জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দিনের বাজেট বক্তৃতা
সংসদ ভবন: অর্থমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমেদ বুধবার জাতীয় সংসদে ১৯৭৪-৭৫ অর্থবছরের জন্য ৪শত ৭০ কোটি ২৩ লাখ টাকার রাজস্ব বাজেট পেশ করেছেন। আগামী বছর উন্নয়ন পরিকল্পনার আকার নির্ধারিত হয়েছে ৫২৫ কোটি টাকা। বৈদেশিক সাহায্য ৩৯৪ কোটি টাকা। পাওয়া যাবে। রাজস্ব উন্নয়ন বহির্ভূত মূলধন খাত থেকে উন্নয়ন কাজের জন্য পাওয়া যাবে ১০ কোটি টাকা। মােট ৪০৪ কোটি টাকার সংস্থান হবে। উন্নয়ন খাতে ঘাটতি ৮৯ কোটি ১৪ লাখ। টাকা অতিরিক্ত কর ও ফি আরােপ করে আদায়ের প্রস্তাব করা হয়েছে। উন্নয়ন খাতে অবশিষ্ট ৩১ কোটি ৫৬ লাখ টাকা ঘাটতি অর্থসংস্থান প্রস্তাব করা হয়েছে। বাজেট বক্তৃতাকালে জনাব আহমদ সার্বিকভাবে জাতীয় সম্পদ বৃদ্ধির প্রতি গুরুত্ব আরােপ করে পরিকল্পিত উপায়ে দেশের উৎপাদন বৃদ্ধির কাজে নিরলস প্রচেষ্টা চালাবার আহ্বান জানানাে হয়। জনাব আহমদ তার বক্তৃতায়। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে লক্ষ্য অর্জনের অক্ষমতার কথা অকপটে স্বীকার করেছেন।
সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্যে সর্বাত্মক প্রয়াস: গত বছর তার বাজেট বক্তৃতায় সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য সর্বপর্যায়ে সর্বাত্মক প্রয়াসের প্রয়ােজনীয়তার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেছেন যে, গত এক বছরে আমাদের প্রচেষ্টা ও অভিজ্ঞতার আলােকে বলতে চাই যে, এই সর্বাত্মক প্রচেষ্টার। যত ব্যাপক ও বিস্তৃত হওয়া প্রয়ােজন ছিল ততটা হয়নি। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ব্যাখ্যাকালে তিনি বলেন, পরিকল্পনা কমিশনের প্রাথমিক মূল্যায়নে ৭২-৭৩ সালের মূল্য মাত্রায় শতকরা ১২ ভাগ বেড়েছে। পরিকল্পনার লক্ষ্য ছিল ন্যূনতমপক্ষে শতকরা ১৪ভাগ বৃদ্ধি। তবে তিনি স্বীকার করেন যে, ভিত্তির আকার কম থাকায় শতকরা হিসেবে এই বৃদ্ধি আপাতদৃষ্টিতে বেশি মনে হলেও সার্বিক উৎপাদনে সম্পূর্ণভাবে লক্ষ্যমাত্রায় উন্নীত করা সম্ভব হয়নি। তিনি আন্তর্জাতিক বাজারে তেল খাদ্যশস্য প্রভৃতির মূল্য বৃদ্ধির ফলে অধিক মূল্য দিতে স্বীকৃত হয়েও অত্যাবশ্যক দ্রব্যাদি সময়মত অর্জিত করতে সরকার সক্ষম হয়নি বলে স্বীকার করেছেন। তিনি আরাে বলেন, এসব কারণে প্রথমত বৈদেশিক সাহায্য ও রপ্তানি আয়ের স্বল্পতার পাশাপাশি অত্যাবশ্যক আমদানি দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি দ্রব্যাদির প্রকৃত আমদানির মাত্রাও সীমিত করে তােলে। তাতে উৎপাদন শুল্ক রাজস্ব বাবদ প্রাপ্তি কম হয়। দ্বিতীয়ত প্রত্যাশিত আমদানি শুল্ক পাওয়া যায়নি। তৃতীয়ত প্রয়ােজনীয় খাদ্যশস্য সরবরাহ ও মৌলিক পর্যায়ে উন্নয়ন কর্মসূচি অব্যাহত রাখতে ও রাজস্ব ব্যয় মেটাতে সরকারকে ১শ ৭৯ কোটি ২৭ লাখ টাকা ঘাটতি অর্থসংস্থান করতে হয়েছে।
রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পের উৎপাদন: জনাব আহমদ বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প বাণিজ্যের ক্ষেত্রে উৎপাদন নৈপুণ্য বাড়ানাে সম্ভব হলেও সার্বিক শিল্প উৎপাদন প্রাক-স্বাধীনতা পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে বলা চলে না। তিনি বলেন, অনেক ক্ষেত্রে উৎপাদন বাড়লেও উৎপাদন ব্যয় বিক্রয় মূল্যের সমান হয়েছে এমনকি ছাড়িয়েও গেছে। তিনি আরাে বলেন, বেসরকারি ক্ষেত্রে উৎপাদন আশানুরূপভাবে বাড়েনি। ৭৩-৭৪ অর্থবছরে বেসরককারির শিল্প ক্ষেত্রে ১৮ কোটি ১৪ লাখ টাকা বৈদেশিক মুদ্রাসহ মােট ৩০ কোটি টাকা বিনিয়ােগ লক্ষ্যমাত্রা ছিল। গত এপ্রিল পর্যন্ত এখানে মােট ৫ কোটি ৩১ লাখ টাকা বিনিয়ােগ করা হয়েছে।
রাজস্ব আয়: জনাব তাজউদ্দীন আহমদ আগামী অর্থবছরে রাজস্ব আয় ও ব্যয় প্রস্তাব করেছেন ৪৭০ কোটি ২৩ লাখ টাকা। রাজস্ব ব্যয়ের মধ্যে সরকারি খাতে খাদ্যসরবরাহের জন্য মােট ক্ষতি ৬০ কোটি টাকা পূরণের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৯ কোটি ৮০ লাখ টাকা। উন্নয়ন বহির্ভুত নীট মূলধন প্রাপ্তি থেকে মােট ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে।
প্রস্তাবিত বাজেটের রাজস্ব আয়ের মধ্যে ১৪৫ কোটি টাকা আমদানি ও রপ্তানি শুল্ক ১২৭ কোটি ৫৫ লাখ টাকা উৎপাদন শুল্ক, ২৪ কোটি ২৫ লাখ টাকা আয়কর কর্পোরেশন কর ও কৃষি আয়কর ৪৬ কোটি টাকা বিক্রয়কর হিসেবে আদায় হবে বলে ধরা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে সংশােধিত রাজস্ব আয় ৩শ ৭৭ কোটি ৩৬ লাখ টাকার তুলনায় হিসাব আগামী বছরের রাজস্ব আয়ের বৃদ্ধির পরিমাণ ৯২ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। আগামী বছর আমদানি রপ্তানি শুল্ক বাবদ চলতি বছর থেকে ২১ কোটি ৭৭ লাখ টাকা বেশি পাওয়া যাবে বলে ধরা হয়েছে। এই অতিরিক্ত প্রাপ্তি হবে শুল্ক আরােপীয় আমদানির মাত্রা বৃদ্ধির অনুযায়ী উৎপাদন করা বাবদ চলতি বছরে প্রাপ্তির চেয়ে অতিরিক্ত ৪৯ কোটি ৩১ লক্ষ টাকা আদায় হবে তেল ও তেলজাত দ্রব্যাদি, তামাকজাত দ্রব্যাদি, সিমেন্ট ও চিনির উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে। চলতি বছরের সংশােধিত হিসাব উৎপাদন করের পরিমাণ ধরা হয়েছে ৭৮ কোটি ২৪ লাখ টাকা। কর্পোরেশন ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাসমূহে প্রদত্ত কার্যকরী ঋণের সুদ হিসেবে চলতি বছরের সংশােধিত বাজেটের প্রাপ্তি নির্ধারিত হয়েছে ২৩ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। আগামী বছর এই খাতে আয় হবে ৩৪ কোটি ১৮ লাখ টাকা। পুনঃনির্মাণ সমাপ্তির ফলে কর্পোরেশনের অন্যান্য সংস্থাসমূহ সরকারি ঋণের সুদ পরিকল্পিতভাবে দিতে সক্ষম হবেন বলে আশা প্রকাশ হয়েছে। চলতি বছরের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসমূহে লভ্যাংশের পরিমাণ ধরা হয়েছে ১৬ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসমূহের লভ্যাংশের পরিমাণ ৭ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। আগামী অর্থবছরে ৯ কোটি টাকা বেশি লাভ পাওয়া যাবে না বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
রাজস্ব আয় : প্রস্তাবিত বাজেটে ১৯৭৪-৭৫ অর্থবছরে রাজস্ব ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৭০ কোটি ২৩ লক্ষ টাকা। চলতি অর্থবছরে সংশােধিত বাজেটে রাজস্ব ব্যয় ছিল ১৯৭৩-৭৪ সালের তুলনায় ১৯৭৪-৭৫ সালের রাজস্ব ১০৫ কোটি ৮৪ লক্ষ টাকা বাড়বে বলে ধরা হয়েছে। মােট রাজস্ব ব্যয়ের শতকরা ১৫ ভাগ প্রতিরক্ষা শতকরা ৭৩.৩৩ ভাগ শিক্ষা ও শতকরা ৪ ভাগ স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় করা হবে। এছাড়া অপ্রত্যাশিত ব্যয় মেটানাের জন্য ১৫ কোটি টাকা, সম্পূর্ণকৃত উন্নয়ন প্রকল্পের স্বাভাবিক ব্যয় সংকুলানের জন্য ৯ কোটি টাকা ও বেতন কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য ২০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে।
উৎপাদন শৃঙ্খলা চাই : জনাব আহমদ তার বাজেট বক্তৃতায় বলেছেন যে, আগামী অর্থবছরে যে উন্নয়ন পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে তা দেশের দীর্ঘমেয়াদী প্রবৃদ্ধির প্রয়ােজনে তা ন্যূনতম প্রয়াস মাত্র। তিনি বলেন, অন্য কথা হতে দেশের নিদারুণ দারিদ্র্য দূর করার কর্মসূচি সফল করতে হলে একাজে যদি আমরা ব্যর্থ হই তা হলে দারিদ্রের অভিশাপ দেশকে মুক্ত করে স্বাধীনতার সম্পূর্ণ সুফল অর্জন করা অদূর ভবিষ্যতে সম্ভব হবে না।’ তিনি এজন্য সার্বিকভাবে জাতীয় সম্পদ বৃদ্ধির প্রয়ােজনীয়তার কথা উল্লেখ করে বলেন, আজ সর্বাধিক প্রয়ােজন সবপর্যায়ে উৎপাদন শৃঙ্খলা ও আর্থিক নিয়মানুবর্তিতা পালন করা। তিনি দৃঢ় আস্থা প্রকাশ করেছেন যে, যে জনগণ বহু ত্যাগ ও সংগ্রামের বিনিময়ে জাতীয় মুক্তি অর্জন করেছেন সেই জনগণ সংকীর্ণ স্বার্থান্বেষণ ও অবাস্তবানুগ কর্মপন্থা অনুসরণ বিভ্রান্ত কিংবা প্রবৃত্তির স্থির লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হবেন না। বাজেট পেশের পর জনাব তাজউদ্দীন আহমেদ সংসদে ১৯৭৪ সালের ফিন্যান্স বিল উত্থাপন করেন। সংসদের অধিবেশন আগামী শুক্রবার বিকেল ৫টা পর্যন্ত মুলতবী ঘােষণা করা হয়েছে।৬৪
রেফারেন্স: ১৯ জুন, ১৯৭৪, দৈনিক পূর্বদেশ
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭৪, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ ও শাহজাহান মৃধা বেণু সম্পাদিত