You dont have javascript enabled! Please enable it!

সংসদে বাজেটের আলােচনা অব্যাহত

সংসদ ভবন: জাতীয় সংসদের অধিবেশনে ১৯৭৪-৭৫ অর্থবছরের বাজেট সম্পর্কে সাধারণ আলােচনায় অংশগ্রহণ করে সতন্ত্র সদস্য মি. মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা বলেছেন, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি দেশের সকল সমস্যার মূল কারণ। তিনি আরাে বলেন, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে দেশে দুর্নীতির রাজত্ব চলছে। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সরকার দুর্নীতিপরায়ণ বলছি না, কিন্তু সরকারকে যারা ঘিরে রয়েছেন তাদের অধিকাংশই দুর্নীতিপরায়ণ। মি. মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা বলেন সরকার খাদ্য শস্যসহ নিত্যপ্রয়ােজনীয় জিনিসপত্রের মূল্য বৃদ্ধির কথা স্বীকার করেছেন। অথচ মূল্যনিয়ন্ত্রণ ও মূল্য হ্রাসের কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণে সরকার ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি চোরকারবারী, মুনাফাখখার, মজুতদারসহ সমাজবিরােধী ব্যক্তিদের দমনে সরকারের ব্যর্থতার অভিযােগ উত্থাপন করে তাদের তালিকা প্রস্তুতের মাধ্যমে জনসম্মুখে তা প্রকাশ করার দাবী জানান। মি. লারমা দেশের বর্তমান আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির বর্ণনাদান কালে বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এর পূর্বে কখনাে ছিল না। তিনি বলেন, দেশে বর্তমানে কারাে জীবনের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা নেই। যদিও সরকারের প্রাথমিক দায়িত্ব হচ্ছে জনগণের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চয়তা প্রদান করার। কিন্তু সরকার এ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন বলে তিনি মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, দেশের সর্বত্র চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, খুন এবং নানাবিধ সমাজবিরােধী কার্যকলাপ অব্যাহত গতিতে চলছে। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সরকার সমাজবিরােধী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সম্প্রতি যে অভিযান পরিচালনা করেছেন, তা ব্যর্থ হয়েছে।’ মি. লারমা সরকারের ব্যর্থতার অভিযােগ উত্থাপন করে বলেন, সরকারের এমন কোন ব্যর্থতার ছাপ পাওয়া যাবে না। তিনি দেশ ও জনগণের স্বার্থে এই ব্যর্থতা কাটিয়ে ওঠার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
মানবতাবাদ: মি, লারমা সরকারকে মানবতাবাদের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে জনগণের কল্যাণে এগিয়ে যাবার আহ্বান জানিয়ে বলেন, অন্যথায় সরকারের ক্ষমতায় থাকার অধিকার নেই। তিনি বলেন, একদিকে সমাজতন্ত্রের কথা বলা হবে অথচ শােষণ পদ্ধতি রাখা হবে তা চলতে পারে না। তিনি বলেন, মানুষের ওপর মানুষের শােষণ অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। তিনি জাতীয় সম্পদের সুষম বণ্টনের দাবী জানিয়ে বলেন, জনগণের ৫টি মৌলিক অধিকার যথা অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা এবং চিকিৎসা নিশ্চয়তা সরকারকে প্রদান করতে হবে। তিনি বলেন, কৃষক শ্রমিককে অর্থনৈতিক মুক্তিদান রাষ্ট্রের অন্যতম মূল দায়িত্ব হতে হবে। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, সরকার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন অথচ তা কার্যকরী হয় না। তিনি এর কারণ অনুসন্ধান করে দেখার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। পরিশেষে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের কথা উল্লেখ করেন। এ প্রসঙ্গে সেখানকার শিক্ষা ও যােগাযােগ ব্যবস্থার বর্ণনা দেন।
আবদুল করিম ব্যাপারী: সরকার দলীয় সদস্য জনাব আবদুল করিম ব্যাপারী বাজেটকে অভিনন্দন করে বলেন, এ বাজেট সাধারণ মানুষের কল্যাণ সাধন করবে বলে তিনি বিশ্বাস করেন। তিনি বিদেশি ঋণ ও সাহায্য অর্থ উপযুক্তভাবে কাজে লাগানাের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, সীমান্তে চোরাচালান হচ্ছে সত্য কিন্তু চোরাচালানের মাধ্যমে দেশ ধ্বংস হতে পারে না। তিনি চোরাচালান বন্ধের জন্য কঠোর পাহারার ব্যবস্থা করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
আবদুল হাকিম মিয়া: সরকার দলীয় সদস্য জনাব আবদুল হাকিম মিয়া বাজেটের বিভিন্ন দিক আলােচনা করে বলেন, এ বাজেট একটি প্রগতিশীল বাজেট। তিনি ফারাক্কার সমস্যার সুষ্ঠু সমাধানের দাবী জানিয়ে বলেন, অন্যথায় ৮টি জেলা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, গণতন্ত্রের মাধ্যমেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। সুতরাং গণতন্ত্রকে অবশ্যই রক্ষা করতে হবে। তিনি বলেন, যারা গণতন্ত্রকে হত্যা করে সমাজতন্ত্র গড়তে চান তারা আসলে জনগণের কল্যাণ কামনা করেন কিনা সন্দেহ রয়েছে। তিনি বলেন, কৃষি শিল্পে তার একই সােনার বাংলাদেশ গঠন করা সম্ভব।
খাইরুল ইসলাম: সরকার দলীয় সদস্য জনাব খাইরুল ইসলাম বলেন, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি সমাজ এবং রাষ্ট্র জীবনে দৃষ্টান্ত হিসাব দেখা দিয়েছে। তিনি বলেন দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি অবিলম্বে বন্ধ করতে না পারলে ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন। তিনি এই ব্যাপারে বিভিন্ন পর্যায়ে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করে তদন্ত সাপেক্ষে দোষী ব্যক্তিদের কঠোর শাস্তি দানের দাবী জানান। তিনি বলেন, এই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না। তিনি সীমান্তে চোরাচালান সম্পর্কে মন্তব্য করে বলেন, চোরাচালান দমনের জন্য পুরাতন পদ্ধতির পরিবর্তন করে জনগণের সহযােগিতা নিতে হবে। জনাব খায়রুল এক শ্রেণির সরকারি কর্মচারী তীব্র সমালােচনা করে বলে, এসব কর্মচারী ইচ্ছকৃতভাবে সরকারকে হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে দুর্নীতি ও কাজে অবহেলা করছে। তিনি এদেরকে নির্মূল করার দাবী জানান।
শামছুল রহমান খান: সরকার দলীয় সদস্য জনাব শামছুল রহমান খান বাজেটকে অভিনন্দিত করেন। তিনি বলেন, সমাজতন্ত্র কায়েমের নামে যদি গণতন্ত্রকে হত্যা করা হয় তাহলে বাংলার বুকে দুর্যোগ নেমে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি বলেন যে, বাংলার মানুষ যুগ যুগ ধরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করেছেন। তিনি চোরাচালান বন্ধের দাবী জানিয়ে এ কাজে জনগণের প্রত্যক্ষ সহায়তা গ্রহণের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। জনাব রহমান দেশের কালাে টাকা উদ্ধারের জন্য অর্থমন্ত্রীকে একটি নীল নকশা প্রণয়ন করে তা কার্যকরী করার আহ্বান জানান।
সিদ্দিক হােসেন: সরকার দলীয় সদস্য জনাব সিদ্দিক হােসেন সবুজ বিপ্লবকে সার্থক করে তােলার জন্য সেচ,সার, পাওয়ার পাম্প ও গভীর নলকূপের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি তামাক উন্নয়ন বাের্ডের তীব্র সমালােচনা করে বলেন, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে বসে থাকা ব্যক্তিদের নিয়ে তামাক উন্নয়ন বোের্ড গঠিত হয়েছে। যার ফলে তামাক সম্পদের কোন উন্নতি হচ্ছে না। তিনি বলেন, রেশনের জন্য সাবসিডি’ যােগাবে সাধারণ মানুষ অথচ তাদের বঞ্চিত করে এ সুযােগ সুবিধা পাবেন শহরের ভদ্রলােকেরা, তা হতে পারে না।
মােজ্জামেল হক সমাজী: সরকার দলীয় সদস্য জনাব মােজাম্মেল হক সমাজী বলেন, এক শ্রেণির সরকারি কর্মচারী সরকারি সিদ্ধান্ত কার্যকরী করতে চায় না। তিনি ঢেউ টিন ও সিমেন্টের প্রস্তাবিত কর হ্রাস করার আবেদন জানান। সরকার দলীয় সদস্য জনাব এনায়েত হােসেন এবং একে মুজিবুর রহমান বাজেটকে অভিনন্দিত করে বলেন, এ বাজেট একটি বৈপ্লবিক বাজেট।১৪

রেফারেন্স: ৫ জুলাই ১৯৭৪, দৈনিক আজাদ
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭৪, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ ও শাহজাহান মৃধা বেণু সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!