের ভার তিনি তাই সইতে পারেননি। উপরুত, সেই ভারে ন্যজ হয়েছেন। রক্ত করবীর আত্ম বিমোহিত রাজার মত দুঃশাসনের আচলায়তন প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। যারা প্রাণ দিল, ষড়যন্ত্রের রাজনীতিকে পদঘাত করে নির্দ্বিধায় অস্ত্র তুলে নিল যারা দেশপ্রেমের সুমহান অঙ্গীকারে রক্ত দিয়ে মাতৃভূমির ঋণ শোধ করল, তাদেরই রক্ত-মাংস-হাড়ের বিনিময়ে তিনি গড়তে চেয়েছিলেন এক অলৌকিক ক্ষমতার দেউল। সেখানে দেবতা একক কিন্তু পুজারী নেই। মানুষকে বাদ দিয়ে শুরু হলো বিগ্রহের রাজনীতি পুতুলের খেল। পরদেশী পটুয়ার হাতে সৃষ্টি হলো পুতুলের রাজা শেখ মুজিবুর রহমান।
এই বিদেশী পটুয়া অবশ্যই সাম্রাজ্যবাদ। রাজনীতির প্রথম জীবনে তিনি ছিলেন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের প্রতি অনুগত তাঁর এই সাম্রাজ্যবাদ প্রীতির কারণেই মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে এসে ন্যাপ গঠন করেছিলেন। ৭১-এর যুদ্ধে আমেরিকা পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করতে আওয়ামী লীগ রাশিয়ার প্রতি অনুগত হয়। শেখ মুজিব দেশে ফিরে আমেরিকার পরিবর্তে রাশিয়ার আনুগত্য মেনে নেন। তাঁর মর্মান্তিক পরিনতির জন্য রাশিয়া বহুলাংশে দায়ী, সমান্তরাল না হলেও যেভাবে রাশিয়া দায়ী চিলির আলেন্দের মৃত্যুর জন্য। শেখ মুজিব যা বিশ্বাস করতেন না তাই করিয়ে নিতে চেয়েছিলো বিদেশীরা তাঁকে দিয়ে।
বাংলাদেশের বুর্জোয়া রাজনীতিতে শেখ মুজিব ছিলেন শেষ ব্যক্তি যাঁর পক্ষে জনসাধারণের একটা বড় অংশকে প্রভাবিত বা মোহগ্রস্ত রাখা সম্ভব ছিলো। তার মৃত্যুর পর তাই তাঁর দলসহ অপর পর বুর্জোয়া দলগুলিও বহুধাবিভক্ত হয়ে যায়। সত্তর দশকের সুত্রপাতেই পুর্ণ উদয় ঘটেছিলো শেখ মুজিবের। মধ্য গগণ থেকে তাঁর বিনাশ ঘটে দশকের মধ্য ভাগে।
’৭০ দশক
মাওলানা ভাসানী
সত্তর দশকে আমরা হারিয়েছি এই উপমহাদেশের সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদ বিরোধী আন্দোলনের একজন পরোগামী নেতা মওলানা ভাসানীকে। ১৯৭৬ সালের ১৪ই নবেম্বর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন মহান জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসনী। অবসান ঘটে তার ৭০ বছরের সংগ্রামবহুল রাজনৈতিক জীবনের। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিলো ৯৬ বছর।
৭০ দশকের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যে ঘটনা-বাংলাদেশের স্বাধীনতা এক হিসেবে মওলানা ভাসানীই এই ঘটনার জনক। তিনি ৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনে প্রথম বিচ্ছিন্নতার অভাস দেন এবং ৭০-এর প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের পর স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করেন এবং স্বাধীনতর দাবীকে সর্বস্তরের জনসাধাণর কাছে যৌক্তিকতার সঙ্গে তুলে ধরেন বিভিন্ন জনসভায়। ৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার পেছনে তাদের দলীয় ৬ দফা কর্মসূচীর চেয়ে মাওলনার স্বাধীনতার ১ দফার ভুমিকা ছিলো বড়ো। স্বাধীন হওয়ার ইচ্ছা নিয়েই সাধারণ মানুষ আওয়ামী লীগকে জিতিয়েছিলো।
৭১-এর যুদ্ধের সময় মওলানা ভাসানী ভারতে যাওয়া মাত্র তাকে অন্তরীণ করা হয়। ৭২ সালে তিনি দেশে ফিরে আসেন। শেখ মুজিবের আওয়ামী বাকশালী সরকারের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রামে অবতীর্ণ হন বর্ষীয়ান মওলানা। ৭২-এ সংবিধান ঘোষণার পর তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। ৭৩ সালে ভূখা মিছিলে নেতৃত্ব দেন মওলানা ৭৪-এ সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের আন্দোলন সুচনা করতে গিয়ে শেষবারের মত সন্তোষে অন্তরীণ হন মওলানা। ৭৫-এর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনকে স্বাগত জানিয়ে মওলানা। সংগ্রামের মোড় পরিবর্তন করেন। সীমান্তের ভারতীয় হামলা ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার কথা বলেন। পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরে সাম্প্রদায়িক শক্তির অশুভ তৎপরতার বিরুদ্ধেও জনগণকে হুশিয়ার করে দেন।
১৯৭৬ সালে ঐতিহাসিক ফারাক্কা মার্চে নেতৃত্ব দেন মওলানা ভাসানী। লক্ষাধিক মানুষের এই বিশাল মিছিলের সমাপ্তি ভাষণে মওলানা বলেছিলেন, কোন হমকি, ধমকানি কিম্বা চোখ রাঙ্গানীতে বাংলাদেশের জনগণকে কাবু করা যাবে না। গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যায় তাদের সার্বভৌম অধিকার কায়েমের সংগ্রাম চলবেই। জতি ধর্ম নির্বিশেষে বাংলাদেশের জনগণ গঙ্গার পানিতে ন্যায্য হিস্যা আদায়ের লড়াই চালিয়ে যাবে।’
ফারাক্কা মার্চের পর থেকে মওলানার শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে। তিনি ফারাক্কা মিছিলের জন্য সংগঠিত বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলির সমন্বয়ে জাতীয় প্রতিরোধ কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেন। কিন্তু তাঁর অসুস্থতার জন্য সেই প্রচেষ্টা কর্যকর হতে পারেনি।
তাঁর জীবনের শেষ সাংবাদিক সাক্ষাৎলনে (১৪ই নবেম্বর ৭৬) মওলানা ভাসানী হাসপাতালের অন্তিম শয্যায় শায়িত অবস্থায় বলেন, ‘বাংলাদেশ আজ এক যুগ সন্ধিক্ষণে। এ দেশের মানুষ ক্ষমতলিপ্সু দুর্নীতি পরায়ন, শুন্যগর্ভ, প্রতিশ্রুতি সর্বস্ব ভাওতাবাজ রাজনীতি প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা কোন অবস্থায় বলগাহীন দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচার ও সর্বব্যাপী নিরাপত্তাহীনতার কাছে ফিরে যেতে চায় না। দালানবাসী সাদাকাপড়ী মানুষের বাজ মেহনতি জনতার জন্য শুধুমাত্র দুঃখ ও দৈন্যই বহিয়া আনে। মাঠের মানুষে, কলের মানুষে, খাল বিল আয় নদীন লার মানুষের রাজ কায়েম করতে হবে। এরাই এ দেশের শতকরা ৮৫ ভাগ।
মওলানা ভাসানী আজীবন কৃষক শ্রমিক মেহনতি মানুষের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছেন। তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সূচনাকাল থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত একই লক্ষ্যে পরিচালিত হয়েছে তার সকল আন্দোলন ও সংগ্রাম। সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্যবাদের শোষণের স্বরুপ তার চেয়ে সহজভাবে আর কোন নেতার পক্ষে তুলে ধরা সম্ভব হয়নি। তার সমসাময়িক রাজনৈতিক নেতাদের কেউই তাঁর মতো মেহনতি মানুষের আপনজন হতে পারেননি। মওলানা ব্যক্তিগত জীবনে একজন ধর্মপরায়ন মানুষ হলেও রাজনৈতিক জীবনে তিনি কম্যুনিস্টদেরই তাঁর প্রকৃত মিত্র মনে করতেন।
পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে এদেশের কম্যুনিস্ট আন্দোলন অনেকাংশে মওলানার দ্বারা প্রভাবিত ছিলো। সত্তরের দশকে সাংগঠনিকভাবে মওলানর সঙ্গে কম্যুনিস্টদের যোগাযোগ না থাকলেও তাদের আপদে বিপদে মওলানা স্নেহময়য় পিতার মত এগিয়ে এসেছেন আওয়ামী বাকশালী আমলে প্রচন্ড কম্যুনিস্ট নির্যাতনের বিরুদ্ধে তিনিই ছিলেন একমাত্র প্রতিবাদী কণ্ঠ। তার সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘হক কথা’ আওয়ামী লীগ সরকরের বিরুদ্ধে জনমত গঠনে যথেষ্ট অবদান রেখেছিলো যে কারণে শেখ মুজিব এই পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ করে দেন। সত্তরের দশকেই মওলানা ভাসানী সন্তোষে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।
মওলানা ভাসানীর মৃত্যু গোটা জাতিকে শোকাহত করেছিলো, যে মৃত্যুকে তুলনা করা যেতে পারে এক বিশাল মহীরুহের পতনের সঙ্গে, যে মহীরুহ ছিলো এ দেশের বিরোধী রাজনীতির প্রধান আশ্রয়স্থল।
’৭০ দশক
সিরাজ সিকদার
১৯৭৫ সালের ২ জানুয়ারী পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টির চেয়ারম্যান সিরাজ সিকদার বন্দী অবস্থায় পুলিশের গুলিতে নিহত হন। ৩ জানুয়ারী দৈনিক পত্রিকালিতে প্রকাশিত ঢাকার পুলিশ সুপারের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয় পর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টি নামে গোপন উগ্রপন্থী দলের প্রধান সিরাজুল হক সিকদার ওরফে সিরাজ সিকদারকে গত ১ জানুয়ারী চট্টগ্রামে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ঐদিনই তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ঢাকায় পাঠান হয়। জিজ্ঞাসাবাদের সময় তিনি স্বীকারোক্তি মুলক বিবৃতি দেন এবং দলীয় কর্মীদের ও অনুমোদিত অস্ত্র-শস্ত্র ও গোলা-বারুদ রাখার গোপন আড্ডায় পুলিশকে নিয়ে যেতে রাজী হন। তদনুযায়ী ২ জানুয়ারী রাতে পুলিশের সঙ্গে একটি পুলিশ ভ্যানে এইসব গোপন আড্ডায় যাওয়ার সময় তিনি সাভারের কাছে পুলিশ ভ্যান থেকে লাফিয়ে পড়েন এবং পালানোর চেষ্টা করেন। তিনি যাতে পালাতে না পারেন সেজন্য পুলিশ গুলি চালনা করে। এর ফলে সিরাঞ্জ সিকদারের সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু ঘটে।
পুলিশ সুপারের প্রেস রিলিযে আরও বলা হয়—‘সিরাজ সিকদার তার গোপন দলের জন্য একদল ডাকাতকে সংগ্রহ করেছিলেন যাদের নিয়ে তিনি হিংসাত্মক কার্যকলাপ চালিয়ে সারা দেশে শান্তি ও সম্প্রীতি নষ্ট করছিলেন। গোপন হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছিলেন থানা বন অফিস টেলিফোন এক্সচেঞ্জ আক্রমণ, ব্যাংক হাটবাযার লুট করছিলেন। রেললাইন তুলে ফেলে মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছিলেন এবং লে কজনের কাছ থেকে জোর করে টাকা আদায় করছিলেন।
সিরাজ সিকদারকে গ্রেফতার করার তিন দিন আগে ২৮ ডিসেম্বর ‘৭ তারিখে সারা দেশে জরুরী অবস্থা ও জরুরী (অস্পষ্ট) অডি’ন্যান্স জারি করেন প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবর রহমান। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে যে লাগামহীন শোষণ, লুণ্ঠন ও উৎপীড়ন আরম্ভ করে যেভাবে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে নির্মুল করার জন্য ব্যাপক তৎপরতা চালায় তারই ফলশ্রুতিতে মার্কসবুদ-লেনিনবাদে বিশ্বাসী কয়েকটি রাজনৈতিক দল গোপন অবস্থায় থেকে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। বিপ্লবী সিরাজ সিকদার ছিলেন এ ধরনো একটি দলের প্রধান নেতা।
১৯৭১ সালে গঠিত পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে অতি অল্প সময়ে যথেষ্ট শক্তি সঞ্চয় করে এবং আওয়ামী লীগ সরকারের প্রশানকে নানাভাবে ব্যতিব্যস্ত রাখে।
ভারতের কম্যুনিস্ট আন্দোলনে চারু মজুমদারের রজনৈতিক লাইনের বিকাশের সঙ্গে সিরাজ সিকদারের তুলনা করা যেতে পারে। এদেশের কম্যুনিস্ট আন্দোলনের অপুরাপুর গ্রুপ কর্তৃক সিরাজ সিকদারের লাইন নানাভাবে সমালোচিত হলেও তাঁর মৃত্যুতে তারাও গভীর শোক প্রকাশ করে। সত্তর দশকের প্রথম পর্বে এদেশের বিপ্লবী। তরুণদের সিরাজ সিকদার প্রচন্ডভাবে প্রভাবিত করেছিলেন।
৭৫-এর সামরিক অভ্যুথানের পর বিভিন্ন রাজনৈতিক মহল থেকে সিরাজ সিকদারের হত্যার তদন্ত ও হত্যাকারীদের বিচার দাবি করা হয়। ‘৭৮-এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এবং ‘৭১-এয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে প্রচারণায় সিরাজ সিকদার হত্যা একটি গুরুতবপূর্ণ ইস্যু ছিলো।
শলড ট্র তগন্ন
এদেশের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনে সিরাজ সিকদারের অবদান গুরুত্বের সঙ্গে স্মরণ করা হবে। সিরাজ সিকদার ছিলেন স্বাধীনতার অব্যবহিত পর থেকে আমাত্য নিন্দা শংকা ও প্রশংসায় আলোচিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব যা’ তাঁর মৃত্যুর পরেও অব্যাহত রয়েছে।
’৭০ দশক
খন্দকার মোশতাক আহমেদ
‘৭৫-এর ১৫ আগস্টের সামরিক অভ্যুথানে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবর রহমান নিহত হওয়ার পর নতুন রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন শেখ মুজিবেরই ঘনিষ্ঠ সহযোগী খন্দকার মোশতাক আহমদ। রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণের পর পরই তিনি সারা দেশে সামরিক ও সান্ধ্য আইন জারি করেন। একই দিন তাঁর সহযোগী ১০ জন মন্ত্রী ও ৬ জন প্রতিমন্ত্রী শপথ গ্রহণ করেন। খন্দকার মোশতাকের নতুন সরকার প্রথম স্বীকৃতি লাভ করে পাকিস্তানের কাছ থেকে।
মাত্র ৮০ দিন প্রেসিডেন্ট পদে আসীন ছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমদ। পেশাগত জীবনে আইনজীবী, রাজনীতিবিদ হিসেবে আওয়ামী লীগ নেতাদের ভেতর সবচেয়ে চতুর কুটবুদ্ধিসম্পন্ন ও বিচক্ষণ খন্দকার মোশতাক আহমদ এদেশের জাতীয় জীবনের (অস্পষ্ট) বিশেষ সংকট মুহুর্তে আলোচনার প্রধান বিষয় ছিলেন। আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতা যখন সোভিয়েট প্লাকের দিকে ঝকেছিলো তখনকার মোশতাক আওয়ামী লীগের পুর্ব ঐতহ্য অক্ষুন্ন রেখে মার্কিনের প্রতি অনুগত ছিলেন। যে কারণে মোশতাক সরকারের প্রতি মার্কিনের বতটুকু সমর্থন ছিলো। ততটকু বৈরিতা ছিলো সোভিয়েটের। প্রকৃতপক্ষে এদেশে মার্কিনের হুত নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে খন্দকার মোশতক গুরুত্বপর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন এবং এই কারণেই সম্প্রদায়িক শক্তি পুনর্জীবনের ক্ষেত্রও তিনি বিশেষ অবদান রেখেছেন। অবশ্য এটাও ঠিক যে সোভিয়েট (অস্পষ্ট) থেকে বেরিয়ে আসার জন্য মার্কিন সমর্থন তখন মোশতাকের জন্য অপরিহার্য ছিলো।
‘৭৫-এর পর মোশতাক আওয়ামী লীগের মার্কিন ঘে’যাদের নিয়ে নতুন দল গঠনের উদ্যোগ নেন এবং ‘ফ্রি ইকনমি’র কথা বলেন। ‘৭৬ সালের জুলাই মাসে রাজনৈতিক দলবিধি জারির পর ডেমোক্র্যাটিক লীগ গঠন করেন। ‘৭৬-এর ২৯ নবেম্বর জিয়াউর রহমান প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্বভার গ্রহণের পর খন্দকার মোশতাকসহ আবদল মলেক উকিল, মতিয়া চৌধুরী, প্রমুখ গ্রেফতার হন।
শেখ মুজিবর রহমানের উত্তরাধিকার হওয়ার সমুহ যোগ্যতা থাকা সত্তেও খন্দকার মোশতকের সীমাবদ্ধতা ছিলো জনবিচ্ছিনতার ভেতর, যে কারণে সাম্প্রদায়িক শক্তি সমূহের পুনর্জীবন ঘটাতে গিয়ে তিনি রাজনৈতিক জীবনে বিপর্যয় ডেকে এনেছেন। অবশ্য প্রকৃত মার্কিন অনরগী হিসেবে তাঁর পুনরুত্থানের সম্ভাবনকে কোনক্রমেই নাকচ করা যায় না।
’৭০ এর দশক
খালেদ মোশাররফ
১৯৭৫-এ সামরিক অভ্যুথানের কিছু কাল পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক মঞ্চে (অস্পষ্ট) মতো অবির্ভাব ঘটেছিলো সেনাবাহিনীর তৎকালীন চীফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফের। ৩ নভেম্বর কারাগারের অভ্যন্তরে নিহত হলেন আওয়ামী লীগের চার প্রধান নেতা। পরদিন শোক মিছিলের প্রথম সারিতে দেখা গেলো খালেদ মোশাররফের বৃদ্ধ মাতা ও ভ্রাতাকে ‘৭৫-এর ৫ নবেম্বর থেকে ৬ নবেম্বর বাংলাদেশের রাজনীতির ষড়যন্ত্র ও চন্দ্রের কলো দিন হিসেবে চিহ্ন হয়েছে। ৫ই নবেম্বর খালেদ মোশাররফ মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হন এবং জিয়াউর রহমানকে সামরিক বাহিনী থেকে আপসারণ করা হয়। ৭ই নবেম্বরের সিপাহী জনতার অভ্যুথানে জিয়াউর রহমান পুনরায় সেনাবাহিনী প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ কনে এবং খালেদ মোশাররফ নিহত হন। ৭১ এর দুই নম্বর সেক্টরের সফল অধিনায়ক খালেদ মোশাররফ যেভাবে রাজনিতীক অঙ্গনে প্রবেশ করেছিলেন ঠিক সেভাবেই তিয়োহিত হয়েচ্ছেন। তবু ৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধে তাঁর গৌরবময় আবদান কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না।
’৭০ দশক
আবু তাহের
সত্তরের দশকে প্রয়ত রাজনৈতিক নেতাদের অন্যতম প্রধান হচ্ছেন জাসদ নেতা লেঃ কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত)। আবু তাহের। ১৯৭৬ সালের ১৭ জুলাই ঢারিখে বিশেষ সামরিক ট্রাইবুনাল ‘সরকার উৎখাত ও বাহিনীকে বিনাশ করার চেষ্টা চালানোর দায়ে বাংলাদেশ দন্ডবিধি ১২১(ক) ধারা ও ১৯৭৫ সালের ১ নং রেগুলেশনের ১৩ নং সামরিক আইন বিধিবলে লেঃ কর্নেল (অবঃ) আবু তাহেরকে মৃত্যুদন্ড প্রদান করে। এই মামলার অন্যতম অভিযুক্ত জাসদ নেতা মেজর (অবঃ) এম এ জলিলকে যাবজ্জীবন এবং আ স ম আবদুর রবকে ১০ বছর সশ্রম কারাদেণ্ড প্রদান করা হয়।
৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধে ১১ নং সেক্টর (ময়মনসিংহ, টাংগাইল ও রংপুর)-এর অন্যতম অধিনায়ক কর্নেল তাহের যুদ্ধে গুরুতরভাবে আহত হন এবং যুদ্ধের পর সামরিক বাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ১৯৭৩ সালে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল গঠিত হবার পর কর্নেল তাহের এই দলে যোগদান করেন। মুলত তাঁরই পরিকল্পনা অনুযায়ী জাসদের গণবাহিনী’ গঠিত হয়। ১৯৭৫ সালের ২৪শে নবেম্বের রাষ্ট্রবিরোধী কাজের অভিযোগে কর্নেল (অবঃ) তাহের, মেজর (অবঃ) জলিল, আ স ম রবসহ ১৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়। ষড়যন্ত্র মামলার রায়ে কর্নেল তাহের সম্পর্কে বলা হয় ..ষড়যন্ত্রের পরিপ্রেক্ষিতে লেঃ কর্নেল (অবসরপ্রাত) অবু তাহের এবং তার কতিপয় সঙ্গী দেশুরুক্ষা বাহিনীকে বিনাশ ধবংস করতে এবং এর স্থলে তথাকথিত গণবাহিনী বসাতে দেশুরুক্ষা বাহিনীর সদস্যদের বাহিনীর সদস্যদের বিপথে পরিচালিত করেন অথবা করতে চেষ্টা করেন। যে দেশুরুক্ষা বাহিনী একটি সার্বভৌম দেশের গৌরব শক্তির উৎস এবং জনগণের পবিত্র আমানত তাতে তারা রাজনৈতিক শিক্ষার ক্লাস চালায় অনিষ্টকর পুস্তক, প্রচারপত্র ও অব্থ বিলি করেন। ষড়যন্ত্রকারীদের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল নিয়মিত বাহিনীকে নির্মল ও ধংস করে তর স্থলে জেএসডি’র এবং কাদের সিদ্দিকীর তথাকথিত গণবাহিনীকে বসানো। কাদের সিদ্দিকী অভিযুক্ত লেঃ কনেল (অবসরপ্রাপ্ত) আবু তাহেরের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণাধীন।……’
কর্নেল তাহের ও তার অভিযুক্ত সহকর্মীদের বিচারের জন্য সরকার একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করেন। তার মৃত্যুদন্ড (অস্পষ্ট) দের কর্মীদের প্রচন্ডভাবে বিদ্ধস্ত করে। বিভিন্ন বামপন্থী রাজনৈতিক দল যার জাসদের কট্রর সমালোচক তারাও কর্নেল তাহেরের প্রকাশ্য বিচার এবং পরে শ্বেতপত্র প্রকাশের দাবি জানিয়েছিলেন। ৭৫-এর ৭ নবেম্বর সিপাহী-জনতার অভ্যুথানের শ্লোগানে কর্নেল তাহেরের নাম বিশেষভাবে উচ্চারিত হয় এবং পরবর্তী কয়েকদিন তিনি রাজনৈতিক আলোচনার প্রধান বিষয় ছিলেন। জাসদ নেতা হিসেবে কর্নেল তাহেরের ভুমিকা বিতর্কিত ও সমালোচিত হলেও ৭১-এ স্বাধীনতার যুদ্ধে তার অবদান সর্বদা গৌরবের সঙ্গে স্মরণ করা হবে।
’৭০ দশক
জিয়াউর রহমান
সত্তর দশকের প্রথমার্ধের রাজনীতি আবর্তিত হয়েছে শেখ মুজিবর রহমানকে কেন্দ্র করে আয় ৭৫-এর ৭ নবেম্বর সিপাহী-জনতার অভ্যুথানের পর বাংলাদেশের রাজনীতির কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন তৎকালীন মেজর জেনাবেল জিয়াউর রহমান। যদিও আনুষ্ঠানিক ভবে রাজনীতিতে যোগ দিয়েছেন তিনি ‘৭৮-এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রাক্কালে। সত্তর দশক হচ্ছে শেখ মুজিবর রহমানের রাজনৈতিক জীবনের চরম উত্থান ও পতনের দশক অর জিয়াউর রহমানের উখানের দশক।
১৯৭১-এর ২৬ মার্চ স্বধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যিনি ‘মেজর জিয়া” নামে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন, নিজেকে যোষণা করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অস্থায়ী সেনাপতি হিসেবে ৫ বছর পর তিনিই সামরিক প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি রাজনীতির অঙ্গনে প্রবেশ করেন। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্ব ও সাফল্যজনক অংশগ্রহণের পর জিয়াউর রহমান সমরিক বাহিনীতে ফিরে গিয়েছিলেন। তাঁর সহযোদ্ধা কর্নেল তাহের বা মেজর জলিলের মতো কোন রাজনৈতিক উচচাশা হার ছিল না। এমন কি ‘৭৫-এর ১৫ আগস্টের সামরিক অভ্যুত্থানেও তাঁর নাম শোনা যায়নি, শোনা গেছে তার অপর সহযোদ্ধা খালেদ মোশাররফের নাম। জিয়া মঞ্চে এলেন ৭ নবেম্বরের আভ্যুথানের মধ্যমে যড়যন্ত প্রতিহতকরীদের নেতা হিসেবে।
১৯৭৭ সালে বছরের আলোচিত চরিত্র হিসেবে বিচিত্রার নির্বাচন ছিলো প্রেসিডেন্ট জিয়া’ এবং ‘৭৪-এর আলোচিত হিসেবে বিচিত্রা নির্বাচিত করেছিলো রাজনীতিবিদ জিয়াকে, যিনি এক সাক্ষাৎকারে বিচিত্রা প্রতিনিধিকে তখন বলেছিলেনঃ “আই উইল মেক পলিটিক্স ডিফিকাল্ট। তাঁর সম্পর্কে তখন বলা হয়েছিলো—বৈঠকখানা-কেন্দ্রিক রাজনীতির দাবার ছকে জিয়াউর রহমান অতি অনায়াসে বিরোধী পক্ষকে ঘায়েল পরেছেন, কখনো পক্ষে এনে মুখ বন্ধ করে দিয়ে কিংবা কখনো দল থেকে বিচিছন্ন করে বিলুপ্তির পথে ঠেলে দিয়ে। এভাবেই জিয়াউর রহমান শেখ মুজিব-উত্তর রাজনীতির সংকটময় সময়গুলিতে নিযেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন অভিজ্ঞ ও দুরদর্শী রাজনীতিবিদ হিসবে।
বিচিত্রার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে ১৯৭৮ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়া বলেছিলেন, কোন নেতাই সম্পূর্ণ নন। নেতারা কথা জানেন, কথা বলেন, কাজ করেন না। অনেকের কাজ করার আগ্রহ আছে। সংগঠন নেই বলে পারেন না। এক দলের রাজনৈতিক পর্যায় শেষ হয় গেছে। আর এক দলের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সময় আসেনি। আমি জানি একদিন আমারও প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে। তার আগেই আমার উপল্বদ্ধিকে আমি গ্রামের মানুষের সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার সমস্যার সঙ্গে মিলিয়ে নিতে চাই।’
রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ একদন সামরিক বাহিনীর ব্যক্তি হয়ে এত অল্প সময়ে জিয়াউর রহমান নিজেকে এদেশের রাজনীতির কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে দাঁড় করাতে পেরেছেন এ কারণেই যে শেখ মুজিবের মৃত্যুর পর এদেশের রাজনীতিতে এক ব্যাপক শুন্যতার সৃষ্টি হয়েছে। জিয়াউর রহমানের যোগ্যতা আছে কিন্তু নেতা হিসেবে তাঁর উত্থানের পেছনে কাজ করেছে এদেশের পরশ্রমজীবীর রাজনীতির চরম সংকটজনক পরিস্থিতি। এই সংসাট উত্তরণের জন্যে জিয়াউর রহমান তর শান্তিপূর্ন বিপ্লবের কর্মসূচী প্রণয়ন করেছেন উৎপাদনের সঙ্গে শরীক হওয়ায় প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছেন। ১৯৭৭ সালে “প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণের পর তিনি যে ১৯ দফা কর্মসুচী ঘোষণা করেছেন সেগুলি যদি বাস্তবায়িত হয় তা হলে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় তাঁর নেতৃত্ব আগামী দশক অবধি ব্যাপ্ত হবে।
[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/05/1979.12.28-bichitra.pdf” title=”1979.12.28 bichitra”]