বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত ভােজসভায় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ভুট্টোর ভাষণের পূর্ণ বিবরণ
মহামান্য প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান, উপস্থিত বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী পরিষদের সদস্যবৃন্দ, ঢাকাস্থ বৈদেশিক মিশনের প্রধানগণ, মহাত্মনবৃন্দ, ভদ্র মহিলা ও ভদ্রমহােদয়গণ। গত ফেব্রুয়ারি মাসে লাহােরে আমাদের সাক্ষাতকারের সময় আমার পুরানাে বন্ধু ও মাননীয় বন্ধু মহামান্য শেখ মুজিবুর রহমান আমাকে বাংলাদেশ সফরের আহ্বান জানান। স্বাভাবিকভাবেই আমি তৎক্ষণাৎ তার সহৃদয় আমন্ত্রণ গ্রহণ করি। আমি শেখ সাহেবের মুখমণ্ডল তার চোখ দেখে বুঝতে পেরেছিলাম এই আমন্ত্রণ কোন নিয়মমাফিক বা আনুষ্ঠানিক ব্যাপার নয়। তাই আমি সানন্দে সাড়া দেই। আমি বুঝতে পারছিলাম তার আহ্বান ভবিষ্যতের সংকেত দিচ্ছিল। আমরা শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দেই। ১৯৭১ সালের দুঃখজনক স্মৃতিকে অতিক্রম করে আমাদের দুই দেশের ১৪ কোটি মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে বাংলাদেশের সঙ্গে একযােগে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশের ভাতৃপ্রতিম জনগণের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে ভবিষ্যত মতাে বিনিময়েরে দৃঢ় উদ্দেশ্য নিয়েই আমরা এখানে এসেছি। একথা অবশ্যই ঠিক যে ঢাকা সফরকালে আমরা চোখ বন্ধ রাখতে এবং আমরা কিছুই মনেই করতে পারছি না। এ ধরনের ভান করতে পারি না। আমরা কি করে ভুলে যাব যে, যেসব মানুষকে আমরা দেখেছি বা যাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি তারা গতকাল পর্যন্তও আমাদেরই অংশ ছিলেন। ঢাকা আমাদের ইতিহাসে যে ভূমিকা গ্রহণ করেছে তা আমরা কি করে মুছে ফেলতে পারি? তবে এমন অনেক দুঃখজনক ও ভয়াবহ ঘটনা আছে তা কেউ ভুলে যেতে চায়। আমরা যে মহান সুযােগ হারিয়েছি তা আর ফিরে আসবে না। এই সুযােগ যথাসময়ে গ্রহণ করলে আমরা হয়তাে ভাইয়ে ভাইয়ে লড়াই ও বিরােধ মিটিয়ে ফেলতে পারতাম। আমরা কি করে স্মরণ রাখবাে যে, কর্তব্য কর্মে অবহেলার দায়ী ব্যক্তিদের অপরাধের চেয়ে নির্দয়। একজন মানুষ কি করে ভুলে যেতে পারে যে, ক্ষমতালােভী জান্তা আমাদের উপর কি দুঃখজনক ঘটনা চাপিয়ে দিয়েছে। ইতােমধ্যেই কি আমাদের আত্মা বিদীর্ণ অত্যাচারিত হয়নি? এটি হচ্ছে আমাদের ইতিহাসের নিষ্ঠার লজ্জাজনক অধ্যায়। দুর্ভাগ্যজনক যে আমরা অতীতকে মুছে ফেলতে পারি না। যাহােক ১৯৭১ সালই ইতিহাসের শুরু বা শেষ। আমাদের ঢাকা সফরকালে আরাে কিছু মনে এসে জড়াে হয় সেগুলাে দুঃখজনক নয়। ব্যর্থপূর্ণ নয়-যা আমাদের দূরে সরিয়ে দেয় না। ঢাকা অতীতের স্মৃতি জাগ্রত করে। যা গর্বের সাথে আমাদের অনুপ্রাণিত করে। এখানেই কিছু স্বপ্ন দ্রষ্টা একটি গৌরবময় স্বপ্ন দেখেছিলেন এমন একটি স্বপ্ন যা ভিন্ন পাকিস্তান কিংবা বাংলাদেশ সৃষ্টি হতে পারতাে না। ঢাকায় এসে আমরা নবাব সলিমুল্লাহ, ফজলুল হক, খাজা নাজিমুদ্দিন, হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন না করে পারি? জনাব প্রধানমন্ত্রী আপনার মতাে ব্যক্তিকেও আমরা কি করে শ্রদ্ধা না জানিয়ে পারি? আপনি জনসাধারণের স্বার্থে লড়াই করেছেন। শেখ সাহেব কোনাে সন্দেহ নেই যে আপনাকে বঙ্গবন্ধু বলে ডাকা হয়। কিন্তু আমার বক্তব্য হচ্ছে যে, আমরা আপনাকে পাকিস্তানেরও বন্ধু বলে মনে করি। পাকিস্তান ও বাংলাদেশের জনগণের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে ঢাকা উল্লেখযােগ্য অংশ নিয়েছে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, ঢাকা ভূমিকা শুধু অতীতে সীমাবদ্ধ নয়। আমাদের মহান আশা আগামী দুদিন আমি ও আপনি যে আলােচনা করবাে তা ভবিষ্যতের সেতুবন্ধন রচনা করবে। জনাব প্রধানমন্ত্রী আমি ও আপনি জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে আমাদের বিশেষ সুবিধা রয়েছে। আমাদের জনগণের নাড়ীর সঙ্গে আমাদের যােগ রয়েছে। তাই আমাদের কর্তব্য পালন করতে হবে। আমরা তাদের বিশ্বাসযােগ্য কণ্ঠস্বর হিসেবে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কথা বলতে পারি। পাকিস্তানের জনগণের পক্ষ থেকে আমি আপনাকে আশ্বাস দিচ্ছি আপনার সম্পর্কে তাদের ধারণা বিরাট। আপনার জনগণের জন্য আপনি যে আত্মত্যাগ করেছেন, নির্যাতন সহ্য করেছেন তার জন্যে তারা আপনাকে শ্রদ্ধা করেন। বাংলাদেশের জনগণের প্রতি পাকিস্তানের জনগণের শুভেচ্ছা ও ভালােবাসা রয়েছে। তারা বাংলাদেশের জনগণের মঙ্গল প্রগতি, সমৃদ্ধি কামনা ও প্রার্থনা করেন। এবং তারা দু’দেশের মধ্যে স্বাভাবিক বন্ধুত্বপূর্ণ ও ভ্রাতৃপ্রতিম সম্পর্ক স্থাপন আশা করেন। জনাব প্রধানমন্ত্রী সার্বভৌম সমতা এবং একে অপরের রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও আঞ্চলিক অখণ্ডতার প্রতি পারস্পরিক শ্রদ্ধাবােধের ভিত্তিতে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের দৃঢ় সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হবে। পাকিস্তানের সরকার ও জনগণ ঐক্যবদ্ধভাবে কামনা করেন যে, ১৯৭১ সনের দুঃখজনক অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটুক এবং পাকিস্তান ও বাংলাদেশের জনগণের পারস্পরিক স্বার্থে ভবিষ্যতে দ্বিপাক্ষিক ভিত্তিতে অকৃত্রিম সমঝােতা ও ভ্রাতৃপ্রতিম সহযােগিতা গড়ে উঠুক।
আমি জোর দিয়ে বলছি যে, অন্যান্য দেশের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক তার নিজস্ব ব্যাপার। পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ব্যাপারে হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থেকেছে এবং থাকবে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মহামান্য জনাব মােহাম্মদ উল্লার সুস্বাস্থ্য কামনা করি। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘ জীবন কামনা করি। বাংলাদেশের জনগণের শান্তি প্রগতি ও সমৃদ্ধির এবং পাকিস্তান ও বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে সমঝােতা শুভেচ্ছা ও চিরস্থায়ী বন্ধুত্ব কামনা করি।৯১
রেফারেন্স: ২৮ জুন, ১৯৭৪, দৈনিক আজাদ
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭৪, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ ও শাহজাহান মৃধা বেণু সম্পাদিত