৮৯ কোটি ১৪ লাখ টাকার অতিরিক্ত কর ধার্যের প্রস্তাব
অর্থমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ আগামী অর্থবছরে বাজেটে ৮৯ কোটি ১৪ লাখ টাকার অতিরিক্ত কর প্রস্তাব করেছেন। যে সমস্ত দ্রব্যের উপর কর ধার্যের প্রস্তাব করা হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে: রেডিও ও টেলিভিশন, বৈদ্যুতিক পাখা, বাস, ট্রাক, মটরগাড়ি, চিনি, রং ও বার্নিশ, প্রাকৃতিক গ্যাস ও সিমেন্ট, ঢেউ টিন, প্রমােদ কর, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহের স্থান ও ভাড়াটে বাড়ি, ডিলারদের লাইসেন্স, নবায়নের ফি বৃদ্ধি, স্ট্যাম্প শুল্ক বৃদ্ধি, পােষ্ট কার্ড ও চিঠিপত্রাদির মাসুল বৃদ্ধি, রেডিও লাইসেন্স ফি বৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবহারের উপর, সীমিত কর, রেল ভাড়া ও মাসুল, চা, কোমল পানীয় ইত্যাদি। অতিরিক্ত কর ধার্যের ফলে দেখা যায়, বিদেশ থেকে যে সমস্ত কাঁচামাল আমদানি করা হয় এবং যার উপর ট্যাক্স আরােপ করা হয়, তার উপর শতকরা ২০ ভাগ আমদানি কর বৃদ্ধি পাবে। এই পরােক্ষ করের ফলে স্বভাবতই আমদানিকৃত বিদেশি কাঁচামালে প্রস্তুত দ্রব্যাদি যথা সিগারেট, দিয়াশলাই, দেশে প্রস্তুত ঔষধ, টুথপেস্ট, সাবান, ব্লেড ও অন্যান্য দ্রব্যের মূল্যও বৃদ্ধি পাবে। চিনির উপর বর্তমানে সের প্রতি ২৫.৭ পয়সা উৎপাদন কর রয়েছে তা বাড়িয়ে ১২৮.৫ পয়সা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর ফলে বছরে ১০ কোটি টাকা সংগ্রহ করা যাবে। এই কর বৃদ্ধির ফলে চিনি প্রতিসের বর্তমান থেকে ১ টাকা বৃদ্ধি পাবে। চায়ের উপর শতকরা ৫০ ভাগ কর বৃদ্ধি করা হবে। এতে অতিরিক্ত ৫০ লক্ষ টাকা আদায় হবে। রং, বার্নিশ, বিলাদ্রব্য বলে তার উপর উৎপাদন করের বর্তমান হার খুচরা মূল্যের শতকরা ২২ ভাগ। এই হার শতকরা ৩০ ভাগ করা হবে এবং এতে অতিরিক্ত ২০ লক্ষ টাকা আদায় হবে। বােতলে প্রক্রিয়াজাত ফান্টা ইত্যাদির উপর অনুরূপভাবে উৎপাদন করের বর্তমান হার খুচরা বিক্রয় মূল্যের শতকরা ২০ ভাগ থেকে ৩০ ভাগ করা হবে। এর ফলে অতিরিক্ত ১৫ লক্ষ টাকা আসবে। বৈদ্যুতিক পাখার খুচরা বিক্রয় মূল্যের শতকরা ১৫ ভাগ হারে কর বৃদ্ধি করা হবে এবং তাতে ১০ লক্ষ টাকা রাজস্ব আসবে। তবে মন্ত্রী উল্লেখ করেন যে, সরবরাহের স্বল্পতা হেতু বৈদ্যুতিক পাখার সমকালীন প্রকৃতমূল্য স্বাভাবিক মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি। রেডিও’র উপর সেট প্রতি সর্বনিম্ন ২৫ টাকা ধরে খুচরা মূল্যের শতকরা ১৫ ভাগ এবং টেলিভিশনের উপর সেট প্রতি সর্বনিম্ন ১ হাজার টাকা ধরে খুচরা মূল্যের শতকরা ৩০ ভাগ হারে উৎপাদন কর ধার্যের প্রস্তাব করা হয়েছে। বস্তুত এখানে যে রেডিও এবং টেলিভিশনের যন্ত্রাংশ যুক্ত করা হয় তার উপর এই কর ধার্য করা হয়েছে। বাস ও ট্রাকের উপর ২ হাজার ও মটর গাড়ির উপর ৫ হাজার টাকা উৎপাদন করের প্রস্তাব করা হয়েছে। এর ফলে ৩০ লক্ষ টাকা আসবে। অন্যান্য জ্বালানির তুলনায় গ্যাসের মূল্য বর্তমানে বৃদ্ধি পায়নি। বর্তমানে প্রতি ইউনিট ৪০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ২টাকা ৪০ পয়সা করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এর ফলে অতিরিক্ত ৫ কোটি টাকা আসবে। বর্তমানে আমদানিকৃত সিমেন্টের মূল্য পূর্বের বহুগুণ তাই দেশীয় সিমেন্টের উপর আরােপিত কর টন প্রতি ৩৬ টাকা থেকে ২০৩ টাকা করা হবে। এর ফলে ৫ কোটি টাকা আসবে। অর্থমন্ত্রী আমদানি শুল্ক আরােপীয় আমদানি দ্রব্যাদির মূল্যের শতকরা ২০ ভাগ হিসেবে অতিরিক্ত লাইসেন্স ফির প্রস্তাব করেন। এ প্রস্তাব গৃহীত হলে ৫১ কোটি টাকা আসবে। তবে খাদ্যশস্য, সার, অপরিশােধিত ও শােধিত তেল, কীটনাশক দ্রব্যাদি ভােজ্য তেল, শিশু খাদ্য, তুলা সুতা, কাপড়, শােধিত নারিকেল তেল, ঔষধপত্রাদি ও সরকারি খাতে উন্নয়ন বহির্ভূত দ্রব্যাদি এর আওতায় আসবে না। এ লাইসেন্স ফি ধার্য করার পরেও দেশে উৎপাদিত ঢেউটিনের তুলনায় আমদানিকৃত ঢেউটিনের দাম বর্তমান শুল্ক হার অনুযায়ী প্রতিটন প্রায় দেড় হাজার টাকা কম হবে। এই মূল্যের সাথে সংগতি রাখার জন্য দেশি ঢেউটিনের শুল্ক শতকরা ২০-৪৫ ভাগ করা হবে। এতে ১ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা আসবে। প্রমােদকর বাড়ানাে হবে। এ জাতীয় কোনাে অনুষ্ঠানে প্রবেশ মূল্যে ১৯ পয়সার অধিক ও এক টাকার অনধিক হলে করের হার হবে শতকরা ১০০ ভাগ। প্রবেশ মূল্য ১ টাকা থেকে ২ টাকা হলে এবং ২ টাকার বেশি হলে কর হবে যথাক্রমে শতকরা ১২৫ ও ১৫০ভাগ। তবে প্রবেশ মূল্য ১৯ পয়সার কম হলেও কোন কর লাগবে না। এতে এক কোটি ৫০ লক্ষ টাকা আসবে।
বর্তমানে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বা দোকানের আয় বহু গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই প্রতিষ্ঠানের উপর প্রতি বর্গফুটে পাঁচ টাকা হারে কুশল শুল্ক আদায় করা হবে। এবং এক কোটি টাকা রাজস্ব আসবে। টিসিবির বার্ষিক ব্যবসায়ের মূল্যে মাত্রার উপর শতকরা পাঁচ ভাগ হারে ব্যবসা-মাত্রার প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে পাঁচ কোটি টাকা আসবে। অর্থমন্ত্রী প্রস্তাব করেছেন, মাসিক ৩শত টাকা পর্যন্ত বাড়িভাড়ার উপর কর লাগবে না। ৩শ ১ টাকা থেকে ৭শত টাকা পর্যন্ত হলে করের হার হবে শতকরা ১০ টাকা। ৭০১ টাকা থেকে ১০০০ টাকা হলে কর হবে শতকরা ১৫ টাকা। এবং ১০০০ টাকার বেশি হলে কর হবে বিশ টাকা। এতে ৫০ লক্ষ টাকা আসবে। রেজিস্ট্রিকৃত ব্যবসায়ে প্রতিষ্ঠানের উপর সুপার ট্যাক্স বৃদ্ধি করা হবে। তাতে দশ লক্ষ টাকা আদায় হবে। স্বর্ণকার ছাড়া সকল ধরনের লাইসেন্সধারীদের নবায়ণ ফি দ্বিগুণ হবে। তবে স্বর্ণকারদের বর্তমান হারের তিনগুণ হবে। ১০ হাজার টাকা মূল্যের উপরে ধার্য ষ্ট্যাম্প শুল্কের বর্তমান হার প্রগতিশীলভাবে বাড়ানাে হবে। এবং তার ফলে এক কোটি টাকা আসবে। অনুরূপভাবে রেজিস্ট্রেশন ফির হার শতকরা ৩০ ভাগ বৃদ্ধি করা হবে এবং এতে ৭০ লক্ষ টাকা আসবে। পােস্টকার্ডের মূল্য ১০ পয়সা থেকে ১৫ পয়সা রেজিস্ট্রিকৃত সংবাদপত্রাদি ২০ তলা ওজন পর্যন্ত ২ ও ৩ পয়সা থেকে ৫ ও ১০ পয়সায়, ২০ তােলার অতিরিক্ত প্রতি ২০ তােলা বা তার ভগ্নাংশ প্রতি ৩ পয়সা ৫ পয়সায় উন্নীত করা হবে। প্যাকেট ও পার্সেলের উপর ধার্য মাশুল অনুরূপভাবে বাড়ানাে হবে। রেডিও ও লাইসেন্স ফি বর্তমান হারের শতকরা ৫০ বৃদ্ধি করা হবে। এতে ২০ লক্ষ টাকা আসবে। বিদেশে অপ্রয়ােজনীয় ভ্রমণ ও বাস নিরুৎসাহিত করার জন্য বৈদেশিক মুদ্রায় ব্যবহারের উপর বিনিময় কর আরােপ করা হবে এবং তাতে ২০ লক্ষ টাকা আসবে। রেলের ভাড়া ও মাশুল বৃদ্ধি করে ৩ কোটি ৩০ লক্ষ টাকা আসবে। মন্ত্রী আশা করেন যে উপরােক্ত কর ও অন্যান্য ব্যবস্থায় ৮৯ কোটি ১৪ লক্ষ টাকার অতিরিক্ত রাজস্ব আয় আসবে।৬৭
রেফারেন্স: ১৯ জুন, ১৯৭৪, দৈনিক পূর্বদেশ
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭৪, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ ও শাহজাহান মৃধা বেণু সম্পাদিত