জাতীয়করণ সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে: আতাউর রহমান
সংসদ ভবন: জাতীয় সংসদে বিরােধী দলীয় নেতা জনাব আতাউর রহমান খান বলেন, আজ বিরােধী দলগুলাের প্রতি যে উপেক্ষা চলছে তা গণতন্ত্র কায়েমের পথে আত্মঘাতী কার্যকলাপ। তিনি বলেন, এই অবস্থা চলতে থাকলে দেশে গণতন্ত্র কায়েম করা হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। প্রসঙ্গত জনাব আতাউর রহমানের দাবী শক্তিশালী বিরােধী দলের উপরেই দেশের শক্তিশালী সরকার কায়েম হতে পারে। জনাব আতাউর রহমান খান গত মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে বাজেটের উপর আলােচনা শুরু করেন। তার বক্তৃতা অসমাপ্ত থেকে যায়। তিনি বুধবার তার বাজেট বক্তৃতা সমাপ্ত করেন। জনাব আতাউর রহমান খান আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, আপনারা জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন। বর্তমানে আপনারা এই সমর্থনের সদ্ব্যবহার করতে পারেন, অপব্যবহারও করতে পারেন। তিনি বলেন, অপব্যবহার করলে শুধু জনগণের নিকটই দায়ী থাকবেন না, আল্লাহর নিকটও দায়ী থাকবেন। তিনি বলেন, আপনারা জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থনের অপব্যবহার করে দেশের সমস্যা আরাে বাড়িয়ে তুলেছেন। জনাব আতাউর রহমান খান বলেন, জনগণের মঙ্গল চাইলে সর্বপ্রথম দেশে আইন-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা ও চোরাচালান বন্ধ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে আইন প্রয়ােগকারী সংস্থাসমূহকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযােগ দিলেই দেশে আইন শৃঙ্খলা ফিরে আসবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নেই: জনাব আতাউর রহমান সংবাদপত্র সম্পর্কে সরকারি নীতির সমালােচনা করে বলেন, দেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নেই। বহু সংবাদপত্র বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সাংবাদিকদের গ্রেফতার করা হয়েছে। এ করে শুধু মন্ত্রীদের ফটো আর সংবাদ ছাপানাে হচ্ছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা না দিলে গণতন্ত্রকে হত্যা করা হবে। তিনি সংবাদিকদের বেতন বাের্ড গঠন করার আহ্বান জানান। জনাব আতাউর রহমান বাজেটের সমালােচনা করে বলেন, পরিকল্পনা কমিশন বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে অবাস্তব পরিকল্পনা করছে। তিনি বলেন বাজেটে ৫২৫কোটি টাকার মধ্যে প্রায় ৪ শত কোটি টাকাই বিদেশ থেকে সাহায্য হিসেবে দেখানাে হয়েছে। কিন্তু কোথা থেকে সাহায্য আসবে তার পথ দেখাতে প্লানিং কমিশন ব্যর্থ হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। জনাব খান বলেন, টাকার ব্যবস্থা না করে পরের আশায় যে বাজেট তৈরি করা হয়েছে তা ব্যর্থ হতে বাধ্য। তিনি চিনি, সিমেন্ট, ঢেউটিন, ঘরবাড়ি ও লাইসেন্সের উপর কর ধার্য করায় বাজেটের সমালােচনা করেন। তিনি বলেন, লাইসেন্সের উপর যে কর ধার্য করা হয়েছে তার মাসুল সাধারণ ক্রেতাদেরই দিতে হবে। প্রসঙ্গত তিনি বলেন, আজ যারা লাইসেন্সধারী তারা প্রকৃত ব্যবসায়ী নয়। লাইসেন্সধারীরা ব্যবসায়ীদের নিকট তাদের লাইসেন্স বিক্রি করে দেয়। ফলে যে অতিরিক্ত কর ধার্য করা হয়েছে। তা ব্যবসায়ীদের নিকট থেকে আদায় করা হবে। ফলে ব্যবসায়ীরা পরােক্ষভাবে সাধারণ ক্রেতার নিকট থেকে মাসুল আদায় করবে বলে জনাব আতাউর রহমান খান উল্লেখ করেন। জনাব আতাউর রহমান খান গত মঙ্গলবার সংসদের কালাে টাকা সম্বন্ধে বলতে গিয়ে সকল এমপি ও মন্ত্রীদের সমানভাবে অভিযুক্ত করেননি। তিনি বলেন, আমি নতুন বাংলা পত্রিকার উল্লেখ করে বলছি, কিছু সংখ্যক এমপি ও মন্ত্রী রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যাচ্ছে।
আবদুস সাত্তার: সংসদে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সদস্য জনাব আবদুস সাত্তার বুধবার বাজেটের উপর বক্তৃতা রাখেন। জনাব সাত্তার তার বক্তৃতায় বাজেটের তীব্র সমালােচনা করেন এবং এটিকে সরকারের ব্যর্থতার দলিল হিসেবে আখ্যা দেন। তিনি বলেন, সরকার গত বছরের বাজেট বাস্তবায়নে যেমনভাবে ব্যর্থ হয়েছেন এবারে বাজেটে অনুরূপ ব্যর্থতার আশঙ্কা রয়েছে। তিনি তার বাজেট বক্তৃতায় সরকারের ব্যয়াধিক্য সম্পদের অপচয়ের সমালােচনা করেন। জনাব সাত্তার বলেন, অর্থমন্ত্রী সাহেব ৩৯৪ কোটি টাকার বৈদেশিক সাহায্যের যে আশা করেছেন তা অর্জিত নাও হতে পারে। বিদেশি রাষ্ট্রসমূহ যদি সাহায্য না দেয় দেশের অন্যান্য কর্মসূচি ব্যর্থ হতে বাধ্য হবে বলে তিনি জানান। জনাব সাত্তার কালাে টাকা, দুর্নীতি ও চোরাচালান প্রসঙ্গে বক্তব্য রাখেন।
সংবাদপত্রের স্বাধীনতা: জনাব সাত্তার তার ভাষণে বলেন, দেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নেই। সরকার মানুষের মৌলিক অধিকার ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বিধানে ব্যর্থ হয়েছেন বলে তিনি জানান। বিরােধী দলের সদস্য জনাব সাত্তার দুঃখ করে বলেন একদিন আওয়ামী লীগই সর্বপ্রকারের কালাকানুন ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছে কিন্তু আজকে তারাই আবার সংবাদপত্রের কণ্ঠ রােধ করতে চাচ্ছে। তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের কারণে বহু সংখ্যক সংবাদপত্র বন্ধ হয়েছে। এবং সাংবাদিকগণ নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। প্রসঙ্গত তিনি গণগণ্ঠ প্রকাশনার উপর পুলিশী হস্তক্ষেপের নিন্দা করেন। জনাব সাত্তার বলেন, একটি জাতীয় সংবাদপত্রকে এভাবে নাজেহালের অর্থ মৌলিক অধিকার ও গণতান্ত্রিক অধিকারে হস্তক্ষেপ করা। প্রসঙ্গত জনাব সাত্তার সাংবাদিকদের প্রতীক ধর্মঘটের কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, সাংবাদিকদের উপর নির্যাতন, তাদের পেশাগত দায়িত্বে বাধা ও গণকণ্ঠের উপর পুলিশী হামলার প্রতিবাদে সাংবাদিকরা প্রতীক ধর্মঘট পালন করছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সাংবাদিকদের এই জাতীয় ধর্মঘট এই প্রথম বলে জনাব সাত্তার উল্লেখ করেন।
জাতীয়করণ: জাতীয়করণের তীব্র সমালােচনা করে জনাব সাত্তার বলেন, সরকারের জাতীয়করণ নীতি সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। এবং এই কারণে জনগণ জাতীয়করণ কর্মসূচির প্রতি বিরক্ত হয়ে পড়েছে। তিনি জাতীয়করণকে স্টেট ক্যাপিটালিজম হিসেবে আখ্যা দিয়ে বলেন, এইভাবে সমাজতন্ত্র বাস্তবায়িত হয় না। তিনি সমাজতন্ত্র বাস্তবায়নের জন্য বিপ্লব অপরিহার্য বলে মতাে প্রকাশ করেন।৮
রেফারেন্স: ৩ জুলাই ১৯৭৪, দৈনিক আজাদ
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭৪, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ ও শাহজাহান মৃধা বেণু সম্পাদিত