You dont have javascript enabled! Please enable it!

15th August A National Tragedy by KM Safiullah (অনুবাদ) | ১৫ আগস্টঃ জাতির করুণ অধ্যায় – কে এম শফিউল্লাহ

Table of Contents

ভূমিকা… 1

পেছনের কথা… 5

সেনাবাহিনীতে অসন্তোষ.. 10

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড.. 33

১৫ আগস্ট ১৯৭৫ এর বিবৃতিগুলোর বিশ্লেষণ. 109

Exhibit A. 156

ভূমিকা

বহুদিন ধরেই ভেবেছি ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ এর ব্যাপারে লিখব। মানুষের মনে ইতোমধ্যে বেশ কিছু বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। আসলে কী হয়েছিলো সেটি পরিষ্কার করা প্রয়োজন বোধ করছি। আরও একটি কারণ হচ্ছে সেসময়ের বেশ কিছু ইউনিফর্মড অফিসার মানুষের কাছে বিষয়টা এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন যার তীর আমার দিকেই লক্ষ্য করা। তারা বিষয়টি এমনভাবে ভুলভাবে বর্ননা করেছেন যেটা তাদের রক্ষা করতে পারে। যখন এসব ভুল তথ্য মিডিয়াতে প্রচার হচ্ছিলো আমি তখন দেশের বাইরে ছিলাম। প্রিন্ট মিডিয়াতে আমার বিরুদ্ধে যে বিষবাষ্প ছড়ানো হয়েছে বহুদিন তার কোন যুক্তিখণ্ডন হয়নি।

সাপ্তাহিক মেঘনা ও আরও কিছু পত্রিকায় সেসব গল্প ছাপা হয়েছিলো। এই সময় যেহেতু আমি দেশের বাইরে ছিলাম তাই সেগুলো আমার নজরে আসেনি। ফলে সেসব গল্পের পাল্টা জবাব দেয়া হয়নি। মানুষ সেগুলোকে সত্য বলে ধরে নেয়। দেশে ফিরে আমি এসব জানতে পারি। এরপর থেকে আমি সেগুলো খুঁজতে থাকি এবং প্রিন্ট মিডিয়ায় সেগুলো চ্যালেঞ্জ করতে শুরু করি।

এটি শুধু বঙ্গবন্ধুর পরিবারের ওপর নয় বরং সমস্ত বাঙালির জন্য একটি জাতীয় দুর্যোগ। বাংলাদেশে কেউ ভাবেনি যে কোনোদিন এমন দুর্যোগ এতোটা ভয়াবহতা নিয়ে নেমে আসবে। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর ওপর। এমনকি বঙ্গবন্ধুও তাই বিশ্বাস করতেন। যখনই আমি বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞেস করতাম, “স্যার, আপনার নিরাপত্তা যথার্থভাবে হচ্ছেনা।“ তিনি বলতেন, “শফিউল্লাহ, চিন্তা করোনা। বাঙালি তোমাকে বা আমাকে হত্যা করবেনা।“ এই ছিলো বঙ্গবন্ধুর মনোবল। আমাকে বঙ্গবন্ধু সম্পূর্ণ বিশ্বাস করতেন এবং মৃত্যুকালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগের সময়েও তিনি জেনে গিয়েছেন যে শফিউল্লাহ তাঁর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেনি। তবে এই আফসোস সেসময় নিশ্চই করেছেন যে কেউ না কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।

আমার স্ত্রী ও সন্তানেরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছে এই ঘটনাগুলোর বিস্তারিত যাতে আমি লিখি। আমি কীসের ভেতর দিয়ে সময় অতিবাহিত করেছি তা তারা দেখেছে। শুধু তারাই নয়, দেশের সকলেরই জানা দরকার সেই ঘটনার বিস্তারিত। আমার লিখতে বসার এটা অন্যতম কারণ। যখন দেশের জাতীয় নেতাকে নিয়ে এধরনের একটা ঘটনা ঘটে সেটি দেশের সকল নাগরিকের জানার অধিকার রয়েছে। ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ আমি তুলে ধরতে চেষ্টা করব। এরপর পাঠক সিদ্ধান্ত নেবে আসলে সেই যুদ্ধ পরিস্থিতিতে আমার কী করার ছিলো। আমি মনে করি আমার পক্ষে যা যা করার ছিলো তার প্রত্যেকটি কাজই আমি করেছিলাম।

আমার লেখায় মনে হতে পারে যে আমি হয়ত কারো সম্পর্কে কিছুটা কর্কশ। তবে এনিয়ে আমার আফসোস নেই। কারণ তাদের সম্পর্কে আমার যে ধারণা আমি সেটাই লিখেছি। মানুষের সত্যটা জানা দরকার। যদিও জনগণের আদালতে আমি অভিযুক্ত। এবং সেটা তারা আমার অনুপস্থিতিতেই করেছে। আমি সেসব জনগণকে অনুরোধ করব তারা যেন দয়া করে আমার এই বইটা পড়েন এবং তারপর বিচারটা করেন। কোন কারণেই আমি দায়িত্বে আলস্য দেখাইনি এবং কখনোই আমার ব্যার্থতাকে অস্বীকার করিনি।

এটা অবশ্যই উল্লেখ করা দরকার যে, সেনাবাহিনী প্রধান যুদ্ধ চলা অবস্থায় বা যখন যুদ্ধ থাকেনা সেই অবস্থায়ও সরাসরি কোন সৈন্যকে কমান্ড করেনা। সে কমান্ড করে তার অধস্তন অফিসারদের আদেশদানের মাধ্যমে – যারা সেদিন তা করতে ব্যার্থ হয়েছিলেন। যদিও সেই ঘটনায় আমার কোন ভূমিকা ছিলো না, কিন্তু আমার পছন্দ হোক বা না হোক, একথা সত্য যে একদল ইউনিফর্মড সেনা অপরাধটি সঙ্ঘটিত করেছে এবং আমি সেই বাহিনীরই চিফ ছিলাম।

পেছনের কথা

বাংলার ইতিহাসে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তারিখটি পুরো জাতির জন্য সবচাইতে কলঙ্কের দিন হিসেবে চিহ্নিত থাকবে। সেদিনের বেদনাময় ঘটনা যে মানুষটির মধ্যে নূন্যতম অনুভিত আছে তাকেই নাড়া দেবে। কোন বিবেকবান মানুষ কোনোদিন সেদিনের ঘটনাকে সমর্থন করতে পারেনা। সেদিনের সেই বেদনাবিধুর দিনে শুধু জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই নন, তার পরিবার – এমনকি শেখ রাসেল যার বয়স কিনা বড়জোর ৯ বছর তাকেও নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। শুধু তাঁর দুই মেয়ে, যারা কিনা সেদিন দেশের বাইরে ছিলেন, তাঁরা সৌভাগ্যক্রমে রক্ষা পান। নিষ্ঠুর খুনিরা সেদিন বঙ্গবন্ধুর কিছু নিকটাত্মীয়কেও ঢাকায় তাদের বাড়ীতে গিয়ে হত্যা করে।

সেদিনের সেই ঘটনা শুধু কিছু বিপথগামী সেনা অফিসারের নির্মম কাণ্ড নয়, বরং এর পেষণে রয়েছে গভীর ষড়যন্ত্র। এই ষড়যন্ত্রের হাত দেশের সীমানা পেরিয়ে বাইরের দেশ পর্যন্ত বিস্তৃত। ইউনিফর্ম পরিহিত লোকগুলো সেদিন শুধু মিশন সম্পন্ন করার একটি অঙ্গ ছিলেন মাত্র। কিছু উচ্চাভিলাষী রাজনৈতিক নেতা এই ষড়যন্ত্রে গভীরভাবে যুক্ত ছিলেন। তাদের অভিলাষ চরিতার্থ করতে তারা কিছু বিপথগামী মিলিটারি অফিসারকে তাদের পকেটে যুক্ত করেছেন মাত্র। তাদের এজেন্টরা সেনাবাহিনীতে প্রবেশ করে তাদের প্রতি সমর্থন তৈরি করতে থাকে। এবং কাজটির জন্য বিপথগামী লোকগুলোকে বেছে নেয়। তাদের পরিকল্পনা ছিলো এমন যে, তারা এমনভাবে ক্ষমতায় যাবে যাতে কেউ তাদের সন্দেহ করতে না পারে। যদিও পরবর্তীতে জানা যায়, এই পরিকল্পনার মাস্টারমাইন্ড ছিলেন খোন্দকার মোশতাক। সে ছিলো বঙ্গবন্ধুর খুবই কাছের একজন সহকর্মী যাকে কোনোভাবেই সন্দেহ হবার কথা নয়। খোন্দকার মোশতাক ছিলো একটা খল। সে বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকেই সব পরিকল্পনা করে। মোশতাকের কাছের লোকদের মধ্যে আরও যারা তাকে এই কাজে সাহায্য করে তাদের মধ্যে তাহেরউদ্দিন ঠাকুর এওং মাহবুব-উল আলম চাষী অন্যতম।

যেমনটা আমি আগেই বলেছিলাম, বাংলাদেশের নেতৃত্ব পরিবর্তনের জন্য একটা গভীর ষড়যন্ত্র চলছিল। কাজেই এই ষড়যন্ত্রকে ধরতে এবং নির্মুল করতে হলে প্রধান দায়িত্ব আসে গোয়েন্দা সংস্থার উপর। কিন্তু সেসময় গোয়েন্দা সংস্থায় যারা ছিলেন হয় তারা বিষয়টি জানতে ব্যার্থ হয়েছেন অথবা তারা বিষয়টি উপেক্ষা করেছেন। আমার কাছে অবাক লাগে যে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এত কিছু ঘটে যাচ্ছে আর তারা কিছুই জানেন না! এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? যদি তারা জেনেও থাকেন হয়ত সেক্ষেত্রে তারা এটি কারো কাছে ফাঁস করেননি। বিশেষ করে যারা দায়িত্বশীল ব্যক্তি। 

            সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে সবার আগে অন্তত আমার জানার কথা। কিন্তু আমাকে একটি লোকও কিছু বলেনি। আমাকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রাখা হয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থায় যারা তখন ছিলেন, হয় তারা এসব জানার মত যোগ্যতা অর্জন করেননি, নাহয় তারাও এই ষড়যন্ত্রের একজন অংশীদার। যে পরিস্থিতিতে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ এর ঘটনা সৃষ্টি হল দুটো অনুমানের (অযোগ্য অথবা অংশীদার) যেটাই সত্য হোক না কেন তা তদন্ত করা জরুরী। 

            যদি প্রথম অনুমানটি বিবেচনায় আনি, গোয়েন্দা সংস্থা বলতে গেলে একেবারে নতুন। তখনো তারা তাদের গোয়েন্দা কার্যক্রম ততোটা বিস্তৃতি ঘটাতে হয়ত পারেনি। হয়ত ষড়যন্ত্রকারীরা সেই সুযোগটাই কাজে লাগিয়েছে। আর যদি দ্বিতীয় অনুমান সত্য হয় (অর্থাৎ তাদের জড়িত থাকার সম্ভবনার বিষয়টি), তবে আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি তাদের উল্লেখযোগ্য অংশ এই ষড়যন্ত্রের অংশীদার ছিলো। আমি বলতে পারি, আমার দ্বিতীয় অনুমানটি আসলে কোন সম্ভবনা নয়, বরং এটাই আসল ঘটনা। সেসময় বেশ কিছু গোয়েন্দা সংস্থা সরকারে কাজ করছিলো। তাদের কেউই যে এধরনের নক্যারজনক ঘটনার বিষয়ে কিছুই জানতে পারেনি তা একেবারেই অসম্ভব। কেউই এই প্রশ্নটা করল না। সবাই আঙ্গুলিনির্দেশ করল শুধু আর্মি চিফ অব স্টাফের দিকে – যে কেন তিনি প্রেসিডেন্টকে রক্ষা করতে পারলেন না। 

            যুদ্ধের পর যখন আমরা ইউনিফর্মড সার্ভিসে যোগদান করলাম তখন আমরা সবাই এক হয়ে কাজ করে যাচ্ছিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আর্মিতে কিছু অনিচ্ছাকৃত অসন্তোষের সৃষ্টি হয়। এই অসন্তোষের প্রধানত দুটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিলো। একটি হচ্ছে কোনরকম যাচাইবাছাই ছাড়াই রিপ্যাট্রিয়েট সেনা অফিসারদের বাংলাদেশ আর্মিতে নিয়োগ দেয়া। দ্বিতীয়ত, অতি উচ্চাভিলাষী ব্যক্তিকে আর্মিতে বহাল রাখা যে সেনাপ্রধান হবার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। আমি বিশ্বাস করিনা যে এই দুটো কাজ আর্মিতে কনফিউশন জিইয়ে রাখার জন্য করা হয়েছে। তবে স্বাধীনতার পর আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্তগুলো নিলে এটি এড়ানো সম্ভব হতো। যদি তা করা হত, তবে পরে হয়ত এমন দুর্ভাগ্য আমাদের হতনা। অতএব, আমি মনে করি, স্বাধীনতার পর সরকার যদি আর্মির ব্যাপারে কোন ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে তবে এই দুটোই হচ্ছে সেই কাজ – যা সঠিক হয়নি। আমি এদুটোর ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা এখানে করতে যাচ্ছি। 

            মানুষকে এটা বোঝানো কষ্টসাধ্য যে, প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা প্রদান করা আর্মি চিফ অব স্টাফের নয়। এর জন্য আলাদা এজেন্সি থাকে যারা এর দায়িত্বে থাকে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কেউ এদের কেউ কোন প্রশ্ন করেনি যে তারা কী করেছে। এই বক্তব্যের মাধ্যমে আমি আমার দায়িত্ব থেকে পিছলে যাচ্ছিনা। যাই হোক না কেন, যারা কাজটি করেছে তারা সেনাবাহিনী লোক এবং আমি সেই বাহিনীর প্রধান ছিলাম। কাজটি কিছু অসন্তুষ্ট ব্যক্তি এবং চাকরী থেকে অবসর পাওয়া চড়া মানসিকতার আর্মি অফিসারদের কাণ্ড। যদিও এই হত্যাকাণ্ডে আমার কোন অংশগ্রহণ নেই, তবুও মানুষ সেটা না বুঝেই আমাকে দোষী সাব্যাস্ত করে – যেহেতু ঐসব ব্যক্তিরা আর্মির লোক এবং আমি তখন আর্মি চিফ। এটা সত্য যে তারা আর্মির লোক এবং আমি চীফ ছিলাম। তবে এটাও সত্য যে আর্মি থেকে কাউকে না কাউকে এই হত্যাকাণ্ডের দায় নিতে হবে এবং এই ঘটনায় প্রতিহত না করতে পারার ব্যার্থতার দায়ও স্বীকার করতে হবে। 

            বেশিরভাগ জনগণের আর্মির কমান্ড দেবার পদ্ধতি সম্পর্কে কোন ধারণা নেই। কারণ কমান্ড ফাংশন কিভাবে কাজ করে তা তাদের জানার কথা নয়। তাই বোঝার জন্য আমাকে বলতে হচ্ছে যে, যুদ্ধ চলমান অবস্থায় অথবা যখন শান্তি বিরাজ করে সেই সময়েও কোন আর্মি চিফ অব স্টাফ সরাসরি তার সৈন্যকে কমান্ড দেয়না। সে কমান্ড দেয় তার অধস্তন সেনা অফিসারদের কমান্ড দেবার মাধ্যমে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, সেদিন সেই ইমিডিয়েট অধস্তন কমান্ডাররা তাদের চিফকে ব্যার্থ করে দেয় – কারণ চিফ তাদেরকে সেনা পাঠিয়ে বিদ্রোহীদের দমন করার যে নির্দেশ দিয়েছিলেন সেটি তারা পালন করতে ব্যর্থ হয়। 

            প্রতি বছর ক্যালেন্ডারের পাতায় যখন ১৫ আগস্ট আছে, যখন বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড নিয়ে আলোচনা হয়, তখন আসলে কী ঘটে তা আমি ঘেঁটে দেখার চেষ্টা করেছি। স্বাভাবিকভাবেই মানুষের মনে অনেক প্রশ্ন দেখা দেয়। যখন নারকীয় সেই ঘটনাটি ঘটছিলো তখন আর্মি চিফ কী করছিলেন? কেন তিনি এটি থামাতে পারলেন না? বা থামানোর জন্য তিনি কী ব্যবস্থা নিয়েছিলেন? কেন তিনি এটি থামাতে সৈন্য পাঠালেন না? আমি ধাবাহিকভাবে, আমার এই লেখায় এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে চেষ্টা করব। যদিও সংক্ষেপে বলতে পারি, চিফ সেদিন কিছু ব্যবস্থা নিয়েছিলেন – তিনি তার ইমিডিয়েট অধস্তন কমান্ডারদের সেনা পাঠাতে বলেছিলেন যাতে বিদ্রোহীদের ঠেকানো যায়। কিন্তু সেদিন সেইসব অধস্তন কমান্ডাররা তার নির্দেশ পালন করেননি বা আমলে নেননি। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন? আমাদের এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে। 

            বঙ্গবন্ধুর সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে দেশে বিদেশে ষড়যন্ত্র চলছিলো। তারচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, খন্দকার মোশতাক, যে কিনা বঙ্গবন্ধুর সম্পূর্ণ বিশ্বাস অর্জন করে বসে তাঁর বিরুদ্ধে ছক আঁকছিলো। কথিত আছে যে, বেশ কিছু আন্তর্জাতিক নেতা বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক করেছিলেন যে হয়ত তাঁর জীবনের উপর হুমকি আসতে পারে, কিন্তু বঙ্গবন্ধু তাতে ভ্রুক্ষেপ করেননি। তাছাড়া, আর্মিতে ক্রমাগত বাড়তে থাকা ক্ষোভ ও অসন্তোষের বিষয়ে জানা থাকা সত্বেও তিনি বিষয়টি ওভারলুক করেছেন। অন্তত একথা বলা যায় যে, এই ব্যাপারে তিনি একেবারেই উদাসীন ছিলেন। ধুর্ত খন্দকার মোশতাক এই অসন্তোষকে টার্গেট করে আর্মিতে অবস্থিত ক্ষোভের আগুন আরও বাড়িয়ে তুলতে চেষ্টা করতে থাকেন। যারা কোন না কোনভাবে নিজেকে বঞ্চিত মনে করেছিলো তারাই এসে খন্দকার মোশতাকের ছায়াতলে অবস্থান নিয়েছে। এবং বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে মনের ঝাল মিটিয়েছে। ক্ষমতা দখল করে নেবার জন্যও একটি গ্রুপ কাজ করছিলো। মিলিটারিতে সৃষ্ট বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানকে আলাদা করে দেখার কোন সুযোগ নেই। 

            একথা অপ্রাসঙ্গিক নয় যে, নীচের র‍্যাংকের ইউনিফর্মড অফিসারদের অনেকেই র‍্যাংক বা ক্লাস নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলো। JCO এবং এর নীচের লেভেলের সেনারা অফিসারদের আধিপত্য তেমন পছন্দ করত না। এই মানসিকতা শুধু আর্মিতে নয়, বরং এয়ার ফোর্স আর নেভিতেও ছিলো। স্বাধীনতার পর তিন বাহিনীতেই এই রকম হুজ্জতি বিরাজ করছিলো। প্রথম গুণ্ডামিটা হয় ১৯৭২ সালে। সেটি ছিলো বিমান বাহিনীতে। সেসময় এয়ার ফোর্স ততোটা গোছানো হয়ে ওঠেনি। সেটি মিটাতে আমাকে সৈন্য পাঠাতে হয় এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে এবং শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে ব্যবস্থা নিতে হয়। পরের ঘটনাটা হয় নেভিতে – ১৯৭৩ সালে। ক্যাপ্টেন নুরুল হক তখন নৌ বাহিনী প্রধান। তিনি আমার কাছে এসে সাহায্য চাইলেন এবং আমি চট্টগ্রাম গ্যারিসন থেকে সৈন্য পাঠালাম। সাহায্য করবার সময় আমি নুরুল হককে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে যদি আমার আর্মিতে এরকম সমস্যা হয় তখন তিনি আমাকে সাহায্য করবেন কিনা? কিন্তু আসলে যখন বিপদ ঘটল তখন কেউই আমাকে সাহায্য করতে আসেনি। 

            যদিও ১৫ আগস্টের বিষয়টা তেমন নয়, তার পরেও মনস্তত্বটা একই রকম। সেনারা বুঝতে পারে যে অফিসাররা তাদের পজিশন উপরে নিতে তাদের ব্যবহার করছে। যদিও ১৫ আগস্টের ঘটনার কাউন্টার একশন ছিলো ৩ নভেম্বর ১৯৭৫ এর ঘটনা। সৈন্যদের ক্ষোভ ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ তারিখে দিনের আলোর মত প্রকাশিত হয়ে পরে যখন তারা “সিপাহি সিপাহি ভাই ভাই, সুবেদারের উপরে কোন র‍্যাংক নাই” – এই বলে মিছিল দিচ্ছিল। এই স্লোগানেই বোঝা যায় যে তারা র‍্যাংকের ব্যাপারে কতটা সচেতন ছিলো এবং উপরের ক্লাসের অফিসারদেকে কতটা অপছন্দ করত। সেদিন সিপাহীরা বেশ কিছু সেনা অফিসারকে হত্যা করে। ব্রিটিশ আমল থেকে একজন সিপাহী একজন অফিসারের রানার হিসেবে কাজ করে। যেমন, ব্যাটম্যান। ৭ নভেম্বর ‘৭৫ এর অভ্যুত্থানের পর দাবী করা হয় যে অফিসারদের জন্য সিপাহিদের থেকে ব্যাটম্যান দেবার প্রথা বাতিল করা হোক। ফলে সেটি বাতিল হয়। আমি যা এতক্ষণ বললাম, এগুলো আরও বেশী আলোচনার অবকাশ রাখে। কারণ একটি শক্ত গাঁথুনির সেনা অফিসার ও সিপাহিদের সম্পর্কের বন্ধন আরও সততা-পূর্ণ হওয়া বাঞ্ছনীয়। 

            উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে, আমি অনুমান করে বলতে পারি ১৫ আগস্ট পঁচাত্তরের ষড়যন্ত্রের মূল খেলোয়াড়রা সম্ভবত দেশের বাইরের কেউ। সমস্ত ঘটনাগুলো ঘটেছে বঙ্গবন্ধুকে কেন্দ্র করে। যেহেতু তিনিই আসল টার্গেট, তাই ষড়যন্ত্রকারীরা তাদেরকেই বেছে নিয়েছে যাদের তাঁর উপর ক্ষোভ আছে। হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি আসলে এই পুরো চক্রান্তের সর্বশেষ প্রায়োগিক পর্ব মাত্র। সেনাবাহিনীতে সৃষ্ট তিক্ততার কারণ নিয়ে পরের অধ্যায়ে আলোচনা করা হবে। এর ফলে পরবর্তী বিষয়ের ধারাবাহিকতা বুঝতে সহজ হবে।

সেনাবাহিনীতে অসন্তোষ

স্বাধীনতার পর আমরা সবাই একত্রে নিজ নিজ কার্যক্ষেত্রে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। আমাদের মূল লক্ষ্য ছিলো একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে শূন্য থেকে আবার গড়ে তুলে একটি নতুন ও সমৃদ্ধশালী দেশ গড়া। সময় নষ্ট না করে, আমরা যারা ইউনিফর্ম পরিহিত, তারা একটি নতুন সৃষ্ট সেনাবাহিনীকে গড়ে তুলতে সর্বশক্তি নিয়োগ করলাম – যাতে এটাকে একটি পূর্ণ কাঠামো দেয়া যায়। তারই প্রেক্ষিতে আমরা যারযার অংশে মনঃপ্রাণ দিয়ে কাজ করতে লাগলাম। যেহেতু সামান্য সম্পদ নিয়েই আমরা যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করতে পেরেছিলাম, তাই আমাদের একটি মনোবল ছিলো যে একইভাবে আমরা সীমিত সামর্থ্যের মধ্যে আমাদের সেনাবাহিনীকে গড়ে তুলতে পারবো। সেই লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছিলাম। মনোবল এরকম ছিলো যে আমরা যেকোন কিছুই অর্জন করতে পারবো। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান থেকে ছাড়া পেয়ে দেশে এসে বললেন পাকিস্তানে নিরুপায় হয়ে পড়া বাঙালি অফিসার ও সৈন্যরা ফিরে আসলে তাদেরকেও নতুন করে গড়া বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে নিয়ে নেয়া হবে। বঙ্গবন্ধু সবেমাত্র পাকিস্তানের বন্দিত্ব থেকে ফিরে এসেছেন। বিষয়টা এরকম মনে হল যেন তিনি বন্দীদশায় পাকিস্তানে যে কষ্ট ভোগ করেছেন, রিপ্যাট্রিয়েটেড অফিসার ও অন্যান্যদের বিষয়টা একইভাবে ভেবে নিয়ে তিনি তাদেরকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করে নেবার সিদ্ধান্ত দিলেন। তাই আমার মনে হল, তাঁর নিজের অভিজ্ঞতার আলোকেই তিনি নিজে এই সিদ্ধান্ত দিলেন। সেসময় তাঁর এই ইচ্ছা, আমার জন্য ছিলো আদেশ। কিন্তু রিপ্যাট্রিয়েটেড অফিসার ও অন্যান্যদের বাংলাদেশ আর্মির সাথে সমন্বয় করে নেবার সিদ্ধান্তটা ছিলো পাকিস্তান তার সারেন্ডার করা (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে) অফিসার ও সৈন্যদের ব্যাপারে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো তার একদম বিপরীত। কারণ, পাকিস্তান তাদের আত্মসমর্পনকারী অফিসার (সিনিয়র অফিসার সহ) ও অন্যান্যদের কাউকেই রিপ্যাট্রিয়েশনের পর চাকরীতে রাখেনি। বরং সবাইকেই অবসর দিয়ে দেয়া হয়েছে। 

            অফিসার ও অন্যান্য যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে (মুক্তিযোদ্ধা) তাঁরা মানসিকভাবে রিপ্যাট্রিয়েটেড অফিসারদের মেনে নিতে পারছিলনা। অনেকটা মেরুকরণ হয়ে গেল। এই মন্তব্যের মাধ্যমে আমি কোন বিশেষ গ্রুপকে খাটো করে দেখাতে চাচ্ছিনা। বাস্তবতা হচ্ছে, প্রথম গ্রুপটা সাহসী, দ্রুত চিন্তা করা, দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা রাখে, এবং যে কোন ধরণের জীবনের ঝুঁকি নিতে তাঁরা সর্বদা প্রস্তুত। আর দ্বিতীয় গ্রুপটির বেশিরভাগ খুব হিসেব করে চলে, সতর্ক থাকে, ধীরে প্রতিক্রিয়া দেখায় এবং ভেবে চিনতে যদি দেখে তা তার নিজের সামনে আগানোতে কোন ভূমিকা রাখবে তবেই সিদ্ধান্ত নেয়। এছাড়া, প্রথম গ্রুপটি (মুক্তিযোদ্ধা) সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্সে ভোগে, আর অপর গ্রুপটি (রিপ্যাট্রিয়েটেড) ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্সে ভোগে। এমতাবস্থায় এই দুই গ্রুপকে একত্রিত করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এমন একটা সময় যখন আমাদের আর্মিকে দাঁড় করাতে শুরু করেছি। 

            একটা দোটানা তৈরি করার জন্য উভয় গ্রুপেই কিছু কুলাঙ্গার ছিলো। আর্মড ফোর্স খুব সেনসিটিভ একটি প্রতিষ্ঠান। তাই এটাকে যথেষ্ট সাবধানতার সাথে চালাতে হয়। চিফ অব স্টাফ হিসেবে আমার দায়িত্ব ছিলো এই দুই গ্রুপকে এক করার ব্যবস্থা করা। লক্ষণীয়ভাবে আমার সীমাবদ্ধতা ছিলো। প্রথমত, আমার বয়স এবং চাকরীর দৈর্ঘ। তারচেয়ে বড় বিষয়, ধ্বংসস্তূপ থেকে একটি সম্পূর্ণ সেনাবাহিনীকে গড়ে তোলার বৃহৎ দায়িত্ব আমার কাঁধে। এই দায়ত্বের মাঝেও আমি এই দুই গ্রুপকে এক করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। কিন্তু সব চেষ্টা সত্বেও সেটা সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি। আমি দুঃখবোধ করি, কারণ এই দুই গ্রুপকে এক করতে যথেষ্ট সময় আমি পাইনি। 

            তাই সেবা প্রদানের স্বার্থে এবং অসন্তোষ দূর করার লক্ষ্যে একটি গ্রুপকে বাড়ীতে পাঠানো উচিৎ ছিলো। আমাকে হয়ত প্রশ্ন করা হতে পারে যে প্রশ্নটি আমি আগে কেন উত্থাপন করিনি। আসল ঘটনা হচ্ছে, আমি আমার দর্শন এখানে সহজেই বলতে পারি, কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মত একজন ব্যক্তিত্বের সামনে এটা বলা বা তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিলোনা। মুক্তিযোদ্ধাদের গ্রুপটি খুব সেনসিটিভ ও ওভাররিয়াক্টিভ ছিলো। যার ফলে তাদের অনেককেই অহমিকার কারণে দীর্ঘদিন ভুগতে হয়েছে। কোর্ট মার্শালের মুখোমুখি হতে হয়েছে – মৃত্যুদণ্ড ভোগ করতে হয়েছে। পাশাপাশি, তাদের বেশিরভাগ চাকরীতে বেশিদিন টিকতে পারেনি। 

            সরকার দ্বিতীয় যে ভুলটি করেছে তা হচ্ছে, চিফ অব আর্মি স্টাফ সিলেকশন ও নিয়োগ। জেনারেল জিয়াকে রহিত করে (সুপারসিড) আমাকে চিফ হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় – যদিও জিয়া ছিলেন আমার সিনিয়র। অভিযোগকারি ব্যক্তিটি আমিই হতাম কিন্তু আমি আমার নিয়োগের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহীর সাথে বিতণ্ডায় যুক্ত হতে পারিনি। সরকার রাজনৈতিক চিন্তা মাথায় রেখে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো। কিন্তু এর ফলে অসন্তোষের সৃষ্টি হয়। এটা এড়ানো সম্ভব ছিলো। আমি আগেও বলেছি যে আমার সেনাপ্রধান হবার কোন তাড়া নেই। নিয়মতান্ত্রিকভাবেই যখন আমার সময় আসতো তখন আমি চিফ হতে পারতাম। এখানে সরকার যে ভুল করল তা হচ্ছে একদিকে জিয়াকে সুপারসিড করে আমাকে আর্মি চিফ করা; আর অন্যদিকে জিয়াকে চাকরীতে বহাল রাখা। যে কারণে জিয়াকে চিফ করা হয়নি, একই কারণে তার চাকরী বহাল থাকার কথা নয়। এরপর সরকার আরও একটি ভুল করলেন। “ডেপুটি চিফ” নামে একটি পদ সৃষ্টি করে সেই পদে জিয়াকে পদায়ন করলেন। একজন উচ্চাভিলাষী লোক হিসেবে জিয়া এটা মেনে নিতে পারেনি। এবং সে ষড়যন্ত্র শুরু করে দেয়। যার একটি পরিণতি ছিলো পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের দুর্যোগ। 

            জেনারেল জিয়া আমার ব্যাচমেট, কিন্তু সে আমার সিনিয়র। ডেপুটি চিফ হিসেবে তার নিয়োগ হবার পর আর্মিতে কিছু কমান্ড দেবার সুযোগ হয়। যদি জিয়াকে আর্মিতে বহাল রাখতেই হয়, তবে তাকে চিফ করে রাখা উচিৎ ছিলো। কিন্তু তা না করে, জিয়াকে চাকরীতে বহাল রেখে তাকে ডেপুটি চিফ করাটা ছিলো সরকারের সবচেয়ে বড় ভুল। তাই সরকার করেছে। তার সাথে কাজ করতে আমার কোনই সমস্যা ছিলোনা। কিন্তু এই ঘটনার পর প্রথম সাক্ষাতেই তার ক্ষোভের পরিমাণ আমি তার কণ্ঠে বুঝতে পারি। ডেপুটির চেয়ারে বসার প্রথম দিন থেকেই সে চক্রান্ত শুরু করে। এটা ছিলো একটা অস্বাস্থ্যকর এবং অপ্রয়োজনীয়ভাবে সৃষ্ট পরিস্থিতি। 

            যুদ্ধের পর জাতীয় পর্যায়ে মুজিবনগর সরকার কোলকাতা থেকে দেশে ফেরার সময় সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো যে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে জাতীয় মিলিশিয়া গঠন করা হবে। এটা রেডিও-টিভিতে প্রচার হয়েছিলো। কিন্তু পরে এই প্রোগ্রাম বন্ধ হয়ে যায়। সিদ্ধান্তটা নেয়া হয় বঙ্গবন্ধু ফিরে আসার পর। বিষয়টা মুক্তিযোদ্ধারা ভালো চোখে দেখেনি। এই সিদ্ধান্ত নিতে বঙ্গবন্ধু যদি কোন ভূমিকা নাও রাখেন, তথাপি, বঙ্গবন্ধু-বিরোধী শক্তি এটাকে লুফে নিয়েছিলো এবং তাঁর বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাতে শুরু করে দেয়। বলতে দ্বিধা নেই, ৯ মাসের রক্তাক্ত সংগ্রামের পর সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে এধরনের প্রচারণা একটি নতুন সরকারের জন্য মোটেও ভালো ছিলোনা। 

            স্বাধীনতার পর সরকার দেখল, দেশের রাস্তাঘাট, রেল, শিল্পকারখানা, অর্থনীতি এবং নৌ যোগাযোগ সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। তার উপরে সারা দেশে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ মানুষের হাতে হাতে। এর কিছু কিছু জেনুইন মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে। আর কিছু রাজাকারদের হাতে। এসব অস্ত্র পুনরুদ্ধার করা দরকার। এবং সেগুলো নিরাপদ জায়গায় স্থানান্তর করা দরকার। অপরদিকে, তারুণ্যে ভরপুর যুবকেরা এদিক সেদিক ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছিল। কিছু একটা নির্দেশনা খুঁজছিল। আরেকদিকে, দেশ স্বাধীন হওয়ায় মানুষের আশা অনেক বেড়ে গিয়েছিলো। একদিকে উচ্চাশা, অন্যদিকে তা না পাওয়ার বাস্তবতায় হতাশা বেড়েই চলছিলো। এর ফলে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হতে শুরু করে। স্বাধীনতার পর, এই ছিলো বাংলাদেশের পরিস্থিতি। এমতাবস্থায়, একটি উন্নয়নশীল দেশের পক্ষে সবাইকে সন্তুষ্ট করা ছিলো খুবই কঠিন। বিশেষ করে যখন আমরা স্বাধীন হয়েছি মাত্র অল্প কিছুদিন আগে। এবং তখনো যুদ্ধের ক্লান্তি মুছে যায়নি। 

            যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশে তখন একটি প্রবাদ খুব প্রায়োগিক হয়ে উঠলো – “অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা।” স্বাধীনতার পর যেহেতু অর্থনীতির চাকা ঘুরতে কিছুটা সময় লাগছিলো, তাই বেকারত্বের করাল গ্রাসে যুবসমাজ হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে যাচ্ছিলো। বেকারত্ব ছিলো দেশের আইন শৃঙ্খলার অবনতির অন্যতম কারণ। পাশাপাশি, গুজব উঠলো যে সেনাবাহিনী ভেঙ্গে দেয়া হচ্ছে। যখন ১৯৭৩ সালে জাতীয় রক্ষী বাহিনী (JRB) গঠিত হল। তখন শোনা যেতে লাগলো যে ধীরে ধীরে এই বাহিনীকে দিয়ে সেনাবাহিনীকে প্রতিস্থাপন করা হবে। যদিও এর কোন রকম সত্যতা ছিলো না, কিন্তু কম বেতনের সৈনিকরা দুশ্চিন্তায় পরে গেল এবং চাকরীর নিশ্চয়তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল। সত্য-মিথ্যা যাই হোক না কেন, রক্ষীবাহিনী সৃষ্টির ফলে গুজব দ্রুত ছড়াতে লাগলো এবং আসন্তোষের সৃষ্টি হতে লাগলো। সরকার-বিরোধী শক্তি এর পূর্ণ সুযোগ নিল এবং সৈনিকদের মনে বিষবাষ্প ছড়াতে লাগলো। 

            জনগণের মনে প্রশ্ন দেখা দিলো যে, আর্মি থাকার পরেও রক্ষীবাহিনীর মত আরও একটি বাহিনীর প্রয়োজনীয়তা কী? এর উত্তর হচ্ছে, রক্ষীবাহিনী গঠন করা হয়েছিলো দেশের আইন শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে আনার নিমিত্তে পুলিশ বাহিনীকে সাহায্য করার জন্য। আমার নিজস্ব ধারণা হচ্ছে, সমস্যা আসলে নতুন বাহিনী করার জন্য নয় – বরং ঐ বাহিনীর নামটায়। রক্ষীবাহিনী। এই নামের বদলে “রিজার্ভ পুলিশ ব্যাটেলিয়ন” অথবা “রিজার্ভ পুলিশ ফোর্স” এরকম কোন নাম হতে পারতো। সেরকমটা করা হলে কেউ আর এনিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারতোনা। প্রশ্ন তখনই উঠলো যখন এর নাম দেয়া হল “জাতীয় রক্ষী বাহিনী।” গুজব রটনাকারীরা এটাকে আর্মির চেয়ে উপরে (সুপিরিয়র) বা সমমানের (প্যারালাল) হিসেবে কথা ছড়াতে করতে লাগলো। এটাও অবিশ্বাস্য যে, যে পুলিশ বাহিনী ২৫ মার্চ ১৯৭১ পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রবল আক্রমণ করেছিলো, সেই বাহিনী স্বাধীনতার পর তাদের নিজেদের কাজটা ঠিক মত করতে পারছেনা। একটা কারণ হতে পারে যে, ২৫ মার্চের পরে অরিজিনাল পুলিশ ফোর্স, অর্থাৎ যারা বীরত্বের সাথে সেদিন লড়াই করেছিলো, তাদের সবাইকে পাকিস্তান সরকার সরিয়ে দিয়েছে এবং সেখানে নিজেদের পছন্দমাফিক লোক বসিয়েছে। এর ফলে, এই পুলিশ বাহিনী স্বাধীনতার পর জনসাধারণের উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করতে এবং তাদের আস্থা অর্জন করতে ব্যর্থ হয় – যার ফলে আরেকটি বাহিনী সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা অনুভব হয়। 

            যুদ্ধের সময় যদিও বেশিরভাগ পুলিশ হয়ত তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই কাজ করেছে, তথাপি, বেশিরভাগ জনগণ মনে করে তারা স্বেচ্ছায় কাজ করেছে। বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধারাও এমনটাই ধারণা করে। ফলে এই পুলিশের মনোবল দুর্বল ছিলো এবং আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণেও তাদের দুর্বলতা দেখা দিয়েছিলো। ফলে যখনই কোন সমস্যা হতো, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আমাকে সেখানে সেনা পাঠাতে হতো। কিন্তু আমাদের কাজ ভিন্ন। এবং আমাদের বাহিনী তখনো কৈশোরে। আমাদের বাহিনীকে প্রস্তুত করতে হবে ভিন্ন লক্ষ্যে। মাঝে মাঝে আর্মি বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে সিভিল পাওয়ারকে সাহায্য করতে পারে, তবে এধরনের কাজে আর্মির ব্যবহার অতিরিক্ত পরিমাণে বেড়ে যাচ্ছিলো। এই অবস্থায় আমাদের নিজস্ব কাজ যাতে আমরা চালিয়ে যেতে পারি সেই লক্ষ্যে সরকার সিদ্ধান্ত নিলেন আমাদেরকে পুলিশ রোল থেকে মুক্তি দেবেন। যার ফলে সৃষ্টি হল রক্ষীবাহিনী, আজকের দিনের র‍্যাবের (RAB) মতো।

    

            এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় সরকারী আদেশ প্রণয়ন করা হল। এরজন্য পর্যাপ্ত লোকবল জোগাড় করতে কোন সমস্যা হল না। কারণ হচ্ছে, বিভন্ন ক্যাম্পে প্রচুর মুক্তিযোদ্ধা ছিলো যারা ন্যাশনাল মিলিশিয়াতে নিযুক্ত হবার জন্য অপেক্ষা করছিলো। ফলে রক্ষীবাহিনীর হেড কোয়ার্টার থেকে তারা শুরু ক্যাম্পগুলোতে গিয়েছে এবং সেখানে যারা তাদের চাহিদা পূরণ করে তাদের বাছাই করে নিয়েছে। যেহেতু এটি একটি নতুন ধারণা তাই এর সব কিছুই নতুন ধরণের। অর্থাৎ তাদের অস্ত্র, পোশাক, বাসস্থান যানবাহন ইত্যাদি। গুজব উঠলো যে, রক্ষীবাহিনী নতুন ওঁ আধুনিক অস্ত্র পাচ্ছে যে ব্যাপারে আর্মি ছিলো নিগৃহীত। বাস্তবতা হচ্ছে, আর্মি যে অস্ত্রগুলো ব্যবহার করছে সেগুলো হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার ব্যবহৃত অস্ত্র। স্বভাবতই সেগুলো দেখতে অনেক পুরনো। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, যেহেতু রক্ষীবাহিনী নতুন একটি বাহিনী তাই এদের যা কিছু দেয়া হচ্ছে সবই নতুন। এটাই আসল ঘটনা। এর বাইরে কিছু নয়। গুজব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল যে রক্ষীবাহিনী অনেক শক্তিশালী। ফলে আর্মির বেশিরভাগ সৈন্য বিশ্বাস করতে লাগল যে আর্মির চেয়ে রক্ষীবাহিনীকে অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে এবং আর্মির সদস্যদের চাকরী নাও থাকতে পারে। যারা প্রোপাগান্ডা ছড়াচ্ছিল তারা এমন সৈনিকদের টার্গেট করল যাদের বেতন অনেক কম এবং যারা সরকারী চাকরীটা হারাতে চাচ্ছিল না। ফলে যে গুজবটি আগে শোনা গিয়েছিলো যে, রক্ষীবাহিনীর কারণে আর্মি ভেঙ্গে দেয়া হতে পারে, সেটা অনেকটাই বিশ্বাসযোগ্যতা লাভ করল। আমার পক্ষে এই গুজবটা ঠেকানো কঠিন ছিলো। অভিযোগ আছে যে, সে সময়কার জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) এর নেতৃত্ব এই গুজবের পেছনে কাজ করছিলো। আরও অভিযোগ আছে যে তারা ইতোমধ্যে আর্মিতে তাদের এজেন্ট নিয়োগ দেবার পরিকল্পনা করেছে যাতে করে তারা সরকারের বিরুদ্ধে বিষোদগারের কাজটি ভালো করে চালাতে পারে। কর্নেল তাহের ছিল এমন একজন এজেন্ট। সেনাবাহিনীতে থাকলেও গোপনে সে এই পার্টির সক্রিয় সদস্যে পরিণত হয়। 

            কর্নেল তাহের ছিলেন একজন AG (Adjutant General) এবং তার অন্যতম কাজ ছিলো সৈনিকদের মানসিক অবস্থা দেখাশোনা করা। কিন্তু তার কার্যকলাপ নতুন সৃষ্ট সেনাবাহিনীর জন্য কোন উপকারে আসছিলোনা। সে কনভেনশনাল আর্মির স্বার্থে নয়, বরং জনগণের আর্মির হয়ে কাজ করছিলো। সেনাবাহিনী তখনো তৈরি হচ্ছিলো। এমতাবস্থায় যে গুজব রটলো তা আর্মির ইন্টারেস্টের বিপক্ষে গেল। আর্মিতে আমার ডেপুটি জেনারেল জিয়া গুজব ছড়াতে কর্নেল তাহেরকে ইন্ধন দিতে থাকলো যাতে করে আমার অথোরিটির ব্যাপার সরকারের অনাস্থা জন্মায়। কর্নেল তাহের জিয়ার প্রমোটার হিসেবে কাজ করেছে, তবে বেশী দিনের জন্য নয়। কারণ দুজনেই ছিল উচ্চাভিলাষী। জেনারেল জিয়া পরবর্তীতে কর্নেল তাহেরের মরণশত্রুতে পরিণত হয়। একটি সময় আসলো যখন কর্নেল তাহেরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহমূলক অভিযোগ এনে মার্শাল কোর্টে বিচার করা হয় এবং তাকে দোষী সাব্যাস্ত করে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। কর্নেল তাহেরের বিচার চলাকালীন সময়ে জেনারেল জিয়া ছিলেন চিফ মার্শাল ল এডমিনিস্ট্রেটর (CMLA). শাস্তির চূড়ান্ত রায়ের আদেশে স্বাক্ষরটাও সেই করে। কর্নেল তাহেরকে ফাঁসি দেয়া হয় এবং সে ক্ষমাপ্রার্থনা করেনি। 

            আর্মি এবং রক্ষীবাহিনী পাশাপাশি এগোচ্ছিলো। রক্ষীবাহিনীর নতুন সদস্যদের ট্রেনিং দেবার জন্য ইন্সট্রাক্টরের প্রয়োজন থাকলেও আর্মি থেকে কোন ইন্সট্রাক্টর দেয়া সম্ভব হলনা। কারণ সেনাবাহিনীতেই এদের সংখ্যা কম ছিলো। ফলে এধরনের সহায়তা করা সম্ভব ছিলোনা। ফলে বাংলাদেশ সরকার ভারতের কাছে সাহায্য চাইলো। ভারত রাজি হলো এবং রক্ষীবাহিনীকে সাপোর্ট দেবার জন্য এগিয়ে আসলো। তারা একরকম আগ্রহের সাথেই কাজটার দায়িত্ব নিল। ফলে ভারত সরকার শুধু ইন্ট্রাকশনাল স্টাফ নয়, বরং অস্ত্র, গোলাবারুদ, যন্ত্রপাতি, পোশাক, ওয়্যারলেস সেট, যানবাহন ইত্যাদি দিলো। 

            ভারত রক্ষীবাহিনীকে ইন্সট্রাকশনাল সাপোর্টের জন্য যে লোকবল দিয়েছিলো তাদের বেশিরভাগ ছিলেন সাউথ ইন্ডিয়ান অরিজিন। সেসব সৈন্যের গায়ের রং ছিলো কালো। ইন্ডিয়ান আর্মি রক্ষীবাহিনীকে যে পোশাক দিল তার রং অলিভ গ্রিন (OG)। এটা দেবার কারণ সম্ভবত অলিভ-গ্রিন ইউনিফর্ম তাদের কাছে পর্যাপ্ত এভেইলেবল ছিলো। যদিও আমাদের ছেলেরা ততোটা কালো ছিলোনা, তথাপি অলিভ-গ্রিন ইউনিফর্মে তাদেরকে কালো কালো দেখাচ্ছিলো। ফলে গুজব উঠলো যে, রক্ষীবাহিনীকে ভারতীয় বাহিনীর মত সজ্জা দেয়া হচ্ছে। এই গুজবটা টিকে গেল। এটা যদি সত্যি হত তবে পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর যখন রক্ষীবাহিনীকে আর্মিতে নিয়ে নেয়া হল তখন সেসব ভারতীয়রা কোথায় গেলেন? 

আরেও একটা গুজব ছিলো যে, রক্ষীবাহিনীকে আর্টিলারি গান এবং ট্যাংক-বিধ্বংসী অস্ত্র দেয়া হচ্ছে। যখন এটি ছড়িয়ে পড়ল তখন আর্মি ইউনিট বাইরে থেকে আর্টিলারি-গান বা ট্যাংক রিসিভ করলনা। এই গুজবটা সৈন্যদের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে আর্টিলারি ও আর্মার্ড সৈন্যদের ওপর। এই দুই বাহিনীর সৈন্যরা ডামি গান এবং ক্যানিবালাইজড ট্যাংক দিয়েই তাদের ট্রেনিং চালিয়ে যেতে লাগলো। তাদের সন্দেহ দূর করতে সৈন্যদের কাছে ব্যক্তিগতভাবে আমাকে রাউন্ডে যেতে হল এবং কথা বলতে হল। এটা আমার জন্য অনেকটা ওয়ান ম্যান ক্রুসেডের মতো হয়ে গেল – অর্থাৎ আমাকে একাই এই গুজবের বিরুদ্ধে লড়তে হচ্ছিলো। যদিও আগস্ট ‘৭৫ এর পর যখন রক্ষীবাহিনী সেনাবাহিনীর সাথে মার্জ করে দেয়া হল তখন দেখা গেল তাদের কাছে শুধুমাত্র ইনফ্যান্ট্রি ওয়েপন আছে। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় এটা। কারণ ইতোমধ্যে অনেক দেরী হয়ে গেছে যখন সৈন্যরা সত্যটা দেখতে পেলো। 

            যখন নানান গুজব আর্মিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছিলো তখন ১৯৭৪ সালে পার্লামেন্টে একটি সেনসিটিভ বিল পাস হল। এতে রক্ষীবাহিনীকে ব্যাপক ক্ষমতা দেয়া হল। এমনকি কোন ওয়ারেন্ট ছাড়াই কাউকে এরেস্ট করার ক্ষমতা দেয়া হল। সেসময়কার পরিস্থিতি বিবেচনায় রক্ষীবাহিনীকে এই ক্ষমতা দেয়া যথার্থ ছিলো। কিন্তু গুজব রটনাকারীরা এটাও লুফে নিলো। তারা বিলের কথা বলে সৈনিকদের কান ভারী করতে লাগলো। তারা সরকারের বিরুদ্ধে বলতে লাগলো যে, রক্ষীবাহিনী আর্মির চেয়ে প্রভাবশালী বাহিনীতে পরিণত হতে যাচ্ছে। সেই স্পর্শকাতর বিষয়ে একটি কথা বলে রাখা ভালো যে, রক্ষীবাহিনীকে যে কাউকে বিনা ওয়ারেন্টে এরেস্ট করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে বলে যে সেটি আর্মিকেও দিতে হবে তা নয়। কারণ আর্মি সিভিল পাওয়ারের জন্য নিয়োজিত নয়। তাছাড়া, রক্ষীবাহিনী যেহেতু সিভিল অথোরিটিকে সহায়তা করবে সেহেতু তাদের এধরনের ক্ষমতার প্রয়োজন রয়েছে। এই ক্ষমতা তাদেরকে এমন কোন ডমিনেটেড বাহিনীতে পরিণত  করেনা যতোখানি গুজব ছড়ানোতে বলা হয়। অন্যদিকে, রক্ষীবাহিনীতে কিছু বিপথগামী ঘটনা ঘটেছে যা তাদের সীমানার বাইরে। তারা কিছু সেনাসদস্যের সাথে অসদাচরণ করে যাদের মধ্যে একজন আর্মি অফসারও আছেন। এসব ঘটনা পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে করে। অন্যায়কারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হলেও যে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে তা সারলোনা। 

           

এসবের পরে আরও একটি বিষয় হচ্ছে, সাধারণ সৈন্যদের মধ্যে এমন একটি ধারণা প্রচলিত আছে যে রাজনৈতিক ব্যাক্তিগন আর্মিকে বিশ্বাস করেনা। প্রায়শই তারা দেখে যে রাজনৈতিক ব্যক্তিরা মিলিটারি ইস্যুতে নাক গলায় এবং তাদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রভাব খাটাতে চেষ্টা করে। ফলে সৈন্যরা ভেবে নেয়, হয়ত আর্মি নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারবেনা। ১৯৭৪ সালের ২৪ এপ্রিল যখন জরুরী অবস্থা ঘোষণা করা হয় তখন এই বিশ্বাসটা দানা বাঁধতে শুরু করে। এই অপারেশনের কোড নেইম ছিল, “অপারেশন সিলভার লাইনিং”। এর লক্ষ্য ছিলো অননুমোদিত লোকদের থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করা। আর্মি যখন সিভিল পাওয়ারকে সাহায্য করছিলো তখন বারবার তারা রাজনৈতিক নেতাদের দ্বারা বাধাগ্রস্ত হচ্ছিলো। তারা হয়ত ভেবেছিলো তারা যেভাবে চাইবে আর্মি সেভাবেই কাজটা সারবে। কিন্তু তাদের ইচ্ছা সফল হয়নি। কারণ আর্মি অফিসার ও সৈন্যবাহিনী তাদের চাপ মেনে নেয়নি এবং যা বলা হয়েছে সেই অনুযায়ী কম্প্রোমাইজ করেনি। ফলে কিছু সমস্যা দেখা দেয় এবং নতুন কিছু পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। অপারেশন চলাকালীন সময়ে প্রথম সমস্যাটা হয় কসবা-কুমিল্লা এলাকায় যেখানে সুনির্দিস্ট তথ্যের ভিত্তিতে আর্মি কন্টিনজেন্ট এক মহিলা এম পি র এলাকায় যায়। সার্চ করার ফলে মাটির নীচে লুকিয়ে রাখা স্থান থেকে প্রচুর পরিমাণ অস্ত্র, গোলাবারুদ ও গুঁড়োদুধ উদ্ধার করা হয়। যে জায়গায় এটি পাওয়া যায় সেটি মহিলা এম পিকে না জানিয়ে করা সম্ভব নয়। সরকারী আইন অনুযায়ী যুদ্ধের শেষে ৩১ জানুয়ারি ১৯৭২ এর পর থেকে কেউ কোন অস্ত্র রাখতে পারবেনা। তথাপি ৭৪ সালের এপ্রিলের দিকে ওই মহিলা এমপির বাড়ির পেছনের দিকের উঠানে এসব অস্ত্র পাওয়া যায়। একজন মহিলা এমপির কাছে এতো বিপুল পরিমাণ অস্ত্র রাখার কোন যৌক্তিকতা নাই, বরং এর কোন অসৎ উদ্দেশ্য থাকতে পারে। তাছাড়া তার নিজ এলাকার প্রয়োজনে যেকোন সময় তিনি গুঁড়োদুধের সরবরাহ বা বিভিন্ন রিলিফ আইটেম পেতে পারেন।  যখন এসব মাটির নীচ থেকে উদ্ধার করা হল তখন সন্দেহ বেড়ে গেল। আমি ব্যক্তিগতভাবে সেই স্থানটি দেখে আসলাম এবং যেভাবে তথ্য যোগাড় করা হয়েছে সেটা জেনে সন্তুষ্ট হলাম। অপারেশন পরিচালনার ব্যাপারেও আমি সন্তুষ্টি প্রকাশ করলাম। 

“অপারেশন সিলভার লাইনিং” এর সময় বাণিজ্যমন্ত্রী কুমিল্লার খন্দকার মোশতাক তার এলাকায় এরকম আর্মি একশন পছন্দ করলেন না। তিনি আমার ও আমার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর কাছে অভিযোগ করলেন। তিনি বললেন, আর্মি মহিলা এমপির বাড়ীতে যা করেছে সেটি অনধিকার চর্চা এবং এতে ওই এমপির এলাকায় ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে। ফলে তিনি আর্মি চিফকে চাকরী থেকে বরখাস্ত করার আবেদন করলেন। প্রধানমন্ত্রী আমাকে তাঁর অফিসে ডাকালেন এবং খন্দকার মোশতাকের অভিযোগের প্রেক্ষিতে আমার ব্যাখ্যা শুনলেন। 

আমি প্রধানমন্ত্রীকে ব্যাখ্যা করলাম যে, আমার বাহিনীর লোক সুনির্দিস্ট তথ্যের ভিত্তিতে ওই মহিলা এমপির বাড়ীতে তল্লাশি করেছে এবং তার বাড়ির পেছনের উঠোনের মাটির নীচ থেকে প্রচুর অস্ত্র ও গুঁড়োদুধ উদ্ধার করেছে। সৌভাগ্যক্রমে অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ সেখানে উপস্থিত ছিলেন। আমার কথা শুনে তিনি বললেন, এটা নিরপেক্ষ কাউকে দিয়ে তদন্ত করতে হবে। তাতে বের করা যাবে অন্যায়টা কার। যদি তদন্তে প্রমাণিত হয় যে আমার বাহিনী সীমা লঙ্ঘন করেছে তাহলে আমার বা আমার বাহিনীর সৈন্যদের ব্যাপারে যে কোন শাস্তি মেনে নেয়া হবে। আর যদি মহিলা এমপি অন্যায় করে থাকেন সেক্ষেত্রে তাকে পার্লামেন্ট থেকে পদত্যাগ করতে বলা হবে। আমি বিষয়টা সম্পূর্ণ জানতাম যে আমার সৈন্যরা কী করেছে – তাই এই সিদ্ধান্তে আমি সন্তুষ্টি প্রকাশ করলাম। কিন্তু তদন্ত কমিটি কোনোদিনই গঠিত হলনা। খন্দকার মোশতাক এই ঘটনাটা ঠিকই মাথায় রেখেছিল এবং ১৫ আগস্ট ‘৭৫ এর ঘটনার পর আমাদের চাকরী থেকে অব্যাহতি দেয়। 

এই একই অপারেশনের সময় (অপারেশন সিলভার লাইনিং) মেজর শরিফুল হক ডালিম কুমিল্লা এরিয়াতে ছিলো। অপারেশন চালাকালীন সময়ে সে সেখানে কিছু কাণ্ড ঘটায় যাতে আমাদের বদনাম হয়। ছাত্রজীবনে মেজর ডালিম ডানপন্থী মতবাদের দিকে ঝুঁকেছিল। এই ছাত্র সংগঠনটি সরকারের মদদপুস্ট ছিলো। এবং বেশ কিছু উচ্ছৃঙ্খলতায় জড়িত ছিলো। আর্মিতে জয়েন করার আগে সে সেই গ্রুপের সদস্য ছিলো। ছাত্রজীবনে তখন তার প্রতিপক্ষের সাথে তার সিরিয়াস কিছু মতবিরোধ ছিলো। সেগুলো সম্ভবত সমাধা হয়নি। ইমার্জেন্সি চলাকালীন সময়ে সে সেই সুযোগটা নেয়। পুরনো হিসেবগুলো মিটিয়ে ফেলতে সে তার কিছু সৈন্য ও পুরনো বন্ধুদের দিয়ে সেইসব সাবেক কিছু ছাত্রকে তার হেডকোয়ার্টারে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকে আনে। হেডকোয়ার্টারে সেইসব সাবেক ছাত্রনেতাদের চড়-থাপ্পড় দেয়া হয় এবং পুলিশ ডেকে তাদের কাস্টডিতে পাঠানো হয়। ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার মাশহুরুল হক বিষয়টা জানতে পারেন এবং আমাকে জানান যে মেজর ডালিম ক্ষমতার অপব্যবহার করে কিছু নিরপরাধ লোককে হেনস্থা করছে। আমি তাকে বললাম ঘটনা তদন্ত করে দেখতে। যদি সত্যি এটি প্রমাণিত হয় তবে তার বিরুদ্ধে কঠিন পদক্ষেপ নেয়া হবে। ব্রিগেড কমান্ডার ঘটনার সত্যতা পান এবং মেজর ডালিমকে ভৎসনা করেন। তিনি ভিক্টিমদের পুলিশ কাস্টডি থেকে ছাড়ানোর ব্যবস্থা করেন। 

এই ঘটনাগুলোর বাইরে, বরিশাল ও খুলনা এরিয়ায় কিছু সমস্যা হয়েছিলো। সেখানকার সমস্যা একটু ভিন্ন ধরণের। আমার অফিসার ও বাহিনীর কয়েকজনের সাথে সেখানকার এমন কিছু লোকের সাথে সখ্যতা গড়ে ওঠে যাদের সাথে হাইয়ার অথরিটির সুসম্পর্ক আছে। ফলে সেখানে সেসব সৈন্য অপারেশন চালাচ্ছিলো তাদের কাজে ব্যাঘাত ঘটে। যখন আমার বাহিনী সেখানে কাজ করছিলো তখন কিছু নেতা তাদেরকে তাদের চাহিদা মত অপারেশন চালাতে চাপ দিচ্ছিল। ফলে এরা ঠিকমত কাজ করতে পারছিলনা। নেতারা এমন কিছু কাজ করতে বলছিলো যা বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। এতে কিছু নেতা ক্ষিপ্ত হন – এমনকি আমার অফিসারদের থ্রেট করে বসে। এর পরেই সমস্যার সৃষ্টি হয়। 

দেশের শীর্ষ নেতৃত্বের সাথে সম্পর্ক থাকার কারণে ঐসব স্থানীয় নেতারা আমার বাহিনীর অফিসারকে হুমকি দেবার মত ঔধ্যত্ব দেখায়। আমাকে বোঝানো হল যে তারা উচ্চপর্যায়ে প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা রাখে এবং আমার অফিসারদের ক্ষতি করা সামর্থ্য তাদের আছে। খন্দকার মোশতাক যদি আমার ও আমার বাহিনীর লোকজনের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীকে বলে আমাকে বা বাহিনীর লোকদের চাকরী থেকে বরখাস্ত করার অনুরোধ করতে পারে – তাহলে সেখানে সবই সম্ভব। যে মুহুর্তে আমার লোকেরা সততার সাথে তাদের অপারেশন চালিয়ে যাচ্ছিলো সেই মুহুর্তে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের এই চাপ আমার কাছে গ্রহণযোগ্য ছিলোনা। যদিও সেসময় যে কোন কিছুই সম্ভব ছিলো। আমি বুঝতে পারলাম যা আমার উপর ঘটতে পারে তা আমার অফিসার বা বাহিনীর লোকদের উপরেও ঘটতে পারে। সেকারণে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাবার আগেই আমি উক্ত এলাকা থেকে দুএকজন অফিসার ও বাহিনীর লোককে সরিয়ে নিলাম। আমি তাদেরকে রক্ষা করার জন্যই এটা করেছিলাম। কিন্তু এতে ফল হল উল্টো। নেতারা ক্ষিপ্ত হলেন, অপমানিত বোধ করলেন এবং আরও রাগান্বিত হলেন। 

দুর্ভাগ্যজনকভাবে সত্য যে এই অসন্তোষ সৃষ্টি করা হয়েছিলো আমার ডেপুটির অফিস থেকে। আমাকে সাহায্য না করে বরং সে বিষয়টাকে উসকে দিলো। এমনকি যেসব অফিসারকে আমি সেখান থেকে নিয়ে আসলাম তারাও আমাকে ভুল বুঝতে শুরু করল। তাদেরকে সেখান থেকে বদলি করে দেয়াটা আমার প্রতি তাদের অসন্তোষের কারণ হয়ে দাঁড়ালো। ধারাবাহিকভাবে র‍্যাংকের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হতে লাগলো এবং সরকারের বিরুদ্ধে একটি বিষোগদার হতে লাগলো। আমি সব সময় বঙ্গবন্ধুকে এই অস্থিরতার ব্যাপারে জানিয়েছি। সরকার বিরোধী শক্তি এবং আমার ডেপুটি সহ আশাপাশের কিছু লোক বিষয়টাকে ব্যবহার করে ইস্যু তৈরি করতে লাগলো এবং এটি আরও বাড়তে থাকলো। সমস্ত পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে উঠলো যখন খোদ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে একটি হঠকারী সিদ্ধান্ত নেয়া হল। মেজর শরিফুল হক ডালিম, ক্যাপ্টেন এ ওয়াই বি নূর এবং আরও কিছু অফিসারকে কোন কারণ দর্শানো ছাড়াই চাকরী থেকে অব্যাহতি দেয়া হল এবং চিফ অব স্টাফকে অবগত করা ছাড়াই এটি করা হল। এই কাজটি ১৫ আগস্ট ‘৭৫ এর শোকাবহ ঘটনার অন্যতম নিয়ামক। 

মেজর ডালিম একজন উশৃংখল অফিসার হলেও বাকিরা নন। উপরে উল্লেখিত অফিসারদের অপরাধ এতোটা ছিলোনা যার জন্য তাদেরকে চাকরী থেকে বরখাস্ত করার মত কড়া সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এদের বিরুদ্ধে অপরাধ হচ্ছে তারা তাদের কলিগ মেজর ডালিমের প্রতি যে অন্যায় করা হয়েছে তার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলো। এটা তাদের চাকরী থেকে বরখাস্ত হবার মত শাস্তিযোগ্য নয়। বরং তার পরিবর্তে তাদেরকে প্রোমোশনের জন্য সিনিয়রিটি বাতিল করা অথবা বড় রকমের ভৎসনা করা যেতো। এটা সত্য যে মেজর ডালিম একজন উশৃংখল অফিসার। বঙ্গবন্ধু সহ সবাই তার চরিত্র সম্পর্কে জানতো। তারপরেও বঙ্গবন্ধু তাকে পছন্দ করতেন। মেজর ডালিমের এই উশৃংখল রেপুটেশন তার চাকরী থেকে বরখাস্তের অন্যতম কারণ। 

তাদের ভাগ্যে কি আছে তা না জেনেই এসব অফিসার মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলো। তারা ছিলো দেশপ্রেমে পূর্ণ তারুণ্যে ভরপুর একদল যুবক। তাদেরকে একটু সহানুভূতির সাথে নিয়ন্ত্রণ করার দরকার ছিলো। আমি মনে করি এদেরকে চাকরী থেকে বরখাস্ত করাটা একেবারেই অন্যায় হয়েছে। সৈন্যদের সরকার-বিরোধী মনোভাব তৈরির এটি অন্যতম কারণ। এবং তারা বিশ্বাস করতে শুরু করলেন যে আওয়ামী লীগ সরকার সেনাবাহিনীকে পছন্দ করেনা। আমি এখন তাদের চাকরী থেকে বরখাস্ত হবার বিস্তারিত কারণ আলোচনা করব। 

সেদিন ছিলো শনিবার। তারিখটা ২২ জুন ১৯৭৫। নিউ ইস্কাটন লেডিস ক্লাবে লে কর্নেল রেজার বিয়ের রিসিপশনের আয়োজন করা হয়। এই অফিসার যাকে বিয়ে করছেন সে সম্ভবত মেজর ডালিমের কাজিন। এই বিয়ে উপলক্ষে মেজর ডালিম অনেককেই দাওয়াত করেছিল। এর মধ্যে রেড ক্রসের চেয়ারম্যান গাজি গোলাম মস্তফা ও তার পরিবার ছিল। গাজি সাহেব প্রোগ্রামে থাকতে পারেন নাই। তবে তার স্ত্রী এবং দুই ছেলে এসেছিল। ঐ ফাংশনে মেজর ডালিমের দূর সম্পর্কের এক আত্মীয় এসেছিল। সে সম্ভবত সুইজারল্যান্ড বা কানাডার রেসিডেন্ট। এই ভদ্রলোকের লম্বা চুল ছিলো। অতিথিরা যখন আসন গ্রহণ করছিলো তখন গাজি সাহেবের ছেলে ও তার বন্ধুরা ঠিক তার পেছিনেই বসেছিল। এই ছেলেগুলো কিছুটা দুষ্টু ছিলো এবং অনেকটা জোরেশোরেই তারা ঐ লোকের লম্বা চুল নিয়ে নানান মন্তব্য ছুড়ে দিচ্ছিল। সেসব মন্তব্যের মধ্যে একটি যেমন, “চুল কি আসল নাকি পরচুলা?”  অথবা এমন কিছু যাতে ঘা লাগে। এক পর্যায়ে একটি ছেলে লোকটির চুল উঁচু করে ধরে। ভদ্রলোক ঘুরে তাদের দিকে মুখ করে তাদেরকে সংযত হতে বলেন। কিন্তু ছেলেগুলো আরও মজা পেয়ে যায় এবং আবারো চুল উঁচু করে ধরে। এইবার লোকটি উঠে দাঁড়ান এবং ছেলেটিকে থাপ্পড় দেন। এই ছেলেটি সম্ভবত গাজি সাহেবের ছোট ছেলে। ছেলেটি তখন দৌড়ে তার মায়ের কাছে গিয়ে বলে যে মেজর ডালিমের শালা তাকে থাপ্পড় দিয়েছে। এতে তিনি মেজর ডালিম ও নিমন্ত্রণকারীদের উপর ক্ষুব্ধ হন। মেজর ডালিম জানতে পেরে মিসেস গাজির কাছে যান এবং তার আত্মীয়ের পক্ষ থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। কিন্তু তিনি এতে খুশি না হয়ে বরং তার ছেলেকে বলেন বাড়ীতে গিয়ে বাবার কাছে নালিশ করতে। তখন ছেলেরা বাড়ীর দিকে যায় এবং এর প্রায় ৪৫ মিনিট পরে রেড ক্রসের মাইক্রোবাসে আরও ডজনখানেক অস্ত্রধারী লোক নিয়ে গাজি সাহেব রিসিপশনে উপস্থিত হন। সশস্ত্র গার্ডরা মাইক্রোবাস থেকে নেমেই কোন প্রশ্ন করা ছাড়াই মেজর ডালিমকে ধরে টেনে মাইক্রোবাসের দিকে নিয়ে আসে। সে তখন সাহায্যের জন্য চিৎকার করছিলো। তাকে কেউ সাহায্য করতে আসেনি। কারণ আর্মড গার্ডদের কারণে পরিস্থিতি কিছুটা ভীতিকর ছিলো।

মেজর ডালিমের স্ত্রী যখন ঘটনাটা দেখলেন তিনি দৌড়ে এসে তার স্বামীকে টেনে নিয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করতে চেষ্টা করলেন। যখন তিনি তা করতে পারছিলেন না তখন একবারে সম্পূর্ণ শক্তি দিয়ে ধরে রাখতে চেষ্টা করছিলেন যাতে তাকে (ডালিমকে) টেনে গাড়ি পর্যন্ত নিতে না পারে। ধস্তাধস্তির ফলে তার ব্লাউজ ছিঁড়ে যায় এবং তার শরীর থেকে শাড়ীটা প্রায় খুলে যায়। তবু তিনি তার স্বামীকে ছাড়ছিলেন না। শেষ পর্যন্ত সশস্ত্র দল তাদের দুইজনকেই গাড়িতে তুলতে সমর্থ হয়। গাড়িটা অতিথিদের দৃষ্টির কিছুটা আড়ালে ছিলো। গাজি সাহেব মাইক্রোবাসের সামনের সিটে বসা ছিলেন। বেশিরভাগ অতিথি হাইজ্যাকিং এর বিষয়টা লক্ষ্য করলেন গাড়িটা চলে যাবার পর। ঘটনাটা এতো দ্রুততার সাথে হয়েছিলো যে কেউ সাহায্য করতে সুযোগই পায়নি। যারা দেখেছে তারাও অস্ত্রবাহী দলের কারণে সামনে আসার সাহস পায়নি। একজন চাক্ষুষ সাক্ষী হিসেবে তখন লেডিস ক্লাব থেকে ডা. রহিম (ডেন্টাল স্পেশালিষ্ট) দৃশ্যটি দেখে প্রভোস্ট মার্শাল লে কর্নেল (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল) এম এ সামাদকে ফোন করেন এবং তাকে বিষয়টা জানান। লে কর্নেল সামাদ বিষয়টা ভেরিফাই করার জন্য পুলিশের আই জি (IGP) নুরুল ইসলাম সাহেবের কাছে বললে তিনি এব্যাপারে কিছু জানেন না বলে জানালেন। 

প্রভোস্ট মার্শাল লে কর্নেল সামাদ তখন সাথে সাথে এডজুটেন্ট জেনারেল (পরবর্তীতে লে জেনারেল) এই এম এরশাদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাকে পেলেন না। AG র সাথে যোগাযোগ করতে না পেরে তিনি ঘটনার খারাপ ফল চিন্তা করে উদ্বিগ্ন হয়ে OC MP ইউনিট মেজর (পরবর্তীতে ব্রিগেডিয়ার) আমিনুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করলেন। তিনি তাকে বললেন গাজি সাহেবের বাসা থেকে মেজর ডালিম ও তার স্ত্রীকে উদ্ধার করতে। যখন এই ট্রুপ্স গাজি সাহেবের বাড়ির দিকে যাচ্ছিলো তখন রক্ষীবাহিনীর সদস্য ভর্তি আরেকটি ট্রাক তাদেরকে ফলো করতে শুরু করে। এটা জানা যায়নি যে কেন তারা তাদের ফলো করছে এবং কারণই বা কী। OC MP ইউনিটকে বিষয়টা জানানো হয় এবং সেখান থেকে নির্দেশ দেয়া হয় যে রক্ষীবাহিনী যদি অস্বাভাবিক কিছু করার চেষ্টা করে তবে যেন তা প্রতিহত করার চেষ্টা করা হয়। যদিও সেরকম কিছু হয়নি। লে কর্নেল সামাদ OC MP ইউনিটকে নির্দেশনা দেবার পর কর্নেল জামিল [MS(P)] কে বিষয়টা অবগত করেন। এবং তিনি (লে কর্নেল সামাদ) কী ব্যবস্থা নিয়েছেন সেটাও জানান। মিলিটারি পুলিশের প্রতি অর্ডার ছিলো গাজি সাহেবের কাছে জিম্মি মেজর ডালিম ও তার স্ত্রীকে নিরাপদে উদ্ধার করার। 

মুহূর্তের মধ্যে ক্যান্টনমেন্টে দাবানলের মত খবর ছড়িয়ে পড়ল যে গাজি গোলাম মোস্তফা ও তার সশস্ত্র দল মেজর ডালিম ও তার স্ত্রীকে কিডন্যাপ করে নিয়ে গেছে। এটা শুনে অনেক আর্মি অফিসার নিজ দায়িত্বে মোটর বাইক নিয়ে গাজি গোলাম মোস্তফার বাড়ির দিকে রওনা দেয়। এই সেনা তৎপরতায় আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় যেন আর্মি অফিসাররা গাজির বাড়ি রেইড করতে যাচ্ছে। আর্মি অফিসারদের এই কাণ্ডে প্রেসিডেন্ট খুশি হননি এবং বিষয়টা নেগেটিভলি নিয়েছিলেন। অভিযোগ করা হয় যে মেজর ডালিম ও তার স্ত্রীকে যখন ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো তখন মেজর ডালিম চিৎকার করে গাজিকে বলছিলেন যে তাকে মারার ধৃষ্টতা যেন না দেখানো হয় – কারণ শতশত মানুষ নিজ চোখে হাইজ্যাক করা দেখেছে। এছাড়া সে বলে, যদি তাদেরকে সে (গাজি) হত্যা করে তবে একইভাবে তাকেও নিহত হতে হবে। এটা শোনার পর গাজি গোলাম মোস্তফা ড্রাইভারকে ভিন্ন গন্তব্যে যাবার নির্দেশ দেয়। ফলে ড্রাইভার গাড়ী ঘুরিয়ে ধানমণ্ডি ৩২ নাম্বারে অবস্থিত বঙ্গবন্ধুর বাসার দিকে রওনা করে। 

বঙ্গবন্ধুর বাড়ি পৌঁছে গাজি গোলাম মোস্তফা গাড়িটাকে বাড়ির সামনে পার্ক করে এবং সিঁড়ি বেয়ে নিজে উপরে উঠে বঙ্গবন্ধুকে বিষয়টা অবগত করে। গাজি সাহেব বঙ্গবন্ধুর কাছে অভিযোগ করে যে মেজর ডালিম তার ছেলের সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে এবং তাকে (ছেলেকে) বিয়ের অনুষ্ঠানের মাঝে চড় মেরেছে। যে বিয়ের অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণকারী তারাই (মেজর ডালিম)। গাজি সাহেবকে সম্ভবত তার ছেলে ভুল তথ্য দিয়েছে। কারণ মূলত মেজর ডালিমের শালাকে টিজ করার কারণে সে (ডালিমের শালা) ঐ ছেলেকে চড় মেরেছে। শুধু নাই নয়, বিষয়টা জানার পরে মেজর ডালিম তার শালার পক্ষ থেকে মিসেস গাজির কাছে ক্ষমাও চেয়েছিল। যাই হোক, বঙ্গবন্ধু যখন সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামছিলেন, তাঁর বাড়ীতে তখন ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়াৎ জামিল ছিলো। কর্নেল শাফায়াৎ জামিলকে নিশ্চই বঙ্গবন্ধু ডেকে পাঠিয়েছেন, যেকারনে সে সেখানে ছিলো।

বঙ্গবন্ধুকে দেখে মেজর ডালিম জানালো যে সে নির্দোষ কিন্তু ঘটনা কি ঘটেছে সেটা ব্যাখ্যা করে নাই। কিন্তু অপরপক্ষে গাজি সাহেব বঙ্গবন্ধুকে আগে থেকে তার নিজের মত করে ব্রিফ করে এসেছে। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু শুধুমাত্র একপক্ষের কথাই জানলেন – অর্থাৎ যেটা গাজি সাহেব বলেছে। ফলে প্রেসিডেন্ট মূল ঘটনা জানতে পারলেন না। অপরদিকে মেজর ডালিম বঙ্গবন্ধু সামনে থাকায় অনেক সাহস পেল। এবং সে গাজি সাহেবের সাথে চিৎকার করে কথা বলছিলো এবং অনেক খারাপভাবে হুমকি-ধামকি দিচ্ছিল। মেজর ডালিমের এহেন আচরণে বঙ্গবন্ধু সন্তুষ্ট হলেন না। অবশ্য এটাও বিবেচ্য যে, যে পরিস্থিতে মেজর ডালিম বঙ্গবন্ধুর সামনে পর্যন্ত এসেছে, তারপর যদি গাজি সাহেবের সাথে রুঢ় আচরণ করে থাকে সেটাই বা আসলে কতো বড় অপরাধ? হয়ত মেজর ডালিমের এই আচরণ এবং গাজি সাহেবের ব্রিফিংএর ফলে মেজর ডালিম সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর একটি খারাপ ধারণা তৈরি হয়েছে। যার ফলে যখন মেজর ডালিমকে চাকরী থেকে অব্যাহতি দেয়া হয় তখন বঙ্গবন্ধু নিশ্চই এই বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখেছিলেন। 

যখন গাজি সাহেব এবং মেজর ডালিমের এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছিলো সেসময় কর্নেল জামিল উদ্দিন আহমেদ MS(P) প্রেসিডেন্টকে জানালেন যে গাজি সাহেবের বাড়ীতে মিলিটারি পুলিশ অবরোধ করেছে। এটা শুনেই প্রেসিডেন্ট খুব রেগে গেলেন। আমি জানিনা সেসময় প্রেসিডেন্ট আমাকে খুঁজছিলেন কিনা অথবা সেখানে আমার উপস্থিতি আশা করেছিলেন কিনা। কিন্তু ঢাকা ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়াৎ জামিল সেখানে উপস্থিত ছিলেন। কর্নেল শাফায়াৎ কে যে সেখানে ডেকে পাঠানো হয়েছে সেটি আমার অজানা। কর্নেল শাফায়াৎ জামিল প্রেসিডেন্টের বাড়ীতে যাবার আগে আমাকে কিছুই জানায়নি। এমনকি ফিরে এসেও সে এই ব্যাপারে কিছু জানায়নি। সেদিন কর্নেল শাফায়াৎ জামিলকে সেদিন প্রেসিডেন্ট হাউজে ডেকে নেয়াটা চেইন অব কমান্ড ভাঙ্গার শামিল। এর প্রভাব অত্যন্ত ভয়ঙ্কর হয়েছিল যা পরবর্তীতে আলোচনা হবে। আমি জানিনা কেন আমার পরিবর্তে সেদিন কর্নেল শাফায়াৎ জামিলকে ডাকা হল। তবে পরের দিন সকালে আমি ঘটনাটা জানতে পারি। 

প্রভোস্ট মার্শাল লে কর্নেল (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল) এম এ সামাদ এডজুট্যান্ট জেনারেল কর্নেল (পরবর্তীতে লে জেনারেল ও প্রেসিডেন্ট) এইচ এম এরশাদ এর সাথে যোগাযোগ করতে না পেরে কিছু তড়িৎ সিদ্ধান্ত নেন। এবং এরপর AG কে অবগত করেন। সেদিন AG আমাকে এই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে কিছুই জানায়নি। এডজুট্যান্ট জেনারেল হিসেবে আর্মির শৃঙ্খলা দেখার সম্পূর্ণ দায়িত্ব কর্নেল এরশাদের। কিন্তু সেদিন সে কোন পদক্ষেপ নেয় নাই এবং প্রভোস্ট মার্শালকে কী করা যায় সেব্যাপারেও কিছু বলে নাই। পরেরদিন সে খুব স্বাভাবিক ধাঁচে এসে আমাকে বিষয়টা যখন অবগত করল ততক্ষণে পুরো আর্মি বিষয়টা জেনে অগ্নিমূর্তি ধরে আছে। ঘটনার ২ দিন পর, ২৪ জুন ১৯৭৫ তারিখে, আর্মি হেডকোয়ার্টারে টান টান উত্তেজনা বিরাজ করছে। সবাই অপেক্ষা করছিল সরকার গাজি গোলাম মোস্তফার বিরুদ্ধে কী একশন নেয় সেটার ব্যাপারে। আর্মি অফিসার এবং সাধারণ সৈনিকদের এই মনোভাব দেখে আমি দ্রুত প্রেসিডেন্টের সাথে একটি এপয়েন্টমেন্ট করি – যাতে বিষয়গুলো তাঁকে অবগত করা যায় এবং তাঁর দিকনির্দেশনা পাওয়া যায়। সেসময় আমার ডেপুটি (জিয়া) কোন সাহায্য করেনি। তার বদলে সে এই ঘটনা নিয়ে অফিসারদের আরও উত্তেজিত করে তুলছিলো। যখন আমি প্রেসিডেন্টকে ঘটনাটা ব্রিফ করছিলাম তখন জেনারেল জিয়া ও শাফায়াৎ জামিল সেখানে উপস্থিত ছিল। 

আমরা প্রেসিডেন্টের সাথে প্রায় ১ ঘণ্টা ছিলাম। যখন আমরা দেখা করলাম প্রেসিডেন্ট একদম রেগেমেগে ছিলেন। তিনি আমাকে চার্জ করলেন কেমন করে মিলিটারি পুলিশ কোন অথোরিটি ছাড়া সিভিলিয়ান এলাকায় যায়? আমি ব্যাখ্যা করলাম যে মিলিটারি পুলিশ সেখানে কোন অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে যায় নাই। তারা সেখানে গিয়েছিলো একজন অফিসার ও তার স্ত্রীকে উদ্ধার করতে যাদেরকে গাজি সাহেব ও তার সশস্ত্র দল কিডন্যাপ করে নিয়ে গেছে। গাজি সাহেব যা করেছেন সেটি যে কোন মাপেই সঠিক হয়নি। কিন্তু প্রেসিডেন্ট আমার কথা শুনতে চাইলেন না। একসময় আমি বললাম, “স্যার, গাজি গোলাম মোস্তফা অনেক বড় একটা অন্যায় করেছে। তার অবশ্যই শাস্তি হওয়া উচিৎ। অন্যথায় এতে সৈন্যদের মনোবল নষ্ট হবে।” এই মুহুর্তে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রচণ্ড বিরক্ত হলেন। 

প্রেসিডেন্ট এক সময় চিৎকার করে আমাকে বললেন, “শাফিউল্লাহ, তুমি কি ভুলে গেছে যে তুমি প্রেসিডেন্টের সাথে কথা বলছ?” হয়ত আমার বলার ধরণটা অপ্রাসঙ্গিক হয়েছে, তবু আমি বললাম, “স্যার, আমি জানি আমি প্রেসিডেন্টের সাথে কথা বলছি।” আমি প্রেসিডেন্টকে আরও বললাম, “স্যার, আমি এখানে আমার নিজের ব্যাপারে বলতে আসিনি। আমি এখানে আপনার ব্যাপারে বলতে এসেছি। শত শত লোকের চোখের সামনে গাজি গোলাম মোস্তফা যা করেছে সেটা ক্ষমার অযোগ্য। সে যা করেছে তার জন্য তার শাস্তি হওয়া উচিৎ। সে একজন অফিসার ও তার স্ত্রীকে তুলে নিয়ে গেছে। এবং খুব সম্ভবত তাদের হত্যা করার জন্য। গাজি গোলাম মোস্তফা সাহেবের এই একশনে সৈনিকদের মনে বিরূপ ধারণা তৈরি হয়েছে। যেকারনেই হোক না কেন স্যার, আপনি নিজে কেন অন্যের ভুল কাজের দায় নিজের ঘাড়ে নিচ্ছেন?” যদিও প্রেসিডেন্ট সেদিন ঘটনার ভয়াবহতা বুঝতে পারেননি এবং তিনি আমার কথায় কর্ণপাত করলেন না। আমি শেষ পর্যন্ত সেদিন এই আরজ করলাম যে গাজি সাহেব যা করেছেন তার শাস্তি অবশ্যই পাওয়া উচিৎ। 

প্রেসিডেন্ট হাউজ থেকে বের হবার আগ মুহূর্তে আমি জোরালোভাবে বললাম যাতে গাজি সাহেবের বিরুদ্ধে অবশ্যই কিছু একশন নেয়া হয়। সে ক্ষমাহীন অপরাধ করেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমার আবেদনের দুই দিন পেরিয়ে গেলেও গাজির বিরুদ্ধে কোন একশন নেয়া হয়নি। প্রচণ্ড হতাশায় মেজর ডালিম তৃতীয় দিন এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন গাজি সাহেবের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে কিনা। আমার মনে হচ্ছিলো দ্রুতই কোন একটা সিদ্ধান্ত আসবে। যদিও সেদিন পর্যন্ত কোন খবর না হওয়ায় মেজর ডালিম সম্পুর্ণ হতাশ হল। প্রচণ্ড ক্ষোভে এক সময় সে আমার টেবিল চাপড়ে দিল। আমি তার এই কাজের জন্য তাকে ধমক দিলাম। এবং এক্ষুনি আমার অফিস থেকে বেরিয়ে যেতে আদেশ দিলাম। 

এই ঘটনার আরও দুই দিন পর প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাকে তাঁর অফিসে ডেকে পাঠালেন এবং প্রায় জেরা করার ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলেন মেজর ডালিম টেবিল চাপড়ানোর অপরাধে আমি তার (ডালিমের) বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নিয়েছি। এই প্রশ্নে আমি একেবারে হতবাক হয়ে গেলাম। আমি প্রেসিডেন্টকে বললাম, “স্যার, মেজর ডালিম আমার অফিসে ইমোশনাল হয়ে পরেছিল। সে তার যন্ত্রণার বহিঃপ্রকাশে কাজটি করেছে। আমার অফিসে সে যা করেছে  তা তার সেই ক্ষোভের বিস্ফোরণের কারণে করে ফেলেছে।” আমি তাকে ধমক দিয়েছি এবং আমার অফিস থেকে বের করে দিয়েছি। কিন্তু আমি অবাক হলাম এটা ভেবে যে সেই ঘটনাটি প্রেসিডেন্টের কান পর্যন্ত কিভাবে আসলো। 

ক্ষমা চেয়ে আমি প্রেসিডেন্টকে বললাম, “স্যার, আপনি কিভাবে এটা জানলেন?” প্রেসিডেন্ট বললেন, “শফিউল্লাহ, তুমি হয়ত তোমার হেডকোয়ার্টারে যা ঘটছে তার অনেক কিছুই জানোনা। কিন্তু আমি জানতে পারি।” তিনি তখন আমার দিকে একটি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন এবং বললেন, “তুমি কি জানো তোমার কিছু অফিসার তাদের লিভিং রুমে অস্ত্র রাখে?” গাজি গোলাম মোস্তফার ঘটনার সময় যখন আমি প্রেসিডেন্ট হাইজে গিয়েছিলাম তখন আমি কিছুটা এগ্রেসিভ মুডে ছিলাম। কিন্তু প্রেসিডেন্টের এই ধরণের প্রশ্নে আমি কিছুটা ডিফেন্সিভ হয়ে গেলাম। তার কাছ থেকে আমি এধরনের প্রশ্ন আশা করিনি! আমাকে অফ-গার্ড করে তিনি অফেন্সিভ হলেন। 

যদিও প্রেসিডেন্টের এই প্রশ্নের সাথে গাজি গোলাম মোস্তফার ঘটনার কোন সম্পর্ক নেই, তবুও আমি আশ্বস্ত করলাম যে এই ব্যাপারে আমি অতি সত্বর ব্যবস্থা নেব। প্রেসিডেন্টের অফিস থেকে বেরিয়ে যাবার আগ মুহূর্তে আমি আমারও স্মরণ করিয়ে অনুরোধ করলাম যাতে এই বিষয়টায় একশন নিতে বেশী দেরী করা না হয়। আমি আবারো বললাম যে, এতে করে সম্পূর্ণ আর্মির মনোবল নষ্ট হয়ে যাবে। যদি গাজি গোলাম মোস্তফার বিরুদ্ধে কোন একশন না নেয়া হয় তাহলে হয়ত পরিস্থিতি আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। তিনি যদিও গাজি সাহেবের ব্যাপারে কোন মন্তব্য করলেন না বা আমাকে কোন ইঙ্গিত দিলেন না যে আদৌ কোন একশন নেয়া হবে কিনা। একরকম অসন্তুষ্টি নিয়েই প্রেসিডেন্ট অফিস থেকে বেরিয়ে আসলাম। 

আসার পথে আমি ভাবতে লাগলাম মেজর ডালিম যে আমার টেবিলে থাপড়েছে সেটা বঙ্গবন্ধুকে কে জানাতে পারে? পরে আমি জানতে পেরেছি যে এই তথ্যটা প্রেসিডেন্ট দুটো সোর্স থেকে পেয়েছেন। একটি হচ্ছে আর্মি হেডকোয়ার্টার – যেমন আমার ডেপুটির অফিস। আর দ্বিতীয়টি DGFI. আর্মি হেডকোয়ার্টার থেকে প্রেসিডেন্ট খবরটা পরের দিনই পেয়েছিলেন। আর তার পরের দিন খবর পেয়েছেন DGFI থেকে। আর নিজের কাছে অস্ত্র রাখার তথ্যটা পেয়েছেন DGFI থেকে এবং ব্রিগেডিয়ার রউফ প্রেসিডেন্টকে এটা জানিয়েছে। ব্রিগেডিয়ার রউফ একজন রিপ্যাট্রিয়েটেড অফিসার। মানসিকভাবে তিনি আমাদের মেনে নিতে পারেন নাই। এর ফলে তিনিও সম্ভবত আর্মিতে সৃষ্ট এই অসন্তোষে ঘি ঢেলেছেন। 

দ্বিতীয় বিষয়, অর্থাৎ নিজেদের কাছে অস্ত্র গোলাবারুদ রাখার ব্যাপারে আমি অফিসে এসেই খোঁজ নিলাম। FIU এর মাধ্যমে আমি বিষয়টা নিশ্চিত হলাম। এবং জানতে পারলাম যে 21C Army MP ইউনিটের ক্যাপ্টেন মতিন তার নিজের লিভিং রুমে গোলাবারুদের একটি বেল্ট দেয়ালে টাঙ্গিয়ে রেখেছে। সে মুক্তিযুদ্ধের স্যুভেনির হিসেবে এটা রেখে দিয়েছিলো। এই জিনিসটা এভাবে ডিসপ্লেতে রাখার ব্যাপারটা যে এতো সিরিয়াস প্রভাব ফেলবে সেটা সে ভাবতেও পারেনি। যৌবনের তারুণ্যে সহজাত চিন্তাটা হয়ত মাথায় আসেনি। অবশ্যই এতে কোন খারাপ উদ্দেশ্য ছিলো না। কারণ এম্যুনিশন বেল্টটা সকলের সামনেই লিভিং রুমে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিলো। যে সোর্স বিষয়টি সর্বোচ্চ অথোরিটির কাছে রিপোর্ট করেছে তাদের আগে উচিৎ ছিলো বিষয়টার লজিকটা চিন্তা করা। বঙ্গবন্ধুর কাছে রিপোর্ট করার আগে ব্রিগেডিয়ার রউফ বিষয়টা নিয়ে প্রয়োজনে অফিসারের সাথে সরাসরি কথা বলতে পারতেন। অথবা তার ইমিডিয়েট সুপিরিয়র অফিসারের সাথেও কথা বলতে পারতেন। এইধরনের রিপোর্টিং এর মূল উদ্দেশ্য ছিলো আসলে মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের প্রেসিডেন্টের কাছে ছোট করা। এবং একই সাথে প্রেসিডেন্টের চোখে আমার ভাবমূর্তি নষ্ট করা। 

যুদ্ধের পর কিছু তরুণ অফিসার বিভিন্ন মিলিটারি আর্সেনাল নিজেদের কাছে যুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে রেখেছেন। তাঁরা কখনো ভাবেননি যে এসবের কারণে তাদের কোনোদিন সমস্যায় পড়তে হবে। লেফটেনেন্ট (পরবর্তীতে ফরেন সেক্রেটারি) শমসের মুবিন চৌধুরী ছিলেন এমন একজন অফিসার। জার্মানি থেকে চিকিৎসা নিয়ে তিনি দেশে ফিরে আসছিলেন। তিনি তাঁর হাতঘড়ির বেল্টের সাথে চারটি ৯ এম এম বুলেট শেল যুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে যুক্ত করে রেখেছিলেন। ফেরার পথে তিনি যখন এয়ারপোর্টের সিকিউরিটি পাঁড় হচ্ছিলেন তখন অনেক বড় সমস্যায় পরে যান। এটা তাদের ভুল নয়। এটা বয়সের দোষ। এর পেছনে তাদের কোন খারাপ উদ্দেশ্য নেই। যাই হোক, ক্যাপ্টেন মতিনের ঘরের লাইভ এম্যুনিশনের তথ্য পেয়ে আমি প্রেসিডেন্টের কাছে ফের যাই এবং তাঁকে আসল ঘটনা তুলে ধরি। এবং বিনয়ের সাথে জানাই যে সোর্স তাঁকে রিপোর্ট করেছে তাদের উচিৎ ছিলো বিষয়টা আমাকেও জানানো। তাঁর অফিসে (বঙ্গবন্ধুর) বিষয়টা আসার আগে আমার নোটিশে আসা উচিৎ ছিলো। যেহেতু সেই অফিসার আমার কমান্ডের অধীনে। সবশেষে, আমি আবারো প্রেসিডেন্টকে অনুরোধ করলাম যেন গাজি গোলাম মোস্তফার বিরুদ্ধে একশন নেয়া হয়। 

গাজি গোলাম মোস্তফার সেদিনের ঘটনার ব্যাপারে সকল তথ্য আমি ডাবল চেক করে নিয়েছি। এবং উপরে বর্নিত সকল তথ্য সঠিক। বঙ্গবন্ধুর সাথে কথা বলার পর আমি অপেক্ষা করছিলাম কবে গাজি গাম মোস্তফা সাহেবের ব্যাপারে একটি খবর পাবো। এর মধ্যে ডিফেন্স মিনিস্ট্রি থেকে আমার অফিসে একটি চিঠি পাই। একেবারে অবাক করে দিয়ে আমি দেখলাম সেটি মেজর ডালিমের চাকরী থেকে বরখাস্তের আদেশ। আমি এটি মেনে নিতে পারছিলাম না। সাথে সাথে মিঃ প্রেসিডেন্টের কাছে গেলাম যদি এটি থামানো যায়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমি ব্যার্থ হই। এই আদেশে আমার কমান্ড একদম ভেঙ্গে পরে। এই আদেশের ফলে আমি চুপসে পড়ি এবং আমার অধস্তন অফিসারদের চোখে আমি একেবারেই ছোট হয়ে যাই। এর ধারাবাহিকতায় আমি চাকরী থেকে ইস্তফা দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তাতে কোন ফল হবেনা। আমার মিশন সামনে আগানো। যদি ভবিষ্যতে সফল হওয়া যায়। 

মেজর ডালিমের কাছে আদেশটি পাঠানো ছাড়া আমার আর কিছু করার ছিলো না। মেজর ডালিম আমার কাছে জানতে চাইল তার অপরাধ কী যার জন্য তাকে এই ট্রিটমেন্ট দেয়া হল। আমি তার প্রশ্নের প্রেক্ষিতে কিছু বলতে পারিনি। মেজর ডালিমের বরখাস্তের এই আদেশ আগুনে ঘি ঢাললো। এর ফলস্বরূপ কিছু অফিসার ঔদ্ধত্বপূর্ণ মন্তব্য করল। তাদের মধ্যে জেনারেল জিয়ার PS মেজর এ ওয়াই বি নূরের কণ্ঠ ছিলো সবচেয়ে জোরালো। এই বিষয়টা ঠিকই প্রেসিডেন্টের কাছে সাথে সাথে পৌঁছে গেল। কিন্তু আমি জানিনা তা কিভাবে। ফলস্বরূপ পরের দিন আমি ডিফেন্স মিনিস্ট্রি থেকে আরেও একটি চিঠি পেলাম। এবার মেজর এ ওয়াই বি নূরের বরখাস্তপত্র পেলাম। এরকম আরও কয়েকটি আমাকে কমিউনিকেট করা হল। এই কাজের মাধ্যমে কফিনের শেষ পেরেকটি মারা হল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাকে একটি টুল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। আমার কোন আইনসংগত বা মানবিক অধিকার রইলনা এই বাহিনীকে সমাবেশ করার – কারণ আমি তাদেরকে নিরাপত্তা দিতে পারিনি। আমার ডেপুটি জেনারেল জিয়া বিষয়টির পূর্ণ সুবিধা নিলো। এবং মুহুর্তেই সে তাদের চ্যাম্পিয়নে পরিণত হল। আমার অধস্তনরা আমার উপর আস্থা হারালো। ঠিক এভাবেই নিজের কোন অপরাধ না থাকার পরেও আমি দোষী হয়ে গেলাম।

ইচ্ছা বা অনিচ্ছাকৃতভাবে এইসকল আর্মি অফিসারদের উপর যে অন্যায় করা হল সেটি ছিলো সেনাবাহিনীতে অসন্তোষ সৃষ্টির অন্যতম কারণ। পরবর্তিতে মেজর ডালিমকে নিশ্চিতভাবেই বঙ্গবন্ধু-বিরোধী শক্তিরা রিক্রুট করেছে – এবং তারপর ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ ঘটনায় তাকে কাজে লাগিয়েছে। মেজর ডালিমই রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর সরকারের পতনের খবর প্রচার করে। সেদিন সকালে কর্নেল শাফায়াতকে নির্দেশ দিয়েছিলাম যেন তাদের বাধা দেয়া হয়। কিন্তু সে মেজর ডালিমকেও ক্যান্টনমেন্টে ঢুকতে বাধা দেয়নি। কর্নেল শাফায়াৎ সম্ভবত মেজর ডালিম কর্তৃক রেডিওতে বঙ্গবন্ধু সরকারের পতনের সংবাদ প্রচারের বিষয়ে অবাক হননি। হতে পারে কর্নেল শাফায়াৎ তার (ডালিমের) প্রতি সহমর্মী ছিলো। একারণেই তার প্রতি কোন একশন নেয়নি। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ এর ঘটনার পাশাপাশি মেজর ডালিম তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে ক্যান্টনমেন্টে প্রবেশ করে। এমনকি কোন রকম বাধা ছাড়াই সে আমার অফিসে তার সৈন্য নিয়ে প্রবেশ করে। 

আমার জানা মতে, যাদের উপর আমি নির্ভর করি তারাই নিজেদের স্বার্থপরতার কারণে আমাকে ব্যার্থতায় পর্যবসিত করে। যেকারন আমি কথাটা বললাম তা হল, ঢাকা ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়াৎ জামিল – যার আমার একমাত্র শক্তি হবার কথা – সে আমার সাপোর্টে এতোটুকু এগিয়ে আসেনি। অন্যদিকে সে আমার আদেশ অমান্য করেছে। যখন আমি তাকে আদেশ দিলাম বিদ্রোহী সৈন্যদের বাধা দিতে – সে সেটা মানেনি। আমার আদেশ না মেনে সে ডেপুটি চিফের শরণাপন্ন হয়েছে অর্ডারের জন্য। এটা চ্যানেল অব কমান্ডের সম্পূর্ণ বরখেলাপ। আরেকজন হলেন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ CGS, তার উপর আমার সম্পূর্ণ বিশ্বাস ছিলো। কিন্তু সেও এমন আচরণ করেছে যা তার থেকে আশা করিনি। পরিস্থিতি আমার নিয়ন্ত্রণে আনতে কাজ করার পরিবর্তে সে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ তারিখ দুপুরে বিদ্রোহী সৈন্যদের জন্য ট্যাংক এম্যুনিশন ইস্যু করেছে। আমার নলেজ ছাড়াই সে ট্যাংক রেজিমেন্টকে এম্যুনিশন ইস্যু করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিভাবে আমি তাকে বিশ্বাস করি? এরপর থেকে আমি একা হয়ে গেলাম। খন্দকার মোশতাক আমার এই দুর্বলতাকে কাজে লাগাল। সে আমাকে অন্যান্য অফিসার ও বাহিনীর অন্যান্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখলো। বঙ্গভবনে আমাকে একরকম আটকে রাখা হল – প্রায় ৭২ ঘণ্টা।

আমার আদেশ মাফিক বিদ্রোহীদের থামানোর পরিবর্তে কর্নেল শাফায়াৎ জামিল তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থাই নিলো না। বিদ্রোহী অফিসাররা (মেজর ডালিম ও মেজর রশিদ) কোন রকম বাধা ছাড়াই ক্যান্টনমেন্টে ঘুরে বেড়াতে লাগলো। এর কারণ হতে পারে যে, সম্ভবত সে তাদের সাথেই আছে। অথবা সে অন্য কারো আদেশ মেনে চলছে যারা বিদ্রোহীদের প্রতি সহমর্মী। এটা সত্য যে বিদ্রোহী অফিসারদের প্রতি সৈন্যদের সহমর্মীতা ছিলো। কিন্তু তারা যে কাজটি করেছে নিশ্চতভাবেই তা কোনরকম সহমর্মীতা পাবার যোগ্য নয়। কর্নেল শাফায়াৎ যদি আমার আদেশ পাবার পরপর সেই মোতাবেক কাজ করত তবে এই বিদ্রোহী সৈন্যদের মোকাবিলা করা যেত – এমনকি পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণে নেয়াটা ঠেকানো যেত। যখন আমি ৪৬ ব্রিগেড এরিয়াতে গেলাম, আমি দেখলাম যে সৈন্যদের মুভ করা হয়নি। তাদের বিপরীতে কোন সৈন্যই আমি যোগাড় করতে পারলাম না। উপরে উল্লেখিত কারণগুলোর জন্য আর্মিতে সৃষ্ট ক্ষোভের ব্যাপারটা অনুধাবন করা যায়। কিছু অফিসারদের প্রতি যে অন্যায় করা হয়েছে সেটিও তাদের সরকার বিরোধী হবার অন্যতম কারণ। 

খন্দকার মোশতাককে বোঝানো হল, যতক্ষণ আমি চিফ অব স্টাফ আছি ততোক্ষণ তার প্রেসিডেন্সি নিরাপদ নয়। তাকে যেভাবে সতর্ক করা হয়, হয়ত তারা ভুল কিছু বলেনি। প্রকৃতপক্ষে আমি চেষ্টা করছিলাম বঙ্গভবন থেকে আর্মার ও আর্টিলারি ইউনিটকে ব্যারাকে নিতে এবং সেগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিতে। যদি সেই যাত্রায় সফল হতাম, তাহলে আমি তাকে আইনের মুখোমুখি করতে পারতাম। তার শক্তি ছিলো আর্মার, আর্টিলারি ইউনিট এবং বিদ্রোহী অফিসাররা। অন্যদিকে আমার শক্তি ছিলো ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ঢাকা ব্রিগেড কমান্ড এর সৈন্য ও বাকি অফিসারগণ। নিজেদের টিকে থাকার জন্যই খন্দকার মোশতাকের মিত্ররা একত্রিত ছিলো। অন্যদিকে আমার মিত্ররা ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ এর সকাল থেকেই বিপথগামী ছিলো। বিশেষ করে ঢাকা ব্রিগেড কমান্ড। সে জেনে বা না জেনে ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট সকাল থেকে বিদ্রোহীদের সমর্থন করে। ক্যান্টনমেন্টে মেজর রশিদ ও মেজর ডালিমের কোনরকম বাধা ছাড়াই অবাধ চলাফেরা এটার সত্যতা প্রমাণ করে। যেভাবেই হোক না কেন, তারা একটি বড় ষড়যন্ত্রের অংশ এবং বাংলাদেশের ইতিহাসে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট সবচেয়ে কালো একটি দিন হিসেবে পুরো জাতির কাছে বিবেচিত হবে।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড

সেদিন যে ঘটনা ঘটেছিলো সেটিকে “Assassination” বা “গুপ্তহত্যা” শব্দটি দিয়ে প্রকাশ করলে কম হবে। সেটি ছিল তীব্র নিষ্ঠুরতা যা বর্ননার বাইরে। অফিসারদের ক্ষোভের কারণ যাই হোক না কেন, এধরনের কাজকে ন্যায্যতা দেয়া যায়না। যারা পরিচালনা করেছে তারা নরপশু। তাদেরকে বোঝানো হয় যে যদি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জীবিত থাকে তাহলে তাদের অস্তিত্ব থাকবেনা। এইধরনের মনস্তাত্বিক বিশ্বাসের কারণে তারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে। যদি তাদের টার্গেট শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধু হয় তাহলে পরিবারের বাকি সদস্যদের কেন হত্যা করা হল? কারণ হয়ত খুনিচক্রের ভেতরে বঙ্গবন্ধুর প্রতি ঘৃণা এতোটাই তৈরি করা হয়েছিলো যে পুরো পরিবারের উপর হত্যাকাণ্ড চালাতে তাদের হাত এতোটুকু কাঁপেনি। 

১৫ আগস্ট ১৯৭৫ এর হত্যাকাণ্ডের পর ঢাকার চ্যানেল অব কমান্ড একেবারে ভেঙ্গে পরে। অন্যভাবে বলা যায়, কমান্ড চ্যানেল শেষ হয়ে গিয়েছিলো। সেদিন আর্মি চিফকে বাইপাস করেই কিছু ঘটনা ঘটে। কর্নেল শাফায়াৎ জামিল ভালো করে জানতেন যে, স্টেশনে যদি চিফ না থাকে তাহলে আর্মিতে আর কেউ নেই যে তার উপর কর্তৃত্ব করতে পারে। যদিও ঢাকা ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়াৎ জামিল চিফ কর্তৃক বিদ্রোহীদের বাধা দেবার আদেশ না মেনে ডেপুটি চিফের কাছে আদেশের জন্য গিয়েছিল। (এটি তার নিজেরই স্টেটমেন্ট যা সে একটি ইন্টারভিউতে বলেছে। সেটি প্রফেসর আবু সাইদের ফ্যাক্টস এন্ড ডকুমেন্টস বইতে ছাপা হয়েছে)। যে মুহুর্তে কর্নেল শাফায়াৎ জামিলকে তার চিফ আদেশ করেছে বিদ্রোহীদের দমন করার জন্য তখন ডেপুটি চিফের কাছে নির্দেশনার জন্য যাবার কোন অধিকার তার নেই। এটি চ্যানেল অব কমান্ড এর স্পষ্ট লঙ্ঘন। 

চিফের কাছ থেকে স্পষ্ট নির্দেশনা পাবার পরেও কেন কর্নেল শাফায়াৎ নির্দেশনা নিতে ডেপুটি চিফের শরণাপন্ন হয়েছিল? এটি তার নিজের বক্তব্যেই উল্লেখ আছে। অপরদিকে ডেপুটি চিফ তাকে সেদিন সজাগ থাকতে বলেছে। এর বাইরে কিছু বলেনি! সেই অবস্থায় কি এটাই সঠিক আদেশ হতে পারে? বিশেষ করে যখন দেশের প্রেসিডেন্টকে হত্যা করা হয়েছে? এই আদেশের মাধ্যমে ডেপুটি আসলে কর্নেল শাফায়েতকে নিষ্ক্রিয় করে রেখেছিলো। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ঢাকা ব্রিগেড কমান্ডার চিফের কাছ থেকে নির্দেশনা পেয়েও ডেপুটি চিফের শরণাপন্ন হয় এবং শেষ পর্যন্ত নিষ্ক্রিয় থাকার পথ বেছে নেয়। কেন তিনি নিষ্ক্রিয় থাকার পথ বেছে নিলেন? এটি কি কোন হুমকি ছিলো? নাকি বিদ্রোহীদের সাথে একতা প্রকাশ? শাফায়াৎ তার অবস্থান পরিষ্কার করেন নাই, তবে এটি বুঝতে এক্সপার্ট হবার প্রয়োজন নেই। 

যখন এরকম একটি ঘটনা ঘটে সেটি জানবার অধিকার মানুষের থাকে। আমি এখানে কী করতে পেরেছিলাম আর কী করতে পারিনি তা লেখার চেষ্টা করব। মূল পর্বতে যাবার আগে পেছনের কিছু ইতিহাস তুলে এনে আলোচনা করা দরকার। এতে বিষয়টার সংযোগসূত্র পেতে সুবিধা হবে। এই বিষয়গুলো বেশ আগের। তাই দিন তারিখ কিছুটা হেরফের হতে পারে। তবে ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত। কিছু কিছু ঘটনা স্মৃতি প্রায় গেঁথে আছে – তাই সেগুলো এখনো মুছে যায়নি। তবে যতদূর আমার মনে পরে আমি পাঠকের জন্য সঠিকভাবে তুলে ধরতে চেষ্টা করব। সেসময় কিছু নোটও আমি সংরক্ষণ করেছি। আমার মতে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের ঘটনায় গোয়েন্দা বাহিনীর পূর্ণ ব্যার্থতা ছিল। নীচে সেগুলো বেশ কিছু আলোচনা করছি। 

সৈন্যদের কাজ সম্পর্কে একটি স্পষ্ট ধারণা চিফের থাকতে হয়। বিশেষ করে সেইসব বিষয় যেগুলো দেশ ও চাকরীর স্বার্থ সংশ্লিষ্ট। এসব তথ্য পেতে হলে চিফকে কিছু এজেন্সির শরণাপন্ন হতে হয় যারা তাকে এই তথ্যগুলো দেবার দায়িত্বে থাকে। ১৫ আগস্ট ‘৭৫ এর ব্যাপারে সেসব এজেন্সি থেকে চিফকে কোন তথ্য দেয়া হয়নি। এই এজেন্সিগুলো চিফের কাছে ছিলো না। সেটি দেশের সর্বোচ্চ নির্বাহী জানতো। কেন সেগুলো চিফের কাছে ছিলোনা নীচে তা আলোচনা করছি। আমি সেগুলো পেতে চেষ্টা করেছি কিন্তু ডিফেন্স মিনিস্ট্রি – বিশেষ করে ডিফেন্স মিনিস্টারের থেকে যতোটুকু সহযোগিতা পাবার কথা সেটি না পাওয়ায় আমি সেগুলো পাইনি। 

সেটি ছিলো ১৯৭৫ এর জুন মাসের দিকে। MI Dte (মিলিটারি ইন্টিলিজেন্স ডাইরেক্ট্রেট) এর ঢাকা ডিটাচমেন্টের FIU মারফত কুমিল্লা গ্যারিসনের একজন NCO (Non-Commissioned Officer) থেকে একটি গোপনীয় ডকুমেন্ট পাওয়া যায়। এতে সেনা অভ্যুত্থানের ব্যাপারে কিছু মেজেস পাওয়া যায়। এটি হঠাত করে হাতে আসে এবং এর পেছনে ইন্টিলিজেন্সের কোন প্রচেষ্টা নেই। এমন সময়ে এটি প্রকাশিত হয় যখন প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জ্যামাইকার কিংস্টনে CHOGM (Commonwealth Heads of Government Meeting) এর মিটিং এ অংশ নেবার জন্য দেশের বাইরে ছিলেন। যে লিফলেট প্রচার হচ্ছিলো তাতে সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভের নির্দিস্ট কিছু বিষয় উল্লেখিত ছিলো। সংক্ষেপে যার অর্থ হচ্ছে সরকার আর্মির সাথে ন্যায়সঙ্গত কাজ করছেনা। এর কারণ ছিলো রক্ষীবাহিনী দিয়ে আর্মিকে রিপ্লেস (প্রতিস্থাপন) করার প্রক্রিয়া। আমি তথ্য পেয়েছিলাম যে যারা এগুলো করছে তাদের র‍্যাংক NCO এর উপরে নয় এবং এর পেছনে ইন্ধন দিচ্ছে জাসদ। তবে নেতৃত্বের লেভেল যাই হোক না কেন এটি ছিলো একটি অশুভ সংকেত। 

সেসময় আর্মি পুরোদমে তার কাজ করার জন্য প্রস্তুত ছিলো না। এবং এধরনের বিষয় ঠেকাতে যে পরিমাণ কাউন্টার ইন্টিলিজেন্সের দরকার হয় তাও ছিলোনা। প্রকৃতপক্ষে পুরো সেনাবাহিনী তখন একটি এড হক অর্গানাইজেশনের মত কাজ করছিলো। যখন আমরা প্রথম DFI (Directorate of Forces Intelligence) করলাম তখন আমাদের ইচ্ছা ছিলো এটি আর্মি হেডকোয়ার্টারের নিয়ন্ত্রণে থাকুক। (যেহেতু ফোর্সের সংখ্যা অনেক)। এবং এর ফলে তিন বাহিনী প্রধানরাই ইন্টিলিজেন্স কাভারের আওতায় আসবে। তাই শুরু থেকেই DFI এর কার্যালয় আর্মি হেড কোয়ার্টারের ভেতরেই ছিলো। এটি করা হয়েছিলো যাতে তিনটি বাহিনী সার্ভিস পায়। এটাও নিশ্চিত হয় যে তিন বাহিনী প্রধানগন তাদের সৈনিকদের কার্যক্রম সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখতে পারেন। সেই থেকে DFI যেসব গোয়েন্দা তথ্য পেত সেগুলো তাদের ডিজির মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট চিফদের কমিউনিকেট করা হত। এবং এরপর যদি প্রয়োজন হয় তবে সেটি প্রেসিডেন্টের কাছে পাঠানো হবে। সেটি চিফ অথবা ডিজি এদের যে কেউ জানাতে পারে। 

১৯৭৩ এর শেষ পর্যন্ত এই নিয়মেই চলেছে। কিন্তু ১৯৭৪ সালে রিপ্যাট্রিয়েশনের পর একটি সময় আসলো যখন DFI এর কার্যালয় আর্মি হেডকোয়ার্টার থেকে প্রেসিডেন্টের সেক্রেটারিয়েটে নিয়ে যাওয়া হল। তখন থেকে ডিজি কর্তৃক চিফদের কাছে রিপোর্ট করার নিয়মটা বদলে যায়। সেই থেকে ডিজি সরাসরি প্রেসিডেন্টের কাছে রিপোর্ট করতে থাকেন। এবং এখানে চিফদের বাইপাস করা হচ্ছে। সার্ভিস চিফরা এভাবে অক্ষম হয়ে গেলেন। যেহেতু সেসময় থেকে ডিজি ইচ্ছাকৃতভাবে বা নিজের সামর্থ্যহীনতার কারণে চিফদের কাছে রিপোর্ট করছিলেন না। এই সময় থেকেই সমস্যার শুরু। 

যেকারনে আমরা DFI কার্যালয় আর্মি হেডকোয়ার্টারের ভেতরে করেছিলাম তার একটি কারণ হচ্ছে বাজেট সীমাবদ্ধতা এবং প্রতারণার সুযোগ এড়ানো। শুরুতে আমরা সার্ভিসে খুব বেশী সংখ্যায় কার্যালয় করতে চাইনি। ফলে আমরা আর্মি হেডকোয়ার্টারে এটা রাখি। এটা করেছিলাম যাতে করে চিফরা চট করে কোন তথ্য খুঁজে পায়। MI Dte (মিলিটারি ইন্টিলিজেন্স ডাইরেক্ট্রেট) এর ইন্টিলিজেন্স লেভেল তখনো এতোটা সজ্জিত হয়নি যে আমরা সেখান থেকে পর্যাপ্ত সাপোর্ট আশা করব। বা একথাও সত্য যে তারা কাজটা সফলভাবে করার জন্য ততোটা অর্গানাইজড হয়ে ওঠেনি। আর্মি হেডকোয়ার্টার থেকে DFI উঠিয়ে নেয়ায় চিফরা মূলত চোখ-কানহীন হয়ে গেল। যেহেতু কার্যালয় প্রেসিডেন্টের সেক্রেটারিয়েটে স্থানান্তর হয়ে গেল তাই আমি একটা নতুন অর্গানোগ্রাম করে MI Dte এর এক্টিভিটি বাড়াতে চেষ্টা করলাম। নতুন অর্গানোগ্রাম সম্পর্কিত কাগজপত্র এপ্রুভালের জন্য ডিফেন্স মিনিস্ট্রিতে অপেক্ষমাণ থাকলো। কোন অজানা কারণে সেটি পাশ হচ্ছিলোনা এবং আমি সম্পূর্ণ অন্ধকারে থেকে গেলাম। একমাত্র স্রস্টাই জানেন ব্লকটা কোথায়! 

যেহেতু আর্মি হেডকোয়ার্টারে আমাদের DFI এর কার্যালয়, তাই নতুন TO&E (Training Operation & Execution) পরিকল্পনায় MI Dte এর কাজ বৃদ্ধি করা হয়নি। সরকারের এপ্রুভালের জন্য আমরা আর্মির অর্গানোগ্রামটা ডিভিশনভিত্তিক করেছিলাম। কিন্তু যখন DFI কার্যালয় আর্মি হেডকোয়ার্টার থেকে সরিয়ে নেয়া হয় তখন আমরা অন্ধ ও বধির হয়ে গেলাম। তাই এই স্বল্পতা কাটাতে আমি MI Dte এর অপারেশন বাড়াতে চেষ্টা করলাম। সেভাবে একটি অর্গানোগ্রাম করে ডিফেন্স মিনিস্ট্রিতে পাঠালাম। কিন্তু কোন কারণ ছাড়াই এপ্রুভাল পেতে দেরী হচ্ছিলো। কিন্তু সরকারের এপ্রুভাল ছাড়া আমি আগাতে পারছিলাম না এবং MI Dte কে পুনর্গঠন করতে পারছিলাম না। এমনকি আমার জোরালো প্রস্তাবনার পরেও সেটি পাশ হচ্ছিলোনা। ফলে পরিস্থিতির মোকাবিলায় আমি আশা করছিলাম অন্তত MI Dte এর অংশটুকু যেন এপ্রুড হয়। এই আশায় আমি ডেপুটি ডিফেন্স মিনিস্টার প্রফেসর নুরুল ইসলামের সাথে দেখা করলাম এবং তাকে আমার সমস্যার কথা খুলে বললাম। আমি তাকে NCO থেকে পাওয়া সেই লিফলেটটাও দেখালাম। 

প্রফেসর নুরুল ইসলাম ঘটনার গুরুত্ব বুঝতে পেরে অতি সত্বর প্রেসিডেন্টের সাথে একটি এপয়েন্টমেন্ট করেন। দ্রুত সময়ের মধ্যেই আমরা গণভবনে প্রেসিডেন্টের সাথে দেখা করতে গেলাম। আলোচনার সময় আমি প্রেসিডেন্টকে বললাম আমার কোন ইন্টিলিজেন্স এজেন্সি নাই যার থেকে আমি আমার ট্রুপ্স সম্পর্কিত কোন তথ্য পেতে পারি। কোন গোয়েন্দা সংস্থা না থাকলে আমার চারপাশে কী ঘটছে সেটা আমার পক্ষে বোঝা সম্ভব না। এই এজেন্সিগুলো আমার চোখ আর কানের মত। এগুলো ছাড়া আমি সম্পূর্ণ অন্ধকারে। যে ঘটনাটা সম্পর্কে আমি রিপোর্ট করতে এসেছিলাম সেটি হঠাত করে আমাদের গোচরে এসেছিলো। এর পেছনে কোন গোয়েন্দাপ্রচেষ্টা নেই। হতে পারে এটা অনেক ছোট কোন পরিকল্পনা; কিন্তু এর পেছনে বড় কিছু থাকতে পারে। এরপর আমি প্রেসিডেন্টকে অনুরোধ করলাম, যদি যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ার কারণে পুরো TO&E এপ্রুভ করতে সময় লাগে তাহলে অন্তত MI Dte এর অংশটুকু যেন এপ্রুভ করে দেয়া হয়। সেই লক্ষ্যে অতি সত্বর কিছু লোক নিতে হবে, তাদের অর্গানাইজ করতে হবে এবং কাজে লাগানোর আগে ট্রেনিং করাতে হবে। 

সমস্যার গুরুত্ব বুঝিয়ে আমি প্রেসিডেন্টকে অনুরোধ করলাম DFI এর কার্যালয় সাময়িক সময়ের জন্য পুনরায় আর্মি হেড কোয়ার্টারে শিফট করতে যাতে করে সাময়িক সময়ের জন্য আমরা সেই সাপোর্টটা পাই। এবং পাশাপাশি যেন MI Dte এর আংশিক এপ্রুভাল যে দেয়া হয়। এটি যখন একটু দাঁড়িয়ে যাবে তখন DFI এর কার্যালয় পুনরায় বর্তমান অবস্থানে নিয়ে আসা যাবে। কিন্তু আমি অবাক হলাম যে যতোটা গুরুত্বের সাথে আমি বিষয়টা উপস্থাপন করলাম বঙ্গবন্ধুর প্রতিক্রিয়া ছিলো সম্পূর্ণ বিপরীত। আমি যতোটা আশা করেছিলাম তিনি বিষয়টা ততোটা সিরিয়াসলি নিলেন না। তখন প্রেসিডেন্টকে আমার বলতে হল, “স্যার আপনি যদি আমাকে কার্যকর দেখতে চান তাহলে আমার দৈনন্দিন কাজের জন্য এই ভাইটাল অর্গানগুলো আমার লাগবে। এই মুহুর্তে আমি একেবারেই জানিনা আমার চারপাশে কী ঘটছে।” 

আমার কথা শুনে প্রেসিডেন্ট প্রশ্ন করলেন, “রউফ (ডি জি এফ আই এর ব্রিগেডিয়ার রউফ) কি তোমাকে সে যা কালেক্ট করে তা দেয়না?” উত্তরে আমি বললাম, “স্যার, যদি সে দিত তাহলে তো আমি আপনাকে অফিসটা আর্মি কার্যালয়ে পুনরায় শিফট করতে বলতাম না। আমার বিশ্বাস ডিজি ব্রিগেডিয়ার রউফ ইচ্ছাকৃতভাবেই আমাকে তথ্য দেন না এবং আমাকে অন্ধকারে রাখেন। উদাহরণস্বরূপ বলতে পারি, স্যার, আপনাকে আজকে আমি যে কাগজটা দেখালাম সেটার ব্যাপারে তিনি কি আপনাকে অবগত করেছেন? যদি সে করে থাকে তবে সে ইচ্ছাকৃতভাবে আমাকে অন্ধকারে রাখছে। একারণেই আমি চিন্তিত স্যার।” যেহেতু প্রেসিডেন্ট কোন মন্তব্য করেননি, তাই আমি বুঝতে পারলাম DGFI প্রেসিডেন্টকে অবহিত করেছে। প্রফেসর নুরুল ইসলাম নিজেও আমার প্রস্তাবের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করলেন। এবং প্রস্তাব করলেন যে MI Dte আংশিক পাশ করা যেতে পারে। তখন প্রেসিডেন্ট প্রফেসর নুরুল ইসলামকে বললেন অতিসত্বর বিষয়টা বাছাই করতে। 

ডেপুটি ডিফেন্স মিনিস্টার প্রফেসর নুরুল ইসলাম এই মিটিং এর বিষয়টি চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত “দৈনিক আজাদী” পত্রিকায় একটি আর্টিকেলে উল্লেখ করেন ১৯৯৪ সালের ২৬ মার্চ। তিনি লেখেন, জেনারেল শফিউল্লাহ ইচ্ছা করে সেই মিটিং এর কিছু তথ্য পত্রিকার কাছে বলেননি। লেখাটা ধাবারাবাহিকভাবে বাংলাবাজার পত্রিকায় ১৫ থেকে ১৯ আগস্ট ১৯৯৪ পর্যন্ত প্রকাশিত হয় এবং ১৫ থেকে ১৮ আগস্ট ১৯৯৪ পর্যন্ত “ভোরের কাগজ” এ প্রকাশিত হয়। এটা ঠিক যে প্রেসিডেন্টের সাথে যত কথা হয়েছে তার সব আমি পত্রিকার কাছে বলিনি। তবে আমি তাদেরকে আমাদের মিটিং এর সারসংক্ষেপ বলেছি। তাছাড়া, সেসময় পত্রিকার কাছে সব খুলে বলায় কোন বিশেষ উদ্দেশ্য সফল হত বলেও আমি মনে করিনা। আমি তাদেরকে যেটুকু প্রযোজ্য শুধু সেটুকুই বলেছি। নুরুল ইসলাম নিজেও সেই অংশটুকু বলেননি যা আমি বলিনি বলে তিনি দাবী করেছেন। তিনি বলেছেন এই মিটিং টা ১৫ আগস্ট ‘৭৫ এর দুই তিন দিন আগে হয়েছিলো। এখানেও সম্ভবত তার স্মৃতিভ্রম হয়েছে। কারণ মিটিংতা হয়েছিলো ‘৭৫ এর জুলাইয়ের শুরু দিকে। 

পাঠক এই অবস্থায় ভাবতে পারেন যে চিফ এখন কেন আর্মির অর্গানাইজেশন এর সমস্যা সম্পর্কে কথা বলছেন। তিনি নিজেই তো ১৯৭৫ সালে চিফ ছিলেন। এখানে বলা দরকার যে ১৯৭১ সালের আগে বাংলাদেশের কোন আর্মি ছিলোনা। আর এটা পুর্ব থেকে স্টাবলিসড কোন আর্মি নয়। এখন আমরা যা দেখি ১৯৭২ সালে চিত্রটা সেরকম ছিলো না। আজকের সেনাবাহিনী স্বাধীনতা যুদ্ধের ফসল। আমরা তাদের সাথে যুদ্ধ করেছি যারা শুধু অস্ত্রটা ধরতে জানতো। তাছাড়া এই বাহিনীতে হরেক রকম সংগঠন থেকে লোক যুক্ত হয়েছে। যেমন, পাকিস্তান আর্মি, ই পি আর, মুজাহিদ এবং মুক্তিযোদ্ধারা। তাদেরকে একসাথে গড়ে তোলা হয়েছে, যুদ্ধের ট্রেনিং দেয়া হয়েছে। কিন্তু এটাকে একটা অর্গানাইজড আর্মি বলা যাবেনা। একটা সময় আসবে যখন এদের সবাইকে একই কমান্ডের অধীনে আনতে হবে। সেই লক্ষ্যে আমরা সবাই হাত লাগাই এবং একটি TO&E প্রস্তুত করি এবং পাশ করার জন্য সরকারের কাছে সাবমিট করি। এটা তৈরি করতে আমাদের বছরখানেক সময় লেগেছে। এবং এটাই আগের পেইজগুলোতে আমি লিখেছি। DFI এর প্রথম ডিজি ছিলেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন (পরবর্তীতে AVM) আমিনুল ইসলাম। এরপর তার স্থলে আসেন লে কর্নেল (পরে ব্রিগেডিয়ার) এ রউফ। তিনি পাকিস্তান থেকে রিপ্যাট্রিয়েটেড হয়ে জয়েন করেন। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ এ বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সময় তিনি DFI এর প্রধান ছিলেন। তার স্থলে আসেন কর্নেল জামিল আহমেদ যিনি প্রেসিডেন্টের MS (P) ছিলেন। কথা ছিলো ১৫ আগস্ট ‘৭৫ এ ব্রিগেডিয়ার রউফ কর্নেল জামিলের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করবে। 

এখন ব্রিগেডিয়ার রউফ সম্পর্কে বলছি। কেন এবং কিভাবে তিনি DFI তে আসলেন। ষাটের দশকের শেষ দিকে রউফ (তৎকালীন মেজর) আই এস আই এর ডাইরেক্টরেটের প্রধান (ISI Det Comd) ছিলেন। সেসময় ৬ দফা দাবীর প্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধুকে এরেস্ট করা হয়। সেসময় “আগরতলা ষড়যন্ত্র” নামে একটি দেশদ্রোহীমূলক মামলা করা হয়। যেখানে জুনিয়র আর্মি, নেভি অফিসার এবং তিন বাহিনীর অন্যান্য র‍্যাংকের কিছু সেনাকে অভিযুক্ত করা হয়। তাদের সবাইকে এরেস্ট করা হয় এবং দেশদ্রোহিতার জন্য বিচার করা হয়। এই সুযোগে পাকিস্তানীরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে থামানোর জন্য তাঁকেও এই মামলায় অন্তর্ভুক্ত করে। শেখ মুজিবুর রহমান উত্থাপিত ৬ দফা পাকিস্তানীরা ভালো চোখে দেখেনি – বিশেষ করে আইয়ুব খান। পাকিস্তানীরা মনে করেছিলো সে খুব বেশী বেশী চাচ্ছে। 

সেকারণে তাঁকে (শেখ মুজিবকে) ঠাণ্ডা করার জন্য তারা “আগরতলা ষড়যন্ত্র” মামলায় তালিকাভুক্ত করে। সেকারণে অন্যান্য দেশদ্রোহীমূলক বাঙালি আর্মি অফিসার ও লোকদের সাথে তাঁকে চার্জ করা হয়। এই অপরাধ প্রমাণিত হলে তার শাস্তি ছিলো মৃত্যুদণ্ড। ISI ডিরেক্টরেট তখন বিষয়টা দেখভাল করছিলো। সেখানেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ব্রিগেডিয়ার (তৎকালীন মেজর) রউফের সাথে পরিচিত হন। 

যখন “আগরতলা ষড়যন্ত্র” মামলা চলমান ছিলো মানুষ স্পষ্ট বুঝতে পারছিলো তাঁকে সরানোর জন্যই এটা করা হয়েছে। ফলে তারা শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে করা মিথ্যা মামলা তুলে নিতে বিদ্রোহ শুরু করে এবং সেটি গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। সেটি তৎকালীন সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে ছড়িয়ে পরে। আন্দোলন এত চরম আকার ধারণ করে যে সরকার বাধ্য হয়ে মামলা বন্ধ করে দেয় এবং শেখ মুজিবকে মুক্তি দেয়। জনগণ তাঁকে ফিরে পেয়ে “বঙ্গবন্ধু” উপাধি দেয়। সেই থেকে শেখ মুজিব আমাদের বঙ্গবন্ধু। 

বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে মামলা তুলে নেবার সাথে সাথে অন্যান্য সকল ইউনিফর্মড অফিসার ও বাহিনীর লোকদের ছেড়ে দেয়া হয়। পরবর্তিতে এসকল অফিসার ও অন্যান্য সবাইকে চাকরী থেকে বরখাস্ত করা হয়। মামলা তুলে নেবার পর, ঢাকায় আই এস আই এর ডাইরেক্টরেটের (ISI Det) এও পরিবর্তন আনা হয়। মেজর (পরবর্তীতে ব্রিগেডিয়ার) রউফকে প্রোমোশন দিয়ে লে কর্নেল করে শিয়ালকোটে বদলি করা হয়। শিয়ালকোটে তাকে ৫ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দায়িত্ব দেয়া হয়। সেটি সেখানেই অবস্থিত ছিলো। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ের পুরোটা লে কর্নেল রউফ পশ্চিম পাকিস্তানের শিয়ালকোটের ব্যাটেলিয়নেই ছিলেন। পরে ১৯৭৩ সালে তিনি এই ব্যাটেলিয়নের সাথে পাকিস্তান থেকে রিপ্যাট্রিয়েটেড হয়ে ফিরে আসেন। 

পাকিস্তান থেকে রিপ্যাট্রিয়েশনের পর প্রায় সকল অফিসার ও বাহিনীর লোককে নতুন গঠিত বাংলাদেশ আর্মিতে নিয়ে নেওয়া হয়। এই রিপ্যাট্রিয়েটেড লোকেরা জানে যে আমরা একটি রিপ্যাট্রিয়েশন বিষয়ক সরকার প্রদত্ত্ব ফর্মুলা অনুযায়ী তাদেরকে চাকরীতে বহাল করেছি। সেই ফর্মুলার ভিত্তিতে তাদেরকে বাছাই করা হয়েছিলো। যতোটা তথ্য পাওয়া যায় তার ভিত্তিতে একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছিলো যে তালিকা অনুযায়ী তাদের বহাল রাখা হবে। লে কর্নেল রউফ আরও অনেকের সাথে সেসময় আর্মিতে বহাল ছিলেন এবং এদেরকে বিভিন্ন ইউনিটে পদায়ন করা হয়। এরপর তারা লক্ষ্য করেন যে একাত্তরের পূর্বের হিসাব অনুযায়ী তাদের কিছু জুনিয়র অফিসার তাদের চাইতে সিনিয়র র‍্যাংকে আছে। সেটি তারা মেনে নিতে পারছিলেন না। বাইরে থেকে তারা যথেষ্ট ভদ্রতা দেখালেও ভেতরে ভেতরে মুক্তিযোদ্ধাদের অবজ্ঞা করতেন। 

রিপ্যাট্রিয়েশন শুরু হবার আগে আমাদের যে গাইডলাইন ছিলো সেই অনুযায়ী আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে কাউকে এমন কোন অফিসারের আণ্ডারে রাখা হবেনা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের আগে যে তাদের (রিপ্যাট্রিয়েটদের) জুনিয়র ছিলো। কিন্তু সর্বোচ্চ চেষ্টা ষত্বেও এটা সব ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা সম্ভব হয়নি। একথা উল্লেখ্য যে, ইতোমধ্যে ঐসব জুনিয়র মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদেরকে ২ বছরের সিনিয়রিটি প্রদান করা হয়েছে। অন্যদিকে, পাকিস্তান আর্মির হিসেবে অনেক রিপ্যাট্রিয়েটেড অফিসার তাদের র‍্যাংকের সর্বোচ্চ পর্যায়ে ছিলেন। বিশেষ করে যারা লে কর্নেল এবং এর উপরের র‍্যাংকের। এদের মধ্যে কে কর্নেল রউফ ছিলেন যিনি সিলিং এর সর্বোচ্চ লেভেলে আছেন। অর্থাৎ তিনি আর প্রোমোশন পাবেন না। তাছাড়া আমরা খেয়াল খুশি মত কিছু করতে পারিনা। এমনকি আমরা এরকমও ভেবেছিলাম যে তাদের কাউকে কাউকে দেশে ফিরে আসার পর পাকিস্তানে যে র‍্যাংক ছিলো তার চেয়ে উপরের র‍্যাংক দেবো। এটা তাদের মনোবল বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে করা হয়। যখন আমি এই বিষয়গুলোর পরিকল্পনা করছিলাম এবং এই অফিসারদের কাকে কোথায় দেয়া যায় সেসব রেডি করছিলাম তখন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাকে বললেন DFI প্রধান গ্রুপ ক্যাপ্টেন (পরবর্তীতে এয়ার ভাইস মার্শাল) আমিনুল ইসলামের স্থলে লে কর্নেল রউফকে দিতে। আগেই বলেছি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লে কর্নেল রউফকে চিনতেন সেই “আগরতলা ষড়যন্ত্র” মামলার সময় যখন তিনি (বঙ্গবন্ধু) মিলিটারি কাস্টডিতে ছিলেন। সেসময় হয়ত কোনোভাবে লে কর্নেল (পরবর্তীতে ব্রিগেডিয়ার) রউফ বঙ্গবন্ধুকে বিমোহিত করেছিলেন এবং তার বিশ্বাস অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সেকারণে সেই বিশ্বাসের স্থান থেকে বঙ্গবন্ধু লে কর্নেল রউফকে ডিজিএফাই করার আদেশ দিলেন।

পাকিস্তান থেকে রিপ্যাট্রিয়েশনের পরে লে কর্নেল (পরবর্তীতে ব্রিগেডিয়ার) রউফ ডিজিএফআই হলেন। এটা একটি স্বতন্ত্র ও খুব গুরুতপূর্ণ নিয়োগ। গোয়েন্দা সংক্রান্ত বিষয়ে তার একদিকে যেমন চিফদের সাথে এক্সেস আছে অপরদিকে সরাসরি রাষ্ট্রপতির সাথেও তার এক্সেস আছে। (এখানে উল্লেখ্য যে রউফ ১৮১ জন পাকিস্তানী অফিসারের একজন)। ডিএফআই তে চাকরীর শুরুতে লে কর্নেল রউফ খুব নিয়মিতভাবেই গোয়েন্দাসংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় আমাদের কাছে (তিন বাহিনী প্রধান) রিপোর্ট করতেন। যতদিন এই অফিসটা আর্মি হেডকোয়ার্টারে ছিলো ততদিন পর্যন্ত তিনি নিয়মিত রিপোর্ট করতেন। কিন্তু কার্যালয়টি এখান থেকে প্রেসিডেন্টের সেক্রেটারিয়েটে স্থানান্তরিত হবার পর থেকে ধীরে ধীরে রিপোর্ট দেবার পরিমাণ কমতে থাকলো। একসময় এমন অবস্থা হল যে প্রেসিডেন্টকে আমার জানাতে হল যে ব্রিগেডিয়ার রউফ আমাকে নিয়মিত গোয়েন্দা রিপোর্ট দিচ্ছেন না – অন্তত যতটুকু তার দেবার কথা। তথ্য পেতে আমাকেই তাকে (রউফ) কল করতে হত। 

নীচের দিকের র‍্যাংকের কিছু সৈন্যদের মাঝে সৃষ্টি হওয়া যে অসন্তোষ নিয়ে আমি প্রেসিডেন্টকে ব্রিফ করেছিলাম সেটি সম্ভবত তাঁর (বঙ্গবন্ধুর) আগে থেকে জানা। আমার প্রশ্ন হচ্ছে আমি জানার আগে প্রেসিডেন্ট সেটা কিভাবে জানতেন? আর্মি বিষয়ক যে কোন বিষয় প্রেসিডেন্টের জানার আগে একজন হলেও সেটা সর্বাগ্রে আমার জানার কথা। যেসব সোর্স থেকে বঙ্গবন্ধু এই তথ্য পেতে পারেন সেগুলো সম্ভবত DFI অথবা NSI হবে। যদি সেটা আর্মি রিলেটেড হয় তাহলে DFI হবে সম্ভাব্য সোর্স। ফিল্ড ইন্টিলিজেন্স ইউনিট (FIU) থেকে আমাকে এটা জানানো হয়। যদি তারা প্রেসিডেন্টকে ইনফর্ম না করে, সেক্ষেত্রে তিনি অন্যান্য সোর্স থেকে (যেমন FIU)  অবশ্যই তথ্য পাবেন। আমি জানিনা যে প্রেসিডেন্টকে জানায় সে কেন আমাকে জানায় না। যদি আমি ভেবে নেই এটা DFI ছাড়া অন্য কেউ তাহলে কি ভুল হবে? 

যদি NSI রিপোর্ট করে সেটা হতে পারে। কারণ ওরা চিফের কাছে রিপোর্ট করেনা। এটা DFI এর কাজ। যেহেতু ডিজি ইচ্ছা করে বা অন্য কোন কারণে আমাকে রিপোর্ট করছেনা তাই অবশ্যই আমার এখানে উদ্বেগের বিষয় আছে। যদি আমি বলি যে, আমাকে সেনসিটিভ তথ্যটা থেকে দূরে রাখা হচ্ছে – সেটা কি ভুল হবে? একারণে এই বাধা দূর করতে আমার ভিন্ন কোন সোর্সের প্রয়োজন যেখান থেকে আমি বাহিনীর মধ্যে কী হচ্ছে সেসংক্রান্ত তথ্য পাবো। একারণেই আমি প্রেসিডেন্টের কাছে গিয়েছিলাম যাতে অন্তত MI Dte অর্গানোগ্রামের আংশিক অনুমোদন দেয়া হয়। ডেপুটি ডিফেন্স মিনিস্টার প্রফেসর নুরুল ইসলাম আমার সাথে ছিলেন। 

প্রেসিডেন্টের অফিসের প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি জনাব রুহুল কুদ্দুস আমাকে জানালেন যে প্রস্তাবিত TO&E (অর্গানোগ্রাম) এপ্রুভ হওয়া এখন শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র। যে কোন সময়ে এটি পাশ হতে পারে। প্রেসিডেন্ট সেদিন আমার অনুরোধে আমার সামনে ডেপুটি ডিফেন্স মিনিস্টারকে অতি সত্বর সময় নষ্ট না করে প্রস্তাবিত প্রোগ্রামটি এপ্রুভ করে দিতে বলেছিলেন। কিন্তু সেটি আমি যতদিন চিফ ছিলাম – অর্থাৎ ২৪ আগস্ট ১৯৭৫ তারিখ পর্যন্ত মন্ত্রণালয় থেকে এপ্রুভ হয়নি। আমি জানিনা কেন এই এপ্রুভাল এত দেরী করে হল। প্রফেসর নুরুল ইসলাম কি অন্য কারো থেকেও নির্দেশ নিচ্ছিলেন? যদি তা না হয় তাহলে ফাইনাল সিদ্ধান্ত দিতে ডিফেন্স মিনিস্ট্রির এত দেরী হবার কারণ কী? এটা নিশ্চিত হবার জন্য আমি প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে একটি এপয়েন্টমেন্ট করি। 

সেদিনের মিটিংএ প্রেসিডেন্ট আমাকে জানালেন যে তিনি জেনারেল জিয়াকে পদত্যাগ করতে বলেছেন। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, “স্যার, এটি কেন চাচ্ছেন?” প্রেসিডেন্ট তখন বললেন যে জিয়া বিভিন্ন সোর্স মারফত তাঁকে অনুরোধ ও জালাতন করছে যাতে আমাকে দ্বিতীয় মেয়াদে আর আর্মি চিফ না করা হয়। (আমার প্রথম মেয়াদ শেষ হয় ১৯৭৫ সালের ৭ এপ্রিল।) বিভিন্ন সোর্স মারফত কাজটি আদায় করাতে না পেরে জিয়া নিজেই প্রেসিডেন্টের মুখোমুখি হয়। সেই সাক্ষাতে জিয়া প্রেসিডেন্টকে অনুনয় করে বলে যেন আমাকে সরিয়ে তাকে চিফ করা হয়। এমনকি সে প্রেসিডেন্টকে এই নিশ্চয়তা দেয় যে, সে আরও ভালো সার্ভিস দিতে পারবে। আমি জানিনা এমন কী সার্ভিস সে দিতো যা আমি দিতে পারিনি। 

প্রেসিডেন্ট সম্ভবত হতাশ হয়ে গিয়েছিলেন এবং তাকে পদত্যাগ করতে বলেছিলেন। প্রেসিডেন্ট সিদ্ধান্তটা নিয়েছিলেন পঁচাত্তরের জুলাইয়ের কোন এক সময়ে এবং তিনি জিয়াকে রেজিগনেশন লেটার জমা দিতে বলেছিলেন। প্রেসিডেন্ট তখন প্রফেসর নুরুল ইসলামকে বলেছিলেন যে জিয়া পদত্যাগ পত্র জমা দিলে সেটা যেন রিসিভ করা হয় এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হয়। ডিফেন্স মিনিস্ট্রির সচিব জনাব মুজিবুল হক সাহেবও প্রেসিডেন্টের এই সিদ্ধান্তটা জানতেন। বঙ্গবন্ধুর ডেপুটি ডিফেন্স মিনিস্টার প্রফেসর নুরুল ইসলাম বঙ্গবন্ধুর এই আদেশ প্রয়োগ করতে তেমন আন্তরিক ছিলেন না। তিনি জেনারেল জিয়ার পদক্ষেপের আশায় ছিলেন। যাতে করে জিয়া নিজে থেকে রেজিগ্নেশন লেটার জমা দেয়। এভাবে ডেপুটি ডিফেন্স মিনিস্টার প্রফেসর নুরুল ইসলাম জিয়াকে এক প্রকার কালক্ষেপণ করতে সাহায্য করছিলেন। 

যখন প্রেসিডেন্ট আমাকে সংবাদটা দিলেন তখন ইতোমধ্যে চিফ হিসেবে আমার দ্বিতীয় মেয়াদ চলছে। এটি এপ্রুভ হয় ‘৭৫ এর এপ্রিল মাসে। তবুও কেউ কোনোভাবে তাকে বুঝিয়েছে যে আমাকে সরিয়ে দেয়া হবে এবং তাকে চিফ করা হবে। প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে এসব শোনার পর আমি বুঝলাম কেউ জিয়াকে নিয়ে খেলছে। কারণ অলরেডি আমার দ্বিতীয় মেয়াদ চলমান আছে। যাই হোক, প্রেসিডেন্ট আমাকে জানালেন জিয়া কী করছে। স্বাভাবিকভাবেই আমি কিছুটা অস্বস্তিবোধ করলাম এই ভেবে যে আমার পেছনে আমার ডেপুটি দেশের সর্বোচ্চ নির্বাহীর বিরুদ্ধে না জানি কী করছে। তাই যখন প্রেসিডেন্ট আমাকে জানালেন যে তিনি জিয়াকে পদত্যাগ করতে বলেছেন, অবাক হলেও আমি তখন কিছু বলিনি। সেই দিন পর্যন্ত সুপিরিয়র কেউ জিয়ার সম্পর্কে খারাপ বললে আমি তাকে রক্ষার চেষ্টা করতাম। কিন্তু সেদিনই আমি চুপ করে থেকেছি। এটা আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল যে কারা আর্মির উন্নয়নে আমার প্রস্তাবকে বাধা দিতে পর্দার আড়ালে কাজ করছে। এবং আমার সাবমিট করা অর্গানোগ্রাম কেন এপ্রুভ হচ্ছেনা। 

যখন বঙ্গবন্ধু আমাকে বললেন যে তিনি জিয়াকে পদত্যাগ করতে বলেছেন আমি তখন বলিনি যে এখনই সিদ্ধান্তটা বাস্তবায়ন করুন। কারণ এর সাথে সরাসরি আমার বিষয়টা যুক্ত। একবার যদি বঙ্গবন্ধু প্রকাশ্যে জিয়াকে স্যাক করার বিষয়টা ঘোষণা দিয়ে ফেলেন তখন সেটা আর না করে পারা যাবেনা। অন্যথায় এটা প্রকাশ্যে বলা যাবেনা। একবার যেহেতু সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাই এটা প্রয়োগ করতে তিনি আর সময় নেবেন না। বঙ্গবন্ধুর মনোভাব জানার পরে জেনারেল জিয়ার মনে বঙ্গবন্ধুর জন্য কোন ভালোবাসা ছিলোনা। অন্যভাবে বলা যায়, আমার উপর একটি হতাশা চাপলো যে একজন আমার পাশে বসেই আমাকে দেখতে থাকবে এবং আমারই বিরুদ্ধে কাজ করতে থাকবে। 

জেনারেল জিয়াকে এই ব্যাপারে নিশ্চই কেউ না কেউ মদদ দিচ্ছে। অন্যথায় তার এতদূর যাবার কথা না। নতুন অর্গানোগ্রামের ফলে অনিশ্চয়তা দূর হবে। তাই সে চাচ্ছিল না যে প্রস্তাবিত TO&E পাশের পর আর্মি আমার আন্ডারে সুসজ্জিত রূপ লাভ করুক। তাই এটাকে বিলম্বিত করার জন্য অবশ্যই যে প্রফেসর নুরুল ইসলামের শরণাপন্ন হয়েছে। এটিকে বিলম্বিত করার জন্য প্রফেসর নুরুল ইসলাম প্রেসিডেন্টকে জানালেন যে আর্মি হেড কোয়ার্টার থেকে তার কাছে দুটো প্রস্তাব এসেছে। একটি হচ্ছে ডিভিশন কনসেপ্ট আর আরেকটি হচ্ছে ব্রিগেড কনসেপ্ট। তাই তিনি সময় নিচ্ছেন কোনটা করবেন। বাস্তবে, ব্রিগেড কনসেপ্ট নামে আর্মি হেড কোয়ার্টার থেকে কোন প্রস্তাব যায়নি। এটি শুধু প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত করার একটি কৌশল। এর লক্ষ্য হচ্ছে আমার মেয়াদে যেন এই প্রপোজাল পাশ না হয়। এই চতুর পরিকল্পনায় অবশ্যই ডেপুটি ডিফেন্স মিনিস্টার প্রফেসর নুরুল ইসলামের হাত রয়েছে। কারণ যে জিয়ার স্বার্থ অনুযায়ী কাজ করার চেষ্টা করছে। 

রেফারেন্স হিসেবে এখানে প্রফেসর নুরুল ইসলামের লেখা আর্টিকেল খুব প্রাসঙ্গিক। তিনি আর্টিকেলে লিখেছেন TO&E এপ্রুভ করার সময় তার সামনে দুটো আলাদা প্রস্তাব আসে। একটি প্রস্তাব করেছেন আর্মি চিফ জেনারেল শফিউল্লাহ। এটি ডিভিশন কনসেপ্ট। এবং অন্যটি প্রস্তাবটি ডেপুটি চিফ জেনারেল জিয়ার। এটি ব্রিগেড কনসেপ্ট। তাই তিনি কিছুটা উভয়সংকটে আছেন যে কোনটা অনুমোদন করবেন। খুবই আশ্চর্য! আমরা কি শিশু? একই হেড কোয়ার্টার থেকে কিভাবে দুটো প্রস্তাব দেয়া যায়? যার একটি চিফের আরেকটা ডেপুটি চিফের? বিষয়টা তো এমন না যে প্রফেসর নুরুল ইসলাম জানেন না এরা কারা? যদি জানেন তাহলে এরকম মন্তব্য কিভাবে করেন? এই মন্তব্যে কি প্রফেসর নুরুল ইসলাম একজন মধ্যস্থতাকারী? মজার বিষয় হচ্ছে আর্মি হেড কোয়ার্টারের কেউ তথাকথিত দ্বিতীয় প্রস্তাবটি অর্থাৎ ব্রিগেড ভিত্তিক প্রস্তাবটি সম্পর্কে কিছুই জানেনা। 

যেহেতু প্রফেসর নুরুল ইসলাম জিয়ার স্বার্থ দেখছেন তাই তাকে এরকম কিছু একটা করতে হত। তাই সে দ্বিতীয় প্রস্তাবের মত বিষয় এনেছে শুধুমাত্র প্রেসিডেন্টকে ভুল পথে পরিচালিত করার জন্য এবং পুরো প্রক্রিয়াটাকে বিলম্বিত করার জন্য। যদি প্রফেসর নুরুল ইসলাম জিয়ার পার্টি না হতেন তবে তো এই প্রস্তাব পাবার সাথে সাথে তার ফিরিয়ে দেবার কথা। তাই একথা নির্ধিদায় বলা যায় সে প্রফেসর নুরুল ইসলাম আর্মিতে পলিটিক্স করছেন। এবং একই সাথে অসন্তোষের বীজ বপন করছেন। তার এই প্রচেষ্টার কারণে দেশকে চরম মূল্য দিতে হয়েছে। এবং অবশ্যই বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারকে মূল্য দিতে হয়েছে সবচেয়ে বেশী। 

নতুন প্রস্তাবিত TO&E পাশ হলে আর্মি অফিসার ও বাহিনীর লোকদের চাহিদা পূরণ হত। ফলে অসন্তোষ এবং হতাশা দূর হত। এটাই জেনারেল জিয়া চায়নি। পাশাপাশি সে প্রথমেই চেষ্টা করেছে TO&E প্রস্তাবটি যাতে পাশ না হয়। এর ফলে অসন্তোষের মাত্রা বাড়তে থাকবে। সেই লক্ষ্যে সে ডেপুটি ডিফেন্স মিনিস্টার প্রফেসর নুরুল ইসলামের শরণাপন্ন হয়েছে যাতে এপ্রুভালটা বিলম্বিত করা যায়। সে ভেবেছিল যে অফিসার ও অন্যান্য সেনাসদস্যদের জন্য সে এমন কিছু করবে যার ফলে তারা চিফ হিসেবে তাকে চায়। প্রফেসর নুরুল ইসলামের লেখা পড়ে আমার আর কোন সন্দেহ নাই যে তিনি জিয়ার পার্টি হিসেবে কাজ করেছেন যার ফলে TO&E প্রস্তাবটা পাশে বিলম্বিত করেছেন। এই লেখা প্রকাশিত হবার আগে আমি বুঝতে পারছিলাম না যে আর কেউ এই চক্রান্তে জড়িত আছে কিনা। আমি এখন তার দিকে আঙ্গুল নির্দেশ করতে পারি। 

পাঠকের জন্য জানাচ্ছি, আমি আর্মির জন্য সরকারের কাছে যে প্রস্তাব দিয়েছিলাম সেটি ডিভিশনাল কনসেপ্ট। যখন আমি প্রেসিডেন্ট সেক্রেটারিয়েটে এই প্রস্তাব উপস্থাপন করি তখন আমার ডেপুটি চিফ জেনারেল জিয়া সহ আর্মির সকল PSO উপস্থিত ছিলেন। যদি ডেপুটি চিফ জেনারেল জিয়ার কোন আলাদা প্রস্তাব থাকতো তবে তিনি সেটা সেই ফর্মে উল্লেখ করতে পারতেন। কারণ সেটি একটি সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছিলো। আমি অবাক হয়েছি প্রফেসর নুরুল ইসলাম কর্তৃক প্রকাশিত তথাকথিত দ্বিতীয় প্রস্তাবে। আমি জানিনা এই দ্বিতীয় প্রস্তাবটা আসলে কার মাথা থেকে এসেছে। এধরনের লেখা পত্রিকায় লেখার আগে প্রফেসর নুরুল ইসলাম নিশ্চই জেনারেল জিয়াকে জানতেন। সে এমন লোক যে আর্মিতে ব্রিগেড কনসেপ্ট ভিত্তিক প্রস্তাব দিয়েছে। কিভাবে সে ১৯৭৫ এর সেপ্টেম্বরে একটি ডিভিশন করল? (নবম ডিভিশন চালু হয় ১৯৭৫ এর সেপ্টেম্বরে)। অর্থাৎ আর্মি থেকে আমাকে অপসারণের ১ মাসে পরেই। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে প্রফেসর নুরুল ইসলাম পরবর্তী সরকারের কেবিনেটে ছিলেন। 

পাঠকের অবগতির জন্য আরও জানাচ্ছি যে আজকের সেনাবাহিনী দাঁড় করাতে প্রচুর পরিশ্রম ও কাগজপত্র প্রস্তুত করতে হয়েছে। এরপর সেগুলোতে সরকারের অনুমোদন নিতে হয়েছে। যখন সরকার পরিবর্তন হল এবং জেনারেল জিয়া আর্মি চিফ হলেন এবং এরপর চিফ মার্শাল ল এডমিনিস্ট্রেটর হলেন তখন এসব প্রশাসনিক পদ্ধতি অনেক পরিবর্তন হয়ে গেল। জিয়া তখন যেটা করতে পারতো তা হচ্ছে ডিফেন্স মিনিস্ট্রির শেলফ থেকে ফাইলটা নামীয়ে ওই পেপারগুলো পাশ করিয়ে ফেলা। ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকায় তাকে কোন আদেশের জন্য অপেক্ষা করতে হয়নি। তাই নবম ডিভিশন সে এভাবেই করেছে। আমি চলে যাবার পর নবম ডিভিশন করতে আর্মি হেড কোয়ার্টারের কাছে কোন আলাদীনের চেরাগ ছিলো না। এটা প্রায় দেড় বছরের পরিশ্রমের ফসল। এতে জিয়াও ছিলো। নতুন ডিভিশন হবার ফলে আর্মি অফিসার ও সদস্যরা দুশ্চিন্তামুক্ত হলেন। যদি এই ডিভিশনটা ১৫ আগস্ট ‘৭৫ এর মাসখানেক আগে হত তাহলে হয়ত ইতিহাসটা এরকম হতনা। প্রফেসর নুরুল ইসলাম এখন আর বেঁচে নেই। তাহলে আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম কোথায় আপনার জিয়া প্রদত্ত সেই ব্রিগেড কনসেপ্ট যার জন্য আপনি আমার প্রস্তাবিত TO&E পাশ করাতে বিলম্ব করছিলেন? আমার ধারণা এটাই যে বঙ্গবন্ধু তার উপর যে বিশ্বাস রেখেছিল সে সেটার বরখেলাপ করেছে। 

প্রফেসর নুরুল ইসলামের ব্যাপারে আমার মন্তব্য কিছুটা রুক্ষ মনে হতে পারে। সে বঙ্গবন্ধুর সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করেছে। যদি সে বঙ্গবন্ধুর প্রতি অনুগত থাকতো, এবং আর্মির অর্গানোগ্রামটা সময় মত পাশ করে দিত তাহলে হয়ত পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের বেদনাদায়ক ঘটনা ঘটত না। এছাড়াও যদি পঁচাত্তরের জুলাই মাসে বঙ্গবন্ধুর কথা মত সে জিয়ার পদত্যাগপত্র রিসিভ করত তাহলেও পরিস্থিতি অন্যরকম হত। সে প্রেসিডেন্টের আদেশের প্রতি শ্রদ্ধা দেখায়নি। বরং উল্টো সে প্রেসিডেন্টের কাছে জিয়ার হয়ে তদবির করেছে যে যদি পদত্যাগপত্রটা বিলম্বিত করে সেপ্টেম্বরের দিকে নেয়া যায়। এই তথ্যের রেফারেন্স প্রফেসর নুরুল ইসলামের নিজের লেখা আর্টিকেলেই রয়েছে যা ১৯৯৪ সালের ২৬ মার্চ “দৈনিক আজাদী” পত্রিকায় ছাপা হয়। এই ঘটনার সাথে কি ১৫ আগস্ট ‘৭৫ এর যোগসূত্র পাওয়া যায়? 

এসকল তথ্য প্রফেসর নুরুল ইসলামের আর্টিকেলে পাওয়া যায়। এটি ১৯৯৪ সালের ২৬ মার্চ “দৈনিক আজাদী” পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে ছাপা হয়  এবং এরপর একই বছর “বাংলাবাজার পত্রিকা” ও “ভোরের কাগজ” এ ছাপা হয়। তিনি সেখানে স্পষ্ট উল্লেখ করেছেন যে প্রেসিডেন্ট তাকে বলেছেন যে তিনি (বঙ্গবন্ধু) জিয়াকে পদত্যাগ করতে বলেছেন এবং তাকে (নুরুল ইসলাম) আদেশ দিয়েছেন জেনারেল জিয়ার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করতে। প্রফেসর নুরুল ইসলামের সাথে যুদ্ধের সময় জেনারেল জিয়ার সাথে চট্টগ্রামের কিছু স্মৃতি রয়েছে। তাই সম্ভবত সে জিয়ার থেকে পদত্যাগপত্র নিতে আন্তরিকতা দেখায়নি। বরং মজার ব্যাপার হচ্ছে, জুলাই ‘৭৫ এর বঙ্গবন্ধুর এই আদেশ মানার পরিবর্তে প্রফেসর নুরুল ইসলাম প্রেসিডেন্টের কাছে অনুরোধ করেছে যাতে জিয়ার পদত্যাগপত্র ১৯৭৫ এর সেপ্টেম্বর মাসে নেয়া হয়। 

এটা উপরে উল্লেখিত আর্টিকেলে লেখা প্রফেসর নুরুল ইসলামের নিজের ভাষ্য। প্রশ্ন হচ্ছে, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যে সময় চাওয়া হল, এর সাথে কি ১৫ আগস্টের কোন সম্পর্ক আছে কিনা? এখানে অবশ্যই ভাবনার খোরাক আছে। সামরিক অভ্যুত্থানের পর বঙ্গবন্ধুর প্রতি জিয়ার কোন ভালোবাসা ছিলোনা। পেছনে থাকালে মনে হয়, গোয়েন্দা ব্যার্থতা এবং সিদ্ধান্তহীনতাই ১৫ আগস্টের বেদনাদায়ক ঘটনার অন্যতম কারণ। যেহেতু আমার নিজস্ব কোন গোয়েন্দা প্রতিষ্ঠান ছিলোনা, তাই বিকল্প হিসেবে আমাকে ডিজিএফ আই ব্রিগেডিয়ার রউফের দেয়া তথ্যের নির্ভর করতে হয়েছে। ব্রিগেডিয়ার রউফ একজন রিপ্যাট্রিয়েটেড আই এস আই অফিসার। সম্ভবত একথা বললে আমার ভুল হবে না যে সেও বঙ্গবন্ধুর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। 

১৫ আগস্ট ১৯৭৫ তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন হবার কথা। সংশ্লিষ্ট সবাই এনিয়ে খুবই ব্যস্ত ছিলো। যেহেতু চ্যান্সেলর ও প্রেসিডেন্ট সেটি উদ্বোধন করতে যাচ্ছেন। এবং ছাত্রদের মাঝে সার্টিফিকেট বিতরণ করা হবে। 

বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন উৎসবমুখর পরিবেশ। সেই পরিবেশের ভেতর ১৪ আগস্ট ১৯৭৫ তারিখে ক্যাম্পাস এরিয়ার ভেতরে কিছু বিস্ফোরণ হল। বিশেষ করে মঞ্চের একদম কাছে যেখান থেকে পরদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্বোধনী ভাষণ দেবার কথা এবং ছাত্রছাত্রীদের মাঝে সার্টিফিকেট দেবার কথা। শোনা যায় যে, জাসদ এই প্রোগ্রাম উপলক্ষে ক্যাম্পাসে অনেকে জড়ো হয়েছে এবং একটি বিধ্বংসী মনোভাব নিয়েছে। গুজব আসে যে তারা প্রেসিডেন্টকে হত্যা করার পদক্ষেপ নিতে পারে যার ফলে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। জাসদের আর্মড উইং এই ভয়ানক কাজটির জন্য সন্দেহ তালিকার শীর্ষে। 

যখন সব আয়োজন চলছিল তখন হঠাৎ করে ১৪ আগস্ট ‘৭৫ একটি ঘটনা ঘটে। পার্বত্য চট্টগ্রামে আমাদের অপারেশনের জন্য ব্যবহৃত একটি ভারতীয় হেলিকপ্টার ফেনীতে বিধ্বস্ত হয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকা সড়ক যোগাযোগের জন্য সব সময় উপযোগী নয়। তাই মাঝে মাঝে আমাদের হেলি-লিফটিং ক্যাপাসিটির দরকার। সেটা সে সময় আমাদের ছিলো না। আমাদের সরকারের অনুরোধে ভারত সরকার আমাদের একটি হেলিকপ্টার (Russian MI-4) দেয়। সাথে ক্রুদের ছোট্ট একটা গ্রুপ এবং পাইলট আমাদের জন্য দেয়া হয়। আমি অপারেশনের জন্য এটাকে পার্বত্য চট্টগ্রাম গ্যারিসনে রাখি। সার্ভিসিং এবং মেইন্টেনেন্স এর জন্য প্রতি মাসে এটাকে কোলকাতা পাঠাতে হয়। ১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবস। এই দিনকে সামনে রেখে ভারতীয় অফিসার ও সদস্যরা হেলিকপ্টারটির সার্ভিসিং ও মেইন্টেনেন্সের জন্য কোলকাতায় যাবার দিন সাজিয়ে নেয়। 

সেই অনুযায়ী এই হেলিকপ্টারটি মাসিক মেইন্টেনেন্সের জন্য কোলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। সংগৃহীত তথ্য মতে, যখন হেলকপ্টারটি ১৪ আগস্ট ‘৭৫ রওনা দিয়ে ফেনী এলাকায় আসে তখন একটি দুর্ঘটনার শিকার হয়। একজন চাক্ষুষ সাক্ষী জানান, যখন এটা ফেনী এলাকা দিয়ে যাচ্ছিলো তখন একটি শকুন হেলিকপ্টারের পাখায় লেগে যায়। এর ফলে পাখাটি খারাপভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর ফলে হেলিকপ্টারটি একটি পাথরের মত মাটিতে পড়ে যায়। এর সমস্ত যাত্রীরা মারা যায়। এই ঘটনাটিতে আর্মি হেড কোয়ার্টার সহ সবার মন বিষণ্ণ হয়ে পড়ে। তারা আমাদের মেহমান। স্বাভাবিকভাবেই এটি আমাদের সবার জন্য দুঃখজনক একটি ঘটনা। আমরা সেই লাশগুলো ঢাকা হয়ে কোলকাতায় পাঠাবার ব্যবস্থা করি। আইন অনুযায়ী ফেনী কুমিল্লা গ্যারিসনের অন্তর্ভুক্ত। ঘটনা ঘটার সাথে সাথে আমি কুমিল্লা গ্যারিসনের কমান্ডার কর্নেল (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল) আমজাদ চৌধুরী পি এস সি এর সাথে যোগাযোগ করে তাকে অতি সত্বর সেখানে কিছু অফিসার ও সেনাসদস্য পাঠাতে বলি যাতে করে তারা ঘটনাস্থল বেষ্টনী করে রাখতে পারে এবং উদ্ধারকাজ চালাতে ও দুর্ঘটনার তদন্ত করতে পারে। 

অন্যদিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বিস্ফোরণের ঘটনায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। কারণ পরদিন বঙ্গবন্ধু সেখানে যাবেন। তৎকালীন আই জি পি নুরুল ইসলাম সাহেব আমার সাহায্য চাইলেন। সেসময় পুলিশ বাহিনীর বিস্ফোরক পদার্থ সনাক্ত করার মত সক্ষমতা বা অভিজ্ঞতা তৈরি হয়নি যাতে করে এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়। ঘটনার গুরুত্ব বিবেচনায় আমি CGS ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে ইঞ্জিনিয়ার ব্যাটালিয়ন থেকে কিছু এক্সপার্ট পুলিশের কাছে পাঠাতে নির্দেশনা দিলাম। একই সাথে আমি FIU কে চোখকান খোলা রাখতে  DMI কে আদেশ দিলাম। কর্নেল জামিল সার্বিক গোয়েন্দা নির্দেশনা দিলেন যার শীঘ্রই ডিজিএফআই হবার কথা। টানটান উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে পুলিশ এবং গোয়েন্দা বিভাগ মিলে পুরো এলাকার জন্য একটি বৃহৎ পরিসরের নিরাপত্তা ব্যবস্থার আয়োজন করল। ডিজি হিসেবে অপেক্ষমাণ ও MS (P) কর্নেল জামিল পুরো কার্যক্রম সমন্বয় করেন। ব্রিগেডিয়ার রউফ, যিনি শীঘ্রই ডিজি থেকে চলে যাবেন, পরেরদিন তার কর্নেল জামিলের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তরের কথা (১৫ আগস্ট ১৯৭৫)। তিনি নিজেও সক্রিয়ভাবে গোয়েন্দা অপারেশন তদারকিতে থাকলেন। 

এভাবেই খুব ব্যস্ততার মাঝে ১৪ আগস্ট ‘৭৫ তারিখটি আমি পার করলাম। গভীর রাত পর্যন্ত ভারতীয় সেনাদের ও পাইলটের লাশ নিয়ে ব্যস্ত থাকলাম। একদম শেষ রাতে আমি ঘুমাতে গেলাম। পরদিন (১৫ আগস্ট ১৯৭৫) সোয়া পাঁচটার কিছু আগে-পরে বা সকাল সাড়ে পাঁচটায় DMI লে কর্নেল সালাউদ্দিন আমার বাসায় আসলেন। তখনো আমি ঘুমে জড়ানো। আমার ব্যাটম্যান হাবিলদার দায়দার আলী আমার দরজায় নক করে আমাকে ডেকে তুললো। দরজা খুলে আমি তার সাথে DMI লে কর্নেল সালাউদ্দিনকে তার সাথে দেখলাম। লে কর্নেল সালাউদ্দিন ইউনিফর্ম পরিহিত, শেভ করেনি এবং সাথে একটি স্টেনগান। দেখে আমি জিজ্ঞেস করলাম কেন সে এভাবে ড্রেস পড়ে আছে। তিনি সেসব কথার জবাব না দিয়ে আমার কাছে জানতে চাইলেন যে আমি আর্মারড ও আর্টিলারি ইউনিটকে শহরে প্রবেশ করতে বলেছি কিনা। আমি এসম্পর্কে না জানায় বললাম যে, “না।” তখন সে আমাকে বলল, দুটো ইউনিট শহরে বেরিয়েছে এবং গণভবন, রেডিও টিভি স্টেশনের সামনে অবস্থান করছে। কিছু ট্যাংক ও আর্টিলারি বঙ্গবন্ধুর ৩২ নাম্বারের বাড়ির দিকে গিয়েছে। এটা শুনে আমার কী করার কথা বা কি একশন নেবার কথা? দ্রুততম উত্তর ছিলো, সম্ভাব্য ভিক্টিমকে এলার্ট কর এবং অতি সত্বর এটাকে ঠেকাতে সৈন্য পাঠাও। এটাকে কার্যকর করতে প্রথমেই আমি চিন্তা করলাম প্রেসিডেন্টকে আগে সতর্ক করি এবং যা হচ্ছে সেসম্পর্কে সম্পর্কে অবগত করি।  এবং ঢাকা ব্রিগেড কমান্ডারকে এটা ঠেকাতে ট্রুপ্স পাঠাতে বলি, কারণ সে ফোর্সে কমান্ডার। আমার প্রাথমিক একশন ছিল এই দুটি বিষয়ের উপর ভিত্তি করে।

DMI থেকে তথ্যটি পেয়ে আমার বুঝতে বাকি রইলনা কী হচ্ছে। ভেবে আর শিরদাঁড়া দিয়ে ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল। আমি DMI কে জিজ্ঞেস করলাম, কর্নেল শাফায়াৎ (অর্থাৎ ঢাকা ব্রিগেড কমান্ডার) কি এই মুভের ব্যাপারে কিছু জানে? সে বললে সে নিশ্চিত না। সে আরও বলল খবর পেয়ে সে সোজা আমার বাসায় চলে এসেছে। আমি সাথে সাথে ১,২ ওঁ ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে তাদের প্রতিহত করার নির্দেশনা সহ  DMI এর মাধ্যমে ঢাকা ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়েত জামিলের কাছে নির্দেশনা পাঠালাম। এই তিনটি ব্যাটেলিয়ন এধরনের সমস্যা মোকাবিলার জন্য ঢাকাতে তার কমান্ডে রাখা ছিলো। 

DMI এর মাধ্যমে শাফায়াৎ জামিলের প্রতি নির্দেশনা সহ কে তার কাছে পাঠিয়ে আমি বঙ্গবন্ধুকে সম্ভাব্য বিপদের ব্যাপারে জানাতে লাল টেলিফোনে তাঁর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করলাম। কিন্তু হায়, আমি তাঁকে পাচ্ছিলাম না। তাঁর টেলিফোন ব্যস্ত। আমি সিভিল ও রেড টেলিফোন দুটোতেই চেষ্টা করতে থাকলাম। কিন্তু তাঁকে পাচ্ছিলাম না। যেহেতু প্রেসিডেন্টের লাল টেলিফোন ও বাসার অন্য ফোন কোনটাতেই আমি পাচ্ছিলাম না তাই সময় নষ্ট যাতে না হয় সেজন্য আমি আমার স্ত্রীকে বললাম প্রেসিডেন্টের লাল টেলিফোনে ডায়াল করে যেতে। এরপর আমি ফোন করলাম ঢাকা ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়াৎ জামিলকে। তার টেলিফোনও ব্যস্ত। তাই আমি আমার হাউজ এক্সচেঞ্জকে বললাম এক্ষুনি আমাকে ঢাকা ব্রিগেড কমান্ডার শাফায়াৎ জামিলকে দিতে। আমার স্ত্রী প্রেসিডেন্টের লাল টেলিফোনে ডায়াল করে যাচ্ছে, একই সাথে আমার হাউজ এক্সচেঞ্জ কর্নেল শাফায়াৎ জামিলকে চেষ্টা করে যাচ্ছে – এই সময়ে আমি আমার সিভিল টেলিফোন দিয়ে অন্যান্য অফিসারদের সাথে যোগাযোগ করতে শুরু করলাম। 

এভাবে আমি MS (P) কর্নেল জামিলকে পেলাম। সে আমাকে বলল যে প্রেসিডেন্ট তাকে ফোন করেছিলেন এবং বলেছেন তিনি কোন একটা বিপদের ধারণা করছেন এবং অতি দ্রুত তাঁর বাড়ীতে যেতে বলেছেন। DMI লে কর্নেল সালাউদ্দিন আমাকে যা আ বলেছে আমি সেটা তাকে জানালাম। এবং বললাম যে আমি হন্যে হয়ে প্রেসিডেন্টকে সতর্ক করার জন্য টেলিফোনে চেষ্টা করে যাচ্ছি কিন্তু পাচ্ছিনা। কারণ তাঁর টেলিফোন ব্যস্ত। এরপর আমি তাকে বললাম যে সে যেন প্রেসিডেন্টকে জানায় যে আমি অলরেডি DMI এর মাধ্যমে কর্নেল শাফায়াৎ জামিলের কাছে এই একশন থামানোর জন্য ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা পাঠিয়েছি। (তখন পর্যন্ত শাফায়াৎ জামিলের সাথে আমার কথা হয়নি।) এই সময়ে যেভাবেই হোক প্রেসিডেন্টকে তাঁর বাড়ী থেকে বেরিয়ে কোন নিরাপদ স্থানে চলে যাবার কথাও কর্নেল জামিলে বললাম। সে আমাকে বলল যে সে বঙ্গবন্ধুর বাড়ীতে গিয়ে সেটা করার চেষ্টা করবে। 

কর্নেল জামিলের সাথে কথা শেষ করতেই আমার হাউজ অপারেটর ঢাকা ব্রিগেড কমান্ডার শাফায়াৎ জামিলকে লাইনে পেল এবং আমাকে দিল। কর্নেল শাফায়াৎ জামিলের কণ্ঠটা কিছুটা বিচিত্র মনে হচ্ছিলো, সম্ভবত দুশ্চিন্তা বা তন্দ্রাচ্ছন্নতা থেকে। টেলিফোনে তার প্রতিক্রিয়ায় এরকমটাই আমার মনে হচ্ছিলো। সময় নষ্ট না করে আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম যে শহরে আর্মারড ও আর্টিলারি ইউনিট প্রবেশের ব্যাপারে সে কিছু জানে কিনা। সে তার অজ্ঞতা প্রকাশ করল। তাই আমি DMI সালাউদ্দিনের থেকে যা জানতে পেরেছি সেটা তাকে জানালাম এবং তাকে (শাফায়াৎ জামিল) বললাম ১, ২ ও ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট – এই তিন ইনফ্যান্ট্রি (যেটা তার কমান্ডে) দিয়ে এক্ষুনি সময় নষ্ট না করে তাদের প্রতিহত করতে। তার উত্তরে মনে হল সে আমার অর্ডার বুঝতে পেরেছে। পরবর্তীকালে কর্নেল শাফায়াৎ জামিল একটি ইন্টারভিউতে বলেছিলো যে আমি তাকে সেদিন সকালে কোন আদেশ বা নির্দেশনা দেই নাই। তবে সে অন্তত এটা স্বীকার করেছে যে সেদিন আমি তাকে ফোন করেছিলাম। যদি তাকে আমি কোন নির্দেশনা নাই দিয়ে থাকি তাহলে এত সকালে আমি তাকে ফোন করেছিলাম কেন? আমি কি তাকে কোন অর্ডার না করতে ফোন করেছিলাম? তাকে নির্দেশ দেবার পরেই আমি ফোন করলাম এয়ার চিফ এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকারকে। এবং নেভি চিফ রিয়ার এডমিরাল এম এইচ খানকে। সেপর্যন্ত যা বুঝতে পারলাম যে তারা জানেনা আসলে কী হচ্ছে। এরপর আমি ডেপুটি চিফ জিয়ার সাথে যোগাযোগ করলাম। যখন আমি তাকে DMI এবং MS (P) কর্নেল জামিল আহমেদের থেকে পাওয়া তথ্য দিলাম সে বলল, “তাই নাকি?” জিয়ার এই কথা শুনে আমি বুঝতে পারলাম সেও আমার থেকেই প্রথমবারের মত বিষয়টা জানতে পারলো। আমি তাকে বললাম এখনই আমার বাসায় আসতে। এরপরের ব্যক্তি হচ্ছে GSC ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ। তাকেও মনে হল যে আমার থেকেই প্রথম বিষয়টা শুনলো। তাকেও আমি দ্রুত আমার বাসায় আসতে বললাম। ব্রিগেডিয়ার রউফ DFI এর ডিজি – যার কিছুদিন বাদে এই পদ থেকে অন্যত্র যাবার কথা – তাকে ফোন করলাম। রিং হচ্ছে কিন্তু কেউ ফোন ধরছেনা। মনে হল বাড়ীতে কেউ নেই। 

যতক্ষণ আমি উপরোক্ত অফিসারদের সাথে ফোন কথা বলছিলাম ততোক্ষণ আমার স্ত্রী টেলিফোনে বঙ্গবন্ধুকে একটানা ডায়াল করে যাচ্ছিলো। এক পর্যায়ে আমি নিজে লাল টেলিফোনটা স্ত্রীর থেকে নিয়ে প্রেসিডেন্টের নাম্বারে চেষ্টা করলাম। সৌভাগ্যক্রমে এইবার আমি লাইন পেলাম। সময়টা সম্ভবত ৬ টার কয়েক মিনিট আগে। আমি ঘড়ি দেখার সময় পাইনি – তবে এটাই সম্ভাব্য আনুমানিক সময়। লাইন পাবার সাথে সাথে প্রেসিডেন্ট আমার কণ্ঠ শুনেই রাগান্বিত ও ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললেন, “শফিউল্লাহ, তোমার ফোর্স আমার বাড়ী এটাক করেছে। কামালরে (বঙ্গবন্ধুর পুত্র) বোধ হয় মাইরা ফেলছে। তুমি জলদি ফোর্স পাঠাও।” আমি শুধু প্রেসিডেন্টকে বললাম, “স্যার, আমি কিছু করছি, আপনি কি ঘর থেকে কোনোভাবে বের হতে পারবেন?” প্রেসিডেন্ট আমার কথার পর কোন উত্তর দিলেন না এবং চুপ করে থাকলেন। কিন্তু আমি বলে চললাম – হ্যালো, হ্যালো, হ্যালো। পরে আমার মনে হল তার সাথে কেউ ছিলো এবং সেই জন্য তিনি রেসপন্স করেননি। আমার এটাও মনে হল যে তিনি হ্যান্ডসেটটা টেবিলের উপর রেখে চলে গেলেন এবং হ্যান্ডসেটটি টেলিফোন সেটের উপর রাখেননি। কারণ প্রায় ৩০ থেকে ৪০ সেকেন্ড পর আমি টেলিফোনে অটোমেটিক ফায়ারের শব্দ শুনতে পেলাম। এর প্রায় মিনিটখানেক পর টেলিফোন লাইনটা ডিসকানেক্ট হয়ে গেল। 

DMI আমাকে জানানোর সাথেসাথে সময় নষ্ট না করে আমি প্রেসিডেন্টকে আসন্ন বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করতে তাঁকে জানানোর জন্য চেষ্টা করলাম। কিন্তু সময়মত তা পারলাম না। তাঁর সকল টেলিফোন ব্যাস্ত। সম্ভবত সেই সময়ে প্রেসিডেন্ট তাঁর কলিগদের সাথে যোগাযোগ করে সাহায্য প্রার্থনা করছিলেন। কিন্তু তিনি আমার সাথে যোগাযোগ করতে পারলেন না। আবার এটাও হতে পারে যে, যখন তিনি আমাকে চেষ্টা করছিলেন তখন আমার ফোন ব্যস্ত। কিন্তু সত্যিই যদি তিনি আমার সাথে যোগাযোগ করতে চাইতেন সেটি তিনি তাঁর অপারেটরের মাধ্যমেই করতে পারতেন। আবার এও হতে পারে যে তাঁর বাড়ীতে আর্মি দেখে তিনি আমার উপর বিশ্বাস হারিয়েছিলেন। এবং সেজন্য হয়ত তিনি আমার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেননি। DMI আমাকে সকাল সাড়ে পাঁচটার দিকে জানায়। তখন থেকে নন-স্টপ চেষ্টা করে ৬ টার কয়েক মিনিট আগে তাঁর লাইন পেয়েছিলাম। অর্থাৎ প্রেসিডেন্টের সাথে যোগাযোগে আমার ২০ থেকে ২৫ মিনিট লেগে গিয়েছিলো। এই পুরোটা সময় আমি তাঁকে পেতে চেষ্টা করেছি এবং তাঁকে সতর্ক করতে ও ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে বলতে চাচ্ছিলাম। শেষ পর্যন্ত কথা হল, কিন্তু হায়, তখন বড্ড দেরী হয়ে গিয়েছিলো! সম্ভবত আমাদের কথা শেষ হবার কিছুক্ষণ পরেই তাঁকে হত্যা করা হয়? ..

প্রেসিডেন্টের সাথে কথা হবার পর আমি নিশ্চিত হতে চাইলাম যে কর্নেল শাফায়াৎ জামিল বিদ্রোহীদের থামাতে ফোর্স মুভ করেছেন কিনা। তাই সেটা জানতে আমি তাকে ফোন করলাম। কিন্তু ফোনে পেলাম না। তার টেলিফোন বিজি। আমি ভাবলাম তিনি হয়ত তখন তার অধস্তন অফিসারদের নির্দেশনা দিতে ব্যস্ত। তাই তাকে পেতে আমি আমার হাউজ অপারেটরকে বললাম এক্ষুনি কর্নেল শাফায়াৎ জামিলকে দিতে। যদি সেটা সম্ভব না হয় তাহলে নিশ্চিত যে কারো না কারো সাথে সে ব্যস্ত। অপারেটর একটু পর জানালো কর্নেল শাফায়াতের ফোন হ্যাং-আপ করা। কারণ হতে পারে যে সে প্যানিক অবস্থায় থাকার কারণে ফোনের রিসিভার যথাস্থানে রাখেনি। অথবা বিদ্রোহীরা তাকে নিউট্রালাইজ করেছে যার ফলে সে কোন একশন বা রিএকশন দিচ্ছেনা। কিন্তু হায়, পরে দেখা গেল আমার দুটো ধারণাই ভুল। এটা ভাবার কারণ হচ্ছে তার পরবর্তী কাজের ধারাবাহিকতায় মনে হল সে সঠিক পথে নেই। ফোর্স মুভ না করে সে নিষ্ক্রিয় হয়ে আছে। অর্থাৎ সে আমার অর্ডার মানেনি এবং ফোর্স মুভ করেনি। 

পরে আমি জানতে পেরেছি যে বঙ্গবন্ধু সৈয়দ নজরুল ইসলাম, জনাব মনসুর আলী, ব্রিগেডিয়ার মাশহুরুল হক [যার MS(P) হবার কথা], কর্নেল জামিল এবং সম্ভবত আরও কয়েক জনের সাথে কথা হয়েছে – কিন্তু আমি বঙ্গবন্ধুর থেকে একটি কল পেলাম না। যেভাবে হোক বাতাসে গুজব ভেসে বেড়ায় যে বঙ্গবন্ধু ১৫ আগস্ট সকালে আমাকে ফোন করেছিলেন এবং অভিযোগ করা হয় যে আমি নাকি তাকে সরি বলেছিলাম। এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং আমার বিরুদ্ধে একটি বিদ্বেষপরায়ণ অপপ্রচার। সত্যটা হচ্ছে, বঙ্গবন্ধু আমাকে কোন ফোন করেননি। যে পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট দেখলেন আর্মি তাঁর বাড়ির সামনে, তখন হয়ত ভাবলেন অন্তত আমার কাছে সাহায্য চাওয়ার কোন মানে হয়না। তাঁর বাড়ীতে আর্মির লোক দেখে হয়ত আমার উপর বিশ্বাস সম্পূর্ণ হারিয়েছিলেন। যার ফলে আমার আর তাঁর কাছ থেকে ফোন পাওয়া হয়নি। অপরদিকে, আমি উন্মত্তের মত তাঁর সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম যাতে তাঁকে আসন্ন বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করতে পারি। তাঁর সাথে কথা আমি বলেছিলাম  – তবে তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে! 

প্রেসিডেন্ট অন্যান্যদের সাথে কখন কথা বলেছেন সেটা আমি জানিনা। কিন্তু এমনও হতে পারে যা হতে যাচ্ছিলো সেটা আমার আগেই তিনি জেনে গিয়েছিলেন। কারণ তিনি অন্যদের কাছে সাহায্য চাচ্ছিলেন। দুর্ভাগ্যক্রমে সকাল ৬ টার আগ পর্যন্ত তিনি বা তিনি যাদের সাথে কথা বলেছিলেন তাদের কেউই আমার সাথে যোগাযোগ করে বিষয়টা জানায়নি।  সেদিন সকালে প্রধানমন্ত্রী জনাব মনসুর আলী ছাড়া আর কারো থেকে কোন টেলিফোন কল পেয়েছি বলে মনে পড়েনা। জনাব মনসুর আলী আমাকে ট্রুপ্স পাঠাতে বলেছিলেন। আমি তাঁকে বলেছিলাম যে আমি ইতোমধ্যে ঢাকা ব্রিগেড কমান্ডারকে ট্রুপ্স পাঠিয়ে তাদের বাধা দিতে বলেছি। এই আলাপটা হয়েছিলো প্রেসিডেন্টের সাথে আমার কথা শেষ হবার পরে। 

এই সংকটময় সময়ে আমার সাথে কেউ যোগাযোগ করেনি কেন সেটা নিয়ে আমি কোন অভিযোগ করতে চাচ্ছিনা। হয়ত আমাকে জানানোর মত পর্যাপ্ত সময় কেউ পায়নি। তাছাড়া যে গ্রুপটা একশনে গিয়েছিলো তাদের সবাই আর্মির লোক। তাই হয়ত তারা ধরে নিয়েছিলো চীফের ইঙ্গিত ছাড়া এরা এতদূর আসার সাহস পাবার কথা না। তাই তারা হয়ত ধরে নিয়েছে আমার সাথে কথা বলে কোন লাভ নেই। যদি তাদের কেউ একজন আমাকে একটু জানাত যে বিদ্রোহীরা টার্গেটের দিকে আগাচ্ছে, তাহলে হয়ত আমি আরও একটু সময় পেতাম ব্যবস্থা নেবার। যখন DMI সালাউদ্দিনের কাছ থেকে আমি খবর পেয়েছি ততক্ষণে বিদ্রোহীরা আঘাত শুরু করে দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট আমাকে বিশ্বাস করতেন। কিন্তু সেদিন তিনিও আমার উপর থেকে বিশ্বাস হারালেন। কারণ যখন তাঁর বাড়ীতে আক্রমণ হল তিনি আমাকে খোঁজেননি। 

যখন আমি তাঁর সাথে কথা বলতে পেরেছিলাম এবং বলেছিলাম যেভাবে হোক ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে, সেই মুহুর্তে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে এই ঘটনার সাথে আমার কোন সংশ্লিষ্টতা নেই। যখন কথা হল তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে। এবং সম্ভবত আমিই শেষ ব্যক্তি যার সাথে তাঁর কথা হয়। একদিন সবাই আমরা মারা যাবো – কেউ আগে কেউ পরে। কিন্তু আমার সন্তুষ্টি এটাই যে মৃত্যুর পূর্বে বঙ্গবন্ধু জেনে গিয়েছেন যে জেনারেল শফিউল্লাহ তাঁর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেনি। আমি অত্যন্ত ব্যাথিত যে আমি আমার প্রেসিডেন্টকে রক্ষা করতে পারিনি। 

ডেপুটি ডিফেন্স মিনিস্টার প্রফেসর নুরুল ইসলাম তার একটি লেখায় অভিযোগ করেছেন যে আমি কোনোদিন তার কথা উল্লেখ করিনি যে সেদিন সকালে যারা আমার সাথে কথা বলেছে তাদের মধ্যে তিনিও একজন। বহু আগের ঘটনা অনেক সময় মনে না থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। তবে আলোচনা যদিও হয়েও থাকে সেটা ইচ্ছাকৃতভাবে লুকানোর মত কোন কারণ নেই। যদি সেটা একটি নিয়মিত ফোন কলের মত বিষয় হয় তাহলে মনে না থাকাটাই স্বাভাবিক। যেহেতু তিনি দাবী করেছেন যে তিনি সেদিন ফোন করেছিলেন, তাই অবশ্যই তিনি করেছিলেন। আমি জনাব মনসুর আলীর কথা ভুলিনি যেহেতু সেটা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলাম; এবং সেটা কোন রুটিন কল ছিলো না। সেদিন অনেক কিছুই ঘটেছিলো। তার বেশ কিছু আমার মাথায় স্থায়ীভাবে গেঁথে আছে। কিন্তু কিছু স্মৃতি একেবারেই মুছে গেছে। যেমন প্রফেসর নুরুল ইসলামের দাবীর বিষয়টা। দিনের প্রথম দিকে যদি তার সাথে আমার কথা হয়ে থাকে সেটা আমার স্মৃতি থেকে মুছে গেছে। নিশ্চই তিনি সব শেষ হয়ে যাবার পরে আমার সাথে কথা বলেছিলেন। যদিও তার সাথে আদৌ আমার কথা হয়েছে কিনা তা আমার মনে পড়েনা। 

নুরুল ইসলাম তার লেখায় লিখেছেন, আমার সাথে যখন তার কথা হয় আমি তাকে বলেছিলাম আধা ঘণ্টার মধ্যে বিদ্রোহীদের দমন করা হবে। তার লেখা অনুসারে, যে সময় সে উল্লেখ করেছে সে সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অলরেডি নিহত হয়েছেন। পরিস্থিতি যদি আমার নিয়ন্ত্রণে থাকতো তাহলে এই হত্যাকাণ্ড সঙ্ঘটিত হতনা। স্বাভাবিকভাবেই সেসময় টানটান পরিস্থিতি আমার নিয়ন্ত্রণে ছিলোনা। এমতাবস্থায় আমি কেমন করে তাঁকে বলি যে আধা ঘণ্টার মধ্যে আমি বিদ্রোহীদের দমন করে ফেলব? বিশেষ করে যখন আমার নিজের কমান্ডই বাধা পরে আছে। ঐদিন ওই সময়ে তাকে এধরনের আশ্বস্ত করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। প্রফেসর নুরুল ইসলাম এখন জীবিত নেই। যদি আমি তার সম্পর্কে বলি সেটা রুচিকর হবেনা। যেহেতু সে এখন নিজেকে ডিফেন্ড করতে পারবেনা তাই আমি মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকছি। 

এসম্পর্কিত বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমি এখানে আলোচনা করতে চাই। প্রফেসর নুরুল ইসলাম ছিলেন ডেপুটি ডিফেন্স মিনিস্টার। সেই হিসেবে তারও কিছু দায়িত্ব ছিলো। ১৫ আগস্ট ‘৭৫ তারিখে শুধু আমাকে একটা ফোন কল করলেই তার দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়না। ১৫ আগস্ট যা হয়েছিলো সেটি ছিলো ফোর্সের অসন্তোষের চরম বহিঃপ্রকাশ। 

ডেপুটি ডিফেন্স মিনিস্টার হিসেবে এই অসন্তোষ দূর করার মত অবস্থানে তিনি ছিলেন। কিন্তু সেটাকে দমন না করে তিনি ক্যান্সারের মত আরও ছড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি ডেপুটি চীফ মেজর জিয়ার সাথে মিলে আর্মিকে অর্গানাইজ করার প্রক্রিয়াকে শেষ পর্যায়ে এনে আটকে রেখেছিলেন। এভাবে ফোর্সে ক্ষোভ বৃদ্ধিতে কাজ করেছেন। তিনি কি সময়মত TO&E এপ্রুভ করতে কোন ব্যবস্থা নিয়েছিলেন? সেটি করলে আর্মিতে কোন অসন্তোষ থাকতোনা। আফসোস, তাকে দোষ দেবার সময়টাও পেরিয়ে গেছে। আগস্ট ‘৭৫ এর পরেই কোন ধরণের পরিবর্তন ছাড়া ডিফেন্স মিনিস্ট্রি TO&E পাশ করে। দ্বিতীয়ত, জুলাই ‘৭৫ এ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমার সামনে প্রফেসর নুরুল ইসলামকে বলেছিলেন অতি সত্বর জেনারেল জিয়াকে চাকরী থেকে সরাতে। কিন্তু কোন একশন না নিয়ে প্রফেসর নুরুল ইসলাম উল্টো বঙ্গবন্ধুকে কনভিন্স করলেন যেন জেনারেল জিয়াকে সেপ্টেম্বর ‘৭৫ পর্যন্ত সময় দেয়া হয়। (প্রফেসর নুরুল ইসলামের লেখা আর্টিকেল এই তথ্যের রেফারেন্স।) তিনি কার উদ্দেশ্য হাসিল করছিলেন? কতোটা দূরভিসন্ধিমূলক পরিকল্পনা! যদি প্রফেসর নুরুল ইসলাম আকজে জীবিত থাকতেন তবে আমি জিজ্ঞেস করতাম আপনি কেন বঙ্গবন্ধু কর্তৃক জিয়াকে সরিয়ে দেবার নির্দেশ তখন পালন করেননি? আপনি কার পারপাস সার্ভ করেছেন?

ডেপুটি ডিফেন্স মিনিস্টার প্রফেসর নুরুল ইসলাম তার লেখায় বোঝানোর চেষ্টা করেছেন যে আর্মি চীফ কে বিদ্রোহী দমনের নির্দেশ দিয়ে তিনি তার দায়িত্ব পালন করেছেন। যখন তিনি চীফের সাথে কথা বলেছিলেন তিনি জানতেন যে প্রেসিডেন্ট ততোক্ষণে মারা গিয়েছেন। (এটা তিনি তার নিজের লেখায় লিখেছেন।) এটা খুব ইন্টারেস্টিং যে বিদ্রোহীরা কাজ সেরে ফেলার পরে তিনি তাদেরকে দমন করার নির্দেশ দিচ্ছেন – তার আগে নয় কিন্তু! এটা সেই কথা সম্পর্কে বলছি যেটার কথা তিনি তার লেখায় উল্লেখ করেছেন। তিনি কি পথের কাঁটা সরে যাবার জন্য অপেক্ষা করছিলেন? যখন তিনি চীফের কাছে অভিযোগ করছিলেন পরিস্থিতি তখন একদম এলোমেলো এবং আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এটা কোন ছোট ঘটনা নয়। সাধারণ কেউ নয় – প্রেসিডেন্টকে হত্যা করা হয়েছে। পরিস্থিতি এতোই খারাপ। সেই পরিস্থিতি থেকে সবকিছু স্বাভাবিক করা সহজ নয়। 

আমি জানি আমি কীসের উপর দিয়ে যাচ্ছিলাম। আমি দুঃখিত যে এসব উল্লেখ করতে হচ্ছে। আমার আশা ছিলো যদি প্রফেসর নুরুল ইসলাম সাহেব জীবিত থাকতেন তিনি আমার এই চিন্তাকে চ্যালেঞ্জ করতেন কিনা। 

            তিনি তার লেখায় আকারে ইঙ্গিতে লিখেছেন যে যেহেতু আমরা সৈন্য আমাদেরকে মৃত্যুবরণ করার মত সাহসী হতে শেখানো হয় – কিন্তু আমরা ব্যার্থ হয়েছি। তিনি জীবিত থাকলে আমি বলতাম, “শত্রুর সাথে যুদ্ধ করে মরতে আমি ভীত নই। এধরনের সৈনিক হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের সময় শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করে আমি সে প্রমাণ দিয়েছি।” এক্ষেত্রে শত্রু কোথায়? তিনি হয়ত আমাকে আমার ট্রেনিং কথা মনে করিয়ে দিলেন। পাঠকের জন্য আমি জানাচ্ছি, আমাদের যে ট্রেনিং দেয়া হয় সেখানে শত্রুকে হত্যা করার ট্রেনিং দেয়া হয়। সেখানে আমাদেরও যে মৃত্যুর ঝুঁকি থাকে সেটা কি আমাদের শেখানো হয়না? কিন্তু এই পরিস্থিতিটি সেরকম নয়। এখানে শত্রু কোথায়? এটি তো কিছু উচ্চাভিলাষী রাজনীতিকের নিজেদের মধ্যকার যুদ্ধ। এটা ভুললে চলবে না যে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর আর্মি ক্ষমতা নেয়নি। বরং রাজনৈতিক লোকেরাই সরকার গঠন করেছে। এবং সেই সরকারে প্রফেসর নুরুল ইসলাম ছিলেন কেবিনেট মিনিস্টারদের একজন। 

            সকালে প্রেসিডেন্টের সাথে কথা বলার পরেই আমার একজন ব্যাটম্যান আমার কাছে একটা রেডিও নিয়ে আসলো এবং আমাকে ঘোষণা শুনতে বলল। মেজর শরিফুল হল ডালিমের কণ্ঠ শুনতে পেলাম। যে বলল যে সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে এবং নতুন সরকার গঠিত হয়েছে। তার কথা হজম করতে করতে জেনারেল জিয়া এসে উপস্থিত হল। সময়টা সোয়া ৬ টা থেকে ৬ টা ২০ মিনিটের মধ্যে হবে। সে ইউনিফর্মে সুসজ্জিত, ক্লিন শেভ করা, তার অফিসিয়াল গাড়িতে এসে নামলো। জেনারেল জিয়ার সাথে কথা বলতে বলতে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ এসে পৌঁছালো। সেও নিজের ব্যক্তিগত গাড়ি চেপে আসলো। সে তখনো পায়জামা পরা এবং শেভ করেনি। আমি জেনারেল জিয়া ও খালেদ মশাররফকে বললাম যে আমি কর্নেল শাফায়াৎ জামিলকে তিনটি ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটেলিয়ন নিয়ে বিদ্রোহীদের প্রতিরোধ করতে বলেছিলাম। কিন্তু আমি কোন মুভমেন্ট দেখিনি বা তার কাছ থেকে কোন ফিডব্যাক পাইনি। আমি তার সাথে কোন যোগাযোগও করতে পারছিনা। আমি তার সাথে কোনোভাবেই সংযুক্ত হতে পারলাম না। অপারেটর আমাকে জানিয়েছিল যে তার টেলিফোন হাং-আপ করা। আমি জানিনা সে কী করছে বা কী তাকে মুভ করতে বাধা দিচ্ছে। 

            ১৯৮৬ সালে একটি ইন্টারভিউতে কর্নেল শাফায়াৎ জামিল (প্রফেসর আবু সাইড লিখিত ফ্যাক্টস এন্ড ডকুমেন্টস বইয়ের ২৯৪-২৯৫ পাতা দেখুন) বলেন, ১৫ আগস্ট ‘৭৫ যখন তিনি জেনারেল জিয়ার বাসায় নির্দেশনা পাবার আশায় গেলেন, তিনি দেখলেন জিয়া শেভ করছেন। আমিও দেখলাম জিয়া আমার কাছে যখন এসেছে তখন সে ক্লিন শেভড ছিলো। একইদিন সকালে যখন আমি জেনারেল জিয়া ও ব্রিগেডিয়ার খালেদের সাথে কথা বলছিলাম এবং অভিযোগ করছিলাম যে কর্নেল শাফায়াৎ জামিল কী করছে – জিয়া তখন একেবারেই বলেনি যে শাফায়াৎ জামিল তার বাসায় গিয়েছিলো তার নির্দেশনা নেবার জন্য। এখানে হয় কর্নেল শাফায়াৎ জামিল পুরোটা সত্য বলেনি, অথবা জেনারেল জিয়া কিছু লুকোবার চেষ্টা করেছে। তার মাথায় অবশ্যই ভিন্ন কিছু ছিলো। যদি জেনারেল জিয়ার অন্য কোন ভূমিকা না থাকতো তাহলে সে কেন সেদিন আমার সাথে দেখা হবার আগে যে কর্নেল শাফায়াতের সাথে তার সাক্ষাৎ হয়েছে সেটা বললনা?   এটা খোঁজা এখন পাঠকের দায়িত্ব যে জিয়া সেদিন কী ভূমিকায় ছিল। 

            কর্নেল শাফায়েতকে অতি সত্বর সৈন্য পাঠিয়ে বিদ্রোহীদের দমন করার আদেশ দেবার পরেও আমি কোন কার্যক্রম দেখতে পাচ্ছিলাম না। আমি চিন্তায় পরে গেলাম। যেহেতু সময় গড়িয়ে যাচ্ছিলো তাই আমি অস্থির হয়ে গেলাম। বাসায় থাকার কারণে যেহেতু আমি কোন কোর্স অব একশন নিতে পারছিলাম না, আমি অফিসে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম যাতে আমি ট্রুপ্স মুভ করতে পারি। তাই আমি ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে ইউনিফর্ম পরে ৪৬ ব্রিগেড এলাকায় আসতে বললাম যাতে কর্নেল শাফায়াৎ ও তার  বাহিনীকে বিদ্রোহীদের দমনে পাঠাতে পারি। ব্রিগেডিয়ার খালেদকে পাঠিয়ে আমি ইউনিফর্ম পড়ার উদ্দেশ্যে ঘরে ঢুকলাম। আমি রেডি হতে হতে আমার ADC ক্যাপ্টেন হুমায়ূন কবির একটি গাড়িতে করে আমার বাসায় চলে আসলো। 

            যে মুহুর্তে আমি অফিসের উদ্দেশ্য বের হচ্ছিলাম সেই সময়ে আমার বাড়ির পেছনের দেয়াল টপকে আমার কাছে আসে ব্রিগেডিয়ার রউফ (তৎকালীন ডিজিএফআই)। সে লুঙ্গি ও গেঞ্জি পরা। করিডোরে দাঁড়িয়ে স্বল্প সময় আমাদের কথা হল। আমি অফিসের উদ্দেশ্যে দ্রুত বের হচ্ছিলাম কারণ আমার তাড়া ছিলো। আমাদের স্বল্প সময়ের আলোচনায় ব্রিগেডিয়ার রউফ আমাকে সাজেশন দিলেন যেন আমি জেনারেল জিয়াকে আমার সাথে না রাখি। আমি জানিনা এর দ্বারা সে আসলে কী বোঝালো। সেও আর কিছু খুলে বলল না। জেনারেল জিয়া আমার ডেপুটি। কোন কারণ না জেনে কিভাবে আমি তাকে আমার কাছে ঘেঁষা বন্ধ করাই। ব্রিগেডিয়ার রউফ সম্ভবত এমন কিছু জানে যে সম্পর্কে আমি সজাগ নই। সে জেনারেল জিয়ার থেকে আমাকে আলাদা রাখতে চাচ্ছিল। জেনারেল জিয়া আমার লিভিং রুমে বসে আছে কারণ আমরা একসাথে অফিসে যাবো। তাই আমি ব্রিগেডিয়ার রউফকে বাসায় গিয়ে পোশাক চেঞ্জ করে দ্রুত অফিসে আসতে বললাম। ব্রিগেডিয়ার রউফ আমাকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়ে আমার স্ত্রীর কাছে গেলেন এবং তাকে বোঝালেন যেন সে আমাকে অফিসে যেতে না দেয় এবং জেনারেল জিয়ার সাথে আমি না যাই। ব্রিগেডিয়ার রউফের মনে কী আছে আমি জানিনা। তবে সে সময় তার সাজেশনের প্রেক্ষিতে আমার কিছু করার ছিলো না। তাই আমি অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা করলাম এবং জেনারেল জিয়া আমার গাড়ির পেছনে আসতে লাগলো। 

            জেনারেল জিয়া আমার ডেপুটি। সেদিন সে আমার প্রতি একটু বিশেষ সৌজন্য দেখাচ্ছিল। সেদিন সকাল থেকে সে আমাকে খুব বেশী “স্যার” “স্যার” বলছিলো। ব্যক্তিগত আলোচনায় জেনারেল জিয়া আমার নাম ধরে ডাকে। এবং অফিসিয়াল ক্ষেত্রে স্যার বলে ডাকে। কিন্তু সেদিনের মত এত বেশী বেশী করে কোনোদিন বলেনি। যাই হোক, অফিসে পৌঁছেই আমি আমার ADC ক্যাপ্টেন হুমায়ূন কবিরকে বর্তমান পরিস্থিতি কী সেটা জেনে জানাতে বললাম। পাশাপাশি আমি ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের থেকে ৪৬ ব্রিগেডে এখন কী হচ্ছে সেই বিষয়েও জানার অপেক্ষায় রইলাম। যেহেতু আমি ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় কোন এক্টিভিটি বা সৈন্য সমাবেশ দেখতে পাচ্ছিলাম না আমার উদ্বেগ বেড়েই চলছিলো। ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়েত জামিল আমাকে এড়িয়ে চলছিলো। এবং সেই তখন থেকে সে কী একশন নিয়েছে সেই ব্যাপারে এখনো কোন রিপোর্ট করেনি। এমনকি সে কি করছে সেটাও জানিনা। 

            সকালে যখন আমি ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে ৪৬ ব্রিগেডে যেতে বললাম জেনারেল জিয়া তাতে কিছুটা দ্বিমত প্রকাশ করল। এবং অনেকটা জোর করছিলো যেন আমি ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে কোনোভাবেই ৪৬ ব্রিগেডে না পাঠাই। ব্রিগেডিয়ার খালেদ চলে যাবার পর, জেনারেল জিয়া এতোটাই মর্মাহত ভাব দেখাল যে অনেকটা বলেই ফেলল যে সে (খালেদ) সবকিছু নষ্ট করে ফেলবে। হয়ত জেনারেল জিয়ার নিজস্ব যুক্তি আছে যার জন্য সে মনে করে যে ব্রিগেডিয়ার খালেদকে সেখানে পাঠানো উচিৎ হবেনা। কিন্তু আমি আর অপেক্ষা করতে পারছিলাম না এবং এই অস্থিরতা বেশিক্ষণ সহ্য করা কষ্টকর। তাই জেনারেল জিয়ার বাধা সত্ত্বেও আমি ব্রিগেডিয়ার খালেদকে ৪৬ ব্রিগেড এরিয়ায় পাঠালাম। আমি ব্রিগেডিয়ার খালেদকে এটাও বললাম যে আমার নির্দেশনা যেন বাস্তবায়িত হয়। এবং যত দ্রুত সম্ভব সে যেন আমাকে লেটেস্ট পরিস্থিতি জানায়। 

            অফিসে পৌঁছে আমি ঢাকার বাইরে ফর্মেশন কমান্ডারদের সাথে যোগাযোগ করি এবং যার সাথেই কথা হয়েছে তাকেই আমি ঢাকায় যা ঘটেছে সেটা জানাই। আমি তাদেরকে প্রস্তুত থাকতে বলি এবং ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছ থেকে পরবর্তী নির্দেশনার জন্য তাদের অপেক্ষা করতে বলি। ঢাকায় কী ঘটেছে সে ব্যাপারে আমার খুব বেশী বলতে হয়নি। মনে হল তারা সবাই এব্যাপারে অবগত। সম্ভবত রেডিও মারফত তারা এসব জেনেছে। আমি প্রত্যেক কমান্ডারকে এটাও বললাম যে ঢাকায় যা ঘটেছে তা আমার সম্মতির বাইরে এবং আমার অজান্তে হয়েছে। এটা আমি বলছিলাম যাতে তাদের কোন রকম সন্দেহ না থাকে। আমি তাদেরকে আরও জানালাম যে আমি ৪৬ ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়াৎ জামিলকে এটা প্রতিরোধ করার জন্য ট্রুপ্স পাঠাতে বলেছি। যখন আমি Fmn কমান্ডারদের সাথে কথা বলছিলাম তখন জেনারেল জিয়া আমার সামনে বসা ছিলেন। তিনি তখন একদম চুপ করে ছিলেন। আমি যখন কমান্ডারদের সাথে কথা বলছিলাম সেই ফাঁকে জেনারেল জিয়া আমাকে বলল আমার উচিৎ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে কল ব্যাক করা। তার একটা অপারেশন অর্ডার তৈরি করা উচিৎ যাতে সৈন্যদের রেডি করে সীমান্তের কাছে পাঠানো যায় যেন তারা ভারত থেকে কোন আক্রমণ হলে তা প্রতিহত করা যায়।

যখন আমি ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে ৪৬ ব্রিগেডে পাঠিয়ে অধীর আগ্রহে সেনামোতায়েন সম্পর্কে তথ্য পেতে অপেক্ষা করছিলাম তখন একটা ফোন এলো। ব্রিগেডিয়ার খালেদ ফোন করেছে। আমি জানতে চাইলাম তখন পর্যন্ত কর্নেল শাফায়াৎ কী ব্যবস্থা নিয়েছে। সে আমাকে জবাব না দিয়ে বলল ৪৬ ব্রিগেড এলাকায় আসতে। যখন আমি আবারো জিজ্ঞেস করলাম তখন সে বলল তারা তাকে (খালেদকে) ফোনে এব্যাপারে বলতে বাধা দিচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম কারা তাকে (খালেদকে) বাধা দিচ্ছে। এবং কেন সে আমাকে ফোন করেছে। সে জবাব দিল তারা তাকে (খালেদকে) দিয়ে আমাকে ফোন করতে বলেছে শুধু আমাকে সেখানে যাবার জন্য। আমি জিজ্ঞেস করলাম তারা কারা? সে বলল এর বেশী তারা তাকে বলতে নিষেধ করছে। তখন আমি ব্রিগেডিয়ার খালেদকে এক্ষুনি আমার অফিসে আসতে বললাম। কিভাবে আসবে তা জানিনা। তবে এসে আমাকে কি হচ্ছে জানাতে বললাম। এটা বলার পর আমি ফোনের রিসিভার ধরে রাখলাম। ব্রিগেডিয়ার খালেদ বললেন যে তারা তাকে স্বল্প সময়ের জন্য আমার অফিসে আসতে দেবে। আমি বুঝলাম না এর দ্বারা সে কী বোঝাতে চাইল, তবে আমি তাকে আসতে বললাম। 

            যখন খালেদ মোশাররফ ৪৬ ব্রিগেড থেকে ফিরে আসছিল তখন আমার এডিসি আসলো এবং জানালো প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়েছে। তখন পর্যন্ত আমার বিশ্বাস হয়নি যে বিদ্রোহীরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে পারে। আমার এডিসি যে সংবাদ দিলো তা আমার জন্য প্রচণ্ড হতাশার। এটা খুব বেদনাদায়ক। এটা আমাকে ইমোশনাল করে ফেলল। বিষণ্ণ মুখে আমি চেয়ারে বসে থাকলাম। এমন সময় ব্রিগেডিয়ার খালেদ আসলো। তাকে খুব ক্লান্ত ও চিন্তিত মনে হল। ব্রিগেডিয়ার খালেদ যখন আসলো জেনারেল জিয়া তখন আমার সামনেই বসা ছিলো। আমি খালেদ মোশাররফের কাছে জানতে চাইলাম কর্নেল শাফায়াৎ কি সৈন্য মুভ করেছিলো? সে বলল, “না স্যার।” সে বলল মনে হচ্ছে পুরো গ্যারিসন আপনার অর্ডারের বিরুদ্ধে (অর্থাৎ চীফের বিরুদ্ধে) বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। এই একশনের পেছনে কে আছে সে ব্যাপারে তার কোন ধারণা নেই। অথবা কে গুজব ছড়িয়েছে সে ব্যাপারেও ধারণা নেই। সে আরও বলল যে একটা ধারণা তৈরি হয়েছে যে পুরো আর্মি সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। অবস্থা এমন যে এই অবস্থায় এটাকে ট্রুপ্স দিয়ে থামানো যাবেনা। 

ব্রিগেডিয়ার খালেদ রিপোর্ট করার সময় জেনারেল জিয়া আমার অফিসে। ব্রিগেডিয়ার খালেদের কথা শেষ হবার আগেই জেনারেল জিয়া বলল GCS এর এখন কোথাও যাওয়া উচিৎ নয়। তার (GCS এর) উচিৎ এখনই বসে ভারতীয় আক্রমণ ঠেকানোর জন্য “Ops Order” তৈরি করা। ফর্মেশন কমান্ডারদের কাছে অর্ডার পাঠানো উচিৎ যাতে শর্ট নোটিশে সৈন্যরা মুভ করতে পারে। আমি একমত হলাম এবং বললাম যে এই সম্ভবনা উড়িয়ে দেয়া যায়না। কিন্তু আমাদের এক্ষুনি কোন উপসংহারে যাওয়া উচিৎ নয়। পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে আরও একটু দেখা দরকার। এরপর পদক্ষেপ নেয়া যাবে। ওইসময় খুবই গুরুতর পরিস্থিতি বিরাজমান ছিলো। আমাদের প্রথম কাজ হবে উশৃঙ্খল পরিবেশ নিয়ন্ত্রণে আনা এবং তারপর সিরিয়াস কিছুতে নিযুক্ত হওয়া। তবুও ব্রিগেডিয়ার খালেদকে আমি বললাম, বর্তমান পরিস্থিতিতে একটি “Ops Order” রেডি করতে এবং এরজন্য আমার থেকে কিছু নির্দেশনা নিতে। 

যখন আমরা এসব বিষয় ও ৪৬ ব্রিগেড নিয়ে কথা বলছিলাম তখন আমি আমার হেডকোয়ার্টারের বাইরে ট্যাংকের শব্দ ও ভারী যান চলার শব্দ পাচ্ছিলাম। অল্প সময়ের মধ্যে দুটো যান এসে আমার আর্মি হেডকোয়ার্টারের সামনে থামল। একটু পরেই আমার অফিস রুমের দরজা খুলে গেল। মেজর ডালিম সজোরে দরজা খুলল এবং কিছু সৈন্য নিয়ে আমার রুমে প্রবেশ করল। তারা সংখ্যায় ১৫ থেকে ১৮ জন। এবং তারা চিৎকার করছিল “চীফ কোথায়?” আমার রুমে ঢুকে সবাই আমার দিকে বন্দুক তাক করল। আমি এই ব্যবহারে ক্ষুব্ধ হয়ে মেজর ডালিমের বন্দুকের নলের মুখে আমার তর্জনি লাগিয়ে (যেটা আমার দিকে তাক করা ছিলো) বললাম, “ডালিম এসব অস্ত্র দেখতে দেখতে আমার অভ্যাস হয়ে গেছে। যদি তুমি এসব ব্যবহার করতে এখানে এসে থাকো তাহলে এক্ষুনি করতে পারো। আর যদি তুমি কিছু নিয়ে কথা বলতে এসে থাকো তাহলে তোমার ট্রুপ্স এবং অস্ত্র রুমের বাইরে পাঠাও এবং তারপর কথা বল।”

যখন মেজর ডালিম ও তার ট্রুপ্স আমার অফিস রুমে ঢুকে আমার দিকে তাদের বন্দুক তাক করে রেখেছিলো তখন আমার সামনে টেবিলের ওইপাশে জেনারেল জিয়া ও ব্রিগেডিয়ার খালেদ আমার মুখোমুখি বসা ছিলো। কর্নেল (পরবর্তীতে লে জেনারেল) নাসিম এবং এম এস আমার বামে দাঁড়ানো ছিলো। অবাক করার বিষয় হচ্ছে, যখন এত অফিসার আমার রুমে অবস্থান করছে তখন মেজর ডালিম ও তার দলের একমাত্র টার্গেট আমিই। সৃষ্টিকর্তার অসীম কৃপায় আমি বিচলিত হইনি। তার পরিবর্তে আমি মেজর ডালিমের প্রতি কঠোর ছিলাম। 

যখন আমি মেজর ডালিমকে তার অস্ত্র ব্যবহারের আদেশ দিলাম সে তখন ধীরে ধীরে তার বন্দুক নামালো। এবং বলল, “প্রেসিডেন্ট রেডিও স্টেশনে আপনার সাথে দেখা করতে চাচ্ছে।” আমি বললাম, “তুমি কার কথা বলছ? আমি জানি প্রেসিডেন্ট মারা গেছে।” সে তখন বলল, “স্যার, এতক্ষণে আপনার জানার কথা যে খন্দকার মোশতাক এখন প্রেসিডেন্ট।” আমি মেজর ডালিমকে বললাম, “খন্দকার মোশতাক তোমার প্রেসিডেন্ট হতে পারে। আমার নয়।” এর উত্তরে সে বলল, “স্যার, আমি আপনাকে রেডিও স্টেশনে নিয়ে যেতে এখানে এসেছি। কিন্তু আপনি আমাকে সেটা জোরপূর্বক করাতে বাধ্য করছেন, যার জন্য আমি আসিনি।” আমি তাকে বললাম, “তুমি তোমার যা খুশি করতে পারো। কিন্তু আমি তোমার সাথে কোথাও যাচ্ছিনা।” আমি আরও বললাম, আমি আমার ট্রুপ্সের কাছে যাবো এবং সিদ্ধান্ত নেব এরপর কী করা যায়। 

মেজর ডালিম যখন আসলো বঙ্গবন্ধুর বেদনাদায়ক হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আমি খুবই মর্মাহত ছিলাম। রেডিওতে ঘোষণা শুনে এবং সে যেভাবে আমার অফিসে প্রবেশ করল এতে করে আমি আমার স্বাভাবিক মেজাজ হারালাম এবং তার সাথে চিৎকার করে তাকে তার অস্ত্র ব্যবহার করতে বললাম। এখন আমি বুঝি আমার চ্যালেঞ্জটা বোকার মত কাজ ছিলো। এই লোকগুলো যে কোন কিছু করবার জন্যই প্রস্তুত ছিলো। তারা বঙ্গবন্ধুকে মেরে আমার এখানে এসেছে। তারা যদি প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধুর মত মানুষকে হত্যা করার ধৃষ্টতা দেখাতে পারে সেখানে আমাকে মারতে তো তাদের কোন তাদের একটুও ভাবতে হবেনা। 

পেছনে তাকালে বুঝতে পারি, কোন শ্রদ্ধা বা ভালোবাসা থেকে মেজর ডালিম যে আমাকে মারেনি তা নয়। বরং তাদের নিজেদের অস্তিত্বের প্রয়োজনে আমাকে জীবিত প্রয়োজন ছিলো। সেদিন সকালে তারা প্রচার করে যে, সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে আর্মি চীফের নির্দেশনায়। তাই তাদের স্বার্থেই আমাকে জীবিত প্রয়োজন। সৈন্যদের কাছে তাদের অবস্থান শক্ত করতে এটা দেখানো প্রয়োজন ছিলো যে তাদের সাথে আর্মি চীফও আছে। আমাকে যদি তারা মেরে ফেলত তাহলে উদ্ভূত পরিস্থিতি কি তারা নিয়ন্ত্রণে নিতে পারতো? তাই উত্তেজিত বাকবিতণ্ডার পরেও আমাকে হত্যা না করবার এটাই সম্ভাব্য কারণ। 

মেজর ডালিমের সাথে উত্তপ্ত কথাবার্তা বলতে বলতে আমি আমার আসন থেকে উঠে দাঁড়ালাম এবং মেজর ডালিমের সৈন্যদের প্রায় ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে পথ করে নিয়ে আমি ৪৬ ব্রিগেড এলাকার দিকে রওনা করতে অফিস থেকে বের হলাম। আমি অফিস থেকে বের হবার পর তারাও আমাকে ফলো করতে লাগলো। আমার অফিস ত্যাগ করার মুহুর্তে আমার অফিসের স্টাফদের সকলের চোখে জল দেখতে পেলাম। মেজর ডালিমের ব্যবহার এবং যেভাবে সে প্রবেশ করেছে সেটা দেখে আমার স্টাফরা মনে করেছে মেজর ডালিম আমাকে মেরে ফেলার জন্য নিয়ে যাচ্ছে। তাই গাড়িতে ওঠার আগে আমি তাদেরকে স্বান্তনা দিলাম এবং ৪৬ ব্রিগেড এলাকায় রওনা দিলাম। মেজর ডালিম ও তার সৈন্যরা আমাকে ফলো করতে লাগলো। যে মুহুর্তে আমি ৪৬ ব্রিগেড এলাকায় প্রবেশ করলাম আমার মনে হল সেখানে কোন উৎসব হচ্ছে। যেন অনেক মহৎ কিছু হয়েছে। সৈন্যরা আমাকে দেখে আরও আনন্দিত হয়ে উঠলো এবং সেটা কিছুটা শোরগোল বা হৈচৈপূর্ণ। সেসব দৃশ্য দেখে তাদের সাথে কী করে কথা বলব সেটাই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। সেখানে আমি আমার মুখই খুলতে পারলাম না। এই বিদ্রোহী ট্রুপ্সরা মেজর রশিদের।  

ব্রিগেড এরিয়ায় একজন অফিসার পাহার দিয়ে আমাকে একটি কক্ষে নিয়ে গেল। ভেবেছিলাম সেখানে কর্নেল শাফায়েতকে দেখতে পাবো। কিন্তু দেখতে পেলাম না। সেখানে বি এম মেজর হাফিজ ও মেজর রশিদের সাথে আমার দেখা হল। যখন মেজর হাফিজকে আমি তার কমান্ডারের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম, সে কোন তথ্য দিতে পারলোনা। এসময় সবচেয়ে বেশী কথা বলছিল মেজর রশিদ। সকাল আমি কর্নেল শাফায়েতকে বলেছিলাম বিদ্রোহীদের দমন করতে। তা এখানে এসে যখন দেখলাম বেশিরভাগ কথা সেই (রশিদ) বলছে এবং তা মেজর রশিদের সামনেই (যে ৪৬ ব্রিগেডের বি এম) তখন ভাবতেই পারছিলাম না যে মেজর রশিদও এই উছৃংখল অভিযানের একজন চরিত্র। মেজর রশিদ যদি এই মঞ্চের নেতা হয় তাহলে মেজর হাফিজ কিভাবে একই সাথে থাকে? এরা তো একে অপরের মুখোমুখি অবস্থান নেবার কথা। এটা ভাবার কোন কারণ ছিলোনা যে মেজর রশিদ এখানে মুক্তভাবে ঘুরে বেড়াবে। ব্রিগেড এরিয়া থেকে মেজর রশিদ ও মেজর হাফিজ উভয়েই আমাকে অনুরোধ করল রেডিও স্টেশনে যাবার জন্য। 

ব্রিগেড লোকেশনে আমার অবস্থানকালীন সময়ে আমি সৈন্যদের মেজাজ বোঝার চেষ্টা করছিলাম। বোঝার চেষ্টা করছিলাম যে আমার কোন দৃষ্টিভ্রম হচ্ছে কিনা। কীভাবে তাদেরকে অন্য মতের কথা বলব? আমি তাদেরকে বলতেই পারলাম না যে সেদিন যা ঘটেছে তাতে আমার কোন ভূমিকা নেই। পরিবেশটা এমন ছিলো যে আমি মুখই খুলতে পারলাম না। সেই অবস্থায় অন্য কোন পরিকল্পনায় যাওয়া একেবারেই অসম্ভব। যেহেতু ঢাকা গ্যারিসনের সব ট্রুপ্স বিদ্রোহীদের পক্ষ নিয়েছে। অথবা ঘুরিয়ে বললে বলা যায় যে তারা সবাই বিদ্রোহী হয়ে গেছে। 

যখন মেজর রশিদ ও মেজর হাফিজ আমাকে রেডিও স্টেশনে যেতে অনুরোধ করছিলেন তখন আমি বললাম যে কোন সিদ্ধান্ত নেবার আগে আমাকে অফিসে গিয়ে আমার অন্যান্য চীফদের সাথে আলোচনা করতে হবে। সম্ভবত তারা এই কথাটা শোনার জন্য অপেক্ষা করছিলো। এবং তাই দ্রুত তারা আমাকে অন্যান্য চীফদের শরণাপন্ন করল। কথা বলার সময় তারা আমাকে বলল দ্রুত তারা ৪৬ ব্রিগেড এলাকায় এসে আমার সাথে দেখা করবে – এবং সেটা তারা দ্রুতই করেছিলো। 

যখন আমি অন্যান্য চীফদের আসার জন্য অপেক্ষা করছিলাম, তখন মনে মনে ভাবছিলাম কোন পথে একশন নেবো। ততোক্ষণে প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হয়েছেন। এই অবস্থা সামলাতে ঢাকায় আমার কাছে কোন ট্রুপ্স নেই। যদি কোনোভাবে ঢাকার বাইরে যেতে পারতাম, যেমন কাছাকাছি ধরলে কুমিল্লা, তাহলেও হয়ত কিছু ব্যবস্থা নিতে পারতাম। সেই সম্ভবনাও নেই যেহেতু মেজর ডালিম ও তার বাহিনী আমি ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে বা বাইরে যেখানেই যাচ্ছি সেখানেই পেছনে পেছনে আসছে। এটা কারো কাছে অজানা নয় যে মেজর ডালিমও একজন বিদ্রোহী অফিসার। সামরিক অভ্যুত্থানে সরাসরি অংশ নেবার পাশাপাশি সে আমাকে টানা নজরে রাখছে এবং ৪৬ ব্রিগেড ও হেডকোয়ার্টার এলাকায় মুক্তভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিদ্রোহী সেনারা ততোক্ষণে খন্দকার মোশতাককে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা দিয়েছে। সকাল থেকে জেনারেল জিয়া আমার প্রতি খুব সন্মান দেখাচ্ছে। এবং ব্রিগেডিয়ার খালেদ আমার থেকে একটু দূরত্ব বজায় রাখছে। সৃষ্টিকর্তাই জানেন তাদের মনে কী ছিলো। যেকোন কারণেই হোক, ব্রিগেডিয়ার খালেদ ছাড়া কাউকে আমার বিশ্বাস হচ্ছিলোনা। সেসময় আমার মনে হচ্ছিলো আমি একজন একা মানুষ। এক, যাই আসুক, টিকে থাকতে হবে অথবা ধ্বংস হয়ে যেতে হবে। যুদ্ধ করতে হবে যত কম সংখ্যক সৈন্য নিয়েই হোক না কেন। দুই, পরিস্থিতি যা আছে তা মেনে নিতে হবে। আমি এই দুইটি পথের কোন পথ বেছে নেব সেটা ভাবছিলাম। এবং সেগুলোর ভালো-মন্দ চিন্তা করছিলাম। প্রথম পথের ক্ষেত্রে, আমার যে সৈন্য দরকার ঢাকায় তা নেই। কারণ হচ্ছে বিদ্রোহীরা (আর্মার্ড ও আর্টিলারি) অসমর্থিত সৈন্যদের কৌশলে সাথে রেখেছে। ফলে তারা বিদ্রোহীদের প্রতি সহমর্মীতা দেখিয়েছে। ফলে তারা আর আমার জন্য নেই। 

এই কাজের জন্য সবচেয়ে কাছের ক্যান্টনমেন্ট হচ্ছে কুমিল্লা। কিন্তু সেখানে পৌঁছান অতিদূর। যদি আমি কুমিল্লায় যেতে পারতাম তাহলে হয়ত একটা শো-ডাউন বা কাম-ব্যাক সম্ভব। এই শো-ডাউনটা অনেক ভয়ংকর হবে – যেহেতু আর্মি ফোর্স নিজেরাই নিজেদের বিদ্রোহীদের মুখোমুখি হবে। ফল হবে অপরিনাম রক্তপাত এবং এর ফলে পুরো দেশে গৃহযুদ্ধ লেগে যাবার মত অবস্থা তৈরি হবে। এই অবস্থায় এরকমও হতে পারে যে আর্মিতে প্রতিপক্ষ গ্রুপ রয়েছে। অবশ্যই আর্মিতে অসন্তোষ রয়েছে কিন্তু কে কার পক্ষ নেবে সেটা বলা মুশকিল। সেই প্রমাণ ৪৬ ব্রিগেড এলাকাতেই দেখতে পাচ্ছি। 

এই অবস্থায় রক্তারক্তির পরিমাণ যতোই হোক না কেন বঙ্গবন্ধুকে ফিরিয়ে আনা যাবেনা। দ্বিতীয় পথের ক্ষেত্রে, আমি রক্তারক্তি এড়াতে পারি। সম্ভ্যাব্য গৃহযুদ্ধ এড়াতে পারি। এবং সর্বপরি আর্মিতে বিভক্তি ঠেকাতে পারি। দ্বিতীয় পথে সম্ভবত আমি আমার অথোরিটি পুনস্থাপন করতে পারবো এবং একটা চ্যানেল অব কমান্ড তৈরি করতে পারবো। একটা পজিশন হয়ে গেলে উশৃঙ্খলদের মাঝে শৃঙ্খলা অনেকটা ফিরিয়ে আনতে পারবো। যাই করিনা কেন যে উদ্দেশ্যে আমি যুদ্ধ করেছি সেটায় হেরে গেছি; প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হয়েছেন। যদি তিনি জীবিত থাকতেন তাহলে হয়ত ঝুঁকি নিলে বা যুদ্ধ করলে কিছু ফল হতে পারতো। যেহেতু তিনি বেঁচে নেই, এই মুহুর্তে বিদ্রোহী দমন করতে গিয়ে দেশকে গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিয়ে ভালো কিছু হবেনা। এই বিষয়গুলো দ্বিতীয় পথ বেছে নিতে আমাকে অনেকটা প্রভাবিত করে। 

যখন আমি মনে মনে এসব ভাবছিলাম ততোক্ষণে অন্যান্য চীফরা এসে পড়লেন। আমরা ৪৬ ব্রিগেড লোকেশনে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করলাম। এবং অল্প কিছুক্ষণ পরেই আমাদের রেডিও স্টেশনে নিয়ে যাওয়া হল। সেখানে পৌঁছানোর পর আমাদের যে রুমে নিয়ে যাওয়া হল সেখানে খন্দকার মোশতাক আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। প্রথমবারের মত আমি সেখানে গিয়েছিলাম। রুমে প্রবেশ করতেই দেখলাম খন্দকার মোশতাক একটি সাদা ন্যাশনাল ড্রেস পরে আছে এবং একটি টেবিলের উপর রাখা একটি রেকর্ডারসহ মাইক্রোফোনের সামনে বসে আছে। তার বাম পাশে আছে তাহেরউদ্দিন ঠাকুর। সে পড়েছে সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবী এবং সে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখার সাথে সাথে খন্দকার মোশতাক বলল, “কনগ্রাচুলেশন শফিউল্লাহ, তোমার সৈন্যরা অভুতপূর্ব কাজ করেছে। এখন যাও বাকি কাজটা শেষ কর।” যখন আমি জিজ্ঞেস করলাম বাকি কাজটা কী, তখন সে জবাব দিলো, “তোমার ভালো জানার কথা।” আমি তখন তাকে বললাম, “তাহলে সেটা আমার উপর ছেড়ে দিন।” সেটা বলেই আমি রুম থেকে বেরিয়ে আসতে লাগলাম। 

যে মুহুর্তে আমি বেরিয়ে আসার জন্য পা বাড়িয়েছি, জনাব তাহেরউদ্দিন ঠাকুর খন্দকার মোশতাককে বলল আমাকে থামাতে – যাতে আমি রেডিও স্টেশন ছেড়ে চলে না যাই। বাইরে আমাদের পথ রুদ্ধ করে মেজর ডালিম ও তার ট্রুপ্স দাঁড়িয়ে ছিলো। তারা আমাদের থামাল। নতুন সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের জন্য রেডিও স্টেশনের একটি কক্ষে আমাদের পাহারা দিয়ে নিয়ে যাওয়া হল। রেডিও ও টেলিভিশনে সম্প্রচারের জন্য একটি ঘোষণার প্রয়োজন। আমরা যখন অপেক্ষা করছিলাম, জনাব তাহেরউদ্দিন ঠাকুর তখন তাড়াহুড়া করে একটা স্ক্রিপ্ট প্রস্তুত করল যাতে বর্তমান সরকারের প্রতি আমাদের আনুগত্য উল্লেখিত আছে। আমাদের সেটা পড়তে বলা হল এবং রেকর্ড করে পরবর্তীতে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সম্প্রচার করা হল। 

এটা করা হল নতুন সরকারের অবস্থান দৃঢ় করার জন্য। আনুগত্য প্রকাশের পেছনে যে বিষয়গুলো আমার মাথায় কাজ করেছে সে বিষয়ে উপরের পাতাগুলোয় আমি উল্লেখ করেছি। রেকর্ডিং এর পর খন্দকার মোশতাক জুম্মার নামাজের পর অনুষ্ঠিতব্য শপথ অনুষ্ঠানে আমাদের সকল চীফদের উপস্থিত থাকতে বললেন। এরপর যেহেতু সেখানে আমার আর প্রয়োজন নাই তাই আমি রেডিও স্টেশন থেকে আমার অফিসে ফিরে আসলাম। ফেরার পথে মেজর ডালিম ও তার ট্রুপ্স আমাকে আবারো ফলো করতে থাকলো। 

অফিসে এসেই আমি দ্রুত কনফারেন্স রুমে আমার ব্রিফিং এর জন্য অফিসারদের একত্র করলাম। আমাকে দেখাতে হবে যে আমি এখনো কমান্ডে আছি। তাই আমার সংক্ষিপ্ত ব্রিফিং এ আমি বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে তাদের অবহিত করলাম। আমি তাদের বললাম যে ঘটনা যা ঘটেছে তাতে ইতোমধ্যে অনেক দেরী হয়ে গেছে এবং বিদ্রোহী সেনারা তাদের লক্ষ্য অর্জন করেছে। যখন আমি ঘটনা সম্পর্কে জানতে পেরেছিলাম তখনই আমি ঢাকা ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়াৎ জামিলকে সেনা পাঠিয়ে এই একশনকে প্রতিহত করতে  আদেশ করেছিলাম। বিদ্রূপাত্মক হলেও সত্য যে কর্নেল শাফায়াৎ আমার অর্ডারের প্রেক্ষিতে কোন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দেখায়নি – কারণ হয়ত শুধু তার নিজেরই জানা। এটা সত্য যে ঘটনাটা প্রতিহত করতে যে সময়ের দরকার ছিলো সম্ভবত সে তা পায়নি। কিন্তু এটাও সত্য যে সে একাবারেই কোন ধরণের প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। প্রতিক্রিয়া দেখাক বা না দেখাক, আমি কী করে বলি যে সে যথেষ্ট সময় পায়নি? সত্যটা হচ্ছে, সে তার সৈন্যদের মুভ করতেই বলেনি। যদি সে তার সৈন্যদের মুভ করাতো তাহলে অন্তত বিদ্রোহী সেনাদের ক্যান্টনমেন্টে ঢোকা বা বের হওয়ায় বাধা দেয়া যেত। 

যদি সে তার ট্রুপ্সকে ক্যান্টনমেন্টে কারো ঢোকা বা বের হওয়ায় বাধা দিতে আদেশ দিত, বিশেষ করে ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটেলিয়নকে, যারা তখনো অসমর্থিত অবস্থানে ছিলো, তাহলে হয়ত ঘটনা অন্যরকম হত। মেজর ডালিম ও মেজর রশিদ এত সহজে ক্যান্টনমেন্টে ঢুকতে বা বের হতে পারতোনা। ক্যান্টনমেন্টে তাদের বিনা বাঁধায় চলাচল দেখে সাধারণ সৈন্যরা ধারণা করেছে যা তারা যাই করছে সেটার অনুমোদন রয়েছে। অভ্যুত্থানের পেছনে যে আর্মি জড়িত সেই ধারণাটা বিশ্বাসযোগ্য হবার এটা অন্যতম কারণ। ফলে বিদ্রোহীরা ক্যান্টনমেন্টে অবাধে প্রবেশ করতে পেরেছে , এমনকি কোন বাঁধাবিঘ্ন ছাড়াই আমার অফিসে প্রবেশ করতে পেরেছে। 

আমি অফিসারদের বললাম, আমি এই ঘটনা ঠেকাতে পারতাম না, আরও বেশী রক্তপাতের ফলে মূলত কোন ফল পাওয়া যেতনা। তাই আমাদের নিয়ন্ত্রণ হারানোর আগে এবং এতদিন আমরা যা সাজিয়েছি তা যাতে নষ্ট হয়ে না যায় সেজন্য এখন চ্যানেল অব কমান্ড পুনস্থাপন করতে হবে এবং আর্মিতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। এই অবস্থা আর আমি চলতে দিতে পারিনা। আমাকে আমার কাজের ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে। আমার প্রধান লক্ষ্য ঐসব বিদ্রোহী সৈন্যদের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাভঙ্গের বিচার শুরু আগে তাদের ব্যারাকে ফেরত পাঠানো। আমার ধারণায় ভুল হতে পারে, তবে সেদিন অফিসারদের সাথে আলোচনায় আমার মনে হয়েছে কিছু কিছু অফিসার যা ঘটেছে সেটাকে অপছন্দ করেনা, শুধুমাত্র খুনের বিষয়টা ছাড়া। আমার সংক্ষিপ্ত বক্তব্যের পর আমি খন্দকার মোশতাকের শপথ অনুষ্ঠানে উপস্থিত হবার জন্য বঙ্গভবনের দিকে রওনা হলাম। মেজর ডালিম ও তার ট্রুপ্স বঙ্গভবন পর্যন্ত আমাকে ফলো করল। 

সকাল থেকে বিদ্রোহী সেনারা নির্বিঘ্নে ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে ঘোরাফেরা করছিলো। কর্নেল শাফায়াৎ যদি আন্তরিক হতেন তাহলে এটা কি সম্ভব হত? আর্মিতে কি কোন দ্বিতীয় কমান্ড চলছে? যদি তাই হয় তবে কার কমান্ডে কর্নেল শাফায়াৎ চলছে? যদি সে আমার কমান্ডে চলত তাহলে অন্তত ক্যান্টনমেন্ট তার নিয়ন্ত্রণে থাকার কথা। সেদিন বিদ্রোহীদের থেকে ক্যান্টনমেন্ট রক্ষার কী করা হয়েছে? তার নিজের এবং আমার হেড কোয়ার্টার ছিলো সম্পূর্ন অরক্ষিত। এবং সহজেই বিদ্রোহীরা সব নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। এমনকি তার বি এম মেজর হাফিজকে বিদ্রোহী অফিসার মেজর রশিদের সাথে একত্রে কাজ করতে দেখলাম। যদি আমার আদেশমত কর্নেল শাফায়াৎ সৈন্য মুভ করাতো তাহলে মেজর ডালিম ও মেজর রশিদ ক্যান্টনমেন্টে ঢোকার সাহস পেতোনা। আমার অর্ডার পালন না করে সে নির্দেশনা নিতে ডেপুটি চীফ জেনারেল জিয়ার কাছে গিয়েছে। সে (জিয়া) তাকে শুধু বলেছে সতর্ক থাকতে। এটা শাফায়াতের নিজের দেয়া বক্তব্য। এই অর্ডারে কী বোঝায়? (জিয়া কর্তৃক ‘সতর্ক থাকতে বলার অর্ডার’)। এর মানে হচ্ছে প্রস্তুত থাকো এবং চুপচাপ থাকো, আর কিছু নয়। এভাবে শুধু সতর্ক থেকে বা নিষ্ক্রিয় থেকে সে কী ফল পেয়েছে? ক্যান্টনমেন্টকে অরক্ষিত পেয়ে বিদ্রোহী সেনারা শুধু ক্যান্টনমেন্টে প্রবেশই করেনি, বরং তারা আমাকে জোর করে রেডিও স্টেশনে নিয়ে গেছে – তাও আবার কর্নেল শাফায়াতের ব্রিগেড এরিয়া থেকেই। যখন মেজর ডালিম আমাকে (চীফকে) ক্যান্টনমেন্ট এলাকা থেকে জোর করে রেডিও স্টেশনের দিকে পাহারা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো তখন কর্নেল শাফায়াৎ জামিল তাদেরকে প্রতিরোধ করতে কোন রকম চেষ্টাই করেনি। এমতাবস্থায় কী করে আমি তাকে বিশ্বাস করি? 

বঙ্গভবনের হল রুমে খন্দকার মোশতাকের শপথ অনুষ্ঠানের আগে ভারপ্রাপ্ত MS (P) লে কর্নেল (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল) আমিন আহমেদ চৌধুরী আমাকে বললেন যে, জেনারেল ওসমানী আমার সাথে কথা বলতে চায়। আমি ফোন ধরার সাথে সাথে জেনারেল ওসমানী আমাকে অভিনন্দন জ্ঞ্যাপন করলেন। তিনি আমার কাজে সন্তুষ্টিজ্ঞ্যাপন করলেন এবং সাহস হারাতে নিষেধ করলেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারায় তিনি আমাকে প্রশংসা করলেন। আমি তার প্রশংসায় বিব্রতবোধ করলাম। কারণ সেই পরিস্থিতিতে আমি কারো প্রশংসা আশা করিনি, অন্ততপক্ষে জেনারেল ওসমানীর থেকে। যখন তিনি আমাকে এত প্রশংসা করছিলেন, আমি ভাবলাম তিনি হয়ত উপহাস করছেন। তাই আমি জিজ্ঞেস করলাম, স্যার, আমি কি এই প্রশংসার যোগ্য?” তিনি বললেন, “ওল্ড বয়, তুমি কি জানোনা তুমি দেশকে কী ভয়ানক বিপর্যয় থেকে রক্ষা করেছ।” আমি জেনারেল ওসমানীর রহস্যময় মন্তব্য বুঝতে পারলাম না, তবে আমি চুপ থাকলাম। 

আমি এখনো পর্যন্ত জানিনা যে সেদিন জেনারেল ওসমানী কেন সমাদর করলেন অথবা তিনি অন্য কিছু বুঝিয়েছিলেন কিনা। আমি এও জানতাম যে, বঙ্গবন্ধুর সাথে তার অনেক বিষয়ে দ্বিমত থাকলেও তাঁকে (বঙ্গবন্ধুকে) তিনি অনেক শ্রদ্ধা করতেন। তিনি বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকতে তাঁর বিরুদ্ধে কিছু করেছেন কিনা বা কোন অসন্মান দেখিয়েছেন কিনা আমি নিশ্চিত নই। তার (ওসমানীর) এই প্রশংসা যে আসল নয় সেটি যদি আমি বলি, তাহলে হয়ত অন্যায় করা হবে।  তাই ভালোটা ধরে নিলে বলাই যায় যে তিনি যা বলেছেন সেটাই বুঝিয়েছেন। সেই খারাপ সময়ে একজন সিনিয়র হিসেবে জেনারেল ওসমানী কর্তৃক আমাকে আশ্বস্ত করাটা হয়ত আমাকে উৎসাহিত করেছে। সৈন্যদের মধ্যে রক্তারক্তি ঘটানোর মত সম্ভবনাগুলো প্রতিহত করতে পেরেছি বলে তিনি হয়ত আমাকে অভিনন্দিত করেছেন। পরিস্থিতি যে উচ্চতায় গিয়েছিলো তাতে গৃহযুদ্ধ বাধার সমূহ সম্ভবনা ছিলো। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যার পরেই এত দ্রুত (২৪ আগস্ট ‘৭৫) তিনি খন্দকার মোশতাকের ডিফেন্স এডভাইজার হিসেবে যোগ দেয়ায় আমি বিরক্ত হয়েছি। তিনি কেন এত দ্রুত খন্দকার মোশতাকের সাথে যোগ দিলেন? এখানে তাঁর বাধ্যবাধকতা কী ছিলো? 

সুপ্রিম কোর্টের ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি এবি মাহমুদ হোসেইন বঙ্গভবনে খন্দকার মোশতাককে শপথবাক্য পাঠ করান। সেসময় প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম দেশের বাইরে ছিলেন। খন্দকার মোশতাক যখন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিচ্ছিলেন তখন তার প্রতিনিধি মেজর রশিদ, মেজর ডালিম, মেজর ফারুক, মেজর শাহরিয়ার এবং তাদের কোম্পানি বঙ্গবন্ধুর কেবিনেটের বিভিন্ন মন্ত্রীদের নিয়ে আসলো। বিকেলে কেবিনেটের শপথ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হল। 

খন্দকার মোশতাক প্রেসিডেন্ট হিসেবে অফিসে বসেই দুটো গুরুত্বপুর্ণ সিদ্ধান্ত নিলেন। প্রথম, প্রেসিডেন্টের প্রিন্সিপ্যাল সেক্রেটারি হিসেবে মাহবুবউল আলম চাষীকে নিয়োগ দিলেন। এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে, রেড ক্রসের (নতুন রেড ক্রিসেন্ট) চেয়ারম্যান জনাব গাজি গোলাম মোস্তফাকে বরখাস্ত করলেন। একই দিনে গাজি গোলাম মোস্তফার স্থলে জাস্টিস এবি সিদ্দিকিকে রেড ক্রসের চীফ হিসেবে নিয়োগ দিলেন। প্রথম দিনেই খন্দকার মোশতাক জনাব মাহবুব উল আলম চাষীকে প্রিন্সিপ্যাল সেক্রেটারি হিসেবে নিয়োগ দেয়ায় এটা প্রমাণিত হল যে সেও (মাহবুব উল আলম চাষী) জনাব তাহের উদ্দিন ঠাকুরের মত বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত। জনাব মাহবুব উল আলম চাষী এর সাথে গভীরভাবে জড়িত। তবে তার (খন্দকার মোশতাকের) দ্বিতীয় সিদ্ধান্ত, অর্থাৎ গাজি গোলাম মোস্তফাকে রেড ক্রসের চেয়ারম্যানশিপ থেকে সরানোর সিদ্ধান্তটা সঠিক হয়েছে। 

জেনারেল ওসমানীর সাথে টেলিফোন আলাপ সেরে যখন আমি হল রুমে গেলাম তখন দেখলাম সেখানে কর্নেল (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল) এম এ মঞ্জুরও উপস্থিত। সেদিন তাকে বঙ্গভবনে দেখে আমি অবাক হলাম। সে দিল্লী মিশনে আমাদের মিলিটারি এডভাইজার ছিলো। সেদিন আমি তাকে ঢাকায় আশা করিনি। জিজ্ঞেস করায় সে জানালো সে কিছুক্ষণ আগে ঢাকা এসেছে। আমি যখন আরও জিজ্ঞেস করলাম যে কে তাকে আসতে বলেছে এবং কিভাবে এসেছে, তখন সে জবাব দিল সংবাদ শুনে যে সড়কপথে এসেছে। আমি জানিনা এত স্বল্প সময়ে দিল্লি থেকে ঢাকা পৌঁছানো কারো পক্ষে সম্ভব কিনা। কারণ ইতোমধ্যে ঢাকার অভ্যন্তরীণ সকল ট্র্যাফিকও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে কেন তাকে আসতে হল? যে কি জানতো ঢাকায় কী হচ্ছে বা হতে যাচ্ছে? এত তাড়াতাড়ি সে কীভাবে আসলো? 

কর্নেল (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল) মঞ্জুরকে “অপারেশন সিলভার লাইনিং” চলাকালীন সময় যশোর গ্যারিসন থেকে বদলি করার প্রয়োজন হয়েছিলো। তাকে কিছুদিন নজরের বাইরে রাখার চেষ্টা করতে হয়েছিল। তাই তাকে নয়াদিল্লীর মিশনে মিলিটারি এডভাইজার হিসেবে পাঠানো হয়। কিন্তু সে এটাকে অপমান হিসেবে দেখে। এই পোস্টিং এর জন্য সে আমাকে এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কখনোই ক্ষমা করেনি। তাই সেদিন বঙ্গভবনে কর্নেল (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল) মঞ্জুরের উপস্থিতি কোন রুটিন বা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে সে কি নিজ থেকেই সেখানে এসেছে? যদি তাই হয় তাহলে কেন? আর যদি তা না হয় তাহলে কে তাকে আসতে বলেছে? 

কর্নেল মঞ্জুরের সাথে কথা শেষ করার পর মেজর ফারুক আমার কাছে আসলো এবং জানালো যে ভারতীয় সৈন্য সীমান্তে জড়ো হচ্ছে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম এটা সে কিভাবে জানতে পেরেছে? সে বলল তার সংবাদসূত্র অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য। এই অবস্থায় মেজর ফারুকের উদ্বেগের সাথে আমার জেনারেল জিয়ার মন্তব্যের কথা মনে পড়ল। সকালে জেনারেল জিয়া একই রকম উদ্বেগ জানিয়েছে। সকালে যখন আমি ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে ৪৬ ব্রিগেড এরিয়ায় গিয়ে কর্নেল শাফায়াৎকে দেয়া আদেশ বাস্তবায়ন করতে বলেছিলাম তখন কেন জেনারেল জিয়া ব্রিগেডিয়ার খালেদকে সেখানে পাঠাতে বাধা দিচ্ছিল? এমন তো নয় যে ব্রিগেডিয়ার খালেদ আমার নির্দেশনা বাস্তবায়নে অযোগ্য। তাহলে কেন সে (জেনারেল জিয়া) উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল? এই ঘটনায় কি তার (জেনারেল জিয়া) কোন হাত আছে? ঘটনার শুরু থেকেই কেন জেনারেল জিয়া ব্রিগেডিয়ার খালেদকে দিয়ে “Ops Order” প্রস্তুত করতে বলছে? এমন কি হতে পারে যে জেনারেল জিয়া চাচ্ছিলেন ব্রিগেডিয়ার খালেদকে অফিসে ব্যস্ত রাখতে, যাতে করে সে (জিয়া) কী করে বেড়াচ্ছে সে ব্যাপারে কোন ক্লু ব্রিগেডিয়ার খালেদ না পায়? 

আমি যখন অন্যান্য কমান্ডারদের নির্দেশনা দিচ্ছিলাম তখন জেনারেল জিয়া আমার পাশে বসা ছিলো। সে অবশ্যই সেসময় ভাবছিলো যদি আমি এই গ্রুপটাকে বাইরের ফর্মেশন দিয়ে প্রতিহত করতে যাই, সেটা কিভাবে থামানো যায়। তাই তথাকথিত ভারতীয় সৈন্যদের বিষয়টা তার কল্পনাপ্রসূত এবং সেই অবস্থায় অনেকটা বিশ্বাসযোগ্যও বটে। তাই সে চেষ্টা করছিলো একটা গল্প ফাঁদতে যাতে করে আমার মনোযোগ বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড থেকে অন্যদিকে অর্থাৎ ইন্ডিয়ান অফেন্সিভের দিকে ধাবিত হয়। তাই যখন আমি কনফারেন্সে উপস্থিত হলাম, তখন আমার চারপাশে এসব ষড়যন্ত্র চলছিলো। 

যাই হোক, মেজর ফারুক যখন আমাকে ভারতীয় সৈন্যদের সীমান্তে জড়ো হওয়া নিয়ে বলছিলো, তখন আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে সে আমার দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরাতে চেষ্টা করছে। সকালে জেনারেল জিয়া একই রকম উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলো। তবুও মেজর ফারুক তার সোর্স এবং উদ্বেগ সম্পর্কে আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করে যাচ্ছিলো। আমি তাকে বললাম খবরটা CGS কে দিতে যাতে সে “Ops Order” এর প্রস্তুতি নিতে পারে। এরপর আমি কনফারেন্সের জন্য প্রেসিডেন্ট অফিসে প্রবেশ করলাম। ঢুকেই দেখলাম খন্দকার মোশতাক আর কর্নেল মঞ্জুর গভীর শলাপরামর্শ করছে। আমার আর সন্দেহ রইল না যে কার সাথে কর্নেল মঞ্জুর যোগাযোগ রেখেছে। আমি তার চীফ ছিলাম। যদি তার কিছু বলার থাকে তাহলে সেটা সবার আগে আমাকে বলার কথা। তাছাড়া, খন্দকার মোশতাক প্রেসিডেন্ট হয়েছেন কয়েক ঘণ্টা মাত্র। আগে থেকে কোন উদ্দেশ্য না থাকলে এত স্বপ সময়ে যোগাযোগ করবার কোন কারণই নেই। 

খন্দকার মোশতাক ও কর্নেল (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল) মঞ্জুরের গভীর আলোচনায় মগ্ন থাকতে দেখে আমার হঠাৎ পুরনো দিনের কিছু দৃশ্য মনে পরে গেল। কর্নেল মঞ্জুর আগে থেকে না জেনে থাকলে এত দ্রুত ঢাকা আসতে পারার কথা নয়। সকাল থেকে জেনারেল জিয়াও আমার সাথে একটু বেশী সৌজন্যতা দেখাচ্ছে। সকালে যখন আমি তাকে (জেনারেল জিয়া) ও ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে আমার বাসায় আসতে বলেছিলাম তখন দুজনেই ১৫ থেকে ২০ মিনিটের মধ্যে এসে পৌঁছেছিলো। জেনারেল জিয়া ইউনিফর্ম পরে এসেছিল, শেভ করা ছিলো এবং তার অফিসিয়াল গাড়িতে ড্রাইভার তাকে নিয়ে এসেছিলো। অন্যদিকে ব্রিগেডিয়ার খালেদ এসেছিলো পায়জামা পরা অবস্থায়, শেভ করা ছিলো না এবং নিজেই নিজের গাড়ি চালিয়ে এসেছিলো। তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন এসে যায়, একই সময়ের মধ্যে জেনারেল জিয়া এসব সেরে আসতে পারলে ব্রিগেডিয়ার খালেদ কেন পারল না? এত স্বল্প সময়ের মধ্যে সে (জিয়া) কিভাবে নিজের গাড়ি ডাকা, ওয়াস নেয়া, শেভ করা, এবং ইউনিফর্ম পরে আসলো যদি না আগে থেকেই সে প্রস্তুত থাকে ও তার জন্য গাড়ি ডেকে আনা থাকে? যদি তাই হয়, তাহলে এত সকালে সে কেন রেডি হচ্ছিলো? সে কি কারো কলের জন্য অপেক্ষা করছিলো? যদি তাই হয়, তবে কার ফোনের জন্য সে অপেক্ষা করছিলো?

বঙ্গবন্ধু আমাকে আদেশ করেছিলেন যশোর গ্যারিসন থেকে কর্নেল মঞ্জুরকে সরাতে। কর্নেল মঞ্জুর নিজেও এটা জানতেন। জেনারেল জিয়া আমাকে সরানোর জন্য এবং তাকে চীফ বানানোর জন্য বঙ্গবন্ধুকে জ্বালাতন করছিল। কিন্তু তার বদলে প্রেসিডেন্ট তাকে বলেছিল পদত্যাগ করতে। কাজেই জেনারেল জিয়া ও কর্নেল মঞ্জুরের বঙ্গবন্ধুর প্রতি কোন ভালোবাসা ছিলোনা। তাদের দুজনই ছিলো উচ্চাভিলাষী। তাই তাদের দুজনের লক্ষ্য একই ছিলো। এবং এর ফলেই তারা হাত মেলায়। তাদের কাছে প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যু কোন উদ্বেগের বিষয় নয়। বস্তুত, তাঁর (বঙ্গবন্ধুর) মৃত্যু তাদের পথের কাঁটা সরিয়ে দিয়েছে। 

খন্দকার মোশতাকের শপথ অনুষ্ঠান শেষ হবার পরপর GCS ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ আমাকে জানায় যে সাভারের JRB হেডকোয়ার্টারে একটি বড় ঘটনা ঘটেছে। সংক্ষেপে যা বলল তা হচ্ছে প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার খবরে একজন রক্ষী (রক্ষীবাহিনীর সৈন্য) আত্মহত্যা করেছে। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে সেখানে টানটান উত্তেজনা বিরাজ করছে। এটা খুব গুরুতর একটি সমস্যা হিসেবে দাঁড়াতে যাচ্ছে। তাই এটি অত্যন্ত দ্রুত এবং নমনীয়তার সাথে সমাধা করতে হবে। পরে আমি জানতে পেরেছিলাম যে, খন্দকার মোশতাকের উপদেষ্টারা (মেজর রশিদ, মেজর ফারুক ও মেজর ডালিম ইত্যাদি) তাকে বলেছে যে একমাত্র জেনারেল শফিউল্লাহ এই পরিস্থিতি শান্ত করতে পারবে। তাই শপথ গ্রহণের পর খন্দকার মোশতাক আমাকে সাভার গিয়ে রক্ষীদের সাথে কথা বলতে বললেন। 

সাভার গিয়ে রক্ষীদের সাথে কথা বলা ছাড়া আমার আর কোন অপশন রইল না। সেদিন বিডিআর এর ডিজি ব্রিগেডিয়ার (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল) খলিলুর রহমানও আমার সাথে সাভার গিয়েছিলেন। সাভার রক্ষীবাহিনীর সদরদপ্তরের পরিস্থিতি খুবই উত্তেজনাকর ছিলো। সেখানে পৌঁছানোর পর রক্ষীবাহিনীর দুই ডেপুটি ডিরেক্টর জনাব আনোয়ারুল আলম (শহীদ) এবং জনাব সারোয়ার মোল্লা আমাদের রিসিভ করে। সামরিক অভ্যুত্থান হঠাৎ করে হওয়ায় রক্ষীরা স্তব্ধ গিয়েছে। তাদেরকে বিভ্রান্ত ও বিষণ্ণ মনে হচ্ছিলো। তারা বুঝতে পারছিলো না কী করবে। ওইধরনের উত্তেজনাকর পরিবেশ এবং বঙ্গবন্ধুর নিহত হবার করুণতম সংবাদের আতিশয্যে রক্ষীদের একজন নিজের অস্ত্র দিয়ে নিজের মাথায় গুলি করে আত্মহত্যা করে। এই ছেলেগুলোর মানসিক প্রেরণা এত শক্তিশালী ছিলো যে সেই মুহুর্তে নিজের জীবন নিয়ে নেওয়া ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারেনি। তাই সে নিজেকে গুলি করে আত্মহত্যা করে। 

রক্ষীবাহিনীর হেডকোয়ার্টারে তাদের অফিসারদের বক্তব্যের পর আমি এবং ব্রিগেডিয়ার (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল) খলিলুর রহমান প্যারেড গ্রাউন্ডে তাদের সামনে বক্তব্য দিলাম এবং তাদেরকে শান্ত থাকতে বললাম। সম্ভবত এতে কাজ হয়েছিলো। তারপর আবার আমরা গাড়িতে করে বঙ্গভবনে খন্দকার মোশতাকের শপথ অনুষ্ঠানে ফিরে এলাম। সাভার থেকে বঙ্গভবনে ফেরার পথে জানতে পারলাম বঙ্গবন্ধুর পুরো কেবিনেট থেকে পার্টির চার জন সিনিয়র মন্ত্রী/ সদস্যকে খন্দকার মোশতাক নিজের পজিশন পোক্ত করার জন্য আলাদা করেছেন এবং এরেস্ট করিয়েছেন। তারা হলেন জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম, জনাব তাজউদ্দীন আহমেদ, জনাব মনসুর আলী এবং জনাব কামরুজ্জামান। এই চারজনের সবাই পার্টির র‍্যাংকিং এ খন্দকার মোশতাকের উপরে ছিলো। বাকি সবাইকে খন্দকার মোশতাকের কেবিনেটে যোগদান করতে বলা হল। এই চারজন সিনিয়র মন্ত্রী এবং জনাব আব্দুস সামাদ আজাদকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রটেক্টিভ কাস্টডিতে রাখা হল। আব্দুস সামাদ আজাদ খন্দকার মোশতাকের চেয়ে জুনিয়র হলেও তার ভিক্টিম হবার কারণটা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের সময় খন্দকার মোশতাককে সরিয়ে তাকে ফরেন মিনিস্টার করা হয়েছিলো। 

কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানোর আগে সিনিয়র নেতাদেরকে বঙ্গভবনে আনা হয়েছিলো। বঙ্গভবনে থাকা অবস্থায় খন্দকার মোশতাক তাদেরকে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সরকারের বদনাম করতে বলেছিলো। কিন্তু এইসব আত্মমর্যাদাসম্পন্ন নেতারা সেটা প্রত্যাখ্যান করে। খন্দকার মোশতাক তাদেরকে তার কেবিনেটে যোগ দিতে বললেও তারা অস্বীকৃতি জানায়। স্বভাবতই একজন জুনিয়র কলিগের অধস্তন হিসেবে কাজ করতে তাদের সন্মানে লাগার কথা। জনাব মন্সুর আলী ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। তাকে আরও দুই দিন ধরে বোঝানো হলেও খন্দকার মোশতাক তার থেকে কথা আদায় করতে ব্যার্থ হয়। সে (মন্সুর) তার উপরের চাপ প্রত্যাখ্যান করে এবং একটি নির্দিস্ট পয়েন্টে স্থিরপ্রতিজ্ঞ থাকে যে, ভালো বা খারাপ যাই হোক না কেন সেও (মন্সুর) আগের সরকারের সমস্ত দায়ভারের অংশীদার। শুধু নেতাকে দোষারোপ করা নীতিগতভাবে ভুল। সে (মন্সুর) নিশ্চিত করে যে, আমাদের সবারই সত্যকে মেনে নেবার সৎসাহস থাকা উচিৎ। সে (মন্সুর) খন্দকার মোশতাককে এটাও মনে করিয়ে দেয় যে মোশতাক নিজেও বঙ্গবন্ধুর কেবিনেটের একজন সদস্য। এরকম কথাও শোনা যায় যে খন্দকার মোশতাক জনাব মন্সুর আলীকে প্রধানমন্ত্রী হবার প্রস্তাবও দিয়েছিলেন। 

কেবিনেটের শপথ গ্রহণ প্রক্রিয়া শেষ হতে হতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। এসময় ফরেন মিনিস্টার ড কামাল হোসেন দেশের বাইরে অবস্থান করছিলেন। কাস্টডিতে থাকা ঐ চারজন নেতা এবং দেশের বাইরে যারা আছে তারা বাদে বঙ্গবন্ধুর কেবিনেটের সবাইকেই খন্দকার মোশতাক তার কেবিনেটে নিয়ে নেয়। শপথ অনুষ্ঠানে সিভিল ও মিলিটারি অফিসারদের বাইরেও অনেক ডিপ্লোম্যাট দাওয়াত পেয়ে এসেছিলেন। জেনারেল জিয়া এবং ব্রিগেডিয়ার খালেদও উপস্থিত ছিলো। সাধারণত বিশিষ্টজনদের স্ত্রীদেরকেও দাওয়াত দেয়া হয়। কিন্তু সেদিনের অনুষ্ঠানটা স্ত্রীদের জন্য মোটেই অনুকূলে ছিলোনা। তবে তারপরেও, মিলিটারি অফিসারদের মধ্যে শুধুমাত্র মেজর রশিদের স্ত্রী সেখানে উপস্থিত ছিলো যাকে খুব একটিভ এবং সপ্রতিভ মনে হচ্ছিলো। 

দিনের প্রথম দিকে আমি খন্দকার মোশতাককে প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সমাধিস্থ করার ব্যাপারে তার মত জানতে চেয়েছিলাম। তাকে জিজ্ঞেস করার কারণ ছিলো সমাধির স্থান জানার জন্য। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম বঙ্গবন্ধুর কবর কি নতুন পার্লামেন্ট বিল্ডিং এর প্রাঙ্গণে হবে নাকি পুরাতন হাই কোর্ট সংলগ্ন এলাকায় হবে (যেখানে জাতীয় চার নেতার সমাধি)। খন্দকার মোশতাককে যখন আমি এই প্রশ্ন করেছিলাম তখন এয়ার চীফ এয়ার ভাইস মার্শাল একে খন্দকারও ছিলো। আমাকে অবাক করে দিয়ে খন্দকার মোশতাক রেগে উঠল এবং বলল, “প্রতিদিন কত লোকই তো মরে, সেসবের দেখভাল কি আমি করব? তাকে ঢাকা বাদে সেখানে খুশি সেখানে কবর দাও।” 

খন্দকার মোশতাকের এই মন্তব্যে আমি কী প্রতিক্রিয়া দেখাব বুঝতে পারছিলাম না। আমি একদম বধির হয়ে গিয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধু যে সে কোন ব্যক্তি নন যে তাঁকে যেকোন স্থানে কবর দেয়া হবে। এসবের বাইরেও তিনি দেশের প্রেসিডেন্ট এবং রাষ্ট্রপ্রধান। রাষ্ট্রপ্রধানকে সমাধি দেবার সময় অনেক নিয়ম কানুন মানতে হয়। যেভাবেই তার মৃত্যু হোক না কেন সঠিক নিয়ম মেনেই আমাদের উচিৎ তাঁকে সমাধিস্থ করা এবং প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ পালন করা। প্রেসিডেন্টের শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের অন্যতম হচ্ছে গান ক্যারিয়েজে করে তার কফিন বহন করে নিয়ে আসা এবং গার্ড অব অনার দেয়া, ইত্যাদি। খন্দকার মোশতাক এসব তাঁর (বঙ্গবন্ধু) জন্য করতে চাচ্ছিলনা। সে চাচ্ছিল যেন ঢাকা বাদে যে কোন জায়গায় কবর দেয়া হয়। খন্দকার মোশতাকের এই আচরণ দেখে আমি এয়ার চীফ এয়ার ভাইস মার্শাল একে খন্দকারের দিকে তাকালাম। সে সামান্য একটু হা সূচক মাথা নাড়ল – যার অর্থ আমাদের জিনিসটা দেখতে হবে। আজকের দিন পর্যন্ত আমি নিজেকে অভিশাপ দেই এটা ভেবে যে কেন আমি খন্দকার মোশতাকের কাছে সমাধিস্থ করার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছিলাম? 

আমরা কী করতে পারতাম? খন্দকার মোশতাক চাচ্ছিলনা যে প্রেসিডেন্টকে ঢাকায় সমাধিস্থ করা হোক। আর আমরাও জাতির পিতাকে যেখানে খুশি সমাধিস্থ করতে পারিনা। তাই সিদ্ধান্ত হল বঙ্গবন্ধুকে টুঙ্গিপাড়ায় তাঁর নিজ গ্রামে তাঁর পিতার কবরের পাশে সমাধিস্থ করা হবে। খন্দকার মোশতাক যে বঙ্গবন্ধুকে ঢাকার বাইরে কবর দিতে বলবে সেটা আমার ধারণারও বাইরে ছিলো। বঙ্গবন্ধুর সাথে তার (মোশতাকের) মতের অমিল থাকতেই পারে, কিন্তু তিনি (বঙ্গবন্ধু) মারা যাবার পরে লাশের সাথে নিশ্চই নয়। যদি এরকম সামান্যতম চিন্তাও আমার মাথায় আসতো আমি মোটেও তাকে এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতাম না। সমস্যাটা তখনই হল যখন আমি খন্দকার মোশতাকের কাছে সমাধির ব্যাপারে সুনির্দিস্ট নির্দেশনা চাইলাম। কতোটা বিদ্বেষপূর্ণ মানুষ ছিলো সে! 

দেশের জন্য বঙ্গবন্ধু তার সমস্ত কিছু বিলিয়ে দিয়েছেন। তাঁর রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের চুড়া এই ঢাকায় হলেও আমরা এতোটাই অকৃতজ্ঞ যে তাঁকে রাজধানীতে শেষ বিশ্রামটুকু নিতে একটু জায়গা দিতে পারলাম না। খন্দকার মোশতাকের জন্য এটা করা গেলনা। খন্দকার মোশতাক কতোটা নির্দয় ও হৃদয়হীন ছিলো! রাজনীতি কতোটা আশ্চর্যের, কতোটা নিষ্ঠুর এবং কতোটা অমানবিক। বঙ্গবন্ধুর জন্য আমার খারাপ লাগে যে খন্দকার মোশতাকের মত কপটকে তিনি চিনতে পারেননি এবং তাকে (মোশতাক) তাঁর ঘনিস্ট বন্ধু মনে করতেন। কিছুক্ষণের ভেতর এয়ার ভাইস মার্শাল খন্দকার একটি হেলিকপ্টার যোগাড় করলেন এবং আর্মি থেকে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ একটি কন্টিনজেন্ট প্রস্তুত করে প্রেসিডেন্টের লাশের সাথে টুঙ্গিপাড়ায় কবর দিতে পাঠানো হল। সেখানে বঙ্গবন্ধুর পিতার কবরের পাশে তাকে সমাধিস্থ করা হয়। আমাকে বলা হয়েছিলো যে কবর দেবার পূর্বে সব ধরণের ধর্মীয় আচার পালন করা হয়েছিলো। বাকিদের ব্যাপারে জেনেছি, তাদের সবাইকে বনানী গোরস্থানে কবর দেয়া হয়েছে। 

প্রেসিডেন্টকে সমাহিত করার কথা আলোচনা করতে যেয়ে আমার বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুতফর রহমানের মৃত্যুর সময়কার কথা মনে পড়ছে। শেখ লুতফর রহমান বার্ধ্যক্যজনিত কারণে ১৬ মার্চ ‘৭৫ তারিখে মৃত্যুবরণ করেন। প্রেসিডেন্টের সাথে তাঁর পিতার সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিস্ট ছিলো। পিতার মৃত্যু তাঁর জন্য অত্যন্ত বেদনাদায়ক ছিলো। তিনি অনেক মর্মাহত ছিলেন। পিতার শেষকৃত্য সম্পন্নের জন্য তিনি স্টিমারে গোপালগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওনা করেন। এসময় তাকে বিদায় দিতে পাগলা স্টিমার ঘাটে তাঁর কেবিনেটের সহকর্মীরা, গণ্যমান্য ব্যক্তিগণ এবং আমরা তিন বাহিনীর প্রধানরা উপস্থিত ছিলাম। অত্যন্ত এই বিষণ্ণ এই মুহুর্তে সবাই চুপচাপ ছিলো। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে খন্দকার মোশতাকের আহাজারি ছিল সবচেয়ে জোরালো। তীব্র বেদনায় সে (মোশতাক) নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলোনা এবং এতো জোরে চিৎকার করে কান্না জুড়ে দিলো যে স্বয়ং বঙ্গবন্ধু, অর্থাৎ যার পিতা মারা গেছে, তিনিও বিব্রত বোধ করলেন। মনে হল তাঁর চেয়ে খন্দকার মোশতাক বেশী ভেঙ্গে পড়েছেন। 

ঢাকা থেকে টুঙ্গিপাড়া অনেক দূরের পথ। সেসময় টুঙ্গিপাড়ার সাথে সড়ক যোগাযোগ ছিলোনা বললেই চলে। একমাত্র নদীপথই ছিলো ভরসা। মার্চ মাসে নদী স্রোতস্বিনী হয়ে ওঠে। ফলে জলপথে টুঙ্গিপাড়া যাওয়াটা কিছুটা সহজ হয়। এই সময় বঙ্গবন্ধু স্টিমারে ঢাকায় থাকা তাঁর পুরো পরিবার এবং কিছু ঘনিস্ট বন্ধুদের নিয়ে রওনা করলেন। খন্দকার মোশতাক তাদের একজন যে সেদিন গিয়েছিলো। 

টুঙ্গিপাড়া যশোর মিলিটারি গ্যারিসনের নিয়ন্ত্রণে। আমি যশোর গ্যারিসন কমান্ডার কর্নেল (পরবর্তীতে লে জেনারেল) মীর শওকত আলীকে জানালাম প্রেসিডেন্টের দলের সবাইকে যেন টুঙ্গিপাড়ায় পর্যাপ্ত সহায়তা দেয়া হয়। পরের দিন হেলিকপ্টারে আমরা তিন বাহিনীর লোকেরাও জানাজা আদায় করার জন্য টুঙ্গিপাড়া পৌছালাম। টুঙ্গিপাড়াতেও খন্দকার মোশতাকের আহাজারি ছিলো সবার চেয়ে বেশী। সেই খন্দকার মোশতাক বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুতে সন্মানজনকভাবে সমাহিত করতে চাচ্ছেনা। কত বড় ভণ্ড সে! এটা দেখে কষ্ট লাগলো যে এমন নীতিহীন ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুর ঘনিস্ট সহচর। 

মন্ত্রীদের শপথ অনুষ্ঠান শেষে জেনারেল জিয়া ব্রিগেডিয়ার খালেদকে জিজ্ঞেস করল “Ops Order” রেডি হয়েছে কিনা। যখন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ বলল যে এখনো রেডি হয় নাই তখন জেনারেল জিয়া হঠাৎ রেগে গিয়ে বলল “Ops Order” এখনো না হলে সে (খালেদ) বঙ্গভবনে কী করছে? জেনারেল জিয়া আমার সামনে যেভাবে ব্রিগেডিয়ার খালেদকে অভিযুক্ত করল সেটা আমার ভালো লাগেনি। আমার মনে হল ব্রিগেডিয়ার খালেদের আমার পাশে থাকাটা জেনারেল জিয়া পছন্দ করছেনা। এটা সকাল থেকেই আমার মনে হয়েছে। বঙ্গভবন থেকে ফিরে যাবার সময় খন্দকার মোশতাক বলল যে রাতে তিন বাহিনী প্রধানদের সাথে সে একটা কনফারেন্স করবে। তাই আমাকে বঙ্গভবন ছাড়তে নিষেধ করল। তাই কনফারেন্সের জন্য আমাকে বঙ্গভবন থাকতে হল।

কনফারেন্সের সময় খন্দকার মোশতাক জানতে চাইল এখন দেশে মার্শাল ল জারি করার প্রয়োজনীয়তা আছে কিনা। আমি জিজ্ঞেস করলাম এই প্রশ্ন এখন তোলার কারণ কী? অলরেডি রেডিও ও টিভিতে মার্শাল ল এর কথা বলা হয়েছে। এখন শুধু একটা কাজই বাকি – গেজেট নোটিফিকেশন ইস্যু করা। খন্দকার মোশতাক জানতে চাইল গেজেট নোটিফিকেশন কে করবে? আমি বললাম প্রেসিডেন্টের অনুমতিক্রমে অবশ্যই সরকার এটা করবে। খন্দকার মোশতাক ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন মার্শাল ল জারি করল আর্মি তাহলে প্রেসিডেন্ট কেন গেজেট জারি করবে? আমি তাকে বললাম একটি সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় আর্মি কখনো মার্শাল ল জারি করতে পারেনা। এটা সরকারের দায়দায়িত্ব। সে (মোশতাক)  উচ্চস্বরে বলল, “যেহেতু তোমার ট্রুপ্স (অর্থাৎ আর্মি) ঘোষণা দিয়েছে সেহেতু এটা করার দায়িত্ব তোমার।” 

আমি খন্দকার মোশতাককে বললাম আমি দায়িত্ব পালনে ভীতু নই। এবং বিরক্তির সাথে বললাম তারা যদি আমার সৈন্যই হবে তাহলে মার্শাল ল জারির সময় আমার নাম কেন বলেনি? তারা আপনার নাম বলেছে, খন্দকার মোশতাক, অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট। তখন তার গলার স্বর একটু নরম হল। এবং সে বলল যে সে আসলে এই মার্শাল ল কে আইনসম্মত করতে চাচ্ছে। সে বলল যে মার্শাল ল অর্ডার সম্পর্কে সর্বসম্মতিক্রমে একটি ড্রাফট করতে চাচ্ছে। সময়ের সাথে সাথে খন্দকার মোশতাক এবং তার সহযোগীরা হয়ত বুঝতে পারল আমার মনে কী আছে। কনফারেন্স আগাবার সাথে সাথে আমি বুঝতে পারছিলাম যে এই কনফারেন্স আসলে আমাকে বঙ্গভবনে ব্যস্ত রাখার একটি কৌশল। তারা এটা করছিলো যাতে আমি খন্দকার মোশতাকের বিরুদ্ধে কোন কিছু করতে না পারি। আমি আসলে ঐ মুহুর্তে যা চাচ্ছিলাম তা হচ্ছে এই ছেলেদের ব্যারাকে ফেরত পাঠানো এবং শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা। আবার ঐ সময়ে তাদেরকে ব্যারাকে পাঠাতে আমি যদি খুব গরজ দেখাই তাহলে কাজটা হবেনা। তাই আমি খন্দকার মোশতাককে সে যা করতে চাচ্ছে সেভাবেই সায় দিলাম যাতে করে আমার মনে কী আছে সে তা টের না পায়। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে আমার প্ল্যান নিয়ে আলোচনা করার মত কেউ আমার সাথে ছিলোনা। তখন আমি বুঝতে পারছিলাম যে আমি কাউকে বিশ্বাস করতে পারছিনা। অপরদিকে খন্দকার মোশতাকের সহচর মেজর রশিদ, মেজর ফারুক, মেজর ডালিম ও অন্যান্যরা প্রতিনিয়ত বঙ্গভবনে আসছে এবং খোন্দকার মোশতাকের সাথে দেখা করছে। এবং তাদের অবস্থান পোক্ত করতে তারা নানান রকম পদক্ষেপ নিচ্ছে। 

আর্মার্ড ও আর্টিলারি ডিভিশন সফলভাবে সামরিক অভ্যুত্থান করতে পারার কারণে এলিট ফোর্সে পরিণত হয়ে গেল। এবং তাদেরকে খন্দকার মোশতাকের প্রোটেকশনে বঙ্গভবনে মোতায়েন করা হল। এই দুই ইউনিটের অফিসাররা ছাড়াও আরও কিছু অফিসার এই বিদ্রোহে অংশ নিয়েছিলো। তারাও অন্যান্য কোন গ্রুপ বা সার্ভিস থেকে থেকে এসেছে। কেউ কেউ তখন সরাসরি চাকরীতে ছিলো না। হয়ত তারা আগেই অবসর নিয়েছে অথবা সরকার কর্তৃক চাকরী থেকে বরখাস্ত হয়েছে। তাই তারা সরকারের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে। তাই বাহিনীতে চ্যানেল অব কমান্ড ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হলে প্রথমেই এইসব অফিসারদের বিদ্রোহী ইউনিট থেকে আলাদা করতে হবে। সেটা করার জন্য এইসব রিটায়ার্ড ও বরখাস্ত অফিসারদের জন্য ইউনিট বণ্টন করলাম।  ১৬ আগস্ট ‘৭৫ আমি এই সব অফিসারদের বঙ্গভবন ত্যাগ করতে বলি এবং তাদের নতুন ইউনিটে যোগ দিতে বলি। এটা তাদের জন্য ছিলো অবাক করা বিষয়। তারা কেউ এটা আশাও করেনি। তাই একসময় তারা একে অপরের দিকে তাকালো। কিছুটা ঝাঁকি খেলো মনে হয়। এতোটাই অবাক যে তাদের কেউ কেউ চোখের জল ফেলল। আমি তাদের সেখানে রেখে কনফারেন্সের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। 

আমি তাদেরকে রেখে কনফারেন্সের দিকে রওনা হবার সঙ্গে সঙ্গে এসব অফিসাররা সময় নষ্ট না করে খন্দকার মোশতাকের কাছে গিয়ে বিষয়টা খুলে বলল। তারা চিন্তায় পরে গেল এবং ঐ মুহুর্তে বঙ্গভবন ত্যাগ করতে চাচ্ছিলনা। কনফারেন্স রুমে বসার একটু আগে খন্দকার মোশতাক এক কোনায় আমাকে নিয়ে এসব অফিসারকে আরও কিছু সময় বঙ্গভবনে রাখার অনুরোধ করল। সে বলল যে তাদেরও এখন প্রোটেকশন দরকার। জনগণ এখন জেনে গেছে কে কী করেছে। তাই এই ছেলেগুলোর জীবন এখন ঝুকিপূর্ণ। 

আমি খন্দকার মোশতাককে বললাম, যতক্ষণ আমরা চেইন অব কমান্ড পুনস্থাপন করতে না পারবো ততোক্ষণ সমস্যা হবে। তবু সে তাদেরকে আরও একটু সময় দিতে চাইল। এই পর্যায়ে আমি আর তাকে বেশী ব্যাখ্যা করতে গেলাম না, দেখা যাবে উল্টো সে আমাকে সন্দেহ করছে। কনফারেন্সের পর আমি অফিসারদের আমার ডেকে বললাম আরও কিছদিন তোমরা বঙ্গভবনে থাকো। এবং কখন তাদের জন্য করা নতুন ইউনিটে যোগ দিতে হবে সেটা পরে বলে দেবো। 

পরের দিন ব্রিগেডিয়ার খালেদ আমাকে জানালো বিদ্রোহীরা যেদিন ঘটনা ঘটালো সেদিন আর্মার্ড ইউনিটের কাছে কোন গোলাবারুদ ছিলো না। এটা শুনে মনে হল আমার শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল। এটা আমার জন্য একটা ভালো সংবাদ। শুনে খুশি হলাম যে ট্যাংকে কোন গোলা ছিলোনা। এগুলো আসলে পিলবক্স ছাড়া কিছুই ছিলো না। আমার মনে হল আমি তাদের সাথে আরও কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারব। নিশ্চিত হবার জন্য আমি ব্রিগেডিয়ার খালেদকে আবারো জিজ্ঞেস করলাম, “এটা কি সত্য?” সে বলল, “জি স্যার, সত্য।” সে আরও বলল যে সে নিজে তাদেরকে গোলাবারুদ আগের দিন (১৫ আগস্ট ‘৭৫)  ইস্যু করেছিলো। আমি রেগে গিয়ে তাকে বললাম, “তুমি আমার অনুমতি ছাড়া কিভাবে বিদ্রোহীদের গোলাবারুদের অনুমতি দিয়েছ?” সে বলল, “আমি ভেবেছি সব শেষ। এখন আর গোলাবারুদ দিয়ে কোন ক্ষতি করতে পারবেনা। তাই দিয়েছিলাম।” 

আমি ব্রিগেডিয়ার খালেদকে ভালো করে চিনি। আমি জানি সে কোন দায়িত্বহীন কাজ করবেনা। কিন্তু তার এধরনের কাজে আমি অবাক হয়েছিলাম। এটা খালেদের করা কাজ হতে পারেনা। আমি মর্মাহত হয়েছিলাম। খবরের শুরুর অংশ শুনে যতোটা আনন্দিত হয়েছিলাম পরের অংশ শুনে ততোটাই বিষণ্ণ হয়ে গেলাম। ব্রিগেডিয়ার খালেদ নিশ্চই বুঝতে পেরেছে সে কী করেছে। সে বুঝেছে যে সে ভুল করেছে এবং তাকে অনুতপ্ত দেখাল। যদি সত্যিই এটা ভুল করে হয়ে থাকে তাহলে খুব বড় রকমের ভুল। যদিও ব্রিগেডিয়ার খালেদ বোকা নয়। এর পেছনে কোন কারণ ছাড়া সে গোলাবারুদ ইস্যু করেনি। কারণ যাই হোক, ভালো বা খারাপ, যদি জানতাম তবে কখনোই বিদ্রোহীদের এসব দেবার অনুমতি দিতাম না। তাছাড়া তখনো তারা আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। গোলা ছাড়াই তারা যে অভিযান করে ফেলেছে এখন গোলাবারুদ সহ তারা যে কোন কিছুই করে ফেলতে পারে। 

ব্রিগেডিয়ার খালেদ চলে যাবার পর আমি  মনমরা হয়ে গেলাম এবং ভাবতে লাগলাম ব্রিগেডিয়ার খালেদও কি আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছে? আমি খুব হতাশ হয়ে গেলাম এবং ভাবতে লাগলাম কাকে এখন বিশ্বাস করব? এমন সময় মেজর রশিদ আসলো এবং আমার রুমে সামনের সোফায় আমার মুখোমুখি বসল। সামরিক অভ্যুত্থানকারীদের মূল পরিকল্পনাকারীদের মধ্যে সে অন্যতম একজন। বলতে গেলে, মূল ব্যক্তি। একদিকে সে আর্টিলারি বাহিনীর কমান্ডিং অফিসার, আরেকদিকে খন্দকার মোশতাকের দূর দূরসম্পর্কে ভাগ্নে। অন্যান্য বিদ্রোহী আর্মার্ড গ্রুপের সেকেন্ড ইন কমান্ড বা ভারপ্রাপ্ত কমান্ডার হচ্ছে মেজর ফারুকউর রহমান। তারা ছিলো ভায়রাভাই। অর্থাৎ তাদের স্ত্রীরা আপন বোন ছিলো। মেজর রশিদ যখন আমার সামনে বসে ছিলো তখন তাকে আমি জিজ্ঞেস করলাম, “এরকম একটা কাজ কীভাবে করতে পারলা তুমি?” সে বলল, “স্যার, এটা লম্বা ইতিহাস।” আমি বললাম, “আমার সময় আছে।” 

তারপর সে আমাকে বলল সফলার ক্ষীণ সম্ভবনা আছে ধরে নিয়েই তারা মিশনে নেমেছিল। তাদের জন্য এটা ছিলো জুয়া। তারা ধরে নিয়েছিলো যে যদি তারা ব্যার্থ হয় তবে ফাঁসিকাষ্ঠে যাবার আগে ঘটনার পেছনের সকল সিনিয়র আর্মি অফিসারদের নাম তারা বলে যাবে। এটাও তারা বলে দেবে যে তারা শুধুমাত্র তাদের সিনিয়রদের স্বার্থ হাসিল করার জন্যই এই মিশনে নেমেছিল। আমি তাকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “সকল সিনিয়র অফিসার” বলতে তুমি কী বোঝাচ্ছ?” সে বলল, “স্যার, ঢাকায় ‘আপনি’ ছাড়া সবার কাছেই যাওয়া হয়েছে এবং উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে।” আমি মেজর রশিদের এই তথ্যে হতবাক হয়ে গেলাম। সে আরও বলল, আমাকে জানানোর জন্যও সে চেষ্টা করেছিলো, কিন্তু আমার সাথে কথা বলার মত সাহস সঞ্চয় করতে পারেনি। বিস্তারিত বলতে গিয়ে সে বলল, “স্যার, আপনার কি মনে পরে গত ঈদের দিনে (ঈদ উল ফিতর) আমি আর আমার স্ত্রীকে আপনি সেনাভবনে (চীফের বাসভবন) ডেকেছিলেন?” আমি বললাম, “হ্যা, মনে আছে।” সে বলল, “স্যার, যদি মনে করতে পারেন, সেদিন আমি অনেক বিষয়ে আলোচনার ফাঁকে ভারতে আমার ট্রেনিং সম্পর্কে বলেছিলাম। কিন্তু আপনার বাড়ীতে যে উদ্দেশ্যে আমি গিয়েছিলাম সেটা সফল হয়নি।” সেদিন আপনাকে আমি আমাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলতে চেয়েছিলাম। আমি জিজ্ঞেস করলাম কেন তাহলে সে আমাকে বলেনি। সে বলল,
“স্যার, যদিও অনেকক্ষণ আমি আপনার সাথে ছিলাম, কিন্তু এই ব্যাপারটা আপনাকে বলার মত পর্যাপ্ত সাহস সঞ্চয় করতে পারিনি।” এরপর আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, অন্যান্য সিনিয়র অফিসার কারা এবং তাদের মতামত কী ছিলো। আমি এও জিজ্ঞেস করলাম যে তারা কি জুনিয়র অফিসারদের সাথে এই ব্যাপারে মুখ খুলেছিল কিনা। এবং সেক্ষেত্রে তারা কী ধরণের প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে? সবশেষে আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তারা বিষয়টা কোন লেভেলের জুনিয়র অফিসার পর্যন্ত আলোচনা করেছে এবং তাদের আনুমানিক সংখ্যাটা কত। তখন সে বলল যে, প্রথমে তারা মিড লেভেলের জুনিয়র অফিসারদের কাছে জিনিসটা বলেছে। অর্থাৎ লে কর্নেল থেকে মেজর। তার ভাষ্যমতে তারা সবাই এটাকে স্বাগত জানিয়েছে এবং প্রস্তাব করেছে যে যদি সিনিয়র অফিসারদের এর সাথে সংশ্লিষ্ট করা যায় তাহলে ভালো হয়। সিনিয়র অফিসারদের সমর্থন ছাড়া হয়ত তাদের মিশন সফল নাও হতে পারে। এই সাজেশন মাথায় রেখে তারা সিনিয়র অফিসারদের শরণাপন্ন হয়। সিনিয়র অফিসারদের নাম বলতে গিয়ে সে যেসব নাম বলেছে সেগুলো হচ্ছে ডেপুটি চীফ জেনারেল জিয়া, CGS ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ এবং ঢাকা ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়াৎ জামিল। এসব নাম শুনে আমি একবারে আকাশ থেকে পড়লাম। কাকে আমি এখন বিশ্বাস করব? আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, অফিসারদের থেকে তারা কী ধরণের প্রতিক্রিয়া পেয়েছে। 

এপ্রশ্নের জবাবে সে বলল, ব্রিগেডিয়ার খালেদের কাছে সে সর্বপ্রথম প্রস্তাব নিয়ে যায়। যেদিন সে প্রস্তাব নিয়ে ব্রিগেডিয়ার খালেদের অফিসে যায় সেদিন সেখানে ঢাকা ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়াৎ জামিল ছিলো। সে তখন তাদের দুজনের কাছেই সরকার পতন ঘটানোর প্রস্তাবটি দেয়। তার ভাষ্যমতে ব্রিগেডিয়ার খালেদ তার কথাকে সিরিয়াসলি নেয় নাই এবং বলে যে, “চলে যাও, শিশুসুলভ কাজ করোনা।” এরপর সে একই প্রস্তাব নিয়ে জেনারেল জিয়ার কাছে যায়। জিয়া জানায় সিনিয়র অফিসার হিসেবে সে (জেনারেল জিয়া) সরাসরি তাদের সাথে যুক্ত হতে পারেনা। যদিও সে (জেনারেল জিয়া) তাকে চালিয়ে যেতে (Go ahead) বলে এবং এও জানায় যে যদি তারা সফল হয় তাহলে পরবর্তীতে সে (জেনারেল জিয়া) তাদের সাহায্য করবে। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে, মেজর রশিদ যাদের কাছে প্রস্তাব নিয়ে গেল এসব অফিসারদের কেউ আমাকে জিনিসটা জানায়নি। 

মেজর রশিদকে আমার ডেপুটি জেনারেল জিয়া সর্বোতভাবে উৎসাহ দিয়েছে। এটা আশা করিনা যে মেজর রশিদের প্রস্তাবে একাত্মতা প্রকাশ করে জেনারেল জিয়া সেটা আমাকে জানাতে আসবে। কিন্তু ব্রিগেডিয়ার খালেদ আর কর্নেল শাফায়াৎ জামিলের কী হল? তারা কেন আমার কাছে এটা লুকাবে? এটা করার কোন কারণ নেই! এই অফিসারদের কেউ আমাকে মেজর রশিদের প্রস্তাব সম্পর্কে বলেনি – হোক সেটা শিশুসুলভ বা কৌতুকপূর্ণ। এমন একজন লোক যে নিজেই সফলভাবে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানোতে জড়িত, তার কাছ থেকে যে নামগুলো আমি শুনলাম তাদের উপর কিভাবে আমি বিশ্বাস রাখি? যদিও আমি তাকে (মেজর রশিদ) পুরোপুরি বিশ্বাস করছিনা, হতে পারে সে সিনিয়র অফিসারদের সম্পর্কে আমাকে বিষিয়ে তুলছে। কিন্তু যদি তাদের ব্যাপারে আমি ভিন্নভাবে ভাবি সেটাও কি ভুল হবে?

মেজর রশিদের থেকে এসব জানার পর সবকিছু পরিষ্কার হতে লাগলো। ১৫ আগস্ট ‘৭৫ সকালে কর্নেল শাফায়াৎ জামিলকে আমি সৈন্য পাঠিয়ে ব্যবস্থা নিতে বলার সুনির্দিস্ট নির্দেশনা দেই। তা সত্ত্বেও সে ট্রুপ্স মুভ করেনি। একই দিন বিকেলে কর্নেল (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল) এম এ মঞ্জুর খন্দকার মোশতাকের অনুমতি ছাড়াই নয়াদিল্লী থেকে ঢাকা আসে। জেনারেল জিয়া সকাল থেকে আমাকে প্রেসিডেন্ট হত্যাকাণ্ড থেকে দৃষ্টি সরিয়ে তথাকথিত সম্ভাব্য ভারত আগ্রাসনের সম্ভবনার দিকে আমার মনোযোগ ঘুরাতে চেষ্টা করে যাচ্ছে। সবকিছু আমার কাছে একদম স্পষ্ট হতে লাগলো। আমি কিছু আত্মকেন্দ্রিক ষড়যন্ত্রকারীদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে আছি। একারণে কাউকেই বিশ্বাস করা যাচ্ছেনা। ব্রিগেডিয়ার খালেদ, যাকে বিশ্বাস করলাম, সেও মনে হচ্ছে সঠিক পথে নেই। তার মনে ভিন্ন কোন পরিকল্পনা আছে কিনা তা আমার জানা নেই। তা না হলে এই পরিস্থিতিতে আমাকে  না জানিয়ে কেন সে বিদ্রোহীদের ট্যাংকের জন্য গোলাবারুদ ইস্যু করবে? মনে করিয়ে দেই, এই ট্যাংকগুলো দিয়ে কোন রকম গোলা ছাড়াই সামরিক অভ্যুত্থান করা হয়েছিলো। আমি বুঝতে পারলাম না যে যখন বিদ্রোহীদের উপর কোন নিয়ন্ত্রণ আমাদের নেই সেই অবস্থায় তাদেরকে গোলাবারুদ ইস্যু করার কী যুক্তি থাকতে পারে। 

১৭/১৮ আগস্ট ‘৭৫ রাত পর্যন্ত ম্যারাথন কনফারেন্স চলতে থাকলো। মিটিং চলাকালীন সময়ে সেদিন রাতে খন্দকার মোশতাক বলল যে সে সকালে একটা মার্শাল ল অর্ডারের ড্র্যাফট দেবে। চলে যাবার আগে আমরা (এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকার, রিয়ার এডমিরাল এম এইচ খান, ব্রিগেডিয়ার খলিলুর রহমান ও আমি) চায়ের অর্ডার দিলাম এবং আরও একটি রাত বঙ্গভবনে থেকে গেলাম। খুব ভোরে ফজর নামাজের পর খন্দকার মোশতাক তার রুম থেকে বেরিয়ে নীচে নেমে আমাদের সাথে জয়েন করল। 

খন্দকার মোশতাক তার সিটে বসল। তার ডান পকেটে একটি ভাজ করা কাগজ দেখলাম। সেটা সে আমার দিকে বাড়িয়ে দিলো। যেহেতু আমি তার ডান পাশে বসা ছিলাম তাই সে সেটা আমার কাছে দিলো। এটা সেই ড্র্যাফট যেটার ব্যাপারে সে রাতে কথা দিয়েছিল। সেটা পড়ার সময় আমি খন্দকার মোশতাককে বললাম, আপনি বিশ্রাম নেন, আমরা এটা পড়ে দেখি কোন ভুলভ্রান্তি আছে কিনা। এটা বলার সাথে সাথে খন্দকার মোশতাকের মুখভঙ্গি পাল্টে গেল। সে খুব নোংরা এবং বিরক্তিকরভাবে তাকালো। আমার মনে হল সম্ভবত আমি খুব আপত্তিকর কিছু করে ফেলেছি। 

কথা সত্য, কারণ তার দীর্ঘদিন আইন পেশায় থাকার অহংবোধকে আমি আহত করেছি, যখন আমি বলেছি আমরা দেখছি এতে কোন ভুল আছে কিনা। আমার একথা শেষ হবার সাথে সাথে খন্দকার মশতাক রেগে গিয়ে বলল, “জেনারেল শফিউল্লাহ, আমি এটা নিয়ে গত তিন মাস কাজ করছি।” আমি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, যা শুনলাম। আমি অবাক হয়ে গেলাম এবং বললাম, “সেক্ষেত্রে এটা অবশ্যই ঠিক আছে।” একথা বলে আমি কাগজটা খন্দকার মোশতাকের পাশে বসা এয়ার ভাইস মার্শাল একে খোন্দকারের দিলাম। আমি জানিনা খন্দকার মোশতাক যা বললেন তা তিনি বুঝলেন কিনা। আরেকটা কারণ হতে পারে যে সে তার কাজের উপর যথেষ্ট আত্মবিশ্বাস রাখে অথবা সে যা করছে তাতে কে কী ভাবল তার কিছু যায়-আসেনা। তখন আর আমার বুঝতে বাকি রইল না কে এসবের পেছনে কাজ করছিলো। সেই একই মার্শাল ল অর্ডার ২০ আগস্ট ‘৭৫ তারিখে গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। 

১৫ আগস্ট কনফারেন্সের শুরু থেকে ১৮ আগস্ট ‘৭৫ সকাল পর্যন্ত আমাকে বঙ্গভবনের বাইরে যেতে দেওয়া হয়নি। প্রায় ৭২ ঘণ্টা। অন্যভাবে বলা যায়, এই সময়টাতে আমাকে কৌশলে নজরে রাখা হয়েছে। ১৫ আগস্ট সকালে সে পোশাক পরা ছিলাম, বঙ্গভবনের এই তিনদিন সেই পোশাকেই কাটাতে হয়েছে। 

এরপর, সেশন শেষে আমাকে অফিসে যেতে দেওয়া হয়। বঙ্গভবন থেকে বের হবার আগে খোন্দকার মোশতাক তার অবস্থান দৃঢ় করতে যা প্রয়োজন সেটা অবশ্যই করে নিয়েছে। কারণ যখন আমি আর্মি হেডকোয়ার্টারের দিকে যাচ্ছিলাম আর কেউ আমাকে ফলো করছিলোনা। কারণ, এপর্যন্ত বঙ্গভবনে জনাব তাহেরউদ্দিন ঠাকুর সবসময় আমার সাথে ছিলেন। এবং মেজর রশিদ, মেজর ফারুক এবং মেজর ডালিম সব সময় ছায়ার মত থেকেছে। 

অফিসে আসার সাথে সাথে আমার এডিসি আমাকে জানায় যে ৪৬ ব্রিগেডে সৈন্যদের মাঝে বড় রকমের ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে – বিশেষ করে ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটেলিয়নের সৈনিকদের সাথে। কারণ হচ্ছে, অভ্যুত্থানের এই সফলতার জন্য তারা অহমিকায় ভুগছে। এবং নিজেদের অন্যদের থেকে সুপিরিয়র মনে করছে। এমনকি তারা অন্যদের নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করছে। ইনফ্যান্ট্রি সোলজাররা যখন বুঝতে পেরেছে যে ‘আর্মি চীফ এই ঘটনায় তাদের সাথে আছে’ একথা বলে তাদের শুরু থেকে ভুল বোঝানো হয়েছে, তখন আর শুধরানোর সময় পায়নি। তাই তারা ভুলের জন্য আফসোস করছে। 

ততক্ষণে খন্দকার মোশতাক দেশে বিদেশে তার অবস্থান পোক্ত করে নিয়েছে। সে দ্রুত বঙ্গবন্ধুর কেবিনেটের প্রায় পুরোটা নিয়ে কেবিনেট গঠন করে। যেহেতু দেশে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারকে হত্যার ফলে তেমন কোন হৈচৈ বা নেতিবাচক কিছু ঘটেনি তাই খন্দকার মোশতাক অনেকটা আত্মবিশ্বাসী হল। ডিপ্লোম্যাটিক ক্ষেত্রে সে আমেরিকার আশির্বাদ পেল। সৌদি আরব ও চায়না বাংলাদেশকে অফিসিয়ালি স্বীকৃতি দিল। এই দুই দেশ সহ পাকিস্তান খুব দ্রুত ঢাকায় বাংলাদেশের সাথে কূটনৈতিক মিশন চালুর কথা প্রস্তাব করল। এদিকে ১৮ আগস্ট ‘৭৫ তারিখে বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে জানাতে DCOS জেনারেল জিয়া ও ব্রিগেডিয়ার খালেদের সাথে আলাপ করে একই দিন সন্ধ্যায় আমার হেড কোয়ার্টারে সংশ্লিষ্ট সকলকে নিয়ে কনফারেন্স ডাকলাম। অন্যান্য চীফদেরকেও বলা হল তাদের মত জানতে। 

একই দিন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় আমরা সবাই আমার অপ্স রুমে জড়ো হলাম। যারা এসেছিলেন তারা হলেন এয়ার চীফ এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খোন্দকার, ন্যাভাল চীফ রিয়ার এডমিরাল এম এইচ খান, DCOS জেনারেল জিয়া, হেড কোয়ার্টারের PSO, ডিজি বিডিআর ব্রিগেডিয়ার খলিলুর রহমান, ডিজি ডিএফআই ব্রিগেডিয়ার রউফ (তিনি তখনো ডিজির চার্জে আছেন। কর্নেল জামিল নিহত হবার আগে তিনি ক্ষমতা হস্তান্তর করেননি) এবং আই জি পুলিশ জনাব নুরুল ইসলাম। উপরোল্লেখিত অফসারগন ছাড়াও DMO কর্নেল এম এ মালেক, GSO-I (Ops) লে কর্নেল (পরবর্তীতে লে জেনারেল) নুরউদ্দিন খান অপ্স রুমে ছিলো। 

আমি আলোচনা শুরু করতেই ব্রিগেডিয়ার রউফ বলল, গত কয়েক দিন ধরে দেখা যাচ্ছে অনেকেই আমাদের মধ্যকার গোপনীয়তা রক্ষা করছেনা, এর ফলে আমাদের কেউ কেউ নির্দ্বিধায় কথা নাও বলতে পারে। আজকে অবশ্যই আমরা এমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়ে আলোচনা করব যা গোপনীয়। তাই আলোচনা শুরুর আগে আমাদের সবাইকে গোপনীয়তার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিশীল হতে হবে। ব্রিগেডিয়ার রউফের নিশ্চই আমাদের বর্তমান লোকেদের কারো কথা মনে মনে ভেবেই একথা বলেছে। অন্যথায়, এমন প্রশ্ন করার কোন মানে নেই। আজকে আমাদের আলাদাভাবে শপথ নেবার প্রয়োজন নেই (গোপনীয়তার বিষয়ে) কারণ পেশাগতভাবেই আমরা গোপনীয়তা রক্ষার ব্যাপারে বিধিবদ্ধ। আমি মনে করি একজন ডিসিপ্লিন্ড অফিসারের জন্য এটুকু বলাই যথেষ্ট। কিন্তু আমার বিশ্বাস আলোচনার বিষয়টা খুবই স্পর্শকাতর। আমাদের মধ্যকার কেউ কেউ মুখ নাও খুলতে পারে। তাই শপথ নেবার ব্যাপারে ব্রিগেডিয়ার রউফের প্রস্তাবে কেউ দ্বিমত পোষণ করেনি। 

সেই মিটিং এ আমরা পুরো পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করলাম। এর মধ্যে সীমান্তের পরিস্থিতিও আলোচনা হল। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিলো বঙ্গবন্ধু হত্যা এবং চ্যানেল অব কমান্ড ভেঙ্গে যাওয়ার বিষয়টি। আমি মনে করি যতক্ষণ না বাহিনীর মধ্যে আমরা শৃঙ্খলা ফিরিয়ে না আনতে পারবো ততক্ষণ পর্যন্ত এই আলোচনা অর্থহীন। 

অংশগ্রহণকারীদের অনেকেই ১৫ আগস্ট ‘৭৫ এর ঘটনার তীব্র নিন্দা করল। প্রায় সকলেই ঘৃণার সাথে হত্যাকাণ্ডের সমালোচনা করল এবং যারা শৃঙ্খলা ভেঙ্গে এসব করেছে তাদের সামরিক আইনে বিচারের পক্ষে মত দিলো। তবে এটাও বলা হল যে তাদের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাভঙ্গের জন্য একশন নেবার আগে তাদের উপর নিয়ন্ত্রণ পুনস্থাপন করতে হবে। ১৫ আগস্টের পরে আমি ফর্মেশন কমান্ডারদের সাথে দেখা করার সুযোগ পাইনি। তাই আমি CGS কে নির্দেশ দিলাম পরেরদিন অর্থাৎ ১৯ আগস্ট তাদের সাথে একটা কনফারেন্সের আয়োজন করতে। ১৮ আগস্ট অপ্স রুমের আলোচনার প্রেক্ষিতে আমি ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে বললাম ১৯ আগস্ট মেজর রশিদ ও মেজর ফারুককে যেন আর্মি হেডকোয়ার্টারে আসতে বলা হয়। কারণ কনফারেন্সের সময় যদি কোন কারণে তাদের প্রয়োজন হয় তাহলে যাতে ডেকে পাই। 

পরের দিন, ১৯ আগস্ট, কনফারেন্স শুরু হবার আগে ৪৬ ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়াৎ জামিল জরুরী ভিত্তিতে আমার সাথে দেখা করতে চাইল। যেহেতু কনফারেন্স শুরু হতে তখনো কিছু সময় বাকি ছিলো তাই আমি আমার ADC কে বললাম তাকে এগিয়ে নিয়ে আসতে। সে (শাফায়াৎ জামিল) বি এম মেজর হাফিজকে নিয়ে আমার কাছে আসলো। আসন গ্রহণের পর কর্নেল শাফায়াৎ জামিল ইতস্ততভাবে কথা বলতে শুরু করল। এবং মূল বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বলল, “স্যার, আপনার ডেপুটি জেনারেল জিয়াকে বিশ্বাস করবেন না। সে পুরো ষড়যন্ত্রের মূল হোতা।” মেজর হাফিজ একইভাবে কর্নেল জামিলের কথায় সূর মিলিয়ে জেনারেল জিয়াকে ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা করছিলো। আমি জানিনা তারা জেনারেল জিয়ার ব্যাপারে কী বোঝাতে চাচ্ছে। কিন্তু এটা ঠিক যে অন্তত একবারের জন্য হলেও তারা আমাকে সঠিক চিত্রটা তুলে ধরতে চেষ্টা করছে। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, এত দেরী করে তারা বুঝল কেন? এবং কেন আগে বলেনি? 

যে কোন কারণেই হোক না কেন, আমি তাদের উপর ভরসা পাচ্ছিলাম না। কারণ হচ্ছে, ১৫ আগস্ট সকালে আমি কর্নেল শাফায়াৎ জামিল্কে বলেছিলাম ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটেলিয়ন পাঠিয়ে বিদ্রোহীদের দমন করতে। কিন্তু সে কোন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। প্রকৃতপক্ষে সে আমার আদেশ অমান্য করেছে এবং তার সৈন্যকে মুভ করতে নির্দেশ দেয়নি। সেদিন সকালের ঘটনায় যদি সে আন্তরিক হত তবে কারো আদেশের জন্য তার অপেক্ষা করার কথা নয়। যে সোর্স থেকেই সে জেনে থাকুক না কেন, তার উচিৎ ছিলো আগে একশনে যাওয়া, এরপর তার কার্যক্রম সম্পর্কে আমাকে রিপোর্ট করা। তার নিজেরই সেই কমান্ড দেবার ক্ষমতা দেয়া আছে। সেটা সে ব্যবহার করেনি বা ব্যবহার করতে চায়নি। পাঠককে মনে করিয়ে দেই মেজর রশিদের কথা, যেদিন সে বলেছিল যে, ব্রিগেডিয়ার খালেদের কাছে অভ্যুত্থানের প্রস্তাব দেবার সময় সেখানে কর্নেল শাফায়াৎ জামিলও ছিলো। কাজেই শাফায়াৎ জামিলের কোন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া না দেখানোর পেছনে সেটা একটা কারণ হতে পারে। অথবা তার (শাফায়াৎ জামিল) সমর্থন তাদের (মেজর রশিদ) পক্ষেই ছিলো। 

যদি কর্নেল শাফায়াৎ আন্তরিক হত তাহলে আমি তাকে অবিশ্বাস করতাম না। কিন্তু তা পারছিনা কারণ সে আমার অর্ডার পালন করেনি। বরং বিদ্রোহীদের বাধা দিতে আমি যে নির্দেশ দিয়েছিলাম সেটা না মেনে সে নির্দেশনা পেতে ডেপুটি চীফ জিয়ার কাছে গিয়েছে। আমি জানি যে আমি যখন তাকে অর্ডার দিয়েছিলাম তখন তার হাতে প্রেসিডেন্টকে রক্ষার জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেবার মত পর্যাপ্ত সময় ছিলোনা। কিন্তু আবারো বলতে হয়, তখন পর্যন্ত আমাদের কেউ তো জানিনা যে প্রেসিডেন্টকে রক্ষার জন্য আমাদের হাতে যথেষ্ট সময় নেই। যদি সে আমার অর্ডার পালন করত তখন আমি হয়ত বুঝতে পারতাম যে পর্যাপ্ত সময় ছিলো কি ছিলোনা। আসল বিষয় হচ্ছে, সে আমার অর্ডার পেয়েও সৈন্যদের মুভ করেনি। আমার আদেশ ছিলো বিদ্রোহীদের বাধা দেয়া। কাজেই সৈন্য মুভ করতে সময় কোন বাধা ছিলোনা। আমার ধারণা যে সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে সৈন্যদের মুভ করতে বলেনি। এবং সেটা আমার আদেশের সম্পূর্ণ বিপরীত। যদি সে আন্তরিক হত তবে অবশ্যই তার কার্যক্রম সম্পর্কে আমাকে অবগত করত। কিন্তু ১৯ আগস্ট ‘৭৫ সকাল পর্যন্ত সে তা করেনি। 

আমি যখন ঘটনা সম্পর্কে জানতে পেরেছি তখন বিদ্রোহী সেনারা তাদের লক্ষ্যের দিকে আগাচ্ছিল। সাথে সাথে পরিস্থিতির ভয়াবহতা আঁচ করে আমি কর্নেল শাফায়াৎ জামিলকে সময় নষ্ট না করে সৈন্য পাঠিয়ে বিদ্রোহীদের দমন করতে আদেশ দেই। সময়টা সম্ভবত ৬ টা বাজার ২০ মিনিট আগে অথবা পৌনে ৬ টায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সম্ভবত সকাল ৬ টা বা তার কিছু পরে হত্যা করা হয়। অর্থাৎ যখন আমি কর্নেল শাফায়াৎ জামিলকে সৈন্য পাঠাতে নির্দেশ দিয়েছিলাম তখন তার হাতে প্রেসিডেন্টকে রক্ষার জন্য সেনা মোতায়েনের জন্য বড়জোর ২০ থেকে ২৫ মিনিট সময় ছিলো। অপরপক্ষে, আক্রমণকারীরা ইতোমধ্যে তাদের লক্ষ্যের উদ্দেশ্যে যাত্রাপথে বা হতে পারে সেখানে পৌঁছে গেছে। এই অবস্থায় কর্নেল শাফায়াৎ জামিলের পক্ষে প্রেসিডেন্টকে রক্ষা করা অসম্ভব ছিলো। 

সেটা যখন আমরা বুঝতে পেরেছি ততোক্ষণে প্রেসিডেন্ট নিহত হয়েছেন। অতএব প্রশ্ন হচ্ছে, কর্নেল শাফায়াৎ জামিল প্রেসিডেন্টকে রক্ষার জন্য কী ব্যবস্থা নিয়েছে? অথবা যখন সে বুঝতে পেরেছে সময় শেষ তখনই বা সে কী করেছে? সেদিন আমি যা দেখেছি তা হচ্ছে সে কোন ট্রুপ্স মুভ করেনি। তাহলে সে কীভাবে বলতে পারে যে সে যথেষ্ট সময় পায়নি? কেন সে তার ট্রুপ্সকে মুভ করতে বলেনি? কেউ কি তাকে সেটা করতে বাধা দিয়েছে? শুধুমাত্র কর্নেল শাফায়াৎ জামিলই এসব প্রশ্নের জবাব দিতে পারবে। যখন আমি কর্নেল শাফায়াৎ জামিলকে সৈন্য পাঠাতে বলেছিলাম তখন পর্যন্ত আমি নিজেও জানিনা বঙ্গবন্ধুর বাড়ীতে বা অন্যান্য জায়গায় কী ঘটছিলো। শুধুমাত্র DMI লে কর্নেল সালাউদ্দিন এবং MS (P) কর্নেল জামিল আহমেদ আমাকে বলেছিলো। কর্নেল শাফায়াৎ আমাকে তার কার্যক্রমের ব্যাপারে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখেছে। প্রকৃতপক্ষে সেদিন থেকে পরবর্তীকালে তার কাজ সম্পর্কে কিছুই সে আমাকে বলেনি। 

ঘটনার প্রায় চার দিন পরে কর্নেল শাফায়াৎ জেনারেল জিয়া ও বিদ্রোহী সেনাদের সম্পর্কে বলতে আমার কাছে এসেছে। আমাকে এসব বলতে কেন সে এত সময় নিল? সেটা কি বিবেকের তাড়নায়? নাকি বিদ্রোহীরা তার সাথেও বিশ্বাসঘাতকতা করেছে? কেননা, এতদিনে বিদ্রোহী সৈন্যদের কাছে কর্নেল শাফায়াতের প্রয়োজন ফুরিয়েছে। ফলে হতে পারে যে তারা তাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। আমার ধারণা এতদিন পরে আমাকে এসব বলতে আসার একটা একটা কারণ হতে পারে। কর্নেল শাফায়াৎকে বিদ্রোহীদের প্রতিহত করতে বলার বিশ থেকে পঁচিশ মিনিটেও যখন আমি সেনা মোতায়েনের কোন লক্ষণ দেখলাম না, তখন আমি শঙ্কিত হয়ে পড়লাম। তখন সে কী করছে জানতে আমি তাকে টেলিফোনে পেতে চেষ্টা করলাম। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাকে পেলাম না। তার টেলিফোন হাং-আপ করা। তখন আমি ভাবলাম সে সম্ভবত উদ্বেগের কারণে টেলিফোন রিসিভারটা যথাস্থানে রাখতে ভুলে গেছে। অথবা হতে পারে বিদ্রোহীরা তাকেও নিউট্রালাইজ করে ফেলেছে। অন্যথায় ইচ্ছাকৃতভাবে এরকম করার কোন কারণ নেই। 

তখন পর্যন্ত কর্নেল শাফায়াৎ জামিল সম্পর্কে আমার এটাই ধারণা ছিলো। সেও যে বিদ্রোহীদের অংশ সেটা তখনো মাথায় আসেনি। (উল্লেখ্য, কর্নেল শাফায়াৎ জামিলকে বঙ্গবন্ধু নিজে বাছাই করেছিলেন ব্রিগেড কমান্ড দেবার জন্য।) যদি সে এসবে জড়িত না থাকে তাহলে কেন এতদিন (১৯ আগস্ট ‘৭৫) আমাকে কেন এড়িয়ে গিয়েছে? তাও আবার যখন আমি কনফারেন্স ডেকেছি ঠিক তার আগমুহুর্ত পর্যন্ত। সে ছিলো ব্রিগেড কমান্ডার এবং ট্রুপ্সদের কমান্ডার। তারই একশন নেবার কথা এবং তার উপর সবকিছু নির্ভর করছিলো। সেও এটা জানতো। তাহলে কেন সে চার দিন পরে এখন এই ব্যাপারে কথা বলতে এসেছে? চারদিন পরে এসে যদি সে বলতে পারে তাহলে আগে কেন নয়? এরমধ্যে অনেক কিছু ঘটে গেছে। আবারো পাঠককে মনে করিয়ে দেয়, ১৭ আগস্ট ‘৭৫ মেজর রশিদ আমাকে জানায় যে যেসব অফিসারের কাছে তারা অভ্যুথান প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছে তাদের মধ্যে কর্নেল শাফায়াৎ জামিলও ছিলো। তাই সেদিন (১৯ আগস্ট ‘৭৫) তার আন্তরিকতা সম্পর্কে আমার সন্দেহ আছে। সে নিজেই তাকে সন্দেহ করার মত অবস্থা তৈরি করেছে। 

মেজর হাফিজের ব্যাপারেও আমি নিশ্চিত নই। কারণ ১৫ আগস্ট ‘৭৫ আমি মেজর হাফিজ ও মেজর রশিদকে একত্রে দেখেছি। সেদিন ৪৬ ব্রিগেড এলাকায় আমি তাদের দুজনকে অন্তরঙ্গ অবস্থায় কাজ করতে দেখেছি। সেদিন পর্যন্ত আমার ধারণা ছিলোনা যে মেজর রশিদ এই সামরিক অভ্যুত্থানের মাস্টারমাইন্ড।কিন্তু কর্নেল শাফায়াৎ জামিল ও মেজর হাফিজ সকালে এটা জানতো। তাছাড়া সেদিন মেজর হাফিজ ও মেজর রশিদ আমাকে রেডিও সেন্টারে যেতে অনুরোধ করে। অতএব মেজর হাফিজের বিশ্বস্ততা সম্পর্কে আমি নিশ্চিত হই কী করে? এই অবস্থার প্রেক্ষিতে, তাদের উপর আমার আস্থা স্থাপন করার কি কোন কারণ আছে? যাই হোক, চলে যাবার আগে আমি কর্নেল শাফায়াৎ জামিলকে বললাম যে আমি সকল আর্মার্ড ও আর্টিলারি ইউনিটকে ইউনিট লাইনে চাচ্ছি কারণ তাদেরকে সীমান্তের দিকে কিছু এসাইন্মেন্ট দেয়া হবে। তাই সে যদি মনে করে বিদ্রোহীরা এখনো শৃঙ্খলায় ফিরে আসেনি তবে এই সুযোগে সে যেন চ্যানেল অব কমান্ড পুনস্থাপন করে। এই স্টেপ নিতে হলে সৈনিকদের তার (শাফায়াৎ জামিল) নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। 

১৫ আগস্ট ‘৭৫ এর পর কমান্ডারদের সাথে এটাই আমার প্রথম মিটিং যেখানে আমি ব্যক্তিগতভাবে তাদের সাথে কথা বলতে পারবো। এই কনফারেন্সে আমি তাদেরকে বললাম কী পরিস্থিতিতে বিদ্রোহী সেনাদের মেনে নিতে হয়েছে। আলোচনাটা খুব সাবলীল হয়েছে এবং সেদিন কী ঘটেছে সেটির চুলচেরা ব্যবচ্ছেদ হয়েছে। ব্রিফিং এর সময় আমি পুরো ঘটনা তাদের বলেছি। এরপর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনায় যাবার আগে আমি CGS কে বললাম মেজর রশিদ ও মেজর ফারুককে ডেকে আনতে। আগেই তাদেরকে হেডকোয়ার্টারে আসতে বলে রাখা হয়েছিলো যাতে প্রয়োজনে ডেকে আনা যায়। গত কয়েকদিনের পরিস্থিতি বলার পর আমি দুটো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু তুলে আনলাম। প্রথম, শৃঙ্খলা ও চ্যানেল অব কমান্ড ফিরিয়ে আনা। দ্বিতীয়, সীমান্তের পরিস্থিতি। প্রথমটি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আমি সবকিছুর উপর হতাশা প্রকাশ করলাম। (বিশেষ করে ৪৬ ব্রিগেড কমান্ডের উপর)। আমি বললাম, কমান্ড ও নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলার অবস্থা যদি এই হয় তাহলে আমাদের প্রাথমিক লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব নয়, অর্থাৎ, দেশকে বহিঃশত্রুর থেকে রক্ষা করা। 

দ্বিতীয় বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আমি জানালাম, রিপোর্ট পাওয়া গেছে যে ইন্ডিয়ান আর্মি সীমান্তে জড়ো হচ্ছে। দেশে যা চলছে সেই পরিস্থিতিতে এই বিষয়টাকে হাল্কা ভাবে নেবার সুযোগ নেই। (প্রকৃতপক্ষে সীমান্তে এরকম কিছু হচ্ছিলনা। কিন্তু তবুও আমি এটার উপর বেশী জোর দিলাম। এর পেছনে কিছু কারণ আছে।) যেহেতু প্রথম দিন থেকে জেনারেল জিয়া ও মেজর ফারুক সীমান্তে ইন্ডীয়ান ফোর্স জড়ো হওয়ার কথা বলে উদ্বেগ প্রকাশ করছে, সেকারণে আমি বিষয়টাকে একটু নাটকীয়তা দিয়ে কমান্ড ও কন্ট্রোল এর উপর গুরুত্ব দিতে চাচ্ছি। (আমার প্রধান লক্ষ্য বিদ্রোহীদের উপর নিয়ন্ত্রণ আনা।) একইভাবে আমি আমার ডেপুটিকে একটা বোঝাতে চাচ্ছি যে আমি ভারতীয় সৈন্যদের ব্যাপারে তার কথাকে গুরুত্ব দিয়েছি। আলোচনা শেষে আমি ফর্মেশন কমান্ডারদের বললাম যে ‘ ‘Ops Order’ প্রস্তুত সম্পন্ন হলে তাদেরকে জানানো হবে। এর মধ্যে তারা যেন অপারেশন এলাকায় যাবার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে রাখে।  

ভারতের কথা এনে আমি বোঝালাম যে যদি আমাদের চ্যানেল অব কমান্ড ঠিক না হয় তাহলে ভারত সম্পর্কিত বিষয় মোকাবিলায় আমাদের সমস্যায় পড়তে হবে। বিপদ দরজায় কড়া নাড়ছে। তবে এখনো আমাদের সময় আছে। এরপর আমি মেজর রশিদ ও মেজর ফারুককে নির্দেশ করে বললাম সময় থাকতে তাদের উচিৎ নিজস্ব ট্রুপ্সএর উপর চ্যানেল অব কমান্ড স্থাপন করা। (এসব সৈন্যদের ভেতরে বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ঘটেছে।) আমাদের সামনে এখন বড় সমস্যা। তাই ব্যক্তিগত লাভের আসায় আমরা যেন দেশের ক্ষতি করে না ফেলি। সবশেষে, আমি মেজর রশিদ ও মেজর ফারুককে বললাম বঙ্গভবন থেকে তারা যেন অতি স্বত্বর তাদের সৈন্য সরিয়ে ফেলে যাতে তারা সামনের অপারেশন এরিয়ার জন্য রিগ্রুপ করতে পারে। আমার এই কনফারেন্সের উদ্দেশ্য ছিলো বঙ্গভবন থেকে সৈন্য সরিয়ে ক্যান্টনমেন্টে ফিরিয়ে আনা। তাদেরকে ব্যারাকে আনার আগ পর্যন্ত আমি তাদের বিরুদ্ধে কোন একশনে যেতে পারছিলাম না। তারা আমার সীমানার বাইরে ছিলো। যখন আমি প্রায় মিটিং শেষ করে ফেলছিলাম তখন হঠাৎ ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়াৎ জামিল ক্ষিপ্ত হয়ে মেজর রশিদ ও মেজর ফারুককে উদ্দেশ্য করে বলল এই দুইজনের জন্য তাদের ট্রুপ্স স্বাভাবিক চেইন অব কমান্ড ভেঙ্গেছে। তাই এদের শাস্তি হওয়া উচিৎ। সে চিৎকার করে বলল যে এদের (ফারুক-রশিদ) কোর্ট-মার্শালে বিচার হওয়া উচিৎ। ঘটনাটা হঠাৎ করে হল। আমি কর্নেল শাফায়াৎ জামিলকে থামতে বলে বললাম তার (শাফায়াৎ জামিল) উচিৎ ছিলো সময়মত ব্যবস্থা নেয়া যাতে তার অধস্তনরা চ্যানেল অব কমান্ড না ভাঙতে পারে। এই ঘটনায় কর্নেল শাফায়াৎ, মেজর রশিদ ও মেজর ফারুক অত্যন্ত বিমর্ষ হয়ে গেল। আমার মনে হল এই ঘটনায় কর্নেল শাফায়াৎ বিনা রক্তপাতে আমার কমান্ড দৃঢ় করার পথে আঘাত করল। আমি এখনো অবাক হই কেন তার ঐভাবে আচরণ করতে হল! সেটা কি অপরাধবোধ থেকে? নাকি আমার প্ল্যানটা ভেস্তে দেবার জন্য একটি ইচ্ছাকৃত চাল? যদি তাই হয়, তবে সে কার স্বার্থে কাজ করছে? 

কর্নেল শাফায়াৎ ঢাকা ব্রিগেড কমান্ডার। সবার চোখ তার ব্রিগেডের দিকে। মিলিটারি সার্কেল বা সিভিলিয়ান – সকলেই সূক্ষ্মভাবে তার ব্রিগেড কী করে সেটা দেখেছে। বিশেষ করে ১৫ আগস্ট ‘৭৫ এর দুর্যোগময় সময়ে। কর্নেল শাফায়াৎ জানতেন যে বঙ্গবন্ধু নিজে তাকে এই ব্রিগেডের কমান্ডার করেছিলেন। এবং দুর্ভাগ্যজনকভাবে তারই ট্রুপ্স বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ঘটাল। কনফারেন্সে যখন সেদিনের ঘটনাবলির ব্যবচ্ছেদ চলছিলো, কর্নেল শাফায়াৎকে খুবই হতাশ দেখাচ্ছিল। তার অধস্তন সেনা চ্যানেল অব কমান্ড ভেঙ্গে সেনাঅভ্যুত্থান করেছে, যা সে ঠেকাতে পারেনি। তার আপসেট থাকার কথা। 

সমস্ত ঘটনা কর্নেল শাফায়াৎকে জড়িয়ে। ফলে কোথাও না কোথাও কোন একভাবে তাকে কথা বলতে হবে। তার হঠাৎ রেগে যাওয়া হয়ত তার কলিগদের সামনে নিজেকে সাহসী প্রমাণের চেষ্টা। হঠাৎ চিৎকার করে মেজর রশিদ আর মেজর ফারুকের কোর্ট মার্শাল হয়ত এজন্যেই চেয়েছে। কনফারেন্স রুমে এটা করা কোনোভাবেই ঠিক হয়নি। সে যদি সত্যিই কোর্ট মার্শাল চায় তাহলে কেন সে এতদিন অপেক্ষা করেছে? যখন তারা ক্যান্টনমেন্ট দিয়ে বাধাহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছিল তখন কেন সে তাদের ধরলনা? যদি এমন হয় যে সেসময় তাদের ধরার মত অবস্থা ছিলোনা, সেক্ষেত্রে তার উচিৎ সবকিছু আগে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে তারপর তাদের বিরুদ্ধে একশন নেয়া। প্রকৃতপক্ষে আমিও তার জন্য সেধরনের গ্রাউন্ড তৈরি করছিলাম। এই কনফারেন্সটা সেজন্যই ছিলো। 

বিদ্রোহী সেনাদের টার্গেট ছিলো ক্যান্টনমেন্টের বাইরে। এবং যখন যারা বেরিয়ে যায় তখন কর্নেল শাফায়াৎ জামিলের কমান্ডে ক্যান্টনমেন্টে তিনটি ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটেলিয়ন ছিলো। এসব সৈন্য তার অর্ডারের অপেক্ষায় ছিলো। কর্নেল শাফায়াৎ তাদেরকে কোন অর্ডার দেয় নাই। ফলে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে কোন একশনে যাবার সুযোগ হারায়। তবে পরবর্তীতে সে অন্তত বিদ্রোহীদের ক্যান্টনমেন্টে পুনরায় প্রবেশ করাটা আটকাতে পারতো। সেটি করার জন্য তার যথেষ্ট সময় ও ট্রুপ্স ছিলো। যদি সে তা করত, তাহলে বিদ্রোহী সেনারা ক্যান্টনমেন্টে প্রবেশের সাহস পেতোনা। কর্নেল শাফায়াতের এত সৈন্য থাকতে কেমন করে মেজর রশিদ ও মেজর ডালিম ভেতরে ঢুকল এবং বিনা বাধায় তাদের কাজ চালিয়ে গেল? কেন তাদেরকে কোর্ট মার্শাল করার কথা বলতে তার চার দিন লেগে গেল? আগে কে তাকে থামিয়ে রেখেছিলো? আগে যদি তার কিছু করার সুযোগ নাই থাকে তাহলে কনফারেন্সের ভেতরে হঠাৎ তাদেরকে হুমকি দেবার কথা কে বলেছে? এভাবে থ্রেট দিয়ে সে কী স্বার্থ হাসিল করতে চায়? 

সে কি নিজে থেকে এটা করছে? নাকি কারো নির্দেশনায়? তার নিজের অবস্থান স্পষ্ট করতে এসবের উত্তর তাকে দিতে হবে। যদি কর্নেল শাফায়াৎ বিদ্রোহী গ্রুপের বিরুদ্ধে কোন একশন নিতে চায় তাহলে সেটা করার জন্য মোক্ষম সময় ছিলো ১৫ আহস্ট ‘৭৫ সকালবেলা। যদি সে তখন আমার কথামত কাজ করত তাহলে তার এই অবস্থা হতনা। আমার কথা না শুনে সে সেই সুযোগ হারিয়েছে। বরং সে চেষ্টা করেছে আমার ডেপুটির অর্ডার শুনতে। কারণ যাই হোক না কেন, তখন পর্যন্ত সে তাদের বিরুদ্ধে কোন একশন নেয় নাই। সেক্ষেত্রে তার উচিৎ ছিলো একটি ভালো সুযোগের অপেক্ষা করা। এরা তার নিয়ন্ত্রণে ছিলো না। কাজেই সেদিনের হুমকি পরিস্থিতিকে আরও ঘোলাটে করেছে। একইভাবে সে আমার অবস্থান দৃঢ় করার সুযোগটাও শেষ করেছে। 

এই গ্রুপটাকে শৃঙ্খলায় ফেরাতে হলে আগে এদেরকে ব্যারাকে আনতে হবে। তারা এদিক সেদিক ছড়িয়ে আছে এবং আমার আয়ত্বের বাইরে। তারা জানে তারা কী করেছে এবং ব্যর্থ হলে তাদের কী শাস্তি হতে পারে। তাই তাদের কন্ট্রোলে আনতে হলে আপাতত ভালো ব্যবহার করতে হবে। তবে তাদের বিশ্বাস অর্জন করা কঠিন কাজ। তাদের টেনশন কমাতে আমি কিছু ছাড় দিয়েছি। এতে করে তারা কিছুটা আশ্বস্ত হয়েছে। কনফারেন্সের আগে যখন কর্নেল শাফায়াৎ আমার অফিসে ছিলো তখন তাকে বলেছিলাম আমি এই কনফারেন্সে কী চাই। কনফারেন্সে আমি যখন মেজর ফারুক ও মেজর রশিদকে বঙ্গভবন থেকে তাদের ট্রুপ্স ব্যারাকে ফিরিয়ে আনতে বলেছি সেটা কর্নেল শাফায়েত নিশ্চই শুনেছে। কিন্তু তার হঠাৎ রেগে যাওয়া লাইনের বাইরে হয়েছে। এই হুমকি দিয়ে সে কি পেতে চেয়েছে? আমার অর্ডারের ফল কী হয় সেটা তার দেখে নেয়া উচিৎ ছিলো। কিন্তু তার হুমকির ফলে তারা দুর্ভাবনায় পড়েছে এবং বঙ্গভবনে তাদের অবস্থান জোরালো করেছে। 

এই দুই বিদ্রোহী ইউনিটকে বুঝতে হলে নীচের বিস্তারিত জানা প্রয়োজন। ১। বেঙ্গল ল্যান্সার – এটা আর্মার্ড রেজিমেন্ট। এটা একটাই ইউনিট এবং ঢাকায় সরাসরি হেড কোয়ার্টারের তত্ত্বাবধায়নে তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে CGS এর আন্ডারে। ট্রেনিং এর কাজ দেখে আর্মি হেডকোয়ার্টার এবং প্রশাসনিক কাজ দেখে স্টেশন হেড কোয়ার্টার। ১ ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারি ইউনিট। এটি ৪৬ ব্রিগেডের ডাইরেক্ট সাপোর্ট ইউনিট। (অর্থাৎ অপারেশন পরিচালনায় তারা ব্রিগেডের অংশ হিসেবে  ব্রিগেডের সরাসরি কমান্ডেকাজ করে।) এদের ট্রেনিং ও প্রশাসনিক কাজ দেখে ৪৬ ব্রিগেড। ফলে এদের কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবে উপরের চ্যানেল দেখভাল করে। যদি এরা কোন অস্বাভাবিক কিছু করে সেক্ষেত্রে এদের সুপিরিয়রা দেখে। 

যুদ্ধের সময় আমাদের কোন ট্যাংক ছিলো না। তবে পাকিস্তান আর্মিতে কাজ করা কিছু সদস্য ও আর্মার্ড ইউনিট আমাদের ছিলো। স্বাধীনতার পর এদেরকে আমরা কোন আর্মস বা সার্ভিসে রাখিনি। এদের দিয়ে আমরা ট্যাংক ছাড়াই আমাদের আর্মার্ড ডিভিশন করেছি। যুদ্ধের আগে পাকিস্তান আর্মির পূর্ব পাকিস্তানে ৮০ টি ট্যাংক ছিলো। এগুলোর মধ্যে আনুমানিক ৩০ টি হচ্ছে M-24 ট্যাংক এবং বাকিগুলো PT-76 এম্ফিবিয়াস ট্যাংক। 

পাকিস্তান আর্মি সারেন্ডারের পর আমরা শুধু চারটা M-24 মিডিয়াম ট্যাংকে হাত বসাতে পেরেছি। বাকিগুলো হয় যুদ্ধের ধ্বংস হয়েছে অথবা ইন্ডিয়ান আর্মি নিয়ে গিয়েছে। তাই এই ট্রুপ্সকে ব্যস্ত রাখতে আমরা শুধু ৪ টি ট্যাংক দিয়েছি। ফলে আর্মার্ড গ্রুপে ট্যাংক না থাকায় হতাশা কাজ করত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এটা বুঝতে পেরেছিলেন। সৈন্যদের মনোবল বাড়াতে মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত যখন বাংলাদেশে আসেন তখন তার কাছে বিষয়টা পাড়লেন। প্রেসিডেন্ট সাদাত সাথে সাথে ৩০ টি ট্যাংক দেবার প্রতিশ্রুতি দিলেন এবং যত কম সময়ে সম্ভব সেগুলো বাংলাদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন। ট্যাংকগুলো আসার সাথে সাথে এই ইউনিটগুলো নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করল। আমরা জানতাম যে একদিন এই ট্যাংকগুলোই বঙ্গবন্ধুকে সরানোর মোক্ষম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হবে। 

এগুলোর ট্রেনিং এর পরিকল্পনার জন্য CGS কে দায়িত্ব দেয়া হল। মেজর ফারুক নামের একজন আর্মার্ড অফিসারকে ভারপ্রাপ্ত কমান্ডিং অফিসার করা হল। এবং ট্রেনিং করাবার দায়িত্ব তাকে দেয়া হল। ঐ মুহুর্তে রিসোর্স ও অর্থসংকটের কারণে আমরা আর কোন আর্মার্ড ইউনিট করতে পারলাম না। মনে রাখতে হবে যে পাকিস্তানে অনেক সিনিয়র আর্মার্ড অফিসার রিপ্যাট্রিয়েশনের অপেক্ষায়। আমি মেজর ফারুককে এর ভারপ্রাপ্ত কমান্ডিং অফিসার করার সিদ্ধান্ত নিলাম। রিপ্যাট্রিয়েশনের পর যখন সেইসব অফিসাররা আসলো তখন নতুন একজনকে কমান্ডিং অফিসার করা হল এবং মেজর ফারুককে সেকেন্ড-ইন-কমান্ড করা হল। সেই থেকে সে মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে গেল। মনঃক্ষুণ্ণ হবার আরও একটি কারণ ছিলো। মুক্তিযোদ্ধাদের যে দুই বছরের সিনিয়রিটি দেয়া হয়েছিলো তাকে সেটা দেয়া হয়নি। এটা না দেবার কারণ হচ্ছে সে এর জন্য কোয়ালিফাই হয়নি। 

যুদ্ধের সময় যখন আমরা পাকিস্তানী সৈন্যদের বিরুদ্ধে লড়াই করছি তখন মেজর ফারুক পশ্চিম পাকিস্তানের একটি আর্মার্ড রেজিমেন্টে ছিলো। সেখান থেকে তাকে গালফ ফোর্সের সাথে আবুধাবি ডেপুটেশন দেয়া হয়। যে মুহুর্তে দেশপ্রেমিক অফিসাররা যুদ্ধে ব্যস্ত তখন মেজর ফারুক গালফ ফোর্সের সাথে লোভনীয় জীবন যাপন করছে। যুদ্ধ যখন প্রায় শেষ দিকে এবং যখন তাকে পাকিস্তান আর্মি বিদেশ থেকে চলে আসতে বলছে তখন সে বাংলাদেশে এসে যুদ্ধে যোগদান করে। তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হয় কোন আর্মিতে সে কাজ করবে – বাংলাদেশ নাকি পাকিস্তান। পরে সে বাংলাদেশ আর্মিতে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। যুদ্ধের পর বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের তাদের অবদানের জন্য দুই বছরের সিনিয়রিটি দেয়। এটি পেতে হলে একজন যোদ্ধাকে একটা নির্দিস্ট সময় পর্যন্ত লিবারেশন ফোর্সের সাথে থাকার শর্ত ছিলো। যেহেতু ফারুক সেই শর্ত পূরণ করতে পারেনি তাই তাকে ঐ সিনিয়রিটি দেয়া হয়নি। এটা নিয়ে সে সবসময়ই অভিযোগ করেছে। 

যেহেতু আর্মার্ড রেজিমেন্টের ট্রেনিং এর দায়িত্ব CGS কে দেয়া হয়েছিলো তাই কমান্ডিং অফিসারের সাথে তার নিয়মিত যোগাযোগ হত। অফিসিয়াল সম্পর্কের বাইরেও CO মেজর ফারুক CGS ব্রিগেডিয়ার খালেদের দূরসম্পর্কের ভাইপো ছিলো। রিপ্যাট্রিয়েশনের পর মেজর মোমেন কমান্ডিং অফিসার হলেও CGSএর সাথে মেজর ফারুকের আগের মতোই যোগাযোগ হত।এর ফলে কমান্ড প্রবলেম দেখা দিল। সমস্যাটা হচ্ছে অনেক সময় মেজর ফারুক তার কমান্ডিং অফিসারের মাধ্যমে না এগিয়ে সরাসরি আর্মি হেডকোয়ার্টারে CGS এর কাছ থেকে বিভিন্ন সময়ে কাজ আদায় করে ফেলত। এভাবে সে তার ইমিডিয়েট কমান্ডিং অফিসারকে এড়িয়ে যেত। এটা যখন আমার কানে আসলো তখন আমি ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে আরও বিচক্ষণ হতে বললাম। 

ট্রেনিং সিলেবাসে ট্রেনিং ডিরেক্টিভ, নাইট ট্রেনিং এগুলো সব ইউনিটের সাথে একত্রে থাকতো। আর্মার্ড ইউনিটের ক্ষেত্রেও প্রতি এক পক্ষকাল সময়ে অন্তত একটি নাইট ট্রেনিং থাকত। এই নিয়মে প্রতি অলটারনেটিভ বৃহস্পতিবার/ শুক্রবারে রাতে ইউনিটের ট্রেনিং হত। (আগস্ট ১৪/১৫ ‘৭৫ ছিলো বৃহস্পতিবার/শুক্রবার রাত)। অন্য সকল ইউনিটের জন্য একই রকম নাইট ট্রেনিং ছিলো। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ট্রেনিং এরিয়া কম ছিলো এবং এটা স্টেশন কমান্ডারের নিয়ন্ত্রণে ছিলো। 

বিভিন্ন ইউনিটের ট্রেনিং এর জন্য এসব ট্রেনিং এরিয়া CGS ও স্টেশন কমান্ডার বরাদ্দ দিতো। ফলে CGS জানতো যে আর্মার্ড ও ৪৬ ব্রিগেড ট্রেনিং এর জন্য কোথায় গিয়েছে। আরও একটি কারণে তাদের এটি জানতে হত। তা হচ্ছে অপারেশন কমান্ডার ও স্টেশন কমান্ডারের মধ্যে সমন্বয়, বরাদ্দ এবং ট্রেনিং এরিয়া চিহ্নিতকরণ। কালেক্টিভ ট্রেনিং পিরিয়ডের সময় আর্মার্ড ও আর্টিলারি ইউনিট একসাথে ট্রেনিং করত। অর্থাৎ এই দুই ইউনিট যে একসাথে ট্রেনিং করছে সেটি CGS ও ৪৬ ব্রিগেড কমান্ডারের জানা থাকতো। কারণ এই দুটো ভিন্ন ফর্মেশন ও কমান্ডারের অধীনে। কাজেই তাদের কর্মকান্ডের খোঁজ রাখতে হত। 

মেজর রশিদ ও মেজর ফারুকের ভাষ্যমতে, তারা অনেকদিন ধরেই সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলো। লক্ষ্য অর্জনের জন্য তাদের কিছু বিশ্বাসী, নিবেদিত এবং ট্রেনিংপ্রাপ্ত সৈন্য দরকার ছিলো। ফলে রাতের ট্রেনিং এ তারা ইউনিট লাইন থেকে তাদের সৈন্য নিত এবং তাদেরকে এই কাজের জন্য প্রস্তুত করত। একদম নিজেদের অল্প কিছু সৈনিক আসল বিষয়টা জানতো। বাকিরা তাদের লক্ষ্য সম্পর্কে একেবারেই অন্ধকারে ছিলো। মেজর রশিদের ভাষ্যমতে, সমমনা অফিসারদের সাথে যখন তারা এগুলো আলোচনা করত তখন তারা উৎসাহ পেত। কিন্তু যার সমর্থন দিতো তাদের বেশিরভাগ প্রকাশিত হতে চাইত না, অর্থাৎ গোপনে সমর্থন থাকতো। মেজর রশিদ বলেছিলো যে যখন সে ব্রিগেডিয়ার খালেদ ও শাফায়াৎ জামিলের কাছে প্রস্তাব দেয় তারা এটাকে শিশুসুলভ বলে সরিয়ে রাখতে বলে। এটাকে তারা এত হাল্কাভাবে দেখেছে যে তাদের নাকের ডগার উপরে মেজর রশিদ ও মেজর ফারুক কাজ করে গেলেও তারা টের পায়নি। 

ঢাকা দেশের রাজধানী এবং স্ররমি হেড কোয়ার্টারও রাজধানীতে। ক্ষমতার খুব কাছে হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু সেখানে যদি একটি একটিভ ব্রিগেড থাকে তাহলে সেটা অবশ্যই আলাদাভাবে দেখতে হবে। যখন আমরা ঢাকায় এই ব্রিগেড করি তখন আমাদের মাথায় এর দীর্ঘমেয়াদী ফল কী হতে পারে তা কল্পনায় আসেনি। এটি ঢাকায় করার পেছনে কোন কুমতলব ছিলোনা। ব্রিগেডটি কুর্মিটোলায় হবার কারণ হচ্ছে ভারত ভাগের আগে থেকে কুর্মিটোলায় একটি মিলিটারি ক্যান্টনমেন্ট ছিলো। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর, পাকিস্তান সরকারও এটাকে কুর্মিটোলা মিলিটারি ক্যান্টনমেন্ট হিসেবে বহাল রাখে। আমরা পাকিস্তানের থেকেই এটা পেয়েছি এবং এখানে সৈন্যসমাবেশের সবরকম ব্যবস্থা আগে থেকেই ছিলো। এতে আমাদের প্রাথমিক সমস্যা দূর হয়েছিলো। তবে রাজধানীর বুকে কুর্মিটোলায় একটি ব্রিগেড স্থাপন পরবর্তীতে একটি বিশেষ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। একারণে এই ব্রিগেডের আলাদা স্ট্যাটাস আছে। এবং একই সাথে এর কমান্ডারের। একজন প্রফেশনাল সৈন্যের কোন রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকা উচিৎ নয়। 

ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হওয়ায় জাতীয় কার্যক্রমের সব কিছুই ঢাকায় হয়। সকল ফর্মেশন কমান্ডার একারণেই ব্রিগেড কমান্ডার হতে চায়। পাশাপাশি শত্রুতা বা হিংসার কারণে ব্রিগেড কমান্ডারদের মধ্যেও এই স্টেশনের দায়িত্ব পাবার জন্য একটি প্রতিযোগিতা থাকে। সরকার স্বভাবতই এমন কাউকে কমান্ডার হিসেবে চায় যে তাদের অনুগত ও নির্ভরশীল। আবার উচ্চাভিলাষী অনেকে গোপনে তাদের নিজেদের পছন্দের কমান্ডারকে চায় যে তাদের স্বার্থসিদ্ধিতে কাজে লাগবে। যুদ্ধের সময় কর্নেল শাফায়াৎ জামিল ব্রিগেডিয়ার খালেদ ও জেনারেল জিয়া উভয়ের সাথেই কাজ করেছে। দুজনেই তার প্রমোটার। ফলে ফর্মেশন কমান্ডার সিলেকশনে অনেক রাজনীতি ছিলো। একজন প্রফেশনাল সৈন্য এইক্ষেত্রে হিমশিম খাবে। কর্নেল শাফায়াতের যুদ্ধকালীন কমান্ডার তাকে প্রধানমন্ত্রীর সামনে পচিরয় করার পদক্ষেপ নেয়। 

আমি ঢাকা ব্রিগেডের প্রথম ব্রিগেড কমান্ডার ছিলাম। এপ্রিল ১৯৭২ এ যখন আমি চীফ হলাম তখন এই পদটি খালি হয়। ব্যাটালিয়ন কমান্ডারদের মধ্যে মেজর (পরবর্তীকালে লে কর্নেল) জিয়াউদ্দিন ছিলেন সবচেয়ে সিনিয়র। সে ছিলো নিরপেক্ষ পছন্দ। ফলে তাকে ব্রিগেড কমান্ডার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। পেশাগত দিক দিয়ে দেখলে মেজর জিয়াউদ্দিনকে সিলেক্ট করা চমৎকার হয়েছে। কিন্তু হঠাৎ করেই তার চাকরী শেষ হয়ে যায়। সাপ্তাহিক পত্রিকা হলিডেতে সরকারের বিরুদ্ধে একটি আর্টিকেল লেখার কারণে তাকে চাকরী থেকে বরখাস্ত করা হয়। লেখার জন্য তাকে ক্ষমা চাইতে বলা হয়। কিন্তু সে ক্ষমা চায়নি। ফলে চাকরী থেকে তাকে বরখাস্ত করা হয়। পরবর্তী সিনিয়র অফিসার যিনি ছিলেন তিনি হলেন লে কর্নেল (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল) মইনুল হোসেন চৌধুরী। তাকে তখন ব্রিগেড কমান্ডার করা হয়। 

স্পষ্টবাদিতা, হাবভাব এবং একগুঁয়ে হবার কারণে অনেকের বিরাগভাজন হলেও আন্তরিকতার দিক থেকে লে কর্নেল মইনকে কেউ প্রশ্ন করতে পারবেনা। তার বিরুদ্ধে কিছু প্রচারণা হয়েছিলো। তবে সেসব এখানে বর্ননা করা আমার জন্য সুখকর নয়। সেই প্রোপাগান্ডা শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর কানে যায় এবং তখন তিনি (বঙ্গবন্ধু) চাচ্ছিলেন ঢাকা ব্রিগেড কমান্ডে একটা পরিবর্তন আনতে। তার ইচ্ছা স্বাভাবিকভাবেই আমার জন্য আদেশস্বরূপ। লে কর্নেল মইনের বিরুদ্ধে যেসব কথা ছড়িয়েছে তাতে তাকে ব্রিগেড কম্যান্ড থেকে সরানোর প্রয়োজন হল। আমার মনে হয় আমাদের ভেতরের কেউ একজন বঙ্গবন্ধুর কাছে লও কর্নেল মইনের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছে। যখন সিদ্ধান্ত হল যে তাকে সরানো হবে তখন নতুন অফিসার খোঁজা হতে লাগলো। 

এই খোঁজাটা আসলে লোকদেখানো ছিলো। আমি বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলাম কর্নেল মইনকে যেন তার পদ থেকে না সরানো হয়। কিন্তু মনে হল তিনি তাঁর সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছেন। এইসময় কর্নেল শাফায়াৎ জামিল রাজশাহী চাঁপাইনবাবগঞ্জে নক্সালদের দমনে ভালো ভূমিকা রাখে। এটা বঙ্গবন্ধুর নজরে আসে। তখন তিনি শাফায়াৎ জামিলকে ঢাকা ব্রিগেড কমান্ডার করতে নির্দেশ দেন। আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় শাফায়েত জামিল বঙ্গবন্ধুর বাছাই করা, তবে আমার মনে হয় এর পেছনে তার (শাফায়েতের) যুদ্ধকালীন কমান্ডারদের ভূমিকা রয়েছে। এভাবেই শাফায়াৎ জামিল ঢাকা ব্রিগেড কমান্ডার হয়। এখন প্রশ্ন আসতে পারে, শাফায়াৎ জামিল কি বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাশা পূরণ করতে পেরেছে? নাকি সে বিপথগামী হয়েছে? ১৫ আগস্ট ‘৭৫ তারিখে শাফায়াৎ জামিলের কিছু কাজ দেখে মনে হয়না যে সে সঠিক পথে ছিলো। আমার মতে সেদিন তার কর্মকান্ডে মনে হয়না যে সে তার উপর রাখা বিশ্বাসের মর্যাদা রক্ষা করেছে। 

১৯ আগস্ট ‘৭৫ এর কনফারেন্সে আমি মেজর রশিদ ও মেজর ফারুককে বলেছিলাম বঙ্গভবন থেকে তাদের সৈন্য ব্যারাকে ফিরিয়ে আনতে এবং অপেক্ষা করছিলাম কবে তারা কাজটি করে। যখন দেখলাম তারা কাজটি করছেনা তখন ২২ আগস্ট তারিখে আমি নিশ্চিত হতে বঙ্গভবন গেলাম। সেখানে খোন্দকার মোশতাক আরও কিছদিন এখানে তাদের রাখতে বললেন। আমি খোন্দকার মশতাককে বললাম আমার এদেরকে রিগ্রুপ করা দরকার এবং সীমান্তের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পাঠানো দরকার। আমার আশ্বস্ত করার পরেও সে আমাকে বলল আরও কিছুদিন এখানে রাখতে। তাতে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হবে। এবং তাদের বিচারের ভয় দূর হবে। এর কারণ হচ্ছে কর্নেল শাফায়াৎ জামিল কর্তৃক কোর্ট মার্শালের হুমকি। আমি খোন্দকার মোশতাককে আর জোর করলাম না, কারণ যে কারণে কাজটা করতে চাচ্ছিলাম সেটা ইতোমধ্যে ভেস্তে গেছে। 

২২ আগস্ট ‘৭৫ আমি যখন বঙ্গভবন গেলাম, মেজর রশিদকে দেখতে পেলামনা। পরে গোপনে একজন আমাকে বলেছিলো খন্দকার মোশতাক তাকে (মেজর রশিদ) জার্মানী থেকে গ্রুপ ক্যাপ্টেন তাওয়াবকে আনতে পাঠিয়েছে। খন্দকার মোশতাকের সম্ভবত এয়ার চিফ এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খোন্দকারের উপর আত্মবিশ্বাস নেই, কারণ সে (একে খোন্দকার) বঙ্গবন্ধু কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত। তার (মোশতাক) এমন কাউকে দরকার যে তার পদলেহন করবে। তাই সে পশ্চিম জার্মানি থেকে গ্রুপ ক্যাপ্টেন তাওয়াবকে আনতে পাঠিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় যখন আমরা যুদ্ধ করতে ব্যস্ত তখন তাওয়াব পশ্চিম জার্মানি ছিলো। সে সম্পূর্ণ মুক্ত ছিলো এবং চাইলেই আমাদের সাথে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করতে পারতো। কিন্তু যখন তাকে যুদ্ধে যোগদান করতে বলা হল তখন সে জানতে চাইলো যদি সে যোগদান করে তবে তাকে কী পোস্ট দেয়া হবে। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন এই আচরণ পছন্দ করেননি, তাই তিনি কোন প্রতিউত্তর দেন নাই। খোন্দকার মোশতাক একজন শুভাকাঙ্ক্ষী মনে করে তাকে (তাওয়াব) আনতে লোক পাঠালো।

ক্ষমতায় এসে একদিকে খোন্দকার মোশতাক পশ্চিম জার্মানী থেকে গ্রুপ ক্যাপ্টেন তাওয়াবকে আনতে মেজর রশিদকে পাঠাল, আরেকদিকে, জেনারেল ওসমানীকে ডেকে পাঠাল। এর আগেই একটি কথা শোনা যেতে লাগলো যে তাকে (ওসমানী) খোন্দকার মোশতাকের ডিফেন্স এডভাইজার করা হবে। ২৪ আগস্ট ‘৭৫ ছিলো রবিবার। আমি সংবাদ শোনার জন্য রেডিওর নব ঘোরাচ্ছিলাম। মাত্র ৫ মিনিটের একটা বুলেটিন শোনানো হল। অন্যান্য খবরের সাথে এটাও জানানো হল যে জেনারেল ওসমানীকে খন্দকার মোশতাকের ডিফেন্স এডভাইজার করা হয়েছে। বুলেটিন শেষ হবার সাথে সাথে আমার লাল টেলিফোন বেজে উঠলো। ওপাশে খোন্দকার মোশতাক। জিজ্ঞেস করলেন আমি রেডিও শুনেছি কিনা। আমি সম্মতি জানাতেই সে জিজ্ঞেস করল নিয়োগ আমার পছন্দ হয়েছে কিনা। আমি কী জবাব দেব? জেনারেল ওসমানীকে নিয়োগ তো দিয়েই ফেলেছেন, এখন তো কারো মত জানার দরকার নাই। তাই আমি বললাম, হ্যা এটা আমার পছন্দ হয়েছে। এরপর সে বলল বিকেল সাড়ে পাঁচটায় বঙ্গভবন আসতে। কথামত আমি বিকেলে বঙ্গভবন গেলাম তার সাথে দেখা করতে। কিন্তু তার কাছে পৌঁছানোর আগে MS (P) আমাকে জানালো খন্দকার মোশতাকের সাথে দেখা করার আগে জেনারেল ওসমানী আমার সাথে দেখা করতে চায়। ততোক্ষণে, জেনারেল ওসমানীকে বঙ্গভবনে একটি অফিস দেয়া হয়েছে। তাই প্রথমে আমি জেনারেল ওসমানীর কার্যালয়ে গেলাম। বঙ্গভবন যাবার সময় দেখতে পেলাম জেনারেল জিয়া ও ব্রিগেডিয়ার খলিল খুব তাড়াহুড়া করে বঙ্গভবন থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন। মনে হল তাদেরকে কোন কাজ দেয়া হয়েছে যার জন্য তাদের এত তাড়া। আমি যখন জেনারেল ওসমানীর রুমে গেলাম তখন মনে হল তিনি খুব উদ্বেগের সাথে আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। 

অফিসে ঢোকার সাথে সাথে জেনারেল ওসমানী আমাকে শুভেচ্ছা জানালেন। এবং বসতে বললেন। বসার সাথে সাথে তিনি বলতে শুরু করলেন, “শফিউল্লাহ, সেনাবাহিনীকে গড়ে তুলতে আর্মি চিফ হিসেবে তোমার অবদান বিশাল। শূন্য থেকে তুমি এটাকে তিলে তিলে গড়ে তুলেছ। আমি জানি তোমার জন্য আমি কী রেখে এসেছিলাম, আর আজ তুমি নিখুঁত একটি সেনাবাহিনী তৈরি করেছো। তুমি এর জন্য গর্ব করতে পারো।” আমি বললাম, “স্যার, আপনার প্রশাংশার জন্য ধন্যবাদ। স্যার, আমি শুধু গর্ব বোধ করিনা, আমি নিজেকে এর অংশ মনে করি। আমি এই সেনাবাহিনী গড়ে তোলার জন্য সর্বান্তঃকরণে চেষ্টা করেছি।” এরপর তিনি ধীরে ধীরে মূল কথায় আসলেন। আমি ভাবতে পারিনি যে তিনি এরকম কিছু বলবেন। আমি বুঝতেই পারিনি যে জেনারেল ওসমানী আমাকে বিদায়ী ভাষণ দিয়েছেন। আমি ভেবেছি ডিফেন্স এডভাইজার হিসেবে জেনারেল ওসমানী আমার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক করতে আর্মি চিফ হিসেবে আমাকে কিছুটা প্রশংসা করছিলেন। আমার কমান্ড যে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে এবং আমাকে শেষ করে দেয়া হয়েছে আমি ধরতেই পারিনি। 

এরপর হঠাৎ করে তিনি মূল বিষয়ে আসলেন। বললেন, “শফিউল্লাহ, এই দেশের জন্য মুক্তিযুদ্ধের সময় এবং তার পরবর্তীকালীন সময়ে তোমার অবদান অপরিসীম। এখন দেশের জন্য বিদেশেও তোমার সার্ভিস দরকার। প্রেসিডেন্ট চান তুমি দেশের এম্বাসেডর হও। পৃথিবীর যে কোন দেশের, যেটা তোমার ইচ্ছা।” আমার জন্য এটা ছিলো বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত। আমি শূন্যতা নিয়ে তার দিকে তাকালাম। আমি এটা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। তাই আমি জিজ্ঞেস করলাম, “আমার স্থানে কে আসছে?” তিনি বললেন, “জিয়া।” আমি জিজ্ঞেস করলাম, “সে কী জানে?” তিনি বললেন, “হ্যা, তাকে বলা হয়েছে।” এরপর আর আমি কী বলতে পারি? আমি জিজ্ঞেস করলাম, “এটা কবে থেকে শুরু হবে?” তিনি বললেন, “এটা আজকে থেকে এবং এই মুহূর্ত থেকে শুরু হবে।” তখন আমি বললাম, “খোন্দকার মোশতাক তার সাথে দেখা করার জন্য আমাকে ডেকেছেন।” 

এমন সময় একজন এসে আমাকে বলল খন্দকার মোশতাক আমাকে ডেকেছেন। যখন আমি উঠে দাঁড়ালাম জেনারেল ওসমানী আমার সাথে আসতে শুরু করলেন। আমাকে দেখে খন্দকার মোশতাক তার সহজাত ভদ্রতা দেখালেন। এবং আমাক বসতে বললেন। এরপর তিনি জেনারেল ওসমানীর দিকে তাকিয়ে ইশারায় কিছু জানতে চাইলেন। সম্ভবত এটা যে আমাকে জানানো হয়েছে কিনা। জেনারেল ওসমানী হা সূচক মাথা নাড়লেন। খোন্দকার মোশতাক একই বিষয়ে কথা শুরু করলেন। তিনিও আমাকে অনেক উৎসাহজনক বাণী দিতে লাগলেন। জেনারেল ওসমানীর মত তিনিও আমার অবদানের কথা বললেন। আমি জানি, খোন্দকার মোশতাক যা কিছু বলছেন সবই মুখের কথা। এর কোন আলাদা অর্থ নেই। বস্তুত আমাকে খালাস করে দেয়া হয়েছে এবং দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেবার পরিকল্পনা করা হয়েছে। তিনি আমার প্রতিক্রিয়া বোঝার চেষ্টা করলেন। 

খন্দকার মোশতাকের প্রস্তাবের ভিত্তিতে আমি বললাম, এই মুহূর্তে বিদেশে কোন এসাইনমেন্টে যাবার ইচ্ছা আমার নেই। তিনি সম্ভবত আমার কাছ থেকে এরকম কিছু আশা করেননি। এই মন্তব্যে তার আচরণ ছিলো কিছুটা রুক্ষ। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কি তোমার পরিবারের নিরাপত্তার কথা ভাবনা? তুমি কি দেখোনা শেখ মুজিবের পরিবারের অবস্থা কী হয়েছে?” তিনি বললেন যে তিনি এই প্রস্তাব করেছেন আমার ও আমার পরিবারের নিরাপত্তার জন্য। আমি তখন যুবক এবং বয়স খুব বেশী হলে চল্লিশ। তার এই হুমকিতে আমার প্রেশার বেড়ে গেল। আমি বললাম, আমি অদৃষ্টে বিশ্বাসী। স্রস্টার উপর আমার দৃঢ় আস্থা রয়েছে। একথা বলতে বলতে আমি আমার তর্জনি আকাশের দিকে নির্দেশ করে বললাম, যুদ্ধের সময় তিনি (সৃস্টা) আমাকে ও আমার পরিবারকে দেখে রেখেছেন। আমি নিশ্চিত তিনি এখনো সেখানে আছেন এবং একমাত্র তিনিই আমাকে ও আমার পরিবারকে দেখবেন। আর কেউ নয়। একথা বলে আমি উঠে দাঁড়ালাম এবং বঙ্গভবন থেকে বেরিয়ে যেতে লাগলাম। খন্দকার মোশতাক কৌশলে আমাকে সরিয়ে দিলো যাতে আমি ক্রিমিনালদের বিরুদ্ধে কোন একশন না নিতে পারি। 

খোন্দকার মোশতাক জানতো যে আমি তাকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে মেনে নেইনি। এবং সেভাবে তাকে কোনোদিন এড্রেস করিনি। সে তার নিজের পরিকল্পনামাফিক যত দ্রুত সম্ভব আমাকে সরিয়েছে। কারণ আমি ছিলাম বঙ্গবন্ধুর নিয়োগ করা চিফ। বর্তমান পরিস্থিতিতে আমার উপর তার কোন বিশ্বাস নেই। আমার বিরুদ্ধে একশন নেবার জন্য সে নিশ্চই সুযোগ খুঁজছিল। বঙ্গভবন থেকে আর্মার ও আর্টিলারি সরানোর জন্য আমি যে চেষ্টা করে যাচ্ছি সেটা টের পেয়েই সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যত দ্রুত সম্ভব আমাকে সরানো দরকার। এই সিদ্ধান্তে নিশ্চই মেজর রশিদ, মেজর ফারুক, মেজর ডালিম ও দলের অন্যান্যদের মত ছিলো। তারা নিশ্চই তাগাদা দিয়েছে যাতে করে তাদেরকে তুলে না নেয়া হয়। 

জেনারেল ওসমানী আমাকে বলেছিলেন যে জেনারেল জিয়া আমার স্থলাভিষিক্ত হচ্ছে। তার উপরে ২৪ আগস্ট ‘৭৫ চিফ ডিফেন্স স্টাফ (CDS) নামে একটি পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। এবং বিডিআর এর ডিজি ব্রিগেডিয়ার খলিলকে সেই পদে আনা হয়েছে। একই দিনে তাকে প্রোমোশন দিয়ে র‍্যাংক মেজর জেনারেল করা হয়েছে। এই পদ সৃষ্টির বিষয়টা অবশ্যই জেনারেল ওসমানীর মস্তিষ্কপ্রসূত। স্বাধীনতার পর সেক্টর কমান্ডারদের প্রথম কনফারেন্সে জেনারেল ওসমানী সেনাবাহিনীর চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ সম্পর্কে সূক্ষ্ম ধারণা দেন। তারা ধারণামতে CDS পদটি তিন বাহিনী প্রধানের উপরের একটি পদ। এবং এই পদের ব্যক্তি তিনবাহিনী প্রধানদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। আমরা এটার বিরোধিতা করেছিলাম। তাই এটা নিয়ে তিনি তখন কোন বাড়াবাড়ি করেননি। কিন্তু যখন জেনারেল ওসমানী ডিফেন্স এডভাইজার হলেন, তখন তিনি সেই সুযোগ ও ক্ষমতা পেলেন। সময় নষ্ট না করে তিনি সেই পদটি তৈরি করলেন। পরবর্তীতে দেখা গেল আমাদের কথা সত্য এবং জেনারেল খলিলকে CDS হিসেবে দেখা গেল। 

সেদিনের প্রোমোশনতালিকা পড়ে দেখলাম তাদের সবাই রিপ্যাট্রিয়েটেড অফিসার। ব্রিগেডিয়ার খলিলউড় রহমানকে মেজর জেনারেল করা হয়েছে। এবং CDS হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ব্রিগেডিয়ার এইচ এম এরশাদ (সে ‘ndc’ কোর্সে ভারত যাচ্ছিলো) কে মেজর জেনারেল করে তাকে ডেপুটি চিফ অব আর্মি স্টাফ করা হয়েছে। এবং ব্রিগেডিয়ার কাজী গোলাম দস্তগীরকে মেজর জেনারেল করে বিডিআর এর ডিজি করা হয়েছে। সবগুলো প্রোমোশন ও নিয়োগ ২৪ আগস্ট ‘৭৫ তারিখে করা হয়। এবং একই দিন থেকে কার্যকর ধরা হয়। সবগুলো নিয়োগের মধ্যে জেনারেল এরশাদের ডেপুটি চিফ হিসেবে নিয়োগ পাওয়াটা ছিলো সবচেয়ে অবাক করার মত। কোন ধরণের কমান্ডিং অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও তাকে ডেপুটি চিফ করা হল। 

খন্দকার মোশতাক কর্তৃক আমাকে খালাস করে বিদেশে এসাইনমেন্টে পাঠানোর সংবাদ মাথায় করে বিষণ্ণ চিত্তে আমি বাসায় ফিরে আসলাম। সেদিন বাসায় আসার আগেই আমি খবর পেলাম যে জেনারেল জিয়া অলরেডি চিফ হিসেবে দায়িত্বগ্রহণ করেছে। তার তাড়া ছিলো। যখন আমি বঙ্গভবনে পৌঁছেছিলাম, তখন সে দ্রুত আর্মি হেডকোয়ার্টারে পৌঁছায়। এবং নতুন চিফ হিসেবে অফিসারদের সামনে এড্রেস করে। জেনারেল জিয়াকে দায়িত্ব হস্তান্তরের কোন সুযোগ আমি পাইনি। এবং আমার বাহিনীর সৈন্যদেরকে বিদায় জানানোর একটা সুযোগও পাইনি। বাসায় পৌঁছানোর পর আমাকে জানানো হয় আমি যেন সেনাভবন থেকে বের না হই। একই রাতে মিনিস্ট্রি অব ডিফেন্স থেকে আমি একটা চিঠি আমার কাছে পাঠানো হয়। সেটা আমাকে অপসারণের অর্ডার। খোন্দকার মোশতাক তার ক্ষমতা গ্রহণের নবম দিনে আমাকে অপসারণ করার সিদ্ধান নিল। সেই দিন পর্যন্ত আমিই একমাত্র ব্যক্তি যার বিরুদ্ধে খন্দকার মোশতাক এধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং বাকিদের প্রোমোশন ও উচ্চপদে পদায়ন করেছে। 

পরের দিন, ২৫ আগস্ট ‘৭৫ জেনারেল ওসমানী আমাকে ফোন করে স্বান্তনা দিলেন এবং বললেন আমি যেন ফরেন এসাইনমেন্টের প্রস্তাব ফিরিয়ে না দেই। আমি জানি জেনারেল ওসমানীর কল এমনি এমনি আসেনি। তবু আমি তাকে জানালাম আমি কোথাও যাচ্ছিনা। তিনি আমাকে “না” বলতে নিষেধ করলেন এবং আরেকটু ভাবতে বললেন। এরপর প্রায়ই জেনারেল ওসমানী আমাকে ফোন করতেন এবং জিজ্ঞেস করতেন আমি মত পাল্টেছি কিনা। আমি প্রতিবারই “না” বলেছি, কিন্তু একদিন একটা সময়ে আমি “হ্যা” বলি। ৩ নভেম্বর ‘৭৫ এর ঘটনার পর আমি আমার মত পাল্টাই। যখন চার জাতীয় নেতা (জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম, জনাব তাজউদ্দীন আহমদ, জনাব মনসুর আলী এবং জনাব কাম্রুজ্জামান) কে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে সরকারী নিরাপত্তা হেফাজতে রেখে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। চাকরী থেকে অপসারণের পর থেকে আমাকে সেনাভবন থেকে বের হতে নিষেধ করা হয়। আমাকে অপসারণের আদেশটি জনসাধারণকে জানানো হয়নি। এমনকি সৈন্যরা জানতোনা যে আমাকে অপসারণ করা হয়েছে। এই খবরটা কাউকে বলতে আমি অত্যন্ত বিব্রতবোধ করতাম। সৈন্যরা সম্ভবত জানতো যে আমি ফরেন এসাইনমেন্টে যাচ্ছি। 

সরকারী চাকরী থেকে অপসারণের পরেও আমি আর্মি চিফের অফিসিয়াল বাসভদন ‘সেনাভবন’ এ থাকছিলাম। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছিলো আমি মুক্ত। কিন্তু মূলত আমি ছিলাম নিরাপত্তা হেফাজতে (প্রটেক্টিভ কাস্টডি)। আমার অবস্থা জেলের চার নেতার চেয়ে ভালো কিছু ছিলো না। পাঠককে মনে করিয়ে দেই, ২৪ আগস্ট ‘৭৫ যখন আমি খন্দকার মোশতাক কর্তৃক আমাকে বিদেশে এসাইনমেন্টের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলাম, সে তখন আমাকে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের পরিণতির কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলো। এরপর আমি দেখলাম, আমাদের জাতীয় চার নেতাকে নিরাপত্তা হেফাজতে রাখা অবস্থায় নির্মমভাবে হত্যা করা হল। ৩ নভেম্বর ‘৭৫ এর ধারাবাহিকতায় ফরেন এসাইনমেন্টে যাবার মত দেয়া ছাড়া আমার আর কিছু করার ছিলোনা। কেউ কেউ আমাকে ভীতু বলতে পারেন – সেক্ষেত্রে আমি জানতে চাইব এরকম পদক্ষেপ কয়জন নিয়েছে? সেই মুহূর্তে আমার পরিবারের নিরাপত্তাই আমার কাছে সবচেয়ে বড়। আমাকে এই সিদ্ধান্ত নিতে জোর করা হয়েছে। এবং আমি আমার স্ত্রী ও সন্তানদের নিরাপত্তার কথা ভেবে সেটা করেছি। 

আমার বিদেশ যেতে রাজি হবার সিদ্ধান্তে মিনিস্ট্রি অব ডিফেন্স দুটো চিঠি ইস্যু করে। প্রথমটি হচ্ছে অপসারণের অর্ডারটি বাতিলকরণ এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে আমাকে ওএসডি (OSD – On Special Duty) করার আদেশ।এরপর আত্তীকরণের জন্য এবং বৈদেশিক এসাইনমেন্টে পাঠানোর জন্য আমার সার্ভিস এফেয়ার্স পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। এরপর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মালয়েশিয়ায় পাঠানোর এগ্রিমেন্ট করে। এটি পাবার পর আমাকে বাইরে যেতে দেবার অনুমতি দেয়া হয় এবং আমার সৈন্যদের থেকে বিদায় নেবার সুযোগ দেয়া হয়। পাহারা সহ কিছু দ্রুত ভিজিটের আয়োজন করা হয় এবং দুই দিনে আমি হেলিকপ্টারে করে চারটি ক্যান্টনমেন্টের সবগুলোতে ভিজিট শেষ করি। এরপর আমি ৩ জানুয়ারি ‘৭৬ কুয়ালালামপুরের উদেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করি। এবং ১৯৯১ সালের ৯ জুলাই পর্যন্ত দেশের বাইরে ছিলাম। ফরেন সার্ভিসে যোগদানের এক বছর পর আমাকে ফরেন সার্ভিস ক্যাডারে আত্তীকরণ করে নেয়া হয়। 

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিবরণ দিতে গিয়ে আমি যা বর্ণনা করেছি সেটা কিছুটা দীর্ঘ মনে হতে পারে। কিন্তু মূল ঘটনা বোঝার জন্য এবং কেন বা কিভাবে এই ঘটনা ঘটেছে তা বোঝার জন্য পেছনের ইতিহাসটা জানা জরুরী। এখানে আমি বঙ্গবন্ধুর একটি কথা মনে করিয়ে দিতে চাই। যখন আমি বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলাম, “স্যার, আপনার নিরাপত্তা পর্যাপ্ত নয়”, তখন তিনি বলেছিলেন, “শফিউল্লাহ চিন্তা করোনা, বাঙালি তোমাকে বা আমাকে হত্যা করবেনা।” এই ছিলো তাঁর মনের জোর। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত বিশ্বস্ত বন্ধু তাঁর পাশে বসেই তাঁকে হত্যার ছক এঁকেছে। এবং সেই ব্যক্তিটি খন্দকার মোশতাক ছাড়া কেউ নয়। বঙ্গবন্ধু আমাকে চিফ করেছিলেন, কিন্তু তিনি আমার পাশে চক্রান্তকারীদের রেখে আমার হাত বেঁধে রেখেছিলেন। আমার হাত যদি খোলা থাকতো তাহলে আমি যে আর্মি গড়ে তুলেছিলাম সেই আর্মি কখনো তাঁর বিরুদ্ধে যেতোনা এবং যদিনা বঙ্গবন্ধু জেনারেল জিয়ার চাকরী বহাল না রাখতেন। 

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড নিয়ে আলোচনায় কেউ যখন প্রশ্ন করে চিফ কী করেছে, তাদের সেই প্রশ্নের উত্তর উপরের আলোচনায় দিয়েছি। উপরে বর্নিত পরিস্থিতির আলোকে চিফের কী করার ছিলো? আমি চিফ হলেও আমার অনেক কাজ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। একদিকে আমার হাত খোলা ছিলো না, অন্যদিকে অসন্তুষ্ট ব্যক্তিরা আমার পেছনে লেগে ছিলো। সবশেষে আরও একটি বিষয় হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর উদারতা যেটাকে কেউ কেউ ব্যবহার করেছে। বঙ্গবন্ধু মাঝে মাঝে বিভিন্ন জিনিস জানতে জুনিয়র কমান্ডারদের ডাকতেন। তিনি সেটা চিফকে এড়াতে করতেন না। এটা সম্ভবত তাঁর অভ্যাস। কিন্তু যাদের তিনি ডাকতেন তাদের কী করা উচিৎ সেটা জানা থাকা দরকার। আমি প্রেসিডেন্টের কাছে গেলে C-in-C জেনারেল ওসমানীকে জানিয়ে যেতাম এবং পরেও জানাতাম। কিন্তু কর্নেল শাফায়াৎ আমাকে কখনো বলত না যে সে প্রেসিডেন্টের কাছে যাচ্ছে বা প্রেসিডেন্ট তাকে ডেকেছে। এই অভ্যাস কর্নেল শাফায়াতকে বিশৃঙ্খল হতে সাহায্য করেছে এবং শেষটা ছিলো ভয়াবহ। 

কিছু কিছু লোক বলেন যে চিফকে সকাল সোয়া পাঁচটায় জানানো হয়েছিলো এবং বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয় ৬ টার দিকে। চিফের হাতে প্রেসিডেন্টকে রক্ষা করার জন্য ৪৫ মিনিট সময় ছিলো। সে কেন সেসময় সেনা পাঠায়নি? তাদেরকে জানতে হবে যে আর্মিতে চ্যানেল অব কমান্ড কীভাবে কাজ করে এবং কীভাবে সৈন্য মোতায়েন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। সৈন্য মুভ করাতে কিছু ধাপ রয়েছে। এটি অবস্থাভেদে ভিন্ন। প্রথমত, যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে প্রত্যেক সৈনিকের কাছে অস্ত্র ও গোলাবারুদ দেয়া হয়। এবং তখন তারা স্বল্প সময়ের নির্দেশে তাদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে। ধরা যাক ১৫ থেকে ২০ মিনিট। দ্বিতীয়টি হচ্ছে ইমার্জেন্সি অবস্থায়। এই সময়েও সৈনিকরা স্বল্প সময়ের নোটিশে মুভ করতে পারে। যদিও তখন তাদেরকে অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করতে হয়। এই অবস্থাতেও ১ ঘণ্টা বা এরকম সময় লাগতে পারে। তৃতীয়তা হচ্ছে শান্তিকালীন সময়। এসময় সব কিছু শিথিল থাকে। এই সময়ে সৈন্য মুভ করতে সময় লাগে। শান্তি কালীন সময়ে সৈন্যরা ব্যারাকে থাকলেও সেখানে তারা সাধারণ আমেজে থাকে। কারণ তখন তারা ১৫ আগস্ট ‘৭৫ বা ২৫ ফেব্রুয়ারী ‘০৯ এ বিডিআর এর সৃষ্ট ঘটনার মত পরিস্থিতির জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকেনা। এই অবস্থা নিয়ন্ত্রণে সৈন্যদের প্রস্তুত থাকতে হয়। ইউনিফর্ম পড়তেও সময় লাগে। এরপর অস্ত্র সংগ্রহ। এটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। অস্রাগারের চাবি থাকে কোয়ার্টার গার্ডের কাছে। সেই চাবি আনতেও ডিউটি অফিসার বা ডিউটি JCO কে কল দিতে হয়। এতে সময় লাগে। এরপর সৈন্য বেরুতে পারে। এই পুরো প্রক্রিয়া শেষ হতে কমপক্ষে ২ ঘণ্টা সময়ের দরকার। তাই যখন কেউ মন্তব্য করে ১৫ আগস্ট ‘৭৫ এ চিফ কেন সাথে সাথে সৈন্য পাঠাননি তখন বলতেই হয় সেসময়টা দেশে ছিলো শান্তিপূর্ন পরিবেশ (peace time situation)। আমি আশা করি জনগণ এতে করে বুঝতে পারবে কেন এত স্বল্প সময়ের নোটিশে সৈন্য পাঠানো সম্ভব হয়নি। দেশে তখন যুদ্ধকালীন বা জরুরী অবস্থা চলছিলোনা, বরং শান্তিপুর্ণ পরিবেশ ছিলো। 

এখানে আমি ১৫ আগস্ট ‘৭৫ এবং ২৫ ফেব্রুয়ারি ‘০৯ এর ঘটনা দুটির কিছু সাদৃশ্য নিয়ে আলোচনা করতে চাচ্ছি। উভয় ক্ষেত্রেই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। কিন্তু মানুষ এরজন্য প্রতিষ্ঠান প্রধান বা দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের দোষারোপ করেন, যে কেন তারা আক্রান্তদের রক্ষা করতে পারলোনা। উভয় ক্ষেত্রেই, যেসব এজেন্সির কাজ ছিলো সংশ্লিষ্টদের বিষয়টা জানানো সেটি তারা করতে ব্যর্থ হয়েছে। কর্তৃপক্ষ তখনি জেনেছে যখন আক্রমণকারীরা একশন শুরু করে দিয়েছে এবং ভিক্টিমরা ততোক্ষণে বন্দুকের মুখে। 

১৫ আগস্ট ‘৭৫ এর ঘটনায় আক্রমণকারীদের টার্গেট ছিলো ক্যান্টনমেন্টের বাইরে। গোয়েন্দা বাহিনীকে ফাঁকি দিয়ে তারা টার্গেটে পৌঁছে যায়। এটাই গোয়েন্দা বাহিনীর ব্যার্থতা। ভিক্টিমরা সব জায়গায় সাহায্য চেয়েছে। কিন্তু কেউ তাদের সাহায্য করতে যেতে পারেনি। 

১৫ আগস্ট ‘৭৫ এর ঘটনায় আক্রমণকারীরা হয়ত শত্রুদের বধ করতে যায়নি, বরং তাদের অস্তিত্বের কথা ভেবে অন দ্যা স্পট সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো। সেদিন সাধারণ নিরপেক্ষ সেনারা, তাদের চিফের একশনকে সমর্থন দেবার কথা থাকলেও, তারা বিদ্রোহীদের প্রতি সমর্থন দিয়ে বসে। ফলে চিফ চেষ্টা করেও ভিক্টিমদের রক্ষা করতে পারেনি। যেহেতু তিনি এই একশনের জন্য পর্যাপ্ত সমর্থন পাননি, তাই তার সকল চেষ্টা ব্যর্থ হয়। 

এখন আসি ২৫ ফেব্রুয়ারি ‘০৯ এর ঘটনায়। ভিক্টিম ও আক্রমণকারী উভয়েই একই জায়গায় ছিলো। আক্রমণকারীরা সিদ্ধান্ত নেয় তাদের বন্দীদের হত্যা করবে। যেহেতু ভিক্টিমরা তাদের হাতে বন্দী, তাই তারা সময় নষ্ট না করে তাদের হত্যা করে। এই সময়ে সাপোর্টিং গ্রুপ – অর্থাৎ আর্মি ও বিমান বাহিনী সাহায্যের জন্য আগ্রহী ছিলো। কিন্তু কর্তৃপক্ষ সেই সাহায্য সাথে সাথে গ্রহণ করেনি। অপরপক্ষে, ভিক্টিমরা চারিদিকে সাহায্য চাইলেও কেউ তাদের সাহায্য করেনি। ১৫ আগস্ট ‘৭৫ এবং ২৫ ফেব্রুয়ারি ‘০৯, উভয় ঘটনায় ভিক্টিমদের মেরে ফেলা হয়। উভয় ক্ষেত্রে যে অবস্থায় ভিক্টিমরা ছিলো সেই অবস্থায় তাদের রক্ষা করা যেত না। যদিও ১৫ আগস্ট ‘৭৫ এর ঘটনায় সৈন্যদের মুভ করা সম্ভব হয়নি। আর ২৫ ফেব্রুয়ারি ‘০৯ এর ঘটনায় সৈন্যরা মুভ করতে প্রস্তুত থাকলেও তাদেরকে ব্যবহার করা হয়নি। 

গুজব শোনা যায় যে, ১৫ আগস্ট ‘৭৫ এ বঙ্গবন্ধু আমাকে ফোন করেছিলেন এবং আমার কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন কিন্তু আমি নাকি ‘সরি’ বলেছি। এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট। যেই এটা বলে থাকুক না কেন, সে আসলে মানুষের কাছে আমাকে ছোট করতে চায়। আমি আগে উল্লেখ করেছি যে বঙ্গবন্ধু আমাকে ফোন দেন নাই, বরং আমি তাঁকে ফোন দিয়েছি। তাঁকে পেতে আমার ২০ থেকে ২৫ মিনিট লেগেছে, শুধু তাঁকে সর্তক করতে এবং জানাতে যে তিনি বিপদে আছেন। এই ২০ থেকে ২৫  মিনিটে বঙ্গবন্ধু নিশ্চই কারো না কারো কাছে সাহায্য চেয়েছেন, কিন্তু কেউ তাঁকে সাহায্য করতে আসেনি। 

যখন আমার সাথে বঙ্গবন্ধুর কথা হল, ততক্ষণে ঘাতকরা তার কাছে পৌঁছে গেছে। ‘সরি’ বলতে হলে আমি কেন তাঁকে ফোন করব? আমি তাঁকে বিপদে ছেড়ে দিতে তো ফোন দেইনি। আমি তাঁকে সাহায্য করার জন্য ফোন দিয়েছি। পিলখানার ঘটনায় জেনারেল শাকিল প্রধানমন্ত্রীকে সাহায্যের জন্য ফোন করেছিলো। এখানেও আক্রমণকারীরা জেনারেল শাকিলকে তাদের মুঠোয় পেয়েছিলো। তাকে (জেনারেল শাকিল) সেই অবস্থা থেকে উদ্ধার করা অসম্ভব ছিলো। কারণ সে ততোক্ষণে বন্দুকের নলের মুখে। উভয় ক্ষেত্রেই ভিক্টিমরা এমন অবস্থায় ছিলো যেখান থেকে তাদের উদ্ধার করা সম্ভব ছিলোনা। একে অপরের ঘাড়ে দোষ চাপানোর যে খেলা চলছিলো সেটা বোঝাতেই এই সাদৃশ্য আমাকে দেখাতে হল।   

১৫ আগস্ট ১৯৭৫ এর বিবৃতিগুলোর বিশ্লেষণ

বঙ্গবন্ধু হত্যার পরপর আমাকে কূটনৈতিক এসাইনমেন্টে বিদেশে জোর করে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এবং ১৯৯১ সালের জুলাই পর্যন্ত আমাকে দেশের বাইরে রাখা হয়। আমার বিদেশে থাকাকালীন সময়ে অনেক লোক বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে অনেক কিছু লিখে ফেলে। হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে এবং আমার সম্পর্কে যা লেখা হয়েছে সেসব বিষয়ে আমি সচেতন ছিলাম না। কিন্তু সেগুলো একসময় ইতিহাসের অংশ হয়ে যায়। সেসবের মধ্যে বেশ কিছু লেখায় আমার ব্যাপারে অপমানকর তথ্য যুক্ত করা হয়েছে। এটি কিছু লোক কর্তৃক আমার চরিত্র হননের লক্ষ্যে অতি পরিকল্পিত একটি কাজ। ঘটনা যাই হোক না কেন, ব্যর্থতাকে স্বীকার করার মত মানসিক শক্তি আমার আছে। সেই দুর্যোগময় মুহূর্তে আমিভুল করেছি না সঠিক করেছি ইতিহাস অবশ্যই সেই স্বাক্ষ্য দেবে। 

আগের অধ্যায়গুলোতে আমি সেই সময়ে যা করেছি, দেখেছি এবং যেসব অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি সেই বিষয়ে লিখেছি। আমি যা বলেছি তার সাথে দ্বিমত পোষণের অধিকার যে কারো আছে। কিন্তু এতদিন পরে সত্য ভিন্ন কিছু বলার কোন প্রয়োজনীয়তা আমার নেই। এটা সত্য যে বহুদিন পেরিয়ে যাবার কারণে যেভাবে অন্যান্য স্মৃতি হারিয়ে যায় সেভাবে এসব কিছু স্মৃতিও হারিয়ে গেছে। আগের অধ্যায়ে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বর্ণনা শেষে আমি এখন এবিষয়ে সেই সময়কার দায়িত্বশীল অন্যান্য ব্যক্তিরা যেসব বিবৃতি দিয়েছে সেগুলোর উপর আমার মতামত দেব। 

ঘটনা সম্পর্কে বা আমার সম্পর্কে যতকিছু বলা হয়েছে সব কিছু নিয়ে লেখা আসলে সম্ভব নয়। তবে আমার চোখে এসেছে এরকম প্রকাশিত কিছু ডকুমেন্টে পাওয়া বিবৃতি সম্পর্কে আমি বলতে চাই। প্রথমেই আমি ব্রিগেডিয়ার রউফ ও কর্নেল শাফায়াৎ জামিলের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিবৃতি নিয়ে বলব। প্রথম জন ডিজিএফআই এবং পরেরজন ঢাকা ব্রিগেড কমান্ডার। এই দুজন অফিসার বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সময় দুটি গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিল। ফলে তাদের দেয়া বিবৃতি সঠিকভাবে পর্যালোচনা করা দরকার। এই অফিসারদের ইন্টারভিউ শুরুতে সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন “মেঘনা” য় প্রকাশিত হয়। একই লেখা হুবহু প্রফেসর আবু সাইদ লিখিত “ফ্যাক্টস এন্ড ডকুমেন্টস, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড” নামক বইয়ের এনেক্সএ পৃষ্ঠা নং ২৬৭-২৮৩ তে ছাপা হয়। একই বইয়ের ২৯৩ থেকে ২৯৮ নং পাতায় ছাপা হয় কর্নেল শাফায়েত জামিলের ইন্টার্ভিউ। 

ব্রিগেডিয়ার রউফ তার ইন্টারভিউতে ঘটনা ও আমার সম্পর্কে অনেক কিছু বলেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তিনি এখন জীবিত নেই। এবং একজন মৃত ব্যক্তির বিবৃতি নিয়ে মন্তব্য করার জন্য আমি দুঃখ প্রকাশ করছি। সাধারনভাবে আমি এসব বিবৃতির জন্য মন্তব্য করতাম না। কিন্তু এখন না বলে পারছিনা কারণ সেসব তথ্য এখন রেফারেন্স হিসেবে বিভিন্ন জায়গায় ব্যবহৃত হওয়া শুরু হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. হাসানউজ্জামান তার গবেষণায় বইটি রিসার্চ ম্যাটেরিয়াল হিসেবে ব্যবহার করেছেন। ফলে আমি এসব বিবৃতি পর্যবেক্ষন করলাম এবং সঠিক তথ্য তুলে ধরতে চেষ্টা করলাম। যে কারণে ১৫ আগস্ট ‘৭৫ এর ঘটনাটি প্রতিহত করা সম্ভব হয়নি তার অন্যতম কারণ হচ্ছে গোয়েন্দা ব্যার্থতা এবং এরপর ট্রুপ্স কমান্ডারের নিষ্ক্রিয়তা। 

আমি জানি ব্রিগেডিয়ার রউফ হাস্যরসাত্মক মানুষ ছিল। সে নানান রকম সাজানো ঘটনা ও কৌতুক বলে শ্রোতাকে মুগ্ধ করে ফেলতে পারতো। কিন্তু আমি ভাবতে পারিনি যে জাতীয় গুরুত্বপূর্ন বিষয়েও সে তা করবে। তার বিবৃতি পড়ে মনে হল সে আমার মত মুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধে তার বিদ্বেষ ঝেড়েছে। দেশে ফেরার পর বেশিরভাগ রিপ্যাট্রিয়েটেড অফিসার মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ঠাট্টা করেছে। তবে কেউ কেউ আমাদের খুবই ঘৃণা করত। ব্রিগেডিয়ার রউফ তাদের একজন। আমার মনে হয়েছে সে তার রচনায় কিছুটা ঐদ্ধত্য দেখিয়েছে। আর্মড ফোর্সে সিনিয়র অফিসারদের প্রতি ঐদ্ধত্য দেখানোর কোন সুযোগ নেই। ব্রিগেডিয়ার রউফ একজন অধস্তন অফিসার ছিলো। সে যেভাবে চিফ অব স্টাফ (আমি) কে নিয়ে মিডিয়ায় বিবৃতি দিয়েছে তা অত্যন্ত আপত্তিকর। তার বিবৃতি পড়ে অনেকে মনে করতে পারে সেই চিফ বস। তার কথার ধরণে মনে হয়েছে সে চিফকে অর্ডার দিচ্ছে। যদিও চিফ এবং ব্রিগেডিয়ার রউফের মধ্যকার যে আলাপের অভিযোগ সে করেছে সেরকম কোন ঘটনাই ঘটেনি। (আমি প্রমাণ করে দেব যে তার সাথে আমার কোন কথা হয়নি।) এভাবে সে চাকরীতে থাকাকালীন সময়ে একজন আর্মি চিফের সাথে কথা বলার সাহস দেখাতে পারেনি। আমি যখন চাকরীতে নেই সেই অবস্থায় সে এই ইন্টার্ভিউতে তার ঘৃণা ছড়িয়েছে। 

তার বিবৃতি সম্পর্কে আমার প্রথম ধারণা হচ্ছে সে খুব কনফিউজড একজন ব্যক্তি। এবং আজেবাজে কথা বলেছে। তার বিবৃতিতে সে অনেক কথা বলেছে। এর মধ্যে কিছু কিছু আছে যার কোন অর্থ খুঁজে পাইনা। তাই, শুধুমাত্র প্রাসঙ্গিক ব্যাপারে তার দেয়া বিবৃতির উপর আমি মন্তব্য করতে চেষ্টা করব। ১৫ আগস্ট ‘৭৫ সম্পর্কে সে যা বলেছে তা নিম্নরূপঃ

“১৪/১৫ আগস্ট ‘৭৫ এ রাত আড়াইটার সময় DFI এর কাউন্টার ইন্টিলিজেন্সের একজন তাকে রিপোর্ট করে যে, সেই রাতে ট্রুপ্স ও ট্যাংক নিয়ে কিছু ভয়ংকর মিশনের পরিকল্পনা করা হয়েছে।” ব্রিগেডিয়ার রউফ লিখেছেন, যখন কাউন্টার ইন্টিলিজেন্সের লোক তার কাছে রিপোর্ট করছিলো, তখন সে “ফোনে অটোমেটিক ফায়ারের শব্দ শুনে।” খবর পেয়ে এবং ফোনে গুলির শব্দ শুনে সে তাকে (ইন্টিলিজেন্স অফিসার) বলে যে, এখন আর সে (ব্রিগেডিয়ার রউফ) ডিজএফআই এর প্রধান নেই। কারণ ফর্মালি পরের দিন অর্থাৎ ১৫ আগস্ট ‘৭৫ সে কর্নেল জামিলের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করতে যাচ্ছে। ব্রিগেডিয়ার রউফ তখন তাকে নতুন বস কর্নেল জামিল (তৎকালীন MS-P) কে ঘটনাটি জানাতে বলে। অফিসার তখন বলে যে সে তার নতুন বস কর্নেল জামিলের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেছে কিন্তু পাচ্ছেনা। তাই সে তার কাছে (ব্রিগেডিয়ার রউফ) রিপোর্ট করছে। এরপর ব্রিগেডিয়ার রউফ অফিসারকে বলে প্রেসিডেন্টকে জানাতে। যেহেতু সে অনেক জুনিয়র অফিসার তাই প্রেসিডেন্টকে বলা তার পক্ষে সম্ভব না বলে সে মত দেয়। ব্রিগেডিয়ার রউফ উল্লেখ করেছে যে তখন সে লাল টেলিফোনে আমাকে (আর্মি চিফ) কল করে এবং ঘটনা সম্পর্কে জানায়। তার মতে, এরপর সে পেছনের বাউন্ডারি দেয়াল পেরিয়ে লুঙ্গি-গেঞ্জি পড়ে আমার বাসায় আসে। ঢুকে সে দেখে আমার বাড়ির সামনে জেনারেল জিয়ার গাড়ি দাঁড়ানো। এবং সে ভাবে “শেষ রাতের এই সময়ে এরা এখানে কী করে?” 

১৫ আগস্ট ‘৭৫ এর ঘটনার প্রেক্ষিতে ব্রিগেডিয়ার রউফের বিবৃতি খুব সতর্কতার সাথে বিশ্লেষণ করা দরকার। লেখাটা আমি যতোই পড়ি ততোই মেজাজ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়না। কেউ যদি তার লেখা পড়ে তাহলে বুঝতে পারবে লেখায় অসংখ্য অসঙ্গতি রয়েছে। আমি এগুলো একে একে প্রমাণ করব। উদাহরণস্বরূপ, তার (ব্রিগেডিয়ার রউফ) নিজের ভাষ্যমতে তার কাছে কাউন্টার ইন্টিলিজেন্সের লোক আসে ১৪/১৫ আগস্ট ‘৭৫ রাত আড়াইটায়। সে তাকেব্রিগেডিয়ার রউফ) জানায় যে ক্যান্টনমেন্টের বাইরে কিছু ট্যাংক যাচ্ছে এবং সম্ভবত সেটি বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডি ৩২ এর দিকে। সে আরও বলেছে সে টেলিফোনে সেসময় ঐসব ট্যাংক থেকে আটোমেটিক ফায়ারের শব্দ শুনেছে। অর্থাৎ সেটা রাত আড়াইটার সময়। 

এখন ব্রিগেডিয়ার রউফের বিবৃতির সাথে মেজর ফারুকের বিবৃতি মেলাই আসুন। মেজর ফারুকের বিবৃতি অনুসারে তারা রাত সাড়ে চারটার আগে ইউনিট লাইন থেকে বের হয়নি। যদি তাই হয় তাহলে ব্রিগেডিয়ার রউফের কাউন্টার ইন্টিলিজেন্স অফিসার কেমন করে রাত আড়াইটার সময় তাদের মুভ করে দেখে? এবং ব্রিগেডিয়ার রউফ কীভাবে ট্যাংক থেকে বের হওয়া সেই শব্দ শোনে? “ফ্যাক্টস এন্ড ডকুমেন্টস” বইয়ের ২৭৩ থেকে ২৭৪ নং পাতা দেখুন। 

এবার আসুন সেনাঅভ্যুত্থানের অন্যতম পরিকল্পনাকারী মেজর ফারুকের বিবৃতি শুনি। সে ট্যাংক গুলোকে সিভিলিয়ান এরিয়ায় যেতে নির্দেশ দিয়েছিলো। মেজর ফারুক বলেছিলো যে সে ভোর সাড়ে চারটার দিকে ট্যাংকগুলোকে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হবার নির্দেশ দেয়। কিন্তু কিছু টেকনিকাল সমস্যার কারণে তারা যথাসময়ে বের হতে পারেনি। যতোই সময় গড়িয়ে যাচ্ছিলো সে অস্থির হয়ে যাচ্ছিলো। সে বলেছে অবশেষে যখন ট্যাংকগুলো ইউনিট লাইন থেকে বের হওয়া শুরু করে তখন ক্যান্টনমেন্টের কেন্দ্রীয় মসজিদে  ফজরের আজান দিচ্ছিল। (যেটা অবশ্যই ৫ টার পর)। এই বিবৃতিটাই মেজর ফারুক বাংলাবাজার পত্রিকায় দিয়েছিলো। এবং একই জিনিস আবার ১৫ আগস্ট ১৯৯৩ তারিখে ঐ পত্রিকায় ছাপা হয়। এবার আসুন অন্যদিকে জনাব এন্থনি মাস্কারেনহাস অভ্যুত্থানের অন্যতম দুই পরিকল্পনাকারী মেজর ফারুক ও মেজর রশিদের যে ইন্টার্ভিউ নিয়েছিলো সেটা দেখি। এন্থনি ম্যাস্কারেনহাস তাদের জিজ্ঞেস করে, “সকাল ৫ টা থেকে সাড়ে ৫ টার দিকে আপনি আপনার টিমকে লক্ষ্যের দিকে পাঠান। আপনি তখন কী করছিলেন? আপনি নিজেকে কোন দায়িত্ব দিয়েছিলেন?” লক্ষ্য করুন, বিদ্রোহীদের টার্গেটের উদ্দেশ্যে পাঠানো হয়েছে ভোর ৫ টা থেকে সাড়ে ৫ টার দিকে। অর্থাৎ ৫ টার আগে কোনোভাবেই তাদের ক্যান্টনমেন্ট এরিয়া থেকে বের হবার কোন সম্ভবনাই নেই। অর্থাৎ ঐ রাতে তাদেরকে ফায়ার করতে দেখার কথা নয়। এখন কাকে বিশ্বাস করবো? অভ্যত্থানের পরিকল্পনাকারী ব্রিগেডিয়ার রউফকে? নাকি বানোয়াট গল্প বলা ব্রিগেডিয়ার রউফকে?

উপরের আলোচনা থেকে বোঝা যায় ট্যাংক যখন মুভ করে তখন ফজরের আযান দিচ্ছিল, অর্থাৎ সোয়া পাঁচটার দিকে। দ্বিতীয়ত, মেজর রশিদ ও মেজর ফারুক তাদের টিম লিডারকে নির্দেশনা দেয় পাঁচটা থেকে সাড়ে পাঁচটার মধ্যে। তাছাড়া টার্গেটে পৌঁছানোর আগে তাদের ফায়ার করার কোন কারণ নেই। এই সময়ের আগে ব্রিগেডিয়ার রউফের পক্ষে সাড়ে পাঁচটার আগে ফায়ারের শব্দ শোনার সম্ভবনা নেই। যদি সে শুনেই থাকে তবে সেটি সাড়ে পাঁচটার পর হতে পারে। এর আগে নয়। আর যদি ফায়ারের শব্দ শুনে সে আমার বাসায় আসে তবে সেটি অবশ্যই সকালের দিকে, রাতে নয়। 

এধরনের তথ্য দেবার কারণে ব্রিগেডিয়ার রউফ নিজেকে একজন দায়িত্বজ্ঞ্যানহীন অফিসার হিসেবে প্রমাণ করেছে। (তার নিজের বিবৃতি দেখতে উপরে উল্লেখিত বইয়ের ২৭৪ নং পাতা দেখুন।) যখন তার কাউন্টার অফিসার তার কাছে এসে ট্যাংক মুভ করার কথা বলেছে সে তখন ঐ অফিসারকে এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করেছে এবং বলেছে ডিএফআই এর নতুন বসের কাছে অথবা সরাসরি প্রেসিডেন্টের কাছে রিপোর্ট করতে। মনে রাখা দরকার যে একটি খুব মারাত্মক ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে এবং সে সেটাকে এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করছে। তখন পর্যন্ত সে কর্নেল জামিলের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করেনি। বিষয়টা এমন যে এটা তার দায়িত্ব হলেও সে এড়িয়ে যাচ্ছে এবং জুনিয়র অফিসারের কাছে পাস করে দিচ্ছে। সে (ব্রিগেডিয়ার রউফ) এটাও বলেছে যে সে আমার সাথে লাল টেলিফোনে কথা বলেছে – এটা একটা ডাহা মিথ্যা। 

সেদিন রাতে যে ব্রিগেডিয়ার রউফ আমাকে ফোন করেনাই বা আমার সাথে কথা বলে নাই সেটা আমি কীভাবে প্রমাণ করব? তার ভাষ্যমতে সেদিন কাউন্টার ইন্টিলিজেন্সের লোক তাকে জানানোর পর যখন সে আমাকে জানায় সেই সময়টা ছিলো রাত আড়াইটা। আমি একটু আগে প্রমাণ করে দিলাম যে সেই সময়ে কোন ট্রুপ্স মুভ করেনি। ফলে সেই রাতে তার পক্ষে কোন গোলার শব্দ শোনা সম্ভব নয়। কারণ সোয়ার পাঁচটার আগে ট্যাংক ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হতে পারেনি। তাই যদি আমি বলি সে মিথ্যা বলেছে সেটা কি ভুল হবে? আমি নিশ্চিত এতক্ষণে পাঠক বুঝতে পেরেছেন যে ব্রিগেডিয়ার রউফ মিথ্যার আশ্রয় নিচ্ছে। কাজেই পাঠকের উপরেই এখন দায়িত্ব থাকলো ব্রিগেডিয়ার রউফ সত্য বলেছে নাকি মিথ্যা বলেছে। 

তার ভাষ্যে ব্রিগেডিয়ার রউফ বলেছে সে  লুঙ্গি-গেঞ্জি পরিহিত অবস্থায় আমার বাসার পেছনের বাউন্ডারি দেয়াল পেরিয়ে আমার কাছে এসেছে। আমি তাকে সেই পোষাকে দেখেছি। আমি কি জানতে পারি কেন সে পেছনের দেয়াল টপকে আমার বাসায় এসেছে? তাও আবার ওইরকম পোশাকে? সেদিন সকালে সবাই যখন মেইন গেট দিয়ে আমার বাসায় ঢুকছে-বেরুচ্ছে সেদিন সে কেন পেছনের দেয়াল টপকে আসলো? একথার জবাব সে দেয়নি, তবে আমি জানি কেন। সেটা আমি বলব। তবে তার আগে আমি প্রমাণ করব যে ঐদিন রাতের অন্ধকারে নয়, বরং সকালে সে আমার বাসায় এসেছিলো। 

ব্রিগেডিয়ার রউফের ভাষ্যমতে, সেদিন রাতে সে আমার বাড়ির পেছনের দেয়াল টপকে ভেতরে ঢুকে দেখে যে জেনারেল জিয়ার গাড়ি আমার বাসার সামনে দাঁড়ানো এবং মনে মনে ভাবে আমরা এতো রাতে এখানে কী করছি। “ফ্যাক্টস এন্ড ডকুমেন্টস” বইয়ের ২৭৬ নং পাতা দেখুন। একই বইয়ের ২৯৪ নং পাতায় কর্নেল শাফায়াৎ জামিল বলছে, “সকাল ৬ টা ১০ মিনিটে মেজর রশিদ তার কাছে এসে বলে যে তারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে।” শাফায়াৎ জামিল তখন জেনারেল জিয়ার বাজায় যায় এবং গিয়ে দেখে জেনারেল জিয়া শেভ করছে। তাহলে এই সময়টা অবশ্যই ৬ টা ১০ মিনিটের পরের কোন সময় হবে। আমি যখন জেনারেল জিয়াকে দেখেছিলাম তখন সে ক্লিন শেভ করা ছিলো। DMI থেকে খবরটা পেয়ে আমি যখন জেনারেল জিয়াকে ফোন করে আমার বাসায় আসতে বলি তখন সকাল সাড়ে পাঁচটা। ফলে জেনারেল জিয়ার পক্ষে আমার বাসায় পৌনে ছয়টার আগে আসা সম্ভব নয়। তখন একেবারে দিনের আলো বিরাজমান। অর্থাৎ ব্রিগেডিয়ার রউফ যে বলল,” তারা এতো রাতে করে কী?”- এটা আসলে মানুষকে রহস্যের জালে পেঁচিয়ে কনফিউজড করে ফেলা ছাড়া কিছু নয়; যাতে মানুষ বিশ্বাস করে যে আমাকে রাতেই জানানো হয়েছিলো। আমি যতদূর জানি এটা একটা ডাহা মিথ্যা। 

আশা করি এটা প্রমাণ করতে পেরেছি যে ব্রিগেডিয়ার রউফ মিথ্যা বলেছে। এটাও মিথ্যা যে সেই রাতে সে আমার সাথে কথা বলেছে। মনে করিয়ে দেয়া দরকার, সকালে DMI জানানোর পরে যদি আমি ব্যবস্থা নিতে পারি তাহলে রাতে জানলে কেন ব্যবস্থা নেবোনা? যদি রাতে সে (ব্রিগেডিয়ার রউফ) আমাকে জানাত তাহলে আমি ব্যবস্থা নিতে আরও বেশী সময় পেতাম। আসল তথ্য হচ্ছে সেদিন রাতে আমি অনেক দেরী করে ঘুমাতে গিয়েছিলাম। কারণ ফেনীতে নিহত ইন্ডিয়ান পাইলট ও অন্যান্য লাশগুলো নিয়ে আমি ব্যস্ত ছিলাম। সেদিন রাতে ঘুমাতে যাবার সময় আমি কারো ফোন পাইনি। প্রথম যে ব্যক্তি আমাকে জানিয়েছে সে হচ্ছে DMI, এবং সেই সময়টা সকালে, ফজরের নামাজের পরে। 

ব্রিগেডিয়ার রউফের ভাষ্যমতে, সেদিন রাতে সে আমাকে জানিয়েছিলো, কিন্তু যাকে তার সাথেসাথে জানানো উচিৎ ছিলো সে হচ্ছে বঙ্গবন্ধু। গোয়েন্দা বাহিনীর প্রধান হিসেবে এর কারণটা নিশ্চই তার জানার কথা। তার DFI সরাসরি এসব নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সাথে কাজ করে। সেই হিসেবে প্রথম ব্যক্তি হওয়া উচিৎ ছিলো প্রেসিডেন্ট, যার কাছে খবরটা যাওয়া দরকার। সে কি প্রেসিডেন্টকে এলার্ট করেছিলো? না, করেনি। অন্যদিকে, সে নিজের দায়িত্ব এড়ানোর জন্য বলেছে, সে চিফকে জানিয়েছে। যেহেতু তার কাজ সরাসরি প্রেসিডেন্টের সাথে তার কি আগে প্রেসিডেন্টকে জানানো উচিৎ ছিলোনা? সেদিন রাতে MS(P) কর্নেল জামিল আহমেদ গোয়েন্দা তদারকি করছিলো। এটাও হতে পারে যে ব্রিগেডিয়ার রউফ তার পদের উত্তরাধিকারীকে অন্ধকারে রাখতে চেয়েছে। এবং যখন ঘটনা ঘটে গেছে সে ভয়ে নিজ বাড়ি থেকে পালিয়েছে। পরে এসব লুকাতে সে কিছু ঘটনা সাজিয়েছে রিপোর্টারদের বলার জন্য। 

আসুন এবার দেখি কেন ব্রিগেডিয়ার রউফ প্রেসিডেন্টকে বা তার পদের উত্তরাধিকারীকে কেন জিনিসটা বলে নাই। ব্রিগেডিয়ার রউফ এর DFI থেকে যাবার কথা পঁচাত্তরের শুরু দিকে এবং MS(P) কর্নেল জামিলের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করার কথা। ডিজিএফআই এর মত এরকম একটি ভালো পদ থেকে সরে যেতে হবে ভেবে ব্রিগেডিয়ার রউফের ভালো লাগেনি। তাই কর্নেল জামিলকে ক্ষমতা হস্তান্তরে সে বিলম্ব করছিলো। এটাও জানা যায় কাউন্টার ইন্টিলিজেন্স অফিসারের সাথে তার যে কথা হয়েছে সেখান থেকে। হয়ত আমার ভুল হবেনা যদি বলি যে প্রেসিডেন্টকে না জানানোর এটাই প্রধান কারণ। 

এবার আসুন দেখা যাক খবর পেয়ে সে কী করেছিলো। অফিসারের থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি পেয়ে ব্রিগেডিয়ার জামিল তাকে বলে সে এখন আর ডিজিএফআই নেই এবং নতুন বসকে (কর্নেল জামিল) জানাতে বলে। মনে করিয়ে দেই, ব্রিগেডিয়ার রউফ তখনো কিন্তু কর্নেল জামিলের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করেনি। এর মানে তখনো সে-ই ডিজিএফআই। এরকম একটা গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে একজন অফিসারের কি এমনটা করা উচিৎ? প্রকৃতপক্ষে তার উচিৎ অতি সত্বর প্রেসিডেন্টের সারে যোগাযোগ করে বিষয়টা জানানো। এবং তার উচিৎ প্রেসিডেন্টের কাছে যাওয়া এবং আসন্ন বিপদ সম্পর্কে অবহিত করা। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে সে কিছুই করেনি। প্রশ্ন হচ্ছে কেন? 

ডিজিএফআই থেকে ব্রিগেডিয়ার রউফকে বদলি করে দেয়ায় সে অখুশি ছিলো, তাই সেই সময়টাই ছিলো তার অসন্তোষ দেখানোর সুযোগ্য সময়। এধরনের একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে খুব সাধারণ ও দায়িত্বজ্ঞ্যানহীন আচরণ কি করা যায়? পরিস্থিতি বিবেচনায় এই বিবৃতির কি কোন মান আছে? তাকে কি বিশ্বাস করা যায়? ধরা যাক সেদিন সে ডিজিএফআই ছিলোনা, কিন্তু অন্ততপক্ষে একজন আউটগোয়িং ডিজিএফআই হিসেবে তো ছিলো। এধরনের গুরুতর তথ্য পেয়ে সে এটাকে কীভাবে এত সাধারণভাবে (ক্যাজুয়ালি) নেয়? এরকম কিছু জানার পর প্রেসিডেন্টকে জানানোটা তো নৈতিক দায়িত্বের ভেতর পরে। কিন্তু হায়! প্রেসিডেন্টকে জানানো তো দূরের কথা, সে কাউকেই জানায় নাই। 

খবর পাবার পর যদি ব্রিগেডিয়ার রউফ প্রেসিডেন্টকে সাথে সাথে জানাতো সেক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট নিজেই হয়ত তখন সাবধান হতেন এবং আমার বা অন্য কারো কাছে সাহায্য চাইতেন। সম্ভবত প্রেসিডেন্ট তার বাড়ি আক্রমণের পরে জানতে পেরেছিলেন। ততোক্ষণে সাহায্য আশা করার সময় পেরিয়ে গেছে। যদি সে সেদিন রাতে প্রেসিডেন্টকে জানাতো অথবা তার পাশের দরজার প্রতিবেশী ঢাকা ব্রিগেড কমান্ডার শাফায়েত জামিলকে জানাতো, তাহলে হয়ত এই জাতীয় বিপর্যয় এড়ানো যেত এবং আজকে প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান জীবিত থাকতেন। 

ফজরের নামাজ শেষ হবার পর সকালে DMI লে কর্নেল সালাউদ্দিন আমাকে ঘটনাটা জানিয়েছে। সময়টা সাড়ে পাঁচটার আশেপাশে হবে। আমি যে সময়টা বললাম এটি একটা সম্ভাব্য সময়। সাথে সাথে মিঃ ঢাকা ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়াৎ জামিলকে তার কমান্ডে থাকা ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের তিনটি ইনফ্যান্ট্রি দিয়ে বিদ্রোহীদের প্রতিরোধ করতে বলি। পর্যাপ্ত সময় যাবার পরও যখন ঢাকা ব্রিগেড ট্রুপ্স এর কোন কর্মকান্ড দেখতে পাচ্ছিলাম না, তখন আমি CGS ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে ৪৬ ব্রিগেড এরিয়ায় যেতে বলি যাতে অর্ডারটা বাস্তবায়নের গতি তরান্বিত হয়; যেটা আমি কর্নেল শাফায়েত জামিলকে দিয়েছিলাম। 

সৌভাগ্যক্রমে ব্রিগেডিয়ার রউফ নিশ্চিত হল যে ব্রিগেডিয়ার খালেদ সেখানে গিয়েছিলো এবং ফিরে আমাকে রিপোর্ট করেছে। এই তথ্যটা কি আমার জন্য উদ্বেগের বিষয় নয়? ব্রিগেডিয়ার খালেদ সেখানে কী করেছে আমি এখান সেটা পয়েন্ট করছিনা। পয়েন্ট হচ্ছে আমি ৪৬ ব্রিগেডে ব্রিগেডিয়ার খালেদকে পাঠিয়েছিলাম কর্নেল শাফায়াৎ জামিলকে সাহায্য করার জন্য এবং সক্রিয় করার জন্য। ব্রিগেডিয়ার খালেদ ফিরে এসে আমাকে জানাতে পারতো সে কী করছে, এবং পরক্ষণে আমি নিজেও সেখানে গিয়ে নিশ্চিত হতে পারতাম যে সৈন্যরা মুভ করেছে। এই বিষয়টা কি আমার কাছে উদ্বেগের বিষয় নয়? বিদ্রোহী সৈন্যরা আক্রমণাত্মক হয়ে তাদের লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে জেনে সকালে যদি আমি প্রতিক্রিয়া জানাতে পারি তাহলে আরও আগে জানলে কেন ব্যবস্থা নেবোনা? আমার এই দাবী কি যুক্তিযুক্ত নয়? যদি তাই হয়, তাহলে কি প্রমাণিত হয়না যে ব্রিগেডিয়ার রউফ যে মিডিয়া ও মানুষকে বলে বেড়াচ্ছে যে সে রাত আড়াইটায় চিফকে জানিয়েছে সেটা ভুল? এখন আসুন দেখি আসলেই ব্রিগেডিয়ার রউফ রাত আড়াইটায় আমাকে জানিয়েছে কিনা। ব্রিগেডিয়ার রউফ এর ভাষ্যমতে কাউন্টার ইন্টিলিজেন্সের থেকে তথ্য পাবার পরে লাল টেলিফোনে সে আমাকে ফোন করে জানায় এবং এরপর আমার বাসায় আসে। যদি তাই হয় তাহলে আমার বাসায় ১০ থেকে ১৫ মিনিটে তার পৌঁছানোর কথা। ধরা যাক পৌনে তিনটা বা তিনটা। কারণ আমার বাসা থেকে তার বাসার দূরত্ব ১০ থেকে ১৫ মিনিটের হাঁটা পথ। তার ভাষ্যমতে আমার বাড়ীতে প্রবেশ করে যে জেনারেল জিয়ার গাড়ি দেখতে পায় এবং হতবাক হয় যে এত রাতে তারা (জেনারেল জিয়া ও আমি) কী করছি। এবার আমি প্রমাণ করে দিচ্ছি যে সে মিথ্যা বলেছে। আমার যুক্তি নিম্নরূপঃ

আমি সম্ভবত সকাল সাড়ে পাঁচটা থেকে পাঁচটা চল্লিশ মিনিটের মধ্যে কর্নাল শাফায়েত জামিলের সাথে কথা বলি। 

*কর্নেল শাফায়াৎ তার ভাষ্যে (‘ফ্যাক্টস এন্ড ডকুমেন্টস’ বইয়ের ২৯৪ নং পাতা দ্রষ্টব্য) বলেছে যে, সেদিন সকালে ৬ টা ১০ মিনিটে মেজর রশিদ তার (কর্নেল শাফায়াৎ) কাছে আসে এবং বলে যে তারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে। সে আরও বলেছে, প্রায় সেই সময়েই আমার থেকে সে একটা ফোন পায়। মেজর রশিদের সাথে সংক্ষিপ্ত কথাবার্তার পরে কর্নেল শাফায়াৎ জেনারেল জিয়ার কাছে যায় এবং দেখতে পায় যে জেনারেল জিয়া শেভ করছে। 

*যখন জেনারেল জিয়া আমার বাসায় আসে তখন সময় ছিলো সোয়া ছয়টা এবং সে ক্লিন শেভ করা ছিলো। 

*ব্রিগেডিয়ার আমার বাসায় আসে জেনারেল জিয়া ও ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ আসার অনেক পরে। তারা (জিয়া ও খালেদ) গাড়িতে করে আসলেও সে (রউফ) বাড়ির পেছনের দেয়াল টপকে আসে। 

এসব তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, আমার বাসায় সোয়া ছয়টার আগে আসা ব্রিগেডিয়ার রউফের পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু সে প্রমাণের চেষ্টা করছে সে শেষ রাতের দিকে আমার বাসায় এসেছিলো। যখন সে জেনারেল জিয়ার গাড়ি আমার বাড়ির সামনে দেখেছে তখন রাতের অন্ধকার ছিলোনা। সম্পূর্ন দিনের আলো বিরাজ করছিলো। তবুও সে (ব্রিগেডিয়ার রউফ) আশর্চবোধক বাক্যে উচ্চারণ করেছে, এতো রাতে তারা (আমি ও জেনারেল জিয়া) কী করে! সবাই আমার সাথে একমত হবেন যে আগস্টের দিকে সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে সূর্য উঠে যায়। ফলে সেসময় রাতের অন্ধকার ছিলোনা। অন্যদিকে বলা যায়, সে যদি রাত আড়াইটা থেকে তিনটার দিকে আমার বাসায় আসেও তাহলে এতক্ষণ সে কোথায় ছিলো? আমি জানি সে কোথায় ছিলো! 

আমার বাসা থেকে ব্রিগেডিয়ার রউফের বাসার দূরত্ব ১০ থেকে ১৫ মিনিটের হাঁটা পথ। অর্থাৎ পৌনে তিনটা থেকে তিনটার মধ্যে তার আমার বাসায় পৌঁছে যাবার কথা। তাই যদি হয় তাহলে রাত আড়াইটা থেকে সাড়ে ছয়টা পর্যন্ত সে কোথায় ছিলো? সে তা বলতে পারবেনা, কিন্তু আমি পারবো। এইসময়ে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের নিয়ে সে তার বাসা থেকে পালিয়ে যায় এবং গলফ কোর্সে আশ্রয় নেয়। একমাত্র স্রস্টাই জানেন কেন তাকে পালিয়ে সেখানে আশ্রয় নিতে হলো। আমার হাউজগার্ড তাদের দেখে আমার ব্যাটম্যানকে জানায় যে তারা ব্রিগেডিয়ার রউফকে গলফ কোর্সের একটা গাছের নীচে তার পরিবার ও কিছু জিনিসপত্রসহ দেখেছে। যাই হোক, যেহেতু সে সময়ের ব্যাপারে মিথ্যা বলেছে, তাই এটা আমাকে প্রমাণ করতে হবে যে সে মিথ্যার আশ্রয় নেয়। 

এটা হতে পারে যে ডিএফআই এর কাউন্টার ইন্টিলিজেন্স আর্মার ও আর্টিলারি ইউনিট ট্রুপ্স নিয়ে বেরিয়ে যাবার অনেক আগে টের পেয়েছে। এটাও হতে পারে যে ব্রিগেডিয়ার রউফ তাকে বিশ্বাস করেনি অথবা এটাকে সিরিয়ারলি নেয়নি। ফলে সে কোন ব্যবস্থা নেয়নি। আমার ধারণা সে ভাবছিলো, সেটা যদি বলে ফেলার পর দেখা যায় সত্য না, তাহলে বিষয়টা খুব স্পর্শকাতর হবে। তার এই ভীতি সম্পর্কে তার বিবৃতিতেই প্রমাণ পাওয়া যায়। ‘ফ্যাক্টস এন্ড ডকুমেন্টস’ বইয়ের ২৭৪ পাতায় দেখা যায় সে নিজেই বলেছে যে এই তথ্য যদি মিথ্যা প্রমাণিত হয় তাহলে সেটা খুব সমস্যা হয়ে যাবে। তারপরেও, যদি সে প্রতিক্রিয়া দেখাতো এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের (প্রেসিডেন্ট সহ) জানাতো তাহলে এই ইউনিটগুলোকে ক্যান্টনমেন্ট ছাড়ার আগেই বাধা দেয়া যেত। তার বাসা কর্নেল শাফায়াৎ জামিলের বাসার পাশেই। অন্তত সে তার পাশের দরজায় থাকা প্রতিবেশীকে (শাফায়াৎ জামিল) জানাতে পারতো। আমি নিশ্চিত সে তা করেনি। 

এটা বললে ভুল হবেনা যদি বলি যে, ব্রিগেডিয়ার রউফ আর্মার্ড ও আর্টিলারি রেজিমেন্টের মুভ করার খবরে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে যায় এবং নিজেকেও টার্গেট মনে করে বাসা থেকে পালিয়ে যায়। এটা বলার কারণ হচ্ছে আমার ব্যাটম্যান হাবিলদার হায়দার আলী সেদিন আমাকে তাই বলেছিল। গলফ কোর্সের পাশের অংশের দায়িত্বে থাকা আমার হাউজগার্ডরা সেদিন অন্ধকার রাতে ব্রিগেডিয়ার রউফকে তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে গলফ কোর্সে একটি গাছের নীচে দেখতে পায়। (এতে বোঝা যায় যে সে বাসায় ছিলো না, যেকারনে আমার ফোন কেউ ধরেনি।) লুঙ্গি গেঞ্জি পরে থাকার কারণে এতো রাতে এই অসময়ে সেখানে কে জড়ো হয়েছে সেটা দূর থেকে বুঝতে পারছিলোনা। ফলে যখন তারা গাছের নীচে জড়ো হয়েছে তখন তাদের উপর গার্ডরা চোখ রাখে। যদিও সেন্ট্রিরা সকালে ব্রিগেডিয়ার রউফকে চিনতে পারে যখন সে তাদেরকে ডাকে এবং আমার বাড়ির দেয়াল টপকাতে তাদের সাহায্য চায়। এভাবে সকালে সে আমার বাসায় আসে। এটাই অনেক নাটকীয় ভঙ্গিতে সে তার বিবৃতিতে উল্লেখ করেছে। ‘ফ্যাক্টস এন্ড ডকুমেন্টস’ বইয়ের ২৭৫ নং পাতা দ্রষ্টব্য। 

একথা বললে ভুল হবেনা যে, ব্রিগেডিয়ার রউফ যাকে নিরাপত্তার দেবার দায়িত্ব ছিলো, তার চাইতে নিজের নিরাপত্তা নিয়ে বেশী চিন্তিত ছিলো। সে নিজেই বলেছে যে সেও বিপদে ছিলো (তার দেয়া বিবৃতিতে)। সে বলেছে সে আমার বাসার পেছনের দেয়াল টপকে এসেছে। আমি জানিনা কেন তাকে এই ঝামেলাযুক্ত পদ্ধতিতে আমার বাসায় প্রবেশ করতে হল। সে সহজেই মেইন গেট দিয়ে আসতে পারতো। ভেতরে ঢোকার জন্য সামনের মেইন গেট দিয়ে আসাটাই সহজ ছিলো। এটা আমার মনে সন্দেহ সৃষ্ট করে। সেন্ট্রিরা তার জন্য কোন বাধা হয়নি, যেহেতু ওরাই তাকে দেয়াল টপকাতে সাহায্য করেছে। সকালে DMI লে কর্নেল সালাউদ্দিন সামনের গেট দিয়েই আমার বাসায় এসেছে। তার কাছে অস্ত্রও ছিলো। তবুও আমার বাসায় ঢুকতে সে কোন বাধা পায়নি। 

আমি বুঝতে পারি, যখন ব্রিগেডিয়ার রউফ বুঝতে পারলো যে আর্মার্ড ও আর্টিলারি ইউনিট খুব ভয়ানক একটা অভিযানে যাচ্ছে সে ভয়ে বাসা থেকে পালায়। পালানোর সময় সে ইচ্ছা করেই লুঙ্গি গেঞ্জি পরে বের হয় যাতে কেউ তাকে সহজে চিনতে না পারে। এবং সহজেই গলফ কোর্সে আশ্রয় নিতে পারে। গলফ কোর্সে বসে সে অপেক্ষা করতে থাকে এবং যখন কিছুটা নিরাপদ মনে করে তখন আমার বাসায় ঢোকার চেষ্টা করে। এটাই সে করেছিলো, যা সে খুব নাটকীয়তার সাথে বিবৃত করেছে। সে এটাকে খুব কৌতূহলিভাবে উপস্থাপন করে যাতে কেউ প্রশ্ন না করে কেন সে ঐভাবে আমার বাসায় ঢুকেছে। আমার আশা ছিলো কেউ তাকে জিজ্ঞেস করুক কেন সে মেইন গেট দিয়ে না ঢুকে ঐভাবে কষ্টকর পথে বাসায় ঢুকেছে। দেয়াল টপকানোর পর সে স্বাভাবিকভাবেই জানায় যে আমার বাসার দরজা লকড দেখতে পায়। ‘ফ্যাক্টস এন্ড ডকুমেন্টস’ বইয়ের ২৭৫ নং পাতা দেখুন। সে যেভাবে দরজা বন্ধের কথা বিবৃত করেছে তাতে মনে হয় আমার মেইন গেট বন্ধ ছিলো। সে যে দরকার কথা বলেছে সেটা আসলে ময়লা ফেলার জন্য একটি পথ, সেটা নিয়মিত প্রবেশপথ নয়। 

সবশেষে আমি বলব, একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকেও ব্রিগেডিয়ার রউফ দায়িত্বহীনের মত আচরণ করেছে। নিজের ব্যর্থতাকে স্বীকার করে নেবার মত নৈতিক সাহস তার নেই। ব্রিগেডিয়ার রউফের ব্যাপারে আমার মত কিছুটা নির্দয় মনে হতে পারে, কিন্তু আমার কিছু করার নেই। সে তার বিবৃতিতে আর্মি চিফ সম্পর্কে এমন কিছু মন্তব্য করেছে এবং সেই ব্যক্তিটি আমি। তার সাথে ১৪/১৫ আগস্ট রাতে যে সম্ভাব্য কথাবার্তা সম্পর্কে সে মিথ্যা বলেছে। তার বিবৃতিতে মানুষ মনে করেছে যে সেদিনের অশুভ পরিকল্পনা সম্পর্কে আমি ঐদিন রাতে অনেক আগে থেকেই জানতাম এবং এটা থামাতে আমি কোন একশন নেই নাই। এটা সত্য থেকে বহু দূরে এবং মানুষের সত্যটা জানা প্রয়োজন। সত্য এটাই যে, আমি যখন জেনেছি তখন আক্রমণকারীরা অলরেডি তাদের লক্ষ্যের পথে রওনা করেছে। তখন থেকেই আমি প্রাণপণে এটাকে বাধা দিতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু ব্যার্থ হয়েছি। আমার আফসোস এটা যে, একদিকে আক্রমণকারীরা আমার চোখ ফাঁকি দিয়েছে, আরেকদিকে আমার অধস্তন কমান্ডাররা আমার আশা অনুযায়ী এগিয়ে আসেনি। 

ব্রিগেডিয়ার রউফের বিবৃতি বিশ্লেষণের পর আমি এখন ৪৬ ব্রিগেডের কমান্ডার কর্নেল শাফায়াৎ জামিলের বিবৃতি সম্পর্কে সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ করব। কর্নেল শাফায়াৎ জামিলের বিবৃতি কিছু জাতীয় সৈনিকে আসে। পরবর্তীতে একই বিবৃতি প্রফেসর আবু সাইদের ‘ফ্যাক্টস এন্ড ডকুমেন্টস, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড’ নামক বইয়ের এনেক্সে ২৯৩ থেকে ২৯৮ নং পাতায় ছাপা হয়। আমি এখানে শাফায়াৎ জামিলের পাবলিক স্টেটমেন্টগুলো নিয়েই আমার আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখবো। 

নিজ কমান্ডের অধীনে যা কিছু ঘটে এবং অধস্তন কমান্ডারদের মাধ্যমে যা কিছু করেন তার জন্য চিফ অব স্টাফ দায়ী থাকেন। একজন কমান্ডার কতটা সফল হবে সেটা নির্ভর করে তার অধস্তন কমান্ডাররা কতটা দক্ষ ও আন্তরিক তার উপর। এখানে উল্লেখিত দুটো যোগ্যতার মধ্যে আন্তরিকতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৫ আগস্ট প্রেসিডেন্টের ভাগ্যে যা ঘটেছে সেটার জন্য চিফ অব স্টাফ দায়ী। কারণ তার কমান্ডের অধীনের লোকেরাই ঐদ্ধত্যপূর্ণ কাজটা করেছে। চিফ যখন তার নৈতিক দায় স্বীকার করছেন, একই সাথে অধস্তন কমান্ডার যারা সৈন্যদের নিয়ে একশন নেবার জন্য সরাসরি জড়িত থাকে তাদের উপরেও দায় বর্তায়। কর্নেল শাফায়াৎ ছিল ফিল্ড কমান্ডার। যেসকল সৈন্য প্রেসিডেন্টকে হত্যা করতে গিয়েছে তারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তার কমান্ডের অধীন। যদিও আমি কর্নেল শাফায়াৎকে যে গ্রুপটা অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে তাদের সাথে সরাসরি বলে দাবী করছিনা, কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে, যখন আমি তাকে বিদ্রোহীদের প্রতিহত করতে সেনা মোতায়েন করতে নির্দেশ দিলাম তখন কেন সে সৈন্য মুভ করেনি? আমি তাকে সে আদেশ দিলাম সে তা প্রত্যাখ্যান করেছে। 

কর্নেল শাফায়াৎ জামিল মিডিয়ায় তার ইন্টারভিউতে বলেছে ১৫ আগস্ট ‘৭৫ সকাল ৬ টা ১০ মিনিটে মেজর রশিদ তার কাছে দৌড়ে আসে এবং জানায় যে তারা শেখ মুজিবকে হত্যা করেছে। এরপর সে বলে যে, প্রায় একই সময়ে একটি টেলিফোন আসে এবং ফোনের ওপাশে ছিলাম আমি (চিফ)। তার ভাষ্যমতে, আমার কণ্ঠটা তার কাছে অত্যন্ত আবেগঘন মনে হল, যেন আমি কাঁদছি। সে উল্লেখ করে যে, আমি তাকে বলেছি যে বঙ্গবন্ধু আমাকে ফোন করেছেন এবং জানিয়েছেন যে কিছু লোক তাঁর বাড়ীতে গোলাগুলি করছে। তাই তিনি (বঙ্গবন্ধু) তখন আমাকে বিশ্বাস করেননি। কর্নেল শাফায়াৎ জামিল আরও বলে যে, ফোনে আমি শুধু আমার আবেগ প্রকাশ করেছি, কিন্তু কোন তাকে অর্ডার বা কী করতে হবে সেরকম কোন নির্দেশনা দেইনি। আরও বলেছে, যেহেতু আমি কোন অর্ডার দেই নাই তাই সে ডেপুটি চিফের কাছে নির্দেশনা পেতে গিয়েছে। যখন সে জেনারেল জিয়ার বাসায় গিয়েছে তখন সে (জেনারেল জিয়া) শেভ করছিলো। জেনারেল জিয়ার বাসায় গিয়ে যখন সে (শাফায়াৎ জামিল) তাকে (জেনারেল জিয়া) ঘটনা জানালো তখন জেনারেল জিয়া বলেছে, “তাতে কী হয়েছে, প্রেসিডেন্ট নিহত হয়েছে তো ভাইস প্রেসিডেন্ট আছে। তুমি তোমার সৈন্যদের এলার্ট রাখো” ‘ফ্যাক্টস এন্ড ডকুমেন্টস’ বইয়ের ২৯৪ থেকে ২৯৫ পাতা দ্রষ্টব্য। 

এখন বিবৃতির এই অংশ নিয়ে আলোচনা করা যাক। কর্নেল শাফায়াৎ অন্তত স্বীকার করেছে যে আমি তাকে ফোন করেছি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমি তাকে এত সকালে কেন ফোন করলাম? এবং সেসময় টেলিফোনে আমাদের কী আলাপ হতে পারে? আমি বলেছি, তাকে ফোন করে আগে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম যা ঘটছে সে তা জানে কিনা। এবং এরপর আমি তাকে DMI এর দেয়া তথ্য দেই এবং এমতাবস্থায় কী করতে হবে সেই নির্দেশ দেই। টেলিফোনে আলাপে আমি বুঝলাম যা ঘটছে সে তা জানেনা। তাই DMI এর তথ্য জানিয়ে আমি তাকে বললাম অতি সত্বর ১,২ ও ৪ নং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে ঘটনাস্থলে মুভ করতে। আমার নির্দেশ ছিলো ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটেলিয়নকে দিয়ে বিদ্রোহীদের থামানো এবং প্রয়োজনে মুখোমুখি (কনফ্রন্ট) হওয়া। যখন আমি এই অর্ডার দেই সেই সময়টা ছিলো সকাল সাড়ে পাঁচটা থেকে ৫ টা চল্লিশ মিনিট। 

সেদিন সকালে যখন আমি কর্নেল শাফায়াতের সাথে কথা বলছিলাম তখন বঙ্গবন্ধুর অবস্থা সম্পর্কে কোন তথ্য আমি তাকে দিতে পারি নাই। কারণ সেই সময় পর্যন্ত আমিও বঙ্গবন্ধুর সাথে যোগাযোগ করতে পারিনি, বঙ্গবন্ধুও আমার সাথে যোগাযোগ করতে পারেননি। কর্নেল শাফায়তের ভাষ্যমতে যদিও ধরেও নেই যে বঙ্গবন্ধুর সাথে আমার কথা হয়েছে, তাহলে ইমোশনাল হয়ে কান্নাকাটির কী আছে? কর্নেল শাফায়াৎ বলেছে, “ফোন ধরার সাথে সাথে আমি শফিউল্লাহ সাহেবের কান্নাজড়িত কণ্ঠ শুনতে পেলাম। তিনি বললেন বঙ্গবন্ধু তাকে ফোন করেছিলো এবং বলেছে কেউ তাঁর বাড়ীতে গোলাগুলি করছে। তিনি (বঙ্গবন্ধু) তখন আমাকে বিশ্বাস করতেন না, তাই তার (চিফ) কণ্ঠ আবেগঘন ছিলো।” এটা যদি কর্নেল শাফায়াৎ জামিলের বিবৃতি হয় সেক্ষেত্রে আমার প্রশ্ন এখানে এতো আবেগের কী আছে যে আমাকে কান্নাকাটি করতে হবে? সে কি আমাকে খেলো করে মানুষের কাছে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছেনা? এটা করে সে কার উদ্দেশ্য হাসিল করছে? অন্যদিকে, কর্নেল শাফায়াৎ জামিলকে আমি কেন বলতে যাবো যে বঙ্গবন্ধু আমাকে ফোন করেছিলেন – কেননা বঙ্গবন্ধু তো আমাকে কোন ফোন করেন নাই। 

অর্থাৎ কর্নেল শাফায়াৎ জামিল আমাদের মধ্যকার কথোপোকথন সম্পর্কে যা বলেছে তা ছিলো কাল্পনিক গল্প। অথবা এটা ছিলো মানুষের কাছে আমাকে ছোট করার জন্য। আমি জানিনা কেন এতো আবেগ মিশিয়ে তাকে গল্পটা বানাতে হল। এটা কি শুধুই আমাকে হীনভাবে মানুষের কাছে তুলা ধরা? যদি তাই হয়, তবে সে সফল। যদিও কর্নেল শাফায়াৎ জামিলের মত অফিসারের কাছ থেকে অপ্রত্যাশিত।  ইন্টার্ভিউতে কর্নেল শাফায়াৎ জামিল আমাদের আলোচনাকে পুরোপুরি ভিন্ন পথে নিয়ে গিয়েছে এবং আমি তাকে যে নির্দেশ দিয়েছিলাম সেটা সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছে। আমি জানিনা কেন সে মিথ্যা বলেছে এবং সত্যগুলো অস্বীকার করেছে। তবে আমি নিশ্চিত সে তার অপরাধ চাপা দিতেই এটা করেছে। সৌভাগ্যক্রমে সে বলে ফেলেছে যে সে আমার থেকে টেলিফোন কল পেয়েছিলো। 

এখানে আমার প্রশ্ন, যদি আমি তাকে কোন অর্ডার না দিয়ে থাকি, তাহলে এতো সকালে আমি কেন তাকে ফোন করে জাগাবো? এধরনের সংকটের সময়ে একজন আর্মি চিফ কী কারণে তার অধস্তন কমান্ডারকে ফোন করতে পারে? অর্ডার দিতে নয়কি? সে কি বলতে চায় আমি শুধু আমার আবেগ দেখাতে তাকে ফোন করেছি? যদি শুধু আমার ইমোশন প্রকাশ করার জন্যই তাকে ফোন করার দরকার হয় তবে আমি এতো সকালে কেন ফোন করতে যাবো? অর্ডার দেবার পরেও যখন দেখলাম ক্যান্টনমেন্ট এরিয়ায় তার কোন সৈন্য মুভ করছেনা তখন আমি কর্নেল শাফায়েতকে একটিভ করতে CGS ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে নির্দেশ দিলাম যাতে সে (কর্নেল শাফায়াৎ) ট্রুপ্স মুভ করে। যখন ব্রিগেডিয়ার খালেদ ব্যর্থ হল তখন আমি  নিজে সেখানে তাদের মুভ করাতে গেলাম। সেটা ব্রিগেডিয়ার রউফ ও কর্নেল শাফায়াৎ উল্লেখ করেছে। এগুলো কি আমার নিষ্ক্রিয়তার প্রমাণ বহন করে? যদি আমি তাকে সৈন্য মুভ করতে কোন আদেশ না দিয়ে থাকি তাহলে কেন আমি তার ব্রিগেড এরিয়ায় যাবো? আমি আমার অফিসে বসে থাকতে পারতাম এবং নির্লিপ্ত থাকতে পারতাম। পরিস্থিতি নিজের হাতে সামাল দেয়া ছাড়া আমার কি আর কোন উদ্দেশ্য ছিলো? যদি এসকল যুক্তি যথার্থ মনে হয় সেক্ষেত্রে কর্নেল শাফায়াৎ যা দাবী করেছে যে, আমি বিদ্রোহীদের প্রতিরোধ করতে কোন নির্দেশ দেইনি, সেটি ভালো কোন উদ্দেশ্য বহন করেনা।  

যে সময়ে আমি কর্নেল শাফায়াতের সাথে কথা বলেছি সেঁতা নিয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই। এটা কোনোভাবেই সকাল ৬ টা ১০ মিনিট নয়। যাই হোক, সৌভাগ্যক্রমে কর্নেল শাফায়াৎ স্বীকার করেছে যে সেদিন সকালে আমি তাকে ফোন করেছিলাম। আমার বাসায় সকাল সাড়ে পাঁচটায় DMI রিপোর্ট করতে এসেছিলো। কর্নেল শাফায়াৎকে দিয়েই একশন নিতে হবে। তাহলে কেন আমি তাকে ৬ টা ১০ মিনিটে ফোন দেব? আমরা যখন কথা বলেছিলাম তখন সময় ছিলো সাড়ে পাঁচটা থেকে পাঁচটা চল্লিশ মিনিট। অথচ কর্নেল শাফায়াৎ বলেছে যে আমি যখন তাকে কল দিয়েছি তখন ৬ টা ১০ মিনিট এবং মেজর রশিদ তাকে রিপোর্ট করেছে যে তারা শেখ মুজিবকে হত্যা করেছে। মেজর রশিদ কখন তাকে রিপোর্ট করেছে সেই সময়টা তার মনে আছে। কিন্তু আমার সাথে কথা বলার যে সময়টা সে উল্লেখ করেছে সেটি সঠিক নয়। যদি তার কথা সত্য হয় তাহলে কেন সে আমাকে জানায়নি যে মেজর রশিদ শেখ মুজিবকে হত্যা করেছে? অবশ্যই কর্নেল শাফায়াতের সাথে আমার কথা হবার অনেক পরে মেজর রশিদ তার কাছে রিপোর্ট করেছে। অতএব, আমাদের কথোপোকথন সম্পর্কে কর্নেল শাফায়াৎ যে বিবৃতি দিয়েছে সেটা সত্যকে বিবৃত করার জন্য এবং মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য। 

সে ইন্টারভিউতে যা বলেছে সেটা আমার পক্ষে বলার কথা নয়। কারণ তখনো বঙ্গবন্ধুর সাথে আমার কোন কথা হয়নি। যদি শাফায়াৎ জামিলের সাথে কথা বলার আগে বঙ্গবন্ধুর সাথে আমার কোন কথা না হয়ে থাকে তাহলে সেসব আমি কিভাবে বলেছি? প্রকৃতপক্ষে কর্নেল শাফায়াৎ জামিলের সাথে কথা হবার অনেক পরে আমার সাথে বঙ্গবন্ধুর কথা হয়। কর্নেল শাফায়াৎ জামিল বলেছে সে সকাল ৬ টা ১০ মিনিটে মেজর রশিদ তার কাছে রিপোর্ট করেছে যে তারা শেখ মুজিবকে হত্যা করেছে। যখন আমি কর্নেল শাফায়াৎ জামিলের সাথে কথা বলেছি তখন আমি জানতাম না বঙ্গবন্ধুর ভাগ্যে কী ঘটেছে। কারণ আগেই বলেছি তার অনেক পরে আমার সাথে বঙ্গবন্ধুর কথা হয়। যদি কর্নেল শাফায়াৎ জানতো যে বঙ্গবন্ধুর ভাগ্যে কী ঘটেছে তাহলে আমাকে কেন সে বলেনি? সে তার বিবৃতির কোথাও সেটা উল্লেখ করেনি। যদি সে আমাদের কথা বলার সময় তার জানা থাকতো তাহলে আলোচনার ধরন ভিন্ন হবার কথা। 

কর্নেল শাফায়াৎ তার বিবৃতিতে বলেছে, আমার থেকে কোন নির্দেশ না পেয়ে সে জেনারেল জিয়ার কাছে নির্দেশ নিতে যায়। মনে রাখা দরকার যে, রশিদ এসে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার রিপোর্ট করার পরে সে (শাফায়াৎ জামিল) জিয়ার কাছে নির্দেশ নিতে গিয়েছে। এধরনের তথ্য পাবার পর কী ধরণের নির্দেশনা তার দরকার? কর্নেল শাফায়াতের মতে জেনারেল জিয়া তাকে এলার্ট থাকতে বলেছে। এই অর্ডারের অর্থ কী? এলার্ট থাকতে বলার মানে হচ্ছে একশনে যাবার জন্য প্রস্তুত থাকা। এর অর্থ এমন না যে মুভ কর এবং বিদ্রোহীদের দমন কর। বরং এর মানে হচ্ছে প্রস্তুত হয়ে থাকো এবং লাইনে অবস্থান কর। যখন রাষ্ট্রপ্রধানকে হত্যা করা হয় সেরকম পরিস্থিতিতে একজন সিনিয়র অফিসারের কি এধরনের নির্দেশ দিতে হয়? অপরদিকে, আমার অর্ডারের কী হল? আমার অর্ডার ছিলো তাদের বাধা দেয়া, অর্থাৎ মুখোমুখি হওয়া। যদি কর্নেল শাফায়াৎ আমার অর্ডার পালন করত সেক্ষেত্রে রক্তপাতের সম্ভবনা ছিলো। কিন্তু জেনারেল জিয়ার অর্ডারের ক্ষেত্রে সেরকম কোন সম্ভবনা ছিলোনা। আমি কি ধরে নেব যে কর্নেল শাফায়াৎ এমন পথ বেছে নিয়েছে যেটায় ঝুঁকি কম? এবং সেকারণেই আমার সকল অর্ডার প্রত্যাখ্যান করেছে? 

এটা কর্নেল শাফায়াৎ জামিলে অজানা নয় যে যখন চিফ স্টেশনে থাকে তখন অর্ডার নেবার জন্য ডেপুটি চিফের কাছে অর্ডার নিতে যাওয়ার কোন অধিকার তার নেই। ডেপুটি চিফ এক্সিকিউটিভ কমান্ডার নন। সে শুধু তখনই কাজ করবে যখন চিফ থাকবেনা। এবং সেটিও অনুমোদিত হতে হবে। ডেপুটি চিফের কাছে যাবার মাধ্যমে একদিকে কর্নেল শাফায়াৎ জামিল চিফ অব স্টাফকে এড়িয়ে গিয়েছে, অপরদিকে স্বাভাবিক চ্যানেল অব কমান্ড ভঙ্গ করেছে। যদি তার অধস্তন অফিসার তার সাথে এরকম করত তখন সে কী করত? ১৫ আগস্ট ‘৭৫ এর ঘটনা স্বাভাবিক চ্যানেল অব কমান্ড ভঙ্গের একটি দৃষ্টান্ত। তাছাড়া, যদি সে নির্দেশ নিতে ডেপুটি চিফের বাসায় যেতে পারে, তাহলে চিফের বাসায় গেলে সমস্যা কোথায়? ১৫ আগস্টে কী ঘটেছে সেটা সঠিক পর্যালচনা করতে হলে এসব বিষয় সতর্কতার সাথে বিবেচনা করা প্রয়োজন। 

পরবর্তী যে বিষয়ে আমি আলোচনা করব সেটি হচ্ছে, কর্নেল শাফায়াতের সাথে ১৫ আগস্ট ‘৭৫ সকালে একবারই আমার কথা হয়। সেসময় ঘটনার বিভীষিকা সম্পর্কে আমার কোন ধারণা ছিলোনা। শুধুমাত্র DMI লে কর্নেল সালাউদ্দিন আহমেদ এবং পরে MS(P) কর্নেল জামিল আহমেদের থেকে যা জানতে পেরেছিলাম মাত্র। DMI এর থেকে তথ্য পেয়ে সবার আগে আমি বঙ্গবন্ধুর সাথে কথা বলতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু পারিনি। এরপর যাকে কল করি সে কর্নেল শাফায়াৎ। তাকেও পাইনি। এরপর MS(P) কর্নেল জামিলকে ফোন করি ও কথা বলি। কর্নেল জামিলের সাথে কথা হবার পর আমি কর্নেল শাফায়াতকে আবার ফোন করি এবং কথা বলি। তখন পর্যন্ত এই দুজন অফিসার ছাড়া আর কারো সাথে আমার কথা হয়নি। তাহলে দেখা যায়, তার ও আমার মধ্যে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কিত যে তথ্য সে দিয়েছে সেটি ভুল। তখন পর্যন্ত যেহেতু বঙ্গবন্ধুর সাথে আমার কথা হয়নি সেহেতু আমি কী করে তাকে ঐসব বলি? আমি শুধুমাত্র কর্নেল জামিলের থেকে অল্প কিছু তথ্য পেয়েছি যে, বঙ্গবন্ধু তাকে (কর্নেল জামিল) তাঁর (বঙ্গবন্ধু) বাসায় যেতে বলেছেন। অর্থাৎ আমাদের কথোপথন সম্পর্কে সে যা বলেছে সেগুলো শুধুই আমাকে ছোট করার জন্য। কর্নেল শাফায়াৎ জামিল নিজের ব্যার্থতাকে চাঁপা দেবার জন্য খুব খারাপভাবে আমাকে নীচে নামিয়েছে। ‘ফ্যাক্টস এন্ড ডকুমেন্টস’ বইতে প্রাপ্ত বিবৃতিতে যা দেখা যায় সে শুধু আমার মর্যাদাহানি করেছে। 

যেকারনে আমি বলছি যে কর্নেল শাফায়াৎ জামিল আমাকে ছোট করেছে তার কারণ হচ্ছে মানুষের কাছে সেভাবেই আমাকে উপস্থাপন করা হয়েছে। তার বিবৃতিতে মনে হয় আমার কোন চরিত্র নেই। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার বদলে আমি শুধু তাঁর সাথে আমার আবেগ ঢেলেছি। এটা একেবারেই নিম্নস্তরের কথা। এমন কিছু তখনো ঘটেনি যার জন্য এত ইমোশনাল হতে হবে। শুধুমাত্র খুনিদেরই কোন অনুভূতি বা ইমোশন থাকেনা। যখন মানুষ তার কাছের লোককে হারায় তখন সে ইমোশনাল হয়।বঙ্গবন্ধু হত্যার খবরটি অবশ্যই আমার জন্য ইমোশনাল কিন্তু সে খবরটি আমি পেয়েছি আমার অফিসে বসে। সেই সংবাদ পাবার পর কর্নেল শাফায়াতের সাথে কথা বলার কোন প্রয়োজন আমার ছিলোনা। যখন থেকে আমি তাকে বলছি বিদ্রোহীদের দমন করতে তখন থেকেই সে আমাকে এড়িয়ে গেছে। সংবাদটা আমি পেয়েছি যখন আমি ৪৬ ব্রিগেড থেকে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। তাকে (খালেদ) আমি ৪৬ ব্রিগেডে পাঠাই কর্নেল শাফায়াৎ ট্রুপ্স মুভ করেছে কিনা সেই ব্যাপারে সাহায্য করতে। 

এখন কর্নেল শাফায়াৎ জামিলের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিবৃতির বিশ্লেষণ করতে চাই। সে বলেছে, “সকাল ৬ টা ১০ মিনিটে মেজর রশিদ আমার বাসায় দৌড়ে এসে জানায় যে তারা শেখ মুজিবকে হত্যা করেছে।” আমি এই সংবাদটা বিশ্লেষণ করতে চাই। প্রথমেই আমাদের দেখতে হবে মেজর রশিদ কে এবং শেখ মুজিব কে? মেজর রশিদ ২ ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারির কমান্ডিং অফিসার এবং সে সরাসরি কর্নেল শাফায়াৎ জামিলের কমান্ডের অধীন। এবং শেখ মুজিব দেশের প্রেসিডেন্ট এবং জাতির পিতা। এখন দেখা যাক এই সংবাদ পেয়ে কর্নেল শাফায়াতের কী করা উচিৎ ছিলো এবং কী করেছে? 

যে মুহুর্তে কর্নেল শাফায়াৎ মেজর রশিদের থেকে খবর পেয়েছে সেই সময়ে তার উচিৎ ছিলো মেজর রশিদকে এরেস্ট করা এবং এরপর আমাকে জানানো। যদি সেই মুহূর্তে সে কাজটা করতে না পারে তাহলে পরে যখনই সুযোগ হয় তখনই করতে পারতো। কিন্তু বিদ্রোহীদের দমন করতে আমি যে নির্দেশ দিয়েছিলাম সেটা না করে সে ডেপুটি চিফের কাছে গিয়েছে নির্দেশ নিতে। এটাও হতে পারতো যে বিদ্রোহী দমনের নির্দেশ দেবার পরে মেজর রশিদ তার কাছে রিপোর্ট করতে গিয়েছে। কর্নেল শাফায়াৎ এরপর জেনারেল জিয়ার কাছে নির্দেশনা নিতে গিয়েছে। আমার ধারণা কর্নেল শাফায়াৎ মেজর রশিদকে নিয়ে জেনারেল জিয়ার কাছে গিয়েছে। আমি কি জানতে পারি কোন সাহসে মেজর রশিদ কর্নেল শাফায়াতের কাছে গিয়ে বলতে পারে যে তারা শেখ মুজিবকে হত্যা করেছে? সে তো আমার কাছে আসেনি। সে গিয়েছে কর্নেল শাফায়াতের কাছে। এরকম একজন মানুষকে হত্যার পর কর্নেল রশিদ কেমন করে তার কমান্ডারের কাছে গিয়ে বলতে পারে যে তারা শেখ মুজিবকে হত্যা করেছে? আমার অধস্তন অফিসার কীসের পেছনে কাজ করেছে সেটা বের করার দায়ভায় এখন আমি আমার পাঠকের হাতে দিলাম। 

কর্নেল শাফায়াৎ জামিল ছিলো ঢাকা ব্রিগেড কমান্ডার এবং সে জানতো বঙ্গবন্ধু ব্যক্তিগত পছন্দে তার নিয়োগ হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, সে কি বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাশা পূরণ করতে পেরেছে? নাকি সে বিপথে গিয়েছে? ১৫ আগস্ট ‘৭৫ এ তার কিছু কাজ দেখে বোঝা যায় সে সঠিক পথে ছিলোনা। সেই দুর্যোগময় সময়ে আমি যা দেখেছি তাতে এই মন্তব্য করে আমি ভুল কিছু বলিনি। সকালে যখন জেনারেল জিয়া ও ব্রিগেডিয়ার খালেদ আমার বাসায় আসলো আমি তখন তাদের বলেছিলাম যে কর্নেল শাফায়াৎকে একশনে যেতে বলার পরে সে যেন শূন্যে মিলিয়ে গেল। তার টেলিফোনও হাং-আপ করা। আমি তার কাছে পৌঁছাতে পারছিলাম না। এবং আমি জানিওনা সে কী করছে। কর্নেল শাফায়াৎ তার বিবৃতিতে বলেছে যে সে জেনারেল জিয়ার কাছে নির্দেশ নিতে গিয়েছে। মেজর রশিদ যখন তাকে জানিয়েছে যে তারা শেখ মুজিবকে হত্যা করেছে, এরপর আর কী নির্দেশ নিতে তার (কর্নেল জামিল) জেনারেল জিয়ার কাছে যাবার প্রয়োজন হতে পারে? অথচ জেনারেল জিয়া আমার উদ্বেগ সত্ত্বেও আমাকে সেটা বলেনি যে আমার বাসায় আসার আগে তার সাথে কর্নেল শাফায়াতের কথা হয়েছে। কর্নেল শাফায়াৎ কি পুরো সত্য বলেছে? নাকি আমার ডেপুটি আমার কাছে লুকাচ্ছে? 

কর্নেল শাফায়াৎ ৩ সেপ্টেম্বর ১৯৯৩ “ভোরের কাগজ” পত্রিকার ইন্টারভিউতে বলে যে, DMI লে কর্নেল সালাউদ্দিন চিফকে ঘটনা সম্পর্কে জানায় ৪ টা তিরিশ মিনিটে। কিন্তু চিফ আমার সাথে কথা না বলে অন্যান্য লোকদের সাথে কথা বলছিলেন এবং আমাকে যখন ফোন করেন তখন সকাল ছয়টা বাজে। অর্থাৎ চিফ জানার দেড় ঘণ্টা পরে আমাকে জানান। লে কর্নেল সালাউদ্দিন এখনো জীবিত আছে। সে নিশ্চিত বলতে পারবে সে কখন আমার বাসায় এসেছে। আমি আগেও বলেছি এখনো বলছি, DMI আমাকে জানানোর সর্বোচ্চ ৫ থেকে ১০ মিনিটের মধ্যে আমি কর্নেল শাফায়েত জামিলকে টেলিফোনে বিদ্রোহীদের দমন করতে বলি। সময়টা সম্ভবত সাড়ে পাঁচটা ছিলো। আমিও আবারো বলছি, কর্নেল শাফায়াৎ দ্বিতীয় ব্যক্তি যাদের সাথে তখন পর্যন্ত আমার ফোনে কথা হয়েছিল। (যদি ফোন করার পর তার ফোন বিজি না থাকতো তাহলে সেই হত প্রথম ব্যক্তি।) সে ছিলো ট্রুপ্স কমান্ডার যার উপর সমস্ত বিষয় নির্ভরশিল। কাজেই তার সাথে কথা না বলে অন্যদের সাথে কথা বলে সময় নষ্ট করেছি এমন প্রশ্ন ওঠার সুযোগই নেই। কেন আমি মূল্যবান সময় নষ্ট করব? 

আমি জানিনা কর্নেল শাফায়াৎ ইন্টারভিউতে কী বোঝাতে চেয়েছে। সে কি বোঝাতে চেয়েছে যে বিদ্রোহীদের কাজে আমার মদদ ছিলো? যদি তাই হবে তাহলে প্রেসিডেন্টকে হত্যার পর মেজর রশিদ আমার কাছে না এসে কেন শাফায়াতের কাছে গিয়েছে? এখানে পাঠককে মনে করিয়ে দিতে চাই, ১৫ আগস্ট ‘৭৫ এর পর আমিই একমাত্র ব্যক্তি যাকে চাকরী থেকে খোন্দকার মোশতাক বরখাস্ত করে। এবং বাকিদের প্রোমোশন ও পুরস্কৃত করা হয়। এটা কর্নেল শাফায়াতের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কারণ তাকেও কোন স্পর্শ করা হয়নি এবং সে ঢাকা ব্রিগেড কমান্ডার হিসেবেই থেকে যায়। কাজেই সে মানুষকে এধরনের পরোক্ষ ইঙ্গিত করে ভুল দিকে পরিচালিত করতে  পারেনা। কর্নেল শাফায়াতের সাথে কথা শেষ হলে আমি অন্যদের ফোন দেই। যেমন, এয়ার চিফ, ন্যাভাল চিফ, DCOS ও CGS, ইত্যাদি। তাদের আমি ফোন দিয়েছি এটা আলোচনা করতে যে সময় নষ্ট না করে শাফায়াতের জন্য বসে না থেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে আমাদের আর কী করা উচিৎ। আমি কর্নেল শাফায়াৎ জামিলকে বিদ্রোহীদের দমনে সৈন্য পাঠাতে বললেও সে কোন সৈন্য মুভ করার অর্ডার দেয়নি। 

সেই প্রশ্নেরও জবাব দিয়েছি যে DMI এর থেকে সাড়ে চারটায় আমি খবর পাইনি। আমার ব্যাখ্যা কারো কারো কাছে মনপুত হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. হাসানউজ্জামানের কাছে আমার ব্যাখ্যা যুক্তিযুক্ত মনে হয়নি। তাকে এতোটাই পক্ষপাতদুষ্ট ও প্রতিহিংসাপরায়ণ মনে হয়েছে যে আমার যুক্তির বিপক্ষে যুক্তি না দিয়ে সে তার লেখায় আমার সম্পর্কে হানিকর ও ব্যঙ্গপূর্ণ মন্তব্য করেছে। একজন উচ্চমানের বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যক্তি হিসেবে তাকে অবস্থান দেয়া যায়না। এবং আমি দুঃখিত হই এই ভেবে যে এধরনের যোগ্যতাসম্পন্ন একজন ব্যক্তি সূক্ষ্ম বিচারশক্তি ও স্বাস্থ্যকর যুক্তি গ্রহণ করার মানসিকতা রাখেন না। আমি যুক্তি দিয়েই প্রমাণ করেছি যে রাত সাড়ে চারটায় DMIএর পক্ষে আমাকে  জানানো সম্ভব ছিলোনা, যেটা কর্নেল শাফায়াৎ দাবী করেছে। যদি আমি সাড়ে চারটায় জানতাম তাহলে এত সময় নষ্ট কেন করব? আমার কি আর কোন পরিকল্পনা ছিলো? উত্তর হচ্ছে, “না”। পাঠকের সুবিধার জন্য আমি আবারো যুক্তি দিচ্ছি যে কেন DMI এর পক্ষে সাড়ে চারটায় আমাকে জানানো সম্ভব নয়। 

১৫ আগস্ট ‘৭৫ এর বিদ্রোহ যারা শুরু করে তাদের নেতাদের মধ্যে মেজর ফারুক অন্যতম। ১৫ আগস্ট ১৯৯২ বাংলাবাজার পত্রিকায় ইন্টারভিউতে সে বলেছে, ১৪/১৫ আগস্ট মাঝরাতে সে তার সৈন্যদের ব্যারাক থেকে বের হতে নির্দেশ দেয়। কিন্তু কিছু কারিগরি ত্রুটির কারণে তাদের যাত্রা বিলম্ব হয়। মেজর ফারুক বলে, “যেহেতু ট্যাংকগুলো মুভ করতে দেরী হচ্ছিলো তাই সে টেনশনে পরে যায় যেন তার হার্ট এটাক হবে।” পরে সে বলেছে, যখন ট্যাংকগুলো রওনা করতে শুরু করে তখন ক্যান্টনমেন্ট কেন্দ্রীয় মসজিদ থেকে ফজরের আযান দিচ্ছিলো। যদি ট্যাংকগুলো সময়মত বের হতে পারতো তাহলে মেজর ফারুক এত উত্তেজনা অনুভব করতনা। অর্থাৎ এটা বললে ভুল হবেনা যে ট্যাংকগুলো পাঁচটার পরে বেরিয়েছে এবং সেই সময়েই ফজরের আযান দেয়। (আগস্টের দিকে প্রায় পৌনে পাঁচটার দিকে ফজরের আযান দেয়।) অতএব, ট্যাংক যখন রওনা করেছে তখন সময় কমপক্ষে পৌনে পাঁচটা। 

ট্যাংকগুলো বের হবার আগে এগুলো ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে একটি জায়গায় জড়ো করতে কিছুটা সময় লেগেছে। মনে রাখা দরকার যে, যতক্ষণ এগুলো ক্যান্টনমেন্টের ভেতর নড়াচড়া করছে ততক্ষণ এটা দেখে সন্দেহ করার কোন কারণ নেই (গোয়েন্দা সম্পর্কিত বিষয় সহ)। তাছাড়া সেদিন রাত (বৃহস্পতি/শুক্রবার) ট্যাংক ও আর্টিলারি ইউনিটের রুটিন ট্রেনিং এর দিন ছিলো। ১৪/১৫ আগস্ট ‘৭৫ রাত ছিলো বৃহস্পতি/শুক্রবার রাত। ফলে ফজর আযান পর্যন্ত কেউ এদেরকে সন্দেহ করতে পারার কথা নয়। যেহেতু তারা ক্যান্টনমেন্ট এলাকার মধ্যেই আছে এবং সেদিন তাদের ট্রেনিং এর দিন। ফলে কোন রকম গোয়েন্দা তথ্য আসেনি যদিনা গোয়েন্দা বিভাগ আগে থেকে কিছু জানতো। শুধুমাত্র যখন ট্যাংকগুলো ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে শহরের দিকে যাচ্ছিলো তখনই গোয়েন্দা বিভাগ এটিকে সন্দেহের চোখে দেখেছে। 

যে তথ্যদাতা (ইনফর্মার) DMI কে তথ্যটা দিয়েছে তাকেও নিশ্চিত হয়ে তা দিতে হয়েছে। এর জন্যও কিছু সময় লাগে। কাজেই যখন ইনফর্মার বুঝতে পেরেছে যে কিছু অস্বাভাবিক কাজ হতে যাচ্ছে সেই সময়টা কোনভাবেই পৌনে পাঁচটার আগে হবার কথা নয়। এরপর DMI কে জানানো হয়েছে। DMI নিশ্চই এই তথ্যের জন্য বসে ছিলোনা। অর্থাৎ আমার কাছে আসার আগে তাকে তথ্যটা ভালো করে বুঝে নিতে হয়েছে, পোশাক পরিবর্তন করে রেডি হতে হয়েছে এবং এরপর সে আমার বাসায় এসেছে। যতক্ষণে সে আমার বাসায় এসে পৌঁছেছে ততোক্ষণে সাড়ে পাঁচটা বেজে যাবার কথা। একারণে আমি বলেছি যে কোনোভাবেই DMI আমার কাছে সাড়ে চারটায় আসেনি। এবং প্রফেসর ড. হাসানউজ্জামান আমার এই যুক্তিটি মেনে নেন নাই। আরও কিছু ব্যাঙ্গাত্ত্বক মন্তব্য তিনি তার লেখায় লিখেছেন। একারণে এসব তথ্য যোগাড় করে প্রমাণ করতে আমাকে কিছুটা খাটতে হয়েছে। কর্নেল শাফায়াৎ দাবী করেছে DMI আমাকে সাড়ে চারটায় জানিয়েছে এবং ড. হাসানউজ্জামান কর্নেল শাফায়াতের দাবীকে সমর্থন করতে চেষ্টা করেছেন। 

‘ফ্যাক্টস এন্ড ডকুমেন্টস’ বইয়ের ২৯৫ নং পাতার পঞ্চম প্যারাগ্রাফে কর্নেল শাফায়াৎ বিবৃতি দিয়েছে যে, “আমি (কর্নেল শাফায়াৎ) সারাদিন বিদ্রোহীদের দমন করার জন্য প্রস্তুত ছিলাম।” একই পৃষ্ঠার দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্যারায় সে বলেছে, ব্রিগেড হেডকোয়ার্টার এলাকায় তার সাথে মেজর ডালিমের উত্তপ্ত কথা বার্তা হয়। এই দুটো তথ্য কি একে অপরের সাথে সাঙ্ঘর্ষিক নয়? একদিকে কর্নেল শাফায়াৎ বলছে যে সে বিদ্রোহীদের দমন করতে প্রস্তুত ছিলো, অপরদিকে বলছে মেজর ডালিমের সাথে উত্তপ্ত কথাবার্তা হয়েছে, যে কিনা (মেজর ডালিম) নিজেই বিদ্রোহী গ্রুপের নেতা। মনে করিয়ে দিচ্ছি যে, মেজর ডালিম যখন তার সাথে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় করছিলো তখন কর্নেল শাফায়াৎ জামিলের নিয়ন্ত্রণে তিনটি ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটেলিয়ন ছিলো।  এটা যদি সত্য হয় তাহলে কর্নেল শাফায়াৎ কীসের কোন প্রস্তুত ছিলো? কর্নেল শাফায়াৎ কি জানতো না মেজর ডালিম কে এবং তারা কী করেছে? সেসময় মেজর ডালিম তার সাথে ছিলো এবং পুরো জাতি জানে মেজর ডালিম কী করেছে। এরপরেও নাকি কর্নেল শাফায়াতের আদেশ প্রয়োজন। ঐসব কাজ সেরে মেজর ডালিম কোন সাহসে কর্নেল শাফায়াতের ব্রিগেড এরিয়ায় যায় এবং কেমন ওরে নিরাপদে বেরিয়ে আসে? ডালিম যখন অল্প কন্টিনজেন্ট গ্রুপ নিয়ে তার (কর্নেল শাফায়াৎ) ব্রিগেড এরিয়ায় অবস্থান করছিলো তখন যদি সে মেজর ডালিমকে বন্দী করতে না পারে কোন ব্যবস্থা নিতে না পারে তাহলে দুই রেজিমেন্ট বিদ্রোহী সেনার সাথে সে কী করবে? এটা কী ধরণের গল্প? সে কাকে বোকা বানাতে চেষ্টা করছে? এই যদি হয় তার প্রস্তুতির অবস্থা তাহলে তার কাছ থেকে আমি কী আশা করতে পারি? 

কর্নেল শাফায়াৎ জামিল বলেছে যে সে সারাদিন বিদ্রোহীদের দমন করার জন্য রেডি হয়ে ছিলো। যদি সে রেডি থাকে তাহলে কেন ব্যবস্থা নেয় নাই? কেন সে বিদ্রোহীদের মুখোমুখি হয় নাই? কেন সে বিদ্রোহীদের ক্যান্টনমেন্টে ঢুকতে বাধা দেয় নাই? কে তাকে বাধা দিয়েছে? তার মুভ করার কথা এবং তাদের চ্যালেঞ্জ করার কথা। কিন্তু সে তা করে নাই। এটাই ছিলো বিদ্রোহী দমনের একমাত্র পথ যা আমি তাকে আদেশ করেছিলাম। কিন্তু আমার আদেশ অমান্য করা হয়েছে। যদি কর্নেল শাফায়াৎ জামিল বিদ্রোহী দমন করতে ইচ্ছুক থাকতো তাহলে সেটা করার জন্য তার হাতে যথেষ্ট সময় ছিলো। সময় মত ব্যবস্থা নিলে অন্তত বিদ্রোহীদের ক্যান্টনমেন্টে প্রবেশ ঠেকাতে পারতো। কিন্তু সে নিষ্ক্রিয় ছিলো। সে তার ট্রুপ্স কে মুভ করতে নির্দেশ দেয়নি। 

সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ যে কর্নেল শাফায়াৎ অন্তত এটা স্বীকার করেছে যে সেদিন সকালে আমি ব্রিগেড এরিয়ায় গিয়েছিলাম। কেন আমি এত সকালে তার ব্রিগেড এরিয়ায় যাবো? আমার সেই শক্তি কোথায়? বিদ্রোহীদের দমন করতে আমার শক্তি হচ্ছে ঢাকা ব্রিগেড ও তার কমান্ডার। সেই হিসেবে কর্নেল শাফায়াৎ জামিলকে সেই শক্তি হিসেবে কাজ করার কথা। কিন্তু কর্নেল শাফায়াৎকে দিয়ে সেই একশন নিতে পারিনি। আমি যখন তার ব্রিগেড এরিয়াতে ছিলাম সে আমার সাথে যাতে দেখা করেনি। সেক্ষেত্রে আমার আর কী অপশন থাকে? আমি আর কী করতে পারি? আমি MS(P) কর্নেল জামিলের মত মৃত্যুবরণ করতে পারি। তাতে কি কোন লাভ হবে? যদি উত্তর “হ্যা” হয় সেক্ষেত্রে আমার ভুল হয়েছে। সে বলেছে ব্রিগেড এরিয়ায় সকাল সাড়ে আট টায় সে আমাকে দেখেছে। কিন্তু কেন সে আমার সাথে দেখা করেনি? তার সৈন্যদের মুভ করানোর জন্য আমি তার ব্রিগেডে গিয়েছি। আমি CGS কে পাঠিয়েছিলাম তাকে সাহায্য করার জন্য। এরপর আমি তার ব্রিগেড এরিয়ায় যাই। কিন্তু কর্নেল শাফায়াৎকে পাওয়া যায়নি। সে আমাকে এড়িয়ে গেছে। আমি জানিনা কেন। সেখান থেকে আমি কী করতে পারতাম? 

সব পথ ঘেঁটে দেখলাম আমার সাথে কেউ নেই। আর কোন পথ তখন নেই। তখন ভাগ্যের উপর নির্ভর করা ছাড়া আর কিছু করার ছিলো না। অপরদিকে কর্নেল শাফায়াৎ জামিল কোন রকম ইতস্তত না করেই বলল আমি অবৈধ সরকারের সাথে হাত মিলিয়েছি। আমার আর কী অপশন ছিলো? আমি কি একা ঠেকাতে পারতাম? এটা ঠিক নয় যে আমি স্বেচ্ছায় রেডিও সেন্টারে গিয়েছি। সত্য হচ্ছে, কর্নেল শাফায়াতের ব্রিগেড এলাকা থেকে মেজর ডালিম ও তার ট্রুপ্স আমাকে জোর করে রেডিও সেন্টারে নিয়ে যায়। ফলে সরকারকে সমর্থন করা ছাড়া আমার আর কোন পথ ছিলোনা। এবং সেই সময়টা ছিলো সকাল ১০ টা থেকে সাড়ে ১০ টা। 

তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম যে চিফ কর্নেল শাফায়াৎকে কোন অর্ডার দেয় নাই। কিন্তু কর্নেল শাফায়াৎ একজন সিনিয়র অফিসার এবং ঢাকা ব্রিগেডের কমান্ডের দায়িত্বে। মেট্রোপোলিশ ফর্মেশন কমান্ডার হিসেবে সে শক্তিশালী ব্যক্তি। যখন মেজর রশিদ তাকে বলেছে যে তারা শেখ মুজিবকে হত্যা করেছে তখন কি তার কোন অর্ডারের অপেক্ষা করার প্রয়োজন আছে? সে নিজ থেকে একশন নিতে পারতো। সেই অবস্থায় যে কোন দায়িত্বশীল কমান্ডার এটা করবে। তার নিজের সেসময় ভেতর থেকেই কমান্ড আসার কথা। কিন্তু কর্নেল শাফায়াৎ ডেপুটি চিফের আদেশে নিষ্ক্রিয় থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। এবং চিফকে দোষ দিতে থাকে যে চিফ তাকে কোন অর্ডার দেয় নাই। 

সবশেষে আমি কর্নেল শাফায়াৎকে বলতে চাই, ১৫ আগস্ট ‘৭৫ যখন মেজর রশিদ তার কাছে গিয়ে বলেছে যে তারা শেখ মুজিবকে হত্যা করেছে, সেই সময় সে কী ব্যবস্থা নিয়েছে? কর্নেল শাফায়াৎ জাতীয় দৈনিকের ইন্টারভিউতে বলেছে মেজর রশিদের সাথে সব সময় এক কন্টিনজেন্ট ট্রুপ্স ছিলো। তাহলে যদি সেসময় রশিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সমস্যা থাকে তাহলে পরে কেন নেয়া হলনা? মেজর রশিদ তো সব সময় তার সাথে ছিলোনা। সে কি তাকে (মেজর রশিদ) ভয় পাচ্ছিলো? মেজর রশিদ ছাড়াও মেজর ডালিম তার ব্রিগেড এরিয়ায় যায়। কর্নাল শাফায়াতের ভাষ্যমতে তাদের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়। সেদিন সকালে আমি মেজর রশিদকে কর্নেল শাফায়াতের BM মেজর হাফিজের সাথে ব্রিগেড এরিয়ায় মুক্তভাবে ঘোরাফেরা করতে দেখি। মনে হল সে (রশিদ) তাদেরই একজন। দেখে বোঝার উপায় নেই যে মেজর রশিদ বিদ্রোহী গ্রুপের নেতা। এতে কী বোঝা যায়? সবশেষে বলতে হয়, যখন ঢাকা পেট্রপলিটন গ্যারিসনের কমান্ডার কর্নেল শাফায়াতের কাছে মেজর রশিদ বলেছে যে তারা শেখ মুজিবকে হত্যা করেছে তখন তাকে এরেস্ট করা ছাড়া কর্নেল শাফায়াতের আর কোন অপশন নেই। এবং এরেস্ট করে এরপর আমাকে জানানো উচিৎ ছিলো। একজন দায়িত্বশীল কমান্ডার এটাই করত। যেহেতু তখন মেজর রশিদের সাথে তার ট্রুপ্স ছিলো সেক্ষেত্রে সে (কর্নেল শাফায়াৎ) তার ইউনিট কমান্ডারদের কাছে মেজর ফারুককে ধরতে মেসেজ পাঠাতে পারতো। কিন্তু সে কিছুই করেনি। যদি কর্নেল শাফায়াৎ মনে করে থাকে যে চিফ এই অভ্যুত্থানের সাথে জড়িত এবং সে (কর্নেল শাফায়াৎ) চিফের সাথে নেই তাহলে তার উচিৎ চিফকে কাস্টডিতে নেয়া এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয়া। মুক্তিযুদ্ধের সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সে তার কমান্ডিং অফিসারকে এরেস্ট করে, যে একজন পাকিস্তানী অফিসার।  ৩ নভেম্বর ‘৭৫ এ সে খোন্দকার মোশতাকের দিকে বন্দুক তোলে, যখন মোশতাক প্রেসিডেন্ট। তাহলে সেই সময়ে (১৫ আগস্ট ‘৭৫) সে কার স্বার্থে কাজ করেহে? 

১৫ আগস্ট ‘৭৫ কর্নেল শাফায়াৎ যদি মনে করে যে অবৈধ সরকারের প্রতি চিফের সমর্থন গ্রহণযোগ্য নয় তাহলে সে চিফের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যেতে পারে। সে যদি প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাকের দিকে বন্দুক তাক করতে পারে তাহলে সে চিফের বিরুদ্ধে কেন করতে পারবেনা? এই অবস্থায় সেদিন কর্নেল শাফায়াতের ভূমিকা কী ছিলো সেই ভার পাঠকের বিবেচনার উপর ছেড়ে দিচ্ছি। কেন মেজর রশিদ কর্নেল শাফায়াতের কাছে গিয়ে বলবে যে তারা শেখ মুজিবকে খুন করেছে? ট্রুপ্স এর কমান্ডার হিসেবে শাফায়াৎকে এই প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। কারণ তারও দায়িত্ব রয়েছে। অন্যকে দোষ দেয়া সহজ, কিন্তু নিজের ব্যার্থতা স্বীকার করতে সাহসের প্রয়োজন। 

দুটো গুরুত্বপূর্ণ ইন্টারভিউয়ের বিশ্লেষণ শেষে আমি এখন প্রফেসর আবু সাইদের লিখিত “ফ্যাক্টস এন্ড ডকুমেন্টস’ গ্রন্থের কিছু মন্তব্য সম্পর্কে লিখতে চেষ্টা করব। আবু সাইদের এই বইতে আমাকে নিন্দার স্বীকার হতে হয়েছে। এর কারণ হচ্ছে ১৫ আগস্ট ‘৭৫ এর সম্পর্কে অন্যান্য অফিসার, যাদের নিজেদের কাজ প্রশ্নবিদ্ধ ছিলো, তারা আমার সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছে সেগুলো মিলে আমার বিরুদ্ধে একটি নেগেটিভ ধারণা তৈরি করেছে। কিন্তু লেখক সেগুলো যাচাই করেননি। যেহেতু সেগুলোকে কেউ চ্যালেঞ্জ করেনি এবং এর মধ্যে আমার নিজের কোন মত প্রিন্ট মিডিয়ায় আসেনি তাই সবাই তাদের মন্তব্যকেই সত্য ধরে নিয়েছে। এবং আমাকে দোষী সাব্যাস্ত করেছে। তাই জনতার আদালতে আমাকে দোষী করা হয়েছে। অন্যদিকে এসব লেখা সম্পর্কে আমি জানতে পেরেছি ১৯৯১ সালে দেশে আসার পর। 

এরপর আমি পত্রিকায় এসব বিষয় চ্যালেঞ্জ করে লিখতে শুরু করি। এই সময়ে বিভিন্ন লোক বিভিন্ন বিষয় পরিষ্কার হবার জন্য আমার কাছে আসে। তাই তাদেরকে আমি ব্যাখ্যা দিতাম কী করেছি এবং আমার কী করা উচিৎ ছিলো। সেসব প্রশ্ন করার জন্য আমি কাউকে দোষ দেইনা। কারণ যারা সেসব প্রশ্ন করেছেন তারা সবাই বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসেন। এবং সেদিনের ঘটনায় তারা সবাই ব্যাথিত। বঙ্গবন্ধু হত্যা প্রশ্নে মিলিটারি অফিসারদের মন্তব্যের প্রেক্ষিতে তারা আমার ব্যাপারে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছেন। কিন্তু আগেও বলেছি, সেগুলো যেহেতু কেউ চ্যালেঞ্জ করেনি এবং সেগুলোর কোন জবাব দেয়া হয়নি তাই তারা সেসব মন্তব্য সঠিক বলে ধরে নিয়েছে। প্রায় ১৬ বছর দেশের বাইরে থাকার কারণে সেসব আমার চোখে পড়েনি। এবং সেগুলোর কোন জবাব দেয়া হয়নি। ফিরে আসার পর আমি সেগুলোর জবাব দিতে চেষ্টা করি এবং আমার সন্মান পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করি। 

ফ্যাক্টস এন্ড ডকুমেন্টস বইতে আমার সম্পর্কে খুব অন্যায় মন্তব্য করা হয়েছে। আমাকে ভিতু হিসেবে দেখানো হয়েছে। লেখকের জানা উচিৎ ছিলো সে কার সম্পর্কে লিখছে। সেসব লিখতে কিছুটা ভাবা উচিৎ ছিলো। আমার সম্পর্কে তার সমালোচনা একেবারেই একপেশে এবং কোন রকম যাচাই ছাড়াই সেগুলো করা হয়েছে। এমনকি আমাকে তিনি জিজ্ঞেস করার মত সৌজন্য দেখাননি। এধরনের সন্মানহানিকর লেখা ছাপানোর আগে লেখকের কি দায়িত্ব নেই সেগুলো ভেরিইফাই করার? লেখক কারো কারো মন্তব্য অতি সরলভাবে বিশ্বাস করেছেন এবং তারা সে গল্প বলেছে সেটাকেই সত্য বলে ধরে নিয়েছেন। একজন লেখকের দায়িত্ব হচ্ছে তিনি যা লিখবেন সেটা যেন সত্যের কাছাকাছি হয়। তাদের নিজের কলমের প্রভাব চিন্তা করতে হবে। তথ্য যাচাই না করে রেকর্ড করা বা প্রিন্টিং মিডিয়ায় দেয়া একটি অপরাধ। 

লেখক কর্নেল শাফায়াতের কাজে খুব মুগ্ধ এবং তার সম্পর্কে কিছু উন্নত প্রশংসাসূচক শব্দচয়ন করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, তার বই “ফ্যাক্টস এন্ড ডকুমেন্টস” এর ১৩৯ নং পাতার ৯ নং প্যারাগ্রাফে লিখেছেন, কর্নেল শাফায়াৎ জামিল এখন শক্ত মনের মানুষ। তিনি ঢাকা ব্রিগেডের কমান্ডার ছিলেন। তিনি সকল সৈন্যকে ডিফেন্সিভ পজিশনে যেতে বললেন। সকল ইউনিটের আর্মার্ড গার্ড রয়েছে। তাদের ঝকঝকে রাইফেল যেন কথা বলতে চাইছে একটি “নতুন ভাষায়” ইত্যাদি। লেখকের বর্ননা খুব দৃষ্টিনন্দন। কোন হিসাব ছাড়াই তিনি কর্নেল শাফায়াৎ জামিলকে এমন চুড়ায় উঠিয়েছেন যার যোগ্য সে না। তার লেখা পড়ে যে কেউ কর্নেল শাফায়াৎ জামিলের পক্ষ নেবে। এবং মনে করবেন যে সেদিন একমাত্র কর্নেল শাফায়াৎ জামিলই কিছু প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। অন্তত সে তার সৈন্যদের ডিফেন্স নিতে বলেছে। অন্যদিকে আমাকে দেখানো হয়েছে একজন কপট ও ভীতু হিসেবে। 

আমার আফসোস হচ্ছে কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করল না যে আমার কিছু বলার আছে কিনা। কেউ কর্নেল শাফায়াৎ জামিলকে জিজ্ঞেস করল না কেন তাদের ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে ডিফেন্সিভ পজিশনে যেতে হল। অথচ তখন তার মুখোমুখি আক্রমণে যাবার কথা। শুধু ডিফেন্সিভ একশন নিয়ে সে কীভাবে বিদ্রোহীদের দমন করবে? বিদ্রোহীরা কি শহরে তার পজিশনের উপর আক্রমণ করবে? যদি তা না হয় তাহলে ডিফেন্সিভ পজিশন নিয়ে কী হবে? এর থেকে সম্ভাব্য সুবিধা কী আসবে? বিদ্রোহীরা শহরে ঢুকে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট দখলে নিয়েছে। এবং সরকার পতন ঘটিয়েছে। তাদের লক্ষ্য সম্পর্কে কোন ধরণের সন্দেহ থাকার কিছু নেই। অতএব তাদের ঠেকাতে হবে। এধরনের কাজ থেকে তাদের প্রতিরোধ করতে হলে তাদেরকে এটাক করতে হবে, ডিফেন্স পজিশন নয়। মনে করিয়ে দেই, অভ্যুত্থানের অন্যতম পরিকল্পনাকারী সেদিন তথাকথিত ডিফেন্স পজিশনে বিনা বাধায় ঘোরাফেরা করছিলো। এই অবস্থায় আমি কি জানতে পারি তার মনে কী ছিলো? উপরের আলোচনায় দেখা যায়, এটাকে ডিফেন্স পজিশন বলা উপহাস ছাড়া কিছুই নয়। কিন্তু মানুষ দেখল না যে এসব গল্পের আড়ালে আমাকে নীচে নামানো হয়েছে এবং উপহাসের মাত্র করা হয়েছে। 

কর্নেল শাফায়াতের বিবৃতি থেকে এটা বোঝা যায় যে, ১৫ আগস্ট ‘৭৫ থেকে সে জেনারেল জিয়ার নির্দেশনায় চলছিলো। সে নিজেই তার বিবৃতিতে বলেছে যে আমার সাথে কথা শেষে সে জেনারেল জিয়ার কাছে নির্দেশের জন্য গিয়েছে। মনে করিয়ে দেই, সে জেনারেল জিয়ার কাছে যাবার আগে মেজর রশিদ তাকে এসে বলেছে যে তারা শেখ মুজিবকে হত্যা করেছে। এরপর কর্নেল শাফায়াৎ নির্দেশনার জন্য জেনারেল জিয়ার কাছে গিয়েছে। মেজর রশিদ কর্তৃক কর্নেল শাফায়াৎকে রিপোর্ট করা এবং অতঃপর তার (কর্নেল শাফায়াৎ) জেনারেল জিয়ার কাছে যাওয়া – এর মধ্যে কি কোন যোগসূত্র আছে? সে তার কাছ থেকে কী নির্দেশনা যাচ্ছিলো? জেনারেল জিয়া তাকে বলেছে এলার্ট থাকতে। আমার অর্ডার ছিলো বিদ্রোহীদের মুখোমুখি হয়ে বাধা দেয়া, যার ফলে রক্তপাত হবার সম্ভবনা থাকে। কিন্তু এই বিবৃতিতে বোঝা যায় সে বিদ্রোহী সৈন্যদের সাথে মুখোমুখি অবস্থানে যেতে চায়না। তাই সে ডিফেন্সিভ পজিশন নেয়। আশ্চর্য বটে! কত সাহসী একশন! 

‘ফ্যাক্টস এন্ড ডকুমেন্টস’ বইয়ের ১৪১ পাতার ১২ নং প্যারায় ১৯ আগস্ট ‘৭৫ তারিখে আর্মি হেডকোয়ার্টারের ঘটনাটাকে সাজানো হয়েছে কর্নেল শাফায়াৎ জামিলের বর্ননা অনুযায়ী। মনে হল পুরো সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা ভেঙ্গে পড়েছে। যেভাবে কনফারেন্সে আর্মি চিফকে উপস্থাপন করা হয়েছে তাতে মনে হল আর্মি চিফের নিয়ন্ত্রণে কিছুই ছিলোনা। এটা ঠিক যে সেই সময়ে কিছু লোক কমান্ডের বাইরে চলে গিয়েছিলো। কিন্তু কর্নেল শাফায়াৎ যেভানে চিত্রায়িত করেছে তেমনটি নয়। 

আমি বলতে চাই, ১৫ আগস্ট ‘৭৫ যাই ঘটুক না কেন, বাংলাদেশ আর্মি যথেষ্ট সুশৃঙ্খল একটি বাহিনী। বইতে কর্নেল শাফায়াৎ যেভাবে বলেছে সেভাবে বলা উচিৎ হয়নি। সত্যটা হচ্ছে সেদিনের কনফারেন্সে যখন ঘটনার চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছিলো তখন সকলেই কর্নেল শাফায়াতের দিকে আঙ্গুলিনির্দেশ করেছিলো। সেসময় তাকে যথেষ্ট হতাশ মনে হয়েছিলো। তার দক্ষতার অভাবে সাধারণ চ্যানেল অব কমান্ড ভেঙ্গে গিয়েছিলো এবং সামরিক অভ্যুত্থ্যানের মত ঘটনা ঘটেছে। তার ব্যার্থতা তাকে খোঁচা দিচ্ছিল এবং সে তার বিরক্তি কোথাও প্রকাশ করতে চাচ্ছিল। ফলে এক পর্যায়ে কর্নেল শাফায়াৎ চিৎকার করে ওঠে এবং মেজর রশিদ ও মেজর ফারুককে কোর্ট মার্শাল করার হুমকি দেয়। এর মূল কারণ ছিলো তার কলিগদের সামনে একটা সাহসী ভাব দেখানো। কিন্তু বইতে ঘটনাটা যেভাবে উল্লেখ করা হয়েছে তা শিষ্টাচারের লিমিট অতিক্রম করেছে। প্রফেসর আবু সাইদ নিজেও এখানে অনেক মসলা যুক্ত করেছেন। 

আমি বইয়ের আরও কিছু লাইন নিয়ে কথা বলতে চাই। বইয়ের ১৪২ পাতার ১৩ নং প্যারাগ্রাফে আছে, “জেনারেল জিয়া ভীতু ব্যক্তির মত চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন। ইতিহাসের পাতায় তার নাম একজন দায়িত্বহীন কমান্ডার ইন চিফ হিসেবে জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। কারণ জাতীয় জরুরী অবস্থায় সে তার দায়িত্ব পালন করতে সম্পূর্ন ব্যার্থ হয়েছে। আমি কি লেখককে জিজ্ঞেস করতে পারি যে ‘ভীতু’র কি কি বৈশিষ্ট্য থাকে? ‘ভীতু’ বলতে বোঝায় সাহস খুব কম থাকা এবং এবং ‘সাহস’ বলতে বোঝায় বিপদের মুখোমুখি হবার ক্ষমতা। আমি দাবী করতে চাইনা যে আমি সাহসী, তবে অবশ্যই আমি ভীতু নই। একারণে আমি লেখকের প্রতি নীচের কথাগুলো বলতে চাই। 

*একজন সৈনিক যখন সরকারের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নেয় সেটি দেশদ্রোহিতার মত অপরাধ। এবং এর বাধ্যতামূলক শাস্তি হচ্ছে ফায়ারিং স্কোয়াডের মুখোমুখি করা। অথবা ফাঁসিতে ঝুলানো। কিন্তু যদি দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে একজন সৈনিক সরকারের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নেয় এবং তার নিজের বাহিনীর সদস্যদের পক্ষ নেয় তাকে কি ভীতু বলা যাবে? আমি তেমন একজন সৈনিক ছিলাম। আমি প্রফেসরের কাছে জানতে চাই তাদের মত কতজন এরকম করে পদক্ষেপ নিয়েছে? 

*যুদ্ধ অনেক বিপদজনক একটা অবস্থা। বিশেষ করে যে লাইনের সামনে থাকে। একজন কমান্ডার, যদিও তার অপশন থাকে পেছনে থাকার, সে চাইলে সামনের লাইনে থাকতে পারে এবং শত্রুর সাথে মুখোমুখি লড়াই করতে পারে। সেই কমান্ডারকে কি ভীতু বলা যাবে? আমি একজন কমান্ডার ছিলাম। আমি চাইনি কেউ এধরনের মুখোমুখি পরিস্থিতির স্বীকার হোক। 

*একজন সৈনিক যে স্বাধীনতা যুদ্ধের পুরোটা সময় তার বাহিনীর সাথে সম্মুখ সমরে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলো তাকে কি ভীতু বলা যাবে? আমি সেরকম একজন সৈনিক ছিলাম। আমি প্রফেসরের কাছে জানতে চাই তাদের কতজন এরকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে। 

আর্মি চিফকে যেভাবে এই বইতে তুলে ধরা হয়েছে সেটা অত্যন্ত আপত্তিকর। এধরনের চিত্রায়নের ফলে শুধু ঐ ব্যক্তিকে নিছে নামানো হয় তা নয়, বরং পুরো জাতিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়। কারণ যে ব্যক্তিকে এখানে এভাবে খাটো করা হয়েছে সেও ঐ সব বীর যোদ্ধাদের একজন। আমি বলিনি যে তাদেরকে কিছু বলা যাবেনা বা তারা সমালোচনার উর্ধে। সেখানে কিছু স্বান্তনা থাকতে পারে, আরও কিছু সত্য থাকতে পারে। সেকারণেই কারো সম্পর্কে এধরনের কিছু বলতে হলে অন্তত সেটা ভেরিফাই করে নেয়া উচিৎ। এবং সেই ব্যক্তিকেও তার নিজের কিছু বলার আছে কিনা সেই সুযোগ দেয়া উচিৎ। 

সেটা নিশ্চিত না হয়েই কিছু একটা বলে ফেলা অন্যায়, অনৈতিক। এবং এটা লেখক সম্পর্কে খুব ভালো কিছুর প্রতিফলন ঘটায় না। আমি হয়ত কোন না কোন ভাবে ব্যার্থ হয়েছি, তবে নিশ্চিতভাবেই আমি ভীতু নই। এটাও এই বইতে বলা হয়েছে যে ইতিহাসের পাতায় একজন দায়িত্বহীন কমান্ডারের জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত হিসেবে আমার নাম লেখা থাকবে, যে কিনা জাতির দুর্যোগময় সময়ে জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করতে পারেনি। আমি আগের অধ্যায়গুলোতে পরিস্থিতি সামাল দিতে কী করেছি সেসব বর্ননা করেছি। কিছুই কাজ হয়নি। চিফকে ব্যক্তি আক্রমণের পূর্বে আমি লেখকের কাছে জানতে চাই ব্যক্তি হিসেবে তারা কী করেছেন? এটা কি অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন? 

আমার চারপাশে যখন এমন কিছু লোক ঘুরে বেড়াচ্ছিল যাদের কাজ ও অবস্থান সম্পর্কে আমি কিছু ধারণা করতে পারছিলাম না, সেই অবস্থায় আমার অপশন সীমিত হয়ে যায়। আমার অপশন ছিলো যা ঘটেছে তা মেনে নেয়া অথবা যুদ্ধ করা। দ্বিতীয় অপশন বিবেচনায় আমার যে শক্তির দরকার ছিলো তা হচ্ছে ঢাকা ব্রিগেড কমান্ডার ও তার ট্রুপ্স, যে এই বইয়ের লেখকের কাছে একজন ‘হিরো’।শুরু থেকেই তারা আমাকে ব্যার্থ করে দেয়। এই অবস্থায় পরেও অন্যান্য ফর্মেশনের সাহায্য নিয়ে আমি মুখোমুখি হতে চেয়েছিলাম। সেটা করতে আমাকে ঢাকার বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন ছিলো। কিন্তু ডালিমের সার্বক্ষনিক পিছু লেগে থাকায় সেটা আমি করতে পারিনি। কারো সাথে আলোচনা করার সুযোগও ছিলোনা। যখন বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে ফেলা হয়েছে, সেই অবস্থায় এধরনের পদক্ষেপ নিলেও তাতে কী ফল হবে অথবা দেশকে সম্ভাব্য গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেবার হিসেবটা করতে আমি ব্যার্থ হয়েছি। তাই আমি তাদের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছিলাম এবং ভেবেছিলাম যে বিদ্রোহীদেরকে নিয়ন্ত্রণে আনার পর তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক একশনে যাবো। সেই লক্ষে আমি চেষ্টাও করেছি। এটা কি দায়িত্বহীনের মত কাজ ছিলো? আলোচনা হোক যে সেই দুর্যোগময় সময়ে আমি দায়িত্বশীলতা নিয়ে কাজ করেছি কিনা। 

আশ্চর্যজনকভাবে লেখকের হিরো কর্নেল শাফায়াৎ জামিলের ভূমিকা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সন্দেহজনক ছিলো। অন্যদিকে, প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা বিধান আর্মি চিফের দায়িত্বের মধ্যে পড়েনা। কিছু এজেন্সি এবং প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিগত সিকিউরিটি সেই দায়িত্বে থাকে। চিফ অব স্টাফ নয়। কিন্তু শুরু থেকেই অন্যায়ভাবে তাকে (চিফ) দোষারোপ করা হচ্ছে। কেউ কি সেসব এজেন্সিকে জিজ্ঞেস করেছে প্রেসিডেন্টকে আক্রমণের সময় বা তার আগে তারা কী করেছে? 

আর্মি প্রেসিডেন্টকে সিকিউরিটি গার্ড হিসেবে কিছু ট্রুপ্স দিয়েছে। তাদের কোথায় কিভাবে রাখা হবে সেটা এজেন্সিগুলোর দায়িত্বে থাকে। এটা আর্মি চিফ নিয়ন্ত্রণ করেননা। সেসব ট্রুপ্সকে পর্যাপ্ত নির্দেশনা ও মোতায়েনের দায়িত্ব এজেন্সিগুলোর। আপাতদৃষ্টিতে তাদের ডিউটিতে কোন দুর্বলতা ছিলোনা। এটাও প্রমাণিত যে বঙ্গবন্ধুর বাসার নিরাপত্তায় থাকা সেনাসদস্যও সেদিন নিহত হয়েছে। কাজেই ঐ সব সিকিউরিটি গার্ডদের আনুগত্য নিয়ে কোন সন্দেহ থাকার কথা নয়। বঙ্গবন্ধুর বাড়ীতে যা হয়েছে সেটাকে কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায়না। তবে কাউকে নীচে নামানোর আগে দায়িত্বশীল যাচাই প্রয়োজন।  

আমি আমার দায়িত্ব সম্পর্কে চিন্তিত নই এবং আমি মনে করি আমার সামনে যে পরিস্থিতি ছিলো সেটা বিবেচনার সাথে মোকাবেলা করেছি। এবং আমার বিচারবুদ্ধিমাফিক ব্যবস্থা নিয়েছি। আমি ভুল করেছি না সঠিক কাজ করেছি এটা এখন ইতিহাসবিদদের দায়িত্ব। আমি মনে করি আমি দেশকে সম্ভাব্য গৃহযুদ্ধ থেকে রক্ষা করেছি। তবুও আমি এখনো স্বীকার করি যে আমার ভুল হতে পারে, তবে আমি ভীতু নই। বিদেশ থেকে ফেরার পর আমি প্রফেসর আবু সাইদ আমার সম্পর্কে তার বইতে যেসব মন্তব্য করেছে সেই ব্যাপারে তার সাথে কথা বলেছি। আমার মনে হয়, সে এখনো মনে করে সে যা লিখেছে তা সঠিক। কারণ সে বই থেকে তার মন্তব্য সরায়নি। আমার উপরোক্ত মন্তব্যগুলো সেসব মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে করা। 

২২ আগস্ট ‘৯৩ “বালা বাজার” পত্রিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. হাসানউজ্জামান লিখেছেন, কিশোরগঞ্জের ধাশুধান গ্রামের আবুল কাসেম ভুঁইয়া নামক এক ব্যক্তি ১৫ আগস্ট ‘৭৫ এর দুর্যোগময় রাতে ঘটনাস্থলে ছিলেন। সে তার স্মৃতিচারণে বলেছে যে সে টেলিফোনে কারো সাথে বঙ্গবন্ধুর কথোপকথন শুনেছে। সেখানে সব শেষে যে কথাটি বঙ্গবন্ধুকে বলতে শুনেছে তা হচ্ছে, “তার মানে কি তুমি কিছু করতে পারবেনা?” ড. হাসানউজ্জামান লিখেছেন, এই ব্যক্তি কে হতে পারে যাকে বঙ্গবন্ধু এই কথা বলেছিলেন? এরপর সে মত দিয়েছে যে, সকল সোর্সএর তথ্য পর্যালচনায় দেখা যায় জেনারেল শফিউল্লাহ ছিলেন সর্বশেষ ব্যক্তি যার সাথে বঙ্গবন্ধুর কথা হয়। 

এই প্যারাগ্রাফের লেখা থেকে এটা বোঝা যায় ড. হাসানউজ্জামান কাকে নির্দেশ করেছেন। আমি জানি সে গবেষণার কাজ করছেন। এই পদ্ধতিতে তিনি ব্যক্তিকে বিচার করতে পারেন না। তাকে খোলা মনে যাচাই করতে হবে এবং পূর্বকল্পিত ধারণা থেকে কিছু বলা যাবেনা। সেই ব্যাক্তিটি (যাকে বঙ্গবন্ধু ঐ কথা বলেছে) কে সেটা নিশ্চিত না হয়ে তিনি (হাসানউজ্জামান) আমার দিকে আঙুল তুলতে পারেন না। একজন গবেষকের মনের অবস্থা যদি এরকম হয় তাহলে তার থেকে কি নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ আশা করা যায়? বঙ্গবন্ধুর সাথে আমার যে কথা হয়েছে তাতে করে আমারও ধারণা যে যাদের সাথে তার কথা হয় তাদের মধ্যে আমিই সর্বশেষ। কিন্তু কী করে ড. হাসানউজ্জামান আবুল কাশেম ভুঁইয়ার কথার উপর ভিত্তি করে নিশ্চিত হলেন যে সেই কথাটা বঙ্গবন্ধু আমাকেই বলেছেন? একারণেই আমি বলি যে আমাদের বিজ্ঞ গবেষকরা যেখান থেকে শুরু করেন সেটা ভুল। এভাবেই যদি সে আগায় এবং গবেষণা শেষে থিসিস প্রকাশ করে তাহলে তার কাজ থেকে ভালো কিছু কি আশা করা যায়? 

তবে এই লেখা থেকে একটি তথ্য বেরিয়ে আসলো যে, কোন এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু সাহায্য চাচ্ছিলেন এবং কেউ না কেউ তাকে বলেছে যে, তারা কিছু করতে পারবেনা। অন্যথায় বঙ্গবন্ধু বলতেন না যে, “তার মানে কি তুমি কিছু করতে পারবেনা?” এই বাক্য থেকে বোঝা যায় যখন বঙ্গবন্ধুর বাড়ীতে আক্রমণ শুরু হয়ে গিয়েছে তখন তিনি সাহায্য চাচ্ছিলেন। এবার আসা যাক কারা সেই সম্ভাব্য ব্যক্তি যাদের কাছে বঙ্গবন্ধু সাহায্য চেয়ে থাকতে পারেন। 

অবশ্যই বঙ্গবন্ধু যখন আক্রান্ত হয়েছিলেন তখন তিনি সাহায্য চাচ্ছিলেন। সেসময় এমন কারো কাছে তিনি সাহায্য আশা করেছেন যার সেই সামর্থ্য আছে বলে তিনি মনে করেছেন। সেরকম সামর্থ্য  যাদের আছে তারা কারা হতে পারে? যাদের কাছে প্রেসিডেন্ট উদ্ধারের আবেদন করতে পারেন তাদের শক্তি ও ফায়ার পাওয়ারের ক্রম অনুযায়ী সাজালে দাঁড়ায় – আর্মি, বিডিআর, রক্ষীবাহিনী, এয়ার ফোর্স, নেভি এবং পুলিশ। আমি এখন আলাদা আলাদা ভাবে প্রত্যেকটি ফোর্স সম্পর্কে আলোচনা করব। 

আর্মি। আমার উপর বঙ্গবন্ধুর পুরো আস্থা ছিলো। এটাই আশা করা যায় যে যখন তিনি বিপদ আঁচ করেছেন তখনই আমাকে ফোন করার কথা। কিন্তু আমি তার থেকে কোন ফোন পাইনি। আমি জানিনা বঙ্গবন্ধু আমাকে কল করার চেষ্টা করেছিলেন কিনা। এবং আমার মনে হয় তিনি চেষ্টা করেননি। আমি ঘটনা জানার পর যদি তিনি যোগাযোগ করতেন তাহলে আমাকে তার ফোনে পাবার সম্ভবনা কম। কারণ ঘটনা জানার সাথে সাথেই আমি টেলিফোনে বঙ্গবন্ধুকে একটানা চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম। কিন্তু তার ফোন ব্যস্ত ছিলো। অথবা সেই সময়ে আমি আমার অধস্তন কমান্ডকে টেলিফোনে নির্দেশনা দিচ্ছিলাম। সেকারণে হতে পারে তিনি (বঙ্গবন্ধু) আমাকে ফোনে পাননি। সেক্ষেত্রে সেই ডায়লগটা আমার সাথে হবার সম্ভবনা বাতিল করছি।  

অপরদিকে, তথ্য পাবার সাথে সাথে আমি বঙ্গবন্ধুকে পেতে টেলিফোনে চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম। আমি শেষ পর্যন্ত তাঁকে পেয়েছিলাম। তাঁকে পেতে আমার প্রায় ২০ থেকে ২৫ মিনিট লেগেছে। আমার ধারণা বঙ্গবন্ধুর সাথে সেদিন যাদের কথা হয়েছে তাদের মধ্যে সর্বশেষ ব্যক্তিটি আমিই। কিন্তু আমাদের মধ্যে যে কথোপকথন হয়েছে সেটি বঙ্গবন্ধু, আমি এবং আমার পাশে বসে থাকা স্ত্রী ছাড়া কারো শোনার কথা না। ড. হাসানউজ্জামান যে কথাগুলো বলেছেন সেধরনের কথোপকথন বঙ্গবন্ধুর সাথে আমার নিশ্চিতভাবেই হয়নি। যদি তাই হত তাহলে এত উৎকণ্ঠা নিয়ে তাঁকে আমার ফোন করার কোন কারণ নেই। বরং তাঁকে সতর্ক করার জন্য আমি ফোনে পেতে চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম। তাঁকে পরিত্যাগ করার জন্য কখনোই নয়। 

একটি গুরুত্বপুর্ণ বিষয় বঙ্গবন্ধুর মনে তখন উদয় হতে পারে যে, যেহেতু তাঁর বাড়ীতে আর্মি আক্রমণ করেছে, সেহেতু তিনি ভেবে নিতে পারেন যে আর্মি চিফের জ্ঞ্যাতসারেই হয়ত এটা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে আর্মি চিফের কাছে সাহায্য চাওয়া বৃথা। আমাকে ফোন না করার এটা একটা কারণ হতে পারে। অতএব সকল সম্ভবনা বিবেচনায় মনে হয় তিনি আমার সাথে বা আর্মির কারো সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেননি। 

বঙ্গবন্ধু কি কর্নেল শাফায়াতের কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন? এটা হতে পারে। কারণ বঙ্গবন্ধু নিজের পছন্দে কর্নেল শাফায়াৎকে তাঁর ব্রিগেডের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। এবং তিনি তাকে সরাসরি তাঁর অফিসে ডাকাতেন। কাজেই যদি বঙ্গবন্ধু কর্নেল শাফায়াৎকে ফোন করে থাকেন এবং সাহায্য চেয়ে থাকেন, সেক্ষেত্রে কর্নেল শাফায়াৎ বঙ্গবন্ধুকে ঐ কথাগুলো বলতে পারেনা। তবে, যেকারনে বঙ্গবন্ধু আমার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেননি, একই কারণে হয়ত তিনি কর্নেল শাফায়াৎ জামিলের সাথেও যোগাযোগ করেননি। অতএব, এই ডায়লগটা কর্নেল শাফায়াতের সাথে হবার সম্ভবনা বাতিল করছি। 

বিডিআর। শক্তি ও ফায়ার-পাওয়ার অনুযায়ী দ্বিতীয় ফোর্সটি বিডিআর। এটা হয়ত বঙ্গবন্ধুকে কিছু ট্রুপ্স পাঠিয়ে সাহায্য করতে পারতো। কিন্তু যেহেতু এখানে আর্মি জড়িত এবং আর্মির চেয়ে বিডিআর এর শক্তি কম হওয়ায় ডায়লগটা বিডিআর এর ডিজি ব্রিগেডিয়ার (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল) খলিলের হতে পারে। 

‘ফ্যাক্টস এন্ড ডকুমেন্টস’ বইয়ে জেনারেল খলিলের বিবৃতি অন্যযায়ী দেখা যায় ১৫ আগস্ট ‘৭৫ সকালে ঘটনা সম্পর্কে তিনি জানতেন। সূর্যোদয়ের পর তিনি বিডিআর কম্পাউন্ডে অবস্থিত নিজ অফিসে যান। 

১২ নভেম্বর ‘৯২ তারিখে “সংবাদ চিত্র” পত্রিকার একটি আর্টিকেলের কিছু পয়েন্ট আমার নজরে আসে। এই লেখাটি লিখেছেন জনাব ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল, বি পি (কর্নেল তাহেরের ভাই)। সে লিখেছে, ১৫ আগস্ট ‘৭৫ রাত ৪ টার সময় সে জেনারেল খলিলকে রেডিও স্টেশনে দেখতে পায়। কিন্তু জেনারেল খলিলের বয়ানে দেখা যায়, সে উল্লেখ করেছে যে ১৫ আগস্ট ‘৭৫ সকালে সে ঘটনা সম্পর্কে জানতে পারে। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে জেনারেল খলিলকে কিভাবে রেডিও স্টেশনে দেখা যাবে? বা কেন সে (ওয়ারেসাত হোসেন) একথা বলতে যাবে? জেনারেল খলিল এখন মারা গিয়েছেন। আমি জানিনা জীবিত অবস্থায় তিনি আর্টিকেলটা দেখেছেন কিনা। রাত ৪ টায় রেডিও স্টেশনে যাবার কোন কারণ আমি খুঁজে পাইনা, যদি না সে চক্রান্তকারীদের সাথে জড়িত থাকে। কোনোভাবেই এই বিষয়ে আমি মন্তব্য করতে পারছিনা। যদিও বঙ্গবন্ধু নিহত হন সকাল ৬ টা বা সাড়ে ৬ টার দিকে। যদি সে (জেনারেল খলিল) কোনোভাবে বিদ্রোহীদের সাথে জড়িত থাকে সেক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুকে ঐদিন ‘সরি’ বলার সম্ভবনা তার রয়েছে। তবে তার পরবর্তি কার্যক্রমে আমার ধারণা, যা ঘটেছে তাতে তার কিছু করার ছিলোনা। 

রক্ষীবাহিনী। খুব সম্ভবত বঙ্গবন্ধু তাদের সাথে যোগাযোগ করেছিলেন। তাদের উত্তর পজিটিভ না নেগেটিভ সেটা বলা মুশকিল। সম্ভবনা হচ্ছে ‘হ্যা’ বলার। কিন্তু তাদের একটা সীমাবদ্ধতা ছিলো। তা হচ্ছে, তাদের হাতে কোন তাৎক্ষনিক গোলাবারুদ ছিলোনা। তাদের গোলাবারুদ বিডিআর এর সুরক্ষিত আর্মারিতে (অস্রাগার) রাখা ছিলো। তাছাড়া তারা যখন তাদের সামনে ট্যাংক দাঁড়ানো দেখেছে, এবং যেহেতু তারা জানে তাদের কোন অস্ত্র নেই, তাই সেদিন হয়ত তারা বঙ্গবন্ধুকে ‘না’ বলেছে। 

বিমান বাহিনী। এয়ার চিফের সাথে যোগাযোগের সম্ভবনা কম। বঙ্গবন্ধুর তাৎক্ষনিক সাহায্য দরকার ছিলো যা তাদের দেয়া সম্ভব না। তাছাড়া সকালে যখন আমি এয়ার চিফের সাথে কথা বলেছিলাম, আমার মনে হয়েছে সে কিছুই জানেনা। অতএব এই সম্ভবনাটা আমি বাতিল করছি। 

নেভি। এয়ার ফোর্সের মতোই। আমার মনে হয়না যে ন্যাভাল চিফের সাথে বঙ্গবন্ধু যোগাযোগ করেছেন, কারণ যখন আমি তার (ন্যাভাল চিফ) সাথে কথা বলেছিলাম তাকেও এই ব্যাপারে অজ্ঞ মনে হয়েছিল। অতএব এই সম্ভবনাটাও বাতিল করছি। 

পুলিশ। হতে পারে বঙ্গবন্ধু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব মনসুর আলীর কাছে সাহায্য চেয়েছেন। আর্মি জড়িত থাকায় পুলিশের আই জি জনাব নুরুল ইসলাম জনাব মনসুর আলীকে কোন পজিটিভ প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারেননি। যদি পুলিশের আই জির কাছ থেকে জনাব মনসুর আলী কোন পজিটিভ প্রতিক্রিয়া পেতেন তাহলে সেদিন সকালে তিনি বঙ্গবন্ধুর বাড়ীতে সৈন্য পাঠানোর কথা বলতে ফোন করতেন না। অর্থাৎ ঐ ডায়লগটা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব এম মনসুর আলীর পক্ষে দেয়া সম্ভব। 

রাজনৈতিক ব্যক্তিদের মধ্যে জনাব তোফায়েল আহমেদের ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক সচিব এবং তার সাথে রক্ষীবাহিনীর যোগাযোগ ছিলো। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সচিব হিসেবে জনাব তোফায়েল আহমেদ রক্ষীবাহিনীর বিষয়ে দেখাশোনা করতেন, যারা প্রতিরোধ গড়তে সক্ষম ছিলো। ঘটনা শুরু হবার সময় রক্ষীবাহিনীর অফিসাররা নিশ্চই তার (তোফায়েল আহমেদ) সাথে যোগাযোগ করেছে এবং তাদের অবস্থান সম্পর্কে জানিয়েছে। যেহেতু তাদের সামর্থ্য সীমিত, তাৎক্ষনিক কোন গোলাবারুদ ছিলোনা, (গোলাবারুদ বিডিআর এর কাস্টডিতে থাকতো), সেক্ষেত্রে নিশ্চই তারাও তাদের অপারগতা জানিয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় যখন বঙ্গবন্ধু জনাব তোফায়েল আহমেদের কাছে সাহায্য চেয়েছে সেসময় তার পক্ষেও কোন প্রকার সহায়তা নিশ্চিত করা সম্ভব ছিলোনা। অতএব উক্ত ডায়লগটি, (অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু যাকে বলছিলেন “তার মানে কি তুমি কিছু করতে পারবেনা?”) বঙ্গবন্ধু জনাব তোফায়েল আহমেদের সাথে কথোপকথনের সময় বলে থাকতে পারেন। 

সর্বশেষে, বঙ্গবন্ধু তাঁর রাজনৈতিক সহকর্মীদের কাছে সাহায্য চাইতে যোগাযোগ করতে পারেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী জনাম মনসুর আলী ও রক্ষীবাহিনীর সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত তোফায়েল আহমেদ ছাড়াও অন্য যাদের কাছে বঙ্গবন্ধু সাহায্য চেয়েছেন তাদের কারো কাছ থেকে সাহায্যের নিশ্চয়তা পাননি। অর্থাৎ এই ডায়লগটি বঙ্গবন্ধুর সহকর্মীদের মধ্যে যাদের সাথে কথা বলেছেন তাদের যে কারো পক্ষেই বলা সম্ভব। ড. হাসানউজ্জামানের প্রতিক্রিয়ার প্রেক্ষিতে এই হচ্ছে আমার পর্যবেক্ষন। 

বিভিন্ন অফিসারদের বিবৃতি বিশ্লেষণের পর, আমি এখন আরও কিছু সিনিয়র আর্মি অফিসারের সম্পর্কে আলোচনা করব যারা সেদিন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আমাকে সাহায্য করতে পারতেন। রক্ষীবাহিনী সেনাবাহিনীকে প্রতিস্থাপন (রিপ্লেস) করতে যাচ্ছে, এমন গুজবে যদিও সেনাসদস্যদের মাঝে কিছু অসন্তোষ ছিলো, তথাপি সমস্ত আর্মি গুজবটা বিশ্বাস করেনি এবং ১৫ আগস্ট ‘৭৫ এর ঘটনায় তাদের কোন সংশ্লিষ্টতা নেই। অল্প কিছু লোক, যারা মূল পরিকল্পনায় ছিলো, তারা ব্যতীত আর্মির কাউকে ১৫ আগস্ট ‘৭৫ এর ঘটনায় দায়ী করা যায়না। এবং আর্মার্ড ও আর্টিলারি ইউনিট বাদে ঢাকা গ্যারিসনের বাকি ট্রুপ্স শুরুতে সেদিন জড়িত ছিলোনা। কিন্তু পরে বিদ্রোহীরা আর্মি চিফ তাদের সাথে আছে এমন গুজব রটিয়ে তাদেরকে কৌশলে পক্ষে নিয়েছে। এতে করে মনে হয় সম্পূর্ণ আর্মি ঘটনায় জড়িত, কিন্তু বস্তুত তা নয়। কিন্তু যখন তারা বুঝতে পারে যে তাদের ভুল বোঝানো হয়েছে, তখন আর তাদের পিছু হটার সুযোগ  ছিলোনা। 

তবে, সেই দুর্যোগময় সময়ে সকল সিনিয়র অফিসার যদি এক হয়ে কাজ করত অর্থাৎ যদি তারা মনে করত যে বিদ্রোহীদের দমন করা দরকার, সেক্ষেত্রে হয়ত তা ঠেকানো যেত। অন্ততপক্ষে পরবর্তী সময়ে যা কিছু ঘটেছে সেসব। আমি এখন সেদিনের ঘটনায় বিভিন্ন অফিসারদের কর্মকান্ড সম্পর্কে সংক্ষেপে পাঠকদের সামনে তুলে ধরতে চাই। ইতিহাসবিদগন বিচার করতে পারবেন এসব অফিসারগন বিদ্রোহ দমনে কতটুকু আন্তরিক ছিলেন। 

জেনারেল জিয়া 

            জেনারেল জিয়া আমার ডেপুটি। এই অবস্থায় আমি আশা করি আমার ডেপুটি নিজে থেকে এগিয়ে এসে আমাকে সাহায্য করবে। ঘটনার প্রথম দুই দিন, জেনারেল জিয়ার সততা নিয়ে আমার কোন সন্দেহ হয়নি। কিন্তু পরে যখন একজন বিদ্রোহী অফিসার (মেজর রশিদ) জানালো যে তারা একশনে যাবার আগে আমার ডেপুটির সাথে বোঝাপড়া হয়েছে তখন আমাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়েছে। অতএব দেখা যায়, প্রথম দিন থেকে সে যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে এবং যেসব সহায়তা করেছে সেগুলো সবই বিদ্রোহীদের সমর্থনে। সেগুলো এখন আমি উল্লেখ করব। 

ক) ১৫ আগস্ট ‘৭৫ সকালে ছয়টার কিছুক্ষণ আগে যখন তাকে আমি আমার বাসায় আসতে বলি, তার ১৫ থেকে ২০ মিনিটের মধ্যে সে পৌঁছে যায়। সে ইউনিফর্ম পরা ছিলো, শেভ করা ছিলো, অফিসিয়াল শেফুর ও অফিসিয়াল গাড়িতে সে এসে পৌঁছায়। অথচ, একই সময়ে আমি ব্রিগেডিয়ার খালেদকে আমার বাসায় আসতে বলি। এবং সে এসেছে পায়জামা (নাইট ড্রেস) পরে, দাঁড়ি কামানো ছিলো না, এবং নিজেই নিজের গাড়ি চালিয়ে এসেছিলো। সেই দুর্যোগময় সময়ে এসব ছোটখাট বিষয় লক্ষ্য করার মত অবস্থা আমার ছিলোনা। একজন এসেছে পুরো অফিসিয়াল সাঁজে, আরেকজন এসেছে একেবারেই সাধারণ (ক্যাজুয়াল) অবস্থায়। যদিও দুজনেই ১৫ থেকে ২০ মিনিটের মধ্যে পৌঁছেছে। তবে সেই পার্থক্য সেসময় আমার খেয়াল হয়নি। তখন আমার চিন্তা ছিলো কিভাবে বিদ্রোহীদের দমন করা যায়। যখন আমি ভাবার সময় পেয়েছিলাম তখন বিশ্লেষণ করেছিলাম কে কী করেছে। 

খ) সকালে যখন জেনারেল জিয়া ও ব্রিগেডিয়ার খালেদ আমার বাসায় আসে, আমি তাদের জানালাম যে কর্নেল শাফায়াৎ জামিলকে বলেছি বিদ্রোহীদের বাধা দিতে। কিন্তু মনে হয় সে (কর্নেল শাফায়াৎ) শূন্যে মিলিয়ে গেছে। আমি জানিনা সে কোন একশন নিয়েছে কিনা। সেই থেকে আমি তাকে পাচ্ছিনা। (‘ফ্যাক্টস এন্ড ডকুমেন্টস’ বইয়ের ২৯৪ থ্বক্ব ২৯৫ নং পাতায় কর্নেল শাফায়াৎ জামিলের বিবৃতি এখানে খুবই প্রাসঙ্গিক)। এই প্যারাগ্রাফে কর্নেল শাফায়াৎ বলেছে যে সে অর্ডার নিতে ডেপুটি চিফ জেনারেল জিয়ার বাসায় গিয়েছে। আমার বাসায় যখন আমি উদ্বেগের সাথে সময় অতিবাহিত করছি তখন জেনারেল জিয়া সেটি আমাকে একেবারেই বলেনি যে কর্নেল শাফায়াৎ তার সাথে দেখা করেছে। যদি কর্নেল শাফায়াৎ যা বলেছে সেটা সত্য হয় সেক্ষেত্রে সেটা আমাকে জানানো কি জেনারেল জিয়ার পক্ষে স্বাভাবিক নয়? তাছাড়া, কর্নেল শাফায়াতের ভাষ্যমতে সে সেদিন সকালে জেনারেল জিয়ার কাছে গিয়েছে নির্দেশনা পেতে। তাহলে জেনারেল জিয়া কর্নেল শাফায়াৎকে কী নির্দেশ দিয়েছে সেটা আমাকে কেন বলল না? এখন যদি আমি বলি যা তদের উভয়েই বিদ্রোহীদের সমর্থনে কাজ করেছে সেটা কি ভুল হবে? 

গ) সকালে কর্নেল শাফায়াৎ জামিলকে অর্ডার দেবার পর আমি আশা করেছিলাম ক্যান্টনমেন্টে খুব ব্যস্ততা দেখা দেবে। কিন্তু যেহেতু আমি কোন ধরণের কার্যক্রম দেখতে পাচ্ছিলাম না, তাই আমি CGS ব্রিগেডিয়ার খালেদকে ৪৬ ব্রিগেডে গিয়ে কর্নেল শাফায়াৎ জামিলকে সাহায্য করার জন্য অর্ডার করলাম। তখন জেনারেল জিয়া দারুণভাবে বাধা দিল। সেই সময়ে সে বারবার আমাকে “স্যার” বলে সম্বোধন করছিলো। এর আগে সাধারণত এরকম সে করেনি। (সাধারণত ব্যক্তিগত সাক্ষাতে জেনারেল জিয়া আমাকে ‘শফি’ হিসেবে সম্বোধন করে এবং অন্যদের সামনে ‘স্যার’বলে।) ব্রিগেডিয়ার খালেদকে বাধা দেবার পাশাপাশি জেনারেল জিয়া বলল, “সে (ব্রিগেডিয়ার খালেদ) সব শেষ করে দেবে।” যখন আমার এসব স্মৃতি মনে পড়ছে তখন মাথায় প্রশ্ন আসলো, জেনারেল জিয়ার এত দুশ্চিন্তার কারণ কী? ব্রিগেডিয়ার খালেদ জেনারেল জিয়ার কোন পরিকল্পনা নষ্ট করে দেবে বলে সে এতো উদ্বিগ্ন? ৪৬ ব্রিগেড কি এমন কিছু করবে যা জেনারেল জিয়ার পরিকল্পনার বিরুদ্ধে যাবে? অন্যথায় আমি ব্রিগেডিয়ার খালেদের একশনে জেনারেল জিয়ার এত দুশ্চিন্তার কোন কারণ দেখিনা। 

ঘ) সকালে যখন আমি আমার অফিসে আসছিলাম, জেনারেল জিয়া আমাকে ফলো করছিলো। সে আমার সাথে অফিসে প্রবেশ করে এবং টেবিলের ওপাশে বসে। যখন আমি অন্যান্য কমান্ডারদের সাথে যোগাযোগ করছিলাম এবং তাদেরকে আমার কথামত মুভ করার জন্য নির্দেশনা দিচ্ছিলাম তখন জেনারেল জিয়া সেখানে ছিলো। ৪৬ ব্রিগেড থেকে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ এসে যখন আমাকে রিপোর্ট করল সে কী করেছে কী দেখেছে, তখনো জেনারেল জিয়া সেখানে ছিলো। যখন ব্রিগেডিয়ার খালেদ রিপোর্টিং শেষ করল, তখন জেনারেল জিয়া বলল, “এখন CGS এর বাইরে যাওয়া উচিৎ হবেনা। এবং তার উচিৎ সীমান্তে সম্ভাব্য ভারতীয় আগ্রাসন ঠেকাতে “Ops Order” (অপারেশন অর্ডার) প্রস্তুত করা। যদিও সেই সময়ে এরকম কোন কিছু চোখে পড়েনি, তবে তখন পর্যন্ত একটা সম্ভবনা থাকতে পারে। আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিলো বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর বিষয়টা ঘাটা। সীমান্তে ভারতীয় সৈন্যের কার্যক্রম সম্পর্কে কোন তথ্য ছিলোনা। তাই আমি জেনারেল জিয়াকে বলি, আমাকে আগে এই স্পর্শকাতর বিষয়টা দেখতে হবে। আমার ধারণা, জেনারেল জিয়া চাচ্ছিল যা ঘটছে এবং সে যা করছিলো তাতে আমি যেন কোন রকম হস্তক্ষেপ না করি। 

ঙ) মেজর রশিদ জেনারেল জিয়া সম্পর্কে যা বলেছে তা সত্য হতে থাকে। সে (মেজর রশিদ) বলেছিলো যে জেনারেল জিয়া তাদেরকে জানায় যে যদি তারা সফল হয় সেক্ষেত্রে জেনারেল জিয়া তাদেরকে সাহায্য করবে। এভাবে জেনারেল জিয়ার আশির্বাদ নিয়েই বিদ্রোহী গ্রুপ পরিকল্পনামাফিক এগিয়েছে। ব্রিগেডিয়ার খালেদের একশন তাদের কাজে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। সেক্ষেত্রে তাদের পুরো পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে পারে। কাজেই তথাকথিত ভারতীয় আগ্রাসনের সংবাদটি আসলে আমার চিন্তা ভিন্ন দিকে পরিচালিত করার জন্য জেনারেল জিয়ার একটি চাল। অর্থাৎ একই কারণে CGS ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে সে “Ops Order” প্রস্তুত করতে বলে ব্যস্ত রাখতে চাচ্ছিল, যাতে সে অফিসের কাজে সীমাবদ্ধ হয়ে থাকে এবং বাইরের বিষয়ে নাক গলাতে না পারে। সেই সময়ে বিদ্রোহী সৈন্যরা তাদের অবস্থান শক্ত করছিলো। 

চ) ২৪ আগস্ট ‘৭৫ আমাকে চিফ অব আর্মি স্টাফ পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয় এবং জেনারেল জিয়াকে আর্মি চিফ করা হয়। জেনারেল জিয়া অর্ডার পেয়ে দায়িত্ব হস্তান্তরের জন্য দেরী করেনি। এমনকি বঙ্গভবন থেকে ক্যান্টনমেন্টে আমার আসার আগেই সে দায়িত্ব নিয়ে নেয়। বস্তুত, যে মুহুর্তে বঙ্গভবনে আমাকে জানানো হচ্ছিলো যে নতুন একজনকে আর্মি চিফ করা হয়েছে, সেই মুহুর্তেই জেনারেল জিয়া আর্মি চিফের দায়িত্ব নিয়ে নেয় এবং আর্মি হেডকোয়ার্টারে আর্মি চিফ হিসেবে অফিসারদের সম্ভাষণ (এড্রেস) করছিলো। 

ছ) আমাকে চিফ করার পর থেকেই জেনারেল জিয়া বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে এবং তার সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রপচার করেছে। খোন্দকার মোশতাক এটা জানতো। এবং তাই সে জেনারেল জিয়ার সহমর্মী হয়ে ওঠে। পরবর্তিতে, খোন্দকার মোশতাক তার কার্যসিদ্ধির জন্য জেনারেল জিয়াকে বেছে নেয়। ১৫ আগস্ট ‘৭৫ এর ঘটনায় আর্মির ভেতর থেকে জেনারেল জিয়া খোন্দকার মোশতাককে সমর্থন দিয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর খোন্দকার মোশতাক বিদ্রোহীদের সক্রিয় সমর্থন ও পছন্দে  জেনারেল জিয়াকে আর্মি চিফ করে। জেনারেল জিয়া শেষ পর্যন্ত যা চেয়েছে সেটা অর্জন করেছে এবং তার চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছাতে কাজ শুরু করে দেয়।

ব্রিগেডিয়ার খালেদ

ব্রিগেডিয়ার খালেদ ছিলো CGS. সে ছিলো আমার ডান হাত। তার উপর আমার পূর্ণ বিশ্বাস ও আস্থা ছিলো। কিন্তু ১৫ আগস্ট ‘৭৫ থেকে তার কিছু কাজ আমার বিশ্বাসের ভিত নাড়া দেয়। ব্রিগেডিয়ার খালেদের উপর বিশ্বাস হারানোর কারণগুলো নিম্নরূপঃ

ক) ১৫ আগস্ট ‘৭৫ সকালে আমি ব্রিগেডিয়ার খালেদকে ৪৬ ব্রিগেডে গিয়ে কর্নেল শাফায়াৎকে সৈন্য মুভ করতে সাহায্য করতে বলি এবং বিদ্রোহীদের বাধা দিতে বলি। কিন্তু ব্রিগেডিয়ার খালেদ তাকে (কর্নেল শাফায়াৎ) মুভ করাতে পারেনি। আমি কর্নেল শাফায়াৎকে একটিভ করতে না পারার কারণে ব্রিগেডিয়ার খালেদকে দোষ দিচ্ছিনা। কিন্তু আফসোস হচ্ছে সে যখন ৪৬ ব্রিগেড থেকে ফিরে আসলো তখন সেখানকার সৈন্য ও স্টাফরা যে বিদ্রোহীদের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে সে সম্পর্কে আমাকে কোন ধারণা দেয় নাই। সে ৪৬ ব্রিগেড এরিয়া থেকে ফেরার পর আমিও সেখানে গেলাম। সেখানে গিয়ে আমি দেখি যে কর্নেল শাফায়াতের BM মেজর হাফিজকে নিয়ে মূল ভূমিকায় মেজর রশিদ সেখানে কাজ করছে। কাজেই মেজর রশিদের কার্যক্রম সম্পর্কে আমার কোন সন্দেহ থাকলো না। ৪৬ ব্রিগেড থেকে ব্রিগেডিয়ার খালেদ আমাকে ফোন করে ব্রিগেড এরিয়ায় আসতে বলছিলো। এবং সে আরও বলে যে এর বেশী কিছু জানাতে তারা তাকে অনুমতি দিচ্ছেনা। সে আমাকে বলেনি ‘তারা’ কারা? এটা নিশ্চই কর্নেল শাফায়াৎ বা মেজর হাফিজ হবেনা। অবশ্যই মেজর রশিদ হবে, কিন্তু সে আমাকে মেজর রশিদ সম্পর্কে কোন ধারণা দেয়নি। তবে এখানেও আমি ব্রিগেডিয়ার খালেদকে দোষ দিচ্ছিনা। কারণ আমার ধারণা ছিলো মেজর রশিদ যে বিদ্রোহীদের সাথে আছে সেটা ব্রিগেডিয়ার খালেদ জানেনা। আমিও জানতাম না। 

খ) ১৭ আগস্ট ‘৭৫ মেজর রশিদকে আমি অপারেশনের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছিলাম। সে তখন বলেছিলো যে অপারেশনের আগে তারা সম্মতি নিতে ব্রিগেডিয়ার খালেদের সাথে দেখা করে। যখন মেজর রশিদ ব্রিগেডিয়ার খালদের অফিসে প্রস্তাব দেয় তখন কর্নেল শাফায়াৎ জামিল সেখানে ছিলো। মেজর রশিদ তাদের পরিকল্পনা সম্পর্কে জানানোর পর ব্রিগেডিয়ার খালেদ এটাকে ‘শিশুসুলভ’ আখ্যা দিয়ে তাকে চলে যেতে বলে। সেটা শিশুসুলভ হোক না না হোক, পরবর্তীতে ব্রিগেডিয়ার খালেদ বা কর্নেল শাফায়াৎ জামিলের কেউ আমার কাছে বিষয়টা জানায় নাই। তবে ১৫ আগস্ট ‘৭৫ এর পর প্রথম দিন থেকেই তাদের কার্যক্রম দেখে আমার মনে হয়েছে যে তারা সঠিক পথে নেই। 

গ) মেজর রশিদের জানানোর পর যে কেউ তাদের কার্যক্রমের উপর নজর রাখার কথা। কিন্তু তারা (ব্রিগেডিয়ার খালেদ ও কর্নেল শাফায়াৎ) সেটা করেনি। একইসাথে এটাকে তারা এতো হাল্কাভাবে দেখে যে, তাদের কার্যক্রম একাবারেই উপেক্ষা করে। একইসাথে, যখন তারা সফলভাবে কাজ সম্পন্ন করে তখন থেকে ব্রিগেডিয়ার খালেদ ও কর্নেল শাফায়াৎ জামিল তাদের বলয়ে থাকতে চেষ্টা করতে থাকে। ফলে পরবর্তী সময়ে তারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তাদেরকে সহায়তা করে ও শান্ত করে। যখন ব্রিগেডিয়ার খালেদ জানতে পেরেছিল যে বিদ্রোহীদের কাছে কোন গোলাবারুদ নেই তখন তার উচিৎ ছিলো তাদের ধরা এবং তাদের বিরুদ্ধে একশন নেয়া। কিন্তু তাদেরকে ধরার জন্য কোন একশনে না নিয়ে উল্টো তাদেরকে আমার অনুমতি ছাড়া গোলাবারুদ ইস্যু করে দেয়। এভাবে ব্রিগেডিয়ার খালেদ তাদের আস্থা অর্জন করে। আমার এই চিন্তাধারা কি সঠিক? এই সৈন্যরা তখনো বিদ্রোহী সৈন্য, এবং কিভাবে CGS তাদের সেই অবস্থায় গোলাবারুদ ইস্যু করে দেয়? অতএব, যদি আমি বলি ব্রিগেডিয়ার খালেদও তাদের সাথে ছিলো, তা কি ভুল হবে?

ঘ) ১৫ আগস্ট ‘৭৫ আমি ব্রিগেডিয়ার খালেদকে ৪৬ ব্রিগেডে গিয়ে কর্নেল শাফায়াৎ জামিলকে সৈন্য মুভ করতে সাহায্য করতে বলি। শুধু সেই (ব্রিগেডিয়ার খালেদ) জানে, সেখানে সে কী করেছে এবং কী করতে পারতো। সে আমাকে ঠিক মত রিপোর্ট করতে সময় পায়নি, অথবা ইচ্ছা করে রিপোর্ট করেনি। কিন্তু আমি যখন বঙ্গভবনে আটকে আছি ব্রিগেডিয়ার খালেদ তখন ৪৬ ব্রিগেডের অন্য সৈন্যদের ব্রিফ করেছে যে তাদের কী করা উচিৎ। একইভাবে সে রক্ষীবাহিনীর দুই ডেপুটি ডিরেক্টর জনাব আনোয়ারুল আলম শহীদ এবং জনাব সারওয়ার মোল্লাকে কল করে এবং তাদেরকেও করনীয় সম্পর্কে ব্রিফ করে। সেদিনের ব্রিফিংএ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ এমন একটি কথা বলে যা ২০০৮ সালে জনাব আনোয়ারউল আলম শহীদ আমাকে জানান এবং বিষয়টা আমাকে লিখিত আকারে দেন যা আমি এই বইয়ের Exhibit A তে যুক্ত করেছি। 

কর্নেল শাফায়াৎ জামিল 

কর্নেল শাফায়াৎ জামিল ছিল ব্রিগেড কমান্ডার এবং সে আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টা সমাধান করার মূল চাবিকাঠি। বিদ্রোহী ইউনিট অর্থাৎ আর্মার্ড ও আর্টিলারি রেজিমেন্ট ছাড়াও তার কমান্ডে আরও তিনটি ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটেলিয়ন (১,২ ও ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট) ছিলো। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের তার কমান্ডের অধীন এই ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটেলিয়নে প্রায় আড়াই থেকে তিন হাজার ইনফ্যান্ট্রি সোলজার ছিলো। কর্নেল শাফায়াতকে আমি স্পষ্টভাবেই সৈন্য মুভ করার নির্দেশে দিয়েছিলাম। কিন্তু সে সৈন্য মুভ করেনি। কেন সে তা করেনি সেই উত্তর একমাত্র কর্নেল শাফায়াৎ জামিল দিতে পারে। আমার শক্তি ছিলো ৪৬ ব্রিগেড। কিন্তু আমি এটাকে কোন একশনের জন্য মুভ করাতে পারিনি। ব্রিগেড কমান্ডার আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করল যে আমি তাকে কোন অর্ডার দেইনি। আমি বিস্তারিত লিখেছি আমি তাকে অর্ডার দিয়েছি কিনা সে ব্যাপারে আগের পাতাগুলোতে বিস্তারিত উল্লেখ করেছি। এখন আমি পাঠক ও ইতিহাসবিদদের বিষয়টা তুলে দিচ্ছি। তারাই সিদ্ধান্ত নেবেন সেদিনের ঘটনায় কর্নেল শাফায়াৎ কী করেছে। 

ক) ১৭ আগস্ট ‘৭৫ বঙ্গভবনে মেজর রশিদ (অভ্যুত্থানের অন্যতম পরিকল্পনাকারী) আমাকে বলেছিল যে কর্নেল শাফায়াৎকে তারা তাদের পরিকল্পনা সম্পর্কে জানিয়েছে। ১৫ আগস্ট ‘৭৫ এ কর্নেল শাফায়াতের নিষ্ক্রিয়তায় প্রমাণ হয় যে মেজর রশিদ ১৭ আগস্ট ‘৭৫ আমাকে যা বলেছে তা সত্য। তার প্রতিফলন ‘ফ্যাক্টস এন্ড ডকুমেন্টস” বইয়ের ২৯৪ পাতায় কর্নেল শাফায়াৎ জামিলের বিবৃতিতে পাওয়া যায়। কর্নেল শাফায়াৎ জামিল বলেছে, ঘটনার দিন মেজর রশিদ তার কাছে এসে জানায় তারা শেখ মুজিবকে হত্যা করেছে। সে (মেজর রশিদ) কিভাবে তার কমান্ডার কর্নেল শাফায়াৎ জামিলের কাছে গিয়ে এটা বলার সাহস পায়?  

খ) মেজর রশিদ কে? সে ২ ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারির কমান্ডিং অফিসার, যেটি সেই সকালে বিদ্রোহে অংশ নেয়। সে সরাসরি কর্নেল শাফায়াৎ জামিলের কমান্ডের অধীনে ছিলো। এধরনের ঘৃণ্য কাজ করে সে কী করে তার কমান্ডারের কাছে গিয়ে বলে যে তারা শেখ মুজিবকে হত্যা করেছে? শেখ মুজিব কে? তিনি স্বয়ং দেশের প্রেসিডেন্ট। আমি কি এখন একটি প্রশ্ন করতে পারি? মেজর রশিদ কর্নেল শাফায়াৎ জামিলকে যখন বলেছে যে তারা শেখ মুজিবকে হত্যা করেছে সেই মুহূর্তে মেজর রশিদের বিরুদ্ধে একশন নেবার জন্য তার (কর্নেল শাফায়াৎ) কি কারো থেকে কোন অর্ডারের প্রয়োজন আছে? কেন সে একশন নেয় নাই? সে কী ভয়ে পেয়েছিলো? নাকি সে তাদের দলে? এটা সর্তকতার সাথে বিশ্লেষণ করা দরকার। 

গ) কর্নেল শাফায়াৎ জামিল তার বিবৃতিতে বলেছে, সে ক্যান্টনমেন্টে ডিফেন্সিভ পজিশন নিয়েছে। এটা নিশ্চই বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, যখন বিদ্রোহীদের মুখোমুখি হওয়া দরকার তখন সে কেন ডিফেন্সিভ পজিশনে গিয়েছে? যদি সে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে ডিফেন্স নিয়ে থাকে তাহলে বিদ্রোহী লিডার মেজর রশিদ ও মেজর ডালিম কেমন করে ঐদিন সকালে ৪৬ ব্রিগেড এলাকা দিয়ে বিনা বাধায় ঘুরে বেড়ায়? এমনকি মেজর ডালিম সেদিন একটা কন্টিনজেন্ট গ্রুপ নিয়ে বিনা বাঁধায় আর্মি হেডকোয়ার্টারে আমার অফিসে কী করে প্রবেশ করে? ক্যান্টনমেন্টে কর্নেল শাফায়াৎ জামিলের নিয়ন্ত্রণে তিনটি ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটেলিয়ন ছিলো। মনে করিয়ে দেই, তার নিজের ভাষ্যমতে, মেজর রশিদ তাকে যখন বলেছে যে তারা শেখ মুজিবকে হত্যা করেছে, তারপর কর্নেল শাফায়াৎ জামিল জেনারেল জিয়ার বাসায় গেছে তার নির্দেশনা নিতে। এই তথ্য পাবার পর তাকে কেন নির্দেশনার জন্য জেনারেল জিয়ার কাছে যেতে হবে? কর্নেল শাফায়াৎ জামিল এটা স্পষ্ট করেননি। আমার ধারণা শুরুতে কর্নেল শাফায়াৎ জামিল তাদের সাথে ছিলো না। তারপরেও কেন তার জেনারেল জিয়ার কাছে যেতে হল? এটা কি মেজর রশিদের জোরাজুরির কারণে? নাকি এর পেছনে কোন যোগসূত্র আছে? তার পরবর্তী একশন প্রশ্নবিদ্ধ। 

ঘ) ১৫ আগস্ট ‘৭৫ সকালে আমি কর্নেল শাফায়াৎ জামিলের ৪৬ ব্রিগেড এরিয়ায় যাই। সে জানতো যে আমি সেখানে গিয়েছি। (তার একটি বিবৃতিতে সে লিখেছে যে সে আমাকে দেখেছে।) তারপরেও সে আমাকে এড়িয়ে গেছে এবং তার ব্রিগেড এলাকায় যাওয়া সত্ত্বেও সে আমার সাথে দেখা করেনি। আমি কেন সেখানে গিয়েছিলাম? আমার শক্তি ছিলো কর্নেল শাফায়াৎ এবং তার ব্রিগেড। আমি জানিনা কেন সে আমাকে এরয়ে গিয়েছে। আমি এটাও জানিনা ঘটনার চার দিন পর ১৯ আগস্ট ‘৭৫ তারিখে সে কেন জেনারেল জিয়ার বিরুদ্ধে আমার কাছে বলতে আসে? এটা হতে পারে যে, ঘটনার পর বিদ্রোহীদের কাছে কর্নেল শাফায়াতের প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়। ফলে তারা তাকে পরিত্যাক্ত করে। যেহেতু তাকে পরিত্যাক্ত করা হয়েছে তাই সে দুশ্চিন্তায় পরে যায়। তাই ঘটনার চার দিন পরে সে আমার কাছে এসে বলে যে আমার ডেপুটির ব্যাপারে সবাধান হওয়া উচিৎ। সে যদি ঘটনার চার দিন পর আমার কাছে আসতে পারে তাহলে আগে কেন আসেনি? 

ঙ) ১৫ আগস্ট ‘৭৫ সকালে কর্নেল শাফায়াৎ ডেপুটি চিফ জেনারেল জিয়ার কাছে অর্ডার নিতে যায়। অর্থাৎ সে স্বাভাবিক চ্যানেল অব কমান্ড ভঙ্গ করেছে। সে বলেছে যে আমি তাকে কোন অর্ডার দেই নাই। তাই সে ডেপুটি চিফের কাছে অর্ডারের জন্য গিয়েছে। যদি তাকে আমি কোন অর্ডার না দিয়ে থাকি তাহলে কেন আমি তাকে এত সকালে ফোন দিয়ে ডেকে তুলবো? সকালে আমি কেন তার ব্রিগেড এরিয়ায় যাব? তার জানার কথা যদি আমি তাকে কোন অর্ডার নাও দেই তবুও ডেপুটি চিফের কাছে অর্ডার নিতে যাবার কোন অধিকার তার নেই, যেহেতু চিফ স্টেশনে আছে। কর্নেল শাফায়াৎ জেনারেল জিয়ার থেকে যে নির্দেশ পেয়েছে তাতে সে বেশী খুশি হয়েছে। কিন্তু সে কী নির্দেশ পেয়েছিলো? তাকে বলা হয়েছিলো এলার্ট থাকতে, অর্থাৎ চুপ হয়ে থাকতে। সেই সময়ে সেটা কি যথার্থ নির্দেশ? এই অর্ডারের মানে হচ্ছে কোন মুখোমুখি হওয়া নয়। এবং কর্নেল শাফায়াৎ এই অর্ডারে খুশি হয়। 

চ) ১৫ আগস্ট ‘৭৫ কোন কিছু না করেও চতুর্থ দিনে (১৯ আগস্ট ‘৭৫) কর্নেল শাফায়াৎ জামিল আমার কাছে এসে বলে জেনারেল জিয়াকে বিশ্বাস না করতে। তার মতে জেনারেল জিয়া এই অভ্যত্থানের পেছনে আছে। কিন্তু আমার ধারণা যে যে কারণে আমার কাছে এসেছে সেটা হচ্ছে ততোক্ষণে বিদ্রোহী গ্রুপের কাছে তার প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়ায় তাকে পরিত্যাক্ত করা হয়েছে। অন্যথায়, এই কথা বলতে তার চারদিন পরে কেন আসতে হবে? 

ছ) ১৯ আগস্ট ‘৭৫ আমি আমার অফিসে ফর্মেশন কমান্ডারদের সাথে একটা কনফারেন্স ডাকি। এর প্রধান কারণ ছিলো আমার অবস্থান জোরদার করা। সেটা করার জন্য বিদ্রোহী গ্রুপে ব্যারাকে ফেরানো প্রয়োজন। আমি কর্নেল শাফায়াৎকে আমার পরিকল্পনার কথাও বলি, অর্থাৎ আমি কিভাবে এটি বাস্তবায়ন করতে চাচ্ছি। তাই আমি একটি গল্প ফাঁদলাম যে আমাদের সীমানায় একজন ভারতীয় সৈন্য নিখোঁজ আছে। এবং সেটি কাউন্টার করতে আমাদের সৈন্য পাঠানো দরকার। আমি কর্নেল শাফায়াৎকে বললাম যে আমি সকল সৈন্যকে ব্যারাকে ফেরত চাই। যতক্ষণ না তারা আমার নিয়ন্ত্রণে আসে ততোক্ষণ পর্যন্ত আমি তাদের বিরুদ্ধে কোন একশন নিতে পারছিনা। এই লক্ষ্যে আমি উপরের পরিকল্পনাটা করি। কর্নেল শাফায়াৎ এটি জানত। তার পরেও সে হঠাৎ করে কনফারেন্সে মেজর রশিদ ও মেজর ফারুককে মার্শাল কোর্টের হুমকি দেয়। এতে আমার পরিকল্পনাটা ভেস্তে যায়। আমার মনে হয় এই পর্বে সে একা ছিলো না এবং আমার পরিকল্পনা ভেস্তে দিতে সে এটা ইচ্ছা করেই করেছিলো। শেষদিকে একটি ষড়যন্ত্রমূলক তথ্য আমার কাছে আসে। বঙ্গবন্ধুর ৩২ নং বাড়ির হাউজগার্ড ছিলো ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট থেকে। ১৪ আগস্ট ’৭৫ তাদেরকে পরিবর্তন করে ২ ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারির গার্ডদের দেয়া হয়। নতুন গার্ডরা ১৫ আগস্ট ’৭৫ সকালের সামরিক অভ্যুত্থানের সাথে জড়িত। ২০০৯ সালে ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের হাবিলদার মোখলেস এটা আমাকে জানায়। সেসময় সে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির গার্ড কমান্ডার ছিলো। এটা অবশ্যই কর্নেল শাফায়াৎ জামিলের অনুমোদনে হয়েছে। কারণ তার BM মেজর হাফিজ এবং মেজর রশিদ মিলে এই পরিবর্তনটা করেছে। এই বিনিময়টা খুব চালাকির সাথে করা হয়। কারণ এটা বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় ছেলে সেকেন্ড লে শেখ জামালের উপস্থিতিতে করা হয়। ঘটনাচক্রে সে ঐদিন রাতে ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ডিউটি অফিসার ছিলো। হাবিলদার মোখলেস আমাকে আরও বলেছিলো যে, যদি সেদিন তাদের গার্ডরা থাকতো তাহলে নিশ্চই ২ ইস্ট বেঙ্গল গার্ডরা শোডাউন করতে পারতো। আমি নিশ্চিত যে এই পরিবর্তনটা কর্নেল শাফায়াতের অনুমতি ছাড়া হয়নি। ১৫ আগস্ট ’৭৫ আমি মেজর হাফিজকে মেজর রশিদের সাথে সক্রিয়ভাবে কাজ করতে দেখি। আমার কি ভুল হবে যদি আমি বলি যে মেজর হাফিজও মেজর রশিদের সাথে ছিলো? আশ্চর্য বিষয় হচ্ছে ঘটনার চার দিন পরে শাফায়াৎ জামিল আর মেজর হাফিজ আমার কাছে এসেছে জেনারেল জিয়া সম্পর্কে নালিশ করতে যে সে (জেনারেল জিয়া) অভ্যুত্থানের পেছনে কাজ করেছে! 

ব্রিগেডিয়ার রউফ

ব্রিগেডিয়ার রউফ ছিলো ডিজিএফআই। গোয়েন্দা বিষয়টা যেহেতু জরুরী তাই এই পদটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বঙ্গবন্ধু এই পদের জন্য তাকে বেছে নিয়েছিলেন। এধরনের স্পর্শকাতর বিষয়ে ব্রিগেডিয়ার রউফ কি বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাশা মেটাতে পেরেছে? যদি আমাকে প্রশ্ন করা হয়, আমি বলব সে পারেনি। এটা তার জন্য অনেক বেশী বড় দায়িত্ব। এই পোস্টের জন্য সঠিক ব্যক্তি সে নয়। এরকম গুরুত্বপূর্ণ অফিসের প্রধান হয়েও সে সঠিক কাজটি করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং যার জন্য কাজ করেছে তাকে পরিত্যাগ করেছে। তার ব্যাপারে আমার কিছু মন্তব্য নিম্নে দেয়া হলঃ

ক) ১৫ আগস্ট ‘৭৫ এর ঘটনা প্রধানত একটি গোয়েন্দা ব্যার্থতা। যেহেতু ঘটনাটা ইউনিফর্ম পরিহিত ব্যক্তি সম্পর্কিত, তাই ব্রিগেডিয়ার রউফ এবং তার অফিসের সজাগ থাকা উচিৎ ছিলো। ঘটনা ঘটার আগে তারা এটি সম্পর্কে জানতে ব্যার্থ হয়েছে। ১৫ আগস্ট ‘৭৫ যা ঘটেছে সেটা তাৎক্ষনিক ঘটে যাওয়া কোন ঘটনা নয়। এটা ঘটার আগে পেছনে অনেক দিন ধরে পরিকল্পনা করতে হয়েছে। কিন্তু ব্রিগেডিয়ার রউফের চোখ সেখানে ছিলোনা। দেশবিরোধীদের খোঁজার চেয়ে তার মূল আগ্রহ ছিলো মুক্তিযোদ্ধাদের পেছনে লেগে থাকা এবং তাদের ভুল বের করা। আগেও যেমন বলেছি, যে ১৫ আগস্ট ‘৭৫ এর ঘটনা তাৎক্ষনিক ঘটে যাওয়া কিছু নয় এবং DFI এর সজাগ দৃষ্টি রাখা উচিৎ ছিলো, যা তারা করতে পারেনি। 

খ) ব্রিগেডিয়ার রউফের বিবৃতি অনুযায়ী, ১৪/১৫ আগস্ট ‘৭৫ রাতে DFI এর একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা তাকে একটি অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে বলে জানায়। রিপোর্টারের কাছে দেয়া ইন্টারভিউতে সে বলেছে, যে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদেরকে সে তথ্যটি জানিয়েছে। কিন্তু আসলে তা নয়। আগে আমি তার বিবৃতি বিশ্লেষণ করেছি এবং প্রমাণ করেছি যে সে সত্য বলেনি। তথ্য পেয়ে কোন একশন না নিয়ে সে এটাকে অন্য কারো ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে। সে কাউন্টার ইন্টিলিজেন্সের লোককে নির্দেশ দেয় তথ্যটা পরবর্তী যিনি ডিজিএফআই হতে যাচ্ছে তাকে জানাতে অথবা সরাসরি প্রেসিডেন্টকে জানাতে, যেটা করার আইনগত অধিকার তাদের নেই। আমার কাছে মনে হয় সে আসলে তার সোর্সকে বিশ্বাস করেনি। এবং সেকারণে কাউকে জানায়নি। পরে যখন ঘটনা সত্যি সত্যি ঘটছিলো, তখন সে ভীত হয়ে যায় এবং বাসা থেকে পালিয়ে ক্যান্টনমেন্টের গলফ কোর্সে আশ্রয় নেয়। 

গ) ব্রিগেডিয়ার রউফের বিবৃতি থেকে জানা যায় সে ১৫ আগস্ট ‘৭৫ সকালে লুঙ্গি-গেঞ্জি পরে আমার বাসার পেছনের দেয়াল টপকে আমার সাথে দেখা করতে আসে। রউফ একজন ব্রিগেডিয়ার। আমার বাসার পেছনের দেয়াল টপকে তার আসার কোন প্রয়োজন নাই। সে সহজেই অন্য সবার মত সামনের গেট দিয়ে আমার বাসায় প্রবেশ করতে পারে। আমার বাড়ির পেছনের দেয়াল টপকে তার প্রবেশ করাটা সন্দেহজনক। কেন সে ঐভাবে আমার বাসায় ঢুকবে? দ্বিতীয়ত, কেন তাকে লুঙ্গি-গেঞ্জি পরিহিত অবস্থায় আসতে হবে? সে যে গলফ কোর্সে ছিলো সেটা তার বিবৃতি এবং আমার হাউজ গার্ডদের দেয়া তথ্য থেকে জানা যায়। সেই রাতে হাউজ গার্ডরা তাকে গলফ কোর্সের সামনে পরিবারের সদস্যদের সাথে একটি গাছের নীচে দেখতে পায়। 

ঘ) কাউন্টার ইন্টিলিজেন্সের লোকের থেকে তথ্য পাবার পর ব্রিগেডিয়ার রউফের উচিৎ ছিলো আরও একটু খোঁজ খবর নেয়া এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দ্রুত জানানো। কিন্তু তার পরিবর্তে সে নিজের নিরাপত্তা নিয়ে বেশী উদ্বিগ্ন হয়ে পরে এবং সেই অন্ধকার রাতে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বাসা থেকে পালিয়ে গলফ কোর্সে আশ্রয়  নেয়। তা না হলে সেই সময় কেন সে এটা করতে যাবে? কাউন্টার ইন্টিলিজেন্সের লোকের থেকে তথ্য পাবার পর তার উচিৎ ছিলো আরও একটিভ হওয়া এবং সংশ্লিষ্টদের এলার্ট করা। কিন্তু তার যা করার কথা সে তা করেনি। কিন্তু ঘটনা ঘটার সময় সে ভয় পেয়ে লুঙ্গি গেঞ্জি পরিহিত অবস্থায় গলফ কোর্সে আশ্রয় নেয়। লুঙ্গি গেঞ্জি পড়া থাকলে হয়ত তাকে সহজে চেনা যাবেনা তাই সে এভাবেই গলফ কোর্সে আশ্রয় নেয়। একারণেই আমি বলেছিলাম যে যখন সে বুঝতে পারে বড় কোন দুর্ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে তখন সে বাসা থেকে পালিয়ে যায়। এতে কি প্রমাণিত হয়না যে সে কত বড় দায়িত্বহীন? কত সাহসী সৈনিক! 

Exhibit A

এম্বাসেডর জনাব আনোয়ার-উল-আলম শহীদের (অবসরপ্রাপ্ত) বিবৃতিটি নীচে দেয়া হল। 

১৫ আগস্ট ‘৭৫ সকালে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ রক্ষীবাহিনীর দুইজন ডেপুটি ডিরেক্টর জনাব আনোয়ারুল আলম শহীদ এবং জনাব সারোয়ার মোল্লাকে ডেকে পাঠান। তিনি তাদেরকে এই অবস্থায় কী করনীয় সে ব্যাপারে ব্রিফ করেন। ব্রিফিংএর সময় ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ নীচের মন্তব্যটি করেন। ব্রিগেডিয়ার খালেদের মন্তব্যটি এম্বাসেডর জনাব আনোয়ার-উল-আলম শহীদের (অবসরপ্রাপ্ত) এর নিজ হস্তাক্ষরে নিম্নে লিখে দিয়েছেন। 

শহীদ সারোয়ার 

“আমি জানি তোমরা দেশপ্রেমিক। কিন্তু আমাদের এটা করতে হয়েছে কারণ আমরা এই দেশে কোন রাজতন্ত্র কায়েম করতে দিতে পারিনা। 

খালেদ মোশাররফ।”

Translated by Dr Razibul Bari

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!