ভােজসভায় রাষ্ট্রপতির বক্তৃতা
ঢাকা: বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি জনাব মােহাম্মদ উল্লা গত সােমবার সেনেগালের প্রেসিডেন্ট সেনঘর এবং মাদাম সেনঘরের সম্মানার্থে আয়ােজিত এক ভােজসভায় বলেছেন যে, বাংলাদেশ বিশ্ব শান্তির আন্তর্জাতিক সম্পর্কের গণতন্ত্রে শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থানে এবং পারস্পরিক সমঝােতার নীতিতে বিশ্বাসী। বাংলাদেশের প্রতি বিভিন্ন সময়ে সেনেগাল সরকার ও প্রেসিডেন্ট সেনঘর ব্যক্তিগতভাবে যে সমর্থন ও সহযােগিতা দিয়েছেন, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি তার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। নিচে রাষ্ট্রপতির বক্তৃতার পূর্ণ বিবরণ দেয়া হল:
আজ আমরা আমাদের মধ্যে একজন মহান রাষ্ট্রনায়ক, বিশিষ্ট নেতা, খ্যাতিমান কবি ও বাংলাদেশের বিশ্বস্ত বন্ধুকে পেয়ে গর্ব ও আনন্দ অনুভব করছি। মি. প্রেসিডেন্ট আমাদের মুক্তির সংগ্রামে সংকট মুহূর্তে সেনগালের সরকার ও জনগণ ব্যক্তিগতভাবে আপনি নিজে যেয়ে যে সহানুভূতি দেখিয়েছেন আমরা কতজ্ঞচিত্তে তা স্মরণ করছি। স্বাধীনতা উত্তরকালে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশের সদস্যপদ অর্জনে আপনাদের সক্রিয় সমর্থন দানের জন্য আমরা কৃতজ্ঞ। মি. প্রেসিডেন্ট শান্তি ও আন্তর্জাতিক সমঝােতার ক্ষেত্রে আপনার বিরাট অবদানের বিষয়ে বাংলাদেশের জনগণ বিশেষভাবে অবগত রয়েছেন। জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের সহযােগী সদস্য হিসেবে বিশ্বশান্তি তথা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের গণতন্ত্রায়ন শান্তিপূর্ণ ও সহ-অবস্থান এবং হিসেবে বিশ্বশান্তি তথা আন্তর্জাতিক সম্পদে পারস্পরিক সমঝােতার নীতিতে রাষ্ট্রসমূহের উন্নয়নে আপনাদের সাথে সাথে আমরাও অঙ্গীকারবদ্ধ। এই আদর্শসমূহ বাস্তবায়নে আমরা সম্মিলিতভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবাে। মি. প্রেসিডেন্ট আন্তর্জাতিক সহযােগিতা ও শান্তির প্রতি বাংলাদেশের সরকার ও জনসাধারণের পূর্ণ আস্থা রয়েছে। আমরা মনে করি, দারিদ্র্য, ক্ষুধা, রােগ, অশিক্ষা ও বেকারত্বের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্যে সামগ্রিক সম্পদ ব্যবহারে মনােনিবেশ করতে হলে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ একান্ত প্রয়ােজন। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার সামগ্রিক সমঝােতা বৃদ্ধির জন্য বিশেষভাবে প্রতিবেশী দেশসমূহের মধ্যে সহঅবস্থান, সার্বভৌম, সমতা ও অপরের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার নীতির প্রতি আমরা সর্বদা সমর্থন জানিয়ে এসেছি। উপমহাদেশের শান্তি প্রতিষ্ঠা করে পারস্পরিক সুসম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণে আমরা সে সময় একটি গঠনমূলক প্রগতিশীল নীতি গ্রহণ করেছি। গত মাসে নয়া দিল্লিতে স্বাক্ষরিত ত্রিপক্ষীয় চুক্তি এই নীতিরই বহিঃপ্রকাশ। এই চুক্তি মাননীয় প্রেসিডেন্টের সরকার সহ সর্বজনীন প্রশংসা অর্জনে সমর্থ হয়েছে। আমরা আশা রাখি এই ত্রিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে সহমর্মিতার যে অনুপ্রেরণা সৃষ্টি হয়েছে তা উপমহাদেশের বিভিন্ন সমস্যা সমাধান করে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত করবে। মি. প্রেসিডেন্ট বর্ণবৈষম্য, উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এশিয়া, আফ্রিকার জনসাধারণের সংগ্রামে আমারও আমাদের একাত্মতা পুনর্বার ঘােষণা ছি। আফ্রিকা মহাদেশের বীর জনগণের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের প্রতিও আমাদের পূর্ণ ন জানাচ্ছি। আফ্রিকার জনগণের মুক্তি সংগ্রামের জয় অবধারিত, এই আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। কারণ তাদের দাবী ন্যায্য এবং ইতিহাস তাদের পক্ষে রয়েছে। মি. প্রেসিডেন্ট, পশ্চিম আফ্রিকার সাম্প্রতিক অবস্থার উন্নতি সত্ত্বেও স্থায়ী শান্তি এখনাে অর্জিত হয়নি। আমরা দৃঢ়তার সাথে এই মতাে পােষণ করি যে, আরব ভূখণ্ড থেকে ইসরাইলীরা সম্পূর্ণভাবে সরে না যাওয়া এবং প্যালেস্টাইনীদের বৈধ অধিকার প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্য সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়। মি. প্রেসিডেন্ট গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ এবং সেনেগালের মধ্যে সম্পর্কের উন্নতিতে আমরা আনন্দিত। দু’দেশের জনগণের মধ্যে সম্পর্ক উত্তরণ ও উন্নতির জন্য আপনার এ সফর এক উল্লেখযােগ্য অবদান রাখবে। আমি বিশ্বাস করি ভবিষ্যতে দু’দেশের মধ্যে বন্ধুত্ব ও সহযােগিতা ঘনিষ্ঠতর হবে। মাননীয় অতিথিবৃন্দ ভদ্রমহিলা ও ভদ্র মহােদয়গণ এবার আমি মহামান্য অতিথি প্রেসিডেন্ট লিওপােল্ড সেদার সেনেঘর ও মাদাম সেনঘরের স্বাস্থ্য ও সুখী দীর্ঘ জীবন এবং সেনেগাল ও বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে স্থায়ী বন্ধুত্ব ও প্রীতি কামনা করে আহ্বান জানাচ্ছি।৯৮
রেফারেন্স: ২৭ মে, ১৯৭৪, দৈনিক আজাদ
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭৪, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ ও শাহজাহান মৃধা বেণু সম্পাদিত